প্রেমোত্তাপ পর্ব-০৫

0
347

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

পর্বঃ ৫

সওদাগর বাড়ির হৈচৈ পরিপূর্ণ সকাল। বাহিরে কোমল আবহাওয়া। রান্নাঘরে মহিলাদের ব্যস্ত হাতে কাজকর্ম চলছে। খাবার টেবিলে বসে আছে বাড়ির বড়ো ছোটো সকল সদস্য। মুনিয়া বেগম ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে এলেন। আজ সকালে খিচুড়ি রান্না করা হয়েছে৷ এই বাড়ির সাপ্তাহিক খাওয়া দাওয়ার একটা রুটিন আছে আর সেই রুটিন অনুযায়ী আজ খিচুড়ি, ইলিশ মাছ ভাজা আর খাঁটি ঘি এর আয়োজন হয়েছে। চিত্রা তাড়া দিলো। পা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
“মা, দ্রুত দেও খাবার, কলেজে দেরি হচ্ছে তো।”

মুনিয়া বেগমও ব্যস্ত হাতে সবাইকে খাবার দিতে দিতে বললেন,
“দিচ্ছি তো, দাঁড়া।”

“এখন খাওয়ার জন্য দাঁড়াতে হবে!”

কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দিলো চিত্রা। মুনিয়া বেগম মুচকি হেসে মেয়ের মাথার পিছে চাপড় দিয়ে বললেন,
“বড়ো হচ্ছিস আর দুষ্টুমি বাড়ছে তোর, তাই না?”

“আর কাজ কী ওর? খাবে দাবে আর বেলাল্লাপনা করবে।”

নুরুল সওদাগর মুখ ঝামটি মেরেই কথাটা বললেন। হাসি হাসি পরিবেশটা মুহূর্তেই গম্ভীর হলো। চাঁদনীর বাবা কিছুটা রুক্ষ স্বরেই ধমক দিয়ে বললেন,
“আহা নুরুল, এসব কেমন কথা তোর? মুখের ভাষা ঠিক কর।”

নুরুল সওদাগর আর কথা বললেন না। দমে গেলো চিত্রাও। তুহিন বাবার দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি ফেলে আবার খাবারে মনযোগ দিলো। রান্নাঘর থেকে তখনই ছুটে এলো অবনী বেগম। চেরির থালে ইলিশ মাছের ডিম তুলে দিলেন। অহির সামনে নিয়ে রুটির থালাটা রাখলেন। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,
“দেরি হয়ে গেছে রুটি ভাজতে। খিচুড়ি খাওয়ার দরকার নেই তোমার। কাল এমনেতেই অনেক তেলের খাবার খেয়েছো। এখন রুটি আর অমলেট টা খেয়ে নেও।”

অহির নজর এতক্ষণ তার বইয়ে থাকলেও মায়ের কথায় সে মায়ের দিকে চোখ তুলে তাকালো। অতঃপর কোনো বাক্যব্যয় না করেই প্লেট টা সামনে থেকে সরিয়ে ফেললো এবং মুনিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বললো,
“মেঝো মা, খিচুড়ি দেও তো। খিচুড়ি খাবো।”

মুনিয়া বেগম নিজের ছোটো জা এর দিকে একবার তাকালো। অবনী বেগম চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
“আহারে, তোমার তো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। এখন যদি খিচুড়ি খাও তবে জ্বালাপোড়া করবে। খাওয়া লাগবে না।”

অহি চোখ মুখ শক্ত করলো, কঠিন কণ্ঠে মায়ের কথার বিপরীতে জবাব দিলো,
“আমি কী খাবো না খাবো তা ও কী এখন আপনি ঠিক করে দিবেন? আমার এতোটা খারাপ দিন এসে পড়লো?”

অবনী বেগম বিস্মিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লজ্জায়, অপমানে উনার চোখ টলমল করে উঠলো। বাকি সবাই চুপ থাকলেও চুপ থাকলো না চিত্রা। সে কপাল কুঁচকে কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠেই বললো,
“এই ছোটো আপা, তুমি সবসময় ছোটো মায়ের সাথে এমন করবে না। ব্যবহার সুন্দর করো।”

“তোমাকে কিছু বলছি আমি, চিত্রা? তুমি নিজের কাজ করো। সব ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না।”

“অবশ্যই নাক গলাতে হবে। তুই ছোটো মায়ের সাথে এমন আচরণ করতে পারিস না সবার সামনে। সমস্যা কী তোর?”

অহির শক্ত ঝাড়ির বিপরীতে কণ্ঠ উঁচু করে জবাব দিলো চাঁদনী। অহি টেবিল ছেড়ে ধপ করে উঠে গেলো। একটা অসহ্য রকমের শব্দ করে বললো,
“উনি পুরো মানুষটাই আমার সমস্যা। আর আমার উপর উনার এই দরদ টা আমাকে বিরক্ত করে। উনি যতদিন এমন নাটক করবে আমিও ততদিন এমন করবো। উনি নাটক বন্ধ দিলে আমারও সমস্যা শেষ হবে।”

কথা শেষ করেই অহি নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলে গেলো সদর দরজা পেরিয়ে। সকলে সেখানে তাকিয়ে হতাশার শ্বাস ফেললো। অবনী বেগমও খুব গোপনে লুকিয়ে ফেললেন নিজের অনাকাঙ্খিত অশ্রু গুলো।

_

সকালের কোমল আবহাওয়া এখন পাল্টে সাদা-কালো রূপ ধারণ করেছে। প্রচন্ড বৃষ্টি আসবে হয়তো। চিত্রার ক্লাস শেষ হলো ঠিক বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। চিত্রা ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে এলো কলেজ থেকে। বিরাট নামকরা এক কলেজেই সে পড়ে। পড়াশোনায় কোনো কমতি রাখেন নি বাবা। বাহার ভাইকে এত অপছন্দ করে কিন্তু চিত্রা একমাত্র তার কাছে ভালো করে পড়ে বিধায় সে এই অসহ্যকর ছেলেটাকে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়।

কলেজ থেকে বের হয়েই চিত্রা বড়ো রাস্তায় দাঁড়ালো। বড় রাস্তার মোড়ে চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকালো চিত্রা। অবাক কণ্ঠে নিজেই বলে উঠলো,
“বনফুল!”

মোড়ে থাকা মেয়েটা ওড়না দিয়ে মুখ চোখ আরও ভালো ভাবে ঢেকে নিলো যা দেখে চিত্রার অবাক ভাব আরও বাড়লো। সে কিছুটা হাঁক ছেড়েই ডাকলো,
“এই বনফুল, এই রে শোন।”

চিত্রার ডাক সকলের কানে পৌঁছালেও পৌঁছায় নি মেয়েটার কানে। সে একটা রিকশা থামিয়ে উঠে পড়লো। চিত্রা তবুও কিছুটা ছুটে গেলো সেখানে কিন্তু ততক্ষণে রিকশা তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ফেলেছে। চিত্রা ভীষণ রকমের অবাক হয়েই আনমনে বলে উঠলো,
“বনফুল তো এখানে কখনো আসে নি, চিনেও না। তবে মেয়েটা এখানে কী করছে!”

চিত্রার ভাবনার মাঝেই আকাশ গম্ভীর ভাবে ডেকে উঠলো। পরিবেশ আরেকটু আঁধার হয়ে উঠলো। আর ঠিক কয়েক মিনিট পেরুতেই ঝপঝপ করে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো প্রকৃতির বক্ষ। শীতল করলো জনজীবন। সকলে ভিজে যাওয়ার ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করলো, খুঁজে নিলো নিজেদের রক্ষা করার স্থান। কেবল মুগ্ধ চোখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো খোলা আকাশের নিচে। তার কোনো তাড়া নেই, ব্যস্ততা নেই, ছুটোছুটি নেই। সেই বৃষ্টির পানি আহ্লাদে ছুঁয়ে দিচ্ছে, খিলখিল করে হেসে উঠছে আপন বেগে আবার আকাশ পানে তাকিয়ে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে। বয়ঃসন্ধির বয়সই তো এমনই। ভীষণ আদুরে, ভীষণ চঞ্চল।

_

সেই বিকেল থেকে তুমুল ঝড় যে শুরু হলো তা আর থামার নাম করলো না। কিছুক্ষণ পর পর প্রকৃতি কাঁপিয়ে বজ্রপাত হচ্ছে, প্রকৃতি কী অদ্ভুত আলোয় আলোকিত হয়ে যাচ্ছে আবার সেকেন্ডেই সে আলো হাওয়ায় মিলিয়ে প্রকৃতি হয়ে যাচ্ছে আঁধার। চিত্রাদের বাড়িতে আজ বিদ্যুৎ নেই। চারপাশের বাড়ির গুলোতেও এক দশা। ধানমন্ডির মতন বিলাসবহুল স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়াটা বিস্ময়কর। কিন্তু ঝড়ের তান্ডব বেশি বিধায়ই এই বিস্ময়কর কাজটার দেখা মিললো।

চিত্রাদের ড্রয়িং রুমে জ্বলছে সৌরবিদ্যুৎ এর বাতি যা খুবই হালকা আলো দিচ্ছে। সে আলোতেই রান্নাঘরের কাজ গুলো সেড়ে নিচ্ছে বাড়ির মহিলারা। অহি তার ঘরের ব্যাটারি সিস্টেমের টেবিল ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। তার কোনো চিন্তা নেই কি হচ্ছে আশপাশে তা নিয়ে। সে পড়তে পারলেই হলো। মেয়েটা পড়ুয়া ছিলো অনেক আগে থেকেই কিন্তু এতটাও পড়ুয়া ছিলো না। সেও হাসতো, একটু দুষ্টুমি করতো, বৃষ্টি এলে ছুঁয়ে দিতো। অনেক গুলো বছর হলো সে সব ছেড়েছে। নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছে একটা বস্তুতে। এটাতেই যেন সে বেঁচে থাকার অক্সিজেন পায়। বেঁচে থাকার জন্য কিছু আঁকড়ে ধরতে হয়, অহি বই আঁকড়েছে।

চাঁদনী দাঁড়িয়ে আছে তার বারান্দায়। খোলামেলা বারান্দা হওয়ার অসুবিধায় বৃষ্টির ছাঁট ছুঁয়ে দিচ্ছে চাঁদনীর শরীর। চারপাশ এতটাই অন্ধকার যে বোঝার উপায় নেই সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর ধ্যান তার আকাশ পানে। চোখে ভেসে উঠছে তার সুন্দর অতীতের দিন গুলো। শাহাদাৎ ছেলেটা খারাপ না বরং একটু বেশিই ভালো বলা যায়। চাঁদনীকে সে অনেক ভালোও বেসেছিল। কিন্তু সবসময় সবার প্রতি ভালোবাসা থাকবে এমন কোনো নিয়ম নেই বিধায়ই এখন সে ভালোবাসা ফুড়িয়েছে। সেজন্য লোকটাকে একবারে খারাপ বলা যায় না। যে এক কালে আমাদের ভালোবাসতো তাকে চিরদিন আমাদের ভালোবাসায় রাখা উচিৎ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষের যে বড্ড অভাব!

“বাড়ির পাশে মধুমতী, পুবাল হাওয়া বয় রে,
বন্ধুর মনে রঙ লাগাইয়া প্রাণে দিলো জ্বালা রে,
ইন্দুবালা নাকি? ঘ্রাণ টা ভীষণ চেনা চেনা কেন লাগছে, হ্যাঁ?”

চাঁদনী চমকে গিয়ে ছিল হঠাৎ গানের স্বর শুনে, কিন্তু কণ্ঠের মালিককে চিনতে তার এক সেকেন্ডও ব্যয় করতে হয় নি। চেনার সাথে সাথেই সে ভ্রু কুঁচকালো। চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,
“মৃন্ময়!”

পাশের বিল্ডিং থেকে সেই পরিচিত কণ্ঠের হাসির শব্দ ভেসে এলো। কিছুটা ঠাট্টা করেই ছেলেটা বললো,
“আমার শরীর থেকেও কী পরিচিত সেই সুঘ্রাণ টা বের হয় ইন্দুবালা? যেই সুঘ্রাণ আপনাকে চিনিয়ে দেয় আমার উপস্থিতি!”

চাঁদনী দৃষ্টি সরু করলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“কোনো সুঘ্রাণ টান আসছে না, তোমার কণ্ঠ শুনে বুঝলাম এটা তুমি। এত সিনেম্যাটিক হয় কীভাবে মানুষ! সাধারণ জ্ঞানও দেখি তোমার নাই।”

“সওদাগর বাড়িতে সবাই এত জ্ঞানী যে আমাদের সাধারণ জ্ঞান গুলোও তাদের দিয়ে দিতে হয়েছে। কী আর করবো বলুন?”

“ঠাট্টা করো না, মৃন্ময়।”

“ঠাট্টা করছি না তো, দুষ্টুমি করছি।”

চাঁদনী তর্ক করলো না। পাশের বিল্ডিং এর অন্ধকারের গাম্ভীর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না। তবে সে বেশ বুঝতে পারছে ছেলেটা একটা পাতলা টি-শার্ট জড়িয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে নিশ্চয় হাসছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে আর বৃষ্টির কিছু অনির্দিষ্ট ফোঁটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছেলেটার মুখ জুড়ে। ভীষণ মিষ্টি লাগছে হয়তো ছেলেটাকে। ইশ, মুখটা দেখতে পেলে ভালো লাগতে।

“ইন্দুবালা, হাঁটতে যাবেন?”

মৃন্ময়ের হুট করে এমন প্রশ্নে বেশ অবাক হলো চাঁদনী। অবাক কণ্ঠেই বললো,
“কিহ্! এমন বৃষ্টিতে কই যাবো হাঁটতে!”

“চলেন না মোড়ের দোকান থেকে চা খেয়ে আসি। বৃষ্টির মাঝে চা খেতে কিন্তু ভীষণ ভালো লাগে। খেয়েছেন কখনো?”

চাঁদনী আনমনেই উত্তর দিলো, “নাহ্।”

“তাহলে চলুন আজ, খেয়ে আসি দু’জনে।”

চাঁদনী কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“আসছি, দাঁড়াও।”

“আমার চিতই পিঠাকে জিজ্ঞেস কইরেন আসবে কি-না।”

“ওর জ্বর এসেছে মৃন্ময়। মোঝো মা বোধহয় যেতে দিবে না।”

“কী বলেন! আমার চিতল মাছের জ্বর এসেছে! আগে বলবেন না। চা খেয়ে ফেরার সময় দেখে যাবো। এখন আপনি নামেন। আমিও নামছি।”

চাঁদনী উত্তর না দিয়েই ঘরে চলে গেলো। কালো টি-শার্ট এর উপরে একটা কালো জ্যাকেট জড়িয়ে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। একদিকে ঘরে টিমটিমে আলো তার উপর সবাই যার যার মতন ব্যস্ত বিধায় চাঁদনীকে তেমন প্রশ্নের মুখেও পড়তে হলো না। অনায়াসেই বেরিয়ে গেলো। ধুপধাপ পায়ে নিচে নামতেই দেখলো মৃন্ময় হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বিল্ডিং এর দিকে তাকিয়ে। ঘর থেকে আকাশটা যতটা অন্ধকার মনে হচ্ছিলো ততটা অন্ধকারও লাগছে না। বেশ আলো আছে। যতটা আলো থাকলে মৃন্ময়ের সুন্দর হাসিটা দেখা যায় ঠিক ততটা আলো।

চাঁদনী রাস্তায় পা রাখার আগেই বেশ মাঝারি আকারের একটা ছাতা তার মাথার উপর মেলে ধরলো মৃন্ময়। চাঁদনী নিজের কপাল চাপড়ালো, কিছুটা আফসোসের স্বরেই বললো,
“আমি তো ছাতা আনতে ভুলেই গেছি।”

“আমি তো সে জন্য এনেছি।”

“তুমি কীভাবে বুঝলে আমি যে ছাতা আনতে ভুলে যাবো?”

“যেভাবে বুঝেছি আপনার আমার মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, ঠিক সেভাবেই এটা বুঝেছি।”

চাঁদনী বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার পানে। মৃন্ময় তখন হো হো করে হাসছে। আজকের দিনের ভেজা, সবচেয়ে নজরকাড়া দৃশ্য বোধহয় এটা। এত স্নিগ্ধ, এত মুগ্ধ!

_

“ভাইজান, গিটার ডা বাজাইবা না আইজ?”

টঙ দোকানের ভেতর থাকা আট নয় বছরের দিনুর কথায় বাহার হাসলো। সে একটা টঙ দোকানে বসে সিগারেট টানছিলো, পরিচিত দোকান। এখানেই সে প্রায় প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার এসে আড্ডা দেয়। আজও এই তুমুল বৃষ্টির মাঝেও সে এখানে বসে মনের সুখে সিগারেট টানছিলো।

দিনু আবার বললো, “গিটার ডা বাজাইবা না ভাইজান?”

“না রে দিনু, বাজাবো না। বৃষ্টির শব্দটা বেশ সুন্দর। গিটারের শব্দও সুন্দর। কিন্তু দুইটা সুন্দর একসাথে মিলে মিশে গেলে ততটা মুগ্ধতা কাজ করে না। তখন তুই কোনটা রেখে কোনটা শুনবি ভেবেই পা গ ল হয়ে যাবি। এরপর একটাও শান্তি লাগবে না। এর চেয়ে ভালো একটাই শোন।”

দিনু বায়না ধরলো। টঙ দোকান থেকে নেমে এসে আবদার করে বললো,
“বাজাও না ভাইজান। তোমার ঐ যন্তর টা বাজাইলে আমার অনেক সুখ সুখ লাগে।”

বাহার হো হো করে হাসলো। দিনুর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
“আচ্ছা তাই নাকি! তোর সুখ সুখ লাগে? কিন্তু কেন?”

“জানিনা গো। কিন্তু কী মিষ্টি লাগে শুনতে। আজ তুমি বাজাও আর আমি হাত তালি দিবো কেমন?”

“আচ্ছা, দিস।”

কথাটা শেষ করেই বাহার গিটারে সুর তুললো, কণ্ঠে গান ধরলো,
“ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো,
দিও তোমার মালা খানি
বাউলের এই মনটারে,
আমার ভিতর ও বাহিরে
অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে,,,”

বাহারের গানের তালে তালে দিনু ছেলেটা হাততালি দিচ্ছি কী দারুণ উচ্ছ্বাসে! কিন্তু মুহূর্তেই সেই আনন্দে মাখামাখি আদুরে মুখটাকে পিষিয়ে দিলো একটা দা ন বী য় ট্রাক। দিনু পথের বেশ কিনারেই হাত তালি দিয়ে লাফাচ্ছিল। কোথা থেকে যেন এই ট্রাক হর্ণ না বাজিয়েই সাঁইসাঁই করে ছুটে এলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ছোটো শরীরটাকে পিষে ফেললো এক লহমায়। বাহারের কণ্ঠের গান থেমে গেলো। গিটারের সরু তাঁরটাও ছিঁড়ে কেটে গেলো বাহারের হাত। বাহার স্তব্ধ চোখে অসহায় সেই ছেলেটাকে দেখলো। যেই আট বছরের ছেলেটার কাঁধে ছিলো বোনের বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন, বাবাকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে ফেলার আশা। সব আজ রাস্তায় পিষে গেলো। দরিদ্রের শখ যেভাবে ধূলোয় লুটায় ঠিক সেভাবে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে