দূর আলাপন পর্ব-০৬

0
221

দূর আলাপন ~ ৬
____________________________
‘তবে তো তোমার নিনাদ ভাইয়ের পছন্দের তারিফ করতে হয়।
তুমি করে বলে ফেললাম। কিছু মনে করো নি তো?’

‘না… মিহি হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। ‘মনে করার কি আছে? কিযে কন…’

আবার সব চুপ। খানিক আগের মতো ফের একবার দুজনের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই নিস্তব্ধতা ফিরে আসছে দেখে তিতিক্ষা নিজেই কথা শুরু করল এবার। পুরো আকাশ জুড়ে তখন কালো মেঘের রাজত্ব। মেঘেদের প্রকট গর্জনে, বন্য ডরালু হাওয়াতে অশনির আগাম সংকেত। তিতিক্ষা একবার আকাশে নজর বুলিয়ে নেয়। ওড়না টা আরেকটু ভালো করে গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পলকা স্বরে জানতে চায়,’তোমার বয়স কত আফরিন?’
‘কিছু মনে কোরো না। এভাবে নাম ধরে ডাকছি তো, তারপর যদি দেখা যায় তুমি আমার চেয়ে সামান্য বড়…’ হাসল তিতিক্ষা, ‘তাই বয়স জেনে নেয়া ভালো। ভুল হয়ে থাকলে যেন শুধরে নিতে পারি।’

সারল্যে ভরপুর আশ্চর্য ছেলেমানুষী মুখটা তোলে আফরিন। একটু মলিন হয়, শিথিল দেখায়।
‘আমার বয়স যে কত তা আমি নিজেও জানি না ঠিকমতো…’ মুখের হাসিটা যেন বিদ্রুপ করে ওঠে ওকে। তিতিক্ষা বিমর্ষ হয়ে চেয়ে রয়। কি সরল মুখটায় কি জটিল কথা!
আফরিন নিজের খেয়ালে বলে যাচ্ছে, ‘তবে চাচি কইছিল এই পৌষে ঊনিশে পরব।
কি হইলো? নিজের বয়স ঠিকঠাক জানি না শুইনা অবাক হইছেন?
আসলে মা নাই তো। আব্বাও নানান খেয়ালে থাকে। আমি ছোডকাল থাইকা একাই বড় হইছি। আদরযত্ন যা পাইবার সব পাইছি চাচি আম্মার কাছে। সে ই বা আর কতদিক দেখব কন? তাছাড়া গেরাম বয়সের হিসাবও বড় একটা রাখে না কেউ।’

‘তোমার তো অনেক দুঃখ! আল্লাহ তোমার সহায় হোন। আমিন।
আমারো মা নেই জানো? আর… গত পৌষে আমার ঊনিশে পড়েছে। বেশকিছু মিল আছে আমাদের দেখছি! গুণে গুণে এক বছরের বড় আমি তোমার!’

চোখেচোখে হয়ে গেল সামান্য হাসির বিনিময়। আফরিন আবারো পূর্বানুরূপ সপ্রতিভ।
হেসে বলে, ‘আপনি খুব ভালা মানুষ। যেমন সুন্দর তেমনি মিশুক। অথচ নিনাদ ভাই কি না কিই কইছিল আমারে……’

সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে তিতিক্ষা, ‘কি… কি বলেছিল তোমার নিনাদ ভাই?’

আফরিন ফের মাথা নুইয়ে শাড়িতে আঙুল পেচাতে থাকে,’সেইসব আজেবাজে কথা। আপনার শুইনা কাম নাই… আপনি দুঃখ পাইবেন।’

‘না না… আজেবাজে কথা হলই বা! আমি ভুল করে না থাকলে দুঃখ কেন পাব? বলো শুনি, কি বলেছেন উনি!’

আফরিন উভয়সংকটে পড়ল। ভাবাবেগে মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেছিল কথাটা, দারুণ ফ্যাসাদে পড়া গেল দেখছি!
ইতস্তত করে সে বলে, ‘নিনাদ ভাইয়ের মাথাভর্তি কিলবিল করে কূটবুদ্ধি। সবকিছু নিয়া ফাইজলামি করা চাই ই চাই… বাড়িত গেলে সারাদিন কিছু না কিছু নিয়া আমার সঙ্গে ঝগড়া করতেই থাকে…’

তিতিক্ষা স্পষ্টতই বুঝতে পারছে নিনাদের দোষ ঢাকার জন্য আসল কথাটা বলার আগে তার হয়ে সাফাই গাইছে আফরিন। ও কিছু বলল না। আফরিনকে কথা শেষ করার সুযোগ দিল।
‘আর শুধু ঢাকার গল্প… ঢাকায় থাহা তার কাছের মানুষজনের গল্প। তেমনি মাঝে মাঝে কইতো বড় আপার কথা, আপনের কথা…
তিহা আপা আর নিমি না কি জানি নাম… ওই আপা… দুজনরে তো আমি আগে থাইকা চিনি। ভিডিয়ো কলে আমার লগে কথা কওয়ায়া দিছিল নিনাদ ভাই। চিনতাম না শুধু আপনারে। তার মুখে শুনতাম আপনার কথা। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা। হি হি… শুইনা হাসি থামাইতে পারতাম না।
কইতো আমি যেইখানে থাকি ওইখানে একটা নাগিনী আছে বুঝলি! আমারে দেখলেই হিস্ হিস্ কইরা ফণা তুইলা ছোবল দিতে আসে… কতবার দুঃস্বপ্ন দেখছি নাগিনীর ছোবলে আমার সারা শরীর বিষে নীল হয়া গেছে….. উউহ…. কি ভয়ংকর! ওরে দেখলেই ডর লাগে আমার।’ বলতে বলতে হাসিতে ভরে উঠছিল আফরিনের মুখ। নিনাদের এইসব ছেলেমানুষী কথাবার্তা যেন ওর কত প্রিয়। কথার মাঝখানে হঠাৎ সচকিত হয়ে থেমে দাঁতে জিভ কাটে আফরিন, ‘ছিঃ ছিঃ… কিসব কইতাছি আমি! আমার মুখের লাগাম নাই। বড় বেহায়া মুখ আমার।
আর নিনাদ ভাইয়ের কথার এমনি ধরন। আমারে খেপানোর জন্যও কতকিছু কয়… আপনে রাগ করছেন?’

দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিল তিতিক্ষা। বহু কষ্টে মুখে একফালি চতুর হাসির আভাস এনে বলল,’বাহ! এত ভালো ভালো কথা বলেছে আমার নামে! আমাকে যে কেউ নাগিনীর সঙ্গে তুলনা করতে পারে, দুঃস্বপ্নেও এতটা ভয় পায় জেনে প্রীত হলাম!’

‘তা আফরিন, তোমার সাথে বুঝি নিনাদ ভাইয়ের খুব ভাব?’

লজ্জার ঈষদুষ্ণ জড়িমায় সিক্ত হয়ে ওঠে আফরিনের মুখ,’হুম… বাড়িতে গেলে তো নিনাদ ভাই সারাদিন আমার সাথেই গল্প করে। আর আমি যা যা বলি শহর থাইকা সব কিইনা নিয়া যায় আমার জইন্য।’

রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়ানোর নরম ভঙ্গিটায় চির ধরে। নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তিতিক্ষা। চোখের দৃষ্টিতে সামান্য কাঠিন্য খেলে যায়। যা জানার সব জানা হয়ে গেছে ওর। সকলকে দেখিয়ে বেরানো নিনাদের ভালোমানুষির পেছনে আসল রূপ তবে এই!
কালো মেঘের পসরা দুরন্ত বেগে ছুটে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে ব্যাস্ত কণ্ঠে তিতিক্ষা বলে,’ভেতরে যাই চলো। বোধহয় বৃষ্টি নামবে এখনি…’

ওরা ঘরে ফিরে আসে। তিহা কিংবা শিউলি ফুআম্মা নেই ভেতরে। রান্নাঘর থেকে ঝিরিঝিরি কথার বৃষ্টি ভেসে আসে। আফরিন সেদিকে পা বাড়ায়। তিতিক্ষাকেও সঙ্গে আসতে বলে।
‘আসরের আযান দিয়েছে। সলাত টা পড়ে তারপর যাই? তুমিও পড়বে তো?’
নির্মোহ শান্ত আহ্বান। এই আবাহনকে অগ্রাহ্য করতে পারে এমন পাষাণ হৃদয় কার আছে?
আফরিন অপ্রস্তুত হাসে,’মাঝে মাঝে তো পড়ি। আচ্ছা, খাড়ান ওযু কইরা আসি।’

মেয়েটা ওযু করে এসে দেখে ঘরের পশ্চিমমুখে দুটো মুসল্লা পাতা রয়েছে। একটাতে ওরই অপেক্ষায় তখনো দাঁড়িয়ে তিতিক্ষা। তিতিক্ষার ওযু ছিল। মুসল্লায় দাঁড়িয়ে থেকে মিহি হাসি ছুড়ে দিল আফরিনের দিকে,’এসো একসাথে সলাত পড়ি।’

.

বাড়িতে প্রতিটা বিকেল তিতিক্ষার কাটে ছোটনের সাথে। হোক ঘুম, খেলা কিংবা ঘুরাঘুরি। বিকেল হলেই মিমিকে ছোটনের চাই। সলাত শেষ করে আফরিন চলে গেল রান্নাঘরে। তিতিক্ষা যাবার আগে একবার ছোটনের খোঁজে বেরিয়ে এদিক সেদিক তাকাল। এখানে আসার পর থেকেই ছোটন ওর দৃষ্টিসীমা থেকে একেবারে উধাও। তিহা আফরিন সবাই রান্নাঘরে। নিনাদ মসজিদে। বাচ্চাটা অতক্ষণ একা একা কি করছে কে জানে! একঝলক না দেখলে মন শান্ত হবে না। তিতিক্ষা বাইরের ঘরে পা বাড়ায়। নতুন খেলনা, চিপসের খোলা প্যাকেট কার্পেটের ওপর পড়ে আছে। আর মহাশয় ঘুমাচ্ছেন সোফায়। তিতিক্ষা পাশে এসে বসল। ছোটনের গালের ওপর রক্তে বোঝাই একটা মশা আরামে বসে ছিল। দ্রুত ওড়না দিয়ে বাচ্চাটার সারা গায়ে বাতাস দিল সে। বালিশ বিহীন মাথাটা তুলে নিল নিজের কোলে।

সন্ধ্যের বেশি বাকি নেই বোধহয়। ছোটনকে ডাকতে যাচ্ছিল তিতিক্ষা। থেমে যায় দরজার নব ঘোরানোর শব্দে। নিনাদ এসেছে নিশ্চিত। রক্ষে যে এই ঘরের দরজাটা প্রায় ভিড়ানো। ওড়নার প্রান্ত আরো খানিকটা ছড়িয়ে দিয়ে ছোটনের গা ঘেঁষে চুপচাপ বসে থাকে তিতিক্ষা। নিনাদ নিশ্চয়ই সরাসরি এখানে চলে আসবে না? এলেও পেছন থেকে ওকে দেখলেই ফিরে যাবে।

মাথা থেকে টুপি নামিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বাসার ভেতরে আসে নিনাদ। ওর কাছে চাবি ছিল বলে কলিংবেল দেয়ার প্রয়োজন পরেনি। তবুও নিনাদ এসেছে কিভাবে যেন টের পেয়ে ছুটে এলো আফরিন। ওদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে বসে দরজার ফাঁকে দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করতে থাকে তিতিক্ষা। এই দুজনের ব্যাপার টা কি, আর কতদূর গড়িয়েছে আজ সে দেখে ছাড়বে। তিড়িংতিড়িং ছুটে আসা আফরিনের কাছে হাতের ঠোঙাটা হস্তান্তর করেই ঘুরে দরজার নব ঘোরানোয় মনোযোগ দিল নিনাদ। আফরিন অস্থির হাতে জায়গায় দাঁড়িয়েই ঠোঙা খোলে। গরম গরম জিলাপি দেখে ভ্রু কুচকে বলে,’ওমা, এত জিলাপি!
জিলাপি না আপনের দুই চোক্ষের বিষ?’

অনেকক্ষণ ধরে দরজার কাছে নিনাদ আছে। জুতা খুলে যথাস্থানে রাখল, চাবি ওপরে তুলে রাখল। এর ফাঁকে আফরিনের প্রশ্নের উত্তর দিল কিঞ্চিৎ গম্ভীর গলায়,’আমি না ই খাইলাম। বাকিরা খাইতে দোষ কি?
কেন, তুই খাস না জিলাপি?’ তিতিক্ষা খেয়াল করে আফরিনের সঙ্গে কথা বলার সময় নিনাদ তার আঞ্চলিক টান বজায় রাখছে।

‘আমি! আমিও তো খাই না। আপনার কথা শুইনাই তো জিলাপি খাওয়া ছাড়ছি আমি! খালি কইতেন জিলাপি নাকি কেঁচোর মতো দেহা যায়.. গা শিরশির করে… সেইকথা শুইনাই তো….
আর চাচি আম্মার না ডায়াবেটিস? ভুইলা গেলেন? এহন এত জিলাপি….’ কথাটা শেষ করা হলো না আফরিনের।

‘সাধে কি তোরে গাধী ডাকি?’ বলে মেদুর হেসে আফরিনের মাথায় একটা গাট্টা মেরে চলে গেল নিনাদ। আফরিন মাথায় হাত ঘঁষল, ভুল কি বলেছে বুঝতে না পেরে ঠোঁট উলটে হেসে ফেলল। তারপর দৌড়ে ছুটে গেল রান্নাঘরে ফুআম্মার কাছে।

দৃশ্যটা দেখে অবচেতনে তিতিক্ষাও কিঞ্চিৎ হাসল। আফরিন মেয়েটা সত্যি বড় মিষ্টি। কিন্তু অতিসত্বর মুগ্ধ ভাব কেটে গিয়ে আবারো মনের ভেতর ডালপালা মেলে দুর্বোধ্য কিছু ভাবনা। নিনাদ আফরিন জিলাপি খায় না, ফুআম্মারো ডায়াবেটিস, আর বুবু তো মিষ্টি কোনো খাবারই পছন্দ করে না। এই তথ্য নিনাদের নিশ্চই জানা ছিল? তবুও সব ছেড়ে ও জিলাপিই আনলো কেন?
তিতিক্ষার পছন্দ বলেই নয়তো?

ধুর! কিসব উদ্ভট কথা ভাবছে সে। নিনাদ অত কিছু ভেবে আনেনি নিশ্চই। সামনে পেয়েছে নিয়ে চলে এসেছে। কিন্তু এখন খচখচানি আরেক জায়গায়। এই অল্পসময়ের দেখায় আফরিনের নিনাদের সম্পর্কটা ঠিক কোন পর্যায়ের কিছুতেই অনুধাবন করতে পারল না তিতিক্ষা। ওদের কথাবার্তায় তো কোনো অস্বাভাবিকতা নেই! কি হবার ছিল আর কি হলো… আচ্ছা, এমন নয়তো যে তিতিক্ষাকে দেখেই নিনাদ এই মাত্রাতিরিক্ত নির্লিপ্ততাটা দেখাল? কম সেয়ানা তো নয়! নইলে কি আর ভার্সিটিতে শ’খানেক ললনার সঙ্গে একই তালে প্রণয় প্রণয় খেলা খেলতে পারে?

.

বাইরে তুমুল বৃষ্টি। দিন ফুড়োবার আগেই শুক্রবারের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে নেমেছে অঝোর বারিধারা। দুইবোনের আর চিন্তার অন্ত নেই। এই বৃষ্টি না থামলে আজ কি করে বাড়ি ফিরবে ওরা! সঙ্গে আবার একটা বাচ্চা।
এদিকে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। বাবা বাড়িতে একা আছেন। তিহা তিতিক্ষা আর ছোটন… তিনজনের চিন্তান্বিত মুখের পানে চেয়ে খানিক করুণা করেও বৃষ্টি এবার একটু থামার নাম করতে পারে না?
শুক্রবার বাদ আছর, দুআ কবুলের মোক্ষম সময়। ভেতরের ঘরে বসে দুহাত তুলে দুআ করে তিতিক্ষা। আর সবকিছুর পাশাপশি নিরাপদে বাড়ি ফেরার তাউফিক চেয়ে নেয়। এত বেলা অবধি বাবা একা আছেন, কল রিসিভ করছেন না অনেকক্ষণ যাবত, ভাবলে বুকে পানি থাকছে না।

তার ওপর এখানের কিছু বিক্ষিপ্ত অপ্রিয় মুহুর্ত। বারবার চেতনার ছায়াপথে একটা কথা আর একটা দৃশ্য ঝিলিক দিয়ে যায়। নিনাদ ওকে আফরিনের সামনে জঘন্য এক উপমায় উপস্থাপন করেছে আর শেষ বিকেলে ওদের সেই চোখেচোখে দৃষ্টির বিনিময়, নিনাদের প্রস্থানের পর আফরিনের অনাভাসিত হাসি।
যতবার এসব ভাবছে তিক্ততার বিষে নীলাক্ত হয়ে পড়ছে ওর অন্তঃকরণ।

এখানকার প্রতিটা ক্ষণ বিষাক্ত লাগছে। লোকলজ্জার ভয় না থাকলে এক্ষুণি ছুটে বেরিয়ে যেত সে। বৃষ্টিরও যেন থামতে নেই আজ! কত বেলা হলো, শহর তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে এলো অথচ বৃষ্টির কড়াল তীক্ষ্ণ তান বিরতিহীন বাজছে।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পরার কথাও দু একবার মনে উঁকি দিয়ে গেল। কিন্তু অচিরেই সেই চিন্তা বাদ দিলে হলো ছোটনের কথা ভেবে।

অবশেষে রাতের প্রথম প্রহরে বৃষ্টি তার গতিতে কিছুটা লাগাম টানল। একে তো বৃষ্টি, তার ওপর আবার ছুটির দিন। সেজন্যই বোধহয় আজ রাস্তাঘাট অন্য দিনের তুলনায় বেশ ফাঁকা। নিনাদ ওদের একা ছাড়তে রাজি হলো না কিছুতেই। তিহা সে প্রস্তাব বারবার প্রত্যাখ্যান করছিল শিউলির কথা ভেবে। এই রাতে দুজন মেয়ে মানুষ কে একা ফেলে নিনাদ ওদের সঙ্গে চলে যাবে… তিনি হয়তো নিনাদের অতটা আন্তরিকতার বাড়াবাড়ি পছন্দ নাও করতে পারেন। কিন্তু দেখা গেল শিউলি ফুআম্মার নিজের আগ্রহও কম নয়। ফলাফল অত নিষেধের পরও শেষতক ক্যাব ডেকে ওদের সঙ্গে উঠে গেল নিনাদ।

মাঝ পথে বৃষ্টির তোড় আবারো বাড়ল। বাড়ির সামনে ক্যাব থামতেই সবার আগে ক্যাব ছাড়ল তিতিক্ষা। মারুফ পড়িমরি করে একটা ছাতা নিয়ে ছুটে আসছিলেন, বৃষ্টির হাত থেকে গা বাচিয়ে যেতে হলে বুবুর পাশাপাশি নিনাদের সঙ্গেও একই ছাতা ভাগাভাগি করতে হয়। ভেবে বৃষ্টির মধ্যেই উঠোনে নেমে গটাগট হেঁটে ভেতরে চলে গেল তিতিক্ষা। নিজের ঘরে গিয়ে দ্বার রুদ্ধ করল তৎক্ষনাৎ।

.

তিহা একপ্রকার জোর করে নিনাদ কে নিয়ে এল ভেতরে। সে ভিজেছে সবচেয়ে বেশি। ক্যাবের খোঁজে শুরুতেই পথে নামতে হয়েছিল ওকে।
ভেতরে এসে দেখা গেল তিতিক্ষা আগে থেকেই দরজার ছিটকিনি এঁটে বসে আছে। বাইরে বিষম গোলমাল, ছোটন নিনাদ সব ভিজে একাকার, একটু চায়ের পানি বসানোও জরুরি। এদিকে মহারাণী নিজেকে নিয়ে পড়েছেন। মেজাজ চড়ে গেল তক্ষনি। দরজার সামনে এসে বিরক্তি মেশানো স্বরে ব্যাস্ত হয়ে তিহা ডাকল,’এসেই দরজা বন্ধ করলি কেন? ছেলেটা ভেজা গায়ে বাইরের ঘরে বসে আছে। গামছা-টামছা কিছু একটা দে। এদিকে ছোটনের মাথাও ভিজে গেছে।রাতেই না আবার জ্বরে পড়ে। ওর বাবা তাহলে আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে! বাবাও নাকি সন্ধ্যা থেকে চা-পানি কিছু খায়নি। কোথায় কাজে সাহায্য করবি তা না…. খিল এঁটে বসে আছিস! জলদি বেরো।’

