দূর আলাপন পর্ব-০৭

0
201

দূর আলাপন ~ ৭
____________________________
নিনাদের ওখানে বেশ যত্নআত্তি করে খাইয়েছে, মেয়েদের মুখে সেকথা শুনে প্রসন্ন হলেন মারুফ। আগেই ভেবে রেখেছিলেন দেশের বাইরে যাবার আগে ছেলেটাকে একবার নিজের সামনে বসিয়ে খাওয়াবেন।
প্রস্তাবটা প্রথম উত্থাপন করলেন ছোট মেয়ের কাছে। সন্ধ্যের পর ছেলেকে নিয়ে পড়াতে বসেছে তিহা। তিতিক্ষা রান্নাঘরে রাতের খাবারের আয়োজন করছে। এক চুলায় ভাত, অন্য চুলায় বেগুন ভাজা। মারুফ নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে মৃদু কণ্ঠে মেয়েকে ডাকলেন,
‘কি করো তিতি মা?’

তিতিক্ষা ব্যস্ত ভঙ্গিতে পেছন ফিরল,’এইতো, ভাত রাধি। আজ রাতের মেন্যু বেগুন ভাজা, টেংরা মাছের তরকারি আর ডাল। চলবে তো বাবা?’

‘দৌড়াবে!’ বলে মারুফ সরল হাসলেন। বাবার এই হাসিতে তিতিক্ষা বারবার দ্রব হয়ে পড়ে। আজও তাই হলো। কিঞ্চিৎ আহ্লাদ নিয়ে বলল,’চা করে দেব বাবা?’ ঠিক যেভাবে পরিণত মায়েরা তাদের বাচ্চা ছেলেকে বলে।

চায়ের নামে মারুফ অবধারিত ভাবেই খুশি হন। সাগ্রহে বললেন, ‘হ্যাঁ দাও… কিন্তু দুটো চুলাই যে বন্ধ!’

‘সমস্যা নেই। ভাত হয়ে গেছে। নামিয়ে চা বসিয়ে দিচ্ছি।’

‘বেশ। তবে আমি যাই।’ ঘরের দিকে কয়েক পদক্ষেপ হেটে পুনরায় মারুফ ফিরলেন পেছনে, ‘তিতি মা শোনো, চা হয়ে গেলে তুমি একবার একটু সময় করে আমার ঘরে এসো। কথা আছে।’

.

চা নিয়ে বাবার ঘরে যেতে যেতে দুরুদুরু বুকে কতকিছু ভাবে তিতিক্ষা। কি বলার জন্য হঠাৎ ডেকেছেন বাবা? খুব সিরিয়াস কিছু?
নাহ, তবে তো বুবুরও ডাক পড়ত। যা হোক, গেলেই দেখা যাবে!

‘বাবা তোমার চা।’

‘হ্যাঁ রাখো।’ মারুফ পিঠ টান করে বসলেন।
‘একটা কথা ছিল মা, নিনাদ তো চলে যাচ্ছে। যাবার আগে ছেলেটাকে একদিন ডেকে ভালো মন্দ খাওয়ানো দরকার। এখন ওর বাড়ির মানুষও আছে…. এই শুক্রবার বরং দাওয়াত করে ওদের। কি বল?’
অপ্রতিভ ভাবটা আড়াল করলে পারল না তিতিক্ষা। বাবার কথায় আপত্তি করাও চলে না। ছদ্ম গম্ভীর নত মুখে একধ্যানে চা নাড়লে থাকে। মেয়ে কি বলে শোনার জন্য ব্যগ্র হয়ে চেয়ে থাকেন মারুফ।

‘তোমার যা ভালো মনে হয়।’ বলে তিতিক্ষা বাবার দিকে বাড়িয়ে ধরে চায়ের কাপ। মারুফ হাসিমুখে চা নিলেন। মেয়ের মেদুর কণ্ঠ তার উচ্ছ্বাস দমিয়ে দিতে পারল না। চায়ে চুমুক দিয়ে ঔৎসুক্য ভরে বললেন, ‘তবে তো ভালো খানাপিনার আয়োজন করতে হয়। কি কি লাগবে তুমি একটা লিস্ট করে ফেলো। কাল বাজারে যাব।’

‘আমি এসবের কিইবা বুঝি! বুবুকে আগে জানাও। ওর বন্ধু, ওর ফুআম্মা…. কি লাগবে কি রাধবে সে নাহয় বুবুই ঠিক করবে।’
অন্যসময়ের তুলনায় মেয়ের স্বরে এখন যে শিথিলতা বিরাজমান,তার তারতম্য একেবারেই টের পেলেন না মারুফ।

বাড়িতে মেহমান আসবে, জমজমাট হাসি আনন্দ খানাপিনা হবে। আপাতত এই ভাবনাতেই তিনি মহা খুশি।
‘হ্যাঁ তাই করো। ডেকে নিয়ে এসো তিহাকে। ওর সঙ্গে পরামর্শ করি।’

‘আচ্ছা।’ শান্ত গলায় বলে শব্দহীন পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল তিতিক্ষা।

.

আজকাল প্রায় রোজ বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষার আকাশে মেঘ যেন অফুরান। সকালে একছত্র বৃষ্টি, বিকেলেও। এই ঘোর বর্ষার মধ্যেই মারুফ সাহেব আসু অতিথিদের আপ্যায়নের বন্দবস্ত করতে লাগলেন। বাজার থেকে এলো বড় কাতলা মাছ, গরুর মাংস, নিনাদের প্রিয় গলদা চিংড়ি। আয়োজন চলতে লাগল পরবর্তী শুক্রবার কে কেন্দ্র করে। নিনাদকে জানানো হল দু দিন আগে। নিনাদ দুঃখ প্রকাশ করে জানাল এই সপ্তাহে ও কিছুতেই আসতে পারছে না। শনিবার ভিসা ইন্টারভিউ। কিছুটা পড়াশোনা আর প্রস্তুতির ব্যাপারও রয়েছে।

বেশ পরিতোষ চিত্তে মারুফ দাওয়াতের তারিখ পেছালেন। রওশানের কথা ভেবে আবারো এক শুক্রবার কে ঘিরে আয়োজন করা হলো, নিনাদের বিদেশ যাত্রার আট দিন আগে। নিনাদ তো থাকবেই তার ওপর আসছে রওশান। তিহা আর তার ছেলে দ্বিগুণ খুশি। কত আয়োজন উদ্দীপনা সেই দিনকে ঘিরে। অথচ সময় যত নিকটে আসতে লাগল আগ্রহ কমে তত স্তিমিত হয়ে যেতে থাকলো তিহা। শুক্রবার তাড়াতাড়ি আসা মানে নিনাদের যাওয়ার দিনও ঘনিয়ে আসা। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর কোথায়, কত দূরের এক দেশে চলে যাবে নিনাদ। যখন তখন ডেকে আনা যাবে না, কথা বলা যাবে না। নিনাদের তখন একটা আলাদা জীবন আর সে জীবন ঘিরে নানান ব্যস্ততা থাকবে। একে একে শিউলি ফুআম্মা আফরিন সবাই যে যার গন্তব্যে ফিরে যাবে। নিজের ছোট জগত নিয়ে হুল্লোড় প্রিয় তিহা হয়ে পড়বে ভীষণ একা।

মন খারাপের সংক্রামক হাওয়া যেন সবার ওপর দিয়েই বলে গেল। ফোনে শিউলি ফুআম্মার সঙ্গে কথাবার্তা আজকাল তেমন জমে ওঠে না। তিনি বারবার হারিয়ে ফেলেন খেই। সরলমনা আফরিন মাঝে মাঝেই নাক টেনে কাঁদে, ওর সঙ্গ দেন শিউলি। তিহা কি বলে এদের স্বান্তনা দেবে ভেবে পায় না। দীর্ঘ এক বছরের জন্য বিচ্ছেদ ও অপেক্ষা। এক বছরে কত কি ঘটে যেতে পারে। যে মানুষ গুলোকে রেখে যাবে, ফিরে এসে সবাইকে নিনাদ নাও পেতে পারে। তাছাড়া দূরদেশে নিনাদই বা একা ভালো থাকবে তো সবসময়? অসুখে পড়লে দেখবে কে? মন খারাপের দিনে একটু সহানুভূতির জন্য ছুটে যাবে কার কাছে?

সবাই আজকাল উপদেশের ওপর রাখছে নিনাদকে। আমেরিকার গিয়ে কি করে চলবে, খাবে-দাবে, কেমন ওষুধ পত্র সঙ্গে রাখবে, হালাল খাবার কি করে মেনেজ করবে আর শীতের দেশের উপযোগী পোশাক…. এসব নিয়ে রাতদিন উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে রওশান। আর ওর সকল হ্যাঁতে হ্যাঁ এবং নাতে না মেলাচ্ছে তিহা। বোন, বোনজামাইয়ের ক্রমাগত আদিখ্যেতা দেখলে তিতিক্ষার গা জ্বলে যায়। বিরক্তিতে মুখ বেজার করে থাকে সারাক্ষণ।
‘বিদেশ তো যাচ্ছে না, যেন রকেটে চড়ে মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছে এলিয়েন খুঁজতে। ন্যাকামি দেখে মাথা ধরে গেল অসহ্য!’

______________________

ভোর বেলা থেকেই বাড়ি জুড়ে আজ ব্যস্ততা চরমে। নানাবিধ ব্যঞ্জন, তার জন্য হাজাররকমের জোগাড়জন্ত। কিন্তু সেসব করার মতো হাত মাত্র দু জোড়া। মা ও মিমির ব্যস্ত ছুটোছুটি দেখে একবার সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল ছোটন… কিন্তু দেখা গেল ও পাশে থাকলে কাজের চেয়ে অকাজ বরং বেশি হচ্ছে। একটা বিভীষণ ধমক দেবার কথা চিন্তা করছিল তিহা, তার আগেই তিতিক্ষা কৌশলে ভাগ্নেকে রান্নাঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। ছোট মানুষ, এত উৎসাহ নিয়ে এসেছে কাজ করতে, ওকে হতাশ করবে কি করে? ভেবে ভেবে একটা সহজ এবং নিরাপদ কাজ খুঁজে বের করল তিতিক্ষা, যেটা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ছোটনকে এক জায়গায় স্থিরও রাখা যাবে। একবাটি চাল আর একটা কুলোর সামনে ছোটনকে বসিয়ে বলল, ‘ছোট মিয়া, তুমি এই সবগুলো চাল আমাকে বেছে দাও তো।’

‘চাল বাছা কি খুব বড় কাজ মিমি?’

‘হ্যাঁ। তা তো অবশ্যই। চালগুলো বেছে দিলে আমার ভীষণ উপকার হয়। দেবে তো কাজটা?’

সজোড়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল ছোটন।

.

যথাসময়ে এলো নিনাদ আফরিন শিউলি ফুআম্মা। তিহা রান্না ফেলে ছুটে এসে আফরিন শিউলি ফুআম্মাকে ভেতরে নিয়ে গেল। পাঞ্জাবি পাজামা আর মাথায় টুপি পড়ে ফুলবাবু সেজে থাকা ছোটনকে হাত ধরে নিনাদ নিয়ে গেল মসজিদে। মারুফও প্রসন্ন মুখে ওদের সঙ্গে গেলেন।

মেয়েদের খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে অন্দরে, তিতিক্ষার ঘরে। ডাইনিং এ বসবে ছেলেরা। এই পর্ব বেশ ভালো ভাবেই শেষ হলো। যথাসময়ে রওশান আসতে পারেনি বলে একটু একা একা লাগছিল নিনাদের। খাওয়া শেষে খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর বাইরে গেল নিনাদ। কিছু বন্ধুদের আসার কথা ধানমন্ডি লেকে। বিকেলে এসে ফুআম্মা আর আফরিনকে ও নিয়ে যাবে।

খাবারের পর শেষ দুপুরের রোদ ছুটে পালাই পালাই করছিল যখন, তখন বাড়িটা যেন একটু ঝিমিয়ে পড়ল। মারুফ সাহেব নিজের ঘরে ভাতঘুম দিতে গেলেন। নিনাদ চলে গেছে বাইরে। অবশ্য আফরিনের মিষ্টি খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল মাঝেমধ্যে তিতিক্ষার ঘর থেকে। তিহার ঘরে গল্পের আসর জমেছিল পাতানো ফুফু ভাতিজিতে মিলে। সেখানেও খরা। কথা বলতে বলতে শিউলি ফুআম্মা তন্দ্রায় হেলে পড়লেন।

অবসর পেয়ে রান্নাঘরে চলে এলো তিহা। বিকেলে রওশান আসবে। বেচারা সময়মত রওনা হতে পারেনি বলে খুব আফসোস করছিল। ওর জন্য খাবার গুছিয়ে তুলে রাখতে হবে।

হঠাৎ আসা তন্দ্রা হঠাৎই ভেঙে গেল শিউলির। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে হাটতে হাটতে চলে এলেন তিতিক্ষা ঘরে। মেয়েটা একা ঘরে বসে আছে। শিউলিকে দেখেই তিতিক্ষা সাগ্রহে বলল,’আসুন ফুআম্মা। এখানে বসুন।’
ঈষৎ হেসে ওর পাশে বসে পড়লেন শিউলি। ‘আপ্পিনিরে দেখতাসি না। হে কই মা?’

‘ছোটন কে নিয়ে ছাদে গেছে। ডাকব?’

‘না.. না..। থাকুক, গেছে ভালোই হইসে। তোমাগর দুই বইনের লগে কিছু কথা কইবার আছিল মা। তোমার আপায় আবার কই গেল?’

অপ্রস্তুত হাসে তিতিক্ষা, ‘আপু বোধহয় রান্নাঘরে। আসবে এক্ষুনি।’
কিন্তু শিউলি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে নারাজ। কখন না কখন চলে আসে আফরিন। অস্থির হয়ে বললেন,’এহন কেউ নাই। কথাটা কওয়ার সুযোগ আছিল। তোমার আপায় তো দেরি করতাসে। আপ্পিনি না আবার নাইমা আসে ছাদ থাইকা।’
তারপর আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তিহা তখনো আসল না দেখে এবার বললেন,’আইচ্ছা, থাউক। এহন তুমারেই কই। পরে যদি আর সুযোগ না পাই। তখন তুমিই কইয়ো তুমার আপারে বুঝায়া। কেমন? ‘
তিতিক্ষা ঘাড় নাড়ল। শিউলি চাপা স্বরে বলতে শুরু করলেন, ‘তুমরার দুই বইনেরে তো নিনাদ খুব মানে। তাই তুমরার কাছেই দুঃখের কথা কই বুঝলা।
পোলাডা বিদেশ যাইতাসে। বিদেশের বাতাস গায়ে লাগলে পুলাপানের স্বভাব বিগড়ায়া যায়। পোলাডারে না করছিলাম দূর দেশে যাইতে। কিন্তু কথা শুনল না। তাই ভাবছি বিদেশ যাওনের আগে ওরে বিয়া দিয়া দিমু। একবার শিকল দিয়া শক্ত কইরা বানতে পারলে সহজে লাগাম আলগা হইব না। বুঝলা না?
আপ্পিনিরেও আনলাম সাথে। আমি ছাড়া তো আর কোনো কাছের আত্মীয়স্বজন কেউ নাই ওই দুইডার। ভাবছিলাম এইহানেই ওগো বিয়াডা দিয়া দিমু।
থেমে বললেন,’আজকালকার পুলাপানের কি যে স্বভাব! মতিগতি বুঝন বড় দায়। পোলার মনে যে কি চলে, বুঝা মুশকিল। খালি গাইগুই করে। বিয়ার কথা হাইসা সব উড়ায়া দেয়। কওতো দেহি, এমনে কিছু হইবো?
এহন তুমরাই আমার ভরসা। তুমরার সব কথাই হে শুনে। তুমরা ওরে বুঝায়া রাজি করাও।’

তিতিক্ষা কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে বসে রইল। শিউলি ফুআম্মার গুরুত্বপূর্ণ কথা তাকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে।
কিছু বলছে না দেখে তিনি আবার বললেন, ‘কি হইল? করবা তো তুমরা আমার এই উফকার টা?’

তিতিক্ষা হঠাৎ সম্বিত ফিরে পায় যেন। মলিন হেসে মৃদু স্বরে বলে,’জি… জি… অবশ্যই। আমি আপুকে বলব নিনাদ ভাইকে বোঝাতে। আপুর কথা উনি ফেলতে পারবেন না। দেখবেন বিদেশ যাওয়ার আগেই উনি বিয়েতে মত দেবেন। আপনি আর ভাববেন না ফুআম্মা।’
শিউলি ফুআম্মা প্রসন্ন মুখে হাসলেন। তিতিক্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি বড় ভালা মাইয়া।’
চলবে…….।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে