Wednesday, June 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 291



চাঁদের বাড়ি বহুদূর পর্ব-০৫

0

#চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(৫ম পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

মায়া বাসায় ফিরছে। আমিও মায়ার খবর শুনে ওদের বাসায় গেলাম। মায়া কোথায় গিয়েছিলো তা প্রকাশ করছে না। ওর বাবা বারেবার জিজ্ঞেস করছে, কিন্তু মায়ার মুখে কোনো জবাব নেই। মায়ার বাবা প্রচন্ডভাবে রেগে আছে।

আমিও ভেবেছিলাম কিছু একটা বলবো,কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কিছু বলার সাহস পেলাম না। মায়া যেহেতু ফিরে এসেছে,কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস নিলাম। কিন্তু আমার মাঝেও প্রশ্ন মায়া এতদিন কোথায় ছিলো,এবং কেনোই বা এমন করলো। মায়ার কারণে তো আমি ফেঁসে যাচ্ছিলাম। ওর কারণে কয়েকবার আবার থানায় যেতে হয়েছে।

মায়া আমাকে সন্ধ্যা বেলায় ফোন করলো। ফোন করেই হঠাৎ বলে উঠলো….

– আবিদ তুমি আমাকে দুই এক দিনের ভেতরে বিয়ে করতে পারবে?

– তুমি যখন বলবে তখনই পারবো।

– কিন্তু একটা শর্ত আছে।

– বলো কি শর্ত!

– আমাকে বিয়ের পরে তুমি কারো পরিচয় দিতে পারবে না শুধু আমি ছাড়া।

– এটা কেমন কথা?

– তুমি যদি পারো তাহলে তোমাকে আমি বিয়ে করতে রাজি আছি।

– আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমার মা…

– দেখো আমি কোনো অযুহাত শুনতে চাচ্ছি না৷ আরেকটা কথা তুমি যেমন তোমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না, তেমনি আমিও আমার ফ্যামিলি ছেড়ে দূরে থাকবো। তোমার যেমন বাবার বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ি থাকবে না, ঠিক আমার বেলায়ও তেমন।

– আচ্ছা ঠিক আছে। বলো কখন বিয়ে করবে?

– আরেকটা শর্ত আছে।

– আবার কি শর্ত?

– আমাদের বিয়ের সাত দিনের ভেতর দেশের বাহিরে চলে যেতে হবে। এই ক বছর আমি যেমন তোমাকে ছাড়া থাকতে পেরেছি,আরো একটা বছরও থাকতে পারবো। আর হ্যা তুমি আমাকে এক বছরের ভেতরে তোমার কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। এই একটা বছর আমি দূরে কোথাও থাকবো।

– আর কি করতে হবে শুনি?

– আমি আর কিছুই চাই না।

– রাতে আসব? বের হতে পারবে?

– না, বিয়ের দিন দেখা হবে আমাদের।

– কোথায় কিভাবে বিয়েটা হবে আমাদের?

– সেটা আমি ব্যবস্থা করবো। তুমি পুরুষ হয়ে স্ট্রংলি যেহেতু কিছুই করতে পারলে না, তাই আমারই করতে হবে সব কিছু। আর হ্যাঁ তুমি আগে ভেবে চিন্তা করে দেখো আমার শর্ত মানতে পারবে কিনা।

– তুমি তাহলে তোমার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে কেনো?

– ছোট মানুষের মত প্রশ্ন করো না তো। বিয়েটা তো হচ্ছে না তাই না?

– হ্যা তা অবশ্য ঠিক।

মায়ার কথা শুনে আমি বেশ অবাক হয়েছি। হঠাৎ করে মায়ার এমন চিন্তাভাবনার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তিনদিন নিখোঁজ হওয়ার পরে হঠাৎ এসে এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিলো। আমিও মায়ার শর্তে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ আমি মায়াকে হারাতে চাই না৷ মায়া কখনো এমন বলেনি সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করবে। ও সব সময় বলে এসেছে পরিবারের সম্মতি ছাড়া বিয়ে করতে পারবে না। এখন নিজের ইচ্ছাতেই আমাকে বিয়েটা করছে।

আমি ভাবলাম মায়ের সাথে বিষয়টা শেয়ার করি। কিন্তু পরে মনে হলো এইটা যদি আমার বাবা কোনোভাবে জানতে পারে তাহলে সে অনেক ঝামেলা করে বসবে। তাই কাউকে কিছুই জানালাম না।

আমার বাবা আমাকে এসে বললেন,

– মায়া তো ফিরে এসেছে। এখন ঝামেলা মুক্ত। কিন্তু তুমি কি করতে চাও?

– আমি কি করতে চাই বলতে?

– তোমাকে দেশে এনেছি বিয়ে দেওয়ার জন্য।

– ওহ আচ্ছা। আমার তো একটাই কথা। বিয়ে করলে মায়াকেই করবো,নাহলে কাউকেই করব না।

– এটাই শেষ কথা?

– হ্যাঁ!

– তাহলে তোমার যেটা ইচ্ছে হয় সেটাই করো। তবে মায়াকে বাদ দিয়ে। তুমি যদি মায়াকে ধরেই থাকো তাহলে কারো জন্য মঙ্গল হবে না।

– দেখেন বিয়ে করে সংসারটা আমিই করবো, তাই বিয়ের সিদ্ধান্ত একান্তই আমার। আমি আমার ভালোবাসার কথা জানিয়েছি, আপনি যদি রাজি হন তাহলে ভালো,আর রাজি না হলে আপনার মতের বাহিরে যেতে হবে।

– তাই?

– হ্যাঁ তাই।

আমি বাবার সাথে আগে এমন ভাবে ব্যবহার করিনি কখনো। কিন্তু ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করলে নিজেকে কঠোর বানাতে হয়। আর মায়া যে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তাই বলে ব্যপারটা এমন না। দিন যতই যাচ্ছে ততই আমাকে প্রেশার দিয়ে চ্যাপ্টা করে দিচ্ছে।

এর পরে সপ্তাহ খানেক ভালোই চলছিলাম। সব কিছু আস্তে আস্তে স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসছে। মায়াকেও বিয়ের চাপ দিচ্ছে না আর অন্যদিকে বাবাও আমাকে কিছু বলছে না। মায়াকে এর মধ্যে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি ‘আমরা বিয়েটা কবে করব?’। মায়ার কাছ থেকে সঠিক কোনো এন্সার আমি পাইনি। তবুও স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারছি।

হঠাৎ করে আমার কিছু টাকার প্রয়োজন হয়। বাবার কাছে চাইতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। আমাকে জবাবে তিনি বললেন…

– যার সিদ্ধান্ত সে নিজেই একা নিতে পারে,তার বাবাকে কোনো প্রয়োজন হয়না। আমি কোনো টাকা পয়সা দিতে পারবো না। আমার কাছে টাকা নেই।

– পাঁচবছরে আমি যে টাকা দিয়েছি সেই টাকা কোথায়?

– জমি কিনেছি আর এই বাড়ি করেছি।

– আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে আগামীকালই।

– আমি কোনো টাকা দিতে পারবো না।

– আপনি দিতে পারবেন না তো কে দিবে? আমি তো টাকা জমাইনি। সবই আপনাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।

– তো আমি কি করবো?

– আপনি কি করবেন সেটা আমি কি জানি? আমার টাকা দরকার।

– দেখো তুমি ছুটিতে এসেছো। তাই আমি চাইনা মানুষে কোনো কিছু বলুক।

– তার মানে আপনি টাকা দিবেন না তাই তো?

– হ্যাঁ।

এখন আমার মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি নিজের জন্য কোন কিছু না করে। আজ আমি যদি পরিবারের কথা চিন্তা না করে নিজের জন্য কিছু করতাম তাহলে হয়তো আজকে এই দিনটা আমার দেখতে হতো না। আমি বিদেশ গিয়ে বাবাকে লক্ষ লক্ষ টাকা পাঠিয়েছি কিন্তু আমার যে পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রয়োজন এখন বাবার কাছে সেই টাকাটা পাচ্ছিনা। বাবার সাথে একটাই অপরাধ করেছি সেটা হচ্ছে আমার ভালবাসাকে চাওয়া। বাবার ভালোবাসার ফল এখন আমার পোহাতে হবে এটা কখনো ভাবতেই পারিনি।

আমি কি করবো ভেবে উঠতে পারছিনা। যে আমি সব সময় আমার পরিবারের কথা চিন্তা করছি সেই আমার বাবা আমার দিকে তাকালো না। কোন কিছু ভেবে উঠতে না পেরে আমি আমার মায়ের কাছে গেলাম। মাকে গিয়ে বললাম…

– বাবা আমার সাথে এমন করছে কেন? আমার প্রয়োজনে বাবার কাছে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইলাম সে আমাকে মুখের উপরে বলে দিল সে টাকা দিতে পারবে না। মা আমি তো নিজের জন্য কোন কিছুই করিনি। আমি যে টাকা ইনকাম করেছি মাস শেষে সেই টাকা বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার কাছে তো এখন কোন টাকা নেই। আমার যদি টাকার প্রয়োজন হয় আমি তাহলে কার কাছে টাকা চাইবো?

– সারা জীবন তো দেখে আসছিস তোর বাবা এমনই একজন মানুষ। সে নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে কোন কিছুই করে না। তার কাছে যেটা সঠিক মনে হয় সে সব সময় সেটাই করে।

– তুমি আমাকে হাজার পঞ্চাশেক টাকা ম্যানেজ করে দিতে পারবে?

– দেখি কি করা যায়, চিন্তা করিস না।

মায়ার সাথে আমার কথা হলো। মায়া আমাকে ফোন দিয়ে জানালো আগামীকালকেই আমরা বিয়ে করছি। বিয়ে করতে তো বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন সেই টাকাটা এখন আমার কাছে নেই। আমি মায়াকে বলতে পারছিনা যে আমার কাছে কোন টাকা নেই। তবুও মায়া যেহেতু বলেছে আমার তো কালকে বিয়ে করতেই হবে এবং বিয়ে করার সপ্তাহখানেক এর ভেতরে নাকি আমার দেশের বাইরে চলে যেতে হবে। তাই আমি আমার এক বন্ধুর কাছে কিছু টাকা চাইলাম।

পরের দিন সকালে বাসা থেকে বের হলাম মায়াকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। এরপরে যেটা আমি শুনলাম তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না…..

#চলবে……

চাঁদের বাড়ি বহুদূর পর্ব-০৪

0

#চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

মায়ার মায়ের সাথে নাকি আমার বাবার সম্পর্ক ছিলো বিয়ের আগে।
বাবার অমতের আসল কারণই এটা। বাবা আর মায়ার মায়ের সম্পর্কে জানতে পেরেছি আমাদেরই এক আত্মীয়ের কাছে।

এই কদিনে আমি বাবার আসল রহস্য বের করলাম। কিন্তু তার ব্যপারে কথাগুলো শুনে আমি ভড়কে গেলাম। মায়ার মা আর বাবার যে সম্পর্ক ছিলো এটা কোনোদিন প্রকাশ করেনি। এবং আমাদের সম্পর্ক মেনে না নেওয়ার এটাই মূল কারণ।

আগে যতটা চিন্তায় না ছিলাম এখন আমার আরো কয়েকগুণ চিন্তা বেড়ে গেলো। যদি সত্যিই এমনটা হয়ে থাকে তাহলে কোনো ভাবেই মানবে না। আর মায়া যদি জানতে পারে তাহলে তো আরো সমস্যা হয়ে যাবে।

এসবের কথা বাদ। আজ তিনদিন হয়ে গেলো মায়ার কোনো খোঁজ নেই। সম্পুর্ন চাপ এখন আমার উপরে। থানা থেকেও আমার উপরে চাপ আসছে। বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে যদি মায়াকে হাজির করতে না পারি তাহলে আমাকে জেলে ঢুকতে হবে। জেলে যাওয়ার চেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।

আমি কি করবো কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না। বাবার হেরে যাওয়ার জীবন থেকেই আমি এখন আমার ভালোবাসাকে হারাতে বসেছি। আমাদের ভালোবাসার আগে থেকে যদি আমি জানতাম তাহলে মায়ার সাথে সম্পর্কে যেতাম না। কিন্তু মাঝ পথে এখন এসব কি হচ্ছে।

আমি গুটিগুটি পায়ে বাবার সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখতেই বাবা বলে উঠলেন…

– আবিদ কিছু বলবে?

– হ্যাঁ বাবা আমার বলার আছে।

– কি বলবে বলো।

– আসলে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।

– ছয়নয় না করে যা বলার সরাসরি বলে ফেল।

– বাবা শুনেছি আপনার আর মায়ার মায়ের মাঝে নাকি আগে একটা সম্পর্ক ছিলো। বাবা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন এভাবে বলার জন্য।

– তোমাকে এসব কে বলেছে।

– বাবা আমি কোনো একজনের মাধ্যমে শুনেছি। সত্যিটা আমাকে বলুন।

বাবা চুপচাপ হয়ে গেলেন। তার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম বাবার মুখটা মলিন হয়ে আছে। আমিও তার সামনে নিরব হয়ে আছি। আমার প্রশ্নের জন্য হয়তো বাবা প্রস্তুত ছিলেন না। তার মাথাটা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন…

– যা শুনেছো সত্যি।

– কিন্তু আপনাদের জন্য আমরা শাস্তি কেনো পাবো বাবা?

– মায়ার মা আমার ভালোবাসার মানুষ ছিলো। আমাদের সম্পর্ক ছিলো মাত্র তিন বছরের। ওদের বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামেই। আমাদের যে সম্পর্ক ছিলো এটা কেউই জানতো না, আমাদের কাছের দুইএকজন ছাড়া। আমাদের যুগে মোবাইল ছিলো না। টুকিটাকি চিঠির মাধ্যমে কথা হতো। আর আমার গঞ্জে একটা দোকান ছিলো। সেখানে প্রায়ই মায়ার মা আসতো। আমরা যে প্রেম করছি তা বুঝতে কেউ পারেনি। আমাদের কথা ছিলো পালিয়ে যাবো। কারণ মায়ার বাবা সেই সময়ের মেম্বার ছিলো। এবং খুবই রাগী মানুষ ছিলো। আর আমরা তখন গ্রামে হাল চাষ করতাম এবং আমার ছোট্ট একটা দোকান ছিলো। এর চেয়ে বড় কথা হলো মায়ার মা ছিলো অনেক সুন্দরী মেয়ে। মোট কথা আমাদের সাথে এবং ওর পরিবাদের সাথে মানানোর মত অবস্থায় আমরা ছিলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নেই আমরা পালিয়ে যাবো। মায়ার মা, অহ মায়ার মায়ের নাম নূর জাহান। ওর নামটা যেমন নূর,ওর চেহারাও ছিলো নূরের মত। যাইহোক, নূর জাহান পারেনি ওর বাবার কাছে এই সম্পর্কের কথা জানাতে,আর আমিও পারিনি আমার পরিবারকে জানাতে। তাই একটাই রাস্তা ছিল আমরা পালিয়ে যাবো। সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক রেখে দিয়েছিলাম। দিন তারিখ সব কিছুই রেডি। এবং কোথায়, কার বাসায় যাবো সবই আগে থেকে আমি রেডি করে রেখেছিলো। পালিয়ে যেদিন যাবো তার দুই দিন আগে শুনি নূর জাহান বিয়ে করে নিয়েছে। সেই মূহুর্তে আমি ঠিক ছিলাম না। বলা যায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছি। আমার আব্বা মানে তোর দাদা ভাবছে আমাকে বোধহয় ভূত-জীনে ধরেছে। বিভিন্ন কবিরাজ দেখাতে থাকে। কিন্তু তারাও বুঝতে পারেনি,ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে আমি এমন হয়ে গিয়েছি। আর আমিও মুখ ফুটে এত কিছু বলিনি। কারণ আমি নূর জাহানকে ভালোবাসছি। ওর বিয়ের পরে যদি এই সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে যায়,তাহলে নূর জাহান শান্তিতে সংসার করতে পারবে না। ভালোবাসার সম্মান দেখিয়ে আমি আর ওর আর আমার সম্পর্কের কথা প্রকাশ করিনি। নূর জাহান যখন বিয়ে করে,সেই বছর মায়ার বাবা হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করে। আগেরকার দিনে গ্রামে কেউ শিক্ষক হলে তার সম্মান ছিলো অপরিসীম। গ্রামে গঞ্জে শিক্ষিতরাই শিক্ষকতার সুযোগ পায়। আর অন্যদিকে আমি ছিলাম প্রায় বলতে গেলে অশিক্ষিত। তখন আমি ধরে নিয়েছিলাম ভালো পাত্র পেয়েই নূর জাহান ওর বাবার পছন্দে বিয়ে করে নিয়েছে। সেই থেকে আমি মায়ার বাবাকে চোখে দেখতে পারতাম না।

– কিন্তু এখানে মায়ার অন্যায় কোথায়? কিংবা আমি শাস্তি পাচ্ছি কেনো?

– মায়ার কোনো অন্যায় নেই। মায়া নিতান্ত গরীব পরিবারের হলেও আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু ওইযে নূর জাহান এবং মায়ার বাবাকে যে আমি সহ্য করতে পারি না। আমার ধারণা মনে এখনো আমার সম্ভবত মায়ার বাবা এবং তোর মা এই সম্পর্কের কথা জানে না। দেখ আবিদ আমি ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি। ভালোবাসার মূল্য আমি বুঝি। কিন্তু তুই এমন একজনকে ভালোবাসলি যে কিনা আমার শত্রুদের মেয়ে। আমি কি করে মায়ার মায়ের সামনে যাবো কিংবা মায়ার মা আমার সামনে আসবে? তুই বিদেশ যাওয়ার আগে আমি জানতাম না মায়া তাদেরই মেয়ে। তুই চলে যাওয়ার পরে যখন মানুষ কানাঘুষা করছিলো তখন আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি মায়ার পরিবার সম্পর্কে। এর পরে ভেবেছিলাম এই সম্পর্ক হয়তো থাকবে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত মায়া তোর অপেক্ষায় থাকবে বুঝতে পারিনি।

– বাবা আপনি আগেরদিনের কথা ভুলে যান আমার কথা চিন্তা করে। আমার মনে হয় এখনো আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, কিন্তু আমিও যদি মায়াকে হারিয়ে ফেলি আমিও তো সারাজীবন কষ্টে থাকব বাবা।

– তোর যদি মায়াকে বিয়েই করতে হয় তাহলে তুই আমার কখনো পরিচয় দিস না। আর এই বাড়িতে মায়াকে নিয়ে কখনো আসতে পারবি না। আর না হয় আমিই এই বাড়ি থেকে চলে যাবো।

বাবার কথা শুনে আমি আর না দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেলাম। হঠাৎ করে একটা প্রশ্ন মনে জাগলো তাই আবারো বাবার কাছে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলাম…

“বাবা মায়া কোথায়?”

– সেটা আমি কি করে জানবো?

– আপনি জানেন না?

– না।

এর পরে আর কথা বাড়াতে চাইনি।

মায়ার বাবার চাপ আর অন্যদিকে থানার চাপে আমি ঠিক মত থাকতে পারছি না। এতদিন হয়ে গেলো কিন্তু মায়া নিঁখোজ এখনো। অন্যদিকে মায়ার জন্য যে ছেলে পছন্দ করে রেখেছিলো তারাও ব্যপারটা জেনে গিয়েছে। তাই তারাও বিয়েতে অমত পোষণ করছে। যাক কিছুটা বাঁচা গেলো কিন্তু মায়া? বা আমার বাবা তো যা বলার বলেই দিয়েছে। মায়া এবং আমার ভালোবাসার মাঝে যে এত কিছু ঘটার জন্য প্রস্তুত ছিলো সেটা আমি কল্পনা করতেও পারিনি। একজনের ভালোবাসার ব্যর্থতার জন্য আমাদের ভালোবাসা আজ মূল্যহীন হয়ে গেলো। এমন ভালোবাসার গল্প তো বহু রয়েছে এই পৃথিবীতে। কই তারাও তো ভালোবাসাকে পেয়েছে,কিংবা সংসার করতে পেরেছে।

অনেক রাত হলো বাবা বাবায় ফিরেনি। মা খাবার রেডি করে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। বাবার দেরি হওয়াতে মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন…

” আজ যে অনেক সময় তোর বাবার সাথে কথা বললি, সে কিছু বলেছে? দেখলাম তার মন খারাপ।”

– না সে কি বলবে?

– ভাবলাম তার মন নরম হয়েছে কিনা। আচ্ছা মায়ার সাথে কি তোর যোগাযোগ হয়েছে?

