Monday, August 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 451



প্রেমোত্তাপ পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

1

#প্রেমোত্তাপ
অন্তিম পর্ব: খন্ড-১

কলমে: মম সাহা

একটি গাঢ় ব্যাথাময় উত্তপ্ত দুপুর মাথার উপর তেজস্বিনী রূপ ধারণ করেছে। অকল্যাণের ডাক নিয়ে কাক গাইছে করুণ সুরে। চিত্রাদের খাবার টেবিল আজ আনন্দ শূন্য। প্লেট গুলো পরে আছে অযত্নে। ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলে। প্রস্থানের সময় নিকটে। ব্যাথাদের তীব্র হামাগুড়ি। ভেতর ভেতর যন্ত্রণারা ছটফটিয়ে মরছে। কিন্তু উপর উপর সবাই শক্ত। অহিকে নিতে এসেছে তার জন্মদাত্রী, ভদ্রমহিলার মুখে হাসির কমতি নেই। প্রথমে অহিরা বের হবে, তারপর চাঁদনীকে দিয়ে আসতে যাবে সকলে এয়ারপোর্টে। অহির ব্যাগ গুছানো শেষ। বিদায়ের সময় হয়ে গেছে। সবার মুখ ভার, কেউ কেউ কাঁদছে। চিত্রা এবং চেরি তো বেশ শব্দ করেই কাঁদছে। চেরি তো কতক্ষণ হাউমাউ করে কেঁদে বায়না করেছে আপাকে সে যেতে দিবে না। কিন্তু আপার মন যে বড়ো পাথর হয়ে গিয়েছে! সে যে ঠিক করে ফেলেছে চলে যাবে! আপার কঠিন অবয়ব দেখে বাচ্চাটা বুঝতে পারে তার আপা আর থাকবে না। কোনো পিছুটান তার আপাকে রাখতে পারবে না। অহি একে একে সকলের কাছ থেকে বিদায় নেয়। কেউ তাকে জাপ্টে ধরে কাঁদে, কেউবা কান্না লুকিয়ে প্রার্থনা করে তার সুখী জীবনের। তা শুনে মনে-মনে হাসে অহি। যেই সুখী জীবনকে সে দাফন দিয়ে যাচ্ছে তা যে আর ফিরে আসবে না! সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেও সে বিদায় নেয় না অবনী বেগমের কাছ থেকে। অবনী বেগম ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে দেখে অহিকে। এ বাড়িতে যখন সে বউ হয়ে এলো, তখন তার বয়স ষোলো মাত্র! আর অহির বয়স আট। মাত্র কয়েক বছরের ছোটো-বড়ো তারা! তার বিয়েটা সাদামাটা ভাবেই হয়। তার বরের দ্বিতীয় বিয়ে কি-না! বাড়িতে যখন পা রাখল, দেখল এই গোলগাল ছোটো মেয়েটা দূরে দাঁড়িয়ে পর্দার আড়াল থেকে তাকে দেখছে। অবনী বেগমও দেখল বাচ্চাটাকে লুকিয়ে-চুড়িয়ে, আড়চোখে। তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হলো গোপনে গোপনে। এরপর দেখা হলো পরেরদিন। তার শাশুড়ি অহিকে কোথা থেকে টেনে আনলেন যেন! এনেই অবনী বেগমের ছোটো হাতের মুঠোয় অহির ছোটো হাতটা রেখে বললেন, ‘ধরো তোমার মাইয়া। অহি ওর নাম। ও যেন কোনোদিনও দুঃখ না করতে পারে যে ওর মা নাই। তুমিই ওর মা, কেমন?’ অবনী বেগম তখনও সংসার বুঝতো না, সন্তান বুঝতো না, দায়িত্ব বুঝতো না। ফ্রক পড়া ছেড়ে তখনও সে থ্রি-পিস পরেনি কিন্তু তার আগেই তার কাঁধে তার অর্ধ বয়সী এক বাচ্চার ভার এসে পড়ল। কানামাছি খেলার বয়সে তার সাথে কানামাছি খেলল তার ভাগ্য। কিন্তু ছোটো অবনী বেগমের মাথায় এতটুকু গেঁথে গেল যে, সে একজন মা। এরপর থেকে উড়নচণ্ডী অবনী বেগম হয়ে উঠলেন দায়িত্বশীল একজন। নিজেও তখন বড়ো হচ্ছেন ধীরে ধীরে। তার সাথে বড়ো হচ্ছিল তার সন্তান। মা-মেয়ের একসাথে বড়ো হওয়ার ব্যাপারটা তার কাছে ছিল কৌতূহলোদ্দীপক কিছু। কিন্তু অহির কাছে পুরোটাই ছিল বিরক্তকর, অসহ্যকর। অবনী বেগম কখনো যত্নের ত্রুটি রাখেননি। সদা সে ছিল সচেষ্ট। তার দায়িত্বে কিংবা ভালোবাসায় কখনো হেলা-ফেলা করেননি। তবুও এই সংসার তাকে আপন করতে পারেনি। সে যেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এসেছিলো, সেই শূন্যস্থান তাকে বিরাট ক্ষত বানিয়েই রেখে দিয়েছিল। স্বামীর আদর পায়নি, সন্তানের ভালোবাসা পায়নি তবুও ছোটো হাতে সবটা সামলে গেছে বছরের পর বছর। কিন্তু সে আজ অনুভব করছে, সেদিন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা অহির সাথে তার যে গোপনে গোপনে দূরত্ব ছিল আজও তা দূরত্বই রয়ে গেল। কাছে আসার গল্প হতে আর পারল না। অবনী বেগম হতাশ হলেন। এ জগতে ভালোবাসার পর আর কোনো বাঁধন নেই যা কাউকে আটকে রাখতে পারে। থাকলে হয়তো অবনী বেগম সেই বাঁধনে বাঁধতো অহিকে।

অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো, বাজলো অহির প্রস্থানের ঘন্টা। পিছে রাখল গোটা সওদাগর পরিবারকে এগিয়ে গেলো সে অযাচিত গন্তব্যের পথে। সবটুকু ভালো থাকা পিছনে ফেলে চলে যাচ্ছে সে। আবার, কখনো নিশ্চয় আসবে এই পরিচিত দালানে প্রিয় সুখ কুড়িয়ে নিতে। হয়তো আসবে!

চেরি ও চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। দু’টো মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায়। চাঁদনীরও ভেতরটা ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপ কিন্তু বাহিরে সে তবুও অটল। সবাই যদি ভেঙে যায় তবে ভরসা হবে কে?

আমজাদ সওদাগর বসে পড়লেন পাশের সোফায়৷ তার মনে পরে অতীত। ছোটোবেলা অহি ছিল ডানপিটে স্বভাবের। বাড়ির এ-কোণ থেকে ও-কোণ ছুটে বেড়াতো কেবল। ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াতো চঞ্চল পাখির ন্যায়৷ কিন্তু হুট করে তার সদ্য গজানো ডানাটা টেনেহিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলে তার জন্মদায়িনী। এরপর মেয়েটা আর উড়তে পারেনি। মায়ের এমন চলে যাওয়াটা ছোট্টো অহির মস্তিষ্কে ভয়ঙ্কর ঘা হয়ে রইল। মেয়েটা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়তো। আমজাদ সওদাগর মেয়ের চিন্তায় যখন দিশেহারা, তখন সবাই বলল- অহির একজা মা প্রয়োজন। আমজাদ সওদাগর দিগভ্রান্ত হয়ে সে কথাও রাখলেন। নিজের প্রথম স্ত্রী’কে অনেক ভালোবাসা স্বত্তেও সে তাকে হৃদয় মাঝে মাটি দিলেন। মায়ের জোড়াজুড়িতে একটা অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করলেন। যদিও সে অবনী বেগমকে বিয়ের দিন দেখে ছিল, এর আগে দেখলে নিশ্চয় সে বিয়েটা করত না। অবনী বেগমের এই অপরিপক্ক বয়সটাই আমজাদ সওদাগরের গলার কাঁটা হয়ে থেকে গেল। তার মেয়ের মা প্রয়োজন বলেই সে বিয়েটা করেছিল অথচ অবনী বেগম ছিল সদ্য কিশোরী। এই সদ্য কিশোরী কী নিজের বয়সের অর্ধেক বয়সী মেয়ের মা হতে পারবে? এমন একটা ভাবনায় তার ভেতর বিতৃষ্ণায় ভোরে উঠেছিল। আর সেজন্য সে অবনী বেগমকে মানতে পারলেন না আর। তবুও, সংসার করে গেলেন। তার উপর দেখলেন, তার মেয়ে নতুন মা আসার পর আরও দূরে সরে গিয়েছে, সেটাও মানতে পারলেন না আমজাদ সওদাগর। আর এই সবটুকু দায়ভার গিয়ে পড়ল অবনী বেগমের উপর। যদিও পরে ধীরে ধীরে সে উপলব্ধি করেছিল অবনী বেগম একজন দারুণ ও চমৎকার মা। কিন্তু তবুও, প্রথম দৃষ্টিতে যে দূরত্ব তৈরী হয়েছিল তা আর ঘুচাতে পারেননি তিনি। আমজাদ সওদাগরের ভেতর অনুশোচনার ঘর বাঁধলো। সে ভুল করে ফেলেছে, বিরাট ভুল। ছোট্টো অহির ডানাটা যিনি নির্মমভাবে ছিঁড়ে ফেলেছিল, তার কাছেই সে বড়ো অহিকে সমর্পণ করে দিল! অথচ যিনি অহির ছেঁড়া ডানাকে বহু বছর যাবত যত্ন করে আবার সুনিপুণ করত চাইল তাকে কোনো দামই দিল না সে! আজকের অনুশোচনাটা যে বড়ো দেরিতে হলো। এখন যে আর কিছুই করার নেই। সে আটকালে অহিটা হয়তো থেকে যেত, অথচ তিনি কীভাবে এতটা পাষাণ হয়ে মেয়েটাকে যেতে দিল! আফসোসে আফসোসে পুড়তে লাগলেন তিনি। কিন্তু বড়ো দেরি হয়ে গেলো যে! এখন আর আফসোস করা উপায় নেই। মানুষ বরাবর ভুল সময়ে এসে আফসোসটা করে।

অহির ঘরের বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে রইল অবনী বেগম নির্নিমেষ। যতক্ষণ না অহিদের গাড়ি অদৃশ্য হলো ঠিক ততক্ষণ। বৈরী বাতাস বয়ে গেল জানালার অবগুণ্ঠন গুলো কাঁপিয়ে। তার তালে অবনী বেগমের চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়র নিরব অশ্রুবিন্দু। ঠিক তখনই অবনী বেগমের চোখ গেল বারান্দার সাথে লাগোয়া বুকশোলফের একটি রঙিন কাগজে। কলমদানি দিয়ে যেটাকে আটকে রাখা হয়েছে। দেখতে প্রায় চিঠির মতন। অবনী বেগমের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। ছুটে গিয়ে কমলা রঙের কাগজটা হাতের ভাঁজে মেলে ধরল। পুরো কাগজ জুড়ে জ্বলজ্বল করছে অহির লেখা……

“প্রিয় মা,
মা বলেছি বলে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়? এতগুলো বছর কেবল এই একটা ডাক শোনার জন্যই তো আপনি আপনার সকল ধ্যান জ্ঞান সমর্পণ করেছিলেন আমার ভালো থাকায়। তাই আমাদের সম্পর্কের আরম্ভে আপনি আমার কেউ না হলেও শেষবেলায় আপনি কেবল আমার মা হয়েই থাকবেন। সেই ছোটোবেলায় বাবা যখন আমার জন্য মা নিয়ে এলেন, তখন আমার কেবল চারপাশের মানুষের বলা একটা কথাই মাথায ঘুরত, আপনি আমার সৎমা। আর সৎমা কখনো নাকি আপন হয় না। সেই কথা থেকেই আমি আপনাকে আমার রূপকথার গল্পের রাক্ষসী ভাবতাম। আর সে থেকে আমাদের দূরে যাওয়া। কিন্তু দিন অতিবাহিত হতে লাগল ঋতুর প্রয়োজনে আর আমিও অনুভব করলাম আপনি আমার রূপকথার গল্পের রাক্ষসী না বরং নির্মাতা। আমি দেখেছি খুব সুক্ষ্ম ভাবে আপনি সৎমা থেকে মা হয়ে উঠার চেষ্টা করেছেন। আমার জ্বর হলে আপনার চেয়ে বেশি বিচলিত হতে কাউকে দেখিনি। আমি একবেলা কম খেলে সে বেলা আপনাকে উপোস থাকতে দেখেছি। আমি রাত জেগে পড়ার সময় খেয়াল করতাম, দরজার আড়ালে একটি প্রাণ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। আমি ঘুমিয়ে গেলে আমার বেখেয়ালি ঘরটা আপনি সাজিয়ে রাখতেন। এই যে আপনার মা হয়ে উঠার আপ্রাণ চেষ্টা আমি ঠিকই দেখেছি। চেরি আপনার রক্তের সন্তান হয়েও আপনার কাছে প্রাধান্য পায়নি। অথচ আপনার কাছে প্রাধান্য পেয়েছিলাম আমি। কারণ আমাকে যে আপনি আপনার আত্মার সন্তান হিসেবে ভেবে নিয়ে ছিলেন। আপনার ষোলো বছর থেকে ত্রিশ বছরের জীবনে এই মা হয়ে উঠার গল্প ভীষণ যত্নের। তাই শেষবেলায় বলে যাচ্ছি, মা তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমার মা-হীন জীবনে মা হয়ে আসার জন্য তোমাকে আজীবন কৃতজ্ঞতা। ভালো থেকো মা, ভালো থেকো। হয়তো কোনো এক বিষণ্ণ ঋতুতে আমাদের দেখা হবে। সেদিন আমি পর্দার আড়ালে লুকাবো না, আর তুমিও গোপনে তাকাবে না। সেদিন আমাদের সাক্ষাৎ হবে প্রকাশ্যে। এবং আমাদের গল্প হবে নিকটের। মা, তোমাকে ভীষণ মনে পড়বে আমার। বিষম ভীষণ মনে পড়বে। আমার নির্ঘুম রাত গুলোতে আর কেউ সঙ্গী হবে না ভাবলেই জানো আমার কত কান্না পায়! তবুও….. ভাগ্য তো মানতেই হবে তাই না বলো? তবে, আমার যে ভাগ্যে তুমি ছিলে, সে ভাগ্যের প্রতি আমার আর কোনো অভিযোগ নেই। ভালো থেকো মা। ভালোবাসাতে থাকবে। তোমার মেয়ে এই যন্ত্রণাময় যন্ত্রের শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে মা, পালিয়ে যাচ্ছে।

ইতি
তোমার চন্দনকাঠ

[পুনশ্চঃ আমি জানি তুমি সেই ছোটোবেলা আমাকে দেখেই নাম রেখেছিলে চন্দনকাঠ৷ যে শক্ত এবং দামী।]”

চিঠিটুকু পড়তে পড়তেই অবনী বেগমের চোখ ঝাপসা হলো। ভেতরে থেকে বেরিয়ে এলো দমফাটা কান্না। অপরদিকে দামী গাড়ির জানালার ফাঁক গলিয়ে একটি মেয়ে তাকিয়ে আছে সুদূরে। যতক্ষণ পর্যন্ত তার মা’কে দেখা যায়, সে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্তই তাকিয়ে রইল। সে জানে, তার বিরহে এই সুখী শহরে একজন মানুষ রোজ কাঁদবে। সে আর কেউ না, তার মা। তার আত্মার মা।

পরিশিষ্ট: সওদাগর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নওশাদ। তার কোলে ছোটো হুমু বার বার আধো কণ্ঠে বায়না করছে আইতকিলিম আন্তিকে দেখার জন্য। নওশাদেরও মন ভালো নেই। কয়েকদিন যাবত অহিটা কেমন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল! কেন এমন করল সে ভেবে পায় না। তন্মধ্যেই সশব্দে বেজে উঠল নওশাদের ফোন। দুপুরের উত্তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে ফোন ধরল নওশাদ, বিরক্ত ছুঁড়ে ফোনের অপর পাশের মানুষটাকে বলল,
“কল করেছেন কেন আপনি? আপনার কী লজ্জা শরম হবে না ভাবী? যতই বলি কল করতে না আপনি ততই জ্বালান!”

অপরপাশের সুন্দরী রমণী হাসলো। বললো, “তুমি বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হও নওশাদ, তাহলেই তো হয়।”

বিপরীত পক্ষের কথায় ঘৃণায় তেঁতো হয় নওশাদের অন্তর। প্রায় ঘৃণা ছুঁড়েই বলে,
“আপনার লজ্জা হয় না ভাবী এসব বলতে? আমার ভাই মারা যেতেই আপনি নিজের এই ছোট্টো মেয়েটার দায়িত্ব ঝেরে ফেললেন। এই ছোটো হুমুকে আমরা মানুষ করছি। আর আপনি কি-না আমাকে বিয়ে করতে লেগে পড়েছেন! ছিহ্। আপনি নোংরা মহিলা।”

কথাটা বলেই ফোন কাটলো নওশাদ। তন্মধ্যেই সওদাগর বাড়ির দারোয়ান জানালো অহি কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আর এই শহরে ফিরবে না কখনো।

নওশাদ যেন হতবিহ্বল। মেয়েটা এভাবে ভালোবাসা জন্মিয়ে ছেড়ে গেল? ঠকালো শেষমেশ! অথচ কেউ জানলো না প্রেমের উত্তাপে ঝলসে গেছে একটি সদ্য গজানো ভালোবাসার চারাগাছ।

#চলবে…..

#প্রেমোত্তাপ
অন্তিম পর্ব: খন্ড দুই

সবেই বিকেলের বিবর্ণ রঙ আকাশ ছুঁয়েছে। পাখিদের ব্যস্ত ডানা ঝাপটানো দেখা যাচ্ছে পুরো আসমান জুড়ে। তাদের কিচিরমিচির শব্দে বিকেলের নৈকট্যতা খুব সহজেই ধারণা করা যাচ্ছে। সওদাগর বাড়ির দু’টো গাড়ি এসে থেমেছে বিমানবন্দরে। চুপসে আসা মনের অনুভূতি এবং দ্বিতীবার হৃদয় খালি হওয়ার যাতনা তারা নিরবতার মাঝে মিশিয়ে দিয়ে নাটকীয় ভালো থাকার চেষ্টা করছে কেবল।
তবে চাঁদনী কান্নাকাটি করেনি। বরং বাড়ির বড়ো মেয়ের মতন খুশি থাকার দায়িত্ব পালন করছে অবিরত।

সকলের থমথমে মুখ যেন চাঁদনীর চলে যাওয়ার ক্ষত আরেকটু গাঢ় করেছে। তবুও সে সামলে নিল নিজেকে। এতটা দূরে সে যেতে চায়নি, যতটা দূরে গেলে পিছু ফিরে আর নিজের মানুষ গুলোকে দেখতে পাওয়া যাবে না। তবুও….. ভাগ্য বুঝি চেয়েছে অন্যকিছু। আমরা যা চাই, সচারাচর দেখা যায় ভাগ্য তার বিপরীতেই চায়। হয়তো সেজন্যই পৃথিবীতে এত মন খারাপের গল্পরা বেনামি ঠিকানায় দূঃখ উড়ায়!
যাওয়ার ঘন্টা বেজে উঠলো গোপনে। এনাউন্সমেন্টে সুরেলা একটি কণ্ঠ দিক নির্দেশনা দিতে আরম্ভ করল। যেই কণ্ঠ দিক নির্দেশনার আড়ালে হয়তো বুঝায়, আর দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই পথিক! সকল পিছুটান পেছনে ফেলে সামনে চলো। কেউ তোমার জন্য থেমে থাকবে না। তুমি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটো, তোমার জন্য পিছুটান বাঁধা নয়।

চাঁদনী বিশাল বড়ো এক শ্বাস ফেলল গোপনে। বুকের ভেতর এমন দমবন্ধকারী ভারী পাথরটা নামাতে চাইল অথচ পারল না। এই শেষ মুহূর্তে এসে তার কেবলই মনে হচ্ছে থেকে যেতে। মনের এই আহ্লাদী আবদার অবশ্য মস্তিষ্কের কাছে নিছকই ঠাট্টায় উড়ে গেল। থেকে যাওয়ার এই নিয়ম ভাঙা আবদার মেনে নিল না মস্তিষ্ক। তার কেবল দূরে যাওয়ার পায়তারা কি-না! কারণ সে তো জানে, বরাবরই মনের সিদ্ধান্ত জীবনে তুমুল ব্যাথা হয়ে থেকে যায়! মন যে কোমল, শীতল। সে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে জানেনা। তাই মস্তিষ্কককেই সেই দায়িত্ব নিতে হয়। জীবনের সবচেয়ে ভালোর জন্য, কখনো কখনো অনুভূতি বিসর্জন দিয়ে কঠিন হতেই হয়।

চাঁদনী তার বাবার হাত থেকে ট্রলিটা নিতে চাইলে আফজাল সওদাগর বললেন,
“তুমি নিতে পারবে না তো, মা। অনেক ভার।”

“জীবনের চেয়ে তো কম হবে তাই না, আব্বু? কখনো কখনো এই ভার নিতে না পারলেও নিতে হয় যে, আব্বু। আর কতকালই-বা আমার ভার বইবে তোমরা বলো? আটাশ বছরের এই বোঝা আমি হালকা করে দিয়ে যাচ্ছি, আব্বু। কয়েকটা দিন তোমরা নাহয় শান্তিতে বাঁচলে!”

কথাটা চাঁদনী মায়ের দিকে তাকিয়েই বলল। কথা শেষ করে কেমন হাসলো! এই হাসিরা মৃত, ভাষাহারা। রোজা সওদাগর মেয়ের এই ফ্যাকাসে মুখের দিকে চাইলো করুণ চোখে। অনেকদিন পর বোধহয় সে এমন বুক ভরা স্নেহ নিয়ে দেখলেন মেয়েকে।

“ছিহ্ঃ আম্মু, তুমি কখনোই আমার বোঝা ছিলে না। কন্যা সন্তান আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড়ো নিয়ামত। আমার পরম সৌভাগ্য ছিল মা যে আমি তোমাকে পেয়ে ছিলাম। আর আজ আমার পরম দুর্ভাগ্য যে আমি তোমাকে হারাচ্ছি।”

শেষের কথাটুকু বলতে গিয়ে অসহায় বাবার কণ্ঠ কাঁপলো। তবে চাঁদনী রইল অনড়। সে শক্ত মনে একে একে বিদায় নিল সকলের কাছ থেকে। সবশেষে বাদ রইল তার মা। চাঁদনী এবার নিজেকে ভীষণ শক্ত করল। যতটুকু শক্ত করলে মা-বাবাকে ছেড়ে যাওয়া যায় ঠিক ততটুকু। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে এলো মায়ের দিকে। মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
“বিদায় দিবে না, মা? তোমার ঘাড়ের বোঝা আজ হালকা হচ্ছে। একটু হাসিমুখে বিদায় দাও আমারে।”

রোজা সওদাগর ঠিক এই কথাটার পরে আর স্থির থাকতে পারলেন না। জাপটে ধরলেন মেয়েকে, হাউমাউ করে কেঁদে বললেন,
“তোরে অনেক দুঃখ দিছি, মা। ক্ষমা করিস তোর অভাগিনী মা’রে।”

এবার চাঁদনীর বন্ধ চোখের পাতা থেকেও গড়িয়ে পড়ল এক বিন্দু অশ্রু। মায়ের পিঠে নিবিড় হাত রেখে অভিযোগ বিহীন বলল,
“তুমি এত যত্ন করে আমারে গড়লে মা, এতটুকু কষ্ট দেওয়ার অধিকার তোমার আছে। আর আশেপাশের মানুষ যত কষ্ট দিয়েছে আমায় তার কাছে তোমার দেওয়া কষ্ট কিছুই না, আম্মু। তবে আমি সেই ব্যাথা ভুলতেই তোমার কোল খুঁজতাম বারংবার। সেই কোল তখন আমায় ভরসা দেয়নি। আসেনি আমার ভরসা হয়ে। এই একটা আফসোস আমার চিরজীবন থাকবে মা, চিরজীবন থাকবে।”

রোজা সওদাগর আরও শক্ত করে যেন আকড়ে ধরল মেয়েকে কিন্তু লাভ কী! শেষবেলায় আকড়ে ধরে যে লাভ নেই। যার যাওয়ার কথা সে যে যাবেই।
চাঁদনী মা’কে যত্ন করে ছাড়িয়ে নিল নিজের থেকে। উদাস চোখে তাকাল বাবার পানে। কেমন এক বিষন্ন স্বরে বলল,
“আব্বু, এই কলঙ্কিনীর ভরসা হওয়ার জন্য তোমায় আমি ভুলব না। পুরো পৃথিবী যখন আমায় কোণঠাসা করে দিয়েছিল তখন আমার পুরো পৃথিবী হওয়ার জন্য আমি চিরজীবন কৃতজ্ঞতা স্বীকার করব। আব্বু, আমি দেশ ছাড়তে চাইনি, তবুও ছাড়তে হলো তোমাদের, আমার এই মন ভালো না থাকার জীবন বেছে নেওয়ার জন্য আমি কিছু মানুষকে কখনো ক্ষমা করব না। জানো আব্বু, আমি সেই দূরদেশে তোমাদের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচবো। আব্বু, জীবন এত জটিল কেন?”

চাঁদনী প্রশ্ন করল ঠিকই কিন্তু উত্তর শোনার অপেক্ষা করল না। জীবন এত জটিল কেন, তার উত্তর যে কারো জানা নেই এমনকি আব্বুরও না সেটা সে ভালো করেই জানে। আফজাল সওদাগর মনে মনে ভীষণ শোকে মূর্ছা গেলেন। তবে বাহির থেকে রইলেন অটল। বাবাদের যে ভেঙে পড়তে নেই।

সকল প্রিয় মানুষ, প্রিয় পরিবেশ, সুন্দর স্মৃতি ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। চোখের উপর ভেসে উঠছে কত স্মৃতি। খুব অগোচরে মৃন্ময়ের মুখটাও বার কয়েক উঁকিঝুঁকি দিল স্মৃতির পাতায়। শাহাদাত এর সাথে দীর্ঘ আট বছরের প্রেমের স্মৃতিরাও জীবিত হলো। বিড়বিড় করে বলল,
“শাহাদাত, তুমি বড়ো নিঠুর প্রেমিক। তোমার প্রেমে আটকে আমার চরম সর্বনাশটুকু হলো। শেষমেশ কি-না নিজের ঠিকানা বদলাতে হলো। কেন প্রেম আসে ব্যাথা দিতে? কেন তোমরা চাঁদনীদের অভিমানের প্রাক্তন হয়ে থাকো? কেন তোমাদের না পেয়ে এত নিঃস্ব হয়ে যাই?”

বুকের ভেতর অসহ্য ব্যাথা নিয়ে চাঁদনী যখন দৃষ্টি সীমানার বাহিরে গেলো, বিমানবন্দরের বাহিরে এক কোণায় দাঁড়িয়ে মৃন্ময় তখন খুব গোপনে আফসোসের শ্বাস উড়িয়ে ফেলল। চির জীবন এই আফসোস নিয়ে কাটাতে হবে ভাবতেই তার বুক ভার হয়।

ল্যাগেজ রেখে বসতেই চাঁদনীর বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। তখনকার মৃন্ময়ের সুদূরে দাঁড়ানো অবয়বটা তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। কীভাবে হবে? এই ছেলেটা তো একদিন হলেও তাকে অসম্ভব ভালোবেসেছে। অকারণে তো আজকাল কেউ-ই ভালোবাসেনা। তবুও তো ছেলেটা বেসেছে। সেই কৃতজ্ঞতা তো চাঁদনীর থেকে যাবে আমরণ।
চাঁদনী চোখ বন্ধ করতেই কানের কাছে বার বার প্রতিধ্বনিত হলো সেদিনের তার বন্ধুর বলা কথা গুলো। যখন চাঁদনী ভাইরাল হওয়া ছবিটা নিয়ে দিশেহারা তখন তার বন্ধু মুমিনুল সাইবার ক্রাইমের একজন আদর্শ কর্মকর্তা তাকে ভীষণ সাহায্য করে। এবং সে-ই জানায় ছবিটা মৃন্ময় ফ্যাক একাউন্ট থেকে পোস্ট করে। চাঁদনীর অবশ্য প্রথম পর্যায়ে একটু রাগ হলেও পরে ঠিক থিতিয়ে আসে সে রাগ। মৃন্ময়কে উদাসীনতা দেখিয়ে বুঝাতে হবে, ভালোবাসার যুদ্ধে কখনো জোরজবরদস্তি খাঁটে না। সেখানে কেবল নিঃস্বার্থ হতে হয়।

মৃন্ময় ফুটপাতে বসে আছে। দৃষ্টি তার আকাশ পানে। দূরে হতে মাথার হাজার মাইল উপর দিয়ে একটি প্লেন উড়ে যাচ্ছে। মৃন্ময়ের প্রেমের ইতি এখানেই। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই নিয়ম উপেক্ষা করে মৃন্ময় কাঁদলো। বলল,
“ইন্দুবালা, আমি আপনার ব্যাথা হতে চাইনি।”

দূরে হতে তখন গান বাজছে,
“সখী ভালোবাসা কারে কয়,
তা কি কেবলই যাতনাময়………”

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
অন্তিম পর্ব: অন্তিম খন্ড

কলমে: মম সাহা

সন্ধ্যার আকাশে এক মুঠো সোনালি আভা দেখা যাচ্ছে খুব ক্ষীণ। মনে হচ্ছে নিভৃতচারীণির গাঢ় অভিমান গগণ বক্ষে আলিঙ্গন করেছে। আজ মন খারাপের অপরাহ্ণ হলেও দিনটি বিশেষ। এতটাই বিশেষ যে প্রতি বছরের ক্যালেন্ডারের পাতায় এই দিনটিকে একটি অষ্টাদশীর কন্যা লাল কালিতে বৃত্ত দিয়ে হাসতে হাসতে যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যতে পা দিবে। এই দিনটির স্মৃতিচারণে সে কখনো কাঁদবে, কখনো বা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আনন্দে আহ্লাদী হবে। আজ যে সকল অপ্রাপ্তিদের প্রাপ্তি হওয়ার দিন। আজ বাহার ভাইকে পেতেই হবে কথার বৈধ দিন।

চিত্রা লাল রঙের একটি জামদানী শাড়ি শরীরে চাপিয়ে নববধূর লজ্জাতে আবেশিত হয়েছে। শাড়িটা বাহার ভাই দিয়েছে তাকে। বিয়ে উপলক্ষেই দেওয়া। বাহার ভাইয়ের পক্ষ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার এটা। বার কয়েক শাড়িটা নাকে চেপে সে ঘ্রাণ শুঁকলো। কেমন যেন নিজের নিজের একটা ঘ্রাণ পাওয়া গেল ! চিত্রা সেই অদৃশ্য ঘ্রাণে পেয়ে লাজুক হাসলো। অতঃপর নিঃশেষ হওয়া গোধূলির দিকে তাকিয়ে ক্ষণ গুনলো সঠিক সময়টা আসার। সন্ধ্যার আকাশের শেষ আলোটুকু বিলুপ্ত হতেই সে নেমে গেল ঘর ছেড়ে। সাবধানী পায়ে এসে থামল গেটের বাহিরে। মৃদু মৃদু শীতল বাতাস এসে শিরশির করে গা কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার। সে এই বাতাসটুকুও অনুভব করল শৌখিন আত্মায়।
নিজের মনমতন জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিনটিতে সে সেজে নিয়েছে। এইতো, আর কয়েকঘন্টা! তারপর, বাহার ভাই মানুষটা চিরতরে তার বলে লিখিত হবে পৃথিবী নিষ্ঠুর বুকে। এক নিদারুণ আনন্দে তার শরীর কাঁপছে। প্রিয় পুরুষকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার যেই গোপন উল্লাস তা আর গোপন থাকছে না। বুক চিরে যেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে আনন্দ।

চিত্রা ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস ফেলছে। অতি আনন্দে বারকয়েক কেঁদেছেও মেয়েটা। প্রাপ্তির যে আনন্দ, সে আনন্দের কাছে পৃথিবীর সকল নিয়ম অনিয়ম হয়ে যায়। প্রেমের উঠতি ফুলে হুট করে ভ্রমর আসার ব্যাপারটা তার নিতান্তই স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এত সুখ তার কপালে ছিল! এতটা সুখ! এই সুখে না আবার মরণ হয় সইতে না পারার যন্ত্রণায়।
ঘড়ির কাটায় বেলা ফুরানোর গান। হাঁটতে হাঁটতে গলির শেষ মাথায় আসতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলল। যাক, কেউ তাকে দেখেনি এটাই বড়ো শান্তির ব্যাপার।

রিকশার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাতেই গলির মোড়ের টঙ দেকানটার দিকে তার নজর স্থির হলো। বার কয়েক কাঁপল ভারী পল্লব বিশিষ্ট নেত্র যুগল। কথা থেমে গেল লাল রঞ্জকে রঞ্জিত ওষ্ঠের সম্মুখে এসে। মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল চারপাশ। অস্ফুটস্বরে ডাকল সে,
“বাহার ভাই!”

টঙ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেটের ধোঁয়ায় জীবন বিলাস করতে থাকা নীল পাঞ্জাবি পরিহিত বাহার সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে চাইল। চিত্রাকে দেখে ক্ষাণিক হাসল কি! বুঝার উপায় নেই। মানুষটার হাসি কান্না সবই যে তার গম্ভীর ব্যাক্তিত্বের নিচে ঢাকা পরে যায়। সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে এগিয়ে এলো বাহার। সেই এলোমেলো চলন, বাঁকা তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি, রুক্ষ শুষ্ক কদমের মতন চুলগুচ্ছ! তবে পড়নের পাঞ্জাবি আজ এক নতুন বাহারের দীপ্তি ছড়িয়েছে। এ এক অন্যরকম বাহার। এ যেন এক প্রেম সৃষ্টি করা ধ্বংস মানব।

চিত্রা স্থির, চোখ আটকে আছে নীল পাঞ্জাবিতে। মোহময় তার মায়া ভরা দৃষ্টি। বলল,
“পৃথিবীর সকল সুন্দরের মাঝে আপনি অন্যতম, বাহার ভাই! আপনি কী সে কথা জানেন?”

“কখনো বলোনি তো, জানবো কীভাবে! তবে আজ জানলাম, তাও পাঞ্জাবির কল্যাণে।”

বাহারের ঠাট্টা মেশানো কথায় হেসে উঠল চিত্রা। বিবশ কণ্ঠে বলল,
“আমার ভাবতেই কেমন যেন লাগছে! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষটা কি-না আমার ভালোবাসায় আছে!”

“ভালোবাসা! সে যে নেহাৎ মরিচীকা মেয়ে। অবেলার কুকুর। যার মূল্য দিতে দিতে আমাদের জীবন চরম মূল্যহীনতায় হারিয়ে যায়। আচ্ছা রঙ্গনা, সবটুকু ভালোবাসা যার নামে তার নামে ঘৃণার ভাগ কতটুকু হবে?”

শেষের প্রশ্নে থেমে গেল চিত্রা। লোকটার স্বভাব কী কখনো বদলাবে না! সবসময় এমন কথা বলতেই হয়! লোকটা জানেনা? এসব কথা অষ্টাদশীর হৃদয়ে যে বড্ড আঘাত হানে।

“কখনো যদি আমায় ভুলতে চাও, মেয়ে, তবে প্রথমে ভুলে যেও, একটা ছেলে ধন্য হতো তোমাকে পেয়ে।”

চিত্রা নিকোটিনে ঝলসে যাওয়া বাহারের ঠোঁট গুলো চেপে ধরল, তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আপনাকে ভুলতে হলে যে সবার প্রথমে আমার নিজেকে ভুলতে হবে, বাহার ভাই। আর নিজেকে ভুলে গিয়ে বাঁচা যায়? আমি বাঁচবো না বাহার ভাই, বাঁচবো না।”

বাহার কথা বাড়াল না আর। একটি রিকশা থামিয়ে উঠিয়ে দিল চিত্রাকে। চিত্রা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“এক জায়গাতেই তো যাচ্ছি, আপনি উঠছেন না কেন? চলুন।”

“কাজ আছে একটু। তুমি গিয়ে অপেক্ষা করো, আমি আসছি।”

কথা থামতেই চলতে শুরু করে রিকশা। চিত্রার বুকের মাঝে কেমন অসহ্য যন্ত্রণা হলো হুট করে। কিছুক্ষণ পর যে মানুষকে চিরতরে পেয়ে যাবে, সে মানুষটার সাথে ক্ষাণিকের বিচ্ছেদটা তার যেন কেমন দমবন্ধকর লাগল। সে চলন্ত রিকশা থেকে পিছু ঘুরে তাকাল। বাহার দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার স্থির। মুখে বহু করুণ মুচকি হাসি। চোখের কোণে কী চিলিক দিল অশ্রু! চিত্রা ঠিক ঠাহর করতে পারল না। রিকশা দৃষ্টি সীমানার বাহিরে যেতেই বাহার আকাশের দিকে মুখ করে চরম বিষাদগ্রস্ত স্বরে বলল,
“তোমার জীবিত মৃত্যুর শোকে বাহার শোকাহত, রঙ্গনা। বখাটে বাহার কখনোই হয়তো তোমার হবে না। তোমার মন ভাঙার অপরাধে, বাহার চির জীবন মৃত্যু নিকটে থাকা রোগীর মতন ছটফট করবে। তুমি ক্ষমা করো না তবুও আমায়। তুমি জানবেও না, তোমার ভালোবাসার সমাধীর পাশে আমি থেমে যাব। আর কখনো গাইবো না, আর কখনো চাইবো না। তুমি সামলে নিও মেয়ে। তুমি আগলে নিও নিজেকে। বাহারের বিরহের শোক কাটিয়ে তুমি ভালো থেকো, রঙ্গনা। আমি নাহয় ভালো থাকবো তোমার বাঁধন হারা অশ্রুর অবসাদে।”

কথা থামিয়ে বাহার উলটো পথে হাঁটা ধরলো। তার নিদারুণ কণ্ঠে সুর তুলল,
“আমি কী বলিবো আর….
বিচ্ছেদের অনলে পুড়ে কলিজা আঙ্গার….”

_

কাজী অফিসের সামনে ধুলোমাখা শরীর নিয়ে চিত্রা ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রজনী নামে ধরায়। অথচ চিত্রাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখানো বাহার ভাই তার কথা রাখে না। চিত্রার চোখে উপচে পড়া অশ্রু। সকালের সাজ সারাদিনের বিষাদে অবসাদ নিয়েছে। লাল টুকটুকে বউ সাজার স্বপ্ন চির প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে গানের তালে ভেসে আসে বিচ্ছেদের বিরহী সুর,
“ভ্রমর কইয়ো গিয়া,
শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে……
আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে,
কইয়ো গিয়া।”

চিত্রা চিৎকার করে আঁধার রাস্তায় বসে পড়ে। জোছনার রঙ হামাগুড়ি খায় তার শরীরে। মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“বাহার ভাই, চলে আসুন প্লিজ। এমনটা করবেন না। আপনি কথা না রাখলে ম রে যাব যে। চলে আসুন প্লিজ। আমার অন্তরটা সত্যিই পুইড়া যায়, চলে আসেন আপনি। আপনি কথা না রাখলে যে আমি ম রে যাব। পাষাণ প্রেমিক আপনি বাহার ভাই। বড়ো পাষাণ। এমনে আমারে মা র তে পারলেন?”

উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। শুনশান রাস্তা কেবল চেয়ে দেখে এই প্রেমোবিচ্ছেদ। চিত্রার চোখে ভেসে উঠে চঞ্চল অতীত। যে অতীতের সবটুকু জুড়ে কেবল একজন বখাটে প্রেমিকের অস্তিত্ব। যে কখনো গান গায়, কখনো বা অবহেলায় হাসে একটু। চিত্রার চোখের পাতা বন্ধ হয়। সেই বন্ধ হওয়া চোখের পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ে বেনামি কষ্টরা। কতক্ষণ বিড়বিড় করে মেয়েটা। তারপর চুপ হয়ে থাকে বহুক্ষণ। শুনশান রাস্তাটাতেও একসময় একাকিত্ব দূর করে কতগুলো গাড়ি শা শা করে ছুটে যায়। অথচ চিত্রার একাকীত্ব কাটে না। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতার ছুরিটা অষ্টাদশীর বুকের ভেতর থাকা অদৃশ্য মাংসপিণ্ডকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে যে! সেথায় আর বসন্ত ফুল ফুটাবে না কখনো। চিত্রার চোখ মুখ কেমন শক্ত হয়ে যায়, কেমন গাঢ় অভিমানে বলে,
“আপনাকে আর চাই না, বাহার ভাই। চাই না।”

এরপর সব চুপ। ভালোবাসারা মৃত।

_

মাথার উপর অর্ধ খন্ডিত চাঁদ নির্লিপ্ত। চিত্রার গাঢ় কাজল অভিযোগে লেপ্টে গেছে চোখের নিচে। প্রেমিকের জন্য খুশিতে আহ্লাদী হওয়া লাল টুকটুকে জামদানী শাড়িটাও ধুলোয় মাখামাখি হয়ে ধরেছে মলিনতা। রিকশার টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে রাতের রাস্তা জুড়ে। চিত্রা বসে আছে মৃত মানুষের ন্যায়। রাত আনুমানিক ক’টা বাজে তার ধারণা নেই। কিংবা ধ্যানও নেই সেইদিকে। তবে রাতের গাম্ভীর্যতা দেখলে আঁচ করা যাচ্ছে বারোটার কাছাকাছি সময়।
চিত্রার রিকশা যখন তার কলেজের গলির সামনে দিয়ে মোড় নিল ঠিক তখনই সে খেয়াল করল কলেজের পাশের গলিটা বন্ধ করা হয়েছে। রেড এলার্ট সাইন বোর্ডও টাঙানো হয়েছে। কয়েকজন কনস্টেবল বসে বসে ঝিমুচ্ছে সেখানে। এবার নির্লিপ্ত চিত্রার মাথায় অদ্ভুত ভাবনা খেলে গেল। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠেই রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে এখানে, মামা? এই গলিটায় পুলিশ পাহারা কেন!”

পথের দিকে ব্যস্ত থাকা আধবয়সী মানুষটা তার কাজে মনযোগ রেখেই বললেন,
“হায় আম্মা, জানেন না কী হইছে! গতকাল রাতেই তো এখানে পুলিশ তদন্ত করছিল। অনেক নেশা জাতীয় জিনিস নাকি এই গলিতে সাপ্লাই করা হয়। অনেক অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে এই নেশার জগতে বুদ হয়ে গেছে নাকি।”

চিত্রার শরীরে অদৃশ্য কম্পন দেখা দিলে। মস্তিষ্কে ভেসে উঠল বনফুলের মুখটা। সে প্রায় কয়েকদিনই তো বনফুলকে এ গলিতে দেখেছিল। এখানে বনফুলের কোনো কাজ না থাকা সত্ত্বেও তো সে এখানে আসতো। তাহলে কি…….
চিত্রা আর ভাবতে পারল না কিছু। তার বোকা সোকা বন্ধুটা এমন আঁধার জগতে বিলীন হয়েছে, এই ভাবনাটা তার মস্তিষ্কে বেশ প্রবল চাপ দিল। অসাড় হয়ে এলো তার দেহ। ভয়ে, আতঙ্কে সে মুখ চেপে ধরল দু-হাতের আঁজলে। মেয়েটা তো এমন ছিল না কখনো। এমন হলো কীভাবে! চিত্রা ভাবলো। ধীরে ধীরে তার ভাবনা স্বচ্ছ হলো। হ্যাঁ, ঠিক যখন থেকে ভাইজান রুক্ষ হলো বনফুলের প্রতি, তখন থেকেই মেয়েটার অধঃপতন শুরু। তাহলে কী এটার প্রতিশোধ নিলো বাহার ভাই! যেমন ভাবে বনফুল মূর্ছা গিয়েছিল, ঠিক তেমন জায়গাতেই এনে চিত্রাকে ফেলল সে! প্রেমিক এত স্বার্থপর হয়!

চিত্রার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই পথ ফুরায়। গন্তব্যতে এসে থামে তিন পায়া বিশিষ্ট যানটি। চিত্রা ক্লান্ত শরীরে নেমে ভাড়া মেটাতেই তার গালে চ ড় পরে। চিত্রা অবাক হয় না। এটা ভবিতব্য জেনেই সে এখানে এসেছে। তার যে এই সওদাগর ভিলা ছাড়া যাওয়ার জায়গা নেই। নিশ্চুপতা ভেদ করে মুনিয়া বেগমের কণ্ঠস্বর শোনা যায়,
“আসার প্রয়োজন কী ছিল? রাত দেড়টায় ভদ্র বাড়ির মেয়ে বাহির থেকে ফিরে না।”

চিত্রা মাথা নত রাখলেও বুঝতে পারল সকলের চোখ-মুখে উপচে পড়া বিস্ময়। তারা হয়তো চিত্রার যন্ত্রণায় ভেঙে আসা ভেতরটার উপলব্ধি করতে পারল বাহির থেকেই! কিন্তু চিত্রাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মুনিয়া বেগম আশ্চর্যের সপ্তম পর্যায়ে চলে গেলেন বোধহয়। হতভম্ব কণ্ঠে বললেন,
“বাড়ির এই খারাপ সময়ে তুমি লাল শাড়ি পরে ঘুরতে গিয়েছিলে! চিত্রা?”

চিত্রা চোখ তুলে তাকায় না। মুনিয়া বেগমের রাগ বাড়ে। সাথে লজ্জিতও বোধ করে ক্ষাণিকটা। বাড়িতে এমন বিষাদ চলছে অথচ তার মেয়ের মনে এত ফূর্তি! ছিহ্! অথচ বাড়ির মানুষ গুলো তাকে কতই না ভালোবাসা দিয়েছে।
এগিয়ে আসে নুরুল সওদাগর। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“একটা নির্লজ্জ মেয়ে জন্ম দিয়েছো। ঘৃণা লাগছে এখন এর প্রতি। তুমি মরে যেতে পারছ না?”

ব্যাথায় জর্জরিত চিত্রার শেষ ভালো থাকার চেষ্টাটুকু নিঃশেষ হয়ে যায়। হাসে সে নিখুঁত করে। গুটি গুটি পায়ে ভাইজানের কাছে এগিয়ে যায়। কী মনে করে বাচ্চার মতন লুটিয়ে পড়ে ভাইয়ের বুকের মাঝে। এবার সওদাগর বাড়ির সকলে কিছুটা চমকে গেল। এই চিত্রার আচরণ বড্ড অপরিচিত। কী হলো মেয়েটার!
তুহিন বোনকে স্নেহের হাতে আগলে নেওয়ার আগেই মেয়েটা বুক থেকে মুখ তুলে। কেমন অভিযোগ করে বলে,
“ভাইজান, আমি হেরে গেছি। প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার এই পৃথিবীতে তোমার চিত্রার খাঁদ বিহীন ভালোবাসার মূল্য কেউ দিল না। ভাইজান, তোমার চিতাবাঘকে মেরে ফেলেছে ওরা। মেরে ফেলেছে।”

আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রা ছুটে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। সশব্দে আটকে দিলো নিজের ঘরের দরজা। সেই শব্দে কাঁপল বোধহয় সওদাগর বাড়ির সুখের শেষ অস্তিত্বটুকু। তুহিন বিভ্রান্ত হয়ে ছুটে গেলো বোনের পেছনে। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে যে!

রক্তে রঞ্জিত সওদাগর বাড়ির সবচেয়ে ভীতু মেয়েটির রুম। শ্বাস চলছে ক্ষীণ। চাঁদের আলো গাঢ় জোছনা ছড়িয়ে দিয়েছে সেই অন্ধকার ঘরটিতে। বাহির থেকে প্রচুর হাঁকডাক হচ্ছে। কিছুটা চিত্রা শুনছে কিছুটা শুনছে না। তার দৃষ্টি জানালার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা রঙচটা দু’তলা বাড়িটির দিকে। যেই বাড়িটির সদর দরজায় ঝুলছে বিরাট তালা। ছাদ খা খা, শূন্য। যে বাড়ির ছেলেটি চিত্রার নিঃশেষ হওয়ার কারণ। যে বাড়ির মেয়েটিও এমন প্রেমেই নিঃস্ব হয়েছিল।
চিত্রার চোখ বুজে এলো। বিড়বিড় করে বলল,
“ভালোবাসার কাছে নাকি সব মিছে? তবে প্রতিশোধ এত বড়ো হয়ে গেলো কীভাবে? আমার সবটুকু ভুল জীবনের শুধু সঠিক বনফুলটার সাথেও আমার এমন আজন্মের দূরত্ব তৈরী হয়ে গেলো কীভাবে? কীভাবে আমার এত ভালোবাসায় পরিপূর্ণ জীবনটা ভালোবাসা শূন্য হলো? বাহার ভাই, কী হতো শেষবেলায় একটু ভালোবাসলে? এভাবে না মারলেও তো পারতেন।”

এত প্রশ্নের উত্তর মিলে না। দূর হতে অকল্যাণের সুর নিয়ে কেবল কানাকুয়ো ডাকে।
কিন্তু প্রেমিকা কী আদৌও জানবে? প্রতিশোধের ধর্ম যে প্রেমিকের নেই।

——————

পরিশিষ্ট:

সুইজারল্যান্ডের ছোটো শহরে হুট করে আজ আশ্চর্যজনক ভোর হলো। চাঁদনীর ঘুম ভাঙলো বহু পুরোনো সেই গান শুনো, “ইন্দুবালা গো, ইন্দুবালা গো……”

চাঁদনী হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমেই উঁকি দিল জানালা দিয়ে। বরফের শহরে আজ সোনালী রোদ্দুর উঠেছে সতেজ হয়ে। চাঁদনীর আঙিনায় বসন্তের দূত এসেছে যে! চাঁদনী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। গান কোথা থেকে আসছে সে জানেনা, তবে কার কল্যাণে আসছে সেটা বোধহয় সে আন্দাজ করতে পারল খানিকটা। তাইতো নিজে নিজেই ঝলমলে কণ্ঠে বলল,
“ইন্দুবালার কাছে পৌঁছাতে তোমার দু’টো বছর লেগে গেল, মৃন্ময়!”

_

সিলেটের আবেশিত বিকেলের পথ ধরে অহি হেঁটে যাচ্ছে। বর্ষাকালের রাস্তা জলে থৈ থৈ। বহুক্ষণ জল্পনা-কল্পনা করে কল লাগাল বহু পুরোনো সেই নাম্বারটিতে। গত এক সপ্তাহ ধরেই কল করবে কি করবে না এর দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে। অবশেষে সকল সংশয় মুছে কল দিল। রিং হলো সেই নাম্বারে। অহির বুকের মাঝে অনাকাঙ্খিত কম্পন। অপর পাশের মানুষটা কল ধরবে তো! অহির সকল সংশয়কে মুক্তি দিয়ে অপরপক্ষে কল রিসিভ হলো। গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠটা বলে উঠলো,
“সাতশ উনপঞ্চাশটা দিন আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে এখন কল দিতে ইচ্ছে হলো! চলেই যদি যাবেন তাহলে এসেছিলেন কেন?”

অহি উত্তর দেয় না। চোখ উপচে বেরিয়ে আসে আনন্দাশ্রু। ভুল বুঝে সে নিজের জীবন থেকে এতগুলো দিন নষ্ট করে ফেলল!
অহির কাঁধে তখন ভরসার হাত রাখে তার জীবনের পরম বন্ধু, তার আত্মার মা- অবনী বেগম। মেয়েকে ভরসা দিয়ে বলেন,
“কাঁদছো কেন? তাকে বলো, তার অপেক্ষা শেষ হলো। তার হুমুর আন্তি ফিরছে খুব শীগ্রই।”

অহি ক্রন্দনরত অবস্থায় মা’কে জড়িয়ে ধরল। ভাগ্যিস এ মানুষটা তার জীবনে ছিল! নাহলে তো কেবল দু’বছর না, পুরো জীবনটাই তার বৃথা হতো।

_

“প্রিয় বাহার ভাই,
আপনাকে ছাড়া রঙ্গন ফুল ঝরে যাচ্ছে অকালে, সূর্যের তেজ তার প্রখরতা হারিয়েছে, অষ্টাদশী হারিয়েছে ভালো থাকা। আপনি জীবনে এসেছিলেন বলেই অষ্টাদশী জানে ধারালো ব্লে ড রগে গাঢ় ভাবে ছোঁয়ালে কীভাবে র ক্তের স্রোত বয়ে যায়। অক্সিজেন মাক্স মুখে নিয়ে কীভাবে শ্বাসকষ্টে আচ্ছাদিত থাকা যায়। আপনার অভাবে কীভাবে একজন মেয়ের একটি জীবন থেমে যায়, আপনি তা দেখলেন না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে- বউ বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে চির প্রতীক্ষায় রেখে চলে যাওয়া বাহার ভাইরা কী ভালো থাকতে পারে?

ইতি
রঙ্গনা”

চিত্রা চিঠিটা শেষ করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাম হাতের কাটা গাঢ় দাগটা কেমন বিদঘুটে ঠেকল তার কাছে। মানুষ বলে, মৃত্যুর পথ কত সোজা! অথচ সে জানে, প্রতি মোনাজাতেও মৃত্যু কামনা করা সে কীভাবে যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে। বাহাররা এতটা নির্দয় কেন! ভোরের সূর্য উদিত হয়। চিত্রার আটানব্বই নাম্বার চিঠিটাও জমে পরিত্যক্ত বাক্সে। কারণ প্রাপকের গন্তব্য যে তার জানা নেই। এই হৃদয়হীন শহরে তার পত্রের মাঝে লিখা বাহার ভাইটা যে আজ ভীষণ দূরে। অষ্টাদশীর চূর্ণবিচূর্ণ মন থেকে অবশ্য দূরে যেতে পারেনি।

চিত্রা জানালা দিয়ে তাদের সামনের বহুদিনের তালাবদ্ধ বাড়িটার দিকে তাকায়। বাড়ির মানুষ গুলো কীভাবে যেন উধাও হয়ে গেলো। চিত্রার মনে এক আকাশ আশা জমিয়ে তারা হাওয়ায় মিঠাইয়ের মতন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। এই শহরের হারিয়ে যাওয়ার গল্পে, হারিয়ে গেল চিত্রার বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা।

তবে বাহার ভাই এর গল্প কেমন হয়েছিল? কী হয়েছে তার ইতি? কংক্রিটের শহর, একুশে পদার্পণ করা প্রেমিকা কী সে কথা কখনো জানবে? না প্রেমিক ও প্রেম এভাবেই হারিয়ে যাবে প্রেমিকার মৃত্যুর প্রার্থনায়!

[সমাপ্ত]

প্রেমোত্তাপ পর্ব-২৯

0

#প্রেমোত্তাপ
পর্ব: ২৯
কলমে: মম সাহা

শাহবাগের মোড়ে তুমুল জ্যামে আটকে আছে চিত্রার রিকশা। তার মন খারাপ। অথচ আজকে তার সবচেয়ে খুশির দিন হওয়ার কথা ছিল। আজকে তার আনন্দের পথে পান্তরে হৈ হৈ করে ছুটে বেড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। চিন্তার নিবিড় চোখ স্থির। এই চঞ্চল চিত্রার স্থিরতা দেখে বাহার শুধাল,

“তোমার সাথে নিরবতা ভীষণ বেমানান, সেটা কী জানো তুমি?”

চিত্রার গভীর ধ্যান কিঞ্চিৎ ভাঙলো। সে অস্ফুটস্বরে কেবল বলল,
“হুহ্!”

বাহার ভ্রু কুঁচকালো। চিত্রার দিকে চাইল সে নিঃসংকোচে। গভীর ভাবে বলল,
“হয়েছে কী?”

বাহারের আহ্লাদী প্রশ্নে চিত্রার মন খারাপ আরও বাড়লো। মন খারাপের উদাস বাতাস ছুঁয়ে গেল যেন তার আঙিনা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পিঠ টান টান করে বসল। বলল,
“অহি আপা না চলে যাবে বলেছে।”

“কোথায়?”

বাহারের প্রশ্নে চিত্রা চোখ রাখল লোকটার দিকে। চোখে চোখ মিলল। চিত্রার চোখ গুলো ছোটো ছোটো। জ্বলজ্বল করছে দুশ্চিন্তায়। খুব সহজেই কেউ চাইলেই মেয়েটার ভেতরের সকল অনুভূতি পড়তে পারবে। মেয়েটার মন স্বচ্ছ। চোখের ভাষারাও ভাসা ভাসা। বাহার দুই ভ্রু আবার উঁচু করল। চিত্রা হতাশ কণ্ঠে বলল,
“আপার মায়ের কাছে। উনি কয়েকবার এসেছিল আপাকে নিতে কিন্তু আপা যায়নি। কিন্তু আজ আপা বলেছে সে চলে যাবে। এবং কালই যাবে। উনাকেও সে জানিয়ে দিয়েছে এটা। চাঁদনী আপারও কাল ফ্লাইট। আমরাও কাল বিয়ে করব। সবাই কেমন আলাদা আলাদা হয়ে যাব কাল! আমাদের ছাড়া আব্বু, বড়ো আব্বু, ছোটো আব্বু, আম্মু, চাচীরা কীভাবে থাকবে? চেরিটাও কান্না করবে। ভাইজান তো প্রতিদিন রাতে একবার আমাকে না দেখে ঘুমায় না। সে কীভাবে ঘুমাবে? আমাদের ছাড়া বাড়িটা যে আর হাসবে না, বাহার ভাই!”

কথা বলে থামল চিত্রা। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের হলুদ নিয়ন বাতি গুলোর আলো এসে মেয়েটার চোখ-মুখ গাঢ় ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে। গোলগাল মুখে হলুদ আভাটা ভীষণ মানিয়েছে। এ যেন মায়ার আলো। আর চিত্রা যেন মায়াকন্যা। বাহার মুগ্ধ চোখে সে মায়াকন্যার চিন্তার ভাষাদের শুনল, জানল। অতঃপর কিছুক্ষণ নিরব থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“বিয়ের দিন পিছিয়ে দিই তবে?”

চিত্রা তৎক্ষণাৎ তাকালো। দৃষ্টি তার তাজ্জব। হড়বড়িয়ে বলল,
“নাহ্।”

চিত্রার না বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল বাহার। তাও বেশ শব্দ করে। নিজের কথায় লজ্জা পেল চিত্রাও। সেকেন্ডে চোখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি নামাল পথে। মাঝে মাঝে সে এত বোকা কাজ করে ফেলে কেন! চিত্রার লজ্জা যেন বাহারকে ভীষণ আনন্দ দিল। তাই সে এই লজ্জার আবরণ আরেকটু বাড়াতে বলল,
“লজ্জা পেলে?”

প্রশ্নটা করে আবারও হো হো করে উঠল বাহার। চিত্রা মুখ ঢেকে ফেলল দু-হাতের আঁজলে। এ যেন এক মন্ত্রমুগ্ধ সন্ধ্যা। এই যেন এক ভালোবাসার দিন। ব্যস্ত রাস্তা যেন মুগ্ধ চোখে এই প্রেমের কীর্তি দেখল। বহুক্ষণ…. চোখ মেলে।

জ্যাম ছুটল। বাহারের হাসি কমল। নিভে এলো মুগ্ধ দৃশ্য। বাহার আবার আগের ন্যায় গম্ভীর হলো। ভরাট কণ্ঠে বলল,
“কাল এমন একটা দিন, এই দিনে বিয়ে করাটা স্বার্থপরের মতন কাজ হয়ে যাবে না?”

চিত্রা মুখ থেকে হাত সরালো। ক্লান্ত চোখে চাইল আবার। বার কয়েক শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“হয়ে যাবে। আপনারে পাওয়ার জন্য আমি স্বার্থপরও হতে রাজি, বাহার ভাই।”

“এ কেমন ভালোবাসলে, রঙ্গনা? নিজেকে হারিয়ে ফেলতেও ভাবছো না! তুমি যে এমন নও, রঙ্গনা। তবে কেন এত স্বার্থপরতা দেখাচ্ছ? যে বাড়ি এবং বাড়ির সদস্যরা তোমার প্রাণ, তাদের এই দুর্দশার দিনে তাদেরকে ছাড়তেও দু-বার ভাবছো না যে!”

“জানেন বাহার ভাই, আমার কেন জানি মনেহয়, তাদের একবার ছাড়লে আমি দ্বিতীয়বার আবার ফিরে পাব। কিন্তু আপনাকে একবার ছাড়লে চিরতরে হারিয়ে ফেলব।”

“হারিয়ে ফেলার ভয়ে বাঁধতে চাচ্ছ, মেয়ে! তুমি জানো না? যে যেতে চায় তাকে কোনো বাঁধনই রাখতে পারেনা। আর যে থাকতে চায়, তাকে কোনো অবহেলাও তাড়াতে পারেনা। আমি ছাড়তে চাইলে বিয়ে আমায় আটকে রাখতে পারবে? সত্যিই কী বিয়ে আটকে রাখার সুতো? যদি তেমনই হতো তাহলে অহির জন্মদাত্রী কী এত ভালোবাসার পরেও তোমার ছোটো আব্বুকে ছেড়ে যেত? তাদের তো বিয়ের সম্পর্কই ছিল, রঙ্গনা! যে যেতে চায়, তাকে আটকে রাখা যে বড়ো দায়।”

বাহার ভাইয়ের সহজ-সরল কথা গুলো কতক্ষণ অসুরের ন্যায় নৃত্য করল চিত্রার ছোট্টো মগজে। মেয়েটা সইতে পারল না এই ভারী সত্যি কথার তোপ। তার উদাসী চোখ জলে টইটুম্বুর হলো,
“আমি এত জটিলতা বুঝিনা, বাহার ভাই। আমি কেবল এতটুকুই বুঝি, আপনারে না পেলে আমার এই জগৎ বৃথা। এই জনম বৃথা।”

বাহার তপ্ত শ্বাস ফেলল। আফসোস নিয়ে বলল,

“করিলে বৃথা জনম, অন্ধ প্রেমে ফেঁসে,
কেউ মরেছে বারে-বারে, প্রচন্ড ভালোবেসে।”

_

ধানমন্ডির এক শুনশান রাস্তায় হাঁটছে চাঁদনী। তার কিছুটা পেছন পেছন হাঁটছে মৃন্ময়। সন্ধ্যার মৃদুমন্দ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ভেতর, বাহির, অন্তর। পথ-ঘাটে গাড়ি আছে বেশ তবে তেমন যানজট নেই। শা শা করে গাড়ি আসছে আর ছুটে চলে যাচ্ছে দূরে, বহুদূরে। কেউ তাদের হাঁটায় বিরক্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, কেউ বাঁধা হচ্ছে না। প্রায় বেশ খানিকটা হাঁটার পর বিরতি নিল মৃন্ময়। পুরুষালি কণ্ঠে বলল,
“কী বলবেন, ইন্দুবালা? কী বলতে এতদূর ডাকলেন?”

চাঁদনী চাঁদের ন্যায় শীতল হাসল। মিহি স্বরে বলল,
“সামনে একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে চলো, চা খেতে-খেতে কথা বলবো।”

মৃন্ময় আর কথা বাড়ালো না। কেবল ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটল। চায়ের দোকানে এসে চায়ের অর্ডার দিল। তারপর নড়বড়ে বেঞ্চটাতে বসলো দু’জনে। আজকে চাঁদনীকে বরাবরের তুলনায় একটু অন্যরকমই লাগছে। প্রায় সময়টাতেই তার মুখে হাসি দেখা গিয়েছে। মৃন্ময় অপলক চোখে কয়েকবার দেখেছেও সেই সুন্দর মুখটি। সেটা অগোচর হয়নি চাঁদনীরও। ব্যস্ত নিবিড় রাস্তায় ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালো চাঁদনী। ভেতরে যেন নতুন এক উদ্যমের সৃষ্টি হলো। চাঁদনী সেই উদ্যমকেই সঙ্গী করে সকল জড়তা কাটিয়ে ঝলমলে কণ্ঠে বলল,
“মৃন্ময়, তুমি কী জানো, তুমি কিন্তু ভীষণ সুদর্শন।”

মৃন্ময় মাত্রই চা-টা মুখে নিয়েছিল, কিন্তু আকস্মিক চাঁদনীর এহেন কথায় চা মহাশয় তার নাক-মুখে উঠে গেলো। যার ফলস্বরূপ তুমুল কাঁশির উৎপাত। অথচ বিচলিত হতে দেখা গেল না চাঁদনীকে। সে বেশ আয়েস করেই চায়ে চুমুক দিতে থাকাল। মিনিট পেরুতেই মৃন্ময় স্বাভাবিক হলো। কিন্তু তার চোখ-মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে এখনো তার ভেতরের হতভম্ব ভাবটা কাটেনি। চাঁদনী দীর্ঘ বিরতির পর আবার বলল,
“তুমি এটাও কী জানো যে তুমি আমার থেকে শতগুণ ভালো মেয়ে ভবিষ্যতে পাবে?”

চাঁদনীর আকস্মিক এমন ধারা প্রশ্নে মৃন্ময় বলার ভাষা হারিয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া সে আর কিছুই যেন করতে পারল না। চাঁদনী হাসল মৃন্ময়ের এহেন দশায়। ভাবুক স্বরে বলল,
“তুমি আমাকে পছন্দ করো এতটুকু অব্দি আমি মেনে নিয়ে ছিলাম। বা বলা যায় এতটুকু অব্দি সব ঠিকই ছিল। তবে ভুল কখন হলো জানো?”

মৃন্ময় ভ্রু কুঁচকালো, শুধালো, “কখন?”

“যখন তুমি আমাকে পছন্দ করো বলে নিজের বিবেক, বিবেচনা বোধ হারালে। কীভাবে পারলে মৃন্ময়! নিজেকে এতটা ছোটো করতে? তবে আমার কোনো অভিযোগ নেই তোমার প্রতি। তুমি ছোটো মানুষ। ভেবেছিলে ছোটোবেলার খেলনা চাওয়ার বায়না আর মানুষ চাওয়ার বায়না বোধহয় এক। তাই ভুল পথে হলেও সেটা পেতে হবে। কিন্তু মৃন্ময়, সবসময় সবকিছু যে আমাদের মনমর্জি মতন চলে না। কখনো না পেয়েও বাঁচার ক্ষমতা রাখতে হয়। তৃমি কী জানো? কখনো মানুষ হেরে গিয়েও জিতে যায়? তোমার অন্তত মানুষ চাওয়ার খেলায় হেরে যাওয়া উচিত ছিল। এত বড়ো ভুল করা উচিৎ হয়নি তোমার।”

চাঁদনীর কথা থামতেই তড়তড় করে ঘামল মৃন্ময়। অতি উত্তেজনায় বসে না থাকতে পেরে চট করে দাঁড়িয়ে গেল। তোতলানো কণ্ঠে বলল,
“কী, কী বলছেন, ইন্দুবালা!”

চাঁদনীও এবার গা ঝারা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। চায়ের বিলটা পরিশোধ করতে করতে বলল,
“কালকে আমার ফ্লাইট। আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব কালই। তবে দেশ ছাড়ার আগে এত বিদঘুটে একটা সত্য না জানলেও বোধহয় ভালো ছিল। তাই না, মৃন্ময়? নাহয় আমি ভুল করেই ভাবতাম, একটা পাগল ছেলে আমার জ্বর আসবে বলে ছাঁদে ওষুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে ভিজে ছিল। আর আমাদের ছবি ভাইরাল হওয়াটা কাকতালীয় ছিল। কিন্তু তোমার ভালোবাসার দুর্ভাগ্য মৃন্ময়, আমি শেষ বেলাতে এসে তোমাকে ভালোবাসার বিনিময়ে আরেকধাপ অপছন্দ করে গেলাম। ভালো থেকো, মৃন্ময়। আর যাকে ভালোবাসবে, তার মন ভেঙো না কখনো। মন ভাঙার যন্ত্রণা মৃত্যুর সমান। জানো?”

মৃন্ময় কথা বলল না। তার মনে হলো পৃথিবী ঘুরছে। এবং সেই ঘুরন্ত পৃথিবীতে চাঁদনী নামক একটি মেয়ে তার থেকে চিরজীবনের মতন দূরে চলে যাচ্ছে।

#চলবে….

#প্রেমোত্তাপ
পর্ব: ২৯ এর বর্ধিতাংশ

কলমে: মম সাহা

নিকোষ আঁধার কালো রাত্রি শোক নামিয়েছে ধরায়। অথচ এই শোককে সুখ করতে ব্যস্ত সওদাগর বাড়ির ছটফটে প্রাণ গুলো। হয়তো তারাও চাচ্ছে তাদের এই বিস্তর বিচ্ছেদের শেষ স্মৃতিটা আনন্দঘন হোক! ড্রয়িংরুমে বসেছে সকলের আড্ডা। যদিও ভেতর ভেতর সকলে ঝিমিয়ে গিয়েছে কঠিন দুঃখে কিন্তু উপর-উপর সকলে এমন ভাবে নিজেকে প্রকাশ করছে যেন তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এমন কেউ বাদ নেই যে এই সওদাগর বাড়ির ড্রয়িং রুমে উপস্থিত নেই। দাদী হতে শুরু করে ছোট্টো চেরিসহ উপস্থিত। দু-চোখ ভোরে সকলেই যেন দেখে নিচ্ছে এই শেষ একত্রিত হওয়ার আনন্দ। এরপর আর কে, কবে একত্রিত হবে কেউ জানেনা। গান হলো, আড্ডা হলো, খাওয়া-দাওয়া হলো ভরপেট। কেউ আহ্লাদে আটখানা হলো, কেউবা সুখের স্মৃতি নিয়ে ঘুমাতে গেল। আজ চিত্রা, চাঁদনী, অহি এই তিনজন একসাথে ঘুমুতে গেল। হয়তো শেষবারের মতন! আর কখনো যদি বালিশ ভাগাভাগি করে ঘুমানো নাহয়!

তিন বোন হাত-মুখ ধুয়ে বসলো বিছানা জুড়ে। সবার ঠোঁটেই কিছুটা কৃত্রিম, কিছুটা অকৃত্রিম হাসি লেপ্টে আছে। চাঁদনী তার ছোটো দুই বোনের দিক তাকাল। বিরাট এক শ্বাস ফেলে বলল,
“তোদের ছেড়ে কতটা দূরে চলে যাচ্ছি! আবার কবে আনন্দ ভাগাভাগি করব বল?”

“সবসময় তো আনন্দ ভাগই করলাম আপাই, আজ কী একটু দুঃখ ভাগ করবো? আমার না ভীষণ ব্যাথা হচ্ছে বুকে। আজ একটু ভাগ করে নিবে দুঃখ? আমি না আর এই ভার বহন করতে পারছি না।”

অহির অপ্রত্যাশিত করুণ আবদারে শিরা উপশিরা কেঁপে উঠল চাঁদনী ও চিত্রার। এই অহি তাদের অপরিচিত। এত ভীষণ অপরিচিত কখনোই লাগেনি তাকে। এই অসহায় অহিকে দেখে ভাষাহারা দু’জন। অহি কাঁদছে। শব্দহীন কান্না। চোখের পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ছে কত সহস্র অশ্রুবিন্দুরা। চাঁদনী, চিত্রা দু’জনই উঠে এলো। জড়িয়ে ধরল বোনকে। যেন ভরসা দিল, তারা আছে। অহিও বিনা সংকোচে মুখ লুকালো বোনদের ভরসাস্থলে। চাঁদনী বরাবরই বুঝদার। তাই সে মুহূর্তেই বুজে ফেলেছে অহির সাথে নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে, নাহয় এমন চাপা স্বভাবের মেয়ে এভাবে তার ব্যাথা প্রকাশ করতো না। অহির শরীর কাঁপছে ক্ষণে ক্ষণে কান্নার দাপটে। তার পিঠ ছুঁয়ে স্বান্তনা দিচ্ছে চিত্রা। বেশ অনেকক্ষণ, অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। কান্নার দাপট কমে এলো অহির। স্তম্ভিত ফিরে পেল সে। তৎক্ষনাৎ সে চাঁদনীর বুক থেকে মাথা তুলল। নিজেকে যথেষ্ট গুছিয়ে কথা ঘুরানোর জন্য বলল,
“কিছু হয়নি আপাই, তুমি চলে যাবে তো তাই কষ্ট হচ্ছিল। তোমাকে ভীষণ মিস করব।”

“কথা ঘুরাচ্ছিস?”

চাঁদনীর কোমল প্রশ্নে তপ্ত শ্বাস ফেলল অহি। বার কয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল। কিন্ত চাঁদনী নাছোড়বান্দা। আগের ন্যায় অটল নিজের জায়গায়। চিত্রাও এবার মুখ খুলল, ভাবুক স্বরে বলল,
“কী হয়েছে ছোটো আপা? বলো আমাদের।”

অহি নিজেকে সংযত করতে চাইলেও বোনদের আহ্লাদে আর গুছিয়ে উঠতে পারল না। সে এমন নরম, কোমল কখনোই ছিল না। সে বরাবরই শক্ত ধরণের মেয়ে ছিল। হবে নাই-বা কেন? যে শিশুটির ছোটো বেলা কেটে যায় তাচ্ছিল্যে তার শক্ত হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। মা পালিয়ে গেছে বাক্যটা নিয়ে সবাই যখন হাসি-তামাশা করত তখন মেয়েটার বয়স কতই বা ছিল? সমাজ এমন বিশ্রী ভাবে তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেছিল যে মনে হয়েছিল তার মায়ের পালিয়ে যাওয়ার দায়ভার সব তার। এরপর থেকেই ছোটো প্রানটা গুটিয়ে নিল নিজেকে। যদিও মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসা দেওয়া অবনী বেগম তাকে আগলে নিয়েছিল কিন্তু ঐ যে একবার পাথর হওয়ার পর আর কোনোকিছুই ছুঁতে পারল না তাকে। তারপর সেই ছোটোবেলার পর আজ বোধহয় তাকে এমন ভাঙতে দেখা গেল। অহির দুঃখের পাল্লা ভারি হয়। ভেঙে আসা কণ্ঠে বলে,
“আমি নিজে মা ছাড়া থেকেছি, আমি জানি মা ছাড়া থাকার যন্ত্রণা কেমন। সমাজ কতটা ভয়ঙ্কর হয়! অথচ আমিই কি-না আরেকটা বাচ্চার মা ছাড়া থাকার কারণ হতে যাচ্ছিলাম, আপাই!”

অহির হেয়ালি কথায় ভ্রু দু’টি কুঞ্চিত হলো বাকি দু’জনের। চিত্রা বলল,
“এই ছোটো আপা, কী বলছো?”

চাঁদনী বলল, “পাগল হলি?”

অহি দু’হাতের আঁজলে মুখ ঢেকে কাঁদে। অস্ফুটস্বরে বলে, “আপাই, আমার নিজেকে অনেক ছোটো লাগছে জানো? এত ঘৃণা লাগছে নিজের প্রতি!”

চাঁদনী আর চিত্রা ঘাটায় না অহিকে। অহি নিজেই অস্ফুটস্বরে বলতে থাকে,
“হুমুর কথা মনে আছে? রেস্টুরেন্টে আমি আর চিত্রা যে আইসক্রিম নিয়ে ঝামেলা করলাম লোকটার সাথে? মনে আছে?”

চিত্রা ও চাঁদনী দু’জনেই মাথা নাড়ায়। অহি দৃষ্টি রাখে জানালার বাহিরে। হতাশ কণ্ঠে বলে,
“হুমুর পাপার নাম নওশাদ। বেশ ভদ্রলোক। রেস্টুরেন্টের পরেও আমার তাদের সাথে দেখা হয়েছিল অনেকবার। যোগাযোগও গাঢ় হয়। হুমু বাচ্চাটাকে দেখলে না কেমন নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যেত। তাই বোধহয় আমি ওর প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলাম। কিন্তু আমার উচিত হয়নি, আপাই। আমার মোটেও ঝুঁকে পড়া উচিত হয়নি।”

“হয়েছে কি সেটা তো বলবি। তুই কী নওশাদকে পছন্দ করিস?”

চাঁদনীর স্বচ্ছ প্রশ্নে অহি ঘাড় ঘুরিয়ে থাকায়। তার চোখ আবারও অশ্রুতে টলমল করে। চোখ দেখেই বুঝা যায় তার ভেতরটা অমোঘ যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছে। চাঁদনীর মায়া হয়। এই যন্ত্রণার ভাষা যে তার বড়ো পরিচিত! সে অহিকে দুহাতে আবারও আগলে ধরে। আদুরে কণ্ঠে বলে,
“তুই ওকে পছন্দ করিস?”

অহি সময় নেয়। ভারী কণ্ঠে বলে,
“আপাই, নওশাদ বিবাহিত। এবং হুমু’র মায়ের সঙ্গে তার বৈবাহিক অবস্থা নাকি বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু আমি তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে নাকি তাদের সংসারটা নষ্ট করে দিয়েছি। বিশ্বাস করো আপাই আমি ভাবতাম নওশাদ হুমুর চাচা হবেন। হুমুর বাবা কখনো হুমুর মায়ের কথা বলেইনি। আমি ভাবতাম হুমুকে এত আদর করে বলে হয়তো সে তার চাচাকে পাপা ডাকে। আমার উচিত হয়নি আপা ভালো করে না জেনে একটা মানুষের সাথে মিশে যাওয়া। সেদিনের আমার জন্মদাত্রীর সাথে আজকের আমার কোনো তফাত রইল না। আমরা দু’জনই একটা বাচ্চার শৈশব নষ্ট করার খেলায় অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু তুমি তো জানো আপা, আমি এমন খারাপ না। আমি হুমুকে এই যন্ত্রণার মাঝে যেতে দিতে পারিনা। তাই আমি আমার সে-ই মায়ের কাছে চলে যাব যার কাছে আমার কখনো মূল্য ছিল না। আমি চলে গেলেই সবদিক থেকে মঙ্গল। সবদিক থেকে।”

কথাটা বলেই ছুটে চলে গেলো অহি। তার চোখের সামনে ভাসছে পরশুদিনের সেই কঠিন দৃশ্যটুকু। যখন হুমুর মা তার সামনে হাত জোর করে কাঁদছিল, তার সংসার ভিক্ষে চাচ্ছিল! অহির নিজেকে তখন এত বেশি পরিমাণ ছোটো লেগেছিল! শেষমেশ সে কিনা একটা নারীর সংসারের কাল হয়ে দাঁড়াল! এই শহরে থাকলে নওশাদ হয়তো তাকে দেখবে এবং সংসার ভাঙতে চাইবে এরচেয়ে চলে যাওয়াই ভালো তার। সে দূরে চলে গেলে নিশ্চয় নওশাদ থেমে যাবে। অহির বুকের ভেতরটা কেমন ফেঁটে যাচ্ছে। শেষমেশ এত বুদ্ধিমতী মেয়েটাও মানুষ চিনতে ভুল করল! এমন ভাবে ঠকলো!

চিত্রা ও চাঁদনী হতভম্ব। চাঁদনী তো প্রায় বসেই পড়ল বিছানাতে। চারদিকে ভাঙনের সুর গুলো কেমন করুণ স্বরে বেজে উঠল। তার ভেতর একটা প্রশ্নই কেবল প্রতিধ্বনিত হলো, কেন আমরা সবসময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি! কেন আমরা যাদের ভালোবাসি তাদের পাইনা?

উত্তর মেলে না প্রশ্নের। তবে চাঁদনীর চোখে জ্বলজ্বল করে আজ সন্ধ্যা বেলার স্মৃতি। মৃন্ময় তার পা জড়িয়ে কেমন বাচ্চাদের মত কেঁদেছিল! কেমন আকুতি-মিনতি করছিল থেকে যাওয়ার জন্য! অথচ চাঁদনী থাকল না! এই যে, মৃন্ময়ও তো ভুল মানুষকে ভালোবাসলো, যেমন করে চাঁদনী, অহি, আমজাদ সওদাগর কিংবা অবনী বেগম ভালোবেসেছে। ভুল মানুষকে ভালোবাসার শাস্তি যে নিরেট যন্ত্রণা। ভেতরটা পুড়ে ছাঁই হয়ে যাবে অথচ দেখার কেউ থাকবে না!

#চলবে…..

প্রেমোত্তাপ পর্ব-২৬+২৭

0

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২৬.

বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে অনবরত। কতগুলো ব্যাকুল প্রাণ পথ চেয়ে বসে আছে, এই বুঝি বাড়ির অবুঝ, বেখেয়ালি মেয়েটা ফিরবে। বোনের প্রাণও আকুল হয়ে অবশেষে গলির মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ছাউনির নিচে দাঁড়িয়েছে তবুও এই দানবীয় বৃষ্টির ছাঁট তাকে আংশিক ভিজিয়ে জুবুথুবু করে দিতে সক্ষম। চাঁদনীর শরীর কাঁপছে মৃদুমন্দ বাতাসে। তবুও তার ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা। যেন পণ করেছে, বোনকে না নিয়ে বাড়ি ফিরবে না। চাঁদনীর ছাউনির নিচেই এলাকার একটি পরিবারের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। দু’জন মহিলা, একটি মেয়ে, দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে আছে। চাঁদনীকে দেখেই তাদের ফিসফিসানি শুরু হয়েছে যা এখনো থামা-থামির নাম নেই। চাঁদনী বুজছে, এখানের আলোচনার বিষয়বস্তু সে, তবুও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বলুক, যার যা ইচ্ছে।

এর মাঝেই কোথা থেকে যেন মৃন্ময়কে ছুটে আসতে দেখা গেল। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলো সে চাঁদনীর দিকে। কাছে এসেই হড়বড়িয়ে বলল,
“পেয়েছেন চিত্রাকে?”

চাঁদনী অস্বস্তি নিয়ে চারপাশে তাকাল। মহিলা গুলো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। একজন তো মুখ ফসকেই বলে ফেলল,
“ছোটো মেয়েটাকেও বুঝি পাওয়া যাচ্ছে না? বাপরে! সওদাগর বাড়ির মেয়েদের তো ভালোই গুণ আছে!”

চাঁদনী যে ভয়টা পেয়েছে সেটাই হলো। তার নামে মানুষ যা ইচ্ছে তা বলুক তার কিছু আসে যায় না কিন্তু তার বোনের নামে কেউ কিছু বললেই তার সহ্য হয় না যে! মৃন্ময় মহিলার কথায় ভ্রু কুঁচকালো,
“একটা মেয়েরে পাওয়া যাচ্ছে না, আর আপনি গুণ নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন! গুণ হিসেব করলে কত মানুষের গুণই বের হবে!”

মহিলাও কম না। মৃন্ময়ের কথার ইঙ্গিত বুঝে আক্রোশের স্বরে বলল,
“কিন্তু যত মানুষের যত গুণই বের হোক, সওদাগর বাড়ির মেয়েদের কেউ পিছে ফেলতে পারবে না। কেন? তুমি কী গুণের খবর রাখোনি? পুরো দুনিয়ার মানুষই তো জানে।”

“না, আন্টি, আমার তো খাওয়া দাওয়ার পরেও অনেক কাজ থাকে তাই কার কি গুণ তা আর খোঁজ করার সময় পাই না। আর অন্যদিকে আপনাদের খাওয়া দাওয়ার পর সময় কাটে অলস তাই আপনারা গসিপ করার জন্য টপিক খুঁজে বেড়ান। এটাও আপনাদের কাজ, আমি সে কাজকে অসম্মান করছি না। যার যেমন যোগ্যতা, সে তো তেমন কাজই করবে তাই না!”

চাঁদনীর মুখের অদৃশ্য হাসিটা এখন দৃশ্যমান হয়েছে। খুব নিরবে তা ছড়িয়ে গিয়েছে পুরো মুখ জুড়ে। তন্মধ্যেই অদম্য বৃষ্টির ছাঁট ভেদ করে দু’জন মানব-মানবীকে আসতে দেখা যাচ্ছে। লম্বা, ছিমছাম গোছের ঝাঁকড়া চুল বিশিষ্ট মানুষটি যে বাহার ভাই তা আর বোধগম্য হতে বাকি নেই চাঁদনীর। তবে বাহার ভাইয়ের পিছরের গুটিশুটি মেরে ছোটো-ছোটো পায়ে এগিয়ে আসা মেয়েটিকে চাঁদনী গাঢ় দৃষ্টিতে দেখল। যখন দেখল মেয়েটি আর কেউ না, তাদের আহ্লাদী চিত্রা, ঠিক সেই মুহূর্তেই চাঁদনী ছাউনি থেকে বেরিয়ে গেল। তার যেন আর তর সইছে না বোনকে ছুঁয়ে দিতে চাওয়ার ইচ্ছে। চাঁদনী ছাউনি ছেড়ে বেরুতেই মৃন্ময় ছাতা মেলে ধরল চাঁদনীর উপর। হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
“ভিজে যাবেন তো, ইন্দুবালা।”

“একটা কথা শুনেছ, মৃন্ময়? ‘যার বৃষ্টি পছন্দ, তার ছাতা হইও না’। শুনেছিলে? আমার ছাতার প্রয়োজন নেই মৃন্ময়। এ জীবনে যারাই ছাতা হয়েছে, তাদের উপরই নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছে আমরা। তারপর যখন তুমুল বৃষ্টি হয়, তখন সেই ছাতারা আমাদের মাঝ রাস্তায় ছেড়ে চলে যায়। আমরা তখন হয়ে যাই একা, নিঃসঙ্গ। একসময় যেহেতু একা হতেই হবে, তবে আজই বা কেন সঙ্গীর বিলাসিতা করব বলো?”

চাঁদনীর কথায় বিস্মিত মৃন্ময় শুধাল, “আপনি রেগে আছেন আমার উপর, ইন্দুবালা?”

“মৃন্ময়, তুমি ছোটো এখনো অনেক। ছেলেমানুষী ভরা। তাই তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। কিন্তু একটা কথা বলি শোনো— যেই কুকুরকে তুমি ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে নিজের কাছে আনো, সে-ই কুকুরকে আর সবাই লা থি দিলেও তোমার কিন্তু লা থি দেওয়ার অধিকার নেই। তুমি হয়তো সেই প্রাণীটার বুকে, পেটে, কিংবা শরীরের একটা বাহ্যিক অংশে লাথি দিবে, অথচ সেই লাথিটা গিয়ে লাগবে প্রাণীটির বিশ্বাসে, ভরসায়, অন্তরে। তখন সে চাইলেও আর মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবে না। আর সব ভেঙো, বিশ্বাস ভেঙো না। কেমন?”

চাঁদনীর কথায় কেমন যে বিমূঢ় দেখাল মৃন্ময়কে। সে যে আর কিছু বলার ভাষা পেল না। আবার হয়তো পেল কিন্তু বলার সাহস হলো না। কিন্তু চাঁদনী বলল,
“আজ সোমবার। আর তিনদিন পর শুক্রবার। সেদিন সকালে আমার সাথে একটু দেখা করো। তোমাকে কিছু বলার আছে।”

মৃন্ময় প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। প্রশ্ন করার আগেই ঠিক সেই সময়ে উপস্থিত হলো বাহার-চিত্রা। বাহার ভাইয়ের মুখ বরাবরের মতন গম্ভীর, দৃঢ়। শীতে কাঁপছে চিত্রা। চাঁদনী ছুটে গেল, আগলে ধরল বোনকে। শাসনের স্বরে বলল,
“দু’দিন পর পর যে এমন নিরুদ্দেশ হচ্ছিস, কাহিনী কী তোর? কী চাচ্ছিস? সবাই টেনশনে মরে যাক? এত ছন্নছাড়া কবে হলি? কিছুই পরোয়া করছিস না যেন আজকাল!”

চিত্রা নিশ্চুপ, স্তব্ধ। বাহার ভাই যে তাকে বিয়ে করবে রাজি হয়েছে, সে সেটা তখনো বিশ্বাস করতে পারছিল না। উত্তর দিল বাহার ভাই,
“বড়োলোকের মেয়েদের ঐ একটু মতিভ্রম হবেই, চাঁদ। তাছাড়া তোমাদের নুরুল সওদাগর যেভাবে সবাইকে নাচান, তাকেও নাচানোর জন্য তো কাউকে প্রয়োজন। তাই আর কেউ না, তার নিজের সন্তানই সেই দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে।”

বাহারের গা-ছাড়া কণ্ঠে ড্যাবড্যাব করে তাকাল চিত্রা। চাঁদনী আলগা হাসল। শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরল বোনকে। চুপ রইল মৃন্ময়। যেন জমে গিয়েছে সে! বোনের সাথে আলাপ-আলোচনার পর্ব শেষ হতেই তারা যখন পা বাড়াল বাড়ির দিকে, ঠিক তখন ছাউনির নিচ থেকে সেই আগের মহিলা ঠাট্টা করে বলল,
“সওদাগর বাড়ির এই গল্প তো সিনেমাকেও হার মানাবে। কী রঙ-তামাশা এদের!”

“তবুও তো সওদাগর বাড়ির মেয়েদের বউ করার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন বাড়ির বাহিরে। আপনাদের দেখলে তো বেহায়াও লজ্জায় দেশ ছাড়বে।”

বাহার ভাইয়ের এক কথা যেন তীরের বেগে সব সমালোচনার নামতা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। মহিলাটা গোলগোল আঁখিদুটি নিয়ে তাকিয়ে রইল চিত্রাদের দিকে অনেকক্ষণ। ঠিক যতক্ষণ বাহার ভাইয়ের দৃঢ় ছায়াটি দেখা যাচ্ছিল সোডিয়ামের আলোয়, ততক্ষণ।

_

বৃষ্টিতে ভিজছে কদম, ভিজছে জুঁইয়ের আঙ্গিনা। সওদাগর বাড়ির সামনে ভিজছে প্রায় পরিবারের সকলে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। মধ্যমনি চিত্রা। আজকে চিত্রার গালে সজোরে চড়টা তার বাবা বসায়নি, বসিয়েছেন তার মা মুনিয়া বেগম। মায়ের কপালের রগ গুলো কেমন নীল হয়ে ফুলে আছে। মুনিয়া বেগম সচারাচর রাগেন না, কিন্তু যখন রাগেন তখন আর তার হুঁশ থাকে না। যেমন আজ করলেন।

চিত্রা চড় খেয়ে মায়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মায়ের জায়গায় বাবা হলে বোধকরি তার এত করুণ দৃষ্টি হতো না, আর তার অনুভূতিও এত বিস্মিত হতো না।

“তুমি বাড়িতে আসবে না। যেহেতু এত রাত অব্দি বাহিরে থাকতে পেরেছো, তার মানে তোমার বাহিরে থাকার জায়গা অবশ্যই আছে। এত মানুষকে না জ্বালিয়ে তুমি বরং বাহিরেই থেকে যাও আজীবন। যাও।”

বাহার, নোঙর, বনফুলও দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির সদর দরজা জুড়ে। চিত্রা মাথা করে রাখল। মুনিয়া বেগম যখন আরেকটু রেগে এগিয়ে আসলো, তাকে থামালো তুহিন। আগলে দাঁড়াল বোনকে। সাবধানী কণ্ঠে বলল,
“মা, ও বড়ো হয়েছে। কি করছো! আশেপাশের মানুষ খারাপ বলবে।”

“খারাপ বলার আর কি বাকি রেখেছে মানুষ? বাড়ি বয়ে এসে মেয়ের গুণগান করে যায়। আমার কি সৌভাগ্য! এসব গুণগান চুপ করে শুনতে হয়। মানুষকে বলার সুযোগ দিলে তো মানুষ বলবেই। সুযোগ ও তৈরি করেছে। মানুষ তাই খারাপ বলছে।”

মুনিয়া বেগমের কথার পরপরই চিত্রার দাদির কন্ঠ পাওয়া গেল। মহিলা বাড়ির রোয়াক থেকেই চেঁচিয়ে বলছে,
“এখন বকছো কেন? খারাপ যেহেতু তোমরা করেছ, এখন ভুগো। এত না মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকতে, তাহলে আজ শাসন করছ কেন? অনেক হয়েছে, মেয়ের ডানা বেশি বেড়ে গেছে। এবার ছাটতে হবে। নুরু, নুরু……..

মহিলা এবার ডাকলেন নিজের ছেলেকে। কণ্ঠ আগের মতই গগনচুম্বী রেখে বললেন,
“তোর মেয়েকে আর ঘরে রাখা যাবে না। জলদিই বিয়ের ব্যবস্থা কর। পরীক্ষা শেষ হতেই বিদায় করে দিবি। একজন তো সম্মান খেয়েছেই, বাকিটা ও খাওয়ার আগেই বিদায় করে দে। মানুষকে তো পরে মুখ দেখাতে পারব না।”

“এমনেও বা আর কতদিনই মুখ দেখাতে পারবেন, বলেন তো দাদী? দুই পা-ই কবরে চলে গেছে। কবে যেন আপনার প্রাণ পাখিও উড়াল দিবে। এরপর আপনার মুখ কেউ-ই দেখবে না এমনেতেও। তাছাড়া আপনার যেই মুখ, মনেহয় যেন বাংলা ছবির ভিলেন রিনা খান। সেটা দেখলে মানুষের অন্তর আত্মা শুকিয়ে যায়। এরচেয়ে বরং আপনি মুখ না দেখালে উপকার হবে।”

বাহারের তীক্ষ্ণ ঠাট্টায় জ্বলে উঠল দাদী। আপন বেগে অসন্তোষ স্বরে বলল,
“অসভ্য কোথাকার।”

“কোথাকার অসভ্য জানেন না? এই তো, আপনাদের সভ্য বাড়ির বরাবর বাড়িটার অসভ্য আমি।”

মুহূর্তেই গমগমে পরিবেশের মুখে মিটমিট হাসি ফুটল। সকলেই চাপা হাসি ধরে রাখতে পারলেও ফিক করে হেসে দিল চেরি। তার দেখাদেখি সশব্দে হেসে দিল চিত্রা। পরপরই অহি, চাঁদনীসহ বাড়ির বাকি সদস্যও হাসল। কেবল থমথমে রইল নুরুল সওদাগর আর মুনিয়া বেগম। আফজাল সওদাগর আজ বাড়িতে নেই। স্ত্রীর সাথে স্ত্রীর বাপের বাড়িতে গিয়েছে বিধায় আজ ঘটনা এতদূর অব্দি গেল।

মুনিয়া বেগম মেয়ের দিকে রুষ্ট দৃষ্টি ফেলে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। পর পর এক এক করে সবাই-ই ভেতরে গেল। বাহিরে রইল গুটি কয়েকজন। তার মাঝে নুরুল সওদাগরও আছেন। মোটামুটি জায়গা খালি হতেই সে দরাজ গলায় বাহারকে ডাকলেন,
“শোনো, বাহার….”

নুরুল সওদাগরের ডাকে থমকে গেল যেন উপস্থিত সকলের শ্বাস-প্রশ্বাস। নুরুল সওদাগর এ অব্দি বাহার ভাইয়ের কখনো নাম নেননি। তুহিন বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করল তার ভেতরের মতিগতি। চাঁদনী আর অহিও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। অবাক না হওয়া বাহার ভাইও আজ অবাক হলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জবাব দিল,
“জি! আমায় ডাকলেন?”

“তুমি ছাড়া কী এখানে কেউ আছে? নেই। তাই তোমাকেই ডাকলাম। চিত্রাকে তুমি পড়াতে আসছো না কেন? পারিবারিক সমস্যার জের ধরে তোমার একটা স্টুডেন্টের ক্ষতি তুমি করতে পারো না। অন্তত এ ব্যাপারে তোমাকে দায়িত্বশীল ভেবেছিলাম।”

নুরুল সওদাগরের এহেন কথায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সকলে। কিন্তু তা আর বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব হলো না। কথা শেষ করেই নুরুল সওদাগর বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। বাহিরে রেখে গেলেন কতগুলো অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টি। বাহার কতক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে দেখল। কি মনে করে যেন হাসলো মনে মনে। অতঃপর তুহিনের উদ্দেশ্যে বলল,
“তোমার বোনকে মেডিসিন দিও। মতিভ্রমের বসে না আবার জ্বর বাঁধিয়ে বসে থাকে। তার তো কোনো খবর থাকেনা৷ তার জন্য কত মানুষের পৃথিবী থমকে থাকে।”

শেষের বাক্যটা ধীরেই বলল যেন। তুহিন হয়তো ঠিক বুঝতেও পারল না। তবে প্রেমিকের মন জানে, তার সকল সুখ অষ্টাদশীতে আবদ্ধ যে!

বিরাট সমস্যার রাতটি গাঢ় হয়ে এসেছে। রাত বেড়েছে নিজস্ব গতিতে সাথে বেড়েছে মুশলধারা বৃষ্টির পরিমাণ। চিত্রার শীতে শরীর কাঁপছে। হুট করে সে অনুভব করল গল গল করে তার নাক দিয়ে কিছু পড়ছে। সে নাক চেপে ধরে তরল পদার্থটার দিকে তাকাতেই ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোয় চিকচিক করে উঠল তার হাতের লাল টকটকে রক্ত গুলো।

#চলবে…..

#প্রেমোত্তাপ
কলমে: মম সাহা

পর্ব: ২৭

কাক ডাকছে কর্কশ কণ্ঠে। তবে বোধহয় সেই কর্কশ কণ্ঠ তেতো না, কেমন এক বিরহী সুর তার! আজকে অবশ্য আকাশের মন ভালো। চারপাশে শুভ্র শুভ্র মেঘগুচ্ছ ভেসে বেড়াচ্ছে। দিনটি বুধবারের প্রাণোচ্ছল দিন। সূর্য তার গন্তব্যে ফিরে যাওয়া আরম্ভ করেছে সবে। তবুও আজ সন্ধ্যার আকাশ উজ্জ্বল। চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে তার বিরাট বারান্দায়। অদ্ভুত ভাবে কেবল সে না, আজ যেন সবারই কেমন ছুটি! অহিও আজ বইয়ে ডুবে না থেকে জানালার কোল ঘেঁষে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে দূর আকাশে। এমন অনিয়ম সচারাচর চোখে পড়ে না। অহি বইয়ের মাঝে না তাকিয়ে মুগ্ধ চোখে আকাশ দেখছে এটা বিষ্ময়কর ব্যাপার। চাঁদনী আপা বসে আছে তার বিছানায়। তবে মাথাটা হেলান দেওয়ানো আছে জানালার সাথে। তার চোখ দু’টি বন্ধ। সকলের এই নিস্তব্ধতার জন্য প্রকৃতপক্ষে একজনকেই দায়ী করা যায়। সে হলো- বাহার ভাই। লোকটার গানের কণ্ঠ ভেসে আসছে বহু কাছ থেকে। ছন্নছাড়া লাইন গুলো,
“আমি তোমায় ভালোবাসি,
জগতে হইয়াছি দোষী…….”

গানের লাইনগুলো যেন খু্ব বিশেষ ভাবে প্রতিটি নিখুঁত ভাবে ভালোবাসতে পারা মানুষদের সাথে জড়িত। যারা প্রকৃতপক্ষে ভালোবেসে কেবল প্রতিদানে পেয়েছে কলঙ্ক। লোকে বলেছে ছি ছি! ভালোবেসেছ! যেন মহা পাপ কিছু করে ফেলেছে। অথচ দিনশেষে এমন ছি ছি মাখা মিছে কলঙ্ক কুড়িয়েও যারা ভালোবাসার মানুষদের পায়নি বা পায়না, এই গানের লাইন গুলো যেন তাদের জন্যই দরদী হয়ে কাঁদে। বনফুল অন্যান্য সময় এত মনোযোগ দিয়ে তার ভাইয়ের গান শুনেনা, অথচ আজ শুনছে৷ তার মনে হচ্ছে ভাই যেন তাকেই গাইছে আরও করুণ ভাবে, নিঃস্ব করে! বনফুল নিবিড়ে হেঁটে তার মায়ের রুমের কোণায় এসে দাঁড়াল। এখান থেকে তুহিনের রুম দেখতে পাওয়া যায় খুব সহজ ভাবে। বনফুলের বেহায়া চোখ খুব গোপনে সেই রুমের দিকে চাইল। ফাঁকা রুমেও যেন সে নিজের ভালোবাসার অস্তিত্ব খুঁজে পেল। বুকের ভেতর তুমুল আ ন্দো ল ন। তার অবুঝ মন প্রশ্ন তুলল- আচ্ছা, আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে পাই না কেন? যাদের ছাড়া আমাদের চলেই না, তারা কেন আমাদের ভালোবাসে না? মন তো প্রশ্ন করে নিরব হয়ে যায় কিন্তু অশান্তিতে ভুগে উত্তর না পাওয়া বনফুল। এই কেন-র উত্তর আদৌও মিলবে! সে শূন্য চোখে তুহিনের রুম দেখে নির্নিমেষ। একমাত্র লোকটাকে পাবে বলে ভদ্র বনফুলও ভদ্রতা ভুলে হাউমাউ করে কেঁদেছিল। কিন্তু কোনো লাভ কী আদৌও হলো! দিনশেষে সমাজের ছি ছি ছাড়া আর কী পেল সে!

বাহারের গান থামতেই পরিবেশ ভয়ঙ্কর রকমের নিরবতায় আচ্ছন্ন হলো। যেন বিষাদের এই বোবা গল্প শান্তি চায়। চিত্রা বারান্দা দিয়ে চাইল। অগোছালো বাহার ভাইয়ের হাতে তখন জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়া উড়ছে উর্ধ্বে। চিত্রা ডাকতে গিয়েও ডাকল না তাকে। কেন যেন এই কথা না বলা ক্ষণটি তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। যেমন পছন্দ হয়েছিল সেই বছর কয়েক আগে কিশোরী চোখে দেখা প্রথম কোনো ছন্নছাড়া পুরুষকে।

এই মোহগ্রস্ত নিরব সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা কাটিয়ে চাঁদনীর ফোন বেজে উঠলো। ঘোর কাটাল চাঁদনীর। চোখ মেলল সে। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা অপরিচিত নাম্বারটির দিকে তাকালো। ফোনটা বাজতে বাজতে প্রায় থামার পূর্ব মুহূর্তে চাঁদনী ফোনটা রিসিভ করল। রিসিভ করে কানে ধরতেই অপর পক্ষ থেকে একটি গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“চাঁদ বলছো?”

চাঁদনী থমকানো, মনে মনে কিছুটা হোঁচটও খেলো বোধ হয়। কিন্তু খুব দ্রুতই আবার নিজেকে সংযত করে নিল। আধো কণ্ঠে বললো,
“শাহাদাত, তুমি!”
শাহাদাত হাসলো। বলল, “এখনো কণ্ঠ চেনো তবে! ভুলোনি?”

“ভুলে যাওয়ার কথা তো আমি কখনো উচ্চারণ করিনি, তাই চিনি। সেটা তো তুমি করেছিলে। তাই তুমি ভুলে গিয়েছো কারণে অকারণে৷”

শাহাদাত হতাশার একটি শ্বাস ফেললো বোধ হয়। বলল,
“এখনো অভিযোগ, অভিমান পুষে রেখেছো!”

“সেই অধিকার তো তুমি কেড়ে নিয়েছ, রাখব কীভাবে? বাদ দাও সেসব কথা। তা হুট করে কল দিয়েছ কেন?”

“চাঁদ……” ডাক দিয়েই থামল শাহাদাত। কণ্ঠটা কী কাঁপছে লোকটার! মনে হলো যেন সে কান্না গিলে নেওয়ার ছোট্টো চেষ্টাটুকু করল বড়ো গোপনে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! চাঁদনী যে মানুষটাকে আগাগোড়া চিনতো একসময়। যার হাসির কণ্ঠ, কান্নার কণ্ঠ, চাঁদনীর মুখস্থ, তার আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা চাঁদনী ধরতে পারবে না? চাঁদনী সময় দিলো মানুষটাকে। শাহাদাত সামলে নিল নিজেকে। কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“চাঁদ, আমি জানি, তুমি কখনো আমাকে অভিশাপ দাওনি। কিন্তু তবুও, তোমার মন ভাঙার মতন পাপের শাস্তি বিধাতা আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। তোমাকে যতটা আমি আঘাত করেছি, তার শাস্তি যে ভোগ করতেই হবে।”

এবার চাঁদনী কিঞ্চিৎ অবাক হলো। বিষ্ময় ধরে রেখেই শুধাল,
“কী হয়েছে, শাহাদাত?”

“আমার স্ত্রী’র তিনমাসের প্রেগন্যান্ট ছিল। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছে তার। এমনকি বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাও।”

চাঁদনী যেন ভুল শুনল। দূর আকাশে তখন হাসল সন্ধ্যার নক্ষত্র। প্রকৃতির খেল বুঝা যে বড়ো দায়!

প্রতিদিনের মতন আজ অভ্যস্ত নিয়মে সন্ধ্যা হলো না। গত কয়েক মাসের গতানুগতিক নিয়ম পাল্টে যেন এই অপরাহ্ন এক বুক হাসি নিয়ে এলো। মন খারাপ উড়িয়ে নিয়ে যাবার এই সন্ধ্যা। চিত্রা যখন নিশ্চুপ চোখে আকাশ দেখতে ব্যস্ত ঠিক তখনই রাস্তা থেকে সরু কন্ঠে ডাক এলো,
“চিতাবাঘ, নিচে আয়। এলাকার মোড়ে ঝালমুড়ি মামা এসেছে। বোম্বাই মরিচ আছে। দ্রুত আয়।”

চিত্রার গভীর ধ্যানে ভাঁটা পরল। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। বনফুল তাকে স্বেচ্ছায় ডাকছে! বনফুল? চিত্রা নিচু করে পথের দিকে চাইল। ভেসে উঠলো বনফুলের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। যেন পুরনো সেই বনফুল যার সরলতায় মুগ্ধ হতো পৃথিবীর সকল উপমা। যেন গত কয়েক মাসের ঘটনাগুলো মুহূর্তেই চাপা পড়ে গেল বনফুলের নিখুঁত হাসির নিচে। চিত্রাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বনফুল আবার ডাকলো,
“আসবি? না আমি চলে যাব?”

চিত্রা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। কোনমতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘরের বাহিরে। পেছন থেকে বার করে ডাকলেন মুনিয়া বেগম কিন্তু মেয়েটার যেন উত্তর দেওয়ার সময় নেই। কেবল হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“মা, বনফুল ডাকছে আমায়। হাত বাড়িয়ে ডাকছে আমার বন্ধুত্ব। আমায় তুমি পিছু ডেকো না, ম। আমার যে পিছু ডাক শোনার সময় নেই।”

মুনিয়া বেগম প্রথমে ধমকাতে গেলেও বনফুলের নাম শুনে থেমে গেল। আর কেউ না জানলেও মায়ের মন তো জানে, মেয়েটা বড়ো বন্ধু ভক্ত। এই কয়েক মাস তো দেখেছে সে মেয়েটা কেমন গুমড়ে গুমড়ে মরত। আজ যেহেতু বাঁচতে চাচ্ছে তাহলে বাঁচুক না! ক্ষতি কী? পিছন থেকে মায়ের ডাক শুনতে না পেরে মনে মনে হাসলো চিত্রা। তার যে কি ভীষণ আনন্দ হচ্ছে! আজকাল যেন পৃথিবীতে স্বর্গ নেমে এসেছে। চারপাশে কেমন আনন্দ আর আনন্দ! কিন্তু ভয় হলো এই আনন্দ কতদিন টিকবে!

চিত্রা নিচে নেমে আরও অবাক হলো। কেবল বনফুল না, বাহার ভাইও দাঁড়িয়ে আছে তার সাথে। যদিও লোকটার চেহারায় তেমন ভাবাবেগ নেই। চিত্রাকে দেখেই বনফুল হেসে এগিয়ে এলো, আবেশে জড়িয়ে ধরল চিত্রার বাহু। উৎফুল্ল বদনে বলল,
“তাড়াতাড়ি চল। ভাইয়া ঝালমুড়ি মামাকে ডেকে এনে দাঁড় করিয়েছে। আয়।”

চিত্রা অবাক চোখে বাহার ভাইয়ের দিকে তাকাতেই মানুষটার অগোছালো হাসি চোখে পড়ল। চোখে ইশারা করে যেন লোকটা বলল,
“আমি আছি।”

চিত্রার অন্তর আত্মা যেন শীতল হয়ে এলো। একজন ‘আমি আছি’ বলা লোকের অভাবে কত মানুষ মারা যায় আফসোস নিয়ে! অথচ চিত্রার আর সেই আফসোস রইল না। ঠিক সেই মুহূর্তে চিত্রার সকল আনন্দকে ভয়ে পরিণত করে আমতে দেখা গেল তুহিন ভাইজানকে। সাথে তার প্রেমিকা নিরু। চিত্রা বীত চোখে বনফুলের হাতটার দিকে তাকাল। যে হাতটা জড়িয়ে আছে চিত্রার বাহু। চিত্রা অপেক্ষা করল, এই বুঝি বাঁধন আবারও ঢিলে হলো!

#চলবে

প্রেমোত্তাপ পর্ব-২৪+২৫

0

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২৪.

অহি বিশাল প্রাচীর ঘেরা একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাঁধে শুয়ে আছে ছোট্টো হুমু। হুট করে রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছিল বাচ্চাটার সাথে, এখন সে আর অহিকে ছাড়বে না। অবশেষে না পেরে, বাধ্য হয়েই বাড়িতে আসতে হলো অহিকে। সুন্দর দোতালা বাড়িটির সামনের জায়গাটিতে বাগান করা। সেখানে ফুটে আছে রঙবেরঙের ফুল। বাগানের ভেতর বসার জন্য একটি সুন্দর জায়গাও আছে। বাগানটির মাঝখানে ছোট্টো জলাশয় টাইপ কিছু আছে যা খুব সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। অহির চোখ ছানাবড়া। হ্যাঁ ওদেরও নিজস্ব বাড়ি এবং বাগান আছে ঠিক কিন্তু এত শৌখিন ভাবে কোনোকিছুই গোছানো নেই। বাড়িটি দেখলেই বুঝা যায় কোনো একজন মানুষ অনেক শখ করেই বাড়িটি বানিয়েছেন।

অহির ভাবনার মাঝেই নওশাদ ডাকল,
“বাড়ির ভেতরে যাবেন না? বাহির থেকেই দাঁড়িয়ে দেখবেন?”

অহির ধ্যান ভাঙে তবে মন টানে না আর ভেতরে যেতে। তন্মধ্যেই খেয়াল করে ছোটো হুমু গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। অহি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হুমুকে দেখিয়ে বলল,
“যার বায়নায় এসেছি, সে-তো ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার না গেলেও চলবে।”

“তাই বলে বাহির থেকে চলে যাবেন না-কি!”

নওশাদের প্রশ্নে অহি গাঁইগুঁই করল। সে বরাবরই কম মিশুকে। হুট করে কারো বাড়িতে চলে যাওয়া তার কাছে বড়ো অশোভনীয় লাগল। আর তাছাড়া বাড়ির ভেতর কে আছে সেটাও সে জানেনা। কে তাকে কোন নজরে দেখবে, তাদের সাথে কীভাবে কথা বলবে, কি বলবে সেটাও ভাববার বিষয়। অথচ এ জায়গায় চিত্রা হলে মহা আনন্দে চলে যেত। মেয়েটা বড়ো মিশুকে কি-না! এক মুহূর্তে মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে। কিন্তু অহির যে বড়ে সংকোচ হয়। তাই এত-শত অস্বস্তি নিয়ে অবশেষে সে মনস্থির করল যাবে না। যেই ভাবনা সেই কাজ। হুমুকে আলগোছে নওশাদের কোলে দিতে দিতে বলল,
“আজ নয়, আরেকদিন যাব। আজ একটু তাড়া আছে।”

“এটা কখনো সম্ভব না। আপনি আমার বাড়ির সামনে থেকে চলে যাবেন আর আমি কিছু বলবো না ভেবেছেন? চলুন এখুনি। নাহয় হুমু কাঁদবে।”

নওশাদের বোকা-বোকা একরোখা উত্তরে অহি বিরক্ত হলো না বরং হাসল,
“যার জন্য যেতাম, সে তো ঘুমেই। তাহলে কীভাবে কাঁদবে সে?”

অহির ভাবলেশহীন উত্তরে ভ্যাবাচেকা খেল নওশাদ। তবে সে দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তাই অহিকে বিব্রত করতে দুষ্টুমির স্বরে বলল,
“হুমু না কাঁদলে হুমুর বাপ কাঁদবে। তাও আপনাকে যেতে হবে।”

“তাহলে বরং হুমুর বাপ একটু কাঁদুক, এরপর ভেবে দেখব যাওয়া যায় কি-না।”

“কাঁদবো সেদিন, যেদিন একবারের জন্য আনবো। খুশিতে কাঁদব। আজ তো মিনিট খানেক থাকবেন। কান্নাটা আজ লস প্রজেক্ট হবে।”

নওশাদের কণ্ঠে দুষ্টুমির ছোঁয়া এবং ঠোঁটে কুটিল হাসি। ইশারা বুঝতে ভুল হয় না অহির। তাই তো সে প্রায় খিলখিল করে হেসে উঠে। নওশাদের থেকে এক ধাপ উপরে গিয়ে বলে,
“তাহলে ঠিক আছে, কান্নাটা সেদিনের জন্যই বরাদ্দ থাক যেদিন এটা লাভ প্রজেক্ট হবে। আজ তবে আসি।”

কথা থামিয়েই বিদায় নিল অহি। নওশাদ চেয়েও জোর করতে পারল না। অতটুকু অব্দি অধিকার তার বোধহয় এখনো হয়ে উঠেনি। যখন হবে, তখন দরকার হয় বেঁধে রেখে দিবে।

_

সবচেয়ে বেশি বেতনের টিউশনিটাও আজ হাতছাড়া হয়েছে বাহারের। ছাত্রীর বিরক্তিকর কর্মকান্ডেই টিউশনিটা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে সে। অল্পবয়সী মেয়েদের আবেগ থাকে গুরুতর। এবং সেই আবেগের সমুদ্রে পড়ে তারা আর কিছু দেখতে চায় না, বুঝতে পারে না। বাহারের ছাত্রী টিনাও সেই শ্রেণীর একজন মানুষ। অতিরিক্ত আবেগে সে অন্ধ হয়ে গিয়েছে। অন্ধ না হলে কী আজ বাহারকে চিঠি দিতে পারত! এমনকি বাহার প্রত্যাখান করায় তার পা ধরে বসে ছিল। অবশ্য বেশ কয়েকদিন যাবতই বাহার এটা খেয়াল করেছিল কিন্তু পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল অল্পবয়সী আবেগকে বেশি গুরুত্ব না দিলে তা আপনা-আপনি থিতিয়ে আসবে। অথচ সে ভুল ছিল। বরং তার নিরবতাকে মেয়েটা সম্মতি ভেবে নিয়ে আরও ভয়ঙ্কর কাজ করার সাহস পেলো।

বাহারের চোখে-মুখে ক্লান্তি আছড়ে পড়ছে। একে একে প্রায় দু’টো টিউশনি হাতছাড়া করল। চিত্রাকে অবশ্য সে ইচ্ছে করেই আর পড়াতে যাচ্ছে না। মেয়েটা আজকাল তার কাছে পড়ছিলোও না। বাহারের সাসনে তার যত অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন, ভাবুক হা-হুতাশ। কী করবে? বয়স অল্প। নিজের পছন্দের মানুষটাকে এত কাছ থেকে দেখে আবেগ সামলাতে পারে না। অনুভূতি দমিয়ে রাখতে পারেনা। এতে প্রকৃতপক্ষে মেয়েটারই তো ক্ষতি হচ্ছে। তাই এসব ভেবেই আর পড়াতে যায় না।

এমন অনির্দিষ্ট হাজার খানেক চিন্তার বোঝা নিয়ে যখন রাস্তা দিয়ে একা হাঁটছিল বাহার, তখন অনুভব করল সে একা নয়। তার পাশে আরও একজন হাঁটছে। নিঃশব্দে, নিরবে, নিভৃতে। বাহার পাশ ফিরে তাকাতেই চিত্রার ঘর্মাক্ত মুখটি চোখে পড়ল। লাল হয়ে আছে মুখটি। বাহার ভ্রু কুঁচকালো,
“তুমি এখানে?”

“আপনি যেখানে, আমি তো সেখানেই থাকব।”

চিত্রার হাসি-হাসি বদনখানি সরু চোখে একবার পরখ করে নিল বাহার ভাই। ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল সে। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তোমার এখন বাড়িতে থাকার কথা। কিছুদিন পর তোমার পরীক্ষা। সব ভুলে গেছ?”

“বাড়িতে কীভাবে থাকব? আপনি বাহিরে থাকলে আমার যে বাড়িতে মন টিকে না।”

“ফাজলামো করছো?”

“না, ভালোবাসা-বাসি করছি। আপনারে ভালোবাসলে এত শান্তি লাগে কেন?”

“কারণ এখনো অশান্তি তোমার ভালোবাসার দুয়ারে এসে দাঁড়ায়নি।”

“কখনো দাঁড়াবেও না। আপনি যেখানে আছেন, সেখানে কোনো খারাপই আসতে পারবে না।”

“হাসালে রঙ্গনা। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে বলছো ‘আগুনকে তুমি বিশ্বাস করো, সে তোমার শরীর জ্বালাবে না’! অন্ধবিশ্বাস করো না, মেয়ে। যখন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তখন বুঝবে আগুনের জ্বালা কতো। আগে থাকতে সামলে যাও।”

চিত্রা দাঁড়াল। আড়চোখে চাইল বাহার ভাইয়ের পানে। বাহার ভাইয়ের দৃষ্টি তখনও গন্তব্যহীন। মিহি মন্দ বাতাস এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের শরীর। চিত্রা সে বাতাসের তালে অন্যমনস্ক হলো। কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,
“আমায় বিয়ে করবেন, বাহার ভাই?”

চিত্রার অসম্ভব রকমের আবদারে থেমে গেল এবার বাহার ভাইয়ের পা। তড়িৎ গতিতে সে চিত্রার দিকে চাইল। মেয়েটার চোখে যেন পৃথিবীসম মায়া। আবদার-আহ্লাদী, আদুরে সকল আধ্যাত্মিক অনুভূতি যেন মেয়েটার মুখমন্ডলে এসে ঘাপটি মেরে বসেছে। অথচ সেই সকল মায়াও ঝেরে ফেলল বাহার। গা-ছাড়া ভাবে চিত্রার সকল অনুভূতিকে হাওয়ায় উড়িয়ে বলল,
“অদ্ভুত আবদার করো না, রঙ্গনা।”

চিত্রা দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। একরোখা ভাবে বলল,
“বিয়ে না করলে যাব না।”

বাহার গা করল না তেমন। চিত্রা ঘাড়ত্যাড়ামি করল। বাহারের হাত জড়িয়ে ধরল। মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
“চলুন, বিয়ে করে ফেলি। আমাদের সকল সমস্যা দেখবেন মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে। চলুন।”

চিত্রার আবদারের কোনো থামা থামি নেই। বাহার বারকয়েক থামতে বললেও চিত্রা শুনলোনা বারণ। পথচারীদের কেমন সন্দিহান দৃষ্টি এসে চিত্রার চোখ-মুখ এবং শরীরেও ছড়িয়ে পড়েছে। চোখ এড়ালো তা বাহারের। অবশেষে হুট করেই সে একটি অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসল। কোমল চিত্রার আদুরে শরীরটা হালকা বল প্রয়োগ করে ধাক্কা দিয়ে দিল। আচমকা ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মেয়েটা। ককিয়ে উঠল ব্যাথায়। অথচ বাহার সেই ব্যাথার আর্তনাদ শুনল না। এর আগেই সে প্রস্থান নিয়েছে। চিত্রার ব্যাথাতুর দৃষ্টি বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। কেউ দেখল না সেই অশ্রু। কেউ দেখলো না অষ্টাদশীর বুকের ব্যাথা।

_

সওদাগর বাড়িতে চিন্তার আরেকটি রাত নেমেছে। বাড়ির মেয়েটি আজ আবার নিরুদ্দেশ। চারপাশে খোঁজ পড়েছে তার। এ নিয়ে আক্রোশে ফেঁটে পড়েছে চিত্রার দাদী মনোয়ারা বেগম। চিত্রার বাবাও বার কয়েক হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে। চিন্তায় সকলের অবস্থা বেসামাল। এর মাঝেই সকলকে লুকিয়ে অহি চেরিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাবধানী ভঙ্গিতে কিছুটা দৌড়িয়ে ছুটে গেল তারা বাহার ভাইদের বাড়িতে। বার কয়েক বেল বাজাতেই দরজা খুলল নোঙর নামের মেয়েটি। প্রথমে অহিকে দেখে কিছুটা ভ্রু কুঁচকালেও পরক্ষণেই চেরিকে দেখতেই তার কুঁচকানো ভ্রু সমান হয়ে এলো। চোখ-মুখে কেমন ছড়িয়ে পড়ল বিরক্ত। কর্কশ কণ্ঠে তবে ফিসফিসিয়ে বলল,
“কী চাই?”

নোঙরের এমন কণ্ঠ পছন্দ হলো না অহির। তাছাড়া মেয়েটাকেও তার পছন্দ নয়। এই মেয়েটাই সেদিন চেরির সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল। তাছাড়া চিত্রাও মেয়েটাকে সহ্য করতে পারেনা। আর অহির সিক্স সেন্স বলে, চিত্রা ও বনফুলের দূরত্বের ভয়ানক পরিণতির কারণ এই মেয়েটাই। মেয়েটা ওদের সম্পর্কের তৃতীয় ব্যাক্তি ছিল। আর সবসময় যেকোনো সম্পর্কেই তৃতীয় ব্যাক্তি গুলো সুচ হয়ে ঢুকে এবং ফাল হয়ে বের হয়। হোক সেটা প্রেমের সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্বের।

“কী সমস্যা? দরজায় এসে সঙের মতন দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কী প্রয়োজন?”

মেয়েটার কথার ভঙ্গিতে খেপে উঠল অহি। দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দিল,
“কাকে সঙ বলছেন আপনি? জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে দিব আপনার। অসভ্য মেয়ে। থাকছেন অন্যের বাড়িতে আবার ভাব করছেন যেন আপনি বাড়ির মালিক!”

অহির এমন আক্রোশ সহ্য হলোনা মেয়েটির। ওদের মুখের উপর দরজাটি বন্ধ করে দিল। মেয়েটির এহেন আচরণে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল তারা। দুই বোন দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। চেরি অসহায় কণ্ঠে বলল,
“থাক, বুবু, চলে যাই আসো। ওরা ঢুকতে দিবে না আমাদের।”

বোনের অসহায় কণ্ঠে রাগ বাড়ল অহির। ইচ্ছে করল মেয়েটাকে ঠাটিয়ে দু’টো চ ড় মারতে। যদিও সে জানেনা মেয়েটা তার বয়সে বড়ো কি-না ছোটো কিন্তু তবুও তার এই অন্যায় কাজটি করার ইচ্ছে হলো। অবশেষে না পেরে দু’জনই বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই বাহার ভাইদের সদর দরজাটা খুলে গেল শব্দ করেই। ভেসে এলো মেয়েলি কণ্ঠ,
“ছোটো আপা? তুমি চলে যাচ্ছ কেন? আসো ভেতরে।”

আকস্মিক বনফুলের কণ্ঠটি কাঠফাটা রোদ্দুরে একবিন্দু বৃষ্টির ন্যায় লাগল অহির। তার আক্রোশ মেটানোরও সুযোগ পেল যেন। তাইতো ভয়ঙ্কর রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
“কীভাবে ভেতরে যাব, বনফুল? তোমাদের বাড়িতে তো নতুন কর্ত্রী এসেছে। সে অনুমতি না দিলে কী আমরা অধম’রা যেতে পারি?”
শেষের কথাটি অহি নোঙরের দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলেই বলল।

“তাই নাকি? শুক্কুর শুক্কুর অষ্টদিন হলো বাড়িতে এসেছে সে, তাও মেহমান হয়ে, সে ঠিক করবে কে বাড়িতে আসবে, কে আসবে না? হাসালে, ছোটো আপা। মেহমান আর যাই হোক কর্ত্রী হতে পারবে না। আর যারা অনির্দিষ্টকালের জন্য আসে, তারা বেশিদিন মেহমানও থাকে না। তারা তখন…… যাক বাদ দাও। ভেতরে আসো, আপা।”

নোঙর যেন অপমানে মূর্ছা গেল। নতজানু মাথাটি তার আরও নত হয়ে এলো। বনফুল তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল। বনফুলের আচরণে অহির ভ্রু কুঞ্চিত হলো। মেয়েটার আচরণে তো আজ কোনো উগ্রতা নেই! বরং চোখ-মুখ যেন কেমন অদ্ভুত লাগছে। চোখের নিচে কালো কালির প্রলেপ। কেমন যেন দেখতে লাগছে! এখন এত-শত ভাবনার সময় নেই বলেই অহি তেমন মাথা ঘামালো না। দ্রুতই বাসায় প্রবেশ করল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“বনফুল, এখন এতকিছু বলার সময় নেই। বাহার ভাই কোথায় বলো তো?”

বনফুল উত্তর দেওয়ার আগেই বাহার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। চিন্তিত অহিকে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“কী হয়েছে?”

“চিত্রাকে খুঁজে পাচ্ছি না, বাহার ভাই। আপনি কী একটু খুঁজতে যাবেন প্লিজ।”

অহির আবদারে থমকাল বাহার। তবে কিছু একটা ভেবে গা-ছাড়া ভাবে বলল,
“তোমাদের বাড়িতে কী লোকসংখ্যা কম পড়েছে খোঁজার জন্য?”

বাহারের উত্তরে তাজ্জব অহি। এতক্ষণের উজ্জ্বল মুখটাতে নেমে এসেছে অন্ধকার। কিন্তু থেমে নেই বনফুল। চিন্তিত কণ্ঠে ভাইকে তাড়া দিল। ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল নিজেই।

বাহার হতাশার শ্বাস ফেলে সেই পথে হাঁটা ধরল যে পথে মেয়েটাকে ফেলে এসেছিল। বিড়বিড় করে বলল,
“রঙ্গনা, জোর করে যন্ত্রণা বেছে নিচ্ছো। চির বেদনা হয়ে থেকে যাবে তোমার প্রেম।”

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

পর্ব: পঁচিশের প্রেম

ঝড় হচ্ছে অবিশ্রান্ত। অক্লান্ত বর্ষণ ধারায় ভিজছে পিচঢালা কংক্রিটের রাস্তাখানি। তার সাথে ভিজছে নিশ্চুপ, নিরবে দাঁড়িয়ে থাকা শত যুগের হলুদ বাল্ব গুলো। যার আলোয় ভেজা রাস্তাটিকে মনে হচ্ছে কুড়ির কৃষ্ণকলি। যৌবন যার দেহে টইটম্বুর। বৃষ্টির এই মধ্যরাত একা। এই ব্যস্ত রাস্তায় রাত বাড়তেই ঝুপ করে নেমে আসে একাকীত্ব। সেই একাকীত্বকেই সঙ্গী করে ভিজছে এক অভিমানী রঙ্গনা। প্রেমিকের বুকে যত্নে থাকা অবাধ্য ক্যাকটাস ফুল।

কম্পনরত হৃৎপিণ্ডটুকু নিয়েই এই একা রাস্তায় ছুটে এসেছে বাহার ভাই। অষ্টাদশীর শখের প্রেমিক পুরুষ। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল গুলো বৃষ্টির ছোঁয়ায় অবাধ্য হয়ে লেপ্টে আছে কপালে। খুব শান্ত, নিবিড় ভাবে। নীল রাঙা টি-শার্টটাও বৃষ্টির কল্যাণে ভিজে একাকার। শ্যামলা পুরুষটির ছিমছাম শরীরে বৃষ্টিকে মনে হলো শৌখিন প্রেমিকা। যে প্রেমিকা, প্রেমিকের দেহ বেশ প্রেম নিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। চিত্রাকে এই ফুটপাতের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে দেখে বাহারের হৃৎপিণ্ড শান্ত হলো কিন্তু কণ্ঠ হলো রুষ্ট। সে প্রায় বাজখাঁই গলায় চেঁচালো,
“এখানেই থাকবে সারারাত?”

হঠাৎ রাশভারি পুরুষ কণ্ঠে চিত্রার গুরুগম্ভীর ধ্যানে ভাঁটা পড়ল। সে ঘোলা-ঘোলা দৃষ্টিতে সামনে চাইল। একটানা বৃষ্টিতে ভেজায় চোখ জ্বালা করছে তার। জ্বর আসবে কী! ঠিক ঠাহর করতে পারল না সে। তবে প্রেমিকের রুষ্ট চোখ জোড়া সে ঠাহর করতে পারল। তাই কিছুক্ষণ মৌন থেকে জবাব দিল,
“আপনাকে আসতে বলেছে কে?”

“আর কে বলবে? তোমার পরিবারের মানুষ ছাড়া? তারা তো ভাবেই আমি আজাইরা। আমার কোনো কাজকর্ম নেই। তাদের মেয়ের মতিভ্রম হবে আর আমি আমার সকল কর্ম ফেলে সেই মতিভ্রমের পিছে বলদের মতন ঘুরবো। আছিই তো আমি। বিনে পয়সার বলদ।”

কথা থামল বাহার ভাইয়ের আর ক্ষত-বিক্ষত হলো চিত্রার অন্তর। সে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইল মানুষটার দিকে। মনে মনে অভিমানও করল। মানুষটা তাহলে তার কথা ভেবে এখানে আসেনি? তাকে আসতে নিশ্চয় জোর করা হয়েছিল তাই এসেছে। সেজন্যই কী এত রেগে গিয়েছে? হয়তো! ভেতরে-ভেতরে কথা গুলো ভেবেই তপ্ত শ্বাস ফেলল চিত্রা। তার এই ছোট্ট জীবনে সবচেয়ে বড়ো আফসোস হলো- মানুষটা তাকে ভালোবাসে না। আর এই আফসোস সবচেয়ে যন্ত্রণার। বাহার ভাই তাকে ভালোবাসলে, তার বোধহয় আর দুঃখ থাকত না।

চিত্রার অভিযোগের গোপন শ্বাস অগোচর হলো না প্রেমিকের। সে-ও এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আসলে চিত্রার প্রতি তার রাগ না, একটা গোপন ভয় তৈরী হয়ে গিয়েছিল। যখন শুনলো মেয়েটা এত রাতেও বাড়ি ফেরেনি, তখন অনাকাঙ্খিত ভয়ে তার মাথা দপ করে উঠেছিল। এই বুঝি মেয়েটা কিছু করে বসল। সেই ভয়টাই কণ্ঠে রাগ হয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বাহার হতাশার শ্বাস ফেলল। বড়ো বড়ো পা ফেলে খুব নিরবে গিয়ে বসল চিত্রার পাশে। নিভৃতে তাকাল মেয়েটার মুখের দিকে। চোখ গুলো কেমন লাল হয়ে গিয়েছে না মেয়েটার? অথচ সে হুশ কী তার আছে? না, নেই। মেয়েটা আজকাল কেমন জেদি হয়েছে। নিজের সকল সিদ্ধান্তে একরোখা মনোভাব প্রকাশ করছে। কীভাবে তাকে বুঝাবে যে দায়বদ্ধতার কাছে ভালোবাসাও বড়ো রঙহীন হয়ে যায় যে! অবুঝ মেয়েটা কী সেটা বুঝবে? বাহার নিবিড় দৃষ্টি পথের দিকে নিবদ্ধ করল,
“এত জেদ করে কী লাভ হয়, রঙ্গনা?”

“প্রেমিককে পাওয়া যায়।” চিত্রার তৎক্ষণাৎ উত্তর। হাসল বাহার ভাই,
“প্রেমিককে পেলে কী হয়, রঙ্গনা?”

“প্রেম স্বার্থক হয়।”

চিত্রার আবার দ্রুতগামী উত্তরে বাহার ভাই একপলক চাইল তার পানে। বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস, সাথে ছন্নছাড়া মানুষটির গোছানো কথা,
“প্রেমিককে পেলেই প্রেম স্বার্থক…. কে বলেছে, মেয়ে? প্রেম স্বার্থক হয় নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়। যেখানে চাওয়া-পাওয়া থাকে সেখানেই স্বার্থ জড়িয়ে যায় যে! আর সম্পর্কে স্বার্থ চলে এলে সঠিক ভাবে ভালোবাসা-বাসি আর হয়ে উঠে না। তখন মানুষ লেগে পড়ে স্বার্থ উদ্ধার করার কাজে। ভালোবাসা হলো খোলা আকাশ। যার দৈর্ঘ্য থাকবে না, প্রস্থ থাকবে না। যার পুরোটা জুড়েই থাকবে প্রশান্তি। হোক প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি, ভালোবাসা হতে হয় অমলিন। যা কখনো, কোনো কিছুর বিনিময়ে হারাবে না। নৈকট্য পেলেই প্রেম থাকবে, দূরত্ব পেলে প্রেম হারাবে— এমন প্রেম যে খাঁটি নয়। নৈকট্য হোক কিংবা দূরত্ব, ভালোবাসার পরিমাণ যখন বদলাবে না, তখনই তো হবে প্রেম স্বার্থক। বুঝলে, রঙ্গনা?”

“খাঁটি প্রেম দিয়ে কী হবে, বাহার ভাই? যদি চাঁদনী আপার মতন না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে হয়?”

চিত্রার গলার স্বর কিছুটা কোমল। হুট করে এমন প্রশ্নে থতমত খেল বাহার ভাই। তড়িৎ গতিতে তাকাল চিত্রার পানে। মেয়েটার চোখে-মুখে অসহায়ত্ব। বা-চোখটা দিয়ে খুব গোপনে মুক্তোর মতো অশ্রুকণা ঝরে পড়ল। এটাও অগোচর হলো না বাহারের। সে খুব গোপনে তপ্ত এক শ্বাস ফেলল।
“চাঁদনীর হয়তো না পাওয়ার যন্ত্রণা আছে তবে সে এটা জেনে শান্তি পায় যে তার তরফ থেকে সে যথেষ্ট ছিল। যখন আমরা নিঃস্বার্থ ভালোবাসি তখন আমরা নিজেরাই ভেতর ভেতর একটা শান্তি অনুভব করি। আমরা জানি, পুরো পৃথিবী মিথ্যে হতে পারে তবে আমাদের ভালোবাসা একমাত্র সত্যি। আর এই শান্তিটা জীবনকে একটি অনন্য মাত্রায় নিয়ে যায়, রঙ্গনা। কেবল পেতেই হবেতে আটকে থাকলে তুমি সেই অনুভূতি অনুভব করতে পারবে না, মেয়ে।”

“আপনি আমাকে যতই বুঝান বাহার ভাই, আমি পেতেই হবেতেই থেকে যাব।”

মেয়েটার একরোখা জেদ অটল রইল। বাহার ভ্রু কুঁচকালো খানিক। বিরক্ত হলো কি-না ঠিক বুঝা গেল না। তবে সে তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বাহারকে উঠে দাঁড়াতে দেখে তৎক্ষণাৎ তাকাল চিত্রা। আবারও অভিমান হানা দিল তার বুকে। বাহার ভাই কি আবারও অষ্টাদশীর অভিমান না বুঝেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে? বুকের ভেতর জবাব বিহীন প্রশ্ন হামাগুড়ি দিতেই চিত্রা বলে উঠল,
“চলেই যেহেতু যাবেন, এসে ছিলেন কেন?”

মেয়েটার প্রশ্নে গা-ছাড়া ভাবে হাসল বাহার। মাথার ঝাকড়া চুল গুলো ঝেড়ে নিল নিঃসংকোচে। অতঃপর একটু নিচু হয়ে চিত্রার ডান হাতের বাহু আঁকড়ে ধরল এবং হেচকা টেনে দাঁড় করিয়ে দিল আকষ্মিক। মেয়েটাও থতমত খেল প্রায়। চিত্রার থতমত হওয়া চেহারার লাল চোখের পাতা গুলো খুব আলতো ছুঁয়ে অগোছালো বাহার ভাই বলল,
“থেকে যাওয়ার জন্যই তো এলাম। রেখে দাও। তোমার কথাই রইল, খুব শীগ্রই আমাদের বিয়ে হবে। রঙ্গনার অবাধ্য বাহার ভাই তার হবে। এবার চলো বাড়ি। নিজের প্রতি তোমার এত অবহেলা আমার একদম পছন্দ নয়, মেয়ে। মনে রেখো, তুমি মানে কেবলই তুমি নও। তুমি মানে কখনো কখনো আমি। তাই তোমার যত্নের নামে তুমি একটু আমার যত্ন নিও।”

চিত্রা এই আকস্মিক প্রেম প্রস্তাবে হতবিহ্বল। অথচ বাহার বেপরোয়া। বেখেয়ালি কণ্ঠে গান ধরল,
“যদি তুমি ভালোবাসো
ভালো করে ভেবে এসো
খেলে ধরা কোনোখানে রবে না
আমি ছুঁয়ে দিলে পরে
অকালেই যাবে ঝরে
গলে যাবে যে বরফ গলে না

আমি গলা বেচে খাবো
কানের আশেপাশে রবো
ঠোঁটে ঠোঁটে রেখে কথা হবে না
কারো একদিন হবো
কারো এক রাত হব
এর বেশি কারো রুচি হবে না

আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবে না…”

#চলবে

প্রেমোত্তাপ পর্ব-২২+২৩

0

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২২।

আকাশে ক্ষণে ক্ষণে মেঘ জমছে। ফেব্রুয়ারি শুরু না হতেই এমন ঝড়ের তান্ডব দেখে মনুষ্যজাতি বিভ্রান্ত। পাখিরা ঘর ছেড়ে বেরুচ্ছে না, দামী দামী গাড়ি করে অফিস যাওয়া কর্মকর্তাদের ভীড়ও নেই পথেঘাটে। কেবল দেখা যাচ্ছে রিকশাচালকদের। ভিজে টইটম্বুর হয়ে থাকা শার্টের সাথে লেগে আছে তাদের ক্ষুধার্থ জীর্ণশীর্ণ দেহখানি। শরীর দেখলেই বোঝা যায়, অভাবের কাছে বৃষ্টির বাহানা নিছকই হাস্যকর। বৃষ্টি হোক কিংবা খড়া, পেটের দায়ে এই মানুষ গুলোকে বেরুতেই হবে বাহিরে। তাদের যে বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ নেই। তাদের পেট যে ক্ষুধার আহাজারি করতে ব্যস্ত।

চিত্রা তার পড়ার টেবিলে বসে পা ঝুলাচ্ছে। বাহার ভাই মনযোগ দিয়ে পড়তে বসতে বলেছে। পড়াশোনা না করলে বাহার ভাই রাগ করবে। সেই রাগের কথা ভেবেই এত তোড়জোড় করে পড়তে বসা। অথচ তার মন পড়ে আছে বাহিরে। আগে যেমন পড়তে বসলে বনফুলকে ডাকতে ডাকতে পাড়া মাথায় তুলতো, আজও সেই পুরোনো কাজটি করতে ইচ্ছে করছে। অথচ আজ মনে এক রাশ অস্বস্তি। কাজটি করলে বনফুল প্রতিত্তর যদি না করে! তাহলে? তাহলে সে তো ভীষণ লজ্জা পাবে। চিত্রার আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝে তার ঘরে আবির্ভাব ঘটে ছোট্টো চেরির। গুটি গুটি পায়ে সে তার বুবুর কাছে এসে দাঁড়ায়। মিষ্টি কণ্ঠে বলে,
“বুবু, তুমি পড়া ফাঁকি দিচ্ছ?”

চেরির আধো কণ্ঠে তার ধ্যান কাটে। চমকে পাশ ফিরে তাকাতেই বাচ্চাটার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী চোখে পড়ল। সে চেরির গালটা আলগোছে টেনে দিয়ে বলল,
“পড়া ফাঁকি কই দিচ্ছি?”

“এইযে তুমি পড়ার টেবিলে বসে পা দোলাচ্ছ আর কি যেন ভাবছো! অথচ সব করছো কিন্তু পড়ছো না।”

চেরির দুষ্টুমি ভোরা কণ্ঠে চিত্রা চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকাল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“ও বাবা! চেরিসোনা কি বুবুকে পাহারা দিচ্ছে? কে বলেছে তাকে এটা করতে, শুনি?”

“কেন, বাহার ভাই।”

চেরির উত্তর শুনে ভ্রু কুঁচকাল চিত্রা। অবাক স্বরে বলল,
“তুমি ওদের সঙ্গে আবার কথা বলতে গিয়েছিলে? তোমাকে না সবাই না করেছিল। ওদের সাথে যেন কথা না বলো।”

“কী করবো আমি, বুবু? বাহার ভাই এত আদর করে ডাকল, আমি রাগ করে থাকতেই পারলাম না। তার উপর সে লুকিয়ে আমার হাতে ইলিশ মাছও খেয়েছিল আমার রাগ ভাঙ্গাতে।”

“কী! কই আমরা তো জানিনা!”

“আরে, সে তো লুকিয়ে এসেছিল। তোমরা জানবে কীভাবে? বনফুল বুবু আমাকে কেমন কঠিন করে বলল— ‘চেরি তুমি যাও। সওদাগর বাড়ির বাতাস এলেই আমরা দরজা বন্ধ করে রাখি আর সেখানে তো ইলিশ মাছ বহু দূরের কথা।’ তারপর ওদের বাড়ির ঐ নোঙ্গর নামের আপুটা দরজা বন্ধ করে দিল। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম অথচ ওদের একটুও মায়া হলো না, জানো বুবু?”

চেরির চোখ আবারও স্মৃতিচারণে টইটুম্বুর হয়ে উঠল। চিত্রা বুঝল বাচ্চাটার কষ্ট, তাইতো আদুরে হাতে কাছে টেনে নিল তাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল স্নেহের। চেরি মিহি ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
“আমাদের আগের বোকা বোকা বনফুল বুবু-ই ভালো ছিল, বুবু। এই বনফুল বুবুকে মোটেও ভালো লাগে না।”

বাচ্চাটার এই সরল সোজা স্বীকারোক্তিতে চোখ ভোরে এলো চিত্রারও। এই গম্ভীর পরিবেশ এড়াতেই সে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
“বনফুল বুবু দেখবে এখনই আমাদের সাথে কথা বলবে। চলো, আমরা আগের মতন সন্ধ্যাবেলা যে কবিতা বলে হাঁক ছাড়তাম, আজ সেটা বলি। দেখবে, তোমার বনফুল বুবু ঘরে থাকতেই পারবে না।”

চিত্রার অপরিপক্ক বুদ্ধিটি পছন্দ হলো চেরিরও। সে হাত তালি দিয়ে উঠল খুশিতে। ঘাড় কাত করে সায় দিল। তারপর দুটো চঞ্চল প্রাণই ছুটে গেল বারান্দায়। বুকে অদম্য সাহস এবং আশা নিয়ে দু’জন আওড়াল বহু পুরোনো সেই ছড়াটি,

“ভুল, ভুল, ভুল জীবনের সবটুকুই ভুল,
তার মাঝে ঠিক, কেবল তুই বনফুল।”

বার কয়েক কবিতাটি আওড়াল। আগে যখন চিত্রা সন্ধ্যাবেলা এই কবিতা বলে হাঁক পারতো, বনফুল দ্রুত লজ্জা মুখে উপস্থিত হতো। লাজুক স্বরে “যাহ্ বাদর” বলতো। অথচ আজ! আজ বার তিনেক ডেকেও সাড়া পেল না। ভেঙে গেল চঞ্চল প্রাণের তুমুল আশা। বুকভার করে উঠলো দু’জনের। তবে চিত্রার ক্ষতটা হলো একটু বেশিই গাঢ়। বন্ধুত্বের অকাল মৃত্যুতে সে চরমভাবে শোকাহত হলো। ভেঙে পড়ল বাজে ভাবে। শেষে আশার বিন্দুও নিঃশেষ হয়ে গেলো। ছোট্টো চেরি হয়তে বড়ো বোনের এই ভেতর ভেঙেচুরে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝল। ছোটে হাতে জড়িয়ে ধরল বোনের হাতটি। স্বান্তনার স্বরে বলল,
“তুমি মন খারাপ করো না, বুবু। বনফুল বুবুই হয়তো ঘুমুচ্ছে। জেগে থাকলে ঠিক উত্তর দিত।”

ছোটো বোনের কোমল স্বরে যেন চিত্রার ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো। হাঁটু মুড়ে বসে জড়িয়ে ধরল বোনকেই। আমরা যখন ভীষণ ক্ষত পাই বুকের গভীরে, তখন এমন করেই আমরা মানুষকে আগলে ধরে একটু শান্তি চাই। চেরিও মন খারাপ করে বোনকে জড়িয়ে রাখল। ঠিক এর মাঝেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটল। পাশের বিল্ডিং থেকে বহু পরিচিত সেই কণ্ঠ ভেসে এলো,
“যাহ্, বাঁদর।”

যা হওয়ার কথা ছিল না তা আকস্মিক ঘটে যাওয়ায় চেরি আর চিত্রার সহসাই বোধগম্য হলো না সেটা। কিন্তু মস্তিষ্কের নিউরনে যখন ছড়িয়ে গেলো সেই ধ্বনি তখন তারা বুঝল আজ অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে গেছে। বন্ধুর গুটিয়ে নেওয়া হাত আবার মেলে ধরেছে। আহ্বানে সাড়া দিয়েছে বন্ধু। চিত্রা, চেরি দু’জনই বিস্ফোরিত নয়নে সামনের দোতালা বিল্ডিংটির দিকে চাইল। বনফুল দাঁড়িয়ে আছে। করুণ হাসি ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে। কেমন আধভাঙ্গা কণ্ঠে বলল,
“চলে যাচ্ছিলি নাকি? আর ধৈর্য নেই অপেক্ষার?”

চিত্রা কথা বলতে চাইল কিন্তু অতি আনন্দ যেন তার গলা চেপে বসে আছে, যার জন্য কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছিল না। কেবল চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল নোনা অশ্রুর বিন্দু গুলো। চেরি বোনকে উৎসাহ দিল,
“বুবু, তাড়াতাড়ি কথা বলো। পরে যদি বনফুল বুবুই চলে যায় রাগ করে? কথা বলো তাড়াতাড়ি।”

চেরির চোখেও অশ্রু টলমল করছে। চিত্রা তখনই কেঁদে দিল খুব অসহায়ের মতন। অভিযোগ করে বলল,
“আমি ভালো নেই, বনফুল। তুই ক্যান আমারে দূরত্ব দিয়েছিস? আমার কষ্ট হয় ভীষণ।”

বনফুল উত্তরে কিছু বলতে নিয়েও কেন যেন চুপ করে গেল। তার করুণ হাসি মিলিয়ে গেল কিসের এক গম্ভীরতায়! কর্কশ কণ্ঠে কেবল বলল,
“ভালো নেই কে বলেছে? আজকাল তোদের অনেক মানুষ হয়েছে!”

বনফুলের কঠিন কণ্ঠের তোপে ফিকে হয়ে এলো চিত্রা ও চেরির আনন্দ। হুট করে কি হলো মেয়েটার? এই তো ভালো ছিল! চিত্রা অবাক চোখে তার পাশের বারান্দায় তাকাতেই থমকে গেল। নিরু নামের মেয়েটি তুহিন ভাইজানের বারান্দা পরিষ্কার করছে। হয়তো বনফুল এটা দেখেই রেগে গেছে। চিত্রা আগ বাড়িয়ে কিছু বলার আগেই হনহন করে স্থান ত্যাগ করল বনফুল। চিত্রা কেবল অসহায় চোখে দেখল সেটা। তুহিন ভাইজান ও নিরুর উপর তার রাগের পাল্লা আরেকটু বাড়ল। সে দিক-বিদিক শুন্য হয়ে নিজের বারান্দার ফুলের টবটি ছুঁড়ে মারল সেখানে। তুমুল শব্দে টবটি ভেঙেচুরে গেল। এই ভয়ানক শব্দ শুনে চমকে উঠল নিরু। ঘর থেকে ছুটে এলো তুহিন ভাইজান। সেকেন্ডের মাথায় পরিবারের সকলে ভীড় করল তুহিনের বারান্দায়। নিরু নিষ্পলক তাকিয়ে রইল চিত্রার দিকে। ডান পায়ে তার খানিক চোটও লেগেছে। তুহিন বিস্মিত ভঙ্গিতে চারপাশে চাইল। বোনের রুদ্রমূর্তির দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি স্থির হলো। অবনী বেগম অবাক কণ্ঠে বললেন,
“কীভাবে ভাঙল এটা! নিরু? ব্যাথা পাওনি তো, মা?”

মেয়েটার চোখ-মুখ কোমল হয়ে এলো। মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
“না আন্টি, ব্যাথা পাইনি। টবটা একপাশে রাখতে গিয়ে পড়ে গেছে।”

“এটা তো চিত্রার ফুলের টব। তুহিনের বারান্দায় কী করে এলো?”

প্রশ্নটি করে থামল মুনিয়া বেগম। পাশ ফিরে লাগোয়া বারান্দায় চিত্রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার ভ্রূদ্বয় কুঞ্চিত হয়ে এলো। কপাল কুঁচকে বললেন,
“চিত্রা, চেরি কী করছিস? এখানে আয়।”

চিত্রার শক্ত মুখের আদল ততক্ষণে বদলে অনুশোচনায় পরিণত হয়েছে। রাগের বশে সে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে মেয়েটাকে আঘাত করেছে ঠিকই কিন্তু মেয়েটা কেমন তাকে বাঁচিয়ে দিল! অনুশোচনায় মাথা নত করে চিত্রা রুমে চলে গেল। শক্ত হাতে খিল দিল দরজায়। চেরিকেও বের করে দিল ঘর থেকে। তার আর বনফুলের মাঝে আজকে কোনো তফাত নেই। তারা নিজেদের ভালোবাসাকে এত বাড়াবাড়ি রকমের প্রাধান্য দিয়ে আশেপাশের সকল কিছুকে তুচ্ছ করে ফেলেছে। চিত্রার লজ্জায় মাথা নত হলো। আজ সে বড়ো বোকামি করে ফেলেছে। ভালোবাসা কি অন্ধ হতে শেখায়?

_

মধ্যরাতে তারা বিহীন আকাশের চাঁদ দেখতে মগ্ন চিত্রা। হুট করে খেয়াল করল বনফুল তার বাড়ি থেকে লুকিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। চালচলনে তার গোপনীয়তা। চিত্রারও সন্দিহান মস্তিষ্ক তার পিছু নিতে বলল। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। এই মধ্যরাতে নির্ভয়ে সে বন্ধুর পিছু ছুটলে। তোয়াক্কা করল না নিজের বিপদের কথা।

#চলবে…

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২৩.

রাতের রাস্তা বিদায় হওয়া শীতের কিঞ্চিৎ ঘন কুয়াশা আঁকড়ে ধরে কেমন শুনশান হয়ে আছে! ব্যস্ত শহরের বুক এখন একাকীত্ব জাপ্টে ধরে হাপিত্যেশ করছে। সেই একা শহরের সঙ্গী হলো কিছু সোডিয়ামের আলো। যারা অক্লান্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে নির্নিমেষ। সেই শুনশান রাস্তায় খুব দ্রুত পদচারণ করছে বনফুল। তার পেছনেই তাল মিলিয়ে হাঁটছে চিত্রা। সাবধানী পায়ে মেয়েটাকে লক্ষ্য রাখছে। বার বার মন কু ডাকছে। কোন কারণে বনফুল এত রাতে বেরিয়েছে তা খুঁজে পেল না চিত্রা। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় অনেকটা পথ এগিয়ে গেল তারা। এলাকা ছেড়ে অনেকটা দূর। ঠান্ডায় চিত্রার গা কেঁপে উঠছো বারংবার। ভেঙে যাওয়া হাতটাও ব্যাথা করছে অতিরিক্ত নড়াচড়ায়। গলা থেকে শুরু করে কান অব্দি তীক্ষ্ণ এক ব্যাথা ছড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো অতিরিক্ত ঠান্ডায় টনসিল বেড়ে যাচ্ছে। কিছুটা অসাবধান হতেই সে পথ হারিয়ে ফেলল। কোন রাস্তায় বনফুল গিয়েছে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। সামনে তিনটি বড়ো রাস্তা ও একটি ছোটো গলি গিয়েছে। বনফুল ঠিক কোন রাস্তায় চলে গেল মুহূর্তের মাঝে চিত্রা ধরতে পারল না। সেকেন্ড খানিক অবচেতন হতেই এমন একটা কাজ হয়ে গেলো। আফসোসে আফসোসে শির-উপশিরায় বিরক্ত ছড়িয়ে পড়ল। তবুও চিত্রা ব্যস্ত হলো। ছুটে গিয়ে ভালো করে প্রতিটা রাস্তা দেখল কিন্তু কোথাও বনফুলের টিকি টুকু খুজে পেল না। একটা ভোঁতা রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। পথের ছোটো পাথরের টুকরোতে সশব্দে এক লাথিও মারল। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল পথের কোণায়। ঠিক কতক্ষণ বসে রইল সেটা সঠিক ঠাহর করতে পারল না সে। তবে পা ঝিম মেরে আসতেই উঠে দাঁড়াল। রাত তখন প্রায় নিঃশেষের দিকে। ভোর হতে চলল। মনের মাঝে তীব্র ভয়, বনফুলের কিছু হয়ে যায়নি তো! সেই ভয়টুকু নিয়েই সে বাড়ির পথে রওনা হলো। খুব বেশি বোকামি করে ফেলেছে সে, বনফুলের পেছন পেছন না এসে তাদের বাড়ির লোকদের আগে খবর দেওয়া উচিত ছিল। মেয়েটার যদি কোনো বিপদ হয়! আরও অকল্যান ভাবনায় চিত্রার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। সে দ্রুতই ছুট লাগাল বাড়ির দিকে।

রাতের আকাশ তখন কুচকুচে আঁধার কাটিয়ে উঠতে শুরু করল। যেমন করে একটি জীবন ভয়ঙ্কর দুঃখ কাটিয়ে উঠে, ঠিক তেমন করে। ঘুটঘুটে অন্ধকার ভাবটি আর আকাশে নেই। হিমেল বাতাসের তীব্রতাও কিছুটা বেড়েছে। বাড়ির সামনে এসেই চিত্রা থমকে গেল। বাহার ভাইদের বাড়ি থেকে কিছু ভাঙার শব্দ ভেসে আসছে। পাওয়া যাচ্ছে বনফুলের মিহি চেঁচামেচির শব্দও। থমকে গেল চিত্রা। যে মেয়েটার আশায় সে পথের ধারে বসে রইল সে মেয়েটা বাড়িতেই! এটা কীভাবে সম্ভব? নিজের প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর পেল না সে। দিকভ্রান্ত হয়ে বাহার ভাইদের দরজার কাছে এসেই থেমে গেল সে। সংশয়ে আর দরজায় টোকা দেওয়া হলো না। অজানা প্রশ্ন গুলো অজানা রেখেই চিত্রা থেমে গেল। সামলে নিল নিজেকে। এমন সময় কারো বাড়ির ব্যাক্তি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। তবুও সে কাল একবার বাহার ভাই ও আন্টিকে সব জানাবে।

_

সকাল হতেই সওদাগর বাড়িতে তুমুল হৈ-চৈ। টেবিলে বসে এক মনে পড়ছিল অহি। অবশেষে সেই হৈ-হল্লাতে অতিষ্ঠ হয়ে সে উঠে গেলো বাহিরে।

ড্রয়িং রুম জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির প্রতিটি সদস্য। অবনী বেগমের গালে চড়ের চিহ্ন। চেরি রুমের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে জুবুথুবু বাচ্চাটি। অহি অবাক হলো। যদিও আগে বাড়ির কোনো চিৎকার চেঁচামেচিতে তাকে পাওয়া যেত না কিন্তু আজ সেই প্রচলিত প্রথা মিথ্যে করে দিয়ে সে কথা বলে উঠল৷ তাজ্জব কণ্ঠে বলল,
“কি করছেন?”

আমজাদ সওদাগর মেয়ের পানে চাইলেন। রুক্ষ চোখ জোড়া তার শিথিল হয়ে এলো প্রায়। একবার অবনী বেগম আরেকবার অহির পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন,
“কিছু না। তুমি ঘরে যাও।”

“কিছু না হলে নিশ্চয় এতো চেঁচামেচি হতো না। তাই বলুন কী করছেন! আপনি বাড়ি ভর্তি মানুষদের সামনে উনার গায়ে হাত তুলছেন? যেখানে আপনার ছয় বর্ষীয়া মেয়েটিও অবস্থানরত আছে। আপনি এমন বিবেকহীন হয়ে গেলেন কীভাবে?”

মেয়ের কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন আমজাদ সওদাগর। থতমত খেলো অবনী বেগমসহ উপস্থিত সকলে। অবশেষে আমজাদ সওদাগর রাশভারি কণ্ঠে বললেন,
“যার যেটা প্রাপ্য, তাকে সেটা দিতেই হবে।”

“আপনিও তো অনেককিছু প্রাপ্য, কেউ তো সেটা আপনাকে দেয়নি।”

“অহি!”

“চিৎকার করবেন না। আপনার চিৎকারে আমি ভয় পাই না, সেটা নিশ্চয় জানেন?”

আফজাল সওদাগর এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে ডেকে উঠলেন। ভাইকে ধমক দিয়ে বললেন,
“আমজাদ, চিৎকার করিস না। মেয়েটা তো তোদের এসবের জন্যই এত পাথর হয়ে গেছে।”

“ভাইজান, আপনি বলে দেন ওদের, অহিকে ওরা নিতে চাচ্ছে আর অহি ওদের সাথেই যাবে। আর কোনো কথা হবে না। আর কেউ একটা কথা বললে তার দুর্গতি আছে।”

শেষের কথাটা আমজাদ সওদাগর তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়েই বলল। আজ চুপ নেই অবনী বেগমও। সেও তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিল,
“তুমি কী দুর্গতি দেখাবে আমিও দেখবো। কিন্তু আমার মেয়েকে আমি কারো কাছেই দিব না। ও আমার সন্তান। ওর ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বও আমার। তুমি বললেও আমি সিদ্ধান্ত নিব, না বললেও আমি নিব।”

অবনী বেগমের এই রণমুর্তি অচেনা সকলের। আমজাদ সওদাগরও হতবিহ্বল হলো। তবে প্রশান্তির হাসি অহির ঠোঁটের কোণে। বেশ শান্ত স্বরে অবনী বেগমের উদ্দেশ্যে সে বলল,
“আপনার এই দিনটি দেখার জন্যই আমি এত কাল অপেক্ষা করেছিলাম। যদি আরো আগ থেকে নিজের সংসারে হালটা শক্ত হাতে ধরতেন তাহলে আপনার জীবন আরো সুন্দর কাটতো।”

অহি নিজের কথা শেষ করেই আবার নিজের রুমে চলে গেল। ড্রয়িং রুমের আলোচনাও স্থগিত হলো সেখানে।

_

সাভারের মোর ঘেষে যাওয়া রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা। আজ সে কলেজে গিয়েছিল এডমিট কার্ড আনতে। উত্তপ্ত রোদে বাজে অবস্থা মেয়েটির। ঘামে ভিজে চুপচুপে তার শরীর। অসহ্য রকমের বিরক্ত নিয়ে নাক মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে সে অথচ আশেপাশে দেখা নেই রিক্সার। মাথায় উত্তপ্ত রোদ্দুর নিয়ে যখন তার নাজেহাল অবস্থা সেই মুহূর্তে চোখে পড়লো অপ্রত্যাশিত একটি দৃশ্য। পরিচিত দুটি মুখ রিকশায় বসে তার সামনে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। চিত্রার মনে হল যেন কেউ তার হৃদয়ের একটি অংশ টেনে হিঁচড়ে ছিড়ে ফেলছে। আর যাই হোক বাহার ভাইকে সে এই অপরিচিত মেয়েটার সাথে সহ্য করতে পারে না। অথচ সেই দৃশ্যই তাকে দেখতে হয়। বেখেয়ালি বাহার ভাই কেমন করে যেন ওই মেয়েটার খেয়াল হয়ে উঠেছে, ভবঘুরে বাহার ভাই কেমন যেন মেয়েটার মাঝে নির্দিষ্ট একটি গন্তব্য স্থাপন করে ফেলেছে যা চিত্রাকে ভালো থাকতে দেয় না। অসহ্য রকমের এক বুক ব্যথা চিত্রা হাপিত্যেশ করে উঠে। মনে হয় তার সবকিছু ধ্বংস করে দিতে। অসহায় দৃষ্টিতে তার হাতের শপিং ব্যাগটির দিকে তাকায় সে। এই তো কিছুক্ষণ আগেও একটি পাঞ্জাবী পছন্দ হওয়াতে বাহার ভাইয়ের জন্য সেটা কিনে ফেলেছে। কখনো লোকটিকে পাঞ্জাবিতে সে দেখেনি তাইতো একটু দেখতে পাওয়ার কি তৃষ্ণা! অথচ এমন একটি দৃশ্য দেখলো যা চিত্রার সকল মুগ্ধতা মুহূর্তেই নষ্ট করে দিল।

অতি দুঃখে পাঞ্জাবিটি পথের ধারে ছুড়ে মারলো। অতিরিক্ত ভালোবাসা যেন এভাবে অবহেলায় থিতিয়ে আসে।

_

আকাশের বুকে তখন বিষন্ন সন্ধ্যার আগমন। চারপাশে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে নীড়ে। ক্লান্ত কৃষাণ ফিরে যাচ্ছে তার গৃহে। ব্যস্ততারও হয়েছে ছুটি। রিক্সার সিটে বসা কপোত-কপোতীরা ফিরে যাচ্ছে যার যার গন্তব্যে। এ যেন এক বিচ্ছেদের সন্ধ্যা।

বিল্ডিং-এ, এলাকায় বিদ্যুৎ নেই দেখে প্রায় সকলেই রাস্তায় বেরিয়েছে। আবাসিক এলাকা দেখে এখানে তেমন কোন যানবাহনের চলাচল নেই। কেবল যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তাদের গাড়িই এলাকায় প্রবেশ করে। বিভিন্ন বাড়ির সামনেই খোলা জায়গা আছে। সেখানে কোথাও মহিলাদের আড্ডা চলছে, কোথাও বা বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি করছে পুরুষ সমাজ। টিনেজার মেয়েগুলো কোথাও রং মিশিয়ে একসাথে বসে খোঁশগল্পে মেতে উঠেছে, কোথাও বা অনেকে ভার্চুয়াল জগতে ডুব মেরেছে। ছেলেগুলো পথে হাঁটছে, কখনো বা বিভিন্ন খেলায় মত্ত হচ্ছে। চারপাশে আড্ডার শোরগোল। এই যেন এক অনন্য পরিবেশ, এইযেন এক সুখের আবহাওয়া। এক মুঠো রাত যেন আঁধারের খামে আনন্দ নিয়ে এসেছে।

সওদাগর বাড়িতে আড্ডার জন্য এসেছেন মৃন্ময়দের বাড়ির সকলে। শাহাদাত, শাহাদাতের নতুন বউ, মৃন্ময়ও এসেছে। বাড়ির সামনে খালি দিকটায় বিশাল আড্ডার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হইচই চারপাশ জুড়ে। কখনো-বা দারুন কথায় সকলে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে কখনো বা ভাবুক সুরে অন্যের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছে। অহি আর চেরি সেখানে বসেই নিজেদের মনমতন গল্প-স্বল্প করছে। তার কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। দৃষ্টি তার আকাশে নিবদ্ধ। বেশ অনেকক্ষণ, একটানা তার দাঁড়িয়ে থাকা। চাঁদনী চোখ বন্ধরত অবস্থায় অনুভব করল তার পাশে এসে কেউ দাঁড়িয়েছে খুব নিরবে, নিভৃতে। চাঁদনী নিষ্প্রাণ হাসলো, ক্ষীণ স্বরে বলল,
“কেমন আছো, মৃন্ময়? আজকাল ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’ গানটা যে গাও না? পড়শিকে বুঝি আজকাল মনে পড়ে না?”

মৃন্ময় চমকালো, ভীষণ অবাক হল। বিস্মিত কন্ঠে শুধালো, “ইন্দুবালা, আপনি আমার সাথে কথা বলছেন নিজে!”

মৃন্ময়ের চোখে-মুখে আনন্দ ছড়িয়ে গেলো স্রোতের বেগে। এই আনন্দ যেন বহু আকাঙ্খিত কিন্তু অপ্রত্যাশিত।

“কথা বলা উচিত নয় বুঝি?”

“সরি, ইন্দুবালা। আমি আপনার এত বড়ো ক্ষতির কারণ হতে চাইনি।”

“সরি বলো না, মৃন্ময়। আমার তোমার উপর আর কোনো রাগ নেই। এই পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস আছে যা আমরা না চাইতেও করে ফেলি বা প্রাকৃতিক ভাবে হয়ে যায়। এতে কারো দোষ থাকে না।”

“তাহলে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন যে?”

“নিজেকে সময় দিয়েছিলাম। মুখ ফিরিয়ে রাখিনি। তোমার চোখে এইসব যতটা হালকা এবং রঙিন আমার চোখে এটাই ততটা কঠিন এবং ফ্যাকাসে। তোমার চোখের প্রিয়— ফ্যান্টাসি। অথচ আমি আটপৌরে। নিজের পছন্দ, ভালোলাগাকে ভালোবাসার সাথে গুলিয়ে ফেলো না, মৃন্ময়।”

মৃন্ময় চুপ করে রইল। তার সামনের নারীটির দিকে আজও তার মুগ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ। অথচ মানুষটার জীবনে বড়ো ক্ষতির কারণও সে।

সকলে যখন আড্ডায় মশগুল, তখন খুব লুকিয়ে বাড়ির গেইটের বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছে চিত্রা। এত মানুষের মাঝে নিজেকে কেমন যেন লাগছিল। অস্বস্তিতে চারপাশ ভোরে উঠেছিল। তাই শান্তির খুঁজেই বাহিরে আসা। চিত্রার চোখ অনির্দিষ্ট পথের বাঁকে আটকে। আঁধারের মাঝেও তার মেয়েলি সুন্দর নারী স্বত্তাটি জ্বলজ্বল করে উঠছে। মোহভরা দু’টি চোখে যেন কত আহাজারির নামতা গুনতে ব্যস্ত। রঙচটা বাড়িটির দিকে হুট করে তাকাতেই দেখল বাহার বাড়িটি দেখে বেরিয়ে আসছে। হাতে সিগারেটের ছোট্টো জ্বলজ্বল আলো নিখুঁত দেখা যাচ্ছে। বাহারকে দেখতেই দুপুরের দৃশ্য মনে পড়ে গেল তার। মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে নিল সে। মনস্থির করল বাড়ির ভেতর যাওয়ার। তার আগেই বাহারের ডাক ভেসে এলো,
“আজকাল নিয়ম বদলেছে নাকি, রঙ্গনা? ছুঁতে চাওয়া মানুষটাকে ফিরে দেখারও প্রয়োজন বোধ করছো না যে, মেয়ে?”

চিত্রা সরু চোখে তাকাল। নয়নে নয়ন মিলল প্রেমোতৃষ্ণার অঘোষিত দম্পতির। রঙ্গনার চোখে অভিযোগের মৌন ভাষাদের বুঝে নিল যেন প্রেমিক। হাসল তাই কিঞ্চিৎ,
“অভিযোগের ভাষারা এত তীক্ষ্ণ কেন? তবে কী অপরাধটি ভয়ঙ্কর করে ফেলেছি নাকি?”

“না, বাহার ভাই। কোনো অভিযোগ তো নেই।”

সদ্য উঁকি দেওয়া অংশুমালীর মিষ্টি আলো চুম্বন খেয়ে যায় গোলগাল চিত্রার মুখাবয়বে। তা দেখে শক্ত প্রেমিকের বুকেও উঠে ঝড়। সে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। এই দৃষ্টি লজ্জায় ফেলে পুতুলের ন্যায় প্রেমিকাকে। সে মিনমিন করে বলে,
“তাকিয়ে আছেন কেন?”

“এত জ্বালাচ্ছ বলে। এত জ্বালিয়ো না আমায়। পুড়ে যাচ্ছি তো, মেয়ে!”

চিত্রা অবাক হলো, “কোথায় জ্বালাচ্ছি?”

“এই যে জ্যোৎস্না এসে আলিঙ্গন করছে তোমায়। রূপে ঢালছে মুগ্ধতা। আমি কী তা দেখে নিজেকে বেখেয়ালি রাখতে পারি, মেয়ে? আমারও তো লোভ হয়, মিঠে আলিঙ্গনের। তবে কী আর করার? জ্যোৎস্নার মতন যে আমার সাধ্য নেই। অত মূল্যবান শরীরটাকে কী এই দেহ ছুঁতে পারবে বলো? কখনো না। চাঁদকে ছোঁয়ার সাধ্য যে আমার নেই, রঙ্গনা। তাই দূর হতেই তোমায় দেখে যাই। যেদিন বেকারত্বের আকাশে সাফল্যের চন্দ্র মুখ তুলে চাইবে, সেদিন জোছনা হয়ে আমি ঝড়বো। ততদিন অব্দি দূর আকাশের চাঁদ আমার হয়ে থাকবে তো, মেয়ে?”

চিত্রা জবাব দেওয়ার আগেই বাহার হাঁটা শুরু করল, কণ্ঠে তার নিপুণ গান,
“বন্ধুর প্রেমও জ্বালায় অঙ্গ জ্বলে,
জ্বালা, কি দিয়া নিভাই…..

#চলবে…..?

প্রেমোত্তাপ পর্ব-২০+২১

0

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২০.

ধরায় তখন প্রহর চলছে অপরাহ্নের সমাপ্তির প্রহর। ব্যস্ত শহরে ঝুপ করে নেমে এসেছে ক্লান্তি। কেউ রিকশার টুংটাং শব্দে খুঁজে নিচ্ছে অবকাশের ভাবনা। আঁধার আকাশে আধো আধো কুয়াশারা হামাগুড়ি দিচ্ছে। হিমেল সমীর জনজীবনে দিয়েছে প্রশান্তি। কেবল শান্তি নেই চিত্রার দেহে, মনে। কেবিনের এক কোণায় বসে সে এই অশান্তির জীবনের হিসেব মেলাচ্ছে। মেলাতে মেলাতে ফলাফল বের হলো, অদ্ভুত জীবন, অচেনা দুঃখ। চিত্রার চোখের কার্নিশ ঘেঁষে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। চোখের পাতায় ভেসে উঠল সেই অপ্রত্যাশিত, নিষ্ঠুর, অপ্রিয় দৃশ্যটি। বাহার ভাই কারো ভরসার কাঁধ হয়েছে, এটা চিত্রা মানতে পারছে না। অবশ্য মানতে না পারারই কথা। যে মানুষ সর্বদা ছিল ছন্নছাড়া, বেখেয়ালি— সে মানুষ হুট করে কারো খেয়াল রাখার কারণ হয়ে যাবে সেটা চিত্রা কীভাবেই বা মানবে? উন্মাদ হলো সে, দ্রুত গতিতে মায়ের ফোন থেকে কল লাগাল কাঙ্খিত সেই নাম্বারটিতে। রিং হলো, চিত্রা তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় ছটফট করতে লাগল। তার তৃষ্ণাকে চির যৌবনা রেখে অপর পাশের মানুষটি ফোন রিসিভ করল না। অবহেলায় মূর্ছা গেলো ফুলের ন্যায় চিত্রা। চোখ তার ঘোলাটে হয়ে এলো। দৃষ্টি এলোমেলো। চারপাশে হাতড়ে একটি ভরসার কাঁধ খুঁজল কিন্তু পেল না। পাবেই বা কীভাবে? তার ভরসার কাঁধ আজ অন্যের আশ্রয় হয়েছে যে! এই চরম সত্যি মানতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটি। চোখের সামনে বখাটে, ভবঘুরে এক পাগলাটে পুরুষের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠল। যাকে ভালোবেসে অষ্টাদশী বিনা লাভে কষ্ট ধার করেছে।

_

একটি সুন্দর সকাল। চোখে-মুখে নতুন উদ্যম নিয়ে তার আগমন। তার আগমনে নাচছে মেঘ। প্রকৃতি আনন্দঘন। সওদাগর বাড়িতেও আনন্দ উপচে পড়ছে। আজ বাড়ির চঞ্চল প্রাণ বাড়িতেই ফিরে আসবে। অবনী বেগম ব্যস্ত হাতে রান্নাঘর সামলাচ্ছেন। তার সাথে সাহায্য করছেন রোজা সওদাগর। ব্যস্ত রান্নাঘরে হুট করে আগমন ঘটল ছোট্টো চেরির। এসেই মায়ের আঁচল টানল, শুধাল,
“কী রাঁধো, আম্মু?”

অবনী বেগমের ব্যস্ত হাত থামল না। কাজ করতে করতে মেয়ের উত্তর দিলেন,
“ইলিশ মাছ রান্না করছি, সোনা। তোমার চিত্রা আপা’র না অনেক পছন্দ? তাই।”

“চিত্রা আপা কী আজ আসবে, আম্মু? কতদিন আপার সাথে খেলি না। আপা না থাকলে মোটেও ভালো লাগেনা, আম্মু।”

অবনী বেগম এবার ব্যস্ত হাত থামালেন, মেয়ের দিকে চাইলেন স্নেহের দৃষ্টিতে। আর কেউ না জানুক, সে-তো জানে, তার মেয়েটা চিত্রা আপা বলতে পাগল। মায়ের বুকের স্নেহ ঢেলে দিল মিষ্টি চেরির পানে চেয়ে। কপালে আদর মাখা মিষ্টি চুমু এঁকে মেয়ের গাল টানলেন,
“তোমার ভালো লাগে না বলেই তো আপা চলে আসছে। আর মন খারাপ করে রেখ না। কেমন?”

চেরি গাল ভোরে হাসল। গোলগাল স্থুল আকার চেহারাটির ডাগর ডাগর অক্ষি যুগল হাসির দাপটে পিটপিট করল। সেই পিটপিট নেত্র মেলে সে বড়ো আম্মুর দিকে চাইল। বড়ো আম্মুকে কাজে ব্যস্ত দেখতেই সাবধানী ভঙ্গিতে মায়ের আঁচল টেনে নত হওয়ার ইশারা করল সে। মেয়ের সাবধানী হাবভাব এড়ায় না মায়ের দৃষ্টি। তাই সেও সাথে সাথে মাথা নামায়। শুধায়,
“সিক্রেট কিছু বলবে?”

চেরি সম্মতিতে মাথা নাড়ে উপর-নীচ। প্রায় ফিসফিস করে বলে,
“আম্মু, তরকারিতে ইলিশ মাছের দু’টো টুকরো বেশি দিও। বাহার ভাই আর বনফুল বুবুও তো ইলিশ মাছ অনেক পছন্দ করে।”

মেয়ের কথায় তাজ্জব বনে যায় অবনী বেগম। ও বাড়ির মানুষ গুলোর সাথে তাদের আজকাল দেখা সাক্ষাৎ নেই বললেই চলে। না আছে সম্পর্ক। তবুও বাচ্চা মেয়েটা ভালোবাসা ভুলেনি। অথচ বড়োরা অনায়াসে তা ভুলে ভালো আছে!

“দিবে তো, আম্মু? দিও প্লিজ। আর না থাকলে, আমারটা দিয়ে দিব। তুমি কাউকে বলো না কেমন?”

অবনী বেগমের চোখ ঝাপসা হয় মেয়ের এমন মায়া ভোরা বায়নায়। সে ঝাপসা চোখে মেয়েকে আদর দিতে দিতে বলে,
“ওদের জন্য দু’টো টুকরো বাড়িয়ে দিব। তুমি চিন্তা করো না।”

মায়ের আশ্বাসে আনন্দ হারা হয় চেরি। ছুটে যায় রান্নাঘর ছেড়ে। মনে মনে ফন্দি আঁটে বাহার ভাইদের বাড়ি যাওয়ার। এখন একবার গিয়ে বুবুকে বলে আসবে যেন দুপুরে ভাত তাড়াতাড়ি না খায়। চেরি মাছ নিয়ে আসবে।

সকাল হতেই চিত্রা হাঁসফাঁস শুরু করে। সে আর হসপিটাল থাকবে না। কোনো ভাবেই না। তাকে বাড়ি নিয়ে গেলেই সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। মেয়ের নাছোড়বান্দা আবদারে মুনিয়া বেগম হার মানেন। সকাল সকালই তাকে ছেড়ে দেওয়ার আর্জি পেশ করেন ডাক্তারদের কাছে। তুহিন মা’কে আগেই পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে। চাঁদনী ও অহি চিত্রাকে নিয়ে আসতে যায়।

চিত্রার চঞ্চল চিত্ত। বাড়ি আসলে সে সুস্থ হয়ে যাবে এই কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। ঠিক কথা হলো— বাড়ির পাশে বসবাসকারী প্রেমিকের সান্নিধ্যে থাকলে সে সুস্থ হবে। ছন্নছাড়া বাহার ভাইয়ের গিটারের শব্দ শুনলে সে সুস্থ হবে। সে সুস্থ হবে আধ্যাত্মিক এক ওষুধের মাধ্যমে। যে ওষুধের কথা কেউ জানেনা, কেবল রোগ জানে আর রোগী জানে।

চিত্রাদের গাড়ি শব্দ তুলে সওদাগর বাড়ির সামনে এসে থামল। খানিক জার্নিতেই মেয়েটার শরীর ক্লান্ত। তুহিন দ্রুত গাড়ি ছেড়ে বের হলো। বোনের নিকট বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত। চিত্রা এক পলক সেই হাতের দিকে চাইল, নির্লিপ্ত দৃষ্টি জোড়া সরিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আমি পারব।”

তুহিনের আশা ভরা হাতটা অগোচরে নিজেকে গুটিয়ে নিল। চাঁদনী ভাই-বোনের এই মান-অভিমানের পালা দেখে হতাশার শ্বাস ফেলল খুব গোপনে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই কিছুটা মিছে ধমক দিয়ে বলল,
“কী তুই পারবি হ্যাঁ? শরীর যা দুর্বল হয়ে আছে, নড়তেই তো পারিস না ভালো করে। আয়, আমার হাত ধর দেখি, আমি ধরছি।”

চিত্রা বাক্যব্যয় না করেই নিরবে চাঁদনীর হাতটি ধরল। তুহিন হতাশার শ্বাস ফেলল। চিত্রা গাড়ি থেকে নামতেই তার দৃষ্টি গেল একতলা বিশিষ্ট রঙ চটা দালানটির দিকে। যেই দালানের আধ-খষা ছাঁদের কোণে বসে ঝিমুচ্ছে শালিক। কয়েকটি মেটে রঙের নিত্য পরিহিত জামাকাপড় উড়ছে ছাঁদের কার্ণিশে। চিত্রা তীর্থের কাকের ন্যায় তাকিয়ে রইল মিনিট দুই। হয়তে পরিচিত মানুষটাকে দেখতে পাওয়ার লোভে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। গাঢ় বিষাদ এসে জমল তার বুকে। কিন্তু হুট করেই সকলের দৃষ্টি আটকে গেল সেই রঙচটা বাড়ির মেইন গেইটের সামনে। একটি ক্রন্দনরত বাচ্চার নিষ্পাপ মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হতেই সকলের মন মুহূর্তেই হাপিত্যেশ করে উঠল। চিত্রা তো এই অসুস্থ, ব্যাথা যুক্ত শরীরটা নিয়ে ছুটে গেল নিষ্পাপ বাচ্চাটির দিকে। স্নেহের হাতে আগলে নিল মুহুর্তে। চিত্রার পেছনে পেছনে চাঁদনী, অহি এবং তুহিনও উপস্থিত হলো। চেরির মুখমন্ডল লাল হয়ে এসেছে, ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে বাচ্চাটা। চিত্রা উত্তেজিত হলো, চঞ্চল কণ্ঠে শুধাল,
“কী হয়েছে আমার চেরি সোনার? কাঁদছে কেন আমাদের প্রিন্সেস?”

চেরির কান্নার স্রোত উত্তাল হলো। ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
“আ আপা, বুবু ভালো না। বনফুল বুবু পচা হয়ে গিয়েছে। সে মোটেও ভালো না।”

সকলের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। চিত্রা আহত চোখে চাইল বন্ধ দরজার দিকে। মনের মাঝে মানতে না চাওয়ার এক ঝড় উথাল-পাতাল ধ্বংস তুলল। বনফুল নামক মিষ্টি মেয়েটা এমন পাষাণ হয়ে গিয়েছে, তা সে মানতে পারল না।

অহি নিজের ছোটো বোনকে বুকে চেপে ধরল। দাঁত কিড়মিড় করে জিজ্ঞেস করল,
“কী করেছে বনফুল তোমার সাথে?”

চেরির ঠোঁট ভেঙে কান্নারা ততক্ষণে আরও প্রসস্থ হলো। তারা জানল না বনফুলের দোষ কি ছিলো। ততক্ষণে সওদাগর বাড়ির ভেতর পৌছে গেল এই সংবাদ। তাদের সামনের বাড়ির মানুষ গুলোর প্রতি এবার রাগ প্রগাঢ় হলো তাদের।

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২০ এর প্রেম বিশেষ পর্ব:

চঞ্চল দিবসের মেঘ স্থির হয়ে গগন বক্ষে বিরাজমান আছে। মুগ্ধ বিকেলের ভ্যাপসা গরমে শহুরে মানুষ অতিষ্ঠ। এবার তেমন শীত পড়েনি। জানুয়ারি শুরু হতে হতেই শীত প্রায় পোটলা-পুটলি নিয়ে বিদায় নিয়েছে সন্ন্যাসী বেশে। রাত হলে একটু ঠান্ডা আবহাওয়া থাকলেও সূর্য উঠতে উঠতে তা হারিয়ে যায় কোন গহীনে। চাঁদনী বসে আছে তার বারান্দায়। ভিসার ঝামেলা কিছুটা মিটমাট করে এসে বসেছে। খুব শীগ্রই তার পাসপোর্ট চলে আসবে, তারপর সে পাড়ি দিবে চেনা মানুষ, চেনা শহর, চেনা অবহেলা-অবজ্ঞার ভীড় ঠেলে। যেখানে গেলে আর কেউ তার মন ভাঙার জন্য থাকবে না, ভালোবেসে ব্যাথা দেওয়ার জন্য থাকবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। একটি হাসতে-খেলতে থাকা জীবন নষ্ট করার জন্য একটি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতাই হয়তো যথেষ্ট!

“তুই তো চলে যাবি বিদেশ। শান্তিতে থাকবি। আমি তো তোকে অনেক যন্ত্রণা দিতাম। ভালো থাকবি এবার, তাই না?”

মায়ের কণ্ঠ পেতেই চাঁদনীর ধ্যান ভাঙল। তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে চাইল। রোজা সওদাগর কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার দরজায়। পড়নে তার বেগুনি রঙের একটি সুতি শাড়ি। পুরোনো হয়েছে বলে রঙটা আর ঝলমল করছে না। কিছুটা মেটে হয়ে আছে। স্বর্ণের মোটা চেইন গলায়, কানেও শোভা পাচ্ছে ভারী স্বর্ণ। চালচলনে পুরো রাজকীয় হাবভাব। মায়ের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল চাঁদনী। রোজা সওদাগর কফির মগ এগিয়ে দিলেন মেয়ের দিকে, কোমল কণ্ঠে বললেন,
“যাকে ভালোবাসতিস, সে কে ছিল?”

চাঁদনী কফির জন্য হাত এগিয়ে দিয়ে থম মেরে গেল মায়ের প্রশ্নে। হৃদপিণ্ডের গতি কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক হলো বোধহয়। তবুও সামলে নিল নিজেকে। ঝাপসা হয়ে আসা প্রেমিককে স্মৃতির পাতা থেকে সরানোর চেষ্টা করে উত্তর দিল,
“ছিল কেউ একজন, এখন তো আর নেই। যে নেই, তার কথা জেনে কোনো লাভ কী আছে, আম্মু?”

“লাভ-লোকসানের তুই কী বুঝবি? বুঝলে এভাবে নিজের পায়ে কুড়াল মারতিস না। তুই কীভাবে এমন একটা কাজ করলি? একটা ছেলেকে এত বছর ভালোবাসলি অথচ জানালি না। এখন আবার শুনি ছেলেটার সাথে সম্পর্ক নেই। সেই শোকে বিদেশ চলে যাবি। একটা বার মা-বাপের কথা কী ভাবার প্রয়োজন মনে করিসনি!”

চাঁদনীর মাথা নত। ধোঁয়া উঠা কফির মগ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। রোজা সওদাগর আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে হতাশার শ্বাস ফেললেন। ক্ষীণ স্বরে যেন গোপন আর্জি পেশ করলেন,
“বিদেশ যাওয়ার কী দরকার? বয়স তো হয়েছে, বিয়ে-থা করে নিলে কী হয়?”

চাঁদনী এবার পলক ঝাপটিয়ে মায়ের পানে চাইল। অন্তরে তার বসে আসা ক্ষতটায় আবার নতুন করে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কণ্ঠে অসহায়ত্ব,
“মা, বিয়েই জীবনের সব নয়। বিয়ে ছাড়াও মানুষ বাঁচে।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোর কাছে তো অন্য একটি ছেলে বড়ো। বাপ মা’র তো কোনো দাম নাই। একটা আইবুড়ো মেয়ে বাপ-মায়ের ঘাড়ে বসে থেকে বাপ-মা’র সুখ খাচ্ছে, বিয়ে করতে তার ভাল্লাগে না। সমাজও তো এ কথা শুনলে ছি, ছি করবে। আবার কয়দিন আগে কোন আন্ধারে এক ছেলের সাথে ধরা পড়ছিলি। কলঙ্ক কইরা রাখলি আমার গর্ভটারে। তোর মতন সন্তানের মুখে আগুন দিই।”

চাঁদনীর হাতে থাকা অতি সুন্দর সিরামিকের কফি মগটি বেশ শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেল। ভেঙে হলো কয়েক টুকরো। কিছু সেকেন্ড আগেও যে মগটা অতি সৌন্দর্যতা প্রকাশ করছিল, কিছু সময়ের পরিবর্তে সে এখন সকল সৌন্দর্যতা হারিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই ভাঙা কফি মগের সাথে চাঁদনী যেন নিজের মনের দারুণ এক মিল পেল। দু’টো সুন্দর জিনিসই অন্যের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত আজ। অস্ফুটস্বরে চাঁদনী চেঁচাল,
“মা!”

রোজা সওদাগর ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে প্রস্থান নিলেন জায়গাটি ছেড়ে। একবার গাঢ় চোখে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টাও করলেন না যে তার মেয়ের নরম আত্মাটি ভয়ঙ্কর ভাবে আজ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। চাঁদনী নিজের ডান চোখের কোণ ঘেঁষে আসা টলমল করা অযাচিত অশ্রুটি ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলের সাহায্যে মুছে নিল। ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে চোখের মনি ঘুরাতেই পাশের বিল্ডিং এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা ভীষণ মুগ্ধ করা ছেলেটির তাজ্জব মুখমন্ডলে তার নজর পড়ল। চাঁদনী থমকে গেল সাথে সাথে। মৃন্ময় সবটা ঘটনাই যে দেখেছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। মৃন্ময় হতভম্ব কণ্ঠে ডাক দিল,
“ইন্দুবালা……”

অথচ চাঁদনী কথা বলার সুযোগ দিল না তাকে। ঝড়ের বেগে চলে গেল বারান্দা ছেড়ে। একটি ছেলেতে তার আর মুগ্ধ হওয়ার কোনো কারণ অবশিষ্ট নেই। ছেলেটি যে তার জীবন দূর্বিষহ করে দিয়েছে !

_

চিত্রার শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বেড়েছে। সন্ধ্যার আকাশ তখন বিদায় ধ্বনিতে মুখরিত। বাসায় বিদ্যুৎ নেই। কেবল বাসায় বললে ভুল হবে, পুরো এলাকাতেই ইলেক্ট্রিসিটি নেই। জেনারেটরও আজকাল খুব বিরক্ত করছে। সন্ধ্যাবেলায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় পুরো মহল্লা জুড়ে যেন ঝুপ করে নির্মল অন্ধকার নেমে এলো। তবে এই নির্মল আঁধার তেমন অসুন্দর নয়। পাখিদেরর নীড়ে ফেরার আনন্দ মেশানো আকাশটি অসুন্দর হতেই পারে না। চিত্রা এই অসুন্দর আকাশটি আজ মুগ্ধ চোখে দেখছে না। শরীর, মন খারাপ থাকলে পৃথিবীর সকল মুগ্ধতাও কেমন বিরক্তিকর ঠেকে!

চিত্রার ভারী পল্লব বিশিষ্ট চোখের পাতাটি বন্ধ। চোখ জুড়ে আবছা আবছা ঘুমু-ঘুমু ভাব। তবে মস্তিষ্ক কিঞ্চিৎ জাগ্রত। আর সেই জাগ্রত মস্তিষ্ক হুট করে চিত্রার জন্য আনন্দ বার্তা আনল। প্রেমের অদৃশ্য রথ নিয়ে এলো। তার জাগ্রত কর্ণে গিটারের মিহি সুর পৌঁছালো। বাহার ভাই বহুদিন পর গিটার বাজাচ্ছেন বোধহয়। চিত্রার মন পুলকিত করা গিটারের সুরটা বড়োই মোহনীয় ঠেকল। যেই মোহ শুয়ে থাকতে দিল না চিত্রাকে। মেয়েটা ঘোরগ্রস্তের মতন উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। এই অন্ধকারে আবৃত পৃথিবীতে প্রেমিকের ছায়া কেমন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন জ্বলজ্বল করছে!

চিত্রার ধ্যানমগ্ন মস্তিষ্ক পুরোটাই বাহারের উপর নিবদ্ধ। তার অক্ষি যুগলে বোধহয় বহু বছরের তৃষ্ণা। প্রেমিককে দেখতে চাওয়ার তৃষ্ণা বোধহয় পৃথিবীর সকল তৃষ্ণাকে হার মানায়। বাহারের আধাঁর শরীরটা আজ চিত্রাদের বারান্দার দিকেই ঘুরে দাঁড়ানো। মানুষটা এখানে কখনোই দাঁড়ায় না, তবে আজ কেন? চিত্রার উত্তর বিহীন প্রশ্ন কতক্ষণ উত্তরের আশায় আহাজারি করে নেতিয়ে গেলে। কানে ভেসে এলো মুগ্ধ করা কণ্ঠের গানের খানিক অংশ,
“যদি দেখার ইচ্ছে হয়,
তোমার নিঠুর মনে লয়,
কালিন্দীরও ঘাটে আইসো দুপুরের সময়।
আমি জল ভরিবার ছল করিয়া
দেখবো নয়ন ভরিয়া…
দেইখো আসিয়া।”

গিটার বাজছে। চিত্রা যেন গানের সুরে লুকায়িত প্রেমিকের আবদার খানি বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারল। বাহার ভাইয়ের চোখ দু’টি আজ হাসছে কী! আঁধারে ঠিক ঠাহর করতে পারল না সে। তবে এই অসুস্থ শরীর নিয়েও ছুটে গেল রুমে। সকালে যখন চেরিকে কাঁদতে দেখল, তখনই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল ঐ বাড়ির মানুষদের সাথে আর কথা বলবে না। বিকেল হতেই সেই প্রতিজ্ঞার জোর কমে এলো। আর এখন যেন তা নিঃশেষ প্রায়।

চিত্রাদের সকল রুমে সৌরবিদ্যুৎ-র ব্যবস্থা থাকা স্বত্তেও আজ সেই ব্যবস্থাও কাজে লাগানো হয়নি। চিত্রার দাদীর আদেশেই সকল আলো বন্ধ। জ্বালানো হয়েছে হারিকেন। বৃদ্ধার নাকি আঁধারে লণ্ঠনের আলো পছন্দ। তার ভাষ্যমতে অন্ধকার নব যৌবন পায় লণ্ঠনের সেই হলুদ আলোয়। যেহেতু সন্ধ্যার সময়, সওদাগর বাড়ির মহিলারা তাই রান্নাঘরে ব্যস্ত। ড্রয়িংরুম জুড়ে কেবল নিস্তব্ধতার সমাবেশ। চিত্রা সেই নিস্তব্ধতার সুযোগ পেতেই ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অসুস্থ শরীর, ভাঙা হাত নিয়েই ধুপধাপ করে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। লুকিয়ে মেইন গেইট পেরুতেই চিত্রা বুঝল— তার উপলব্ধি ভুল নয়। প্রেমিকের গান যে কেবল গানই ছিল না, তা প্রমাণ পেল বাহারের শীতল উপস্থিতিতে। চিত্রা কথা বলার জন্য ওষ্ঠ খানিক ফাঁক করতেই বাহারের মেঘমন্দ্র কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হুসসস, কথা বলো না, রঙ্গনা। এই সুন্দর আঁধারে প্রেমের নিরব আলিঙ্গন কেবল অনুভব করে হাঁটো। পারবে হাঁটতে?”

বাহারের প্রশ্নের উত্তরে চিত্রা শব্দ ব্যয় বিহীন উত্তর দিল কেবল মাথা দুলিয়ে। চোখে ভর করেছে তার অভিমানী অশ্রু। দু’কদম এগুতেই চিত্রা নিজের হাতে উষ্ণ একটি হাতের নিরব উপস্থিতি পেল। এই ছোঁয়ায় বিস্মিত, হতভম্ব সে। বাহার ভাই নিজ থেকে তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে! কীভাবে সম্ভব! এবারও চিত্রার বিস্ময়ের কারণের কোনো সঠিক বিশ্লেষণ পেল না। কেবল তার ডাগর ডাগর নয়ন যুগল নির্নিমেষ বিস্ময় ভঙ্গিতেই রইল।

প্রায় পাঁচ মিনিটের পথ হাঁটতেই বাহারের গমগমে স্বর ভেসে এলো,
“মামা, যাবেন?”

চিত্রা চোখ তুলে তাকাল। হাঁটতে হাঁটতে তারা এলাকা পেরিয়ে চলে এসেছে। কেউ দেখে ফেলেনি তো! ভাবনার মাঝেই চিত্রার হাতে নরম টান পড়ল। সে চোখ তুলে চাইতেই চোখাচোখি হলো প্রিয় পুরুষের চোখ জোড়ার সাথে। শরীর বেয়ে বিদ্যুৎ এর গতিতে ছড়িয়ে গেল প্রেমের নতুন বীজের অস্তিত্ব। নতুন করে গাঢ় হলো যেন সেই প্রেম।

সোডিয়ামের আলোয় রিকশা চলছে গন্তব্যহীন। বাহার ভাইয়ের এত নিকটে থেকে এই বোধহয় চিত্রার গন্তব্য বিহীন ভ্রমণ। গলায় যেন আটকে আছে অবলিষ্ঠ শব্দ গুলো। প্রগাঢ় নিরবতায় কেটে গেছে আধাঘন্টা বোধহয়। চঞ্চল চিত্রা আজ চঞ্চলতার নামতা গুনেনি।

“কথা বলবে না, রঙ্গনা? প্রেমের চেয়েও কী রোষাবেশ গাঢ় হয়?”

বাহারে আদ্র কণ্ঠের প্রশ্নে, রঙ্গনার ধ্যানচুত্য হলো। সে খানিক গোঙানির শব্দ করল, “হুহ!”

বাহার হেসে উঠল উচ্চশব্দে। গা দুলিয়ে হাসছে লোকটা। নিরব রাস্তায় ঝঙ্কার তুলছে সে হাসি। কবি এবং তার কবিতা বলে— নারীর হাসির চেয়ে সুন্দর কিছু নাকি নেই। অথচ তারা যদি একবার প্রেমিকের হাসি দেখত, তাহলে তাদের এই ভ্রান্ত ধারণা মুহূর্তেই মিশে যেত। চিত্রার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। লোকটা কী অকারণেই হাসছে আজ! এর আগে কখনো তো সে এমন আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে হাসেনি। চিত্রার শুধাল,
“এভাবে হাসছেন কেন?”

“কান্না করার কোনো কারণ নেই বলে।”

বাহারের তৎক্ষণাৎ উত্তরে খানিক হোঁচট খেল সে। চিত্রার হতভম্ব মুখ দেখে যেন প্রেমিকের বড়ো আনন্দ হলো। তাই তো সে মিহি স্বরে বলল,
“আমার হাসি কী বেশি অসুন্দর?”

বাহারের প্রশ্নে চিত্রা ডানে-বামে মাথা নাড়াল। নিভু নিভু কণ্ঠে বলল,
“একটু বেশিই সুন্দর।”

“তাহলে আমার সেই হাসি কেন কেড়ে নিচ্ছ, রঙ্গনা?”

বাহারের শীতল তবে তীক্ষ্ণ প্রশ্নে চিত্রার মুখ ভার হলো। সে কষ্ট দিচ্ছে বাহারকে! সে? হাহ্! অথচ লোকটার দেওয়া কষ্টে মেয়েটা প্রতিনিয়ত পুড়ছে। রাগে-দুঃখে মেয়েটা তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে নিল বাহারের দিক থেকে। বাহার তা দেখে শরীর এলিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে রিকশায় হেলান দিয়ে বসল। ঘোরগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,
“রঙ্গনা, অভিমান কী মুখ ফিরিয়ে নিতে বলে?”

“এখন এসব জিজ্ঞেস করছেন? আপনি মুখ ফিরিয়ে থাকেননি?”

“থেকে ছিলাম, বুঝি? আচ্ছা রঙ্গনা, চোখ যদি কিছু না দেখে তাহলে তার উপস্থিতি পৃথিবী কী মিথ্যে বলে ঘোষণা করে?”

বাহারের হেঁয়ালি প্রশ্নে চিত্রার হতভম্বতা —“কী!”

বাহার আকাশের দিকে চাইল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জানো মেয়ে, তোমার হসপিটালের করিডোরে মশা অনেক বেশি। আমাকে একটা রাতও শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি।”

“হসপিটালে আপনি গিয়েছিলেন?”

চিত্রার প্রশ্নে হেঁয়ালি হাসল বাহার। উত্তর দিল না আর। মনে মনে অপরাধবোধে চিত্রার মাথা নুইয়ে এলো। লোকটা তাহলে হসপিটালে যেত রাতে! সে কখনো দেখেনি! দেখবেই বা কীভাবে? ঘুমের ইনজেকশন তাকে যে রাত জাগতে দিত না। চিত্রার ভাবনা ছেদ করে বাহারের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“রঙ্গনা, প্রেমের অপর নাম কী জানো? প্রেমের অপর নাম হলো- যন্ত্রণা। যা তুমি তুমুল আবেগে লুটেপুটে নিচ্ছ আর আমিও দান করছি। যন্ত্রণায় ভেতরটা ক্ষত হচ্ছে, তবুও প্রেমিক ছাড়ছ না কেন, মেয়ে?”

চিত্রা এবার আর প্রশ্ন শুনে হতভম্ব হলো না, বরং হাসল। খোলা রাস্তায় হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে গেলে তাদের শরীর। চিত্রা মায়াময় চোখে চাইল বাহারের প্রশ্নে। নিখাদ কণ্ঠে বলল,
“আমার বোধহয় কেবল প্রেম নয়, ভালোবাসাও আপনি।”

“যন্ত্রণা তোমার এত প্রিয়?”

“উহু, আপনি আমার এত প্রিয়।”

“এই পৃথিবীতে হাজার খানেক ঋণ না থাকলে, যন্ত্রণার বাহার তোমার হতো, মেয়ে। অথচ সম্পর্কের ঋণে আজ তোমার প্রিয় পুরুষ দেউলিয়া হয়ে বিলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। তাই যন্ত্রণাই হতে পারবে সে, মলম আর হয়তো হতে পারবে না।”

চিত্রা বিচলিত হলো বাহারের কথায়। কিছু বলার আগেই বাহার আলগোছে তার হাতের মুঠোয় নিজের হাত রাখল। গুনগুনিয়ে সুর তুলল,
“আমি গলা বেচে খাবো
কানের আশেপাশে রবো
ঠোঁটে ঠোঁটে রেখে কথা হবে না,
কারো একদিন হবো
কারো এক রাত হব
এর বেশি কারো রুচি হবে না।

আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবে না
আমার এই বাজে স্বভাব
কোনোদিন যাবে না…

রঙ্গনা, আমি তোমার যন্ত্রণা হয়ে থেকে যাব। ভুলে যাবে না তো আমায়? আমায় ভালোবাসা ছেড়ে দিবে কী?”

এই প্রশ্ন করা বাহার ভাইকে চিত্রার কাছে বড়ো অসহায় ঠেকল। মানুষটা কী ভেতর ভেতর ভেঙে গেছে?

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২১.

ক্লান্ত রজনী। ফুরিয়ে আসা দিনের বিজ্ঞাপন নিয়ে পথে নেমেছে নিবিড় রাত্রি। চিত্রার একা বসে থাকা তেপায়া যানটা এসে থেমেছে তাদের বাড়ির সামনেটায়। সাথে চিত্রার মলিন একাকীত্ব এবং পেছন ফেলে আসা প্রিয় প্রেমিকের স্মৃতিও এসেছে তার সাথে। রিকশা থেকে নামতেই এলাকার কোণায় কোণায় জ্বলতে থাকা হলুদ বাল্বের কল্যাণে আলোকিত পথটার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তার ভাইকে। কেবল ভাইজান একা নয়, একটু গাঢ় চোখে তাকাতেই খেয়াল করল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে তার আব্বু আর বড়ো আব্বু। মৃন্ময় ভাইয়াকেও দেখা যাচ্ছে। বিল্ডিং এর মূল গেইটের সামনে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার তিন বোন। চিত্রা রিকশা থেকে নামতেই সকলের ধ্যান যেন তার উপর এসে নিবদ্ধ হলো। বিস্মিত, হতভম্ব দৃষ্টি সকলের। সবার এই তাজ্জব দৃষ্টি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ছড়িয়ে যেতেই চিত্রার মনে হলো রাত ঘন হয়েছে অথচ সে অবলীলায় বাড়ির বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বাড়ির মানুষ গুলো কী তার চিন্তাতেই বাহির হয়েছে! চিত্রার দুরুদুরু বুকে প্রশ্নের স্তূপ। সেই স্তূপ চাপা দিয়েই সে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল। ততক্ষণে তার বাড়ির সকলে ছুটে চলে এসেছে তার সামনে। চিত্রা রিকশা থেকে নামতে দেরি অথচ সশব্দে তার গালে চ ড় পড়তে দেরি হলো না। ভয়ানক চ ড়ে মেয়েটার চোখ-মুখ অন্ধকার করে এলো। চোখের সামনে আঁধার করে যেন পুরো পৃথিবী ঘুরে উঠল। চিত্রা কিংকর্তব্যবিমূঢ় নয়ন যুগল মেলে সামনে তাকাতেই নিজের বাবার অগ্নি দৃষ্টির ভয়ঙ্কর দাবানলে ঝলসে গেল তার চিত্ত। সে গালে হাত দিল, ভীত নয়ন নত করল। সাথে সাথে ভেসে এলো নুরুল সওদাগরের ভয়ঙ্কর হুঙ্কার,
“রাত-বিরাতে না বলে বাসা থেকে উধাও হয়ে গেছো যেহেতু, সেহেতু ফিরে আসার কী প্রয়োজন ছিল? ফিরে না আসলেই তো পারতে। ফিরে এলে কেন? হ্যাঁ?”

চিত্রাদের বিল্ডিং-এর আশেপাশের বিল্ডিং গুলোর বন্ধ থাকা প্রত্যেক রুমে আলো জ্বলে উঠল। প্রায় সবাই জানালা-দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে বুঝার চেষ্টা শুরু করল কি হচ্ছে নিচে। আর ইতিমধ্যে যারা জেনেছে চিত্রার নিখোঁজের খবরটা তারা বলাবলি করছে কি যেন! তুহিন ছুটে এলো বোনের সামনে, আগলে দাঁড়াল বোনকে। ছেলেটার চোখ-মুখও রাগে লাল হয়ে গেছে। আশেপাশে তাকিয়েই সে রাগ সংবরণ করল, দাঁত কিড়মিড় করে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনার বুঝতে হবে যে সব জায়গায় সিনক্রিয়েট করা উচিৎ নয়। বয়সটা কী এমনেই হয়েছে?”

নুরুল সওদাগরের চেহারায় ক্রোধ নেমে গিয়ে ভর করল অবাক। সে তাজ্জব বনে গিয়ে বলল,
“কী বলছো তুমি এসব? তোমাদের আশকারার কারণে আজ ও মাথায় উঠেছে। তোমরা তা বুজছো না।”

“আশকারা যেহেতু আমরা দিয়েছি, শাসনও আমরাই করব। আপনি যেহেতু স্নেহের বেলায় উদাসীন সেহেতু শাসনের বেলায় এগিয়ে আসার কোনো প্রয়োজন নেই।”

নুরুল সওদাগর আরেকটি ভয়ঙ্কর ধমক দেওয়ার জন্য মুখ খোলার প্রস্তুতি নিতেই তাকে থামিয়ে দিলেন আফজাল সওদাগর। গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“নুরু, বাড়ির সম্মান নিয়ে রাস্তায় মজা উড়ানোর কাজ তোকে মানায় না। আর বাড়ির মেয়ের গায়ে হাত তোলা আমার পছন্দ না জানার পরও কাজটা কীভাবে করেছিস? আর একটা কথাও বাড়াবি না। যা কথা বলার, বাড়ির ভেতরে হবে।”

ভাইয়ের কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা নেই নুরুল সওদাগরের। তাই সে চুপ হয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ পাশের বিল্ডিং থেকে একটি ধারাল কটুক্তি ধেয়ে এলো,
“সওদাগর বাড়ির মেয়েদের তো ভালো গুণ! কেউ রাত-বিরেতে ভাইরাল হচ্ছে, কেউবা ঘর ছাড়ছে। বাহ্! একেকজন খুব গুণী।”

কটুক্তিটা বেশ ভয়ঙ্কর ভাবেই তেড়ে এসে হামলে পড়ল যেন সওদাগর বাড়ির সম্মানের উপর। সবচেয়ে বেশি আঘাত করল চাঁদনীকে। যে মেয়েটা সারাটি জীবন সম্মান নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল আজ তার সম্মান নিয়েই টানা-হেঁচড়া হচ্ছে খোলা রাস্তায়। মৃন্ময়ও তড়িৎ গতিতে চাঁদনীর দিকে চাইল কথাটি শুনে। মেয়েটা সদর দরজার ভেতর আরেকটু যেন আড়াল হয়ে গেল। হয়তো লজ্জায়! মৃন্ময়ের রাগ উঠল, হুঙ্কার দিয়ে উঠল কটুক্তি করা মানুষটির উপর। বেশ ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলল,
“সওদাগর বাড়ির কে কি করছে তা না দেখে, আপনার বাড়ির কে কি করছে তা দেখেন আন্টি। সওদাগর বাড়ি ভাইরাল হলেও মুখে চুন কালি মাখার মতন কিছু করেনি। অথচ আপনাদের এমন অনেক কাহিনী আছে যা ভাইরাল হলে আপনাদের মরা ছাড়া উপায় নেই।”

মৃন্ময়ের জবাবেই সকলের মুখ বন্ধ করতে যথেষ্ট ছিল৷ আশেপাশের বাড়ির বেশিরভাগ মানুষ লাইট বন্ধ করে ভেতর চলে গেলো। কেউবা রয়ে গেলো শেষপর্যন্ত মজা দেখার লোভে। চাঁদনী ছুটে ভেতর চলে গেলো। আফজাল সওদাগর মৃন্ময়কে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না।

নিষ্ঠুর রজনী গাঢ় হলো, সাথে গাঢ় হলো সওদাগর বাড়ির আলোচনা। একেক জনের একেক রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হলো চিত্রা কিন্তু উত্তরে সে ছিল উদাসীন, ভাবুক, নিশ্চুপ। অবশেষে কথা বললেন মনোয়ারা বেগম। চিত্রার সম্মুখীন হয়ে রাশভারী কণ্ঠে শুধালেন,
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? কাউকে না বলে?”

আর সবাইকে তোয়াক্কা না করলেও দাদীকে অসম্মান করার ইচ্ছে নেই চিত্রার। তাই ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল,
“আমার একা একা ঘরে ভালো লাগছিল না। তাই ভেবেছিলাম বাহির থেকে হেঁটে আসি। হাঁটতে হাঁটতে একটি জায়গায় বসলাম, অথচ এতটা সময় কেটে গেল টেরই পাইনি।”

চিত্রার সাজানো মিথ্যে উত্তরটা গ্রহণীয় হলো তা সকলের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও দাদী থেমে নেই, বরং নিজের ছেলেদের উদ্দেশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,
“আফজাল, নুরু, আমজাদ….. তোমরা তোমাদের সন্তানদের, বিশেষ করে মেয়েদের এত আহ্লাদ আর স্বাধীনতা দিয়েছ যে তারা তোমাদের সম্মান নিয়ে ভাবছে না। আফজাল তো তার মেয়েকে দেশ ছাড়া করে স্বাধীনতার পথ আরও সুদীর্ঘ করেছেই, তাকে আর আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু নুরু আর আমজাদ, তোমরা শক্ত হাতে হাল ধরো। যদিও অহিকে কখনো অস্বাস্থ্যকর কিছু করতে দেখিনি তবুও, এ পরিবেশে থাকলে অস্বাভাবিক হতে সময় লাগবে না। প্রত্যেকের বিয়ের বয়স হয়েছে। বিয়ের তোরজোর করো। নাহয় একজন ধরা পড়েছে রাতে এক ছেলের সাথে, আরেকজন না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, এরপর কী হবে আমি ভাবতে পারছি না।”

আবারও কথার তীর চাঁদনীর বুকে এসে ক্ষত বাড়িয়ে দিল তার দ্বিগুণ। সে দাঁত মুখ শক্ত করে রাখল যেন তার দুর্বল সত্তা খোলশ ছেড়ে বেরিয়ে না আসে। চিত্রাও অসহায় দৃষ্টিতে চাইল বোনের পানে। তার জন্যই আজ বার বার আপাটাকে মানুষ আকারে-ইঙ্গিতে কথা শোনাচ্ছে। কিন্তু দমে গেলেন না মুনিয়া বেগম, বরং মেয়েদের দেয়াল হয়ে কিছুটা কর্কশ কণ্ঠে বললেন,
“একটা মানুষের সারাদিন ঘরবন্দী জীবন ভালো না-ই লাগতে পারে, তাই বলে তাকে বিয়ে দিতে হবে আরও হেনতেন বলার কোনো মানে নেই। তাছাড়া চাঁদনীকেও কথায় কথায় টানার কোনো কারণ দেখিনা। রাত-বিরেতে ভাইরাল হওয়াটা ছিল ওর ভাগ্যের নির্মমতা, কিন্তু ওর চরিত্র এখনো দাগহীন আমি জানি। ঘরের মানুষই যদি দুর্বলতায় আঘাত করি তাহলে বাহিরের মানুষ আমাদের ছেড়ে কথা বলবে?”

মনোয়ারা বেগম তার পুত্রবধূর উপর ক্ষুব্ধ হলেন। কিছুটা রাগী কণ্ঠে বললেন,
“তোমাকে এ বাড়ির বউ করে আনাটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল।”

“সত্যিই তাই। আপনার ভুলের জন্য আমাকে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ভুল একজনের আর আফসোসের জীবন কাটছে আরেকজনের। হাহ্! সবই ভাগ্য।”

মুনিয়া বেগমের মোক্ষম যুক্তির পরে হতবিহ্বল মনোয়ারা বেগম। নুরুল সওদাগরও সরু চোখে স্ত্রীর পানে চাইল। আর বাকিদের ঠোঁটে মিটমিট হাসি ছড়িয়ে গেল। দাদীকে এমন জবাব না দিল৷ তিনি চুপ হতেন না আর একমাত্র এই মানুষটি ছাড়া কেউ এমন জবাব দিতেও পারত না। মায়ের প্রতি ভালোবাসা চিত্রার দ্বিগুণ বাড়ল। বাবা তাকে অবিশ্বাস করলেও মা তাকে কত বিশ্বাস করে! বড়ো চাচীর মতন মা অবুঝ নয়। সন্তানকে আঘাত করেন না তিনি! সেই আলোচনার ইতি ঘটল সেখানেই।

_

অহির ব্যস্ত পা জোড়া নির্নিমেষ ছুটছে। আজ ইম্পর্ট্যান্ট একটি ক্লাস আছে অথচ ঢাকা শহরের জ্যামের জন্য তার বুঝি সেই ক্লাস আর করা হলো না! রিকশা একাধারে জ্যামে আটকে থাকায় সে পায়েই হাঁটা শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি তো পৌঁছানো যাবে। বড়ো রাস্তা ছেড়ে গলি ধরল সে। সূর্যের তেজ মাথার উপর তখন বাড়ছে। রোদে চোখ ঝিমিয়ে আসতেই তার মাথার উপর ছাতা তুলে ধরল কেউ। অহি অবাক হলো, বিস্মিত ভঙ্গিতে পাশ ফিরে চাইতেই দেখল ফর্মাল পোশাকে হাসছে এক সুপুরুষ। পুরুষটির হাসি ছড়িয়ে গেল অহির ঠোঁট অব্দি। মেয়েটা মুচকি হেসে বলল,
“আরে, হুমুর বাপ যে! কী খবর শুনি?”

নওশাদের হাসির আরেকটু প্রশস্ত হলো। গা দুলিয়ে হেসে বলল,
“কোনো খবর নেই আপাতত। আপনি দু’কদম এগিয়ে এলে সম্ভবত নতুন কোনো খবর হয়তো তৈরী হবে।”

অহি ভ্রু জোরা কুঁচকাল, সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “কোন আগানোর কথা বলছেন?”

“যে আগানোতে আপনার সাথে হুমুর দেখা হবে। এই তো সামনে আমার গাড়ি। হুমু সেখানেই আছে। আসুন। এই আগানোর কথাই বললাম। অন্যকিছু ভাববেন না, ম্যাডাম।”

নওশাদের দুষ্টু কণ্ঠে হেসে উঠল অহি। মাথা দুলাতে দুলাতে বলল,
“আমার সাথে চালাকি? সাইকোলজির স্টুডেন্ট আমি। সব বুঝি, হুহ্৷”

“মন বুঝেন তো?”

নওশাদের গাঢ় ইশারায় অহি মাথা ঘুরিয়ে ফেলে। লোকটা লজ্জা দিচ্ছে আজকাল।

_

ধরায় তুমুল সূর্যের তাপ দেওয়ার পর গগন এখন শান্ত। গুরু-গম্ভীর ভাবে ডেকে উঠছে সে কিছুক্ষণ বাদে বাদে। চিত্রা উদাসীন চোখে সেই আঁধার আকাশ দেখছে। আজকাল তার আকাশ দেখতে ভালো লাগে। কেমন মন ভালো হয়ে যায় সেখানে চাইলে! চিত্রার ধ্যানের মাঝেই গগন চিরে বেরিয়ে এলো বৃষ্টির বিন্দু। শীতল করল ধরা। শান্তি, স্বস্তিতে ভোরে উঠল প্রকৃতি। বৃষ্টির ফোঁটায় ভেসে এলো অতীত। বেজে উঠল ব্যাথার সুর। আগে বৃষ্টি নামলেই চিত্রা আর বনফুল পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়তো। হৈচৈ করে ভিজতো অনেকক্ষণ। কী আনন্দ ছিল তখন! তখন চিত্রা দুঃখ চিনতো। অথচ আজ….!

চিত্রার বুক ভার করা অতীত বিশ্লেষণের মাঝেই পথ হতে বহু পুরোনো সেই খিল খিল হাসির হুঙ্কার শোনা গেলো। যেই হাসিতে মুগ্ধ হলো আকাশ, বাতাস, পাতাল ও পৃথিবী। মুগ্ধ হলো বন্ধুত্বের বীজ। চিত্রা বনফুলকে ভিজতে দেখে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলে নিচে। কারো ডাক শুনল না, বাঁধন মানল না। এই বুঝি বন্ধুত্ব তাকে দু-হাত মেলে ডাকছে। এখন আর কোনো পিছুটান তার জন্য নয়। আনন্দের রথে করে যখন চিত্রার সকল সুখ ফিরে এলো ঠিক তখনই থেমে গেল চিত্রা। মেইন গেইটটার সামনে এসে থামকে গেল পা। আজ বনফুল একা ভিজছে না, তার সঙ্গী হয়েছে নতুন। চিত্রার জায়গায় আজ নোঙর নামক মেয়েটির অবস্থান। দু’জনেই আনন্দে হাসছে। চিত্রা ড্যাবড্যাব করে সেই দৃশ্য দেখল। বুকের ভেতর তাজা ক্ষত। চোখে অশ্রুদের ভীড়। ভগ্নাবশেষ মনটুকু নিয়ে ফিরে যেতে নিলেই তার হাত আঁকড়ে ধরে বাঁধা দিল কেউ৷ চিত্রা থেমে গেল। তার ভাঙা মনটাকে জোরা দিতে দিতে প্রেমিক বলল,
“ভিজবে না, রঙ্গনা? বৃষ্টি না তোমার বড়ো প্রিয়?”

চিত্রা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। বাহার ভাইয়ের নিখাঁদ হাসি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। চিত্রা অভিমানী স্বরে বলল,
“কার সাথে ভিজবো? বনফুলের যে সঙ্গী হয়েছে নতুন।”

বাহার হাসল। ঝাকড়া চুল গুলো এলোমেলো করে বলল,
“কষ্ট পেয়ো না, রঙ্গনা। পৃথিবীর নিয়মই যে এমন! পুরাতন অবহেলা পায় নতুনের উন্মাদনায়। কোনো শূন্যস্থান পৃথিবী অপূর্ণ রাখে না যে! তাই তো আজ আমি তোমার সঙ্গী হলাম। তোমার এটুকু দুঃখের ভার নাহয় আমিই নিলাম কাঁধে। কষ্ট পেয়ো না, মেয়ে। দিনশেষে মানুষ যে বদলাবেই।”

“আমার ভীষণ কষ্ট হয়, বাহার ভাই।”

“তাইতো আমি, তোমার সুখ হয়েছি মেয়ে।”

#চলবে

প্রেমোত্তাপ পর্ব-১৮+১৯

0

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৮.

উত্তপ্ত গরম, ঘামে ভিজে একাকার চিত্রা। আজ কলেজ এসেছে এডমিট কার্ড নিতে। এইতো আর কিছুদিনের মাথায় তার পরীক্ষা শুরু হবে। এডমিট কার্ড নিতে এসে ভীড়ে সে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। মাথা ঘুরছে খালি। এত রোদও যে আজ কী মনে করে ওঠলো সে বুঝে পাচ্ছে না। কী বিরক্তকর!

এডমিট কার্ড নিয়ে চিত্রা কলেজ থেকে বেরুতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দমবন্ধ ভাবটা কিছুটা কম লাগছে। চিত্রা ডানে-বামে তাকালো। রিকশার খোঁজ করলো। কোনো রিকশা নেই আশেপাশে। যেদিন প্রয়োজন পরে সেদিনই রিকশা গুলো উধাও হয়ে যায়। কোথায় যায় কে জানে! চিত্রাকে বিরক্ত করতে বাহার ভাইয়ের পাশাপাশি প্রকৃতিও সচেষ্ট।

চিত্রা আশপাশ তাকাতেই তার ডান দিকের গলিটাতে বনফুলকে ছুটে যেতে দেখা গেল। চিত্রা কিছুটা বিস্মিত হলো। বনফুলের কলেজ এ রাস্তায় না। এতটা দূরে মেয়েটার একা আসারও কথা না। কিন্তু ও এখানে কী করতে এলো! বনফুল তত চতুর মেয়েও না যে একা একা এখানে চলে আসবে। তাহলে এখানে কেন এলো মেয়েটা! চিত্রার কপাল কুঁচকে গেলো চিন্তায়। সেও কিছুটা ছুটেই সে গলির দিকে গেলো। বনফুল ততক্ষণে অনেকটা দূরে৷ চিত্রা জোরে ডাক দিতে গিয়েও দিলো না। কি মনে করে যেন থেমে গেলো। বনফুলের হাবভাব তার স্বাভাবিক ঠেকছে না। মেয়েটা কেমন সাবধানী চোখে আশেপাশে তাকাচ্ছে। কিসের ভয় মেয়েটার? কিসের ভয়ে সে এমন করছে! চিত্রা পায়ের গতি আরও বাড়ালো। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। দ্রুত ছুটতে গিয়ে চলন্ত এক মোটর সাইকেলের সাথে ভয়ঙ্কর এক ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গিয়ে পড়ে সে পথের ধারে। মুখ থুবড়ে পড়ায় বা-হাতটা চিনচিন এক তীক্ষ্ণ ব্যাথা করে উঠলো। সেই ব্যাথায় ঘুরে ওঠলো চিত্রার মাথা। অসহ্যকর ব্যাথাটা সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা গগন বিদারক চিৎকার দিয়ে ওঠে। মটর সাইকেলের ছেলেটা তৎক্ষণাৎ তার গাড়ি থামিয়ে ছুটে এলো। ছেলেটাকে ঝাপসা চোখে দেখে চিত্রা বিড়বিড় করে ওঠলো, ধীর স্বরে বলল,
“আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও।”

তারপর মেয়েটা জ্ঞান হারালো। শূন্য মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়ে কেমন নিস্তেজ হয়ে গেলো।

_

অহি ভার্সিটি থেকে ফিরতেই অপ্রিয় মহিলার মুখমন্ডল দর্শন করে বিরক্ত হলো। বিরক্তি ছড়িয়ে পড়লো তার চোখ-মুখে। সে নিজেকে কিছুটা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেই তার রুমের দিকে এগিয়ে যেতে উদ্যোত হলো কিন্তু শেষমেশ সে আর যেতে পারলো না, তার আগেই মহিলাটা হাসি মুখে কাছে এলেন, গদোগদো করে বললেন,
“আমার অহু কেমন আছে?”

অহি বিরক্ত চোখে তাকালো। ড্রয়িং রুমে তার বাবা, চাচা, বড়ো আব্বু, বড়ো আম্মু, মেঝো আম্মুসহ সবাই উপস্থিত। সাথে মহিলাটার স্বামীও এসেছেন বোধহয়! এত গুলো মানুষের সামনে বাজে ব্যবহার করতে বাঁধলো অহির। তাই কিছুটা তিতে কণ্ঠেই বলল,
“ভালো থাকারই তো কথা। ভালো থাকবো বলেই তো সবার এত আয়োজন। খারাপ থাকার সুযোগ নেই।”

অহির এমন আচরণেও মহিলাটার গদোগদো ভাব কমলো না বরং সে আহ্লাদ করে নিজের আঁচল দিয়ে মেয়েটার ঘাম মুছিয়ে দিতে নিলেন। কিন্তু এত আহ্লাদ বোধহয় সহ্য হলোনা অহির। তাই মহিলাটার হাত কিছুটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে অবনী বেগমের উদ্দেশ্যে চেচিয়ে বলল,
“আমি কলেজ থেকে এলে যে শরবত দিতে হয় সে-ই প্রথাও কী সবাই ভুলে গেছে? সবাই কী পেয়েছে, হ্যাঁ? যার যা মন চাইবে, সে আমার সাথে তা-ই করবে?”

“অহি!”

নিজের বাবা আমজাদের সাবধানী ডাক ভেসে এলো। বাবা বোধহয় তাকে শান্ত হওয়ার জন্য এই ডাকটা দিলেন। অহি বাবার দিকে তাকাল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আপনি একটা মানুষই…”

অহির কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই অবনী বেগম রান্নাঘর থেকে শরবত নিয়ে এলেন। চোখ-মুখ তার ফুলে আছে। শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে আধভাঙা কণ্ঠে বললেন,
“আমি খেয়াল করিনি তুমি এসেছো। নেও।”

অহি শরবতের গ্লাসটা কিছুটা টেনেই নিলো। তন্মধ্যে আমজাদ সওদাগর স্ত্রীকে ধমকে বললেন,
“খেয়াল কোথায় থাকে তোমার? বাসায় করোটা কী তুমি?”

“কেন, আপনাদের খোশামোদ করে।”

বাবাকে উত্তরটা দিয়েই অবনী বেগমের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “আর হ্যাঁ আপনি, খেয়াল আর কবে করবেন? কে এলো, কে গেলো সব খেয়াল করুন। সংসারটা আপনার। চোখ ফুলিয়ে কাঁদলে আর কণ্ঠস্বর ভাঙলেই যদি জগতে সুখে থাকা যেত বা সবটা পাওয়া যেত তবে আমার সকল অশ্রু আমি বিসর্জন দিতাম।”

অহি কথা শেষ করেই ভদ্রমহিলার দিকে তাকালো। ভদ্র মহিলা বিমূঢ়। বিস্মিত নয়ন জোড়া মেলে বললেন, “অহু বড়ো হয়ে গেছিস!”

“বড়ো হয়ে গেছি কি-না জানিনা তবে সামলে নিয়েছি। এর জন্যই তো ছেড়ে গিয়েছিলেন, তাই না?”

মহিলা আর জবাব খুঁজে পেলেন না। তার সাথে আশা ভদ্র পুরুষটি তখন ওঠে দাঁড়াল। কিছুটা মিষ্টি হেসে এগিয়ে এসে অহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পিতৃ-স্নেহে। কোমল কণ্ঠে বললেন,
“তুমি বেশ বুদ্ধিমতী, মা। ভালো আছো?”

অহি চেয়েও লোকটার সাথে খারাপ ব্যবহার করে পারলো না। কিন্তু ধীর কণ্ঠে জবাব দিল,
“ভালো আছি। আপনারা আসছেন, বসুন, খাবেন তারপর চলে যাবেন। আমি আশা করবো এই ভদ্র মহিলা যেন এ বাড়িতে আর না আসেন।”

অহির তীক্ষ্ণ কথাতেও বিচলিত হতে দেখা গেল না লোকটাকে। সে শান্ত ভঙ্গিতেই বলল,
“তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ উনি তোমার….. ”

“সরি টু সে, উনি আমার কেউ না আঙ্কেল। আপনি ভুল কথা বলবেন না।”

অহির আচরণে ভদ্রমহিলার চোখের কোণে অশ্রু দেখা গেল। অশ্রু এলো অবনীর চোখের কোণে। মুখ তার ভীতিগ্রস্ত। নুরুল সওদাগর ওঠে এলেন, বিজ্ঞ কণ্ঠে মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন,
“শিমুল, কেঁদে লাভ নেই। মেয়েটা তোমার আচরণে অনেক ব্যাথা পেয়েছে যার কারণে আজ সে পাথর। তুমি তোমার প্রাপ্য আচরণেই তার কাছ থেকে পাচ্ছো।”

শিমুল নামের মহিলাটি তার চোখের স্বচ্ছ গ্লাসটা খুললেন। চোখের অশ্রুখানি আলগোছে মুছে বললেন,
“আমাদের তোমাকে প্রয়োজন।”

“আমার আপনাকে প্রয়োজন নেই। আমার প্রয়োজনে যে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে তাকে আমার চাই না।”

“অহি, তুমি ওর সাথেই যাবে। ওদের সাথেই থাকবে। আর কোনে কথা না।”

আমজাদ সওদাগর নিজের কথাটা বলেই হনহনিয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে। অহি ফেটে পড়লো ক্রোধে। হাতের কাচের গ্লাসটা সর্ব শক্তি দিয়ে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো। চিৎকার দিয়ে বলল,
“আপনারা কেউ আমাকে ভালোবাসেননি। সবসময় নিজেদের কথা ভেবেছেন। আপনারা তো নিজেদের কথা ভেবে সুখী হয়েছেন, আমাকে কেন ফেলেছেন বাতিলের খাতায়? একটা সন্তানকে যদি মা-বাবা হয়ে সুখই দিতে না পারেন তো জন্ম দিয়েছিলেন কেন? বাবা-মা হিসেবে আপনারা ব্যর্থ। মানুষ হিসেবে আপনারা ব্যর্থ। একটা মানুষের সুখ কেড়েছেন আপনারা। শৈশব থেকে কত মানুষের ঠাট্টার পাত্রী হয়েছি আমি। এসব আমি ভুলবো না। ভুলবো না। এ বাড়ি থেকে আমার লাশ বের হবে, আমি তো না-ই।”

কাচের গ্লাসের টুকরো গুলো পা দিয়ে মাড়িয়েই অহি নিজের রুমে ছুটে চলে গেলো। পেছনে ফেলে গেলো কিছু ব্যাথাতুর, অবাক দৃষ্টি। বিষাক্ত অতীত কখনো সুখের স্বাদ দিতে পারে না যে!

_

অফিসের কাজে ব্যস্ত হাত চাঁদনীর। চাকরিচ্যুত হওয়ার চিঠিটাও সে জমা দিয়ে ফেলেছে। জমে থাকা কাজ গুলো সম্পন্ন করে তুলে দিবে দায়িত্বরত সিনিয়র অফিসারের হাতে তারপর তার ছুটি, চির অবসাদ। ছুটি দিবে আপন মানুষ, ছুটি দিবে দেশ। তার মনের সাথে সাথে তার দেহ ভুগবে একাকীত্বে। তাও ভালো, কেউ তখন আর কাঁদাবে না তাকে, কেউ তাকে আর ঘটা করে হাসবে না। কেউ তখন তাকে পাওয়ার জন্য ‘বেয়াদব’ হতে চাইবে না। তাও ভালো, কেউ তখন আর জানবে না চাঁদ মেয়েটা মরছে রোজ।

এসব ভাবতেই হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো চাঁদনীর ভেতর থেকে। তন্মধ্যেই তার কলিগ মামুন সাহেব উপস্থিত হলো কার কক্ষে। নিজের চকচকে দাঁত গুলো দেখিয়ে হেসে বলল,
“কী মেডাম, চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন শুনলাম?”

চাঁদনীর ব্যস্ত হাত থামলো। না চাইতেও মামুন সাহেবের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,
“ঠিকই শুনেছেন।”

“চাকরি ছাড়বেন কেন? দোষ তো করেছেন আপনি, চাকরি তো না।”

মামুন সাহেবের ঠেস মারা কথায় কপাল কুঁচকালো চাঁদনী। কিছুটা অবুঝ হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“জি? বুঝিনি।”

মামুন সাহেব এগিয়ে এলেন। চাঁদনীর সামনের চেয়ারটাতে বসে পা ঝুলাতে ঝুলাতে কেমন বিদঘুটে হাসি দিয়ে বললেন,
“সাদা জামাতে বৃষ্টিতে ভিজে প্রেমিকের সাথে ছবি তো আপনি তুলেছেন। অফিস বা চাকরির দোষ কী?”

চাঁদনী ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এই লোকটার সাথে কথা বলতে তার রুচিতে বাঁধছে। এর মাঝেই তার ফোনে নোটিফিকেশন এলো। মৃন্ময়ের উনপঞ্চাশটা কল আর ছিয়ানব্বইটা ম্যাসেজ। সবশেষ মানে বর্তমান ম্যাসেজটা জ্বলজ্বল করছে ফোনের স্ক্রিনে। সেখানে ছোটো করে লিখা ‘আমি অফিসের নিচে ইন্দুবালা, তাড়াতাড়ি আসুন।’

চাঁদনীর মাথা গরম হলো ছেলেটা পেয়েছি কী তাকে? আজ এর একটা বিহিত সে করবেই। তার উপর মামুন সাহেবের গা জ্বালা হাসিতে সে অতিষ্ঠ হয়ে যেই না ওঠে চলে যেতে নিবে তখনই পেছন থেকে লোকটা বলে ওঠলো,
“ভিজে জামায় আপনাকে দারুণ লাগছিল।”

লোকটার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হবে না কারো। চাঁদনীরও হয়নি। কিন্তু সে প্রকাশ করলো না তার ঘৃণা। বরং মুচকি হেসে বলল,
“আপনার আর সুইটির অন্তরঙ্গ কিছু ছবিও দারুণ। ভাবীকে দেখাবো, কী বলেন?”

মামুন সাহেবের মুখের হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। চাঁদনী গা দুলাতে দুলাতে নেমে গেলো অফিস থেকে।

অফিসের বাহিরে আসতেই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মৃন্ময়কে তার চোখে পড়লো। রাগটা সাথে সাথে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠলো। সে কিছুটা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে এমন মাঝ রাস্তায় সশব্দে চ ড় বসিয়ে দিলো ছেলেটার গালে। ছেলেটা আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব। কেবল বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “ইন্দুবালা…”

“আই হেইট ইউ, মৃন্ময়। তোমার বাচ্চামো আজ আমার চরিত্রে কলঙ্কের কালি লেপেছে। কখনো ক্ষমা করবো না তোমাকে। কখনো না।”

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৯.

জানুয়ারির ব্যস্ত শহরে এখনো ঝিমিয়ে আসা শীত উঁকি দেয়। কৃষ্ণচূড়ার লাজুক ডালে এখনো শূন্যতা উপস্থিত। এখনো শহরের অলিতে-গলিতে প্রেমের প্রত্যাখ্যান জ্বলজ্বল করছে ডিসেম্বরের বিদায়ে। কোথাও বা তুমুল আহ্লাদে প্রেম গাঢ় হচ্ছে! এই এত হওয়া- না হওয়া ব্যাপারটার মাঝেই একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। যেই ঘটনায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে সওদাগর বাড়ির সুখ। সেই বাড়ির চঞ্চল প্রাণে আজ করুণ আহাজারি। হসপিটালের গাঢ় পরিবেশে সেই আহাজারি জীবন্ত, সতেজ এবং যন্ত্রণার।

চঞ্চল চিত্রার দেহ এখন নিস্তেজ প্রায়। ক্লান্ত চোখের পাতা এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। হসপিটালের গুমোট করিডোরে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছে প্রিয়জনেরা। ভাইয়ের দেহ ভেঙে আসতে চাচ্ছে চিন্তায়। আদুরে বোনের এই বিরাট ব্যাথা যে তার সহ্য হচ্ছে না। সে আজকে ভার্সিটি ছিল। হুট করে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো, জানানো হলো তার বোনের এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কথা। তারপর সে যেন প্রায় ঘোরের মাঝেই ছুটে এলো। তার সাথে এলো নিরু মেয়েটিও। মাহিন— চিত্রার এক্সিডেন্ট যার বাইকের সামনে ঘটেছিল, তার উপর ক্ষেপে যায় তুহিন। ক্ষুব্ধ হয়ে ছুটে যায় প্রহার করতে। কিন্তু ছেলেটা থামায় তুহিনকে, বিনীত স্বরে জানায় দোষ তার নয়। সে সাবধানেই চালাচ্ছিল। হঠাৎ চিত্রা কোথা থেকে ছুটে এলো সে ঠাহর করতে পারল না। মধ্য গতির বাইকটি থামতে থামতে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। তুহিন তবুও থামতে চায় না তবে সামলায় নিরু। ততক্ষণে বাড়ির প্রায় সকলে উপস্থিত হয়। চাঁদনী আপা, অহি, চিত্রার মা, চেরি, অহির মা-বাবা, আফজাল সওদাগরসহ সকলে।

প্রিয়জনদের দীর্ঘস্থায়ী অপেক্ষার পালা শেষ হলো, ডাক্তার বেরিয়ে এলো সুসংবাদ নিয়ে,
“চিত্রা সওদাগরের এখন অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল। তবে…..”

ডাক্তারের অযাচিত বিরতি বড়োই অসহ্যকর ঠেকল সওদাগর পরিবারের কাছে। মুনিয়া বেগম সহ্য করতে পারল না সে বিরতি। ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালেন,
“তবে?”

“উনার বা’হাতের আঘাত মারাত্মক পর্যায়ে ছিল যার জন্য তার কবজির হাড়ে ফাটল ধরেছে বলা যায়। আমরা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। এবং যেহেতু মাথায় ও পিঠেও আঘাত পেয়েছে সেহেতু দু’দিন আমরা অবজারবেশনে রাখবো তাকে। অতিরিক্ত ব্যাথা থেকে জ্বর আসবে। আর এখন জ্ঞান নেই। কিছুক্ষণের মাঝেই জ্ঞান ফিরলেই তার সাথে দেখা করতে পারবেন।”

উপস্থিত সকলের মাঝে তুহিনকে বেশি ভেঙে পড়তে দেখা গেল। সে ধপ করে বসে পড়ল সাথের চেয়ারটাতে। মুখ ঢেকে ফেলল যন্ত্রণায়। মেয়েটা কত বেশিই না ব্যাথা পেয়েছে! ছোটো নাজুক শরীরটা কতটা আঘাত পেল! তুহিন যেন বাইক চালানো ছেলেটার উপর আরও একধাপ বেশি রেগে গেল। কেবল প্রকাশ করল না। মুনিয়া বেগম হলেন ছেলের আশ্রয়স্থল। এই ভয়ঙ্কর বিপদেও সে দৃঢ় স্বরে বললেন,
“তুহিন, এটা সামান্যই। ওর জানের ক্ষতিও তো হতে পারতো? তাই না? কিন্তু বেঁচে গিয়েছে। সেজন্য শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ নয় কী?”

মুনিয়া বেগম সদা কঠিন থাকার একটি ক্ষমতা নিয়ে জন্মিয়েছেন বোধহয়। কখনো, কোনো ব্যাপারে তাকে মারাত্মক রকমের বিচলিত দেখা যায় না। সবসময় বিপদে ভেঙে আশা মানুষের ভরসা হয়েই থাকেন তিনি।

অহি মিহি স্বরে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। ক্ষণে ক্ষণে নাকও টানছে। চাঁদনী যে কাঁদছে না, তেমনটা নয়। তবে অহির কান্না, চেরির কান্না সামলানোর দায়িত্ব যেহেতু তার ঘাড়ে পড়েছে তাই তার আর আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে কান্না করা হচ্ছেনা। তবে তার ভেতরটা ভেঙে আসছে। চিত্রা তার খারাপ সময়ের কঠিন ঢাল। অভিমানী মেয়েটাও চাঁদনী আপাকে বাঁচাতে বড়োদের সামনে বুক পেতে রাখে। চাঁদনী আপার কষ্ট দেখে, সে-ই মেয়েই তো হাউমাউ করে কাঁদে। পৃথিবীতে আমাদের জন্য কান্না করা মানুষের বড়োই অভাব। বেঁচে থাকা মানুষের জন্য সচারাচর কেউ কাঁদতে চায় না। কাঁদে তো মৃত মানুষের জন্য। অথচ সেই প্রথা মিথ্যে করে দিয়ে, চিত্রা প্রায় রোজই কাঁদে চাঁদনী আপার দুঃখে। এই মেয়েটাকে হারালে, চাঁদনী যে নিজের জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল শুভাকাঙ্খীকে হারাবে! কত-শত ভাবনার মাঝেই চাঁদনীর ফোন বেজে উঠল খুব গোপনে। ফোনের ভাইব্রেশনের তোপে কাঁপছে যেন শরীরও। চাঁদনী ভ্রু কুঁচকালো, ফোন বের করতেই, ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল ‘মৃন্ময়ের’ নাম্বারটি। মৃন্ময় নামটা দেখেই চাঁদনীর রাগ সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেল। ভেতর ভেতর ভোঁতা একটি রাগ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তার চরম সর্বনাশ করেও, এমন মাঝ রাস্তায় চ ড় খাওয়ার পরেও কী এই নির্লজ্জটার শিক্ষা হবে না? চাঁদনী ফোনের দিকে তাকিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে গেল। চাঁদনী জানে, সে যতক্ষণ ফোন না ধরবে ততক্ষণ একটানা ছেলেটা ফোন দিতেই থাকবে। তাই সে অপেক্ষা করে দ্বিতীয়বার কলের জন্য। কিন্তু চাঁদনীর অপেক্ষারা সময় বাড়িয়ে সেকেন্ড থেকে মিনিট হয়, অথচ দ্বিতীয় কলটি আর আসেনা। ক্ষণে ক্ষণে চলতে-চলতে মিনিটের কাটা পাঁচে গিয়ে ঠেকে। চির-পরিচিত অভ্যাসটি মিথ্যে হয়ে যায় কোন সে অবহেলায়! নতুন নিয়মে। ছেলেটি আর কল দেয় না। চাঁদনী তীর্থের কাকের ন্যায় নির্মিশেষ তাকিয়ে থাকে ফোনের স্ক্রিনে। অতঃপর সে অনুভব করে, তার অপেক্ষা, কেউ একজন উপেক্ষা করে নিয়ম বদলে ফেলেছে। ভেতর থেকে ভারী শ্বাস বেরিয়ে আসে। বদলে যাওয়ার এই পৃথিবীতে সকল নিয়ম যে অনিয়মেই এসে ঠেকে, চাঁদনী তা ভুলে গেল কী করে!

চিত্রার জ্ঞান ফিরতেই কেবিনে ভীড় করে তার প্রিয়জনেরা। চিত্রা চোখ মেলে তাকায়। তীক্ষ্ণ একটি ব্যাথা তার শরীর জুড়ে ছড়াছড়ি করে। সে ঘোলা চোখে চারপাশে তাকায়। আবছা দৃষ্টিতে সকলের মুখ দৃষ্টিগোচর হয়। তুমুল ব্যাথা নিয়েও চিত্রা ক্ষীণ হাসলো। অসুস্থ স্বরে বলল,
“কাঁদছো কেন? আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছি।”

এতটুকু কথা বলতে গিয়েও যেন মেয়েটা হাঁপিয়ে উঠল। অহির ফ্যাচফ্যাচ কান্না ততক্ষণে শব্দতে রূপান্তরিত হলো। চিত্রা হাসল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,
“এ আমি কী দেখছি! ছোটো আপা আমার জন্য কাঁদছে?

অহি এবার পুরোদমে কেঁদে উঠল, শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
“তুমি এত কেয়ারলেস কেন? এজন্যই তুমি বকা খাও। সাবধানে চলতে না পারলে রাস্তায় বের হবে না। শুধু শুধু আমাদের চিন্তায় ফেলেছ। তোমাকে যদি আর একা বের হতে দিয়েছি, তো দেখো।”

“ভাগ্যিস বের হয়েছিলাম! নাহয়, ছোটো আপা যে আমায় এত ভালোবাসে, সেটা কী জানতাম নাকি!”

মেয়েটা এ অবস্থাতেও দুষ্টুমি করে যাচ্ছে দেখে অহির মায়া আরও বাড়লো। সেই মায়া নিয়ে সে আদুরে ভঙ্গিতে ছুঁয়ে দিল বোনের চোখ-মুখ। অহির ভাব-ভঙ্গিতে কখনো এত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। কিন্তু ভালোবাসা যে খুব বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। চিত্রার ডান চোখের কার্নিশ ঘেঁষে খুব গোপনে পালিয়ে গেল মুক্তোর মতন অশ্রুবিন্দুরা৷ একে একে বাড়ির সাকলেই তাকে আদর করল। কিন্তু তুহিন দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা দূরে, দরজার সাথে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নিরু। বাড়ির সকলের আদরের পালা যখন শেষ হলো, তখন নিরু এগিয়ে এলো, মিষ্টি হেসে শুধাল,
“ভালো আছো?”

চিত্রা শুনল প্রশ্নটা, তবে জবাব দিল না। বরং মুখ ফিরিয়ে নিল সাথে সাথে। নিরু মেয়েটা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল বোধহয় চিত্রার আচরণে। তবুও চিত্রার মাথায় আদুরে হাত রাখল, ক্ষীণ স্বরে বলল,
“সুস্থ হয়ে উঠো তাড়াতাড়ি। তোমার ভাই তো তোমার এ অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে নিজের অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছে।”

“আপনি তো আছেন, সামলানোর জন্য। আপনি থাকলেই আমার ভাইয়ের আর কিছু লাগবে না।”

চিত্রার গলার স্বর কঠিন। তাজ্জব বাড়ির লোক। মুনিয়া বেগম ধমকে উঠলেন,
“চিত্রা!”

নিরু মেয়েটার মুখে তবুও হাসি। সে চিত্রার মাথায় হাত আগের মতন রেখেই উত্তর দিল,
“আমি সামলাতে হয়তো পারবো কিন্তু তোমার শূন্যতা আদৌও আমি পূরণ করতে পারতাম? তোমার ভাইয়ের জীবনে তোমার জায়গাটা ঠিক কী, তা বোধকরি আমার বলে দিতে হবে না, তাই না? তাহলে কেন শুধু শুধু আমার সাথে তোমার তুলনা করে তোমার নিজের জায়গাটাকে হালকা করছো?”

মেয়েটার কথা শুনে, চিত্রার শক্ত মুখের আদল নরম হলো। কিন্তু সে তবুও নিরু মেয়েটার উপস্থিতি ভালো ভাবে নিতে পারল না। পুরোনো ক্ষতে নতুন জ্বলন তৈরী হলো। ভাইয়া আর এই নিরু মেয়েটার জন্যই আজ তার এবং বনফুলের সম্পর্কে ঘূণে ধরেছে। নরম হয়েছে বন্ধুত্বের শক্ত ভিটে। চিত্রার চোখে যন্ত্রণার অশ্রু। আজকের দিনটা অন্যরকম হতে পারতো। আজকে তার পাশে বসে বনফুল মেয়েটার হাউমাউ করে কান্না করার দৃশ্য হতে পারতো। বোকা বোকা কণ্ঠে মেয়েটা হয়তো চিত্রাকে বকতো। বন্ধুত্বের বন্ধন আরও গাঢ় হতো, হয়তো। কিন্তু কিছু হলো না তেমন, কিছু না। সব বদলে গেছে। তার এমন ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা জেনেও বনফুলের মন গলেনি। আসেনি মেয়েটা তাকে দেখতে। কিচ্ছু আর আগের মতন নেই, কিচ্ছু না। চিত্রার কোমল মনে আছড়ে উঠল শূন্যতা। সে ফুপিয়ে কেঁদে দিল সেই শূন্যতা সামলাতে না পেরে। ভাইয়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“চলে যাও তুমি, ভাইজান। চলে যাও। তুমি আমার সুখে কালি দিয়েছ, তোমাকে আমি ক্ষমা করব না। চলে যাও।”

তুহিন ফ্যালফ্যাল করে বোনের ক্রন্দনরত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর মিনিট পেরুতেই মাথা নত করে কেবিন ছাড়ল। সকলেই এ-সব হতবিহ্বল চোখে দেখল। এছাড়া তাদের করার যে কিছুই নেই।

_

আকাশের বুকে বিরাট রূপোর থালার মতন চাঁদ এঁঁকে নির্বিকার হাসছেন সৃষ্টিকর্তা, একেকটা তাজা-তাজা প্রাণের অসহ্য ব্যাথা দেখে। ভাবছেন, মনুষ্য জন্ম গেল দুঃখ পুষেই! অথচ মানুষ চাইলেই দুঃখ ভুলে সুন্দর জীবন সাজাতে পারত।

চাঁদনীর ভেজা চুল থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে তার জামায়। চুলের জলে ভিজে গেছে পিঠের একাংশ। অথচ মেয়েটার হেলদোল নেই। সে শূন্য চোখে চাঁদ দেখতে ব্যস্ত। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। হসপিটাল থেকে এসেই গোসল করেছে। গরম-শীতের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় সে প্রায় জুবুথুবু। মোবাইল স্ক্রিনে থমকে গেছে তার অপেক্ষারা। চির স্থায়ী ভাবেই হয়তো!

সে হতাশার শ্বাস ফেলল। টানা দেড় ঘন্টা যাবত বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার পরও পাশের বিল্ডিং থেকে আজ চিরপরিচিত স্বরে কেউ ‘ইন্দুবালা’ বলে ডাক দেয়নি। এমনকি কেউ আধো আদ্র সুরে গান তুলেনি ‘ইন্দুবালা গো, ইন্দুবালা গো’ বলে। নিজের এহেন ভাবনায় বিরক্ত চাঁদনী। না, সে মৃন্ময়কে ভালোবেসে এসব ভাবছে তেমনটা না। সে ভাবছে অভ্যাসবশত। মানুষ সব বদলাতে পারলেও অভ্যাস বদলাতে তার বহু সময় লাগে। তাই হুট করে চাঁদনী চাইলেও তো আর অভ্যাস বদলাতে পারছে না। অভ্যাসের তোপে না চাইতেও ভেবে ফেলছে ছেলেটাকে। তন্মধ্যেই চাঁদনীর ফোনে নোটিফিকেশন আসে। সে ফেসবুক অন করতেই মৃন্ময়ের কতগুলো হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখতে পায়। কোথাও একটা গিয়েছে সে, কারো বিয়ের অনুষ্ঠান বোধহয়! বন্ধু-বান্ধবের সাথে আনন্দের ছবি দিয়ে ভাসাচ্ছে নিউজফিড। কই, মৃন্ময়ের মুখের কোথাও তো দুঃখের কোনো প্রলেপ নেই! তবে! তবে চাঁদনী কেন তাকে ভেবে দেড়টা ঘন্টা বিসর্জন দিল? নিজের প্রশ্নের ভারে নুইয়ে আসে চাঁদনীর অনুভূতি। সবশেষে সে ব্লক করে মৃন্ময়ের ফেসবুক আইডিটা। হতাশার শ্বাস ফেলে তাচ্ছিল্য করে বলে,
“আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, মৃন্ময় শাহাদাৎ এর ভাই!”

ব্যস্, এখানেই হয়তো আরেকটা সদ্য জন্ম নেওয়া ভালোলাগার পুষ্প অঙ্কুরেই বিনষ্ট হলো!

_

হসপিটালের বেডে চিত্রার ক্লান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে। সাথে হতাশাও। কিসের একটা বুক ভার করা অনুভূতি তাকে শান্তি দিচ্ছে না। কিসের সেই অনুভূতিটা? বনফুল আর বাহারের অনুপস্থিতিই কী সেই বুক ভারের কারণ? মুনিয়া বেগম বসে আছেন তার বেডের পাশেই। চোখে রাজ্যের ঘুম তবে মেয়েকে পাহারা দেওয়ার জন্য ঘুম আর হয়ে উঠছে না।

নিস্তব্ধতা ঠেলে চিত্রার কেবিনে কারো প্রবেশ ঘটতেই সজাগ হয়ে গেলো মুনিয়া বেগমের ক্লান্ত দেহ। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের স্বামীকে দেখতেই ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“তোমার সময় হয়েছে তাহলে!”

নুরুল সওদাগর স্ত্রী’র পানে চাইল গম্ভীর দৃষ্টিতে, রাশভারি কণ্ঠে বললেন,
“সময় হয়েছে বলেই এসেছি। এক্সট্রা কথা আমার পছন্দ নয়।”

মুনিয়া বেগম হয়তো আরও দু-চারটে কঠিন কথা বলতেন কিন্তু চিত্রার কোমল মুখ পানে চেয়ে মায়ের ভাষারা নরম হয়ে গেলেন। স্বামীর দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলে চুপ হয়ে গেলেন সে, মুহূর্তেই। নুরুল সওদাগর গম্ভীর পায়ে এগিয়ে এলেন, গমগমে স্বরে বললেন,
“সাবধানে চলতে পারো না? সামনে পরীক্ষা তোমার, আর তুমি হা-পা ভেঙে বসে আছ?”

চিত্রার মাথা নত, ক্ষীণ স্বরে উত্তর দেয়,
“সরি, আব্বু।”

চিত্রা ভেবেছিল তার বাবা হয়তো আরও কয়েকটা কথা শোনাবেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বাবা আর বকা-ঝকা করলেন না। কিয়ৎক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে অতঃপর প্রস্থান নিলেন। মুনিয়া বেগমও স্বামীর এহেন আচরণে তাজ্জব। হজম করতে পারল না ব্যাপারটা। তাই তৎক্ষণাৎ স্বামীর পেছন পেছন সে-ও বেরিয়ে গেল। চিত্রা হতাশার শ্বাস ফেলল। অবশ চোখে আশপাশ তাকাতেই মায়ের ফোনটা চোখে পড়ল। একবার ফোন, আরেকবার বাহিরে দৃষ্টি দিয়েই চিত্রা ফোনটা তুলে নিল। যন্ত্রের মতন ডায়াল করল মুখস্থ নাম্বারটিতে। প্রথমবারে অপর পাশ থেকে রেসপন্স এলো না। চিত্রা তাই ব্যস্ত গতিতে আবার কল দিল। এবার বার কয়েক রিং হতে বাহারের মেঘমন্দ্র কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কে বলছেন?”

চিত্রার চোখ বুজে আসে। মায়ের নাম্বারটাও লোকটার কাছে সেভ নেই! হাহ্! দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় হসপিটালের কেবিন। বাহার আবার শুধায়,
“কাকে চান?”

চিত্রা সময় নিল না, ঝটপট উত্তর দিল, “আপনাকে।”

অপর পাশ উত্তর শুনে তুমুল নিরবতায় আচ্ছন্ন হলো। পরপর চিত্রার অসুস্থ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনাকে চাচ্ছি, দিবেন কী আমায়?”

বাহার কিঞ্চিৎ হাসল চিত্রার প্রশ্নে। ধানমন্ডির বিশাল হসপিটালের সামনের পার্কেই তার অবস্থান। সেখান থেকে হসপিটালের দিকে তাকিয়ে সে গাঢ় স্বরে উত্তর দিল,
“আমি যে সওদা করতে পারিনা। পারলে না-হয় আদান-প্রদানের বিষয়টা আগানো যেত!”

“ভালোবাসতে পারেন কী? সেটা পারলেই হবে।”

“পারিনা।”

চিত্রার উৎফুল্ল ভাব মিইয়ে এলো বাহারের উত্তর শুনে। চোখ জুড়ে টইটম্বুর হয়ে এলো অশ্রুরা। লোকটা কী তাকে চিনতে পারেনি! সংশয়ে মন টলে চিত্রার। উভয় পক্ষই নিরব তখন। প্রায় সেকেন্ড পেরুতেই নিরবতা ভেঙে প্রিয় পুরুষ বলে উঠল,
“রঙ্গনা, এই ভালোবাসতে না পারা আমিকে নিয়ে তুমি কী করবে বলো! কেন যেচে যন্ত্রণা টানছো, বলোতো? তাজা প্রাণে ব্যাথা পাওয়ার এত ইচ্ছে!”

চির-পরিচিত সেই ডাক শুনে চিত্রার চোখ বুজে এলো। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
“আপনি যন্ত্রণা হলে, আমি নির্দ্বিধায় তা বইতে রাজি।”

বাহার হাসল, বিবশ কণ্ঠে বলল,
“কাঁদছ কেন, মেয়ে? যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর আগেই কেঁদে ভাসাচ্ছ! তুমি জানো না? তুমি কাঁদলে সকল যন্ত্রণা নরম হয়ে যায়, তুমি কাঁদলে সকল ব্যাথা সুখ হয়ে যায়। কেঁদেই কী তাই মাত দিতে চাচ্ছ, মেয়ে? তবে শুনে রাখো রঙ্গনা, তোমার জন্য- যন্ত্রণার বাহার, সুখ হতেও রাজি।”

বাহারের কথায় ফিক করে হেসে উঠল চিত্রা। পরপরই বাবা-মায়ের তুমুল কণ্ঠ ভেসে আসতেই সে থেমে গেল। সেখানে কান দিতেই আবছা ভাবে বাবার কণ্ঠে তার বিয়ের কথা ভেসে এলো।

#চলবে…..?

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৯ এর বর্ধিতাংশ:

একটি গাঢ় ভোর কুয়াশার আবছা চাদর জড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে পদচারণ করছে প্রকৃতি বক্ষে। খুব দূর থেকে আধো ঘুমু শহরের কালো কাকটি তার কর্কশ কণ্ঠে ডেকে-ডেকে দিশেহারা প্রায়। সূর্য উঠেনি। জানুয়ারিতেও বোধহয় সূর্যের ছুটি শেষ হয়নি। শীতের হালকা প্রলেপ আজও আকাশ জুড়ে লেপা। চিত্রা ঘুমিয়ে আছে তার কেবিনে। বিভোর ঘুমে সে মগ্ন। তার সামনে বসে আছে তুহিন। চোখ গুলো যেন রক্তজবা। সারারাত ঘুমায়নি ছেলেটা। যদি বোনের ঘুম ভেঙে যায়! রাতে যদি বোনের কিছু প্রয়োজন পড়ে! মা’কেও পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়ি। বোনের বিশাল দায়িত্বের ভারে চোখ আর বন্ধ করার ফুরসত মেলেনি। চিত্রার শরীরে ধুম জ্বর। মধ্য রাতের দিকেই জ্বর এসেছে। জ্বরের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন ডাক্তার, তবে কোনো কাজ হয়নি। থেকে থেকে জ্বর বাড়ছে মেয়েটার। তুহিন অবশ্য বাড়িতে এই খবরটা পৌঁছায়নি। এমনেতেই সকলে চিন্তিত, তার উপর এমন খবর দিলে সবগুলো আবার হৈহল্লা করে ছুটে আসবে। তুহিন বরাবরই ঠাণ্ডা মাথার ছেলে। হুটহাট সে কোনো সিদ্ধান্তই নেয় না। কেবল সেদিন বিকেলে বনফুলকে চড় মারা ছাড়া।

সেই বিকেলের কথা ভাবতেই দীর্ঘশ্বাসে ভারি হলো তার বুক। বোনটা জ্বরের ঘোরেও প্রায় অনেকবার মেয়েটার নাম নিয়েছে। খুব দেখতে চাচ্ছে। কিন্তু তুহিনের যে কিছুই করার নেই! আদৌও কিছু করার নেই! প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতেই মনের গহীনে একটি অনাকাঙ্খিত উত্তর উঁকি দিল। সে তার ডালা-পালা মেলে জবাব দিল— ‘পথ আছে, পথ আছে’। তুহিন বড়ো শ্বাস ফেলল। উপায় আছে। অবশ্যই আছে। এতক্ষণ দুঃখের ঘোরে সে-ই উপায়ের কথা মাথায় আসেনি। সেটাই স্বাভাবিক। মানুষ যখন ভীষণ দুঃখ কিংবা সুখে আবেগে আপ্লূত থাকে তখন তার ব্রেইন ভাবতে চায় না কোনো কিছু নিয়ে। কথায় আছে না, আবেগ আর বিবেক… দু’জন দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বী।

এত শত ভাবাভাবির কার্য স্থগিত রেখে তুহিন নিজের মোবাইল বের করল, ফোন লাগাল চির-পরিচিত নাম্বারটাতে। যেই নাম্বারটিতে সে কখনো কল দেয়নি এই জীবনে, পড়েছিল পরিত্যক্ত অথচ প্রয়োজনীয় হয়ে। প্রথমবার রিং হতে হতে কেটে গেল। অপরপক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। তুহিন তাই আবার কল লাগাল। দ্বিতীয়বার আর তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। সেকেন্ডের মাথায়ই অপর পাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হলো। পরপরই সজাগ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যালো।”

তুহিন যতটা স্বাভাবিক ভাবে ফোন দিয়েছিল, অপর পাশে ফোন রিসিভ হওয়ার পর সে আর ততটা স্বাভাবিক থাকতে পারল না। তার যেন মনে হল, বিরাট এক দুঃসাহসিকতার কাজ সে করে ফেলেছে। এটা করা উচিৎ হয়তো হয়নি। মেয়েটা তার থেকে নিজেকে আড়াল করে ভালো থাকতে চাচ্ছে, শক্ত হতে চাচ্ছিল, আর সে কিনা মেয়েটাকে আবার দুর্বল করে দিল! তুহিনের ভাবনার মাঝেই অপর পাশ থেকে আবারও ক্ষীণ স্বর ভেসে এলো,
“তুহিন ভাই, কিছু বলবে?”

তুহিন যেন ডাকটা শুনে চমকে গেল তৎক্ষণাৎ। বিস্মিত চোখে বার কয়েক ফোনের স্ক্রিনে তাকাল। তার জানামতে, সে কখনো এই নাম্বার থেকে বনফুলকে কল দেয়নি, তবে মেয়েটা পেল কোথায় নাম্বার? বিস্ময়ে তুহিনের কথা হারিয়ে যাচ্ছে, কণ্ঠ দিয়ে বের হচ্ছে না শব্দ। বহু কষ্টে তবুও উচ্চারণ করল,
“তুমি আমার এই নাম্বারটি কোথায় পেলে?”

“কেবল এইটা না, এই অব্দি তুমি যতগুলো সিম চেঞ্জ করেছ, সবগুলোর নাম্বারই আমার জানা। রবি সিম তোমার দু’টো, গ্রামীণ একটি, টেলিটক একটি এবং বাংলালিংক তিনটে সিম। এর মাঝে সবচেয়ে ব্যবহারকৃত সিমটি হলো গ্রামীণ। আর টেলিটকটি ব্যবহার করো তোমার অফিসের কার্যক্রম চালাতে। বাকি গুলো তেমন ব্যবহার করো না। ঠিক?”

তুহিন যেন আজ পর পর হতভম্ব হচ্ছে। বনফুলের শেষ প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচেকা খেল, অবাক হয়ে শুধাল,
“সবই তো দেখি জানো!”

“হয়তো! তবে তুমি যে চ ড় মারতে পারো, সেটা আগে কখনো জানিনি। তবে এখন জানি।”

বনফুলের শেষ কথাটা কেমন তীক্ষ্ণ ছিল! তুহিনের বুক যেন এফোড় ওফোড় করে দিল মুহূর্তেই। অপর পাশে থাকা মেয়েটিও চুপ। সে হয়তো নিজের প্রিয় মানুষের নিস্তব্ধতা উপভোগ করছে মন ভোরে। তুহিন থামল, নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“একটা কথা রাখবে, বনফুল?”

“কী?” জবাব দেওয়ার সময় বনফুলের কণ্ঠ যেন অত্যাধিক রকমের শীতল মনে হলো। তবে পাত্তা দিল না সেটা তুহিন। বরং অসহায় কণ্ঠে বলল,
“একবার কী হসপিটালে আসবে বনফুল? চিত্রা তোমাকে বড়ো দেখতে চাচ্ছে।”

তুহিনের আবদার মিনিট পেরুতেই বনফুলের নিরব তাচ্ছিল্যের ভাষায় হেঁয়ালি হয়ে উড়ে গেল। বনফুল উত্তর না দিয়ে তৎক্ষণাৎ বিচ্ছিন্ন করল কলটি। তুহিন চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার উচিত হয়নি মেয়েটাকে কল দেওয়া। মেয়েটার দিক না ভেবেই সে আবার আঘাত করল! বয়ঃসন্ধির মেয়েরা আবেগের দিক থেকে পৃথিবীর যেকোনো বিষয় থেকে এগিয়ে। তাদের জীবনে আবেগ প্রাধান্য পায় সবচেয়ে বেশি। আর সে আবেগে তারা যদি কিঞ্চিৎ আঁচড় পায় তাহলে তারা হয়ে উঠে ধ্বংসের বীজ। সবকিছু ধ্বংস করতে তারা সচেষ্ট।

“কেন কল দিলে, ভাইজান? ও তো আসবে না। আমি জানি।”

হুট করে চিত্রার অসুস্থ কণ্ঠ ভেসে আসতেই তুহিন চমকে বোনের দিকে তাকাল। মেয়েটার জ্বরে মুখ লাল হয়ে আছে। চোখ বেয়ে নিরবে নিভৃতে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণারা। ভাই স্বান্তনা দিতে চাইল কিন্তু চিত্রা যেন অনেক বুঝদার হয়ে গেলো। বুঝদার কণ্ঠে বলল,
“আমি কষ্ট পাচ্ছি না, ভাইজান। মোটেও কষ্ট পাচ্ছি না। তুমি চিন্তা করো না, ভাইজান। আমি সামলে নিব নিজেকে।”

তুহিন ভাষাহারা। তার এত বছরের জীবনে নিজেকে এত বেশি অসহায় সে কখনোই অনুভব করেনি। আজ মনে হচ্ছে, নিজের বোনের কথা ভেবে অন্তত তার নিজের ভালোবাসা ভুলে যাওয়া উচিত ছিল। সে বড়ো ভুল করে ফেলেছে, বড়ো ভুল।

_

চিত্রার অসহ্য রকমের জ্বরে নাজেহাল অবস্থা তবুও সে বেডে শুয়ে থাকছে না। কিসের একটা অস্থিরতা তার শরীর জুড়ে। ধরণীর বুকে তখন অপরাহ্নের মুগ্ধতা। আজান দিচ্ছে চারপাশে। পাখির মৃদু কিচিরমিচির শব্দে সে আর বসে থাকল না কেবিনে। তার মা আর ভাই গিয়েছে ডাক্তারের চেম্বারে রিপোর্ট নিয়ে। আশপাশ ফাঁকা পেতেই সে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে। এই ধুম জ্বর নিয়ে সে করিডোর জুড়ে পায়চারী শুরু করল। হুট করে তার পা থেমে গেল করিডোর দিয়ে বাহিরে তাকাতেই। অনাকাঙ্খিত মানুষটাকে হসপিটালের ভেতরে ঢুকতে দেখে তার আনন্দরা যেন বাঁধ ভাঙলো। বনফুল হসপিটালে ব্যস্ত পায়ে প্রবেশ করছে, তার পেছনে বাহার ভাইও!

চিত্রা করিডোর ছেড়ে এগিয়ে গেল। বনফুল সকল রাগ ভেঙে তার কাছে এসেছে, এটা সে যেন বিশ্বাস করতে পারল না। চিত্রার মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। তবে সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। যখন সে দেখল বাহার আর বনফুল গাইনী বিভাগে প্রবেশ করছে। চিত্রা অবাক, হতভম্ব। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে দেখল সেখানে বাহারের বান্ধবী ঐ নোঙর নামের মেয়েটাও আছে। কেবল আছে না, সে বাহার ভাইয়ের কাঁধে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে।

#চলবে…..

প্রেমোত্তাপ পর্ব-১৬+১৭

0

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৬.

গত দু’দিন যাবত প্রকৃতি প্রায় মন খারাপের রূপ নিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি হয় আবার কিছুটা বিরতি নেয়। তারপর আবার অঝোর ধারায় ঝরে। মানুষের প্রাত্যাহিক জীবন যাপনে কিছুটা মিলেছে বিশ্রাম। অনেকে বৃষ্টি দেখে স্কুল যাচ্ছে না, কলেজ যাচ্ছে না, কেউবা নিয়েছে কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি। আবার যাদের পেট চালানোর জন্য সবসময় পরিশ্রম করতে হয় তাদের এখন রিকশা নিয়ে রাস্তার কোণে ভিজতে থাকা ছাড়া উপায় নেই। বৃষ্টিও ধনী গরীবের পার্থক্য বুঝে! তাই তো কেউ তাকে পেয়ে খুশি আর কেউ তার যন্ত্রণায় পেটে ক্ষুধা আর মনে আশা নিয়ে বসে আছে এই বুঝি রোজগার করতে পারবে কিছু।

সেই বৃষ্টি ভেজা এক অবসাদগ্রস্থ দিনে অহি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। কর্দমাক্ত রাস্তা তাকে প্রায় নাজেহাল করেছে। তার উপর কোনো রিকশা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কোনো গাড়িতে সিট খালি নেই অথচ তার আজ গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা। পরীক্ষা দিতেই হবে তাকে। সাইকোলজির স্টুডেন্ট হয়ে বড়ো বিপাকেই পড়েছে। পড়াশোনা এত কষ্ট জানলে খুব সাদামাটা একটা বিষয় নিয়েই পড়তো নাহয়। অহি তার হাতের ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে সময় দেখে নিল। সকাল সাড়ে সাতটা বাজছে। দশটায় পরীক্ষা। বাসা থেকে ভার্সিটির দূরত্ব অনেক তার উপর বৃষ্টি। সে হিসেব করেই একটু আগে বের হয়েছে কিন্তু তাও বৃষ্টির জন্য কোনো লাভই হচ্ছে না। আকাশের রঙও ভীষণ ধোঁয়াশা। সময়টা সকাল সাতটা মনে না-হয়ে যেন মনে হচ্ছে সন্ধ্যা সাতটা। সময় নিজ গতিতে বয়ে যাচ্ছে অথচ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। হাতের ছাতাটা বৃষ্টির ভার বোধহয় আর বহন করতে পারছে না। বাতাসের ছাঁটে বেশ খানিকটা ভিজেও গেছে সে। জামার হাতাটা ছোটো হওয়ায় হাত ভিজে গেছে যার ফলস্বরূপ ভীষণ ঠান্ডাও লাগছে। তন্মধ্যেই একটা বাস ছুটে আসতে দেখে অহি ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত বাড়াল, দ্রুত ছুটে গেল বাসটার দিকে। বাসটার গতি ধীর হলেও থেমে গেল না। সেই আধো ছুটন্ত বাসেই প্রায় যুদ্ধ করে ওঠে দাঁড়াল অহি। বাস দেখেই ছাতা বন্ধ করে দিয়েছিল যার কল্যাণে তার শরীর এখন পুরো ভিজে একাকার। অহি বিরক্ত দৃষ্টিতে বাসের এধার থেকে ওধার চোখ ঘুরিয়ে নিল একটু বসতে চাওয়ার আশা নিয়ে। এবং তার ভাগ্যের সুদৃষ্টিতে সে একটা সিটও পেয়ে গেল। যেই দ্রুত ছুটে গিয়ে বসতে নিবে ঠিক তখনই পরিচিত পুরুষ মুখমন্ডলটা তার দৃষ্টিগোচর হলো। সে অবাক কণ্ঠে বলল,
“আরে হুমুর বাপ যে!”

নওশাদ আশ্চার্য ভঙ্গিতে চোখ উঠিয়ে চাইল অহির পানে। সেও অবাক কণ্ঠে বলল,
“আইসক্রিম আন্টি যে! তা আজ তো হুমুর আইসক্রিম লাগবে না কিন্তু তবুও আন্টির দেখা মিলল যে!”

অহি মুচকি হেসেই নওশাদের পাশের সিটে বসল। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আন্টির আজ পরীক্ষা, তাই আন্টি বের হয়েছে। হুমু কেমন আছে?”

“আর বলবেন না, হুমু তো প্রায়ই আপনার কথা বলে, তার আইতকিরিম আন্তি বলে কথা। কিন্তু আমরা তো হুটহাট দেখা হওয়া মানুষ সেটা ওকে কীভাবে বলি, বলুন তো?”

“ওর কথা আমারও প্রায় মনে পড়ে। দেখা করিয়ে দিয়েন একদিন।”

“আচ্ছা। তা আপনার কী পরীক্ষা? কোন ডিপার্টমেন্ট? কোন ইয়ার?”

“সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট, থার্ড ইয়ার।”

নওশাদ চোখ বড়ো বড়ো করে চাইল। অবাক কণ্ঠে বলল, “থার্ড ইয়ার! বুঝা যায় না। ছোটো লাগে। তা সাইকোলজির স্টুডেন্ট, আমি কিন্তু বেশি ইন্টারেস্টেড এই বিষয়টা নিয়ে।”

“স্বাভাবিক ভাবেই এটা নিয়ে যারা জানেনা তারা সকলেই আগ্রহ প্রকাশ করে।”

“তা, আপনি মানুষ পড়তে পারেন?”

নওশাদের প্রশ্নে হাসল অহি। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “বই পড়েই কূল পাই না আর আপনি বলেন মানুষ পড়তে! বড্ড কঠিন কাজ তা।”

“কিন্তু আমার জানা মতে, আইসক্রিম আন্টি সবই বোধহয় পারবে।”

_

চাঁদনী আজ কয়েকদিন যাবত অফিস যায় না। লজ্জায় ঘরের বাহিরেও তেমন যায় না। ফোন, স্যোশাল মিডিয়াতেও সে একটিভ নয়। যেন দুনিয়া থেকে নিজেকে আড়াল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করেছে। কিন্তু আজ বৃষ্টি তার ভেতরটা তৃষ্ণার্ত করেছে। আজ ভিজতে ভীষণ ইচ্ছে করছে তার, ভিজে অজানা গন্তব্যে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে করছে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। চাঁদনী আলগোছে শরীরের জামাটা পাল্টে নেয়। টাকার ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।

সকাল হওয়ায় রোজা সওদাগর আর অবনী বেগম রান্নাঘরেই ব্যস্ত। তার উপর বাহিরে বৃষ্টি। বাড়িতে তুহিনও আছে। বৃষ্টি বলে সে বের হয়নি। সকলে নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। চাঁদনী বেশ আড়াল হয়েই বেরিয়ে গেল।

খুব দ্রুতই সে বৃষ্টির ছাঁট নিয়েও এলাকা ছেড়ে বেরুলো। এতক্ষণ মুখে ওড়না দিয়ে ঘোমটা জড়ানো থাকলেও এলাকা ছেড়ে বেরুতেই ঘোমটা খানা ছাড়িয়ে দেয়। খোলা রাস্তায় প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। বুক ভরে যায় তৃপ্তিতে। আহা, জীবন কতটা নির্মল! মাটির ভিজে গন্ধে তার শরীর তাজা হয়ে ওঠে। মন খারাপ যেন নিমিষেই হারিয়ে যায়। তন্মধ্যেই পেছন থেকে তার এককালীন প্রিয় পুরুষের কণ্ঠ ভেসে আসে,
“চাঁদ!”

চাঁদনী থমকে যায়। বৃষ্টির এমন তুমুল নৃত্যে চোখ মেলে থাকাটা দায় হয়ে যায় তবুও সে তাকায়। শাহাদাৎ এর ছাতার নিচে গম্ভীর মুখটা দৃষ্টিগোচর হয়। শাহাদাৎ আরেকটু এগিয়ে আসে, অবাক কণ্ঠে বলে,
“বৃষ্টিতে ভিজছো যে! ঠান্ডা লাগবে না?”

চাঁদনীর কঠিন চোখে তাকানোর কথা থাকলেও সে তাকায় কোমল ভাবে। ধীরে উত্তর দেয়,
“ঠান্ডা লাগবে কিনা জানিনা। তবে শান্তি লাগছে।”

“তোমার সাথে যে ছেলেটার ছবি ভাইরাল হয়েছে, সেটা কে ছিল?”

শাহাদাৎ এর প্রশ্নে চাঁদনী কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“ছিল আমার কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী।”

“শুভাকাঙ্ক্ষী যে দুঃখ ডেকে আনল!”

“অভাগা যেখানে যায়, সমুদ্র শুকিয়ে যায়- প্রবাদ বাক্যটা শুনেছিলে? আমি সেই অভাগা। দোষ শুভাকাঙ্ক্ষীর না, দোষ তো আমারই কপালের। তুমিও তো আমার প্রিয় ছিলে, ভাগ্যের জোরে আজ প্রাক্তন। ভাগ্যেরই তো সব খেলা, তাই না বলো?”

শাহাদাৎ কিছুটা মাথা নত করলো। লজ্জিত কণ্ঠে বলল,
“আমি তোমায় বিশ্বাস করি। তা, আমাকে ক্ষমা করবে না কখনো?”

“করে দিয়েছি অনেক আগে। আমি সবসময় চাই তুমি সুখী হও। সুখী হওয়ার জন্য যদি তোমার আমাকে ছাড়তে হয় তাতেও আমার আপত্তি ছিল না। আর আজ যখন দেখলাম তুমি আমাকে ছাড়া সত্যিই সুখী, তখন আমার শান্তি লাগছে। বরং তুমি আমার সাথে থাকলে কিন্তু সুখী হলেনা সেটা আমাকে কষ্ট দিত। অথচ আজ শান্তি পাচ্ছি।”

“আমাকে আর চাও না?”

শাহাদাৎ এর অদ্ভুত প্রশ্নে হেসে প্রায় খুন চাঁদনী। হাসতে হাসতে বলল,
“তোমাকে চাওয়া সেদিনই ছেড়ে দিয়েছি যেদিন শুনেছি তুমি অন্য কাউকে চাও। যে আমার, সে আমারই। তার এক অংশ যদি অন্যকারো হয় তবে তা আমার চাই না। অথচ তুমি আগাগোড়া পুরোটাই অন্যকারো। কীভাবে চাই তোমাকে বলো?”

শাহাদাৎ এর লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে এলো। চাঁদনী কালো মেঘের পানে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,
“পৃথিবী বড্ড নিষ্ঠুর, যে যাকে ভালোবাসে সে তাকে পায় না। এমনটা কেন হয় শাহাদাৎ? সৃষ্টিকর্তা কী জানেনা? ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া আমরা বড্ড যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকি। এ বেঁচে থাকায় কোনো মহত্ত্ব নেই, শাহাদাৎ। তোমরা কেন দিনশেষে এমন বদলে যাও? তোমরা তো জানোনা শাহাদাৎ, তোমরা একটা মানুষকে মেরে ফেলো হয়তো অজান্তেই।”

_

পুরো শহর যখন বৃষ্টিতে দুঃখবিলাস করছে চিত্রা তখন গায়ে জ্বর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগের মোড়ে। শরীরে দেখা দিয়েছে মৃদু কম্পন। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বাহার, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার। চিত্রার চোখ-মুখ তখন প্রায় অনেক বেশিই লাল হয়ে আসছে। বাহার ধমক দিল,
“এই মেয়ে, বৃষ্টির মাঝে তোমার বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁপতে ভালো লাগছে! অদ্ভুত সব কর্মকান্ড।”

“ভালো লাগছে। আপনি পাশে থাকলে আমার সবই ভালো লাগে।”

বাহার আড় চোখে চাইল মেয়েটার পানে। কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠেই বলল,
“আমি তোমার টিচার হই, মনে রেখো।”

“সেটা তো পড়ার টেবিল অব্দি। শাহবাগের মোড়ে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন আমার সবচেয়ে পছন্দের পুরুষ হয়ে।”

“জ্বর কী আবেগ বাড়িয়ে দিল?”

“না তো, প্রেম বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার বড্ড প্রেম পাচ্ছে, বাহার ভাই।”

মেয়েটার লাগামহীন কথাবার্তায় বাহার কপাল কুঁচকে ফেলল। চিত্রার কিছুটা কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখল। না জ্বর তো ততটা বাড়েনি তবে শরীর মোটামুটি ভালোই গরম। কিন্তু উল্টোপাল্টা বকার মতন অবস্থা হয়নি। তবে মেয়েটা ইচ্ছাকৃত এসব বলছে! বাহারকে লজ্জা দেওয়ার উদ্দেশ্যে! চিত্রা ততক্ষণে বাহারের হাতটা চেপে ধরল, ফিসফিস করে বলল,
“জ্বরটা শরীরের না, মনের। একটু উষ্ণতা চাচ্ছে মন।”

বাহার হাতটা ছাড়িয়ে নিল। পকেট থেকে সিগারেট বের করল। সিগারেটে ফুক দিয়ে বলল,
“পৃথিবীতে সবচেয়ে মিষ্টি অনুভূতি কী জানো, রঙনা?”

চিত্রা চোখ উল্টে তাকালো। মন খারাপ নিয়ে বলল, “কী, বাহার ভাই?”

“প্রেমিকার ঠোঁটের চুমু।”

বাহারের লাগামহীন কথায় চিত্রা হতভম্ব। সে বাহারকে অবাক করতে চেয়েছিল কিন্তু বাহার নিজেই এমন কথা বলবে তা যেন সে ভাবতেও পারেনি। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“বাহার ভাই!”

বাহার উচ্চ স্বরে হেসে দিলো। চিত্রার বেশ ক্ষানিকটা কাছে এসে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা কোমল কোমড়টা। ঘোরগ্রস্তের মতন বলল,
“আগুনের সংস্পর্শে এলে মোম গলে আর প্রেমিকার সংস্পর্শে এলে প্রেমিক গলবে না তা কী করে হয়, রঙনা? আমিও তো প্রেমিক হতে চাই, পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি অনুভূতি আমারও তো পেতে ইচ্ছে করে।”

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৭.

সওদাগর বাড়ির মিলন মেলা যেখানে হয় সেটা হলো তাদের খাবার টেবিল। রাত হলেই বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ সেই মিলন টেবিলে উপস্থিত হয়। ছোটোবড়ো সকলে একসাথে বসে খাবার খায়। আজও কার ব্যাতিক্রম হলো না। সকলেই খাবার খেতে বসলো একসাথে। বাড়ির মহিলারা সকলকে খাবার পরিবেশন করছে। অন্যান্য দিনের মতন আজকের দিনটি উৎসবমুখর না। থমথমে একটা ভাব বিরাজমান। মাঝে মাঝে চিত্রার হাঁচি-কাশির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে অতঃপর সবটা আবার নিরবতায় আচ্ছন্ন। চামচের টুংটাং শব্দ হচ্ছে। সকলের মনযোগ খাবার খাওয়ায়৷ যেন মনযোগ সড়লেই বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে।

খাবার পথে চিত্রা আবার হাঁচি দিলো। জ্বরে মেয়েটার নাজেহাল অবস্থা। মেয়েটা নাক টানতেই তার বাবার গুরুগম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“তুমি কী শুরু করলে? বৃষ্টি এলে তো হুশ থাকে না আর এখন সবাইকে বিরক্ত করছো।”

চিত্রা মুখটা আরেকটু নিচু করে ফেলল। মুনিয়া বেগম অবাক কণ্ঠে নিজের স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“এ কেমন কথা! হাঁচি-কাশি এলে সেটা কী আটকে রাখা যায়! অদ্ভুত সব কথাবার্তা।”

“তুমিই তোমার মেয়েকে আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছ মেঝোবউ। এত আহ্লাদ দেওয়ার কিছু কি হয়েছে? মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে সেটা তুমি বকাঝকা না করে আবার তার পক্ষ ধরে কথা বলো তাই-না?”

মুনিয়া বেগম হতাশার শ্বাস ফেললেন। তার চিত্রাকে নিয়ে এই দু’টো মানুষের কী এমন সমস্যা সে বুঝে পায় না। হ্যাঁ, চিত্রা যখন হলো তখন তারা আশা করেছিল তুহিনের পর আরেকটা ছেলে সন্তান হবে যেহেতু তার ভাসুর আর দেবরের কোনো ছেলে সন্তান ছিলো না। কিন্তু তাই বলে এত সমস্যা হওয়ার আদৌও কোনো যৌক্তিকতা আছে! তাদের তো প্রথম সন্তান ছেলে। ছেলে সন্তান নিয়ে এত হা হুতাশের তো কোনো কারণই সে দেখে না।

মুনিয়ার ভাবনার মাঝেই আফজাল সওদাগর খাবার থামিয়ে নিজের মেয়ের দিকে চায়। মেয়েটার চোখ-মুখ শুকিয়ে শূন্য প্রায়। মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় ক্লান্ত সে! কত রাত ঘুমায় না! বাবাদের চোখ বোধহয় ফাঁকি দিতে পারেনা চতুরতা। সন্তানের হাহাকার ছুঁয়ে দেয় বাবার চিত্ত। সে শব্দ করে গলা পরিষ্কার করল। মূলত সবাইকে নিজের দিকে মনোযোগী করল। অতঃপর বিজ্ঞ মানুষের ন্যায় মাথা দুলাতে দুলাতে ডাকলেন,
“চাঁদআম্মু….. ”

চাঁদনী তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন। বাবার ডাকে ধ্যান ভাঙে তার। ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতন বলে,
“বলো, আব্বু?”

“মা, তুমি কী আমাকে বিশ্বাস করো?”

আফজাল সওদাগরের এমন প্রশ্নে চাঁদনীসহ উপস্থিত সকলে অবাক হলো। চাঁদনী কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
“এমন কথা বলছো কেন, আব্বু?”

“তুমি উত্তর দেও, আম্মু।”

“হ্যাঁ আব্বু, নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।”

“তুমি কী এটা মানবে যে আমি যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা অবশ্যই তোমার ভালোর জন্য নেই?”

চাঁদনীর এবার বুক কাঁপছে। শরীর বেয়ে ঘাম শিশির বিন্দুর ন্যায় গড়িয়ে পড়ছে। বাবা কী এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে এটা মানতে পারবে না? বাবা ভয়ঙ্কর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেই তো এভাবে বলছেন। বাবা কী তাকে বিয়ে দিয়ে দেবে? চাঁদনীর শক্ত চোখের কোণে মুক্তোর দানার মতন অশ্রুরা কত গীতিকাব্য লিখছে! কিন্তু পরিস্থিতির কারণে মুক্তি পাচ্ছে না।

রোজা সওদাগর স্বামীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন তুললেন,
“কী বলবে খুলে বলো? ওর বিয়ের ব্যাপারে যে বলেছিলাম সেটা ভেবেছিলে?”

রোজা সওদাগরের কথার পিঠেই চাঁদনীর দাদীও প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“আমি যে ছেলেটার কথা বলেছি তাকে নিয়েই কী কিছু বলবি? ছেলে কিন্তু ভালো।”

চাঁদনী মাথা নিচু করেই রইলো। চোখ বেয়ে উপচে পড়ছে অশ্রু তবে সে তা প্রকাশ্যে আনবে না। ভুল তো তার হয়েছেই এবার নাহয় প্রায়শ্চিত্ত করবে! আর তার এই ভুলে যে অংশীদার ছিল সে তো বেমালুম ভুলেই বসে আছে চাঁদনী নামক মেয়েটার কথা। এই মেয়েটার জীবন যে কতটা নরক করেছে, সেই কথা ছেলেটার অবগত নেই বোধহয়।

চিত্রা অসহায় চোখে তাকালো, ভেঙে আসা অসুস্থ স্বরে বলল,
“বড়ো আব্বু, আপাকে এখনই বিয়ে দিয়ে দিবে? আর ক’টা দিন সময় দিলে…..”

“তোমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেছ বেয়া দব মেয়ে। বড়োদের মাঝখানে কথা বলতে আসো, লজ্জা শরম নেই? সব তোমার জন্য বুঝলে। একমাত্র তোমার জন্যই আজ এত সমস্যা।”

বাবার ধমকে নাজুক চিত্রার লজ্জায় অপমানে চোখে জল এলো। বড়ো ভাই বুঝলো হয়তো বোনের কষ্ট তাই তো বেশ মশকরা করে বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
“এ আর নতুন কী? পৃথিবীর সব ঘটনার দোষ চিত্রার। পৃথিবী যদি কোনোদিন গোল থেকে ত্রিভুজ আকৃতির হয়ে যায় তবে সে দায়ভারও চিত্রার।”

“তুহিন!”

“আহা, আমি একটা কথা বলছি তো! কী শুরু করলি নুরু? কথাটা শেষ করতে দিবি তো নাকি?”

আফজাল সওদাগরের ধমকে নিশ্চুপ পুরো পরিবেশ। চাঁদনীর নত মাথার দিকে তাকিয়ে আফজাল সওদাগর প্রশ্ন করলেন,
“আমি যেকোনো সিদ্ধান্ত এখন জানাবো। তার আগে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল, আমি কী করবো?”

চাঁদনী ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। আফজাল সওদাগর সম্মতি পেতেই জিজ্ঞেস করলেন,
“কাউকে তোমার পছন্দ? মানে, কাউকে ভালোবাসো?”

চাঁদনী চোখ তুলে বাবার দিকে তাকালো। চোখে তার অশ্রুতে টইটুম্বুর। কণ্ঠ কাঁপছে। তবুও বহু কষ্টে উত্তর দিল,
“বাসতাম আব্বু।”

উপস্থিত মহলে যেন নিবিড় বজ্রপাত হলো। চাঁদনীর মা হায় হায় করে ওঠল। চিত্রার চোখে জমলো জল। তার আপার যে এ কথাটা বলতে কতটুকু বুক ফেটেছে তা বোধহয় তার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। রোজা সওদাগর তখন অগ্নিশর্মা। মেয়ের দিকে তেড়ে যেতে নিলে বাঁধা দিলেন আফজাল সওদাগর। ধমকে বললেন,
“যদি ওর শরীরে একটা টোকাও পড়ে তবে তোমার শরীর কত টুকরো হবে তুমি আন্দাজও করতে পারবে না। আমার ক্ষমতা নিশ্চয় তুমি ভুলে যাওনি?”

রোজা সওদাগর নিজের স্বামীর এহেন ধমকে যেন কিছুটা শিহরিত হলেন। দাঁড়িয়ে গেল শরীরের লোমকূপ। স্বামীর অতীত তার অজানা নয়। একসময় ভয়ঙ্কর লোক ছিলেন তিনি। চাঁদনী নিজের বাবার পানে চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। বাবা কী এমন বলবেন যে সবাইকে এতটা চুপ করিয়ে দিচ্ছেন! নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কিছু!

আফজাল সওদাগর আবার মেয়ের পানে তাকালেন, কোমল কণ্ঠে বললেন,
“ভালোবাসতে? তার মানে এখন বাসোনা তাই তো?”

চাঁদনীর কথাটা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে তবুও সে উত্তর দিলো, “না।”

“কতদিনের সম্পর্ক ছিল?”

চাঁদনী অস্বস্তি জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিল, “প্রায় আট বছর।”

থেমে গেলো সকলের শ্বাস প্রশ্বাস। বি স্ফোরি ত নয়ন জোড়া মেলে সবাই চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে রইলো অথচ চাঁদনীর দৃষ্টি নত। চিত্রা তখন নিঃশব্দে কাঁদছে। তার আপার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সেটা কীভাবে বুঝাবে সবাইকে?

অবাকের স্বরে অবনী বেগম বললেন, “আট বছর!”

চাঁদনী কেবল উপর-নীচ মাথা নাড়লো। চাঁদনীর মা রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,
“সেজন্যই বিয়ে করতে চাইতে না? আমাদের ঘাড়ে এত বছর বসে খেয়েছ মাথা আর সেদিন খেলে ইজ্জত। ছিহ্!”

“আম্মু, সব তো খেয়েই ফেললাম তোমাদের এবার বোধহয় তুমি আমার জান খেতে চাচ্ছো?”

চাঁদনীর ধীর একটা বাক্যে মায়ের স্বত্তা নেড়ে উঠলো। আফজাল সওদাগর নিজের স্ত্রীর পানে তাকালেন চোখ রাঙিয়ে। লোকটার চক্ষু রক্তজবা প্রায়। রোজা সওদাগর তা দেখে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে দিলেন। ছুটে চলে গেলেন নিজের ঘরে। পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হতে এবার শ্বাস ফেলে পুরো দমে কথা বললেন আফজাল সওদাগর,

“চাঁদমা, আমি তোমার বাবা। আমি অবুঝ নই। আমি বুঝতে পেরে ছিলাম আমার মেয়েটা ভালো নেই। বেশ অনেকদিন যাবত সে খারাপ আছে। তোমার মা বুঝেনি। সেটা তার ব্যর্থতা। তোমার ছবি নিয়ে একটা কেলেঙ্কারি হলো যা তোমার প্রাপ্য নয়। তবুও অপমান জুটেছে তোমার ভাগ্যে। ঐ যে, মানুষ অন্যের ভালো সহ্য করতে পারেনা। সেই জন্য বোধকরি আমাদের সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের হিংসে করা কোনো মানুষ দুর্বলতা বানিয়ে নোংরামি ছড়িয়ে দিয়েছে এলাকা জুড়ে। এতে কী হয়েছে? বড়জোর মানুষ তোমাকে খারাপ ভাবছে। তবে মানুষের ভাবনায় কী আর আমার ফুলের মতন চাঁদের গায়ে কলঙ্ক লেপে যায়? যায় না। তুমি ভয় পাচ্ছো আব্বু তোমার প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে খারাপ কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কি-না? কিন্তু তোমার আব্বুর এখনো এতো মন পাষাণ হয়নি। তুমি দীর্ঘ আট বছর কাউকে ভালোবেসেছ। তাকে এত সহজে তুমি হয়তো ভুলতে পারবে না। আমি চাইও না তোমার উপর কিছুটা চাপিয়ে দিতে। তবে আম্মু, বাবা হিসেবে চাই তুমি ভালো থাকো। আর সেইজন্যই আমি তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমাকে অন্যকোনো সম্পর্কের সাথে জড়াবো না। কিন্তু তোমাকে বাঁচাতে আমি তোমাকে এ দেশ থেকে পাঠিয়ে দিব অন্য কোথাও। তুমি একা থাকবে, ভালো থাকবে, নিজেকে গুছিয়ে নিবে সেই প্রত্যাশায়। আর আমি তোমার পাশে আছি। ভালো থাকার জন্য তোমার আরেকটা মানুষ প্রয়োজন এটা আমি বলবো না। একাও ভালো থাকা যায়। আর তুমি আপাতত একা-ই ভালো থাকবে। তুমি বলেছিলে তোমার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার ইচ্ছে। বরফ দেখার ইচ্ছে। তোমার সেই শখ পূরণ করবে তোমার বাবা। তুমি খুব শীগ্রই সেখানে চলে যাবে। তোমার ভিসা তৈরী। ভেবেছিলাম তোমাকে উপহার হিসেবে দিব, সেই জন্যই না জানিয়ে তোমার ভিসার কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। কে জানতো সে উপহার তোমাকে একটা বার বাঁচানোর জন্য কাজে লাগাতে হবে! আমার পরম ব্যর্থতা, তোমাকে দেশ ভ্রমণের ভিসা দিতে পারলাম অথচ ভালো থাকার মানুষটাকে হয়তো দিতে পারলাম না। তুমি ভালো থাকবে চাঁদ। ভালো থাকবে তুমি। তাই না আম্মু?”

চাঁদনী বাবার থেকে এতটা ভালোবাসা বোধহয় আশা করেনি। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। আফজাল সওদাগর চেয়ার ছেড়ে ওঠে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। কেঁদে উঠলেন পাহাড়ের মতন বাবাও। সন্তানের অসহায়ত্বে বাবাও যে নিজেদের বড়ো ব্যর্থ মনে করেন! উপস্থিত সকলের চোখেই অশ্রু। চিত্রাও ডুকরে কেঁদে উঠলো। চাঁদনী আপার এত ভালো ভাগ্য দেখে তার আজ তৃপ্তি লাগছে। যাক, অন্তত কিছুতো পেলো মানুষটা!

_

মধ্য রাতে বাতায়নের কোল ঘেষে জ্যোৎস্না হামাগুড়ি দিচ্ছে চিত্রার ঘরের মেঝেতে। আজ পুরো এলাকাতে বিদ্যুৎ নেই। কিছু একটা কারণবশত বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ঘুম নেই মেয়েটার চোখে। বাহার ভাইয়ের সাথে সেদিন রাস্তায় কথা বলার পর আর দেখা হয়নি। তার অসুস্থতার জন্য পড়াতে আসেনি মানুষটা। গত কয়েকদিন যাবতই মেয়েটার থেমে থেমে জ্বর আসছে আর শুকনো কাশি দেখা দিয়েছে। অতিরিক্ত ঠান্ডা থেকেই বোধহয় এই সমস্যা।

হুট করেই বাহির থেকে গিটারের শব্দ ভেসে এলো। চিত্রার অবসাদ ছুটে গেলো। বাহার ভাই অনেকদিন পর গিটার ধরেছে বোধহয়। অনেকদিন গিটারের শব্দ পায়নি সে। তৃষ্ণার্ত মন সে শব্দ পেয়ে উল্লাসিত হলো। আগে বিদ্যুৎ কখনো ভুল করে যদি রাতে না থাকতো, চিত্রা আর বনফুল তখন রাস্তায় ফুটপাতে বসে কত গল্প করতো! তাদের এলাকায় যেন মেয়ে দুটোর হাসির শব্দে পুষ্প বৃষ্টি হতো! আর আজ, ভাগ্যের খেলা তাদের দু’জনকে দুই পৃথিবীতে আবদ্ধ করেছে।

চিত্রার ভাবনার মাঝেই রাস্তা থেকে খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে এলো। চিত্রা জানালার দিয়ে রাস্তায় চাইলো। বনফুল বরাবরের নিয়ম অনুযায়ী আজকেও হাসছে তবে আজকে তার সাথে চিত্রা নেই হাসছে নোঙর নামক মেয়েটা। চিত্রার কান্না পেলো। কেঁদেও দিল সে। বাহারের গিটার তখন উন্মাদনা ছেড়ে করুণ স্বরে বাজছে। প্রেমিকার মনের ভাব কী বুঝেছেন লোকটা? কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার তুমুল কাশি শুরু হলো। মুখ চেপে ধরতেই হাতে তরল কিছুর উপস্থিতি অনুভব করল চিত্রা। হাতটা চোখের সামনে ধরতেই জ্যোৎস্নার আলোয় চিকচিক করল লাল রঙের তরল পদার্থ। পাশের ছাঁদের বাহার ভাইয়ের অবয়বটাও নিশ্চুপ। তার গিটারের সুর হুট করে ছন্দপতন হলো। তার গিটারও কি বুঝলো ঝড়ের পূর্বাভাস!

#চলবে

প্রেমোত্তাপ পর্ব-১৪+১৫

0

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৪.
বাহিরে ঝড়। গাছপালা বাতাসে হেলে যাওয়ার উপক্রম। পুরো ঘরময় ছড়িয়ে গেছে ঝড়ের মিষ্টি বাতাস। শীতলতায় ছেয়ে গেছে রুম। মোটা একটা কম্বলের নিচের চিত্রার আদুরে, কোমল দেহটা চুপসে আছে। তার সামনেই অভিজ্ঞ চোখে তাকে পরোখ করছে। চিন্তিত ভঙ্গিতে দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে বাহার। ঘরের ভিতরেই দাঁড়িয়ে আছে তুহিন। সোফায় বসে আছে চাঁদনী। মেয়েটারও ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। বার কয়েক হাঁচিও দিয়েছে। ঠান্ডায় জুবুথুবু প্রায়। ডাক্তার বিজ্ঞ চোখে অনেকক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“মেয়েটার তো অনেক জ্বর। আমি কিছু মেডিসিন সাজেস্ট করছি তোমরা এনে খাইয়ে দেও।”

তুহিন মাথা দুলাতেই ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তুহিন বোনের ওষুধ আনতে এবং ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে গেলো। ঘরে রইলো বাহার আর চাঁদনী। চাঁদনীর নাজেহাল অবস্থা চোখ এড়ালো না বাহারের। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“চাঁদ, তোমার গিয়ে এখন ঘুমানো উচিৎ। ঘরে কোনো জ্বরের ওষুধ আছে? থাকলে অবশ্যই সেটা খেতে হবে।”

বাহারের কথায় চাঁদনী ঝিমিয়ে আসা নেত্র যুগল নিয়ে বলল,“না সমস্যা নেই, বাহার ভাই।”

“অবশ্যই সমস্যা আছে। সবাই একসাথে অসুস্থ হয়ে গেলে তো হবেনা, তাই দ্রুত যাও আর ওষুধ খেয়ে ঘুমাও।”

চাঁদনী আর দ্বিমত পোষণ করলো না বাহারের কথায়। সোফা থেকে উঠে চিত্রার মাথায় বার কয়েক হাত বুলালো। মেয়েটা এত আদুরে! চাঁদনীর মনে হয় কেবল- গোটা পৃথিবীর সুখ যদি সে মেয়েটাকে এনে দিতে পারতো! মেয়েটা কিছু আবদার করলে তা পূরণ করতে না পারলে তার নিজেকে পাগল পাগল লাগে। সে জানে, এই যে এতরাতে তারা ঢাকা চলে আসছে, এর জন্য অনেক কথাই তাদের শুনতে হবে। চাঁদনীকে খোঁটা দেওয়া হবে তার সত্তা নিয়ে। এতবছর যাবত বাবার ঘাড়ে বসে খাওয়ার খোঁটাটা তার মা নিবিড় ভাবেই দিবে। তবুও তার আফসোস নেই। মেয়েটা যে একটু স্বস্তি পেয়েছে সেটাই তার শান্তি।

বোনের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়েই চলে গেলো চাঁদনী। পুরো ঘরে কেবল একা রইলো বাহার। চিত্রার শরীর তখন গুটিশুটি মেরে কম্বলের নিচে আরাম খুঁজতে ব্যস্ত। আর বাহার ব্যস্ত সেই চিত্রার মুখে নিজের শান্তি খুঁজে নিতে।

মেয়েটা নড়তে গিয়ে কম্বলের অনেকটা অংশ শরীর থেকে ফেলে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ ঠান্ডা বাতাসে সে কাঁপছে। বাহার এগিয়ে এলো, যত্ন করে কম্বলখানা তুলে দিল শরীরে। চিত্রার গভীর ঘুম মুহূর্তেই হালকা হয়ে এলো। ভেঙে যাওয়া অসুস্থ কণ্ঠ নিয়ে ক্ষীণ স্বরে ডাকলো,
“বাহার ভাই..”

বাহারের ব্যস্ত হাত থেমে গেলো। চোখ তুলে তাকালো অসুস্থ মুখটার পানে। আনমনেই সে উত্তর দিলো,
“হুম?”

“বনফুল আসেনি?”

বাহার এবার চোখ তুলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল চিত্রার দিকে। মেয়েটা অসুস্থ অবস্থাতেও বনফুলকে খুঁজছে! বাহার তপ্ত শ্বাস ফেলল। চিত্রার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বলল,
“ও অসুস্থ তো, তাই আসেনি। পরে আসবে। অনেক রাত হয়েছে না?”

“আন্টিও আসেনি তাই না?”

এবারের প্রশ্ন বাহারকে অসহায় করলো। সে অসহায় ভাবেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো উত্তর বিহীন। বাহিরে কালো আকাশের বুকে সোনার কাঠির ন্যায় যেন বিদ্যুৎ চমকালো। গমগমে শব্দে বজ্রপাত হলো আকাশের বুকে। চিত্রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বাহারের দিকে। বেশ ক্ষাণিকটা সময় তাকিয়ে থাকার পর বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলল,
“দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন যে বাহার ভাই? আপনিও বুঝি দূরে যাওয়ার ছন্দ আঁকছেন মনে? কতটা দূরে যাবেন? বনফুল আর আন্টির মতন দূরে? নাকি আকাশ থেকে মাটির দূরত্বের মতন দূরে?”

বাহার স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। জ্বরে কি মেয়েটা ভুলভাল বকছে! কিন্তু বাহারের হৃদয় মন্দিরতো জানে, মেয়েটা ভুল বলছে না সবটা। আকাশ যতটা কাছের মনেহয় ততটা কাছে তার বসবাস যে নয়। মেয়েটার মন কি সেটা ধরে ফেলল!

চিত্রা আবার বলল, “দূরে যাচ্ছেন?”

“কাছে ছিলামই বা কবে?”

বাহার প্রশ্ন করলো ঠিক কিন্তু উত্তর শুনলো না। চিত্রার উত্তর দেওয়ার আগেই সে প্রস্থান নিয়েছে রুম থেকে। চিত্রাও উত্তর দিলো না। কেবল দু-চোখ ভরে দেখলো সে প্রস্থানের নিয়ম। প্রেমিক পুরুষরা বড্ড পাষাণ হয় বোধহয়। নাহয় এমন করে মন ভাঙতে পারে? বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। চিত্রার ভীষণ কান্না পেলো কিন্তু কাঁদলো না। এই কান্নাটা বাহার ভাইকে হারানোর ভয়ে না। এই কান্নাটা নিজের বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ের। সে আজ অনুভব করেছে, এতদিন বনফুলকে জড়িয়ে ধরলে আত্মার যে শীতলতা মিলতো আজ তা আর সে পায়নি। পরিচিত মুখ কোথাও একটা বড্ড অপরিচিত ঠেকলো তার। প্রানপ্রিয় বন্ধুত্ব হারানোর শোক চিত্রাকে আরেকটু নিস্তেজ করলো। অতঃপর সে আবার তলিয়ে গেলো গভীর নিদ্রায়।

_

পৃথিবীতে রাত অনেক আসে কিন্তু কিছু কিছু রাত নিগার মন খারাপ, শূণ্যতা নিয়ে আসে। আজ চাঁদনীর রাতটাও তেমন একটা রাতের অন্তর্ভুক্ত। চোখ ভর্তি ঘুম অথচ মন ভর্তি বিষন্নতার লড়াইয়ে হেরে গেল ঘুম এবং জিতে গেল বিষন্নতা যার ফলস্বরূপ সে জেগে রইল। দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনা। কষ্ট হয় বুকে। চোখের সামনে যখন শাহাদাত এবং তার নববধূর সংসার ভেসে উঠে তখন গোটা একটা পৃথিবী চাঁদনীর কাছে অসহ্যকর লাগে। এই অনুভূতির বিশ্লেষণ করা যায় না, আর না কাউকে সংজ্ঞা দেওয়া যায় তার। কেবল বুকে বয়ে বেড়ানোই স্থায়ী।

চাঁদনীর মাথা ব্যাথাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তার বালিশের নিচে থাকা মোবাইলটা কেঁপে উঠল। ঝিম ধরা শব্দে ভারী হয়ে গেল চাঁদনীর মাথা। অথচ ফোনটার থামারই নাম নেই! চাঁদনী আর না পেরে ফোনটা তুলল, রিসিভ করে কানে লাগাতেই অপর পাশ থেকে একটা ব্যস্ত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ছাঁদে আসুন। আমি আপনাদের ছাঁদে।”

কথাটুকু বলেই সাথে সাথে কলটা বিচ্ছিন্ন করা হলো। চাঁদনী হতভম্ব নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এতরাতে তাকে ছাঁদে ডাকছে! এই ছেলেটার সাহস কত বড়ো! চাঁদনীর মন একরোখা হলো। চ ড় খেয়েও যে ছেলের শিক্ষা হয়নি, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে আবার ঘন্টা পেরুতেই তাকে ছাঁদে ডাকছে যে ছেলে সে ছেলের সাথে আর যাই হোক, চাঁদনীর কোনো সম্পর্ক নেই। চাঁদনী চোখ বন্ধ করলো। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা চালালো। ক্ষণে ক্ষণে আকাশে তখন বজ্রপাত হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমাকাচ্ছে নতুন ছন্দে! চারপাশ আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় চোখ বন্ধ করে রাখতে রাখতে চাঁদনীর ঘুম এলো। বোধহয় এক ঘন্টা সে ঘুমিয়েও নিলো নির্দ্বিধায়। কিন্তু মনের খুঁতখুঁত সে ঘুমকেও স্থায়ী হতে দিলো না। আচমকাই ঘুম কেটে গেছে তার। ঘুম ভাঙতেই মাথায় এলো মৃন্ময়ের কথা। ছেলেটা পাগল, কে জানি এখনও ছাঁদে আছে কি-না! আনমনেই চাঁদনীর ভীষণ চিন্তা হলো। শরীরে ওড়না জড়িয়ে সাবধানী পায়ে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে ওঠেই হাতে থাকা ছাতাটা মেলে ধরলো মাথার উপর। বৃষ্টি হওয়ায় ছাঁদের বাতিও বন্ধ। অন্ধকারে চাঁদনী প্রায় কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক চাইলো। বার কয়েক ডাকলো ছেলেটার নাম ধরে অথচ কোনো সাড়াশব্দ নেই! চাঁদনী ভাবলো হয়তো ছেলেটা চলে গেছে। যেই না সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াবে তখনই পুরো পৃথিবী আলোকিত করে যেন সোনার কাঠি আদুরে ভাবে তার রূপ এঁকে দিলো আকাশের বুকে। সে আলোয় দেখা গেল ভিজতে থাকা সিক্ত মৃন্ময়ের মুখ। চাঁদনী প্রথমে কিছুটা চমকে গেলেও পরে এগিয়ে গেলো তার দিকে। ছাঁদের লাইটটাও জ্বালিয়ে দিলো কিন্তু আলো খুবই নিভু নিভু। চাঁদনী এগিয়ে গিয়ে বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“এত রাতে এখানে কী? বে য়া দ বীর সীমা ছাড়াচ্ছো।”

“ভালোবাসা বেয়াদবী হলে আমি হাসিমুখে হাজার বার বেয়াদব হতে রাজি।”

মৃন্ময়ের কণ্ঠ অনেকটা বসে গেছে। কথা গুলো কেমন ভাঙা ভাঙা শোনালো। চাঁদনী ধমক দিল,
“এতটুকু একটা ছেলে কি-না প্রেম নিয়ে পড়েছে। যাও বাড়ি।”

“এই নিন ওষুধ, জানি ঠান্ডা লাগবে আপনার কিন্তু আপনি ওষুধ খাবেন না, তাই নিয়ে এলাম। এক্ষুণি খাবেন এটা তারপর আমি যাবো।”

মৃন্ময়ের কথায় তাজ্জব চাঁদনী। ছেলেটা তাকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য এখানে এসেছে! এতটা পা গ ল! চাঁদনীর চোখ ভরে জল এলো। বৃষ্টির জল থেকে সে জল আলাদা করার উপায় নেই তার উপর আঁধার। কিন্তু ছেলেটা কেমন যেন বুঝে গেল! অসহায় কণ্ঠে বলল,
“আমি আরও চ ড় খেতে রাজি, তবুও কাঁদবেন না।”

চাঁদনী দ্বিতীয়বারের মতন অবাক হলো। ছেলেটা এমন কেন! এই ছেলেটার জন্য আজ তার নিজেকে ভাগ্যবতী লাগছে। কত ভাগ্য করেই না এসেছে সে! নাহয় এমন একটা পা গ ল ছেলের সাথে পরিচয় হতো আদৌ! চাঁদনী ভীষণ স্নেহে মৃন্ময়ের বড়ো বড়ো চুল গুলো এলোমেলো করে দিলো। ছাঁদের হলুদ বাল্বটায় বড্ড স্নিগ্ধ দেখালো সে দৃশ্য।

_

রাত ভীষণ অন্যরকম যাওয়ার পরেই আজ সওদাগর বাড়িতে উলোটপালোট করা একটা দিন এলো। বাড়ির বড়ো মেয়ের নামে রটলো ভীষণ বাজে কথা। তাদের সোসাইটির ফেসবুক গ্রুপে ভাইরাল হলো একটা ছবি। যে ছবিতে সওদাগর বাড়ির বড়ো মেয়ের মুখ স্পষ্ট অথচ ছেলেটার কেবল পিঠ দেখা যাচ্ছে। সওদাগর পরিবার সকালেই ছুটে আসে শহরে। মেয়ের এমন কলঙ্কে দিক ভ্রষ্ট তারা। অথচ চাঁদনী তখনও কিছু জানেনা। দৈনন্দিন কাজের স্রোতে ছুটে গিয়েছে অফিস।

#চলবে
#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৫.

গোছানো একটি জীবনের যখন ছন্দপতন শুরু হয় তখন সে জীবনটা বয়ে বেড়ানো কষ্ট সাধ্য হয়ে ওঠে। চাঁদনীর বেলাও ব্যাতিক্রম হলো না। তার সুন্দর, স্বচ্ছ জীবনটাকে হুট করেই এতটা ঘোলা হয়ে যেতে দেখে সে দিকভ্রান্ত হয়ে গেলো। কান্নার সাহসও হলো না তার চোখ দুটোর। আর কত কাঁদবে! ক্লান্তি বলেও তো একটা জিনিস আছে?

চাঁদনী ফ্যালফ্যাল নয়ন জোড়া মেলে বসে আছে নিজের আঁধার ঘরটায়। বাকরুদ্ধ, বিমর্ষ চোখ গুলো আজ চির নিদ্রা চাচ্ছে। যে চোখে কাজলের আস্তরণ মায়া সৃষ্টি করত আজ সে চোখে ধূ-ধূ মরুভূমি। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় পুরুষকে হারিয়েছে, হারিয়েছে সকল রঙ শেষে কিনা চরিত্রটার উপরও এত গাঢ় কলঙ্ক পড়তে হলো?

অভিযোগ অভিযোগে ভারি হয় মন। ফোনের স্ক্রিন অন করে তার আর মৃন্ময়ের আলোচিত সেই ছবিটি দেখে। আপাত দৃষ্টিতে ছবিটিতে অশ্লীলতার ছিটেফোঁটা নেই কিন্তু এই একটা ছবি চাঁদনীর জীবনটা নরক করতে যথেষ্ট। ছবিটি সকাল অব্দি তাদের সোসাইটির গ্রুপে থাকলেও তা আপাতত ফেসবুক তোলপাড় করেছে বিভিন্ন ক্যাপশন সমেত। সেগুলোও খারাপ না, ভীষণ রোমান্টিক ক্যাপশনে তা শেয়ার করেছে মানুষ। অথচ সকলে যা ভাবছে তার এক ফোঁটা যদি সত্যি হতো তবুও চাঁদনীর আফসোস থাকতো না। কিন্তু এটার আগাগোড়া পুরোটাই তো মিথ্যে। কিন্তু তার গালে চ ড়ের ছাঁপ মিথ্যে নয়। তার পরিবারের চোখে তাকে নিয়ে বিস্ময়টা মিথ্যে নয়। সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে নিজের নামে এমন ভয়ঙ্কর কথাটাও তো মিথ্যে নয়!

চাঁদনী ফোনের স্ক্রিনের ছবিটায় কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এখানে যে মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে কেউ বিশ্বাসই করবে না। ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না তবে চাঁদনীর হাসি মুখটা বেশ স্পষ্ট। চাঁদনী কখনোই কারো সাথে কোনো শত্রুতা করেনি জানা স্বত্তে, তবুও কে এমনটা করল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। বিনা কারণে কেউ এমনটা কেন করবে! চাঁদনীর মাথায় হুট করে একটা কথা এলো। সবাই যেহেতু ছবিটা দেখেছে তার মানে সবার মাঝে মৃন্ময়ও আছে। কিন্তু এমন একটা ছবি দেখার পরও ছেলেটা তার সাথে একটুও যোগাযোগ কেন করল না? মৃন্ময় যা পা গ ল ছেলে, এতক্ষণে তো তার তান্ডব চালানোর কথা কিন্তু সে এতটা নিশ্চৃপ কেন? চাঁদনী নিজের মনেই প্রশ্নটা করে উত্তর হীন দিশেহারা হলো। তৎক্ষণাৎ কল লাগাল মৃন্ময়ের ফোনে। পর পর কয়েকবার রিং হয়েই ফোনটা কেটে গেল। চাঁদনী তখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য উতলা। সে আবার কল দিল। প্রায় কিছুক্ষণ রিং হতেই অপর পাশ থেকে মৃন্ময়ের ঘুম ঘুম কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যালো ইন্দুবালা…”

“মৃন্ময়, কোথায় তুমি? তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।”

“কী কথা? বলুন?”

“তুমি কোথায় এখন? আমার সাথে দ্রুত দেখা করো। তোমার সাথে কথা আছে। তুমি কী কিছুই জানো না?”

“কী জানার কথা বলছেন? হয়েছে কী? আমি তো….”

মৃন্ময় বাকি কথা বলার আগেই কলটা বিচ্ছিন্ন হলো। চাঁদনী তখন উন্মাদ প্রায়। আবার ব্যস্ত গতিতে কল দিতেই অপর পাশ থেকে একটি নারী কণ্ঠ বলে উঠল ‘আপনার কলটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।’

চাঁদনীর আর সহ্য হলো না এত লুকোচুরি, এত যন্ত্রণা। সে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত গিয়ে নিজের ফর্মাল পোশাকটা বদলে এলো। সাদা রঙের একটা জামা পড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। সওদাগর বাড়ি তখন নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ আগেই সে বাড়ির উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছে বাড়িটাকে। চাঁদনীর বাবা আফজাল সওদাগর প্রায় অসুস্থ হয়ে গেছেন। চাঁদনীর মা রোজা সওদাগর নিজের এত বড়ো মেয়ের গায়েও হাত তুলতে ভুলেননি। চাঁদনীর দাদী অবশ্য চিত্রাকেও কথা শুনিয়েছেন। কী বিশ্রী ভাবে দোষারোপ করেছেন! তার ভাষ্যমতে, না চিত্রা গ্রাম থেকে শহরে আসার ইচ্ছে পোষণ করতো আর না এতকিছু হতো।

ড্রয়িং রুমে কাউকে না পেয়ে সেই সুযোগে বেরিয়ে গেল চাঁদনী। রাত তখন আটটা বাজছে। পথে ঘাটে পথচারী দেখা যাচ্ছে বেশ। চাঁদনী ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল, যদি কেউ তাকে আবার কথা শোনায়! সেই ভয়ে। চাঁদনী অনেকটা লুকিয়েই মৃন্ময়দের বাড়িতে উপস্থিত হলো। সংশয়ে তার বুক কাঁপছে। কলিং বেলটা বাজাবে কি-না ভেবে সে ক্লান্ত। তবুও মনে সাহস সঞ্চয় করল, দাঁত মুখ খিঁচে বাজিয়ে ফেলল কলিংবেল। কলিংবেল বাজানোর সেকেন্ড পেরুতেই দরজা খুলে দিল বাড়ির নতুন বউ। মেয়েটা চাঁদনীকে চিনতে সময় ব্যয় করল না। চাঁদনীকে দেখেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,
“আরে আপু, আসুন না ভেতরে। আপনাকে দেখাই যায় না। আজ কি মনে করে এলের! আল্লাহ্, ভেতরে আসুন না।”

চাঁদনী চোরা চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“আঙ্কেল আন্টি কেউ বাসায় নেই?”

“না তো। ওরা একটু গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে।”

“মৃন্ময় আর শাহাদাৎ কোথায়?”

“ভাইয়া তো বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গেছেন আর উনি অফিস থেকে এখনও আসেনি।”

চাঁদনীর মাথায় যেন বজ্রপাত হল। মৃন্ময় শহরে নেই মানেই চাঁদনীর এই সময়টা আরও ভয়াবহ হয়ে যাবে। এটা ভাবতেই চাঁদনীর মাথা ঘুরে উঠলো। তার উপর সারাদিন না খাওয়া। নিলা হয়তো বুঝলো চাঁদনীর অবস্থা। চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“আপু, আপনি কী অসুস্থ?”

“না না, নিলা, তেমন কিছু না।”

“ভেতরে আসুন না আপু। এসে বসুন।”

চাঁদনী তাকাল নিলার পানে। মেয়েটা এত স্বাভাবিক ব্যবহার কীভাবে করছে তার সাথে? মেয়েটা কী চাঁদনীর ভাইরাল হওয়া ছবিটা দেখেনি? হয়তো দেখেনি, দেখলে নিশ্চয় এত ভালো আচরণ করতো না। নিশ্চয় ঠেস দিয়ে কিছু বলত।

চাঁদনীর ভাবনার মাঝেই নিলা আবার বলল, “আসুন না আপু। এসে একটু বসুন। আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে অনেক।”

“না নিলা, দরজাটা আটকে দেও। আমার একটু কাজ আছে। পরে আসব।”

কথাটা শেষ করেই চাঁদনী পা আগালো পথের দিকে। পেছন থেকে নিলার আশ্বাস ভরা কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আপনাকে আমি অনেক বিশ্বাস করি, আপু। আপনি এমন একটা মানুষ, যাকে দেখলেই মনেহয় পবিত্রতা শব্দটা কেবল আপনার জন্য সৃষ্টি। আমি কখনোই আপনার সম্পর্কে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারিনা। সেখানে এসব ছবি দেখে আপনার ভেঙে যাওয়া মোটেও মানায় না।”

চাঁদনী অবাক চোখে ঘুরে দাঁড়াল। নিলা মেয়েটার মুখে মিষ্টি হাসির রেখা। চাঁদনী যেন ছোটো এই কথা গুলোর মাঝে বিরাট ভরসা খুঁজে পেল। এই হাসিটা কোথাও একটা তাকে আবার নতুন করে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি দিল। মেয়েটার সাথে তার পরিচয় খুবই সীমিত সময়ের কিন্তু তবুও মেয়েটা কত বিশ্বাস করেছে তাকে। অথচ তার নিজের মা, যে তাকে দশমাস গর্ভে আর এত বছর হৃদয়ে ধারণ করেছে সে মা’ই কেমন ভুল বুঝল। আহারে জীবন!

_

বাহিরে বাতাস, ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও পড়ছে। সেই বৃষ্টিতে প্রায় কাক ভেজা হয়ে চিত্রাকে পড়াতে এসেছে বাহার। মেয়েটা জুবুথুবু হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। জ্বরটা বোধহয় কমেনি। বাহার এসে রাশভারি কণ্ঠে ডাক দিল,
“চিত্রা..”

চিত্রা আধো আধো চোখে তাকাল, অসুস্থ কণ্ঠ বলল,
“আজ পড়াবেন?”

“পড়াতেই তো এলাম। পড়বে না?”

“বাড়ির পরিস্থিতি খারাপ। জানেন না চাঁদনী আপার কী হয়েছে?”

“কী হয়েছে?”

“আপার ছবি তো ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে।”

“তো?”

বাহারের ভাবলেশহীন উত্তরে চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো। অবাক কণ্ঠে বলল,
“আপনি তো বলছেন কেন? এটা নিয়ে বাড়িতে অনেক ঝামেলা হয়েছে।”

“তোমাদের বাড়ির মানুষ গুলা একেকটা তো মগজ ছাড়া। ছবিটাই তো আমি এমন কিছুই দেখিনি। চাঁদনী একটা ছেলের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। স্বাভাবিক একটা ছবি। বন্ধু কিংবা ভাইয়ের মাথাতেও এমনে হাত বুলায় মানুষ। তাই বলে এত হা হুতাশ করতে হবে? তোমরা কী ভাত খাও না ভুসি?”

বাহারের কথা যুক্তিযুক্ত ছিল কিন্তু তা সহ্য হলো না নুরুল সওদাগরের। দরজায় দাঁড়িয়ে একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
“বেয়াদব ছেলে। আমরা ভুসি খাই?”

“সেটা আমি কীভাবে জানব? আমি কী আপনাদের ভুসি কিনে দিয়ে যাই? কিন্তু আপনাদের মাথা থেকে বের হওয়া গোবর মার্কা বুদ্ধি দেখে বুঝতে অসুবিধা হবেনা যে আপনারা কী খান।”

নুরুল সওদাগর তেড়ে এলেন। ধমকে বললেন,
“রাস্কেল।”

“শালা, ভালোর কোনো জামানায় রইল না। ভালো কথা বললেও মানুষ খেঁকিয়ে উঠে।”

নুরুল সওদাগর এবার রেগে বাহারকে ধাক্কা দিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কায় ছেলেটা দু-পা পিছিয়ে গেলেও ঠোঁটে ঝুলানো ছিল মুচকি হাসি। চিত্রা দুর্বল শরীরটা নিয়ে দ্রুত উঠে বসল। তার ভয় হচ্ছে, এখানে কিছু উল্টোপাল্টা না হয়ে যায়। কিন্তু চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে বাহার মুচকি হেসে বলল,
“আপনার শরীরে তো ভালোই জোড় আছে। সেজন্য তো বলি ষাঁড় লাথি দিলে মানুষের হাড় ভাঙে কেন। ভুসির অনেক ক্ষমতা।”

বাহারের উদ্দেশ্য ছিল নুরুল সওদাগরকে খ্যাপানো আর সেই লক্ষ্যে সে সক্ষম হলো। নুরুল সওদাগর যখন রেগে চিৎকার দিলেন বাহার তখন হেলেদুলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। চিত্রা অসহায় চোখে সেটা দেখল কেবল।

#চলবে

প্রেমোত্তাপ পর্ব-১২+১৩

0

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১২.

ফোনের অপর পাশ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও চিত্রা ফোনটা নিজের কানেই ধরে রাখলো। তার কর্ণে কেবল প্রতিধ্বনিত হলো একটি কথা “ভালো আর রাখলে কই”! অষ্টাদশীর মনে প্রশ্নদের হামাগুড়ি, সত্যিই কী সে ভালো রাখেনি? অথচ যা ঘটেছে তা তো তার হাতের বাহিরে ছিলো তবে বাহার ভাইয়ের অভিযোগ তার উপর কেন? সে তো ভালো রাখতে চেয়েছিল কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিলো অন্যরকম। তাতে সেই-বা কী করতে পারে! অথচ বাহার ভাইটা তার কথা শুনলে তো! বাহার ভাই তো নিজের অভিযোগের ছড়া শুনিয়েই বিচ্ছিন্ন হলো কল থেকে। চিত্রার অসহায়ত্বের কবিতাখানা আর পাঠ করতে দিলো কই!

চিত্রা তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো পুকুরপাড়ের ঘাট হতে। এই গ্রামে তার মোটেও মন টিকছে না। অথচ গ্রাম তার প্রিয় একটি জায়গা। তখন দুপুরের কড়া রোদে তার শরীরে ম্লান আলো ছড়াচ্ছে। চিত্রা হেলতে দুলতে পুরোনো রাজকীয় বাড়িটায় প্রবেশ করলো। উঠোনের মাঝখানে বিরাট একটা বটগাছ আছে যা মার্বেল পাথর দিয়ে খোদাই করা। চকচক করছে। দেখে বুঝাই যাচ্ছে নিয়মিত এটা পরিচর্যা করা হয়। পরিচর্যা করাটাও স্বাভাবিক। দাদী যেমন কঠোর ও পরিষ্কার মানুষ, সে অপরিষ্কার জিনিস কখনোই পছন্দ করবেন না। চিত্রা মার্বেল পাথরে খোদাই করা বসার জায়গাটাই গিয়ে বসলো। মনের মাঝে আকাশ-পাতাল ভাবনা নিয়ে পা দুলাতে লাগলো। দুপুরের রোদের মাঝে কিছু মিঠে বাতাসও এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার শরীর। খারাপ লাগছে না। আবহাওয়াটা আরামদায়ক। এই আবহাওয়ায় খারাপ করে থাকা যায় না। দুপুরের সকল রোদ যেন শুষে নিয়ে যায় দুঃখ।

“এই, তুমি এখানে বসে আছো কেন ভরদুপুরে?”

দাদীর গম্ভীর কণ্ঠে চিত্রার ভাবুক সত্তা কেঁপে উঠলো। আমতা-আমতা করে বলল,
“আসলে ঘুম আসছিল না তো, তাই আরকি….”

“তাই আরকি ভূতের মতন এখন বসে আছো! তোমার কী ক্লান্তি টান্তি লাগে না? সারারাত জেগে এতদূর এলে। ঘুম কী নেই? তোমাদের বাড়িতে যখনই কথা হতো তখনই তো শুনতাম তুমি কুম্ভকর্ণের মতন ঘুমাচ্ছো তবে এখানে ঘুমাচ্ছো না কেন?”

চিত্রা উত্তর দিলো না বৃদ্ধার কথায়। আসলে সচারাচর এমনই হয়, আমরা যাদের পছন্দ করিনা তাদের কোনো ভালো কথাও আমাদের ভালো লাগে না আর ঠেস মারা কথা তো মনে হয় শরীর জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু দাদী বয়সে অনেক বড়ো দেখে হজম করতে হয় সে কথা।

চিত্রার নিরবতার মাঝেই আনোয়ারা সওদাগর আবার বললেন,
“যাও ঘরে। দেশ গ্রামে ভূতের অভাব নেই যে তোমাকে সে দায়িত্ব নিতে হবে। চুপচাপ গিয়ে ঘুমাও।”

চিত্রা আরও কিছু বলতো কিন্তু থেমে গেলো। দাদীর সাথে কথা বলা মানেই এক কথায় দু’কথা, দু’কথায় তিন কথা করে কথা বাড়বে। এরচেয়ে নিরবতা শ্রেয়।

_

চিত্রা রুমে ঢুকতেই দেখে সকলেই ঘুমে নিমজ্জিত। কেবল জেগে আছে চাঁদনী আপা। খোলা বারান্দার গ্রিল চেপে বাহিরে তাকিয়ে আছে। নাকটা লাল হয়ে আছে। নিশ্চয় কেঁদেছিল। বড় আপার আর কী কাজ! কান্না ছাড়া সে কোনো কাজই করতে পারেনা যেন!

চিত্রা ঘরময় পায়চারী করল। বাহার ভাই কল কেটে দিয়েছে দ্রুত যার কারণে সে জিজ্ঞেসই করতে পারেনি যে বনফুল ঠিক আছে কিনা! অথচ তার ভেতর ভেতর চিন্তায় হাহাকার করছে। বিরক্তিতে তেঁতো অনুভব হচ্ছে অনুভূতি।

চিত্রার পায়চারীতে চাঁদনী আপাও স্থির হয়। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“এই চিতাবাঘ, এমন ঘরের মাঝে ছুটোছুটি কেন করছিস? কী সমস্যা?”

চিত্রা থামলো। অসহায় চোখে তাকালো আপার দিকে। তার এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এমন নাস্তানাবুদ ধরণের পরিস্থিতে সে কখনো পড়েনি। তাই জানা নেই এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়। তার উপর চিন্তারা পেয়ে বসেছে আহ্লাদ। এবার বোধহয় বুক ভার করে জমেছে কান্না।

চাঁদনী বোধহয় বুঝলো তার বোন কিছু নিয়ে ভীষণ টানাপোড়েনে আছে তাই নিজেই এগিয়ে এলো বোনের কাছে। আশ্বস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে আমার চিতাবাঘের? তার এত চিন্তা কিসের শুনি?”

চিত্রা এবার হামলে পড়ল এই ভরসার বক্ষস্থলে। চোখের জমিয়ে রাখা এতক্ষণের অশ্রু গঙ্গা বাঁধ ভেঙে ফেলল। অসহায় ও ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
“জানো আপা, কাল যখন এখান থেকে ফোন গেলো? তার কিছুক্ষণ আগেই বাহার ভাইদের বাড়ি থেকে আমি একটা এম্বুলেন্স বের হতে দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু বলার আগেই দাদীর এমন ঘটনার কথা শুনলাম যে পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে গেলো। আজ বনফুলকে কল দিলাম ধরলো বাহার ভাই। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে কেটে দিলো। আমার মনে হচ্ছে বিরাট গড়বড় হয়ে গেছে। আমি কী করবো, আপা!”

চিত্রার দীর্ঘ কথায় চাঁদনীর কপাল কুঁচকে এলো। চিন্তা নামক রোগটা কিছুটা সংক্রামিত। এটা একজনের মস্তিষ্ক থেকে খুব দ্রুতই আরেকজনের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই নীতি মোতাবেক রোগটা ছুঁয়ে ফেললো চাঁদনীকে। সে হতবিহ্বল হয়ে বলল,
“তুই এত বড়ো ঘটনা এখন বলছিস, চিত্রা? কী সর্বনাশ কাহিনী হয়ে গিয়েছে আর তুই এতক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে ছিলিস? এটা ঠিক করিসনি।”

চাঁদনী আপার কথায় চিত্রার অপরাধবোধ যেন বেড়ে গেল তড়তড় করে। কান্নার দাপটও বাড়লো। নিস্তব্ধ কান্নারা এখন শব্দ ছুলো। চাঁদনী দ্রুত মুখ চেপে ধরলো চিত্রার। সাবধানী কণ্ঠে বলল,
“আস্তে আস্তে, চিতাবাঘ! অহি, চেরি ঘুমাচ্ছে। একবার যদি দাদী জানতে পারে তুই তোর বান্ধবীর জন্য হাউমাউ করে কাঁদছিস কী হবে ভাবতে পারিস? হৈচৈ করিস না। হৈচৈ করলে ঝামেলা বাড়বে।”

চিত্রা বহু কষ্ট করে কান্নাদের শব্দগুলো গিলে ফেলল। দু’হাতে চেপে ধরলো মুখ। যেন সেও চায় ঝামেলামুক্ত ভাবে একটা সমাধান। চাঁদনী চিত্রার অসহায়ত্ব দেখে ভরসা দিলো। আশ্বাস দিলো সে কিছু করবে।

_

দুপুরের খাবার টেবিলে জমেছে ভীড়। সওদাগর বাড়ির সকলে একসাথে খেতে বসেছে। এত মানুষ একসাথে বসার পরও কোনো রকমের টু শব্দ অব্দি হচ্ছে না। কেবল শোনা যাচ্ছে বাসনপত্রের খুটখাট শব্দ। একসাথেই খেতে বসেছে সব। খাবার বেড়ে দিচ্ছে বাড়ির কাজের মানুষেরা। চিত্রার খাবার ঠিক যেন গলা দিয়ে নামছে না। এক চিন্তা তার ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে। খালি চোখে ভেসে উঠছে বনফুলের মুখটা। কী স্নিগ্ধ, সহজ সরল সেই মুখমন্ডল! সদা হাস্যোজ্জ্বল মেয়ে সে বনফুল! আর এই বনফুলই না-কি গতকাল এমন বিরাট একটা কাজ করে বসেছে! ভালোবাসার মানুষটাকে পাবেনা বলে হাউমাউ করে কেঁদেছে! বিনা কারণে লজ্জায় নুইয়ে থাকা বনফুল কিনা নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার লোভে বেহায়া, নির্লজ্জ কথা শুনেছে! মানুষ কী না করে একটু ভালোবাসার জন্য! আহারে ভালোবাসা!

চিত্রার চিন্তিত মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হয়না চাঁদনীর। সাথে সাথে মাথায় আসে বনফুলের ভাবনাও। অতঃপর হাজার দোনোমোনো নিয়ে নিজের বাবা আফজাল সওদাগরকে শুধায়,
“আব্বু, আমরা বাড়ি ফিরবো কবে?”

খাবার পাতে দীর্ঘ নিরবতার সমাপ্তি ঘটলো। সকলে চোখ তুলে তাকালো বনফুলের দিকে। আনোয়ারা সওদাগর পছন্দ করেনা খাবার পাতে কেউ কথা বলুক। অথচ বোনের জন্য চাঁদনী সেই অপছন্দের কাজটাও করলো। সাথে সাথেই দাদীর তীক্ষ্ণ বাণও ভেসে এলো,
“কেন? এটা কী বাড়ি না? বটতলা?”

চাঁদনী থেমে গেলো। দাদী যে এমন কোনো কথা বলবে তা তার আগেই জানা ছিলো। তবুও ভেতর ভেতর একটু লজ্জা ও অপমানও বোধ করলো। চাঁদনী আপার নতজানু মুখটা দেখে মায়া হলো চিত্রার। অতঃপর বোনের পক্ষ ধরে সে বলল,
“দাদী আমিই আপাকে এটা জিজ্ঞেস করতে বলেছিলাম। আসলে কলেজে পরীক্ষার নোটিশ দিয়েছে তো তাই।”

আনোয়ারা সওদাগর কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন চিত্রার দিকে। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“এখনও মানুষ হলেনা।”

ব্যস্! চিত্রার ও চাঁদনীর সকল সাজানো কথা মালার উপর পানি ঢেলে দিলো এই মহিলা। চিত্রা বলতে পারলো না তার অন্তর জ্বলে যাওয়ার কথা।

_

বাহিরে তুমুল বৃষ্টি। বনফুলদের ছোটো দু’তালা বাড়িটা অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্লান্ত। বাড়ির ভেতরে আজ তত আলো জ্বলানো নেই। করুণ স্বরে কাঁদছে যেন কেউ। সময়টা রাতের দ্বিপ্রহর। ছাঁদ থেকে আবার ভেসে আসছে গিটারের সুর। বৃষ্টির মাঝেও বাড়ির বেপরোয়া ছেলেটা নিজের পছন্দের কাজটা করছে বোধহয়। বাড়ির বাহিরের হলুদ বাল্বটা আজ বন্ধ।

এই মধ্যরাত্তিরে আঁধারের সকল গম্ভীরতা ভেদ করে বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠলো। খুব ব্যস্ত গতিতে পর পর কয়েকবার বাজলো। দরজার ওপাশের মানুষটা বোধহয় বড্ড অধৈর্য। সেই শব্দে ছাঁদ থেকে ছুটে এলো এলোমেলো মানুষটা। আঁধার হাতড়ে দরজা খুলতেই আবছা এক মেয়েলী অবয়ব ভেসে এলো। বাহার সেই অবয়বকে স্বচ্ছ করার জন্য বাহিরের আলো জ্বালালো। হলুদ আলো পড়তেই সিক্ত নারী দেহখানা চোখে ভেসে উঠলো। হলুদ আলোয় অষ্টাদশীর গোল মুখটা চকচক করে উঠতেই বাহার চমকালো। মেয়েটার চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। বাহার বিচলিত হলো। মেয়েটার কপালে ব্যস্ত হয়ে হাত ছোঁয়াতেই চমকে উঠলো বাহার। অবাক কণ্ঠে বলল,
“এই মেয়ে, এত জ্বর কেন শরীরে? আর এত রাতে কোথা থেকে এলে? তুমি না কাল গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলে? কাঁপছো কেন রঙনা? কি হয়েছে তোমার?”

বাহারের বিচলিত কণ্ঠের বিপরীতে অষ্টাদশী নির্বাক। তার আকাশ ছোঁয়া অসুখ যেন মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেলো। কাউকে দেখার অসুখ যে পৃথিবীর দীর্ঘতম অসুখ। জ্বর নিয়ে বাঁচা গেলেও সে অসুখ নিয়ে বাঁচা যায় আদৌও?

#চলবে

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৩.

বাহিরে তুমুল বর্ষণ। বৃষ্টির নৃত্যে প্রকৃতি মুগ্ধ। হলুদ আলোয় জ্বলজ্বল করছে মায়াবী মুখখানি যা পুরুষের সুঠাম হাতের কবলে নিত্যান্তই নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে দু’হাতের আঁজলে যেন ফুটন্ত পদ্ম। কন্যার চক্ষু প্রায় নিভু নিভু। শরীর থেকে অসহনীয় একটা উত্তাপ বের হচ্ছে। সেই তাপেই ঘোর নেমেছে চোখে। মস্তিষ্ক ফাঁকা অনুভব হচ্ছে। প্রেমিকের চিত্ত তা দেখে উন্মাদ প্রায়। ছটফটিয়ে উঠছে প্রেম পায়রা। চিন্তিত চেহারায় কয়েক ভাঁজ পড়লো। আলতো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ঠিক আছো রঙ্গনা! ভীষণ জ্বর তো শরীরে।”

“শরীরের উত্তাপ দেখছেন আর মনের উত্তাপ লাগছে না বুঝি? ওটা ছুঁয়ে দেখা যায় না বলে কী ব্যাথা কম না তাপ কম? শুনি?”

চিত্রার বেসামাল কথায় বাহারের চিন্তা বাড়লো। গালে কোমল ভাবে ছুঁয়ে বলল,
“ভেতরে আসো দ্রুত। এত জ্বর নিয়ে ভিজেছো কেন? আর এত রাতে এখানে এসেছোই বা কীভাবে? ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার পথ তো অনেক! অনেক দূরত্ব রাস্তার।”

“দূরত্বের চেয়ে গুরুত্ব বেশি ভূমিকা রেখেছে। তাই তো দূরের পথও ব্যাপার নয়।”

চিত্রার কণ্ঠস্বর প্রায় জড়িয়ে আসছে। বাহার যখন অথৈয় ভাবনায় দিক ভ্রষ্ট তখনই চিত্রার পাশে এসে উপস্থিত হলো চিত্রার বটবৃক্ষের ন্যায় বড়ো ভাই- তুহিন। তার চোখে-মুখেও একটা চিন্তা লেপটানো। বাহার অবাক হলো তুহিনকে পাশে দেখে। প্রায় বিস্মিত কণ্ঠেই বলল,
“তুহিন, তুমি এসেছো! তোমরা সবাই কী চলে এসেছো? আর এত রাতে চলে আসার কারণ কী? কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“সমস্যা তো আপনার সামনেই দাঁড়ানো, বাহার ভাই। ওর জন্যই তো এত রাতে আমার ফিরতে হলো এখানে।”

তুহিনের কথায় ভ্রু কুঁচকালো বাহার। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো চিত্রার পানে। কিছুটা সংশয় নিয়েই বলল,
“মেয়েটার তো জ্বর শরীরে। তার উপর ভিজেছে। কী বাজে অবস্থা ওর। লাল হয়ে গেছে মুখটা। কি এমন হয়েছে যে এই রাতে ফিরলে?”

বাহারের কথায় তুহিন তপ্ত একটা শ্বাস ফেলল। প্রায় অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে বলল,
“দোষ অবশ্য আমারই। সেদিন বনফুলের সাথে এত খারাপ আচরণ করে একবারও জানতে চাইলাম না মেয়েটার অবস্থা কী। অবশ্য সুযোগই পেলাম না। সেদিন রাতেই দাদীর গুরুতর অবস্থা শুনে ছুটে গেলাম সেখানে। গতকাল খাবার টেবিলে চিত্রা আর চাঁদনী আপু হুট করে বলছে চিত্রার নাকি পরীক্ষা সে ঢাকায় আসবে। কিন্তু দাদীকে তো চেনেনই, বড্ড কঠোর। সে চিত্রাকে আসতে দিবে না। তারপরই বিকেল থেকে মেয়েটার জ্বর। ধীরে ধীরে জ্বর বাড়তে লাগলো। সেই গ্রামের বাড়িতে রাত একটা বাজে ডাক্তার ডাকা হলো। চিত্রা বেহুঁশ অবস্থায় কেবল বলছিল, ঢাকা আসবে। ডাক্তার জানালেন জ্বরটা ঋতু ভিত্তিক না, অতিরিক চিন্তার ফলে মস্তিষ্কে প্রেশার পড়াতে এই জ্বরের সৃষ্টি। ডাক্তার ওষুধ দিলেন কিন্তু জ্বর কমার নাম নেই। আজ সারাদিন সে কোনো খাবার মুখে তুলেনি। তার এক আবদার, সে বাসায় আসবে। কিন্তু দাদী এক কথার মানুষ, সে চিত্রাকে এ অবস্থায় কোনো রকমে ঢাকায় আসতে দিবেনা। অতঃপর আমি আর না পেরে তাকে আশ্বাস দিলাম আমি নিয়ে আসবো ওরে। সবাই যখন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমালো তখন ওরে নিয়ে রওনা হলাম সাথে চাঁদনি আপুও আসছে। তিনজন কাউকে না বলে চলে আসলাম। কাল একটা তুলকালাম হবে হয়তো। মেয়েটা বকাও খাবে। কিন্তু ওর জেদের কাছে আমরা পরাজিত। ও নাকি বনফুলকে যে কোনো মূল্যে দেখবে। নাহয় শান্তি পাবেনা।”

বাহার দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। চিত্রাও বাহারের হাতটা আঁকড়ে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। তন্মধ্যেই দক্ষিণ দিকের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বনফুল। দু’দিনেই মেয়েটার লাবণ্য কমে গিয়েছে শতগুণ। চোখের নিচে দেখা দিয়েছে ক্লান্তির চিহ্ন, ডান হাতের মাঝে ব্যান্ডেজের ছোঁয়া যেন বুঝিয়ে দিলো মেয়েটার ভেঙে পড়ার মাপকাঠি। চিত্রা চোখ তুলে তাকালো, চোখ উপচে আসছে তার অবাধ্য অশ্রুরা। সে আর অপেক্ষা করলো না, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বনফুলকে। বাচ্চাদের মতন মুহূর্তেই কেঁদে দিলো সে। বনফুল নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দরজার সামনে দাঁড়ানো সুঠামদেহী প্রিয় পুরুষের দিকে। বাহার খেয়াল করলো বোনের দৃষ্টি। মেয়েটা তো এ দুদিন উন্মাদের মতন করেছিল, আজও না আবার তেমন কিছু করে বসে! গা হীম হয়ে আসে তার। চিত্রার সাথে না আবার হিংস্রতা দেখিয়ে ফেলে! মেয়েটা যে তাহলে মানতে পারবে না। বনফুলকে চিত্রা কতটা ভালোবাসে তা কারোই অজানা নয়।

বাহারকে অবাক করে দিয়ে বনফুল চিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো। মিষ্টি হেসে বলল,
“কাঁদছিস কেন চিতাবাঘ? কী হয়েছে তোর?”

চিত্রা আরও শক্ত করে বনফুলকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার কণ্ঠ জড়িয়ে এলো। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“বনফুল, তুই আমায় ক্ষমা করেছিস তো?”

“ক্ষমার কথা আসছে কোথা থেকে চিতাবাঘ? তোর সাথে কী আমার সেই সম্পর্ক?”

চিত্রা মাথা তুললো। বনফুলের ব্যান্ডেজ করা হাতটা আলতো ছুঁয়ে দিলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন, বনফুল? কী হয়েছে তোর?”

চিত্রার প্রশ্ন পুরোপুরি এড়িয়ে গেল বনফুল,
“তোর শরীর তো মারাত্মক গরম, চিতাবাঘ? শীতে কাঁপছিস। এই অবস্থা কেন শরীরে!”

চিত্রা উত্তর দিতে পারলো না। তার আগেই শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। বনফুল শক্ত হাতে আগলে ধরলো মেয়েটাকে। ছুটে এলো বাহার আর তুহিনও। বোনকে জাপটে ধরলো ভাই পরম যত্নে। ক্রমশ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“চিত্রা, এই চিত্রা, কী হয়েছে তোর? কী হলো তোর? চিত্রা, শোন বাবু, কি হয়েছে তোর? ভাইকে বল।”

চিত্রা ততক্ষণে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে। জ্ঞান নেই এক ফোঁটাও। এত হৈচৈ শুনে ছুটে এলেন বাহারের মা আয়েশা খাতুন। চিত্রা আর তুহিনকে দেখেই আয়েশা খাতুনের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো কিন্তু চিন্তার একটা স্বচ্ছ রেখা গেল তার মুখ জুড়ে। সে ছুটে এলেন চিত্রার কাছে। চিত্রার গালে ছোটো চ ড় দিয়ে বার কয়েক ডাকলেনও মেয়েটাকে। কিন্তু ওর হুশ নেই। আয়েশা খাতুন ছুটে পানি নিয়ে এলেন কয়েক বার চোখ মুখে ছিটালেনও। তবুও ভাবান্তর ঘটেনা মেয়েটার। আয়েশা খাতুন গম্ভীর স্বরে বলে,
“ওকে ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডাকো। ভীষণ জ্বর তো শরীরে।”

_

তুমুল বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়। ছেলেটার চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। কতক্ষণ যাবতই এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছেও না আবার চাঁদনীকেও যেতে দিচ্ছেনা। এক পর্যায়ে বিরক্ত হলো চাঁদনী, কিছুটা ধমকে বললো,
“মৃন্ময় সমস্যা কী তোমার? এত রাতে রাস্তাতে কী তোমার? আর পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

“আপনাকে আগলাতে পারছি না বলেই পথ আগলাচ্ছি।”

“উল্টোপাল্টা কথা বলে চ ড় খেও না মৃন্ময়।”

“সোজা কথা বলবো?”

“হ্যাঁ বলো।”

মৃন্ময় কিছুক্ষণ সময় নিয়ে হুট করে বললো,“ভাইয়ার মতন আমায় ভালোবাসবেন?”

কথা শেষ করতেই চাঁদনী সশব্দে একটা চ ড় বসিয়ে দিলো ছেলেটার গালে।

#চলবে