ধ্রুব ডায়েরি বন্ধ করে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো, আমাকে মাফ করে দাও মা। আমি তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছি, আ’ম সরি। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি মা, অনেক ভালোবাসি। বাবাও তোমাকে অনেক ভালোবাসে, সে তোমাকে ঘৃণা করে না। আমি তাকে কাঁদতে দেখেছি তোমার ছবি বুকে জড়িয়ে। তোমার কথা উঠলেই বাবার চোখ দু’টো কেমন টলটল করে উঠে। আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাজ তাকিয়ে আছে নিজের ছেলের দিকে। নাহ ছেলের কান্না আর সহ্য করা সম্ভব নয় তার জন্য। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো ছেলের দিকে। পাশে বসে ধ্রুবর কাঁধে হাত রাখলো। ধ্রুব ভেজা চোখে ঘুরে তাকালো তাজের দিকে। তাজ কিছু বুঝে উঠার আগেই ধ্রুব তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
তাজ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ছেলেদের এভাবে কাঁদতে হয় না বাবা।
ধ্রুব কান্নারত গলায় বললো, তাহলে তোমার চোখে পানি কেনো ?
এবার উত্তর খোঁজে পেলো না তাজ। ধ্রুব ভাঙা গলায় বললো ডায়েরিতে লেখা কথাগুলো। কতটা কষ্ট করে ধ্রুবকে জন্ম দিয়েছে, তাজের সাথে কেনো অন্যায় করেছে। তাজ বুঝতে পারলো তিতির তার বিরুদ্ধে কিছু বলেনি ধ্রুবকে। ধ্রুব একসময় কিছুটা শান্ত হলো।
মা আমাদের সাথে থাকলে আমাদেরও সুন্দর একটা পরিবার হতো, তাই না বাবা ?
তাজ মুচকি হেসে বললো, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
ধ্রুব ধরা গলায় বললো, মা চলে যাওয়াতে কী ভালো হয়েছে বাবা ?
ধ্রুব তাজকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে তার দিকে তাকালো।
তোমার মা বেঁচে থাকলে আমি হয়তো কোনোদিন তার মূল্য বুঝতাম না। আর সবচেয়ে বড় কথা তোমার মায়ের হায়াত আল্লাহ যতদিন রেখেছিলেন সে ততদিন ছিলো এই পৃথিবীতে। তাই সে চলে যাওয়ায় কী ভালো হয়েছে বা খারাপ হয়েছে সেটা হিসাব করা বোকামি। ধ্রুব এই পৃথিবীটা আমাদের কাছে একটা ভ্রমণ ক্ষেত্রের মতো। এখানে আসবো আবার চলে যাবো এটাই নিয়তি। তবে জীবনটা এমনভাবে কাটাও যাতে পরকালটা সুন্দর হয়। তোমার মায়ের সাথে আমাদের আবার দেখা হবে, সেখানে আর তোমার মা আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না। আমরা সবাই একসাথে থাকবো সেখানে।
ধ্রুব মলিন হাসলো, তোমার মনে পড়ে না মায়ের কথা ?
তাজ ছেলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, মনে তাকে পড়ে যাকে মানুষ ভুলে। তোমার মা সবসময় আমার মনেই থাকে তাই তাকে নতুন করে মনে পড়ার সুযোগ তো নেই।
বাবা, মা তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছে তাই না বাবা ?
তাজ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললো, তোমার মা আমার সাথে যা অন্যায় করেছে সেটা সবাই জানে। তবে তোমার মায়ের সাথেও আমি অন্যায় করেছি, সেটা তোমার মা আমার আর তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। এ জন্য তার প্রতি আমি যেমন সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো, তেমনই তার কাছে মাফ চাওয়ার সুযোগ না পাওয়ার আফসোসও আমার সারাজীবন থাকবে। সে তার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করেছে, সবার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। আমি সেই সুযোগ পাইনি, এটাই হয়তো আমার অন্যায়ের শাস্তি। অন্যের কাছে অপরাধী হওয়ার চাইতে নিজের কাছে অপরাধী হওয়া যে বেশি যন্ত্রণাদায়ক।
ধ্রুব হঠাৎ বলে উঠলো, প্লিজ বাবা, তুমি মাকে ঘৃণা করো না। মা নিজের ইচ্ছায় তোমাকে কষ্ট দেয়নি।
তাজ ধ্রুবকে হুট করে জড়িয়ে ধরলো, তোমার মাকে আমি ভালোবাসি ধ্রুব। তাকে আমি ভালোবাসি, ঘৃণা কীভাবে করবো ?
৪০.
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে রাহি আর রায়হান, চারপাশে পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে। নিজের গোপন আস্তানায় রাহিকে দেখে চরম অবাক হয়েছে রায়হান।
এসবের মানে কী আম্মু ? তুমি এখানে কীভাবে এলে ?
রাহি মলিন হেসে বললো, তোমাকে আমি আর কোনো অন্যায় করতে দিবো না পাপা।
রায়হান বিস্মিত গলায় বললো, তারমানে এসব পুলিশ তুমি নিয়ে এসেছো ?
রাহি মুচকি হাসলো, দীর্ঘ একবছর চেষ্টার পর তোমার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ জোগাড় করেছি আমি। একটা বছর একটু একটু করে কষ্ট পেয়েছি।
রায়হান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রাহির দিকে, কিন্তু কেনো আম্মু ? আমি তো তোমার যত্নে কোনো ত্রুটি রাখিনি। তবে মেয়ে হয়ে কেনো বাবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে ?
রাহির চোখে পানি এলে সে চিৎকার করে উঠলো, তুমি কেনো আমার থেকে আমার পরিবারকে আলাদা করেছো ?
রায়হান কম্পিত গলায় বললো, মানে ?
মলিন হাসলো রাহি, মৌমিতা রহমান আর সুফিয়ান আহমেদ শান নাম দুটো চিনতে পারছো পাপা ? কিংবা শায়িনী আহমেদ ?
বুক কেঁপে উঠলো রায়হানের, তুমি এসব কীভাবে জানলে ?
সত্যিটা তুমি কতদিন লুকিয়ে রাখতে পাপা ? একটা বছর এই সত্যিটা জেনেও চুপ থেকেছি শুধু আজকের দিনটার অপেক্ষায়।
রায়হান কাঁপা গলায় বললো, তোমাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারবো না আম্মু। তোমাকে ছাড়া আমি শ্বাসও নিতে পারবো না।
রাহি জানে রায়হান তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। তাই রাহির চোখেও পানি এলো।
মনে মনে বললো, আমি তোমার কাছেই থাকবো পাপা। তবে তার আগে তোমাকে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
মুখে কিছু বলার আগেই হুট করে রায়হান নিজের গা*ন তাক করলো রাহির দিকে। রাহি যেনো অবাক হওয়ার সময়ও পেলো না। পরপর দুটো গুলির শব্দে কানে ঝিম ধরে গেলো। নিজের দিকে তাকিয়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন না দেখে সামনে তাকালো।
রায়হানের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো রাহি, পাপা।
রায়হান ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। বুকের বা পাশটায় একটা বুলেট গিয়ে লেগেছে রায়হানের। রাহি দৌড়ে গিয়ে রায়হানের সামনে বসলো। পেছন থেকে রায়হানের সাথে ডিল করতে আসা একজন রাহিকে টার্গেট করেছিলো। রাহি এখানে পুলিশ নিয়ে এসেছে সেই রাগে। রায়হান সেটা খেয়াল করে তার দিকে টার্গেট করলে পুলিশ মনে করে রাহিকে টার্গেট করেছে। রায়হানের বুলেট লোকটাকে আঘাত করেছে আর পুলিশের বুলেট রায়হানকে। রায়হান ফ্লোরে পড়ে গেলে রাহি তার মাথা নিজের কোলে নিলো।
কাঁদতে কাঁদতে বললো, পাপা এটা কী হলো ?
রায়হান কাঁপা হাতে রাহির চোখের পানি মুছে দিলো।
নোনাজল মাখা হাতটা চোখের সামনে নিয়ে মুচকি হাসলো, আমার সারাজীবনের প্রাপ্তি এটাই। পৃথিবীতে কেউ একজন তো রইলো আমার কথা ভালোবেসে মনে রাখবে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিলো না আম্মু। আই লাভ ইউ আম্মু।
রাহি ডুকরে কেঁদে উঠলো, আই লাভ ইউ টু পাপা, আই লাভ ইউ টু।
রাহির চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজল মুছে দিলো মৌ। মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিলো। কত বছরের শূন্য বুকে নিজের কলিজার টুকরো মেয়েকে ফিরে পেয়েছে।
সেই মেয়ের চোখে পানি দেখে বিচলিত হলো মৌ, কাঁদছিস কেনো মা ?
চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকালো রাহি, পাপার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হয় মা।
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো মৌ। মাস দুয়েক পার হয়েছে সেই ঘটনার, তবে ভুলতে পারেনি রাহি। রায়হানের দেওয়া রাহি নামটা নিজের নামের সাথে রেখে দিয়েছে। সবাই এখন রাহি বলেই ডাকে তাকে। রাহি আগলে রেখেছে রায়হানের স্মৃতি। রায়হান খারাপ মানুষ হলেও, খারাপ বাবা ছিলো না।
মৌ মেয়ের চোখের পানি মুছে দিলো পুনরায়, এখানে তোর কোনো হাত ছিলো না মা। নিজেকে অপরাধী মনে করে শুধু শুধু কষ্ট পাস না। নিয়তি মানুষকে কখন কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় কেউ জানে না মা।
রাহি মৌয়ের কোমর জড়িয়ে পেটে মুখ গুজে দিলো। মৌ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। রায়হানের কথা মনে হলে মৌয়ের কেবল দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুক চিঁড়ে। আজ আর রায়হানের উপর রাগ নেই মৌয়ের।
★★★
ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছে ইরিনা আর ন্যান্সি। সিলেট এসেছে সবাই ছুটি কাটাতে। এই একটা জায়গায় সবাই একসাথে আসে সবসময়। ড্রয়িংরুমে তাদের সাথে বসে দুষ্টুমি করছে প্রান্তিক। ধ্রুবর রুম থেকে ভেসে আসছে ধ্রুবর ধমকের শব্দ। হয়তো তারাকে বকছে কিছু নিয়ে। পাখি আর আহান আছে নিজেদের রুমে। তাজ কোথায় সেটা হয়তো খেয়াল নেই কারো।
তারা তোকে বারবার বলেছিলাম আমার রুমে আসবি না। তবু তুই আমার রুমে এসে জিনিসপত্র গুছানোর নামে সব এলোমেলো করে রেখেছিস।
কাচুমাচু গলায় তারা বললো, কী খুঁজছো আমাকে বলো ? আমি খোঁজে দিচ্ছি।
রাগী চোখে তাকালো ধ্রুব, তোকে পাকনামি করতে কে বলেছে সেটা আগে বল।
উত্তর দেয় না তারা আর রাগ বাড়ে ধ্রুবর, কানে ধরে এক পা উঁচু করে দাঁড়া।
তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে ধ্রুব জোরে একটা ধমক দিতেই তাড়াতাড়ি এক পা উঁচু করে কানে ধরে দাঁড়ালো তারা। ধ্রুব উল্টো ঘুরে মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে বকলে সে গাল ফুলায়, তার ফুলানো গাল দেখতে বেশ লাগে ধ্রুবর।
★★★
পুতুল দাঁড়াও না চুপচাপ। এভাবে এতো লাফালাফি করলে কী আর শাড়ি পড়ানো যায় ? নিজেই শাড়ি পড়ার বায়না ধরে এখন দুষ্টুমি হচ্ছে।
আহান শাড়ির কুঁচি করে যেই গুঁজে দিতে যাবে আবার সব এলোমেলো করে দিলো পাখি। আহান রাগী চোখে পাখির দিকে তাকালে। পাখি খিলখিলিয়ে হেসে উঠলে আহানও হেসে দিলো। এই মেয়েটার সাথে রাগ করা তার সাধ্যের বাইরে। আহান আর ভালো করে শাড়ি না পড়িয়ে কোনোরকমে পেঁচিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলে দিলো পাখির।
পাখির মুখটা দেখে বললো, মাশাআল্লাহ।
লজ্জায় মাথা নিচু করলো পাখি। আহান শব্দ করে হেসে উঠলো পাখির লজ্জা পাওয়া দেখে। বুকে জড়িয়ে নিলো নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে।
★★★
একটা গান শুনাবেন স্যার। অনেক দিন হলো আপনার গান শুনি না। মনে হচ্ছে আপনার আওয়াজও ভুলতে বসেছি।
ছাঁদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তাজ। চাঁদের দেখা নেই তবে অসংখ্য তারা জ্বলছে মিটমিট করে। হঠাৎ তিতিরের আওয়াজ পেয়ে পাশ ফিরে তাকালো তাজ। তিতির ধীর গতিতে এসে তাজের পাশে বসে কাঁধে মাথা রাখলো।
তাজ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তুমি যেমন আমার আওয়াজ ভুলতে বসেছো তেমনই আমিও গান গাইতে ভুলে গেছি।
তিতির আদর মাখা গলায় বললো, প্লিজ।
তিতিরের আদর মাখা গলা উপেক্ষা করতে পারলো না তাজ।
জানি তুমি আসবেনা ফিরে
বাসবেনা ভালো আমাকে
জানি তুমি ভেঙেছ হৃদয়
সেই আশাতে দুঃখ যে পেলাম।।
এ হৃদয়ের এতো কাছে
ছিলে তুমি মনে কি পরে?
এ হৃদয়ের এতো কাছে
ছিলে তুমি মনে কি পরে?
মনে কি পরে?
জানি তুমি আসবেনা ফিরে
বাসবেনা ভালো আমাকে
জানি তুমি ভেঙেছ হৃদয়
সেই আশাতে দুঃখ যে পেলাম।।
এ হৃদয়ের এতো কাছে
ছিলে তুমি মনে কি পরে?
এ হৃদয়ের এতো কাছে
ছিলে তুমি মনে কি পরে?
মনে কি পরে?
কত আপন তুমি ছিলে
কেনো আমাকে কাঁদালে?
জানিনা কি অভিমানে
কেনো চলে গেলে?
কত আপন তুমি ছিলে
কেনো আমাকে কাঁদালে?
জানিনা কি অভিমানে
কেনো চলে গেলে?
এ হৃদয়ের এতো কাছে
ছিলে তুমি মনে কি পরে?
এ হৃদয়ের এতো কাছে
ছিলে তুমি মনে কি পরে?
মনে কি পরে?
জানি তুমি আসবেনা ফিরে
বাসবেনা ভালো আমাকে
জানি তুমি ভেঙেছ হৃদয়
সেই আশাতে দুঃখ যে পেলাম।।
এ হৃদয়ের এতো কাছে
ছিলে তুমি মনে কি পরে?
এ হৃদয়ের এতো কাছে
ছিলে তুমি মনে কি পরে?
মনে কি পরে?
গান শেষ করে পাশে তাকালো তাজ, কোথায় তিতির ? তাজ আকাশের উজ্জ্বল তারাটার দিকে তাকালো। আছে তো তিতির, তাজের নিশ্বাসের সাথে মিশে আছে, প্রতিটা হার্টবিটের সাথে মিশে আছে। তাজের গাল বেয়ে একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে যেতেই হাতে পেতে সেটা নিজের হাতে নিলো তিতির।
ছেলেদের চোখের পানি মুক্তার থেকেও মূল্যবান। এটাকে এভাবে নষ্ট করবেন না। আপনি যতদিন চাইবেন, আমি এভাবেই আপনার পাশে থাকবো। হোক না কল্পনা হয়ে।
তাজ মুচকি হেসে তিতিরের কোলে মাথা রেখে শুইয়ে পড়লো। তিতির হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো তাজের মাথায়। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাজকে, চোখের কোণে নোনাজল আর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি।
তিতির ফিসফিস করে বললো, ক্রাশড এগেইন।
তাজের হাসিটা প্রশস্ত হলো যেনো। কল্পনার এই তিতির কখনো তাকে ভালোবাসি বলেনি আর সেও বলেনি তিতিরকে। তাদের ভালোবাসা এই অব্যক্ত। তবে দুজনেই দুজনের প্রতি আসক্ত। বিষাক্তফুলের আসক্তি কারো জন্য সুখ বয়ে আনতে পারে কী ?
ধ্রুব ভাইয়া তুমি এমন কেনো বলো তো ? আমি তোমার এত খেয়াল রাখি তবু তুমি আমাকে দেখতেই পারো না। দেখলেই কেমন ধমকে উঠো।
ধ্রুব কপাল কুঁচকে বললো, দেখ তারা একদম জ্বালাবি না আমাকে। দেখছিস প্যাকিং করছি তবু বিরক্ত করছিস।
তারা ধ্রুবর হাত থেকে টিশার্ট কেড়ে নিয়ে বললো, আমাকে দাও আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।
ধ্রুব কোমরে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ফ্রক পড়া বছর দশের তারার দিকে, তুই নিজের চুল বাঁধতে পারিস না আর তুই আমার ব্যাগ প্যাকিং করে দিবি ?
তারা দাঁত বের করে হেসে বললো, আমি নিজের কাজ নিজে করতে না পারলেও তোমার কাজ খুব ভালো করেই করতে পারি।
তারার হাসি দেখে ধ্রুব নিজেও মুচকি হাসলো। তাহিয়া চৌধুরী তারা, পাখি আর আহানের একমাত্র মেয়ে। একটা চার বছরের ছেলেও আছে তাদের, তার নাম প্রান্তিক চৌধুরী।
সেদিন তাজ আহানকে সাথে করে বাংলাদেশ নিয়েই এসেছে, তখন থেকে সামনের বাড়িটাতে আহান থাকে সবাইকে নিয়ে। পাখি এখন কিছুটা সুস্থ হয়েছে। পাখি একদিন ছোট একটা এক্সিডেন্ট করে। তখন মাথায় আঘাত পেলে আহান তাকে চিকিৎসা করার সময় জানতে পারে পাখি জন্মগতভাবে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নয়। জন্মের পর তার মাথায় আঘাত লেগেছিলো, হয়তো সেই রাতে কোনোভাবে লেগেছিলো। আহান নিজের সবটা দিয়ে পাখির চিকিৎসা করেছে, পুরোপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব নয়, তবে অনেকটা সুস্থ হয়েছে পাখি।
তিতির প্রেগন্যান্ট থাকাকালীন বলতো তার ছেলে হলে নাম রাখবে তাহিয়ান খান ধ্রুব আর মেয়ে হলে নাম রাখবে তাহিয়া খান তারা। আহান সেই নামটা রেখেছে নিজের মেয়ের। বয়স কেবল দশ বছর তারার কিন্তু কথায় মনে হয় পাকা বুড়ি একটা। তারা আর প্রান্তিক দুজনেই সম্পূর্ণ সুস্থ। দেখতে একদম জীবন্ত পুতুলের মত দু’জনই। তারা সারাদিন ধ্রুবর পিছনে আঠার মতো লেগে থাকে তাই ধ্রুব ওকে ধমকের উপর রাখে।
দু’দিন পর ধ্রুবর আঠারো বছর পূরণ হবে, তাই সবাই সিলেট যাবে। ধ্রুবর আজই এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে আর এসেই ব্যাগ প্যাকিং শুরু করে দিয়েছে সে। ধ্রুব অনেক বেশি এক্সাইটেড এবারের জন্মদিন নিয়ে, একে তো পরীক্ষা শেষ, ইচ্ছে মতো মজা করবে আর এবার তার মায়ের রেখে যাওয়া গিফট পাবে সে। সেটা নিয়ে ধ্রুব খুব বেশি এক্সাইটেড।
তারা এলোমেলো করে ব্যাগ প্যাক করে দিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকালো, দেখছো আমি করতে পারি কিনা ?
ধ্রুব নিজের ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বললো, প্যাকিং ভালোই করেছিস কিন্তু আমার আইরন করা শার্টের একটার আইরনও আর আস্ত নেই। তুই নিজের ব্যাগ প্যাক করেছিস ? এবার কিন্তু আমরা অনেকদিন সিলেটে থাকবো।
তারা মাথা চুলকে বললো, আমার ব্যাগ তো গ্র্যানি প্যাক করে দিয়েছে মনে হয়।
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকালো তারার দিকে আর তারা দাঁত বের করে হাসলো।
ধ্রুব বললো, মাম্মাম আর প্রান্তিক কোথায় ?
আমি তো মা আর প্রান্তিকের সাথে লুকোচুরি খেলতে এখানে এসে লুকিয়েছি।
ধ্রুব নিজের পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বললো, এখন আমার রুম থেকে যা তুই। আমি ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবো।
তারা মাথা চুলকে বললো, দাদুমণি তো আমাকে পাঠিয়েছিলো তোমাকে খাবার খেতে ডাকার জন্য।
ধ্রুব থেমে দাঁড়িয়ে বিরক্ত গলায় বললো, যেটা করতে এসেছিলি সেটা না করে বাজে বকবক করলি এতক্ষণ। যা এখন গিয়ে দাদুমণিকে বল আমি বন্ধুদের সাথে বাইরে খেয়ে এসেছি। এখন ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবো, আমাকে যেনো কেউ বিরক্ত না করে।
কথা শেষ করে ধ্রুব ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো। তারা সেদিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো।
ধ্রুব ওয়াশরুমের দরজা আটকে ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বললো, বলেছিলাম না ভেংচি কাটলে আমি তোর ঠোঁট কেটে দিবো।
থতমত খেয়ে গেলো তারা আর মনে মনে ভাবলো, ধ্রুব ভাইয়ার মনে হয় পেছনেও দু’টো চোখ আছে। নাহলে দেখলো কীভাবে আমি ভেংচি কেটেছি ?
তারা চিন্তায় পড়ে গেলো ধ্রুব কীভাবে দেখলো ও ভেংচি কেটেছে। গাধা মেয়েটা বুঝতে পারেনি দরজা বন্ধ করার আগে ওয়াশরুমের আয়নায় তারাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে তারা বের হয়ে গেলো ধ্রুব রুম থেকে। ধ্রুব ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে তারার কথা ভেবে মুচকি হাসলো। মেয়েটাকে ধমকের উপর রাখলেও তার বোকা বোকা কথা আর এলোমেলো কাজ ধ্রুবর খুব ভালো লাগে। তার পেছন পেছন ঘুরে বলে বকা দিলেও, ধ্রুবও মনে মনে চায় তারা তার সাথেই থাকুক।
লম্বা চওড়া দেহ, সদ্য গোঁফ দাঁড়ির রেখা দেখা দিয়েছে চেহারায়, মুখের কিশোর ছাপটা কাটতে শুরু করেছে ধ্রুবর। এই বয়সটা খুব আবেগের বয়স, এই বয়সে কেবল নিজের সিদ্ধান্ত নিজে গ্রহণের প্রবণতা তৈরি হয়। সেই সময়ে ধ্রুবর জন্য হয়তো কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হবে না। কিন্তু তার জন্য তো তেমন কিছুই অপেক্ষা করছে।
৩৭.
চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে তাজ। হঠাৎ মনে হলো কপালে শীতল হাতের স্পর্শ পেলো। মাথার দু একটা পাকা চুল জানান দিচ্ছে বয়স বাড়ছে। দেখতে দেখতে বেলা যে কম হলো না। ইকবাল খান গত হয়েছেন তাও দুই বছর হতে চললো। সময় কী কারো জন্য অপেক্ষা করে ?
তাজ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলো হাসোজ্জল এক রমণীর মুখ। আজও গায়ে জড়ানো ধবধবে সাদা শাড়ি। ঠোঁটের কোণে হাসিটা তাজের বুকে কম্পন ধরালো।
রমণী মুচকি হেসে বললো, মাথা ধরেছে ?
তাজ রমণীর হাতটা নিজের কপালে চেপে ধরলো, তুমি হাত বুলিয়ে দাও তাহলে ভালো লাগবে।
তাজের কথার অবাধ্য হলো না সেই রমণী। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তাজের। তাজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রমণীর দিকে।
সেটা খেয়াল করে রমণী বললো, কী দেখেন ?
তাজ মুচকি হেসে বললো, দেখছি তোমার মুখে বয়সের ছাপ পড়ে না কেনো ? তোমার চুলে পাক ধরে না কেনো ?
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো রমণী, আমার যে বয়সই বাড়ে না জনাব। আমার বয়স তো একটা সংখ্যাতেই আঁটকে আছে। তাহলে বয়সের ছাপ কীভাবে পড়বে ?
তাজ মুগ্ধ চোখে দেখছে সে হাসি, তোমার মুসকান নামটা সার্থক।
মুসকান মুচকি হেসে তাজের কপালে নিজের শীতল ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো তাজ।
সবুজকে আসার অনুমতি দিয়ে কাজে মন দিলো তাজ। মুসকানের বিচরণ তার একাকিত্বে। তাজ জানে না মুসকান তার ভ্রম, হ্যালুসিনেশন নাকি অন্যকিছু আর জানতেও চায় না। সে ভালো আছে এভাবেই। যখনই সে একা থাকে দেখতে পায় মুসকানকে, তার গন্ধ, তার স্পর্শ অনুভব করতে পারে। নিজের মনের কথা শেয়ার করে তার সাথে। কত দুষ্টুমি, মান অভিমান চলে তাদের। তবে সেটা একান্ত তাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কাউকে বললে হয়তো তাজকে পাগল বলবে, কী দরকার বলার ? তাজ তো বেশ আছে নিজের স্ত্রী সন্তান নিয়ে। ধ্রুবকে কোলে নিয়ে যখন ঘুম পাড়িয়ে দিতো, আলতো করে কাঁধে মাথা রাখতো মুসকান। এভাবেই কাটছে তাজের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর। তবে কারো উপস্থিতি অনুভব করলেই কোথায় পালিয়ে যায় মুসকান। আগে তাজের কষ্ট হতো, তবে এখন মুসকান এভাবে পালিয়ে গেলে সে মুচকি হাসে।
বিকেলেই যেতে হবে। ধ্রুবর সাথে আবার ক্রিকেট খেলতে হবে গিয়ে।
সবুজ ঘড়ি দেখে বললো, স্যার চারটার বেশি তো বাজে আর কখন যাবেন ?
সবুজের কথা শুনে তাজ নিজের ঘড়ি দেখলো, ওহ্ শিট লেইট হয়ে গেলো মনে হয়। ছেলেটা গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। বুঝলে সবুজ, আমি বুঝি না আমার ছেলেটা এমন মেয়েদের মতো গাল ফুলানোর অভ্যাস কোথায় পেলো ?
সবুজ হেসে বললো, আসলে স্যার যে মেয়েরা বাবার বেশি আদর পায় তাদের এমন গাল ফুলানোর অভ্যাস হয়। ছোট স্যার তো আপনার অতিরিক্ত ভালোবাসা পায় তাই এমন গাল ফুলায়।
সবুজের কথা শুনে তাজ মুচকি হাসলো শুধু, কিছু বললো না। তাজ সত্যি অতিরিক্ত আদরে বড় করেছে ধ্রুবকে। কোটি টাকা লস দিয়েও ছেলের অনেক ইচ্ছে পূরণ করেছে। এমন অনেক দিন গেছে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছেড়ে ছেলের এক ফোনে ছুটে গেছে তার স্কুলে। অনেকবার ধ্রুব মিথ্যা বলে তাজকে স্কুলে নিয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকা সত্ত্বেও। শুধু বন্ধুদের দেখাতে তার বাবা তাকে কতটা ভালোবাসে। তবু তাজ একটা ধমক পর্যন্ত দেয়নি ধ্রুবকে, সেটা এখন পর্যন্ত কোনদিন দেয়নি। ধ্রুব কোনো ভুল করলে তাজ কৌশলে সেটা বুঝায়, রেগে নয়। তাই তো সবার এতো ভালোবাসা পেয়েও বখে যায়নি ছেলেটা।
ধ্রুবর যখন ষোল বছর তখন একদিন সিগারেট মুখে দিয়েছিল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। সেটা তাজের কানে আসতে দু সেকেন্ড সময় লাগেনি, কারণ ধ্রুবর আশেপাশে ছায়ার মতো বেশ কয়েকজন গার্ড থাকে সবসময়। তবে সেই ব্যাপারে ধ্রুব কিছু জানে না। সিগারেট নিয়ে তাজ ধ্রুবকে কিছুই বলেনি।
তবে আহান একদিন ধ্রুবকে তার পছন্দের জায়গায় নিয়ে যায়। ধ্রুবর মনটা তখন খুব ভালো, আহান তাকে বলে কতটা কষ্ট করে তিতির তাকে জন্ম দিয়েছে। নিজের জীবনের বিনিময়ে ধ্রুবকে বাঁচিয়েছে। এই জীবনটা নষ্ট করা মানে তিতিরকে কষ্ট দেওয়া। আহান এমনভাবে সব বুঝিয়ে বলেছে ধ্রুবকে, সে কেঁদে কেটে ওয়াদা করেছে এই জীবনে সে কখনো খারাপ পথে পা রাখবে না। এভাবেই তাজ আর আহান আগলে রেখেছে ধ্রুবকে।
তাজ দ্রুত বাসায় চলে গিয়ে সোজা ধ্রুবর রুমে গেলো। গিয়ে দেখে ধ্রুব ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত ছেলের কপালে চুমু খেলো তাজ।
দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, জানি না তোমার মায়ের ডায়েরি আমাদের সম্পর্কটার মোড় কোনদিকে নিবে। তবে তোমার সিদ্ধান্ত যাই হোক আমি মেনে নিবো।
ধ্রুব ঘুমের ঘোরে ধ্রুবর কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা রেখে ঘুম জড়ানো গলায় বললো, বাবা তুমি আজও লেইট করেছো।
ধ্রুব পিটপিট করে তাকালো তাজের দিকে, তুমি আসছিলে না দেখেই তো আমি ঘুমচ্ছিলাম।
তাজ ধ্রুবর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো, ঠিক আছে আমি সরি। তুমি এখন ফ্রেশ হয়ে ব্যাট বল নিয়ে গার্ডেনে যাও, আমিও ফ্রেশ হয়ে আসছি।
ধ্রুব উঠে ঢুলতে ঢুলতে চলে গেলো ওয়াশরুমে আর তাজও উঠে নিজের রুমে গেলো। তাজের বিকেলটা সবসময় তার ছেলের নামে। ফ্রেশ হয়েই দু’জন গার্ডেনে চলে গেলো খেলতে। ধ্রুবর খেলার জন্য বাড়ির একপাশে বাগানকে মাঠে পরিণত করেছে তাজ। বিকেল হলেই বাড়ির সব গার্ডসহ খেলাধুলা করে বাবা ছেলে। মাঝে মাঝেই তাদের সাথে যুক্ত হয় আহান।
৩৮.
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে রাহি যাকে নিজের বাবা বলে জেনে এসেছে সে রাহির নিজের বাবা নয়। এই সত্যিটা জানার পর রাহির কী রিয়াকশন দেওয়া উচিত সে বুঝতে পারছে না। কতই বা বয়স তার, এই তো মাস কয়েক আগে পনেরো বছরে পা রেখেছে। ছোট্ট মনে এতবড় ধাক্কা সামলাতে পারছে না। আবার সামনে শুয়ে থাকা মুমূর্ষু রোগীর কথা অবিশ্বাস করতেও পারছে না। মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কেউ নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলবে না। রাহির সামনে হসপিটালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে রকি নামের লোকটা। যার ভাষ্যমতে সেই রাহিকে কিডন্যাপ করে রায়হানের হাতে তুলে দিয়েছিলো।
লম্বা শ্বাস টেনে রকি বললো, আমি মিথ্যা বলছি না রাহি। তোমার নাম রাহি চৌধুরী নয়, তোমার আসল নাম শায়িনী আহমেদ।
রকি প্রথম থেকে সব খোলে বললো শায়িনীকে। শায়িনীর চোখ টলটল করছে নোনাজলে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তার চোখে কখনো পানি আসতে দেয়নি বাবা নামক লোকটা আর আজ তার জন্যই শায়িনী কাঁদছে।
সব বলে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো রকি, জীবনে অনেক পাপ করেছি আমি। তার শাস্তিও পেয়েছি, পরিবার হারিয়ে এখন নিজের জীবনটাও শেষ হতে চলেছে। তাই মৃত্যুর আগে তোমাকে সত্যিটা জানালাম, যদি পাপের বোঝাটা একটু কমে। তবে একটা কথা সত্যি বলছি রাহি মা। রায়হান চৌধুরী জীবনে অনেক পাপ করেছে কিন্তু তোমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। হয়তো নিজের সন্তানকেও এতোটা ভালোবাসতো না।
শায়িনী আর বসে থাকতে পারলো না। টলমল পায়ে বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। পনেরো বছরের জীবনে অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে আজ সে। বুঝে উঠতে পারছে না তার এখন কী করা উচিত।
সবার ডিনার শেষে টেবিল গুছিয়ে নিচ্ছে মৌ। দু’তালায় দাঁড়িয়ে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে আছে শান। মৌ আর স্বাভাবিক হয়নি। অনেক খোঁজেও শায়িনীকে না পেয়ে মৌ দিনদিন আরো অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিলো। শান বাধ্য হয়ে তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যায়, আগের বাসা চেঞ্জ করে, এতে একটু স্বাভাবিক হলেও পুরোপুরি হয়নি। ডক্টর শানকে পরামর্শ দেয় আরেকটা বাচ্চা নেওয়ার। তারপর তাদের কোল আলো করে আবার আসে এক পুত্র সন্তান মাহিম আহমেদ। মৌ আরো একটু স্বাভাবিক হয়, নিজের সন্তান, সংসার হসপিটাল সব আবার সামলাতে শুরু করে। তবে হয়ে যায় এক যন্ত্রমানবী। হয়তো এভাবেই কাটবে তার বাকি জীবন। সন্তান হারানোর ক্ষত যে শুকাবার নয়।
শান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ছেলের রুমে গেলো। মাহিম ঘুমিয়ে পড়েছে, শান তার গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বের হয়ে গেলো তার রুম থেকে। তার যাওয়ার কিছুক্ষণ পর এলো মৌ। কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো ছেলের দিকে। ছেলেটার মুখ দেখলে বুকটা খা খা করে মৌয়ের। ছেলের মুখের আদুল মেয়েটার মতোই হয়েছে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো মৌ। এখন আর তাজের কথা ভেবে কষ্ট পাওয়ার সময় হয় না মৌয়ের। মেয়ের কথা ভেবে কেঁদেই দিন কাটে তার। অনেকটা সময় ছেলের কাছে থেকে নিজের রুমে গেলো মৌ।
শান বেডে বসে একটা রোগীর ফাইল দেখছে আগামীকাল তার অপারেশন। মৌ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে।
শান ফাইল রেখে মৌয়ের দিকে তাকালো, এবার কী স্বাভাবিক হওয়া যায় না মৌ ?
মৌ শান্ত চোখে তাকালো শানের দিকে, আপনার কাছে স্বাভাবিক হওয়া মানে আমার মেয়েটাকে ভুলে যাওয়া। যার মুখে প্রথম মা ডাক শুনেছি তাকে কীভাবে ভুলে যাবো শান ? আপনি ভুলতে পেরেছেন সেই আধো আধো বুলির বাবা ডাক ?
চোখ ঝাপসা হলো শানের। হ্যাঁ সেও পারেনি সেই ডাক ভুলতে, কোনোদিন পারবেও না। এখনো ঘুমালে মনে হয় কেউ তুলতুলে হাতে তার গাল স্পর্শ করবে আর সে মুচকি হেসে সেই হাতে শ’খানেক চুমু খাবে। সে ঘুমায় ঠিকই কিন্তু গালে আর সেই তুলতুলে স্পর্শ পায় না।
চোখ মুছলো মৌ, যা নিজে পারছেন না তা আমাকে করতে বলছেন ?
শানের উত্তরের অপেক্ষা না করে মৌ বেলকনিতে চলে গেলো। শান চোখ বন্ধ করে বালিশে মাথা এলিয়ে দিলো। তার চোখের কোণ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো বালিশে। আজ আর দু’জনের কারো ঘুমানো হবে না বোধহয়।
৩৯.
সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে বাসায় ফিরেছে সবাই। দুপুরে অসহায় মানুষদের হাতে খাবার তুলে দিয়েছে ধ্রুব নিজ হাতে। এই কাজটা করতে তার অসম্ভব ভালো লাগে। এমনিতেও সবসময় চেষ্টা করে মানুষকে সাহায্য করার। ধ্রুবর জন্মদিনে কেক কাটা হয় না কিংবা কোনো পার্টি করাও হয় না। জন্মদিনের সকাল শুরু হয় দাদুমণি আর গ্র্যানির হাতে পায়েস খেয়ে। দুপুরে শাহজালাল মাজারের সামনে অসহায় মানুষদের খাবারের ব্যবস্থা করে, সবাই সেখানেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়। ধ্রুবর প্রত্যেকটা জন্মদিন কাটে সিলেটে। আজও সবাই মাজারে গিয়েছিলো, ফিরে এসে যে যার রুমে চলে গেলো রেস্ট নিতে। আহান গেলো নিজের রুমে। আলমারি খোলে সযত্নে আগলে রাখা ডায়েরিটা বের করলো। ডায়েরিতে আলতো করে হাত বুলিয়ে চশমা খোলে নিজের চোখ মুছে নিলো। ধ্রুবর রুমের দিকে পা বাড়ালো।
দরজায় নক করলো, বাবাই আসবো ?
ধ্রুব বেডে শুয়ে ফোনে বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো। দরজার দিকে তাকিয়ে আহানকে দেখে ফোন রেখে উঠে বসলো।
আহান মুচকি হেসে রুমে প্রবেশ করে ধ্রুবর পাশে বসে মাথায় হাত রাখলো, আমার বাবাই তো এখন আর ছোট্টটি নেই। সে বড় হয়েছে তাই তার রুমে আসতে এখন অনুমতি নিতে হয়।
আহানের কথা শুনে ধ্রুব মাথা নিচু করে লাজুক হাসলো, আমি তোমার আর বাবার কাছে সবসময় ছোট ধ্রুবই থাকতে চাই পাপা।
আহান ধ্রুবর কথা শুনে তার কপালে চুমু খেলো, তুমি সবসময় আমার কাছে সেই ধ্রুবই থাকবে। যে ধ্রুবকে শুভ্র তোয়ালে মোড়ানো অবস্থায় তুতুলের বুক থেকে নিজের বুকে তুলে নিয়েছিলাম।
চোখ ঝাপসা হলো আহানের সাথে ধ্রুবরও। আহানের নিজের দুই সন্তান আছে এখন, তবু ধ্রুবর জায়গা তার জীবনে সম্পূর্ণ আলাদা। ধ্রুবকে যতটা ভালোবাসে নিজের সন্তানদের ততটা ভালোবাসতে পেরেছে কিনা জানে না আহান।
ডায়েরিটা দেখে খুশিতে চকচক করে উঠলো ধ্রুবর চোখমুখ। ধ্রুব কাঁপা হাতে ডায়েরিটা নিলো। আহান ডায়েরি দিয়ে ধ্রুবর গালে হাতে রেখে আদর করে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। ধ্রুব ডায়েরি নিয়ে বাড়ি থেকে বের পুকুরপাড়ে চলে গেলো।
উত্তেজনায় এখনো হাত কাঁপছে ধ্রুবর। প্রত্যেকটা জন্মদিনে সে অনেক অনেক উপহার পেয়েছে সবার থেকে। লক্ষ লক্ষ টাকার সেসব উপহারের চেয়ে আজ হাতে থাকা সামান্য একটা ডায়েরি তার কাছে অধিক মূল্যবান মনে হচ্ছে। যেদিন এই ডায়েরির কথা শুনেছে সেদিন থেকে এটা হাতে পাওয়ার প্রহর গুনছে সে। এই ডায়েরিটাতে তার মায়ের স্পর্শ আছে ভাবতেই শরীর কেঁপে উঠছে তার। সাদা আর সোনালী রঙের ডায়েরির উপর ধ্রুবতারা লেখাটায় হাত বুলালো ধ্রুব। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার, হয়তো তার মাও এখানে হাতে রেখেছে অসংখ্য বার। ধ্রুব ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। ধ্রুব নিজের অজান্তে পুকুরের সেই একই সিঁড়িতে বসেছে যেখানে অনেকগুলো বছর আগে তাজ বসে পড়েছিল “বিষাক্তফুলের_আসক্তি” আর আজ একই জায়গায় ধ্রুব পড়ছে “ধ্রুবতারা।”
কম্পিত হাতে ধ্রুব ডায়েরির প্রথম পাতা উল্টালো। তার চোখে পড়লো সাদা পৃষ্ঠার উপর পেন্সিলে আঁকা এক ছবি। একটা বাচ্চাকে পরম আদরে বুকে জড়িয়ে রেখেছে তার মা। ধ্রুব হাত রাখলো সেই ছবিতে। তার মা হয়তো এভাবেই তাকে কোলে তুলে নিতে চেয়েছিলো। চোখ ঝাপসা হলো ধ্রুবর। ডায়েরির পাতায় এক ফোটা নোনাজল পড়তেই ধ্রুব নিজের চোখ মুছে নিলো। পৃষ্ঠা উল্টে পরের পৃষ্ঠা বের করলো।
আমি যখন এই ডায়েরিটা লিখছি তখন তুমি আমার মধ্যে অবস্থান করা একটা ভ্রুণ আর তুমি যখন এই ডায়েরিটা পড়ছো আমি তখন কেবল সবার স্মৃতি মাত্র। আমি এখন এটাও জানি না তুমি আমার তাহিয়ান খান ধ্রুব নাকি তাহিয়া খান তারা। তুমি ধ্রুব হও কিংবা তারা, তুমি আমার জীবনের ধ্রুবতারা। ধ্রুবতারা দিক হারানো মানুষকে দিক ঠিক করতে সাহায্য করে। আমি যখন জীবন গোলকধাঁধায় আঁটকে গেলাম, তুমি আমাকে বাঁচার একটা পথ হয়ে দেখা দিলে। তাই তুমি আমার জীবনের ধ্রুবতারা। তোমাকে আজ একটা গল্প বলবো। কখনো তো তোমাকে রাজা-রানির গল্প শোনানো হয়নি। জানি এখন তুমি বড় হয়ে গেছো রাজা-রানির গল্প শোনার আগ্রহ নেই। তবু আমি আজকে তোমাকে এক ধোঁকাবাজ রাজকন্যার গল্প শুনাবো।
এক রাজ্যে অনেক হাসিখুশি এক রাজকন্যা ছিলো। বাবা-মাকে নিয়ে সে খুব ভালো ছিলো। কিন্তু একরাতে রাক্ষসদের আক্রমন হলো রাজা-রানি আর রাজকন্যার উপর। রাজা-রানি মারা গেলো আর রাজকন্যা একরাতের ব্যবধানে এতিম হয়ে গেলো। রাজ্য দখল করে নিলো রাক্ষসরা, রানী মারা যাওয়ার আগে আরো এক রাজকন্যা দিয়ে গেলো বড় রাজকন্যার কাছে। রাজকন্যা নিজেই তখন ছোট আবার তার কাঁধে এলো ছোট বোনের দ্বায়িত্ব। ধীরে ধীরে সব মানিয়ে বড় হতে থাকলো রাজকন্যারা। তাদের আগলে রাখলো রাজ্যের বিশ্বস্ত সেনাপতি। কিন্তু একদিন সেনাপতিও মারা গেলো। আবার একা হয়ে গেলো দুই রাজকন্যা। বড় রাজকন্যা দ্বায়িত্ব নিলো ছোট রাজকন্যার। ছোট রাজকন্যা যে অসুস্থ, বড় হয়েও সে ছোট। বড় রাজকন্যা যখন অসহায় তখন এক রাজপুত্রের সাথে দেখা। রাজপুত্র তাদের অন্ধকার জীবন আলোকিত করে দিলো। ভালো চলছিলো রাজকন্যার জীবন কিন্তু আবার সেই রাক্ষসদের আগমন হলো রাজকন্যাদের জীবনে। ছোট রাজকন্যার জীবন বাঁচাতে বড় রাজকন্যা ধোঁকা দিলো রাজপুত্রকে। রাজপুত্রের সবকিছু ধ্বংস করে দিলো বড় রাজকন্যা, অপবাদের কালিমা লেপন করে দিলো রাজপুত্রের মাথায়। রাজপুত্র ঘৃণা করতে শুরু করলো রাজকন্যাকে। কিন্তু রাজকন্যার কিছুই করার ছিলো না। এভাবেই চলতে থাকলো দিন, রাজপুত্রের ঘৃণা বাড়তে লাগলো রাজকন্যার উপর। তখনই আরেক রাজপুত্র ফেরেস্তার মতো এলো রাজকন্যাদের জীবনে। তার সাহায্যে রাজকন্যা সবার কাছে রাজপুত্রকে নির্দোষ প্রমাণ করে তার থেকে দূরে চলে গেলো ছোট রাজকন্যাকে নিয়ে। রাজপুত্র জানতে পারলো না রাজকন্যা তাকে কতটা ভালোবাসে, রাজপুত্র এটাও জানতে পারলো না রাজকন্যা একা যায়নি সাথে নিয়ে গেছে রাজপুত্রের সন্তানকে। রাজপুত্র যে রাজকন্যাকে প্রচন্ড ঘৃণা করতো তাই রাজকন্যার সাহস হয়নি রাজপুত্রকে তার সন্তানের কথা জানানোর।
গল্পের সেই ধোঁকাবাজ রাজকন্যাটাই ছিলো তোমার মা আর তোমার বাবা সেই রাজপুত্র। আচ্ছা তুমিও কী আমাকে ঘৃণা করবে মিষ্টি বাচ্চা আমার ? তুমি জানো, ডক্টর যখন জানালো আমার ভেতরে আরো একটা প্রাণ একটু একটু করে বেড়ে উঠছে। সেই অনুভূতি আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না। আনন্দ, ভয় সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। এরপর ডক্টর যখন বললো তোমাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গেলে আমার জীবনের ঝুঁকি আছে, তখন আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। চোখের সামনে কোনো পথ দেখতে পাচ্ছিলাম না। তোমার খালামণিকে তুমি জানো, আমি না থাকলে তাকে কে দেখে রাখবে আর তোমারই বা কী হবে ? আমি চারদিকে কেবল অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিলাম। তোমার বাবার চোখে আমার জন্য তখন সীমাহীন ঘৃণা। একবার সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাকে আমি পৃথিবীর আলো দেখাবো না। এই কথা জানার পর হয়তো তুমি আমাকে ঘৃণা করবে। তোমার মা তোমাকে অনেক ভালোবাসে সোনা। কিন্তু সেদিন আর কোনো পথ খোলা পায়নি সে। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে যখন আমি ডুকরে কাঁদছি তখন ফেরেস্তার মতো হাজির হলো আহান। তাকে বোধহয় তুমি পাপা বলে চিনো। সে তো বলতো তোমাকে সে পাপা ডাকতে শেখাবে। তোমার পাপা আলাদীনের জিনির মতো আমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে এসেছিলো। তোমার মাম্মামকে দেখে রাখার চিন্তা আমার আর ছিলো না তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তুমি পৃথিবীর আলো দেখবে।
এতটুকু পড়ে ধ্রুব ডায়েরি বন্ধ করে নিজের চোখ মুছলো। দাদুমণির কাছে অনেকটা শুনেছে সে। তবু মায়ের ডায়েরি পড়ে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। না সে নিজের মাকে ঘৃণা করার কথা ভাবতেও পারছে না। তাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর সিদ্ধান্ত না নিলে আজ তার মা বেঁচে থাকতো।
ধ্রুব ডায়েরি বুকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো, আমি তোমাকে ঘৃণা করার কথা ভাবতেও পারি না মা। আমি তোমাকে খুব খুব, খুব বেশি ভালোবাসি।
চোখ মুছে আবার পড়তে লাগলো ধ্রুব। এরপরে তিতির ধ্রুবকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে সব লেখা। প্রতি মাসের পরিবর্তনে ধ্রুব তিতিরকে কত জ্বালিয়েছে, ধ্রুব কবে ফাস্ট কিক করেছে সেটাও লেখা। অনেক জায়গার লেখা ছড়িয়ে গেছে, কালার চেঞ্জ হয়ে গেছে, হয়তো তিতিরের চোখের পানি পড়েছিলো। তিতির যেদিন জানতে পারে তারা নয় ধ্রুব আসছে সেদিনটার কথাও লেখা। তিতির ধ্রুবর সাথে একা একা যা কথা বলতো সবই লিখে রেখেছে। ধ্রুব সেসব পড়ে কখনো হাসছে তো কখনো কাঁদছে। কতই না কষ্ট দিয়েছে সে তার মাকে।
এক পৃষ্ঠায় লিখেছে, তোমার জীবনটা আমার কাছে অনেক মূল্যবান ধ্রুব। কখনো ভুল পথে পা রেখে আমার কষ্টগুলো বৃথা হতে দিও না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সৎ পথে থেকো। তোমার জন্য যেনো আমি পরকালেও গর্বিত হতে পারি।
ধ্রুব মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো সে তার মায়ের কষ্ট বৃথা যেতে দিবে না। আবার পড়তে লাগলো।
তোমার আগমনের সময় ঘনিয়ে আসছে আর হয়তো আমার বিদায়ের। আজকাল শরীরটা আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তোমার বাবা এখনো জানে না তোমার কথা। হয়তো একদিন জানতে পারবে, ফিরিয়ে নিতে আসবে তোমাকে। আমি তোমার বাবার জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছি।
গল্পের শেষের পাতায় আমি প্রথমবারের মতো কিছু দিতে চাই তাজকে। সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ, আমার ধ্রুব। আমার ধ্রুব সোনা কী রাখবে না তার মায়ের কথা ? সেও কী সবার মতো তার স্বার্থপর মাকে ঘৃণা করে ? যদি এই স্বার্থপর মাকে ঘৃণা না করো, তবে ফিরে যাও বাবার কাছে, এতোটা ভালোবাসো যাতে তোমার মায়ের প্রতি থাকা তার ঘৃণা ভুলে যায় সে। ভালোবাসতে না পারলেও ঘৃণা যেনো আর না করে। তোমার বাবা অনেক ভালো একজন মানুষ ধ্রুব। কখনো তার মনে কষ্ট দিও না। তার যেনো কখনো মনে না হয়, আমার মতো আমার অংশও তার জীবনের অভিশাপ। নিজের বাবাকে ভালো রেখো আর তুমিও অনেক ভালো থেকো আমার সোনা বাচ্চা। পারলে আমার প্রতি তোমার বাবার ঘৃণা মুছে দিও তার মন থেকে।
এরপরে বড় একটা সমাপ্ত লিখে শেষ করেছে “ধ্রুবতারা” ডায়েরির লেখা।
বাসায় ফিরে শানের পা থমকে গেলো। ফ্ল্যাটের খোলা দরজার সামনে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে রেখা। কিছু সময়ের জন্য শান যেনো থমকে গেলো। হুঁশ ফিরতেই দ্রুত এগিয়ে গেলো রেখার দিকে। গালে থাপ্পড় দিয়ে কয়েকবার রেখা রেখা বলে ডেকেও রেখার রেসপন্স পেলো না। রেখাকে সেখানে রেখে ভেতরে গেলো দৌড়ে। তন্নতন্ন করে খোঁজেও শায়িনীর কোনো চিহ্ন পেলো না। ড্রয়িংরমে তার খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কেবল। শান এক গ্লাস পানি নিয়ে এগিয়ে এলো রেখার কাছে। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে গালে থাপ্পড় দিতে লাগলো। বেশ কিছুটা সময় ধীরে ধীরে চোখ খুললো রেখা।
শায়িনী কোথায় রেখা আর তুই এখানে এভাবে পড়ে আছিস কেনো ?
রেখার মাথা ঘুরছে তখনো। মেডিসিনের রেশ কাটেনি পুরোপুরি। রেখা মনে করার চেষ্টা করলো কী হয়েছিলো।
শান অস্থির গলায় রেগে বললো, কী হলো রেখা চুপ করে আছিস কেনো ?
রেখা নিজের মাথা চেপে ধরে বললো, আসলে ভাইয়া আমি মনে করেছি তুমি এসেছো। তাই শায়িনীকে কোলে নিয়ে দরজা খোলে দিয়ে দেখি একটা অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরিচয় জানতে চাইলে লোকটা তোমার আর ভাবির নাম বলে জিজ্ঞেস করলো এটা তোমাদের বাসা কিনা। আমি হ্যাঁ বলতেই মুখে কিছু স্প্রে করে দিলো তারপর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে আসে আমার। এরপর কী হয়েছে কিছু মনে নেই।
শান রেগে গেলো রেখার কথা শুনে, তুই কে এসেছে না দেখে দরজা খুলেছিস কেনো ?
রেখা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমি ভেবেছি তুমি এসেছো।
শান নিজের মাথার চুল খামচে ধরলো। কী করবে বুঝতে পারছে না সে। মেয়েটা যে তার আর মৌয়ের জান। মৌ পাগল হয়ে যাবে মেয়েকে হারালে। শান ভাবলো মৌকে এখনই জানাবে না। আগে পুলিশকে ইমফর্ম করতে হবে। পুলিশকে কল করার জন্য পকেট থেকে ফোন বের করতেই মৌয়ের কল এলো।
শান ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো মৌয়ের ভেজা গলা, আমার শায়িনী কোথায় শান ?
শান কিছু বলবে তার আগেই মৌ বললো, আমাকে মিথ্যা বলবেন না শান। আমার কাছে কল এসেছিলো অচেনা নাম্বার থেকে, সে বলছে শায়িনী তার কাছে আছে তাই সত্যিটা বলুন।
শান বুঝতে পারলো মৌকে মিথ্যা বলে লাভ নেই তাই সবটা খোলে বললো।
মৌ অস্থির গলায় বললো, আপনি পুলিশকে ফোন করবেন না। তাহলে আমার মেয়েটার ক্ষতি করে দিবে। আমি না আসা পর্যন্ত কাউকে কিছু বলবেন না।
শান ব্যস্ত গলায় বললো, তুমি কোথায় যাবে ?
মৌ অসহায় গলায় বললো, জীবনে করা কিছু ভুলের মাশুল দিতে।
অস্থির হয়ে উঠলো শান, মৌ তুমি কোথাও যাবে না আমি এখনই আসছি তোমার কাছে।
শানের কথা না শুনে মৌ কল কেটে দিলো। শান ব্যস্ত ভঙ্গিতে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল।
৩৩.
একটা পুরনো বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামলো মৌ। এতক্ষণ চোখ বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে বসে ছিলো মৌ তাই বুঝতে পারছে না জায়গাটা কোথায়। মেয়েকে পেতে হলে হসপিটালের সামনে থাকা গাড়িতে উঠে বসতে বলেছিলো ফোনে আর মৌ তাই করেছে। মেয়েটা যে তার জান।
গাড়িতে থাকা লোকটা কর্কশ গলায় বললো, ভেতরে চলে যান।
মৌয়ের নিজের জন্য ভয় হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে ভেতরে গেলে মেয়েকে পেয়ে যাবে তাই দেরি না করে ভেতরে চলে গেলো।
দরজার ওপারে পা রাখতেই কেউ বলে উঠলো, ওয়েলকাম মিসেস সুফিয়ান আহমেদ শান।
আওয়াজটা চিনতে এক সেকেন্ড সময় লাগলো না মৌয়ের, রায়হান তুই ?
কথা বলতে বলতে রায়হান দুতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। মৌ তখনো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার মেয়ে কোথায় রায়হান ?
বাহ্ মেয়েকে দেখছি খুব ভালোবাসিস। তোর ভালোবাসা ঠিক বুঝতে পারি না আমি। তুই নাকি পাগলের মতো ভালোবাসতি তাজকে। অথচ তাকে ভুলে ঠিক অন্যজনের সাথে সুখের সংসার করছিস। তাহলে মেয়ের জন্য এতো অস্থির হচ্ছিস কেনো বল তো ? আরেকটা মেয়ে দিয়ে এই মেয়ের অভাব পূরণ করে ফেলবি।
রায়হানের কথায় রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলো মৌ, রায়হান ভালোয় ভালোয় আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দে।
সামনের একটা চেয়ারে আরাম করে বসলো রায়হান, আগে বল তো তাজকে ভুলে অন্যকারো সাথে কীভাবে সংসার করছিস ? না মানে আমি চেষ্টা করতাম তোকে ভুলে অন্যকারো সাথে জীবন সাজানোর।
একজনকে মনে রেখে অন্যকারো সাথে জীবন কাটানোর কষ্ট তুই বুঝতে পারবি না। একজনকে ভুলতে না পারার কষ্ট আর অন্যজনকে ভালোবাসতে না পারার কষ্ট প্রতিনিয়ত একটু একটু করে শেষ করে দেয় ভেতরটা।
গলা কাঁপছে মৌয়ের। মানুষকে উপর থেকে যতটা সুখী মনে হয় ভেতর থেকে সে কী ততটাই সুখী। এই উত্তরটা কারো কাছেই সহজ নয়। রায়হান মৌকে অনেক কিছু বলবে ভেবেছিলো কিন্তু বলতে পারছে না। তাজ যেদিন মৌয়ের বিয়ের কথা বলেছিল যন্ত্রণায় বুকটা জ্বলে পুড়ে গেছে রায়হানের কিন্তু তাজকে বুঝতে দিতে চায়নি। রায়হানও মৌকে সত্যি ভালোবেসেছিল হয়তো স্বার্থপরের মতো। তার ভালোবাসার ধরনই হয়তো ভিন্ন ছিলো।
কাউকে আসতে বললো রায়হান আর মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, শেষবারের মতো নিজের মেয়েকে দেখে নে।
মৌ ভীত গলায় বললো, মানে ?
রায়হান মুচকি হেসে বললো, তোকে পাইনি তবে আমার বেঁচে থাকার জন্যও তো কাউকে প্রয়োজন। আজ থেকে শায়িনী আমার মেয়ের পরিচয়ে বড় হবে। তোদের সবাইকে তার স্মৃতি থেকে মুছে দিবো আমি।
একটা মেয়ে শায়িনীকে কোলে নিয়ে সামনে এলো। মৌ নিজের মেয়ের দিকে এগিয়ে যেতে গেলে আরেকটা মেয়ে তাকে ধরে ফেললো। মৌ চিৎকার করে বলছে তাকে তার মেয়ের কাছে যেতে দিতে কিন্তু কেউ শুনছে না তার কথা। হঠাৎ ঘাড়ে সুচালো কিছু অনুভব করলে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে লাগলো মৌ। এবার শায়িনীকে মৌয়ের কাছে দেওয়া হলো। মৌ আলতো করে বুকে জড়িয়ে নিলো মেয়েকে। তারপর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
চোখ খোলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলো মৌ।
ধীরে ধীরে সব মনে পড়লে আশেপাশে তাকিয়ে নিজের মেয়েকে খুঁজতে লাগলো, আমার মেয়ে কোথায় ?
মৌয়ের আওয়াজ শুনে শান দ্রুত এগিয়ে এলো। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে শানের, চোখের নিচে কালি পড়েছে। দুদিন ধরে মৌয়ের জ্ঞান ছিলো না আর এদিকে মেয়ের কোনো খোঁজ নেই। পুলিশ কোনো খোঁজ পায়নি শায়িনীর। অজ্ঞাত কেউ মৌকে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
মৌ শানের দিকে তাকিয়ে অস্থির গলায় সবটা খোলে বললো শানকে তারপর বললো, আমাদের শায়িনী কোথায় শান ?
কী উত্তর দিবে শান ? তার কাছে যে এই প্রশ্নের উত্তর নেই। মৌয়ের সাথে একটা চিরকুট পেয়েছে শান।
“আপনার বউকে ফিরিয়ে দিলাম তবে মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিন।”
টপ করে এক ফোটা নোনাপানি গড়িয়ে পড়লো শানের চোখ থেকে।
শানের চোখে পানি দেখে মৌ বললো, তারমানে রায়হান সত্যি নিয়ে গেছে আমার শায়িনীকে।
দু’জন যখন থম মেরে আছে তখনই কেবিনে ঢুকলো তাজ আর আহান। একই শহরে থেকেও দীর্ঘ পাঁচ বছর পর দেখা মৌয়ের সাথে তাজের। ইকবাল খান হসপিটাল থেকে রিলিজ হওয়ার পর আর কোনোদিন মুখোমুখি হয়নি দু’জন। তাজ তাকিয়ে দেখলো এক সন্তান হারানো বিধস্ত মাকে। কী বলে শান্তনা দিবে বুঝতে পারছে না। তাজ ভেবেছিলো রায়হান হয়তো নতুন করে তার জীবনে আবার কোনো ঝড় নিয়ে আসছে। কিন্তু সে ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই রায়হান মৌয়ের জীবন এলোমেলো করে দিয়ে উধাও হয়ে গেছে৷ কোথায় গেছে কেউ জানে না। বাংলাদেশে নেই সেটা নিশ্চিত হয়েছে তাজ, কারণ গত পাঁচ বছর আগের তাজ আর এখনকার তাজের অনেক তফাৎ। আগের তাজ কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইতো না তাই সবসময় জীবনের সোজা পথে হেঁটেছে। তবে এই তাজ সোজা পথের সাথে বাঁকা পথটাও চিনে নিয়েছে। সেই বাঁকা পথের সাহায্যেই তাজ জেনেছে রায়হান দেশ ছেড়েছে সমুদ্র পথে। সেই খবর শানকে জানাতে এসে দেখলো মৌয়ের জ্ঞান ফিরেছে। মৌ কান্না করছে না কেমন থম মেরে বসে আছে। এতবছর পর তাজকে দেখেও তার কোনো রিয়াকশন হলো না। তাজ শানকে একটু অন্যদিকে ডেকে সবটা খোলে বললো রায়হান দেশ ছেড়ে চলে গেছে। শান পড়ে যেতে নিয়েও দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিলো। অসহায় চোখে তাকালো পুতুলের মতো বসে থাকা মৌয়ের দিকে।
৩৪.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো বেশ কয়েকটা দিন। মৌ একদম চুপ হয়ে গেছে। সেদিনের পর মুখে একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি সে আর না একটুও কান্না করেছে। শান মৌকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে চলেছে। একদিকে মেয়েকে হারিয়ে, অন্যদিকে মৌয়ের এমন অবস্থায় শান নিজেও ভেঙে পড়েছে। দুজনের বাবা সব জেনে চলে এসেছে তাদের কাছে। সবাই মিলে মৌকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। এদিকে পুলিশ আর রায়হানের কোনো খোঁজ পায়নি আর না তাজ পেয়েছে।
আহান এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে সবাইকে নিয়ে। রায়হানের জন্য কয়েকদিন পিছিয়ে গেছে লন্ডন ফিরতে। তবে আজ চলে যাচ্ছে কিন্তু তাজ আসেনি তাদের ছাড়তে। আসার আগে আহানের হাত ধরে শুধু বলেছে ধ্রুবকে সারাজীবন এভাবেই আগলে রাখতে। আহান বুঝতে পারছে না তাজের এমন শান্ত আচরণের মানে।
আহান চিন্তা করছে তাজ কেনো ফিরে চাইলো না ধ্রুবকে। আহানের হঠাৎ তিতিরের কথা মনে পরে গেলো। তিতির চিঠিতে লিখে গিয়েছিলো তাজ যদি ধ্রুবকে ফিরে চায় তবে ধ্রুবর আঠারো বছর হলে সে ঠিক করবে তাজের কাছে ফিরে যাবে কিনা। হয়তো তাজকেও এমন কিছুই বলেছে ডাইরিতে। কিন্তু তিতির তো ভেবেছিলো তাজ বিয়ে করে নিজের জীবনে সুখী আছে তাই ধ্রুবকে ফিরিয়ে দিতে চায়নি। ভেবেছিলো ধ্রুবর থাকা না থাকায় তাজের খুব একটা অসুবিধা হবে না। সেসব তো ঠিক নয়, তাজ ভালো নেই সেটা আহান নিজের চোখের সামনে দেখেছে। আহান তাকালো ধ্রুবর দিকে, সে আহানের কোলে বসে বাইরেটা কৌতুহলী চোখে দেখছে। আসার সময় তাজের জন্য কান্নাও করছিলো, কয়েকদিনে তাজের প্রতি ধ্রুবর একটা মায়া তৈরি হয়েছে আহান বুঝতে পারছে। তাজকে ফেলে আসতেই চাইছিলো না, হয়তো এটাই রক্তের টান। তাজ ধ্রুবকে কোল থেকে নামিয়ে তিতিরের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে আর বের হয়নি।
আহান কিছু চিন্তা করে ব্যস্ত গলায় বললো, ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে খান ভিলায় চলুন।
আহানের কথায় সবাই খানিকটা অবাক হলো। আধঘন্টার মধ্যে তাদের ফ্লাইট আর আহান এখন ফিরে যাওয়ার কথা বলছে।
ন্যান্সি বললো, কী হলো মাই সান ?
আহান চিন্তিত গলায় বললো, আমার কিছু একটা গন্ডগোল লাগছে। এখনই খান ভিলায় না পৌঁছালে বিপদ হয়ে যাবে।
তিতিরের রুমে বসে আছে তাজ। একহাতে তিতিরের একটা ওড়না আর অন্যহাতে পি*স্ত*ল। তিতির হুট করে চলে যাওয়ায় তার সব জিনিস এই রুমেই থেকে গিয়েছিলো। আট মাস পরে তাজ দেশে ফিরে একরাতে তিতিরের রুমে গিয়েছিলো অজানা কারণে। রুমে ঢুকতেই ভ্যাপসা গন্ধ আর ধুলো নাকে এসে লাগে। নিজের হাতেই রুমটা পরিষ্কার করেছিলো আর তারপর থেকে নিজেই এই রুমটা পরিষ্কার করে। তিতির হয়তো তাড়াহুড়ায় চেঞ্জ করা জামা ভুলে বেডে রেখে গিয়েছিলো। তাজ সেটা বেডেই পড়ে থাকতে দেখে ধুলোয় মাখামাখি হয়ে। জিনিসগুলো আগের মতোই রেখেছে তাজ। মনটা বড্ড বেশি অস্থির হয়ে উঠলে এই রুমেই দরজা বন্ধ করে বসে থাকে আগে থেকেই ৷ তাই আজ ইরিনাও মাথা ঘামায়নি বিষয়টা নিয়ে। ইকবাল আর ইরিনা ধ্রুবকে রাখার কথা বলতে চেয়েছিল আহানকে কিন্তু তাজের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় আগানোর সাহস পায়নি।
তিতিরের ওড়না হাতে পেঁচিয়ে পি*স্ত*লে গুলি লোড করতে লাগলো তাজ আর মাত্র কয়েকটা মিনিট তারপর তো ধ্রুবকে নিয়ে আকাশে উড়ে যাবে ফ্লাইট আর হয়তো তাজের প্রাণও তখনই মুক্তি পাবে দেহ থেকে।
গাড়ি থামতেই ধ্রুবকে নিয়ে দৌড়ে ভেতরের দিকে যেতে লাগলো আহান।
লোড করা হয়ে গেলে পি*স্ত*লের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তাজ, আম কামিং মুসকান, আম কামিং। জীবনটা নিজের কাছেই বোঝা হয়ে গেছে আর বইতে পারছি না।
চোখ বন্ধ করে পি*স্ত*ল মাথা লাগাতেই কেউ দরজায় নক করলো তাজের কানে ভেসে এলো ধ্রুবর গলা, বাবা।
তাজ ভাবলো হয়তো সে ভুল শুনেছে।
পরক্ষণে আবারও ধ্রুবর গলা শোনা গেলো, বাবা দরজা খোলো না কেনো ?
তাজ উঠে ছুটে গিয়ে দরজা খোলে দিলো। দরজার সামনে ছোট্ট ধ্রুবকে দেখে চোখ ভিজে উঠলো। জাপ্টে কোলে তুলে নিয়ে সারা মুখে অজস্র চুমুতে ভড়িয়ে দিলো।
আপনার মতো মানুষের থেকে এমনটা আশা করিনি তাজ ভাইয়া।
আহানের মলিন আওয়াজ শুনে তার দিকে তাকালো। তাজের হাতে এখনো পি*স্ত*লটা রয়েছে। আহান সেটা তাজের হাত থেকে নিয়ে নিলো।
প্রথম থেকেই আপনার এমন স্বাভাবিক আচরণই আমার কাছে অস্বাভাবিক লেগেছিলো। গাড়িতে বসে পুরোটা বিষয় চিন্তা করলে হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল করেছি মনে হলো। আপনি যখন ধ্রুবকে কোল থেকে নামিয়ে তিতিরের রুমের দিকে যাচ্ছিলেন তখন আপনার কোমরে গুঁজে রাখা পি*স্ত*লের এক অংশ চোখে পড়ে আমার। তখন ব্যাপার গুরুত্ব না দেওয়ায় বুঝতে পারিনি। কিন্তু গাড়িতে বসে সবটা চিন্তা করতেই হিসাব মিলে গেলো। এটা আপনি কী করছিলেন ? ভাইয়া আত্মহত্যা মহাপাপ সেটা কী আপনি ভুলে গিয়েছিলেন ? ইহকালের সামান্য কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে অনন্তকাল জাহান্নামের আগুনে পুড়ার পথ বেছে নিচ্ছিলেন ? সেই অসহনীয় কষ্ট কীভাবে সহ্য করতেন একবার ভেবেছিলেন। সেখান থেকে কোথায় পালাতেন ? একবার ধ্রুবর কথা মনে হয়নি আপনার ? ছেলেটা জন্মের পর থেকেই মাতৃহারা, এখন আপনি ওকে পুরোপুরি এতিম করে দিচ্ছিলেন।
তাজ এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো, এতকিছু মাথায় আসেনি আহান। শুধু মনে হয়েছে আমার ছেলেটা যদি সব সত্যি জেনে আমাকে ঘৃণা করে ? নিজের সন্তানের ঘৃণার দৃষ্টি মনে হতেই আমার কলিজা কেঁপে উঠে আহান। আমি অপেক্ষা করতাম আমার সন্তানের জন্য কিন্তু সব জেনে সে যদি আমায় ঘৃণা করে। সেটা আমি সহ্য করতে পারবো না আহান।
মুচকি হাসলো আহান, এখনও চিনতে পারলেন না আমার তুতুলকে।
তাজ প্রশ্নবোধক চাহনি তাকালো, মানে ?
ভাইয়া আমি আপনাকে বলেছিলাম আমার বাবা কতটা জ*ঘ*ন্য অন্যায় করেছিলো তুতুলের পরিবারের সাথে। তবু তুতুল বাবার কোনো অন্যায়ের কথা আমাকে বলেনি। কারণ ও চায়নি আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি। মেয়েটা নিজের বাবাকে খুব বেশি ভালোবাসতো। ও কখনো চায়নি একজন সন্তানের সামনে তার বাবা ছোট হয়ে যাক। সেখানে তুতুল আপনাকে ভালোবাসে তাজ ভাইয়া। সে কীভাবে চাইবে আপনার সন্তান আপনাকে ঘৃণা করুক ? আর আপনাকে ঘৃণা করে আপনাদের সন্তানও নিশ্চয়ই খুব ভালো থাকবে না। কোনো মা চাইবে তার সন্তান খারাপ থাকুক ?
তাজ এতকিছু ভেবে দেখেনি। তার শুধু মনে হয়েছে ধ্রুব যদি জানে সে তার বাবার হিংস্রতার ফল, তবে তাজ তাকে মুখ দেখাতে পারবে না। এসব চিন্তায় তাজ নিজের হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ঠিক ভুল বিচার করতে ভুলে গিয়েছিলো।
তাজ একহাতে জড়িয়ে নিলো আহানকে, এতবড় পাপ করা থেকে তুমি আজ বাঁচিয়েছো আমায়। তোমার এত ঋণ আমি কীভাবে শোধ করবো আহান, ভাই আমার ?
আহান মুচকি হেসে বললো, ভাইয়া বলে ডেকেছি আপনাকে। ভাইয়ের কাছে ভাইয়ের কীসের ঋণ ?
তাজ আহানকে ছেড়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। কে বলবে রায়হান আর আহান একই মায়ের পেটের দুই ভাই। দু’জন সম্পূর্ণ দুই মেরুর মানুষ। রায়হান হয়েছে তার বাবার মতো দূষিত মস্তিষ্কের আর আহান হয়েছে তার মায়ের মতো।
আহান ধ্রুবর গালে হাত রেখে কাঁপা গলায় বললো, আপনার আমানত আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম। বাবাইয়ের আঠারো বছর হলে সে তার মায়ের ডায়েরি পড়ে নাহয় ঠিক করবে আপনার কাছে থাকবে কিনা। এখন বরং আপনার কাছেই থাক।
আহান ভেজা চোখে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে। আহানের মনে হচ্ছে নিজের কলিজা ছিঁড়ে অন্যকারো হাতে তুলে দিয়েছে। ধ্রুবর কপালে চুমু খেয়ে কিছু বলতে চাইলো ধ্রুবকে কিন্তু গলা দিয়ে কথা বের হলো না।
তাজের উদ্দেশ্যে বললো, নিজের কলিজা ছিঁড়ে আপনার হাতে দিয়ে গেলাম।
আহান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তাজ বললো, ভাইয়া বলে ডেকেছো। ভাইয়ার কাছে থেকে যাওয়া যায় না ? মা তো পায়নি আমার ছেলেটা, দুই বাবার ভালোবাসা পেয়ে নাহয় বড় হোক।
আহান ঘুরে তাকালো না, আমি যেখানেই থাকি আমার সব ভালোবাসা থাকবে আমার বাবাইয়ের জন্য।
আহান দ্রুত বের হয়ে গেলো খান ভিলা থেকে। ন্যান্সি বারবার কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। তাজ আর আহানের কথার মাঝে ইরিনা, ন্যান্সি আর পাখি ছিল নিরব ভূমিকায়। সব শুনেছে তাই কিছু বলতে পারছে না ন্যান্সি। এদিকে পাখি ধ্রুবর জন্য কান্না করতে করতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। ধ্রুবকে ছাড়া যে পাখিরও এক মুহূর্ত চলে না। ন্যান্সি দুধের শিশুকে কোলেপিঠে করে এতবড় করেছে তারও বুকটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা তো মানতেই হবে ধ্রুব তাদের কাছে ছিলো আমানত হিসাবে। আহান বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, টপটপ নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে চোখ থেকে। অনেকগুলো বছর পর আবার হারানোর যন্ত্রণায় পুড়ছে আহান। জীবনের হিসাবের খাতা খোলে বসেছে সে। প্রথমে তুতুলকে হারালো সেই ছোটবেলায়, তারপর বাবা-মা থেকে দূরে চলে যেতে হলো, মাকে হারিয়ে ফেললো চিরতরে, ভাই তো থেকেও ছিলো না কখনো। আহানের আজ নিজেকে বড্ড একা লাগছে। আহান লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে পাখিকে দেখলো। এই পুতুলটা ছাড়া জীবনের প্রাপ্তির খাতায় আর কিছু পেলো না আহান। চোখদুটো ঝাপসা হলো আবার।
৩৫.
ছেলেকে নিজের হাতে রেডি করিয়ে দিচ্ছে তাজ। নিজের মতো ছেলেকেও সাদা পাঞ্জাবি পড়িয়ে মাথায় টুপি দিয়ে দিলো। আজকাল তাজ প্রায় সবসময় সাদা পড়ে আর ছেলেকেও পড়ায়। ছেলের হাত ধরে চললো মসজিদের উদ্দেশ্যে। এখন প্রতিটা সকাল এভাবেই শুরু হয় বাবা ছেলের।
মসজিদ থেকে এসে আবারও নিজের সাথে ম্যাচিং করে সাদা আর কালো রঙের কম্বিনেশনে জগিং সুট পড়িয়েছে ছেলেকে আর পায়ে সাদা কেডস। দেখে মনে হচ্ছে জুনিয়র তাজওয়ার খান তাজ। রেডি করিয়ে ছেলের কপালে আর দুই গালে চুমু খেলো তাজ।
মাশাআল্লাহ আমার ছেলেকে একদম প্রিন্স লাগছে। বাবাকে আদর দিবে না বাবার প্রিন্স।
ধ্রুব দাঁত বের করে হেঁসে বললো, দেবে তো।
ধ্রুব নিজের ছোট ছোট হাতদুটো তাজের দুই গালে রেখে কপালে আর দুই গালে চুমু খেলো।
তাজ ছেলেকে কোলে তুলে বললো, আমার সোনা বাবাটা৷ চলো এবার আমরা জগিংয়ে যাবো।
ধ্রুব কোলেই লাফিয়ে উঠে বললো, ইয়ে চলো।
তাজ ধ্রুবকে নিয়ে বাড়ির সামনে গার্ডেনে এক্সারসাইজ করতে লাগলো। ছোট্ট ধ্রুব বাবার সাথে দৌড়াদৌড়ি করছে। ধ্রুবকে পিঠে বসিয়ে পুশআপ করছে তাজ। এভাবেই ছেলের সাথে সব এক্সারসাইজ করছে তাজ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে ইরিনা খান। বাড়িটা এখন আর নিরবতায় ছেয়ে থাকে না এখন। ধ্রুব সবসময় মাতিয়ে রাখে বাড়ি। প্রথমদিকে ধ্রুবকে সামলানো কষ্ট হয়েছিলো তাজের। আহান, পাখি আর ন্যান্সির জন্য অনেক কান্না করতো। তাজ এক মুহূর্তের জন্য ছেলেকে কাছ ছাড়া করেনি। দেখতে দেখতে মাস পার হয়ে গেছে। ধ্রুব তাজের সাথেই হাসিখুশি থাকে, তাজকে ছাড়া কিছু বুঝে না। তবে আহান, পাখি আর ন্যান্সিকে খোঁজে মাঝে মাঝে। তখন তাজ বলে নিয়ে যাবে তাদের কাছে।
ইরিনা চলে গেলো ব্রেকফাস্ট বানাতে। ধ্রুবর খাবার ইরিনাকে নিজের হাতে বানাতে হয়। ধ্রুবর খাবার নিয়ে অন্যকারো উপর ভরসা করে না তাজ।
এক্সারসাইজ করে রুমে চলে এলো বাবা-ছেলে। একসাথে শাওয়ার নিয়ে নিলো। তাজ অফিসের জন্য রেডি হয়ে ধ্রুবকেও রেডি করিয়ে দিচ্ছে। স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে ধ্রুবকে। ধ্রুবও স্কুলে যেতে খুব আগ্রহী তার নতুন বন্ধু হয়েছে এখানে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে তাজ নিজে খাচ্ছে আর ধ্রুবকেও খাইয়ে দিচ্ছে। ইকবাল খান খাবার রেখে ছেলে আর নাতির দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ ধ্রুব বললো, তুমি খাচ্ছো না কেনো দাদাভাই ?
চমকে উঠলো ইকবাল খান। ধ্রুব তাকে যতবার দাদাভাই বলে ডাকে ইকবাল অনুশোচনার আগুনে পুড়ে। তিতিরের কথা মনে পড়ে যায়, কতই না ভুল বুঝেছিল মেয়েটাকে। ইকবাল ভাবে মেয়ের কদর করতে জানে না বলেই হয়তো আল্লাহ তাকে একটা মেয়ে দেননি।
ইকবাল দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, খাচ্ছি তো দাদাভাই। তো আজ ধ্রুব সোনা কার সাথে স্কুলে যাবে দাদাভাই নাকি দাদুমণি ?
ধ্রুব মিষ্টি হেসে বললো, দাদুমণির সাথে যাবো।
তাজ ধ্রুবর মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো, তুমি সোফায় গিয়ে বসো, বাবা এখনই আসছে। তোমাদের ড্রপ করে দিয়ে আমি অফিসে যাবো।
ইকবাল আর ইরিনা তাকালো তাজের দিকে, হঠাৎ লন্ডন কেনো ?
আহান আর পাখিকে ফিরিয়ে আনতে। ওরা ধ্রুবকে নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছে পাঁচটা বছর। ধ্রুবকে ছেড়ে ওদের কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা আমি বুঝতে পারছি। আমি চাই ওরা আমাদের সাথেই থাকুক, ধ্রুবর সাথেই থাকুক।
আহান তো এখানে থাকতে জানি হয়নি সেদিন।
আহান খুব আত্মসম্মান সম্পূর্ণ মানুষ। সে আমাদের বাড়িতে এভাবে থাকতে রাজি হবে না মা।
ইকবাল চিন্তত গলায় বললো, তাহলে ?
আমাদের বাড়ির সামনের বাড়ি শান্তিনিড় বিক্রি হবে। সেটা কেনার জন্য আমি এডভান্স করে দিয়েছি। আহান আমাদের বাড়িতে না থাকুক সামনের বাড়িটা কিনে সেখানে থাকবে। আগামীকাল গিয়ে আহানকে সবটা বুঝিয়ে বলে সাথে করেই নিয়ে আসবো।
ইকবার খাবার নাড়াচাড়া করে বললো, যদি না আসে ?
বাবা আহান ধ্রুবকে নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। ধ্রুবকে কাছে পেতে সে অবশ্যই আসবে।
৩৬.
ধ্রুবর একটা টেডিবিয়ার বুকে জড়িয়ে শুইয়ে আছে পাখি। তার মাথার কাছে বসে আছে আহান। তিতির চলে যাওয়ার পর পাখির পাগলামি যেমন বেড়েছিল, ধ্রুবকে রেখে আসার পর আবার পাখি তেমন হয়ে গেছে। আহানের নিজেকে অসহায় লাগে আজকাল। সে কোন মুখে তাজের কাছে ধ্রুবকে ফেরত চাইবে। সে তো নিজের ইচ্ছেতে ধ্রুবকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ধ্রুবকে ছাড়া আহানের নিজেরও তো অনেক কষ্ট হয় কিন্তু তার কষ্ট দেখার মতো কেউ কী আছে ? আহান একবার ভাবছে বাংলাদেশে ফিরে যাবে। তাজের বাড়িতে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে কিন্তু আশেপাশে থেকে ধ্রুবকে তো দেখতে পারবে যখন ইচ্ছে তখন। এই বাসাতে ধ্রুবকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসে সবার। ন্যান্সিও কেমন চুপচাপ নিজের কাজ করে, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। আহান কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
মাঝে একদিন কেটে গেলো, পাখি এখন কিছুটা সুস্থ। আহান সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজে ফ্রেশ হয়ে পাখিকেও ফ্রেশ করিয়ে দিলো। ওয়াশরুমে ধ্রুবর ছোট্ট ব্রাশটা দেখে বুকের ভেতরে জ্বালাপোড়া বাড়লো আহানের। পাখিকে বেডে বসিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলো আহান আর ভাবতে লাগলো ধ্রুবর কথা। কেমন আছে ছেলেটা ? ফোনেও কথা বলার সাহস হয় না আহানের। ছেলেটাকে দেখে বা তার আওয়াজ শুনে নিজেকে সামলাতে পারবে কিনা বুঝতে পারে না। তাই কল করতে গেলেও ফোনটা রেখে দেয় আর তাজ দিলেও ধরে না।
আহান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পানির গ্লাস টেবিল থেকে নিতে যাবে তার আগেই কেউ আহানের চোখ চেপে ধরে। পাখি চোখ বন্ধ করে আছে তাই সেও দেখতে পায়নি। আহানের এই কোমল স্পর্শ খুব ভালো করে চেনা। আহান নিজের চোখের উপর রাখা ছোট ছোট হাতের উপর নিজের কাঁপা হাতটা রাখলো আলতো করে।
দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো তাজ আর ন্যান্সি। ন্যান্সির চোখ দু’টো ভেজা। সকালবেলা গোমড়া মুখে ব্রেকফাস্ট করছিলো সে। ধ্রুব নেই আর পাখি অসুস্থ বাসাটা তার কাছে মরা বাড়ি মনে হচ্ছিল। তখনই কলিংবেল বেজে উঠলে বিরক্তি নিয়ে দরজা খোলে দেখে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টি হেসে আর তার পেছনে তাজ। ন্যান্সি চিৎকার করতে গেলে তাজ আর ধ্রুব নিজেদের ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চুপ থাকতে ইশারা করে। এদিকে আহান অন্যমনস্ক থাকায় কলিংবেলের আওয়াজ খেয়ালই করেনি। আহান হাতের প্লেটটা রেখে ধ্রুবকে ছুঁ মেরে কোলে তুলে নিলো। বুকের সাথে মিশিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো আর তার বন্ধ চোখের কোণে জমা হলো আনন্দঅশ্রু।
সমুদ্র সৈকতে সাদা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী। শীতল বাতাসে শাড়ীর আঁচল বাধাহীন হয়ে উড়ছে। তাজ মুচকি হেসে পেছনে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গেলো সেই রমণীর দিকে।
তুমি সবসময় সাদা কেনো পড়ো মুসকান ?
হকচকিয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে তাজকে দেখে আবার সামনে তাকলো তিতির, সাদা আমার বাবার প্রিয় রং ছিলো। সাদা রংটা আমার সাথে থাকলে মনে হয় বাবাও আমার সাথেই আছে।
তাজ এবার সামনে তাকালো, বাবাকে খুব ভালোবাসতে বুঝি ?
পানি এলো তিতিরের চোখে, হুম।
তাজ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, চলো সামনে হাঁটি।
তাজের কথায় তিতির সম্মতি জানিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো।
হাঁটতে হাঁটতে তিতির বললো, আপনার তো শুটিং আছে স্যার।
তাজ বিরক্ত বোধ করলো, এতো কাজ কাজ করে আর ভালো লাগে না। এই মুভির হিরোইন মিস রোমানা খুব গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে। এমন মেয়ের সাথে কাজ করতে হচ্ছে, ভেবেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। কন্ট্রাক্ট করায় কিছু বলতেও পারছি না, লাস্ট মুহূর্তে এসে হিরোইন কেনো চেঞ্জ করলো বুঝতে পারছি না।
তাজের কথায় তিতির আড়ালে মুচকি হাসলো, রোমানা ম্যাম তো খুব ভালো অভিনয় করে।
উনি আপনার কো-অ্যাক্টর। আপনি যেহেতু আমার স্যার তাহলে উনি তো ম্যামই হবেন।
আমি তোমার স্যার হলেও আমার আশেপাশের কেউ তোমার স্যার বা ম্যাম নয়। কথাটা আজ ভালো করে শুনে নাও আর কখনো যেনো এদের স্যার বা ম্যাম বলতে না শুনি।
তিতির মাথা নাড়িয়ে বললো, ওকে স্যার।
তাজ মুচকি হেসে বললো, গুড।
আবার কিছুটা সময় নিরবতায় পাশাপাশি হাঁটতে লাগলে হঠাৎ তাজ বললো, বুঝলে মুসকান তোমার হাসবেন্ড অনেক লাকি হবে।
তাজের কথায় লজ্জায় লাল হলো তিতিরের মুখ, কেনো স্যার ?
তাজ একটু শব্দ করে হেসে বললো, এই যে তুমি কথা কম বলো তাতে তোমাদের ঝগড়া হবে কম। মেয়েদের ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদার স্বভাব, সেটাও তোমার নেই। তোমার পিছনে তোমার হাজবেন্ডকে মেকআপ খরচ করতে হবে না, গাদা গাদা শপিং করতে হবে না। উফফ আমার এসব ভাবতেই তোমার ফিউচার হাসবেন্ডের উপর হিংসা হচ্ছে।
তাজের কথা শুনে তিতির লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
তাজ তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললো, একি মুসকান তুমি তো দেখি লজ্জা লাল নীল হয়ে যাচ্ছো।
তাজ কথা শেষ করে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। তিতির মাথা নিচু করে লজ্জায় মুচকি হাসছে, তাজ দেখতে পেলো না সেই হাসি। দেখতে পেলে হয়তো বলতো তোমার মুসকান নাম সার্থক। হঠাৎ পায়ের নিচে কিছু তীক্ষ্ণ অনুভব করলে তিতির আউচ বলে উঠে।
তাজ ব্যস্ত গলায় বললো, কী হলো মুসকান ?
স্যার, পায়ে কিছু ফুটলো মনে হয়।
তাজ হাঁটু গেড়ে বসলো তিতিরের সামনে, কোথায় দেখি ?
তিতির ছিটকে একটু পিছিয়ে গেলো, কী করছেন স্যার ?
তাজ গম্ভীর গলায় বললো, দেখাও বলছি।
তাজ সবসময় হাসিখুশি থাকে তাই তার গম্ভীর গলায় ভয় পায় তিতির। কথা না বাড়িয়ে শাড়ি একটু উঁচু করে পা দেখালো।
তাজ কিছু না ভেবে তিতিরের পা নিজের হাঁটুর উপর নিলো। তিতির কেঁপে উঠলো তাজের স্পর্শে, নিজের ব্যালেন্স রাখতে তাজের কাঁধে হাত রাখলো।
তাজ কণ্ঠের গম্ভীরতা বজায় রেখে বললো, তুমি খালি পায়ে সমুদ্র সৈকত কেনো এসেছো তিতির ? জানো না সৈকতে অনেক মরা শামুক থাকে। এখন গেলো তো পা কেটে।
তাজ যখন ভালো মুডে থাকে তিতিরকে তখন মুসকান বলে ডাকে আর যখন রেগে থাকে তখন তিতির বলে। তাই তিতির বুঝতে পারলো তাজ রেগে গেছে।
আমতা আমতা করে বললো, আসলে স্যার সমুদ্র সৈকতে বালির উপর খালি পায়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছিলো।
তাজ নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে তিতিরের পায়ে বেঁধে দিলো, নাও এবার হয়েছে ইচ্ছে পূরণ। এখন চলো ডক্টরের কাছে, শামুক ভেঙে ভেতরে ঢুকে আছে কিনা কে জানে।
তিতির কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যাথা করছে খুব কিন্তু তাজের ভয়ে মুখে বলতেও পারছে না। নিজের বোকামির উপর নিজের রাগ হলো। তিতির যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত তখনই তাজ তিতিরকে কোলে তুলে নিলো।
চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তিতিরের, কী করছেন স্যার ?
অনেকটা কেটেছে হাঁটতে পারবে না আর যদি শামুক ভেঙে ভেতরে ঢুকে থাকে তাহলে হাঁটলে আরো ভেতরে চলে যাবে।
তাজ হয়তো দায়িত্ববোধ থেকে এসব করছে তবু তিতির লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে, অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার ৷ শেষে কিনা স্যারের কোলে উঠতে হলো তাকে।
তাজ বললো, এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু হয়নি। একজন অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করছি মানুষ কিছু মনে করবে না।
স্যার এভাবে আমাকে আর আপনাকে একসাথে কেউ দেখলে মুখোরোচক নিউজ বানাবে।
কেনো আমাকে চেনা যাচ্ছে বুঝি ?
এতক্ষণে তিতিরের খেয়াল হল তাজ একটা হুডি পড়েছে আর মুখে মাস্ক লাগানো। সে চিনলেও অন্যকারো চেনার উপায় নেই তাজকে।
তাজ ভ্রু নাচিয়ে বললো, আমি তোমার মতো মাথামোটা নই মিস রোবট।
তাজ তিতিরকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলে ডক্টর দেখে বললো শামুক ভেঙে ভেতরে ঢুকে আছে। তাজ পাশে দাঁড়িয়ে রইলো আর ডক্টর শামুক বের করার জন্য তুলো দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করছে। ভাঙা অংশ বের করতে গেলে তিতির চোখমুখ কুঁচকে তাজের হাত খামচে ধরে। তিতিরের হাতে লম্বা লম্বা নখ রাখা না থাকলেও যেটুকু আছে তাজের হাতে ডেবে গেলো। তিতিরকে কিছু না বলে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করলো তাজ। ড্রেসিং শেষে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার পর তাজের হাতের দিকে খেয়াল গেলো তিতিরের।
তিতির মাথা নাড়িয়ে বুঝালো করছে না ব্যাথা। আসলে তাজের হাত দেখে তিতির নিজের ব্যাথার কথা ভুলে গেছে। তাজ ডক্টরের থেকে একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নিলো নিজের হাতে। বাকি সময় তিতির আর স্বাভাবিক হতে পারলো না। বারবার চোখ চলে যেত তাজের হাতের দিকে আর ভয়ে জড়সড় হয়ে যেত।
৩১.
মাথায় কোমল হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙলো তাজের। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলো তার মাথার কাছে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে।
তাজকে তাকাতে দেখে বললো, তুমি এখানে ঘুমিয়ে আছো কেনো বাবা ?
তাজ খেয়াল করে দেখলো সে তিতিরের কবরের উপর ঘুমিয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে তখন এলোমেলো পায়ে এখানে এসে শুয়ে পড়েছিলো। কখন ঘুমিয়ে পড়লো বুঝতে পারেনি। ঘুমের মাঝে চোখে ভাসছিল তিতিরের সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত। তাজ উঠে এলো সেখান থেকে। ধ্রুবকে কোলে তুলে নিলো।
তুমি এখানে এসেছো কেনো বাবা ? সামনে পুকুর যদি কোনোভাবে পড়ে যেতে।
আমি তো সুইমিং জানি বাবা। আমি আর পাপা কতবার সুইমিং কম্পিটিশন করেছি তুমি জানো ? পাপা সবসময় হেরে যায়।
কথাটা শেষ করে ধ্রুব খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। তাজ মুগ্ধ হয়ে দেখছে সেই হাসি। তিতিরের হাসিমুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাজের, হয়তো তিতিরের হাসিও এমন নির্মল ছিলো। তাজ ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে মাথায় চুমু খেলো। তাকালো হাতের ডায়েরির দিকে। এখনো অনেকটা পড়া বাকি থেকে গেছে। পুরোটা পড়তে হবে তাকে।
তাজ পুকুরের এপাশে সেই সিঁড়ির কাছে এসে ধ্রুবকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো, বাবা তুমি মাম্মামের সাথে খেলো গিয়ে।
ধ্রুব মুচকি হেসে বললো, আমি তো মাম্মামের সাথে লুকোচুরি খেলছি। আমি এখানে লুকিয়ে আছি মাম্মামকে বলো না কিন্তু।
ধ্রুবর হাসি দেখে তাজের ঠোঁটে হাসি ফোটে উঠলো। তাজের হাসি কান্না সব এখন এই নিষ্পাপ মুখেই নিবদ্ধ।
এই তো পেয়ে গেছি ধ্রুবকে। এবার আমি লুকাবো তুমি খুঁজবে।
তাজ আর ধ্রুব সামনে তাকিয়ে দেখলো পাখি দাঁড়িয়ে হাত তালি দিচ্ছে আর এসব বলছে। ধ্রুব ধরা পরে গিয়ে গাল ফুলালো। তবে কিছু না বলে পাখির সাথে চলে গেলো। তাজ সেদিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে ডায়েরি খুললো আবার।
আমার জীবনের সুখের সময়কাল বরাবরই খুব কম হয়। বেশ তো কাটছিলো আপনার সাথে আমার দিনগুলো। তখন চাকরির প্রায় দেড় বছর পার হয়ে গেছে। আপনার কেবিনে সোফায় বসে কাজ করছিলাম আমি। তখনই কেউ নক করলো দরজায়৷ আপনার মনে আছে সেইদিনের কথা ?
আপনি বললেন, কাম ইন।
ঝড়ের বেগে কেউ প্রবেশ করে জাপ্টে ধরলো আপনাকে। আমার হাত থেকে ফাইল পরে গেলো। সেটা কে ছিলো মনে আছে ? মৌ আপু ছিলো সেটা। গত দেড় বছর ধরে আমার একটু একটু করে সাজানো ভালোবাসা একটা দমকা হাওয়ায় সব এলোমেলো হয়ে গেলো। গত দেড় বছরে আপনি মৌ আপুর নামটা পর্যন্ত বলেননি আমাকে। আপনার বুকে মৌ আপু আর আমি সামনে বসে দেখছি আপনাদের। উফফ সে কী নিদারুণ কষ্ট। বুকের ভেতর যেনো কেউ কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আমি তোমাকে কতটা মিস করেছি জানো তাজ ? আমার ফোনটাও ঠিকমতো রিসিভ করো না তুমি।
আপনি নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলেন মৌ আপুকে, মৌ ব্যস্ত থাকি আমি। তুই দেশে ফিরলি কবে ?
এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি।
এতক্ষণে মৌ আপুর নজর পরে আমার দিকে, টলমলে চোখে আমি তখন তাকিয়ে আছি আপনাদের দিকে।
এটাই তো তিতির, তাই না তাজ ? এই মেয়েটার কথাই তো বলতে ফোনে। ভারি মিষ্টি তো দেখতে মেয়েটা।
আপনি আমার কথা মৌ আপুকে বলতেন সেটা শুনে অবাক হওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না আমি। আমি তো যন্ত্রণায় ছটফট করতে ব্যস্ত।
আপু এগিয়ে এলেন আমার দিকে, হাই আমি মৌমিতা রহমান তাজের ফিয়ন্সে।
আপনি কপাল কুঁচকে তাকালেন আপুর দিকে, মৌ আমি কিন্তু এখনো মত দেইনি।
আপু মুচকি হেসে বললো, আজ বা কাল তোমার এই মৌকেই বিয়ে করতে হবে।
এটাই শোনার বাকি ছিলো। কতটা কষ্টে নিজের চোখের পানি আঁটকে রেখেছিলাম সেটা হয়তো আমি জানি আর জানে আমার উপরওয়ালা। আমি আপুর সাথে সৌজন্যমূলক কথা বলে বের হয়ে আসি আপনার কেবিন থেকে। ওয়াশরুমে গিয়ে কষ্টগুলো মুক্ত করে দেই চোখের পানিতে। তারপরের দিনগুলো বদলে গেলো। আমি আবার হাসতে ভুলে গেলাম। নিজেকে বুঝাতে লাগলাম আপনার পাশে মৌ আপুর মতো কাউকেই মানায়, আমার মতো কোনো এতিমকে নয়। তবু খুব কষ্ট হতো আপনার পাশে আপুকে দেখে। যে আমি আপনার পাশে হিরোইন সহ্য করতে পারতাম না, যেখানে জানতাম সব সাজানো সেখানে আপুকে মানতে হতো সবটা সত্যি জেনেও।
আপনাদের বিয়ের পাঁচদিন আগে জানতে পারি বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে। প্রথমে একটু কষ্ট হয়েছিলো, ততদিনে নিজেকে অনেকটা সামলে নিলেও প্রথম ভালোবাসা তো তবু কষ্ট হয়েছিলো। নিজেকে সামলে নিলাম, ততদিনে এটুকু বুঝেছি মৌ আপুও আপনাকে ভালোবাসে। মানুষ হিসাবেও অনেক ভালো, আপনার জন্য পারফেক্ট। আপনি তো আমার না ছুঁয়া স্বপ্ন তাই হাসিমুখে মেনে নিলাম সবটা। কিন্তু কী নিষ্ঠুর আপনি, আমাকে সাথে নিয়ে গেলেন বিয়ের শপিং করতে। আমাকে কষ্ট দিয়ে বুঝি আপনার আনন্দ হচ্ছিল। আমিও কষ্ট গিলে স্বাভাবিক থাকার নাটক করে যাচ্ছিলাম। আপনি যে মৌ আপুকেও ভালোবাসতেন না, ততদিনে সেটাও বুঝে গিয়েছিলাম। আমার প্রতি আপনি যতটা যত্নশীল ছিলেন আপুর প্রতি তো তাও ছিলেন না। আপনি সত্যি ভালোবাসতে জানেন না কিন্তু আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য করতে পারেন। আপনি কী সুন্দর একটা হলুদের শাড়ি কিনে দিলেন আমাকে, আপনার হলুদে পড়ে যাওয়ার জন্য। আচ্ছা হৃদয় পোড়ার গন্ধ আপনি একটুও পাননি।
ডায়েরি বন্ধ করলো তাজ। এসব পড়তে তার কষ্ট হচ্ছে, প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। অনুভব করতে পারছে সেই প্রতিটা মুহূর্ত।
সেদিন শপিংয়ে গিয়ে তাজেরও কষ্ট হচ্ছিল অজানা কারণে। মৌকে রেখে বারবার মন চলে যাচ্ছিল তিতিরের দিকে। মনে হচ্ছিল সে মৌকে নয় তিতিরকে চায় নিজের জীবনে। কিন্তু পরক্ষণে নিজেকে শাসিয়ে বললো তিতিরের তার সাথে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। তিতিরকে নিজের জীবনে জড়ালে এই সমাজ কী বলবে ? সবাই বলবে সুপারস্টার তাজওয়ার খান তাজ নিজের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট কে বিয়ে করেছে। তার ক্যারিয়ারের জন্য সেটা ভালো কিছু হত না। হ্যাঁ তাজ নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে স্বার্থপর হয়েছিলো সেদিন। ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে নিজের মনকে পাথর তৈরি করেছিলো। সে চেয়েছিল তিতির তার বিয়েতে না আসুক। আসলে হয়তো শেষমেশ নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না। আবার শাড়িটা দেখে মনে হয়েছিলো কেমন লাগবে তিতিরকে সাদার পরিবর্তে এই হলুদ সবুজ কম্বিনেশনের শাড়িটাতে। শাড়িটাতে তিতিরকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। নিজের অনুভূতিতে এলোমেলো হয়েছিল তাজ সেদিন। যতবার তিতিরের কথা মনে পড়েছে নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে মনটাকে দমিয়ে রেখেছে।
তাজ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আবার ডায়েরি খোলে পড়তে লাগলো।
প্রায়দিন আপনি আমাকে আমার বাসার সামনে নামিয়ে দিতেন। কিন্তু শপিং শেষে আপনি আমাকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে মৌ আপুর সাথে চলে গেলেন। আপনি একবার পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেলেন ভেজা চোখে তাকানো তিতিরকে। তখন মনে হয়েছিলো এর থেকে বোধহয় মৃত্যু যন্ত্রণা কম হবে। পরক্ষণে চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার অবুঝ বোনুটার মুখ। আমাকে যে বাঁচতে হবে, মরে গিয়েও বাঁচতে হবে। আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে আরো একটা জীবন। নিজেকে সামলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ভাবলাম আপনার বিয়ের জন্য অফিশিয়াল কাজের চাপ কম। বোনুকে কয়েকদিন অনেক সময় দিতে পারবো। এসব ভেবে নিজেকে শান্ত করেছিলাম।
মানুষ যা ভাবে সবসময় সেটা হয় না। নিয়তি হয়তো অন্যরকম ছিলো। বাসায় গিয়ে দেখলাম আমার প্রাণভোমরা নেই। কাউকে কল দেওয়ার আগেই আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। রায়হান চৌধুরী নিয়ে গেছে আমার বোনুকে। তার কথামতো কাজ না করলে প্রায় ষোল বছর যাকে বুকে আগলে বড় করেছি তার ছোট ছোট টুকরো করে আমাকে উপহার দিবে। বিশ্বাস করুন সেদিন যদি আমার বোনুর জীবনের ঝুঁকি না থেকে আমার জীবনটা কেউ চাইতো তবু আপনার ক্ষতি করার কথা ভাবতাম না। নিজের জীবন দিয়ে হলেও আপনার ক্ষতি আটকাতাম। কিন্তু এক ভালোবাসার জন্য আরেক ভালোবাসার কোরবানি দিতে পারিনি আমি। তাই রায়হান চৌধুরীর হাতের পুতুল হয়ে চলে গেলাম আপনার চরম ক্ষতি করতে। আপনি সবসময় আমাকে রোবট বলতেন। সেদিন সত্যি রোবটে পরিণত হয়েছিলাম আমি। কিন্তু সে রাতে আপনার হিংস্র আচরণ আমি মেনে নিতে পারিনি মন থেকে। দু’বছরের আগলে রাখা ভালোবাসার মানুষের থেকে কোনো মেয়ে এমন হিংস্রতা মেনে নিতে পারবে না। আপনি আমায় ধ*র্ষ*ণ করেছিলেন তাজ, ধ*র্ষ*ণ। তার জন্য আপনাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না। অন্যভাবেও শাস্তি দিতে পারতেন, মারধর করতে পারতেন। তবে আপনার অন্যায় মেনে নিতে না পারলেও আপনাকে ঘৃণা করতে পারিনি। বরং আপনি আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন। আপনার মনে যেদিন থেকে আমার প্রতি ঘৃণা জমা হতে শুরু করেছে, সেই ঘৃণা আমার আসক্তিতে পরিণত হয়েছে৷ কারণ ঘৃণা আর ভালোবাসা দু’টো জিনিসই মানুষ মনের গভীরে জায়গা দেয়। ভালোবাসা যতটা গভীর হয় ঘৃণা তার থেকেও বেশি গভীর হয়। আপনার মনে আমার জায়গা হয়েছে, হোক না ঘৃণা হিসাবে তবু আমি খুশি। আপনার ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি তাই আপনার ঘৃণাই কবুল। আপনার ঘৃণা বারবার দেখতে চাওয়া আমার আসক্তিতে পরিণত হয়। আপনার ঘৃণা এই বিষাক্তফুলের আসক্তি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই আসক্তি থেকে মুক্তি পাইনি আমি।
আপনার ভাষ্যমতে আমি একটা বিষাক্তফুল আপনার জীবনে। আপনার জীবন থেকে শুধু কেড়ে নিয়েছি, কিছু দিতে পারিনি। আজ আবারও একটা জিনিস কেড়ে নিলাম আপনার থেকে। আপনার শান্তির ঘুম, আপনি আমাকে ধ*র্ষ*ণ করেছিলেন। এই একটা বাক্য আজ থেকে আপনাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিবে না। তাহিয়ান খান ধ্রুব আপনার ছেলে, আমাদের ছেলে। ওর দিকে তাকালে আপনি শান্তির শ্বাস নিতে পারবেন না। কারণ আপনার সেই হিংস্রতার ফল ধ্রুব। আপনি যতবার ওর দিকে তাকাবেন আপনার মনে পড়বে আমার প্রতি করা আপনার হিংস্রতা। আপনার হয়তো আক্রোশ হয়েছে আমি কেনো আপনাকে ধ্রুবর কথা জানায়নি। এটা কী সত্যি জানানোর মতো বিষয় ছিলো ? ধ্রুব যদি আপনার আমার ভালোবাসার ফল হত তাহলে আপনি জানার অধিকার রাখতেন। ধ্রুবর অস্তিত্ব সম্পর্কে যখন আমি জানতে পারি তখন আপনার মনে আমার জন্য আকাশ সমান ঘৃণা। কে জানে ধ্রুবকে মেনে নিতেন কিনা ? হয়তো তাকেও ঘৃণা করতেন। সেটা একজন মা হয়ে কীভাবে হতে দিতাম আমি ? পৃথিবীর সবাই আমাকে ঘৃণা করুক আমি হাসিমুখে মেনে নিবো কিন্তু আমার অনাগত সন্তানকে তারই পিতা ঘৃণা করবে সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি না। আপনার জীবনের বিষাক্তফুল ছিলাম আমি এরপর হয়তো আমার সন্তান হতো। সারাজীবন আপনার মনে হতো এই সন্তান আপনার সুখের জীবনের বাঁধা। সেটা মা হয়ে কীভাবে মেনে নিতাম আমি ? কথাগুলো লিখতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। ভাগ্য ভালো মুখে বলতে হয়নি। আমি চাইনি আমি কিংবা আমার সন্তান আপনার সুখের বাধা হোক। কিন্তু আজ যখন ধ্রুবকে ফেরত চাইছেন। নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রী ধ্রুবকে মেনে নিতে রাজি হয়েছে। তাই আপনাকে ফেরাবো না আমি। ধ্রুবর আঠারো বছর পূরণ হলে সে সব জানবে। তখন একমাত্র ও চাইলেই আপনি ওকে ফিরে পাবেন তার আগে নয়। এই অধিকারও আপনার থেকে কেড়ে নিলাম আমি। আমি সত্যি আপনার জীবনের বিষাক্তফুল আর এই বিষাক্তফুলের আসক্তি আপনি। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনাতে আসক্ত ছিলাম আমি। ভালোবাসি তাজ, আমার ভালোবাসাও বিষাক্ত তাই শুধু কষ্টই পাবেন আমার থেকে। বিষে শান্তি খোঁজা যে বোকামি, অনেক বড় বোকামি, বিষ কেবল কষ্ট দিতে জানে।
ডায়েরির শেষ পাতায়ও তিতির তাজের জীবনের বিষাক্তফুল প্রমাণিত হল। তাজের চোখের কোণ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। তাজ তিতিরের ডায়েরি শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখলো।
তোমার শাস্তি আমি মাথা পেতে নিলাম মুসকান। তবে সে রাতে প্রথমদিকে রাগে হিংস্রতায় তোমাকে কাছে টেনে নিলেও পরে ভালোবেসেই আপন করেছিলাম। ঘোরের মাঝে রাগ, প্রতিশোধ সব ভুলে গিয়েছিলাম। সেটা হয়তো তুমি উপলব্ধি করতে পারোনি যেমন আমি নিজের কাছে স্বীকার করতে পারিনি সেদিন। তোমাকে আমি ভালোবাসি সেটা স্বীকার করতে চাইনি তাই এটাও মানতে পারিনি আমি তোমাকে ভালোবেসে আপন করেছিলাম। গত ছয়টা বছর আমি অনুতাপের আগুনে পুড়েছি। এই কষ্ট নিয়ে আরো তেরো বছর ধরে অপেক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি হয়তো ভেবেছো মৌকে বিয়ে করে সুখের সংসার করছি আমি। কিন্তু মুসকান তুমি ভুল, তুমি ভুল।
৩২.
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে রায়হান। হাতে মৌয়ের হ্যাপি ফ্যামিলির ছবি। শান মৌয়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে আছে আর মৌ নিজের কোলের শায়িনীকে।
রায়হান মুখের ধোঁয়া ছবিটার উপরে ছাড়লো, সবার জীবন এলোমেলো করে দিয়ে তুই সুখের সংসার করছিস এটা কীভাবে মেনে নেই বল তো মৌ ? তুই আদৌও তাজকে ভালোবাসতি তো ? যদি ভালোবেসে থাকিস তবে এতো সহজে অন্যের সংসার কীভাবে করছিস ? আমি তো পারিনি তোকে ভুলে অন্য কাউকে নিয়ে জীবন সাজাতে। তাজ বলে তুই আমার ভালোবাসা নয় বরং জেদ। তবে তুই যদি নিজের ভালোবাসা ভুলে অন্যের সাথে সুখের সংসার করতে পারিস তবে আমি কেনো নিজের জেদ ভুলে অন্য কাউকে নিয়ে জীবন সাজাতে পারলাম না। হিসাব টা কিছুতেই মিলাতে পারি না রে মৌমাছি। তবে এবার হিসাব মিলবে, তুই মিলাবি।
স্যার মেয়েটা আয়ার কাছে থাকে ম্যাম হসপিটালে চলে যাওয়ার পর।
রকি আমি শুধু মেয়েটাকে আমার সামনে চাই। সেটা তুই কীভাবে করবি আমি জানি না।
রায়হান ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার সিগারেটে টান দিতে ব্যস্ত। জেল থেকে পালিয়েছে রায়হান। সারা শহরের পুলিশ তাকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে। রায়হান হসপিটালে ভর্তি ছিলো, সেখান থেকেই পালিয়েছে।
মৌ নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করে বের হয়ে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
আজ সকাল থেকে মেয়েটা কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলো না। তাকে শান্ত করে বের হতে লেইট হয়ে গেছে মৌয়ের। শান রাতে ইমারজেন্সি হসপিটালে গেছে বাসায় ফিরেনি আর। দুপুরের দিকে বাসায় ফিরে যাবে, শায়িনী ততক্ষণ রেখার কাছেই থাকবে। রেখা মেয়েটা অনেক আগে থেকেই শানদের গ্রামের বাড়িতে থাকতো শানের বাবা-মার সাথে। শান বিয়ের পর মৌকে নিয়ে বাসায় উঠলে শানের মা রেখাকে শানের বাসায় রেখে গেছে মৌয়ের সাহায্যের জন্য। রেখাকে অনেক ভরসা করে সবাই, তাই শায়িনীকে রেখার কাছে রেখে নিশ্চিন্তে থাকে মৌ। হসপিটালে পৌঁছে মৌ জানতে পারলো শান ওটিতে আছে, সেটা শেষ করে বাসায় চলে যাবে আবার বিকেলে হসপিটাল আসবে। মৌ নিজের চেম্বারে গিয়ে রোগী দেখতে লাগলো।
রেখা শায়িনীকে নিয়ে খেলছে, মৌ চলে গেলে শায়িনীকে নিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কোনো কাজ থাকে না। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে রেখা ভাবলো শান এসেছে।
কিছু না ভেবে দরজা খোলে দেখলো অচেনা লোক, কে আপনি ?
অচেনা ব্যক্তি রেখার কোলে শায়িনীর দিকে তাকালো, এটা কী ডক্টর মৌ আর ডক্টর শানের বাসা ?
লোকটাকে সুবিধার মনে হচ্ছে না রেখার তাই ভয়ে ভয়ে বললো, হ্যাঁ কিন্তু আপনি কে ?
লোকটা আর কিছু না বলে রেখার মুখে কিছু স্প্রে করে দিলো। চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলো রেখা। কোলে থাকা শায়িনীর বাঁধন আলগা হতে লাগলো।
ড্রয়িংরুমে খেলছে ধ্রুব আর তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাজ। আর মাত্র কিছুটা সময়, দুপুরের ফ্লাইটে সবাইকে নিয়ে লন্ডন ব্যাক করছে আহান। তাজ ধ্রুবকে দেখে নিজের চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে। তাজ কী করতে চাইছে বোঝার উপায় নেই। আহানকে সে একবারও বলেনি ধ্রুবকে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে কিংবা এটাও বলেনি বাংলাদেশে থেকে যেতে। সে তিতিরের শাস্তি মেনে নিয়েছে। তবে এভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে। মনে মনে সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা একমাত্র সেই জানে।
ফোনের আওয়াজে হুঁশ ফিরলো তাজের। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো সবুজের নাম্বার। সবুজকে তাজ সাত দিনের ছুটি দিয়েছে। যদিও সবুজ যেতে চায়নি তবু জোর করে পাঠিয়েছে তাজ। তাজ নিজের ছেলে সাথে থেকেছে গত পাঁচদিন আর সবুজকে তার ছেলের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
কল রিসিভ করলো তাজে, হ্যাঁ বলো সবুজ।
সবুজ অস্থির গলায় বললো, স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে।
তাজের কপালে ভাজ পড়লো, কী হয়েছে ?
স্যার রায়হান চৌধুরী অসুস্থ ছিলো তাই তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু হসপিটাল থেকে পালিয়ে গেছে সে।
তাজ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো, হোয়াট ?
সবুজ ভয়ে ঢোক গিললো, জী স্যার।
আমি আজই ঢাকায় ফিরছি ফ্লাইটে, তুমিও দ্রুত চলে এসো।
কল কেটে ফোন পকেটে রেখে দিলো তাজ। রায়হান আবার কোন ধ্বংসের খেলায় মেতেছে ভাবতেই ভয় হলো তাজের। তাজ তাকালো ধ্রুবর দিকে, তিতিরকে সে নিজের জীবনে ধরে রাখতে পারেনি কিন্তু ধ্রুবকে সে কিছুই হতে দিবে না।
পানির গ্লাস হাতে ড্রয়িংরুমে এসে তাজকে চিন্তিত দেখে আহান বললো, কী হয়েছে তাজ ভাইয়া ?
তাজ গম্ভীর আওয়াজে বললো, রায়হান জেল থেকে পালিয়েছে।
আহানের হাতে থাকা কাঁচের গ্লাস ফ্লোরে পরে ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেলো ঝন ঝন আওয়াজ তুলে, হোয়াট ?
তাজ বললো, তুমি দ্রুত সবাইকে নিয়ে লন্ডন ফিরে যাও। আমি চাই না রায়হান আর কারো কোনো ক্ষতি করুক।
না ভাইয়া, আমি এবার আর পালাবো না। ভেবেছিলাম রায়হান চৌধুরীর মুখোমুখি আর কোনোদিন হবো না। কিন্তু এবার আমাকে তার মুখোমুখি হতে হবে, তার কাছে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি।
আহানের গলা গম্ভীর শুনালো। তাজ একবার আহানের দিকে তাকিয়ে আবার ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুব ভাঙা কাঁচের দিকে তাকিয়ে আছে আর তার দিকে তাজ, আহানের দৃষ্টি।
কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে পেছনে ফিরে তাকালো তাজ, আহান দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। সেদিন আহানও তো কেঁদেছিল, এভাবেই কেঁদেছিল তুতুলকে হারিয়ে।
নিজেকে সামলান তাজ ভাইয়া। এভাবে কাঁদলে কী তিতির ফিরে আসবে ? আসবে না, আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। আসলে প্রবলেমটা কোথায় জানেন ? আমরা মানুষরা নিজের কাছের জিনিসটার মূল্য দিতে জানি না। যখন সেটা চিরতরে হারিয়ে যায় তখন তার মূল্য বুঝে হাহাকার করতে থাকি।
আহানের কথায় তাজের চোখের পানির পরিমাণ বাড়লো বই কমলো না। বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো ধ্রুবকে।
আহান ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললো, ভেতরে চলুন বাইরে অনেক ঠান্ডা পড়েছে। ধ্রুবর ঠান্ডার প্রবলেম আছে।
তাজ তাকালো ঘুমন্ত ধ্রুবর দিকে। এই মুখটার দিকে যতবার তাকাচ্ছে ততবার বুকটা পোড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে তাজের। তাজ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে আহান তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। তাজ এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো বাড়ির দিকে। আহান তাকালো তিতিরের দিকে।
ধরা গলায় বললো, তুতুল তুই সত্যি খুব বেশি স্বার্থপর। এতগুলো মানুষের চোখের পানি তোর হৃদয় একটু নাড়াতে পারলো না।
কথাগুলো তিতির শুনতে পেলে হয়তো বললো, রাতের পর রাত আমার কান্নার আওয়াজ তো কেউ শুনতে পায়নি আহু। আমার চোখের পানিগুলো তো বরাবর সবার কাছে নাটক মনে হয়েছে। আমার আত্মচিৎকার তো পারেনি কারো হৃদয় স্পর্শ করতে। তবু দিনশেষে স্বার্থপর উপাধিটা কেনো আমার জন্যই থেকে যায় ? সত্যি কী স্বার্থপর শুধু আমি একাই ছিলাম ? মৌ আপু তাজকে ভালোবেসে রায়হানের সাথে অন্যায় করেও সে স্বার্থপর হয়নি। রায়হান মৌকে ভালোবেসে একটা নোংরা খেলা খেলে সবার জীবন এলোমেলো করে সেও স্বার্থপর হয়নি। অন্ধের মতো শুধু নিজের ক্যারিয়ারের দিকে দৌঁড়ে স্বার্থপর হয়নি তাজও। স্বার্থপর শুধু তিতির কারণ এই জীবন গল্পে বিষাক্তফুলের নাম যে তিতির। এই বিষাক্তফুল তার স্বার্থপরতার শাস্তি পেয়ে গেছে, এবার বাকি সবার পালা।
কী জানি আহান তিতিরের না বলা কথাগুলো শুনতে পেলো কিনা তবে চোখ থেকে তার নোনাজল ঠিকই গড়িয়ে পড়লো। আহান আর দাঁড়ালো না, তাজের পিছনে পিছনে ভিতরে চলো গেলো।
তিতির মনে হয় পেছনে থেকে বললো, এবার পালিয়ে যাচ্ছিস কেনো আহু ?
আহান তাজকে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসিয়ে দিলো। দৌঁড়ে এগিয়ে এলো ইরিনা আর ইকবাল। তাদের আহান বলে গিয়েছিল সে তাজকে নিয়ে আসছে।
ইরিনা বললো, কোথায় গিয়েছিলি বাবা ?
তাজের মুখে কোনো উত্তর নেই, সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর দিকে। বিড়বিড় করে কিছু বলছে মনে হয়।
আহান ধ্রুবর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, দিন রুমে শুইয়ে দিচ্ছি বাবাইকে।
তাজ ফট করে ধ্রুবকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো, না না ওকে কারো কাছে দিবো না আমি। ও আমার কাছে থাকবে। নাহলে ও তিতিরের মতো ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে আমাকে একা রেখে।
ধক করে উঠলো আহানের বুক। তবে কী এবার যার আমানত তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় হয়ে গেছে ? কিন্তু এই ধ্রুবতারাটা ছাড়া আহানও যে দিকভ্রষ্ট হয়ে যাবে। পথ হারিয়ে ফেলবে জীবন চলার। তাজ ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে কিছু বিড়বিড় করছে। তাজের আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে আহানের কাছে। ধ্রুবকে আর নিলো না তাজের বুক থেকে।
৩১.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো কয়েকটা দিন। তাজ কেমন চুপ হয়ে গেছে। ধ্রুব ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না তেমন। পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে বসে তিতিরের কবরের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। আহান গিয়ে বসলো তাজের পাশে।
তাজ আনমনে বলে উঠলো, মুসকান এভাবে সবার হাসি কেড়ে নিয়ে চলে গেলো কেনো আহান ?
আহান চমকে উঠলো তাজের কথায়। তিতিরকে মুসকান বলে একমাত্র তিতিরের বাবা ডাকতো। তখন তিতিরের মুখে সারাদিন হাসি লেগেই থাকতো। পাঁচ দিনের নবজাত শিশুর হাসি দেখেই আবির মাহমুদ তার নাম রেখেছিল মুসকান আর তিতির নাম রেখেছিল তিতিরের মা। সবার কাছে তিতির নামটা বেশি পরিচিত হয়ে গেলেও আবির মাহমুদ মুসকান বলেই ডাকতো, তার হাসিতে যেনো আবির মাহমুদের দুনিয়া হাসতো। এটা মামির কাছেই শুনেছিল আহান। আহান ছিলো তিতিরের মাত্র পনেরদিনের বড়। তিতিরের সাথে এই মাহমুদ ভিলাতেই কাটতো তার সারাদিন।
আহান মলিন হেসে বললো, জানেন ভাইয়া তুতুলের জীবনের সুখের সময়ের মেয়াদকাল ছিলো খুবই কম। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো শৈশবের নয় বছর। রাজা রানির সাত বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঘন কুয়াশা ঘেরা এমনই এক শীতের সকালে নাকি জন্ম হয়েছিল এই মাহমুদ ভিলার রাজকন্যা তুতুলের। সবাই খুব ভালোবাসতো মেয়েটাকে। বাড়ির কাজের লোকগুলোরও চোখের মণি ছিলো তুতুল। তার হাসির আওয়াজে যেনো পুরো মাহমুদ ভিলা খিলখিলিয়ে হাসতো। রাজা, রানি, রাজকন্যা আর একটা সুখের সাম্রাজ্য। কিন্তু সেখানেই নজর লাগে আব্দুর রহমান চৌধুরী নামক লোভী অমানুষের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি আমার জন্মদাতা পিতা। মামার মেডিকেল ইকুইপমেন্টের বিজনেস ছিলো সাথে একটা হসপিটাল। সেখানেই ইন্টার্নি চিকিৎসক হিসাবে জয়েন করে আমার বাবা। আমার মা আনিতা মাহমুদের সাথে সেখানেই পরিচয় হয় আমার বাবার। পরিচয় থেকে ভালোলাগা একসময় তা ভালোবাসা। মামা সব জেনে গেলে অমত করেনি, বোনের সুখের কথা চিন্তা করে বিয়ে দিয়ে দেয়। আমার নানা-নানি ছিলো না, মায়ের বিয়ের পর মামা একা হয়ে যায়। এরপর মা নাকি মামিকে পছন্দ করে মামার সাথে বিয়ে দেন, সব ভালোই চলছিল। বাবা-মার বিয়ের এক বছরের মাথায় ভাইয়ার জন্ম। কিন্তু মামির বাচ্চা হচ্ছিল না, অনেক চিকিৎসা করেও লাভ হয়নি, শেষে আশা ছেড়ে দেয়। ভাইয়া বড় হতে থাকে, তার যখন পাঁচ বছর তখন আবার আমার আগমনের বার্তা পায় মা। এর মাস খানেক পর মামী বুঝতে পারে সেও মা হতে চলেছে। সেদিন নাকি মামা পুরো শহরের অসহায় মানুষদের পেট ভরে খাইয়েছিলো খুশি হয়ে। সবাই খুশি হলেও খুশি হতে পারেনি আমার বাবা। সে ভেবেছিলো মামার কোনো সন্তান না হলে সমস্ত সম্পত্তি তার হয়ে যাবে। যখন তুতুল হলো তখন বাবা ভাবলো যেভাবেই হোক তুতুলের সাথে ভাইয়ার বিয়ে দেবে আর সমস্ত সম্পত্তি দখল করবে। সে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে থাকে। তুতুল হওয়ার পর মামী আর কনসিভ করতে পারেনি তাতে আমার বাবা খুশী হন। চলতে থাকে দিন ভালোভাবে। বড় হতে থাকি আমি আর তুতুল। আমি তুতুলকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না।
তাজ তাকালো আহানের দিকে। আহানের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। যেনো আহান হারিয়ে গেছে সোনালী সেই অতীতে। আহানের চোখের ভাষা বুঝতে পারলো তাজ। মনে মনে প্রশ্ন জেগে উঠলো আহান ভালোবাসতো তিতিরকে ?
আহান মুচকি হেসে বললো, ভাইয়া আর আমার ছোটবেলা থেকে বনিবনা হতো না। ভাইয়া মাঝে মাঝে তুতুলকে বকতো তাতেই হাতাহাতি লেগে যেতো আমাদের দুজনের। আমাকে আর ভাইয়াকে একসাথে রাখা দিনদিন অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল। শেষে বাবা-মা বাধ্য হয়ে ভাইয়াকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয় আমার ফুপুর কাছে। আমি ছোট ছিলাম তাই বাবা-মা আমাকে কাছে রাখে। সময়ের সাথে বড় হতে থাকি আমি আর তুতুল। নিজের বাড়ি রেখে আমি পরে থাকতাম তুতুলের কাছে। মাহমুদ ভিলায় আবার খুশীর সংবাদ আসে নয় বছর পর। তুতুলের ভাইবোন আসতে চলেছে, তুতুলের খুশী দেখে কে। সব মেয়েরা ভাই চায় কিন্তু তুতুল সবসময় বোন চাইতো। সে নিজের বোনকে কত ভালোবাসবে তা বলে বলে কান পঁচাতো আমার। আমি তাকে রাগানোর জন্য বলতাম তার বোনকে বিয়ে করবো, মাঝে মাঝে সেটা মেনেও নিতো তুতুল। সব ভালো লাগলেও এটা ভালো লাগতো না। ছোটবেলা থেকে তুতুলের সাথে বর বউ খেলে এখন অন্য কাউকে বউ বানাবো শুনেও তুতুল যখন রাগ না করে খুশী হতো আমার মুখ কালো হয় যেত।
আহান সত্যি হারিয়ে গেছে অতীতে। তাই সব যে তাজকে বলে দিচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। তাজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহানের দিকে। কথাগুলো শুনতে তার ভালো লাগছে নাকি খারাপ সে নিজেই বুঝতে পারছে না।
আহানের কথাতেই আবার ঘোর কাটলো তাজের, দু’দিন ধরে টানা বৃষ্টি চলছিল সিলেটে। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজে তুতুলের সাথে খেলে বাড়ি চলে যাই আমি৷ পরদিন যখন এই বাড়িতে আসি চারদিকে কেমন নিস্তব্ধতা। একরাতে আমার চেনা জীবন বদলে গেলো। বেলা গড়াতেই অ্যাম্বুলেন্স করে বাড়ি ফিরলো মামা মামির র*ক্তা*ক্ত লা*শ।
গলা ধরে এলো আহানের। তাজ বুঝতে পারছে আহানের বলতে কষ্ট হচ্ছে।
তাজ আগ্রহ নিয়ে বললো, তারপর ?
জানাজানি হলো মামার বিশ্বস্ত বডিগার্ড নুরুল মামা মামিকে খু*ন করেছে আর তুতুলের কোনো খোঁজ নেই।
একটু দম নিলো আহান তার চোখ টলমল করেছে পানিতে, আসলে বাবা নাকি মামাকে মজার ছলেই ভাইয়া আর তুতুলের বিয়ের কথা বলেছিলো। কিন্তু মামা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলো বাবা যেনো এসব মাথায় না আনে। তার কাছে ভাগ্নে ভাগ্নের জায়গায় আর মেয়ের জামাই তার জায়গায়। বাবা বুঝতে পেরে যায় তার পরিকল্পনা কাজ করবে না। এদিকে ভাবতে থাকে এবার যদি ছেলে হয় তাহলে তো সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। তাই পথের কাটা সরিয়ে দিয়েছিলো। তুতুলকে হারিয়ে তখন আমি পাগল প্রায়। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিলো দূরদেশ লন্ডন।
টপটপ করে পানি পড়ছে আহানের চোখ থেকে। ছেলেদের কাঁদতে হয় না আরো একবার মিথ্যা প্রমাণ করলো এই কথা।
তাজ নিজের জিহবা দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, এসব তুমি কীভাবে জানলে ?
আহান শান্ত গলায় বললো, বাবা বলেছে নিজের মুখে।
তাজ চমকে উঠলো আহানের কথায়, তোমার বাবা ?
আহান নিজের চোখ মুছে বললো, ভাইয়া তুতুলের খোঁজ পাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাবা কিংবা ভাইয়া কারো সাথেই আমার তেমন ভালো সম্পর্ক নয়। তাই তাদের সাথে আমার যোগাযোগ হয়ে উঠতো না খুব একটা। বাবা অসুস্থ এই খবরও আমি জানতাম না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে জড়িত ছিলো বাবাও। সেখানেই এক ঝামেলায় বাবার হাতে গুলি লাগে। ডায়াবেটিকস ছিলো বাবার, ক্ষত স্থানে পচন ধরে যায়। একসময় কেটে ফেলতে হয় হাত, তবে সুস্থ হয় না পুরোপুরি বরং বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে শরীরে ছড়িয়ে পরে এটা, অবস্থা খারাপের দিকে যায়। দীর্ঘ দুই বছর ধুঁকে ধুঁকে নিজের পাপের ফল ভোগ করে বাবা। যখন নিজের ভুল বুঝতে পারে তখন তুতুলের সাথে দেখা করতে চায়। তুতুল আমার সাথে যাওয়ার এক মাস পরেই বাবার অসুস্থতার কথা জানতে পারি। তিতির কখনো আমার বাবার পাপের কথা আমাকে বলেনি। ও চায়নি আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি। কিন্তু বাবা নিজের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তুতুলের কাছে মাফ চায় আর সব সত্যি স্বীকার করে। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে কী জানেন ভাইয়া ?
তাজ কাঁপা গলায় বললো, কী ?
আহান তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, আমার মাকেও খু*ন করেছিলো আমার বাবা। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো তাকেও সম্পত্তির লোভে শেষ করে দিয়েছে। মামা-মামীকে খু*ন করার বছর দুয়েক পরে মা সব সত্যিটা জানতে পেরে যায়। মা ভেঙে পড়েছিলো প্রাণপ্রিয় স্বামীর এমন জ*ঘ*ন্য রুপ দেখে। পুলিশের কাছে সব বলে দিতে চাইলে মাকে গলা টিপে খু*ন করেছে আমার বাবা নামের অমানুষটা। মায়ের কথাটা ভাইয়াও জানে না। বাবা আমাদের জানিয়েছিলো মা হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। নিয়তি দেখেছেন ভাইয়া, আমার বাবা যে হাতে গলা টিপে নিজের ভালোবাসার মানুষের জীবন নিয়েছিলো। মৃত্যুর সময় সেই হাত উনি সাথে নিয়ে যেতে পারেননি। এই পৃথিবীর বুকে থাকতেই সেই হাত পঁচে গলে গেছে। পাপ করে কেউ ছাড় পায় না। আমার বাবাকে এই পৃথিবীর কোনো দেশের আইন শাস্তি দিতে পারেনি কিন্তু উপরওয়ালার আদালতে ঠিক শাস্তি হয়েছে তার। জীবিত অবস্থায় একটু একটু করে পঁচে গলে গেছে তার শরীর। ভ*য়ং*ক*র মৃ*ত্যু হয়েছে তার।
তাজ হাত রাখলো আহানের কাঁধে। ছেলেটার ভেজা চোখদুটো টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। হয়তো রাগে কিংবা কষ্টে।
আহান নিজের চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করে নিলো, আগামীকাল দুপুরের ফ্লাইটে আমরা লন্ডন ব্যাক করছি।
বুক কেঁপে উঠলো তাজের। এতগুলো বছর অপেক্ষা করে একজনের দেখা না পেলেও অন্যজনকে ফিরে পেয়েছে। তাকেও কী হারাতে হবে এবার ? তাজ এবার আর বাঁচবে না ধ্রুবকে হারিয়ে ফেললে।
আহান তিতিরের রেখে যাওয়া ডায়েরিটা নিজের সাথে করেই নিয়ে এসেছিলো। যতবার বাংলাদেশে আসে সাথে করেই নিয়ে আসে৷ কখন তাজের সাথে দেখা হয়ে যাবে এই ভেবে। ডায়েরিটা দিতেই এখন তাজের কাছে আসা আহানের।
ডায়েরিটা এগিয়ে দিলো তাজের দিকে, এটা আপনার জন্য রেখে গেছে তুতুল৷ জানি এটা এতে কী আছে, তবে আশা করি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। এটাও জানতে পারবেন আপনি ধ্রুবকে পাবেন কী, পাবেন না। আমি কেবল তুতুলের ইচ্ছে পূরণ করবো।
আহান উঠে চলে গেলো তাজের কাছে থেকে। তাজ তাকিয়ে আছে ডায়েরির দিকে। নীল রঙের ডায়েরির উপরে লেখা “বিষাক্তফুলের আসক্তি ”
তাজ আলতো হাতে স্পর্শ করলো লেখাটা। সামনে একবার তিতিরের কবরের দিকে তাকালো। হাত কাঁপছে তাজের, কী লেখা আছে এটাতে ? এই ডায়েরির উপরই কী নির্ভর করছে ধ্রুবকে তাজ পাবে কিনা ?
শুনেছি বেদনার রঙ নীল আবার বিষের রঙ ও নীল। তাই বিষাক্তফুলের কথাগুলো বিষাক্ত রঙেই ফুটিয়ে তুললাম। তাজওয়ার খান তাজ আপনি যদি আমার হতেন না, আমি সত্যি আপনাকে আমার মাথার তাজ করে রাখতাম। কিন্তু আপনি আমার নন, তাই আপনি যার তার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কেমন আছেন নিজের আসল ভালোবাসার মানুষের কাছে ? নিশ্চয়ই খুব ভালো আছেন। আমিও মন থেকে চাই আপনি খুব ভালো থাকেন। নিজের ভালোবাসার মানুষের খারাপ থাকা কেউ চায় না। অবাক হচ্ছেন আপনাকে নিজের ভালোবাসার মানুষ বলায়, অবাক হবেন না প্লিজ। কারণ আপনি এতোটাও অবুঝ ছিলেন না আমি আপনাকে ভালোবাসি আর আপনি সেটা বুঝতেই পারেননি। তবু যদি না বুঝে থাকেন তাহলে আজ স্পষ্ট করেই বলি। আপনাকে আমি ভালোবাসি, প্রচন্ড ভালোবাসি। ভালোবাসতাম বলবো না, কারণ ভালোবাসার কোনো পাস্ট ফর্ম হয় না। আজ আমার বলতে কোনো বাঁধা নেই কারণ আপনি যখন এই ডায়েরি পড়ছেন তখন আমার অস্তিত্ব মুছে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। আপনি ভালোবাসতে জানেন না তাজ, ভালোবাসতে জানেন না। আপনি জানেন না, আপনি আমার ক্রাশ ছিলেন আগে থেকেই। আপনার গান শুনেই মুগ্ধ হয়েছিলাম আর আপনাকে দেখে ক্রাশড। একটু ফাঁকা সময় পেলেই আপনার গান শুনতাম মুভি দেখতাম। কিন্তু আপনি যখনই কোনো হিরোইনের সাথে ক্লোজ হতেন রেগে টিভি অফ করে দিতাম। শান্ত মেয়েটার মাঝের এমন পাগলামো কেউ জানতো না, কেউ না।
আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার দিনের কথা মনে আছে ?
এতদিন যাকে টিভিতে, ফোনে দেখে এসেছি তাকে সামনে থেকে দেখবো। উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপছিলো। আপনি এলেন এক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে বলতে। আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম আপনার দিকে। আপনার হেয়ারস্টাইল থেকে পায়ের শো পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আপনার হাঁটার স্টাইল, হাত নেড়ে কথা বলা, মনে হচ্ছিল আমি জ্ঞান হারাবো। আপনি যখন ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ, যেনো সামনে তাকালে অনেক বড় অপরাধ হয়ে যাবে। আমাকে দেখে আপনার এক্সপ্রেশন দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। আপনি নাম জিজ্ঞেস করলেন কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম। সেদিনের প্রতিটা সেকেন্ড আমার মনে গাঁথা। সেদিন থেকেই হয়তো ক্রাশ ভালোবাসায় রুপ নিতে থাকে। আপনি অন্যদের সাথে কথা বললে আমি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর যখনই আমার দিকে তাকাতেন আমার দৃষ্টি মাটিতে।
একদিন আপনি আমার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম মুসকান কে রেখেছে ?
আমি নিচু গলায় বলেছিলাম, বাবা রেখেছে।
মুসকান নামের অর্থ জানো তুমি ?
জী স্যার জানি, মুসকান নামের অর্থ হাসি।
মুসকান মাহমুদ তিতির। মুসকান মানে হাসি আর তিতির মানে পাখি। দু’টো নামের সাথে মিশে আছে চঞ্চলতা কিন্তু তোমাকে আমি যখনই দেখি মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখে কাজ করছো, এখন পর্যন্ত হাসতে দেখিনি। অদ্ভুত না ব্যাপারটা, যার নাম হাসি সে হাসতেই জানে না।
সেদিন আপনাকে বলতে পারিনি আমি হাসতে ভুলে গেছি। জানেন তো আমি এমন ছিলাম না। আমার হাসির আওয়াজে মাহমুদ ভিলার প্রতিটা বস্তু যেনো হাসতো। আমার মুখের হাসি আমার বাবার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতো। কিন্তু একটা রাত আমার জীবনের সব হাসি কেঁড়ে নিয়েছে। মাত্র নয় বছর বয়স তখন আমার। আমার বোনুটা কখন আমার কোলে আসবে সেই আশায় প্রহর গুনছিলাম। টানা দু’দিন বৃষ্টি হচ্ছিল সিলেট শহরে। বিকেলে আহুর সাথে বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর উঠেছে আমার গায়ে। মা নিজের ঐ অবস্থায় আমার মাথার কাছে বসে উদ্বিগ্ন হয়ে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে আর বাবার ফোনে কল করে যাচ্ছে। জ্বরের ঘোরে তখন আমি শুধু বিড়বিড় করে বাবার নাম নিচ্ছি। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে বাড়ি ফিরলো বাবা সাথে তার বডিগার্ড নুরুল মামা। ছোটবেলা থেকে তাকে মামা বলেই ডাকতাম আমি। আমার জ্বর দেখে মামা নিজের রুমে গেলেন না। মামার কেউ ছিল না, ছোটবেলা থেকে বাবার কাছেই বড় হয়েছে, বাবাকে ভাইয়া বলেই ডাকতো। বাবা-মা দু’জনে মাথার কাছে বসে রইলো আর মামা সোফায় বসে রইলো। মধ্যরাতে সবাই তখন খানিকটা ঝিমাচ্ছে আর আমার জ্বর কমায় আমি ঘুমিয়ে আছি। মায়ের চিৎকারে ঘুম ভাঙলো আমার। বাবা মাকে ধরে জানতে চাইছে কোথায় কষ্ট হচ্ছে। লিভার পেইন শুরু হয়েছিলো মায়ের। ঝুম বৃষ্টি তখন বাইরে। বাবা কী করবে বুঝতে পারছে না। একদিকে অসুস্থ আমি আর অন্যদিকে মা। বাবা ড্রাইভারকে বললো দ্রুত গাড়ি বের করতে। বাবা মাকে নিয়ে গাড়ির পিছনের সীটে বসলো আর মামা আমাকে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে। ততক্ষণে আবার ধুম জ্বর উঠেছে আমার। হসপিটালে গিয়ে আমাকে আলাদা কেবিনে নিলো মামা আর মাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হল। মামা একবার বাবার কাছে যায় একবার আমার কাছে। হঠাৎ আমি মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য বায়না শুরু করলে মামা আমাকে শান্ত করার জন্য আমার কাছেই থেকে গেলেন। মামা আমার কাছে বসে অস্থির অস্থির করছিলো ওদিকে মায়ের কী অবস্থা জানার জন্য কিন্তু আমাকে রেখে যেতেও পারছিলো না। ঘণ্টা খানেক পার হওয়ার আগেই র*ক্তা*ক্ত অবস্থায় তোয়ালে মোড়ানো ছোট পুতুল বুকে জড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে কেবিনে প্রবেশ করলো বাবা।
মামা ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনার এই অবস্থা কীভাবে হলো ভাইয়া ?
পাখিকে মামার কোলে তুলে দিলো বাবা, আমি তোর পায়ে পরছি নুরুল আমার মেয়ে দু’টোকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যা। ওরা আমার মেয়ে দুটোকেও মে*রে ফেলবে।
এসব কী বলছেন ভাইয়া ? কী হয়েছে, আপনার এই অবস্থা কে করলো ?
নুরুল আপনজন বিশ্বাসঘাতক হয়ে যায় কেনো রে ? এতো ভালোবাসার বিনিময়ে কীভাবে পিঠে ছু*রি বসালো ? আমার পারুকে কী নিশংসভাবে মে*রে ফেললো রে নুরুল। আমি কিছুই করতে পারলাম না। এবার আমার মেয়ে দুটোকেও মে*রে ফেলবে, আমি কিছু করতে পারবো না। তুই দয়া করে ওদের নিয়ে দূরে চলে যা। আমার বোনটাকে আমি একটা জানোয়ারের হাতে তুলে দিয়েছি নুরুল। জানি না আমার বোনটার কপালে কী আছে।
এবার আর মামার বুঝতে বাকি রইলো না এসবের পেছনে কে আছে। ফুপির কথা শুনে বুকটা খা খা করে উঠে মামার। মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলো মনেই কবর দিয়ে বড্ড ভুল করেছে মনে হয়েছিল।
নিজেকে সামলে বললো, আপনাকে এভাবে একা ফেলে আমি কোথাও যাবো না ভাইয়া।
বাবা দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে বসলো, আমার হাতে সময় নেই নুরুল। তুই যদি আমাকে নিজের ভাই মনে করে থাকিস তবে দয়া করে আমার মেয়েদের বাঁচা আমি তোর পায়ে,,
বাবা কথা শেষ করার আগেই মামা বাবার বাড়িয়ে দেওয়া হাত নিজের হাতে শক্ত করে ধরে কেঁদে দিলো। বাবার জায়গা মামার জীবনে কোথায় সেটা একমাত্র মামাই জানতো।
বাবার অনুরোধে মামা আমাকে আর বোনুকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসে ঐ বিশ্বাসঘাতকের শহর থেকে। দু’জনকে বুকে আগলে বড় করতে থাকে। নয় বছরের ছোট মেয়ের কাঁধে এসে পরে নিজের ছোট বোনুকে বড় করার দ্বায়িত্ব। সেই রাত আমার জীবন থেকে সব হাসি, সুখ, আনন্দ কেঁড়ে নিয়েছিলো।
কিন্তু আপনার জন্য আবার হাসতে শিখেছিলাম আমি। আপনার সেদিনের কথা শুনে বাসায় এসে আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখেছি। আয়নাটা আপনি মনে করে হাসার চেষ্টা করেছি কিন্তু কিছুতেই হয় না। অথচ আপনার কথা চিন্তা করে কত আনমনে হেসেছি তার হিসাব আমার কাছে নেই কিন্তু আপনার দিকে না তাকাতে পেরেছি, না হাসতে। আসলে মেয়েরা যাকে ভালোবাসে তার চোখে চোখ রাখতে পারে না। আপনার দিকে তাকাতেই লজ্জা লাগলো, সেখানে হাসি অসম্ভব।
আপনার সাথে আমার প্রতিটা মুহূর্ত কাটতো মুগ্ধতায়। এতো মেয়ে আপনার জন্য পাগল কিন্তু আপনি তাদের প্রতি আগ্রহ দেখান না। আমি মাঝে মাঝে ভয় পেতাম যদি আমার দুর্বলতা টের পেয়ে যান আর চাকরি থেকে বের করে দেন। চাকরিটা ভীষণ প্রয়োজন ছিলো আমার। তাই সবসময় নিজেকে একটা কঠিন আবরণে আবৃত করে রাখতাম। তবু মাঝে মাঝে মনের প্রফুল্লতা কচ্ছপের মতো শক্ত আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসতো কিন্তু আপনি খেয়াল করতেন না।
তাজ এতটুকু পরে ডায়েরি বন্ধ করে দিলো। চোখে ভাসছে তিতিরের সাথে কাটানো হাজার স্মৃতি। আজ স্মৃতিগুলো অনুভব করতে পারছে তাজ। তিতিরের আঁড়চোখে তাকানোর মানে বুঝতে পারছে। মজার ছলে বলা তার সামান্য অ্যাডাল্ট কথায় তিতিরের লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারছে। তার প্রতি মেয়েদের এতো ইন্টারেস্ট দেখানো ভালো লাগতো না তাজের। হঠাৎ একদিন সিম্পল সাদা চুড়িদার পড়া, মাথায় রঙচঙে চুলের বদলে সাদাসিধা একটা বেনি করা মেয়ে চোখের সামনে দেখে থমকে গিয়েছিলো তাজ। যেখানে সব মেয়ে তার দিকে ঘন্টা খানেক হা করে তাকিয়ে থাকতো, সেখানে মেয়েটা মাথা নিচু করে ছিলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠেছিলো তাজের। প্রথম দেখার সেই দিনের কথা তাজেরও খুব ভালো করেই মনে আছে। যেখানে সবাই তাজের সাথে ভাব জমাতে ব্যস্ত হতো সেখানে তিতির প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলতো না। তাজ যা বলতো ছোট ছোট উত্তর দিতো। তাজের তাই ভালো লাগতো তিতিরকে কিন্তু সেটা কখনো গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি তাজ। তবে আজ সেই ছোট ছোট স্মৃতিও তাজের চোখে ভাসছে। বুকের বা পাশটায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তাজ আবারও ডায়েরি খুলে পড়তে লাগলো।
আপনার মনে আছে তাজ, একবার আপনার মুভির শুটিংয়ের জন্য আমরা ভারতের কাশ্মীর গিয়েছিলাম। শীতের প্রকোপে কাশ্মীর তখন সাদা বরফে ঢাকা পড়েছে। আপনি শুটিংয়ে ব্যস্ত আর আমি কাশ্মীরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রকৃতির মাঝে এতোটাই ডুবে গিয়েছিলাম কোনো দিকে হুশ ছিলো না।
সেদিন প্রথম আমাকে মুসকান বলে ডেকেছিলেন আপনি। কতগুলো বছর পর এই নামে কেউ ডেকেছিলো। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি আমার চোখে চিকচিক করতে থাকা পানি। বাবা যখন বাড়ি ফিরে আমার মুসকান মা কোথায় বলতো, আমি যেখানেই থাকতাম এক ছুটে চলে আসতাম। এতগুলো বছর পর কেউ আবার সেই নামে ডাকলো। প্রত্যেক মেয়ে তার নিজের জীবনে বাবার মতো কাউকে চায়। যে তার সব আবদার হাসিমুখে পূরণ করবে, যেমনটা তার বাবা করে। আমি সেদিন আপনার মাঝে আমার বাবার ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো আপনি সেই মানুষ যাকে আমার জীবনে প্রয়োজন।
আপনার ধমকেই ঘোর কাটলো আমার, তুমি এই পাতলা ফিনফিনে চাদর গায়ে জড়িয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কোন সেন্সে ?
আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে বললাম, আমার ঠান্ডা লাগছে না স্যার। আমি একদম ঠিক আছি।
দেখেছো আমি ঠিক জানতাম তুমি একটা রোবট। নাহলে সাধারণ কোনো মানুষের মাইনাস ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঠান্ডা লাগবে না এটা অসম্ভব। এই মেয়ে হাসে না, কাঁদে না, কথা বলে গুনে গুনে এখন আবার বলছে তার শীতও লাগে না। আস্ত একটা রোবট তো তুমি মুসকান।
আমি মাথা নিচু করে আপনার বকা শুনছিলাম। বাবাও ঠিক এভাবে শাসন করতো যখন আমি কারো কথা শুনতে চাইতাম না। আপনি সেদিন দেখেননি আমার চোখের আনন্দ অশ্রু। তাহলে আর আমাকে রোবট বলতে পারতেন না। আমাকে চরম পর্যায়ে অবাক করে দিয়ে আপনি নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন।
শুনো মেয়ে নিজের খেয়াল রাখো, এখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে কে দেখবে তোমাকে ? আমি তো নিজের কাজেই ব্যস্ত হয়ে থাকবো।
কথাগুলো বলে আপনি নিজের রুমে চলে গেলেন আর আমি আপনার জ্যাকেট আঁকড়ে ধরে ঘ্রাণ নিতে লাগলাম। (লেখনীতে তাহমিনা তমা)
তাজ আপনি ভালোবাসতে জানেন না কিন্তু আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য করতে ঠিকই জানেন। কোনো মেয়ে এমন একজন মানুষকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে, বলতে পারেন ?
এমন ছোট ছোট অনেক ঘটনার কথা লিখে রেখেছে তিতির। ঘটনাগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে তাজের স্মৃতিতে। তাজ অর্ধেক পড়ে-ই ডায়েরি বন্ধ করে ফেলেছে। কেউ কী বিশ্বাস করবে একজন মৃত মানুষকে ভালোবেসে ফেলছে তাজ। এতোটা ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছিলো জেনে ভালোবেসে ফেলছে তিতিরকে। হয়তো অনুভুতিগুলো তাজের মনে আগেই ছিলো কখনো বুঝতে পারেনি। কই মৌও তো কত ভালোবেসেছে কিন্তু সেটা জেনে তার প্রতি তো তাজের অনুভূতির জন্ম হয়নি। কিন্তু তিতিরকে হয়তো প্রথম থেকেই ভালোবেসেও উপলব্ধি করতে পারেনি কিন্তু এখন পারছে, বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে। দু’টো বছর তার ছোট থেকে ছোট জিনিসের খেয়াল রেখেছে তিতির। তাজের কখন কী চাই মুখ দেখে বুঝে যেত। এতো ভালোবাসার বিনিময়ে তাজ তাকে কী দিয়েছে ? অপমান, অবহেলা, অপবাদ, ঘৃণা। আচ্ছা একটা ডায়েরি পড়ে কাউকে ভালোবাসা যায় ? তার প্রতি আসক্ত হওয়া যায়, তাও একজন মৃত মানুষের ? তবে তাজ কীভাবে ভালোবেসে ফেলেছে তিতিরকে ? ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদলো তাজ।
ফিরে এসো মুসকান, একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দাও। একবার ভালোবাসি বলার সুযোগ দাও। এতো ভালোবাসার ঋণ মাথায় নিয়ে কীভাবে বাকি জীবন বাঁচবো আমি ? একটু ভালোবাসার সুযোগ দাও, ফিরে এসো।
কে বলে ছেলেরা কাঁদে না। এই তো তাজ কাঁদছে, আশপাশের বাতাস ভারী হচ্ছে তার কান্নায়। কিন্তু আজ আফসোস ছাড়া কিছুই করার নেই তার। কারণ সে নিজের ভালোবাসা অনুভব করতে পেরেছে মানুষটাই চলে যাওয়ার পর।
প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা নিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম কোথায় আছি। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম এটা হসপিটাল, পাশেই একজন নার্স দাড়িয়ে কিছু করছে। মনে করার চেষ্টা করলাম এখানে কীভাবে এলাম।
কুয়াশা ঘেরা সকাল দেখে একটু ঘুরতে ইচ্ছে হলো পাহাড়ি রাস্তায়। ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিয়ে সবুজকে কিছু না বলেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাই। ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছিলাম আর আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম৷ হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম গাড়ির গতি বাড়ছে, চেষ্টা করেও কমাতে পারছি না। তারপরই বড় ঝটকা খেলাম, ব্রেক কাজ করছে না। এমনি পাহাড়ি রাস্তা, তার উপর ব্রেক কাজ করছে না। কোনোভাবে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলাম না, তখনই সামনে দেখতে পাই একটা গাড়ি দাঁড় করানো। সেটা পাশ কাটিয়ে একটা গাছে ধাক্কা লাগে, মাথায় ব্যাথা অনুভব করি তারপর আর কিছু মনে নেই।
ধীর গলায় বললাম, নার্স।
২৮.
মিস্টার খানের জ্ঞান ফিরেছে শুনে হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে গিয়ে বললাম, এখন কেমন লাগছে মিস্টার খান ?
তাজ ঘুরে তাকালো আহানের দিকে, জী আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আপনি ?
নার্স বললো, স্যারই আপনাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছেন।
তাজ প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে বললো, স্যার ?
আহান মুচকি হেসে বললো, আমি আহান চৌধুরী। এই হসপিটালটা আমাদেরই বলতে পারেন।
আহানের বাকি কথা তাজের কানে গেলো না। শুধু আহান নামটাই মস্তিষ্কে তীব্র বেগে আঘাত করলো।
অস্থির হয়ে উঠলো তাজ, তি,,,তিতির কোথায় ? আমি জানি তিতির আপনার কাছেই আছে। আপনি আমার ছোট হবেন বয়সে, তবু হাত জোর করে বলছি বলুন তিতির কোথায় ? গত প্রায় ছয়টা বছর যাবত হন্নে হয়ে খোঁজে চলেছি ওকে।
তাজের অস্থিরতা দেখে বুক কেঁপে উঠলো আহানের। তাজের চোখমুখ বলে দিচ্ছে সে তিতিরের জন্য কতটা অস্থির হয়ে আছে। সত্যিটা জানলে মানতে পারবে তো ?
আহান নিজেকে সামলে বললো, আপনি আগে শান্ত হন। এখন এত উত্তেজনা আপনার শরীরের জন্য ঠিক নয়। মাথার ক্ষতটা খুব গভীর না হলেও উত্তেজিত হলে ক্ষতি হবে।
তাজ আগের মতো অস্থির হয়েই বললো, আমি একদম ঠিক আছি। আপনি দয়া করে তিতিরের কাছে নিয়ে চলুন আমাকে।
কথা শেষ করে তাজ বেড থেকে নামতে গেলে আহান দ্রুত এসে ধরে ফেলে, আরে আরে করছেন কী ? আপনি এখনো অনেক উইক, অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে। ডান হাতটা ভেঙে গেছে, আপনি প্লিজ শান্ত হন।
তাজ এতক্ষণে খেয়াল করলো তার ডানহাতে ব্যান্ডেজ করা। এদিকে আহান নিজের ভুল বুঝতে পারলো। এখনই তাজের সামনে আসা ঠিক হয়নি তার। কিন্তু এতোকিছু ভাবেনি সে। তাজ এতটা ডেস্পারেট হয়ে উঠবে বুঝতে পারেনি।
তাজ তবু একই কথা বললো, প্লিজ বলুন তিতির কোথায় ? আমি আর সহ্য করতে পারছি না এই অপরাধবোধের বোঝা।
আহান কী করবে বুঝতে পারছে না। তাজকে এখনই সবটা জানালে সেটা তাজের জন্য ক্ষতিকর হবে। এদিকে তাজকেও শান্ত করা প্রয়োজন।
আহান তাজের কাঁধে হাত রাখলো, আপনি শান্ত হন আগে। তিতির আমার কাছেই আছে। আপনি সুস্থ হয়ে উঠলেই নিয়ে যাবো আপনাকে।
তাজ যেনো হাতে চাঁদ পেলো, সত্যি বলছেন আপনি ?
আহান তাজকে আশ্বস্ত করে বললো, জী আমি সত্যি বলছি।
মনে মনে বললো, আমাকে মাফ করবেন মিস্টার খান। তিতির আমার কাছে থেকেও নেই। কিন্তু এই মুহুর্তে এটা আপনাকে জানানো যাবে না।
হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করলো ইরিনা। তাজকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো, এসব কীভাবে হলো বাবা ?
আমি ঠিক আছি মা, প্লিজ কান্না করো না।
কে শুনে কার কথা ইরিনা ছেলেকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। তাজের এক্সিডেন্টের কথা শুনে তাদের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো। ফ্লাইট পেতেই চলে এসেছে। এবার কেবিনে ঢুকলো সবুজ আর ইকবাল।
ইকবাল ভেজা গলায় বললো, এসব কীভাবে হলো তাজ ?
দুজনেই অস্থির হয়ে উঠলো তাজকে নিয়ে। তাজ যে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তাজ বাবা-মাকে বুঝাতে লাগলো সে ঠিক আছে। ইকবাল সবু্জকে ইচ্ছে মতো বকলো তাজকে একা ছাড়ার জন্য। একপাশে দাঁড়িয়ে আহান সবই দেখছে। চোখে নোনাজলের আনাগোনা দেখা গেলো তার।
মনে মনে বললো, সবার জীবনে কিছু শূন্যতা থেকেই যায়। মাকে বড্ড মনে পড়ছে আজ আহানের। সেই সাথে বাবার প্রতি হচ্ছে তীব্র ঘৃণা। চোখ মুছে নিলো আহান।
কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তাজ বলে উঠলো, মা তিতিরকে পেয়ে গেছি আমি।
তাজের এক কথায় চমকে উঠলো সবাই। কেবিনে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।
আহানকে দেখিয়ে তাজ বললো, তিতির আহানের কাছে আছে মা। আহান তিতিরের কাজিন।
ইকবাল আর ইরিনা দুজনেই তাকালো আহানের দিকে। আহানের আর পা বাড়ানো হলো না। সে জায়গাতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সবার দৃষ্টি এখন তার দিকে।
ইরিনা এগিয়ে এলো আহানের দিকে, তিতির তোমার কাছে ?
টলমল চোখে ইরিনার দিকে তাকালো আহান, সময় হলে সব জানতে পারবেন আপনারা। আপাতত আমাকে যেতে হবে এখন।
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেলো আহান। রেখে গেলো কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখ। আহান অস্থিরতা নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটলো। সবুজের থেকে তাজের গত পাঁচ বছরের জীবনযাপনের সম্পর্কে জেনেছে আহান। সন্ধ্যা পেরিয়ে বাড়িতে পৌঁছালো সে। সোজা চলে গেলো তিতিরের কবরের কাছে।
তুই যে বলেছিলি তাজ তোকে ভালোবাসে না। তবে কেনো তোর জন্য এতো অস্থিরতা তার ? এবার কীভাবে সবটা বলবো আমি তাকে ? সে তো তোর আশায় বসে আছে এখনো। বিয়ে পর্যন্ত করেনি তোর আর তোদের সন্তানের আশায়। তুই সত্যি স্বার্থপর রে তুতুল।
তাজ একাই আছে এখন কেবিনে। তিতিরের দেখা পাওয়ার জন্য ছটফট করছে৷ হঠাৎ তাজের মনে হলো নিজের সন্তানের কথা। তিতিরের খোঁজ পাওয়ার খুশিতে বাচ্চার কথা ভুলেই গিয়েছিলো তাজ। আহানকে বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করতে মনেই নেই। নিজের কান্ডকারখানায় নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলো তাজ। বাচ্চাটার জন্য অস্থির হয়ে ছিলো সে আর তিতিরের খোঁজ পেয়ে বাচ্চার কথা মনেই নেই তার। এটা কীভাবে সম্ভব ? আহান তো বললো তিতির তার কাছেই আছে। তারমানে তিতির ভালো আছে, সুস্থ আছে আর বাচ্চাটা ? এত প্রশ্নের ভীড়ে মাথা ব্যাথা করছে তাজের। চোখ বন্ধ করে শুয়ে ভাবতে লাগলো কীভাবে তিতিরের কাছে মাফ চাইবে। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো তাজ।
২৯.
দু’দিন হসপিটালের বেতে ছটফট করে কাটালো তাজ। আহান আড়াল থেকে তাজের খোঁজ খবর নিয়েছে কিন্তু সামনে যায়নি। আবার তিতিরের কথা জানতে চাইলে কী উত্তর দিবে সে ? নার্স জানালো তাজ তাকে খোঁজছে বারবার কিন্তু আহান নিরুপায়৷ তাজের এই অবস্থায় এমন একটা ধাক্কা সহ্য করতে পারবে না।
দু’দিন পর তাজকে আর হসপিটালে রাখা গেলো না। হসপিটাল থেকে আহানের ঠিকানা নিয়ে মাহমুদ ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সাথে আছে সবুজ, ইকবাল আর ইরিনা হোটেলে আছে। গাড়ি ড্রাইভ করছে সবুজ।
হঠাৎ তাজ বলে উঠলো, আমার ভয় করছে সবুজ।
অবাক হয়ে তাজের দিকে তাকালো সবুজ। তাজের মুখে ভয় শব্দটা তার কাছে পৃথিবীর আরেকটা আশ্চর্যের বস্তু মনে হলো। তাজ আর ভয় শব্দটা ঠিক মেলাতে পারছে না সবুজ। তার হঠাৎ মনে হলো, মাত্র দু’দিন আগে এক্সিডেন্ট করেছে তাই হয়তো গাড়িতে ভয় লাগছে।
সবুজ বললো, স্যার আমি সাবধানে চালাচ্ছি গাড়ি।
তাজের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আনাগোনা দেখা গেলো, তিতিরের সামনে কীভাবে দাঁড়াবো আমি সবুজ ?
সবুজ এতক্ষণে বুঝতে পারলো তাজের ভয়ের কারণ। সাথে অনেকটা অবাক হলো, তাজের মতো মানুষও বউকে ভয় পায়। যার তীক্ষ্ণ চাহনিতে মানুষের কাপড় নষ্ট হওয়ার অবস্থা হয়, সে নাকি বউয়ের সামনে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে। আনমনে হাসলো সবুজ।
স্যার আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে।
তাজ আগ্রহ নিয়ে বললো, কী বুদ্ধি ?
স্যার কিছু না ভেবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলবেন সরি আর আই লাভ ইউ।
সবুজের কথা শুনে সরু চোখে তাকালো তাজ। সবুজ ঢোক গিলে বললো, স্যার আমি এটাই করি তাই বললাম।
তাজ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তোমাদের মতো আমাদের সম্পর্কেটা স্বাভাবিক নয় সবুজ।
গাড়িতে আর কোনো কথা হলো না। তাজ নিজের ভাবনায় ডুবে গেলো। আজ সে তিতিরের কাছে মাফ চেয়ে তাকে ফিরে চাইবে নিজের জীবনে। নতুন করে সূচনা করবে জীবনের। অতীতের সব বিষাক্ততা ভুলে এক মুগ্ধতার সম্পর্ক তৈরি করবে।
স্বপ্নগুলো যখন এক ঝটকায় ভেঙে গুড়িয়ে যাবে কী অবস্থা হবে তাজের ? গাড়ি যত এগিয়ে যাচ্ছে তাজের হার্টবিট তত ফাস্ট হচ্ছে। সবুজও হয়তো পাশে বসে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সেই শব্দ।
গাড়ি এসে থামলো মাহমুদ ভিলার সামনে। তাজ জানলা দিয়ে তাকালো বাড়িটার দিকে। বেশ পুরনো রাজকীয় ডিজাইনের বাড়িটা। গেইটের সামনে দেয়ালে সুন্দর করে পাথরে খোদাই করে লেখা “মাহমুদ ভিলা” তার নিচে লেখা “তিতিরপাখির নীড়”। তাজ নেমে গেলো গাড়ি থেকে। তিতির লেখাটা আলতো ছুঁয়ে দিলো। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে গেইটে টোকা দিলে দারোয়ান গেইট খোলে দিলো।
কাকে চাই ?
আহান চৌধুরীর সাথে দেখা করতে এসেছি, উনাকে বলুন তাজওয়ার খান তাজ এসেছে তাহলেই চিনতে পারবেন।
সবুজ ততক্ষণে গাড়ি রাস্তার পাশে পার্ক করে তাজের পিছনে এসে দাড়ালো।
দারোয়ান গেইট ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললো, ভেতর আসুন।
দারোয়ান ভেতরে গেলো আহানকে জানাতে তাজের আসার খবর। তাজ আর সবুজ গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। তাজ আশপাশটা নজর বুলিয়ে দেখে নিচ্ছে।
ধ্রুব আমি কিন্তু খেলবো না, তুমি বল করছো না ভালো করে।
ধ্রুব পূর্বের মতো ভাঙা বাংলায় বললো, আমি তো ভালো করেই করছি মাম্মাম। তুমি খেলতে পারো না তাই বল দেখতে পাও না।
ধ্রুবর আওয়াজ কানে যেতেই বুকটা কেঁপে উঠলো তাজের। আওয়াজের উৎস খোঁজে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলো বাগানের এপাশে গাছের ছায়ায় একটা মেয়ে আর একটা বাচ্চা ছেলে ক্রিকেট খেলছে। বাচ্চাটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটার হাতে ব্যাট আর বাচ্চাটার হাতে বল। তাজ কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে তার। একটু কাছে গেলে পাখিকে চিনতে পারলো তাজ।
ধ্রুব গাল ফুলিয়ে বললো, তুমি চিটিং করছো আমি খেলাবো না।
ধ্রুব উল্টোদিকে ফিরে গেলো। এবার ধ্রুবর মুখ দেখতে পেলো তাজ। মুহূর্তে শ্বাস আটকে এলো তাজের। অবিকল তিতিরের মুখটাই যেনো দেখতে পেলো ধ্রুবর মাঝে। কোনো ভুল করে তাজের বকা খেলে গম্ভীর তিতিরটাও তো এভাবে গাল ফুলাতো। তাজের পা কাঁপছে, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তার। নিজের সাথে যুদ্ধ করে এগিয়ে গেলো তাজ। হাটু গেড়ে বসলো ধ্রুবর সামনে। হঠাৎ তাজকে দেখে খানিকটা চমকে উঠলো ধ্রুব। তবে ভয় পেলো না, অদ্ভুত চাহনিতে দেখছে তাজকে। এই মুখটা তো ধ্রুব দেখেছে কোথাও। ছোট্ট মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে ধ্রুব মনে করার চেষ্টা করলো তাজকে কোথায় দেখেছে ধ্রুব। তাজকে মোটেও অচেনা লোক লাগছে না ধ্রুবর কাছে। তাই ভয় পেয়ে সরেও যাচ্ছে না।
তাজ হুট করে বুকে জড়িয়ে নিলো ধ্রুবকে। ছোট্ট ধ্রুব কিছু না বুঝে ঘাপটি মেরে পরে রইলো তাজের বুকে। ধ্রুবকে বুকে নিয়ে তাজের বুকে যেনো প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো। ধ্রুব তখনো ব্যস্ত তাজকে চেনার।
হঠাৎ করেই অস্পষ্ট গলায় বললো, বাবা।
হ্যাঁ ধ্রুব চিনতে পেরেছে তাজকে। প্রতিদিনই তো তাজ আর তিতিরের ছবি দেখে সে৷ তার বাবা-মা বলেই তো পরিচয় করিয়ে দেয় আহান। ধ্রুবর মুখে বাবা ডাকটা যেনো তাজের পুরো পৃথিবী নাড়িয়ে দিলো। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। এতগুলো বছরের অপেক্ষার ফল এখন তার বুকে। এ অনুভূতি হয়তো পৃথিবীর অন্য কিছু দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ধ্রুবকে বুক থেকে তুলে মুখটা বা হাতের আঁজলে নিয়ে চুমু খেতে লাগলো তাজ। আজ দু’চোখের নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে বাঁধ ভেঙে। ধ্রুব তার ছোট ছোট হাত দিয়ে তাজের চোখ মুছে দিলো। তাজ অবাক চোখে তাকালো ধ্রুবর দিকে।
তুমি কাঁদছো কেনো বাবা ?
ধ্রুবর ছোট ছোট হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আবারও চুমু খেলো গুটি কয়েক।
মনে মনে বললো, তোমার মতো একটা নিষ্পাপ জীবন বাঁচাতে তিতির যা করেছে তাতে অন্যায় করেনি। যদি কিছু না করে তোমার ক্ষতি হতে দিতো তাহলেই বরং অন্যায় হতো। কোথায় তুমি তিতির ? প্লিজ সামনে এসো।
তাজ আশেপাশে তাকিয়ে তিতিরকে খুঁজতে লাগলো। না আশেপাশে তার দেখা মিললো না।
আহান বললো, ভেতরে চলুন মিস্টার খান।
তাজ মুচকি হেসে বললো, তুমি তিতিরের কাজিন তাই ভাইয়া বললেই খুশী হবো। তুমি করেই বললাম কিছু মনে করো না, তুমি বয়সে অনেকটা ছোট আমার থেকে।
তাজের কথায় আহানের বুক ধক করে উঠলো। ফিরে তাকালো তাজের দিকে৷ তাজের হাসিখুশি মুখটা আহানের ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। সত্যিটা জানলে কী অবস্থা হবে তাজের ভাবতেই বুক কেঁপে উঠলো।
আহান জোরপূর্বক হেসে বললো, ভেতরে চলুন ভাইয়া, সেখানে বসেই নাহয় কথা হবে। এমনিতেও আপনি অসুস্থ।
আহান কথা শেষ করে দু’কদম যেতেই তাজ বললো, তিতির কোথায় আহান ?
পা থেমে গেলো আহানের। এই প্রশ্নের ভয়েই তো তাজের সামনে যায়নি আহান। তবে এবার কীভাবে এড়িয়ে যাবে এই প্রশ্ন ?
আহান শুকনো ঢোক গিলে বললো, আগে ভেতরে চলুন তারপর নাহয় কথা বলি।
আহানের অস্থিরতা এবার নজরে এলো তাজের। আহান কেনো বারবার এই প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চাইছে ? তবে কী তিতির আহানের কাছে নেই ? এসব প্রশ্নে তাজের ভয় হতে লাগলো। মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো তার। ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে তাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো।
কাঁপা গলায় বললো, তিতির তোমার কাছেই আছে তো আহান ?
আহান বুঝতে পারলো তাজ ছাড়ার পাত্র নয়। সে এই প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে দিবে না আহানকে। আহান জিহবা দিয়ে নিজের শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। সেই বা আর কতক্ষণ তাজের থেকে সত্যিটা আড়াল করবে। তাজকে তো সত্যিটা আজ না হয় কাল জানাতেই হবে।
আহান নিজেকে শক্ত করে তাজের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো, তিতির আমার কাছে থেকেও নেই।
তাজের হাত-পা কাঁপছে ভয়ে, সে কী তবে তিতিরকে পেয়েও পেলো না।
ভীত গলায় তাজ বললো, মানে ?
আহান এগিয়ে এলো তাজের দিকে। ধ্রুবকে তাজের কোল থেকে নিজের কোলে নিলো। তারপর তাজের এক হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। তাজ বিস্ময় নিয়ে আহানের কাজ দেখছে শুধু। আহান বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটু একটু করে আগাতে লাগলো। তাজ আর আহানের পিছনে যাচ্ছে কোতুহলী সবুজ আর ভীত পাখি। একেক কদম আগাচ্ছে আর তাজের ভেতরটা অস্থিরতায় ছেয়ে যাচ্ছে। আহান নিজেও অস্থিরতা অনুভব করছে। কী হবে এরপরে সেটা ভেবে ভয় হচ্ছে। পুকুরের ওপাড়ে বকুল গাছটার নিচে গিয়ে থামলো আহান। চারপাশে বকুল ফুলের সুবাস মম করছে। তাজ আশেপাশে না তাকিয়ে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকিয়ে আছে আহানের দিকে।
আহান আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে সামনে তাকাতে বললো। তাজ আহানের আঙ্গুলের ইশারায় ধীরে ধীরে সামনে তাকালো। পাথরে বাঁধানো চকচকে তিনটা কবর দেখতে পেলো তাজ। প্রত্যেকটা কবরে নাম, জন্মতারিখ আর মৃত্যু তারিখ লেখা। প্রথমটায় লেখা আবির মাহমুদ, তারপর সুলতানা পারভীন।
শেষেরটা পড়তে গিয়ে তাজের গলা ধরে এলো, মুসকান মাহমুদ তিতির।
দু’কদম পিছিয়ে গেলো তাজ। মৃত্যু তারিখটা দেখলো আজ থেকে আরো পাঁচ বছর আগের। তাজের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে গেলো। চোখেমুখে নেমে এলো অন্ধকার।
আহান উদাস গলায় বললো, তুতুল আমার কাছে থেকেও নেই তাজ ভাইয়া। আমি চাইলেও আর কোনোদিন তুতুলের সাথে আপনার দেখা করাতে পারবো না। চাইলেও ফিরিয়ে দিতে পারবো না ধ্রুবকে তার মা। কারণ তুতুল আরো পাঁচ বছর আগে ধ্রুবকে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়ে নিজেই হারিয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। তাকে আপনি আর কোনোদিনই খোঁজে পাবেন না তাজ ভাইয়া।
ধৈর্যের বাঁধ ভালো তাজের। কেউ বুঝে উঠার আগেই তাজ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো বকুল ফুল ছড়ানো ঘাসের বিছানায়।
সবুজ চিৎকার করে উঠলো, স্যার।
আহান হতভম্ব হয়ে তাকালো তাজের দিকে। আহান জানতো তাজ শক খাবে কিন্তু সেটা সামলে উঠতে পারবে না সেটা বুঝতে পারেনি। সবুজ দৌড়ে এসে তাজের সামনে বসে পড়লো।
৩০.
তিতিরের রুমেই শুয়ে আছে তাজ। ছোটবেলায় এটাই তিতিরের রুম ছিলো। যদিও একা কখনো থাকতো না এই রুমে। রুমটা আগের মতো নেই। বাড়িটা আগের হলেও অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে হয়েছে৷ অনেক বছরের অযত্নে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো অনেকটাই। আহানই সব ঠিকঠাক করিয়েছে। তাজের পাশে বসে আছে ধ্রুব। রুমে সকলেই উপস্থিত সাথে তাজের বাবা-মাও। সবুজের মাধ্যমে তাদেরও খবর দিয়ে এনেছে আহান। তাজের এখনো জ্ঞান ফিরেনি। এক্সিডেন্টের আঘাতই সামলে উঠতে পারেনি এখনো, তার মধ্যে এতবড় মানসিক আঘাত সহ্য করতে পারেনি। আহান দেখেছে তাজকে, এমনি প্রবেলম নেই তবে জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে। ইরিনা ধ্রুবর সাথেই তাজের পাশে বসে নিঃশব্দে কান্না করছে আর মাঝে মাঝে ধ্রুবকে বুকে টেনে নিচ্ছে। সোফায় হতভম্ব হয়ে বসে আছে ইকবাল খান। আহানের থেকে তিতিরের মৃত্যুর কথা শুনে তারা সত্যি হতভম্ব।
ইকবাল খান তাকালো ধ্রুবর দিকে। তার বংশধর তার সামনে সহিসালামত বসে আছে একটা মেয়ের আত্মত্যাগের ফল হয়ে। যে মেয়েটাকে কিনা সে সবসময় অপছন্দ করে গেছে। সব সত্যিটা জানার পরও স্বার্থপর বসে আখ্যায়িত করে গেছে নির্দ্বিধায়। নিজের কাজে নিজেকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে ইকবালের। অর্থ, প্রতিপত্তি আর বংশমর্যাদার অহংকারে সবসময় ছোট করা মেয়েটার বংশপরিচয় তাকে আরো বেশি লজ্জিত করছে নিজের কাজে। অপরাধবোধ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে কিন্তু তার থেকে মুক্তি পাওয়ার পথও নেই। কারণ মেয়েটার কাছে মাফ চেয়ে নিজের অপরাধবোধের বোঝা কমাতে পারবেন না কোনোদিন। বাকি জীবন এই অপরাধবোধের বোঝা মাথায় নিয়ে কাটাতে হবে। এসব ভেবে ইকবালের চোখ গেলো বিছানায় পড়ে থাকা ছেলের ক্লান্ত মুখশ্রীর দিকে। ইকবাল আজ বুঝতে পারছে তাজের কষ্ট। ছেলেটা যে গত প্রায় ছয়টা বছর ধরে এই অপরাধবোধ বয়ে বেড়াচ্ছে আর বাকি জীবনটাও বয়ে বেড়াতে হবে। নিজের ছেলের জন্য কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে ইকবালের। সহ্য করতে না পেরে এবার বের হয়ে গেলো রুম থেকে। ইরিনা ধ্রুবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
ধ্রুব হঠাৎ বললো, বাবা কী ঘুমাচ্ছে ?
ইরিনা মুগ্ধ হয়ে শুনলো ধ্রুবর কথা। আসছে পরে ধ্রুব এই প্রথম কথা বললো। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, আসলের চেয়ে সুদ মিষ্টি। নাতিকে পেয়ে ইরিনার অবস্থাও তেমন।
,,,,,,
শুভ্র রঙের শাড়ি গায়ে জড়ানো, মাথায় সদ্য ফোঁটা সাদা গোলাপের ব্যান্ড। সাদা গোলাপের বাগানের মাঝে হেঁটে যাচ্ছে এক রমণী, কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা চুলগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে।
দাঁড়াও কে তুমি ?
রমণী ফিরে তাকালো না তাজের কথায়। তাজের কানে বারি খেলো খিলখিল হাসির আওয়াজ। সে হাসিতে তাজের বুক কেঁপে উঠলো। তাজকে উপেক্ষা করে সেই রমণী চলে যেতে নিলে তাজ পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরলো।
“বুঝবে তুমি বুঝবে
যেদিন সব বুঝবে
হারিয়ে আমায় খুঁজবে
তবে দিনশেষে শূণ্য হাতে
নিজের নীড়ে ফিরবে
বিষাক্তফুল নেই আপন করতে
তার ঘ্রাণেও যে হবে প্রাণনাশ”
রমণী না হাত ছাড়ালো আর না তাজের দিকে ফিরে তাকালো। ছন্দ ছন্দে কথাগুলো বলে আবার খিলখিলয়ে হাসতে লাগলো। সে রমণীর হাত ছেড়ে দিলো তাজ।
মুচকি হাসলো তিতির, না একটা হিসেব এখনো বাকি রয়ে গেছে।
তিতির নিজের পেছন থেকে হাত ধরে বের করে আনলো ছোট্ট ধ্রুবকে। ছোট্ট ধ্রুবর ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে মিষ্টি হাসি।
এই হিসেবটা বাকি থেকে গেছে তাজ। মনে পরে সেই রাতের কথা ? সেই রাতের প্রমাণ আমার জীবনের ধ্রবতারা এই তাহিয়ান খান ধ্রুব। ও শুধু আপনার সন্তান নয় তাজ। আপনার সারাজীবনের শাস্তি, অনুশোচনা, অপরাধবোধ। আপনি যতবার ওর দিকে তাকাবেন নিজের অনুশোচনার আগুনে পুড়বেন। আপনি তো বলেন আমি আপনার জীবনের বিষাক্তফুল। যেখানে বিষাক্তফুলের ঘ্রাণেও হয় প্রাণনাশ সেখানে ধ্রুব এই বিষাক্তফুলের একটা অংশ তাজ। তাজ পারবেন তো বিষাক্তফুলের এই অংশ আগলে রাখতে।
তাজ কাঁপা গলায় বললো, পাড়বো।
তিতির ধ্রুবর ছোট হাতটা তাজের হাতে তুলে দিলো, তবে নিন আপনার শাস্তি।
ধ্রুবকে তাজের হাতে দিয়ে তিতির সামনে হাঁটতে লাগলো আবার।
তাজ পেছন থেকে চিৎকার করে বললো, দাঁড়াও তিতির যেও না। আমাকে একবার সুযোগ দাও মাফ চাওয়ার, একবার ফিরে এসো আমার জীবনে।
ধীরে ধীরে কুয়াশায় মিলিয়ে গেলো তিতির, তাজের হাতে রেখো গেলো তাজের শাস্তি।
তিতির বলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো তাজ। ঘামে সারা শরীরে ভিজে গেছে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো তাজ। অনেকটা সময় লাগলো নিজেকে সামলাতে। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে৷ নিজের পাশে বেডে চোখ পড়তেই দেখতে পেলো ধ্রুব ঘুমিয়ে আছে তার পাশে। ফ্লোরে বসে বেডে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে ইরিনা আর সোফায় ইকবাল। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে গেলো তাজের। অস্থির হয়ে উঠলো তাজ। পাশ থেকে ধ্রুবকে একহাতে কোলে তুলে নিলো। বের হয়ে গেলো রুম থেকে। দরজায় ধরাম করে শব্দ হলে ঘুম ভেঙে গেলো ইরিনার। বেডে তাজ বা ধ্রুব কাউকে না দেখে চোখের ঘুম উধাও হয়ে গেলো।
ওগো শুনছো ছেলেটা কোথায় গেলো আবার ?
ইরিনার কান্নারত চিৎকারে ঘুম ছুটলো ইকবালের। ইরিনার থেকে শুনে রুম থেকে বের হয়েই তাজকে ডাকতে লাগলো জোরে জোরে। আহান ঘুমায়নি তাই বের হয়ে এলো নিজের রুম থেকে। ইকবালের থেকে সবটা জেনে ছুটলো তিতিরের কবরের দিকে।
ঘুমন্ত ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে কবরের পাশে ধপ করে বসে পড়লো তাজ। কৃত্রিম আলোয় চারপাশ আলোকিত, তবে অন্ধকার নেমে এসেছে তাজের জীবনে। আদৌও কী আর কখনো কাটবে এই অন্ধকার ? না এ অন্ধকার কাটার নয়। তাজের চোখের পানি টপটপ করে পড়ছে তিতিরের কবরে।
প্লিজ ফিরে এসো তিতির। একবার মাফ চাওয়ার সুযোগ দাও। একটা ভুলের এতবড় শাস্তি তুমি কীভাবে দিতে পারো আমাকে ? একবার ফিরে এসো, তোমাকে অভিযোগ করার সু্যোগ দিবো না আর কোনোদিন।
ডুকরে কেঁদে উঠলো তাজ। তিতিরের কী একটুও মায়া হচ্ছে না তাজের উপর ?
ঝুম বৃষ্টিতে অন্ধকার রাত আরো নিকষকালো অন্ধকারে রুপ নিয়েছে। শীতকালের বৃষ্টি কারোই পছন্দ হওয়ার কথা নয়, তবে মৌয়ের ভালোই লাগছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে সে, বাতাসের ঝাঁপটায় বৃষ্টির ছিটেফোঁটা গায়ে এসে লাগছে। পাতলা ফিনফিনে শাড়ি ভেদ করে ঢোকা ঠান্ডা বাতাসে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এতেও মন্দ লাগছে না। মৌ ঘুরে তাকালো রুমের দিকে। দুই বছরের ছোট্ট মেয়ে শায়িনীকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে শান। মৌ ভালো আছে, তার সংসার আজ পরিপূর্ণ তবু কোথাও রয়ে গেছে চাপা দীর্ঘ শ্বাস। সবার সামনের সুখী দাম্পত্য জীবনের আড়ালের এই দীর্ঘ শ্বাস কেউ দেখে না, শানও নয়। শান নিসন্দেহে একজন ভালো মানুষ, ভালো স্বামী আর ভালো বাবাও। মৌকে কখনো তার অতীত মনে করিয়ে দেয়নি বরং চেষ্টা করেছে তার ভালোবাসায় সব ভুলিয়ে দিতে। দিন শেষে মৌ মানিয়ে নিয়েছে নিয়তির সাথে। তার জীবনে তাজ নয় শানই ছিলো। তবে মাঝে তাজের আসাটা কী খুব জরুরি ছিলো ? ভাগ্য যখন শানের সাথেই জুড়ে ছিলো তাহলে তাজের জন্য মায়া কেনো তৈরি হলো মনে ? তাজের প্রতি তার ভালোবাসা কোনো আবেগ ছিলো না, সেটার প্রমাণ আজও একান্তে মৌয়ের মনে তাজের বিচরণ। মৌ জানে এটা পাপ, অন্যায় কিন্তু মন ? সেটা যে অবুঝ পাখি, খাঁচায় বন্দী রাখলেও ডানা ঝাঁপটে যন্ত্রণা দেয় আর মুক্ত করে দিলে উড়ে গিয়ে বসে নিষিদ্ধ গাছের ডালে। একান্ত সময়গুলো বড্ড যন্ত্রণায় কাটে মৌয়ের, জীবনের পূর্ণতার খাতায় একটা শূন্য অংশ সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে তাকে।
মৌ কালো মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালো, হে খোদা যার জন্য যাকে বানাও নাই তার জন্য মায়া কেনো দাও ? কেনো নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের এতো আকর্ষণ। আমি তো চাই আমার স্বামীকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে। কিন্তু কোথায় যেনো তবু ফাঁকা থেকে যায়।
মৌ অনুভব করলো তার চোখ ভিজে উঠেছে। আজকের চোখের জল তাজকে না পাওয়ার নয়, তাজকে ভুলে শানকে পুরোপুরি ভালোবাসতে না পারার ব্যর্থতার। যে ব্যর্থতা কিছুতেই চায় না মৌ। এখন সে চায় তার মনে কেবল শানের রাজত্ব চলুক, শুধুমাত্র শানের। গায়ে কিছু মেলে দেওয়ায় শীত অনুভব না হলে মৌ নিজের দিকে তাকালো। একটা শাল জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার গায়ে। মুহূর্তে একজোড়া হাত পেছন থেকে জড়িয়ে নিলো তাকে।
এই শীতের মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছো ?
বৃষ্টি বিলাশ করছিলাম।
চমকে উঠলো শান, তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেনো মৌ ?
শান মৌকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মুখটা উঁচু করে ধরলো। মৌয়ের চোখ ভেজা দেখে বুক ধক করে উঠলো শানের। এই চোখের পানি সহ্য হয় না তার।
ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে বউ তুমি কাঁদছো কেনো ?
মৌ কিছু না বলে শানকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো, আমি অনেক খারাপ তাই না ?
শান মুচকি হেসে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো মৌকে, কে বলেছে আমার বউ খারাপ কার এতবড় সাহস ?
মজা করবেন না শান।
আচ্ছা বাবা মজা করবো না। এখন বলো কী হয়েছে কাঁদছো কেনো ?
নিজের প্রাণকে ভালো না বেছে থাকা যায় বলো ? আমি জীবনে কোনোদিন প্রেম করিনি, আমার সব ভালোবাসা আমার বউয়ের জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম। এতো বছর ধরে যার জন্য ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছি, তাকে ভালো না বাসলে কাকে ভালোবাসবো ?
কান্নার বেগ বাড়লো মৌয়ের, আমি যে আমার অতীত ভুলতে পারি না তবু।
দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো শান, অতীত ভুলা যায় না মৌ। প্রথম ভালোবাসা তো আরো ভুলা যায় না। কিন্তু অতীত আঁকড়ে কষ্ট পাওয়া বোকামি। আমাদের উচিত অতীতটাকে মনের এক কোণে সযত্নে লুকিয়ে রেখে বর্তমানটা উপভোগ করা। অতীত তুমি যত ভুলতে চাইবে তত বেশি মনে পড়বে। তাই সেটা ভুলতে চেষ্টা না করে বরং বর্তমানকে ভালোবাসার চেষ্টা করো মৌ।
মৌ শানকে শক্ত করে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো শান সেভাবে কিছু সময় থেকে বললো, রুমে চলো এখানে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে শেষে মেয়েও কষ্ট করবে।
আর একটু থাকি না।
শান আর কিছু বললো না। মৌকে ভালো করে জড়িয়ে নিলো শাল দিয়ে। সেভাবেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন।
২৬.
প্রতি বছর এই দিনে সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশে আসে আহান। সাতদিন এখানে থেকে ফিরে যায় নিজেদের ব্যস্ততম জীবনে। বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো আহান। এই দেশের মাটিতে মিশে আছে তার আপনজন। ধ্রুব আর পাখি খুশীতে লাফাচ্ছে। ন্যান্সি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে মলিন মুখে। দু’টোই যে অবুঝ তারা কী জানে এখানে এসেছে আনন্দ করতে নয়। হায় কপাল যদি বুঝতে পারতো।
সবাইকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো আহান। এখানে আসলে তার কষ্ট হয়, পুরানো ক্ষত তাজা হয়ে উঠে।
ধ্রুব আহানের দিকে তাকিয়ে বললো, পাপা আমরা কোথায় যাচ্ছি ?
এ নিয়ে একই প্রশ্ন অনেকবার করেছে ধ্রুব কিন্তু নিরব ভূমিকা পালন করেছে আহান। আজ তার কারো সাথেই কথা বলতে ভালো লাগছে না। আহান ধ্রুবকে নিয়ে ড্রাইভারের পাশের সীটে বসেছে আর পাখি, ন্যান্সি পিছনে।
আহান ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে বললো, তোমার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
ধ্রুব গোল গোল চোখে তাকালো আহানের দিকে। তার কথার মানে বুঝতে পারেনি যে।
বেশ অনেকটা জার্নি করার পর কাংখিত জায়গায় পৌঁছে গেলো সবাই। ধ্রুব ঘুমিয়ে পড়েছে আহানের বুকে। তাকে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো আহান। পাখিও নেমে গেছে, আশপাশটা দেখছে সে। আহানকে দেখে দৌড়ে এগিয়ে এলো এক ভদ্রলোক।
স্যার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো ?
আহান শান্ত গলায় বললো, নাহ। এদিকে সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে ?
জী স্যার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
আহান তাকালো বাড়ির দিকে। এখন আর বাড়িটাকে কেউ ভূতের বাড়ি বলতে পারবে না। রঙচটা বাড়ি চকচক করছে নতুন রঙে, বাড়ির আঙিনা জঙ্গলের পরিবর্তে নানা প্রজাতির ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে। আহান তো আর তার তুতুলকে যেখানে রেখেছে সেখানকার প্রতি উদাসীন থাকতে পারে না। আহান কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা কবরের দিকে পা বাড়ালো।
ন্যান্সির উদ্দেশ্যে বললো, পুতুলকে নিয়ে ভেতরে যাও মাম আমরা আসছি।
ন্যান্সি পাখিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এতটা জার্নি করে পাখিও ক্লান্ত তাই সে আর কোনদিকে না তাকিয়ে ন্যান্সির সাথে চলে গেলো। আহান দিয়ে দাঁড়ালো কবরের সামনে, তার কোলে ঘুমন্ত ধ্রুব। বুকল ফুল পড়ে বিছিয়ে আছে কবরের উপর, বকুল ফুলের মিষ্টি সুবাস নাকে লাগছে।
কেমন আছিস তুতুল ? হয়তো ভালোই আছিস, ভালো থাকার জন্যই তো এভাবে চলে গেলি। আমি কিন্তু ভালো আছি, নিজের কথা রেখেছি। এই দেখ তোর ছেলে, কত বড় হয়ে গেছে। দু-হাতে আগলে বড় করছি, কখনো বাবা-মায়ের অভার বুঝতে দেয়নি আর কোনদিন দেবো না। আমি কিন্তু ধ্রুবর জীবন থেকে তোর পরিচয় মুছে দেয়নি। সবার সামনে ধ্রুব আমার ছেলে হলেও খাতা কলমে তোর ছেলে হয়েই আছে। মাম্মাম-পাপা হিসাবে আমাকে আর পাখিকে জানলেও বাবা-মা হিসাবে তোকে আর মিস্টার খানকে জানে। আহান চৌধুরীর ছেলে নয় বরং তাজওয়ার খান তাজ আর মুসকান মাহমুদ তিতিরের ছেলে তাহিয়ান খান ধ্রুব। আমি তোদের পরিচয়েই বড় করছি ওকে। কিন্তু একটা ভুল করে ফেলেছি রে। ভুলতে বসেছি ধ্রুব আমার কাছে আমানত, ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে। ফিরিয়ে দিতে খুব কষ্ট হবে রে তিতির কিন্তু তুই চিন্তা করিস না। আমি আমার এই কথাও রাখবো যত কষ্টই হোক মিস্টার খান চাইলে দিয়ে দিবো তাকে তার ছেলে।
আহানের চোখের পানি ধ্রুবর ঘাড়ে পড়লে ঘুম ভাঙলো ধ্রুবর।
মুখ তুলে আহানের দিকে তাকিয়ে ছোট ছোট হাতে তার চোখ মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে বললো, তোমার কী হয়েছে পাপা, তুমি কাঁদছো কেনো ?
ধ্রুবর কাজে চমকে উঠলো আহান। দ্রুত নিজের চোখ মুছে নিলো।
ধ্রুবর গালে কিস করে বললো, আমার কিছু হয়নি বাবাই। তোমার ঘুম ভেঙে গেছে পাপা সরি।
ধ্রুব আশেপাশে তাকালো, আমরা এখানে কী করছি পাপা ?
আহান ধ্রুবকে তিতিরের কবর দেখিয়ে বললো, তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে এসেছি।
ধ্রুব কবরের দিকে একবার তাকিয়ে আহানের দিকে তাকালো, এখানে তো কেউ নেই পাপা।
আছে তো বাবাই, এখানে ঘুমিয়ে আছে তোমার মা। ঐ যে তোমাকে ছবিতে মা দেখালাম।
ধ্রুব কবরের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললো, মা।
বুক কেঁপে উঠলো আহানের। ধ্রুব কোন বাংলা স্পষ্ট বলতে পারে না। কিন্তু মা শব্দটা এতোটাই স্পষ্ট উচ্চারণ করলো আহানের বুক কেঁপে উঠলো শুনে।
আহান কাঁপা গলায় বললো, আবার বলো তো বাবাই, মা।
ধ্রুব আবারও বললো, মা উঠে না কেনো ? মায়ের ঘুম কখন ভাঙবে পাপা।
ধ্রুবকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো আহান, মায়ের ঘুম আর কোনদিন ভাঙবে না বাবাই। নিজের জীবনের বিনিময়ে তোমার জীবন পেয়েছে তোমার মা, কখনো এই জীবন নষ্ট করো না বাবাই।
আহানের বড় বড় কথার মানে ধ্রুব বুঝতে পারলো না। তবে আহানের বুকের সাথে মিশে তাকিয়ে রইলো কবরের দিকে।
আহান মনে মনে বললো, ছেলের ডাকও কী শুনতে পাস না তুতুল ?
সিলেট বাংলাদেশের অন্যতম এক পর্যটন এলাকা। এখানেই একটা রিসোর্ট বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে এসেছে তাজ। জায়গা দেখে তার মালিকের সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করার জন্যই সিলেট আসা। তাছাড়া যান্ত্রিক জীবনের বাইরেও একটু সময় কাটানো হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠে তাজ। মনে হয় ঘড়ির মতো একই নিয়মে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে সে। এজন্যই বিজনেসটা সে প্রফেশন হিসাবে নিতে চায়নি প্রথম থেকে। দেশ বিদেশ ঘুরে শুটিং করে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্যই সব ফেলে সেটাকে প্রফেশন হিসাবে নিয়েছিল। কিন্তু সেটাই জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো তাজের।
দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিলো তাজ। ঢাকা শহরের দালানকোঠা আর ব্যস্ততম মানুষের ছুটে চলা দেখে দেখে চোখ দু’টোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
স্যার আগে হোটেলে যাবেন নাকি জমি দেখতে ?
তাজ দৃষ্টি বাইরে রেখেই বললো, আগে হোটেলে চলো। ফ্রেশ হয়ে বিকেলে প্রোপার্টির মালিকের সাথেই যাবো।
ঠিক আছে স্যার।
হোটেলে গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে নিলো তাজ। দুপুরের লাঞ্চের সময় হয়েছে তাই ফোন করে খাবার রুমে দিয়ে যেতে বললো। খাবার খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেবে ভেবে নিলো।
ভেজা চুল মুছতে মুছতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। ঢাকা আর সিলেট শহরের তফাৎ অনেক, ঢাকায় বড় বড় দালানকোঠার দেখা মিললেও গাছের দেখা মেলা দুষ্কর। কিন্তু সিলেট শহরে দালানকোঠার সাথে আছে সবুজ গাছের সতেজতা। গত পাঁচ বছরে রায়হানের সাথে অনেকবার দেখা করেছে তাজ শুধুমাত্র তিতিরের ঠিকানা জানার জন্য। রায়হান প্রতিবার একটু একটু করে বলেছে তাজকে, কখনো সম্পূর্ণ বলে না। হয়তো তাজকে এভাবে তড়পাতে দেখতে ভালো লাগে রায়হানের। রায়হান বলেছে তিতির সিলেটের মেয়ে, তার জন্ম এই সিলেট জেলায়, বাবা-মায়ের সাথে শৈশবও কেটেছে এখানে। কিন্তু বাবা-মা খু*ন হওয়ার পর তিতিরের জীবনটা এক ঝটকায় এলোমেলো হয়ে গেছে। তাজের কাছে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে, তিতিরের বাবা-মা খু*ন হয়েছিলো কীভাবে ? রায়হানের বাবা-মা কোথায় ? রায়হানের বাবার শাস্তি কেনো হয়নি এখনো ? রায়হান তো সব বলে দিয়েছে সবার সামনে। তিতির এখন কোথায় আছে আর তিতিরের বাবার বাড়ি সিলেটের কোথায় ? এমন অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া বাকি তাজের। সিলেট আসলে তাজ নিজের অজান্তে খোঁজে তিতিরকে। যদিও জানে সেটা নেহাৎ বোকামি ছাড়া কিছু নয় কারণ গত পাঁচ বছরে গোটা সিলেট তন্নতন্ন করে খুঁজেছে তিতিরকে। সে যদি এখানে থাকতো তবে পেয়ে যেত তাজ। তাজ এটুকু বুঝতে পেরেছে তিতির আহানের কাছেই আছে কিন্তু আহানের কোনো তথ্য দেয়নি রায়হান। রুমের কলিংবেল বাজলে তাজ বুঝলো খাবার চলে এসেছে।
২৭.
সিলেটের শাহজালাল মাজার চিনে না এমন মানুষ হয়তো সারা বাংলাদেশে খোঁজে পাওয়া যাবে না। মাজারের সামনে যত অসহায় মানুষ আছে সবার হাতে খাবার তুলে দিচ্ছে ছোট্ট ধ্রুব। আহান ধ্রুবকে কোলে নিয়ে তার হাতেই সবাইকে খাবার দিচ্ছে।
আহানের চোখে ভেসে উঠলো আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগের দৃশ্য। তিতির যাওয়ার আগে তার বাবা-মায়ের কবর আর শাহজালালের মাজার দেখে যেতে চেয়েছিলো। আহান দুটো জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো তিতিরকে।
মাজার থেকে বের হতেই ছোট্ট এক বাচ্চা হাত টেনে ধরলো তিতিরের।
বাচ্চাটা সিলেটের ভাষায় বললো, পেটর মাঝে যে বুক করের।
তিতির হাঁটু গেড়ে বসলো বাচ্চাটার সামনে, নাম কী তোমার ?
বাচ্চাটা কিছু না বলে তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে, যেনো বুঝতে পারেনি তার কথা। তিতির বাচ্চাটাকে আর কিছু না বলে সামনের একটা হোটেলে নিয়ে গেলো। নিজের ইচ্ছে মতো খাবার অর্ডার করে খাইয়ে দিলো। খাওয়া শেষে বাচ্চাটার হাতে কিছু টাকাও দিয়ে দিলো।
বাচ্চাটা হাসিমুখে চলে গেলে তিতির নিজের পেটের উপর হাত রেখে আনমনে বললো, হে আল্লাহ আমার বাচ্চাটাকে তুমি সুস্থভাবে পৃথিবীর আলো দেখাও। আমি তার প্রতি জন্মদিনে এখানকার অসহায় মানুষদের একবেলা পেট ভড়ে খাওয়াবো।
আহান তিতিরের পাশেই ছিলো তাই তিতিরের কথাটা শুনতে অসুবিধা হয়নি তার। তিতির নেই তাই তার কথা রাখতে হলেও আহান ধ্রুবর প্রতি জন্মদিনে তার হাতেই এখানকার অসহায় মানুষদের একবেলা পেট ভরে খাওয়ায়।
ক্লান্ত হয়ে সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো আহান। ফ্রেশ হয়ে সবাই রেস্ট নিচ্ছে, আজ আর কোথাও যাবে না। আগামীকাল সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যাবে ঠিক করেছে।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো আহান। শীতের দিন চারপাশের কুয়াশা এখনো কাটেনি, চা বাগানের মাঝ দিয়ে ধীর গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছে আহানদের।
ন্যান্সি বললো, এই কুয়াশায় বাইরে গেলে ধ্রুবর ঠান্ডা লাগবে তো আহান।
আহান ধ্রুবকে মাস্ক পড়িয়ে বললো, গরম কাপড় পড়িয়ে নিয়েছি আর মুখেও মাস্ক থাকবে, কিছু হবে না।
পাখি ফুপিয়ে কেঁদে বললো, আমাকে কেউ আদর করে না, আমি থাকবো না।
আহান পাখির দুগাল ধরে নিজের দিকে করে বললো, আমার ছোট্ট বউটা বুঝি রাগ করেছে ?
পাখি মাথা উপর নিচ করে বুঝালো হ্যাঁ সে রাগ করেছে।
আহান পাখির কপালে নিজের অধর ছুঁইয়ে বললো, তুমি না ধ্রুবর মাম্মাম। নিজের ছেলের সাথে হিংসা করলে হবে ?
তুমি সমান সমান আদর করবে তাহলে আমি রাগ করবো না।
আচ্ছা ঠিক আছে, সমান সমান আদর করবো। এখন চলো আমাদের যেতে হবে।
পাখিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলো আহান, এবার খুশি ?
পাখি হাত তালি দিয়ে বললো, ইয়ে কী মজা ?
আহান মনে মনে বললো, আর একটু বুঝদার হলে খুব অসুবিধা হত কী ?
গাড়ির কাছাকাছি এসে পা থমকে গেলো আহানের। কুয়াশা ভেদ করে দেখতে পেলো একটা প্রাইভেট কার এলোমেলো হয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে আহানের গাড়িতে ধাক্কা মারবে।
আহান চিৎকার করে বলে উঠলো, ধ্রুব।
পাখি ভয়ে আহানের গলা জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। গাড়িটা আহানের গাড়ি ধাক্কা দিতে গিয়েও একটুর জন্য পাশ কাটিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে গাছে ধাক্কা মারলো। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে আহান কিছুটা সময়ের জন্য থমকে গেলো। হুঁশ ফিরতেই পাখিকে কোল থেকে নামিয়ে দৌঁড়ে সেই গাড়ির দিকে গেলো। গাড়ির সামনের অংশ ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। স্টিয়ারিং এর উপর মাথা রেখে পরে আছে একজন। আহান গাড়ির ভেতরে দেখলো আর কেউ আছে কিনা, না কেউ নেই। আহান স্টিয়ারিং থেকে মাথা তুলে মুখটা দেখে থমকে গেলো। এটা সে কাকে দেখছে ? কোনোদিন সামনাসামনি না দেখলেও মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হলো না আহানের।
বিড়বিড় করে বললো, মিস্টার খান ?
আহান যে নিজের বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কী করবে, কী করা উচিত কিছু বুঝে উঠতে পারছে না সে ? তাজের সাথে এখানে এভাবে দেখা হবে কল্পনা করতে পারেনি আহান।
কী হয়েছে আহান ?
গাড়ি থেকে ন্যান্সি, ধ্রুব, রবি সবাই নেমে এসেছে। আহানের হুঁশ ফিরলো তাদের ডাকে। নিজেকে সামলে তাজের হাত ধরে পালস চেক করলো। না বেঁচে আছে এখনো, পালস চলছে।
রবি আমাকে হেল্প করো।
আহান আর রবি অনেক কষ্টে গাড়ি থেকে বের করলো তাজকে। পাখি কেমন অস্থির হয়ে উঠলো এতো রক্ত দেখে।
পাখি মাথা চেপে ধরে বললো, আপুনি আপুনি। আমার আপুনি, রক্ত, আপনি কাঁদে।
আহান যেনো অথৈ সাগরে পড়লো এবার। কাকে সামলাবে সে ? তাজকে দ্রুত হসপিটালে নেওয়া প্রয়োজন, এদিকে পাখি ডেস্পারেট হয়ে উঠেছে আবার। তার মনে পড়ে গেছে তিতিরের কথা। এদিকে তাজের মুখ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে ন্যান্সি। সেও চিনতে পেরেছে তাজকে। যদিও হুবহু ছবির মতো নেই চেহারা, ছয় বছরে চেঞ্জ হয়েছে। কিন্তু যার ছবি বুকে নিয়ে তিতির রোজ সবার আড়ালে কাঁদতো, নিজের সন্তানের সাথে কথা বলতো যার ছবি দেখিয়ে, তাকে ন্যান্সির চিনতে অসুবিধা হলো না। তাছাড়া আহান তো প্রায় তিতির আর তাজের ছবি দেখায় ধ্রুবকে। ন্যান্সি আহানের দিকে তাকালে আহান অসহায় চোখে তাকালো তার দিকে। ন্যান্সি ধ্রুবকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। ধ্রুবকে উল্টো দিকে মুখ করিয়ে কোলে নিয়েছে ন্যান্সি। বাচ্চা ছেলে রক্ত দেখে ভয় পাবে ভেবে। ধ্রুব বারবার দেখার চেষ্টা করলেও ন্যান্সি শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে তাকে।
আহান বললো, রবি অ্যাম্বুলেন্স ডাকার মতো সময় নেই। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।
চিন্তা করবেন না স্যার, আমি নিয়ে যাচ্ছি।
আহান ন্যান্সির দিকে তাকিয়ে বললো, মাম আমরা বাড়ি থেকে বেশি দূরে আসিনি। আমি ফোন করে দিচ্ছি বাড়ি থেকে গাড়ি আসলে তুমি ওদের নিয়ে বাড়ি চলে যাও।
আহান তাজকে গাড়ির পেছনের সীটে শুইয়ে দিয়ে মাথায় নিজের রুমাল বেঁধে দিতে দিতে বললো। ন্যান্সি তখনো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আহান তাড়াহুড়ো করে সব করার চেষ্টা করছে। রবি ড্রাইভিং সীটে বসে পড়েছে।
আহান দৌড়ে এসে পাখিকে জড়িয়ে ধরে বললো, শান্ত হয়ে যাও আমার পুতুল। তোমার আপুনি ভালো আছে।
আহান কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। পাখি নিজের মাথার চুল খামচে ধরে আপুনি আপুনি করে যাচ্ছে। ন্যান্সি ধ্রুবকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ধ্রুবও কেমন ছটফট করছে কী হয়েছে দেখার জন্য। নানা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।
রবি বললো, স্যার লোকটা মরে যাবে এভাবে থাকলে।
আহান চিৎকার করে উঠলো, নাহ উনাকে বাঁচতে হবে। উনার অনেক কিছু জানার বাকি আছে।
আহান দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে বসে তাজের মাথা নিজের কোলে তুলে নিলো। সাদা রুমাল রক্তে ভিজে উঠেছে। রবি যত দ্রুত পারছে গাড়ি চালাচ্ছে। আহান বাড়িতে ফোন দিয়ে দ্রুত গাড়ি পাঠাতে বললো আর তাজের গাড়িতে ফোন বা অন্যকিছু পাওয়া যায় কিনা দেখতে বললো। তার ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ করার মতো।
আহান তাকালো তাজের মুখের দিকে। ধ্রুব মায়ের অনেকটা পেলেও বাবারও কিছুটা পেয়েছে। আহান সেটা আজ বুঝতে পারলো। তাজের গায়ের সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে গেছে। ফোনের আওয়াজ পেয়ে আহান তাজের পকেটে খুঁজতে লাগলো। কারণ এটা তার ফোনের আওয়াজ নয়।
ফোন পেয়ে বের করে দেখলো ফোন অক্ষত আছে, সবুজ নামের কেউ কল দিচ্ছে। রিসিভ করলে আহান বুঝতে পারলো সবুজ তাজের পি.এ। আহান সব খুলে বলে তাজেকে কোন হসপিটালে নিচ্ছে তার নাম বলে দিলো। এদিকে ভয়ে সবুজের গলা শুকিয়ে গেলো। ফোন কাটতেই স্কিনে তিতিরের ছবি ভেসে উঠলো। আহান অবাক হয়ে তাকালো ফোনের স্কিনে তারপর তাজের মুখের দিকে। আহান যতটা জানে তাজ ভালোবাসতো না তিতিরকে, তবে তিতিরের ছবি কেনো তার ওয়ালপেপারে এখনো ?
বিশাল দুতলা বাড়ির দক্ষিণপাশে পুকুরের ওপারে বকুল গাছের নিচে ঘুমিয়ে আছে তিতির। এপারে পুকুরের সিঁড়িতে বসে আছে আহান। তিতিরপাখিকে নিয়ে লন্ডন যাওয়ার আগেও একবার এই বাড়িতে এসেছিলো তারা। রঙচটা বাড়িটা যেনো ভূতের বাড়িতে রূপ নিয়েছে। একসময় কত হাসিখুশিতে ভরপুর থাকতো এই বাড়িটা, আজ চারদিকে কেবল নিস্তব্ধতা। বাড়িতে গুটিকয়েক কাজের লোক ছাড়া কেউ নেই। বাড়ির আঙিনায় কতশত স্মৃতি আহু আর তুতুলের। আহান চোখ মুছে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। এটা আট মাস আগে বাংলাদেশে এসে কিনেছিলো সেই ফোন। আহান সব প্রমাণ পুলিশকে দিয়ে ফোন থেকে সেই যে সিম খুলে ফেলেছিলো আর সিম লাগায়নি। তিতিরের মৃত্যুর পর এই কয়েকদিনে অনেকবার চেয়েছে তাজের সাথে যোগাযোগ করে সবটা জানাতে। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছে, যেখানে তিতির ইচ্ছে করে তাজকে কিছু জানায়নি সেখানে সে কীভাবে জানাবে ? তিতির তো বলে গেছে তাজ যদি কোনোদিন ধ্রুবর খোঁজে আসে তবে ডায়েরিটা তাকে দিতে কিন্তু আহানকে বলেনি তাজকে খুঁজতে। আহান ফোনটা আবার রেখে দিলো পকেটে। তাজকে সে দেখেছে তিতির ফোনে ছবিতে এছাড়া চিনে না। মাত্র নয় বছর বয়সে এই দেশ ছেড়েছে, এখন খুব একটা ধারণা নেই এই দেশ সম্পর্কে। আহান উঠে দাঁড়ালো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে একটা পদ্মফুল ছিঁড়ে নিলো, হাতে কাঁটাও ফুটলো। কাঁটা দেখে মুচকি হাসলো, ছোটবেলায় তুতুল কত বায়না ধরতো এই ফুল এনে দিতে কিন্তু আহান কাঁটার ভয়ে আসতো না। ফুলটা হাতে নিয়ে কবরের দিকে এগিয়ে গেলো, শ্যাওলা ধরা পাথরে বাঁধানো দু’টো পুরানো কবরের পাশে একটা নতুন বাঁধানো কবর। আহান ফুলটা তুতুলের কবরের মাথার দিকে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
আহান মুচকি হেসে বললো, তোর মনে আছে তুতুল, ছোটবেলায় দুপুরবেলা তুই যখন মামির পাশে এভাবে শুইয়ে ঘুমিয়ে থাকতি। আমি পা টিপেটিপে এসে তোকে তুলে নিয়ে খেলতে চলে যেতাম দু’জনে। আজ আর আমার সেই সাধ্য নেই রে। তুই বরং ছোটবেলার মতো বাবা-মার রাজকন্যা হয়ে এখানেই শান্তিতে ঘুমা আমি বরং আসি। কত দায়িত্ব দিয়ে গেছিস আমাকে, সেসব পালন করতে হবে তো নাকি ? ভালো থাকিস তুই, আমিও অনেক ভালো থাকবো দেখিস।
মুখে মুচকি হাসি আর চোখের কোণে নোনাজল আহানের। চোখ মুছে কবর জেয়ারত করে লম্বা কদমে চলে এলো সেখান থেকে। সোজা নিজের গাড়িতে গিয়ে বসলো, গাড়িতে বসে একবার কবরের দিকে তাকিয়ে জানলায় কাঁচ তুলে দিলো। ড্রাইভারকে বললো এয়ারপোর্টের দিকে যেতে। একবার মনে হয়েছিলো রায়হানের সাথে দেখা করে জানতে চাইবে কী লাভ হলো এতো পাপ করে ? কিন্তু পরক্ষণে ইচ্ছেটা মরে গেছে, তাই সোজা লন্ডন ফিরছে আহান। সেখানে ন্যান্সি একা আছে পাখি আর ধ্রুবর সাথে। সিলেটের সবুজ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আহান চললো এয়ারপোর্টের দিকে। সবুজের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,
“যদি আপন না হবে প্রিয় তবে স্বপ্ন কেন দেখাও,
যদি ছেড়েই চলে যাবে তবে মায়া কেন বাড়াও।”
২৪.
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রায়হানের সাথে দেখা করতে এসেছে তাজ। তাজের সাথে করা অন্যায় আর হসপিটালের অসহায় রোগীদের স্বল্প টাকায় অপারেশনের নামে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ (যেমনঃ চোখ, কিডনি) এসব বের করে নিয়ে বিদেশে পাচার করার জন্য যাবত জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তার। ডার্ক ডেভিল নামে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে সংযুক্ত ছিলো সে। অনেক ইনফরমেশন রায়হানের থেকে উদ্ধার করেছে র্যাব। তবে কয়েকদিন ধরে তাজের সাথে সে দেখা করতে চাইছে কিন্তু তাজ যায়নি। কিন্তু লাস্টবার বলেছে তিতিরের খোঁজ চাইলে যেনো তার সাথে দেখা করে। তাজ যাওয়ার কিছুক্ষণ পর দেখা হলো রায়হানের সাথে। জেলের ওপারে রায়হান আর এপারে তাজ। চুল, গোঁফ, দাঁড়িতে রায়হানকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে তাজের। তবে তার চোখেমুখে কোনো অনুশোচনা দেখা গেলো না।
তাজ উত্তেজিত হয়ে বললো, বল তিতির কোথায় ?
রায়হান মুচকি হেসে বললো, তুই মুক্ত হয়ে সারা পৃথিবীতে ঘুরে জানিস না তিতির কোথায় আর আমি ঐ চারদেয়ালে বন্দী থেকে কীভাবে জানবো তিতির কোথায় ?
রেগে গেলো তাজ, তাহলে আসতে বলেছিস কেনো ?
রায়হান কিছু না বলে হা হা করে হাসতে লাগলো, তোকে দেখে বড্ড করুণা হচ্ছে আমার তাজ। যদিও সেটা তোর হওয়া উচিত আমার জন্য বাট উল্টোটা হচ্ছে।
তাজ বিরক্ত হলো রায়হানের কথায়। এর এসব ফা*ল*তু কথা শোনার ইচ্ছে নেই তাজের তাই চলে যেতে নিলে রায়হান পেছন থেকে ডাকলো, আরে শুনে তো যা কেনো আসতে বলেছি।
তাজ ঘুরে তাকিয়ে বললো, তোর বা*জে বকবক শোনার ইচ্ছে নেই আমার। তবে হ্যাঁ তোকে একটা গুড নিউজ দেওয়ার আছে। বিয়ে হয়েছে মৌয়ের, নাহ্ আমার সাথে নয়, তোদের কলিগ শানের সাথে।
রায়হান মুচকি হেসে বললো, তোর সাথে তো হয়নি আমি এতেই খুশি।
আসলে তুই মৌকে কখনো ভালোই বাসিসনি। তোর শুধু হিংসা ছিলো আমার উপর।
রায়হান তাজের হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের কলার থেকে, একদম ঠিক ধরেছিস তুই। ভালোবাসা থাকলেও একসময় সেটা জেদে পরিণত হয়েছিলো। তোর থেকে আমি তো কোনোদিকে কম ছিলাম না, তবু মৌ আমার ভালোবাসা পায়ে পিষে বারবার তোর পিছনে ঘুরঘুর করেছে। তাই ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি মৌকে পাই আর না পাই তোকে পেতে দিবো না।
তাজ রাগে ফোঁস ফোঁস করে বললো, তুই একটা সাইকো রায়হান।
তাজ রেগে বের হতে গেলে রায়হান পেছন থেকে সেই সুরে শিস বাজাতে লাগলো। তাজ থেমে গেলো, আটমাস আগে রায়হান আসার সময়ও এই সুরে শিস বাজিয়েছে। কিছু তো রহস্য আছে এই সুরে। তাজ আবার ঘুরে তাকালো রায়হানের দিকে।
রায়হান মুচকি হেসে বললো, আসল কথা না জেনেই চলে যাচ্ছিস তুই।
তাজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো রায়হানের দিকে রায়হান এবার গেয়ে উঠলো,
ওরে খোকা তুই আমার দু’চোখের মণি
কষ্ট ভুলে যাই ‘বাবা’ ডাকিস যখনই।
দেখে তোর হাসি, আমি সুখে ভাসি-
দুঃখরা ঝরে যায় তখনই…
খোকা, আয় তুই বুকে এখনই খোকা,
আয় তুই বুকে এখনই।
সেই সুরের গানের কলিটা গেয়ে উঠলো রায়হান। তাজ কিছু বুঝতে না পেরে শুধু তাকিয়ে আছে রায়হানের দিকে। কী বুঝাতে চাইছে রায়হান সেটা বুঝার চেষ্টা করছে।
রায়হান তাজের দিকে তাকিয়ে আবার হা হা করে হেসে বললো, তোর মস্তিষ্কে জং ধরেছে তাজ।
তাজ বিরক্ত গলায় বললো, মানে কী এসবের ?
রায়হান জেলের রড ধরে ফিসফিস করে বললো, তোর মতো হতভাগ্য বাবা এই পৃথিবীতে দু’টো নেই রে তাজ। যে নিজের সন্তানের আগমনের কথাই জানে না। যে নিজের সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনে সুখে ভাসতে পারবে না।
শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেলো তাজের। রায়হান এসব কী বলছে ? অজানা অনুভূতিতে বুক ঢিপঢিপ করছে, হাত-পা কাঁপছে, চোখে পানির কণা চিকচিক করছে।
রায়হান আয়েশ করে বলতে লাগলো, তিতিরকে যে রাতে তুই ওর ফ্ল্যাটে দিয়ে এসেছিলি সে রাতেই আমার লোক ফোন করে জানায় আহান পাখিকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। আহান আমার ভাই যার কাছে আমি তিতিরের বোন পাখিকে রেখেছিলাম। বিয়ের খুশিতে কারো খবর নেয়নি তেমন। কিন্তু সেই ফোন পেয়ে প্রথমে ফোন দেই যে তিতিরের উপর নজর রাখে তার কাছে। সে জানায় তিতির আজ একটা হসপিটালে গিয়েছিলো কোনো কারণে, সেখান থেকে বেড়িয়ে সামনের রাস্তায় বসে কাঁদতে থাকে আর সেখান থেকে তুই গিয়ে তাকে তার ফ্ল্যাটে রেখে এসেছিস। একটু খটকা লাগে আমার, তখনই হসপিটালে আমার থাকা লোকের মাধ্যমে জানতে পারি তিতির প্রেগনেন্ট। বুঝেছিস তাজ, এতোদিনে তোর সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেছে হয়তো। কিন্তু তুই বাবা হয়ে সেটা জানতেই পারিসনি।
তাজ কাঁপা গলায় বললো, এজন্য সেদিন বলেছিলি তিতির যাওয়ার আগে আবার আমার থেকে কিছু কেঁড়ে নিয়ে গেছে।
রায়হান অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তাজের হাত নিজের কলার থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। তাজের শরীরে যেনো অসীম শক্তি ভড় করেছে।
বল ওরা কোথায় আছে ? আমি জানি তুই সব জানিস।
তাজের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কারারক্ষী এগিয়ে এলো। রায়হানের থেকে তাজকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করলো। রায়হানের কলার ছেড়ে দিলেও রড শক্ত করে ধরে রাখলো তাজ আর বারবার তিতিরের কথা জানতে চাইলো। অনেক কষ্টে কয়েকজন কারারক্ষী মিলে একটু দূরে আনলো রায়হানের থেকে। রায়হান তখনো অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ছে।
রায়হান হঠাৎ থেমে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, এই রিয়াকশনটা দেখার জন্যই আজ সত্যিটা তোকে জানালাম আমি। আমি এই চার দেয়ালে বন্দী থাকবো আর তোরা শান্তিতে বাঁচবি সেটা কীভাবে হয়। গত আটমাস হন্যে হয়ে তিতিরকে খুঁজেছিস, এটা ভেবে অস্থির হয়েছিস তিতির কী কেঁড়ে নিয়েছে আবার তোর থেকে ? আর আজ থেকে দু’জনকে খুঁজবি তুই। নিজের সন্তানকে একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য ছটফট করবি। আমি তো সেটাই চেয়েছিলাম।
কথাগুলো বলে রায়হান চলে গেলো ভেতরে, তাজ নিজের ভাড় ছেড়ে দিলো। হাঁটু গেড়ে ধপ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। কারারক্ষীরা ছেড়ে দিলো তাকে।
তাজের চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে শুকনো ফ্লোরে, এটা কেনো করলে তিতির ? আমার তো অধিকার ছিলো নিজের সন্তানের কথা জানার।
তাজ উঠে দাঁড়ালো কোনোমতে। টলমলে পায়ে বের হয়ে গেলো। দিকবিদিকশুন্য হয়ে গাড়ি ছুটালো। বেশ কয়েকবার এক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে গেলো।
ইকবাল অনেকটা সুস্থ এখন তাই বাড়িতে আনা হয়েছে। ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো ইরিনা আর ইকবাল। কোনোদিকে না তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো তাজ, সেদিকে একবার তাকিয়ে নিজের মতো রইলো ইকবাল আর ইরিনা। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারলো না, উপরে বিকট আওয়াজ পেয়ে কেঁপে উঠলো।
ইকবাল উপরের দিকে তাকিয়ে বললো, দেখো তো ইরি কী হলো ?
ইরিনা সম্মতি জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। তাজের দরজার সামনে দাঁড়াতেই একটা ফুলদানি তার পায়ের কয়েক ইঞ্চি দূরে পরে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। ভয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেলো ইরিনা।
এসব কী তাজ ?
তাজের কানে সে কথা পৌঁছালো না, রুমের জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। ইরিনাও আগাতে পারছে না, শেষে কোনটা এসে শরীরে লাগে। সব ভাঙা শেষ হয়ে গেলে চুল খামচে ধরে ফ্লোরে বসে পড়লো তাজ। জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগলো। ইরিনা সাবধানে পা ফেলে তাজের কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো।
কী হয়েছে আমার বাবার ?
তাজ নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না। বসা অবস্থায় মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ইরিনা তাজের পাশে বসলে তাজ মায়ের কোলে মাথা রেখে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ইরিনা সময় দিলো তাজকে, এখন জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতে পারবে না ছেলেটা। অনেকটা সময় পর ঠান্ডা হলো তাজ, চুপচাপ শুয়ে আছ। ততক্ষণে দরজায় এসে দাঁড়ালো ইকবার।
ইরিনা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, এবার বল কী হয়েছে বাবা ?
তাজ ভেজা গলায় বললে, সবাই আমার সাথেই কেনো এমন করলো মা ? আমি তো কারো সাথে কোনো অন্যায় করিনি। রায়হান বন্ধু হয়ে এভাবে পিঠে ছুরি বসালো। আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করলো বন্ধুত্ব, মৌকে তো আমি বলিনি রায়হানকে বাদ দিয়ে আমাকে ভালোবাসতে। এ কেমন ভালোবাসা মা ? যে ভালোবাসা কেঁড়ে নিতে শেখায়। আর তিতির, তাকে তো আমি আমার জীবনে জোর করে আনিনি, সে নিজের ইচ্ছায় জোর করে এসেছে আমার জীবনে। আমি মানছি রাগের বশে একটা ভুল করে ফেলেছি, অন্যায় করে ফেলেছি তার সাথে। তাই বলে সে আমাকে না জানিয়ে আমার সন্তানকে আমার থেকে লুকিয়ে চলে যাবে ? আমার তো অধিকার আছে আমার সন্তানের উপর, তাই না মা ? যতটা অধিকার তিতিরের আছে, ঠিক ততটা অধিকার আমারও আছে।
স্তব্ধ হয়ে আছে ইরিনা আর ইকবাল। তাজের কথায় মাথা হ্যাং হয়ে গেছে তাদের। ইরিনার মনে পরলো শেষের কিছুদিন তিতিরের অসুস্থতা। সে এমন কিছুই সন্দেহ করেছিলো কিন্তু যখন তাজ আর তিতিরের মধ্যকার সম্পর্কের অবস্থা মনে হয় তখন সে ইগনোর করে যায় ব্যাপারটা। ইকবাল এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা।
গম্ভীর গলায় বললো, বাচ্চার কথা তুমি কীভাবে জানলে ?
রায়হান বলেছে সব, তাজ একে একে সব খুলে বললো রায়হান যা যা বলেছে।
ইকবাল বললো, হয়তো এবারও সব মিথ্যে বলছে রায়হান।
না এবার আর কিছুই মিথ্যা নয়। রায়হানের থেকে সব শুনে আমি সেখানেই গিয়েছিলাম তিতিরকে যেখানে বসে কাঁদতে দেখেছি। এটা সত্যি না হলে ঐ হসপিটালের বাইরে বসে কেনো কেঁদেছিলো তিতির। তার আশেপাশে ঐ একটাই হসপিটাল ছিলো সেখানে খোঁজ নিয়েছি আমি। তিতির সেখানেই ডক্টর সাবিত্রী দেবীর কাছে গিয়েছিলো, রিপোর্টও ফেলেই চলে এসেছিলো। সেই ফাইল আমাকে দেখিয়েছে ডক্টর সাবিত্রী। অনেক কমপ্লিকেশন ছিলো তিতিরের প্রেগনেন্সিতে, সেসব বলেছে আমায়, লাইফ রিস্কও ছিলো। ডক্টর সাবিত্রী তিতিরকে এবরশন করাতে বলেছিলো তার তিতির ভাবার জন্য সময় চেয়ে বের হয়ে আসে। তাই হয়তো ওভাবে কাঁদছিলো।
ইকবাল দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তিতির যা স্বার্থপর মেয়ে দেখো এবরশন করে কবেই শেষ করে দিয়েছে তার অস্তিত্ব।
তাজ যেনো ধপ করে জ্বলে উঠলো, বাবা।
তাজের মনে ভয় ঢোকে গেলো। বেঁচে আছে তো তার সন্তান, আর তিতির সেই বা কেমন আছে ? কীভাবে খোঁজে পাবে তাদের ?
আবারও সাদা বরফে ঢাকা পড়েছে আভিজাত্যের শহর লন্ডন। বরফের ছোট ছোট বল বানিয়ে বছর পাঁচের ছোট ছেলে ছুঁড়ে মারছে বছর একুশে’র এক তরুণীকে। সেই তরুণী খিলখিল করে হাসছে তাতে, নিজেও বরফের বল বানিয়ে ছুঁড়ছে বাচ্চাটার দিকে।
ধ্রুব, পাখি অনেক হয়েছে তোমাদের খেলা এবার বাসায় চলো। আহান বাসায় ফিরলে দু্’টোকে বকবে কিন্তু।
ধ্রুব আর পাখি সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলো পঞ্চাশোর্ধ ন্যান্সি কোমরে দু’হাত রেখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। ধ্রুব আর পাখি একে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু বুঝাপড়া করে নিলো। তারপর দু’জনে একসাথে ন্যান্সির দিকে বরফের বল ছুঁড়তে লাগলো আর খিলখিল করে হাসতে লাগলো।
পাখি হাসি বজায় রেখে বললো, মাম তুমিও আমাদের সাথে খেলো।
মাম ভালো হবে না কিন্তু, এভাবে বল মেরো না। আহান চলে এলে তোমাদের বকবে।
গম্ভীর গলায় কেউ বলে উঠলো, কী হচ্ছে এখানে ?
পাখি আর ধ্রুবর হাত থেমে গেলো। ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো বয়স ত্রিশের সুদর্শন আহান দাঁড়িয়ে আছে। চশমার নিচে গভীর চোখের দৃষ্টি ধ্রুব আর পাখির দিকে।
ধ্রুব চট করে ভাঙা বাংলায় বললো, আমি কিছু করিনি পাপা সব মাম্মাম করেছে।
আহান তাকালো পাখির দিকে, ধ্রুব কী বলছে পুতুল ?
পাখি হুট করে নিচ থেকে বরফের একটা বল তুলে আহানের দিকে ছুঁড়ে দিলো, হ্যাঁ আমি করেছি কী করবে তুমি ?
আহান নিজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো, তবে রে।
আহান পাখির দিকে দৌড় দিলে পাখি উল্টোদিকে ছুট লাগালো আর খিলখিল করে হাসতে লাগলো, আমাকে ধরতে পারে না।
বরফের জন্য বেশি দৌড়াতে পারলো না পাখি ধরে ফেললো আহান তাকে। ধাক্কা দিয়ে বরফে ফেলে ইচ্ছে মতো বরফ দিয়ে ঢেকে দিলো। ধ্রুব লাফাচ্ছে আর হাত তালি দিচ্ছে।
আহান বললো, আরো দুষ্টুমি করবে ?
পাখি মুখ ফুলিয়ে বললো, না।
আহান উঠে দাঁড়িয়ে পাখিকে টেনে তুললো, অনেক খেলা হয়েছে এবার বাসায় চলো।
আহান এগিয়ে এসে ধ্রুবকে কোলে তুলে নিলো। সারা মুখে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। ধ্রুবর মুখের দিকে তাকালে তার তুতুলকে দেখতে পায় আহান। ধ্রুবর মুখের আদুল একদম তিতিরের মতো। তিতিরের সাথে পাখির মিল থাকলেও ধ্রুব যেনো মায়ের কপি হয়েছে। আহান ভুলতে বসেছে ধ্রুব তার কাছে আমানত, যেকোনো সময় ফিরিয়ে দিতে হতে পারে। ভালোবাসায় আগলে রেখেছে তিতিররে রেখে যাওয়া দু’টো ভালোবাসাকে। তিতির চলে যাওয়ার দু’বছর পর পুতুলের যখন আঠারো হয়েছে তখনই পুতুলকে বিয়ে করেছে আহান। নিজের মনে অন্য কাউকে জায়গা দিতে পারবে না আহান। তাই তিতিরের কথা রাখতে, পাখিকে সারাজীবন আগলে রাখতেই বিয়ে করেছে। তবে পাখির জন্য ধীরে ধীরে মনে একটা জায়গা তৈরি হয়ে আহানের। তিতিরকে ভুলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে পাখিকে ছাড়া থাকার কথা চিন্তাও করতে পারে না। এদিকে পাখি ভুলতে বসেছে তার আপুনিকে, এইদিক থেকে পাখি অবুঝ হওয়ায় ভালোই হয়েছে। প্রথমদিকে পাখি যেমন পাগলামি করতো সারাজীবন তেমন করলে আহান সামলাতে পারতো না। তিতিরের রক্তাক্ত অবস্থা দেখে পাখির মানসিক অবস্থার আরো অবনতি হয়েছিলো। ন্যান্সি ছিলো বলে আহান দু’দিক সামলে উঠতে পেরেছে। তবে এখনো মনে পড়লে খোঁজে তার আপুনিকে। ন্যান্সির উপকার কোনোদিন ভুলতে পারবে না আহান। সেও এখন ন্যান্সিকে মাম বলেই ডাকে।
বাসায় ফিরে ধ্রুবর পোশাক বদলে দিলো আহান। তারপর নিজেও ফ্রেশ হয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে দেখলো পাখি তখনো চেঞ্জ না করে বসে আছে।
আহান ধ্রুবকে সোফায় বসিয়ে পাখিকে বললো, তুমি এখনো চেঞ্জ না করে বসে আছো কেনো ?
আহান বিষম খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। পাখি মাঝে মাঝেই এমন উদ্ভট আবদার করে বসে। আহান আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ন্যান্সি নেই, তাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মেয়েটা মাঝে মাঝে ন্যান্সির সামনে লজ্জায় ফেলে দেয় আহানকে।
আহান অসহায় গলায় বললো, একা করে নাও না রে বাবা।
পাখি আগের মতোই বললো, আমি যাবো না।
আহান হতাশ হয়ে ধ্রুবর হাতে একটা রুবিকস কিউব দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললো, বাবাই এটা মেলাও পাপা এখনই আসছে। এখান থেকে কোথাও যাবে না, ওকে ?
ধ্রুব শান্ত হয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ধ্রুব অনেক শান্ত বাচ্চা, হয়তো মায়ের কথা রাখতেই শান্ত হয়েছে। আহান ফিরে না আসা পর্যন্ত এখানেই বসে থাকবে। আহান পাখিকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো চেঞ্জ করিয়ে দিতে। পাখিটা মাঝে মাঝে বড্ড জ্বালায় আহানকে।
সন্ধ্যার নাশতা খাওয়ার সময় আহান বললো, মাম আগামীকাল কী মনে আছে তো ?
ন্যান্সি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, বাকি জীবনে কোনোদিন হয়তো ভুলতে পারবো না এই দিনটা।
আহানও চাপা শ্বাস ছেড়ে বললো, আগামীকাল আমরা বাংলাদেশে যাচ্ছি সব গুছিয়ে রেখেছো তো।
আমি সব গুছিয়ে রেখেছি মাই সান।
হঠাৎ ধ্রুব ভাঙা বাংলায় বললো, গ্রানি আমি পানি খাবো।
ধ্রুব বাংলার থেকে ইংলিশ ভালো বলতে পারে। তবে বুঝতে পারে দু’টোই। বাংলাটা এখনো শিখছে। আহান সময় কম পায় তাই শেখাতেও পারে কম। ন্যান্সি তো আর বাংলা শেখাতে পারে না আর পাখি, সে তো সেই। ন্যান্সি মুচকি হেসে চলে গেলো ধ্রুবর জন্য পানি আনতে। আহান ধ্রুবর গালে চুমু খেয়ে টিভির দিকে তাকালো।
পাখি বললো, আমাকে হামি দিলে না কেনো ?
আহান নিজের মাথা চাঁড়াল, তবে কিছু না বলে পাখির গালেও একটা কিস করলো। সোজা হয়ে বসার আগেই পাখিও আহানের গালে কিস করলো। আহান মুচকি হেসে টিভি দেখায় মনোযোগ দিলো।
২৫.
অফিসে মনোযোগ দিয়ে ফাইল দেখছে তাজ। ইকবাল খান অফিস থেকে পুরোপুরি অবসরে গিয়েছেন বলা চলে। সম্পূর্ণ দায়িত্ব এখন তাজ পালন করে। একসময়ের হাসিখুশি অভিনেতা এখন গম্ভীর বিজনেসম্যান। শেষ কবে গান গেয়েছিলো সেটা হিসেব করতে বসতে হবে। তাজ বদলে গেছে, পুরোপুরি বদলে গেছে। প্রয়োজন ছাড়া কথা বললে যেনো অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কেনো এমন হয়ে গেলো তাজ ? তিতির তো তাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে ভালো থাকতে, তবে কেনো ভালো নেই সে ? সারাদিন কাজে ডুবে থাকে, শুধুমাত্র নিজের করা একটা ভুলের অনুশোচনা ভুলে থাকতে। কাজের ফাঁকে জীবনের তাগিদে ছুটে চলা মানুষের ভীড়ে তাজ খুঁজে চলে তিতিরকে, তার সন্তানকে। আচ্ছা তাজ যে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য এতো উতলা হয়ে আছে, সেই সন্তান ফিরে পেলে তার চোখে চোখ রাখতে পারবে তো ? সে যে তাজের ভালোবাসার নয় অন্যায়ের প্রমাণ। এমন হাজারো প্রশ্নের বেড়াজালে বন্দী তাজ। এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর পেতে মরিয়া হয়ে আছে সে।
অন্ধকার অনেক আগেই গ্রাস করেছে আশপাশটা, অফিসে হয়তো আর একজনও খোঁজে পাওয়া যাবে না। তাজ উঠে দাঁড়ালো, চেয়ারে ঝুলানো ব্লেজার হাতে নিয়ে এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে লম্বা কদমে বের হলো কেবিন থেকে।
স্যার গাড়ি বার করতে বলবো ?
তাজ পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো তার পি.এ সবুজ দাঁড়িয়ে আছে।
তাজ সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো, তোমাকে না বললাম বাসায় চলে যেতে।
সবুজ মাথা নিচু করে বললো, স্যার আপনাকে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে করেনি।
আগামীকাল দু’দিনের জন্য সিলেট যাচ্ছি আমরা। পরিবারের সাথে একটু সময় কাটাতে বাসায় যেতে বলেছিলাম তোমাকে।
সবুজ তাকালো তাজের দিকে। এতো গম্ভীর মানুষটার মন কতটা ভালো সেটা সবুজ প্রমাণ পেয়েছে বারবার। তাজ গম্ভীর, কথা কম বলে কিন্তু কাউকে ধমক দিয়ে কথা বলে না। কাউকে শাসানোর হলেও খুব ঠান্ডা মাথায় আর শান্ত গলায় শাসায়। এতেই সামনের মানুষের ঘাম ছুটে যায়। পাঁচ বছর ধরে সবুজ আছে তাজের সাথে। তবে এখন পর্যন্ত তাকে একটা ধমকও দেয়নি তাজ, শুধু শান্ত নজরে একবার তাকালেই সবুজের ঘাম ছুটে যায় ভয়ে। ভয় দেখানোর জন্য সবসময় চেঁচামেচি করাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সবুজ সেটা তাজকে দেখে শিখেছে। তাজ আর সবুজ দু’জনে চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে লিফটের কাছে চলে এলো।
সবুজ অনেকটা সাহস নিয়ে বললো, স্যার সিলেট থেকে এসে আমার দু’দিনের ছুটি লাগবে।
মুলত এটা বলার জন্যই সবুজ অপেক্ষা করছিলো তাজের। কারণ কাজের সময় অন্য কথা পছন্দ করে না তাজ।
তাজ বেশ ঠান্ডা গলায় বললো, কেনো ?
স্যার চারদিন পর আমার ছেলের জন্মদিন। ছেলে অনেকদিন ধরে জেদ ধরছে এবার জন্মদিনে সে সমুদ্র দেখতে যাবে।
একটা ভুলের জন্য সে হারিয়েছে এই শব্দ বলার সুযোগ। আচ্ছা তার ছেলে হয়েছে না মেয়ে ? সে তাজের কাছে থাকলে সেও এমন জেদ ধরতো ? তাজ ভালো সন্তান, ভালো স্বামী কিংবা ভালো মানুষ হয়তো হতে পারেনি কিন্তু নিজের সন্তানকে কাছে পেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা ঠিক হয়ে যেত। আচ্ছা তার সন্তান বেঁচে আছে তো আর তিতির সে বা কেমন আছে ?
স্যার ?
সবুজের ডাকে হুঁশ ফিরলো তাজের। না এসব ভাবতে চায় না তাজ। সে মন ভড়ে দোয়া করে তিতির আর তার সন্তান যেখানেই থাকুক, যেনো ভালো থাকে। তাজ নিজের করা সব পাপের জন্য প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ে মাফ চায় আল্লাহর কাছে। ফিরে চায় নিজের সন্তান আর তিতিরকে। ওদের ফিরে পেলে তাজ আর কোথাও যেতে দিবে না তাদের। তিতির তাজের কাছে থাকতে না চাইলে তাজ নিজেকে বদলে তিতিরের মনের মতো করে গড়ে তুলবে। তবু তাজ ফিরে চায় নিজের পরিবারকে। তাজ তাকিয়ে দেখলো সবুজের দিকে, সে আশা নিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করছে।
কাজটা ভালোভাবে কমপ্লিট হয়ে গেলে তোমাকে পাঁচদিনের ছুটি দেবো।
খুশীতে চকচক করে উঠলো সবুজের মুখ। সে জানতো তাজ তাকে হতাশ করবে না। পাঁচ বছর ধরে চিনেছে তো।
বাড়িতে পৌঁছে কলিংবেল বাজালে দরজা খোলে দিলো ইরিনা।
ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।
তাজ ছোট করে হুম বলে উপরে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। ইরিনা তাজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে খাবার টেবিলের দিকে গেলো। খাবার সাজিয়ে ইকবালকেও ডেকে পাঠালো। আধঘন্টা পরে তাজ ভেজা চুলে উপস্থিত হলো ডাইনিং টেবিলে। কোনদিকে না তাকিয়ে খাবারে মনোযোগ দিলো।
ইরিনা আর ইকবাল একে অপরের দিকে তাকিয়ে উশখুশ করছে৷ দু’জন কিছু বলতে চাইছে তাজকে কিন্তু কেউ বলতে পারছে না। একজন আরেকজনকে বলতে ইশারা করছে।
হঠাৎ তাজ বলে উঠলো, কিছু বলতে চাইছো তোমরা ?
চমকে উঠলো ইরিনা আর ইকবাল। তবে ইকবাল নিজেকে সামলে বলে উঠলো, এভাবে আর কতদিন চলবে তাজ ?
তাজ স্বাভাবিক গলায় বললো, কীভাবে ?
তুমি বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি তবু হেয়ালি করছো কেনো ? বয়স তো কম হয়নি আর কত এভাবে থাকবে ? ছত্রিশ চলছে তোমার আর কত ? এমন তো নয় তুমি তিতিরকে ভালোবাসতে, তার বিরহে এমন দেবদাস হয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে।
তাজ তাকালো নিজের বাবার দিকে, পাঁচ বছর আগেই তোমাকে বলেছিলাম। নিজের ছেলেকে চোখের সামনে দেখতে চাও নাকি চিরদিনের জন্য হারাতে ? আবার যদি এই কথা উঠে সারা বিশ্ব তন্নতন্ন করে খোঁজেও ছেলের হদিস পাবে না। মনে রেখো যে নিজে থেকে হারিয়ে যায় তাকে খোঁজে পাওয়া যায় না, তার প্রমাণ তিতির আর রইলো দেবদাস হওয়ার কথা। আমাকে মদ গিলে কোথায় পরে থাকতে দেখেছো ? তিতির তিতির বলে মুখে ফেনা তুলতে দেখেছো কবে ? আমার সামনে এসব ফা*ল*তু কথা দ্বিতীয়বার শুনতে চাই না।
তাজ এবারও স্বাভাবিক রইলো, জন্ম মৃত্যু সবই আল্লাহর ইচ্ছে। আমার চাওয়া না চাওয়ায় কিছু যায় আসে না। পৃথিবীতে যার যতদিন আয়ু আছে, সে ততদিনের এক সেকেন্ড বেশি সময় থাকতে পারবে না।
তাজ খাওয়া ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো হনহনিয়ে। কোনো বাবা-মা একমাত্র ছেলের এমন জীবন মেনে নিতে পারবে ? তাজ বরাবরই প্রেম, ভালোবাসা, সংসার এসবে উদাসীন ছিলো, এখন আরো উদাসীন হয়ে গেছে। কিন্তু তার এমন ফেকাসে জীবন মেনে নিতে পারছে না ইরিনা আর ইকবাল। এখন মনে হচ্ছে তিতিরকে খোঁজে পেলে ছেলের সংসারটা অন্তত হত। সেটাও হচ্ছে না আর অন্য কিছু করারও সুযোগ নেই, কিছু বলতে গেলেও চলে যাওয়ার হুমকি দেয়।
তাজ রুমে গিয়ে থম মেরে বসলো, সত্যি কী সে একটুও ভালোবাসেনি তিতিরকে ? গত প্রায় ছয় বছর ধরে প্রতিটা সেকেন্ড তার কথা চিন্তা করে একটুও ভালোবেসে ফেলেনি ?
তাজ ভাবতে চায় না এসব। এখন সবই উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিয়েছে। সিলেট যাওয়ার জন্য প্যাকিং করতে লাগলো। জীবনের মোড় কী ঘুরতে চলেছে এই সিলেট ভ্রুমণে ?
শীতের ঝরা পাতার মতো সবার জীবন থেকে ঝরে গেছে অনেকগুলো মাস। চোখের পলক ফেলার মতো যেনো দিনগুলো কেটেছে। লন্ডনের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করছে তিতির। নয় মাসের ভরা পেট নিয়ে চলাফেরা কষ্ট হয়ে গেছে তিতিরের। প্রেগনেন্সির গত কয়েকটা মাস তিতির নিজের শরীরের সাথে যেনো নিজে যুদ্ধ করেছে। একেকটা মাস পার হয়েছে আর একেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিতিরের প্রেগনেন্সি কমপ্লিকেশনের কথা আহান জানতে পারে প্রেগনেন্সির পাঁচ মাসে। তখন এবরশন করাও অনেক বেশি রিস্ক। সেদিন আহান তিতিরের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো তুই কোনো সবটা আমার থেকে লুকিয়ে গেলি তুতুল। সেদিন কোনো উত্তর দিতে পারেনি তিতির। বলতে পারেনি তাজকে সে কতটা ভালোবাসে। সে পারেনি তার অংশ নিজের থেকে সরিয়ে দিতে। অদৃশ্য এক মায়ায় জড়িয়ে গেছে ভেতরে থাকা ছোট প্রাণটারও। গত কয়েকটা মাস আহান যেনো তিতিরকে নিজের হাতের তালুতে আগলে রেখেছে। আহানের আজ একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে, তাই বাধ্য হয়ে ভার্সিটিতে গেছে। সকাল থেকে পেটে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে তবু আহানকে বলেনি, তাহলে সব ফেলে বাসায় বসে থাকতো। এমনি নিজেকে আহানের বোঝা মনে হয় তিতিরের কাছে। আবার তার জন্য আহানের পড়াশোনার ক্ষতি হোক সেটা চায় না তিতির। হাতের কলম ডাইরির ভাজে রেখে দিলো। গত আট মাসে তিতির দুটো ডায়েরি লিখেছে, একটা তার ছেলে ধ্রুবর জন্য আর আরেকটা তাজের জন্য। হ্যাঁ তিতিরের ছেলে হবে সেটাই জানিয়েছে ডক্টর। তিতিরের মন বলছে তার সময় ফুরিয়ে এসেছে এই পৃথিবীতে। তাই তাজকে না বলা কিছু কথা লিখে রেখেছে যদি কোনোদিন তাজ তার খোঁজে আসে তাহলে যেনো ডায়েরিটা পায় তাই লিখেছে। আর ছেলের সাথে তার কথা হবে না তাই ছেলের জন্য সব লিখে রেখেছে।
তিতির দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করে পাখিকে ডাকলো কিন্তু পাখির সাড়াশব্দ নেই, তিতির এবার ন্যান্সিকে ডাকলো। আহান তিতির আর পাখির দেখাশোনার জন্য ন্যান্সিকেই রেখেছে। ন্যান্সিও নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসে আগলে রেখেছে তিতিরপাখিকে। তিতিরের একটু ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন এখন কাউকে পাচ্ছে না। দিনদিন শরীরটা বয়ে চলাও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তিতিরের। নিজের কাছে নিজের শরীরের ওজন মণ খানেক মনে হয়। তিতির দূর্বল শরীর নিয়ে বেড আর দেয়াল ধরে ধরে ওয়াশরুমে গেলো। ওয়াশরুমে পা রেখে মুচকি হাসলো। যাতে কোনো এক্সিডেন্ট না হয়, তাই ওয়াশরুমে ফ্লোর মেট বিছিয়ে দিয়েছে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আতঙ্কিত গলায় ন্যান্সিকে ডাকলো তিতির। র*ক্তপাত হচ্ছে তার, যেটা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়।
কান্নার ফলে পাখির কথা বুঝা যাচ্ছে না। আহান পাখিকে কাঁদতে দেখে ভয় পেয়ে গেছে। তিতিরের নাম শুনেই দৌড়ে ভেতরে ঢুকলো।
তিতিরের দরজার সামনে এসে চিৎকার দিয়ে বললো, তুতুল।
ন্যান্সি কাঁদতে কাঁদতে বললো, আহান কিছু করো মাই সান।
আহান কিছু না ভেবে দ্রুত কোলে তুলে নিলো তিতিরকে। তিতিরের চোখ বুজে আসছে। এখন আর ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না, শরীরটা কেমন তুলোর হালকা লাগছে তিতিরের। তিতির ঝাপসা চোখে আহানের জায়গায় যেনো তাজকে দেখলো।
বিড়বিড় করে বললো, আপনি এসেছেন ? এতো দেরি কেনো করলেন, আমার যে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
তিতিরের বলা কোনো কথা কারো কানে গেলো না। আহান তিতিরকে নিয়ে গাড়িতে শুইয়ে দিলো। ন্যান্সি তিতিরের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসেছে। পাখি যেনো আজ বুঝদার হয়ে গেছে, নিজে নিজে সামনের সীটে গিয়ে বসলো। শীত কাল চলছে লন্ডনে, চারদিকে সাদা বরফে ঢাকা। বাসা থেকে মাত্র পাঁচমিনিটের রাস্তা হসপিটাল কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি স্টার্ট করতে পারলো না আহান। প্রকৃতি বোধহয় আজ তিতিরের সাথ দিতে চাইছে না। গাড়িতে সময় নষ্ট না করে আহান নেমে তিতিরকে কোলে তুলে ছুটলো হসপিটালের দিকে। তার পেছনে ন্যান্সি আর পাখি। বরফের নিচে লুকিয়েছে রাস্তা, আহান পনেরো মিনিটে পৌঁছাল হসপিটালে। এক মিনিটের জন্যেও থামেনি তিতিরের র*ক্তপাত। দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো তিতিরকে।
ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগে আহান তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোর করে করুন গলায় বললো, স্যার প্লিজ বাঁচিয়ে দিন আমার তুতুলকে।
ডক্টর আহানের ভার্সিটির স্যার সে হতাশ গলায় বললো, I will try to my best but you know the condition of the patient.
ডক্টর ভেতরে চলে গেলে হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে মুখ লুকিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে আহান। সে কী হারাতে চলেছে তার তুতুলকে ?
২০.
হসপিটালের করিডোরে বসে আছে তাজ। প্রায় আট মাস পর দেশের মাটিতে পা রেখেছে। সে ঘটনার পরদিন দেশ ছাড়ে। যাওয়ার আগে প্রেস মিডিয়া ডেকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে অফিশিয়ালি বিদায় নিয়ে যায় আর যাই হোক কারো সেক্রিফাইসের ক্যারিয়ার বয়ে চলা সম্ভব নয় তার পক্ষে। বাবা-মাও ভুল বুঝেছিলো তাকে। কেনো থাকবে সে এই দেশে। কিন্তু দু’দিন আগে হার্ট অ্যাটাক করেছে ইকবাল খান। তাজ প্রথমে মনে করেছিলো তাকে দেশে ফেরানোর জন্য মিথ্যা বলেছে কারণ এর আগেও এমন করেছিলো কিন্তু এবার খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সবটা সত্যি। তাই পারেনি দূরে থাকতে, ছুটে এসেছে বাবা-মায়ের কাছে। এখনও আইসিইউতে রাখা হয়েছে ইকবালকে। ইরিনাও অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই তাকেও ভর্তি করা হয়েছে।
কেমন আছো ?
পরিচিত কণ্ঠে মাথা তুলে তাকালো তাজ।
মৌ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। আট মাসে পরিবর্তন হয়েছে মৌয়ের। আগের তুলনায় শুকিয়ে গেছে অনেকটা, তবে দেখতে সুন্দর লাগছে।
তাজ কিছু বলার আগেই মৌ বললো, ভয় নেই আজ আর ভালোবাসার দাবি নিয়ে তোমার সামনে আসিনি। একজন ডক্টর হিসাবেই এসেছি।
তাজ আর কিছু বললো না। মৌ চুপচাপ তাজের পাশে বসলো।
আঙ্কেলের হার্টের অবস্থা ভালো না। এটা উনার দ্বিতীয় এ্যাটাক সেটা হয়তো তোমারও জানা আছে। আবার কোনো মানসিক চাপ বা উত্তেজনা সহ্য করার মতো শক্তি উনার নেই। চেষ্টা করো উনাকে হাসিখুশি রাখতে। উনাদের ছেড়ে আর দূরে যেও না, আমি তো মেনে নিয়েছি আমার নিয়তি।
তাজ তাকালো মৌয়ের দিকে, মৌ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তাজ রায়হানকে আমি আগে অনেকবার তোমার পথ থেকে সরে যেতে বললেও গান রেকর্ডিং ছাড়তে বলিনি। সেটা নিজের ইচ্ছেতে ছেড়েছে রায়হান। তবু তোমার শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছি তবে কেনো তুমি তোমার বাবা-মা ফেলে দূরে গিয়ে পরে আছো।
তাজ সোজা হয়ে বসলো, তোর জন্য বাবা-মাকে ছেড়ে যায়নি আমি। তারাও নিজের সন্তানকে বিশ্বাস করেনি তার শাস্তি দিয়েছি।
আঙ্কেলের অবস্থা এখন মোটামুটি ভালো। তাকে কেবিনে শিফট করা হবে একটু পর। তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে।
তাজ কিছু বললো না। মৌ কিছুটা সময় তাজের পাশে চুপচাপ বসে থেকে উঠে চলে গেলো। একটু পরই ইকবালকে কেবিনে দেওয়া হলে তাজ সেখানে উপস্থিত হলো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো ইকবাল। তাজ বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ইকবাল তাকালো ছেলের দিকে।
তাজ অসহায় গলায় বললো, বাবা এভাবে বলো না প্লিজ আর কোথাও যাবো না তোমাদের ছেড়ে৷ আজ থেকে যা বলবে তাই করবো তবু রাগ করে থেকো না, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও।
ইকবাল আবার তাকালো তাজের দিকে, তুমি আমার একমাত্র সন্তান তাজ। খান বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী। সব বাবা-মা চায় তার সন্তান ভালো থাকুক আর আমরাও সেটা চাই। এটাই কী আমাদের অপরাধ ?
না বাবা কোনো অপরাধ নেই তোমাদের।
ইকবাল ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, আমার একটা কথা রাখবি বাবা কথা দে।
ইকবাল হাত বাড়িয়ে দিলে তাজ হাতটা ধরে বললো, বললাম তো বাবা তোমাদের সব কথা শুনবো।
ইকবাল কোনো ভুমিকা ছাড়াই বললো, মৌকে বিয়েটা করে নে বাবা। মেয়েটা সত্যি ভালোবাসে তোকে। আমি আমার ছেলেকে সুখী দেখতে চাই।
মৌ এসে ব্যস্ত গলায় বললো, তোমাকে বললাম আঙ্কেলকে উত্তেজিত করো না৷ এবার এ্যাটাক হলে কিছু হাতে থাকবে না।
পাথরের মতো বসে আছে তাজ। গত আট মাস ধরে পাগলের মতো খুঁজেছে তিতিরকে। কিন্তু মেয়েটা যেনো কর্পূরের মতো উবে গেছে রাতারাতি। মেয়েটার কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত সে পারবে না নিজের জীবন এগিয়ে নিতে। তাজ বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। এমনিতে আজ মনটা বড্ড বেশি অস্থির হয়ে আছে তাজের, হয়তো বাবা-মা অসুস্থ তাই।
তাজ বাইরে গিয়ে বসতেই মৌ বের হয়ে বললো, আঙ্কেল তোমাকে ডাকছে। আমি বারবার বলছি তাজ, উনার উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়।
তাজ বাধ্য হয়ে ভেতরে যেতেই ইকবাল ঘনঘন শ্বাস টেনে বললো, তাজ তুমি আমার হাত ধরে কথা দিয়েছো।
২১.
অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টর বের হতেই আহান দৌড়ে সমানে গেলো। ন্যান্সি আর পাখিও হসপিটালে পৌঁছে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে পাখির ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে।
আহান বললো, স্যার আমার তুতুল ?
ডক্টর মাথা নিচু করে বললো, Sorry Ahan. I tried my best. রোগীর হাতে বেশি সময় নেই তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে।
আহান মুহুর্তে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলো যেনো। রোবটের মতো এগিয়ে গেলো অপারেশন থিয়েটারে দিকে। অক্সিজেন মাস্ক মুখে লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে তিতির। আহানকে দেখে কাঁপা হাত উঁচু করলো বেড থেকে। আহান এগিয়ে গিয়ে তিতিরের হাতটা নিজের মুঠোয় নিলো।
অক্সিজেন মাস্ক খুলে তিতির কাঁপা গলায় ভেঙে ভেঙে বললো, তুই বলেছিলি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোকে আমার পাশে পাবো। তুই তোর কথা রেখেছিস। তাই আজ তোর থেকে আরো একটা কথা চাইছি আহু। আমাকে ছুঁয়ে কথা দে আমার বোনু আর আমার ধ্রুবকে তুই আগলে রাখবি।
আহান পাশে তাকিয়ে দেখলো নার্সের কোলে সাদা কাপড়ে মোড়ানো ফুটফুটে একটা বাচ্চা কান্না করছে। নার্স টলমল চোখ তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে।
আহান কান্না গিলে বললো, কথা দিলাম তোকে। একটা ফুলের টোকাও পড়বে না ওদের গায়ে।
হাজার যন্ত্রণায় তিতিরের ঠোঁটের কোণে ফোটে উঠলো তৃপ্তির হাসি। প্রত্যেকটা কথা বলতে তার তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে, তবু বলছে নাহলে আর যে বলা হবে না। তিতির নার্সকে ইশারা করলো বাচ্চাটাকে তার কোলে দিতে। নার্স বাচ্চাটাকে তিতিরের বুকের উপর শুইয়ে দিলো।
তিতির চুমু খেলো ছেলের মাথায়, মা থাকবে না সোনা তুমি মিষ্টি বাচ্চা হয়ে থেকো।
তিতির আহানের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার ছেলের জন্য একটা উপহার রেখেছি আর একটা তার বাবার জন্য। সেগুলো ঠিক সময়ে তাদের দিয়ে দিস।
আহান চোখ মুছে বললো, তোর কষ্ট হচ্ছে প্লিজ কথা বলিস না তুতুল।
আহান অক্সিজেন মাস্ক পড়ানোর জন্য হাতে নিতেই তিতির লম্বা শ্বাস টেনে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেলো। ডক্টর পাশেই ছিলো সে তিতিরের পালস চেক করে জানালো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে তিতির। আহান পিছিয়ে গেলো দু’পা। তিতিরের বুকে লেপ্টে থাকা ছোট্ট ধ্রুব গলা ছেড়ে কাঁদছে। কী জানি সেও হয়তো বুঝে গেছে, জীবনের মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছে সে। নার্স তিতিরের বুক থেকে বাচ্চাটা সরিয়ে নিতে গেলে আহান বাঁধা দিলো।
কাঁপা গলায় বললো, থাকতে দিন না আর কিছুটা সময়। এটাই তো ওর মায়ের প্রথম এবং শেষ স্পর্শ আর কোনদিন চাইলেও কোথাও খোঁজে পাবে না এই স্পর্শ।
আহানের চোখে বাঁধ ভেঙেছে। শব্দ হচ্ছে না কেবল গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে কিন্তু বুঝাতে পারছে না কাউকে। এ কেমন দম বন্ধ করা কষ্ট। নাহ্ আর সহ্য করা গেলো না। তিতিরের বুক থেকে ধ্রুবকে তুলে নিয়ে বের হয়ে গেলো আহান। তার যে এখন অনেক দ্বায়িত্ব, তাকে ভেঙে পড়লে চলবে নাকি ?
ইকবাল তাকিয়ে আছে তাজের দিকে তার উত্তরের অপেক্ষায়।
তাজের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো মুহুর্তে, বাবা আগে তুমি ঠিক করে নাও। ছেলেকে জীবিত দেখতে চাও নাকি মৃত। এক অপরাধবোধের বোঝা মাথায় নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছি আমি। অনুশোচনার আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছি ক্ষণে ক্ষণে। আরো একটা অন্যায় করতে বললে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। আর এটাও তুমি ভুলে যাচ্ছো তিতির আইনত এখনো আমার স্ত্রী।
মৌ কিছু না বুঝে বাবা আর ছেলের কথা শুনে যাচ্ছে তখনই দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ বললো, মৌ।
মৌ সহ সবাই ফিরে তাকালো দরজার দিকে। এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মৌয়ের কপালে বিরক্তির ছাপ দেখা দিলো।
তাজ বললো, আপনি কে ?
যুবক ভেতরে ঢুকে তাজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো, আমি ডক্টর সুফিয়ান আহমেদ শান মৌয়ের হাসবেন্ড।
তাজ প্রথমে শকড হলেও পরে মুচকি হেসে হাত মিলিয়ে বললো, আমি,,,।
তাজকে কথা শেষ করতে দিলো না শান, আপনাকে দুই বাংলার কে না চেনে ? এতো ফেমাস অ্যাক্টর এন্ড সিঙ্গার।
তাজ মুচকি হেসে বললো, প্রাক্তন শব্দটা এড করতে ভুলে গেছেন মিস্টার শান।
ভুলিনি, তবে ইচ্ছে করেই এড করিনি। আপনাকে প্রাক্তন হিসাবে দেখতে চাইনি তাই।
তাজ সেদিকে কথা না বাড়িয়ে বললো, নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। কী রে মৌ, বিয়ে করলি জানালি না ?
মৌ মাথা নিচু করে বললো, এক সপ্তাহ আগে আকদ হয়েছে। এখনো তেমন কেউ জানে না, পরে অনুষ্ঠান হলে সবাইকে জানাবে বাবা।
তাজ ঠোঁটের কোণে হাসিটা বজায় রেখে বললো, শুভকামনা।
মৌ চোখ তুলে তাকালে সবাই দেখতে পেত তার চোখের পানি। বাবা-মা বিষের বোতল হাতে নিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করেছে তাকে। মৌও তাদের একমাত্র সন্তান। কাল মাথার উপর থেকে বাবা-মার ছায়া সরে গেলে একা মেয়ে কীভাবে টিকে থাকবে এই পৃথিবীতে। মৌ কিছু না বলে বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে।
শান তাজের দিকে তাকিয়ে বললো, আসছি বস, ভালো থাকবেন।
মৌ আর শান চলে যেতেই তাজ নিজের বাবার দিকে তাকালো। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ইকবাল। সে ঘুনাক্ষরে জানতেন না মৌয়ের বিয়ের ব্যাপারে।
ইকবাল কিছু বলবে তার আগেই তাজ বললো, ওয়েট আমার কথা আগে শুনে নাও। আজ তোমাকে একটা কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি বাবা। আজকের পর যদি কখনো তুমি আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলো তাহলে আর কখনো খুঁজে পাবে না আমাকে। আমাকে যদি আমার মতো থাকতে দাও তাহলে তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না। তোমার প্রবলেম ছিলো মৌ আমাকে ভালোবেসে নিজের জীবন নষ্ট করছে, এবার তো মৌ নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। আমি আগেও মৌকে বিয়ে করতে চাইনি কারণ বন্ধু ছাড়া অন্যকিছু ভাবিনি ওকে। শুধু তোমাদের কথায় রাজি হয়েছিলাম কিন্তু আমি আর মৌ একে অপরের জন্য নই তাই আলাদা হওয়ারই ছিলো। এখন আমি শুধু তিতিরকে খুঁজে পেতে চাই আর তার কাছে ক্ষমা চাইবো। সে যদি আমার জীবনে ফিরতে চায় ফিরিয়ে নিবো আর যদি মুক্তি চায় মুক্তি দিবো। সে আমার জীবন যতটা নষ্ট করেছে, যাওয়ার আগে সেটা ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু আমি তার জীবন যতটা নষ্ট করেছি, আমি ঠিক করতে পারবো না। তাই তার কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আমার একটা মুহুর্ত শান্তিতে কাটবে না।
তাজ চলে গেলো কেবিন থেকে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ইকবাল। সে চেনে নিজের ছেলেকে। একবার যেটা না বলে দিয়েছে সেটা তাকে দিয়ে আর করানো সম্ভব নয়।
ইকবাল বিড়বিড় করে বললো, তিতির মেয়েটা আমার ছেলের জীবনে একটা বিষাক্তফুল। যে চলে গিয়েও তার বিষের রেশ রেখে গেছে।
তাজ প্রচন্ড স্প্রিডে ড্রাইভ করছে। মনের অস্থিরতা কমানোর জন্য এমন করছে। বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে তার। হঠাৎ তাজের দৃষ্টি ঝাপসা হলে সে চোখে হাত দিলো। তার চোখে নোনাজল কিন্তু কেনো ? তাজ অস্থির হয়ে এই নোনাজলের কারণ খুঁজতে লাগলো কিন্তু পেলো না। বারবার ফোন বেজে বিরক্ত করছে তাই গাড়ি এক সাইডে নিয়ে ফোন রিসিভ করলো।
স্যার রায়হান চৌধুরী আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।
২২.
আহান বাইরে আসতেই দেখতে পেলো বিধস্ত দুটো মানুষ বসে আছে চেয়ারে৷ কী উত্তর দিবে আহান তাদের ?
পাখি দৌড়ে এসে আহানের সামনে দাঁড়ালো, আপুনি কোথায় আহান ? আমি আপুনির কাছে যাবো।
আহান অসহায় চোখে তাকালো পাখির দিকে, তোমার আপুনি তো ঘুমিয়ে পড়েছে পুতুল। তার ঘুম আর কখনো ভাঙবে না।
পাখি কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আহানের দিকে। আহান কোলে থাকা ছোট্ট ধ্রুবকে পাখি দিকে এগিয়ে দিলো।
পাখি তাকালো ধ্রুবর দিকে মুহুর্তে হাসি ফোটে উঠলো পাখির মুখে। এক আঙ্গুল দিয়ে ধ্রুবকে ছুঁয়ে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো সে। আহান টলমলে চোখে তাকিয়ে আছে পাখির দিকে। মেয়েটা যখন জানতে পারবে তার আপুনি আর কখনো ফিরে আসবে না তখন কীভাবে তাকে সামলাবে আহান ?
তুমি ওকে নিবে পুতুল ?
পাখি হাত বাড়িয়ে দিলো। আহান সাবধানে ধ্রুবকে পাখির কোলে দিলো। ধ্রুব এখন শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে।
আহান বললো, ব্যাথা পাবে কিন্তু সাবধানে রাখবে।
পাখি ধ্রুবকে কোলে তুলে চেয়ারে চুপটি করে বসলো। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধ্রুবর মুখের দিকে। এবার ন্যান্সি এগিয়ে এলো আহানের দিকে। আহানের কাঁধে হাত রাখতেই বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলো আহান।
আমার তুতুলটা চলে গেলো মাম। ওকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো এখন ? পুরনো ক্ষত কেবল শুকাতে শুরু করেছিলো কিন্তু এবার যে ক্ষত দিয়ে গেলো সেটা তো আর সারাজীবনেও শুকাবে না মাম।
ন্যান্সি ভেজা গলায় বললো, তিতির কথায় কথায় বলতো ওর যদি কিছু হয়ে যায় ওকে যেনো বাংলাদেশে ওর বাবা-মার কাছে কবর দেওয়া হয়। এই কথা শুনে আমি কত বকতাম আহান। আর আজ দেখো সত্যি চলে গেলো মেয়েটা।
তিতিরের লাশ হসপিটালের মর্গে রাখা হলো। বাংলাদেশে নেওয়ার সব ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত এখানেই রাখা হবে। পাখিকে একবার দেখানো হয়েছে তার আপুনিকে। পাখি তিতিরকে ডাকতে গেলে আহান বলে তিতির ঘুমিয়ে আছে, ঘুম ভেঙে গেলে তার কষ্ট হবে। অবুঝ পাখি সেটাই বিশ্বাস করে নিয়েছে। সে নতুন একটা পুতুল পেয়েছে সেটা নিয়ে মেতে আছে। পুতুলটা নড়াচড়া করে, কাঁদে সব ভালো লাগে পাখির।
ধ্রুব আর পাখি ন্যান্সির কাছে আছে। ধ্রুব তিতিরের বানানো কাঁথায় ঘুমাচ্ছে আরামে। বাজারে পাওয়া পাউডার দুধ হয়েছে তার খাবার। সাদা বরফে ঢাকা লন্ডন শহর ঘুমিয়ে গেছে, ঘুম নেই আহানের চোখে। তিতিরের রুমে বসে আছে সে। এখনো সে চাইলেই দেখতে পারবে তার তুতুলের মুখটা কিন্তু দুদিন পর ? তিতিরের রুমের ছোট ছোট জিনিস ছুঁয়ে দেখছে আহান। টেবিলের উপর ডায়েরি দেখে থমকে গেলো কিছুটা সময়।
হাতে নিয়ে দেখলো উপরে জ্বলজ্বল করছে আমার ধ্রুবতারা লেখাটা। আহান হাত বুলালো লেখাটার উপর। ডায়েরির ভেতরে একটা কাগজ ভাজ করে রাখা, সেটা বের করলো আহান। ডায়েরিটা রেখে কাগজের ভাজ খুললো,
প্রিয় আহু
ডায়েরিটা লিখে প্রতিদিন এটা এখানেই রাখি সাথে এই চিঠি। যাতে হুট করে আমার কিছু হয়ে গেলে সহজে পেয়ে যাস। আজ এটা পড়ছিস মানে আমি তোদের থেকে অনেক অনেক দূরে চলে এসেছি। জানি তুই ভালো নেই তবুও বলবো কষ্ট পাস না প্লিজ। আহু রে মেয়েদের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। সামনে থাকা ছেলেটা তাকে কোনো নজরে দেখে সেটা বুঝার অদ্ভুত ক্ষমতা। তুই আমাকে ভালোবাসিস সেটা আমি বুঝতে পেরেছি প্রথম দিকেই কিন্তু তুই যখন আমার জীবনে ফিরে এলি তখন এক ঝড়ে আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। মনে জায়গা দিয়ে ফেলেছি অন্য কাউকে, তুই আরো আগে কেনো ফিরে এলি না ? তোর জীবনেও আমি একটা স্বার্থপর প্রমাণিত হলাম। বিশ্বাস কর আমি বুঝেও না বুঝার ভান করতাম যাতে তুই কষ্ট কম পাস। তুই যদি এই কষ্টটা বুকে আগলে জীবনটা থমকে দিস তাহলে মরেও শান্তি পাবো না, নিজেকে দায়ী মনে করে। আমার বোনুটা যদি সুস্থ থাকতো তাহলে আমি বেঁচে থাকতেই ওর সাথে তোর বিয়ে দিতাম। কিন্তু ওকে তোর জীবনে চাপিয়ে দিয়ে তোর জীবনটা নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না আহু, তুইও এগিয়ে যা এতেই আমি খুশি হবো। শুধু এতটুকু অনুরোধ আমার দুটো প্রাণকে আগলে রাখিস। ধ্রুব তোর কাছে আমানত, যদি কোনোদিন ওর বাবা ওর কথা জেনে ফিরিয়ে নিতে আসে তবে তাকে আমার রেখে আসা উপহারটা দিস। যেটা আলমারিতে রাখা আছে একটা নীল রঙের ডায়েরি আর তোর সামনে রাখা ডায়েরিটা আমার জীবনের ধ্রুবতারা, আমার সন্তানের। তার ১৮তম জন্মদিনে এটা আমার তরফ থেকে তার উপহার। সেদিন সে সিদ্ধান্ত নিবে তার বাবার কাছে ফিরে যাবে, নাকি যাবে না। তবে তুই তাকে নিজের কাছে আমানত হিসাবেই রাখিস, যাতে ফিরিয়ে দিতে হলে আবার কষ্ট না হয়। জীবনটা এগিয়ে নিয়ে যাস আহু। একটা কথা মনে রাখিস,
“তোদের হাসিতেই আমার বাস।”
ইতি
তোর স্বার্থপর তুতুল
আহান নিজের ঝাপসা চোখ মুছে নিলো। চিঠিটা বুকে জড়িয়ে চুপ করে বসে রইলো কিছুটা সময়। টেবিলের উপর থেকে ধ্রুবতারা ডায়েরিটা হাতে নিলো। এগিয়ে গেলো আলমারির দিকে। খোলে সামনেই পেলো নীল রঙের ডায়েরিটা। এমন জায়গায় রেখেছে যাতে সহজেই পাওয়া যায়। নীল রঙের ডায়েরিটা হাতে তুলে নিতেই চোখে পড়লো উপরের জ্বলজ্বল করতে থাকা লেখাটা, “বিষাক্তফুলের আসক্তি”। ডায়েরি দু’টো বোধ হয় নিজে ডিজাইন করে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনেছে তিতির। দেখে তেমনই মনে হলো আহানের। কত যত্নে আগলে রেখেছিলো তিতির। আহান দু’টো ডায়েরি নিয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। যত্ন করে তুলে রাখলো সেগুলো আর তার জন্য রেখে যাওয়া চিঠিটাও আলাদা করে তুলে রাখলো।
২৩.
বাবার অফিসে জয়েন করেছে তাজ। ইকবাল খান এখনো হসপিটালে তাই অফিসের জরুরি কাজে তাজকেই সিলেট আসতে হয়েছে। কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছে আজই। এই সরু রাস্তায় দুটো গাড়ি পাশাপাশি একসাথে যেতে পারে না। তাজের গাড়ি আর একটা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স মুখোমুখি দাঁড়ালো। অ্যাম্বুলেন্স দেখে তাজ নিজের গাড়ি একটু পিছিয়ে নিয়ে সাইড করলো। ধীর গতিতে পাশ কাটিয়ে চলতে লাগলো অ্যাম্বুলেন্সটা, পাশাপাশি হতেই তাজের বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো। কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে, চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে বুকের বা পাশটায়। তাজ তাকালো অ্যাম্বুলেন্সটার দিকে, কষ্টটা যেনো বাড়লো, কে জানে ভেতরে কার আপনজন শুয়ে আছে চিরনিদ্রায়। ভেতরে তিতিরের লাশের কফিনটা সামনে নিয়ে বসে আহান। সিলেট তিতিরের নিজের শহর, এখানেই আছে তার বাবা-মায়ের কবর। সেখানেই তাকে চিরশায়িত করতে যাচ্ছে আহান। তাজ যাকে পাগলের মতো খোঁজে ফিরছে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে শুয়ে আছে সে কিন্তু তাজ জানতেও পারলো না। অ্যাম্বুলেন্সটা চলে যেতেই তাজ হাসফাস করে নিজের গাড়ি ছুটালো।
রায়হান কথাটা শেষ করতেই সজোরে থা*প্প*ড় পরলো তার গালে। সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হলো বার কয়েক। মহিবুল আর রেহেনা স্তব্ধ হয়ে আছে নিজের মেয়ের কাজে।
রায়হান রক্তচক্ষু করে তাকালো মৌয়ের দিকে, মৌ ?
মৌ নিজের ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে শান্ত গলায় বললো, চুপ একদম চুপ। তোর ঐ নোংরা মুখে আমার নামও নিবি না রায়হান।
মহিবুল মেয়েকে ধমক দিয়ে বললো, এটা কেমন ব্যবহার মৌ ?
মৌ বাবার দিকে টলমলে চোখে তাকিয়ে বললো, এই বি*কৃ*ত মস্তিষ্কের লোকটা এই ব্যবহারটাও ডিজার্ভ করে না বাবা।
মহিবুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মেয়ের দিকে, এসব কেনো বলছিস মা ?
এখনই দেখাচ্ছি বাবা।
মৌ ড্রয়িংরুমের স্মার্ট টিভির সাথে নিজের ফোন কানেক্টেড করে নিলো। যে ভিডিওতে তিতির সব সত্যিটা স্বীকার করেছে সেটা প্লে করলো সবার সামনে। মহিবুল আর রেহেনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা দেখে।
মহিবুল আফসোসের সুরে বললো, ছেলেটা সেদিন আবার আবার বলেছিলো সে নিদোর্ষ কিন্তু আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি তাকে।
রাগে চোখমুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে রায়হানের। এই মুহুর্তে তিতিরকে সামনে পেলে কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়া খু*ন করে ফেলতো। মেয়েটা তাকে শেষ করে দিয়েছে একদম। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই রায়হান কোমর থেকে পি*স্ত*ল বের করে মহিবুলের মাথায় ঠেকালো। চমকে উঠলো মৌ আর রেহেনা। ঘৃণায় মৌয়ের মুখ ভরে থু থু এলো।
মৌ ক্ষিপ্ত গলায় বললো, আর কত নিচে নামবি রায়হান ?
রায়হান রেগে ফুসফুস করছে, একদম বা*জে বকবক করবি না। তুই বিয়েটা না করলে তোর বাবা-মাকে এক সেকেন্ডে উপরে পাঠিয়ে দিবো। এই বরযাত্রী ভেতরে আয় তো সবাই।
রায়হানের বলার সাথে সাথে তার দল-বল ভেতর প্রবেশ করলো কাজি নিয়ে। সে সব ব্যবস্থা করেই এসেছে। সে জানতো তিতির হাত গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে নয়। কিছু একটা করবে মনে করেই প্রস্তুত হয়েই এসেছে রায়হান। মহিবুল আর রেহেনার হাতমুখ বেঁধে রুমের এক কোণে বসিয়ে দিলো রায়হানের লোকজন আর তাদের মাথায় পি*স্ত*ল তাক করে আছে দুজন। রায়হানের একটা ইশারায় সব শেষ করে দিবে তারা। মৌ নিজের বাবা-মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রায়হানের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকালো। রায়হান আরাম করে সোফায় বসে মৌকে সরাসরি সামনের সোফায় বসার ইশারা করলো।
মৌ না বসলে ধমকে উঠলো রায়হান, কী সমস্যা বসতে বলেছি তো ?
রায়হান হাতে পি*স্ত*ল ঘুরাতে ঘুরাতে বললো, তোকে পাঁচ মিনিট সময় দিলাম ভাবার জন্য। ভেবে নে কী করবি ? কোনো ঝামেলা ছাড়া আমাকে বিয়ে করবি নাকি একসাথে বাবা-মায়ের লা*শ দেখবি।
মৌ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, তুই এমন কী করে করতে পারিস রায়হান ?
রায়হান মুচকি হেসে বললো, আমি কী কী করতে পারি সেটার ধারণা তিতির খুব সুন্দর করে বর্ণনা করেছে তো। তিতিরপাখির সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক, আমার বোন হয়। নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য নিজের বোনদের ব্যবহার করতে একবার ভাবিনি, তাদের খু*ন করা লাগলে তাই করতাম। সেখানে তোর বাবা-মা আমার কেউ না, কী মূল্য আছে তাদের বল। বিয়ে তোকে করতে হবে মৌ, সেটা তোর নিজের ইচ্ছেতে কিংবা কিছু বিধ্বংসী মুহূর্ত উপভোগ করার পর বাধ্য হয়ে।
মৌ ডুকরে কেঁদে উঠলো এবার। এখন বেশ ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছে তিতিরের অসহায়ত্ব। মেয়েটা দীর্ঘ দেড় মাস এই যন্ত্রণা ভোগ করেছে। যেখানে কয়েক মিনিটে মৌয়ের দম বন্ধ হয়ে আসছে। মৌ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
হঠাৎ রায়হানের এক লোক এসে জানালো তাজ এসেছে নিচে। মৌ যেনো আশার আলো খোঁজে পেলো একটু। কিন্তু রায়হানের কথা শুনে ধপ করে নিভে গেলো সেটাও।
রায়হান বাঁকা হেসে বললো, ভালো করে খাতির যত্ন করে উপর নিয়ে আয়। মিস্টার তাজওয়ার খান তাজ তোর সাথে তো অনেক বছরের হিসাব করা বাকি আছে আমার।
মৌ ব্যস্ত গলায় বললো, তাজকে কিছু করিস না প্লিজ।
রায়হান ঘাড় কাত করে বাঁকা চোখে তাকালো মৌয়ের দিকে, কত ভালোবাসা ? এর অর্ধেক ভালো যদি আমাকে বাসতি আজ এসব কিছুই হতো না।
রায়হান চোখমুখ শক্ত করে বললো, যা নিয়ে আয় ম্যাডামের আশিককে।
মৌ গুটিশুটি মেরে বসে আছে সোফায়। কাঁদতে ভুলে গেছে সে। কী করবে বুঝতে পারছে না। রায়হান গত দশ মিনিট ধরে তাকিয়ে আছে মৌয়ের দিকে আর মৌ নিজের বাবা-মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আর চোখ মুছছে। তখনই তাজকে টানতে টানতে রায়হানের সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেললো রায়হানের লোকজন। তাজকে দেখে পিলে চমকে উঠলো মৌয়ের।
চিৎকার করে বললো, তাজ।
তাজ নিভু নিভু চোখে তাকালো সামনে বসে থাকা রায়হানের দিকে। সারা মুখে র*ক্তে মাখামাখি তার। নাক থেকে র*ক্ত বের হচ্ছে, ঠোঁটের কোণ আর কাপাল কে*টে ফিনকি দিয়ে র*ক্ত বের হচ্ছে।
রায়হান তাজের গাল চেপে ধরে উপরে তুলে দেখে বললো, খাতির যত্ন কম হয়ে গেছে তো।
আসলে উনার ফ্যান ছিলাম তো তাই একটু কনসিডার করেছি। স্যার এটা কেমন হিরো বলুন তো। মুভিতে দেখি একাই একসাথে কতজনকে মে*রে কাত করে দেয় আর একটা ঘু*ষি পর্যন্ত দিতে পারলো না আমাদের। ধুর আমি বুঝে গেছি মুভিতে যা দেখায় সব বানানো। আমি আর মুভিই দেখবো না।
রায়হান ছেড়ে দিলো তাজের গাল বাঁকা হেসে বললো, তা যা বলেছিস সব বানোয়াট। কিন্তু তাজ তুই নাকি ক্যারেটে শিখেছিস, বক্সিং করিস, এক্সারসাইজ করে কী বডি বানিয়েছিস। এতসব করে কী লাভ ভালো নিজেকেই তো রক্ষা করতে পারলি না। শেম অন ইউ ইয়ার, এত দূর্বল প্রতিপক্ষ নিয়ে খেলা জমে না।
তাজ ভাঙা গলায় বললো, কেনো করছিস এসব ?
রায়হানের চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো আর তাজের গাল চেপে ধরলো, সেই ছোটবেলা থেকে মৌয়ের জন্য একটার পর একটা সেক্রিফাইস করে এসেছি। ওর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ইচ্ছে করে তোকে ক্লাস টপার হতে দিয়েছি। প্রায় কম্পিটিশন তোকে জেতানোর জন্য নিজে সরে এসেছি। কেনো শুধুমাত্র মৌ খুশি হবে বলে। এমন কী গান রেকর্ডিংয়ের মতো সুযোগ ছেড়ে দিয়ে তোকে সুযোগ করে দিয়েছিলাম।
তাজ অবাক হয়ে বললো, মানে ?
তোর প্রথম গান যে রেকর্ড করেছে সে প্রথমে আমাকে সিলেক্ট করেছিলো। বাবার সাথে এক পার্টিতে গিয়ে তুই আমি দু’জনেই গান গেয়েছিলাম মনে আছে ?
তাজ একটু ভেবে বললো, হ্যাঁ মনে আছে। আমার প্রথম গানের মিউজিক ডিরেক্টর বলেছিলো সেই পার্টিতেই সে আমার গান শুনেছে।
রায়হান তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, মিথ্যা বলেনি। সেই পার্টিতে দুজনের গান শুনে প্রথমে আমাকে রেকর্ডিংয়ের অফার দেয়। আমি খুশি হয়ে জানিয়েছিলাম মৌকে।
কিন্তু মৌ শুনে বললো, তোকে একা বলেছে তাজকে বলেনি ?
আমি যখন বললাম, না তাজকে বলেনি।
মৌয়ের হাসিখুশি মুখে আধার নেমে এলো। সেটা তীরের মতো বিঁধল আমার বুকে। বাড়ি ফিরে সেই লোককে জানিয়ে দিলাম আমি গানটা গাইতে পারবো না সে যেনো তোর গান রেকর্ড করে। যে মুভিতে আমার গান মুক্তি পাওয়ার কথা ছিলো সেই মুভিতে তোর প্রথম গান মুক্তি পেলো। তারপর আর তোকে ফিরে তাকাতে হয়নি। গানের সাথে একসময় মুভির অফারও পেয়ে গেলি। আর সেদিনের পর আমি পুরোপুরি সরে আছি নিজের স্বপ্ন থেকে। আমারও স্বপ্ন ছিলো বড় সিঙ্গার হওয়ার, অভিনেতা হওয়ার। শুধুমাত্র মৌকে খুশি রাখার জন্য, যার জন্য আমি এত এত সেক্রিফাইস করলাম শেষে তুই তাকেও নিজের করতে চাইলি। এবার কীভাবে চুপ থাকবো আমি তাজ ? সব ছেড়ে দিয়েছি তোর জন্য কিন্তু যাকে পাওয়ার জন্য এসব করলাম তাকে কীভাবে দিয়ে দেই তোকে ?
তাজ একবার ঘুরে তাকালো মৌয়ের দিকে, এসবের মাত্র কয়েকটা ঘটনা জানা ছিলো তাজের। কিন্তু সবটা জানার পর কী রিয়াকশন দেওয়া উচিত ভুলে গেছে। তার এতদিনের গড়া ক্যারিয়ারে শুধু তার পরিশ্রম ছিলো না, ছিলো কারো আত্মত্যাগ। তাজের হঠাৎ নিজেকে অনেক ছোট মনে হতে লাগলো, তার ক্যারিয়ার অনেকটা দান করেছে রায়হান। ভাবতেই চোখমুখ কুঁচকে গেলো তাজের।
তাজ নিজেকে সামলে বললো, তিতিরকে কেনো আনলি এসবের মাঝে ?
রায়হান সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো, তিতিরকে আনা অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মা*রার মতো। তিতিরপাখি আমার মামাতো বোন। আজ থেকে প্রায় ষোল বছর আগে তিতিরের বাবা মানে আমার মামা আবির মাহমুদের থেকে তার সম্পত্তি দখল করার জন্য, আমার বাবা খু*ন করে মামা-মামী দুজনকেই। কিন্তু মামার বিশ্বস্ত বডিগার্ড নুরুল তিতিরপাখিকে নিয়ে পালিয়ে যায়। বাবা প্রোপার্টি দখল করতে গিয়ে জানতে পারে সব তিতিরের নামে উইল করে রেখেছে মামা। তিতির হওয়ার পর মামী আর কনসিভ করতে পারেনি। তাই তিতিরের নামে সব উইল করে দিয়েছিলো কিন্তু তিতিরের যখন আট বছর তখন আবার কনসিভ করে মামী। যে রাতে পাখির জন্ম হয় সেই রাতেই বাবা মামা-মামীকে খু*ন করে, কীভাবে যেনো নুরুল পালিয়ে যায় তিতিরপাখিকে নিয়ে। কিন্তু প্রোপার্টি দখল করতে গিয়ে বাবা যখন জানতে পারে সব তিতিরের নামে তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। পুরো শহর তন্নতন্ন করে খোঁজেও পায়নি। কিন্তু দু’বছর আগে তিতিরকে খোঁজে পাই আমি। বাবা চেয়েছিলো তিতিরের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে সম্পত্তি পুরোপুরি নিজের নামে করতে। কারণ বিয়ের আগে তিতির সেই প্রোপার্টি কাউকে দিতে পারবে না আর তিতিরের সন্তান জন্ম নিলে অটোমেটিক সব তার নামে হয়ে যাবে এমনই উল্লেখ ছিলো উইলে। কিন্তু আমি তো তিতিরকে কখনোই বিয়ে করবো না আর নুরুল মা*রা যাওয়ায় তখন তিতিরের আর্থিক অবস্থা খারাপ। সংসার চালিয়ে পাখির দেখাশোনা সব মিলিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কিছুদিন নজর রাখার পর বুঝতে পারলাম তিতিরের প্রাণ ভোমরা পাখি। পাখির জন্য ও যেমন নিজের জীবন দিতে পারবে, তেমন কারো জীবন নিতেও দু’বার ভাববে না। দুধের শিশুকে ছোট হাতে মায়ের মতো বড় করেছে তো। তখনই আমার মাথায় প্ল্যান চলে আসে। তিতিরের সাথে তোর বিয়ে দিয়ে প্রোপার্টিও দখল করা হয়ে যাবে আর মৌয়ের জীবন থেকে তোকেও সরানো হয়ে যাবে। ব্যাস আমার প্ল্যান সাকসেসফুল করতে কৌশলে তিতিরকে তোর পি.এ হিসাবে পাঠিয়ে দেই। তুই ক্যারিয়ার ছাড়া সবকিছুতে উদাসীন সেটা আমি জানি, এতবছরে মৌকে ভালোবাসতে পারিসনি তিতিরকেও পারবি না সেটা জানতাম। তাই লোক লাগিয়ে রাখি তোদের সাথে, এক্সিডেন্টলি কাছে আসা মুহুর্তের ছবি তুলে প্রমাণ হিসাবে জমাতে থাকি আর একজন ডাক্তার হিসাবে একটা রিয়াল প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট জোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। মোক্ষম সময়ে এসব সামনে এনে তোর ক্যারিয়ার আর মৌ দুটোই কেড়ে নিলাম। যেসব প্রমাণ সামনে এনেছিলাম একটাও ফেইক ছিলো না শুধু একটু বুদ্ধির খেলা ছিলো। শহরের প্রতিটা হসপিটালে আমার লোক আছে তাই তুই সঠিক তথ্য বের করতে পারিসনি, প্রতিটা হসপিটাল থেকে একই রিপোর্টের কপি দেওয়া হয়েছে তোকে।
কথাগুলো শেষ করে রায়হান বি*শ্রিভাবে হাসতে লাগলো। প্রথমে রায়হানের করা সেক্রিফাইজের কথাগুলো শুনে তাজের কষ্ট হয়েছিলো তার জন্য। কিন্তু পরে তার কৃতকর্মের বর্ণনা শুনে ঘৃণায় গা গুলিয়ে এলো। তিতিরের সাথে করা ব্যবহারের জন্য নিজের প্রতি রাগ হতে লাগলো, আফসোসও হচ্ছে খুব। তাজ সোজা রায়হানের নাক বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিলো। মুহুর্তে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। রায়হানের লোকজন এগিয়ে আসতে নিলে রায়হান হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো।
রায়হান বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে রক্ত মুছে নিলো, আরে থাক থাক কিছু বলিস না। নায়ক সাহেব ক্যারিয়ার হারানোর দুঃখে এটুকু করতেই পারে। অনেক হয়েছে ড্রামা এবার বিয়ে হবে আর আমাদের বিয়ে সাক্ষী হবে সুপারস্টার তাজওয়ার খান তাজ।
মৌ চিৎকার করে বললো, তোর মতো বি*কৃ*ত মস্তিষ্কের মানুষকে কখনো বিয়ে করবো না আমি।
রায়হান মৌয়ের বাবা-মায়ের মাথায় পি*স্ত*ল তাক করে রাখা ছেলেকে বললো, জুয়েল এ মনে হচ্ছে সোজা কথায় কাজ করবে না। তোর আঙ্গুলটা বাঁকা করতেই হবে।
রায়হান মৌয়ের বাবা-মায়ের মাথায় পি*স্ত*ল তাক করে রাখা ছেলেকে বললো, জুয়েল এ মনে হচ্ছে সোজা কথায় কাজ করবে না। তোর আঙ্গুলটা বাঁকা করতেই হবে।
একদিন নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে তোকে বাঁচিয়েছিলাম। ভালো প্রতিদান দিলি কিন্তু রায়হান। আচ্ছা একটা কথা বল তো রায়হান। আমার ভুলটা কোথায় ছিলো ? না তোকে বলেছি আমার জন্য কিছু ছাড় দিতে আর না মৌকে বলেছি তোকে রেখে আমাকে ভালোবাসতে। কিন্তু সবদিক থেকে ক্ষতি তুই আমিই করেছিস। ভালোবাসা শব্দটার উপর ঘৃণা ধরে গেছে আমার।
রায়হান শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। না সে চোখে রাগ দেখা যাচ্ছে আর না অনুশোচনা।
তাজ রায়হানের পাশে সোফায় নিজের পা তুলে দিয়ে টি-টেবিলে হেলান দিয়ে বসলো।
থাক সেসব কথা, তোকে একটা শো দেখাই। আমার ফেবারিট শো।
রায়হান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাজের দিকে। তাজ টি-টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে টিভি অন করলো। টিভি স্কিনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো রায়হান। তাজ টিভির উল্টো দিকে মুখ করে রায়হানের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজ একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করে লাগলো। প্রত্যেকটা চ্যানেলে লাইভ দেখা যাচ্ছে রায়হানকে। তাজ মনের সুখে শিস বাজাতে লাগলো। টিভিতে শোনা যাচ্ছে তাজের শিস বাজানোর শব্দ।
রায়হান রেগে তাজের কলার ধরে দাঁড় করিয়ে বললো, কী হচ্ছে এসব ?
তাজ নিজের কলার থেকে রায়হানের হাত ছাড়িয়ে বললো, সারাদেশের মানুষের সামনে যে দাগ আমার চরিত্রে লাগিয়েছিলি সেই দাগ সারাদেশের মানুষের সামনেই মুছে ফেললাম। তোর কী মনে হয়, তাজওয়ার খান তাজ ঘাসে মুখ দিয়ে চলে ? এতো কষ্ট করে কারাটে, বক্সিং শিখলাম তোর চুনোপুঁটি লোকের হাতে মার খেতে ? সত্যিটা সবার সামনে তোর নিজের মুখে স্বীকার করানোর জন্যই এই চুনোপুঁটি মেরে হাত গন্ধ করতে চাইনি।
রায়হান রেগে আবার কলার চেপে ধরলো তাজের আর তাজ হাহা করে হাসতে লাগলো।
রায়হান তাজকে মারার উদ্দেশ্যে হাত উঁচু করতেই পেছন থেকে আওয়াজ এলো, দ্যা গেইম ইজ ওভার মিস্টার রায়হান চৌধুরী ওরফে ডার্ক ডেভিল।
রায়হান বিস্ফোরিত চোখে ঘুরে তাকালো পেছনে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে র্যাবের একটা টিম। রায়হানের প্রত্যেকটা লোকের মাথায় গান তাক করে রেখেছে। চোখের পলকে সবাইকে হাতকড়া পরিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গেলো।
রায়হান ঢোক গিলে বললো, ডার্ক ডেভিল মানে ?
ভয়ে রায়হানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আনাগোনা দেখা দিলো। তার কোড নেইম এরা কীভাবে জানলো বুঝতে পারছে না রায়হান।
র্যাবের টিম ইনচার্জ এএসপি মাসুদ আহমেদ মুচকি হেসে বললো, সেটা তো আমাদের সাথে গেলেই বুঝতে পারবেন।
মাসুদ তার সাথের একজন অফিসারকে ইশারা করলো রায়হানকে হাতকড়া পড়াতে, সে তাই করলো।
রায়হান তাজের দিকে তাকিয়ে শাসিয়ে বললো, তোকে আমি ছাড়বো না তাজ। তবে যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই তোকে।
রায়হান তাজের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, তিতির যাওয়ার আগে তোর জীবন থেকে আবারও কিছু কেড়ে নিয়ে গেছে। তুই ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাবি সেটা কী ? কিন্তু এর উত্তর তুই কোনদিন পাবি না আর না পাবি কোনোদিন তিতিরের দেখা।
রায়হানও যেতে যেতে শিস বাজিয়ে কোনো গানের সুর তুললো। কিন্তু তাজের চেনা চেনা লাগলেও বুঝতে পারলো না সেটা কোন গানের সুর। হয়তো সেই সুরে তাজ উত্তর পেয়ে যেত আবার কী কেঁড়ে নিয়েছে তিতির। রায়হান মৌয়ের দিকে একটা কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বের হয়ে গেলো র্যাবের সাথে। তাজ ধুপ করে বসে পড়লো সোফায়। রায়হানের সামনে নিজেকে কঠিন দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তিতির সাথে করা অন্যায় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। মৌ দৌড়ে গিয়ে বাবা-মায়ের হাত মুখের বাঁধন খুলে দিলো। রেহেনা ছাড়া পেয়ে কাশতে লাগলো।
মৌ ব্যস্ত হয়ে বললো, বাবা তুমি মাকে নিয়ে ভেতরে যাও।
মহিবুল রেহেনাকে নিয়ে নিজেদের বেডরুমে চলে গেলো। মৌ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তাজের দিকে অনেক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে কাছে দাঁড়ালো তাজের।
তাজ নিজের মাথার চুল খামচে ধরে ধীর গলায় বলছে, How could I do that ? I r*a*p*ed her.
তাজের কথা শুনে মৌ যেনো জমে গেলো। কী বলছে এসব তাজ ?
মৌ কাঁপা গলায় বললো, এসব কী বলছো ?
তাজে গর্জে উঠলো, শুনতে পাসনি কী বলছি ? আমি রে*প করেছিলাম ঐ মেয়েটাকে। যেখানে সকলে পরিস্থিতির স্বীকার সেখানে কেবল তাকেই শাস্তি দিয়েছি আমি। হিং*স্র জা*নো*য়ারের মতো আচরণ করেছিলাম সেই রাতে। রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি আর এই সবকিছুর জন্য দ্বায়ী তুই।
মৌ দু’কদম পিছিয়ে গেলো তাজের থেকে, আমি ?
তাজ রাগে থরথর করে কাঁপছে, হ্যাঁ হ্যাঁ তুই। তোর জন্য রায়হান এমন ডেস্পারেট হয়ে উঠেছে। তুই স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছিস ওকে।
মৌয়ের চোখে পানি টলমল করছে, আমি তো শুধু তোমাকে ভালোবেসে এসব করেছি।
তাজ দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, কে চেয়েছে তোর এমন ভালোবাসা ? তুই ভালোবেসে এসব করে থাকলে রায়হানও তোকে ভালোবেসে এতো অন্যায় করেছে। ভালোবাসার শাস্তি যদি রায়হান পায় তাহলে তোরও পাওয়া উচিত। কারণ তুইও কম অন্যায় করিসনি রায়হানের সাথে।
মৌ কাঁপা গলায় বললো, কী শাস্তি ?
তাজ নিজের চোখ মুছে গম্ভীর গলায় বললো, রায়হান যেমন ওর ভালোবাসা পায়নি ঠিক তেমনই তুই কোনোদিন পাবি না তোর ভালোবাসা। আজকের পর আর কোনোদিন তুই আমার সামনে আসবি না আর এটাই তোর শাস্তি।
তাজ হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো মৌদের বাসা থেকে। নিজেকে তার পাগল পাগল লাগছে। একবার হলেও তিতিরের দেখা পাওয়া দরকার। সেরাতের আচরণের জন্য সরি বলতে হলেও তিতিরের দেখা পাওয়া দরকার। এখানে নির্দোষ তো কেউ নেই, তবে শাস্তি কেনো একা তিতিরের ভাগ্যে লেখা। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে তাজের হৃদয়। চোখের সামনে ভাসছে তিতিরের সাথে করা জঘন্য সেই ব্যবহারগুলো।
“বুঝবে তুমি বুঝবে
যেদিন সব বুঝবে
হারিয়ে আমায় খুঁজবে
তবে দিনশেষে শূণ্য হাতে
নিজের নীড়ে ফিরবে
বিষাক্তফুল নেই আপন করতে
তার ঘ্রাণেও যে হবে প্রাণনাশ”
তিতিরের বলা ছন্দের মানে আজ বুঝতে পারছে তাজ। তবে কী আর কোনোদিন দেখা হবে না বিষাক্তফুলের সাথে তাজের ? জানা হবে না সে হয়ে উঠেছিলো আর জীবনের বিষাক্তফুলের আসক্তি। মেয়েটা আসক্ত হয়েছিলো তাজ নামক মানুষের।
১৯.
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
আঙুলে আঙুল রাখলেও হাত ধরা বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
তোমায় যত গল্প বলার ছিল…
তোমায় যত গল্প বলার ছিল
সব পাপড়ি হয়ে গাছের পাশে ছড়িয়ে রয়েছিল
দাওনি তুমি আমায় সেসব
কুড়িয়ে নেওয়ার কোনো কারণ
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
ওই মায়া চোখে চোখ রাখলেও ফিরে তাকানো বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
শূন্যে ভাসি রাত্রি এখনও গুনি
তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনও শুনি
শূন্যে ভাসি রাত্রি এখনও গুনি
তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনও শুনি
তাই মুখ লুকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে
বসন্তের এই স্মৃতিচারণ
প্রেমে পড়া বারণ
কারণে অকারণ
মনে পড়লেও আজকে তোমায় মনে করা বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
প্রেমে পড়া বারণ
গানটা শেষ করতেই তিতিরের বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে গেলো নোনাজল। আহান তাকিয়ে আছে তার তুতুলের দিকে। এভাবে তো সে দেখতে চায়নি তার তুতুলকে। যুদ্ধে পরাজিত হওয়া সৈনিক হিসাবে দেখতে চায়নি তাকে। সে চেয়েছিলো ছোটবেলার মতো চঞ্চল আর প্রাণোবন্ত মেয়েটাকে ফিরে পেতো।
ছদ্মবেশে সিলেটের ছোট একটা কটেজে উঠেছে তারা, সকালে এসে সিলেট পৌঁছেছে। কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য তিতিরকে ডাকতে এসেছিল। তিতির কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে গানটি গাইছে দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়।
মনে মনে বললো, কিছু বারণ মানতে ইচ্ছে করে না তুতুল। কিছু বারণ উপেক্ষা করে নিজেকে পোড়াতে ইচ্ছে করে কারো প্রেমের আগুনে। তাই তো মানুষ জেনে শুনে প্রেম নামক আগুনে ঝাঁপ দেয়।
গতরাতে তিতির যখন বলেছিলো সে প্রেগনেন্ট। আহান কিছু সময়ের জন্য পাথর হয়ে গিয়েছিলো যেনো। কোনমতে নিজেকে সামলে শুধু বলেছিলো ঘুমিয়ে নে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত তিতিরের সাথে আর কথা হয়নি। আহান অনেক ভেবে ঠিক করেছে বাচ্চাটাকে প্রয়োজনে নিজের পরিচয়ে বড় করবে তবু তিতিরকে আর একা ছাড়বে না।
কিছু খেয়ে নিবি চল। এই অবস্থায় বেশি সময় না খেয়ে থাকা ঠিক না।
তিতির চমকে উঠে পেছনে ফিরে তাকালো, খেতে ইচ্ছে করছে না।
নিজের জন্য না হলেও ভিতরে বেড়ে উঠা প্রাণটার জন্য খেতে হবে।
পাখি কোথায় ?
তোর জন্য অপেক্ষা করছে। আজ সে আপুনির হাতে ছাড়া খাবে না।
তিতির কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। আহান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে তিতিরের পিছনে গেলো। তিতির যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে বোনুকে। তিতির নিজে খাচ্ছে না দেখে আহান একটু খাবার নিয়ে তিতিরের মুখের সামনে ধরলো। তিতির তাকালো আহানের দিকে তবে কিছু বললো না। চুপচাপ খাবারটা মুখে নিলো।
আহান নিজের মুখেও খাবার তুললো, ভাইয়াকে র্যাব ধরে নিয়ে গেছে।
তিতিরের হাত থেমে গেলো তাকালো আহানের দিকে, তবে আমরা এবার স্বাধীন।
আহান ছোট করে বললো, হুম।
তিতির আবার পাখিকে খাওয়ানোতে মনোযোগ দিলো, তোকে গতকাল একটা প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরটা এখনো দিসনি। আমার বোনুকে দেখে রাখবি বিনিময়ে সব প্রোপার্টি আমি তোর নামে করে দিবো আহু।
আহানের হাত থেকে গেলো। চামচটা প্লেটে রেখে দিলো একটু শব্দ করে, তুই কী আমাকেও রায়হান চৌধুরীর মতো মনে করিস তুতুল ?
সেটা হতে যাবো কেনো ? তোকে রায়হান চৌধুরীর মতো মনে করলে তার সাথে আসতাম না বরং তোর থেকে পালানোর চেষ্টা করতাম।
তবে কেনো মনে করছিস, প্রোপার্টির স্বার্থে আমি পুতুলের খেয়াল রাখবো।
তিতির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, রাখতে না চাইলে থাক। আমি অন্য ব্যবস্থা করে নিলো।
আহান তিতিরের এক হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো, তুই চাইলে আমি নিজের জীবনটাও দিতে রাজি তুতুল।
তিতির প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো আহানের দিকে আহান বললো, আজ থেকে পুতুল আর তোর সব দ্বায়িত্ব আমার। তোর এই বন্ধুকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পাশে পাবি। একবার হারিয়ে গিয়েছিলি আর হারাতে দিবো না।
তিতিরের চোখে টলটল করছে নোনাজল। নুরুল মারা যাওয়ার পর যেনো অথৈ সাগরে পড়েছিলো বোনুকে নিয়ে৷ পাশে পায়নি কাউকে তারপর জবটা হলো। সেখানেই হয়তো সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলো জীবনের, জবটা নিয়ে।
আহু রে আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। আমি চাইনা আমার বোনুর জীবনটা এলোমেলো হোক। বড্ড বেশি ভালোবাসি ওকে।
তিতির ভয় পেয়ে বললো, রায়হান চৌধুরী যদি আবার কিছু করে।
আহান বললো, ভয় পাস না রায়হান চৌধুরী জেলে, সে কিছুই করতে পারবে না আর লন্ডনে আমি নিজের ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলেছি। সেখানে আমাদের এতো সহজে খোঁজে পাবে না ভাইয়া বা অন্য কেউ।