এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৩

0
309

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৩)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

আজ আবরার আর শ্রেয়ার বিয়ে। সকাল থেকে জোর কদমে আয়োজন চলছে, আত্মীয়রা ইতিমধ্যেই চলে এসেছেন। আত্মীয় বলতে আবাররের মামা বাড়ির লোকজন এবং নাজিয়ার বাবা মা।

অনেকদিন পর মাকে দেখামাত্রই নাজিয়া আবেগী হয়ে পড়েছিল, জড়িয়ে ধরে দুজনের সেকি কান্না। সদ্য এক মেয়েকে হারিয়ে নাজিয়ার মাও বড্ড একা হয়ে গেছেন, মেয়ের শশুর বাড়িতে আসতেই কষ্টগুলো তাজা হয়ে উঠছে।মেয়ের সংসারের গল্পগুলো স্মৃতিচারণ করতে লাগলেন, আবিরের সাথে কথা বললেন কিছুক্ষণ তারপর প্রানকে মনভরে আদর করলেন। ছেলেটা তার মেয়ের শেষচিহৃ, তাদের সকলের প্রান।

সবাই সবার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঈশার নামাজ পর বিয়ে পড়ানো হবে ঠিক করা হয়েছে, তারপরে সবাই খাওয়া দাওয়া করবে তার জন্য দুপুরের খাবার পর থেকেই আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। দুপুরে খেতে বসে নাজিয়া আবরার কেউই ঠিকমতো খায়নি, গলা দিয়ে খাবার নামছে না আর কিভাবেই বা নামবে! নাজিয়ার বি’ষাক্ত কিছু অনুভূতি হচ্ছে, ইচ্ছা করছে‌ সবকিছুর বাঁধন খুলে আবরারের কাছে চলে যেতে কিন্তু সেটা যে আর সম্ভব না।

আবরার মনখারাপ করে বসে আছে দেখে আবির ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
– “কিরে এইভাবে বসে আছিস কেন?”
– “তো! কি করব?”
– “জীবনে একবারই বিয়ে করবি, কোথায় আনন্দ করবি তা না এইভাবে মনখারাপ করে বসে আছিস?”
– “ভালোবাসার মানুষটাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব কথাটা ভাবতেই আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছে, আর তুমি আনন্দের কথা বলছ!!” কথাটা নিজের মনে মনে বলল আবরার, আবিরের সামনে আর প্রকাশ করতে পারল না।

আবির আবরারের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
– “ভাই বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়, এইটা একটা সম্পর্ক সাত জনমের বন্ধন। বিয়ের পর মানিয়ে নেওয়া ও মেনে নেওয়া জীবন সুন্দর হয়ে উঠে।”

আবরার বিরক্ত হয়ে বলল,
– “আমাকে এইসব বলছ কেন?”
– “কারন আজকে তোর বিয়ে।”

আবরার মেকি হেসে বলল,
– “কিছু পারি আর না পারি মানিয়ে ও মেনে নিতে খুব ভালোই পারি।”

আবরার উঠে চলে যায়, ওর যাবার দিকে তাকিয়ে আবির মৃদু হাসল।

বিকাল ৩টের দিক করে, প্রানের জন্য দুধ গরম করতে গিয়ে নাজিয়ার চোখ পড়ে নিজের হাতের মেহেন্দির দিকে। কালকে রাতে শ্রেয়া একপ্রকার জোর করেই পড়িয়ে দিয়েছে। মেহেন্দির রং গাঢ় লাল হয়েছে দেখে নাজিয়া মেকি হেসে মনে মনে বলল,
– “মেহেন্দির লাল হয়েই বা কি হবে! ভালোবাসার মানুষটি আজ অন্য কারোর হতে চলেছে।”

কিছু অনুভূতি সকলের সামনে প্রকাশ করা যায় না, নিজের মধ্যে রেখে গুমড়ে মরতে হয়। নাজিয়াও আজ গুমড়ে মরছে, না পারছে কাউকে কিছু বলতে আর না পারছে সবকিছু সহ্য করে যেতে।’ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারোর হয়ে যেতে দেখার সৌভাগ্য কারোর না হোক’ এর থেকে অসহনীয় যন্ত্রনা আর একটাও হয় না। তবুও নাজিয়া চাই আবরার আর শ্রেয়া ভালো থাকুক।

– ‘নাজিয়া নাজিয়া।”

শ্রেয়ার ডাক শুনে নাজিয়া নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে, কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে সেই খেয়াল নেই। নাজিয়া নিজের চোখ মুছে, শ্রেয়ার কাছে যাবে বলে বের হচ্ছিল তখনি সেখানে শ্রেয়া চলে আসে।

– “তুমি এইখানে? আর আমি গোটা বাড়ি তোমাকে খুঁজে চলেছি।”
– “কেন কি হয়েছে?”
– “অনেক কিছু। চলো এইবার”
– “কোথায়? ”
– “আহ্ গেলেই দেখতে পাবে চলো তো।”

শ্রেয়া নাজিয়াকে টেনে ওর‌ঘরে নিয়ে আসল। রুমের মধ্যে শাড়ি, গহনা ফুল এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আছে, নাজিয়া প্রথমে ভাবল শ্রেয়া ওকে সাজিয়ে দিতে বলবে কিন্তু ওর ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত করে শ্রেয়া বলল,
– “এইবার চুপ করে বসে পড়ো তো তোমাকে সাজিয়ে আবার নিজে সাজব।”
– “আমি কেন সাজব?”
– “আমি বলছি তাই, কি আমার কথা রাখবে না?”

নাজিয়া কিছু বলতে পারল না, মেয়েটা সত্যি ভালো মনের মানুষ। সবকিছুতেই মুখে হাসি লেগে থাকে।

বেশ অনেকটা সময় পর..
শ্রেয়া নাজিয়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে, নাজিয়া তো বসে বসে বোর হয়ে যাচ্ছিল। শ্রেয়া এত কি সাজাচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না।

শ্রেয়া নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “সব সাজ কমপ্লিট এইবার শুধু শাড়িটা পড়ানোর পালা।”
– “কি এতো সাজাচ্ছ আমাকে?প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও, আমার প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি হচ্ছে।”
– “কোনো ছাড়াছাড়ি নেই। আজকের দিনে একটু সাজবে না তো‌ কবে সাজবে?”

নাজিয়া মেকি হেসে বলল,
– “নিজের বিয়ের দিন সাজব।”

শ্রেয়া নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হেসে বলল,
– “আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে একবার দ্যাখো, বুঝে যাবে সবকিছু।”

নাজিয়ার কৌতুহল জাগল, গুটি গুটি পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চমকে উঠল। সাজটা একেবারে ব্রাইডালদেল মতো, গায়ে বেনারসী থাকলে পুরো বউ বউ লাগবে। নাজিয়া পেছন ফিরে বলল,
– “এইসব কি শ্রেয়া ‘দি?”
– “এখনো বুঝতে পারছ না?”
– “মানে? কি বুঝব!
– আমি জানি তুমি আর আবরার দুজন দুজনকে ভালোবাসো কিন্তু কোনো কারনে তুমি আবরারকে এক্সসেপ্ট করছিলে না। বড়ো দিদি হিসাবে একটা কথা বলছি তোমাকে, ভালোবাসা আগলে রাখতে হয়, এইভাবে অবহেলা করতে নেয়। সবার কপালে সত্যিকারের ভালোবাসা জোটে না, তোযার কপালে এসেছে আবরার তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে আর তুমি কি করছ! বারবার ওকে ফিরিয়ে দিয়েছ, ওর জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে কবেই তোমাকে ভুলে অন্যকাউকে আপন করে নিত কিন্তু ওহ! আজও তোমার অপেক্ষায় আছে, তুমি যদি এখন একবার বলো ওকে বিয়ে করতে চাও ওহ পরিবারের সবার বিপক্ষে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করবে”

নাজিয়া মাথা নিচু করে নিল, শ্রেয়ার কথাগুলো একটাও মিথ্যা নয়। কিন্তু এইখানে নাজিয়ার দোষ কোথায়! ওহ তো দুই পরিবার ও নিসা -আবিরের সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য নিজের ভালোবাসাকে ত্যাগ করেছে।

শ্রেয়া নাজিয়ার গালে হাত দিয়ে বলল,
– “যাকে ভালোবাসো তাকে আগলে রাখতে শেখো, দেখবে জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে।”

নাজিয়া আহত কন্ঠে শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “শ্রেয়া’দি তুমি এইসব কি বলছ? আজকে তোমাদের বিয়ে!”
– “হু, তোমাদের নয় বলো আমাদের।”
– “মানে?”
– “আজকে তোমার আর আবরারের বিয়ে নাজিয়া।”

নাজিয়া চমকে উঠল, ওর আর আবরারের বিয়ে মানে!! শ্রেয়ার কথা ওর কাছে মজা মনে হলো, কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

– “তুমি এইসব কি বলছ?”
– “ঠিকই বলছি। দুই পরিবারের সকলে মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তোমাদের জানানো হয়নি সারপ্রাইজ দেবার জন্য”

নাজিয়ার তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না কথাগুলো, সত্যি কি দুই পরিবার মিলে ওদের বিয়ে ঠিক করেছে!! নাকি শ্রেয়া ওর সাথে মজা করছে? কিন্তু এই বিষয়ে মজা করে লাভ কি!!

নাজিয়াকে আনমনা থাকতে দেখে শ্রেয়া বলল,
– “নাজিয়া এখন চলো শাড়িটা পড়িয়ে দিই।”
– “হু।”

নাজিয়ার মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, নিজেকে কিরকম একটা কাঠের পুতুলের মতো লাগছে কি রিয়াকশন দেওয়া উচিত সেটাই বুঝতে পারছে না। একদিকে ভালোবাসার মানুষটার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে শান্তি লাগছে আবার আবরারের মায়ের অমতের বিষয়টা ভেবে অস্বস্তি হচ্ছে। নাজিয়ার ভাবনার মাঝে শ্রেয়ার সাজানো কমপ্লিট। নাজিয়াকে খুব মিষ্টি লাগছে, শ্রেয়া শয়তানি করে বলল,
– “আজকে নাজিয়াকে দেখে আবরার শিওর হার্ট এ্যাটাক করবে।”

না চাইতেও লজ্জায় নাজিয়ার গাল দুটো রক্তিম আভা ধারন করল, ইচ্ছা করছে মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে।

শ্রেয়া নাজিয়ার সাথে টুকটাক মজা করছে, তখনি দরজায় টোকা মারার শব্দ হয়। শ্রেয়া দরজা খুলে দেখল আবিরের মা দাঁড়িয়ে আছেন।

– “মামনি তুমি? ভেতরে এসো না।”
– “সাজানো কমপ্লিট?”
– “হুমম।”
– “আচ্ছা তুই যা ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

শ্রেয়া রুম থেকে বের হয়ে যেতে আবিরের মা দরজাটা লক করে দিলেন। নাজিয়ার হঠাৎ করেই একটা ভীতি কাজ করছে, যে মানুষটা ওকে পছন্দই করেনা সে কেন এই বিয়েতে রাজি হয়েছে? নাকি তার এই বিয়েতে মত নেয়!!

– “এতক্ষনে নিশ্চয় জেনে গেছ, আবরার আর তোমার বিয়ের কথা।”
– “জ্বি।”

আবিরের মা গম্ভীর গলায় বললেন,
– “আপনি কেন এই বিয়েতে রাজি হয়েছি জানো?”

নাজিয়া মাথা তুলে ওনার দিকে তাকাল, ওনার এই বিয়েতে রাজি হবার কারন কি?

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে