Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 288



প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-০৮

0

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৮
,
বাইরে তখন মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে প্রায় শেষ হওয়া একটা সিগারেট ধরানো। শাহিন ক্লাব ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে সামনেই শশীর হাত পিছনে মুড়িয়ে বাঁধা মুখেও কাপড় দিয়ে বাঁধা। নরম হাত এতো শক্ত করে বাঁধার দরুন কব্জিতে লাল দাগ পড়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে ফুলে গেছে এখন আর কান্না করার মতো শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। হাতের সিগারেট টা ফেলে দিয়ে শাহিন শশীর দিকে তাকিয়ে বলল।

তোর আব্বা যদি প্রথমেই আমার কথা মেনে নিতো তাহলে আমার এইটা করতে হতো নাহ আর তোকেও এই কষ্টটা পেতে হতো নাহ। ব্যাস এখন শুধু সকাল হওয়ার পালা চিন্তা করিস নাহ তোকে আমি ছোঁবো নাহ। শুধু তোর চরিত্রে দাগ লাগাবো কাল সকালে যখন গ্রামের সবাই তোকে আর আমাকে একসাথে দেখবে তখন সবার যা বোঝার বুঝে যাবে। সালিশ বসবে জামশেদ মাস্টার এর মান সম্মান সব ধূলোর সাথে মিশে যাবে। তখন তোর গলায় কলসি বেঁধে নদীতে ডুবে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে নাহ। না না আর একটা উপায় আছে আর তা হলো আমার সাথে বিয়ে যেহেতু আত্ম*হত্যা পাপ আর আত্ম*হত্যা করলে তার জানাজা পড়ানো হয় নাহ এই গ্রামে তাই জন্য তোর আমাকে বিয়ে করা ছাড়া কোনো উপায়ই থাকবে নাহ। তাই এতো কান্না না করে চুপ করে বসে থাক বাইরে যে বৃষ্টি এই বাগানের দিকে কেউ খুঁজতেও আসবে নাহ। পুকুর ভেসে এদিকে হাঁটু পানি হয়ে গেছে আর তোর স্যান্ডেল তোদের বাগানে রেখে এসেছি। তাই তোকে ওরা ওদিকেই খুঁজবে এদিকে কেউ আসবে নাহ৷ এই পথধরে তো মেইন রাস্তায় উঠতে হয় শহরে যাওয়ার পথ এতো রাতে কেই বা শহরে যাবে আর তোকে খুঁজতে আসবে। তাই তোকে খুঁজে পাওয়ার কোনো আশাই নেই চুপচাপ ঘুমায় পড় কালকে সকালে আমাগো বিয়া আমার তো খুশিতে ঘুমই আসতাছে নাহ।

কথাগুলো বলে শাহিন একটা হাসি দিয়ে গলায় থাকা গামছাটা নিচে বিছিয়ে সেখানে শুয়ে পড়ল। শশী অনেক চেষ্টা করেও হাতের বাঁধন খুলতে সক্ষম হলো নাহ। উল্টো টানাটানি করার জন্য চিকন দড়িটা হাতে আরো বসে গিয়ে ব্যাথা হচ্ছে। মুখ বাঁধা শব্দ ও করতে পারছে নাহ৷ আর শব্দ করেই বা কি লাভ এই বৃষ্টির মধ্যে তার গলার আওয়াজ কেই বা শুনবে।
,,,,,,,,,,
মাস্টার বাড়ি পেরিয়ে প্রায় অনেকটা দূরেই চলে এসেছে সমুদ্র। মাটির রাস্তা কাঁদায় একেবারে মাখামাখি বৃষ্টিও নেমেছে মুষলধারে কিছুদূর যাওয়ার পর হটাৎ গাড়ি থেমে গেলো। হাজার চেষ্টা করেও সামনে এগোচ্ছে নাহ। সমুদ্র রেগে স্টিয়ারিং এর উপর থাবা মেরে স্টার্ট বন্ধ করে চাবিটা পকেটে ভরে গাড়ি থেকে নামলো। ততক্ষণে বৃষ্টির পানিতে গায়ের শার্টটা শরীলে আস্টেপিস্টে মিশে গিয়েছে। চাকার দিকে তাকাতেই দেখলো চাকা কাঁদার মধ্যে আটকে গিয়েছে। সমুদ্র গাড়িতে লাত্থি মেরে আশেপাশে তাকালো। মাঠের মধ্যে দিয়ে এই মাটির রাস্তাটা চলে গেছে। আরো বেশকিছু দূর পরেই হাইওয়ে, এখানেই প্রথম সমুদ্র শশীর কাছে জিগাস করেছিলো জামশেদ মাস্টার এর বাড়ি কোনটা। হঠাৎ সমুদ্রের শশীর কথা মনে আসলো মেয়েটাকে কি পেয়েছে? পাক না পাক তাতে ওর কি। এমন আরো অনেক কিছু চিন্তা করে গাড়ির মধ্যে গিয়ে বসলো। ভিজা হাতে ফোনটা হাতে নিয়ে রোদ্রকে কল দিলো৷ বৃষ্টির জন্য নেটওয়ার্ক ও তেমন পাচ্ছে নাহ। অনেক চেষ্টার পর ফোনগেলো তবে রোদ্র ধরলো নাহ৷ পরের বার আবার দিতেই ফোনটা রিসিভ হলো। ওপাশে বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দে কথা কিছুই শোনা যাচ্ছে নাহ। রোদ্র কি বলছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে নাহ সমুদ্র কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

মেয়েটাকে কি খুঁজে পেয়েছে?

নাহ ভাইয়া শশীকে এখনো কোথাও খুঁজে পায়নি। আমিও খুঁজতেছি কি আজব গ্রাম ভাই বললাম পুলিশে খবর দিতে কিন্তু কেউ রাজি হলো নাহ বলে মেয়ের বদনাম হবে এটা কোনো কথা? ভাই শুনতে পাচ্ছো আমার কথা তুমি কোথায় এখন?

সমুদ্র ফোনটা কেটে গাড়ির সিটে ছুঁড়ে মারল খানিকক্ষণ ভেবে গাড়ির ডোর লক করে মাটির রাস্তা ছেড়ে ক্ষেতের মধ্যে নেমে গেলো। পায়ের নিচে থেকে প্যান্ট ফোল্ড করে হাঁটুর নিচে অবধি ভেঙে রাখা। হাঁটু পযন্ত কাঁদায় মাখামাখি মাঠ পেরিয়ে ক্ষেতের শেষ মাথায় আসতেই শশীদের পুকুর আর পুকুরের ওপাশে ওদের বাড়ি। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে কারেন্ট নাই সেই জন্য পুরোটা অন্ধকার। সমুদ্র সামনে তাকালে দেখলো বেশদূরে লাইটের আলো হয়ত সবাই শশীকে খোঁজাখুঁজি করছে। সমুদ্র নিজের হাতে থাকা ছোট টর্চটা বন্ধ করে সেদিকে যেতে গিয়ে আবার কি মনে করে টর্চটা জ্বালালো। পুকুর ভেসে হাঁটু পানির বেশি হয়ে গেছে সমুদ্র তারমধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনেই সেদিনের সেই ক্লাবঘর, পুরো অন্ধকার সমুদ্র ক্লাবঘরের কাছাকাছি যেতেই পানি কমে আসতে লাগল। উপরে টিন দিয়ে পুরোটা ইটদিয়ে গাঁথা টিনের চালের উপর বৃষ্টির পানি পড়ায় বেশ জোরে শব্দ হচ্ছে। সমুদ্র ক্লাবঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকালো চারপাশে কেউ নেই সমুদ্র হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে আবার সামনের দিকে গেলো।কিন্তু তখনি মনে হলো কানে কোনো ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসলো। হয়ত হবে কোনো কিছুর সমুদ্র সেদিকে কান না দিয়ে সামনে যেতে লাগল।
,,,,,,,
শাহিন ঘুমিয়ে গেছে পুরো রুম জুড়ে অন্ধকার বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তার আলো রুমে আসায় মাঝে মাঝে রুমটা আলোকিত হচ্ছে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে শশী টেনে চোখটা খুলতেই দরজার বাইরে শব্দ পেলো। দরজার নিচের দিকে তাকাতেই বাইরে আলো দেখতে পেলো হয়ত তার খোঁজেই কেউ এসেছে। বাঁচার ক্ষীণ আশায় মুখ দিয়ে শব্দ করতে লাগলো তবে মুখ বাঁধা থাকায় তেমন কোনো শব্দই হলো নাহ। মাথা ডানেবামে নাড়াতেই বাঁধন ঢিলে হয়ে গেলো তাতেই নিজের শরীলের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচালো তবে সেটা একবারই। কারণ ততক্ষণে শাহিন এর ঘুম ভেঙে গেছে আর সেও বুঝতে পেরেছে বাইরে কেউ আছে নিজের আসন্ন বিপদ বুঝতে পেরে আবার শশীর মুখ বেঁধে দিলো। বাইরে থাকা মানুষ টাও ততক্ষণে চলে গেছে শশী নিরাশ হয়ে চোখ বুজে নিলো বন্ধ চোখের কোণ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। বাঁচার বোধহয় আর কোনো আশায় নেই সারাজীবন মরার মতো বেঁচে থাকতে হবে। তার নিয়তিতে হয়ত এটাই লেখা ছিলো, আব্বার কথা খুব মনে পড়ছে না জানি কেমন আছে। বাড়ির সবাই হয়ত অনেক চিন্তা করছে মনে মনে একটাই প্রার্থনা কালকের সকালটা যেনো না আসে।

শাহিন সস্তির একটা শ্বাস ফেলে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসতেই বিকট শব্দে ঘুণে খাওয়া দরজাটার সিটকেনি ভেঙ্গে খুলে গেলো। শাহিন চমকে উঠে দাঁড়াতেই নাক বরাবর শক্ত হাতের একটা ঘুষি পড়ল। সোজা নিচে পড়ে গিয়ে ব্যাথায় কাতরাতে লাগলো নিজের বাম হাতটা নাকে ছুঁইয়ে সামনে আনতেই দেখলো রক্ত। শাহিন ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে এককোণে বসে পড়ল। সমুদ্র কিছু সময় শাহিনের দিকে চেয়ে শশীর দিকে তাকালো মেয়েটার অবস্থা খুবি করুন৷ সমুদ্র একটা শ্বাস নিয়ে শশীর দিকে এগিয়ে গেলো। ওর কোথায় থাকার কথা ছিলো আর কোথায় আছে, হাতের বাঁধন টা খুলে দিতেই গড়িয়ে নিচে পড়তে গেলো। সমুদ্র শশীকে ধরে বুকের সাথে ঠেকিয়ে মুখের বাঁধন ও খুলে দিলো। শশী সমুদ্রের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কুটুর কুটুর চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র শশীর দুই কাঁধে ধরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসায়ে বলল।

বাইরে অনেক বৃষ্টি আপাতত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। তোমার শরীলের এই অবস্থায় যদি বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি নিয়ে যায় তাহলে তোমাকে বাঁচানোই মুশকিল হয়ে যাবে।

শশী কিছু বললো নাহ শুধু নিজের হাতটা আলতো করে ধরে ওতে ফুঁ দিচ্ছে আর কাঁদছে। সমুদ্র আবার শাহিনের দিকে তাকালো সমুদ্রের তাকানো দেখে শাহিন পড়িমরি করে দৌড়ে বাইরে চলে গেলো।
,,,,,,,,,
আব্বা বিশ্বাস করো আমি নিজের চোখে ওদের দুজনকে খারাপ অবস্থায় দেখেছি। আর আমি যেনো কাউকে না বলতে পারি এই জন্য আমাকে মেরেছেও দ্যাখো।

ভরা সালিশে শাহিন কথাটা বলে নিজের ব্যান্ডেজ করা নাকটা দেখালো। চেয়ারম্যান নিজের ছেলের মুখে কথাটা শুনে বাঁকা হেসে জামশেদ মাস্টার এর দিকে তাকালো। সে যেনো মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে বিয়ের প্রাস্তাব নিয়ে যাওয়াই তাকে বেশ কথা শুনিয়েছিলো এখন কোথায় গেলো সেই দেমাগ কেমন মাথা নিচু করে বসে আছে। সকালের আলো ফুঁটতেই শাহিন গ্রামের লোকজন নিয়ে ক্লাবঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। সবাইকে বুঝিয়েছে শশী শহরের এক ছেলের সাথে এখানে খারাপ কিছু করছিলো। মেয়েকে পাওয়া গিয়েছে শুনেই মাস্টার বাড়ির সবাই চলে এসেছে মেয়েরা শশীকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে গিয়েছে। সমুদ্র ও বাইরে তাকিয়ে কিছু না বলে বাড়ির দিকে চলে গিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘরে পড়তেই গ্রামের চেয়ারম্যান সহ আরো বয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়ে মাস্টার বাড়ি সালিশ বসিয়েছে। চেয়ারম্যান ব্যাঙ্গ করে জামশেদ মাস্টার কে বলল।

কি মাস্টার এখন কি করবা তুমিই কও এই মাইয়া বিয়া দিবা কেমনে আর এমন মেয়েকে আমরা গ্রামে রাখতেও দিবো নাহ। কি বলেন আপনারা?

চেয়ারম্যান এর কথার সাথে প্রায় সবাই তাল মেলালো। সমুদ্র শার্ট পাল্টে দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো এদের কথাশুনে কিছুটা অবাকই হলো বটে এগিয়ে এসে জামশেদ মাস্টার এর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, মানে আমিতো কিছুই বুঝলাম নাহ আপনারা কিসের ভিত্তিতে একটা মেয়ের চরিত্রে এমন দাগ লাগাচ্ছেন। আর আপনি এখানকার চেয়ারম্যান না কি আপনার ছেলেই শশীকে কালকে সন্ধ্যায় ওই ক্লাবঘরে বেঁধে রেখেছিলো আমি না গেলে নাজানি কি করতো।

আব্বা দেখছো কেমনে মিথ্যা কথা কইতাছে।

শাহিন এর কথাশুনে সমুদ্র রেগে শাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা মাড়ে কিছুই হয়নি দেখছি আরো কয়েকটা দিলে ভালো হতো।

সমুদ্রের ঠান্ডা হুমকিতে শাহিন ভয়ে একপাশে সরে গেলো। পরিবেশ ঠান্ডা করতে চেয়ারম্যান বলল, থামো তোমরা কি শুরু করছো। এখানে আমরাও আছি, শোনো মানলাম শাহিন এই কাজ করছে কিন্তু তবুও একটা যুবতি মাইয়া এমনে আরেকটা যুবকের সাথে এক ঘরে রাত কাটানো মানুষ মোটেও ভালো চোখে দেখবো নাহ। তাই মাস্টার হয় তোমার মাইয়ারে এই পোলার সাথে বিয়া দেও নয়ত অন্য কারো সাথে। এমন মাইয়াকে ঘরে রাখলে আমরা মানবো নাহ গ্রামেতো আরো মাইয়া আছে।

সমুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, আজব তো আমি কেনো ওকে বিয়ে করবো। আপনাদের তো উচিত আমাকে ধন্যবাদ জানালো তা না করে এসব কোন ধরনের বিচার করেন আপনারা।

সমুদ্রের কথা শুনে শাহিন সুযোগ পেয়ে বলল, আব্বা তুমি অনুমতি দিলে শশীরে আমিই বিয়া করমু। গ্রামের ছেলে হিসাবে তো আমার একটা দায়িত্ব আছে।

ছেলের এমন কথাশুনে চেয়ারম্যান খুশি হয়ে বলল, এই না হলে আমার পোলা এমনেই সকলের পাশে খাড়াইবা বাপ। তা মাস্টার তুমি কি কও।

জামশেদ মাস্টার কিছু না বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে একটু সময় দেন আমি বিকালে বলব।

মাস্টাররের এমন কথায় রাগ হলেও চেয়ারম্যান কিছু না বলে সায় দিয়ে বলল, তাহলে বিকালে আবার বসবো সবাই এখন সবাই চলো।
,,,,,,,,,
মা তুমি এসব কি ধরনের কথা বলো আমি ওকে বিয়ে করতে যাবো কেনো। তাছাড়া আমি ওর থেকে বয়সেও অনেক বড়। একটা হাঁটুর বয়সী মেয়েকে কীভাবে বিয়ে করতে বলো।

শাহানারা ছেলের পাশে বসে বোঝানোর সূরে বলল, বয়স তেমন কিছু না তুই রাজি হয়ে যা নয়ত ওই চেয়ারম্যান এর ছেলের সাথে ওই ফুলের মতো মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেবে ওর জীবনটা শেষ হয়ে যাবে

এখানে আমার কি করার আছে মা এখন তো মনে হচ্ছে আমার কালকে চলে যাওয়াই ভালো ছিলো। ওকে বাঁচিয়েই দেখছি ভুল হয়েছে। তোমরা যা খুশি করো কিন্তু আমাকে বাদে আমি এখনি ঢাকা যাবো।

তুই এই কথা কীভাবে বলতে পারিস তুই ভালো করেই জানিস ওই ছেলেটা কেমন। আচ্ছা তুই কি সত্যিই চাস শশীর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক?

মায়ের কথায় সমুদ্র কিছু একটা ভেবে বলল, ওকে ফাইন তুমি ওই মেয়েটাকে তোমার ছেলের বউ বানাতে চাও তাইতো? তো ঠিক আছে রোদ্রতো আছে ওর সাথে বিয়ে দাও। তাহলে তো আর কোনো সম্যসা নেই এবার অন্তত আমাকে ছাড়ো।

এটা কী ধরনের কথা বড় ছেলেকে রেখে মোজো ছেলের বিয়ে দেবো? লোকে কি বলবে?

লোকের কথা তোমায় কে শুনতে বলেছে মা আমি বিয়ে করবো নাহ। তাই তুমি রোদ্রের সাথে বিয়ে দিবে হয়ে গেলো এতো কথার কি আছে। এখন সরো আমি বের হবো।

কথাটা বলে সমুদ্র রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, শাহানারা হতাশ হয়ে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে রোদ্রের ঘরের দিকে গেলো। গিয়ে দেখলো রোদ্র বিছানায় বসে আছে হয়ত কিছু একটা ভাবছে। শাহানারা ছেলের পাশে গিয়ে বসে বলল, তোর কাছে একটা আবদার নিয়ে এসেছি আশা করি তুই রাখবি।

এভাবে বলছো কেনো মা তুমি আমায় আদেশ করো।

শাহানারা ছেলের হাত ধরে নরম কন্ঠে বলল, তুই শশীকে বিয়ে কর বাবা এই বিপদ থেকে ওকে বাঁচা।

মায়ের কথায় রোদ্র অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মায়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আলতো হেসে বলল, তুমি যেটা চাইছো সেটাই হবে আমি রাজি।

#চলবে?

প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-০৭

0

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৭
,
আকাশে বেশ মেঘ করেছে হয়ত আর কিছুক্ষণ পরেই ঝুম বৃষ্টি নামবে।চারপাশটা কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে যেনো এই রাত নেমে আসবে। শশী যতটা পারছে দ্রুত হাঁটছে সমুদ্রের দেওয়া ঔষুধ টা বেশ কাজে দিয়েছে। সকাল হতেই কেমন সুস্থ অনুভব হচ্ছে তবে এখন যদি আবার বৃষ্টিতে ভেজা হয় তাহলে এবার আর রক্ষে নেই। শশী ও পাড়াতে গিয়েছিলো তার সখীর বাড়িতে কিন্তু আসতে আসতে যে মেঘ এমন ভয়ংকর রুপ ধারন করবে কে জানতো। রাস্তা ছেড়ে বাগানের পথ ধরলো শশী এই বাগানটা পেরোলেই তাদের পুকুরঘাট আর পুকুরের ওপাশেই ওদের বাড়ি। পাকা রাস্তা দিয়ে গেলে আরো দেরি হবে ততক্ষণে বৃষ্টি তে ভিজে কাক ভেজা হয়ে যাবে এই জন্য বাগানের পথই বেঁছে নিলো। বাগানের মাঝে ক্লাবঘর এখানে বসে সব ছেলেরা তাস খেলে আড্ডা দেয়। শশী ক্লাবঘর পাড় করে সামনে আসতেই পিছন থেকে কেউ ডাক দিলো। শশী একটু থেমে পিছনে তাকিয়ে দেখে শাহিন দাঁড়িয়ে আছে। পড়নের লুঙ্গি নিচে থেকে তুলে হাঁটুর উপর পযন্ত এনে গিট দিয়ে বাঁধা।

কিরে এই সময় তুই বাগান দিয়া কই যাস?

তোকে বলবো কেনো? তুই শুনে কি করবি আর খবরদার এভাবে আমাকে পিছন থেকে ডাকবি নাহ৷ কথাটা বলে শশী সামনে হাঁটতে গেলে শাহিন দৌড়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আরে এতো রাগ করিস কেনো তোর আব্বা কে এতো তেলমারি কিন্তু তোর আব্বা কিছুই বোঝে নাহ। আমার আব্বা স্বয়ং চেয়ারম্যান তোর আব্বা কে আমার লগে তোর বিয়ের প্রস্তাব দিলো কিন্তু তোর আব্বা কি কয় আমার মতো এইট ফেল ছেলের সাথে নাকি তোরে বিয়ে দেবে নাহ।

আব্বা তো ঠিকি কইছে দেখ তোর সাথে এতো কথা বলার সময় নাই আমার রাস্তা ছাড় নয়ত আব্বারে বলে দিমু।

যা বল তোর আব্বা আমার কিছুই করতে পারবে নাহ দেখিস শেষে তোরে আমার সাথেই বিয়ে দিতে হবে।

হ্যাঁ স্বপ্ন দেখেন স্বপ্ন দেখা ভালো মন শরীল সব ভালো থাকে। কিন্তু শুধু রোমান্টিক স্বপ্ন না মাঝে মাঝে একটু মারামারি স্বপ্ন ও দেখিয়েন।

পিছন থেকে আসা পুরুষালী কন্ঠস্বর শুনে শাহিন আর শশী দুজনেই সেদিকে তাকালো। রোদ্র ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে, একটু এগিয়ে এসে ছাতাটা শশীর মাথার উপর ধরতেই শাহিন রোদ্রকে বলল, তুমি কেডা? ওইদিনও দেখলাম শশীর লগে মাঠে আবার এখানেও কে তুমি?

কাঁটা।

রোদ্রের কথাশুনে শাহিন কিছু বুঝতে না পেরে বলল, মানে?

মানে হলো আমি হলাম কাঁটা ওই যে গোলাপের গাছের যে কাঁটা থাকে ওটাই আমি তবে এই কাঁটা অন্যসব কাঁটার মতো সাধারন কোনো কাঁটা নয় এই কাঁটা বিষাক্ত তাই সাবধান।

এতো কথা বলার কি আছে বুঝলাম না তোকে বলেছি ওকে নিয়ে সোজা চলে আসবি তা না করে কিসব কথা বলছিস। আর ছাতাটা আমি তোকে দিয়েছি তুই নিজের মাথায় না ধরে ওর মাথায় ধরে রেখেছিস কেনো?

সমুদ্রের কথা শুনে রোদ্র চুপ হয়ে গেলো। ওতো নিজের মনে ছবি আঁকছিলো কিন্তু হঠাৎ করে এমন অসময়ে মেঘ করায় সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে যলদি করে বাড়ি ফিরে আসলো। কেবলি রুমে গিয়ে সবটা রেখে বিছানায় বসতেই তার বড় ভাইয়ের আগমন। সমুদ্র রুমে এসে ফোনের দিকে তাকিয়েই রোদ্রকে বলল, ওই মেয়েটা নাকি এখনো আসেনি মা বলল ওকে গিয়ে নিয়ে আসতে আমার এতো সময় নেই তুই গিয়ে নিয়ে আয়।

কোন মেয়ে ভাই তুমি কার কথা বলছো?

ওই যে সেই বাচ্চা মেয়েটা শশী না কি।

কি বলো ও এখনো বাড়ি আসেনি? কথাটা বলেই রোদ্র দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ততক্ষণে বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রোদ্র যেতেই সমুদ্র রুমের বাইরে আসতেই শাহানারা রেগে সমুদ্র কে বলল, তুই এখনো যাসনি মেয়েটা কেবল জ্বর থেকে উঠল এখন বৃষ্টি তে ভিজলে তো আবার জ্বর আসবে।

মা আমি রোদ্রকে পাঠিয়েছি ও গেছে চলে আসবে এখনি।

সেকি রোদ্র গিয়েছে ও ছাতা নিয়ে গিয়েছে? ওরতো আবার বৃষ্টির পানি সয্য হয় নাহ। তোরা দুইভাই আর কত আমাকে জ্বালাবি বলতো এখনি ছাতা নিয়ে যা বৃষ্টি জোরে আসবে।

সমুদ্রের এই মুহুর্তে শশীর উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে যেনো হাতের কাছে পেলে একটা আছাড় মারলে শান্তি পেতো। মায়ের কাছ থেকে ছাতা নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেলো। খানিক দূর যেতেই রোদ্রের সাথে দেখা ওকে ছাতাটা দিয়ে ফিরে আসতে গেলে কি মনে করে আবার থেমে গেলো একটু সামনে গিয়ে দেখলো সেদিন এর সেই ছেলেটার সাথে রোদ্র কথা বলছে।

ভাই ও শশীকে বিরক্ত করছিলো।

বিরক্ত করার মতো কাজ করলে বিরক্ত তো করবেই। ও জানতো এই সময়ে এখানে কোনো মানুষ থাকবে নাহ তারপরেও ও এই রাস্তা দিয়ে আসলো কেনো। কেউ সেধে বিপদে পড়তে চাইলে বিপদ তো তাকে ধরবেই।

সমুদ্রের এমন বেহুদা কথাশুনে শশীর রাগ উঠে গেলো। এতোক্ষণ শাহিন বিরক্ত করে মারছিলো এখন আসছে আরেকজন শশী রেগে কিছু বলতে যাবে তখনি সমুদ্র বা হাতে শশীর হাত ধরে টেনে ওখান থেকে চলে গেলো। রোদ্রও একবার শাহিন এর দিকে রেগে তাকিয়ে চলে গেলো। এতোটা সময় শাহিন চুপ করে ছিলো তবে সমুদ্র শশীর হাত ধরা দেখে শাহিন একা একা বলল, অনেক হয়েছে অপেক্ষা আর নয়। এখন দেখছি আমাকেই কিছু করতে হবে নয়ত পাখি অন্য বাসায় উড়াল দিবে।
,,,,,,,,,,
শত চেষ্টা করেও শাহানারা সমুদ্র কে আটকাতে পারলো নাহ। আজকে সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা কাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। গ্রামে প্রচলিত একটা বাক্য আছে রবিবারে বৃষ্টি শুরু হলে নাকি তিনদিন ধরে বৃষ্টি হয়। আর মঙ্গলবারে বৃষ্টি শুরু হলে সাতদিন। তাই সবার মতে এই বৃষ্টি তিনদিনের আগে থামবে নাহ। কেবল তো একদিন হয়ছে, ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে সমুদ্র বাইরে তখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। উঠানে কাঁদায় মাখামাখি পা দেওয়ার অবস্থা নেই এই জন্য বাড়ির ছেলেরা ইট পেতে দিয়েছে যেনো তার উপর দিয়ে হাঁটা যায়।

আর কয়েকটা দিন থেকে গেলে হতো নাহ বাবা এতো তাড়া কিসের তোর। সেইতো বাসায়ই যাবি এই অসুস্থ শরীলে একা থাকতে পারবি নাহ। আমি কতকরে বললাম আমিও যায় কিন্তু তুই তো তাও শুনলি নাহ।

মা এক কথা আর কতবার বলবে তুমি এখানে বেড়াতে এসেছো তোমার ইচ্ছে মতো তুমি সময় কাটাও। আমার ভালো লাগছে নাহ তাই চলে যাচ্ছি।

কথাটা বলে সমুদ্র সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে নেমে এলো। দূরে মাইকে আসরের আযান দিচ্ছে বাইরে মেঘের জন্য মনে হচ্ছে যেনো রাত নেমে এসেছে। সমুদ্র সবাইকে বলে যখনি ইটের উপর পা দিয়ে সামনে আগাবে তখনি জোনাকি দৌড়ে বাড়িতে আসলো হাঁপাতে হাঁপাতে মাকে বলল, মা আপাকে তো কোথাও পাচ্ছি নাহ।

পারভিন উঠানে নেমে এসে জোনাকিকে রেগে বলল, তোকে তো বললামই ও পাশের বাড়ি গিয়েছে বই আনতে। তোকে ডাকতে পাঠালাম আর তুই বলছিস ওকে পাসছিস নাহ।

আমিতো ওই বাড়িতেই গেলাম পরে ওরা বলল আপা নাকি বই নিয়ে সেই কখন চলে গেছে। আমি ভাবলাম হয়ত বাগানের দিকে গেছে তাই আমিও ওদিকটাই খুঁজে এলাম। দেখো না কেমন ভিজে গেছি তবে বাগানে খালি আপার স্যান্ডেল টাই পেলাম আপাকে তো পেলাম নাহ।

ছোটো মেয়ের কথাশুনে পারভিন এর বুকটা কেমন কেঁপে উঠল। উঠানে কাঁদার মধ্যে বসে পড়ল ধপাস করে শাহানারা দৌড়ে পারভিন এর কাছে বসল। পারভিন কোনোমতে মেয়েকে বলল মোড়ের মাথায় ওর আব্বা আছে যেনো ডেকে নিয়ে আসে। বাড়িতে শুধু শশীর ছোটো কাকা ছিলো কথাটা শুনতেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ির মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে নাহ তার কি এখন বসে থাকার সময় আছে। রোদ্র সেই সকালের দিকে বেরিয়েছে শাহানারা কে বলে গেছে তার খুবি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে সেটা সারতেই যাচ্ছে। সমুদ্র কিছু সময় দাঁড়িয়ে সবটা দেখেও কিছু বললো নাহ। শুধু মায়ের দিকে তাকালো শাহানারা তখন পারভিন এর মাথায় তেল পানি বসাতে ব্যাস্ত। মাথা ঘুরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকাতেই সমুদ্র ইশারায় বলল সে চলে যাচ্ছে। কথাটা বলেই সমুদ্র টানা পা ফেলে চলে গেলো। ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হতাশ নিশ্বাস ফেললো শাহানারা। তার বড় ছেলে মোটেও এতোটা দায়িত্ব ঙ্গানহীন নয় তাহলে আজকে কি হলো এমন খবর পাওয়া সত্বেও কীভাবে যেতে পারলো।

#চলবে?

প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-০৬

0

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৬
,
ভর দুপুর মাস্টার বাড়ি তখন ফাঁকা বাড়ির ছেলেরা নামাজ থেকে ফিরে যে যার কাজে গিয়েছে। বাড়ির মহিলারাও তখন সব এক জোট হয়ে পুকুরে গিয়েছে গোসল করতে। যদিও বাড়িতে গোসল এর ব্যাবস্হা আছে কিন্তু শাহানারা বলল সে পুকুরে গোসল করবে এই জন্যই সব একসাথে গিয়েছে। শশী তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মোল্লাদের বাগান থেকে পেয়ারা পেরে এনেছে। উড়নার একপাশে সেটা বেঁধে নিয়ে আরেকটা খেতে খেতে বাড়ি আসলো। কয়েকবার নিজের মাকে ডাকার পরেও কোনো সাড়া শব্দ পেলো নাহ। তাই পেয়ারাগুলি রান্নাঘরের ঝুড়িতে রেখে নিজের রুমের দিকে গেলো। রুমে যাওয়ার আগে একবার ভাবলো রোদ্রের কাছে গিয়ে জেনে আসবে তার ছবি আঁকা শেষ হয়েছে নাকি৷ কিন্তু রুমে গিয়ে দেখে রোদ্র ঘুমিয়ে আছে। তাকে আর না ডেকে দরজা চাপিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসলো। তখনি ওর রুমের পরের রুমের দিকে চোখ পড়ল সমুদ্রের রুমের দরজা খোলা শশী দরজা আটকানোর জন্য সেদিকে পা বাঁড়ালো। দরজা আটকাবে তখনি ভিতরে তাকাতেই দেখলো সমুদ্র ঘুমিয়ে আছে। শশী কিছু একটা ভেবে গুটি গুটি পায়ে ভিতরে গেলো একবার সমুদ্রের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আবার অন্যদিকে তাকালো। হঠাৎ টেবিলে রাখা একটা জিনিস এ চোখ পড়তেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। আস্তে আস্তে টেবিলের কাছে গিয়ে ভালো করে তাকাতেই বুঝলো ওটা রিভলবার শশীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। জীবনে খেলনা পিস্তল অনেক দেখেছে এমনকি আব্বার সাথে মেলায় গিয়ে নিজের জন্যও কিনেছে। তবে কখনো আসল টা দেখা হয়নি, শশী প্রায় অনেকটা সময় তাকিয়ে থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে ওটা ধরতে যেতেই পিছন থেকে সমুদ্র বলে উঠল।

ওটা খেলার কোনো জিনিস নয়, ওটার একটা গুলিই তোমার জন্য যথেষ্ট।

শশী চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখে সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। শশী কি বলবে সেটা ভেবে না পেয়ে দৌড়ে বের হতে গেলে সমুদ্র বলে উঠল, এক পাও নড়বে নাহ দাঁড়াও ওখানে। তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না? তার পরেও আমার রুমে কেনো এসেছো?

শশী কি বলবে বুঝতে পারছে নাহ। কোন কুক্ষণে যে এই ঘরে এসেছিলো। শশী আমতা আমতা করছে তবে কিছু বলতে পারছে নাহ সমুদ্র এগিয়ে এসে টেবিল থেকে রিভলবার টা হাতে তুলে নিয়ে শশীর দিকে তাক করতেই। শশীর চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেলো ভয়ে চিৎকার করে ওখানে অঙ্গান হয়ে পড়ে গেলো। কারো চিৎকার শুনে রোদ্রের ঘুম ভেঙ্গে গেছে বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে রুমের বাইরে এসে দেখলো সমুদ্রের রুমের দরজা খোলা সেদিকে গিয়ে রুমের দরজার সামনে দাঁড়াতেই দেখলো সমুদ্র রিভলবার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আর শশী মেঝেতে পড়ে আছে রোদ্র শশীকে পড়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল।

ভাই কি হয়েছে?

এই ইডিয়ট টাকে এখান থেকে নিয়ে যা রিভলবার দেখে ভয়ে ঙ্গান হারিয়েছে।

কথাটা বলে সমুদ্র বিছানায় বসে হাতের রিভলবার টা পরিষ্কার করতে লাগল৷ রোদ্র হতাশ চোখে একবার শশীর দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, মেয়েটা যে ঘুরে ফিরে কেনো তার ভাইয়ের সামনে আসে কে জানে।
,,,,,,,,,,
সন্ধ্যা পড়তেই শশীর ধুম জ্বর এলো শরীল কাঁপানো জ্বর। মেয়ের এমন অবেলায় জ্বর দেখে জামশেদ মাস্টার তড়িঘড়ি করে হাট থেকে ফেরার পথে সাথে করে ডাক্তার নিয়ে এলো। এদিকে পারভিন মেয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছে আরেকদিকে রাগে শশীকে বকা দিচ্ছে। এই গরমে এমন টইটই করে রোদে রোদে ঘুরলে জ্বরতো আসবেই। গরমেই এমন জ্বর এসেছে রোদ্র একপাশে দাঁড়িয়ে শশীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন ভাই ওকে নিয়ে যেতে বললে টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ওর মুখে একটু পানি ছিঁটাইতে শশীর ঙ্গান ফিরে এসেছিলো। উঠে বসে একবার রোদ্রের দিকে তাকিয়ে আবার সমুদ্র কে দেখেই পড়িমরি করে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে কপালের একপাশে আলুর মতো ঢিপ বানিয়েও ফেলেছে। রোদ্র বুঝতে পেরেছে তখন মেয়েটা প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়েছে তার দরুনই এমন শরীল কাঁপানো জ্বর। মেয়েটা এতো নাজুক সেটা তার ভাই বুঝতেই চাই নাহ। শাহানারা শশীর পাশেই বসে ছিলো হঠাৎ রোদ্রের দিকে চোখ পড়তেই কিছু একটা ভেবে বিছানা থেকে উঠে রোদ্রের কাছে গেলো। রোদ্র কে টেনে রুম থেকে বাইরে নিয়ে গিয়ে বলল।

সত্যি করে বলতো শশীর হঠাৎ করে এমন জ্বর আসলো কেনো? তোর চোখমুখ দেখেতো মনে হচ্ছে তুইই কিছু করেছিস।

এসব কি বলছো মা আমি কি করবো আমি কিছুই করিনি।

তাহলে মুখটাকে এমন চোরের মতো করে রেখেছিস কেনো? সত্যি করে বল আর সমুদ্র কোথায়?

ভাইয়াতো সেই বিকেলে বের হয়েছে এখনো ফেরেনি।

আচ্ছা ঠিক আছে এখন বল ঘটনা কি?

বিশ্বাস করো মা আমি কিছুই করেনি ভাইয়ার ও এখানে কোনো দোষ নেই আসলে হয়েছে কি ভাইয়া তার রিভলবার টা পরিষ্কার করছিলো তখনি শশী রুমে ঢুকে পড়ে আর ভাইয়ার হাতে রিভলবার দেখে ভয়ে অঙ্গান হয়ে যায়। হয়ত অতিরিক্ত ভয়ের কারণেই এমন জ্বর এসেছে।

মেজো ছেলের মুখে ঘটনা শুনতেই শাহানারা হতাশ চোখে অন্যদিকে তাকালো। সে তার বড় ছেলেকে হাড়ে হাড়ে চেনে নিশ্চয়ই এমন কিছু করেছে যে বাচ্চা মেয়েটা এমন ভয় পেয়েছে। এই ছেলেটাকে নিয়ে আমি আর পারি নাহ।

কি ব্যাপার তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? কিছু হয়েছে?

পিছন থেকে আসা সমুদ্রের গলার স্বর শুনে শাহানারা ছেলের দিকে তাকালো তারপর সমুদ্রের হাত ধরে টেনে ওর রুমে নিয়ে গিয়ে রেগে বলল, তুই কি চাস বলতো আমায়। মানে তুই কি ঠিক করেই রেখেছিস যে আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবি নাহ। সমুদ্র আমরা এখানে বেড়াতে এসেছে এখানে এসেও তোকে ঝামেলা পাকাতে হবে?

মায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো নাহ সমুদ্র। পকেট থেকে ম্যানিব্যাগ ফোন আরো বাকি সবকিছু বের করে টেবিলে রেখে বিছানায় মায়ের পাশে বসতে বসতে জিগাস করলো। একটু পরিষ্কার করে বলবে কি হয়েছে। তোমার কথার মাথা মন্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি।

শশীকে কি করেছিস?

শশী কে?

ছেলের মুখে এই কথাটা শুনে শাহানারার রাগ আরো বেড়ে গেলো। রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, জামশেদ ভাই এর মেয়ে শশী ওকে তুই কি করেছিস সত্যি করে বল। মেয়েটা জ্বরে কাতরাচ্ছে রোদ্র বলল তোর হাতে রিভলবার দেখে নাকি ভয় পেয়েছে কিন্তু আমি জানি কাহিনী অন্যকিছু সত্যি করে বল কি বলেছিস তুই ওকে?

মা তুমি এসব কি ধরনের কথা বলো ওইটুকু একটা বাচ্চা মেয়েকে আমি কি বলবো? মানে তোমার কথাশুনে মনে হচ্ছে আমি ওকে মেরেছি আজব কথাবার্তা বলো।

মারতেও পারিস তোকে আমি এক বিন্দুও বিশ্বাস করি নাহ।

কথাটা বলে শাহানারারা রুম থেকে রেবিয়ে গেলো সমুদ্র মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে উঠে তার ছোট ব্যাগটা থেকে কিছু একটা বের করলো তারপর সেও রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
,,,,,,,,,,,
খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছে শশী আর তারপাশেই পারভিন বসে ভাত মাখিয়ে লোকমা বানিয়ে মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে। শাহানারা ও পাশে বসে আছে সে ভিতরে ভিতরে ছেলের করা কাজে ভীষণ চিন্তিত। তখনি দরজা দিয়ে সমুদ্র ঢুকলো সমুদ্র কে দেখে শশী ভয়ে মায়ের দিকে আরো চেপে গেলো। সমুদ্র একটা মলম আর বড়ির পাতা বিছানায় ফেলে বলল।

আন্টি খাওয়ানোর পরে এখান থেকে একটা ট্যাবলেট ওকে খাইয়ে দিয়েন। আর এই মলমটা কপালে লাগিয়ে দিবেন এটা অনেক কার্যকরি আমাদের দেওয়া হয়। মলমটা ঘা শুকাতে অনেক সাহায্য করবে।

কথাটা বলে সমুদ্র রুম থেকে বেরিয়ে গেলো শশী সমুদ্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, আজকে ওনার জন্যই আমার এই অবস্থা জুতা মেরে গরুদান করতে এসেছে। খারাপ লোক একটা কতবড় সাহস আমাকে মারার হুমকি দেয় তাও আবার আমারি বাড়িতে বসে এর প্রতিশোধ তো নিতেই হবে।
,,,,,,,,,
সমুদ্র নিজের রুমে এসে ওর জামা কাপড় সব ব্যাগে ঢুকাতে লাগল। শাহানারা এসেছিলো সমুদ্র কে খাওয়ার জন্য ডাকতে তবে এভাবে ছেলেকে সবকিছু গুছাতে দেখে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে এসে জিগাস করলো। কিরে এভাবে সবকিছু গোছগাছ করছিস কেনো?

আমি চলে যাবো কালকে মা তোমরা থাকো আমার এখানে থেকে কোনো কাজ নেই। তাই বাসায় চলে যাবো অনেক কাজ পেন্ডিং পড়ে আছে জবেও জয়েন করতে হবে অনেক তো হলো ছুটি কাটানো।

কিন্তু তুই এখনো পুরোপুরি সুস্থ হসনি এই অবস্থায় কীভাবে কাজে যাবি। আর বাড়িতে একা থাকবিই বা কীভাবে।

ওসব তোমাকে চিন্তা করতে হবে নাহ আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিবো।

না তুই কোথাও যাবি নাহ আরতো মাএ কয়েকটা দিন তার পরেতো চলেই যাবো। তুইও আমাদের সাথে সাথে যাবি এটাই আমার শেষ কথা, খেতে আয়৷

কথাগুলো বলে শাহানারার চলে গেলো সমুদ্র বিছানায় বসে পড়ল এই মুহুর্তে তার যাওয়াটা খুবি দরকার ওদিকে কি হচ্ছে কে জানে। কেনো যে মায়ের কথা রাখতে এখানে আসলাম এসে পুরাই ফেঁসে গেলাম।

#চলবে?

প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-০৫

0

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৫
,
তখন পুকুর ঘাট থেকে আসার পরেই রাগে রাগে হাতের ব্যান্ডেজ আর বুকে থাকা ব্যান্ডেজ খুলে মেঝেতে ফেলে দিয়েছে সমুদ্র। প্রায় শুকিয়ে আসা ঘাঁতে টান পড়ায় সেটা আবার কাঁচা হয়ে ক্ষত স্থান থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে লাগলো। সেই সময় রেগে গাছে পাঞ্চ করায় সেখানেও লাল হয়ে ছিঁলে গেছে। কিন্তু সমুদ্রের সেদিকে খেয়াল কোথায় সেতো এখন নিজের রাগ মেটাতে জেদ করে বেথ্যা সয্য করছে। শশী আচমকা রুমে এসে এসব দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে এসে কাঁপা গলায় বলল।

এতো রক্ত? এসব কি করে হলো এই ব্যান্ডেজ খুললো কীভাবে আর এতো রক্ত ঝড়ছে আপনি তবুও কাউকে ডাকেননি কেনো?

রুম থেকে বেরিয়ে যাও।

বেরিয়ে যাবো মানে কি কত রক্ত বের হয়েছে আমি এখুনি আপনার মাকে ডাকছি।

কথাটা বলে শশী বেরিয়ে যেতে গেলে সমুদ্র রেগে পিছন থেকে শশীর চুলের বেণী ধরে টেনে একটু পিছিয়ে এনে রক্ত মাথা হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে বলল, কথা বললে শোনো নাহ? আমি বলেছি তো কারো করুণা আমার চাইনা। আর একটা কথাও বলবে নাহ চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে যাও।

শশী সমুদ্রের হাত নিজের গলা থেকে সরানোর চেষ্টা করতেই সমুদ্র ওর গলা ছেড়ে দিলো। শশী কাশতে কাশতে একবার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। শশী বের হতেই সমুদ্র মেঝে থেকে ব্যান্ডেজ গুলো কুঁড়িয়ে নিয়ে হাতের রক্ত মুছতে লাগল তখনি রুমে হুরমুর করে শাহানারা এসে দৌড়ে সমুদ্রের কাছে গিয়ে কান্না করে বলল।

এসব কীভাবে হলো ব্যান্ডেজ খুললো কীভাবে আমাকে একবার ডাকবি নাহ। কত রক্ত বের হয়েছে তুই কেনো এমন করিস বলতো আর কত জ্বালাবি আমায়।

কথাটা বলে শাহানারা নিজের কাপড়ের আঁচল দিয়ে রক্ত মুছে দিতে লাগল। ততক্ষণে রোদ্র নতুন ব্যান্ডেজ আর ক্ষত স্থানে লাগানোর জন্য মলম নিয়ে আসছে। সমুদ্র রেগে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা শশীর দিকে তাকালো। এই মেয়েটাই সবাইকে বলেছে সমুদ্র ওর মাকে শান্ত করার জন্য বলল, তেমন কিছু হয়নি মা তুমি এতো কান্নাকাটি করো নাতো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর রোদ্র মাকে নিয়ে যা এবং বাকি সবাই এখান থেকে যান আমি ঠিক আছি।

সমুদ্রের কথাশুনে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। জামশেদ মাস্টার কেবলি খেতে বসেছিলো মেয়ের মুখে কথাটা শুনতেই এঁটো হাত নিয়েই দৌড়ে এসেছে সাথে ওনার দুই ভাইও এসেছে। তবে সমুদ্রের এমন কথা ওনার মোটেও ভালো লাগেনি ছেলেটা কেমন যেন লাগাম ছাড়া। নেহাত অতিথি তাই নয়ত নিজের ছেলে এমন হলে কাঁচা কুঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে সোজা করে দিতাম। শাসন একবারই করবো ছোট বেলা থেকে ঠিকমতো শাসন করলে এখন এই অবস্থা হতো নাহ। সবাই চলে গেলেও রোদ্র আর শাহানারা যায়নি। শশী ভয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে তখন কেমন গলা চেপে ধরেছিলো আর একটু হলে তো শ্বাস আটকে মরেই যেতাম। কথাটা মনে হতেই শশী নিজের গলায় হাত দিলো সেখানে অল্প সল্প রক্ত লেগে আছে। সমুদ্র দরজার দিকে তাকিয়ে শশীকে দেখতে পেয়ে ধমকে বলে উঠল।

এই মেয়ে তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেনো যাও।

ছেলের এমন কান্ডে শাহানারা বেজায় চটে গেলেন সমুদ্র কে ধমক দিয়ে বলল, ওকে ধমকাচ্ছিস কেনো ও গিয়ে না বললে তো জানতেই পারতাম নাহ। আর তোকে তো চিনি তুইও বলতি নাহ।

রোদ্র শশীর দিকে এগিয়ে এসে নরম গলায় বলল, ভাইয়ের কথায় কিছু মনে করো না। ভাই একটু রাগী কি বলোত বড় ভাইয়া হলো খানিকটা নারকেল এর মতো বাইরেটা শক্ত কিন্তু ভিতরটা নরম। যাও অনেক রাত হয়েছে তুমি নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

শশী আরেকবার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। আজকে ও যতটা ভয় পেয়েছে এমন ভয় এই জীবনে পায়নি। এভাবে কেউ কারো গলা চেপে ধরে নাকি এই জন্যই বলে সেধে কারো উপকার করতে হয় নাহ। কথায়ই তো আছে উপকারীকে বাঘে খাই।
,,,,,,,,,,,,
আজকে বৃহস্পতিবার বিধায় হাফ বেলায় ছুটি হয়ে গিয়েছে। দুই বোন স্কুল থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিয়েছে। সামনেই শশীর এসএসসি পরিক্ষা বাবা বলেছে পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে ফোন কিনে দিবে। এই জন্য সামনের কয়েকটা মাস ঘুরাঘুরি একটু কমিয়ে দিয়ে পড়াশোনায় মন দিয়েছে। সিঁড়ি বেঁড়ে উঠানে নেমে চড়াটের উপর বসতেই রান্নাঘর থেকে পারভিন মেয়েকে ডেকে উঠল। শশী দৌড়ে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই পারভিন মেয়েকে বলল।

এই গরম পানিটা কলপাড়ে রেখে একটু সমুদ্র কে ডেকে আনতো মা। দুপুর গড়িয়ে গেলো এখনো গোসল করেনি ওর জন্য গরম পানি করেছি।

শশীর কালকে রাতের ঘটনা মাথায় আসতেই বলল, আমি পারবো নাহ অন্য কাউকে বলো।

কাকে বলবো আর বাড়িতে কেউ আছে নাকি তোর ছোট কাকী জুনাইদ কে ঘুম পাড়াচ্ছে। আর মেজো গরুর গোয়াল পরিষ্কার করছে। জোনাকি তো বই গুলো রাখতে যত দেরি না খেয়েই দৌড়ে পাড়ায় চলে গেছে। এই গরমের মধ্যে তুই আর আমায় জ্বালাস নাহ তো জলদি ডেকে আন পানি ঠান্ডা হয়ে যাবে।

গরমের সময় আবার গরম পানি করেছো কেনো ওনার শীত লাগছে নাকি?

শোনো মেয়ের কথা ছেলেটা অসুস্থ তারউপর কালকে রাতে যা হলো তোর আব্বা তো অনেক রেগে গিয়েছিলো। ক্ষতস্থান গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ঔষধ লাগাতে হবে। এখন বেশি কথা না বলে যাতো।

শশী বিরক্তি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠান পযন্ত আসলো তারপর কি মনে করে আবারও রান্নাঘরে গিয়ে ওর মাকে বলল, আচ্ছা মা ওনারা আমাদের বাড়ি থেকে যাবে কবে?

মেয়ের এমন ধারা কথা শুনে পারভিন রেগে গেলো। এসব কি ধরনের কথা শশী ওনারা মেহমান যতদিন ইচ্ছে থাকবে তোর এতো চিন্তা কিসের বেশি কথা না বলে সমুদ্র কে ডেকে নিয়ে আয়।
,,,,,,,,
বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে সমুদ্র উত্তরের খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তখনি দরজা খোলার শব্দ হলো বিরক্ত নিয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখলো শশী দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র কপাল কুঁচকে উঠে বসে কিছু বলার আগেই শশী বলল।

মা আপনার জন্য গরম পানি করে কলপাড়ে রেখে দিয়েছে। আমাকে পাঠালো আপনাকে ডাকার জন্য জলদি আসেন।

কথাটা বলে শশী চলে যাওয়া ধরতেই সমুদ্র পিছন থেকে ডেকে উঠল, এই মেয়ে শোনো নাম কি তোমার?

সমুদ্রের এহেন প্রশ্নে শশী পুরাই অবাক হয়ে গেলো পুরো গ্রামের মানুষ তার নাম জানে অথচ এই বেডা আমাদের বাড়িতে থেকেই আমার নাম জানে নাহ মাথার তাড় ছেঁড়া হলে যা হয়। মনে মনে কথাগুলো বলে শশী মুখে বলল, শশী।

নামটা একদম বাজে শশী কারো নাম হয় নাকি আচ্ছা কিসে পড়ো তুমি?

লোকটা বলে কি আমি নাকি চাঁদের মতো দেখতে তাই আব্বায় ভালোবেসে নাম রাখছে শশী আর এই লোকটা বলে কিনা বাজে। শশী রেগে সমুদ্রের পরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, বলবো নাহ আর আমি অচেনা কাউকে এতোকিছু বলি নাহ।

কথাটা বলে রুম থেকে চলে গেলো শশীর এমন কাজে সমুদ্র কপাল কুঁচকে বিরবির করে বলল, বিয়াদপ মেয়ে একটা বড়দের সম্মান করতে শেখে নাই। ছোটো থেকে শাসন না করলে যা হয় আদরে আদরে বাঁদড় তৈরি হয়েছে।

কথাটা বলে বিছানা থেকে নেমে বাইরে চলে গেলো গোসল করতে হবে। আর যতদ্রুত সম্ভব এখান থেকে যেতে হবে যলদি কাজে জয়েন করতে হবে অনেক রেস্ট করা হয়েছে আর নয়।

#চলবে?

প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-০৪

0

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৪
,
এখান থেকে যতগুলো চাষের জমি দেখছেন এই সবগুলো আমাদের। আব্বার মুখ থেকে শুনেছি দাদু নাকি নিজে কৃষকদের সাথে মাঠে নেমে কাজ করতেন। আমাদের বাড়িটাও দাদু করেছে ওনি ওনার তিন ছেলেকে একসঙ্গে দেখতে চেয়েছিলেন। তাই বাড়িটা এতোবড় করেছেন। আমার তিন কাকু ছোট কাকুর চার ছেলে মেজো কাকুর দুই মেয়ে এক ছেলে আর আমার আব্বা সবার বড়। তাই আমি বাড়ির বড় মেয়ে আমরা সবাই একসঙ্গে থাকি কত মজা করি। আর ওই যে দূরে পুকুর দেখতে পাচ্ছেন আমার যখন মন খারাপ হয় তখন ওই পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসে বসে গাছের সাথে বাতাসের সাথে কথা বলি। যদিও আমার ওতোবেশি মন খারাপ হয় নাহ মাঝে মাঝে একটু যখন হয় তখন আরকি। শশী অনবরত মুখ নাড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে রোদ্রকে এটা ওটা দেখাচ্ছে কিন্তু রোদ্রের তাতে মন কোথায়। গাছে হেলান দিয়ে দু হাত বুকে গুঁজে সে এই চঞ্চল হরিণী মেয়েটাকে দেখতেই ব্যাস্ত। শশী পিছনে ঘুরে রোদ্র কে বলল।

আরে আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো নিন আঁকা শুরু করুন নয়তো একটু পড়ে সন্ধ্যে নামলে তখন আর কিছুই আঁকতে পারবেন নাহ।

ভাবছি আজকে আর কিছু আঁকবো নাহ, আজকে তোমার সাথে সবকিছু দেখে নিয়ে কালকে নিরিবিলিতে আঁকবো।

ওদের কথা বলার মাঝেই শশী দেখতে পেলো ক্ষেতের মাঝ দিয়ে করা আইল দিয়ে তিনটা ছেলে ওদের দিকেই আসছে। রোদ্র ওদের চিনতে না পারলেও শশী ঠিক চিনতে পেরেছে। একটা চেয়ারম্যান এর বিগরে যাওয়া ছেলে আর পিছনে দুটো তার চেলা। ওরা শশীদের সামনে এসে দাঁড়ালো শশী আর রোদ্রের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, কিরে শশী এই বিকেলে পোলা নিয়া মাঠে কি করিস।

ছেলেটার কথা শুনে রোদ্র রেগে কিছু বলতে যাবে তখনি শশী হাত দিয়ে রোদ্রকে বাঁধা দিয়ে বলল, আরে আপনি কই যান আপনি পারবেন নাহ ওকে সোজা করতে তো আমি একাই একশো।

কথাটা বলে শশী একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, কেনোরে শাহিন তোর চোখ কী নষ্ট হয়ে গেছে দেখিস না কি করি। ওনি আমাগো অতিথি তাই ওনাকে আমাদের গ্রাম দেখাতে এনেছি। বেশি ঝামেলা করিস নাহ নয়ত তোর ওই গালে আমার হাতের চড় পড়তে সময় লাগবে নাহ।

শশীর কথাশুনে শাহিন দাঁত বের করে হেসে ডান হাত গালে ঘষতে ঘষতে বলল, তোর ওই নরম হাতে চড় খেতে তো আমি এক পায়ে রাজি।

চড়টা যদি আমার হাতের খাও তাহলে দিনের বেলায় চোখে চাঁদ তারা দেখবে খাবে নাকি?

পিছন থেকে আসা কারো গম্ভীর গলার স্বর শুনে ওরা সবাই পিছনে তাকালো দেখলো সমুদ্র আর জয় দাঁড়িয়ে আছে। জয়ের দুহাতে পিঠা একহাতের টা শেষ হয়ে গেছে অপর হাতেরটা সে তখন খেতে ব্যাস্ত। শাহিন সমুদ্র কে দেখে আর কিছু না বলে চলে গেলো। সমুদ্র আর একটু এগিয়ে এসে রোদ্রকে বলল, গ্রাম দেখতে আসার আগে জয় কে নিয়ে আসা যায় নাহ? ও একা একা কোথায় ঘুরবে বসে বসে আমার মাথা খাচ্ছে। আর যে কারো সাথে এভাবে চলে আসবি নাহ পরে বিপদে তুইই পরবি অন্য কেউ নাহ।

সমুদ্র কথাটা বলে সামনের পুকুর পাড়ে চলে গেলো। শশী রেগে রোদ্রকে বলল, দেখেছেন? আমি জানি ওনি শেষের কথাগুলো আমাকেই খুঁচা দিয়ে বলেছে।

শশীর কথশুনে রোদ্র হেসে বলল, তাহলে ভাইয়ার সামনে বললে নাহ কেনো? এখন ভাইয়া চলে যাওয়ার পরে বলছো কেনো?

আমি কি পাগল নাকি এমনিতেই ওনাকে দেখলে আমার ভয়ে হাঁটু কাঁপে শুধু শুধু ওনার সাথে লাগতে গিয়ে সেধে চড় খাওয়ার কি দরকার। কথাগুলো বিরবির করে বলে শশী রোদ্রকে বলল, ভাইয়া এখন চলেন বাড়িতে যায় বেলা প্রায় পড়ে এলো এই সময় মাঠে ঘাটে থাকা ভালো নয়।

রোদ্রও জয়ের হাত ধরে আইল দিয়ে হাঁটছে শশী পিছন ফিরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রোদ্রকে বলল, ওনি আসবে নাহ?

কে ভাইয়া? আসবে হয়ত পরে।

পরে কেনো ওনাকে এখনি আসতে বলেন জানেন তো আমি কাকীর মুখ থেকে শুনেছি অনেক অনেক বছর আগে আমাদের এই মাঠে ইংরেজরা নীল চাষ করতো। ওনারা নাকি কৃষক দের উপর অনেক অত্যাচার করতো তো একদিন সব কৃষকরা মিলে ওই ইংরেজদের লিডারকে ধরে মেরে ফেলে এই মাঠেই নাকি কোথায় পুঁতে রেখেছিলো। এখনো রাত হলে নাকি ওনার আত্মা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়ায়।

শশীর কথাশুনে রোদ্র মুচকি হেসে বলল, তাহলে তো ভালোই দুই ইংরেজ একসাথে হয়ে দেশের হালচাল নিয়ে কথা বলবে সেখানে আমাদের কি কাজ বলো তার চেয়ে বরং চলো আমরা বাড়ি যায়।

শশী মাথা চুলকে আবারও পিছনে সমুদ্রের দিকে তাকালো এই লোকের ভয়ডর নাই নাকি এই ভর সন্ধ্যে বেলা কেমন পুকুরপাড়ে দাঁড়ায় আছে। কি জানি বাপু যায় যা ইচ্ছে করুক আমি বরং যায়।
,,,,,,,,,
কিরে হঠাৎ করে কোথায় লুকিয়ে পড়লি আমার ভয়ে।

ফোনের ওপাশ থেকে এমন উপহাস মূলক কথা শুনে সমুদ্রের হাতের মুট শক্ত হয়ে গেলো। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বাঁকা হেসে বলল, হিংস্র বাঘকে ডেকে নিজের বিপদ বাড়াস নাহ।

আরে ছাড়তো তুই আমার কিচ্ছু করতে পারবি নাহ উল্টো নিজেই দু দুটো গুলি খেয়ে কুপকাত হয়ে আমার ভয়ে লুকিয়ে আছিস।

সমুদ্রের রাগ হলেও কিছু বললো নাহ কারণ ও জানে মূর্খের সাথে তর্ক করলে সময় নষ্ট ছাড়া অন্য কিছুই হবে নাহ। তাই চুপ করে থেকে বলল, তোকে সময় দিচ্ছি যত খুশি উড়ে নে আমি ফিরে আসলে দম ফেলানোর সময় পাবি নাহ।

আরে ছাড়তো তুই আমার টিকিটাও ছুঁতে পারবি নাহ, তোর সামনেই আমার ড্রাগস এর ব্যাবসা রমরমা চলছে কিছু করতে পেরেছিস? ওহ শোন আজকে রাতে বাইরে থেকে এক ট্রাক নতুন মাল আসবে তোকে জানিয়ে রাখলাম পারলে ঠেকা। আমি ভাবছি বাইরের দেশ থেকে টাকা খরচ করে এসব আর না এনে বরং দেশেই শুরু করি কি বলিস। আমাদের দেশে তো আবার ইয়াং ছেলেদের অভাব নাই তাদের কেই কাজে লাগাবো। কিরে চুপ হয়ে গেলি কেনো কিছু বল।

ভাবছি তোকে আর কিছু বলবো নাহ কারণ পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।

সমুদ্রের কথাশুনে ওপাশের লোকটা যেনো ভারি মজা পেলো হাসতে হাসতে বলল, তুই আর আমাকে কি বলবি যে নিজের বাপকেই রক্ষা করতে পারলো নাহ তার আবার এতো কথা।

সমুদ্র চোখ বন্ধ করে মুঠো করা হাতে পাশের গাছে জোরে একটা পাঞ্চ মারলো। ওপাশের লোকটা যেনো সমুদ্রের অবস্থা বেশ ভালো বুঝতে পেরেছে তাই আবার বলা শুরু করলো। জানিস তো ভাবছি এবার সামনের নির্বাচনে আমিই দাঁড়াবো আমার বাপ আর কতদিন এসব করবে বল ছেলে হিসাবে তো আমারও একটা কর্তব্য আছে।

ওই যে বললাম বাঘ সব সময় বাঘই থাকে যতই সে আহত হোক নাহ কেনো। বিড়াল ক্ষমতা পেলে দুই দিনের জন্য নিজেকে বাঘ মনে করলেও বিড়াল বিড়ালই থাকে।

তুই সালা বড়ই জেদী তোকে তো সুযোগ দিছিলামই আমার বোন তোকে পছন্দ করে ওকে বিয়ে করলে এতোকিছুই হতো নাহ। তোর বাপও বেঁচে থাকতো। চল তোকে আরো একবার সুযোগ দিলাম আমার বোনকে বিয়ে করে আমার সাথে হাত মেলা। কি বলতো এক রাজ্যে দুই রাজা থাকে নাহ।

সেটাই এক রাজ্যে একটাই রাজা থাকে তবে সেটা কে সেতো সময় হলেই দেখা যাবে।

বাহ এই না হলো কথার মতো কথা কি বলতো সামনের জন্য শক্তিশালী না হলে যুদ্ধ করে মজা পাওয়া যায় নাহ। তুই আর আমি একদম এক টার্গেট আলাদা হলেও আমাদের পছন্দ একদম এক। আর আমরা কেউই নিজের পছন্দের জিনিস অন্যকে দিতে নারাজ আমার কি মনে হয় বলতো এই জন্য দেখিস ভবিষ্যতে তোর সাথে বিশাল যুদ্ধ লাগবে আমার।

আর সেই যুদ্ধে আমি না জিতলেও তোর মৃত্যু নিশ্চিত।

সেটা তো সময় হলেই দেখা যাবে।

সমুদ্র ফোন কেটে সামনে তাকালো লাল হওয়া সূর্য টা তখন মেঘের আড়ালে লুকাতে ব্যাস্ত। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো।
,,,,,,,,,,
সমুদ্র কে রাতের খাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে কিন্তু ও আসেনি তখন বাড়ি ফিরে রুম থেকে আর বের হয়নি। জয়কে বলেছিলো ডাকতে তবে সে এখন রোদ্রের সাথে ছবি দেখতে ব্যাস্ত আর জোনাকি ঘুমিয়ে গেছে এই জন্য শশীকেই পাঠালো। শশী সিঁড়ি দিয়ে বিরক্তি ভাবে উপরে উঠছে যেনো তার সমুদ্র কে ডাকার কোনো ইচ্ছেই নেই। বাবার কাছে নেক্যা কান্না করে নিজের রুম আবার ফিরে পেয়েছে তবে তার পাশের রুমটাই সমুদ্রের। অপন মনে নক না করে রুমে ডুকতেই শশী সামনে তাকিয়ে আতংকে চিৎকার করে বলে উঠল।

একি এটা কি করছেন আপনি?

#চলবে?

প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-০৩

0

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_৩
,
মেজর ইকবাল হাসান এর তিন ছেলে বড় ছেলে সমুদ্র মেজো ছেলে রোদ্র আর ছোট ছেলে জয়। দুই ছেলের পরে মেয়ের আশায় আবার বেবি নিয়েছিলো কিন্তু সেই আশা আর পূরণ হয়নি। তবে বড় ছেলে যতটা রাগী আর বদমেজাজি মেজোটা তার পুরো উল্টো শান্ত মেজাজের ছেলেটা ছবি আঁকা বেশ পছন্দের। বাবা আর বড় ভাই আর্মির বড় পোস্টে থাকলেও সে ওসব এ না গিয়ে আঁকাটাকেই বেছে নিয়েছে। রং তুলি নিয়ে খেলতে সে বেশ পছন্দ করে। শশী রোদ্রর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল।

আপনি সত্যি ছবি আঁকতে পারেন?

শশীর করা প্রশ্ন শুনে রোদ্র মুচকি হেসে বলল, অবশ্যই পারি। আমি মূলত তোমাদের গ্রামে এসেছি ইউনিক কিছু ছবি আঁকানোর জন্য কিন্তু আঁকার জন্য ভালো কোনো জায়গায় খুঁজে পাচ্ছি নাহ। তবে তুমি যদি একটু সাহায্য করতে তাহলে খুবি ভালো হতো।

অবশ্যই আমি আপনাকে সাহায্য করবো এই হিজলতলীর এমন কোনো জায়গা নেই যে আমি চিনি নাহ। কালকে আমি আপনাকে নিয়ে যাবো আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা তবে আমার একটা শর্ত আছে।

হ্যাঁ বলো কি শর্ত?

আগে আমার একটা সুন্দর করে ছবি একেঁ দিতে হবে তারপর।

রোদ্র শশীর মুখের দিকে এক নজরে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, তোমার ছবিতো আমি আমার সবটা দিয়ে আঁকবো একদম নিজের মনের মতন করে।

ওদের কথা বলার মাঝেই ফট করে সমুদ্র দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। ওরা যেহেতু রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো তাই সমুদ্র দরজা খুলে দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে একবার দুজনকে দেখে গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। শশী সমুদ্রের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এই লোকটা কেমন যেনো আমি আমার জীবনে এমন লোক দেখেনি। বদমেজাজি আর অসভ্য লোক একটা।

শশীর কথা শুনে রোদ্র হেসে মজা করে বলল, আরে আস্তে আস্তে বলো ওনি শুনতে পাবেতো। তুমি জানো ওনি কে ওনি আর্মিতে চাকরি করে অনেক বড় পদে আর ওনার অনেক বড় বড় রাইফেল আছে সেটা দিয়ে যদি একবার তোমাকে গুলি করে তাহলে তুমিতো শেষ ভাই।

রোদ্রের কথা শুনে শশী ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে আবার সমুদ্রের যাওয়ার পথে তাকালো। শশীর এমন ভয়ে ভীতু হওয়া চেহারা দেখে রোদ্রের বেশ হাসি পেলো। হাসতে হাসতে শশীকে বলল, আরে আমি মজা করছিলাম ওনি আমার বড় ভাইয়া তবে তুমি ওনার থেকে একটু দূরে দূরেই থাকো নয়ত ওনার ওই হাতে আড়াই কেজি ওজনের চড় খাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

আমার বয়েই গেছে আমি তো ওনার সামনেই আর পড়বো নাহ।

কথাটা বলে শশী চলে গেলো আর রোদ্র শশীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলল, তোমার ছবিতো আমি যত্ন করে এখানে আঁকবো তবে রং তুলি দিয়ে নয় ভালোবাসার রং দিয়ে।
,,,,,,,,,,,
এই এলইডি লাইট এদিকে আসো কালকে আমাকে গোবরে ফেলে দিয়েছিলে আজকে তার বিচার হবে।

জোনাকি ছাঁদে এসেছিলো আচার চুরি করার জন্য। সে খবর পেয়েছে তার মা আচার রোদে দিয়েছে ছাঁদে সেটা নেওয়ার জন্যই এসেছিলো তবে তার এতো সুন্দর নামটাকে বদলে অন্যনামে ডাক শুনে পিছনে ঘুরে তাকালো দেখলো জয় দাঁড়িয়ে আছে। জোনাকি রেগে জয়ের দিকে তেড়েফুঁড়ে গিয়ে বলল, এই তুমি আমাকে কি বললে?

এলইডি।

নিজে কি হ্যাঁ ছোট্ট হাতি একটা সবসময় শুধু খেতেই থাকো খবরদার যদি আবার আমাকে ওসব উল্টো পাল্টা নামে ডাকো তাহলে এবার আপাকে বলে বকুলের মায়ের সাথে তোমাকে বেঁধে রাখবো।

আরে যাওতো তোমার ওই আপা আমার কিচ্ছু করতে পারবে নাহ। ওই যে ওখানে তাকাও ওটা কে জানো? আমার বড় ভাইয়া তোমাকে এক হাত দিয়ে একটা আছাড় মারলে আর খুঁজেও পাওয়া যাবে নাহ।

জয়ের কথাশুনে জোনাকি দূরে ছাঁদের কিনায় তাকিয়ে দেখে লম্বা চওড়া বডি বিল্ডার মতো একটা লোক বসে ফোন টিপছে। জোনাকি ভয় পেলেও সেটা জয়কে বুঝতে না দিয়ে বলল, নিজে পারে না আবার ভাইকে ডেকে আনে ভীতু একটা।

তুমি কি হ্যাঁ তুমিও তো তোমার বোনকে ডেকে আনো।

ওদের ঝগড়ার মাঝেই সমুদ্র নিচে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই জয় কাঁদো কাঁদো গলায় সমুদ্র কে বলল, বড় ভাইয়া জানো কালকে এই মেয়েটা আমাকে গোবরে ফেলে দিয়েছিলো। বিশ্বাস করো আমি কোনো দুষ্টমী করেনি একদম শুধু শুধু। ওর গরুর বাচ্চা কে গরু বলেছিলাম তাই জন্য, এখন তুমি বলো ভাইয়া গরুকে গরু না বললে কি বলবো।

ওর নাম বকুল ওটা বললেই হতো।

সমুদ্র ভ্রু কুঁচকে একবার জোনাকির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, এই বয়সে এতো অকাম না করে ভালো করে পড়াশোনা করো। এরপর যেনো আর এমন করতে না দেখি।

কথাটা বলে সমুদ্র চলে গেলো আর জয় বিশ্ব জয় করার মতো একটা হাসি দিয়ে সমুদ্রের পিছনে গেলো। জোনাকি রেগে ধুপধাপ পা ফেলে শশীকে খুঁজতে গেলো যে করেই হোক আপাকে বলে এই মস্তান মার্কা লোকটাকে একটা শিক্ষা দিতেই হবে।

“””””””””
গোসল সেরে জামা নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। যদিও কলপাড়ে বদলানো যেতো বাড়িতে এখন পুরুষ লোক তেমন কেউ নেই তবুও সেই খারাপ লোকটা আছে। এই জন্য সোজা নিজের রুমে চলে এসেছি এখানে আর কেউ আসবে নাহ। বিকেলে আবার রোদ্র ভাইয়াকে ছবি আঁকানোর জায়গায় নিয়ে যেতে হবে উফফ কত কাজ আমার। একা একা কথাগুলো বলছিলো আর এক এক করে শরীল থেকে ভিজে কাপড় গুলো খুলে মেঝেতে রাখছিলো শশী। সবটা খুলে গায়ে একটা গামছা পেঁচিয়ে খাটে রাখা শুকনো জামাগুলো সোজা করছিলো তখনি রুমের দরজা খুলে কেউ রুমে ঢুকে পড়ল। শশী হাতে জামা নিয়ে সামনে তাকালো সমুদ্র খালি গায়ে শুধু একটা টাওজার পড়ে আছে৷ জিম করা শ্যামবর্ণের বডিটা যে কোনো মেয়েকে আর্কষিত করতে সক্ষম। বুকের বাঁ দিকে একটা নতুন করে ব্যান্ডেজ লাগানো। শরীলে লম্বা লম্বা অনেক গুলো কেটে যাওয়া দাগ শশী হা করে সেদিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্র এভাবে শশীকে দেখে একটু বিব্রতবোধ করলো তবুও সেটা প্রকাশ না করে চেয়ারে রাখা নিজের ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে দরজার দিকে চলে গেলো। বেরোনোর আগে পিছনে না ফিরেই গম্ভীর স্বরে বলল।

চেঞ্জ করার সময় দরজা আটকাতে হয় এইটুকু সাধারণ ঙ্গান নেই।

কথাটা বলেই শব্দ করে দরজা আটকিয়ে চলে গেলো। দরজা আটকানোর শব্দে শশীর যেনো হুঁশ ফিরলো ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল চোখের কোণে পানি জমে গেছে। ওনি এভাবে আমাকে দেখে ফেললো ছিঃ দরজা আটকানোর কথা মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গিয়েছে। খানিকক্ষণ এভাবে বসে থাকার পর কেনো জানি মনে হলো দোষ টা আসলে ওই লোকটার কারণ ওনি যখন দেখলো দরজা খোলা তখন ওনার উচিত ছিলো চলে যাওয়া তা না করে সরাসরি রুমের মধ্যে চলে আসলো। এভাবে একটা মেয়ের রুমে কেউ ঢুকে পড়ে? না না এর একটা বিচার করতেই হবে। কথাগুলো ভেবে জামা পড়তেই নিচে থেকে জোনাকির ডাক ভেসে আসলো গলা ফাঁটিয়ে ওকেই ডাকছে। শশী দ্রুত ভিজে কাপড়গুলো হাতে নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।

আপা তুই বল আমি কত ছোটো আর আমার মত এতো ছোটো মানুষ কে ওনি ধমক দিয়েছে এটা কি ঠিক? আমিতো বকুল কেও কখনো ধমক দেয়নি আর ওনি আমাকে কীভাবে ধমক দিলো। তুই এর বিচার করবি যদি না করিস তাহলে আমি কিন্তু দুপুরের ভাত খাবো নাহ।

ছোট বোনের কথাশুনে শশী বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। ও নিজেই ওই দানব লোকটাকে ভয় পায় সেখানে বিচার করবে কীভাবে। কিন্তু নাহ বিচার করতেই হবে আমার ছোট বোনকে যখন ধমক দিয়েছে তখন তো ওনাকে শাস্তি পেতেই হবে। কথাগুলো মনে মনে ভেবে শশী জোনাকির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তুই যা ভাত খেয়ে নে আমি ভেবে দেখছি ওনাকে কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায়।

শশীর কথা শুনে জোনাকি খুশি হয়ে গেলো। মাথার দুইপাশে ঝুটি ধরে নাচতে নাচতে খেতে চলে গেলো। আর শশী চড়াটের উপর শুয়ে শুয়ে ভাবছে কীভাবে সমুদ্র কে নাকানি চুবানি খাওয়ানো যায়। ভেজা চুলগুলো মাটি ছুঁই ছুঁই তখনি রোদ্র সেখানে এসে মিস্টি হেসে বলল

কি ছোট্ট পাখি যাবে নাহ?

#চলবে?

প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-০২

0

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_২
,
ঢাকা থেকে এতোটা পথ জার্নি করে এসে অনেক ক্লান্ত লাগছিলো তাই রেস্ট করার জন্য সমুদ্র কে একটা রুম দেওয়া হলো। সমুদ্র রুমের দরজা খুলে ভিতরে যেতেই কপাল কুঁচকে সামনে তাকালো। পুরোটা রুম জুড়ে মরিচ বাতি মাথার উপড়ে রঙিন কাগজ দিয়ে তারা এবং চাঁদ বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখা। দেওয়ালের সাথেও রঙিন কাগজ দিয়ে নানা ধরনের ফুল বানিয়ে আঠা দিয়ে লাগানো। সমুদ্র এসব তোয়াক্কা না করে সোজা বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। কখন যে দিন পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে তার খেয়াল নেই হঠাৎ মেয়লী একটা চিৎকার এ ঘুম ভেঙে গেলো। কিন্তু উঠে বসার আগেই সে রুম ত্যাগ করেছে। সমুদ্র সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো মাথাটা প্রচুর বেথ্যা করছে কড়া করে এককাপ চা খেলে ভালো লাগত।

দোতলা বাড়ির সামনের উঠানে বসার জন্য জামশেদ মাস্টার বেশ বড়সড় করেই একটা চড়াট পেতে রেখেছে। গরমের সময় কারেন্ট চলে গেলে যেনো এখানে বসতে পারে সবাই। সেই চড়াটে বসে পা ঝুলিয়ে দিয়ে দুই বোন মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আর তাদের সামনে কাঠের চেয়ার নিয়ে বসে আছে জামশেদ মাস্টার খানিকক্ষণ পর তিনি বলে উঠলেন।

আম্মা আপনাদের কি হয়েছে আমায় বলবেন কি? এভাবে রাগ করে আছেন কেনো? শুনলাম এখনো নাকি খান নাই কিন্তু কেনো? রাত কত হয়ছে আপনাদের না বলেছি রাত আটটার মধ্যে খেয়ে নিবেন তাহলে খান নাই কেনো?

বাবার কথা শুনে শশী মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, মন ভালো নাই আব্বা অনেক রাগ করে আছি রাগের জন্য পেট ফুলে আছে তাই খিদা লাগেনাই।

হঠাৎ এতো রাগের কারনটা কি আম্মা? আপনাদের মা কি আপনাদের রাগ করছে? এই জন্য রেগে আছেন? কথাটা বলেই জামশেদ মাস্টার গলা ছেড়ে ডাকলো। বড় বউ এইদিকে আসো আজকে তোমার নামে বিচার বসামু তোমার কতবড় সাহস তুমি আমার আম্মাদের রাগ করো।

হ আমার তো কোনো কাজকাম নাই যে ওদের রাগ করতে যাবো। আপনার মেয়েরাতো ননীর পুতুল একটু কিছু হলেই ওদের রাগ হয়। অথচ যখন সারা গ্রামের মানুষ কে জ্বালায় তখন কিছু হয় নাহ।

মায়ের কথা শুনে রাগটা যেনো আরো বেশি পাকাপোক্ত হলো। জামশেদ মাস্টার বউয়ের কথায় কান না দিয়ে আদর মাখা কন্ঠে আবার ও মেয়েদের জিগাস করলো। তাহলে কী জন্য এমন কঠিন রাগ করে আছেন আম্মা আমাকে বলা যায় নাহ?

এটা কেমন বিচার আব্বা এভাবে আমাকে না বলে আমার রুমে অন্য একজন কে কেমনে থাকার অনুমতি দিলেন আপনি। আমি এটা মোটেও আশা করেনি আপনার থেকে। শশীর কথা শেষ হতেই জোনাকীও সাথে তাল মিলিয়ে বলল, আর ওই মোটা ছেলেটা ওতো আরো বেশি বদমাশ আমার বকুল কে গরুর বাচ্চা বলেছে।

এবার যেনো সবটা পরিষ্কার হলো কি জন্য তার দুই মেয়ে এমন রাগ করে আছে তিনি এতক্ষণে সেটা ধরতে পারলেন। ওনার বাবা মারা গেছে বেশ কিছুবছর হলো, ওনার বাবার একমাত্র বন্ধু ছিলেন ইসহাক তারই ছেলের বউ এবং তিন নাতি ঢাকা থেকে ওনাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। ইসহাক কাকা মারা যাওয়ার পরে ওনাদের সাথে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। তবে ইসহাক কাকার ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে যোগাযোগ হয়েছে। ইসহাক কাকার ছেলে ছিলো আর্মিদের মেজর শুনেছি কোনো একটা মিশনে গিয়ে গুলি লেগে ওনি মারা গিয়েছে তবে সঠিক খবর কেউ বলতে পারে নাহ। দুই মেয়ের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বোঝানোর সূরে বললেন।

আমি কি যেনো শিখেছিলাম ছোটো বেলায় আমার আম্মাদের সেটা একটু কনতো দেহি আমি একটু শুনি।

বাবার কথা শুনে দুই বোনই এবার মুখ ঘুরিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে বলে উঠল, অতিথি হলো সম্মানিও ব্যাক্তি। তাদের যেনো কোনো সম্যসা না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখা উচিত আর সব সময় বড়দের সম্মান করা উচিত।

কথাটা শেষ হতেই তিনি হেসে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন তাহলে এবার কি রাগ কমছে? একটু একটু ক্ষিদা লাগছে? বাবার কথার শেষ হতেই দুই বোনই হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

দূরে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা শাহানারা দেখলো মুচকি হেসে রান্নাঘরে কাজ করতে থাকা শশীর মা পারভিনকে বলল, আপা আপনার মেয়ে দুটো তো মাশাল্লাহ কত লক্ষী মুখটা একদম চাঁদের মতো। সারাদিন তো ওদের দেখলাম নাহ আমরা আসছি সেই বিকালে কিন্তু দেখলাম এখন।

দুটোতে বাড়ি থাকলে তো দেখবেন আপা স্কুল থেকে এসেই না খেয়ে বের হয়েছে আসলোই সেই সন্ধ্যার সময়। আপা রাত অনেক হয়ছে আপনি বরং সমুদ্র বাবারে একটু ডেকে দেন খেয়ে নিক ছেলেটা অসুস্থ তারউপর আবার এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে আসছে। এসেও তো কিছু খাইনি।

বড় ছেলের কথা শুনতেই একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন শাহানারা। তার বড় ছেলেটা দিনদিন কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠছে লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে। কতবড় একটা বিপদের মুখ থেকে আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছে। কবে যে একটু শান্তিতে শ্বাস ফেলতে পারবো ওকে নিয়েই যত চিন্তা আমার।
,,,,,,,,,,,
এটা কেমন কথা আংকেল আমি বলছিতো আমি সুস্থ তারপরেও আপনি এই কথা কীভাবে বলতে পারেন?

সমুদ্র তুমি আমার কথা কেনো শুনতে চাইছো নাহ তুমি ভুলে গেছো তোমার দু দুটো গুলি লেগেছে। তারপরেও তুমি কীভাবে বলো তুমি সুস্থ। সময় নাও পরিবারের সাথে সময় কাটাও তোমাকে তোমার পরিবারের প্রয়োজন। সময় হলে আমিই তোমাকে ফোন করবো এখন রাখছি।

কথাটা বলেই ওপাশের ব্যাক্তিটা ফোন কেটে দিলো। রেগে কান থেকে ফোন সরিয়ে ফোনটা বিছানায় ফেলে দিলো সমুদ্র। চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল,কীভাবে আমি পরিবারকে সময় দিবো মায়ের দিকে তাকালেই যেনো মনে হয়। ওই মুখ থেকে সারা জীবনের জন্য হাসি মুছে দেওয়ার পিছনে আমি দায়ী। নিজের বাবার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী উফফ এই যন্ত্রণা থেকে কবে মুক্তি পাবো।

নিজের রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে শশী ওর কোলবালিশ ছাড়া ঘুম আসেনা তাই সেটা নেওয়ার জন্যই আসা কিন্তু রুমের মধ্যে থেকে জোরে কথা বলার আওয়াজ শুনে আর ভিতরে যাওয়ার সাহস হয়নি। কিছুক্ষণ পর কোনো সাড়া না পেয়ে ভিতরে ঢুকলো। সমুদ্র তখন চেয়ারে বসে ফোন টিপছিলো শশীকে দেখে এক নজর তাকিয়ে আবার ফোনে মগ্ন হয়ে গেলো। শশী রেগে দাঁত কিড়মিড় করে সমুদ্র কে একবার দেখে বিছানায় উঠে গেলো। কোলবালিশ নিতে নিতে নিজের মনে বিরবির করতে লাগল।

ইস এক বেলায় বিছানাটা কেমন অগোছালো বানায় ফেলছে। পুরো রুম এলোমেলো করে ফেলছে। যদি জানতাম এই লোকটা আমাদের বাড়ি আমার রুমে থাকবে তাহলে তখনি ওনাকে ওনার গাড়ি সমেত ঢাকায় ফেরত পাঠায় দিতাম।

কোলবালিশ টা দুই হাতে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে পিছন ঘুরতেই কারো শক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খেলো শশী। নাকে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলল, উফফ এতো শক্ত কারো বুক হয় আমার নাকটা পুরো চাপ্টা বানায় দিছে।

সমুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল, তোমার কাজ শেষ হলে রুম থেকে যাও।

কথাটা শশীর ইগোতে লাগল যদিও সামনে থাকা বিশাল দেহি লোকটাকে দেখে ভয় লাগছে তবুও অনেক খানি সাহস সঞ্চয় করে মিনমিন করে বলল, দেখুন এটা আমার রুম এই রুমের কোনো জিনিসে হাত দিবেন নাহ। আর এই মাথার উপরে ঝুলতে থাকা তারাতে তো আরো নয়। আর দেওয়ালে থাকা ফুল, বাকিটা বলার আগেই সমুদ্র শশীর হাতের কব্জি ধরে টেনে রুমের বাইরে এনে ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো। শশী পুরো বোকা বনে গেলো কোলবালিশ চেপে ধরে রেগে দরজায় লাত্থি দিয়ে বলল।

শুধু আব্বা বলেছে অতিথি সম্মানিয় তাই কিছু বললাম নাহ নয়ত দেখিয়ে দিতাম এই শশী কি জিনিস। কত বড় সাহস আমাকে আমার রুম থেকে বের করে দেয়। আমি বুঝি নাহ বাড়িতে কোনো মেহমান আসলে বার বার শুধু আমাকেই কেনো নিজের রুম ছাড়তে হয়।

একা একা বকবক করতে করতে কোলবালিশ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো তখনি সামনে থেকে আসা কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে হাত থেকে কোলবালিশ টি নিচে পড়ে গেলো। শশী রেগে সামনে তাকিয়ে বলল, এই চোখে দেখেন না নাকি এভাবে ধাক্কা দিলেন কেনো।

কিন্তু সামনে থাকা লোকটার কোনো সাড়া নেই সেতো খোলা চুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই ছোটো মেয়েটাকে দেখে ব্যাস্ত। কেউ এতোটা সুন্দর কীভাবে হতে পারে এ যেনো রং তুলি দিয়ে আঁকা কোনো ফুটন্ত গোলাপ। সামনের জনের কোনো সাড়া না পেয়ে শশী হাত নাড়িয়ে বলল আরে ঘুমিয়ে গেলেন নাকি কে আপনি?

আমি রোদ্র তোমাদের বাড়িতে আসা সম্মানিত মেহমান।

#চলবে?

প্রিয় অর্ধাঙ্গীনি পর্ব-০১

0

#প্রিয়_অর্ধাঙ্গীনি
#সুমাইয়া_সুলতানা_সুমী
#পর্ব_১

এই মেয়ে জামশেদ মাস্টার এর বাড়ি কোনটা চিনো?

মনের সুখে পেয়ারা খাচ্ছিলাম তখনি পিছন থেকে কারো গম্ভীর স্বরে ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি ইয়া লম্বা চওড়া আর বিশাল বডি নিয়ে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। কপালের ডান পাশে ব্যান্ডেজ করা বাম হাতেও ব্যান্ডেজ যেনো মনে হচ্ছে এইমাত্র মারামারি করে এসেছে। লোকটার সামনে আমাকে নিতান্তই লিলিফুট লাগছে। এনার একটা হাতও যদি আমার উপর পড়ে তাহলে নিশ্চিত আমি পটল তুলবো। এনাকে আগে কখনো গ্রামে দেখেনি তারউপর আবার এতোবড় গাড়ি নিয়ে আসছে হয়ত কোনো কাজে এসেছে।

চিনবো না কেনো এই শশী হিজলতলী গ্রামের এমন কোনো জায়গা নেই যে চিনে নাহ।

যদি চিনেই থাকো তাহলে এতো বেশি বকবক না করে বলো।

আরে লোকটাতো ভারি অভদ্র অচেনা কারো সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও জানেনা দেখছি। মনে মনে কথাটা বলে ওনাকে বললাম, বলতে পারি আগে সুন্দর করে জিগাস করেন তারপর বলবো।

ডিজগাস্টিং।

কথাটা বলে সমুদ্র চোখে চশমাটা পড়ে গাড়ির মধ্যে গিয়ে বসে পড়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলো। দুপাশে মাঠ আর মাঝখান দিয়ে বেশ বড়সড় মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা গাড়ি চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সমুদ্র কে এভাবে যেতে দেখে শশীও রেগে হাতের আধ খাওয়া পেয়ারাটা গাড়ির দিকে ছুঁড়ে মারল। যদিও সেটা গাড়ির গায়ে লাগেনি।

বিয়াদপ লোক ছোটোদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেটাও জানে নাহ৷ আমার আব্বার কাছে শিক্ষা নিতে আসিয়েন গ্রামের নাম করা মাস্টার জামশেদ মাস্টার হু।
,,,,,,,,,
এই ছেলে তুমি আমার বকুল কে গরু বলেছো কেনো?

দুহাত ভর্তি নারিকেল এর নাড়ু।বাম হাতে নাড়ু আর ধরবে নাহ, ডান হাতেও বেশ কয়েকটা। মোটাসোটা গুলুমুলু টাইপ এর একটা ছেলে এক মনে দাঁড়িয়ে নাড়ু খাচ্ছে। পরনে তার হ্যাফ প্যান্ট এবং কালো রঙের টিশার্ট। পিছন থেকে আসা চিকন গলার স্বর শুনে ছেলেটি মুখের মধ্যে একটা নাড়ু নিয়েই পিছনে তাকালো। তার সামনে চিকন গড়নের গোল ফ্রক পড়া একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কমড়ে হাত রেখে। মাথার সবগুলো চুল একত্রে করে কমলা রঙের খোপা দিয়ে ঝুঁটি করা। তার পিছনে আরো তিন থেকে চার জন কমড়ে হাত রেখে দাঁড়ানো দেখে মনে হচ্ছে তাড়া যেনো বেজায় চটে আছে কারো উপর।

আমাকে বলছো?

মুখের মধ্যে নাড়ু থাকায় কথাটা কেমন যেনো অস্পষ্ট শুনালো। ছেলেটার এহেন কথায় যেনো সামনে দাড়ানো মেয়েগুলোর রাগের আগুনে ঘি পড়ল। সবার চেয়ে সামনে যে ছিলো সে আরো কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁত কিড়মিড় করে রেগে ঝড়ঝড় করে বলে উঠল।

এখানে তুমি ছাড়া আর কে আছে শুনি? মুখের মধ্যে তো আর জায়গা হবে না তবুও নাড়ু গুলো ঠুসে যাচ্ছো। যাগকে সে কথা এখন বলো আমার বকুল কে গরু বলেছো কেনো?

মেয়েটার কথায় যেনো ছেলেটা হা বনে গেলো। তার মনে পড়ে না সে কখনো কাউকে অসম্মান করেছে বা অসম্মান জনক কোনো কিছু বলেছে। কিন্তু মেয়েটার কথা অনুযায়ী সে কাউকে গরু বলেছে। আর কাউকে গরু বলে সম্বোধন করা নিতান্তই অসম্মান জনক কাজ। কিন্তু তার যতদূর মনে পড়ছে সে কাউকেই এমন ধরনের কিছু বলেনি। মা ভাইয়াদের সাথে গ্রামে বেড়াতে এসে সে মোটেও কোনো দুষ্টমি করেনি তাহলে মেয়েটা এমন কেনো বলছে? মুখের মধ্যে থাকা নাড়ুটা দ্রুত চিবিয়ে গিলে ফেলে তাড়াহুড়ো করে বলল।

তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি কাউকেই এমন কিছু বলেনি৷ আর কি যেনো বললে হ্যাঁ বকুল, আমিতো তাকে চিনিই না তাহলে তাকে গরু কেনো বলবো?

ছেলেটার সাফায় দেওয়াই এবার মেয়েটার রাগ সপ্তমে সে আরো একধাপ রেগে বলল, কি মিথ্যাবাদী রে আমি নিজের কানে শুনেছি তুমি আমার বকুল কে গরুর বাচ্চা বলেছো। তুমি জানো এতে আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি? তার থেকেও বড় কথা আমার বকুল কতটা কষ্ট পেয়েছে। সে মন খারাপ করে বসে আছে আমার সাথে খেলছেও না। দেখো কেমন একা একা খেলছে।

কথাগুলো বলে মেয়েটা তার আঙুল দিয়ে দূরে দেখালো। ছেলেটা মেয়েটার আঙুল অনুসরণ করে তাকাতেই বড় রকমের একটা ঝটকা খেলো কেননা দূরে একটা বড় গরু শুয়ে এক মনে ঘাস চিবোচ্ছে। আর তারপাশে ছোট্ট একটা বাছুর লাফালাফি করে খেলছে। তখন তার মনে পড়ল এখানে এসে সে বাগানের দিকে এসেছিলো তখনি এই ছোট গরুটা তার সামনে এসে কেমনে দৌড়াদৌড়ি করছিলো। তাই সে বলেছিলো, যা হুস গরুর বাচ্চা । তারমানে মেয়েটা এর কথায় বলছে, ছেলেটা এবার রেগে বলল।

আজব তো গরুর বাচ্চা কে গরুর বাচ্চা বলবো নাতো কি হাতির বাচ্চা বলবো?

কিহ তোমার এত বড় সাহস তুমি আবার আমার বকুল কে গরুর বাচ্চা বললে? ভাগ্যিস ও শুনেনি। এবার তোমার বিচার হবে চলো আমার আপার কাছে চলো সে তোমার বিচার করবে।

কিহ? একটা গরুকে গরু বলেছি বলে আমার বিচার করা হবে? হাও ফানি। এই তুমি জানো আমি কে? তার চেয়েও বড় কথা আমার বড় ভাইয়া কে চেনো? তার ইয়া বড় বড় রাইফেল আছে সেটা দিয়ে তোমার মতো পুচকিকে ফুস করে উড়িয়ে দেওয়া যাবে।

কিহ আবার আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? এই মলি,পলি,টিয়া,জলি একটা দড়ি আনতো এটাকে বেঁধে তারপর আপার কাছে নিয়ে যাবো।

ঠিক আছে জোনাকি আমরা এখনি আনছি।

কথাটা বলেই দুইটা মেয়ে দৌড়ে চলে গেলো। তার কিছুক্ষন পর ছাগল বাঁধার একটা বেশ বড়সড় দড়ি এনে জোনাকির কাছে দিলো। এবার জোনাকী দড়িটা হাতে নিয়ে পাশের মেয়েটাকে বলল, এবার এটা ওর কমরে পেঁচা তারপর টানতে টানতে আপার কাছে নিয়ে যাবো। কথাটা বলেই ওরা সবকটা মিলে সামনে থাকা জয় এর কমরে দড়ি পেঁচাতে লাগল। জয় ভয়ে লজ্জায় কিছু বলতে পারলো নাহ। হাতে থাকা নাড়ুগুলো প্যান্টের পকেটে কোনোমতে রাখল। পেঁচানো শেষে টানতে গেলে জয় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

দ্যাখো তোমরা জানোনা আমি কে এবার কিন্তু আমি রেগে যাচ্ছি। এখন সত্যি আমি আমার বড় ভাইয়াকে বলে তোমাদের বকা শোনাবো।

আরে যাওতো তুমি আর তোমার বড় ভাই আমার আপাকে চেনো নাহ৷ এই হিজলতলীর রানী বুঝলে তাকে সবাই ভয় পাই। তোমার বড় ভাইয়াকে তো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে তাইনারে জলি,মলি,পলি,টিয়া।

হ একদম ঠিক কথা শশী আপা আমাগো কুইন।
,,,,,,,,,,

বাগানের সবচেয়ে মোটা আর লম্বা গাছের ডালের সাথে, বড় একটা কাঠের তক্তা দিয়ে দোলনা বানানো সেখানেই বসে শশী দোল খাচ্ছে। তার হাঁটু সমান চুলে বর্তমানে বেণী করা দোলার সাথে সাথে লম্বা বেণীটাও দুলছে। পাশেই ছোট গাছের ডালে তার সখীরা পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দূরে জোনাকি কে আসতে দেখে রিতু শশীর উদ্দেশ্য বলল, এই শশী তোর বোন আবার কাকে বেঁধে আনতেছে। এই পিচ্চি পোলা আবার কি করছে?

রিতুর কথা শুনে সবাই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো শশী দোল খাওয়া বন্ধ করে দোলনায় বসে থাকলো। জোনাকী জয় কে নিয়ে শশীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, উফফ কী মোটা রে বাবা এই টুকু আনতেই হাঁপিয়ে গেছি। যাকগে আপা শোন আমার একটা বিচার আছে এই ছেলে আমার বকুলরে গরু বলছে। ওরে তুই ওহন শাস্তি দিবি।

শশী ভ্রু কুঁচকে জয়কে পা থেকে মাথা অবধি দেখে বলল, তুমি কেডা? তোমারে তো আগে এই গ্রামে দেখি নাই।

আমি এখানে বেড়াতে এসেছি আর এই মেয়েটা আমাকে বেঁধে নিয়ে আসছে। এখন তুমি যদি আমাকে সাহায্য করো তাহলে তোমাকে কিছু বলবো নাহ। নয়ত আমার বড় ভাইয়ার কাছে তোমার নামেও বিচার দিবো।

শশী দোলনা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে জয় এর মাথায় টুকা দিয়ে বলল, কেনো তোমার বড় ভাই পুলিশ নাকি আর্মি যে তুমি বিচার দিলে সে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে। শোনো তুমি ভুল করছো তাই তোমার শাস্তি হলো বকুল রে ওই যে পাশের গোয়াল ঘরে নিয়া আটকায় রাখবা নয়ত ও রোদে পুড়ে অসুস্থ হয়ে যাবে।

শশীর কথা শুনে জয় নাক সিটকে বলল, ইয়াক মোটেও নাহ আমি কখনোই ওই নোংরা জায়গায় যাবো নাহ। আমাকে ছাড়ো আমি আম্মুর কাছে যাবো।

শোনো পোলা বেশি কথা বলবা না নয়ত আমাগো পাশের পঁচা জুলা থেকে চুবাইয়া আনবো তোমারে।

ওদের কথা বলার মাঝেই ওখানে দশ বছরের একটা ছেলে দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, শশী বু তোমরা এখানে জলদি বাড়িত যাও বড়মা অনেক রেগে আছে। তোমাদের সেই কখন থেকে ডাকছে আজকে তোমাগো দুইজনরে শুকনা বাঁশের কাঁবাড়ি দিয়া পিঠাবে।

ছেলেটার কথা শুনে শশী আর জোনাকী দৌড়ে বাড়ির দিকে চলে গেলো। বাকিরাও নিজেদের বাড়ি চলে গেলো জয় কমর থেকে দড়ি খুলে দৌড় দিতে গেলে ধপাস করে পাশে থাকা গোবরে পড়ে গেলো। পড়ে গিয়ে কান্না করতে করতে উঠে বসতেই পাশে থেকে কেউ বলে উঠল।

একিরে তোর এই অবস্থা হলো কেমন করে?
,,,,,,,,,

বাড়ির গেটে মাথা ঢুকিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে দুইবোন চোরের মতো গুটিগুটি পায়ে যেই ভিতরে যাবে তখনি পিছন থেকে কেউ ডাক দিলো। ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে ওদের মা লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বলি বাড়ি আসার দরকারটা কি ছিলো শুনি। পাড়ায় থেকে গেলেই তো পাড়তি, সারাটা দিন খাওয়া নাই টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। সেই সকালে বেড়িয়ে এখন তোদের আসার সময় হলো, এখনিতো মাগরিবের আযান দিবে। পড়াশুনা নাই না কি, এখনি ভদ্রলোকের মতো দুজনেই হাত পা ধুয়ে পড়তে বসবি। আর জোরে জোরে পড়বি যেনো আমি রান্না ঘর থেকে শুনতে পাই। আর হ্যাঁ পড়তে বসে যদি দুটোতে এক চুল ও মারামারি করিস তাহলে এই লাঠি দুটোর পিঠে ভাঙ্গবো এই বলে দিলাম।

মায়ের কথায় দুজনেই ভালো মেয়ের মতো কলপাড়ে গিয়ে হাত পা ধুয়ে নিলো। তারপর শশী আগে আগে নিজের রুমে গিয়ে বিছানার দিকে তাকাতেই দেখলো কেউ একজন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। শশী ভাবলো কোলবালিশ হয়ত তাই ওতো পাত্তা না দিয়ে বই নিয়ে বিছানায় বসে ওটাতে হেলান দিতেই ওটা নড়ে উঠল। ভয় পেয়ে সাথে সাথে চাদর সরাতেই অচেনা একটা ছেলেকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল।

#চলবে?

দূর আলাপন পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

0

দূর আলাপন ৩১ (শেষ পর্ব প্রথম অংশ)

———————————–
ভাদ্রের শেষাশেষি। আজকাল আকাশ থাকে বড় অশান্ত। কখনো রৌদ্র ঝলোমলো তো কখনো মেঘের গম্ভীর নিনাদে ভারী। দোচালা টিনের বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন। উঠোনের চারপাশ ঘেরাও করে আছে নানান প্রজাতির ফলজ বৃক্ষরাজি। মাঝ উঠোনে বসে শিউলি কুলোয় ঝেড়ে আলগা করছেন ধানের কুড়া। ঘন দুপুর। মাথার ওপর চড়া রোদ। ঘামে, ধূলিতে শিউলির পরিশ্রান্ত মুখ বদলে ধারণ করেছে অন্য রঙ। ধান ঝাড়তে ঝাড়তে ক্লান্ত হয়ে একসময় কুলো নামিয়ে রাখেন। নিবন্ত চোখে তাকান সম্মুখের আকাশ পানে। কয়েক হাত দূরে রোদে শুকোতে দেয়া ধান পায়ের সাহায্যে মেলিয়ে দিচ্ছে পাশের বাড়ির খুশি। খুশি শিউলির অগণিত পোষ্যদেরই একজন। খাইয়ে পড়িয়ে, মাস শেষে হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে খুশিকে তিনি নিজের ভক্তকূলের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। তার সাহচার্যপ্রাপ্ত হয়েই ধান ভানা থেকে মশলা বাটা পর্যন্ত সবেতে এখন খুশির অপার দক্ষতা।

আকাশ দেখতে দেখতে আনমনে শিউলি বলেন, ‘কাইল বেইন বেলায় আর ধান রোদে দিস না রে খুশি। বাদলা নামবার পারে।’

‘আইচ্ছা খালা।’

কপালের ঘাম আঁচলে মুছে শিউলি ক্রমশ তার দৃষ্টি নামিয়ে আনেন নিচে। আকাশের নিম্নভাগ জুড়ে ছিন্নভিন্ন সাদা মেঘ, তার নিচে ঘন পাহাড়ের ন্যায় দূরান্তে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সারি, তারও নিচে জমিন…
কিন্তু শুধুই কি জমিন? ওই দূরে ওটা কি দেখা যায়? করতলে একবার নীরস চোখ দুখানা ডলে নিলেন। তারপর আবারো ভালো করে চাইলের মাঠ শেষের ওই দূরান্তের পথের পানে। হ্যাঁ, সত্যিই কারা যেন আসছে এই পথে!

‘ও খুশি, দেখ্তো কেডা আসে।’

ধান নাড়া স্থগিত রেখে খুশি সম্মুখপানে চাইল গভীর আগ্রহে। এক মিনিট.. দুই মিনিট.. হঠাৎ উচ্ছ্বাসে চিৎকার করে খুশি।
‘খালাম্মা ওইডা দেহি আমাগর নিনাদ ভাই! কিন্তু লগে যেন কেডা… লম্বা মতো, বোরকা পরা…
একটু বিরতি নিয়ে,’ ওমাগো! নিনাদ ভাই দেহি বউ নিয়া আইসে! ও খালাম্মা শুনছেন?
দেহেন দেহেন… আইসা দেহেন এইহানে।’

ধান কুলো কুড়া সব ফেলে সচকিত শিউলি সত্বর উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত ভাবে চেয়ে রইলেন একদৃষ্টে পথের পানে। ভেতর টা অল্প অল্প কাঁপছে। অস্বস্তিটা বাড়ছে ক্রমশ। দূরের ছায়াগুলো একসময় দৃষ্টির খুব কাছে চলে এলো। বিস্ময়ের মোহ ভেঙে শিউলি দেখলেন মাত্র কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা!

নিনাদ এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল হাত। অনুতাপ জর্জরিত গলায় অকস্মাৎ ডাকল,’ফুআম্মা.. এহনো রাইগা আছো আমার ওপর?’

শিউলি আজ আর কোথায় যান? কি করে এতদূর চলে আসা ছেলেমেয়ে দুটোকে ফেরান? তবু শতভাগ টললেন না। তিতিক্ষার সালামের জবাবে অল্প হাসি, গলায় সামান্য সৌজন্য মেশানো স্বর, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছোস তোরা?’

এবার তিতিক্ষা এগিয়ে এসে শিউলির অপর হাতটিও ধরল।
‘আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল। কিন্তু আপনাকে ছাড়া পুরোপুরি ভালো কি আর থাকা যায়? আর আপনিও যে আমাদের ছাড়া খুব ভালো নেই তা কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একমাসেই কত শুকিয়েছেন আপনি!’

হুড়মুড় করে একগুচ্ছ আবেগ এসে জড়িয়ে যায় শিউলির চোখে। চোখে বালি পড়েছে হঠাৎ এমন করে আঁচলে দ্রুত চোখ মোছেন।
‘না গো বউ। এইডা তুমার চোখের ভুল। আসো, ভিতরে আসো তুমরা। এতডা রাস্তার জার্নি। আমি শরবত কইরা আনি।’

শিউলির পাশাপাশি হেটে ওরা ভেতরে এলো। আপ্যায়নের অজুহাতে শিউলি উঠতে চাইতেই নিনাদ ফের চেপে ধরল তার হাত।
‘কোথাও যাইবা না তুমি। এহানে বসো। তোমার সাথে অনেক বোঝাপড়া বাকি আছে আমার।’

ভাতিজার ছদ্ম গম্ভীর মূর্তি দেখে শিউলি অকাতরে হাসলেন। ‘ক দেহি, শুনি কি তোর বোঝাপড়া?’

‘তুমি যে আমার ওপর রাইগা আছো এইকথা বলনাই কেন্?’

‘ওমা, পোলার কথা শুনো! রাগ করলে সেই রাগের কথা কেউ মুখে জানান দেয়রে বোকা?’ বলে শিউলি খুব হাসতে থাকেন। সে হাসিতে অস্পষ্ট ভাবে যোগ দেয় তিতিক্ষাও। নিনাদ ক্ষোভিত চোখে দুজনকে দেখে। সম্মোধনে তিতিক্ষাও আছে বলে এইবার আপনা থেকেই ওর মুখ আসে শুদ্ধ ভাষা।
‘তোমরা হাসছো কেন?’

‘এই যে তুই এহনো কতো আলাভোলা আছোস, তা দেইখা হাসি। ভাবছিলাম বিয়ার পর বউয়ের ছায়ায় ছায়ায় থাইকা একটু চালাক হবি। এহন দেখি তোর চেয়ে তোর বউডাও কম বেকুব না।’

‘বেকুব কেন ফুআম্মা?’ তিতিক্ষা না বুঝে প্রশ্ন করল।

‘মানুষ চায় ঝামেলা এড়াইতে। আর তুমরা দুইজন পায়ে হাইটা সেই ঝামেলার কাছে হাজির হইছো। তুমরা বেকুব না তো কি?’

‘দুর! আপনি বুঝি ঝামেলা হলেন?’

‘ঝামেলাই গো মায়া। তুমরা দুইজন সহজসরল বইলাই অতসত পেচগোজ বুঝো না।’
বলতে বলতে তিতিক্ষার গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ান শিউলি।
‘মায়া গো, তুমি বড় ভালা। আমি বুঝবার পারি নাই। পোলার জন্য নিজে পছন্দ করলাম যেই মাইয়ারে, তার চোক্ষেও যহন শেষমেশ আমার জন্য বিরক্তিই দেখলাম তহন মনে হইল শহরের মাইয়া হইয়া তুমি আর তার চেয়ে কত ভালা হইবা?
এহন বুঝি, আমিই ভুল আছিলাম। যাইহোক এহন জলদি জলদি আমার পোলার পাশে একবার বসোতো। দুইজনরে একলগে দেইখা একটু চোখ জুরাই।’ বলে শিউলি নিজেই হাত ধরে টেনে তিতিক্ষা কে বসালেন নিনাদের পাশে। প্রাণ ভরে দেখলেন ওদের।
‘মা শা আল্লাহ। নজর না লাগুক। তোরা দুইডারে আল্লাহ তাআলা সবসময় কল্যাণের সাথে একত্রে রাহুক। আমিন। সুম্মা আমিন।’

শিউলির মুখে সত্যিকারের সুখের হাসি প্রস্ফুটিত হলো। আরো কিছু বলবার আগেই শুনলেন উঠোনে লোকের গুঞ্জন। নিনাদ বউ নিয়ে এসেছে, খুশি নিশ্চয়ই এ খবর এতক্ষণে পাড়ায় রটিয়ে দিয়েছে..

.

বহুকাল পর আজ বড় পরিতৃপ্তির সঙ্গে ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে একবেলা খেলেন শিউলি। পাশের ঘরে এখনো লোক ভীড় করে আছে। পাড়া ভেঙে মেয়ে বউরা এসেছে নতুন বউ দেখতে। তিতিক্ষা সবার সাথেই হেসে হেসে কুশল বিনিময় করছে, তিনি একফাঁকে দেখে এসেছেন। পান মুখে দিয়ে এবার ফিরলেন নিনাদের দিকে।
‘ও নিদু। এইবার তো কিছু একটা ব্যবস্থা করন লাগে।’

‘কিয়ের ব্যবস্থা ফুআম্মা?’

‘বিয়ার পর তুই পরথম বউ নিয়া আইলি। পাড়া পরশিরা সবাই আমারে ধরছে বউভাত করতে হইব। তুই কি কস?’

‘আ.. আমি.. কি বলতাম.. তোমার ইচ্ছা হইলে.. কিন্তু টাকাপয়সা তো সাথে কিছু নিয়া আসিনাই।’ অপ্রস্তুত গলায় বলে নিনাদ।

‘ওমা! টাকার চিন্তা তোরে করতে কইসে কেডা? তোর বাপে যে ফসলি জমি রাইখা গেছিল। ফসল বেইচা তো সেই টাকা প্রতিবছর আমার কাছেই জমা রাখছি। জোর করলেও তুই কহনো নেস নাই। কইসস কোনো সময় বিপদে আপদে দরকার হইলে নিবি। সেহান থাইকা কিছু নিয়া আর বাকিটা আমি দিমু।’

‘না না.. তুমি কেন্? যা লাগে ওইখান থাইকাই নাও তাহলে।’

‘চুপ থাক। আমার ভাতিজার বউভাত। আমি যেভাবে ইচ্ছা আয়োজন করুম। তোর কোনো এখতিয়ার নাই আমারে থামানোর।’

শিউলির হুঙ্কারে নিনাদ দমে যেতে বাধ্য হয়, ‘আচ্ছা.. আচ্ছা… তোমার যা ইচ্ছা।’

.

বিকেল তখন কমলা রঙ ধরেছে। আকাশের দু’ধারে থরে থরে এসে জমেছে সফেন মেঘের পশরা। শরতের বেলাশেষের আকাশে রঙধনুর রঙ, মেদুর বাতাসে ঈষৎ আরাম আরাম আবেশ। তিতিক্ষা পেছন পানে চাইল, ফিঁকে হাসির আভা ঠোঁটের কোণে, ‘আসছি ফুআম্মা।’

‘যাও বাছা। সাবধানে যায়ো। ও নিদু, দেইখা রাখিস আমার বউরে।’

শিউলির শেষ সতর্কবাণীর যথাযথ উত্তর করলো না নিদু। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে ব্যস্ত পদক্ষেপে সামনে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে ওদের দুজনের গমন পথে শিউলি চেয়ে আছেন। যতক্ষণ ওদের ছায়া হারিয়ে না যায় ততক্ষণ চেয়েই রইলেন।
.

‘একি! এই রাস্তায় এত কাঁদা কেন?’

পেছন থেকে নিনাদ দায়সারা উত্তর করে, ‘গ্রামের পথঘাট তো। একটু বৃষ্টি হলেই কাঁদা জমে যায়।’

‘আমাদের কি এর ওপর দিয়েই যেতে হবে?’ ভয়ে ভয়ে জানতে চায় তিতিক্ষা।

হাটতে হাটতে তিতিক্ষা কে ছাড়িয়ে সামনে চলে এসেছে নিনাদ। তার অনুসন্ধানী চোখ আশপাশ ভিড়তে থাকে। শেষে তিতিক্ষার ওপর চোখ স্থির করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে, ‘এছাড়া তো আর পথ দেখছি না!’

নিরুপায় তিতিক্ষা হার মানল, ‘আচ্ছা, আপনি আগে আগে চলুন। আমি পেছন পেছন আসছি।’

‘তুমি শুওর হাটতে পারবে? সমস্যা হলে নাহয় আমার হাত ধরো।’

‘না।’ কড়া উত্তর ভেসে এলো পেছন থেকে।

‘ঠিকাছে, তোমার যেমন ইচ্ছে।’ বড় বড় পা ফেলে কাঁদার ওপর দিয়ে অক্লেশে হেঁটে চলে গেল নিনাদ। তার অনুগামী হতে গিয়ে দ্বিতীয় পদক্ষেপেই তিতিক্ষার পা পড়ল নোংরা জলকাঁদার পাকে।

‘ইন্না-লিল্লাহ। ছিঃ… এবার কি হবে!’

‘কি?’

‘দেখতে পাচ্ছেন না কি?’ নিনাদের বোকা প্রশ্নে সে কটমট করে তাকায়।

‘আগেই বলেছিলাম। আমার হাত ধরো। একলাফে পার করে দিচ্ছি।’

‘বাজে কথা ছেড়ে এখন সমাধান বলুন।’

‘সমাধান একটাই। এই পা নিয়েই হেঁটে বিল পর্যন্ত যেতে হবে। বিলের পানিতে পা ধুয়ে নিয়ো। ব্যস!’

ক্ষণকাল অসহায় চোখে তাকিয়ে রয় তিতিক্ষা। একসময় পরিস্থিতি মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই বুঝে নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘ঠিকাছে তা চলুন…’

.

বিলের আনাচ কানাচ থৈথৈ করছে জলে। জলাভূমির ফাঁকে ফাঁকে তূলনামূলক উঁচু ভিটেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিস্তর ধানক্ষেত। জলের আকাশী রঙের গায়ে মিশে আছে কাঁচাপাকা ধানের হলুদ সবুজ শীষ। তারই অন্যপাশ জুড়ে কচুরিপানা আর বাঁকে বাঁকে ডিঙি নৌকা চলাচল উপযোগী সরু জলপথ। ওপরে আকাশের গায়ে জলরঙের বাহারি শেডের ছোঁয়া।
বিস্তীর্ণ এই বিলের খানিক গভীরে স্থিত পদ্ম ফুলের বিশাল এক বন। আশপাশের কয়েক গ্রামের ছেলেমেয়ের কাছে সে এক দর্শনীয় স্থান।

ওদের ছোট্ট ডিঙি নাও ধীরে ধীরে বিলের সে অঞ্চলের দিকেই এগোচ্ছে। নিনাদ বইঠা বাইছে আর বিলের অপার সুষমাময় রূপ দেখছে। তখন নাওয়ের অন্যপাশে আঁটসাঁট হয়ে বসে তৃতীয় বারের মতো সন্দিহান স্বরে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটাল তিতিক্ষা।
‘আপনি সত্যিই নৌকা বাইতে জানেন তো?’

মুহুর্মুহু এক প্রশ্নে নিনাদ ততক্ষণে চূড়ান্ত মাত্রায় বিরক্ত। চোখেমুখে প্রবল নিরাসক্ত ভাব নিয়ে প্রতুত্তর করল, ‘না জানলেই কি বা করা যাবে? বিয়ে করে মাথায় ভূত হয়ে চেপে বসার মতো এই নৌকাতেও চেপে বসেছো যখন, তখন বুঝতে হবে নৌকা উল্টোলে এখন আমার যা হয় তোমারো তাই হবে।’

‘মানে?’

‘কোনো মানেফানে নেই।’

‘আমি আপনার মাথায় ভূত হয়ে চেপে আছি?’

‘সরি, ভূত না। পেতনি হয়ে।’

‘কিহ! আপনি…’ রাগে তোতলাতে আরম্ভ করে তিতিক্ষা।

‘হ্যাঁ আমি…’

‘এ.. এ একটা অসভ্য লোক আপনি!’

‘এই কথাটা আর কতবার বলবে? সেই কলেজের সময় থেকে শুনছি আমি নাকি মহা মহা অসভ্য। অথচ অসভ্যতাটা কি করেছি আজও জানলাম না!’

‘এখন যা করছেন সেসব কি অসভ্যতা নয়?’

‘এই যদি হয় তোমার দৃষ্টিতে অসভ্যতা, তাহলে বলতে হয় অসভ্যের সঠিক সংজ্ঞাই তুমি জানো না।’

প্রতি উত্তর করতে গিয়েও তিতিক্ষা দমে। তর্কে আজ কিছুতেই নিনাদকে পরাস্ত করতে পারছে না বুঝতে পেরে একেবারে নিরব থাকাই স্থির করে।

.

আরো কিছুটা এগোতেই জলাভূমির ভেতর ছোট ছোট দ্বীপের মতো অসংখ্য মাটির উঁচু ঢিবি নজরে পড়ে ওদের। বিকেল শেষে পাখিরা সেসব নির্জন ক্ষুদ্রকায় দ্বীপে বসেছে দিনান্তের শেষ আহারের সন্ধানে।

‘দেখুন দেখুন ওইযে বক!’ তিতিক্ষা কিশোরির মত উচ্ছাসে ভেসে হাতের ইশারায় একঝাঁক বক দেখালো।

‘দেখেছি’

‘ওটা কি পাখি? হাঁসের মতো দেখতে আবার আকাশে উড়ছে..’

‘ওগুলো পাতিহাঁস।’

‘আর দূরে কুব কুব শব্দ করছে যে পাখিটা?’

‘কুব পাখি।’

‘আপনি সব চেনেন?’ ভারী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে তিতিক্ষা।

‘গ্রামের ছেলেমেয়ে মাত্রই এসব চেনে।’

প্রকৃতির বিমোহন মাধুর্য দেখতে দেখতে অন্যরকম উৎসন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল তিতিক্ষার মন। অন্যমনস্ক ভাবে একসময় বলে, ‘মণীদ্র গুপ্তের সেই বিখ্যাত আত্মজীবনীতে প্রথম পড়েছিলাম কুব পাখির নাম। নামের সঙ্গে এর ডাকের যে এত মিল হতে পারে ভাবতেই পারিনি!’

‘আত্মজীবনীর নাম?’

‘অক্ষয় মালবেরি’ নামটা সুন্দর। তাই না?’

একহাতে বইঠা সামলে অন্যহাতে চুল ঠিক করতে করতে নিনাদ গম্ভীর মুখভাব করে বলে, ‘হুম।’

‘নামের মতোই বইটাও ভীষণ সুন্দর জানেন! আমার খুব প্রিয় বই। সুযোগ পেলে বইটা আমি এখনো পড়ি! নির্দিষ্ট কোনো অংশ নয়। বই খুলে প্রথম যে পৃষ্ঠা চোখে পড়ে, পড়া শুরু করি।’ প্রিয় বইয়ের কথা বলতে গিয়ে আনমনে হেসে ফেলে তিতিক্ষা। নিনাদ ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে খেয়াল হতেই গম্ভীর হবার মিথ্যে চেষ্টায় রত হয়।

‘কি হলো?’

‘হবে আবার কি?’

‘বন্ধ করলে কেন?’

‘কি বন্ধ করলাম?’ তিতিক্ষা অসস্থি নিয়ে জিজ্ঞেস করে। সে বুঝতে পারছে না আজ এত বেশি কথা কেন বলছে!

‘কথা বলা বন্ধ করলে কেন তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। শুনতে তো বেশ…’ বেফাঁস কিছু বলে ফেলছে বোঝা মাত্র চুপ হয়ে যায় নিনাদ।

অপ্রতিভ হয়ে তিতিক্ষাও ফেরে অন্যপাশে। মিনিট পাঁচেক পর পদ্ম বিলের প্রথম দৃশ্য নজরে আসতেই আবারো চেঁচায়।
‘ওটাই বুঝি পদ্মবিল? এতো ফুল একসাথে ফুটেছে! সুবহানাল্লাহ।’

বিলের এই দিকটা বেশ শুনশান। কোনো কোনো জায়গায় পদ্মবিলের মাঝখান দিয়েই মাটির ঢিবিতে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় কাশফুল। কাশফুলের বন কয়েকটা আড়াল সৃষ্টি করেছে বিলের মধ্যে। দু’ধারে জেগে ওঠা কাশবন আর মাঝের জলে প্রস্ফুটিত বড় আকৃতির কিছু পদ্মফুল সমেত সরু খালের মতো স্থানটা দেখিয়ে তিতিক্ষা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’ওদিকে যাওয়া যায় না?’

‘সবদিকেই যাওয়া যায়।’ শুনে দ্বিতীয় আর কোনো প্রশ্ন কিংবা অনুরোধ করল না তিতিক্ষা। একপাশে ঝুঁকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পদ্মফুল তোলায়। হাতভর্তি ফুল নিয়ে যখন সামনে ফিরল, চমকিত হয়ে দেখল ওদের ডিঙি নাও সেই খালের ধারেই যাচ্ছে। মানুষটার অনুগ্রহে সে কৃতজ্ঞ না হয়ে পারল না। ফলস্বরূপ শত চেষ্টার পরও মুখ এঁটে রইল চাপা উচ্ছ্বাস মাখা হাসি।

.

নির্জন বিলমধ্যে তখন আস্তে আস্তে নেমে আসছে সন্ধ্যের অন্ধকার। নিনাদ নাও ঘোরাতে ব্যস্ত। অনেকক্ষণ হলো তিতিক্ষাও নিশ্চুপ। একসময় নিনাদের কানে আসে একা একা বিরবির করে কি যেন বলছে মেয়েটা। চেয়ে দেখে জলের ওপর ঝুঁকে ও গভীর ধ্যানে কিছু একটা দেখছে।
হঠাৎ সোজা হয়ে বসে। আশাহত চোখে পেছনে ফেলে আসা খালের শেষ প্রান্তে তাকিয়ে অন্যমনে বলে, ‘ওই ফুলগুলোর রঙ অন্যগুলোর চেয়ে একদম আলাদা। বোধহয় অন্য কোনো প্রজাতির পদ্ম। না?’

‘হুম’ নাও ঠিক করতে করতে তিতিক্ষার অন্যমনস্ক ভাব খেয়াল করতে থাকে নিনাদ।

‘খালের ওই পাশটা তো বেশ সরু। ওদিকে বোধহয় যাওয়া যায় না…’

‘যায়.. তবে নাওয়ে করে নয়।’

‘তাহলে কিভাবে? ‘

‘সাঁতরে।’

‘ও আচ্ছা… ‘ এবার আরো মলিন হয় তিতিক্ষা।

‘কি হয়েছে? ফুল লাগবে?’

সে ঝট করে উত্তর দেয়, ‘না না!’ অপ্রস্তুত হেসে দ্রুত চোখ ফেরায় সেদিক থেকে। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বলে, ‘একটা মজার ঘটনা মনে পড়েছে। ছোট বেলায় একবার নানুবাড়িতে গিয়ে এমনি এক পদ্ম বিলে ঘুরতে গেছিলাম আমরা। ভাড়ার নৌকায় করে। নৌকা থেকে দূরে একটা ফুল ভালো লেগেছিল আমার। কিন্তু মাঝি সেদিকে যেতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। বাবা তখন কি করল জানেন? ধুপ করে ঝাপ দিল জলে। আমরা সবাই তো চিৎকার জুড়ে দিয়েছি ভয়ে। কিন্তু কয়েক মিনিট পেরোতেই দেখি বাবা ঠিক ওই ফুলটাই সাঁতরে নিয়ে ফিরে আসছেন। দেখে সবার কি খুশি! জানেন, ওই ফুলটা এখনো আমার কাছে আছে! শুকিয়ে রেখে দিয়েছি ডায়েরিতে।’

ওরা তখন ঘন কাশফুলের বনে ছাওয়া একটা বাঁক পেরোচ্ছে। সরু সেই খাল পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে অনেকটা দূর। বাঁকের জন্য খালের কোনো অংশ এখন আর নজরেই পরছে না। সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে ঘন। নাওয়ের শেষ প্রান্তে জলে পা ডুবিয়ে বসে তিতিক্ষা আয়েশ করে দেখছে জলের সূর্যাস্ত। হঠাৎ পেছনে একটা ভোতা আওয়াজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠল ডিঙি। ডিঙিটা অতিশয় ক্ষুদ্র বলে নড়াচড়া করতে হয় খুব সাবধানে। দেখেশুনে ঘুরে বসল তিতিক্ষা। অতঃপর সামনে তাকিয়ে যা দেখল হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার জন্য সেটা যথেষ্ট। বৈঠা যথাযথ স্থানে পড়ে আছে কিন্তু নিনাদ কোথাও নেই!

প্রথমে ধীরে ধীরে তারপর শব্দ করে তিতিক্ষা ডাকতে আরম্ভ করে নিনাদকে।
‘নিনাদ…’
‘কোথায় আপনি?’
‘নিনাদ… অ্যাই নিনাদ… শুনছেন আমার কথা?’
নানান দুর্বিনীত অভিশঙ্কায় স্বর কেঁপে ওঠে তার। মনষ্যবিহীন নিরালা বিলের মাঝে হতবিহ্বল হয়ে পাগলের মতো এদিক সেদিক ফেরে নিনাদের সন্ধানে। ওর ব্যস্ত সঞ্চালনে ছোট্ট নাও ঘনঘন বিলের জলে তরঙ্গ তোলে। সে যে সাঁতার জানে না, এত দোলালে নৌকাটা যে হঠাৎ উলটে যেতে পারে এসব আশঙ্কার বেমালুম বিস্মৃত হয় তিতিক্ষা। সহসা ওর সন্দেহ হয় মানুষটা জ্ঞান টেন হারিয়ে জলে পড়ে যায়নি তো? নয়তো নিমিষের মাঝে কোথায় হারাবে?

চিন্তাটা মস্তিস্কে ঠাই পাবার সঙ্গে সঙ্গে তিতিক্ষা ঝুঁকে পড়ল জলে। জলে কতরকম তরঙ্গ খেলা করছে, দিক দিক ছড়িয়ে যাচ্ছে তার আওয়াজ। কত বিচিত্র প্রাণীর অস্তিত্বও সেখানে। আর সেই জলেই চিরকালের ভয় তিতিক্ষার। কিন্তু সব ভুলে পদ্মপাতার ফাঁকে ফাঁকে হাত গলিয়ে আজ জলের গভীরে একটা গোটা মন্যষদেহ খুঁজে বেরাচ্ছে সে।
‘ইয়া আল্লাহ সাহায্য করুন। ইয়া আল্লাহ সাহায্য করুন। লা ইলাহা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ্ জ্বলিমিন…’
বির বির করে বলতে বলতে চোখের জল মোছে তিতিক্ষা। মুখের ওপর থেকে কখন নিকাব সরে গেছে সে হুশও থাকে না। তখন প্রচন্ড বেগে নৌকাটা দুলে ওঠে আবারো। তিতিক্ষা মুখ ফিরিয়ে দেখে গলা পর্যন্ত জলে ডুবে দাঁড়িয়ে আছে নিনাদ। হাতে একগুচ্ছ ফুল।

তিতিক্ষার বিমূঢ় মূর্তির সামনে আস্তেধীরে নিনাদ নাওয়ে উঠে এলো। গায়ে লেপ্টে থাকা জলজ লতাপাতা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,’কি হলো? এমন হা করে তাকিয়ে আছো কেন?
একি! কাঁদছিলে নাকি?’

এতক্ষণে কথা ফোটে তিতিক্ষার নির্বাক মুখে। ‘আ প নি… তারমানে আপনি ইচ্ছে করে… ‘

‘হ্যাঁ মানে… ফুল আনতে গেছিলাম খালের কাছে …’

‘ফুল আনতে! আপনি ফুল আনতে গেছিলেন! আর এদিকে আমি… ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম আমি!’ আক্রোশের আতিশয্যে আবারো জল গড়ায় তিতিক্ষার চোখ থেকে।

‘কি আশ্চর্য! এতো রাগছো কেন? শুধু তো কয়েক মিনিটেরই ব্যাপার। এজন্য জানিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।’

‘আপনি বলেননি আর আমি ভেবেছি সাঁতার না জেনে পানিতে পড়ে এতক্ষণে…’ কথা শেষ না করেই চোখ মুছতে আরম্ভ করে তিতিক্ষা। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখে নিনাদ মিটমিটিয়ে হাসছে।

‘হাসছেন কেন?’ সে ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন ছোড়ে।

‘ভাবছি কত বোকা হলে কেউ এমন ভাবনা ভাবতে পারে!’

এই শেষ অপমানটা সহ্য হলো না তিতিক্ষার। জল থেকে এক এক করে উঠিয়ে জমা করা পদ্মফুল গুলো হাতের নাগালেই ছিল। নিয়ে ছুড়লো নিনাদকে লক্ষ্য করে।
‘আমাকে বোকা বলছেন আপনি? আমি কি করে জানব আপনার মতলব কি ছিল?’

নিনাদ হাসতে হাসতে বলে, ‘সে নাই বা জানলে। কিন্তু গ্রামের ছেলে হয়ে আমি সাঁতারও জানব না এমন ধারণা কি করে হলো?
উঃ কি সৌভাগ্য আমার! রেগে গেলে মানুষের বউ ছোড়ে আলো টমেটো নয়তো জুতো। আর আমার বউ ছুড়ছে ফুল! বাপরে!’

কিছু বলতে গিয়েও তিতিক্ষা থামে। ঠোঁটের কোণে আভাসিত হাসি গোপন করা মুশকিল হয়ে পড়ে ওর জন্য।

‘যাইহোক, এখন জলদি জলদি ফুলগুলো নিয়ে আমায় উদ্ধার করো। হতচ্ছাড়া ফুলের জন্য বউয়ের মারও আজ কপালে জুটল।’

‘ফুল ছু্ড়ে মেরেছি বেশ করেছি!’ বলে ফুলগুলো হাতে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে দেখে তিতিক্ষা। উদার গলায় বলে, ‘ফুল এনেছেন এজন্য শুকরিয়া। তবে জেনে রাখবেন এই ফুলগুলো যত সুন্দর আপনি তত বাজে।’

‘জানি জানি। এই বদনাম আর জীবনে ঘুচলে হয়… ‘

‘কিসব বলছেন বিরবির করে?’

‘কিছু না।’

‘এখন জলদি জলদি পাড়ে চলুন। মাগরিবের সময় হয়ে গেছে।

‘যাব… তার আগে একটা শেষ কথা শুনবে?’ নিনাদের স্বরে কিঞ্চিৎ আবদারের সুর।

‘কি?’ ফুল দেখতে ব্যস্ত তিতিক্ষা আড়চোখে তাকায়।

‘এই ফুলগুলোও শুকিয়ে রাখবে ডায়েরির ভাঁজে?’

চলবে….

দূর আলাপন (শেষ অংশ)

—————————–
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শিউলির উঠোন আজ জনারণ্য। একাধারে গোল হয়ে বসে মেয়েরা সবজি কুটছে, অন্যধারে মশলা বাটছেন জনাকতক মধ্যবয়সী। খোশগল্প আর গুঞ্জনে মুখর সারাবাড়ি। খুশির ভাই সজীবকে শিউলি শেষ রাতে পাঠিয়েছেন আড়ত থেকে বড় দেখে গোটাকতক মাছ আনতে। এই ভোরবেলা মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে বাকিসব কাজের তদারক করছেন তিনি। রান্নাঘর থেকে ভুরভুর করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে নজরে আসতেই এবার চপল পায়ে ছুটলেন সেদিকে।

নতুন বউয়ের ইচ্ছে সবাইকে চা করে খাওয়ায়। শহুরে মেয়ে, মাটির চুলোয় কি করে রাঁধতে হয় জানে না। কিন্তু বউয়ের রান্নার বড় শখ। শুনে শিউলি বেশ তৃপ্ত হলেন। যদিও শুরুতে নিষেধ করেছিলেন। কে জানে, গনগনে আগুনের আঁচে মোমের মতো গাত্র না আবার পুড়ে মলিন হয়। কিন্তু ওই মুখের মিষ্টি অনুরোধে শেষতক নিমরাজি হতেই হলো।

রসুইঘরে উঁকি দিয়েই শিউলি চমকিত হন। লাকড়িজ্বলা ধোয়ায় কাশতে কাশতে, নাকের জলে চোখের জলে একাকার হয়েছে বউয়ের মুখ।
‘দেহি বউ সরো সরো। আমি করতাসি।’

তিতিক্ষাকে জোর করে তুলে তার স্থানে নিজে বসলেন শিউলি।
‘শহরের মাইয়া হয়া লাকড়ির ধুয়ায় কি তুমরার অভ্যাস আছে? দেহি, কি সর্বনাশ! এত কালি ভরাইলা কেমনে? যাও, জলদি গিয়া কলপাড়ে মুখ ধুয়া আসো।’

‘আর একটু…’

‘না না… এহনি যাও। গায়ের রঙ জ্বইলা যাইব যে। চা নামায়া আমিই তুমারে ডাকমু। তহন নাহয় সবাইরে দিয়া আইসো।’

অগত্যা তিতিক্ষা কে উঠতে হয়। মুখ হাত ধুয়ে এক পা দু পা করে রসুইঘরের চালার পাশে দাঁড়িয়ে সে বিস্ময় নিয়ে দেখে গোটা বাড়ি ঘিরে চলতে থাকা অতগুলো মানুষের অবিরাম ব্যতিব্যস্ততা। কত মানুষ, কত হাসি আর কত তাদের আয়োজন। মানুষে মানুষে এমন মিল সে আর দেখেনি কোথাও। অনুষ্ঠান এক বাড়ির অথচ কাজ করছে পুরো পাড়ার সব মেয়ে বউ।

বেলা বাড়লে বাড়তে থাকে সমারোহ। বাড়ে ওদের শশব্যস্ত ভাব আর গল্পের ডালপালা। ঘরে বসে বাইরের পৃথিবীর সেসব মিশ্র শব্দ তিতিক্ষা নিঃশব্দে শোনে। কখনো একা একা বাক্য বিনিময় করে রিনরিনের সাথে। শিউলি ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। আজকের আয়োজন তাকে ঘিরে। অনুষ্ঠান শুরু হলে এমনিই তো আত্মীয়ারা দেখবে। তার আগ পর্যন্ত ঘরে থাকাই শ্রেয়।

ঘড়ির কাঁটা যখন বারো ছুই ছুই। বাইরে তখন হঠাৎ একটা শোরগোল পাওয়া গেল। আনমনা তিতিক্ষা রিনরিনের পাশে গালে হাত রেখে বসে ভাবছিল নিজের পরিবারের কথা।
‘জানো রিনরিন? বাবাকে ছেড়ে কখনো এত দিন দূরে থাকিনি আগে। বুবুকে ছেড়েও না। ভীষণ মনে পড়ছে ওদের কথা। ছেলে আর সংসার নিয়ে বুবুর নিশ্চয়ই এখন ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে? এত ব্যস্ত যে একটা কল করার ফুরসত পর্যন্ত নেই! অথচ আমাদের এখানে আসার পেছনের মূল হোতা কে বলতো?
সেই বুবুই!
আফরিনের সঙ্গে কথা বলে ফুআম্মার অভিমানের ব্যাপার টা নিশ্চিত হলাম যখন, তখন বুবুই পরামর্শ দিয়েছিল বুঝলে? ফুআম্মার রাগ ভাঙানোর জন্য যেন সোজা এখানে চলে আসি…’

অকস্মাৎ হৈচৈয়ে মোহ ভাঙলে রিনরিনকে ছেড়ে লঘু পায়ে তিতিক্ষা এসে দাঁড়ায় জানালার কাছে।
উঠোনে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। দূর থেকেও তাদের ছেড়া ছেড়া কথা ভেসে এলো তার কানে। তারপর অল্প কিছুকাল, আচমকা জানালার গরাদ ছেড়ে তিতিক্ষা ছোটে দরজার অভিমুখে। কপাট খুলে আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রহর গোণে, সবচেয়ে কাছের, সবার চেয়ে পছন্দের মানুষ টা কখন আসবে ওর সনে দেখা করতে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা রত থাকতে হলো না। সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষ করেই মেয়ের খোঁজ জেনে মারুফ ঘরের দাওয়ায় উঠে এলেন।

‘আসসালামু আলাইকুম। আমার আম্মাজান কেমন আছে?’

দরজার পেছন থেকে বেরিয়ে তিতিক্ষা অস্পষ্ট গলায় সালামের জবাব দেয়। চোখে গড়ায় জল।

‘ছি ছি আম্মাজান। শশুর বাড়ির লোকের সামনে বাবাকে দেখে অমন করে কাঁদতে আছে? ওরা ভাববে মেয়ে নিশ্চয়ই ছিচকাঁদুনি। কেঁদে কেঁদে বাপকে আমাদের নামে বিচার দিচ্ছে!’

‘ভাবলে ভাবুক!’

‘হা হা.. কি বলে আমার মা! শুনলাম এখানে এসেও আমার মা নাকি খুব মন মরা হয়েছিল? বেয়ান অনুরোধ করলেন চলে আসতে। তা মেয়েকে দেখার এমন সুযোগ ছাড়ি কি করে? চলে এলাম। ভালো করিনি?’

দু পা এগিয়ে বাবার হাত ধরে তিতিক্ষা, ‘খুব ভালো করেছো বাবা। আফরিন আর মিমহাজ ভাইও তো দেখলাম এসেছে। কিন্তু তুমি একা যে? বুবুরা আসেনি?’

‘আসেনি আবার! তোর বুবু এসেই বাকিদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে হেশেলে ঢুকেছে যে।’

‘আমার সঙ্গে দেখা না করেই সোজা হেশেল?’

‘তোর মায়ের মেয়ে না? হেশেলের গন্ধ পেলে ওর কি হুশ থাকে? রেহনুমাও এমন ছিল। রান্নার ক্ষেত্রে নো কম্প্রোমাইজ! হা হা…’

.

শাড়ি দেখে হারিয়ে গেল তিতিক্ষার মুখের রঙ।
‘এতো জমকালো শাড়ি! আরেকটু সাদামাটার মধ্যে পেলে না বুবু?’

তিহা দমে না। শাড়ি নিয়ে যে ছোট বোনটি প্রশ্ন তুলবে এ তার জানাই ছিল। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,
‘আরে অত ভাবলে চলে? বিয়ে জীবনে মাত্র একবার। একটু সাজগোছ করবি না?’

‘বিয়ে! বিয়ে কোথায়? এ তো ওয়ালিমা।’

‘ওই একই হলো।’

দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে তিতিক্ষা গম্ভীর হয়।

‘কিরে রাগলি নাকি? মাত্র তো একটা দিন। পড়ে নে না।’

‘ঠিকাছে পড়ব। কিন্তু এক শর্তে।’

‘কি?’

‘অন্য কেউ নয়। আমার সাজ আমি নিজেই সাজবো।’

‘বলিস কি! বউ সাজাতে পার্লারের মেয়েরা এসে বসে আছে যে।’

‘ওদের খাইয়ে দাইয়ে বিদায় করে দাও।’

‘পাগল হলি?’

‘হইনি তবে ওদের কাছে সাজলে হবো নিশ্চয়ই।’

‘নিদুটার সঙ্গে সারাক্ষণ তর্ক করে করে একেবারে তার্কিক বনে গেছিস তুই। বুঝলি!’

‘বুঝলাম’

‘বড় বোনের কোনো ইচ্ছের মূল্য নেই তোর কাছে…’

‘এও বুঝলাম!’

‘বড্ড দেখছি বাচাল হয়েছিস!’

‘তুমি তো তাই চেয়েছিলে।

‘আমি! কবে? কখন?’

‘যখন একা ঘরে বসে কাঁদতাম, তখন যে বারবার বলতে ‘কথা বল তিতি। তোর যা ইচ্ছে তাই বল। তবুও শুধু কথা বল…..’

‘ফের ওসব কথা মুখে আনছিস?’

‘ওসবও তো জীবনেরই অংশ। পুরোপুরি ভুলে যাই কি করে বলো? ‘

‘আচ্ছা আয় বুবুর কাছে। বুবু আদর করে দিচ্ছি।’

তিতিক্ষা এসে বোনের কোলে মাথা রাখে। আলতো হাতে ওর চুলে বিলি কেটে দেয় তিহা।

সস্নেহ গলায় বলে, ‘তিতি, আমার ওপর তোর কোনো রাগ নেইতো?’

‘না তো। রাগ কেন থাকবে?’

‘এইযে, তুই চাইছিলি না তবুও নিদুর সঙ্গে তোকে জুড়ে দিলাম। হয়তো ভেবেছিস তোর চেয়ে নিদুর ভাবনাটাই আমার বেশি।
না রে। আসলে ব্যাপার ঠিক উল্টো। নিদু যেমনি হোক, কিন্তু ওর কাছে তোর একটা বিশেষ মূল্য আছে। অনেকদিন ধরে তো ওকে চিনি। এসব অল্প অল্প টের পাওয়া যায়। তাই একসময় মনে হলো আর কেউ না হোক, আল্লাহ চাইলে হয়তো নিদু তোকে ভালো রাখতে পারবে। সৃষ্টিগত ভাবে দুর্বল আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই হয়তো তারও কখনো তোর প্রতি বিরাগ বিতৃষ্ণা আসবে। ঝগড়া, মনকষাকষি তোদের মধ্যেও হবে। কিন্তু দিনশেষে নিনাদ জানবে তুই ওর শেষ গন্তব্য। এর পথটা কিন্তু দুর্গম। তোকেই তৈরি করে নিতে জানতে হবে। এমন আসনে অধিষ্ঠিত হতে হবে যেখান থেকে চাইলেই কেউ টেনেহিঁচড়ে নামাতে পারে না।’

‘কিরে?’

‘কি…’

‘চুপ করে আছিস যে? পারবি তো এমন কেউ হয়ে দেখাতে?’

‘জানি না বুবু…’

‘ধুর, তোর মধ্যে কোনো কনফিডেন্স নেই।’

‘নাইবা থাকল।’

‘নিদুটার কপালই দেখছি মন্দ।’

‘সে আর বলতে!’

‘ফের মুখে মুখে কথা!’

‘আচ্ছা আফওয়ান’

‘তাহলে এতক্ষণ যা বললাম, একদিন সত্যি হয়ে দেখাবি বল?’

‘আচ্ছা বাবা। হবো হবো হবো…’ বলে তিতিক্ষা বোনের গাল টিপে দেয়।

তিহার অস্ফুট স্বরে মেকি বিরক্তি ঝরে, ‘উফফ দিনে দিনে কিযে হচ্ছিস তুই…। পেতনীর রাণি একেবারে!’

‘তুমিও আমায় পেতনী বললে?’

‘আমার আগে আরো কেউ বলেছে নাকি?’

‘কি হলো কথা বলিস না কেন?’

‘তোমার বন্ধু বলেছে।’

‘এতো বড় সাহস নিদুর! আমার বোনকে পেতনী বলে! আচ্ছা যা তুই পেতনী হলে ও একটা মেছো ভূত। শুধু মেছো ভূত না মেছো ভূতের সর্দার!’ শুনে হেসে ওঠে তিতিক্ষা।

‘আবার হাসি! বিশ্বাস কর, মিথ্যে বলছি না রে। হাসলে তোকে সত্যি পেতনীর মতো দেখায়!’

‘ভালো, তবু আমি হাসবো।’ বলে আবারো হাসে তিতিক্ষা।

বোনের দিকে অপলক চেয়ে থেকে তিহা চোখের জল মোছে। মনে মনে প্রার্থনা জানায় রবের কাছে,’ইয় রব, আপনি এই হাসির রেখা আর কখনো ম্লান হতে দিয়েন না। চিরটা কাল আমার বোন যেন এভাবে দ্বিধাহীন হাসতে পারে।’

.

কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই সম্পন্ন হলো সমস্ত আয়োজন। উঠোনের একাধার জুড়ে টানানো শামিয়ানার নিচে জোড়ো হওয়া শতেক মানুষের হাসিতে, গুঞ্জনে, কল্লোলে সন্ধ্যাতক মুখর রইল সারাবাড়ি। পাড়াপড়শি মেয়েবউরা কনে দেখতে এসে কত রঙ বেরঙের গল্প আর অশেষ দুআ রেখে গেল তিতিক্ষার জন্য। তবে সন্ধ্যে নামতেই ওদের সব কলরোলে যেন ভাটা পড়ল। গ্রামের চিরাচরিত জীবন রীতি অনুসারে সন্ধ্যের পরই গৃহস্থরা ধীরে ধীরে রাত্রির বিশ্রামের আয়োজন শুরু করে। তাছাড়া সারাদিন স্বেচ্ছায় কাজে অংশগ্রহণ করে ওরা তখন ক্লান্তও ভীষণ। ফলাফল রাত আটটা বাজতে না বাজতে ফাঁকা হয়ে গেল উঠোন।

ভেতর বাড়িতে তখন যদিও অন্য চিত্র। শিউলির দোচালা টিনের বাড়ির ঘরে ঘরে জমেছে রমরমা আড্ডার আসর। মিনহাজ রওশান নিনাদ আর শহর থেকে আগত নিনাদের জনাকতক বন্ধুর সহযোগে ওদের গল্পগুজব তখন তুঙ্গে। একের পর এক নাশতার ট্রে যাচ্ছে আর খালি হয়ে ফিরে আসছে। সজীব আর খুশি ভাইবোন দুজনে অক্লেশে অক্লান্তভাবে আপ্যায়ন করে যাচ্ছে সবাইকে। একঘর পরের চিত্রও তাদৃশ।

খুশির বয়োবৃদ্ধ দাদি গল্প বলায় ওস্তাদ। প্রাচীন মানুষ, ঝুলিতে অদ্ভুত গল্পের অভাব নেই। তিনি এক একটি অদ্ভূতুরে কাহিনি নিজের ঝুলি থেকে বের করেন। আর সবাই মুখিয়ে ওঠে শোনার জন্য। গরম গরম পেয়াজু আর চানাচুরে মাখানো বোলভর্তি মুড়ি ভর্তা মাঝখানে রেখে ওরা গোল হয়ে বসেছে খাটের চারপাশে। শিউলির গা ঘেঁষে তিহা আর বিছানার উল্টোপাশের দেয়ালে হেলে আফরিন। বুড়ির কথাতে সামান্যমাত্রায় হাস্যরস পেলেই হাসতে হাসতে সে এলিয়ে পড়ছে এর ওর গায়ে।

এবার একটু কনের কাছ থেকে ঘুরে আসা যাক।

বাড়ির শেষ কামরা, দোচালা ঘরের কয়েক হাত দূরে একটা আলাদা একচালা ঘরে স্থান হয়েছে তিতিক্ষার। বলা ভালো মাথা ব্যথার প্রাবল্যে ও নিজেই গল্পের আসর ছেড়ে ঠাই নিয়েছে এখানে। সে এখন গুরুতর ভাবে জবড়জং এই শাড়িখানা ছুড়ে ফেলার পায়তারা খুঁজছে। জানলে ফুআম্মা রাগ করবেন নিশ্চিত তবে ভাদ্রের উত্তাপে, মাথার যন্ত্রণায় আর শাড়ির ওজনে ওর অবস্থা এখন বিভীষণ। আরেকটু হলে যেন মাথাটাই ব্যথায় ছিড়ে পড়ে যাবে ঘাড় থেকে। পরিস্থিতি এমন যে কারো রাগ জেদের পরোয়া করলে আর চলছে না।

মাথা ব্যাথায় ওষুধ সে খায়না কখনো। একটু ঘুমোতে পারলে হয়তো ব্যথাটা কমে যেত। অথচ এখনো এশার সলাত বাকি। বাকি বোধহয় আরো অনেক কিছু। হয়তো খানিক পরেই শিউলি এসে ডেকে বলবেন ভাত খেতে চলো, নয়তো মুরুব্বি কেউ এসেছে শুনে দেখা করতে চলো…
বিরক্তিতে দুহাত কপালে চাপে তিতিক্ষা। কি রেখে কি করবে তা ভেবে উঠতে পারে না কিছুতেই। ঘরজুড়ে পায়চারি করতে করতে শেষে সিদ্ধান্ত নেয় শাড়ি বদলে সলাত পড়ে ও এখন একটু ঘুমোবে। যা হবার হোক…

.

তখন নিশুতি রাত। সারাদিনের কর্মব্যস্ত বাড়ি রাতের অন্তিম হাতছানিতে ঢলে পড়েছে গভীর গাঢ় সুষুপ্তির কোলে। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে কোলাহলে মত্ত ঝিঁঝিঁর দল। দূরের বনের ওপারে বিরহিণীর করুণ সুরে গান ধরেছে সন্তানহারা একজোড়া ডাহুক। নির্জন নিশীথের রহস্যে ক্রমে এসে মিশে যাচ্ছে ঘনঘোর আঁধারের বিভ্রম। রাত্রী তার রহস্যের উত্তরীয় উন্মোচন করে আবরণে ঢেকে দিচ্ছে সমস্ত ঊষর চরাচরকে…

একা ঘরে হঠাৎ ছুটে গেল তিতিক্ষার ঘুম। চোখ মেলতেই ওর চারপাশে একটা ভয়ের চিত্রপট রচিত হলো। অন্ধকার ঘর, একবিন্দু আলো কোথাও নেই, দূরে কোথায় যেন অবিশ্রান্ত ভাবে ডেকে চলেছে একদল শেয়াল। রাতের নিবিড়তা ভেঙে দেয়া সে ডাক শোনায় কি ভয়াবহ! তড়াক করে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তিতিক্ষা। নিজের বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শব্দটা ও এত স্পষ্ট শুনতে পেল যে চমকে উঠল। সেখানে দাঁড়ালো না আর এক মুহুর্ত। দরজার নিচ গলিয়ে আসা একফালি চাঁদের আলো অনুসরণ করে ছুটে এসে হাতড়াতে হাতড়াতে খুললো দরজার কপাট। তারপর এক পা চৌকাঠের বাইরে রাখতেই আবারো গা হিম!

একটা মনুষ্যমূর্তি চৌকাঠের নিচে দুইধাপ বিশিষ্ট সিড়ির একপাশে, সিমেন্টের মাচায় বসে আছে। দেখামাত্র কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যাহ জায়গায় জমে যায় তিতিক্ষা। পর পর কয়েকটা বিট মিস করে শীতল গলায় সাহস করে জিজ্ঞেস করে,’কে?’

মনুষ্য মূর্তি উঠে দাঁড়ায়। ফেরে ওর পানে। পিছিয়ে যেতে গিয়েও তিতিক্ষা থমকায়।
‘আপনি!’

নিনাদের শান্ত প্রতুত্তর, ‘ঘুম ভেঙেছে তাহলে?’

‘হ্যাঁ.. মানে… আ… আপনি এতরাতে এখানে বসে আছেন যে? রাত ক’টা বাজে? আ আমি কি এতক্ষণ ধরেই পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছি?’

‘বেশি নয়। মাত্র বারোটা দশ। ঘুমিয়েছ ভালো করেছো। তোমার মাথা ব্যথা কি কমেছে?’

‘হ্যাঁ… আলহামদুলিল্লাহ…’

‘হাটতে পারবে?’

‘পারবো…’

‘তাহলে এসো আমার সাথে।’

‘কিন্তু… এতরাতে কোথায়.. ‘

‘আমার ওপর ভরসা নেই?’

নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকে তিতিক্ষা। কিয়ৎকাল অপেক্ষা করে নিনাদ একসময় হাত বাড়ায় ওর দিকে।’

উঠোনে নেমে হাত ধরতে গিয়েও তিতিক্ষা ফের থামে, ‘বাইরে যাব? বোরকা পড়িনি যে!’

‘বোরকা!’ নিনাদ এবার একটু শব্দ করেই হাসে। ‘এতরাতে কে দাঁড়িয়ে আছে তোমার পর্দা নষ্ট করার জন্য বলতো?’

‘কিন্তু… ‘

‘শোনো, এটা শহর নয় যে আধরাত পর্যন্ত লোকজন কাজের জন্য বাইরে থাকবে। এ হলো গ্রাম। ঘোর গ্রাম। এখানে রাত নটা’র পর কোনো জনপ্রাণীই গুরুতর প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোয় না।’

‘এখনো আমার কথায় সন্দেহ আছে? আচ্ছা থাক, তাহলে বরং…’

‘যাবো।’ বলে দ্রুত প্রাঙ্গণে নেমে আসে তিতিক্ষা। চাঁদের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে তার শাড়ি। নিনাদ একবার তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকায়।
‘শাড়ি পড়ে হাটতে অসুবিধে হবে না তো?’

‘হলেও বা। এ ছাড়া তো আর পথ নেই!’

‘বেশ, এসো।’

.

নির্জন মাটির রাস্তা ধরে ওরা হাটছে। মাথার ওপর কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ মাঠ বন পেরিয়ে ওদের সঙ্গ নিয়েছে। ওদের ফিসফিসিয়ে বলা কথার গুঁজন আলোড়ন ছড়াচ্ছে বাতাসে। নিরবতা ভেঙে একসময় তিতিক্ষা মেদুর গলায় শুধায়,

‘এত রাতে আপনি বাইরে কি করছিলেন বলুন তো!’

‘তোমার অপেক্ষা করছিলাম।’ তেমনি হালকা অথচ সৌষ্ঠব স্বরে উত্তর দেয় নিনাদ,

‘আমার ঘুম নিয়ে কেউ কোনো কথা তোলেনি তো?’

‘তোলার সুযোগ পেল কই? আমিই সবাইকে বললাম তিতিক্ষা ঘরে আছে। আমি যাচ্ছি ওর কাছে। কিছু দরকার হলে ও নিজেই এসে নিয়ে যাবে। ব্যস, সবাই চুপ করে গেল।’

‘এরকম ভাবে কথা বলেছেন আপনি!’

‘কি করবো। আর কিছু আমার মাথায় আসছিল না।’

‘আচ্ছা, সে যাক। বাবা কোথায় শুয়েছে বলুন তো? বিকেলের পর আর বাবাকে একবার দেখলাম পর্যন্ত না।’

‘পূবের ঘরে’

‘কাল আপনি যে ঘরটাতে ছিলেন?’

‘হ্যাঁ’

‘আর ফুআম্মা বুবু আফরিন… ওরা?’

‘ফুআম্মার ঘরে।’

‘ছোটন কার সাথে ঘুমালো?’

‘তোমার বাবার সাথে।’

‘রওশান ভাই আর বাকিরা…’

‘থাকার জায়গা হচ্ছিল না বলে ওদের সবাইকে নিয়ে মিনহাজ নিজের বাড়িতে গেছে আজ রাতের জন্য।’

‘ওহ, ভালো।’

ক্ষণকাল ওদের কেউ আর কোনো কথা বলল না।
একসময় তিতিক্ষাই ফের জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, পশ্চিমের এই ঘরটাই তো আমাদের থাকার জন্য কাল রঙ করা হয়েছিল, না? যেখানে আজ ঘুমিয়েছি।’

‘হ্যাঁ। ফুআম্মার খুব শখ ছিল আমি বিয়ে করলে সামনে বাগানবিলাসের ঝাড় ওঠা ওই পশ্চিমের ঘরে বউ নিয়ে উঠব। কিন্তু কাল আমরা হুট করে চলে আসায় ঘরটা গোছাতে পারেন নি৷ কিছু মেরামতও জরুরি ছিল। সেজন্য আমাকে পূবের ঘরে থাকতে বললেন। আর ওই ঘরেই আমাদের প্রথম থাকতে দেবেন বলে তোমাকে রাখলেন নিজের ঘরে নিজের সাথে।
আসলে ফুআম্মার মধ্যে কিছু ছেলেমানুষী ব্যপার স্যপার রয়ে গেছে এখনো।’ বলতে বলতে নিনাদ আনমনে একটু হাসে।

মাথা নিচু করে তিতিক্ষা, ‘তবে উনি খুব ভালো মনের মানুষ।’
মনে মনে তখন একটা নতুন প্রশ্ন উদয় হয়েছে তার। এতক্ষণ ধরে হাটছে। অথচ কিছুই তো নজরে আসছে না। ওদের গন্তব্য আদতে কোথায়?

তিতিক্ষার মনে মনে সাজানো প্রশ্নের সন্ধানই যেন নিনাদ পেয়ে যায় টেলিপ্যাথির মাধ্যমে। সহসা নিজ থেকে বলে,’ আমরা প্রায় এসে এসেছি। ওইতো দিঘির ঘাট দেখা যাচ্ছে। তার আগে একবার এদিকে এসো।’ নিনাদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলে তিতিক্ষা।

‘ওইযে সারি সারি নারকেল গাছ দেখছো। ওর নিচে আমার বাবা মায়ের আর.. ছোট ভাইয়ের কবর।’

‘ওহ..’ একটু অপ্রস্তুত মনে হয় তিতিক্ষাকে। সে কবর দেখার দুআ পড়ে সঙ্গে সঙ্গে, ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর…’

.

মধ্যাকাশে স্থিত চাঁদের আলো পড়ে ঝলমলায় দিঘির স্বচ্ছ জলে। টলমল জলের কালো রঙ দেখায় অন্যরকম। হিমানী বাতাসে তিরতির করে সেই কালো জলে স্রোত বইতে থাকে। বাতাসের অনুষ্ণ ভাব গায়ে জন্ম দেয় মৃদু শিরশিরে অনুভূতি। পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে নীল জ্যোৎস্নায়। শাঁন বাধানো ঘাটের শীতল সিড়ির ধাপে বসে চাঁদের আলোয় ওরা দেখে নিশীথের অন্য আরেক রূপ ও রঙ। কতক্ষণ কেঁটেছিল কে জানে! স্মৃতি কাতরতায় সমাচ্ছন্ন নিনাদ সহসা বলতে আরম্ভ করে কথা,
‘ছেলেবেলায় এই ঘাট আর এর আশেপাশেই গড়েছে আমার শৈশব কৈশোরের সবচেয়ে সুন্দর কিছু স্মৃতি। যখন আম্মা ছিল, আব্বা ছিল আর ছিল আমার ছোট ভাই… বনের পরে ওই জঙ্গলের কাছে একটা ভাঙা কাঠের বাড়িতে আমরা থাকতাম। রোজ ভোরে ঘুম ছেড়ে উঠেই দিঘির পাশের ওই মাঠে ডাংগুলি খেলতে চলে আসতাম আমি আর বন্ধুরদল। তারপর সারাদিন ওই মাঠেই পড়ে থাকতাম খেলা নিয়ে। কখনো আম্মা এসে কান ধরে বাড়ি নিয়ে যেত। কখনো আব্বাকে পাঠাতো। আব্বা এলে আর কান ধরাধরি নেই। সোজা কাঁধে চড়িয়ে ফিরতেন বাড়ি।’

‘তাহলে তো বলতে হয় বেজায় আনন্দে কেটেছে আপনার ছেলেবেলা।’

‘হ্যাঁ, ততকাল আনন্দেই কেটেছে আব্বা আম্মা বেঁচে ছিল যতকাল..’

‘তারপর কি হলো? ‘

‘যা হবার তাই হলো! ভাগ্যের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে এলো। সেই থেকে জীবনের সঙ্গে আজও যুঝছি।’ খানিকটা অন্য মনা হয়ে পড়ে নিনাদ।

‘আপনার জীবনের শুরুটা বেশ করুণ। তবে যাদের শুরুটা মন্দ দিয়ে হয়, সাধারণত তাদের শেষটা হয় সুন্দর। কিন্তু আফসোসের কথা হলো শুরুর মতো আপনার শেষটাও বোধহয় মন্দই হবে। দুর্ভোগ, দুরাকাঙ্ক্ষায় একদিন সুখ নামের পাখি চিরতরে পিঞ্জর ছেড়ে পালাবে।’

সম্বিৎ ফিরে অবাক গলায় প্রশ্ন করে নিনাদ, ‘তারমানে?’

‘সত্যি জানেন না?’ একটু কাষ্ঠ হাসি হাসে তিতিক্ষা।
‘অনেক দুঃখ দুর্দশায় এতটা পথ পাড়ি দিয়ে একজীবনে যাকে অর্জন করেছেন, তার জীবন আবার কলঙ্কের হাজার প্রলেপে কালিমালিপ্ত। আজ হোক কিংবা কাল, আপনার প্রিয় মানুষেরা যখন এই সত্য জানবে, ধীরে ধীরে আপনার বিতৃষ্ণা জন্মাবে এই সম্পর্কের প্রতি, আমার প্রতি। মনে হবে সবাই নির্ভেজাল কাউকে নিজের করে পেল, আর আমি পেলাম…’

নেমে এলো মৃত্যুর মতো নিদাঘ নিরবতা। তিতিক্ষা ভেবেছিল নিনাদ সেই মুহুর্তেই ওর কথার প্রতিবাদ করে উঠবে। করল না দেখে ওর ধারণাই আরো দৃঢ় হলো। এই অল্প কিছু কালের তরে ওরা যতটা কাছে এসেছিল হটাৎ তার থেকে শত আলোকবর্ষ দূরে ছিটকে পরল দুজনে। পূর্বানুরূপ খেয়াল অনুসারে তিতিক্ষার আবারো মনে হলো পৃথিবীকে শোনানোর জন্য যে যত নীতিকথার বুলিই আওড়াক না কেন, দিনশেষে ওরা সবাই মানুষ, ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে না ওঠা সাধারণ স্তরের মানুষ। কম্প্রোমাইজ করতে করতে ওদেরও মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় জিতে যেতে। প্রতিবার অন্যের সুখের জন্য ছাড় দিতে দিতে একবার অন্তত নিজের করে কিছু পেতে। নিনাদকে কি সে এসবের ঊর্ধ্বে কেউ মনে করেছিল? ভেবেছিল কি নিনাদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম হবে আর দশজনের চেয়ে? এমন ভাবাটা কি উচিত না যুক্তিসংগত?

‘তিতিক্ষা..’

ডাক শুনে মোহ ভাঙে তিতিক্ষার। ও পাশ ফেরে।

‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর উপমা কি জানো? চাঁদের সাথে মানুষের তুলনা। যুগে যুগে প্রিয়র মুখকে তুলনা করা হয়েছে চাঁদের অপার সৌন্দর্যের সঙ্গে। অথচ সেই চাঁদের গায়েও আছে কলঙ্ক।’

নিঃসাড়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে তিতিক্ষা, ‘কিন্তু আমি তো চাঁদ নই…’

‘চাঁদ হওয়া বুঝি খুব ভালো? নক্ষত্রের চাঁদের মতো ঐশ্বর্য নেই। নেই বলে ওদের দুঃখও নেই। ছায়াপথ জুড়ে অগণিত নক্ষত্রেরা কি সুন্দর মিলেমিশে থাকছে দেখো। অথচ আলোহীনা চাঁদ, সূর্যের আলোয় আলোকিত হবার দুঃখে সবার চেয়ে বিচ্ছিন্ন। নিজের গায়ে অযাচিত কলঙ্কের ছাপে সদাসর্বদা বিব্রত। এই দ্বিধা ওর কোনো উপকারে আসেনি। কেবল দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে সবার থেকে।

যে বিপর্যয়ে তোমার কোনো হাত ছিল না তার জন্য সবার থেকে দূরে সরে যাওয়াই কি একমাত্র সমাধান?’

‘আমি দূরে সরে যেতে চাইনি।’

‘অবশ্যই চেয়েছো। আগে প্রকাশ্যে চাইতে। এখন অন্য কিছুর মধ্যস্থতায় চাইছো।’

‘আমি কি চাই না চাই তা বুঝি আপনি আমার চেয়ে বেশি জানেন?’

‘জানি। তুমি চাইছো আমি, আমরা সবাই যেন তোমাকে একা ছেড়ে দিই। নিজের কষ্টদায়ক অতীত অধ্যায় নিয়ে তুমি একা বাঁচো।’

‘না, এমন কিছু কখনো চাইনি আমি!’

‘সত্যি চাওনি?’

কয়েক মুহুর্ত ভাবে তিতিক্ষা। তারপরই পূর্বের সেই দৃঢ়চেতা ভাবটা ওকে ছেড়ে দূরে কোথায় পালিয়ে যায়।

‘যদি তাই হয় তাহলে যে অতীতের কথা ভুলে আমরা সবাই তোমাকে আগের তিতিক্ষা হিসেবে মানতেই বেশি আগ্রহী, তুমি নিজে কেন তা পারছো না? কেন আমরা ভুলতে চাইলেও তুমি বারবার সেসব মনে করো? তোমার এসব আচরণের জন্য প্রতিটা মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। যখনি স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে চাইছে, তোমার আর্তনাদ থামিয়ে দিচ্ছে তাদের।
আর কি বলছিলে? আমার প্রিয় মানুষেরা কখনো এসব জানলে ওদের কথায় প্রভাবিত হয়ে তোমার নিয়ে আমি আফসোস করবো?
এত নীচ ধারণা আমার সম্পর্কে তোমার?’

ক্রুদ্ধ চোখে ওর মুখপানে তাকিয়ে রয় নিনাদ। ভাঙবে না বলেও একসময় কান্নায় ভেঙে পড়ে তিতিক্ষা। মনে হতে থাকে সত্যিই প্রতিটি মুহুর্তে সে শুধু ধোঁকা দিয়ে গেছে তার প্রিয় মানুষ দেরকে। সবাই ওকে আগের নির্মল তিতিক্ষা হিসেবে মেনে নিতে চেয়েছে, আর সে নিজে… পলে পলে কষ্ট পেয়েছে অতীতকে ভেবে।
তিতিক্ষার মনে হলো চিৎকার করে পৃথিবীকে শোনায়, ‘আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি। কখন জেনেবুঝে কষ্ট দিতে চাইনি তোমাদের। বিশ্বাস করো, একবার বিশ্বাস করো আমাকে..’

‘তোমার কি সত্যিই ধারণা যে সমুদয় অতীত সহ তোমায় আমি কখনো গ্রহণ করতে পারবো না? হলে অকপটে জানাও। একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার আমাদের।’

তিতিক্ষা বিহ্বল হয়ে চাইল।

‘কিছু একটা বলো।’

স্তব্ধতা ভেঙে বলল,’ যদি বলি ‘না’। তাহলে কি আপনি আমায় ছেড়ে দেবেন?’

‘তুমি কি এটাই চাও?’

‘আমার চাওয়ার কথা বলছি না। আপনার ছেড়ে দেবেন কিনা তাই বলুন।’

উত্তর করতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হল নিনাদের,’তুমি যদি চাও তাহলে হয়তো…. ধরে রাখবো না…’

‘যেতে দেবেন যেখানে খুশি?’ তিতিক্ষা সজল চোখে তাকায়।

‘কোথায় যাবে তুমি?’

‘দেখতে চান?’

নিনাদ কিছু বলে না। দুর্বোধ্য চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্ষণকাল পরে ওর চোখের সামনে দিয়ে তিতিক্ষা নিচে নামতে থাকে দিঘির সিড়ি বেয়ে।

‘কোথায় যাচ্ছো?’ দ্রুত সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে নিনাদ। বিস্ময়ভারাতূর দৃষ্টি ওর চোখে।

‘আপনি না রাখলে যেখানে যাওয়ার কথা…’

‘তাই বলে দিঘির জলে?’

তিতিক্ষা চোখের জল মুছে বলে, ‘আপনি ছেড়ে দিলে তো যাওয়ার জায়গা নেই। আর কোথায় যাব?’

দু পা এগিয়ে এসে হঠাৎ তিতিক্ষার ধরে ফেলে নিনাদ। রাগত স্বরে বলে, ‘তিহা যে বলে তুমি বাচাল হয়ে যাচ্ছো। মিথ্যে বলে না।’

‘আপনাকে যে মেছো ভূতের সর্দার বলে সেটাও তাহলে সত্যি।’

‘এইসব বলেছে তিহা!’

‘আরো অনেক কিছু বলেছে।’

‘কি বলতো?’

‘বলা যাবে না।’

‘কেন?’

‘আমার ইচ্ছে তাই!’

‘সবসময় শুধু তোমার ইচ্ছে? আমার ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই?’

‘নেই নাকি?’

‘না নেই৷ এই যেমন ধরো আমার এখন ইচ্ছে হচ্ছে তোমার কোলে মাথা রেখে সারারাত এই ঘাটে শুয়ে চাঁদ দেখি। ইচ্ছেটা কি পূরণ হবে?’

তিতিক্ষা গুরুতর ভঙ্গিতে বলে, ‘হবে না। কারণ এখন আমি আপনার কোলে শুয়ে বকবক করবো আর আপনি আমার মাথায় বিলি কেটে দেবেন।
কি হলো, মুখে রা নেই কেন? দেবেন না?’

‘আসলেই তুমি একটা পেতনি!’

‘আর আপনি মেছো ভূতের সর্দার।’ বলে ওরা দুজন একসাথে হেসে ওঠে। দূর থেকে দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে সে হাসির রিনরিনে ঝংকার।
————সমাপ্ত

দূর আলাপন পর্ব-৩০

0

দূর আলাপন ৩০

____________________________
প্রতি শুক্রবার তিতিক্ষাদের বাড়ি কিছু বিশেষ খাবারের আয়োজন হতো। আর শুক্রবারের সেই বিশেষ রান্নায় দু বোনের সাথে যোগ দিতেন বাবাও। খিচুড়ির সাথে বাহারি পদের ব্যাঞ্জন, কখনো দম বিরিয়ানি, কখনো আবার সাদা ভাতের সঙ্গে ঝাল ঝাল গরুর মাংস।
ঘরের সাফসুতরো করতে করতে পুরনো কথা মনে করে তিতিক্ষার খেয়াল হয়, সকালের কলে বুবুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি আজ ওবাড়িতে স্পেশাল কি রান্না হচ্ছে। গরুর মাংস আর সাদা ভাত হওয়াই বেশি যুক্তিযত। এটা বাবার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।

চপল হাতে কাজ করে আর আনমনে চিন্তা করে তিতিক্ষা, শুক্রবারের নিমিত্তে বিশেষ কি রান্না করবে আজ। খিচুড়ি আর মাংস নিনাদের পছন্দের খাবার। রান্না হলে কেমন হয়? ওর ভাবনার পরিসর খেয়াল করে সে নিজেই অবাক মানে। পছন্দের কথা বলতে শুরুতেই কেন নিনাদের নাম এলো! এবাড়ির কর্তা ও বলেই বুঝি?

বোধহয় তাই। এইতো স্বাভাবিক। নিনাদ এবাড়ির কর্তা, তারও কর্তা। নিনাদের সমস্ত কথা মাথা পেতে মেনে নেয়াই এখন ওর কর্তব্য। অবাধ্য মেয়েও তিতিক্ষা নয়। কিন্তু ওর ঠিক ভালো লাগে না মানুষ টার ধরনধারণ। পূর্বেও লাগেনি না কখনো। কে জানে লোকটা এখনো তেমনি আছে কিনা! ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবসময় বন্ধুদের নিয়ে হুল্লোড়ে মেতে থাকা, যাকে তাকে হাসির পাত্র বানিয়ে উপহাস করা মানুষেরা যে সহজে প্রিয়র তালিকাভুক্ত হয় না।
তাছাড়া কৈশোর থেকেই নানান উপায়ে সকলের সামনে তিতিক্ষাকে পরিহাসের উপজীব্য করতে পছন্দ করতো নিনাদ। পাশাপাশি ওর মনে বোধহয় তিতিক্ষার জন্য আলাদা একটা অনুভূতির প্রকোষ্ঠও ছিল। যেমন ছিল রাজনের। দুজনের ভাবাবেগের পন্থা হয়তো ভিন্ন কিন্তু আলাদা হয়েও উদ্দেশ্য টা যেন ঠিক আলাদা নয়।

তিতিক্ষার কৈশোরের জাদুময় দিনগুলোকে আতঙ্কে রুপান্তরিত করতে ওদের কারো জুড়ি ছিল না। স্কুলের রাস্তায় রাজন দাঁড়াতো ওর পথ আগলে। রাজনের বাজে কথা, বাজে ভাষায় লেখা চিঠি ক্রমশ ওর কঠিন বাস্তবতা বিবর্জিত নিকষিত মনকে দুঃসহ করে তুলছিল।

অপরদিক থেকে ছিল নিনাদের দেয়া মানসিক পীড়ন।
নিনাদ তিহা তখন সবে ভার্সিটির গন্ডিতে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। জীবনটা ওদের কাছে বায়োস্কোপের বর্ণিল ছবির মতই রঙের একখানা পসরা।

—–

‘তিতিকে নিয়ে হয়েছে আরেক বিপদ বুঝলি!’

