Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 289



দূর আলাপন পর্ব-২৮+২৯

0

দূর আলাপন ~ ২৮

————————————
বিয়ে ঠিক হলো। আশু দিনটিকে ঘিরে আয়োজন চলল অত্যন্ত মন্থর ভাবে। কোথাও কোনো হইচই নেই, আগত খুশির উচ্ছ্বাস নেই। নিভৃতে একে একে সমস্ত কাজ গুছিয়ে আনলেন শিউলি। বিয়ের মূল নিয়ন্তা হওয়া সত্ত্বেও শিউলি একবারের তরে এবাড়ির কারো সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ পর্যন্ত দেখালেন না। বিয়ের দিনক্ষণ সহ যাবতীয় বিষয়াদী নিয়ে কথা হলো ফোনকলে।

স্পষ্টতই তিহা বোঝে, এসব ছোটখাটো ত্রুটি মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। মসজিদে বিয়ে পড়ানো হবে ঠিক হয়েছে। মলিন এই উৎসবে আসবে না কোনো বাড়তি লোকজন। শিউলি, আফরিন, ওর স্বামী মিনহাজ আর এদিক থেকে তিহা, রওশান, মারুফ। এর বাইরে নিনাদ তিহার কজন বন্ধুদের জানানো হয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের জীবন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। তবু তিহার আশা শেষ সময়ে হলেও হয়তো ওরা আসবে।

এত সাদামাটা আয়োজন মানতে একটু কষ্টই হয় হুল্লোড় প্রিয় তিহার। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস গোপন করে এই ভেবে যে ওদের বিয়েটা তো ঠিক সুখের বিয়ে নয়। কত জলঘোলা হয়েছে, হাঙ্গামা ঘটেছে। এবার যত অনাড়ম্বরে কাজটা সম্পন্ন করা যায় ততই ভালো।

এক বিকেলে অবশ্য শিউলি কিছুক্ষণের জন্য এলেন। সেটা বিয়ের তিন দিন আগে। শত হোক বিয়ে তো। বউয়ের জন্য অল্প সল্প কিছু কেনাকাটা করতেই হয়। শিউলি এলেন আঙটির মাপ নিতে। কাবিন নিয়েও একটু কথা বলে যাবেন। মিনহাজ দেশের বাড়ি থেকে ফিরেছে। আজ সকালে ওরা দুটিতে কোথায় যেন ঘুরতে গেছে। শিউলি তাই জোর করে নিনাদকেই সঙ্গে নিয়ে এলেন। আঙুলের মাপ নিয়ে নিউমার্কেট যাবেন৷ সন্ধ্যের পর মিনহাজকে নিয়ে আফরিনের সেখানেই আসার কথা।

বিকেলে শিউলি আসবেন শুনে তিহা বেশ ভালো আয়োজন করেছে। শিউলি তো এখন কেবল পাতানো ফুআম্মা নন, কিছুদিন পর হতে যাচ্ছেন তিতিক্ষার ফুফু শাশুড়ী।
এত আপ্যায়ন, সৌজন্য তবু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। শিউলি চেয়েও স্বাভাবিক হতে পারছেন না। সামনের টেবিল ভর্তি নাশতা। তিনি কিছুই ছুঁয়ে দেখলেন না। এমনকি মেয়ের স্থান দেয়া তিহার জন্যে তার চোখে সদাসর্বদা যে বাৎসল্য মাখা ভাবখানা জ্বলজ্বল করতো তারও আজ অনুমাত্র ছাপ পাওয়া গেল না।

একেকবার তিহার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হয়, ফুআম্মা সম্ভবত এই বিয়েতেই নারাজ। তিনি বোধহয় ভাবছেন বিয়ের সব তোড়জোড় সম্পন্ন হবার পর অন্তিম মুহুর্তে এসে তিহাই বোনের কথা বলে নিনাদের মাথাটা বিগড়েছে। এমন ভাবা তো অসম্ভব না। নিনাদ যেভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে এরকম সন্দেহই বরং স্বাভাবিক।

একসময় চা আনার কথা বলে তিহা ওঠে। রান্নাঘরে এসে দেখে তিতিক্ষা চুপচাপ উত্তপ্ত চুলার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁচের কেতলিতে ওঠা বুদবুদ দেখছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তিতিক্ষার সারা শরীর কালো আচ্ছাদনে ঢাকা। তিহা হতবাক গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে কি করছিস এখানে? ‘

‘কিছু না। ‘ বলতে বলতে তিতিক্ষা পেছন ফেরে, ‘একটা কথা ছিল বুবু।’

‘কি কথা?’

‘নিনাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। শিউলি ফুআম্মাকে কিছুক্ষণের জন্য তোমার রুমে ডেকে নিয়ে যেতে পারবে?’

বোনের কথা শুনে তিহা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল কয়েক পল। এই ধাঁতের কিছু ও বলতে পারে তা ধারণাতেও ছিল না। অথচ তিতিক্ষার মুখ ভাব অবিচল। দেখে ক্রমশ লীন হয়ে আসে তিহার বিহ্বলতা।

‘তুই নিনাদের সঙ্গে দেখা করবি?’

‘হ্যাঁ করবো। এতে এতো অবাক হবার কি আছে? বিয়েটা যদি সত্যিই হয় তবে তার আগে কিছু কথা বলে রাখা প্রয়োজন।’

‘কি…. কি কথা?’ ঈষৎ ভয় জাঁকিয়ে বসে তিহার মনে। আদতে কি বলতে চায় মেয়েটা? শেষ কালে বিয়েটা ভাঙবে না তো?

তিতিক্ষা যেন ওর মনের আশঙ্কাটাই ঠিক ঠিক টের পেয়ে গেল, ‘ভেবোনা। বিয়ে ভাঙে এমন কিছু বলবো না। কাজটা করতে পারবে?’

‘হ্যাঁ… ‘ তিহা একটু ইতস্তত করল। ‘দেখছি কি করা যায়… ‘

.

তিহার সকাতর অনুরোধে বাসার অন্দরে এলেন শিউলি। মনের তেতো ভাব কিছুটা কমেছে। ভেবেছিলেন এখানে এসে চোখের সামনে নানান বেহায়াপনা দেখেও মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। শহুরে প্রেমিক প্রেমিকারা বিয়ে নিয়ে যেসব নখড়া করে তেমন কিছু। নিনাদ তিতিক্ষার দেখা হবে। চোখে চোখে বিনিময় হবে হাসি৷ একসময় হয়তো তিহা বলে বসবে ‘আঙটি কিনতে আমারাও আসি?’

তেমন কিছু ঘটল না দেখে শিউলি মনে মনে বেশ স্বস্তি পেলেন। বিয়ের আগের ছেলেমেয়ের নখড়া তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। দুজন দুজনকে আঙটি পড়িয়ে দাও, হলুদ সন্ধ্যা, মেহেদি সন্ধ্যার নামে একসাথে নাচানাচি করে বেহেয়ামির চূড়ান্ত করো আরো কত কি…

আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, আর যাই হোক এরা ঠিক অমন হালকা মেজাজের নয়। আঙটির মাপ নেয়ার নিমিত্তেই তিহার সঙ্গে আসা। শিউলি বসলেন বিছানার একপাশে। শান্ত স্বরে বললেন, ‘তা কই তিতিক্ষা?’

ম্লান হাসলো তিহা, ‘ ও আসছে…’

নিঃশব্দে অপেক্ষা করছেন শিউলি। তিহা অবাক চোখে খেয়াল করছে অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে অপরিচিত হয়ে ওঠা পুরনো সেই প্রিয় পরিচিত মানুষটিকে। মাত্র কিছুদিন আগেও এই শিউলি ফুআম্মার প্রতিটি কথায় তিহার জন্য চুইয়ে পড়তো ভালোবাসা। আর আজ.. যেন আজকের আগে তাদের আর দেখাই হয়নি কখনো।
মিনিট দুয়েক যেতেই শিউলি হঠাৎ ব্যস্ত স্বরে বললেন, ‘আইচ্ছা ও আসুক। তার আগে বরং কাবিনের ব্যাপার ডা শেষ করি।’

‘জি, নায়হ তাই বলুন। ‘ তিহা দ্রুত প্রতুত্তর করল।

.

বসার ঘরে তখন তিতিক্ষা সত্যি গেছে নিনাদের সঙ্গে কথা বলবে বলে। অন্যমনস্ক ভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল নিনাদ। সালামের শব্দে সহসা মাথা তুলে বোরকা পরিহিতাকে দেখে ঠিক ঠাওর করতে পারল না মানুষ টা কে। অল্পকাল পর বুঝতে পারা মাত্রই চা রেখে উঠে দাঁড়াতে উদ্দ্যত হলো।
‘আপনি বসুন। কয়েকটা কথা বলেই আমি চলে যাব।’

নিনাদ বসলো। অপেক্ষা করল তিতিক্ষা কি বলে শোনার জন্য।

‘ আমাকে বিয়েটা করতে হচ্ছে পরিবারের কথা ভেবে। যেন ওরা বাকি জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত হতে পারে। আপনি নিশ্চয়ই এটা জানেন?’

নিনাদ জানে। কিন্তু সেকথা এখন মুখে বলা অজরুরি।

‘আমার ব্যাপার টা ঠিক আর সকল মেয়েদের মতো নয়। কিছু তিক্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছি বলেই সবাই যা পারে অনায়েসে আমি তা পারি না। তাই বিয়ে হলেই সমস্ত অধিকার আপনার হয়ে যাবে, এরকম আশা না করাই ভালো। আমার সময় প্রয়োজন।’
কথা শেষে তিতিক্ষা প্রতুত্তরের অপেক্ষা করে। কিন্তু ওপাশের মানুষ টা নিরব। মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হয় তিতিক্ষার। লোকটা আসলেই ওর কথা শুনছে তো?

‘আপনি কি আমার কথা শুনছেন?’ অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন করে সে।

‘শুনছি।’

কয়েক মুহুর্ত কি যেন ভেবে বোনের আশঙ্কা বিস্মৃত হয়ে হঠাৎ একটা সাহসী পদক্ষেপ নেয় তিতিক্ষা।
‘আমার দাবি মানতে না পারলে আপনি সাচ্ছন্দ্যে এই সম্মন্ধ ভেঙে দিতে পারেন। আমি বা আমরা পরিবার এর জন্য কখনো আপনাকে অভিযুক্ত করবো না।’

নিনাদ এবারেও উত্তর দিতে বিলম্ব করছে। তিতিক্ষার একটু রাগ চড়ে যায়। লোকটা ওর সাথে তামাশা করছে নাকি? কথার বিপরীতে কথা নেই। এদিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। শিউলি ফুআম্মা হঠাৎ চলে এলে দুর্বোধ্য এক দৃশ্যের অবতারণা হবে। কিছু না বুঝেই তিনি হয়তো ওকে বেহায়া উপাধিতে ভূষিত করবেন।

তিতিক্ষা বিরক্ত গলায় বলল, ‘কিছু বলছেন না কেন? দাবি শুনে বিয়ের ভূত পালালো বুঝি?’

ওর তিরিক্ষি কথার বিপরীতে নিনাদ সহজ ভাবে একটু হাসলো।
‘জি না। ভূত পালায় নি। বরং মাথায় আরো জেঁকে বসেছে।’

শেষ কথাটা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে গেল তিতিক্ষার। ‘যা বলার স্পষ্ট করে বলুন। আমার হাতে অত সময় নেই।’

‘সময় না থাকলে ভেতরে চলে যাও। বাকি কথা পরে হবে।’

‘পরে কবে?’ সন্দিহান প্রশ্ন তিতিক্ষার।

‘সেটা সময় বলে দেবে।’

—————

ওদের বিয়েটা হল শুক্রবারে। সেদিন শেষ মধ্যাহ্নে আকাশ অন্ধকার করল ভীষণ। ঈশান কোণে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ গজরাচ্ছে কালো মেঘ। খরশাণ বাতাসের সাথে দলছুট মেঘেরা ধেয়ে যাচ্ছে আকাশের এমাথা থেকে ওমাথা।
যেন হঠাৎ ভীষণ হুঙ্কারে আজ বান ডাকবে বৃষ্টির ক্ষরস্রোত। এইরকম এক ঝড়ো আবহের মধ্যেই মসজিদে বিবাহ কার্য সমাধা করে খেজুর বিলিয়ে ফিরে এলেন মারুফ ও বাকি ছেলেরা। বাইরের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। ফেরার চিন্তা গ্রাস করে নিল মিনহাজ আফরিন সহ বিয়েতে আগত তিহা নিনাদের বন্ধুদের। আবহাওয়ার বৈরিভাব দেখে ওরা শেষ পর্যন্ত বেরিয়েই পড়ল খাওয়া দাওয়ার পর। বাকিরা ব্যস্ত হলো তিতিক্ষা নিনাদের বিদায়ের তোড়জোড়ে। এই বেলা না বেরোলেই নয়। দেরি করলে পথিমধ্যে ঝড়ের কবলে পড়ার আশঙ্কা।

দীর্ঘক্ষণ তিতিক্ষার পাশে বসে থেকে একসময় বসার ঘরের এলেন শিউলি। এককোণে বসলেন নিঃশব্দে। ডাইনিং থেকে ভেসে আসছে তিহা রওশান আর আফরিন মিনহাজের সম্মিলিত হাসির শব্দ। ছোটন হুটোপুটি করছে বাবার কোল জুড়ে। নিমিষেই আবার নেমে ছুটে যাচ্ছে বউয়ের সাজে সজ্জিত মিমির কাছে। অনেকদিন পর এবাড়িতে এত মানুষ আর আনন্দের ফোয়ারা দেখে সে ভীষণ খুশি।

প্লেটে প্লেটে আইসক্রিম সাজাচ্ছে তিহা। তা সবার হাতে হাতে তুলে দিচ্ছে আফরিন। ফাঁকে ফাঁকে চলছে ওদের আড্ডা। রওশানের সাথে মিনহাজের বেশ ভাব জমে গেছে এর মধ্যেই। তিহা আফরিনের ভাব তো আগে থেকেই ছিল।
নিনাদ দেখল নব আর পুরাতন যুগলের মাঝে রসায়ন টা বেশ ভালো জমেছে।
তবে ওদের সঙ্গে আজ নিনাদ ঠিক একাত্মাবোধ করতে পারছিল না। ওরা আড্ডা দিচ্ছে যুগলবন্দী হয়ে। অথচ নিনাদের পাশে কেউ নেই। তাছাড়া ওদের আড্ডার বিষয়বস্তুও দাম্পত্য সম্পর্কিত। সেখানে থেকে ও করবেটা কি? তিহা অভিযোগ করছে রওশানের মতো সুতার্কিক নাকি দেশে আর দুটো নেই। ঝগড়ায় রওশানকে কোনোদিন সে পরাস্ত করতে পারেনি। শুনে হাসতে হাসতে আফরিন বলল তাদের বেলায় ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। মিনহাজটা এতই সরলসিধে যে মুখের ওপর একশো কথা বললেও বেচারা সামান্য প্রতিবাদটুকু করতে পারে না।

নিনাদ উঠে এলো। বন্ধুরা চলে যাওয়ায় হঠাৎ বেশ শূন্য শূন্য বোধ হচ্ছে। আনমনে এসে বসলো ফুফুর পাশে। ফুআম্মার সাথে আজ সারাদিনে খুব কম কথা হয়েছে। তিনি সারাক্ষণই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত। নিনাদের অন্যমনস্ক মুখের পানে একবার আড়চোখে তাকালেন শিউলি। ধীরে ধীরে ব্যাগের ভেতর থেকে একগোছা চাবি বের করে বাড়িয়ে দিলেন ওর দিকে।
‘নিনাদ, শুন আব্বা, এইযে রইলো তোর বাসার চাবি। ঘরবাড়ি গোছানই আছে। আলমারির চাবি রাখা আছে তোর ওয়ারড্রবের উপরের তাকে। রাতের খাবারদাবার সবই আছে। বউমারে শুধু একটু গরম কইরা নিতে কইস। আর.. ‘ শিউলি একটু থামলেন। ‘আর তোরার সংসার খুব সুখের হোউক। আল্লাহ দুইজনরে চিরকাল একসাথে ভালা রাখুক। আমিন। ‘

সচকিত হয়ে শিউলির দিকে ফেরে নিনাদ। ফুআম্মার সব নির্দেশ ব্যতিরেকে একটা ব্যপারে ওর মনযোগ আটকে যায়। ফুআম্মা এভাবে কথা বলছেন কেন? তিনি কি তাদের সাথে যাবেন না?
‘চাবি আমায় দিচ্ছো কেন? তোমার কাছেই তো থাকা ভালো।’

শিউলি সরল হাসলেন। যেন খুব একটা ছেলেমানুষী কথা বলে ফেলেছে নিনাদ। ইচ্ছে হলো এই মুহুর্তে কিছু তিক্ত কথা ওকে শুনিয়ে দেন। কিন্তু নিজেকে রুখলেন। আজ ছেলেটার জীবনের একটা বিশেষ দিন। এইদিনে কিছু তিক্ত সত্যি নাই-বা বললেন। সব কষ্ট তো তিনি আগেই বুকে চাপা দিয়েছেন। হৃদয় খুঁড়ে সেসব আবার জাগিয়ে তুলে কি লাভ?

‘তা কি আর হয় বাজান? ছোট একখান বাসা। তোমরারই জায়গা অসংকুলান। সেখানে এখন আমি গিয়া থাকি কেমনে?’

‘কি বলছো এসব! তুমি আমাদের সাথে যাবে না এ কখনো হয় নাকি?’

‘হয় গো বাজান। সময় মানুষ রে কত কিছু করতে বাধ্য করে।’

‘না না। আমি কোনো কথা শুনবো না। তুমি যাচ্ছো ব্যাস।’

শিউলি একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন নিনাদের অস্থির মুখটার পানে। তাকে ফিরিয়ে নিতে কি ব্যস্তই না হয়ে উঠেছে। অথচ এসব কথা যে তিনি ওরই কারণে ওরই প্রতি তীব্র অভিমান থেকে বলছেন বোকা ছেলেটা তা বুঝতেও পারছে না। না বুঝলেও নিনাদের এখনদার দাবিটা সত্যিই ওর অন্তর থেকে করা। এ-ই তো সে, নিসন্তান জীবনে যাকে তিনি সবচেয়ে বেশি স্নেহ মমতায় নিজের পুত্রের মতো বড় করেছেন।

আর ছেলের বউ, নাতিনাতনির মধ্য দিয়ে সেই ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার সময় যখন হলো, নিনাদ কষ্ট দিল তাকে। সিদ্ধান্ত তিনি সেদিনই নিয়েছিলেন, যেদিন নিনাদ নাকোচ করেছিল শিউলির পছন্দ করা মেয়েটিকে। ছেলের বিয়ে নিয়ে মায়েদের কত স্বপ্ন থাকে। নিনাদ সেসবের ধারই ধারল না। তবু মাঝে মাঝে শিউলির ইচ্ছে হয়, তীব্র ভাবে মন চায় ছেলের দেয়া সমস্ত কষ্ট ভুলে গিয়ে ওকে মার্জনা করে দিতে। কিন্তু শতবছরের জমানো অভিমান কি একদিনের ক্ষমা ভিক্ষায় শেষ হয়?

.

জীবনের শ্রেষ্ঠ কান্নাটা মারুফ আজ কাঁদলেন। যেমন কেঁদেছিলেন রেহনুমা মারা যাবার পর, যেমন কেঁদেছিলেন তিতিক্ষার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় সংঘটিত হবার দিনে। প্রাণপ্রিয় মেয়ের সঙ্গে অবস্থানের দূরত্বের কথা ভাবতে গিয়ে বুক চিড়ে বেরিয়ে আসছে সুতীব্র হাহাকার। সঙ্গে সদর দরজা পর্যন্ত একসাথে গিয়ে মারুফ থামলেন। নিনাদ নম্র স্বরে বলল, ‘আসি বাবা।’
মারুফ কথা বলতে কিছুটা সময় নিলেন। ডানদিকে মাথাটা হালকা কাৎ করে চাপা স্বরে বললেন,’এসো।’
আবার নিরবতা। তিহা রওশান দাঁড়িয়ে আছে বাবার পেছনে। তাদের সামনে, সিড়ির প্রথম ধাপে নিনাদ, তার পাশে তিতিক্ষা। আর সবার পেছনে এককোণে শিউলি। নিনাদটা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না তাকে ছাড়া যেতে। শেষকালে আফরিন এসে বিপদ থেকে উদ্ধার করল। বলল, ‘চাচি আম্মারে অনুরোধ কইরা লাভ নাই। আমিই জোর করছি আমার সাথে যাবার জন্য। চাচি আম্মার কাপড়চোপড় তো আগেই নিয়া গেছি। কয়দিন চাচি আম্মা আমার কাছে থাকুক।’
তবুও কি নিনাদ মানতে চায়? কত কি বলতে হলো, কত মিথ্যে আশাভরসার কথা শোনাতে হলো। তবে ও গম্ভীর মুখে নিমরাজি হলো।

ঘরভরা মানুষের সামনে বৃদ্ধের চোখের জল বড় বেমানান। দীর্ঘ শ্বাসটা চেপে, গম্ভীর মুখটাতে বহুকষ্টে খানিক হাসি ফুটিয়ে মারুফ ডাকলেন, ‘নিনাদ।’
নিনাদ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি ওর হাত ধরলেন। সাথে সাথে অপর হাত দিয়ে তিতিক্ষার হাতটাকেও টেনে আনলেন। থেমে থেমে বললেন, ‘আমার মা মরা মেয়ে…
জীবনে খুব বেশি কিছু ওকে কখনো দিতে পারিনি। মা হীন ঘরে অযত্নে, অবহেলাতেই একরকম বড় হয়েছে। তবুও অনুযোগ করেনি কোনদিন। ধৈর্য ধরে গেছে সব সময়। সেটুকুর পরও..
আল্লাহর বোধহয় অন্যকিছু ইচ্ছা ছিল। যে অভিশপ্ত মুহুর্তের কথা ভাবলেও বাবা মায়ের বুক কাঁপে, আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েকে সেইদিনও দেখতে হলো। আজকাল মাঝেমধ্যে বাবা হিসেবে বড় ব্যর্থ মনে হয় নিজেকে। যাইহোক, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তোমাকে ওর অভিভাবক হিসেবে মনোনীত করেছেন। এইবার আমি দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নিলাম। মনে রেখো এই বেলা থেকে ওর ভালো মন্দের সব দায়ভার তোমারি।
শোনো বাবা, নিজের মেয়ে বলে বলছি না। আমার মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো। শুধু ওই রাগটা যা একটু বেশি। ওর প’রে সবসময় ক্ষমার পরোয়ানা জারি করে রেখো তুমি। যদিও স্বইচ্ছায় অপরাধ করার মেয়ে সে নয়। তবুও নাহয়…
আমার বিশ্বাস তুমি ঠকবে না। পারানী হিশেবে আমার মেয়ে ছাড়া আর কোনো মূল্যবান সম্পদ দিতে পারলাম না তোমাকে।’ বলে নিনাদের হাতে তিতিক্ষার হাত রেখে নিজের হাতটাকেও তিনি তার ওপর রাখলেন। চোখের কোণে অশ্রু লুকিয়ে মৃদু হেসে আস্বস্ত করলেন তাদের।

মধ্যাহ্ন শেষের সেই ভীষণ অন্ধকার আকাশের নিচে পুরো পৃথিবীটাতে যেন হঠাৎ ঘোর সন্ধ্যা নেমে এল। ধূলো উড়ছে বাতাসে, আকাশে গজরাচ্ছে মেঘ। তিতিক্ষা মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো তাকাল দরজা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা তার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ গুলোর দিকে। ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টি। ধূলোময় বাতাসে, অপ্রতিরোধ্য অশ্রুতে চোখ বারবার বুজে আসছে। গালে জল গড়াচ্ছে। তার মন চাইছে একটা গগনবিদারী চিৎকার করে, সব ছেড়ে সেদিকে ছুটে যেতে। কিন্তু পারল না। অদৃশ্য এক শিকল যে তার পায়ে বাঁধা। তাই সে শুধু চেয়ে রইল। ঠোঁটের কোণে তার মলিন হাসি ফুটল। আজ সে মুক্তি দিয়েছে। সেথায় দাঁড়ানো তার সব প্রিয় মানুষকে। এইবার জীবনে তার যাই ঘটুক। আর ভয় নেই বাবার প্রেসার বেড়ে যাওয়ার, বোনের গুমরানো কান্নার চাপা আর্তনাদের। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে সে ঘুরে দাঁড়ালো। নিনাদ তখনো তার হাত ধরে আছে। সে হাটতে শুরু করল নিনাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে।

চলবে…….

দূর আলাপন ২৯

__________________________________
সকালের কফিটা তিতিক্ষা একা খেতেই ভালোবাসে। এবাড়ি এসে গড়েছে ওর এই নতুন অভ্যেস। এখানে তিহা নেই যে চুলায় পানি বসাতে দেখলেই মিঠে হেসে কফির আবদার জুড়বে। ঘর ছেড়ে দু পা সামনের বারান্দায় এসে রোজ সকালে বাজরিকা দুটোর মিষ্টি ঝগড়া দেখতে দেখতে সে কফির স্বাদ আস্বাদন করে। কোলে থাকে রিনরিন। পেজা তুলোর পুটুলির মতো একফালি রিনরিনকে কোলে নিয়ে ঘুরতে ভীষণ ভালো লাগে তিতিক্ষার।

কফির পর ছোট খাট গৃহস্থলি কাজ সেরে তিতিক্ষা বসে ওদের ছোট্ট ডাইনিং এ নাশতা খেতে। আজ ডিম ভাজি মুখে দিতেই সে কোচকায় মুখ। অতিরিক্ত লবণ। ভাজাটাও কেমন ন্যাতন্যাতে হয়েছে। ভাজি পাশে সরিয়ে খালি পরোটা চিবোতে চিবোতে তিতিক্ষা ঠিক করে দুপুরে ডালের সঙ্গে ভাজিটা খেয়ে নেবে।

নাশতা শেষ করে ওকে ভাবতে বসতে হয় রান্নার কথা। দুপুরের রান্নার দায়িত্বটা পড়েছে তার ভাগে। খায়ও সে একা। কিছুদিন হলো নিনাদের চাকরি জুটেছে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে। পদমর্যাদা মন্দ নয়। পাশাপাশি বেশ সনামধন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টার এ পড়ানোর পুরনো কাজটাও আছে। দুইয়ে মিলে অর্থের দিক দিয়ে নিনাদ এখন বেশ নির্ভার।

তবে ব্যস্ততাটা অসম্ভব বেশি। তাতে অবশ্য
তিতিক্ষা খুশিই হয়। চব্বিশ ঘন্টার প্রায় চৌদ্দ ঘন্টাই বাসায় তার একার রাজত্ব। নিনাদ এলেও যে খুব অসুবিধে তা নয়। ও বেচারাকে ফিরেই জুড়তে হয় রাতের রান্নার আয়োজন। নিয়মটা শুরু থেকেই এভাবে গড়েছিল। কোনো পরামর্শ ছাড়াই ওদের মধ্যে ঠিক হয়েছিল সকাল ও রাতের রান্না নিনাদ করবে আর দুপুরের রান্নাটা তিতিক্ষা। সবকিছুতে কেন এই ভাগাভাগির ব্যবস্থা সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তিতিক্ষার। হয়তো ওর আন্তরিকতার অভাবই নিনাদকে এমন সাবলেটে থাকা ভাড়াটিয়ার মতো আচরণ করতে উদ্যোগী করেছে। তাছাড়া আর করবে কি? দু একটা দরকারী কথার ব্যাতিরেকে
সারাদিনে তাদের মধ্যে বাড়তি একটা বাক্যবিনিময় পর্যন্ত হয়না যেখানে।

রাতে নিনাদ রান্নাঘরে খুটখুট শব্দ তুলে কাজ করে যখন, তিতিক্ষা তখন ইচ্ছে হলে নিজের ঘরের খিল এঁটে বসে থাকতে পারে আনমনে, কখনো বা পাখি জোড়ার সঙ্গে জুড়ে দেয় খুনসুটি। সে সময় রিনরিন থাকে বাবার কাছে। শুরু থেকে সে নিজেকে বাবা ভাবতে শিখিয়েছে রিনরিনের কাছে। তিতিক্ষা আবডাল থেকে দেখে। ভারি অসহ্য লাগে ওর, একটা খরগোশ ছানাকে ঘিরে নিনাদের আহ্লাদপনা।

.

ওর থাকার ঘরটা সুন্দর। বলা যায় এই ঘরটাই বাড়িই প্রধান ঘর। একা একা ঘুরে ঘুরে বেডরুমটা গোছাতেও তিতিক্ষার ভালো লাগে। অথচ প্রথম দিন এসে তিতিক্ষা কিনা ভেবেছিলো পাশের ওই মলিন এলোমেলো ঘরখানি হবে তার স্থায়ী আশ্রয়।

বলতে নেই নিনাদ যে সেধে ওকে এই ঘরখানাতে থাকবার অনুমতি দিয়েছে তাতে সে যারপরনাই কৃতজ্ঞ। নিজের একান্ত আরামের আবাস ছেড়ে পাশের ঘরে ছন্নছাড়া ভাবে নিনাদকে থাকতে হচ্ছে ভেবে মাঝে মাঝে যদিও তিতিক্ষার একটু অনুশোচনা হয়। তবে সেটা নিতান্ত সাময়িক। তাছাড়া রাজত্ব হারিয়ে রাজা বেচারা যে বেজায় দুঃখ আছে ওর হাবভাবে তো তেমন কিছু ফোটে না!

.

রাত আটটায় বেল বাজল। তিতিক্ষা খেয়াল করেছে এই সময়ের গড়বড় নেই। রোজ আটটা বাজতেই লোকটা ফেরে। কখনো কি সময়ের একটু হেরফের হতে নেই?
বেল শুনেও সঙ্গে সঙ্গে উঠল না তিতিক্ষা। কিঞ্চিৎ বিলম্ব হলে ক্ষতি কিছু নেই। বরং সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলে লোকটা অন্যরকম ভাবতে পারে। ঢিমেতালে ওড়না মাথায় জড়াতে জড়াতে তিতিক্ষা আশ্চর্য হয়ে ভাবে মানুষটার সমস্ত ব্যপারে তার এমন উৎসন্ন হওয়া কেন? আগে আগে দরজা খুললেই ওকে হ্যাংলা ভাববে আর বিলম্বে গেলেই আত্মাভিমান বজায় থাকবে ষোলো আনা, এমন সস্তা ধারণা হঠাৎ কেন হলো ওর?

দরজা খুলে সরে দাঁড়ায় তিতিক্ষা।
‘আসসালামু আলাইকুম’

নিনাদ নিবন্ত চোখে একঝলক তাকায়।
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’

জুতা খুলতে খুলতে বলে, ‘বাসায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

তিতিক্ষা খেয়াল করল এই প্রশ্নটাও নিত্যকার। কিঞ্চিৎ বিরক্তি জাগে মনে। যেন এই একঘেঁয়ে রোবটিক প্রশ্ন গুলো ছাড়া লোকটা আর কথা জানে না।

‘না’

‘ফুআম্মা কল দিয়েছিল?’

আবারো একটা ‘না’ বলে দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে ফিরে যেতে যেতে তিতিক্ষা শোনে ওর শেষ কথা।

‘ওহ, আমাকেও দেয়নি।’

.

শূন্য ডাইনিং এ একা খেতে বসে তিতিক্ষা ফের একটু মনস্তাপের দংশনে নিপতিত হলো। নিনাদ ওর সাথে খেতে বসে না। খিদে নিশ্চয়ই ওরও পেয়েছে? তবু তিতিক্ষা না উঠলে আসবে না কখনো। তার কারণ বিয়ের দ্বিতীয় দিন একসাথে খেতে বসে খাবার নিয়ে তিতিক্ষার পাশের ঘরে চলে যাওয়া। এটুকু বোধহয় বাড়াবাড়ি। নিনাদ শত্রু তো নয়। তবু যেন কি হেতু শুরু থেকে অসহ্য বোধ হয় ছেলেটাকে। বিয়ের শুরু থেকে, পরিচয়ের শুরু থেকে আর মনোভাব জানার শুরু থেকেও।

তিতিক্ষার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় এককোণে একটা কাঠের খুপরি তে নরম কাপড় বিছিয়ে হয়েছে রিনরিনের থাকার ব্যবস্থা। যদিও তিতিক্ষা জানে বারান্দার আশ্রয় ফেলে রিনরিন প্রায় রাতেই বাবার সঙ্গে ঘুমায়। খাওয়া শেষে সিঙ্কে প্লেট ধুতে ধুতে তিতিক্ষা খেয়াল করল রিনরিনকে নিয়ে নিনাদ খেতে বসেছে। ওরা দুজন ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে বলছে কিছু। মূলত বলছে নিনাদ। তবে রিনরিনের হাবভাবও ফিসফিসিয়ে কথা বলার মতই।

‘আফরিন বলল ফুআম্মা ওর বাসায় নেই। বিয়ের দুদিন পরই নাকি গ্রামে ফিরে গেছেন। অথচ আমি জানলাম আজ। কে জানে কেন, ফুআম্মা আজকাল কলও ধরেন না। তুমি কিছু জানতে?’ একনাগাড়ে অনেক গুলো কথা বলে নিনাদ থামে।

তিতিক্ষা হতচকিত হয়ে ওর পানে তাকায়। হঠাৎ লোকটার মনে এই প্রশ্নের উদয় হবে কে জানতো? তবে ফুআম্মার কথা বলতে গিয়েই নিনাদ যে সহসা অনেকখানি বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে দূর থেকেও সে তা টের পেল। এইমাত্র নিনাদ বলল ফুআম্মার কল না ধরার কারণ নাকি ও জানে না। আসলেই তাই? লোকটা এত নিরেট নাকি? ওদের বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠার পর থেকে যে মানুষটার রাগের উৎপত্তি, এতদিন পরে এসেও সেসম্পর্কে কোনোকিছু জ্ঞাত নয় সে?

তিতিক্ষা আবছা ভাবে বলে,’ না। আমাকেও তো কেউ বলেনি।’

উত্তর টা যেন নিনাদ শোনেই না৷ অন্যমনে বলতে থাকে নানান কথা, ‘হঠাৎ কি যে হলো। ফুআম্মা কেন..’ বাক্যটা শেষ করে না। থেমে ক্লেশজড়িত ভাবে মৃদু নিশ্বাস ফেলে।

তিতিক্ষা দেখে ভাবনায় ডুব দিয়ে অকারণ নাড়াচাড়া করতে করতে নিনাদ চারপাশে ভাত ছেটাচ্ছে। আজ নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যেও ফুআম্মার চিন্তা ওকে তাড়া করে বেড়াবে। ক্ষীণ নিশ্বাস ফেলে ও চলে আসে নিজের ঘরে। করুক যা খুশি। ও নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে৷ নিনাদের ব্যপারে নাক গলানো নিশ্চয়ই ওর এখতিয়ারভুক্ত নয়?

.

দুখানা কামরার এই ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়ির সবেতে ছড়িয়ে আছে শিউলির অস্তিত্বের রেশ। গাঢ় রঙের পর্দা, চকচকে চাদর আর নানান ঝকমারি সরঞ্জামে চারদিক সাজানো। গাঢ় রঙ তিতিক্ষার অসহ্য লাগে ভারী। নরম রঙের ফুলতোলা চাদর, মিহি সাদা অথবা আকাশী পর্দা ওর চিরকালের পছন্দ। অভিরুচির এই সুস্পষ্ট তারতম্যে শুরুতে নিজের ঘর ভাবতে বেজায় কষ্ট হয়েছিল এই ঘরটাকে। সাহস করে দুএকবার গিয়েছিল সাজসজ্জা অদলবদলের অভিপ্রায়ে। কিন্তু কোত্থেকে একঝলক ভাবাবেগ এসে প্রতিবার বিক্ষিপ্ত মনকে তরলে পরিণত করে দিল। হোক রুচির হেরফের, না হোক পছন্দসই তবুও এসব তো সেই বৃদ্ধা মানুষটি নিজ হাতে সাজানো মমতার শেকলে বাঁধা সংসার। তার একান্ত স্বস্তির জন্য অন্য কারো ভাবাবেগের নিদারুণ অবমূল্যায়ন কি যথোচিত কাজ হবে?

‘নাশতা করেছিস?’

‘না বুবু। তুমি কি দিয়ে খেলে?’

‘গরম গরম চাপটি আর চেপা ভর্তা।’

তিতিক্ষা করুণ মুখে স্ক্রিনে তাকায়।

‘কি হলো? ‘

‘আমারো খেতে ইচ্ছে করছে।’

‘শেষ হয়নি তো। এক কাজ কর। নিদুকে পাঠিয়ে দে। আরো কয়েকটা চাপটি বানিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

‘রাখো তো বুবু।’ তিতিক্ষার কড়া প্রত্যাখ্যানে মনে হল এ যেন এক অসম্ভব প্রস্তাব।

‘তুই রাখ তো। নিদু কই? ওকে ডাক। আমি ওকে আসতে বলে দিচ্ছি।’

নিনাদকে ডাকার কথাতে এবার ও আরো বিরক্ত হয়।
‘নিদুকে ডেকে কাজ নেই। নাশতা বানানো হয়ে গেছে। আমি এক্ষুনি খেয়ে নিচ্ছি।’

‘ওমা, নাশতা বানালি কখন? ঘন্টা খানেক ধরে তো ভিডিও কলে আছিস আমার সঙ্গে!’

বিপাকে পড়ে কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে তিতিক্ষা।
‘আ.. আমি বানাইনি তো।’

‘তবে?’

‘তবে আর কি? নাশতা তোমার নিদুই বানিয়েছে।’ তিতিক্ষা দায়সারা স্বরে বলল।

বোনের কথায় অবাক মানল তিহা। সাত বছরের সংসার জীবনে কখনো এককাপ চা তৈরি করাতে পারেনি রওশানকে দিয়ে। আর বিয়ের এক মাস হতে না হতে এই নিয়ে পঞ্চম বারের মতো শুনলো নিদুর রান্নার কথা।

‘নিদু নাশতাও বানিয়েছে! কোথায় ও? ওকে একটু দে তো।’

পুনরবার বিরক্তি ভর করে তিতিক্ষাকে। আড়চোখে একবার তাকায় পাশের ঘরে। নিনাদ পত্রিকা পড়ছে।
‘ওকে ডেকে কি হবে বুবু? আমি তো রয়েছিই।’

‘তুই আছিস ঠিকি। তবে তোর ঘাড়ের একটা রগ বাঁকা। তাই আমার নিদুকে প্রয়োজন।’

‘আর সেই আদরের নিদু তোমার জন্য মাহরাম না। কথাটা বুঝি ভুলে যাও বারে বারে?’

একটু আমতা আমতা করে তিহা, ‘আ..আমি কি আর অত পরহেজগার নাকি। একটুআধটু আমল ইবাদত শুরু করেছি মাত্র। যদি আল্লাহ কবুল করেন…’

‘সবাই অল্প থেকেই শুরু করে বুবু। তবে চেষ্টাটাকে অল্পতেই আটকে রাখলে হাশরের ময়দানে রব্বুল আলামিনের সামনে আমরা কি নিয়ে দাঁড়াব বলোতো? কবুলের মালিক সুমহান রব, তবে তাঁর সৎকর্মশীল বান্দা হবার জন্য আমাদের চেষ্টা করে যাওয়াটাও ভীষণ জরুরি। অন্তত আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য যেসব বিধিনিষেধ নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেসবের অবাধ্য হয়ে কি করে আমরা প্রতিবার আল্লাহর কাছ থেকে রহমত আর ক্ষমা আশা করতে পারি?’

তিহা চুপ করে আছে। হঠাৎ খেয়াল হয় তিতিক্ষার।
‘বুবু, তুমি কি রাগ করলে? আমি শুধু তোমার ভালোর জন্যই… ‘ থেমে বলে, ‘বন্ধুর প্রতি তোমার স্নেহটা ভাতৃসম আমি জানি। তবে পৃথিবীর কোনো সম্পর্কই আল্লাহর নিষেধের ঊর্ধ্বে নয়। একটা সময় তুমি অনেক কিছু জানতে না। আজ যখন জানো, মানলে তোমার এই ত্যাগটা হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া একজন মুমিনের জীবনে আর কি আছে বলতো?’

খানিকক্ষণ ভাবলো তিহা। একসময় নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘সত্যিই কিছু নেই রে।’

‘তাহলে কি তুমি আমার কথা মানছো?’ ফিঁকে একটু হাসির রেখা দেখা দেয় তিতিক্ষার মুখে৷

‘মানছি।’

‘আমার মিষ্টি বুবু। ভালোবাসি তোমাকে। ছোটবাবা কোথায়? ওকে ডাকো।’

বোনের আদুরে কথা শুনে হেসে ফেললো তিহা৷
‘ডাকছি বাবা!’

চলবে…….

দূর আলাপন পর্ব-২৬+২৭

0

দূর আলাপন ~ ২৬

_________________________
একা ঘরে সোফায় বসে আছেন শিউলি। ক্লেশিত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখ। রাতের খাবার খাওয়া হয়নি। অনেক সেধেছিল আফরিন। শিউলি খেতে পারেন নি। ছেলেটা রুদ্রমূর্তি নিয়ে বেরিয়ে গেল। এসে না জানি কি বলে সেই চিন্তাতে সবকিছু বিস্বাদ লাগছে। সোফার উল্টো পাশের সিঙ্গেল খাটে বিছানা পাতা। বেডশিট এলোমেলো, বালিশ গুলো এদিক ওদিক ছড়ানো। নিনাদটা বড় অগোছালো। মূলত ওর বেডরুমটা পাশের ঘরে, তবু ফেরার পর থেকে ও এখানে থাকছে। থাকছে কারণ ছোট্ট এই ফ্ল্যাট বাড়িতে আফরিন আর শিউলির থাকার জন্য দ্বিতীয় কোনো ঘর নেই। নিনাদের বউ এলে ওই ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে। শিউলি আফরিনের একসাথে এখানে এসে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। বউটা ভালো না পড়লে হয়তো শিউলিদের আসাটাই বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে। তা বলে কি ছেলের বিয়ে দেবেন না? চিরকাল ছেলের মতো আদর স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন যাকে, বিয়ে দিয়েই তো তার ওপর সমস্ত দায়িত্বের ইতি টানতে হবে। তারপর যদি নসিবে বউ, নাতি নাতনিকে কাছ থেকে দেখার, থাকার সৌভাগ্য জোটে তবে তা হবে…

দরজার নব ঘুরল। শিউলি মুখ তুলে দেখলেন ক্লান্ত উদভ্রান্ত নিনাদ ফিরে এসেছে। জুতো খুলে রেখে নিনাদ এগিয়ে এলো। নিঃশব্দে এসে বসল শিউলির পায়ের কাছে। নিনাদ ফিরেছে টের পেয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আফরিন৷ শিউলি ওকে একবার দেখে মুখ ফিরিয়ে ভালো করে তাকালেন নিনাদের দিকে। নিনাদকে এমন দেখাচ্ছে কেন? খুব ক্লান্ত, চিন্তাগ্রস্ত। ও কি কিছু বলতে চায়? এমন কিছু যা শুনলে শিউলি কষ্ট পাবেন। সেজন্যই এসে সোজা পায়ের কাছে বসলো? এ তো ওর পুরনো স্বভাব, কোনো আবদার নিয়ে আগে পায়ের কাছে বসবে।

‘ফুআম্মা…’

‘কি?’

নিনাদ নিচু স্বরে থেমে থেমে বলে,’আমি একটা ভুল করে ফেলেছি।’

ধড়ফড়িয়ে ওঠে শিউলির ভেতরটা। কি বলছে নিনাদ? কিসের ভুলের কথা বলছে? শিউলি বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলেছেন শুনে তখন ছেলের মুখটা ওভাবে শুকিয়ে গেছিল যে, তবে কি গোড়াতেই তিনি কোনো গণ্ডগোল করলেন? নিনাদের কি অন্য কোথাও মন দেয়া নেয়া আছে…?
এতদিনের এসব অদ্ভুত আচরণ, পাগলামো তো তেমন কিছুই নির্দেশ করে। ভাইপোর কথার উত্তরে শিউলি আর জিজ্ঞেস করতে পারলেন না, ভুলটা কি।

নিনাদ ইতস্তত করে একসময় নিজেই বলল,’এখানে বিয়েটা আমি করতে পারবো না। কারণ… আ আমি আসলে অন্য আরেকজনকে কথা দিয়েছি…..’

শিউলি খুব বেশি চমকালেন না, কিছু বললেন না। স্থানু হয়ে নিজের জায়গায় বসে রইলেন। যেন এমনি কিছু হবার ছিল। নিনাদের কিছু একটা হয়েছিল বলেই ভয় পেয়ে দ্রুত বিয়ে ঠিক করেছিলেন। সেই কিছু একটা যে কি তা কখনো জানা হয়নি৷ আজ বোঝা গেল…
নিজের ওপরে গাঢ় আত্মবিশ্বাসে আজ হাসিই পেল শিউলির। তিনি ভেবেছিলেন মনের মতো একটা মেয়ের সঙ্গে কিঞ্চিৎ জোরাজুরি করে বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে ছেলের সমস্ত পাগলামি কোথায় ভেসে যাবে..
কিন্তু ও যে আর বাচ্চা ছেলে নয়, যার হাত থেকে
একটা খেলনা কেড়ে নিয়ে অন্যটা ধরিয়ে দিলে সে প্রতিবাদ করতে পারবে না, এটা কেন শিউলির নিরেট মাথায় আসেনি?

‘ফুআম্মা, তুমি কিছু বলছো না কেন? আমি ভুল করেছি। তুমি আমায় বকো। যা খুশি বলো। কিন্তু আমার দিকটাও একটু বুঝতে চেষ্টা করো। আমি জানতাম না তুমি সত্যিই বিয়ে নিয়ে এত সিরিয়াসলি ভাবছো। তাহলে আগেই বলতাম। আমিও নিরুপায়। ওদের কথা দিয়ে এসেছি।’

কিছুতেই আর চমকাচ্ছিলেন না শিউলি। নিনাদ কথা দিয়ে এসেছে। হয়তো এইমাত্রই…
আর সেই কথার দাম ওর কাছে এত বেশি! অথচ… শিউলি এই শেষ বয়সে এসে নিজে বারবার গেছেন মেয়ের বাড়ি, ওর বাবা ভাইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, ওদের মেয়েকে ভালো রাখবেন কথা দিয়েছেন। শিউলির সেসব কথার যেন কোনো দাম নেই!
হঠাৎ একটা চিন্তা অলক্ষ্যে চলে আসে মাথায়। শিউলি নিনাদ দুজনেই এখন নিজেদের দেয়া কথার মান রাখা নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু ওই মেয়েটা যাকে এক সপ্তাহ পর বিয়ের সাজে সাজানোর, নতুন জীবন শুরুর স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল তার কেমন লাগবে? শিউলির ভিটে বাড়ির একেবারে পাশের গ্রামে বাড়ি ওদের। কথাটা শীগ্র ছড়িয়ে পড়বে। লোকে জানবে শিউলি বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে হঠাৎ কি এক কারণে পিছিয়ে এসেছেন। মেয়েটার বাবা ভাই হয়তো নানান হাঙ্গামা করবে, পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়বে শিউলির কীর্তির কথা।
এসব কি নিনাদ ভেবেছে? ভাববে কখনো?

অনেকক্ষণ গুম হয়ে নানা আশঙ্কার কথা ভাবলেন শিউলি। পায়ের কাছে বসে নিনাদ অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। শিউলি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেন। পর কি কখনো আপন হয়? নিজের মা হলে নিনাদ কি আরেকটু সচেতন হতো না এই কঠিন কথাগুলো বলার আগে? কিজানি হয়তো হতো… হয়তো হতো না। প্রেম তো অন্ধ হয়। সেই অন্ধত্বের পর্দা চোখে বাধলে তখন মা ফুফু সবই সমান। কাউকে কিচ্ছু বলতে বাধে না।

শিউলি ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন কি চাস বল?’

নিনাদ একটু চমকে ওঠে। শিউলির দুর্বোধ্য মুখের পানে তাকিয়ে কিছু একটা বুঝবার চেষ্টা করে। ‘কি চাই? আমি… আমি আসলে জানি না ফুআম্মা আমার কি করা উচিত।’

থেমে বলে,’ তুমি হয়তো ভাবছো একটা মেয়ের প্রেমে পাগল হয়ে আমি অসভ্যের মতো এই স্বার্থপর কথা গুলো বলতে পারছি। আসলে ঠিক তা না। প্রেম, মোহ এসব কিছু নয়।
জানি না কি করে তোমায় বোঝাব। তবে এটা একটা বড় দায়িত্ব। একজন মানুষের সবচেয়ে বাজে সময়ে তার সঙ্গী হওয়ার, তার সমস্ত খারাপ পরিস্থিতিতে তাকে আগলে রাখার ল ড়া ই। জীবনের এইসব জটিল দিক কখনো আমি মোকাবিলা করতে চাইনি ফুআম্মা। দায়িত্ব এড়াতে চাইলে তোমার কথা মেনে নেয়াই উচিত হবে। গ্রামের সাদাসিধে একটা মেয়েকে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে দিন যাপন করবো। কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের কলুষ জর্জরিত মনটাও হিপোক্রেট হতে অস্বীকার করে। সেজন্যই বোধহয় চেষ্টা করেও এই বেলা আমি নিশ্চিত জীবন বেছে নিতে পারছি না। নিখাত সুখ শান্তির আবাহন উপেক্ষা করে যেচে কিছু তিক্ত সময়কে নিজের জীবনে টেনে আনছি। হয়তো এতে আমার কোনো ভালো হবে না। চিরকাল তোমার আর ওই মেয়ের নিরব কান্না অভিশাপ হয়ে আমাকে তাড়া করে বেড়াবে কিন্তু মুদ্রার ওপিঠে অন্য একটা চিত্রও আছে। সেখানে কিছু মানুষ নিশ্চিত হবে, মনে শান্তি নিয়ে মরতে পারবে। আর… আমি ভালো না থাকলেও জানবো আমার ভালোবাসার মানুষ দূরে কোথাও নয়, আমার পাশেই আছে। ‘

বিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছেন শিউলি। চোখের কোণে জল, ভেতর টা অতুগ্র কোলাহলে মত্ত হাতির মতো দিকবিদিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এত আঘাত, যন্ত্রণার মাঝেও একটা জিনিস বিশেষ ভাবে শিউলির মন কেড়ে নিল। নিনাদ খুব সুন্দর কথা বলতে শিখেছে। এসব যদি আদতেই ওর মনের কথা হয় তবে নিঃসন্দেহে বলতে হয় নিনাদের ভেতর টা খুব শুদ্ধ। পৃথিবীর দূষিত আলো হাওয়া এখনো ওই একফালি স্থান গ্রাস করে নেয়নি।
শিউলি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, অদেখা অজানা মেয়েটার জন্য তার মনেও খানিকটা করুণা এসে জমা হয়েছে। কিন্তু আদতে কি হয়েছে ওই মেয়ের? নিনাদ ওকে ভালোবাসে অথচ কেন বলছে একসাথে থাকলেও ওদের সুখী হবার ব্যপার টা আপেক্ষিক? অর্থাৎ ভালোবাসার মানুষকে চিরদিনের জন্য পেলেও সুখটা যেন অনিশ্চিত। নিনাদের এসব দুরূহ কথার অর্থ কি?

‘মেয়েটা কে? কি হয়েছে ওর?’

‘মানুষের জীবনে কত বিপর্যয় আসে। ছোট, বড়…. সহনীয়, অসহনীয়… তেমনি কিছু একটা ধরে নাও।’

নিনাদ কি তবে কারণটাও বলবে না? এত দূরের মানুষ হয়ে গেছেন শিউলি? যাক, শিউলি আর কোনোদিন জিজ্ঞেস করবেন না। কিন্তু এবার কিছু তো করতে হবে? কি করবেন? সব ছেড়ে ছুড়ে কালকের বাসেই বাড়ি ফিরে যাবেন? এত সহজ? নিজের সন্তানের মতো আদর যত্নে বড় করেছেন যাকে, সে ভুল করলেই তাকে ছেড়ে যাওয়া যায়? কোনো মা পারে?

মায়েদের ধর্মই যে অন্ধ ভালোবাসা৷ ভুল সন্তান করুক, ভোগান্তি অন্যজন পোহাক তবু তো সব স্নেহ এসে ওই সন্তানের জন্যই জড়ো হয়। সামনে কি কি দুর্বিষহ সময় তার জন্য অপেক্ষা করছে সেসব ভুলে শিউলি বুকে পাথর বাধলেন। মায়ের স্থান নিয়েছেন, এখন ছেলের ইচ্ছে পূরণ করে তার প্রায়শ্চিত্তও তো করতে হবে।

প্রস্তরের গলায় জিজ্ঞেস করলেন,’মেয়েটা কে সেটা কি বলা যাবে? নাম ধাম পরিচয়… আর এখন কি করবি ঠিক করলি?’

প্রথম প্রশ্নটা আবারো এড়ালো নিনাদ। ‘কি করবো জানি না।’

‘কি আর করবি বিয়ে ছাড়া? বিয়ে কর। আর মেয়ের পরিচয় তুই এখনো বললি না।’

নিনাদের চোখেমুখে অস্বস্তির গাঢ় আস্তরণ পড়ে। অস্থির ভাবে দু একবার দৃষ্টি এদিক সেদিক ফিরিয়ে নিচু স্বরে বলে, ‘তুমি ওকে চেনো। ওর নাম… তিতিক্ষা’

দরজার ওপাশে একটা তুমুল আওয়াজ ওঠে। হতবিহ্বল শিউলি মুখ তুলে তাকান। শব্দ শুনে পেছন ফেরে নিনাদ৷ দেখে আফরিন দরজার কপাট ঘেঁষে বসে পড়েছে। পাশে ছিটকে পড়ে আছে ওর ফোন। আফরিনের চোখে প্রবল অবিশ্বাস একই সাথে তীব্র উচ্ছ্বাসের জোয়ার। পড়ে গিয়ে ও পায়ে সামান্য ব্যথা পেয়েছে। সেই কথা ভুলে আফরিন ঔৎসুক্যে চেচিয়ে বলে ওঠে, ‘নিনাদ ভাই সত্যি! সত্যি তিতিক্ষা আপুরে বিয়া করবেন আপনি!’

__________

সারারাত সজাগ রইলেন শিউলি। শুয়ে থেকে ভাবছেন কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ব্যপার টা। এখনো তার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আর কেউ নয়, শেষে কিনা তিতিক্ষা! আজ মনে হচ্ছে সবচেয়ে বড় বোকামিটা তিনিই করেছেন। হাতের কাছে এত ভালো মেয়ে রেখে বারবার নিনাদের জন্য এদিক সেদিক মেয়ে খুঁজে বেরিয়েছেন। শিউলি গ্রামীণ মানুষ। বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের সম্পর্ক কোনো খাতেই তার দৃষ্টিতে ভালো নয়। নিনাদের হয়তো প্রেম ঘটিত ব্যাপার স্যাপার কিছু আছে ভেবে দ্রুত তোড়জোড় করেছিলেন বিয়ের জন্য।

আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ রহমত। বোঝা যাচ্ছে নিনাদ প্রেম অন্তত করেনি। এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে মেয়েটির পরিচয় জেনে। রূপে গুণে সবেতেই তিতিক্ষা অন্যন্য। ওর সঙ্গে বিয়েতে তিনি নারাজি হতে পারেন এমন ধারণা নিনাদের কেন হলো কে জানে!
তিনি বোধহয় এখনো নিনাদের তত আপন হতে পারেন নি। সামান্য এই ভুল বুঝাবুঝির জন্য ওই নিরীহ গ্রামের মেয়েটিকে কি কষ্টই না দিতে হবে। তাছাড়া.. আস্তে আস্তে কিছু ছবি পরিষ্কার হলো শিউলির মনে। সেদিন তিহার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কথা বলার জন্য যখন গেছিলেন ওদের বাড়ি, তিতিক্ষাকে সেদিন ঠিক স্বাভাবিক মনে হয়নি। আর নিনাদই বা কি বলছিল, কিসব বিপর্যয়, জটিল সময়ের কথা…
যে ভয় খানিক আগে দূর হয়ে গেছিল আবার সে ভয় ক্রমে শিউলির মনে বিস্তার লাভ করছে। নিনাদ নিশ্চয়ই তার কাছ থেকে তিতিক্ষার সম্মন্ধে গোপন করছে একটা কিছু। হয়তো এমন কিছু যা শুনলে তিনি তিতিক্ষার মতো মেয়েকেও নিনাদের বউ হিসেবে মেনে নেবেন না।
চলবে…..

দূর আলাপন ~ ২৭

____________________________
গুড়িগুড়ি বৃষ্টির বোলে আকাশ ঘোলাটে। বাইরে কুয়াশার মতো ভোর। ছাদে একা পায়চারি করছে তিতিক্ষা। মনের আবহ স্থবির। না সুখের আবেশ, না বেদনার নিঃসীম ঘনঘোর। এসব কে ছাপিয়ে মনটা শ্রাবণ দিনের মেঘের মতো ভার হয়ে আছে। বৃষ্টির সুক্ষ্ম ছোট ছোট ফোঁটায় গায়ে হয় শিরশিরে ভাব, সেই সাথে প্রবল একটানা বাতাস। তিতিক্ষার ইচ্ছে হয় নিকাব খুলে মুখ বাড়িয়ে দেয় বৃষ্টিতে৷ শেষতক সে অবশ্য অবগুণ্ঠন সরায় না। পাশের কোন ছাদ থেকে কে কখন দেখে ফেলে তার কি ঠিক আছে!

লোহার সিড়িরে থপথপ আওয়াজ হচ্ছে। কিঞ্চিৎ অবাক হয় তিতিক্ষা। বুবু অত ভোরে ছোটনকে ফেলে উঠে এসেছে? তিহা আসছে বুঝতে পেরে অন্যমনস্ক ভাবে সে খানিকটা হেটে বাড়ির পেছনের পতিত ভূমির ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। একসময় ছাদে ভারী পায়ের শব্দ ওঠে, পলকের জন্য পেছন ফিরে তিতিক্ষা থমকায়। তিহা নয় এসেছেন মারুফ।
‘বাবা… তুমি এই বৃষ্টিতে ছাদে কেন এলে?’ তিতিক্ষা ব্যস্ত হয়ে মারুফের পাশে দাঁড়ায়।

‘তোকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম রে মা। এত ভোরে ছাদে কি করিস?’

‘কিছু না। হাটছিলাম…’ বলতে বলতে নিভে আসে তিতিক্ষার স্বর।

‘ফজরের পর আর ঘুমাস নি?’

‘না…’ তিতিক্ষা থেমে বলে, ‘চা খাবে বাবা? নিচে চলো। চা করে দিচ্ছি।’

‘খাবো। তবে এখানেও মন্দ লাগছে না। আর একটুক্ষণ থাকি।’ বলতে বলতে ছাদের একাধারে পাতা কাঠের বেঞ্চিতে গিয়ে মারুফ বসে পড়লেন।

‘তিতি মা এদিকে আয়।’

শিথিল পদাঙ্কে তিতিক্ষা বাবার পাশে এসে দাঁড়ালো।

‘বোস এখানে।’

মৃদু অস্বস্তি তাড়া করে বেড়াচ্ছে তিতিক্ষা কে। কেন যেন মনে হচ্ছে বাবা হুট করে চলে আসেন নি। এসেছেন আগাম কিছু পরিকল্পনা নিয়ে। বাবা কি গতকালের ব্যাপারে কিছু বলবেন? কোন ব্যাপার? বিকেলের নাকি রাতের? এসব নিয়ে কথা বলতে যে ওর ভালো লাগে না কেউ কি তা বোঝে? আর কতকাল এসব অস্বস্তিজনক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে ওকে?

মনের মধ্যে দূরাভিশঙ্কার ঘুর্ণি নিয়ে সে বাবার পাশে গিয়ে বসে।

‘মা তোকে একটা গল্প শোনাব আজ৷ সত্যিকার গল্প। মন দিয়ে শুনবি কেমন?’
মারুফ গল্প শুরু করলেন,
‘তুইতো জানিস বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান ছিলাম আমি। আমার নিজের ভাইয়ের পাশাপাশি এক সৎ ভাই ছিলেন সেলিম নামে। উনি অবশ্য মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। সেলিম ভাই ছিলেন ভীষণ সাহসী। মানুষ হিশেবেও অসাধারণ। একাত্তরের যু দ্ধে তিনি একটা পা হারান। যু দ্ধের পর বাড়ি ফেরেন একেবারে অচল হয়ে। তার নামের সাথে যোগ হয় পঙ্গু শব্দটি। ঘরে রেখে গেছিলেন গর্ভবতী স্ত্রীর আর ছোট দুই বোনকে। সেলিম ভাইয়ের মা মারা গেছেন কৈশোরে। তারপর বাবা বিয়ে করেন আমার মা কে। অবশ্য বাবাও বেশিদিন বাঁচেন নি৷ আমরা তিন ভাইবোন জন্মানোর কিছুদিন পর মারা যান। তারপর যু দ্ধ শুরু হলো, আমরাও মামার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। বাবার ওখানে সেলিম ভাই তখন থাকতেন দুই বোন আর স্ত্রী কে নিয়ে। বোন দুটি তখন সবে মাত্র বালিকা আর তিনি নিজে যু দ্ধ শেষে অথর্ব হয়ে ফিরেছেন। আয় রোজগারের পথ নেই এদিকে ঘরে চার চারটে মুখ খাবারের জন্য হা করে আছে।

আমরা তখন খুব ছোট। মায়ের সাথে মামার ওখানে স্থায়ী ভাবে থাকি। বাপের ভিটেয় ফিরে আসার চিন্তাও ক্রমশ মুছে যাচ্ছে মন থেকে। তবে পাশাপাশি গ্রাম বলে ওবাড়ির সব খবরই আমাদের কানে আসে। একদিন শুনলাম অভাব সইতে না পেরে আমার ভাইয়ের পোয়াতি স্ত্রী মানুষের বাড়ি কাজ শুরু করেছেন। গ্রামে অন্যের বাড়িতে কাজ মানে তো শুধু ঘর মোছা, বাসন মাজা নয়। ধান ভানতে হয়, বিশাল ডেকচিতে করে ধান সেদ্ধ বসাতে হয়। সব তিনি করলেন পরিবারের মুখ চেয়ে। সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে দিনশেষে অল্প চাল, পয়সা কড়ি যা পেতেন তাই দিয়ে আহার যুগিয়ে ধরতেন পঙ্গু স্বামী আর ওই দুটি বালিকার সামনে। ভাবির বাপের বাড়ির লোকজন কতবার এল তাকে নিতে। বলল বাচ্চাটা হয়ে গেলে ফের বড় ঘরে বিয়ে দেবে। ভাবি শুনলেন না। পঙ্গু স্বামী নিয়েই কাটিয়ে দিলেন গোটা জীবন।

একটু বড় বেলায় এসে আমরা ওবাড়ি যাওয়া শুরু করেছিলাম। রাত দিন এক করে ভাবির অক্লান্ত খাটুনি আমরা দেখেছি। অথচ সেজন্য কোনদিন আমার ভাইকে হীনমন্যতা বোধ করতে দেখে নি। তাকে দেখে কখনো মনে হয়নি এই জগত সংসারে অন্যের সাহায্য ছাড়া তিনি বড় বেশি অসহায়, সর্বক্ষণ কারো না কারো করুণার প্রার্থী। সেলিম ভাইয়ের আল্লাহর ওপর ছিল অগাধ আস্হা। আমরা দুই ভাই গেলেই প্রতিবার তিনি হেসে আমাদের স্বাগত জানাতেন। নিজের অসহায়ত্ব, দুঃখ নিয়ে কখনো কোনো কথা বলতেন না। তার সদাপ্রসন্ন মুখ, সবার সঙ্গে আন্তরিক ব্যাবহার দেখে মাঝে মাঝে মনে হত যা হয়েছে আর যা হচ্ছে তাতে যেন তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত নন বরং বেশ খুশি।

প্রথম প্রথম আমি খুব অবাক হতাম। পঙ্গু একটা মানুষ, স্ত্রীর কামাইয়ে দিন গুজরান করে। সে কি করে এত হাসিখুশি থাকতে পারে! আর একজন স্ত্রী-ই বা কি করে মুখ বুজে মেনে নেয় সবটা?

সেই প্রশ্নের উত্তর আমি পেলাম কিছু বছর পর। তোর মা কে বিয়ে করে।
জানিস তিতি, তোর মায়ের ছিল মধুর মতো গায়ের রঙ। কালো অথচ কি নির্মল। আর আমাকে সবাইকে চিনতো গোটা পরিবারের সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে হিসেবে। যেদিন আমি রেহনুমাকে বিয়ে করে ঘরে আনলাম, বুঝলাম ওকে দেখামাত্র বিয়ে বাড়ির সব রোশনাই হঠাৎ স্তিমিত হয়ে গেছে। তাকে দেখে ফুঁড়িয়ে গেছে সব হাসি, আলো…
আমার ছোট বোন মেরি। যে কিনা দেখতে ছিল ইরানি গোলাপের মত সুন্দর। ওকে দেখলাম বউ দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে গেল ঘরে। ওর সাথে সাথে বাকি ভাই বোনেরা। আমি পাশে তাকালাম। তোর মা নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে। ও বুঝতে পেরেছে সবটা, অথচ ওর চোখেমুখে কোথাও হীনমন্যতার ছাপ নেই। এই যে সেদিন তাকে দেখে সবার মুখের আলো নিভে গেছিল সেজন্য কোন আফসোস ছিল না রেহনুমার। আমাদের সংসার জীবনের পুরোটা সময় ও এমনই ছিল। কারো কথা, দৃষ্টিভঙ্গি, আড়ালের বিদ্রুপ নিয়ে রেহমুনার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না।

যখন তোদের দু বোনকে নিয়ে আমরা চারজন একসাথে বেড়াতে যেতাম। লোকে ভাবত তোর মা বুঝি আমার দুর্সম্পর্কের কোন আত্মীয়া। আমার স্ত্রী এবং তোদের মা হিশেবে কেউ স্বীকৃতি দিতেই চাইতো না রেহনুমাকে। তোর মা শুধু হাসত। উচ্ছল গলায় বলতো, ‘মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য বুঝি এত গুরুত্বপূর্ণ! এই গায়ের রঙ তো আমি বানাইনি। আল্লাহ সয়ং আমার জন্য নির্ধারণ করেছেন। তিঁনি যতটুকু নির্ধারণ করেছেন হাজার চেষ্টা করেও তার যাররা পরিমাণ বেশি তো আমি পাবো না। কাজেই আমি আমার রবের সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থাকি।’

তোর মায়ের ছিল আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা আর নিজের অবস্থানের প্রতি দৃঢ়তা।
জানিস, রেহনুমা কোথায় পেয়েছিল এই দৃঢ়তা, যেমনটা ছিল আমার সেই ভাইয়ের?
এই দৃঢ়তা হল ভালোবাসার অদৃশ্য শিকল। যে বন্ধনের জোড়ে পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে গিয়েও রেহনুমা ঠিক জানতো সে আমার যোগ্য। ঠিক যেমন সেলিম ভাই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেও কখনো ছোট করে দেখেননি নিজেকে। কারণ তিনি জানতেন তাদের ভালোবাসার জোরের কাছে এইসব অতি তুচ্ছ।
‘শোন মা, অযুহাত সেখানেই বড়, ভালোবাসা যেখানে বিলাসিতা।’
কথা শেষ করে খানিকক্ষণ নিরব থেকে মারুফ বললেন, ‘কিছু বুঝলি?’

বুঝেছে, সত্যিই বুঝেছে তিতিক্ষা। বাবা নিশ্চয়ই কাল রাতে বুবুকে দেয়া তার প্রতুত্তর শুনেছিলেন। বিকেলে ওরকম একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যপার ঘটে যাবার পরও সে রাতে যখন তিহা আবার নিনাদের বার্তা বয়ে নিয়ে এলো, তখন সত্যি সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছিল তিতিক্ষার। সুপ্ত আক্রোশটা হটাৎ তীব্র অমর্ষণের রূপ নিয়ে আছড়ে পড়েছিল সম্মুখের মানুষ টির ওপর৷ এত কিছুর পরও বুবুর নতুন কারো নাম মুখে আসে? মানুষটা আবার অন্য কেউ না নিনাদ।
সারাজীবন যে ছেলেটা ওকে মানুষের সামনে বিব্রত করে বিকৃত আনন্দ পেয়েছে এবার তিন কবুল বলে ওরই গলগ্রহ হতে হবে? তিতিক্ষা যে নিনাদকে স্বেচ্ছায় নয় বরং নিজের অনিশ্চিত জীবনটার একটা নিশ্চিত গন্তব্য পাবার জন্য বিয়ে করছে এই সত্য কি ও কখনো জানবে না? সত্যের পর্দা সরে গেলে সম্পর্ক টা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে? আর তাছাড়া… নিনাদ কেন ওর মতো অসম্পূর্ণাকে বিয়ে করবে। নিনাদের ভালো ভালো ডিগ্রি আছে, ভালো অবস্থানে যাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা আছে।

এক শ্রেণির রাঘব বোয়াল আছেন যাদের টাকার ওপর বসবাস। যেহেতু অর্থের অভাব নেই, তাই এই শ্রেণির মানুষেরা শেষতক নিজেদের ছেলেমেয়ের জন্য রূপে গুণে অন্যন্য, মেধাবী অথচ উচ্চবিত্ত নয় এমন জীবনসঙ্গী খোঁজেন। নিনাদকে তো তারা যে কেউ লুফে নিতে পারে! এত যোগ্যতা নিয়ে নিনাদ ওর পাণিপ্রার্থী হতে চাইছে কেন? অপমান করার সুযোগ টা যেন সারাজীবন পায় সেজন্য? আর বুবু, সমস্ত জেনে-বুঝে বুবু কি করে পারল নিনাদের কথাটা ওর কান পর্যন্ত পৌঁছাতে? নাকি ওরা সবাই দল পাকিয়ে তিতিক্ষার জঞ্জালে মোড়া ক্ষয়িষ্ণু জীবন টা নিয়ে মজা কুড়োতে চাইছে?

ক্রোধে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে এসব কথা চেচিয়ে বলেছিল তিহাকে। বাবা শুনেছেন। তারপর শেষ অস্ত্র হিসেবে তিতিক্ষার সবচেয়ে বড় দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছেন। তিক্ততার ঘোরটপে বাঁধা বর্তমান জীবনের সাথে মিলিয়েছেন তার মায়ের বেদনাবিধুর অতীতকে। আয়েশা রেহনুমা। তিতিক্ষার জন্মদায়িনী। যে মানুষটার কোনো স্মৃতি মনে না রেখেও তিতিক্ষা চিরকাল তাকে উজার করে ভালোবেসেছে। সলাতের প্রতিটি দুআয় যে মানুষটার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ প্রত্যাশা করে এসেছে।

‘তুমি কি করবে তিতি?’ বাবার স্বর গম্ভীর হয়ে এলো। নির্ণিমেষ বোধহীনের ন্যায় সম্মুখের পানে চেয়ে রইল তিতিক্ষা। সামনে কিছুদূর হাটলেই ছাদের শেষ, নিচে শুরু হয়েছে বিস্তৃত পতিত ভূমি। কচুরিপানার তলে বৃষ্টির জল যেখানটায় থৈথৈ করছে, ঘনঘোর কুয়াশার মতো গুড়িগুড়ি বর্ষণে আবছায়া যার চারিদিক। তিতিক্ষা জানে ওদের ছাদের ঠিক নিচ বরাবর এই জল কাদা নেই। বরং একটা শান বাঁধানো মজবুত দেয়াল আছে। যার ওপরটা লোহার কাঁটা গিয়ে ঘেরা। তিতিক্ষার হঠাৎ একটা দুর্জ্ঞেয় ইচ্ছে হলো। বুকের ভেতর বুদবুদ ফোটাতে থাকল এমন তীব্র দ্বেষ ভাব যা ব্যাখ্যার ভাষা ওর ঠিক জানা নেই। সেই অপ্রশম্য অনুভূতির বশে তিতিক্ষার একবার মনে হলো ঠিক এই মুহুর্তে ছাদের ওই প্রান্তটা থেকে লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? আর কোনো জ্বালা যন্ত্রণা থাকবে না, অপমানের ক্লেশিত আবেশে মত্ত হবে না দুচোখ, আর কখনো মুখোমুখি হতে হবে না বাবা বোনের দুর্বোধ্য প্রশ্নগুলোর সামনে…
খুব না দুচিন্তা ছিল বাবার, ছোট মেয়েটিকে নিয়ে? তার চোখের সামনে সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটুক। কয়েকটা দিন হয়তো বাবা খুব কাঁদবে। সারাক্ষণ তিতি মা বলে একা একা ডাকবে। কিন্তু তারপর… শোকটা একটু জিইয়ে এলে অরবে বাবা কি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে না? কম দুঃখ তো দেয়নি ও বাবাকে। মানুষ শেষ জীবনে আরাম চায়, বাবার ভেতর বাহিরের সব আরাম ঘুচে গেছে ওর জন্য।

তিতিক্ষা কি করে? কি করলে এখন সবদিক শান্ত হয়? সবাই শুধু ওর রাগটা দেখে, বাহ্যিক পাগলামো দেখে। মনে মনে ও যে কতশত বার মরে গেছে কেউ তো রাখেনি খোঁজ। সবাই বলে অতীত ভুলে যেতে, আবার নতুন করে সবটা শুরু করতে। কিন্তু ওই ব্যাপার টা যে শুধু অতীত নয়, তিতিক্ষার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় মোড়। জীবনের স্থবির ঘটনাপ্রবাহে হঠাৎ বয়ে যাওয়া একটা সর্বগ্রাসী সুনামি। চাইলেই কি ভুলে যাওয়া যায়? ভুলতে পারলে তিতিক্ষা বুঝি ভুলতো না?

‘তিতি!’

ঘোর ভাঙে তিতিক্ষার। চকিতে একবার বাবার পানে তাকায়। আবার মুখ ফেরায়। ওই পলকের দৃষ্টিতে মারুফের নজরে আসে মেয়ের মুখে একটা গভীর দুর্বহ ধোঁয়াশা। যেন কত হাজার বছর ধরে পৃথিবীর আলো বাতাস শুষে নিতে নিতে মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ও একদৃষ্টে চেয়ে আছে ছাদের শেষ প্রান্তে। চাহনিটা মৃদু অস্বস্তি দেয় মারুফ কে। ঠিক তরুণী মেয়ের চাহনি ওঠা না। জীবনের প্রতি প্রবল বিতৃষ্ণা নিয়ে বৃদ্ধারা যেভাবে মৃত্যুকে আশু কামনা করে, ঠিক সেভাবে কিছু একটার প্রত্যাশায় প্রাচীন ঢঙে চেয়ে আছে তিতিক্ষা।

দীর্ঘক্ষণ মারুফ কিছু বলতে পারলেন না। বয়স বাড়লে ছোট হয়ে আসে মানুষের চিন্তার পরিসর। তাই যেন বাকিসব ছাপিয়ে মারুফ আবারও মেয়েকে শুধান, ‘তিতি… কি ঠিক…’

সবটা শেষ করতে দিল না তিতিক্ষা। ভাবাবেগ শূন্য গলায় বলল, ‘তুমি যা বলবে তাই। আজ বললে আজই।’ বলে ও চাইল মারুফের হতবাক মুখের পানে।
‘এবার তুমি খুশি?’

‘খুশি রে মা। অবশ্যই খুশি। তুই খুশি হোসনি?’

‘আমি!’ তিতিক্ষা অদ্ভুত ভাবে একটু হাসে। ‘আমার মন সুখ দুঃখের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। এখন থেকে তোমাদের সুখই আমার সুখ। তোমাদের কষ্ট আমার কষ্ট। তোমরা যা বলবে তাই আমি শুনবো। আর কখনো তোমাদের কোনো সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট পাবে না আমায়।’

চলবে….

দূর আলাপন পর্ব-২৪+২৫

0

দূর আলাপন ~ ২৪

___________________________
রাতে সেদিন বেশ একটু দেরি করেই বাসায় ফিরল নিনাদ। আজকাল প্রায় সারাক্ষণ তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে থাকে। বদ্ধ ঘরের নির্মক্ষিক জীবন সেই মেজাজে আরো রঙ ছড়িয়েছে। দিন যত যায়, যত সুশৃঙ্খল হতে থাকে নিনাদের মস্তিষ্ক, সে আরো ভালো করে বুঝতে পারে মানসিক অস্থিতিশীলতার দরুন একই সময়ে একাধিক বোকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। যার জন্য এখন প্রতিনিয়ত পস্তাতে হচ্ছে।
নিনাদের প্রথম ভুলটাই হয়তো ছিল তিহার কথা শোনার পর আগেপাছে কিছু না ভেবে দেশে ফেরা মনস্থির করা, দ্বিতীয় ভুল হঠাৎ করা ওই অসমবদ্ধ আচরণ। ওহিওতে বসে তার অনিয়মিত যোগাযোগ আর উদ্ভট ব্যবহারে ফুআম্মার মনে যারপরনাই সন্দেহের চারাগাছ রোপিত হয়েছে। আর শেষতক ক্রোধ সামলাতে না পেরে তিহার সঙ্গে বাজে ব্যবহার।

ঠিক এভাবে, এসব এলোমেলো সময় ও অপ্রতিরোধ্য আবেগের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে এখানে ফেরার উদ্দেশ্যটাই যেন ক্রমশ ধোঁয়াটে হয়ে উঠল নিনাদের কাছে। আজকাল নিজেকে জিজ্ঞেস করে সে, কোথায় হারালো সেই অদম্য ইচ্ছেশক্তিটা? যে কারণ টা ওকে উদ্ভুদ্ধ করেছিল ফিরতে?
আদতেই সেসব হারিয়ে গেছে। এমনকি তিহার কথা শুনে ওর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল… সেসবও আজকাল স্পষ্ট মনে পড়ে না। নিনাদ বোধহয় সেদিন এক অবিদিত ঘোরে সন্নিবেশিত হয়ে পড়েছিল। আচমকা পাওয়া মানসিক আঘাত, আফসোস, ক্রোধ, অনুশোচনা.. সবকিছু একসাথে আঁকড়ে ধরেছিল ওকে।

তারপর.. এখানে এসেও সেই সমাচ্ছন্ন ভাব পুরোপুরি কেটে গেল না৷ ঢাকায় আসার পর গোটা একটা সপ্তাহ সে পড়ে থেকেছে ঘরবন্দী হয়ে। একদম অকারণ। অবসরে সব ঘটনা পুনরনিরীক্ষণ করতে গিয়ে নিজের ওপরেই মুহুর্মুহু ফেটে পড়েছে অসহায় রাগে।
সেই খিচঁড়ে যাওয়া মেজাজটাকে খানিক মেরামত করতেই আজকাল একটু আধটু বাইরে বেরুতে শুরু করেছে নিনাদ।

আসরের সলাতের সময় ঘর ছেড়েছিল, যখন ফিরল তখন দেয়াল ঘড়ির কাটা শব্দ তুলে জানান দিচ্ছে রাত ন’টা বাজে।
আজকাল দুটো বাড়তি কথাও কারো সঙ্গে বলতে ইচ্ছে যায় না। যেন ঘরে ফিরেই কারো মুখোমুখি হতে না হয় সেজন্য নিনাদ বাসার চাবি নিয়ে বেড়িয়েছিল। চুপচাপ দরজা খুলে ভেতরে চলে যাবে, এই মনোবাঞ্ছা নিয়ে দরজা খুলতেই সামনে একটা দৃশ্যপট স্পষ্ট হয়ে উঠল।
ঘরের শুরুতে আধখানা ডাইনিং এ দুটো চেয়ার পেতে মুখোমুখি বসে আছে আফরিন ও ফুআম্মা। কি একটা কথা নিয়ে দুজনে খুব হাসছে। নিনাদ ভেতরে পা রাখতেই কথা থামিয়ে দুজনে ঘুরে তাকাল ওর দিকে। ঠোঁটের ভাজে তখনো হাসির লীন রেখা। আফরিন মৃদু হর্ষধ্বনি করলো, ‘নিনাদ ভাই ফিরছে!’

ওর ছেলেমানুষী উৎসাহে হাসলেন শিউলি। নরম গলায় বললেন,’কিরে, এতো দেরি হইলো যে?’

‘এমনিই.. কাছেই ছিলাম। হাটছিলাম এদিক সেদিক…’

‘আয়, এহানে আইসা বস।’ শিউলির সহাস্য আন্তরিক আহ্বানের সামনে কিঞ্চিৎ বিব্রত বোধ করে নিনাদ। বসতে ইচ্ছে করছে না, চলে যাওয়াটাও চরম বেয়াদবি হবে। নিজের করনীয় ঠিক করতে না পেরে নিনাদ দু পা এগিয়ে টেবিল থেকে বোতল তুলে একটা গ্লাস টেনে পানি ঢালে। তারপর সেই পানি খাওয়াকে নিমিত্ত করে বসে পড়ে একটা চেয়ার টেনে।
‘অন্য কিছু খাবি?’

‘নাহ’ নিনাদের নিরাসক্ত উত্তর শোনামাত্র আফরিন ব্যস্ত হয়ে তাড়া দেয় শিউলিকে।

‘ও চাচি আম্মা… আসল কথাডা কন না নিনাদ ভাইরে…’

শিউলি ভ্রু কুঁচকে তাকান,’অত তাড়া যখন তাইলে তুই ই ক।’

‘আমি! না না… আপনি থাকতে আমি কেন!’

‘কেন? তোর বলাতেই বা অসুবিধা কি? একজন কইলেই হইলো।’

‘আচ্ছা তাহলে কইতেসি।’ বলে রিমঝিম হেসে শাড়ির আঁচলে আঙুল পেঁচিয়ে কথা শুরুর পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করে আফরিন।
তীব্র উৎসাহে চোখ ঘুরিয়ে বলে, ‘আজ বড় আপুর লগে কথা হইসে। কি কইসে জানেন?’

মূল কথাটা বলার আগেই মাঝপথে নিনাদের প্রশ্ন ওকে থামিয়ে দেয়।
‘কোন বড় আপু?’

‘ওমা! বড় আপু আবার কয়জন? তিহা আপুরেই তো আমি বড় আপু ডাকি। আর তিতিক্ষা আপুরে ছোট আপু..’

‘তিহা কল দিয়েছিল?’ সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করে নিনাদ। যেন বিশ্বাস করতে পারে না এতকিছুর পর তিহা নিজ থেকে কল দেবে।

‘না আপু কল দেয় নাই। আমিই দিসিলাম। কল দিলাম দেইখাই তো জানতে পারলাম কথাডা!’

‘ও… কি কথা?’ ভ্র জোড়া সন্দিগ্ধ করে নিনাদ তাকিয়ে রইল।

আফরিন হাসল। দুরন্ত পাজি হাসি। অতুগ্র উৎসাহে
তিহার কথাটাতেই রঙ ছড়িয়ে দুটো একটা কথা বাড়তি যোগ করে বেচারি বলল,’আপনে দেখি কিছুই জানেন না!ছোট আপুরে তো আজ দেখতে আইসে। আজই আঙ্কটি পড়ায়া যাবে। আপুর বিয়া হইতেও আর দেরি নাই বুঝলেন? সামনের সপ্তাহে আপনার বিয়া, আর তারপর শীগ্রই কোনো একদিন ছোট আপুর…
এইটাই বেশ হইলো, আপনের বিয়ার সাথে সাথে ছোট আপুর বিয়াটাও খায়া যাইতে পারমু। না চাচিআম্মা?’

নিনাদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। একই সাথে কয়েকটা মানসিক ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ও। এসব কি বলছে আফরিন? হতভম্ব হয়ে নিজেকেই শুধাল, বোনের বিয়ে ঠিক করে ফেলছে তিহা? এত জলদি? আর শেষে কি বলল আফরিন?
নিনাদ কি ঠিক শুনেছিল? ওর নিজের বিয়ে নাকি সামনের সপ্তাহে!
আর এইকথা সে জানলো মাত্র আজ, ছোটবোনের মুখ থেকে!

‘তিতিক্ষার বিয়ে’ এই দুটো শব্দ মাথার ভেতর অশনির মতো ঝিলিক দিয়ে বারবার ফিরে ফিরে আসছে। আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না। তবে সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব বুদ্ধি হারালো না নিনাদ। ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, আজও তার পুনরাবৃত্তি ঘটুক তা সে চায় না। শিউলির সামনে তিতিক্ষা বিষয়ক যেকোনো কথা তোলাই এখন অসমীচীন হবে। মনের এই দুর্বহ অবস্থাতেও এই সহজ কথাটা বুঝতে পেরে নিনাদ শান্ত হলো। দ্বিতীয় কথাটার ওপর জোর দিয়ে হঠাৎ সচকিত ভাবে তাকাল সম্মুখের মানুষ দুজনের পানে।

‘সামনের সপ্তাহে আমার বিয়ে মানে? আফরিন এসব কি বলছে ফুআম্মা?’ নিনাদের চোখে তীব্র প্রশ্নের বান।

ছেলের এই রুদ্রমূর্তির সামনে শিউলি কিঞ্চিৎ অসহায় বোধ করলেন। বিয়েতে তার নিজের আগ্রহের আতিশয্য অন্যদিকে ছেলের উদ্ভট নির্বিকার আচরণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পর্যবসিত হয়ে সবকথা ছেলেকে না জানিয়েই বিয়ের তারিখ ঠিক করেছিলেন শিউলি। আড়ম্বরহীন বিয়ে, তেমন কোনো জোগাড়জন্ত যখন হবে না, সয়ে সয়ে লোককে দাওয়াত করার হ্যেপা পোহাতে হবে না, তবে বিয়ের সময় অত পিছিয়েই বা লাভ কি? তাছাড়া নিনাদের হালচালও তো বড় একটা সুবিধের ঠেকছে না। সব দিক বিবেচনা করেই… মেয়ের বাবা ভাইয়ের সঙ্গে বসে তারিখটা এগিয়ে এনেছেন।
আজ সকালে ভয়ে ভয়ে ছেলের ঘরে গেছিলেন এই কথাটাই জানাতে। নিনাদ তখনো বিছানা ছাড়েনি। আধ ঘুম নিয়ে উঠে বসেছিল ফুআম্মার কথা শুনতে। ছেলের অমনোযোগীর সুযোগে শিউলিও অসীম সাহসে অনর্গল বলে গেলেন সমস্ত কথা। এর ফলে পরবর্তীতে অন্তত নিনাদ তার বিরুদ্ধে কিছু না জানানোর অভিযোগ তুলতে পারবে না।

আধো ঘুমে আধো জাগরণে নিনাদ কি শুনেছিল কে জানে! শিউলির সব কথাতেই হু হু করে যেতে লাগল। কথা শেষ করে শিউলি উঠে আসতেই আবারো বিছানায় শুয়ে পড়ল কাঁথা গায়ে জড়িয়ে।
এখন বোঝা যাচ্ছে সকালে ও আসলে কিছুই শোনেনি।

ঢোক গিললেন শিউলি। ঈষৎ ভয়ও হলো। আগের নিনাদ হলে কোনো চিন্তা ছিল না। তবে এই নিনাদ সামান্য অন্যরকম। কখন কি চাইছে, কি করছে শিউলি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। সামান্য ইতিউতি করে শিউলি কৈফিয়ত সরূপ ইতস্তত করে বলার চেষ্টা করলেন,’বিয়ের দিন আগানোর কথাডা তো সকালে তোরে…’

শিউলির কথার মাঝখানে সহসা উঠে দাঁড়ালো নিনাদ৷
‘আমি একটু আসছি। এই নিয়ে তোমার সাথে ফিরে কথা হবে।’ বলে যেপথে এসেছিল, সেপথেই আবার বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো।

.

ডাইনিং এ মাথায় নত করে বসে আছেন মারুফ। পাশাপাশি দুটো ঘর। এক ঘরের দরজা বিকেলের পর থেকে বন্ধ। পাশের ঘর থেকে ক্রমাগত ছোটনের ফোঁপানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। বিকেলের ওই ঘটনার পর পাত্রপক্ষ চলে যাবার পর মেজাজ সামলাতে না পেরে তিহা ছেলের গায়ে দু ঘা বসিয়েছে। মারুফ অসহায় চোখে দরজা দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। বড় মেয়েটা তো ওর বাচ্চা ছেলের ওপর আক্রোশ ঝেরে খানিক বাদেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তখন ছেলের প্রতি ওর মমতার অন্ত থাকবে না। কিন্তু ছোট মেয়ে? ওর কি হবে? তিতির সঙ্গে কত কি ঘটে গেছে, বাবা হয়ে তিনি সেসব থামাতে পারেন নি। সে দায় তো কম নয়। সর্বক্ষণ অনুতাপে মারূফ আড়ালে আড়ালে পুড়ে মরেন। তার ওপর আজ আবার অমন তিক্ত ব্যপার ঘটে গেল।

বিয়ের সিদ্ধান্তে হয়তো মন থেকে তিতিক্ষার সায় ছিল না। তবু রাজি হয়েছিল নিজের বাবা বোনের কথা ভেবে। অথচ ওকে কিনা আবার কষ্ট পেতে হলো। সেই প্রথম বার, তিতিক্ষা কে ঘিরে বিপর্যয়টা সংগঠিত হয়েছিল যখন, মারুফ তখনো অনেকটাই নিরুপায় ছিলেন। কিন্তু আজ, আজকের এই অঘটনে যে মারুফের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তিতি কি এবারও বাবাকে নিঃশর্ত ক্ষমা করবে?
যদি না করে? বড় ভয় হতে থাকে মারুফের…

সন্ধ্যায় তিহা কষ্টে ক্ষোভে বলেছিল তিতিক্ষার বিয়ে দেবার প্রচেষ্টা এখানেই সমাপ্ত থাক। আর দরকার নেই ওই ভঙ্গুর প্রাণ টিকে নিয়ে অযথা টানাহেঁচড়া করার। এরচেয়ে যতকাল সম্ভব ও নিজের মতো করে ভালো থাকার চেষ্টা করুক। ভবিষ্যতে কি হবে, তা ভবিষ্যতেই দেখা যাবে। আপাতত আর বিয়ের কথায় কাজ নেই।
কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বাবাকে জানিয়ে ঘরে চলে গেল তিহা। মারুফের মনে হলো তিহাও হয়তো এবার একটু মুক্তি চাইছে এই অবিশ্রান্ত মানসিক যন্ত্রণা থেকে। চাইবেই তো! আর কতকাল দুর্ভোগ বইবে বেচারি বাবার সংসারের জন্য?

মারুফ পুনরায় মাথা নিচু করে ঝিম ধরে বসে রইলেন। একসময় ঘরের বাতাসে দ্বিতীয় কারো অস্তিত্ব প্রতিভাত হতেই চোখ মেলে অবাক হয়ে দেখলেন মাথার কাছে তিতিক্ষা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা কখন দরজা খুলে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে তিনি অনুমাত্র আভাস পাননি। অস্ফুটে মারুফের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘তিতি মা…’

পাথরের মতো নিশ্চল তিতিক্ষার মুখ। কোনোরকম আবেগ অনুভূতির সামান্যতম আঁচড় সেখানে নেই। খড়খড়ে গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ভাত খাবে না বাবা?’

মারুফ শূন্য চোখে উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকেন। ঘোরনিবিষ্টের মতো বলেন, ‘ভাত….’

‘হ্যাঁ ভাত খাও। আমি বেড়ে দিচ্ছি।’

খানিকটা সময় কেটে যেতে মনের সামান্য থৈ খুঁজে পেলেন মারুফ। সম্বিত ফেরার মতো বললেন,
‘না রে মা আজ আর ভাত খাব না।’

‘কেন খাবে না?’ নিস্পন্দ জিজ্ঞাসা তিতিক্ষার।

মারুফ প্রতুত্তর দিতে পারলেন না। নিরবে চোখ বুজে বসে রইলেন।

কিয়ৎকাল পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে তিহা। একসময় ফিরে আসে মূল কথায়। কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ বলে, ‘শুনেছি আমার বিয়ে নিয়ে তোমার খুব দুশ্চিন্তা ছিল। থাকবারই কথা। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে দিয়ে যেতে না পারলে দুনিয়া আখিরাত উভয় জাহানে পাকড়াও হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। বাবা হিসেবে যথেষ্ট চেষ্টাও তুমি করেছো। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তোমার ঐকান্তিক চেষ্টাটা দেখেছেন, আশা রাখছি তিঁনি হয়তো এর জন্য পরকালে তোমায় পাকড়াও করবেন না বাবা। আর দুনিয়ার কথা?
সে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছেড়ে দাও। আমার নসিবে যা আছে, যতটুকু আছে। তারচেয়ে সামান্য কম কিংবা বেশি আমি পাব না। এসব অহেতুক চেষ্টা বন্ধ করে তোমরা বরং আমায় ক্ষণকালের জন্য একটু মুক্তি দাও। পাড়াপড়শি, আত্মীয় স্বজনের কূট কথা শুনতে শুনতে জীবনের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা অনেক আগেই এসে গেছে। নতুন করে আমাকে আর অপমানের উপলক্ষ হতে অনুরোধ করোনা৷’

মারুফ থমকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ, বহুক্ষণ… একসময় হতশ্বাসে জর্জরিত হয়ে বলেন,’জানি মা তুমি প্রতিনিয়ত মানুষের কথার আঘাতে কষ্ট পাচ্ছো। আজও যে ওরা বাকিদের মতই কাজ করবে সে আমি ঘুনাক্ষরেও বুঝিনি। বুঝলে তোমার কাছ পর্যন্ত ওদের যাবার সুযোগ দিতাম না। কিন্তু তাই বলে… সব বন্ধ করে দেয়া… সব মানুষ তো এক না। হয়তো সামনে আরো ভালো… ‘

বাবার কথার মাঝখানে কথা বলে ওঠে তিতিক্ষা।
‘দুনিয়াটাকে তুমি এখনো যথেষ্ট ভালো ভাবো, এটা তোমার সরলতা বাবা। তবে দুনিয়ার আদত রূপ আমার কাছে অনেক আগেই উন্মোচিত হয়েছে। আমি জানি মানুষ সামান্য একটু চিত্তপ্রসাদের জন্যও কতটা অমানুষ হতে পারে। তোমার মতো সরল চোখে দুনিয়াকে দেখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু একবার যে এর সরূপ দেখে ফেলে তার চোখে আর কিছুতেই দুনিয়ার কোনো ভালো মানুষি ধর্তব্য হয় না।’
হঠাৎ একটু দৃঢ়তার সাথে তিতিক্ষা বলে, ‘বাবা তুমি বুঝতেই পারোনি ওরা আজ যা বলেছে তা নিতান্তই স্বাভাবিক। বোঝোনি কারণ সমাজে আমার অবস্থান কোথায় তুমি এখনো স্পষ্ট করে জানোনা। এই ধরনের মেয়েদের একটা সুস্থ জীবনের কামনা করাও অপরাধ। আমি যেখানেই যাই, সমাজ কিছুতেই আমাকে আমার অতীত ভুলে থাকতে দেবে না।
তাছাড়া এইদেশে হাজার হাজার কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা আছে, তাদের মেয়েদের হয়তো আমার মতো কোনো সর্বনাশা অতীত নেই, খুঁত নেই, বদমেজাজ নেই। কেন ওদের ছেড়ে কেউ আমাকে বিয়ে করবে বলতো?
এইসব অলীক স্বপ্ন দেখা বাদ দাও। আমি একটু শান্তি চাই ব্যস। সেটুকুও দিতে না চাইলে তোমরা আমায় বলে দাও। যেদিকে দুচোখ যায় আমি চলে যাব।’

‘তিতি….’ ক্ষীণ একটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে মারুফের গলা দিয়ে। বাবার ডাকের পরোয়া না করে তিতিক্ষা তখন নিজের ঘরের দিকে হাটতে শুরু করেছে।
চলবে…..

দূর আলাপন ~ ২৫

_________________________
দরজা খুলে চমকে গেলেন মারুফ। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে রাত এখন প্রায় দশটা। এত রাতে হঠাৎ কেন নিনাদ এখানে? কোনো দুঃসংবাদ নয়তো? দরজার ওপাশে বিব্রত নিনাদ তখন অস্থির চোখে মারুফকে ডিঙিয়ে পেছনে তাকিয়েছে। কেউ নেই দেখে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো জিজ্ঞেস করল,’আঙ্কেল তিহা কোথায়?’

‘আছে…’ ধীরজ গলায় উত্তর দেন মারুফ। তার স্বরে আজ আপ্যায়নের তোয়াজ নেই বুঝেও খুব একটা আমলে নিল না নিনাদ। ও এসেছে দরকারে। দরকার ফুড়োলেই চলে যাবে। নিনাদ পুনরায় ব্যস্ত হয়ে অনুরোধ করে,
‘আঙ্কেল তিহাকে একটু ডেকে দেবেন প্লিজ।’

দরজা ছেড়ে নিঃশব্দে সরে দাড়ান মারুফ। নিনাদকে ওভাবেই রেখে অন্দরে পা বাড়ান বড় মেয়েকে ডাকতে।

মেয়েকে ডেকে দিয়ে মারুফ আর এলেন না। বসলেন সদ্য কান্না থামা নাতিটার কাছে। হতবাক ভাবটা নিয়েই বেরিয়ে এলো তিহা। তাড়াহুড়ায় হাতের কাছে সলাতের হিজাব পেয়ে সেটাই পড়ে এসেছে। কেন আজ হঠাৎ নিনাদের সামনে আসার আগেও হিজাব জড়ানোর চিন্তাটা মাথায় এলো তিহা জানে না। আজকাল সে বাইরে গেলে প্রায় সবসময় বোরকা পড়ে। এই মুহুর্তে হিজাব পড়ার সপক্ষে তিহার যুক্তি হলো যদি বাইরের মানুষের সামনে পর্দা রক্ষাই বোরকার প্রকৃত উদ্দেশ্য হয় তবে বাইরের মানুষ বাসায় এলে কেন সেই পর্দায় শিথিলতা আসবে?

নিনাদ তখনো ছন্নছাড়া ভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তিহা বিস্মিত গলায় বলে, ‘নিনাদ তুই এত রাতে? বাসায় সব ঠিক আছে? ‘

‘আছে।’

‘আয়, ভেতরে এসে বোস।’

দ্বিরুক্তি না করে অসংলগ্ন পদাঙ্কে নিনাদ সোফায় এসে বসে।

পুরনো বিরোধ ভুলে সত্রাসে জিজ্ঞেস করে তিহা, ‘এবার বল কি হয়েছে?’

‘তুই তিতিক্ষার বিয়ে ঠিক করেছিস?’ নিনাদের চোখেমুখে খেলা করছে প্রবল নিষ্করুণ ভাব।

ওর অতর্কিত প্রশ্নে তিহা ঈষৎ চমকায়,’ হ্যাঁ… আসলে ঠিক বিয়ে নয়। ওরা শুধু তিতিকে দেখতে এসেছিল।’

‘কারা?’ নিনাদের গলায় সন্দিগ্ধতার ছাপ।

‘ছেলে.. ছেলের খালা আর.. ওনার বউমা।’

‘তিতিক্ষা ওই ছেলের সাথে দেখা করেছে?’

একটু মেজাজ খিচঁড়ে গেল তিহার। নিনাদের কথাতে বিকেলের ছবিটাই আরো স্পষ্ট হয়ে ভাসল মনের পটে। অনুভূত হলো কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা পড়ার মত কষ্ট। তাছাড়া নিনাদ অত অধিকারবোধ দেখাচ্ছেই বা কেন? সতেজে বলল তিহা,’ তিতি ওই ছেলের সঙ্গে দেখা করুক আর নাই করুক। তা জেনে তোর কি লাভ?’

একটু থতমত খেয়ে যায় নিনাদ। আক্রোশে মাথাটা ঠিক সহজ ভাবে কাজ করছে না। ওর প্রশ্ন গুলো হয়তো একটু বেশি ব্যক্তিগত হয়ে গেছে, ‘আ… আমার কিচ্ছু না… তবে… ওর জীবন নিয়ে যা ইচ্ছে করার অধিকার তোরও কিন্তু নেই।’

চটপট প্রতুত্তর দেয় তিহা,’এটাকে যা ইচ্ছে করা বলে না। মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলে স্বাভাবিক ভাবেই সব অভিভাবক বিয়ে নিয়ে ভাবেন। তাছাড়া আমার বোনের আগেপাছে তো আর কেউ নেই। বাবার ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে তিতি একেবারে নিরাশ্রয়। ওর নিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা তো আমাদেরকেই চিন্তা করতে হবে!’

নিনাদ বুঝল, তিহার কথায় আদতে কোনো ভুল নেই। ও যা কিছু করছে বোনের ভালোর জন্য। সে অধিকার ওর আছে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই যেন ধীরে অনবদমিত হয়ে পড়ে নিনাদের অন্ধ ক্রোধ টা। স্তিমিত হয়ে আসা স্বরে একসময় বলে,
‘হ্যাঁ… তুই হয়তো ঠিক বলেছিস।’ বলে দ্রুত প্রসঙ্গ পালটায়, ‘তারপর কি হলো বল, কদ্দূর এগোলো বিয়ের সম্মন্ধ?’

‘কদ্দূর এগিয়েছে?’ নিবিড় ঘোরে নিনাদের প্রশ্নেরই পুনরাবৃত্তি করে তিহা। তারপর চুপ হয়ে যায়।

‘তিহা’

‘হু’

‘বলবি না?’

তিহা আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, ‘কি বলবো? ব্যপার টা তো এগোয় নি আর। হয়তো কখনো… কারো সাথে এগোবেও না…’

‘কখনো এগোবে না? কেন?’

নিশ্বাস ফেলে তিহা, ‘কারণ তো হাজারটা। ক’টা বলি? আর এসব জেনে তোরই বা কি লাভ? আগামী সপ্তাহে বিয়ে। এসব অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারাদী বাদ দিয়ে তোর এখন সে নিয়েই জোড় দিয়ে ভাবা উচিত।’

নিনাদের মুখে খেলে যায় একটু বিদ্রুপজড়িত হাসি,’তোর কানেও খবরটা এসেছে তাহলে? তবে কি আমিই সবার শেষে জানলাম!’

‘কি শেষে জানলি?’

‘আমার বিয়ের খবর টা।’

‘ওমা! আগে জানতি না বুঝি?’

‘শুনেছিলাম ফুআম্মা মেয়ে বাছাই করেছেন। তবে সেই বিয়ে যে এত জলদি, একেবারে সামনের সপ্তাহে তা তো জানতাম না।’

‘শিউলি ফুআম্মা তোর মতামত না নিয়েই এতটা এগিয়েছেন?’ তিহা বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকে।

‘আমার মতামতটা কখনোই কারো কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ তো ছিল না। যাকগে ওসব কথা। তিতিক্ষার ব্যপারে তুই কিছু একটা বলছিলি সেটা শেষ কর।’

তিহা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মাথা নুইয়ে বসে। মেঝের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলে, ‘বলার কিছু নেই… ওদের আচরণ, কথাবার্তা ঠিক আশানুরূপ ছিল না… বাবা আগেই তিতির অতীত সম্মন্ধে কিছুটা বলে রেখেছিল, সেজন্যই কিনা কে জানে.. শুরু থেকে ওদের তিরস্কারের দৃষ্টি, কথার ভঙ্গি তিতিকে রাগিয়ে তুললো। ওকে তো জানিস, অল্পতে রেগে কাই হয়। তিতিও রাগলো আর ভদ্রমহিলাও তিতির অতীত তুলে উল্টোপাল্টা কথা বলতে আরম্ভ করলেন। এসব ব্যতিরেকেও আরো বড় যে কারণ টা আছে তা হলো ছেলের নামে রাজন। বুঝতেই পারছিস এই সম্মন্ধ কখনো হবার নয়…
শেষমেশ ওরা মুখ কালো করে ফিরে গেছে আর তিতি… ও বাবাকে বলেছে এসব অহেতুক চেষ্টা একেবারে ছেড়ে দিতে। নয়তো… ‘

‘নয়তো কি?’

‘ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।’

‘বেরিয়ে যাবে কোথায়? ‘

‘কে জানে! অন্যকারো মুখে এসব কথা শুনলে হয়তো আমরা পরোয়াও করতাম না কিন্তু তিতি… ও অন্যরকম। বেরিয়ে যাবার চিন্তাটা মাথায় আছে বলেই সেটা ওর মুখ পর্যন্ত এসেছে।’

শেষ কথাটা শুনে কিছুক্ষণ নিরবে বসে রইল নিনাদ। একসময় নিচু স্বরে বলল,’তিতিক্ষার এই মানসিক হালতে ওকে এসবের মধ্যে টানাই মস্ত ভুল হয়েছে। কোনো টিপিক্যাল বয়স্ক মহিলা যে অতীত টাকে স্বাভাবিক ধরে ওর সাথে ট্রিট করবেন না সে তো জানা কথা।’

‘ওরা আজ তিতিকে যা তা বলেছে।’ বলতে বলতে তিহার রুদ্ধবাক স্বরে আচমকা একটা ফোঁপানোর আওয়াজ ওঠে। কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। নিনাদ অবাক হয়ে দেখে মাথা নিচু করে তিহা কাঁদছে।

‘কেন যে এসব ঘটানোর আগে আরেকটু সময় নিলি না…’

‘সব বুঝি রে.. তবু আমরা যে নিরুপায়। ভীষণ ভয় হচ্ছিল সামনের দিন গুলোর কথা ভেবে। যখন বাবা থাকবেন না, নিজের সংসার নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকবো… আমার বোন টা তো একেবারে ভেসে যাবে। ওর অতীত, ওর আত্মসম্মান কখনো ওকে কারো দয়ার পাত্র হতে দেবে না। দিনশেষে ও হবে চির আশ্রয়হীন, নিঃস্ব…’

কেউ আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ নিজের স্থানে ভাবুক হয়ে বসে রইল নিনাদ আর অন্যপাশে তিহা নিরবে মুছতে লাগলো চোখের জল।
সহসা তিহার স্বাভাবিক সৌজন্য বোধটুকু উদয় হতেই ও প্রস্তাব করল,’এত রাত হলো। তুই নিশ্চয়ই কিছু খেয়ে আসিস নি। আমি ভাত দিচ্ছি, বাবার সঙ্গে বসে পড়।’ বলে উঠতে যেতেই নিনাদের ডাক ওকে থামালো।

‘ওসব কথা থাক। এখানে বোস। আমার একটা কথা শোন।’

নিনাদের চিন্তাগ্রস্ত দুর্বোধ্য মুখের পানে চেয়ে তিহা পুনরায় বসে পড়ে। নিনাদকে দেখে অনুধাবন করে ওর ভেতরে দুটো স্বত্তার মাঝে প্রবল দ্বন্দ্ব চলছে। একসময় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিনাদ ডাকে, ‘তিহা’

‘কি?’

‘একটা কথা বলবো?’

কয়েক মুহুর্ত ইতস্তত করে তিহা। অস্বস্তি নিয়ে বলে, ‘বল..’

‘ছোট গিন্নিকে আমার দিবি?’

তিহা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। ও আশঙ্কা করছিল এমন কিছুর। নিনাদের বাস্তব জ্ঞান বরাবর কম। যেখানে প্রতিটা ছেলে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে সবচেয়ে নিখুঁত, কলুষ মুক্ত একজনকে বেছে নিতে চায় সেখানে ও যেচে তিতিক্ষার মতো কাউকে বিয়ে করতে চাইছে। একমাত্র নিনাদের দ্বারাই বোধহয় এমন মুহুর্তে এমন একটা প্রস্তাব পেশ করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা ভুললে তিহার চলে না। নিনাদ নাহয় রাজি হবে তবে ওর পরিবার? ফুআম্মা? ওরা কি বুঝবে?
সম্বিত ফিরতেই তিহা শীতল গলায় বলে,’সম্ভব না নিনাদ। প্লিজ এই নিয়ে আর কিছু বলিস না।’

‘কেন সম্ভব না? ‘

‘তুই বুঝতে পারছিস এটা হলে কতগুলো মানুষের মন ভাঙবে? এমনকি শিউলি ফুআম্মার সঙ্গে তোর সম্পর্কে চিড় পর্যন্ত ধরতে পারে। ‘

‘ফুআম্মা নিশ্চয়ই আমাকে বুঝবেন।’

‘আর ওই মেয়েটা? যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছেন ফুআম্মা?’

‘বিয়েটা তো ফুআম্মা আমার অমতে ঠিক করেছেন। আমার মতামতের পরোয়া যখন করেননি, হিসেবে তখন আমার আপত্তি জানানোটাই তো যুক্তিযত। তাছাড়া ওই মেয়েটা.. ওকে তো আমি দেখিও নি। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত যার অস্তিত্ব সম্মন্ধেও জ্ঞাত ছিলাম না, তাকে বিয়ে করবো না বলা কি খুব বেশি নিষ্টুরতা? অল্প কদিনের নোটিশে ঠিক হওয়া বিয়ে অল্প কদিনে ভেঙে গেলে কোনো পক্ষেরই এতে দারুণ ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে না।’

‘অতকিছু আমি জানি না। কিন্তু… এটা একটা অসম্ভব প্রস্তাব।’

‘আমি তো অসম্ভব কিছু দেখছি না! ফুআম্মাকে রাজি করানো আমার দায়িত্ব। আর তুই… তুই এদিকটা সামলা।’

ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছিল তিহা, ‘রাজি করানো কি এতই সোজা? বললাম আর হয়ে গেল! তিতিকে চিনিস না তুই?’

‘চিনি বলেই তো যেচে খড়্গ মাথায় নিতে চাইছি। দুদিন পর পর মেজাজ দেখিয়ে বাইরেই একটা ছেলের মাথার ও খড়্গ ঘোরাবে, তারচেয়ে সব দায়ভার আমারি থাকুক।’

চলবে….

দূর আলাপন পর্ব-২২+২৩

0

দূর আলাপন ~ ২২

____________________________
নিনাদের কি যেন হয়েছে। ওই হতচ্ছাড়া দেশ ছেড়ে আসার পর থেকে ছেলেটা গুম হয়ে আছে নিজের মধ্যে। কিছু একটা যে ঠিক নেই তা বেশ বুঝতে পারেন শিউলি। আড়াল আবডাল থেকে ছেলের অদ্ভুত ভাবভঙ্গি যত নজর করেন, দুশ্চিতার অথৈজলের আরো গভীরে তলায় তার মন। হুল্লোড়প্রিয় ছেলে হঠাৎ অমন নিভে গেল, না বাইরে যাওয়া, না বন্ধুদের সঙ্গে আধ রাত্রির পর্যন্ত আড্ডা দেয়া আর নাই বা আফরিনের সঙ্গে খোঁচাখুঁচি। এমনকি খোদ শিউলির সঙ্গেও দুটো বাড়তি দুটো কথা কয় না আজকাল! এসব তো ভালো লক্ষন নয়।

শিউলির মনে নানারকম কুট সন্দেহ দানা বাঁধে। ওই পোড়ামুখো দেশটাতেই নিনাদ কোনো কান্ড বাঁধিয়ে এলো না তো? শুনেছেন বিদেশ বিভূঁইয়ে নাকি লজ্জাশরম নামক বস্তুটির কোনো অস্তিত্ব নেই। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে অকপটে পথঘাটে চলাফেরা করে। অমন বেহায়ার রাজ্যে থাকলে ছেলে মানুষের মাথা বিগড়ে যাওয়া তো অসম্ভব কিছু না। একমাত্র আল্লাহই জানেন কি ঘটেছে। তবে প্রবাস থেকে ফেরার কয়েক দিন পরেও যখন নিনাদ পুরোপুরি স্বাভাবিক হলো না শিউলির দুশ্চিন্তা প্রকট হলো।

তা তরুণ বয়সে এক আধবার ছেলেরা এমন বিগড়ে যায় ই। এর মোক্ষম সমাধান অবশ্যি শিউলির জানা আছে। দ্রুত বিয়ে দিয়ে ছেলেকে ঘরমুখো করা। শিউলি নিজের মতো তোড়জোড় শুরু করলেন। হবু বেয়ান বাড়ির সঙ্গে কথা বলে এগিয়ে আনলেন বিয়ের তারিখ। নিনাদ কিছু জানলো না। তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না শিউলি। জানিয়ে কি হবে? বরং আগে শুনলেই না আবার নতুন করে কোনো বিপত্তির সূচনা হয়…

.

বাইরে নরম সুন্দর রোদে ঘেরা সকাল। সোনা রঙের লহরি খেলছে কাঁচের জানালা জুড়ে। জানালা খুলে, দুহাতে টেনে পর্দা সরিয়ে দিল তিতিক্ষা। এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। দরজাটা খুলতেই হুড়মুড় করে একরাশ রোদ গ্রিল গলে এসে লুটিয়ে পড়ল ঘরের ভেতর। বারান্দার দরজা খুলে রেখে তিতিক্ষা ভেতরে চলে এলো। চারপাশটা দেখল ঘুরে। জানালার বাইরে পাখিদের প্রবল কিচিরমিচির আর শান্ত ঘরে সকালের স্নিগ্ধ রোদের লহরি। আজকের সকাল অন্যরকম সুন্দর। ভুল হলো, শুধু আজকের সকাল নয়। প্রতিটা দিনই হয়তো সকাল ঠিক এরকম সুন্দর হয়। এতকাল খেয়াল করেনি বলেই উপলব্ধি করেনি তিতিক্ষা।

রোজ ভোরেই তো এরকম মিষ্টি আলো ফেলে সূর্য দিনের প্রথম হাসি হাসে। বিকেলে গাছের ফাঁকে রোজ জাফরানি রোদ্দুর মেখে দিনের সমাপ্তি ঘোষণা করে সূর্যের তেজী আভা৷ অথচ প্রকৃতির এই আয়োজন একান্ত করে দেখার ইচ্ছে বহুকাল হয়নি তিতিক্ষার। দিনের পর দিন পেরিয়ে গেছে, ও সারাক্ষণ ডুবে থেকেছে একান্ত নিজের দুঃখভূমে। পৃথিবীর কোনো আলো, সুখ, গন্ধ, তৃপ্তি ওকে স্পর্শ করেনি। তিতিক্ষা নিজের জন্য স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে এক দুর্বিষহ জীবন, আর নিজের দুঃখ দিয়ে তিক্ত করেছে পরিবারের বাকি মানুষ গুলোর জীবনকে।

কত বিভৎস স্মৃতির অনুরণনে, কান্নায়, ক্লেশে আর পরিতাপে দগ্ধ হয়ে হয়ে কেটেছে তিতিক্ষার দিনকাল। সহ্য করতে না পেরে, বিষাক্ত স্মৃতি মুছতে না পেরে একেক সময় সে পাগলামো করেছে। কষ্ট দিয়েছে নিজেকে আর নিজের সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষকে…
সেই বিষাক্ত স্মৃতি পিছু ছাড়েনি। বোধহয় খুব সহজে ছাড়বেও না। এইতো… এইমাত্রই তো দুর্বহ অতীত স্মৃতির এক টুকরো ছবি ওর মনের কোণে এঁকে দিয়ে গেল অগ্নি হল্কার ছাইভষ্ম। তবে তিতিক্ষা এইবার নিশ্চল। আজ সে কাঁদবে না। অস্থির হবে না। বিচলিত বোধ করবে না শিরার অসহ্য দপদপানিতে। এ ওর নিজের কাছে নিজের অঙ্গিকার।

নির্বিকার, নিথর হয়ে বিছানায় বসে জানালার গ্রিলে চোখ তুলে চেয়ে থাকে তিতিক্ষা। গায়ে চিনচিনে অসহ্য জ্বালা শুরু হয় একরকম। এই জ্বালাটা সে আগেও টের পেত। সেসময় সহ্য করতে না পেরেই আঘাত করতো নিজেকে, সামনে যা পেত সব ধ্বংস করার পণ নিয়ে শুরু করতো ভাঙচুর।

ক্রমে বাড়ছে শরীরের চিনচিনে জ্বলুনিটা। মস্তিষ্কের অন্ধ কুঠুরিতে স্মৃতি নামক অভিশাপের দহন আর বুকের ভেতর অসহনীয় জ্বালা। তিতিক্ষা নাকাল বোধ করে। নিজেকে, নিজের অযাচিত অন্ধ ক্রোধকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যায়। তবু… সব সহ্য করে শিথিল হয়ে বসে থাকে। বুবুকে, বাবাকে অনেক শাস্তি দেয়া হয়েছে। আর না। ওদের মুখের সব হাসি গায়েবে করে, মনের মধ্যকার সমস্ত আনন্দ তরঙ্গ শোষণ করে, তিতিক্ষা সকলের জীবনকে বিস্বাদ করে তুলেছে। আর কতকাল নিরীহ দুজন মানুষ সহ্য করবে এই অনাচার?

যাই হয়ে যাক আজ, ওদের আর কাঁদাবে না তিতিক্ষা। কষ্ট হলে সয়ে নেবার চেষ্টা করবে, যতখন, যতদিন পারা যায়.. কিন্তু বাবা আর বোনের মুখে মেঘের কালো ছায়া আসতে দেবে না আর কখনো।
‘ইয়া আল্লাহ আমাকে সাহায্য করুন। অতীত ভুলিয়ে দিন। অন্তরের অস্থিরতা দূর করে দিন ইয়া রব।’ ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দে দুআ করতে করতে বুকের ভেতরে আগুনের শতধা নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায় তিতিক্ষা, ওযু করার উদ্দেশ্যে। ওযু নিশ্চয়ই তার অস্থিরতা প্রশমিত করবে।

ওযু শেষে যখন ফিরে আসে ওর চেহারায় তখন ঝিকমিকাচ্ছে ফোঁটায় ফোঁটায় জল। চোখের দৃষ্টি পরম শান্ত৷ তিতিক্ষা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে, ওর ভেতরের অহেতুক ক্রোধের বেপরোয়া আস্ফালন তিঁনি থামিয়ে দিয়েছেন বলে। ওযুর উদ্দেশ্য ছিল মূলত রাগ দমন করা। তবে এবার কৃতজ্ঞতায় নতজানু হয়ে তিতিক্ষা বইয়ের তাক থেকে কুরআনও তুলে নিল। বুকে জড়িয়ে বারান্দার কাছে মাটিতে বসে পড়ল পা ভেঙে। কাঠের রেহালে কুরআন নামিয়ে রেখে পরম যত্নে পৃষ্ঠা উলটে থামল সূরা আরাফে। নম্র কোমল সুরে কুরআন পড়তে আরম্ভ করার পরই আস্তে আস্তে অবর্ণিত যাতনার বাষ্পে ভারাক্রান্ত হৃদয় হালকা হল। অন্তঃস্থল দখল করে নিতে শুরু করল নিখাঁদ প্রশান্তির ফল্গুধারা।

❝নিশ্চয়ই যারা তোমার পালনকর্তার সান্নিধ্যে রয়েছে, তারা অহংকারে তাঁর ইবাদতে বিমুখ হয় না ও তাঁর-ই মহিমা ঘোষণা করে এবং তাঁর-ই কাছে সিজদাবনত হয়। [ সুরা আরাফ – ২০৬]❞

কুরআন তিলাওয়াত করতে করতে কুরআনের সুরের সঙ্গে তিতিক্ষা আরো নিবিড় হয়ে মিশে যেতে থাকে। মনে মনে দৃপ্তকণ্ঠ বারবার স্বীকার করে, ‘এই আমার পরম প্রশান্তির স্থান.. কুরআন আমার প্রশান্তি… ইয়া রব, আপনি এই অসীম নিয়ামত টুকু আমার থেকে কখনো কেড়ে নিয়েন না। আপনার এই কালামকে এভাবে আকঁড়ে ধরে আমি চিরকাল শান্তি পেতে চাই। আমি মারা যেতে চাই কুরআন কে ভালোবেসে, কুরআনের বুলি আওড়াতে আওড়াতে। আমিন ইয়া রব্বুল আলামীন….’

.

বোনের ঘরে এসে তিহা মৃদু অবাক। পরিপাটি করে গোছানো আলো ঝলমলে ঘর। ওয়ারড্রবের সামনে দাঁড়িয়ে তিতিক্ষা কাপড় ভাজ করছে। মাথায় জড়ানো বড় ওড়না, মুখজুড়ে লেপন করে আছে নিরতিশয় স্নিগ্ধকর আভা। তিহা এসেছিল গুরুতর প্রসঙ্গ উত্থাপনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে। সব শুনে বোনের গোঁড়ামি বাড়াবাড়ি মনে হলে খানিকটা কঠোর হবার পরিকল্পনাও মাথায় ছিল। কিন্তু এখন তিতিক্ষার শান্ত সরল অভিব্যক্তি দেখে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। সেই কঠোর, জেদী, আগ্রাসী মুখ তো এ নয়। এই চেহারার সবটা ঘিরে শুধুই নির্মলতা বিরাজমান। যেন ও চিরকাল এমনি ভীষণ নম্র, ভীষণ বাধ্য। কখনো কারো অবাধ্য ছিল না। এক মুহুর্তের তরেও না…
সে যেন সমস্তরকম অনৈতিকতা বিবর্জিত নিষ্পাপ এক প্রাণ। এইরকম এক মানবীর প্রতি কি করে কঠোর হয় তিহা?

বোনকে দেখে বহুপূর্বের হারানো সাহস আজ আবার তিহা ফিরে পায়। এইরকম মেয়ের কাছে হয়তো যা খুশি বলা যায়। না পূরণ হওয়া ইচ্ছেগুলোর কথা, স্বপ্নের কথা, শঙ্কার কথা.. আর মনের গহিনে যত অনিশ্চয়তার ঝাপতাল লুকিয়ে আছে, যত না বলা যাতনার সাতকাহন গচ্ছিত আছে… সব বলা যায় এমন মনের কাছে।

হাত ধরে বোনকে টেনে বসালো তিহা। নিজের খুব কাছে। মায়ের মতো স্নেহে মাথায় চুমু খেয়ে বলল,’বুবুর একটা কথা রাখবি?’

নির্মল নিস্তরঙ্গ হাসি তিতিক্ষার মুখে,’কি কথা বুবু?’

‘বলছি.. তার আগে একটা খবর জানাই। তোর দুলাভাই সকালে কলে জানিয়েছে আর কিছুদিনের মধ্যেই ওকে ঢাকায় পোস্টিং হয়ে যাবে।
তারপর হয়তো আর এবাড়িতে থাকা হবে না আমাদের….’
একদম অকারণে অযাচিত ভাবে গলার স্বর সামান্য কেঁপে ওঠে তিহার।

তিতিক্ষার উজ্জ্বল মুখ নিভে যেতে কয়েক মুহুর্ত মাত্র সময় লাগে।
‘থাকবে না?’

থেমে বলে, ‘একেবারে চলে যাবে বুবু?’ তিতিক্ষার স্বরে তীব্র অবিশ্বাস। খানিকটা অস্বাভাবিক ভাবে অবিশ্বাসের আঁচটা ওর চেহারায় ফুটে ওঠে।

কিশোরী মেয়ের মতো নাক টেনে হঠাৎ কেন যেন কেঁদে ফেলল তিহা।
‘যেতে হবে রে.. ‘

‘আর ছোটন…?’

‘ওকেও তো সঙ্গে নিতেই হবে। ‘

স্তব্ধ হয়ে কিয়ৎকাল বসে থাকল তিতিক্ষা। প্রস্তরীভূতের ন্যায়। অথচ… এই সময়টা খুব যে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল, তা তো নয়। বিয়ের পর থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে রওশান, ওর পোস্টিং টা কিভাবে ঢাকায় আনা যায়। তখন তিহার সাথে সাথে তিতিক্ষাও অনুযোগের স্বরে বারবার বলতো, ‘রওশান ভাইয়ের ঢাকায় আসতে আর কত দেরি বলতো বুবু? কবে যে তোমাদের একটা নিজের সংসার হবে…’

আর আজ, সেই শুভসময় আসতে যখন আর খুববেশি বাকি নেই, ওরা দুবোন তখন নিজেদের হাসির মুখোশ খুলে ফেলে একে অন্যের সামনে বসে কাঁদছে।
‘তোমরা চলে গেলে একা আ..আমি কি থাকবো বুবু? আর বাবা… বাবা কি করে ছোটনকে ছাড়া থাকবে?’

‘জানি না রে.. কিন্তু যেতে তো হবেই। কি করে আটকাই?’

সেই তো… সংসার তো নারীই গড়ে তোলে। নিজের সংসারে না ফিরে বুবু করবে কি? কিন্তু… কিন্তু… তিতিক্ষা তাহলে বাঁচে কি করে ওদের ছাড়া?

নিঃশব্দে খানিকক্ষণ বোনের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করল তিহা। আশু একাকীত্বের আশঙ্কায় বিবর্ণ হয়ে তিতিক্ষা এখনি দিশেহারা বোধ করছে। মাথার ওপর থেকে ছাদ সরে গেলে যেভাবে শূন্য পরাভব হয় মানুষ, তেমন রিক্ত হাবভাব তিতিক্ষার মুখচোখে।

‘তিতি…’

‘বলো…’

‘তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন?’

‘তোমাদের ছাড়া কি করে থাকবো বুবু?’

‘চিরকাল কি কেউ কারো হয়ে থাকে রে বোকা? যে সন্তান মায়ের এত প্রিয়, সেই নাড়ী কাটা ধনকেও তো একদিন চির পর করে অন্যের ঘরে পাঠাতে হয়। সেখানে তুই আমি… আমরা তো দুইবোন। নিয়তির অমোঘ পরিকল্পনাতেই আমাদের গন্তব্য আলাদা করে লেখা। আমার তো যাবার কথা আরো আগেই ছিল। যাক, এতদিনে নিজের করে কিছু একটা পাব। আজ না হোক কাল, তোরও তো আপনার সংসার হবে। দেখবি তখন এসব দুঃখ কোথায় হারিয়ে যাবে… ‘

তিতিক্ষা যেন কি এক স্বপ্নের অতল গহনে আবিষ্টমান। চোখে শঙ্কার কোলাহল তুলে বলল,’আমি কোথাও যাব না… কক্ষনো যাব না বাবাকে ছেড়ে… ‘

‘কিন্তু বাবা যে কারো চিরকাল থাকে না তিতি… তখন তোর কি হবে বলতো? কে তোকে আশ্রয় দেবে? কার নিরাপত্তায় গোটা একটা জীবন একাকী কাটাবি তুই?’

বাস্তবতার নিঠুর মাটিতে তিতিক্ষার কল্পনাবিভোর মন আঁছড়ে পড়ে। সত্যিই তো! এই প্রশ্নের উত্তর নেই ওর কাছে। অথচ তিতিক্ষা স্পষ্ট বোঝে, নিয়তিকে এড়ানোর কোনো উপায় তার হাতে নেই। দূরভিশঙ্কা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে না পেয়ে, নিজের জীবনের চরম বাস্তবতাকে আরো একবার গভীর ভাবে উপলব্ধি করে আচমকা তিতিক্ষা হু হু করে কেঁদে ওঠে। কেন? কেন এত নির্দয়ভাবে একা হবে একটা মানুষের জীবন?
কেন ক্ষুদ্র এক জীবনে সব হারিয়ে চূড়ান্ত একা হবার দুঃখ সইতে হবে একজন মানুষকে?

বোনকে উজার হয়ে কাঁদার সুযোগ তিহা দিল। ধৈর্য ধরে নিঃশব্দে ওকে ওর মতো কষ্টের ভার কমানোর সময় দিল। একসময় তিতিক্ষার কান্না লহু হয়ে এলে তিহা নিজের শীতল হাত রাখে ওর মাথায়।
‘বেশি কষ্ট হচ্ছে রে আপু? বুবুকে মাফ করে দে। বিশ্বাস কর, তোকে কষ্ট দিতে আমারও ততটাই কষ্ট হয়। কিন্তু বাস্তবতা যে আমাদের কল্পনারও অতীত। এভাবে বলতে চাইনি কিন্তু না বলেই উপায় কি বল? আমি নিজের সংসারে চলে যাব। প্রকৃতির নিয়মেই একসময় বাবাও আর থাকবেন না। তোর পরিণতি কি হবে বলতো? তুই রওশানের অধীনে থাকবি না ও তোর মাহরাম নয় বলে। বাবার অনুপস্থিতিতে তখন তোর মাহরাম কে হবে?
ভাবতে পারিস, তোর সমস্ত বিপদে আপদে, অসুখে বিসুখে সাহায্য লাগবে এমন একজনের, যার ছোঁয়া তোর জন্য হারাম। এই গ্লানির সামনে কিছু বাস্তবতাকে মেনে নেয়া কি খুব কঠিন?’

‘তাহলে আ.. আমি.. কি করবো বুবু? কোথায় যাব আমি?’ কান্নায় ভেঙে আসা স্বরে বিহ্বলতা জড়িত গলায় তিতিক্ষা জিজ্ঞেস করে।

‘তোকে কিছু করতে হবে না আপু। তুই শুধু আমাদের কথা শোন। তোর নিজের প্রয়োজনে, একান্ত আপনার স্বার্থে আমাদের একটা দাবি মেনে নে।’

‘কিসের দাবি?’

‘বিয়েতে সম্মতির দাবি। আমরা তোকে নিরাপদ দেখতে চাই। আর একটা মেয়ে তার বাবার পরে একমাত্র স্বামীর অধীনেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। ভেবে দেখ। তোর কোনো ভাই নেই, মামা নেই, একজন চাচা শুধু আছেন। তারও আবার দুটো ছেলে। বাবার পরে কার আশ্রয়ে নিরাপদ থাকবি তুই? এখানে এই বাসায় একা একা?
এও কি সম্ভব?’

কিছুকাল দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে রইল তিতিক্ষা। গালে জলের ভেজা ছাপ স্পষ্ট, চোখে তীব্র সংশয়।

‘বল পারবি তুই?’ বোনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে তিহা জিজ্ঞেস করে।

তিতিক্ষা চোখ বোজে। চাপা স্বরে কান্না ছাপিয়ে সমাচ্ছন্নের মতো উত্তর দেয়,’ আমি কিছু জানি না… কিছু জানি না… ভয় করছে আমার.. বেঁচে থাকা এত কঠিন কেন বলতে পারো? একজীবনে বাঁচতে গেলে কেন এত খারাপ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়? আমি আর সহ্য করতে পারছি না বুবু.. তোমরা প্লিজ আমায় রেহাই দাও। একটু শান্তি চাই আমি। আর কোনো অভিযোগ, অপমান, প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চাইনা। আমাকে বাঁচাও। এই দুঃস্বপ্নের জীবনের হাত থেকে সবসময়ের জন্য আমায় উদ্ধার করো…’

‘সত্যিই যদি পারতাম… আর একবিন্দু আঘাত না দিয়ে তোর সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতাম রে আপু। কিন্তু তা যে সম্ভব নয়। ভালো কিছুর অর্জন সবসময় কষ্ট সাপেক্ষ। আপাতত আমরা তোর ভালোর একটা পথই দেখছি। তা হলো… তোর বিয়ে…
যার মাধ্যমে একজন দায়িত্বশীলের হাতে তোকে তুলে দিয়ে আমি, আমরা চিরকালের মতো নিশ্চিন্ত হতে পারবো। ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তা তো আমরা জানি না। তবে সুযোগ্য কাউকে খোঁজার ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টার কোনো কমতি রাখবো না। এই শেষ বারের মতো বুবু ওপর একটু ভরসা রাখ…’

বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল তিতিক্ষা, দীর্ঘ সময় ধরে। একসময় তিহা অধৈর্য হয়ে বোনের গা ঝাঁকালো,’কি রাখবি না?’

হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফেরে তিতিক্ষার। ঘনঘন বারকয়েক চোখের পলক ফেলে, ঢোক গেলে। একসময় বাষ্পরুদ্ধ গলায় বোনের কথার স্বীকৃত স্বরূপ বলে, ‘রাখবো…’
চলবে…..

দূর আলাপন ~ ২৩

__________________________
মেয়েকে বিয়ে দেয়ার নিবিড় প্রচেষ্টা শুরু করলেন মারুফ। এতকিছুর পর মেয়ে রাজি হয়েছে। কখন আবার মত বদলে ফেলে… তার আগেই বিয়ের কাজ সমাধা করা প্রয়োজন। অবশ্য প্রথম সম্মন্ধটি ফোনকল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকল। তিতিক্ষার অতীত শুনে ছেলে মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করায় প্রারম্ভেই পিছপা হলেন মারুফ। দিন কতক পর সন্ধান পাওয়া গেল আরও একটি ছেলের৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামান্য চাকুরীজীবী। শহরে নেই কোনো স্থায়ী আবাস। মেসে থাকে। ছেলেটির কোনো দাবিদাওয়া নেই। সব জেনেই রাজি হয়েছে। মারুফ পরম শান্তি বোধ করলেন। দুপক্ষের আলোচনার জন্য নির্দিষ্ট হলো দিনক্ষণ। ছেলেটির বাবা নেই। বৃদ্ধ মা গ্রামে থাকেন। শহরবাসী খালার সঙ্গে ছেলে নিজেই আসবে।

তিহার পরিবার নিজেদের মতো আয়োজন শুরু করল। অথচ পাত্রপক্ষ আসবার দিন সকালেও দেখা গেল তিতিক্ষা পূর্বের ন্যায় নির্বিকার। স্পষ্টতই টের পাওয়া যায়, ওর ভেতরে উচ্ছ্বাস আগ্রহ নামক বিষয়াদির কোনো আতিশয্য নেই। না আছে আশু ব্যপার টি নিয়ে সামান্যতম প্রতিক্রিয়া কিংবা কৌতুহল। যাকিছু হচ্ছে আর হবে সেসবকে ও স্রেফ নিজের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে।

বিকেলে কল আসে আফরিনের। তিহা তখন মেহমানদের নাশতার আয়োজনে মহাব্যস্ত। রিনরিনে হাসি হাসি গলায় কুশল জিজ্ঞেস করে আফরিন। তবে ওর উচ্ছ্বাস খানিকটা চাপা পড়ে যায় তিহার শশব্যস্ততার সামনে।
‘আমি ভালো আছি আফরিন। তোমার কি অবস্থা বলো? খুব খুশি মনে হচ্ছে?’

‘খুশির খবরে খুশি হমু না আপু? আর এক সপ্তাহ পরেই তো আমাগর নিনাদ ভাইয়ের বিয়া!’

‘নিনাদের বিয়ে… এরমাঝে তারিখও পড়ে গেছে? এতো তাড়াতাড়ি… বাহ… ‘ বলতে বলতে স্বর নিভে আসে তিহার। বিয়ে নিয়ে নিনাদের বুঝি এতো তাড়াহুড়ো ছিল? অতটাও তিহা আশা করেনি….

আফরিন তখন পুনরায় বলে চলেছে,’শুভ কাজে দেরি কইরা লাভ কি কন? তাছাড়া মাইয়াডাও ভালা পাওন গেছে। সুন্দরী মাইয়া তো, হের ওপর গ্রামে থাকে। রোজ এইগ্রাম ওইগ্রাম থাইকা সম্মন্ধ আসে। এদিকে মাইয়ার বাপের আবার নিনাদ ভাইরেই পছন্দ। তাই আর দেরি করতে চাইলো না কেউ।’

ধাক্কাটা ততক্ষণে কিঞ্চিৎ সামলে নিয়েছিল তিহা। নিস্তরঙ্গ গলায় বলল,’শুনে খুশি হলাম। নিদুর বিয়েটা শেষমেশ তাহলে হচ্ছে…
খানিক ইতস্তত শেষে জানাল,’ আজ অবশ্য আমাদের এদিকেও সামান্য একটা আয়োজন হচ্ছে। তোমাদের জানাতাম। সময় হচ্ছিল না। ভালোই হলো তুমি আজই কল করলে।’

‘কিসের আয়োজন আপু?’

মুহুর্তকাল ভাবে তিহা। তারপর স্বরে প্রসন্নতার মৃদু আভাস এনে বলে,’তিতির জন্য একটা সম্মন্ধ দেখা হচ্ছে। ওদের আজ আসবার কথা। সব ঠিক থাকলে হয়তো আজই আঙটি পড়িয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। দুআ করো আফরিন। খুব ভয়ে ভয়ে আছি…’

কথা শেষ হতেই তিহা শুনলো আফরিন চমকিত হয়ে ফোনের ওপাশে চিৎকার করছে,’ওমা! কি কন আপু! সত্যি? ছোট আপুরও বিয়া! কি আশ্চর্য .. একই সাথে দু বাসাতে বিয়ার ধুম লাগছে। আমার কিযে আনন্দ লাগতাসে… আপনি কেন আরো আগে জানাইলেন না কন তো?’

‘আরে এখনো তেমন কিছু তো হয়নি। শুধু দেখতে আসা মাত্র। এর মাঝেও কত কি হতে পারে… নিশ্চিত না হয়ে কি করে বলি বলতো?’

‘সে কথাও ঠিক। তবে এইবার কিন্তু আর কিছু গোপন করা চলব না। ছোট আপুর বিয়ের সব কাজে আমি থাকমু।’

‘সে তো থাকবেই.. তোমাদের ছাড়া আমাদের এই শহরে আর আছেই বা কে বলো?’ কথার ফাঁকে ঘড়ি দেখে তিহা। আচ্ছা আফরিন, ওরা মনে হয় এবার চলে আসবে। রাখি এখন? পরে কথা হবে। ঠিকাছে? ‘

‘হ্যাঁ হ্যাঁ… রাখেন আপু। পোড়া মুখ আমার। এত ব্যস্ততার মধ্যে আপনেরে কথায় আটকায়া রাখছি। আপনি মেহমানের দিকে নজর দেন আমি বরং খবরটা ফুআম্মারে জানাই।’

লাইন কেটে গেল। ফোন হাতে নিয়ে মুহুর্তকাল স্থির দাঁড়িয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো তিহা। আশ্চর্য! সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক গুলোও কিরকম পালটে যায়! যে নিনাদ একটা সময় নিজের সমস্ত খুটিনাটি কথাও ওদের না জানিয়ে থাকতে পারতো না আজ সে বিয়ের মতো অতবড় একটা ব্যপার চেপে রেখেছে। এই তাহলে বন্ধুত্বের আদত রূপ? এত ঠুনকো এই সম্পর্কের গাঁথুনি? অথচ বন্ধুদের একসময় জীবন মনে করতো তিহা। শুধু তিহা কেন? মনে করত ওরা সবাই… নিনাদ, নিমি, পাপড়ি, রাকিব…

.

ছেলের নাম রায়হানুল আমিন। বেশ ভদ্র গোছের ছেলে। বসার ঘরে আলাপরত মারুফের মনে মনে বেশ পছন্দ হলো। তিহার সাথে অন্দরে এসেছেন বাকি দুজন অতিথি। পাত্রের খালা ও খালার পুত্রবধূ। তিহা তাদের নিজের ঘরে এনে বসালো। কথায় বার্তায় আর আচরণ পরখ করে মৃদু আভাসও পেয়ে গেল দুজনের মানসিকতার। ওরা বোধহয় কিঞ্চিৎ সঙ্কীর্ণ ঘেঁষা। খালাতো ভাইয়ের বউটি ঘুরে ঘুরে দেখছে তিহার কামরা আর কামরার সমস্ত আসবাব। মেয়েটির চোখে সজাগ সন্ধানী দৃষ্টি। খালা ভদ্রমহিলাটি যেন আরেক ধাপ এগিয়ে। আসার পর থেকে এমন ভাব করছেন যেন তিহা আর তিহাদের গোটা বাড়িটা অচ্ছুৎ। এখানে পা ফেলে তিনি এদের ওপর বড়ই দয়া করেছেন। তিহা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। মারুফ ফোনে এনাদের মৃদু আভাস দিয়েছিলেন তিতিক্ষার অতীতের ব্যপারে। হয়তো এজন্যই ভদ্রমহিলার আচরণে এই অসঙলগ্নতা।

মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা একসময় চোখ স্থির করলেন তিহার দিকে। হাসি হীন নির্বিকার মুখ। বললেন, ‘মেয়ে কোথায়? নিয়ে আসো দেখি।’

দুজনের আচরণ খেয়াল করতে থাকা তিহা সম্বিত ফিরে পেয়ে বিনীত ভাবে হাসে,’জি নিয়ে আসছি।’

নিজের ঘরে ওই দুজন মানুষের সামনে নিয়ে যাবার আগে দরজার কাছে এসে তিহা বোনের হাত ধরল। তাকাল বোনের বিবর্ণ হয়ে আসা ত্রস্ত মুখের ওপর।
‘একদম নার্ভাস হবি না। বুবু আছি তো তোর সঙ্গে। শুধু খানিকক্ষণ ওদের পাশে বসতে হবে। পারবি না?’

তিতিক্ষার মুখে অনুমাত্র দোলাচল নেই। উত্তরের আশা নেই বুঝতে পেরে হাত ধরে বোনকে নিয়ে চলল তিহা।

‘আসো.. বসো আমার পাশে।’ ভদ্রমহিলা হাত বাড়িয়ে দিলেন তিতিক্ষার দিকে। নিশ্চল মূর্তির মতো তিতিক্ষা পাশে বসল। শাশুড়ী বউমা দুজনেই বিস্মিত নেত্রে ওকে দেখছেন। ব্যাপার টা খেয়াল করে মৃদু অস্বস্তি তাড়া করে বেড়াতে থাকে তিহাকে। মানুষ গুলোর চাহনি যেন কেমন। তিতিক্ষার পা থেকে মাথা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

সহসা ভদ্রমহিলা তিতিক্ষার হাত ধরলেন। মুখে ম্লান হাসি জিইয়ে রেখে বললেন,’ দেখি… তোমার চুল গুলো দেখি।’ কথাটা শেষ করেই অনুমাত্র আভাস না দিয়ে ওদের দুইবোনকে হতভম্ব করে একটানে মাথার অবগুণ্ঠন খুলে অসংকোচে হাত রাখলেন তিতিক্ষার চুলে। খানিকক্ষণ পরখ করার পর মৃদু স্বরে ভেসে এলো মন্তব্য,’সবই তো ভালো…’ মুখে ফুটল অস্ফুট পরিতৃপ্তির হাসি।

অদূরে দাঁড়ানো তিহা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে। খেয়াল করে তিতিক্ষার মুখের শিথিলতা হারিয়ে ক্রমে যেন একটু ক্রুর ভাব ফুটে উঠছে। মৃদু ত্রাসভাব ছলকে ওঠে তিহার বুকে। জন্মকাল থেকে শহুরে জীবন যাপনে অভস্ত্য ওরা দুইবোন মেয়ে দেখার এসব উদ্ভট আচার ব্যবহারের সঙ্গে আদতেই অপরিচিত। তার ওপর সকল কিছুতে তিতিক্ষার স্পর্শকাতর হয়ে পড়ার ওই প্রবণতাটা। স্বাভাবিক ভাবেই এসব আচরণ দুবোনের চোখে ভীষণ দৃষ্টিকটু। এমনকি তিহার মৃদু আশঙ্কাও হলো, তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের বোন হয়তো যেকোনো সময় রাগে ফেটে পড়বে।

তিতিক্ষা কে দেখেই কিনা কে জানে, কিছু সময় যাবার পর ভদ্রমহিলার মুখের রূঢ়তা আস্তে আস্তে কমে আসছিল। সহজ স্বাভাবিক আলাপে অভস্ত্য হচ্ছিলেন তিনি। নিজের ভাগ্নে সম্পর্কে একটা দুটো কথাও বলতে আরম্ভ করলেন। পাশে বসা তিতিক্ষা আগের মতই নির্বিকার নিঃশব্দ। সৌজন্যতা বজায় রাখতে অল্পস্বল্প হাসতে হচ্ছিল তিহাকে। অকস্মাৎ ভদ্রমহিলার একটা কথা শুনে থমকে গেল তিহা। ভাগ্নের কথা বলতে গিয়ে তিনি হঠাৎ রাজন নামটির উল্লেখ করলেন। দীর্ঘ দিন ধরেই এই বাড়িতে রাজন নামটির উচ্চারণ কঠিন ভাবে নিষিদ্ধ। এই নিয়ম আপনাতে তৈরি হয়েছে, আর বেশ নিষ্ঠার সাথেই এতকাল পালিত হয়ে এসেছে। ভদ্রমহিলার কথার ঢঙে তিহা বুঝলো রায়হানুল আমিনেরই অন্যনাম রাজন। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঢোক গিলল তিহা। স্পষ্টতই টের পেল এই সম্মন্ধ এগোনোর আর কোনো আশা নেই।

তখনো পরম মমতা ভরে ভাগ্নের নাম উচ্চারণ সমেত নানারকম সুনাম গেয়ে যাচ্ছেন তার খালা। পাশে বসা তিতিক্ষার মুখ ক্রমে ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। বহুদিন পর ওই নামটা কানের কাছে এত বার শুনে বিভীষিকাময় স্মৃতি পুনরবার জাগরূক হয়ে উঠছে ওর মানসপটে। তিহা কি করবে সহসা ভেবে পেল না। বোনের রক্ত সরে যাওয়া মুখের পানে বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। কিছু বলতে গিয়ে তোতলাতে লাগলো।

ভদ্রমহিলার কথা আর তিহার বিমূঢ়তা সব স্থানু করে দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো তিতিক্ষা। মুখ অস্বাভাবিক কঠিন, কপালে ঘাম, আর ফুলে ওঠা শিরার রগ… সবকিছু নিয়ে কম্পিত স্বরে ঘোষণা করল,’আমি আসছি।’

রাজনের খালা ভদ্রমহিলা টি নিতান্তই সরল অথবা অত্যধিক চতুর। তিতিক্ষার রাগ তিনি টের পেলেন না কিংবা ইচ্ছে করেই তার পরোয়া করলেন না। অতর্কিতে ওর হাত ধরে ফেলে ভাবলেশহীন গলায় বললেন,’আরো কিছুক্ষণ বসে যাও।’

এই অনধিকার চর্চা মানতে পারল না তিতিক্ষার নাজুক মন। ক্রোধে শক্ত হয়ে এলো তার হাতের মুঠি। পেছন ফিরে স্থবির স্বরে বলল,’হাত ছাড়ুন।’

দৃষ্টিতে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রমহিলা।
‘ওমা! এমন করছো কেন? রাগ করলে নাকি?’

তিতিক্ষা আগের কথার পুনরাবৃত্তি করল,’হাত ছাড়ুন আমার।’

‘কি রাগ মেয়ের! অত কাহিনি ঘটাবার পরেও দেখছি তেজ কমেনি!’

যেন আক্রোশে ফেটে পড়ে কেউ তিতিক্ষার গালে প্রবল এক চপটা’ঘাত বসাল। পেছন ফিরে প্রস্তরমূর্তির ন্যায় মধ্যবয়সীর পানে তাকিয়ে রইল তিতিক্ষা।
‘তাকিয়ে আছো কেন? কিছু মিথ্যে বলেছি? অত বাজে অতীত যার সে তো সবার পা সেপে থাকবে। উল্টো তুমি কিনা আমার সাথেই তেজ দেখাচ্ছো?’

বুকটা ধড়াস করে ওঠে তিহার। এসব কি হচ্ছে ঘরে! এসবকিছু কি সত্যিই ঘটছে? কোথায় চারিদিকে খুশির জোয়ার বইবার কথা ছিল আজ.. আর সেখানে কিনা তার বোনকে অতীতের কথা তুলে চরম ভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে..
আবারো… আবারো এরকম একটা মানসিক আঘাত পেল তিতিক্ষা। পেল তার বড় বোনেরই জন্য। ইয়া আল্লাহ, এই সব মিথ্যে হয়ে যাক। যা কিছু আজ হলো সব তুমি দুঃস্বপ্নের মত ক্ষণস্থায়ী করে দাও। কিচ্ছু চাই না। দরকার নেই আমার বোনের বিয়ের। শুধু এই লাঞ্চনা থেকে তুমি আমার বোনকে উদ্ধার করো!’

রাজনের খালা অতটুকুতে থামলেন না। বয়সজনিত কর্তৃত্বের নিরিখেই তার মনে হলো মা হীনা এই দুই তরুণী কে আরো কিছু সৎ উপদেশ দেয়া উচিত। কড়া গলায় আরো দু চার কথা শুনিয়ে তিনি খান্ত হলেন। নিরবে সবটা গলাধঃকরণ করল তিতিক্ষা। কথা শেষ হলে শান্তভাবে একবার তাকাল বোনের মুখে। তারপর ধীরস্থির পদক্ষেপে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার কয়েক মুহুর্ত পর তিহা শুনলো পাশের ঘরের দরজাটা মৃদু শব্দে বন্ধ হয়ে যেতে।
চলবে…

দূর আলাপন পর্ব-২০+২১

0

দূর আলাপন ~ ২০
____________________________
নিনাদের ঘুম ভাঙে বিদঘুটে গরমে। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাসে তাপদাহের ছোঁয়া। হাতের ভাজে চিটচিট করছে ঘাম। মস্তিষ্কটা নাকাল, গায়ে দীর্ঘ নিদ্রাজড়িত আলস্য। ঘুমের রেশ লাগা বোজা বোজা চোখে প্রথমে সে কিছু বুঝতে পারে না। ভাবে আমেরিকাতেই আছে এখনো। তবে গরমটা যেন এখানকার আবহাওয়ার তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি। রুম হিটার ছাড়া যেখানে চলে না একমুহুর্ত আজ হঠাৎ সেখানে চলছে ফ্যান….

ক’টা বাজে জানা দরকার। ক্লান্তি ঝেড়ে উঠে বসে নিনাদ। পাশে হাত রাখতেই ফোনটা পেয়ে যায়। সকাল আটটা ত্রিশ। সময় দেখে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘরে তাকিয়ে থমকে যায়। এ কোথায় সে! কয়েক পল কাটে হতবিহ্বলতায়।
ঘিঁয়ে রঙা সেই পুরনো পলেস্তারা খসা দেয়াল, খয়েরী রঙের কাঠের আসবাব, আকাশী রঙা চাদর, পর্দা… এ-তো তার নিজের ঘর!
এখানে এলো কবে? নাকি স্বপ্ন দেখছে? মাথাটা ভীষণ ফাঁকা লাগে নিনাদের। দুহাতে কপাল চেপে ভাবতে চেষ্টা করে আদত ব্যাপার টা কি।
ধীরে ধীরে… ক্রমে ক্রমে একের পর এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা জোড়াতালি দিয়ে গোটা চিত্রটা নিনাদের চোখে পরিষ্কার হয়। হ্যাঁ, সে নিজেই এসেছিল বাংলাদেশে। এসেছিল রবিবার বিকেলে। তারপর… আগেপিছে কিছু না ভেবেই চলে গেছিল তিহাদের বাড়ি। গিয়ে… নিনাদের মনে পড়ল না যাবার পর কি হয়েছিল আর নিজের বাসাতেই বা ফিরে এসেছে কিভাবে!

তবে আস্তে আস্তে সেসবও স্মরণে আসে। মনে পড়ে একটা দুর্বিনীত অসহায় ঘোরের মধ্যে বিকেলে পথে নেমেছিল সে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটতে হাটতেই বোধহয় একসময় একটা সিএনজি ডেকে ফিরে এসেছিল বাড়ি। তারপর… তারপর… ফুআম্মা আর আফরিনের অজস্র প্রশ্নের মুখোমুখি। কোনোকিছুর প্রত্যুত্তর না করে নিনাদ চলে গেল নিজের ঘরে। জেটলেগের ক্লান্তি, মানসিক অস্থিতিশীলতা আরো যেন কি কি… সব মিশে একাকার করে ফেললো নিনাদের অসুস্থ মনকে। পোশাক পর্যন্ত বদলানোর শক্তি রইলো না। বিছানায় শুতেই গহন ঘুমের কিংবা অচৈতন্যের রাজ্যে ডুবে গেল সে…

এক সন্ধ্যা থেকে শুরু করে সকাল পর্যন্ত ঘুমিয়েছে নিনাদ। কি সর্বনাশ! তিন ওয়াক্তের সলাত কাযা করেছে। ফুআম্মাও নিশ্চয় চিন্তায় পাগল হয়ে আছেন। তড়িঘড়ি করে নামতে গিয়ে কবজিতে অকস্মাৎ একটা যন্ত্রণার ধাক্কা টের পায়। সঙ্গে সঙ্গে চোখ চলে যায় ব্যান্ডেজের দিকে। ভুলেই গেছিল হাতের ক্ষতটার কথা।
ঠিক এক বছর এক মাস পর বাংলাদেশে ফিরল। ভেতরে বাহিরে ক্ষত নিয়ে। এমনকি ঘরে ফিরে পরিবারের মানুষদের সঙ্গে ঠিকঠাক কথাও বলেনি। ডুবে গেছিল নিজস্ব দুঃখবোধের নিভৃত আলয়ে। ফুআম্মা আর আফরিনের মনে নিশ্চয়ই হাজার প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে ওর উদ্ভট আচরণ। ফুআম্মাকে দেয়ার মতো একটা যুতসই ব্যাখা এখন দ্রুত দাঁড় করানো প্রয়োজন।

আর কিছু ভাবার আগেই দরজার নব নড়েচড়ে ওঠে। নিনাদের যতদূর মনে আছে কালরাতে দরজার নব ভেতর থেকে সে বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিল। বোধহয় এতক্ষণে ওরা চাবির সন্ধান পেয়ে গেছে। দরজা খুলে গেল। ওপাশে আফরিন। হতবাক হয়ে একপলক তাকিয়ে থাকল তার পানে, তারপর দ্রুত ঘুরে চলে গেল। কিয়ৎক্ষণ পরেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন শিউলি। পেছন পেছন আফরিন।

চোখের পানি, নাকের পানি এক করে অবুঝ মেয়ের মতো নিনাদকে ধরে শিউলি কিছুকাল আহাজারি করলেন। সংশয়, দুশ্চিন্তা ভরা প্রশ্ন করে করে নিনাদকে করে তুললেন ব্যতিব্যস্ত।

.

তখন সকাল দশটা। ফুআম্মার জোড়াজুড়িতে নিনাদকে গোসল, খাওয়া দুটোই সম্পন্ন করতে হয়েছে। একফাঁকে নিনাদ পড়ে নিয়েছে কাযা সলাত গুলো। ফুআম্মা এতক্ষণ পাশে পাশেই ছিলেন, সবে গেলেন আফরিনের রান্না তদারক করতে। দীর্ঘদিন পর ছেলে প্রবাস থেকে ফিরেছে। ভালো কিছু রান্না না হলেই নয়।
যাবার আগে অবশ্য ঘরের সব কটা জানালা খুলে দিয়ে গেছেন। গ্রিলের ফাঁক গলে আসছে মন ভালো করা সকালের মিঠে রোদ।
ঢাকার সাদামাটা এই সকালের সময়ের ছবি আমেরিকায় থাকতে প্রায় রোজ মনে পড়তো নিনাদের। অথচ আজ জানালার পাশে বসে সুতীব্র আলোক রশ্মিতে অবগাহন রত হয়ে এসব দৃশ্য ঠিক তেমন উপভোগ্য মনে হচ্ছে না। মাথার দুপাশে চিনচিনে ব্যথা। কড়া এককাপ ব্ল্যাক কফি এই মুহুর্তে বিশেষ প্রয়োজন। সবচেয়ে ভালো হতো যদি নিজে বানিয়ে খাওয়া যেত। গুড স্ট্রিডের ওই একফালি উঠোন সমেত বাড়িতে যা সে রোজই বানাতো।
কিন্তু এখন ওর বিছানা থেকে নামা আর হাটাচলার ব্যপারে ফুআম্মা কড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। অগত্যা বিছানার বাজুতে মাথা হেলিয়ে নিনাদ পুনরায় চোখকে বিশ্রাম দেবার চেষ্টায় রত হয়। তখনো মনের মধ্যে দাপিয়ে বেড়াতে থাকে তীব্র এক অস্থিরতা। নিনাদের ঘুমন্ত বিবেক ওকে স্মরণ করিয়ে দেয়, শুধু প্রিয় মানুষ গুলোর সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোর নিমিত্তে সে এদেশে ফিরে আসেনি।

পলকা তন্দ্রাঘোরে নিনাদ একবার শোনে দূরে… বহু দূরে একনাগাড়ে কেউ ওকে ডেকে চলেছে। মিহি স্বরের মন্দ্রিত আহ্বান। খানিক পর একটা মন্থর পায়ের ধিমিধিমি আওয়াজ ক্রমে নিকটবর্তী হয়। বিচরণ করতে থাকে ওর ঘরজুড়ে। সে হাটছে… ঘরময় মৃদুমন্দ সুরের লহরী, বাতাসে তার নিশ্বাসের সৌরভ হাসনাহেনার গন্ধের মতো ভাসে… অন্যমনে একেবারে অকারণে সহসা ডেকে ওঠে নিনাদ, ‘তিতিক্ষা…..’

দরজা ঠেলার কর্কশ শব্দে ভাঙে তন্দ্রা ওর। নিনাদ সচকিত হয়ে তাকায়। ঘরজুড়ে সমান লয়ে রিমঝিম নেচে চলেছে আলো এবং অন্ধকার। যে এগিয়ে আসে তাকে দেখে এতক্ষণ পরে নিনাদের বুক চিরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। পলকা অভিমানে মুখ ফেরায় সে। তিহা বিছানা থেকে অনেকটা দূরে, একখানা কাঠের চেয়ার টেনে বসে। ক্লান্ত, গম্ভীর মুখ। যে মুখ অনেকদিন হাসে না, আনন্দ কলরোলে উচ্ছ্বাসিত হয় না, যার বুকের হিমে তরঙ্গ ছলকে ওঠে না যখন তখন। পুরনো বন্ধুর এই ক্লেশ জড়িত কান্তি দেখে তার ভেতরের অবস্থা খানিকটা আন্দাজ করে নেয় নিনাদ।

‘কেমন আছিস?’ পরিশ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটা বাতাসে ভর করে নিনাদের কানে এসে থামে।

‘ভালো… আলহামদুলিল্লাহ।’ থেমে থেমে বলে নিনাদ। ‘তুই?’

‘আমিও… আছি একরকম… ‘ সবসময় বলা তিতিক্ষার একটা কথা মনে পড়তেই তিহা সাথে যোগ করে ‘আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল’

সৌজন্য জ্ঞাপনের পরই কথা হারিয়ে ফেলে ওরা। অথচ আগে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত বন্ধুরা কেউ একবার কথা শুরু করলে। সেসব দিনের কথা ভেবে আজকাল খানিকটা আফসোস হয় তিহার। তার জীবন যাপনের পদ্ধতিটা বোধহয় বড় বেশি হালকা ধাঁচের ছিল। কোথাও কোনো গভীরতা নেই, স্থিরতা নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই। ছেলেবেলা থেকেই বেশ একটু বেপরোয়া ছিল ওর চলাফেরার ধরন। বড় বেলায় এসেও যখন ইচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরেছে, সন্ধ্যারাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছে ক্যাম্পাসে, মর্জি হলেই খেতে চলে গেছে কোনো নামি-দামি রেস্তোরাঁতে। ইচ্ছেমতো বাঁচতে গিয়ে জীবনবোধ টোধ আর তেমন ভাবে জন্মাতে পারে নি। নিছক রংতামাশায় ডুবে থেকে সব একেবারে রসাতলে গেছে।

কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকে তিহা। একসময় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে,’কাল এসে অনেকক্ষণ বসেছিলাম আমি আর বাবা। তুই সাড়া দিস না, দরজা খুলিস না…ওদিকে ফুআম্মা কেঁদেকেটে একাকার।’

‘কিচ্ছু টের পাইনি৷ রুমে এসেই শুয়ে পড়েছিলাম। একেই ধরল জেট লেগ, তার ওপর আগের রাতটাও নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে ফ্লাইট ধরার জন্য। সব মিলিয়ে খুব টায়ার্ড ছিলাম।’

‘হাতের আঘাত টা কবেকার? হাসনাত তো এসব কিছু বলেনি!’

‘বলতে আমিই নিষেধ করেছিলাম।’

‘কেন?’

নিনাদ প্রতুত্তর করল না।

নিশ্বাস ফেলে পুনরায় কথা শুরু করল তিহা,’ফুআম্মা খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন গোটা ব্যাপার টা নিয়ে। ওখানে তোর অসুস্থ হয়ে পড়া… তারপর না বলেকয়ে হঠাৎ দেশে ফিরে আসা…

তিহার শেষ কথাটা শুনে নিনাদ বাঁকা হাসে।
‘আমার চলে আসায় ফুআম্মা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ! অথচ যাবার বেলা ফুআম্মার আপত্তিই ছিল সবচেয়ে প্রবল।
ছাড়, তোর কথা বল? আমি আসাতে তোরও কোনো অসুবিধা হয়নি তো? না মানে এখন তো আমি আছি, বোনের বিয়ে দিতে চাইলে হয়তো যেকোনো সময় বেগড়া দিয়ে বসতে পারি!’

একটু আহত ভাব ফুটে ওঠে তিহার চোখে। অস্ফুটে বলে, ‘নিনাদ!’
তারপরই গুম হয় দীর্ঘ সময়ের জন্য। মুখ নিচু, চোখের পলক পড়ছে না। ভেতর ভেতর তিহা পুড়তে থাকে তীব্র অনুতাপবোধে। ভুল কিছু তো বলেনি নিনাদ। একটা সময় সত্যিই এমন ছিল তিহার ধারণা যে তিতিক্ষার বিয়েতে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে নিনাদ। কিন্তু খেলার ছক এভাবে উলটে যাবে কে জানতো?
যা কিছু আজ হয়েছে তার পেছনে সবচেয়ে বড় দোষটা বোধহয় তিহারই। অস্বীকার করতে পারে না সে। দু দুটো মানুষের জীবন জ্বলে পুড়ে তচনচ হয়েছে। আর মাঝে দাঁড়িয়ে তিহা ওদের অঙ্গার হতে দেখছে।

জানালার বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর ঘেরা সকাল হঠাৎ ঘনঘোর হয়ে উঠল। অকস্মাৎ আলোর মাত্রা কমে এলো ঘরে। দুচোখে অশ্রুসায়র নিয়ে মুখ তুললো তিহা। প্রায়ান্ধকার ঘরেও যা নজর এড়ালো না নিনাদের।
‘নিনাদ, ভাই আমার, আমায় ক্ষমা করে দে।’ তিহার বাষ্পরুদ্ধ স্বরে আর্তনাদের মতো শোনালো কথাগুলো।

সহসা প্রতুত্তর করল না নিনাদ। যেন জানে এখনি তিহা আবার কিছু বলবে।
‘আ.. আমার ভুলের জন্যই এসব হয়েছে। আমি…. আমি… আমার বোনের খেয়াল রাখতে পারিনি। অথচ ও ছিল আম্মার রেখে যাওয়া শেষ আমানত…
আমার তিতির বিয়ে হবে… কত আলো জ্বলবে, মানুষ আসবে… এসবের উচ্ছ্বাসে অনেক জটিল বাস্তবতা আমার নজর এড়িয়ে গেছিল। ভুলে গেছিলাম সেই মানুষ রূপী হায়নার কথা, তার হুমকির কথা। শেষ পর্যন্ত আমার ভালো বোনটাকে সেসবের খেসারত দিতে হলো… ‘ তিহা হু হু করে কাঁদছে। কান্নার সঙ্গে ঝরছে তার বুকভাঙা হাহাকারের বেদনা। কান্নার রূপ এমন করুনও হয়! বড় কষ্ট হলো নিনাদের। ব্যস্ত গলায় বলল,
‘আহা… কিসব ছেলেমানুষী তিহা। দোষ কেন তোর হতে যাবে? ভাগ্য বলেও তো কিছু থাকে। তাছাড়া… আমিই বা কে যাকে তুই কৈফিয়ত দিচ্ছিস?’

সহসা মুখ তোলে তিহা। স্বরে প্রকাশ পায় বিস্ময়, ‘তুই ওর কেউ না?’

নিনাদ ওর ভুল ধারণা ভেঙে দেয়, ‘না। আমি শুধু তোর ভালো বন্ধু।’

তিহা মুহুর্তকাল স্তব্ধ থাকে,’তবে কেন ওর বিপদের কথা শুনে দূরদেশ থেকে ছুটে এলি? কেন আমার বোনের জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ে তোর নার্ভাস ব্রেকডাউন হলো?’

কিছু কথার উত্তর নিনাদের কাছে নেই। গম্ভীরতার চাদরে নিজেকে আড়াল করে তাই সে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে।
‘প্লিজ তিহা এই নিয়ে আর কথা নয়। যেকোনো সময় ফুআম্মা চলে আসবেন।’

‘সেই ভালো। বোন আমার, সে সম্পর্কিত যাবতীয় বোঝাপড়াও আমারই করা উচিত। তুই সবে ফিরলি। কিছুদিন রেস্ট নে। সামনে বিয়ে, তা নিয়ে ভাব। নতুন জীবনের শুরুটা যেন নির্ঝঞ্ঝাট হয় দুআ রইল। ভালো থাকিস।’ দ্বিতীয় কোনো কথার সুযোগ না দিয়ে তিহা ঘর ছাড়ল।

চলবে…..।

দূর আলাপন ~ ২১

____________________________
বুকভরা বেদনার ফুলঝুরি নিয়ে বাড়ি ফেরে তিহা। নিনাদ বলেছে সে শুধু তিহার ভালো বন্ধু। আর কোনো সম্মন্ধ নেই তিহার পরিবারের সঙ্গে। হ্যাঁ, তাই তো! এমনি তো হবার কথা। অকারণে তিহা বেশিকিছু আশা করে বসেছিল ওর কাছে। আবেগের ঘোরটপে বাঁধা পড়ে বিস্মৃত হয়েছিল বন্ধুত্বের সীমারেখা।

এই ভুল তিহা দ্বিতীয় বার করবে না। আর কখনো যেচে যাবেনা নিনাদের কাছে। নিনাদের সামনে ভালো একটা সময় আসছে। সারাজীবন নিবিড় একাকীত্বের কষ্ট সয়েছে ছেলেটা। শীঘ্র শুরু করতে যাচ্ছে নতুন সংসার। এইবার ওকে ওর মতো একা ছেড়ে দেয়া উচিত। কেন ওর ভালো সময়ের আগে নিজের দুঃখের ঝাপি খুলে বসে নিনাদের চিরকালের কষ্টসহিষ্ণু মনটাকে আরো একবার অনবদমিত করে দেবে তিহা?

তারচেয়ে এইবার গুরুত্বের সাথে বোনের জীবন গোছানোর কথা ভাবা যাক। একটা নিজের সংসার, নিজের মানুষ… তিতিক্ষার মতো মেয়েদের জন্য এসব চাওয়া কি খুব বেশি কিছু? ভীষণ যত্ন আর ভালোবাসায় ভরপুর আপনার একটা সংসার কে না চায়? অতীতে যা কিছু হয়েছে তাতে তিতিক্ষার তো কোনো দোষ ছিল না। তিহা কানাঘুঁষোয় শুনেছে রাজন নাকি বিয়ে করেছে। বউ নিয়ে সেদিন ঘুরেও এসেছে বালি থেকে। অথচ.. যে মেয়েটার জীবন সে তচনচ করল, গোটা সমাজের কাছে সেই মেয়ে আজ ঘোর কলঙ্কিনী। ওর ঘর থেকে বের হওয়া বারণ, বিয়ে করা বারণ, সামান্য একটু হাসাও বারণ। তাহলেই লোকে বলবে, ‘নির্লজ্জ মেয়ের অবস্থাটা দেখো। এত বড় ঘটনার পরেও ওই মুখে এখনো হাসি আসে! ‘

অথচ যার দোষে এই কলঙ্ক হলো সে আজ ষোলো আনা স্বাধীন, কেউ ওর দিকে আঙুল তুলছে না, কটু কথা শোনাচ্ছে না। তৎপরিবর্তে মজলুমকে নিষেধের যাতা কলে প্রতিনিয়ত পিষ্ট করে যাচ্ছে এই সমাজ। আজকাল তিহার ঘৃণা হয় এই সমাজ আর সমাজের সব নিয়ম কানুনের প্রতি।

.

বাসায় ফিরতে ফিরতে বেলা একটা বেজে গেল। দরজা খুললেন মারুফ। হাতে পত্রিকা, মুখে মৃদু হাসিখুশি ভাব। কারণ টা তিহার বোধগম্য হয় না।
‘কি অবস্থা দেখে এলে ওর?’

তিহা নিশ্বাস ফেলে বলে,’ভালো, বেশ ভালো বাবা।’

‘আলহামদুলিল্লাহ, আচ্ছা এখন ভেতরে যাও মা।’

‘যাই..’ মাথা নুইয়ে ডাইনিং ছাড়িয়ে তিহা ভেতরের দিকে পা বাড়ায়। ডাইনিংয়ের পরেই রান্নাঘর। সেখান থেকে ভেসে আসছে টুকটাক আওয়াজ। ভেতরে এক পা ফেলে মুহুর্তের জন্য থমকায় তিহা। চুলার পাশে দাঁড়িয়ে বেশ মন দিয়ে তিতিক্ষা কি যেন রাঁধছে। পেছনে নিরাপদ দূরত্বে থেকে উৎসুক ভাবে মিমির রান্না দেখছে ছোটন।

তিহার মনে পড়ে না গত ছ মাসে একবারের জন্য বোনকে রান্নাঘরে দেখেছে কিনা। আজ তবে হঠাৎ…. তাহলে কি ওর বোনটা একটু একটু করে সুস্থ হতে আরম্ভ করেছে? ফিঁকে একফালি আশার আলো তিহার মনে ছলকে ওঠে। পেছন ফিরে ছোটনকে কি যেন বলতে গিয়ে সহসা তিহাকে দেখে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে পড়ে তিতিক্ষা। কথাটা মাঝ পথে থাকতেই ভেতরে টেনে নেয়। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায় চুলোয় পাশে। বুবুর রান্নাঘর, বুবুর সংসার। দীর্ঘ সময়কাল ধরে এসব একা সামলাচ্ছে তো বুবুই। এতদিন পর আজ হঠাৎ এখানে তিতিক্ষার আসাটা হয়তো অনভিপ্রেত লাগবে বুবুর কাছে। স্বাভাবিক ভাবেই নিজের গোছানে সংসারে মেয়েরা অন্যের কর্তৃত্ব অপছন্দ করে।

তিহা ততক্ষণে বোনকে দেখে নিজের জায়গায় বিমূঢ়, ‘কিরে, রান্নাঘরে কি করছিস তুই?’

বোনের বলার ধরনে তিতিক্ষার অস্বস্তি আরো বাড়ে।
জবাবদিহির মতো খুন্তি সমেত হাতটা নামিয়ে ফেলে বলে,’ছোটনের খুব খিদে পেয়েছিল। বুয়া খালা আসেননি। ছোটন বলছিল নুডুলস খাবে, তাই….’

‘তুই নুডুলস রেঁধেছিস! দেখি ‘ ঔৎসুক্যে তিহা ঝুকে পড়লো প্যানের ওপর। কুচনো আদা, ছোট ছোট মাংসের ফালি, আর ডিম সমেত তিতিক্ষার এই নুডুলসের রেসেপি ছোটনের ভীষণ পছন্দ।

‘কি সুন্দর সুঘ্রাণ আসছে রে.. আমিও ভাগ পাব তো?’

বুবুর হালকা মেজাজ বুঝে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তিতিক্ষা। ম্লান হেসে গিন্নির মতো ভারিক্কি আওয়াজে বলে,’সবাই ভাগ পাবে। বসার ঘরে চলো।’

‘তোরা যা, আমি এক্ষুনি বোরকা টা ছেড়ে আসছি…’

.

বারান্দায় বসে মারুফ পা নাচাচ্ছেন। হলুদাভ ল্যাম্পপোস্টের মায়াবী আলো চুইয়ে আসছে ভেতরে। সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। কামিনী ফুলের সুবাস বয়ে আনছে ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস। ফুড়ফুড়ে মেজাজে থাকা মারুফ আপন মনে একটু গুনগুনিয়ে উঠলেন। আজকের দিনটাই অন্যরকম। সব ভালো ভালো ঘটনার সমাহারে পূর্ণ বিশেষ একটা দিন। তিতিক্ষার নিজের হাতে নাস্তা করে খাওয়ানো যেমন অবিশ্বাস্য ছিল তার চেয়েও অবিশ্বাস্য ছিল ডাইনিংয়ে সবার সাথে একসঙ্গে ওর খেতে বসা।

‘বাবা আসবো?’ দু কাপ চা হাতে তিহা দাঁড়িয়ে আছে।

‘আসো মা।’

‘আজ যে তোমায় খুব খুশি দেখছি বাবা?’

মারুফ আহ্লাদিত হলেন, ‘আমার তিতি মাকে দেখেছিস? আজ কেমন স্বাভাবিক ব্যবহার করছিল!’

‘দেখলাম। কিন্তু আল্লাহ না করুক যদি আবার বিগড়ে যায়… ‘

‘সে সম্ভবনাও ফেলে দেয়া যায় না। তবে তিতি আজকাল আগের চেয়ে খানিকটা স্বাভাবিক। তাই না?’

তিহা অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়লো, ‘হ্যাঁ। আ..
বাবা… তিতিকে নিয়ে একটু কথা ছিল। তোমায় সময় হবে?’

‘বসেই তো আছি। কি কথা?’

‘একটা জিনিস খেয়াল করেছো বাবা? চারপাশে এখন বিয়ের খুব ধুম। আফরিন মেয়েটার বিয়ে হলো, সামনে নিনাদেরও বিয়ে। তিতিক্ষার কাছে দূরের যে গুটিকয়েক বান্ধুবি ছিল শুনেছি ওদেরও প্রায় সবার বিয়ে হয়ে গেছে। অনার্সে ওঠার পর সহশিক্ষায় থাকবে না বলে তিতি পড়া ছেড়ে দিল। পড়লে এতদিনে হয়তো ওর অনার্সটা শেষ হয়ে যেত। ওর বয়সী মেয়েরা এখন কি সুন্দর গুছিয়ে সংসার করছে।
আর আমার বোনটা…. তিতি তো পুরোপুরি পাগল নয় বাবা। এক বড় বিপর্যয়ের ধাক্কায় হয়তো খানিকটা মানসিক ভাবে এলোমেলো। কত ত্রুটিপূর্ণ ছেলেমেয়ের তো বিয়ে হয়। আমাদের তিতির হতে পারে না?’

হাসিখুশি মারুফ গম্ভীর হলেন, কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন,’খুবই জটিল প্রশ্ন রে মা। এই যুগে ভালো ছেলের সন্ধান পাওয়া এমনিতেই দায়। তার ওপর তিতির অতীত জানার পর হয়তো কেউ আর রাজিই হবে না। আমার মেয়ের কোনো দোষ না থাকুক। কিন্তু সব কলঙ্কের দাগ তো মুছে ফেলা যায় না। তাছাড়া অত ভালো মনের ছেলে পাব কই বল?’

সেই তো… জেনেশুনে কে বিয়ে করবে ওর বোনকে? এমন কত মেয়ের কথা শোনা যায় সেচ্ছায় চরিত্রহনন করেও যারা শেষমেশ বাবা মায়ের ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে সাচ্ছন্দ্যে বিয়ে করে হেসেখেলে সংসার ধর্ম করছে অথচ কোনো অন্যায় না করেও সমাজের সব তিতিক্ষাদের জীবনটা হয় অভিশপ্ত।

‘তবু একবার চেষ্টা করে হয়তো দেখা যেতে পারে। বয়স তো আমারো কম হলো না। আর কদিন বাঁচি না বাঁচি… খুব দুশ্চিন্তা আজকাল। মেয়েটার একটা গতি করে যেতে না পারলে..

‘চেষ্টা করে দেখবে বাবা?’

‘করবো ইন শা আল্লাহ।’ মারুফ নিবিড় হন। মুখে চিন্তার ছায়া। তিহাটা আজ হঠাৎ বোনের বিয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল কেন বুঝতে পারছেন না।

তিহাও বলতে পারল না ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত আঘাতই ওকে আজ হঠাৎ বোনের ভবিষ্যত ভাবনায় দৃঢ় হতে উদ্দীপ্ত করেছে।

.

শুরুতে মেয়ের কথা শুনে দূরভিশঙ্কায় অস্থির হলেও তিতিক্ষার বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে মারুফ প্রায় সারারাত ভাবলেন। বার্ধক্যের শরীর, সহজে ঘুম আসতে চায় না। খোলা বারান্দায় বসে মেয়ে দুটির ভবিষ্যত চিন্তায় কেটে গেল অর্ধেক রাত।
ফজরের পর চা খেতে বসে বড় মেয়েকে প্রথম নিজের সিদ্ধান্তের কথাটা জানালেন।

‘তিতি কোথায়? এখনো ঘরে?’ মারুফের স্বরে কিঞ্চিৎ ফিসফিস ভাব।

‘হ্যাঁ, কুরআন পড়ছে।’

‘আচ্ছা, এখানে বসো, কথা বলি।’

তিহা বাবার পাশে চেয়ার টেনে বসে,’বলো বাবা।’

‘মা রে শোন, সংসার হলো জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষাক্ষেত্র। সংসারের প্রয়োজনে মানুষ বদলায়, বদলাতে হয়। এমন কত বাউন্ডুলে ছেলেকে দেখেছি সংসারে পড়ে একেবারে দায়িত্বজ্ঞান বোধ সম্পন্ন পুরুষ হয়ে উঠেছে।
আমার তিতির জীবনের দুঃখ ফেলনা নয়, তবে চেষ্টা করলে হয়তো এই অসীম দুঃখবোধকেও খানিকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। তিতির কাছে আর কোনো ভালো থাকার উপকরণ নেই বলেই দুঃখটাকে কেন্দ্র করে সে সারাক্ষণ ঘোরে।
এইযে একা একা কাঁদা, কথা বলা, ভাঙচুর করা… বাস্তবিক জটিলতায় পড়লে নিজের দুঃখ নিয়ে এত স্পর্শকাতর হবার সময় কি ওর হতো?
কথাগুলো হয়তো রূঢ় শোনাচ্ছে। না রে মা?
ভাবছিস সংসার তো তাহলে খুব মন্দ জিনিস। ব্যস্ততায় আটকে মানুষকে আত্মবিস্মৃত করে দেয়।
হ্যাঁ, হয়তো খানিকটা তাই। কিন্তু সংসারে রূঢ় বাস্তবতার পাশাপাশি থাকে গভীর মায়ার শৃঙ্খল। যে একবার সংসারে ঢোকে, মায়ার মজবুত আবেষ্টন তাকেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলে। তখন সংসারের জন্য রক্ত জল করা সব পরিশ্রম, সমস্ত আত্মত্যাগকেও সামান্যই মনে হয়। সংসার হলো কাঁটা গাছের ফুলের মতো। কাঁটা বিঁধে যাবার যন্ত্রণাও যেমন থাকে, তেমনি থাকে নির্মল ফুলের সৌরভ।

আমি আশা করছি তিতিক্ষার এইসব একাকী কষ্টের দিনগুলো হয়তো আর থাকবে না, যদি ওকেও আমরা একটা সংসার গড়ে দিতে পারি।’

তিহা বিহ্বলতা কাটিয়ে শুধু জানতে চায়, ‘ওকে সংসার গড়ে দেবে? কিন্তু কিভাবে বাবা?’

মেয়ের চোখে শঙ্কার ঝাপতাল মারুফের দৃষ্টি এড়ালো না। বললেন,’আমাদের মেয়ের যেহেতু একটা খামতি আছে, এমন কাউকেই আমাদের খুঁজতে হবে যে খামতি সহ আমার মেয়েটিকে গ্রহন করতে প্রস্তুত। তাতে হয়তো আগের মতো ভালো ঘর, ভালো বর পাব না। একটা দরিদ্র ছেলে যদি খুঁজে পাই, যার সঙ্গে বিয়ে হলে আমার মেয়েটা আমার কাছেই থাকবে… আমি একা মানুষ, তিতি মা যদি স্বামী সংসার নিয়ে চিরকাল আমার কাছে থাকে তবে তো আমি বর্তে যাই।
তুই কি বলিস?’

‘তাই হোক বাবা। কিন্তু তিতি… কি করে ওকে এসবের জন্য রাজি করাই?’

‘একদিনে তো কিছু হবে না। সময় সুযোগ অনুযায়ী রোজ অল্প অল্প বোঝালে একসময় তিতি হয়তো বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করবে। দেখ তুই পারিস কিনা।’

‘দেখবো।’ বলে তিহা মলিন মুখে একটু হাসে।

চলবে….

দূর আলাপন পর্ব-১৮+১৯

0

দূর আলাপন ~ ১৮
___________________________
কয়েক জোড়া সতর্ক নজরের জালে সে আজকাল বন্দি সারাক্ষণ। নিনাদের প্রতিটি সঞ্চালন, আক্ষেপ আর অভিব্যক্তিকে খেয়াল করছে যারা। সময়ে সময়ে খাদ্য, যত্ন, স্নেহ দিয়ে শোধ করছে জীবনের কোন অবিদিত উপকারের ঋণ।

ঘুমভেঙে লাফিয়ে উঠে বসে নিনাদ। শূন্য চোখে চারপাশ ফিরে তাকায়। মাত্র কয়েক পল, তারপরই বুঝতে পারে নিজ ঘর নয়, হাজার কিলোমিটার দূরের অচেনা শহরে সে পড়ে আছে অবরুদ্ধ নার্সিং হোমের নির্জন কক্ষে।

বুকের ভেতর বর্ণনাতীত অস্থিরতা। থেকে থেকে মনে হয় এক্ষুনি, ঠিক এই মুহুর্তে দেশে ফেরা প্রয়োজন। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ঝিগাতলার একতলা বাড়িতে, সদর দরজা পেরিয়ে তিতিক্ষার ঘরের সামনে। আর তারপর….

.

‘অনেক শুকিয়ে গেছো। খাওয়া দাওয়া বোধহয় একেবারে কমিয়ে দিয়েছো।’

‘তেমন কিছু নয়।’

‘তেমন কিছু না হলেই ভালো। নিনাদ, তুমি কি জানো কি পরিমাণ বদলে গেছো তুমি?’

শ্রান্ত দুচোখে প্রশ্নের ঝাপতাল নিয়ে তাকিয়ে থাকে নিনাদ।

‘এয়ারপোর্টে যখন তোমায় প্রথম রিসিভ করতে গেছিলাম, তোমার গুরুভার অভিব্যক্তি, সৌম্যতা দেখে অবাক হয়েছিলাম। ঢাবির দুর্দান্ত মেধাবী আর প্রাণোচ্ছল নিনাদ যেন রয়ে গেছে দেশেই। এখানে যে এসেছে সে গভীর, পছন্দ করে নির্জনতা।
তখনো জানতাম না সামনে আরো কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে। হাসনাতের কাছে শুনেছি ওহিওতে শিফট হবার পর থেকে ও তোমায় অন্যরূপে দেখছে। দূরের মসজিদে সময়মতো নামাযে যাওয়া, গান, মুভি সহ যাবতীয় স্থুল বিনোদন কে পরিহার করা আর সবচেয়ে বড় বিস্ময় মেয়েদের কে সর্বাত্বক ভাবে এড়িয়ে চলা।
অথচ ক্যাম্পাসে তুমি অন্যরকম ছিলে। আমাদের জুনিয়র তবু বাতাসে তোমারই মেয়েবাজির ভেসে বেড়ানো গল্প শুনে হতবাক হতাম। আর আড়ালে ঈর্ষা করতাম তোমার ভাগ্যকে। কোন মোহমন্ত্রে সব মেয়েদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলে জানতে ভীষণ ইচ্ছে করতো।’

শেষ কথাটা বলে তাওহীদ স্পষ্ট তাকায় নিনাদের চোখে। অস্বস্তি ঢাকতে নিনাদ মাথা নত করে। ছেলেটার কালোর কাছঘেঁষা গায়ের রঙ ওহিওর বিশুদ্ধ জল হাওয়া লেগে যেন কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হয়েছে। মুখে ঘন দাড়ি, অযত্নে বেড়ে ওঠা মাথার একরাশ ঝাকড়া চুল আর ঘন পল্লবিত চোখের গাঢ় শ্যামলা ছেলেটাকে আজ আবার নতুন করে ঈর্ষা হলো তাওহিদের। অনেকক্ষণ নিনাদের দিকে তাকিয়ে থেকে আভাসে হেসে বলল,’নিনাদ, তোমার এই বিরহ যদি কারো উপেক্ষার কারণে হয় তবে দিস ইজ হাই টাইম টু গো ব্যাক টু হার। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তোমার এই মূর্তি দেখলে সে যত পাষাণই হোক ফেরাতে পারবে না।’

তেমনি নিরবচ্ছিন্ন গম্ভীরতার চাদরে নিজেকে জড়িয়ে রাখলো নিনাদ। একসময় নৈঃশব্দ্য ভেঙে বলল,’ভাইয়া আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কিছু নয় আসলে। আমার এক কাছের মানুষের পরিবারে কিছু বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে। খবরটা আমি জেনেছি অনেক পরে। এই সময় আমার ওদের পাশে থাকা প্রয়োজন।’

‘কবে নাগাদ ফেরার কথা ভাবছো?’

‘যত শীঘ্র সম্ভব।’

——————–

রোজ হাসনাতকে কল করে নিনাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতো তিহা আর রওশান। একটা সময় হাসনাত ছেলেটা নিশ্চিত করলো নিনাদ এখন অনেকটা সুস্থ। তবে তিহা কিংবা রওশানের সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত নয়। যাক তার পরও ছেলেটা ভালো থাক। তিহার ছন্নছাড়া জীবনে আবারো স্বস্তি নেমে আসে। কটা দিন বড় এলোমেলো কেটেছে। এসবের প্রেক্ষিতে ভালো করে নজর দেয়া হয়নি তিতিক্ষার দিকে। এই অন্ধিসন্ধির চোরাপথ ধরে আজকাল আবারো নিজের মধ্যে গুম হতে শুরু করেছে তিতিক্ষা। তিহা সংসার গোছায়, রান্না দেখে, ছুটোছুটি করে ছেলেকে নিয়ে আর বাকি সময় ডুবে থাকে বিষাদে। অন্যদিকে একা ঘরে তিতিক্ষা নিজের অন্ধকার জগতে হয়ে থাকে আবিষ্টমান।

‘কি করছিস?’

হাতে থাকা বইটার দিকে দৃষ্টি ভিড়ালো তিতিক্ষা, ‘পড়ার চেষ্টা করছি।’

‘প্রচ্ছদটা তো বেশ সুন্দর। মরুভূমির গায়ে এঁকেবেঁকে চলা খেজুর গাছ বিছানো পথ। ‘নবীজির পাঠশালা’ নাম দেখে তো মনে হচ্ছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী গ্রন্থ।’

‘ঠিক জীবনী নয়। তবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বর্ণিত কিছু শিক্ষনীয় ঘটনা আকর্ষণীয় ঢঙে লেখা। আমার খুব প্রিয় বই।’

‘কত বই পড়িস তুই! আমাকে একটা বই দিবি?’
বোনের আদ্র স্বরে অবাক চোখে ফিরে তাকায় তিতিক্ষা
‘তুমি পড়বে বুবু?’

‘হ্যাঁ… দেখি চেষ্টা করে… যদি কিছু জ্ঞানগম্যি জন্মায়…’

‘দাঁড়াও এক্ষুনি দিচ্ছি।’ প্রবল উৎসাহে বইয়ের তাকে তিতিক্ষা ঝুঁকে পড়ল। অদূরে দাঁড়িয়ে বোনের ঔৎসুক্য দেখছিল তিহা।
‘এই নাও বুবু। এটা দিয়েই শুরু করো। বেশ সাবলীল ভাষায় লেখা। পড়ে আরাম বোধ করবে।’

কথা বলতে বলতে একঝলক হাসির বিচ্ছুরণ কি সত্যিই খেলে গেছিলো তিতিক্ষার মুখ জুড়ে? নাকি ভুল দেখেছে তিহা? কাল সন্ধ্যায় এই মেয়েটাই চেয়ার উলটে ফেলেছিল। একটা গ্লাস ছুড়ে মেরেছিল দেয়ালে। এইবার অবশ্য নিজেকে আঘাত করার পরিস্থিতিতে যায়নি, তার আগেই বোনকে থামিয়ে ফেলেছিল তিহা।
সেই মেয়েটাই কিনা আজ এত শান্ত সুস্থির হয়ে হেসে হেসে কথা বলছে! বিশ্বাস হয়?

.

‘বেলা ফুড়াবার আগে’ বইটা নিয়ে তিহা নিজ ঘরে ফিরে এলো। ছোটন তার নানা ভাইয়ের সঙ্গে উঠোনে খেলছে। আকবরের মা রাতের জন্য তরকারি কুটছেন রান্নাঘরে। বই নিয়ে বিছানায় পা মুড়ে বসলো তিহা। শেষ বিকেল, অল্প কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আযান দেবে। ততক্ষণ পর্যন্ত বইটা পড়া যাক।

তিতিক্ষা অনেকক্ষণ ছোটনকে দেখছে না। স্কুল থেকে ফেরার পর শেষ দেখা হয়েছিল। তারপর বাচ্চাটা গোসল খাওয়া সেরে মায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়ল। বিকেলে যখন এঘরে ঢু দিল তিতিক্ষা তখন আসরের সলাতে।
বাচ্চাটাকে একঝলক দেখার জন্য বইয়ের ভাঁজে বুকমার্ক রেখে সে বেরিয়ে আসে আপনার ঘর ছেড়ে। কিছুক্ষণ আগেও উঠোনে নানা নাতির হুটোপুটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। মৃদু পায়ে সদর দরজার দিকে হেটে যায় তিতিক্ষা। মুখে একটু চোরা হাসি। দরজা খুলতেই হয়তো ছোটন খেলা ফেলে ছুটে এসে মিমিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরবে। আর তখন হাটু ভেঙে বসে বাচ্চাটাকে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সঙ্গে চেপে কপালে চুমু খাবে তিতিক্ষা।

দুরন্ত ইচ্ছেটা বুকে নিয়ে সে নব ঘোরায়। বিকেলের শেষ আলো ওদের গোটা বাড়িকে কমলা রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। একদিকে গাঢ় আলো অন্যদিকে সন্ধ্যার আগমনী অন্ধকার। দিন ও রাতের এই ক্রান্তিলগ্ন দিব্য মাধুর্যের চাদরে ঘেরা। দরজা খুলতেই বিকেল শেষের রাঙা আলোর প্রথম ছঁটা তিতিক্ষার সারা গায়ে মেখে গেল। ধাঁধা লাগে চোখে। এবাড়িতে কোনো গাইরে মাহরাম নেই জেনেও উঠোনে নামার আগে অভ্যেসের বসে মাথার ওড়নাটা আরও একটু ভালো করে মুখের চারপাশে টেনে দেয় তিতিক্ষা। প্রকট আলোর শেষ ছঁটা বিচ্ছুরণ করতে থাকে ওর সারা মুখ জুড়ে। তিতিক্ষা ভালো করে তাকাতে পারে না প্রথম কয়েক মুহুর্ত। কতদিন… কতদিন পর ঘরের বাইরে পা রেখেছে আজ…

আলোর নিচে চোখকে অভ্যস্ত করতে করতে অস্ফুটে হাঁক ছাড়লো তিতিক্ষা, ‘ছোটন….’

উত্তর এলো না উঠোন থেকে।
‘ছোটন… ছোটবাবা কোথায় তুমি?’
বলতে বলতে সাবধানে সিড়িতে পা ফেলে ক্রমে নেমে এলো উঠোনে।
কোথাও কেউ নেই। শূন্য উঠোন খাঁ খাঁ করছে। বোধহয় বাবা ছোটনকে লজেন্স কিনে দিতে মোড়ের দোকানে নিয়ে গেছে। ব্যাপার টাতে ধাতস্থ হতে না হতেই তিতিক্ষা শোনে উঠোনের ওপাড়ে লোহার গেটের হাতল ঘোরানোর শব্দ। সন্দেহাতীত ভাবে ছোটন ফিরে এসেছে।
অনেক গুলো দিন পেরিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখার উচ্ছ্বাসে তিতিক্ষা তখনো সুখের পলকা স্রোতে ভাসমান। ওড়নাটা সাবধানে সারা গায়ের ওপর ভালো করে টেনে এগিয়ে গেল লোহার গেটের দিকে। আজ দরজার এপাশে থেকে নানা নাতিকে বিভীষণ চমকে দিয়ে দেখবে ওদের মুখের অবস্থাটা কিরূপ হয়!

অস্বাভাবিক স্থিরতার সঙ্গে দরজার হাতল ঘুরল। ওপাশে কোনো আওয়াজ নেই। বাবার কোলে থাকা ছোটন আজ এতো শান্ত হলো কি করে। আশ্চর্য তো!
খুলে গেল দরজা।
আবছায়া গাম্ভীর্যের আড়ালে দুর্বোধ্য হাসিটাকে সযত্নে সংগোপন করে তাকায় তিতিক্ষা। আর সঙ্গে সঙ্গে স্থানুবৎ হয়ে যায়। মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত অতীতের যে স্মৃতি, মুহুর্তে তা ওর চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভেতরের নাকাল হৃদয়ে হঠাৎ যেন ঘটে দুরূহ আস্ফালন। জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে তিরতির করে কাঁপতে শুরু করে তিতিক্ষা। দরজার ওপাশের লোকটা তিতিক্ষার মাহরাম কেউ নয়। তবু সে ভুলে যায় মুখ ঢাকতে কিংবা সরে যেতে। সম্মুখের দৃশ্যপট ক্রমে ঝাপসা হতে থাকে। অতীত বর্তমানের সীমারেখা ভুলে তিতিক্ষা বিস্মৃতির জালে আটকে যায়।

ওপাশের মানুষটার কণ্ঠে সকাতর আহ্বান, ‘তিতিক্ষা….’

মুখের ওপর দরাম করে বন্ধ হয়ে গেল লোহার দরজা। দরজার অন্যপারে কারো ত্রস্ত পায়ে ছুটে পালানোর সংকেত। নিনাদ স্তব্ধ, স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।
চলবে…..

দূর আলাপন ~ ১৯
____________________________
পাশের ঘরের দরজাটা হঠাৎ দারুণ শব্দে বন্ধ হয়ে যেতে সম্বিৎ ফেরে তিহার। পড়া থামিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
‘শব্দ কিসের খালা?’

‘ছোট আপু একটু আগে বাইরে গেছিলো। হঠাৎ ফিরা আইসা দরজায় খিল দিলো।’

‘তিতি একা গেছিল বাইরে?

‘হ’

দৃষ্টি বা দিকে ঘোরাতেই দেখা গেল সদর দরজা তখনো হাট করে খোলা। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে তিহা। আর কোনো প্রশ্ন না তুলে ছুটে যায় বোনের ঘরের দিকে।

‘তিতি, দরজা বন্ধ করেছিস কেন? খোল, এই তিতি।’
ওপাশ নিরুত্তর। তিতিক্ষা কি ভাঙচুর করছে ভেতরে? নাকি নিজের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করছে? বুকে অসহনীয় অস্থিরতা নিয়ে তিহা কান পাতে দরজায়। একটা ভোঁতা গোমরানো আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তিহার ভেতরটা মুচড়ে ওঠে আতঙ্কে। এই ভর সন্ধ্যায়, একা বাসায় কি করবে সে? দরজায় হাত রেখে তিহা স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ভেতর থেকে নানান রকম আওয়াজ আসছে। কান্না, গোঙরান… সবই তিহার পূর্ব পরিচিত।

একসময় উৎকীর্ণ হয়ে শোনে মসজিদে আযান পড়ছে। তিহা কি করবে ভেবে পায় না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ঘরে ফিরে সলাত শুরু করবে? মারুফ তখনো ফেরেননি। ছোটনকে নিয়ে বাবাই বা গেলেন কোথায়?
ভীষণ অসহায় লাগছিল তিহার। হঠাৎ মনে পড়ে তিতিক্ষার বলা একটা কথা। অনেক দিন আগে ও বলেছিল আযানের পরবর্তী সময়ের দুআ কবুল হয়। ঝুম সন্ধ্যায় অন্ধকার করিডরে একা দাঁড়িয়ে রবের কাছে দু হাত তুললো তিহা,
‘ইয়া আল্লাহ, আরহামুর রহিমীন। আপনি সব কিছু সহজ করে দিন। আমার বোন যেন নিজের কোনো ক্ষতি না করে বসে। আপনার বান্দাদের যাবতীয় কষ্টে আপনিই তো একমাত্র সহায়। আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করুন, ইহকালীন সমস্ত পরীক্ষায় আমাদের জয়ী হবার তাওফিক দান করুন আর উত্তম ভাবে ক্ষমা করুন। আমিন।’

দুআ শেষ করে বোনকে সে অবস্থায় রেখে তিহা ফিরে যেতে শুরু করল নিজের ঘরে সলাত আদায়ের জন্য। হঠাৎ এতো মনের জোর কি করে পেলো তিহা জানে না। শুধু মনে হচ্ছিল সলাত টা যাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত, তিনিই তো বোনকে দেখবেন। সামান্য বান্দা হয়ে সে আর কিইবা করতে পারে? তবে কেন এত অধীরতা? আল্লাহ চাইলে পরিস্থিতি আপনাতেই সহজ হয়ে আসবে।

.

বাড়ির পরিবেশ থমথমে। নাতিকে নিয়ে মসজিদ থেকে ফিরে মারুফ সোফায় চিন্তিত মুখে বসে আছেন। সামনে পড়ে আছে দুখানা খবরের কাগজ আর এককাপ গরম চা। ছুঁয়ে দেখার আগ্রহটুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না। বিকেলে ছোটনকে নিয়ে মোড়ের দোকানে গেছিলেন। তারপর পাড়ার দু একজনের সঙ্গে খোশগল্পে সময় বয়ে গেল। একসময় খেয়াল হলো মাগরিবের ওয়াক্ত হতে আর বেশি বাকি নেই। বাড়ি ফিরে নাতিকে রেখে আসতে গেলে জামাতটা সময়মতো ধরা দায় হয়ে পড়ে। অগত্যা না ফিরে নাতিসহ মসজিদে যাবার সিদ্ধান নিলেন।

সন্ধ্যার পর যখন বাড়ি ফিরলেন, তিহা তখনো সলাতে। বসার ঘরে ফেরার পথে ছোট মেয়ের ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন মারুফ। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। দৃশ্যটা মারুফের জন্য আশঙ্কাজনক। মারুফ ঘামতে লাগলেন। শ্বাসপ্রশ্বাস অত্যধিক দ্রুত। এর মধ্যেই প্রেসার বাড়ল কিনা কে জানে। দরজা বন্ধের ব্যাপারে তিতিক্ষার ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবুও কয়েকবার সেসব অমান্য করে বন্ধ দরজার ওপাশে পাগলামো করেছে সে। আজও কি তেমনি কিছু….

.

তিহার হৃদয়ে অবিদিত আনন্দধারা কলকল শব্দ বয়ে যাচ্ছে। দুআ কবুলের মুহুর্তরা বুঝি এমনি সুন্দর হয়! হয়তো এটাই প্রথম, যখন পরিবারের কারো হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজের অসুস্থতাকে লড়াইয়ে পরাভূত করতে পেরেছে তিতিক্ষা। কিঞ্চিৎ সময় ইতস্তত শেষে খোলা দরজা পেরিয়ে তিহা ভেতরে আসে। না, ঘরের কোথাও কোনো অসঙ্গতি নেই, নেই কোনো ঝড়ের চিহ্ন। তবে কি তিতিক্ষার কিছু হয়নি? বুঝি এমনিতেই দরজা বন্ধ করে বসেছিল এতক্ষণ! আর তিহা কি না কি ভেবে বসে আছে….

স্বস্তি পেতে গিয়েও তড়াক করে চিন্তাটা তিহার মাথায় ফিরে আসে। আচ্ছা, তিতিক্ষা গেছে কোথায়? ঘর তো পূর্বাবস্থাতেই রয়েছে কিন্তু তিতি… ও কেন ঘরে নেই?
ঘর, বাথরুম সব খুঁজে দেখল তিহা। তিতিক্ষা কোথাও নেই। বারান্দার কথাটা শুরুতে ওর মাথায় খেললো না। তিতিক্ষার ঘরের বারান্দাটা ঠিক ভালো জায়গায় নয়। গ্রীলের ওপাশে বিশাল পতিত ভূমি। জানা অজানা গাছ গাছড়ায় ভরপুর জায়গাটা। সন্ধ্যার পর পারতপক্ষে ওদিকটায় কেউ যায় না। এই রাতের বেলা তিতিক্ষা কেন ওই অন্ধকার বারান্দায় যাবে?
ভাবতে ভাবতেও তিহা পা বাড়ায় সেদিকে। তখনো ওর একহাত নিজের হাতের মুঠোয় আগলে রেখেছে ছোটন। তিহা অন্যহাতে ঠেলে খুললো বারান্দার ভিড়ানো দরজা।

ছোটন মুখ ভার করে নানা ভাইয়ের পাশের সোফায় গিয়ে বসল।
মারুফ মাথা তুলে নাতিকে দেখলেন,’কি হলো নানাভাই? মন খারাপ করেছো কেন?’

‘মিমি খুব কাঁদছিল। আমি কাছে যেতে চাইলাম তাই আম্মু আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে।’

‘মিমি কাঁদছিল! কেন কাঁদছিল নানাভাই?’

ছোটন সেভাবেই উত্তর দিল, এতকাল যেভাবে সে শুনে এসেছে,’মিমির কত কষ্ট তুমি জানো না? মিমি তো কাঁদবেই!’

.

বিহ্বলতা কাটিয়ে বোনের পাশে বারান্দার শীতল মেঝেতে বসে পড়ে তিহা। দরজার ফাঁক গলে আসা আবছায়া সাদা আলোয় দেখে কাছে বসা বোনটা কেমন দূরের মানুষ হয়ে একা একা কেঁদে যাচ্ছে।
‘এই তিতি, কি হলো তোর?’ তিহার গলার স্বরে বেজে ওঠে পলকা আতঙ্কজড়িত আহ্বান।

তিতিক্ষার ক্লান্ত ভেজা চোখজোড়া স্থির হয়। ওর কপালে হাত রেখে তিহা টের পায় দুদিনের পুরনো জ্বরটা রাক্ষুসে উত্তাপে আবারো বোনের গায়ে উপবিষ্ট হয়েছে। আপনাতে তিহার মায়াভরা হাতের ছোঁয়া বোনের সিক্ত গালে নেমে আসে। উষ্ণ অশ্রুর রেখা মুছে দিয়ে তিহা ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে, ‘কি হয়েছে? একা একা আর কত এই কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াবি? আপুকে বল, আয় কাছে আয়।’
তিহা হাত বাড়িয়ে দিল বোনের দিকে।

বাচ্চা মেয়ের মতো হামাগুড়ি দিয়ে কাছে এসে বোনের কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ল তিতিক্ষা। বৃষ্টি বাদলার মরশুম। ঘরের মালকিনের অন্যমনস্কতার দরুন বারান্দায় জমে থাকা বৃষ্টির জল সরানো হয়না। বারান্দার এককোণায় জমে আছে বৃষ্টির জল। তিহার শুষ্ক পরিপাটি শাড়ির আঁচল ভিজছিল নোংরা জলে। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।
বোনের মাথায় স্নেহভরে হাত রেখে পুনরায় বলল, ‘কি হয়েছে রে আপু?’

‘কিছু না বুবু। আমার ভেতরে কেন যে এত কষ্ট হয়… এই বর্ণনাতীত কষ্টের শেষ কোথায় বলতে পারো? আজকাল আম্মার কথা খুব মনে পড়ে। আম্মা থাকলে এসব হতো না। তাই না?’

তিহা নিরুত্তর থাকে। কাঁদতে ইচ্ছে করে তারও।
অন্ধকারে তার কোলে মাথা রেখে নিস্তেজ গলায় তিতিক্ষা আবারো কিছু বিরবির করে, ‘ছোটবেলায় দেখতাম বন্ধুরা কেউ ব্যথায় কষ্ট পেলে ওদের মায়েরা সূরা পড়ে পানিতে ফু দিয়ে বাচ্চাদের খাওয়াতো। রাগের সময় মারতো কিন্তু একটু পরেই কাছে টেনে সন্তানের মুখ চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিতো।
দূর থেকে দেখে আমি হাসতাম। ভাবতাম কিসব পাগলাটে স্বভাব থাকে মায়েদের! অথচ আজ বড় আফসোস হয় ভেবে যে আমার শৈশবে এমন কোনো পাগলাটে স্মৃতি নেই। ইচ্ছে করে আম্মা যেখানে আছে সব ফেলে সেখানে ছুটে যাই। কিন্তু মৃত দের কাছে যাবার সবচেয়ে বড় বাঁধাই যে বেঁচে থাকা। আজকাল বেঁচে থাকতেও…’

‘চুপ কর আপু। তোর না কত ধৈর্য? এতকাল সব সইতে পেরেছিস তবে আজ কেন অকারণে এত ভেঙে পড়ছিস?’

‘অকারণ ভেঙে পড়ছি? হ্যাঁ ভেঙেই পড়ছি হয়তো। বিষের মতো অতীত সামনে এলে ভাঙতেই হয়। ছাড়ো এসব.. আমার কষ্ট শুধু আমারই। তোমরা কেউ বুঝবে না কখনো।’ বোনের স্নেহাতুর বন্ধন ছাড়িয়ে উঠে চলে গেল তিতিক্ষা। তিহা শুনলো বাথরুমের দরজা বন্ধ হবার শব্দ। ভেতর থেকে অনবরত জলের ঝাপটার আওয়াজ আসছে। এই রাতের বেলা গায়ে মাথায় পানি ঢালছে নাকি মেয়েটা?

‘আম্মু তোমার ফোন…’
পাশের ঘর থেকে ছেলের ডাক ভেসে আসে। নিশ্বাস ফেলে সেদিকে পা বাড়ায় তিহা।
‘আম্মু দেখো দেখো, কে যেন ফোনের ওপাশে কাঁদছে।’
শূন্য দৃষ্টিতে ছেলের মুখে তিহা তাকিয়ে রয়। আবার কান্না! তিহার চারপাশের জগতে মানুষের বুঝি কান্না ছাড়া কিছু নেই…

‘হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?’

‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপু আমি আফরিন।’

‘আফরিন! সব ঠিক আছে তো? ছোটন বলল কে নাকি কাঁদছিল.. ‘

‘চাচি আম্মার কথা কইসে আপু। উনিই প্রথমে কল দিসিলেন। কানতে কানতে আবোলতাবোল বকতাসেন তাই আমি ফোন নিসি।’

‘ফুআম্মা কাঁদছেন! কিন্তু কেন?’

‘মেলা কাহিনি গো আপু। আপনি পারলে একবার এহনি বাসায় আসেন। চাচিআম্মা তো কানতে কানতেই বেহুশ। আমি একলা কেমনে এসব সামলাই। এদিকে উনিও আজই দেশের বাড়িতে গেলেন। আসবেন না আপু?’

তিহা বুঝলো উনি বলতে আফরিন মিনহাজকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু এদের ব্যাপার টা কি এখনো জানা গেল না। মেয়েটা সব বলেছে শুধু আসল কথাটা ছাড়া।
‘কিন্তু আফরিন হয়েছে কি বলবে তো?’

‘কি যে কই! আমার নিজের মাথাই আউলায়া গেছে এসব দেইখা।
সন্ধ্যার পরে হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুইনা দোর খুইলা দেখি নিনাদ ভাই! আমসি মুখ, হাতে ব্যান্ডেজ। কারো দিকে স্পষ্ট কইরা তাকায় না, হাসে না। ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঘরে গিয়া দোরে খিল দিলো। তারপর অনেক ডাকাডাকিতেও এহনো খোলে নাই।
নিনাদ ভাইয়ের ভাবভঙ্গি ভালো না আপু। আজই যে দেশে ফিরব সেই কথাটাও আমরা জানতাম না। চাচিআম্মা চিন্তায় অস্থির। আপনি পারলে একবার আসেন আপু।’

‘আ.. আমি!’ তিহা দ্রুত ভাবছে। বোনকে এই অবস্থায় একা ফেলে যায় কি করে? অথচ ওখানেও তাকে প্রয়োজন। ফুআম্মা তো জানে না নিনাদের এই হালত হবার কারণ কি। কিন্তু আফরিন যে ব্যান্ডেজের কথা বলল। কই, হাসনাত তো আগে এই কথা বলেনি!
আর কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে তিহার জন্য?

.

‘মিমির বাধ্য হয়ে থাকবে। আমি জলদি ফিরে আসবো।’ তিহা ছেলের কপালে চুমু খেল। ‘আমরা বেরোচ্ছি। দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে মিমির কাছে গিয়ে বসো। কেমন?’

মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করল ছোটন। দরজার নব ঠিকঠাক ঘুরিয়ে গুটিগুটি পায়ে চলে এলো তিতিক্ষার ঘরে। মিমির বিছানা তথা পালঙ্কটি বেশ একটু উচুতে হওয়ায় ওকে উঠতে খানিকটা কসরত করতে হলো। ততক্ষণে তিতিক্ষা এমুখে ফিরে বসেছে। ভাগ্নেকে আলতো হাতে টেনে বিছানায় তুলে নিল। আদুরে বেড়ালছানার মতো মিমির গা ঘেঁষে বসে পড়ল ছোটন। বুকে দুরুদুরু ভয়। ভয়টা মিমির গম্ভীর মুখকে।
‘তোমার মা কোথায় গেছে ছোটবাবা?’

ছোটন অবাক হয়ে তাকায়, ‘কেন মিমি? যাবার আগে আম্মু তোমায় বলেনি?’

‘না তো!’

কিঞ্চিৎ ক্ষণ ইতস্তত করে ছোটন। একসময় বলে, ‘একজন খুব অসুস্থ। তাকে দেখতে গেছে। ‘

‘কে অসুস্থ ছোটন?’

‘সেটা তো আম্মু বলেনি। কিন্তু….. আমি জানি!’

জ্বরটা ক্রমে বাড়ছিল। গালের নিচে হাত রেখে আস্তে আস্তে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তিতিক্ষা ‘জানো?’

‘হ্যাঁ। আমি বলতে পারি কিন্তু তুমি আর কাউকে বলবে না তো?’

‘না ছোটবাবা।’

‘নিনাদ মামার খুব অসুখ। ওর ফুপ্পি ফোন করে কান্না করছিল। আমি শুনে ফেলেছি!’

ছোটন দেখল তার মিমির মুখটা হঠাৎ করেই কৌতুহল শূন্য হয়ে গেছে। ক্লান্ত উদাস চোখে তাকিয়ে আছে সামনে।
‘তোমার কি খারাপ লাগছে মিমি?’

‘না আব্বু।’

‘জানো মিমি আজ বিকেলে নানাভাইয়ের সঙ্গে মোড়ের দোকানে যাবার সময় আমি নিনাদ মামাকে দেখেছি। আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। নানাকে বললাম নানা কিছুতেই বিশ্বাস করলো না। বললো মামা নাকি অনেক দূরে, আ মেরিকায়। কিন্তু এখন তো সবাই দেখছে মামা এখানে। তারমানে আমি সত্যি দেখেছি। তাই না বলো?’

তিতিক্ষা নিরুত্তর।

‘আচ্ছা মিমি, তুমিও কি দেখেছিলে? আম্মু বলেছে বিকেলে আমায় খুঁজতে তুমিও উঠোনে গেছিলে।’

‘কথা বোলো না বাবা। খেলনা দিয়ে খেলো।’

‘তাহলে তুমি কি করবে মিমি? ঘুমোবে? তবে তো একা একা আমার খুব ভয় করবে।’ শিশুটির মুখে সত্যিকারের আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। তিতিক্ষা একদৃষ্টে কিছুক্ষণ দেখে ওকে। বুবু একটা ব্যস্ত থাকার সরঞ্জাম রেখে গেছে। এই ছোট প্রাণের কাছাকাছি থেকে চাইলেও নিজের নিভৃত জগতে একক বিচরণ সম্ভব নয়। তারচেয়ে ওর মনের ভয়কে জয় করার প্রয়াস চালানো যাক। ছোট করে নিশ্বাস ফেলে দুহাত বাড়িয়ে দেয় তিতিক্ষা, ‘মিমির কাছে এসো শোও আব্বু। তোমায় রূপকথার গল্প শোনাব আজ।’
চলবে…..

দূর আলাপন পর্ব-১৬+১৭

0

দূর আলাপন ~ ১৬
____________________________
কথায় কথায় শিউলি তার একটা আশংকার কথাও একফাঁকে বললেন। নিনাদটা কিছুদিন যাবৎ অদ্ভুত গা ছাড়া আচরণ করছে। নিজে থেকে তো কল দেয়ই না। শিউলি যেচে যোগাযোগ করতে চাইলেও বেশিরভাগ সময় কল রিসিভ করে না। একা বিদেশবিভুঁইয়ে বাস। কি হতে কি হয়… শিউলির বড় চিন্তা হয়। এদিকে ছেলের বিয়ের কথাটাও বেশ অনেকটা এগিয়ে রেখেছেন। শেষ সময়ে এসে যদি নিনাদ বিগড়ে যায় তবে মস্ত কেলেঙ্কারি হবে।

তিহা নিঃশব্দে সমস্তটা শুনলো। তার মুখে রেখাপাত ঘটালো কালো ছায়া। বলতে কি, বোনের জীবনের বিপর্যস্ত দিনগুলোর কথা নিনাদকে জানানোর অভিপ্রায় তিহারও ছিল না। ছিল না কারণ এর ফলে হয়তো চিরকালের মতো তিতিক্ষাকে ছোট করার একটা উপলক্ষ জুটে যাবে নিনাদের। কিন্তু কথার পিঠে কথা এসে যায়। যখন কথায় কথায় দুর্ঘটনার খানিক আভাস পেয়ে গেল নিনাদ, তখন গোপন রাখা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ল ওর কাছ থেকে।

তিহার মনে আছে, সেদিন নিঃশব্দে তার সমস্ত কথা শুনেছিল নিনাদ। মাঝখানে কোনো মন্তব্য করেনি, একবারের জন্য ওকে থামায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল সেটা তিহার কাছে অজানাই থেকে গেছে। সেই মুহুর্তে ওর বোন পাগলামো করছিল, কোনোরকম বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই কল কেটে ছুটে যেতে হয়েছিল তিহাকে।

হয়তো কষ্টই পেয়েছিল নিনাদ। সে সম্ভাবনাই প্রবল। যত যাই হোক, তিতিক্ষার প্রতি ওর একটা দূর্বলতা তো ছিলই। কিন্তু একেবারে ভেঙে পড়া কি সাজে? তারিখ মিলিয়ে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয়না সেদিনের পর থেকেই নিনাদ শিউলি ফুআম্মার সাথে দূরত্ব রেখে চলছে। কষ্ট? সত্যিই কি তাই? একপাক্ষিক ভালো লাগায় এতটাও কি হয়?

ফুআম্মা কেমন মানুষ সে তো নিনাদের অজানা নয়। তিনি অস্থির হবেন, দুচিন্তায় পড়েবেন জেনেও তবে কেন এই ছেলেমানুষী?
আচ্ছা, তিহা যা ভাবছে ব্যাপার টা তার থেকেও গভীর নয়তো? দূরদেশে একা ভালো আছে তো নিনাদ? তিহার সম্বিত ফেরে আফরিনের ডাকে। মেয়েটা মলিন স্বরে কাছে এসে জানায়, ‘ছোট আপুর খুব জ্বর’
ব্যস্ত হয়ে তিহা ছুটে যায় অন্দরে। পেছন পেছন ছোটেন শিউলি আর আফরিন।

বোনের অবস্থা দেখে অচিরেই তিহা অতিথিদের কথা বিস্মৃত হল। গা ঘেঁষে বসামাত্র মেয়েটার গায়ের উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। জ্বরটা বোধহয় মাথায় চড়ে গেছে। দিশেহারা হয়ে কি করবে ভেবে না পেয়ে বোতলের পানিতে ওড়না ভিজিয়ে বোনের কপালে দিতে থাকল তিহা। শিউলি মৃদু পায়ে এসে তিতিক্ষার হাত আর পায়ের তাপমাত্রা দেখলেন। মেয়েটার হাত পা বরফের মতো শীতল। শুনলে তিহা আরো বিচলিত হবে ভেবে নিচুকণ্ঠে আফরিনকে বললেন রান্নাঘর থেকে সরিষার তেল নিয়ে আসতে। আফরিন ছুটে গেল। বিছানার দুদিকে দুজন দাঁড়িয়ে। তিহা ব্যস্ত হয়ে বোনের কপালে সেঁক দিচ্ছে। আর উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তাকে দেখছেন শিউলি। কেবল জ্বরই হয়েছে, হয়তো একটু বেশি তবে এতেই তিহার মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা অবাক করার মতন। আচমকা শিউলির চোখ সরে যায় তিতিক্ষার নিস্পন্দ মুখের ওপর।

রাত নেমেছে। শিউলি চোখেও আজকাল অত ভালো দেখেন না। নয়তো আরো আগেই ব্যাপার টা তার চোখে পড়ার কথা। কয়েক মাস আগে দেখা তিতিক্ষার সঙ্গে এই তিতিক্ষার তফাৎ টা আকাশপাতাল। যদিও মেয়েটা এখন ঘুমিয়ে আছে। তবু ওর গাঢ় কালিমালিপ্ত চোখের কোল, মুখের ক্ষতিচিহ্ন গুলো নিশ্চয়ই মিথ্যে বলছে না! তিহা বলেছিল তিতিক্ষার অসুখ। কিন্তু এ কি ধরনের অসুখ! স্বাস্থ্য কমে গেছে, কণ্ঠার হাড় বেড়িয়ে পড়েছে আর গায়ের রঙ হয়েছে এমনই ফ্যাকাসে যে মনে হয় রক্তশূন্যতায় ভুগছে।
শিউলির মন যখন এই রকমের অসংখ্য ভাবনার দোলাচালে দুলছিল তখন প্রথমবারের মতো চোখ মেললো তিতিক্ষা। আফরিনও তেলের কৌটো নিয়ে ফিরে এলো সেই মুহুর্তে।

.

বোনের ভেজা চুল মুছে দিচ্ছে তিহা। জ্বরের বাড়বাড়ন্ত দেখে শেষ পর্যন্ত শিউলি পরামর্শ দিয়েছিলেন মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালার জন্য। বিছানার পাশে চেয়ারে বসে শিউলি শুধালেন,’এখন কেমন লাগতাসে আম্মাজান?’

বোনের কাঁধে দূর্বল মাথা ঠেকিয়ে তিতিক্ষা একদৃষ্টে চেয়ে রইল আফরিনের বর্ণিল সাজসজ্জায় পূর্ণ দেহাবরণের দিকে। শিউলির প্রশ্ন ওর কর্ণগোচর হয়েছে বলে মনে হলো না। বিব্রত পরিস্থিতি এড়াতে তিহা হাসল,’তিতি, ফুআম্মা কি জিজ্ঞেস করছেন বল? এখন একটু ভালো লাগছে তো?’

তিতিক্ষা এবারেও নিরুত্তর। ভাষাহীন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্মুখে।

‘থাউক, মাত্র জ্বরটা নামতাসে। আম্মাজান এহন একটু বিশ্রাম নেক।’ কথা শেষ করে শিউলি গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবতে শুরু করলেন। এতক্ষণে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, তিতিক্ষা মেয়েটা সত্যিই খুব অসুস্থ। তবে তার কতটা শরীরি আর কতটা মনের সেটুকুই ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। ওকে দেখে শিউলি যতদূর বুঝেছেন, মেয়েটা মানসিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ নয়। তিহা বলেছিল বিয়ে ভাঙার পর থেকে তিতিক্ষা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। সারাক্ষণ একা একা থাকে। কারো সঙ্গে কথাটথা তেমন বলে না। ইচ্ছে থাকলেও সবটা বিশ্বাস করতে পারলেন না শিউলি। শুধু বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় কোনো মেয়ে এতটা প্রভাবিত হয়? প্রেমের বিয়ে হলেও নাহয় একটা কথা ছিল! তবে এদের ব্যাপারখানা কি? খুব বড় কিছু কি ওরা লুকোচ্ছে শিউলির থেকে? তাই বা কেন হবে? তিহা তেমন মেয়ে তো নয়। তবে কি এমন ঘটতে পারে এই কয়েক মাসের ভেতর, যা শিউলিকে বলতেও তিহার মুখে বাধছে?

.

নিনাদের কথা সেদিনের মতো চাপা পড়ে গেল। রাত বাড়ছে। শিউলি ব্যস্ত হলেন আফরিনকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য।
বাইরে তখন বৈশাখী ঝড়ের তান্ডব পুরো রাতের আকাশ জুড়ে। অবসন্ন মুখে শিউলি ফেরার জন্য প্রস্তুত হলেন। যাওয়ার আগে একবার শেষ বারের মতো দেখতে এলেন তিতিক্ষা কে। একটা সময় এই রমণীর সৌন্দর্যের সামনে আফরিন কে বড় মলিন দেখাতো। অথচ আজ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন আফরিনের বর্তমান রূপগুণের কাছে তিতিক্ষা কতই না ম্লান! যেন সুন্দর একটি ফুলের জীবন দুমড়েমুচড়ে বিধস্ত করে দিয়েছে কেউ। পরিতোষ বদনে এবাড়িতে এলেও শিউলিকে ফিরতে হলো ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। আফরিনও যেন অনেকটা নিভে গেছে। ওর সমস্ত হাসি, রিমঝিম কথার ফুলঝুরি সব থমকে গেছে ওই একাকিনী ঘরবন্দী অসুখী মেয়েটিকে দেখে।

.

বাইরে গহন তমসার চাঁদোয়া বিছানো রাত। বাড়ির ভেতরের তমসা যেন আরো প্রখর। খানিক আগে যে হলঘরে ভাসছিল কলরব, নেমেছিল কথার ফোয়ারা, এখন সেখানে নিবিড় হয়ে বসে আছেন একজন বিষন্ন প্রৌঢ়। মারুফের সামনে ধীর পায়ে তিহা এসে দাঁড়ায়।
‘বাবা, ঘরে যাও। রাত অনেক হলো। ঘুমোবে না?’

প্রলম্বিত নিশ্বাস ফেললেন মারুফ, ‘আর ঘুম…’

‘তুমি জেগে বসে থাকলেই বা কি হবে বলো তো? উল্টো চিন্তায় চিন্তায় তোমারই প্রেসার বেড়ে যাবে। তারচেয়ে ঘরে গিয়ে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো। তিতির পাশে আমি তো আছি। কোনো দরকার হলে তোমায় জানাব।’

মেয়ের কথায় বৃদ্ধ বাবা খানিকটা ভরসা পেয়ে উঠলেন। তিহা ফিরে গেল বোনের ঘরে। বিছানার একপাশে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ওর পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলেটা। অন্যপাশে তিতিক্ষার জ্বরের ঘোরে ফেলা জোরালো শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরজুড়ে আধো আলো আধারির অন্তর্জাল। বাইরে অশনি গজরাচ্ছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির নিক্কণে বাতাস ভারি। জানালার একটা অর্ধখোলা কপাট দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছিল। তিহা ছুটে গিয়ে জানালা বন্ধ করল। তারপর ক্লান্ত পায়ে এসে বসল বোনের শিয়রে।

একে একে মনে পড়তে লাগলো নানান কথা।
শিউলি ও আফরিন দুজনের মুখই আজ ঝলকাচ্ছিলো। এতিম দুটো ছেলে মেয়েকে মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করেছিলেন শিউলি। নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার পর ওরা মাতৃসম শিউলিকে মনে রেখেছে। নিনাদের ঘরের কর্তৃত্ব চিরকাল শিউলির হাতে। এখন আফরিনের নতুন সংসারেও শিউলির অবাধ বিচরণ। এখানেই শিউলি স্বার্থকতা। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে, সামনে ছেলেটারও বিয়ে হবে। শিউলির এখন সুখের দিন। নিনাদের বিয়েতে আরো কত আলো জ্বলবে… কত মুখ হাসবে…

আর এই বাড়ি? হাহ্! বরাবরের মতো নিভে গেছে এই বাড়ির সমস্ত আলো। তিহার বোনের একটা ভালো বিয়ে হবে না। অনেক আত্মীয়স্বজন, অনেক উজ্জ্বল মুখ, হাসি আনন্দ কিছুই হবে না। সেসব সম্ভাবনা চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে সেই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে…

এতো গেলো বাইরের মানুষের সঙ্গে তুলনা। বিষাদভারাতুর মন নিয়ে তিহা এবার হিসেব কষতে বসে একান্ত নিজের সমস্ত পাওয়া না পাওয়ার। জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই তার ভাগ্যটা ভারি গোছানো। প্রথম সন্তান বলে ছেলেবেলায় বাবা মায়ের অফুরন্ত স্নেহের একা ভাগিদার ছিল। তারপর অনেক দিন পরে একটা ছোট্ট মিষ্টি বোন এলো। সঙ্গে এলো মায়ের দেহে হাজার রকমের অসুখ। সারাটাক্ষন মাকে নিজের অসুস্থতা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হতো। তিতিক্ষা বড় হচ্ছিল বেশ একটু অযত্নে, অবহেলায়। তারপর মাও মারা গেলেন তিতিক্ষার অল্প বয়সে। তিহা ততদিনে কৈশোরে পদার্পণ করেছে। তখন আর মায়ের স্নেহ মমতায় ডুবে থাকার বয়স নয়। সুতরাং তিহার তেমন কোনো অসুবিধে হল না মাকে ছাড়া।

কষ্ট যা পোহাবার পোহাচ্ছিল ওই কোলের বোনটা। মা বেচে থাকতে যেটুকু যত্ন পেত, মারা যাবার পর সেটুকুও ওর ভাগ্য থেকে মুছে গেল। কাজের জন্য বাবাকে বেশিরভাগ সময় থাকতে হতো বাড়ির বাইরে। বাড়ি এলেও স্কুলের পরীক্ষার খাতা, একপাল ছাত্রছাত্রী আর তাদের অভিভাবকদের আনাগোনা থাকতই। সবটা সময় বঞ্চিত হয়ে, অবহেলা পেয়ে, একাকীত্বে ডুবে কষ্ট পেয়েছে তিতিক্ষা। তিহার ভাগ্য জন্ম থেকেই যেমন প্রসন্ন বিপরীতে তিতিক্ষার ভাগ্য জীবনের প্রারম্ভকাল থেকেই তেমনি যেন ওর সুখের ঘোর বিরোধী। কষ্টে, একাকীত্বে বড় হওয়া তিতিক্ষা আজও দিয়ে চলেছে জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা। অথচ তারই সহোদরা বোন হয়ে স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখে পূর্ণ একটা জীবন তিহা কাটাচ্ছে।

একে কি নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস বলা যায়? নাহলে একই ছাদের নিচে বসবাস করা দুটো মানুষের নিয়তি এত ভিন্ন কি করে হয়?
স্কুলে কলেজে সবসময় ক্লাসমেটদের দ্বারা নির্মম তাচ্ছিল্যের স্বীকার হতে হতো তিতিক্ষাকে। কখনো নিজের বিরল গম্ভীর ব্যক্তিত্বের জন্য কখনো আবার অকারণেই।
অন্যদিকে তিহা ছিল বন্ধুমহলের প্রাণ। ওকে ছাড়া কোনো ট্যুর প্ল্যান হয় না, পিকনিক করার প্রশ্নই ওঠে না, ওকে ছাড়া কোনো আড্ডাও ভালো করে জমে না। মাঝে মাঝে করুন চোখে বুবুর দিকে তাকিয়ে থাকতো তিতিক্ষা। যখন বান্ধুবিরা তিহাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করতো।
সব ভালোবাসার রিয্ক কি শুধু তিহার জন্যই বরাদ্দ ছিল? আর রাজ্যের যত অবহেলা, অপমান শুধু তিতিক্ষার জন্য?

অথচ এতকিছু প্রাপ্তির পরেও যে প্রাপ্তিদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নোয়াবার সামান্য প্রেরণা টুকু তিহা পায়নি। বিপরীতে অপ্রাপ্তির যাতনা ভুলতে তার বোনই প্রতিবার রবের সামনে সিজদায় ঝুকেছে। যতবার কোনো দুনিয়াবি আঘাত এসে ওকে টলিয়ে দিতে চেয়েছে ততবার আরো বেশি রবের কৃতজ্ঞ বান্দা হবার চেষ্টায় রত হয়েছে তিতিক্ষা।

মাঝে মাঝে তিহার ভয় হয় সত্যি। আল্লাহ কেন তাকে এতটা ছাড় দিচ্ছেন? নাকি তাকে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন এখনো? কিন্তু প্রতি মুহুর্তে যে সেই সুযোগ কে ধূলিসাৎ করে তিহা আরো বেশি করে দুনিয়াবি মোহের প্রতি ঝুকছে, শেষ পর্যন্ত আদৌও রবের অনুগ্রহ তার ভাগ্যে জুটবে তো? অত কাছে থেকে তার বোন জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে তবুও কি তিহা বুঝবে না? ফিরবে না আলোর পথে?

কত অসহিষ্ণু ছিল তিতিক্ষার পর্দার ধরন। কারো কোনো অনুরোধের খাতিরেই নিজের পর্দার লাগামকে এক মুহুর্তের জন্য আলগা করেনি সে। অথচ তারই বোন হয়ে তিহা হাজারটা ছেলের সঙ্গে মিশেছে। এমনকি এখনো তার কাছের বন্ধুদের অর্ধেকই ছেলে….
কতবার তিতিক্ষা বুঝিয়েছে তাকে এই পথ ভ্রান্তির, এই পথ আল্লাহর অবাধ্যতার…. কিন্তু তিহা যেন বিক্রি হয়ে গেছে জাগতিক মোহের কাছে।
আজ কেন এত মনে পড়ছে তিতিক্ষার দেয়া সেইসকল নসিহাহ গুলো? কেন নিজের ভুলের কথা ভেবে এত কষ্ট হচ্ছে? আর কতদিন অবাধ্যতার অন্ধ স্রোতে ভাসতে ভাসতে বাচবে তিহা? শেষ পর্যন্ত কি আলোর পথে ফেরা হবে না? এভাবেই আল্লাহর অবাধ্যতায় অবগাহনরত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে সে?

তিহা সমাচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। বাইরে তখন ঝড় প্রবল। লোডশেডিং হয়েছে। বাতি জ্বালানোর কথা তিহার খেয়াল থাকে না। নিঝুম অন্ধকার ঘরে একা জেগে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে তিহা আল্লাহর দরবারে দুআ ধরে। চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে অনুতাপের জল।
তিহা কাতর গলায় বলে,’ইয়া আল্লাহ, পরম করুনাময়। না চাইতেও সারাজীবন আপনি আমার ও আমার পরিবারের ওপর অপার রহমাহ বর্ষন করেছেন। আপনার দেয়া নিয়ামতে ডুবে থেকেও আমি অবাধ্য হয়েছি বারবার। তবু আপনি আমাকে শাস্তি দেননি, প্রতিবার সুযোগ দিয়েছেন নিজেকে শুধরে নেবার। আর প্রতিবারই এই গাফেল বান্দা আপনার অনুগ্রহ সম্পর্কে উদাসীন থেকেছে। ইয়া রব, আসমান জমিনের মালিক, আপনি আমাকে সর্বাত্মক ভাবে ক্ষমা করুন। আপনার সৎকর্মশীল বান্দা হিসেবে কবুল করুন। আর জাগতিক সমস্ত কষ্ট আসান করে দিন আমার ও আমার পরিবারের জন্য। আমিন ইয়া রব।’

চলবে….

দূর আলাপন ~ ১৭
___________________________
সলাতের পাটি ভাজ করে শুয়ে পড়ল তিহা। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর গোটা একটা রাত জেগে থেকে শরীর এইবার ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে। নিঝুম প্রায়ান্ধকার ঘরে একা বিছানায় শুতেই ঘুমে জড়িয়ে এলো দুচোখ। ছোটন আজ তার মিমির সঙ্গে মিমির ঘরে ঘুমিয়েছে। ছোট পরিসরের খাটে জায়গা অপ্রতুল বলে ফজরের সলাতের জন্য বোনকে জাগিয়ে তিহা ফিরে এসেছিল আপনার ঘরে। সলাত শেষ করে শোয়ার পর বোধহয় দশ মিনিটের মতো ঘুমিয়েছিল। শেষ রাতের নিরবতা ভেঙে অতর্কিতে বেজে উঠল ফোন। অবসন্ন দেহে আর একবিন্দু নড়ার শক্তিও নেই। তবু একটা নিশ্বাস ফেলে ঘুমের ঘোরে উঠে হাতড়ে হাতড়ে ফোন খুঁজে বের করল তিহা।

আধো চোখে ফোন হাতে নিয়ে দেখে অপরিচিত এক বিদেশি নাম্বার। একরকম আচ্ছন্নতার মাঝে ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকালো।
‘হ্যালো…’ তিহার দায়সারা স্বর।

‘আসসালামু আলাইকুম আপু। আপনি কি তিহা বলছেন?’
‘হ্যাঁ… ওয়া আলাইকুমুস সালাম…. কে আপনি?’ ঘুম জড়ানো স্বরে থেমে থেমে তিহা বলে।

‘আমি হাসনাত। নিনাদের বন্ধু। গুড স্ট্রিটে আমরা একই বাড়িতে থাকি। বড় অসময়ে ফোন করে ফেললাম বোধহয়। তার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখীত। বাংলাদেশে এখন মধ্যরাত। তাইনা?’

‘মধ্যরাতও নয়। শেষরাত এখন। ভোর হতে আর খানিক সময় বাকি… কিন্তু… হঠাৎ আপনি কল দিলেন যে? নিদু কোথায়? এত কল করা হচ্ছে ও রিসিভ করছে না কেন?’

‘আসলে… কিভাবে যে বলি… দূরদেশে থাকা কাছের মানুষের প্রতি মানুষের আবেগটা হয় অন্যরকম। ভালোবাসার সঙ্গে মিশে থাকে তীব্র ভয়। ব্যাপার টা হয়তো নিনাদের ফুফুকেই প্রথম জানানো উচিত ছিল। কিন্তু অতটা সাহস আমার হলো না।’

‘কিসব বলছেন আপনি? নিনাদের কি হয়েছে?’

‘আপনি শান্ত হোন। বলছি। আপনি ব্যাপার টা স্থির ভাবে নেবেন বলেই আমার বিশ্বাস। নিনাদের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে। একটু মেজর। প্রেসার ফল করেছে, সেদিন দুপুরে চেয়ার থেকে হঠাৎ পড়ে গেল। জ্ঞান নেই। কাছাকাছি একটা নার্সিং হোমে নিয়ে জানলাম নার্ভাস ব্রেকডাউন। পড়ে হাতে পায়ের দু একটা জায়গায় অল্প আঘাত পেয়েছে। আসলে আমরা বুঝতে পারছি না হঠাৎ কেন আর কিভাবে এমন হলো। তবে নিনাদটা মানসিক ভাবে খুবই বিধস্ত অবস্থায় আছে।’

‘কিহ! ইন্না-লিল্লাহ… এ…এসব কবে হলো? এখন কেমন আছে ও? অবস্থা বেশি খারাপ নয়তো?’

‘ঘটনা টা কদিনের পুরনো। আপনাদের জানাবো কি-না, এই দ্বিধা দ্বন্দ্বে দুটো দিন এমনিতেই কেটে গেল। আলহামদুলিল্লাহ, আপাতত ভালোই আছে বলা যায়।
শিউলি ফুফু ওর মা স্থানীয়। ছেলের অসুস্থতার খবর জানার অধিকার ওনার আছে। তাছাড়া এই কদিন তিনি লাগাতার কল দিয়ে গেছেন। কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না তাই আমরা কেউ রিসিভ করিনি৷ আপনি এবার প্লিজ ব্যাপার টা যতটা সম্ভব হালকা ভাবে ওনাকে জানান। এই সময়ে মায়ের মতো কারো দুআ নিনাদের ভীষণ প্রয়োজন।’

‘হ্যাঁ… বলবো… বলবো আমি।’ তিহার গলার স্বর খাদে নেমে আসে। কাটার মতো কিছু একটা যন্ত্রণা হয়ে গলায় বিঁধতে থাকে।

‘আপু, আর একটা কথা…. ইয়ে… তিতিক্ষা কে আপনি জানেন?’

‘কেন?’ সন্দিগ্ধ তিহার নিশ্বাস আটকে এলো।

‘নিনাদ বেশ কয়েকবার ওই মানুষটার খোঁজ করেছিল। আর বলছিল ওকে দ্রুত বাংলাদেশে ফিরতে হবে।’

‘এখনি… সময় ফুড়াবার এত আগেই ও দেশে ফিরতে চাইছে?’

‘হ্যাঁ, এই অবস্থাতেও চেষ্টা করছে ফ্লাইটের তারিখ এগোনোর। সামনের মাসের টিকিট ক্যান্সেল করে কিছুদিনের মধ্যে যেন বাংলাদেশে যাওয়া যায়।’

উত্তরে কি বলবে খুঁজে পেল না তিহা। স্তব্ধতা থামিয়ে একসময় শুধু বলল,’হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র কবে পাবে? আর ভাই আপনারা ওর একটু খেয়াল রাখবেন প্লিজ…’

‘তা তো অবশ্যই। ডক্টর অবশ্য বলেছেন ঝুকিটা এড়ানো গেছে। আসলে ক্ষতটা তো অধিকাংশেই মানসিক। কোনো একটা ঘটনার নিমিত্তে ও চূড়ান্ত ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শীগ্রই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।’

‘তাই যেন হয়…’

‘শুধু বুঝতে পারছি না এসবের পেছনে কারণ টা ঠিক কি! নিনাদের কোনো প্রেম ঘটিত ব্যপার স্যপার আছে বলে তো জানা ছিল না। সরল শান্ত ছেলে, হৈ-হুল্লোড় এড়িয়ে চুপচাপ নিজের মতো থাকে। আগে যদিও বেশ প্রাণোচ্ছল ছিল, এখানে এসে যেন বেশ নিবিড় হয়ে গেছে।’

উত্তরে নিঃশব্দ তিহা।

‘আচ্ছা আপু এখনকার মতো ফোন ছাড়ছি। ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।’

‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম… ‘ওপাশে কল কেটে যাবার পরও কিছুক্ষণ কানে ফোন নিয়ে বসে থাকে তিহা।

দীর্ঘ দিবসের ক্লান্তিতে কাতর চোখজোড়া থেকে ঘুম উধাও। তিহা লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবে নিনাদের দিকের অনুভূতি গুলো কি তবে নির্ভেজাল? অথচ অত কাছের বন্ধু হয়েও তিহা বোঝেনি! কি অনায়েসে বোনকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো অন্যত্র। সব ঠিক থাকলে এতদিনে তিতিক্ষা অন্যকারো ঘরনি হতো!
আর তিতিক্ষা… তার মনের গহনেও কি অনুভূতি নামক চারাগাছের কোনো ডালপালাই বিস্তার লাভ করেনি? না, তা কি করে হয়? হলে কি আর অত সহজে সেই প্রভাষকের সঙ্গে বিয়েতে সম্মত হতো তিতিক্ষা? নিনাদের ভালোবাসা কি তবে চিরকাল একপাক্ষিকই ছিল?
চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়ালো। নিনাদটা অত দুর্ভাগা কেন? কেন ভালোবাসা নামক রিযকের এত সল্পতা তার জীবনে? তিতিক্ষা কি কোনোদিন নিনাদের জীবনের শূন্যতা একটুও বুঝেছে? বোঝার চেষ্টা করেছে?
না করার সম্ভাবনাই প্রবল অথচ তিতিক্ষার জীবন বিপর্যয়ের গল্প মুঠোফোনে শুনেও কেমন করে নিনাদ ভেতর থেকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল সেটা তিহা টের পেয়েছিল অল্পস্বল্প। বাক্যবাগীশ নিনাদ, যার কথার মাঝে সদাসর্বদা একটা দুরন্তপনার অভিসন্ধি প্রচ্ছন্ন থাকে, সে ভয়ংকররকম নিস্তব্ধ হয়ে গেছিল সেসব শুনতে শুনতে।

.

স্যুপের বাটি নিয়ে তিহা দরজায় দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলে,’আসব?’

‘এসো’ তিতিক্ষার শান্ত প্রত্যুত্তর।

চিরন্তন অধিকারবোধ থেকে কাছে গিয়ে বোনের কপালে হাত রাখে তিহা,’ জ্বর তো কমেছে মনে হচ্ছে। অন্যকোনো অসুবিধে নেই তো?’

‘না আলহামদুলিল্লাহ এখন ঠিক আছি।’ বলতে বলতে তিতিক্ষা বিস্ময়ের চিহ্নখচিত মুখখানা ওপর তুলে স্থির হয়ে যায়, ‘মা শা আল্লাহ বুবু। এই পোশাকে তোমায় আরো পবিত্র দেখায়।’

ঈষৎ লজ্জা পেল তিহা। সেটা দ্রুত ঢাকতেই কণ্ঠে আবারো জড়িয়ে নিল গম্ভীরতার চাদর।
‘আমি বেরোচ্ছি। আজ তো বৃহস্পতিবার। ছোটনের হাফডে। দ্রুত ফিরব ইন শা আল্লাহ। খালা রইলো, কিছু লাগলে ওনাকেই বলিস।’

‘আচ্ছা বুবু। আসসালামু আলাইকুম।’

নিম্ন স্বরে সালামের জবাব করে আরো কিছুকাল দাঁড়িয়ে থাকে তিহা। মাথায় জড়ানো হিজাব, গায়ে বোরকা। একটা প্রচ্ছন্ন অস্বস্তি। ছোটনের বন্ধুর মায়েরা তিহাকে আধুনিকা বলে বেশ সমীহ করে। শাড়ি, অলংকার কেনার আগে পর্যন্ত তিহার পরামর্শ না পেলেই না। আজ তিহাকে নতুন বেশে দেখে ওদের অভিব্যক্তি গুলো কেমন হবে? তাচ্ছিল্য, তিরস্কার, নাকি উৎসাহ?

যদিও রাতের সেই অসহায়, অবর্ণিত আতঙ্কের আবেশটা এই দিনের আলোতে বেশ সুদূর বলে মনে হয়। সমস্ত ভয় ভীতির চিন্তারা যেন রাতের জমাট অন্ধকারের সাথে সাথে মনের বিশুদ্ধ কোন ছেড়ে গায়েব হয়েছে। তবু কিছু একটা তিহাকে নিজের এই নতুন সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকতে বারবার উৎসাহিত করে। এটাই কি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবার প্রতিক্রিয়া? তিনিই কি তবে তাকে এই পথে অবিচল থাকার শক্তি দিচ্ছেন?

ভেবে আনমনে তিহার দৃষ্টি একাই নিপাতিত হয় বোনের নিষ্প্রভ মুখের পানে। নিমীলিত চোখের ফ্যাকাসে মুখটা যেন শরতের সবুজ দীঘিতে ফোঁটা শ্বেতপদ্মের মতই নির্মল। অবচেতন ভাবে তিহা সেই ক্লেশ জড়িত স্থির কান্তিতে কিছু একটা খোঁজে। হয়তো সামান্য একফালি ভালোবাসার চিহ্ন… হ্যাঁ, নিনাদের জন্য ওই মায়াময় মুখের কোথাও কি সামান্যতম অনুভূতির স্ফুরণ নেই?
কিন্তু কই, কিছুই তো নজরে আসছে না। ভালোবাসার যে স্বতন্ত্র ভাষা থাকে। ঐচ্ছিকতা তাকে যতই আড়াল করার চেষ্টা করুক, অবচেতনে তার সামান্য প্রকাশ যে অবধারিত। তিহা খুঁটিয়ে দেখে বোনের মুখ, অতল দুখানা চোখ, ভ্রুলেখার ঋজুতা…. সব জুড়ে কেবল মায়া আর মায়া। অথচ… যা খুঁজে বেরাচ্ছে তার সন্ধান যেন কোথাও নেই! এত বছরেও কিছু জন্মায়নি যখন তবে আর কবে জন্মাবে?

.

আজকাল তিহার দিনগুলো কাটছে একটু ভিন্নরকম ব্যস্ততায়। সলাতে সে আগে থেকেই নিয়মিত ছিল। এই অভ্যেস ছোট কালের। বাবা শিখিয়েছিলেন জীবনে যত ঝড়-ঝঞ্ঝা আসুক, এক ওয়াক্ত সলাত কখনো যেন বাদ না পড়ে। মানুষের দেহের খোরাক যেমন খাদ্য, তেমনি রূহের খোরাকী হলোর প্রভুর একান্ত ইবাদাত। দেহের খোরাক ছাড়া যেমন কোনো মানুষ সুস্থ হয়ে বাঁচে না তেমনি রূহের খোরাকী ছাড়াও তার মৃত্যু অবধারিত।
তবে এই সলাতকে তিহা তার জীবনের একটা দায়সারা অংশ ভেবে নিয়েছিল। মুসল্লায় দাঁড়িয়ে কলের পুতুলের মতো একের পর এক সূরা আবৃত্তি করে যাওয়া। যেথায় কোনো প্রাণ নেই, রবের সান্নিধ্যে অন্তরে তীব্র ভাবাবেগের জোয়ার নেই।

এখন সে এই সলাতটাকে ঠিক করার প্রয়াস চালাচ্ছে। হাশরের ময়দানে সবার আগে নাকি হিসেব নেয়া হবে বান্দার সলাতের। তাছাড়া কোথায় যেন শুনেছিল, সহিহ ভাবে সলাত আদায় বাকি সব পাপকাজ থেকেও বান্দাকে দূরে রাখে। তিহা ভেতরে প্রবল এক তাড়না অনুভব করে আজকাল। তাকে এই জীবন ধারা বদলাতে হবে। যার জন্য সবার আগে প্রয়োজন করুণাময়ের প্রতি একান্ত প্রার্থনা সঠিক উপায়ে করা।
চলবে…..

দূর আলাপন পর্ব-১৪+১৫

0

দূর আলাপন ~ ১৪
___________________________
কথা ছিল এই মাসের শেষে ফিরবে নিনাদ। এরই মধ্যে শিউলি নিনাদের বাড়ির তালা খুলে সেখানে উঠেছেন। আর দেরি নয়। মেয়ে পছন্দ করাই আছে। এদিকে সব গুছিয়ে রাখবেন তিনি। ছেলে দেশে ফিরলে কোনরকম বিলম্ব না করে তিন কবুল পড়িয়ে দেয়া হবে। শিউলির সঙ্গে আছে আফরিন। নিনাদ ভাইয়ের বিয়ে অথচ সে থাকবে না এমন হতে পারে কখনো?

ভাতিজিকে নিয়ে শহরে এসে একটু গুছিয়ে উঠতেই শিউলির মন উচাটন হয়ে ওঠে বিয়ের চিন্তায়। ঠিক করলেন যাবেন নিনাদের বন্ধুর বাড়ি। তিহা ও তার পরিবারের সঙ্গে নিনাদের নিখাত বোঝাপড়ার ব্যপারটা শিউলি যারপরনাই অবগত। তাছাড়া ওরা সব এ যুগের ছেলেমেয়ে। বিয়ের সাজপোশাকে কোন জিনিসটার চল এখন, ওরাই জানবে ভালো। নিনাদের বিয়ের ব্যাপারে তিহার পরামর্শ নেয়া শুধু সৌজন্যতা নয় জরুরিও বটে। এক বিকেলে তিহাকে খবর দিয়ে ভাতিজিকে সঙ্গে নিয়ে শিউলি বেড়িয়ে পরলেন ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

——————-

তখন মধ্যদুপুর। জোহরের সালাত শেষে তিতিক্ষা কুরআন তিলাওয়াতে বসেছে। বৈশাখের উত্তপ্ত দিনগুলো কেটে যাচ্ছে সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে। শিথিল সবকিছু, জীবন, জীবনের খেয়াল আর তার গতি। দুপুরের গাঢ় সোনালি রঙের রোদ হেলে পড়ে বারান্দায়। বারান্দার দোরের গা ঘেঁষে বসে তিতিক্ষা আনমনে গায়ে মাখে রোদ। রোদে আগুনের হলকা। যেন শুধু সোনালি আলো নয়, উত্তপ্ত অনলের কণা ছড়াচ্ছে দুপুরের বাতাস। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তিতিক্ষার কপালে। সে তবু নির্বিকার, একমনে আচ্ছন্ন সুরে পড়তে থাকে কুরআন। মাঝে মাঝে মুখ শুকিয়ে এলে দু’দন্ড থেমে তাকায় বাইরে। দায়সারা ভাবে দেখে বারান্দায় তিড়িংবিড়িং নেচে বেড়ানো, অনবরত কিচিরমিচির করতে থাকা একদল চড়ুইকে। তারপর মুখ ফেরায় আবারো। এই ভীষণ উপেক্ষা বোধহয় চড়ুই দলের পছন্দ হয় না। ওরা হাঁকডাক বাড়িয়ে তোলে। তিতিক্ষা অবশ্য আর ফিরেও তাকায় না। দুপুর রঙের পাখিরা বিস্ময় নিয়ে দেখে কি নির্দয় নিষ্ঠুর মন মেয়েটির!

একসময় পড়া থামিয়ে দেয়ালে কাঠের তাকে কুরআন তুলে রেখে, আবারো পূর্বের জায়গায় মেদুর পায়ে ফিরে এসে চুপচাপ শুয়ে পরে নিচে। ঠান্ডা মেঝেতে শরীর এলিয়ে খুব ধীরে ধীরে শ্রান্তির নিশ্বাস ছাড়ে তিতিক্ষা। চোখ বুজে পড়ে রয় অনেকক্ষণ। একসময় তিহা এসে বোনের অবিমিশ্র তন্দ্রায় ছেদ ঘটায়। পাশে বসে কোলের ওপর তিতিক্ষার মাথাটা তুলে নিয়ে আঙুল বুলোতেই ও চোখ মেলে। মাথার ওপর ঝুঁকে থাকা তিহার মলিন মুখে ম্লান হাসি। হাতে থাকা ক্রিমটা নিয়ে আস্তে আস্তে বোনের মুখের কাটা দাগ গুলোর ওপর মেখে দেয়। যন্ত্রণায় তিতিক্ষা একবার মুখ কোঁচকায়।
‘জ্বালা করছে?’
তিতিক্ষা নিরুত্তর।

‘একটু পর আর জ্বালা করবে না।’

‘ছেড়ে দাও বুবু।’

‘তা বললে কি হয়? ওষুধ না মাখলে যে ইনফেকশনের ভয়।’

কিয়ৎকাল নিরব থেকে তিহা পুনরায় বলে, ‘তিতি, একটা কথা বলব?’

‘বলো’

দু দন্ড ইতস্তত করে তিহা,’বাসায় দুজন মেহমান আসার কথা বিকেলে। আজ একটু বোনের বাধ্য হয়ে থাকতে হবে। কোনো এলোমেলো আচরণ করা যাবে না, কেমন?’

তিতিক্ষা এবার স্পষ্ট করে চোখ মেলে। সারা মুখে ছড়িয়ে যায় মৃদু সহজাত হাসির আভা, ‘আমি তোমাদের খুব জ্বালাই। তাই না বুবু?
কোন ভদ্র বাড়িতেই বোধহয় অতটা অনাচার কেউ সহ্য করতো না।’

তিহা কিঞ্চিৎ হতবাক হয়। আজকাল তিতিক্ষার মন মস্তিষ্ক প্রায় সারাক্ষণই উত্তপ্ত থাকে। আচার আচরণের অসংলগ্ন তো রয়েছেই, তাই ওর সামনে কথা বলার ব্যপারে অত সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয় আজকাল তিহা খেয়াল রাখে না। কথা পছন্দসই না হলে তিতিক্ষা অভিমান করবে, এমন সম্ভবনা নেই বলে।
কিন্তু আজ…..

উত্তর না পেয়ে তিতিক্ষা আবারও বলে,’আচ্ছা বুবু, তোমার ক্লান্ত লাগে না? দিনরাত একটা পাগল মেয়ের সঙ্গে থাকো, নিরবে সমস্ত অত্যাচার সহ্য করো। আমি হলে কখনো পারতাম না জানো?’
তিহা এবারেও কথা বলল না। বোনের মুখপানে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। অনেক অনেকদিন পর তিতিক্ষা নিজ থেকে কথা বলছে ওর সঙ্গে। এই তীক্ষ্ণ গহন চাহুনি, ধীর শান্ত মুখ কতকাল দেখেনি তিহা। আজ ও কথা বলুক, তিহা শুধু শুনবে।

‘বিকেলে কারা আসবে বুবু?’

‘তোর শিউলি ফুআম্মা আর আফরিন।’

‘আফরিনের কি বিয়ে হয়েছে?’ দেয়ালের পানে তাকিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে তিতিক্ষা।

‘হ্যাঁ’

কিছুকাল স্তব্ধতা।

‘ইন শা আল্লাহ আমি কিছু করব না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’

তিতিক্ষার কথায় কেন যেন হঠাৎ চোখে জল এলো তিহার। বাষ্পরূদ্ধ স্বরে বলল, ‘সবসময় কেন এমন থাকতে পারিস না বলতো?’

‘চাই তো। কিন্তু… পারি না যে…
মাথার ভেতর কি যেন হয় হঠাৎ হঠাৎ… বোধহয় একটা পাজি পোকা কামড় বসায় কুট করে। আর তারপর শত চেষ্টায়ও আমি আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারি না।
আমার সমস্যা টা তুমি, তোমরা কেউ কখনো বুঝবে না বুবু। যার জীবনে অমন বিষাক্ত কালো অধ্যায় নেই তারা কেউ কোনোদিন বুঝবে না। মাঝে মাঝে কি ইচ্ছে হয় জানো? শিরার রগটা কেটে সব যন্ত্রণার অবসান ঘটাই। একা ঘরে আমি তন্দ্রার মতো সুখের মাঝে মরব। আশেপাশে বাধা দেয়ার মতো কেউ থাকবে না। কিন্তু… এরপরই মনে হয়, ইচ্ছে হলেই মরে যাওয়াটা আসলে একটা বোকা সিদ্ধান্ত। যারা স্ব ইচ্ছায় মরে তাদের না থাকে ইহকাল আর থাকে পরকাল বলে কিছু। আল্লাহ কে পাওয়ার শেষ আশাটুকুও সেই মৃত্যুর সাথে সাথে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এরচেয়ে বাজে আর কিছুই হয়না। তাই আমি কখনো আত্মহ ত্যা করবো না বুবু, বুঝলে?’

‘কিসব উল্টোপাল্টা কথা বলিস তুই! চুপ কর…
তোর কোনো অপরাধ নেই, একথা আমরা সবাই জানি। তবে তুই কেন মরার কথা বলিস?’ বলতে বলতে জল গড়ায় তিহার গাল বেয়ে।

‘অপরাধ হয়তো নেই কিন্তু অপবাদ ষোলোআনা আছে। তোমার হাজার প্রতিরোধের পরেও যা ঠিকই আমার কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কষ্ট হয়। বছরের পর বছর ধরে অর্জিত সম্মান মানুষ হারিয়ে ফেলে কত অল্প সময়ে! একটা অভাবিত ঘটনা বদলে দিতে পারে কতকিছু। দুনিয়াটা যে কত ঠুকনো আজকাল বেশ ভালো বুঝতে পারি। মানুষ শুধু সেটুকুই বিশ্বাস করে যেটুকু তারা চোখে দেখে। এর বাইরে আর কিছুই যেন সত্যি হবার নয়। একসময় আমাকে তারা সমাজের আর দশটা মেয়ের আদর্শ বলে স্বীকার করত অনায়াসে। যখন সব আধুনিকার মাঝে একা আমি ছিলাম অন্তঃপুরবাসিনী। এখন আমাকে মেয়ে জাতের কলঙ্ক বলেও স্বীকার করে অনায়াসে। যখন তাদের সামনে অভিসারিণী বলে প্রমানিত হলাম আমি।’

‘কিন্তু তোর কোনো ভুল তো নেই… তবু কেন যে আল্লাহ এতবড় পরীক্ষায় ফেললেন…’তিহার গলায় বাজে আফসোসের সুর। তিতিক্ষা নির্বিকার।

সহিষ্ণু কণ্ঠে বলে,
‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতীত কিছু চাপিয়ে দেন না বুবু। সব কষ্টেরই দাওয়াই আছে আল্লাহর কালামে। সেজন্যই বিশ্বাসীরা কুরআন থেকে প্রশান্তি পায়। আজ আমার ওপর যে পরীক্ষা এসেছে কুরআনে তারও নিয়ামক নেই ভেবেছো? পূর্ববর্তী যুগে আল্লাহর এক প্রিয় বান্দিকেও তো এভাবেই সমাজের রোষানলে পড়তে হয়েছিল, কোনো অপরাধ ছাড়াই। একান্ত ভাবে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন মারইয়াম যখন কোনো পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়া অলৌকিক ভাবে গর্ভবতী হলেন তখন তাকে সমাজ থেকে দূরে যেতে হলো নিজেকে আড়াল করার জন্য। একা একজন মেয়ে, জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর সময়ে যার পাশে কেউ নেই। বিরান স্থানে একা খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে তিনি তখন কষ্টে কি বলছিলেন জানো?
❝হায়, আমি যদি এর আগেই মরে যেতাম আর মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম❞

মারইয়াম আলাইহিসসালামের দুঃখের মাত্রাটা তুমি অনুভব করতে পারো বুবু? আল্লাহ চাইলেন তার মাধ্যমে এক অলৌকিক ঘটনার সৃষ্টি হবে। যুগে যুগে মানুষকে যা বিস্ময়াভিভূত করবে কিন্তু মারইয়াম যে সাধারণ এক মানুষ, তারও যে আছে মানবীয় দুঃখ কষ্ট। যা সইতে না পেরে তিনি উপরিউক্ত কথা বলেছিলেন।
তাছাড়া যে যন্ত্রণা তিনি ভোগ করছিলেন তা লাঘব হবারও কোনো পথ ছিল না কারণ সন্তান জন্মাবা মাত্র সেই সন্তানের পিতৃ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কলঙ্কিত করা হবে মারইয়ামের চরিত্রকে। অথচ এই পুরো ঘটনায় তার কোনো হাত নেই!

মারইয়ামের এই মানবীয় দুর্বলতাকে কিন্তু মহান রব তিরস্কার করেননি। বরং ফেরেশতা জিবরিল আলাইহিসালাম আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মারইয়ামকে জানিয়েছিলেন,
❝তুমি দুঃখ করো না❞

এবার তুমি বলো বুবু, আমার দুঃখ মারইয়ামের দুঃখের তুলনায় কতটুকু? তবু কি আমি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? আফসোস করবো আল্লাহ আমার ওপর পরীক্ষা আরোপ করেছেন বলে?

তিহা বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। এত সুন্দর করে কথা বলা কোথা থেকে শিখল মেয়েটা? ছোট বেলা থেকেই তো ছিল ভীষণ গম্ভীর। কারো সঙ্গে বেশি মিশতো না… কথা বলতো না… দিনরাত নিজের মনে একা একা খেলতো। একটি প্রশ্নের উত্তর শুধু একটি শব্দেই দিত। তখনো মাঝে মাঝে ঠিক এভাবে গুছিয়ে খুব সুন্দর কিছু কথা সে বলতো। তার সেসব অল্প কিন্তু আকর্ষণীয় কথা শোনার জন্য বাবা চাতক পাখির মত অপেক্ষা করে থাকতেন। তিতিক্ষার সব কথাই বাবা গভীর আবেগ নিয়ে শুনতেন। শুনতেন কারণ তিতিক্ষার মাঝে মায়ের ছায়া প্রবলতর ভাবে ছিল বলে। যখন ও কথা বলতো, হাসতো খিলখিল করে তখন যেন মায়েরই পূর্ণ প্রতিচ্ছবি দৃশ্যতঃ হতো ওর মাঝে।

কিন্তু মায়ের সব সৌখিন স্বভাব গুলো অমন নিখুঁত ভাবে তিতিক্ষা নিজের মধ্যে ধারণ করল কেমন করে? মা যখন মারা গেলেন, তখনো ও কেবল কোলের শিশু। তবুও মায়ের সেই দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা, সেই একগুঁয়ে স্বভাব আর রেগে যাওয়া কপালের বক্র কুঞ্চন… সব পেয়েছে তিতিক্ষা। পরিপূর্ণ ভাবেই পেয়েছে। তিতিক্ষা যখন রাগে, যখন ওর চোখে জলের আভাস দেখা দেয়, তিহার মনে পড়ে বহু বছরের পুরনো এক দৃশ্য। ঝাপসা হয়ে আসা মায়ের স্মৃতি। চলায়, বলায় তিতিক্ষা যেন আদতেই তাদের মা আয়েশা রেহনুমার প্রতিচ্ছবি।

গভীর মমতায় বিগলিত হয়ে বোনের মাথায় হাত রাখে তিহা। চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়ায়, তিহা বলে, ‘এইতো মায়ের আদর্শ মেয়ের মতো কথা। এমন করে কতকাল তুই কথা বলিস না আপু। তোর বোকাসোকা অজ্ঞ বোন কত কি ভুলভাল কথা বলে ফেলে, তুই ই তো সবসময় তাকে ঠিক টা চিনিয়ে দিতি। তাওয়াক্কুল হারিয়ে ফেললে নতুন করে মনের আশার আলো সঞ্চার করতি। কেন আগের মতো হয়ে যাস না?’

_____________________

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শিউলি ফের একবার নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখলেন। বিরক্তিতে কপালে ভাজ পড়ল। বিকেলটা প্রায় গড়িয়েই গেল। আর কখন যাওয়া হবে? আফরিনের সাজগোছ মনে হচ্ছে অন্তত কাল ধরে চলবে। এবার একটা কড়া গলায় ধমক দেয়া দরকার। ঢাকা শহরের কতটুকুই আর তিনি চেনেন। যেটুকু চেনেন, সন্ধ্যা নামার পর সেটুকুও গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা প্রবল। অথচ সব জেনেও ওই বিলাসী মেয়ে এখন বিয়ের বাড়ির সাজ সাজতে বসেছে। চরম বিরক্ত হয়ে শিউলি তীক্ষ্ণ তানে চেচালেন।

ভেবেছিলেন পুনরায় বাসার ভেতরেই যাবেন, কান ধরে টেনে নিয়ে আসবেন বদ মেয়েকে। তার আগেই দেখা গেল মেয়ে রিনঝিন শব্দ তুলে দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। বেশ মনোযোগ দিয়ে দরজায় তালা দিচ্ছে। শিউলি আড়চোখে তাকালেন। গাঢ় নীল জমিনের ওপর সাদা, গোলাপি নকশাদার শাড়ি, আচঁলের টার্সেলে ঝুনঝুনি জাতীয় কি যেন লাগানো। যখনি ও হেলছস দুলছে, মৃদু লহরে ঝনঝন শব্দ বাজছে। দুহাত ভর্তি রেশমি চুড়ি, পুরূ লম্বা বেণি পিঠের ওপর শান্ত ভাবে হেলে আছে। মেয়েটাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। তবে আজকের উপলক্ষের সঙ্গে এই সাজগোছ কিঞ্চিৎ বেমানান। গ্রামের মেয়ে, সাজপোশাক নিয়ে অত জ্ঞান থাকার কথা নয়। তবু মেয়েটাকে সাজলে ভালোই লাগে কিন্তু কোথায় কোন জিনিসটা মানানসই সে জ্ঞান একেবারে নেই।

আফরিন অবশ্য অনেকক্ষণ ধরে হাসছিল মিটিমিটি। একটা ছেলেমানুষী দুষ্টুমির ফন্দি এঁটেছে ও, তাই ভেবে এত হাসি। নিনাদকে নিষেধ করেছিল বিয়ের খবর টা ওবাড়িতে এখন জানাতে। আফরিনের ইচ্ছে নতুন বউদের সেজেগুজে তিতিক্ষাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে সবাইকে বিয়ের খবরটা দিয়ে চমকে দেবে।

শিউলি গম্ভীর হয়ে ভাতিজির পানে তাকালেন,’হইসে অত নিটকাইস না। বিয়াইত্তা মাইয়া। কোনো লাজ শরম নাই। নিজের বিয়ার খবর নিজে ঢাকঢোল পিটায়া কইবার খুশিতে নিটকাইতাসে কেমনে দেহো! পিড়িত কইরা তো মিনহাইজ্জার মাথাডা খাইসস। সাথে কি এহন নিজের লাজ শরমও গিলা খাইসস? চল!’

ফুআম্মার কাছে একটা রাম ধমক খেয়েও আফরিনের হাসি মুখ মলিন হল না। শিউলির পিছু পিছু রাস্তায় বেরিয়ে এমনকি মোহাম্মদপুর থেকে ঝিগাতলা আসবার সারা পথে সে তার নির্লজ্জ হাসি বহাল রাখল।

.

ঘরের বাইরে শিউলিকে দেখে বহুদিন পর হাসিতে ঝলমলিয়ে ওঠে তিহার মুখ।
‘এইতো এসে গেছে! আসসালামু আলাইকুম ফুআম্মা।’

-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছোস তোরা? তোর বুড়াটা কই?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। বুড়া কই আবার! কাছেপিঠেই আছে। অনেকদিন পর এলেন তো। একটু লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়। তাই ভদ্রতা দেখিয়ে আড়ালে আছে আরকি। দুটো মিনিট পার হতে দিন, কোথায় উড়ে যাবে ওর লজ্জাফজ্জা! দেখবেন কেমন মাথায় উঠে নাচে।’

বলতে বলতে শিউলির পেছনে আফরিনকে দেখে উচ্ছ্বাসে চেচিয়ে ওঠে তিহা,’ আরে আফরিন! ফুআম্মার আড়ালে কেন? এসো এসো সামনে এসো দেখি। বাহঃ কি মিষ্টি দেখাচ্ছে! ঠিক নতুন বউদের মতো। তা নতুন বউ বউ ঘোরটা বুঝি এখনো কাটেনি তোমার?’

আফরিন চমকে তাকাল। দপ করে নিভে গেল মুখের হাসি। তার এত বারণের পরও নিনাদ ভাই তাহলে এদেরকে সত্যিটা বলে ফেলেছে! বাচ্চাদের মত ভ্রুকুটি করে গোমড়া মুখে বলল,’ধ্যাৎ! আমি ভাবছিলাম সারপ্রাইজ দিমু। নিনাদ ভাই সমসময় এমন করে আমার সাথে। দেখছো চাচি, নিনাদ ভাই ঠিকি কয়া দিসে। দেশে আসুক শুধু, নিনাদ ভাইয়ের একদিন কি আমার একদিন…’

আফরিনের ছেলেমানুষী দেখে তিহা হেসে ফেলে, ‘রাগ করো না আফরিন। নিনাদটা কেমন মাথামোটা জানোই তো। ওর কি কিছু খেয়াল থাকে?’

নিনাদকে মাথা মোটা বলায় আফরিন অতন্ত্য আনন্দিত হল। ওপর নিচ মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক কইছেন। নিনাদ ভাইয়ের মাথা পুরাডাই গোবর পোড়া। আইচ্ছা থাউক, মাফই কইরা দিলাম।’

আফরিনের ভীষণ কথাটা শুনে শিউলি কটমট করে তাকালেন,’বেত্তমিজ মাইয়া চুপ কর। সামনে তো আমার নিনাইদ্দারে বাঘের মত ডরাস। আর পিছনে বয়া এমনে বেত্তমিজি করস? আয়ুক এইবারে নিনাইদ্দা। তোর বহুত বাড় বাড়ছে। বিয়া অইসে দেইখা কি হইছে? মাফ পাইবি ভাবসস?’

ফুআম্মার শাসানিতে বোধহয় একটু ভয় পেল আফরিন। ছটফটানি বন্ধ করে স্থির রইল খানিকক্ষণ। তারপরই ছোটনের সঙ্গে মিশে পুনরায় ফিরে গেল আগের রূপে।

ফুফু ভাতিজির মিষ্টি ঝগড়া উপভোগ করছিল তিহা। সহসাই হুশ হলো, অতিথিদের নাশতার ব্যবস্থাও একা হাতে ওকেই করতে হবে। হাসি থামিয়ে বিব্রত ভাবে তিহা বলল,’ফুআম্মা বসুন আমি একটু আসছি…’
আশেপাশে কৌতুহলী চোখ বুলিয়ে তখন কাউকে একটা খুঁজছিল আফরিন। না দেখে শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে উঠে দাঁড়াল। পিছু ডাকল তিহাকে,’আপু… ছোট আপু কই? ওনারে যে দেখলাম না একবারো।’

চলতে চলতে তিহার পা জোড়া থামে। পেছন ফিরে একফালি কাষ্ঠ হাসি ছুড়ে দেয় চঞ্চলা মেয়েটির দিকে। তিহা জানতো আজ অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ওকে। উত্তর তৈরিই ছিল, ‘তুমি বসো আফরিন। খানিক পর তোমাকে নিয়ে যাব ওর কাছে। আসলে গত কয়েক মাস ধরে ও একটু অসুস্থ তো। এখন বোধহয় ঘুমোচ্ছে। আমি আসছি দাঁড়াও।’
দ্বিতীয় কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে তিহা চলে গেল।

সেবার খুব ভাব হয়েছিল আফরিন আর ছোটনের মাঝে। তার রেশ ধরে এবারেও ওদের আড্ডা জমলো বেশ। আফরিন বলতে শুরু করল গ্রামের উদ্ভট যতসব ভূতুড়ে গল্প। শ্রোতা হিশেবে ছোটন বরাবর ভালো। আজকাল আর মিমি তাকে গল্প শোনায় না, অনেকদিন পরে আফরিনের সংস্পর্শে এসে এই খামতিটুকু দূর হলো ছোটনের।

চায়ে চুমুক দিয়ে শিউলি তখন নিনাদের বিয়ে নিয়ে আলাপ জুড়েছেন তিহার সাথে। নিনাদের বিয়ের কথায় তিহারও প্রবল উৎসাহ। মারুফ মসজিদে গেছিলেন আসরের সলাত আদায়ের জন্য। নিজের ঘরে শুধু তিতিক্ষাই একা বসে। বাড়ির প্রতিটি কোণের সমস্ত কলরব এসে থমছে গেছে সেই ঘরের সম্মুখে। কিছুক্ষণের জন্য বাদবাকি সবাই ভুলে গেল বাড়িতে আরও একটি মানুষ রয়েছে। যে অহোরাত্র নিজ গৃহে স্বেচ্ছায় বন্দিনী। তিহার হুশ ফিরল তখন, যখন ভেতরের ঘরে থাকা ফোনের রিংটোন তার কানে এসে লাগল।
শিউলিকে বলে সেদিকে পা বাড়িয়েছিল তিহা। ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে পুনরায় ফিরে যাচ্ছিল বসার ঘরে। সহসা নজর পরল তিতিক্ষার ঘরের দরজায়। দরজার ফাঁকে ওর পোশাকের একাংশ দেখা যাচ্ছে। ফোন কানে চেপেই তিহা সেদিকে এগোয়। কাছে গিয়ে দেখে দরজায় হেলান দিয়ে তিতিক্ষা বসে রয়েছে মেঝেতে। তার দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির, বহু দূরে বাইরের ওই উঠোনে, যেখানে আফরিন ছোটনের পাশে বসে জাদুময়ী ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে নেড়ে কত কি বলে চলেছে। মুখের ভাজে ভাজে লেগে রয়েছে অনাবিল সুখের প্রচ্ছন্ন রেশ।
তিহার কথা থেমে যায়। ফোনের ওপাশে রওশান তখনো কি সব যেন বলছে। তিহা শুনতে পায়না। ফোন কানে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বোনের পাশে হাটু মুড়ে বসে পড়ে। তিতিক্ষার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে জিগ্যেস করে,’কি দেখছিস অমন করে?’
তিতিক্ষা নিশ্চল স্থির চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে সঙ্গিন স্বরে বলে,’ওর দেহে এত প্রাণ, আমি একটু ধার নেব।’
চলবে………

★অদ্রিজা আশয়ারি

দূর আলাপন ~ ১৫
___________________________
নির্জন ঘরটার সামনে এসে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আফরিন। এই অসময়ে ঘরের কপাট ভিড়ানো। অন্ধকার চুইয়ে আসছে ভিড়ানো কপাটের ফাঁক গলে। হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারে না সে। ইতস্তত করে একবার কড়া নাড়ে। কোনো সারা নেই। খানিক্ষন অপেক্ষমান থেকে একসময় নিরুপায় হয়ে বেশ একটু শব্দ করে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে পা বাড়ায় ভেতরে।

খানিকটা তন্দ্রার মতো পেয়েছিল তিতিক্ষাকে। সন্ধ্যায় সলাত ও মাসনুন আমল শেষের এই সময়টা রোজ বুবু ছেলেকে নিয়ে আসে। হালকা কিছু খাবার আর চায়ের সরঞ্জাম থাকে তার সঙ্গে। আজ কেউ এলো না। মাঝে মাঝেই বাইরে থেকে মিহি সুরে ভেসে আসছে কথার অনুরণন। আজ হয়তো বুবু আসবে না। ভীষণ ব্যস্ত নিশ্চয়ই। হওয়ারই কথা। এবাড়িতে তার নিজের মতো অকর্মা তো আর কেউ নেই। ভেবে মুসল্লা ভাজ করে উঠে বাতি নিভিয়ে দেয় তিতিক্ষা। আচ্ছন্নের মতন শুয়ে পড়ে বিছানায়। বালিশে মুখ ডুবিয়ে শুতেই গায়ের উত্তাপটা আবারো টের পায়। একটা জ্বর জ্বর গন্ধে যেন ওর আশেপাশের বাতাসটা ভারি হয়ে ওঠে ক্রমশ। ঈষৎ শীত শীত লাগে। পায়ের কাছে ভাজ করা পাতলা কাঁথাটা টেনে দেয় গায়ের ওপর। ঝুম অন্ধকার ঘরে জ্বরের রিমঝিম ঘোরে, মৃদু শীতল আমেজে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুতেই আরামে তার চোখ মুদে আসে। কিন্তু ঘুম যেন বহু দূরের বস্তু। তন্দ্রার মাঝে তিতিক্ষা টের পায় জ্বরের বেড়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে অবশ্য খারাপ নয়। ঝিমঝিমে অবশ এক অনুভূতির মাঝে পড়ে থাকা।

কতক্ষণ কেটেছিল কে জানে! হঠাৎ সে কপালের ওপর টের পায় একটা নরম ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। চোখ মেলতেই মৃদু আলোর রেখা ছুটে এসে ওর চোখের কোলজুড়ে লুটিয়ে পড়ে। সম্মুখে একটা মুখ, অস্পষ্ট অবয়ব। একরকম অবুঝ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তিতিক্ষা। যেন মনে করার চেষ্টা করে মানুষটি কে? ক্রমে সে বুঝতে পারে, মেয়েটা দূরের কেউ না। একসময় বেশ সখ্য গড়েছিল ওদের মধ্যে। যদিও তার স্থিতিকাল অল্প…
তিতিক্ষার কপালে তখনো আফরিনের হাত। জ্বরাচ্ছন্ন অসুখী মেয়েটার আকস্মিক চাহুনিতে আফরিন স্তব্ধতার হতশ্বাসে স্বাভাবিক কান্ডজ্ঞান অল্পকালের জন্য খুইয়ে ফেলেছে। তখন আস্তে আস্তে তিতিক্ষা তার হাতটা ধরল। মুহুর্তের জন্য একটু তরঙ্গ বয়ে গেল আফরিনের শরীরে। জ্বরে সমাচ্ছন্ন তিতিক্ষার হাত অস্বাভাবিক শীতল।
‘কেমন আছো আফরিন?’

আফরিন প্রশ্নটা শুনলো। শুনেও চেয়ে রইল তিতিক্ষার ঠান্ডা অভিব্যক্তিহীন মুখের পানে। না পরিতোষ, না অহং… কিছুরই ছাপ নেই। পরম শান্ত আর সম্ভ্রমের একটা প্রচ্ছন্ন প্রলেপ শুধু লেগে আছে ওই মুখে। ওটুকুই আফরিনের স্বস্তি। আর যা হোক, মেয়েটা অহংকারী ছিল না কোনোকালে।

আফরিন আরো কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে তিতিক্ষার শিয়রে এসে বসে। মাথার কাছে নিবিড় হয়ে বসে সে মেয়েটার বিচিত্র অসুখ নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে। ঠিক কি হয়েছে তিতিক্ষার? তিহার মুখেই শুনেছিল ওর অসুস্থতার কথা কিন্তু অসুস্থতাটা আদতে কি, সে তার জানা ছিল না।
অথচ এখন তিতিক্ষাকে দেখার পর একটা বিশাল ঝড়ের আভাস পেল ও। একটা অবশ্যম্ভাবী তান্ডবের রেশেই যেন লণ্ডভণ্ড হয়েছে সব। অনিবার্য এক যাতনার অভিঘাতে বদলে গেছে তিতিক্ষার পৃথিবী…

বর্ণিল রঙে ভরা জীবনে আজ শুধু সাদাকালো দিন। তিতিক্ষার এই ঘরে অন্যরকম সুখের সন্ধান পেয়েছিল, প্রথমবার যখন এসেছিল আফরিন। হাজার রঙের সমাহার, অনুক্ষণ আনন্দঘন এক আবেশ। বইয়ের তাকে থরে থরে সাজানো বাহারি প্রচ্ছদে মোড়া বই, এককোণে জ্বলছে নিভছে পীতাভ ফেইরি লাইট, ঘরজুড়ে ছোট ছোট ইনডোর প্ল্যান্টের ছড়াছড়ি…
সুন্দর মন, সুন্দর মানুষ আর সুন্দর ঘর… সে বার সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিল আফরিন।

আর আজ… মনে হচ্ছে যেন তিতিক্ষার অসুস্থ বিষাদীত মনের ছায়া পড়েছে এই ঘরেও। আগেকার রঙ, বাহারি আসবাব কিছুই আর নেই। শুধু হাল আমলের পুরনো উঁচু পালঙ্কটা জায়গাতেই আছে। আর একটা আলমিরা। তার গা ঘেঁষে প্লাস্টিকের বইয়ের তাক।

আফরিনের মনে হলো এইঘরে যেন সদাসর্বদা মৃত্যুগন্ধি বাতাস আসা যাওয়া আছে। এখানে দুর্বিনীত আতঙ্ক বিরাজ করে সবসময়। সত্যিই কি আফরিন যা ভাবছে তাই ঠিল? মানুষের সাথে সাথে এত বদলে যেতে পারে একটা ঘরও? নাকি অত রঙ, অত আলো একসঙ্গে দেখেছিল বলে আজকের এই আড়ম্বর হীনতা আফরিনের অত চোখে লাগছে?

আফরিনের সম্বিৎ ফেরে একটা মৃদু তানে। চমকিত হয়ে দেখে তার রেশমি চুড়ি পড়া রাঙা হাতে নিজের ফ্যাকাসে আঙুল ছুঁইয়ে তিতিক্ষা চুড়িগুলো নাড়ছে। মিষ্টি রিমঝিম শব্দের ফোয়ারা তৈরি হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে।
মৃদু হাসে আফরিন। খেয়াল হয় কয়েক মুহুর্ত আগে তিতিক্ষা ওকে কুশল জিজ্ঞেস করেছে।
অস্বস্তি নিয়ে বলে ‘আমি ভালো আছি। আর আপনে?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালোই…’

‘সেইটা আপনেরে দেইখা মনে হইতাসে না একদম। গায়ে জ্বর, মুখেও যেন রক্ত নাই…’ বলতে বলতে তিতিক্ষার গালের রক্তিম আঁচড় গুলোর দিকে অবধারিত ভাবে দৃষ্টি চলে যায় আফরিনের। স্বাভাবিক বোধ থেকেই সে বোঝে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা ভদ্রতার খেলাফ। কিন্তু স্বরে মন খারাপি টা আর ঢাকতে পারে না।
বিষন্ন গলায় বলে, ‘আপনে তো অনেক অসুস্থ আপু। আমি বুঝতে পারি নাই। ভাবছিলাম হয়তো…. আফরিন থামে। নত মুখ তুলে দেখে শান্ত চোখে ওর পানে তাকিয়ে আছে তিতিক্ষা। দৃষ্টিতে ভাস্বরতা নেই। যেন কিঞ্চিৎ অসংলগ্ন ওই চাহুনি। বোধহয় ওর কোনো কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনেনি মেয়েটা। আফরিনের মনে পড়ে পুরনো দিনের কথা। আগের তিতিক্ষার এমন গা ছাড়া ভাব ছিল না কখনো।

‘তোমায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আফরিন।’
ঈষৎ লজ্জার আঁচড় লাগে আফরিনের মুখে। মৃদু কণ্ঠে বলে, ‘আপনি তো সাজসরঞ্জাম ছাড়াই আমার চেয়ে সুন্দর।’

চুড়ি নাড়াচাড়া থামিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইল তিতিক্ষা। প্রতুত্তর করল না। তারপর হঠাৎ কোনোরূপ পূর্বাভাস না দিয়ে উল্টো দিকে ফিরে শুয়ে পড়ল।
আফরিন কিঞ্চিৎ বিস্মিত। সহসাই ওর মনে হলো শারিরীক অসুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে তিতিক্ষার যেন কিছু মানসিক অসুস্থতাও শুরু হয়েছে। কথাবার্তার তাল ঠিক রাখতে পারছিল না। আর এখন এমন অদ্ভুত ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল….

ঘরজুড়ে নেমে আসে প্রগাঢ় স্থবিরতা। কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে আফরিন। এই ধরনের গাঢ় নৈশব্দের সাথে আফরিন ঠিক অভস্ত্য নয়। অস্থির চাহুনিতে বিধ্বস্ত ঘর আর ঘরের মালকিনকে পরখ করতে থাকল সে। যে আশা নিয়ে এখানে এসেছিল তার সবটাই পণ্ড হয়েছে। ঔৎসুক্যে ভরপুর মনটা সমস্ত উদ্বেলতা হারিয়েছে তিতিক্ষাকে দেখে।

অথচ এর উল্টোটাই কি হবার কথা ছিল না? নিজের আশ্চর্য বিয়ের গল্পটা শোনাবার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে নিয়ে এঘরে পা রেখেছিল আফরিন। ধারণা ছিল তিতিক্ষা হয়তো খুব আগ্রহ নিয়েই গল্পটা শুনতে চাইবে। ভাবতে ভাবতে আফরিন আড়চোখে তাকিয়ে দেখে তিতিক্ষাকে। তার কিশোরী মন ছটফট করে কথা বলার জন্য। পড়ালেখার পাট চুকেবুকে গেছে সেই কবে। তারপর থেকে আফরিন কোনো সমবয়সীকে বন্ধু হিসেবে পায়নি। প্রতিটি বয়সের আলাদা কিছু বিশেষণ থাকে, গল্প থাকে। আফরিনের এমন কেউ নেই যার সঙ্গে নিজের ছাপোষা জীবনের ছোট ছোট সুখ দুঃখ নিয়ে গল্প করে।

তিতিক্ষা বলেছিল তারও কোনো বন্ধু নেই। সুতরাং তারা সাচ্ছন্দ্যে একে অন্যের বন্ধুত্বের স্থানটা নিতে পারে। তবে হয়তো আফরিনের ধারণা ভুল। তিতিক্ষার সম্মন্ধে মিথ্যে মোহ পুষে রেখেছিল সে বুকে। ভেবেছিল এতদিন পর দেখা হলে তিতিক্ষা সাদরে ওকে নিজ জগতে অভ্যর্থনা জানাবে।
আর আফরিন বলবে ওর আকস্মিক হওয়া বিয়ের গল্পটা। মিনহাজের সাথে তার বিয়েটা যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে গোটা গ্রাম জুড়ে সে খবর জানিয়ে চমকিত করবে তিতিক্ষাকে।

আফরিনের সৎ মায়ের বদ্ধ ছিল শেষ অবধি কোনো এক দিনমজুরের ঘাড়ে ঝুলতে হবে আফরিনকে। গ্রাম বাসির ধারণাও কিছু ভিন্ন ছিল না। কিন্তু সৎ মায়ের এবং পুরো গ্রাম বাসির আশার মুখে ছাই দিয়ে আফরিন শেষে বিয়ে করল এক বিদেশ ফেরত শহুরে ছেলেকে। মিনহাজের জন্ম গ্রামে হলেও ছেলেবেলা থেকে সে শহরেই মানুষ। সিঙ্গাপুরে গিয়েও ছিল সেখানে বেশ কিছুদিন। তারপর আবার দেশে ফিরে ব্যাবসায় ঢুকেছে।
গ্রামের অনেক ছেলের সাথেই মিথ্যে প্রেমের উপাখ্যান গড়েছিল আফরিন। সৎমায়ের অবর্ণিত অত্যাচার আর সবার কাছে পাওয়া মাত্রাতিত অবহেলার মাঝে এভাবেই নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছিল সে। তার মায়াবী মুখশ্রী আর মোহনীয় চোখের কটাক্ষ দেখে বহু ছেলেই পাগলপারা হত। আফরিনও ওদের দূর্বলতা টের পেয়ে সুযোগের সৎ ব্যাবহার করতো। তার যাবতীয় প্রসাধন, বিলাসিতার খরচ যোগাতো প্রেমিকেরা।
এমনি কিছু একটা অভিসন্ধি থেকে মিনহাজকে জালে ফাসিয়েছিল। কিন্তু একসময় দেখা গেল মিনহাজের চেয়েও মস্ত ফাঁদে সে নিজে আটক হয়েছে। মিনহাজ ভালো ছেলে, তবে সম্মোহিত হবার মতো সুন্দর নয়। মা মারা গেছেন কৈশোরে, বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন। তার পর থেকে সংসারটা দ্বিতীয় পক্ষের ইশারায় চলে। অবিলম্বে মিনজান টের পেয়েছিল গ্রামে থাকা তার আর চলে না। শহরে মামার বাড়িতে এসে উঠল। অল্প বয়সে মামার ব্যবসায় নামল। ইতোমধ্যে নিজের আলাদা ক’টি ব্যাবসা দাড় করিয়েছে। উন্নতিও হচ্ছে বেশ। ঢাকায় নিজের থাকার মতো একখানা বাড়ি করেছে। সামনে হয়তো আরো কিছু হবে। ঠিক এই সময়ে পুরো গ্রামকে অবাক করে দিয়ে বিয়ে হল মিনহাজ বিয়ে করল আফরিনকে। বাজ পড়ল গ্রামের অনেক মেয়ের বাবার মাথায়।

আফরিন ভেবেছিল বিয়ের সমস্ত ইতিহাসটা শোনাবে তিতিক্ষাকে। শুনতে শুনতে কখনো হয়তো বিস্ময়ের আঁচড় পড়বে তিতিক্ষার মুখে, হয়তো কখনো হেসে উঠবে খিলখিলিয়ে। কিন্তু… কিছুই হলো না যে। ভাবতে ভাবতে তিতিক্ষার ওপর কিঞ্চিৎ ঝুঁকে পড়ে আফরিন। ধীর নিশ্বাস পড়ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে মেয়েটা। শ্রান্তিচ্ছন্ন দুচোখ ডুবে আছে নিদ্রার কোলে।

অচিরাৎ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নির্বাপিত হয় আফরিনের ভেতর থেকে। উপলব্ধি করে কোনো এক বিপর্যয় এসে আমূল বদলে দিয়েছে তিতিক্ষার জীবন যাপনের ধরন। ওর ঘুমোনোর ভঙ্গিমাতে পর্যন্ত কত মায়া মেশানো। গালের নিচে হাত রেখে ঘুমোচ্ছে সে। মুখের উজ্জ্বল রঙটা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফ্যাকাসে সাদা মুখ, এখানে সেখানে আঁচড়ের দাগ। একগাছি চুল ছিল মেয়েটার। এখন যেন ওর চুল আগের চেয়ে অনেক পাতলা। যেটুকু আছে তাতেও অযত্নের ছাপ বড় স্পষ্ট।
চোখের ওপর খয়েরি রেখা, পড়নে হালকা ধূসর রঙা একটা সুতির কুর্তি। জামার রঙ মিশে গেছে তার রঙে। যেন এক আসমানী পরী ঘুমিয়ে আছে আকাশসম দুঃখের পাহাড় নিয়ে। ভীষণ যাতনায় ক্লান্ত যার মন, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদাস যার দৃষ্টি। আফরিনের চোখ ধাধিয়ে যায় সেই বন্দিনী অভিশপ্ত আসমানী পরীর দিকে চেয়ে।

চলবে…..

দূর আলাপন পর্ব-১২+১৩

0

দূর আলাপন ~ ১২
___________________________
ঘরময় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। এককোণে উলটে পড়ে আছে কাঠের চেয়ার। ভাঙা কাঁচের গ্লাসের টুকরো সারাঘরে ছড়ানো। আয়নায় ভাসমান এক অপ্রকৃতস্থ মানবীর প্রতিবিম্ব। হাপরের মতো যে নিশ্বাস ফেলছে, উত্তেজনায় তিরতির কাঁপছে। হঠাৎ তার নজর পড়ে আয়নাতে। ক্ষণকাল স্থির চোখে চেয়ে দেখে নিজের রুক্ষ বিধ্বস্ত মূর্তি। দুচোখে যার অগাধ ধোঁয়াশার ঢেউ।

আয়নাতে কে ও? ছিঃ কি বাজে দেখতে! শনের মতো চুল লেপ্টে আছে গালে, মুখে অসংখ্য ক্ষতের চিহ্ন, চোখ দুটিতে অবিরল ঝরছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা। সহ্য হয়না। ক্রমে ক্রমে ওর নিশ্বাসের গতি বাড়ে, শিরায় শিরায় কিলবিলে পোকারা বসায় মরণ কামড়। সইতে না পেরে দুহাতে মাথা চেপে ধরে সে। আতিপাতি করে খুঁজে হাতের কাছে একটা ফুলদানি পেয়ে যায়। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ফুলদানিটা ছোড়ে আয়নার দিকে। ঝনঝন শব্দে পাহাড়ি ঝর্ণার মতো ভূতলে লুটিয়ে পড়ে টুকরো টুকরো কাঁচ।

শব্দটা ভালো লাগে। অস্থির মস্তিষ্কে প্রশান্তির ফল্গুধারা বইয়ে দেয়। কিন্তু এতে কিছু হবে না।
তার আরো শান্তি দরকার। আরো আরো…

দরজার বাইরে থেকে স্থানুর মতো দৃশ্যটা দেখছিল ছোটন। কি হচ্ছে এসব? এ কি প্রলয়?ওই ডাকিনী পিশাচীনি কি এবার ওর ঘাড়টাও মট করে ভেঙে রক্ত চুষে খাবে? ছোট্ট শরীর থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। সারা গায়ে খিল ধরে যায় ভয়ে। নিজের ঘর ছেড়ে দৌড়ে আসে তিহা। ছোটনকে বোনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে। মুহুর্তকাল বিলম্ব না করে ছেলেকে কোলে নিয়ে সরে যায় দরজা থেকে। নিজের ঘরে গিয়ে বাচ্চাকে নামিয়ে রেখে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাইরে থেকে খিল তুলে দেয়। ছুটে এসে ঢোকে বোনের ঘরে।

তিতিক্ষা তখন মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। সারা দেহ এলিয়ে ঢলে আছে বিছানার গায়ে। অনেক ভাঙচুর আর ক্রুদ্ধ আস্ফালনের পর ওর চোখের দৃষ্টি এখন নরম, যদিও মুখের পেশির শক্তাভাব আর দাঁতে দাঁত ঘষে চলাটা তখনো থামেনি।

তবু আর ভয় নেই, জানে তিহা। দৌড়ে বোনের কাছে ছুটে যায়। উবু হয়ে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বোনকে। কান্নার প্রকোপে কথা জড়িয়ে আসে, বাষ্পরুদ্ধ গলায় তিহা থেমে থেমে বলে,
‘কি.. করে.. ছিস.. তুই? কি.. করেছিস..এসব? নিজেকে কেউ এভাবে মারে? কষ্ট দেয়?’ বলতে বলতে নিজের ওড়না দিয়ে মুছে দিতে থাকে বোনের গাল।
‘কি হয়েছে আমার আপু? কেন এমন করেছিস বলতো?’

তিতিক্ষা তখনো হাঁপাচ্ছে। চিৎকার করে করে গলা ভেঙেছে। ব্যগ্র ভাঙা গলায় বলে,’আমি কিছু করতে চাইনি বিশ্বাস করো। কিন্তু ওরা…. ওরা… বাজে কথা বলছিল আমাকে।’ হু হু করে কাঁদতে থাকে তিতিক্ষা।
‘আমাকে বলে কিনা নষ্টা মেয়ে। জানো বুবু, ওদের কত করে বললাম কিছু করি নি আমি। আমার কোন দোষ নেই। তবু ওরা কেউ আমার কথা বুঝতে চাইল না….
এসব শুনলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। তখন… নিজেকে আর সামলাতে পারি না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই না বুবু? পাগলরা এমন করে। এবার আমাকেও তোমরা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবে। না?’

কাঁদতে কাঁদতে তিহা থমকে যায়। পাখির ছানার মতো চারপাশ থেকে বোনকে আগলে ধরে বলে,’ এইসব বাজে কথা কে বলেছে তোকে? তুই আমাদের বাড়ির প্রাণ। তোর সাথে আমরা অমন করবো ভাবলি কি করে? ‘

‘কিন্তু আ.. আ.. মি যে পাগল। পাগলকে কি কেউ ভরসা করে? বিশ্বাস করো, আমি এমন করতে চাইনি। কিন্তু… কিন্তু… ওই আওয়াজ টা… সবাই মিলে ওরা যখন আমাকে বে….’

‘চুপ… চুপ….কেউ কিছু বলেনি তোকে। কান খাড়া করে শুনে দেখ…
আর তুই কেমন তা তুই নিজে জানিস না? কেউ কেন তোকে শুধুশুধু বাজে কথা বলবে? ভুল শুনেছিস… সবটা ভুল…’

বোনের যুক্তিনির্ভর কথা বোঝার মতো মানসিক অবস্থা তিতিক্ষার নয়। কিছু শুনছে, কিছু শুনছে না। নিজের মনে বলে চলেছে আপনার কথা…..
‘ওরা খুব কষ্ট দেয় আমায়। দেখো, একদিন আমি ঠিক মে রে ফেলব ওদের। সবাই আমার শত্রু। সবাইকে মে রে ফেলব আমি।’
বলতে বলতে আবারো উচ্চগ্রামে চড়ে তিতিক্ষার স্বর। তিহা কিছু বোঝবার আগে দুহাতে নিজের চুল খা ম ছে ধরে তিতিক্ষা। ওকে থামাতে গিয়ে তিহা নিজেও অল্পবিস্তর আহত হয়। কিন্তু এই আসুরিক শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠে কার সাধ্য?
ক্লান্ত তিতিক্ষা হার মেনে একসময় ঢলে পড়ে বোনের গায়ে। অনতিবিলম্নে চেতন হারায়। শান্ত নরম ঘুমন্ত একটা মুখ। কে বলবে এই নরম মুখের মায়াবী তরুণী খানিক আগে ধ্বংসযোজ্ঞ চালিয়েছে এই ঘরে!

তিতিক্ষার দুচোখের পাতায় চেপে বসেছে কালঘুম। যে ঘুমের জন্যই অপেক্ষা ছিল তিহার। বোনের ঘুম এবার সহজে ভাঙবে না। পাগলামির কিছুক্ষনের ভেতর ও ঘুমিয়ে পড়ে সবসময়। তিহা গলা ছেড়ে আকবরের মাকে ঘর পরিষ্কার করতে ডাকল। বৃদ্ধা মৃদু সংশয় নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
‘ভয় নেই। ও ঘুমোচ্ছে। আমাকে একটু সাহায্য করুন ওকে ওপরে ওঠাতে।’

দুজন মিলে তিতিক্ষাকে তুলে বিছানায় শোয়ালো। এবাড়িতে মাস পাঁচেক হলো কাজে রাখা হয়েছে আকবরের মাকে। তিতিক্ষার সেবাযত্ন আর সংসারের সমস্ত কাজ একা কুলিয়ে উঠতে পারছিল না তিহা।
আকবরের মায়ের ষাটের ওপর বয়েস। গায়ে এখনো মোষের মতো শক্তি। তিহা ধরতে না ধরতেই তিতিক্ষার পলকা দেহটা তুলে ওপরে শুইয়ে দিল। ফার্স্ট এইড বক্স এনে তিহা বোনের মুখের ওপর ঝুঁকলো। তুলোয় ডেটল মেখে কাঁপাকাঁপা হাতে পরিষ্কার করে দিতে লাগল মুখের ক্ষতস্থান।

আকবরের মা কাছেই দাঁড়িয়ে। একমনে দেখছে। একসময় নিচু হয়ে তিতিক্ষার হাতের শক্ত মুঠি খোলার চেষ্টা করল। তিহা তাকিয়ে ছিল। মুঠো খুলে যেতেই দেখল বোনের হাতে একগাছি ছেড়া চুল। চুলগুলো আকবরের মা তিতিক্ষার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল।
‘দেহেন অবস্থা, নিজের চুল নিজে ছিড়ছে।
আর অমন চাঁদপানা মুখটারে কি করছে খামছি দিয়া। নিজেরে খামছাইয়া, চুল ছিড়া কি পায় আল্লাহ জানে! মা মরা মাইয়া… জীবনডা কি হয়া গেল….’
কথা শেষ করে আকবরের মা তাকায় তিহার পানে। সচকিত হয়ে দেখে স্থবির ভঙ্গিতে অসহায়ের মত বোনের দিকে চেয়ে আছে তিহা। চোখের কোণে পুনরায় জলের আভাস। এই মেয়েটাই বা কত করবে? চেষ্টার কোন ত্রুটি তো রাখছে না। নিজের ওইটুকু একটা বাচ্চা, চারজনার সংসার, তার ওপর এই অসুস্থ বোন! সবার ভার তার একার ওপরে। পাঁচ মাস আগে যা দেখেছিল তার চেয়ে এখন অনেক শুকিয়েছে তিহা, চোখ সেঁধিয়েছে কোটরে। নিরবে ঘুরে ঘুরে সবই খেয়াল করে আকবরের মা।

.

সেদিন সারাদিন অসংখ্য বার নিনাদ কল করল তিহাকে। রেসপন্স না পেয়ে একসময় রওশানকেও। কেউ ফোন তুলল না।
মাঝরাতে নিনাদ তখনো একা জেগে বসে। মনে নানা অশুভ ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। কি হতে পারে, কি এমন হতে পারে তিতিক্ষার?
তিহার কল এল তখন। প্রথমেই সে জিগ্যেস করল,’এখনো জেগে বসে আছিস জানার জন্য না? আগের মত বেহায়াই রয়ে গেলি তুই! বলতে না চাইলেও…’

‘প্লিজ বলে দে কি হয়েছে..’নিনাদের ব্যগ্র স্বর।

তিহা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ক্ষণকাল নিশ্চুপ থাকে। আবার আর্তস্বরে তাড়া দেয় নিনাদ, ‘কি হলো? বলতে বলছি না?’

‘বলছি..’ ঢোক গেলে তিহা। সঙ্গে সঙ্গে গলায় ব্যথার মতো কি যেন একটা বাজে। চোখের কার্ণিশে দেখা দেয় জলের আভাস। ভাবাবেগ ঝেড়ে ফেলে তিহা দৃঢ় হয়। কষ্ট হোক, তবুও আজ সে নিনাদকে বলবে, তার জীবনের সবচেয়ে অপছন্দনীয় দুঃখ গাঁথা।

.

নিনাদ দেশ ছেড়ে আসার পর তিতিক্ষার বেশ কিছু ভালো বিয়ের সম্মন্ধ এসেছিল। সম্মন্ধ যে আগেও আসেনি তা নয়৷ তবে নিনাদের উপস্থিতিতে বোনকে অনত্র বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করা তিহার জন্য অস্বস্তিকর ছিল।
বন্ধু দেশ ছাড়াতে সে দ্বিধা দূর হলো৷ বাঁধা দেয়ারো কেউ রইল না।

কয়েক মাসের ব্যবধানে আসা চারটে সম্মন্ধের মধ্যে প্রভাষকের সম্মন্ধটাই মারুফের বেশি পছন্দ হলো। পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ আর খোঁজখবর নিয়ে যা জানলেন, তাতে বাকিদেরও আপত্তি রইল না। ছেলে একটি বেসরকারি নামজাদা কলেজের প্রভাষক, বাবাও এককালে মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। বাবা মা আর ছোট অবিবাহিত বোন নিয়ে যাত্রাবাড়ীতে থাকে। ছোট নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। বড় মেয়ের কাছে জানলেন তিতিক্ষারও বিশেষ আপত্তি নেই।

সুতরাং তোড়জোড় শুরু হলো। মেয়ের বিয়েতে সবচেয়ে উচ্ছ্বাসিত হলেন মারুফ। এমন যোগ্য, নম্র ছেলে… বেশ ধার্মিক না হলেও তার উল্টোটা নয়। নিয়মিত সলাত পড়ে, কোন বদ অভ্যেস নেই। সৎ, কর্মোঠ, মেধাবী… সবমিলিয়ে মারুফের ভীষণ পছন্দ। কাছের গুটিকয়েক আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হবে ঠিক হল। এই ছিল অনেককাল থেকে তিতিক্ষার ইচ্ছে।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। তিতিক্ষাদের একতলা বাড়ি সাজানো হয় বাহারি রঙা ফুল আর বাতির পসরায়। উঠোনে বাঁধা হয় শামিয়ানা। মামা, চাচা, ভাই, বোন আত্মীয়ের ভিড়ে বিয়ে বাড়ির শোরগোল চারিদিকে। সবকিছু ভালো ভাবে এগোচ্ছিল। তিহা খুশি… বাবা খুশি… আর হয়তো তিতিক্ষাও খুশি। কিন্তু নিয়তিতেই যে অন্যকথা লেখা ছিল। খণ্ডন করে কার সাধ্যি?

অশনির প্রথম সংকেতটা বাজে বিয়ের দিন সকালে। মা নেই, একমাত্র বোনের বিয়ে। সমস্ত কাজের ভার তিহার একার কাঁধে। বাড়িতেই রান্নাবান্না হবে। বিয়ের বাজার, জোগারযন্ত… কম কথা নয়। দু দন্ড বিশ্রাম নেবার ফুরসত মিলছে না। ভোররাত থেকে ছুটোছুটি করছে।

সকালে যার যার কাজ তাকে বুঝিয়ে দিয়ে বোনের ঘরে এসে প্রথম খেয়াল করে তিতিক্ষা ঘরে নেই। ফোন, বোরকা সবকিছু রয়েছে। কিন্তু তিতিক্ষার দেখা নেই। বেশি ভাবান্বিত হয় না তিহা। বোরকা ছাড়া তিতিক্ষার বেরোনোর প্রশ্নই আসে না। হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছে। বাবাকে ছেড়ে চলে যাবে বলে মন খারাপ নিয়ে হয়তো ছাদেই বসে আছে।

বিয়ের বাড়ির হাজার রকম কাজ। তদারকের ভারটা সন্দেহাতীত ভাবেই তিহার ওপর বর্তায়। তিতিক্ষার ব্যপার টা সে বেমালুম ভুলে বসে কাজের চাপে। বেলা বাড়লে খেয়াল হয়। বোনকে তৈরি করা হয়নি। জুম্মাবার, জামাত শেষ করেই চলে আসবে সবাই।
উঠোনে বড় পাতিলে রান্না হচ্ছে। দিনভর সেখানেই ছিল তিহা। কাজের ধ্যানে অন্যমনস্ক হয়ে বোনের ঘরে এসে টের পায় বোন তখনো আসেনি! ফোন, বিয়ের শাড়ি, সাজসরঞ্জাম যেটা যেভাবে রেখেছিল সেভাবেই পড়ে আছে।
বুকের ভেতরটা কি এক ভাবনাতীত আশংকায় ধক করে ওঠে। ভয়ে ভয়ে নরম গলায় কথাটা সে জানায় মারুফকে। অনতিবিলম্বে কাছেপিঠের দু চারজন আত্মীয়স্বজন, যারা এসেছিল বিয়েতে, কথাটা ওদের কান পর্যন্ত প্রচার হয়ে যায়। তারপর সবাই মিলে খোঁজ চলতে থাকে। বাড়ির প্রতিটি ঘর, ছাদ, উঠোন, স্টোররুম.. আনাচকানাচ কিছুই বাদ দেয়া হয়নি। তিতিক্ষা কোথাও নেই!

আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে আসে তিহার মুখ। কি হলো? এমন কি করে হতে পারে? তিতিক্ষা তো আর দশটা মেয়ের মতো নয়। অন্যের বেলায় অনায়েসে যা সন্দেহ করা যেত, তিতিক্ষার বেলায় যে তা ভাবনাতীত। সে ঘরকুনো মেয়ে। চিরকাল বাবা বোনের গা ঘেঁষে থাকা অভ্যেস। ওর কোনো বন্ধু নেই, নিজের বোন ছাড়া আর কারো সঙ্গে গভীর একাত্বতা নেই। কোথায় যাবে ও? আর কেনই বা যাবে? কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। অথচ কি হতে পারে ঘুনাক্ষরেও তার আন্দাজ পর্যন্ত করতে পারল না তিহা।

সম্মানহানির চিন্তা পাশে রেখে একান্ত ভাবে বোনের দুশ্চিন্তায় কাঠ হয়ে রইল সে। কি এমন হতে পারে? কোনো বড় বিপদে পরেনি তো তিতিক্ষা? ইতোমধ্যে রওশান বাসার বাইরেও খুঁজতে শুরু করেছে। জলের মতো সময় বয়ে যাচ্ছে। কোনো খবর নেই। বোনটা আদৌ ভালো আছে তো? হাজার রকম শঙ্কার বায়ু উড়ে বেড়াতে থাকে তিহার মনের আকাশে। মাথাটা বিবশ হয়ে আসে। ঠিক ভুল, যুক্তি অযুক্তি দিয়ে ভাবার ক্ষমতা ক্রমশ লোপ পেতে থাকে। আবোলতাবোল চিন্তায় অস্থির তিহার সহসা মনে পড়ে, ফজরের সলাতের পর তার বোন রোজ ভোরবেলা বাইরে হাঁটতে যেত। আজও গিয়েছিল। এমনকি ভোরে বাইরের দরজা খোলার শব্দ সে শুনেছিল! কিন্তু তারপর তিতিক্ষার ফিরে আসার আর কোন আওয়াজ বা ইঙ্গিত পায়নি।

দুপুর হয়ে আসে। বরযাত্রীরা চলে এসেছে। সংখ্যায় তারাও খুব বেশি নয়। তিহার মামা চাচা ছুটে গেল ওদের আপ্যায়ন করতে।
ঘরের ভেতর বাবা মেয়ে স্থানুবৎ হয়ে বসে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মারুফের অভিব্যক্তির দারুণ পরিবর্তন ঘটেছে। ফ্যাকাসে সাদা মুখ, চোখের দৃশ্য ঝাপসা, শ্বাসপ্রশ্বাস অবিশ্বাস্য রকমের জোড়ালো। মুখে রা নেই। আদরের মেয়েটা এতক্ষণ ধরে নিখোঁজ। অথচ বিয়ে বাড়িতে বদনাম রটবে বলে পুলিশে খবর দিতে দিচ্ছে না তার আত্মীয়স্বজন। বলছে, বোঝাচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টার আগে নাকি শত অনুরোধেও পুলিশ কোন ব্যাবস্থা নেবে না। মারুফ পাথর হয়ে বসে থাকেন। অনতিদূরে দেয়ালে গা এলিয়ে পড়ে থাকে তিহা। বিয়ে, সমাজ, সম্মান কিচ্ছু চাই না তাদের। শুধু যে পথে তিতিক্ষা বেরিয়েছে, ভালোভাবে ঘরে ফিরে আসুক….

বরযাত্রী সবাইকে বাইরে আপ্যায়নে ব্যস্ত রাখা গেলেও ছেলের মা বোনের সঙ্গে পেরে ওঠা গেল না। পুত্রবধূকে একঝলক দেখার জন্য ব্যকুল ছেলের মা। ভরা বাড়ির বাতাসে ভেসে বেড়ানো দু একটা ফিসফিস, কূট কথাও তাদের কানে এসে থাকবে। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সোজা অন্দরমহলে চলে এলেন। হাসিমুখে আবদার করলেন ‘কই আমার বৌমা? চাঁদমুখখানি একবার দেখি!’

সদুত্তর দিতে পারলো না কেউ। ব্যস্তসমস্ত হয়ে চূড়ান্ত বিব্রত মারুফ একসময় নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তিহা তখনো এলিয়ে পড়ে আছে। সৌজন্যতার ধার ধারলো না। এখন আর একবিন্দু লড়ার শক্তি তার নেই। এই সেই নানানরকম কথার জালে ছেলের মা বোনকে থামিয়ে রাখা হলো। কিন্তু এই ছলনাও আর কতক্ষণ? একসময় তারা অধৈর্য হয়ে পড়েন। দু একটা কড়া কথা বলে বসতে তখন আর বাঁধে না। ঘরভরা মানুষের সামনে মারুফ নিশ্চুপ। বোবা হয়ে অপমানের ঢোক গিলছেন। সেসময় বাড়ির সামনে একটা মাইক্রো এসে থামে। গাড়ির গর্জন, মানুষের শোরগোলে অনেকে ছুটে যায় সেদিনে। সবার চোখে বিস্ময় খেলা করে। বর তো আগেই এসে গেছে। তবে এই মাইক্রোতে, এমনি মহাসমারোহে আবার কে এলো?

অদ্রিজা আশয়ারী
চলবে…..

দূর আলাপন ~১৩
___________________________
মাইক্রো থেকে প্রথম যে ব্যাক্তিটি নামে তাকে দেখেই সর্ব শরীর কেঁপে ওঠে তিহার। পৃথিবীটা দুলতে থাকে। বুকে অবাধ কান্নার উতরোল। সে বোঝে এবার সব সম্ভব হতে পারে। তার বোনের অপহরণ, গুম কিংবা এর চেয়েও ভয়ানক কিছু….. সব করতে পারে এই ছেলে! রাজনকে চেনে সে। নিকৃষ্ট বাবার নিকৃষ্টতম পুত্র। এলাকার নামী মাস্তান। স্কুল জীবন থেকে তিতিক্ষাকে হয়রানি করে আসছিল। ওর চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্য, ওর অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য কিশোরী বয়সেই বোরকা গায়ে জড়িয়েছিল তিতিক্ষা। সব তিহার জানা। জানতো নাই বা কে? কতবার নিনাদ শাসিয়েছিল রাজনকে। কোন লাভ হয়নি। বড় বেলায় এসে তিতিক্ষার অতিরিক্ত কঠোরতার জন্য বেয়াড়াপনার সুযোগ পায়নি ঠিক, কিন্তু অনুক্ষণ ওর গতিবিধি নজরে নজরে রাখতো।

এতসব কিছু জানার পরেও কি করে এতটা নিশ্চিন্তে বোনের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল তিহা? কয়েকটা বছর রাজনের সমস্ত অমিতাচার স্তিমিত ছিল। সে নিরবতাকেই বুঝি ভেবে নিয়েছিল অপরাধবোধ। হয়তো রাজন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। হয়তো আর কখনো তিতিক্ষার পেছনে লাগবে না। কিন্তু… কিন্তু…. হঠাৎ যেন সব ধোঁয়াশা দূর হয়ে যায় তিহার দৃষ্টির সামনে থেকে। ও স্পষ্ট বুঝতে পারে পরিস্থিতি এখন সম্পুর্ন রাজনের নিয়ন্ত্রণে। বোবা আর্তনাদে তিহার পৃথিবী ভারি হয়ে ওঠে। কি করে এতবড় ভুল হয়ে গেল! কি করে এতটা অসতর্ক থাকল সে! নিনাদকে পথের কাটা ভেবে, ও দূরে সরে যেতেই বোনের বিয়ের আয়োজন করেছিল…. অথচ… অথচ নিনাদই একমাত্র ছিল যাকে রাজন একটু ভয় করতো। মহাজনেরও মহাজন আছে। নিনাদ জানতো কোন প্রতিষেধকে রাজনের মতো বিষধর সাপকে কাবু করা যায়।

আনন্দের আতিশয্যে তিহা অন্ধই হয়ে গেছিল সত্যি। নাহয় কি করে ভুলে গেল রাজন যেকোনো মূল্যে তিতিক্ষাকে চাইবে। সে চাওয়ায় প্রেম নেই, অনুরাগের আসঞ্জন নেই, আছে শুধু চাওয়া, নিপাট শরীরি আবেদন। এলাকার সমস্ত মারামারি, খুনোখুনি আর যত অপরাধ ছিল… সবেতে চিরকাল অগ্রগামী এই রাজন। কেউ ওকে কিছু বলে না, শত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় না। রাজন ক্ষমতাবান বাবার ছেলে। পাড়াজোড়া মানুষ ওদেরকে ভয়ই করে। তবু তিহা নির্বিকারে বোনের নতুন সংসার সাজাচ্ছিল। কোনো সাবধানতার ধার ধারেনি, নিরাপত্তার কথা ভেবে দেখেনি। নির্দয় সত্যিটা হলো একমাত্র নিনাদকেই এতকাল আসল প্রতিপক্ষ ভেবে এসেছিল তিহা। নিনাদ নামক বাঁধা দূর হতেই আর সব সমস্যা ধূসর হয়ে গেল ওর কাছে। দুচোখে নতুন স্বপ্নের লাল নীল জড়িমায় তিহা বিস্মৃত হয়ে গেল বাকিসব বিপদ সম্মন্ধে….

শীতল আমেজে গাড়ির বাইরে পা ফেলে রাজন। তারপরই গাড়ি থেকে নামেন তার বাবা। লোহার গেট পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়ান। পেছন পেছন সুঠাম দেহ, একফালি নিষ্ঠুর হাসিমাখা শান্ত মুখ নিয়ে রাজন অপরাধীর মত বাবার পেছনে দাঁড়ায়। তারপর একে একে আসে রাজনের বাবার জনাকতক চেলা ও এলাকার কিছু বিশিষ্ট জনেরা। রাজনের বাবা ঝানু ব্যাবসায়ী। পাশাপাশি সংসদের সদস্যপদ পেয়েছেন অল্পদিন আগে। অতন্ত্য ক্ষমতাশালী এবং তুখর বুদ্ধিমান ব্যক্তি। জনসমাগমও সেজন্য তুলনামূলক বেশি। তিনিই প্রথম কথা শুরু করলেন। মারুফ তখনো ঘরের অন্যপাশে নির্বাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনেই কি সমবেদনা জানাতে এসেছে লোকটা? নাহয় আর কি কারণ থাকতে পারে?
নমনীয় গলায় রাজনের বাবা হাঁকলেন,’মারুফ সাহেব, আপনি দেখছি বড় ভেঙে পড়েছেন। আদরের মেয়েটা না বলে কয়ে একরাত বাইরে কাটালে বাবা হিসেবে কষ্ট পাওয়ারই কথা… ‘

মারুফ চমকে তাকালেন। সন্দেহ হলো হয়তো তিনিই ভুল শুনেছেন। তা নাহলে এই বয়স্ক লোকটা ঘরভরা মানুষের সামনে এমন মিথ্যে কথা কেন বলবে? তিতিক্ষাকে আজ শেষ রাতেও তিনি সচোক্ষে দেখেছেন। ফজরের ওয়াক্তে মেয়েটা তার সলাতের জন্য ওযুর পানি এনে দিয়েছে। অথচ লোকটা বলছে তার মেয়ে একরাত ধরে নিখোঁজ!

‘দেখুন মারুফ সাহেব, ছেলেমেয়েরা তো ভুল ত্রুটি করবেই। ওদের যা বয়েস, এই বয়সে আমরাও তো আর সাধুসন্ন্যাসি ছিলাম না।
যাইহোক, পিতামাতার কাজ হলো ক্ষমা করে দেওয়া। নিজের সন্তানের সাথে আমাদের কোনদিন বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে না বলেই ওরা ভুল পথ বেছে নেয়। আমাদের দায়ও এইক্ষেত্রে কম না। ওরা ছেলেমানুষ… না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে। আমার টাকে আমি মাফ করেছি, এইবার আপনের টাকে আপনি মাফ করুন!’

লোকটার কথাবার্তা আদতেই মারুফের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই দুশ্চিন্তাতে অস্থির তিনি, যেখানে মেয়েই নেই সেখানে ক্ষমা করার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে?
কিয়ৎকাল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন সামনের মানুষটার দিকে। তারপর আগেপিছে কিছু না ভেবে হঠাৎ ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করেন,’ভাই আমার মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় আছে জানেন আপনি?’ এই আলাভোলা মানুষটার এমন সরল অকপট প্রশ্নে লোকটা মুহুর্তের জন্য ভরকায়। পেছন ফিরে গম্ভীর গলায় একজনকে আদেশ দেয়, ‘গাড়ি থেকে ওকে নিয়ে এসো।’

মারুফের দুচোখ যেন জ্বলে ওঠে হঠাৎ, ‘আ.. আমার মেয়ে আপনার গাড়িতে?’

‘হ্যাঁ, এতক্ষণ যাবৎ সে কথা টাই তো বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম। আপনার মেয়ে আর আমার ছেলে মিলে একটা ভুল করে ফেলেছে। বোঝেনই তো এই….’

‘কি ভুল করেছে ওনার মেয়ে?’ গর্জে ওঠেন বরের বাবা। অনেকক্ষণ ধরে এসব তামাশা সহ্য করছেন তিনি। বিয়ের আসর যেন ক্রমেই একখানা রঙ্গমঞ্চে পরিণত হচ্ছে। এক এক করে অভিনেতা আসছে, নিজের মতো কাহিনি রচনা করে যাচ্ছে। আর না। বহুক্ষণ ধরে যে কথাটা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল তা যে এমন প্রকট রূপ সত্যি হয়ে ধরা দেবে কল্পনাও করেন নি তিনি। মারুফ একজন সম্মানিত লোক। এলাকার সবাই ভদ্র, সম্ভ্রমশীল ব্যক্তি হিসেবে একনামে চেনে। শুধুমাত্র সেজন্যই তার মেয়ের নামে কলঙ্কের রটনা হবার পরও তিনি অপেক্ষা করেছেন। আশা ছিল হয়তো এর একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন মারুফ। কিন্তু… ক্রমে সে আশাও ফুড়িয়েছে।সাদা হায়েস গাড়িটা থেকে যখনি এই বাবা ছেলে নামলো তখনি বুঝলেন জল অনেকদূর গড়িয়েছে। রাজনের বাবা আমজাদ কে না চেনে? এই লোক যখন ঘটনায় প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত অতএব ব্যাপার কিছুতেই সামান্য নয়…

আমজাদ নিরীহ ভাবে মুখ ফেরালেন, ‘ও আপনিই বুঝি মারুফ সাহেবের হবু বেয়ান ছিলেন? তা কি আর বলবেন। বিয়েটা তো আর হচ্ছে না! বলবো কি ভাইসাব, আজকালকার ছেলেমেয়ের খেয়াল বোঝেন না? বাবা মেয়েটার অমতে বিয়ে ঠিক করেছিল। মেয়ে মানতে না পেরে রাত বিরেতে অভিমান করে আমার ছেলের কাছে গিয়া উঠল। দুইজন দুইজনকে ছোটকাল থেকে মহব্বত করে কিনা। বিয়ে ঠিক করার আগে মেয়েটার মতামত আছে কিনা সেকথা জেনে নিলে এত ঝামেলা হতোই না। যাক, এই বয়সে এমন ভুল অনেকেই করে। বয়সের দোষ। এখন কাজী ডেকে ওদের বিয়েটা পড়িয়ে দিলেই হয়।’

রাজনের বাবার কথা শেষ হওয়া মাত্র চারিদিকে একটা হৈচৈ পড়ে গেল। মুহূর্তেই অসংখ্য খারাপ মন্তব্য ভেসে আসতে শুরু করল ভিড় থেকে। সে সবই তিতিক্ষাকে ঘিরে।
‘আগেই জানতাম, ওই ঘোমটার নিচে আসলে একটা শয়তান বাস করে।’

‘সুন্দরী মেয়ে, মা ছাড়া মানুষ। কত আর ভালো হবে? বোরকার আড়ালে তবে এইসব করে বেড়াতো এতকাল!’

এরপরের কাহিনি বলা বাহুল্য। বরপক্ষ মারুফের কোনোরকম কৈফিয়ত শুনতে নারাজ। তারা নিজ চোখেই দেখেছেন মেয়ে নিখোঁজ, বাপ বোনের মুখে রা টুকু নেই। এরপর আর কিছু বলার থাকে না। যে সমারোহে তারা এসেছিলেন, এখন সেই পথে কটুবাক্য ছড়াতে ছড়াতে ফিরে যেতে উদ্যত হলেন।
পরিস্থিতির আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়েছিল তিহা। চোখে জল নেই, দৃষ্টিতে ভাস্বরতা নেই। ও শুধু বুঝতে পারছিল, আড়ালে আড়ালে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র চলছে ওদেরকে ঘিরে, ওর বোনকে ঘিরে। এসবই যেন একটা দুঃস্বপ্নের অংশ। না… না… বাস্তবতা কখনো এত জঘন্য হতে পারে না। নিশ্চয়ই শেষ রাতের অমানিশায় কোনো বাজে স্বপ্ন দেখছে তিহা। এখনি ঘুম ভাঙবে, জেগে উঠে বা দিকে থুথু ছেটাবে সে। দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবে আর সমস্ত বিপর্যয় কেটে যাবে। আসবে নির্মল শান্তিঘেরা ভোর। বোনকে জড়িয়ে ধরে তিহা হাসবে, বলবে ‘তোকে আমি নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসি।’

কিন্তু কই? এত চেষ্টা করেও তিহা স্বপ্ন ছেড়ে জেগে উঠে বসতে পারছে না তো! উল্টো চারপাশের চিৎকার, শোরগোল ক্রমশ বাড়ছে। হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে তিহা, ‘মিথ্যে… মিথ্যে… এসবই মিথ্যে। সাজানো নাটক সব। আমার বোন নিখোঁজ হয়েছে ভোর থেকে। তাহলে রাতে সে কিভাবে রাজনের কাছে গেল? অনুরোধ করছি এসব বিশ্বাস করবেন না আপনারা। ষড়যন্ত্র… সব ষড়যন্ত্র… ‘
কিন্তু না, কেউ শুনল না তিহার কথা। উল্টো তিতিক্ষার বদনামই বাড়তে লাগল। বরপক্ষ চলে যাচ্ছে, আশেপাশের শোরগোলও ক্রমেই বেড়ে উঠছে দেখে তিহা এবার হুশ জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত দৌড়ে গিয়ে রাজনের কলার চে পে ধরল। চিৎকার করে বলল, ‘আমার বোন কোথায় বল?’
রাজনের ছদ্মবেশী মুখে অশনির মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে মৃদু হাসি। কলার থেকে তিহার হাত ছাড়িয়ে পেছন ফিরে হাটতে শুরু করে সে। বেশিদূর যেতে হয়না। ততক্ষণে একজন নারীর গায়ে ভর দিয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে ফিরে আসছিল তিতিক্ষা। রাজন গিয়ে নিঃসংকোচে ওকে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে তিতিক্ষাকে ছেড়ে কিঞ্চিৎ দূরে সরে যায় নারীটি। ঘোর বিস্ময় নিয়ে তিহা দেখে, তার বোনের গায়ে অজ্ঞাত পুরুষের ছোঁয়া লাগা সত্ত্বেও তিতিক্ষা আজ সরে আসছে না, এমনকি কোনোরকম প্রতিক্রিয়াই দেখাচ্ছে না। মন্ত্রে বশ হওয়া মানুষের মতো অনুভূতি শূন্য চোখ নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। পা কাঁপছে, বোধহয় হাটতে কষ্ট হচ্ছে। আর… আর… ঘরভরা মানুষের লুব্ধ দৃষ্টি ওকে ঘিরে বর্ষিত হচ্ছে জেনেও তিতিক্ষা আজ নির্বিকার। এমন তো হবার কথা না… আর যাইহোক পর্দা নিয়ে তিতিক্ষা সহনশীল হবে এতো ভাবনার অতীত! তবে কেন ও নড়ছে না? কেন কিছু বলছে না? কেন ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে না এই জনারণ্য ছেড়ে? আদতে কি হয়েছে তিতিক্ষার? ওর সারা গায়ে এত মারের দাগ কেন? কাপড় ছেড়া কেন? কেন চুল এলোমেলো? এসব কে করেছে? কেন করেছে? এসব কি কোনো অশুভ ঘটনার সংকেত দিচ্ছে? তিতিক্ষাকে কি কিছু করেছে কেউ? খুব বাজে কিছু? কি ঘটে থাকতে পারে ওর সাথে?
না না… কিছুতেই চূড়ান্ত কথাটা ভেবে উঠতে পারছিল না তিহা। ভাবতে গেলে দুনিয়া অন্ধকার লাগে। কেন এমন হবে? কেন কেউ ওর বোনের অতবড় সর্বনাশ করবে?

রাজন তিতিক্ষাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে এলো তিহার সম্মুখে। ঠেলে দিল তিহার দিকে। বোধহয় হুড়মুড় করে মাটিতেই গিয়ে পড়ত। খপ করে দু’হাতে বোনকে আঁকড়ে ধরে ফেললো তিহা। অবিশ্বাস নিয়ে আবারো তাকাল বোনের দিকে। সারা শরীরে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ, ছোপ ছোপ রক্ত মাখা জামাকাপড়ের কিয়দাংশ ছেড়া, গায়ে ওড়নাটাও ঠিকমতো জড়ানো নেই। হঠাৎ যেন সব স্পষ্ট হয়ে গেল। না, আর কিছু বাকি নেই। সব শেষ হয়ে গেছে! ধ্বংস হয়ে গেছে তার বোনের জীবন। অস্ফুট আর্ত চিৎকার বেড়িয়ে এলো তিহার মুখ দিয়ে। ঘোর আবিষ্ট অবস্থায় বোনকে নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল তিহা।

তিতিক্ষার আগমন ঘটা মাত্র ক্রুদ্ধ জনস্রোতে নতুন জোয়ার উঠেছে। ছোট বৈঠকঘর খানা যেন এবার মনস্যকণ্ঠের আস্ফালন সইতে না পেরে ভেঙে পড়বে। চিৎকার, হৈচৈ, অসংখ্য নোংরা কথা আর অপবাদে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস।

সেসবের কেন্দ্রে মধ্যমণি হয়ে বসে আছে তিনজন। তিহা তিতিক্ষা আর তাদেরকে ঘিরে অসহায় বাবা মারুফ। তিহা তখনো অপ্রকৃতস্থের মতো চিৎকার করছে। অথচ যাকে ঘিরে এত কিছু, সে যেন চিরনিথর, নিস্প্রভ এক জীব। ওর ভেতরে যেন কোনোদিন ছিল না প্রাণের সঞ্চার….

রাজনের বাবা অতিশয় কাতর হয়ে দাড়িতে হাত বোলালেন, ‘তাহলে বিয়েটা….’
‘বেরিয়ে যান এক্ষুনি। আপনাকে আর আপনার ওই বেজন্মা ছেলেকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবই। যান এখান থেকে। আমি খু নো খু নি বাঁধানোর আগেই বেরিয়ে যান।’
তিহা চেঁচিয়ে ওঠার সাথে সাথে নাটকীয় ভাবে মুখভঙ্গি পালটে যায় রাজনের পিতার। হেসে ওঠেন তাচ্ছিল্য ভরে। এত বড় কীর্তির পর এটুকু অপমান সওয়াই যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে ফিরে যেতে উদ্যত হন। যাওয়ার আগে রাজনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘চলে এসো রাজ। খেলা শেষ। তুমি যা চেয়েছিল তা তো পেয়েছই।’

আমজাদ বেরিয়ে গেলেন। বাবার যাওয়ার পথে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে সম্মুখে দৃষ্টি স্থাপন করল রাজন। হাটু গেড়ে বসল তিহার সামনে। মুখে পিশাচসুলভ হাসি। তিতিক্ষার নিস্পন্দ মুখ একবার দেখে নিয়ে ফিসফিস করে তিহাকে বলল,’খুব শখ ছিল না বোনের বিয়ে দেবার? এবার দে দেখি। এখন তো ও সবার কাছে একটা বে*। এখন না আমি তাকে বিয়ে করব না অন্য কেউ।’ বলে বিকৃত একটা হাসি দিয়ে চলে গেল।

সেই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত তিতিক্ষা নির্বাক ছিল। চোখের দৃষ্টি ছিল শূন্য। নিজেকে নিয়ে রাজনের শেষ মন্তব্যটা শুনে সে একবার একটু কেঁপে ওঠে মাত্র। তারপর এই প্রথম দুচোখের কূল ভেঙে অশ্রুর ফোয়ারা নামতে শুরু করে।

.

একদা এক গহীন বনমধ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে স্বচ্ছ সরোবরে ফুটেছিল একটি পদ্মফুল। অহোরাত্রি হাজারো সর্প তারে পাহারা দিত। কোনদিন কোনো মনষ্যচক্ষু দেখেনি সে ফুলের মাধুর্য। যে ফুলের উজ্জ্বল কান্তিতে আলোকিত হত অরণ্যপ্রভা। তারপর হঠাৎ একদিন কোথা থেকে এক হিংস্র শ্বাপদের আগমন ঘটলো বনে। গভীর অরণ্য মধ্য হতে সে এসে পদ্মফুলের শোভা দেখে থমকে গেল। লোভে চকচক করে উঠল তার চোখজোড়া। অতঃপর নিজের তীক্ষ্ণ ধারালো নখ দিয়ে সকল প্রহরিণী সর্পকে হত্যা করে সে অবশেষে নাগাল পেল পদ্মফুলের। দুমড়ে মুচড়ে বিধস্ত করে ফেলল ফুলটিকে। একে একে অত্যুজ্জ্বল সকল পাপড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল ফুল। গহীন অরণ্য মধ্যে কি ঘটে গেল কেউ জানল না। কেউ কি আছে যে সেই পদ্ম ফুলের দুঃখ বোঝে? বুঝলে সে জানতো কেন মরনো সেই যন্ত্রণার চেয়ে বেশি কাম্য। আজ থেকে যেমন তিতিক্ষা জানে….

চলবে…….

দূর আলাপন পর্ব-১০+১১

0

দূর আলাপন ~ ১০
__________________________
এয়ারপোর্টে সবাই এসেছিল নিনাদকে বিদায় জানাতে। বিশাল বন্ধুর দল, শিউলি ফুআম্মা, আফরিন, এছাড়া ঢাকায় থাকা কিছু দুঃসম্পর্কের আত্মীয় সকলে…
তবু যেন কার শূন্যতা মনগগনে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো। কি এক অজানা প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা যেন আনমনে নিনাদ করছিল।
আফরিন উৎসুক হয়ে তাকাচ্ছে এদিক-সেদিক। তাকাচ্ছে নিনাদও। তিহা সপরিবারে আসবে। সেজন্যই বুঝি প্রছন্ন এই তীব্র প্রতীক্ষা। আজ নিশ্চয়ই পরিবারের সঙ্গে আসবে তিতিক্ষা?
আসবে… নিশ্চয়ই আসবে… আজকের দিনে না আসতে হলে যতটা নির্দয়তা প্রয়োজন, তিতিক্ষা নিশ্চয়ই এই শেষ সময়ে তার ওপর অতটা নির্দয় হবে না!

আফরিনের প্রসারিত হাসি দেখে নিনাদ বোঝে ওরা এসেছে। সবার আগে ছেলে কোলে নিয়ে রওশান সামনে আসে। নিনাদ অস্ফুট হাসিটা মুখে ধরে রেখে ওদের স্বাগত জানায়। তারপর পুনরায় তাকায় আগমনী পথের দিকে। একে একে আসেন মারুফ তিহা সবাই। সন্দিগ্ধ চোখদয় ওদের ফেলে আসা পথে বিছিয়ে রাখে নিনাদ। হয়তো এক্ষনি এসে যাবে ছোট গিন্নি। ভাবগম্ভীর অভিমানী মুখ স্থির করে রাখবে দেয়ালের পানে।
কিন্তু কোথায় সে? কতদূরে? তিহা পর্যন্ত চলে এল, তবে এত দেরি কেন হচ্ছে তিতিক্ষার? নিনাদ কি একটু দেখে আসবে?
না, তা হয়না যে। ওকে ঘিরে জড়ো হওয়া এতগুলো মানুষ, এদের সবার স্নেহ অগ্রাহ্য করে কি করে মরিচীকার পেছনে সে ছুটে যাবে?

বুকের ভেতর গহন শূন্যতার হাহাকার আগে থেকেই ছিল। এত এত প্রিয় মুখের মায়া, স্মৃতি সব ফেলে কোথায় না কোথায় চলে যাচ্ছে নিনাদ। যাচ্ছে এমন স্থানে, চাইলেই যেখান থেকে ছুটে আসা যাবে না, তীব্র মন খারাপের সময়ে শিউলি ফুআম্মার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যাবে না, একা একা লাগলে ফোন করে বন্ধুদের ডেকে আড্ডা দেয়া যাবে না। প্রিয় মানুষ গুলোর সঙ্গে এমন অকাট্য দূরত্ব তো কখনো নিনাদ চায়নি! অথচ কে না জানতো দেশ ছাড়া মানে সমস্ত মায়া কাটিয়ে পাথর হয়ে যাওয়া! এই নিঃসীম হাহাকার, সবাইকে ছেড়ে যাবার যন্ত্রণা আর তিতিক্ষার প্রকাশ্য অবহেলা।

সবের প্রতি নিনাদের বিতৃষ্ণা জাগছিল। অস্থির সুস্থির অবস্থার এক ঘোরের মাঝেই সবার সাথে কথা বলে যেতে হলো ওকে। সবাই শুভকামনা জানিয়ে ছোট ছোট উপহার ধরিয়ে দিচ্ছে। একজোট হওয়া বন্ধুরা প্রচুর হাসছে আর আলাপে মশগুল হয়ে আছে। এক ফাঁকে তিহাকে জিগ্যেস করল তিতিক্ষার কথা। ভেতরের দাবদগ্ধ আবহের আঁচ কেউ যেন না পায় সেজন্য সবার সঙ্গে হাসছিল নিনাদ।
‘কিরে ছোট গিন্নি এল না যে?’

বোনের কথা ওঠাতে তিহা একটু নিভে যায়। কি বলবে হঠাৎ যেন বুঝে উঠতে পারে না। ম্লান হয়ে বলে,’ নারে, এত করে বললাম আমি আর বাবা। কথা শুনলে তো। বলল সবাই চলে এলে বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকবে। সেকথা অবশ্য ঠিক।’
‘ও ভালো কথা! তিতিক্ষা একটা গিফট পাঠিয়েছে তোর জন্য।’ ব্যস্ত হাতে প্যাকেট টা বন্ধুকে দিল তিহা। নিনাদ যন্ত্রের মতই নিল।
একটু চুপচাপ, একটু ছন্নছাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল নিনাদ। আর হাসলো না, বাড়তি কথা বলল না। ডাক পড়তেই ব্যস্ত হয়ে জিনিসপত্র এক করে চলে যেতে উদ্যত হলো।
ফ্লাইটের বেশিক্ষণ বাকি নেই, সব বুঝে শুনে গুছিয়ে নিয়ে উঠতে হবে। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে, আরেক দফা ফুআম্মার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে শেষ বারের মতো নিনাদ সবাইকে একনজর দেখল। অবচেতন মনে তখনো ক্ষীন আশা হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছে তিতিক্ষা। শেষ পর্যন্ত না এসে পারেনি। কিন্তু কোথায়?

কোথাও নেই। নিজেকে প্রবোধ দেয় নিনাদ। প্রস্তরের ন্যায় স্থবির দৃষ্টি সম্মুখে নিক্ষেপ করে হাটতে শুরু করে। পেছনে শিউলি আফরিন তিহা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। পেছন না ফিরে হাটার গতি বৃদ্ধি করে নিনাদ। ওদের কান্নার আওয়াজ কি তার কানে এসে পৌঁছায় নি? পৌঁছালে নিনাদ কি করে অত নির্বিকার হয়ে চলে যেতে পারল? নিনাদ এতই নিষ্ঠুর!

______________________

ওহিও’র বাহারি রঙের মেঘপূর্ণ শীতল আকাশে তখন রাত্রি নেমেছে। রাতের গভীরতার সাথে সাথে আকাশে মেঘ সরে গিয়ে উঠেছে মস্ত থালার মত বড় এক রূপালী চাঁদ। তীব্র স্বচ্ছ প্রস্ফুটিত পূর্ণ চাঁদের আলোয় পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে।
কত বড় চাঁদ! নিনাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। বাংলাদেশের আকাশে চাঁদকে কখনো এত বড় আর উজ্জ্বল দেখেনি।

নিনাদ চাঁদের পানে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ। যে বাড়িটায় সে উঠেছে সেখানে ছাদ নেই। আশেপাশের কোন বাড়িতেই ওপরে ওঠান মতো ছাদ নেই। কিন্তু বাড়ির সামনে বিশাল খোলা জায়গা আছে। এই মধ্যরাত্তিরে নিনাদ খাপছাড়া ভাবে খোলা স্থানে হেটে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে দেখে ওই একফালি রূপোর থালাটাকে। হঠাৎ হঠাৎ কেমন শূন্য লাগে চারপাশ। বুকের ভেতরে যেন এক ঊষর মরুভূমি সম শূন্যতা। কত আনন্দময় বিচিত্র জীবন এখানে। যেদিকে চায় সবুজের গাঢ় আবাহন, ঝকঝকে তকতকে পথঘাট, রুমমেটরা প্রত্যেকে অত্যন্ত মিশুক। মাসে একবার ওরা ফিশিংয়ে যায়, লেক ইরিতে যাওয়া হয় সময়ে অসময়ে ইচ্ছে হলেই। বড় ভাইয়েরা, নতুন বন্ধুরা সবাই ওকে খুব স্নেহ করে। এখানে সে সবার চেয়ে বয়সে ছোট ও নতুন বলে।

নিনাদ জানে, এখানে তার জীবন সকল বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। যা ইচ্ছে তাই করতে পারে সে। বাঁধা দেবে না কেউ, বিবেক ছাড়া। তবু যে কেন এত বিস্বাদ লাগে সব তার কারণ জানে না ও। কতরকম কাজ সারাদিনে। পড়াশোনা, ছুটোছুটি, নতুন দেশে সেটেল হবার হাবিজাবি নানান ঝামেলা। দিনগুলো কেটে যায় ভীষণ ব্যাস্ততায়। কিন্তু রাতগুলো যেন ফুরাতে চায় না কিছুতেই।

একা একা রাত জাগবার সময় টুকুতে বহুদূরের অতীত পর্যন্ত ঠান্ডা হাওয়ায় মতো ওকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়। মনে পড়ে বহু বছর আগের সেই বিভীষিকাময় রাত্রি গুলোর কথা। যখন অভাবের সংসারে মাঝপথে তাদের ফেলে বাবা চলে গেলেন ওপারে। বাবার মৃত্যুতে ভীষণ শোকে আর অদূরবর্তী ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন মা। তিনিও বাবার পথেই হাটলেন৷ মানসিক যাতনা আর সইতে না পেরে মারা গেলেন বাবার মৃত্যুর ঊনিশ দিনের মাথায়। নিনাদ তখন সাত মাসের কোলের ভাইটাকে নিয়ে এই পৃথিবী নামক মাঝদরিয়ায় পুরোপুরি একা। ভাইটাকে সে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল নিজের সর্বোচ্চ টুকু দিয়ে। অনাহারে নিজে শুকিয়ে মরছিল, তবু ভাইটার জন্য একমুঠো খাবার জোগাতে দিনরাত ছুটতো। এতো একাগ্র চেষ্টার পরও ভাইটা বাঁচল না। এক শরত দুপুরে প্রচন্ড জ্বরে ধুঁকে ধুঁকে, অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেল নিনাদের শেষ আপনজন। পৃথিবীর আলো, বাতাস, জল ছাড়া আর নিজের বলে কিছু রইল না নিনাদের।
আত্মীয়স্বজনের এবার দয়া হলো। একে একে ছুটে এলো অনেকে। কিন্তু কেমন যেন হয়ে পড়েছিল নিনাদ। চোখেমুখে স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। শেষতক দূর গ্রাম থেকে ছুটে এলেন নিনাদের বাবার সৎ বোন স্বামীহীনা নিঃসন্তান শিউলি। তাকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি। ধীরে ধীরে সুস্থ হলো নিনাদ। ওকে ভর্তি করিয়ে দিলেন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে।

স্কুলের শিক্ষকরা কিছুদিন পরই শিউলিকে ডেকে নিয়ে জানাল নিনাদ পড়াশোনায় বেশ ভালো। এক ক্লাস ওপরের পড়া ধরে ফেলতে পারে অনায়াসে। ফাইভ পাসের পর স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিজ উদ্যোগে ওকে শহরে পড়ার জন্য পাঠাতে চাইলেন। শিউলি বেগম গ্রামের মেয়ে হলেও ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। আবেগী মন তার ছিল না। তিনি রাজি হলেন ছেলেকে শহরে পড়াতে। ঢাকার পাশে মানিকগঞ্জের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে নিনাদ আবার এল শহরে। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে গেল।

নিনাদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। কি দিন ছিল, কি দিন এল, জীবনে কত সে পেল, কত সে হারাল। শুরুতে সে যেমন একা ছিল আজও তেমনই একা সে রয়ে গেল। মাঝে যে এসেছিল মাঝেই সে চলে গেছে। না, সে আদৌও কখনো আসেনি নিনাদের জীবনে। নিনাদ জোর করে টেনে এনেছিল তাকে। এবার স্বইচ্ছায় ছেড়ে দিল। আর কেউ আসবে? প্রয়োজন নেই। নিনাদ একা ভালো থাকতে শিখে গেছে।

রাতের পর দিনের আগমনের যে স্বাভাবিকতা, নিনাদের জীবন এখানে সেই নিয়মে বাঁধা। নিগূঢ় আঁধারের রাত্রি গুলো কেটে যায়, ফের দিন আসে। নিনাদ খায়, দায়, ভার্সিটি যায়। সবকিছু চলছে ঠিক যেমন চলার কথা। তবে এইসব একঘেয়ে দিনের মাঝেও কিছু কিছু ভিন্নতা আছে। নিসঙ্গতায় বোঝা যায় লোকসমাগমের মাহাত্ম্য। নিনাদও ঠিক তেমনি এখানে একা, ভালোবাসাহীন হয়ে বুঝেছে মনস্যজীবনে ছোট ছোট মায়ার বাঁধন, মিষ্টি বোঝাপড়ার অপরিহার্যতা। যতক্ষণ কাজে ডুবে থাকে ততক্ষণই ভালো। সামান্য অবসর পেলেই চারদিক থেকে চেপে ধরে একাকীত্ব।

কত যে অতীত স্মৃতি, পুরনো কথা, হারানো মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা মাথা চারা দিয়ে ওঠে সেসময় সময়… অস্থিরতা কমাতে, দু দুন্ড শান্তির নিমিত্তে আজকাল ইবাদাতে বেশ মনোযোগী হয়েছে নিনাদ। একান্ত নিজের মানসিক স্থিরতার জন্যই আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ খুঁজে চলেছে হন্যে হয়ে। বুকের খাঁচায় আর কারো জন্য জাগতিক ভালোবাসা পুষে রাখা নেই বলেই যেন আল্লাহকে ডেকে এত শান্তি পায়।

আজকাল কাজ ছাড়া নিনাদ ঘরের বাইরে পা বাড়াতে চায় না একটুও। মানুষের লঘু আলাপে সঙ্গদানের চাইতে নিজের ঘরে একা বসে থাকতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অবসরে বই, জার্নাল পড়া আর প্রত্যেক সকাল বিকেলে একা একা ঘুরে বেড়ানোই এখন ওর বাঁধা রুটিনে পরিণত হয়েছে। নবাগত ছেলেটার এই অদ্ভুত ধরনধারণ দেখে বাকিরা অবাক হয়। সাধারণত প্রথম প্রথম এখানে আসার পর কি রেখে কি করবে, কোন জায়গা ছেড়ে কোন জায়গায় যাবে সেসব ভেবেই অস্থির থাকে সবাই। অথচ শুরু থেকেই কোন কিছুতে আগ্রহ নেই ছেলেটার। সে যেন আমেরিকা নামক বন্দী জেলখানায় বছরের পর বছর অবরুদ্ধ থেকে ভীষণ ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছে। একটুখানি বাইরের আলো বাতাসের জন্য ভেতর যেন হাঁসফাঁস করছে সবসময়।
আজও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সবাই যখন প্রস্তুতি জুড়ে দিল লেক ইরিতে যাওয়ার জন্য, তখনো নিনাদ বসে রইল চুপচাপ। জিগ্যেস করলে জানাল শরীর ভালো লাগছে না। অবশেষে তাকে রেখেই বিকেলে বেরিয়ে পড়ে সবাই। অনেকক্ষণ জেরার পর একটু একা হতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচে নিনাদ।

_________________

তখন সায়ংকালের শুরু, জানালার পর্দা সরিয়ে নিনাদ বাইরে তাকায়। রাস্তা দিয়ে সা সা করে একের পর এক গাড়ি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলেছে। গুড স্ট্রিটের ইতস্তত ছড়ানো বাড়ি গুলোয় সন্ধ্যেতেই যেন মাঝরাত্রির নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কোনো আওয়াজ নেই, কারো বাড়ির আঙ্গিনায় কোন মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। নিনাদ সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়। সঙ্গোপনে ফেলে দীর্ঘ নিশ্বাস। এতো একা কেন সে?

আজ চার মাস হতে চলল তিহা বা তার পরিবারের কারো সাথেই যোগাযোগ নেই। প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিক ছিল। নিয়মিত কথা হত তিহা ছোটন আর রওশানের সাথে। তারপর হঠাৎ একদিন অসময়ে তিহার কল। ছোট বাচ্চাদের অবুঝ আবদারে বড়রা যেভাবে ভোলাতে চায়, ছলনা করে বোঝাতে চায় যে “তাদের চাহিদার বস্তুটি দূর আকাশের চাঁদ। নাগাল পাওয়া যার অসম্ভব। অতএব পাওয়ার বাসনা তাকে ছাড়তে হবে।” ঠিক সেভাবেই সেদিন তিহাও তাকে কিছু একটা বুঝিয়েছিল…

জানালার কাছ থেকে সরে নিনাদ আলমিরার সামনে এসে দাঁড়ায়। আলমিরা খুলে খুব সন্তর্পণে বের করে কিছু একটা। একটা রেপারে মোড়ানো গভীর সবুজে রাঙানো মুসল্লা আর খুব সুন্দর কাঠের রেহাল ও অনুবাদ সহ একটা কুরআন।
একে একে সবগুল বের করে নিনাদ। কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেয়, দেশের ঘ্রাণ, দেশের ধুলো বাতাসের ঘ্রাণ। ঘ্রাণ নিতেই ওহিও’র গুড স্ট্রিটের একটি বাড়ির নিভৃত আধো অন্ধকার ঘরে বসে থেকেও সে যেন ফিরে যায় বাংলাদেশে, তার ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোতে। তখন যা ছিল অতি তুচ্ছ, হয়তো যা কিছুই ছিল না। এখন যেন তা-ই নিনাদের কাছে এক সমুদ্র দুঃখের মাঝে হয়ে ওঠে এক পশলা সুখের মতন। অতীতের একই স্মৃতি আজ কেবলই অনুরণনের মত বারবার বেজে যায় তার কানে।

এটুকুই তিতিক্ষার শেষ স্মৃতি চিহ্ন হিশেবে রয়ে গেছে তার কাছে। আর কিছু নেই। নতুন করে কোন স্মৃতি জমানোর সুযোগও নেই। তিতিক্ষাকে আর কোনোদিন ছোট গিন্নি বলে ডাকা যাবে না। তিহার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে সম্ভবত তিতিক্ষা এখন অন্যের ঘরনি!
যেদিন অনেক বার ইতস্তত শেষে প্রথম কথাটা জানিয়ে ছিল তিহা তারপর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে নিনাদের যোগাযোগ একরকম বন্ধই হয়ে আছে। তবে এখনো রোজ কল করেন ফুআম্মা। আগের মতো সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে না নিনাদ। ইচ্ছে, কিংবা জোর কোনটাই পায়না।

কখনো অরবে সরবে বিষাক্ত সময়ের কিছু আখ্যান এখনো মনে পড়ে। মনে পড়ে তিহার শেষ স্বান্তনা। তিতিক্ষা ওকে, ওর মতো কাউকে নাকি চায়নি কোনোদিন। স্বাধীনচেতা মেয়ে তিতিক্ষা, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো ভাবপ্রবনতা নেই ওর। সুতরাং নিনাদ যেন আর আশা না রাখে।

শান্ত হয়ে সবটা শুনলো নিনাদ৷ বিরোধিতা করার চিন্তা টুকুও যেন বড় ক্লান্তিকর। তাই নিরব থেকে শুনে গেল তিতিক্ষার কথা, তার হবু স্বামীর কথা। মস্ত নাকি বিজ্ঞ ব্যাক্তি। দশ এলাকার ছেলেদের আদর্শ! একটা খ্যাতনামা কলেজের প্রভাষক। নিনাদ হাসল। ভালোই হলো। এমন ছেলেকেই তো মানায় তিতিক্ষার পাশে। আর নিনাদ! আস্তাকুড় থেকে উঠে আসা শেকড় হীন মানুষ সে। যার চরিত্রের ঠিক নেই, মতিগতির স্থিরতা নেই। এমন খেয়ালি মানুষের তো সাধারণ একটা জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখাও পাপ! ভালো থাকুক ওরা দুজন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মিলেমিশে থাকুক। নিজের অভিশপ্ত জীবনের আখ্যান নিয়ে নিনাদ কখনো ওদের দ্বারে ভিড়বে না!
চলবে…..

দূর আলাপন ~ ১১
____________________________
বহুদিন আগে গত হয়েছে বসন্ত। শেষ হয়েছে লাল গোলাপি, আর সবুজ নীলের আবছায়া সুখের সময়। ঋতুচক্রে এখন বৈশাখ, প্রকৃতির রুক্ষতম মাস। স্থল জল অন্তঃরীক্ষ সব খাক করে, প্রচন্ড দাবদাহ আর কাঠফাটা রোদ্দুরে মানুষকে জ্বালিয়ে নিষ্ঠুর ঋতু হাসে বিজয়ীর হাসি।
বৈশাখের এই খাঁ খাঁ দুপুরে, বিগতবসন্তের কোকিলের ডাক কান পাতলে এখনো শোনা যায়। ডাকতে ডাকতে ওরা ক্লান্ত হয়, থেমে যায় সুর, তৃষ্ণায় বিশুষ্ক হয়ে ওঠে ঠোঁট। পাখিগুলো এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে বসে। তৃষ্ণায় ছটফটানো ছোট্ট বুক দ্রুত ওঠানামা করে। পাখিদের এত কষ্ট, অস্থির ছটফটানি আর পিয়াসায় দুরন্ত নেচে বেড়ানো কিছুই যেন স্পর্শ করে না নির্দয় ঋতুর বিবেককে।

ঘরের ঝকঝকে সাদা মেঝেতে একটা নিস্পন্দ বস্তু পড়ে আছে। জানালার পলকা সফেদ পরদা উড়ছে অবিরল। খোলা বারান্দা গলে হু হু করে ভেসে আসে তপ্ত বিধুর হাওয়া। ঘরের ভেতরের উত্তাপে যেন স্ফুলিঙ্গ ঝরে। বারান্দায় তাকালে শ্রান্ত বৈশাখ দুপুরের শুষ্ক রূপ ভীষণ ভাবে চোখে পড়ে। নজরে আসে সেই তৃষ্ণার্ত পাখিটার অস্থির ছটফটানিও।

দরজার বাইরে থেকে খুব ক্ষীণ স্বরে ডাকছে কেউ। খানিকটা ত্রাস, অত্যল্প স্নেহ মেশানো সে ডাক। মেঝেতে পড়ে থাকা বস্তুটি হঠাৎ একটু নড়েচড়ে ওঠে। তখন বোঝা যায় বস্তু নয়, ওটা একটা প্রাণ। জীবন মৃত্যুর সীমারেখা বিস্মৃত হওয়া অলীক এক মানুষ।

তিহা আবার ডাকে। ধীরে ধীরে ভীষণ যত্নে পুনরাবৃত্তি করে ক’টা শব্দ,’তিতি… দরজা খোল তিতি…’
কোন সারা নেই। নির্জীব দেহখানা অসার হয়ে মিশে থাকে মেঝের সঙ্গে। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে আশ্চর্য ওই আকাশের পানে। ধাঁধা লাগে, চোখ বুজে আসতে চায়, তবুও সে চেয়ে থাকে অহেতুক অকারণ।

সময়ের সাথে সাথে দরজার বাইরে গলার আওয়াজ একসময় জোড়ালো হয়ে আপনাতে নিভে যায়। হতাশ হয়ে ডাকা বন্ধ করে তিহা। চলে যায় দরজা ছেড়ে।

বস্তুরুপী প্রাণ চেতনাশূন্যের মতো মেঝেতে গা এলিয়ে পড়ে থেকে শোনে দূর মসজিদে পড়ছে যোহরের আজান।

হাইয়া আলাস্ সলাহ
হাইয়া আলাল ফালাহ

সলাতের জন্য এসো
সাফল্যের জন্য এসো

প্রলম্বিত নিশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে সে উঠে বসে। সময় হয়েছে, একান্ত এবং একমাত্র প্রিয়জনের সাথে কথা বলার।
স্থবির গা হাত-পা ঠেলে উঠিয়ে বাথরুমের দিকে চলে যায়।
ক্ষণকাল পরে ঢিলেঢালা পোশাকের ওপর বড় ওড়না জড়িয়ে মুসল্লায় দাঁড়িয়ে নিয়ত বাঁধে। অযত্নে মাথা মোছার ফলে তখনো ভেজা চুল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে , মুখে লেগে রয়েছে বিন্দু বিন্দু ওজুর পানি।
পরম আবেশে, নির্ভেদ একাত্বতার সাথে সে রবের ইবাদতে মশগুল হয়। কিছুক্ষণ… আরো কিছুক্ষণ….. তারপর আরো কিছুক্ষণ….. নিরন্তর সময় বয়ে যায়। সিজদায় পড়ে থাকে তিতিক্ষা। মুখে কোনো রা নেই, চোখ বেয়ে শুধু জল গড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায়। যিনি অন্তর্যামী, তার সম্মুখে কয়েকটা এলোমেলো শব্দ উচ্চারণের কিইবা প্রয়োজন?

.

মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে আওয়াজ পেয়ে ছুটে আসেন মারুফ। পেছন ফিরে বাবাকে দেখে আবার কাজে মন দেয় তিহা। ওর বিমর্ষ ম্লান মুখে তাকিয়ে মারুফ কি যে বলতে এসেছিলেন ভুলে বসলেন। রান্নাঘরের দোরগোড়ায় অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। চিন্তার খেই হারানো বাবার ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি দেখে একসময় মায়া হলো তিহার।
‘কি বলতে এসেছো বাবা?’

‘কি আর? আমার ছোটমায়ের কথা। ও কি কিছু খেয়েছে? কিছু বলল?’

তিহা মলিন হাসে,’আজকের দিন কি অন্য দিন থেকে আলাদা বাবা? যে ও কথা বলবে? কথা বলা, খাওয়া এসব তো দূর! দরজাই যে খোলে নি।’
মারুফের ক্লান্ত মুখ ঝুলে পড়ে। সহসা ব্যস্ত গলায় বলেন,’যাই, ছোটনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। ও এলে যদি কথাটথা বলে… দুটো খাবার মুখে দেয়…’

তিহা নিশ্চুপ। রোজ রোজই তো ছোটনকে পাঠাচ্ছে ওইঘরে। কোনো লাভ নেই।

.

স্কুল থেকে ছোটন ফিরলে ছেলের পোশাক বদলে, খাইয়ে আজও তিহা বোনের ঘরে ঠেলে দিল। যাওয়ার আগে শিখিয়ে পড়িয়ে নিল কি করতে হবে। আজকাল মিমির কাছে যাওয়ার নামে মুখ শুকিয়ে আসে ছোটনের। মিমিকে এখন বাঘের মত ভয় পায় বাচ্চাটা। তবু যায় ছোটন। সেই যে একটা সময় ছিল, যখন মিমি তাকে খুব ভালোবাসতো, রাতদিন তারা দুজন একসাথে কাটাতো। কত হাসি, কত দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখতো সারাবাড়ি… সেসব দিনের কথা মনে করেই, মিমির কাছে একা যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে ছোটন।
তিহাও নিরুপায়। ছেলেটা ডরায় জেনেও রোজ ওকে পাঠায়। কারণ একমাত্র ছোটন ডাকলেই যে ও ঘরের অবরুদ্ধ দরজা ক্ষণকালের জন্য খোলে।

ভয়ে ভয়ে কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল ছোটন। মায়ের ইশারায় একসময় ডাকলো,’মিমি… আমি ছোটন, দরজা খোলো। ও মিমি, দরজা খুলবে না?’
কিঞ্চিৎ সময় পর ওপাশে নব ঘোরানোর আওয়াজ হয়। দরজা খুলে আবার গিয়ে আগের জায়গায় বসে পড়ে তিতিক্ষা। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে ছোটন মিমির পাশে মাটিতে বসে। মায়ের শেখানো কথাগুলো একে একে ভুলে যেতে থাকে। শেখানো বুলি বিস্মৃত হলেও ছোটনের নিজের মনের মধ্যে কথা কম জমা নেই। আস্তে আস্তে ও সহজ হয়। মিমির গা ঘেঁষে বসে খাপছাড়া যত কথা আরম্ভ করে।
‘জানো মিমি, স্কুলে সামিন নামে আমার যে বন্ধুটা আছে? আজ ও পরে গেছিল মাঠে, সবার সামনে… হো হো করে সবার সে কি হাসি… সামিন খুব কাঁদছিল তখন।’
তিতিক্ষার অচল গম্ভীর কায়া একটু নড়েচড়ে ওঠে। রুক্ষ চোখে তাকিয়ে সহসা বলে,’ তুমি কি করলে তখন? হাসছিলে সবার সাথে?’

মিমির ককর্শ স্বরে ছোটন দমে যায়। নিচু গলায় ভয়ে ভয়ে বলে, ‘ও তো আমার বন্ধু হয়। আমারও খুব কান্না পাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে ওকে টেনে তুলেছি।’

তিতিক্ষার বাঁকানো ভ্রু জোড়া আবার সরল হয়ে আসে। ভাবলেশহীন দৃষ্টি আবারো সম্মুখে নিক্ষেপ করে সে।

‘আমি ভালো করিনি মিমি?’

‘হুম’

‘কেউ কষ্ট পেলে আমাদের হাসা উচিত নয়। তাই না মিমি?’

‘হুম’

‘মিমি, তোমার কি অনেক কষ্ট? তোমার কষ্টে সবাই খুব হেসেছিল। এজন্য তুমি সবসময় মন খারাপ করে থাকো। তাই না?’

কিছুটা সময় কেটে যাবার পর তিতিক্ষা পাশ ফিরল। ছোটন দেখল মিমির চোখের পানি নাকের পাশ দিয়ে ক্রমান্বয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অল্প অল্প নাক টানছে, ক্রমে বাড়ছে তার কান্নার বেগ।

মুখেচোখে কষ্টের ছাপ ফুটে ওঠে ছোটনের। তার মিমির এত কষ্ট, যদি পারতো ইরেজার দিয়ে কষ্টের সবকটা দিন মুছে দিতো সে মিমির জীবন থেকে। তিতিক্ষার অবস্থা দেখে ছোটন নিজের ভয় ভুলে গেছে। পাশ থেকে উঠে মিমির কোলে চড়ে বসেছে অনায়েসে। ছোট ছোট হাতে মিমির চোখ মুছে দিয়ে বলল,’তুমি কেঁদো না মিমি। আমি আছি তো! যে তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছে বড় হয়ে আমি তাকে ভীষণ শাস্তি দেব। ও তোমাকে মেরেছিল, তাই না মিমি? আমিও ওকে খুব মারবো। শুধু আরেকটু বড় হয়ে নিই।’ বলে তিতিক্ষার কপালের কাটা দাগের ওপর চুমু খেল ছোটন। সমস্ত নিঃসাড়তা ভুলে দু হাত বাড়িয়ে সন্তানসম শিশুটিকে একসময় জড়িয়ে ধরল তিতিক্ষা। তার নিঃশব্দ কান্নার নিরব সাক্ষী হয়ে রইল দরজার আড়ালে দাঁড়ানো তিহা…

__________________

ভালোবাসা সর্বগ্রাসী! একটা মানুষকে কত সহজে নিজের আসন ছেড়ে টেনে হিচঁড়ে নামিয়ে আনে রাস্তায়। মানুষ ভুলে যায় তার আত্মমর্যাদা, তার অবস্থান।
দীর্ঘ পাঁচমাস পর নিনাদ যখন নিজের তাগিদে তিহাকে প্রথম কল করল, নিজেকে তার ভীষণ নির্লজ্জ আর নাছোড় মানুষ বলেই মনে হল। তার গোটা জীবন জুড়েই ভালোবাসার অপ্রতুলতা ছিল চিরকাল। তাই যেখানে একটু অনুরাগের আভাস পেয়েছে, কাঙালের মত ছুটে গেছে সেদিকে। না পাওয়ার ব্যর্থতা এক, আর পেয়ে হারানোর যাতনা আরেক। দুইয়ে আকাশপাতাল পার্থক্য। একসময় নিনাদের প্রায় কেউ-ই ছিল না। মানিয়ে গেছিল এই পরিস্থিতির সঙ্গে। তারপর একে একে অনেক গুলো প্রিয় মুখ একসঙ্গে জড়ো হলো। আজ তাদের অনেকে নেই। হয়তো কোথাও আছে ওদের অস্তিত্ব, কিন্তু নিনাদের সঙ্গে আর সম্মন্ধ টুকু বজায় নেই। সবাই সব ভুলেছে, ভুলে যেতে পারেনি কেবল নিনাদ। পারেনি কারণ পুরনো কে ভুলতে গেলে যে নতুন আসঞ্জনের প্রয়োজন। কিন্তু এখন তখন… কখনোই নিনাদের কোনো আসঞ্জন ছিল না। নির্লজ্জের মত আগ বাড়িয়ে আবারো তাই পুরনোর পথে ধাবিত হতে চায় তার বেহায়া মন…

ফোন কানে চেপে নিনাদের কেমন অস্বস্তি হতে থাকে। মাঝখানে কতগুলো দিন কেটে গেছে, তিহা আগের মতই হেসে কথা বলবে তো? ছোটন ডেকে উঠবে তো বন্ধু বলে? নাকি ওর কথা এরমধ্যে ভুলে গেছে ছোটন!
আবোলতাবোল নানান কথা ভেবে একসময় নিনাদ মনে প্রাণে চাইতে থাকে কলটা যেন কেটে যায়। থাক দরকার নেই পুরনো সম্পর্ক জিইয়ে তোলার। ওরা যেমন আছে তেমনি থাকুক। এতগুলো দিন যখন নিনাদকে ভুলে থাকতে পেরেছে সামনেও পারবে।

কিন্তু মনস্কামনা পুরোপুরি ব্যার্থ করে দিয়ে তখনই ওপাশ থেকে তিহার দায়সারা গলা ভেসে আসে, ‘হ্যালো।’
নিনাদ ভারি অপ্রস্তুত হয়। কিঞ্চিৎ কাল স্তব্ধ থাকার পর ইতস্তত হেসে জিগ্যেস করে,’ভালো আছিস? ওহ আসসালামু আলাইকুম!’

কে ফোন করেছে এতক্ষণে ঠাওর করতে পেরে অস্ফুট হাসে তিহা। কণ্ঠে স্বাভাবিকতা ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলে, ‘ওহ তুই! বিদেশি নাম্বার খেয়াল করিনি। ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমরা ভালো আছি। এতদিন পর যে? শেষতক মনে পরল তাহলে আমাদের কথা?’

মনে তো তিহারও পরে নি। এই কয়েক মাসে কল করে নি একবারও। কিন্তু নিনাদ সেসব কথার ধার দিয়ে না গিয়ে সম্পুর্ন অপরাধ নিজের দিকে টানে, ‘ব্যাস্ততা অনেক বেড়েছে রে। যদিও একটা কল করার মত সময়ও ছিল না বললে বাড়িয়ে বলা হয়। অজুহাত দেব না। ভুল তো ছিলই।’

ওপাশ থেকে শুধু একটা অস্ফুট শব্দ ভেসে এল। তিহার প্রাণহীন নিস্পন্দ হাসি। তারপর কথা হারিয়ে ফেললো দুজনে।
অবাক লাগে নিনাদের। তিহার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক টা এত দূরের হয়ে গেছে যে কথা খুঁজে পাচ্ছে না আজ।
‘ওদিকে সবার কি অবস্থা? ছোটন, রওশান ভাই, আঙ্কেল… ভালো আছে তো সবাই?’
অনেক ভেবে যুতসই একটা প্রশ্ন খুঁজে পেল নিনাদ।

‘আলহামদুলিল্লাহ, সবাই ভালোই আছে। তুই ফিরছিস কবে? এক বছর তো হয়েই গেল…’

‘তা জানাতেই কল করেছিলাম। ফিরছি একমাস পর। ফুআম্মা বলে রেখেছেন দেশে এলেই গলায় দড়ি পড়াবেন। মেয়ে ফেয়ে সব নাকি ঠিক। দড়ি যখন পড়তেই হবে তবে অত তাড়াহুড়োর কি? সেজন্য ভাবছিলাম আসাটা পিছিয়ে দেব… ‘

‘বাহ! শেষতক তোর বিয়েটা ঠিক হয়েই গেল তাহলে। আসা পেছাবি কেন? তাড়াতাড়ি আয়। শুভ কাজে দেরি কি? তা পাত্রীটা কে? আমাদের আফরিন ই তো?’

নিনাদ হাসলো,’কি যে বলিস…. কোনো খবর রাখিস না দেখি তুই! আফরিনের বিয়ে সেই কবে হয়ে গেছে!’

‘কিহ! সত্যি বিয়ে হয়ে গেছে?’ স্থবিরতা কাটিয়ে এতক্ষণে সত্যিকারের বিস্ময় ফুটে উঠল তিহার মুখে।

‘হ্যাঁ। বিয়েটা ফুআম্মাই দিয়েছেন। ইয়ে… আমাদের গ্রামের এক ছেলের সাথে আফরিনের একটা সম্পর্ক মত ছিল…’

‘ফুআম্মা নিজেই বিয়ে দিলেন! তোর সাথে ওর বিয়ে নিয়ে কত উৎসাহ ছিল ফুআম্মার… আর আফরিন, তলে তলে অমন সেয়ানা তা তো দেখে বুঝিনি!’

আবারো হাসে নিনাদ,’বুঝিস ই তো। বিদেশবিভুঁইয়ে থাকা ছেলেরা এমনিতেই সন্দেহজনক হয়, তার ওপর পরিবারের শেকড় বলতে যার কিছু নেই, আদব, লেহাজ, চরিত্র সেসব কিছুও তো তেমন যুতসই নয়। ফুআম্মাই বা কেন রিস্ক নেবেন? তুই যেমন আমি দেশ ছাড়তেই সুযোগ পেয়ে বোনের শুভ কাজটা সেরে ফেললি, তেমনি ফুআম্মাও আর বাজে ছেলের জন্য ধৈর্য রাখতে পারলেন না।’

উত্তরে তিহা কিছু বলল না। নিনাদ তাহলে সেসব কথা এখনো মনে রেখেছে… আজ সুযোগ পেয়ে কি সুন্দর শুনিয়ে দিল। ভালোই করেছে নিনাদ। ভুলতে শুরু করা অতীত ক্ষতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। কিন্তু ও কি করে জানবে যে নিজের করা ভুলের মাশুল তিহাকে কত ভয়াবহ ভাবে গুনতে হয়েছিল। গুনতে হচ্ছে আজও।

উত্তর না পেয়ে নিনাদ ডাকে,’কিরে, কি হল? রাগ করলি? বোকা মেয়ে! আমি তো শুধু তোকে খেপানোর জন্য বলছিলাম। তা নাহলে আমি কি আর জানি না তিতিক্ষার কত অযোগ্য আমি? সত্যি বলতে ওর বিয়ের কথা শুনে আমি খুশিই হয়েছি। তিতিক্ষা যোগ্য বর পেয়েছে। আর আফরিনের ব্যাপার টা তো শুরু থেকেই কিছুকিছু জানতাম। সেজন্য তখন ফুআম্মার এত জেদের কাছেও বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকতে হয়েছিল। এবার বুঝলি?’

এবারো প্রতুত্তর করল না তিহা। ভেতরে দলা পাকিয়ে উঠছে উতরোল কান্নার বেগ। নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে৷ মনে মনে নিজের বুকে শতবার চাকুর ফলা বিঁধিয়ে তিহা হিসহিস করে, ‘সব দোষ আমার… সব দোষ আমার… পৃথিবীর দু প্রান্তে দুটো প্রাণ বেঁচেও বাঁচার স্বপ্ন হারিয়েছে আমার ভুলের জন্য। তিতিক্ষা প্রতিনিয়ত জ্বলছে পুড়ছে অবর্ননীয় যাতনার খরতাপে, আর প্রিয় মানুষ গুলোর থেকে সবচেয়ে কঠিন ধাক্কা খাবার পর নিনাদ বেঁচে আছে পাথর হয়ে।
এসব কি করেছিলাম আমি? কেন এত জটিল খেলা খেলেছিলাম সামান্য একটু সাচ্ছন্দ্যের জন্য। অবুঝের মত নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করতে থাকে তিহা।

‘তিহা, কি হলো তোর? কাঁদছে কে তোর পাশে? হ্যালো… তি.. তিহা তুই ই কাঁদছিস নাতো?
কি সর্বনাশ! আমার কথায় কেঁদে ফেলতে হবে? আমি কি অত বুঝেশুঝে সব কথা বলি নাকি? এই বোকা কথা বল। কাঁদলে ফোন রেখে দিচ্ছি। ছাড়লাম…’

‘না… নিনাদ শোন। একটা…. একটা… কথা বলা হয়নি তোকে…’ তিহার রুদ্ধ স্বর নিলীন হয়ে আসে। কিছু একটা টের পায় যেন নিনাদ। সঙ্গিন গলায় উত্তর করে, ‘হ্যাঁ বল না।’

আরো দু দন্ড নিরব থাকে তিহা। সহসা বলতে শুরু করে, ‘তিতিক্ষার বিয়েটা আসলে হয়নি। বিয়ের দিন সকালে… ওরা ভেঙে দিয়েছে।’ বলে হু হু কান্নার ভেঙে পড়ে তিহা।

‘বিয়ে ভেঙে দিয়েছে! এটা কোনো ব্যাপার হলো? বিয়ে ভেঙে গেছে তো কি হয়েছে? আবার বিয়ে হবে। এজন্য তুই কাঁদছিস? এই যুগে এসব কেউ গোনে নাকি? তুই ভাবিস না। আমি এসে ওর ভালো জায়গায় বিয়ে দেব… ‘

কথার মাঝখানেই তিহা ওকে থামায়, ‘ না রে। কিছু জানিস না তুই। তিতিক্ষার আর কখনো বিয়ে হবে না। একটা ঝড় এসে আমার বোনের জীবন চিরতরের জন্য ওলট-পালট করে দিয়ে চলে গেছে। এরপর আর কিছু হবার নয়।’

‘মানে?’ অতল গম্ভীরতা ভেঁদ করে কাঁকিয়ে ওঠে নিনাদ।

‘মানেটা খুব কঠিন। তুই নিতে পারবি না।’

‘কিসব আজেবাজে কথা বলছিস। দ্রুত বল আমাকে কি হয়েছে। হ্যালো… তিহা…. ‘

‘আমি…’ কথাটুকু শেষ পর্যন্ত বলা হলো না তিহার। অদূর থেকে ভেসে আসা এক অশরীরির করুণ আর্তনাদ ওকে ফোন ছাড়তে বাধ্য করল। দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে, ছুটে গেল বোনের ঘরে। তিতিক্ষার আসুরিক চিৎকার আর ভাংচুরের শব্দ ঘরের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে।

বিছানার এককোণে অবহেলায় পড়ে থাকা সেলফোনের অন্যপাশ থেকে তখনো চেঁচাচ্ছে নিনাদ,’ তিহা….. তিহা….. কথা বল তিহা। কি হয়েছে তিতিক্ষার? বল… হ্যালো….. ‘
চলবে…….