দূর আলাপন পর্ব-০৮

0
209

দূর আলাপন ~ ৮
____________________________
ছোটন বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে সাদা আঁকার খাতায় লাল নীল রং তুলির ছোঁয়া লাগিয়ে নিজের ছোট্ট বেপরোয়া মনের অসংখ্য কল্পনা মিশিয়ে আঁকিবুঁকি করছিল।
পাশে বসে বই পড়ছিল তিতিক্ষা। বইয়ের বিষয়বস্তু বোধহয় হাসির। কারণ কয়েক মুহূর্ত পর পর অস্ফুট একটা হাসির আভাসে ভরে উঠছিল ওর মুখ। মাঝে মাঝে বইয়ের ফাঁকে আড়চোখে চেয়ে দেখে নিচ্ছিল ছোটন নিজের কাজ ঠিকমত করছে কিনা।

ছেলেবেলা থেকে তিতিক্ষা আঁকে ভীষণ ভালো। কখনো আঁকার মাস্টার রাখতে হয়নি, কাউকে দেখিয়ে দিতে হয়নি। তবু চিরকাল স্কুলের সব পরীক্ষায় আঁকার খাতায় তিতিক্ষার নাম্বার সবার ওপরে। অলিখিত ভাবেই তাই ছোটনকে আঁকা শেখানোর দায়িত্ব টা এসে ওর ঘাড়ে পড়েছে। এমনিতে ছাত্রটির সম্মন্ধে তিতিক্ষার কোনো অভিযোগ নেই। বয়সের প্রেক্ষিতে আঁকে ভালোই। কিন্তু ওর দুরন্তপনা সামলানই বড় মুশকিল। আঁকছে তো আঁকছে, হুট করে দেখা যাবে মাথার পোকা নাড়া দিয়েছে। রংপেন্সিল, আঁকার খাতা ফেলে ভোঁ দৌড়।

ছোটনের উদাসী ভাব লক্ষ্য করে তাই খানিকটা উৎসাহ যোগানোর জন্য তিতিক্ষা বলে, ‘ছোট মিয়া, পুরো মনোযোগ দাও। ভালো করে আঁকাটা শেখো। মিমির মান রাখতে হবে কিন্তু তোমাকে! ঠিকঠিক শিখলে মিমি তোমায় অনেক উপহার দেব।’

উপঢৌকনের নাম শুনে ছোটনের উদাস ভাব উবে যায় মুহুর্তে। আকুল কণ্ঠে বলে, ‘কি কি উপহার মিমি?’

‘উমম… আপাতত ৩৬ শেডের একটা প্যাস্টেল রঙের বক্স আর তিনটা গল্পের বই।’

উপহারের কথায় ছোটনের চোখে আলোর ঝলকানি খেলে গেল। কিন্তু মিমির শেষ কথাটা স্মরণ করে সচেতন হয়ে উঠল মুহুর্তে।
‘শুধু এই দুটো! তুমি না বললে অনেক গিফট?’

‘হুম অনেক গিফট ই তো। আপাতত এই দুটো রাখো, কিছুদিন পর আবার পাবে আর…. সবচেয়ে বড় গিফট টা দেব তুমি বড় হবার পর।’

চোয়াল ঝুলে পড়ে ছোটনের। ‘কিহ! বড় হবার পর… এতদিন কি করে অপেক্ষা করবো মিমি?’ ছোটন হতাশ গলায় বলে।

‘তা কি করি বলো! ভালো জিনিস পেতে হলে তো একটু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবেই।’

‘কি গিফট সেটা মিমি?’

‘ছোট মিয়ার না খুব বউয়ের শখ? ভাবছি ছোট মিয়াকে একটা সুন্দর বউ উপহার দেব!’

‘কেমন সুন্দর বউ মিমি?’

‘একটা লাল টুকটুকে খুব সুন্দর দেখতে বউ।’

ছোটন কৃতার্থ হল। চোখমুখে আলো ছড়িয়ে আরেকটা প্রশ্ন ছুড়ল তিতিক্ষার দিকে।

‘বউটা কি পুতুলের মতো মিমি? তাহলে তো খুব মজা হবে। তাই না?
আচ্ছা মিমি, লাল টুকটুকে বউটা কি এখনি দেয়া যায় না?’

তিতিক্ষার মন আজ বেশ প্রফুল্ল। নাহয় এই ধরনের ছেলেমানুষী কথা সে বলে না সাধারণত। ভাগ্নের কথাগুলো ভারি উপভোগ করছিল ও। রহস্য করে হেসে বলল,’বউ তো আগে খুঁজে বার করতে হবে। তার আগে কিভাবে দেই বল ছোট মিয়া? আর বউদের যে অনেক বায়না। টাকা, খাবার, পোশাক… পারবে তুমি সব দিতে?’

এতকিছু! ছোটন বিস্ময়ে হা হয়ে থাকে। ও নিজেই তো একটা ছোট মানুষ। মায়ের হাতেপায়ে ধরে লজেন্স কেনার টাকা নেয়। ও কি করে বউকে এতকিছু দেবে?
সরল মনে নিজের হিজিবিজি আঁকার খাতাটা দেখিয়ে বলে,’এটা দিলে হবে না? এতে আমার অনেক প্রিয় প্রিয় ছবি আছে। সবই নাহয় দিয়ে দেব। আর রঙ তুলিও।’ রঙ তুলি দেবার কথা বলতে গিয়ে স্বর কেঁপে যাচ্ছিল ছোটনের। কত প্রিয় ওর রঙতুলি…

খিলখিল করে হেসে ওঠে তিতিক্ষা। ছোটনের গাল টিপে দিয়ে বলে, ‘ওলে বাবালে.. বউয়ের কত শখ ছেলের… অত সাধের রঙ তুলি পর্যন্ত দিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। থাক থাক… অত কষ্ট করতে হবে না। আর কিছুদিন সবুর করো। আমার একটা মেয়ে হোক। তোমাকেই মেয়ে জামাই করব ইন শা আল্লাহ। রোজ রোজ রসগোল্লা আর জিলাপি খাওয়াব। ঠিকাছে?’

তীব্র ঔৎসক্যে মাথা নাড়ে ছোটন। সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ছবি ভাবতেই চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু একই সময়ে আরো একটা সুদূর সম্ভাবনার কথা ওর মনোজগতে ছায়া ফেলে। মিমি আজ যা বলল ঠিক একইরকম কথা বলেছিল আরেকজন। মিমি ওকে মেয়ে জামাই করে রসগোল্লা আর জিলাপি খাওয়াবে বলেছে। ওদিকে নিনাদ ইতোমধ্যে তাকে নিজের মেয়ের জামাই ঘোষণা করে অগ্রিম অনেক আকর্ষণীয় উপহার দিয়েছে ভবিষ্যতের সেই ব্যপারে টিকে উপলক্ষ করে। কিন্তু দুজনের মেয়ে জামাই সে একসঙ্গে হয় কি করে? দুটো লাল টুকটুকে বউ তো তার প্রয়োজন নেই। তবে সে কোনটা ছাড়ে?

মুখ করুন হয়ে আসে ছোটনের। ভ্রু কুঞ্চন করে তিতিক্ষা।
‘কি হলো ছোট মিয়া? মুখটা হঠাৎ ভার হয়ে গেল কেন?’

‘আমি তোমার মেয়ে জামাই হতে পারব না মিমি।’

‘ওমা কেন?’

‘বড় হয়ে আমাকে নিনাদ মামার মেয়েকেই যে বিয়ে করতে হবে। সেইজন্য মামা কত গিফটও দিয়েছে আমাকে… কি করে না করি?’

‘তারমানে নিনাদ মামাকে মিমির থেকেও বেশি পছন্দ ছোট মিয়ার! আর আমি কিনা ভাবতাম ছোটন আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।’ মেঁকি কান্নার ভাব করে ঠোঁট উলটে ফেলে তিতিক্ষা।

ছোটনের মনও মুহুর্তে ভার হয়ে আসে। সে তো চায় না মিমি একটুও কষ্ট পাক। কিন্তু কিইবা করার আছে? কি করে দুজনকেই খুশি রাখা যায় সে নিয়ে নানান উপায় ভাবতে থাকে ছোটন।
কোনটাই যুতসই মনে হয় না। তখন তার মনে পড়ে স্কুলের বন্ধু রাফানের কথা। রাফানকে যদিও সবাই ইঁচড়েপাকা ছেলে বলে, তবে এই মুহুর্তে রাফানের ফিসফিস করে বলা কথাটা বেশ কাজের মনে হলো। এরকম হলে আর চিন্তার কিছু নেই। ছোটন উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে উঠে মিমিকে বলে, ‘একটা উপায় পেয়েছি মিমি!’

‘কি?’

‘রাফান আমায় বলেছে বিয়ে করলে সবার বাবু হয়। এক কাজ করো, তুমি নিনাদ মামাকে বিয়ে করে ফেল মিমি। আমি তাহলে দুজনের মেয়ে জামাই হতে পারব!’

