এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৪

0
297

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৪)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

“আমি এই বিয়েতে রাজি হয়েছি কারন!

এতটুকু বলে আবিরের মা নাজিয়ার মুখের দিকে তাকালেন, ওর চোখেমুখে কৌতুহল সাথে চিন্তার ছাপ। আবিরের মায়ের এই প্রথম নাজিয়াকে দেখে মায়া হলো, ভালো করে নজর দিয়ে দেখলেন মেয়েটা দেখতে মাশাল্লাহ বেশ সুন্দর। এতদিন জেদ করে মেয়েটা ভালো করে খেয়াল করাই হয়নি, মনে মনে আফসোস করলেন। কয়েক বছর আগে যদি এই ভুলটা বুঝতে পারতেন তাহলে হয়তো এতকিছু হতো না।

নাজিয়াকে অবাক করে দিয়ে উনি এগিয়ে এসে নাজিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– “এই কয়েকদিনে একটা কথা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছি, এই পরিবার, আবরারের জন্য তোমার থেকে যোগ্য কেউ হতেই পারে না।”

নাজিয়া অবাক নয়নে ওনার দিকে তাকিয়ে আছে, বিশ্বাস করতে পারছে না। যে মানুষটা ওকে সব থেকে বেশি অপছন্দ করে আজকে সেই মানুষটা তার ছেলের জন্য যোগ্য মনে করেছে!!

– “জানি আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি, নিজের জেদ-ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি সাথে নিজের ছেলে’কেও। তোমার কাছে আমি মাফ চাইব না, শুধু অনুরোধ করব আমার বর্তমান ও অবর্তমানে আমার সংসার’টাকে আগলে রেখো।”

নাজিয়া হঠাৎ করেই ইমোশনাল হয়ে গেল, আবিরের মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতদিন, এতটা বছর একটা জিনিসই চেয়েছে আবিরের‌ মা ওকে মেনে নিক কিন্তু সেটা হয়নি। আর আজ সেই ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছে, এর থেকে আনন্দের আর‌ কি হতে পারে!!

আবিরের মা নাজিয়াকে আগলে নিলেন, এতদিন মেয়েটাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন আর দিতে চান না। মন থেকে দোয়া করলেন, ছেলে আর ছেলের বউ যেন খুব ভালো থাকে।

আবিরের মা দুইদিন আগের ঘটনার স্মৃতিচারণ করলেন,

অতীত…

– “আবরার আর নাজিয়ার বিয়ে দিতে চাই।”

আবিরের মা চমকে উঠে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন।

– “তুই এইসব কি বলছিস আবির?”
– “হ্যাঁ মা। আবরার আর নাজিয়া একে অপরকে ভালোবাসে, শ্রেয়ার সাথে আবরারের বিয়ে হওয়া মানে একসাথে তিনটে জীবন নষ্ট করে দেওয়া।”
– “তুই সব জানিস?”
– “হ্যাঁ মা। আমি সবকিছু জানি, আর নাজিয়াকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার পেছনে শুধু নিসাই একমাত্র কারন ছিল না। আমি আবরার আর নাজিয়াকে এক করতে চেয়েছিলাম।”

আবিরের মা একটার পর একটা চমক পাচ্ছেন। কি সিদ্ধান্ত নেবেন সেইটাই বুঝে উঠতে পারছেন না, আবির ওর মায়ের হাতটা ধরে বলল,

– “মা জোর করে সংসার করা যায় না, তুমি প্লিজ এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাও।”

আবিরের মা কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। তারপর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– “কিন্তু আবির আমি যে তোর মামাকে কথা দিয়েছি শ্রেয়াকে এই বাড়ির বউ করব।”
– “মা যেখানে ছেলে-মেয়েদের মত নেই সেইখানে জোর করাটা কি উচিত হবে?”
– “শ্রেয়ার মত নেই?”
– “না মা। শ্রেয়াও অন্য একজনকে ভালোবাসে। এখন তুমিই বলো ওদের বিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?”

আবিরের মায়ের মুখ থেকে চিন্তার ভিড় সরে গেল, শ্রেয়ার কথা ভেবেই এতক্ষন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এখন যেহেতু শ্রেয়ার মত নেই তাই বিষয়টা এইখানে থামিয়ে দেওয়াই ভালো। কখনো কখনো সন্তানদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হয়।

– “আচ্ছা আমার কোনো আপত্তি নেই। তোর বাবাকে বলেছিস?”
– “হুমম। বাবা অলরেডি নাজিয়ার বাবা মায়ের সাথে কথাও বলে নিয়েছেন ওনারাও রাজি আছেন। শুধুমাত্র তোমার মতের অপেক্ষায় ছিলাম।”

আবিরের মা অমত করার মতো আর কিছুই পেলেন না, সবাই রাজি আর উনিও এই কয়েকদিনে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন তাই দুজন ভালোবাসার মানুষকে এক করে দিলে মন্দ হয় না। তারপর হঠাৎ করেই দুইদিন পর বিয়ে ঠিক করা হয়, সেইদিন রাতে আবিরের বাবা আবরারের উদ্দেশ্যে বললেন,

– “আগামী পরশু তোমার বিয়ে।”

আবরার সবেমাত্র ভাত গালে দিয়েছিল‌ বাবার কথা শুনে বিষম খেয়ে যায়। নাজিয়া পাশে দাঁড়িয়ে সবাইকে বেড়ে দিচ্ছিল, আবরারকে বিষম খেতে দেখে পানি এগিয়ে দিল তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে লাগল। আবরারের প্রতি কেয়ার দেখে সবাই মৃদু হাসল।

আবরার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
– “আমার বিয়ে মানে?”
– “বিয়ে মানে বিয়ে। আগামীকাল শ্রেয়াকে নিয়ে গিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করতে যাবে আর এইটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।”

বাবার মুখের উপর কিছু বলতে না পেরে আবরার খাবার রেখে দিয়ে চলে গেল। নাজিয়াও ঠিকমতো খেতে পারেনি সেইদিন।

নাজিয়ার ডাকে আবিরের মা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। উনি নাজিয়ার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,
– “আর কান্না নয়, অনেক কান্না করছ এইবার থেকে সবসময়ে হাসি-খুশি থাকবে। মনে থাকবে!”
– “হুমম।”
– “তুমি এইখানে ওয়েট করো, ওদের হয়ে গেলে তোমাকে নিয়ে যাবে।”
– “আন্টি প্রানকে খাওয়ানোর ছিল।”
– “সেটা তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, আমি প্রানকে খাইয়ে দিয়েছি। আর শোন মেয়ে, এইসব আন্টি-টান্টি বলা যাবে না আমাকে মামনি বলে ডাকবে আমাকে। আমি কখনোই তোমার মায়ের জায়গা নিতে পারব না, মা ডাকটা তোমার মায়ের জন্যই থাকুক। আমি না হয় বন্ধুর মতো শাশুড়ি হবো!”

নাজিয়া ওনাকে আবারো জড়িয়ে ধরল। মানুষটা খারাপ না, কিন্তু কিছু জেদ-অভিমানের ভীড়ে ভালো মানুষটা চাপা পড়ে গিয়েছিল যেটা পুনরায় প্রকাশিত হচ্ছে।

বিয়ে ইশার নামাজের পর পড়ানোর কথা থাকলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। মাগরিবের পর বিয়ে পড়ানো হবে, সেই কারনেই শ্রেয়া তাড়াতাড়ি নাজিয়াকে রেডি করিয়ে দিয়েছে। আবরার সাদা রঙের একটা পাঞ্জাবী-পায়জামা পড়ে সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে, একবারের জন্যও মাথা তুলে তাকাচ্ছে না। কাজি সাহেব আসতেই কনেকে নিয়ে আসার জন্য তাড়াতাড়ি করতে লাগল। শ্রেয়া নাজিয়াকে নিয়ে এসে আবরারের মুখোমুখি বসিয়ে দিল, আবরারের দৃষ্টি তখনও মাটিতে। আর নাজিয়া! সে তো ভয়েই শেষ, কি হবে! প্রচন্ড রকমের নার্ভাস লাগছে কি করবে?

কাজি সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন, আবরার নিজের ধ্যানে এতটাই মগ্ন ছিল যে খেয়াল করতেই ভুলে গেছে পাত্রীর নাম কি বলল।‌ হয়তো খেয়াল করলে বুঝে যেত, অন্য কেউ নয় ওর প্রিয় মানুষটাই ওর সহধর্মিনী হতে চলেছে।

আবরার আর নাজিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময়ে হঠাৎ করেই আবরারের চোখ আটকায় পাত্রীর নামের জায়গায়, চমকে ওঠে! নাজিয়া!! আবরার সাইন না করে সামনে তাকাতেই আরেকদফা চমক খেল। নাজিয়া বিয়ের সাজে বসে আছে আর শ্রেয়া নর্মাল ড্রেসাপে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আবরারের সবকিছু এলোমেলো লাগল, বিয়ের কথা শুনে কি পরিমান টেনশনে ছিল সেটা একমাত্র ওই জানে। আবির, শ্রেয়া উভয়ের কাছে বারবার গেছে কিন্তু ওরা প্রতিবারই ফিরিয়ে দিয়েছে নানান বাহানা দিয়েছে ‌ তারমানে সবকিছু সবার সাজানো প্ল্যান ছিল! ওর পরিবার – নাজিয়া ওর সাথে গেম খেলেছে কথাটা ভাবতেই মাথাটা গরম হমে উঠল। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন না করেই বলল,
– “এইসবের মানে কি? শ্রেয়ার জায়গায় নাজিয়া কেন?”

আবির শান্ত কন্ঠে বলল,
– “কারন বিয়েটা তোর আর নাজুর তাই।”

আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– “আমি এই বিয়ে মানি না।”

উপস্থিত সকলের মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ল। আবরার বিয়ে মানে না মানেটা কি??

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে