Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 290



দূর আলাপন পর্ব-০৯

0

দূর আলাপন ~ ৯
___________________________
নিনাদের যাওয়ার দিন প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। বিয়ে নিয়ে আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অথবা আড়ালে কিছু আয়োজন শুরু হয়ে থাকলেও তার খবর পেলনা তিতিক্ষা। শিউলি ফুআম্মা কি আদৌ ব্যপার টা আগে ভেবেছেন? নিনাদ কি রাজি হয়েছে? বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে কি আফরিন?
নাহ! কিচ্ছু জানে না তিতিক্ষা। ওবাড়ির কারো সাথেই যোগাযোগ তেমন নেই ওর। ছিল না কখনো। অথচ তারই বড় বোন তিহা সারাদিন ফোনে গুজুরগুজুর করে ওবাড়ির লোকেদের সাথে। রান্নার সময় কানে ফোন, ছেলেকে পড়ানোর বেলায় কানে ফোন। রাতে দিনে অনুক্ষণ কি অত কথা বলে ওদের সঙ্গে বুবু? বিয়ে নিয়ে আলাপ? কি রঙের শাড়ি পরবে আফরিন… কোন ফুলের ঝালরে ওদের বাড়ি সাজানো হবে… এইসব?

আজকাল তিতিক্ষা আপনার জগতে আরো বেশি একা। বুবুর দেহ এখানে কিন্তু মনের সবটুকু পড়ে থাকে মোহাম্মদপুরের এক ছোট ফ্ল্যাটে। এরমধ্যে মারুফকে আবার যেতে হলো দেশের বাড়ি। কিশোরগঞ্জে নিজেদের গেরস্তের বাড়ি, দুটো দুধেল গাভী আর জমিজমাও যথেষ্ট রয়েছে। সেসব দেখাশোনা করে মারুফের দুসম্পর্কের এক ভাই। মাসে মাসে গিয়ে তিনি গেরস্ত দেখে আসার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সকল কিছুর হিসেবপত্তর নিয়ে আসেন।

বাবা বাসায় নেই। ফিরতে অন্তত দুদিন লাগবে। দুই বোন ছানাটিকে নিয়ে বাসায় একা।
সন্ধ্যে থেকেই আকাশ গজরাচ্ছে। এলোমেলো দমকা হাওয়ার সাথে অনবরত লোডশেডিং। বাবা টর্চটা সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এখন মোমবাতিই ভরসা।
ঘরের চারকোণে চারটা মোমবাতি জ্বালিয়ে চায়ের ট্রে এনে পা মুড়ে আয়েস করে সোফায় বসে তিতিক্ষা। মায়ের সঙ্গে কথা থামিয়ে ছোটন হামলে পড়ে মাখানো মুড়ির বাটিতে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তিতিক্ষা বুবুকে বলে, ‘আজ আর ঝামেলা না ই করি। চালে ডালে মিলিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিই। গরম খিচুড়ি আর গরুর মাংস। এই আবহাওয়ায় বেশ হবে!’

দ্বিমত করবার কোনো কারণ নেই। অগত্যা চা শেষ করেই মাতা-পুত্র-ভগিনী তিনে মিলে চলল রান্নাঘরে ধুন্ধুমার বাঁধাতে। রাতের দিকে বাইরের উত্তাল আবহাওয়া তখন আরও উগ্র। সন্ধ্যার আকাশ দেখে এতটা বোঝা যায় নি। বাবা বাড়ি নেই। কিছুটা ভয় ভয় করছিল দুই বোনের। যদিও মনের শঙ্কা প্রকাশ করল না কেউ। বরং জমপেশ আড্ডায় রান্নাঘর হয়ে উঠল জমজমাট। কখনো মা কথা বলছে মিমি হাসছে, কখনো বা মিমির কথায় মা আর ছোটন হেসে কুপোকাত। আজ নানাভাই নেই, মা মিমি দুজনের সমস্ত আদর আহ্লাদের একমাত্র মধ্য মণি তাই ছোটন। ওরা একসাথে ওযু করল, এশার সলাত পড়ল, মিমির সঙ্গে হাত তুলে ছোটন আল্লাহর কাছে দুআও করল। সব মিলিয়ে আজ সে বেজায় খুশি।

কিন্তু খানিক বাদেই ছোটন অবাক হয়ে দেখে মায়ের মুখখানা কেমন মিইয়ে গেছে। একটু আগের উৎফুল্ল ভাব একেবারে নেই। তিতিক্ষা টেবিলে খাবার গোছাচ্ছিল। এক ফাঁকে এসে রান্নাঘরে বোনকে মলিন মুখে সালাদ কাটতে দেখল।
‘কি হয়েছে বুবু? হঠাৎ মনমরা দেখাচ্ছে কেন?’

‘না রে। কি আবার হবে?’

‘বলোনা বুবু। কিছু তো নিশ্চিত হয়েছে। কারো কথা মনে পড়ছে?’

ম্লান মুখ তুলে তিহা তাকায় বোনের পানে। এত যে আগ্রহ দেখাচ্ছে তিতিক্ষা। অথচ স্পষ্ট জানে মন খারাপের কারণ বলা মাত্র মেয়েটা রেগে আগুন হবে।
‘কিছু না।’

চোখের সামনে বুবুর মলিন মুখখানা দেখে সত্যি খারাপ লাগছিল তিতিক্ষার। এই না খানিক আগেও বুবু কত হাসছিল! ইচ্ছে হলো যেকোনো উপায়ে বুবুর মন ভালো করে দেয়।
‘বলো না প্লিজ। না বললে কি করে তোমার মন ভালো করার উপায় খুঁজি বলোতো?’

‘বললেও তো তুই রাগই করবি।’

‘যা! কি বলছো!’

‘হ্যাঁ।’

‘বাজে কথা। অকারণে কেন রাগ করবো? বলেই দেখোনা। যা করলে তোমার মন ভালো হয় তাই করবো।’

বলার আগে তিহা কিছুক্ষণ সময় নেয়। বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় নিশ্বাস ফেলে বলে,’আর মাত্র তিনদিন। তারপরই নিনাদ কত দূরে চলে যাবে। ও খিচুড়ি খেতে খুব ভালোবাসে। গতকাল কথায় কথায় বলেছিল খাবার কথা… ‘

বুবুর বিমর্ষ হবার কারণ তবে এই! মুখের রঙ বদলায় মুহুর্তে। এব্যপারে বুবুকে কোনোরকম সাহায্যের পথ তার জানা নেই।
দুজনকে ঘিরে নেমে আসে অমোঘ নিরবতা। একসময় নিরবতা ভেঙে তিহা মৃদ্যু গলায় অস্পষ্ট আওয়াজে বলে, ‘বলেছিলাম না তুই রেগে যাবি?’

‘আমি রাগিনি।’

‘তাহলে নিনাদ কে ডাকি?’

তিতিক্ষা ঝাপসা চোখে তাকায়।

কৈফিয়তের সুরে তিহা বলে,’খেয়েই চলে যাবে। একদন্ড বসতেও বলবো না। দেখিস!’

দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল তিতিক্ষা। স্বরে আভাসিত হলো মৌন সম্মতি,’কিন্তু তোমার তো পর্দা নষ্ট হবে। মুখে ভাই বললেও ওযে তোমার লা মাহরাম।’

‘পর্দা তো করি না। নষ্ট হবার কি?’

‘কিন্তু করাই উচিত ছিল।’ তিতিক্ষার গলায় আফসোস ঝরে পড়ে।

‘করবো করবো… তুই আল্লাহ ওয়ালা মানুষ। আমার জন্য বেশি করে হেদায়েতের দুআ করে দিস!’ তিহার স্বরে খুশির নতুন মাত্রা। রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে নিচু গলায় বলল,’যাই, নিনাদ কে একটা ফোন করে আসতে বলে দিই।’

বুবুর ছায়া পুরোপুরি বিলীন হবার পর একা রান্নাঘরে তিতিক্ষা চাপা রাগে আস্ফালন করল। ফোঁস ফোঁস করে বলল,
‘শুধু নিনাদকেই বা কেন ডাকবে? ওর বউ নাকি হবু বউ আফরিন। ও কি দোষ করেছে? ওকেও ডাকো। দুজন একসাথে আসুক৷ একটা ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ব্যাবস্থা করে দিই। খেতে খেতে প্রেম করুক!’

.

বাইরে তখন ঝোড়ো হাওয়ায় পরিবেশ উত্তাল। থেকে থেকে অশনির চমক আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির নিস্বন। টং দোকানের সাধারণ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নিনাদ সামনে ফেরে। সঙ্গে ছাতা নেই। ভালোই হলো। আধভেজা কাঠের বেঞ্চ ছেড়ে ওঠার জোরটা ঠিকঠাক পাচ্ছে না।
চা টা বিস্বাদ, রোজকার মতো। তবু নিনাদ রোজ আসে, বসে, চা খায়। ভালো লাগে।
কেন ভালো লাগে তার কারণ খতিয়ে দেখার কথাটা নিনাদ ভাবে না। ভাবতে ভালো লাগে না। কিছু আবেগ এতটাই অর্থহীন যে তা নিয়ে ভাবতেও অস্বস্তি বোধ হয়।

সামনে, অদূরে, ওই হলুদাভ ল্যাম্পপোস্টের আলো অবিরত নিয়ন আলো ছড়াচ্ছে যেখানে, তার ঠিক ডানে একতলা বাড়িটা তিতিক্ষাদের। আজ যে বাইরের পৃথিবীটা এত অস্থির, দুর্নিবার ঝড়ে সমাচ্ছন্ন, ভেতরের নিরাপদ আলয়ে কি করছে ওরা, কি করছে তিতিক্ষা?
কখনো, ভুলেও কি একবারের জন্য নিনাদের নামটা ওর মনে পড়েছে? মনে পড়া মাত্রই কি তিতিক্ষা ভীষণ ক্ষোভে তেঁতে উঠেছে? হ্যাঁ, তাই তো হবার কথা। নিনাদ নাম টা যে বড় অপ্রিয় তিতিক্ষার। নিনাদ শব্দটাই এত বিরক্তিকর। না রেগে পারে না মেয়েটা। অথচ তার প্রিয় পাত্র হবার চেষ্টা নিনাদ এখনো করে যাচ্ছে। করে গেছে আজীবন।

কিন্তু অত রাগী, অত সাবধানী, অত খুঁতখুঁতে যার রুচি সব ব্যপারে, তার প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠা সোজা কথা তো নয়! যেমন সে দশটা মেয়ের চেয়ে আলাদা, তেমনি আলাদা ধরন তার চাওয়া পাওয়ার। ওর মনের মতো হতে গেলে যে নিনাদকে নিজের গোটা জীবনের ছকটাই বদলে ফেলতে হয়। এতটা ও পেরে ওঠে কি করে? পারে না বলেই বুঝি এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেল তিতিক্ষা। এই দূরত্ব কখনো ঘুচবে সেরকম ধারণাও এখন প্রহসন ছাড়া কিছু না।

আর তিনদিন মাত্র। তারপর কতশত বার পৃথিবী ঘুরবে নিজ কক্ষপথে, কত সন্ধ্যা নিজের রঙ হারিয়ে ঝরে যাবে বৃষ্টি হয়ে, কত আশ্চর্য বিকেল, অলীক ভোর কেটে যাবে। নিনাদ নিবিড় নিঃসঙ্গতায় একা হয়ে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পড়ে থাকবে। এখানে ঘটে যাবে কত অত্যাশ্চর্য ঘটনা। সেসব থামানোর ক্ষমতা নিনাদের তো নেই!

অথচ শেষ সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু বলা হলো না, বলা গেল না৷ যেভাবে রেখে যাচ্ছে, সেভাবেই থাকবে তো সব? নিজের জগৎ নিয়ে তিতিক্ষা আলাদা থাকতে চায় থাকুক। শুধু একইরকম রয়ে যাক, কখনো অতটা দূরে না যাক যাতে ওর স্মৃতি বিস্মৃতির পথে পা বাড়ায়…

বেজে ওঠে ফোন। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তিহা বলে বড় বোনের মতো আবদারের গলায়,’ওরে নিদু, একবার জলদি আয় তো। এক্ষুনি আসতে হবে কিন্তু। পারবি না?’

‘আসছি। কেন?’

‘আছে আছে… এভাবে বলা যায় নাকি? যেখানে আছিস, আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে পর। এলেই দেখবি।’

খেয়ালি তিহা ডাকছে, হয়তো তিহার মতই খেয়ালি কোনো কারনে। না গেলে হয় না? একটা মিথ্যা বাহানা দিয়ে যাবে না বলে দিলেই তো হয়! কিন্তু নিজের চাওয়া পাওয়ার বাইরেও তো কতকিছু করতে হয় মানুষকে। বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নিনাদ। টাকা মিটিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আবছায়া পথে নামে তিতিক্ষাদের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে।

__________________

নিনাদের ঘুম হয় না। হালফিল রাতগুলো জেগে কেটে যাচ্ছে। এরপর হয়তো এটাই তার রুটিন হয়ে দাঁড়াবে। দিনভর ঘুমিয়ে রাতটা জেগে কাটানো। বাংলাদেশে যখন দিন, তখন আমেরিকায় গাঢ় রাত। সেখানে গিয়ে রাতের বেলা ঘুমালেও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দিনেই ঘুমানো হয়। হিসেবে দাঁড়ায় একরকম।

এদেশে আজ শেষ রাত। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে অস্থির মন নিয়ে নিনাদ শোয়া থেকে উঠে বসে। এই রাতটাও নির্ঘুম যাবে।
অথচ কাল বিকেলে ফ্লাইট। একটা ঘুমের ওষুধ কি খেয়ে নেবে? ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সজাগ যতক্ষণ, উটকো দুর্ভাবনারা ওকে মুহুর্তের তরে রেহাই দেবে না। এই মুহুর্তে একটাই অনুশোচনা ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, এতটাই যে দেশ ছাড়ার কষ্টটাও এর কাছে ফিঁকে হয়ে গেছে।

কেন যে তখন বলতে গেছিল ওসব কথা। ও সুযোগ দিল বলেই তো অতগুলো কথা শোনানোর সুযোগ পেয়েছিল তিতিক্ষা। বিকেলের সবটা স্মৃতি মনে পড়ে নিনাদের।
তিহা বলে রেখেছিল যাবার আগে নিনাদকে কিছু মাংসের কোয়াব বানিয়ে দেবে। বিদেশবিভুঁইয়ে কি না কি খেতে হয়। এজন্য তিহা যত পারছে শুকনো খাবার সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছে। কোয়াব নিয়ে কথা বলার জন্যই বিকেলে ওর নাম্বারে কল করতে উদ্যত হল নিনাদ। ফোনে ব্যলেন্স শেষ দেখে শেষ পর্যন্ত কল করেছিল আফরিনের ফোন থেকে। তিহা তখন ছেলেকে নিয়ে ছাদে। বুবুর ফোনে আননোন নাম্বার দেখে ইতস্তত করে রিসিভ করল তিতিক্ষা।
নিনাদের স্বর শুনে রেখেই দিচ্ছিল। অনেক অনুরোধ উপরোধের পর কল কাটায় এক মিনিট বিলম্ব করতে রাজি হলো। মূলত রাজি হলো দয়াবশত। হয়তো সত্যিই কোনো জরুরি কথা বলার আছে ছেলেটার। খানিক পরেই যদিও শতভাগ ভুল প্রমাণিত হয় তিতিক্ষা। ঝাঝালো গলায় ও যখন প্রথম বলল
‘কি বলার আছে জলদি বলুন। আমি বুবু এলে বলব।’

নিনাদ প্রত্যুত্তর করল,
‘তিহার সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা পরেও বলা যাবে। কল যেহেতু ধরেছো তোমার সঙ্গে কথাটা আগে সেরে নিই।’

তিতিক্ষা সন্দিগ্ধ হয়,’কিসের কথা?’

‘আমাদের কথা। না মানে আমাদের ফিউচারের কথা।’

‘আপনার সঙ্গে আমার ফিউচার সম্পর্কিত কথা কি করে থাকতে পারে?’

‘ওমা! থাকতে পারে না?’

‘না!’

নিনাদ নড়েচড়ে বসল,’আচ্ছা তর্কাতর্কি রাখো। দেখো তিতিক্ষা আমি ফ্র‍্যাঙ্কলি একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। তুমি কি আমার জন্য একটা বছর অপেক্ষা করবে?’

‘আপনার জন্য আমার অপেক্ষা করার কথা ছিল নাকি?’

‘তবে কি অপেক্ষা করবে না?’

‘এই ধরনের কোনো কমিটমেন্ট আমি কারো সঙ্গে করেছি বলে তো মনে পড়ছে না।’

‘তবে কি বিয়েই করে ফেলবে?’

‘সেটা আল্লাহর মর্জি। তিনি যখন যার সঙ্গে বিয়ে লিখে রেখেছেন তার সঙ্গেই তো হবে!’

নিনাদ আৎকে উঠল,’না না… যার তার সঙ্গে কেন? এক বছর পরে আমিই তো ফিরছি…’

‘আমি ফোন রাখছি।’

‘কেন?’

‘কারণ আপনি অবান্তর কথা বলছেন।’

‘বিয়ের কথা অবান্তর কেন হতে যাবে!’

‘বিয়ে কথাটা অবান্তর না। একে কেন্দ্র করে আপনি যা ভুলভুলাইয়া গড়ছেন সেটা অবান্তর। ‘

‘কেন আমাদের কি বিয়ে হতে পারে না? ‘

‘না।’

‘কারণ?’

‘কারণ আপনার সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গির আকাশ পাতাল পার্থক্য। আর…’

‘আর?’

‘আরো নানা রকম জটিলতা.. ‘

‘জটিলতা কার জীবনে নেই বলো? এরকম অজস্র জটিলতা নিয়েই তো পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ একে অন্যের সঙ্গে দিনের পর দিন বাস করছে। আমরাও পারব।’

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আরো কিছু অপ্রিয় সত্য বলতে গিয়ে থেমে যায় তিতিক্ষা। বুঝতে পারে, নিনাদ এসব কথা বলছে একটা ঘোরের বশে। ঘোর কেটে গেলেই পূর্বাবস্থায় ফিরবে। তখন এসব কথা ওর নিজের কাছেই বড় ঠুকনো মনে হবে।
ছলনা করেই হোক কাউকে খুশি করবে, এমন মেয়ে তিতিক্ষা নয়। স্পষ্টতই বলল, ‘আমার মানসিকতার সঙ্গে আমার নিজের পরিবারেরই বিস্তর পার্থক্য। আপনার সঙ্গে মিল হবার প্রশ্নই আসে না।
একথা বলাই বাহুল্য যে আমি যেমন, তেমন কাউকেই আমি চাইব। আল্লাহর সমস্ত বিধান পালনের ক্ষেত্রে যত্নবান, আদর্শ, চরিত্রবান কেউ। প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি তার নাই-বা থাকল, দুবেলা পেট পুরে নাই-বা খেতে পেলাম কিন্তু বাকি ক্ষেত্র গুলোতে আমি ছাড় দিতে পারি না।
দুনিয়াতে কিছু না হোক অন্তত আখিরাতে একটা
স্থায়ী সুখের আবাস চাই আমার।’
উত্তর শুনে নিনাদের মনে হল এতদিনে এই মেয়েটিকে সে কিছুমাত্র চিনতে পারে নি। তার এতদিনের সমস্ত স্বপ্ন, আশাও বৃথাই আঁকা হয়েছিল। এই মেয়ের চিন্তাধারা বয় অন্য এক স্রোতে, যার ধারে কাছে নিনাদের অস্তিত্বের কোনো চিহ্নও নেই!

বিকেলের আলো মরে আসছিল, সেই সাথে আলো হারাচ্ছিল নিনাদের বিমর্ষ মন। হঠাৎ সে সচেতন হয়ে ভাবতে চেষ্টা করল নিজের সরূপের প্রকৃত পরিচয়। কান পেতে শুনলো তার বহুদিনের জমানো সমস্ত আশার ধূলিসাৎ হবার, ওপাশের দরজাটা চিরতরে বন্ধ হবার নিদারুণ ভয়ানক শব্দ।
চলবে…….

দূর আলাপন পর্ব-০৮

0

দূর আলাপন ~ ৮
____________________________
ছোটন বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে সাদা আঁকার খাতায় লাল নীল রং তুলির ছোঁয়া লাগিয়ে নিজের ছোট্ট বেপরোয়া মনের অসংখ্য কল্পনা মিশিয়ে আঁকিবুঁকি করছিল।
পাশে বসে বই পড়ছিল তিতিক্ষা। বইয়ের বিষয়বস্তু বোধহয় হাসির। কারণ কয়েক মুহূর্ত পর পর অস্ফুট একটা হাসির আভাসে ভরে উঠছিল ওর মুখ। মাঝে মাঝে বইয়ের ফাঁকে আড়চোখে চেয়ে দেখে নিচ্ছিল ছোটন নিজের কাজ ঠিকমত করছে কিনা।

ছেলেবেলা থেকে তিতিক্ষা আঁকে ভীষণ ভালো। কখনো আঁকার মাস্টার রাখতে হয়নি, কাউকে দেখিয়ে দিতে হয়নি। তবু চিরকাল স্কুলের সব পরীক্ষায় আঁকার খাতায় তিতিক্ষার নাম্বার সবার ওপরে। অলিখিত ভাবেই তাই ছোটনকে আঁকা শেখানোর দায়িত্ব টা এসে ওর ঘাড়ে পড়েছে। এমনিতে ছাত্রটির সম্মন্ধে তিতিক্ষার কোনো অভিযোগ নেই। বয়সের প্রেক্ষিতে আঁকে ভালোই। কিন্তু ওর দুরন্তপনা সামলানই বড় মুশকিল। আঁকছে তো আঁকছে, হুট করে দেখা যাবে মাথার পোকা নাড়া দিয়েছে। রংপেন্সিল, আঁকার খাতা ফেলে ভোঁ দৌড়।

ছোটনের উদাসী ভাব লক্ষ্য করে তাই খানিকটা উৎসাহ যোগানোর জন্য তিতিক্ষা বলে, ‘ছোট মিয়া, পুরো মনোযোগ দাও। ভালো করে আঁকাটা শেখো। মিমির মান রাখতে হবে কিন্তু তোমাকে! ঠিকঠিক শিখলে মিমি তোমায় অনেক উপহার দেব।’

উপঢৌকনের নাম শুনে ছোটনের উদাস ভাব উবে যায় মুহুর্তে। আকুল কণ্ঠে বলে, ‘কি কি উপহার মিমি?’

‘উমম… আপাতত ৩৬ শেডের একটা প্যাস্টেল রঙের বক্স আর তিনটা গল্পের বই।’

উপহারের কথায় ছোটনের চোখে আলোর ঝলকানি খেলে গেল। কিন্তু মিমির শেষ কথাটা স্মরণ করে সচেতন হয়ে উঠল মুহুর্তে।
‘শুধু এই দুটো! তুমি না বললে অনেক গিফট?’

‘হুম অনেক গিফট ই তো। আপাতত এই দুটো রাখো, কিছুদিন পর আবার পাবে আর…. সবচেয়ে বড় গিফট টা দেব তুমি বড় হবার পর।’

চোয়াল ঝুলে পড়ে ছোটনের। ‘কিহ! বড় হবার পর… এতদিন কি করে অপেক্ষা করবো মিমি?’ ছোটন হতাশ গলায় বলে।

‘তা কি করি বলো! ভালো জিনিস পেতে হলে তো একটু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবেই।’

‘কি গিফট সেটা মিমি?’

‘ছোট মিয়ার না খুব বউয়ের শখ? ভাবছি ছোট মিয়াকে একটা সুন্দর বউ উপহার দেব!’

‘কেমন সুন্দর বউ মিমি?’

‘একটা লাল টুকটুকে খুব সুন্দর দেখতে বউ।’

ছোটন কৃতার্থ হল। চোখমুখে আলো ছড়িয়ে আরেকটা প্রশ্ন ছুড়ল তিতিক্ষার দিকে।

‘বউটা কি পুতুলের মতো মিমি? তাহলে তো খুব মজা হবে। তাই না?
আচ্ছা মিমি, লাল টুকটুকে বউটা কি এখনি দেয়া যায় না?’

তিতিক্ষার মন আজ বেশ প্রফুল্ল। নাহয় এই ধরনের ছেলেমানুষী কথা সে বলে না সাধারণত। ভাগ্নের কথাগুলো ভারি উপভোগ করছিল ও। রহস্য করে হেসে বলল,’বউ তো আগে খুঁজে বার করতে হবে। তার আগে কিভাবে দেই বল ছোট মিয়া? আর বউদের যে অনেক বায়না। টাকা, খাবার, পোশাক… পারবে তুমি সব দিতে?’

এতকিছু! ছোটন বিস্ময়ে হা হয়ে থাকে। ও নিজেই তো একটা ছোট মানুষ। মায়ের হাতেপায়ে ধরে লজেন্স কেনার টাকা নেয়। ও কি করে বউকে এতকিছু দেবে?
সরল মনে নিজের হিজিবিজি আঁকার খাতাটা দেখিয়ে বলে,’এটা দিলে হবে না? এতে আমার অনেক প্রিয় প্রিয় ছবি আছে। সবই নাহয় দিয়ে দেব। আর রঙ তুলিও।’ রঙ তুলি দেবার কথা বলতে গিয়ে স্বর কেঁপে যাচ্ছিল ছোটনের। কত প্রিয় ওর রঙতুলি…

খিলখিল করে হেসে ওঠে তিতিক্ষা। ছোটনের গাল টিপে দিয়ে বলে, ‘ওলে বাবালে.. বউয়ের কত শখ ছেলের… অত সাধের রঙ তুলি পর্যন্ত দিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। থাক থাক… অত কষ্ট করতে হবে না। আর কিছুদিন সবুর করো। আমার একটা মেয়ে হোক। তোমাকেই মেয়ে জামাই করব ইন শা আল্লাহ। রোজ রোজ রসগোল্লা আর জিলাপি খাওয়াব। ঠিকাছে?’

তীব্র ঔৎসক্যে মাথা নাড়ে ছোটন। সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ছবি ভাবতেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু একই সময়ে আরো একটা সুদূর সম্ভাবনার কথা ওর মনোজগতে ছায়া ফেলে। মিমি আজ যা বলল ঠিক একইরকম কথা বলেছিল আরেকজন। মিমি ওকে মেয়ে জামাই করে রসগোল্লা আর জিলাপি খাওয়াবে বলেছে। ওদিকে নিনাদ ইতোমধ্যে তাকে নিজের মেয়ের জামাই ঘোষণা করে অগ্রিম অনেক আকর্ষণীয় উপহার দিয়েছে ভবিষ্যতের সেই ব্যপারে টিকে উপলক্ষ করে। কিন্তু দুজনের মেয়ে জামাই সে একসঙ্গে হয় কি করে? দুটো লাল টুকটুকে বউ তো তার প্রয়োজন নেই। তবে সে কোনটা ছাড়ে?

মুখ করুন হয়ে আসে ছোটনের। ভ্রু কুঞ্চন করে তিতিক্ষা।
‘কি হলো ছোট মিয়া? মুখটা হঠাৎ ভার হয়ে গেল কেন?’

‘আমি তোমার মেয়ে জামাই হতে পারব না মিমি।’

‘ওমা কেন?’

‘বড় হয়ে আমাকে নিনাদ মামার মেয়েকেই যে বিয়ে করতে হবে। সেইজন্য মামা কত গিফটও দিয়েছে আমাকে… কি করে না করি?’

‘তারমানে নিনাদ মামাকে মিমির থেকেও বেশি পছন্দ ছোট মিয়ার! আর আমি কিনা ভাবতাম ছোটন আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।’ মেঁকি কান্নার ভাব করে ঠোঁট উলটে ফেলে তিতিক্ষা।

ছোটনের মনও মুহুর্তে ভার হয়ে আসে। সে তো চায় না মিমি একটুও কষ্ট পাক। কিন্তু কিইবা করার আছে? কি করে দুজনকেই খুশি রাখা যায় সে নিয়ে নানান উপায় ভাবতে থাকে ছোটন।
কোনটাই যুতসই মনে হয় না। তখন তার মনে পড়ে স্কুলের বন্ধু রাফানের কথা। রাফানকে যদিও সবাই ইঁচড়েপাকা ছেলে বলে, তবে এই মুহুর্তে রাফানের ফিসফিস করে বলা কথাটা বেশ কাজের মনে হলো। এরকম হলে আর চিন্তার কিছু নেই। ছোটন উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠে মিমিকে বলে, ‘একটা উপায় পেয়েছি মিমি!’

‘কি?’

‘রাফান আমায় বলেছে বিয়ে করলে সবার বাবু হয়। এক কাজ করো, তুমি নিনাদ মামাকে বিয়ে করে ফেল মিমি। আমি তাহলে দুজনের মেয়ে জামাই হতে পারব!’

বই নিয়ে বিছানায় বাজুতে হেলান দিয়ে বসে ছিল তিতিক্ষা। এই কথা শুনে সোজা হয়ে বসল। শীতল চোখদয় কিছুক্ষণ স্থির করে রাখল ছোটনের মুখের ওপর। সহসা কড়া গলায় বলল, ‘ছোটন! স্কুলে গিয়ে তবে এইসব পাকামো শেখা হচ্ছে তোমার? বাজে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে ভারি দুষ্টু হচ্ছো তো দিনদিন! আঁকা শেষ করো জলদি!’

শেষ কথাটা অতিরিক্ত জোরের সাথে বলে বইয়ে মুখ ডোবায় তিতিক্ষা।
কিন্তু মন বসাতে পারে না। বই নামিয়ে চেয়ে দেখে টলমল দুচোখ নিয়ে ছোটন নত মাথায় বসে আছে। একফোঁটা জল গড়িয়ে ওর কোলে পড়ে তখনি। নাক টেনে ঠোঁট উলটে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে ছোটন।

ঢোক গিলল তিতিক্ষা। বাচ্চাটা ভুল বলেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু ও এত ছোট যে নিজের কথার মর্মার্থ টুকু পর্যন্ত ওর জানা নেই। এই অবস্থায় ওকে অতর্কিত শাসনের জেরে ফেলা তিতিক্ষার আরো চরম ভুল। এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবক স্থানীয় হিসেবে তিতিক্ষা কর্তব্য ছিল কোমল ভাষায় বাচ্চাটাকে ভবিষ্যতে এ ধরনের কথা বলার ব্যাপারে সাবধান করা। অথচ তা না করে সে কিনা….

তিতিক্ষা বই বন্ধ করে পাশে রাখে। নরম আদুরে গলায় ডাকে ছোটনকে। চিরকাল মিমির একচেটিয়া আদরে অভস্ত্য ছোটন তখন অভিমানে দিশেহারা। মিমি ওকে টেনে নিজের কোলে বসাতেই মৃদু আওয়াজে একটা কাট্টি ঘোষণা করে ছোটন।
ছেলেমানুষী রাগের ধরন দেখে তিতিক্ষা না হেসে পারল না। স্নেহাতুর পরশ বুলিয়ে দিল মাথায়, ‘ মিমি খুব খুব সরি বাবা। আর রাগ করে থেকো না? প্লিজ…. বলে মাথায় কপালে অসংখ্য চুমু দিল তিতিক্ষা। আদুরে গলায় বলল, ‘এখন জলদি জলদি আড়ি ভাঙো তো দেখি!’

আদরে তরল হয়ে গিয়ে অল্প একটু হাসি ফুটে ওঠে ছোটনের মুখে। হাত বাড়িয়ে আড়ি ভেঙে বলে, ‘ভাঙলাম আড়ি।’

‘জাযাকিল্লহ খাইর আব্বু। এখন মিমি একটা কথা বলব, মন দিয়ে শুনবে ঠিকাছে?
শোনো ছোটন তুমি আজ যা বলেছ সেটা ভালো কথা নয় বাবা। এভারে আর কখনো বলবে না ঠিকাছে?’

ছোটন ততক্ষণে মিমির আদরে আদ্র। ওপর নিচ মাথা নাড়ল। আর কখনো বলবে না।

‘আই লাভ ইউ আব্বু। আজ আর আঁকতে হবে না। নানুভাইয়ের সঙ্গে একটু খেলা করে এসো।’

‘আই লাভ ইউ টু মিমি।’ বলে মিমির গালে চুমু খেয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল ছোটন।

কিয়ৎক্ষণ একা ঘরে বসে থাকে তিতিক্ষা। আবোলতাবোল ভাবনা ভাবতে ভাবতে ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে ওর মন। সে যে কিসের জন্য, তিতিক্ষা তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না। কি যেন একটা অসঙ্গতি কাটার মতো আটকে থাকে মনের চারপাশে। ছোটনকে বকা দেয়াটা সন্দেহাতীত ভাবেই বাড়াবাড়ি ছিল। ছোট বাচ্চারা এমন কত কথাই তো বলে। মূলত যার সাথে জড়িয়ে কথাটা বলেছে, সেটা মানতে পারে নি তিতিক্ষা। তাই হঠাৎ প্রতিক্রিয়া করে বসেছে।

এই দুঃখ বোধহয় ওর জীবনে ঘুচবে না। ঘুরে ফিরে জীবনের যেখানে তার অপমান, যন্ত্রণা, অভিঘাতের স্পর্শ.. সেখানেই কোথায় যেন নিনাদের উপস্থিতি বিদ্যমান। নিনাদ শব্দটা তার জন্য ক্লেশের কারন হয়েছে সর্বদা। নিজে যেচে কখনো যায়নি সে নিনাদের আশেপাশে। নিনাদই এসেছে বারবার। আর চারপাশের মানুষের কথা, ইয়ারর্কি দুঃখ দিয়েছে তাকে।

বিয়ে নিনাদ আফরিন কেই করুক। কিছু আসে যায় না তিতিক্ষার। কিন্তু ওই নিপাট সারল্যে ভরপুর গ্রাম্য মেয়েটির পাশে নিনাদ কে সে ঠিক মানতে পারে পারে না। মেয়েটা সরল, নিনাদের শত চতুরীর সামনে সামান্য প্রতিরোধ গড়ার সাধ্য ওর নেই। অথচ নিনাদের যে স্বরূপের সঙ্গে চিরকাল তিতিক্ষা পরিচিত, তার কানা কড়ি মিলও আফরিন মেয়েটার সঙ্গে নেই।
নিনাদ ছেলেবেলা থেকে ভীষণ চটপটে। নিজের মেধা আর সপ্রতিভ আচরণের জন্য সব স্তরের মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য। নিজের মেধা ও সুরূপের আকর্ষণ দিয়ে সারাজীবন ধরে বহু মেয়েকে সে নিজের দিকে আকৃষ্ট করেছে। তাদের সাথে তার সম্পর্ক টা ঠিক কোন পর্যায়ের ছিল সে নিয়েও একটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে তিতিক্ষার মনে।

উল্টো দিকে আফরিন মেয়েটা পুরোপুরি পরিণত মনস্ক নয়। গ্রামের সরল মনা দুরন্ত কিশোরী। ছোট বেলায় মা কে হারিয়ে সৎ মায়ের অসংখ্য লা থি-ঝাটা আর বাবার অনাদর অবহেলায় মানুষ। সুখের মধ্যে শুধু ছিল নিনাদের ফুফু, তথা ওর দূরসম্পর্কের চাচি শিউলি বেগমের স্নেহটুকু। অসহনীয় কষ্ট ভোগ করা ছাড়া জীবনের আর কোনো ক্ষেত্রে তেমন অভিজ্ঞতা নেই আফরিনের, অমন একটা দুরন্ত এক ছেলেকে শেকল পড়াতে পারবে তো আফরিন? শেষপর্যন্ত কে কার ফাঁদে আটকাবে? সবার ধারণা মিথ্যে করে শেষতক আফরিন নিজেই যদি নিনাদের জীবনের সরচিত নিয়মের দুর্বোধ্য ফাঁদে আটকে যায় যদি? সরলমনা মেয়েটার পাশে কে ছায়া হয়ে দাঁড়াবে তখন?

এই এক চিন্তা আজকাল তিতিক্ষার মাথায় জেঁকে বসেছে। বুবুকে শিউলি ফুআম্মার বলা প্রতিটি কথা ও জানিয়েছে। বুবুও বেশ খুশি এই সম্মন্ধে। হওয়ারই কথা। নিজের একান্ত আপনজনের মত বুবু চিরকাল নিনাদের দোষ গুলো আড়াল করে গুণোগান গেয়ে বেড়িয়েছে। এমনকি কখনো কখনো তিতিক্ষার সম্মুখেও!
নিনাদের বেপরোয়া জীবন সম্মন্ধে আগাগোড়া ধারণা থাকার পরও যে শুধুমাত্র নিনাদের ভালোর কথা ভেবে তিহা এই সম্মন্ধে রাজি হয়ে যাবে, তা বিলক্ষন জানতো তিতিক্ষা। আফরিনের জীবনে ধ্বংস নেমে আসুক, তবু নিনাদ ভালো থাকুক।

তিহা আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছে এই জেনে যে নিনাদের মনে যাই চলুক, তিতিক্ষা কখনো মন ফেরাবে না ওর দিকে। সেজন্য ও চায় নিনাদ আর আফরিনের বিয়েটা হোক।
চাইতে পারছে না শুধু তিতিক্ষা। চোখের সামনে একটা সহজ-সরল মেয়েকে ধোঁকা খেতে দেখে কিভাবে চুপ থাকবে সে! এইসব জটিল ধাঁধার প্রতক্ষ্যদর্শী অথচ প্রতিবাদ করবে না। এর জন্য কি পরকালে তাকে জবাবদিহি করতে হবে না?

চলবে….

দূর আলাপন পর্ব-০৭

0

দূর আলাপন ~ ৭
____________________________
নিনাদের ওখানে বেশ যত্নআত্তি করে খাইয়েছে, মেয়েদের মুখে সেকথা শুনে প্রসন্ন হলেন মারুফ। আগেই ভেবে রেখেছিলেন দেশের বাইরে যাবার আগে ছেলেটাকে একবার নিজের সামনে বসিয়ে খাওয়াবেন।
প্রস্তাবটা প্রথম উত্থাপন করলেন ছোট মেয়ের কাছে। সন্ধ্যের পর ছেলেকে নিয়ে পড়াতে বসেছে তিহা। তিতিক্ষা রান্নাঘরে রাতের খাবারের আয়োজন করছে। এক চুলায় ভাত, অন্য চুলায় বেগুন ভাজা। মারুফ নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে মৃদু কণ্ঠে মেয়েকে ডাকলেন,
‘কি করো তিতি মা?’

তিতিক্ষা ব্যস্ত ভঙ্গিতে পেছন ফিরল,’এইতো, ভাত রাধি। আজ রাতের মেন্যু বেগুন ভাজা, টেংরা মাছের তরকারি আর ডাল। চলবে তো বাবা?’

‘দৌড়াবে!’ বলে মারুফ সরল হাসলেন। বাবার এই হাসিতে তিতিক্ষা বারবার দ্রব হয়ে পড়ে। আজও তাই হলো। কিঞ্চিৎ আহ্লাদ নিয়ে বলল,’চা করে দেব বাবা?’ ঠিক যেভাবে পরিণত মায়েরা তাদের বাচ্চা ছেলেকে বলে।

চায়ের নামে মারুফ অবধারিত ভাবেই খুশি হন। সাগ্রহে বললেন, ‘হ্যাঁ দাও… কিন্তু দুটো চুলাই যে বন্ধ!’

‘সমস্যা নেই। ভাত হয়ে গেছে। নামিয়ে চা বসিয়ে দিচ্ছি।’

‘বেশ। তবে আমি যাই।’ ঘরের দিকে কয়েক পদক্ষেপ হেটে পুনরায় মারুফ ফিরলেন পেছনে, ‘তিতি মা শোনো, চা হয়ে গেলে তুমি একবার একটু সময় করে আমার ঘরে এসো। কথা আছে।’

.

চা নিয়ে বাবার ঘরে যেতে যেতে দুরুদুরু বুকে কতকিছু ভাবে তিতিক্ষা। কি বলার জন্য হঠাৎ ডেকেছেন বাবা? খুব সিরিয়াস কিছু?
নাহ, তবে তো বুবুরও ডাক পড়ত। যা হোক, গেলেই দেখা যাবে!

‘বাবা তোমার চা।’

‘হ্যাঁ রাখো।’ মারুফ পিঠ টান করে বসলেন।
‘একটা কথা ছিল মা, নিনাদ তো চলে যাচ্ছে। যাবার আগে ছেলেটাকে একদিন ডেকে ভালো মন্দ খাওয়ানো দরকার। এখন ওর বাড়ির মানুষও আছে…. এই শুক্রবার বরং দাওয়াত করে ওদের। কি বল?’
অপ্রতিভ ভাবটা আড়াল করলে পারল না তিতিক্ষা। বাবার কথায় আপত্তি করাও চলে না। ছদ্ম গম্ভীর নত মুখে একধ্যানে চা নাড়লে থাকে। মেয়ে কি বলে শোনার জন্য ব্যগ্র হয়ে চেয়ে থাকেন মারুফ।

‘তোমার যা ভালো মনে হয়।’ বলে তিতিক্ষা বাবার দিকে বাড়িয়ে ধরে চায়ের কাপ। মারুফ হাসিমুখে চা নিলেন। মেয়ের মেদুর কণ্ঠ তার উচ্ছ্বাস দমিয়ে দিতে পারল না। চায়ে চুমুক দিয়ে ঔৎসুক্য ভরে বললেন, ‘তবে তো ভালো খানাপিনার আয়োজন করতে হয়। কি কি লাগবে তুমি একটা লিস্ট করে ফেলো। কাল বাজারে যাব।’

‘আমি এসবের কিইবা বুঝি! বুবুকে আগে জানাও। ওর বন্ধু, ওর ফুআম্মা…. কি লাগবে কি রাধবে সে নাহয় বুবুই ঠিক করবে।’
অন্যসময়ের তুলনায় মেয়ের স্বরে এখন যে শিথিলতা বিরাজমান,তার তারতম্য একেবারেই টের পেলেন না মারুফ।

বাড়িতে মেহমান আসবে, জমজমাট হাসি আনন্দ খানাপিনা হবে। আপাতত এই ভাবনাতেই তিনি মহা খুশি।
‘হ্যাঁ তাই করো। ডেকে নিয়ে এসো তিহাকে। ওর সঙ্গে পরামর্শ করি।’

‘আচ্ছা।’ শান্ত গলায় বলে শব্দহীন পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল তিতিক্ষা।

.

আজকাল প্রায় রোজ বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষার আকাশে মেঘ যেন অফুরান। সকালে একছত্র বৃষ্টি, বিকেলেও। এই ঘোর বর্ষার মধ্যেই মারুফ সাহেব আসু অতিথিদের আপ্যায়নের বন্দবস্ত করতে লাগলেন। বাজার থেকে এলো বড় কাতলা মাছ, গরুর মাংস, নিনাদের প্রিয় গলদা চিংড়ি। আয়োজন চলতে লাগল পরবর্তী শুক্রবার কে কেন্দ্র করে। নিনাদকে জানানো হল দু দিন আগে। নিনাদ দুঃখ প্রকাশ করে জানাল এই সপ্তাহে ও কিছুতেই আসতে পারছে না। শনিবার ভিসা ইন্টারভিউ। কিছুটা পড়াশোনা আর প্রস্তুতির ব্যাপারও রয়েছে।

বেশ পরিতোষ চিত্তে মারুফ দাওয়াতের তারিখ পেছালেন। রওশানের কথা ভেবে আবারো এক শুক্রবার কে ঘিরে আয়োজন করা হলো, নিনাদের বিদেশ যাত্রার আট দিন আগে। নিনাদ তো থাকবেই তার ওপর আসছে রওশান। তিহা আর তার ছেলে দ্বিগুণ খুশি। কত আয়োজন উদ্দীপনা সেই দিনকে ঘিরে। অথচ সময় যত নিকটে আসতে লাগল আগ্রহ কমে তত স্তিমিত হয়ে যেতে থাকলো তিহা। শুক্রবার তাড়াতাড়ি আসা মানে নিনাদের যাওয়ার দিনও ঘনিয়ে আসা। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর কোথায়, কত দূরের এক দেশে চলে যাবে নিনাদ। যখন তখন ডেকে আনা যাবে না, কথা বলা যাবে না। নিনাদের তখন একটা আলাদা জীবন আর সে জীবন ঘিরে নানান ব্যস্ততা থাকবে। একে একে শিউলি ফুআম্মা আফরিন সবাই যে যার গন্তব্যে ফিরে যাবে। নিজের ছোট জগত নিয়ে হুল্লোড় প্রিয় তিহা হয়ে পড়বে ভীষণ একা।

মন খারাপের সংক্রামক হাওয়া যেন সবার ওপর দিয়েই বলে গেল। ফোনে শিউলি ফুআম্মার সঙ্গে কথাবার্তা আজকাল তেমন জমে ওঠে না। তিনি বারবার হারিয়ে ফেলেন খেই। সরলমনা আফরিন মাঝে মাঝেই নাক টেনে কাঁদে, ওর সঙ্গ দেন শিউলি। তিহা কি বলে এদের স্বান্তনা দেবে ভেবে পায় না। দীর্ঘ এক বছরের জন্য বিচ্ছেদ ও অপেক্ষা। এক বছরে কত কি ঘটে যেতে পারে। যে মানুষ গুলোকে রেখে যাবে, ফিরে এসে সবাইকে নিনাদ নাও পেতে পারে। তাছাড়া দূরদেশে নিনাদই বা একা ভালো থাকবে তো সবসময়? অসুখে পড়লে দেখবে কে? মন খারাপের দিনে একটু সহানুভূতির জন্য ছুটে যাবে কার কাছে?

সবাই আজকাল উপদেশের ওপর রাখছে নিনাদকে। আমেরিকার গিয়ে কি করে চলবে, খাবে-দাবে, কেমন ওষুধ পত্র সঙ্গে রাখবে, হালাল খাবার কি করে মেনেজ করবে আর শীতের দেশের উপযোগী পোশাক…. এসব নিয়ে রাতদিন উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে রওশান। আর ওর সকল হ্যাঁতে হ্যাঁ এবং নাতে না মেলাচ্ছে তিহা। বোন, বোনজামাইয়ের ক্রমাগত আদিখ্যেতা দেখলে তিতিক্ষার গা জ্বলে যায়। বিরক্তিতে মুখ বেজার করে থাকে সারাক্ষণ।
‘বিদেশ তো যাচ্ছে না, যেন রকেটে চড়ে মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে এলিয়েন খুঁজতে। ন্যাকামি দেখে মাথা ধরে গেল অসহ্য!’

______________________

ভোর বেলা থেকেই বাড়ি জুড়ে আজ ব্যস্ততা চরমে। নানাবিধ ব্যঞ্জন, তার জন্য হাজাররকমের জোগাড়জন্ত। কিন্তু সেসব করার মতো হাত মাত্র দু জোড়া। মা ও মিমির ব্যস্ত ছুটোছুটি দেখে একবার সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল ছোটন… কিন্তু দেখা গেল ও পাশে থাকলে কাজের চেয়ে অকাজ বরং বেশি হচ্ছে। একটা বিভীষণ ধমক দেবার কথা চিন্তা করছিল তিহা, তার আগেই তিতিক্ষা কৌশলে ভাগ্নেকে রান্নাঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। ছোট মানুষ, এত উৎসাহ নিয়ে এসেছে কাজ করতে, ওকে হতাশ করবে কি করে? ভেবে ভেবে একটা সহজ এবং নিরাপদ কাজ খুঁজে বের করল তিতিক্ষা, যেটা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ছোটনকে এক জায়গায় স্থিরও রাখা যাবে। একবাটি চাল আর একটা কুলোর সামনে ছোটনকে বসিয়ে বলল, ‘ছোট মিয়া, তুমি এই সবগুলো চাল আমাকে বেছে দাও তো।’

‘চাল বাছা কি খুব বড় কাজ মিমি?’

‘হ্যাঁ। তা তো অবশ্যই। চালগুলো বেছে দিলে আমার ভীষণ উপকার হয়। দেবে তো কাজটা?’

সজোড়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল ছোটন।

.

যথাসময়ে এলো নিনাদ আফরিন শিউলি ফুআম্মা। তিহা রান্না ফেলে ছুটে এসে আফরিন শিউলি ফুআম্মাকে ভেতরে নিয়ে গেল। পাঞ্জাবি পাজামা আর মাথায় টুপি পড়ে ফুলবাবু সেজে থাকা ছোটনকে হাত ধরে নিনাদ নিয়ে গেল মসজিদে। মারুফও প্রসন্ন মুখে ওদের সঙ্গে গেলেন।

মেয়েদের খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে অন্দরে, তিতিক্ষার ঘরে। ডাইনিং এ বসবে ছেলেরা। এই পর্ব বেশ ভালো ভাবেই শেষ হলো। যথাসময়ে রওশান আসতে পারেনি বলে একটু একা একা লাগছিল নিনাদের। খাওয়া শেষে খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর বাইরে গেল নিনাদ। কিছু বন্ধুদের আসার কথা ধানমন্ডি লেকে। বিকেলে এসে ফুআম্মা আর আফরিনকে ও নিয়ে যাবে।

খাবারের পর শেষ দুপুরের রোদ ছুটে পালাই পালাই করছিল যখন, তখন বাড়িটা যেন একটু ঝিমিয়ে পড়ল। মারুফ সাহেব নিজের ঘরে ভাতঘুম দিতে গেলেন। নিনাদ চলে গেছে বাইরে। অবশ্য আফরিনের মিষ্টি খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল মাঝেমধ্যে তিতিক্ষার ঘর থেকে। তিহার ঘরে গল্পের আসর জমেছিল পাতানো ফুফু ভাতিজিতে মিলে। সেখানেও খরা। কথা বলতে বলতে শিউলি ফুআম্মা তন্দ্রায় হেলে পড়লেন।

অবসর পেয়ে রান্নাঘরে চলে এলো তিহা। বিকেলে রওশান আসবে। বেচারা সময়মত রওনা হতে পারেনি বলে খুব আফসোস করছিল। ওর জন্য খাবার গুছিয়ে তুলে রাখতে হবে।

হঠাৎ আসা তন্দ্রা হঠাৎই ভেঙে গেল শিউলির। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে হাটতে হাটতে চলে এলেন তিতিক্ষা ঘরে। মেয়েটা একা ঘরে বসে আছে। শিউলিকে দেখেই তিতিক্ষা সাগ্রহে বলল,’আসুন ফুআম্মা। এখানে বসুন।’
ঈষৎ হেসে ওর পাশে বসে পড়লেন শিউলি। ‘আপ্পিনিরে দেখতাসি না। হে কই মা?’

‘ছোটন কে নিয়ে ছাদে গেছে। ডাকব?’

‘না.. না..। থাকুক, গেছে ভালোই হইসে। তোমাগর দুই বইনের লগে কিছু কথা কইবার আছিল মা। তোমার আপায় আবার কই গেল?’

অপ্রস্তুত হাসে তিতিক্ষা, ‘আপু বোধহয় রান্নাঘরে। আসবে এক্ষুনি।’
কিন্তু শিউলি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে নারাজ। কখন না কখন চলে আসে আফরিন। অস্থির হয়ে বললেন,’এহন কেউ নাই। কথাটা কওয়ার সুযোগ আছিল। তোমার আপায় তো দেরি করতাসে। আপ্পিনি না আবার নাইমা আসে ছাদ থাইকা।’
তারপর আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তিহা তখনো আসল না দেখে এবার বললেন,’আইচ্ছা, থাউক। এহন তুমারেই কই। পরে যদি আর সুযোগ না পাই। তখন তুমিই কইয়ো তুমার আপারে বুঝায়া। কেমন? ‘
তিতিক্ষা ঘাড় নাড়ল। শিউলি চাপা স্বরে বলতে শুরু করলেন, ‘তুমরার দুই বইনেরে তো নিনাদ খুব মানে। তাই তুমরার কাছেই দুঃখের কথা কই বুঝলা।
পোলাডা বিদেশ যাইতাসে। বিদেশের বাতাস গায়ে লাগলে পুলাপানের স্বভাব বিগড়ায়া যায়। পোলাডারে না করছিলাম দূর দেশে যাইতে। কিন্তু কথা শুনল না। তাই ভাবছি বিদেশ যাওনের আগে ওরে বিয়া দিয়া দিমু। একবার শিকল দিয়া শক্ত কইরা বানতে পারলে সহজে লাগাম আলগা হইব না। বুঝলা না?
আপ্পিনিরেও আনলাম সাথে। আমি ছাড়া তো আর কোনো কাছের আত্মীয়স্বজন কেউ নাই ওই দুইডার। ভাবছিলাম এইহানেই ওগো বিয়াডা দিয়া দিমু।
থেমে বললেন,’আজকালকার পুলাপানের কি যে স্বভাব! মতিগতি বুঝন বড় দায়। পোলার মনে যে কি চলে, বুঝা মুশকিল। খালি গাইগুই করে। বিয়ার কথা হাইসা সব উড়ায়া দেয়। কওতো দেহি, এমনে কিছু হইবো?
এহন তুমরাই আমার ভরসা। তুমরার সব কথাই হে শুনে। তুমরা ওরে বুঝায়া রাজি করাও।’

তিতিক্ষা কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে বসে রইল। শিউলি ফুআম্মার গুরুত্বপূর্ণ কথা তাকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে।
কিছু বলছে না দেখে তিনি আবার বললেন, ‘কি হইল? করবা তো তুমরা আমার এই উফকার টা?’

তিতিক্ষা হঠাৎ সম্বিত ফিরে পায় যেন। মলিন হেসে মৃদু স্বরে বলে,’জি… জি… অবশ্যই। আমি আপুকে বলব নিনাদ ভাইকে বোঝাতে। আপুর কথা উনি ফেলতে পারবেন না। দেখবেন বিদেশ যাওয়ার আগেই উনি বিয়েতে মত দেবেন। আপনি আর ভাববেন না ফুআম্মা।’
শিউলি ফুআম্মা প্রসন্ন মুখে হাসলেন। তিতিক্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি বড় ভালা মাইয়া।’
চলবে…….।

দূর আলাপন পর্ব-০৬

0

দূর আলাপন ~ ৬
____________________________
‘তবে তো তোমার নিনাদ ভাইয়ের পছন্দের তারিফ করতে হয়।
তুমি করে বলে ফেললাম। কিছু মনে করো নি তো?’

‘না… মিহি হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ‘মনে করার কি আছে? কিযে কন…’

আবার সব চুপ। খানিক আগের মতো ফের একবার দুজনের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই নিস্তব্ধতা ফিরে আসছে দেখে তিতিক্ষা নিজেই কথা শুরু করল এবার। পুরো আকাশ জুড়ে তখন কালো মেঘের রাজত্ব। মেঘেদের প্রকট গর্জনে, বন্য ডরালু হাওয়াতে অশনির আগাম সংকেত। তিতিক্ষা একবার আকাশে নজর বুলিয়ে নেয়। ওড়না টা আরেকটু ভালো করে গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পলকা স্বরে জানতে চায়,’তোমার বয়স কত আফরিন?’
‘কিছু মনে কোরো না। এভাবে নাম ধরে ডাকছি তো, তারপর যদি দেখা যায় তুমি আমার চেয়ে সামান্য বড়…’ হাসল তিতিক্ষা, ‘তাই বয়স জেনে নেয়া ভালো। ভুল হয়ে থাকলে যেন শুধরে নিতে পারি।’

সারল্যে ভরপুর আশ্চর্য ছেলেমানুষী মুখটা তোলে আফরিন। একটু মলিন হয়, শিথিল দেখায়।
‘আমার বয়স যে কত তা আমি নিজেও জানি না ঠিকমতো…’ মুখের হাসিটা যেন বিদ্রুপ করে ওঠে ওকে। তিতিক্ষা বিমর্ষ হয়ে চেয়ে রয়। কি সরল মুখটায় কি জটিল কথা!
আফরিন নিজের খেয়ালে বলে যাচ্ছে, ‘তবে চাচি কইছিল এই পৌষে ঊনিশে পরব।
কি হইলো? নিজের বয়স ঠিকঠাক জানি না শুইনা অবাক হইছেন?
আসলে মা নাই তো। আব্বাও নানান খেয়ালে থাকে। আমি ছোডকাল থাইকা একাই বড় হইছি। আদরযত্ন যা পাইবার সব পাইছি চাচি আম্মার কাছে। সে ই বা আর কতদিক দেখব কন? তাছাড়া গেরাম বয়সের হিসাবও বড় একটা রাখে না কেউ।’

‘তোমার তো অনেক দুঃখ! আল্লাহ তোমার সহায় হোন। আমিন।
আমারো মা নেই জানো? আর… গত পৌষে আমার ঊনিশে পড়েছে। বেশকিছু মিল আছে আমাদের দেখছি! গুণে গুণে এক বছরের বড় আমি তোমার!’

চোখেচোখে হয়ে গেল সামান্য হাসির বিনিময়। আফরিন আবারো পূর্বানুরূপ সপ্রতিভ।
হেসে বলে, ‘আপনি খুব ভালা মানুষ। যেমন সুন্দর তেমনি মিশুক। অথচ নিনাদ ভাই কি না কিই কইছিল আমারে……’

সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে তিতিক্ষা, ‘কি… কি বলেছিল তোমার নিনাদ ভাই?’

আফরিন ফের মাথা নুইয়ে শাড়িতে আঙুল পেচাতে থাকে,’সেইসব আজেবাজে কথা। আপনার শুইনা কাম নাই… আপনি দুঃখ পাইবেন।’

‘না না… আজেবাজে কথা হলই বা! আমি ভুল করে না থাকলে দুঃখ কেন পাব? বলো শুনি, কি বলেছেন উনি!’

আফরিন উভয়সংকটে পড়ল। ভাবাবেগে মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছিল কথাটা, দারুণ ফ্যাসাদে পড়া গেল দেখছি!
ইতস্তত করে সে বলে, ‘নিনাদ ভাইয়ের মাথাভর্তি কিলবিল করে কূটবুদ্ধি। সবকিছু নিয়া ফাইজলামি করা চাই ই চাই… বাড়িত গেলে সারাদিন কিছু না কিছু নিয়া আমার সঙ্গে ঝগড়া করতেই থাকে…’

তিতিক্ষা স্পষ্টতই বুঝতে পারছে নিনাদের দোষ ঢাকার জন্য আসল কথাটা বলার আগে তার হয়ে সাফাই গাইছে আফরিন। ও কিছু বলল না। আফরিনকে কথা শেষ করার সুযোগ দিল।
‘আর শুধু ঢাকার গল্প… ঢাকায় থাহা তার কাছের মানুষজনের গল্প। তেমনি মাঝে মাঝে কইতো বড় আপার কথা, আপনের কথা…
তিহা আপা আর নিমি না কি জানি নাম… ওই আপা… দুজনরে তো আমি আগে থাইকা চিনি। ভিডিয়ো কলে আমার লগে কথা কওয়ায়া দিছিল নিনাদ ভাই। চিনতাম না শুধু আপনারে। তার মুখে শুনতাম আপনার কথা। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা। হি হি… শুইনা হাসি থামাইতে পারতাম না।
কইতো আমি যেইখানে থাকি ওইখানে একটা নাগিনী আছে বুঝলি! আমারে দেখলেই হিস্ হিস্ কইরা ফণা তুইলা ছোবল দিতে আসে… কতবার দুঃস্বপ্ন দেখছি নাগিনীর ছোবলে আমার সারা শরীর বিষে নীল হয়া গেছে….. উউহ…. কি ভয়ংকর! ওরে দেখলেই ডর লাগে আমার।’ বলতে বলতে হাসিতে ভরে উঠছিল আফরিনের মুখ। নিনাদের এইসব ছেলেমানুষী কথাবার্তা যেন ওর কত প্রিয়। কথার মাঝখানে হঠাৎ সচকিত হয়ে থেমে দাঁতে জিভ কাটে আফরিন, ‘ছিঃ ছিঃ… কিসব কইতাছি আমি! আমার মুখের লাগাম নাই। বড় বেহায়া মুখ আমার।
আর নিনাদ ভাইয়ের কথার এমনি ধরন। আমারে খেপানোর জন্যও কতকিছু কয়… আপনে রাগ করছেন?’

দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিল তিতিক্ষা। বহু কষ্টে মুখে একফালি চতুর হাসির আভাস এনে বলল,’বাহ! এত ভালো ভালো কথা বলেছে আমার নামে! আমাকে যে কেউ নাগিনীর সঙ্গে তুলনা করতে পারে, দুঃস্বপ্নেও এতটা ভয় পায় জেনে প্রীত হলাম!’

‘তা আফরিন, তোমার সাথে বুঝি নিনাদ ভাইয়ের খুব ভাব?’

লজ্জার ঈষদুষ্ণ জড়িমায় সিক্ত হয়ে ওঠে আফরিনের মুখ,’হুম… বাড়িতে গেলে তো নিনাদ ভাই সারাদিন আমার সাথেই গল্প করে। আর আমি যা যা বলি শহর থাইকা সব কিইনা নিয়া যায় আমার জইন্য।’

রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়ানোর নরম ভঙ্গিটায় চির ধরে। নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তিতিক্ষা। চোখের দৃষ্টিতে সামান্য কাঠিন্য খেলে যায়। যা জানার সব জানা হয়ে গেছে ওর। সকলকে দেখিয়ে বেরানো নিনাদের ভালোমানুষির পেছনে আসল রূপ তবে এই!
কালো মেঘের পসরা দুরন্ত বেগে ছুটে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে ব্যাস্ত কণ্ঠে তিতিক্ষা বলে,’ভেতরে যাই চলো। বোধহয় বৃষ্টি নামবে এখনি…’

ওরা ঘরে ফিরে আসে। তিহা কিংবা শিউলি ফুআম্মা নেই ভেতরে। রান্নাঘর থেকে ঝিরিঝিরি কথার বৃষ্টি ভেসে আসে। আফরিন সেদিকে পা বাড়ায়। তিতিক্ষাকেও সঙ্গে আসতে বলে।
‘আসরের আযান দিয়েছে। সলাত টা পড়ে তারপর যাই? তুমিও পড়বে তো?’
নির্মোহ শান্ত আহ্বান। এই আবাহনকে অগ্রাহ্য করতে পারে এমন পাষাণ হৃদয় কার আছে?
আফরিন অপ্রস্তুত হাসে,’মাঝে মাঝে তো পড়ি। আচ্ছা, খাড়ান ওযু কইরা আসি।’

মেয়েটা ওযু করে এসে দেখে ঘরের পশ্চিমমুখে দুটো মুসল্লা পাতা রয়েছে। একটাতে ওরই অপেক্ষায় তখনো দাঁড়িয়ে তিতিক্ষা। তিতিক্ষার ওযু ছিল। মুসল্লায় দাঁড়িয়ে থেকে মিহি হাসি ছুড়ে দিল আফরিনের দিকে,’এসো একসাথে সলাত পড়ি।’

.

বাড়িতে প্রতিটা বিকেল তিতিক্ষার কাটে ছোটনের সাথে। হোক ঘুম, খেলা কিংবা ঘুরাঘুরি। বিকেল হলেই মিমিকে ছোটনের চাই। সলাত শেষ করে আফরিন চলে গেল রান্নাঘরে। তিতিক্ষা যাবার আগে একবার ছোটনের খোঁজে বেরিয়ে এদিক সেদিক তাকাল। এখানে আসার পর থেকেই ছোটন ওর দৃষ্টিসীমা থেকে একেবারে উধাও। তিহা আফরিন সবাই রান্নাঘরে। নিনাদ মসজিদে। বাচ্চাটা অতক্ষণ একা একা কি করছে কে জানে! একঝলক না দেখলে মন শান্ত হবে না। তিতিক্ষা বাইরের ঘরে পা বাড়ায়। নতুন খেলনা, চিপসের খোলা প্যাকেট কার্পেটের ওপর পড়ে আছে। আর মহাশয় ঘুমাচ্ছেন সোফায়। তিতিক্ষা পাশে এসে বসল। ছোটনের গালের ওপর রক্তে বোঝাই একটা মশা আরামে বসে ছিল। দ্রুত ওড়না দিয়ে বাচ্চাটার সারা গায়ে বাতাস দিল সে। বালিশ বিহীন মাথাটা তুলে নিল নিজের কোলে।

সন্ধ্যের বেশি বাকি নেই বোধহয়। ছোটনকে ডাকতে যাচ্ছিল তিতিক্ষা। থেমে যায় দরজার নব ঘোরানোর শব্দে। নিনাদ এসেছে নিশ্চিত। রক্ষে যে এই ঘরের দরজাটা প্রায় ভিড়ানো। ওড়নার প্রান্ত আরো খানিকটা ছড়িয়ে দিয়ে ছোটনের গা ঘেঁষে চুপচাপ বসে থাকে তিতিক্ষা। নিনাদ নিশ্চয়ই সরাসরি এখানে চলে আসবে না? এলেও পেছন থেকে ওকে দেখলেই ফিরে যাবে।

মাথা থেকে টুপি নামিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বাসার ভেতরে আসে নিনাদ। ওর কাছে চাবি ছিল বলে কলিংবেল দেয়ার প্রয়োজন পরেনি। তবুও নিনাদ এসেছে কিভাবে যেন টের পেয়ে ছুটে এলো আফরিন। ওদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে বসে দরজার ফাঁকে দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করতে থাকে তিতিক্ষা। এই দুজনের ব্যাপার টা কি, আর কতদূর গড়িয়েছে আজ সে দেখে ছাড়বে। তিড়িংতিড়িং ছুটে আসা আফরিনের কাছে হাতের ঠোঙাটা হস্তান্তর করেই ঘুরে দরজার নব ঘোরানোয় মনোযোগ দিল নিনাদ। আফরিন অস্থির হাতে জায়গায় দাঁড়িয়েই ঠোঙা খোলে। গরম গরম জিলাপি দেখে ভ্রু কুচকে বলে,’ওমা, এত জিলাপি!
জিলাপি না আপনের দুই চোক্ষের বিষ?’

অনেকক্ষণ ধরে দরজার কাছে নিনাদ আছে। জুতা খুলে যথাস্থানে রাখল, চাবি ওপরে তুলে রাখল। এর ফাঁকে আফরিনের প্রশ্নের উত্তর দিল কিঞ্চিৎ গম্ভীর গলায়,’আমি না ই খাইলাম। বাকিরা খাইতে দোষ কি?
কেন, তুই খাস না জিলাপি?’ তিতিক্ষা খেয়াল করে আফরিনের সঙ্গে কথা বলার সময় নিনাদ তার আঞ্চলিক টান বজায় রাখছে।

‘আমি! আমিও তো খাই না। আপনার কথা শুইনাই তো জিলাপি খাওয়া ছাড়ছি আমি! খালি কইতেন জিলাপি নাকি কেঁচোর মতো দেহা যায়.. গা শিরশির করে… সেইকথা শুইনাই তো….
আর চাচি আম্মার না ডায়াবেটিস? ভুইলা গেলেন? এহন এত জিলাপি….’ কথাটা শেষ করা হলো না আফরিনের।

‘সাধে কি তোরে গাধী ডাকি?’ বলে মেদুর হেসে আফরিনের মাথায় একটা গাট্টা মেরে চলে গেল নিনাদ। আফরিন মাথায় হাত ঘঁষল, ভুল কি বলেছে বুঝতে না পেরে ঠোঁট উলটে হেসে ফেলল। তারপর দৌড়ে ছুটে গেল রান্নাঘরে ফুআম্মার কাছে।

দৃশ্যটা দেখে অবচেতনে তিতিক্ষাও কিঞ্চিৎ হাসল। আফরিন মেয়েটা সত্যি বড় মিষ্টি। কিন্তু অতিসত্বর মুগ্ধ ভাব কেটে গিয়ে আবারো মনের ভেতর ডালপালা মেলে দুর্বোধ্য কিছু ভাবনা। নিনাদ আফরিন জিলাপি খায় না, ফুআম্মারো ডায়াবেটিস, আর বুবু তো মিষ্টি কোনো খাবারই পছন্দ করে না। এই তথ্য নিনাদের নিশ্চই জানা ছিল? তবুও সব ছেড়ে ও জিলাপিই আনলো কেন?
তিতিক্ষার পছন্দ বলেই নয়তো?

ধুর! কিসব উদ্ভট কথা ভাবছে সে। নিনাদ অত কিছু ভেবে আনেনি নিশ্চই। সামনে পেয়েছে নিয়ে চলে এসেছে। কিন্তু এখন খচখচানি আরেক জায়গায়। এই অল্পসময়ের দেখায় আফরিনের নিনাদের সম্পর্কটা ঠিক কোন পর্যায়ের কিছুতেই অনুধাবন করতে পারল না তিতিক্ষা। ওদের কথাবার্তায় তো কোনো অস্বাভাবিকতা নেই! কি হবার ছিল আর কি হলো… আচ্ছা, এমন নয়তো যে তিতিক্ষাকে দেখেই নিনাদ এই মাত্রাতিরিক্ত নির্লিপ্ততাটা দেখাল? কম সেয়ানা তো নয়! নইলে কি আর ভার্সিটিতে শ’খানেক ললনার সঙ্গে একই তালে প্রণয় প্রণয় খেলা খেলতে পারে?

.

বাইরে তুমুল বৃষ্টি। দিন ফুড়োবার আগেই শুক্রবারের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে নেমেছে অঝোর বারিধারা। দুইবোনের আর চিন্তার অন্ত নেই। এই বৃষ্টি না থামলে আজ কি করে বাড়ি ফিরবে ওরা! সঙ্গে আবার একটা বাচ্চা।
এদিকে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। বাবা বাড়িতে একা আছেন। তিহা তিতিক্ষা আর ছোটন… তিনজনের চিন্তান্বিত মুখের পানে চেয়ে খানিক করুণা করেও বৃষ্টি এবার একটু থামার নাম করতে পারে না?
শুক্রবার বাদ আছর, দুআ কবুলের মোক্ষম সময়। ভেতরের ঘরে বসে দুহাত তুলে দুআ করে তিতিক্ষা। আর সবকিছুর পাশাপশি নিরাপদে বাড়ি ফেরার তাউফিক চেয়ে নেয়। এত বেলা অবধি বাবা একা আছেন, কল রিসিভ করছেন না অনেকক্ষণ যাবত, ভাবলে বুকে পানি থাকছে না।

তার ওপর এখানের কিছু বিক্ষিপ্ত অপ্রিয় মুহুর্ত। বারবার চেতনার ছায়াপথে একটা কথা আর একটা দৃশ্য ঝিলিক দিয়ে যায়। নিনাদ ওকে আফরিনের সামনে জঘন্য এক উপমায় উপস্থাপন করেছে আর শেষ বিকেলে ওদের সেই চোখেচোখে দৃষ্টির বিনিময়, নিনাদের প্রস্থানের পর আফরিনের অনাভাসিত হাসি।
যতবার এসব ভাবছে তিক্ততার বিষে নীলাক্ত হয়ে পড়ছে ওর অন্তঃকরণ।

এখানকার প্রতিটা ক্ষণ বিষাক্ত লাগছে। লোকলজ্জার ভয় না থাকলে এক্ষুণি ছুটে বেরিয়ে যেত সে। বৃষ্টিরও যেন থামতে নেই আজ! কত বেলা হলো, শহর তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে এলো অথচ বৃষ্টির কড়াল তীক্ষ্ণ তান বিরতিহীন বাজছে।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পরার কথাও দু একবার মনে উঁকি দিয়ে গেল। কিন্তু অচিরেই সেই চিন্তা বাদ দিলে হলো ছোটনের কথা ভেবে।

অবশেষে রাতের প্রথম প্রহরে বৃষ্টি তার গতিতে কিছুটা লাগাম টানল। একে তো বৃষ্টি, তার ওপর আবার ছুটির দিন। সেজন্যই বোধহয় আজ রাস্তাঘাট অন্য দিনের তুলনায় বেশ ফাঁকা। নিনাদ ওদের একা ছাড়তে রাজি হলো না কিছুতেই। তিহা সে প্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যান করছিল শিউলির কথা ভেবে। এই রাতে দুজন মেয়ে মানুষ কে একা ফেলে নিনাদ ওদের সঙ্গে চলে যাবে… তিনি হয়তো নিনাদের অতটা আন্তরিকতার বাড়াবাড়ি পছন্দ নাও করতে পারেন। কিন্তু দেখা গেল শিউলি ফুআম্মার নিজের আগ্রহও কম নয়। ফলাফল অত নিষেধের পরও শেষতক ক্যাব ডেকে ওদের সঙ্গে উঠে গেল নিনাদ।

মাঝ পথে বৃষ্টির তোড় আবারো বাড়ল। বাড়ির সামনে ক্যাব থামতেই সবার আগে ক্যাব ছাড়ল তিতিক্ষা। মারুফ পড়িমরি করে একটা ছাতা নিয়ে ছুটে আসছিলেন, বৃষ্টির হাত থেকে গা বাচিয়ে যেতে হলে বুবুর পাশাপাশি নিনাদের সঙ্গেও একই ছাতা ভাগাভাগি করতে হয়। ভেবে বৃষ্টির মধ্যেই উঠোনে নেমে গটাগট হেঁটে ভেতরে চলে গেল তিতিক্ষা। নিজের ঘরে গিয়ে দ্বার রুদ্ধ করল তৎক্ষনাৎ।

.

তিহা একপ্রকার জোর করে নিনাদ কে নিয়ে এল ভেতরে। সে ভিজেছে সবচেয়ে বেশি। ক্যাবের খোঁজে শুরুতেই পথে নামতে হয়েছিল ওকে।
ভেতরে এসে দেখা গেল তিতিক্ষা আগে থেকেই দরজার ছিটকিনি এঁটে বসে আছে। বাইরে বিষম গোলমাল, ছোটন নিনাদ সব ভিজে একাকার, একটু চায়ের পানি বসানোও জরুরি। এদিকে মহারাণী নিজেকে নিয়ে পড়েছেন। মেজাজ চড়ে গেল তক্ষনি। দরজার সামনে এসে বিরক্তি মেশানো স্বরে ব্যাস্ত হয়ে তিহা ডাকল,’এসেই দরজা বন্ধ করলি কেন? ছেলেটা ভেজা গায়ে বাইরের ঘরে বসে আছে। গামছা-টামছা কিছু একটা দে। এদিকে ছোটনের মাথাও ভিজে গেছে।রাতেই না আবার জ্বরে পড়ে। ওর বাবা তাহলে আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে! বাবাও নাকি সন্ধ্যা থেকে চা-পানি কিছু খায়নি। কোথায় কাজে সাহায্য করবি তা না…. খিল এঁটে বসে আছিস! জলদি বেরো।’

বাধ্য হয়ে পানসে মুখে দরজা খোলে তিতিক্ষা। ভেজা বোরকা আর পোশাকের বদলে ওর গায়ে তখন একপ্রস্ত নতুন জামা। মুখের ভাব শান্ত গম্ভীর।
ওয়ারড্রব থেকে একখানা নতুন তোয়ালে এনে এগোল বসার ঘরের দিকে। কিছুদূর এগিয়ে দেয়ালের এপাশ থেকে ছুড়ে মারল নিনাদের সামনের সোফায়। কাজ শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে হাটা ধরল রান্নাঘরের দিকে। চুলা জ্বালিয়ে কেতলিতে পানি বসাল চায়ের জন্য।

নিনাদ বসার ঘরে একাই ছিল। চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি। এরকম ভিজে জবজবে গায়ে অন্যের বাড়িতে, অন্যের সোফায় বসতে খারাপ লাগে। কিন্তু না বসে উপায় নেই। নয়তো এ নিয়েও ঝগড়া বাঁধাবে তিহা। ভিজে চুলে আঙুল চালাতে চালাতে এসব ভাবে নিনাদ। আচমকা তোয়ালেটা এসে ওর সামনে পড়ে। সচকিত হয়ে দরজার পানে তাকায় নিনাদ। ততক্ষনে তিতিক্ষা অদৃশ্য। এটা নিশ্চিত ভাবে ছোট গিন্নি কাজ। সাধে কি আর সাপের সঙ্গে তুলনা দেয়?

একটা পরিণত উষ্ণ গন্ধ বাতাসে ভেসে ভেসে একসময় এসে বাড়ি খায় নিনাদের নাকে। মাথা মুছতে মুছতে গন্ধের আবেশে কেমন যেন হয়ে দূরবর্তী ভাবনায় খেই হারিয়ে ফেলে নিনাদের মনটা। প্রকট সুঘ্রাণ বিশিষ্ট চা পাতার গন্ধ। নিশ্চয়ই সাধারণ চা পাতা নয়। এসব ছোট ছোট ব্যপারে তিতিক্ষা বেশ শৌখিন। শুনেছে মাঝে মাঝেই নাকি শ্রীমঙ্গল থেকে চা পাতা আনায়। বৃষ্টির ভেজা গন্ধ সেই ঘ্রাণকে আরও প্রবল করে তুলেছে। এই চা-পাতার ঘ্রাণ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা চামচ নাড়ানোর ক্ষীণ আওয়াজ, ঘরের থমকে থাকা আবহ… সব নিয়ে সুখানুভবের অন্যরকম সুরসঙ্গতি। এইসব অপরিচিত, অনাদি অনুভব, সুখের নিতান্ত ছাপোষা কিছু সরঞ্জাম…. বারবার এখানে ছুটে আসতে বাধ্য করে নিনাদকে।

একখানা ছিপছিপে সাজানো বাড়ি তারও আছে। আছে একান্ত একার সংসার। অথচ ওই নির্জন কুটিরে এমন সুখ তো নেই! কিসেরই বা অভাব ওর? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর ক্ষনে ক্ষনে নিনাদের কানে এসে ঠেকে ‘মানুষের অভাব’!
মানুষের ঐচ্ছিক অনৈচ্ছিক সমস্ত কথা, হাসি, আচরণে যে ঘরের দেয়াল মুখরিত হয়নি, আদতে প্রাণের সঞ্চারও সেখানে নেই। সেজন্যই তার সংসার আছে, সংসারের যাবতীয় সরঞ্জাম আছে অথচ এমনি সুখ সুখ অনুভব সেথায় নেই।

অগোছালো আরো অনেক ভাবনা একে একে এসে ভিড়তে থাকে নিনাদের নিবিড় মনে। কিছু কিছু অভাববোধ আবারো ওকে খোঁচাতে শুরু করে। ভাবতে ভাবতে একা বসে প্রলম্বিত নিশ্বাস ফেলে নিনাদ।
চলবে….

দূর আলাপন পর্ব-০৫

0

দূর আলাপন ~ ৫

__________________________
আরো কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। শুক্রবার দুপুরে নিমন্ত্রণ। কথাটা খাপছাড়া হাওয়ায় মতো ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরের বাতাসে। দু বোনের মধ্যে চাপা অস্বস্তি আর উৎকণ্ঠা। ছোট বোনটা যে গোঁয়ার ভীষণ। শেষে না যাওয়া নিয়ে কোনো ঘাড়ত্যাড়ামি শুরু করে। ভেবে মাঝে মাঝে উদ্বেল বোধ করে তিহা।
ওদিকে তিতিক্ষা বিপন্ন হয়ে ভাবে এই ঝামেলা কি করে ঘাড় থেকে নামাবে। সব ঠিক ছিল, স্পষ্ট মানা করেই দিত সে। কিন্তু বিপত্তি টা বাঁধালেন শিউলি ফুআম্মা।
সামাজিক যেকোনো আয়োজনে মিশবার ক্ষেত্রে তিতিক্ষা চিরকাল বেশ সাবধানী। যেখানে আছে বেপরোয়া মেলামেশা, বেহায়াপনার বাড়াবাড়ি, ছেলেদের হুল্লোড়, ঘন সমাবেশ… সেসব স্থান সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে এতকাল। এই যুগে ছেলেমেয়ের অবাধ স্বাধীন মেলামেশাটা ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ তিতিক্ষার। নিজের স্বস্তির জন্য এসব থেকে দূরে থাকে সে। মারুফ কিংবা তিহা কতবার বুঝিয়েছেন। মেয়েটাকে জোর করে ঠেলেছেন সমাজের বৈরী সংস্কৃতির দিকে। টলেনি তিতিক্ষা, এসব ওর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর এই একটা ব্যপারে তিতিক্ষার অটলতা দেখার মতন।

কিন্তু… কিন্তু… আজ যে এর সঙ্গে আরও একটা ব্যপার এসে জুড়েছে। প্রশ্নটা এখন বাৎসল্যের, এক সন্তানহীনা বৃদ্ধার সস্নেহ অনুরোধের। শিউলি ফুআম্মা নিজে ওকে যাবার কথা বলেছেন বিশেষ ভাবে। এড়ায় কি করে তিতিক্ষা?

তাছাড়া বুবু কথার আভাসে ওকে আস্থা দেবার একটা চেষ্টাও করেছে। বুবুর কথাটাকে ভরসা করলে দুশ্চিন্তার আর কিছুই তেমন থাকে না।
নিনাদের দিক থেকে ওর প্রতি সামান্য কিছু আছে। এই কথা বোধহয় আর অজানা নয় কারো। শুধুমাত্র এই একটা দোষের কারণে নিনাদ সম্পর্কিত সব ব্যপারে তিতিক্ষা কড়া হয় ভীষণ। দাওয়াতে না যেতে চাওয়ার সুপ্ত কারণ টাও তাই। উল্লেখ করা না হলেও তিহা তা জানে। এই ব্যপারে তিতিক্ষাকে নিশ্চয়তা দিল সে। মেহমান হয়ে গেলে নিনাদ কক্ষনো বাদরামো করবে না। হতেই পারে পাজির পাঝারা। ফিচেল বুদ্ধির রাজা। তবে অসভ্য কখনো নয়।

তিতিক্ষা দাওয়াতে যাবে, যে দাওয়াত দাতা সয়ং শিউলি ফুআম্মা, সেখানে উৎপীড়ন করবার মতো বোকামি ও কেনই বা করবে?

অনেক ভেবে দেখল তিতিক্ষা। যাওয়াই বোধহয় ঠিক। নাহয় অনেক গুলো মানুষের রোষানলে পড়বে সে। বাবা, বড় বোন আর হয়তো শিউলি ফুআম্মারও….
অতএব যাওয়া স্থির হলো। তাছাড়া নিনাদ এখানে এসে যত অমিতাচারই করে থাকুক, নিজের বাড়ি ডেকে অপমান নিশ্চয়ই তিতিক্ষা কে করবে না? এটুকু ভরসা তো সে করতে পারে!

_____________________

মোহাম্মদপুর টাউনহল বাজারের কাছে একটি ছোট ফ্ল্যাটে নিনাদের আবাস। সেখানে সে একা থাকছে আজকাল। আগে আরও দুজন ছেলে ছিল।
বছর দুয়েক হল ওদের একজন চাকরি পেয়ে বাড়ি ছেড়েছে। অন্যজন বিয়ে করে আলাদা বাসায় উঠেছে। একজনের পক্ষে নিতান্ত বেশি, সমস্ত যেন বাড়াবাড়ি। তবু বাসাটা ছাড়ল না নিনাদ। দুটো ঘর, আধখানা ডাইনিং, একটা শান্ত ছোট বারান্দা আর রান্নাঘর। সবকিছু ভারি সুন্দর। হাতিলের সৌখিন গুটিকতক ফার্নিচার, বেতের সোফা আর অসংখ্য গাছ দিয়ে ঘেরা পুরো বাড়ি। কিন্তু ঘর সুন্দর হলে কি হবে, ঘরের কর্তা বেজায় এলোমেলো। এখানের জিনিস পড়ে আছে ওখানে-সেখানে। আসবাবপত্রের ওপর ধুলোর আস্তরণ। এবার শুধু ফুফুর ভয়ে আর তিহা, তিতিক্ষার কাছে মান-সম্মান বাচাতেই বহুদিন পর সেসব সাফসাফাইয়ের জোয়ার উঠেছে।

তিতিক্ষা আর নিজের ছানাটিকে নিয়ে তিহা যখন নিনাদের বাড়ি এসে পৌঁছাল সে সময় ভর দুপুর। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। ঢাকার ব্যাস্ত সড়ক আজ বেশ ফাঁকা, যারা আছে তাদেরও ফেরার তাড়া ভীষণ। অন্য দিনের মত ছুটির দিনটাকে দীর্ঘ জ্যামে বসে খোয়াতে চায় না কেউ।
তিতিক্ষা ভাগ্নেকে নিয়ে দাঁড়ালো বোনের পেছনে। ভেবেছিল হয়তো নিনাদই দরজা খুলতে আসবে। সেরকম অবশ্যি হলো না। ওদের খানিকটা চমকে দিল খোলা দরজার ওপাশে দাঁড়ানো একটা অচেনা মেয়ে। যার মুখভরা হাসিতে মুহুর্তে পূর্ণ হয়ে উঠল চারিদিক। হাসিতে, চঞ্চল চাহনিতে, ভ্রুর কুঞ্চনে ব্যস্তসমস্ত হয়ে গৃহে অভ্যর্থনা জানাল। এরপরই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন শিউলি ফুআম্মা। তিহাকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিহাও তাই। অসংকোচে দু পা এগিয়ে শিউলি ফুআম্মাকে জড়িয়ে ধরল। মাকে হারিয়েছে আজ বহুবছর হল। এরপর শিউলি ফুআম্মা ছাড়া আর কাউকেই মায়ের কাছাকাছি মর্যাদা দিতে পারে নি। এই শ্রদ্ধা, ভালোবাসার সবটা শিউলি অর্জন করেছেন নিজের প্রানান্ত স্নেহ, মমতা আর ভালোমানুষি দ্বারা। এতদিন পর দেখা হওয়ায় সত্ত্বেও তাই যেন তিহা নিজেকে সামলাতে পারল না।

তিতিক্ষা কিঞ্চিৎ বিব্রত। শিউলি এবং তিহা উভয়ে নিজেদের অতীত স্মৃতিচারণ নিয়ে ব্যস্ত। ছোট্ট ছোটন আর তিতিক্ষা যে পাশে দাঁড়িয়ে, ওদের দিকে নজর দিচ্ছে না কেউ। পরিবেশ হালকা করতে মেয়েটিই এবার সচেষ্ট হলো। রিমঝিম মিষ্টি হেসে তিতিক্ষা ও তার ভাগ্নেকে ভেতরের ঘরে নিয়ে বসাল।

অল্প সময়ের মধ্যে ছোটনের সাথে খুব ভাব হয়ে গেল সবার। নিঃসংশয়ে গোটা বাড়ি জুড়ে হুটোপুটি করে বেড়াচ্ছে সে। নিনাদ গেছিল জুম্মার নামাযে। এলো খানিক পর।
রান্নাঘরে ততক্ষণে সরগরম আড্ডা। তিহা কাটছে সালাদ, ফুআম্ম পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছেন।
বরাবর একটু চুপচাপ তিতিক্ষা। নিভৃতেই ওর শান্তি। তাই ভেতরের ঘরে বসে রইল একা। এখানে একপাশের দেয়াল জুড়ে সয়ে সয়ে সাজানো বই। নেড়েচেড়ে দেখেছিল দু একটা। মেয়েটা তখন আবার এলো। একজন আস্ত মানুষের উপস্থিতি থাকতে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখা ভারি অন্যায়। তাই বইটা রেখে দেয় তিতিক্ষা। মেয়েটার পানে ঘুরে তাকায় আলাপ জমানোর নিমিত্তে।
‘দাঁড়িয়ে কেন বসুন।’
বিছানায় তার পাশে অল্প দূরত্ব রেখে মেয়েটা বসে।
হাসি হাসি মুখ। বলে,’এইখানে নিনাদ ভাই আসব না। আপনি মুখ খুলেন। আপনারে একটু দেহি। তহন তাড়াহুড়ায় ভালো কইরা দেখি নাই।’

কলিংবেল বাজার পর নিকাব পরে নিয়েছিল তিতিক্ষা। আস্বস্ত হয়ে নিকাব খুলল।
‘ও মা! আপনে তো মেলা সুন্দর! শহরের মাইয়া তবুও পর্দা করেন! সুন্দর দেইখাই বুঝি?’

ম্লান হেসে ফেলে তিতিক্ষা। ‘পর্দা করা তো প্রতিটি মুসলিম নারীর প্রতি আল্লাহ রব্বুল আলামিনের আদেশ। আল্লাহর পৃথিবীতে, আল্লাহর দয়ায় বেঁচে থেকে তাঁর আদেশের বিরুদ্ধে যাবার দুঃসাহস আমার নেই। সেজন্য পর্দা করি।’

‘কি সুন্দর কথা কন আপনে! আমাদের গেরামে একটা কথা আছে, সুন্দর মাইনষের সবই সুন্দর।’

ওর ভুল ভাঙানোর জন্যই যেন তিতিক্ষা বলে,’সৌন্দর্যের মূল আধার হলো মানুষের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। যার দেখার চোখ সুন্দর তার কাছে পৃথিবীর অতি তুচ্ছ ছবিও সুন্দর।’
বলে তিতিক্ষা ভালো করে চোখ তুলে তাকায় মেয়েটির দিকে। নিখাত গ্রাম্য সরল চেহারা। অল্প বয়স, অন্তত তিতিক্ষার ছোট হবেই। পড়নে খয়েরি পাড়ের লাল কালো ফুল তোলা সুতির শাড়ি। কাঁধের একপাশে শান্ত ভাবে পড়ে আছে একটা পুরূ বেণী। আর মুখটা মায়াবী। সবমিলিয়ে ভারি সুন্দর।

‘আপনি ভীষণ মিষ্টি দেখতে।’ আনমনে বলে ফেলে তিতিক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে শরীর দুলিয়ে হেসে ওঠে মেয়েটা।

‘কি যে কন! আমারে বাড়িতে সবাই ডাকে কালি। আমি নাকি আবার সুন্দর! হি হি….’
তিতিক্ষা ওর কথায় কিঞ্চিৎ বিস্মিত। কি অকপটে নিজেকে নিয়ে এমন একটা কথা বলে ফেলল মেয়েটা! নিপাট সারল্যে ভরপুর এক মেয়ে। মুখে যার সর্বদা হাসি লেগেই আছে। কি সুন্দর প্রাণবন্ত সে হাসি! কোনো খাদ নেই, কৃত্রিমতা নেই।

‘কি নাম আপনার?’ তিতিক্ষা মিহি স্বরে জানতে চায়।

‘আফরিন আমার নাম। গেরামে সবাই ডাকে আপ্পিনি। সুন্দর না? নিজের কথাকে বিদ্রুপ করে নিজেই হো হো করে হেসে উঠল আফরিন।
হাসল তিতিক্ষাও। বেশ মিশুক মেয়ে বটে।

‘কিন্তু আফরিন নামটাই বেশ সুন্দর।’

‘সুন্দর হইলে কি হইব কন? কেউ তো ডাকে না। খালি একজন… ‘
থেমে সে আবার বলে,’আপনের নাম কিন্তু আমি আগে থাইকা জানি। তবে বেজায় কঠিন নাম কিনা! কইতে কষ্ট লাগে।’
বলে শাড়ির আঁচলে আঙুল পেচাতে থাকে আফরিন।
তিতিক্ষার মন ততক্ষণে আফরিন নামক উজ্জ্বল আলোর দিকে পুরোপুরি হেলে পড়েছে। মনে হচ্ছে বহুদিন পর একটা খাঁটি মানুষের দেখা পেয়েছে। আফরিনের কথা, হাসি, চপলতা সবকিছু বেজায় ভালো লাগছে তিতিক্ষার। কি সুন্দর হেসে হেসে, মুখ চোখ ঘুরিয়ে, ভ্রু নাচিয়ে কথা বলে আফরিন। জড়তা নেই, দুর্বোধ্য বোঝাপড়া নেই। নিদারুণ অকপট। প্রাণ যেন ওর শরীর জুড়ে বিরাজমান।
অল্প সময়ের মধ্যে খুব ভাব হয়ে গেল ওদের। কিন্তু বেশিক্ষণ বসা হল না আফরিনের। খাবারের সময় হয়ে গেছে। শিউলি ফুআম্মা রান্নাঘর থেকে বিষম হাঁকডাক ছাড়ছেন।

খাবার পর শিউলি ফুআম্মা আর তিহার আলাপ ফের আরম্ভ হলো। এই কথা থেকে লাফিয়ে সেই কথা, এক গল্প থেকে অন্য গল্পে ক্রমশ মশগুল হলেন দুজনে। ঠিক যেন দূরের শহরে বিয়ে হওয়া মেয়ে আর তার নিঃসঙ্গ একাকিনী মায়ের প্রতিচ্ছবি। তিতিক্ষা আর আফরিনও বসল ওদের ঘিরে। ছোটন তখন বাইরের ঘরে নিনাদের সাথে হুলুস্থুল বাধিয়েছে। নিনাদ জিজ্ঞেস করে,’বাবা জীবনের হবু শ্বশুর বাড়ি পছন্দ হয়েছে তো?’
ভারিক্কি চালে মাথা নাড়ে ছোটন। আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের ধ্যানে। হবু শশুর মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় এখন ওর নেই। ছোটন আসবে বলে চিপস চকলেট আইসক্রিম মজুদ রেখেছিল নিনাদ। আপাতত সেসব সাবার করার মহৎ কাজে ব্যস্ত ছোটন।

বুবু আর এই বৃদ্ধার সংসারি আলাপে বারবার মনযোগ হারিয়ে ফেলছিল পাশে বসা দুই অসংসারী তরুণী। তিতিক্ষা সর্বদাই স্বল্পভাষী। সে গালে হাত রেখে একমনে কথা শুনছিল। কেন যেন ওদের কথায় ঘুম পাচ্ছিল। সহসা ওড়নায় টান পড়তে পেছন ফেরে। আফরিন ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে, ‘শুনতে ভাল্লাগতাসে?’

মনের কথাটাই বলল তিতিক্ষা, ‘না।’

‘তাহলে উইঠা আসেন। তারা আলাপ করুক। আমরা বারান্দায় যাই চলেন।’

সঙ্গে সঙ্গে উঠে আফরিনের পিছু পিছু বারান্দায় চলে এল তিতিক্ষা। এসে ভারি অবাক। খোলা বারান্দা জুড়ে উত্তরে হাওয়া, বাতাসের তালে টবে লাগানো গাছগুলোর হেলদোল আর দুটো ছোট্ট বাজরিকা পাখির খাঁচার ভেতর অনবরত কিচিরমিচির ডাক। সবকিছু মুগ্ধ করে দিল ওকে। তিতিক্ষা আবিষ্কার করল পুরো বাড়ির মধ্যে এই বারান্দাটা সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। শুধু সুন্দর নয়, ভয়ানক সুন্দর!
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এই বাসা আর এই সুন্দর বারান্দা সব নিনাদের। এসব সাজাতে তো একটা স্বচ্ছ মনের দরকার। তিতিক্ষা যে নিনাদকে চেনে তার তো এমন হবার কথা নয়। কিন্তু সারাবাড়ির শোভা চিত্র কি তবে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে?

পাশেই বারান্দার রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে আফরিন। চোখের দৃষ্টি সামনে, বহুদূর। সূর্য মেঘের আড়ালে চলে গেছে অনেকক্ষণ। বৃষ্টির আগমনী সংকেত পুরো আকাশ জুড়ে। পশ্চিম থেকে ভেসে আসা কালো মেঘ, প্রবল শীতল বাতাসের ঝাপটা। এবার শুধু ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার অপেক্ষা। তিতিক্ষা তাকিয়ে রইল। আফরিনকে সুন্দর দেখাচ্ছে। প্রকৃতির মত বিশুদ্ধ সুন্দর। ওর পড়নের শাড়ি, হাতের সাধারণ কাঁচের চুড়ি… সবেতে যেন ভালোমানুষির ছোঁয়া লেপ্টানো।
মেয়েটা ওরই বয়সি।
ওকে দেখেই কিনা কে জানে! আজ হঠাৎ শাড়ির প্রতি সামান্য একটা টান অনুভব করে তিতিক্ষা। শাড়ি পরে, কাঁচের রেশমি চুড়ি হাতে গলিয়ে এইরকম আটপৌরে বেশে থাকতে ইচ্ছে হয় অকস্মাৎ। তিতিক্ষা হালকা গলায় বলে, ‘শাড়িটা সুন্দর।’

কথাটা শুনে লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল আফরিন। শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে লাজুক হেসে বলল,’শিউলি চাচিও তাই কইছে। ঢাকায় আসার পর নিনাদ ভাই এই শাড়ি টা আমারে কিইনা দিসে। চাচি বলে নিনাদ ভাই আমার জন্য যা কিনে তাই নাকি খুব সুন্দর মানায় আমারে…’
কথা শেষেও মুখ তুললো না আফরিন। অকারণে খানিকটা লজ্জায় আচ্ছন্ন হয়ে নিচে তাকিয়ে রইল। আর ওর মুখে স্থির তাকিয়ে রইল তিতিক্ষা। যেন খুঁজে ফিরল অজানা কিছু। কিছু রঙ… দুরন্ত অনুভব…
আকাশের রঙ ক্রমে হারিয়ে গেল। ভীড় করে এলো আগমনী সন্ধ্যার কালো পসরা। তেমনি একটা আবছায়া কালো রঙে ছেয়ে গেল তিতিক্ষার মুখ!
চলবে………

অদ্রিজা আশয়ারী

দূর আলাপন পর্ব-০৪

0

দূর আলাপন ~ ৪
___________________________
শ্রাবণের আরও একটি বিষন্ন দুপুর। আকাশ জুড়ে ভেসে থাকা ছিন্ন কিছু সাদা মেঘ আর সোনালী রোদ। শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে দুপুরের ঝিকরিমিকরি রোদের লুকোচুরি খেলা। কখনো বা ছাদের এককোণে, কখনো গাছের ডালে, পাতায় পাতায় নেচে বেড়ায় একফালি রোদ্দুর।

তিতিক্ষাদের বাড়ির উঠোন এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। সকালের ঝুম বৃষ্টির রেশ রয়ে গেছে আদ্র মাটিতে। অতিবৃষ্টির ফলেই কিনা এই অসময়েও নাকে এসে লাগে কামিনীর গন্ধ। ঝুমদুপুর, বাড়ির সবাই নিশ্চিন্তে ভাতঘুম দিচ্ছে। ঘুমের পরোয়া নেই শুধু একজোড়া আঁখির। শান্ত শিথিলে দুপুরের রোদ ডিঙিয়ে সে সোঁদা গন্ধ ওঠা ভেজা মাটির উঠোনে ধীর পায়ে হেটে বেড়ায়। স্বাদ পরিবর্তনের জন্য আজ হাতে নিয়েছে একখানা ইংরেজি কবিতার বই। চোখ বুজে মাঝে মাঝে আওড়াচ্ছে কবিতার একটা দুটো পঙক্তি।

As I looked into his eyes
And found his longing stare
I stopped myself from saying words
That would show how much I care….

লোকে ভাবে, যে ধর্ম নিজেকে আড়াল করতে শেখায়, অট্টহাসিতেও নিষেধ দেখায় সে ধর্ম তো সন্ন্যাসেরই নামান্তর! যে নামায পড়ে, কোরআন পড়ে, সে হাতে তবে কেন অন্য বই উঠবে? তিতিক্ষা চোখ বুজে কথাটা ভেবে আনমনে হেসে ওঠে। এই ধারার কথা জীবনে সে কম বার তো শোনেনি। স্কুলের দিনগুলোতে টিফিন টাইমে বাকিরা যখন কানামাছি খেলতে ছুটে মাঠে যেত, তিতিক্ষা তখন সেই ফাঁকা ক্লাসে বসে ফরজ সালাতটুকু শেষ করে গল্পের বইয়ে পাতা ওল্টাতো। মেয়েরা মুখ ভেঙচিয়ে বলত, ‘ঢং দ্যাখ! দিনরাত হাদিসের বুলি ঝেড়ে এখন আবার গল্পের বই পড়া হচ্ছে! যুগে যুগে আর কত কি যে দেখবো….’

কথাগুলো ভেবে তিতিক্ষার এখন দুঃখ হয়না আর। সবাই ত্যাগ করেছে ওকে। সমাজ… আত্মীয়… বন্ধু-বান্ধব… ছাড়তে পারেনি শুধু সে নিজেকে নিজে। গোটা ‘আমি’ টাকে নিয়েই সবার আড়ালে চলে গেছে। অথচ আজও সমাজের কাছে তার ভুলের কোনো অবধি নেই। যত্রতত্র তরল কথাবার্তায় যোগ দেয় না, অট্টহাসিতে ঘর ভরে তোলে না, গায়ে জড়ায় না জাঁকজমকের মোড়ক বসানো পোশাক…. তাই নাকি সে দাম্ভিক, হিংসুক, পরশ্রীকাতর, গেয়ো ভূত আরো কত কি! অতএব সমাজে তার স্থান অতি ন্যূন।
সেই নিস্তব্ধ দুপুরে বিষন্ন মনের অনুকূল আবহাওয়ায় তিতিক্ষা আরো অনেক কথা ভাবে। নানান ভাবনার মাঝে একটা অপ্রিয় ভাবনাও উঁকি মেরে যায় থেকে থেকে। তিতিক্ষা ভাবতে চায় না। আবার এই অভেদ্য রহস্য ভেদ করতে না পেরে শান্তিও পায় না। কি ভীষণ জ্বালা!

ওড়না প্রান্তে হেচঁকা টান পড়তেই তিতিক্ষা ঘুরে তাকায়। ছোটন দাঁড়িয়ে আছে। ঘুম ভাঙা ফোলা ফোলা চোখ মুখ, এলোমেলো হয়ে থাকা মাথার চুলে তাকিয়ে বাৎসল্যের উষ্ণ ঢেউ তিতিক্ষার ভেতর উথলে ওঠে। বাচ্চাটাকে কাছে ডেকে আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করে দেয়। কবিতার বই সিড়ির ওপরের ধাপে নামিয়ে রেখে কোলে তুলে নেয় ওকে।
‘ছোট মিয়ার ঘুম এতো জলদি শেষ? মা জানলে পিঠে যে দুরুম দুরুম পড়বে। সে খেয়াল আছে তো?’
ছোটন ভেংচি কাটে। ভাবটা এমন দেখায় যেন মায়ের শাসনের অনুমাত্র পরোয়া ও কখনো করে না।
তিতিক্ষা স্মিত হাসে।
‘তা এই ভরদুপুরে কি চাই? এর চেয়ে কি মায়ের সাথে ঘুমানোটাই ভালো ছিল না? ‘
ছোটন ডানে-বামে মাথা নাড়ে। বলে, ‘আম্মো তো ঘুমায় না। আম্মোর মন খারাপ। তাই রাগ করে আমাকে শুধু মারে। সেজন্যই তো চলে এসেছি। আর যাবোই না।’

মারের কথা শুনে তিতিক্ষার ভুরু বাঁকলো। বুবুর এই বাজে স্বভাব যে কবে ফিরবে… কিছু হলেই ছেলের পিঠে কিল-চড়… অতটুকু বাচ্চা কিইবা বোঝে? তার সব কথায় অত রেগে যেতে আছে? তিতিক্ষা ছোটনের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
‘ফের মেরেছে তোমাকে? ভারি অন্যায় তো! বুবু দেখছি এবার শাসন না করলেই না। তুমি মন খারাপ কোরো না বাবু। পরের বার ঠিক বকে দেব।”
সায় পেয়ে মিমির কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে ছোটন।
মৃদু পায়ে উঠোন জুড়ে হাটতে থাকে তিতিক্ষা। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে,’ছোট মিয়া?’
‘হু’
‘তোমার আম্মোর আজ খারাপ কেন বলতো?’
তিতিক্ষা উত্তরের অপেক্ষা করে না। মনের খেয়ালেই প্রশ্নটা সে করেছিল।
ছোটন অত কিছু বোঝে না। সেদিন রাতে ভবিতব্য শ্বশুর নিনাদ ওরফে তার বেস্টু ফোন রাখার পর থেকেই সে দেখছে মায়ের মন খারাপ। সেটাই তিতিক্ষাকে বোঝাতে লাগলো। এর আগেও কয়েকবার নানান কথা দিয়ে ব্যাপার টা মিমিকে বোঝাতে চেয়েছে। তবে ছাত্রীটি নিতান্ত অচতুর হওয়ার দরুন বারবার ব্যার্থ হয়েছে। তিতিক্ষা কিছু বোঝেনি। শুধু টের পেয়েছে আড়ালে কি যেন একটা ঘনিয়ে উঠছে। গুরুতর কিছু। তবে আনন্দদায়ক নয়!

এইটুকু বুঝতে গত দুদিনে বুবুর হাবভাবের রকমসকম লি যথেষ্ট ছিল। শুরুতে ভেবেছিল রওশান ভাই চলে গেছে বলে হয়তো মন খারাপ। কিন্তু রওশান ভাইয়ের এই চলে যাওয়াটা তো অকস্মাৎ নয়। নিয়ম করে সে আসছে, চলে যাচ্ছে। কখনো তো বুবুকে এমন গুম মেরে থাকতে দেখেনি!
আজ, ছোট মিয়ার কথায় এইমাত্র সে বুঝলো ব্যপার যা-ই হোক ওতে নিনাদ জড়িত। এর মাঝে থাকা তার চলে না। ফলস্বরূপ তিতিক্ষা আগ্রহ হারালো। দেখাই যাক না কি হয়!

ক্রমে ক্রমেই বেলা পেরিয়ে জ্বলজ্বলে দুপুর অদৃশ্য হয়ে শহরের আকাশে ধূসর অপরাহ্ন নেমে এলো। তিতিক্ষা সোফায় হেলে একটা বাচ্চাদের গল্পের বই জোরে জোরে পড়ে শোনাচ্ছে। ছোটন তার পাশে আধশোয়া হয়ে বই পড়া শুনছে। তখন শেষ মধ্যাহ্নে উঠোনে হাটাহাটির পর আসরের আযান পড়তেই তারা দুজন ঘরে ফিরে এসেছিলো। তারপর তিতিক্ষা ছোটনকে পাশে নিয়েই সলাত আদায় করেছে। এরপর থেকেই এখানে বসে এরূপে তাদের বইপড়া চলছে। মারুফ সাহেব এখনো মসজিদ থেকে ফেরেননি। তিহা রান্নাঘরে আলুর চিপস ভাজছে।

ক্রিংক্রিং করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। তারপর অনবরত বাজতেই থাকলো। ছোটন গভীর মনোযোগে শুনছিল রাজকন্যার রাক্ষসপুরীতে বন্দী হওয়ার কাহিনি। তাই হঠাৎ এভাবে বাঁধা পরায় সে যেন একটু বেশিই বিরক্ত হলো। চোখ ছোট করে ভীষণ একটা ভ্রুক্ষেপ করল টেলিফোনের দিকে। ওটার প্রকট সুর তখনো ঘরময় বিরাজমান। তিতিক্ষা বই উল্টে রেখে হাত বাড়িয়ে ফোন কানে তুললো, ‘আসসালামু আলাইকুম। কাকে চাই?’
ওপাশে নিরবতা।
‘হ্যালো, কে বলছেন? ‘
আবারো নিরবতা।
তিতিক্ষা টেলিফোন মুখের সম্মুখে এনে সন্দিগ্ধ হয়ে তাকায়। ভুরু কুঁচকে নাম্বার টা দেখে নিয়ে ইশারায় কাছে ডাকে ছোটনকে। মাঝে মাঝেই বাজে ছেলে ছোকরারা এভাবে রং নাম্বার থেকে কল করে ডিস্টার্ব করে। ছোটন কাছে এলে টেলিফোনে হাত চেপে সে ফিসফিস স্বরে বলে, ‘দেখো তো ছোট মিয়া কি বলে।’
এতবড় দায়িত্ব পেয়ে আত্ম অহামিকায় ছোট মিয়ার বুক তখন ফুলে উঠেছে। টেলিফোন হাতে নিয়ে সে যতটা সম্ভব গলার স্বর কঠিন করে বলে, ‘হ্যালো।’
এবারেও ওপাশে নিরবতা অবিচল।
ছোট মিয়া ফের ‘হ্যালো’ বলল। উত্তর নেই। অতএব ছোট মিয়ার রক্ত গরম হতে বেশি সময় লাগলো না। ছোট্ট শরীরের সর্বশক্তি এক করে চেঁচিয়ে বলল,’হ্যালোওওওওও।’
কাজ হলো বোধহয়। ওপাশ থেকে একজন বৃদ্ধার খড়খড়ে গলায় আওয়াজ শোনা গেল। বিষম বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ও মারে মা…. আমার কানডা শ্যাষ…. ওই নিনাইদ্দা! এইডা কার নাম্বারে ফোন করছস তুই? চিককুর পাইরা আমার কানের পুক লারায়ালছে! ওরে আল্লাহ!’
নিনাদ লাফিয়ে ফোন হাতে নিল। কল করে প্রথমে তিতিক্ষার কণ্ঠ শুনেই সে চুপ করে ছিল। তারপর বৃদ্ধার হাতে ফোন দিতে যতটা সময় লাগে। এর মাঝেই কি আবার হলো!
‘ হ্যালো। ‘
তিতিক্ষা ছোটনের দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করলো, ‘কে ছোট মিয়া?’

ওপাশে বৃদ্ধার খড়খড়ে গলার কথা শুনে ছোট মিয়ার ততক্ষণে মুখ শুকিয়ে এসেছে। সে টেলিফোনে কান থেকে নামিয়ে নিয়েছিল তৎক্ষনাৎ। বললো, ‘জানি না। ‘ বলেই টেলিফোন মিমির হাতে ছেড়ে ভোঁ দৌড়। তিতিক্ষা পড়ল মস্ত বিপদে। ছোটন কেন এভাবে হঠাৎ ভয় পেয়ে পালালো? ওপাশে কে আছে? না জেনে একদম কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ওদিকে তার হাতে থাকা টেলিফোন তখনো ভাইব্রেট হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ওপাশে নিশ্চয়ই কেউ কিছু বলছে। তিতিক্ষা সংকোচ নিয়ে ফোন কানে তুললো,’হ্যালো। আপনি কে বলছেন?
এই স্বর চিনতে নিনাদের দেরি হয় না। তৎক্ষনাৎ পাশে থাকা বৃদ্ধার হাতে পুনর্বার ফোন হস্তান্তর করে সে,’ধরেছে, নাও কথা বল।’
বৃদ্ধা ফোন নিলেন। মুখের বিরক্ত ভাব গায়েব, সরল হেসে বললেন, ‘তিহা নাকি তুমি? কেমুন আছো? কউ তো আমি কেডা?’

তিতিক্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কে এই বৃদ্ধা? এভাবে পরিচিতের মতো কথা বলছেন। অথচ সে চিনতে পারছে না…. যেই হোক, বুবুর খুব কাছের কেউ নিশ্চয়ই!
মিনমিনে স্বরে বলল, ‘জ্বি……আসলে। আপু তো এখানে নেই। আমি ওর ছোট বোন। একটু অপেক্ষা করুন, এক্ষুনি আপুকে ডেকে দিচ্ছি।’

ভদ্র মহিলা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললেন,’ও তুমি তাইলে তিতিক্ষা বুঝি? প্রথমে ঠাওর করতে পারি নাই। তোমারেও তো আমি চিনি। কেমুন আছো মা?’
‘জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো আছেন? ‘
‘আল্লায় রাখছে এক রকম। তোমার আপায় কই? তারে ডাকো। বল শিউলি ফুআম্মা ফোন দিসে। ‘

‘জ্বি….জ্বি…. এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি।’ বলে ফোন নামিয়ে রেখে তিতিক্ষা বাঁচলো হাফ ছেড়ে। পরক্ষণে ছুটে গেল রান্নাঘরে তিহাকে ডাকতে। ওকে বাইরের ঘরে পাঠিয়ে এবার চিপস ভাজায় নিযুক্ত হল নিজে। বাবা এলেন, ছোটন ঘরের লুকোনো কোণ ছেড়ে বেরোলো। ওদের সঙ্গে বসে চা বিস্কিট আর গরম চিপস ভাজা খেল তিতিক্ষা। অথচ তখনো তিহার টিকিরও দেখা নেই! সে এলো বিস্তর সময় পর মুখে একরাশ হাসি নিয়ে।
‘কে ছিলো বুবু? এতো সময় ধরে যে কথা বললে?’ স্বাভাবিক কৌতুহল থেকে তিতিক্ষা চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে শুধাল।

‘শিউলি ফুআম্মা কে মনে আছে তোর? একবার স্কুলে থাকতে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম নিনাদের বাসায়। তখন এসেছিল।’
নিনাদের নাম শুনেই তিতিক্ষার সমস্ত উৎসাহ মুহুর্তে উড়ে গিয়ে রাশি রাশি বিরক্তি এসে জমা হয়েছে। বিরস মুখে বলল,’মনে নেই বুবু।’
নিজের খুশিটুকু যেভাবেই হোক প্রকাশ করতে তিহা উতলা তখন। চুপসে না গিয়ে দিগুণ উৎসাহে চেঁচালো,’ ফুআম্মা কে ভুলে গেলি! নিনাদের বাসায় গেলদ কত যত্নআত্তি করতো… একদম নিজের আপন চাচি-ফুফুর মতো…. তোকেও তো সেবার কত আদরযত্ন করল। সব ভুলে গেলি?’

‘তোমার স্কুলে পড়ার সময়। সে অনেককাল আগের কথা বুবু। মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক।’

‘ছাই!’ তিহা মুখ বাঁকাল। ‘আচ্ছা শোন না। আসল কথাটাই তো বলা হয়নি তোকে! ফুআম্মা কেন ফোন করেছিল জানিস?
নিনাদ তো চলেই যাচ্ছে… সেজন্য ফুআম্মা
কে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। নিনাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবেন। ও যাবার আগে ওর সাথে সাথে আমাদের সঙ্গে একবার দেখা করতে চান। তাই নিজেই দাওয়াত দিলেন। সামনের শুক্রবার নিনাদের বাড়িতে। আমি, ছোটন আর তুই। ইশশ কি দারুণ হবে, তাই না? ফুআম্মার হাতের রান্না কত বছর ধরে যে খাই না… এই সুযোগ!’

এসব কোন কথাই তখন আর তিতিক্ষা বিশেষ খেয়াল করে শুনছিল না। বুবুর বলা ওই একটা কথাতে আটকে আছে সে। বুবু যে বলল নিনাদ চলে যাচ্ছে! এর মানে কি? হঠাৎ কোথায় যাচ্ছে সে? কেনই বা যাচ্ছে? এজন্যই বুঝি বুবুর আজকাল এত মন খারাপের বাড়বাড়ন্ত?
কোথায় যাবে নিনাদ? দূর? খুব দূর?
তা কি করে হবে! হয়তো পাহাড় টাহাড় কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে….
নিনাদ কি আর ছেলেমানুষ? যদি দিন কয়েকের জন্য সেখানে যায় ই, তবে সবার এত আদিখ্যেতার কি আছে? আর সেই সুদূর গ্রাম থেকে নিজের ফুফুকে আনিয়ে এত আয়োজনই বা কেন?
ধুর…. যেখানে ইচ্ছে চলে যাক অভদ্র বেহায়া ছেলেটা… তিতিক্ষার তাতে কিইবা এসে যায়?

তিহা তখনো দারুণ উত্তেজনায় হড়বড় করে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। কিছু মন দিয়ে শুনছে না তিতিক্ষা। ভাবছে… কি নিয়ে যে তার অত ভাবনা…. তবে আর যাই হোক! বুবুর ওই বেহায়া বন্ধুর হঠাৎ চলে যাওয়া নিয়ে মোটেও ভাবিত নয় সে।
ওকে ভাবাচ্ছে যাওয়ার এই আগাম আয়োজন, সকলের ব্যস্ততা, বুবু আর রওশান ভাইয়ের অস্থিরতা… সবার তোড়জোড় দেখে মনে হয় যেন বহুদিনের জন্য, বহু দূরের কোনো মুলুকে হারাচ্ছে নিনাদ… সাথে একটা সুখস্বপ্ন নিয়ে। যেকারণে এই বিচ্ছেদও সবার কাছে এতটা আনন্দের!

________________________

সেদিন রাত্রিবেলা তিহা, রওশানের জোরের কাছে হেরে বাধ্য হয়ে সব জানাতে হয়েছিল নিনাদকে। শান্ত ধীর স্বরে ও বলল কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার হঠাৎ প্রয়োজন পড়েছে। বাইরে মানে আমেরিকায়। ঢাবিতে অনার্স-মাস্টার্স শেষে একমাত্র যে লক্ষ্যটার পেছনে দিনরাত সে মরিয়া হয়ে ছুটেছিল। আজ সে লক্ষ্যপূরনের দোর গোরায় নিনাদ দাঁড়িয়ে। জিআরই আর আয়েল্টস এর রেজাল্টের পর আমেরিকার তিনটা ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিল। এরমধ্যে টলেডো থেকেই শুধু গ্রীন সিগনাল আসে। তার প্রোফাইলও পছন্দ হয় ওদের। ভিসা আবেদন করা শেষ। এবার শুধু ভিসা ইন্টারভিউ টা বাকি। আর দিন পনেরোর মধ্যে বোধহয় সেটাও হয়ে যাবে। এরপর সামনের মাসেই কোন একটা দিন আকাশে উড়াল দেবে সে।
নিনাদের কথা শেষ হতেই ফোনের এপাশে তিহা রওশান সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। ফোন লাউড স্পিকারে ছিল। তিহা চেচিয়ে বলল,’তুই সত্যি বলছিস? সত্যি তোর স্কলারশিপ টা হয়ে গেছে? আমি একটুও বিশ্বাস করি না। তুই এক্ষুনি কসম কাট তো।’
নিনাদ অস্ফুটে হাসলো,’কসম কাটতে পারবো না। ভয় ডর নেই নাকি আমার?’
‘যদি সত্যি যেতে পারিস তাহলে একটা কসমে তোর কি সমস্যা? আমি কিছু শুনবো না। তুই কসম কাট জলদি।’
‘আচ্ছা, যা কাটলাম। আল্লাহর কসম বলছি সত্যি যাবো…. যদি না শেষ সময়ে ওরা আমাকে বাতিল করে দেয়। এমনটা যদিও হওয়ার সম্ভবনা নেই…. তবু কসমই যখন কাটব রিস্ক রেখে লাভ কি এখন ঠিক আছে তো?’
তিহা হাসলো। আর কিছু বলা হলো না ওর। খুশিতে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে হাসছে, একইসাথে চোখে জলে ভিজে যাচ্ছে গাল। ও জানে, ওর এই বন্ধু রূপী ভাইটার পুরো জীবন কেমন শূন্যতায় মোরানো। মা, বাবা, ভাই, বোন কাছের আত্মীয়স্বজন… যা কেউ নেই। সবাই তাকে রেখে বহু আগেই ওপারে নৌকা ভিরিয়েছে। শুধু রয়ে গেছে সে একা। জীবনের লড়াইটা সে তাই একাই লড়ে গেছে সবসময়। নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে। নিনাদ ওপাশ থেকে তিহার নাম ধরে ডাকছে। তিহা চোখ মুছল। সে কাঁদলে নিনাদ কষ্ট পাবে ভীষণ।

নিনাদের কথা শুনে রওশান তখন থেকে হা হয়েই ছিল কিছুক্ষণ। এবার বলল, ‘শালাবাবু, মাথা টাথা ঠিক আছে তো তোমার? ‘
নিনাদ কিছু বুঝতে না পেরে বলে, ‘কেন ভাই?’
‘নাহয় এমন একটা খবর কি আর কেউ এমন মুখ গম্ভীর করে দেয়! মনে হচ্ছে স্কলারশিপ পেয়ে নয়। তুমি নিতান্ত অনিচ্ছায় আমেরিকার কোনো এক কারাগারে দাসত্ব বরণে যাচ্ছো!
একথার উত্তর নিনাদ মুখে দিল না। তার গগনবিদারী হাসি মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে চূড়ে খানখান করে দিল।
তিহার ধ্যান তখন এখানে আর নেই। সেই অন্ধকার রাত্রিতে, সবার মাঝে থেকেও যেন সে খুব একা অনুভব করলো। দু’হাত একত্রে তুলি আকাশের দিকে তাকিয়ে বারবার শুকরিয়া জানাতে লাগলো আরশের মালিকের দুয়ারে।
বহুদূরের কোনো এক অন্ধকার রাতের নিচে বসে নিনাদের হঠাৎ করা গগনবিদারী হাসির শব্দ কি আর কারো কানেও এসে পৌঁছেছিল? সেও কি কেঁপে উঠেছিল অজানা অনুভূতির শিহরণে। কে সে? তিতিক্ষা নয়তো? কে জানে!
চলবে……

দূর আলাপন পর্ব-০৩

0

দূর আলাপন ~ ৩
(সম্পুর্ন গল্পের লিংক কেন ওপেন হচ্ছে না, এই নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করছেন। সবাইকে অনুরোধ করবো একটু ধৈর্য ধরতে। গল্পটা দু বছর আগে লেখা। অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। সেসব ঠিক করে এখন প্রতিদিন একটা করে পর্ব দেয়া হবে ইন শা আল্লাহ। গল্প নিয়মিত পেতে পেজে চোখ রাখুন। পুরনো লিংক ওপেন হবে না। প্রথম কারণ আগের কাঁচা হাতের লেখা আর কেউ পড়ুক আমি চাইছি না, দ্বিতীয়ত আমার আইডি ডিএক্টিভ।)
___________________________
নিনাদ এসে তিহার পানে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চাপা রাগ ঝরে পড়ে ওর স্বরে, ‘লিলি কি বলতে এসেছিল ওকে?’

তিহার মুখ ততক্ষণে ফ্যাকাসে, ‘কি আবার! তার যা কাজ। ফোন নাম্বার নিতে এসেছিল।’

‘তোর বোন কি করলো? দিয়ে দিল ফোন নাম্বার? ‘

‘তাই তো করেছে দেখলাম। আমি ইশারায় নিষেধ করছিলাম। ও বুঝতে পারেনি।’

‘বাহ! তাহলে তো আর কথাই নেই। এবার তাহলে রং নাম্বার থেকে কল এলে বলিস তোর বোনকে জমিয়ে পিরিত করতে !’

বন্ধুর কথায় আরো চুপসে যায় তিহা, নিনাদ আরো দু কথা শুনিয়ে না দেয়। সেজন্য তাড়াতাড়ি বলে, ‘আচ্ছা বাদ দে। লিলির স্বভাবই তো অমন। এর-তার জন্য মেয়ে খুঁজে বেরানো। কেউ ডিস্টার্ব করলে সে নাহয় তখনি দেখা যাবে। তুই তো আছিসই।
জানিস, এই মেয়ের চক্করে পরে আমার খাওয়াটা ঠিকঠাক হলো না! ‘

‘খাওয়া হলো না! আর কত খাবি তুই? সেই কখন থেকে দেখছি শুধু খেয়েই যাচ্ছি। তোর আর খেতে হবে না। প্লেটে এখনো একটা আস্তো লেগ পিস রয়েছে দেখা যায়! দে প্লেটটা আমায় দে। কামলা খাটতে খাটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল করে ফেললাম। এখনো কিছু খেতে দিলো না ওরা।এত পরিশ্রমের বিনিময়ে এই! ভেবে দেখ একবার! পাপড়িটারও কি হুশ আছে? ছবির পোজ দিতে দিতে মুখ বেঁকে যায় অবস্থা। পুরাই আজিব চিজ এরা সব!’ বলে তিহার আধখাওয়া প্লেট টেনে নিল নিনাদ। তখনক ঘুরে বসতে যেতেই ঘটে গেল ভয়ানক একটা দুর্ঘটনা।
তিতিক্ষা হাত ধুয়ে ফিরছিল। নিনাদ খেয়াল করেনি। তিতিক্ষাও ভেবেছিল পেছনেই অপেক্ষা করবে। নিনাদের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আসর জমানোর কোনো ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু এরকম অকস্মাৎ পিছিয়ে আসবে কে জানতো!
দুজন মুখোমুখি হতেই ঘটে গেল সংঘর্ষ। নিনাদের হাতে থাকা খাবারের প্লেট গিয়ে পড়লো তিতিক্ষার গায়ের ওপর। সবকিছু এত দ্রুত ঘটল দুর্ঘটনা এড়ানোর সুযোগ টুকু তিতিক্ষা পেল না। নিজেকে বাঁচানোর সামান্য প্রচেষ্টায় সে চোখ বুজে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছিল। চোখ খুলে এবার যা দেখলো তাতে ওর কান্না পেয়ে গেল। ঝকঝকে বোরকাটা মাংসের লাল ঝোলে মাখামাখি, খানিকটা ঝোল চুইয়ে ক্রমে ওর পায়ে গড়িয়ে পড়ছে। অদূরেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে নিনাদ। মুখেচোখে প্রবল অনুতাপবোধের ছাপ। বেচারার হতভম্ব ভাব কাটা মাত্র কি অঘটন ঘটিয়েছে বুঝতে পেরে ও ব্যাস্ত হয়ে উঠল।
টেবিল থেকে একসাথে অনেক গুলো টিস্যু টেনে নিয়ে তিতিক্ষার বোরকা পরিষ্কারে মনোযোগী হলো।
তিতিক্ষা নির্বাক। চেষ্টা করেও হঠাৎ সরে যেতে পারলো না। তার বোরকা টেনে ধরে আছে নিনাদ। টিস্যু দিয়ে ঝোল পরিষ্কার করছে। আপাতত আর কোনো খেয়াল নেই বেচারার। বারবার বলেছে ‘সরি। খুব ভুল হয়ে গেল। একদম খেয়াল করিনি আমি।’

তিতিক্ষা নিরুপায় হয়ে কাঁদোকাঁদো মুখে বোনের দিকে তাকালো। তিহা তখনো সম্বিত ফিরে পায় নি। তাকিয়ে ওদের দেখছে হা করে।

আশেপাশে বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেছে ব্যপার টা নিয়ে। বিয়ে বাড়ির হাজার লোক, হাজার রঙের কথা!
যে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে ব্যাপার টা উপভোগ করছে। মুখ দেখা যায় না, চুল দেখা যায় না, কালো বেশধারী এমন এক মেয়ে র সারা গায়ে মাংসের ঝোল মাখানো। কাছেই একটি আসমানি রঙা পাঞ্জাবি পড়া গাঢ় শ্যামবর্ণের, ঝাকড়া চুলের ছেলে বসে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে সেসব পরিষ্কার করছে। কেউ কেউ এদের স্বামী-স্ত্রী ভেবে নিয়ে নিনাদকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘লাভ নাই ভাই। এভাবে পরিষ্কার হবে না। ভাবিরে নিয়ে বাসায় যান।’
একটুকু হলেও বোধহয় চলতো। কিন্তু তিহার বন্ধুমহলের সবাই যখন একসাথে এসে জুটলো, তাদের কথায় তখন তিতিক্ষার কান আঙুল দেয়া ছাড়া পথ রইল না। পূর্ব থেকেই তিতিক্ষাকে নিনাদের কথা তুলে খেপাতে ওরা বেশ মজা পেত। আজ সুযোগ পেয়ে ওদের মশকরা চরমে এসে পৌঁছালো। কথার সাথে সাথে কেউ কেউ আবার শিশ বাজাচ্ছে।
তিতিক্ষা শেষ বারের মতো চাইল বোনের দিকে।তিহা এখনো বুঝতে পারছে না কি করা উচিত। বন্ধুদের কে থামানোও যাচ্ছে না। বিয়ে বাড়ির সবেতেই হাসিঠাট্টা করার একটা অমোধ বিধান যেন নির্ধারিত হয়ে আছে। বন্ধুরা সেই সুযোগে যাচ্ছেতাই ভাবে ওর রাগী বোনটাকে পচাচ্ছে। নিতান্ত স্বাভাবিক একটা বিষয় যে নিনাদ-তিতিক্ষা কে কেন্দ্র করে হতেই এতো অস্বাভাবিক হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি তিহা।

বোরকাটা মোটামুটি ঝোলমুক্ত করে নিনাদ সরে এলো। ছাড়া পাওয়া মাত্র কারো পরোয়া না করে হাওয়ার বেগে আসর ছাড়ল তিতিক্ষা। তৎক্ষনাৎ ছোটনের হাত ধরে বোনের পিছু পিছু ছুটল তিহা। বুঝলো বাড়ি ফিরে আজ তুফানের মুখোমুখি হতে হবে…

.

নিজের ঘরে এসে দ্বার রুদ্ধ করলো তিতিক্ষা।অনেক ধাক্কাধাক্কিতেও আর দ্বার খুললো না সে রাতে। মারুফ খানিক পর পর এসে মেয়ের ঘরের সামনে চিন্তিত মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।মেয়েকে তিনি জানেন। বড্ড রাগী আর অভিমানী। কিছু একটা তো হয়েছে নিশ্চই। অকারণে গাল ফোলানোর মেয়ে ও নয়। শেষতক ডাকার সাহসটা করে উঠতে পারলেন না ঠিকঠাক। বড় মেয়ের কাছে গেলেন। এই ভেবে যে তিহা হয়তো তার অভিমানী কন্যার হঠাৎ হওয়া অভিমানের কারণ জানে। তিহা বাবাকে চিন্তামুক্ত করতে হেসে ব্যাপার টা খুব হালকা ভাবে উড়িয়ে দিল। কিন্তু সবকিছু উড়িয়ে দিতে চাইলেই যে অক্লেশে উড়ে যাবে এমন তো নয়। সেদিনের ঘটনার রেশ কাটলো না সহজে। তিতিক্ষার বিক্ষুদ্ধ ধমর্ঘটে বাড়ির আবহ শীতল রইল বেশ কিছুদিন। এই কদিন প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকেই বেরোলো না ও। তারপর একদিন ফজরের সালাতের পর তিহা রান্নাঘরে চা করছিল। সহসা তিতিক্ষার আগমন। ঘুমভাঙা
পেলব চোখ মেলে চাইল বুবুর দিকে। বুবুর মুখখানা আজ বেশ মলিন। অনুতাপে দগ্ধ হলো যেন তিতিক্ষা। কি দরকার ছিল বুবুর সঙ্গে অত রাগ দেখানোর! বুবুর তো দোষ ছিল না। ইতস্তত মৃদু গলায় প্রথম কথা বলল তিতিক্ষা,’আমাকে চা দেবে বুবু?’

তিহার চোখেমুখে চমকিত ভাব।

‘তুই! রাগ ভাঙল তবে মহারানীর? দিচ্ছি। ডাইনিং এ গিয়ে বোস।’

দুইবোন মুড়ি দিয়ে চা খাচ্ছে। তিতিক্ষা পরিতোষ চিত্তে হঠাৎ ঠিক যেন আবদারের সুরে বলল,’আজকের আবহাওয়াটা বেশ! হাটতে যাবে বুবু?’
তিহা মনে মনে খুশি হলো। এই তো তিতিক্ষার প্রকৃতি রূপ। গম্ভীর অথচ কি সারল্যে ভরপুর। এমনিতে বোনটা তো তার বেশ ভালোই। শুধু যা একটু রাগের বেলা মাথা ঠিক থাকে না। তিহার মনের খুশি মুখে প্রকাশ পেল না বিন্দুমাত্রও। তিতা করলাকে আরো একটু অনুতপ্ত বোধ করাবে সে। দুখী দুখী চেহারা করে বলল, ‘যাবি হাটতে? কিন্তু… ‘

‘কোনো কিনতি না বুবু। প্লিজ চলো না..। ছোটনের স্কুলেও তো আজ ছুটি।’

‘এত করে বলছিল যখন…. আচ্ছা চল।’

বোনের কথা চতুরতার সন্দেহ তোলা তখন অমূলক। বরং বুবুর নিষ্প্রভ মুখখানি দেখে তিতিক্ষা মনে ততক্ষণে অপার করুণা জাগ্রত হয়েছে। এই কদিন বুবুর সাথে দূরত্ব রেখে চলার পরিতাপে সে পুড়ে খাক হচ্ছে।
ছি! অত প্রিয় বুবুর সঙ্গে কিভাবে যে করতে পারলো এত রাগ। তার দ্বীন তো কখনো এমন বেপরোয়া অভিমানের শিক্ষা দেয় না!

বুবুর হাত ধরে সেদিন সকালে অনেকক্ষণ ঘুরে বেরালো তিতিক্ষা। হাটল ভোরের স্নিগ্ধ-শীতল শান্তিময় আবহাওয়ায় এক পথ থেকে অন্য পথে। দুদিনের অবিরত বর্ষণে ধানমন্ডি লেকের স্বচ্ছ পানি তখন আরও স্বচ্ছ, ঝলমলে হয়ে উঠেছে।ভোরের তরুণ সূর্য পুরো লেক জুড়ে ছড়িয়ে রেখেছে তার সোনালী আলোর বিচ্চুরণ। ওরা লেকের পাড়ঘেঁষে হাটল, বসে সুখ,দুঃখের গল্প করল খানিকক্ষণ। বাড়ি ফিরে তিতিক্ষা আবার আগের মতো হাসিখুশি, প্রানবন্ত হয়ে গেল। মেয়ের হাসিমুখ দেখে ঝলমলিয়ে উঠলেন মারুফ।

সেই বিয়ের একমাস কেটেছে। এরমধ্যে একবারো তিতিক্ষাদের বাড়িমুখো হবার সাহস দেখায়নি নিনাদ। ধাক্কা খেয়ে ভুলবশত গায়ে খাবার ফেলে দেয়া ঘটনা হিসেবে তেমন কিছু না। তিতিক্ষার জায়গায় অন্য যেকোনো মেয়ে হলে হয়তো হেসে উড়িয়ে দিতো সবটা। তবে দূর্ভাগ্যবশত মেয়েটা তিতিক্ষা ছিল এবং সেখানে বন্ধু রূপী কিছু শত্রুর উপস্থিতিও ছিল। তাদের কথাগুলো জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ করলো। যদিও নিনাদের বন্ধুরা শুধুমাত্র কৌতুক করেই কথাগুলো বলছিল। কিন্তু তাদের হয়তো ধারণা ছিল না সে কথাগুলো কারো অন্তঃকরণে এতো গভীর আঘাত হানতে পারে। নিনাদও অনুতপ্ত। অপরাধ সে জেনে-বুঝে কিছুই করেনি। তবু তিহার সঙ্গে কিঞ্চিৎ দূরত্ব বাড়ালো। মন খারাপ হলো তিহার, শেষে কিনা নিনাদটাও ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? সেও আগ বাড়িয়ে করবেনা যোগাযোগ। দেখবে কি হয়!
এই সব দূরত্ব এক লহমায় দূর করে দিল একটা ফোন কল!

তিহার স্বামী রওশান বান্দরবান থেকে ফিরে তিহার মুখে সবকিছু শুনলো।নিনাদ কে সে বিশেষ পছন্দ করতো। নিনাদের সোজাসাপ্টা কথা বলার ধরনের জন্য। তাছাড়া ভার্সিটিতে তুখোড় মেধাবী হিশেবে যথেষ্ট সুনাম থাকলেও আচরণে তার কিছু অপরিপক্কতা রয়েই গেছিলো।সেই দূর্বলতা দিয়ে সে খুব সহজে অন্যের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারতো। তদতিরিক্ত! যে সুদর্শন, মেধাবী, বাক্যে পটু অথচ নীতিতে সরল। অন্যের ভালোবাসা অর্জনে তার কিই বা বাঁধা !

রাতে খাবার পর স্ত্রী পুত্র নিয়ে ছাদে হেল রওশান। ছাদের মাঝখানে কাঠের বেঞ্চি পাতা। রওশান তিহা দুজন দু’দিকে বসা। মাঝে ছোটন তার ছোট ছোট হাত দিয়ে বাবা-মা দুজনেরই হাত চেপে ধরে বসে আছে। খুশিতে ঝিকিমিকি দুটি চোখ, প্রফুল্লতায় ভরপুর ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি। সুদীর্ঘ দিবস রজনী অপেক্ষার পর বাবা মাকে একসঙ্গে কাছে পেয়েছে সে।

অনবরত কল বেজে চলেছে। ছেলেটা ফোন কানে তুলছে না। রওশান ভাবলো সে বোধহয় কল টা অসময়ে করেছে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা। এর আগে দু’বার রিং বেজে বেজে কেটে গেছে ।এবার রওশান নিজেই কল কেটে দেয়ার কথা ভাবলো। তখনই ওপাশ থেকে একটা ক্লান্ত বিষন্ন গলার স্বর ভেসে এলো,’আসসালামু আলাইকুম। কি অবস্থা ভাইয়া?’

আমুদে ভাব চলে এলো রওশানের কথায়। এই ছেলেটার সঙ্গে কথা বললে হাসি আপনাতে ওর ঠোঁটে চলে আসে।
‘তোমার সহচার্য যার নিত্য অভ্যাস, তার সাথে মানুষ যেমন অবস্থায় থাকতে পারে আমিও তেমন অবস্থায়-ই আছি। হাটছি, ফিরছি, খাচ্ছি, ঘুরছি। আর মুখ দিয়ে তার’ অপছন্দনীয় কথা কিছু বের হওয়া মাত্রই পিঠে আঘাত অনুভব করছি। এইতো! ‘

কথা শেষ হওয়া মাত্র তিহা হেসে ওর পিঠে আবারো মৃদু আঘাত করল। রওশান সাথে সাথে ওপাশের মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে বললো , ‘এইতো! মাত্রই আমার কথা আবারো সত্য প্রমাণিত হলো। কিযে এক ঝামেলা তোমরা চাপিয়েছ আমার ওপর শালাবাবু… তপমার বোনের মার খেতে খেতে চিড়েচেপ্টা হয়ে যাচ্ছি…’

নিনাদ আর মুখ গোমড়া করে থাকতে পারলো না। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। নিশ্বাস ফেললো রওশান।
‘যাক! অবশেষে মেঘ কাটলো। এই ভাগ্যবান শ্রবণেন্দ্রিয় জোড়া শালাবাবুর সুমধুর হাসির শব্দ শুনতে পেল!’

নিনাদ ফের হাসলো। ‘আর লজ্জা দিয়েন না ভাইয়া। ঢাকায় এলেন কখন? কবে দেখা করছেন তাই বলুন।’

‘আমার আসার আবার সময়-অসময়! যখন ইচ্ছে করছে তখনই হুট করে চলে আসছি। এখন আর আগের মতো পাহাড় দেখলেই কবিতা আসে না। ওখানে থেকে কি করি বলো!
আচ্ছা ছাড়ো এসব। আমার কথা বাদ দাও।তোমার আলাপ বলো। আমার রেজিস্ট্রি করা সত্যিকারের ছোট গিন্নির সাথে নাকি কিসব গন্ডগোল বাঁধিয়েছ? একেবারে নাকি ফিল্মি ব্যাপার স্যাপার? ‘

নিনাদের কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা পড়ার মতো অবস্থা হলো। সে লজ্জিত হয়ে চুপ করে রইল।

ব্যাপার টা বুঝতে পেরে ফোনের এপাশে রওশান ফিচেল হাসে। তিহাও যোগ দেয় সে হাসিতে।ছোটন একমনে আকাশের তারা গুনছিল। গোনা বাদ দিয়ে অবাক হয়ে তাকাল বাবা মায়ের মুখের দিকে।

বন্ধুকে নিয়ে মজা নিলেও তিহার মনের একটা পাশ ঠিক ওর জন্য কাতর হচ্ছিল। রওশানের হাত থেকে ফোন নিয়ে প্রথমেই নিনাদকে বিশাল আকারের একটা ঝারি দিল আজকাল তার দেখা পাওয়া এমন অসম্ভব হয়ে উঠেছে কেন তা জানতে চেয়ে। তারপর তুললো ট্যুরের কথা। বললো এবার শীতে ওরা বান্দরবানে ট্যুর দেবে।রওশান তো সেখানে আছেই। ও ই তাদের সবাইকে ঘুরে ঘুরে দেখাবে সব। এবার যাওয়াটা ফাইনাল করে ফেলতে হবে। কে কে যাচ্ছে, কতদিনের জন্য যাচ্ছে….
নিনাদকে এবিষয়ে খুব একটা আগ্রহী দেখালো না। নিরবে সায় দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গাম্ভীর্যের সাথে হু হা করে যেতে লাগলো। ওর অবস্থান্তরে তিহা অবাক। নিনাদ যাই করুক যত ঝড়ই বয়ে যাক এর ওপর। বরাবর হাসিখুশি ছেলে ও। এতটা নির্লিপ্ত তো কখনো থাকে না।
‘কিরে, হু বললি যে শুধু?’
নিনাদের শীতল প্রতুত্তর,’ আর কি বলবো? তোরা প্ল্যান করতে থাক।’
‘প্রতিবছর তো তুই-ই সবকিছু প্ল্যান প্রোগ্রাম করিস। বরং আমরাই থাকি চুপচাপ। এবার উল্টো নিয়ম যে? কি এমন হলো হঠাৎ?’
‘কি হবে? কিছু না। তোরা প্ল্যান চালিয়ে যা।’
কিসের যেন একটা সামান্য আভাস পেল তিহা। স্বরে সন্দিগ্ধতা এনে বলল,’সত্যি করে বলতো নিনাদ কি হয়েছে তোর? কথা এমন ভাবে বলছিস যেন এবার আমাদের ট্যুর আসার আগেই তুই দেশ ছেড়ে পগারপার হবি!’
নিনাদ স্থির কণ্ঠে বলল,’হতেও পারে। ‘
‘ফাজলামো ছাড়। আসল কথাটা বল। অনেকক্ষণ ধরেই মনে হচ্ছে খুব বড় কিছু একটা তুই আমাদের থেকে লুকোচ্ছিস।’
নিনাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো তিহা জানে না নিজের অজান্তেই কখন সে নিনাদের না বলা কথাটা বলে ফেলেছে।

রাত বারছে। সেই সাথে ধীরে ধীরে বারছে রাতের বাতাসের শীতল ভাব। শ্রাবণের অনাকাঙ্ক্ষিত স্বচ্ছ রাতের আকাশে ছোট বড় অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে।পশ্চিম আকাশ থেকে ভেসে আসা সাদা মেঘের আড়ালে মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ছে তারাগুলো। কি আশ্চর্য সুন্দর এই মধ্যরাতের আকাশ, পৃথিবী ! শুধুমাত্র এই সৌন্দর্য দেখার জন্য কি কেউ কখনো জাগতে পারে? রাতের পর রাত? যে পারে সে নিশ্চয়ই প্রেমিক! প্রেমিক ছাড়া আর কার চোখই বা এই রাতের কাব্য বোঝে!

তিহা আর রওশান দুজনেই এবার বুঝলো কিছু একটা গন্ডগোল নিশ্চয়ই আছে নিনাদের সাথে। আজ তার কথাগুলো কেমন যেন খাপছাড়া। বড় এলোমেলো। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে নিনাদকে ধরলো। যে করেই হোক নিনাদের গোপন কথাটা আজ তারা জেনে তবে ছাড়বে। তিহা তো ফোনেই প্রায় নিনাদের গলা চে পে ধরতে চাইল! নিনাদ ভয় পেল, হার মানলো। বুঝলো এরা নাছোড়বান্দা। না বললে আর এই যন্ত্রণার মুক্তি নেই। ফলাফল, সে রাতে নিনাদ তাদের দুজন কে একটা বিস্ফোরক তথ্য জানাতে বাধ্য হল!
চলবে………

দূর আলাপন পর্ব-০২

0

দূর আলাপন ~ ২

____________________________
রাতে এশার সলাতের পর তিতিক্ষা বারান্দায় হাটছিল। যদিও শ্রাবণ মাস। আকাশে তবু মেঘের দেখা নেই। রুক্ষ রাতের আবহ থমকে আছে জানালার বাইরে। চারিদিকে গুমোট একপশলা বাতাস। তাপদাহে ঘরে টেকা দায়।এদিকটা তবু কিছু ঠান্ডা। তিতিক্ষা গ্রীল ধরে দাঁড়ায়। বাইরে তখন শ্রাবণের অন্ধকার রাতের আকাশে, ভীষণ কালো মেঘেদের আনাগোনার বদলে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে। বাড়ির পাশেই একটি বড় কামিনী গাছ । বহু বছর ধরে গাছটি এবাড়িতে রাজত্ব করছে। তার সরু সরু ডালপালা আর গাঢ় সবুজ পাতা দিয়ে সে ঘিরে রেখেছে বাড়ির সামনের চারপাশ। গাছের ফুলের মাদকতাময় গন্ধে ছেঁয়ে গেছে সারা বাড়ি। থেমে থেমে বাতাস ভেসে আসে। শরীর হিম করে দেয়া শীতল বাতাস নয়। আদ্র বাতাসে কামিনী ফুলের গন্ধ আরও জোড়ালো হয়ে নাকে এসে লাগে।

তিহা পেছনে এসে দাঁড়ালো। মুখ ফিরিয়ে তাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে তিতিক্ষা হাসে। তিহা যেন বোঝে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। রাগী বোনের সাথে কথা বলাই যায়।
‘এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছিস, ওদিকে ছোটন তোকে খুঁজে হয়রান। ‘

‘একটু আগেই তো দেখলাম বাবার সাথে খেলছে।তাই আর ডাকি নি।’

তিহা বোনের আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালো।’ আজ পাপড়ি ফোন দিয়েছিল। জানিস কি বলল… ‘

‘তুমি বললেই জানবো! তার আগে বলো এশার সলাত শেষ করেছো?’

‘করেছি তো! তুই কি ভাবিস। তুই একাই আল্লাহর ইবাদত করিস শুধু? ‘

তিতিক্ষা হাসলো,’একদমই ভাবি না। আমার ধারণা তো আমি আল্লাহর অতিশয় নিকৃষ্ট এক বান্দা। আচ্ছা যাক সে কথা, পাপড়ি আপু কি বললো ?’

পাপড়ি কথা উঠতেই পুনরায় তিহার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,’ওর বিয়ের কথা চলছে বলেছিলাম না? বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’

‘বলেছিলে নাকি ? কই মনে পড়ছে না তো!’

‘ফাজলামি করবি না একদম। তোকে বলেছিলাম আমি। মনে আছে আমার। ‘

‘কিন্তু আমার মনে নেই যে!’

‘সত্যি মনে নেই? এত ভুলো মনা কেন তুই? এখন কাজের কথা শোন, পাপড়ির বিয়ে পরের শুক্রবার। কাল আমরা শপিংয়ে যাবো।’

‘আচ্ছা যেও… থামো থামো… আমরা কারা বুবু?’

‘ওমা! কারা আবার! তুই আমি আর নিমিরা বোধহয় যাবে দু একজন.. ‘

‘আমি গিয়ে কি করবো?’

‘বিয়েতে যাবি। শপিং করবি না?’

‘আমি বিয়েতে যাচ্ছি কেন বলল?’

‘ওমা! তুই যাবি না? পাপড়ি আমাকে ফোনে বিশেষ করে তোর কথা এতবার বলে দিল। আর তুই বলছিস যাবি না!’ তিহার বিস্ময় মাখা চাহনি স্থির হয়ে রইল তিতিক্ষার মুখের ওপর।

বুবুর উদ্বেল হাবভাবের সামনে কিছুটা সংকুচিত বোধ করে তিতিক্ষা। সেই পুরনো কথা বুবুকে আবার বোঝাও…. বিয়েতে যেতে ভালো লাগে না।
‘তুমি তো জানো বুবু। মানুষের ভীড় ভালো লাগে না আমার। বন্ধুর বিয়ে, তোমরা সবাই একসাথে যাও।’

‘তুই সত্যি যাবি না?’

তিতিক্ষা নিরুপায় হয়ে মাথা নাড়ল। সে যাবে না। তিহা তার বোন কে চেনে। জানে এই মেয়ে যখন না বলেছে, শেষে সত্যি যাওয়া নিয়ে টালবাহানা শুরু করবে। মুহূর্তকাল কড়া দৃষ্টিতে বোনকে পরোখ করে সোজা বাবার কাছে চলে গেল।
কিঞ্চিৎ সময় পর বাবা মেয়ে একসাথে এসে তিতিক্ষাকে ঘিরে দাঁড়াল। মারুফ বরাববের ন্যায় গম্ভীর মুখে বললেন, ‘কি ব্যাপার তিতি। তুমি নাকি বিয়েতে যাবে না বলেছো? মেয়েটা নিজে আমাকে বলেছে বিয়ের দুদিন আগে যেন ওর বাসায় তোমাদের পাঠিয়ে দিই। সে নাহয় এড়ানো যাবে। তা বলে বিয়েতে যাবে না? কেন মা? কোনো সমস্যা?’

বাবার সামনে তিতিক্ষা সবসময় সুবোধ বালিকা। ব্যস্ত হয়ে মাথা নাড়ল,’তেমন কিছু নয় বাবা। এমনিই… ভালো লাগছিল না..’

মারুফ নিশ্বাস ফেললেন,’তিতি, তুমি তো ছোট নও মা। বড় হয়ে গেলে এমন অনেক কিছু আমাদের করতে হয় যা আমাদের ভালো লাগে না। তুমি যত বড় হবে পরিস্থিতির সঙ্গে তোমাকে মানিয়ে নেয়া শিখতে হবে। মাঝেমাঝে নিজের পছন্দের চেয়ে অন্যের চাওয়াটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিয়ে বাড়ির কোলাহল তোমার পছন্দ না সে আমি জানি ।কিন্তু সে আবেগটুকু কি একজনের স্নেহের আবদারের থেকেও বেশি? ভালোবাসা এভাবে তুচ্ছ কারনে পায়ে ঠেলতে নেই মা। নাহয় সে ভালোবাসা একসময় পিছু ছেড়ে দেয়। হাতড়ে বেরালেও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবু আমি জোর করছি না। তুমি যেতে না চাইলে যেও না। এখন খেতে চলো। আমার নানুভাই টেবিলে একা অপেক্ষা করছে।’

বাবা চলে গেলেন। পিছু পিছু বেরিয়ে গেল বুবু।জানালার গ্রিল ধরে একা দাঁড়িয়ে রইল তিতিক্ষা।ওর চোখে খানিকটা জ্বালা করছে। তুচ্ছ একটা কারনে বাবা তার ওপর রুষ্ট হয়েছেন। তিতিক্ষা জানে। বাবার রাগী মুর্তিটাও এমনি শান্ত, কোমল। অথচ এত এত উপদেশ না দিয়ে বাবা নিজে শুধু একবার বললে সে এমনিতেই চলে যেত। সবসময় বাবার বাধ্য মেয়ে হয়েই তো তিতিক্ষা। বাবা কি তা বোঝেন না ?

শত শত তারার আড়ালে কাস্তের মতো চিকন যে চাঁদটা লুকিয়ে ছিল তিতিক্ষা এবার তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। আজ যে চাঁদটা চোখে দেখা না যাওয়ার মতোই সামান্য, দিন কয়েক পর সে চাঁদ টাই তার রূপোরঙা আলো দিয়ে পৃথিবীর রাতের আকাশকে সর্গীয় আভায় ভরে তুলবে। কি আশ্চর্য সুন্দর এইসব রহস্যে ঘেরা অলীক একেকটা রাত!

.

পরদিন সকালে ওরা শপিং এ বেরোল। তিহা তিতিক্ষা আর ছোটন। রিকশায় বসে ঢাকার বিখ্যাত জ্যামে আটকা পড়ে তিহা একসময় জানাল পাপড়ির বিয়েতে তারা সব বন্ধুরা এক রঙের পোশাক পড়ছে।
তিহার এই সহজ কথার পেছনে অন্য ইঙ্গিতটা তিতিক্ষা বুঝল সঙ্গে সঙ্গে। বোনের দিকে ঘুরে বসে ভুরু কুচকে বলল, ‘তোমার বন্ধুরা কি আসছে?’

সাজগোজের বিষয়ে বরাবরই তিহার দূর্বলতা। একরঙের পোশাক কিনবে যখন ওদেরকেও তো আসতেই হবে। বন্ধুদের কথা শুনলে মুখচোরা তিতিক্ষা হয়তো আসতোই না। তার কিছু কেনাও হতো না। তারপর হয়তো এ অজুহাতেই বিয়েতে যাওয়া ক্যান্সেল করে দিতো। এসব ভেবেই ও আগেভাগে খোলাসা করে কিছু বলেনি বোনকে। এখন আমতা আমতা করল।
‘বোধহয় আসবে দু’একজন।’

তিতিক্ষা রাগতে গিয়েও সামলে নেয়,’নিমি আপুরাই তো? কোনো ছেলে বন্ধুকে খবর দাওনি তো বুবু?

তিহা মুখ বাঁকায়,’ছেলে বন্ধু আমার আর কই? নিমিরাই তো আসবে।

তিতিক্ষা নিশ্বাস ফেলে। বুবুর কথায় কিছু গোলমালের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই সবে শুরু… এজন্য এসব অনুষ্ঠান এড়াতে চায় সে….

.

তিহা তিতিক্ষা নিউমার্কেটের এক দোকানে বসে শাড়ি দেখেছে। নিমি কল করে জানিয়েছে ওরা পথেই আছে। তিহা আড়চোখে একবার বোনের মুখ দেখে নিমিকে জিগ্যেস করে তার সাথে আর কে কে আছে। নিমি ওপাশ থেকে কি বলল বোঝা গেল না। তিহা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোন রেখে হাসি মুখে বলে,’শুধু নিমি আর নিনাদ। বাকিদের সাথে কথা বলা হয়ে গেছে। আমরা যা পছন্দ করবো ওরা তাই পরবে। দেখেছিস, আমি আগেই বলেছিলাম আমার ছেলে বন্ধু একেবারে নেই… শুধু নিনাদ…. আর দু চারটা…’

তিতিক্ষা কিছু না বলে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফেরাল। রাগে রি রি করছে সে। বোনের অগ্নিমূর্তির দিকে নজর করতে করতে দেখা গেল দূর থেকে নিনাদ আর নিমি হেঁটে আসছে। চওড়া হাসি ফুটল তিহার মুখে আর পাশে দাঁড়িয়ে বিব্রত ভাবে মাথা নোয়াল তিতিক্ষা। ছোটনের হাত ধরে বোনের পেছনে এসে দাঁড়াল। নিনাদকে কাছে আসতে দেখে ছোটন তিতিক্ষার হাত ছেড়ে ততক্ষণে ভোঁ দৌড় দিয়েছে। ছোটনকে পেয়ে নিনাদ তাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল ।

.

নিমির সঙ্গে কথা বলছিল তিহা। তিহার পেছনে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে তিতিক্ষা নিমির সাথে কুশল বিনিময় করলো।
অদূরে ছোটনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে নিনাদ হাসল মনে মনে। হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। তিতিক্ষার দিকে ইশারা করে বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে তিহাকে বলল,’তোর পেছনে কালো ভূতের মতো ওটা কে রে? ভূতের মতো দেখাচ্ছে। দিনেদুপুরে মানুষের হার্ট অ্যাটাক করাবি নাকি?’

তিহার ভ্রুতে পড়ে বিশাল কুঞ্চন। আর তিতিক্ষা রাগে মুখটাই ঘুরিয়ে ফেলে, ‘এখানে এসেও তোর বাদরামি! আমার বোন অনেক দামি, তাই প্যাকেট করে নিয়ে এসেছি।
ও কি তোর ইয়েদের মতো যে টপ আর শর্টস পরে নাচতে নাচতে শহর ঘুরে বেড়াবে?’

নিনাদের কথাশুনে তিতিক্ষার রাগ হচ্ছিল।এবার তিহার কথা শুনে তার কান্না পেয়ে গেল। বুবুটা এসব কি বলছে! টপ শর্টসের কথাটা কি না বলতে হতো না? এভাবে সবার মাঝখানে মান ইজ্জত ডোবানো টা কি খুব জরুরি ছিল?’

ইয়েদের কথা ওঠা মাত্র নিনাদও চুপসে গেল।এ বিষয়ে কথা বাড়তে না দেয়াই ভালো। বলা যায় না কখন তিহা মুখ কখন বাকিটাও বলে বসে। কিছু ঘনিষ্ঠ মেয়েবন্ধু নিনাদের আছে সত্যি। তা সিরিয়াস কিছু নয়। কিন্তু তিতিক্ষা এসব বোঝার মেয়ে! শুনলেই যে ছিছিক্কার জুড়ে দেবে!

নানান বিষয় নিয়ে তিহা, নিনাদের মধ্যে তর্ক চলতে থাকল। নিনাদ যা-ই বলে তাতেই তিহা তার পিঠে একটা করে কিল বসিয়ে দেয়। তিহা, নিমি চলে গেল একদলে।শপিংমলে নিনাদকে মাঝে রেখে দুটি সুন্দরী রমণী দু’দিক থেকে ঘিরে হাটছে। মাঝে মাঝে একটা দুটো কিল পড়ছে তার পিঠে। পেছন থেকে এই দৃশ্য দেখে তিতিক্ষা হা হয়ে রইল।এদের মারামারি দেখে মনে হচ্ছে এরা এখনো স্কুলের গন্ডি পেরোয় নি। মনে মনে চুড়ান্ত বিরক্ত বোধ করল তিতিক্ষা। এরকম শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের পথেঘাটে এ কি আচরণ! আশ্চর্য!

মারামারির মাঝেই নানান কথা বলতে বলতে পোশাকের কথাটা ওঠা মাত্র নিমি জানালো বিয়েতে তারা সবাই আকাশী রঙা পোশাক পরবে।ছেলেরা আকাশী পাঞ্জাবি, মেয়েরা আকাশী শাড়ি। কাল রাতে আলাপ আলোচনা পর এটাই ফাইনাল হয়েছে।তারপর দুপুর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে ওরা সবকিছু কিনলো। তিতিক্ষা শুরু থেকে শেষ অবধি চুপ রইল। মাঝে মাঝে তিহাকে খোঁচা দিয়ে বাড়ি ফেরার তাড়া দিল শুধু ।শপিং শেষে বাইরে বেরিয়েই নিনাদ বলল, ‘ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে রে।তোদের কিল খেতে খেতে পেটের খাবার সব হজম হয়ে গেছে আমার।এখানেই চল কোথাও বসে খেয়ে নিই।’

সঙ্গে সঙ্গে তিহা উৎসুক গলায় বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সামনের ওই রেস্তোরাটায় বসি চল।’

তিতিক্ষা পেছন থেকে তিহার পিঠে মৃদু চিমটি কাটে। ‘উউউ’ চেচিয়ে পেছন ফেরে তিহা। বোনের মুখপানে তাকায় সপ্রশ্ন চোখে।
তিতিক্ষা ক্রুদ্ধ ফিসফিসানো স্বরে বলল , ‘ এইবার কিন্তু বারাবাড়ি হচ্ছে বুবু। যোহরের সলাতের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমার কথায় অনেক থেকেছি। এবার আমি বাড়ি ফিরবো। ওদের সাথে রেস্তোরায় যাওয়ার হলে একাই যাও। আমি ফিরছি…’

বোনের হুমকিতে দমে গেল তিহা। ওর ম্লান মুখে চেয়ে নিনাদ ভ্রু কোঁচকায়, ‘কি কানপড়া দিচ্ছিলো ও তোকে? খেতে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে। না? ‘

মাথা নাড়ল তিহা,’তোরা যা রে। আজ আমি আর যাব না। নামাযের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে।বাড়ি ফিরে নামায পড়তে না পারলে ছোটনের মিমি আমাকে চিবিবে খেয়ে ফেলবে।তাই না ছোটন ?’
ছোটন হাসি হাসি মুখ করে মাথা নাড়লো। বললো, ‘হ্যাঁ নামায পড়তে না পারলে খুব রেগে যায় মিমি। কান্নাও করে।’

বাকিটুকু আর বলা হলো না ছোটনের। তিতিক্ষা ওর মুখ চে পে ধরেছে। খানিকটা ক্রুর চোখে তাকাচ্ছে ভাগ্নের পানে। এই ছেলে পুরো মায়ের মতো। ক বলতে বলা হলে কলকাতা পর্যন্ত বলে ফেলে।
‘আর কিছু বলতে হবে না ছোটন। আমরা বুঝতে পেরেছি।’ বাঁকা সুরে বলল নিনাদ। নিমি তার পাশে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো মুখ টিপে।

.

শুক্রবার তিহার বান্ধুবির বিয়ের দিন একটা দারুন ব্যাপার ঘটে গেল! বরাবরই তিহা বন্ধু পাগল আর ভীষণ ছটফটে। সেকথা তিতিক্ষার অজানা নয়।তাই সে বিয়ে বাড়ি যাবার আগে বারবার করে বোনকে বলে রাখল। যেন বিয়ে বাড়িতে বন্ধুদের পেয়ে তাকে একা ছেড়ে না দেয়। এবং সবিশেষ! তাকে নিয়ে তার বন্ধুমহলে যেন কোন কথা না ওঠে। তিহা ওকে আশ্বাস দিল। অনুক্ষণ তার পাশে পাশেই থাকবে এবং এবিষয়ে কথার কোনো নড়চড় করবে না।

বিয়ে বাড়ি এসে তিতিক্ষা আড়ষ্ট হয়ে তিহার পেছন পেছন হাটতে লাগলো। তার পড়নে বোরকা। বোনের পাশে আজ সে বড্ড বেমানান! তিহা যেন রৌদ্র দিনের উজ্জ্বল সাদা-নীল আকাশের সমস্ত সৌন্দর্য নিজের গায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছে! পরনে আকাশী রঙা জামদানী, সাদা ব্লাউজ, হাতে এক-গাছি সাদা রেশমি চুড়ি, খোপায় বেলীফুলের গাঁজড়া আর গলায় একটা ভারি চিক। কাছেপিঠে যারাই আসছে ওর সাজের আমূল প্রশংসা করছে। আত্মগৌরবে সহাস্যে সামনে পা বাড়াল তিহা। তিতিক্ষা অস্বস্তিতে আরো গুটিয়ে গেল। ওপর বড় নিকাব,হাত-পা মোজায় ঢাকা।সে অস্বস্তিতে আরো গুটিয়ে গেল। হঠাৎ এই দৃশ্য দেখলে যে কেউ বিচলিত হয়ে পরবে সন্দেহ নেই। তবে অদূরে দাঁড়ানো তিহার বিশাল বন্ধুর দল একটুও হলো না।তারা এক উদর থেকে জন্ম নেয়া, পৃথিবীর দুই মেরু সমান পার্থক্য বিশিষ্ট এই বোনদের চেনে।
তিহা দূর থেকে হাত নাড়ল বন্ধুর দল কে দেখে। উত্তেজনা দমাতে না পেরে শপথ ভঙ্গ করেই ছোট বোন কে একা ফেলে ছুটে গেল সেদিকে। বিয়ে বাড়ির বিশাল জনকলরোলের মধ্যেখানি জাঁকানো বিড়ম্বনা নিয়ে ভাগ্নের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল তিতিক্ষা। আশেপাশের অনেক গুলো চোখ অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওকে দেখছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। বোধহয় ওর বেশভূষা নিয়েই… তিতিক্ষা বুঝল আজ দিনের মধ্যে আরও অসংখ্যবার তাকে এই অপমানের ভাগ নিতে হবে। ছোটনের কাছেও মায়ের এই ছেলেমানুষী , বেখেয়ালী স্বভাব অপরিচিত নয়, এসব দেখে সে অভস্ত্য। সে তার মিমির হাত ধরে সুবোধ বালক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

পুরো সময় বন্ধুদের পাশে থাকলেও খাওয়ার বেলায় তিহাকে তিতিক্ষার কাছে ফিরতে হলো। তিতিক্ষা তার বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে বসে খাবে না একথা সে আগেই জানিয়েছিল।তিহা তাই বোনকে নিয়ে একদম কোণার দিকে কোলাহল থেকে আড়ালে খেতে বসলো। তিতিক্ষার পর্দা রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা। খাওয়া শেষ হতেই কোথা থেকে এক মেয়ে এসে হাজির। তিহা তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে কথা শুরু করলো। তিতিক্ষা তিহার সব বন্ধুদের চিনতো কিন্তু এই আগন্তুক কে বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে রইল। তিহার সাথে কথা শেষ করে মেয়েটি এবার তার দিকে ফিরলো। তিহাকে ইশারায় জিগ্যেস করে জানল এ তিহারই ছোট বোন। তারপর তিতিক্ষার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা সহসা তার ফোন নাম্বার চেয়ে বসলো। তিতিক্ষা অস্বস্তি নিয়ে মেয়েটির পেছনে দাঁড়ানো তার বোনের দিকে তাকালো।দেখলো তিহা তাকে ইশারায় বারবার নিষেধ করছে নাম্বার দেয়ার জন্য।ওদিকে মেয়েটি তখনো ফোন নাম্বার দেয়ার জন্য তাড়া দিয়ে যাচ্ছে।তিতিক্ষা একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকে ফোন নাম্বার দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো।এই পুরো ব্যাপারটা একজন দূর থেকে প্রত্যক্ষ করছিল।তিতিক্ষা কে যেতে দেখে এবং তারপর ওই মেয়েটিকেও জায়গা ছাড়তে দেখে সে এবার সতেজে তিহার সামনে এসে দাঁড়ালো।
চলবে……
অদ্রিজা আশয়ারী

দূর আলাপন পর্ব-০১

0

#দূর_আলাপন -১
অদ্রিজা আশয়ারী

বুবু শেষ বারের মতো বলছি তোমার বন্ধুকে বলে দাও আর যেন কখনো আমাকে ছোট গিন্নি বলে না ডাকে।’ তীক্ষ্ণ মেজাজি স্বরে বলে ওঠে তিতিক্ষা।
তিহা কাঁথা সেলাই করছিলো। বোনের কথা শুনে কাঁথা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিস্মিত হয়ে বলে, ‘নিনাদ এসেছে? কখন এলো? ও যে আজ আসবে আমাকে তো জানায় নি। আর এসেই তোর পেছনে লাগতে শুরু করেছে! দাঁড়া দেখছি আমি।’ উত্তরের অপেক্ষা না করে ত্বরিতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

তিতিক্ষা ভয়ানক রেগে চোখ মুখ কঠিন করে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ। বোঝে বুবুর কাছে বিচার দেয়াটা তার বোকামি হয়েছে। তিহা নামক এই দয়ালু বিচারক যে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে চোখ বুজে অবশেষে সেই নির্লজ্জ অপরাধীর পক্ষ হয়েই রায় দেবে সে কে না জানতো!

তিহা ব্যাস্ত পায়ে হেঁটে বসার ঘরে গেল। সেখানে বড় জানালাটর পাশে বেতের সোফায় একজন যুবা বসে। পড়নে কফি রঙের ফুলহাতা শার্ট, কালো জিন্সের প্যান্ট, মুখভরা অযত্নের দাড়ি। চুল এলোমেলো ভাবে একপাশে আচঁড়ানো। শার্টের হাতা খানিকটা ফোল্ড করা। শ্যাম বর্ণ গায়ে সুন্দর মানিয়েছে শার্টটা। সে তার ঘন পাপড়ি বেষ্টিত ধূসর চোখ সম্মুখে স্থাপন করে একমনে পত্রিকা পড়ছে। চোখে চশমা নেই। বোধহয় পড়তে ভুলে গেছে। ফলে পত্রিকার ছোট ছোট অক্ষর দেখতে গিয়ে চোখ দুটো কিছুটা সংকুচিত হয়ে এসেছে। তিহা আনমনে হাসল। সেই শুরুতে যেমন ছিল আজও ঠিক তেমনই আছে। একদম খামখেয়ালি।

ছেলেটি তখনই মুখ তুলল। সামনে তিহাকে দেখতে পেয়ে মুহূর্তে তার দেহে প্রাণ ফিরে এলো। তৎক্ষনাৎ পত্রিকা বন্ধ করে বলল, ‘এলি তুই? উফফ বাঁচালি আমায়! আমি তো ভেবেছিলাম তোর বোন বুঝি দা-বটি কিছু একটা আনতে গেছে। এসেই আমাকে কো’পাবে। যা অগ্নিমূর্তি রূপ দেখিয়ে গেল…’

তিহা বেশ শব্দ করেই বসল তার পাশে। মাথায় একটা গাট্টা মে রে বলল, ‘তুই ওকে খেপাতে গেলি কেন? জানিস না ও কেমন কাঠখোট্টা। ঠাট্টা বোঝে না একদম। বাবাকে যেদিন বলে দেবে সেদিন বুঝবি। ‘

নিনাদ একপেশে হাসে ‘ছোট গিন্নির ক্ষমতা যে কদ্দুর সে তো আমার জানা। নাগিনীদের মতো ফোঁস ফোঁস করা ছাড়া ও আর কিইবা করতে পারে? ‘

তিহা মুখ টিপে হাসলেও সঙ্গে সঙ্গে ফিসফিস করে বলে, ‘আস্তে বল। শুনতে পেলে কিন্তু আর রক্ষে নেই। নাগিনীর ছোবল খেতে হবে।’

ওর কথা শেষ হতেই রান্নাঘর থেকে জিনিসপত্রের ধুপ ধাপ শব্দ ভেসে আসে। মনে হয় কেউ খুব রেগে এটা সেটা রাখছে।
তিহার চুপসে যাওয়া কণ্ঠে ফের ফিসফিস, ‘সর্বনাশ! আজ আর রক্ষা নেই। তিতিক্ষা বোধহয় শুনতে পেয়েছে সব!’

নিনাদের মুখের হাসি নিভে গেল তৎক্ষনাৎ। চিন্তিত স্বরে বলল, ‘কি বলিস! আমি কি তাহলে ভাগবো?’ ওর কণ্ঠে ব্যাস্ত ভাব। হাটুর বয়সি মেয়েটিকে মনে মনে সে সত্যি খানিক ভয় পায়।

তিহা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আরে ধুর। ভাগবি কেন? বোস তুই। ও তো তোর সামনেই আসতে চায় না। কিছু করবে আর কি?
রাগ যা দেখাবার আমাকেই দেখাবে পরে। দাঁড়া আমি দেখে আসি একবার।’

তিহা ধীর পায়ে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে তাকে একবার দেখে নিয়ে তিতিক্ষা নামের রাগী মেয়েটা গম্ভীর মুখে বলে, ‘এগুলো নিয়ে যাও বুবু। চা বসিয়েছি। পাঁচ মিনিট পর এসে নিয়ে যেও।’

তিহা আড়চোখে বোনের দিকে তাকাল। তিতিক্ষা রাগ ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মুখের অভিব্যক্তিতে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। অথচ এতো রাগের কারণ যে মানুষ, তার জন্য এতো যত্ন করে নাস্তা সাজিয়েছে।

তিহা নাস্তা নিয়ে বেতের সোফার সামনে ছোট টি-টেবিলে রাখল। নিনাদ তাকাল দরজার দিকে। কেউ আসছে না দেখে টেবিলে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, ‘স্বভাব হোক যেমন তেমন। তোর বোনের মনটা বড় আছে রে। মুখ দেখে মনে হয় ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরি। লাভা টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু খেতে দিতে কার্পণ্য করে না কখনো। আসতে না আসতেই নাস্তা হাজির।’

তিহা তার কথা শুনে হেসে এইবার পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল।
‘আর তুই হলি বেশরম। তুই এলে আমার বোনটা তোকে নাস্তা দেয়ার জন্য কত ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সবসময়। অথচ সুযোগ পেলেই তুই ওকে জ্বালাস শুধু।’

নিনাদ স্পেগেটি মুখে পুরে চিবাতে চিবাতে বলে, ‘ওকে জ্বালাতন করতে হয় নাকি? ও তো এমনিতেই একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। সময়ে-অসময়ে লাভা বিস্ফোরণ হচ্ছে।
আচ্ছা, একটা কথা বল?
তোর বোন আমাকে ভালো টালো বাসে না তো?
দেখ, এমনিতে এতো রাগ দেখায়। সামনে পড়লে ঘোমটা টানতে টানতে হাটু পর্যন্ত ঢেকে ফেলে আবার ঠিকি এতো এতো নাস্তা তোর হাত দিয়ে পাঠায়। সত্যি করে বল আমার ধারণা ঠিক কিনা?’

তিহা কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে নিজের বাল্যবন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হো হো করে হেসে উঠে বলে,’ফাজিল! তুই অসভ্য জানতাম। কিন্তু এতটা জানা ছিলো না। সবাইকে তোর মতো ভাবিস? তিতিক্ষা কে তোর ভার্সিটির ওইসব সুন্দরী ললনা মনে হয়? যে ব্রাউন আইস, সিক্স প্যাক আর রেজাল্ট দেখে প্রেমে পড়ে যাবে?
তিতিক্ষা এসব শুনলে বরং এখানে এসে মজার মজার নাস্তা খাওয়া তোমার চিরজীবনের ঘুচবে মনে রেখো।’ বলে সে উঠে ফের রান্নাঘরে চলে যায়। ফিরে আসে হাতে দু’কাপ চা নিয়ে।

নিনাদ চা’এর কাপ টেনে নিয়ে বলে, ‘তুই যাই বলিস ওটা আমি ছাড়ছি না। ছোট গিন্নির হাতে বানানো খাবার খেয়ে আলাদা একটা তৃপ্তি আছে। নইলে কি আর সেই মুহাম্মদপুর থেকে এই ঝিগাতলা এভাবে বেহায়ার মতো দুদিন পর পর ছুটে আসি!’

-‘চাপার জোর আর দেখিও না। মুহাম্মদপুর থেকে যে তুমি কোন মৌচাকের মধু খেতে আসো সেকথা সবার জানা। ‘

নিনাদ গলার স্বর খাদে নামিয়ে ভীত স্বরে বলল, ‘ছোট গিন্নি জানে না তো?’

-‘না।’

-‘তাহলেই চলবে। আচ্ছা ওসব কথা ছাড়। প্রেম পিরিতির আলাপ আজকাল আর ভালো লাগে না একদম ।
ছোট গিন্নির কথা বল। বেচারি বোধহয় আমাকে গোপনে খুব ভালোবাসে বুঝলি। মুখ ফুটে বলতে পারছে না। তাই আজ স্পেগেটি, কাল বিরিয়ানি এসব খাইয়ে আমাকে বসে আনতে চাইছে। তাই না?’

তিহা বিরস মুখে বলল,’আজ বোধহয় তোর মার খাওয়ার শখ জেগেছে খুব। না?
চুপ-যা এখন। ওদিকে আগ্নেয়গিরি ফুলে-ফেঁপে উঠছে। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ হবে। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তোকে একেবারে!
তিতিক্ষার সাথে অন্য মেয়েদের তুলনা একদম করবি না। আমরা এক মায়ের পেটের বোন তবুও ওর সাথে আমারই কোন মিল নেই। ও আলাদা। ও প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলে দ্বীনের নিয়ম মেনে। নাস্তার কথা যে বললি ওটাও তার দ্বীনি শিক্ষা। মেহমানের যথার্থ আপ্যায়ন ও কদর করা একজন মুসলমানের ঈমানি কর্তব্য। তিতিক্ষা তাই বলে। সেজন্য তোর এতো কদর। বাকি মেহমানদের মতো। বুঝলি?
ওসব প্রেম পিরিতি থেকে তিতা করলা একশো হাত দূরে। হুহ্।’

উত্তরে নিনাদ কি একটা বলতে যাচ্ছিল। কলিংবেল বেজে উঠল। নিনাদ কপাল চাপড়ে বলে উঠল,’দেখেছিস, আজ ছোট বাবার কথা একদম মনে ছিল না। এখন আমাকে দেখলেই চকলেটের জন্য ঘাড় ধরে ঝুলে পরবে।’
তিহা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,’তুই তিতিক্ষার নামে কুটনামি করে সময় পেলে তবে তো ওর কথা মনে পরবে।
আচ্ছা শোন, আব্বা আসছে। তোর পিরিতের আলাপ দয়া করে এখন বন্ধ কর। আর বলবি না।’
নিনাদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

দরজার খুলতেই পাঁচ বছরের একটা ছোট বাচ্চা ছেলে, ‘আম্মোও’ বলে চিৎকার করে উঠল। তিহা হেসে মাথা নোয়াল। ছেলেটির মুখের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ছোটন, জানো কে এসেছে আজ বাসায়?’
-‘কে?’ চোখ বড় বড় করে বাচ্চা জানতে চাইল ছোটন।

-‘তোমার বেস্টু। ওইযে বসে আছে। কাছে যাও।’

ছোটন এবার কাধের ব্যাগ ফেলেই সেদিকে এক ছুটে চলে গেল।
-‘এইতো আমার মেয়ের জামাই এসে গেছে।’ বলে নিনাদ চোখ টিপে ছোটনের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দেয়।
ছোটন তার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। পেছন থেকে একজন বৃদ্ধর শান্ত স্বর শোনা যায়।
‘কেমন আছো নিনাদ? সব ভালো তো?’

নিনাদ ছোটন কে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে সালাম জানিয়ে বলল ভালো আছে।
বৃদ্ধ হাসি মুখে বললেন, ‘বসো নিনাদ। জিলাপি খেয়ে যাও।
তিতি জিলাপি খেতে পছন্দ করে তো। রোজ রোজ অল্প করে আনতে হয়। বসো তুমি আমি যাই, ফ্রেশ হই গিয়ে। ‘
নিনাদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। বৃদ্ধ নিজ ঘরে চলে গেলেন। ইনি তিহা আর তিতিক্ষার বাবা মারুফ হক।অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। বর্তমানে দুই মেয়ে এবং পাঁচ বছরের ছোট নাতি নিয়ে এ বাসায় থাকেন।

নিনাদ বসলো। ছোটন তাকে মুহূর্তে তার অসংখ্য কথা, ক্রিয়া-কলাপ দ্বারা ব্যাস্ত করে তুলল। তার কথা আর শেষ হতে চায় না। নিনাদ কে পেয়ে সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
তিহা এলো খানিক পর জিলাপি নিয়ে। নিনাদ উঠে দাঁড়ালো। ছোটনকে তিহার কোলে দিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,’বাবা জীবন, আজ আমি আসি। চকলেটের কথা একেবারে মনে ছিল না। কাল আমি তোমাকে চকলেট দিয়ে যাবো। শত হোক আমার ভবিষ্যত মেয়ে জামাই তুমি! ‘

ছোটন চোখ মুখ উজ্জ্বল করে হাসে। তিহা শব্দ করে হেসে ওঠে, ‘ফাজিল! জিলাপি খেয়ে যা।’

-‘এখন আর বসে খাওয়ার সময় নেই। আর দেরি করলে স্টুডেন্টের মায়েরা আমাকে ঝাড়ু পেটা করবে। দু একটা দে পকেটে পুরে নিয়ে যাই। রাস্তায় যেতে যেতে খাওয়া যাবে। ‘এই বলে সে সত্যি সত্যি দুটো জিলাপি নিজের প্যান্টের পকেটে পুরে ফেললো।তারপর আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল।

পরদিন সকালে একই সময় ফের এ’বাড়িতে নিনাদের আগমন ঘটল। এবার আর ভেতরে এলো না। দরজার বাইরে থেকে ছোটন কে ডাকল। ছোটন সবে স্কুল থেকে ফিরেছে। নিনাদ কে দেখে সে ছুটে এল। পকেটে থেকে একটা বড় চকলেট বার বের করে ছোটনের হাতে দিল নিনাদ। ‘বাবা জীবন, আপাতত এটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো। মেয়ের বিয়ের সময় আরো দেবো। খেয়ে শেষ করতে পারবে না।’

তিহা রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে, ‘তোর সাথে থেকে থেকে ছোটনও আজকাল খুব পেঁকে যাচ্ছে। এসব কি শেখাচ্ছিস তুই! আজ থেকে না আবার নতুন জেদ ধরে। দেখা যাবে চকলেটের লোভে তোর জন্ম না নেয়া মেয়েকে বিয়ে করার জন্যই কাঁদছে এখন থেকে!’

-‘কাঁদুক না। আমার মেয়ে জন্মাতেও তো আর বেশি দেরি নেই। একবার আমার বিয়েটা হয়ে যেতে দে শুধু। তোর ওপরেই তো সব!’

তিহা অবাক হয়ে বলে, ‘কি! আমি তোর বিয়ের কি করবো? বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয় না..’

-‘তোর বোন আমার কথায় নাচতে নাচতে বিয়ের পিড়িতে বসে যাবে। তুই কি তাই ভাবিস?
তুই একবার রাজি করিয়ে বিয়ের পিড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দে। বাকিটা আমি দেখছি। ভেতরে আসা যাবে না এখন। সময় নেই। ‘

‘কি বললি! তুই ভাগ। যা এখান থেকে। ক্যাম্পাসে শ’খানেক ললনা রেখে এখন আমার বোনের পিছনে পরেছিস?’ তিহা জোড় পূর্বক হাসি আটকে নিনাদ কে বাইরে পাঠাল।

নিনাদ মাথায় আঙুল চালিয়ে বলে ‘চলেই তো যাচ্ছি। যাবার আগে আমার বউকে একটু ডেকে নিয়ে আয়। দেখে চোখ জুড়াই!’

‘ভাই দোহাই লাগে তোর। আমাকে আর বিপদে ফেলিস না। তিতি এসব তামাসা একদম নিতে পারে না। শুনলে খুব রেগে যাবে।’ তিহার স্বরে সত্যিকারের ভয়।

‘তবে আর কি! আমি গেলাম। বউটাকে তোর হেফাজতে রেখে যাচ্ছি। ফুলের টোকাও যেন গাঁয়ে না লাগে। ‘

নিনাদ গুনগুন করতে করতে চলে গেল। হাসি থামিয়ে তিহা দরজা বন্ধ করলো। পরক্ষণেই মাথায় তার নতুন চিন্তা এসে হাজির হলো। বাঘিনী নিশ্চয়ই এসব শুনেছে। ঘরে বসে হয়তো ফোঁস ফোঁস করছে। তাকে যা করে হোক সামলাতে হবে।

স্কুল জীবন থেকে তিহা, নিনাদ ছিল দুজন দুজনের বন্ধু। তারপর একই কলেজ আর ভার্সিটি। এর মধ্যে তিহার বিয়ে হয়েছে। এখন এক ছেলের মা সে। তার স্বামী বান্দরবানে বন বিভাগে চাকরি করে। সরকারি চাকরি। সে বেচারা চাকরি ছেড়ে আসতে পারে না। আবার সেই গহীন বনে বউ বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারে না।
তিহার শ্বশুরবাড়ি গ্রামে। সেখানকার পরিবেশের সাথে শহুরে বউ নিজেকে মানিয়ে চলতে পারে না। তাই বছরের বেশিরভাগ সময় সে থাকে বাবার বাড়িতে। সেই সুবাদে নিনাদের সাথে যোগাযোগ টা এখনো অক্ষুণ্ণ। ছোট বেলা থেকে নিনাদের সাথে তার সম্পর্ক পিঠাপিঠি ভাইবোনের মতো। সারাদিন মারামারি আবার কাউকে ছেড়ে কেউ থাকতে পারতো না। তিহার বিয়ের সময় নিনাদের শোচনীয় অবস্থাটা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। তিতিক্ষা আর বাবাও অত ভেঙে পড়েনি যতটা নিনাদ ভেঙে পড়েছিল। নিজেদের বন্ধুত্বের এতগুলো বছরে সেদিন প্রথম বারের মতো তিহা তাকে কাঁদতে দেখেছিল। অবাক হয়ে গিয়েছিল সবাই। তারপর তিতিক্ষা আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে জোরালো এক ধমক দিতেই একবারে চুপ।

তিহার বোন হলেও তিতিক্ষা স্বভাবে পুরো উল্টো। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর গম্ভীর মেজাজের মেয়ে সে। দ্বীনের ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস। অকারণ হাসি-ঠাট্টা তার একদম পছন্দ নয়। কিন্তু মনটা ভীষণ ভালো। কারো কষ্ট একবিন্দু সইতে পারে না। গোলগাল ফর্সা মুখজুড়ে আদুরে ভাব। গম্ভীর মেজাজ দিয়ে সর্বদাই সেই আদুরে ভাবটা সে ঢেকে রাখতে চায়। কখনো কখনো হয়তো বা সফলও হয়। তবে একজনের সামনে এলেই তার সব জারিজুরি থেমে যায়। মুখটা গম্ভীর করতে গিয়ে অস্বাভাবিক করে ফেলে। হাত পা কঠিন করতে গিয়ে বোঝে তারা আগে থেকেই অবশ হয়ে আছে। সব শব্দরা যেন ডানা মেলে উড়াল দেয়। মুখ দিয়ে কথা আসে না। শরীর জুড়ে অস্বস্তি শুরু হয়। চারপাশের সব মিথ্যে মনে হয় ঠিক সামনের মানুষটার মতো। তিতিক্ষা নিজ দেহ আর মনের এই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থাকে ভীষণ ভয় করে। তার ওপর আছে নিনাদের কথার বাণ।তিতিক্ষা কে দেখলেই পৃথিবীর সব অপমান আর লজ্জাজনক কথা তার যেন মনে পড়ে যায়। নানান কথার তোড়ে তিতিক্ষাকে আহত নিহত করে সে যেন শান্তি পায়। ছোট বেলায় তিতিক্ষা অত বুঝতো না।নিনাদের নিষ্ঠুরতম আচরণ আর কথায় অপমানিত হয়ে নাক টেনে টেনে কাঁদতো শুধু। নিনাদ যখন তাকে সবার সামনে বউ বউ বলে ডাকতো দুঃখে তখন তার মরে যেতে ইচ্ছে করতো। দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতো শুধু, ‘আমি কালো বরকে একদম বিয়ে করবো না বাবা। কালো বর আমার একটুও পছন্দ না।’

বাবা হেসে বলতেন, ‘আমার এতো সুন্দর পরির মতো মেয়েকে কালো বরের কাছে বিয়ে দেব আমি ? কক্ষনো না।’
-‘বড় হলে ভুলে যাবে না তো?’
-‘আমার তিতা আম্মার কথার আমি ভুলতে পারি কখনো?’

বড় হওয়ার পর নিজের ছোট বেলাকার আচরণে তার লজ্জা হতো ঠিকি। তবে নিনাদের এসব বেহায়াপনা আচরণকে আজও সে ঘৃণা করে। নিনাদের সাথে তিহার এই সখ্যতাও তার অসহ্য ঠেকে। সে নানা ভাবে তিহাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। শতহোক নিনাদ তার ছেলে বন্ধু। পরিবারের কাছের কেউ নয়। তাদের এই ঘনিষ্ঠতা ধর্মবিরুদ্ধ। নিনাদ তার জন্য গাইরে মাহরাম।
তিহা যে বিষয় টা বোঝে না এমন নয়। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই নিজের ছোট ভাইয়ের আসনটা সে নিনাদকে দিয়ে রেখেছে ।রক্তের সম্পর্ক নাই বা থাকুক। ভাই ভাবে তো। হঠাৎ করে সে তাকে কিভাবে ছেড়ে দেয় ! তার এসব কথা শুনে অবশেষে তিতিক্ষাও হার মেনেছে। সে আর কথা বলে না এসব বিষয়ে।

_________________

ছোটন আগে আগে দৌড়াল। পেছন পেছন তিহাও গেল বোনের ঘরে। তিতিক্ষা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিল । তার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। রাগে টগবগ করে ফুটছে যেন সে। আড়চোখে তিহাকে একবার দেখে তাচ্ছিল্য মেশানো স্বরে সে বলল ,’কথা শেষ হলো বুবু? চলে গেল তোমার প্রাণের বন্ধু ?’

তিহা মিনমিনে স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ, ছোটন কে চকলেট দিতে এসেছিল। দিয়েই চলে গেছে।’

তিতিক্ষা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর সহসা প্রবল স্বরে বলে উঠল,’শোনা বুবু। নিনাদ ভাইকে বলে দেবে। তার মুখে আমার নাম আর শুনতে চাই না আমি। সে এ’বাড়িতে আসে আসুক, তোমার সাথে কথা বলুক। আমাকে যেন আর না ঘাটে। ভদ্রতার খোলস ছেড়ে নাহয় বেরিয়ে আসতে হবে আমাকে এবার । ‘

তিতিক্ষার কথা শুনে তিহা ভয় পেয়ে গেল। কোন কাজ তিতিক্ষা মুখে বলবে অথচ কাজে করে দেখাবে না। এমন মেয়ে সে নয়। সে যখন বলেছে তখন সত্যি নিনাদকে কঠিন কথা শোনাতেও তার বাঁধবে না।
চলবে….

চাঁদের বাড়ি বহুদূর পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

#চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(৬ষ্ঠ এবং শেষ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

পরের দিন সকালে বাসা থেকে বের হলাম মায়াকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। এরপরে যেটা আমি শুনলাম তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। আমি যেনো ঠিক মত দাঁড়াতে পারছি না।

এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ফোন দিয়ে বলে আমার মা এক্সিডেন্ট করেছে। লোকটি মেডিকেলের ঠিকানা দিয়ে দ্রুত আমাকে যেতে বললো।

আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেডিকেলে গেলাম। আমি যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বাবা সেখানে উপস্থিত। কিন্তু আমি মায়ের কাছে যেতে পারলাম না। অপারেশন থিয়েটারে মাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ এক ডাক্তারের কাছে জানতে পারলাম মায়ের অবস্থা গুরুতর। মাথায় প্রচন্ডভাবে আঘাত পেয়েছে, জ্ঞান তো ফিরছেই নাই,এবং শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। আমি ডাক্তারের কথা শুনে মেডিকেলে মধ্যেই লুটিয়ে পরলাম।

আমার মাথার কাছে মায়া বসে আছে। মেডিকেলের একটা রুমে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমি বাবাকে ডাকলাম,কিন্তু তাকে পাচ্ছি না। উঠে বসে তাকে কয়েকবার ফোন দিলাম,সে ফোনটাও রিসিভ করলো না। আমার চিন্তা বেড়েই চলছে। আমি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। মায়াও আমার সাথে আছে। মায়ার কাছে আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। মায়া আমাকে শান্ত হতে বলে।” মা এখন আইসিউতে আছে। চিন্তা করো না। আল্লাহ তায়ালা সুস্থ্য করে দিবেন।”

আমার গলা শুকিয়ে আসছে, চারিদিক অন্ধকার মনে হচ্ছে। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। ডাক্তারদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমার মায়ের কাছে যেতে পারবো কিনা। ডাক্তার জানালেন তিনি এখন আইসিউতে অবজারভেশনে আছেন। এই মুহূর্তে কোনো ভাবেই যাওয়া যাবে না।

মায়াকে আমার সাথে দেখে বাবা সম্ভবত আমার সামনে আসছে না। মায়া আমাকে বললো….

– তোমার বাবা সম্ভবত আমাকে দেখে সামনে আসছে না। আমি বরং বাসায় চলে যাই।

– ওকে।

এখন আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বাবাকে দেখলাম রিসিপশনের সামনের চেয়ারের এক কোনো বসে আছে। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম,তার চোখে পানি। মাথা নিচু করে বাবা নীরবে চোখের পানি ফেলছে। এই প্রথম আমি বাবার চোখে পানি দেখলাম। আগে কখনো আমার এই রাগি বাবার চোখে পানি দেখিনি। তাও আবার আমার মায়ের জন্য কাঁদছে৷ যে মানুষটা সব সময় মায়ের সাথে রাগারাগি করতেন। সেই মানুষটাই আজ মায়ের জন্য কাঁদে। আসলে কাউকে দেখে বুঝার উপায় নেই তার ভেতরটা কেমন,বা ভেতরে কি চলছে। হয়তো বাবা মাকে ভালোবাসতেন,কিন্তু প্রকাশ করেনি। অথবা এটাও হতে পারে এই প্রথম মাকে হারানোর ভয়টা তার ভেতরে কাজ করছে। আমি তার পাশের চেয়ারে বসলাম। আস্তে করে বাবার একটা হাত আমি ধরে বললাম…

– আপনি এভাবে ভেঙে পরবেন না বাবা, দেখবেন মা তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে যাবে।

বাবা আমার কথায় কোনো সাড়া দিলো না। একদম চুপচাপ বসে আছে। আমি বুঝতে পারলাম সে চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছে। আমি আর কিছু না বলে বাবার কাঁধে হাত রেখে আবারো বললাম…

– প্লিজ শান্ত হোন বাবা।

এইবার তিনি আমাকে উত্তর দিলেন, উত্তরে বললেন…

– সকালে তোর মা যখন বাসা থেকে কোথাও যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো তখন ওকে আমি প্রচুর গালাগালি করেছিলাম। কিন্তু তোর মা আমাকে কোনো জবাবই দিচ্ছিলো না। শুধু বললো “আপনি সন্তানের পিতা হতে পারেন নি, সন্তানেরা কি চায় সেইটা বুঝার ক্ষমতা আপনার হয়ে উঠেনি। আমি আবিদের জন্য টাকা আনতে যাচ্ছি। আপনি তো সন্তানকে টাকা দিবেন না। অথচ আবিদই আপনার সকল সমস্যা থেকে কাটিয়ে আপনাকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসছে। ছেলেটা এত বছর পরে দেশে এসে যখন আপনার কাছে টাকা চাইলো তখন আপনি তাড়িয়ে দিলেন। আমাকে প্লিজ বাঁধা দিবেন না।”

একটু থমকে গিয়ে বাবা আবারো বললেন..

– তোর মায়ের দিকে তাকিয়ে আজ আমি অনুভব করতে পারছিলাম,তোর জন্য তার ভেতরটা কতটা পুড়ে যাচ্ছে। যে মানুষটা এতদিনে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি,সেই মানুষটা তোর জন্যই আমাকে কথা গুলো বলার সাহসটা খুঁজে পেয়েছে।

– কিন্তু বাবা, আমাকে তো মা বলেনি আজ আমার জন্য টাকা নিতে বের হবে।

– দেখ আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দ্বায়ী একমাত্র আমি। এখন আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।

আমি বাবার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম বাবা আমার মাকে অসম্ভব ভাবে ভালোবাসে। কিন্তু সে সব সময় রাগটাই দেখিয়ে গিয়েছে৷ এমন হতে পারে,পুরনো ব্যথা বাবা আর কাটিয়ে উঠতে পারছিলো না। তাই তার ব্যবহারটা এমন হয়ে গিয়েছিলো। সে যেনো কোনো ভাবেই পুরনো দিনের কথা গুলো ভুলতে পারছিলো না।

ডাক্তার আমাদের ডাক দিয়ে বললেন, মায়ের অবস্থা নাকি আগের চেয়ে ভালো। তবে শঙ্কা কাটাতে অনেক সময় লাগবে। মায়ের কাছে একজনই যেতে পারবে। চাইলে আমাদের ভেতরে যে কেউ যেতে পারি। বাবা বললেন তিনি মায়ের কাছে যাবে। সেই থেকে বাবা আর মায়ের কাছ থেকে দূরে যায়নি। সব সময় মায়ের কাছাকাছি থাকছে। হয়তো তার ভেতরে অনুশোচনা কাজ করছে। কিন্তু তিনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আমার মাকে আঘাত যা দেওয়ার তা তিনি আগে দিয়ে ফেলেছেন। বাবা যতই মাকে ভালোবাসুক কিংবা ভুল বুঝতে পেরে মায়ের কাছাকাছি থাকুক,তবুও মায়ের অন্তরের ক্ষত শুকাতে পারবে না।

চার দিন পরে মাকে বেডে নেওয়া হলো। এই কদিন বাবা মায়ের কাছ থেকে একটুও নড়াচড়া করেনি। সব সময় মায়ে কাছাকাছি থেকেছেন।

প্রায় বারোদিন আমরা মেডিকেলে ছিলাম। এই বারোদিন বাবা মায়ের সকল সেবাযত্ন করেছেন। আমার মা হয়তো ভাবতেই পারেনি,বুড়া বয়সে এসে বাবার ভালোবাসা দেখতে পারবেন। বাবার যত্ন দেখে আমার মা ফেলফেলিয়ে তাকিয়ে থাকতে। হয়তো বাবাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু শারিরীক কষ্টে বাবার সাথে ভালোমত কথাও বলতে পারেনি।

এই কদিনে মায়া বেশ কয়েকবার খোঁজ খবর নিয়েছে। কিন্তু বাবার জন্য মায়া হসপিটালে আর আসেনি। আমিও ব্যস্ততার জন্য মায়ার সাথে সেভাবে কথা বলতে পারি নি। যতটুকু সম্ভব কথা বলেছি।

যখন দেখলাম মা একটু সুস্থ্যের দিকে তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশে আর থাকা যাবে না। আমার কর্মস্থলে চলে যাবো। এভাবে আর দেশে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে আর দিতে চাইনি। তাই মায়াকে বিয়ে করার কথা মন থেকে ভুলে গেলাম। কাপুরুষের মত ভালোবাসা ছেড়ে দিয়ে দেশটা ছাড়বো আমি। এই মুহূর্তে বিয়ে করার কথা মাথায় আনাও বোকামি। বাবাকে আর রাগাতে চাইনি। যদি বিয়ের প্রসঙ্গ উঠাই বাবা তাতে রেগেও যেতে পারে। তাই আমি আর চাই না বাবার রাগটা আমার মায়ের উপরে পরুক। এই কদিনে মা,বাবার কাছে বেশ ভালোবাসা পেয়েছে। পেয়েছে বাবার যত্ন। তাই আর নতুন করে ঝামেলা করতে চাচ্ছি না।

রুমের ভেতর চুপচাপ বসে আছি। প্রায় দেড় মাস হলো দেশে আসলাম কিন্তু একটা দিনও ভালোমত থাকতে পারলাম না। মানুষ কয়েকবছর পরে দেশে আসে ভালোবাসার মানুষ গুলোর সাথে সময় কাটাতে, নিজেকে একটু রিলাক্স করতে। আমি তো কিছুই পারলাম না বরং আমার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে বসেছি। এমনকি আমার কারণে আমার মায়ের অবস্থা এরকম। আমার জন্য টাকা আনতে যদি না বের হতো,তাহলে মায়ের এতবড় দূর্ঘটনা হতো না। নিজের কাছে এখন নিজেকেই খারাপ লাগছে।

হঠাৎ বাবা আমার রুমে আসলেন। রুমে এসে বাবা আমার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলেন। তিনি বললেন…

– তোর ছুটি এখনো দেড় মাস আছে,এখনি বাইরে যেতে হবে কেন?

– বাবা অফিস থেকে ফোন আসছিলো,তাই আমার যেতে হবে।

– টিকেট কাটিস না আর কিছুদিন থেকে যা।

– না বাবা, আমার যেতে হবে। আপনি এসেছেন ভালো হয়েছে,আপনাকে কিছু বলার ছিলো।

– আপাতত আমি কিছুই শুনবো না। তোর মা এখনো অসুস্থ। এই পরিস্থিতিতে তাকে রেখে যাস না। সে খুব কষ্ট পাবে।

– কিন্তু বাবা দেশে থাকলে যে আমি কষ্ট পাবো।

বাবা আমার হাতটা চেপে ধরলেন। তিনি সম্ভবত আমার ফোনে বলা কথাগুলো শুনে নিয়েছেন। তাই জানতে পেরেছেন যে আমি দেশ থেকে চলে যাচ্ছি। আমি কাউকে জানাতে চাইনি যে হঠাৎ করেই চলে যাবো। এমনকি মায়াকেও না।

মায়ার চোখে আমি ঘৃণার পাত্র হয়ে যাবো। আমি মায়াকে এতদিন অপেক্ষা করিয়ে শেষ পর্যায়ে আমি তাকে ঠকাতে চলছি। ওইদিন বিয়েটাও করতে পারলাম না,মায়ের এক্সিডেন্টের জন্য। হয়তো ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না। তা না হলে এতবার বাজে সিচুয়েশনে পরতে হত না। আমি নিজের ইচ্ছায় মায়াকে এতদিন বিয়ে করিনি শুধুমাত্র আমার মায়ের জন্য। বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে যদি বিয়েটা করতাম তাহলে এই বাড়িতে আমার মায়ের ঠাঁই হত না। যখন সব কিছু বাদ দিয়ে মায়াকে আপন করতে গেলাম,তখন আল্লাহের পক্ষ থেকে একটা বাঁধা পেলাম। এমনটাও হতে পারে যে যদি বিয়েটা আমি করেই ফেলতাম তাহলে হয়তো মায়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা দেখতে পেতাম না।

বাবার কথায় কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অন্যদিকে মায়ার সাথে যোগাযোগটাও কমিয়ে দিয়েছি। খুব একটা কথা বলি না। কারণ এতটা বছর মায়াকে আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ে মায়াকে আপন করে নিতে পারলাম না।

তিনদিনের মত দেশে আছি। তিনদিন পরে রাতের ফ্লাইটে সুদূর দুবাই চলে যাবো। তাই আর আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে কোথাও যাচ্ছি না। সব সময় মায়ের কাছাকাছি থাকি। মাকে কয়েকবার বলতে চেয়েছিলাম ‘ মা আমি দুবাই চলে যাচ্ছি।’ কিন্তু মাকে বলার সাহসটা পাচ্ছি না। কারণ এই মুহূর্তে মা নিতে পারবে না।

রাতের দিকে দেখলাম আমার বাবা মায়ার পরিবারসহ সবাইকে নিয়ে এসেছেন। মায়াকে দেখে আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। এই কদিনে ওর চাহারা আগের মত নেই। কান্না করে সম্ভবত চোখমুখ ফুলিয়ে রেখেছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

সবাই আমার মায়ের রুমে এসেছেন। এদের ভেতরে শুধু মায়ার মাকে দেখতে পেলাম না। বাবার মুখ খুব হাসিখুশি। আমি তাকে যত দেখছি,তত চমকে উঠছ। এ আমি কি দেখছি। মায়ার বাবা হাসতে হাসতে বললেন…

“আবিদ তোমার বাবার জন্য আর পারলাম না। আমার বাসায় গিয়ে যেভাবে রিকোয়েস্ট করলেন তাতে আর না এসে পারলাম না। সে নাকি তার বউমাকে মানে মায়াকে ছাড়া বাড়িতেই ফিরবে না।”

আমি কিছুই বললাম না। দেখলাম বাবা আমার মায়ের হাত ধরে কিছু একটা বলতে যাবে। তখনি মা আস্তে আস্তে বললো….

“তুমি কি বলবে আমি জানি। এটা আর বলতে হবে না নতুন করে। ওসব আমি ভুলে গিয়েছি। তুমি ভাবছো তোমার ব্যপারে আমরা কেউই কিছু জানি না? আমি জানার পরেই মায়ার মায়ের সাথে কথা বলে, মায়াকে বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। মানে মায়া যে নিখোঁজ হয়েছে,তা আমার এবং মায়ার মায়ের যুক্তিতেই আবিদের মামার বাড়িতে পাঠিয়ে ছিলাম।”

মায়ার বাবা আমার বাবার হাত ধরে বললেন ” ভাই সাহেব সব কিছু ভুলে গিয়ে ওদের জন্য দোয়া করে দেন।”

বাবা সবার মাঝে আমার উদ্দ্যেশ্যে বললেন…

– আবিদের কাছে আমার কিছু চাওয়ার আছে।

মা জবাবে বললেন”আবার কি?”

– আবিদ আমাদের ছেড়ে আর বিদেশে যেতে পারবে না। এই ক’বছর থেকেছে তাতেই হবে। আবিদের ইনকামের সব কিছুই আবিদের জন্য রেখে দিয়েছি। ও হয়তো আমাকে ভুল বুঝেছে। আর আমি ক্ষমা চাচ্ছি এতদিনের ব্যবহারের জন্য। আমি এই জীবনের সব কিছুই ভুলের ভেতর ছিলাম,এবং সবার সাথে অন্যায় করেছি। তাই জীবনের বাকি দিন গুলো সবাইকে নিয়ে একসাথেই কাটাতে চাই।

মায়া আর আমি ছাদে চলে গেলাম। মায়াকে একটু জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মায়া বাঁধা দিয়ে, অভিমান সূরে বললো…

“কাজি সাহেব আসুক তারপর পরে জড়িয়ে ধরবে।”

আমিও গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। মায়া আমার কাঁধে মাথা রেখে…..

-আমাকে রেখে তো পালিয়ে যেতে চেয়েছিলে।
কিন্তু তুমি কি জানো আমাদের আলাদা হতে, চাঁদের বাড়ি যতদূর,
ততদূর গেলে হয়তো আমরা আলাদা হয়ে যেতাম। ওই যে দেখো “চাঁদের বাড়ি বহুদূর।”

(সমাপ্ত)