বাধ্য হয়ে পানসে মুখে দরজা খোলে তিতিক্ষা। ভেজা বোরকা আর পোশাকের বদলে ওর গায়ে তখন একপ্রস্ত নতুন জামা। মুখের ভাব শান্ত গম্ভীর।
ওয়ারড্রব থেকে একখানা নতুন তোয়ালে এনে এগোল বসার ঘরের দিকে। কিছুদূর এগিয়ে দেয়ালের এপাশ থেকে ছুড়ে মারল নিনাদের সামনের সোফায়। কাজ শেষ করে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে হাটা ধরল রান্নাঘরের দিকে। চুলা জ্বালিয়ে কেতলিতে পানি বসাল চায়ের জন্য।

নিনাদ বসার ঘরে একাই ছিল। চুল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি। এরকম ভিজে জবজবে গায়ে অন্যের বাড়িতে, অন্যের সোফায় বসতে খারাপ লাগে। কিন্তু না বসে উপায় নেই। নয়তো এ নিয়েও ঝগড়া বাঁধাবে তিহা। ভিজে চুলে আঙুল চালাতে চালাতে এসব ভাবে নিনাদ। আচমকা তোয়ালেটা এসে ওর সামনে পড়ে। সচকিত হয়ে দরজার পানে তাকায় নিনাদ। ততক্ষনে তিতিক্ষা অদৃশ্য। এটা নিশ্চিত ভাবে ছোট গিন্নি কাজ। সাধে কি আর সাপের সঙ্গে তুলনা দেয়?

একটা পরিণত উষ্ণ গন্ধ বাতাসে ভেসে ভেসে একসময় এসে বাড়ি খায় নিনাদের নাকে। মাথা মুছতে মুছতে গন্ধের আবেশে কেমন যেন হয়ে দূরবর্তী ভাবনায় খেই হারিয়ে ফেলে নিনাদের মনটা। প্রকট সুঘ্রাণ বিশিষ্ট চা পাতার গন্ধ। নিশ্চয়ই সাধারণ চা পাতা নয়। এসব ছোট ছোট ব্যপারে তিতিক্ষা বেশ শৌখিন। শুনেছে মাঝে মাঝেই নাকি শ্রীমঙ্গল থেকে চা পাতা আনায়। বৃষ্টির ভেজা গন্ধ সেই ঘ্রাণকে আরও প্রবল করে তুলেছে। এই চা-পাতার ঘ্রাণ, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা চামচ নাড়ানোর ক্ষীণ আওয়াজ, ঘরের থমকে থাকা আবহ… সব নিয়ে সুখানুভবের অন্যরকম সুরসঙ্গতি। এইসব অপরিচিত, অনাদি অনুভব, সুখের নিতান্ত ছাপোষা কিছু সরঞ্জাম…. বারবার এখানে ছুটে আসতে বাধ্য করে নিনাদকে।

একখানা ছিপছিপে সাজানো বাড়ি তারও আছে। আছে একান্ত একার সংসার। অথচ ওই নির্জন কুটিরে এমন সুখ তো নেই! কিসেরই বা অভাব ওর? এই প্রশ্নের একটাই উত্তর ক্ষনে ক্ষনে নিনাদের কানে এসে ঠেকে ‘মানুষের অভাব’!
মানুষের ঐচ্ছিক অনৈচ্ছিক সমস্ত কথা, হাসি, আচরণে যে ঘরের দেয়াল মুখরিত হয়নি, আদতে প্রাণের সঞ্চারও সেখানে নেই। সেজন্যই তার সংসার আছে, সংসারের যাবতীয় সরঞ্জাম আছে অথচ এমনি সুখ সুখ অনুভব সেথায় নেই।

অগোছালো আরো অনেক ভাবনা একে একে এসে ভিড়তে থাকে নিনাদের নিবিড় মনে। কিছু কিছু অভাববোধ আবারো ওকে খোঁচাতে শুরু করে। ভাবতে ভাবতে একা বসে প্রলম্বিত নিশ্বাস ফেলে নিনাদ।
চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে