দূর আলাপন পর্ব-১০+১১

0
191

দূর আলাপন ~ ১০
__________________________
এয়ারপোর্টে সবাই এসেছিল নিনাদকে বিদায় জানাতে। বিশাল বন্ধুর দল, শিউলি ফুআম্মা, আফরিন, এছাড়া ঢাকায় থাকা কিছু দুঃসম্পর্কের আত্মীয় সকলে…
তবু যেন কার শূন্যতা মনগগনে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো। কি এক অজানা প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা যেন আনমনে নিনাদ করছিল।
আফরিন উৎসুক হয়ে তাকাচ্ছে এদিক-সেদিক। তাকাচ্ছে নিনাদও। তিহা সপরিবারে আসবে। সেজন্যই বুঝি প্রছন্ন এই তীব্র প্রতীক্ষা। আজ নিশ্চয়ই পরিবারের সঙ্গে আসবে তিতিক্ষা?
আসবে… নিশ্চয়ই আসবে… আজকের দিনে না আসতে হলে যতটা নির্দয়তা প্রয়োজন, তিতিক্ষা নিশ্চয়ই এই শেষ সময়ে তার ওপর অতটা নির্দয় হবে না!

আফরিনের প্রসারিত হাসি দেখে নিনাদ বোঝে ওরা এসেছে। সবার আগে ছেলে কোলে নিয়ে রওশান সামনে আসে। নিনাদ অস্ফুট হাসিটা মুখে ধরে রেখে ওদের স্বাগত জানায়। তারপর পুনরায় তাকায় আগমনী পথের দিকে। একে একে আসেন মারুফ তিহা সবাই। সন্দিগ্ধ চোখদয় ওদের ফেলে আসা পথে বিছিয়ে রাখে নিনাদ। হয়তো এক্ষনি এসে যাবে ছোট গিন্নি। ভাবগম্ভীর অভিমানী মুখ স্থির করে রাখবে দেয়ালের পানে।
কিন্তু কোথায় সে? কতদূরে? তিহা পর্যন্ত চলে এল, তবে এত দেরি কেন হচ্ছে তিতিক্ষার? নিনাদ কি একটু দেখে আসবে?
না, তা হয়না যে। ওকে ঘিরে জড়ো হওয়া এতগুলো মানুষ, এদের সবার স্নেহ অগ্রাহ্য করে কি করে মরিচীকার পেছনে সে ছুটে যাবে?

বুকের ভেতর গহন শূন্যতার হাহাকার আগে থেকেই ছিল। এত এত প্রিয় মুখের মায়া, স্মৃতি সব ফেলে কোথায় না কোথায় চলে যাচ্ছে নিনাদ। যাচ্ছে এমন স্থানে, চাইলেই যেখান থেকে ছুটে আসা যাবে না, তীব্র মন খারাপের সময়ে শিউলি ফুআম্মার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যাবে না, একা একা লাগলে ফোন করে বন্ধুদের ডেকে আড্ডা দেয়া যাবে না। প্রিয় মানুষ গুলোর সঙ্গে এমন অকাট্য দূরত্ব তো কখনো নিনাদ চায়নি! অথচ কে না জানতো দেশ ছাড়া মানে সমস্ত মায়া কাটিয়ে পাথর হয়ে যাওয়া! এই নিঃসীম হাহাকার, সবাইকে ছেড়ে যাবার যন্ত্রণা আর তিতিক্ষার প্রকাশ্য অবহেলা।

সবের প্রতি নিনাদের বিতৃষ্ণা জাগছিল। অস্থির সুস্থির অবস্থার এক ঘোরের মাঝেই সবার সাথে কথা বলে যেতে হলো ওকে। সবাই শুভকামনা জানিয়ে ছোট ছোট উপহার ধরিয়ে দিচ্ছে। একজোট হওয়া বন্ধুরা প্রচুর হাসছে আর আলাপে মশগুল হয়ে আছে। এক ফাঁকে তিহাকে জিগ্যেস করল তিতিক্ষার কথা। ভেতরের দাবদগ্ধ আবহের আঁচ কেউ যেন না পায় সেজন্য সবার সঙ্গে হাসছিল নিনাদ।
‘কিরে ছোট গিন্নি এল না যে?’

বোনের কথা ওঠাতে তিহা একটু নিভে যায়। কি বলবে হঠাৎ যেন বুঝে উঠতে পারে না। ম্লান হয়ে বলে,’ নারে, এত করে বললাম আমি আর বাবা। কথা শুনলে তো। বলল সবাই চলে এলে বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকবে। সেকথা অবশ্য ঠিক।’
‘ও ভালো কথা! তিতিক্ষা একটা গিফট পাঠিয়েছে তোর জন্য।’ ব্যস্ত হাতে প্যাকেট টা বন্ধুকে দিল তিহা। নিনাদ যন্ত্রের মতই নিল।
একটু চুপচাপ, একটু ছন্নছাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল নিনাদ। আর হাসলো না, বাড়তি কথা বলল না। ডাক পড়তেই ব্যস্ত হয়ে জিনিসপত্র এক করে চলে যেতে উদ্যত হলো।
ফ্লাইটের বেশিক্ষণ বাকি নেই, সব বুঝে শুনে গুছিয়ে নিয়ে উঠতে হবে। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে, আরেক দফা ফুআম্মার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে শেষ বারের মতো নিনাদ সবাইকে একনজর দেখল। অবচেতন মনে তখনো ক্ষীন আশা হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছে তিতিক্ষা। শেষ পর্যন্ত না এসে পারেনি। কিন্তু কোথায়?

কোথাও নেই। নিজেকে প্রবোধ দেয় নিনাদ। প্রস্তরের ন্যায় স্থবির দৃষ্টি সম্মুখে নিক্ষেপ করে হাটতে শুরু করে। পেছনে শিউলি আফরিন তিহা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। পেছন না ফিরে হাটার গতি বৃদ্ধি করে নিনাদ। ওদের কান্নার আওয়াজ কি তার কানে এসে পৌঁছায় নি? পৌঁছালে নিনাদ কি করে অত নির্বিকার হয়ে চলে যেতে পারল? নিনাদ এতই নিষ্ঠুর!

______________________

ওহিও’র বাহারি রঙের মেঘপূর্ণ শীতল আকাশে তখন রাত্রি নেমেছে। রাতের গভীরতার সাথে সাথে আকাশে মেঘ সরে গিয়ে উঠেছে মস্ত থালার মত বড় এক রূপালী চাঁদ। তীব্র স্বচ্ছ প্রস্ফুটিত পূর্ণ চাঁদের আলোয় পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে।
কত বড় চাঁদ! নিনাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। বাংলাদেশের আকাশে চাঁদকে কখনো এত বড় আর উজ্জ্বল দেখেনি।

নিনাদ চাঁদের পানে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ। যে বাড়িটায় সে উঠেছে সেখানে ছাদ নেই। আশেপাশের কোন বাড়িতেই ওপরে ওঠান মতো ছাদ নেই। কিন্তু বাড়ির সামনে বিশাল খোলা জায়গা আছে। এই মধ্যরাত্তিরে নিনাদ খাপছাড়া ভাবে খোলা স্থানে হেটে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে দেখে ওই একফালি রূপোর থালাটাকে। হঠাৎ হঠাৎ কেমন শূন্য লাগে চারপাশ। বুকের ভেতরে যেন এক ঊষর মরুভূমি সম শূন্যতা। কত আনন্দময় বিচিত্র জীবন এখানে। যেদিকে চায় সবুজের গাঢ় আবাহন, ঝকঝকে তকতকে পথঘাট, রুমমেটরা প্রত্যেকে অত্যন্ত মিশুক। মাসে একবার ওরা ফিশিংয়ে যায়, লেক ইরিতে যাওয়া হয় সময়ে অসময়ে ইচ্ছে হলেই। বড় ভাইয়েরা, নতুন বন্ধুরা সবাই ওকে খুব স্নেহ করে। এখানে সে সবার চেয়ে বয়সে ছোট ও নতুন বলে।

নিনাদ জানে, এখানে তার জীবন সকল বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। যা ইচ্ছে তাই করতে পারে সে। বাঁধা দেবে না কেউ, বিবেক ছাড়া। তবু যে কেন এত বিস্বাদ লাগে সব তার কারণ জানে না ও। কতরকম কাজ সারাদিনে। পড়াশোনা, ছুটোছুটি, নতুন দেশে সেটেল হবার হাবিজাবি নানান ঝামেলা। দিনগুলো কেটে যায় ভীষণ ব্যাস্ততায়। কিন্তু রাতগুলো যেন ফুরাতে চায় না কিছুতেই।

একা একা রাত জাগবার সময় টুকুতে বহুদূরের অতীত পর্যন্ত ঠান্ডা হাওয়ায় মতো ওকে ছুঁয়ে দিয়ে যায়। মনে পড়ে বহু বছর আগের সেই বিভীষিকাময় রাত্রি গুলোর কথা। যখন অভাবের সংসারে মাঝপথে তাদের ফেলে বাবা চলে গেলেন ওপারে। বাবার মৃত্যুতে ভীষণ শোকে আর অদূরবর্তী ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন মা। তিনিও বাবার পথেই হাটলেন৷ মানসিক যাতনা আর সইতে না পেরে মারা গেলেন বাবার মৃত্যুর ঊনিশ দিনের মাথায়। নিনাদ তখন সাত মাসের কোলের ভাইটাকে নিয়ে এই পৃথিবী নামক মাঝদরিয়ায় পুরোপুরি একা। ভাইটাকে সে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল নিজের সর্বোচ্চ টুকু দিয়ে। অনাহারে নিজে শুকিয়ে মরছিল, তবু ভাইটার জন্য একমুঠো খাবার জোগাতে দিনরাত ছুটতো। এতো একাগ্র চেষ্টার পরও ভাইটা বাঁচল না। এক শরত দুপুরে প্রচন্ড জ্বরে ধুঁকে ধুঁকে, অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেল নিনাদের শেষ আপনজন। পৃথিবীর আলো, বাতাস, জল ছাড়া আর নিজের বলে কিছু রইল না নিনাদের।
আত্মীয়স্বজনের এবার দয়া হলো। একে একে ছুটে এলো অনেকে। কিন্তু কেমন যেন হয়ে পড়েছিল নিনাদ। চোখেমুখে স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। শেষতক দূর গ্রাম থেকে ছুটে এলেন নিনাদের বাবার সৎ বোন স্বামীহীনা নিঃসন্তান শিউলি। তাকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি। ধীরে ধীরে সুস্থ হলো নিনাদ। ওকে ভর্তি করিয়ে দিলেন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে।

স্কুলের শিক্ষকরা কিছুদিন পরই শিউলিকে ডেকে নিয়ে জানাল নিনাদ পড়াশোনায় বেশ ভালো। এক ক্লাস ওপরের পড়া ধরে ফেলতে পারে অনায়াসে। ফাইভ পাসের পর স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিজ উদ্যোগে ওকে শহরে পড়ার জন্য পাঠাতে চাইলেন। শিউলি বেগম গ্রামের মেয়ে হলেও ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। আবেগী মন তার ছিল না। তিনি রাজি হলেন ছেলেকে শহরে পড়াতে। ঢাকার পাশে মানিকগঞ্জের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে নিনাদ আবার এল শহরে। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে গেল।

নিনাদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। কি দিন ছিল, কি দিন এল, জীবনে কত সে পেল, কত সে হারাল। শুরুতে সে যেমন একা ছিল আজও তেমনই একা সে রয়ে গেল। মাঝে যে এসেছিল মাঝেই সে চলে গেছে। না, সে আদৌও কখনো আসেনি নিনাদের জীবনে। নিনাদ জোর করে টেনে এনেছিল তাকে। এবার স্বইচ্ছায় ছেড়ে দিল। আর কেউ আসবে? প্রয়োজন নেই। নিনাদ একা ভালো থাকতে শিখে গেছে।

রাতের পর দিনের আগমনের যে স্বাভাবিকতা, নিনাদের জীবন এখানে সেই নিয়মে বাঁধা। নিগূঢ় আঁধারের রাত্রি গুলো কেটে যায়, ফের দিন আসে। নিনাদ খায়, দায়, ভার্সিটি যায়। সবকিছু চলছে ঠিক যেমন চলার কথা। তবে এইসব একঘেয়ে দিনের মাঝেও কিছু কিছু ভিন্নতা আছে। নিসঙ্গতায় বোঝা যায় লোকসমাগমের মাহাত্ম্য। নিনাদও ঠিক তেমনি এখানে একা, ভালোবাসাহীন হয়ে বুঝেছে মনস্যজীবনে ছোট ছোট মায়ার বাঁধন, মিষ্টি বোঝাপড়ার অপরিহার্যতা। যতক্ষণ কাজে ডুবে থাকে ততক্ষণই ভালো। সামান্য অবসর পেলেই চারদিক থেকে চেপে ধরে একাকীত্ব।

কত যে অতীত স্মৃতি, পুরনো কথা, হারানো মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা মাথা চারা দিয়ে ওঠে সেসময় সময়… অস্থিরতা কমাতে, দু দুন্ড শান্তির নিমিত্তে আজকাল ইবাদাতে বেশ মনোযোগী হয়েছে নিনাদ। একান্ত নিজের মানসিক স্থিরতার জন্যই আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ খুঁজে চলেছে হন্যে হয়ে। বুকের খাঁচায় আর কারো জন্য জাগতিক ভালোবাসা পুষে রাখা নেই বলেই যেন আল্লাহকে ডেকে এত শান্তি পায়।

আজকাল কাজ ছাড়া নিনাদ ঘরের বাইরে পা বাড়াতে চায় না একটুও। মানুষের লঘু আলাপে সঙ্গদানের চাইতে নিজের ঘরে একা বসে থাকতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অবসরে বই, জার্নাল পড়া আর প্রত্যেক সকাল বিকেলে একা একা ঘুরে বেড়ানোই এখন ওর বাঁধা রুটিনে পরিণত হয়েছে। নবাগত ছেলেটার এই অদ্ভুত ধরনধারণ দেখে বাকিরা অবাক হয়। সাধারণত প্রথম প্রথম এখানে আসার পর কি রেখে কি করবে, কোন জায়গা ছেড়ে কোন জায়গায় যাবে সেসব ভেবেই অস্থির থাকে সবাই। অথচ শুরু থেকেই কোন কিছুতে আগ্রহ নেই ছেলেটার। সে যেন আমেরিকা নামক বন্দী জেলখানায় বছরের পর বছর অবরুদ্ধ থেকে ভীষণ ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছে। একটুখানি বাইরের আলো বাতাসের জন্য ভেতর যেন হাঁসফাঁস করছে সবসময়।
আজও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সবাই যখন প্রস্তুতি জুড়ে দিল লেক ইরিতে যাওয়ার জন্য, তখনো নিনাদ বসে রইল চুপচাপ। জিগ্যেস করলে জানাল শরীর ভালো লাগছে না। অবশেষে তাকে রেখেই বিকেলে বেরিয়ে পড়ে সবাই। অনেকক্ষণ জেরার পর একটু একা হতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচে নিনাদ।

_________________

তখন সায়ংকালের শুরু, জানালার পর্দা সরিয়ে নিনাদ বাইরে তাকায়। রাস্তা দিয়ে সা সা করে একের পর এক গাড়ি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলেছে। গুড স্ট্রিটের ইতস্তত ছড়ানো বাড়ি গুলোয় সন্ধ্যেতেই যেন মাঝরাত্রির নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কোনো আওয়াজ নেই, কারো বাড়ির আঙ্গিনায় কোন মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। নিনাদ সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়। সঙ্গোপনে ফেলে দীর্ঘ নিশ্বাস। এতো একা কেন সে?