বই নিয়ে বিছানায় বাজুতে হেলান দিয়ে বসে ছিল তিতিক্ষা। এই কথা শুনে সোজা হয়ে বসল। শীতল চোখদয় কিছুক্ষণ স্থির করে রাখল ছোটনের মুখের ওপর। সহসা কড়া গলায় বলল, ‘ছোটন! স্কুলে গিয়ে তবে এইসব পাকামো শেখা হচ্ছে তোমার? বাজে ছেলেদের পাল্লায় পড়ে ভারি দুষ্টু হচ্ছো তো দিনদিন! আঁকা শেষ করো জলদি!’

শেষ কথাটা অতিরিক্ত জোরের সাথে বলে বইয়ে মুখ ডোবায় তিতিক্ষা।
কিন্তু মন বসাতে পারে না। বই নামিয়ে চেয়ে দেখে টলমল দুচোখ নিয়ে ছোটন নত মাথায় বসে আছে। একফোঁটা জল গড়িয়ে ওর কোলে পড়ে তখনি। নাক টেনে ঠোঁট উলটে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে ছোটন।

ঢোক গিলল তিতিক্ষা। বাচ্চাটা ভুল বলেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু ও এত ছোট যে নিজের কথার মর্মার্থ টুকু পর্যন্ত ওর জানা নেই। এই অবস্থায় ওকে অতর্কিত শাসনের জেরে ফেলা তিতিক্ষার আরো চরম ভুল। এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবক স্থানীয় হিসেবে তিতিক্ষা কর্তব্য ছিল কোমল ভাষায় বাচ্চাটাকে ভবিষ্যতে এ ধরনের কথা বলার ব্যাপারে সাবধান করা। অথচ তা না করে সে কিনা….

তিতিক্ষা বই বন্ধ করে পাশে রাখে। নরম আদুরে গলায় ডাকে ছোটনকে। চিরকাল মিমির একচেটিয়া আদরে অভস্ত্য ছোটন তখন অভিমানে দিশেহারা। মিমি ওকে টেনে নিজের কোলে বসাতেই মৃদু আওয়াজে একটা কাট্টি ঘোষণা করে ছোটন।
ছেলেমানুষী রাগের ধরন দেখে তিতিক্ষা না হেসে পারল না। স্নেহাতুর পরশ বুলিয়ে দিল মাথায়, ‘ মিমি খুব খুব সরি বাবা। আর রাগ করে থেকো না? প্লিজ…. বলে মাথায় কপালে অসংখ্য চুমু দিল তিতিক্ষা। আদুরে গলায় বলল, ‘এখন জলদি জলদি আড়ি ভাঙো তো দেখি!’

আদরে তরল হয়ে গিয়ে অল্প একটু হাসি ফুটে ওঠে ছোটনের মুখে। হাত বাড়িয়ে আড়ি ভেঙে বলে, ‘ভাঙলাম আড়ি।’

‘জাযাকিল্লহ খাইর আব্বু। এখন মিমি একটা কথা বলব, মন দিয়ে শুনবে ঠিকাছে?
শোনো ছোটন তুমি আজ যা বলেছ সেটা ভালো কথা নয় বাবা। এভারে আর কখনো বলবে না ঠিকাছে?’

ছোটন ততক্ষণে মিমির আদরে আদ্র। ওপর নিচ মাথা নাড়ল। আর কখনো বলবে না।

‘আই লাভ ইউ আব্বু। আজ আর আঁকতে হবে না। নানুভাইয়ের সঙ্গে একটু খেলা করে এসো।’

‘আই লাভ ইউ টু মিমি।’ বলে মিমির গালে চুমু খেয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল ছোটন।

কিয়ৎক্ষণ একা ঘরে বসে থাকে তিতিক্ষা। আবোলতাবোল ভাবনা ভাবতে ভাবতে ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে ওর মন। সে যে কিসের জন্য, তিতিক্ষা তা স্পষ্ট করে বলতে পারে না। কি যেন একটা অসঙ্গতি কাটার মতো আটকে থাকে মনের চারপাশে। ছোটনকে বকা দেয়াটা সন্দেহাতীত ভাবেই বাড়াবাড়ি ছিল। ছোট বাচ্চারা এমন কত কথাই তো বলে। মূলত যার সাথে জড়িয়ে কথাটা বলেছে, সেটা মানতে পারে নি তিতিক্ষা। তাই হঠাৎ প্রতিক্রিয়া করে বসেছে।

এই দুঃখ বোধহয় ওর জীবনে ঘুচবে না। ঘুরে ফিরে জীবনের যেখানে তার অপমান, যন্ত্রণা, অভিঘাতের স্পর্শ.. সেখানেই কোথায় যেন নিনাদের উপস্থিতি বিদ্যমান। নিনাদ শব্দটা তার জন্য ক্লেশের কারন হয়েছে সর্বদা। নিজে যেচে কখনো যায়নি সে নিনাদের আশেপাশে। নিনাদই এসেছে বারবার। আর চারপাশের মানুষের কথা, ইয়ারর্কি দুঃখ দিয়েছে তাকে।

বিয়ে নিনাদ আফরিন কেই করুক। কিছু আসে যায় না তিতিক্ষার। কিন্তু ওই নিপাট সারল্যে ভরপুর গ্রাম্য মেয়েটির পাশে নিনাদ কে সে ঠিক মানতে পারে পারে না। মেয়েটা সরল, নিনাদের শত চতুরীর সামনে সামান্য প্রতিরোধ গড়ার সাধ্য ওর নেই। অথচ নিনাদের যে স্বরূপের সঙ্গে চিরকাল তিতিক্ষা পরিচিত, তার কানা কড়ি মিলও আফরিন মেয়েটার সঙ্গে নেই।
নিনাদ ছেলেবেলা থেকে ভীষণ চটপটে। নিজের মেধা আর সপ্রতিভ আচরণের জন্য সব স্তরের মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য। নিজের মেধা ও সুরূপের আকর্ষণ দিয়ে সারাজীবন ধরে বহু মেয়েকে সে নিজের দিকে আকৃষ্ট করেছে। তাদের সাথে তার সম্পর্ক টা ঠিক কোন পর্যায়ের ছিল সে নিয়েও একটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে তিতিক্ষার মনে।

উল্টো দিকে আফরিন মেয়েটা পুরোপুরি পরিণত মনস্ক নয়। গ্রামের সরল মনা দুরন্ত কিশোরী। ছোট বেলায় মা কে হারিয়ে সৎ মায়ের অসংখ্য লা থি-ঝাটা আর বাবার অনাদর অবহেলায় মানুষ। সুখের মধ্যে শুধু ছিল নিনাদের ফুফু, তথা ওর দূরসম্পর্কের চাচি শিউলি বেগমের স্নেহটুকু। অসহনীয় কষ্ট ভোগ করা ছাড়া জীবনের আর কোনো ক্ষেত্রে তেমন অভিজ্ঞতা নেই আফরিনের, অমন একটা দুরন্ত এক ছেলেকে শেকল পড়াতে পারবে তো আফরিন? শেষপর্যন্ত কে কার ফাঁদে আটকাবে? সবার ধারণা মিথ্যে করে শেষতক আফরিন নিজেই যদি নিনাদের জীবনের সরচিত নিয়মের দুর্বোধ্য ফাঁদে আটকে যায় যদি? সরলমনা মেয়েটার পাশে কে ছায়া হয়ে দাঁড়াবে তখন?

এই এক চিন্তা আজকাল তিতিক্ষার মাথায় জেঁকে বসেছে। বুবুকে শিউলি ফুআম্মার বলা প্রতিটি কথা ও জানিয়েছে। বুবুও বেশ খুশি এই সম্মন্ধে। হওয়ারই কথা। নিজের একান্ত আপনজনের মত বুবু চিরকাল নিনাদের দোষ গুলো আড়াল করে গুণোগান গেয়ে বেড়িয়েছে। এমনকি কখনো কখনো তিতিক্ষার সম্মুখেও!
নিনাদের বেপরোয়া জীবন সম্মন্ধে আগাগোড়া ধারণা থাকার পরও যে শুধুমাত্র নিনাদের ভালোর কথা ভেবে তিহা এই সম্মন্ধে রাজি হয়ে যাবে, তা বিলক্ষন জানতো তিতিক্ষা। আফরিনের জীবনে ধ্বংস নেমে আসুক, তবু নিনাদ ভালো থাকুক।

তিহা আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছে এই জেনে যে নিনাদের মনে যাই চলুক, তিতিক্ষা কখনো মন ফেরাবে না ওর দিকে। সেজন্য ও চায় নিনাদ আর আফরিনের বিয়েটা হোক।
চাইতে পারছে না শুধু তিতিক্ষা। চোখের সামনে একটা সহজ-সরল মেয়েকে ধোঁকা খেতে দেখে কিভাবে চুপ থাকবে সে! এইসব জটিল ধাঁধার প্রতক্ষ্যদর্শী অথচ প্রতিবাদ করবে না। এর জন্য কি পরকালে তাকে জবাবদিহি করতে হবে না?

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে