এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০৬

0
312

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৬)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

“নাজু তাড়াতাড়ি হসপিটালে আয়, নিসাকে ভর্তি করানো হয়েছে।’

– ‘আমি এখুনি আসছি।’

নাজিয়াকে উত্তেজিত হতে দেখে হিরক বলল,
– ‘এনিথিং রং নাজিয়া!’
– ‘দিদিকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে, আমাকে এখুনি যেতে হবে।’
– ‘আমার কাছে বাইক আছে চল পৌঁছে দিয়ে আসি।’

নাজিয়া ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিল। এখন হিরক’কে না বলা মানে বোকামী, এই মুহূর্তে ওর নিসার কাছে পৌঁছানো’টাই আসল উদ্দেশ্য।

কলেজ থ হসপিটালের দূরত্বটা অনেকটাই। তবুও বাইকে করে পৌঁছেছে বলে দ্রুত পৌঁছে গেছে, নাহলে যেতে অনেকটা সময় চলে যেত। নাজিয়া হসপিটালের সামনে এসে হিরক’কে কিছু না বলে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়।

নাজিয়া ভেতরে এসে দেখল, আবির বিধ্বংস্ত হয়ে বসে আছে। আবিরের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। নাজিয়া এলোমেলো পায়ে আবিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল

– ‘আবির’দা আমার দিদি কেমন আছে?’

আবির নাজিয়ার দিকে মাথা তুলে তাকাল কিন্তু কিছু বলতে পারল না। চোখগুলো ছলছল করে চলেছে,মনে হচ্ছে ওর উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। আবিরের দিকে তাকিয়ে নাজিয়ার বুকটা কেঁপে উঠল, মনের কোনে ভয়ের সঞ্চার হলো দিদির কোনো ক্ষতি হয়ে গেল না তো! ভয়- ভীতির মধ্যে নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, ডুকরে কেঁদে উঠল নাজিয়া।

আবরার দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই খেয়াল করছিল, নাজিয়া এতটা তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলো সেটা ওকে বারবার ভাবাচ্ছে। নাজিয়ার কান্না দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের বুকে টেনে নিল। একটা আশ্রয় স্থান পেয়ে নাজিয়ার কান্নার গতি আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে, আবরার তার প্রেয়সীর কান্না নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।

বাইক পার্ক করে, কেবিন খুঁজতে গিয়ে হিরকের আসতে অনেকটা সময় লেগে যায়। ও.টি রুমের সামনে আসতেই দেখে নাজিয়া একটা পুরুষের বুকে মাথা রেখে কেঁদে চলেছে, আর পুরুষটি পরম যত্নে নাজিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। হিরকের বুকটা ধ্বক করে উঠল, নিজের প্রিয় মানুষটাকে অন্যকারোর বুকে দেখে মনটা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। নাজিয়াকে আগলে রাখা পুরুষটির আগলে রাখার ধরন বলে দিচ্ছে নাজিয়ার সাথে তার সম্পর্ক কতটা গভীর। আর নাজিয়া! সেও বিশ্বস্ত মানুষ পেয়ে নিজের মনের কষ্টটা ঝেড়ে ফেলছে।

– ‘এই নাজু কান্না থামাও প্লিজ। দ্যাখো তুমি না গুড গার্ল, তোমাকে তো স্ট্রং থাকতে হবে তাই না। তুমি কান্নাকাটি করলে আন্টিকে কে সামলাবে।’
– ‘আবরার আমার খুব ভয় লাগছে, দিদি ঠিক হয়ে যাবে তো! আর পুচকু ঠিক থাকবে তো?’
– ‘ ইনশাআল্লাহ সব ঠিক থাকবে তুমি আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা রাখো।’
– ‘হুমম।’

আবরার নাজিয়ার হাতটাকে শক্ত করে ধরে রাখল, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। এইদিকে হিরকের বুকের ব্যথাটা বেড়েই চলেছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারোর সাথে দেখার ভাগ্য কারোর না হোক, এ যে এক অসহনীয় ব্যথা। যা সহ্য করার ক্ষমতা কোনো প্রেমিক পুরুষ রাখে না।

আরো বেশ কিছু সময় পর একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল, সকলের প্রানে কিছুটা ফিরে এসেছে। নতুন একটা প্রান সবার মাঝে আসতে চলেছে এর থেকে আনন্দের কি হতে পারে। আবির অধৈর্য হয়ে পায়চারি করে চলেছে, আবরার নাজিয়ার হাতটা ছেড়ে আবিরের কাছে যায়।

– ‘দাদা চিন্তা করিস না, দেখবি সব ভালো হবে।’
– ‘আমার খুব টেনশান হচ্ছে কিছুতেই শান্ত হতে পারছি না রে।’

কিছুক্ষন পর নার্স সাদা তোয়ালেতে করে একটা ছোট পুতুলকে নিয়ে বাইরে আসল। নাজিয়া দৌড়ে গেল বাচ্চাটাকে দেখার জন্য, পুচকু’কে দেখার জন্য কতশত অপেক্ষা করছে ফাইনালি অপেক্ষার অবসান ঘটল।

– ‘ কনগ্রাচুলেশন আপনাদের ছেলে হয়েছে।’
– ‘ আলহামদুলিল্লাহ।’

নাজিয়া নার্সকে বলল,

– ‘আমি কি বাবুকে কোলে নিতে পারব!’
– ‘নিন।’

ছোট রাজপুত্র’টাকে নাজিয়া নিজের হাত দিয়ে আগলে ধরল। ছোট ছোট হাত-পা নরম তুলতুলে শরীর, অনুভূতিটাই অন্যরকম। বাবুকে কোলে নিয়ে নাজিয়ার নিসার কথা মাথাতে আসে
– ‘নার্স আমার দিদি কেমন আছে?’

নাজিয়ার প্রশ্নে আবিরের ধ্যান ফেরে, এতক্ষন ছোট বাবুটাকে দেখতে ব্যস্ত ছিল। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না, ওর ভালোবাসার অংশ ওর সামনে। আবির কিছু মুহূর্তের জন্য অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে, ওর কি করা উচিত সেটা প্রায় ভুলতে বসেছিল।

– ‘আসলে প্রেসেন্টে’র অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, অতিরিক্ত ব্লাড যাচ্ছে। প্রেসেন্টের যেকোন সময়ে যা কিছু হতে পারে।’

সময়টা মনে হয় সেইখানেই থমকে গেল। আবির এক পা পিছিয়ে পড়ে যেতে গেলে আবরার সামলে নেয়। নাজিয়া বাবুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, মনের ভয়টা আরো তীব্রতর হয়ে উঠছে। বারবার আল্লাহ কে ডাকছে যাতে নিসা সুস্থ হয়ে যায়। নিসার কিছু হয়ে গেলে আবির পাগল হয়ে যাবে আর এই বাচ্চাটার বা কি হবে!

বাচ্চাটাকে নিয়ে সবার এত এত আনন্দ ছিল সেটা নিমিষেই হারিয়ে গেল। নিসার চিন্তায় সবাই প্রায় ভুলতে বসেছে নতুন একটা প্রান, সদস্য ওদের মধ্যে উপস্থিত আছে। বাচ্চাটা মায়ের সঙ্গ না পেয়ে কেঁদে উঠল, নাজিয়া আগে কখনোই কোনো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সামলাই নি বাবুকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। নাজিয়ার বেহাল অবস্থা দেখে হিরক এগিয়ে আসতে যাবে তার আগেই আবরার নাজিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়।

– ‘কি হয়েছে বাবু কাঁদছে কেন?’
– ”জানিনা, কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি একটু দেখবে!’
– ‘দাড়াও আমি দেখছি।’

আবরার চলে গেল কিছুক্ষণ পর একজন নার্সকে নিয়ে ফিরে আসলো। নার্স বাবুকে দেখে বলল,
– ‘বেবির খিদে পেয়েছে। আপনারা ওকে ওর মায়ের কাছে দিন।’
– ‘আসলে নার্স আমাদের প্রেসেন্ট এখনো অসুস্থ তাই..
– ‘ওকে, আমি একটা মিল্কের নাম লিখে দিচ্ছি এইটা একটু কিনে এনে কষ্ট করে বেবিকে খাইয়ে দিন।’
– ‘ওকে।’

বেবিকে কিভাবে খাওয়াতে হবে সবটাই নার্সটা’ সব বলে দেয়। আবরার তাড়াতাড়ি করে মিল্ক ও ফিটার কিনে এনে খাবার রেডি করে নাজিয়ার হাতে দেয়। অনেক কষ্টের পর দুজন মিলে বাবুকে থামাতে সক্ষম হয়। (নোট- সদ্য জন্মানো বেবী কেমন হয়, কি খেতে দিতে হয় তা সম্পর্কে আমার সঠিক কোনো ধারনা নেই। তাই কিছু ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

হিরক দূর থেকে দাঁড়িয়ে নাজিয়া আবরার ওহ বাবুকে দেখে চলেছে, ওর কাছে মনে হচ্ছে বাচ্চাটা নাজিয়া আর আবরারে’রই ওরা যেভাবে আদর যত্ন করছে তাতে অন্য মানুষের কাছে সেটাই মনে‌ হবে। বিষয়টি শুধু হিরক নয় আবিরও খেয়াল করেছে আবরার আর নাজিয়ার জায়গায় নিজেকে এবং নিসাকে অনুভব করতেই চোখটা পানিতে ভরে উঠছে। কথা ছিল তো দুজন একসাথে বেবী’কে আদর করবে, বেবি হয়েছে আর নিসার কথা মতো ছেলেই হয়েছে অথচ নিসা এখনো নিজের ছেলেটাকে একপলক দেখতে পারল ন, আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে পারল না। বেডে শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে চলেছে, আবিরের ভেতর থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

আবির আবরার ওহ ওর বাবাকে নিসার হসপিটালে ভর্তির কথা জানালেও ওর মাকে জানায়নি। নিসার বাবা নিসাকে ভর্তি করিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন, বাড়িতে নিসার মা একা আছেন, আবরার জোর করেই ওনাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওনারা এখনো‌ জানেন না নিসার কোনো খবর।

সময় যত এগিয়ে যেতে লাগল সবাই তত অধৈর্য হয়ে উঠেছে। বেশকিছুক্ষন সময় কেটে যাবার পরেও নিসার কোনো খবর পাওয়া গেল না। আবির আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না নাজিয়া আবরারও অধৈর্য হয়ে পড়েছে। নাজিয়া ও আবরারকে একসাথে সহ্য করতে না পেরে হিরক নাজিয়াকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেছে আর বলেই বা কি হতো! নাজিয়ার কি আদৌও ওর কথা মনে আছে!

ডক্টর বেরিয়ে আসতেই আবির অধৈর্য স্বরে বলল,
– ‘ডক্টর আমার ওয়াইফ কেমন আছে, ওহ ঠিক আছে তো।’
– ‘আপনারা নিজেদের সামলান, আমরা অনেক চেষ্টা করেও প্রেসেন্টকে বাঁ’চাতে পারিনি। সি ইজ নো মোর ভেরি সরি…

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে