Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 257



অমানিশা পর্ব-১৬

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব: ১৬

আয়ানকে মেসেজ দেবে কিনা ভাবছে রাত্রি। যতবার ফোন হাতে নিচ্ছে কেমন একটা লজ্জা আর দ্বিধা ঘিরে ধরছে ওকে।

সেদিন সুপার শপে কি বোকার মতো কান্না করল ও। এত বড় মেয়ে হয়ে এমন বাচ্চামি কিভাবে করল এটা ভাবতেই নিজের মনেই হাসি পাচ্ছে বারবার।

ও যখন কাঁদছিল আয়ান টিস্যু এগিয়ে দিতে গিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল,

ভয় নেই,ও আসলে আমার কাজিন। ওর হাজব্যান্ডকে একটা সারপ্রাইজ গিফট করবে তাই আমাকে নিয়ে এসেছে। দুলাভাই আর আমার জামাকাপড়ের মাপ একই। তাই আমাক সাথে নিয়ে এসেছে।

এই কথায় রাত্রির কান্না একটু কমল।

এভাবে বাচ্চার মতো কাঁদলে আপনাকেতো ভীষণ কিউট দেখতে লাগে!

রাত্রি হেসে ফেলল।

আপনি না রাগ করলে একটা কথা বলি?

বলুন। রাগবো না।

আমি না এভাবে আজীবন আপনার এই বাচ্চামো কিউট মুখটা দেখতে চাই। আপনার আপত্তি না থাকলে বাসায় ফেরার পর আমাকে একবার নক দেবেন।

রাত্রির ভীষণ লজ্জা লাগছে এভাবে ধরা পড়ে যাওয়ায়। ও কোনোরকমে বিদায় নিয়ে চলে এলো।

এরপর দুইদিন চলে গেছে।‌ কিন্তু লজ্জায় আয়ানকে কল করতে পারেনি ও। আজকেও কল করবে কিনা ভাবতে ভাবতে শেষে মেসেজ দিল।

কেমন আছেন?

মিনিট খানেকের মধ্যেই রিপ্লাই আসল,

ওমাই গড! আপনি মেসেজ দিলেন অবশেষে। আমি ভালো আছি।
আপনি?

ভালো আছি।

আমি কিন্তু ঐদিন থেকেই আপনার কলের অপেক্ষায় আছি। যাক কল না হোক মেসেজ তো করেছেন! কিন্তু এতো দেরি করলেন কেনো?

আপনিও তো নক করতে পারতেন।

পারতাম কিন্তু কথা ছিল আপনি নক দেবেন। আমি দিলে আপনি যদি বিরক্ত হতেন। তবে এখন মনে হচ্ছে আমাকেই আগে আগে সব করতে হবে।

জ্বি?

এই যে আপনি নক দিতেই দু’দিন পার করে দিলেন আপনার আশায় থাকলে আমার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাবে।

আপনি কিন্তু একটু দুষ্টু আছেন।

একটু না রাত্রি, আমি অনেক দুষ্টু। আর আপনার সাথে আরও অনেক দুষ্টুমি করতে চাই।

লেখা পড়েই রাত্রির গাল লাল হয়ে গেল। আয়ান আবার লিখল,

মাকে আপনার কথা বলেছি।

এমা! কি বলেছেন।

বলেছি এই বাসায়তো কান্না করার মতো কেউ নাই। তাই একটা বাচ্চামো করা মেয়ে আনতে চাই। যে মাঝে মাঝে ভ্যা ভ্যা করে কান্না করবে।

হায় খোদা! কেনো যে কান্না করেছিলাম। এখন এটা নিয়ে আমার কত বার যে কথা শুনতে হবে।

হাজার বার,লক্ষ,কোটি বার।

রাত্রি মাকে আয়ানের কথা জানালো। ওর বাসা থেকে যে আসতে চায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে সেটাও বলল। নাজমা খুশি হলেন। এখানে যদি বিয়েটা হয় খুব ভালো হবে। তার আর কোনো চিন্তা থাকবে না মেয়েকে নিয়ে।

নাজমা গোধূলীকে ফোন করে রাত্রিকে দেখতে আসবার কথা জানালেন। সেইসাথে সাব্বিরসহ ঐদিন আসতে বললেন। শুক্রবার আয়ানদের বাড়ি থেকে আসার কথা জানানো হলো।

বৃহস্পতিবার গোধূলি শাশুড়িকে বলল,

মা কাল একটু ঐ বাড়িতে যাব।

ঐ বাসায় যাবা ভালো কথা। রোজ ছুটির দিনেই তো ওখানে গিয়ে থাকছ। এদিকে এই বাসার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছো? আমি থাকি অফিসে। ছুটির দিনে কত কাজ থাকে। আজ আর যেতে হবে না। বাসাটা ঝাড়পোছ করতে হবে।

কিন্তু কালতো আপাকে দেখতে আসবে। মা যেতে বলেছেন।

দেখতে আসবে তোমার আপাকে তুমি গিয়ে কি করবে। তুমি থাকলে বরং উলটা পালটা কিছু হবে। তুমি থেকেইতো সাব্বিরের সাথে বিয়েটা এগোয়নি। আপাকে দেখতে আসা ছেলের সাথে তুমি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলে।

গোধূলির রাগ লাগল। পুরোনো কথা টেনে শাশুড়ি তাকে খোঁটা দিচ্ছে। ও বলল,

আপনার ছেলেরই তো দোষ। উনিইতো আমাকে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেলেন।

পুরুষ মানুষতো এমন করবেই। মেয়ে দেখলে ছোঁক ছোঁক করাই ওদের স্বভাব।কিন্তু তোমার নিজের বোনের সাথে তুমি কি করছ সেটা ভেবে দেখো।

গোধূলি আর শাশুড়ির মুখের ওপর কথা বলতে পারল না। কারণ এই মহিলাকে একটু ভয় পায় গোধূলী।

রাতে ঘুমানোর সময় সাব্বিরকে বলল,
কাল ঐ বাসায় যেতে চাইলাম মা কথা শুনিয়ে দিলো।

কি বলেছেন?

যা তা বললেন। আপনার সাথে আপার বিয়ে হলো না আমার জন্য এসব।

সাব্বির এসব মেয়েলি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। কিন্তু এই মুহূর্তে গোধূলিকে কিছু বলা যাবে না। ওদের বাসা নিয়ে একটা প্লান আছে ওর। তাই গোধূলিকে খুশি রাখতে হবে আপাতত। তাই সাব্বির কথা ঘোরাতে বলল,

তোমার আপার বিয়ে যার সাথে হচ্ছে তার কথা কিছু জানো?

নাতো।

তোমার আপার সাথে আগে থেকেই ওর পরিচয়। ওরা এক স্কুলেই চাকরি করতো।

তাই নাকি!

হুম, আমারতো মনে হয় ওদের মাঝে রিলেশন আছে। আমার কানে এমন কিছু কথা এসেছে।

কি বলেন! কে বলল?

আরে এসব কথার এমনিতেই পাখা গজায়।

আপা প্রেম করছে!

সেটাই বলছি। তোমার আপা আসলে ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না এমন ভাব করে থাকে অথচ দেখো ঠিকই নিজের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে। একেবারেই কাটিং টু ফিটিং।

তাইতো বলি,পাত্র দেখার নাটক করে অথচ বিয়ে ভেঙে দেয়। গতবার ছেলেটার সাথে হওয়া বিয়েটা ভেঙ্গে গেল। এতদিনে বুঝলাম কেনো বিয়ে ভাঙছে। আর দোষ হয় আমার।

তোমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করছে তোমার বোন। শোনো আমরা না গেলেও বিয়েতো আটকাবে না। আর তাছাড়া আমি ছোট জামাই। ওখানে থাকলে কেমন দেখায়। বড় বোনের বিয়ে হয়নি আর ছোট জামাই উপস্থিত।আমি না গেলেইতো ভালো।

হুম আপনার আর কি। আমি এখানে শুধু খাটলেই আপনার ভালো।

তোমার ঘর তুমিই তো খাটবে। মা বাবা আর কয়দিন থাকবেন। তাছাড়া একটু গুছিয়ে নিতে পারলে তোমাকে নিয়ে আলাদা হবো ভাবছি।

এই কথায় গোধূলি খুশি হলো।

সাব্বির ততক্ষণে গোধূলির শরীর নিয়ে মেতে উঠেছে। যদিও গোধূলীকে এখন আর ভালো লাগে না ওর। নওমির চনমনে শরীরটাকে ভেবে ভেবে কাজ চালিয়ে নেয়। তবে গোধূলীকে আদর করলে সহজেই মানানো যায়।

আয়ানের মা,বাবা,দুই বোন আর দুলাভাই এলো পরের শুক্রবার। নাজমার সাথে আগেই ফোনে কথা হয়েছে আয়ানের মা বাবার। নাজমা সাধ্যমতো আয়োজন করলেন নতুন আত্মীয় হতে যাওয়া অতিথিদের আপ্যায়ন করতে।

সাব্বির না এলেও গোধূলী আসল বিকেলের দিকে। সকালে ঐ বাড়ির সব কাজ শেষ করে তবেই আসার অনুমতি মিলেছে ওর। এমন নয় যে বোনের বিয়ের কথাবার্তায় থাকতে এতোটা আগ্রহ ওর। বরং কি হবে না হবে,কেমন ছেলেকে পছন্দ করল আপা, কিভাবে একটা গোলমাল পাকানো যায় এইসব ওর আসল উদ্দেশ্য এখানে আসার।
নাজমা বললেন,

কিরে জামাই এলো না। ওকেতো বলেছিলাম থাকতে।

ওর কি যখন তখন বললেই আসবার সময় আছে নাকি। আর তাছাড়া আমরা না আসলেও কিছুই আটকাবে না। তোমার বড় মেয়ে আগেই এই ছেলেকে পছন্দ করে রেখেছে আর মাঝ দিয়ে শুধু শুধু পাত্র দেখার নাটক করল।

এসব আজগুবি কথা না বললেই হয় না?

আজগুবি না আম্মা। এই ছেলে আপার সাথে ঐ স্কুলে চাকরি করত। তখন থেকেই জানাশোনা।

তো পরিচিত হলেই যে সম্পর্ক আছে এমনটা তো কথা নেই।

এমনটাই কথা। তুমি আসলে কিছুই বোঝো না। আপাকে সবসময় ফেরেশতা ভাবো।

শোন মা,এসব কথা শুনলে মেয়েটা মনখারাপ করবে। এভাবে ওর সামনে এসব যেন বলিসনা।

গোধূলি মায়ের কথায় মুখ বাঁকিয়ে ঘরে চলে গেল।

গোধূলিই আগ বাড়িয়ে নাশতা দিলো মেহমানদের। সবার সাথে পরিচিত হলো। আয়ানের মা জানতে চাইলেন,

কিসে পড়ো মা তুমি?

গোধূলি চট করে বলল,

আপাতত পড়ছিনা। আমারতো বিয়ে হয়ে গেছে।

ও আচ্ছা। তবে পড়াশোনা বন্ধ করাটা ঠিক হয়নি।

হুম, শুরু করব। আর বলবেন না আন্টি, আপাকে দেখতে এসে ছেলে আমাকে পছন্দ করল। এমন পাগল হয়ে গেলো যে বিয়েটা হয়ে গেলো। সব ভাগ্য। আর তাছাড়া ভালো ছেলেতো আর সবসময় পাওয়া যায় না।

হুম সেটাও ঠিক।

নাজমা আগেই সবকথা জানিয়েছেন ফোনে। তবুও গোধূলির এই আগ বাড়িয়ে কথা বলাতে বিরক্ত হলেন উনি। মেয়েটা অযথাই বড় বোনের সাথে হিংসা করছে। মেয়ের এমন কর্মকাণ্ডে হতাশ লাগল নাজমার।

এসব বলে তেমন পাত্তা না পেলেও গোধূলী হাল ছাড়লো না। আয়ানের বোন আদিতাকে ছাদ দেখানোর নামে নিয়ে গিয়ে টুক করে বলল,

আয়ান ভাইতো আপাকে আগে থেকেই চেনে। আরো আগেইতো প্রস্তাব দিতে পারতেন। মাঝে শুধু শুধুই পাত্র দেখার নাটক করল। এসব টেনশনেই তো আব্বা চলে গেলেন। আগের বিয়েটাতো হয়েই যেত কিন্তু আপার কারণেই ভেঙে গেছে। কি যেন ঝামেলা করেছিল আপা।

তাই নাকি!

হুম । আর পছন্দই যদি আছে তাহলে আবার অন্য ছেলেদের যাচাই বাছাই করার কি দরকার ছিলো। আসলে তখনতো আয়ান ভাইয়ের ভালো চাকরি ছিলো না।এখন যেই দেখেছে আয়ান ভাই ভালো চাকরি পেয়েছে অমনি ভাইয়াকে ধরেছে।

হতে পারে।

হতে পারে কি। এটাই সত্যি। যতই আমার নিজের বোন হোক কিন্তু বিয়েশাদীর বিষয়। সব আগে থেকেই খুলে বলাই ভালো। আয়ান ভাইয়া আর আপাতো একজন অন্যজনকে পছন্দ করে আগে থেকেই তাই হয়তো আপনাদের সব কথা ভাইয়া খুলে বলেনি। আমার কিন্তু এসব পছন্দ না। কোনো কিছু লুকিয়ে বিয়ের মতো কাজ করাটা ঠিক না একদম।

আয়ানের বোন আদিতা হেসে বলল,

হুম,কথাতো ঠিক। বাসায় গিয়ে সব খুলে বলব আমি।

তবে গোধূলি যা কিছুই বলুক আয়ানের পছন্দের ওপর ওর পরিবারের সবার পুরো আস্হা আছে। তাছাড়া রাত্রি আর নাজমার আচরণে খারাপ কিছু চোখে পড়েনি কারো। বরং ওদের আন্তরিকতা মুগ্ধ করল আয়ানের মা বোনকে। আর তাছাড়া আয়ান যেখানে সুখী হবে সেখানেই ছেলেকে বিয়ে দিতে রাজী ওরা।

রাত্রিকে গলায় সোনার চেইন পরিয়ে দোয়া করলেন আয়ানের মা আয়েশা। সেইসাথে বিয়ের সম্ভাব্য একটা ডেট ঠিক করলেন সবাই মিলে।

রাত্রির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

আমার আয়ানের পছন্দ আছে বলতে হয়। ভীষণ মিষ্টি দেখতে তুমি মাশাআল্লাহ।

আয়ানের দুইবোনের সাথেও বেশ ভাব হলো রাত্রির।

গোধূলির ভীষণ হিংসে হলো। এতো চমৎকার একটা ছেলের সাথে আপার বিয়ে হতে চলেছে। তাও আবার প্রেম করে। অথচ কেউ কিছু বুঝতেই পারছে না। শুধু ওকেই সবাই খারাপ ভাবে। আর আপা কি চালাক। ঠিকই সম্পর্ক করে নিজের পছন্দের পাত্র কে বিয়ে করতে যাচ্ছে।

আর সাব্বিরের থেকেও কত ভালো জব করে আয়ান। বিসিএস ক্যাডার। দুই জামাইয়ের মধ্যেতো আপার জামাই সবসময় উপরে থাকবে। আজীবন ওকে হীনমন্যতায় ভুগতে হবে এটা নিয়ে।

রাতে খেতে বসে নাজমা বললেন,

আয়ান ছেলেটা কিন্তু ভীষণ ভালো। আর ওদের সবার ব্যবহার কি চমৎকার। মনে হলো যেন কত আগের চেনা।

গোধূলি বলে উঠল,

কোথায় আর তেমন সুন্দর।‌ সাব্বিরের কাছে কিছুই না। ওর থেকেও খাটো হবে। গায়ের রঙটাও ময়লা।

আহা সাব্বিরের সাথে তুলনা করতে কে বলেছে।

এমনিতেই বললাম। আর একদিনেই মানুষের ব্যবহার কি বোঝা যায় আম্মা। আগে বিয়ে হোক পরে বোঝা যাবে।

তবুও কিছুটাতো বোঝা যায়।

হুম ভালো হলেই ভালো।

রাত্রি গোধূলির এমন বাচ্চামোতে মনে মনে হেসে ফেলল।

রাত্রির বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই গোধূলী ভীষণ রকম হিংসাত্মক আচরণ শুরু করল। কিভাবে রাত্রিকে কষ্ট দেয়া যায়,এ বাড়িতে ওর নিজের আধিপত্য বিস্তার করা যায় সে চিন্তা ঘুরতে থাকল ওর মাথায়।

রাত্রিদের গেস্ট রুমে কোনো এটাচড বাথ নাই। প্লানে আছে কিন্তু তৈরি করা হয়নি। সাব্বির এলে ঐ গেস্ট রুমেই গোধূলিসহ থাকে।

কিন্তু রাত্রির বিয়ে ঠিক হবার পর গোধূলী ভাবল আপার বিয়ে হলে তখন তাদের দু’বোনের এই ঘরে থাকবে জামাইসহ। এটাই এ বাড়ির সবথেকে বড় আর সুন্দর ঘর। দখিন দিকে বেশ বড়সড় জানালা। গরমে হুহু করে বাতাস আসে। কিন্তু গেস্ট রুমটা সে তুলনায় একটু ছোট। তাই এটা বিয়ের আগেই দখল করতে হবে।

তাই একদিন ও বলল,

আপা তুই একা মানুষ। সাব্বির এলে তুই ঐ গেস্ট রুমে গিয়ে থাকবি। সাব্বিরের ঐ রুমে থাকতে সমস্যা হয়।

নাজমা বললেন,

ঐ রুমে কি সমস্যা?

সমস্যা আছে মা। বাথরুম করতে বাইরে আসতে হয়। আর এতো ছোট ঘর। দমবন্ধ লাগে। আমার শশুর বাড়ীতে রুমগুলো সব বড়। এতো ছোট রুমে সাব্বিরের থেকে অভ্যাস নাই।

কি আশ্চর্য! তাই বলে তোর আপা নিজের ঘর ছেড়ে দেবে। তুই আসিস বেড়াতে। এক দুইদিন একটু এডজাস্ট করা যায় না?

আপার ঘর মানে কি? ওটাতো আমারও ঘর। আর তাছাড়া আমি না হয় যেমন তেমন করে থাকলাম কিন্তু জামাই মানুষকেতো আর যেভাবে সেভাবে রাখা যায় না।

রাত্রি বলল,

আচ্ছা মা ঠিক আছে। গোধূলি,আমি ঐ রুমে থাকব তোর জামাই এলে।

তোর জামাই আবার কি কথা আপা।‌সাব্বির ভাই বলবি ওনাকে।

আচ্ছা বলব। সাব্বির ভাই যেদিন করে আসবে, আমি গেস্ট রুমে থাকব।

উঁহু ,রোজ রোজ এঘর ওঘর না করে একবারে গেলে ভালো হয়। আমিতো প্রায়ই এখানে এসে থাকি। আর তাছাড়া স্কুলে যেতে শুরু করব ভাবছি। তখন এখানেই বেশি থাকতে হবে।

রাত্রি এবার একটু আঘাত পেল বোনের কথায়। সেই সাথে বিরক্ত হলো।

আমার ঘর একেবারে ছেড়ে দেব?

হুম,তুই থাকলে আমার ফোনে কথা বলতে সমস্যা হয়। স্বামী স্ত্রীর মাঝে কত কথা থাকে। একটা প্রাইভেসি আছে না নিজেদের।

নাজমা গজগজ করতে লাগলেন।

রাত্রি হুম বলল ঠিকই কিন্তু মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল ওর। তবে ও যদি এখন রাজী না হয় তবে গোধূলী ঝামেলা করবে আর মাও এটা নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করবে । তাই চুপ করে গেল রাত্রি।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-১৫

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১৫

দোয়া পড়ার দিন গোধূলিকে বাবার বাড়িতে নামিয়ে অফিসে চলে গেল সাব্বির। গোধূলি থাকতে বললেও অফিসের দোহাই দিয়ে চলে গেল। আর তাছাড়া ওর শাশুড়ি ফোন দিয়ে বলেওনি ওদের বাড়ির কাউকে। তাই সেইটাও বলল গোধূলিকে।

আসলে সাব্বির আজকে আর এ বাসায় নামতে চাচ্ছে না। অফিসে যাবে আজ। এতো শোকের পরিবেশ ভালো লাগে না ওর।

ঐ দিন অফিস করে আর বাড়িতে ফিরলো না সাব্বির । সোজা চলে গেল ভাড়া বাড়িতে। নওমিকে আগেই মেসেজ করে জানিয়ে দিলো।
গোধূলি বাবার বাড়িতে আছে। এখন বাসায় না গেলেও কেউ খোঁজ করবে না।

বাবা মারা যাওয়ায় গোধূলির মনটনও খারাপ । কেমন একটু ঝিমিয়ে গেছে। গতরাতে কাছে টেনেছিল কিন্তু সাড়া দেয়নি।‌সাব্বির তাই আজ এ বাসায় এসেছে। একটু রিল্যাক্স করা দরকার।
তাছাড়া নওমিও কয়েকবার মেসেজ দিয়েছে দেখা করতে। মেয়েটা বিছানায় বেশ এগ্রেসিভ। ওকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয় সাব্বিরকে। এই বয়সের একটা মেয়ের কাছে এতোটাও আশা করেনি ও। আর এটাই ভালো লাগে ওর। কেমন একটা নেশায় পড়ে গেছে নওমির।

সাব্বির রাত করেই ঢুকল বাড়িতে। নওমি আসবে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে। ওর মামা মামী খুব একটা মাথা ঘামায় না ওকে নিয়ে। আর তাছাড়া ওর মামীর হাই প্রেশার। ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমালে আর কিছু টের পায়না। আর মামাও আর রাতে ওর ঘরে উঁকি দেয় না। তাই রাতে আস্তে ধীরে দরজা লক করে বাইরে আসে নওমি।

গ্রাম থেকে এখানে আসার পর খুব একঘেয়ে লাগছিলো সবকিছু। বাইরে বেরুবার ওয়ে নাই। এখনো কোচিং এ ভর্তি হয়নি। এই বাসা আর ছাদ করে করে দিন কাটছিলো নওমির। গ্রামে সোহাগের সাথে অযথাই ঝামেলা হয়ে গেল। সোহাগ ওদের গ্রামের রানিং মেম্বারের ছেলে। বয়সে নওমির বছর চারেকের বড়। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। একটা বাইকে করে সারাদিন টো টো করে বেড়ায়। নওমির স্কুলে যাবার পথে ওকে দেখে শিস বাজায়। একদিন ওকে থামিয়ে একটা চিরকুট দিলো। সেটাতে ভালোবাসার কথা লেখা। নওমিকে নদীর ধারে দেখা করতে বলেছে।

নওমি দেখা করল। সেই থেকে শুরু।
তবে আর নদীর পাড়ে না। একটা নির্জন শালবন আছে গ্রামের একপাশে। সেখানেই দেখা করত ওরা। একদিন কিভাবে যেন পাতা ঝাড় দিতে আসা কয়জন মহিলা দেখে ফেলল ওদের। ব্যস, বিচার ,শালিস। সব দোষ নওমিকে দিলো সোহাগ। কাপুরুষ একটা। তবে সম্পর্ক থাকার সময় সোহাগ সবসময় হাতখরচ দিয়েছে ওকে।

এই ঘটনার পর গ্রামে থাকাটা কঠিন হয়ে গেলো। বাবা মাও ভীষণ ক্ষেপে গেলেন ওর ওপর। শেষে এখানে মামার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তবে ওর এখানে আসতে আপত্তি ছিলো না। ও একটু মুক্ত জীবন চাইছিলো। শহরে কেই বা কার খোঁজ রাখে। ভালো একটা জায়গায় ভর্তি হতে পারলেই কোনো একটা মেসে উঠে যাবে। তখন পাখির মতো উড়তে আর কোনো বাঁধাই থাকবে না।

কিন্তু এই বাসায় থাকার সময়টা ভীষণ বিরক্ত লাগছিল ওর। সাব্বির লোকটার সাথে পরিচয় হবার পর সময়টা এখন ভালো কাটছে। এমন বিবাহিত লোকের সাথে সম্পর্কে ঝামেলা কম। এদের কোনো এক্সপেকটেশন থাকে না। শুধু শরীর চায় এরা। বিনিময়ে বাড়তি কিছু পাওয়া গেছে। এর মাঝেই ওকে কয়েকটা ড্রেস গিফট করেছে সাব্বির। কোনো বাড়তি মেদ নেই এমন সম্পর্কে। নওমি খুব এনজয় করছে সময়টা।

সাব্বির ঘরে বসেই ইয়াবা খেলো আজ। গত কয়েক মাস থেকে নতুন এই নেশা হয়েছে ওর। আসবার সময় নিয়ে এসেছে। ওর এক বন্ধুর থ্রুতে দুইজন সাপ্লায়ার এর সাথে পরিচয় হয়েছে। কল করলেই সুবিধামতো জায়গায় দিয়ে যায়।

নওমি দরজায় টোকা দিতেই খুলে দিল সাব্বির। ঘরটা ধোঁয়া দিয়ে ভরে আছে। নওমি ঢুকতেই সাব্বির একহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে দরজা লাগাল। ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। এতোসব ন্যাকামি ন ওমির পোষায়না। নওমি নিজেই টপসটা খুলে ওকে টেনে বিছানায় নিয়ে গেল।

দোয়া পড়ার পরদিন বাড়িতে লোকজন সবাই চলে গেছে। গোধূলি সাব্বিরকে ফোন করে বলল,অফিস শেষে এ বাড়িতে এসে থাকতে। সাব্বির আসল বিকেলে। মৃত্যুর দিন তেমন কথা হয়নি। আজ এসে টুক করে নাজমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ফেলল।

নাজমাকে বলল,

আম্মা চিন্তা করবেন না। সবাইকে তো একদিন যেতেই হবে। আমিতো আছি। এখন থেকে আপনাদের দেখেশুনে রাখার দায়িত্ব আমার। যেকোনো সমস্যায় আমি আছি আম্মা।

নাজমা কিছু বললেন না। তার স্বামী বলে গেছেন গোধূলিকে ফিরিয়ে আনতে। মেয়েকে মেনে নেয়া মানে জামাইকে মানতেই হবে। আর তাছাড়া এখন তাদের একজন পুরুষ অভিভাবক দরকার। তার ভাইয়েরা আছেন ঠিক। তবে সবারই নিজের নিজের সংসার আছে। কতদিন আর বোনের সংসারের সবকিছু দেখবে ওরা।

জামাই যদি ছেলের মতো সব সামলে নেয় তাহলে সেটাতে খারাপ কিছু নেই। এই ছেলেতো তার বড় জামাই হতে পারত। এখন ঘটনাক্রমে ছোট মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে। এটা মেনে নেয়া ছাড়া তো কোনো উপায় নেই।

তবে গোধূলিকে পড়াটা শুরু করতে বলবেন। রাত্রিটাকেও খুব জলদি বিয়ে দেয়া দরকার। মানুষটা থাকলে এতসব চিন্তা তাকে করতে হতো না। তখন ভাবনা থাকলেও মনে একটা শক্তি ছিলো যে‌ যা সামলাতে হয় স্বামী সামলে নেবেন। এখন কিছুটা হলেও একটু দূর্বল হয়ে পড়েছেন উনি।

তরফদার সাহেবের চলে যাবার দু’মাস হয়ে গেছে। গোধূলি এখন প্রায়ই বাবার বাসায় এসে থাকে।‌ সাব্বির ওকে বুঝিয়েছে এখানে এসে না থাকলে রাত্রি একাই কতৃত্ব নিয়ে নেবে সবকিছুর।

গোধূলির শাশুড়ি সাবেরা কোনো আপত্তি করেননি। বরং খুশিই হয়েছেন। এই মেয়ে বাড়িতে না থাকলেই ভালো।‌ ছেলের মন থেকেও এই মেয়েটা উঠে গেলেই ভালো। প্রথম থেকেই গোধূলিকে ঘিরে একটা নেগেটিভ ভাবনা তার মনে গেঁথে গেছে। নিজের ছেলের দোষ যতই থাক সেটা মুখ্য না। ছেলের বৌ হতে হবে মনমতো।

গোধূলির সাথে সাথে সাব্বির মাঝে মাঝেই শশুর বাড়িতে গিয়ে থাকে। এক ছুটির দিনে আফসার উদ্দিন গ্রাম থেকে এলেন গোধূলিদের বাড়িতে। উনি তরফদার সাহেবের দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই। গ্রামের জমিজমা উনিই দেখেন। বছরে দুইবার ফসলের টাকা নিজে এসে দিয়ে যান। সেইসাথে পুকুরের মাছ, গাছের ডাব,ক্ষেতের সবজি নিয়ে আসেন সাথে করে।
আজকেও তিনি এসেছেন ফসলের টাকা দিতে। এইতো মাস ছয়েক আগেও তরফদার সাহেবের হাতে টাকা দিয়ে গেছেন । আজ আর মানুষটা নেই।

টানা বারান্দায় কয়েকটা চেয়ার পাতা আছে। সেখানেই বসতে দেয়া হয়েছে আফসারকে। দুপুরে এসে ভাত খেয়েছেন‌ এখানে। এখানে বসে ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে গেল আফসার উদ্দিন এর।

ফসলের টাকাটা আগেই ভাবির হাতে দিয়েছেন। এখন পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা হিসাবের ছোট কাগজ নাজমাকে দিয়ে বললেন,

বাড়িতে যেই এতিমখানায় খাওয়াতে বলেছিলেন এখানে হিসাব আছে ভাবিসাব।ঐটা কেটে রেখে টাকা দিছি।

আচ্ছা ঠিক আছে।

সাব্বির পাশেই রুমে ছিলো। ওদের আলাপ শুনে বেরিয়ে এলো।

আম্মা হিসাবটা দেখি।

বলে নিজেই কাগজটা নিলো।

কিছুক্ষণ দেখে বলল,

এত জমি থেকে মাত্র এই টাকা আসে! অনেক কমতো।

আবাদের যে খরচ, পোষায় না বাবাজি।

আরে রাখেন। এসব সবাই বলে। এভাবে নামকাওয়াস্তে একটা হিসাব দেখিয়ে আর কতদিন চলবেন? এনারা বোঝে না বলে এভাবে ঠকাবেন!

কি বলেন এইসব! আমি সেই প্রথম থেকেই ভাইজানের জমিজমা দেখতেছি। কখনো উনিশ বিশ হয় নাই। আমি অমন মানুষ না। এরা জানে আমার সম্পর্কে।

এমনটা সবাই বলে। এসব বলেই তো সহজে ঠকানো যায়।

নাজমা এবার বললেন,

আহ বাবা,কাকে কি বলছ। থাক তুমি রাখো,আমি দেখে নেব। তুমি জামাই মানুষ।তোমাকে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

এইটা কি বললেন মা। এখন বাবা নাই আপনাকে ঠিকঠাক সবকিছু দেখতে হবে। বুঝেশুনে চলতে হবে। যে যা হিসাব দিলো সেটাই ঠিক ভেবে নিবেন না। এতগুলো জমির টাকা। একটা হিসাব বুঝায় দিলেইতো হলো না।

আহ,কিসব বলছ। উনি আমাদের নিজেদের লোক। বাইরের কেউ না। না জেনে এভাবে কথা বলাটা ঠিক না।

কিন্তু মা।

বললাম তো হিসাব আমি দেখে নেব। তুমি ঘরে যাও।

সাব্বির রেগে চলে গেল। গোধূলির কাছে গিয়ে বলল,

আমি কি কেউ না। আমার কথা বাদ দিলাম, তোমার বাবা যা রেখে গেছেন তা তো তোমাদেরই। সেটা যেনতেন ভাবে নষ্ট করাটা কি তোমাদের জন্য ভালো হবে?

কি হয়েছে?

আরে ঐ যে আফসার না কি নাম, জমির টাকার ফেইক হিসাব দিতে এসেছে। তোমাদের জাস্ট ঠকাচ্ছে লোকটা। আমি বলতে গেলাম আর মা কথা শুনিয়ে দিলো।

গোধূলি বলল,

আমি দেখছি।

গোধূলি নাজমার কাছে গেল। আফসার তখন চলে গেছে। গোধূলি বলল,

মা তোমার জামাই কে কি বলছো?

কি বলেছি?

বাইরের লোকের সামনে তুমি অপমান করেছ ওকে।

আফছার অনেক পুরোনো মানুষ। ওকে তোমার বাবা বিশ্বাস করতেন। তোমার জামাই নতুন এসেই তাকে আজেবাজে কথা বলতেছে।

কি আজেবাজে বলছে। আব্বা নাই এখন সবাই চাইবে আমাদের ঠকাতে। ওতো ঠিক কথাই বলছে। একটা বাইরের লোক বেশি হলো তোমার কাছে!

আমি আজেবাজে কিছু বলিনি।

আসলে আমি ভালো থাকি এটাই তোমরা চাওনা। আর আমার জামাইকেতো শুরু থেকেই কেউ কোনো দাম দিচ্ছে না। বেচারা নিজের মনে করে তোমাদের কথা ভেবে দু’টো কথা বলে শুধু শুধু কথা শুনল।

গোধূলি কান্না শুরু করে দিলো।

নাজমা মেয়ের কথায় বিরক্ত হলেন,তবে কিছু বললেন না। তার মাথা ব্যথা করছে। ভাবলেন জামাই হয়তো ভালোর জন্যই বলেছেন। তবে এভাবে মুখের ওপর না বললেও পারত। এখন গোধূলির ব্যবহার অসহ্য লাগছে। কিন্তু কড়া করে কিছু বলতেও পারলেন না। তার মন আসলেও অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়েছেন । কোনো ঝুট ঝামেলা ভালো লাগে না আর। উনি উঠে ঘরে চলে গেলেন।

বাসায় চাপাতা নাই। আরো কিছু টুকটাক জিনিস শেষের দিকে। স্কুল শেষে রাত্রি একটা সুপার শপে ঢুকল। শপটা স্কুলের ঠিক উল্টো দিকে।

চাপাতা কিনে দুইরকম বিস্কিট নিলো ও। ঠিক এই সময় একটু দূরে আয়ানকে দেখতে পেলো। একটা বেশ সুন্দরী মেয়ে সাথে। দুই জন হেসে হেসে কথা বলছে। নিশ্চয়ই বিয়ে টিয়ে করেছে। ভালো চাকরি পেয়েছে। ছেলেরা ভালো চাকরি পেলে বিয়ে করতে দেরি করেনা। হঠাৎ রাত্রির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

টিস্যু বক্স নিতে হবে। কিন্তু সেটা নিতে হলে আয়ানদের পাশ কেটে যেতে হবে। এই মুহূর্তে আয়ানের সামনে পড়তে ইচ্ছে করছে না ওর। ও উল্টো দিকে ঘুরে অন্যপাশে চলে যেতে চাইছিল কিন্তু পেছন থেকে আয়ান ডেকে উঠল।

আরে রাত্রি ম্যাম যে! কেমন আছেন আপনি?

রাত্রির দাঁড়াতে হলো। অবাক হবার ভান করে বলল,

এই তো ভালো আছি। আপনি এখানে!
হুম কেনাকাটা করতে এলাম। আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।

তা আপনার নতুন চাকরি কেমন চলছে?

হুম ভালো। ট্রেনিং চলছে এখনো। পোস্টিং হয়নি। চিটাগাং এ ট্রেনিং করছি।

ও আচ্ছা।

এমন সময় সুন্দর করে মেয়েটা আয়ানকে দূর থেকে বলল,

আমি একটু ওদিকটায় যাচ্ছি। কিছু কসমেটিকস দেখব।

আচ্ছা যাও।

রাত্রি জানতে চাইল,

উনি?

আয়ান রাত্রির চোখ দেখে মনের ভাবটা বুঝে নিল হয়তো। কিছু না বলেই হাসল ও।

বিশেষ কেউ?

তেমনটাই বলতে পারেন।

বাহ্! ঠিক আছে আমার একটু তাড়া আছে। আজ আসি।

পরে কি আর দেখা হবার সম্ভাবনা আছে?

জ্বি?

না মানে এমনভাবে ‘আজ আসি’ বললেন যেন কাল আবারও দেখা হবে।

হঠাৎ একটু রাগের কন্ঠে রাত্রি বলল,

আমার সাথে দেখা হবার কি কোনো প্রয়োজন আছে আপনার?

সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো ও।

সরি, ভালো থাকবেন।

রাত্রি দ্রুত উল্টো ঘুরে হাঁটতে লাগল। ওর চোখ ভিজে উঠেছে। অল্পতেই কান্না পায় যে কেনো। আর এখানে কান্না করার মতো কিই বা হয়েছে। নিজের ওপরই রাগ লাগছে ওর। সাব্বির তো ওর প্রেমিক না যে ওকে অন্য মেয়ের সাথে দেখে এমন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে হবে।

শপের একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছল ও। চোখ খুলেই দেখল আয়ান সামনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।

কি হয়েছে ম্যাম? কাঁদছেন কেনো!
না মানে চোখে কি যেন পড়েছে।

অনেক পুরোনো এক্সকিউস এটা। আপনি আসলে আমার ঐ বিশেষ কেউ এর কথা শুনে কাঁদছেন।

আরে কিসব যে বলেন!

আর কত লুকাবেন নিজেকে? মাঝে মাঝে মানুষের চোখে মনের কথা ফুটে ওঠে।

রাত্রি আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। ছোটদের মতো কাঁদতে শুরু করল। আশেপাশের কয়জন ভাবল,

কি আশ্চর্য! একটা মেয়ে ছোটদের মতো কাঁদছে আর একটা ছেলে তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিয়ে হেসেই যাচ্ছে মিটিমিটি করে।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-১৪

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১৪

বাড়িতে ফেরার আগেই মায়ের ফোন এলো রাত্রির ফোনে।

হ্যালো মা,বলো।

তুই কোথায় ? এখুনি একটু বাসায় আয়।

কিছু হয়েছে? বাবা ঠিক আছেন তো?

বাবা ঠিক আছে। তুই কি কামরুলের সাথে আছিস? ওখানে আর থাকার দরকার নেই। এখুনি চলে আয়।

কেনো মা? বলবেতো কি হয়েছে!
তোর বাবা বিয়েটা হবে না বলে দিয়েছেন।

কামরুল কি ফোন করেছিল?

না।

আমি এখুনি ফিরছি।

রাত্রি যে আগেই চলে এসেছে এটা বললো না। বাসায় কিছু একটা হয়েছে এটা বুঝল। কামরুল যেহুতু ফোন দেয়নি তাহলে অন্য কোনো ঝামেলা হয়েছে যার জন্য বাবা বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন।

এমনটা হলে যা হয়েছে ভালই হয়েছে। ওকে আর এসব নোংরা কথা বাড়িতে বলতে হবে না। বিয়ে যখন ভেঙেই গেছে তখন আর এসব কিছু বলে পরিস্থিতিকে মুখরোচক করার কিই বা দরকার। মানুষ মাত্রই তিলকে তাল বানাতে পছন্দ করে। এইসব নিয়ে শেষে রাত্রির নামেই উলটা পালটা কথা ছড়াবে। মা হয়তো নিজের ভেবে কাছের মানুষের কাছে বলবেন। তারাই আবার রঙচঙ দিয়ে বলে বেড়াবে।

কামরুলের গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর হাঁটতেই রিকশা পেল রাত্রি। সেটা নিয়ে বড় রাস্তায় উঠে সিএনজি নিয়ে বাড়িতে ফিরল।

বাড়িতে ফিরলে নাজমা কামরুলের খালা কি বলেছেন সেটা জানালেন মেয়েকে। রাত্রি ভেতরে ভেতরে কেমন যেন হালকা অনুভব করল। এই কয়দিন একটা মানসিক চাপ ওকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল। আজ সেটা এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল।

রাতে খাবার পর তরফদার সাহেব রাত্রিকে ডাকলেন। নাজমা পাশেই বসে ছিলেন।

উনি রাত্রির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

মন খারাপ করিসনা মা। এই ছেলের পরিবার লোভী। তুই সুখী হতে পারবি না। তোর জন্য অনেক ভালো ছেলে অপেক্ষা করে আছে, দেখিস।

আমার মনখারাপ হয়নি আব্বা। আপনি এটা নিয়ে টেনশন করবেন না। আপনার শরীর খারাপ করবে।

আচ্ছা যা ঘরে যা। কালতো স্কুল আছে তোর। আর অন্য চাকরির কি খবর। পড়াশোনা করছিস তো!

করছি আব্বা। কয়েক জায়গায় এপ্লাই করেছি। পরীক্ষার ডেট হয়নি এখনও।

আচ্ছা মা দোয়া করি তোর মনের‌ ইচ্ছে পূরণ হোক।

রাত্রি চলে গেলে নাজমাকে বললেন,
ছোটরা না জেনে অনেক ভুল করে। কিন্তু বড়রা যদি সেই ভুলকে আঁকড়ে ধরে থাকে তাহলে ভুলের পাকে জীবনটা বরবাদ হয়ে যায়। তুমি গোধূলীকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করো। ওকে পড়াশোনা করতে বলো। আমি থাকি না থাকি আমার দুই মেয়ের ওপর সবসময় তোমার স্নেহের হাত যেন থাকে।

আপনি এসব কি বলতে শুরু করলেন। আপনি কোথায় যাবেন আমাদের ছেড়ে!

আরে পাগল কান্না করছ কেনো। মানুষ এর হায়াত মউতের কথা কি কেউ আগে থেকে বলতে পারে। আমিতো কথার কথা বলছি। আমার দুই মেয়ের কারো যেন মনে না হয় যে বাবা-মার জিদের জন্য তাদের জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। আমাদের যতটা চেষ্টা আমরা তাতে কমতি রাখবো না রাত্রির মা।

আচ্ছা ঠিক আছে। গোধূলির সাথে যোগাযোগ করব আমি। সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি অশুভ চিন্তা করবেন না।

তরফদার সাহেব মারা গেলেন ভোর রাতে, ঘুমের মধ্যে। নাজমা যখন ফজরের নামাজ পড়ে স্বামীর পাশে বসলেন দেখলেন ওনার হাত পা অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা হয়ে আছে। উনি মৃদু ডাকলেন।‌ শরীর ধরে ঝাঁকালেন। কোনো সাড়া না পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

রাত্রিরে, তোর বাবা আমাদের একা করে চলে গেলেনরে মা।

সকাল হতে হতেই আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভরে গেলো। রাত্রি কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নাজমা বেগম যথেষ্ট কান্না করলেও এখন ওযু করে কোরআন শরীফ পড়ছেন। তিনি জানেন যত কান্নাকাটি হবে মূর্দা তত কষ্ট পাবে। তাই নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছেন। তবে চোখের পানি বাঁধ মানছে না। পড়তে পড়তেই আয়াতগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে।

সকাল থেকেই এলাকায় মাইকিং হচ্ছে মৃত্যু সংবাদের। আশেপাশের অনেক পরিচিত অপরিচিত লোকজন এসে শেষদেখা দেখছেন।

নাজমার ভাই ভাতিজারা সব তদারকি করছেন। কবর খোঁড়া,আগত লোকজনের খাওয়া দাওয়া, মাদরাসা হুজুর দিয়ে কোরআন খতম সব কাজ চলছে। বাদ আছর‌ দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

নাজমা একফাঁকে তার বোনের ছেলেকে বললেন,

গোধূলিকে কেউ একটা খবর দিস। শেষদেখা দেখে যাবে।

সাব্বির শশুড়ের মারা যাবার খবর পেল অফিসে যাবার আগে আগে। একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল করে একটা ছেলে বলল,

আপনি কি সাব্বির বলছেন?

জ্বি।

আমি গোধূলির কাজিন বলছিলাম। একটা খারাপ খবর আছে। গোধূলির বাবা, আমার খালু আজ ভোররাতে ইন্তেকাল করেছেন। আপনি কি গোধূলীকে নিয়ে আসবেন একটু?

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। অবশ্যই আসব। আমি এখুনি নিয়ে আসছি ওকে।

অসুখের খবর লুকালেও মৃত্যুর খবর তো আর লুকানো ঠিক হবে না। সাব্বির গোধূলীকে বলল,

গোধূলি নাশতা করেছ?

হুম করেছি।

তৈরি হয়ে নাও।

এখন কোথায় যাব, আপনার অফিস আছে না?

তোমাদের বাড়িতে যেতে হবে।

আমাদের বাড়িতে কেনো?

এতো কথা বলছো কেনো। জলদি তৈরি হয়ে নাও। গেলেই দেখতে পাবে। ও বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। তোমার বাবা অসুস্থ।

রাত্রির চোখগুলো ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। সবাই এসে সান্ত্বনা দিচ্ছে আর রাত্রির আরও বেশি কান্না পাচ্ছে। আত্মীয়রা অনেক আফসোস করছে এটা বলে যে আহারে,মেয়েটাকে পাত্রস্থ করে যেতে পারলো না বেচারা। রাত্রির নিজেকে অপরাধী লাগছে। তার বিয়ে ভেঙে যাবার জন্যই বাবা হয়তো চলে গেলেন।

গোধূলি যখন সাব্বিরসহ আসল সবাই কৌতুহলী হয়ে তাকাল। ফিসফিস করে অনেকেই বলল,

এইটা ছোট মেয়েটা না, পালিয়ে যে গেল। আজকেই এলো প্রথম।

বাড়িতে এতো লোকজন দেখেই সন্দেহ হলো গোধূলীর যে খারাপ কিছু একটা হয়েছে। বাবাকে উঠানে খাটিয়াতে দেখেই চিৎকার করে উঠল গোধূলী,

ও বাবা,বাবা, কোথায় গেলে তুমি? এসব কিভাবে হলো?

গোধূলি সারাদিন বাবার বাসায় থাকল। বাবার লাশ যেখানে রাখা আছে তার আশেপাশেই থাকল। মাঝে মাঝে একা একাই ডুকরে কান্না করল। আত্মীয়রা কেউ কেউ ওকে সান্ত্বনা দিলো। সাব্বির মাঝে মাঝে গোধূলির কাছে এসে কিছু সময় বসে থাকে। আবার বাইরে চলে যায়। গোধূলি একবার বলে,

আপনাকে কেউ একটু কিছু খেতে দিয়েছে? আমি বলব?

আরে না,আমি ঠিক আছি। এখন এসব ভাবতে হবে না তোমার।

বাইরে একটু ফাঁকা মতো জায়গায় সামিয়ানা টানিয়ে বসার চেয়ার দেয়া হয়েছে। আত্মীয় শুভাকাঙ্ক্ষী যারা এসেছেন এখানে বসে আছেন অনেকে। সাব্বির সবার মাঝেই বসে রইল। এখানে বেশিরভাগ লোকজন তাকে চেনেনা। অনেকেই তার সামনেই বলতে লাগল,

ছোট মেয়েটা এমন একটা কান্ড করল যে বাবাটা সহ্য করতে না পেরে শয্যাশায়ী হলো। শেষ পর্যন্ত মারাই গেল। এমন সন্তান থাকার থেকে নিঃসন্তান থাকা অনেক ভালো।

কেউ কেউ আবার বলল,

শুনলাম মেয়েটা যে পালিয়ে গেছিল এসেছে আজ। এখন কান্নার নাটক করছে। ওরজন্যই তো লোকটা মারা গেল।

সাব্বির চুপচাপ সব শুনল। সবাই গোধূলিকে দায়ী করছে এই মৃত্যুর জন্য।

একটু পরেই সেই ঘটক যে সাব্বিরের বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল তার সাথে দেখা হলো। কথায় কথায় রাত্রির বিয়ে ভাঙার ঘটনা জানাল সাব্বিরকে।

বাড়ির ভেতরে তরফদার সাহেবের আত্মীয় স্বজন প্রায় সবাই এসেছে। নিজের লোক বলতে ছোট দুই বোন আর ভাই একজন। সবথেকে ছোট যে বোন মিতা, সে গোধূলীকে দেখেই রেগে গেল।

ওর সামনেই বলতে থাকল,

এই অলক্ষী মেয়ে আমার ভাইটাকে খেল। এখন আবার কেনো এসেছে বাপকে দেখতে। ও খুনী। ওকে বের করে দাও সবাই।

এসব শুনে গোধূলী ফুসে উঠল। বলল,

এতো যে ভাইয়ের জন্য দরদ দেখাচ্ছেন,আজীবনতো আমার বাবাকে জালিয়েছেন। কি আদায় করে নেবেন সেই ধান্দা করেছেন সবাই। কয়দিন খোঁজ রেখেছেন ভাইয়ের? এখন এসেছেন আমার দোষ ধরতে।

মিতা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল এর মাঝে নাজমা উঠে এসে ননদকে বললেন,

আহ মিতা,এখন এসব কথা বলার সময় না। মেয়ে তার বাপকে শেষ দেখা দেখতে এসেছে। বাড়িভর্তি লোক। তুমি শান্ত হয়ে বসো। তোমার ভাইয়ের জন্য দোয়া কালাম পড়ো। রাগারাগি, চিৎকার চেঁচামেচি করলে তোমার ভাইয়ের আত্মা কষ্ট পাবে।

চিৎকার চেঁচামেচি ওখানেই থেমে গেল। বাড়ির ভেতরে আবার কান্নার রোল উঠল।

গোধূলি খেয়াল করল মা একবারও তার সাথে কথা বলেনি। রাত্রি আপা ঘরে আছে। অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে বারবার। ও যখন বাড়িতে ঢুকল ওকে দেখে জড়িয়ে কান্না করল কিছু সময়। গলা ভেঙ্গে গেছে আপার। তারপর বাবার লাশের উপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেল।
সবাই ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল।

আছর এর পরপর দাফন হলো। আত্মীয় স্বজন কেউ কেউ থাকল। যারা কাছের তারা চলে গেলো।

সাব্বির গোধূলীকে থেকে যেতে বলল কিন্তু গোধূলির এই মনমরা বাড়িতে একদম থাকতে ইচ্ছে করছে না। এখানে থাকলে শুধু কান্না পাচ্ছে। মা একবারও তার সাথে কথা বললো না। মামা,চাচারাও ওর কাছে আসেনি। সাব্বির যে এসেছে সেদিকেও কারো খেয়াল নেই। হাজার হোক জামাই মানুষ। পরে আবার এটা নিয়ে কথা শোনাতে পারে। গোধূলির একটু রাগ হলো সবার ওপর। সন্ধ্যায় নীরবে বের‌ হয়ে এলো বাড়ি থেকে।

বাসায় পৌছে সাব্বির বলল,

তুমি ওখানে আজ থাকতে পারতে।চলে আসাটা উচিত হয়নি।

ওখানে দেখেছেন কেউ কথা বলল ঠিক করে?

আহা মরা বাড়ি,কারো কি মাথা ঠিক আছে নাকি?

মাথা সবার ঠিকই আছে। আমার নামে তো ঠিকই সবাই বদনাম করছে। তখনতো আর শোক দেখলাম না কারো চেহারায়।

হুম,আমিও দেখলাম। সবাইতো তোমাকেই দায়ী করছে বাবার মৃত্যুর জন্য।

আপনিও শুনেছেন?

হুম বাইরে সবাই কানাঘুষা করছিলো।

এদিকে ছোট ফুফুতো মুখের ওপর যা তা বলল। আমাকে বলে কিনা বাড়ি থেকে বের করে দিতে।আমিও দুচার কথা শুনিয়ে দিয়েছি।

কাহিনী তো এখানেই। সবাই তোমাকে দোষ দিচ্ছে কিন্তু আসল ঘটনা কেউ জানেই না।

কি আসল ঘটনা!

তোমার বোন যে পাত্রের সাথে ঝামেলা করে হওয়া বিয়ে ভেঙে দিলো সেটা কি বলেছে একবারও। কেনাকাটা সব হয়ে গেছিল,দাওয়াত দেয়াও শেষ। কিন্তু হঠাৎ করেই তোমার বোন পাত্রের সাথে কি নিয়ে যেন ঝামেলা করেছে। এতবড় ধাক্কা না সামলাতে পেরেই তোমার বাবা মারা গেছেন।

কি বলেন! আমিতো জানিইনা কিছু।

জানালে তো জানবে। কেউ যেন না জানে এটাই তো ওরা চাইছে। আমি শুধু ভাবছি মা পর্যন্ত কিভাবে চুপ করে থাকলেন। তুমি ওনার নিজের মেয়ে তো? সবাই তোমাকে দোষ দিক কিন্তু উনিতো জানেন সব ঘটনা। অথচ একটা কথাও বললেন না!

আপনি এতসব কিভাবে জানেন।

আমার সাথে ঐ ঘটকের দেখা হয়েছিল। সেই বলল। তোমার বোনের দেখো অন্য কোনো কেইস আছে তাই বিয়ে করছে না। আর দোষ হচ্ছে তোমার। দেখো আলটিমেটলি বাবার মৃত্যুর জন্য তোমাকেই দোষী করতে চাইছে যেন তোমার ওপর থেকে সবার মন উঠে যায়।

তা কেনো করবে!

আরে মেয়ে ঢাকা শহরে বাড়ির জায়গা,পেনশন সব একাই ভোগ করবে। বোঝোনি?

তাইতো,এটাতো ভাবিনি। এজন্যই আমাকে কেউ থাকতে বললো না,ঠিকমতো কথা পর্বযন্ত বললো না।

একদম। এমন করেছে যাতে তুমি যেন ওখানে আর না যাও। তোমার উচিত হবে একবার যখন ঐ বাড়িতে ঢুকেছ, এখন থেকে ঘনঘন যাওয়া। ওখানে নিজের জায়গাটা নিশ্চিত করা। তোমারতো হক আছে তাই না? কেনো তুমি নিজের হক থেকে বঞ্চিত হবে। তুমি তো মানুষ খুন করোনি। বিয়ে করেছো। এক দিন না একদিন বিয়েতো দিতেই হতো। হয়তো মা বাবা পছন্দ করে দিতেন। আর হায়াত মউত সব খোদা ঠিক করেন। কারো মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী থাকে না। উনি অসুস্থ ছিলেন তাই মারা গেছেন। এটাতে তোমার যদি দোষ কেউ দেয় তবে সেটা ঠিক না। সেইভাবে দেখলে তোমার বোন দায়ী সবকিছুর জন্য। তুমি মনখারাপ করে থেকো না। এখন থেকে ও বাড়িতে নিয়ম করে যাবে বুঝলে?

হুম, আপনি ঠিক বলেছেন। আর আমি কিনা সবার কথায় রাগ করে চলেই আসলাম।

মৃত্যুর শোক কেটে একটা হিংসাত্মক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল গোধূলীর মনে। সাব্বির খুব চতুরতার সাথে সেই বীজ বপন করে দিলো। গোধূলি ঠিক করল দোয়া পড়ার দিন বাবার বাড়িতে গিয়ে কয়টা দিন থেকে আসবে।

তিনদিনের দিন দোয়া পড়ার অনুষ্ঠানে গোধূলী এলো লাগেজসহ। সাব্বির বাইরে নামিয়ে দিয়ে গেছে। গোধূলি এমনভাবে বাড়িতে ঢুকল যেন কিছুই হয়নি। এ বাসায় স্বাভাবিক যাতায়াত আছে ওর। আগে ঘরে গিয়ে লাগেজ রাখল। তারপর বাইরে এলো।

নাজমা বসে ছিলেন বাইরের বারান্দায়।

গোধূলি বলল,

মা আমি ক’টা দিন এখানে থাকব।

নাজমা বললেন,

থাকো। তোমার কারণে কষ্ট পেয়ে তো লোকটাই চলে গেল। কিন্তু যাবার আগেও তোমার কথা ভেবেছেন উনি। আর তুমি কিভাবে সেই লোকটাকে এত কষ্ট দিতে পারলে।

গোধূলি দেখল মা তাকে তুমি তুমি করে বলছে। ওকে দূরের করে দিয়েছে। অভিমানে ফুঁসে উঠল ও।

এইসব ভুল কথা মা। আমার জন্য বাবা চলে যায়নি। আমি কি এমন করেছি! কাল থেকে একটা কথা বলেই যাচ্ছে সবাই। আসল ঘটনা লুকিয়ে রেখেছ তোমরা। আপার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণেই এসব হয়েছে।

এসব কি যা তা বলছিস ! ওরা কেনো বিয়ে ভাঙবে। তোর বাবাই মানা করে দিয়েছিল।

তুমি সবসময় তোমার বড় মেয়েকে নির্দোষ দেখাও। ওর জন্য বাবা চলে গেছে। ওর বাজে আচরণের জন্য বিয়ে ভেঙে দিয়েছে ছেলেপক্ষ। আর এখন আমাকে দোষী বানাচ্ছো। এসব করে আমাকে তাড়াতে পারবে ভেবেছ? কোনো লাভ নেই। এটা আমারো বাড়ি। আমার এখানে থাকবার অধিকার আছে। বাবার সবকিছুতেই আমার অধিকার আছে।

রাত্রি পাশের ঘরেই ছিলো। চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসে বলল,

তুই ভুল বুঝছিস। তোকে কেউ তাড়াতে চাইছে না। তুই থাক না যতদিন খুশি।

কিরে আপা, আজকে বেশ কথা বলছিস। সেদিন সবাই আমাকে যা তা বলল তারপরেও তুই চুপ করে ছিলি। সত্যি টা লুকিয়ে রেখেছিস। ভালো মানুষের মুখোশ আর কত পড়ে থাকবি।

এসব আজেবাজে কথা বলার সময় এটা না। তুই সবটা জানিস না তাই উলটা পালটা বকছিস। তোকে কেনো তাড়াতে চাইব আমি। তুই নিজেই তো চলে গিয়েছিলি। যাই হোক,তোকে কেউ তোর অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না।

চাইলেও করতে পারবে না। সারাজীবন আমাকে অবহেলা করেছ তোমরা। এখন আর আমি একা না। কাউকে ছাড় দেবো না এক বিন্দুও।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-১৩

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১৩

রাত্রির খালাতো ভাই শোভনের বৌ রিমু। এই রিমুকে নিয়েই সেদিন বিয়ের শপিং এ সাথে নিয়ে গিয়েছিল রাত্রি। কামরুল কিভাবে যেন রিমুর সাথে যোগাযোগ করে রাত্রিকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবার জন্য ম্যানেজ করল। রিমু ভাবি এসে বলল,

এই রাত্রি,কাল স্কুল থেকে একটু আগে বেরুতে পারবে?

কেনো ভাবি?

কেনো আবার? তোমার বরতো আমাকে ফোন করে করে পাগল করে দিচ্ছে। তোমার সাথে দেখা করতে চায়। ওর বন্ধু আর তাদের বৌয়েরা সবাই নাকি একটা পার্টি করছে তোমাদের দু’জনের বিয়ে উপলক্ষ্যে। সেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে চায়।

এখনো উনি আমার বর হয়নি ভাবি। আর তোমাকে বলেছে এ কথা!

হুম, তুমি নাকি বলেছ যে এভাবে দেখা করতে পারবা না।‌ বাড়িতে এসব পছন্দ করবে না তাই আমাকে ধরেছে। আমি খালাকে বলেছি। উনি বলেছেন সমস্যা নেই। তবে সন্ধ্যার আগে ফিরতে হবে।

রাত্রির এই রিমু ভাবি মেয়েটা একটু সহজ সরল। কেউ একটু ভালো করে কথা বললেই তাকে ভালো ভেবে বসে। কামরুলের আসল ইচ্ছেটাতো রাত্রি ভালো করেই জানে। ও বলল,

এইতো একসাথে শপিং করলাম। আবার দেখা করতে হবে কেনো। আর বিয়ে হোক তখন ওনার বন্ধুদের সাথে তো দেখা হবেই। আগে পার্টি করার কি দরকার।

আরে বিয়ের আগে কিসব অনুষ্ঠান করে। ব্যাচেলর পার্টির মতো আর কি। আর আসল কথা হলো বিয়ের আগে একটু একসাথে সময় কাটাতে চায় তোমার সাথে। আজকালকার ছেলে। হবু বৌয়ের সাথে প্রেম করতে চায়।

রিমু চোখ টিপে হাসতে লাগল। রিমু সবসময় ইয়ার্কি ফাজলামো করে। বেশি কথা বলে মেয়েটা। রাত্রি বলল,

আমি যাবো না।

আরে কি বলো! যাও, ভালো লাগবে। এখনতো সবাই প্রেম করেই বিয়ে করে। তোমার তো আর প্রেম করা হয়নি। বিয়ের আগে একটু ভাব ভালোবাসা না করলে কি হয় নাকি!

আমার এসব পছন্দ না ভাবি।

গেলেই ভালো লাগবে।

শোনো ভাবি,ছেলেটাকে আমার সুবিধার মনে হয় না।

কি যে বলো। ছেলেতো ভালো। তা নাহলে আজকাল সম্বন্ধ করে বিয়ের অপেক্ষায় থাকে নাকি? নিজের পছন্দ থাকত।

ঐ ছেলে আমাকে কি বলে শুনবা?

কি বলে!

রাত্রি রুম ডেটের কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলো।

চুপ হয়ে গেলে যে। কি বলছে।

আমার ব্লাউজের মাপ জানতে চাইছে।

রাত্রির কথা শুনে রিমু হো হো কর হেসে উঠল। এই কথা! আরে মেয়ে, ছেলেরা বিয়ের আগে এমন কত কথাই বলে। তোমার ভাই কি করছিলো জানো? বিয়ের আগের রাতে ছাদ বেয়ে চুপ করে আমার ঘরে এসেছিল। তারপর কথা বলতে বলতে আচমকা আমাকে বুকে টেনে চকাস করে চুমু খেয়েছিল। আমিতো ভয়েই শেষ। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে।

রাত্রি বুঝল রিমুকে এসব বলে লাভ নেই। ও আসলে বুঝতেই পারছে না কিংবা রাত্রি বোঝাতে পারছে না। কামরুল ছেলেটার কন্ঠে কোনো প্রেম ছিলো না এসব বলার সময়। আর তাছাড়া রিমু আর শোভন ভাইয়া পূর্ব পরিচিত। তাদের প্রেম না থাকলেও একজন আরেকজনকে পছন্দ করত মনে মনে। আর কামরুল সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন। তাও যদি এনগেজমেন্টের আগে এমন কিছু বোঝা যেত রাত্রি না করে দিত। এখন বিয়ের কেনাকাটা পর্যন্ত শেষ। বাবার এতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেছে। আর তাছাড়া আত্মীয় স্বজন অনেকেই জানে। বারবার ওর বিয়ে নিয়ে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে বাবার জন্য সেটা খুব অসম্মানের হবে।
কিন্তু এখন এই ছেলেকে মোটেই বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে না রাত্রির। কি করবে ও। মাকে কি সব কিছু খুলে বলবে? মা নিশ্চয়ই বাবাকেই বলবে। তাহলেও তো সেই আবার বিয়েটা ভেঙ্গে দেবার কথাই আসবে।

রাত্রি কিছুই বুঝতে পারছে না। কিছু কিছু সময় আসে মানুষের জীবনে যখন ভীষণ অসহায় লাগে। রাত্রির এখন তেমন সময় যাচ্ছে।

রাতে মা নামাজ শেষে ঘরে এলেন। রাত্রির গায়ে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিলেন। তসবিহ গোনা শেষ করে বললেন,

তোর চোখমুখ এতো শুকনা লাগছে কেনো,ঘুমাসনি রাতে?

ঘুমিয়েছি।

শোন, কামরুল ছেলেটার বন্ধুরা নাকি তোদের জন্য কাল কি একটা অনুষ্ঠান করতে চায়। রিমুকে জানিয়েছে। তুই তৈরি হয়ে থাকিস মা। ছেলেটা আশা করেছে। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে দেবে বলেছে।

আমি যেতে চাইনা মা। আমার এখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।

পাগল‌ মেয়ে। বিয়ে জিনিস টাই এমন মা। তখন শুধু নিজের ইচ্ছায় সব করা যায় না।‌আরো কিছু মানুষের ইচ্ছেকে তখন মূল্যায়ন করতে হয়। যা,ছেলেটা ওর বন্ধুদের কাছে ছোট হয়ে যাবে না হলে। ওদের বৌয়েরাও থাকবেতো।

রাত্রি মাকে জড়িয়ে কান্না করে দিলো।

নাজমা ভাবলেন মেয়ের মন হয়তো খারাপ। বিয়ে হয়ে যাবে,এ বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে তাই মনটা এমন ভার হয়ে আছে। বিয়ের আগে আগে সব মেয়েরই এমনটা হয়।

পরদিন রাত্রির ঘুম ভাঙল একরাশ বিষন্নতা নিয়ে। সারারাত দুশ্চিন্তায় তেমন ঘুম হয়নি আসলে। কামরুলের সাথে আজ বাইরে যেতে হবে। কামরুল বন্ধুদের গেট টুগেদারের বিষয়টা বানিয়ে বলেছে। রাত্রি চেষ্টা করেও মাকে বলতে পারেনি সবটা। বিয়েটা না হলে বাবা যদি আবার আঘাত পায় এই ভাবনাটা ওর উচিত অনুচিত বোধকে গলা টিপে ধরেছে। ও হয়তো বেশি বেশি রিয়েক্ট করছে,এটাই হয়ত আজকাল স্বাভাবিক বিষয়। যাই হোক কামরুলের আশা সে পূরণ হতে দেবেনা। যেভাবেই হোক বিয়ের আগে কোনো অনৈতিক কাজ সে করবে না।

কামরুলের আসার কথা দুপুরে।‌ রাত্রি একটু আগেই তৈরি হয়ে নিলো। সিদ্ধান্ত নিলো পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াবে ও। ভীত হয়ে পালিয়ে যাবে না।

কামরুল গাড়ি নিয়ে নিজে আসেনি। ওর এক খালাতো বোনকে পাঠাল রাত্রিকে পিক করতে। একটু দূরে আসার পর কামরুল উঠল। ড্রাইভারের পাশে বসল। রাত্রি আর কামরুলের বোন পেছনে বসেছে। রাত্রিকে দেখে তেলতেলে হাসি দিলো। কামরুলের বোন একটা শপিং মলের সামনে নেমে বলল,

তোমরা যাও। আমার একটু কাজ আছে এখানে।

কামরুল নেমে পেছনে এসে রাত্রির পাশে বসল।

গাড়ি নিয়ে ওরা এলো উত্তরা দিয়াবাড়ির দিকে। কামরুল ড্রাইভারকে বলল,

গাড়িটা একপাশে সাইড করে রেখে এক প্যাকেট সিগারেট আনো।

ড্রাইভার গাড়ি সাইড করে নেমে পড়ল।

রাত্রি দেখল আশেপাশে কোনো দোকানপাট নাই। ও বলল,

এখানে তো দোকান দেখছি না।

কামরুল বলল,

একটু সামনে গেলেই আছে। ও নিয়ে আসবে। ওনার সামনে তোমার সাথে মন খুলে কথা বলা যাবে না।

কামরুল কাছে সরে এসে রাত্রির হাত ধরল।

রাতু,আমার তোমাকে খুব ভালো লাগছে। বিয়েটা আরো আগায় আনলে ভালো হতো। তোমাকে দেখার পর থেকে ঘুম নাই আমার রাতু। এতদিন কিভাবে থাকব।

রাত্রি হাত ছাড়িয়ে বলল,

কয়টাতো দিন,দেখতে দেখতে চলে যাবে।

কামরুল আচমকা রাত্রিকে চেপে ধরে পাগলের মতো গালে গলায় চুমু খেতে লাগল।

এখুনি ছাড়ুন আমাকে। নাহলে চিৎকার করব।

এখানে কেউ শুনবে না তোমার চিৎকার।

রাত্রি ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলে কামরুল আরো উন্মাদ হয়ে গেল।

আহা,এমন করলে তোমার কষ্ট বেশি হবে। এমন করছো যেন কচি খুকি। একটু চেখে দেখতে দাও। তরকারি নামানোর আগে লবণটাতো চাখতে হয় সোনা। না দেখেশুনে কি বিয়ে করা যায় বলো।

হঠাৎ ঘাড়ের কাছটায় জলুনি টের পেল কামরুল। ধারালো কিছু চেপে ধরেছে রাত্রি।

রাত্রি বলল,

এখুনি ছাড়ুন,নাহলে পোচ দিতে দেরি হবে না।

কামরুল ভয় পেয়ে সরে গেল। ড্রাইভারকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এসব চরিত্রের ছেলেরা দূর্বল চিত্তের হয়। একা থাকলে বেশ ভয় পায়।

কামরুলের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো ও। চিৎকার করে বলল,

তুই একটা দুশ্চরিত্র ছেলে। তোর মতো ছেলেকে বিয়ে করার থেকে আজীবন একা থাকা ভালো।

রাত্রি দরজা খুলে বেরিয়ে হাঁটতে লাগল। ও ঠিক করল বাড়িতে ফিরে বিয়ে ভেঙে দেবে ও নিজেই।

তবে ওকে কিছুই করতে হলো না। রাত্রি বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার একটু পরেই কামরুলের খালার ফোন এলো নাজমার কাছে।

আসসালামুয়ালাইকুম বিয়াইনি।

ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছেন?
সব ঠিক আছেতো?

জি ভাই,সব ঠিক আছে। একটা কথা জানাতে ফোন দিলাম।

বলুন।

আমাদের কামরুতো সোনার টুকরা ছেলে। এই যুগে এমন ছেলে পাওয়া সহজ কথা না। এইতো আমাদের পাড়ায় এক মেয়ের বাবা ছেলেকে ফ্লাট লিখে দিতে চেয়েছিল।‌ কিন্তু ঐ মেয়ের গায়ের রঙ একটু ময়লা তাই কামরু রাজি হয়নাই। ছেলের আবার ইচ্ছা সুন্দর মেয়ে বিয়ে করবে।‌ আপনাদের মেয়েতো মাশাআল্লাহ ভালো দেখতে শুনতে। দু’জনকে মানাবে মাশাআল্লাহ।

জ্বি আপা,সব আল্লাহ পাকের ইচ্ছা।

তবে কিছু না মনে করলে একটা কথা ছিল।

জ্বি বলেন।

ছেলেতো আপনাদের ঘরের ছেলেই হলো বলা চলে। ছেলের একটা ছোট আব্দার আছে। এটাকে আবার অন্যভাবে নেবেন না।

না ঠিক আছে।‌ বলেন আপনি।

আপনারা তো জানেন ছেলেদের বাপ ভাইয়েরা একসাথে ব্যবসা করে। তবে ছেলে চাইছে আলাদা একটা দোকান দিতে। আপনাদের বাসার ছাদে একটা শোরুম দিতে চায়।

ভালো তো। বিয়েটা হোক,সেসব বিয়ের পর ভাবা যাবে। আমাদের তো একটাই মেয়ে। সবকিছু তো ওরই থাকবে।

না ভাবীসাব, এভাবে না। ছেলে বাড়ির ওপরের অংশ ওর নামে লিখে চাইছে।

কি বলেন, লেখালেখি করতে হবে কেনো।

আপনাদের তো আরও একটা মেয়ে আছে।‌ সেতো আপত্তি করতে পারে ভবিষ্যতে। তাই লিখেপড়ে দিলে ভালো না? ঐ মেয়েতো শুনছি নিজেই বিয়ে করে চলে গেছে। কিন্তু সময়মতো এসে দেখবেন ঠিক সম্পত্তির ভাগ দাবি করবে।

নাজমা অবাক হয়ে গেলেন। তারা নিজেরাই এতো কিছু ভাবেননি অথচ বাইরের লোকজন কতদূর ভেবে ফেলেছে। আর তাছাড়া গোধূলিকেতো তারা ত্যাজ্য করে দেননি। আর লোকজন সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে ফেলছে।

তিনি বললেন,

আমিতো কিছু একা বলতে পারি না আপা। ওর বাবার সাথে কথা বলতে হবে। আর তাছাড়া রাত্রির বাবা এসব একদম পছন্দ করবে না। এভাবে চাওয়া মানে তো যৌতুক দাবি করা।

ছি ছি যৌতুক কেনো। ছেলের ভালো মানেতো আপনার মেয়েরই ভালো। ওতো আপনাদের ছেলেই হয়ে গেল বলা চলে।

আচ্ছা দেখি,আমি জানাব।

নাজমা বিষয়টা রাত্রির বাবাকে বললেন। তরফদার সাহেব বললেন,

এরা তো দেখছি লোভী মানুষ। এই ঘরে মেয়ে বিয়ে দিবো না।

গোধূলি ভেবেছিল এ বাসায় উঠলে সব সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সমস্যা সবে শুরু হলো। সাবেরা কাজের লোককে বিদায় দিয়ে দিয়েছেন। এখন পুরো বাসায় কাজ ওকেই করতে হয়। এমনকি সাবেরা অফিস যাবার আগে বালতি ভরে সবার পরনের কাপড় পর্যন্ত ভিজিয়ে রেখে যান। সেসবও ওকে ধূতে হয়। সারাদিন কাজ করে হাঁপিয়ে ওঠে গোধূলি। তারপরেও সাবেরা ফিরে এসে এটা ওটা ভুল ধরতে থাকে। ঐ এক কথা বকবক করতে থাকেন,

কি মেয়ে যে আনল সাব্বির। কোনো গুন নাই, কামাই রোজগার নাই। আমার ছেলের ঘাড় ভেঙে খাচ্ছে। অথচ ঘরের কাজ পর্যন্ত ঠিকঠাক করতে পারে না। এর থেকে গ্রামের কোনো মেয়ে আনলে অন্তত ঘরের কাজগুলো ঠিকমত হতো।

সাব্বির এসব যেন দেখেও দেখে না। একদিন গোধূলি এতো কাজ করতে কষ্ট হয় এমন বোঝাতে গেলেই সাব্বির বলল,

সংসারে তো কাজ থাকবেই। আমার মাতো সারাজীবন চাকরি সংসার দুটোই করল। আর তুমিতো সারাদিন বাসাতেই শুয়ে বসে থাকো। তোমার আবার কষ্ট কি। আর তাছাড়া সংসারটাতো তোমারই। তোমার সংসারতো তোমাকেই দেখতে হবে।

গোধূলি আর কিছু বলতে পারলো না। সংসারের দায়িত্ব নামমাত্র তার। কি রান্না হবে, কি কিনতে হবে, কাজের লোক লাগবে কি না সব সিদ্ধান্ত তার শাশুড়ি নেয়। সে শুধু কাজের লোকের মতো হুকুম তামিল করে।

তবে গোধূলির সব কষ্ট দূর হয়ে যায় সাব্বির যখন ওকে কাছে টানে, পাগলামি করতে থাকে। তখন ও যেন অন্য এক মানুষ । তখন গোধূলি ওর জন্য সবচেয়ে প্রিয় । ওর কানে কানে যখন বলে,

তুমি একটা আগুন, তোমাকে ছেড়ে এক মূহুর্ত বাঁচতে পারবো না আমি।

গোধূলির তখন নিজেকে রানী মনে হয়।
সাব্বির এতোটাই পাগল ওর জন্য যখন কাছে চায় তখন কিছুই বুঝতে চায় না। এইতো সেদিন বিকেলে নাশতা করার পর গোধূলীকে সাবেরা বলল রাতের জন্য তরকারি করতে। গোধূলি সবজি কাটতে শুরু করেছে এমন সময় সাব্বির বাইরে থেকে এসে বলল,

গোধূলি একটু ঘরে আসো।

একটু পর আসছি।

উহু এখুনি আসো।

সাবেরার দিকে তাকিয়ে দেখল ওনার মুখ ভার হয়ে গেছে। গোধূলি সবজি কাটা রেখে উঠে ঘরে যেতেই সাব্বির দরজা লাগিয়ে দিলো। গোধূলি বলল,

এই কি করছেন,এখন এই সময় দরজা লাগালেন যে,মা কি ভাববেন!

সাব্বির গোধূলীকে টেনে বুকের কাছে নিয়ে বলল,

কে কি ভাবল জানি না, তোমাকে এখন কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।

গোধূলি টের পেল সাব্বির নেশা করেছে। মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে। ও আর না করলো না। নিজেকে ছেড়ে দিলো সাব্বিরের কাছে।

এই যে সবকিছু অগ্রাহ্য করে সাব্বির ওর‌ জন্য পাগল হয়ে যায় এতেই ভীষণ সুখী লাগে ওর নিজেকে।

আজ অফিস শেষে সাব্বির চলে গেল ওদের ভাড়া বাড়িতে। বাড়িওয়ালা এখনও জানে না যে গোধূলি এখন আর থাকবে না এখানে।‌ আজকে জানিয়ে দেবে সাব্বির। এডভান্স দিয়েই এ মাসের ভাড়াটা এডজাস্ট হবে তাহলে। উপরে এসে দরজা খুলতে যাবে এমন সময় নওমি পেছন থেকে বলল,

কি ব্যাপার দুলাভাই,কেমন আছেন?
দেখাই যায় না আজকাল।

সাব্বির ঘুরে দেখল নওমি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে বেশ টাইট একটা টপস আর স্কার্ট। ওড়নাটা গলায় পেঁচিয়ে রেখেছে। শরীরের ভাঁজ সব প্রকট হয়ে চোখে পড়ছে। সাব্বির চোখ সরিয়ে নিল।

এই মেয়েটা সাব্বিরকে পছন্দ করে এটা বোঝে সাব্বির। সবসময় অফিস যেতে আসতে যখনই সাব্বির সিঁড়ি দিয়ে নামত ওর সাথে দেখা হয়ে যাবে। মেয়েটা ইচ্ছে করেই ঐ সময়ে বের হয়। আর আগ বাড়িয়ে কথা বলে। প্রথম থেকেই দুলাভাই বলে ডাকে। অথচ গোধূলির সাথে তেমন আলাপ নাই।

নওমির বাবার বাড়ি গ্রামের দিকে। ওখানে কোন এক ছেলের সাথে কি যেন সমস্যা হয়েছে তাই এখানে মামার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে ওর মা বাবা। এসব অবশ্য নওমি বলেনি। দাড়োয়ানের কাছে শুনেছে। রাতে সিগারেট কিনতে তে যখন নিচে নামত তখন দাড়োয়ান গুটুর গুটুর করে গল্প করতো ওর সাথে । মেয়েটার মধ্যে একটু চুলবুলি ভাব আছে। অহেতুক শরীর কাঁপিয়ে হাসে কথা বলতে গিয়ে।

সাব্বিরের চেহারা বেশ ভালো। বয়স ঠিক কত তা বোঝা যায় না। কমবয়সী মেয়েরাও ওর প্রেমে পড়ে। বিষয়টা বেশ উপভোগ করে ও। বিভিন্ন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করতে ভালো লাগে ওর। তবে ষোড়শী মেয়েদের দিকে ঝোঁক একটু বেশি। ঠিক এজন্যই রাত্রি মেয়েটাকে দেখতে গিয়ে গোধূলিকে পছন্দ হয় ওর।

সাব্বির নওমিকে বলল,

এই তো কেমন আছো?

মেয়েটা আহ্লাদ করে বলল,

ভালো নাই। আপনার দরজায় দু’দিন থেকে তালা ঝুলছে। বৌ সহ হানিমুন গেছিলেন নাকি?

আর হানিমুন। মনের মতো মানুষ না পেলে মুনে কি আর হানি পাওয়া যায় নাকি!

সাব্বির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল।

নওমিও দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
এমা! কেনো,বৌকি মনের মতো না ! দেখতে তো সুন্দর।

শুধু সুন্দর হলেই কি মনের মতো হয়।

তো,আর কি লাগে?

এই যেমন তুমি, তুমি যখন হাসো তোমার পুরো শরীর খিলখিল করে হেসে ওঠে। এমনটাতো সবাই না।

তাই বুঝি। ফ্লার্ট করছেন?

নওমি নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ নাচাল।

নাহ্ এই মেয়ে একেবারে নিজেই হেঁটে এসেছে ধরা দিতে। খুব সহজেই একে বিছানায় নেয়া যাবে। চাইলে এখুনি। সাব্বিরের ভেতরটা শিহরিত হলো।
সাব্বির একটু এগিয়ে এসে নওমির কাঁধে হাত রেখে বলল,

তোমাকে ছুঁয়ে বলছি। সত্যি, সত্যি সত্যি।

নওমি পুরো শরীর দুলিয়ে হেসে ওঠে।

বৌকি আজ আসবে নাকি?

নাহ,ওর সাথে ঝগড়া হয়েছে। বাড়িতে গেছে।

কি নিয়ে ঝগড়া হলো!

আরে আমার একটু চাহিদা বেশি। সে বুঝতে চায় না। কাছে আসতে চায়না সহজে।

তাহলেতো তোমার মনটা সত্যিই খারাপ। এই যা তুমি বলে ফেললাম।

ভালো লাগছে তোমার মুখে তুমি ডাক। ভেতরে এসে বসো। ঘরটা কিন্তু ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে।

আচ্ছা আমি গুছিয়ে দিচ্ছি।

নওমি ওড়নাটা খুলে মেঝেতে রেখে উপুড় হয়ে বিছানায় চাদর গোছাতে লাগল। ওর টপসের গলাটা একটু বড়। হেলে থাকার কারণে অনেকটা নেমে গেছে। সাব্বির এর নেশা ধরে গেলো। ও দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে নওমির কাছে চলে গেলো। নওমি সাব্বির কে টেনে নিলো নিজের দিকে।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-১২

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১২

পরের শুক্রবার কামরুলের মা বাবা এসে রাত্রিকে আংটি পরিয়ে দিলেন। কামরুল এক ফাঁকে বলল,

আংটি পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ।

বাইরের এটা। দুবাই থেকে আনানো।

হুম।

বিয়ের ডেট ঠিক হলো আগামী মাসের ১৬ তারিখ। ঐ সময় একটা ছুটি আছে। সবার আত্মীয় স্বজন আসতে পারবে।
কেনাকাটা করতে একদিন বাইরে গেল রাত্রি,ওর ভাবী,কামরুলের ছোট বোন,কামরুল।

রাত্রি পছন্দ করে কিনবে বলে গেলেও কামরুল আর ওর বোন মিলেই সব পছন্দ করল। নিজের জন্য কামরুল সব দামি দামি জিনিস নিলো। কাপড়চোপড় সব নেয়া হলো কামরুলদের দোকান থেকে। কর্মচারীরা সবাই ভাবী ভাবী করতে লাগল। রাত্রির একটু অস্ত্বস্তি লাগল। তবে দেখল দোকান আসলেই অনেক বড়।

কেনাকাটার একফাঁকে কামরুল রাত্রিকে বলল,

ভাবিরা যাক,আমি তোমাকে পরে নামিয়ে দেই।

রাত্রি বলল,

কেনো!

একটু ঘুরতাম আর কি। দু’জন তো একা কথাই হলো না।

রাত্রি না করে দিল।

রাতে কামরুল মেসেজ দিলো।

রাত্রি কি করো?

এইতো আছি।

কি পরে আছো।

মানে!

না মানে ভিডিও কল দেই?

না এখন না।

তুমি শুধু না না করো। সকালে বললাম একটু দু’জন ঘুরে আসতাম।

ভাবির সাথে বের হয়েছি। এখন আপনার সাথে একা গেলে কেমন দেখায়।

কেমন আবার দেখাবে? বিয়ের আগে দুইজন দুইজনকে একটু দেখাশোনা দরকার না?

আমাদের তো দেখাশোনা হয়েই বিয়ে ঠিক হলো।

আরে এত কম বুঝো কেন,
আজকালকার মেয়েরা তো সব বোঝে। আমি কি ঐ দেখাশোনার কথা বলছি নাকি।

তো?

আমার বন্ধুরা সবাই বিয়ের আগে ক’ বার করে রুমডেট করছে জানো? এইটা খারাপ কিছু না।

আমার এসব পছন্দ না। এমন হলে বিয়ে ভেঙে দেন।

আচ্ছা বাদ দাও। তোমার জন্য আরও কয়টা শাড়ি নিছি। ছবি দিছি দেখো।

আচ্ছা দেখব।

ইয়ে মানে আরও কিছু কেনাকাটা বাকি আছে।

আর কি?

তোমার শাড়িগুলোর ব্লাউজ বানাতে হবে। মাপটা যদি বলতে। ভাবি চাইছিলো।

রাত্রির কান গরম হয়ে গেলো। ও বলল,

আমি ভাবিকে বলে দিব।

আমাকে বললে কি হবে। লজ্জা পাচ্ছো নাকি! আমি কি জানতে পারি না? কয়দিন পরতো আমাকেই সব দেখতে হবে।

আচ্ছা আমি রাখছি।

আরে শোনো,ভিডিও কলে আসো না একটু প্লিজ।

শুনুন আমি রাখছি। মা ডাকছে।

মাপটা তো বলো সোনামনি।

রাত্রি ফোন কেটে দিলো।

শাড়ির ছবিগুলো দেখতে ইচ্ছে করছে না। ফোন রাখতেই আরো একটা ছবি আসল।

একটা নুড ছবি। একটা ছেলের কোলে একটা নগ্ন মেয়ে বসে আছে। নিচে কামরুল লিখে পাঠাল,

এভাবে তোমাকে আদর করতে চাই।

রাত্রির কান্না পেলো। তার সাথে যাদের বিয়ের কথা হয় সবাই কি এমন উদ্ভট আর বাজে নাকি সব পুরুষই এমন!

জামশেদ সাহেব বাড়ি ফিরে দেখলেন গোধূলি বসার ঘরে বসে টিভি দেখছে। উনাকে দেখেই মাথায় ঘোমটা টেনে টুক করে পা ধরে সালাম করে বলল,

আব্বা কেমন আছেন , আপনার শরীর এখন কেমন?

তুমি কে? আর আমাকে আব্বা ডাকছ কেনো!

আমি আপনার ছেলের বৌ।

জামশেদ সাহেব বৌকে ডাকলেন,
সাবেরা,ও সাবেরা এদিকে আসো।
সাবেরা এসে গোধূলিকে ইশারায় ভেতরে যেতে বললেন। তারপর স্বামীকে সব কিছু বললেন।
জামশেদ ভীষণ রেগে গেলেন। কিন্তু গোধূলিকে কিছু বললেন না।

সাবেরাকে বললেন,

তোমার ছেলের কান্ড দেখেছ। ও আসলে বলে দেবে এই মেয়েকে নিয়ে যেন আমার বাসা থেকে চলে যায়। নিজেই যখন সবকিছু একা করছে তাহলে একাই চলুক। ওকেও আমাদের কোনো দরকার নেই।

গোধূলি সব শুনল। কিন্তু গায়ে মাখলো না। নিজের বাসার মতো ঘুরতে লাগল। নিজেই খাবার নিয়ে খেলো। বিকেলে চা বানিয়ে খেলো। রাতে সাবেরাকে বলল,

মা আপনার ছেলে কি ফোন দিয়েছে?

সাবেরা জবাব দিলেন না।

সাব্বির ফিরল চারদিন পর। বাসায় ঢুকেই দেখল মুখ থমথমে হয়ে আছে মায়ের। কিছু একটা হয়েছে।

সাব্বির কে দেখেই বললেন,

আসার সময় হলো? কোথায় ডুব মেরেছিলা?

কেনো কি হয়েছে?

ঘরে গিয়ে দেখ। যে ঝামেলা বাইরে বাধিঁয়েছো সেটা ঘরে হেঁটে এসেছে।

মানে কি! পরিস্কার করে বলো।

গোধূলি মেয়েটা বাসায় এসেছে। ওকে নাকি বিয়ে করেছিস?

সাব্বির বুঝল এখন মিথ্যা বললে পরিস্থিতি জটিল হবে।

হুম। বিয়ে করেছি। তো?

আজীবন কি তুই উলটা পালটা কাজ করেই যাবি।

কি উলটা কাজ করেছি। পছন্দ হয়েছে বিয়েইতো করেছি। অবৈধভাবে তো থাকছিনা।

সাবেরা চুপ করে গেলেন। এই ছেলে কোনোকালেই তার শাসন মানেনি।
কলেজে পড়ার সময় নীলা নামের এক মেয়ে মাঝে মাঝে বাসায় আসত।

সাব্বির বলত,ওরা নাকি রিডিং পার্টনার। একসাথে আলোচনা করে পড়ে। এতে নোট করতে ,বুঝতে সহজ হয়।

একদিন বিকেলে নীলা বাসায় আসল। সাব্বিরের রুমেই পড়ে ওরা। নীলা ছেলের রুমে গেল। সাবেরা নুডুলস করেছিলেন। ভাবলেন মেয়েটা যখন এসেছে রুমেই নাশতা দিয়ে আসেন। নাশতা নিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখলেন সাব্বির এর রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ভেতরে হাসির শব্দ। সাবেরা নিজেই লজ্জা পেলেন। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। বাসায় মা আছে তবুও তার ছেলে এমন কাজ করতে পারল ভেবে হতভম্ব হলেন তিনি। কলেজে ওঠার পর থেকেই সাব্বির একটু বেশি উগ্র হয়ে গেছে।‌ বাসাতেই রুমের দরজা বন্ধ করে সিগারেট খায়। সেই ধোঁয়া পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। রাতে দেরিতে ফেরে।‌ কিছু বললেও গা করে না। এই নিয়ে বাবা আর ছেলের মাঝে প্রায়ই ঝামেলা হয়।

নাশতার প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে ভাবলেন কি করবেন। নাশতা কি ফিরিয়ে নেবেন? ভাবতে ভাবতেই তিনি দরজায় নক করলেন। ভেতর থেকে সাব্বির বলল,

কে?

সাবেরা বললেন,

দরজা খোল।

দাঁড়াও।

একটু পর সাব্বির বেরিয়ে এলো। মেয়েটা ওড়না ঠিক করছে। চুলগুলো এলোমেলো।

এত জোরে কেউ দরজা ধাক্কায়, ডাকাত পড়েছে নাকি?

সাবেরার ইচ্ছে হলো ছেলের গালে চড় বসিয়ে দেন। কিন্তু ছেলে বড় হয়েছে। এখন গায়ে হাত তোলাটা অশোভন দেখায়। তাছাড়া বাইরের একটা মেয়ে আছে।

দরজা বন্ধ করেছিস কেনো?

কাজ ছিল।

সাব্বির তোর কি মনে হচ্ছে না বেয়াদবি করছিস তুই।

কিছুই হয়নি। তুমি বাড়াবাড়ি করছ।আমি বড় হয়েছি। আমার একটা প্রাইভেসি আছে। তুমি কি চাও বাইরে গিয়ে তোমাদের নাম ডুবাই।

মায়ের হাত থেকে নাশতার ট্রে নিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দিলো সাব্বির।
সাব্বির এর আচরণে থমকে গেলেন সাবেরা। এই ছেলেকে কিছু বলা মানেই সিনক্রিয়েট করা,লোক হাসানো। স্বামী কেও বলার সাহস পাননি। এ নিয়ে বাপ ছেলেতে তুলকালাম না হয়ে যায়। তাই স্বামীকে এসব কিছুই তেমনভাবে জানতে দেননি।

নীলাকে একদিন বলেছিলেন যে সাব্বির ছেলেমানুষ, কিন্তু তুমিতো মেয়ে। তোমার তো লজ্জা থাকা উচিত। এভাবে মেলামেশা করলে তোমার ক্ষতিই হবে। ঐ মেয়ে হেসে বলেছে,

কিছু চিন্তা করবেন না আন্টি। আমরা ভালো বন্ধু। একসাথে শুধু পড়াশোনা করি। আমার বাবার বন্ধুর ছেলে অস্ট্রেলিয়া থাকে। ওর সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আমার পড়াশোনা শেষ হলেই ওখানে চলে যাব। আপনার ছেলেকে আঁচলে বাঁধার আমার কোনো ইচ্ছা নেই। We are just having good times.

এমন আরও কত কাহিনী যে তার ছেলে করেছে। আর তিনি চুপচাপ সেসব হজম করে গেছেন। ভেবেছেন সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ পর্যন্ত কিছুই ঠিক হয়নি।

এখনতো গোধূলি ওর বিয়ে করা বৌ। কিই বা বলবেন উনি। লোক হাসানো ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হবে না। তাই আর কথা বাড়ালেন না। তবে তিনি এই মেয়েকে মানতে নারাজ। যেই মেয়ে নিজের বোনের কথা ভাবেনি,সেই মেয়ে কখনো ভালো হতে পারে না।

সাব্বির ঘরে ঢুকে দেখল গোধূলি কাপড় গোছাচ্ছে।

মেজাজ একটু খারাপ হলো ওর। মেয়েটার সাহস একটু বেশি। তাকে না বলেই এখানে চলে এসেছে। তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ওখানের বাসা ভাড়া, যাতায়াত এসবে হাঁপিয়ে উঠেছিল ও। এখন এখানে থাকুক। আর তেমন লুকোচুরি করতে হবে না। আর তাছাড়া ওখানে বাড়িওয়ালার ভাগ্নি নওমির সাথে এখন ঐ বাসায় গিয়ে দু একদিন ডেট করা যাবে। মাস শেষ হতে দেরি আছে এখনো। এডভান্সের টাকাটাও এখন বাড়ি ছাড়ার কথাটা জানিয়ে দিলে সমন্বয় করা যাবে।

তবুও রেগে গোধূলিকে বলল,

তুমি এখানে এসেছ কেনো?

গোধূলি কাছে এসে টাই খুলে দিতে লাগল।

আপনি একদিনের কথা বলে কোথায় ছিলেন? ফোনেও পাচ্ছিলাম না।

আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছিল। আর তোমার নাম্বার মুখস্থ ছিলো না তাই জানাতে পারিনি। কিন্তু তুমি হুট করে এ বাড়িতে উঠলে কেনো।‌ কত কথা এখন শুনতে হবে আমাকে? দুটা দিন সহ্য হলো না?

কিছু হবে না। কে কি বলবে? এক দুইদিন পর মা বাবার রাগ কমে যাবে।

আমার অনুমতি ছাড়া এখানে এসে একদম ঠিক করোনি তুমি। এমন যেন আর না হয়।

আচ্ছা আর এমন হবে না। আপনাকে না বলে কিছু করবো না।

হুম,কথাটা মাথায় রেখো। আর ও বাসায় কিছু বলে এসেছ? এখানে যে আসবে এমন কিছু বলেছ কাউকে?

না।

আচ্ছা ঐ বাসাটা তাহলে ছেড়ে দেব।

গোধূলি মাথা নাড়ল। যাক,আপাতত এ বাড়িতে তো তার অধিকার এর জায়গাটা পাকা হলো। এখন আর কোনো ভয় নেই।

সন্ধ্যায় জামশেদ সাহেব এসে চিৎকার শুরু করলেন।

সাবেরা, তোমার ছেলেকে বলো এখুনি বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে। অপদার্থ একটা ছেলে। যা খুশি তাই করে বেড়াবে আর আমাদের সেসব মানতে হবে নাকি। মগের মুল্লুক পেয়েছে!

সাবেরা স্বামীকে শান্ত হতে বললেন।

সাব্বির রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল,

বাবা,আমিতো নিজে নিজে জন্ম নেইনি। আপনি জন্ম দিয়েছেন। তাই এ বাড়িতে আমার অধিকার আছে। আপনি বললেও আমি বের হবো না। পারলে পুলিশ ডেকে বের করুন। এভাবে শুধু শুধু চিৎকার করে নিজের প্রেশার বাড়ানো ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হবে না। তাই চুপ থাকুন।

দেখেছ,কত বড় বেয়াদব ছেলে। একে আমি ত্যাজ্য করব বলে দিলাম।

সাবেরা স্বামীকে অনেক অনুনয় করে শান্ত করালেন।

তিনি বুঝিয়ে বললেন,

ছেলেতো ছোট নেই। বড় হয়েছে, বিয়ে করেছে পছন্দ করে। কি করবেন বলেন। যুগটাই এমন। আপনি এটা নিয়ে চেঁচামেচি করবেন না আর।

রাতে খাবারের পর ঘরে এসে গোধূলি দেখল সাব্বির ল্যাপটপে কিছু একটা কাজ করছে। ও ভেবেছিল কয়দিন পর এসে গোধূলিকে কাছে পেতে অধীর হয়ে থাকবে। কিন্তু কেমন আলগা আলগা লাগছে ওনাকে।

গোধূলি আলমারি খুলে একটা নাইটি নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। জামা ছেড়ে নাইটিটা পরে নিল। হালকা সাজগোজ করল। আজ সাব্বিরকে পাগল করবে ও। বেচারা রেগে গেছে ওর ওপর। তবে ওকে আয়ত্তে আনার মন্ত্র জেনে গেছে গোধূলি। বাইরে এসে গোধূলি দেখল সাব্বির শুয়ে পড়েছে।‌সাব্বিরের কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল গোধূলি।‌ সাব্বির ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

খুব ঘুম পাচ্ছে আমার। বিরক্ত করোনাতো।

ছেলেকে শাসন করতে না পেরে মনে মনে গোধূলির ওপর রেগে থাকলেন সাবেরা। পরদিন গোধূলি সাব্বিরের সাথে নাশতার টেবিলে আসল। সাবেরা বললেন,

নতুন বৌ উঠেছে এতো বেলা করে,এতো নবাবী চাল হলে চলবে? তোমাকে কি আমি রান্না করে খাওয়াব? এ বাসায় সবাই চাকরি করে। একমাত্র তুমিই বাড়িতে থাকবে। সব কাজকর্ম তোমাকেই তো করতে হবে। বিয়ে করে আমার ছেলের সাথে যখন সংসারে এসেছ তখন সংসার সামলানোর সব ভার হাতে নাও।
গোধূলি সাব্বিরের দিকে তাকাল। ও চুপচাপ শুনছে।

গোধূলি বলল,

আমারতো সকালে ওঠার অভ্যাস নাই। সকালে উঠলে মাথা ব্যথা করে।

এতো বেলা করে ঘুমালে কাজ করবে কে?

কাজের লোকতো আছে মা। আমি সব কাজ ঠিকমত করতেও পারি না।

কিছুই পারো না অথচ বিয়ে করে বসে আছো। না আছে পড়াশোনা,না জানো কাজ। তোর বৌকে তাহলে শোকেসে তুলে রাখ।

সাব্বির এবার মুখ খুলল,

শোনো,কাল থেকে মায়ের সাথে সাথে কাজে সাহায্য করবে। সকাল সকাল এসব নিয়ে ঝামেলা ভালো লাগে না।

সাবেরা দু’দিন পর কাজের মেয়েকে বিদায় দিলেন। এই মেয়ে যখন শখ করে বৌ হয়ে এসেছে তখন মজা বুঝুক। বসে বসে এ বাড়িতে খেতে দেবেন না। বাইরে যাবার সময় নিজের ঘরে তালা দিয়ে গেলেন। হঠাৎ করে এই মেয়ের হাতে বাসা ছাড়তেও মন চাইছে না ওনার।

সাব্বির যত খারাপই হোক সংসারের এসব বিষয়ে নাক গলাবে না এটা উনি জানেন। তাই গোধূলি এসব নিয়ে ছেলের কানভারী করে সুবিধা করতে পারবে না।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-১১

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১১

সাব্বির আজ চট্টগ্রাম যাবে। অফিসের কি একটা কাজ আছে। গোধূলিকে সাবধানে থাকতে বলল। কিছু লাগলে পাশের স্টোর থেকে আনিয়ে নিতে বলল।

এমনিতেও গোধূলিকে মাঝে মাঝেই একা থাকতে হয়। কিন্তু আজকের বিষয়টা আলাদা। এই শহরের বাইরে যাচ্ছে সাব্বির। গোধূলির একটু অস্থির লাগছে। ও বলল,

আমিও যাই আপনার সাথে?

তুমি গিয়ে কি করবে?

না মানে একা থাকতে ভয় করবে।

কি যে বলো,ভয় কিসের? সিকিউরিটি গার্ড আছে, বাড়িওয়ালা আঙ্কেল তো বেশ ভালো। কোনো সমস্যা হবে না আশা করি। আর তুমি তো একাই থাকো মাঝে মাঝে।

আমি গেলে কি সমস্যা?

আমি সারাদিন মিটিং এ থাকব। শেষ হলেই রাতের বাসে উঠব। শুধু শুধু তুমি কেনো জার্নি করতে যাবে বলোতো। একটাইতো দিন।

আচ্ছা ঠিক আছে যান।‌ জলদি চলে আসবেন।

আচ্ছা আসব।

একদিনের কথা বলে গেলেও তিনদিন পেরিয়ে গেল।‌ সাব্বিরের কোনো খবর নেই। তার ওপর আবার ফোনে কল যাচ্ছেনা। ওর নাম্বার ব্লক দেখাচ্ছে। গোধূলি চিন্তায় পড়ে গেল। এমনতো কখনো হয়না।

দু’দিন অপেক্ষার পর গোধূলির আর ভালো মনে হলো না বিষয়টা। কেমন একটা সন্দেহ কুঁড়ে খাচ্ছে ওকে। আজকাল সাব্বির প্রায়ই নিজের বাসায় থেকে যায়। গোধূলির একাই এ বাড়িতে পড়ে থাকতে হয়। ছাদের ওপর এই রুমের একটাই মেইন দরজা। গোধূলির কোনো কোনো রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়, ভীষণ ভয় পায় ও। আর এভাবে ব্লক করার কারণে আরও বেশি খারাপ চিন্তা মাথায় আসছে। সাব্বির কি ওর কাছে আর আসবে না!

তবে ওতো বাসার ঠিকানা জানে। এমন করলে গোধূলি বাসায় গিয়ে হাজির হবে এটাতো সাব্বির জানে। গোধূলি চট করে ঠিক করল এইটাই সুযোগ শশুড় বাড়িতে গিয়ে ওঠার। ফোনে না পেয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে বাসায় চলে এসেছে এটা বলা যাবে সাব্বিরকে।

ও পরনের কাপড় গুছিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী সাব্বিরদের বাড়িতে চলে গেল।

সাবেরা স্কুলে ছিলেন। ফিরে দেখলেন একটা মেয়ে ব্যাগ হাতে মাথায় ঘোমটা দিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গোধূলির নাম শুনলেও কখনো দেখেননি। তাই চিনতে পারলেন না।

কাছে আসতেই গোধূলি সালাম দিল,

আসসালামুয়ালাইকুম।

সালামের জবাব দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

কাকে চাই?

আমি গোধূলি।

এবার বুঝতে পারলেন। তবুও না চেনার ভান করে বললেন,

কোন গোধূলি? রাত্রির বোন গোধূলি?

জ্বি।

তা এখানে কি দরকার?

সাব্বির কি বাসায়? ওনার খোঁজে এসেছি।

নাতো, ওর কাছে কি দরকার তোমার!

উনি আপনাকে কিছু বলেননি?

কি ব্যাপারে?

আমাকে উনি বিয়ে করেছেন।

এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন সাবেরা। তার সন্দেহ আর গুজব সত্যি তাহলে। এই মেয়েকে বিয়ে করেছে তার ছেলে।
সাবেরা চারদিকে তাকালেন। কেউ আবার দেখলো কিনা বুঝতে পারছেন না। নাহ, আশেপাশে কেউ নেই।

কতক্ষণ হয় দাঁড়িয়ে আছো?

আধ ঘন্টা হবে।

আশেপাশের কেউ কিছু জানতে চেয়েছে?

না।

আচ্ছা ভেতরে এসো।

গোধূলি সাবেরার পেছন পেছন ভেতরে গেলো।

ভেতরে ঢুকেই সাবেরা বললেন,

কতদিন হয় বিয়ে হয়েছে?

তিনমাস।

কোথায় বিয়ে করেছ?

চট্টগ্রামে।

রেজিস্ট্রি হয়েছে? কাবিন কত?

গোধূলি বানিয়ে বলল,

দশ লাখ।

কেমন মেয়ে তুমি। বোনের পাত্রের সাথে পালিয়ে গেলে।

উনিইতো আমাকে পছন্দ করল।

অচেনা পুরুষ মানুষ পছন্দ করল আর তুমি পালিয়ে গেলে। বোনের কথা ভাবলেও না একবার।

গোধূলি চুপ থাকল। ভাবল এসব নিয়ে তর্ক করার দরকার নাই।

এখন এই বাসায় কি চাও? নিজেরা বিয়ে করছো যখন তখন একাই থাকতে। এখানে কেনো এসেছ?

উনাকে দু’দিন থেকে ফোনে পাচ্ছি না।

মানে কি, ও তোমার সাথে থাকে না?

থাকেন, দু’দিন হলো চট্টগ্রামে গেছেন অফিসের কাজে।

কাজে গেছে চলে আসবে। তারজন্য বাড়িতে চলে আসতে হবে?

একদিনের কথা বলে গেছেন এখন ফোনে আমার নাম্বার ব্লক করা।

সাবেরা ছেলের এই স্বভাব জানেন। আগে থেকেই কয়েকদিনের জন্য না বলে উধাও হতো ছেলে। তাই তাকে তেমন চিন্তিত দেখা গেলো না। বরং মনে মনে খুশি হলেন। এই মেয়ে সাব্বিরকে আঁচলে বাঁধুক এটা তিনি চান না। দু’দিন গেলেই ঘোর কেটে যাবে। কিন্তু এতগুলো টাকা কাবিন করতে গেলো কেনো!

তিনি বললেন,

তুমি বাসায় ফিরে যাও। এই বাড়িতে তোমাকে মেনে নেবার কোনো ইচ্ছা আমাদের নাই। সাব্বির তোমাকে একা বিয়ে করেছে তাই তোমাকে একাই ওর সাথে থাকতে হবে। তবে আমি বলি কি, যা করেছ করেছ। এখনো তেমন কিছু হয়নি। তুমি বাসায় চলে যাও। আমার ছেলের কতদিন তোমাকে ভালো লাগবে তার ঠিক নেই।

আমাকে বাসায় জায়গা দেবে না।

তাহলে যেখানে ছিলে সেখানে যাও।

উনি আসলেই চলে যাব। ততদিন এখানে থাকব।

সাবেরা বুঝলেন এই মেয়ে ভয় পাবার মেয়ে না। কেমন ঠাস ঠাস করে কথা বলছে। কোনো জড়তা নেই। ইচ্ছা করছে ঘাড় ধরে বের করে দিতে। কিন্তু কি না কি করে বসে। দেখা যাবে বাইরে গিয়ে সাংবাদিক ডেকে অনশন করবে। সেই নিউজ ভাইরাল হবে। মান সম্মান কিছু থাকবে না তখন। আজীবন ছেলের কুকীর্তি লুকাতে হয়েছে তাকে। এবারেও তাই করতে হবে। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

আচ্ছা থাকো। তবে সাব্বির এলে সাথে সাথেই চলে যাবে। আর কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। কেউ বললে বলবে আমাদের আত্মীয় তুমি। এখানে কোচিং করতে এসেছ।

আচ্ছা।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে রাত্রি দেখল বসার ঘরে বেশ কয়জন অচেনা অতিথি। মা ডাইনিং টেবিলে নাশতার প্লেট সাজাচ্ছেন । রাত্রিকে দেখে বললেন,

এসেছিস,যাতো মা জলদি ফ্রেশ হয়ে আয়।

কি হয়েছে মা?

হঠাৎ করেই তোকে দেখতে এসেছেন এনারা। ছেলে ব্যবসা করে। অবস্থা ভালো। তোর আব্বার কলিগ রায়হান ভাইয়ের আত্মীয়।

এভাবে না বলে আসবে তাই বলে?

কি করব বল,এসে যখন পড়েছে তাড়িয়ে তো দিতে পারিনা।

রাত্রি বোঝে মায়ের এই অসহায় ভাবের কারণ। বেশ কয়টা ঘর এসেছে রাত্রির জন্য কিন্তু কেউ আগায়নি যখন শুনেছে ছোট বোন পালিয়ে বিয়ে করেছে। কিভাবে যেন রটে গেছে যে রাত্রির প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে গোধূলি। মেয়েকে নিয়ে তাই চিন্তায় আছেন নাজমা। বাবাও অসুস্থ হয়ে ছুটি নিয়ে বাড়িতেই আছেন। রাত্রির বিয়েটা হয়ে গেলে অনেকটাই টেনশন মুক্ত হবেন ওনারা। রাত্রি তাই কথা বাড়ায়না। ঘরে ঢুকে ব্যাগ রেখে বিছানায় বসে পড়ল।

রাত্রির কেনো জানি হঠাৎ আয়ানকে মনে পড়ল। কি আশ্চর্য ওর সাথে কি আয়ানের তেমন কিছু ছিল? অথচ মন খারাপ লাগছে ওর। খুব অভিমান হচ্ছে আয়ানের ওপর। এভাবে কেন চলে গেল ছেলেটা! অথচ থাকারও তো কথা ছিলো না। কি বোকা বোকা অনুভূতি হচ্ছে ওর!

রাত্রি গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলো। কিন্তু মনখারাপ ভাবটা গেলো না ওর। নাশতা নিয়ে ঘরে ঢুকে সালাম দিলো। রাত্রির খালাত ভাই কথা বলছে অতিথিদের সাথে। উনি নাশতার প্লেট নিজের হাতে নিয়ে রাত্রিকে বসতে বলল। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ছেলেও এসেছে। সাথে ছেলের মামা, দুলাভাই,বাবা আর বড় ভাই এসেছে। আরো এসেছে ছোট বোন। ওনারা রাত্রির নাম, পড়াশোনা কোথায় করেছে,এখন কোথায় চাকরি করে এসব জানতে চাইল।

ছেলে একপাশে চুপ করে বসে আছে। রাত্রি একফাঁকে দেখল ছেলেটাকে। শ্যামলা,বেশ স্বাস্থ্য ভালো। রাত্রি উঠে গেল একটু পর। ভীষণ মাথা ধরেছে ওর।

নাশতা করার পর ছেলের সাথে আলাদা করে কথা বলতে হলো রাত্রিকে। বাসার ভেতরের দিকের বড় বেলকনিতে দু’জনের বসার ব্যবস্থা করা হলো।

রাত্রি চুপ করে আছে। ছেলেটাই আগে কথা বলল।

আমি কামরুল, ভালো নাম মোহাম্মদ কামরুল হাসান। আপনার ভালো নাম?

আমার ভালো খারাপ একটাই নাম,রাত্রি।

আগে পরে কিছুই নাই?

জ্বি না।

ইসলামী নাম আছে কত ভালো ভালো। অন্তত মোছাঃ তো থাকতে হয়। শুধু রাত্রি নামটা একটু কেমন যেন। আচ্ছা হোক,আপনিতো স্কুলে মাস্টারি করেন?

জ্বি আমি টিচার।

আমাদের বংশে আবার চাকরি বাকরির বালাই নাই। চাকরি করা পোষায়না। কয়টা আর টাকা চাকরির। আমাদের কাপড়ের বিজনেস আছে।

আচ্ছা।

কাপড়ের ব্যবসা দেখে ছোট ভাবিয়েন না। বিশাল দোকান। একপাশে রেডিমেড, থ্রিপিস,শাড়ি,শার্ট প্যান্ট,আরেকপাশে থানকাপড়। আবার অনলাইন পেইজ আছে একটা। দুইটা বড় গোডাউন আছে।

বেশ ভালো।

দাদার আমলের ব্যবসা। খানদানি ব্যবসা বলতে পারেন।

রাত্রির বিরক্ত লাগছে। এই ছেলে তার দোকানের বাইরে আর কোনো কথাই বলছেনা।

অবশ্য আপনাদের বাসার পজিশন ভালো। এখানেও একটা শোরুমে দিলে ভালো চলবে।

রাত্রি মাথা নাড়ল।

আপনে বেতন কত পান?

কি ম্যানারলেস! বেতনের কথা এভাবে কেউ জানতে চায়? রাত্রি বলল,

এই চলে যায়।

যা ভাবছিলাম, বলার মতো না। মাস্টারির চাকরির আর কত বেতন! যাক,বিয়ের পর আর কষ্ট করতে হবে না। তাছাড়া আমার বাপ ভাইয়েরা মেয়েদের বাইরে কাজ করা পছন্দ করেনা। তাদের কথা হলো‌ মেয়েরা করবে সংসার। আর রাতে স্বামীর মনোরঞ্জন। বাইরে গিয়ে পুরুষ মানুষের গাইগুতা খেয়ে টাকা কামানোর কি দরকার। এসব করবে বাজারি মেয়েলোকেরা। টাকা কামাই করবে পুরুষ লোক। যেই পুরুষ মেয়েদের কামাই করায় হেইডা বেডা না বেইট্যা।

রাত্রির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এ যুগে এসেও কি চিন্তা ভাবনা। রাত্রি বলল,

আপনি ভুল জানেন। ছেলেমেয়ে যেকেউ কাজ করলে সেটা খারাপ কিছু না। এটা আসলে আত্মসম্মানের বিষয়। স্বনির্ভর হবার বিষয়। মেয়েরা শুধু মনোরঞ্জনের খেলনা না।

আইচ্ছা থাক। এটা নিয়ে আলাপ না করি। বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েমানুষ ভালো ভালো পোশাক আর গয়না পাইলেই খুশি। আমাদের বাড়ির মেয়েদের জামাকাপড়ের আল্লাহ দিলে বাহার দেখলে বুঝবেন। গাইট খুলে সেরা কাপড় আগে বাড়ির মেয়েরা রাখে। এইদিকে কোনো কিপটামো চলেনা।

রাত্রি হাসল। এই ছেলের জীবন কাপড়ের গাইটে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে নাকি আবার পড়াশোনাও করেছে। অথচ চিন্তা ভাবনায় তার কোনো ছাপ নাই।

ছেলেরা চলে গেল। রাত্রি কিছু বললো না। বাবা অসুস্থ। কোনো কিছু নিয়েই পরিবেশ খারাপ করা যাবে না। যা তার কপালে আছে তাই হবে। তার হয়তো এই ছেলের সাথে বিয়ে লেখা। বাসর রাতে এই ছেলে হয়তো তাকে যে বিয়ের শাড়ি দেয়া হয়েছে সেটার গুনগান করবে। শাড়ির সুতা,পাকারঙ এসব নিয়ে গল্প করতে করতে রাত ভোর হয়ে যাবে।

রাত্রি মনখারাপের মাঝেও হেসে ফেলল একা একা।

রাতে পাত্রের বাড়ি থেকে কল দিয়ে জানাল মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। আগামী শুক্রবার এনগেজমেন্ট করে ডেট ফাইনাল করতে চায় ওরা।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-১০

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১০

সাব্বির আর গোধূলির সংসার জীবনের একমাস কেটে গেলো।‌ সংসার বলতে গোধূলিকে একা একাই সারাদিন থাকতে হয়। টুকটাক রান্না আর ঐ একটা রুমে খাট,রান্নার হাড়ি পাতিল,কাপড় গুছিয়ে রাখা। সারাদিন আর কোনো কাজ নেই। গোধূলি মোবাইলে সময় কাটায়। ইউটিউবে রান্নার ভিডিও দেখে,নাটক সিনেমা দেখে। সাব্বির কে মেসেজ করে। সাব্বির অনেক দুষ্টুমি করে। মাঝে মাঝে নুড অবস্থায় ওকে দেখতে চায়। তখন গোধূলি দরজা জানালা লাগিয়ে ভিডিও কলে আসে। সাব্বির নেশা নেশা চোখে তাকিয়ে থাকে।

সাব্বির রোজ এই বাসায় থাকে না। যেদিন করে আসে অনেক রাত হয়ে যায়। কোনো কোনো দিনে নেশা করে আসে ও। মাতাল সাব্বির ভীষণ এগ্রেসিভ আচরণ করে বিছানায়। আরো কিছু অদ্ভুত আচরণ করে সাব্বির।‌কিছু পাতলা ফিনফিনে নাইটি এনেছে গোধূলির জন্য। রাতে ওসব পরে থাকতে হয় ওর সামনে। এসব অবশ্য গোধূলির খারাপ লাগে না।

বাড়িতে বিয়ের কথা কিছু বলেনি সাব্বির। মনিকে বারণ করে দিয়েছে কাউকে কিছু বলতে। এর ওর কাছে থেকে বাবা মা শুনেছেন যে গোধূলি নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে আর এর পেছনে তার ছেলের হাত আছে। সাব্বিরের বাবা জামশেদ ছেলেকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করেননি। তার ছেলেটা ছোট থেকেই উচ্ছৃঙ্খল। মুখে মুখে তর্ক করে। স্ত্রীকে বললেন, ছেলের কাছে থেকে ঘটনা কি তা শুনতে। সাবেরা ছেলেকে একদিন বললেন,

গোধূলির ঘটনাটা কি। ও নাকি পালিয়ে গেছে। ঘটক তোর কথা বললেন সেদিন। তুই জানিস কিছু?

নাতো আমি তো কিছু জানি না।

ছেলে এক কথায় না বলে দিল। তবে সাবেরার সন্দেহ দূর হলো না। ছেলে রাতে মাঝে মাঝে বাইরে থাকে। বলে অফিসের কাজে গাজীপুরে যেতে হয়। বিশ্বদ্যালয়ের কি একটা প্রজেক্ট শুরু হবে ওখানে। ওটার জন্যই ওদিকটায় থাকতে হবে মাঝে মাঝে। সাবেরা এটা ভেবে চুপচাপ থাকলেন যে বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়নি। ঐ মেয়েকে অন্তত বৌ করে ঘরে তুলে আনেনি ছেলে। খুব জলদি একটা সুন্দর চাকরি করে এমন মেয়ে দেখে ছেলেকে বিয়ে করাবেন ঠিক করলেন।

গোধূলি মোটামুটি যেসব না হলেই না সেসব কিছু কিনেছে। তবে আরও কিছু দরকারি জিনিস,ঘর সাজানোর জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে হবে। কিন্তু সাব্বির রাজি হয়না। বলে এখানে এত জিনিস কেনাকাটা করার দরকার নাই। কয়দিন গেলেই তো বাসায় চলে যাব আমরা।

পড়াশোনার বিষয়ে সাব্বির কিছু বলেনি। গোধূলিও চুপ থেকেছে। পড়তে তার ভালো লাগেনা আগে থেকেই। তবে এখন মনে হয় সংসার করাটাও কম ঝামেলা না।

তবে সাব্বির যখন রাতে কাছে টেনে নেয় তখন সব কিছু সুন্দর মনে হয়। এইতো সেদিন এসে একটা প্যাকেট হাতে দিয়ে বলল,

এটা তোমার জন্য। খুলে দেখো।
গোধূলি প্যাকেট খুলে দেখল একটা সুন্দর শাড়ি আর সাথে ম্যাচিং চুরি, কানের দুল।

এসব পরে আসো। বাইরে ঘুরতে যাব।
গোধূলি সেজেগুজে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেই লজ্জা পায়। ওকে ভীষন সুন্দর লাগছে। সাব্বির ওকে দেখেই বিছানা থেকে উঠে এসে ওয়াও বলে ওঠে। মোবাইলে অনেক ছবি তোলে নানা পোজে। তারপর বলে,

তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো লক্ষী বৌ?

কখনও না।

তোমার কাজলটা দাওতো।

কি করবে?

আহা দাওতো।

তারপর কাজলের পেন্সিল দিয়ে ওর থুতনিতে ছোট একটা দাগ কেটে বলে,

এতো সুন্দর বৌটার যেন নজর না লাগে কারও। কেউ যেন কেড়ে না নেয়।

এভাবেই দিনগুলো স্বপ্নের মতো কাটতে লাগল। সাব্বির ওকে একদিন বলল,

তুমি তো একা একাই থাকো। একটা কিছু করতে পারো তো।

কি করব?

এখানেই পাশে ছোটদের একটা কোচিং সেন্টার আছে। ওখানে পড়াবে? আমার এক বন্ধুর ওটা।

আমাকে নেবে ওখানে?

আমার বন্ধুরতো। বললেই নেবে।

গোধূলি রাজি হয়ে গেল। সারাদিন একা থাকার চেয়ে সময় কাটবে ওখানে গেলে। কিছু হাতখরচাও পাওয়া যাবে।

প্রায় দু’মাস কেটে গেল। সাব্বির সপ্তাহে দু-তিন দিন গোধূলির কাছে আসে। এ বাসায় আরো কয়জন ভাড়াটিয়া আছে। যেতে আসতে দেখা হয়। টুকটাক কথাবার্তা বলে দোতলার এক ভাবী। তবে সাব্বির কারো সাথে বেশি মিশতে নিষেধ করে দিয়েছে।

বাসার ছাদে ভাড়াটিয়াদের ওঠা মনে হয় নিষেধ। বাড়িওয়ালার এক ভাগ্নি আছে সে আসে মাঝে মাঝে। তবে গোধূলির সাথে কথা বলে না তেমন। একদিন গোধূলি নিজ থেকে জানতে চাইল,

আপু,আপনি ক’ তলায় থাকেন?

মেয়েটা বলল,

তিনতলায়। বাড়িওয়ালা আমার মামা।

আর কিছু না বলে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। গোধূলিও আর তেমন কথা বলল না। তবে একদিন সকালে ও ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। সাব্বির যখন অফিসে যায় গোধূলি ছাদের রেলিং এ দাঁড়িয়ে দেখে।

গোধূলি দেখল সাব্বির আর ঐ মেয়ে একসাথে বেরুল। তারপর দাঁড়িয়ে বেশ কিছু সময় কথা বলল দু’জন। সাব্বির কি যেন বলছে আর মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে সাব্বির আগে থেকেই চেনে ওকে। গোধূলির কাছে বিষয়টা কেমন যেন ঠেকল। ওর সাথে সেদিন কথাই বললো না মেয়েটা অথচ সাব্বিরের সাথে কত হেসে কথা বলছে।

একদিন কোচিং থেকে এসে দেখে ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে বাড়িওয়ালার ভাগ্নি বসে গল্প করছে সাব্বিরের সাথে। অথচ এসময়তো সাব্বির আসে না সাধারণত। গোধূলি সাব্বিরকে বলল,

আপনি কখন এসেছেন?

এইতো একটু আগে। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে।

আমিতো এই সময় থাকি না। তা ফোনতো দিতে পারতেন।

না মানে এদিকে একটা কাজ ছিল,জলদি শেষ হয়ে গেল তাই ভাবলাম আজ তোমাকে নিয়ে বাইরে যাব।

অথচ আমাকে না জানিয়ে বসে গল্প করছেন। আর আপনি এখানে? কোনো দরকার ছিল। আমার সাথেতো কথাই বলেন না অথচ আমার বরের সাথে দিব্যি কথা বলছেন একা ঘরে।

না মানে ছাদে এসে দেখলাম সাব্বির ভাই দাঁড়িয়ে তাই এলাম।

অমনি একা ঘরে পরপুরুষের সাথে হাসাহাসি করতে লাগলেন।

সাব্বির ভীষণ রেগে উঠল।

গোধূলি এটা কি ধরণের অসভ্যতা। এভাবে কেউ কথা বলে অতিথির সাথে। সরি বলো।

আমি কেনো সরি বলব। ভুল কিছু তো বলিনি।

মেয়েটা ডিসগাস্টিং বলে রেগে বেরিয়ে গেল।

সাব্বির মেয়েটার পিছনে পিছনে নিচে নেমে গেল।

গোধূলির বিষয়টা ভালো লাগল না। একা ঘরে মেয়েটা কেনোই বা ঢুকবে। আর এত হাসাহাসি করার কি আছে। আর এদিকে গোধূলিকে রেখে ঐ মেয়ের সাথে সাব্বির চলে গেল। ওকে বলল সরি বলতে। বৌয়ের থেকে বাইরের একটা মেয়ে বেশি হলো ওর কাছে!

