Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 380



এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০৫

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৫)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

আবির রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখল নাজিয়া রান্নার মাঝে একহাত দিয়ে চোখ মুছে চলেছে, তারমানে মেয়েটা সব শুনে নিয়েছে।

– ‘নাজু বোন আমার।’

আবিরের গলা পেয়ে নাজিয়া তাড়াহুড়ো করে চোখটা মুছে নিল। আবির মেকি হেসে বলল,
– ‘আমি তোর চোখে পানি দেখেছি, লুকিয়ে লাভ নেই। সরি রে..
– ‘আবির’দা তুমি সরি বলছ কেন? তোমার তো কোনো দোষ নেই আসলে দোষটা আমার ঘুমিয়ে না পড়লে এতকিছু হতো না।’
– ‘ঘুমিয়ে না পড়লে মানে কি? সারারাত জেগে একটুখানি ঘুমিয়েছিস আর এখন বলছিস ওইটা না ঘুমালে ভালো হতো পাগল হয়েছিস! এইরকম করলে অসুস্থ হয়ে পড়বি তো।’
– ‘কিছু হবে না। তুমি অফিস যাবে তো দেখি হয়ে আসো আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। আর হ্যাঁ দিদিকে কিছু বলো না প্লিজ।’

আবির নাজিয়ার মুখের দিকে তাকাল, মেয়েটা কি দিয়ে তৈরি যে দেখে তত মুগ্ধ হয়। সত্যি নাজিয়ার মতো বোন কজনের ভাগ্যে থাকে!

আবরারের মা ক্রমাগত কেঁদে চলেছে, একটা বাইরের মেয়ের জন্য আবার ওনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে এটা মেনে নিতে পারছেন না। নাজিয়ার উপর রাগ বাড়ছে, মেয়েটাই সবকিছুর মূলে।

স্ত্রীর ব্যবহারে আবরারের বাবার মাথা লজ্জায় নত হয়ে পড়েছে, যে মেয়েটা ওনাদের ভালোর জন্য এই বাড়িতে পড়ে আছে আজকে তাকেই এতগুলো কথা শুনতে হচ্ছে!

আবরারের মা মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

মায়ের চেঁচামেচি, নাজিয়ার কান্না সবটা সম্পর্কে আবরার অবগত তবে সেও কিছু বলল না। শ্রেয়াকে নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল, এতকিছুর পর গলা দিয়ে খাবার নামবে বলে মনে হয় না।

ছেলেকে না খেয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে আবরারের মা নাজিয়ার উপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, জানা নেই এর পরিনাম কি হতে চলেছে!

সেই দিনটা মোটামুটি ভালো ভাবে চলে গেলেও ২দিন পরের ঘটনাটা নাজিয়ার জীবনে অভিশপ্ত হয়ে উঠল। সকাল বেলাতে আবরার ব্যাগ-পত্র নিয়ে হাজির।

– ‘কিরে আবরার বাবা তোর হাতে লাগেজ কেন? কোথায় যাবি!’
– ‘মা আমার জরুরি কাজ পড়ে গেছে, তাই যেতে হবে।’

আবরারের মা ছেলের কথার বিপরীতে কোনো কথা বললেন না, চুপ করে রইলেন। ছেলে বাড়ির বাইরে যাবার পরপরই শুরু হলো তান্ডব…

– ‘আবির, বউমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি নীচে নাম।’

মায়ের ডাকাডাকি শুনে আবির, নিসা আর ওদের বাবা বসার ঘরে উপস্থিত হন। নাজিয়া রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে কিন্তু ওনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস হয় না।

– ‘কি হলো মা! এত চেঁচামেচি করছ কেন?’
– তোদেরকে একটা সিদ্ধান্ত জানানোর আছে।’
– ‘কি সিদ্ধান্ত!’ (আবরারের বাবা)
– ‘আবির তোর শালিকা যদি এই বাড়িতে থাকে তাহলে আমি এই বাড়ি ত্যাগ করব।’

উপস্থিত সকলে চমকে উঠল। ওনার মুখে এই কথাটা আশা করেননি কেউ। আবরারের বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন,

– ‘দ্যাখো আবিরের মা রোজকার ঝামেলা আমার ভালো লাগছে না। আমি বুঝি না এই বাচ্চা মেয়েটার প্রতি তোমার এত রাগ কেন?’
– ‘তোমার চোখে তো কিছুই পরেনা। ওই মেয়ে একটা অ’লক্ষী যে দিন থেকে আমার বাড়িতে এসেছে সব সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে।’

নাজিয়া এক পা পিছিয়ে গেল, যার জন্য এত বড়ো একটা কথা শুনতে হলো!

– ‘মা তুমি এইসব কি বলছো!’
– ‘ ঠিক বলছি। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি এখন তোমরা ঠিক করো কি করবে।’

নিসা নিরবে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলে চলেছে, শুধুমাত্র ওর কারনে মেয়েটা কারনে অকারণে এতগুলো কথা শুনে চলেছে। আর নাজিয়া! সে তো নিরব হয়ে গেছে, আবিরের মায়ের রাগের কারনটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না।

আবির মাকে নানান ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিন্তু উনি তো নাছোড় বান্দা যেটা বলেছেন সেটাই করবেন। আবিরের মা নিসা, নাজিয়া এবং নিজের স্ত্রীর দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন,

– ‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
– ‘কি সিদ্ধান্ত বাবা!’ (আবির)
– ‘তোর মায়ের যখন নাজিয়াকে নিয়ে এতটাই প্রবলেম তাহলে নাজিয়া এই বাড়িতে থাকবে না।’

আবিরের মায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল। অবশেষে মেয়েটা বিদায় হচ্ছে।

– ‘নাজিয়ার সাথে সাথে নিসাও এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।’

আবিরের মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ল। আবিরের মাও অবাক হয়েছে, নিসাকে প্রথম প্রথম অপছন্দ করলেও এখন ভালোবেসে ফেলেছেন। মেয়েটাকে এই প্রেগন্যান্সির সময়েও বাবার বাড়ি যেতে দেননি সেখানে ওনার স্বামী মেয়েটাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছেন কেন?

– ‘বাবা তুমি এইসব কি বলছ?’
– ‘ঠিক বলছি। আবির তুমি নিসা ও নাজিয়াকে ওদের বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসবে। তুমি ওই বাড়িতে যখন ইচ্ছা যেতে পারো, বউমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু তোমাদের মা নিসার সাথে কোনোরকমের যোগাযোগ রাখতে পারবে না এটাই আমার শেষ কথা। আমার কথার বিপরীতে গেলে ফলাফল ভালো হবে না।’

সবাই নিরবে শুনে যায়, আবিরের বাবা চুপচাপ স্বভাবের মানুষ তবে রেগে গেলে ভয়ানক হয়ে উঠেন। নাজিয়া ওর বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়, ওর কারনেই ওর বোনকে ঘর ছাড়তে হচ্ছে। আবির বাবার সিদ্ধান্ত শুনে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে যান। আর আবিরের মা! নাজিয়া বাড়ি ছাড়বে শুনে মহাখুশি আবার বউমা চলে যাবে শুনে কষ্ট লাগছে। অনেক ভেবে ঠিক করলেন, স্বামীর মাথা ঠান্ডা হলে ওনাকে বোঝাবেন যাতে নিসা এই বাড়িতেই থাকে।

আবির আবরারের নম্বরে ডায়াল করতেই আবরার ফোনটা রিসিভ করে বলল,

– ‘হ্যাঁ দাদা বল।’
– ‘তুই এইবার খুশি তো!’
– ‘মানে? আমি আবার খুশি হবো কেন?’
– ‘নাজিয়া বাড়ি থেকে চলে যাবে আর বাবা বলেছে নিসাও যাবে ওর সাথে তুই এইবার খুশি তো!!’
– ‘হোয়াট! এইসব কখন হলো, মা নিশ্চয় কিছু করেছে তাই না।’

আবির কিছু বলল না। আবরারের বুঝতে অসুবিধা হলো না বিষয়টা কি। ওহ শান্ত স্বরে বলল,

– ‘দাদা যা হচ্ছে হতে দে। হয়তো মা নিজের ভুলটা বুঝতে পারবে।’
– ‘সব বুঝতে পারছি কিন্তু নিসার এই অবস্থাতে ওকে একা’কে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না।’
– ‘নাজিয়া আছে তো ঠিক সামলে নেবে চিন্তা করিস না।’
– ‘হুমম।’

আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, মাথাতে অনেক কিছুই ঘুরে চলছে। দেখা যাক ভাগ্য কোথায় দাঁড় করায়।

নিসার একদিকে মনখারাপ আবার ভালোও লাগছে। প্রতিটা মেয়েই প্রেগন্যান্সির সময়ে মায়ের আদর -যত্ন ভালোবাসা আশা করে। আবিরের জেদের কারনে নিসা বাপের বাড়িতে যেতে পারেনি নাজিয়াকে এইখানে নিয়ে রেখেছে। এতদিন আবির ও ওর মা যথেষ্ট কেয়ার করেছে,তবুও মা তো মা হয় তার জায়গাটা কেউ কখনোই নিতে পারে না। মায়ের কাছে যাবে শুনে নিসার মনটা ভালো হলেও এই বাড়িতে নাজিয়াকে নিয়ে ঝামেলা তার উপর আবিরের কথা ভেবে মনটা বিষন্ন হয়ে আছে। আবির ওকে খুব ভালোবাসে, ভালোবেসে বিয়ে করেছিল আবার তার মান রেখেছে কখনোই কষ্ট দেয়নি। এমনটি প্রেগন্যান্ট না হবার কারনেও কখনোই কথা শোনায় না।, নিজেদের ভাগ্যের উপর বিশ্বাস রেখে নিসাকে বিশ্বাস জুগিয়েছে এইরকম স্বামী কতজনের ভাগ্যে থাকে!

– ‘কিরে দিদি মনখারাপ!’

নাজিয়ার ডাকে নিসা ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে, মেকি হেসে বলল,
– ‘একটু মনখারাপ তো লাগছে, তোর জিজু’কে ছেড়ে থাকতে পারিনা।’
– ‘আহা গো কত ভালোবাসা। দোয়া করি তোমাদের ভালোবাসাই নজর না লাগে।’

নিসা নাজিয়ার কথা বলার ধরন দেখে হেসে দিল, মনের মাঝে আর একটা প্রশ্ন উঁকি দিলো.. সত্যি কি ওর আর আবিরের ভালোবাসা এইরকম আজীবন থাকবে!

– ‘এই দিদি কোথায় হারিয়ে যাচ্ছিস?’
– ‘এই তো। বলছি বোন পড়াশোনা শেষ করতে আর কতদিন লাগবে!’
– ‘হঠ্যাৎ এই প্রশ্ন?’
– ‘না তোর বিয়ের বয়স হচ্ছে। একটা সংসার করে নিজেকে গুছিয়ে নে না।’
– ‘বিয়ের সময় হলে ঠিকই বিয়ে হবে ,তোমাকে এতটা চিন্তা করতে হবে না।’

নিসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, চিন্তা কি আর এমনি এমনি হয়। ছোট বোনটাকে ভালো পাত্রস্থ করতে পারলে তবেই শান্তি।

আবির মনখারাপ করে নিসা ও নাজিয়াকে ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসল। নাজিয়া বারবার বাড়ির ভেতরে যেতে বললেও আবার যায়নি, প্রিয়তমাকে এই অবস্থাতে একা রেখে যেতে মন মানছে না। নিসা বিষয়টা বুঝল তাই নাজিয়াকে জোরাজুরি করতে বারন করল।

– ‘দিদি শোন না, মা বাবাকে ওই বাড়িতে ঝামেলার কথাগুলো বলিস না ওনারা কষ্ট পাবেন।’

নিসা বোনের মুখের দিকে তাকাল, ওই বাড়িতে এতটা লাঞ্ছিত হবার পরেও বাবা মাকে বিষয়টি জানাতে বারন করছে, মেয়েটা এতটা ভালো কেন!

দিন চলতে লাগল, নিসার ডেলিভারির ডেট আগিয়ে আসছে, তার সাথে আবিরের দুশ্চিন্তাও। নিসা সামনে থাকলে একটু শান্তি পেত কিন্তু এখন তো সেটাও নেই আর রোজ রোজ শশুড় বাড়িতে গেলে বিষয়টা খারাপ দেখায়। প্রতিদিন নিসার সাথে ভিডিও কলে কথা হয়, নাজিয়াকে ফোন করে খোঁজ খবর নেই কিন্তু শান্তি পাই না। মনে হয় এখুনি নিসাকে নিজের কাছে নিয়ে চলে আসতে।

ওই বাড়িতে একটা কাজের লোক রাখা হয়েছে, যার রান্নার হাত ভালোই কিন্তু খাবার খেয়ে কোনো তৃপ্তি পাওয়া যায় না।।

আবিরের মা খাবারের থালায় আঁকিবুঁকি করে চলেছে, অনেকক্ষণ থেকে একটা প্রশ্ন করবে করবে করে করা হয়ে উঠছে না। আবিরের বাবা বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরে আবিরকে বলল,

– ‘কিরে আবির নিসা মায়ের ডেলিভারির ডেট কবে দিয়েছে ডক্টর?’
– ‘সামনের মাসের ২০ তারিখ।’
– ‘ওহ। ডক্টর বলেছে সব কিছু ঠিক আছে তো!’
– ‘হুমম।’

আবির নিজের খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেল, মায়ের সাথে একবারও কথা বলল না। বিষয়টিতে আবিরের মায়ের মনখারাপ হয়, নিসার বাড়ি থেকে চলে যাওয়াতে ওনার মনখারাপ হয়েছে ঠিকই কিন্তু নাজিয়ার উপরে তার থেকে বেশি রাগ জমা হয়েছে। মনে মনে হয়েছে, নাজিয়ার জন্যই নিসা এই বাড়ি থেকে চলে গেছে।

আবির নিজের রুমে গিয়ে নিসাকে ভিডিও কল করে দুইবার বাজার পর কলটা রিসিভ হয়,

– ‘আসসালামু আলাইকুম আবির’দা।’
– ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুই ফোনটা রিসিভ করলি! নিসা কোথায়?’
– ‘দিদি ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই আমি কলটা রিসিভ করলাম।’
– ‘নিসার শরীর ঠিক আছে তো!’
– ‘হুমম ঠিক আছে তুমি চিন্তা করো না। আর একটা কথা।’
– ‘কি?’
– ‘আমাকে কয়েকদিনের জন্য হোস্টেলে যেতে হবে। বাড়িতে মা বাবা থাকবে তবুও তুমি পারলে মাঝে মধ্যে এখানে এসে থেকো।’
– ‘হোস্টেলে কেন? খুব বেশি দরকার কি!’
– ‘হ্যাঁ। পরের মাস করে এক্সাম শুরু হবে, তাই কিছু কাজ করার ছিল।’
– ‘আচ্ছা যা সাবধানে থাকিস কেমন।’
– ‘তুমিও।’

আবিরের সাথে কথা বলার দুদিন পরেই নাজিয়া হোস্টেলে চলে গেছে। সামনেই ইয়ার ফাইনাল এক্সাম, মাঝে কয়েকমাস নিসার অসুস্থতার জন্য ক্লাস করতে পারেনি এখন কলেজ না গেলে শিওর ডাব্বা মারবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হোস্টেলে ফিরতে হয়েছে, কিন্তু মন নিসার কাছেই আটকে আছে। নাজিয়া হোস্টেলে যাবার পর থেকে ক্লাস নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এইটাই শেষ এক্সাম তারপরেই গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাবে।

নাজিয়া কলেজে আসতেই প্রথমেই দেখা হয়ে যায় হিরকের সাথে। হিরকের বলা সেই কথাটার পর থেকে নাজিয়া ওকে ইগনোর করে চলেছে, তবে কলেজে আসার পর থেকে না চাইতেও ওর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রতিদিনের মতো হিরক ওর কাছে এসে বলল,

– ‘কিরে নাজিয়া তুই কি আমাকে ইগনোর করছিস?’
– ‘প্রতিদিন এক কথা বলতে তোর বিরক্ত লাগে না! দেখা হলেই আমাকে ইগনোর করছিস বলে বলে মাথা খারাপ করিস কেন?ষ

প্রতিদিনের এক কথায় নাজিয়া বিরক্ত হয়ে উঠেছে, এতদিনের রাগটা শেষমেশ ঝেড়েই দিলো।
– ‘আরে কুলল। এত রেগে যাচ্ছিস কেনো? আমি তো মজা করছিলাম।’
– ‘তাই বলে প্রতিদিন এক মজা! আর আমি যদি ইগনোর করা তো তুই কি করবি!’

হিরক দাঁত বের করে বলল,
– ‘তোকে কিডন্যাপ করে বিয়ে করে নেব।’

নাজিয়া রাগী চোখে তাকাতেই হিরক নিজের হাসি থামিয়ে দিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নাজিয়ার ফোনে কল আসে…

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০৪

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৪)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

নাজিয়া কিছুতেই নৌকায় উঠতে চাইছে না, কিন্তু শ্রেয়ার জোরাজুরির কবলে পড়ে নাও করতে পারছে না। আবরার নাজিয়ার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘ভীতু মানুষরা এইসব থেকে দূরে থাকাই ভালো।’

কথাটা নাজিয়ার গায়ে লাগল। আবরার’কে কিছূ না বলেই নৌকায় চড়ে বসলো। শ্রেয়া সেটা দেখে মুখটা ফ্যাকাশে করে বলল,

– ‘ওহ তো আমাদের নৌকা’টাই বসে পড়ল। এখন আমরা কোথায় বসবো?’
– ‘তুমি আর নাজিয়া একটাতে বসো আর আমি অন্যটাতে বসছি।’
– ‘কেন?’
– ‘নাজিয়া পানিতে ভয় পাই, তাই তোমাকে যেতে বলছি।’
– ‘থাক বাবা তুমিই যাও। আমি সামলাতে পারব না।’
– ‘আচ্ছা।’

আবরার নাজিয়ার নৌকায় উঠে বসতেই নাজিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আপনি এইখানে কেন?’
– ‘তুমি যেখানে আমিও সেইখানে।’
– ‘ধ্যাত যান তো।’
– ‘যা বাবা, যার জন্য আসলাম সেই বলে চলে যেতে।’
– ‘আমি কি আসতে বলেছি নাকি?’
– ‘কিন্তু পানিতে ভয়টা তো পাও।’

নাজিয়া আবরারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
– ‘এখনো আমার সম্পর্কে প্রতিটা ছোট বড়ো বিষয় তুমি মনে রেখেছ। কেন এতটা ভালোবাসলে আমাকে, আমি যে তোমাকে কিছুতেই গ্রহন করতে পারব না।’

মনের কথাগুলো হয়তো নাজিয়া আবরার’কে কখনোই বলতে‌ পারবে না।

নৌকা চলতে শুরু করল। শ্রেয়া আনন্দ করছে, ছবি তুলছে আর নাজিয়া? ভয়েতে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আবরার মৃদু হেসে আশেপাশের ছবি ক্যামেরা বন্ধী করার মাঝে নাজিয়ার কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।

– ‘এতই যখন ভয় তাহলে তেজ দেখিয়ে নৌকায় ওঠার কি দরকার বুঝি না বাবা।’

আবরারের ঠেস মারা কথা শুনে নাজিয়া চোখ খুলে তাকাল। আবরার ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, ফলে ওর রাগটা আরো বেড়ে গেল। রাগ নিয়ে উঠতে যাবে তখনি নৌকাটা ঠলে যায়, আবরার দুহাতে আগলে ধরে। দুজন দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়, দুজন দুজনের চোখেই নিজেদের জন্য ভালোবাসা অনুভব করতে পারছে। নাজিয়ার ধ্যান ভাঙতেই সরে এসে বসে পড়ল।

আবরার নাজিয়ার কাছে বসে বলল,
– ‘তোমার চোখের ভাষা বলে দেই তুমি কি চাও তবুও মুখ ফুটে বলতে এতটা বাঁধা কেন?’
– ‘চোখের ভাষা আবার হয় নাকি?’
– ‘হুমম হয় তো। যারা যাদেরকে ভালোবাসে তাদের চোখের ভাষা পড়তে পারে, কেন তুমি পড়তে পারোনি?’
– ‘আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না, তাহলে কিভাবে আপনার চোখের ভাষা বুঝবো!’

আবরার মৃদু হাসল। নাজিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
– ‘হাসছেন কেন?’
– ‘ না আমি কি একবারও বলেছি তুমি আমাকে ভালোবাসো! তাহলে তুমি কেন কথাটা বললে? ওই যে বলে না চোরের মন তল্পির দিকে।’
– ‘কাকু নৌকাটা পাড়ে নিয়ে চলুন আমরা নামবো।’ (নাজিয়া বিরক্ত হয়ে বলল)
– ‘না খবরদার নয়, আমরা এখন এইখানে থাকব। আপনি নৌকা চালিয়ে যান।’

নৌকা চলতে লাগল। আবরার নাজিয়ার কাছাকাছি বসে পড়ল। নাজিয়া’ও চুপ করে নৌকা চড়া-টাকে উপভোগ করে চলেছে, এইটা নিয়ে দ্বিতীয় বার নৌকা চড়া। প্রথম বার নৌকাতে উঠে কেঁদে ফেলেছিল। সে কি যাচ্ছে চাই অবস্থা আর সেটা নিয়ে আবরার কম ক্ষেপায় নি ওকে। আজকে দ্বিতীয়বার নৌকাতে উঠল কিন্তু অতটাও ভয় লাগছে না, কিন্তু কেন? অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে বলে, নাকি আবরার আছে বলে?

– ‘কেমন লাগছে?’ (আবরার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল)
– ‘ভালো।’

বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ওরা বাড়ির পথে রওনা দেয়। নাজিয়ার মনটা ভালো হয়ে উঠেছে। দিন আগিয়ে যেতে লাগল। নিসার শরীরের অবস্থার অবনতি ঘটাতে লাগল, নাজিয়া ওই বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে আর আবরার’ও বাড়িতেই আছে। শ্রেয়া ২দিন পর ফিরে যাবে এই নিয়ে আবরারের মায়ের কত অভিযোগ, উনি কিছুতেই ওনার আদরের ভাতিজাকে ছাড়তে রাজি নন। কিন্তু শ্রেয়ার পড়াশোনা আছে, এইভাবে বসে থাকলে চলবে না তাই বাধ্য হয়েই ফিরতে হচ্ছে। নাজিয়ার সাথে আবরারের সম্পর্কের কোনরকম উন্নতি ঘটেনি, নৌকায় চড়ার পর থেকে নাজিয়া যেন আরো এড়িয়ে চলছে ওকে। আবরারের মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় কিছুতেই নাজিয়াকে বোঝাতে পারছে না নিজের মনের কথা। ঠিক করলো, সরাসরি নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করবে নাজিয়ার সামনে। কি হবে এর পরিনাম?

নাজিয়া ঘর গোছা-ছিল তখনি আবরারের কন্ঠস্বর শুনে পেছন ফিরে তাকাল, আবরার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

– ‘আপনি?’
– ‘হুমম তোমার সাথে কথা আছে, ছাদে আসো।’
– ‘কেন এইখানেই বলুন।’
– ‘প্লিজ ছাদে আসুন।’
– ‘যা বলার এইখানেই বলুন আমার অনেক কাজ আছে।’ (নাজিয়া বিরক্ত হয়ে বলল)

আবরারের রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, এমনিতেই কয়েকদিন ধরে নাজিয়ার ইগনোর ওর মাথা খারাপ করে ছেড়ে দিচ্ছে তার উপরে এইরকম কথা শুনে রাগটা কন্ট্রোল করতে না পেরে এগিয়ে এসে হাতটা ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো। রাগী গলায় বলল,

– ‘এত তেজ কেন তোমার?’
– ‘এইসব আপনি কি বলছেন?’
– ‘কেন বুঝতে পারছো না? না বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করছ?’
– ‘হাতটা ছাড়ুন, কেউ চলে আসবে।’
– ‘আমি কাউকে ভয় পাইনা।’

নাজিয়া আবরারের হাতটা ঝাড়া দিয়ে বলল,
– ‘আপনি ভয় না পেলেও আমি ভয় পাই। আপনারা ছেলেরা সবকিছু করে পার পেয়ে গেলেও আমরা মেয়েরা কিন্তু সেইটা পাবো না, তাই সাবধান থাকা উচিত। আর একটা কথা, আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না ফলাফল কিন্তু খুব একটা ভালো হবে না তাতে।’

আবরার তেঁতে উঠল, নাজিয়ার হাতটাকে পুনরায় ধরে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
– ‘কি করবে তুমি!’

নাজিয়া আবরারের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
– ‘এই বাড়ি সারাজীবনের জন্য ত্যাগ করব।’

আবরারের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল, পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক সে চাই না। আবরার অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

– ‘এইসব তুমি কি বলছো?’
– ‘ঠিক বলছি। আপনি এমন কিছু করবেন না যাতে এই বাড়িতে আসা বন্ধ করতে হয় আমাকে।’

আবরার ব্যথিত কন্ঠে বলল,
– ‘ঠিকাছে আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না তবুও তুমি এই বাড়িতে আসা বন্ধ করো না।’

নাজিয়া কোনো উত্তর দিলো না, আবরার নাজিয়াকে ছেড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।

গভীররাত সবাই ঘুমে মগ্ন কিন্তু দুটো মানুষের চোখে ঘুম নেই। একজন প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে প্রত্যাখান পেয়ে ব্যথিত আর অন্যজন আঘাত দিয়ে সেই আঘাতে ব্যথিত। কি আছে দু-প্রান্তের মানুষ দুটোর কপালে। দূরত্ব যে বেড়েই চলেছে, এর পরিনাম কি হবে!

আজ শ্রেয়া বাড়ি ফিরে যাবে, স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসার দায়িত্বটা আবরারের ঘাড়েই পড়েছে। এই দুইদিনে আবরার নাজিয়ার সাথে কোনোরকমের কথা বলার চেষ্টা করেনি, সামনে পড়লেও এড়িয়ে গেছে বিষয়টি নাজিয়ার কাছে কষ্টদায়ক হলেও হাসিমুখে মেনে নিতে হচ্ছে।

নাজিয়া রান্নাঘরে সকলের জন্য ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে, আবরার আর শ্রেয়া একটু পরেই বের হবে ওদের জন্য একটু তাড়াতাড়িই তৈরি করছে। শ্রেয়া রেডি হয়ে নীচে আসতেই আবরারের মা খাবারের জন্য তাড়া দিতে লাগলেন, নাজিয়া তাড়াহুড়ো করে করতে লাগল।

হাঁক-ডাক করতে দেখে শ্রেয়া বলল,
– ‘মামনি এত তাড়াহুড়া করতে হবে না, একটু ওয়েট করো নাজিয়া নিয়ে আসছে তো‌।’
– ‘ওর জন্য কি ছেলে-মেয়ে দুটো না খেয়ে বের হবে! জানত তো আজ সকাল সকাল তোরা বের হবি একটু আগে উঠলে কি ক্ষতি হতো?’

আবরারের মায়ের কথা শুনে নাজিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়। রান্নাঘর থেকে বসার ঘরের কিছুটা অংশ এবং সমস্ত কথা শুনতে পাওয়া যায়, তাই ওহ পাচ্ছে।সে তো আর ইচ্ছা করে দেরিতে উঠেনি, তাড়াতাড়ি উঠেই রান্নাঘরে এসেছে যাতে ওরা না খেয়ে না যায়। তারপরেও এইসব কথা শুনতে কার ভালো লাগে!

মায়ের কথা শুনে আবিরের ভ্রু কুঁচকে গেল, রাগী গলায় বলল,

– ‘মা কাকে কি বলছো তুমি!’
– ‘দ্যাখ না বাবা শ্রেয়া-রা এখুনি বের হবে এখনো রান্না হয়নি তাই…
– ‘মা আমি সবটা শুনেছি তাই আলাদা করে কিছু বলতে হবে না। মা কাল তোমার বৌমার পেইন উঠেছিল, নাজু সারারাত ওর কাছে ছিল ভোরের দিকে এসে ঘুমিয়েছে তাই উঠতে দেরি হয়ে গেছে। আর মা নাজু নিসার ছোটবোন আমাদের বাড়ির আত্মীয় কাজের মেয়ে নয় যে তুমি ওকে এইভাবে কথা বলবে। নিসা অসুস্থ তাই আমি ওকে এখানে এনেছি নিসার দেখাশোনা করার জন্য তবুও তো ওহ আমাদের গোটা সংসার সামলাচ্ছে।’
– ‘তুই মেয়েটার জন্য আমাকে এতগুলো কথা শোনা-লি?’ (অবাক চোখে)
– ‘মা নাজিয়া আমার কাছে ছোটবোনের মতো। নিসা এবং আমাদের সন্তানের জন্য আমি নাজু’কে ওর হোস্টেল থেকে এখানে নিয়ে এসেছি, আসার সময়ে ওর বাবাকে বলেছিলাম ওর পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না কিন্তু দেখো মেয়েটা সারাদিন সংসারের কাজ করতে করতে পড়ার সময় পাচ্ছে না। এখানে আমার মুখটা কোথায় থাকবে তুমিই বলো!’

আবরারের মা ক্ষেপে উঠলেন,
– ‘তাহলে তুই কি বলতে চাইছিস আমি সংসারের সব কাজ করব!’
– ‘না মা আমি সেটা কখনোই বলিনি। আমি তো চেয়েছিলাম একটা কাজের মেয়ে রাখতে কিন্তু তুমি রাজি হওনি। একটিবার ভেবে দেখছে, নাজু না থাকলে তুমি একা হাতে কিভাবে সবটা সামলাতে!!’
– ‘আমি ঠিক পারতাম, আমি আমার সংসারের জন্য একাই যথেষ্ট। ওই মেয়েকে আর কিছু করতে হবে না, আমি আজ থেকে সবকিছু একা করব। ওকে যে কাজে এনেছিস সেটা ভালো করে করতে বল।’
– ‘মা তুমি ভুল বুঝছ..
– ‘থাক আমার আর কিছু বোঝার নেই, সব বুঝে গেছি। তোর কাছে তোর মায়ের থেকে তোর শালি বেশি আপন হয়ে গেছে, সব বুঝেছি আমি।’

আবরারের মা কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে গেলেন, আবার মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ওর মা এতটা অবুঝ কেন? শ্রেয়া বিরক্ত হলো ওনার কাজকর্মে, এই কয়েকদিনে দেখেছে নাজিয়া এই পরিবারের জন্য কতটা করছে ওর জায়গায় অন্য কেউ কি ওহ নিজে হলেও এতটা করত না। শ্রেয়ার মনে প্রশ্ন জাগল, মামনি নাজিয়ার প্রতি এতটা ক্ষিপ্ত কেন!

চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০৩

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– ‘নাজু তুই কি আবরারকে পছন্দ করিস বা করতিস?’

নাজিয়া চমকে উঠল। নিসার জানা বা সন্দেহ করার কথা নয় বিষয়টিতে, নাজিয়া কখনোই এমন কিছু করেনি যেটাতে আবরারের প্রতি ওর অনুভূতি প্রকাশিত হয়। তাহলে নিসা কিভাবে কথাটা বলছে?

– ‘এইসব তুই কি বলছিস?’
– ‘না আমার মনে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। সত্যি বল না বোন।’
– ‘নারে দিদি সেইরকম কিছু না। তোর দেবর আমার সাথে একটু মজা করতো এইটাই যা।’
– ‘সত্যি তো।’
– ‘হুম।’

দুই বোন আড্ডাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নিসার শাশুড়ি মা শ্রেয়ার জন্য অনেক রকমের পদের রান্না নিজে হাতে করছে, নাজিয়া সাহায্য করতে চাইলে সরাসরি না বলে দিয়েছে তাই থাকা না বাড়িয়ে নাজিয়া নিজের বরাদ্দকৃত ঘরটিতে বসে ফোন ঘাটছিল। তখনি ওর ক্লোজ ফ্রেন্ড হিরক ভিডিও কল করে, নাজিয়াও রিসিভ করে কথা বলতে থাকে। কথার একটা পর্যায়ে হিরক বলে উঠে,

– ‘এই নাজু তুই আগের থেকে কিউট হয়ে গেছিস। ইচ্ছা করছে খেয়ে নিতে।’

নাজিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে, হিরক এই কথাটা বলবে কখনোই আশা করেনি। অন্যদিকে হিরক কথাটা বলে অস্বত্বিতে পড়ে যায়, নাজিয়াকে দেখতে দেখতে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে কখন কথাটা বলে ফেলেছে সেইদিকে খেয়ালই নেই।

– ‘কি বললি তুই!’
– ‘দূর একটু মজাও বুঝিস না তুই।’

নাজিয়া আর কথা বাড়ায় না, হিরকের কথাটা শোনার পর থেকে প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছিল তাই কাদের বাহানায় ফোনটা রেখে দেই।

– ‘দিদি ডাকছে, ফোনটা রাখছি পরে কথা হবে।’
– ‘আচ্ছা।’ (মনখারাপ করে)

নাজিয়া কলটা কেটে উঠে বসতেই দরজায় টোকা পড়ে, দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল আবরার পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

– ‘আপনি এইখানে কি করেন?’
– ‘না দেখতে এলাম ভাবির বোনের কান্ড।’

নাজিয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল। কথাটার মানে বুঝতে না পেরে বলল,

– ‘মানে?’
– ‘ভাবি জানে কি তার বোন ছেলেদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে?’
– ‘আমার ফ্রেন্ডের সাথে আমি কথা বলতেই পারি, তাতে কাউকে জানানোর কি আছে?’

নাজিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে কথাটা বলল। এমনিতে হিরকের কথাটা শুনে কেমন যেন এলোমেলো লাগছে।

– ‘শুধুমাত্র কথা বললে কিছুই নয় কিন্তু অন্যকিছু করলে তো ভাবিকে জানাতেই হচ্ছে।’
– ‘এই আপনি কি মিন করতে চাইছেন?’
– ‘তোমার ফ্রেন্ড তোমাকে কি বলেছে সবটাই আমি শুনেছি। আর এই কথাটা কে কাকে বলতে পারে সেটাও আমার জানা।’ (রাগী গলাতে)
– ‘কি শুনেছেন আপনি?’

আবরার উত্তর না দিয়ে নাজিয়ার কাছাকাছি গিয়ে বলল,
– ‘অন্য কেউ তোমাকে নিয়ে ওইরকম কথা বলবে কেন?’
– ‘আরে কি বলেছে সেটাই তো বূঝতে পারছি না।’

আবরার রেগে গেল। নাজিয়া বাম হাতটা ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
– ‘সত্যি বুঝতে পারছ না, নাকি নাটক করছো?’
– ‘সত্যি বুঝতে পারছি না। আর আমার হাতটা ছাড়ুন, আমার অস্বস্থি হচ্ছে।’
– ‘আমি স্পর্শ করলেই তোমার অস্বস্তি হয়। অন্য কোনো ছেলে স্পর্শ করলে, সুন্দর কমেন্ট করলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না।’ (রাগ নিয়ে একটু জোরেই কথাটা বললো)

নাজিয়া প্রচন্ড রাগ নিয়ে আবরার দিকে তাকায়, কিন্তু তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। আবরারের ফর্সা মুখশ্রী রাগে লাল হয়ে আছে, সবথেকে আকর্ষনীয় লাগছে নাকটা ইচ্ছা করছে একটু টেনে দিতে। এখন নাজিয়ার ইচ্ছা করছে হিরকের বলা কথাটি আবরারকে বলে দিতে।

– ‘এই আমি কিছু বলছি।’ (নাজিয়াকে নাড়িয়ে দিয়ে)

নাজিয়ার ধ্যান ভাঙতেই বলল,
– ‘ছাড়ুন আমাকে।’

আবরার নাজিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
– ‘ওই ছেলের সাথে বেশি মেলামেশা করবে না।’
– ‘কেন?’
– ‘তুমি জানো না, একটা ছেলে কখন একটা মেয়েকে এইরকম কথা বলে? না জানলে আমিই বলে দিচ্ছি ছেলেটি তোমাকে পছন্দ করে, আমি স্পষ্ট দেখেছি ছেলেটি তোমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল।’

আবরার দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলল। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে ওর, তখনের দৃশ্যটা মনে‌ পড়লেই রাগ হচ্ছে প্রচন্ড পরিমানে। কথাটা শুনে নাজিয়াও চমকে উঠল, হিরক ওকে পছন্দ করে কথাটা ভাবতেই মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তবুও আবরারকে বুঝতে না দিয়ে বলল,
– ‘পছন্দ করে তো কি হয়েছে!’

আবরার নাজিয়াকে আবারো নিজের কাছে টেনে নিলো। দুজন দুজনের নিঃশ্বাস স্পর্শ করছে, আবরার নাজিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
– ‘আমাদের মাঝে হাজার দূরত্ব থাকলেও তুমি শুধুই আমার। আর আমি আমার জিনিসের উপরে অন্যকারোর নজর সহ্য করব না, তাই ওই ছেলের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে নাহলে ফলটা খুব একটা ভালো‌ হবে না। মাইন্ড ইট।’

**

নাজিয়া তম মেরে দাঁড়িয়ে আছে, আবরারের কথাগুলো কানে বেজে উঠছে বারবার।

– ‘কি বলে গেল ওহ!’

নাজিয়া কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না। আবরারের কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। নাজিয়া রান্না করতে গিয়ে দেখল আবরারের মা শ্রেয়ার‌ সাথে বসে গল্প করছে। নাজিয়াকে দেখা মাত্রই শ্রেয়া বলল,

– ‘আরে নাজিয়া কোথায় যাচ্ছো? আসো না বসে গল্প করি।’
– ‘আসলে শ্রেয়াদি দিদির জন্য কিছু রান্না করতে হবে, আমি রান্নাটা করে তোমার সাথে গল্প করছি।’

নাজিয়া রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ল। শ্রেয়া ওর মামনি বলল,

– ‘মামনি মেয়েটা বেশ লক্ষি তাই না।’

আবিরের মা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
– ‘বেশি মাথায় তুলবি না একদম। কয়েকদিন দিদির বাড়িতে আছে কদিন পর চলে যাবে আর তুই এই বাড়ির বউ হবি। তোকে শক্ত হাতে সবকিছু সামলাবে।’
– ‘মানে?’

শ্রেয়া কিছুই বুঝল না। আবিরের মা নিজের মনে মনেই বকবক করতে লাগলেন, শ্রেয়া একটু বিরক্ত হলো তবে কিছুই বলল না। নাজিয়া দিদির জন্য স্যুপ করে নিসাকে দিয়ে আসে। তারপরে বসার ঘরে এসে বলল,

– ‘শ্রেয়া দি কি খাবে বলো। আমি করে দিচ্ছি।’

শ্রেয়া কিছু বলতে যাবে তার আগে আবিরের মা বলল,
– ‘দরকার নেই। শ্রেয়া এখুনি আবরারের সাথে ঘুরতে বের হবে। তুমি তোমার কাজে যাও।’

কথাটা শোনার পর নাজিয়ার একমুহুর্ত ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাইল না, চলে যেতে যাবে তার আগে শ্রেয়া বলল,
– ‘মামনি নাজিয়াও আমাদের সাথে যাক না। দারুন মজা হবে।’
– ‘কিন্তু…
– ‘প্লিজ।’
– ‘মা নাজুও যাক না, একটু ঘুরে আসবে।’ (আবির)

আবিরের মা সামনাসামনি কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগলেন। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ দেখে শ্রেয়া নাজিয়াকে বলল রেডি হয়ে আসতে। আবিরের মায়ের মত নেই বুঝতে পেরে নাজিয়া বলল,

– ‘শ্রেয়া দি তুমি যাও না,আমি গিয়ে কি করবো?’
– ‘কোনো কথা নয়, রেডি হয়ে নাও। আচ্ছা চলো আমি তোমাকে রেডি করিয়ে দেব।’

শ্রেয়া নাজিয়াকে টেনে নিয়ে চলে গেল। আবিরও নিজের কাজে চলে যায়, আর আবিরের মা রাগে ফুঁসতে লাগলেন।

শ্রেয়া নাজিয়ার বারন সত্ত্বেও সরকারি ব্লু রঙের সালোয়ার কামিজের সাথে হাল্কা সিম্পল মেকাপ করিয়ে সাজিয়ে দিলো।

– ‘দ্যাখো কেমন লাগছে?’

নাজিয়া আয়নার দিকে তাকাল, কতদিন পর সাজগোজ করলো। এখন তো ঠিকমতো আয়নার সামনেই দাঁড়ানো হয়না, নিজের খেয়াল রাখা হয়না অথচ একটা সময়ে এই সাজ-গোজ কতটা ভালোবাসত, নিজের পেশা হিসাবে নিতে চেয়েছিল সবটা এখন অতীত। কিছু কিছু গল্প, ইচ্ছা সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে যায়।

নাজিয়া কে একভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শ্রেয়া বলল,
– ‘কি হলো বলো।’
– ‘সুন্দর লাগছে।’
– ‘পাগলি।’
– ‘এইবার যাও রেডি হয়ে আসো‌।’
– ‘হুম।’

শ্রেয়া মুচকি হেসে নিজে রেডি হতে চলে গেল। নাজিয়া আবারো আয়নার নজর রাখল, নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তখনি পেছন থেকে আবরার বলে উঠল…

– ‘বউ বউ লাগছে।’

ঘোরলাগা চেনা কন্ঠস্বরে নাজিয়ার গোটা শরীর কেপে উঠল। বউ ডাকটা বুকের মাঝে অজানা কম্পনের সৃষ্টি করছে, নাজিয়ার বড্ড লজ্জা লজ্জা লাগছে।

– ‘লজ্জায় তো একেবারে টমেটো হয়ে যাচ্ছো।’
– ‘এই আপনি চুপ করবেন।’
– ‘কেন কেন? আমি কি কারোর নাম ধরে বলেছি নাকি।’
– ‘আপনাকে আমি…
– ‘কি বলো, শুনি আমি।’
– ‘ধ্যাত।’

নাজিয়া বিরক্ত হয়ে ঘরের বাইরে চলে যেতে যাবে আবরার ওর হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল,
– ‘একদিন না একদিন তো আমার বউ হয়েই আসবে তাহলে এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে।’
– ‘আমি আপনাকে বিয়ে করবো না, সেইখানে বউ হবার কথা আসছে কোথা থেকে?’
– ‘হবে হবে সব হবে।’

আবরার শিষ বাজাতে বাজাতে চলে যায়। নাজিয়া ভেবে পাইনা কি করবে, এইভাবে চলতে থাকলে নিজের মনকে শাসন করে রাখতে পারবে না কিছুতেই।

শ্রেয়ার ডাকে নাজিয়া বাইরে আসে। তারপর তিনজন মিলে বেরিয়ে পরে ঘোরাঘুরির জন্য। শ্রেয়া আর নাজিয়া পেছনে বসেছে, আর আবরার সামনে ড্রাইভার গাড়ি ড্রাইভ করছে। আবরার ইচ্ছা করেই ড্রাইভার নিয়েছে, ওহ ভালো করেই জানে নাজিয়া ওর পাশে বসবে না, শ্রেয়া বসবে তার থেকে ভালো ওরা দুজনেই পেছনে বসুক।

গাড়ি চলেছে নিজ গতিতে শ্রেয়া প্রশ্ন করছে, আবরার উত্তর দিচ্ছে আর নাজিয়া চুপচাপ ওদের কথোপকথন শুনে চলেছে।

– ‘আবরার আমরা তো ঘুরতে বের হলাম ঠিকই কিন্তু কোথায় যাবো।’

আবরার কিছু একটা ভেবে বলল,
– ‘প্রিন্সেপ ঘাট। একসাথে অনেকগুলো কাজ হয়ে যাবে।’
– ‘কিরকম!’
– ‘হাওড়া ব্রিজ, হুগলি নদী এন্ড নৌকা চড়াও হয়ে যাবে।’

শ্রেয়া লাফিয়ে উঠল, ছোট থেকেই নৌকা চড়তে ওর দারুন লাগে। কিন্তু নাজিয়া ঢোক গিলল, ছোট থেকেই পানি জিনিসটাকে খুব ভয় পাই তারপরে নৌকা সোজা হার্টএট্যাক করবে। নাজিয়ার ভীতু মুখটা দেখে আবরার বাঁকা হেসে মনে মনে বলল,
– ‘আমিও দেখব কিভাবে আমাকে এড়িয়ে চলো।’

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০২

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব
#তানজিলা_খাতুন_তানু

(২)

সকালের খাবার টেবিলে আবিরের মা বললেন,

– ‘আবরার বাবা শ্রেয়া আসবে, ওকে স্টেশন থেকে একটু নিয়ে আয় তো।’

শ্রেয়া আসল কারনটা কেউ না বুঝলেও নাজিয়ার বুঝতে অসুবিধা হলো না। তবুও সেইদিকে কান‌ না দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগল, বিষয়টা ওদের পারিবারিক ব্যাপার ওর নাক না গলানোই ভালো।

– ‘মা হঠাৎ করে শ্রেয়া কেন?’
– ‘অনেকদিন আসেনি তাই আমিই আস্তে বললাম। যা না বাবা নিয়ে আয় না।’

আবরার বিরক্ত হলো, শ্রেয়া ওর মামাতো বোন কিন্তু ওহ মোটেও পছন্দ করেনা মেয়েটাকে। কিরকম একটা গায়ে পড়া মেয়ে, আবরারের একদম সহ্য হয় না। কিন্তু মায়ের কথা ফেলতে পারল না, বিধায় বিরক্ত মুখে স্টেশনে যাবার জন্য রেডি হতে গেল।

রেডি হয়ে নীচে থামতেই আবির বলল,

– ‘ভাই একটা কাজ করে দিবি।’

আবরারের বিরক্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সকাল সকাল‌ সবাই পেয়েছেটা কি?

– ‘কি বলো।’
– ‘নাজুকে একটু নামিয়ে দিতে পারবি।’
– ‘কোথায়?’
– ‘আসলে ওকে এখানে নিয়ে চলে এসেছি কিন্তু ৩মাস পর ওর পরীক্ষা। এতদূর থেকে টিউশন পড়তে পারবে নাহ তাই কাছেই ভর্তি করিয়ে দেব। আমিই যেতাম আমার একটু কাজ পড়ে গেছে তাই।’

আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর‌‌ মা বলল,

– ‘ওকে একাকেই চলে যেতে বল। ওহ গেলে শ্রেয়া আসবে কিভাবে?’

ইতিমধ্যেই ওইখানে নাজিয়া উপস্থিত হয়েছে। আবিরের মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারল, আবির ওকে আবরারের‌ সাথে পাঠানোর প্ল্যান করছে আর ওনাদের মা সেটা নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করছেন। নাজিয়া আবিরের কাছে গিয়ে বলল,

– ‘আবিরদা আমি একাই চলে যেতে পারব। তুমি চিন্তা করো না। আমি আসছি।’

নাজিয়া চলে যেতে যাবে তার আগেই আবরার এক ধমক দিলো,
– ‘এই মেয়ে তোমাকে পাকামো করতে কে বলেছে?’

আবরারের‌ ধমক শুনে ওর্ দিকে সবাই চোখ ছোট ছোট করে‌ তাকায়। আবিরের মা বিরক্ত হয়ে উঠেছেন, কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে আবরার বলল,
– ‘মা আমি বাইক নয় গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। তাই ওনাকে নিয়ে যেতে আমার কোনো প্রবলেম হবে না। দাদা তুমি চিন্তা করো না, ওনাকে ভর্তি করিয়ে সাথে করেই বাড়ি ফিরবো। আসছি।’

নাজিয়ার হাতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বেড়িয়ে গেল।‌ আবির সেইদিকে পাত্তা না দিলেও আবিরের মা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। আর নাজিয়া? সে তো এতদিন পর ভালোবাসার মানুষটির স্পর্শে কেঁপে উঠেছে, নাজিয়ার কাঁপন অনুভব করে আবরার মৃদু হেসে মনে মনে‌ বলল,

– ‘মুখে যতই অস্বীকার করো না কেন? আজও তুমি আমাকেই ভালোবাসো। কি কারনে তুমি আমার থেকে দূরে চলে গেছো আমি জানি না,তবে এইবার আমি তোমাকে আপন করে নেবেই। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’

আবরার নাজিয়ার হাত ছেড়ে গাড়ি বের করতে চলে যায়। নাজিয়া এখনো‌ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে, কিছুক্ষন আগের ঘটনা মনে পড়তেই নিষিদ্ধ অনুভূতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। নাজিয়া নিজের মনকে শাসন করে বলল,

– ‘ না নাজু আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লে হবে না। তোকে স্ট্রং থাকতে হবে, তোর আর আবরারের মধ্যে কিছু হওয়া অসম্ভব। তোর কাছে আবরার মানে ‘এক আকাশ দূরত্ব’।’

আবরারের হর্নে নাজিয়ার ধ্যান ভাঙে। পেছনে বসতে গেলে আবরার ধমক দিয়ে বলে,
– ‘এই আমি কি তোমার ড্রাইভার নাকি। চুপচাপ সামনে‌ এসে বসো।’
– ‘পারবো‌ না।’
– ‘দ্যাখো নাজিয়া আমাকে রাগাবে না একদম। চুপচাপ এসে বসো।’

কথাটা নাজিয়ার বুকে গিয়ে লাগল। আবরারের‌ মুখে নাজিয়া ডাকটা কখনোই আশা করেনি, কিন্তু ওই তো‌ বলেছিল নাজু না ডাকতে তাহলে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?

নাজিয়া চুপচাপ সামনের সিটে বসে সিটবেল্টটা বেঁধে নিল। বিষয়টিতে আবরার বিরক্ত হলো, ওর তো‌ ইচ্ছা ছিল সিটবেল্ট বেঁধে দেবার ফাঁকে নাজিয়ার চুলের ঘ্রান নেবে কিন্তু মেয়েটা সব ঘেঁটে দিয়েছে। আবরার মুখ গোমড়া গাড়ি চালাতে লাগল।‌ নাজিয়া আড়চোখে আবরারের মুখের অবস্থা দেখে মিটমিট করে হাসতে লাগল। নাজিয়ার হাসি দেখে আবরার ধমক দিয়ে বলল,

– ‘এই হাসছো কেন?’

ধরা পড়ে গিয়ে নাজিয়া মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,
– ‘কই না তো আমি হাসিনি।’
– ‘খবরদার মিথ্যা বলবে না। তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ আমার জানা, চোখ বন্ধ‌ করে বলে দিতে পারি তুমি কি করছো।’

নাজিয়ার গা বেয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেল। আজ কতদিন পর মানুষটির কাছাকাছি তবুও দুজনের মাঝে কত দূরত্ব। আবরার নাজিয়াকে রাগানোর জন্য বলল,

– ‘মা মনে হয় শ্রেয়াকে আমার বিয়ের জন্য আনছে। মা কিন্তু শ্রেয়াকে খুব পছন্দ করে।’

আবরার ভেবেছিল কথাটাই নাজিয়া রিয়াক্ট করবে কিন্তু কিছুই হলো না, কথার বিনিময়ে নাজিয়া মেকি হাসল।‌ আবরারের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে, নাজিয়ার নিরবতা যতটা না পোড়াচ্ছে, তার থেকে বেশি পোড়াচ্ছে নাজিয়ার মুখের নকল হাসি। ওদের দুজনের সম্পর্ক বলতে কিছুই ছিল‌ না, দুজন দুজনকে কখনোই ভালোবাসি বলেনি। তবে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, আর যেটা এতটাই গভীর যে একে অপরের প্রতিটা পদক্ষেপ মুখ দেখেই বুঝতে পারে।

**
আবরার রাগ নিয়ে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল। মনে মনে বলল,
– ‘আমাকে আর শ্রেয়াকে কাছাকাছি দেখেও তুমি কতটা ঠিক থাকতে পারো আমিও দেখব। তোমার আর আমার মাঝের এক আকাশ দূরত্ব আমি ঘোচাবোই প্রমিস মাই লাভ।’

আবরার নাজিয়াকে কোচিং এর সামনে নামিয়ে দিয়েই গাড়ি নিয়ে চলে গেল। নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ওহ আশা করেছিল আবরার ওর সাথে আসবে। নাজিয়া কোচিং এর‌ হেডের রুমে ঢুকবে, কোথা থেকে আবরার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওহ চমকে উঠল, আবরারকে দেখে নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠল।

আবরার ভেতরে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,
– ‘ওহ নাজিয়া ওর ভর্তির জন্যই আমার দাদা আবির ফোন করেছিল।’
– ‘তাহলে তুমিই নাজিয়া তাই তো।’
– ‘জ্বি।’
– ‘বসো তোমরা।’

উনি কথা বলে নাজিয়াকে ভর্তি করিয়ে নেন। তারপরে ওরা দুজন বেরিয়ে আসে, নাজিয়া কাঁচুমাচু করে বলল,
– ‘আপনি শ্রেয়া’দিকে আনতে চলে যান। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’
– ‘বাড়ি থেকে বের‌ হবার সময়ে কথাটা কি কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি?’
– ‘আমি স্টেশনে গিয়ে কি করবো?’
– ‘জানি না চুপচাপ চলো।’

নাজিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস নিয়ে আবরারের‌ পাশে বসে পড়ল। এই গরমে স্টেশনে মানুষের ভীড় দেখে ঢোক গিললো আবরার, ছোট থেকেই ভীড় অপছন্দ করে আর আজকে এই ভীড় ঠেলে শ্রেয়াকে আনতে যেতে হচ্ছে অসহ্য।

শ্রেয়া আবরারকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরল। আবরার নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে শ্রেয়াকে সরিয়ে দিল, ইচ্ছা করছে মেরে গাল লাল করে দিতে। সামনে নাজিয়া দাঁড়িয়ে সবটা দেখে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, আশা করেছিল আবরার শ্রেয়াকে একটা থাপ্পর দেবে কিন্তু সেইসব না হয়ে উল্টে আবরার শ্রেয়ার সাথে মিষ্টি হেসে কথা বলতে শুরু করল।

– ‘কিরে শ্রেয়া কেমন আছিস?’
– ‘আমি তো ভালো আছি তুমি কেমন আছো? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম, ইশ্ আগের থেকে কত রোগা হয়ে গেছো।’

নাজিয়া চোখ ছোট ছোট করে‌ করে আবরারের দিকে তাকাল। আবরার আগের তুলনায় রোগা হয়ে গেছে ঠিকই তবে এখন আগের থেকে বেশি কিউট লাগছে। আর এই মেয়ে এমন করে বলছে যেন রোগা কাঠ হয়ে গেছে অসহ্য।

আবরার শুকনো কাশি দিলো, এই চেহারা দেখে কত মেয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেই আর এই মেয়ে এই চেহারার অপমান করছে। আচ্ছা ওহ কি দেখতে এতটাই খারাপ, এই কারনেই কি নাজিয়া ওকে পাত্তা দেয় না। ভাবতেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল আবরারের।

আবরারের মুখের রং বদলে যেতে দেখে নাজিয়ার পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে, কিন্তু এখন কিছুতেই হাসা যাবে না। তাই কোনোরকমে হাসি আটকে বলল,
– ‘আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি আপনারা আসুন।’

কথাটা বলে নাজিয়া গাড়ির কাছে চলে গিয়ে হাসতে শুরু করল। হ্যান্ডস্যাম মানুষকে রোগা বললে তার মুখের অবস্থা কিরকম হয় সেটা আবরারকে না দেখলে কখনোই বুঝতে পারত না।

– ‘শ্রেয়া বাড়ি চলো।’
– ‘চলো।’

ওদেরকে গাড়ির দিকে আসতে দেখে নাজিয়া হাসি থামিয়ে ভালো মেয়ের দাঁড়িয়ে রইল। আবরার ড্রাইভার সিটে বসতেই নাজিয়া পেছনের সিটে গিয়ে বসে পড়ল, আর শ্রেয়া সামনে। আবরার নাজিয়ার দিকে রাগী লুক নিয়ে তাকাল কিন্তু ওহ সেইদিকে পাত্তা না দিয়ে ফোনে টুকটুক করতে লাগল।

বাড়িতে যাওয়া মাত্রই আবরারের মা শ্রেয়াকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিলেন।

– ‘কতদিন পর আসলি। এতোদিনে মামনির কথা মনে পড়ল।’
– ‘তোমাকে সবসময়েই মনে পড়ে। কিন্তু সবমিলিয়ে আসা হয়ে উঠে না।’
– ‘হুমম সব বুঝি। এখন ফ্রেশ হবি চল।
– ‘হুম।’

আবরারের মা শ্রেয়াকে নিয়ে চলে যেতেই আবরার নাজিয়াকে বলল,
– ‘তুমি তখন পেছনে বসলে কেন?’
– ‘তো কি করব?’
– ‘দূর তোমার সাথে কথা বলাই বেকার।’
– ‘সেটা আজকে জানলেন বুঝি।’
– ‘তুমি না বড্ড ফাজিল হয়ে গেছো।’
– ‘কে বললো।’
– ‘আমি বলছি।’
– ‘আপনার আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হবে না, আপনি বরং শ্রেয়া’দিকে নিয়ে ভাবুন।’

কথাটি বলেই নাজিয়া নিসার কাছে চলে গেল।

আবরার নাজিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
– ‘এই পাগলির পাল্লায় পড়ে আমি নিজেই না পাগল হয়ে যায়।’

নিসা নিজের ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে।

– ‘দিদি কি করছিস?’
– ‘এই তো‌ বই পড়ছি। তো কোচিং এ ভর্তি হলি?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘শ্রেয়া এসেছে।’
– ‘হুম।’
– ‘এইবার মনে হয় মা ভাইয়ের বিয়েটা দিয়েই দেবে।’
– ‘ভালো তো। একটা বিয়ে খেতে পারব।’
– ‘নাজিয়া একটা সত্যি কথা বলবি?’
– ‘কি বল।’

নিসার কথা শুনে নাজিয়া চমকে উঠে।

#চলবে…

এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০১

0

#এক_আকাশ_দূরত্ব
#পর্ব_১
#তানজিলা_খাতুন_তানু

“এতগুলো বছর এই বাড়িতে না আসার কারনটা কি নাজিয়া?”

আরবার এর প্রশ্নে নাজিয়া চমকে উঠল। আনমনে ছাদে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিবিলাসে ব্যস্ত ছিল তখনি আগমন ঘটে আরবারের। নাজিয়া একপলক তাকিয়ে চোখটা ততক্ষনাত সরিয়ে নেয়, এই মানুষটির দিকে তাকানোর অধিকার যে ওর নেই।

– ‘কি হলো নাজু বলো।’
– ‘আমাকে নাজু বলে না ডাকলেই খুশি হবো। এই নামটা আমার ব্যক্তিগত আপন মানুষদের জন্য।’
– ‘আমি কি তোমার আপন নয়?’
– ‘না।’

আরবার চমকে উঠল। নাজিয়ার মুখ থেকে এইরকম কথা কখনোই আশা করেনি, আরো কিছু বলবে তার পূর্বেই নাজিয়া ছাদ থেকে চলে যায়। আরবার হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

নাজিয়াকে ওর পছন্দ সেই দাদার বিয়ের দিন থেকেই। বিয়ের গেটে দাঁড়িয়ে কি ঝগড়াটাই না করেছিল ভাবলেই হাসি পাই। সময়ের সাথে দুজনের মাঝে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে কিন্তু হঠাৎ করেই নাজিয়া আরবারের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেই এমনকি এই বাড়িতে আসাও বন্ধ করে দেই। আরবার অনেক চেষ্টা করেও নাজিয়ার সাথে কথা বলতে পারেনি, নাজিয়া সেই সুযোগ দেয়নি। পড়াশোনার নাম করে দূরে হোস্টেলে চলে যায়, আরবার ওহ নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে মনের মাঝে নাজিয়ার জন্য অনুভূতি আগের মতোই রয়ে গেছে। তাই তো নাজিয়ার আসার খবর পেয়ে সব কাজ ফেলে বাড়িতে ছুটে এসেছে।

নাজিয়া ছাদ থেকে নেমে সোজা নিসার ঘরে যায়। নিসা কিছু একটা নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে, আর ওর বর আবির রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। ওদের কান্ড দেখে নাজিয়া ফিক করে হেসে দিল। ওদের দুজনের ভালোবাসাটা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়, দুজন দুজনের প্রতি কতটা কেয়ারিং।

– ‘কি হলো জিজুজী কি নিয়ে মান অভিমান চলছে?’
– ‘দ্যাখ না নাজু তোর দিদি এখন ফুচকা খাবে বলছে, ওইটা এখন ওর পক্ষে ভালো নয় সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি কিন্তু মহারানির রাগ হয়ে যাচ্ছে।’ (হতাশ কন্ঠে)
– ‘দিদি কি শুরু করেছিস তুই।‌ আবিরদা তো ঠিক বলেছে, এখন এইসব খাওয়া ঠিক নয়।’
– ‘তুই নাজু তোকে আনা হয়েছে আমার দেখাশোনা করার জন্য ওর চামচা গিরি করার জন্য নয়।’ (রাগ নিয়ে)

দিদির কথার পরিপ্রেক্ষিতে নাজিয়া ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবিরের দিকে তাকাল। সেও করুন চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নিসার প্রেগন্যান্সি চলছে, বিয়ের ৫বছর পর প্রথমবারের মতো প্রেগন্যান্ট হয়েছে। ডক্টররা খুব সাবধানে থাকতে বলেছে তাই তো আবির নিসার দেখাশোনার জন্য নাজিয়াকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে। দিদির শারিরীক অবস্থা,আবিরের রিকুয়েস্ট সবটা দেখে নাজিয়া না করতে পারেনি একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই বাড়িতে এসেছে।‌ নাহলে কখনোই এই বাড়ি মুখো হবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বিধাতা হয়তো অন্যকিছু ভেবে রেখেছে।

– ‘দিদি দ্যাখ আমরা তো ভালোই চাই বল। আর তুই যদি এইরকম করিস তো তাহলে আমি আজকেই বাড়ি চলে যাবো আর কখনো এই বাড়িতে আসব না।’ (রাগ দেখিয়ে)

নাজিয়ার কথাতে নিসা কিছুটা শান্ত হলো। চারবছরে অনেক বলেও নাজিয়াকে এইবাড়িতে আনতে পারেনি, আজ ওর কারনেই এই বাড়িতে আবারো এসেছে।

– ‘ঠিক আছে লাগবে না আমার।’
– ‘এই তো আমার সোনা দিদি।’

আবির মুচকি হাসল। নিসা আর নাজিয়ার সম্পর্কটা স্ট্রং, আর নিসাকে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা একমাত্র নাজিয়ার আছে। নাজিয়া ঠিক কোনো না কোনো ভাবে নিসাকে প্রতিটা বিষয়ে মানিয়ে নেয়, আর এই সুযোগের সৎ ব্যবসার করে আবির।

আবির আর নিসার লাভ ম্যারেজ। আর এই বিয়েটার মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল নাজিয়া, প্রতিটা বিষয়ে আবিরকে হেল্প করছে। ওর কারনেই আবির আর নিসা দুজন একসাথে তাই তো আবির নাজিয়াকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে।

– ‘এই নাজু অনেকদিন তোর হাতে রান্না খাইনি, আজকে তুই রান্না করবি প্লিজ?’

আবিরের কথা বলার ধরন দেখে নিসা আর নাজিয়া ফিক করে হেসে দিলো। নাজিয়া আবিরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলল,

– ‘দিদি দেখছিস আবিরদা বউয়ের হাতের থেকে শালির হাতের রান্না বেশি পছন্দ করছে। কি ব্যাপার জিজুজী।’ (ভ্রু নাচিয়ে)

– ‘কিছুই না শালিকা, অনেকদিন হলো তোর হাতের রান্না খাইনি তাই বললাম। আর সত্যি কি জানিস তোর দিদি না তোর মতো রান্না করতে পারে না।’
– ‘দেখেছিস দিদি আবিরদা কি বলছে?’
– ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বুঝেছি আমাকে আর ভালোবাসে না।’
– ‘আহা গো আমার বউটার রাগ হয়েছে বুঝি।’ (ন্যাকা স্বরে)

ওদের কান্ড দেখে নাজিয়া হাসতে হাসতে শেষ। দরজায় দাঁড়িয়ে নাজিয়ার প্রানখোলা হাসি দেখতে ব্যস্ত।

**

নিসার চোখ পড়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আবরারের দিকে। আবরার একধ্যানে এইদিকেই তাকিয়ে আছে, নিসা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,

– ‘আরে ভাই ওইখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো।’

নিসার কথা শুনে আবির আর নাজিয়া দুজনেই দরজার দিকে তাকাল। আবরারকে দেখে নাজিয়ার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল।

নিসা আবরারকে ভেতরে আসতে বলতেই নাজিয়া উশখুশ করতে লাগল। নাজিয়ার উশখুশানি বুঝতে পেরে আরবার বলল,

– ‘না ভাবি ঠিক আছে, আসলে তোমার শরীর কেমন আছে সেটাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম।’
– ‘ভালোই করেছ, ভেতরে এসো তো দেখি সবাই মিলে একটু আড্ডা মারি।’

নিসার কথার উপরে কিছু বলতে না পেরে আবরার ভেতরে গিয়ে বসল। উঠে চলে গেলে খারাপ দেখায় তাই বাধ্য হয়েই নাজিয়াকে বসে থাকতে হচ্ছে।

– ‘তা ভাই এতদিন পর বাড়িতে ফিরলে, এইবার এইখানে থাকবে তো!’

নাজিয়া একটু চমকে উঠল। নিসার কথার অর্থটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।

আবরার একপলক নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘দেখি কি হয়। কাজ পড়লেই আবারো ছুটতে হবে।’
– ‘এইভাবে আর কতদিন?’

আবির বিরক্ত হয়ে কথাটা বললো। আবরার কথাটির কোনো উত্তর দিলো না দেখে নিসা বলল,
– ‘ভাই বলি কি এইবার বিয়ে করে সংসারটা গুছিয়ে নাও। মায়ের ওহ বয়স হচ্ছে তো।’

– ‘বিয়ে তো করতেই চাই কিন্তু তোমার আদরের বোন তো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।’

মনের কথাটা মনেই থেকে গেল, মুখ ফুটে আর বলতে পারল না। কথাটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য বলল,

– ‘আমার বিয়ে নিয়ে পড়লে কেন তোমরা।’
– ‘কেন গো তোমার বিয়ে নিয়ে কিছূ বলতে বারন নাকি?’
– ‘আরে না। ভাবি তোমার বোনের ওহ তো বয়স হচ্ছে তার বিয়ে নিয়ে তো কেউ কথা বলছো না তো।’

নাজিয়া ফোস করে উঠল, এইখানে আর বসে থাকা সম্ভব নয়। তাই কাজের বাহানা দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

– ‘আমি রান্নাঘরে যায় রাতের রান্নাটা করতে হবে।’

কাউকে কিছু বলতে না দিয়েই নাজিয়া চলে গেল।‌নিসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

– ‘মেয়েটা কেমন যেন হয়ে গেছে।’

আবরার বারবার ভেবেও বুঝে উঠতে পারছে না নাজিয়ার এই পরিবর্তনের কারন। আর না নাজিয়াকে জিজ্ঞেস করলে ওহ নিজে থেকে কিছু বলছে।

রাতে খাবার টেবিলে,

নাজিয়া কয়েকটা পদ রান্না করে খাবার টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। তারপরে সকলে ডেকে খেতে বসালো। নিসা খেতে বসতে চাইছিল না, নাজিয়ার জোড়াজুড়িতে খেতে বসতে বাধ্য হয়েছে। সবাইকে খেতে বসিয়ে নাজিয়া খাবার সার্ভ করে দিচ্ছিল তখনি নিসার শাশুড়ি বললেন,

– ‘আজকে খাবারটা খেতে পারব তো?’

ওনার এইরকম কথাতে নাজিয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। উনি যেভাবে বলছেন এতটাও খারাপ রান্না করে না নাজিয়া। আবির নাজিয়ার গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘মা খাবারটা আগে খাও তারপরে না হয় বলো।’

আবির কথার উপরে আর কিছুই বলতে পারলেন না, এখন কথা বলা মানেই নিজের মনের অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশিত হয়ে যাওয়া আর সেটা এখন কিছুতেই করা যাবে না।

সবাই চুপচাপ খেতে লাগল, আবিরের মা খাবারটা মুখে দেওয়ার আগে সকলের দিকে তাকালেন। সকলেই বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে বিশেষ করে ওনার স্বামী যিনি কিনা ওনার রান্নাতেও খুঁত ধরেন। সেই মানুষটা তৃপ্তি করে খাচ্ছে! আবিরের মা খাবারটা মুখে তুলে অবাক হয়ে গেলেন, সত্যি খাবারটা অতুলনীয়।

আবিরের বাবা খাওয়া শেষ করে হাসি মুখে বললেন,
– ‘এখন থেকে মাঝেমধ্যেই আমাকে রেঁধে খাওয়াতে হবে কিন্তু। আমি কিন্তু তোমার রান্নার ফ্যান হয়ে গেছি।’

নাজিয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তখন আবির বলল,
– ‘নাজু সত্যি খুব ভালো রান্না করে, আমি আগেও খেয়েছি তাই তো আজকে ওকে রাঁধতে বললাম।’

সকলের প্রশংসায় আবিরের মায়ের মুখটা রাগে লাল হয়ে গেল। নিজের মনে মনে বলল,
– ‘কখনো তো আমার রান্নায় এইরকম করে গুনগান করোনি কেউ। আজকে এই বাইরের মেয়ের রান্নার এত প্রশংসা।’

কোনো একটা কারনে নাজিয়াকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনা আবিরের মা‌। নাজিয়া এই বাড়িতে এসে থাকবে এটাতে ওনার ঘোর আপত্তি ছিল কিন্তু ছেলে আর স্বামীর কাছে হার মেনে নিতে হয়েছে। তাই আচার আচরণে বারবার নাজিয়াকে বুঝিয়ে দিতে চাইছে ওর এই বাড়িতে থাকাটাই ওনার আপত্তি আছে।

নাজিয়া সব বুঝেও চুপ করে আছে, আবিরকে কথা দিয়েছে দিদির ডেলিভারির আগে কোনোভাবেই দিদিকে একা ছাড়বে না। নাজিয়াকে এই বাড়িতে আনার জন্য কম কাঠখড় পোড়ায়নি আবির। একরোখা,জেদি নাজিয়াকে মানাতে অনেকটাই কষ্ট করেছে আবির। তবে নাজিয়াকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার পেছনে কি শুধুই নিসার দেখাশোনা নাকি আরো কিছু?

#চলবে

প্রিয়ানুভব পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রিয়ানুভব [শেষপর্ব]
লেখা: প্রভা আফরিন

বাড়িওয়ালা সফেদ মোল্লা মানুষটা দেখতে রুক্ষ, শুষ্ক হলেও মনটা নামের মতোই পরিষ্কার। তাই বিয়ের পরদিনই অনুভব প্রিয়াকে দুপুরের দাওয়াত দিয়ে বসেছেন। এই সময় নব দম্পতি বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি, আত্মীয়দের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে কূল পায় না। কিন্তু অনুভব-প্রিয়ার যা বাপের বাড়ি তাই শ্বশুরবাড়ি। যেহেতু ওদের বিয়েটা ঘরোয়াভাবে হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনও তেমন নেই, তাই বউ ভাতের নামে দুপুরে ওদের খাওয়ানোর ইচ্ছে পোষণ করেছেন সফেদ মোল্লা। কিন্তু দাওয়াত দেওয়ার সময় স্বয়ং সিসিমপুর দলটি উপস্থিত ছিল বলে সফেদ মোল্লা চেয়েও এড়াতে পারেননি ওদের। ভেবেছিলেন সৌজন্যতা দেখিয়ে দাওয়াত করলে ওরাও সৌজন্যতা দেখিয়ে মানা করে দেবে। কিন্তু নন্দিনী নামের দাদাগিরি করা মেয়েটি মোটেও সেটা করল না। গদগদ হয়ে সবার পক্ষ থেকে প্রস্তাব গ্রহণ করল। সেই সুবাদে পরদিন হইহই করে বন্ধুরা হাজির হলো সাদার রাজ্যে। সাদা মহলের সম্মান রক্ষার্থেই আজ নন্দিনী সাদা ফতুয়া ও ফিসকাট প্যান্ট পরে এসেছে। ঈষৎ কোকড়ানো চুলগুলো টুইস্ট করে বাঁধা। লাইট মেকাপ করেছে মুখশ্রীতে। দিগন্ত পরেছে সাদা পাঞ্জাবি, গা থেকে মৃদুলয়ে বেরোচ্ছে ভারসাচির লেবু ও কাঁচা আপেলের মাইল্ড ফ্লেভারের মাইন্ড রিফ্রেস করা সুবাস। টুকটুকিও একই রঙের শাড়ি পরেছে। ঠোটে লাইট পিচি পিংক কালার লিপস্টিক। তিনজন কোমল স্নিগ্ধতা জড়িয়ে রেখেছে চারপাশে। যেন একঝাঁক সাদা পায়রা। ওরা এখন অনুভবের ফ্ল্যাটে। জোহরের পর বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে যাবে। চারবন্ধু নিজেদের স্টাইলে পোশাক পরলেও রঙ মিলিয়ে পরা হয়েছে অনেকবার। আজ অনেকদিন বাদে আবারো রঙ মিলিয়ে পরে ওরা আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত।

দিনের মধ্যভাগেও অনুভবের দুচোখে ঘুমু ঘুমু ভাব। চোখে লালচে আভা। দিগন্ত ওর অবস্থা দেখে কাছে সরে আসে। দাঁত কেলিয়ে লঘু স্বরে বলে,
“বারবার হাই তুলছিস যে! রাতে বুঝি খুব ধকল গেছে? একটুও ঘুম হয়নি?”

অনুভব মুখে হাত রেখে হাই তুলে জবাব দেয়,
“উহু, বললাম না হাডুডু খেলেছি।”

“সব ঠিকঠাক ছিল? কোনো সমস্যা নেই তো? থাকলে কিন্তু চিন্তা করবি না। আমি তোর কলিজার বন্ধু। না সরি, কলিজায় তো হাসু থাকে। আমি তোর কিডনির বন্ধু। আমাকে বিনা সংকোচে জানাবি। ভালো হার্বালিস্টের কাছে নিয়ে যাব। এক কোর্সই যথেষ্ট।”

অনুভবের মুখটা লাল হয়ে গেল। দিগন্তের ঘাড়ে থাবা বসিয়ে কপাল কুচকে বলে উঠল,
“আন্টি জানে, যেই ছেলেকে তিনি কচি খোকা করে রাখতে চেয়েছেন সেই ছেলে পেকে ঝুনা হয়ে যাচ্ছে?”

দিগন্ত ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে। দাঁতে দাঁত চিপে বলে,
“তোদের মতো ফরমালিনযুক্ত বন্ধু থাকলে পাকতে মৌসুম লাগে নাকি?”

“আর তুই কী? ব্যাটা হাইব্রিড প্রজাতি!”

ওরা কথা বলছিল নিচু গলায়। দিগন্তকে মুখ বিগড়ে ঘাড় ডলতে দেখে টুকটুকি বলে উঠল,
“তোদের আবার কী হলোরে?”

“কিছু না। গিয়ে দেখ তো হাসু রেডি কিনা। ইকরি-মিকরি এত সময় ধরে কী সাজাচ্ছে?”

অনুভব তাড়া দিয়ে প্রসঙ্গ বদলায়। সকাল থেকে প্রিয়া তাকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে। ভুলক্রমে সামনে পড়ে গেলেও মুখ লুকিয়ে সরে যাচ্ছে। দরকারে ডাকলে পাঠাচ্ছে দিয়াকে। শুরুতে বউয়ের পালিয়ে বেড়ানো উপভোগ করলেও এখন অনুভবের মন উতলা হয়েছে দেখা পেতে। দেখা পাওয়া গেল আরো বিশ মিনিট বাদে। নন্দিনী প্রিয়াকে ঘরোয়াভাবেই মিষ্টি করে সাজিয়ে দিয়েছে। নতুন বউ ভাবটা ফুটিয়ে তুলতে পরিয়েছে লাল শাড়ি। শাড়িটা প্রিয়ার মায়ের। এক সময় বেশ শৌখিন পোশাক পরতেন তিনি। উত্তরাধিকার সূত্রেই হোক বা নতুন শাড়ি কিনে দেওয়ার অপারগতায়, মুনিরা বেগম সেগুলো মেয়েকে দিয়েছেন। ন্যাপথলিনের গন্ধযুক্ত শাড়িতে মা মা ঘ্রাণ ও অতীতের সুখস্মৃতি বিজড়িত বলেই বোধহয় প্রিয়ার কাছে শাড়িগুলো সেরা উপহার।

বাইরে এসে অনুভবের সামনে পড়ে প্রিয়া গুটিয়ে গেল। শুভ্র পাঞ্জাবিতে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন স্বামীকে এক পলক দেখে মাথা নত করে রাখে। ঠোঁটের কোণে খুবই সুক্ষ্ম এক লাজুক হাসি বিচরণ করছে তার। এদিকে অনুভব ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। বউ হয়ে গেলে মেয়েরা হুট করে এত সুন্দর হয় নাকি! টুকটুকি ওর অবস্থা দেখে বাকিদের শুনিয়ে বলল,
“হাসুর কানের পিঠে কাজল দে কেউ। নয়তো স্বয়ং বরেরই নজর লেগে যাবে।”

প্রিয়া নুইয়ে পড়লেও অনুভব মোটেও লজ্জা পেল না। নন্দিনী ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“আমার মেকআপের জাদু কেমন হইছে মাম্মা?”

অনুভব বলল,
“ভয়ে ছিলাম না জানি মুখের নকশাই বদলে দিস। তোরা তো মেক-আপ করলে হয়ে যাস জুহি চাওলা। আর মেকআপ তুললে পোড়া কয়লা। সে তুলনায় আজকে ভালোই হয়েছে। কারণ বউ আমার এমনিতেই সুন্দর। যা দশ টাকা বখশিশ দেব।”

মেকআপ নিয়ে অপমানজনক মন্তব্যে নন্দিনী ক্ষেপে গেল। ক্রুর হেসে বাঁকা স্বরে বলল,
“হালা! তোর শিল্পকর্ম ঢাকতে আমার যে পরিমাণ মেকআপ খরচ হইছে তার দাম শুনলেও তব্দা খাবি। সম্মানটা যে বাঁচায়ে দিলাম তার জন্য আমারে ধন্যবাদ দে।”

কথার মর্মার্থ উদ্ধার করে অনুভব কেশে উঠল। সন্ধানী চোখে চেয়ে দেখে বউয়ের ঘাড়, গলার দাগগুলো নিপুণভাবে ঢেকে গেছে। প্রথমবারের মতো মেকআপে নন্দিনীর পারদর্শীতার প্রশংসা করতে ইচ্ছে হলো ওর। টুকটুকি ও দিগন্ত এ জগতের কিছুই বোঝে না এমন ভাব করে হাসি চাপার চেষ্টা করছে। প্রিয়া লজ্জায় ওদের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচল। অনুভব মেকি হেসে বলল,
“মাইকিং করে সম্মান বাঁচাচ্ছিস! তোর মানবতায় আমি মুগ্ধ!”
এ কথায় সকলে শব্দ করে হেসে ফেলল।

ঘড়ির কাটায় দেড়টা বাজে। দাওয়াতে যেতে দেরি হচ্ছে বলে ইতিমধ্যে দোতলা থেকে রিমাইন্ডার এসে গেছে। অনুভব ইচ্ছে করেই প্রিয়াকে আটকে দিয়ে বাকিদের বলল,

“তোরা যা। আমরা আসছি।”

রুমে যেতে যেতে প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার হাতঘড়িটা খুঁজে দাও তো, হাসু। সকাল থেকে পাচ্ছি না।”

অভিজ্ঞ বন্ধুরা তার অভিপ্রায় বুঝে ইচ্ছাকৃত গলা খাকারি টেনে ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। প্রিয়া অসীম লজ্জায় ডুবে রুমে ঢুকেই কড়া চাহনি দিল। অনুভবের বন্ধুরা সবাই ওর অনেক সিনিয়র। বেচারি এমনিতেই ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। এদিকে নির্লজ্জ স্বামী অস্বস্তি বাড়িয়েই চলেছে। প্রিয়া গম্বীর স্বরে বলল,
“আপনি নির্লজ্জ হতে পারেন, আমি তো নই। কেন সবার সামনে এভাবে অস্বস্তিতে ফেলেন?”

অনুভব দুই হাতের দৃঢ় বাঁধনে স্ত্রীকে বেঁধে ফেলে। গালে নাক ঘষে বলে,
“সকাল থেকে দূরে আছো কেন? এটা তার ছোট্টো একটা শাস্তি। আমাকে ইগনোর করার চেষ্টা করলে এরপর থেকে আরো ভয়ানক শাস্তি দেব।”

প্রিয়া কপাল চাপড়ে মুখ লুকায়। এখন ওকে শান্তিতে লজ্জাটাও পেতে দেবে না! অনুভব ওকে ভালোমতো দেখে নিয়ে আদেশ দিল,
“কানের পিঠে কাজল দাও, ফাস্ট। নজর লাগা বিষয়টা আমি বিশ্বাস করি। আমার বউয়ের দিকে কারো নজর পড়ুক সেটা আমি চাই না।”

প্রিয়া অনামিকা আঙুলের সাহায্যে নিজের চোখের কোল থেকে কাজল নিয়ে অভাবনীয় ভঙ্গিতে সেটা অনুভবের কানের পিঠে লাগিয়ে দিল। মুগ্ধতায় মগ্ন স্বরে বলল,
“মাশাআল্লাহ! নজর না লাগুক আমার সুদর্শন স্বামীর।”
_____________

স্নিগ্ধ গোধূলি একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হাজির হয়েছে নবদম্পতির দুয়ারে। শ্রান্ত অনুভব বাইরে থেকে ফিরেই ফাইলপত্র অবহেলায় ফেলে রেখে খাটে বসল। শার্টের বোতাম খোলার সময় প্রিয়া গুটিগুটি পায়ে পানির গ্লাস নিয়ে হাজির হয়। অনুভব হাসার চেষ্টা করে ওকে দেখে। হাসিটা নিষ্প্রাণ দেখায়। চারজনের সংসার, বাড়িভাড়া, পড়াশোনার খরচ মিলিয়ে অনুভব প্রিয়া দুজনই সর্বোচ্চ সাহায্য করার চেষ্টা করে চলেছে। একা হাতে সংসারের কাজ করে প্রিয়া। মেয়েটার কষ্ট যেন কম হয় তাই একটা টিউশনই কন্টিনিউ করতে বলেছে আপাতত। অনুভবের হাতে আছে দুটো টিউশন। চাকরি যেন মহার্ঘ্য বস্তু। সামনে আবার মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার সময় এসে গেছে। তিক্ত অভিজ্ঞতা ওদের দাম্পত্যের মধুর দিনগুলোতে প্রভাব ফেলছে। দুজনই তা বুঝতে পারছে। তবুও তীব্র মনের জোর ও ভালোবাসার পবিত্র শক্তিতেই যেন ওরা সকল ক্লেশ ঢেকে রাখে। একাত্ম, অনড় থাকে মন। ক্লান্তিময় দিনগুলো এসে পুনরুজ্জীবিত হয় একে অপরের স্পর্শে। নব উদ্যম জাগে পরবর্তী দিনের লড়াইয়ের জন্য।

অনুভব তিন চুমুকে ঢকঢক করে গ্লাস ফাঁকা করল। ফ্রিজের কনকনে ঠাণ্ডা পানি খেতে ইচ্ছে করছিল ভীষণ। মনে পড়ল বাড়িতে ফ্রিজ নেই৷ টাকা বাঁচিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবগুলোই আগে কিনতে চেষ্টা করছে। অনুভব ফাঁকা গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“আরেকটু পানি দাও।”

প্রিয়া এনে দিয়ে পাশে বসে। স্বামীর বিক্ষিপ্ত চোখমুখ দেখে বলল,
“শরীর খারাপ লাগছে নাকি মন খারাপ?”

“বউয়ের একটু আদর পেলে সব খারাপই বাপ বাপ করে পালায়।” অনুভব হালকা গলায় মজা করল।

“ফ্রেশ হয়ে আসুন। ভালো লাগবে। আমায় এখন রাতের রান্না করতে হবে।” অনুভবকে হতাশ করে প্রিয়া তরাক করে সরে গেল।

বেলা প্রায় ডুবন্ত। দিয়া ছাদে গিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো। এখনো না আসায় খোঁজ নেওয়ার জন্য প্রিয়া ছাদে যায়। কিন্তু ছাদে কেউ নেই। এমনিতেই নতুন পরিবেশ। দিয়াকে অচেনা কারো সঙ্গে চট করে মিশতে বারণ করেছে সে। সমবয়সী বন্ধু নেই বিল্ডিংয়ে। অনুভব বাড়িতে থাকলে হাসি-মজায় মাতিয়ে রাখে ওকে। অথচ আজ অনুভবকে দেখে সে ছুটে এলো না। তাহলে গেল কোথায় মেয়েটা? প্রিয়ার মনে ভয় ঢোকে। বাবার ছায়া থেকে সরে পুরো পৃথিবীটাই তাদের কাছে অচেনা হয়ে উঠেছে। বিপদের হাতছানি সর্বত্র। ও রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়, নিচে উঁকি দিয়ে দেখে। দিয়াকে দেখা গেল কলাপসিবল গেইটের সামনেই। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু ভাই। প্রিয়া অবাক হয়। নেমে আসে দ্রুত পায়ে। রঞ্জুর বোধহয় ইচ্ছে ছিল না প্রিয়াকে দেখা দেওয়ার। তাই মুখোমুখি হতেই সে চমকিত হয়। পরিপাটি পোশাকে আজ তাকে যথেষ্ট মার্জিত দেখাচ্ছে। ফ্যাকাসে ঠোঁটে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“প্রিয়ামণি, কেমন আছো?”

“ভালো আছি, রঞ্জু ভাই। এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাড়িতে আসুন না।”

“না না, আমি এদিকেই আইছিলাম ছোটো ভাই ব্রাদারগো লগে। দিয়ারে দেইখা ডাক দিলাম। শুনছি তোমার বিয়া হইছে অনুভব ভাইয়ের লগে। নতুন সংসার গোছগাছ কইরা লও। তারপরে আইসা দাওয়াত খাইয়া যামু।”

রঞ্জুর কণ্ঠ নিরুত্তাপ। যতটা উৎসাহ সে প্রকাশ করতে চাইছে তার অর্ধেকও পারছে না। চুড়ি পরা হাত, নাকে জ্বলজ্বল করা ছোট্টো নাকফুলটা শেলের মতো বিঁধছে বুকে। তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করে। নারীপ্রিয় রঞ্জু চোখের সামনে কত মেয়ের বিয়ে দেখল, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বস্তির কত মেয়েকে বিয়েও দিল। কিন্তু এই যে এখন, দিনান্তের প্রান্তে এক নববধূকে দেখে যে শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরেছে তা বোধহয় কোনো নারীই তৈরি করতে পারেনি। কোনো নারী পূরণও করতে পারবে না। কে জানত, যাকে পাওয়ার সাধ্যি নেই তার প্রতিই রঞ্জু এককালে মনের দিশা হারাবে! অবশ্য ওর মনে কোনো বিদ্বেষ সৃষ্টি হলো না। নারীদের প্রতি ও কখনো বিরূপ আচরণ করেনি, বিরূপ ভাবেনি। সেখানে প্রিয়া সব নারীদের মধ্যে সদা বিশেষ। তার জন্য অন্তর থেকে আসে অফুরন্ত শুভকামনা। প্রিয়া যেখানেই থাকুক, সুখে থাকুক।

প্রিয়া শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিল। রঞ্জু মাথা নত রেখে ইতস্তত করে বলল,
“আজ আসি কেমন? চাচিরে আমার সালাম দিয়ো। এক সময়ের প্রতিবেশী ছিলা, জামাই নিয়া বেড়াইতে আইসো বস্তিতে।”

প্রিয়া ডাকল,
“রঞ্জু ভাই!”

“হু?” রঞ্জু মাথা তুলল না।

“আপনি ভীষণ ভালো মানুষ। বস্তিতে আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন। সেই ঋণ শোধ করতে পারব না, তবে আপনার জন্য দোয়া করব। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন।”

রঞ্জু প্রস্থান করল। ছুটন্ত পায়ে পেছনে ফেলে গেল এক টুকরো গন্তব্যহীন আবেগ।

প্রিয়া বোনের হাত ধরে তেতলায় ফেরে। দিয়ার জন্য চিপস, জুস, চকলেট দিয়ে গেছে রঞ্জু। মেয়েটা আপাতত তাই নিয়ে ব্যস্ত। প্রিয়া নিজের ঘরে ঢুকে দেখল অনুভব গোমড়া মুখে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গোসল করার ফলে ভেজা চুলগুলো সব লেপ্টে রয়েছে। প্রিয়ার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে ও বলল,
“দেখা হয়েছে রঞ্জুর সঙ্গে?”

“হয়েছে।”

“বাড়ি এলো না?”

“না। বাইরে থেকেই চলে গেল।”

“ছেলেটা তোমার প্রতি ভয়াবহ দুর্বল কিন্তু।”

এটা খোঁচা ছিল কিনা বোঝা গেল না। প্রিয়া এতক্ষণে স্বামীর গোমড়ামুখের কারণ টের পেল। মহাশয় বাড়িতে ঢোকার সময়ই বোধহয় দেখেছে রঞ্জুকে। অনুভব জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। প্রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রঞ্জুর প্রতি তার কোনো অনুভূতি নেই। কৃতজ্ঞতা আছে। কাজেই সে বড়োজোর কামনা করতে পারে যেন রঞ্জু তাকে ভুলে সামনে এগিয়ে যায়। প্রিয়া পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি অন্যের দুর্বলতায় ব্যথিত নই। আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না।”

অনুভব হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টানে। বলে,
“দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা যায়, আসক্তি কাটানো মুশকিল। তুমি আমার আকাঙ্ক্ষিত আসক্তি। তাছাড়া আমি আমার ভালোবাসার ওপর কনফিডেন্ট। কাজেই রঞ্জু টঞ্জুকে নিয়ে ফালতু ভাবনার প্রয়োজন নেই। আমার মতো হ্যান্ডসামের ধারেকাছে কেউ আছে নাকি!”

স্বামীর রূপের গর্বে প্রিয়া হেসে ফেলল। ঘাড় নেড়ে বলল, “কেউ নেই।”
_______________

রহস্যময় রজনী সকল কোলাহল শুষে নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। শান্ত হচ্ছে শহরের বুক। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বিশ্রামে যাচ্ছে পরিশ্রমী প্রাণেরা। অনুভব বিছানায় বসে একমনে চাকরির বই পড়ছে। বেসরকারি চাকরির সুযোগ তার অহরহ। কিন্তু অনুভব একটা সরকারি স্থায়ী চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। মাস্টার্সের পাশাপাশি বিসিএসের প্রস্তুতিটা এবার আটঘাট বেঁধেই নিতে শুরু করেছে। একটানা অনেকক্ষণ পড়ে একটু ব্রেক নিয়ে সময়টা দেখল অনুভব। রাত এগারোটা বাজে। অনেকক্ষণ হলো বউয়ের দেখা নেই। নিশ্চয়ই কোনো কাজে মশগুল। চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। কিছু না কিছু করতেই থাকে সারাক্ষণ। অনুভব বাইরে বেরিয়ে দেখল তার ধারণাই ঠিক। ঘর সাজানোর সরঞ্জামাদি নিয়ে খুটখাট করছেন মহারানী৷ ইদানীং তার শখ হয়েছে আসবাবহীন ফ্ল্যাটের দেয়াল সাজাবে। মুনিরা বেগমও ঘুমাননি। মেয়েকে সঙ্গ দিতেই বোধহয় রয়ে গেছেন। অনুভব মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তার সামনে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। পানি খেতে গেল। পেট ফুলিয়ে পানি পান করেও বউয়ের কৃপাদৃষ্টিতে পড়ল না। হতাশ হয়ে মুনিরা বেগমের পাশে এসে বসল। বলল,
“আপনার মেয়ে ছোটো থেকেই পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ, তাই না? একদিনও বই নিয়ে বসতে দেখলাম না।”

“নিজে বউ নিয়ে বসে থাকলে বই ধরার সময় কোথায় মিলবে?” বলতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল প্রিয়া। শুধু শাণিত একটা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে পুনরায় কাজে মন দিল।

মুনিরা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
“ও খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। প্রথম দ্বিতীয় না হলেও টপে থাকত। শুধু যদি কাজের চাপটা নিতে না হতো তাহলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়ে যেত।”

প্রিয়া চুপসে আছে। পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারার গোপন আফসোস তার মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে প্রায়ই। দশম শ্রেণি থেকে স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাসে চড়বে ও। তখন দুচোখ ভরা শুধু স্বপ্নই ছিল। আর এখন শুধু খাওয়া-পড়ার চিন্তা। মা-বোন সঙ্গে প্রাণপ্রিয় স্বামীর জন্যও চিন্তা। মানুষটা তাদের জন্য দিনরাত খাটছে। সমস্ত সুবিধা-অসুবিধা খেয়াল করছে। হাসিমুখে সমস্ত আবদার মেটাতে চেষ্টা করছে। অথচ চোখে একফোঁটা অভিযোগ নেই। অনুভব প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যা গেছে তা নিয়ে আফসোস না করে যা আছে তা নিয়ে সুখে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই না, আম্মু?”

মুনিরা বেগম প্রসন্নতার সঙ্গে হাসলেন। ছেলেটা যখন আম্মু বলে ডাকে মনে হয় কত পুরোনো সম্পর্ক তাদের। কত চেনাজানা। মায়া ভর করে মনে। প্রিয়া সব কাজ রেখে বলল,
“আজ থাক। ঘুমাতে চলো, মা।”

প্রিয়া মাকে শুয়িয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে নিজের ঘরে এলো। অনুভব খাটের একপাশে বসে আছে। প্রিয়া অন্যপাশে বসে নিজের বইপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। অনুভব ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
“এখন পড়া দেখানো হচ্ছে?”

“আমি নাকি ফাঁকিবাজ! তাই পড়াশোনা করি নাহয় একটু।”

“আচ্ছা পড়ো।”

প্রিয়া বইয়ে চোখ রেখে উশখুশ করতে লাগল। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থাকলে পড়া হয়?”

“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?”

অনুভব গালে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে৷ প্রিয়া চোখ উলটে বলল,
“নিজের রূপের প্রশংসা করেই তো ফুরসত পান না। আবার অন্যের প্রশংসা করছেন?”

“হ্যাঁ, কারণ আমার রূপের আলোয় তুমিও আলোকিত হয়ে গেছো। সুতরাং তোমার রূপের রহস্য আমার সান্নিধ্য।”

“ওহহ আচ্ছা! প্রশংসা করে ইন্ডাইরেক্টলি সেটাই মনে করাচ্ছেন?”

“কেন নয়!”

অনুভব ভাবের সঙ্গে উত্তর দিল। প্রিয়া হাসি আড়াল করতে বইটা মুখের সামনে ধরল। অনুভব বুঝল পড়া আর হচ্ছে না। দুষ্টু হেসে বাতি নিভিয়ে দিল বিনাবাক্যে। প্রিয়া হতভম্ব হয়ে বলল,
“এটা কী হলো? এখন কি আপনার রূপের আলোয় পড়াশোনা করব?”

অনুভব ওকে দুহাতের বাঁধনে বেঁধে গালে টপাটপ কতগুলো আর্দ্র চুমু খেয়ে বলল,
“তুমি আমার প্রেমের ক্যাম্পাস। তোমাতেই আমার নিত্য বসবাস। বাকিসব আপাতত হয়ে যাক বোগাস।”

প্রিয়া মুখ ঢেকে হেসে উঠল। আবছা আঁধার চোখ সয়ে এসেছে। দক্ষিণা জানালা গলে দূরবর্তী বিল্ডিংয়ের আলোকছটা উড়ে আসে। সেই ক্ষীণ আলোতে প্রিয়া এক উন্মাদ প্রেমিককে দেখে। যার সুদর্শনতায় সে বিমোহিত, আবেগময় আবেদনে আপ্লুত, ক্লান্তিহীন দায়িত্বশীলতায় কৃতজ্ঞ জনমভর। প্রিয়া মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রবোধ দেয়, এই মানুষটা একান্তই তার! সুখের অশ্রুতে চোখদুটি তার কানায় কানায় পূর্ণ হয়। সব হারিয়ে এমন অমূল্য প্রাপ্তিই বুঝি ছিল ওর কপালে!

প্রিয়ানুভব কোনো স্ট্রাগলের গল্প নয়৷ জীবনের উত্থান-পতনের বাঁকে স্ট্রাগলে জর্জরিত হওয়া দুটো মানব-মানবীর হৃদয়ের গল্প। ওদের জীবন রাতারাতি বদলায় না৷ কোনো রূপকথার পরী এসে সোনারকাঠি-রুপারকাঠি ছুঁইয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়ে যায় না। রোগ, শোক, তাপ উপেক্ষা করে ওরা নিরন্তর ছুটে চলে ভালো থাকার আশায়। তবুও… তবুও কখনো কখনো ওদের বাস্তবতায় পিষ্ট, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মনের জরাজীর্ণ জানালায় প্রেম এসে কড়া নাড়ে। মনের দখিনা দুয়ার মেলে ওরা খানিক জিরিয়ে নেয়। আর বলে, জীবন সুন্দর, যদি মনের মানুষটা মেলে।

(সমাপ্ত)

প্রিয়ানুভব পর্ব-১৮

0

#প্রিয়ানুভব [১৮]
লেখা: প্রভা আফরিন

শুক্রবার সকালে উৎসবের আমেজে বিছানা ছেড়েছে টুকটুকি৷ গোসল করে কাঁচা হলুদ রঙের একটা শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে৷ সাজগোজে একটুও কমতি রাখেনি। বন্ধুদের মধ্যে প্রথম কারো বিয়ে হচ্ছে। হোক সেটা বড়ো কি ছোটো, আনন্দ, উল্লাসের কোনো কমতি ওরা রাখবে না। গতকাল রাত দেড়টা পর্যন্ত বন্ধুরা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে এক্টিভ ছিল। বিয়ের সমস্ত প্ল্যানিং, কেনাকাটা সংক্রান্ত আলোচনা সব দুদিন ধরে গ্রুপেই হয়েছে। কাজের কথার চেয়ে অকাজের কথা, তর্ক, একে অন্যকে খোঁচানোটাই হয়েছে বেশি। ঠিক করা হয়েছে টুকটুকি ও নন্দিনী হবে কনেপক্ষ। দিগন্ত হবে পাত্রপক্ষ। কিন্তু দেখা গেল স্বয়ং পাত্রই কনে পক্ষ হতে মরিয়া। এ নিয়ে হাসি-মজাও কম হয়নি। অনেকদিন বাদে আগের মতো লম্বা একটা আড্ডা হওয়ায় মনটাও বেশ ফুরফুরে টুকটুকির। ভেজা চুলগুলো পিঠের ওপর ছেড়ে দিয়ে কানে দুল পরল সে। দরকারী সমস্ত মেকাপ আইটেম ব্যাগে ভরে নেয়। দুই বান্ধবী মিলে আজ প্রিয়াকে বউ সাজাবে। সবাই মিলে নবদম্পতির ছোট্টো সংসারের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করেছে দুদিন ঘুরে ঘুরে। সেসব সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে হবে। টুকটুকির আজ ছোটোবেলায় পুতুল বিয়ে দেওয়ার মতো আনন্দ হচ্ছে। সে ব্যাগপত্র নিয়ে সিএনজিতে চড়ে বসে।

সফেদ মোল্লার সাদামহলের তিন তলার দক্ষিণের ফ্ল্যাটে সকাল থেকে ব্যস্ততার বহর। অনুভব-প্রিয়ার বিয়েতে আত্মীয় বলতে শুধু প্রিয়ার মামা-মামীরা এসেছেন। আর অনুভবের বন্ধুবান্ধব। আরেকজন প্রধান অতিথি আছে। জাভেদ হাসান, অনুভবের একমাত্র অভিভাবক। তাকে আসতে রাজি করিয়েছেন প্রিয়ার মা। মুনিরা বেগম বিয়ের দিন ঠিক করার আগে অনুভবকে সঙ্গে নিয়ে কথা বলেছিলেন তার বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন,
“বাবা-মায়ের অবর্তমানে এতদিন ধরে ভাইকে তুমি খাইয়েছো, পড়িয়েছো, আদর-যত্নে রেখেছো। সেই ভাই কাকে বিয়ে করবে একবার যাচাই করে নেবে না? তুমিই তো ওর একমাত্র অভিভাবক। অভিভাবকের দায়িত্ব কিন্তু বিশাল। ধৈর্য, সহ্যক্ষমতা বেশি থাকতে হয়। রাগের পাশাপাশি দায়িত্বশীলতাও থাকতে হয়। তোমারও তো একটা সন্তান আছে। সন্তান ভুল করলে বাবা-মাকে ভুল করতে নেই। বরং শাসন করে হলেও সঠিক পথটা আমরা বাতলে দেই। তেমনই তোমার ভাই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে কিনা নিজে যাচাই করে দেখো। তোমার অমত থাকলে, আমাদের যোগ্য মনে না হলে এই বিয়ে হবে না। কিন্তু বাবার ভুলের জন্য আমার নির্দোষ মেয়েকে তুমি অপছন্দ করবে, তা আমারও মানতে কষ্ট হবে।”

জাভেদ হাসান চমৎকৃত হয়েছিল। ভেবেছিল কোথাকার কোন খারাপ মেয়ের পাল্লায় পড়েছে ভাই। কিন্তু মুনিরার মার্জিত, বুঝদার বাক্য তাকে অবাক করে। সে এসেছিল প্রিয়ার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। শিক্ষিত, নম্র, বুদ্ধিমতি একজন মায়ের আন্তরিকতায় জাভেদ মুগ্ধ হয়েছে। ক্ষোভের সঙ্গে পুষে রাখা ভুল ধারণাগুলো কথা বলার সময় ক্রমেই বানোয়াট মনে হয়েছে নিজের কাছে, দ্বিধা কেটে গিয়েছে অনেকটাই। একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে আসবে বলে আশ্বাসও দিয়েছে। জাভেদের একবার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল বিয়ের পর নতুন বউ নিয়ে অনুভব তার ফ্ল্যাটে উঠুক৷ কিন্তু সম্পর্কের জল ঘোলা হয়ে গেছে। অন্তরা নিজের সংসারে দেবর ও দেবরানিকে মানতে পারবে না। কখনো কখনো দূরত্ব সম্পর্ক ভালো রাখে। কিন্তু এই সম্পর্কগুলোকে আত্মার সান্নিধ্যে আত্মীয়তা না বলে নাকি সামাজিক রীতিতে সৌজন্যতা বলাই বোধহয় ভালো।

বেলা দশটায় পিকআপ ভ্যান নিয়ে হাজির হলো দিগন্ত। বিয়ে উপলক্ষে সমস্ত কেনাকাটা বন্ধুরা মিলে করলেও দিগন্ত আলাদাভাবে একটি সেগুন কাঠের খাট উপহার দিচ্ছে। রুমে এনে খাটটাকে ঠিকঠাক বসিয়ে, তোষক, চাদর পেতে ক্লান্ত হয়ে সে খাটেই শুয়ে পড়েছে। দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে যেই না স্বস্তির নিশ্বাসটা ফেলতে যাবে তখনই দেখল হলুদ শাড়িতে নন্দিনী আসছে। এতক্ষণ সে পাশের রুমে কনের রূপচর্চা নিয়ে ব্যস্ত ছিল বলে দেখা হয়নি। নন্দিনী ওকে শুতে দেখেই খ্যাঁকিয়ে উঠল,
“এইডা কী হুতনের সময়? কাম নাই তোর?”

দিগন্ত কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে নন্দিনীকে আপাদমস্তক দেখে। এরপর কপাল কুচকে বিরক্ত গলায় বলে,
“কী বিশ্রী লাগছে তোকে! মনে হচ্ছে সরিষা খেতের ভূত চলে আসছে। সামনে থেকে সর। এইসব ডাকিনীমার্কা লুক দেখলে মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়।”

“মেজাজ ধুইয়া পানি খা। বাসর ঘর সাজানোর ফুল কই? সময়মতো না পাইলেরে হালুম, ডাকিনী তোর কল্লাডা জাস্ট আলাদা কইরা দিব।”

দিগন্ত মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যেতে যেতে বলল,
“সকল কাজের কাজি তো এক আমিই। নিজেরা সব পটের বিবি সেজে হুকুম চালাও। তা নিজের হাতে সাজতে গেলি কেন? বলতি আমিই সাজিয়ে দিতাম।”

নন্দিনী ওর যাওয়ার দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে থাকে।

মুনিরা বেগম অনুভবের বন্ধুদের আন্তরিকতায় রীতিমতো মুগ্ধ। দিয়া উৎসাহে ঘুরঘুর করছে আশেপাশে। বহুদিন বাদে একটা উৎসব উৎসব আবহ পেয়ে সে অবুঝ আনন্দে বলে উঠল,
“ভাইয়া আর আপুকে প্রতিদিন বিয়ে দাও, মা। তাহলে প্রতিদিন মজা হবে।”

ওর কথায় মুনিরা বেগম হেসে ফেললেন। কতদিন বাদে সকলে প্রাণখুলে হাসছে! এই হাসিটা অমলিন থাকুক। দোয়া ছাড়া আর কীই বা করতে পারেন মেয়েদের জন্য!

প্রিয়ার আজ অফুরন্ত অবসর। টুকটুকি ও নন্দিনী তাকে যেভাবে বলছে সেভাবেই থাকতে হচ্ছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি পরিচর্যায় লেগেছে দুই বান্ধবী মিলে। নামমাত্র হলুদের রীতি রক্ষায় সকালে হলুদের শাড়ি পরে এসেছে দুই বান্ধবী। পরানো হয়েছে প্রিয়াকেও। বিছানায় হাঁটু গুটিয়ে বসে আছে ও। লাজুক আভায় ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হয়েও গুটিয়ে যাচ্ছে বারবার। পাশেই টুকটুকি ভিডিও কলে বন্ধুর সাথে তর্ক করছে। অনুভব অনুনয় করে বলে চলেছে,

“একটা বার দেখতে দে না। তুই তো এমন পাষাণ ছিলি না টুকটুকি। আমার ভালো বন্ধু তুই। বাচ্চাকাল থেকে একসাথে আছি আমরা। সেই খাতিরে…”

“উহু উহু, কোনো খাতির চলবে না। বন্ধুত্ব ভুলে যা আজকের জন্য। আমি কনেপক্ষ আর তুই পাত্র। টাকা ছাড়া কোনো কাজ হবে না। ফেলো কড়ি মাখো তেল।”

“আচ্ছা, চকচকে দশ টাকার নোট দেব। এবার দেখতে দে। একটা মাত্র বউ আমার। তার হলুদের সাজ না দেখলে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে।”

“এইসব ফাঁকিবাজি চলবে না। দশটাকা দিয়ে আজকাল ভেলপুরিও জোটে না। তোর বউয়ের একটা ডিমান্ড আছে তো নাকি! সারাজীবনের আফসোসের দাম দশটাকা হতে পারে না। দাম বাড়াও নতুন জামাই।”

দিগন্ত ওপাশ থেকে বলল,
“আচ্ছা আট আনা বাড়িয়ে দেব, চলবে?”

টুকটুকি কটাক্ষের দৃষ্টি হেনে বলল,
“এখন বোঝ, হুদাই ইকরি তোরে ফইন্নির পোলা বলে না।”

“আর তুই কী করতেছিস? বন্ধুর ইমোশন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করেছিস।” দিগন্ত চোখ পাকায়।

টুকটুকি পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“তোদের ইমোশন যে ভ্যালুলেস সেটা তো জানতাম না।”

দিগন্ত হম্বিতম্বি করে ওঠে, “এত্ত বড়ো অপমান! এই আমার চেকবই, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডগুলা কেউ বের কর।”

বন্ধুদের ঝগড়া শুনে প্রিয়া মিটিমিটি হাসছে। অবাক হয়ে দেখছে যে মানুষগুলো হাজার হাজার টাকা খরচ করে বন্ধুর বিয়ের আয়োজন করেছে তারাই আবার দশ-বিশ টাকা নিয়ে তর্ক করে হয়রান হচ্ছে! অনেক তর্ক-বিবাদের পর একশ টাকায় ডিল হলো তাদের। টুকটুকি টাকার অংকে খুশি না তাই মুখ গোমড়া করে ফোনটা প্রিয়ার দিকে ফেরায়। অনুভব হা করে তাকায়। কাঁচা হলুদ শাড়িতে শ্বেত চন্দনের মতো মখমলি মেয়েটাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। ছোটো মুখশ্রীতে আজ গম্ভীরতা নেই। আছে লজ্জার ফুলঝুরি। প্রিয়া চোখ তুলল না মোটেও। অনুভব গদগদ হয়ে উচ্চারণ করে,

“মাশাআল্লাহ! নজর না লাগুক আমার বউয়ের। কানের পিঠে কাজল দাও।”

টুকটুকি কাশি দিল, “আমরা কিন্তু আছি, দোস্ত।”

অনুভব ধমক দিয়ে বলল,
“তোদের এখানে কী ব’দ’মাশ? প্রাইভেসি দে আমাদের। দেখছিস না হাসু লজ্জা পাচ্ছে!”

“কবুল বলার আগে নো প্রাইভেসি। হাসুর লজ্জা তাড়ানোর জন্য সারাজীবন পাবি।”

প্রিয়া হাঁটুতে মুখ লুকায়। পাজি লোকটা নিজে তো হাসু ডাকে এখন তার বন্ধুরাও হাসু বলেই ডাকছে! বোধহয় তার প্রিয়া নামটা শুধু খাতা কলমে লেখার জন্যই বেঁচে থাকবে একসময়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রিয়ার রাগ হচ্ছে না। হাসু নামটাকেই আপন মনে হচ্ছে। তারচেয়েও বেশি আপন সম্বোধনকারী মানুষটা।
_________________

ছাদের প্রান্তে গোধূলির নিবিড় ছায়াতলে নবদম্পতির ফটোশুটের আয়োজন করা হয়েছে। অনুভব বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে লজ্জারাঙা বউকে আঁকড়ে ধরে আছে। তার পরনে কালো শেরওয়ানি। প্রিয়াকে সাজানো হয়েছে টুকটুকে লাল বেনারসিতে। গাজরা ফুলের মালা ঘাড়ের দুদিক দিয়ে ঝুলছে। দুই হাত ভর্তি চুড়ির টুংটাং শব্দ যেন প্রণয়ের মৃদঙ্গ হয়ে বাজছে। প্রিয়ার কাজলরাঙা দুই চোখে ভাসছে ছলছল জল। কবুল বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল কিনা! দুই মা-মেয়ের কান্নায় ইস্তফা দিতেই বন্ধুরা ওদের ছাদে এনেছে ছবি তুলতে। নন্দিনী একের পর এক পোজ দেখাচ্ছে, দিগন্ত ক্যামেরাম্যান হয়ে শুয়ে-বসে বিভিন্ন এঙ্গেলে নবদম্পতিকে ক্যাপচার করছে। টুকটুকি মাঝখান দিয়ে ক্যামেরাম্যানকে হাইজ্যাক করে নিজের ছবি তুলে নিচ্ছে।

অনুভব কবুল বলার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্য প্রিয়ার হাত ছাড়েনি। সকলের সামনে অস্বস্তিতে প্রিয়া বেশ কয়েকবার ছাড়াতে চেয়েছে। প্রতিবারই অনুভব কড়া চাহনিতে তাকাচ্ছে যেন প্রিয়া মূল্যবান কিছু ছিনিয়ে নিতে চাইছে। হাত ঘেমে একাকার দুজনের। তবুও ছাড়ার নাম নেই৷ বিয়ের দিনেই যা নমুনা দেখাচ্ছে তাতে সারাজীবন যে কী পরিমান জ্বা’লাবে ভাবতেই প্রিয়া হয়রান। অনুভব সকলের অগোচরে ওর কানের পিঠে একটা ছোটো চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল,

“প্রিয়তমা হাসু, অনুভবে মত্ত হতে আপনি প্রস্তুত তো?”

প্রিয়ার শুকনো ঢোক গিলল। থুতনি ঠেকে রইল বুকের সঙ্গে। এক অচেনা অনুভূতি ওর মনের অলিগলি গ্রাস করে নিচ্ছে৷ জানান দিচ্ছে অন্তরে অন্যকেউ আধিপত্য ছড়াচ্ছে সদর্পে।

বাসর সাজাতে সাজাতে রাত দশটা বেজে গেছে। বন্ধুরা সবাই এখন বাড়ি ফিরবে। দিগন্ত একলা পেয়ে অনুভবকে খোঁচা দিয়ে বলল,
“দোস্ত, সবচেয়ে মজবুত খাটটা কিন্তু দিয়েছি। সেগুন কাঠের। ভাঙার সম্ভাবন নেই। তাও যদি ভাঙে একটুও লজ্জা পাবি না। আমি আরো মজবুত খাট আনিয়ে দেব।”

অনুভব কপট রাগের ভঙ্গিতে ওর পিঠে ঘু’ষি দিল। ছেলেরাও যে লজ্জায় টুকটুকে লাল হয় সেটা সুদর্শন অনুভবকে না দেখলে বুঝতই না দিগন্ত। সেই লালাভ আভায় মিশে আছে প্রিয় মানুষকে পাওয়ার সুখ। ঠোঁটের কোণে লেপ্টে আছে পূর্ণতার মৃদু হাসি। প্রিয় মানুষকে পেয়ে সে আজ জগতের সবচেয়ে সুখী পুরুষ।
_____________

ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। প্রিয়াদের ফ্ল্যাট নির্জন হয়ে উঠেছে। দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটে স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রিয়ার মামা-মামীরা রাতেই বিদায় নিয়েছেন। মা ও দিয়ার সারাদিন ধকল গেছে বলে প্রিয়া নিজেই ওদের শুতে পাঠিয়েছে। নিজে দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের দরজার সামনে। দক্ষিণের ঘরের দরজাটা ভিড়িয়ে রাখা। সদ্য বিয়ে করা স্বামী সেই ঘরে তার অপেক্ষায়। প্রিয়ার পায়ে যেন শেকড় গজিয়েছে৷ ওই ঘরে যাবে ভাবলেই বুকের ভেতর দুরু দুরু কাঁপন উঠছে। আধঘন্টার বেশি সময় ধরে সে এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে এতটা পেরেশানি তার হয়নি। গায়ের বেনারসি কুটকুট করছে। মেকাপ তোলা হয়নি। ক্লান্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। এদিকে মনের ভেতর অজানা ঝড় তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে৷

অনুভব নববধূর অপেক্ষা করে করে এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বাইরে উঁকি দিল। প্রিয়া লাফিয়ে উঠে গোছানো বাসনগুলো আবারো গোছাতে শুরু করল। অনুভব বিরক্ত হয়ে বলল,
“ওখানে কী?”

“এই তো একটু…” প্রিয়া মিথ্যা বলতে পারছে না বলে চুপ করে গেল। অনুভব আর কথা না বাড়িয়ে আবারো ভেতরে চলে যায়। পাঁচ মিনিট বাদে আবার উঁকি দিয়ে দেখল প্রিয়া এক জায়গাতেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অনুভব ওর সামনে এসে হাত ধরল। বলব,
“এসো।”
প্রিয়া জায়গা থেকে নড়ল না। ওর হাত ঘামছে, কাঁপছে।

“তুমি কী বাসর রাতটা এখানেই বাসি করার মতলব করছো?”
অনুভব কথাটা এত জোরে বলল যে প্রিয়ার সন্দেহ হলো মা শুনে ফেলল কিনা। লজ্জায় সে তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে গেল। অনুভব মুচকি হেসে পেছনে এসে দরজা বন্ধ করে।

“নির্লজ্জতার সীমা পার করে ফেলছেন আপনি।”
ঘরে ঢুকেই প্রিয়া কটমট করে বলে উঠল।

অনুভব ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি যে ধৈর্যের সীমা পার করে ফেলছো তার বেলায়? অর্ধেক রাত তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দিলে।”

প্রিয়া নিশ্চুপ। ম-ম করা ফুলের সুবাস নাসারন্ধ্র ভেদ করতেই রাগের স্ফুলিঙ্গ নেতিয়ে আবারো লজ্জার ফুলঝুরি ছুটল। অনুভব তার চুপসে যাওয়া মুখশ্রী দেখে স্মিত হাসে। আরেকটু ভড়কে দেওয়ার অভিপ্রায়ে হুট করেই কোলে তুলে নেয়। প্রিয়ার আত্মা লাফিয়ে ওঠে। খা’মচে ধরে স্বামীর কাঁধের কাছের পাঞ্জাবী। প্রথমে সীমাহীন বিস্ময় এবং পরবর্তীতে লজ্জা খেলে যায়। শরীর কাঁপে থরথর করে। টেনে টেনে শ্বাস নেয় ও। অনুভব ওকে কোলে রেখেই খাটে বসে। উদ্বিগ্ন হয়ে গালে হাত রেখে বলে,

“এই! কী হলো তোমার? এত প্যানিক হচ্ছো কেন? পানি খাবে?”

প্রিয়া চোখ বুজে কোনোমতে মাথা নাড়ে। পানি খাবে সে। ভেবেছিল পানি আনার সুবাদে অনুভব কোল থেকে নামাবে। কিন্তু বদ লোক হাত বাড়িয়েই গ্লাস পেয়ে গেল। সব একদম পরিপাটি করেই রাখা। পানির বদলে ওর সামনে ধরল দুধের গ্লাস। প্রিয়ার পানি তেষ্টা পেয়েছিল সত্যিই। দুধ দেখে মুখ কুচকে ফেলল।

অনুভব তা খেয়াল করে বলল,
“অপছন্দ?”

“হু, আমি বাইরে থেকে পানি খেয়ে আসি।”

প্রিয়া উঠলে চাইল। ওকে প্যাঁচিয়ে রাখা অনুভবের হাতটা শক্ত হয়ে পেট চেপে ধরে। দুষ্টুমিপূর্ণ চাপা স্বরে বলে,
“উহু, এটাই খেয়ে নাও। মনে হচ্ছে এনার্জি আজ তোমার দরকার।”

প্রিয়া দুই ঢোক খেয়ে আর পারল না। গা গুলিয়ে উঠছে। অনুভব আর জোর না করে প্রিয়ার লিপস্টিক গ্লাসের যেখানটায় দাগ ফেলেছে সেখানে মুখ লাগিয়ে বাকিটা খেয়ে ফেলল। ওর ঠোঁটের ওপরে গোফের মতো দুধ লেগে গেছে। প্রিয়া তা দেখে ইশারা করতেই অনুভব ফুরফুরে গলায় বলে উঠল,
“বউয়ের আঁচল থাকতে আমি কষ্ট করতে যাব কেন? মুছে দাও।”

অনুভব মুখ বাড়িয়ে দেয়। প্রিয়া অতিষ্ট চোখে চেয়ে শাড়ির আঁচলে ঠোঁট মুছে দেয়। দুজন স্পর্শে উত্তাপ বিনিময় করছে। প্রিয়ার বিমূঢ়তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিপরীতে বাড়ছে অনুভবের মুগ্ধতা। সেই প্রথম দিন তার সৌন্দর্য নিয়ে বিদ্রুপ করা মেয়েটাই এখন তার বউ! অনুভব তাকে মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসে। বুকের মধ্যে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়তে থাকে তাকে ভাবলে। অনুভব উদ্বেলিত আবেগে বশিভূত হয়ে প্রেয়সির ঠোঁটে একটা আর্দ্র চুমু খেতে উদ্যত হয়। ঠিক তখনই ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠল,

“আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেল রে ম’রার কোকিলে…”

আবেশিত সময়টুকু মুহূর্তেই খান খান হয়ে গেল। অনুভব হতভম্ব। এমন রিংটোন কস্মিনকালেও তার ফোনে ছিল না। প্রিয়া ঠোঁট চেপে হাসি আটকে কোল থেকে নেমে গেল। ওর ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন। তাই অনুভবও আর আটকাল না। মেজাজ খারাপ করে ফোন হাতে নিয়ে দেখল নন্দিনী কল করেছে। বুঝতে বাকি নেই এমন রিংটোনের আইডিয়া কার থেকে বেরিয়েছে।

“হেই মামা, হোয়াটস্ আপ?” ফোনের ওপাশ থেকে নন্দিনীর উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে আসে।

অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“কোকিলের বাচ্চা, রাত বারোটায় ফোন করে জানতে চাইছিস হোয়াটস্ আপ? তোরে সামনে পেলে বুঝিয়ে দিতাম মেজাজ কতটা আপ।”

আর কোনো বাক্যব্যয় না করে অনুভব ফোন কাটল। প্রিয়ার ফ্রেশ হয়ে ফেরার মাঝে আরো একবার ফোন এলো। এবার কল করেছে দিগন্ত। বুঝতে বাকি নেই সব প্রি-প্ল্যানড। অনুভব ফোন রিসিভ করল অত্যন্ত শান্ত মেজাজে।

দিগন্ত ফোকলা হেসে বলল, “ফোনের আউটগোয়িং সার্ভিসটা ডিস্টার্ব করছিল কয়েকদিন, বুঝলি। জাস্ট দেখতেছিলাম কল ঠিকঠাক যায় কিনা। ভেবেছিলাম ফোন বন্ধ থাকবে তোর। তুই এত রাতে জেগে আছিস দোস্ত?”

“হ্যাঁ দোস্ত৷ হাডুডু খেলছি। খেলবি?”

দিগন্ত শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল, “আমার কী সেই কপাল আছে? বিয়ের বয়স হয়েছে, এদিকে বাপ-মা জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। হায়! এই মধ্যরাতে এসে মনে হচ্ছে, হাডুডু খেলার জন্য হলেও যে একটা মনের মানুষ চাই। হ্যালো! শিকু, তুই শুনতে পাচ্ছিস? আই অ্যাম সো ডিপ্রেসড ইয়ার।”

অনুভব ভয়ংকর গালি দেওয়া থেকে কোনোমতে নিজের জবান সামলাল। ফোন কেটে সরাসরি সুইচ অফ করে দিল। প্রিয়া ততক্ষণে পোশাক বদলে সুতি শাড়ি পরে বেরিয়েছে। প্রসাধনহীন স্নিগ্ধ মুখটা ক্ষণেই অনুভবের থিতিয়ে থাকা অনুভূতিটাকে সতেজ করে দিল। বৃষ্টিঝরা প্রকৃতিও তখন সতেজ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিতেই একরাশ হাওয়া এসে ভরিয়ে দেয় ঘরের অলিগলি। স্বামীর নিষ্পলক দৃষ্টির সামনে প্রিয়া কী করবে ভেবে পায় না। কখনো হাত মোচড়ায়, কখনো চুল ঠিক করে। অনুভব মুচকি হেসে তা উপভোগ করে। দুচোখে ঘোর লেগে যায়। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে,
“এসো।”

প্রিয়া জড় পদার্থের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। অনুভব ওর কোমল হাতটা মুঠোয় পুরে জানালার কাছে টেনে এনে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ে থুতনি ছুঁইয়ে বলে,
“আমার সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। তুমি এখন থেকে আমার ব্যক্তিগত মানুষ, আমার বউ। সবচেয়ে সুন্দর পুরুষটাকে তুমি পেয়ে গেছো, হাসু। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ।”

প্রিয়া ভ্রু কুচকায়, “আপনাকে পেয়েছি বলে আপনি আমার ওপর প্রাউড ফিল করছেন?”

অনুভব গদগদ হয়ে বলল,
“হ্যাঁ। তোমারও করা উচিত।”

“আপনি নিজের সৌন্দর্যকে খুবই ভালোবাসেন, তাই না?”

“অবশ্যই। তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি এই মেয়েটির রাগী মুখটা। একেবারে বুকে এসে লাগে।”

প্রিয়া লজ্জাবনত হয়ে মুচকি হাসে। অনুভব ওর কানে ঠোঁট রেখে আকুল কণ্ঠে ফিসফিস করে,
“ইউ নো, আই লাভ চকলেট। অ্যান্ড ইয়্যুর স্মাইল লুক লাইক মেল্টিং হট চকলেট। আই কান্ট রেসিস্ট মাইসেল্ফ।”

শিরশিরে অনুভূতিতে আক্রান্ত প্রিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকায়। যেমনটা চাঁদ লুকিয়েছে মেঘের আড়ালে। আ’গ্রা’সী অনুভব ততক্ষণে প্রিয়তমার ওপর অনুরাগের আ’ক্র’মণ চালিয়েছে। একই স্পন্দনে মত্ত হয়ে ওরা হয়ে উঠল একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দখিনা জানালা একরাশ সুখানুভব নিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ের রচনা করতে লাগল।

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-১৭

0

#প্রিয়ানুভব [১৭]
লেখা: প্রভা আফরিন

মুনিরা বেগম এখন আগের মতো হুইলচেয়ারে চলাচল করেন। অনুভবকে কিছুতেই এটা কেনা থেকে নিবৃত্ত করতে পারেননি তিনি। টাকার মায়ায় নিষেধ করলেও এখন বড্ড সুবিধা হয়েছে। মেয়েরা বাড়ি না থাকলে জড়বস্তু হয়ে থাকতে হয় না। রান্নাবান্নার সমস্ত কাজ করতে পারেন অনায়াসে৷ তাতে প্রিয়ার অনেকটা সময় বাঁচে। মেয়েটাকে একটু অবসর দিতে পেরে মাতৃহৃদয়ে প্রশান্তি খেলে যায়।

রোদ ম রা অলস বিকেল। টিউশনে বেরোনোর আগে প্রিয়া ছোটাছুটি করে হাতের কাজগুলো সেড়ে নিচ্ছিল। ওকে হড়বড় করতে দেখে মুনিরা বললেন,
“অনেক হয়েছে। বাকিটা আমি পারব। একটু বিশ্রাম নিয়ে তো বেরোবি নাকি?”

প্রিয়া ব্যস্ত স্বরে বলল,
“হয়ে গেছে। আর কিছু করতে হবে না। তোমাকে কাজে হাত দিতে দেখলে দিয়াও পাকামো করে এসে হাত লাগাবে। ওকে পড়া থেকে উঠতে দেবে না একদম। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে কপালে দুঃখ আছে বলে দিয়ো।”

প্রিয়া বাসন মেজে রেখে বেসিনে হাত ধুতে নিলে ফোনটা বেজে উঠল। পড়া থেকে ওঠার বাহানায় দিয়া ফোনটা নিয়ে ছুটে বাইরে এলো। বলল,
“বড়ো চাচি কল করেছে।”

প্রিয়া থমথমে চোখে চায়। একের পর এক সর্বনাশ করেও শান্তি হয়নি চাচির! আবার ফোন করেছে! মুনিরা বেগম মেয়ের ভাবভঙ্গির উষ্ণতা টের পেয়ে নিজেই ফোনটা নিয়ে রিসিভ করলেন। প্রিয়া ছুটে এসে ছো মেরে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। লাউড স্পিকার অন করে পুনরায় ফেরত দেয় মায়ের হাতে। ওপাশ থেকে ভেসে এলো শায়লা চাচির করুণ স্বর,
“হ্যালো, প্রিয়া?”

মুনিরা গলা খাকারি টেনে বললেন,
“আমি ভাবি।”

“কে মুনিরা? তোমার সাথে কথা বলতেই ফোন করলাম। তোমাগো জন্য সুখবর আছে।”

প্রিয়ার ভ্রু কুচকে এলো। মুনিরা বেগম শান্ত কণ্ঠে জানতে চান,
“কীসের সুখবর, ভাবি?”

“তোমাগো আর বস্তিতে থাকতে হবে না। আমি তোমার ভাসুরকে বলেছি তোমরা এখন থেকে আবার এই বাড়িতেই থাকবা।”

“হঠাৎ…”

মুনিরা বেগম হতভম্ব। যে মানুষটা তাদের তাড়িয়ে সুখে ছিল এখন আবার ফিরিয়ে নিতে চাইছে কেন? এক মুহূর্তের জন্য ভাবলেন প্রিয়ার বাবার জেল থেকে মুক্তির সময় এগিয়ে আসছে। ফিরে নিশ্চয়ই তিনি সম্পত্তির হিসেব চাইবেন। অংশ চাইবেন। সন্তানদেন বঞ্চিত করার কৈফিয়তও চাইবেন। হয়তো তখন কিছুটা ঝামেলায় পড়বে ভাইয়েরা। সেই ঝামেলা এড়াতেই আবার তাদের ফিরিয়ে নিয়ে মিমাংসা করতে চাওয়া। যদিও সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ জে’লখাটা ভাইকে কৌশলে বঞ্চিত করে সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করতে তাদের একটুও ঝামেলা পোহাতে হবে না। উপরন্তু ভাইয়ের পঙ্গু স্ত্রী ও সন্তান তাদের কাছে বোঝা ছাড়া কিছু না। মুনিরা বেগমের ধোঁয়াশার মাঝেই শায়লা মৃদু গুঙিয়ে উঠে উত্তর দিলেন,

“হঠাৎ না, অনেকদিন ধরেই ভাবতেছি। সময়ের অভাবে বলা হয় নাই। তোমার স্বামী দোষ করছে। শাস্তি পাইতেছে…”

“আমি, আমার নিষ্পাপ দুই মেয়ে কীসের শাস্তি পাচ্ছে?” কথার মাঝেই মুনিরা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লেন।

“স্বামী-স্ত্রী হইল একে অপরের অর্ধেক অঙ্গ। কাজেই স্বামীর দোষের ভার তোমারেও বহন করতে হইতেছে। তোমার ভাগ থেকে তোমার মেয়েদের। মনে করো আল্লাহ তোমাগো শাস্তি দিছে। শাস্তির মেয়াদ শেষ। তোমরা বাড়ি ফিরা আসো। সবাইরে আমি বুঝাইছি এতগুলা দিন। তোমাগো থাকতে অসুবিধা হইব না।”

কথা শেষ করে শায়লা আবারো গুঙিয়ে উঠলেন। মুনিরা বেগম বললেন,
“আপনি অসুস্থ নাকি ভাবি?”

“আর বইলো নাগো, মুনিরা। সিড়ি থেকে পিছলে পড়ে মাজাটা গেছে। আজ এক সপ্তাহ বিছনায় পড়ছি। উঠবার ক্ষমতা বুঝি গেল। হাগা-মুতা সব ঘরের মাঝেই। বড়ো মেয়েটারে বিয়ে দিলাম। মেজোটাও ধারেকাছে আসে না এখন। খালি বলে, আমার ঘরে নাকি গন্ধ। কও, কাকে খাইয়ে পড়িয়ে বড়ো করলাম! ছোটোকালে কার হাগা-মুতা পরিষ্কার করলাম? এখন সে আমারটা সহ্য করতে পারে না!”

প্রিয়া তীক্ষ্ণ চোখে চায় মায়ের দিকে। সুখবরের কারণটা জলের মতো পরিষ্কার এখন। হাতি কাদায় পড়েছে। টেনে তোলার অবস্থা নেই। তাই কাদায় নেমে সেবা-যত্ন করার লোক প্রয়োজন। ওখানে ফিরে গেলে যে প্রিয়াদের নিজের বাড়িতে কাজের লোক হয়ে থাকতে হবে, ফাইফরয়েমাশ খাটতে হবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। শায়লা বিছানায় পড়েও নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু ভাবছেন না।
প্রিয়ার খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,
“অন্যের শাস্তির খুব সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন। তাহলে নিজের কেন এই দুরবস্থা? তার কোনো ব্যাখ্যা আছে কী, চাচি?”

তা আর বলা হয় না। কে কতটুকু সুখ-দুঃখের দাবিদার তা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু প্রিয়ার শঙ্কা মা আবার গলে গিয়ে মেনে না নেন। ওকে অবাক করে মুনিরা বেগম এই প্রথম শক্ত গলায় বললেন,
“মেয়ের বিয়ে দিলেন তা তো জানালেন না, ভাবি? তখন আমাদের ভাগ্যের শাস্তি শেষ হয়নি বলে দাওয়াতের কাতারেও পড়িনি?”

শায়লা আমতা আমতা করে বললেন,
“এত তাড়াহুড়ায় বিয়ে হলো যে সবাইরে ডাকতে পারি নাই। তুমি তা ভেবে রাগ ধইরো না, মুনিরা। চলে আসো বাড়িতে।”

“রাগ করিনি, ভাবি। আগেও করিনি, এখনো করি না। আপনার জন্য দোয়া করব। আল্লাহ আপনাকে শেফা দান করুক। আপনিও আমার মেয়েদের জন্য দোয়া করবেন। সামনের শুক্রবার প্রিয়ার বিয়ে। আমি গরীব হলেও কাউকে দাওয়াত দিতে কার্পণ্য করব না। মেয়ে বিয়ে দিয়ে ছেলে সন্তানের শখটাও পূরণ করতে চলেছি। একটা ছেলে নেই বলে কম গঞ্জনা তো শুনিনি। এবার মেয়ের বিয়ে দিয়েই ছেলে আনব। তাদের নিয়েই বাকি জীবন আমার চলে যাবে। আমাদের বিলাসবহুল বাড়ি দরকার নেই।”

“তারমানে তুমি আসবা না?” শায়লার কণ্ঠের কোমলতা মুছে গেছে।

“আপনাকে দেখতে নিশ্চয়ই যাব।”

শায়লার গোঙানি হঠাৎ ক্ষোভের আকার ধারণ করল। যেন য’ন্ত্র’ণার কারণটা তারাই। কটাক্ষ করে বললেন,
“তো কার ঘাড়ে ঝুলাইতেছো মেয়েরে? সব জানে? মেয়ে বিয়াই যখন দিবা তাইলে আমার সম্বন্ধটা কী দোষ করছিল?”

“মেয়ে আমার ঝুলানোর বস্তু না। তাকে আমি সামাজিক রীতি মেনেই বিয়ে দিচ্ছি। চোখের সামনেই সংসার দেখব। জামাই বিচক্ষণ বলেই সব জানাতে সংকোচ হয়নি। আপনি ভালো থাকবেন, ভাবি। প্রিয়া টিউশনি করাতে যাবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মুনিরা বেগম উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ফোন রাখলেন। দিয়া লাফিয়ে উঠে বলল,
“আপুর বিয়ে! আমি পড়ব না এ কয়দিন।”

সে ছুটে গিয়ে বইখাতা গোছাতে লাগল। প্রিয়া লজ্জাবনত হয়ে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মেঝে খুঁটতে থাকে। মুনিরা বেগম তাকে বললেন,
“বাবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে আয়। বলিস আমাদের নিয়ে চিন্তা না করতে।”

প্রিয়া জায়গা থেকে নড়ে না। ডাকে,
“মা?”

“হু?”

“আমাদের এরূপ অবস্থার জন্য বাবার ওপর তোমার রাগ হয় না?”

মুনিরা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন না। বলেন,
“তোর রাগ হয়?”

“হু, ভীষণ! বাবার একটা ভুলে আমাদের গোটা পৃথিবী বদলে গেল। আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত ছিল সামনে। দিয়ার সুরক্ষিত কৈশোর ছিল৷ তুমি হুইলচেয়ার ছেড়ে এতদিনে নিজের পায়ে হাঁটতে পারতে। কেউ আমাদের চোরের মেয়ে বলে গালি দেওয়ার সাহস পেতো না। খাবারের কষ্ট থাকত না। আর না থাকত অনিরাপত্তা। বাবা কেন এই ভুলটা করল? আমরা নাহয় অল্প খেতাম, অল্প পরতাম। তাতেও সয়ে যেতো। অসম্মানের লাঞ্ছনা সইতে কষ্ট হয়।”

প্রিয়ার চোখ ছলছল করে। মুনিরা হুইলচেয়ার ঠেলে মেয়ের নিকটে যান। ওর হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনেন। প্রিয়া হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের কোলে মাথা রাখে। মুনিরা বলেন,
“প্রিয় মানুষের অপ্রিয় রূপ কারই বা সহ্য হয়! আমারও হয়নি। কিন্তু এটাও তো সত্যি মানুষটা আমাদের সঙ্গে কখনো অন্যায় করেননি। স্বামীর দায়িত্বে, পিতার দায়িত্বে হেলা করেননি। এতদিন বাদে হঠাৎ লোভে পড়ে ভুল পথে কেন পা বাড়িয়েছিলেন তার উত্তর আজও মেলাতে পারি না। পাপকে ঘৃণা করলেও পাপীকে ঘৃণা করতে পারি না। হয়তো লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিলেন। শাস্তিও তো পাচ্ছেন। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন। স্বয়ং আল্লাহ যেখানে তার অনুতপ্ত বান্দার প্রতি ক্ষমাশীল, আমি তো অতি তুচ্ছ কোমল প্রাণের মানবী। বাবার ওপর রাগ পুষে রাখিস না, মা। অনুভবকে নিয়ে দেখা করতে যা৷ দুজনে দোয়া নিয়ে আয়।”
_____________

রেজাউল করীম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন অতিশয় সুদর্শন ছেলেটির দিকে। এরপর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান মেয়ের পানে। প্রিয়া জুবুথুবু ভঙ্গিতে মাথা নত করে আছে। বাবার সঙ্গে আগে যেভাবে চড়ুইয়ের মতো কিচিরমিচির করত, এখন আর তা পারে না সে। রেজাউল করীমও মেয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন না। লজ্জায় দৃষ্টি আপনাতেই ঝুঁকে থাকে। কিন্তু আজ উনার দুচোখে বিস্ময়। প্রিয়া মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারছিল না। জড়তায় তার জিভ জমে গেছিল। অনুভবই উনার সংশয় দূর করল।

“আসসালামু আলাইকুম, বাবা। আপনি কেমন আছেন?”

রেজাউল করীম থমকে গেলেন। সুপুরুষ যুবকের কণ্ঠে বাবা ডাক শুনে ঝটকায় তাকালেন মেয়ের দিকে। প্রিয়া আজ শাড়ি পরে এসেছে। বছর দেড়েক আগে বাচ্চা একটা মেয়েকে তিনি ফেলে এসেছিলেন। আজ সে মেয়েকে এরূপ পরিণত বেশে দেখে উনার বুকের ভেতর শুকিয়ে থাকা মমতাখানি যেন খামচে ধরে। চোখ ছলছল করে ওঠে। বলেন,
“তোমরা কী বিয়ে করে নিয়েছো?”

অনুভব সামান্যতম না ঘাবড়ে বলিষ্ঠ সুরে বলল,
“জি না, বাবা। আমরা আপনার সম্মতি চাইতে এসেছি। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, কন্যাটি আপনার। মেয়ের জন্য আপনার চেয়ে বড়ো শুভাকাঙ্ক্ষী এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তাই নিজের পক্ষ থেকে কন্যাকর্তার কাছে বিবাহের আর্জি পেশ করতে এসেছি। এবং একইসাথে একজন পিতৃহীন সন্তান হিসেবে আবদার করতে এসেছি আপনাকে আমায় বাবা বলে ডাকার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।”

রেজাউল করীম ছেলেটির স্পষ্টতা, স্বচ্ছতায় বিভ্রান্ত হলেন। কিছুটা সময় লাগল ব্যাপারটা ধরতে। কারাগারের ভেতর একজন পাত্র উনার কাছে কন্যার হাত চাইতে এসেছে! এ যেন ভাবনাতীত চমৎকৃত ঘটনা। তিনি চিন্তিত স্বরে বললেন,
“তুমি কী আমার ও আমার পরিবার সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত?”

“জি বাবা। আম্মু অর্থাৎ প্রিয়ার মায়ের সঙ্গে আমার এ নিয়ে কথা হয়েছে। আমি সব জানি। তবে আপনাকে আমার ব্যাপারে অবগত করা প্রয়োজন।”

অনুভব রয়েসয়ে নিজের ব্যাপারে বিস্তারিত জানাল। এ-ও বলতে ভুলল না একমাত্র ভাইও তার সঙ্গে নেই। চাকরিটা এখনো হয়নি। দুটো টিউশনির ওপর ভরসা করেই সংসার করার সাহস করে ফেলেছে। আরো একটা টিউশনি শুরু করতে চলেছে এ মাসে। বিলাসিতা দিতে না পারলেও ভরনপোষণের বেলায় কোনো গাফিলতি সে করবে না। অনুভব একাকী পুরুষ। প্রিয়ার মাধ্যমে একটি পরিবার গঠন করতে চায়। ওর চাওয়া শুধু একটি পরিবার।

রেজাউল করীম দ্বিধান্বিত হন। বিচক্ষণ দৃষ্টিতে যতদূর বুঝতে পারেন ছেলে ও মেয়ের মাঝে একটি হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক ঘটে গেছে। কিন্তু পরিবারহীন, আশ্রয়হীন, চাকরিবিহীন এক ছেলের সঙ্গে উনার মেয়ের বিয়ে কী করে দেবেন? আর এই বয়সে তো তিনি কখনোই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না। অন্তত গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করার আগে তো নয়ই৷ পরমুহূর্তেই নিজের বর্তমান অবস্থার কথা মনে পড়ে। ভাবনায় রাশ টানেন। বলেন,
“মুনিরার মত কী?”

“আম্মুর অমত নেই। তিনি আপনার মতামত পেলেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবেন।”

রেজাউল করীম আর কিছু ভাবলেন না। মুনিরা শিক্ষিত, আধুনিক, রুচিশীল মনের মানুষ। যথেষ্ট বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমতিও। সে যেহেতু সম্মত হয়েছে, নিশ্চয়ই সবদিক ভেবেই হয়েছে। রেজাউল করীম ওদের বর্তমান অবস্থা তেমন কিছুই জানেন না। মুনিরাই জানাতে বারণ করেছেন। তবে তিনি বোকা নন। প্রতিবার মেয়ের হাল দেখেই বুঝতে পারেন ওরা ভালো নেই। নাদুসনুদুস সুরতের মেয়েটি শুকিয়ে গেছে। গায়ের উজ্জ্বল ফরসা রংটা রোদে ঝলসে গেছে। কোমল, নিদাগ হাত দুটোয় এখন রান্নার ফলে কাটাছেঁড়া, পোড়া, ছ্যাঁকা লাগার দাগ। কতটা দুঃসহ সময়ের মাঝ দিয়ে গেলে এরূপ অবস্থা হয় তা তিনি কিছু তো অনুমান করতে পারেন। বেদনার মাত্রা তখন আরো বাড়ে। যে সন্তানকে কোনোদিন ফুলের টোকা দেননি সে যে বাস্তবতার নিষ্ঠুর হাতে প্রতিনিয়ত অ’ত্যা’চারিত হচ্ছে।
রেজাউল করীম বলেন,
“মুনিরার ওপর আমার মতামত নেই। সে যেহেতু এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে নিয়েছে। শুধু আফসোস, আমার মেয়ের বিয়ে আমি নিজের হাতে দিতে পারব না। কে জানে ভাগ্য আর কতকিছু আমার জীবন থেকে কেড়ে নেবে!”

“বাবা…” প্রিয়া বাবার একটি হাত আঁকড়ে ধরে। ছোটোবেলায় রাস্তায় বের হলে যেভাবে বাবার হাত ধরে থাকত, সেভাবে। বুকের ভেতর থেকে উথলে ওঠা কান্নাটুকু তার কণ্ঠ রোধ করে। নিশ্বাস ভারী হয়। সে আর কিছুই বলতে পারে না। দীর্ঘদিন বাদে কন্যার থেকে পাওয়া এটুকু স্পর্শই রেজাউল করীমের মনকে তারল্যে পরিণত করে। তিনি কোনোমতে বলেন,
“বাবাকে ক্ষমা করিস, মা। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমি তোর পাশে থাকতে পারলাম না।”

অনুভব বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না, বাবা। আপনার অবর্তমানে আপনার পরিবারকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার। যদিও আপনার মতো পারব না। তবুও কতটুকু পারলাম আপনি এসে মিলিয়ে নেবেন। যতটুকু কমতি রয়ে যাবে তা শিখিয়ে পূরণ করে দেবেন। আর বিয়ে দেখা নিয়ে আফসোস করবেন না। আপনি ফিরলে আপনার অনারে আমরা আবার জাঁকজমকপূর্ণভাবে বিয়ে করব।”

আধঘণ্টা পেরোতেই ওদের সময় ফুরাল। কন্যা বিদায়ের ক্ষণের মতোই বেদনাদায়ক এক মুহূর্ত ধরা দিল পিতা-কন্যার মাঝে। অশ্রুসিক্ত চোখে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে প্রিয়া। অনুভব ওর মন ভালো করতে চকোবার আইসক্রিম কিনে দেয়। প্রিয়া তাতে কামড় বসিয়ে বলল,
“একটা কেন? আপনি খাবেন না?”

অনুভব প্রিয়ার হাত ধরে নিজের মুখের কাছে আনে। প্রিয়া আইসক্রিমের ঠিক যেখানে কামড় বসিয়েছে সেখানেই কামড় বসায়। চোখ টিপে বলে,
“ভাগাভাগি করে খাওয়ার অভ্যাস করে নাও। টাকাও বাঁচবে, ভালোবাসাও বাড়বে।”

“ইশ! খুব হিসেব করে চলেন যেন!”

“এখন থেকে চলব। আমাদের ভবিষ্যৎ হাঁসের বাচ্চাদের জন্য আগে ভাগে প্রস্তুতি নিতে হবে তো নাকি!”

প্রিয়া রাগ করতে গিয়েও মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলল। অনুভব ওর গাল টেনে দিয়ে স্বগোতক্তি করল,
“আমার হাসু। শুধুই আমার।”

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-১৬

0

#প্রিয়ানুভব [১৬]
লেখা: প্রভা আফরিন

শুভ্র ভোরের শুভ সূচনা। মনুষ্যসৃষ্ট শব্দকে ছাপিয়ে কানের খুব কাছেই শালিক জুটির ঝগড়াঝাটি শোনা যাচ্ছে। কিছুদিন ধরে ঘুম ভেঙে প্রিয়ার শরীরে অদ্ভুত আলস্য ঘিরে ধরে। মনে হয় সে আবার তার পুরোনো বাড়িতে আছে। সেই ধবধবে দেয়াল, নান্দনিক নকশায় আঁকা ফলস সিলিং, টাইলসের ঝকঝকে মেঝে। চাকচিক্যের মোহে ডুবে প্রিয়ার মনে হলো, মাঝের সময়টা মিথ্যা। কোনো বেদনা ছিল না, কাছের মানুষের মুখোশ খুলে পড়ার যাতনা ছিল না, ছিল না ষড়যন্ত্র। অভাবের টানে জুতোর তলা খোয়াতে হয়নি। টিনের মরচে ধরা ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের মধ্যে বসবাস করে মায়ের হতাশা, বোনের কাতরতা কিছুই দেখতে হয়নি। ওরা আবারো নিজেদের আভিজাত্য ঘেরা বাড়িতে আছে। জীবনের চোরাগলিতে কোনো চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, দুঃখ নেই। সম্মানপূর্ণ জীবনে কারো চোখ রাঙানি, তাচ্ছিল্য, অপমান, কটাক্ষ সহ্য করার দায় নেই।

জানালা দিয়ে আসা সূর্যকিরণ গা স্পর্শ করতেই প্রিয়া ঘোরের জগৎ থেকে ছিঁটকে বেরিয়ে আসে। এও তার বাড়ি নয়। কিছুই কল্পনা নয়। তাকে আবারো মুখোমুখি হতে হবে বাস্তবতার। ওরা নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠেছে আজ সপ্তাহখানিক হলো। খাট না থাকায় ফ্লোরিং করে ঘুমাতে হচ্ছে। তাতেও দুঃখ নেই। বড়ো ঘরে হাত-পা মেলে, ফেলে-ছড়িয়ে থাকা যায়।
বিছানা ছেড়ে বাইরে যেতেই চমকে উঠল প্রিয়া। অনুভব ডাইনিং রুমে বসে আছে মায়ের পাশে। হেসে হেসে গল্প করছে দুজনে। প্রিয়ার এলোমেলো অবস্থার দিকে অনুভব এক পলক চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ওড়নাহীন মেয়ে দেখে সে অনভ্যস্ত এমন নয়। তার বন্ধু কিংবা সহপাঠি মেয়েরা কাঁধ খোলা, স্লিভলেস ড্রেস পরলেও অনুভবের সমস্যা হয় না। কিন্তু প্রিয়া তেমন নয়। সে পরিপাটি করে ওড়না ঝুলিয়ে রাখে গলায়। সেটাই তার কম্ফোর্টজোন। অনুভব অন্যের কম্ফোর্টকে সম্মান করে। সে অস্বস্তিতে না পড়লেও প্রিয়া যে অস্বস্তিতে পড়বে তা নিয়ে সন্দেহ নেই বলেই চোখটা প্রেয়সীর ঘুমভাঙা মুখটাকে উপভোগ করার বাসনা পরিত্যাগ করল।

প্রিয়া অনুভবের দৃষ্টির চাঞ্চল্য দেখেই তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে যায়। মা পিঠ দিয়ে ছিলেন বলে ক্ষণিকের এই অপ্রস্তুত অবস্থা সম্পর্কে অনবগত রইলেন। সে গায়ে ওড়না জড়িয়ে পুনরায় বাইরে আসতেই খেয়াল হলো অনুভব ও মা চা খাচ্ছে। দিয়া চায়ের কাপ ও নোনতা বিস্কুট নিয়ে দক্ষিণের খালি ঘরটায় গিয়ে বসেছে। প্রিয়া ভ্রু কুচকায়। বাড়িতে না আছে চা পাতা, না চিনি, দুধ। মুনিরা ওর সংশয় দূর করলেন। বললেন,
“দেখ, সকাল সকাল চায়ের উপকরণ নিয়ে চলে এসেছে ছেলেটা। ওর নাকি সবার সাথে চা খেতে ইচ্ছে করছে। নিজের হাতে বানিয়েও দিয়েছে।”

“সবই তোমাকে পটানোর ধান্ধা।”
বলতে ইচ্ছে করলেও কথাটা প্রিয়া গিলে নিল। অনুভব মাঝেমধ্যই দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। তবে সে প্রিয়ার সঙ্গে মোটেও কথা বলতে আসে না। সে আসে মুনিরার সঙ্গে কথা বলতে৷ যেন মা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ বাস করে না। আর কেউ গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রিয়ার অন্তরে ক্ষোভের একটা চোরাস্রোত বয়ে যায়।
নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে সে একটু দূরে সরে বসল তাদের থেকে। চুমুক দিয়ে দেখল খেতে ভালোই হয়েছে। অনুভব ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জানতে চায় চা কেমন হয়েছে। প্রিয়া সত্যিটা বলল না। কাঁধ ঝাকিয়ে বোঝাল চা কোনোরকম হয়েছে।

অনুভব তাতে দমে গেল না মোটেও। সে বলে চলেছে,
“আম্মু, আপনার চলাচলের সুবিধার জন্য একটা হুইল চেয়ার কিনব। একদম নতুন পারব না। অনেক দাম নেবে। সেকেন্ড হ্যান্ড পেয়েছি এক বন্ধুর কাছে। ভালো কোয়ালিটির। বন্ধুর বাইক এক্সিডেন্টের পর দুই মাস ইউজ করেছিল। অল্পদামে দেবে। বিকেল নাগাদ নিয়ে আসব।”

“কত দাম পড়বে?” মুনিরা ইতস্তত করে জানতে চান।

“আট হাজার নেবে, আম্মু। পরিচিত বলে কমে দিচ্ছে।”

মুনিরা বেগম আঁতকে উঠলেন,
“কম হলেও অনেক টাকার ব্যাপার। প্রয়োজন নেই, বাবা। আমি মানিয়ে নিয়েছি।”

অনুভব ভয়ানক বিমর্ষ হয়ে মাথা নত করে। বলে,
“আপনি তো আমায় ছেলে হিসেবে গ্রহণ করছেন না, আম্মু। তাই আমিও আপনাকে মায়ের সেবাটুকু অধিকারবোধে নির্দ্বিধায় করতে পারছি না। চিন্তা নেই। ধার হিসেবেই নেবেন। প্রিয়া ইভেন্টের জবটায় জয়েন করে ধীরে ধীরে শোধ দেবে নাহয়। চাকরিটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। টিউশনি কবে না কবে পাবে, মনমতো পাবে কিনা তার ঠিক নেই। ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার গজাচ্ছে। টিউশন মিডিয়া হচ্ছে। সব টিউশনি তারাই ক্যাচ করে ফেলছে বলে এখন স্বাচ্ছন্দ্যে ভালো টিউশনি পাওয়াও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি গ্রেজুয়েশন দিয়ে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছি বলে স্টুডেন্টদের ফ্যামিলির কাছে যতটা প্রায়োরিটি পাব, প্রিয়া তত সহজে পাবে না। তারচেয়ে নন্দিনীর এনে দেওয়া জবটাই প্রেফারেবল। অবশ্য ইভেন্টের জবটায় বেতন দিয়ে কোনোমতে চললেও নানান জায়গায় ইভেন্ট এরেঞ্জ করতে যেতে হয় বলে ফিরতে রাত হবে। পাশে কেউ থাকলে ওরও সুবিধা হতো।”

প্রিয়া বিস্ময়ে হতভম্ব। কত্ত বড়ো নির্লজ্জ! একে তো দমে দমে আম্মু আম্মু করছে, আবার ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝাচ্ছে তার বডিগার্ডরূপী স্বামী প্রয়োজন! লজ্জায় প্রিয়া বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। মায়ের দিকে তাকাতেও সংকোচ লাগে। অনুভব দিয়ার সঙ্গে গল্প করার বাহানায় স্থান ত্যাগ করে দক্ষিণের ঘরটায় ঢুকে গেল। যাওয়ার আগে চোখ টিপে মেয়েটার লজ্জা ও অপ্রস্তুতভাব আরেকধাপ বাড়িয়ে দিতে ভুলল না।

দক্ষিণের রুমটায় কেউ থাকে না। ফাঁকা পড়ে আছে। প্রিয়া মা-বোনকে নিয়ে পাশের ঘরটাতেই থাকে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া বাড়িতে কোনো ফার্নিচারও নেই। সবটা ধীরে ধীরে গড়তে হবে। দিয়া জানালার গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে দেখছিল। অনুভবকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“এই বাড়িটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে, ভাইয়া। আমাদের বাড়িটার মতো সুন্দর না হলেও বস্তির বাড়িটা থেকে অনেক সুন্দর। কিন্তু এখানে আমার কোনো বন্ধু নেই। তুমি আমাদের সঙ্গে কবে থেকে থাকবে? অনেক মজা হবে তাহলে।”

অনুভব ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিল। দুজনের ভাব হয়েছে অতি দ্রুত। সে বুঝে পায় না এমন মিষ্টি আর মিশুক পরিবারের মেয়ে হয়ে প্রিয়াটা কী করে অমন গম্ভীর, মেজাজি, মুরুব্বি টাইপ হয়েছে! অনুভব স্মিত হেসে বলল,
“থাকব। তোমার রাগী আপুটার রাগ কমলেই থাকব। কিন্তু এই রুম ফাঁকা কেন? তোমরা কেউ থাকছ না?”

“না, মা বলেছে এটা তোমার আর আপুর রুম হবে।”

“কী বললে?” অনুভব স্তব্ধ স্বরে জানতে চাইল। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারল না।

দিয়া একই কথা পুনরাবৃত্তি করল। অনুভব ডগমগিয়ে ওঠে। আম্মু বলেছে! তারমানে উনি মেনে নিয়েছেন! খুশিতে দিয়াকে কোলে নিয়ে একপাক দেয় সে। দিয়ার খিলখিল হাসি ফাঁকা ঘরের দেয়ালে বারি খেয়ে উচ্চধ্বনি করে ওঠে। দিয়া মায়ের ডাকে ছুটে বেরিয়ে যেতেই কিছুক্ষণ বাদে প্রিয়া এলো। তার মুখ থমথমে। একটু আগের নির্লজ্জতার জন্য রাগ দেখানোর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সে। মুখ খুলতে যাওয়ার আগেই অনুভব ওকে প্রায় বাহুর মাঝে লুফে নেয়। প্রিয়া বিস্ময়ে হতবাক! রাগ সরে জড়তা ধরা দিল মুখশ্রীতে। চঞ্চল চিত্তে, অস্থির ভঙ্গিতে দরজার দিকে চায় ও। বলিষ্ঠ বন্ধনের বন্দিত্বে কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হতেই টের পায় উত্তেজনায় দেহ কাঁপছে অনুভবের। যা ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হচ্ছে প্রিয়ার দেহে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে একজোড়া অনুরাগমথিত দৃষ্টি ওকে স্পর্শ করছে অদৃশ্য, কোমল, স্নেহমাখা হাতে। প্রিয়ার কম্পিত, শঙ্কিত দেহটি মুচড়ে ওঠে। ক্ষীণ স্বরে বলে,
“দিয়া চলে আসবে।”

অনুভব সে কথায় পাত্তা দিল না৷ একটু আগে যাকে এলোমেলো দেখতেও বাঁধছিল এখন তাকেই বুকের মাঝে নিতে সংকোচ লাগছে না। আরো ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এটুকুতেই নাজুক মেয়েটি যেভাবে কাবু হয়ে গেছে। আরেক পা এগোলেই মূর্ছা যাবে। অনুভব বলল,
“আম্মুর এটুকু কাণ্ডজ্ঞান আছে হবু স্বামী-স্ত্রী আলাদা কথা বললে তাদের স্পেস দিতে হয়। কেউ আসবে না।”

প্রিয়া ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে। কঠিন গলায় বলে,
“অত লাফালাফির কিছু নেই। আমি এখনো রাজি হইনি।”

ওর কণ্ঠের কাঠিন্যটুকু যেন নিতান্তই বাচ্চাসুলভ শোনায় অনুভবের কাছে। বাচ্চাদের সব অবাস্তব কথাকে যেমন পাত্তা দিতে নেই তেমনই প্রিয়ার কথাকেও সে পাত্তাই দিল না। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“খুব জ্বা’লাচ্ছো, হাসু। তোমার অভাবে যে আমি জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি সেটা দেখো না?”

“অঙ্গারের ছ্যাঁকা লাগছে। আমি আবার গরম সহ্য করতে পারি না। দূরে যান।”

“লাগুক ছ্যাঁকা। সারা দেহে, মনে প্রেমানলে ঝলসানোর ছাপ পড়ে যাক। সবাই জানুক তুমি আমার ব্যক্তিগত সম্পদ। এ সম্পদ বিনিময় কিংবা হস্তান্তরযোগ্য নয়।”

প্রিয়া মাথা নত করে। ঠোঁট কামড়ে ধরে। লজ্জায় তার শ্বেত চন্দনের মতো গালে পেলব লালিমা খেলে যায়। ঠোঁটের কোণে মিটমিট করে জ্বলতে থাকে লাজুক হাসি। তবুও বাঁকা কথায় খোঁচা দিতে ছাড়ে না,
“যেভাবে ঢোল পিটিয়ে সবাইকে মায়ের হবু জামাই বলে পরিচয় করান, দমে দমে আম্মু আম্মু করেন, তাতে কারো জানতে বাকি আছে বলে আমার মনে হয় না। এরপর বিয়ে না হলে আমার গায়ে কলঙ্ক লেগে যাবে।”

অনুভব ঝুঁকে এসে গাঢ় স্বরে বলে,
“কলঙ্কের কালি নয়, আমি তোমার চোখের কাজল হতে চাই। তোমার অশ্রু রোধের বাঁধ হতে চাই।”

প্রিয়ার নিশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পায়। বেহায়া নজর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ঝুপ করে মুখ গুজে দিল প্রশস্ত বুকে। অনুভব হাসল। কিছুটা আবেগে আচ্ছন্ন সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই পেটের খাদ্যাভাব জানান দিল প্রিয়া অভুক্ত। শুধু চায়ে সকালের নাশতা হয় নাকি! দিয়াকে স্কুলে পাঠানোর আগে পেট ভরে ভাত খাওয়ায় ও। সেই কাজ বাকি, নয়তো এই বাহানাতেও দুষ্টু মেয়েটা স্কুল কামাই করবে। প্রিয়া বুক থেকে মাথা তুলে বলল,
“রান্না চড়াই। খেয়ে যাবেন।”

তেতো মুখে মিষ্টি কথা শুনে অনুভব অবাক হওয়ার ভান করে,
“আরেব্বাস! আমার তো এবার নিজেকে গৃহকর্তা মনে হচ্ছে। অফিস যাওয়ার আগে বউ খেয়ে যেতে বলছে! লোভ ধরিয়ে দিচ্ছো, হাসু। এরপর দূরে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে।” শেষ কথায় অনুভবের কণ্ঠ আবেশ খেলে গেল।

প্রিয়া নিস্ফল ক্রোধে ফুঁসল। মুখ ঝামটে বলল,
“খাবেন কিনা বলুন। অত বেশি ভাবতে কে বলেছে?”

“খাব না আবার! তুমি জানো, আমি হলের ক্যান্টিনের খাবার একদমই খেতে পারি না। পেট ভরানোর জন্য কোনোমতে পানি দিয়ে গিলে খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। আমি না বাঁচলে তো তুমি স্বামী পাবে না। তোমার জন্য হলেও আমায় বাঁচতে হবে। আমার প্রতিটা স্ট্রাগলে তোমার চিন্তা, দেখেছো?”

“আপনার স্ট্রাগলের গল্প শুনে আমার মোটেও কান্না পাচ্ছে না।”

“আই ফিল পিটি ফর মাইসেল্ফ। একটা নিষ্ঠুর বউ জুটতে চলেছে।”

“তাই গুণীজনরা বলেছেন, ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।”

অনুভব চোখমুখ শক্ত করে। কিছুটা রাগ, কিছুটা বেদনার সঙ্গে উচ্চারণ করে,
“জ্ঞান দেবে না, খবরদার! একটু নরম হও মেয়ে। এত প্র‍্যাক্টিক্যাল হতে কে বলেছে তোমায়? জীবনটাকে ক্যালকুলেটর বানিয়ে ফেলছো একদম। দুঃখের হিসেব করা ছেড়ে সুখের স্বপ্ন দেখো। তুমি জানো কতদিন পরিবারের সাথে, আপন মানুষের সাথে বসে একসঙ্গে থাকা হয় না আমার। হলের দেয়ালগুলো প্রতিনিয়ত নিঃসঙ্গতা মনে করিয়ে দেয়। আমার আপন বলে অধিকার দেখানোর মতো কেউ নেই। কেউ না। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি ইয়াং জেনারেশন ডিপ্রেশনে ভোগে কেন। সেই ডিপ্রেশন থেকে বাঁচতে হলেও একটা শান্তির নিবাস চাই। অবশ্য তুমি যদি আমায় ভালো না বাসতে পারো, স্বামী হিসেবে না মানতে পারো তাহলে ভিন্ন কথা। আমি আর জোর করব না।”

প্রিয়া বিহ্বল হয়ে আছে। পুরুষালি বুকের উত্তাপে ওর সমস্ত দুশ্চিন্তা বরফের মতো গলে গিয়ে দেহটা এক লহমায় নির্ভার হয়ে গেছে। মা ব্যতীত অন্য কারো বন্ধন এতটা নির্মল, আদুরে, প্রশান্তিকর হতে পারে সে জানত না। অনুভব সাড়া না পেয়ে ব্যথিত হয়। প্রিয়া তাকে ভরসা করে না! ভালোবাসে না! সে কী আসলেই মন ছুঁতে ব্যর্থ হলো? অনুভব প্রিয়াকে ছেড়ে দিয়ে স্বপ্ন সাজানো দক্ষিণমুখী জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দৃষ্টিসীমায় ভাসে মেঘহীন খরতপ্ত আকাশ।

ক্ষণকাল বাদে প্রিয়া এসে তার পাশে দাঁড়ায়। চোখের কার্নিশ ছলছল করছে ওর। অনুভবের শুকনো মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কেন লোকটার স্থাস্থ্য ভেঙে যাচ্ছে দিন দিন। সারাদিন-রাত পড়াশোনা করা, আপনজনদের থেকে দূরে থাকা, খাবারের কষ্ট, আশানুরূপ চাকরি না পাওয়ার হতাশা, আর সবশেষে একাকিত্বের যন্ত্রণা। সেদিক থেকে প্রিয়া ভাগ্যবতী। তার মা-বোন সঙ্গে আছে। নিঃসঙ্গতা নেই। ওর যন্ত্রণা অভাবের, সম্মানের। আর অনুভবের একাকিত্বের।

প্রিয়া পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে বুঝেও অনুভব ফিরে তাকায় না। অভিমান স্পষ্ট ওর চোখের তারায়৷ প্রিয়া মন ভোলানো সুন্দর কথা বলতে পারে না। সে আসলেই এসবে আনাড়ি। ইতস্তত ভাব নিয়ে অনুভবের বাহুতে মাথা রাখল। চোখ বুজল ভরসায়। মিহি স্বরে বলল,
“শুনুন, আপনাকে আর হলের ক্যান্টিনে খেতে হবে না। আমি রান্না করে বক্সে ভরে দিয়ে দেব। সেটাই খাবেন।”

অনুভব তাচ্ছিল্য করে বলল,
“কী দরকার পরের ছেলের জন্য এত কষ্ট করার?”

“যেন আমার কপালে একটা অসুস্থ স্বামী না জোটে।”
বলে ফেলেই প্রিয়া ঠোঁট টিপল। চোখ তুলে তাকানোর ক্ষমতাটুকু হলো না। ফুরফুরে হাওয়া অনুভবের কানে কানে শুনিয়ে গেল প্রেয়সীর নিরব সমর্পণ। পুলকিত হলো হৃদয়ভূমি। তবুও গম্ভীরতা এঁটে রইলো মুখভঙ্গিতে। বলল,

“তো কতদিন চলবে বক্সে করে খাবার আনা-নেওয়া? রোজ আসা-যাওয়া করতে বাড়তি খরচও তো হবে।”

এ প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন অর্থ ছিল যে, বিয়ের জন্য আর কত দেরি। বুঝতে অসুবিধা হলো না প্রিয়ার। লাজুক স্বরে বলল,
“মায়ের সঙ্গে কথা বলুন।”

প্রিয়া এক প্রকার পালিয়েই যাচ্ছিল। অনুভব তড়িৎ ওর হাতের কবজি চেপে ধরল। কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আমি ছাড়া এ পৃথিবীতে তোমার আর কোনো গন্তব্য না থাকুক। অনুভবে কাঁপুক প্রিয়ার প্রতিটি লোমকূপ।”

চলবে…

প্রিয়ানুভব পর্ব-১৫

0

#প্রিয়ানুভব [১৫]
লেখা: প্রভা আফরিন

চারতলা বাড়িটা সম্পূর্ণ সাদা রঙ করা। জনবহুল, দোকানপাটে ঠাঁসা এই এলাকায় এমন এক ধবধবে সাদা বাড়ি বিস্ময়ের বটে৷ একদম রাস্তা সংলগ্ন হওয়ায় বাড়ির চারপাশে আলাদা করে কোনো পাঁচিল নেই। ঢুকতেই কলাপসিবল গেইট। বাইরের সম্মুখভাগের দেয়ালে বিরাট অক্ষরে লেখা, ‘দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ’। সেই নিষেধাজ্ঞা আদৌ বিজ্ঞাপনদাতারা মানেনি। বিজ্ঞাপনদাতাদের ধর্মই তারা ঘাড়ত্যাড়ামি করবে। যেখানে সেখানে পোস্টার সেঁটে দেবে। এখানেও সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। সাদা দেয়ালের গায়ে টিউশনি নিয়োগ থেকে শুরু করে কলিকাতা হারবালের পোস্টার চোখে লাগার মতো করে আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে ওপরের তিনটে তলা দেখতে রুচিসম্মত মনে হলেও নিচতলা সেই যোগ্যতা হারিয়েছে।

নন্দিনী, দিগন্ত এবং অনুভবের গন্তব্য দোতলায়, বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে। বাড়িওয়ালা লোকটা টেকো মাথার বেটেখাটো একজন লোক। গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা। নন্দিনীর মনে হলো এই লোক ধবধবে বলেই বোধহয় বাড়ির রঙটাও সাদা। সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে একটা বাড়ি নির্মান করে তিনটে তলা ভাড়া দিয়ে সম্পূর্ণ দোতলা জুড়ে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখা গেল লোকটার ঘরের প্রায় সব জিনিসই সাদা। ভদ্রলোক তিনটে যুবক-যুবতীকে চশমার ভারী কাচে নিরীক্ষণ করে নিলেন। ম্যাড়মেড়ে স্বরে বললেন,

“তোমরাই বাসা দেখতে এসেছো?”

অনুভব নম্র গলায় বলল,
“জি, আঙ্কেল।”

নন্দিনী চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
“আপনার নাম কী সাদা মিয়া বা এই টাইপ কিছু?”

ভদ্রলোক কপালে লম্বা ভাজ ফেলে বললেন,
“হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারণ কী?”

“আপনার বাড়ির সবই সাদা। আপনিও দেখতে অস্ট্রেলিয়ান সাদা চামড়ার লোকেদের মতো। যদিও লম্বায় ফেল মে’রেছেন। তাই মনে হলো।”

ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন। ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের এই সবজান্তা ভাব আর অতিরিক্ত কৌতুহল উনার একদমই পছন্দ নয় মনে হচ্ছে। বললেন,
“কার জন্য বাসা দেখছো? কে থাকবে? আমি কিন্তু আগেই বলেছি ভার্সিটির স্টুডেন্টদের বাড়ি ভাড়া দেব না। সাবলেটও নয়।”

“কেন? আপনার কি চঞ্চল কিশোরী বা যুবতী মেয়ে আছে?”

নন্দিনীর প্রশ্নে ভদ্রলোকের কপালে এবার আরেকটি ভাজের রেখা বৃদ্ধি পায়। যা স্পষ্ট বলে মেয়েটিকে তিনি পছন্দ করছেন না। বিরক্ত গলায় বললেন,
“থাকলে কী সমস্যা আর না থাকলেই বা কী সমস্যা?”

“না থাকলে সমস্যা নাই, থাকলেও সমস্যা নাই। কারণ আমার এক বন্ধু বর হতে চলেছে। আরেকজন বিশ্বভদ্র। মাইয়াগো দিকে চায় না। কাজেই আপনার চিন্তার কারণ নাই।”
নন্দিনী একটু থেমে আবার উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মেয়ে না থাকুক। আপনার আনম্যারিড ছেলে নাই তো? তাহলে চিন্তার কারণ আছে। আপনারও, আমারও।”

বাড়িওয়ালা ভ্রুকুটি করেন। বলেন,
“আমার ছেলের সঙ্গে তোমার চিন্তার কী কারণ থাকতে পারে? তোমাদের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।”

নন্দিনী মুখ খুলতে যাচ্ছিল। দিগন্ত সপাটে ওর মুখ চেপে ধরে সরল ও দুঃখী ভাব করে বলল,
“কিছু মনে করবেন না, আঙ্কেল। আসলে খুব ছোটোবেলায় ও পুকুরে পড়ে গেছিল। প্রায় পাঁচ মিনিট ডুবে ছিল। এরপর থেকে ওর মেন্টাল কন্ডিশন নড়বড়ে হয়ে গেছে। কখন কী বলে আর কী করে ঠিক নেই।”

নন্দিনী কটমট করে চাইল দিগন্তের দিকে। অন্যদিকে বাড়িওয়ালার চোখমুখ থেকে বিরক্তি সরে গেছে। অতীতের দুর্ঘটনা শুনে তিনি করুণার দৃষ্টিতে নন্দিনীকে দেখছেন। অনুভব বলে উঠল,
“আমার জন্য বাসা দেখতে এসেছি, আঙ্কেল। এখন আমার ফ্যামিলির মেয়েরা উঠবে। আমি কয়েকদিন পরে উঠব।”

“কেন? পরে কেন?”

উত্তরটা দিগন্ত দিল, “বিয়ের পর একেবারে উঠবে। এটা তো কাজিন বিয়ে নয়। তাই বিয়ের আগে হবু বউ-শাশুড়ির সঙ্গে এক বাড়িতে থাকাটা স্বস্তিজনক নয়।”

ভদ্রলোক অবাক হয়ে অনুভবকে দেখেন। বলেন,
“তুমি তাহলে হবু শ্বশুর বাড়ির লোকেদের জন্য বাসা ঠিক করতে এসেছ?”

“ঠিক তাই।”

“বিয়ের পর তাদের সঙ্গে থাকবে, মানে ঘর জামাই থাকবে?”

“জি না, বউয়ের পরিবার আমার সঙ্গে থাকবে।”

“কেন? তোমার বাবা-মা কই?”

“কেউ নেই।”

“স্যাড! কিন্তু শুধু মেয়েরা কেন থাকবে? শ্বশুর বা তার ছেলে পেলে নেই?”

ভদ্রলোকের চশমা ঠাসা চোখের কোটরে প্রশ্নেরা ভিড় করছে দলে দলে। সকলেই এবার বিরক্ত হলো। বাড়ি ভাড়া করতে এসে কী অতীত ইতিহাস তুলে ধরতে হবে! নন্দিনী উষ্ণ গলায় বলল,

“থাকল কী না থাকল তাতে সমস্যা কী, ধলা কাক্কু? আমরা কী এইখানে ওর জীবনকাহিনীর পো’স্ট’ম’র্টে’ম করতে বসেছি?”

ভদ্রলোক যেন এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“কাকে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছি জেনে নেওয়া আমার কর্তব্য। যাইহোক, চলো বাসা দেখাই।”

ফ্ল্যাটটা তিন তলায়। এখানেও সবকিছুর রঙ সাদা। দুটো বেডরুম ও ডাইনিং স্পেস নিয়ে ছোটো একটা ফ্ল্যাট। অনুভবের সামর্থ্যে এই ছোটো ফ্ল্যাটটাও অনেক দামী। হন্য হয়ে আরেকটা টিউশনি খুঁজছে ও। চাকরির চেষ্টাও অব্যাহত। তার নিজের সংসার হতে চলেছে যে। প্রিয়ার মায়ের থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো জবাব না পেলেও সে নিজের যুক্তি, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা দিয়ে মুনিরাকে একপ্রকার নিজের দিকে টেনে ফেলেছে।
মুনিরা বেগম জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে লড়ে যাওয়া অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নারী। মানুষ চেনার ক্ষমতা উনার আছে। অনুভবের প্রতিটি কথা তিনি মন দিয়ে শুনেছেন, বুঝেছেন। কিন্তু ডিসিশন জানাননি। অনুভব অবশ্য বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। একটা আত্মীয়হীন, বেকার, একলা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে যে কারো সাহস হওয়ার কথা না। এখন একমাত্র তুরুপের তাস প্রিয়া। সে মুখ ফুটে বললেই সবটা সহজতর হয়ে উঠবে। অনুভব আসার আগে এও বলে এসেছে বিয়ে না হোক, তাদের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য একটা নিরাপদ, ঝামেলাবিহীন বাড়ি দরকার। সেই সূত্রেই আজ বাড়ি দেখতে আসা।

বাড়িওয়ালা চারিদিক ঘুরে দেখিয়ে বললেন,
“আমার র’ক্ত জল করা টাকার বাড়ি। খুবই যত্নের। ভাড়াটিয়াদের কাছে আমার একটাই চাওয়া, বাড়িটার যত্ন নিতে হবে। দেয়ালে যেন দাগ না লাগে।”

নন্দিনী লোকটার ওপর যারপরনাই বিরক্ত। ডান-বাম, উপর-নিচ সাদায় মুড়িয়ে দিয়ে বলে যেন দাগ না ফেলে! আরে ভাই বাড়িতে একটু ফেলে ছড়িয়ে না থাকলে সেটা বাড়ি হলো? মনে হচ্ছে ভাড়াটিয়া হয়ে নয়, টাকা দিয়ে মেহমান হিসেবে আসবে। এতই যখন মায়া তো ভাড়া দেওয়া কেন? বুকে আগলে রাখুক না। ও বিড়বিড় করে গজগজ করতে লাগলে ভদ্রলোক বললেন,
“কিছু বলছো?”

দিগন্ত বাড়িওয়ালার নিকটে গিয়ে ফিসফিস করে উত্তর দিল,
“এটা ওর স্বভাব, আঙ্কেল। একা একা কথা বলা। ওই যে একটু আগে বললাম না মেন্টালি…”

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে আবারো দয়ার চোখে তাকালেন। আহা! এত সুন্দর মেয়েটার কী অবস্থা! তিনি নন্দিনীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“অসুস্থ হলেও তুমি বুদ্ধিমতি। আমার নাম সাদা না হলেও একই অর্থের। আমার নাম সফেদ মোল্লা।”

ভাড়া বিষয়ক সব কথাবার্তা চূড়ান্ত করে সাদামহল থেকে রঙিন দুনিয়াতে পা রেখে অনুভব প্রিয়াকে ফোন দিল। প্রিয়া ফোন রিসিভ করে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“আপনার গায়ে ওগুলো কীসের দাগ ছিল কাল? গুটি গুটি লাল লাল।”

অনুভবের কপালে ভাজ পড়ে৷ স্মরণ হয় নিজের দেহে অগণিত মশার কামড়ের কথা। দুষ্টু হেসে জবাব দিল, “লাভ সাইন।”

“মানে?” প্রিয়া বুঝল না কথার অর্থ।

অনুভব ঠোঁট কামড়ে হেসে লঘু স্বরে বলল,
“রাতের বেলা একলা পেয়ে বনের দুষ্টু মেয়েরা আমায় ভীষণ জ্বা’লাতন করেছে। তারই চিহ্ন এসব। বিয়ের পর তোমাকেও শিখিয়ে দেব।”

“কোথাকার মেয়ে? কী বলছেন এসব?” প্রিয়া হতবুদ্ধি হয়ে যায়।

“বলব না। পারলে এসে দেখে ইনভেস্টিগেট করে বের করো। আগের কথা ছেড়ে এবার আমার বর্তমান কথা শোনো। আমাদের সংসার গড়ার বাড়িটা ঠিক করে ফেলেছি। তিন তলায় ফ্ল্যাট। দক্ষিণমুখী একটা ঘর পাওয়া গেছে। ভাবছি মা আর ছোটোবোনকে পশ্চিমদিকের ঘরটা দিয়ে তুমি আর আমি দক্ষিণের ঘরটায় থাকব। ফুরফুরে হাওয়ায় প্রেমটা ভালো জমবে।”

অনুভব হাসছে। প্রিয়ার কণ্ঠ জমে আসে। বিয়ের নিশ্চয়তা নেই আর এই লোক কোন ঘরে থাকবে সেটাও কল্পনা করে সেড়েছে! বলল,
“লজ্জা-শরম সব নিলামে তুলেছেন? আমাদের বিয়েটা যে হচ্ছে আপনি এত নিশ্চিত কী করে?”

“তাহলে তুমি আমার জায়গায় অন্য পুরুষকে স্বামী হিসেবে কল্পনা করছো? অন্যকেউ তোমার হাত ধরবে, তোমায় জড়িয়ে ধরবে।”

“ছি! তা কেন হবে?”

“তারমানে আমাকেই কল্পনা করো, তাই তো? কী কী কল্পনা করো?”

প্রিয়া অপ্রতিভ হয়। ছেলেটার জবান ইদানীং লাগামছাড়া হয়ে গেছে। অবশ্য লাগাম ছিলই বা কবে! পরিচিত ছিল বিধায় একটু শালীনতা বজায় রাখত। এখন পরিচিত থেকে প্রিয় হয়ে আর সেসবের বালাই নেই। প্রিয়া অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলে,
“আপনি বাজে কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি ফোন রাখছি…”

অনুভব হুমকির স্বরে বলল,
“দেখো হাসু, ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে যাও। নয়তো তোমাকে সারাজীবন আইবুড়ো থাকতে হবে। আমি দশ-বারোটা বিয়ে করলেও তোমাকে বিয়ে করতে দেব না।”

“দশ-বারোটা! কম হয়ে গেল না?” প্রিয়ার কণ্ঠে ঝাঁঝ ওঠে।

“হু, কমই হলো। যদি তুমি আগেভাগে রাজি হও তবে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ তুমি আমার ফুলস্টপ। তবে চিন্তা নেই সতীনের সংসার করতে হবে না। তুমি এলে বাকি সবাই লাইফ থেকে ডিসকোয়ালিফাইড। আমার বাবুর আম্মু তুমিই হবে। হাসুর পেট থেকে অনেকগুলো বাচ্চা হাসু আসবে। সারাক্ষণ প্যাকপ্যাক করে ডাকবে। হ্যাপি হাঁসমার্কা সংসার।”

“ধুর আপনি ভালো না।”

প্রিয়া ফোন রেখে দিল সঙ্গে সঙ্গে। অনুভব মিটিমিটি হাসছে। তৃপ্তির হাসি। তাকে স্পেস দিয়ে দূরের এক চায়ের দোকানে বসেছিল দিগন্ত, নন্দিনী। অনুভবের হাসি দেখে দিগন্ত মুচকি হেসে বলল,
“ও খুব সুখী হবে হাসুকে পেলে।”

নন্দিনী চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল,
“মনের মানুষ পাইলে সবাই সুখী হয়রে পাগলা। কিন্তু তুই সুখী হবি না। আমার বদদোয়া আছে লগে।”

দিগন্ত ক্রুদ্ধ মেজাজে বলল,
“শকুনের দোয়ায় গরু ম রে না।”

“রাইট! তুই একটা গরু। হাম্বা…হাম্বা!”

চলবে…