আজ চার মাস হতে চলল তিহা বা তার পরিবারের কারো সাথেই যোগাযোগ নেই। প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিক ছিল। নিয়মিত কথা হত তিহা ছোটন আর রওশানের সাথে। তারপর হঠাৎ একদিন অসময়ে তিহার কল। ছোট বাচ্চাদের অবুঝ আবদারে বড়রা যেভাবে ভোলাতে চায়, ছলনা করে বোঝাতে চায় যে “তাদের চাহিদার বস্তুটি দূর আকাশের চাঁদ। নাগাল পাওয়া যার অসম্ভব। অতএব পাওয়ার বাসনা তাকে ছাড়তে হবে।” ঠিক সেভাবেই সেদিন তিহাও তাকে কিছু একটা বুঝিয়েছিল…

জানালার কাছ থেকে সরে নিনাদ আলমিরার সামনে এসে দাঁড়ায়। আলমিরা খুলে খুব সন্তর্পণে বের করে কিছু একটা। একটা রেপারে মোড়ানো গভীর সবুজে রাঙানো মুসল্লা আর খুব সুন্দর কাঠের রেহাল ও অনুবাদ সহ একটা কুরআন।
একে একে সবগুল বের করে নিনাদ। কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেয়, দেশের ঘ্রাণ, দেশের ধুলো বাতাসের ঘ্রাণ। ঘ্রাণ নিতেই ওহিও’র গুড স্ট্রিটের একটি বাড়ির নিভৃত আধো অন্ধকার ঘরে বসে থেকেও সে যেন ফিরে যায় বাংলাদেশে, তার ফেলে আসা সোনালী দিনগুলোতে। তখন যা ছিল অতি তুচ্ছ, হয়তো যা কিছুই ছিল না। এখন যেন তা-ই নিনাদের কাছে এক সমুদ্র দুঃখের মাঝে হয়ে ওঠে এক পশলা সুখের মতন। অতীতের একই স্মৃতি আজ কেবলই অনুরণনের মত বারবার বেজে যায় তার কানে।

এটুকুই তিতিক্ষার শেষ স্মৃতি চিহ্ন হিশেবে রয়ে গেছে তার কাছে। আর কিছু নেই। নতুন করে কোন স্মৃতি জমানোর সুযোগও নেই। তিতিক্ষাকে আর কোনোদিন ছোট গিন্নি বলে ডাকা যাবে না। তিহার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে সম্ভবত তিতিক্ষা এখন অন্যের ঘরনি!
যেদিন অনেক বার ইতস্তত শেষে প্রথম কথাটা জানিয়ে ছিল তিহা তারপর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে নিনাদের যোগাযোগ একরকম বন্ধই হয়ে আছে। তবে এখনো রোজ কল করেন ফুআম্মা। আগের মতো সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে না নিনাদ। ইচ্ছে, কিংবা জোর কোনটাই পায়না।

কখনো অরবে সরবে বিষাক্ত সময়ের কিছু আখ্যান এখনো মনে পড়ে। মনে পড়ে তিহার শেষ স্বান্তনা। তিতিক্ষা ওকে, ওর মতো কাউকে নাকি চায়নি কোনোদিন। স্বাধীনচেতা মেয়ে তিতিক্ষা, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো ভাবপ্রবনতা নেই ওর। সুতরাং নিনাদ যেন আর আশা না রাখে।

শান্ত হয়ে সবটা শুনলো নিনাদ৷ বিরোধিতা করার চিন্তা টুকুও যেন বড় ক্লান্তিকর। তাই নিরব থেকে শুনে গেল তিতিক্ষার কথা, তার হবু স্বামীর কথা। মস্ত নাকি বিজ্ঞ ব্যাক্তি। দশ এলাকার ছেলেদের আদর্শ! একটা খ্যাতনামা কলেজের প্রভাষক। নিনাদ হাসল। ভালোই হলো। এমন ছেলেকেই তো মানায় তিতিক্ষার পাশে। আর নিনাদ! আস্তাকুড় থেকে উঠে আসা শেকড় হীন মানুষ সে। যার চরিত্রের ঠিক নেই, মতিগতির স্থিরতা নেই। এমন খেয়ালি মানুষের তো সাধারণ একটা জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখাও পাপ! ভালো থাকুক ওরা দুজন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মিলেমিশে থাকুক। নিজের অভিশপ্ত জীবনের আখ্যান নিয়ে নিনাদ কখনো ওদের দ্বারে ভিড়বে না!
চলবে…..

দূর আলাপন ~ ১১
____________________________
বহুদিন আগে গত হয়েছে বসন্ত। শেষ হয়েছে লাল গোলাপি, আর সবুজ নীলের আবছায়া সুখের সময়। ঋতুচক্রে এখন বৈশাখ, প্রকৃতির রুক্ষতম মাস। স্থল জল অন্তঃরীক্ষ সব খাক করে, প্রচন্ড দাবদাহ আর কাঠফাটা রোদ্দুরে মানুষকে জ্বালিয়ে নিষ্ঠুর ঋতু হাসে বিজয়ীর হাসি।
বৈশাখের এই খাঁ খাঁ দুপুরে, বিগতবসন্তের কোকিলের ডাক কান পাতলে এখনো শোনা যায়। ডাকতে ডাকতে ওরা ক্লান্ত হয়, থেমে যায় সুর, তৃষ্ণায় বিশুষ্ক হয়ে ওঠে ঠোঁট। পাখিগুলো এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে বসে। তৃষ্ণায় ছটফটানো ছোট্ট বুক দ্রুত ওঠানামা করে। পাখিদের এত কষ্ট, অস্থির ছটফটানি আর পিয়াসায় দুরন্ত নেচে বেড়ানো কিছুই যেন স্পর্শ করে না নির্দয় ঋতুর বিবেককে।

ঘরের ঝকঝকে সাদা মেঝেতে একটা নিস্পন্দ বস্তু পড়ে আছে। জানালার পলকা সফেদ পরদা উড়ছে অবিরল। খোলা বারান্দা গলে হু হু করে ভেসে আসে তপ্ত বিধুর হাওয়া। ঘরের ভেতরের উত্তাপে যেন স্ফুলিঙ্গ ঝরে। বারান্দায় তাকালে শ্রান্ত বৈশাখ দুপুরের শুষ্ক রূপ ভীষণ ভাবে চোখে পড়ে। নজরে আসে সেই তৃষ্ণার্ত পাখিটার অস্থির ছটফটানিও।

দরজার বাইরে থেকে খুব ক্ষীণ স্বরে ডাকছে কেউ। খানিকটা ত্রাস, অত্যল্প স্নেহ মেশানো সে ডাক। মেঝেতে পড়ে থাকা বস্তুটি হঠাৎ একটু নড়েচড়ে ওঠে। তখন বোঝা যায় বস্তু নয়, ওটা একটা প্রাণ। জীবন মৃত্যুর সীমারেখা বিস্মৃত হওয়া অলীক এক মানুষ।

তিহা আবার ডাকে। ধীরে ধীরে ভীষণ যত্নে পুনরাবৃত্তি করে ক’টা শব্দ,’তিতি… দরজা খোল তিতি…’
কোন সারা নেই। নির্জীব দেহখানা অসার হয়ে মিশে থাকে মেঝের সঙ্গে। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে আশ্চর্য ওই আকাশের পানে। ধাঁধা লাগে, চোখ বুজে আসতে চায়, তবুও সে চেয়ে থাকে অহেতুক অকারণ।

সময়ের সাথে সাথে দরজার বাইরে গলার আওয়াজ একসময় জোড়ালো হয়ে আপনাতে নিভে যায়। হতাশ হয়ে ডাকা বন্ধ করে তিহা। চলে যায় দরজা ছেড়ে।

বস্তুরুপী প্রাণ চেতনাশূন্যের মতো মেঝেতে গা এলিয়ে পড়ে থেকে শোনে দূর মসজিদে পড়ছে যোহরের আজান।

হাইয়া আলাস্ সলাহ
হাইয়া আলাল ফালাহ

সলাতের জন্য এসো
সাফল্যের জন্য এসো

প্রলম্বিত নিশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে সে উঠে বসে। সময় হয়েছে, একান্ত এবং একমাত্র প্রিয়জনের সাথে কথা বলার।
স্থবির গা হাত-পা ঠেলে উঠিয়ে বাথরুমের দিকে চলে যায়।
ক্ষণকাল পরে ঢিলেঢালা পোশাকের ওপর বড় ওড়না জড়িয়ে মুসল্লায় দাঁড়িয়ে নিয়ত বাঁধে। অযত্নে মাথা মোছার ফলে তখনো ভেজা চুল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে , মুখে লেগে রয়েছে বিন্দু বিন্দু ওজুর পানি।
পরম আবেশে, নির্ভেদ একাত্বতার সাথে সে রবের ইবাদতে মশগুল হয়। কিছুক্ষণ… আরো কিছুক্ষণ….. তারপর আরো কিছুক্ষণ….. নিরন্তর সময় বয়ে যায়। সিজদায় পড়ে থাকে তিতিক্ষা। মুখে কোনো রা নেই, চোখ বেয়ে শুধু জল গড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায়। যিনি অন্তর্যামী, তার সম্মুখে কয়েকটা এলোমেলো শব্দ উচ্চারণের কিইবা প্রয়োজন?

.

মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে আওয়াজ পেয়ে ছুটে আসেন মারুফ। পেছন ফিরে বাবাকে দেখে আবার কাজে মন দেয় তিহা। ওর বিমর্ষ ম্লান মুখে তাকিয়ে মারুফ কি যে বলতে এসেছিলেন ভুলে বসলেন। রান্নাঘরের দোরগোড়ায় অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। চিন্তার খেই হারানো বাবার ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি দেখে একসময় মায়া হলো তিহার।
‘কি বলতে এসেছো বাবা?’

‘কি আর? আমার ছোটমায়ের কথা। ও কি কিছু খেয়েছে? কিছু বলল?’

তিহা মলিন হাসে,’আজকের দিন কি অন্য দিন থেকে আলাদা বাবা? যে ও কথা বলবে? কথা বলা, খাওয়া এসব তো দূর! দরজাই যে খোলে নি।’
মারুফের ক্লান্ত মুখ ঝুলে পড়ে। সহসা ব্যস্ত গলায় বলেন,’যাই, ছোটনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। ও এলে যদি কথাটথা বলে… দুটো খাবার মুখে দেয়…’

তিহা নিশ্চুপ। রোজ রোজই তো ছোটনকে পাঠাচ্ছে ওইঘরে। কোনো লাভ নেই।

.

স্কুল থেকে ছোটন ফিরলে ছেলের পোশাক বদলে, খাইয়ে আজও তিহা বোনের ঘরে ঠেলে দিল। যাওয়ার আগে শিখিয়ে পড়িয়ে নিল কি করতে হবে। আজকাল মিমির কাছে যাওয়ার নামে মুখ শুকিয়ে আসে ছোটনের। মিমিকে এখন বাঘের মত ভয় পায় বাচ্চাটা। তবু যায় ছোটন। সেই যে একটা সময় ছিল, যখন মিমি তাকে খুব ভালোবাসতো, রাতদিন তারা দুজন একসাথে কাটাতো। কত হাসি, কত দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখতো সারাবাড়ি… সেসব দিনের কথা মনে করেই, মিমির কাছে একা যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে ছোটন।
তিহাও নিরুপায়। ছেলেটা ডরায় জেনেও রোজ ওকে পাঠায়। কারণ একমাত্র ছোটন ডাকলেই যে ও ঘরের অবরুদ্ধ দরজা ক্ষণকালের জন্য খোলে।

ভয়ে ভয়ে কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল ছোটন। মায়ের ইশারায় একসময় ডাকলো,’মিমি… আমি ছোটন, দরজা খোলো। ও মিমি, দরজা খুলবে না?’
কিঞ্চিৎ সময় পর ওপাশে নব ঘোরানোর আওয়াজ হয়। দরজা খুলে আবার গিয়ে আগের জায়গায় বসে পড়ে তিতিক্ষা। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে ছোটন মিমির পাশে মাটিতে বসে। মায়ের শেখানো কথাগুলো একে একে ভুলে যেতে থাকে। শেখানো বুলি বিস্মৃত হলেও ছোটনের নিজের মনের মধ্যে কথা কম জমা নেই। আস্তে আস্তে ও সহজ হয়। মিমির গা ঘেঁষে বসে খাপছাড়া যত কথা আরম্ভ করে।
‘জানো মিমি, স্কুলে সামিন নামে আমার যে বন্ধুটা আছে? আজ ও পরে গেছিল মাঠে, সবার সামনে… হো হো করে সবার সে কি হাসি… সামিন খুব কাঁদছিল তখন।’
তিতিক্ষার অচল গম্ভীর কায়া একটু নড়েচড়ে ওঠে। রুক্ষ চোখে তাকিয়ে সহসা বলে,’ তুমি কি করলে তখন? হাসছিলে সবার সাথে?’

মিমির ককর্শ স্বরে ছোটন দমে যায়। নিচু গলায় ভয়ে ভয়ে বলে, ‘ও তো আমার বন্ধু হয়। আমারও খুব কান্না পাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে ওকে টেনে তুলেছি।’

তিতিক্ষার বাঁকানো ভ্রু জোড়া আবার সরল হয়ে আসে। ভাবলেশহীন দৃষ্টি আবারো সম্মুখে নিক্ষেপ করে সে।

‘আমি ভালো করিনি মিমি?’

‘হুম’

‘কেউ কষ্ট পেলে আমাদের হাসা উচিত নয়। তাই না মিমি?’

‘হুম’

‘মিমি, তোমার কি অনেক কষ্ট? তোমার কষ্টে সবাই খুব হেসেছিল। এজন্য তুমি সবসময় মন খারাপ করে থাকো। তাই না?’

কিছুটা সময় কেটে যাবার পর তিতিক্ষা পাশ ফিরল। ছোটন দেখল মিমির চোখের পানি নাকের পাশ দিয়ে ক্রমান্বয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অল্প অল্প নাক টানছে, ক্রমে বাড়ছে তার কান্নার বেগ।

মুখেচোখে কষ্টের ছাপ ফুটে ওঠে ছোটনের। তার মিমির এত কষ্ট, যদি পারতো ইরেজার দিয়ে কষ্টের সবকটা দিন মুছে দিতো সে মিমির জীবন থেকে। তিতিক্ষার অবস্থা দেখে ছোটন নিজের ভয় ভুলে গেছে। পাশ থেকে উঠে মিমির কোলে চড়ে বসেছে অনায়েসে। ছোট ছোট হাতে মিমির চোখ মুছে দিয়ে বলল,’তুমি কেঁদো না মিমি। আমি আছি তো! যে তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছে বড় হয়ে আমি তাকে ভীষণ শাস্তি দেব। ও তোমাকে মেরেছিল, তাই না মিমি? আমিও ওকে খুব মারবো। শুধু আরেকটু বড় হয়ে নিই।’ বলে তিতিক্ষার কপালের কাটা দাগের ওপর চুমু খেল ছোটন। সমস্ত নিঃসাড়তা ভুলে দু হাত বাড়িয়ে সন্তানসম শিশুটিকে একসময় জড়িয়ে ধরল তিতিক্ষা। তার নিঃশব্দ কান্নার নিরব সাক্ষী হয়ে রইল দরজার আড়ালে দাঁড়ানো তিহা…

__________________

ভালোবাসা সর্বগ্রাসী! একটা মানুষকে কত সহজে নিজের আসন ছেড়ে টেনে হিচঁড়ে নামিয়ে আনে রাস্তায়। মানুষ ভুলে যায় তার আত্মমর্যাদা, তার অবস্থান।
দীর্ঘ পাঁচমাস পর নিনাদ যখন নিজের তাগিদে তিহাকে প্রথম কল করল, নিজেকে তার ভীষণ নির্লজ্জ আর নাছোড় মানুষ বলেই মনে হল। তার গোটা জীবন জুড়েই ভালোবাসার অপ্রতুলতা ছিল চিরকাল। তাই যেখানে একটু অনুরাগের আভাস পেয়েছে, কাঙালের মত ছুটে গেছে সেদিকে। না পাওয়ার ব্যর্থতা এক, আর পেয়ে হারানোর যাতনা আরেক। দুইয়ে আকাশপাতাল পার্থক্য। একসময় নিনাদের প্রায় কেউ-ই ছিল না। মানিয়ে গেছিল এই পরিস্থিতির সঙ্গে। তারপর একে একে অনেক গুলো প্রিয় মুখ একসঙ্গে জড়ো হলো। আজ তাদের অনেকে নেই। হয়তো কোথাও আছে ওদের অস্তিত্ব, কিন্তু নিনাদের সঙ্গে আর সম্মন্ধ টুকু বজায় নেই। সবাই সব ভুলেছে, ভুলে যেতে পারেনি কেবল নিনাদ। পারেনি কারণ পুরনো কে ভুলতে গেলে যে নতুন আসঞ্জনের প্রয়োজন। কিন্তু এখন তখন… কখনোই নিনাদের কোনো আসঞ্জন ছিল না। নির্লজ্জের মত আগ বাড়িয়ে আবারো তাই পুরনোর পথে ধাবিত হতে চায় তার বেহায়া মন…

ফোন কানে চেপে নিনাদের কেমন অস্বস্তি হতে থাকে। মাঝখানে কতগুলো দিন কেটে গেছে, তিহা আগের মতই হেসে কথা বলবে তো? ছোটন ডেকে উঠবে তো বন্ধু বলে? নাকি ওর কথা এরমধ্যে ভুলে গেছে ছোটন!
আবোলতাবোল নানান কথা ভেবে একসময় নিনাদ মনে প্রাণে চাইতে থাকে কলটা যেন কেটে যায়। থাক দরকার নেই পুরনো সম্পর্ক জিইয়ে তোলার। ওরা যেমন আছে তেমনি থাকুক। এতগুলো দিন যখন নিনাদকে ভুলে থাকতে পেরেছে সামনেও পারবে।

কিন্তু মনস্কামনা পুরোপুরি ব্যার্থ করে দিয়ে তখনই ওপাশ থেকে তিহার দায়সারা গলা ভেসে আসে, ‘হ্যালো।’
নিনাদ ভারি অপ্রস্তুত হয়। কিঞ্চিৎ কাল স্তব্ধ থাকার পর ইতস্তত হেসে জিগ্যেস করে,’ভালো আছিস? ওহ আসসালামু আলাইকুম!’

কে ফোন করেছে এতক্ষণে ঠাওর করতে পেরে অস্ফুট হাসে তিহা। কণ্ঠে স্বাভাবিকতা ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলে, ‘ওহ তুই! বিদেশি নাম্বার খেয়াল করিনি। ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমরা ভালো আছি। এতদিন পর যে? শেষতক মনে পরল তাহলে আমাদের কথা?’

মনে তো তিহারও পরে নি। এই কয়েক মাসে কল করে নি একবারও। কিন্তু নিনাদ সেসব কথার ধার দিয়ে না গিয়ে সম্পুর্ন অপরাধ নিজের দিকে টানে, ‘ব্যাস্ততা অনেক বেড়েছে রে। যদিও একটা কল করার মত সময়ও ছিল না বললে বাড়িয়ে বলা হয়। অজুহাত দেব না। ভুল তো ছিলই।’

ওপাশ থেকে শুধু একটা অস্ফুট শব্দ ভেসে এল। তিহার প্রাণহীন নিস্পন্দ হাসি। তারপর কথা হারিয়ে ফেললো দুজনে।
অবাক লাগে নিনাদের। তিহার পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক টা এত দূরের হয়ে গেছে যে কথা খুঁজে পাচ্ছে না আজ।
‘ওদিকে সবার কি অবস্থা? ছোটন, রওশান ভাই, আঙ্কেল… ভালো আছে তো সবাই?’
অনেক ভেবে যুতসই একটা প্রশ্ন খুঁজে পেল নিনাদ।

‘আলহামদুলিল্লাহ, সবাই ভালোই আছে। তুই ফিরছিস কবে? এক বছর তো হয়েই গেল…’

‘তা জানাতেই কল করেছিলাম। ফিরছি একমাস পর। ফুআম্মা বলে রেখেছেন দেশে এলেই গলায় দড়ি পড়াবেন। মেয়ে ফেয়ে সব নাকি ঠিক। দড়ি যখন পড়তেই হবে তবে অত তাড়াহুড়োর কি? সেজন্য ভাবছিলাম আসাটা পিছিয়ে দেব… ‘

‘বাহ! শেষতক তোর বিয়েটা ঠিক হয়েই গেল তাহলে। আসা পেছাবি কেন? তাড়াতাড়ি আয়। শুভ কাজে দেরি কি? তা পাত্রীটা কে? আমাদের আফরিন ই তো?’

নিনাদ হাসলো,’কি যে বলিস…. কোনো খবর রাখিস না দেখি তুই! আফরিনের বিয়ে সেই কবে হয়ে গেছে!’

‘কিহ! সত্যি বিয়ে হয়ে গেছে?’ স্থবিরতা কাটিয়ে এতক্ষণে সত্যিকারের বিস্ময় ফুটে উঠল তিহার মুখে।

‘হ্যাঁ। বিয়েটা ফুআম্মাই দিয়েছেন। ইয়ে… আমাদের গ্রামের এক ছেলের সাথে আফরিনের একটা সম্পর্ক মত ছিল…’

‘ফুআম্মা নিজেই বিয়ে দিলেন! তোর সাথে ওর বিয়ে নিয়ে কত উৎসাহ ছিল ফুআম্মার… আর আফরিন, তলে তলে অমন সেয়ানা তা তো দেখে বুঝিনি!’

আবারো হাসে নিনাদ,’বুঝিস ই তো। বিদেশবিভুঁইয়ে থাকা ছেলেরা এমনিতেই সন্দেহজনক হয়, তার ওপর পরিবারের শেকড় বলতে যার কিছু নেই, আদব, লেহাজ, চরিত্র সেসব কিছুও তো তেমন যুতসই নয়। ফুআম্মাই বা কেন রিস্ক নেবেন? তুই যেমন আমি দেশ ছাড়তেই সুযোগ পেয়ে বোনের শুভ কাজটা সেরে ফেললি, তেমনি ফুআম্মাও আর বাজে ছেলের জন্য ধৈর্য রাখতে পারলেন না।’

উত্তরে তিহা কিছু বলল না। নিনাদ তাহলে সেসব কথা এখনো মনে রেখেছে… আজ সুযোগ পেয়ে কি সুন্দর শুনিয়ে দিল। ভালোই করেছে নিনাদ। ভুলতে শুরু করা অতীত ক্ষতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। কিন্তু ও কি করে জানবে যে নিজের করা ভুলের মাশুল তিহাকে কত ভয়াবহ ভাবে গুনতে হয়েছিল। গুনতে হচ্ছে আজও।

উত্তর না পেয়ে নিনাদ ডাকে,’কিরে, কি হল? রাগ করলি? বোকা মেয়ে! আমি তো শুধু তোকে খেপানোর জন্য বলছিলাম। তা নাহলে আমি কি আর জানি না তিতিক্ষার কত অযোগ্য আমি? সত্যি বলতে ওর বিয়ের কথা শুনে আমি খুশিই হয়েছি। তিতিক্ষা যোগ্য বর পেয়েছে। আর আফরিনের ব্যাপার টা তো শুরু থেকেই কিছুকিছু জানতাম। সেজন্য তখন ফুআম্মার এত জেদের কাছেও বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকতে হয়েছিল। এবার বুঝলি?’

এবারো প্রতুত্তর করল না তিহা। ভেতরে দলা পাকিয়ে উঠছে উতরোল কান্নার বেগ। নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে৷ মনে মনে নিজের বুকে শতবার চাকুর ফলা বিঁধিয়ে তিহা হিসহিস করে, ‘সব দোষ আমার… সব দোষ আমার… পৃথিবীর দু প্রান্তে দুটো প্রাণ বেঁচেও বাঁচার স্বপ্ন হারিয়েছে আমার ভুলের জন্য। তিতিক্ষা প্রতিনিয়ত জ্বলছে পুড়ছে অবর্ননীয় যাতনার খরতাপে, আর প্রিয় মানুষ গুলোর থেকে সবচেয়ে কঠিন ধাক্কা খাবার পর নিনাদ বেঁচে আছে পাথর হয়ে।
এসব কি করেছিলাম আমি? কেন এত জটিল খেলা খেলেছিলাম সামান্য একটু সাচ্ছন্দ্যের জন্য। অবুঝের মত নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করতে থাকে তিহা।

‘তিহা, কি হলো তোর? কাঁদছে কে তোর পাশে? হ্যালো… তি.. তিহা তুই ই কাঁদছিস নাতো?
কি সর্বনাশ! আমার কথায় কেঁদে ফেলতে হবে? আমি কি অত বুঝেশুঝে সব কথা বলি নাকি? এই বোকা কথা বল। কাঁদলে ফোন রেখে দিচ্ছি। ছাড়লাম…’

‘না… নিনাদ শোন। একটা…. একটা… কথা বলা হয়নি তোকে…’ তিহার রুদ্ধ স্বর নিলীন হয়ে আসে। কিছু একটা টের পায় যেন নিনাদ। সঙ্গিন গলায় উত্তর করে, ‘হ্যাঁ বল না।’

আরো দু দন্ড নিরব থাকে তিহা। সহসা বলতে শুরু করে, ‘তিতিক্ষার বিয়েটা আসলে হয়নি। বিয়ের দিন সকালে… ওরা ভেঙে দিয়েছে।’ বলে হু হু কান্নার ভেঙে পড়ে তিহা।

‘বিয়ে ভেঙে দিয়েছে! এটা কোনো ব্যাপার হলো? বিয়ে ভেঙে গেছে তো কি হয়েছে? আবার বিয়ে হবে। এজন্য তুই কাঁদছিস? এই যুগে এসব কেউ গোনে নাকি? তুই ভাবিস না। আমি এসে ওর ভালো জায়গায় বিয়ে দেব… ‘

কথার মাঝখানেই তিহা ওকে থামায়, ‘ না রে। কিছু জানিস না তুই। তিতিক্ষার আর কখনো বিয়ে হবে না। একটা ঝড় এসে আমার বোনের জীবন চিরতরের জন্য ওলট-পালট করে দিয়ে চলে গেছে। এরপর আর কিছু হবার নয়।’

‘মানে?’ অতল গম্ভীরতা ভেঁদ করে কাঁকিয়ে ওঠে নিনাদ।

‘মানেটা খুব কঠিন। তুই নিতে পারবি না।’

‘কিসব আজেবাজে কথা বলছিস। দ্রুত বল আমাকে কি হয়েছে। হ্যালো… তিহা…. ‘

‘আমি…’ কথাটুকু শেষ পর্যন্ত বলা হলো না তিহার। অদূর থেকে ভেসে আসা এক অশরীরির করুণ আর্তনাদ ওকে ফোন ছাড়তে বাধ্য করল। দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে, ছুটে গেল বোনের ঘরে। তিতিক্ষার আসুরিক চিৎকার আর ভাংচুরের শব্দ ঘরের দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে।

বিছানার এককোণে অবহেলায় পড়ে থাকা সেলফোনের অন্যপাশ থেকে তখনো চেঁচাচ্ছে নিনাদ,’ তিহা….. তিহা….. কথা বল তিহা। কি হয়েছে তিতিক্ষার? বল… হ্যালো….. ‘
চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে