Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1040



বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-১৩+১৪

0

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১৩+১৪

গাইনোকোলজিস্ট সাবিত্রী দেবীর চেম্বারে থম মেরে বসে আছে তিতির। যে মিথ্যা দিয়ে গল্পের শুরুটা হয়েছিলো, সেই মিথ্যাটা এখন সবচেয়ে কঠিন সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে তিতিরের সামনে।

সাবিত্রী দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তিতির তুমি আমার মেয়ের বয়েসী। তাই নিজের মেয়ে মনে করেই বলছি তুমি এবরশন করে ফেলো। এই বাচ্চাটা তোমার শরীরের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে।

মনে হচ্ছে কেউ শক্ত করে তিতিরের গলা চেপে ধরেছে। কিছুতেই গলা থেকে আওয়াজ বের করতে পারছে না।

অনেক কষ্টে বললো, কিন্তু ম্যাম ওর কী দোষ ?

দোষ ওর নয় তিতির, দোষ তোমার শারিরীক অবস্থার। তোমার শারিরীক অবস্থা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়।

কিন্তু পঁচিশ বছর তো বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত বয়স তাহলে ?

উপযুক্ত বয়স হলেও তোমার অনেক কমপ্লিকেশন আছে সেটা রিপোর্টে স্পষ্ট। যত সময় যাবে তুমি তত অসুস্থ হতে থাকবে। ডেলিভারিতে তোমার আর বাচ্চার দুজনেরই লাইফ রিস্ক হয়ে যাবে।

তিতির কী বলবে বুঝতে পারছে না।

তিতির কোনমতে বললো, আমার একটু সময় চাই।

ঠিক আছে, তুমি ভালো করে চিন্তা ভাবনা করে দেখো। তবে বেশি দেরি করো না, তাহলে এবরশনও রিস্ক হয়ে যাবে।

তিতির এলোমেলো পায়ে বের হয়ে গেলো হসপিটাল থেকে। মাঝে আরো দুটো দিন পেরিয়েছে, একটু বেশি অসুস্থ ফিল করায় হসপিটালে এসেছিলো তিতির। এখানে এসে এসব জানতে পারবে কল্পনাও করেনি। এবার কী করবে সে ? বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়ে যদি সেও মা*রা যায় তাহলে পাখিকে কে দেখবে। বাচ্চাটা এখনো একটা ভ্রুণ মাত্র কিন্তু পাখিকে সে কোলেপিঠে করে বড় করেছে ষোল বছর ধরে। নিজের সন্তানের থেকে কোনো অংশে কম নয় পাখি। কাকে বেছে নিবে তিতির সন্তান, নাকি বোন। আর তাজ সে কখনো এই বাচ্চা মেনে নিবে না। সবাই যদি এই বাচ্চার কথা জানতে পারে তাহলে মৌ ফিরে পাবে না তাজকে। নাহ তিতির কাউকে জানতে দিবে না এই বাচ্চার কথা। তিতির নিজের পেটে হাত রেখে অনুভব করার চেষ্টা করলো। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তিতিরের, এখানে ছোট একটা প্রাণ আছে।

তিতির কাঁদতে কাঁদতে বললো, মাকে মাফ করে দে সোনা। তোর মা যে বড্ড স্বার্থপর। শুধু যদি নিজের জীবনের ঝুঁকি থাকতো তাহলে কখনো তোকে মে*রে ফেলার কথা ভাবতাম না। কিন্তু তোর এই স্বার্থপর মায়ের জীবনের সাথে আরো একটা জীবন জড়িয়ে আছে যে সোনা। তোর স্বার্থপর মা তোকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারবে না। তুইও ঘৃণা কর তোর মাকে, প্রচন্ড ঘৃণা।

কাঁদতে কাঁদতে ফুটপাতে বসে পড়লো তিতির। এদিকটায় নিরিবিলি, খুব একটা মানুষজন নেই। তিতিরের কান্নার আওয়াজে ভারী হয়ে উঠলো আশপাশটা। নিজের সন্তান খু*নের দ্বায় মাথায় নিয়ে কীভাবে বাঁচবে সে ? সারাজীবন এই যন্ত্রণা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। কিন্তু এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তার সামনে।

তুমি এখানে কী করছো ?

গম্ভীর আওয়াজে মাথা তুলে তাকালে তিতির। সামনে তাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি নিজের চোখের পানি মুছে ফেললো।

তাজ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, এখানে বসে কান্না করছো কেনো ? চোখের পানি জমিয়ে রাখো, খুব তাড়াতাড়ি এই পানির প্রয়োজন হবে।

তিতির না বুঝে ভাঙা গলায় বললো, মানে ?

খুব তাড়াতাড়ি জানতে পারবে সেটা। এখন এখানে বসে সিনক্রিয়েট না করে গাড়িতে গিয়ে বসো। তোমার নাটক দেখতে দেখতে আমি নিজেই অভিনয় ভুলে গিয়েছি।

তিতির কথা না বাড়িয়ে উঠে তাজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো, যেটা রাস্তার অপর পাশে পার্ক করা। তিতিরকে দেখে তাজ গাড়ি থামিয়েছে। তিতির রাস্তায় পা রাখতেই তাজ হাত ধরে টান দিলো। দ্রুত গতিতে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো একটা প্রাইভেট কার।

কী করছিলে এখনই উপরে চলে যেতে।

তিতির তাকালো চলে যাওয়া গাড়ির দিকে তারপর তাজের দিকে তাকালো, আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি স্যার। উপরে চলে গেলে একটু বিশ্রাম অন্তত পেতাম।

তাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো তিতিরের দিকে। তিতির তাজের দৃষ্টি উপেক্ষা করে হাতের দিকে তাকালো। সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিলো তাজ। তিতির রাস্তার এপাশ ওপাশ দেখে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। তাজও তার পিছনে গেলো। গাড়িতে উঠে সিট বেল লাগিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো তিতির। তাজ একবার তিতিরের দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তাজের হঠাৎ খেয়াল হলো গত দেড় মাসে তিতির শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখের নিচে গাড়ো কালো দাগ পড়েছে, ফর্সা মুখে যেটা খুব বাজে লাগছে। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে সাদা হয়ে আছে, মনে হচ্ছে কেউ শরীরের সব রক্ত শুষে নিয়েছে।

তাজ সামনে তাকিয়ে বললো, এদিকে কোথায় গিয়েছিলে ?

তিতির স্বাভাবিক গলায় বললো, আরো একটা পাপ করার প্রস্তুতি নিতে।

তাজ বাঁকা চোখে তাকালো তিতিরের দিকে। মেয়েটা সবসময় এমন এমন কথা বলে রাগে তাজের মাথায় রক্ত উঠে যায়। যেমন এখন রাগে ইচ্ছে করছে গাড়ি থেকে লা*থি দিয়ে ফেলে দিতে। আ*ব*জ*র্নাটাকে গাড়িতে উঠানো ভুল হয়েছে তার। নাকমুখ কুঁচকে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো তাজ। তিতির আঁড়চোখে তাকালো তাজের দিকে। তিতিরের হাতটা আপনাআপনি চলে গেলো নিজের পেটে।

মনে মনে বললো, ওর কথা আপনি কোনদিন জানতে পারবেন না। যেদিন জানতে পারবেন সেদিন হয়তো ও থাকবে না কিংবা আমি। সেদিন হয়তো আরো একটু বেশি ঘৃণা করবেন আমাকে।

তিতির বললো, আমাকে একটু আমার ফ্ল্যাটের সামনে নামিয়ে দিয়েন।

তাজ সরু চোখে তাকিয়ে বললো, কেনো ?

তিতির বললো, আজ রাতটা সেখানেই থাকতে চাই।

তিতির কোথায় থাকলো না থাকলো তাতে কিছু যায় আসে না তাজের। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। তিতির আগের মতো লুকিয়ে দেখছে তাজকে, প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছে। কোনো জানি মনে হচ্ছে আর দেখতে পাবে না এই মানুষটাকে। শেষবারের মতো নিজের আসক্তিকে প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছে তিতির। তাজ তিতিরের দিকে তাকালে দেখতে পেলো সে চোখ বন্ধ করে আছে, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল তিতির তাকে দেখছে। বা*জে চিন্তা বাদ দিয়ে গাড়ি চালানোয় মন দিলো তাজ। তিতিরের ফ্ল্যাটের সামনে গেলে তিতির চুপচাপ নেমে যায়। তাজ তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে। আজ একটু বেশি বিধস্ত দেখাচ্ছে তিতিরকে কিন্তু কারণটা বুঝতে পারছে না তাজ।

তাজ নিজের উপর বিরক্ত হয়ে বললো, এতো কী ভাবছিস তাজ ? দেখ গিয়ে এটা আবার নতুন কোন নাটক শুরু করেছে।

১৫.
রাত নেমেছে পৃথিবীর বুকে। রুমের এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছে তিতির। গায়ের শাড়িটা এখনো চেঞ্জ করা হয়নি তার। নিজের পেটের উপর হাত রেখে চুপচাপ বসে আছে।

আজ রাতটা শুধু তোর আর আমার। আজ সারারাত মা ছেলে মিলে গল্প করবো ঠিক আছে সোনা বাচ্চা আমার। ইশ তুই ছেলে নাকি মেয়ে সেটা তো জানিই না।

চোখে পানি চলে এলো তিতিরের, আর কোনোদিন জানতেও পারবো না। তুই আমার ছেলে কারণ ছেলেরা যে মাকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু তোর মাকে তো কেউ ভালোবাসে না, তুইও বাসবি না আমি জানি। তবে বিশ্বাস কর তোর মা তোকে খুব ভালোবাসে কিন্তু সে অসহায়, নিরুপায়।

হু হু করে কেঁদে উঠলো তিতির। কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার, খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে আজ।

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বললো, আই লাভ ইউ সোনা।

হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে চমকে উঠলো তিতির। এতরাতে এখানে কে আসবে। তাজ ছাড়া তো কেউ জানে না সে আজ এখানে আছে, তাহলে কী তাজ ? কিন্তু সে কেনো এখানে আসতে যাবে ? তিতির ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। অনেক সাহস নিয়ে দরজা খুললো। ঝড়ের বেগে কেউ জাপ্টে ধরলো তাকে। ঝোঁক সামলাতে না পেরে দু’কদম পিছিয়ে গেলো।

ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেউ বললো, আপুনি।

হুঁশ ফিরলো তিতিরের ভেঙে ভেঙে বললো, বোনু তুই ?

পাখিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তিতির। ছেড়ে দিলে আবার হারিয়ে যাবে যেনো। বেশ অনেকটা সময় লাগলো তিতিরের নিজেকে সামলে উঠতে। পাখিকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে সারামুখে চুমু খেতে লাগলো। আবার বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তিতিরের কান্নায় পাখিও কাঁদছে। দীর্ঘ দেড় মাস পর বোনুকে পেয়েছে তিতির। গত ষোল বছরে একটা দিনও বোনুকে দূরে রাখেনি সে।

তিতির কাঁদতে কাঁদতে বললো, কোথায় চলে গিয়েছিলি বোনু ? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি তুই ? আর কখনো একা ছাড়বো না তোকে।

আহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে। এটাই তার তুতুল বিশ্বাস করতে পারছে না। কী বিধস্ত অবস্থা চেহারার। ছোটবেলায় নাদুসনুদুস চেহারার মেয়েটার এই হাড্ডিসার দেহ, গলার হাড়গুলো যেনো চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে, ফ্যাকাশে মুখে চোখের নিচে গাড়ো কালো দাগ।

আহান অস্পষ্ট আওয়াজে বললো, তুতুল।

এতক্ষণে তিতিরের চোখ পড়লো পাখির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আহানের দিকে। তার আওয়াজ শুনতে পায়নি তিতির, তবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে একটু থমকালো।

পাখিকে নিজের থেকে একটু সরিয়ে, আপনি কে ?

আহান কাঁপা গলায় বললো, তুতুল তুই আমাকে চিনতে পারছিস না ?

কেঁপে উঠলো তিতির। আজ কতগুলো বছর পর এই নামে কেউ ডাকলো তাকে। নামটা তো সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো। তিতির ভালো করে দেখতে লাগলো সামনে দাঁড়ানো অচেনা ছেলেটাকে। তিতিরের চোখ আঁটকে গেলো ছেলেটার ডানপাশের ভ্রুর কাটা দাগে। ধূলোপড়া স্মৃতি হাতড়ে উঠিয়ে আনলো সেই দিনটা।

তিতির ভাঙা গলায় বললো, আহু ?

আহান বাচ্চাদের মতো ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে মাথা উপরে নিচে নাড়িয়ে বুঝালো হ্যাঁ সে আহু। তুতুলের খেলার সাথী আহু।

তিতির দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আহানকে। আহানও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তার তুতুলকে। এত বছরের হাহাকার করা বুকে যেনো এক পশলা বৃষ্টি হলো আহানের।

কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি তুই তুতুল। সেদিন ঘুম থেকে উঠে তোদের বাড়ি গিয়ে দেখি কেউ নেই। মামা-মামী, তুই কেউ নে। বেলা গড়িয়ে মামা-মামীর লা*শ বাড়িতে এলো তারপর আর কোনোদিন তোকে খোঁজে পায়নি আমি। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম, বাবা বাধ্য হয়ে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়।

বাবা শব্দটা শুনে ছিটকে দূরে সরে গেলো তিতির। এত বছর পর নিজের ছোটবেলার খেলার সাথীকে দেখে কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিলো অতীতের ভয়ংকর সেই রাতের কথা। তিতির দৌড়ে পাখির কাছে এসে বুকে জড়িয়ে নিলো পাখিকে।

ভীত গলায় বললো, তোকে রায়হান চৌধুরী পাঠিয়েছে তাই না ? পাখিকে ফিরিয়ে দিতে পাঠিয়েছে, কাজ হয়ে গেছে এবার চলে যা।

আহান কঠিন গলায় বললো, আমাকে রায়হান চৌধুরী পাঠায়নি, আমি রায়হান চৌধুরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পাখিকে তোর কাছে নিয়ে এসেছি। কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তোর ঠিকানা পেতে, জানিস তুই ?

তিতির অবাক হয়ে বললো, রায়হান চৌধুরী জানে না তুই পাখিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিস ?

নাহ্ রায়হান চৌধুরী কিছুই জানে না।

তিতির চমকে উঠলো আহানের কথা শুনে। ব্যস্ত গলায় পাখির দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের এখনই এখান থেকে চলে যেতে হবে বোনু। রায়হান চৌধুরী জানতে পারলে তোকে আবার কেড়ে নিবে আমার থেকে।

আহান বলল, কী বলছিস এসব ?

তিতির তাকালো আহানের দিকে কিছু ভেবে আহানের সামনে হাত জোর করলো, পাখিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে অনেক বড় উপকার করেছিস। এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে আর একটা সাহায্য কর আহান। এর বিনিময়ে তুই যা চাইবি তাই দিবো আমি। শুধু রায়হান চৌধুরীর নাগালের বাইরে নিয়ে চলে।

আহান মনে মনে বললো, তুই চাইলে তো নিজের জীবনটাও দিয়ে দিবো রে তুতুল।

চল আমার সাথে।

তিতির যেতে গিয়েও থেমে গেলো, এক মিনিট দাঁড়া।

তিতির দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ব্যস্ত হাতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। আর কখনো দেখতে পাবে না এই রুমটাকে। জীবনের দীর্ঘ ষোলটা বছর কাটিয়েছে এখানে, কতশত স্মৃতি এখানে। এসবের মায়া করলে হবে না এখন, পাখিকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যেতে হবে তাকে, অনেক অনেক দূরে। আহান তিতির আর পাখি গাড়িতে গিয়ে বসতেই আহান গাড়ি নিয়ে ছুটতে লাগলো ব্যস্ত ঢাকা শহরের বাইরে৷

তিতির চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললো, ভালো থাকবেন স্যার। ভালো থেকো মৌ আপু, তোমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম তোমাকে। মাফ করবেন স্যার যাওয়ার সময়ও আপনার জীবন থেকে কিছু কেড়ে নিয়েই গেলাম। তবে আজ আপনার জীবন থেকে বিষাক্তফুলের বিদায় হল তার বিষাক্ততা নিয়ে।

তিতির গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো, আবার কী আসা হবে এই শহরে ? হয়তো না।

১৬.
এতরাতে ফোনের আওয়াজে বিরক্ত হলো রায়হান। সারাদিন হসপিটালে থেকে, বিয়ের কেনাকাটা করে ক্লান্ত হয়ে শুয়েছে। এখন আবার কে বিরক্ত করছে তাকে।

ফোন রিসিভ করে ঘুমঘুম গলায় বললো, হ্যালো।

স্যার দুদিন ধরে আহান স্যার তার ফ্ল্যাটে নেই আর মেয়েটাও।

এক ঝটকায় ঘুম উড়ে গেলো রায়হানের, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো।

ধমকে উঠলো, ফ্ল্যাটে নেই মানে কী ?

স্যার, দু’দিন আগে আহান স্যার মেয়েটাকে নিয়ে বাইরে আসে। আমরা ভেবেছিলাম অন্যদিনের মতো ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা নজর রেখেছি কিন্তু আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। ভেবেছিলাম খোঁজে পেয়ে যাবো তাই আপনাকে জানায়নি। কিন্তু আজ জানতে পারলাম আহান স্যার মেয়েটাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে।

চমকে উঠলো রায়হান, হোয়াট ?

ভীত গলায় উত্তর এলো, ইয়েস স্যার।

প্রচন্ড বেগে গাড়ি ড্রাইভ করছে রায়হান। সে ছুটে চলেছে তিতিরের ফ্ল্যাটের দিকে।

একহাতে ফোন কানে কাউকে চিৎকার করে বলছে, ঢাকার মধ্যেই আছে ওরা প্রত্যেকটা অলিগলি তন্নতন্ন করে খোঁজ। সকালের মধ্যে আহান আর পাখিকে আমি আমার আস্তানায় দেখতে চাই। খোঁজে বের করতে না পারলে তোদের একটাকেও বাঁচিয়ে রাখবো না আমি।

ফোন রেখে দিলো রায়হান। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে তার। মৌকে পাওয়ার আনন্দে এতোই মত্ত ছিলো যে আহান, পাখি কিংবা তিতির কারো উপরেই আগের মতো নজর রাখেনি। নিজের উপর রাগ হচ্ছে রায়হানের। এতোটা কেয়ারলেস সে কীভাবে হতে পারলো ? ওরা যদি একবার তিতিরের কাছে পৌঁছে যায় তাহলে সব খেলা শেষ হয়ে যাবে। তার এতদিনের সাজানো প্ল্যান সব ন*ষ্ট হয়ে যাবে। সেটা সে কিছুতেই হতে দিবে না। মৌকে পাওয়ার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তাকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট সহ্য করতে পারবে না রায়হান। ঝড়ের বেগে তিতিরের ফ্ল্যাটের সামনে এলো। কিন্তু ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। তলা ঝুলছে দরজায়, কিন্তু রায়হান ভালো করেই খোঁজ নিয়েছে তিতির আজ এখানে এসেছে আর তাজের বাড়িতে লাগানো ক্যামেরা বলে দিচ্ছে তিতির সেখানে ফিরে যায়নি। রায়হান দু-হাতে নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে উঠলো।

আহান তুই আমার নিজের ভাই হয়ে এতবড় ক্ষতি করে দিলি। আমারই ভুল হয়েছে, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুতুলের জন্য তুই নিজের ভাইকে খু*ন করতেও দু’বার ভাববি না। সে জন্য তিতির আর পাখির পরিচয় গোপন রেখেছিলাম। কিন্তু তুই সব জানলি কী করে ? আমারই ভাই তো তাই মাথার ব্রেনও আমার মতোই। কিন্তু ভাই, তুই যদি চলিস ডালে ডালে আমি চলি পাতায় পাতায়। বাংলাদেশের যে প্রান্তেই তুই থাকিস আমি খোঁজে বের করবো। আর তিতির আমার কথার অবাধ্য হওয়ার চরম মূল্য দিতে হবে তোকে। শুধু একবার হাতের নাগালে পাই।

রায়হান তিতিরের ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজায় লাথি দিয়ে বের হয়ে গেলো। যে করেই হোক এই তিনজনকে খোঁজে বের করতে হবে তাকে। একবার মৌ বা তাজের কাছে পৌঁছে গেলে সব শেষ হয়ে যাবে। সিকিউরিটি রুমে গেলো ফুটেজ দেখতে, যে গাড়িতে গেছে তার নাম্বার পাওয়া যায় কিনা।

১৭.
আমরা কোথায় যাচ্ছি আহান ?

আপাতত ঢাকার বাইরে চলে এসেছি। ভাইয়ার সম্পর্কে যতটা জেনেছি সারাদেশে তার লোক আছে। তবে ঢাকায় তার পাওয়ার বেশি। এখন বড় কোনো শহরে যাওয়া যাবে না। সেখানে ধরা পরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পুরোপুরি গ্রামেও যাওয়া যাবে না, সেখানে আমরা সবার নজরে পড়বো সহজে আর ভাইয়ার লোক থাকলে বিপদ হয়ে যাবে। ছোটখাটো কোনো শহরে গা ঢাকা দিতে হবে।

তিতির আহানের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো, আহু তুই আর রায়হান চৌধুরী এক মায়ের পেটের ভাই তো ?

আহান জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো, এ কথা কেনো বলছিস তুই ?

তিতির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, যেখানে রায়হান চৌধুরী নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য এতটা নিচে নেমে গেছে। নিজের বোনদের ব্যবহার করতেও তার বিবেকে বাঁধেনি। সেখানে তুই তারই ভাই হয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে আমাদের সাহায্য করছিস।

আহান তিতিরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো, তুই যদি একবার বুঝতে পারতি আমার জীবনে তোর জায়গাটা কোথায়। রায়হান চৌধুরীর সাথে এই একটা জায়গায় আমার মিল আছে রে তুতুল, ভালোবাসা। তবে আমার ভালোবাসার ধরণটা তার থেকে আলাদা। সে ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য এতো নিচে নেমেছে আর আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে ভালো রাখতে সব করতে পারবো। সে আমার কাছে ভালো থাক বা অন্যকারো কাছে।

কথাগুলো মুখে বলা হলো না আহানের। সামনে তাকিয়ে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো। তিতির নিজের ব্যাগ থেকে আবার ফোনটা বের করলো।

অন করার আগেই আহান বললো, কী করছিস ?

তিতির মলিন হাসলো, রায়হান চৌধুরীর কথায় দুটো জীবন এলোমেলো করে দিয়েছি রে আহু। সেগুলো আমাকেই ঠিক করতে হবে। নাহলে সারাজীবন সেই পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে।

আহান ব্যস্ত গলায় বললো, তোর ফোন অন করলে ভাইয়া লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে জেনে যাবে আমরা কোথায় আছি।

তিতির চিন্তিত হয়ে পড়লো, কিন্তু কাজটা করা যে খুব বেশি জরুরি।

আহান একটু চিন্তা করে বললো, আমার ফোনটা দিয়ে করতে পারবি ?

তোর ফোন অন করলে বুঝবে না ?

নাহ্ এটা সম্পূর্ণ নতুন ফোন। ঢাকায় এসে প্রথমেই একটা ফোন কিনেছি।

আহানের ফোনটা নিলো তিতির। নিজের ফোনের এসডি কার্ড খুলে আহানের ফোনে লাগিয়ে নিলো। নিজের ফোনটা জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো।

আহান এসডি কার্ড উদ্দেশ্য করে বললো, এটা দিয়ে কী কাজ ?

এটাতে রায়হান চৌধুরীর সব পাপের প্রমাণ আছে। এগুলো স্যারের কাছে পৌঁছে দিলেই হয়ে যাবে।

আহান কৌতূহল নিয়ে বলে, স্যার কে ? আমার কাছে এখনো সবটা পরিষ্কার না তুতুল। ভাইয়া পাখিকে কি*ড*ন্যা*প কেনো করেছিলো আর কীভাবে করেছিলো ? আর গাড়িতে উঠে কী সব বলে একটা ভিডিও বানালি তাও বুঝলাম না।

আহানের কথা শুনে তার দিকে তাকালো তিতির, অনেক কিছুই তুই জানিস না আহু। সব এখনই তোকে বলা সম্ভব নয়। এখন যেটুকু বলা সম্ভব সেটুকুই বলছি।

তিতির পাখির কি*ড*ন্যা*প হওয়া থেকে শুরু করে, রায়হানের হু*ম*কি, তিতিরের তাজকে ব্ল্যা*ক*মে*ই*ল করে বিয়ে করা, সব একে একে খুলে বললো আহানকে। তিতিরের বিয়ের কথা শুনে মাথা শূন্য শূন্য লাগছে আহানের। তার তুতুল অন্যকারো হয়ে গেছে এটা মানতে পারছে না।

তিতির বললো, এবার সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে স্যারকে নির্দোষ প্রমাণ করে নিজেকে কিছুটা পাপ মুক্ত করতে চাই।

তিতির আহানের ফোনের সাহায্যে তাজের কাছে সব প্রমাণ পাঠিয়ে দিলো। তিতিরের ফোনে কল রেকর্ডের অপশন অন করে রাখা ছিলো আগে থেকেই। সেখানে রায়হানের সমস্ত কথা রেকর্ড হয়েছে। সে কীভাবে তিতিরকে বাধ্য করেছে তাজের নামে মিথ্যা বলতে সব আছে। তিতির একটা ভিডিওতে নিজে সবটা স্বীকার করেছে সেটাও পাঠালো। তিতির সমস্ত প্রমাণ তাজ আর মৌ দুজনের ফোনেই পাঠিয়ে দিলো।

আহান নিজেকে সামলে বললো, ফোনটা দে আমি পুলিশের কাছে সব পাঠাচ্ছি। আমার বন্ধুর বাবা পুলিশ কমিশনার। সেই বন্ধুর সাহায্যে তোকে খোঁজে বের করেছি। ওর কাছে পাঠালে ওর বাবা একশন নিতে পারবে।

আহান ফোনটা নিয়ে সব প্রমাণ পাঠিয়ে দিলো ওর বন্ধুর কাছে। সকালের মধ্যে রায়হানের কাছে পুলিশ পৌঁছে যাবে।

মিস্টার খানকে ভালোবাসিস তাই না রে তুতুল ?

আহানের কন্ঠটা কেমন অসহায় শোনালো। তিতির আহানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো, স্যার আমার জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত একটা অধ্যায় আর আমিও তার জীবনে। সে অন্যকারো ছিলো আর অন্যকারোই থাকবে।

আর তুই ?

তিতির তাকালো আহানের দিকে। বুঝার চেষ্টা করলো তার কথার মানে। আহান চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। তুতুলের চোখে চোখ রাখার সাহস হচ্ছে না আহানের। যদি সে চোখে অন্যকারো জন্য ভালোবাসা দেখে, তবে সেটা সহ্য করতে পারবে না। তিতির কিছু না বলে পেছনে তাকিয়ে পাখিকে দেখে নিলো। সে পিছনের সীটে ঘুমিয়ে পড়েছে।

বোনু তোকে অনেক জ্বালিয়েছে না রে ?

আহান মুচকি হেসে বললো, ছোটবেলায় তুই যেমন দুষ্টু ছিলি পুতুল তেমন হয়েছে।

তিতির প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো আহানের দিকে, পুতুল ?

তুই হয়তো ভুলে গিয়েছিস, আমি বলেছিলাম ওকে আমি পুতুল বলেই ডাকবো। তবে দেখতেও কিন্তু পুতুলের মতোই হয়েছে রে মাশাআল্লাহ। থাক এসব বাদ দে, তুই একটু ঘুমিয়ে নে, নাহলে শরীর খারাপ করবে।

শরীরের কথা শুনতেই তিতিরের মুখ কালো হয়ে গেলো। মনে পরে গেলো নিজের ভেতরে বেড়ে উঠা আরেকটা অস্তিত্বের কথা। তিতির ফট করে তাকালো আহানের দিকে। আহানকে তিতির বিশ্বাস করে নিজেকে যতটা বিশ্বাস করা যায় ঠিক ততটা। যদিও সময়ের সাথে মানুষ বদলে যায়, তবে গত কয়েক ঘণ্টায় তিতির যতটুকু বুঝেছে আহান ঠিক আগের মতোই আছে।

তিতির নিজের পেটে হাত রেখে বললো, আমার কিছু হয়ে গেলে আমার বোনুটাকে একটু দেখে রাখতে পারবি আহু ?

তড়িৎ গতিতে ব্রেক কষলো আহান। সীট বেলের জন্য বেঁচে গেছে তিনজনই। পাখি ঘুমের মধ্যে সামনে হেলে পড়েছে।

তিতির পেছন ফিরে পাখির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বললো, পাগল হলি এভাবে কেউ ব্রেক করে ?

আহান তাকালো তিতিরের দিকে, এখনই কী বললি তুই ?

বললাম এভাবে কেউ ব্রেক করে ?

এটা নয়, তার আগে কী বললি ?

পাখিকে হাত বাড়িয়ে সোজা করার চেষ্টা করছিলো তিতির। এবার তিতির তাকালো আহানের দিকে অসহায় দৃষ্টি তার, বলেছি আমার কিছু হয়ে গেলে আমার বোনুকে একটু দেখে রাখবি ? এই পৃথিবীতে তোকে ছাড়া বিশ্বাস করার মতো আমার আর কোন জায়গা নেই আহু। দেখ বেশি কিছু করতে হবে না, তিনবেলা একটু খাবার আর পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করবি, এটুকুই।

আহান সীট বেল খুলে এগিয়ে এলো তিতিরের দিকে। তিতিরের দুগালে নিজের হাত রেখে অসহায় গলায় বললো, এসব কেনো বলছিস তুতুল ? তোর কেনো কিছু হতে যাবে ?

তিতির আহানের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো, জীবনটা অদ্ভুত রে আহু। কখন কোন দিকে মোড় নেয় বলা মুসকিল। এই দেখ না সকালে ঘুম থেকে উঠার সময় আজকে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার জন্যও আমিও প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু তাতে কিছু আঁটকে থেকেছে কী, যা হওয়ার ঠিক হয়েছে।

অশান্ত হয়ে উঠলো আহান, না এভাবে কথা ঘুরাবি না তুই। কিছু তো একটা হয়েছে, আমাকে বল কী হয়েছে তোর ? নাহলে আমি এখনই হসপিটালে নিয়ে যাবো, তোকে দেখতেও অনেক অসুস্থ মনে হচ্ছে। আমার কাছে লুকাতে পারবি না তিতির, এখনো ডাক্তার না হলেও ডাক্তারি পড়ছি আমি।

অবস্থা বেগতিক দেখে তিতির মুখ খুলতে বাধ্য হলো, আহু আমি প্রেগনেন্ট।

বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেনো আহানের মাথায়, হোয়াট ?

তিতির আর কিছু বলতে পারলো না। আহান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে প্রেগনেন্ট এটা বললেও ডক্টরের বাকি কথা সে কিছুতেই কাউকে জানতে দিবে না। তিতির ঠিক করে নিয়েছে এই বাচ্চাটা সে কিছুতেই মে*রে ফেলতে পারবে না। এতোটা নিষ্ঠুরতম কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয় আর একটা অদৃশ্য মায়ায় জড়িয়ে গেছে এই বাচ্চার সাথে। সাথে সাথে তখন এটা উপলব্ধি করতে না পারলেও ধীরে ধীরে পেরেছে। সে পারবে না বাচ্চাটাকে নিজের জীবন থেকে সরিয়ে দিতে। আর এই বাচ্চাটাই তার জীবনে তাজের একমাত্র চিহ্ন। এদিকে আহান একের পর এক ঝটকা সামলে উঠতে পারছে না। নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে তার। আরো তো অনেককিছু জানা বাকি, সব সহ্য করবে কীভাবে ?

১৮.
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নিজের ফোন হাতে নিলো তাজ। এতোগুলো নোটিফিকেশন দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নোটিফিকেশন অপেন করে দেখলো একটা অচেনা নাম্বার থেকে অনেকগুলো অডিও ভিডিও আরো কী সব ডকুমেন্টস আছে। ভিডিওটা প্লে করে দেখে হাতের টাওয়েল ফ্লোরে পড়ে গেলো তাজের। ভিডিওতে তিতির নিজের মুখে সব স্বীকার করছে, সে কেনো রায়হানের কথায় সব করতে রাজি হয়েছে। কীভাবে কীভাবে রায়হান প্ল্যান করে তাজের নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাকে এবাড়িতে পাঠিয়েছে সব স্বীকার করছে তিতির।

ভিডিও শেষে তিতির বললো, স্যার নিদোর্ষ তার কোন ভুল নেই। দু’বছর আমি তার সাথে কাজ করেছি সে কখনো আমার দিকে বা*জে নজরেও তাকায়নি। তার জীবনটা এভাবে ন*ষ্ট করার দ্বায় আমারও আছে, সেটা আমি অস্বীকার করছি না। তবে আমি পরিস্থিতির স্বীকার। ভালো থাকবেন স্যার, যেভাবে হুট করে আপনার জীবনে এসেছিলাম আবার সেভাবে হুট করেই চলে গেলাম। পারলে মাফ করবেন আমাকে।

তিতিরের ঠোঁটের কোণে ঝুলছে মলিন হাসি। শেষে ভেসে উঠলো তিতিরপাখি দুই বোনের হাসোজ্জল কিছু ছবি। কত হ্যাপি মনে হচ্ছে তাদের দেখে। তাজ পাখির বিষয়ে কিছুই জানতো না। তাজ একে একে সব প্রমাণ ভালো করে দেখে নিলো। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য এর থেকে বেশি আর কিছুরই প্রয়োজন হবে না তাজের। তাজ তাড়াতাড়ি কল দিলো তিতিরকে কিন্তু বন্ধ বলছে।

তাজ চিন্তিত গলায় বললো, এসব কে পাঠালো, তিতির ? তিতির পাঠালে নিজের নাম্বার থেকেই পাঠাতে পারতো। তবে কে পাঠালো আর তিতিরই ফোন ধরছে না কেনো ? তবে কী সত্যি চলে গেছে তিতির ?

তাজ কোনমতে চেঞ্জ করে ছুটলো তিতিরের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে। কী হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার। এদিকে মৌ নিজের বেডে থম মেরে বসে আছে। সবগুলো প্রমাণ সে নিজেও দেখেছে। রায়হান এতোটা নিচে নেমে গেছে ভাবতে পারছে না সে। হঠাৎ করেই তিতিরের জন্য কষ্ট হচ্ছে মৌয়ের। শেষের ভিডিওটা আবার প্লে করলো মৌ। এটা মৌকে পাঠালেও তাজকে পাঠায়নি তিতির।

কেমন আছো মৌ আপু ? হয়তো ভালো নেই কারণ তোমার ভালো থাকার কারণ কেড়ে নিয়েছিলাম আমি। সব প্রমাণ দেখে এতক্ষণে হয়তো জেনেও গেছো আমি বাধ্য ছিলাম। আমার জায়গায় অন্যকেউ হলে কী করতো আমার জানা নেই ? তুমি কী করতে আপু ? যদি তোমার বাবা-মার জীবন বাঁচাতে এমন কিছু করতে বলা হতো ? আপু আমার জীবনে আপন বলতে ঐ বোনটা ছাড়া আর কেউ নেই। খুব খুব বেশি ভালোবাসি বোনুটাকে। আপু আমার বোনুটা বুদ্ধি প্রতিবন্দী, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর কিছুই বুঝে না ও।

তিতির ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুমন্ত পাখিকে একবার দেখালো। মৌয়ের নিজেরও মায়া হলো ঘুমন্ত মেয়েটার উপর, সেখানে তিতির তার বোন।

তিতির আবার ক্যামেরা নিজের দিকে করে বললো, থাক সেসব কথা। আজ থেকে তুমি ভালো থাকবে আপু, তোমার ভালো থাকার কারণ তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম। কখনো হয়তো দেখা হবে না আর, আমি চাইও না আমার বিষাক্ত ছায়া তোমাদের জীবনে আবার পড়ুক। স্যার সত্যি বলে আমি বিষাক্তফুল। ভালো থেকো আপু আর স্যারকেও অনেক ভালো রেখো। পারলে মাফ করে দিও এই খা*রা*প মেয়েটাকে, আল্লাহ হাফেজ।

মৌ বুঝতে পারলো তার চোখে নোনাজলের বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আজ তো তার খুশি হওয়ার কথা তবে এতটা কষ্ট কেনো হচ্ছে, কেনো তিতিরের মলিন মুখটা চোখে ভাসছে ? বাইরে চেঁচামিচির আওয়াজ শুনে মৌ দরজা খোলে ড্রয়িংরুমে এলো।

রায়হান উঁচু গলায় বলছে, বিয়েটা আজ আর এখনই হবে। পরে অনুষ্ঠান করা যাবে কিন্তু বিয়ে এখনই হবে।

চলবে,,,,

বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-১১+১২

0

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১১+১২

আহান দ্রুত ফোন রিসিভ করে বললো, কোনো ইনফরমেশন পেয়েছিস ?

ওপাশ থেকে উত্তর এলো, ভাই ঢাকা শহর মোটেও ছোট জায়গা নয়। প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ বাস করে এই ঢাকা শহরে। এখানে একটা নাম আর একটা ছবি দিয়ে কাউকে খোঁজা মানে খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো। তুই মেয়েটার পুরো নামও জানিস না, কীভাবে খোঁজে পাবো ?

আসলে ভাইয়া যখন পাখিকে এখানে রেখে যায় আমি ওর উপর প্রচন্ড বিরক্ত ছিলাম তাই কিছু জানার আগ্রহ দেখায়নি। এখন যদি ভাইয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করি সন্দেহ করতে পারে।

তুই মেয়েটার পাসপোর্ট খোঁজে বার কর। সেখানে অনেক তথ্য পাবি আশা করি।

আরে ইয়ার এটা তো আমার মাথাতেই আসেনি।

তোর মাথায় তো এখন শুধু পাখি উড়ছে তাই আসেনি। এখন বাজে না বকে পাসপোর্ট খোঁজে দেখ, আরো কিছু জানতে পারিস কিনা।

ঠিক আছে।

আহান কল কেটে পাখির রুমের দিকে গেলো পাসপোর্ট খোঁজে বার করতে। পাসপোর্ট পেলে অনেক কিছুই জানা যাবে। তিতিরের সারা রুম তন্নতন্ন করে খোঁজে কিছুই পেলো না। হতাশ হয়ে বসে পড়লো আহান। একটা সূত্র পাওয়ার আশা করেছিলো সেটাও ব্যর্থ হলো।

১৩.
নিজের কেবিন এলোমেলো করে কিছু খুঁজছে রায়হান। জিনিসটা যে তার কাছে অনেক বেশি দামী। কতগুলো বছর ধরে সেটা আগলে রেখেছে সে। আজ কীভাবে হারিয়ে গেলো, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার। মৌ রায়হানের কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে তার অস্থিরতা দেখছে।

কিছু সময় পর শান্ত গলায় বললো, এটা খুঁজছিস রায়হান ?

মৌয়ের আওয়াজে চমকে পিছনে ফিরে তাকালো রায়হান। মৌয়ের হাতে কাংখিত জিনিস দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো। দ্রুত পায়ে মৌয়ের কাছে এসে জিনিসকে নিজের হাতে নিয়ে নিলো।

হাসি মুখে বললো, এটাই তো খুজছিলাম। তুই এটা কোথায় পেলি ?

মৌ স্বাভাবিক গলায় বললো, তিতিরের বেডে পরে ছিলো।

রঙ বদলে গেলো রায়হানের চেহারার। ভীত চোখে তাকালো মৌয়ের দিকে।

মৌ চেয়ার টেনে বসে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো, একই রকমের দুটো কলম কিনেছিলাম আজ থেকে তাও কয়েক বছর আগে। একটা তোকে দিয়েছিলাম আর একটা তাজকে। দেওয়ার দুদিনের মাথায় তাজের কলমটা হারিয়ে ফেললেও তোর বুক পকেটে সবসময় কলমটা আমি দেখেছি এতবছর ধরে। কিন্তু আজ সেটা তিতিরের বেডে গেলো কীভাবে বল তো ?

রায়হান কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না। মনে মনে সাজাতে লাগলো কী বলে এই পরিস্থিতি থেকে বের হবে।

মৌ আবার বললো, প্রথমদিন তোকে দেখে তিতিরের ভয় পাওয়া আমার সন্দেহ তৈরি করে। আমি খেয়াল করেছি তিতির তোকে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলো। আজও দেখলাম ডুকরে কাঁদছে মেয়েটা আর বেডে পরে থাকতে দেখলাম তোর কলম। এবার বল তিতিরের সাথে তোর কী সম্পর্ক ?

রায়হান আমতা আমতা করে বললো, তুই ভুল বুঝছিস মৌ। তিতিরের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

মৌ কঠিন গলায় বললো, সত্যিটা বল রায়হান। আমার সাথে মিথ্যা বললে তার ফল ভালো হবে না।

রায়হান এবার স্বাভাবিক গলায় বললো, তিতির আমার মামাতো বোন।

মৌ অবাক চোখে তাকালো রায়হানের দিকে। যদি বোনই হয় তাহলে পরিচয় দিতে এতো সংকোচ কেনো রায়হানের আর তিতির ভয় কেনো পাচ্ছে নিজের ভাইকে।

মৌ সন্দেহাতীত ভাবে বললো, তিতির যদি তোর বোন হয় তাহলে ও ভয় কেনো পাচ্ছে তোকে আর তুই পরিচয় কেনো দিতে চাইছিলি না।

রায়হান নিজের চেয়ারে বসে বললো, তিতির ছোটবেলা থেকেই ভয় পায় আমাকে। মাঝে অনেক বছর যোগাযোগ ছিলো না তাই ভয়টা বেড়েছে হয়তো।

তিতির কাঁদছিলো কেনো তুই ওর কাছে যাওয়ার পর।

সেটা আমি জানি না।

মিথ্যা বলবি না রায়হান।

আমি কোনো মিথ্যা বলছি না। জানি না কেনো কাঁদছিলো তিতির।

এদিকে থম মেরে বসে আছে তাজ। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না তার।

ভাঙা গলায় গার্ড তারেকের উদ্দেশ্যে বললো, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে তারেক।

তারেক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না স্যার। নাম্বারটা আমার বন্ধু রায়হান চৌধুরী ইউজ করছে জেনে বারবার চেক করেছি কিন্তু বরাবরই এক ফলাফল।

তাজ বিধস্ত গলায় বললো, রায়হান আমার সেই ছোটবেলার বন্ধু। ও কেনো আমার সাথে এমনটা করবে তারেক ?

তারেক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, এটুকু জেনেই ভেঙে পড়েছেন স্যার ? বাকিটা কীভাবে সহ্য করবেন তাহলে ?

তাজ হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো তারেকের দিকে, আর কী বাকি আছে তারেক ? আমার জীবনে প্রিয় বন্ধুর তালিকায় দুজন মানুষ আছে। তাদের একজন আমার এতবড় ক্ষতি করলো, বিশ্বাসঘাতকতা করলো আর কী বাকি আছে ?

স্যার, আপনার বন্ধু দিনের আলোতে একজন দয়াবান ডক্টর আর রাতের অন্ধকারে জেগে উঠে তার আরেক রুপ।

মানে কী বলতে চাইছো ?

যে হসপিটালে রায়হান চৌধুরী আছে, গরীব অসহায় মানুষদের অল্প ব্যয়ে চিকিৎসা দিয়ে সবার সামনে মহৎ সাজে তারা। রাতের অন্ধকারে জেগে উঠে সেই হসপিটালের আরেকটা রুপ। সেটা সবার চোখের আড়ালে।

তুমি কী বলতে চাইছো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তারেক।

ঐ হসপিটালের রাতের অন্ধকারে একটা নোংরা রহস্য লুকিয়ে আছে স্যার। আমাদের কাছে প্রমাণ নেই, তবে এসব সত্যি। আপনি চাইলেই রায়হানের সাথে পেরে উঠবেন না। সে অন্ধকারে নিজের একটা রাজত্ব তৈরি করেছে। সেখানে কেবল তারই রাজ চলে। স্যার আমাদের যা করতে হবে ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে কেবল বিপদ বাড়বে।

তাজ কিছু ভাবতে পারছে না। সে এতবড় ধাক্কা সামলাতে পারছে না। বন্ধু যদি শত্রু হয়ে তাহলে সেটা অনেক ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তার জানা থাকে আপনার প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য সকল বিষয়ে।

তাজ টলমল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি কিছু ভাবতে পারছি না তারেক।

তারেক আশ্বস্ত করে বললো, স্যার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন। রায়হান চৌধুরী কেনো আপনাকে নিজের শত্রু মনে করে একটু চিন্তা করলেই আপনি বুঝতে পারবেন। একটু চেষ্টা করুন, বুঝার।

তাজ এলোমেলো পায়ে নিজের গাড়ির দিকে গেলো। কোনরকমে বাড়ি পৌছে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তাদের এত বছরের বন্ধুত্ব।

রাজ তুই কেনো কম্পিটিশন থেকে নাম কেটে দিয়েছিস ?

আমাকে রাজ বলবি না। আমার নাম রাজ নয়, রায়হান।

তাজ বিরক্ত হয়ে বললো, এতবড় নাম বলতে ভালো লাগে না আমার। তাই তো কত সুন্দর করে আমার নামের সাথে মিলিয়ে তোর নাম রেখেছি রাজ। তাজ আর রাজ কত সুন্দর মিলে গেছে।

রাজ আর কিছু না বলে চুপ করে রইলো। আজ তাদের স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাজ আর রাজ দুজনেই কম্পিটিশনে নাম দিয়েছিলো। দুজনের গানের গলায় অনেক ভালো আবার অভিনয়ও করবে একটা নাটকে। তারা সহপাঠীরা মিলে একটা নাটক করবে আজ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাজ নিজের নাম কেটে দিয়েছে।

তাজ বললো, এখন বল নাম কেটে দিয়েছিস কেনো ?

আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।

তুই কত কষ্ট করে রিয়ার্সেল করেছিলি। এখন এসে এমন বলছিস কেনো ?

তোর কাজ তুই কর গিয়ে, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

রাজ হনহনিয়ে চলে গেলো তাজের সামনে থেকে। তাজ হা করে তাকিয়ে আছে রাজের যাওয়ার পানে। রাজ এখন সবসময় তার সাথে এমন রেগে থাকে কেনো বুঝে উঠে না তাজ। যেদিন থেকে মৌ তাজকে প্রপোজ করেছে সেদিন থেকে অদ্ভুত আচরণ করছে তাজ। তাজ আর বেশি না ভেবে নিজের কাজে চলে গেলো। একটু পরেই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।

রাজ স্কুলের পেছন দিকে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হলো স্কুল ড্রেস পরা কিউট একটা মেয়ে।

রাজের পাশে বসে বললো, তুই রাগ করেছিস রাজ ?

আমার নাম রাজ নয় রায়হান।

এতদিন তো রাজ বলেই ডাকতাম আমরা।

এখন থেকে রায়হান বলে ডাকবি। রাজ রাজ বলে মাথা নষ্ট করবি না।

মৌ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, তুই রাগ করেছিস আমার উপর। ঠিক আছে যা তুই কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট কর, আমি কিছু বলবো না।

মৌ উঠে চলে আসতে গেলে রাজ হাত টেনে ধরলো তার, তোর মুখের হাসি দেখার জন্য এতো কষ্ট করার পরও কম্পিটিশন থেকে সরে এলাম তাও এমন করে কাঁদবি ?

তুই তো রেগে আছিস, কাঁদবো না কী করবো, নাচবো ?

রাজ মুচকি হেসে বললো, তুই তো নাচতেই পারিস না।

মৌ নাক ফুলিয়ে তাকালো রাজের দিকে। রাজ নাক টেনে দিলো মৌয়ের। এই মেয়েটাকে খুশি করতেই রাজ নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছে।

মৌ রাজের পাশে বসে বললো, আসলে তাজ অনেক কষ্ট করেছে এই কম্পিটিশনে জেতার জন্য। এই কম্পিটিশনে জিতে গেলে আন্টি একটা গিটার কিনে দিবে বলেছে। তাজের সবচেয়ে বড় কম্পিটিটর তুই, কারণ স্কুলে তোরা দু’জনই সবচেয়ে ভালো গান গাইতে পারিস আর অভিনয় করতে পারিস। তাই তোকে বলেছি নাম কেটে দিতে। প্লিজ রাগ করসি না তুই। তুই তো আমার বন্ধু না ?

রাজ মনে মনে বললো, তাজের কষ্টটা তুই দেখলি আর আমারটা দেখলি না। আমিও কী কম কষ্ট করেছি এই কম্পিটিশন জেতার জন্য ? আজ শুধুমাত্র তোর হাসিমুখ দেখার জন্য সরে এলাম। তোর জন্য আমি সব করতে পারি মৌমাছি আর তুই তাজের জন্য।

শেষের কথাটা মনে মনে আওড়ে তাচ্ছিল্যে হাসলো রায়হান।

রুমে ফোনটা তখন থেকে বেজে চলেছে। ফোনের আওয়াজে বর্তমানে ফিরে এলো তাজ। মৌয়ের কথায় রাজ সরে গিয়েছিলো, সেটা অনেক পরে জানতে পারে তাজ। সেই কম্পিটিশন অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জিতে যায় তাজ। কিন্তু সব জানার পর সেই জিতে কোন আনন্দ খোঁজে পায়নি সে৷ মৌকে অনেক বকেছিস এর জন্য। মৌ তাজের জন্য সব করতে রাজি ছিলো তো, রাজ মৌয়ের জন্য সব করতে রাজি। দশম শ্রেণিতেই মৌ প্রথম তাজকে প্রপোজ করেছিলো কিন্তু তাজ মজা ভেবে উড়িয়ে দেয় আর রাজের ব্যবহার পরিবর্তন হতে থাকে তখন থেকে। তাজের সাথে দুরত্ব বাড়তে থাকে। এভাবে চলতে থাকে তাদের জীবন। মৌ অনেকবার গোপনে তাজের পথ থেকে সরিয়ে এনেছে রাজকে। তাজ সেটা কোনো না কোনোভাবে পরে জেনেও গেছে।

তাজ বিড়বিড় করে বললো, সেসবের প্রতিশোধ নিতেই কী রায়হানের এই পদক্ষেপ। সেসব তো ছোটবেলার বাচ্চামি ভেবে কবেই ভুলে গেছি আমি। রায়হান কী সে সবই পোষে রেখেছে নিজের মনে ? কিন্তু পরে তো রায়হান নিজের ইচ্ছায় মৌয়ের সাথে মেডিক্যালে পড়েছে আর আমি বিজনেস। এই সবকিছুর উত্তর কেবল রায়হানের কাছেই আছে।

কে*টে গেছে আরো এক সপ্তাহ। তিতির এই এক সপ্তাহ হসপিটালেই ছিলো। তার সাথে ছিলো তাজ, তবে তাজের হসপিটালে থাকার উদ্দেশ্য ছিলো অন্য। তাজ নজর রেখেছে হসপিটাল আর রায়হানের উপর। হসপিটালে গোপন কিছু চলছে সেটা আন্দাজ করতে পারলেও সঠিক তথ্য পায়নি। এদিকে রায়হানের উপর নজর রেখে এটুকুও বুঝতে পেরেছে মৌ তাজের আশেপাশে থাকলে সেটা রায়হান ভালোভাবে নিচ্ছে না। কোনো না কোনো বাহানা দিয়ে তাদের আলাদা করার চেষ্টা করে। তিতিরের দেখাশোনার জন্য নার্স আছে তাই তার দিকে নজর দিতে হয়নি তাজের। আজ হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাবে, সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে তাজ। তিতির বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে আর তাজ বেডের পাশের টেবিল থেকে রিপোর্টগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে।

তিতির ভাঙা গলায় বললো, নিজের নাক কে*টে পরের যাত্রা ভঙ্গ। কথাটা শুনেছেন স্যার।

তিতিরের গলা পুরোপুরি ঠিক হয়নি তবে কথা বুঝা যায়। তাজ তার কাছাকাছি থাকায় স্পষ্ট বুঝতে পারলো তিতিরের কথা।

তাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, মানে ?

তিতির মুচকি হেসে বললো, আমাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলেন ? আমি নিজেকে কষ্ট দিয়ে আপনাকে নাকানিচুাবানী খাইয়ে দিলাম।

তাজ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালো তিতিরের দিকে, তারমানে তুমি ইচ্ছে করে এমন করেছো ?

তিতির হাসিটা বজায় রেখে বললো, তো আপনার কী মনে হয় ? ওয়াশরুমে ভূতে এসে আমাকে বাথটবে ফেলে রেখে গিয়েছিলো ?

তাজ গাল চেপে ধরলো তিতিরের, তোমার মতো চরিত্রহীন মেয়ের দ্বারাই এসব সম্ভব। আর আমি কিনা নিজেকে দোষারোপ করে অপরাধবোধে ভুগছিলাম। আই জাস্ট হেইট ইউ তিতির।

তাজ রেগে বের হয়ে গেলো তিতিরের কেবিন থেকে।

টলমলে চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো তিতির, আপনি কোনো অপরাধ করেননি স্যার। তাই আপনার চোখে অপরাধবোধ দেখে নিজেকে আরো বেশি অপরাধী মনে হচ্ছিল। আজকে বলা কথাগুলোর জন্য আপনি হয়তো আরো বেশি ঘৃণা করবেন আমাকে, তবে নিজেকে তো অপরাধী মনে করবেন না। আপনার চোখে আমার জন্য অপরাধবোধ নয় ঘৃণা মানায়। আপনার ঘৃণা যে আমার আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। আমি আর যে কয়েকদিন আপনার সাথে আছি, আপনার ঐ চোখে আমার জন্য তীব্র ঘৃণা দেখতে চাই কেবল। আমি যতদিন এই পৃথিবীতে শ্বাস নেই ততদিন যেনো আপনার চোখে আমার জন্য তীব্র ঘৃণা থাকে। আপনার ঘৃণা আমার আসক্তি। আপনার মনে আমার জন্য যদি একটুও মায়া তৈরি হয়, ভ,,ভালোবাসা তৈরি হয়, তার প্রকাশ যেনো হয় আমার মৃ*ত্যু*র খবরে আপনার চোখের দুফোঁটা নোনাজল।

তিতির চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখের কোণ বেয়ে পড়ছে নোনাজল। কেবিনে কারো উপস্থিতি অনুভব করে চোখ মেলে তাকালো তিতির। মৌ এসেছে সাথে তিতিরের চিকিৎসা করা ডক্টর।

ডক্টর ইশরাক তিতিরের উদ্দেশ্যে বললো, নিজের প্রতি একটু যত্নশীল হন মিসেস খান।

মিসেস খান শব্দটা মৌয়ের বুকে তীরের মতো বিঁধল। এই ডাকটা শোনার অধিকার তো তার হওয়ার কথা ছিল। মৌ তিতিরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। ইশরাক আরো কিছু কথা বলে চলে গেলো। মৌ এগিয়ে গেলো তিতিরের দিকে।

তিতির মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার উপর তোমার অনেক রাগ তাই না আপু ?

মৌ মলিন হেসে বললো, সত্যি বলবো নাকি মিথ্যা ?

মিথ্যা শুনতে ইচ্ছে করছে না, সত্যিটা বলো।

মৌ বসলো তিতিরের পাশে চেয়ার টেনে, তাজকে আমি কবে থেকে ভালোবাসি সেটা আমি নিজেও জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, ভালোবাসা কী সেটা বুঝার আগে থেকে আমি তাজকে ভালোবাসি। বিয়ের আসরে তোমার কথা শুনে আমার সারা পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো। এত ভালোবাসার প্রতিদান কী এমন হওয়ার কথা ছিলো ? কিন্তু সেদিন বাসায় গিয়ে তুমি যখন বললে তাজ নির্দোষ তখন তোমাকে খু*ন করতে ইচ্ছে করেছিল আমার। সেটাকে তুমি রাগ বলবে নাকি অন্যকিছু সেটা তোমার ইচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীতে ঠান্ডা মাথায় তোমার বলা সব কথা চিন্তা করার পর বুঝতে পারি তুমি পরিস্থিতির স্বীকার। কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটা হয়তো তুমি চেয়েও সবার সামনে আনতে পারছো না। তারপর তোমার উপর থেকে রাগ চলে গেছে। তাজকে আমি ভালোবাসি আর শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত বাসবো। এখন কোনোদিন তাজ আমার হবে কি, হবে না। সেটা আমি নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি। তাজ যদি আমার হয় তাহলে হাজার বাঁধা পেরিয়ে সে আমার হবে। আমার ভালোবাসা মিথ্যা কিংবা আবেগ নয় তিতির। আর যদি সে আমার না হয়,,,

মৌ কথা অসমাপ্ত রেখে বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। তিতির কাঁদছে, সে একজনের এতবছরের ভালোবাসায় আঘাত করেছে। নিজেকে আবর্জনা মনে হচ্ছে তাজ আর মৌয়ের জীবনের।

তিতির কাঁদতে কাঁদতে বললো, তাজ তোমার হবে আপু, হতেই হবে। তাজ তোমার ছিলো আর তোমারই থাকবে।

১৪.
সময় বহমান দেখতে দেখতে মাস পেরিয়ে গেছে। তিতিরের প্রতি তাজের ঘৃণা বেড়েছে। তিতির নিজেই সেটা তৈরি করেছে নতুন নতুন কারণ দিয়ে। তাজের মুখে আই হেইট ইউ শব্দটা তিতিরকে অদ্ভুত প্রশান্তি দেয়। তাজ যখন তার দিকে একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকায়, সেই দৃষ্টি বুকে লাগে তিতিরের। তিতির কখনো ভুলতে পারবে না তাজকে আর ভুলতে চায়ও না। কিছুদিন ধরে সবকিছু অনেক অস্বাভাবিক শান্ত মনে হচ্ছে তিতিরের কাছে। যেনো আবার কোন বড় ঝড় আসতে চলেছে তাদের দিকে।

তিতির এক কাপ চা দিয়ে যাও।

ইরিনার ডাকে চিন্তার জগৎ থেকে বের হয়ে এলো তিতির। এ বাড়িতে আছে প্রায় দেড় মাস হতে চললো। তাজ আর ইকবাল খানের চোখের বিষ বলা চলে তিতিরকে। কিন্তু ইরিনা প্রথমদিকে তিতিরকে এড়িয়ে চললেও এখন খানিকটা স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করে। হয়তো একা একা থাকেন তাই তিতিরের সাথে টুকটাক কথা বলে নিজের একাকীত্ব কাটাতে চান। তিতির চা নিয়ে গেলো ইরিনার কাছে। ইরিনা বেলকনিতে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

তিতির চায়ের কাপটা রেখে বললো, আপনার চা।

ইরিনা তিতিরের দিকে তাকিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিলো, তোমাকে কেমন অসুস্থ দেখা যাচ্ছে। সারাদিনে কিছু খাওনি।

বেশ কিছুদিন ধরে তিতির অসুস্থ ফিল করছে, অস্বস্তি হচ্ছে, শরীরটাও দূর্বল লাগছে। আজ সকালে তো বমিও করেছে। প্রেশার আর গ্যাস্টিকের সমস্যা মনে হচ্ছে তার কাছে। খাবার খেতে ইচ্ছে করেনি তাই আর খায়নি।

তিতির নিচু গলায় বললো, গ্যাস্টিকের সমস্যা হয়েছে একটু।

ইরিনা সন্দেহাতীত ভাবে বললো, বেশি অসুস্থ ফিল করলে বলো আমাকে। এখন একটা মেডিসিন নিয়ে কিছু খেয়ে নাও।

তিতির মাথা নাড়িয়ে ঠিক আছে বুঝিয়ে ইরিনার রুম থেকে চলে এলো। তার খাবার দেখে বমি পাচ্ছে তাই আরো খেলো না। সে ছাঁদে চলে গেলো একটু ফ্রেশ বাতাস নিতে। পাখির কথা বড্ড মনে পড়ছে তার। শেষ কথা বলেছিলো আরো সাতদিন আগে। পাখির সাথে কথা বলার সময় রায়হান সবসময় তাদের মধ্যে থাকে। কখনো একা কথা বলার সুযোগ হয়নি। সেদিন কথা বলার পর রায়হানেরও কোনো খোঁজ নেই। তিতিরের কেমন ভয় ভয় করছে, কিছু তো একটা হতে চলেছে আবার।

***
বিয়েটা আমি করতে কারবো না বাবা, হতাশ গলায় কথাটা বলে বাবার দিকে তাকালো মৌ।

মহিবুল রহমান গম্ভীর গলায় বললো, কেনো করতে পারবে না ? রায়হান তোমার ছোটবেলার বন্ধু, দু’জন দু’জনকে বুঝবে। ছেলেটা তোমাকে ভালোবাসে, তাহলে প্রবলেম কোথায় ?

বাবা তুমি ভালো করেই জানো আমি তাজকে ভালোবাসি।

মহিবুল এবার কঠিন গলায় বললো, তাজ এখন বিবাহিত অন্যকারো স্বামী সেটা তুমিও ভালো করেই জানো।

মৌ অসহায় গলায় বললো, বাবা।

মহিবুল গম্ভীর গলায় বললো, বিয়েটা তুমি না করলে আমার মরা মুখ দেখবে। প্রত্যেক বাবার স্বপ্ন থাকে নিজের রাজকন্যাকে সাজিয়ে এক রাজপুত্রের হাতে তুলে দেওয়ার, আমারও আছে। এখন সিদ্ধান্ত তোমার উপর।

মহিবুল বের হয়ে গেলো মেয়ের রুম থেকে আর মৌ ধুপ করে বসে পড়লো নিজের বেডে। সে কিছুতেই তাজের জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারবে না।

মৌ বিড়বিড় করে বললো, এটা তুই ঠিক করছিস না রায়হান।

***
কাবার্ড থেকে বাসায় পড়ার পোশাক বের করতে গিয়ে একটা ছোট ব্যাগ চোখে পরে আহানের। পাঁচদিন ধরে বড্ড বেশি উদাসীন হয়ে আছে সে। পাঁচদিন আগে রায়হান হঠাৎ হাজির হয় আহানের ফ্ল্যাটে। আহানের হাতে এই ব্যাগটা দিয়ে বলে আহান যেনো তার বলার সাথে সাথে পাখিকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। রায়হান অপেক্ষা করেনি, ব্যাগটা দিয়ে আবার চলে গিয়েছে। আহান কিছু না বুঝে রায়হানের দিকে কেবল তাকিয়ে ছিলো। পাখিকে ফিরিয়ে দিতে হবে ভাবতেই আহানের বুকের ভেতর কেমন করে উঠে। মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে। পারবে না তাকে ছাড়া থাকতে। পাখিকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা শুনে সেই ব্যাগের প্রতি আর আগ্রহ হয়নি আহানের। এখন চোখে পড়তেই ইচ্ছে হলো এটাতে কী আছে দেখার জন্য। আহান ব্যাগটা নিয়ে নিজের বেডে বসলো। ব্যাগ খোলে ভেতরের জিনিস দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো আহানের। এটাতে পাখির পাসপোর্ট সহ যাবতীয় কাগজপত্র রাখা। আহান তাড়াতাড়ি পাসপোর্টটা নিয়ে খোললো। সবার আগে নামটা দেখলো, মানহা মাহমুদ পাখি। নামটা দেখে আহান থমকে গেলো।

মনে হচ্ছে স্পষ্ট স্বরে ছোট মেয়েলি কণ্ঠে বলছে, আহু আমার বোন হলে নাম রাখবো মানহা মাহমুদ পাখি।

সাথে সাথে ছোট একটা ছেলে বলছে, আর যদি বোন না হয়ে ভাই হয়।

নাহ আমার ভাই হবে না, আমার বোন চাই তাই বোন হবে। আমি আমার বোনকে পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখবো, অনেক ভালোবাসবো।

বাহ্ ভালো তো তুতুলের বোন পুতুল। আমি ওকে পুতুল বলেই তাকবো। আমার কাছে বিয়ে দিবি তোর বোনকে ?

খানিকটা চিন্তা ভাবনার পর মেয়েটা উত্তর দিলো, নাহ তোর কাছে আমার বোনকে বিয়ে দিবো না। আমার বোন সবসময় আমার কাছে থাকবে। আমি দুইভাই দেখে বিয়ে করবো, বড় ভাইকে আমি বিয়ে করবো আর ছোট ভাইয়ের সাথে আমার বোনুর বিয়ে দিবো। তারপর সবসময় আমার বোনু আমার সাথে থাকবে।

আমরাও তো দুই ভাই রে বোকা, তুই ভাইয়াকে বিয়ে করে ফেলবি আর আমি তোর বোনুকে।

নাহ্ রাজ ভাইয়া পঁচা, আমি তাকে বিয়ে করবো না।

আমাকে বিয়ে করবি তুতুল।

তুই না বললি আমার বোনুকে বিয়ে করবি।

তুই আমাকে বিয়ে করলে অন্য কাউকে বিয়ে করবো না, গড প্রমিস।

তুই আগে ঠিক কর আমাকে বিয়ে করবি, নাকি আমার বোনুকে।

তোকে।

টপ করে চোখ থেকে নোনাজল গড়িয়ে পড়লে হুঁশ ফিরে আহানের। কত বছর হয়ে গেছে স্মৃতিগুলো আজও তরতাজা। মুখটা স্পষ্ট হয়ে গেছে স্মৃতিতে, তবে অনুভূতিগুলো সতেজ। শুধু মানুষটা হারিয়ে গেছে কোথাও।

আহান চোখ মুছে বললো, তোকে আমি মাফ করবো না তুতুল। তুই আমাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলি। এতো বছরেও তোকে ভুলতে পারিনি আমি।

আহান পাখির বাবা-মার নাম দেখে আরো একবার হোঁচট খেলো, আবির মাহমুদ ,সুলতানা পারভীন মামা মামী ? এজন্যই কী ভাইয়া বলেছিলো পাখি আমাদের আপন কেউ ?

আহান বিড়বিড় করে বললো, এক মিনিট তবে পাখির আপুনি তিতির, মুসকান মাহমুদ তিতির ?

আহানের সব হিসেব মিলে গেলো মুহুর্তে। পাখির আপুনি আর কেউ নয় মুসকান মাহমুদ তিতির।

খুশিতে চকচক করে উঠলো আহানের চোখদুটো, পাখির আপুনি তিতির আর কেউ নয় আমার তুতুল। পাখির পরিচয় খুঁজতে গিয়ে আমি আমার তুতুলকে পেয়ে গেছি। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও অন্য কোনো মেয়েকে নিজের মনে জায়গা দিতে পারিনি রে তুতুল। পাখির মধ্যে হয়তো তোর ছায়া খোঁজে পেয়েছিলাম তাই ওর মায়ায় জড়িয়ে গেছি। এবার তোকে খোঁজে বের করবো আমি।

আহান হাসিমুখে নিজের চোখের পানি মুছে ফেললো। উঠে দাঁড়ালো পাখির কাছে যাওয়ার জন্য।

চলবে,,,,

বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-০৯+১০

0

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৯+১০

খাবার খাওয়া শেষে তিতির উঠে নিজের রুমের দিকে যেতেই তাজ গম্ভীর গলায় বললো, ওদিকে কোথায় যাচ্ছো ?

তিতির থমকে দাঁড়ালো আর কাঁপা গলায় বললো, রুমে।

তাজ খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়িয়ে তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, একটু আগে কী বলেছি কানে যায়নি তোমার ?

তিতির কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেললো। তাজ নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বললো, চুপচাপ রুমে এসো।

তিতিরের গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। তাজের এমন অদ্ভুত ব্যবহারের মানে খোঁজে পাচ্ছে না তিতির। তাজ একটু বেশি স্বাভাবিক আচরণ করছে যা তিতিরের কাছে আরো বেশি অস্বাভাবিক লাগছে। তাজ রুমে চলে গেলে তিতির কাঁপা পায়ে অগ্রসর হতে লাগলো তাজের রুমের দিকে। বুকে সাহস সঞ্চার করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে মুখের উপর এসে কিছু পড়লো। তিতির ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো তখনই কানে এলো।

সরি সরি আমি তোমাকে একদমই খেয়াল করিনি। একবার ডাকলেই চলে আসবে সেটাও বুঝতে পারিনি। অবশ্য তোমার মতো টাকার কাছে নিজের চরিত্র বিক্রি করা মেয়ের এটা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তিতির চমকে উঠলো তাজের কথা শুনে। অবাক চোখে তাকালো তাজের দিকে। তার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি তিতিরের রুহ কাঁপিয়ে দিয়েছে।

কী ভাবছো নিচে এসব কেনো বললাম ?

তিতির উত্তর দিলো না দেখে তাজ নিজেই আবার বললো, ভেবে দেখলাম যা হবার হয়ে গেছে। বিয়েটাও হয়ে গেছে সেটা তো মিথ্যা নয়। আমার কপালে হয়তো তোমার মতো একটা চরিত্রহীন মেয়েই আল্লাহ রেখেছিলো। কী আর করার তাই মেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি।

পরের কথাটা তাজ আফসোসের সুরে বললো। অপমানে চোখ থেকে এক ফোটা নোনাপানি গড়িয়ে পড়লো তিতিরের। নিচে তাকিয়ে দেখলো তার পায়ের কাছে একগাদা কাপড় পরে আছে তাজের।

তাজ সেটা খেয়াল করে বললো, আসলে এগুলো অনেক নোংরা হয়ে গেছে ধোয়া প্রয়োজন। আমার রুমের ওয়াশিং মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। একটু ধুয়ে দাও তো।

তিতির অবাক হয়ে বললো, এই রাতের বেলা ?

তাজ গম্ভীর গলায় বললো, রাত হয়েছে তো কী ? আমি বলেছি ধোয়া প্রয়োজন, মানে এখনই ধুবে।

তিতির কিছু না বলে কাপড়গুলো ফ্লোর থেকে তুলে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। তাজ বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলে তিতির ভয় পেয়ে পিছনে ফিরে তাকায়।

দরজায় ধাক্কা দিতেই তাজ বললো, কাপড় কাচার আওয়াজে আমার ঘুম হবে না। কাচা হয়ে গেলে নক করো আমি খোলে দিবো।

তিতির কিছু না বলে কাপড় ধুয়ে দিতে লাগলো। কাটা জায়গায় চাপ করতেই রক্ত বেরুতে লাগলো, ব্যাথায় হাত অবশ হয়ে আসছে। তবে কিছু করার নেই, ওভাবেই কাপড় কাচতে লাগলো। জামার লম্বা হাতার কারণ তিতিরের হাতের ব্যান্ডেজ চোখ পরেনি কারো। অনেক বেশি কাপড় হওয়ায় অনেক সময় লাগলো ধুতে, এদিকে গরমে ঘেমে একাকার অবস্থা তিতিরের। কাপড় ধোয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালে দেখলো পুরো জামাটাই ভিজে গেছে পানিতে নাহয় ঘামে। জামার হাতায় রক্তের দাগ লেগে ভিজে গেছে অনেকটা। তিতির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দরজায় নক করে অপেক্ষা করতে লাগলো তাজের জন্য। অনেকটা সময় পরেও দরজা না খুললে আবারও নক করলো। দরজা খুলছে না দেখে তিতির ভয় পেয়ে গেলো, জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে তবু কোনো সাড়াশব্দ নেই। একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো তিতির। এতগুলো কাপড় ধুয়ে এমনই ক্লান্ত সে, এখন আর শরীর চলছে না।

দরজা ঘেঁষে ফ্লোরে বসলো তিতির, ঘুমের মানুষের ঘুম ভাঙানো গেলেও জাগ্রত মানুষের ঘুম কখনো ভাঙানো যায় না। উনি তো ইচ্ছে করেই এখানে আঁটকে রেখেছে আমাকে।

অতিরিক্ত গরম লাগলে তিতির উঠে বাথটাবের দিকে এগিয়ে গেলো। বাথটবে শুয়ে পানি ছেড়ে দিলো। মুহূর্তে ঠান্ডা পানি তার শরীর ঠান্ডা করে দিচ্ছে।

তিতির বিড়বিড় করে বললো, আমাকে অপমান করে, কষ্ট দিয়ে আপনার যদি একটুও শান্তি হয় তাহলে আমার কোনো আফসোস নেই।

এদিকে তিতিরের দরজা ধাক্কানো বন্ধ হতেই তাজ শান্তিতে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। মেয়েটা অতিরিক্ত বিরক্ত করছিলো। এবার শান্তিতে ঘুমাতে পারবে সে। মেয়েটাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিবে সে কতবড় ভুল করেছে তার জীবন এলোমেলো করে। আবার অপর দিকে আসল কালপ্রিট জিতে গেছে মনে করে কোনো ভুল পদক্ষেপ নিবে তার অপেক্ষায় আছে তাজ। এসব চিন্তা করে বাঁকা হেসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো।

১১.
সকালের সোনালী রোদ চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙলো আহানের। পিটপিট করে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসলো। হাতে চোখ কচলে বুঝার চেষ্টা করলো নিজের অবস্থান। ফ্লোরে বসে বেডে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। সামনে তাকিয়ে ঘুমন্ত একটা মুখ চোখে পড়লো। মায়াবী সেই মুখে চোখ আঁটকে গেলো তার। হাতটা আপনাআপনি চলে গেলো সামনে থাকা মায়াবিনীর কপালে। ছোটছোট চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে অপলক তাকিয়ে রইলো সেই মুখপানে। আহানের কী হলো সে নিজেও বুঝতে পারছে না। একটু এগিয়ে তার কপালে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে দিলো। কেঁপে উঠলো সেই মায়াবিনী, হাত আঁকড়ে ধরলো আহানের। হাতটা নিজের বুকে জড়িয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলো। তার এহেন কাজে জমে গেলো আহান। নড়াচড়া করার শক্তিটাও যেনো পাচ্ছে না। ধীরে গতিতে তার দখল থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। পিটপিট করে তাকালো পাখি।

আহান মুচকি হেসে বললো, এখন কেমন লাগছে ?

ঠোঁট উল্টে উঠে বসলো সে। অন্যদিন তার এমন ঠোঁট উল্টানো বিরক্ত নিয়ে দেখে আহান তবে আজ সেই ঠোঁট উল্টানোতে অদ্ভুত মুগ্ধতা খোঁজে পাচ্ছে।

পাখি নিচু গলায় বললো, ব্যাথা করছে।

আহান পাখির হাত ধরে দেখে বললো, ব্যাথার মেডিসিন দিয়েছিলাম তো। তবু ব্যাথা কমেনি কেনো ?

পাখি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মাথা দেখিয়ে বুঝালো মাথা ব্যাথা করছে তার। আহান বুঝলো জ্বরের জন্য মাথা ব্যাথা করছে। দিন-রাত জ্বরে ভোগে সকালে জ্বর ছেড়েছে।

আহান বললো, কিছু হবে না। আমি ম্যাজিক করে ব্যাথা গায়ের করে দিবো।

গোল গোল চোখে তাকালো পাখি অবাক কণ্ঠে বললো, আপনি ম্যাজিক পাবেন পঁচা ভাইয়া ?

আহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো পাখির ডাক শুনে। তাকে ভাইয়া ডাকছে তাও আবার পঁচা ভাইয়া।

আহান একটু রেগে বললো, আমাকে পঁচা ভাইয়া বলবে না।

পাখি চিন্তিত হয়ে গেলো, তাহলে কী বলবো ?

আহান বললো, আমার নাম আহান। তুমি আমাকে আহান বলে ডাকবে আর তুমি করে বলবে।

পাখি ব্যস্ত গলায় বললে, না না নাম বলা যাবে না। আপুনি বলেছে, বড়দের নাম ধরে ডাকতে নেই আর তুমি করেও বলতে নেই। এসব বললে আমাকে পঁচা মেয়ে বলবে সবাই।

আহান মুচকি হেসে বললো, আমি তো তোমার বড় না। আমরা বন্ধু আর বন্ধুকে নাম ধরে ডাকতে হয়।

পাখি খিলখিল করে হেসে বললো, আমরা সত্যি বন্ধু ?

আহান পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, হ্যাঁ আমরা অনেক ভালো বন্ধু।

পাখি খুশি হয়ে বললো, ঠিক আছে আমি তোমাকে আহান বলবো। জানো তুমি, ঐ টিয়া ছাড়া আমার একটাও বন্ধু নেই। আপুনি তো আমাকে বাইরে যেতেই দেয় না,,,,

হঠাৎ থেমে গেলো পাখি। আহান প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে আছে।

পাখি হঠাৎ অস্থির গলায় বলে উঠলো, আমার আপুনি কোথায় ? আমি আপুনির কাছে যাবো।

কথা শেষ হতেই হাত-পা ছড়িয়ে কান্না করতে লাগলো পাখি।

আহান বেডে উঠে পাখির পাশে বসে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে বললো, কাঁদে না পাখি। তোমার আপুনি আছে তো, আসবে তোমার কাছে।

পাখি হেঁচকি তুলে বললো, আমি এখনই আপুনির কাছে যাবো।

আহান রাগ করার অভিনয় করে বললো, তুমি কান্না করলে আমি নিয়ে যাবো না তোমার আপুনির কাছে।

পাখি কান্না থামানোর জন্য ঠোঁটে এক আঙ্গুল চেপে ফুপিয়ে বললো, আমি কাঁদবো না তাও আপুনির কাছে নিয়ে চলো।

আহান পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, চিন্তা করো না আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে তোমার আপুনির কাছে নিয়ে যাবো। তোমার কাছে এটা আমার ওয়াদা আর আহান চৌধুরী নিজের ওয়াদা রক্ষা করতে ভুলে না কখনো। এখন ন্যান্সিকে ডেকে দিচ্ছি ফ্রেশ হয়ে নাও খেয়ে মেডিসিন নিবে। তারপর আমরা ঘুরতে যাবো আজ।

ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে আছে রায়হান। তাজ হার মেনে নিয়েছে এতে তার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু সেটা পারছে না সে। কেনো জানি এতো তাড়াতাড়ি তাজের হার মেনে নেওয়া স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না সে। তাজের বাড়ির অনেক জায়গায় গোপনে ক্যামেরা লাগিয়েছে রায়হান সাথে মাইক্রোফোন। তবে বেডরুমে লাগাতে নিজের কাছেই কেমন জেনো লেগেছে তাই সেখানে লাগায়নি। যতই হোক সম্পর্কে তিতির তার ছোটবোন, হোক না মামাতো বোন। রুমে তাজ একা নয় তিতিরও থাকবে তাই ক্যামেরা লাগায়নি। কিন্তু ডাইনিং টেবিলের কাছে ছোট ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনের সাহায্যে গতরাতে তাজের কথাগুলো শুনতে তার অসুবিধা হয়নি। তখন থেকেই চিন্তায় ডুবে আছে রায়হান। তাজ তো এতো সহজে হার মেনে নেওয়ার পাত্র নয়। রায়হান ঠিক করলো তাজ আর তিতিরের উপর আরো কড়া নজর রাখতে হবে এবার। তাজের মাথায় কী চলছে বুঝতে হবে।

ফোনের আওয়াজে হুঁশ ফিরলো রায়হানের। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো হসপিটাল থেকে ফোন দিয়েছে। শেষরাতের দিকে তার একটা অপারেশন ছিলো সেটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলো। কিছু কাজ দিনের আলোতে করা যায় না, সেসব করার জন্য বেছে নিতে হয় অন্ধকারে লুকনো রাতকে। রায়হান গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলো হসপিটালের দিকে। উদ্দেশ্য আরো একটা পাপ কাজ করা, যাতে হয়তো অন্ধকার নেমে আসবে অচেনা কারো জীবনে।

অলস ভঙ্গিতে রেডি হচ্ছে মৌ। গতরাতে তাজের নাম্বার খোলা পেলেও তাজ রিসিভ করেনি তার কল। তাজের এড়িয়ে চলা কষ্ট দিচ্ছে তাকে। এদিকে তিতির নামক মেয়েটাও সেদিনের পর লাপাত্তা। পুরো কথা শুনার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করেছে মৌ কিন্তু তিতির সেটা হতে দেয়নি। মৌয়ের কাছে নিজের জীবনটা এখন মাঝ নদীতে ভাসমান বৈঠা ছাড়া নৌকার মতো মনে হচ্ছে। জীবন তাকে কোন তীরে নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না সে।

মৌয়ের মা রুমে প্রবেশ করে বললো, তোমার বাবা একটা ছেলে দেখেছে। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো, তারা দেখতে আসবে।

মৌ কপাল কুঁচকে বললো, আমি বিয়ে করবো না মা।

তেতে উঠলেন রেহেনা, বিয়ে করবে না কেনো শুনি। উনত্রিশ বছর চলছে তোমার। ঠিক সময়ে বিয়ে দিলে পাঁচ বছরের বাচ্চা থাকতো। কার অপেক্ষায় বসে রইলে, ঐ তাজ ? যার জন্য এতকিছু করলে সে এখন আরেক জনের স্বামী।

আরেক জনের স্বামী কথাটা মৌয়ের বুকে তীরের মতো বিঁধল। সত্যি তাজ এখন অন্যকারো স্বামী, সেটা মানতে পারে না মৌ।

পুনরায় রেহেনার কথা কানে পৌঁছালো মৌয়ের, এখন আর কোনো তালবাহানা শুনবো না আমি। ছেলেটা ঐ তাজের থেকে হাজার গুণ ভালো। ঠিক সময়ে যেনো তোমাকে বাড়িতে দেখতে পাই।

মৌ অসহায় চোখে তাকালো নিজের মায়ের দিকে। রেহেনা তা উপেক্ষা করে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। মৌ ধপ করে বসে বেডে। আজ প্রায় নয় বছর ধরে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সে। অধিক সুন্দরী হওয়ায় দু’হাতে বিয়ের প্রস্তাব ঠেলে সরিয়ে তাজের জন্য অপেক্ষা করেছে সে। তবে এখন আর জোর পাচ্ছে না মনে। তার জানা নেই সামনে কী হতে চলেছে। সে এটুকু জানে সে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটু শান্তি দরকার তার।

সকালে প্রায় ন’টায় ঘুম ভাঙলো তাজের। উঠে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলতে গেলে দেখে লক করা। গতরাতের কথা মনে পরে যায় তার। দ্রুত দরজা খোলে ভেতরের গিয়ে চমকে উঠলো। বাথটাবের পানিতে ওয়াশরুমের ফ্লোরে ভিজে আছে আর বাথটবে ডুবে আছে তিতির। মুহূর্তে রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো তাজের। রেগে বাথটাবের সামনে দাঁড়িয়ে তিতিরের মুখের দিকে তাকালো। ফ্লোর পানিতে ভাসিয়ে গোসল করে হচ্ছে এখানে তার। পানি বন্ধ করে তিতিরের হাত ধরে টান দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করলো। তিতিরের কোনো হেলদোল না দেখে আরো রাগ হলো তাজের। হঠাৎ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো তাজ। পানি মেশানো লাল রক্তে হাত ভিজে উঠেছে তার। সাথে সাথে তিতিরের হাত ছেড়ে দিলো তাজ। এবার খেয়াল হলো বাথটাবের পানি অনেকটা লালচে হয়ে গেছে। ধীর গতিতে আবার তিতিরের বাম হাতটা আলতো করে তুলে নিলো। জামার লম্বা হাতা একটু উপরে তুলতেই লাল টকটকে ব্যান্ডেজ চোখে পড়লো, হাত টাও কেমন বরফের মতো ঠান্ডা। ছিটকে দূরে সরে এলো তাজ।

বিড়বিড় করে বললো, এই মেয়ে কী এখন আমাকে মার্ডার কেসে ফাঁসাতে চাইছে ?

তাজ কাঁপা পায়ে আবার এগিয়ে গেলো তিতিরের দিকে। নাকের কাছে হাত নিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো বেঁচে আছে কিনা, তাজের হাতটা অসম্ভব কাঁপছে।

হসপিটালের করিডোরে বসে আছে তাজ। আজ সাতদিন যাবত এখানেই আছে। তিতিরকে যখন হসপিটালে আনা হয় তার জীবন প্রদীপ নিভু নিভু করছে। তেল শেষে প্রদীপ যেমন নিভু নিভু করে তিতিরের অবস্থাও তেমনই ছিলো। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ আর ঠান্ডার জন্য অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়, এখনো বিপদ কাটেনি। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ডক্টর কিছু আশ্বাস দিতে পারছে না। তিতিরের হয়তো জীবনের হিসাব কিছু বাকি আছে তাই মরে মরে বেঁচে গেছে। তার বেঁচে থাকাও ডক্টরদের কাছে বিস্ময়। কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকালো তাজ। মৌকে দেখে আবার সামনে তাকালো।

মৌ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, বাসায় যাও একটু রেস্ট নিয়ে এসো।

তাজ নির্বিকার গলায় বললো, আমি মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু এভাবে নয় মৌ। ওর কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনো মাফ করতে পারবো না।

মৌ শান্ত গলায় বললো, ওর কিছু হবে না তাজ। তুমি চিন্তা করো না।

অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমার জন্য একটা মেয়ে আজ সাতদিন ধরে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। একবার চিন্তা কর, আমি প্রতিশোধের নেশায় কতটা অমানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটা যখন আধমরা হয়ে বাথটবে পরে ছিলো আমি তখন ওর কথা চিন্তা না করে ভেবেছিলাম ও মরে গেলে আমি মার্ডার কেসে ফেঁসে যাবো।

মৌ কী বলবে খোঁজে পাচ্ছে না। সেদিন ডাক্তার যখন জানালো তিতিরের অবস্থা অনেক খারাপ, বাঁচানো যাবে কিনা বলা যাচ্ছে না। তখন থেকেই তাজ অপরাধবোধে ভুগছে। তখন তার হুঁশ ফেরে সে কতটা অমানুষে পরিণত হয়েছে।

তাজ সোজা হয়ে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, মৌ বিশ্বাস কর আমি মেয়েটাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চাইনি। ও আমাকে যেমন মানসিক কষ্ট দিয়েছে সেটা ওকে বুঝানোর জন্য মানসিক কষ্ট দিতে চেয়েছিলাম।

মৌ কিছু বলবে তার আগেই একজন নার্স এসে বললো, রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার আপনাকে যেতে বলেছেন।

মৌ আর তাজ চমকে তাকালো নার্সের দিকে। তাজ কিছু না ভেবে উঠে তিতিরের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। মৌ তাজের পিছনে যেতে গেলে রায়হান হাত টেনে ধরলো পেছন থেকে।

মৌ পেছন ফিরে নিজের হাতের দিকে তাকালো যা আপাতত রায়হানের দখলে। মুখ তুলে তাকালো রায়হানের দিকে।

রায়হান বললো, তুই কোথায় যাচ্ছিস ?

মৌ বললো, তিতিরের কেবিনে।

রায়হান বিরক্ত গলায় বললো, তুই কী কিছুই বুঝিস না মৌ। ওরা হাসবেন্ড ওয়াইফ এখন ওদের একা ছাড়া উচিত।

মৌ ভ্রু কুঁচকে তাকালো রায়হানের দিকে। এই ছেলে গত সাতদিন ধরে তাকে বিভিন্নভাবে বুঝাতে চাইছে তাজ মেনে নিয়েছে মৌকে। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না মৌয়ের তবু সে চুপ আছে। কারণ সে তো জানে তাজের এই অস্থিরতা কেবল অপরাধবোধ থেকে।

মৌ বিরক্ত গলায় বললো, আমি বাচ্চা না রায়হান। আমাকে বুঝানোর প্রয়োজন নেই কোনটা ঠিক কোনটা ভুল।

রায়হান গম্ভীর গলায় বললো, এবার তোর উচিত তাজ আর তিতিরের জীবন থেকে সরে যাওয়া।

মৌ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, কে কার জীবন থেকে সরবে সেটা তো সময় বলে দিবে।

মৌ রায়হানের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে তিতিরের কেবিনের দিকে গেলো। রাগে চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো রায়হানের। গত সাতদিন তাজ আর মৌ প্রায় সবসময় একসাথেই ছিলো হসপিটালে। রায়হানের এখন ইচ্ছে করছে তিতিরকে মেরেই ফেলতে। সে তাজ আর মৌকে দূরে সরানোর পরিবর্তে আরো কাছাকাছি আনছে।

রায়হান বিড়বিড় করে বললো, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। তাজ মৌয়ের থেকে দূরে না সরলেও মৌয়ের বাবা-মার মনে তার জায়গা নষ্ট হয়েছে। সেটাই কাজে লাগাতে হবে।

রায়হান এসব চিন্তা করে সেও মৌয়ের পিছনে চলতে লাগলো। মৌ কেবিনে গিয়ে দেখলো তাজ ডক্টরের সাথে কথা বলছে আর তিতির শূন্য দৃষ্টিতে উপরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

মৌ তিতিরের পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, কেনো এভাবে কষ্ট পাচ্ছো ? শুধু আমাদের কষ্ট দিতে গিয়ে নিজেও তো কম পাচ্ছো না। বলে দাও না সত্যিটা সবার সামনে।

তিতির ঘুরে তাকালো মৌয়ের দিকে দূর্বল গলায় বললো, আমার জীবনের চেয়ে অন্য একটা জীবন অনেক বেশি দামী আমার কাছে। সেই জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজের জীবন দিতেও রাজি। ওপারে গিয়ে বাবা-মার সামনে মাথা উচু করে বলতে পারবো আমি আমার দ্বায়িত্ব পালন করেছি। আর নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে তার কিছু হয়ে গেলে এখনো আয়নায় নিজের সাথেই চোখ মেলাতে পারবো না। সেই মুহূর্ত আমি চাই না আপু।

ঠোঁট নড়লেও গলা দিয়ে আওয়াজ আসছে না তার। গলার ব্যাথায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। মৌ কিছুই শুনতে পায়নি তার কথা।

মৌ বললো, আমি বুঝতে পারছি না তোমার কথা।

মৌয়ের কথা খেয়াল করে ডাক্তার বললো, অনেক সময় ঠান্ডা পানিতে ভিজে থাকার কারণ গলার এই অবস্থা। আওয়াজ ঠিক হতে সময় লাগবে। উনাকে কথা বলতে বাধ্য করবেন না ডক্টর মৌ। কথা বলতে উনার অনেক কষ্ট হচ্ছে।

ডক্টরের কথা শুনে চুপ করে গেলো মৌ। তাজ তাকালো তিতিরের দিকে। সাত দিনে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। গলার হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। তাজ গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। মেয়েটাকে সে সবসময় দেখেছে গোছানো, পরিপাটি। আজ কেমন বিধস্ত দেখাচ্ছে। জীবন মৃত্যুর লড়াইয়ে জিতে গিয়েও কেমন উদাসীন। দরজায় দাঁড়িয়ে লাল চোখে তিতিরের দিকে তাকিয়ে আছে রায়হান। তার মনে কোনো মায়াদয়া হচ্ছে না তিতিরের জন্য। মেয়েটা মরে গেলে তার সব খেলা নষ্ট হয়ে যেত সেটা ভাবতেই রাগ হচ্ছে তার উপর। রায়হান সরে গেলো দরজা থেকে। সে অপেক্ষা করছে তিতিরকে একা পাওয়ার।

একটু পর ইরিনা এসে হাজির হলো, ইকবাল আসেনি সে অফিসে।

ইরিনা তিতিরকে দেখে ডক্টরের উদ্দেশ্যে বললো, বাচ্চাটার কী অবস্থা ডক্টর ?

ইরিনার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলো ডক্টর। এদিকে মৌ আর তাজ অবাক চোখে একবার ইরিনার দিকে তো একবার ডক্টরের দিকে তাকাচ্ছে।

ইরিনা বললো, এতদিন ওর জীবন নিয়েই টানাটানি ছিলো তাই এটা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি।

ডক্টর আমতা আমতা করে বললো, মিসক্যারেজ হয়ে গেছে উনার।

তাজের এসব নিয়ে ঝামেলা করার ইচ্ছে হলো না, তাই কিছু বললো না। মৌ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ডক্টর ইশরাকের দিকে। এই ডক্টরও মিথ্যা বলবে ভাবেনি মৌ। তবে মৌও কিছু বললো না।

তিতির মনে মনে বললো, আমার এই অবস্থায় নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভুল করলেন না মিস্টার রায়হান চৌধুরী। অবশ্য ভালোই হলো আরো একটা মিথ্যা নাটক আমাকে করতে হলো না। রায়হান চৌধুরী আপনার পাপের পরিমাণ আকাশ ছুঁতে চলেছে। পাপের শাস্তি আপনাকে পেতে হবে, কঠিন শাস্তি।

ইরিনা তিতিরের মাথায় হাত রেখে বললো, যাক মেয়েটা তো বেঁচে গেছে।

তিতির তাকালো তাজের দিকে। তাজের দৃষ্টিও তিতিরে সীমাবদ্ধ। তিতির ব্যাকুল হয়ে একটু ঘৃণা খুঁজলো তাজের চোখে। কিন্তু আজ তাজের দৃষ্টিতে কেবলই অপরাধবোধ।

তিতির মনে মনে আওড়ালো, আপনার চোখের ঘৃণা দৃষ্টি আমার আসক্তি। আমার জন্য আপনার চোখে কেবলই ঘৃণায় দেখতে চাই আমি অন্যকিছু নয়। আপনার ঘৃণা যে আমার আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। আপনার জীবনের এই বিষাক্তফুলের আসক্তি আপনার ঘৃণা।

১২.
মনে হচ্ছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কেউ তাকিয়ে আছে, প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে চোখ মেলে তাকালো তিতির। তার ধারণাই সঠিক। রায়হান দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে, দৃষ্টি তার দিকে। তিতির আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো কেবিনে কেউ নেই। তিতিরকে মৌয়ের কাছে রেখে তাজ তার মায়ের সাথে বাড়ি ফিরেছে। হসপিটালে থাকতে থাকতে সেও ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো।

রায়হান বাঁকা হেসে বললো, কেমন আছিস বোন ?

তিতির ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। রায়হান হুট করে তিতিরের গাল চেপে ধরলো শক্ত করে।

চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, তোকে আমি যে কাজে তাজের কাছে পাঠিয়েছি তুই তার উল্টো কাজ করছিস। তোর জন্য যদি আমার পরিকল্পনা বিফলে যায় তোদের দু’বোনকে কেটে টুকরো টুকরো ফেলবো আমি।

ভয়ে রক্তশূণ্য হয়ে গেলো তিতিরের মুখমন্ডল। বারবার মাথা নাড়িয়ে পাখির ক্ষতি করতে না বুঝালো। হাত জোর করলো রায়হানের সামনে। রায়হান তিতিরের গাল ছেড়ে কাটা হাত চেপে ধরলো। সেখানে ইনফেকশন হয়েছে ঠিক হতে সময় লাগবে। ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলো তিতির।

আজ তুই মরে গেলে আমার পুরো খেলাটা গন্ডগোল হয়ে গেলো। আমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তুই মরতেও পারবি না তিতির। তুই মরে গেলে আমি তোর বোনের জীবন নরক করে দিবো। বেঁচে থেকেও ধুঁকে ধুঁকে মরবে। তোর অবুঝ বোনটাকে মানুষ রুপী হয়নার দল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নে ভালো করে, তুই মরার আগেও আমার অনুমতি নিতে হবে তোকে।

রায়হান হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। ডুকরে কেঁদে উঠলো তিতির। নিজের নিয়তির উপর কেবলই ধিক্কার আসছে তার। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে। মৌ কেবিনে এসে তিতিরকে কাঁদতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো।

তিতিরের মাথায় হাত রেখে বললো, কী হয়েছে তুমি কাঁদছো কেনো ?

তিতির কিছু না বলে কেবল কান্না করে যাচ্ছে। মৌ কিছু বুঝে উঠার আগেই তিতিরের পাশে পরে থাকা একটা জিনিস তার চোখে পড়লো। জিনিসটা চিনতে অসুবিধা হলো তা মৌয়ের। কারণ এটা তার নিজের কেনা। মৌ একটু হিসাব করতেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেললো। তিতিরকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। মৌয়ের অজানা কারণে রাগ কাজ করে না তিতিরের উপর। মৌ এটুকু বুঝতে পেরেছে তিতির নিরুপায়, সে বাধ্য হচ্ছে এসব করতে। তাই রেগে থাকতে পারেনি তিতিরের উপর। তিতির কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো আবার। তিতির ঘুমিয়ে যেতেই জিনিসটা হাতে নিয়ে মৌ বেরিয়ে পড়লো জিনিসটার মালিকের উদ্দেশ্যে। মৌ যেনো একটু একটু করে হিসাবটা মিলাতে শুরু করেছে।

বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুম দিয়েছিলো তাজ। তখনই ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। বিরক্তি নিয়ে তাকালো ফোনের দিকে। নাম্বারটা দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো, স্যার নাম্বারের ডিটেইলস পাওয়া গেছে।

ঠিক আছে আমি এখনই আসছি।

রেস্ট নেওয়া আর হয়ে উঠলো না তাজের। কোনরকমে শার্টটা গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে গেলো ফার্ম হাউসের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে হয়তো জীবনের দ্বিতীয় ধাক্কা খেতে চলেছে সে। সহ্য করতে হয়তো অনেকটা বেগ পেতে হবে।

এদিকে রায়হানকে লুকিয়ে পাখির সব ইনফরমেশন বের করার চেষ্টা করছে আহান। এই কয়েকদিনে মেয়েটার পাগলামো তার হৃদয় ছুয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। মেয়েটা যা করে তাতেই যেনো মুগ্ধ হয় আহান। এই কয়েকদিনের কষ্টের ফল হিসাবে বাংলাদেশ থাকা তার এক বন্ধু তাকে কিছু ইনফরমেশন দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তার ফোনের অপেক্ষায় বসে আছে আহান। সামনে পাখি পুতুল নিয়ে খেলছে।

পাখি হঠাৎ বললো, আহান তোমার পুতুলের সাথে আমার পুতুলের বিয়ে দিবে ?

পাখির কথায় আহানের ঘোর কাটলে মুচকি হাসলো, আমার তো পুতুল নেই।

পাখি ঠোঁট উল্টে বললো, তোমার পুতুল নেই কেনো ?

আমাকে তো কেউ পুতুল কিনে দেয়নি।

আমার কাছে একটা বয় পুতুল আছে সেটা তোমাকে দেবো। তারপর আমার পুতুলের সাথে তোমার পুতুলের বিয়ে দিবো।

আহান দুষ্টু হেসে বললো, বিয়ে দিলে কী হবে ?

পাখি খিলখিল করে হেসে বললো, এ মা তুমি দেখি অনেক বোকা। তুমি জানো না বিয়ে দিলে একসাথে ঘুমাতে পারবে, তাহলে আর ভয় পাবে না কেউ। আপুনি বলেছে বিয়ে হলে একসাথে ঘুমানো যায় তাই ভূত আসতে পারে না।

আহান ঠোঁটের কোণে হাসিটা বজায় রাখলো, আমাকে বিয়ে করবে তুমি ? আমরাও একসাথে থাকবো তাহলে, একসাথে ঘুমাবো। আমি তো ভূতে ভয় পাই অনেক।

পাখি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো আহানের দিকে। আহান আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে পাখির উত্তরের অপেক্ষায়।

পাখি খানিকটা সময় চিন্তা করে বললো, আমি তো রিদুকে বিয়ে করবো। তুমি জানো রিদু অনেক কিউট। আমি রিদুকে বিয়ে করে আমার কাছে রাখবো সবসময়। তুমিও কিউট কিন্তু আমি তো রিদুকে বিয়ে করবো বলেছি আপুনিকে।

আহান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে পাখির দিকে। সে বুঝার চেষ্টা করছে এই রিদু আবার কে। পাখি কথা শেষ করে নিজের মতো খেলতে লাগলো। আহান কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই ফোন বেজে উঠলো। স্কিনে বাংলাদেশের সেই বন্ধুর নাম্বার দেখে ফোন নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো।

চলবে,,,,

বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-০৭+০৮

0

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৭+০৮

একটা চেয়ারে হাতপা বাঁধা অবস্থায় সেন্সলেস হয়ে আছে ডক্টর রাজিব হোসেন। তার ঠিক সামনে বসে আছে তাজ। এসব করতে তার মোটেও ভালো লাগছে না৷ পর্দায় একশন মুভি করলেও বাস্তব জীবনে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সব ঝামেলা। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে এসব করতে বাধ্য করছে। চোখেমুখে পানির ছিটা দিতেই জ্ঞান ফিরলো রাজিবের। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। সামনে তাজকে বসে থাকে দেখে অবাক হলো।

এসব কী তাজ ?

তাজ নির্লিপ্ত গলায় বললো, আমিও সেটাই বলছি আঙ্কেল। এসবের মানে কী ? আপনি আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর, বলতে গেলে ফ্যামিলির একজন মেম্বার। আপনি কীভাবে পারলেন নির্দ্বিধায় এমন একটা মিথ্যা বলতে।

এবার মাথা নিচু করে ফেললো রাজিব।

তাজ বললো, টাকার জন্য এতো বছরের বিশ্বাস বিক্রি করতে একবারও বিবেকে বাঁধলো না।

রাজিব এবার তাকালো তাজের দিকে, পৃথিবীতে টাকার থেকে অধিক মূল্যবান অনেক কিছু আছে তাজ। তার মধ্যে আপনজন একটা। ছোট একটা মিথ্যার জন্য আমি আমার আপনজনদের মৃত্যু দেখতে পারবো না নিশ্চয়ই।

তাজ অনেকটাই অবাক হলো, মানে ?

রাজিব নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো, মিথ্যা বলার জন্য হয়তো তুমি আমাকে শাস্তি দিবে এখন। কিন্তু মিথ্যাটা না বললে আমাকে আমার পুরো পরিবার হারাতে হতো। তুমি আমাকে যা ইচ্ছে শাস্তি দিতে পারো আমার কোনো অভিযোগ নেই।

তাজ গম্ভীর গলায় বললো, লোকটা কে ?

সেটা আমি নিজেও জানি না। তোমাদের বাড়ি থেকে ফোন আসার পর আমি যখন তোমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। তোমাদের বাড়িতে পৌঁছানোর পাঁচ মিনিট আগে আমার কাছে কিছু ছবি আর একটা ম্যাসেজ আসে। পরিবারের জীবন বাঁচাতে আমি বাধ্য হই মিথ্যা বলতে।

তাজের মাথা হ্যাং করছে। সে ভেবেছিলো রাজিবের থেকে কিছু অন্তত জানতে পারবে কিন্তু এবারও ফলাফল শূন্য। ম্যাসেজ আর ছবি তাজকে দেখালো রাজিব। পরিবারের প্রতিটা মানুষের গলায় ছুরি ধরে রাখা হয়েছে। সাথে ছোট একটা ম্যাসেজ, সারাদেশের মানুষ যেটা জানে সেটাই যেনো বলে রাজিব। নাম্বারটা নিয়ে কল করে দেখলো বন্ধ। একটা ক্রাইম করে এখনো নাম্বারটা ইউজ করার মতো বোকা নিশ্চয়ই তারা নয়। নাম্বারের ডিটেইলস বের করতে বলে রাজিবকে বাসায় পৌঁছে দিতে বললো তাজ৷ তারপর বের হয়ে গেলো গোডাউন থেকে।

৮.
নিজের ফ্ল্যাটে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে তিতির। মনে হচ্ছে এখনই বিকট শব্দে বেজে উঠবে তার ফোনটা আর রায়হানের থেকে শুনতে হবে ভয়ংকর কিছু। সারা রুম জুড়ে পাখির টেডিবিয়ার, খেলনা, জিনিসপত্র রাখা। রুমের আনাচকানাচে পাখির হাজারো স্মৃতি। তিতিরের মনে হচ্ছে পাখি বলছে আপুনি আমার কষ্ট হচ্ছে। তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার অনেক কষ্ট হয়, আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে।

তিতির নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, তোর কিছু হতে দিবো না বোনু। আমি তোর কিছু হতে দিবো না। এতে যা করতে হয় করবো কিন্তু তোর কিছু হতে দিবো না। কেনো এমন করছেন রায়হান চৌধুরী কেনো ? আমি মুক্তি চাই এসব থেকে।

অনেকটা সময় পরেও রায়হানের কোনো ফোন না পেয়ে ভয় বাড়তে লাগলো তিতিরের। রায়হানের তো এতো শান্ত থাকার কথা নয়। এ যেনো ঝড়ের পূর্বাভাস। তিতির দু’হাতে চোখমুখ মুছে উঠে দাড়ালো। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে গেলো খান ভিলার উদ্দেশ্যে। গতরাতে যে রুমে ছিলো সেই রুমেই গেলো, সে ঠিক করেছে সেখানেই থাকবে। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। যত সময় যাচ্ছে ভয়ে তিতিরের দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাকি দিন তিতির বন্ধ রুমেই কাটিয়ে দিলো, সার্ভেন্ট খাবার দিয়ে গেলেও গলা দিয়ে তা নামলো না।

বেলকনিতে বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো তিতির। এশারের নামাজ পড়েই বেলকনিতে গিয়ে বসেছে। আকাশে চাঁদ নেই, তবে তারা দেখা যাচ্ছে দুয়েকটা। পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠলে চমকে উঠলো তিতির। স্কিনে রায়হানের নাম দেখে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। কাঁপা হাতে ফোন তুলে রিসিভ করলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারলো না শত চেষ্টা করেও।

তোকে বলেছিলাম আমার কথার বাইরে গেলে তার চরম মূল্য দিতে হবে তোকে।

রায়হানের শান্ত গলায়ও ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তিতিরের, আ,,আমার ভুল হয়ে গেছে। দয়া করে পাখির কিছু করবেন না।

আমি ঠিক সময়ে না গেলে আমার দুই বছরের সাজানো খেলা এক মিনিটে শেষ করে দিতি তুই। এমন একটা কাজের শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে তিতির। নাহলে তোর সাহস বেড়ে যাবে। আজ মৌকে বলতে গিয়েছিলি কাল সরাসরি তাজকেই বলে দিবি। তোর সাহসটা কমানোর জন্য হলেও শাস্তি তো পেতে হবে।

তিতির ব্যস্ত হয়ে উঠলো, ন,,না না আমি কাউকে কিছু বলবো না আর। মরে গেলেও মুখ খুলবো না, দয়া করে আমার পাখিকে কিছু করবেন না।

রায়হান উচ্চস্বরে হেসে বললো, বড্ড দেরি হয়ে গেলো যে বোনটি। আমি তো যা করার করে ফেলেছি।

তিতিরের কলিজা কেঁপে উঠলো রায়হানের কথা শুনে, ক,,কী করেছেন আপনি ?

ওয়েট এখনি দেখাচ্ছি।

তিতিরের ফোনে একটা ভিডিও সেন্ড করে দিলো রায়হান, এনজয় দ্যা ভিডিও।

তিতির কাঁপা হাতে ভিডিও ওপেন করে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, পাখি।

পাখির হাত থেকে টপটপ রক্ত পড়ছে। পাখি হাতের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁদছে আর আশেপাশে তাকিয়ে আপুনি বলে ডাকছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হাতটা। তিতিরের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। ইচ্ছে ফোনের ভেতরে ঢুকে বোনকে বুকে জড়িয়ে নিতে।

তিতির ফোনের দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো, আমার জন্য হয়েছে বোনু। আমাকে মাফ করে দে আমি তোর পঁচা আপুনি। আমি তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।

পাখিকে কত অসহায় মনে হচ্ছে, আশেপাশে আপুনিকে খুঁজছে সে। তিতিরের বুক চিঁড়ে যাচ্ছে কষ্টে৷ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছে তার কাছে। ভিডিও শেষ হলে ফোনটা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো তিতির। কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না সে। তিতির পাগলের মতো রুমে ছুটে এলো, কিছু খুঁজতে লাগলো। সাইড টেবিলে পেয়েও গেলো কাংখিত জিনিস। ফলের সাথে রাখা ছুরিটা নিয়ে নিজের হাতে একটা টান দিলো। মুহূর্তে চামড়া কেটে লাল টকটকে তরল বের হয়ে এলো। আরো একবার ছুরি বসাবে তার আগেই বেলকনিতে থাকা ফোনট আবার বেজে উঠলো। ছুরি ফেলে দৌড়ে গেলো বেলকনিতে।

রায়হানের কল দেখে সাথে সাথে রিসিভ করলো, আমি আমার বোনুর সাথে কথা বলতে চাই এখনই। আ,,আমি আর কিছু বলবো না কাউকে। সত্যি বলছি একটা শব্দ বের করবো না মুখ থেকে।

তিতির কথা শেষ করে মুখে হাত চেপে কান্না করতে লাগলো। এদিকে হাতের রক্তে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই তার।

ওয়েট পাখির সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি আর আজকের মতো ভুল দ্বিতীয়বার করার সাহস করিস না।

তিতির অপেক্ষা করতে লাগলো পাখির সাথে কথা বলার। হাতের কথা তার মাথা থেকেই বের হয়ে গেছে।

৯.
মেয়েটার হাত কাটলো কীভাবে ন্যান্সি ?

ন্যান্সি ভয়ে ভয়ে বললো, রায়হান স্যার সকালে কল করে জানালো পাখিকে নিয়ে বাইরে গিয়ে যেনো একটু হাঁটিয়ে আনি। রুমে থেকে থেকে ডেস্পারেট হয়ে যেতে পারে। আমি সকালে সামনের রাস্তায় হাঁটতে বের হয়েছিলাম তাকে নিয়ে। হঠাৎ একজন আমাকে সে বললো কেউ ডাকছে আমাকে। পাখিকে পাশের বেঞ্চে বসিয়ে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। অনেক খুঁজেও কাউকে পেলাম না। ফিরে এসে দেখি পাখির হাত থেকে রক্ত পড়ছে। তাই তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে এলাম।

আহান রেগে গেলো ন্যান্সির কথা শুনে, কেউ ডাকলো আর মেয়েটাকে একা রেখে আপনি চলে গেলেন।

ন্যান্সি মাথা নিচু করে ফেললো, সরি।

আহান বেডে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা পাখির দিকে তাকালো। বাসায় আসার পর ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে আহান। হাতের কাটা গভীর না হলেও মেয়েটা ভয় পেয়েছে প্রচুর। শান্ত করতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে মাত্র। ভাগ্য ভালো আহান বাসায় ছিলো নাহলে কী হতো আল্লাহ জানেন। আহানের ফোন বেজে উঠলে স্কিনে রায়হানের নাম্বার দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সে তো পাখির খেয়াল রাখতে পারেনি। এখন কী বলবে ভাইকে ?

ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলো আহান, হ্যালো ভাইয়া।

রায়হান শান্ত গলায় বললো, পাখি কোথায় ?

আহান আমতা আমতা করে বললো, আসলে ভাইয়া।

আমি সবই জানি তাই বাহানা করার প্রয়োজন নেই। তুই পাখির কাছে দে আমি কথা বলবো।

পাখি তো ঘুমাচ্ছে ভাইয়া।

ডেকে বল ওর আপুনি কথা বলবে।

আহান অবাক হয়ে বললো, কিন্তু ?

যেটা বলছি সেটা কর, বেশি কথা পছন্দ নয় আমার।

ন্যান্সি নিচু স্বরে ডেকে তুললো পাখিকে। মেয়েটা এখনো কেমন ভয়ে গুটিয়ে আছে।

রায়হান বললো, ফোনটা পাখির কাছে দিয়ে তোরা চলে যা।

আহান কিছু বুঝতে পারছে না। তবে কথা না বাড়িয়ে পাখির কাছে ফোন দিয়ে চলে গেলো আহান আর ন্যান্সি। ভিডিও কলে পাখি স্কিনে রায়হানকে দেখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

পাখি ঠোঁট উল্টে বললো, আপনি কে ? আমার আপুনি কোথায় ?

রায়হান কিছু না বলে তিতিরকে এড করে দিলো কলে। তিতিরকে দেখে কেঁদে দিলো পাখি।

আপুনি তুমি আসছো না কেনো ? দেখো আমি ব্যাথা পেয়েছি। একটা পঁচা লোক আমাকে ব্যাথা দিলো তো।

তিতির কেঁদে উঠলো বোনের কথা শুনে। কতদিন পর বোনটাকে দেখতে পেলো।

কাঁদতে কাঁদতে বললো, কাঁদে না সোনা। আমি চলে আসবো তো, তুমি একদম ভয় পাবে না। তুমি গুড গার্ল হয়ে থাকো আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।

আমি দুষ্টুমি করবো না, তুমি চলে আসো। আমার একা থাকতে ভালো লাগে না তো।

খুব বেশি ব্যাথা লেগেছে বোনু ?

হ্যাঁ তো, ব্যাথা করছে তো। প্লিজ তুমি চলে আসো ব্যাথাও চলে যাবে।

পাখির কথা শুনে কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে তিতিরের। ইচ্ছে করছে বোনকে বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে যাতে আর কেউ কেঁড়ে নিতে না পারে, দু’বোনে কাঁদতে লাগলো। আরো কিছু সময় কথা বলার পর রায়হান কেটে দিলো কল। সে চুপচাপ দু’বোনের কথা শুনে গেছে। তবু পাথর মনে একটু দয়া হয়নি তার। তিতির ফোনটা বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো বেলকনিতে। হাতের রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেলো একাই, শুকিয়ে যেতে লাগলো।

আহান থম মেরে বসে আছে নিজের রুমে। তার মাথায় কিছুই আসছে না। নিজের রুমে থেকে তিতির আর পাখির কথোপকথন শুনেছে সে। রায়হানের মাথা থেকে হয়তো এই ব্যাপারটা বেরিয়ে গেছে। আহান কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছে না। রায়হান তাদের বলেছিলো পাখির আপুনি মারা গেছে তাহলে পাখি কথা বললো কার সাথে। দু’জনের কথায় তো মনে হয়নি অন্যকেউ। ল্যাপটপের স্কিনে তিতিরকেও দেখেছে আহান। পাখির সাথে তার চেহারায়ও অনেক মিল আছে। প্রথম থেকেই পাখিকে চেনা চেনা লেগেছে আহানের কাছে কিন্তু মনে করতে পারেনি কোথায় দেখেছে। রায়হান যখন বললো পাখি তাদের আপন কেউ তখন আর মাথা ঘামায়ন, ভেবেছে আত্নীয় কেউ হবে। আগে দেখেছে তাই চেনা লেগেছে। কিন্তু আহান এখন বুঝতে পারছে পাখিকে তার চেনা চেনা লাগার কারণ। সে পাখিকে নয় বরং তিতিরকে আগে কোথাও দেখেছে আর তিতিরের সাথে পাখির চেহারায় মিল থাকায় পাখিকে চেনা চেনা লেগেছে। আহানের বুঝতে অসুবিধা হলো না এখানে অন্য কোনো গল্প আছে, রায়হান কিছু লুকাচ্ছে তার থেকে। সত্যিটা না জানা পর্যন্ত শান্তি পাবে না আহান।

আহান বিড়বিড় করে বললো, কে এই তিতির আর পাখি ?

গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে পাখির। ন্যান্সি পাখির মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। মেয়েটা জ্বরের ঘোরেও আপুনিকে ডেকে যাচ্ছে। আহান পাখির কপালে হাত রেখে বুঝার চেষ্টা করলো জ্বর কমেছে কিনা।

আহান ন্যান্সির উদ্দেশ্যে বললো, আপনি এবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি আছি পাখির কাছে।

ন্যান্সি বললো, কিন্তু স্যার আপনার তো সকালে ভার্সিটি যেতে হবে।

আহান পাখির দিকে তাকালো, আমার সমস্যা হবে না আপনি যান।

ন্যান্সি আর কিছু না বলে পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলো। আহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাখির দিকে। আহান কখনো পাখির দিকে বিরক্তির দৃষ্টি ছাড়া তাকায়নি। কিন্তু আজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাখিকে স্নো হোয়াইট নাম দিতে ইচ্ছে করছে। অনেক বছর আগে এই নামটা দিয়েছিলো ছোট একটা পুতুলকে আজ মনে পড়ে যাচ্ছে তার কথা। ধবধবে ফর্সা মুখটায় রক্তগোলাপের মতো রক্তবর্ণ ঠোঁট, কৃষ্ণবর্ণ লম্বা চুল। এক কথায় স্নো হোয়াইটকে যেনো বাস্তবে দেখছে আহান।

আহান বিড়বিড় করে বললো, কে তুমি ? আমাকে যে সেটা জানতেই হবে।

১০.
দু’দিন যাবত ঘরবন্দী তিতির। তাকে কেউ বন্দী করে রাখেনি সে নিজেই বের হয় না রুম থেকে। সার্ভেন্ট খাবার দিয়ে গেলে মন চাইলে খায়, আবার না চাইলে সেভাবেই পড়ে থাকে খাবারগুলো। তাজ দু’দিন বাড়ি ফিরেনি, তার বাবা-মা তার চিন্তায় অস্থির, মনে হয় ভুলেই গেছে বাড়িতে একটা মেয়ে। তিতির রায়হানকে কল দিলো বেলকনিতে গিয়ে।

রায়হান রিসিভ করে বিরক্তি নিয়ে বললো, এতবার বিরক্ত করছিস কেনো তিতির ?

তিতির রাগী গলায় বললো, আমার বোনুকে ফিরিয়ে দিন আপনার মতো লোকের ছায়াও মাড়াবো না আমি।

বলেছি তো সময় হলে ফিরে পাবি।

আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে এই বাড়িতে। দয়া করে আমাকে এবার মুক্তি দিন।

আমার কাজ তো এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে অবশ্যই মুক্তি দিবো তোদের।

আর কী কাজ বাকি আছে ? আপনার উদ্দেশ্য ছিলো স্যারের ক্যারিয়ার ধ্বংস করা, সেটা হয়ে গেছে।

এতো ছোট একটা কাজ করার জন্য এতো কষ্ট করলাম নাকি আমি। আরো অনেককিছু বাকি আছে। তোর এতকিছু জেনে কাজ নেই। বেশি না এক মাস থাকতে হবে তোকে।

তিতির আঁতকে উঠলো, অসম্ভব আমি কিছুতেই এক মাস এখানে থাকতে পারবো না।

রায়হান বাঁকা হেসে বললো, তোর মনে হয় বোনের চিন্তা নেই রে তিতির। তিতিরপাখি শব্দটা থেকে পাখি বাদ দিতে চাইছিস।

তিতির অস্থির হয়ে উঠলো বোনের কথা শুনে, না আমার বোনের কিছু করবেন না। আমি থাকবো যতদিন চাইবেন ততদিন থাকবো।

কার সাথে কথা বলছিস রায়হান ?

মৌয়ের গলা শুনে চমকে উঠলো রায়হান। পরক্ষণে নিজেকে সামলে পেছনে ফিরে মৌয়ের দিকে তাকালো। মৌ সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রায়হান কোনমতে পরে কথা বলছি বলে কল কেটে ফোন পকেটে রেখে দিলো। মৌ তখনো তাকিয়ে আছে রায়হানের দিকে।

রায়হান জোরপূর্বক হেসে বললো, এমনই একটা জরুরি কল ছিলো।

মৌ বললো, তাহলে কথা শেষ না করে রেখে দিলি কেনো ?

কথা শেষ তো, তাই রেখে দিলাম। কিন্তু তুই এখানে কী করছিস ? তোর তো রোগী দেখার কথা এখন।

দম বন্ধ লাগছিলো তাই একটু ব্রেক নিয়েছি।

রায়হান ব্যস্ত হয়ে বললো, তোর শরীর ঠিক আছে ?

মৌ বললো, আমি ঠিক আছি। তবে একটু একা থাকতে চাইছি। এপাশটা নিরিবিলি তাই এলাম।

ঠিক আছে তুই থাক তাহলে, আমি আসছি। আমার আবার একটা অটি আছে কিছুক্ষণ পর।

মৌয়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলো রায়হান। মৌ তাকিয়ে আছে রায়হানের যাওয়ার দিকে। একই হসপিটালে আছে তারা। মৌয়ের সন্দেহ একটু একটু করে গাড়ো হচ্ছে।

মৌ বিড়বিড় করে বললো, সেদিন তোকে দেখে তিতিরের ভয় পাওয়া। আজ তোর বলা কথা সব মিলিয়ে কিছু তো একটা রহস্য আছে রায়হান। তিতিরপাখি শব্দটা থেকে পাখি বাদ দিতে চাইছিস। মানে কী হতে পারে এই কথার ? তিতিরের সাথে তোর কী সম্পর্ক ?

মৌ এসে রায়হানের বলা লাস্ট কথাটুকু শুনেছে। মৌ বুঝতে পারছে রায়হানের সাথে তিতিরের কোনো একটা কানেকশন আছে কিন্তু সেটা কী ধরতে পারছে না।

কিছুক্ষণ এসব চিন্তা করে তাজকে কল দিলো। সে রাতের পর তাজের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি মৌয়ের। এবারও ফোন বন্ধ বলছে, সে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। মৌ খোঁজ নিয়েছে দু’দিনে তাজ বাড়িও ফিরেনি।

মৌ ফোন বের কর তাজের পিক দেখে বললো, কোথায় তুমি তাজ ?

স্যার দু’দিনে মেয়েটা বাড়ি থেকেই বের হয়নি। তবে কল লিস্ট বের করে একটা নাম্বার পাওয়া গেছে। কিছুদিন যবত এই একটা নাম্বারে কথা বলে যাচ্ছে। আপনার বিয়ের পাঁচদিন আগেই প্রথম কথা বলে এই নাম্বারে। কিন্তু তার আগে কখনো এই নাম্বার থেকে না কল এসেছে আর না গেছে।

গার্ডের কথা চুপচাপ শুনলো তাজ। তিতিরকে সুযোগ দিতেই তাজ দু’দিন বাড়ি ফিরেনি। তাজ দেখতে চেয়েছিলো তিতির কার সাথে দেখা করে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। তাই আজ তিতিরের কল লিস্ট বের করতে বলে।

তাজ অনেক ভেবে বুঝতে পেরেছে সত্যি মিথ্যা সামনে আনার জন্য তিতিরের পিছনে সময় নষ্ট না করে, আসল কালপ্রিটকে খোঁজা বুদ্ধিমানের কাজ। আসল কালপ্রিটকে খুঁজে পেলে এমনই সব সামনে চলে আসবে।

ঐ নাম্বার কার তার ডিটেইলস বের করো। মনে হচ্ছে এই নাম্বারের মালিকই আসল কালপ্রিট। তিতিরের উপর আরো কড়া নজর রাখো।

ঠিক আছে স্যার।

তিতিরের পুরো লাইফ ডিটেইলস বের করতে বলেছিলাম তার কী হলো ?

স্যার সেই কাজও হয়ে গেছে। তিতিরের বাবা আবির মাহমুদ। একসময় বেশ বড় পারিবারিক বিজনেস ছিলো। আবির মাহমুদ আর তার স্ত্রী মারা গেছে বেশ রহস্যজনক ভাবে। তারা মারা যাওয়ার পর সেই বিজনেসের মালিক হয়েছে আবির সাহেবের বোন-জামাই আব্দুর রহমান চৌধুরী। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তিতির বড় হয়েছে তার বাবার এক বিশস্ত গার্ড নুরুলের কাছে।

তাজ অবাক হয়ে শুনছে গার্ডের কথা। তাজ শুধু জানতো তিতিরের বাবা-মা নেই। সে একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে। এর বেশি জানার ইচ্ছে হয়নি কখনো।

তাজ অবাক হয়ে বললো, আত্মীয় স্বজন থাকতে গার্ডের কাছে কেনো বড় হয়েছে।

যতটুকু জানা গেছে আবির সাহেব মারা যাওয়ার পর আত্নীয় স্বজনরা প্রোপার্টি দখলে ব্যস্ত হয়ে যায়, প্রোপার্টির পরিমাণ অনেকটাই বড় ছিলো। তিতিরের খোঁজ কেউ করেনি। নুরুলই বড় করেছে তিতিরকে কিন্তু বছর দুয়েক আগে নুরুল মারা গেছে কার এক্সিডেন্টে। তারপর থেকে একাই আছে তিতির। তবে মাঝে মাঝে তার সাথে আরো একটা মেয়েকে দেখা গেছে কিন্তু সেটা কে জানা যায়নি। তিতির আপনাদের বাড়ি যাওয়ার পর থেকে তার ফ্ল্যাট ফাঁকা পরে আছে।

তাজ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, অন্য মেয়েটা কে সেটা খোঁজে বের করো দ্রুত।

ইয়েস স্যার।

তাজ বের হয়ে গেলো ফার্মহাউস থেকে। গত দুদিন সে এখানেই ছিলো। গাড়ি স্টার্ট করে বাড়ির পথে এগোতে লাগলো।

স্টিয়ারিং হাতে ভাবতে লাগলো, এবার খেলাটা জমবে মিস তিতির উপস সরি মিসেস তিতির। আর তাড়াহুড়ো নয়, এবার সব হবে ঠান্ডা মাথায়। ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছো তাই না। যে ক্যারিয়ারে ঘুণ ধরেছে সেটা তো আর বয়ে বেড়াবে না এই তাজওয়ার খান তাজ। আমার চরিত্রে লাগা দাগতো আমি তুলবো কিন্তু আগের জীবনে আর ফিরে যাবো না। তাই কোনো তাড়া নেই আমার, সবটা সময়ে আনবো আমি। এতে যত সময় লাগুক। তুমি আমার সাথে গেইম খেলেছো এবার আমি তোমার সাথে গেইম খেলবো। তোমরা যত মনে করবে আমি সবটা মেনে নিতে শুরু করেছি তত কাজটা সহজ হবে আমার জন্য। তোমরা যেটা চাইবে আজ থেকে সেটাই হবে। আজ থেকে তোমাদের উড়তে দিবো আমি, উড়তে উড়তে যখন আকাশ ছুঁতে চাইবে ঠিক সেই সময় ডানা কেনে দিবো। মুখ থুবড়ে মাটিতে পরে তড়পাবে তোমরা। শেষ খেলাটা তো এই তাজওয়ার খান তাজ জিতবে, জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।

কথাগুলো নিজের মনে আওড়ে বাঁকা হাসলো তাজ।

বাড়ি ফিরে কলিংবেল বাজালে দরজা খোলে দিলো সার্ভেন্ট। সোজা নিজের রুমে গিয়ে লম্বা সময় শাওয়ার নিলো।

১১.
তাজ ডিনার টেবিলে গিয়ে দেখলো তার বাবা-মা বসে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাজ নিজের চেয়ার টেনে বসলো।

ইকবাল খান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো, গত দু’দিন কোথায় ছিলে ?

বাবা-মায়ের উপর অভিমানটা জমিয়ে রেখেছে তাজ। সবটা সামনে আসুক তারপর বাবা-মায়ের সাথে বুঝাপড়াটা হবে৷

তাই এখন স্বাভাবিক ভাবে নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিতে নিতে শান্ত গলায় বললো, এর আগে মাসের পর মাস বাইরে থেকেছি, তখন তো কৈফিয়ত দিতে হয়নি।

তখনকার সময় আর এখনকার সময়ে অনেক তফাত। তখন তুমি কাজের জন্য বাইরে থাকতে।

তাজ শান্ত গলায় বললো, নিজেকে সময় দিতে গিয়েছিলাম।

তাজ এক সার্ভেন্টের দিকে তাকিয়ে বললো, মেয়েটা আই মিন তিতিরকে ডেকে নিয়ে এসো।

সার্ভেন্ট তিতিরকে ডাকতে গেলে ইরিনা বললো, ওকে কেনো ডাকছিস ?

তাজ বললো, কিছু কথা বলতে চাই সেটা তিতিরেরও জানা প্রয়োজন।

তিতির ফোনে তার আর পাখির ছবি দেখছিলো তখনই দরজায় নক হয়।

তিতির বলে উঠে, কে ?

ছোট স্যার আপনাকে ডাকছে, এখনই যেতে বলেছে।

তিতির বুঝতে পারলো তাজ এসেছে। কিন্তু তাকে কেনো ডাকছে সেটা বুঝতে পারছে না। ভয়ে এক ঢোক গিলে বেড থেকে নেমে গেলো। ওড়না মাথায় দিয়ে দরজা খোলে বের হয়ে এলো। সার্ভেন্টের পিছন পিছন ডাইনিং টেবিলের সামনে হাজির হলো। তাজ একবার তাকালো তিতিরের দিকে।

বেশ শান্ত গলায় বললো, বসো।

তিতির চমকে উঠলো তাজের কথায়। তাজ খুব সাধারণ একটা কথা বলেছে তবু সেটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। সেদিনের পর আজ প্রথম তাজ ভালো করে কথা বললো তার সাথে। তিতির কাঁপা হাতে চেয়ার টেনে বসলো।

তাজ সার্ভেন্টকে উদ্দেশ্য করে বললো, খাবার দিন ওকে।

এবার অনেক বেশি চমকে উঠলো তিতির। কাঁপা গলায় বললো, আ,,আমি খাবো না।

তাজ শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো তিতিরের দিকে। তাজের শান্ত দৃষ্টি তিতিরের গলা শুকিয়ে দিলো, দ্রুত মাথা নিচু করে ফেললো।

তাজ সার্ভেন্টকে বললো, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেনো ? ওকে খাবার দিতে বললাম তো।

সার্ভেন্ট দ্রুত তিতিরের সামনে খাবার রাখলো। ইকবাল আর ইরিনা অবাক দৃষ্টিতে ছেলের কান্ডকারখানা দেখে যাচ্ছে।

তিতিরের সামনে খাবার দিলে তাজ বললো, নাও শুরু করো।

তিতির একবার তাজের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেললো।

তাজ তা দেখে ধমক দিয়ে বললো, কী হলো শুরু করতে বললাম না ?

তিতির কেঁপে উঠলো তাজের ধমকে। কাজ করার সময় তাজ কখনো ধমক দিয়ে কথা বলতো না তিতিরের সাথে৷ তাই তিতির কখনো ভয়ও পেত না তাকে। কিন্তু এখন তাজের দিকে তাকাতেও ভয় লাগে তিতিরের। হাত-পা অস্বাভাবিক হারে কাঁপে।

তিতির কাঁপা হাতেই চামচ তুলে নিলো আর একটু খাবার মুখে দিলো।

তাজ বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমরা বসে আছো কেনো, খাও।

সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিলো, তিতির চামচ দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে শুধু। তিতির বুঝতে পারছে না তাজের এমন ব্যবহারের কারণ।

তাজ খেতে খেতে হঠাৎ বললো, অনেক ভেবে দেখলাম যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার সবটা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করাই ভালো।

খাওয়া থেমে গেলো সবার, শুধু তাজ নিজের মতো স্বাভাবিকভাবে খেয়ে যাচ্ছে।

ইকবাল খান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, মানে কী বলতে চাইছো ?

তাজ এবার তাকালো বাবার দিকে, মানে খুব সহজ। আমি মেনে নিচ্ছি সবটা, হয়তো আমারই কোথাও ভুল ছিলো। তিতির সবসময় আমার সাথেই থাকতো, হয়তো দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম কোনো মুহূর্তে। আমি সবটা মেনে নিয়ে সামনে আগাতে চাইছি।

তিতিরের হাত থেকে চামচটা প্লেটে পড়ে ঝনঝন আওয়াজ তুললো। তিতির হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। মাথা ঠিক আছে তো, কী সব আবোল তাবোল বকছে। তাজ আঁড়চোখে তিতিরের হতবিহ্বল অবস্থা দেখে বাঁকা হাসলো।

মনে মনে বললো, তোমরা তো এটাই চাইছিলে আমি হাড় মেনে নেই, সবটা মেনে নিতে বাধ্য হই। জেতার জন্য নাহয় হাড় মানার অভিনয় টাই করলাম।

তাজ বাঁকা হাসলো পুনরায়। তাজের বাবা-মা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো তাজের কথা শুনে।

চলবে,,,

বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-০৫+০৬

0

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৫+০৬

খবরের কাগজ হাতে থম মেরে সোফায় বসে আছে ইকবাল খান। প্রত্যেকটা নিউজপেপারে তাজের নামে জঘন্য থেকে জঘন্যতম নিউজ ছাপা হয়েছে। টিভি অন করে সোফাতে বসে আছে ইরিনা রহমান। ছেলের নামে এমন জঘন্য কথা শুনতে হবে কোনোদিন কল্পনা করেনি দুজনের কেউই। যে ছেলের জন্য একদিন গর্বে বুক ভরে এসেছিলো আর সেই ছেলের জন্য লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ইকবাল খান অফিসে যেতে ভয় পাচ্ছেন। মানুষের কথা শোনার ভয়ে সে বাড়ি থেকেই বের হতে চাইছেন না।

ইকবাল খান হতাশ গলায় বললো, ইরি এসব দেখার জন্যই কী বেঁচে ছিলাম ?

ইরিনা কী বলবে, সে নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেছে।

ইকবাল পুনরায় বললো, তাজ কোথায় ?

ইরিনা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, সার্ভেন্ট বললো সকালেই তাজ বেড়িয়ে গেছে মেয়েটাকে নিয়ে।

ইকবাল অবাক হয়ে বললো, কোথায় গেছে ?

সেটা তো জানি না। তবে সার্ভেন্ট বললো মেয়েটাকে নাকি এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে, অনেক রেগে ছিলো তাজ।

ইকবাল নিউজপেপার রেখে বললো, মহিবুলের সাথে একবার কথা বলা দরকার কিন্তু কোন মুখে তাদের সাথে কথা বলবো। মৌয়ের কী অবস্থা সেটাও জানা প্রয়োজন।

মেয়েটা সেই ছোটবেলা থেকে তাজকে ভালোবাসে কিন্তু তাজ কখনো ওকে বুঝার চেষ্টাই করেনি। মেয়েটা অনেক বড় আঘাত পেয়েছে। মহিবুল অনেক শান্ত প্রকৃতির মানুষ। মহিবুলের জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো অনেক সমস্যা করতো।

বুঝলে ইরি, জীবনে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে মানুষ সেই পরিস্থিতির কাছে অসহায় হয়ে যায়। চাইলেও কিছু করার থাকে না। আমি অফিসে যাচ্ছি, পরিস্থিতি খারাপ বলে তো আর ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকা যাবে না। সেলিব্রিটিদের জীবন বরাবরই আমার পছন্দ নয়, তার বড় একটা কারণ হচ্ছে এদের পার্সোনাল লাইফ বলতে কিছু নেই। এদের বেডরুমের কথাও মানুষের নখদর্পনে।

ইকবাল খান রুমে চলে গেলেন অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে। ইরিনা রহমান বসে রইলেন সোফায়। মহিবুল ইরিনা রহমানের ছোট চাচার ছেলে। তাজ আর মৌ সম্পর্কে মামাতো ফুপাতো ভাইবোন হয়।

ব্রেকফাস্ট করে রায়হান বসে আছে মৌয়ের কাছে। হালকা খাবার খাইয়ে মেডিসিন দেওয়া হয়েছে মৌকে। জ্বর কমতে শুরু করেছে, মৌ এখন ঘুমাচ্ছে। মৌয়ের বাবা-মা গেছে ব্রেকফাস্ট করতে।

রায়হান মৌয়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, কী ভেবেছিলি মৌমাছি ? আমাকে ফাঁকি দিয়ে তাজের হয়ে যাবি ? ছোটবেলার সেই বোকা রায়হান নই রে আমি। তোর ধোঁকা খেতে খেতে বুঝতে শিখে গেছি, নিজের জিনিস কীভাবে নিজের করতে হয়। এখন বোকা তুই নাকি আমি সেটা বুঝতে পারছি না। দেখ তাজের তোকে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই, তবু তুই তাজের জন্য পাগল। আমি তোকে এতোটা ভালোবাসি সেটা সারাজীবন তুই শুধু ব্যবহারই করে গেছিস। এদিকে তুই আমার থেকে পালাই পালাই করিস কিন্তু আমি তোকে ছাড়তে পারছি না আর কোনো দিন পারবও না। এখন বোকাটা কে বল তো। তুই আমাকে বাধ্য করেছিস এই নোংরা খেলাটা খেলতে। আমার এতে দোষ নেই রে মৌমাছি।

৭.
কারো উচ্চস্বরে পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আহানের। কানের উপর বালিশ চাপা দিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না।

Jhony, Jhony.
Yes papa ?
Eating sugar ?
No papa.
Telling lie ?
No papa.
Open your mouth.
Ah, ah, ah.

বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো আহান। শব্দের উৎস খুঁজতে আশেপাশে তাকালে স্পিকারের দিকে চোখ গেলো। পাখির সেফটির জন্য তার রুমে একটি ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন লাগিয়েছে আহানের বড় ভাই। সেটার সাহায্যে আহান যেখানেই থাকুক পাখি রুমে কী করছে আর বলছে সব দেখতে আর শুনতে পারবে নিজের ফোনে বা ল্যাপটবে। আহানের রুমের স্পিকারে পাখির কথা সবসময় শোনা যাচ্ছে, আহান রুমে থাকলে। আহানের বিরক্ত লাগলেও কিছু করার নেই, বড় ভাই চব্বিশ ঘণ্টা পাখির উপর নজর রাখতে বলেছে। একটা পাগল মেয়ে তার ভাইয়ের কাছে এতটা ইম্পর্ট্যান্ট কেনো বুঝতে পারছে না আহান। গতরাতে এজন্যই পাখির চেঁচামেচি নিজের রুমেই শুনতে পেয়েছিলো। আহান চরম বিরক্তি নিয়ে পাখির রুমে গিয়ে দেখে পাখি বেডের উপর বসে শব্দ করে ছড়াটা বারবার পড়ছে।

আহান ধমক দিয়ে বললো, এই মেয়ে তুমি কী পাঁচ বছরের বাচ্চা ? এটা কী ছড়া পড়ছো হ্যাঁ ?

পাখি ভয় পেয়ে কেঁপে উঠে আহানের দিকে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো, জনি জনি।

আহান পুনরায় ধমক দিয়ে বললো, কী জনি জনি ? বাচ্চাদের ছড়া তুমি বারবার পড়ছো কেনো ?

পাখি ঠোঁট উল্টে কান্নার ভাব করে বললো, এটা আমার ফেবারিট ছড়া।

আহান বিরক্ত গলায় বললো, এতবড় মেয়ের নাকি জনি জনি ছড়া ফেবারিট।

পাখি এবার ঠোঁট উল্টে কান্না করে বললো, আপনি আমাকে বকেন কেনো সবসময় ? আপুনি তো কখনো আমাকে বকে না। আমি কতকিছু ভেঙে ফেলি আপুনি কিচ্ছু বলে না আমাকে আর কিছু না করলেও বকেন আপনি। খুব পঁচা আঙ্কেল তো আপনি।

আহান চোখ বড় বড় করে বললো, হোয়াট ? আঙ্কেল, আমাকে আঙ্কেল বললো ?

আহান নিজের বিস্ময় কাটিয়ে জোরে ধমক দিয়ে বললো, এই মেয়ে আমাকে তোমার আঙ্কেল মনে হয় ?

পাখি এবার জোরে জোরে কান্না শুরু করে দিলো, পাখির কান্নার আওয়াজ শুনে দৌড়ে এলো ন্যান্সি।

আহান থতমত খেয়ে বললো, মহা জ্বালা তো।

ন্যান্সি পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কী হয়েছে বেবি ?

পাখি আহানকে দেখিয়ে বললো, আঙ্কেলটা বকেছে।

আহান থতমত খেয়ে ধমক দিয়ে বললো, এই মেয়ে খবরদার আঙ্কেল বলবে না আমাকে। আর একবার আঙ্কেল বললে একদম বাসা থেকে বের করে দিবো।

আহান হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। পাখি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আহানের যাওয়ার দিকে।

ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে বললো, পঁচা আঙ্কেল।

ন্যান্সি বাংলা বুঝতে আর বলতে পারে ভালো করেই। পাখিও ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেছে বেশ ভালোই। তাই পাখির সাথে কথা বলতে ন্যান্সির প্রবলেম হয় না। ন্যান্সি ইংরেজিতে বললে সেও ইংরেজিতে বলে আবার ন্যান্সি বাংলা বললে সেও বাংলা বলে। তিতির পাখিকে যতটা শেখানোর যায় চেষ্টা করেছে শিখাতে।

ন্যান্সি মুচকি হেসে বললো, আঙ্কেল বলে না বেবি।

পাখি ভাবুক ভঙ্গিতে বললো, তাহলে কী বলবো ?

তুমি ভাইয়া বলতে পারো।

ঠিক আছে ভাইয়া বলবো, পঁচা ভাইয়া।

ন্যান্সি মুচকি হেসে বললো, চলো ব্রেকফাস্ট করবে।

আপুনি কখন আসবে ?

তুমি গুড গার্ল হয়ে থাকলে তাড়াতাড়ি চলে আসবে।

ঠিক আছে আমি একদম গুড গার্ল হয়ে থাকবো।

ন্যান্সি দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো পাখির দিকে তাকিয়ে। কারণ সেও জানে পাখির আপুনি বেঁচে নেই। এদিকে আহান নিজের রুমে গিয়ে পাখিকে ইচ্ছে মতো বকতে বকতে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। মেয়েটাকে একদমই সহ্য হচ্ছে না আহানের। কিন্তু কিছু করারও নেই তার।

৮.
রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে তাজের। যতগুলো হসপিটালে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছে, ইমারজেন্সি রিপোর্ট বের করেছে। সবগুলো রিপোর্ট একই কথা বলছে, তিতির প্রেগনেন্ট। কিন্তু সেটা তো অসম্ভব, মাথায় কিছুই ঢুকছে না তাজের। সারাদিন একটার পর একটা হসপিটালে গিয়েছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাজ যেখানে জানে তিতির প্রেগনেন্টই নয় সেখানে ডিএনএ টেস্ট করার মানেই হয় না। তাজ এটাই প্রমাণ করতে পারছে না তিতির প্রেগনেন্ট নয়, সেখানে ডিএনএ টেস্ট করে পজিটিভ কিছু আশা করাও বোকামি মনে হয়েছে তাজের কাছে। সেটাও তাজের বিরুদ্ধেই আসবে, তাজের বুঝা হয়ে গেছে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে পুরো খান পরিবার। ইকবাল খান গম্ভীর মুখে বসে আছে। ইরিনা রহমান একবার ছেলের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার স্বামীর দিকে তাকাচ্ছে।

ইকবাল খান গম্ভীর গলায় বললো, গতরাতে একবার মনে হয়েছিলো আমার হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। তুমি এমন একটা জঘন্য কাজ করতে পারো না। কিন্তু এতগুলো হসপিটালের রিপোর্ট কীভাবে ভুল হয় তাজ ?

তাজ অসহায় গলায় বললো, প্লিজ বাবা বিলিভ মি।

কীভাবে বিশ্বাস করবো বলো তো ? একটা হসপিটালের রিপোর্টও যদি ভিন্ন হতো তাহলে তুমি এই কথা বলতে পারতে।

তাজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। কীভাবে তাকে বুঝাবে সে মিথ্যা নয় বরং এই মেয়েটা মিথ্যা, সবগুলো রিপোর্ট মিথ্যা। ইরিনা বরাবরই শান্ত মেজাজের মানুষ, তাই সে নিরব ভূমিকা পালন করছে। ইরিনা ঘুরে তাকালো একটু দূরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে।চোখমুখ বলে দিচ্ছে সে প্রচন্ড ক্লান্ত, দাঁড়িয়ে থাকতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। মেয়েটার মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা। কেমন অনুভূতিহীন পুতুলের মতো নিষ্প্রাণ চোখে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিজের ছেলের দিকে তাকালো। রাগ, হতাশা আর অসহায়ত্ব চোখে মুখে স্পষ্ট। নিজের বাবার দিকে তাকালো অসহায় দৃষ্টি যেনো বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা বলছে না। ইরিনা রহমানের নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হতে লাগলো। কেমন গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে সবকিছু। ধুপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজে সবাই ঘুরে তাকালো। তিতির লুটিয়ে পড়েছে ফ্লোরে। ইরিনা দ্রুত এগিয়ে গেলো তিতিরের দিকে।

ব্যস্ত গলায় বললো, কেউ এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো।

একজন সার্ভেন্ট দ্রুত এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো ইরিনার দিকে। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিয়েও কোনো লাভ হলো না।

তাজের দিকে তাকিয়ে বললো, ওকে রুমে নিয়ে চল।

তাজ অবাক হয়ে বললো, আমি ?

এতকিছু ভাবার সময় নেই তাজ। মেয়েটা যেমনই হোক একজন মানুষ সে। এই অবস্থায় তো ফেলে রাখা মানুষের মতো কাজ হবে না। রাজিব ভাইকে একটা কল করুন তো, ইকবালের উদ্দেশ্যে বললো।

তাজ বাঁধ্য হয়ে তিতিরকে কোলে তুলে নিচের গেস্ট রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে তাজদের ফ্যামিলি ডক্টর রাজিব হোসেন হাজির হলো।

তিতিরকে পরীক্ষা করে বললো, দেখে মনে হচ্ছে প্রচন্ড মানসিক চাপের মধ্যে আছে। বেশ কয়েকদিন ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করেনি, শরীর একদমই দূর্বল। এভাবে চলতে থাকলে আরো অবণতি হবে, খারাপ কিছু হতে সময় লাগবে না। এই সময়ে তো আরো দিগুণ দেখাশোনার প্রয়োজন। নাহলে দুজনেরই ক্ষতি হবে।

তাজ তাকিয়ে আছে রাজিবের দিকে। একটা অন্তত আশা ছিলো, রাজিব হোসেন বুঝতে পারবে তিতির প্রেগনেন্ট নয়। সেই আশায় পানি ঢেলে দিলো। রাজিব কিছু মেডিসিন দিয়ে, তিতিরের খেয়াল রাখতে বলে চলে গেলো।

ইরিনা বললো, তাজ মেডিসিনগুলো আনানোর ব্যবস্থা কর।

তাজ বিরক্ত হয়ে বলো, সব নাটক।

ইরিনা শান্ত গলায় বললো, রাজিব ভাই আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর। সে নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলবে না।

তাজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। নিজের বাবা-মাই তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না, এটা তাকে আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছে। তিতিরের দিকে রক্তচক্ষু করে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। মেয়েটার প্রতি ঘৃণা যেনো তাজের ধাপে ধাপে বেড়ে চলেছে।

ঘন্টা খানেক সময় শাওয়ার নিয়ে রুমে এসেছে তাজ। মাথায় ঘুরছে নানা প্রশ্ন। কিছুতেই কিছু মিলাতে পারছে না। তাজের মনে হচ্ছে সে ক্রমশ একটা ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। যত বের হওয়ার চেষ্টা করছে ততটাই বাজেভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। ফোনের রিংটোনে ভাবনায় ছেদ পড়লো তার। ফোন হাতে নিয়ে মৌয়ের নাম্বার দেখে বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। এতসবের মধ্যে মৌয়ের কথা যেনো মাথা থেকে একেবারেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ করেই মৌয়ের উপর তীব্র অভিমান অনুভব করলো তাজ। মানুষ তো তার উপর অভিমান করে যাকে সে ভালোবাসে। কিন্তু তাজ তো মৌকে কখনো ভালোবাসেনি তবে কেনো এতো অভিমান হচ্ছে। না ভালোবেসে তো, বন্ধু হিসাবে, সত্যি কী তাই ? কেনো মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী অবিশ্বাস করলেও মৌয়ের উচিত ছিলো তাজকে বিশ্বাস করা। তাজ নাহয় মৌকে সেভাবে ভালোবাসেনি কিন্তু মৌ তো বেসেছে। তবে কেনো বিশ্বাস করতে পারলো না তাজকে। তাজের ভাবনার মাঝেই কল কেটে গেলো। সাথে সাথেই আবার বেজে উঠলে রিসিভ করলো তাজ।

গম্ভীর গলায় বললো, হ্যালো।

তাজের আওয়াজ শুনতেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো মৌ। তাজ বেশ শান্ত ভঙ্গিতে শুনতে লাগলো মৌয়ের কান্না। তবে বুকের ভেতর কেমন একটা করছে মৌয়ের কান্না শুনে। মৌকে সবসময় হাসিখুশি দেখে এসেছে তাজ। তাই হয়তো কান্নাটা ঠিক মানতে পারছে না।

তাজ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, কিছু বলবি নাকি কেটে দিবো কল।

মৌ এবার শব্দ করে কেঁদে দিলো, কেনো এমন করলে তাজ ?

তাজের অজানা কারণে রাগ হচ্ছে না এখন বরং কষ্ট হচ্ছে। মানতে পারছে না মৌও তাকে ভুল বুঝছে।

তাজ বেলকনিতে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে বসে শান্ত গলায় বললো, মৌ আমি তোকে কখনো বলিনি ভালোবাসি। কিন্তু উনত্রিশ বছর ধরে তোকে চিনি। আমাকে যদি কেউ এসে বলে মৌ এমন জঘন্য একটা কাজ করেছে। আমি কিন্তু বিশ্বাস করবো না, যতক্ষণ না তুই নিজে সেটা স্বীকার করছিস। কারণ আমি চিনি তোকে। অপরদিক দেখ তুই আমাকে হাজারবার বলেছিস ভালোবাসি। কেউ একজন এসে বললো তাজ এমন আর তুই বিশ্বাস করে নিলি ? একবার মনে হয়নি তাজ এমন কিছু করতে পারে না। ভালোবাসার কথা নাহয় বাদই দিলাম, উনত্রিশ বছরে তুই এই চিনলি আমাকে ? মৌ শুধু ভালোবাসি বললেই হয় না, তার উপর বিশ্বাস রাখতে হয়। সারা পৃথিবীর মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে শুধু ভালোবাসার মানুষের কথায় যেদিন বিশ্বাস করতে পারবি সেদিন বুঝবি তুই তাকে ভালোবাসিস।

মৌ কী বলবে বুঝতে পারছে না। সত্যি তো শুধু ভালোবাসলে হয় না বিশ্বাস থাকতে হয়। বিশ্বাস হচ্ছে ভালোবাসার ভিত্তি, বিশ্বাসই যদি নড়বড়ে হয় তাহলে ভালোবাসা টিকে থাকবে কীভাবে ?

মৌ কিছু বলছে না দেখে তাজ বললো, রাখছি এখন।

মৌ তাড়াতাড়ি বললো, না।

আবার কিছুটা সময় নিরবতায় কেটে গেলে তাজ বললো, একদিন সব সত্যি সামনে আসবে মৌ। আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি। সেদিন তোরা আমার চোখে চোখ রাখতে পারবি তো ? তোর দোষ নেই রে, যেখানে আমার নিজের বাবা-মা আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না সেখানে তোর কী দোষ। তবে মনে রাখিস সত্য কোনোদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। সত্য হচ্ছে দিনের আলোর মতো, নিজের পথ খোঁজে ঠিক বেড়িয়ে আসবে আর সেদিন তোরা কীভাবে আমার চোখে চোখ রাখতে পারিস আমি দেখবো। সেদিন কাউকে মাফ করবো না আমি। আমার বাবা-মা আমাকে অবিশ্বাস করার চরম শাস্তি পাবে সেদিন আর সাথে তুইও। এসবের পিছনে যে আছে তাকে আমি ছাড়বো না। প্রত্যেককে তার শাস্তি ভোগ করতে হবে। এই গল্পটির সবচেয়ে অসহায় ব্যাক্তি আমি, তোরা কেউ নয়। নিজে সত্যিটা জেনেও প্রমাণ করতে না পারার মতো অসহায়ত্ব আর কিছুতেই নেই। নির্দোষ হয়েও সবার ঘৃণার দৃষ্টি সহ্য করার মতো কষ্ট আর কিছুতে নেই। একটু একটু করে গড়ে তোলা স্বপ্ন, ক্যারিয়ার চোখের সামনে ধূলোয় মিশে যাওয়ার মতো তীব্র যন্ত্রণা কিছুতেই নেই। কাউকে ছাড়বো না আমি, কাউকে না। আমার প্রতিটা অপমানের প্রতিশোধ নিবো।

মৌয়ের হঠাৎ মনে হলো সে ভুল করেছে তাজকে অবিশ্বাস করে। অন্যায় করে এতোটা কনফিডেন্স কারো থাকতে পারে না। মৌয়ের চোখে ভেসে উঠলো গত উনত্রিশটি বছর, যেটা সে তাজের সাথে কাটিয়েছে। স্কুল থেকে প্রপোজ পাওয়া শুরু হয়েছিলো তাজের, সব পায়ে মাড়িয়ে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছে কেবল। মেয়েদের কখনো অসম্মান করেনি, কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি। তাহলে সেই ছেলেটা কীভাবে এমন নিম্ন কাজ করবে। না না আরো দেরি হয়ে যাওয়ার আগে তাজকে সরি বলতে হবে মৌয়ের।

তাজ বললো, রাখছি এখন। বড্ড ক্লান্ত আমি, ঘুমাবো।

মৌ অস্থির গলায় বললো, আ,,আম সরি।

তাজ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, কেনো ?

মৌ জিহ্বা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, ক্ষণিকের জন্য পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম।

আগামীকাল কেউ নতুন কিছু বললে আবারও পথ হারিয়ে ফেলবি। তুই বরং আগে নিজের সঠিক পথটা খোঁজে বার কর। বারবার পথ হারালে সমস্যা তোরই হবে।

মৌকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো তাজ। সবকিছু বিষাক্ত লাগছে তার কাছে। যতদিন তার জীবনে তিতির নামক বিষাক্তফুলটা আছে ততদিন সব এমনই বিষাক্ত থাকবে।

তাজ বিড়বিড় করে বললো, এভাবে হবে না তাজ। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর। এই ষড়যন্ত্রের জাল থেকে বের হওয়ার একটা রাস্তা ঠিক পেয়ে যাবি তুই।

৭.
গত কয়েকদিনের অনিয়মে একদমই দূর্বল হয়ে গেছে তিতির। খাওয়াদাওয়া না করা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ঠিকমতো না ঘুমানো সব মিলিয়ে শরীরটা আর পেরে উঠেনি। তাজ সারাদিন এক হসপিটাল থেকে আরেক হসপিটাল ছুটালেও এক দানা খাবার খাওয়ানোর প্রয়োজন মনে করেনি। তাই হঠাৎ করেই চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এসেছে। পিটপিট করে চোখ খোলে সামনে ইরিনাকে বসে থাকতে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো।

ইরিনা সেটা খেয়াল করে গম্ভীর গলায় বললো, এতো ছটফট করার প্রয়োজন নেই।

সাইড টেবিলে দেখিয়ে বললো, খাবারগুলো খেয়ে মেডিসিন খেয়ে নাও আর নিজের খেয়াল রাখতে শেখো। নিজের জন্য না হলেও যে আসছে তার জন্য।

কথাগুলো বলে ইরিনা বের হয়ে গেলো রুম থেকে। তিতির বেডে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। সাইড টেবিলে তাকিয়ে খাবার দেখে ধীরে ধীরে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিলো, খুব বেশি ক্ষুধা পেয়েছিলো। খাবার খেলেও মেডিসিন খেলো না। এতক্ষণে খেয়াল হলো এটা তাজের রুম নেই। সেটা বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আজ অন্তত একটু ঘুমানো যাবে। তিতির কিছু না ভেবে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।

ফজরের আযানে ঘুম ভাঙলো তিতিরের। কয়েকদিনের ঝামেলায় ঠিকঠাক নামাজও পড়া হয়নি। ওযু করে এসে নামাজ পড়ে নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। সকালের সতেজ বাতাসে মনটা একটু শান্ত হলো। সকালের ব্রেকফাস্ট তিতিরের রুমে দিয়ে গেলো এক সার্ভেন্ট, তিতিরও চুপচাপ খেয়ে নিলো। দশটার দিকে রুম থেকে বেড়িয়ে অনেকটা ইতস্তত হয়ে তাজের রুমের দিকে গেলো। গতকালের ড্রেসটাই এখনো পরে আছে সে। মুলত একটা ড্রেস নিতেই তাজের রুমে আসা। দরজায় নক করে সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমে গিয়ে দেখলো তাজ নেই। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কাবার্ড থেকে একটা ড্রেস নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলো তাজের রুম থেকে। গতরাতে যে রুমে ছিলো সেখানে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে রেডি হলো। তিতির ঠিক করেছে আজই সে মৌয়ের সাথে দেখা করতে যাবে। রেডি হয়ে বের হতেই ড্রয়িংরুমে ইরিনার সামনে পড়লো।

ইরিনা গম্ভীর গলায় বললো, কোথায় যাচ্ছো ?

তিতির নিচু গলায় বললো, আমার একটু কাজ ছিলো বাইরে। বেশি সময় লাগবে না তাড়াতাড়ি চলে আসবো ?

ইরিনা শান্ত দৃষ্টিতে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো তিতিরের দিকে। তবে আর কিছু বললো না, এদিকে তিতির কনফিউজড সে যাবে কী যাবে না।

কিছু সময় পর ইরিনা গম্ভীর গলায় বললো, তাজ ফিরার আগে যেনো তোমাকে বাসায় দেখি আমি।

তিতির মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেলো বাসা থেকে। মুখে মাস্ক পরে গেইটের বাইরে এসে একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পড়লো। উদ্দেশ্য মৌয়ের বাসা, তারপর নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র আনতে হবে। তার জানা নেই খান ভিলায় আর কতদিন থাকতে হবে তাকে।

কলিংবেল বাজাতে গিয়েও তিতির হাত সরিয়ে নিচ্ছে বরাবর। তাকে দেখে এ পরিবারের সবার কেমন রিয়াকশন হবে সেটা ভাবতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু মৌয়ের সাথে কথা বলা যে খুব বেশি প্রয়োজন তার। অনেকটা সাহস নিয়ে কলিংবেল বাজালো তিতির। কিছুক্ষণ পর দরজা খোলে দিলো মৌয়ের মা রেহেনা।

তিতিরকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো, এই মেয়ে তুমি এখানে কী করছো ? আমার মেয়ের জীবনটা নরক করে শান্তি হয়নি তোমার ? আবার কী ধ্বংস করতে এসেছো এখানে।

তিতির ভীত গলায় বললো, আমি মৌ আপুর সাথে একটু কথা বলতে চাই।

রেহেনা অনেক রেগে গেলো, তুমি এখনই এখান থেকে না গেলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। কারো সাথে কথা হবে না তোমার, যাও এখান থেকে।

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মৌ বাইরে এসে বললো, কী হয়েছে মা এভাবে চেঁচামেচি করছো কার সাথে ?

তুই রুমে যা মৌ।

দরজায় তিতিরকে দেখে অনেক বেশি অবাক হলো মৌ। তিতিরকে গায়ে নিজের কেনা ড্রেস দেখে বুকে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো। মৌ নিজেই এগুলো কিনে তাজের কাবার্ডে রেখেছিলো। এতে তাজ অনেক হেসেছিলো তার কান্ড দেখে।

একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় বললো, ওকে আসতে দাও। আমারও কিছু কথা আছে ওর সাথে।

রেহেনা বললো, কিন্তু।

প্লিজ মা, আসতে দাও।

রেহেনা তিতিরের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন৷ তিতির ধীর পায়ে প্রবেশ করলো ভেতরে। মৌ তাকে ইশারা করলো তার সাথে যেতে। তিতির বাধ্যঁ মেয়ের মতো মৌকে অনুসরণ করলো। মৌ তিতিরকে নিয়ে নিজের বেলকনিতে গিয়ে বসলো।

মৌ শান্ত গলায় বললো, কী বলবে বলো ?

তিতির কিছুটা সময় থম মেরে বসে থেকে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে বললো, স্যার সত্যি বলছে তার কোনো দোষ নেই।

মৌ অনেক অবাক হলো তিতিরের কথা শুনে। তাজ নিদোর্ষ শুনে না বরং তিতির তাকে সত্যিটা বলছে বলে অবাক হচ্ছে।

তিতির আবার বললো, না আমি প্রেগনেন্ট আর না স্যারের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো কোনো কালেই।

রাগে শরীরের রক্ত গরম হয়ে আসছে মৌয়ের। ইচ্ছে করছে তিতিরকে গলা টিপে মেরে ফেলতে। দুটো জীবন নষ্ট করে, দুটো পরিবারের মান সম্মান মাটিতে মিশিয়ে মেয়েটা কতো সহজে সব স্বীকার করে নিচ্ছে। আদোও বুঝতে পারছে মেয়েটা কত বড় অপরাধ করেছে।

মৌ লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো, তাহলে এসব কেনো করলে ?

অকপটে তিতিরের উত্তর, বাধ্যঁ হয়ে।

মৌ অবাক হয়ে বললো, মানে ?

এবার টলমলে চোখে তিতির তাকালো মৌয়ের দিকে ভেজা গলায় বললো, আপনার জীবনের বেঁচে থাকার কারণ যে মানুষটা। কেউ যদি তার মাথায় গান তাক করে বলে তার কথা না শুনলে শেষ করে দিবে মানুষটাকে। আপনি কী করতেন আপু ? আমি স্বার্থপর মানুষ আপু, পারিনি নিজের স্বার্থের সাথে আপোষ করতে।

তিতিরের গাল বেয়ে এক ফোটা নোনাপানি গড়িয়ে পড়লো। মৌ বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছে না। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে।

মৌ কাঁপা গলায় বললো, কে করেছে এমনটা আর কেনো ?

তিতির চোখ বন্ধ করে একটা ঢোক গিলে বললো, র,,,

মৌ কোথায় তুই ?

কারো আওয়াজে থেমে গেলো তিতির। এই আওয়াজ তার খুব ভালো করে চেনা। এই তো সেই নরপশুটা যে সবার জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তিতিরের। কী করবে বুঝে উঠার আগেই বেলকনিতে প্রবেশ করলো রায়হান, মিস্টার রায়হান চৌধুরী। রহমান চৌধুরীর বড় ছেলে। তিতির বড় বড় চোখে তাকালো রায়হানের দিকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আনাগোনা দেখা গেলো তিতিরের।

রায়হান শান্ত দৃষ্টিতে একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার মৌয়ের দিকে তাকালো, শরীর কেমন এখন তোর ?

মৌ কিছুটা সময় চুপ থেকে বললো, আলহামদুলিল্লাহ। তুই এখানে কেনো ?

তিতির অবাক হয়ে তাকালো মৌয়ের দিকে। মৌয়ের কথা শুনে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না রায়হান শুধু তার পরিচিত নয় বরং কাছের কেউ। তিতির বুঝতে পারেনি রায়হান মৌয়ের পরিচিত। তিতির তাজের সাথে রায়হানের শত্রুতার কারণ জানে না। তিতির ভাবতেও পারেনি রায়হান মৌয়ের পরিচিত কেউ।

রায়হান তিতিরের দিকে তাকিয়ে শান্ত আর স্বাভাবিক গলায় বললো, মেয়েটা কে ?

রায়হানের শান্ত গলায়ও ভয়ে কেঁপে উঠলো তিতির।

মৌ বললো, আমার পরিচিত একজন।

তিতির হঠাৎ বলে উঠলো, আজ আমি আসি আপু।

মৌ বললো, কিন্তু..

মৌয়ের কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই তিতির উঠে বের হয়ে গেলো দ্রুত। মৌ আটকানোর সময়ও পেলো না। তিতির কিছু বলতে চাইছিলো সেটা সম্পূর্ণ শুনতে পারলো না মৌ।

রায়হান বললো, মেয়েটা এভাবে চলে গেলো কেনো ?

তোকে দেখে হয়তো আনইজি ফিল করছিলো। এখন কী মনে করে এসেছিস সেটা বল।

তোর খোঁজ নিতে এলাম।

মনে মনে বললো, আমি ঠিক সামনে না এলে তো আমার দুই বছরের সাজানো খেলা এক মিনিটে শেষ করে দিচ্ছিলো তিতির। এর ফল তোকে ভোগ করতে হবে তিতির।

চলবে,,,,

বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-০৩+০৪

0

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৩+০৪

ভোর হতে খুব একটা সময় বাকি নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে ঘন্টাখানেক ধরে৷ রাগের বশে কী করে ফেলেছে বুঝতেই নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে তাজের। সে কীভাবে এই মেয়েকে কাছে টেনে নিতে পারলো ? বেডে আধশোয়া হয়ে বসে আছে তাজ। এখন মনে হচ্ছে একটা সিগারেটের খুব দরকার। স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় সকল প্রকার নেশাদ্রব্য থেকে বরাবরই দূরে থাকে তাজ। তাই একটা সিগারেটও নেই তার কাছে। গায়ের ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে টাওয়েল জড়িয়ে নিলো কোমরে। বেডে চোখ পড়তেই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।

How is this possible?

বেডের সাদা চাদরে ছোপ ছোপ রক্তের দাগগুলো যেনো বলে দিচ্ছে মেয়েটা ভার্জিন ছিলো। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব ? মেয়েটা তো প্রেগনেন্ট তাহলে ? মস্তিষ্কে একটু চাপ দিতেই গতরাতের প্রতিটা মুহুর্ত স্পষ্ট হয়ে উঠলো তাজের সামনে। রাগের বশে তখন বুঝতে না পরলেও এখন ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেলো, মেয়েটা ভার্জিন ছিলো। তিতিরকে দু’বছর ধরে চেনে তাজ। তার কোনো কালেই বয়ফ্রেন্ড ছিল না, এটাও জানে।

তাজ মাথা চেপে ধরে বেডে বসে পড়লো, আমি তো ভেবেছিলাম সব মিথ্যে হলেও তিতির প্রেগনেন্ট এটা সত্যি। কিন্তু এখন দেখছি সেটাই সবচেয়ে বড় মিথ্যে। তাহলে রিপোর্টটা কার ? আর তিতির কেনো নিজের নামে এতবড় মিথ্যা বললো। নাহ্ আর ভাবতে পারছি না।

ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে আছে তিতির। শরীরের খুব কম জায়গায় অক্ষত আছে। পানি স্পর্শে প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করছে।

তিতির নিজের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, দেখ বোনু তোকে ভালোবাসার পুরষ্কার পেয়েছি আমি। বাবা-মায়ের দেওয়া দ্বায়িত্ব পালনের কত সুন্দর পুরষ্কার মিলেছে আজ। তোকে ভালোবাসার অপরাধে সবার চোখে আজ আমি চরিত্রহীন ঘৃণ্য একজন মানুষ। না স্যারের উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। তার থেকে আমি যা কেড়ে নিয়েছি সে তুলনায় এসব তো কিছুই না। আমি জানি আরো কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কিন্তু তুই চিন্তা করিস না বোনু তোর জন্য আমাকে যতটা স্বার্থপর হতে হয় হবো, যতটা নিচে নামতে হয় নামবো। পৃথিবীর সব মানুষ আমাকে ঘৃণা করুক শুধু তুই ভালোবেসে আপুনি বলে গলা জড়িয়ে ধরলেই হবে, সব ভুলে যাবো আমি। কিন্তু তোর গায়ে ফুলের টোকাও পড়তে দিবো না আমি। তোকে যেদিন ফিরে পাবো সবকিছু থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাবো আমরা। যেখানে আপন মানুষের মুখোশধারী নরপিশাচরা থাকবে না।

তাজ উঠে ওয়াশরুমের দরজায় আঘাত করে বললো, এই মেয়ে বের হ বলছি। এই মুহুর্তে বের না হলে দরজা ভেঙে ফেলবো।

তাজের আওয়াজে চমকে উঠলো তিতির। কিন্তু বের হবে কী করে ? তার কাছে তো পড়ার মতো কোনো কাপড় নেই। তাজ সমানে দরজা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় দরজা ভেঙে যাবে। তিতির কোনোরকমে টাওয়েল জড়িয়ে দরজা খোলে দিলো। তাজ কোনো দিকে খেয়াল না করে হাত ধরে টেনে বেডের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো।

রাগী গলায় বললো, তুমি যদি প্রেগনেন্ট হও। তাহলে এসবের মানে কী ?

ছোপ ছোপ রক্তের দাগগুলো দেখে আবার চোখ ভড়ে এলো তিতিরের, আনমনে বলে উঠলো, পঁচিশ বছরের আগলে রাখা সতীত্বের প্রমাণ।

কথাটা বারবার কানে বাজতে লাগলো তাজের। এই মেয়ে নিজের মুখে স্বীকার করছে সে প্রেগনেন্ট নয়।

তাজ রেগে ধমক দিয়ে বললো, What ?

তাজের ধমকে হুঁশ ফিরলো তিতিরের। আনমনে কী বলে ফেলেছে ভাবতেই চমকে উঠলো। তার তো কিছু বলার অনুমতি নেই। তাকে তো শুধু কাঠের পুতুলের ন্যায় অন্যের ইশারায় নাচতে বলা হয়েছে। তোতাপাখির মতো শেখানো বুলি আওড়াতে বলা হয়েছে। সে কোনো ভুল করলে তার মাশুল যে দিতে হবে অবুঝ প্রাণটাকে।

রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তাজের। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। কিছু হিসাব মিলে গিয়েও আবার গড়মিল হয়ে যাচ্ছে। ড্রয়ার থেকে প্রেগনেন্সি রিপোর্ট বের করে তিতিরের দিকে ছুঁড়ে দিলো তাজ।

এসব যদি তোমার সতীত্বের প্রমাণ হয় তাহলে এটা কী ?

তিতির কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। কোনো উত্তর না পেয়ে রাগ বেড়ে গেলো তাজের।

একটু দম নিয়ে বললো, তারমানে এতসব নাটকের মুল উদ্দেশ্য আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়া, আমাকে ধ্বংস করে দেওয়া। এই জন্যই বেছে বেছে বিয়ের দিনটা টার্গেট করেছিস। যাতে মিডিয়ার সাহায্যে সারাদেশের মানুষের সামনে আমাকে খারাপ আর চরিত্রহীন প্রমাণিত করতে পারিস।

তিতিরের প্রতি তাজের ঘৃণা বেড়ে গেলো কয়েক গুণ। এগিয়ে এসে তিতিরের গাল চেপে ধরলো, কত টাকার বিনিময়ে এসব করেছিস ? এই নাটকের মুল চরিত্র কে বল ? তোর একার পক্ষে এসব করা সম্ভব নয় আর আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে তো তোর কোনো লাভও নেই। বল কে আছে এসবের পিছনে ? আমার ভাবতেই ঘৃণা লাগছে একটা মেয়ে হয়ে টাকার বিনিময়ে নিজের চরিত্র বিক্রি করে দিয়েছিস তুই।

তিতির তাজের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বললো, টাকা ?

কিছুটা সময় দম নিয়ে আবার বললো, স্যার আমি তো এই খেলার কেবল একটা গুটি মাত্র। পারলে আসল কালপ্রিটটাকে খোঁজে বার করুন আর আমাকেও মুক্তি দিন।

তাজ ছেড়ে দিলো তিতিরকে। হনহনিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তার বুঝা হয়ে গেছে মেয়েটা কারো হাতের পুতুল। এর থেকে কিছুই জানা যাবে না। যা করার তাকেই করতে হবে। তাজ চলে যেতেই তিতির বেডে বসে পড়লো ধপ করে। একটা ফোন করা খুব প্রয়োজন কিন্তু তাজ থাকতে সেটা সম্ভব নয়। নিজের দিকে তাকিয়ে খেয়াল হলো এখনো টাওয়েল পড়ে আছে। চেঞ্জ করা প্রয়োজন কিন্তু পড়বেটা কী ? অনেক ভেবে তাজের কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেলো। একপাশে তাজের পোশাক রাখা আর অন্য পাশে কিছু শাড়ি আর ড্রেস। মনে হয় মৌয়ের জন্য ছিলো এগুলো। মৌয়ের কথা ভাবতেই দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক চিঁড়ে।

বিড়বিড় করে বললো, এতো মানুষের অভিশাপে তুই শেষ হয় যাবি তিতির। আপুটার কী দোষ ছিলো তিতির ?

মৌয়ের একটা ড্রেস বের করে ওয়াশরুমের দিকে একবার তাকিয়ে রুমেই চেঞ্জ করে নিলো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে একটু ঘুমানো প্রয়োজন। কাবার্ড থেকে নতুন চাদর নিয়ে বিছানায় বিছিয়ে নিলো আর আগেরটা ঝুঁড়িতে রেখে দিলো। কিছু না ভেবেই শুয়ে পড়লো বেডে। চোখ বন্ধ করতেই মরিচের মতো জ্বলছে চোখ, অসহ্য ব্যাথা হচ্ছে সারা শরীরে। তবু একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো। এখনো অনেক কিছু হওয়া বাকি আছে, অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হবে তাকে। অনেকটা সময় শাওয়ার নেওয়ার পর বের হলো তাজ। বের হয়ে তিতিরকে বেডে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ধপ করে মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। তার জীবন নরক করে শান্তির ঘুম দেওয়া হয়েছে। তাজ চেঞ্জ করে বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে তিতির, যেটা একদমই সহ্য হচ্ছে না তাজের। হাত ধরে টান দিয়ে বসিয়ে ফেললো এক ঝটকায়। কেবল ঘুম লেগেছিলো চোখে, হঠাৎ এমন করায় ধড়ফড়িয়ে উঠে তিতির।

তাজ দাঁত খিঁচিয়ে বললো, তোর সাহস হলো কী করে আমার বেডে ঘুমানোর ?

তিতির কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বললো, কোথায় ঘুমাবো তাহলে ?

যেখানে ইচ্ছে ঘুমা আমার বেডে তোর জায়গা হবে না, নাম বলছি।

তিতির কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো বেড থেকে। আশেপাশে তাকিয়ে সোফা দেখে সেখানে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। তাজ বেডে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

এখন শুধু সকালের অপেক্ষা তার। সকাল হলেই হসপিটালে গিয়ে সব টেস্ট করে সত্যিটা সবার সামনে আনার পালা। বিয়ের আসরে এমন বিশ্রি একটা পরিস্থিতিতে পড়ে চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছিল তার। তখন এটা মাথায় আসলেই এই ঘৃণ্য মেয়েটাকে এতোটা সময় সহ্য করতে হতো না তাকে। কিছুটা সময় এসব চিন্তা করতে লাগলো তাজ। অপর দিকে তিতির ভাবছে শেষ কোথায় এই নাটকের। সে তো অভিনেত্রী নয়, হাঁপিয়ে গেছে এতটুকু সময়েই।

বোনু কোথায় তুই, কীভাবে খোঁজে পাবো তোকে আমি ? এতগুলো বছর সবার থেকে লুকিয়ে রেখেও শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। ঠিক তোর খোঁজ পেয়ে গেলো রাক্ষসগুলো। ছিনিয়ে নিয়ে গেলো আমার থেকে আর আমাকে নামিয়ে দিলো জঘন্য এই খেলায়। খুব কষ্ট হচ্ছে রে বোনু।

৪.
আপুনি।

আশেপাশে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে কান্না করে দিলো ষোল বছরের মেয়েটা। একটা টেডিবিয়ার জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলো, নিজের আপুনিকে স্বপ্নে দেখেই ঘুম ভেঙে গেছে। কোথায় তার আপুনি ? আপুনি তো তাকে একা ফেলে কোথাও যায় না। মানহা মাহমুদ পাখি, বয়স ষোল হলেও বুদ্ধি আট বছরের বাচ্চার সমান। কারণ মেয়েটা মৃদু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। পরণে তার বেবি পিংক কালার টিশার্ট আর প্লাজু। পুতুলের মতো মেয়েটাকে দেখতেও নিতান্তই বাচ্চা মনে হচ্ছে। পাখি বেড থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো।

আপুনি দরজা খোলো না, আমার ভয় লাগে তো।

কেউ দরজা খুলছে না দেখে কান্না করে দিলো পাখি। তবে দরজা ধাক্কানো বন্ধ করলো না। একসময় বিরক্ত হয়ে দরজা খোলে ঘুম ঘুম চোখে সামনে দাঁড়ালো বছর পঁচিশের একটা ছেলে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রচন্ড বিরক্ত সে।

এই পাগল ছাগল ঘুমাতে না ঘুমাতেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিস কেনো ? কেবল একটু ঘুম লেগেছিলো, দিলি নষ্ট করে।

ভয়ে গুটিয়ে গেলো পাখি। কান্নাও বন্ধ করে দিয়েছে কারণ সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে ভয় পায় সে।

ছেলেটা রেগে ধমক দিয়ে বললো, কী হলো এখন চুপ করে আছিস কেনো ? বল কেনো চিৎকার করছিলি ?

পাখি ঠোঁট উল্টে বললো, আপুনি।

ছেলেটা বিরক্ত গলায় বললো, এই পাগল তো দিনরাত আপুনি আপুনি করে আমার মাথা খেয়ে ফেলছে। ভাইয়া কেনো যে এই পাগল আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে বুঝতে পারছি না। এই ন্যান্সি, ন্যান্সি।

ঘুম ঘুম চোখে হন্তদন্ত হয়ে মধ্য বয়সী এক মহিলা এসে হাজির হলো।

আমেরিকান ইংরেজিতে বললো, কী হয়েছে স্যার ?

উত্তরে ছেলেটা বললো, এই মেয়েকে সামলান। আমি এখন ঘুমাবো আবার যদি আমাকে বিরক্ত করেছে এর খবর আছে।

কথাগুলো শেষ করে ছেলেটা পাশের রুমে ঢোকে ঠাস করে দরজা আটকে দিলো। সেই শব্দে কেঁপে উঠলো পাখি। লন্ডনের একটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে আছে পাখি। তার আপুনির থেকে হাজার মাইল দূরে। ন্যান্সি নানা কথায় ভুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো পাখিকে, নিজেও রুমে না গিয়ে পাখির সাথে ঘুমিয়ে পড়লো।

ছেলেটার আবার ঘুম ভেঙে গেলো ফোনের শব্দে। বিরক্তিতে বাজে গালি দিলো একটা তবে স্কিনে নিজের বড় ভাইয়ের নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো।

কী করছিস আহান ?

হ্যাঁ ছেলেটার নাম আহান চৌধুরী। লন্ডনের নামকরা ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তারি পড়ছে সে। এখানে সে একাই থাকে। পাখিকে দিয়ে যাওয়ার সময় তার দেখাশোনার জন্য ন্যান্সিকেও রেখে গেছে তার বড় ভাই।

আহান মনে মনে বললো, আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে জিজ্ঞেস করছে কী করছি ?

মুখে বললো, এই তো ঘুমাতে যাচ্ছিলাম।

অপর পাশ থেকে বললো, পাখির কী অবস্থা ?

আহান অসহায় গলায় বললো, ভাইয়া এই পাগলকে কোথায় পেয়েছো তুমি ? প্লিজ এটাকে নিয়ে যাও নাহলে আমিও পাগল হয়ে যাবো। সারা দিনরাত আপুনি আপুনি করে আমার মাথায় খায়।

দেখ আহান তোকে আগেই বলেছি মেয়েটা আমাদের আপন কেউ যদিও ওর পরিচয় এখনই তোকে দিতে পারছি না আমি। আপুনি ওর বড় বোন, যে মারা গেছে কিছুদিন আগে। সেটা পাখি জানে না তাই ওকে সামলে রাখ। সময় হলে আমি ওকে ফিরিয়ে আনবো। তবে মনে রাখিস ওর গায়ে যেনো ফুলের টোকাও না পড়ে। তাহলে আমি ভুলে যাবো তুই আমার ভাই।

ওকে ভাইয়া, আমার উপর তুমি বিশ্বাস রাখতে পারো।

নিজের আর পাখির খেয়াল রাখিস।

ফোন রেখে আহান ঘুমিয়ে পড়লো আর অপর পাশের ব্যাক্তি চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো, পাখি হচ্ছে এই খেলার প্রাণভোমরা। যতক্ষণ পাখি আমার হাতের মুঠোয়, তিতির ততক্ষণ আমার হাতের পুতুল। তাই প্রাণভোমরা তো আগলে রাখতেই হবে।

আবার ফোন বেজে উঠলে স্কিনে তিতির নামটা দেখে পৈশাচিক হাসি ফোটে উঠলো লোকটার ঠোঁটের কোণে।

আবার ফোন বেজে উঠলে স্কিনে তিতির নামটা দেখে পৈশাচিক হাসি ফোটে উঠলো লোকটার ঠোঁটের কোণে।

কেমন আছিস বোন ?

বিতৃষ্ণায় মুখ কুঁচকে গেলো তিতিরের। ঝাঁঝালো গলায় বললো, আপনার মুখে বোন শব্দটা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শব্দ মনে হচ্ছে। দয়া করে এমন পবিত্র একটা সম্পর্ক আপনার নোংরা মুখে নিয়ে অপবিত্র করবেন না।

তিতিরের কথায় উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো লোকটি, আচ্ছা নিলাম না এই শব্দ। তো কেমন কাটলো খান ভিলায় প্রথম রাত ?

ঘৃণায় কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এই লোকের সাথে কিন্তু তিতিরের আর কোনো পথ খোলা নেই।

আমার বোনু কোথায় ? আমি তো আপনার কথা অনুযায়ী সবকিছু করেছি। আমাদের দুই বোনের সমস্ত প্রোপার্টি এখন আপনাদের। তাজ স্যারের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। এবার আমার বোনুকে ফিরিয়ে দিন।

সেটা তো এখনই সম্ভব নয় তিতিরপাখি।

তিতির এবার রেগে বলল, আর কত নিচে নামাবেন আমাকে ? নিজের বোন না হলেও আপনার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক। নিজের রক্তের সাথে আর কত বেইমানি করবেন।

বোন হয়ে ভাইয়ের এতটুকু কাজ করে দিতে পারছিস না ?

কে ভাই, আপনি ? আমার কোনো ভাই নেই। এই পৃথিবীতে আমার একটা বোন ছাড়া আর কেউ নেই। যেই বোনটাকেও আপনি কেড়ে নিয়েছেন আমার থেকে।

চিন্তা করিস না, পাখি যেখানে আছে ভালো আছে। তুই যতক্ষণ আমার কথা মতো চলবি ততক্ষণ পাখির গায়ে একটা ফুলের টোকাও পড়বে না তার গ্যারান্টি আমি দিচ্ছি তোকে।

আমার বোনুর সাথে কিছু করার কথা স্বপ্নেও ভাববেন না। এই তিতিরের একমাত্র দূর্বল জায়গা তার বোনু। সেখানে আঘাত করলে তার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হবে আমি কল্পনাটও করতে পারবেন না। যে বোনের জন্য তাজের মতো মানুষকে ধ্বংস করতে আমি দু’বার ভাবিনি, মৌ আপুর মতো মানুষের জীবন নষ্ট করেছি। সেখানে আপনাকে ধ্বংস করতে আমি দু সেকেন্ড সময় নিবো না। আহত বাঘিনীর আক্রমন কতটা ভয়ংকর হয় সেটা আপনার জানা আছে নিশ্চয়ই।

তুই যাদের এত মহান মনে করছিস তারা এতটাই মহান তো ? থাক সেসব, তুই আমার কথা মতো চল, আমি আমার কথা রাখবো। কাজ হয়ে গেলে অক্ষত অবস্থায় তোর বোনকে তোর কাছে পৌঁছে দিবো।

ফোন কেটে বেলকনিতে দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পড়লো তিতির। ফোনের স্কিনে পাখির হাসোজ্জল মুখটা ভাসছে। তিতির হাত বুলিয়ে দিলো বোনের মুখে। আজ পাঁচদিন হলো পাখিকে দেখে না তিতির। আপুনি বলে গলা জড়িয়ে ধরে না কেউ। বাবা-মা যখন খুন হয় তিতিরের বয়স তখন কেবল দশ বছর আর পাখি এক বছরের বাচ্চা। এক বছরের ছোট পাখিটাকে আগলে বড় করেছে তিতির। আপনজনের মুখোশধারী নরপিশাচদের থেকে লুকিয়ে রেখেছে দীর্ঘ পনেরোটি বছর। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি। যে প্রোপার্টির জন্য তার বাবা-মাকে খুন করা হয়েছে সেসব তো তিতির দিয়েই দিয়েছে। তারপরও কেনো এই নোংরা খেলায় নামিয়েছে তাকে।

তিতির বিড়বিড় করে বললো, তুই চিন্তা করিস না বোনু আমি তোর কিচ্ছু হতে দিবো না। মিস্টার চৌধুরী এবার বুঝবে কার সাথে খেলছে। একবার তোকে পেয়ে যাই। চৌধুরীদের পাপের শাস্তি দিয়ে তবেই তোকে নিয়ে দূরে চলে যাবো। বাবা-মায়ের খুনের প্রমাণ আমার কাছে থাকলেও কখনো সাহস হয়নি শাস্তি দেওয়ার। কিন্তু এবার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এদের শাস্তি না দিলে বারবার আমাদের জীবনে বিষাক্ত ছোবল দিবে। তবে যাওয়ার আগে স্যার আর মৌ আপুর জীবন গুছিয়ে দিয়ে যেতে হবে। আমি তাদের জীবনে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো সব এলোমেলো করে দিয়েছি আবার আমিই সব ঠিক করে দিবো। একটু সময়ের প্রয়োজন শুধু।

নানা রকম চিন্তা করতে করতে একসময় বেলকনিতে ঘুমিয়ে পড়লো তিতির।

আজ পাঁচটি রাত ধরে ঘুম নেই তার চোখে। তাজের প্রতি তিতিরের ভালোবাসা অপ্রকাশিত। পাখির পর পৃথিবীতে এই একজনকে সে ভালোবেসেছে। কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি, কখনো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনি। তিতির তাজকে দেখতো তাজের থেকে লুকিয়ে। পাঁচদিন আগেই তাজ আর মৌয়ের বিয়ের কথা জানতে পারে। প্রথম একটু কষ্ট হলেও পরে নিজেকে সামলে নেয়। তাজ তার নয়, তাজ তার জীবনে একটা না ছোঁয়া স্বপ্ন। মৌকে তার ভালো লেগেছে তাজের স্ত্রী হিসাবে, মেয়েটা খুব ভালোবাসে তাজকে। এ নিয়ে বেশ খুশি হয়েছিলো তিতির। আগামী দশদিন বিয়ের জন্য তাজের অফিশিয়ালি কাজের চাপ কম তিতিরের উপর। বোনুকে অনেকটা সময় দিতে পারবে ভেবে খুশি মনে চকলেট, আইসক্রিম নিয়ে ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখে পুরো ফ্ল্যাট এলোমেলো হয়ে পরে আছে। পাখিকে দেখাশোনা করা মেয়েটাও উধাও। পুরো ফ্ল্যাট খোঁজে পাখির অস্তিত্ব না পেয়ে ভয় পেয়ে যায় তিতির। কী করবে বুঝে উঠার আগেই ফোন বেজে উঠে। বার কয়েক রিং হবার পর তিতিরের হুঁশ ফিরে। ফোনটা ছিলো মিস্টার চৌধুরীর, তখন থেকে তিতির তার হাতের পুতুল।

৫.
মৌ দরজাটা খোল মা।

উঠে গিয়ে দরজা খোলার মতো শক্তি মৌয়ের অবশিষ্ট নেই। গতরাতে কতটা সময় বাথটবে ডুবে ছিলো সে হিসাব নেই তার কাছে। প্রচন্ড শীত অনুভব হতেই উঠে এসে কোনোরকমে চেঞ্জ করে বেডে শুয়েছে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে। অনেকটা সময় ডাকাডাকি করার পরও মৌয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো মৌয়ের মা রেহেনা খন্দকার। স্বামীকে ডেকে এনে চাবি দিয়ে রুমের লক খুললেন। মেয়েকে শুয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও কাছে গিয়ে আঁতকে গেলেন। শীতে কাঁপছে মেয়েটা, কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠলেন।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, জ্বরে তো শরীর পুড়ে যাচ্ছে।

মহিবুল রহমান ব্যস্ত গলায় বললো, তুমি ওর কাছে বসো আমি ডাক্তারকে ফোন দিচ্ছি।

মিতা মিতা কোথায় তুই ?

ড্রয়িংরুম থেকে আওয়াজ আসতেই মৌয়ের বাবা-মা একে অপরের দিকে তাকালো। এত সকালে কে এসেছে বুঝতে পারছে না।

রেহেনা মহিবুলের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি গিয়ে দেখো কে এসেছে।

মহিবুল বের হয়ে গেলো রুম থেকে। রেহেনা ওয়াশরুমে গেলেন পানি আনতে, মাথায় পানি দেওয়ার জন্য। ওয়াশরুমের ফ্লোরে ভেজা বেনারসি দেখে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। এক বালতি পানি নিয়ে রুমে এসে মেয়ের মাথায় পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগলেন।

আন্টি মিতার জ্বর এলো কীভাবে ?

পেছন থেকে আওয়াজ আসতেই রেহেনা ঘুরে তাকালেন দরজার দিকে। দরজার সামনে রায়হান দাঁড়িয়ে আছে। রেহেনার অনুমতির অপেক্ষা না করে রুমে চলে এলো রায়হান।

রেহেনা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, মেয়েটার উপর দিয়ে যা গেলো। বেঁচে আছে এতেই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।

রায়হান মৌয়ের ড্রয়ারে ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজতে খুঁজতে রেহেনার কথা শুনে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, যা গেলো বলতে ?

রেহেনা কিছু না বলে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন। রায়হান উত্তর না পেয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে মৌয়ের কাছে গেলো। বক্সে প্রয়োজনীয় সব পেয়েও গেলো। থার্মোমিটার মুখে পুরে দিলো জ্বর মাপার জন্য।

রেহেনা শান্ত গলায় বললো, তুই দেশে ফিরলি কবে ?

সকাল ছয়টায় ল্যান্ড করেছি। সেখানে থেকে সোজা মিতার সাথে দেখা করতে এলাম।

থার্মোমিটার বের করে দেখলো ১০৩° জ্বর।

আন্টি জ্বর তো অনেক৷ তুমি এক কাজ করো মাথায় পানি দিয়ে শরীরও মুছিয়ে দাও। আমি কিছু মেডিসিন নিয়ে আসছি, খাবারের পর খাইয়ে দিও।

তুই তোর আঙ্কেলকে দে, সে নিয়ে আসবে। তুইও ফ্রেশ হয়ে আয় ব্রেকফাস্ট করবি। মেয়েটার এই অবস্থা, তুই আজ এখানে থাক।

রায়হান কিছুটা সময় চিন্তা করে বললো, ঠিক আছে।

রেহেনা ওয়াশরুমে চলে গেলো মৌয়ের শরীর মুছে দেওয়ার জন্য পানি আনতে। রায়হান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৌয়ের শুকনো মুখটার দিকে। তাজ, মৌ আর রায়হান তিনজনই ছোটবেলার বন্ধু। মৌ আর রায়হান ডাক্তার হলেও তাজ আলাদা হয়ে গেছে তাদের থেকে। এক মাসের জন্য দেশের বাইরে ছিলো রায়হান। আজই দেশে ফিরেছে তাই গতকালের কিছুই জানা নেই তার। অজানা কারণে মৌ আর তাজ নিজেদের বিয়ের খবর সবচেয়ে কাছের বন্ধুকেই জানায়নি। তাজ জানাতে চাইলেও মৌ বাঁধা দিয়েছে।

রেহেনা এসে রায়হানকে একইভাবে বসে থাকতে দেখে বললো, কী হলো এখনো বসে আছিস কেনো ? গেস্ট রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়। মেডিসিন তোর আঙ্কেলকে আনতে বলে যা।

রায়হান মৌয়ের দিকে একবার তাকিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। রেহেনা মৌয়ের শরীর মুছে দিতে লাগলো।

৬.
ফোনের রিংটোনে ঘুম ভেঙে গেলো তাজের। ফোন রিসিভ করে ওপাশের কথা শুনে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। নতুন যে মুভির জন্য সাইন করেছিলো সেটা ক্যান্সেল করতে চাইছে পরিচালক। তাজের সাথে কাজ করতে চায় না সে। তার সাথে একপ্রকার ঝামেলা করে ফোন রেখে দিলো তাজ। থম মেরে বসে আছে বেডে। এটা তো হওয়ারই ছিলো, কেবল শুরু তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়ার। সকাল সকাল এমন একটা নিউজে সারা শরীর রাগে ফেটে যাচ্ছে তাজের। রেগে সোফার দিকে তাকিয়ে তিতিরকে দেখতে পেলো না। আশেপাশে খোঁজে না পেয়ে বেড থেকে নেমে বেলকনির দিকে গেলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমানো মলিন মুখটা দেখে মায়া হলো না তাজের। তিতিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে গাল চেপে ধরলো।

চমকে উঠলো তিতির, সামনে তাকিয়ে তাজকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।

রাগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, তোকে যদি এখন খুন করতে পারতাম তাহলে হয়তো একটু শান্তি হতো আমার। তোকে যেই শাস্তি দেই না কেনো কম হয়ে যাবে।

তিতির কিছু না বুঝে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। তাজের চোখে তার জন্য তীব্র ঘৃণা হৃদয় ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনই গরগর করে সব সত্যি বলে দিয়ে তাজ আর মৌয়ের জীবন থেকে সরে যেতে। তিতিরের মনে হচ্ছে সে তাজ আর মৌয়ের জীবনের সূর্য গ্রহণ।

তাজ ছেড়ে দিলো তিতিরকে,বসে পড়লো মেঝেতে।

তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই যত টাকার বিনিময়ে এসব করছিস তার থেকে কয়েকগুণ বেশি টাকা আমি তোকে দিবো। তবু এই নোংরা খেলাটা বন্ধ কর।

তিতির এবারও চুপ, যেনো সে কথা বলতে শিখেনি।

একবার আমি সত্যিটা জানতে পারি। তোকে নিজের হাতে খুন করে সবকিছুর বদলা নিবো আমি।

ফ্রেশ হয়ে আসছি তারপর হসপিটালে যাবো। তোর সব মিথ্যে সকলের সামনে আসলে এমনই সব স্বীকার করতে বাধ্য হবি।

তাজ চলে যেতেই দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো তিতির। তার জানা আছে তাজ তাকে যেখানেই নিয়ে যাক রিপোর্ট একই আসবে। শহরের প্রত্যেকটা হসপিটালে শয়তানটার লোক আছে। তারা হসপিটালে যাওয়ার সাথে সাথে তার কাছে খবর পৌঁছে যাবে।

তিতির বললো, না এভাবে বসে থাকলে হবে না। বোনুকে খুঁজতে হবে৷ একমাত্র বোনুকে খোঁজে পেলেই এই খেলা শেষ করা যাবে। আচ্ছা আমি কী মৌ আপুর কাছে যাবো একবার ? মৌ আপুর কাছে গেলেও সে সব জেনে যাবে ? একবার চেষ্টা তো করে দেখি। তুমি চিন্তা করো না আপু, আমি যেমন ভেসে আসা মেঘের মতো তোমাদের জীবনে উড়ে এসেছি, ঠিক সেভাবেই উড়ে চলেও যাবো। একবার শুধু আমার বোনুকে পেয়ে যাই।

চলবে,,,

বিষাক্তফুলের আসক্তি পর্ব-০১+০২

0

#বিষাক্তফুলের আসক্তি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০১+০২
১.
বিয়ের আসরে কনে প্রেগনেন্সির রিপোর্ট হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। না না রিপোর্টটা কিন্তু তার নয়। রিপোর্টটা বিয়ের আসরে হাজির হয়ে বরের প্রেমিকা দাবি করা মেয়েটার। আশেপাশের এতো সেলিব্রিটি আর মিডিয়ার হইচই কিছুই কানে যাচ্ছে না মৌয়ের। রিপোর্টে পজিটিভ লেখাটা জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে। একজন ডাক্তার হওয়ার দরুন রিপোর্টটা ফেইক নয় সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না মৌয়ের। জলে টইটম্বুর চোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বর বেশের ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু, কিশোরী মনের প্রথম মুগ্ধতা, প্রথম প্রেম আর মনের কোণে লুকানো গভীর ভালোবাসার মানুষটার দিকে তাকালো। চিরচেনা মানুষটাকে আজ বড্ড বেশি অচেনা লাগছে।

এসব কী তাজ ?

তাজ রাগী গলায় বললো, আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি এসবের মানে কী ?

তাজের বাবা ইকবাল খান রক্তবর্ণ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে সজোরে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো ছেলের গালে। এতক্ষণের অশান্ত পরিবেশ এক নিমিষেই শান্ত হয়ে গেলো একটা থাপ্পড়ের আওয়াজে।

বর্তমানে দুই বাংলার মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ সুপারস্টার তাজওয়ার খান তাজ। চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেছে বছর পাঁচেক হয়েছে কিন্তু জনপ্রিয়তা তার তুঙ্গে আর সে দাঁড়িয়ে আছে সফলতার চূড়ায়। ৬ ফুট উচ্চতার ছেলেটা যেমন হ্যান্ডসাম দেখতে, তেমনই তার আকর্ষণীয় পার্সোনালিটি, সাথে আছে মনোমুগ্ধকর গানের গলা আর অভিনয় দক্ষতা। এতেই দুই বাংলার মানুষের মনে জায়গা করেছে গভীরভাবে। হাজারো তরুণীর স্বপ্ন পুরুষ আজ সবার মন ভেঙে বিয়ের পিড়িতে বসেছিলো বাবার অনুরোধে। পাত্রী তারই ছোটবেলার বান্ধবী মৌমিতা রহমান। কাজী কেবলই তাজকে কবুল বলতে বলেছে তখনই মেয়েলি কণ্ঠে সবাই থমকে গেলো।

এই বিয়ে হবে না কাজী সাহেব ?

গলার আওয়াজ অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে নিজের ম্যানেজার মিস মুসকান মাহমুদ তিতিরকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলো তাজ। তিতির তার নিজের ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলে বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেনি। তাজের প্রফেশনাল লাইফের বড় একটা দ্বায়িত্ব সামলায় তিতির। আজ দু’বছর ধরেই সেই কাজ করে আসছে। সে কেনো হঠাৎ তাজের বিয়ে আটকাচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না।

তাজ ভ্রু কুঁচকে বললো, এসব কী বলছো তুমি তিতির ?

তিতির রোবটের মতো বললো, আপনি এই বিয়ে করতে পারেন না স্যার ?

তাজ এবার রাগী গলায় বললো, But why Titir ?

তিতির পূর্বের ন্যায় বললো, আপনি এভাবে আমাকে ধোঁকা দিতে পারেন না স্যার।

তাজ অবাক আর বিস্মিত গলায় বললো, What are you talking nonsense ?

ইতিমধ্যে পুরো বিয়ের আসরে নানা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। সবাই নিজেদের মধ্যে নানা রকম কথাবার্তা বলে চলেছে। মৌমিতা আর চুপ করে থাকতে পারলো না এবার।

কাঁপা গলায় বললো, এসবের মানে কী তিতির ? কেনো এসব বলছো তুমি ?

তিতির বরাবরের মতোই যান্ত্রিক গলায় বললো, স্যারের সাথে আমার এক বছরের সম্পর্ক। আমি স্যারের সন্তানের মা হতে চলেছি। এই বিয়ে হলে আমি আমাদের সন্তানকে কার পরিচয়ে বড় করে তুলবো ?

তিতিরের কথা শুনে সবার মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। মৌ দুই কদম পিছিয়ে গেলো তিতিরের কথা শুনে। বাকি সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তিতিরের কথা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সবার।

তাজ হতবিহ্বল হয়ে চেঁচিয়ে বললো, What ?

তিতির নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ যেনো অনুভূতিহীন কোনো জড়পদার্থ সে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজের ব্যাগ থেকে প্রেগনেন্সি রিপোর্ট বের করে তাজের দিকে এগিয়ে দিলে মৌ খপ করে নিয়ে যায় সেটা। তারপরেই উপরিউক্ত ঘটনা ঘটে গেছে।

ইকবাল খান রাগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, এজন্যই আমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এতটা ঘৃণা করি। এজন্যই আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম তোমাকে এই নোংরা জগতে পা রেখো না। কিন্তু তুমি আমার কথা একবারের জন্যেও গুরুত্ব দাওনি। নর্দমায় নামলে গায়ে সেই নর্দমা আবর্জনা লাগবে এটা অস্বাভাবিক আর কী ? তুমি আমার ছেলে এটা ভাবতেই লজ্জায়, ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।

তাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিজের বাবার দিকে। এটা তারই বাবা তো ? যে বাবা কখনো তার গায়ে ফুলের টোকা দেয়নি সেই বাবা আজ সারাদেশের মানুষের সামনে তাকে থাপ্পড় মারলো। নিউজ চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার করছে এই অনুষ্ঠানের সব নিউজ। তাজ নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কী হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না এই মুহুর্তে, মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। পাঁচ বছর ধরে একটু একটু করে কুড়ানো সম্মান, ভালোবাসা সবই আজ মাটির সাথে মিশে গেছে এক নিমিষেই।

তাজ ভাঙা গলায় বললো, সবকিছু মিথ্যা। She is lying.

মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে তিতির। মৌ পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। মৌকে আগলে ধরে রেখেছে তার মা।

তাজ এবার চিৎকার করে বললো, সব মিথ্যা। ওর বলা প্রত্যেকটা শব্দ মিথ্যা।

তিতির মনে মনে বললো, আমাকে মাফ করবেন স্যার। আমার যে কিছুই করার নেই আজ। সময় আমাকে স্বার্থপর হতে বাধ্য করছে।

তিতির নিজের ব্যাগ থেকে আরো কিছু প্রমাণ বের করে সামনের টেবিলে রাখলো। আপাতত যেখানে তাজ আর মৌয়ের বিয়ের চকচকে সাদা কাগজের কাবিনখানা রয়েছে। শুধু সাইন করা হয়ে উঠেনি কারো। তিতিরের প্রমাণগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ছবি, যেখানে হাসোজ্জল কিছু ছবি তিতির আর তাজের। দেখে কারো বুঝতে অসুবিধা হবে না তারা সুখী কাপল, কারণ ছবিগুলো তেমন পোজে তোলা, একটা মোবাইল, যাতে আছে কিছু কল রেকর্ড আর ভিডিও ক্লিপ। মৌ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছবিগুলোর দিকে। কেউ আর বাকি প্রমাণ যাচাই করে দেখার আগ্রহ দেখালো না। দেখার মতো মানসিক অবস্থাও নেই কারো এখন। তাজ তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে আর তিতির নিজের দৃষ্টি মাটিতেই আবদ্ধ রেখেছে। তিতিরের যে আজ তাজের চোখে চোখ রাখার সাহস নেই, যদিও আগেও কোনোদিন ছিলো না। তবে আজকের পর আর কোনোদিনই হয়তো সেই সাহস আর হয়ে উঠবে না। আর তাজ তিতিরকে চিনতে পারছে না আজ। তার সমানে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মাঝে গত দুই বছরের চেনা তিতিরকে খোঁজে পাচ্ছে না। এদিকে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাজ আর ইকবাল খানের সব গার্ড মিলেও প্রেস মিডিয়া কন্ট্রোল করতে পারছে না৷ তারা নানারকম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে তিতির আর তাজের দিকে। ইতিমধ্যে নিজেদের মনগড়া কাহিনী বানিয়ে প্রচার করাও হয়ে গেছে।

ইকবাল খান পরিস্থিতি সামলাতে বললো, তাজের বিয়ে হবে আর সেটা আজ আর এখনই। তবে মৌমিতার সাথে নয় তিতিরের সাথে।

ইকবাল খানের এক কথায় সকলেই তাকালো তার দিকে, একমাত্র তিতির ছাড়া। তাজ তাকিয়ে আছে নিজের বাবার দিকে। মৌমিতা আর এতোটা সহ্য করতে পারলো না সেন্সলেস হয়ে নেতিয়ে পড়লো।

২.
সুপারস্টার তাজওয়ার খান তাজের স্ত্রী হয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে মিস তিতির উপস সরি মিসেস তিতির, উপফে মিসেস তাজওয়ার খান তাজ।

তাজের রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিলো তিতির। ভাবছিলো কী থেকে কী করে ফেললো আজ সে ? তখনই তাজের মাতাল কণ্ঠে কেঁপে উঠলো তিতির। ভয়ে হাত-পা জমে আসছে তার। তার জানা মতে তাজ কখনো ড্রিংস করে না, তবে আজ ?

তাজ তিতিরের কাঁধ ধরে এক ঝটকায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো।

গাল চেপে ধরে বললো, কেনো করলে এমন ? কী ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার ?

তাজ এতো শক্ত করে গাল ধরেছে তিতিরের মনে হচ্ছে দাঁত ও ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাবে। তবু তিতির একটা আওয়াজও করলো না। চোখ বন্ধ করে ব্যাথা সহ্য করতে লাগলো।

তাজ আবার বললো, সোনার চামচে খেয়ে বড় হয়েছে এই তাজওয়ার খান তাজ। খান গ্রুপ অব কোম্পানির একমাত্র উত্তরাধিকারী। এই সবকিছু ফেলে নিজের স্বপ্ন পুরণের পিছনে ছুটেছে এই তাজ। পাঁচ বছরে নিজের বাবার পরিচয়ের বাইরে আলাদা একটা পরিচয় তৈরি করেছে একটু একটু করে। স্বপ্ন পূরণের স্বাদ যখন উপভোগ করার সময় এসেছে ঠিক তখনই এক মিনিটে তুই সব মাটির সাথে মিশিয়ে ফেললি। যে তাজ বলতে মেয়েটা পাগল ছিলো তারাই আজ তাকে ছি ছি করছে। একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য যারা হুমড়ি খেয়ে পড়তো তারাই ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আজ।

তাজ এবার তিতিরের গলা টিপে ধরে বললো, সবকিছু হয়েছে শুধুমাত্র তোর জন্য। আমার বাবা-মাও আমাকে ভুল বুঝেছে শুধুমাত্র তোর জন্য।

দম বন্ধ হয়ে আসছে তিতিরের। তবে কী আজই তার জীবনের শেষ দিন ? কিন্তু তার তো এখনই মরলে চলবে না। যার জন্য সে এতোটা স্বার্থপর হয়ে তাজকে ধ্বংস করে দিলো, তিতির মরে গেলে তার কী হবে ? এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মানুষগুলো তো শিয়াল শকুনের মতো ছিঁড়ে খাবে অবুঝ প্রাণটাকে। না না তিতিরকে বাঁচতে হবে, নিজের জন্য নয় সেই প্রাণটার জন্য হলেও আজ নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে।

তিতির মনে মনে আওড়াতে লাগলো, আমাকে বাঁচতে হবে ?

নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তাজকে ধাক্কা দিলো। তাজ খানিকটা পিছিয়ে গেলো তিতিরের থেকে। কিছুটা ড্রাংক থাকায় তাজকে সরাতে সক্ষম হয়েছে তিতির। তাজ সরে যেতেই তিতির কাশতে কাশতে নিচে বসে পড়লো। চোখ থেকে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। নিয়তি বরাবরই তার জন্য নিষ্ঠুর। গত দুই বছর তো ভালোই ছিলো সে। তাজ অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। হাসিখুশি আর বন্ধুসুলভ সবার জন্য। এতো বড় একজন মানুষ হয়েও বিন্দুমাত্র অহংকার নেই তার মধ্যে। তিতিরকে কতোটা সাহায্য করেছে সেটা একমাত্র তিতির বলতে পারবে। আজ অসহায় হয়ে সেই মানুষটার সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে তিতির। বলতে গেলে যার নুন খেয়েছে তার সাথেই নিমকহারামি করেছে। কিন্তু তিতিরের যে হাত-পা বাঁধা। দু’হাতে মুখ লুকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো তিতির।

ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ায় দিগুণ রেগে গেলো তাজ। এগিয়ে এসে তিতিরের চুলের মুঠি ধরে দাড় করালো। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো তিতির কিন্তু মুখে একটা শব্দও করছে না।

তাজ দাঁত খিঁচিয়ে বললো, এতবড় সাহস তোর ? এই তাজওয়ার খান তাজকে ধাক্কা দিস। যার বিছানা সঙ্গী হওয়ার জন্য এতো বড় নাটক করলি তাকেই ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিস কেনো ? তুই এতবড় অভিনেত্রী আগে জানলে আমার মুভির হিরোইন বানাতাম।

তিতির চোখ বন্ধ করে আছে। এখন পর্যন্ত একবারও চোখ তুলে তাকায়নি তাজের দিকে। এবার পিটপিট করে তাকালো তাজের দিকে। তিতিরের মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে তাজের মুখখানা। রাগে পুরো মুখ লাল হয়ে আছে, যে চোখ দেখে তিতির একসময় তার প্রেমে পড়েছিলো সেই চোখদুটো আজ ভয়ংকর লাগছে তিতিরের কাছে। তাজের গায়ের এলকোহলের গন্ধে তিতির নাড়িভুড়ি দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসতে চাইছে যেনো।

তিতির অনেক কষ্টে বললো, স্যার আমার লাগছে, প্লিজ ছাড়ুন।

তিতিরের কথায় তাজ আরো রেগে গেলো যেনো। হাতের মুঠোয় আরো শক্ত করে ধরলো তিতিরের চুল।

তাজ বুকের বা পাশে আঙ্গুল রেখে বললো, আমারও লাগছে ঠিক এখানে। তোর জন্য আজ আমি কী কী হারিয়েছি তোর কোনো ধারণা আছে ? তোকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম মনে হয়েছিলো ফুটফুটে পবিত্র একটা ফুল। কিন্তু তুই তো বিষাক্তফুলের রুপ নিলি আমার জীবনে।

তিতির আবারও কেঁদে উঠলো। নোনাজল গাল বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। তাজ বা’হাতে তিতিরের চুল ধরে আছে। ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলের ডগায় তিতিরের এক ফোটা চোখের পানি তুলে নিলো।

গম্ভীর গলায় বললো, এটা তো কেবল শুরু মিসেস তিতির। আজ থেকে তোমার জীবনের প্রতিটা মুহুর্তে এই নোনাজলের স্বাদ পাবে তুমি। যতটা কষ্ট আমাকে দিয়েছো তার থেকেও হাজার গুণ কষ্ট তোমাকে ফিরিয়ে দিবো। স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট ঠিক কতটা হাড়ে হাড়ে টের পারে। আপন মানুষগুলোর ঘৃণার দৃষ্টি কতটা ক্ষত বিক্ষত করে তুমি বুঝতে পারবে।

কিছুটা সময় চুপ করে তিতিরের দিকে তাকিয়ে রইলো তাজ। কতটা নিষ্পাপ মেয়েটার মুখ। কেউ কী বিশ্বাস করবে এই মেয়েটা এমন জঘন্য একটা কাজ করেছে। এই মায়াভরা মুখটা দেখে যে কেউ ধোঁকা খেয়ে যাবে। ফর্সা মুখটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে কাঁদতে কাঁদতে। নাকের ডগা টকটকে লাল হয়ে গেছে, লাল রঙা ঠোঁট দুটো মৃদু কাঁপছে।

তাজ হঠাৎ কঠিন গলায় বলে উঠলো, আচ্ছা বল তো কার পাপের ফসল আমার উপর চাপিয়ে দিলি ? আমি কখনো কল্পনাও করিনি মানুষ চিনতে আমার এতটা ভুল হবে। তোকে দেখে বরাবরই নিষ্পাপ আর পবিত্র মনে হয়েছে। কিন্তু তুই তো একটা চরিত্রহীন মেয়ে। তোর পেটের পাঁপটা কার বল তো।

তিতির অসহায় চোখে তাকালো তাজের দিকে। যে মেয়ের হাত কোনো ছেলে এখন পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি তাকে আজ চরিত্রহীন অপবাদ শুনতে হচ্ছে। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছে না। চিৎকার করে বলতে পারছে না আমি চরিত্রহীন নই, নেই কারো পাপের ফসল আমার পেটে, নই আমি চরিত্রহীন। আমি তো কেবল কারো নোংরা খেলার একটা গুটি মাত্র। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল আপনার চাকরিটা করা। তা নাহলে আজ এতবড় একটা মিথ্যা অপবাদ নিজের কাঁধে নিতে হতো না। আপনি সব হারিয়ে থাকলে আমিও সব হারিয়েছি। কারণ আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের কাছে তার সম্মানই সবকিছু। যেটা আমি সারাদেশের মানুষের সামনে নিজ হাতে জলাঞ্জলি দিয়েছি।

তাজ তিতিরের থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে বললো, যার পাপ পেটে নিয়ে ঘুরছিস তার কাছে না গিয়ে আমাকে কেনো ফাঁসালি ? তাজওয়ার খান তাজের স্ত্রী হওয়ার লোভে ? পাওয়ার, প্রোপার্টি এসবের লোভে ?

এলকোহলের নেশা অনেকটাই কেটে গেছে তাজের। এসবে অভ্যস্ত না থাকায় খেতে পারেনি খুব একটা। এলকোহলের নেশা কেটে গিয়ে তাজের মাথায় প্রতিশোধের নেশা চেপে বসেছে।

তিতিরের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, খুব শখ সুপারস্টার তাজওয়ার খান তাজের স্ত্রী হওয়ার। আজ সেই শখ পূরণ করবো আমি তোর। নরক যন্ত্রণা ভোগ করবি আজ তুই।

তিতির মাথা নিচু করে কাঁদছিলো। তাজের কথা শুনে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। তিতির কিছু বুঝে উঠার আগেই তাজ হাত বাড়িয়ে তিতিরের চুল মুঠি ধরে কাছে টেনে আনলো। ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে করে ফেললো তিতির। ঠোঁটে আরেক জোড়া ঠোঁটের অস্তিত্ব অনুভব হতেই বড়বড় চোখে তাকালো। জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়ে শিহরিত হওয়ার আগেই তীব্র ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলো। তীক্ষ্ণ ধারালো দাঁতের আঘাতে মুহূর্তে ঠোঁট কেটে নোনতা স্বাদের তরল বেড়িয়ে এলো। এতে হেলদোল হলো না অপর পাশের ব্যক্তির। সে নিজের রাগ মেটাতে ব্যস্ত। অনেকটা সময় পর তাজ ছেড়ে দিলো তিতিরকে। ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে আছে তিতির।

তাজ তিতিরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে তিতিরের ঠোঁটের রক্ত মুছে নিয়ে রক্তমাখা আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে বললো, তাজ এই প্রথম কোনো মেয়েকে স্পর্শ করলো। কেমন লাগলো মিসেস তিতির ? আমার যদিও এটা প্রথম কিন্তু আপনার তো প্রথম নয়। আগে হয়তো স্বর্গ সুখ উপভোগ করেছিলেন এবার নরক যন্ত্রণা ভোগ করবেন। নিজেকে তো আমি নির্দোষ প্রমাণ করবোই তার আগে তোর জীবন নরক করে দিবো।

কথাটা শেষ করে তিতিরের চুলের মুঠি ধরে টেনে রুমে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেললো। তিতির তাজের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। তাজ নিজের শেরওয়ানীটা খোলে ফেলে দিলো ছুঁড়ে। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে তাজ। মৌ ছাড়া কোনো মেয়ের সাথে তাজ কখনো ফ্রী ভাবে কথাও বলেনি। হিরোইনদের সাথেও কাজের বাইরে খুব একটা কথা হয় না তার। সেই ছেলেটাকে সবাই চরিত্রহীন উপাধি প্রদান করেছে এই মেয়ের জন্য ৷ কীভাবে মেনে নিবে তাজ ? তাজের সব শেষ করে দিয়েছে মেয়েটা। এবার তাকে শেষ করে তাজ। হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তিতিরের উপর। তাজ ব্যস্ত নিজের রাগ মেটাতে আর তিতির নরক যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

৩.
তাজের মা মিসেস ইরিনা রহমান নিচু গলায় বললো, এভাবে তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দিয়ে কী ঠিক করলেন আপনি ? নিজের ছেলেটার কথা একবার বিশ্বাস করতে পারলেন না। একবার সত্যি মিথ্যা যাচাই করা উচিত ছিলো না কী ?

ইকবাল খান ইজি চেয়ারে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। স্ত্রীর কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে বললো, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গিয়েছিলো। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল ভাবার সময় ছিলো না। তবে এখন কেনো জানি মনে হচ্ছে অনেক বড় ভুল হয়ে গেলো। আমাদের শিক্ষা তো এমন নয়। আমাদের ছেলে এমনটা করতে পারে না।

ইরিনা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আপনি চাইলেই সত্যিটা যাচাই করতে পারতেন খুব সহজে।

এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়লে কারো মাথায় ঠিকভাবে কাজ করবে না। এখন তো অনেক কিছুই মনে হচ্ছে। কথায় আছে না, “চোর গেলে বুদ্ধির উদয় হয় “। এখন নিজের অবস্থা তেমনই মনে হচ্ছে।

ইরিনা বললো, তিতির মেয়েটাকেও আমি ভালো করেই চিনি। খুবই ভদ্র আর শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে। ঐ মেয়েটাই বা মিথ্যা বলবে কেনো বুঝতে পারছি না।

আমাকে ভাবতে দাও ইরি। এখানে অনেক বড় ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে মনে হচ্ছে।

এদিকে বিয়ের বেনারসিটা এখনো গায়ে জড়িয়ে আছে মৌ। চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে তার। এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তাজ এমনটা করেছে। একই সাথে বড় হয়েছে তারা। তাজ মৌয়ের দেড় বছরের বড়, তবু তাদের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকে। তাজ বরাবরই মেয়েদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখতো। এজন্যই মুভিতে কাজ করতে গিয়ে প্রথম দিকে হিরোইনদের সাথে কাজ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। পরে ধীরে ধীরে সহজ হয়েছে। তবে কী এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তাজের এতোটা অধঃপতনের কারণ। তাজের ফিল্মে যাওয়া নিয়ে ইকবাল খানকে মৌ রাজি করিয়েছিলো অনেক কষ্টে। সেটাই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল মনে হচ্ছে মৌয়ের কাছে।

হঠাৎ মৌয়ের মনে হলো, আচ্ছা আমি কোনো ভুল করলাম না তো ? তাজ তো বলছিলো মেয়েটা সব মিথ্যে বলেছে। কিন্তু একটা মেয়ে কীভাবে নিজের নামে এতবড় একটা মিথ্যা বলবে ? আর রিপোর্টটা তো ফেইক ছিলো না, সেটা বুঝতে আমার ভুল হতে পারে না। আর সেই ছবিগুলো, সেগুলো দেখেই তো আমার দুনিয়া উলটপালট হয়ে গেছে। সত্যি মিথ্যা যাচাই করার শক্তিটুকুও ছিলো না।

মৌ আর ভাবতে পারছে না। একবার মনে হচ্ছে তাজ সত্যি বলছে আবার মনে হচ্ছে মেয়েটার প্রমাণগুলো তো মিথ্যা ছিলো না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে গেলো মৌ। বাথটবে গিয়ে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করতেই চোখের কোণ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। চোখে ভাসতে লাগলো তাজের সাথে কাটানো হাজারো মধুর স্মৃতি। মুহুর্তে কেঁদে উঠলো মৌ।

তিনটা হাসোজ্জল মুখের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে এক জোড়া চোখ। ঠোঁটের কোণে তার পৈশাচিক হাসি। একটা লাইটার দিয়ে ছবির এক কোণে আগুন জ্বালিয়ে দিলো লোকটা।

তারপর উচ্চ স্বরে হাসতে হাসতে বললো, দুই বছরের সাজানো খেলা এতো সহজে নষ্ট করতে পারবি না মিস্টার তাজওয়ার খান তাজ। দুই বছর ধরে খেলাটা সাজিয়েছি আমি। তারপর জাস্ট একটা চাল এতেই তোর সবকিছু চোখের পলকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলাম। তোর মানসম্মান, ক্যারিয়ার, আপনজন, ভালোবাসা সব এক চালেই শেষ। অনেক কষ্টে সাজিয়েছি খেলাটা। বেচারি তিতির বোনটা আমার। ও তো আমার খেলার একটা গুটি মাত্র। যে গুটিটা চেলেছি আরো দুই বছর আগে। যত ইচ্ছে যাচাই করে নে কিন্তু কিছুতেই সত্যিটা সামনে আনতে পারবি না। রিপোর্ট তো সেটাই আসবে যেটা আমি চাইবো। আমি যে কাঁচা খেলোয়াড় নই। বাচ্চাটা তোর নয় সেটা প্রমাণ করা তো দূর তুই এটাই প্রমাণ করতে পারবি না তিতির প্রেগনেন্ট নয়। একটা সময় ছিলো তুই আমার থেকে এগিয়ে ছিলি কিন্তু এখন আমার ক্ষমতার কাছে তুই কিছুই না। এবার আমি যেমন চাইবো তেমনই হবে তোর জীবনে। শুধু তোকে হারাবো বলে অন্ধকার জগতে পা রাখার আগে একবারও ভাবিনি আমি।

চলবে,,,,,

মন গহীনে তুমি পর্ব-০৭(শেষ পর্ব)

0

#মন গহীনে তুমি
#লেখকঃRabi_Al_Islam
#পর্বঃ৭ ( শেষ )
আদ্রিশের পরিবার বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজকেই বিয়েটা হবে৷ আদ্রিশ বিয়েটা আটকাতে পারেনি।

কায়রা আদ্রিশকে লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আদ্রিশ রিসিভ করছেনা। রিসিভ করেই বা কি বলবে। আদ্রিশ তো কায়রাকে বলেছিলো যে করেই হোক বিয়েটা ভাঙবে৷ কিন্তু ও এখনও সেটা করতে পারেনি। আজকে বিয়ে অথচ আদ্রিশ এখন পর্যন্ত ওর পরিবারকে বলতে পারেনি ও বিয়েটা করতে চায়না৷

আর এদিকে কায়রা লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছে। আদ্রিশ একসময় বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করলো৷

কায়রা বললো, আপনাকে আমি কি বলেছিলাম আর আপনি কি করলেন? আপনার মত খারাপ মানুষ আমি আমার লাইফে আজ পর্যন্ত দেখিনি৷ আমার বয়ফ্রেন্ড আছে এটা বলেছি তাও আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন। আপনার মন- মানসিকতা এতটাই নিচে যে কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করতেও আপনার আপত্তি নেই।

আদ্রিশ রাগীভাবে বললো, হ্যা আমি খারাপ৷ আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আপনাকে বিয়ে করবো। এতদিন শুধু বিয়ে ভাঙার নাটক করেছি। হয়েছে এবার? শান্তি আপনি?

আপনি আমার সিচুয়েশনটা কখনই বুঝার চেষ্টা করেননি। সবকিছু তো আমার উপর ছেড়ে দিলেন৷ কারন আপনি আপনার বাবার কাছে খারাপ হতে পারবেন না। আমি খারাপ হই তাতে কোন সমস্যা নেই। আমাকে সবাই অপমান করুক,মারুক তাতে তো আপনার কিছু যায় আসেনা। আপনি সবার কাছে ভালো হলেই হলো৷
সত্যি বলতে আপনার মত স্বার্থপর মানুষ আমি কখনও দেখিনি৷ একবার নিজেকে আমার জাগায় রেখে ভাবুন৷

আমার পরিবার,রিলেটিভ, আপনার পরিবার সবার বিরুদ্ধে আপনাকে যেতে হবে। আপনার তো কোন সমস্যা নেই কারন আপনি তো সবাইকে বলবেন আপনি বিয়ে করার জন্য রাজি আছেন৷ ছেলেটা যদি আপনাকে বিয়ে না করে তাহলে তো আপনার কিছু করার থাকবেনা। সবাই ছেলেটাকে খারাপ বলবে। আপনাকে সমবেদনা জানাবে।

শুধুমাত্র একটা কথার জন্য আপনি দিনের পর দিন আমাকে অপমান করে গেছেন আর আমি সব সহ্য করেছি৷ আমি যদি আপনাকে এভাবে অপমান করতাম তাহলে আপনি কি আমার মত সব সহ্য করতেন?

করতেন না। আমাকে কিছু না কিছু বলতেন। কলেজ লাইফে একটা মেয়ের সাথে রিলেশন ছিলো আমার। ও আমার সাথে রিলেশনে থাকা অবস্থায় আরও অনেকগুলো রিলেশন করতো। একটা সময় আমি বুঝতে পারি। ওকে জিজ্ঞেস করলে ও বলে, ও সবার সাথে টাইমপাস করেছে।

আমি ওকে বলেছি, আমি এমন একজনকে বিয়ে করতে চাই যার লাইফে আমি একমাত্র ছেলে হবো।

তখন ও আমাকে বলেছিলো, আমি কোন ভা*র্জি*ন মেয়ে বিয়ে করতে পারবো না। মেয়েরা নাকি ৮/৯ থেকে রিলেশন শুরু করে। না চাইতেও কারও না কারও মায়ায় পরে যায়।

ও চলে যাওয়াতে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। প্রথম ভালোবাসা এত সহজে তো ভুলে থাকা যায়না। তবে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কখনও রিলেশনে জড়াবো না। বিয়ে করবো মন মত কোন মেয়েকে৷

সবসময় মনের ভিতর একটা ভয় কাজ করতো। আমি কারও জিবনে দ্বিতীয় ব্যক্তি হতে চাইনি৷ এসব কথা আপনি ওইদিনই বলতাম। কিন্তু তার আগেই তো আপনি বলে দিলেন বিয়েটা হবেনা৷ তাই আপনাকে বলার প্রয়োজন মনে করিনি। এখন কেন বলছি তাও জানিনা। কিছু জিনিস আড়ালেই ভালো লাগে। আমাদের মন গহীনেই লুকিয়ে থাকে৷ এটাই মায়া যা নিজের কাছে থাকে৷

আপনি চিন্তা করবেন না৷ আমি যখন কাউকে কথা দেই তখন অবশ্যই তা রাখার চেষ্টা করি৷ আপনাকে যখন বলেছি বিয়েটা হবেনা তখন অবশ্যই বিয়েটা হবেনা সে যা হোক না কেন। আর এর জন্য আপনাকে কেও দোষ দিবেনা এটা নিশ্চিত থাকুন।

এসব বলে আদ্রিশ কল কেঁটে দিলো। ওর কাছে এখন একটা মাত্র অপশন রয়েছে বিয়েটা ভাঙার আর ও সেটাই কাজে লাগাবে৷

আদ্রিকে সবাই বললো, এখনও রেডি হসনি কেন? আমরা তো কিছুখন পরই বের হবো।

– এইতো হব

– তাড়াতাড়ি কর

———–

আদ্রিশের পরিবার মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে সবার সামনে আদ্রিশকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি আমাকে ভালোবেসে অন্য কাউকে কিভাবে বিয়ে করতে পারো? তুমি তো বলেছিলে কখনও ছেড়ে যাবেনা৷ তাহলে এখন কেন আমার সাথে এমন করতেছো?

সবাই অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই ভাবতেছে মেয়েটা কি সব বলছে।

– তোমার মাথা ঠিক আছে তো কিসব বলছো? আদ্রিশের কোন রিলেশন আছে এটা অসম্ভব। ওর লাইফের সবকিছু আমাদের সাথে শেয়ার করে।

– এটা করেনি৷ আর সত্যি না মিথ্যা তা আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করেন

সবাই আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিশ কি বলে তা শোনার জন্য। আদ্রিশ মাথা নিচু করে বলে, হ্যা ওর সাথে আমার রিলেশন ছিলো। রাগারাগীর কারনে মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে যাবে তা বুঝতে পারিনি৷ তোমাদের অনেকবার বলতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি৷ জানি এটা সঠিক সময় না কিন্তু এখন সবকিছু না বললে আমাকে সারাজীবন কষ্ট পেতে হত৷

” তুই এরকমটা করবি তা আমরা কখনও কল্পনাও করিনি। তুই আগে আমাদের বলতি তাহলে তো মেয়ে দেখতে যেতাম না আমরা। তোর মন যা চায় তাই করবি। মেয়েটার সম্মানের কথা একবারও ভাবলি না? এখন মেয়েটাকে আমরা কি বলবো? মেয়েটার পরিবারকেই বা কি জবাব দিবো।

——-

আদ্রিশের বাবা কায়রার বাবাকে কল দিয়ে মাফ চাইলো৷ কায়রার বাবা অনেক বাজে ব্যবহার করতেছে। অনেক কিছু বলতেছে। অসম্মান করে কথা বলতেছে। তাও আদ্রিশের বাবা চুপ করে আছে কারন দোষটা যে তাদেরই৷ আদ্রিশের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ও কখনও ওর বাবাকে ছোট হতে দেখেনি৷ আজকে ওর জন্য ওর বাবা এতটা অপমানিত,ছোট হলো৷ সব দোষ ওর। ও একজন যোগ্য ছেলে হতে পারেনি৷ এসব মনে হতে লাগলো আদ্রিশের।

কায়রার বাবা ওকে বললো, আমাকে তুই মাফ করে দে মা৷ ছেলেটা এত খারাপ হবে তা আমি কখনও কল্পনাও করিনি৷ আর কখনও তোর অনিচ্ছায় বিয়ে ঠিক করবো না।

কায়রা কিছু বলছেনা৷ একদম পাথর হয়ে আছে। ওর জন্য আদ্রিশ আর ওর পরিবার এত অপমানিত হলো কায়রা তা মেনে নিতে পারছেনা৷ ও আজ পর্যন্ত শুধু শুধুই আদ্রিশকে অপমান করে এসেছে কিন্তু আদ্রিশ কখনই তার প্রতিবাদ করেনি। আদ্রিশের সামনে গিয়ে সরি বলারও ক্ষমতা ওর নেই। ও কখনও লজ্জায় আদ্রিশের সামনে দাঁড়াতে পারবেনা। মনে হচ্ছে জিবনের প্রথমবার ও মানুষ চিনতে ভুল করেছে৷

২ দিন পর

ফিহা আদ্রিশকে বলতেছে, তুমি কেন এমন করলা? কায়রার জন্য কেন তোমার পরিবারকে ছোট করলা? নিজেকে সবার সামনে খারাপ বানালা?

– ও চায়না বিয়েটা হোক।

– কিন্তু তুমি তো ওকে ভালোবাসতা৷ বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যেতো।

– ওর বয়ফ্রেন্ড ও আছে৷ আর ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কিছু করবো না৷

– আর তোমার ভালোবাসার কি হবে?

– মন গহীনেই থাকবে।

সমাপ্ত

মন গহীনে তুমি পর্ব-০৬

0

#মন গহীনে তুমি
#লেখকঃRabi_Al_Islam
#পর্বঃ৬
আপু বললো, তোর ভাইয়ার তো আর বেশিদিন ছুটি নেই তাই বিয়েটা ২/৩ দিনের মধ্যেই হবে। তোর সময় না থাকলে সাদামাটাভাবে বিয়েটা হউক। পরে সময় বুঝে সবকিছু করা যাবে। কাজী সাহেব সাথে যাবে বিয়েটা পরাবে তারপর আমরা মেয়ে নিয়ে আসবো।

– হঠাৎ আপু এমন কিছু বলবে তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না৷ ভেবেছিলাম যে করেই হোক বিয়েটা আটকাতে পারবো৷ আজকে বাসায় এসে এটা নিয়ে কথাও বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার আগেই তারা আমাকে চমক দিয়ে দিলো। বিয়ের সব প্রস্তুতি শেষ তাদের অথচ আমি কিছুই জানিনা। ১/২ দিনের ভিতরে তারা সবকিছু শেষ করেছে। এখন তাদের কিভাবে বলবো, “আমি এই বিয়েটা করতে চাইনা ” সেটাই মাথায় আসছেনা।

একদিকে আমার পরিবার অন্যদিকে ওই মেয়েটা। কি করলে যে এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবো তাও জানিনা৷ যা করার তা তো আমাকেই করতে হবে। মেয়েটা নিজে থেকে কিছুই করতে পারবেনা। সবাইকে দেখাবে সে বিয়েটা করতে চায় অথচ আমাকে প্যাড়া দিচ্ছে বিয়েটা ভাঙার জন্য।

———

কায়রার বাবা ওকে বললো, আদ্রিশ খুবি ভালো একটা ছেলে। আমি জানতাম তোরও আদ্রিশকে পছন্দ হবে। ওর সাথে থাকলেই বুঝা যায় তুই কতটা খুশি। এখনই একে অপরের সাথে এমন ভাবে কথা বলছিস মনে হয় তোরা কত আগে থেকে জানিস। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আমি ভুল করছি৷ তোর সাথে চুক্তি করে তারপর বিয়েটা দিচ্ছি। কিন্তু আমি জানতাম তুই আদ্রিশকে পছন্দ করবি।

– কায়রা হাসবে না কাঁদবে বুঝতেছে না। সবাই সবকিছু পজিটিভ ভাবে নিচ্ছে। একবার নেগেটিভ ভাবে নিলে সব কিছু ঠিক হয়ে যেতো। এখন যদি ওর বাবাকে সত্যিটা বলে দেয় তাহলে ওর বাবা অনেক কষ্ট পাবে৷ এমনিতেই তার হার্টের সমস্যা আছে। তাই যা করার ওই অভদ্র ছেলেটাকেই করতে হবে। তাকেই এই বিয়েটা ভাঙতে হবে।

তাকে একটা কল দেওয়া উচিত। সে তো বললো আজকে বাসায় গিয়ে সবাই বলবে। দেখি কি হলো।

কায়রা আদ্রিশকে লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছে আর আদ্রিশ কেঁটে দিচ্ছে। এটা দেখে আদ্রিশের পরিবার হাসতে লাগলো। তারা বুঝতে পেরেছে কায়রা কল দিচ্ছে। আদ্রিশ সবার সামনে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে তাই কেঁটে দিচ্ছে।

– এখনই একমুহূর্ত কথা না বলে থাকতে পারেনা। বিয়ের পর তো আমাদেরকেই ভুলে যাবে।

আদ্রিশ কিছু না বলে রুমে চলে আসলো। কায়রার উপর অনেক রেগে আছে আদ্রিশ। ও ভেবে পাচ্ছেনা কিভাবে ওর পরিবারকে বলবে তার উপর কায়রা এখন কল দিলো। সবাই তো আরও উল্টা- পাল্টা ভাবলো।

আদ্রিশ কল দেওয়ার পর কায়রা বললো, এত বার কল দিলাম কেঁটে দিলেন কেন? এতবার যখন কল দিতেছি তখন তো বুঝা যায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু।

– যখন আমি বারবার কল কেঁটে দিলাম তখন তো বুঝা যায় আমি কথা বলার পরিস্থিতিতে নাই। তারপরও লাগাতার কল দিলেন কেন? আপনার কি কমন সেন্স বলতে কিছু নেই।

– আপনি কেন বুঝলেন না গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে তাই তো কেঁটে দেওয়ার পরও কল দিচ্ছে।

– আপনি কেন বুঝলেন না গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে তাই কেঁটে দিচ্ছে। আমি আমার পরিবারের সাথে কথা বলছিলাম। সবাই বুঝতে পেরেছে আপনি কল দিয়েছেন। কি লজ্জারে বাবা। আপনার জন্য সবসময় আমি এমন সিচুয়েশনে পরি।

– আজব! আমি কি জানতাম নাকি আপনি পরিবারের সাথে কথা বলতেছেন।
– কেঁটে দেওয়ার পরও যে বুঝতে পারেনা তার আর যাই হোক কমন সেন্সটা নাই।

– দেখুন মোটেও আমাকে এসব বলবেন না। আপনার দোষ এটা।

– মেয়েদের এই একটা অভ্যাস যখন কথায় পারবেনা তখন বলে দিবে আপনার দোষ। তা এখন বলেন কি সেই গুরুত্বপূর্ণ কথা যার জন্য এতবার কল দিলেন।

– আপনি বলছিলেন বাসায় গিয়ে সবাইকে বলবেন। বলেছিলেন কি?

– আমি বলার আগেই তারা আমাকে চমক দিয়ে দিলো।

– মানে?

– তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১/২ দিনের ভিতরেই সাদামাটাভাবে বিয়েটা হবে। কাজী সাহেব যাবেন বিয়েটা হবে তারপর আমারা খাবো৷ তারপর মেয়ে নিয়ে আসবো।

– আপনি কিছু বললেন না কেন?

– কি আর বলবো। তারা সবাই বুঝতে পেরেছে আমরা একে অপরকে কতটা পছন্দ করি। আপনি হুটহাট সবার সামনে এরকম করেন তাইতো তারা এমন ভেবেছে।

– দেখুন এখন সব দোষ আমাকে দিবেন না। আপনারও সমান দোষ। আমার বয়ফ্রেন্ড আছে তারপরও আপনি এই বিয়েটা ভাঙার কোন চেষ্টা করছেন না তাতেই বুঝা যায় আপনি কেমন। আপনি এতদিন আমার সাথে গেইম খেলেছেন। আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।

– আর আমি মনে হয় আপনাকে বিয়ে করার জন্য নাচতেছি৷ আমারও আপনাকে বিয়ে করার কোন ইচ্ছে নেই। দরকার হলে সারাজীবন বিয়ে না করে থাকবো। তারপরও আপনাকে বিয়ে করবো না।

– তাহলে বিয়েটা ভাঙছেন না কেন?

– ভাঙাটা যদি এত সহজই হত তাহলে আপনিই এটা করতেন৷ আমার সিচুয়েশনটা একবার বুঝার চেষ্টা করেন৷

– আপনার সিচুয়েশন বুঝতে বুঝতে বিয়েটা হয়ে যাবে। আর আপনি এটাই চান। আপনার মত অভদ্র ছেলের চিন্তা-ভাবনাই এমন।

দিলাম কল কেঁটে। সবসময় আমাকে অপমান করে কথা বলবে৷ নিজেকে যে কি মনে করে। মেয়ে মানুষ বলে কিছু বলতেও পারছিনা৷ একবার একটা প্রশ্ন করেই যে হাল হয়েছে। কিছু না বুঝে বলবে।

মেয়েটা আবার কল দিলো৷ রিসিভ করার পর বললো, আমার কথা শেষ হওয়ার আগে আপনি কল কেঁটে দিলেন কেন?

– আপনি আমাকে অপমান করে কথা বলবেন আর সেগুলো আমাকে শুনতে হবে?

– হ্যা শুনতে হবে৷ দোষ করলে তার ফল ভোগ করতে হবে এটাই স্বাভাবিক।

– আপনি নিজে বলেন আর নিজেই শুনেন আমি বাধ্য নই।

– কালকে যেনো আমি শুনি বিয়েটা হবেনা।

কায়রা কল কেঁটে দেওয়ার পর আদ্রিশ ভাবতেছে, কি বলবে সবাইকে? সবাই যখন জানতে চাইবে কেন বিয়েটা করবো না তখন কি বলবো?

যদি বলি মেয়েটাকে পছন্দ হয়নি তাহলে এটা কেও বিশ্বাস করবেনা৷ তখন অনেক গুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। একটা উপায় আছে যেটা বললে ওর পরিবার বিয়েটা ভেঙে দিবো। শুধু বলতে হবে মেয়েটার চরিত্র খারাপ৷ ওর অন্য আর একটা রিলেশন আছে। কিন্তু এটা যদি তারা বিশ্বাস না করে তখন কি হবে৷ কায়রাকে তো তারা অনেক ভালো জানে আর বিশ্বাসও করে৷

চলবে—

মন গহীনে তুমি পর্ব-০৫

0

#মন গহীনে তুমি
#লেখকঃRabi_Al_Islam
#পর্বঃ৫
আপু বললো, এখনও কিছু কিনলি না তোরা? তোদের বলেছিলাম পছন্দমত কিছু কিনে নিতে তা না করে তোরা এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিস৷বিয়ের পর তো সবসময়ই কথা বলতে পারবি৷ এখন শপিং শেষ কর।

কায়রা কিছুটা লজ্জা পেলো। আদ্রিশ অবাক হয়ে কায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। ও ভাবছে, এখানে লজ্জার কি হলো? তার এসব কাহিনীর জন্যই তো সবাই উল্টা- পাল্টা ভাবে৷

আপু যাওয়ার পর কায়রাকে বললাম, আপু কি এমন বললো যে আপনার লজ্জা পেতে হবে?

– আপনি তো অভদ্র মানুষ আপনার লজ্জা না থাকতে পারে কিন্তু আমার যথেষ্ট আছে৷

– মেয়েরা কখন, কি কথায় লজ্জা পায় তা বুঝা মুসকিল। তা এখন শপিং করা যাক। তা না হলে তো আপু আবার আসবে৷ সবকিছু কম দামেরটা কিনবেন৷

———

কায়রা মূল্য দেখে সবকিছু কিনছে। যেটার মূল্য বেশি ওইটা নিচ্ছে। আদ্রিশ ইশারায় অনেক বুঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কায়রা যেনো বুঝেও না বুঝার ভান করে আছে। আদ্রিশ দোকানের ভিতর কায়রাকে কিছু বলতেও পারছেনা৷ কায়রা আদ্রিশকে বললো, আপনি কিছু কিনছেন না কেন?

আদ্রিশ কিছু না বলে চুপ করে আছে। রাগীভাবে কায়রার দিকে তাকিয়ে আছে৷ কেনাকাটা শেষ হলে আদ্রিশ কায়রাকে বললো, আপনাকে কি বলেছি আর কি করলেন আপনি৷

– আমি আবার কি করলাম?

– আপনাকে বলেছিলাম কম দামেন গুলা নিতে আর আপনি সব বেশি দামেরটা নিলেন কেন? দোকানের ভিতরে তো কিছু বলতেও পারছিলাম না। ইশারায় বলার চেষ্টা করলাম। আপনি বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকলেন৷

– তখন আপনি আমার বাবার থেকে ইচ্ছে করেই এতকিছু নিয়েছেন৷ তার উসুল করার বিন্দুমাত্র প্রয়াস৷

– ঠিক আছে সময় আমারও আসবে

———-

সবার কেনাকাটা শেষ। আদ্রিশ আর কায়রা দুজন একসাথে এক গাড়িতে যাচ্ছে। আদ্রিশ ড্রাইভ করছে আর কায়রাকে জিজ্ঞেস করছে, আপনার বয়ফ্রেন্ডের নাম কি? সে কি করে?

– আপনাকে কেন বলবো?

– আচ্ছা বলা লাগবেনা৷ আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে তাতে বিয়েটা সহজেই ভেঙে যাবে।

– বলুন

– আপনি আপনার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যান৷ সব খরচ আমি দিবো। তারপর অনেক বছর পর আসবেন৷ তখন আপনার বাবা তার নাতি- নাতনি দেখে সব কষ্ট ভুলে যাবে৷

– আপনি যেমন অভদ্র আপনার আইডিয়াও অভদ্র। আমি কোথাও যাবো না, কিছু বলবো না৷ যা করার আপনি করবেন৷ বিয়েটা আপনি ভাঙবেন৷

– বার বার আমাকে অভদ্র বলে অপমান করবেন না তো৷ আমি কিন্তু সবসময় আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করি আর আপনি সবসময় আমাকে অপমান করে কথা বলেন৷

ট্রাফিক জ্যামে গাড়ি আটকে আছে। হঠাৎ এক বাচ্চা এসে বললো, স্যার ফুল নিবেন?

আদ্রিশ বাচ্চাটার কাছ থেকে সব ফুল কিনে নিলো। সাথে বাচ্চাটাকে বখশিশ ও দিলো।

কায়রা বললো, আমার কাছে ভালো সাজার জন্য এসব করলেন নাকি?

কায়রার কথা শুনে আদ্রিশ গাড়ি ব্রেক করলো। হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝতেছে না।

কায়রাকে বললো, আপনাকে দেখানোর কি আছে৷ আমার মন- মানসিকতাই এমন।

– মেয়েদের সাথে যে খারাপ ব্যবহার করে তার মন- মানসিকতা আর যাইহোক ভালো হতে পারেনা৷

– মাফ চাই। আপনার সাথে কথা বলাই বৃথা৷ যা খুশি ভাবতে পারেন আপনি৷ খারাপ ভেবেই থাকুন৷ আমি কিছু বলবো না৷

– খারাপ মানুষকে খারাপ ভাবলে তার বলার কিছু থাকেও না৷

আদ্রিশ আর কিছু না বলে ড্রাইভ করতে লাগলো। আমি যা কিছুই করিনা কেন এই মেয়েটা সবকিছু নেগেটিভ ভাবে নিবে৷ সে যা ভাবার ভাবুক৷ তার কাছে নিজেকে ভালো প্রমান করতে হবে এমনটা তো না৷

কায়রা ভাবতেছে, আদ্রিশকে যতটা খারাপ ভাবছি আসলে কি ও ততটা খারাপ। এখন যা দেখলাম এর জন্য সবার মন- মানসিকতা থাকেনা৷ আদ্রিশ চাইলেই তো মেয়েটাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারতো। কিন্তু ও মেয়েটাকে ছোট করতে চাইনি। মেয়েটা যাতে বুঝে ও নিজের উপার্জন এটা তাই সব ফুল কিনে নিলো। আমি যে পরিমান অপমান ওকে করি তারপরও আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছেনা৷ আমি যা বলছি তাই করছে৷

হঠাৎ কায়রার আদ্রিশের সেই কথা মনে পরে গেলো। এটা মনে পরতেই কায়রা আবার আদ্রিশকে খারাপ ভাবতে শুরু করছে। যার এরকম চিন্তা-ভাবনা থাকে সে আর যাইহোক ভালো মানুষ হতে পারেনা৷ কাউকে সাহায্য করলেই তো আর সে ভালো মানুষ হয়ে যাবেনা।

আদ্রিশ কায়রাকে বললো, আমি আপনার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে চাই। কল দিন তাকে।

– আপনি ওর সাথে কেন কথা বলতে চান?
– কেন আবার। এত বড় ঝামেলায় আছি তাকে তো জানাতে হবে। পরে তো সে আবার আপনার মত আমাকে খারাপ ভাবতে শুরু করবে। আর কিভাবে কি করা যায় সেটা নিয়েও তার সাথে আলোচনা করতে হবে।

– আপনাকে খারাপ ভাবার কিছুই নেই কারন আপনি অলরেডি খারাপ আছেন। ওর সাথে আপনার কথা বলতে হবেনা। পরে উল্টা-পাল্টা কিছু বলে ফেলবেন। আপনার আচরন যে কেমন তা তো জানেনই।

– দেখুন সবসময় আপনি আমাকে এমন করে বলবেন না তো। এমনিতেই কত বড় ঝামেলায় আছি আপনি তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আপনাকে বললাম তার সাথে কথা বলতে হবে। তা না করে উল্টো আমাকে এসব বলছেন৷

– ঝামেলা তো আপনি নিজেই বাঁধিয়েছেন। আপনাকে কে বলেছিলো শপিং করতে আসতে৷ আবার আমার পরিবারকেও নিয়ে এসেছেন৷

– আমি নিজের পায়ে নিজে কেন কু*ড়া*ল মারতে যাবো। আমি তো জানতাম ও না শপিং করার কথা। আমি বাসায় যাওয়ার পর তারা আমাকে নিয়ে আসলো৷

– সে যাই হোক। ওর সাথে আপনার কথা বলতে হবেনা৷ বিয়েটা আপনাকে নিজেই ভাঙতে হবে।

আদ্রিশ আর কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলো। এই মেয়ের সাথে কথা বলে কোন লাভ হবেনা তা আদ্রিশ বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। কায়রাকে ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওর বাসায় চলে আসলো। বাসায় আসার পর ওর আপু যা বললো তাতে ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো।

চলবে—-