– মা কিসব বলছো? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

-আমি কিছু জানি না,মায়াকে তুই এই বাড়ির বউ করে আনবি।

আমি মনে মনে বললাম ” মা তুমি যদি কিছু জানতে তাহলে তুমিও মায়াকে দুই চোখে দেখতেও পারতে না।”

#চলবে…..
(ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। )

চাঁদের বাড়ি বহুদূর পর্ব-০৩

0

#চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(৩য় পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

মায়া নিখোঁজ! গতকাল রাতেও আমার সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু সকাল থেকে মায়াকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। সকাল শেষ হয়ে দুপুরও গড়িয়ে গেলো। কিন্তু মায়ার কোনো হদিস মিলছে না। মায়া হঠাৎ করে এভাবে হারিয়ে যাওয়ার কারণটা খুঁজে পেলাম না।

মায়ার বাবা বলাবলি করছে আমি নাকি মায়াকে লুকিয়েছি। অথচ এই ব্যপারে আমি কিছুই জানি না। মায়া এমনিতেই আমার সাথে ঠিকঠাক ভাবে কথা বলছিল না। আমি কিভাবে মায়াকে ওর বাসা থেকে সরিয়ে নিবো? মায়ার চিন্তায় আমি নিজেই শেষ হয়ে যাচ্ছি সেখানে মায়াকে আমি লুকিয়ে রাখবো কি করে। আর তাছাড়া মায়া নিজেই আমাকে বলেছে ওর বাবার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করবে। সেখানে আমার কথা মত মায়া পালিয়ে যাবে, এমনটা তো কখনোই হওয়ার কথা না।

যদি সম্ভব হতো আমি দেশে এসেই মায়াকে পালিয়ে বিয়ে করতাম,কাউকে না জানিয়েই। যেখানে আমি দেখছি আমার পরিবার মায়াকে মেনে নিচ্ছে না। সবার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েটা করাটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তা আমি করিনি। আমি যদি মায়াকে বিয়েই করতাম নিজের ইচ্ছায় তাহলে,মায়ার বাবা এই গ্রামে টিকতে পারতো না। আমার বাবা তার উপরে ক্ষমতার অপব্যবহার করতো। মায়ার পরিবারকে অপমানিত করতো। মায়ার বাবা সাদাসিধে একজন মানুষ। আর তাছাড়া মায়া কখনো চাইবে না ওর পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে। আমাকে যেমন ভালোবাসে তেমন ওর পরিবারকেও ঠিক সেরকম ভাবে ভালোবাসে। ভালোবেসে সবার অমতে গিয়ে বিয়ে ঠিকই করা যায়,কিন্তু পরিবার বিরোধিতা করলে দুজনের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার।

মায়ার নিখোঁজ হওয়াতে নাকি ওর বাবা থানায় ডায়েরি করেছে। সবার চোখ নাকি আমার দিকে। কিন্তু আমার বাবার কারণে কেউ ওপেনলি বলতে পারছে না মায়াকে আমি সরিয়েছি। থানা থেকে ফোন আসলো। আমার বাবার আমাকে নিয়ে থানায় গেলো। গিয়ে বললো…

– দেখুন আমার ছেলেকে সন্দেহ করাটা স্বাভাবিক ব্যপার। কারণ আমার ছেলের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিলো ওই মেয়েটির। আমি ওদের সম্পর্ক মেনে না নেওয়ায় মায়ার বাবা মায়ার বিয়ে ঠিক করেছে। এই দিকে আমিও আমার ছেলের জন্য মেয়ে দেখছি। খুব তাড়াতাড়ি ওর বিয়েটাও হয়ে যাবে। আমি চাইনা আমার ছেলের বিরুদ্ধে কোনো ডায়েরি থাকুক। মাত্র তিন মাসের ছুটিতে দেশে এসেছে। আপনি সাধারণ ডায়েরিটা তুলে নিন। এই নিন…

বাবা পুলিশ অফিসারের দিকে দুইটা বান্ডিল এগিয়ে দিলেন। পুলিশ অফিসার হেসে দিয়ে বললেন…

-ছি! এসবের দরকার নেই।

– রেখেদিন, চা খাবেন।

আমার ইনকামের টাকা দিয়ে বাবা অপব্যবহার করছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমি টাকা ইনকাম করেছি,আর বাবা আমার সেই টাকা যেখানে-সেখানে ঢালছে। আমি শুধু বাবার কর্মকাণ্ড দেখছি। সে একটাবারও আমার কথা চিন্তা করলো না।

আমার হাত-পায়ে শক্তি পাচ্ছি না। দেশে এসে আমি বড় ধরনের বিপদে পড়ে গেলাম। কারণ আমি যদি না আসতাম তাহলে এরকম সিচুয়েশনে আমার পরতে হতো না। নানান দিক থেকে আমি ফেঁসে যাচ্ছি । অথচ এমনটা হওয়ার কোন কথাই ছিল না। আমি যদি দেশে না আসতাম তাহলে হয়তো এত সহজেই মায়াকে আমি হারাতাম না। ওর সাথে আমার যোগাযোগ হতো কন্টিনিউ।

মায়াকে আমার যেকরেই হোক খুঁজে বের করতে হব। প্রথমত সবাই আমার দিকে আঙ্গুল তুলছে। আর দ্বিতীয়ত মায়াকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসাকে পেতে হলে অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয়। যেমন জীবনের মায়া ত্যাগ করতে হয়, আবার কোন কারনে পরিবারের মায়াও ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু আমি কোন কিছুই পারছি না কারণ আমি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, সেই পরিবারে থেকে কোন কিছুই করা সম্ভব না। আমি আমার পরিবারের বিরুদ্ধে কিছু করলে সব দ্বায়ভার নিতে হবে মায়া পরিবারের।

ইন্টার ফাইনালে ইয়ারে আমি মায়াকে যখন প্রপোজ করি..

” মায়া বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে কখন কিভাবে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি জানি না। এতদিন বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে তোমাকে ভালোবাসি কথাটা বলতে পারিনি। কিন্তু ভেবে দেখলাম সময় যতই গড়িয়ে যাবে ততই তোমাকে হারানোর ভয়টা আমার ভেতরে কাজ করবে। তাই আর দেরি না করে আমার ভালোবাসার কথাটা জানিয়ে দিলাম। প্লিজ সারাজীবন এর জন্য তুমি আমার হয়ে যাও।”

মায়া আমাকে জবাবে বলেছিলো..

” আবিদ তুমি ভালো করেই জানো আমার বাবা একজন শিক্ষক, আর তোমার বাবার রাজনৈতিক পাওয়ার আছে। তাই আমি চাইনা তোমার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করে আমার বাবাকে কথা শুনাতে। তুমি আমার সেই ছোট বেলার বন্ধুর মতই থেকে যাও।”

– দেখো মায়া ভালোবাসার কাছে, বর্ণ,ধর্ম,সমাজ কিংবা, পারিবারিক কিছুই মানে না। ভাবতে পারো এটা আমার ছেলে মানুষি, কিন্তু সত্যিই আমি ভালোবাসি। এবং তোমাকেই আমি সারাজীবন জন্য চাই।”

এর পরে আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্ক ভালোবাসায় পরিনত হয়। তারপর থেকে আমি মায়ার পরিবারের কথা চিন্তা করে বা ওর বাবার সম্মানের দিকে তাকিয়ে বাড়াবাড়ি করতে যাইনি। তা নাহলে সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি মায়াকে আপন করে নিতে পারতাম।

কিন্তু এখন নিজেকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে কিংবা অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার কারণেই মায়ার পরিবারের এই অবস্থা। এমনকি মায়াও নিখোঁজ।

দুইদিন পাড় হয়ে গেলো মায়ার কোনো সন্ধান মিললো না। মায়ার বাবা সব জায়গা খোঁজ নিয়েছে কিন্তু কারো বাসায় বা কারো কাছে মায়া যায়নি।। এক পর্যায়ে মায়ার বাবা আমাকে তার কাছে ডেকে পাঠালেন। আমি তার কাছে যাওয়ার পরে বললেন…

– আবিদ আমি তোমার বা তোমার পরিবারের কোনো ক্ষতি করেছি কিনা যানি না। কিংবা আমার মনেও পড়ছে না। তোমরা কেনো আমার সাথে এমন করছো? প্লিজ তুমি আমার মায়াকে ফিরিয়ে দাও। সামনে ওর বিয়ে, এখন মায়ার এই অবস্থা যদি ছেলে পক্ষ শুনতে পারে তাহলে কি মায়ার বিয়েটা হবে? আর তোমার বাবা যেমন তোমাদের সম্পর্ক মানবে না ঠিক তেমনি আমিও মানবো না। তোমার কাছে হাত জোর করে অনুরোধ করছি প্লিজ তুমি মায়াকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।

– চাচা আপনি কি বলছেন? মায়াকে আমিই যদি নিয়ে যাই তাহলে আমি বাড়িতে কেনো থাকবো? আর আমি তো চাইলে পালিয়ে বিয়েও করতে পারতাম। আপনারা আমাকে যেভাবে প্রশার দিচ্ছেন তা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

– দেখো আবিদ সব কিছুর পেছনে দ্বায়ী তুমি। তুমি যদি এর কোনো সমাধান না করো তাহলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।

আমি এখন কোথায় যাবো কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। সবাই এখন আমার বিরুদ্ধে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম খুব তাড়াতাড়ি দেশ ছেড়ে আমার কর্মস্থলে চলে যাবো। টিকেট কাটার জন্য এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করলাম। কিন্তু ইমিডিয়েট ভাবে টিকেটের কোনো ব্যবস্থা নেই। তিন চারদিন পরের টিকেটে যেতে হবে। তাই টিকেটটা কনফার্ম করলাম না। আরেকটু ভাবতে হবে আমাকে।

আমি যে ফোনে এজেন্সির সাথে কথা বলেছি তা আমার মা শুনে ফেলেছে। সন্ধ্যা টাইমে আমি পুকুরপাড়ে বসে আছি। মা অজু করতে আসলেন। আমাকে একা পেয়ে বললেন…

– আবিদ এভাবে হেরে গেলে তো হবে না। তোর বাবার ভয়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিস না যে মায়া আর তুই আলাদা হয়ে যাবি।

– আলাদা হতে আর দূর কোথায় মা ?

– দেখ মায়া হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে। মায়া বাড়িতে ফিরলে যেকোনো ভাবে ওকে তুই বিয়ে করে নিবি। এতদিন তো আমি সব কিছুই দেখেছি। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। আর সত্যি কথা বলতে মায়াকে আমার সেই আগে থেকেই পছন্দ। আমিও চাই মায়া আমার ছেলের বউ হয়ে এই বাড়িতে আসুক। আমি তোর মা হয়ে তোকে অর্ডার করলাম মায়াকে খুঁজে বের করে যেভাবেই হোক ওকে আমার ছেলের বউ করে আনবি। সারা জীবন তোর বাবার অত্যাচার আমি সহ্য করে গিয়েছি,তার মানে এই নয় তোরাও সেই অত্যাচার সহ্য করবি……

#চলবে…..

চাঁদের বাড়ি বহুদূর পর্ব-০২

0

#চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(২য় পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

কয়েকদিন পরেই মায়ার বিয়ে। যে ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেই ছেলে শহরে চাকরি করে। তাই ছুটি নিয়ে আসতে কয়েকদিন সময় লাগবে। আমার জানা মতে মায়া সেই ছেলেকে দেখেনি। ওর বাবার পছন্দেই মায়া মত দিয়েছে।

মায়া আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। দেখা করতে চাইলেও আমার সামনে আসছে না। আমরা একই গ্রামে থাকি,তবুও এখন মায়াকে অপরিচিত মনে হচ্ছে। আমার বাবার বন্ধুদের দিয়ে বাবাকে রিকোয়েস্ট করালাম। তাতেও কাজ হলো না। আমার বাবার একটাই কথা মায়াকে আমার বউ হিসেবে মানবে না।

এক সুত্রে জানতে পারি। গতকাল বাবা নাকি মায়াদের বাসায় গিয়েছিলো। সেই বাসায় গিয়ে মায়ার বাবাকে অনেক কথা শুনিয়ে এসেছে। মায়ার বাবা একজন প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক। তাই সে সম্মানের খাতিরে মায়ার কাছে অনুনয় বিনয় করেছে। এমনকি আমার বাবার আচরনে মায়ার কাছে খুব খারাপ লেগেছে। তাই মায়া সব কিছু চিন্তা ভাবনা করে আমার জীবন থেকে সরে যাচ্ছে।

গতকাল মায়া আমাকে বলেছিলো। আমি যদি মায়ার সাথে সিনক্রিয়েট করি কিংবা ওর পরিবারের সম্মান নিয়ে টান দেই তাহলে মায়া নাকি আত্মহত্যা করবে। মায়া খুবই জেদি মেয়ে। ছয় বছরের সম্পর্কে মায়া আমার সাথে জেদ না দেখালেও, ও খুব জেদি। যদি কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা কষ্টকর।

আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। আমাকে দেশে এনে, বাবা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। বিদেশ গিয়ে নিজের কথা না ভেবে পরিবারের কথা আমি সব সময় ভেবেছি। সবার চাওয়া পূরণ করেছি। শেষ পর্যন্ত আমার চাওয়াটা কেউ পূরণ করছে না। যখন যেটা আমার কাছে চেয়েছে,সবই আমি দিয়েছি। কিন্তু আমার বেলায় একেবারে শূন্য।

আমি সাহস করে বাবার সামনে গেলাম। গিয়ে বাবাকে বললাম….

– বাবা আমি কখনো নিজের জন্য কিছুই চাইনি। চাওয়ার ভেতর চেয়েছি বিদেশ যেতে। তাও আমার পরিবারের কথা চিন্তা করে। এর বাহিরে কিছুই আপনাদের কাছে আমি চাইনি। আমার আপনাদের কাছে প্রথম এবং শেষ চাওয়া মায়াকে। আমি মায়াকে প্রচন্ড ভালোবাসি। মায়াও আমাকে ভালোবাসে। আমি বিদেশ যাওয়ার আগে থেকেই আপনারা কিছুটা হলেও জানতেন। আপনি যদি সব কিছুতেই সিদ্ধান্ত নেন,তাহলে আমার এই জীবনের মূল্য কোথায়?

– সব সময় তোর ভালো চেয়েছি,এখনো চাই।

– প্লিজ বাবা আমাকে বলতে দেন। আমি অনেক আশা নিয়ে দেশে ফিরেছি। ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেওয়ার আনন্দ নিয়েই দেশে ফিরেছি। দেশের বাহিরে গিয়ে আমার থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। তারপরেও আপনাদের কথা চিন্তা করে কখনো কিছুই প্রকাশ করিনি আমি। যে ছেলে বাবা মাকে ছাড়া দুইটা রাত কোথাও থাকিনি,সেই আমি পাঁচটা বছর সবাইকে ছেড়ে বাহিরে সময় কাটিয়ে দিয়েছি। শুধু মাত্র আপনাদের জন্য। আপনাদের সুখের জন্য। আমি কিছুই নিজের জন্য করিনি। আমার কাছে কোনো টাকাই রাখিনি কিংবা কোনো ব্যাংক ব্যালেন্সও করিনি। মাস শেষে আপনার কাছে টাকা গুলো পাঠিয়ে দিয়েছি। নিজের চিন্তা না করে আপনাদের কথা আমি চিন্তা করেছি। সেই আপনারা কেনো আমার দিকে তাকাচ্ছেন না? বাবা কষ্ট পাবেন না। আর ভাববেন না আপনাকে আমি খোঁটা দিচ্ছি। আসলে আমার মনের কথা আমি কখনো প্রকাশ করতে পারিনি। আপনি সুযোগ দেননি। আমি শেষবারের মত বলছি। মায়াকে আমি ভালোবাসি,এই মায়াকেই আমার জীবনে লাগবে।

– মায়াকে আমি মেনে নিতে পারব না, এটাই আমার ফাইনাল কথা।

বাবার কথা শুনে প্রচন্ড ভাবে রাগ হচ্ছে এবং ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি। নিজেকে মেরুদণ্ডহীন একজন মানুষ মনে হচ্ছে এখন। যেখানে আমার কোনো সিদ্ধান্ত নেই,আমার সব কিছু যেনো শিকলে বাঁধা। আমি তো একজন মেরুদণ্ডহীন মানুষ। ইচ্ছা করছে আমিই নিজেকে শেষ করি। কিন্তু শেষ করলে তো আমার মায়াকে পাওয়া হবে না,কিংবা মায়াকে পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করা হবে না। প্রকৃত প্রেমিকরা তো পরিস্থিতির স্বীকার হয়েও পিঁছু হটে না কিংবা নিজেকে শেষ করে হার মেনে নেয় না। যে করেই হোক মায়ার বিয়ে আটকাতে হবে এবং মায়াকে আমার করে নিতে হবে।

আমার মনে আছে, মায়া এবং আমার যখন সম্পর্ক হয় তখন ওর বাবা যেনে যাওয়ার সময় অনেক মেরেছিলো। তবুও কখনো বলেনি আমাকে ভূলে যাবে। গ্রামের মেয়েরা ভালোবাসার অপরাধে মার খেলে কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। কারণ সবাই সেই মেয়েকে দেখে হাসাহাসি করে কিংবা ভালো চোখে দেখে না। সবার কাছে মনেহয় মেয়েটা ভালো না। যেসব মেয়েরা প্রেম করে তারা সমাজের কাছে খারাপ। এমনটাই মনে করে সব সময়। তাই ভালোবেসে মার বা পিটানি খাওয়ার পরেও বাসার কোণে মুখ লুকিয়ে চোখের জল ফেলতে হয়। এমনকি দিনেরপর দিন না খেয়েও কাটাতে হয়। মায়ার বেলাও সেরকমটা হয়ে ছিলো। আমি বিদেশ চলে আসার পরে ওর পরিবার ভেবেছিলো এই সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু আমাদের ভালোবাসায় কখনো কমতি হয়নি।

কোনো একজনের মাধ্যমে আমি মায়ার সাথে দেখা করার সুযোগটা পেলাম। মায়াকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম…

– মায়া কি হয়েছে? হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিলে?

– দেখো তোমার সাথে আমার কথা বলাটা এখন অন্যায় হবে। কারণ তোমার সাথে কথা বললে আমার বাবা অপমানিত হবে। তোমার জন্য ছয়টা বছর আমি অপেক্ষায় ছিলাম। এই ছয় বছরে আমার বাবা কম চেষ্টা করেনি বিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো ভাবেই আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিতে পারেনি। তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় ছিলাম। যেকোনো ভাবে আমি আমার পরিবারকে মানিয়ে রেখেছিলাম। তার মানে এই নয় যে তোমার পরিবারের সবার কথা আমার শুনতে হবে। এবং আমার বাবা-মাকে অপমানিত করতে হবে।

– কি হয়েছে সেটা তো বলবে।

– তুমি জানো গতকাল তোমার বাবা কি বলে গিয়েছে? আমি নাকি তোমার টাকার জন্য এখনো তোমার জীবনে পড়ে আছি? তুমি বলতে পারবে এই পাঁচ বছরে তোমার কাছে কখনো কোন কিছু চেয়েছি কিনা? কিংবা তোমার কাছে কখনো টাকা চেয়েছি কিনা ? অথচ তোমার বাবা গতকাল আমাদের পরিবারে এসে বেশ কিছু টাকার অফার করে, যাতে আমাদের এই সম্পর্ক কখনো না আগাই। অবশ্য আমার বাবা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল যে তোমরা আমাদের সাথে ঝামেলা করবে । তাই তুমি আসার পরপরই আমার জন্য বাবা ছেলে দেখে। তোমার পরিবার থেকে যদি আমার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো তখন হয়তো আমার বাবা রাজি হত। আমি সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু ভালোবাসার বিনিময় যে অপমানিত হতে হবে সেটা কখনো ভাবতে পারিনি।

– আমি খুবই লজ্জিত আমার বাবার কারণে। আমিও কখনো ভাবতে পারিনি বাবা এমনটা করে বসবে।

– দেখো যা হওয়ার হয়েছে। আমি আর চাইনা নতুন করে কোন ঝামেলা হোক। সব ভালবাসার সমাপ্তি সুখের হয় না, কিছু কিছু ভালোবাসার সমাপ্তি কষ্টেরও হয়। আমি এটাই মেনে নিয়েছি। বিধাতা আমাদের এক হতে দিতে চায়নি তাই আমরা এক হতে পারছি না।
তোমার কাছে আমার একটাই রিকুয়েস্ট প্লিজ কখনো তুমি আমার সাথে আর যোগাযোগ করতে এসো না।

– মায়া তুমি এসব কি বলছো?

– আমি ঠিকই বলেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। তবে আমি এটাই বুঝতে পারছি না। তোমার আমার সম্পর্কে তোমার বাবার এত সমস্যা কোথায়? কি নিয়ে তার এত আপত্তি?

– আমিও সেটা বুঝতে পারছি না।

মায়া বেশি সময় এখানে দাঁড়ালো না। আমার কাছ থেকে মায়া চলে গেলো। আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। কি করব বুঝতে পারছি না। যদি আমার বাবা বেশি ঝামেলা করে বসে, তাহলে আমি খুব তাড়াতাড়ি টিকিট কেটে দেশের বাইরে চলে যাব। আমি যদি মায়াকে না পাই তাহলে অন্য কাউকে কখনো বিয়ে করতে পারব না।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশে এসেছিলাম। কিন্তু কষ্ট নিয়ে এভাবে ফিরে যেতে হবে কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। মায়া এমন মেয়েও নয় যে আমার সাথে পালিয়ে যাবে।

তবে আমি এমন কিছু করে বসব…….

#চলবে….

চাঁদের বাড়ি বহুদূর পর্ব-০১

0

গল্পঃ #চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(১ম পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda .

পাঁচ বছর পর বিদেশ থেকে দেশে এসেছি ছুটিতে। উদ্দেশ্য হলো বিয়ে করা। যদিও আমি এই সময়টাতে দেশে আসতে চাইনি,কিন্তু পরিবারের রিকোয়েস্টে তিন মাসের ছুটিতে দেশে ফিরেছি।

যে মেয়েটি এই পাঁচ বছর আমার অপেক্ষায় ছিলো, দেশে আসার পরে সেই মেয়েকে আমার পরিবার মানতে নারাজ। আমিও আসার আগে ভাবছিলাম, আমার পরিবার খুব সহজেই মেনে নিবে।

মায়া! আমরা একই গ্রামে বড় হয়েছি। পড়াশোনায় দুজনে একই ক্লাসে ছিলাম। মায়া এবং আমার সম্পর্কের কথা এলাকার সবাই জানতো। ইন্টার ফাইনাল ইয়ারে আমাদের সম্পর্ক হয়।

বছর দেড়েক পরে পারিবারিক আর্থিক সমস্যার কারণে বিদেশ যেতে বাধ্য হই। আমি পরিবারের বড় সন্তান। তাই আমার দ্বায়িত্ব পরিবারে বেশি। তাই আমার সিদ্ধান্তেই আমি দেশের বাহিরে চলে যাই।

আমি বিদেশে যাওয়ার পরে অনেকেই মায়াকে বলেছে, বিদেশ গেলে আমি মায়াকে ভুলে যাবো। আমার জন্য আর অপেক্ষা না করতে। মায়ার পরিবার অনেক চেষ্টা করেছে বিয়ে দিয়ে দিতে। কিন্তু মায়াকে কেউ কথা শোনাতে পারেনি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মায়া আমার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।

আমি বিদেশ থাকতে মায়া আমাকে বলেছিলো,এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে মায়া যাবে। আমিও ভেবেছিলো হয়তো মায়া আসবে। কিন্তু আমার পরিবার এক পর্যায়ে মায়ার পরিবারের সাথে ঝামেলা পাকিয়ে বসে।

মায়া দেখতে অতটা সুন্দরী না হলেও আমার চোখে মায়া পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী। লেখকেরা বলে থাকেন,”প্রেমিক, প্রেমিকার চোখে ভালোবাসার মানুষটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন/ সুন্দরী মানুষ। আমার কাছেও ব্যাতিক্রম নয়।

বাড়িতে আসার পরে বিকেলে মায়ার সাথে দেখা করতে গেলাম। এত বছর পরে আমাকে দেখে মায়া কান্নার সূরে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমিও নিজের অজান্তে মায়াকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। আশপাশের মানুষ কে কি দেখলো, বুললো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। মায়া আমার ভালোবাসার মানুষ।

মায়ার সাথে দেখা করা শেষ হলে বাসায় যাই। ডাইনিং টেবিলে বসে বাবা বললেন..

– ‘আবিদ শোনো! আমরা তোমার বাবা মা। তোমার ভালো-মন্দ আমরা বুঝি। মায়ার সাথে যোগাযোগ অফ করে দাও। তোমার জন্য আমরা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি।’

আমি চুপচাপ খাবার খাচ্ছি। বাবার কথায় আমি কোনো জবাব দেইনি। মা পাশ থেকে বাবাকে চুপ করতে বললেন। কিন্তু বাবা আবারো বলে উঠলেন…

-‘আজকে মায়ার সাথে দেখা করেছো ভালো কথা। পরবর্তীতে এমনটা যেনো না হয়। এই সমাজে আমার একটা মানসম্মান আছে। ওর পরিবার আর আমার পরিবারের দিকে তাকিয়ে একবার দেখো। ওর যদি কোনো পাওনা থাকে তাহলে সেটা তুমি পরিশোধ করে দাও৷ প্রয়োজনে কিছু টাকা দিয়ে দাও।

– বাবা টাকা দিয়ে কি হবে?

– যদি সে চায় আরকি।

– আপনার কথা আমি কিছুই বুঝলাম না। ওর পরিবারের দিকে আমি তাকাতে কেনো যাবো। একবার আমাদের আগেরকার সময়ের পরিবারের দিকে তাকান। আমি যখন বিদেশ গিয়েছিলাম,পরিবারের দেনার দ্বায় মাথায় নিয়েই গিয়েছিলাম। দেখুন বাবা আমি বেশি কথা বলে আপনাকে অসম্মান কিংবা কষ্ট দিতে চাই না।

পরেরদিন সকালে বাবা ঘুম থেকে ডাকলেন। আমি ফ্রেশ হওয়ার পরে বাবা আমাকে বললেন..

– একটু পরে মেয়ে দেখতে যাবো,খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে নাও।

– মেয়ে দেখতে যাবেন আমাকে একবারো বলেছেন? আর তাছাড়া আমি যেতে পারবো না।

– আমি তাদের কথা দিয়েছি, ওয়াদার বরখেলাপ করা যাবে না।

– এই করার জন্য আমাকে দেশে এনেছেন? আমি তো দেখছি দেশে আশার পরে রীতিমতো আমাকে বাধ্য করেছেন।

– আমি তোমার বাবা, ভুলে যেও না।

– তাই বলে সবটাই আপনাদের ইচ্ছায় হবে?

– হ্যাঁ। আমরা সকলেই তোমার ভালো চাই।

বাবার সাথে আর কথা বাড়াতে গেলাম না। তার কথা মত মেয়ে দেখতে গেলাম। মেয়ে দেখে বাবার পছন্দ হয়েছে। অবশ্য আমি দেশে আসার আগেই বাবা এই মেয়ে দেখে রেখেছে এমনকি পছন্দও করেছে৷ শুধু আমার দেশে আসার অপেক্ষায় ছিলো। এখন আমি রাজী হলেই বাবা বিয়ের তারিখ ঠিকঠাক করে আসবেন। সবার সামনে আমি তাদের কাছে সময় নিলাম। মেয়ের পরিবার সময় দিতে পারলেও বাবা যেনো সময় দিতে নারাজ। আমি জোর করেই সময় নিয়ে বের হয়ে চলে আসলাম।

বাসায় আসার পরে বাবা আমার সাথে অনেক রাগারাগি করলেন। নিজের কাছে নিজেকে অসহায় মনে হলো। আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম আমি বিয়ে করতে পারবো না। আমি যদি আমার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে না পারি তাহলে কাউকেই বিয়ে করতে পারব না। যে মানুষটা আমার জন্য এতবছর অপেক্ষায় ছিলো সেই মানুষকে আমি কষ্ট দিতে পারবো না। আর তাছাড়া দুজন দুজনাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনেছি। খুব সহজেই আমি হার মানবো না।

রাতের দিকে মায়া আমাকে ফোন করে দেখা করতে বলে। আনুমানিক রাত এগারোটা হবে। আমি মায়ার সাথে দেখা করি। দেখার করার পরে, আমি যে গিফট গুলো দিয়েছিলাম মায়াকে সেগুলা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে…

– আবিদ আমি এগুলো রাখতে পারবো না। তার চেয়ে তুমি নিয়ে নাও।

– পাগল হয়ে গেছো তুমি? কত শখ করে তোমার জন্য নিয়ে আসছি জানো?

– দেখো এই দামী ফোন, গোল্ডের চেইন,ব্রেসলেট আমার সাথে মানায় না। আমি এর ওজন সইতে পারছি না। প্লিজ এগুলো ধরো। আমার বাবা দেখে ফেললে ঝামেলা হয়ে যাবে।

– কি হয়েছে আমাকে বলো না। মায়া প্লিজ।

– এখন বলার মত সময় আমার হাতে নেই,প্লিজ এগুলা নিয়ে তুমি চলে যাও।

আমাকে কিছু না বলতে দিয়ে, সব কিছু আমার হাতে রেখে মায়া এক দৌড়ে চলে গেলো। আমি রাতের অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি মায়ার চোখে জল। চোখের জল চিকচিক করছে। আমার বুকের মধ্যে কেমন জেনো একটা ধাক্কা লাগলো। বুকটার ভেতর ব্যথাও করছে কিছুনা। আমি সেখানে অনেক সময় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম মায়া আবারো আসবে। কিন্তু আসেনি। কয়েকবার ফোনও দিয়েছিলাম ফোনটাও বন্ধ। হঠাৎ করে কি হলো কিছুই বুঝলাম না। মায়া আমাকে এত ভালোবাসে, অথচ আজ প্রথমবার মায়ার ভেতর চেঞ্জ দেখতে পেলাম।

আমি দেশে আসার সময় মায়া আমাকে বলেছিলো পায়েল আনতে। এবং আমার নিজ হাতে ওর পায়ে পায়েল পড়িয়ে দিতে বলেছিলো। আমিও মায়ার জন্য,চেইন,ব্রেসলেট, পায়েল এবং ফোন এনেছিলাম কারণ মায়া তো আমারই বউ হবে। কিন্তু এখনকার মায়াকে দেখে আমার ভয় লাগলো।

এমনও হতে পারে আমার পরিবার থেকে মায়াকে কিছু বলেছে। তাই এমনটা করছে মায়া। কিন্তু মায়ার কাছে তো আমি কিছুই জানতে পারলাম না।

অনেক রাত করে বাসায় ফিরলাম। বাবা চৌকিতে বসে আছেন। বাড়িতে ঢুকতেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন…

– এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

– বাইরে। একটু কাজ ছিলো।

– তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়ো।

আমি চুপচাপ সেখান থেকে চলে আসলাম। বাবার শাসন, হুকুম দেখে নিজেকে দশ বছরের শিশু মনে হলো। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার হাত পা শিকলে বাঁধা। তারা আমাকে যেভাবে যা বলবে সেভাবেই তা করতে হবে।

পরেরদিন শুনতে পেলাম মায়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কথাটা শুনে আমার বিশ্বা হলো না। কারণ যে আমার জন্য এতবছর অপেক্ষায় ছিলো, তার অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হতে পারে না। আমি আর দেরি না করে মায়াদের বাসায় গেলাম। গিয়ে মায়াকে ডাকলাম। মায়া এসে আমাকে বললো…

– আবিদ তুমি এখন আর কোনো সিনক্রিয়েট করতে এসো না। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার ইচ্ছাতেই বিয়েতে হচ্ছে। আমি যেমন আমাকে নিয়ে ভাবছি তুমিও তোমাকে নিয়ে ভাবো এবং বিয়ে করে নাও বাবা মায়ের পছন্দ মত। প্লিজ তুমি আর বাঁধা হয়ে এসো না। প্রত্যেকটা বাবা মায়ের স্বপ্ন থাকে তাদের সন্তানদের নিয়ে। তাই আমি আমার বাবা মায়ের দিয়ে তাকাচ্ছি। তুমিও তাই করো।

– তোমার মাথা ঠিক আছে? এসব কি বলছো?

– আমার মাথা ঠিক আছে,এবং স্ব জ্ঞানে বিয়েটা মানিয়ে নিচ্ছি।

– তোমার বিয়ে আমি হতে দিবো না।

– তুমি যদি কিছু করো তাহলে আমি সুইসাইড করতে বাধ্য হবো। তুমি কি চাও এমনটা হোক।

আমার মুখ থেকে আর একটাও কথা বের হলো না। শেষ পর্যন্ত আমি মায়া মুখে কি শুনলাম। এত আশা আকাঙ্খা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে?

#চলবে….

অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#সমাপ্ত
#বর্ষা
দশদিন অতিক্রম হয়েছে।আজ ইলিয়ানার গায়ে হলুদ।একসাথেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।অনেক বন্ধু-বান্ধব ছুটি পায়নি।তাইতো ইলিয়াস চৌধুরী নিজে অনুরোধ করেছে ইলিয়ানার কাছের ফ্রেন্ডদের হাজব্যান্ডদের ছুটির জন্য।যাতে তারা আসতে পারে।

ইলিয়ানা এখন মোটামুটি সুস্থ।দেশেই তার বিয়ের আয়োজন হয়েছে। অবশ্য ইলিয়ানার সিঙ্গাপুরের সহকর্মীরাও‌ এসেছে ওর বিয়েতে।ডক্টর জোবেদা আসতে পারেননি। আমেরিকায় ছেলের কাছে গিয়েছেন দিন দুয়েক।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটা জাঁকজমকপূর্ণ।লাইটিং করা হয়েছে।ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে রিসোর্টটা।সাঈদা,মেহের ইলিয়ানাকে হলুদ শাড়িতে সাজিয়েছে।সাঈদা তো জড়িয়ে ধরে বলেই ফেললো,

—দেখলি‌ তো আমি বলেছিলাম না আল্লাহ চাইলে তুই স্যারকে পাবি।তুই স্যারকে পাচ্ছিস ইলিয়ানা।

সাঈদাকে ধরেই ইলিয়ানা ঘুরতে থাকে।আজকে যেন সেই ছোট্ট বেলার কথাটা মনে পড়ে গেলো। ছোট্ট বেলায় একবার সে বলেছিলো যে যদি ভালোবাসার মানুষটিকে পাই তবে সবার আগে তোর হাত ধরেই আমি ঘুরবো।ইচ্ছে পূরণ করলো।

স্টেজে বসে গায়ে হলুদ লাগানো হচ্ছে।ইলিয়ানার পাশেই আহান স্যার বসে। দুজনের একইসাথে হলুদ সন্ধ্যা হচ্ছে।আহান স্যারের কলিগরাও এসেছেন আজ।তবে অনেকে কানাঘুষা করছে। কেননা এত সাকসেসফুল, সুন্দরী মেয়ের সাথে সুদর্শন একজন প্রফেসরের বিয়ে হচ্ছে বলে কথা!তবে তাদের সমালোচনার মুখ্য বিষয় হচ্ছে নিশ্চয়ই চক্কর চলছিলো এদের।আবার অনেকে বলছে বয়সের কি তফাৎ,দেখবি কয়দিন বাদেই ডিভোর্স,বয়সের তো একটা মিল আছে নাকি!সবকথাই ইলিয়ানার কানে আসছে। প্রচন্ড রাগ লাগছে তার।

নুকতা ইলিয়ানার পাশে এসে বসতেই দেখে তার মাম রাগছে।চারপাশে নজর দিয়ে বিষয়টা বুঝতে সময় লাগে না নুকতার। স্পেনে বড় হওয়া ছেলেটা খুব অবুঝ কিন্তু নয়।যেহেতু মাতৃভাষা বাংলা জানে তাই বেশ বুঝেছে আত্মীয়দের কথার মানে।

—মাম মানুষের কাজই কথা বলা,মতবাদ দেওয়া। এ নিয়ে কষ্ট পেয়ো না,আর রাগও করোনা।এতে ওদের নয় বরং তোমারই ক্ষতি।গায়ে হলুদ ইঞ্জয় করো।জীবনে একবারই পাবে।

কথাটা বলেই নুকতা চোখ টিপ দেয়।ছেলেটা ইলিয়ানার সাথে পুরোপুরি মিশে গেছে।জোয়া ও রায়দা ছুটি এসে ইলিয়ানার পাশে বসে।নুকতাকে উঠিয়ে দেয়।নুকতা উঠে ইলিয়ানাকে একটু হলুদ ছুঁইয়ে নিচে নেমে আসে।নাচ,গান সোর-সারাবা চলতে থাকে।আর এদিকে টুকুর টুকুর চোখে চোখে প্রেম প্রেম খেলা খেলছি ইলিয়ানা-আহান!

ভোর থেকেই আয়োজনের শেষ নেই। একপাশে রান্নার কাজ চলছে।আরেকপাশে সুন্দর স্টেজে গান বাজনা চলছে।রিসোর্ট দুভাগে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।একপাশে মেয়েপক্ষ তো আরেকপাশে ছেলেপক্ষ। ছেলে পক্ষের ওখানে উঠেছে ইলমা আপু ,রায়হান ভাইয়েরা।তবে বাচ্চা-কাচ্চাগুলো ইলিয়ানার দিকে।

লাল বেনারসীতে অপরূপা লাগছে ইলিয়ানাকে।গায়ে ভারী গহনা।ভারী মেকআপ।পুরো সাজটাই এমেলি সাজিয়েছে।ফরেনে পার্লারে ট্রেনিং নিয়েছিলো সে।পরে পার্লারে জব না করে স্টেশনারিতে জব করেছিলো।আর সেখানেই তো প্রথম দেখা হয়েছিলো ইলিয়াসের সাথে তার।ধীরে ধীরে আলাপ।তারপর বন্ধুত্ব,প্রেম এবং বিয়ে।

গ্র্যান্ড ভাবে এন্ট্রি নেয় ইলিয়ানা।স্টেজে উঠতে হাত বারিয়ে দেয় আহান স্যার।দুজনকেই পাশাপাশি অপূর্ব লাগছে।যেন মেড ফর ইচ আদার!

বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরপরই পুলিশের আগমন হয় সেখানে। তুরহাম খন্দকার ইলিয়াস চৌধুরীর সাথে কথা বলতে চান একান্তে। ইলিয়াস হয়তো বিষয়টা বুঝতে পারে তাই একান্তে যায়।

—মি.চৌধুরী এতো রিস্কি কাজ কেন করেন?আপনার কাজে যে আপনার পরিবারের লোকেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভয় পান না?

—কি বিষয়ে বলছেন আপনি?

—আপনি কি সত্যিই জানেন না?

—না!

—আচ্ছা,শুনেন আমরা ক্রিমিনাল আটক করেছি।

—আপনারা করেছেন না কেউ সাহায্য করেছে!

ইলিয়াস চৌধুরীর কথায় চতুর তুরহাম খন্দকার যা বোঝার বুঝে ফেলে।তবে উপদেশ দিয়ে বলে,

—ডক্টর মেহতাব রাহাত কিন্তু প্রতিশোধ পরায়ণতা থেকেই ইলিয়ানার ওপর আক্রমণ করেছিলো।আমরা চেষ্টা করবো তার সর্বশাস্তির ব্যবস্থা করতে।তবে…নিজের শত্রুদের স্বীকার পরিবারকে বানাবেন না।যার পরিবার নেই সেই বোঝে পরিবারের মানে!

শেষের কথাটায় যে দুঃখ প্রকাশিত হয়েছে তা বেশ বোঝে ইলিয়াস।কারণটা তার জানা। অবশ্য তার কাছে তার কাছের মানুষদের সাথে জড়িত সব মানুষদের খবরাখবর আছে কিংবা জোগাড় হয়ে যায়।তুরহাম খন্দকার পেছন ফিরে চলে যেতে গিয়েও ফিরে এসে ইলিয়ানার দিকে দৃষ্টি রেখে ইলিয়াসকে বলে,

—আপনার থেকেও কয়েক কদম এগিয়ে মিস. ইলিয়ানা জেহের চৌধুরী।বিপর্যয়ী রমনী!

তুরহাম চলে যান। ইলিয়াস গিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে বোনের পাশে বসে।কয়েকটা ছবি তুলে নেয় স্মৃতির পাতায় জুড়ে দেয়।ইলিয়াস সবাইকে খেতে পাঠিয়ে দেয় লোক দিয়ে।ইলিয়ানা আর আহান স্যার কথোপকথনের সময় পায়।

—তো মিশন শুরু করবো আজ থেকেই।কি বলো?

—কিসের মিশন?

—দ্রুত বেবির মিশন।

—নির্লজ্জ

—তোমারই জামাই

_________________ছয়বছর পর________________

”বাবাই,বাবাই আজ তো মাম্মাম ফিরবে তাই না?”

পুচকি একটা মেয়ে‌ আহানের কাছে ছুটে এসে প্রশ্ন করে।আহান মেয়েটার কপালে চুম্বন করে।আদর করে বলে,

—হুম মাম্মাম।আজই তোমার মাম্মাম আসবে।

—চলো না আমরা কোনো সারপ্রাইজ প্ল্যান করি মাম্মামের জন্য। প্লিজ

একদম ইলিয়ানার মতো করেই আবদার করে ইরহা বিনতে আহান।আহান যেন মেয়ের মাঝে নিজের প্রিয়তমাকে খুঁজে পায়।মেয়েটা কত দ্রুতই বড় হয়ে গেছে।চার বছরে পা দিয়েছে।কি ট্যাটনা ট্যাটনা কথা বলে!

বিকেলের দিকে কলিংবেল বাজতেই আহান স্যার দরজা খুলে দেন।ইলিয়ানা লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে। ইমার্জেন্সি অপারেশনের জন্য দুই দিনের জন্য দিল্লিতে গিয়েছিলো সে।মেয়েটার জন্য যেন প্রাণটা যায় যায় অবস্থা।বাসায় এসেই আহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

”আজ আপনার স্কুল নেই?বাসায় কেন আপনি?আর আমার ইরহা কোথায়?

”সারপ্রাইজ,মাম্মাম”

আহানের পেছন থেকে ইরহা বলে ওঠে। তিনজনের ছোট্ট পরিবার ওদের।বাংলাদেশেই রয়ে গিয়েছে ইলিয়ানা।স্বামী,সন্তান নিয়ে তিন-চার সিঙ্গাপুর গেলেও স্থায়ী ভাবে থাকতে চায়নি আহান কেননা মাতৃভূমিতেই তার সব।আর ইলিয়ানাও জোর করেনি কেননা স্বামী যেখানে সম্মানবোধ নিয়ে থাকতে পারবে সেখানে সে নিজেও সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে!

ইলিয়ানা ইরহাকে জড়িয়ে ধরে। আহান কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।ইলিয়ানা মেয়ে,স্বামী দুজনকে পুরো আড়াইদিন পর একত্রে জড়িয়ে ধরে।কিছু সময় পর আহান বলে,

—ইলিয়ানা আমার না তোমার ওপর মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়….

—মানে?কি বললেন আপনি?

—আরে বাবা অন্যদিকে যেও না।আগে শুনো তো

—বলুন..শুনতাছি

—এতো লম্বা ট্রেভেল করে আসলে..আর সাওয়ার না নিয়েই মেয়েসহ আমাকে জড়িয়ে ধরলে।ডাক্তার রা তো সচেতন থাকে এইসব বিষয়ে।তাই..

—হি হি হি মাম্মাম।বাবাই তোমার ডাক্তারী নিয়ে সন্দেহ করছে!

ইলিয়ানা চোখ কাচুমাচু করে লাগেজের ওপর রাখা হ্যান্ডব্যাগ ছুঁড়ে মারে আহানের দিকে।রাগ দেখিয়ে ওয়াসরুমের দিকে চলে যায়।আহান বলে,

—তোমার পোশাক রাখা আছে।গোসল করেই বের হয়ো।

ছয় বছরের এই খুনসুটিময় জীবনটা কতশতই না ঝগড়া হয়েছে ইলিয়ানা আর আহানের।তবে ভালোবাসা কমেনি কিঞ্চিত পরিমাণ।দুজনই দুজনের প্রফেশনকে সমান সম্মান দেয়। দুজনকে সাপোর্ট করে। ওদের সম্পর্কে দুজনের ইফোর্টই সমান।শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিদিন নিজেদের সাথে সময় স্পেন্ড করতে ভুল হয়না ওদের।বেবির সময়টা তো আলাদাই।

সব ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েও অনেকসময় পায় না।তবে আহান-ইলিয়ানার ভালোবাসার পূর্ণতার প্রমাণ ইরহা।আর সুন্দর বেড়ে ওঠাই ওদের সম্পর্কের সুন্দর ভীতির মাঝে লুকিয়ে। পিতা-মাতার সম্পর্ক যতটা সুন্দর হয়, সন্তানদের বেড়ে ওঠার ওপর ততটাই ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।দোয়া রইলো এভাবে পূর্ণতা পাক সকল ভালোবাসার মানুষগুলো।তবে সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না।দুইজন সুখী হলেও অজান্তেই তৃতীয় কোনো ব্যক্তি চরমভাবে আহত হয়।যেমন ইলিয়ানা আর আহানের মিল হলেও ইলিয়ানার জন্য এখনো কাতরাচ্ছে ম্যারিও!তবে এনির জীবনে এসেছে নতুন কেউ।সুখী সেও হয়েছে তবে কয়েকদিন আগ পিছে।

সমাপ্ত

অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-১৭+১৮

0

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৭
#বর্ষা
জুনায়েদ চৌধুরীর সামনে মাথা নুইয়ে ইলিয়ানা দাঁড়িয়ে।বাবার হঠাৎ আগমনে যতটা আনন্দিত ঠিক ততটাই ভীত সে। অবশ্য জুনায়েদ চৌধুরীর কাছে আজ অব্দি সে কখনোই বকাঝকার শিকার হয়নি।তবে সে অফিস কর্মচারী এবং বাইরের জগৎ থেকে জেনেছে, জুনায়েদ চৌধুরী প্রচন্ড রাগী স্বভাবের মানুষ।

—ডেড ডেড

ইলিয়ানা শুধু ডেড ডেড সম্বোধনেই আটকে আছে।ইলিয়াস তাদের থেকে অনেকটা দূরে সোফায় বসে জেনির সাথে খেলছে। প্রায় দিন ছয়েক পর পাপাইকে কাছে পেয়ে বুকে লেপ্টে আছে।বাবা-মেয়ের সম্পর্ক তো মা-সন্তানের মতো।বাবা হয় সন্তান আর মেয়ে হয় মা।বাচ্চা মেয়েটাও কি মিষ্টি মিষ্টি শাসন করে!

এমেলি এসে পাশে দাঁড়ায় ইলিয়ানার। জুনায়েদ চৌধুরীর দৃষ্টি এখনো নিচের দিকেই।একবারও মেয়ের দিকে ফিরে তাকাচ্ছেন না।ইলিয়ানাও মাথা উঁচিয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না।বলে না যে আমায় শাসন করে কম তাকে আমি ভয় পাই বেশি,এমন ঘটনাই ঘটছে ইলিয়ানার সাথেও।এমেলি ইলিয়ানার হাতটা শক্ত করে ধরে জুনায়েদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—ডেড তুমি তো জানতে ইলিয়ানা বাংলাদেশে এসেছে।তখন যখন তুমি ওকো ক্ষমা করেছো এখনও করে দেও..

এমেলি ভাবী আর কিছুই বলতে পারেন না। জুনায়েদ চৌধুরী ফিক করে হেসে সামনে তাকান।এমেলি ভাবী বোকা বনে দাঁড়িয়ে থাকে। জুনায়েদ চৌধুরী ইলিয়ানার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

—গতকাল রাতে যখন শুনলাম ইলিয়ানার বিয়ে ঠিক হয়েছে প্রচন্ড কষ্ট পেলাম।আমি আমার মায়ের সাথে একদম রাগ করিনি।কিভাবে করি?ইলিয়ানা যে আমার মেয়ে নয় মা।আর মায়েরা তো সঠিক সিদ্ধান্তই নেয় সবসময়।তবে কষ্টটা ছিলো তীব্রতর।তাইতো মায়ের থেকে জানতে এতদূর থেকে আসলাম কেন আমার মা আমায় না জানিয়ে নিজের বিয়েটাও ঠিক করে ফেললো!

জুনায়েদ চৌধুরীর চোখে অশ্রুকণা ঝলঝল করছে।চোখ পিটপিট করলেই হয়তো গড়িয়ে পড়বে।ইলিয়ানার কষ্ট হয় নিজের ডেডের জন্য।তবে প্রাউড ফিল করে সে তার ডেডকে নিয়ে।আজ যদি তার স্থানে অন্য কোনো পিতা হতো তবে এতক্ষণে ইলিয়ানার শরীর থাকতো রক্তাক্ত, মানসিক চাপে আত্মার মৃত্যু হতো।

অবশ্য একজন সাইকোলজির স্টুডেন্টের কাছে এমনটাই প্রত্যাশা।হ্যা, জুনায়েদ চৌধুরী একজন সাইকোলজিস্ট।তবে এই বিষয়ে পড়াশোনা করলেও পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ব্যবসায়িক পেশা। সাইকোলজিস্ট হওয়ার সুবিধার্থে ক্লাইন্টকে ইমপ্রেস করতে ক্লাইন্টদের খুব সুক্ষ্ণ জিনিসকেও লক্ষ করে খুবই দুর্লভ সব প্রেজেন্টেশন তৈরি করতেন।তাইতো তার আজ এতো উন্নতি।তার দেখানো পথেই তো ইলিয়াস চলছে।

—ডেড আ’ম সরি।বাট ট্রাস্ট মি আই লাভ হিম ঠু মাচ।

ইলিয়ানার কথায় জুনায়েদ চৌধুরী মুচকি হেসে বললেন,

—আমাদের থেকেও বেশিই ভালোবাসো মনে হয় নয়তো গার্ডবিহীন শত্রুর মুখে পড়তে না তার সাথে বিয়ে করার জন্য এদেশে থেকে।

ইলিয়ানা মাথা নামিয়ে দেয়। জুনায়েদ চৌধুরীকে জড়িয়ে কেঁদে দেয়।চিৎকার করে কান্না করা যাকে বলে।এখন তারা সেই রিসোর্টে যেখানে জ্যাক ইলিয়ানার বন্ধুদের রেখেছিলো।ইলিয়ানার বন্ধুরা নিজ দেশে ফিরে গেলেও এখন রিসোর্টে আছে ইলিয়ানার পরিবার। চারপাশে অনেক গার্ড যেন দেশের কোনো বড়সর মানুষ এসেছেন এখানে।আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে স্থানীয়রা গেট থেকেই দৃষ্টিপাত করছে।তবে ততটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

ইলিয়ানা জুনায়েদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথেই কেউ গুলি করে। অবশ্য গুলিটা জুনায়েদ চৌধুরীর লাগার কথা হলেও লাগে ইলিয়ানার গায়ে।পেটের কাছে লাগে।ইলিয়ানা ভর ছেড়ে দেয় জুনায়েদ চৌধুরীর ওপরে। কয়েকজন গার্ড গুলি চালানো লোকটার পেছনে ছোটে।আর কয়েকজন ওদের সেফটি দিতে এগিয়ে আসে।ইলিয়াস ছুটে এসে জেনিকে এমেলির কোলে দিয়ে বোনকে কোলে তুলে নেয়।গার্ডকে গাড়ি বের করার আদেশ দেয়।

সকাল থেকেই ইলিয়ানার খোঁজ না পেয়ে কিছুটা হলেও চিন্তিত রায়হান ভিলার মানুষেরা।নুকতা তো একটু পরপর এসেই খোঁজ নিচ্ছে তার মাম ফিরেছে কিনা এটা।আর রাহিদ পেছনে পেছনে কিছুটা দূর থেকেই শুনছে তার পিপির খোঁজ।তবে আশানুরূপ কোনো খবরই এখনো অব্দি নেই।

ইলমা আপু চিন্তায় পাগল।এই দু’টো দিন বোনকে সে একদমই সময় দিতে পারেনি। কেননা ভিসা শেষ হওয়ায় ভিসা রিনিউ করতে দেশে আসা এনাদের। পাশাপাশি পাসপোর্টের মেয়াদও তো বাড়াতে হবে নাকি।

—হ্যা,রায়হান ইলিয়ানার খোঁজ পেয়েছো?

ইলমা আপু ফোনে চিন্তিত কন্ঠে বলেন।রায়হান ভাইয়ের বলা কথাটায় হয়তো সন্তুষ্ট হতে পারেননি ইলমা আপু।ফোন রেখে যেন আরো অস্থির হয়ে উঠেছেন।আহান স্যার ফোনের ওপর ফোন দিয়েই চলেছেন।পাগল প্রায় লোকটা। একঘন্টার লম্বা সফরে গাজীপুর এসেছেন। উদ্দেশ্য ইলিয়ানা।এখন বিকাল।

আহান স্যারের উপস্থিতিতে যেন ইলমা আপু আরো বেশি অস্থিরতা বোধ করছেন।তারিফ দুলাভাইয়ের সাথে আহান বেরিয়েছেন। আহানের অবস্থাটাও বেশি বোধগম্য নয়।মেয়েটার চিন্তায় একদম ছন্নছাড়া। চুলগুলো এলোমেলো।শার্টের হাতাও দু’টো দুরকম উচ্চতায়।

—আহান এতো চিন্তা করবেন না।ইলিয়ানা তো আর বাচ্চা নেই।

তারিফ দুলাভাইয়ের কথায় আহান স্যার সেদিকে তাকান।শক্তিহীন কন্ঠে বলেন,

—ভাই ইলিয়ানা বাচ্চা না হলেও মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের মতোই আচরণ করে।ওর কিছু হয়ে গেলে যে আমি ঠিক থাকতে পারবো না।

আহানের কন্ঠে ছিলো ইলিয়ানার প্রতি অগাধ প্রেম।বেচারা জানতেও পারছে না যে তার প্রিয়তমা কোন মুসিবতে পতিত হয়েছে। টানাহেঁচড়া হচ্ছে তাকে নিয়ে হসপিটালে। আহানের ধ্যান ভাঙে তারিফ দুলাভাইয়ের কথায়।

—আহান ইলিয়ানা হসপিটালে…

—মানে?

চিৎকার করে আহান ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।তারিফ দুলাভাই আহানের দিকে একটু তাকিয়ে সরে আসে সেখান থেকে।ইলমা আপুকে আর রায়হান ভাইকে ফোন দেয়।জানিয়ে দেয় মাত্র খবরে দেখা বিষয়টা। ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে ই.জি.সি গ্রুপের চেয়ারম্যানের মেয়ে এবং সিইও এর বোন গুলিবিদ্ধ।

হসপিটাল করিডোরে অপারেশন থিয়েটারের সাথে ঠেকনা দিয়ে বসে আছে আহান।চোখ মুখ ফোলা ফোলা।কে বলবে এই পুরুষের বয়স আটত্রিশ!

—আহান উঠে দাঁড়াও।নিজেকে শক্ত রাখো।আমি চাইনা আমার বোনের সামনে কেউ দুর্বল হয়ে দেখা করতে যাক।আমি চাইনা কারো দূর্বলতা দেখে আমার বোন আরো দুর্বল হয়ে যাক।বুঝলে?

ইলিয়াসের গম্ভীর গলায় বলা কথাগুলো শুনে আহানের মনে হলো লোকটা হয়তো এক পাষন্ড।তবে ইলিয়াসের চোখ দেখে আঁতকে উঠলো সে। রক্ত লাল! রক্ত কি চোখে উঠেছে?না উঠলে এতো লাল হলো কিভাবে!

অপারেশন থিয়েটার থেকে একটু পরেই কয়েকজন ডাক্তার বেরিয়ে আসেন।ডাক্তার জানায়,

—অপারেশন সাকসেসফুল…তবে আন্ডার অবজারভেশনে আইসিইউতেই রাখতে হবে দুই ঘন্টা।যেহেতু গুলিটা একটু জন্য কিডনি স্পর্শ করেনি।তাই জানে বাঁচলেও‌ রিস্কটা থেকেই যায়।

তানহা হাসপাতালেই আনা হয়েছে ইলিয়ানাকে।যেহেতু গত পরশুরাতে ডক্টরসদের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করেছে সেহেতু সিনিয়র অনেক ডক্টররাই গাজীপুরে ছিলো।তাই তারা দ্রুত ছুটে এসেছে তানহা হসপিটালে!

আহান এশার আযান দিতেই সাততলায় ছুটেছে।নামাজ পড়ে মোনাজাতে বসেছে।বলছে,

”হে আমার আল্লাহ,,,দশবছর পর ফিরিয়ে দিয়েও অনুগ্রহ করে কেড়ে নিবেন না।আমি যে ইলিয়ানার সাথেই ঘর বাঁধতে চাই।একসাথে জান্নাতের পথে হাঁটতে চাই। আখিরাতের জন্য একটু একটু করে গোছাতে চাই।প্লিজ আল্লাহ ইলিয়ানাকে সুস্থ করে দিন।প্লিজ আল্লাহ প্লিজ”

আহানকে প্রেয়ার করতে বাইরে থেকে একজন সাদা অ্যাপ্রোনধারী শোনে।তবে বাঁকা হাসে।বিড়বিড় করে বলে,

—অপারেশন সাকসেসফুল হোক বা না হোক।ইলিয়ানা জেহের চৌধুরীকে যে মরতেই হবে।খুব পাখা গজিয়েছে তার,এবার পাখাটা ছেঁটে ফেলতে হবে। মরতে হবে।হা হা হা

হসপিটালে পুলিশ তুরহাম খন্দকার ইনভিস্টেগেশন করছে। জুনায়েদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাঁসি হাসে।তারপর আবারো গার্ডসদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। জুনায়েদ চৌধুরীর দিকে আবারো চোড়াচোখে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে বলে,

”কে মারতে চাইলো ওই মেয়েকে?কার এতো সাহস যে ইলিয়াস চৌধুরীর বোনকে মারতে চাইছে!তবে সাহস আছে ক্রিমিনালের, খোঁজ তো লাগাতেই হচ্ছে ”

চলবে?

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৮
#বর্ষা
”পুলিশি পাহারায় আবারো আক্রমণ ”এমনই শিরোনাম প্রত্যেকটি সংবাদ পত্রের।তানহা হাসপাতালে আইসিইউতে থাকা অবস্থাতেই হামলা হয়েছে ইলিয়ানার ওপর।স্টিচ খুলে গেছে টানাহেঁচড়ায়।ব্লিডিং হওয়ায় জ্ঞান হারিয়েছে ইলিয়ানা।তবে আক্রমণ কারীকে অজ্ঞান করেই অজ্ঞাত সে।

পুলিশ অফিসার তুরহাম খন্দকার যেন নিজের ব্যর্থতা মানতেই পারছেন না।সব রাগ ঝাড়ছেন সামনের চেয়ারা বাঁধা লোকটার ওপর। ইচ্ছে মতো পিটিয়ে ঠান্ডা পানি ঢালছে কনস্টেবল নোমান। হুকুম তুরহামের।লোকটার চুলের মুঠি ধরে তুরহাম উঁচু করে ওনার মাথা।লোকটা পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে।

—কু**বাচ্চা তাড়াতাড়ি বল,কে পাঠিয়েছে তোকে এখানে?

লোকটা কিছু বলতে চায় তবে মুখ দিয়ে শব্দগুলো আটকে আটকে বের হয়।তুরহাম আরো খেপে ওঠে।কলার ধরে লোকটার কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করে,

—তোর নাম কি?

—আ আ আমার…

—তোকে যা জিজ্ঞেস করছি তা শুধু বল।পুরো বাক্য বলতে বলা হয় নাই তোকে‌

—মা..মাহিম

—এখন বল কে তোকে এইসব করতে বলছে। তাড়াতাড়ি বলবি।

তুরহামের ধমকে আর শরীরের যন্ত্রণায় আবারো জ্ঞান হারায় মাহিম।তুরহাম দাঁতে দাঁত চেপে চেয়ারে সজরে আঘাত করে।কাঠে হালকা ফাটল ধরলেও তেমন কিছু হয়নি।তবে আঘাতটা সেই পেয়েছে।

—এই কু**বাচ্চার জ্ঞান ফেরাও।

তুরহামের গালাগালিতে যেন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে থানার পুলিশ গুলো।তাইতো আর কেউ তার গালাগালিতে অস্বস্তিতে ভুগছে না।থানার বড়কর্তা বলে কথা।চৌত্রিশ বছরের তুরহাম খন্দকার পুরান ঢাকার মানুষ।এখনো বিয়ে সাদীতে নিজেকে জড়ায়নি।না কথা বলেছে নিজ পরিবার নিয়ে কারো সামনে।খুব সামলে চলে পরিবারের বিষয় আসলেই।তবে এছাড়া তার আচরণ ছন্নছাড়া মেঘের মতো।

তুরহাম সিগারেট ধরিয়ে জ্যাকেট কাঁধে বেরিয়ে পড়ে সেল থেকে। উদ্দেশ্য হসপিটালে যাওয়া। আজকে সকালে আক্রমণের পর আর যাওয়া হয়নি।কেস নিয়েই দিনটা ব্যস্ততায় কেটেছে। খোঁজ লাগিয়েছে সে এই মাহিমের।সোর্স আইডি কার্ড। তুরহামের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ক্রিমিনালগুলোকে থাপ্পড়াতে।মাঝে মাঝে নিজেই বিরবির করে বলে,”ভাই তুই ক্রিমিনাল, তুই ক্রাইম করবি।তোর কেন আইডি কার্ড সাথে নিয়ে ঘুরতে হবে?কেন তুই খালি হাতে চাকু ধরে খুন করে সেই চাকু ফেলে যাবি?কেন তুই পার্সোনাল গান দিয়ে খুন করবি?এমন আরো কতকিছু।”

তানহা হসপিটালের নিচে রিপোর্টাররা নিউজ করছে।ই,জি,সি গ্রুপের মতো বিশাল কোম্পানির সিইও এবং চেয়ারম্যান যে এই ছোট্ট শহরে তার নিউজ করতেই এতো ভীর। বর্তমান নিউজ রিপোর্টাররা ট্রেনিং নিউজই খোঁজে। তাইতো বিখ্যাত প্রায় নিউজ চ্যানেলের দুই একজন এখানে ক্যামেরা হাতে ঘুরছে।

—ওইতো কেস তদন্তকারী কর্মকর্তা…

একজন রিপোর্টারের কথায় সবাই ছুটে আসে তুরহামের দিকে।তুরহাম চোখের সানগ্লাস খুলে প্যান্টের পকেটে রাখে।আর হাতের লাঠিঠা ঘোরাতে ঘোরাতে হসপিটালে ঢুকতে নেয়।তবে মাঝপথে বাঁধা পেয়ে রাগান্বিত হলেও রাগ প্রকাশ করে না। কেননা এই প্রেসের লোকদের সাথে ঝামেলা জড়ানো মানে নিজের হাতে লাইফ হেল করা। এদের সাথে হয় এক,এরা বানায় আরেক।

তুরহাম কোনো মতে এড়িয়ে ওপরে চলে আসে। তবে দোতলায় ধাক্কা খায় একজন রমনীর সাথে।সরি বলতে গিয়েও থেমে যায়।সেই ঠোঁট,সেই চোখ,সেই মুখায়ব সবটাই যেন সেই পুরনো ক্ষতকে বিক্ষত করে জাগিয়ে দেয় ব্যথাটাকে।সামনের রমনীও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।বুকের ডান’পাশে আইডি কার্ড ঝোলানো।তন্মি আরা জান্নাত‌।তুরহাম কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়েই ওপরের দিকে উঠতে থাকে।স্মৃতি গুলো সামনে আসতে থাকে।

—তুরহাম ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড আই ডন্ট লাভ ইউ।আমি তোমাকে ভালোবাসি না।আর তোমার এতটাও যোগ্যতা নেই যে তুমি আমার আব্বুর কাছে আমাদের বিয়ের কথা বলবে।আমি আব্বুকে কসম দিয়েছি যে আমি আমার আব্বুর পছন্দে বিয়ে করবো।তাই ফারদার আমার সামনে আসবে না তুমি।

সেইদিন কফিশপে এই কথাটা বলেই উঠে চলে যায় জান্নাত।পেছনে ফিরে আর তাকায় না সে।হয়তো পেছনে ফিরলে সেদিন দেখতে পারতো ক্ষত-বিক্ষত তুরহামকে।সেই ঘটনার পেরিয়েছে বহু লগ্নক। প্রায় একযুগ।জান্নাত কি এখন বিবাহিত?প্রশ্ন জাগলেও নিজ মনেই তুরহাম উত্তর দেয় যে জান্নাত বিবাহিত।বয়স তো আর কম হয়নি ঊনত্রিশ হবে তার জানুয়ারীর পঁচিশ তারিখে।তারিখটা এখনো স্মরণে আছে তুরহামের।প্রিয় মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ দিন কি চাইলেও ভোলা যায়?হয়তো যায় ‌তবে সবাই ভুলতে পারে না।

—স্যার ইলিয়ানাকে মারতে আসা লোকটা কিছু বলেছে?

আহান চটজলদি প্রশ্ন করে তুরহামকে‌।সিড়ির পাশেই বসে ছিলো সে।তাইতো তুরহামকে দেখা‌।তুরহাম ভাবনা থেকে বেরিয়ে উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে। জিজ্ঞেস করে,

—মি.আহান ডক্টর চৌধুরীর অবস্থা কেমন এখন?

—আগের চেয়ে বেটার।খুনি?

—মি.আহান ধৈর্য ধরুন।খুনিকে ধরুন বললেই দু’মিনিটের মাঝে ধরা যায় না।সময় লাগে।

—আপনাদের সময় দিতে গিয়েই আমার বোনের এঅবস্থা আজ।আপনারা না পারলে আমাদের বলে দিন।আমরা নিজেরাই খুনিকে ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারবো।

ইলিয়াস চৌধুরী গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠেন।তুরহাম সেদিকে তাকায়।শুস্ক মুখশ্রী।হয়তো বোনের দুশ্চিন্তায় খাওয়া নাওয়া বাঁধ পড়েছে।তুরহাম কোনো ত্যাড়া জবাব দেয় না। অবশ্য ত্যাড়া জবাব দিলেও সে মনের শান্তি করতে পারতো না।তাইতো ইলিয়াস চৌধুরীকে কিছু প্রশ্নাদি করে বেরিয়ে পড়ে হসপিটাল থেকে।থানা থেকে ফোন এসেছে মাহিম স্বীকারোক্তি দিয়েছে।

ইলিয়ানা এখন আগের তুলনায় সুস্থ আছে।চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়েছে।চব্বিশ ঘন্টায় ব্যথা অনেকটাই কমে আসে আর কথাও বলার পরিস্থিতি থাকে। অবশ্য অপারেশন চব্বিশ ঘন্টা আগে হলেও আবারো বারো ঘন্টার মাথায় স্টিচ ফিক্সড করতে আরেকটা ছোট অপারেশন করতে হয়। পাশাপাশি রক্তও দিতে হয়।এ পজেটিভ রক্ত।ব্লাড ব্যাংক থেকেই পাওয়া গিয়েছে।

একে একে সবাই দেখা করলেও আহান ঠাঁয় বাইরে দাঁড়িয়ে।ইলিয়ানা জুনায়েদ চৌধুরীকে আহানের কথা জিজ্ঞেস করতেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বাইরে এসে আহানকে ইশারা করেন ভেতরে যেতে। প্রথমে যেতে না চাইলেও জুনায়েদ চৌধুরীর কথা রাখতে ভেতরে আসে সে।

—রা..রাগ করে থাকবেন?

আহান স্যার চুপ করেই থাকে।ইলিয়ানা আহান স্যারের চুপটি দেখে হাত দুটো কানের কাছে আনতে নিলেই হাতে টান লাগে।ক্যানেলার সুচে ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠে সে।

—এই মেয়ে ঠিক আছো তুমি?এই শরীর নিয়েও এতো নড়চড় করতে হবে কেন তোমায়?

—আপনিই তো ফিরছিলেন না।তাই কান ধরতে নিয়েছিলাম।দেখুন না হাতে লাগলো।

মাসুম চেহারা করে ইলিয়ানা বলে।আহান স্যার চোখে অশ্রু নিয়েই হাসেন।ইলিয়ানা বায়নার সুরে বলে,

—ভাই আর ডেডকে একটু ভেতরে আসতে বলবেন?

আহানের মুখশ্রী চুপসে আসে।সে তো ভেবেছিল ইলিয়ানা তার সাথে কিছুক্ষণ থাকতে চাইবে।তবে না সে তো তার ভাই আর ডেডকেই চায়।আহান স্যার মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই ইলিয়ানা আরো বলে,

—ওনাদের সাথে আপনিও আসবেন।

আহানের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটে।ইলিয়াস বোনের তলব শুনে কাল বিলম্ব না করেই উপস্থিত হয়।সাথে জুনায়েদ চৌধুরী এবং আহান।ইলিয়ানা নার্সকে বলে পিঠের সাইডের বেডটুকু উঁচু করে নেয়।অনুরোধ করে তাদের একা ছাড়তে কিছুক্ষণের জন্যে।নার্স যেতেই ইলিয়ানা বলে,

—ভাই ,ডেড ইনি হলেও আহান তালুকদার।
আর আহান স্যার ব্লাক ব্লেজার আমার ডেড জুনায়েদ চৌধুরী এবং ব্রাউন ব্লেজার আমার ভাই ইলিয়াস চৌধুরী।

—জেহের আমার তোমার অসুস্থতার প্রহর কাজে লাগিয়ে আগেই পরিচিত হয়ে গিয়েছি।বুঝলে?

ইলিয়াস বোনকে হাসাতে মুখটা হাসি হাসি করে বলে। ইলিয়ানা ভাইয়ের উদ্দেশ্য বুঝে কিঞ্চিত হাসে। তাদের কথার মাঝেই নুকতা আর রাহিদ ছুটে আসে।ইলিয়াস আটকাতে গেলেও নুকতা এক ছুটে চলে আসে ইলিয়ানার কাছে।বাচ্চাটার চোখমুখ ফোলা ফোলা।হয়তো কেঁদেছে। চোখের চশমাটা খুলে চোখ মুছে আবারো চশমা চোখে দেয় নুকতা।

—মাম তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?দেখো পুলিশ আংকেলরা কাউকে ছাড়বে না।তোমাকে যারা কষ্ট দিয়েছে সবাই শাস্তি পাবে।

ইলিয়ানা বামদিক দিয়ে নুকতাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।স্বল্পদিনের দীর্ঘপরিচিত মামকে আগলে যেন নুকতাও শান্তি অনুভব করে।রাহিদকে ছাড়ার ইশারা দিতেই ইলিয়াস রাহিদকে ছেড়ে দেয়।রাহিদ দৌড়ে যায় ডানদিকে।ইলিয়ানার হাতে ক্যানোলা থাকলেও সে হাতেই জড়িয়ে ধরে রাহিদকে।ব্যথাটা যেন আর উপলব্ধি হয় না। ভাগ্নে আর ভাতিজার ভালোবাসা দেখেই যেন ব্যথাগুলো আর ব্যথা লাগে না।ইলমা আপুরা দেখা করে গেলেও ওদেরকে পাঠায়নি কেননা ওরা যদি ছোটাছুটি করে ব্যথা দেয় তাই।তাইতো ইলিয়ানাই পড়ন্ত বিকেলে ওদের সাথে দেখা করার আর্জি জানালো।

পুরো রুম পিনপিন নিরবতায় ভরে যায় ইলিয়াস চৌধুরী আর জুনায়েদ চৌধুরী বাচ্চাদের নিয়ে চলে যেতেই।আহান স্যার বামপাশ দিয়ে ইলিয়ানার পাশে গিয়ে বসে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,

—বাচ্চা তোমার খুব পছন্দের তাই না?

—অনেক।

—বিয়ের পর তাহলে তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে নিবো।কি বলো?

আহান স্যারের নির্লজ্জ মার্কা কথায় প্রচন্ড লজ্জা পায় ইলিয়ানা।মুখ ফুটে বলেই ফেলে,

—এতো নির্লজ্জ হলেন কবে?

—অনেক আগে।তা তুমি কি আমার বাবুর আম্মু হবে না?

ইলিয়ানা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। অবশ্য লাল হওয়াটা তো কথার কথা।তবে ইলিয়ানার মুখায়ব দেখে পরিলক্ষিত যে সে লজ্জা পাচ্ছে।ভয়ানক লজ্জা যাকে বলে। আচ্ছা, ডাক্তারদের নাকি লজ্জা থাকে না।তবে ইলিয়ানা ডাক্তার হয়েও লজ্জা পাচ্ছে..। অদ্ভুত বলার অবশ্য কিছুই নেই কেননা প্রফেশনের ক্ষেত্রে পেশেন্টের জীবন বাঁচাতে নির্লজ্জ হলেও নিজ জীবনে ডাক্তাররাও প্রচন্ড লজ্জা পায়।

চলবে?

অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-১৫+১৬

0

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৫
#বর্ষা
সন্ধ্যা ছয়টা কি সাতটা!ইলিয়ানা ডক্টর জোবেদার নতুন ফ্লাটে এসেছে।সাথে আছে আরো কয়েকজন ডক্টর।ওনারাও ইনভাইটেট। অবশ্য ইলিয়ানার সাথে সবার পরিচয় নেই।আর ইলিয়ানা এতোটা আগ্রহও দেখায়নি নিজেকে সকলের সাথে পরিচিত করতে।অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের গুটিয়ে চলতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে আর তাদের একজনই ইলিয়ানা।এই অভ্যাসটা শুধুই অপরিচিতদের জন্য। কাছের মানুষদের কাছে তো চঞ্চল সে।

—মিস ওর মিসেস?

অচেনা কারো কন্ঠ কানে আসতেই ভ্রু কুঁচকে উপরের দিকে তাকায় ইলিয়ানা। শক্তপোক্ত গড়নের শ্যাম এক পুরুষ।ইলিয়ানাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

—আপনাকেই জিজ্ঞেস করেছি মিস বলবো নাকি মিসেস?না মানে আপনার পাশে তো জায়গা আছে বসতাম আরকি।

ইলিয়ানা উত্তর না দিয়ে নিজের পাশের দিকটায় চোখ বুলায়।সে তো এককোণে বসেছে যাতে গল্পের আসর বসাতে সমস্যা না হয়।তবুও এলোকের এই জায়গাটাই নজরে আসলো!ইলিয়ানা বলে ওঠে,

—দেখুন ভাইয়া,এখানে আপনার বসার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই।কান্ডলি ডক্টর মোতালেব সাহেবের কাছে গিয়ে নাহয় বসুন।

ইলিয়ানা কথাটা বলেই মাথা নুইয়ে নেয়।শ্যাম পুরুষটি আবারো জিজ্ঞেস করে,

—তা আপনাকে কি মিস বলবো নাকি মিসেস বলবো?

—আমাকে ডক্টর চৌধুরী নামে সম্বোধন করলেই চলবে।

—আমি মেহতাব রাহাত। বর্তমানে তানহার একজন গাইনোকলজিস্ট।

ইলিয়ানা মুচকি হাসে মাথা তুলে।বুঝতে পারে ছেলেটা প্রচন্ড চিপকু টাইপের।তবে কোনো মেয়েরই এরকম ছেলে একদম পছন্দের না। তাদের তো এমন ছেলে পছন্দ যারা তাদের প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরবর্তীতে মন-প্রাণ উজাড় করে আগলে রাখতে জানবে।ইলিয়ানাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখে রাহাতের ইগো হার্ট হয়। ওখান থেকে সরে এসে সিনিয়র এক ডক্টরের পাশে বসে। অবশ্য তাকে পাশে বসানোটা অন্যান্য ডক্টরদের জন্য লাভজনক। কেননা বাংলাদেশের টপ টেন অভিনেতার একজন মেহতাবের পিতা।তবে কেউই বুঝতে পারে না এই ছেলে অভিনয় জগৎ ছেড়ে ডক্টরী লাইনে কি করছে!!

ডক্টর জোবেদা কিচেন ক্লোথেই ড্রয়িংরুমে আসেন।সবাই অবাক হয়।বর্তমান যুগে একটু টাকা হলেই যেখানে বাড়ির নারীরা রান্না ঘরে ঢোকা বন্ধ করে সেখানে এতোবড় একজন চিকিৎসক হয়ে তিনি রান্না করছেন অতিথিদের জন্য।ইমপ্রেসিভ!ডক্টর জোবেদা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন আবারো। পরিচয় পর্ব শেষে ইলিয়ানাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

—ডক্টর চৌধুরী যদি কিছু মনে না করেন তবে আমার সাথে একটু লাইব্রেরি রুমে আসুন।

ইলিয়ানা বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়ায়। এখানে বসে থাকতে তারও বিরক্তই লাগছিলো।ডক্টর জোবেদা কিচেন ক্লোথ লাইব্রেরী রুমে এসেই খুলে ফেলেন।ইলিয়ানাকে চেয়ারা বসতে ইশারা করেন।ইলিয়ানা বসতেই তিনিও বসে পড়েন এবং বলেন,

—ডক্টর চৌধুরী আপনি বয়সে আমার অনেক ছোট।তবে নামডাকের দিক থেকে বহুৎ বিখ্যাত‌।তবে তোমায় কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলি। শুনবে?

ইলিয়ানা নিজেও জানে বাস্তব অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে সে অন্যান্য মানুষদের মতো নয়। তাছাড়া একেকজনের অভিজ্ঞতা একেক রকম।যেমন ইলিয়ানার অভিজ্ঞতার সাথে ডক্টর জোবেদার অভিজ্ঞতা মিলবে না। তাইতো ইলিয়ানা নতুন জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হয়ে বসে।ডক্টর জোবেদা বলতে শুরু করেন,

—আমার শুরুটা তোমায় নাই বললাম।তবে আমার সফল হওয়ার পরের ঘটনা বলছি তোমায়। সাধারণ মানুষ তথা বাঙালি ঠুনকো কারণে লাফায়।তখন সারাদেশে হরতাল।জনগণ নাকি ঠিকঠাক বেতন পাচ্ছে না।তখন কি হলো। শুরু হলো ভাঙচুর যেন বেতন বাড়ায়। আচ্ছা বলতো তো ভাঙচুর করে কি লাভ হলো?বেতন কি বাড়লো? বরং ক্ষতি হলো গার্মেন্টস মালিকদের। শেষমেশ বেতন বাড়লেও তা ছিলো স্বল্প।যেই লাউ সেই কদুই রইলো।তবে মালিক পক্ষের চোখে নিজেদের নোংরা প্রতিচ্ছবি আঁকলো।

ডক্টর জোবেদা কিছুক্ষণ থামলেন।নিঃশ্বাস নিলেন।ঠগঠগ করে একগ্লাস পানি খেলেন।তিনি আবারো বলতে শুরু করলেন যে,

—হসপিটালে সেদিন অনেক রোগী।তার মাঝেই গার্মেন্টস শ্রমিকরা আন্দোলন‌ করে। হসপিটালে ভাংচুর করে।নিচতলা আর দোতলা ভাঙচুর করে সব শেষ করে দেয়।কারেন্টস সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। জেনারেটর সাপ্লাই চালু করতে যে যাবে তারও ইয়াত্তা নেই। মানুষগুলো নির্মম রুপ ধারণ করেছিলো। অবশ্য তাদের মাঝে কতগুলো মানুষ জেনারেটর সাপ্লাই চালু করতে আমাদের লোকদের সাহায্য করেছিলো।পুলিশের লোক লুকিয়ে ছিলো হসপিটালে। তখন তারা নিজেদের সমর্পন করে যাতে রোগীরা বাঁচতে পারে।এখন বলুন তো এখানে শিক্ষণীয় কি?

ইলিয়ানা ঘটনা আগে থেকেই জানে তবুও এর মাঝে থেকে শিক্ষণীয় কিছু জানতে জিজ্ঞেস করে,

—কি?

—সব প্রফেশনের মানুষ যেমন ভালো হয় না ঠিক তেমনি সেসকল প্রফেশনের অধিকাংশ খারাপও হয় না!আর যখন তোমাদের হৃদয়ে অন্যদের জন্য বাঁচার মনোভাব আসবে তখন তুমি নিজের দিকটা নয় বরং তোমার আশেপাশের মানুষদের কথা ভাববে। দুঃখিত আপনাকে তুমি করেই বলে ফেলায়।

—নো ম্যাম,আপনি তো আমার সিনিয়র।আপনি আমায় তুমি করেই সম্বোধন করতে পারেন!

—আচ্ছা ডক্টর চৌধুরী তোমায় একটা প্রশ্ন করি?

—জ্বী বলুন

—তুমি তো সিঙ্গাপুরের সন্তান। সিঙ্গাপুর তো তোমার মাতৃভূমি অর্থাৎ সেখানেই বসবাস করো। তাহলে এতো ভালো বাংলা কিভাবে বলো তুমি?

—সিঙ্গাপুর আমার মাতৃভূমি নয়, সিঙ্গাপুর আমার পিতৃভূমি।আর মাতৃভূমি বাংলাদেশ! আচ্ছা ম্যাম একটা প্রশ্ন করি?

—করো

—আমার সাথেই কেন শেয়ার করলেন আপনার অভিজ্ঞতা?

—তোমার মাঝে ভবিষ্যৎ দেখি তাই।কোনো ভুল সিদ্ধান্ত জীবনে নিয়ে নিলেও সেটাকে সঠিক সিদ্ধান্তে রুপান্তরিত করো যাতে আফসোস করতে না হয়।আর সবসময় আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা রাখবে।তবে এখন চলো ড্রয়িংরুমে যাই।মিতা মনে হয় ডাইনিং এ খাবার দিয়েছে।

ইলিয়ানা এবারো পিছুপিছু বেরিয়ে আসে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সকলে।সবাই আরো কিছুক্ষণ থাকবে জানালেও ইলিয়ানা একটু তাড়া দেখায়।আড়ালে ডক্টর জোবেদাকে ডেকে বলে,

—ম্যাম এখানে আমি আমার এক রিলিটিভস এর বাসায় উঠেছি। এখনই যেতে হবে।নয়তো ক্যাচাল হতে পারে।বুঝতেই পারছেন।

ডক্টর জোবেদা ইলিয়ানাকে যাওয়ার দিকটায় নজর দেন। যেতে বিদায়ও দেন। তবে একটু ওয়েট করার কথা বলে ভেতরে যান।হাতে করে মাঝারী সাইজের একটা রেপিং পেপারে মোড়ানো বক্স নিয়ে বেরিয়ে আসেন। সকলের অগোচরে ইলিয়ানার হাতে দিয়ে বলেন,

—যখন জীবনের মানে খুঁজে পাবে না তখন খুলবে এই গিফট বক্সটা।আগামী দেখা হোক বা না হোক।আশা করি বক্সটা তোমায় সাহায্য করবে।আমাকেও সাহায্য করেছে এর ভেতরের জিনিসটা।আজ যোগ্য কারো হাতে তুলে দিতে পেরে আমি ধন্য।ভালো থেকো।

ইলিয়ানা বিদায় জানিয়ে বাইরে আসে। ইচ্ছে হয় বক্সটা খুলে দেখার।তবে ইচ্ছেটা দমিয়ে রেখে রিক্সায় চড়ে রায়হান ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।রায়হান ভিলা দিয়েই পরিচিত এই ভিলা।প্রায় নাকডাক আছে এলাকায়।থাকবেই না কেন ফ্রিল্যান্সিং করে যেমন নিজে স্বচ্ছল হয়েছে ঠিক তেমনি অন্যদেরকে ট্রেনিং দিয়ে একটা নিজের গ্রুপ বানিয়ে নিয়েছে এলাকায়।সফল ব্যক্তিদের সফল সব কারবার।

আহান স্যারকে কল দেয় ইলিয়ানা।লোকটা কালকে রাতের পর আর কল দেয়নি।আগেই বলেছিলো আজ কল দিতে পারবে না।কলেজে কি কাজ পড়েছে। ছুটি নিয়েছিলো।ছুটিও শেষ তাই নাকি কাজের চাপটা একটু বেশিই। ময়মনসিংহের দিকে থাকেন।ইলিয়ানা কল দিতেই দুইবার রিং হতেই কল রিসিভ করেন।

—সাহেব কি ব্যস্ত নাকি?

—মাত্রই রাতের খাবার খেয়ে রুমে আসলাম।তুমি কি করছো?

—রিক্সায়।

—কোথায় গিয়েছিলে?

—ডিনারে।তা মহাশয় আমায় কি আজ ভুলে গিয়েছিলেন?

—কার সাথে গিয়েছিলে?

—ডক্টর জোবেদার বাসায়।অনেকজন ডক্টরসরা একসাথে।

—ওহ

—হুম।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইলিয়ানা প্রশ্ন করে,

—কবে আসছেন আমাকে আপনার করে নিয়ে যেতে?

—যেদিন তুমি বলবে।

—তা আপনার পছন্দের রমনীর কি হলো?আমাকে কবে ভালোবেসে ফেললেন?

—যেদিন তোমার বোকা বোকা কথাগুলো মনে করে দিওয়ানা হয়ে যাচ্ছিলাম,তোমাকে মিস করছিলাম সেদিন।যেদিন তুমি প্রথমবারের মতো আমায় দেখেও দেখোনি সেদিন।যেদিন তুমি আমায় রেখে অন্যজনকে বেশি মাহাত্ম্য দিয়েছিলে সেদিন বুঝেছিলাম ভালোবাসি তোমাকে।

—এটা তো জেলাসি..আর ভালোবাসলে জানাননি কেন?

—যদি জানাতাম,তবে কি ডাক্তার বউ পেতাম!আর জেলাসি তো ভালোবাসায় থাকেই তাই নয় কি।

—হুম জনাব বুঝলাম।

—কি বুঝলে?

—অনেক কিছু।

—আমাকেও‌ বলো,আমিও শুনি।

এভাবেই খুনসুটি চলতে থাকে এই ভবিষ্যৎ দম্পতির।ইলিয়ানার মুখের হাসি সরছেই না।পাশের বাইক থেকে একজন নজর রাখছে ইলিয়ানার ওপর।কাউকে ফোন করে ওই বাইকের পেছনে বসা লোকটা বলে,

—কনফর্ম,ইলিয়াস চৌধুরীর বোন গার্ডবিহীন বাংলার ভূখণ্ডে।স্যার খাল্লাস করে দিবো?

ইলিয়ানা খাল্লাস শব্দটা শুনে সেদিকে তাকায়।তবে সব বুঝেও সে যেন কিছুই বোঝেনি এমন অভিনয় করে ফোনে কথা কান্টিনিও করতে থাকে।ইলিয়ানা কি আজ শিকার হবে এই বদলোকদের?যদিও বা শিকার না হয় তবে কি ঘটবে তার সাথে?আর এরাই বা কারা যারা ইলিয়াস চৌধুরীর পরিবারের ক্ষতি করতে চাইছে?প্রশ্ন অনেক তবে উত্তর সময়ে লুকিয়ে!

চলবে?

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৬
#বর্ষা
গাজীপুরে দুটো খুন!পুলিশের চৌকিদারীতে মৌচাক এলাকাবাসী ভীত।মৌচাকেই আছে পুলিশ ফেরি আর সেই স্থানেই নাকি লাশ ভাবা যায়! পুলিশেরা আশে পাশে নজরদারি চালাচ্ছে। পাশাপাশি লোক দুটোর খোঁজও লাগিয়েছে। তবে দু’ঘন্টা পেরলেও কোনো খোঁজই এখনো অব্দি আসেনি।আদৌ আসবে কিনা তারও ঠিকঠিকানা নেই। আধুনিক মাধ্যমগুলোর ব্যবহার করা হয়েছে পরিচয় পেতে কেননা লোক দুটো এখানকার নাও হতে পারে।

অফিসার তুরহাম খন্দকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ললাটে স্লাইড করছে।ছোট দুটো ছোট ছোট করে রেখেছে।হয়তো কিছু ভাবছে!নিউ পোস্টিং পেয়েই এতো দ্রুত কেস পাবে তাও খুনের কেস তা সে ভাবেনি। অবশ্য খুনের কেস সলভ করার পেছনের ট্রাডেজি আলাদা।

—স্যার কি ভাবছেন?

কনস্টেবল খালিদের কথায় তুরহাম খন্দকার একচোখ ছোট করে মুখটা একটু বেঁকিয়ে তার দিকে তাকায়।খালিদ ভয় পায়। কেননা সে তো ভুলেই গিয়েছিলো ইন্সপেক্টর তুরহাম খন্দকার প্রশ্নচ্যুত হতে নয় বরং করতে পছন্দ করে।খালিদ মুখ কাচুমাচু করে বলেন,

—সরি স্যার

তুরহাম খন্দকার বাঁকা হেঁসে কিঞ্চিত হা করে বলেন,

—ওপস খালিদ জি আমার ডান পাশের মস্তিষ্ক কি ভাবছে তা আমার বাম পাশের মস্তিষ্ক জানে না সেখানে আমি আপনাকে কি করে বলি!

খালিদ পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ান।এই কয়দিনে বেশ বুঝতে পেরেছেন তুরহাম খন্দকার একজন সাইকো পেশেন্টের নাম যে সুস্থবেশধারী হলেও গুরুতর অসুস্থ।বিড়ালের ডাক পছন্দ না হওয়ায় গুলি করে হত্যা করেছে এই লোক। অবশ্য বলা তো যায় না,আজ ওই বিড়ালের স্থানে কোনো মানুষও তো হতে পারে তাই নয়কি!

ইলিয়ানা টিভি নিউজ দেখছে।তার মাঝে এতোটুকুও আশ্চর্যচাকিতা নেই যে কালকে তাকে খাল্লাস করতে চাওয়া ব্যক্তিদের লাশ পড়ে আছে!নুকতার আগমনে নিউজ চ্যানেল চেঞ্জ করে অ্যাবাকাস নিয়ে কথা বলা একটা চ্যানেলে যায় ইলিয়ানা।সে নিজে অ্যাবাকাস না পারলেও নুকতা যে বেশ অ্যাবাকাস পারে তা সে জানে।

—মাম তোমায় মিমি ডাকছে

নুকতা আর জোয়া তাদের মামিকে মিমি বলে ডাকে।ইলিয়ানা খুঁজে পায় না কেন তমা ভাবী তাকে ডাকছে।তাই খোশগল্প না করে তমা ভাবীর রুমের দিকে যায় ইলিয়ানা।সেকেন্ড দুয়েকের মাঝেই ভাবীর রুমে সে।

—ভাবী আসতে পারি?

তমা ভাবী মাথা উঁচিয়ে একবার দেখেন।ভেতরে আসার অনুমতি দেন।ইলিয়ানা ভেতরে আসতেই দরজা লাগিয়ে খাটে বসেন তিনি।বলেন,

—আমায় ক্ষমা করেছো?

—কোনো অন্যায় করেছিলেন আপনি?

—তোমায় সেই কিশোরী বয়সে বিয়ে দিতে চাওয়ার,তোমার সাথে দূর্ব্যবহার করার…

—আমি অতীত ভুলে ভালো আছি।আপনিও অতীত ভুলে থাকার চেষ্টা করুন।

ইলিয়ানার কথায় তমা ভাবী মাথা নুইয়ে ফেলে।ইলিয়ানা বুঝতে পারে সে ধাঁচ নিয়ে কথা বলে ফেলেছে।হয়তো তমা ভাবী কষ্ট পেয়েছে।ইলিয়ানাও তো তখন কষ্ট পেতো।তবে ইলিয়ানা পরিস্থিতি নরমাল করতে আবারো বলে,

—ভাবী রুমে বসে দম বন্ধ বন্ধ লাগে।চলুন না আশেপাশে কোথাও থেকে আমরা ঘুরে আসি।

ইলিয়ানার কথায় তমা ভাবী নরমাল না হলেও কৃত্রিম হাসি হেসে বলে,

—তোমার ভাইয়া আসুক তারপর দেখছি।

তমার মন খারাপের জায়গা নেই। কেননা সে তার কৃতকর্মের হালনাগাদই করছে। মানুষ তার কর্মের জন্য সামনের ব্যক্তির কাছে ব্যবহারের আশা রাখে।তমার তো আশাই ছিলো না ইলিয়ানা তার সাথে কথা বলবে। সেখানে ইলিয়ানা যেভাবে কথা বলছে তা আল্লাহর বহুত রহমত তার ওপর।তবে কষ্ট তো লাগবেই। মানুষ যখন অনুশোচনায় ভোগে তখন নিজের কর্মগুলোর কথা আরো বেশি বেশি মাথায় আসে, ঘুরঘুর করে। অনুশোচনা প্রবল করে দেয়।

ইলিয়ানা রুম থেকে বেরতেই দেখতে পায় রাহিদ খাবার টেবিলে বসে বসে খাবার খাওয়ার পরিবর্তে খাবার সামনে রেখে কার্টুন দেখছে।আর রায়দা এখনো ঘুমাচ্ছে।জোয়া তাদের রুমে বসে তারিফ দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলছে।মেয়েটা বাপ পাগলী।

ইলিয়ানা ডাইনিং টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।রাহিদ ভয় পায়।কোনো এক অজানা কারণে ছেলেটা ইলিয়ানাকে বেশ ভয় পায়।নুকতার মতো এতোটা ঘেঁষেও না।যেন পালিয়ে পালিয়ে থাকে।ইলিয়ানার সন্দেহ হয় তবে কিছু বলে না।তবে আজ ভাতিজাকে একটু আদর করার ইচ্ছা হওয়ায় ভাতিজার সাথে কথা বলতে এগিয়ে যায়।

—রাহিদ?

ইলিয়ানার ডাকে যেন থতমত খায়।মোবাইলটা টেবিলে উল্টো করে রেখে দ্রুত খেতে থাকে।খাবার তালুতে ওঠে।ইলিয়ানা পানি এগিয়ে দিয়ে শান্ত হতে বলে রাহিদকে।পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।

—আমায় ভয় পাও কেন তুমি?

—আ আমি ভয় পাই না।

—তাহলে আমাকে দেখলেই এতোটা কাপাকাপি করো কেন তুমি?আমি কি পঁচা নাকি যে আমায় দেখলেই পালাই পালাই করো।

রাহিদ নিশ্চুপ থাকে।ইলিয়ানা আরেকটু জোর দেয় কি হয়েছে তা জানতে। কেননা বাচ্চাটা প্রথম দেখায় যতটা প্রাণচাঞ্চল্য দেখাচ্ছিলো ততটা এই তিনদিনে ইলিয়ানা দেখেনি।নিশ্চিত কিছু না কিছু একটা হয়েছে।

—আমি কি হই তোমার তা কি জানো তুমি?

ইলিয়ানার প্রশ্নে না বোধক মাথা নাড়ায় রাহিদ।ইলিয়ানা অবাক হলেও তা প্রকাশ করে না।ইলিয়ানা বলে,

—ইলমা আপুকে তুমি কি বলো?

—পিপি ..

—আমাকেও পিপি বলবে।আমি তোমার ইলমা আপুর বোন।বলবে তো?

—আচ্ছা।

—শোনো?

—হুম

—কেউ কিছু বললে আমায় বলো।আমি তাকে আচ্ছা মতো পিট্টি দিয়ে দিবো যাতে তোমায় কেউ কিছু না বলে।কেউ কিছু বলেছে?

রাহিদের চোখ জলজল করে ওঠে।যেন পলক ফেললেই কেঁদে দেবে।তবে না বাচ্চাটা কাঁদে না।ইলিয়ানা অবাক হয় আটবছরের শিশুর নিকট অদ্ভুত আচরণ পেয়ে।রাহিদ কিছু না বলে প্লেট হাতে সরে পড়ে।ইলিয়ানার ফোন বেজে ওঠায় সেদিকটায় আর নজর দিতে পারে না সে।রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।

বিকেল চারটা কি তারও বেশি।এলাকা জুড়ে মেলা হচ্ছে।আজ এখানে তো কাল ওখানে।ইলিয়ানা রেডি হয়ে নেয়।বাচ্চাগুলো নিয়ে মেলায় যাবে সে।নুকতা প্রথমে যেতে না চাইলেও পরে মজা হবে শুনে যেতে রাজি হয়েছে।তবে মেলার স্থানটা এখান থেকে বেশ অনেকটাই দূরে।আজ বৃহস্পতিবার নয়তো আহান স্যার আসতো।বেচারা আসতে পারবে না দেখেই তো ভিডিও কলে কথা বলছে প্রিয়তমার সাথে।

—কেমন‌ লাগছে আমায়?

—দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মতো।

—দশম শ্রেণীতে থাকতে লাগছে পঞ্চম শ্রেণীর বাচ্চাদের মতো।আর এখন লাগছে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মতো।সিরিয়াসলি!

আহান স্যার হাসেন।হাসিতে হয়তো কিছু একটা ছিলো।ইলিয়ানা আবারো মায়ায় জড়ায়।মানুষটা হাসলে গালে টোল পড়ে বেশ লাগে।ইলিয়ানা হাসলেও তার গালে টোল পড়ে।তবে তা লক্ষণীয় বা বোঝা যায় এমন না।ইলিয়ানার কোনো আফসোস নেই নিজের টোল পড়া নিয়ে।তার তো চিন্তা অন্য কিছু নিয়ে।

—ভাবুক রানী কি ভাবতে হারালেন?

—কিছু না।

—কে জেনো বলতো মেয়েদের কিছু না শব্দের মাঝেই অনেক কিছু লুকানো!

—কে বলতো?

—আমার বউ!

—আপনার বউ কিভাবে? আপনি কি এখনো আমায় বিয়ে করেছেন নাকি?

—করিনি তো কি হয়েছে।করবো।

—করার পর বইলেন তাহলে।

—আমি তো এখনই বলবো আমার বউ।

—ধূর..থাকেন রাখছি।

—কই যাবেন বউউউউ

—আপনি আমায় আপনি করে বলছেন কেন?

—সম্মান দিতে।

—আপনার কাছে আপনি শব্দটা শুনলে পরপর লাগে।তুমি শব্দেই আপন আপন লাগে।

—স্বার্থপর..

—স্বার্থপর হওয়ার মতো কি করলাম?

—নিজের কাছে তো আপন আপন ফিল আনো।আমার ক্ষেত্রে?আমাকে যখন আপনি করে বলো তখন আমার কাছে যে দূরের মত মানুষ লাগে তখন।আমাকে তুমি করে বলবে।

—আপনি আমার অনেক সিনিয়র। কিভাবে বলি তুমি করে?

—তাহলে এতো সিনিয়রকে ভালোবাসলে কেন?যখন তুমি করেই বলতে পারবে না।

—আপনাকে কে বললো যে আপনি ডাকে ভালোবাসা নেই?ভালোবাসতে হলে তুমি করেই ডাকতে হবে!কে বলেছে আপনাকে?

—তুমিই না বললা?

—আমি?কখন?

—আমি তোমায় আপনি করে বলায় তুমিই না বললা এই সম্বোধনে দূরের দূরের লাগে।

ইলিয়ানার নিজের কপাল চাপড়াতে মন চায়।এই লোকটা যখন কম বোঝার তখন অনেক বেশিই বোঝে।আর যখন পুরোটা ভালো মতো বোঝার তখন বুঝতেই চায় না।ইলিয়ানা যেমন সর্ট টেম্পারের ঠিক তার বিপরীত চরিত্র আহান স্যারের ছিলো দশ বছর পূর্বে।তবে এখন পরিবর্তন হয়েছে।আহান স্যার হয়েছে স্বল্প ধৈর্যের রাগান্বিত পুরুষ আর ইলিয়ানা সে হয়েছে প্রশস্ত ধৈর্য্যের শান্তি পরায়ন নারী।হয়তো বয়স বদলানোর পাশাপাশি সবকিছুই বদলায়। শুধু অনুভূতিরা আগের মতোই কোথাও থেকে যায়। তাইতো এতো বছরেও‌ ভালোবাসায় গ্রহণ লাগেনি।

চলবে?

অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-১৩+১৪

0

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৩
#বর্ষা
ইলিয়ানার মুখের হাসি যেন সরছেই না।তবে মনের মাঝে একটা ভয় এসে বাসা বেঁধেছে।ইলিয়াস ভাই কি রাজি হবে এতে!তবে ইলিয়ানা পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে।নেই কোনো ভয়,কিংবা ডর। রায়হান ভাইয়ের মুখে বিরক্তির রেশ স্পষ্ট।ইলমা আপুও যে কম বিরক্ত তা কিন্তু নয়।তবে পাত্র সংশয় লাজ লজ্জা পায়ে ঠেলে পাত্রীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।এই দৃষ্টি সরানোর নয়।

আহান স্যারের তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার বিষয়টায় যে পরিমাণ লজ্জা ইলিয়ানা পাচ্ছে তা প্রকাশ করতেও হিমশিম খাচ্ছে। গাল দুটো হালকা লাল বর্ণ ধারণ করেছে‌। রায়হানের কাশিতে আহান স্যার দ্রুত চোখ সরান।বয়সে সমবয়সী দু’জনে।তবুও রায়হান ভাই দুই বাচ্চার বাপ আর আহান স্যার সুদর্শন সিঙ্গেল প্রফেসর!

—তা আপনারা আজ আসলেন যে?

রায়হান ভাইয়ের প্রশ্নে আহান স্যার সোজা হয়ে বসেন। নিজের দুলাভাইকে ইশারা করেন কিছু একটা বলতে। নাহিদ দুলাভাই যে খুব একটা স্বাচ্ছন্দে বসে আছে তাও কিন্তু নয়। বিরক্তি না থাকলেও তিনি যে বেশ অস্বস্তিতে ভুগছেন তা ইলিয়ানা বেশ বুঝলো।তবে নাহিদ দুলাভাই অস্বস্তি কাটিয়ে বললেন,

—রায়হান,তুমি তো আমার ছোট ভাইয়ের মতো।আবারো তোমার কাছে আগের আবদারটা নিয়েই আসলাম।এবার ফিরিয়ে দিয়ে না।ইলিয়ানাও তো এখন বুঝদার।

নাহিদ দুলাভাইয়ের কথার কিছুই বুঝলাম না।রায়হান ভাই ক্ষেপে কিছু বলার আগেই দরজা থেকে ইলমা আপুর জামাই অর্থাৎ ইলিয়ানার দুলাভাই তারিফুজ্জামান বলে ওঠেন,

—ভাইয়া ইলিয়ানা বুঝদার হলেও আপনার শালার সাথে আমার মেয়ের বয়স খাপ খায় না।তাহলে বলুন আবারো একই ভুল কিভাবে করবে রায়হান?

দুলাভাইয়ের কথায় আরো ঘোলাটে লাগছে ইলিয়ানার।আবারো শব্দটা কেন আসছে বারবার?তবে কি এর আগের বারও এনার সাথেই…?না,না তা কি করে সম্ভব!এমনটা হলে তো অন্তত পক্ষে আহান স্যার ইলিয়ানাকে জানাতো‌।তাই নয় কি! তাছাড়া আহান স্যারের সাথে ওর বিয়ের কথা পূর্বে না হলে ‘আবারো’ শব্দটা আসছে কোথা হতে!

ইলিয়ানার ভাবনার মাঝেই হাতে থাকা ফোনটায় রিং বেজে ওঠে। এমেলি ভাবী ফোন করেছে।ইলিয়ানা সবার দিকে একবার তাকিয়ে কল কেটে দেয়।তবে আবারো ফোনটা বেজে ওঠে।ইলিয়ানা এবার ভয় পায়।কিছু হলো নাতো আবার!ইলিয়ানা পার্মিশন নিয়ে একটু সরে আসে।

—ভাবী কিছু কি হয়েছে?

—আরে বোকা মেয়ে তোমার ভাই গাজীপুর গিয়েছে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে।তবে এখন নাকি তার তোমার ঠিকানা মনেই নেই।তাই আমাকে বললো তোমার থেকে ঠিকানা জানতে..জলদি বলো

‘তোমার ভাই গাজীপুর গিয়েছে’ এই কথাটাতেই যেন ইলিয়ানার দম বন্ধ হয়ে আসছে।ইলিয়ানা কিছু না বলেই ফোন কেটে দেয়। শুধু এতোটুকু শুনেই তার ঘাম ছুটে গেছে।এখন যদি ইলিয়াস এখানেই চলে আসে তখন! ইলিয়ানাকে ইলিয়াস কখনো মারেনি কিংবা বকেনি তবে শাসন করেছে মিষ্টি ভাষায়। অবশ্য সে শাসনে ছিল ইলিয়াসকে হারিয়ে ফেলার ভয় দেখানো।এমনভাবে কথাগুলো মস্তিষ্কে গেঁথেছে যে ইলিয়ানা চাইলেও এই শব্দগুলো ভুলতে পারে না।যে কেউ তার অবচেতন মস্তিষ্কেও গেঁথে দিয়েছে এসকল শব্দগুলো।

—কোনো সমস্যা মাম?

নুকতা পেছনে এসে দাঁড়ায়।ইলিয়ানা ফিরে তাকায়। ছোট্ট নুকতাও তাকে মাম ডাকতো।তবে আবারো আদরের নুকতার মুখে নিজের জন্য ‘মাম’ সম্বোধন যেন খুশির জোয়ারে ভাসিয়ে দেয় তাকে।ইলিয়ানা নুকতাকে কাছে টেনে কাঁধে হাত রেখে বলে,

—আবে ইয়ার তেরি মামকো কই মুসিবত ছু ভি না সাক্তা..

—মাম মুসিবত কি ছেলে?তুমি যে বললা সাক্তা?আর মুসিবত যদি ছেলে না হয় তবে কি মেয়ে?তাহলে তো সাক্তি হতো তাই না!

নুকতার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে ইলিয়ানা নিজের ছেলেবেলায় যেন ফিরে যায়।এমন আজেবাজে প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি সেই করতো।এমন যদি হতো ইলিয়ানা এই পরিবারের মেয়ে হয়েই বড় হতো তবে ইলমা আপু ঠিকই বলতো যে,”পুরো ইলিয়ানার কার্বন কপি!”

—নুকতা শোনো বাপ আমি এতো ব্যাখ্যা না জানি না।তুমি একটু রিসার্চ করে আমাকে জানাও?

—ছিঃ ছিঃ তুমি মস্ত বড় ডাক্তার হয়েও সামান্য বিষয়ে জানো না?সেম অন ইউ মাম

ইলিয়ানা মাথা চাপড়ে ভাগ্নের দিকে তাকায়।রায়দা,জোয়া আর রাহিদ বাসায় নেই।বিকেল হওয়ায় এখন সবগুলোই বাইরে।ইলিয়ানা ভাবে নুকতা এখানে কি করছে!তবে পরক্ষণেই মনে পড়ে,পড়াকু বাচ্চাগুলো মাঠে নয় পড়ার টেবিলেই থাকে!

—আচ্ছা বাপ আমি জানি না ।সেম অন মি।তুমি জানো তো?

—আমি জানবো না কেন?আমি অবশ্যই জানি

—তাহলে আমায় বলো।আমি একটু শিখে নেই।

—আমি তোমায় বলবো না।

—কেন?

—আমার ইচ্ছে নেই।এখন আমি বাইরে যাবো।সরো

নুকতা মুখ লুকিয়ে পালায়। ইলিয়ানা বুঝেছে নুকতা যে বিষয়টা সম্পর্কে অবগত নয়। তবে অন্যের কাছে হার মানতেও নারাজ সে।একদিকে এটা ভালো গুণ হলেও অন্যদিকে খারাপ।হার না মানার ফলে সে একসময় নিজ থেকে এ বিষয়টা আহরণ করবে,তবে হার মেনে নিলে সে কিন্তু আগেই বিষয়টা সম্পর্কে অবগত হতে পারবে এবং সময়ও বাঁচবে!

ইলিয়ানা ড্রয়িংরুমে ফিরে আসে।ইলিয়াসকে ম্যাসেজ পাঠায়।ম্যাসেজে লেখে,

”ভাই তুমি তো চাইতে আমি বিয়ে করি তাই না?ভাই আমি করবো‌।তবে ছেলে হবে আমার পছন্দের।আমি একজনকে নিজের থেকেও অনেক বেশি ভালোবাসি।সেই ছোট্টটি থেকেই।নিষেধ করো না। তোমাদের নিষেধাজ্ঞা পেলে বিয়ে করবো না,তবে তাকে না পেলে আর কাউকে জীবনের সাথে জড়াবোও না”

ইলিয়ানা দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস নেয়।কখনো আগে ভাইয়ের কাছে কিছু চায়নি সে,আর না চেয়েছে বিয়ে করতে। ভাই তো অনেক জোর করেছে। অবশ্য কখনো কাউকে সামনে ধরে এনে বলেনি যে তোমাকে একেই বিয়ে করতে হবে।ইলিয়ানা উপস্থিত হতেই তারিফুজ্জামান বলেন,

—শালী কি বলো তুমি?করবে বিয়ে নাকি না করে দিবো?

ইলিয়ানা লোকলজ্জা ভুলে বলেই ওঠে,

—ভাইয়া আমি রাজি‌।তবে আমার একটু সময় লাগবে ডেড এবং ভাইকে মানাতে।

সবার মুখেই কিঞ্চিত খুশি প্রকাশিত হলেও আহান স্যার ইলিয়ানার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে।হয়তো ভাবনা এটাই আবার কোন ডেড আর ভাইয়ের কথা বলছে ইলিয়ানা!

ইলিয়াস মোবাইল ঠোঁটের সাথে লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবছে। হঠাৎ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুকণা।চোখটা মুছে ইলিয়াস মোবাইলের গ্যালারি ওপেন করে।ইলিয়ানার মতো দেখতেই হুবুহু গড়নের এক রমনীর ছবি।বের ষোলো,সতেরোর ছেলে আর কাপড়ে মোড়ানো ছোট বাচ্চাটার ছবি।ইলিয়াস কেঁদে দেয়।বলে ওঠে,

—মাম্মাম কেন আমরা এতো ধনী হলাম?আমরা কেন আলাদা হয়ে গেলাম?কেন তোমার মৃত্যু হলো?আর কেনই বা ইলিয়ানা আমাদের থেকে হারিয়ে গেলো!

ইলিয়াসের কান্না থামে।তবে আবারো ঢুকড়ে কেঁদে ওঠে সে।চোখের পানি মুছতে মুছতেই আবারো গড়িয়ে পড়ে।ইলিয়াস বলে,

—মাম্মাম জানো আজ আমাদের ইলিয়ানা বিয়ে করবে বলে জানিয়েছে।আমার বোনটা হয়তো সত্যিই কাউকে ভালোবাসে।এতোদিন তো বিয়েই করতে চাইনি,আমি সব দেখে শুনে বিয়ে দিবো।আমার বোনটাকে আগলে রাখবো।তোমার মতো হারিয়ে ফেলবো না

ইলিয়াসের ফোনটা বেজে ওঠে।’ওয়াইফি’ দিয়ে সেভ করা নাম্বার।ইলিয়াস নিজেকে শান্ত করে। চোখেমুখে পানি দেয়।পানি খায়।ড্রাইভারকে জানালা খুলে গাড়িতে ঢোকার নির্দেশ দেয়। ইলিয়াস কল ব্যাক করে।

—হ্যা বলো?(ইলিয়াস)

—কি হয়েছে ইলিয়াস?তোমার মন খারাপ?(এমেলি)

—আরে না।টানা ট্রাভেলে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছি এই আরকি।যাইহোক তুমি ফোন দিয়ে যে…(ইলিয়াস)

—ওহ হ্যা,ডেড তোমায় তাকে ফোন দিতে বলেছে।আর শোনো আমি মমের সাথে দেখা করতে যাবো একটু।জেনিকে ডেডের কাছেই রেখে যাবো ভেবেছি।কি বলো?(এমেলি)

—তোমার ইচ্ছে। আচ্ছা রাখছি।ডেডকে একটু ফোন দিয়ে দেখি কি বলবে (ইলিয়াস)

—আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ (এমেলি)

—হুম….

ইলিয়াস কল কেটে গাড়িতে শরীর এলিয়ে দেয়।ড্রাইভার মৌচাকের দিকে গাড়ি নিচ্ছে।জ্যাক লোকেশন সেন্ট করেছে।এখনো পার্শ্ববর্তী ওই রিপোর্টেই ম্যারিও,এনি সবাই রয়ে গেছে।

চলবে?

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১৪
#বর্ষা

—ব্রাদার প্লিজ ডু সামথিং।ইউ নো আই লাভ জেহের ঠু মাচ।

ম্যারিও কাঁদতে কাঁদতে ইলিয়াসের পায়ে পড়ে যায়। ইলিয়াস জানে যে ম্যারিও ইলিয়ানা বলতে কতটা পাগল।ইলিয়ানা যখন আমেরিকান ইংলিশে কাঁচা হওয়ায় অন্যদের কাছে কিছুটা হাস্যের পাত্রী হতো সেখানে ম্যারিও ইলিয়ানাকে সবটা দিয়ে আগলে রেখেছে।তবে ইলিয়ানার পারফেক্টনেস বাড়লেও ম্যারিও কেয়ার আগের মতোই আছে।

ইলিয়াস সোফায় গা এলিয়ে দেয়।বিরক্ত লাগছে তার এখন ম্যারিও কে। ইলিয়াসকে ইলিয়ানা আগেও জানিয়েছে যে ম্যারিও নাকি ইলিয়ানাকে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছে। অবশ্য ইলিয়ানা হাসতে হাসতেই বলেছিলো তা যেন কোনো মজার বিষয়ে কথা বলছে সে। ইলিয়াস গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—ম্যারিও তোমরা সবাই আজই সিঙ্গাপুর ব্যাক করছো।আর শোনো মরীচিকার পেছনে ছুটো না।ইলিয়ানা তোমাকে ভালোবাসে না।তাই সে তোমার জন্য মরীচিকার মতো হওয়া উচিত।এনিকে গুরুত্ব দেও।

এনি লজ্জা পায় ইলিয়াসের কথায়।তবে ভয়ও পায় বেশ।কষ্টও পায় ম্যারিও এর জন্য।যারা ভালোবাসা নামক অনুভূতি একবার অনুভব করে তারা জানে ভালোবাসার মানুষের জন্য কষ্টটা চিত্তে কত গভীরত্ব বানাতে পারে!

জ্যাক সবাইকে নিয়ে ওই রুম ফাঁকা করে দেয়।সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেকক্ষণ।তাইতো উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে সে।জ্যাক ততক্ষণে ব্ল্যাক কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে এসেছে। ইলিয়াসের ইশারায় খাবার রেখে বেরিয়ে আসে জ্যাক। ইলিয়াস নামক মানুষটা পরিবারের কাছে যতটা নরম,ঠিক ততটাই কঠিনত্ব বজায় রাখে বাইরের জগৎ এ।

‘মাই ডটার’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা থেকে কল হাসতেই ইলিয়াসের মুখে হাসি ফোটে।স্যান্ডউইচটা প্লেটে রেখে কল রিসিভ করে।বাচ্চাটার ঠোঁট ফোলানো দৃশ্য ভেসে ওঠে।

—পাপাই,হোয়ার আর ইউ?জেনি মিস ইউ সো মাচ

জেনির ঠোঁট ফুলানো কথায় ইলিয়াসও মুখ চুপসানোর অভিনয় করে মাসুম চেহারা বানিয়ে বলে,

—বেবি পাপাই সরি।তুমি তো জানো পাপাই আন্টসকে নিতে এসেছে।তুমি আন্টসকে চাও না?

—হোয়ার ইজ মাই আন্টস?আই মিস হার ঠু ঠু ঠু মাচ।প্লিজ গিফ হার দ্যা ফোন।আই ওয়ান্ট টু টক টু হার।প্লিজ পাপাই

ইলিয়াস ঠোঁট কামড়ে হাসে।মেয়েটা একদম মায়ের কার্বন কপি হয়েছে।কথা মানাতে মায়ের মতোই মুচকি একটা হাসি দিয়ে তৎক্ষণাৎ গাল ফোলায়। ইলিয়াস মেয়েকে বলে,

—বেবি তোমার আন্টস তো এখন পাপাইয়ের সাথে নেই।আন্টস আসলে পাপাই তোমায় কল দিবে।ঠিক আছে?

—ওকে পাপাই।

—ওকে বেবি তাহলে পাপাই এখন রাখছি।তোমার কিন্তু এখন ডিনারের সময়। খেয়েদেয়ে ঘুমি দেও।পাপাই আন্টস আসলেই তোমায় জাগিয়ে তুলবে।

—প্রমিস?

—হুম,প্রমিস।

ইলিয়াস কল কেটে দেয়।ইলিয়ানা কল দিয়েছিলো।জেনির সাথে কথা বলায় কল রিসিভ করতে পারেনি।তাইতো তাড়াতাড়ি কল কেটে ইলিয়ানাকে কল দিলো ইলিয়াস।

ইলিয়ানা রুমে বসেছিলো।নুকতা পাশেই বসে বসে সাহিত্যের একটা বই পড়ছে।চোখে এখনই চশমা উঠেছে এই ছেলের।ইশ,কি পড়াকু বাচ্চা ভাবা যায়!ইলিয়ানা ভাইয়ের ফোন পেয়েই দ্রুত কল রিসিভ করে।

—ভাই কোথায় তুমি?তুমি কি আমার সাথে রাগ করে ফিরে গিয়েছো?

—তোমার সাথে রাগ করবো কেন?কি করেছো তুমি?

ইলিয়াসের গম্ভীর কন্ঠে আঁতকে ওঠে ইলিয়ানা।ভাই কি তবে অভিমান করেছে তার সাথে!ভয় জাগে মনে।ইলিয়ানা কেঁদে দেয়।বলে ওঠে,

—ভালোবাসা কি অন্যায়?তুমিও তো ভাবীকে ভালোবেসেই আগলে নিয়েছিলে‌।তাহলে আমার ক্ষেত্রে কেন তুমি অভিমানী হচ্ছো ভাই?কেন!ভাই আমি যে বড্ড ভালোবাসি তাকে।পুরো বারোটা বছর আমি তাকে ভালোবাসি ভাই।বারোটা বছর!প্লিজ ভাই অভিমান করো না।

ইলিয়ানার ভেজা কন্ঠ কর্ণকুহুরে যেতেই ইলিয়াস আর রাগ করে থাকার অভিনয় করতে পারে না।ফিচলে হেঁসে বলে ওঠে,

—পাগলী আমার!আমি কি বলেছি ভালোবাসা অন্যায়? ভালোবাসা পবিত্র একটা অনুভুতি।যা জন্মাবে কখন কার প্রতি তা বলা মুশকিল।তোমার প্রিয়তম যদি তোমার যোগ্য হয় তবে সতিই আমি তার হাতেই তোমাকে তুলে দিবো। বুঝলে?

—থ্যাঙ্কিউ ভাই।লাভ ইউ।

—লাভ ইউ টু মাই প্রিন্সেস।

ইলিয়ানা হাসে।ভাইয়ের সাথে আরো কিছু কথা বলা কলটা কেটে দেয়।ইলিয়াস ম্যারিও এর কথাগুলো জানায় না ইলিয়ানাকে। কেননা নয়তো ইলিয়ানা যে চিন্তিত হতো,ফ্যাছাদে জড়াতো। ইলিয়াসের ফোন রেখেই ইলিয়ানা হেঁসে ওঠে।

ইলিয়ানাকে কাঁদতে দেখে অদ্ভুত চোখে নুকতা তার দিকে তাকিয়ে ছিলো।ইলিয়ানা ভাগ্নেকে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সত্যিই ওড পরিস্থিতিতে পড়ে যায়।সে তো ভুলেই গিয়েছিলো তার পাশে কে বসে আছে।রাহিদ মাত্রই এসে বসেছে।বাকি দুটো তমা ভাবীর পেছনে রান্না ঘরে।আর ইলমা আপু তারিফুজ্জামান দুলাভাইয়ের সাথে একটু বাইরে গেছে।

”কি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন নুকতা?”

ইলিয়ানার কথায় নুকতার হেলদোল নেই।রাহিদের দিকে তাকিয়ে থেকে ধমক দিয়ে বললো,

—এই রাহিদ তোমার পড়াশোনা নেই?যাও বই নিয়ে এসো।মাম পড়াবে।যাও

রাহিদ ঠোঁট উল্টিয়ে চলে যায়।বের আটেকের বালক সে।রাহিদ যেতেই নুকতা ইলিয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো,

—মাম তুমি কি বোকা নাকি?

ইলিয়ানা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,—কেন?

—আরে মাম তুমি কেন অন্যদের সামনে কাঁদবে?অন্যদের সামনে কাদলে তো তোমার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে।

ইলিয়ানা ভাগ্নের কথায় হাসে।নুকতার চুলগুলো আরেকটু অগোছালো করে বলে,

—কান্না দূর্বলতা নয় বরং নিঃসঙ্গতা থেকে বেরোতে সাহায্য করে।কান্না সবাই করতে পারে না। বরং নিজের ইন্টার্নাল ক্রাইয়িংকে রুপ দিতে না পেরে ডিপ্রেশনে গিয়ে ঝুলে পড়ে।তারপর কি হয় নিশ্চই জানো?

—হুম।

—নুকতা ভাইয়া এই যে আমার ভাই…

ইলিয়ানা আর নুকতার কথার মাঝেই রাহিদ এসে উপস্থিত হয়।ছেলেটা ইলিয়ানার থেকে দূরে দূরেই থাকে। অবশ্য নতুন আত্মীয়ের সাথে মিশতেও একটু সময় লাগে। তবে নুকতা তো ইলিয়ানাকে সেই ছোট থাকতে থেকেই চিনে।তখন তো নুকতার বয়স তিন যখন ইলিয়ানা বাড়ি ছাড়ে!

ভোরবেলা থ্রিপিস পড়ে সুন্দর করে রেডি হয়ে নেয়।আজ একটু হসপিটালে যেতে হবে।আজ পেশেন্টকে ছুটি দেওয়া হবে।তাইতো আরো একবার রিচেক দিতে হবে এবং ইন্টার্নাল ইমপ্রুভমেন্ট কতটুকু তা জানতে একটা লাস্ট চেকআপ করতে হবে।

ডাইনিং টেবিলে রায়হান ভাই আর তারিফুজ্জামান ভাই খেতে বসেছে।বাচ্চারা এখনো ঘুম থেকেই ওঠেনি।ঠান্ডাটা আর নেই। প্রতিদিন রোদের দেখা মেলে সকাল হতেই।এসময় ইলিয়ানাকে তৈরি হয়ে ডাইনিং টেবিলে দেখে তারিফ দুলাভাই জিজ্ঞেস করে,

—শালী সকাল সকাল রেডি হয়ে কোথায় যাচ্ছো?

—এইতো ভাইয়া,তানহা হসপিটালে যাবো।পেশেন্টকে আর একবার দেখে ডিসচার্জ দিয়ে দেবো।

টেবিলে বসতে বসতে ইলিয়ানা বলে।তারিফ দুলাভাই হাসে।রায়হান ভাইয়ের মুখ দেখে বোঝা যায় না সে হাসছে নাকি রাগছে! অবশ্য রাগান্বিত হওয়ার মতো কোনো কথাই হয়নি এখানে।

আজ কোনো এক ডে হয়তো! সে দিনটাই উজ্জাবিত হচ্ছে। অবশ্য ইলিয়ানার মাঝে এই ডে গুলো তেমন প্রভাব ফেলে না।ইলিয়ানা রিক্সায় চড়ে সফিপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সফিপুরেই তো তানহা হসপিটাল। অবশ্য বর্তমানে কলেজ শাখায় খোলা হয়েছে।আগে এতো কিছু ছিলো না।দশ বছরে অনেক কিছুই পাল্টেছে।

ইলিয়ানা জ্যামের মাঝে রিক্সায় বসে দেখতে থাকে বাইরের দিকটা। রাস্তাটা প্রশস্ত হওয়ায় বড় বড় গাড়িগুলোর যাতায়াত এখন এদিক দিয়েই প্রায়শই।

”আই লাভ ইউ ছোঁয়া ”

হঠাৎ এই ব্যস্ত সড়কে কথাটা শুনে এদিক ওদিক ইলিয়ানা তাকায়।রাস্তার একপাশে একটা ছেলে একটা মেয়ের সামনে বসে আছে।ইলিয়ানা দেখে।হয়তো কলেজের শিক্ষার্থী এরা।পোশাক দেখেই মনে হচ্ছে এরা কলেজের শিক্ষার্থী।

ইলিয়ানার ফোনটা বেজে ওঠে।ইলিয়ানাকে সেদিকে মন দিতে পারে না।ফোন রিসিভ করে জানতে পারে ডক্টর জোবেদা নাকি হসপিটালে এসেছেন আজ।ইলিয়ানার সাথে ডিনার ফিক্সড করেছেন। ইলিয়ানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাজি হয়। অবশ্য ইলিয়ানার ভুলু মন ভুলে গেছে তাকে সাহায্য করা ছেলেটার নাম!কি যেনো ছিলো নিউ ইন্টার্ন ডক্টরের নাম?

চলবে?

অনুরক্তি এসেছে তোমার শহরে পর্ব-১১+১২

0

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১১
#বর্ষা

সাঈদাকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইলিয়ানা।আজই শেষদিন রিইউনিয়নের।অনেকে তো অলরেডি প্রস্থান করেছে।ইলিয়ানার হৃদয়ে চলছে উত্থাল পাত্থাল ঝড়। ইলিয়ানা আগ বাড়িয়ে কথা না বলায় আহান স্যারও কিছুই বলেননি।তবে ইলিয়ানা লক্ষ্য করেছে আড়চোখে তাকানোর বিষয়টা।ওই বিষয়টাই তো হৃদয়ে ঝড় তুলতে যথেষ্ট।

—আর কাঁদিস না। মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে।

ইলিয়ানা কথাটা বলেই হেসে দেয়।সাঈদাও একটা কিল মেরে ইলিয়ানাকে ছেড়ে দেয়‌।কান্নাও থামিয়ে হেসে দেয়। অন্তরা কালই চলে গিয়েছে।বাচ্চাটা নাকি মায়ের অনুপস্থিতিতে কান্না কাটি করে জ্বর বাধিয়েছে।আর তাসনিম গিয়েছে আজ।অনন্যা রিইউনিয়ন থেকে বিদায় নিলেও গাজীপুর থেকে যায়নি কেননা তার বাবার বাড়ি এই স্থানেই।হয়তো বিকেলের দিকে দেখা করতে আসবে।

—কিরে তোরা দুইটা কান্নাকাটি করতাছোস কেন?

মেহেরের কথায় ইলিয়ানা আর সাঈদা সেদিকে তাকায়। মেহেরের ওপরেও ওদের রাগ কেননা বিকেলের দিকে দুলাভাই এসে নিয়ে যাবে ওকে।আর সেটা কিছুক্ষণ আগেই বলেছে সে।ইলিয়ানা রাগ করে চলে যায় সেখান থেকে।হয়তো এখন আর বেষ্ট ফ্রেন্ড নেই তাই বলে কি আগের মতো কথাগুলো শেয়ার করা যায় না!কই যখন তারা কিশোরী তখন তো মেহেরের সুখ-দুঃখ সবকিছুর খবরই থাকতো ইলিয়ানার নিকটে।সময় বদলানোতে সত্যিই পরিস্থিতি আর ব্যক্তিত্ব বদলেছে।

আজ দিন কয়েক বাদে চড়া রোদ উঠেছে।ইলিয়ানার মনে হাহাকার।আজ তার দিন কয়েকের বেষ্টু রুমানের জন্মদিন।তবে যে সে উইশ করবে না তাকে। কেননা রুমানের দূর্বলতা যে এখনো রয়েছে সে।ইলিয়ানা হঠাৎ করে বলে ওঠে,

—ভালোবাসায় দুইজন ব্যক্তি সুখে থাকলেও তৃতীয় একজন চরম কষ্ট পায়।রুমান আমায় ভালোবেসে আমায় না পেয়ে কষ্ট পাচ্ছে আর আমি তাকে না পেয়ে!কই সে তো আমার অভিমান,রাগ বোঝে না,তবে কি আমি তাকে পেয়েও হারাবো আমার অভিমান,রাগের কারণে?

ইলিয়ানা আর ভাবে না।সময়ের ওপর ছেড়ে দেয়। আজকের দিনটা শুধু। অবশ্য ইলিয়ানা তো আরো দিন দুয়েক থাকবে বাংলাদেশে। কেননা সে যে কথা দিয়েছে তার ইলমা আপু আর রায়হান ভাইকে।

ইলিয়ানা ফোন হাতে দাঁড়িয়ে।চারদিন পরে তার ফ্লাইট।আর কাল নাকি ইলিয়াস চৌধুরী কাজের সূত্রে বাংলাদেশে আসছেন।ইলিয়ানা যে কথা দিয়েছে ইলমা আপু আর রায়হান ভাইকে যে সে ভাইয়ের বাড়ি বেড়াবে।তবে কি পারবে না ইলিয়াসের কারণে!চিন্তিত ভঙ্গিতে ভাবুক সে।কিছু চিন্তা করলেই মাথায় ব্যথার সৃষ্টি হয়।

ইলিয়ানার দ্বিতীয় ভাবনা আহান স্যার কোথায়। কেননা লোকটা যেন নিরুদ্দেশ হয়েছে।একবারের জন্যও আজ ইলিয়ানার সামনে ধরা দেয়নি।ইলিয়ানার হৃদয়ে লালন করা অনুভূতিটা আহত হচ্ছে।

ফোনের কর্ক ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় ইলিয়ানার ভাবনা। কিছুটা নড়ে চড়ে উঠে ফোনটা রিসিভ করে সে।তবে রাগান্বিত হয় পরক্ষণেই অপরপ্রান্তের প্রথম সম্বোধন শুনে। নিজ ভাষায় প্রকাশ করছে অনুব্যক্তি।

”বেবি, কবে দেশে ফিরবে ? আমি আর সহ্য করতে পারছি না।তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হচ্ছি।জলদি ফিরে আসো। বিয়ে করে একেবারে নিয়ে আসবো তোমায় আমার নামে”

ইলিয়ানা মাড়ির দাঁত একটা আরেকটার উপর চেপে ধরে।ম্যাসেঞ্জারের কল সে কেন ধরলো এই ভুলের জন্য নিজেকে থাপ্পর মারতে গিয়েও মারে না। অবশ্য তার নিজেরই ভুল বিরক্তিকর,অসহ্যকর মানুষদের লাই দিয়েছে সে নিজেই।সে চাইলেই ব্লক করতে পারতো।তবে তা করেনি। রেস্ট্রেক্টড করা ছিলো।রায়দা ফোন নিয়ে গেমস খেলছিলো।আর খেলতে খেলতে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে পুরো গোলমাল করে দিয়েছিলো। হয়তো তখনই আন রেস্ট্রেক্টড হইছে।

ইলিয়ানার ভাবনার মাঝে কল কেটে যায়।আবারো কল আসে।ইলিয়ানা ভাবনাচ্যুত হয়।অবাক হয় কেননা সে তো কল রিসিভ করেই ছিল তাহলে আবার কিভাবে কি!ইলিয়ানা অবাকতা কাটানোর পূর্বেই কলটা আবারো কেটে যায়।ইলিয়ানা দ্রুত আইডি রেস্ট্রেক্টড করে দেয়।আইডিটার নিকনেম ”বিরক্তিকর ব্যক্তি” ইলিয়ানা বাংলায় দিয়েছে যাতে কেউ বুঝতে না পারে.

ইলিয়ানা দূরে দাঁড়ানো লাবিব স্যারের দিকে হাঁটা দেয়।স্কুল মাঠটা প্রায় ফাঁকা। বেশিরভাগই চলে গিয়েছে। হাতেগোনা কয়েকজন রয়েছেন। ইলিয়ানাকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে লাবিব স্যার ভীত হোন।তবে নিজেকে সংযত রেখে নিশ্চুপ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

—স্যার ভাবীর ছবি দেখাবেন না?

লাবিব স্যার ভ্রু কুঁচকে ইলিয়ানার দিকে ফিরে তাকান।পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী কথা বলার পূর্বে সামনে পড়া চুলগুলো ডান হাত দিয়ে পেছনের দিকে সরিয়ে দেন।

—কোন ভাবী?(লাবিব)

—আপনার বউ

—আমার স্ত্রী তোমার ভাবী হয় কি করে?(লাবিব)

—বাহ রে ক্লাস এইটে থাকতে যে আপনাকে ভাই বানিয়েছিলাম ভুলে গেলেন! অবশ্য ভুলে যাওয়ারই কথা কেননা আপনি তো ভাইয়া থেকে ছাইয়া হয়েছিলেন।

—মুখে লাগাম রাখো।আর তোমার কারণে যে ছড়াছড়ি হইছিলো (লাবিব)

—পিকনিকে আমাকে জোর করে নিজের সাথে রোলার কোস্টারে উঠিছিলেন।স্যারদের সামনে।সেটাও তো আমার কারণেই হইছে। তাই না?

লাবিব স্যার মাথা নুইয়ে ফেলে।আর কি বলার আছে তার। নিজের দোষে সে দুইটা জীবন বীভৎস করেছিলো।প্রথম ইলিয়ানার আর দ্বিতীয়ত নিজের।ইলিয়ানা মুচকি হেসে বলে,

—স্যার আমি জানি আপনি আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র আপু শায়লাকে বিয়ে করেছেন।নীড় কিন্তু সম্পূর্ণটাই শায়লা আপুর প্রতিচ্ছবি হয়েছে।

—ইলিয়ানা?