‘ছোট গিন্নিকে নিয়ে বিপদ? কোনো ছেলের সাথে নটঘট বেঁধে যায়নি তো?’

‘আরে দূর! ও অমন মেয়ে নাকি? স্কুলে গিয়ে ক্লাসের এককোণে চুপচাপ বসে থাকে। ওর সঙ্গে মেয়েরাই মেশে না ঠিক করে আর ছেলে! একেই মুখচোরা, তাতে আবার টিচারের সামনে সবসময় পড়া পারে বলে আড়ালে মেয়েরা নানারকম কটুক্তি করে। শুধু এটুকু হলেও চলতো। কিন্তু… স্কুল থেকে আসার সময় পথে একা পেয়ে রাজন আজকাল আবারো বাজে কথা বলতে আরম্ভ করেছে। গেল সপ্তাহে ওর ব্যাগ টেনে জোর করে চিঠি রেখে দিয়েছে।’

‘কিহ! ফের এসব করছে? এত সাহস ওই ছেলের!’

‘শুধু কি এই? পুরোটা শোন। স্কুলের মেয়েরা দূর থেকে এই ঘটনা দেখে কেড়ে নিয়ে সেই চিঠি পড়েছে। কিসব উল্টোপাল্টা কথা নাকি লেখা ছিল। তাই নিয়ে স্কুলে বিরাট হইচই। মেয়েরা ছড়িয়েছে তিতি ওই বাজে ছেলের সাথে প্রেম করে। শেষমেশ ব্যপার টা টিচার্স রুম অবদি গড়ালো। হেড মাস্টারের রুমে ডাক পড়ল তিতির।
আমার বোনটাকে তো চিনিস। মান অপমান বোধ ভীষণ প্রবল। বাড়ি ফিরল চোখ মুখ লাল করে। সেদিনই পড়ল জ্বরে। প্রথমে কিছু বলতে চায়নি৷ খুব খাটুনি করে কথা বের করতে হয়েছে। তারপর এক সপ্তাহ গত হলো। তিতি স্কুলে যাচ্ছে না। কিছু বললেই মুখ গম্ভীর করে ঘর বন্ধ করে বসে থাকে। বাবা তো চিন্তায় অস্থির। ওদিকে তিতি সব কথা ফাঁস করার আগে ওয়াদা করিয়েছে এসব কিছু বাবাকে জানানো যাবে না। তাহলে নাকি ও লজ্জায় মরে যাবে। আমি পড়েছি মহা যন্ত্রণায়। না পারি বলতে, না পারি সইতে। কি বিপদে আছি এবার চিন্তা কর! ‘

এর বেশ কিছুদিন পর স্কুলে যাবার পথে আবারো তিতিক্ষার পথ আটকায় রাজন। সেদিন তিতিক্ষা বাড়ি ফেরে ভীষণ এক গম্ভীর মুর্তিতে। এসেই দরজা বন্ধ। পরদিন তিহার ভার্সিটির অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবার শেষ তারিখ ছিল। ভার্সিটির কাজ নিয়ে তিহা মহাব্যস্ত। বোনের মনোদূর্যোগের খবর রাখার সময়ই হলো না। পরদিন সকালে তাড়াহুড়ায় নাশতা খেতে গিয়ে তিহার প্রথম খেয়াল হলো বিকেলের পর থেকে বোনটাকে দেখেনি আর। খেয়েছে কিনা সে খবরও নেই জানা।

অনেক ধাক্কানোর পর দরজা খুলেছিল তিতিক্ষা। বোনের ফোলা মুখ দেখে তিহা ঘাবড়ালো ভীষণ। তারপর অনেক মান ভাঙানো কথার শেষে বোনের কাছ থেকে যেসব তথ্য আদায় করা গেল তাতে এমনকি তিহার নিজেরো প্রিয় বন্ধুর ওপর রাগ না এসে পারেনি।

সেদিন তিহার মুখে সব শুনেই নাকি মহাখাপ্পা হয়ে নিনাদ দেখা করেছিল রাজনের সঙ্গে। ওর অপকর্মের জন্য ওকে শাসানোর পাশাপাশি দৃঢ় গলায় বলে এসেছে তিতিক্ষা ওর ভবিষ্যৎ বউ। কাজেই তিতিক্ষাকে ভুলে যাওয়াই ওর জন্য সর্বদিক থেকে মঙ্গলকর। তাছাড়া আজ হোক কাল হোক বউই যখন হবে, তাই ওর সব ব্যপারে নিনাদের কথাই শেষ কথা।

সহজাত ভাবেই রাজনের চিন্তাধারা ঋণাত্মক খাতে চলে। নিনাদের ওই হুমকির পর ক্রোধে অপমানে আর স্বপ্ন ভঙ্গের দুঃখে নিনাদ তিতিক্ষা কে জড়িয়ে কিছু বিশ্রী ধারনা রাজনের মাথায় স্থায়ী হয়ে গেল। সেসবই উগরে দেবার জন্য পুনরায় এক দুপুর শেষে ছুটির লগ্নে স্কুলে এসেছিল রাজন।

‘এত কাণ্ড করেছে নিনাদ! ওকে সব বলাই দেখছি আমার মহা ভুল হয়েছিল। তা ওর কীর্তি তো শুনলাম এবার রাজন কি বলেছে সেটা বল?’
চোখের জল মুছে রাগে গজরাতে গজরাতে তিতিক্ষা বলল, ‘ওইসব জঘন্য কথা উচ্চারণের রুচি আমার নেই। তবে তুমি শুধু একটা কথা জেনে রাখো বুবু, যে ছেলেটার জন্য আজ এতো বিভৎস একটা স্মৃতি আমার জীবন খাতায় যুক্ত হলো, পৃথিবীতে ছেলের মহা আকাল পরলেও কখনো ওকে আমি বিয়ে করবো না। চিনিনা জানিনা কোত্থেকে দুদিনের এক বৈরাগী এসে ঘোষণা দেবে সে আমার হবু বর, শুনে সঙ্গে সঙ্গে নাচতে নাচতে আমি ছুটে যাব পদসেবার জন্য, এমন কিছু কখনো হবে না, কোনোদিন না।’

.

কৈশোরের সেসব আলোড়নময় দিন কবে পেরিয়েছে। কত নতুন নতুন অভিশঙ্কায়, দূর্যোগে ফেনিল হয়েছে তিতিক্ষার জীবনআকাশ। জটিল সেসব বোঝাপড়ার কবলে পড়ে ওর নির্মল অন্তঃকরণ আজ হয়েছে বিক্ষিপ্ত। সময়ের ঘেরান্তে জীবনবোধের ঝুলি হয়েছে অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। এতসবের প্রভাব কি পারে একদিনের তরে মুছে যেতে? প্রকৃতির নিয়মে যে অধিকারনামা হস্তান্তর হয়, তারই সাথে সাথে কি মনের হলফনামাও হস্তান্তর হয়ে যায়? এই কি নিয়তি? হয়তো তাই। নইলে পৃথিবীর শত শত নারী আর যুবা কাবিননামায় সাক্ষরের পরই পারে কি করে সুস্থিরচিত্তে বাস করতে এক ছাদের নিচে? এটা নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তায়ালার অপার রহমা’রই এক নিদর্শন। তার নিজের বাবা মায়ের গল্পটাও তো ভিন্ন নয়। বিয়ের আগে তারা কখনো একে অপরকে দেখেন নি। অথচ কাবিননামায় সাক্ষরের পর প্রথম দেখা মানুষটিকে চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে ভালোবেসে গেছেন। গায়ের রঙের জন্য বিয়ের দিন থেকে সবার কাছে নিগৃহীত ছিলেন তিতিক্ষার মা।কিন্তু বাবা গোটা পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে শুরুর দিন থেকে সহানুভূতিশীল ছিলেন সেই মেয়েটির প্রতি।

হাহ্.. বড় আফসোস হয় আজ তিতিক্ষার। কেন তার মনস্তত্ত্ব হলো না আর দশজনের মতো স্বাভাবিক? কেন সে এত সুক্ষ্ম দর্শনে, সুক্ষ্ম ভাবাবেগে বিশ্বাসী হলো? মানব প্রকৃতির যা কিছু উৎকৃষ্ট শৌখিনতা চরিত্রভেদে খুঁজে পাওয়া যায় তার সবই কি চিরনির্মল? যে লোকটা নিজের শৌখিন ভাবাবেগের প্রতি যত্ন দেখাতে গিয়ে একুরিয়ামে লক্ষ টাকার রঙিন মাছ পোষে অথচ তার পাশের বাড়িতে মানুষ মারা যায় বিনে চিকিৎসায়, সেই ভাবপ্রবনতার মূল্য আদতে কত?

অথচ নিজের এই সুক্ষ্ম দর্শন নিয়েই তিতিক্ষার আত্মঅহম ছিল এককালে। সেই আত্মগৌরব, সেই বিলাসবহুল শৌখিনতার অন্ধ পর্দা বুঝি এখনো লেপ্টে আছে ওর স্বপ্নভঙ্গ পরাহত দুই চোখের ডানায়। তাই অপ্রিয় মানুষটা আজ স্বামী হলেও তাকে সে এড়াতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে।

এতকাল মানুষ টাকে ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ করায় কিছুই যায় আসেনি। না ছিল ধর্মীয় কোনো প্রতিবন্ধকতা। রক্তসম্পর্কীয়.. দূরাত্মীয়.. কিছুই তো নয় মানুষটা। অথচ এই মানুষ টিকে ঘিরে আজ তার সমবায় বর্তমান আর ভবিষ্যতের ভাবনা নিহিত। এরকম অবস্থায় যারা পড়ে নিজের ভালোর জন্য হলেও তারা একসময় সংসারে মন ফেরায়। স্থায়ী একখণ্ড আশ্রয়, নিশ্চিত নিরাপদ আবাস, আর্থিক আনুকূল্য ইত্যাদির সমন্বয় যে একটা বয়সের পর সব মেয়ের জন্য ভীষণ দূর্লভ প্রাপ্তি। অনেক অপমান, অনেক বিষাদিত অধ্যায় শেষে আজ এর প্রত্যেকটা অর্জন করেছে তিতিক্ষা। অথচ তার মনের প্রাচীরে একখণ্ড শীতল শান্তির হাওয়া পর্যন্ত নেই। রঙহীন সে আকাশে কেবল বিষাদভারাতূর মেঘেরা গম্ভীর জলযোগে গজরায়। সহস্র অভিশপ্ত ঘাতকিনীর কিন্নর কান্না আছঁড়ে পড়ে ওর মন সংলগ্ন সায়র তটে। নিজের শৌখিন অন্তঃকরণে নিজের প্রতি স্থিত কট্টর দাসত্বের এই স্বরূপ উদঘাটিত হতেই সহসা তিতিক্ষার অনুমেয় হলো কতটা স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে সে ক্রমে ক্রমে। গভীর এক নিশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তিতিক্ষা।

আজ শনিবার, এখন সন্ধ্যে সাতটা। বাইরে রাত্রির গাঢ় তমসা। জানালার পর্দা সরিয়ে সে অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে। এলোমেলো ভাবে খানিকক্ষণ কি যেন চিন্তা করে। হঠাৎ ফোন নিয়ে ডায়াল করে একটা নাম্বারে। আলাপচারিতার সমাপ্তি শেষে কল করে দ্বিতীয় আরেকটি নাম্বারে। এই মানুষটি ওর প্রিয়দের তালিকার ওপরের দিকে থাকা একজন। দীর্ঘক্ষণ কথার শেষে বেশ কিছুক্ষণ ইতস্ততর পর শেষতক একটা অসচরাচর নাম্বারে কল করে ফেলে তিতিক্ষা। ওপাশের মানুষ টা কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে ওঠায় ফোন। শোনা যায় তার ব্যস্ত স্বর, ‘বাসায় সব ঠিক আছে? কোনো ঝামেলা হয়নি তো?’ স্বরটা হঠাৎ অনেক নিভে আসে, ‘আর তুমি ঠিক আছো তো?’

‘আছি।’

‘তাহলে? ‘

‘কি তাহলে? ‘

‘না মানে হঠাৎ কল.. কখনো তো দাও না। তাই ভাবলাম কোনো ঝামেলা হলো কিনা..’

‘নাহ, কোনো ঝামেলা হয়নি তো!’ একটু খাপছাড়া ভাবে বলে ওঠে তিতিক্ষা।

‘ও আচ্ছা। ‘ ওপাশেও কথা হারিয়ে যায়।

‘কি ও আচ্ছা?’

‘হুম?’ মানুষ টা অন্যমনস্ক ভাবে শুধায়।

‘কিছুনা। কখন ফিরবেন?’

‘রোজ যখন আসি। আটটায়। আচ্ছা আজ কি কেউ আমার খোঁজে এসেছিল?’

‘না তো!’

‘ও আচ্ছা। ‘

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

‘তোমার এমন হুট করে কল করার কারণ টা বোধগম্য হচ্ছে না। সেজন্যই মনে হলো…’

‘মনে হয় খুব অসময়ে কল টা গেছে। আফওয়ান। আমি এখনি রেখে দিচ্ছি।’

‘আরে না না.. তাই বললাম নাকি? আ..আমি তো ফ্রিই আছি।’

‘কাজের জায়গায় বসে ফ্রি! ভারি আশ্চর্য তো!’

‘না মানে ছুটির সময় হয়ে গেছে তো। এজন্য কাজের চাপ এখন কিছু কম।’

‘ভালো’

মানুষ টা বোকার মত উত্তর করে, ‘হ্যাঁ… ‘

হাসি পায় তিতিক্ষার। সামলে নিয়ে গম্ভীর আঁচে বলে, ‘কাজ করুন। রাখছি।’

‘এখনি রাখবে?’

‘তো আর কি করবো? ‘

‘না না রেখেই দাও।’

‘আচ্ছা’

‘ঠিকাছে’

একের পর এক বোকা জবাবে হাসি থামানো দায় হয়ে পড়ে তিতিক্ষার জন্য। গট করে কল কেটে মৃদু শব্দে হো হো করে সে হাসে। ওপাশের মানুষ টা নিতান্ত নির্বোধের ন্যায় তখনো ফোন কানে চেপে রাখে। লাইন কেটে যাওয়ার শব্দটা আজ হঠাৎ তার কাছে বড় নির্দয় মনে হয়। মনে হয় এপাশের মানবী ইচ্ছে করেই, ওকে ভীষণ অপছন্দ করে বলেই এত রুক্ষ ভাবে কাটল কল!

.

টেবিলের নিচে খুট করে একটা শব্দ হতেই খাওয়া ফেলে সেদিকে ঝুঁকলো নিনাদ। একটা তেলাপোকা কুটকুট করে কি যেন খাচ্ছে। চোখে বিরাগ নিয়ে সে মুখ ঘোরায়। রিনরিন ভেবে হঠাৎ অনেকখানি আশান্বিত হয়ে উঠেছিল। একা খেতে বসার এই সময়টা বড় বিরক্তিকর। মানুষ না হোক অন্তত খরগোশ ছানাটা আশেপাশে থাকলে একাকীত্ব কিছু কম বোধ হয়।
কিন্তু আর আজ বাড়ি ফিরে শুরুতেই রিনরিনকে আবিষ্কার করেছে তিতিক্ষার কোলে। রুদ্ধ কপাটের ওপাশে রিনরিনকে নিয়ে তিতিক্ষা বোধহয় এখনো আহ্লাদ করছে।

‘ফুআম্মার ব্যপার নিয়ে কিছু ভেবেছেন?’

হঠাৎ উড়ে আসা প্রশ্নে একটু হতচকিত হয়ে নিনাদ পাশ ফেরে।
‘না.. না তো।’

‘উনি আর কল করেছিলেন?’

‘উহু। তোমাকে?’

‘আমাকেও না। আপনি নিজে একবারও কল করেননি?’

‘করেছি। কখনো ধরেন না।’ উত্তর দিয়ে নিনাদ মাথা নুয়ায়। ভাতের প্লেটে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে উদাসীন হয়ে।

‘আপনি কি ফুআম্মার ব্যপার টা কিছু আঁচ করতে পারছেন?’ বলতে বলতে অবশিষ্ট শেষ চেয়ার টেনে তিতিক্ষা পাশে বসে। ভাতের প্লেটটা আলতো করে নামিয়ে রাখে সামনে।

‘কি আঁচ করবো?’ ভাবলেশ শূন্য চোখে তাকাল নিনাদ।

‘বিয়ের দিনই ফুআম্মা কেন চলে গেলেন, কেন আর আসলেন না ইত্যাদি…’ আধপোড়া আলুভাজি নিঃসাড়ে প্লেটে তুলে নিয়ে তিতিক্ষা বলে চলে।

‘এখানে আঁচ করার মতো কি আছে? ফুআম্মা সম্ভবত সুযোগ পাচ্ছেন না। গ্রামের বাড়িতে অনেক রকম কাজ থাকে। আর নাহয় তিনি বোধহয় অসুস্থ… ‘

‘ব্যস এই! আর কিছু মনে হয়না আপনার? এতদিনে আপনি কি কিছুই টের পাননি?’

‘কি টের পাব? আশ্চর্য! ‘

লম্বা একটা প্রশ্বাস টানে তিতিক্ষা। শান্ত গলায় হুকুম করে।
‘ভাত ঠান্ডা হচ্ছে। দ্রুত খান। আমি কিছু বিষয় আপনাকে বলব। ভেবে দেখবেন।’

পোড়া আলুভাজি সমেত ভাত মুখ দিয়ে আরো ম্নান হলো নিনাদের মুখ। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আচ্ছা’

‘শুরুতেই জানিয়ে রাখছি, এসব স্রেফ আমার অনুমান নির্ভর কথা নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাদের কে বেশি অনুমান থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।’

একটু থামে তিতিক্ষা। পুনরায় বলতে আরম্ভ করে, ‘ফুআম্মার আচরণে সুক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন বোধকরি আপনার নজরে এসেছে। শুরুটা আমাদের বিয়ের কথা ওঠার পর থেকে। ছেলেমেয়ের বিয়ে নিয়ে মায়েদের নানান স্বপ্ন থাকে। ফুআম্মারও ছিল। সেসব পন্ড হয়েছে আমার জন্য। ফুআম্মার নিজের পছন্দ করা সুরূপা, সয়ংসম্পূর্ণা মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করে আপনি একটা.. ‘ দুজনের মধ্যে মুহুর্তের স্তব্ধতা।

‘যা হোক, ফুআম্মা আমাদের প্রতি অভিমান থেকে যোগাযোগ বন্ধ করেছেন। আমি ভেবেছিলাম একটা সময় ব্যাপার টা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। এক মাস পেরিয়ে যাবার পরও পারছেন না বলেই নিজ থেকে বলতে হলো।
আমি যথা সম্ভব নিশ্চিত হবার চেষ্টা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আফরিনের দারস্থ হতেই সবটা জানা গেল।’

‘কি জানলে?’

‘এই যে, উনি নিজেই আফরিনের বাসায় ওঠার প্রস্তাব করেছিলেন। যাতে সেখান থেকে নির্বিঘ্নে গ্রামে ফেরা যায়।’

নিনাদের হতবাক ভাবটা কাটছেই না। অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে বসে আকাশপাতাল নানান ভাবনা ভাবল সে। ভাত মাখতে মাখতে আড়চোখে সেসব খেয়াল করল তিতিক্ষা। পর পর দু গ্লাস পানি গলাধঃকরণ করে ক্ষণকাল পরে নিনাদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,’এবার কি করবো? কিভাবে ফিরিয়ে আনব ফুআম্মাকে।’

প্রকৃতির সুক্ষ্ম ইশারাতেই হয়তো অপ্রিয় মানুষটাকেও আজকাল কিঞ্চিৎ বুঝতে শুরু করেছে তিতিক্ষা। মাতৃসম শিউলি কে ছাড়া নিনাদ আদতেই কতটা অসহায়, অল্প দূরে বসে ওর দিকে একঝলক তাকিয়েই সে বুঝে নিল। চাইল অন্যসময়ের মতো দৃপ্ত স্বরে পরের কথাগুলো বলতে। অথচ কণ্ঠে আওয়াজ আসতেই তিতিক্ষা অবাক হয়ে শুনলো ওর নিজের স্বরে ঝরে পড়ছে সহমর্মিতার মেদুর আভা!
‘অত জটিল তো হবার কথা নয়। মায়ের মন, একটু করুণ ভাব দেখালেই হয়তো দূর্বল হয়ে যাবে। আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে।’

‘কি প্ল্যান?’ নিনাদ মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে।

নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সম্মুখে মুখ ফেরায় তিতিক্ষা। ধীর সুস্থে এক চামচ তরকারি নিজের প্লেটে তুলে নেয়। মনোযোগ সহকারে ভাতে মাখতে থাকে। মহাবিরক্ত হয়ে অপেক্ষারত নিনাদ ওরপানে চেয়ে রইল। তিতিক্ষা কয়েকবার ভাত মুখে দিল। লবণ কম হয়েছে বলে একটু কাঁচা লবণ নিয়ে পুনরায় ভাতে মাখলো। পুরটা সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল নিনাদ। ক্ষীণ একটা
রাগের হলকা চনমনিয়ে মাথার অভিমুখে ছুটছে। অমর্ষণ ফেটে পরবে এই মুহুর্তে তিতিক্ষা হালকা গলায় বলল,’অফিস থেকে কিছুদিনের ছুটি নিন। আমরা নিজে মানিকগঞ্জ গিয়ে ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলে ফুআম্মা কিছুতেই ফেরাতে পারবেন না।’

উত্তাপটা ক্রমশ সরে যেতে লাগলো নিনাদের মুখ থেকে। হঠাৎ গুরুতর ভঙ্গিতে ঝুঁকে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’সত্যি কাজ হবে? কদিনের ছুটি নেব?’

তিতিক্ষার হঠাৎ মনে হলো বিয়ে করে, বউয়ের অত্যাচারের সঙ্গে যুঝতে না পেরে লোকটা বোধহয় সত্যিই বোকা বনে গেছে। কদিনের ছুটি নেবে, সে ভাবনাটাও এখন নিজে ভাবতে পারছে না।

‘অন্তত এক সপ্তাহ। ফুআম্মার মান ভাঙিয়ে আমরা আমাদের সাথে করে নিয়ে আসবো। এসবে একটু সময় তো লাগবেই।’

‘এখানে নিয়ে আসার কথা তুমি বলছো? ফুআম্মা যদি পার্মানেন্টলি আমাদের সাথেই থাকতে চান..’

তিতিক্ষা বিস্ময় নিয়ে তাকায়, ‘উনিতো পার্মানেন্টই থাকবেন!’

‘ফুআম্মা পার্মানেন্ট থাকবেন, একথা জেনেও আসতে বলছো?’

‘কি আশ্চর্য! আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?’

একটু থতমত খেয়ে যায় নিনাদ। ওর বলার ধরনটাতে হয়তো কিছু গড়বড় ছিল। কিন্তু কি আর করা, তিতিক্ষার সদ্য বলা কথাটা এতই অবিশ্বাস্য যে না বলে পারল না। ফুআম্মার নিজের পছন্দ করা মেয়ে পর্যন্ত যেখানে শর্তারোপ করেছিল বিয়ের পর ফুফু শাশুড়ির সঙ্গে এক হাড়িতে খাবে না, সেখানে তিতিক্ষা নিজ থেকে এমন একটা প্রস্তাব সত্যিই কি কখনো মন থেকে করতে পারে?

‘কি হলো? ‘

‘না কিছু না। তুমি ফুআম্মাকে নিয়ে থাকতে চাইছো এটা বিশ্বাস হচ্ছিল না।’

‘থাকতে চাইব না এটা কেমন কথা! উনি আপনাকে মায়ের মতো করে মানুষ করেছেন। আমার শাশুড়ী সম। এমন একজন মানুষ আমাদের পাশে সর্বদা থাকবেন এইতো সৌভাগ্যের কথা।’

বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে নিনাদ বলল,’ও আচ্ছা। তাহলে আ.. আমিই বোধহয় ভুল ভেবেছিলাম। ‘

‘কি ভেবেছিলেন?’

দৃষ্টি এদিক সেদিক ফিরিয়ে ইতস্তত করে নিনাদ বলে, ‘ভেবেছিলাম ফুআম্মা আমাদের বিয়েতে খুশি হননি তাই তুমি ফুআম্মাকে পছন্দ করো না।’

‘একটু আগেই তো বললাম অধিক অনুমান করা থেকে আল্লাহ তায়ালা আমাদের দূরে থাকতে বলেছেন।’

‘মনে ছিল না। ‘

শূন্য থালা নিয়ে তিতিক্ষা চেয়ার ছেড়ে ওঠে। যেতে যেতে স্বর মেদুর করে বলে, ‘এবার থেকে মনে রাখবেন।’

চলবে…
অদ্রিজা আশয়ারী