হলুদ রাঙা বাতি গুলো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার কোণ ঘেঁষে। যেন প্রেমিকের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রূপসী প্রেমিকা। চলন্ত গাড়িটাই বাজছে গান খানা। চিত্রার চিত্ত উত্তেজিত, দৃষ্টি তার গাড়ির বাহিরের ঘোলা কাঁচে। গাড়ি চালাচ্ছে তুহিন। গাড়িতে অবস্থিত তার মা, বাবা, অহি আপা, চাঁদনী আপা। পেছনের গাড়িতে পরিবারের বাকি সদস্যরা। এখন রাত সাড়ে তিনটা। তাদের গন্তব্য কুমিল্লা। ঢাকা থেকে এত রাতে কুমিল্লা যাওয়ার কারণ অবশ্যই ভয়াবহ। চিত্রার দাদীর অবস্থা শোচনীয়। হয়তো আজ রাতটুকুও সময় নেই বৃদ্ধার হাতে। সংসারের সকলকে দেখার বড্ড ইচ্ছে। তাই এই রাতকে উপেক্ষা করেই সকলে ছুটে যাচ্ছে সেখানে। মৃত্যুর আগে একটা বার মানুষটাকে দেখতে পারলেই সবার শান্তি। নাহয় চিরকাল একটা আফসোস থেকে যাবে।
চিত্রা ঘাড় ঘুরিয়ে সকলের দিকে খুব সাবধানে দৃষ্টি রাখলো। একমাত্র তুহিন ভাই ছাড়া সকলেই ঘুমে। অবশ্য সকলকেই কাঁচা ঘুম থেকে জাগিয়ে তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়া হচ্ছে তাই হয়তো কারোই ঘুম কাটে নি। কেবল ঘুম নেই চিত্রার চোখে। বাহার ভাইদের বাড়ির কোল ঘেষে খসে পড়া বিধ্বস্তার গল্প তাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছে না। তাড়াহুড়ায় সে কাউকে বলতেও পারেনি কিছুক্ষণ আগে যে বাহার ভাইদের বাড়ি থেকে একটা এম্বুলেন্স বেরিয়ে গেছে। বলার আগেই তো গ্রামের বাড়ি থেকে কল এলো সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ঠিক এমন সময় চিত্রা চেয়েও আর বলতে পারেনি। তবে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে সে আবার ভালো করে বাহার ভাইদের ঘরটা দেখেছে। গেইটে বড়ো তালা তখনও ঝুলছিল। তার মানে এই বাড়িটার সাথেও খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছে। অথচ চিত্রা কি করবে বুঝতেই পারছে না। দাদীও তার পর না। দাদীকেও দেখতে যাওয়া উচিত। আবার বনফুলের সাথেও তার আত্মার সম্পর্ক। অথচ মূল্য দেওয়ার বেলায় আত্মার সম্পর্কের আগে রক্তের সম্পর্ক মূল্য পেলো।
চিত্রার দমবন্ধ লাগছে। গাড়ির কাঁচটা খুলে দিলে সে একটু বোধহয় শ্বাস নিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতো। কিন্তু সে তুহিনের সাথে কথা বলছে না। কীভাবে জানাবে তার মনের আকুতি! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। তার সেকেন্ড কয়েক পরেই চিত্রার পাশের জানালাটা খানিক খুলে গেলো। বাহিরের উন্মাদ বাতাস ছুঁয়ে দিলো চিত্রার চোখ মুখ। এতক্ষণের বুক ভারটা যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো। চিত্রা আড়চোখে ভাইয়ের পানে তাকালো। তুহিনের দৃষ্টি সামনের ঘুমিয়ে থাকা আঁধার রাস্তায়। চিত্রার খুব ইচ্ছে হলো ভাইজানকে মনের অস্থিরতা জানাতে কিন্তু পরক্ষণেই বিকেলের কথা মনে পড়ে সে ইচ্ছে পথেই মারা গেলো। যে মেয়েটা পাগলের মতন ভালোবেসেছে বলে ভাইজান তাকে এত গুলো মানুষের সামনে চড় দিতে দ্বিধাবোধ করেনি, সে মেয়েটার ভয়ানক খবরও হয়তো তার ভাইকে বিচলিত করতে পারবে না। চিত্রা জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিলো। হুট করেই মনে হলো বনফুলের ফোনে একটা কল করে দেখা যাক রিসিভ হয় কি-না। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মুহূর্তেই তার হাতের পার্সটা থেকে ফোন বের করলো। ফোন লাগালো কাঙ্খিত নাম্বারে। তার মনের অস্থিরতার মাঝে দুমুঠো তাচ্ছিল্য ছুড়ে দিয়ে ফোনের অপর পাশ থেকে মহিলা কণ্ঠটি বলে উঠলো ‘আপনার কলটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’। চিত্রার মন ছোটো হয়ে এলো। বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকে একসাথেই আসে।
আরও সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চিত্রার চোখ নিভে এলো নিদ্রায়। অতঃপর সে তলিয়ে গেলো গভীর ঘুমে।
_
দীর্ঘ অনেকটা পথ পেরিয়ে ব্রাক্ষনবাড়িয়ার নিবিড় ছোটো শহরটায় এসে গাড়ি থামে চিত্রাদের। বিশাল প্রাচীর ঘেরা বাড়িটায় লাল ইটের সৌন্দর্য। পুরোনো হওয়ায় কিছুটা রঙ তামাটে হয়েছে। পুরোনো পুরোনো একটা সাজ তার আদল জুড়ে। বিশাল লোহার গেইট পাড় হয়েই বাড়িটা।
বিশাল এক জার্নির পর মানুষ গুলো ক্লান্ত। গাড়ি থামতেই সকলে বেরিয়ে এলো গাড়ি ছেড়ে। বাড়ির কাজের লোকগুলো ছুটে এসে ব্যাগ গুলো নামিয়ে ফেললো গাড়ি থেকে।
সকলেই ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেলো বাড়ির ভিতর। শুনশান নিরবতায় বাড়িটা আচ্ছন্ন। সকলে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই হতভম্ব। কারণ গতকাল রাতে বৃদ্ধার যে অবস্থার কথা শুনে তারা ছুটে এসেছিল তার এক ফোটা চিহ্নও বৃদ্ধার মাঝে নেই। সওদাগর গিন্নী পায়ের উপর পা তুলে রাজকীয় ভাবে বসে আছে। কারুকাজ সংবলিত সোফা খানায় সাদা চামড়ার সত্তর উর্ধ্ব নারীও কেমন উজ্জ্বল লাভা ছড়াচ্ছে। সওদাগর বাড়ির তিন ছেলেই ছুটে এলেন নিজেদের মায়ের কাছে।
আনোয়ারা সওদাগর ছেলেদের পানে তাকালেন, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আমি মরি নি, এত সহজে বোধহয় মরবো না। কেবল তোমাদের মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম যে তোমাদের মা জীবিত তাই এ পথ অবলম্বন করা।”
আফজাল সওদাগর, নুরুল সওদাগর ও আমজাদ সহ বাকিরাও অবাক হলো। আনোয়ারা সওদাগর খুব কঠোর আর চতুর একজন মানুষ তাই বলে নিজের শরীর নিয়ে এত বড়ো কথাটা যে বলতে পারে কেউ ভাবেইনি।
নুরুল সওদাগর কপাল কুঁচকে ফেললেন মায়ের এহেন হেয়ালিতে। বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন,
“আপনি তো শহরে চলে গেলেই পারতেন আম্মা। আমাদের সকলেরই ব্যস্ততা রেখে ছুটে এসেছি আপনার গুরুতর অবস্থার কথা শুনে। আর আপনি কি-না ঠাট্টা করছেন!”
“নুরু, তুই কী আমার জীবিত চেহারা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করছিস? কালকের বলা মিথ্যা টা সত্যি হলেই কী খুশি হতিস নাকি?”
মায়ের শক্ত কণ্ঠের দাপটে থেমে গেলেন নুরুল সওদাগর। বাড়ির বউরা এগিয়ে গিয়ে শাশুড়ির হালচাল জিজ্ঞেস করলো। নাতি নাতনিরাও দাদীকে নিয়ে হৈচৈ করলো কেবল এক কোনায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ রইলো। দাদীর সাথে বরাবরই তার ভাব তেমন বেশি না। দাদী সবসময় সবাইকে কঠিন কঠিন কথা বলেন যা চিত্রার অপছন্দ। আর সেই অপছন্দই দু’জনের মাঝে একটা দেয়াল তৈরী করেছে।
আনোয়ারা সওদাগর সকলের সাথে ভাব বিনিময় করে সবাইকে যার যার রুমে পাঠিয়ে দিলেন। বাড়িতে রুম অনেক গুলো থাকা স্বত্তেও সবসময় গ্রামে এলে চিত্রারা চার বোন এক রুমে থাকে। আজও ব্যাতিক্রম হয়নি। চিত্রা, চাঁদনী, চেরি, অহি একটা রুমেই উঠলো। এত মানুষ এক সাথে বিধায় একটা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠান ভাব দেখা দিলো এতদিনের ঝিমিয়ে থাকা বাড়িটাই। সকলে ফ্রেশ হয়ে আবার বিশ্রাম করতে চলে গেলো। কেবল ঘুম নেই চিত্রার চোখে। বিরাট ঝড়ের আশংকায় তার বুক যেন কেমন করে কাঁপছে।
_
বাড়ির সাথে লাগোয়া এক রাজকীয় পুকুর ঘাট রয়েছে। ঘাটের একটা সুন্দর নামও রয়েছে। নীলকণ্ঠ ঘাট। পুকুরের পানি গুলো বিশেষ কোনো কারণ বশত নীলচে রঙের। এবং সেই কারণেই ঘাটের নাম নীলকণ্ঠ ঘাট। এই ঘাটের পশ্চিম দিকে বিশাল সরষে ক্ষেত। জায়গাটা নিরিবিলি তবে সুন্দর। চিত্রার পছন্দের একটি জায়গা। ঘুম না আসাতে সে চলে এলো পুকুরপাড়। পাথরের তৈরী মোটা পাড়ে বসলো। পা গুলো ডুবিয়ে দিয়ে আনমনে বসে আছে সে। সূর্য তখন মাথার উপরে আলো ছড়াচ্ছে তবে গাছ গাছালির জন্য সূর্যের প্রখরতা ছুঁতে পারছে না চিত্রাকে।
চিত্রা হাতের মুঠোফোন টা আবার তুলে ধরলো। কিছুটা দোনোমোনো করে কল লাগালো বনফুলের নাম্বারে। সে ভেবেছিল এবারও হয়তো কলটা যাবে না অপর পাশে। এবারও হয়তো চিত্রার মনটা তুমুল খারাপ করে অপর পাশ থেকে নারী কণ্ঠটা শুনাবে অসহায়ত্বের বাণী। কিন্তু চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে অপর পাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হয়। গমগমে গলায় পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“হ্যাঁ রঙ্গনা, বলো?”
চিত্রার বোধহয় হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে উঠলো। সে হতভম্ব কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,
“বাহার ভাই! ভালো আছেন?”
মানুষের জীবনে অতি অনাকাঙ্খিত জিনিস বা ঘটনা গুলো মানুষ কখনো সহজে মানতে পারে না। আর তার ফলস্বরূপ দেখা যায় সবটা ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে। ঠিক তেমনই হলো সওদাগর বাড়ির ঘটনা। নিরু নামের মেয়েটিকে দেখে পরিস্থিতি কেমন থমকে গেলো। নিরু মেয়েটিকে সওদাগর বাড়ির প্রত্যেকেই চেনে। মেয়েটা তুহিনের ক্লাসমেট ছিল। দু একবার হয়তো এসেছিল বাড়িতে। কারো তেমন একটা সন্দেহ হয় নি তখন। কিন্তু কে জানতো এই মেয়ে এমন একটা পরিস্থিতির কারণ হবে!
সবটা যখন প্রায় থমকে রইলো, অনাকাঙ্খিত ঘটনায় অস্বাভাবিক কাজটা করে বসলো বনফুল। সে সোফা থেকে উঠে ধাম করে জড়িয়ে ধরলো তুহিনকে। বিস্ফোরণের উপর বিস্ফোরণ যেন ঘটে যাচ্ছে ঘরটায়। সবাই কেবল থ বনে দেখে গেলো। বনফুল তুহিনকে পা গ লের মতন জাপ্টে ধরে অনবরত প্রলাপ বকা শুরু করলো,
“তুমি দুষ্টুমি করছো তাই না? তুমি মজা করছো। নিরু আপুকে নিয়ে মজা করছো কেন? তুমি তো আমার। সবাই জানে তুমি আমার।”
তুহিনও বোধহয় কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। বনফুলকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
“ছাড়ো বনফুল। আর তাছাড়া মজা করার কী আছে! আজকে ভালো একটা দিন তাই ভাবলাম সবাইকে একটু সারপ্রাইজ দেই। এভাবে ধরে আছো কেন বনফুল। ছাড়ো, আমি বিরক্ত হচ্ছি।”
তুহিন মেয়েটার বাহু ধরে বার বার সরানোর চেষ্টা করছে কিন্তু মেয়েটা শক্ত হয়ে কেমন লেপ্টে রইলো তুহিনের শরীরের সাথে। ভাব এমন যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে মানুষটা।
চিত্রা এলো এবার, বনফুলকে টেনে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু ফলাফল শূন্য। ততক্ষণে বনফুলের মা ও বাহারও ছুটে এসেছে খবর পেয়ে। চেরি গিয়ে ডেকে এনেছে।
আয়েশা খাতুন নিজের মেয়ের এমন নির্লজ্জতায় মাথা নত করে ফেললেন। শক্ত কণ্ঠে মেয়েকে ডাকলেন,
“বনফুল, চলে আয়। করছিস কী? ছিহ্!”
মেয়েটা তবুও এক চুল নড়লো না। বরং আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“না আম্মু, ও আমার, ও আমার। আমি দিবো না ওকে। নিয়ে যাবে তো ওরে। আমি দিবো না, আম্মু।”
তুহিন উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। নিরুর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
“সত্যি বলেই তো আজ এনে ছিলাম ওরে। কিন্তু বনফুল এসব কী করছে! ছাড়ো বনফুল।”
বনফুলের মতন ঠান্ডা মেয়েটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলো। তুহিনকে ছেড়ে চিত্রার হাত ধরলো। মেয়েটার হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
“কিরে চিতাবাঘ, তোর ভাই কেমন করছে দেখেছিস। তুই তো জানিস, জানিস না বল উনি আমার কাছে কী? তাহলে উনি এসব বলছে কেন আজ? তুই, তুই কিছু বলবি না? কিরে বলছিস না কেন?”
বনফুলের শ্যামলা মুখশ্রী ততক্ষণে কেঁদেকেটে বাজে অবস্থা। পরিবেশ কেমন বিশৃঙ্খল হয়ে গেলো। মুনিয়া বেগমও এলেন, বনফুলের বাহু এক হাতে জড়িয়ে ধরে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“মা, তুমি এমন করছো কেন? কী সমস্যা? বলো। এমন করো না, মানুষ খারাপ বলবে তো।”
বনফুল কেঁদেকেটে একাকার হলো। আবার তুহিনকে জাপ্টে ধরতে গেলে বেশ শব্দ করে একটা চ ড় পড়ে তার গালে। মুহূর্তেই হৈচৈ এ পরিপূর্ণ পরিবেশটা আবার চরম গম্ভীরতায় নিমজ্জিত হলো। সুখের খামে কেমন করে যেন দু মুঠো বিষাদ নিয়ে এলো গোপন করে! যে বিষাদ হঠাৎ করেই বদলে দিতে যাচ্ছে কতো গুলো সুন্দর সম্পর্কের চিত্র।
বনফুল হতভম্ব চোখে চ ড় দেওয়া মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার হৃদয় মাঝে খোদাই করা গভীর বিশ্বাসে কে যেন তাচ্ছিল্যের আচড় কেটে গেলো। কে যেন বনফুলকে শুনিয়ে গেলো ভাগ্যের নির্মমতার গল্প। বনফুল নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো তার চির পরিচিত তুহিন ভাইয়ের অপরিচিত মুখমন্ডলের দিকে! সদা কোমল মুখশ্রী আজ কেমন হিংস্র! কেমন বিরক্ত চুইয়ে পড়ছে তার শরীর ভেদ করে! এই তুহিনকে তো বনফুল চেনে না। এই তুহিন বড্ড অচেনা, বড্ড অপরিচিত। বনফুলের গায়ে হাত তুলতে পারে এমন তুহিনকে তো বনফুল কখনো চেনে নি! তবে আজ এ কেমন অপরিচিত দুঃখ এঁকে গেলো পরিচিত মুখ?
গম্ভীর এই পরিবেশে ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করলো চিত্রা। অসম্ভব সম্মান করা বড়ো ভাইয়ের বুকে আনমনেই সে ধাক্কা দিলো। বেশ জোরে চিৎকার দিয়ে বললো,
“ভাইজান! তুমি বনফুলকে মারলে!”
তখনো কারো বিশ্বাস হচ্ছিলো না তুহিন নামক ছেলেটা এত নির্মম হতে পারে! এত পাষাণ হতে পারে! বোনের চিৎকার স্তম্ভিত ফিরে পেলো ভাই। ফ্যালফ্যাল নয়নে বনফুলের দিকে তাকালো। অপরাধবোধ তখন তার শিরায় শিরায় শুরু করলো আন্দোলন। সে কেমন করে এত নিষ্ঠুর হলো? অষ্টাদশীরা ভালোবেসে নাহয় একটু অবুঝ হয় তাই বলে সেও নিজের বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে অষ্টাদশীর আবেগে গভীর ক্ষত করবে! তেমন ছেলে তো সে ছিলো না।
ঠিক এই মুহূর্তের অনাকাঙ্খিত চড়টা কেবল বনফুল না, আয়েশা খাতুনের সম্মানের গায়েও যেন খুব গোপনে আঁচড় কেটেছে যার ফল স্বরূপ ঠান্ডা আয়েশা খাতুন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। ছুটে গিয়ে এলোপাথাড়ি হাত চালান মেয়ের মুখে, পিঠে। বনফুল এখন নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। যেন চির পরিচিত চঞ্চলতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কথা বলা অঙ্গ গুলো গভীর আলস্যে লুকিয়ে গেছে কোন এক সীমানায়। বাক্য গুলো দলবল নিয়ে হয়তো হারিয়ে গেছে দিগন্তে। তারা আর বনফুলের কণ্ঠ খসে বের হবে না। তারা আর সুর তুলে জানান দিবে না আবেগ অনুভূতির।
বাহার আগলে দাঁড়ালো বোনকে। বনফুল তখনো চুপ। সকল ভাষা হারিয়ে মেয়েটা যেন নিঃস্ব। বাহার মায়ের হাতটা নিজের বিশাল হাতের মুঠোয় নিলো, সাবধানী কণ্ঠে বললো,
“মা থামো, ওর লাগছে।”
“লাগুক ওর। লাগুক। এমন মেয়ে আমি পেটে ধরে ছিলাম? এমন মেয়ে? যে মেয়ে কি-না আমার সম্মান মাটিতে পিষে দিয়েছে?”
আয়েশা খাতুনের রাগান্বিত কণ্ঠের নিচে কেমন যেন চাপা অভিমান। মেয়ের ধ্বংসাত্মক রূপ মানতে না পারার ভাষা গুলোই অভিমান হয়ে জমে গিয়েছে বোধহয়। বাহার অভিজ্ঞ ব্যাক্তির মতন মায়ের জ্বলন্ত কথার বিপরীতে উত্তর দিলো,
“সম্মান নিয়ে ভাবছো আম্মা? ব্যাথা নিয়ে ভাবছো না? তোমার বনফুল ভেঙে পড়েছে, তাকে আর ভেঙো না। তাকে যে তুলতে হবে, বাঁচাতে হবে। এই মুহূর্তে সম্মান আমাদের জরুরী না।”
“মরে যাক ও, মরে যাক। আমি চাই না এমন মেয়ে।”
“মরে গিয়েছে ও, আম্মা। মরে গিয়েছে। এবার এখান থেকে চলো।”
আয়েশা খাতুন দুই হাত জোর করে তুহিনের সামনে দাঁড়ালো। চোখ মুখ তার হুট করে ভীষণ শক্ত হয়ে উঠলো। কণ্ঠ চওড়া করে তুহিন ও বাকিদের উদ্দেশ্যে বললো,
“আমার মেয়ে ছোটো, ভুল করেছে। ক্ষমা করবেন। আশা রাখি, এই ভুল আর কখনো নতুনত্ব লাভ করবে না। ও তোমার মুখও দর্শন করবেন না, বাবা। আমি কথা দিলাম।”
মুনিয়া বেগম এগিয়ে এলেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“ছিঃ ছিঃ ভাবী, ছোটো মানুষ ভুল করেছে এসব বলছেন কেন? বরং আমরা দুঃখীত তুহিনের আচরণে।”
আয়েশা খাতুন আর কথা বললেন না। তুহিনের খুব ইচ্ছে হলো একটু ক্ষমা চাইতে, বনফুলের ভেঙে আসা মুখশ্রীতে হাত বুলিয়ে চির শান্তি দিতে কিন্তু সে পারলো না। সত্যিই সে কখনো বনফুলকে ভালোবাসেনি, তবে মেয়েটার ভালো চেয়েছে সবসময়। আজ সে নিজেই বড্ড কঠিন আচরণ করে ফেলেছে মেয়েটার প্রতি, অথচ সে তো এমন না!
আয়েশা খাতুন আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়ের হাত টানতে টানতে চলে গেলো ফ্লাটের বাহিরে। চলে গেলো বাহারও। পেছনে রেখে গেলো আরেক অষ্টাদশীর আবেগ।
সওদাগর বাড়ি নিশ্চুপ। অথচ কোলাহল চারপাশে। সামনের সেই পরিচিত বেশ পুরোনো ছোটো বাড়িটা থেকে ভেসে আসছে কেমন চিৎকার! ভেঙে যাওয়া মেয়েটা কাঁদছে। অসহায় সেই কান্নার স্বর। চিত্রা তার রুমের বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই বাড়িটার দিকে। অসহায় তার দৃষ্টি। এমন ভেঙে যাওয়া দৃশ্য সে নিজ চোখে দেখলো অথচ জোরা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। এখন হয়তো বনফুল নামের ফুলের মতন মেয়েটা আর বারান্দা দিয়ে চিতাবাঘ বলে ডাকবে না! ফুল যে আজ চরম আঘাতে মূর্ছা গেছে। তুহিন নামক মানুষটা কোমল ফুলকে পিষে ফেলেছে পায়ের আঘাতে। এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সামলে উঠতে পারবে মেয়েটা? মেয়েটার উড়তে পারার ডানা গুলো আজ যেন কেউ ভেঙে ফেলেছে। আর উড়তে পারবে মেয়েটা!
সন্ধ্যা হয়ে আসে। চির পরিচিত অলিগলি আজ নিশ্চুপ হয়ে রইলো। পাশের বাড়ির ছাঁদ থেকে অষ্টাদশীর খিলখিল হাসি ভেসে এলো না, চিলেকোঠা থেকে ভেসে এলো না গিটারের সুর। চিত্রা তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে। চোখ মেলে অনাকাঙ্খিত গাড়ির সুরে। বারান্দায় গ্রিলে হেলে থাকা মাথাটা নাড়িয়ে তাকায় পথ পানে। বাহার ভাইদের রঙচটা বাড়ির কোল ঘোষে চলে যায় গাড়ি তার রঙিন বাতি মেলে। অ্যাম্বুলেন্সের ভয়ঙ্কর শব্দে চিত্রার বুক কাঁপে। চিত্রার হৃদকম্পন আরেকটু বাড়িয়ে দিতে দৃষ্টিতে পড়ে বাহার ভাইদের কাঠের দরজায় বিরাট তালাখানি। ঘড়ির কাঁটা শব্দ তুলে জানান দেয় রাত প্রায় মধ্য। এত রাতে বাড়িটা খালি করে হসপিটালে কেন গেছে মানুষ গুলো? অপ্রত্যাশিত ভাবনায় বুক কাঁপে চিত্রার। মেয়েটা ভুল করে বসেনি তো?
আজ শুক্রবার। নুরুল সওদাগরের জন্মদিন উপলক্ষে আজ বাড়িতে কিছুটা খুশির আমেজ। জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন চলছে। সেটা অবশ্যই রান্নাবান্নার দিক দিয়ে। আর আশ্চর্য রকম ভাবে আজ চিত্রারও জন্মদিন। বাবা-মেয়ের একই দিনে জন্মদিন। রান্নাঘরে ব্যস্ত সকল রমনীগণ। উপর থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্র সংগীত। খুব সম্ভবত তুহিনের রুম থেকে গানটা বাজানো হচ্ছে। ছেলেটা বেশ গান প্রিয়। ধীর আওয়াজে রবীন্দ্র সংগীত শুনবে সবসময়। কোনো ক্লান্তি নেই। সময়টা আজ খুব বেশি না। মাত্রই সাতটা বাজে। মৃন্ময়দের, বাহারদের, চিত্রার ফুপুর পরিবারকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে বিধায় রান্নাবান্নার আজ চাপটা বেশি। বাড়ির এই তিন নারী বাদে সবাই ই মোটামুটি ঘুমে। ছুটির দিনে সবাই একটু বেলা করে উঠতেই পছন্দ করে।
মৃন্ময় সকালেই উঠে গোসল সেরে নিয়েছে। শুভ্র রঙের একটা পাঞ্জাবি শরীরে চাপিয়ে বাহিরের বের হয়ে এলো। এই সময় রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকে। হাঁটতে বেশ দারুণ লাগে। আর শুক্রবারে তুহিনের সবচেয়ে পছন্দের কাজই হলো সকাল বেলা হাঁটতে বের হওয়া।
বিল্ডিং পেরিয়ে রাস্তায় নামতেই বনফুলের হাসি হাসি মুখটা চোখে পড়লো সাথে নোঙরও আছে। তুহিন ক্ষীণ হেসে ভ্রু কুঁচকালো। কোমল কণ্ঠে বললো,
“বনফুল যে! এখানে কী?”
মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো, “তোমার সাথে হাঁটতে যাবো। নিবে?”
তুহিন হাসলো। মেয়েটা কেবল আজ না, প্রায় সবসময়ই এই বায়না টা করে। তবে আজ ভিন্নতা আছে। আজ মেয়েটার হাসির বিস্তৃতি বেশি। চঞ্চলতা বেশি। সাথে আবার আরেকজন মেয়েও আছে। খুব বেশি ভুল না হলে এটা বাহার ভাই এর সেই বান্ধবী যাকে নিয়ে বাড়িতে টুকটাক কথা শুনেছিল।
তুহিনকে চুপ থাকতে দেখে বনফুল আবার বললো,
“নিবে না আমায়?”
“নিবো না কেন! চলো।”
বনফুল ঘাড় কাত করলো। নোঙর এর হাতটা শক্ত-পোক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করলো বনফুল। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ অতিক্রম হওয়ার পর বনফুল তুহিনকে বলে উঠলো,
“তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই চলো, এটা নোঙর আপু, আমাদের অতিথি। আর নোঙর আপু এটা চিতাবাঘের বড়ো ভাই, তুহিন।”
নোঙর বিনীত কণ্ঠে বললো, “আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
তুহিনও সুন্দর করে সালামের জবাব দিলো। আবারও হাঁটতে শুরু করলো। নোঙর এবার প্রায় ফিসফিস করেই বনফুলকে বললো,
“আচ্ছা বনফুল, একটা কথা বলো তো?”
বনফুল প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কী আপু?”
“তুহিন ভাইয়া চিতাবাঘের ভাইয়া, কিন্তু তোমার কী বলো তো?”
বনফুল থেমে গেলো। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো নোঙরের দিকে। খানিকটা লজ্জাও পেলো৷ আমতা-আমতা করে বললো,
“কি, কি বলছো?”
“না না, কিছু বলি নি। আমরা তো কিছু বুঝিই না।”
বনফুল লজ্জায় লাল হয়ে গেলো আর নোঙর তা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতির মাঝে প্রেম অন্যতম বোধহয়।
_
দুপুর হতেই জমজমাট আয়োজন চলছে। টেবিল জুড়ে সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে ভরে গেছে চারপাশ। অথচ চিত্রা শাড়ি পরে পড়ার টেবিলে বসে আছে। কারণ আজকের দিনেও বাহার ভাই নামক লোকটা তাকে পড়াতে এসেছে। কী অদ্ভুত! চিত্রা পা দুলাতে দুলাতে বাহার ভাই এর দিকে তাকালো। কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো,
“বাহার ভাই, মা বলেছে আজ আমার সাথে ভাত খেতে।”
চিত্রার কথায় ভ্রু কুঁচকালো বাহার৷ চিত্রার রুম থেকে যেতে নিয়েও ফিরে তাকালো, বেশ কিছুটা অবাক হয়েই বললো,
“কেন? তোমার সাথে ভাত খাবো কেন? আমাদের বাড়িতে কী ভাতের টান পড়েছে?”
“কারণ আজ চিত্রার জন্মদিন। আর চিত্রা চায় বাহার ভাই তার পাশে বসুক, একসাথে খাবার খাক।”
বাহারকে কথাটা বলার পরও বিশেষ হেলদোল দেখা গেলো না লোকটার ভেতর। বরং সে বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই উত্তর দিলো,
“না, পারবো না খেতে। আমার জন্য আমার আম্মু হয়তো ভাত নিয়ে বসে আছেন। তুমি খেয়ে নেও। আমার আরেকটা টিউশনিও আছে এখন।”
“আজ আমার জন্মদিন, বাহার ভাই। অন্তত আজকের দিনটা তো আমার কথা রাখতেই পারেন!”
“ধনীর দুলালি বলে আজ জন্মদিন তোমার কাছে যতটা জাঁকজমকপূর্ণ মনে হচ্ছে, আমার কাছে ঠিক ততটাই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে৷ পড়াটা পড়ে রেখো।”
চিত্রা কিছু বলার আগেই লোকটা গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো। এক রাশ হতাশা আর মন খারাপ নিয়ে টেবিলেই মাথাটা নামিয়ে নিলো সে। তার বুকে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সে অভ্যস্ত এসবে। সে জানে বাহার ভাই এমন, আর তার এই এমন বাহার ভাই এর প্রতিই এক আকাশ সমান টান।
_
ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীর টা নিয়ে যেই না বাহার খাবার টেবিলে বসেছে, ঠিক সে মুহূর্তে কোথা থেকে ছুটে এসে ধপ করে তার সামনের চেয়ারে বসে পড়লো গোল গাল, ফর্সা মিষ্টি চেহারার চিত্রা। আরামে বসে পা নাড়াতে নাড়াতে রান্নাঘরের ভেতরে থাকা বাহারের মায়ের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো,
“ চাচী, খাবারও দেও, আমি এসেছি।”
রান্নাঘর থেকে তৎক্ষনাৎ ডালের বড়ার প্লেটটা নিয়ে বেরিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখলো বাহারের মা আয়েশা খাতুন। অবাক কণ্ঠে বললো,
“কিরে, আজ না তোর জন্মদিন? তোদের বাড়িতে দেখলাম ভালো মন্দ রান্না হলো। বনফুলও তো তোদের বাড়িতে। আর তুই কিনা এখানে এসেছিস ডাল-ভাত খেতে!”
“আমি যদি না আসি তবে তোমার ডালের বড়াটা কে খাবে শুনি? আমার পছন্দ বলেই তো বানিয়েছ। দেও দেখি তাড়াতাড়ি, আমার খিদে পেয়েছে তো।”
আয়েশা খাতুন বেশ যত্নের সাথে দু’জনকে ভাত বেড়ে দিলেন। তারপর আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন ডিম ভাজতে। চিত্রার ডিম ভাজাও বেশ প্রিয়। বাহার ততক্ষণে ভাত মাখিয়ে মুখে নিয়েছে। চিত্রা ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
“আমাকে এক লোকমা খাইয়ে দেন না।”
“কেন! তোমার প্লেটে নাই খাবার?”
বাহারের সন্দিহান দৃষ্টি চিত্রার দিকে। চিত্রা মন খারাপ করে বললো,
“একটু খাইয়ে দিলে কী হয়?”
“আমার হাত খসে পড়ে যাবে। হয়েছে শান্তি? এবার নিজে খাও।”
“আপনার মতন মানুষ আমি বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠিতে দেখি নি।”
“দেখবে কীভাবে? তোমার বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্ঠিতে সব গুলো একেকটা অকাজের মানুষজন।”
“একদম খারাপ কথা বলবেন না ওদের নিয়ে। খান আপনার খাবার আপনি। আজ আপনার সাথে খাবো বলে নিজের বাসা থেকে লুকিয়ে এসেছি আপনার বাসায়। নিজের মনের ইচ্ছে নিজে পূরণ করি আমি। আর আপনি কিনা এত পাষাণ! আল্লাহ্ ভুল করে আপনাকে মনের জায়গায় ইট বোধহয় দিয়ে দিছে।”
“আর তোমাকে ব্রেইনের জায়গায় গোবর।”
বাহারের খোঁচা মারা কথায় চুপ হয়ে গেলো চিত্রা। সে সত্যি সত্যিই আর খাবার গুলো ছুঁয়ে দেখলো না। খাবার প্লেট সামনে নিয়ে বসে রইলো থম মেরে। চোখে অশ্রু টলমল করছে। বাহারের খাবারও প্রায় শেষদিকে। পাষাণ লোকটার এমন কাঠিন্যতা মেনে নিতে না পেরে যেই না চিত্রা উঠতে নিবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ভেসে এলো মানুষটার গম্ভীর কণ্ঠ,
“খাবার ফেলে রেখে কোথায় যাচ্ছো? এগুলো আমার ঘুষের টাকার খাবার না, কষ্টের টাকায় রোজগার করা। চুপচাপ খাও।”
বিশাল মন খারাপের স্তূপ জমা হলো চিত্রার মনে। মাথা নিচু করলো সে। অশ্রু লুকানোর বৃথা চেষ্টা করলো, অথচ ভাতের পাতে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। বাহার ভাই আজও তার অভিমান বুঝলো না! কথাটা ভাবতেই কান্না ঠেলে আসলো চিত্রার। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার মুখের সামনে এক লোকমা ভাত তুলে দিলো কেউ। চিত্রা অবাক চোখে তাকাতেই দেখলো বাহার ভাই কপাল কুঁচকে ভাত ধরে আছে তার মুখের সামনে। প্লেটের শেষ লোকমাটা।
চিত্রাকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাহার গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“নেও মুখে। খাবার পাতে কেউ কাঁদুক, তা আমার পছন্দ না।”
“এ্যাহ্, এতক্ষণে আসছে খাওয়াতে।”
“হা করবে নাকি আমি উঠে যাবো?”
চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে হা করলো। লোকটা অনভিজ্ঞ হাতে ভাত দিলো চিত্রার মুখে। কিছুটা খাবার লেপ্টে গেলো মেয়েটার ঠোঁট জুড়ে। খিলখিল করে হেসে উঠলো চিত্রা। তা দেখে বাহার গা-ছাড়া ভাবে বললো,
“অত খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমার পেট ভরে গিয়েছিল বলে দিয়েছি তোমায়।”
চিত্রা কথার বিপরীতে মুখ ভেংচি দিয়ে নিজের প্লেট থেকে খাবার খাওয়া শুরু করলো। বাহার হাত ধুতে গিয়ে মাকে আরেকটু তাগাদা দিলো জলদি করে ডিম ভেজে দেওয়ার জন্য। মেয়েটা ডিম ছাড়া খেতে পারে না। হাত মুছতে মুছতে যেই না বাহার নিজের ঘরে যাবে, ঠিক তখনই পেছন থেকে চিত্রার ডাক ভেসে এলো,
“বাহার ভাই।”
“কী?”
“আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি।”
বাহার হাসলো, ঠাট্টা করে বললো, “এ বয়সে যেটাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসা মনে হয়, প্রাপ্ত বয়সে সেটা কেবল পাগলামো মনে হবে।”
“তাহলে আপনি অপেক্ষা করুন, প্রাপ্ত বয়সেও যে আমি আপনাকে ভালোবাসবো, তা নাহয় দেখিয়ে দিবো।”
“নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি তোমার বড্ড ঝোঁক, রঙ্গনা।”
“তাতে কী?”
বাহার স্মিত হেসে উত্তর দিলো, “জ্বলে যাবে রঙ্গনা”।
“আগুন যদি আপনি হন, আমি নির্দ্বিধায় পুড়তে রাজি।”
বাহার হাসলো, গুনগুন করে বললো,
“ভুল করেও ভুলকে নিও না বেছে,
খালি হাতে ফিরতে হবে দিনশেষে।”
_
চিত্রাদের ফ্লাটে যেন একটা আনন্দ উৎসব লেগে গেলো। পুরো ফ্লাট জুড়ে অতিথিদের মেলা। চিত্রা বাহারদের বাড়িতে খেয়ে আবার ছুটে এসেছে নিজের বাড়ি। সময়টা ঠিক বিকেল। আকাশ কমলা রাঙা রঙ জড়িয়ে আছে নিজের বক্ষ মাঝে। মৃন্ময়দের পরিবারের সকলে এসেছে কেবল শাহাদাৎ আর তার বউ বাদে কারণ তারা হানিমুনে গিয়েছে। অহি, চাঁদনী, চিত্রা, বনফুল, নোঙর, মৃন্ময় সহ বাকি বড়ো সদস্যরা ড্রয়িং রুম জুড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। চিত্রা বনফুলকে ঠাট্টা করে একেকটা কথা বলছে আর মেয়েটা লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছে। তন্মধ্যেই বাড়ির সবচেয়ে ভদ্র, ঠান্ডা ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একদম সোজা হয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ ঝলমলে হেসে বললো,
“আব্বু, বড়ো আব্বু আজকে আপনাদের একজনের সাথে পরিচয় করাবো যদি আপনারা অনুমতি দেন৷”
নুরুল সওদাগর ও তার বড়ো ভাই আফজাল সওদাগর তুহিনের দিকে চাইলো। আপাতত সে মধ্যমনি হয়ে গেছে। আফজাল সওদাগর হেসে বললেন,
“হ্যাঁ করাও পরিচিত। কে সে?”
সকলের কৌতুহল দৃষ্টি যখন তুহিনের দিকে তখনই দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। তুহিন মুচকি হেসে দরজা খুলতেই একটা অসম্ভব সুন্দর রকমের মেয়ে চোখে পড়লো সবার। তুহিন মেয়েটার হাত ধরে ভেতরে এসে হাসি প্রসস্থ করে বললো,
“ও নীরু, তোমাদের ছেলের প্রিয় মানুষ। তোমাদের বংশের হবু বউ।”
ল্যাম্পপোস্টের নিবিড় আলো ছুঁয়ে দিচ্ছে ক্লান্ত মানুষের ভেঙে আসা দেহকে। ভিজে রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের রঙিন আলো প্রতিফলিত হয়ে কেমন ঝলমল করছে! মনে হচ্ছে আকাশের অগণিত তারা হামাগুড়ি খাচ্ছে রাজপথে। লাল, নীল, কালো বিভিন্ন রকমের ছাতার মেলা মানুষের হাত জুড়ে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার উপায়ই এটা। সেই যে বিকেল থেকে হুটহাট বিজ্ঞাপন বিহীন বৃষ্টি এলো এরপর আর থামাথামির নাম-ই নেই! বাহার ব্যস্ত পায়ে বিশ্রাম হীন রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে। আজকে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল যার জন্য টিউশনি করাতে যেতে বেশ দেরি হয়ে গেছে আর পড়ে গেছে অনাকাঙ্খিত বৃষ্টির মুখে।
বাহারের কালো শার্টটা বৃষ্টির ছাঁটে প্রায় বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছে। সুন্দর, লম্বা চুলগুচ্ছ দিয়ে শিশির বিন্দুর ন্যায় পানি পড়ছে। বাহার চুল গুলো ঝাড়তে ঝাড়তে শান্ত নিরিবিলি রাস্তার বেশ কিনারে টং দোকানটার সামনে দাঁড়ালো। এই রাস্তাটা কিছুটা আলো আঁধারের মিশেলে ধোঁয়াশা চাদর জড়িয়ে আছে। বৃষ্টির দাপট ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাহার হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো। বৃষ্টিতে ভিজে সেটা সাড়ে পাঁচটার দিকে গিয়ে যে থেমেছে, আর নড়চড় হয় নি। অথচ প্রকৃতি থেকে বুঝা যাচ্ছে এখন কমপক্ষে সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটা বাজছে। বাহার ঠোঁট উঁচু করে বিরক্তের শ্বাস ফেললো। চিত্রা মেয়েটার দুদিন পর পরীক্ষা অথচ সে পড়াতে যাচ্ছে না, মেয়েটা যে একটু পড়তে চায় না তাকে ছাড়া সেটা তো তার বেশ ভালো জানা।
“আমার কথা ভাবছেন নাকি, বাহার ভাই?”
বাহার চমকালো মেয়েলি কণ্ঠে। তাও পরিচিত অঙ্গনার কণ্ঠ৷ চমকে সে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে চিত্রার প্রাণ খোলা হাসি বিশিষ্ট মুখ। মেয়েটা লাল টকটকে ছাতাটা মাথার উপর ধরে রেখর কী সুন্দর হাসছে! বাহার অবাক কণ্ঠে বললো,
“তুমি, এখানে কেন? ভর সন্ধ্যা বেলা?”
চিত্রা হাতের খোলা ছাতাটা বন্ধ করতে করতে বললো,
“এসেছিলাম ইট্টু গিফট্ কিনতে।”
“আমি ইট্টুই বলবো। শব্দটা কী সুন্দর না বলেন? আমার মতন মিষ্টি।”
বাহার মেয়েটার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো কিন্তু এতে চঞ্চল চিত্রার কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। সে আগের ন্যায় দুলতে দুলতে বললো,
“আমাকে বকতে ইচ্ছে করছে? বকে ফেলুন তাহলে। আমি মাইন্ড খাবো না।”
“আবার উল্টোপাল্টা বাক্য বলছো। মাইন্ড খাবো না আবার কী?”
বাহার এবার নিজেই হেসে দিলো। মেয়েটা দিন দিন একটু বেশিই দুষ্টু হচ্ছে। বাহারকে হাসতে দেখে চিত্রা আনমনে বললো,
“জানেন বাহার ভাই, কাল আপনাদের বাড়িতে মেয়েটাকে দেখে আমি এক মুহূর্তের জন্য ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম এবার বুঝি বাহার ভাইকে চিরতরে হারালাম। বুকের ভিতর সে-কি ব্যাথা! আমার ছোট্টো জীবনের এত বড়ো ব্যাথা কখনো হবেন না তো? কথা দেন।”
বাহারের দৃষ্টি তখন ভেজা পথের দিকে। যে পথের বক্ষে বৃষ্টি খুব মোলায়েম গতিতে নৃত্য করছে। চিত্রা হাত বাড়িয়ে রাখলো তৃষ্ণার্ত নয়ন জোরা মেলে। তার মনে একটা বিশ্বাস ছিলো, বাহার হয়তো কথা দিবে। কিন্তু চিত্রার অষ্টাদশী মনকে ভীষণ বাজে ভাবে ভেঙে দিয়ে বাহার ভাই কথা দিলেন না। বরং পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। চিত্রা দেখলো, প্রতিবার ধোঁয়ায় চিত্রার দুঃখ গুলো উড়ছে। বাহার নামক মানুষটাকে ভালোবেসে সে কত দুঃখেরই না ভাগীদার হলো!
চিত্রার বাড়িয়ে রাখা হাত একই অবস্থানে থাকতে থাকতে ঝিমঝিম করে উঠলো। অবশ হয়ে এলো রক্ত সঞ্চালন করা রগ গুলো। মেয়েটার বুক ভার করে অভিমান হলো। অবশ হাতটা তার স্থায়িত্ব আর টিকিয়ে রাখতে না পেরে যেই না পড়ে যেতে নিলো ঠিক সেই মুহূর্তে চিত্রা অনুভব করলো তার হাতে নরম, ভেজা কিছুর আদুরে ছোঁয়া। চিত্রা পূর্ণদৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই দেখলো বাহার নামক গুরু-গম্ভীর মানুষটা তার হাতে এক গোছা কদম গুচ্ছ তুলে দিয়েছে। আর নিজের সুবিশাল হাতটা দিয়ে চিত্রার সেই অবশ হওয়া হাতটা ধরে রেখেছে। যেন চিত্রার ভালোবাসার হার কিছুতেই হতে দিবে না মানুষটা। চিত্রা হাসলো। বাহার সিগারেটে টান দিয়ে মেঘের মতন ধোঁয়া গুলো আকাশে উড়িয়ে দিতে দিতে বললো,
“তোমার অনুভূতি যেখানে শেষ, ঠিক সেখান থেকে এই বাহারের অনুভূতি শুরু রঙ্গনা। যে অনুভূতির দৈর্ঘ্য প্রস্থ হিসেব করতে গেলে ভালোবাসাও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। কেবল বেকারত্ব নামক ছোটো একটা থলে সেই বিরাট অনুভূতি দমিয়ে রেখেছে তবে দাফন করতে পারে নি। শোনো মেয়ে, ঠিক যতটুকু গিয়ে তুমি ক্লান্ত হবে, তারপর থেকে আমি আছি। বৃষ্টির দিনে তোমার শুদ্ধতম অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিলাম আমি একগুচ্ছ কদমের বিনিময়ে। শুনো মেয়ে রঙ্গনা,
যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…
যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়…
বিক্ষিপ্ত নয়ন জোড়া নিয়ে বনফুল তাকিয়ে আছে পথের দিকে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি তার অকৃপণ হাতে নিজেকে দান করছে। প্রকৃতির এক প্রলয়ঙ্কারী রূপ যেন দেখছে সে। অথচ তুহিন নামক লোকটার আসার কোনো খবর নেই! মানুষটা যে কখন আসবে কে জানে? তাকে দেখার জন্য যে ছোটো মনটা উথাল-পাতাল ঢেউ তুলে সেটা কী মানুষটা কখনো জেনেছে! বুঝেছে!
টেবিলের সামনে মোমবাতি ঝড়ের দাপটে কিছুটা নিভু নিভু হয়ে আসছে। বনফুল তাকিয়ে আছে জানালা ভেদ করে হালকা আলো মাখানো পথের দিকে। চোখে-মুখে তার তীব্র অপেক্ষা। বনফুলের সেই এক ধ্যানের অপেক্ষার মাঝে ঘরে শব্দ হলো। বনফুল কিছুটা চমকে ভেতরে তাকাতে দেখলো নোঙর নামক বাহার ভাইয়ের বান্ধবীটা ঘরের পর্দা খুলে জানালাটা লাগিয়ে দিচ্ছে। বনফুল ভ্রু কুঁচকালো। বৃষ্টি এলে সে সারা ঘরের জানালা খুলে রাখতে পছন্দ করে। কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে যায় রুমটা! তার বেশ শান্তি লাগে সেই শীতল রুমটা। মনে হয় স্বর্গ এসে দাঁড়িয়েছে তার দুয়ারে৷ অথচ নোঙর আপু কি-না তার এই সুখে এমন দেয়াল টেনে দিলো! নিজের ছোটোখাটো রুমটাতে এই অপরিচিত মেয়েটার আধিপত্যটা বেশ বিরক্তই লাগলো বনফুলের। কাল ভাইয়ার আদেশে মেয়েটাকে নিজের ঘরে থাকতে দিয়েছিল। কয়েকটা দিনের জন্য নাকি বেড়াতে এসেছে সে। তাই বনফুলের ঘরই হলো তার ঠিকানা। এ বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর রুমটাই বনফুলের রুম। কিছুটা মাঝারি আকারের রুম। দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ডিজাইন আঁকা। পুরোনো দিনের কারুকার্য শোভিত একটা কাঠের আলনা আর খাট আছে যা সদা পরিপাটি থাকে আর সুন্দর একটা পড়ার টেবিল ও দুটো চেয়ার আছে। পুরো ঘরে জিনিসপত্র বলতে এতটুকুই আর একটা বিশাল আয়না লাগিয়েছে মেয়েটা নিজ উদ্যোগে তাও ভীষণ সুন্দর ডিজাইন করা রঙ দিয়ে। তার ঘরটাকে সে নিজ অবস্থানে সর্বোচ্চ সুন্দর রাখার চেষ্টা করেছে। আর সেই প্রিয় রুমে আরেকজন নিজের নাক গলাচ্ছে সেটা কারই বা পছন্দ হবে? তবে বনফুল মেয়েটা ভীষণ ঠান্ডা মেজাজের ও ভদ্র বলে মুখের উপর কাউকে কিছু বলে না। যেমন এখন জানালা আটকে দেওয়াতেও বললো না। কেবল নিরবে একবার সেদিকে তাকিয়ে আবার রাস্তায় ধ্যান দিলো।
নোঙর মেয়েটা বিছানা ঝাঁট দিতে দিতে বনফুলের উদ্দেশ্যে বললো,
“বনফুল, তোমার কাছে কোনো উপন্যাসের বই আছে?”
বনফুল রাস্তার দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো, “না।”
“একটাও নেই?”
“না আপু।”
মেয়েটা হতাশার শ্বাস ফেললো, চট করেই কিছু মনে পড়তে বললো,
“বাহার ভাইয়ার আছে?”
বনফুল এবার তাকালো নোঙরের মুখ পানে। সাদামাটা একটা মেয়ে নোঙর, গালে, কপালে রয়েছে অসংখ্য দাগ অথচ কণ্ঠটা ভীষণ মিষ্টি। বনফুল হুট করেই বলে উঠলো,
“তুমি গান গাইতে পারো তাই না?”
নোঙর বোধহয় কিছুটা চমকালো। বেশ প্রশংসা করে বললো,
“তুমি কীভাবে বুঝলে বলো তো?”
বনফুল বিজ্ঞদের মতন করে বললো, “আমি সব বুঝি। এবার বলো তো তুমি গান গাইতে পারো কি-না?”
নোঙর প্রশ্নের উত্তরে উপর-নীচ মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে পারে। বনফুল যে-ই না আবদার করবে তাকে যেন গান শুনানো হয় ঠিক সেই মুহূর্তে রিকশার সুমধুর সুর তার কানে ঠেকলো। অপেক্ষা শব্দা ভীষণ মিষ্টি যখন আমরা জানি অপেক্ষা তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিন্তু যদি এটা অনির্দিষ্টকালের জন্য হলেই গলার কাঁটা হয়ে যায়।
নোঙরকে কিছু বলতে না দিয়েই বনফুল ছুটে চলে যায় নিচে। নোঙর অবাক চোখে কেবল তাকিয়ে থাকে।
_
সওদাগর বাড়িতে বসেছে রাতের খাবারের আয়োজন। বিশাল বড়ো টেবিলের এককোণ হতো অপর কোণা অব্দি মানুষে পরিপূর্ণ। সওদাগর বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর নিয়ম তারা রাতের খাবার সকলে একসাথে খায়। এই নিয়ম কখনো এলোমেলো হয় নি আর হবেও না। তবে আজ চিত্রা বাহির থেকে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল যার দরুন সবাই তাকে ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে গেছে। অবশেষে তুহিন ভাই যখন ডাকলো তারপর মেয়েটা উঠলো। ঘুম ঘুম চোখে টেবিলে এসে বসতেই সবার খাওয়া শুরু করলো।
নুরুল সওদাগর ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে প্রায় ঠেস মেরেই বললেন,
“তোমার বোধহয় স্বভাবেই সময়ের কাজ সময়ে না করা। অদ্ভুত মেয়েছেলে।”
চিত্রা আঁড়চোখে বাবার দিকে তাকালো। মুনিয়া বেগম মাছের বাটিটা নিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন। কিছুটা ফিসফিস করেই বললেন,
“তোমার সবসময় এমন না করলে চলে না?”
নুরুল সওদাগর জবাব দিলেন না। চিত্রাও ঘুম ঘুম চোখে ভাত মুখে তুললো। মুনিয়া বেগম মাছের বিরাট মাথাটা স্বামীর পাতে দিতে নিলেই নুরুল সওদাগর হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“আমাকে মাছের পেটি দেও। মাথা খাবো না রাত করে।”
মুনিয়া বেগম অবাক হলেন, অবাক কণ্ঠে বললেন, “কবে থেকে তুমি আবার পেটি খাওয়া শুরু করলে?”
নুরুল সওদাগর বোধহয় বিব্রতবোধ করলেন স্ত্রীর কথায়, তাই কিছুটা মিছে মিছে রাগ দেখিয়ে বললেন,
“দিলে দেও না দিলে যাও।”
চিত্রা বেশ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
“তবে মাথাটা আমাকে দেও, মা।”
বাবার ধমকে চিত্রা আবারও চুপ হয়ে গেলো। তুহিন বিরক্ত চোখে একবার বাবার দিকে তাকালো। আর কোনো কথা হলো না। চিত্রা খাবার শেষ করে উঠার সময় বাবার হাতে একটা বক্স এগিয়ে দেয়। মিনমিন কণ্ঠে বলে,
“হ্যাপি বার্থডে আব্বু।”
নুরুল সওদাগর মেয়ের দিকে অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। চিত্রা ততক্ষণে চলে গিয়েছে নিজের ঘরে। নুরুল সওদাগর বক্সটা খুলে দেখলেন সিলভার কালারের বেশ সুন্দর একটা ঘড়ি। নুরুল সওদাগর তা দেখে আহ্লাদে মেতে উঠলেন। মুনিয়া বেগমকে দেখিয়ে কেমন বাচ্চামো করে বললেন,
“দেখেছো মুনি, দেখেছো, মেয়েটা কেমন অবাক করে দিলো। তোমরা তো মনেও রাখো না আমার জন্মদিনের কথা। মেয়েটা কেমন পা গ লি, দেখলে?”
ঘুম থেকে উঠার পর একটা বি স্ফো রি ত খবর চিত্রাকে মুহূর্তেই বাকরূদ্ধ করে দিলো। সে ভয় পেলো অনেক, অথচ মানতে নারাজ। সে মনে প্রাণে যেন একটা বিশ্বাস এটে রেখেছে, তার বাহার ভাই তাকে এতটা ব্যাথা দিতেই পারে না। অসম্ভব এবং অসম্ভব এটা। সে বারান্দায় ছুটে গেলো। বাহার ভাইয়ের বাড়ির ভেতরটা অনেক উঁকিঝুঁকি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো কিন্তু সক্ষম হলো না। অন্যান্য দিনের মতন হাঁক ছেড়ে ডাকলো বনফুলকে কিন্তু তাও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। সে আবার ঘরে এলো ব্যস্ত পায়ে৷ ঘরে আসার সময় তার সবচেয়ে পছন্দের রঙ্গনা ফুলের গাছটা ভুলবশত পায়ে লেগে ভেঙে গেলো। চিত্রার সেদিকে ধ্যান নেই। অন্যসময় এ কাজটা হলে সে কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় তুলতো। কারণ এ গাছটা তার বাহার ভাই তাকে দিয়েছে যে! বড়ো যত্নের গাছ কি-না! কিন্তু আজ তার কোনো খেয়ালই নেই। বরং সে কিছুটা ছুটেই গেলো বাহার ভাইদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। জুতো জোড়া পড়লো উল্টো। চেরি কয়েকবার পিছু ডাকলেও সেদিকে তার ধ্যান নেই।
বাহারদের বাড়িতে সকলের জটলা। একটা মেয়েকে ঘিরে বসে আছে বাহার ভাইয়ের মা-সহ চিত্রাদের বাড়ির মহিলাগণ। তার মাঝে রয়েছে অবনী বেগম আর রোজা সওদাগর। চিত্রার মা তো কলেজ থাকেন এ সময়টা। চিত্রা চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। শুকনো, জীর্ণ-শীর্ণ একটা নারী দেহ বসে আছে সেখানে। মুখে ব্রণের অস্তিত্ব, কালো কালো কত গুলো এলোমেলো দাগ, টানা মায়া মায়া দুটো চোখ, সরু নাক মেয়েটার। চেহারাটা ভীষণ মিষ্টি। বয়সটা ঠিক আন্দাজ করা যাচ্ছে না। কতই বা হবে? তেইশের এপাড়-ওপাড়! ঠোঁট দু’টো শুষ্ক। গালে লেপ্টে আছে অশ্রুর চিহ্ন। মেয়েটা বোধহয় কান্নাকাটি করেছিল কিছুক্ষণ আগে। চিত্রার অন্তর আত্মা কিঞ্চিৎ মোচড় দিয়ে উঠলো। মেয়েটা কেঁদেছিল কেন? মেয়েরা তো বিয়ের সময় বাবার বাড়ি ছেড়ে আসার সময় কান্না করে। এই মেয়েটা কী সেজন্যই কান্না করেছে? এবার চিত্রার নিজেরই কান্না পাচ্ছে। বাহার ভাই সত্যি সত্যিই তাকে ধো কা দিলো না তো!
আয়েশা খাতুনের দৃষ্টি পড়লো চিত্রার দিকে। মুচকি হেসে বললো,
“এমা, আজ কে ডাকলো তোরে? তোদের বাড়ির মানুষ তো আমাদের বাড়িতে। উঠলি কীভাবে?”
চিত্রার চোখ জলে পরিপূর্ণ হলো। গলায় কান্নারা দলা পাকিয়ে আসছে। সে চোখ উল্টিয়ে কিছুক্ষণ আশেপাশে তাকিয়ে চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সক্ষম হলো না। চোখের জল কী আমাদের কথা শুনে? শোনে না। সে সবসময় অবাধ্য। আর তার এই অবাধ্যতার কারণে আমরা কখনো কখনো নিজেকে মানুষের কাছে দুর্বল প্রমান করে ফেলি কখনো বা নিজেদের বানাই হাসির পাত্র।
এমন আদুরে স্বর শুনে কান্নারা কী আর চুপ থাকে? চিত্রার কান্নারাও চুপ রইলো না। চিত্রা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। মনে মনে বার বার সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে বললো এটা যেন দুঃস্বপ্ন হয়৷ চিত্রার যেন এখনই ঘুম ভেঙে যায়৷ সে নাহয় খারাপ স্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবে সব। কিন্তু চিত্রার ডাক বোধহয় উপরওয়ালা শুনলো না। পুরোটাই বাস্তব হলো।
আবনী বেগমের পাশাপাশি এবার যুক্ত হলো আয়েশা খাতুনও। মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে সে আর বসে থাকতে পারলো না। এসেই চিত্রার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“কী হয়েছে তোর? ভয় পেয়েছিস? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস, মা?”
চিত্রা কেঁদেই চলেছে। কান্নার কোনো থামা থামি নেই। সকলে মুহূর্তেই তাজ্জব বনে গেলো। বাহারও ধপধপ পায়ে দ্রুত নেমে এলো ছাঁদ থেকে। লোকটার চুল বেয়ে বরাবরের মতনই পানি পড়ছে। ছাঁই রাঙা টি-শার্ট টা শরীরকে মুড়িয়ে রেখেছে। লোকটা কপালে ভাঁজ ফেললো, বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“এই মেয়ে, কাঁদছো কেন? কী সমস্যা?”
বাহার সহ উপস্থিত সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো। বাহার তো বেশ জোরেসোরেই বললো,
“কী! কী খেয়েছো ঘুম থেকে উঠে!”
বাহারের অভিব্যক্তিই চিত্রাকে যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিলো। সে যে বড়সড় একটা ভুল করে ফেলেছে সেটাও বুঝে ফেললো মুহূর্তেই। সে চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,
“ঐ, ঐ মেয়েটা কে?”
“ও তোর বাহার ভাইয়ের বান্ধবী। বেড়াতে আসছে।”
আয়েশা খাতুনের দুই বাক্যেই চিত্রার কান্না নির্বাসিত হলো। চেরি মেয়েটার কথায় লাফানো যে তার বিরাট ভুল হয়েছে সেটা তার মস্তিষ্ক মুহূর্তেই অনুভব করে ফেললো। অবনী বেগমের কণ্ঠে এখনো চিন্তার ছোঁয়া, সে চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
“কান্না করেছিলে কেন, চিত্রা?”
চিত্রা মুচকি হাসলো। তার বুকের উপর থেকে বড়সড় একটা পাথর যেন মুহূর্তেই পরে গেলো। আহা, কী শান্তি। ঘুম থেকে উঠে কি কান্নাকাটিই না করতে হলো মিছিমিছি! চিত্রা আড়চোখে তাকালো বাহার ভাইয়ের দিকে। লোকটা কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে! মনে হচ্ছে এই যেন ভ স্ম করে দিবে তাকে। চিত্রা আর বাক্যব্যয় না করে ছুটে গেলো নিজেদের বাড়ি। জেনেশুনে বাঘের মুখে পড়ার কোনো মানেই হয় না।
_
তুমুল রোদ মাথার উপরে। বিশাল আকাশে সূর্য যেন তার সবটুকু আলো ঢেলে দিয়েছে। গরমে ঘেমে একাকার অহি। মাথার উপরে গোলাপি রঙের ছাতাটা কিছুটা ছায়া দেওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত। তবে এমন তুখোড় রোদের কাছে ছাতাটা নিতান্তই সামান্য কিছু। অহি চোখের গোলগোল চশমাটা আরেকটু ঠেলে দিয়ে আঁটসাঁট করলো চোখের সাথে। শরীরে একটা হাঁটু সমান ঢিলে সাদা রঙের শার্ট, গলায় ঝুলিয়ে রাখা স্কার্ফ গাঢ় খয়েরী রঙের, হাতে চিকন চেইনের ঘড়ি মুখে নেই কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া। মেয়েটা সবসময় সাধারণ থাকতে পছন্দ করে। ফার্মগেটের রাস্তা পেরিয়ে সরু গলি ধরলো সে। পথে আজ রিকশা, গাড়ি খুব স্বল্প আর যতটুকু আছে সেগুলো ধানমন্ডি অব্দি যেতে চাচ্ছে না। কী ভীষণ যন্ত্রণায় পড়লো সে! তাই কিছুটা পথ হেঁটেই এগোচ্ছে। দেখা যাক কোনো রিকশা গাড়ি আদৌও পায় কি-না!
বেশ খালি রাস্তায় একটা মিষ্টি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনেই আইসক্রিমের ভ্যান। অহি চোখ পিটপিট করে তাকালো মেয়েটার দিকে। ভীষণ পরিচিত মনে হলো বাচ্চাটাকে৷ অহি তাই ছোটো কণ্ঠে ডাক দিলো,
“এই বাবু।”
অহির এক ডাকেই বাচ্চাটা অহির দিকে তাকালো। মিনিট কয়েক ব্যয় করলো অহির মুখমন্ডলে। তারপর হুট করেই রাজ্য হয় করা এক হাসি দিয়ে ছোটো ছোটো পায়ে দৌড়ে এলো। অহির হাঁটু জড়িয়ে হলো ভীষণ আদুরে হাতে।
বাচ্চাটা আদুরে ভঙ্গিতে মাথা দুলালো। অহিও হাসলো। এই মেয়েটার জন্যই তো সে সেদিন রেস্টুরেন্টে কেমন বাচ্চাদের মতন ঝগড়া করেছিলো! ভাবতেই অহির লজ্জা লাগে। মাঝে মাঝে সে কতটা বোকামি করে বসে তাই না!
কথাটা বলেই বাচ্চাটা দু-হাত বাড়িয়ে দিলো। ছোটো ছোটো গোল গোল হাত গুলো। অহি হাসলো, বাচ্চাটার নাক টেনে বললো,
“তোমার কী আইসক্রিম ছাড়া আর কিছু ভালো লাগে না?”
বাচ্চাটা উপর-নীচ মাথা দুলালো, যার অর্থ লাগে। অহি গাল টিপে বললো,
“আর কী ভালো লাগে?”
“তোমাকে।”
অহি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো মেয়েটার দিকে। কী পাঁকা মেয়ে! বাচ্চাটা তার মাঝেই তাড়া দিয়ে বললো,
“আইতকিরিম দেও আন্তি।”
অহি হাসলো। আইসক্রিমের ভ্যানটার কাছে গিয়ে ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিম কিনে দিলো। বাচ্চাটা ছোটো ছোটো হাতে সাবধানে ধরলো সেটা। অহি বাচ্চাটার চুল ঠিক করে দিতে দিতে বললো,
“আচ্ছা হুমু, তুমি একা কেন? তোমার পাপা কোথায়?”
অহির কথায় উত্তর দিলো না হুমু। মনের সুখে সে ঠোঁট চাপলে আইসক্রিমে। এর মাঝেই কোথা থেকে ছুটে এলেন সেদিনের ভদ্রলোকটা। ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে গেছে, কপালের মাঝে চিন্তার রেখা। মেয়েকে কিছুটা টেনে নিজের কোলে নিয়ে অনবরত চুমু খেকে লাগলেন। হুমু বাবার চিন্তিত মুখটা দেখে গলা জড়িয়ে ধরলো বাবার। কেমন বড়োদের মতন করে বললো,
“ভয় পেয়ো না পাবা, এইতো আমি এখানে, আন্তির সাতে (সাথে)।”
মেয়ের কথায় হুশ ফিরলো ভদ্রলোকের। সে অহির দিকে তাকিয়ে চমকে গিয়ে বললো,
“আরে ঝগড়ুটে মহিলা, আপনি!”
এমন ডাকে অহির বেশ রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও রাগলো না। লোকটাকে বেশ অবাক করে দিয়ে হেসে উঠলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
“হ্যাঁ আমি, আজও আইসক্রিম কিনে দিতে এলাম বোধহয়।”
অহির ঠান্ডা মেজাজে এবার লোকটা নিজেইই লজ্জা পেলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“ধন্যবাদ, আমার মেয়েকে রাখার জন্য।”
অহি স্মিত হেসে উত্তর দিলো,
“আজকের আইসক্রিমের দাম মাত্র চল্লিশ টাকা, চারশত টাকা দিবেন নাকি আজ?”
ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কৃতজ্ঞতার তো দাম নেই। সেদিনের জন্য দুঃখীত।”
“হুমুর বাপকে ক্ষমা করা হলো।”
অহি কথাটা বলে নিজেই চমকে গেলো। চিত্রার সাথে থাকতে থাকতে সেও যে ওর মতন হয়ে যাচ্ছে ভেবেই হাসি এলো। অতঃপর দু’জন একসাথে হেসে উঠলো। লোকটা হাসতে হাসতে বললো,
“আমি হুমুর বাপ তবে নাম নওশাদ।”
আকাশে মেঘপুঞ্জ ভেসে বেড়াচ্ছে মনের আনন্দে। কড়া রোদ্দুরে নাজেহাল প্রকৃতি। সময় টা ঠিক বিকেলের আগমুহূর্ত। অহি ভার্সিটি থেকে ফিরেছে বাসায়। ঘরের বাহিরে জুতার স্তূপ দেখে আপনা-আপনি ভ্রু কুঁচকে এলো অহির। আজকে তো বাড়িতে কারো আসার কথা ছিলো না! তবে এত অপরিচিত জুতোর হাট বসেছে কেন? কৌতূহলী হয়েই সে পা রাখলো ড্রয়িং রুমে। অনেক অপরিচিত মুখের মাঝে একটি পরিচিত মুখমণ্ডল দেখেই চমকে গেলো অহি। বিরাট বড়সড় একটা ধাক্কাও যে খেলো তা নির্দ্বিধায় আঁচ করা যায়।
অহিকে দেখে বৈঠকখানার আলোচনা যেন বিরতি ঘোষণা করলো। মুহূর্তেই রমরমা পরিবেশটা থিতিয়ে গেলো। সোফা থেকে সুন্দরী এক ভদ্রমহিলা উঠে এলেন। অহির গোলগাল ছোটো মুখশ্রীতে হাত বুলিয়ে দিলেন বেশ আদুরে হাতে। আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন,
“বড়ো হয়ে গেছিস তো!”
অহি জবাব দিলো না। সামনের চশমা পড়া, সুন্দর নারী মুখশ্রীটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভদ্রমহিলা আবারও আদুরে কণ্ঠে বললেন,
“কবে অত বড়ো হলি!”
“আপনি যাওয়ার পর পরই। খোঁজ নেন নি তো তাই জানেন না। অবশ্য খোঁজ নেওয়ার জন্য তো আপনি জাননি।”
অহির কাঠ কাঠ উত্তরে সামনের ভদ্রমহিলা বোধহয় কিছুটা ভড়কে গেলেন। সরু চোখে সোফায় বসে থাকা এক ভদ্র পুরুষের দিকে তাকালেন। লোকটা চোখ দিয়ে কি যেন ইশারা করে আশ্বাস দিলেন। তন্মধ্যে রান্নাঘর থেকে ব্যস্ত পায়ে ছুটে এলেন অবনী বেগম। হাতে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত। মেয়ের দিকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে ভাঙা কণ্ঠে বললেন,
“নেও তোমার শরবত। বাহিরে ভীষণ গরম।”
অহি অবনী বেগমের দিকে পূর্ণদৃষ্টি দিলো। শ্যামলা গড়নের এই নারীর চোখ মুখ আজ বেশ শুকনো লাগছে। কপালে চিন্তিত একটা রেখাও আছে। সে যে বর্তমানে খুব ভীতিগ্রস্ত তা তার হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে। অহি ঠান্ডা শরবতের গ্লাসটা আলগোছে নিয়ে বেশ তৃপ্তি সহকারে পান করলো সেটা। যতক্ষণ না শরবত শেষ হয় ঠিক ততক্ষণ অবনী বেগম ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়ের খাওয়া শেষ হতেই গ্লাসটা নিয়ে আবার চলে গেলেন রান্নাঘরে। অবনী বেগম রান্নাঘরে যেতেই অহি নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। তার মাঝেই ভদ্রমহিলা পিছু ডাকলেন,
“তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।”
অহি বিরক্ত হলো বেশ। বিরক্তিকর একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“আমি এখন ক্লান্ত।”
ভদ্র মহিলা আরেকটু এগিয়ে এলেন। প্রায় অহির গায়ের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গদোগদো কণ্ঠে বললেন,
“আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস কেন, বাবু?”
অহির কণ্ঠ এবার ক্ষাণিকটা উঁচুতে উঠলো। মহিলাটার হাতটা ঝাড়া মেরে বললো,
“আমি এভাবেই কথা বলি। এটাই আমার স্বভাব। ভালো লাগলে ভালো আর না লাগলে রাস্তা মাপুন। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
কথা শেষ করেই গটগট পায়ে অহি নিজের রুমে চলে গেলো। বেশ শক্ত হাতেই দরজা টা আটকালো। বিকট এক শব্দ হলো, যে শব্দ অহির রাগের পরিমাণ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণাও দিয়ে দিলো। ভদ্রমহিলা তাজ্জব বনে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে দিকে।
_
চিত্রা ছটফটে মন নিয়ে বসে আছে বনফুলদের ছাঁদে। বনফুল নিজের বাংলা বইটা একটু ঘেটেঘুটে দেখছে। মেয়েটাও পড়াশোনায় বেশ ভালো। চিত্রা অধৈর্য হয়ে একবার সিঁড়ি আরেকবার রেলিঙ পেরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। বনফুল বার কয়েক চিত্রার দিকে তাকালো। মেয়েটার উৎকণ্ঠা সে কিছুটা অবশ্য আঁচ করতে পেরেছে। কিন্তু তবুও ইনিয়েবিনিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে চিতাবাঘ, এমন করছিস কেন? কোনো সমস্যা?”
চিত্রা রাস্তা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বনফুলের দিকে তাকালো। মেয়েটা যে মিটমিট করে হাসছে তা চিত্রার চোখ এড়ালো না। তবুও সে বুঝতে পারে নি এমন একটা ভাব করে বললো,
“না রে, কোনো সমস্যা না। তোকে না একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।”
বনফুল আগ্রহী কণ্ঠে বললো,
“কী কথা?”
“আসলে তুহিন ভাই আজ বাড়ি এসে পড়েছে তাড়াতাড়ি। আমি যখন তোদের বাসায় আসছিলাম তখন আমাকে বলেছিল তোকে যোন একটু যেতে বলি। দরকারি কথা আছে নাকি তোর সাথে। আমি বলতেই ভুলে গেলাম।”
তুহিনের নাম শুনতেই কাঁপা-কাঁপি শুরু মেয়েটার। কণ্ঠ খাদে নিয়ে বললো,
“কী কথারে চিতাবাঘ? তুই জানিস কিছু?”
চিত্রা পায়ের উপর পা তুলে মাথাটা হেলিয়ে দিলো চেয়ারে। আয়েশি ভঙ্গিতে বসে অতঃপর বললো,
“জানিনা তো, তুই গেলেই তো জানবি। তোর কথা আমি কীভাবে জানবো অদ্ভুত! যা তো তাড়াতাড়ি। এমনেতেই লেট হয়ে গেছে।”
বনফুল দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। বইটা বন্ধ করেই ছুট লাগালো চিত্রাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো চিত্রা, অস্ফুটস্বরে বললো “পা গ লি মেয়ে।”
সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে প্রায় হেলে পড়েছে। প্রকৃতি আঁধার। চিত্রার চোখ ঘুমে ভার ভার হয়ে এসেছে। চোখ কিছুটা লেগে আসতেই কারো পায়ের ধ্বনি কানে ভেসে এলো। চোখে গভীর ঘুম আর মনে প্রমিক পুরুষকে দেখতে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছেয় তার ভেতর ভেতর তুমুল যু দ্ধ শুরু হলো। অতঃপর ঘুমে ভেঙে আসা চোখ গুলোকে সে টেনে খোলার চেষ্টা করলো। বার কয়েক চেষ্টায় সে সফলও হলো। নিভু নিভু চোখের পাতা ঝাপ্টাতে ঝাপ্টাতে অস্পষ্ট ভাবে তার আশপাশের দৃশ্য ফুটে উঠলো চোখের পাতায়। এমন গরম আবহাওয়ার মাঝেই একটা শীত শীত ভাব তাকে জেঁকে ধরেছে। প্রকৃতিটা বেশ আরামদায়ক ঠেকছে। চিত্রা নড়েচড়ে বসলো। চোখ গুলোকে পুরোপুরি খুলে আশেপাশে তাকাতেই দেখলো প্রকৃতির বুকে গম্ভীর রাত নেমে গিয়েছে ততক্ষণে। তার চোখ লেগেছে অনেকটা সময়ই হয়েছে বোধহয়। চিত্রা বা’দিকে তাকাতেই তার শীত শীত লাগার উৎস উদ্ভাবন করতে পারলো। বাহার ভাইয়ের ঘরের বিশাল টেবিল ফ্যানটা তার দিকে ঘুরিয়ে চালু করা। জানালা ভেদ করে সেই দা ন বী য় ফ্যানের বাতাসই তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ছাঁদের হলুদ বাল্বটাও জ্বালিয়ে দেওয়া এমনকি চিলেকোঠার ঘরেরও আলো জ্বলছে।
চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো। বাহার ভাই এসে পড়েছেন অথচ তাকে ডাকলো না কেন! গত তিন চার দিন যাবত পড়াতেও যাচ্ছেন না! বাহার ভাই এর এমন উদাসীনতা বেশ ভাবাচ্ছে চিত্রাকে। চিত্রা উঠে দাঁড়ালো। অনেকক্ষণ এক টানা বসে থাকার কল্যাণে পা গুলো ঝিমঝিম করছে। সে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ পা ঝাঁকালো। হাঁটার শক্তি সঞ্চিত হতেই সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বাহার ভাই এর ঘরের দিকে। জানালার কাছটাতে এসেই সে থামলো। ঘরের ভেতরে কারো দেখা নেই। আলোটা জ্বালালো কে? ফ্যানটাও বা ছাড়লো কে? চিত্রা ধপধপ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। রান্নাঘরের বনফুলের মা তখন ব্যস্ত হাতে রাঁধছিলেন। চিত্রাকে দেখেই মুচকি হাসলো। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“কী ব্যাপার হুম? তুই কী আজকাল ঘুমোস না? ছাঁদেই দেখি ঘুমিয়ে গেলি?”
চিত্রা রান্নাঘরের সামনে থাকা ওয়াশরুমে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
“ওহ্, তুমিই তবে ফ্যান লাইট জ্বালিয়ে এসেছো?”
আয়েশা খাতুন মুচকি হাসলেন মেয়েটার কথা শুনে। কাজে মনযোগ রেখেই বললেন,
“তো, তুই কী ভেবেছিস? কে জ্বালিয়েছে।”
চিত্রা আমতা-আমতা করে বললো, “কেউ না।”
আয়েশা খাতুন খিলখিল করে হাসলেন। চিত্রার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তুই যার কথা ভেবেছিস সে তো গত চারদিন ধরে বাড়িতেই আসে নি। কোথায় গেলো, কি হলো কিছুই জানিনা। ছেলেটা যে কবে মানুষ হবে।”
“তোমার ছেলে কী মানুষ না? পরী টরী নাকি গো?”
কথা শেষ করে দু’জনই আবার নতুন উচ্ছ্বাসে হেসে দিলো।
_
তুহিন খাটে হেলান দিয়ে ফোন টিপছে। বনফুল কফির কাপ নিয়ে দরজার বাহিরে দাঁড়ালো। এ বাড়িতে এসেছে অনেকক্ষণ হলেও এঘরে এতক্ষণ আসার সুযোগ হয় নি। যখন দেখেছে তুহিনকে কফি দিতে হবে তখনই কাজটা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে উছিলায়।
“আসো বনফুল, দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
তুহিনের কণ্ঠে কেঁপে উঠলো মেয়েটার সর্বাঙ্গ। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তুহিনের কাছে, কফির কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“তোমার জন্য দিয়েছিল বড়ো চাচী।”
তুহিন উঠে বসলো, মিষ্টি হেসে বললো, “তুমি কষ্ট করে আনতে গেলে কেন?”
মেয়েটার থুতনি প্রায় চিবুকের সাথে লেগে যাওয়ার জোগাড়। মাথাটা তেমন নিচু রেখেই ছোটো ছোটো করে বললো,
“কোথায় কষ্ট! অল্প একটু কাজ তো।”
বনফুল ডানে মাথা দুলালো। তুহিন কফিতে চুমুক দেওয়ার পর মেয়েটা প্রশ্ন ছুড়লো,
“তুমি কী কিছু বলবে আমাকে? চিতাবাঘ বললো।”
চিত্রার নাম শুনে তুহিন ভ্রু কুঁচকালো। কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে বললো, “না তো! কী বলবো!”
বনফুল চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো৷ তার যা বোঝার সে বুঝে গেছে। মেয়েটা তার সাথে নিশ্চয় মজা করেছে আর সে কিনা লাফাতে লাফাতে চলে এলো! নিজেে কাজে নিজেই লজ্জা পেলো সে। লজ্জায় সেখান থেকে চলে আসতে নিলে বাঁধ সাধলো তুহিন। কফির কাপটা খাটের সাথে লাগানো ছোটো টুলটার উপর রেখে বললো,
“বনফুল দাঁড়াও, এসেছো ভালো হয়েছে। একটা কথা আছে।”
তুহিন খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। অফিসের ব্যাগটা থেকে একটা প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিলো বনফুলের দিকে, মিষ্টি হেসে বললো,
“শুনেছিলাম, তোমার পায়ে নুপুর নাকি ভীষণ ভালো মানাবে? তাই এনেছি।”
তুহিনের কথা শুনে মেয়েটা চমকে গেলো। অনাকাঙ্খিত আনন্দে৷ তার চোখ টলমল করে উঠলো। কাঁদতে গিয়েও কাঁদলো না। বহু কষ্টে চোখের জল আটকে রেখে বললো,
“কে, কে বলেছে!”
“শুনেছি কোথায় যেন। এবার নেও তো দেখি।”
তুহিনের তাড়া দেখে বনফুল হাত এগিয়ে দিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেট টা নিয়েই ছুটে চলে গেলো তুহিনের ঘর ছেড়ে। লোকটা তার পছন্দের এত দাম দেয়! এতটা? ভাবতেই তার ভীষণ রকমের কান্না এলো।
_
বেশ রাত করে ঘুমানোর ফলে চিত্রার মাথা ভার হয়ে আছে ঘুম থেকে উঠার পরপরই। বাহার ভাই এর চিন্তায় মেয়েটার আজকাল ঘুম হচ্ছে না। কিন্তু সে খবর কী মানুষটার আছে? গত চার পাঁচদিন ধরে নিখোঁজ হয়ে আছে। এদিকে চিত্রা মানবী কেঁদেকেটে রাত পাড় করেছে। তাছাড়া রাতে ভীষণ বাজে স্বপ্নও দেখেছে যার জন্য শরীরটা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে।
চিত্রা ঘড়ির দিকে তাকালো। দুপুর একটা বাজছে! চিত্রা অবাক। এত বেলা অব্দি সে ঘুমিয়েছে! ধড়ফড় করে খাট থেকে উঠে বসলো। বার কয়েক নিজের মাকে ডাকলো। কিন্তু উত্তর এলো না। একে একে সবাইকে ডাকলো কিন্তু কোনো জবাব নেই। পুরো বাড়ি নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। চিত্রার কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো। এর মাঝেই ছোটো চেরি ছুটে এলো। খুব বিজ্ঞ স্বরে বললো,
“এই চিত্রা বুবু, জানো কী হয়েছে?”
সওদাগর বাড়ির হৈচৈ পরিপূর্ণ সকাল। বাহিরে কোমল আবহাওয়া। রান্নাঘরে মহিলাদের ব্যস্ত হাতে কাজকর্ম চলছে। খাবার টেবিলে বসে আছে বাড়ির বড়ো ছোটো সকল সদস্য। মুনিয়া বেগম ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এলেন। আজ সকালে খিচুড়ি রান্না করা হয়েছে৷ এই বাড়ির সাপ্তাহিক খাওয়া দাওয়ার একটা রুটিন আছে আর সেই রুটিন অনুযায়ী আজ খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা আর খাঁটি ঘি এর আয়োজন হয়েছে। চিত্রা তাড়া দিলো। পা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
“মা, দ্রুত দেও খাবার, কলেজে দেরি হচ্ছে তো।”
মুনিয়া বেগমও ব্যস্ত হাতে সবাইকে খাবার দিতে দিতে বললেন,
“দিচ্ছি তো, দাঁড়া।”
“এখন খাওয়ার জন্য দাঁড়াতে হবে!”
কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দিলো চিত্রা। মুনিয়া বেগম মুচকি হেসে মেয়ের মাথার পিছে চাপড় দিয়ে বললেন,
“বড়ো হচ্ছিস আর দুষ্টুমি বাড়ছে তোর, তাই না?”
“আর কাজ কী ওর? খাবে দাবে আর বেলাল্লাপনা করবে।”
নুরুল সওদাগর মুখ ঝামটি মেরেই কথাটা বললেন। হাসি হাসি পরিবেশটা মুহূর্তেই গম্ভীর হলো। চাঁদনীর বাবা কিছুটা রুক্ষ স্বরেই ধমক দিয়ে বললেন,
“আহা নুরুল, এসব কেমন কথা তোর? মুখের ভাষা ঠিক কর।”
নুরুল সওদাগর আর কথা বললেন না। দমে গেলো চিত্রাও। তুহিন বাবার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি ফেলে আবার খাবারে মনযোগ দিলো। রান্নাঘর থেকে তখনই ছুটে এলো অবনী বেগম। চেরির থালে ইলিশ মাছের ডিম তুলে দিলেন। অহির সামনে নিয়ে রুটির থালাটা রাখলেন। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,
“দেরি হয়ে গেছে রুটি ভাজতে। খিচুড়ি খাওয়ার দরকার নেই তোমার। কাল এমনেতেই অনেক তেলের খাবার খেয়েছো। এখন রুটি আর অমলেট টা খেয়ে নেও।”
অহির নজর এতক্ষণ তার বইয়ে থাকলেও মায়ের কথায় সে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকালো। অতঃপর কোনো বাক্যব্যয় না করেই প্লেট টা সামনে থেকে সরিয়ে ফেললো এবং মুনিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বললো,
“মেঝো মা, খিচুড়ি দেও তো। খিচুড়ি খাবো।”
মুনিয়া বেগম নিজের ছোটো জা এর দিকে একবার তাকালো। অবনী বেগম চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“আহারে, তোমার তো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। এখন যদি খিচুড়ি খাও তবে জ্বালাপোড়া করবে। খাওয়া লাগবে না।”
অহি চোখ মুখ শক্ত করলো, কঠিন কণ্ঠে মায়ের কথার বিপরীতে জবাব দিলো,
“আমি কী খাবো না খাবো তা ও কী এখন আপনি ঠিক করে দিবেন? আমার এতোটা খারাপ দিন এসে পড়লো?”
অবনী বেগম বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লজ্জায়, অপমানে উনার চোখ টলমল করে উঠলো। বাকি সবাই চুপ থাকলেও চুপ থাকলো না চিত্রা। সে কপাল কুঁচকে কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠেই বললো,
“এই ছোটো আপা, তুমি সবসময় ছোটো মায়ের সাথে এমন করবে না। ব্যবহার সুন্দর করো।”
“তোমাকে কিছু বলছি আমি, চিত্রা? তুমি নিজের কাজ করো। সব ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না।”
“অবশ্যই নাক গলাতে হবে। তুই ছোটো মায়ের সাথে এমন আচরণ করতে পারিস না সবার সামনে। সমস্যা কী তোর?”
অহির শক্ত ঝাড়ির বিপরীতে কণ্ঠ উঁচু করে জবাব দিলো চাঁদনী। অহি টেবিল ছেড়ে ধপ করে উঠে গেলো। একটা অসহ্য রকমের শব্দ করে বললো,
“উনি পুরো মানুষটাই আমার সমস্যা। আর আমার উপর উনার এই দরদ টা আমাকে বিরক্ত করে। উনি যতদিন এমন নাটক করবে আমিও ততদিন এমন করবো। উনি নাটক বন্ধ দিলে আমারও সমস্যা শেষ হবে।”
কথা শেষ করেই অহি নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলে গেলো সদর দরজা পেরিয়ে। সকলে সেখানে তাকিয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো। অবনী বেগমও খুব গোপনে লুকিয়ে ফেললেন নিজের অনাকাঙ্খিত অশ্রু গুলো।
_
সকালের কোমল আবহাওয়া এখন পাল্টে সাদা-কালো রূপ ধারণ করেছে। প্রচন্ড বৃষ্টি আসবে হয়তো। চিত্রার ক্লাস শেষ হলো ঠিক বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। চিত্রা ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে এলো কলেজ থেকে। বিরাট নামকরা এক কলেজেই সে পড়ে। পড়াশোনায় কোনো কমতি রাখেন নি বাবা। বাহার ভাইকে এত অপছন্দ করে কিন্তু চিত্রা একমাত্র তার কাছে ভালো করে পড়ে বিধায় সে এই অসহ্যকর ছেলেটাকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়।
কলেজ থেকে বের হয়েই চিত্রা বড়ো রাস্তায় দাঁড়ালো। বড় রাস্তার মোড়ে চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকালো চিত্রা। অবাক কণ্ঠে নিজেই বলে উঠলো,
“বনফুল!”
মোড়ে থাকা মেয়েটা ওড়না দিয়ে মুখ চোখ আরও ভালো ভাবে ঢেকে নিলো যা দেখে চিত্রার অবাক ভাব আরও বাড়লো। সে কিছুটা হাঁক ছেড়েই ডাকলো,
“এই বনফুল, এই রে শোন।”
চিত্রার ডাক সকলের কানে পৌঁছালেও পৌঁছায় নি মেয়েটার কানে। সে একটা রিকশা থামিয়ে উঠে পড়লো। চিত্রা তবুও কিছুটা ছুটে গেলো সেখানে কিন্তু ততক্ষণে রিকশা তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ফেলেছে। চিত্রা ভীষণ রকমের অবাক হয়েই আনমনে বলে উঠলো,
“বনফুল তো এখানে কখনো আসে নি, চিনেও না। তবে মেয়েটা এখানে কী করছে!”
চিত্রার ভাবনার মাঝেই আকাশ গম্ভীর ভাবে ডেকে উঠলো। পরিবেশ আরেকটু আঁধার হয়ে উঠলো। আর ঠিক কয়েক মিনিট পেরুতেই ঝপঝপ করে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো প্রকৃতির বক্ষ। শীতল করলো জনজীবন। সকলে ভিজে যাওয়ার ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করলো, খুঁজে নিলো নিজেদের রক্ষা করার স্থান। কেবল মুগ্ধ চোখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো খোলা আকাশের নিচে। তার কোনো তাড়া নেই, ব্যস্ততা নেই, ছুটোছুটি নেই। সেই বৃষ্টির পানি আহ্লাদে ছুঁয়ে দিচ্ছে, খিলখিল করে হেসে উঠছে আপন বেগে আবার আকাশ পানে তাকিয়ে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে। বয়ঃসন্ধির বয়সই তো এমনই। ভীষণ আদুরে, ভীষণ চঞ্চল।
_
সেই বিকেল থেকে তুমুল ঝড় যে শুরু হলো তা আর থামার নাম করলো না। কিছুক্ষণ পর পর প্রকৃতি কাঁপিয়ে বজ্রপাত হচ্ছে, প্রকৃতি কী অদ্ভুত আলোয় আলোকিত হয়ে যাচ্ছে আবার সেকেন্ডেই সে আলো হাওয়ায় মিলিয়ে প্রকৃতি হয়ে যাচ্ছে আঁধার। চিত্রাদের বাড়িতে আজ বিদ্যুৎ নেই। চারপাশের বাড়ির গুলোতেও এক দশা। ধানমন্ডির মতন বিলাসবহুল স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াটা বিস্ময়কর। কিন্তু ঝড়ের তান্ডব বেশি বিধায়ই এই বিস্ময়কর কাজটার দেখা মিললো।
চিত্রাদের ড্রয়িং রুমে জ্বলছে সৌরবিদ্যুৎ এর বাতি যা খুবই হালকা আলো দিচ্ছে। সে আলোতেই রান্নাঘরের কাজ গুলো সেড়ে নিচ্ছে বাড়ির মহিলারা। অহি তার ঘরের ব্যাটারি সিস্টেমের টেবিল ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। তার কোনো চিন্তা নেই কি হচ্ছে আশপাশে তা নিয়ে। সে পড়তে পারলেই হলো। মেয়েটা পড়ুয়া ছিলো অনেক আগে থেকেই কিন্তু এতটাও পড়ুয়া ছিলো না। সেও হাসতো, একটু দুষ্টুমি করতো, বৃষ্টি এলে ছুঁয়ে দিতো। অনেক গুলো বছর হলো সে সব ছেড়েছে। নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছে একটা বস্তুতে। এটাতেই যেন সে বেঁচে থাকার অক্সিজেন পায়। বেঁচে থাকার জন্য কিছু আঁকড়ে ধরতে হয়, অহি বই আঁকড়েছে।
চাঁদনী দাঁড়িয়ে আছে তার বারান্দায়। খোলামেলা বারান্দা হওয়ার অসুবিধায় বৃষ্টির ছাঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে চাঁদনীর শরীর। চারপাশ এতটাই অন্ধকার যে বোঝার উপায় নেই সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর ধ্যান তার আকাশ পানে। চোখে ভেসে উঠছে তার সুন্দর অতীতের দিন গুলো। শাহাদাৎ ছেলেটা খারাপ না বরং একটু বেশিই ভালো বলা যায়। চাঁদনীকে সে অনেক ভালোও বেসেছিল। কিন্তু সবসময় সবার প্রতি ভালোবাসা থাকবে এমন কোনো নিয়ম নেই বিধায়ই এখন সে ভালোবাসা ফুড়িয়েছে। সেজন্য লোকটাকে একবারে খারাপ বলা যায় না। যে এক কালে আমাদের ভালোবাসতো তাকে চিরদিন আমাদের ভালোবাসায় রাখা উচিৎ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষের যে বড্ড অভাব!
চাঁদনী চমকে গিয়ে ছিল হঠাৎ গানের স্বর শুনে, কিন্তু কণ্ঠের মালিককে চিনতে তার এক সেকেন্ডও ব্যয় করতে হয় নি। চেনার সাথে সাথেই সে ভ্রু কুঁচকালো। চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,
“মৃন্ময়!”
পাশের বিল্ডিং থেকে সেই পরিচিত কণ্ঠের হাসির শব্দ ভেসে এলো। কিছুটা ঠাট্টা করেই ছেলেটা বললো,
“আমার শরীর থেকেও কী পরিচিত সেই সুঘ্রাণ টা বের হয় ইন্দুবালা? যেই সুঘ্রাণ আপনাকে চিনিয়ে দেয় আমার উপস্থিতি!”
চাঁদনী দৃষ্টি সরু করলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“কোনো সুঘ্রাণ টান আসছে না, তোমার কণ্ঠ শুনে বুঝলাম এটা তুমি। এত সিনেম্যাটিক হয় কীভাবে মানুষ! সাধারণ জ্ঞানও দেখি তোমার নাই।”
“সওদাগর বাড়িতে সবাই এত জ্ঞানী যে আমাদের সাধারণ জ্ঞান গুলোও তাদের দিয়ে দিতে হয়েছে। কী আর করবো বলুন?”
“ঠাট্টা করো না, মৃন্ময়।”
“ঠাট্টা করছি না তো, দুষ্টুমি করছি।”
চাঁদনী তর্ক করলো না। পাশের বিল্ডিং এর অন্ধকারের গাম্ভীর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না। তবে সে বেশ বুঝতে পারছে ছেলেটা একটা পাতলা টি-শার্ট জড়িয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে নিশ্চয় হাসছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে আর বৃষ্টির কিছু অনির্দিষ্ট ফোঁটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছেলেটার মুখ জুড়ে। ভীষণ মিষ্টি লাগছে হয়তো ছেলেটাকে। ইশ, মুখটা দেখতে পেলে ভালো লাগতে।
“ইন্দুবালা, হাঁটতে যাবেন?”
মৃন্ময়ের হুট করে এমন প্রশ্নে বেশ অবাক হলো চাঁদনী। অবাক কণ্ঠেই বললো,
“কিহ্! এমন বৃষ্টিতে কই যাবো হাঁটতে!”
“চলেন না মোড়ের দোকান থেকে চা খেয়ে আসি। বৃষ্টির মাঝে চা খেতে কিন্তু ভীষণ ভালো লাগে। খেয়েছেন কখনো?”
চাঁদনী আনমনেই উত্তর দিলো, “নাহ্।”
“তাহলে চলুন আজ, খেয়ে আসি দু’জনে।”
চাঁদনী কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“আসছি, দাঁড়াও।”
“আমার চিতই পিঠাকে জিজ্ঞেস কইরেন আসবে কি-না।”
“ওর জ্বর এসেছে মৃন্ময়। মোঝো মা বোধহয় যেতে দিবে না।”
“কী বলেন! আমার চিতল মাছের জ্বর এসেছে! আগে বলবেন না। চা খেয়ে ফেরার সময় দেখে যাবো। এখন আপনি নামেন। আমিও নামছি।”
চাঁদনী উত্তর না দিয়েই ঘরে চলে গেলো। কালো টি-শার্ট এর উপরে একটা কালো জ্যাকেট জড়িয়ে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। একদিকে ঘরে টিমটিমে আলো তার উপর সবাই যার যার মতন ব্যস্ত বিধায় চাঁদনীকে তেমন প্রশ্নের মুখেও পড়তে হলো না। অনায়াসেই বেরিয়ে গেলো। ধুপধাপ পায়ে নিচে নামতেই দেখলো মৃন্ময় হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বিল্ডিং এর দিকে তাকিয়ে। ঘর থেকে আকাশটা যতটা অন্ধকার মনে হচ্ছিলো ততটা অন্ধকারও লাগছে না। বেশ আলো আছে। যতটা আলো থাকলে মৃন্ময়ের সুন্দর হাসিটা দেখা যায় ঠিক ততটা আলো।
চাঁদনী রাস্তায় পা রাখার আগেই বেশ মাঝারি আকারের একটা ছাতা তার মাথার উপর মেলে ধরলো মৃন্ময়। চাঁদনী নিজের কপাল চাপড়ালো, কিছুটা আফসোসের স্বরেই বললো,
“আমি তো ছাতা আনতে ভুলেই গেছি।”
“আমি তো সে জন্য এনেছি।”
“তুমি কীভাবে বুঝলে আমি যে ছাতা আনতে ভুলে যাবো?”
“যেভাবে বুঝেছি আপনার আমার মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, ঠিক সেভাবেই এটা বুঝেছি।”
টঙ দোকানের ভেতর থাকা আট নয় বছরের দিনুর কথায় বাহার হাসলো। সে একটা টঙ দোকানে বসে সিগারেট টানছিলো, পরিচিত দোকান। এখানেই সে প্রায় প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার এসে আড্ডা দেয়। আজও এই তুমুল বৃষ্টির মাঝেও সে এখানে বসে মনের সুখে সিগারেট টানছিলো।
দিনু আবার বললো, “গিটার ডা বাজাইবা না ভাইজান?”
“না রে দিনু, বাজাবো না। বৃষ্টির শব্দটা বেশ সুন্দর। গিটারের শব্দও সুন্দর। কিন্তু দুইটা সুন্দর একসাথে মিলে মিশে গেলে ততটা মুগ্ধতা কাজ করে না। তখন তুই কোনটা রেখে কোনটা শুনবি ভেবেই পা গ ল হয়ে যাবি। এরপর একটাও শান্তি লাগবে না। এর চেয়ে ভালো একটাই শোন।”
দিনু বায়না ধরলো। টঙ দোকান থেকে নেমে এসে আবদার করে বললো,
“বাজাও না ভাইজান। তোমার ঐ যন্তর টা বাজাইলে আমার অনেক সুখ সুখ লাগে।”
বাহার হো হো করে হাসলো। দিনুর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
“আচ্ছা তাই নাকি! তোর সুখ সুখ লাগে? কিন্তু কেন?”
“জানিনা গো। কিন্তু কী মিষ্টি লাগে শুনতে। আজ তুমি বাজাও আর আমি হাত তালি দিবো কেমন?”
“আচ্ছা, দিস।”
কথাটা শেষ করেই বাহার গিটারে সুর তুললো, কণ্ঠে গান ধরলো,
“ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো,
দিও তোমার মালা খানি
বাউলের এই মনটারে,
আমার ভিতর ও বাহিরে
অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে,,,”
বাহারের গানের তালে তালে দিনু ছেলেটা হাততালি দিচ্ছি কী দারুণ উচ্ছ্বাসে! কিন্তু মুহূর্তেই সেই আনন্দে মাখামাখি আদুরে মুখটাকে পিষিয়ে দিলো একটা দা ন বী য় ট্রাক। দিনু পথের বেশ কিনারেই হাত তালি দিয়ে লাফাচ্ছিল। কোথা থেকে যেন এই ট্রাক হর্ণ না বাজিয়েই সাঁইসাঁই করে ছুটে এলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ছোটো শরীরটাকে পিষে ফেললো এক লহমায়। বাহারের কণ্ঠের গান থেমে গেলো। গিটারের সরু তাঁরটাও ছিঁড়ে কেটে গেলো বাহারের হাত। বাহার স্তব্ধ চোখে অসহায় সেই ছেলেটাকে দেখলো। যেই আট বছরের ছেলেটার কাঁধে ছিলো বোনের বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন, বাবাকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে ফেলার আশা। সব আজ রাস্তায় পিষে গেলো। দরিদ্রের শখ যেভাবে ধূলোয় লুটায় ঠিক সেভাবে।
আকাশে আলো আঁধারের মিশেলে মুগ্ধ একটা রঙ সৃষ্টি করেছে কারণ- সময়টা ঠিক সন্ধ্যা। সন্ধ্যাবেলা টা একেক জনের কাছে একেক ভাবে পরিচিত৷ কেউবা সন্ধ্যাকে মন খারাপের সাথে তুলনা করে, কেউবা বলে সন্ধ্যা হলো মুক্ত অনুভব করানোর সময়, সারাদিন ব্যস্ততা শেষে এই সন্ধ্যাবেলা মানুষকে এক আকাশ সমান বিরতি দেয়, কারো কাছে প্রেমের গদ্য হলো সন্ধ্যা, আকাশে যেন প্রেমিকার মুখ ভাসে। কিন্তু চাঁদনীর কাছে সন্ধ্যা মানেই কেবল বিষন্নতা। এই সময়টা তাকে মনে করিয়ে দেয়, সে একজন মানুষকে ভালোবেসে খুব বাজে ভাবে ঠকেছে। যে মানুষটার সাথে তার ঘর করার কথা ছিলো, সে মানুষটার সাথেই ঘর করছে অন্য কেউ। যে মানুষটা তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিয়েছে, সে মানুষটাই আজ নিজের ঘরে অন্য একটা বউ নিয়ে সুখে মেতে আছে। যাকে ছাড়া চাঁদনীর চলবেই না ভেবেছিলো, তাকে ছাড়াই চাঁদনী বেঁচে আছে। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না!
চারদিকে সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসছে। চাঁদনীর বিশাল রুমটা অন্ধকারে ডুবে আছে ঠিক চাঁদনীর মতন। এক ফোঁটা আলো নেই। চাঁদনী বালিশে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে আছে। অন্যান্য দিন সে এ সময়টা অফিসেই থাকে। একটা নামকরা প্রাইভেট অফিসেই উচ্চ পদে কর্মরত সে। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর পরই সে চাকরিতে জয়েন করে। ভালো ছাত্রী বিধায় চাকরির এই মূল্যবান বাজারে চাকরি পেতে অসুবিধা হয় নি। তাছাড়া বাবা চাচার নাম ডাকও ভূমিকা পালন করেছে বলা যায়। আজ চাঁদনিী অফিস যায় নি। তার মায়ের জন্য ই যেতে পারে নি বলা যায়। আজকে তাদের বাড়ি মেহমান আসবে। শাহাদাৎ এবং তার নতুন বধূ সহ তাদের পরিবারের সবাইকে সওদাগর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আজ। ব্যবসায়িক একটা ভালো সম্পর্ক আছে এই দুই পরিবারের ভিতরে, সেই সুবাদেই এই আয়োজন।
খুব বেশিক্ষণ চাঁদনীর শুয়ে থাকা হলো না। তার আগের তার মা রোজা সওদাগর ব্যস্ত পায়ে ছুটে এলেন মেয়ের ঘরে। পুরো ঘর আঁধার দেখে খানিকটা চেঁচিয়ে বললেন,
“কী ব্যাপার চাঁদ? তুই ঘরের লাইট জ্বালাস নি কেন?”
চাঁদনী উত্তর দিলো না। তা দেখে ভদ্র মহিলা আরেকটু বিরক্ত হলো। আঁধার হাতড়ে সুইচ বোর্ড খুঁজে বের করে পুরো ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। ঘর, ঘরের সাথে লাগোয়ক বারান্দা এমনকি বিছানার সাইটের ছোটো লাইট অব্দি জ্বালিয়ে দিলেন। এতক্ষণ অন্ধকারে ছিলো বিধায় হঠাৎ আলোটা চাঁদনীর চোখে গিয়ে বিঁধলো। সে বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“মা, জ্বালাচ্ছো কেন?”
“আমি জ্বালাচ্ছি? হ্যাঁ, আমি জ্বালাচ্ছি। তোরা আমার র ক্ত মাংস চিবিয়ে খাচ্ছিস না? তোদের সংসারে পরে আমার জীবনটা শেষ।”
“উফ্ মা, বিরক্ত করো না।”
মেয়ের মনের অবস্থা বুঝলেন না রোজা সওদাগর বরং কিছুটা চেঁচিয়েই বলে উঠলেন,
“তোরে কে বিরক্ত করছে? বিয়ের বয়সী একটা মেয়ে এখনো বাপের ঘাড়ে বসে আছে, কেউ কিছু বলে না তাই মাথা কিনে নিয়েছিস। আমি বলি তাই আমাকে সহ্য হয় না, তাই না।”
চাঁদনী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। গত কয়েকটা দিন যাবত হাসিখুশি মেয়েটা নেতিয়ে গিয়েছে, চোখের নিচে পড়েছে কালো প্রলেপ। হাঁটুর বয়সী মেয়েটা বুঝতে পারছে তার আপা ভালো নেই অথচ তার মা! তার মা কি সুন্দর আরও ভেঙে দিলো! বাবা-মা গুলো মাঝে মাঝে এতটা অবুঝ হয় কেন? তারা একটু সন্তানকে সঠিক সময় বুঝলে খুব কী ক্ষতি হয়ে যেতো? চাঁদনী খুব শক্তপোক্ত মেয়ে কিন্তু তার মায়ের আচরণ তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। মুহূর্তেই তার শুকনো চৌচির হয়ে থাক চোখ গুলো অশ্রুতে টলমল করে উঠলো। অথচ রোজা সওদাগর নিজের মতন কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন আর পড়ার টেবিল টা গোছাচ্ছেন। মায়ের এত হৈচৈ, চিৎকার চেঁচামেচির মাঝেই চাঁদনী কোমল, অসহায় কণ্ঠে বললো,
“আমি কী তোমাদের বোঝা হয়ে গেছি, আম্মু? আমাকে কী আর বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে না?”
রোজা সওদাগর থেমে গেলেন। আড়চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। মায়ের কঠিন মন বোধহয় কিছুটা নরম হলো। সে আর চেঁচামেচি করলেন না তবে ধীর কণ্ঠে বললেন,
“আমাদের তুই ই একটা সন্তান। আমাদের কী ইচ্ছে করে না তোকে বিয়ে দিবো, তোর সংসার দেখবো। তোর সুখ দেখবো।”
“বিয়ে করলেই সবাই সুখী হয় আম্মু? কই, ছোটোমা তো বিয়ে করলো চাচ্চুকে, তাকে তো সুখী হতে দেখলাম না।”
“চাঁদ, মুখ সামলে কথা বল। বে য়া দব হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন।”
চাঁদনী হাসলো কিন্তু উত্তর দিলো না। রোজা সওদাগর বাহিরে যেতে যেতে তাড়া দিয়ে বললেন,
“এসব জামাকাপড় বদলে শাড়ি পড়। মেহমান আসবে, সেখানে একটা মানানসই পোশাক দরকার। তোর বয়সী ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে। আর তুই ঘরে পড়ে পড়ে কেবল বেয়াদবী করে যা। আর কী করবি।”
কথা শেষ করেই রোজা সওদাগর আবার চঞ্চল পায়ে চলে গেলেন। চাঁদনী তার মায়ের যাওয়ার পানে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো। মুখে ফুটে আছে চরম তাচ্ছিল্যের হাসি। ভিতর থেকে অন্তর আত্মা হয়তো চিৎকার দিয়ে বলছে,
“আমায় একটু বুঝলে না কেন, আম্মু। আমায় একটু বাঁচতে দিচ্ছো না কেন। আমার যে বাঁচতে ইচ্ছে করছে, আমায় সাহায্য করো তোমরা। আর ভেঙে দিও না।”
কিন্তু মেয়ের আর্তনাদ মা অব্দি পৌঁছালো না। হয়তো ‘কুড়িতে বুড়ি’ প্রবাদ বাক্য বিশ্বাস করা সমাজ কুড়ির পর আর মেয়েদের মন বলতে কিছু থাকে তা ভুলে যায়। মেয়ে তখন অযত্নের এক শোপিস হয়ে ঘরের কোণায় পড়ে থাকে। যে শোপিসের কোনো দরকার নেই অথচ বাবা-মা দয়া করে পালেন।
_
চিত্রা আর বনফুল চিত্রার রুমে বসে আছে। বাহিরে তখন অতিথি গমগম করছে। চিত্রা তার প্রিয় বান্ধবী ছাড়া বাড়ির একটা অনুষ্ঠানেও থাকে না। বনফুলকে তার চাই ই চাই। অন্যান্য দিন হলে চিত্রার মনে উচ্ছ্বাস থাকতো। মেহমান এসেছে আর পড়া লাগবে না, সে ভেবে খুশি থাকতো কিন্তু আজ ব্যাপারটা উল্টো। আজ তার মেহমানের সামনে যেতে মন চাচ্ছে না। শাহাদাৎ লোকটাকে তার দু-চোখে সহ্য হচ্ছে না। এত বিরক্তিকর মানুষ তার জীবনে আর একটাও দেখে নি সে।
অন্যদিকে বনফুল মেয়েটা আজ চঞ্চল পায়ে এধার ওধার হাঁটাহাঁটি করছে। মেয়েটা চিত্রার মতন তত চঞ্চল না। কিছুটা সহজ সরল আর বোকা বোকা ধরণের। শরীরের রঙটা একটু চাপা, রোগা-সোগা শরীর, কোঁকড়া চুল কিছুটা ভাইয়ের মতনই। কিন্তু বাহার ভাই আর বনফুলের চেহারায় কোনো মিল নেই, এমনকি বাহার ভাইয়ের সাথে তার মায়ের চেহারারও মিল নেই না আচরণের মিল আছে, একদম বিপরীত ধর্মী সে। সে রাগী, গম্ভীর অথচ বনফুল কখনো রাগ করে না, অভিমান করে না। চিত্রাই যেন তার সর্বেসর্বা। কিন্তু আজ মেয়েটা একটু উত্তেজিত, কিছু একটা কারণে প্রচন্ড উতলা হয়ে আছে। চিত্রা হয়তো জানে সে কারণ। তাই তো মিটমিটিয়ে হাসছে।
চিত্রা গলা পরিষ্কার করার মতন শব্দ করলো। কিছুটা গম্ভীর গম্ভীর ভাব ধরে বললো,
“বনফুল, একটা কাজ করে দিবি আমার?”
“কি কাজ বল, আমি এখনই করে দিবো। ঘর ঝাড়ু দিবো?”
বনফুলের কথায় চিত্রা নিজেই নিজের কপালে চাপড় মারলো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“ধরে থাব্রা দিবো তোরে। ঘরের কাজ করতে আসিস নাকি এখানে। তোর কাজ হলো তুহিন ভাইয়ের ঘরে যাওয়া।”
তুহিন নামটা শুনতেই বনফুলের কোমল চিত্ত চঞ্চল হয়ে গেলো। হৃদপিণ্ড আকস্মিক তার কম্পন বাড়িয়ে দিলো। মেয়েটার কাঁপা কাঁপিও শুরু হলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“কেন, কেন?”
“ভাইয়া মাত্র অফিস থেকে এসেছে হয়তো, গিয়ে বলবি আমার ঘরে আসতে। আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিবো। যা।”
বনফুল ভীতু ভীতু কণ্ঠে বললো, “তুই, তুই যা চিতাবাঘ। আমি যাবো না।”
“কী? তুই এই আমাকে ভালোবাসিস? এত ছোটো একটা কাজও করে দিতে পারবি না?”
বোকা মেয়েটা চিত্রার কৌশল বুঝলো না। বান্ধবী কষ্ট পেয়েছে ভেবে সে তৎক্ষনাৎ বললো,
“রাগ করিস না চিতাবাঘ। আমি যাচ্ছি এক্ষুনি। তবুও তুই রাগিস না।”
“হু, যা।”
চিত্রা খুব কষ্টে নিজের হাসি চেপেই গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো। বনফুলও ছুটে গেলো সাথে সাথে। বনফুল বেরিয়ে যেতেই চিত্রা হেসে উঠলো। মেয়েটা যে কেন এত ভয় পায় তার ভাইকে সে বুঝে উঠে না। আবার এই ভাইয়ের জন্য ই রাত সাতটা বাজে জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন তুহিন নামক লোকটা আসবে আর বনফুল তা দেখে চোখ জুড়াবে।
চিত্রার ভাবনার মাঝেই হৈ হৈ করে ঘরে প্রবেশ করলো মৃন্ময়, তার পিছে পিছে চাঁদনী ও অহিও হাজির হলো। চিত্রা হা হয়ে মৃন্ময়ের দিকে তাকাতেই ছেলেটা মিষ্টি হাসি দিলো। মিষ্টি করে বললো,
“ওহে প্রিয় চিতই পিঠা, তোমারে না দেখিতে পাইয়া মোর মন আনচান আনচান করছিলো। তাই তোমার বোনদের সহিত চলে এলাম তোমাকে দেখতে।”
চিত্রাও মৃন্ময়ের মতন ভঙ্গিমা করে বললো,
“ওহে আমার মৃগী রোগী ওরফে মৃন্ময় ভাইয়া, তোমায় দেখিয়া মোর হৃদয় ছলাৎ করিয়া উঠিলো।”
দু’জনই দু’জনের অদ্ভুত কথা বলে হেসে উঠলো। চাঁদনীও কিঞ্চিৎ হাসলো। কেবল মুখ গোমড়া করে চিত্রার পড়ার টেবিলের সাথে থাকা চেয়ারে এসে বসলো অহি৷ কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“এই মৃন্ময় ভাইয়া টা আমারে একটু পড়তে দিলো না। চেরি কে দিয়ে এমন তাড়া পাঠালো, আমি তো ভাবলাম কি না কি যেন বলবে।”
মৃন্ময়ের কথায় হেসে দিলো চিত্রা ও চাঁদনী। অহি মুখ ফুলিয়ে ফেললো তা দেখে। চিত্রা এবার চাঁদনী আপার দিকে তাকালো, মানুষটা কী সুন্দর সাদা শাড়ি পড়েছে! কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করা ছাড়াও মেয়েটা কী সুন্দর চাঁদের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে। অথচ এমন একটা মেয়েকেই ফিরিয়ে দিয়েছে কোনো পুরুষ! কী বোকা সে!
তন্মধ্যেই তাদের ঘরে উপস্থিত হলো শাহাদাৎ এবং তার নতুন বউ। রোজা সওদাগরই নিয়ে এসেছেন তাদের। এসেই ধমকে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
“ওরা ওখানে একা বসে আছে আর তোরা আড্ডা দিচ্ছিস। ওদের ডাকবি না।”
অতঃপর শাহাদাৎ এর দিকে তাকিয়ে গদোগদো কণ্ঠে বললো,
“বাবা, আম্মু তোমরা বসো এখানে। ওদের সাথে আড্ডা দেও। আমি শরবত পাঠাচ্ছি।”
মহিলা আবার ব্যস্ত পায়ে চলে গেলো সেখান থেকে। চাঁদনী ছোটো একটা হতাশার শ্বাস ফেললো। তার মা না জেনেই তার ভেতর কেমন ক্ষত করে ফেলছে!
মৃন্ময় ছুটে গেলো নতুন বউয়ের দিকে। উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
“এটা আমাদের ঘরের বউ। কিউট না? ও নিলা, সবে এসএসসি দিয়েছে। আমার অনেক ছোটো অবশ্য। তবে বেশ আদুরে তাই না?”
অহি মাথা দুলালো কিন্তু চিত্রা দাঁড়িয়ে রইলো শক্ত মুখে। চাঁদনী খাটে বসে ছিলো, মিষ্টি হেসে মৃন্ময়ের উত্তরে বললো,
“হ্যাঁ ভীষণ সুন্দর। নাহয় আমিও তো বলি, তোমার ভাই এমন পাগল হলো কেন। বিদেশ থেকে এসে এক সপ্তাহেই বিয়ে করে নিলো। অল্প বয়সী পুতুল বউ।”
চাঁদনীর কথায় শাহাদাৎ মাথা নিচু করে রাখলেও নিলা মেয়েটা সুন্দর এক হাসি উপহার দিলো। মৃন্ময় মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
“ভাইয়ার ছোটো বউ ভাল্লাগে আর আমার সিনিয়র বউ। কেমন একটা এডভেঞ্চার ভাব থাকে।”
“তোমার কপালে বউ জুটলে তো!”
কথাটা বলেই চিত্রা ভেংচি কাটলো। চাঁদনী সে দিকে ধ্যান না দিয়ে তাকিয়ে রইলো নিলার দিকে। অল্প বয়সী একটা মেয়ে। সদ্য ফোটা পুষ্পের ন্যায়। সেজন্যই তো প্রেমিক পুরুষ পথ ভুলেছে, প্রেম ভুলেছে সাথে ভুলেছে প্রেমিকা। চাঁদনীর সাথে শাহাদাৎ এর যখন প্রেম শুরু হয় তখন চাঁদনীও সদ্য যুবতী। নিলার চেয়েও বোধহয় সুন্দর তার রূপ। শাহাদাৎ এর সাথে এক ক্লাসে পড়তো। শাহাদাৎ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতো। এরপর সেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা ছেলেটার প্রেমে যে সে পড়লো, দুনিয়ার আর কোনো ছেলেকে আর ভালো ই লাগলো না। অথচ সেই রূপ আজ কিছুটা চাপা পড়েছে, তাই প্রেমিকের প্রেমও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কিন্তু বয়সের এই সরল নামতা যেই প্রেমিকের জন্য পাড় করলো, সেই প্রেমিকই আজ বয়সের দোহাই দিয়ে ছেড়ে গেছে। আহা প্রেমিক, আহা জীবন!
চাঁদনীর ভাবনা ভাঙলো মৃন্ময় আর চিত্রার তুমুল ঝগড়ায়। এটা নতুন কিছু না। ছেলেটা সবার সাথেই এমন লেগে থাকে। চাঁদনী বসা থেকে উঠে এসে নিলার হাত ধরলো, মিষ্টি হেসে বললো,
“এসে নিলা, বসবে এসো।”
“এ মা, না না আপু, আপনি বসুন। এটা আপনার স্থান তো।”
“সব জায়গা কী সবসময় সবার থাকে? কখনো কখনো কিছু জায়গা ছেড়ে দিতে হয় নতুনদের জন্য।”
নিলার কথার বিপরীতে বাহার তার গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলতে বলতেই ঘরে প্রবেশ করলো।
_
সওদাগর বাড়ির সবচেয়ে দক্ষিণ দিকের রুমটায় নীল রঙের নিভু নিভু একটা বাতি জ্বলছে। লো ভলিউমে রবীন্দ্র সংগীত ‘আমারও পরানে যাহা চায়’ বাজছে। ফ্যানের নিঃশব্দ বাতাসে উড়ছে ঘরের পর্দা গুলো। বাথরুম থেকে ভেসে আসছে পানির শব্দ। আর ঘরে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে বনফুল। এটা বাড়ির বড়ো ছেলে তুহিনের রুম। সবচেয়ে ভদ্র ছেলে সে। অথচ তাকে দেখলেই বুক কাঁপে বনফুলের। কেন কাঁপে সে জানেনা। হৃদপিণ্ড টা তার কম্পন বাড়িয়ে দেয়। মনে হয় এই বুঝি শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। এ কেমন মরণ মরণ অসুখ! তবে বনফুল এই মরণ মরণ অসুখটা ভালোবাসে। লোকটা যে তার ভীষণ প্রিয়!
বনফুলের ভাবনার মাঝে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো তুহিন। ভিজে শরীরে সাদা একটা পাঞ্জাবি পড়া। লাল হয়ে আছে নাকটা। মাথা থেকে শিশির বিন্দুর ন্যায় জলের ফোঁটা পড়ছে।
বনফুলকে নিজের ঘরে দেখে হাসলো তুহিন। মিষ্টি কণ্ঠে শুধালো,
“আরে বনফুল যে! তা এ ঘরে যে? কোনো দরকার?”
মেয়েটা মাথা তুলে তাকালো না। মেঝেতে দৃষ্টি রেখেই বললো,
“তোমাকে চিতাবাঘ ডাকছে। সবাই একসাথে আড্ডা দিবে।”
“ও তাই নাকি! আচ্ছা যাচ্ছি। তা তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“ভা, ভালো ভাইয়া।”
বনফুলের কথায় হাসলো তুহিন। ঠাট্টা করে বললো, “হ্যাঁ আমি তো ভালো জানি, পড়াশোনাটা কেমন চলছে!”
বনফুল অস্বস্তিতে আরেকটু মাথা নত করলো। তা দেখে তুহিন হো হো করে হেসে উঠলো। লোকটা হাসলে কতো সুন্দর লাগে! কিন্তু এই মুগ্ধতা বেশিক্ষণ টিকলো না। চিত্রার রুম থেকে কেমন ধমক ভেসে এলো। বনফুল আর তুহিন দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত ছুটে গেলো চিত্রার রুমের দিকে। চিত্রার রুমের দরজায় গিয়ে তুহিনের চক্ষু চড়কগাছ। চিত্রা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনে দেয়াল হিসেবে বাহার দাঁড়িয়ে আছে।
#চলবে
মম সাহা
#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা
পর্বঃ ৪
হৈচৈ এ পরিপূর্ণ রুমটা মুহূর্তেই নিশ্চুপতায় মগ্ন হলো। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা শব্দ করে জানান দিলো সময় অতিবাহিত হওয়ার গল্প। বাহার দাঁড়িয়ে আছে রণমুর্তি ধারন করা একজন মানুষের সামনে, চিত্রা তার পিছনেই গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার গাল লাল হয়ে আছে, চোখে অশ্রুদের মাখামাখি। মৃন্ময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলে উঠলো,
“আঙ্কেল, ও মজা করছিলো। চ ড় দেওয়ার মতন,,,,”
মৃন্ময়ের কথা শেষ করার আগেই শক্ত পুরুষ মূর্তি টা থামিয়ে দিলো তাকে। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন
“শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দরকার নেই, মৃন্ময়। আমি নিজের চোখে দেখেছি সবটা।”
নুরুল সওদাগরের রাগী কণ্ঠ পরিস্থিতি আরও বিপরীতে নিয়ে গেলেও উপস্থিত একজনের মুখে হাসি ফুঁটে রইলো। অগোছালো সেই লোকটা হাসে কম আর যতটুকু হাসে তা ভুল জায়গায় তবে সঠিক হাসি। এখনও তাই হলো। হাসতে হাসতে সে কিছুটা হেয়ালি করে বললো,
“সমস্যা টা তো এখানেই, স্যার। আপনারা নিজের চোখে যা দেখেন তা দেখেই বিচার করতে উঠে পড়ে লেগে যান। চোখের আড়ালেও যে গল্প থাকে, সেটা আর জানার কিংবা বোঝার চেষ্টা করেন না।”
“আচ্ছা! আপনার কী মনে হয়, মানুষ কিছু করতে বলবে এরপর আমি সেটা করবো!”
নুরুল সওদাগর আরেকটু রাগলেন। হাত বাড়িয়ে বাহারের পেছনে লুকিয়ে থাকা চিত্রাকে ধরতে নিলেই হাত টা ধরে ফেললো বাহার। বেশ গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বললো,
“আহা স্যার, এত নিজের মন মতন নাচবেন না তো। আপনার অনেক ক্ষমতা আছে বুঝলাম কিন্তু বাহার যেখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে ক্ষমতা দেখানো নেহাৎ ই বোকামি।”
“ক্ষমতা দেখাবো আমি। কী করবে তুমি? কী করবে হ্যাঁ?”
কথাটা বলেই বাহারের দিকে তেড়ে গেলেন নুরুল সওদাগর কিন্তু বেশি কিছু করতে পারলেন না, তার আগেই তুহিন এসে পড়লো। বেশ শান্ত কণ্ঠে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
“আপনি সিনক্রিয়েট করতে ভালো জানেন সেটা আমাদের জানা আছে কিন্তু তাই বলে বাহিরের মানুষের সামনে ঘরের মেয়েকে অপমান করার কোনো অধিকার আপনার নেই।”
নুরুল সওদাগর কিছুটা দমে গেলেন ছেলেকে দেখে। কিন্তু পুরোপুরি থেমে গেলেন না। সে কড়া চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছেলেকে বিশ্লেষণ করে বললেন,
“তোমার বোন কী করেছে জানো? আমি দরজার সামনে এসে শুনি সে হিংস্র চোখে শাহাদাৎ এর দিকে তাকিয়ে মৃন্ময়কে বলছে, এমন ব্রিলিয়ান্টের ধার নাকি সে ধারে না। শাহাদাৎ নাকি মানুষ ভালো না। বাড়িতে ডেকে এনে মেহমানকে অপমান করার শিক্ষা কোথা থেকে পেলো সে?”
বাবার কথায় ভ্রু কুঁচকালো তুহিন। বোনের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক কণ্ঠেই বললো,
“আমার চিতাবাঘ, তুই তো এসব এমনি এমনি বলার মেয়ে না। কী জন্য বলেছিস এমন?”
“তুহিন, তুমি আশকারা দিচ্ছো ওকে। ঘরের মানুষ, বাহিরের মানুষ সবাই মিলে আমাকে অপদস্ত করার খেলায় মেতেছো দেখি!”
বাবার ভরাট কণ্ঠের বিপরীতে তুহিন তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিলো, “যে নিজে যেচে অপদস্ত হতে চায়, তাকে তো সেটাই করা হবে। অহি, বল তো কী হয়েছে এখানে।”
শেষের কথাটা তুহিন অহির দিকে তাকিয়ে বললো। অহি ভীতু ভীতু চোখে একবার নুরুল সওদাগরের দিকে তাকালো অতঃপর ঢোক গিলে বলতে লাগলো,
“সবাই ই কথা বলছিল। বাহার ভাই ও এসেছিলেন চিত্রাকে পড়াতে। এর মাঝেই চাঁদ আপা নিলা ভাবীকে বললো ‘নিলা, তোমার শাড়িটা তো বেশ সুন্দর। লাল টকটকে। নতুন বিয়ে হয়েছে, শাড়ি দেখলেই বোঝা যাবে।’ তখন মৃন্ময় ভাইয়া ফোড়ন কেটে আপাকে বললেন, ‘ওর না-হয় নতুন বিয়ে হয়েছে বলে লাল শাড়ি পড়েছে তা আপনার কী জামাই মারা গেছে যে সাদা ধবধবে একটা শাড়ি পড়ছেন বুড়িদের মতন।’ বাহার ভাই আবার মৃন্ময় ভাইয়ার কথার পিঠে বলেছেন ‘হ্যাঁ স্বামী মারা গেছে বলেই পড়েছে। কোথায় সৃষ্টি তো কোথাও ধ্বংস। কারো গায়ে সৃষ্টির মেলা কারো বা ধ্বংসের খেলা।’ এরপর আরেকটু কথা কাটাকাটি হয় মজার ছলেই তখন চিত্রা রেগে গিয়ে মৃন্ময় ভাইয়াকে বলে, ‘শাহাদাৎ ভাইয়ার কোনো যোগ্যতা নেই ভালো মানুষ হওয়ার। আপার সাথে তার তুলনা চলে না। এমন ব্রিলিয়ান্টের কেথায় আগুন যদি সে মানুষই না হতে পারে।’ আরও অনেক কিছু বলে। এর মাঝেই মেঝো বাবা এসে পড়ে এবং চিত্রাকে ধরে চ ড় মেরে বসে।”
তুহিন চুপ করে একবার চিত্রাকে পর্যবেক্ষণ করলো। মেয়েটা লজ্জায়, অপমানে যে একবারে মূর্ছা গেছে তা বুঝাই যাচ্ছে। তার আরেকটু দূরে চাঁদনী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। মৃন্ময়েরও মাথা নত করা। সাথে শাহাদাৎ আর নিলাও স্তব্ধ। তুহিন সবসময়ই বুদ্ধিমান ছেলে। বাবার এমন বিবেকহীন কাজটা তার ভীষণ অপছন্দ হলেও সে আর কথা বাড়ালো না বরং বেশ গম্ভীর কণ্ঠে শাহাদাৎ এর উদ্দেশ্যে বললো,
“শাহাদাৎ ভাইয়া আর ভাবী, কিছু মনে করবেন না। আমার পরিবারিক সমস্যার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।”
অতঃপর সে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কিছু মনে করবেন না আব্বু, আপনার আচরণ দিন দিন বাজে হচ্ছে। নিজেকে সুস্থ করুন। আর বাহার ভাই, আব্বুর হয়ে ক্ষমা চাচ্ছি আমি। আমার বোনকে রক্ষা করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।”
বাহারের ঠোঁটে তখনও বাকি হাসি। শার্টের কলারটা সে পিছে ঠেলতে ঠেলতে বললো,
“মনুষ্যত্ব ছাড়া নাকি মানুষ হওয়া যায় না, স্যার? অথচ আপনাকেও নাকি লোকে মানুষ বলে! হাস্যকর। শালা, পৃথিবীতে সব এতো হাস্যকর ক্যান? টাকাই সব, টাকাই রব।”
বাহার আর দাঁড়ালো না। অলস পায়ে ঘরে এলেও বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছিলো তার রাজ্যের ব্যস্ততা। ভাব এমন, কোনো একটা রাজ কার্য করতে যেন যাচ্ছে। নুরুল সওদাগর সেখানে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে ছোটো কণ্ঠে বললেন, “বেয়াদব ছেলে” অতঃপর বেরিয়ে গেলেন সেও। তুহিন, শাহাদাৎ আর নিলাকে নিয়ে গেলো। অহিও দ্রুত রুম ত্যাগ করলো। পুরো রুমে দাঁড়িয়ে রইলো চিত্রা, মৃন্ময়, বনফুল আর চাঁদনী। মৃন্ময় আমতা-আমতা করে চিত্রাকে বললো,
“আমার চিতই পিঠা, রাগ করো না।”
চিত্রা অগ্নি দৃষ্টি ফেলে তৎক্ষণাৎ রুম ছাড়লো। মৃন্ময়কে আর কিছু বলার সুযোগও দিলো না। চিত্রার পেছন পেছন বনফুলও চলে গেলো। চাঁদনী আগের জায়গায় মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটাকে শাড়ি নিয়ে বলার পর থেকে এতই চুপ করলো যে আর একটা শব্দ করলো না। মৃন্ময়ের খারাপ লাগছে, মজা করতে গিয়ে হয়তো বাজে মজাই করেছে নাহয় পরিস্থিতি এত খারাপ হতো না। মৃন্ময় দু’পা এগিয়ে এলো চাঁদনীর দিকে। অপরাধীর ন্যায় বললো,
“আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাই নি, ইন্দুবালা।”
“সমস্যা নেই, ঠিক আছি আমি।”
আজ চাঁদনী রাগ দেখালো না, ধমকালো না। মৃন্ময়ের অপরাধ বোধ আরও বাড়লো। সে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আপনাকে বুড়ি বলা উচিৎ হয় নি।”
“বুড়িকে বুড়ি বলবে সেটাই তো স্বাভাবিক তাই না? আমি কিছু মনে করি নি। তুমি সত্যি বলার সৎসাহস রাখো সেটাই অনেক।”
“কে বলেছে আপনি বুড়ি? আপনি হাসি দিলে পুরো দুনিয়া আপনার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে আর আপনি বলেন আপনি বুড়ি।”
চাঁদনী মুচকি হাসলো মৃন্ময়ের কথায়৷ ছেলেটার কোঁকড়া চুল গুলো আলগোছে এলোমেলো করে দিয়ে আদুরে স্বরে বললো,
“তোমার কথায় আমি কষ্ট পাই নি। তবুও তুমি আমাকে হাসানোর চেষ্টা করেছো তাই নির্দ্বিধায় তুমি পৃথিবীর সুন্দর মনের মানুষের মধ্যে একজন। তোমার আশেপাশের মানুষ গুলো এমন সুন্দর হলে হতোই।”
“আমার আশেপাশের মানুষ গুলো কে?”
চাঁদনী জবাব দিলো না। ধীর পায়ে চলে যেতে নিলেই মৃন্ময়ের হেয়ালি কণ্ঠে বললো,
“আশেপাশের মানুষটা কী আমার ভাই?”
বাহার চিলেকোঠার ঘরে মাত্রই প্রবেশ করলো। ওদের ছাঁদটা অন্ধকার। ও ঘরে ঢুকেই ছাঁদের হলুদ বাতিটা জ্বালিয়ে দিলো। ঘরের বাতি জ্বালালো। ঘড়ির কাঁটা গিয়ে থেমেছে দুইয়ের দিকে। তার মানে রাত দু’টো বাজছে। বাহার নিজের খাটে বসলো। সারাদিন প্রচুর খাটাখাটুনির পর সে ক্লান্ত। টি-শার্ট নিয়ে চলে গেলো গোসলে। এটা তার সবসময়ের স্বভাব। যখনই ঘরে ফিরবে তখনই গোসল করবে।
গোসল সেড়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসলো সে। চোখ জুড়ে ঘুম আসছে কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। তার ইচ্ছে গুলোই বড়ো অদ্ভুত। বাহার তার বইয়ের টেবিলের পাশ থেকে গিটার টা তুলে নিলো। মাঝরাতে তার গিটার বাজাতে ভীষণ ভালো লাগে। এক প্রকার তৃপ্তি পায় সে। এই মহল্লাটা শান্তি প্রিয়। কোনো হৈচৈ তাদের পছন্দ না। বাহারের এই গিটার বাজানো নিয়ে কয়েকজন প্রায় কমপ্লেইন করতো আগে কিন্তু বাহার কারো কথা পাত্তাই দেয় নি। বরং কেউ তাকে বুঝাতে এলে সে বলে দেয়, যা তাকে সুখ দেয় সে তা করবেই। মানুষের তো স্বভাবই, অন্যের সুখে বাঁধা দেওয়া। সেসব ভাবলে সুখী হওয়া যায় না। লোকে বলে সবাইকে নিয়ে সুখী হতে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সবাইকে নিলে আর সুখী হওয়া যায় না।
ছাঁদের চওড়া রেলিঙে আরাম করে বসলো বাহার। কেবল একটা আঙ্গুল ছুঁয়ে দিলো গিটার। ঠিক সে মুহূর্তে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলো,
“বাহার ভাই, খাবেন না?”
এমন রাতে মেয়েলি কণ্ঠ শুনে বাহারের ভীষণ রকমের চমকে যাওয়ার কথা কিন্তু বাহার চমকালো না। বরং চোখ গিটারে রেখেই পা ঝুলাতে ঝুলাতে বললো,
“এত রাতে এখানে কী?”
বাহারের একই প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হলো চিত্রা। কোমড়ে দু-হাত চেপে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
“আপনার জন্য খাবার এনেছি।”
“ফিরিয়ে নিয়ে যাও।”
বাহার এখনো চিত্রার দিকে তাকালো না। চিত্রা ভীষণ বিরক্ত হলো। সিঁড়ির কাছটাতে কাঠের মোড়ায় ঢেকে রাখা প্লেটের খাবারটা নিয়ে এলো। বাহারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আজ তো আপনাদের দাওয়াত ছিলো আমাদের বাড়ি। আপনি তো গেলেন না পরে আর। তাই আপনার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।”
“অপেক্ষা না করে পড়াশোনা করলে কাজে দিতো না? যাও বাড়ি। অনেক রাত হয়েছে।”
“আপনি খাবেন না? অনেক কষ্ট করে লুকিয়ে এনেছিলাম।”
“খাবো না বলেই তো বলছি নিয়ে যেতে। আমরা পান্তা ভাতের পেট নিয়ে এসেছি, বিরিয়ানি সহ্য করতে পারবে না। যাও, মেয়ে।”
চিত্রা ঠোঁট ফুলালো। অভিমান করলো। সেও তো খায় নি, লোকটা কী জানে সে কথা? একটা বার জিজ্ঞেস করলে কী ক্ষতি হতো শুনি!
বাহার এবার কণ্ঠ উঁচুতে তুললো, কিছুটা ধমকের স্বরে বললো,
“রাত বিরাতে এমন মানুষের বাড়ি আসবে না। লোকে কী বলবে সেটা ভেবে বলছি না, আমার ভালো লাগে না তাই বলছি। যাও।”
চিত্রার তো কান্না এসে পড়লো। লোকটা পাষাণ, বড্ড পাষাণ। কিন্তু চিত্রা যে বড্ড কোমল! সে তাও ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“আপনি খাবেন কী তাহলে?”
“বনফুল ভাত আর ডিম ভাজি রেখে গেছে। খেয়ে ফেলবো।”
“তাও আমার আনা খাবার খাবেন না?”
“এক কথা বার বার কেন বলছো? না এর কোনো সমার্থক শব্দ আছে? থাকলে সেটা দিয়েও বলছি, আমি খাবো না। যাও।”
চিত্রা ভীষণ অভিমান করলো। খাবার হাতেই নেমে গেলো দ্রুত। বাহার আকাশ পানে তাকিয়ে গিটারে সুর তুললো। কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে বের হলো না কোনো সুর, ছন্দ। বাহার ঘাড় ঘুরিয়ে পথের দিকে তাকালো। মেয়েটা ছুটে যাচ্ছে নিজের বিল্ডিং এর দিকে। বাহার হাসলো। কোমল কণ্ঠে বললো,
“রঙ্গনা, এমন মিষ্টি অভ্যাস হয়ে এসো না আমার কাছে। পরে হারিয়ে গেলে আমার শূন্যতা জাগবে। সব শূন্যতা পূরণ করা গেলেও তোমার শূন্যতা কখনো পূরণ করা যাবে? শুনছো মেয়ে, তুমি চাঁদ দেখো দশ তলা বিল্ডিং এ শুয়ে, আর আমি চাঁদ দেখি চিলেকোঠার জানলার ফাঁকে। আমাদের আলাদা করতে এর চেয়ে বড়ো পার্থক্য হয়? তুমি যেই আকাশের চাঁদ আমি সেই আকাশের নিচে বসে থাকা সর্বস্ব হারা এক পথিক। আমাদের যে বড্ড তফাত, বড্ড পার্থক্য! রঙ্গনা, তুমি তোমার অবুঝ আবেগ সামলে নিও, তোমার প্রেমিক যে বাস্তবতার বেড়াকলে বড্ড বেশিই পাষাণ, হৃদয়হীন।”
চিত্রা বিল্ডিং এর ভেতর ঢুকে পড়তেই বাহার গলা ছেড়ে গান ধরলো,
“বন্ধু মন ভাঙিয়া চইলা গেলে
সুখ মেলে না মেলে না,
প্রেম করিয়া ছাইড়া গেলে
সুখ মেলে না মেলে না
প্রেম করে মন দিলা না,
আমি মরলে একটুও কানবা না।”
গম্ভীর রাত। চাঁদের রূপালি ছোঁয়া বাতায়নের কোল ঘেঁষে লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে। রুমটা আঁধারে নিমজ্জিত। একবারে আঁধারও বলা যায় না, কিছুটা আলো জানালার ঝাপসা কাঁচ বেয়ে লুকিয়ে এসে রুমটার ক্ষানিকটা আঁধার হালকা করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। জানালার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পুরুষ অবয়ব। কণ্ঠ ছেড়ে তার গান ভেসে এলো,
“কেউ রাখে মন, কেউ ভাঙে মন
মিলে না হিসাব,
আরে কেউ ভাঙে মন, কেউ রাখে মন
মিলে না হিসাব,
কারো মনেরই অভাব,
কারো মন ভাঙার স্বভাব।”
পুরুষ অবয়বটা’র কিঞ্চিৎ দূরে হাঁটু মুড়ে বসে আছে একটা নারী দেহ। পিঠ গলিয়ে যাওয়া তার শাড়ির আঁচল গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। মিনিটে মিনিটে কেঁপে কেঁপে উঠছে সেই কোমল দেহখানা। তার কিছুটা দূরেই চিত্রা বিরস, অসহায় মুখে বসে আছে। বড়ো বোনের কান্নাটা যে তার ভীষণ কষ্টের কারণ সে কথা তো সবারই জানা।
বাহার ভাই গান থামালেন,গগন বক্ষে থাকা হাসিখুশি চাঁদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠেই নারী চাঁদকে প্রশ্ন করলেন,
“চাঁদ, কাঁদলেই কী প্রেমিক ফিরে? যদি ফিরে আসে তবে তোমাকে আমি কাঁদতে বারণ করবো না আর যদি না ফিরে তবে অবশ্যই বোকামি বন্ধ করতে বলবো।”
বাহার ভাইয়ের ছোটো বাক্যটাই মেয়েটার কান্নার দাপট কমিয়ে দিলো। এতক্ষণ কান্নার মিহি স্বর পাওয়া গেলেও এখন সবটাই নিশ্চুপ। একেবারেই যে সে কান্না বন্ধ করে নি, তা না দেখেও বোঝা যায়। মন ভাঙার আর্তনাদ কী কথার মলম কমাতে পারে? তবে আগের চেয়ে কমে গিয়েছে কান্নার স্রোত।
বাহার ভাই কণ্ঠ আগের ন্যায় রেখেই বললেন,
“তোমার ঘরে শব্দ হওয়াতে চিত্রা ভয় পেয়ে গিয়েছিল কিন্তু আমি পাই নি। যে মেয়েটা জীবনের আঠাশ টা বছর পাড় করেছে সে জানে জীবন কতটা মূল্যবান। আমার মতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের জীবনটা এক অংশ হলেও বেশি কঠিন এ দেশে। যে দেশ মেয়েদের বোঝা মনে করে, সে দেশে একটা মেয়ের আঠাশ বছরের জীবনটা নির্দ্বিধায় বহু সংগ্রামের পর প্রাপ্তি। আর একটা সংগ্রামী মেয়ে কখনোই এত সুন্দর জীবন দু আনার প্রেমিকের জন্য নষ্ট করবে না, তা আমার জানা ছিলো৷”
চিত্রা তাকালো বাহার ভাইয়ের দিকে। লোকটার শার্টের বোতাম খোলা, চুলগুলো উসকোখুসকো, চোখের নিজের কালচে দাগ আর পোড়া ঠোঁট। কেমন অগোছালো ভঙ্গি তার! অথচ সেই অগোছালো মানুষটা কত সুন্দর করেই না কথা বলে!
“ভুল মানুষকে ভালোবাসার শাস্তি পেলে। তুমি বুদ্ধিমতী, আশা করি ব্যাথা ভুলে উঠে দাঁড়াবে। আর এই যে কাঁদছো, সেটা আঁধার ঘরেই রাখবে। যে মানুষটা তোমাকে ছেড়ে গেছে সে জেনেই গেছে যে তুমি তাকে ছাড়া প্রচুর ভেঙে পড়বে। তবুও তো সে গিয়েছে তাই না? সে তোমার চোখের জলের মূল্য দিলে কী যেতো? তাহলে কেন কাঁদবে তার সামনে? তাকে কেন বুজতে দিবে তুমি দুর্বল? আকাশের চাঁদ হাজারো তারার ভীড়ে থাকে কিন্তু বলার সময় আমরা বলি সে একা কিন্তু কখনো বলেছি সে দুর্বল? তাহলে মানুষ চাঁদ কেন দুর্বল হবে? কোনো একদিন চাঁদের নির্মমতার গল্প শুনবো। আজ নাহয় চাঁদ শোকে ডুবে থাকুক। কান্না করা ভালো, কষ্ট কমে যায়, কাঁদো। তবে সেটা যেন ঘরের বাহিরে না পৌঁছায় কেমন? গ্লাসটা ভেঙেছিলে কেন? কষ্ট কমানোর জন্য তাই তো? তবে কমাও। সব ভাঙো কিন্তু মনটাকে ভাঙতে দিও না৷ আমি যাই তাহলে।”
চাঁদনী উঠে দাঁড়ালো, দিন দুনিয়ার কথা না ভেবে ছুটে গিয়ে আকস্মিক ভাবে জড়িয়ে ধরলো বাহারকে। চিত্রাও কিছুটা চমকে গেলো। চাঁদ আপা যে নিজের মাঝে নেই সেটা সে জানে তবুও তার কষ্ট হচ্ছে। বাহার ভাই যে তার, কষ্ট হওয়াটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু চিত্রাকে অবাক করে দিয়েই রাগী বাহার স্নেহের হাত রাখলো চাঁদনী আপার মাথার পেছনে, আদুরে কণ্ঠে বললো,
“কেঁদো না চাঁদ, আমরা আছি তো। চিন্তা কিসের তোমার? মনে রেখো তোমার সাথে আর কেউ থাক বা না থাক তোমার এই বাহার ভাই আছে।”
চিত্রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বাহার ভাইয়ের দিকে। লোকটাকে যত দেখে ততই মুগ্ধ হয় সে। এই মুগ্ধতার শেষ কোথায়!
_
বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো চিত্রার। বেলাটা যে দিনের অর্ধ বেলা হয়ে গেছে সে খবর কী তার আছে? চোখে মুখে রোদ আদুরে চুম্বন দিতেই তার হুশ হলো, ঘড়ির কাটার দিকে তাকাতেই চক্ষু ছানাবড়া। বিস্ময়ে কিছুটা চিৎকার দিয়েই বললো,
“বেলা তিনটে বেজে গেলো অথচ কেউ আমায় ডাক দিলো না! এটা কী আমার বাড়িই নাকি অন্য কোথাও চলে এসেছি!”
রুমের চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো। না, এটা তো তারই ঘর, তারই বাড়ি, তবে কেউ তাকে ডাকলো না কেন! এই বাড়িতে এত বেলা অব্দি ঘুমানো তো অসম্ভব। চিত্রা নিজের কোমড় সমান চুলের গোছাটা মুড়িয়ে হেয়ার স্টিক দিয়ে বেঁধে নিলো। হালকা বাদামী আর কালোর মিশেল চুল গুলো রোদের আলোয় চিলিক দিয়ে উঠছে। চিত্রা বিরাট এক হামি দিলো৷ কাল রাতে চাঁদ আপার চিন্তায় তার ঘুমই হয় নি। তার উপর পাশের বাড়িতে উচ্চস্বরের বক্স তাকে বিরক্ত করে তুলেছিল। বাড়ির মানুষ ফেরার পর প্রায় শেষ রাতের দিকে সে ঘুমিয়েছিল তাই হয়তো টেরই পায় নি।
চিত্রাদের জানালার মুখোমুখি এক তলা বিশিষ্ট বাড়ি থেকে একটা শ্যামলা বর্ণা মেয়ে উঁকি দিয়ে ফিচলে হাসলো। ঠাট্টা করে বললো,
“তা ভোর হলো নাকি চিতাবাঘের?”
“ভোর হয়েছে ভেবেই উঠেছিলাম। ওমা, উঠে দেখি এটা যে ভোর না, এটা ভরদুপুর।”
মেয়েটা চিত্রার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো। মেয়েটা চিত্রার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী বনফুল। নামটা অদ্ভুত কিন্তু বাহার ভাই খুব আদর করে নাকি এই নামটা রেখেছেন। বনফুল বাহার ভাইয়ের ছোটো বোন আর চিত্রার ভীষণ কাছের লোক। দুই বান্ধবীর আড্ডা জমে উঠার আগেই চিলেকোঠার ঘর থেকে বাহারের রাশভারী কণ্ঠের ধমক ভেসে এলো,
“এই, তোরা চিৎকার করে পাড়া মাথায় তুলেছিস ক্যান? তোদের জন্য কী শান্তিতে থাকতে পারবো না? বনফুল, যা ঘরে, গিয়ে তাড়াতাড়ি গোসল কর। বেলা তিনটা বাজে আর তুই গোসল ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছিস। আর চিত্রা, তুমি তো সব কিছুর উর্ধ্বে। একটা এইচএসসি ক্যান্ডিডেট কীভাবে তিনটে বাজে ঘুম থেকে উঠে আমি ভেবেই অবাক হচ্ছি। যাও গিয়ে ফ্রেশ হও। কানের মাথা খেও না।”
বনফুল আর চিত্রা দুজনেই মুখ ভেংচি কাটলো। লোকটা সবসময়ই বেশি বেশি করে। চিত্রা ধুপধাপ পায়ে রুম থেকে বেরুলে। মা, মা চিৎকার করেই ডায়নিং টেবিলের সামনে হাজির হলো। এ কী অবস্থা! রান্নাঘরে আজ বাড়ির মহিলা মহল নেই কেন? এ কী অবাক কান্ড! আজ তো শুক্রবার, মায়ের কলেজ নেই, তুহিন ভাইয়ের ভর্সিটি নেই, ছোটোমার তো রান্নাঘরেই থাকার কথা, বড়ো মায়ের তো ডেকে বাড়ি মাথায় তোলার কথা অথচ কেউ নেই! বাবা, ভাইয়া, চেরি, বড়আব্বু কেউ নেই! কী অদ্ভুত!
চিত্রার ভাবনার মাঝে পেছন থেকে মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে এলো। বেশ গম্ভীর মেয়েলি কণ্ঠটা বলে উঠলো,
“চিতাবাঘ, মাত্র উঠেছিস!”
চিত্রা পেছনে তাকালো। স্বাভাবিক চাঁদ আপাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েই মাথা দুলালো। চাঁদনী স্মিত হাসলো। কোমল কণ্ঠে বললো,
“ওরা সবাই বিয়ে খেতে গেছে। আমি, অহি, চেরি আর তুই বাসায় তাই রান্না করে নি। আমরা কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে আজ পেট পুরে খাবো। কী বলিস? যা দ্রুত গোসল করে আয়। আর বনফুলকে বল রেডি হতে। ওটারেও নিয়ে যাবো। যা৷”
চিত্রা ভেতর ভেতর তুমুল বিস্মিত হলেও প্রকাশ করলো না। দ্রুত ছুটে গেলো নিজের ঘরে। হাঁক ছেড়ে ডাকলো বনফুলকে। চাঁদনী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবনে বাঁচতে হলে কোনো নির্দিষ্ট্য একটা মানুষ যে জীবনে থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। ঐ নির্দিষ্ট্য একজন ছাড়াও পৃথিবী অনেক বড়ো, আর বাঁচাও যায়। কেবল ভালো থাকা আর হয় না। বেঁচে যে থাকতে পারে সেটাই অনেক। ভালো থাকাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না।
_
ধানমন্ডির বিলাসবহুল এক রেস্টুরেন্টের আলিশান সোফায় বসে আছে অহি, চিত্রা, চেরি, চাঁদনী, বনফুল। বেশ জমিয়ে তারা আড্ডা দিচ্ছে সবাই, কেবল অহি বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। মেয়েটা এত পড়ুয়া। এত পড়াশোনা মানুষ কীভাবে করে তা মাথায় আসে না চিত্রার। আর অহি এত পড়ে বলেই চিত্রা তাকে তেমন পছন্দ করে না। বাড়ির সবাই কেবল তাকে অহির মতন হতে বলে। অচঞ্চল, ভদ্র, ঠান্ডা, পড়ুকে মেয়ে। কিন্তু সবাই যদি একরকম হয় তবে পৃথিবী আর সুন্দর থাকবে? সব তো অহিময় হয়ে যাবে। অথচ চিত্রার এই কথা বুঝতে চায় না কেউ।
অহির ভীষণ ধ্যান তার হাতের বইটার মাঝে। ‘মাইন্ড রিডার’ নামের একটি বই। যেহেতু সে সাইকোলজির স্টুডেন্ট তাই সে এসব বই নিয়ে বেশিই গবেষণা করে। ওর ধ্যান, জ্ঞান যেন বই আর বই। হুট করেই অহির বা’হাতের তালুতে ছোটো ছোটো শীতল হাতের ছোঁয়া পেলো। মুহূর্তেই চমকে গেলো অহি। বিস্মিত দৃষ্টি হাতের দিকে ঘুরতেই দেখে এক জোড়া ছোটো আদুরে চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। অহি চমকালো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“এই বাবু, তুমি কে?”
বাচ্চা টা আধো আধো কণ্ঠে মিষ্টি করে উত্তর দিলো, “আইকরিমটা (আইসক্রিম) দিবে আমায়? তুমি তো তাবে (খাবে) না।”
অহি নিজের সামনে থাকা ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিমটার দিকে তাকালো। বাচ্চাটার আদুরে মুখের দিকে তাকিয়ে সে আর না করতে পারলো না বরং মিষ্টি হেসে বললো,
“তুমি খাবে?”
“দেও।”
কথাটা বলেই বাচ্চাটা দুই হাত মেলে দিলো। ততক্ষণে চিত্রা, চাঁদনী, ছয় বছরের চেরি ও বনফুলও উৎসাহী চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কী মিষ্টি ও আদুরে চোখ মুখ! অহি আইসক্রিমের বাটি টা এগিয়ে দিলো বাচ্চাটার দিকে। বাচ্চাটা সাবধানী হাতে সেটা ধরতেই কোথা থেকে এক পুরুষ ছুটে এলো। কিছুটা ধমক দিয়েই বললো,
“হুমু, তুমি পচা কাজ করছো কেনো? আন্টির আইসক্রিম আন্টিকে ফিরিয়ে দেও।”
সবাই ছেলেটার দিকে তাকালো। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষই বলা যায়। সাদা ধবধবে গায়ের রঙ, নাক মুখ সুন্দর। দেখতে এক কথায় অসাধারণ বলা যায় নির্দ্বিধায়। ছেলেটা এগিয়ে এসে বাচ্চাটার হাত থেকে আইসক্রিমের বাটিটা নেওয়ার চেষ্টা করতেই কেঁদে দিলো বাচ্চা টা। ঠোঁট ফুলিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো,
“পাপা, তুমি পতা (পচা)। তুমি আইতকিরিম দেও নি।”
হুমুর কথায় ছেলেটা চোখ ছোটো ছোটো করে আরেকটা ধমক দেওয়ার আগেই উঠে দাঁড়ালো অহি। বেশ বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“অদ্ভুত তো! বাচ্চাটা কী আদুরে, ওকে ধমক দিতে বুকে বাঁধে না আপনার? কী পাষাণ!”
ছেলেটা অবাক চোখে অহির দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে বললো,
“আমার মেয়ে, ধমক দিবো, আদর করবো, সেটা আমার ব্যাপার। আপনি কে এসব বলার?”
“ধমক দিবেন কেন? এত সুন্দর বাচ্চাকে কারো ধমক দিতে মন চায়! কি আজব!”
“আরে, আপনি ঝগড়া করছেন কেন মেডাম?”
“কি কি, আমি ঝগড়া করছি? পাজি লোক। একটা বাচ্চার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় জানে না আবার আমাকে বলে আমি নাকি ঝগড়া করছি।”
অহি রীতিমতো রেগে গিয়েছে। তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে চিত্রা রাও। ছেলেটা আর কিছু বললো না। মেন্যু কার্ড থেকে আইসক্রিমের দামটা দেখে এক হাজার টাকার দু’টি নোট অহির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাচ্চা টাকে কোলে তুলে নিলো। মুচকি হেসে বললো,
“নেন ভদ্র নারী, আইসক্রিমের দাম।”
আকষ্মিক ঘটনায় অহি হা হয়ে গেছে। ছেলেটা তাকে অপমান করলো! টাকার গরম দেখালো? রাগে তার চোখে মুখ লাল হয়ে গেলো। শরীর কাঁপা শুরু করলো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
“তোমরা কিছু বলবে না? আপা, চিত্রা কিছু বললে না তোমরা ছেলেটাকে? এত বে য়া দ ব ছেলে।”
চিত্রা হা করে থাকা মুখটা বন্ধ করলো। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“দাঁড়াও বলছি।”
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই দাঁড়ালো ভদ্রলোক। চিত্রা রেস্টুরেন্টের কিচেনের সামনে গিয়ে মিনিট দুইয়ের মাঝেই ফিরে এলো হাতে আরেকটা আইসক্রিমের বাটি নিয়ে। রেস্টুরেন্টের সবাই মোটামুটি তাদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো হচ্ছেটা কী। লোকটা নিজেও অবাক সাথে অহি, চাঁদনী ওরাও।
চিত্রা আইসক্রিমের বাটিটা এনে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিলো। শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,
“ভাইয়া এটাও হুমুর জন্য। ও না খেতে পারলে আপনি খাবেন।”
ছেলেটা হা হয়ে বোঝার চেষ্টা করছে আসলে হচ্ছেটা কী। চিত্রা ডান হাত মেলে ধরলো ছেলেটার দিকে, গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এবার তিন হাজার টাকা দেন।”
ছেলেটা সহ উপস্থিত সকলে অবাক, বিস্মিত হয়ে গেলো। বিস্ময়ের মাত্রা আকাশ ছোঁয়ার সাথে সাথে ছেলেটা কিছুটা উচ্চস্বরেই বললো,
“কী?”
“এবার তিন হাজার টাকা দেন আমাকে আগে।”
“কিন্তু কেন?”
“অহি আপার আইসক্রিমের দাম ছিলো দুইশত টাকা কিন্তু আপনি তাকে দিলেন দুই হাজার টাকা। আমি যেটা দিলাম সেটার দাম তিনশত টাকা এবার অহি আপার টাকা অনুযায়ী আমাকে দিবেন তিন হাজার টাকা। দেন ভাইয়া এবার।”
চিত্রার কথায় তাজ্জব বনে গেলো সবাই। মুহূর্তেই হাসির রোল পড়ে গেলো সেখানে। লোকটাও হেসে দিলো ফিক করে। প্রশংসা করে বললো,
“বিনোদন আর কিঞ্চিৎ অপমানও হয়ে গেলো। গুড।”
“মানুষ কতটা নির্দয় হলে নিজের স্বামী, এক কালীন ভালোবাসার মানুষটার দ্বিতীয় বিয়ের হলুদের অনুষ্ঠান দু’চোখ মেলে দেখতে পারে, আপা? তোমার কী বুকে একটুও ব্যাথা হচ্ছে না! নিজেকে এমন পৈচাশিক দুঃখ দিয়ে কী মজা পাচ্ছো?”
চিত্রার চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতা অথচ যাকে প্রশ্ন করা হলো তার ভেতর কোনো হেলদোল নেই, সে নিরলস তাকিয়ে আছে তার পাশের বিল্ডিং এর ছাঁদে। দারুণ সাজসজ্জা আর বিয়ের অনুষ্ঠানে মুখরিত সেই ছাদ। বর বেশে বসে থাকা মানুষটাও ভীষণ হেসেখেলেই যে নিজের বিয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। চিত্রার সামনে দাঁড়ানো মানবী নিরুত্তর। চিত্রা অধৈর্য্য হলো , কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠেই বললো,
“চাঁদ আপা, এখন ভর সন্ধ্যা বেলা, চারপাশে কুয়াশার ছড়াছড়ি, এ অবস্থায় কেবল পাতলা একটা শাড়ি জড়িয়ে আছো শরীরে। শরীরটার এত অযত্ন করছো কেন?”
“যার মনই সাথে নেই, তার আর শরীরের যত্ন দিয়ে কী হবে চিতাবাঘ? মৃত মনের মানুষকে ওসব ছুঁতে পারে না।”
চিত্রা থমকে গেলো। ততক্ষণে তার চাঁদনী আপার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা মুক্তোর দানার মতন অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। চিত্রা বড্ড নাজুক ধরণের মেয়ে। কারো কান্না তার সহ্য হয় না। তার উপর যদি মানুষটা প্রিয় হয় তবে তো হলোই। চাঁদনী আপার কান্না দেখে কেঁদে দিলো মেয়েটাও। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,
“আমি কষ্ট পাচ্ছি, আপা। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শাহাদাৎ ভাই কেন তোমারে বুঝলো না?”
ছোটো বোনের কান্না দেখে চমকে গেলো চাঁদনী। তাড়াতাড়ি বোনকে বুকে জড়িয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বললো,
“কাঁদছিস কেন পাগলি? প্রেমে পড়লে ঐ একটু কষ্ট পেতেই হয়। কষ্ট যদি সহ্য করতেই না পারলাম তবে কেমন ভালোবাসলাম বল তো?”
চাঁদনী আপার ছোট্টো কথায় চিত্রার মনে তোলপাড় করে ঝড় তুললো। প্রেমে পড়লে কষ্ট পেতেই হবে ! প্রেম অনুভূতি টা এত সুন্দর তবে কষ্ট কেন পেতে হবে? চাঁদনী আপা আরেকটু শক্ত হাতে জড়িয়ে রাখলো তার বোনটাকে। দৃষ্টি তার সেই পাশের ছাদ টাতেই। লোকটা কী সুন্দর হেসেখেলেই না বিয়েটা করছে! অথচ এদিকে যে একটা মেয়ে জিন্দা লাশ হয়ে যাচ্ছে, সে খবর কী লোকটার আছে! চিত্রাও বোনের বুক থেকে মুখ তুললো, বেশ ফিসফিসিয়ে বললো,
“আপা, তোমাদের বিয়ের খবর না কেউ জানলো আর না এমন বিচ্ছেদের কথা কেউ জানবে। তুমি একটু স্বার্থপর হতে পারলে না, আপা? জানিয়ে দিতে তোমার আর শাহাদাৎ ভাইয়ের এত বছরের সম্পর্কের কথা। আট টা বছর তো মুখের কথা না! সে বিদেশ যাবে বলে তোমাকে বিয়েও করে গেলো, অথচ বিদেশের হাওয়া গায়ে লাগতেই তুমি এমন অপছন্দের হয়ে গেলে! ভালোবাসা এতটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো?”
“বোকা বোকা কথা বলিস না, চিতাবাঘ। আট বছর ভালোবেসেছে বলেই আমার সাথে তার চিরজীবন থাকতে হবে এমনটা তো কোথাও লিখা নেই তাই না? ভালোবাসতে যেহেতু পেরেছি তবে দুচোখ মেলে তার সুখও আমি দেখতে পারবো। কাঁদিস না, এক জীবনে সব পেয়ে গেলে তো জীবনের মজা নেই তাই না বল? কিছুটা থাক অপ্রাপ্তি।”
“অথচ তুমি তো তার জন্য জীবনের আঠাশ টা বসন্ত অপেক্ষা করলে, সেটা?”
“অপেক্ষা সবসময় মিষ্টিই কেন হতে হবে, চিতাবাঘ? কখনো কখনো অপেক্ষা তিতে হোক, পানসে হোক, রঙহীন হোক। কিছু প্রেম উত্তাপ থাক।”
চিত্রা মহা বিরক্ত হলো, কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে আপার জন্য অথচ আপা নিজেই নিজের প্রতি কত নির্দয়! চিত্রার আর সাহস হলো না এই বিচ্ছেদের গল্প দেখার, সে দ্রুত ছাঁদ পেড়িয়ে চলে গেলো নিজেদের ফ্লাটে। ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদনী তা দেখে হাসলো। আঠারো বছরের বোকা মেয়েটা কেমন আবেগে কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছে বোনের কথা ভেবে! এই মেয়েটার জীবনে কখনো এমন দিন না আসুক, মেয়েটা যে সহ্য করতে পারবে না।
চাঁদনী চোখ বন্ধ করলো, তার কাঁধ গলিয়ে পড়ে থাকা নীল রঙের জামদানী শাড়ির আঁচল টা তখন বাঁধা হীন উড়ছে। শীতের কনকনে ঠান্ডা বাতাসে চাঁদনী কেঁপে কেঁপে উঠলো। চোখে ভেসে উঠলো কতো সুখের স্মৃতি। যে-ই মানুষটাকে বিশ বছর বয়সে খুব যত্নে বুকে এঁকেছিল তাকে যে সে চাইলেও মুছতে পারবে না। কিন্তু মানুষটা তাকে মুছে ফেলেছে নিঃসংকোচে। বিবেকেও বাঁধে নি, হৃদয়েও না। অথচ সেই মানুষটার প্রিয় রঙটাই শরীরে জড়িয়ে আছে আজ। ভালোবাসার মানুষটার সুখ দেখতেও ভালো লাগে, এটা কী আর আবেগীয় চিত্রা বুঝবে!
“আরে, পাশের ছাঁদে দেখি নীল জোছনার হাট! ব্যাপার কী? রাত বিরাতে চাঁদের এমন সৌন্দর্যতার কারণ কী?”
চাঁদনী নিজের ব্যাক্তিগত সময়টায় অন্যকারো হস্তক্ষেপে ভ্রু কুঁচকালো, ঘাঁড় ঘুরিয়ে তার পেছনের দিকে তাকাতেই গোলাপের ন্যায় সুদর্শন এক ছেলেকে চোখে পড়লো। ছেলেটাকে দেখেই সে অবাক হলো, কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললো,
“মৃন্ময়, তুমি এভাবে কথা বললে! হ্যাঁ?”
চাঁদনীর প্রশ্নের বিপরীতে মৃন্ময় নামের ছেলেটা ভীষণ আদুরে এক চিলতে হাসি দিলো। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল গুলো ঝাকাতে ঝাকাতে বললো,
“আমি না, আমার অসভ্য মুখটা বলেছে। সিনিয়র আপু দেখলেই এই বেয়াদবটা আমার কথা শুনে না, ঠুসঠাস বেফাঁস বলে ফেলে, ইন্দুবালা।”
চাঁদনী বেশ বিরক্ত হলো মৃন্ময়ের কথায়, কিছুটা ধমকেই বললো,
“তোমাকে না বলেছি এসব অদ্ভুত নামে ডাকবে না আমাকে। তোমার থেকে ঠিক চার বছরের বড়ো আমি। আমাকে যেখানে তোমার আপু ডাকা উচিৎ, সম্মান করা উচিৎ সেখানে তুমি এসব নামে ডাকছো! এত বেয়াদব কেন তুমি?”
“সব আমার অসভ্য মুখের দোষ ইন্দুবালা। আর ইন্দুবালা নামটা কই অদ্ভুত? ‘ইন্দুবালার ভাতের হোটেল’ নামের একটা উপন্যাস আছে তো জানেন না? কবি লিখেছে ইন্দুবালার ভাতের হোটেল আর আমি লিখবো ‘ইন্দুবালার রাগের হোটেল’। সুন্দর হবে না?”
“দিন দিন বেয়াদব হচ্ছো। যাও, তোমার ভাইয়ের ওখানে গায়ের হলুদ হচ্ছে আর তুমি এখানে কী করছো? যাও ওখানে।”
“আপনার পরিবার এখানে অনুষ্ঠানে এসেছে আর আপনি ওখানে ছাঁদে এমন সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ও হো, সাজতে বেশি সময় নিয়ে ছিলেন নাকি? সে জন্য তারা আনে নি? আহা, আসুন, এখান থেকে একটা লাফ দিয়ে আমার কোলে ওহ্ সরি আমাদের ছাঁদে চলে আসুন।”
চাঁদনী মৃন্ময়ের দিকে তাকালো। এমনেতে তার মন খারাপ তার উপর মেজাজ বিগড়ে দিতে এই ছেলে চলে এসেছে। বিরক্তিতে তেতো হয়ে উঠলো তার ভেতর। সে মুখ দিয়ে অসহ্য রকমের একটা শব্দ করে হনহনিয়ে নেমে গেলো ছাঁদ থেকে। তা দেখে খিলখিল করে হাসলো মৃন্ময়, সিনিয়দের সাথে হেয়ালি করতে এত মজা এই ইন্দুবালাকে না দেখলে সে জানতোই না। কঠিন, রাগী রাগী মেয়েটা কেমন একটুতেই ফুঁসে উঠে! মৃন্ময়ের বড্ড ভালো লাগে। এসব ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে মৃন্ময়ের ডাক আসতেই সে ছুটে সেখানে চলে গেলো। তার বেশ কাজ আছে, আজ তার বড়ো ভাইয়ের গায়ের হলুদ। সব দায়িত্ব তো তার উপরই।
–
পড়ার টেবিলে গম্ভীর মুখে বসে আছে বাহার ভাই। তার সামনে চিত্রা বারংবার একটা অংক ভুল করছে আর বাহার ভাই চুপচাপ সেটা দেখে চলছে। এক পর্যায়ে চিত্রা অধৈর্য্য হয়ে লিখা থামিয়ে দিলো। ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ গোলগোল করে তাকালো বাহার ভাইয়ের দিকে, আহ্লাদী স্বরে বললো,
“বাহার ভাই, হচ্ছে না তো!”
চিত্রা ঝটপট উত্তর দিলো, “ডিসেম্বর। জানেন না এটা? জানবেন কীভাবে! সারাদিন চোখে-মুখে রাগ লেপ্টে রাখলে আর কিছু কী পড়বে চোখে? পড়বে না।”
“ডিসেম্বরের কত তারিখ?”
চিত্রা এবার নড়েচড়ে বসলো। বাহার ভাই অহেতুক কথার লোক না, যেহেতু সে জিজ্ঞেস করছে তার মানে কোনো জরুরী কিছু। কিন্তু কী! আজকে কী কোনো বিশেষ দিন? কই চিত্রার তো মনে পড়ছে না। তার তো পড়া বাদে পৃথিবীর সব কথাই মনে থাকে, তাহলে আজকের দিনটার গুরুত্বটার কথা তার মনে পড়ছে না কেন? চিত্রা মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে গেলো, ছোটো স্বরে বললো,
“আজ ডিসেম্বরের সতেরো তারিখ, বৃহস্পতিবার। রাত সাড়ে সাতটা বাজছে। কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছেন?”
প্রশ্নটা করেছে ঠিক কিন্তু উত্তর শোনার অপেক্ষা করলো না সে। বরং খুব দ্রুতই টেবিলের সাথে লাগোয়া ক্যালেন্ডারের কাছে ছুটে গেলো। তারিখটা বার বার ঘুরিয়ে দেখলো৷ কই, সে তো এখানে লাল কালি দিয়ে দাগ দেয় নি। বিশেষ কোনো দিন হলে তো দাগ দিয়ে রাখতোই। তাহলে বাহার ভাই এত করে জিজ্ঞেস করছে কেন?
চিত্রা আবার ব্যস্ত পায়ে ছুটে এসে চেয়ারে বসলো। আগ্রহী কণ্ঠে বললো,
“সতেরো তারিখই তো। আজ তো কোনো বিশেষ দিন না, বাহার ভাই। তবে জিজ্ঞেস করলেন যে?”
চিত্রার প্রশ্নটা করতে দেরি অথচ তার ফর্সা হাতটাতে কাঠের স্কিলের বাড়ি পড়তে দেরি হলো না। তাও একটা না, পর পর দু’টো প্রহার করলো। চিত্রা হতভম্ব, বিস্মিত চোখে কেবল তাকিয়ে রইলো। তার মস্তিষ্কে তখনো ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না। বাহার ভাই তাকে মারলো কেন? কিন্তু কষ্ট করে চিত্রাকে মারের রহস্য বের করতে হলো না তার আগেই বাহার বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলে উঠলো,
“তোমাকে তারিখ জিজ্ঞেস করেছি আর তুমি চলে গেছো বিশেষ দিন খুঁজতে অথচ আর তিন চার মাস পর যে তোমার বোর্ড পরীক্ষা তা তোমার মাথাতেই নেই। কী অদ্ভুত! ফেইল তো করবেই সাথে আমার মান ইজ্জত ডুবাবে। খাতায় বড়ো বড়ো ডিম নিয়ে আসবে। তারপর সবাই আমাকে বলবে ঐ যে দেখ, খাতায় ডিম পাওয়া চিত্রার টিচার যাচ্ছে। তাই না? এটাই চাচ্ছো তুমি? এলাকায় আমার নাম খারাপ করতে তাই না?”
চিত্রার চোখে তখন অভিমানী অশ্রু হানা দিলো। সে আর কিছু না বলেই চোখ মুখ ফুলিয়ে বইয়ের দিকে দৃষ্টি দিলো। বাহার ভাই টা সবসময় বেশি বেশি করে। আজকে বাড়ির সবাই শাহাদাৎ ভাইয়ের গায়ের হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছে, কই সে তো গেলো না। একমাত্র বাহার ভাই রাগ করবে ভেবেই তো যায় নি। তাছাড়া অবশ্য চাঁদনী আপার কথা ভেবেও সে যায় নি। কিন্তু সে যাই হোক, প্রথম কারণ তো বাহার ভাই। কিন্তু লোকটা তা বুঝলে তো!
ঠিক পাঁচ মিনিট খুব নিরবে অতিবাহিত হলো। দুষ্ট চিত্রা দুষ্টুমি করলো না। ভাব এমন যে, খুব বেশিই মনযোগ দিয়ে ফেলেছে পড়ার টেবিলে। বাহারও চুপ করে চিত্রার মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটা বোধহয় বেশিই ব্যাথা পেয়েছে নাহয় তো এমন চুপ করে থাকার পাত্রী সে না। তার মাঝেই বাহির থেকে তুমুল শব্দের গান ভেসে এলো। নিরব চিত্রাকে মুহূর্তেই সরব করে দিলো। সে সুন্দর দুই হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে গাইতে শুরু করলো,
“দিলবার দিলবার, ও দিলবার দিলবার।”
বাহার হতাশার শ্বাস ফেললো। কপাল চাপড়ে বলে উঠলো,
“একটা কথা আছে না, ময়লা যায়না ধুইলে, স্বভাব যায় না মরলে।”
ঠিক সেই মুহুর্তে পাশের রুম থেকে বেশ শব্দ করেই কিছু পড়ার শব্দ হলো। চিত্রা আচমকাই থমকে গেলো। মাথায় খেলে গেলো চাঁদনী আপার কথা। কোনো অঘটন হলো না তো!