মাহিরের ডাকে স্যারের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলো ইলিয়ানা।আবার দেখা হবে কি হবে না।মাহির প্রপোজ করেছিলো একবার ইলিয়ানাকে।তবে ইলিয়ানা বুঝিয়ে সুঝিয়ে না করে দিয়েছিলো। কেননা মানুষ ভুল একবার করে,দুইবার করে কিন্তু তৃতীয়বার করে। মানুষ দুইবারেই শিখতে পারে।

—বল কি বলবা?(ইলিয়ানা)

—তুমি আমাকে এখনো তুমিতেই রাখছো দেখে খুশি হলাম (মাহির)

—আমি ফাহিম,আয়ান,এরাম ওদের তুই করে বলি কেননা ওরা আমার বাল্যকালের বন্ধু তাই‌।আর তোমাকে/তোমাদের তুমি করে বলি কেননা স্বল্প পরিচিতদের তুই করতে বলতে ওড লাগে।(ইলিয়ানা)

—ভুল বললা। মানুষ কিন্তু তার প্রিয় ব্যক্তিকেই তুমি করে বলে(মাহির)

—তার মানে বলতে চাচ্ছো আহান স্যার, মুহাম্মদ স্যার,প্রিন্সিপাল স্যার সবার প্রিয় আমরা!(ইলিয়ানা)

—আমি তা কখন বললাম?(মাহির)

—স্যাররা তো আমাদের তুমি করেই বলে। সেক্ষেত্রে তোমার কথার মানে কি দাঁড়ায়?(ইলিয়ানা)

—স্থানভেদে অর্থ পরিবর্তিত হয়।(মাহির)

—ঠিক তেমনি স্থানভেদে অর্থ পরিবর্তিত হওয়ায় এবং তুমি আমার স্বল্প সময়ের ক্লাসমেট হওয়ায় আমি তোমায় তুমি করে বলি।অন্য মানে বের করো না যেন!(ইলিয়ানা)

মাহির যুক্তির কাছে হেরে গেছে।নিজের কথার কারণেই সে আজ হারলো। অবশ্য স্কুল লাইফ থেকেই ইলিয়ানাকে কেউ যুক্তি তর্কের বিষয়ে হারাতে পারেনি।তবে মারামারির মাঝে খুব কমই কিংবা পাওয়া যায়নি বললেই চলে।কি নিশ্চুপ আসতো!বন্ধুরা আসলে হাসি ফুটতো নয়তো এককোণে গুটিয়ে বসে থাকতো।তবে আশ্চর্যের বিষয় এই মেয়েটার বন্ধুগুলো ছিলো এই স্কুলের তৎকালীন সবচেয়ে চঞ্চল পাঁচ সদস্য!

ইলিয়ানার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়।রাত হয়ে এসেছে।আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা।তারপর সব বন্ধুগুলো আবারো আলাদা। অবশ্য এখন ওদের টিমের এখানে আছে ইলিয়ানা,সাঈদা আর আফরোজা।কবে না কবে আবারো দেখা হবে কে জানে!

সাঈদা আর আফরোজা বাইরে গেছে।কি যেনো কিনবে!ইলিয়ানা আন্দাজ করতে পেরেছে।আফরোজাকে নিস্তেজ দেখেই সে বুঝে গিয়েছে মেয়েলী সমস্যা হয়েছে। অবশ্য এই সময়টা না হলে যে একটা মেয়ের মা হয়ে ওঠা সম্ভব না।এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আল্লাহ তায়ালা মেয়েদের মা হওয়ার ক্ষমতা দান‌ করেন।তবে এক্ষেত্রেও‌ আল্লাহ তাআলা সুন্দর বিচার করেছেন। নারী-পুরুষকে একজন আরেকজনের ওপর নির্ভর করেছেন।নারী যেমন পুরুষহীন মাতৃত্বের স্বাদ নিতে অক্ষম,ঠিক তেমনি পুরুষও নারীহীন পিতৃত্বের স্বাদ গ্রহণে অক্ষম।

ইলিয়ানার ফোনে জ্যাকের ফোন আসে।ইংরেজি কয়েক শব্দ উচ্চারণ করে জ্যাক বলে,

—ম্যাম ম্যারিও স্যার ড্রিংক করে মাতলামো করছে।

—রুমে লক করে রাখো।(ইলিয়ানা)

—ম্যারিও স্যার বারবার আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেন।(জ্যাক)

—আমি কি বলেছি শুনোনি?(ইলিয়ানা)

—সরি ম্যাম (জ্যাক)

ইলিয়ানার ধমক খেয়ে বেচারা সরি বলে ফোন কেটে দেয়।বুঝতে পারে আজ ইলিয়ানা বেজায় চটেছেন।যখন তখন বর্ষণ হতে পারে।তাই আর ঘাটায় না ইলিয়ানাকে।কল রেখে ম্যারিও কে রুমে বন্ধ করে দেয়।এনি কিছু বলতে গিয়েও বলে না। কেননা মিনিট দুয়েক আগেই প্রিয় মানুষটার হাতে সর্বশক্তি প্রয়োগকৃত চড় পড়েছে তার গালে।

ইলিয়ানা মোবাইলটা শক্ত করে ধরে সামনের পানে তাকিয়ে। অবশ্য এতক্ষণ যাবৎ সে তাঁবুর বাইরেই দাঁড়ানো। দূর থেকে দেখতে পায় আহান স্যারের গঠনের কেউ এগিয়ে আসছে তারই দিকে।ইলিয়ানা প্রচন্ড খুশি হয়।এগিয়ে যেতে গিয়েও যায় না।

আহান স্যার পাশে এসে দাঁড়ায়।দুজনেই নিশ্চুপ।ইলিয়ানার নিশ্চুপতা সহ্য হয়না।ইলিয়ানা জানে লোকটা এমনই।প্রথম কয়েক মুহূর্ত নিজ থেকেই কথা বলতে চাইলেও পরমুহূর্তেই এমন ভাব করবে যেন সে ইলিয়ানাকে সহ্য অব্দি করতে পারে না।

—কোথায় গিয়েছিলেন?(ইলিয়ানা)

—একটা জায়গায়।(আহান)

—কোন জায়গায় তাই জানতে চেয়েছি।(ইলিয়ানা)

—জেনে কি করবে?(আহান)

—আমার মাথা করবো। বিরক্তিকর!(ইলিয়ানা)

—কি?(আহান)

—কি?(ইলিয়ানা)

—তুমি না বিরক্তিকর বললা।তা কেন বললা?(আহান)

—আপনার কি আমাকে রাগাতে অনেক মজা লাগে?(ইলিয়ানা)

—তুমি রাগছো?(আহান)

ইলিয়ানা রাগাশ্রয়ী মুখশ্রীতে তাকায়।আহান স্যার ইলিয়ানার রাগাশ্রয়ী মুখশ্রীতে তাকিয়ে থাকে।মেয়েটাকে রাগলে খারাপ লাগে না।বেশ সুন্দরই লাগে।যেন আল্লাহর বেশ যত্নে বানানো মানুষ। অবশ্য আল্লাহর সকল সৃষ্টিই অসম্ভব সুন্দর।

চলবে?

#অনুরক্তি_এসেছে_তোমার_শহরে
#পর্বঃ১২
#বর্ষা
ইলিয়ানা সকলের থেকে বিদায় নিয়ে রিইউনিয়ন ত্যাগ করেছে।রায়হান ভাইয়ের বাড়ি রিক্সায় মিনিট দশেকের দূরত্ব।ইলিয়ানা রিক্সায় চড়ে বসে। কিছুক্ষণের মাঝেই পৌঁছে যায় রায়হান ভাইয়ের বাড়ি দরজায়।তবে আসার পূর্বে ভাগ্নে,ভাগ্নি,ভাতিজা,ভাতিজির জন্য চকলেটস,কেনডিস সব আনিয়েছে জ্যাককে দিয়ে। জ্যাক আশ্চর্য হলেও তেমন কিছুই বলেনি। কেননা ইলিয়ানার হুমকিতে জ্যাক এখনো ভীতস্থ।

ইলিয়ানা ফ্লাটে প্রবেশ করতেই বাচ্চারা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ইলিয়ানাকে।তবে নুকতা কিছুটা দূরত্ব রেখেই দাঁড়ায়।ইলিয়ানা একদম অবাক হয় না। ছোটবেলায় তার বোনটা তাকে সবসময় নন মাহরাম পুরুষদের থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলো।সে ক্ষেত্রে ইলিয়ানা তো নুকতার বাইয়োলজিকাল খালামনি না,সেহেতু তারা মাহরামও না।

ইলিয়ানার কষ্ট হলেও বাস্তবতা সে মেনে নিয়েছে। কেননা সেই ছোট্টটি থেকেই সে বাস্তবতা মেনে নিতে শিখেছে। প্রথমে ভাবীর প্ররোচনায় ভাইয়ের পরিবর্তন।

ইলিয়ানা বাচ্চাদের হাতে চকলেটস দিয়ে ইলমা আপুকে বলে ফ্রেশ হতে রুমে চলে যায়।লাগেজ থেকে টপস আর প্লাজু বের করে পড়তে নিলেও পরমুহূর্তেই মন পড়ে এগুলো এখানে পড়লে সেই অড মুহূর্ত ফেস করবে। কেননা ভাই-বোনের সাথে দূরত্বটা বছরের! অভিমানের।

১০ বছর পূর্বের ফ্লাশ ব্যাক,,,,,,,

”ইলিয়ানা,সামনের বছর তোমার এসএসসি পরীক্ষা আর তুমি মোবাইলের ভেতর ঢুকে আছো?এ কেমন প্রস্তুতি নেওয়া তোমার!”

সাবিনা বেগমের কথায় একবিন্দু হেলদোল না দেখিয়ে ইলিয়ানা মোবাইল টিপতেই থাকে।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতর ভক্ত বলে কথা।এতদিন কবিতা পড়েছে আর এখন কবিতা লেখা।মিসেস সাবিনা মেয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলে রায়হানকে বলেন,

”রায়হান তোর বোন কি করছে দেখ!আজ বাদে কাল প্রথম টিউটোরিয়াল আসছে।আর সে বসে বসে মোবাইল টিপছে!”

ভাইকে বলার সাথে সাথেই গম্ভীরমনা রায়হান ”ইলিয়ানা” বলে ডাকার পূর্বেই ইলিয়ানা বই খাতার ভিরে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।পুরো বিছানায় বই খাতা দিয়ে তার গম্বুজ তৈরি করা।রায়হান হাসে বোনের কর্মে। মেয়েটা তাকে যে বড্ড ভয় পায়।

ইলিয়ানা সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত পড়ে খাওয়ার নাম করে সেই যে ওঠে তারপর ফোন নিয়ে বসে পড়ে‌। প্রতিদিনের মতো প্রিয় মানুষটিকে বিরক্ত করতে ম্যাসেজ দেয়।হ্যা দশম শ্রেণীর ছাত্রীর মনে তখনি প্রণয়ের উদ্ভাবন হয়।তবে এ ভালোবাসা প্রথমে ছিলো শুধু মাত্রই প্রিয় ব্যক্তির তালিকায়।যা এখন প্রণয়ে রুপ নিয়েছে। কিসের লুকোচুরি আর!যখন সেই মানুষটি জানে যে ইলিয়ানা তাকে ভালোবাসে।তখন অনুভূতি লুকানো কি যায়!

ইলিয়ানা একটা ম্যাসেজ দিয়েই ইউটিউবে মুভি দেখতে শুরু করে।তবে তার অভিজ্ঞতাকে ভুল প্রমাণিত করে আহান স্যার।মুভি শেষে মোবাইল হাতে নিয়ে অবাক হয় সে।প্রায় ঘন্টাখানেক আগে রিপ্লাই দিয়েছে আহান স্যার।ইলিয়ানা অবাক এবং হতভম্ব হয়।এভাবেই চলছিলো দিনগুলো।তবে হঠাৎ নেমে এলো ইলিয়ানার জীবনে ধ্বংস।

দিনটা ছিলো রবিবার।কোনো এক কারণে স্কুল বন্ধ। সারাদিন ঘুমিয়ে কাবার করার চিন্তা করলেও ভোর করেই ঘুম ভাঙে তার। তবে প্রতিদিনের মতো আর তার মাতা সাবিনা বেগম জেগে ওঠেন না‌।ইলিয়ানার জীবনটা যেন থমকে দাঁড়ায়।কাল রক্তদানের পর শরীর দূর্বল থাকায় জ্ঞান হারিয়ে সে রাত্রি কাবার করেছে‌।তাই মায়ের শরীরের উত্তাপ হারানো‌ শরীর জড়িয়ে ঘুমিয়ে থেকেও উপলব্ধি করেনি সে।

কাঁদতেও পারেনি বেচারি।স্তব্ধ বসে ছিলো।জ্ঞান হারিয়ে পুরো একঘন্টা পড়ে ছিলো।ইলমা এসে বোনকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেই চলেছিলো।মেয়েটা একটুও নড়চড় করেনি।এযেন মা হারিয়ে অতি কষ্টে পাথর হওয়া!

ইলিয়ানা সেদিন একটা কথাই বলেছিলো,”আজ আমার সব শেষ।হয়তো তোমাদের সাথে সম্পর্কের শেষ আজ থেকেই শুরু।”

শান্ত কন্ঠে এতোটুকু বলেই অঝোর ধারায় কেঁদে বলে উঠেছিলো,

”আম্মু আব্বু তো আমায় সেই ছোট্টটি রেখেই চলে গেলো।আর তুমিও আমায় একা করে চলে গেলে!আমি আজ তোমাদের ছাড়া পুরোপুরি অনাথ হয়ে গেলাম।”

ইলিয়ানার সেই কষ্ট দেখার কেউ ছিলো না।ইলমা আপু ছোট্ট নুকতার কান্না থামাতে ব্যস্ত ছিলো। ইলিয়ানার কান্না কেউ দেখেনি।স্কুল কামাই ছিলো পুরো দশটা দিন।কেউ একটা খোঁজও নেইনি।প্রথম কয়েকটা দিন দু-চারজনের ম্যাসেজ থাকলেও কেউ আর ম্যাসেজ দেয়নি।

দশদিন পরে স্কুলে গিয়ে দরখাস্ত লেখে সে স্কুল কামাইয়ের ছুটি নিতে।স্যারকে দরখাস্ত দেখায়।স্যার পড়ে দেখে না। বরং ধমকে জিজ্ঞেস করে বাসা থেকে গার্ডিয়ান দিয়ে ফোন দেওনি কেন।ইলিয়ানার কান্না পায়।তবে একফোঁটা অশ্রুও গড়ায়নি‌।ইলিয়ানা ক্লাসটিচারের ধমক শুনে বলে ওঠে,

”স্যার প্রিন্সিপাল স্যারের থেকে ছুটি নিয়ে আসি?”

স্যার রাগ দেখিয়ে বলেন,”যাও”

সেদিন ইলিয়ানা এতো সকালে প্রিন্সিপাল স্যারকে খুঁজে পায়নি।স্যার আসেননি। কেননা তিনি অন্য একস্কুলে জয়েন করবেন।ইলিয়ানা অনেক সময় বাইরে অপেক্ষা করে ক্লাসে আসলে স্যার তাকে ভেতরে আসার অনুমতি দিলেও কারণ না জেনে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করে।ইলিয়ানা আর কান্না থামাতে পারে না। কেঁদে দেয়।কাছের বান্ধুবীগুলো তাকে মেন্টাল সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করে।তবে মা হারার কষ্ট কি তা কি কেউ বোঝে!

ইলিয়ানা স্যারকে বলে,”স্যার আমি যেহেতু আপনাকে কল করেনি, পাশাপাশি প্রিন্সিপাল স্যারের থেকে সাইনও আনতে পারিনি।আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি।সাইন আনতে পারলেই আসবো”

ইলিয়ানাকে ক্লাসটিচার রাগ দেখিয়ে বলে,”তোমার ইচ্ছে হলে দাঁড়িয়ে থাকো,বসে থাকো,ক্লাসের বাইরে যাও।যা মন চায় করো”

ইলিয়ানা ক্লাসের বাইরে চলে যায়। রাগ সংবরণ করতে না পেরে উল্টো করে রাখা বেঞ্চে জোরে করে নিজের হাত মারে সে।পাশের ক্লাস থেকে আহান স্যার ইলিয়ানাকে পর্যবেক্ষণ করে।একটা সময় বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

”বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?”

ইলিয়ানা ততক্ষণে কান্না থামিয়েছে তবে রাগ কমেনি একবিন্দুও।তাইতো প্রিয় মানুষটির সাথেও রাগ দেখিয়ে বলে,
”আমার ইচ্ছে হয়েছি দাঁড়িয়ে আছি। আপনার সমস্যা?”

আহান স্যার মুচকি হেসে বলেন,”ইচ্ছা হলে দাঁড়িয়ে থাকো”

আহান স্যার চলে যান।ইলিয়ানা সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে বার এক নিচ তলা থেকে ঘুরে আছে।একবার জানালার কাছে দাঁড়ায়,তো আবার ফিরে এসে চারতলার নিজ ক্লাসের সামনে উল্টো করে রাখা বেঞ্চে বসে পড়ে।আহান স্যার এবার ইলিয়ানাকে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। ইলিয়ানাদের ক্লাস টিচারকে জিজ্ঞেস করেন।ইলিয়ানার মতো তাদের ক্লাস টিচারেরও উত্তর এমন ছিলো যে,”ওর ইচ্ছে হইছে তাই ও এখানে বসে আছে!”

আহান স্যার কিছু হয়তো বলে গিয়েছিলো।তাই তো ইলিয়ানাকে একটু পর ভেতরে আসতে বলেন ক্লাসটিচার।তবে দোষ না করেও কথা শোনানোতে সে বলে যখন পার্মিশন আনতে পারবো তখনই ঢুকবো।সেদিন ইলিয়ানা পার্মিশন নিয়েই ঢুকেছিলো।

দেখতে দেখতে দিনগুলো এভাবেই যাচ্ছিলো।তবে মায়ের মৃত্যুর আগেরদিন যেই দাদুকে সে রক্ত দিয়েছিলো সেই দাদুর সাথে আবারো দেখা হয় তার। অবশ্য দাদুটাই তাকে দেখে দৌড়ে আসে।তবে আজ তিনি একা ছিলেন না।ছিলেন একটা কমবয়সী ভাইয়ার মতো পুরুষ।আর একজন মাঝবয়সী পুরুষ। তাদের কথায় ইলিয়ানা যেন বিশতলা ছাদ থেকে পরে।মাঝবয়সী লোকটা ইলিয়ানাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

”ইলিয়ানা মাম্মাম কেমন আছো তুমি?কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে ডেডকে রেখে!”

ইলিয়ানাকে অবাক করে সেদিন কিছু তথ্য তার সামনে আসে।সব অস্বীকার করে বাসায় ফিরে আসে সে।তবে বাসায় এসে আশ্চর্য চকিত হয় যে তার ভাই তাকে না জানিয়েই বিয়ে করে এনেছে আজ।মেয়েটা অনেক সুন্দর।ইলিয়ানা কষ্ট পেলেও খুশি হয়।ভাইকে জানায় না আজকের ঘটনা।ইলিয়ানার খুশিটা হয়তো ধরার ছিলো না।

তাইতো ইলিয়ানার টেস্ট পরীক্ষার মাঝেই রায়হান ওর বিয়ে ঠিক করে অচেনা কারো সাথে।কি কান্নাটাই না কাঁদে সেদিন ইলিয়ানা।তবে শেষমেশ রাজি হয়।বাবা-মা মরার পর অধিকাংশ ভাই-বোন যে পর হয়ে দাঁড়ায়!তবে বিয়ের দিন রাতে ইলিয়ানার বাঁধা ভেঙে ইলিয়াস পুলিশ নিয়ে হাজির হয়।হাতে ডিএনএ রিপোর্ট।ইলিয়ানা ওর হারিয়ে যাওয়া বোন।ও ওর বোনকে নিয়ে যাবে।ইলিয়ানা কষ্টে এতোটাই কাতর হয়ে পড়েছিলো যে বর নামক ব্যক্তিটিকে না দেখেই রায়হানের অবাধ্য হয়ে ইলিয়াসকে ভাই বলে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো।কে ছিলো তার বর?

ইলমা আপু আসতে অনেকটা দেরি করেছিলো।তাইতো ইলিয়ানাকে অন্য কারো বুকে লুটোপুটি খেতে দেখে টেনে নিজের কাছে এনে ঠাসিয়ে দু’ঘা লাগিয়েছিলো।সেই যে অভিমান হলো, এসএসসি অব্দি গাজীপুরে থাকলেও যোগাযোগ করেনি আর পালক ভাই-বোনের সাথে।নিজ পরিবারের সাথেই মানিয়ে নিলো!নিজ স্কুল থেকে এসএসসি দিয়ে একেবারেই নিরুদ্দেশ হলো।নাম,পরিচয় কতকিছুই না পরিবর্তন হলো।ইলিয়ানার গলায় নাম লেখা লকেটটা আঁকড়ে এখনো জীবনটা অতিবাহিত করছে!

ফ্লাসব্যাক শেষ;(বিঃদ্রঃ ঘটনাক্রমে আরো কিছু অতীত সামনে আসবে।যা বর্তমানকে নাড়িয়ে দিবে)

ইলিয়ানা বাচ্চাদের সাথে খুনসুটিতে মেতে ওঠে।যেন জেনিকে ওদের মাঝে খুঁজে পায়।জেনিকে যে ছোট্টটি থেকেই একদম কাছে পেয়েছে সে।যেমন প্রথম কয়েকবছর নুকতাকে পেয়েছিলো সে।তাইতো জেনির মতো নুকতার প্রতিও আলাদা টান তার।তমা ভাবীর কথায় তাচ্ছিল্য যে যুক্ত ছিল তা প্রকাশিত করেই তিনি বলেন,

”ইলিয়ানা দেখে যাও তোমার পরিচিত কয়েকজন লোক এসেছেন”

ইলিয়ানা ড্রয়িংরুমে গিয়ে অবাক হয়।আহান স্যার এসেছেন। কিন্তু কেন?আর তার সাথে এতোগুলো লোকই-বা কেন?

চলবে?