সাব্বির ফিরল রাত করে। গোধূলি কোনো কথা বললো না। সাব্বির ওরজন্য গোলাপ নিয়ে এসেছে। কিন্তু গোধূলির মুখ দেখে বুঝল রেগে আছে। নিজেই সরি বলল তখনকার বিহেভের জন্য। গোধূলি নরম হলো।

আরো কিছুদিন পরের ঘটনা। রাতে ঘুম ভেঙ্গে গোধূলি দেখল সাব্বির পাশে নেই। বেলকনিতে খুব আস্তে কারো সাথে কথা বলছে ফোনে। গোধূলি উঠে বসে কান পাতল। কার সাথে যেন রেগে কথা বলছে। গোধূলি উঠতে যাবে এমন সময় ঘরে ঢুকল সাব্বির।

ঘুম ভেঙ্গে গেলো?

হুম,কার সাথে কথা বলছিলেন।

আমার এক বন্ধু কল করেছিল।

ও আচ্ছা।

তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।

আরে না, সমস্যা নাই।

গোধূলি সাব্বিরকে বলল,

আমরা বাড়ি কবে যাব?

কেনো,এখানে কি সমস্যা হচ্ছে?

সমস্যা না তবে একা একা থাকতে ভালো লাগে না।

একটু সময় দাও। মাকে বলেছি বিয়ের কথা। বাবাকে বলা হয়নি এখনও। মা বলেছেন উনি বাবাকে বুঝিয়ে বলবেন। ক’টা দিন যাক।

আচ্ছা ঠিক আছে।

একদিন দুপুরে সাব্বির গোসলে গেছে। এমন সময় ওর মোবাইলে টুং শব্দে মেসেজ আসল পরপর কয়টা। গোধূলি দেখল ওর শাশুড়ি সাব্বিরের মা মেসেজ করেছেন। গোধূলি ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখল একটা মেয়ের ছবি পাঠিয়েছেন উনি।

নিচে লেখা,

এই মেয়েটা কেমন দেখতো। তোর পছন্দ হলে সামনের শুক্রবার দেখতে যাব।

গোধূলি কিছুই বুঝতে পারলো না। উনি তো জানেন যে গোধূলিকে বিয়ে করেছে তার ছেলে তাহলে এভাবে মেয়ের ছবি পাঠালেন কেনো। তাহলে কি সাব্বির বাড়িতে কিছুই জানায়নি। সাব্বির বের হয়ে দেখল গোধূলি ফোন হাতে বসে আছে।

আপনার মা মেসেজ পাঠিয়েছেন।

দাও দেখি।

সাব্বির মেসেজ দেখে গোধূলিকে বলল,

ও আচ্ছা। আমার মামাতো ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে। ও আবার বলেছে যে আগে আমি দেখব। আমার পছন্দ হলে তবেই ও দেখতে যাবে। তাই মা আমাকে মেয়ের ছবি পাঠিয়েছেন।

কিন্তু গোধূলির মনে খচখচানি থেকেই গেলো। সাব্বির সত্যি বলছে না মিথ্যা বলছে এটা নিয়ে দ্বিধা থেকে গেল।
এদিকে বাসায় নিয়ে যাবার কোনো চিন্তাও নেই সাব্বিরের। প্রথমে গোধূলি ভেবেছিল এভাবে একার সংসার ভীষণ সুখের। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শশুড় বাড়িতে যাওয়া দরকার। এখানে এভাবে পড়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। নিজের অধিকারের জায়গা বুঝে নিতে হবে ওকে।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-০৯

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৯

আয়ান টিচার্স রুমে বসে একটা বই পড়ছিল। রুহিয়া পাশে এসে বসল।

রাত্রি ম্যামের বাবাকে নাকি দেখতে গিয়েছিলেন,এখন কেমন আছেন উনি?

হুম, আঙ্কেল এখন মোটামুটি সুস্থ আছেন।

শুনলাম রাত্রির প্রেমিকের সাথে ওর ছোট বোন পালিয়ে গেছে,এই চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক। কেমন পরিবাররে বাবা! এক ছেলেকে নিয়ে দুইবোনের টানাটানি।

এসব কে বলেছে আপনাকে?

আরে এসব কথা বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। বলতে হয়না। অদ্ভুত সব কাহিনী তো বুঝলেন না!

আমরা মনে হয় টিপিক্যাল বাঙালির মতো গিবত করছি।

আরে না সত্যি ঘটনা বললে দোষের কি? সবার জানা উচিত কে কোন পরিবেশ থেকে এসেছে।

আপনার কি মনে হয়না আপনি অযথাই একজনের নামে কুৎসা রটাচ্ছেন। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে অন্যের পরিবার নিয়ে এ ধরণের উক্তি করা একদম ছোট মনের পরিচয়। আর তাছাড়া যেখানে ওনার ওপর দিয়ে রীতিমত একটা ঝড় বয়ে গেছে। এসময় ওনাকে নিয়ে এমন আলোচনা একেবারেই অমানবিক।আশা করি আপনি আমার সাথে,না ভুল বললাম,অন্য কারো সাথে অন্যের‌ ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে এমন নিন্দা করে নিজের ছোট মনের পরিচয় দিবেন না।

রাত্রিকে দেখেই আয়ান হাসিমুখে এগিয়ে এলো। রাত্রি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

রাত্রি একটু কথা ছিলো আপনার সাথে।

আমার ক্লাস আছে।

বেশি সময় নেবনা।

দেখুন আয়ান আমার সাথে আপনার এতো কি কথা বলুনতো। আর কারো সাথে তো আপনি এতো গায়ে পড়ে কথা বলেননা?

এতো রেগে আছেন, কি হয়েছে? আর কি বলছেন এসব!

ঠিক বলছি। আপনার এমন গায়ে পড়ে কথা বলার জন্য আমাকে বিব্রত হতে হচ্ছে। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করুন।

কিন্তু আমিতো,,

আমি আশা করব দরকার ছাড়া আমরা কথা বলবো না। আমি আপনার বন্ধু না আয়ান। আমরা শুধু কলিগ। তাই ফর্মাল বিহেভ করবেন।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল রাত্রি।

আয়ান হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

সাব্বিরের কাজিন মনির বর একটা গার্মেন্টসে এজিএম পোস্টে জব করে। মনি পুরোপুরি গৃহিণী। বেশ মিশুক মেয়েটা। এখনও বাচ্চা কাচ্চা হয়নি। এটা নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ মনখারাপ করে থাকে।
বিয়ের চার বছর হয়ে গেছে অথচ এখনও ছেলেপুলে হয়নি বলে শশুড়বাড়িতে কথা বলা শুরু হয়ে গেছে।

মনি গোধূলিকে বলল,

শোনো মেয়ে, তোমার বয়স কম। তবুও বিয়ে যখন করেছ বাচ্চা নিয়ে নিও। কনসিভ করলে এবরশন করাতে যেওনা। আমাকে দেখো, বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে কনসিভ করলাম। তোমার ভাইয়া বলল এত জলদি বেবি নেয়ার দরকার নাই। সে আরও কিছু সময় আমাকে একান্ত করে পেতে চায়। লাইফটা এনজয় করতে চায়। বাচ্চা হলে স্বামী স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়। তাই কাউকে বলতে নিষেধ করল। আমিও বাধ্য বৌয়ের মতো চুপচাপ এবরশন করালাম। আর এখন আর কনসিভ হচ্ছে না।

ভাইয়া কি বলে?

কি আর বলবে। এখনতো সবার সব কথা আমাকে হজম করতে হচ্ছে। ওতো সেসব কথা ভুলে গেছে। নিজের দোষটা স্বীকার করেনা। পুরুষগুলো এমনি। যতক্ষণ তুমি পুরোটা বিলিয়ে দেবে ততক্ষণ ভালো। আর কিছু ঘাটতি হলেই মুখ ফিরিয়ে নিতে সময় লাগে না। গোধূলির মায়া লাগল মনির জন্য।

মনি বেশ গোছানো মেয়ে।‌ পুরো বাড়ি ঝকঝক করছে। অল্প কিন্তু রুচিশীল আসবাব দিয়ে পুরো বাসা সাজিয়েছে। প্রত্যেক রুমে আলাদা আলাদা পর্দা টানানো তার সাথে ম্যাচিং বিছানার চাদর। বোঝা যায় বেশ শ্রম দেয়া হয়েছে বাসা সাজাতে। গোধূলি মনে মনে ভাবে সেও এভাবে বাসা সাজাবে। সারাদিন মন দিয়ে ঘরের কাজ করবে। কোনো কোনো বিকেলে বাইরে ঘুরতে বের হবে দুইজন। রাতে সাব্বিরকে খুব খুব ভালোবাসবে। আর যত দ্রুত সম্ভব বেবি নিয়ে নেবে। পরে যদি আবার সমস্যা হয়।

সাব্বির পরদিন আর এলো না। গোধূলির অস্থির লাগছে। মনি যদিও ওর সাথে গল্প গুজব করছে, কিন্তু ওর বর আসার পর গোধূলি গেস্ট রুমেই কাটালো। লোকটা একটু গম্ভীর। কেমন রাগী রাগী ভাব ধরে থাকে চোখেমুখে। আর সবসময় মনিকে ধমকাতে থাকে।‌অবশ্য রাতে খাবার টেবিলে গোধূলির সাথে হাসিমুখে কথা বলল। কিসে পড়ে, বাসায় কে কে আছে সেসব জিজ্ঞেস করল।

গোধূলির কাছে ফোন না থাকায় সাব্বিরের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে না। একবার মনির ফোন থেকে কথা হয়েছে। গোধূলি ফোন করে বলল,

আপনার আব্বু কেমন আছেন?

তোমার শশুর? হুম ভালো এখন।

আপনি কবে আসবেন?

আজ একটু বিজি। কাল যাব। মনখারাপ করোনা। কোনো সমস্যা হচ্ছে ওখানে?

না।

আচ্ছা আমি দু একটা বাসা দেখেছি। কাল পরশু একটা কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

সাব্বির এলো পরদিন বিকেলে। হাতে মিষ্টি আর নাশতা নিয়ে এলো। ওগুলো মনির হাতে দিয়ে বলল,

একটু চা করে দেতো। আর গোধূলি রেডি হয়ে নাও। বাসা ঠিক হয়ে গেছে। আজকেই ওঠা যাবে।

মনি বলল,

আজকেই চলে যাবি?

হুম, বাসার কিছু কেনাকাটা আছে। ওকে নিয়ে কিনব।

চা নাশতা খেয়ে গোধূলিকে বলল,

তোমার কাছে কিছু টাকা হবে? আসলে এডভান্স করতে হয়েছে বাসাটার জন্য। হাত খালি হয়ে গেছে আমার।

হুম আছে আমার কাছে।

আচ্ছা চলো বেরিয়ে পড়ি।

গোধূলি ওর কাছে থাকা ক্যাশ টাকাটা পুরোটাই সাব্বিরকে দিল। নতুন বাসার জন্য একটা তোশক, দুটো বালিশ, কিছু হাড়ি পাতিল কেনা হলো। রাতে বাইরে খেয়ে বাসায় উঠল ওরা। বাকি টাকা সাব্বির নিজের কাছেই রাখল।

বাসা বলতে একটা তিনতলা বাড়ির ছাদে চিলেকোঠার একটা ঘর। সাথে টয়লেট। রান্নার জন্য আলাদা কোনো জায়গা নাই। ঘরেই একপাশে চুলা বসাতে হবে। সামনে বড় একটা ছাদ। সেখানে বাগান করেছে কেউ।

ঘরটায় রাজ্যের ময়লা চারপাশে। অনেক দিন খালি ছিলো হয়ত। মাকড়সার জাল পুরো ঘরে। টয়লেটও অপরিস্কার। সাব্বির বলল,

একটু পরিস্কার করে নিতে হবে তোমাকে।

গোধূলির ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কেনাকাটা করতে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়েছে। বেশ রাতও হয়ে গেছে। এখন এই ঘর পরিষ্কার করতে হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগল ওর। ঘুম ঘুম ভাব নিয়েই ঝাঁটা হাতে পরিস্কারের কাজ করতে লাগল। সাব্বির ‘একটু আসছি’ বলে নীচে চলে গেলো। ঘর টয়লেট পরিষ্কার করে গোধূলিকে গোসল করতে হলো। এত রাতে গোসল করাতে ঠান্ডা লেগে গেল। সাব্বির বিছানায় বসে মোবাইল টিপছে। কোনো কাজেই সাহায্য করলো না। শুধু তোশক বিছিয়ে দিলো। গোধূলি চাদর বিছিয়ে দিলো। বিছানায় শরীর দিতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে লাগল ওর। জ্বর আসবে বোধ হয়।

সাব্বির বলল,

আলোটা নিভিয়ে দিলে না?

গোধূলি আবার উঠে আলো নিভিয়ে বিছানায় আসতেই সাব্বির হাত বাড়াল গোধূলির দিকে।

গোধূলি বলল,

খুব শরীর খারাপ লাগছে আমার।
সাব্বির সেদিকে কান না দিয়ে গোধূলির ওপর চড়াও হলো।

গোধূলির এই প্রথম মনে হলো,
বিয়ে করাটাই একটা বিরাট ঝামেলা।

তরফদার সাহেব এর শরীর এখন বেশ সুস্থ। নিজে নিজে খেতে পারছেন, চলাফেরা করছেন। রাত্রির জন্য উপযুক্ত পাত্র দেখতে কিছু নিকটজনদের বলে রাখলেন। মেয়েটাকে খুব দ্রুত বিয়ে দিতে হবে। ছোট বোনের এমন কান্ড করার পর আর দেরি করলে নানারকম কথা রটবে। এমনিতেই নানা কথা বলা শুরু করেছে লোকজন।

রাত্রি স্কুলে গিয়ে দেখল টিচার্স রুমে খাওয়ার দাওয়ার আয়োজন চলছে। আয়া খালা নাশতার প্লেট সাজাচ্ছেন। রাত্রি জানতে চাইল,

কিসের জন্য এতো আয়োজন চলছে?

ঐযে আয়ান স্যার আছেন,উনারতো অন্য খানে ভালো চাকরি হইছে।‌ স্যারতো এই চাকরি ছাইড়া দিছে। তাই তারে বিদায় দেবে আজ।

রাত্রি অবাক হয়ে গেলো। এত বড় একটা খবর অথচ ও জানেই না। আয়ান একবারও তো বললো না ওকে। অবশ্য রাত্রি যে রুড বিহেভ করেছে তাতে করে ওকে না বলাই তো স্বাভাবিক।

তবুও রাত্রির কষ্ট হচ্ছে। আয়ান চলে যাচ্ছে আজ। কি আশ্চর্য ওর চোখ এমন ভিজে যাচ্ছে কেনো। খালা কি মনে করবে। রাত্রি দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেলো।

আয়নায় দাঁড়িয়ে চোখেমুখে পানি দিলো রাত্রি। কি আশ্চর্য! এই ছেলের জন্য ওর এমন অনুভূতি কেনো হচ্ছে হঠাৎ! শুধু মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে ও।

চা নাস্তার পর্ব শেষে স্কুলের কমিটির সভাপতি,হেডস্যার সবাই অভিনন্দন জানিয়ে কিছু কথা বলল। আয়ান সবার শেষে সবার কাছে বিদায় নিল। বিসিএস এর প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছে ও। ওর হাতে সবাই টুকটাক কিছু না কিছু গিফট দিচ্ছে। রাত্রি তো জানেই না। ও কিছুই দিতে পারলো না। আয়ান একবারও ওর কাছে এলো না। সেদিনের পর থেকে কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে ছেলেটা। রাত্রির সাথে আর তেমন কথাবার্তা বলেনি। রাত্রি নিজ থেকে কাছে গিয়ে বলল,

অভিনন্দন। আমিতো জানতাম না। তাই কিছু দিতে পারলাম না।

না ঠিক আছে। ভালো থাকবেন।

এটুকু বলেই আয়ান অন্যদিকে চলে গেল।‌সবার‌ সাথে একে একে কথা বলল আয়ান। রুহিয়া হাসিমুখে একটা ফুলের বুকি নিয়ে আয়ানের হাতে দিল। আয়ান হাসিমুখে ওটা নিলো। দু’জন কথা বলল বেশ খানিকটা সময়। রাত্রির খারাপ লাগছে কেনো। ওর কি হিংসা হচ্ছে। ছিঃ এমনতো উচিত না।

রাত্রি ক্লাসে চলে গেল। কি আশ্চর্য! ক্লাসে মন বসলো না ওর। শুধু মনে হচ্ছে ছেলেটা এতো ভাব দেখালো ওর সাথে!

রাত্রি ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো। টিচার্স রুমে এসে দেখল আয়ান নেই।

দপ্তরীর কাছে জানতে চাইল‌,

আয়ান স্যারকে দেখেছেন?

স্যারতো চলে গেছেন।

রাত্রির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-০৮

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৮

তরফদার সাহেব কে আইসিইউ থেকে কেবিনে নেয়া হয়েছে। রাত্রি দিনরাত এক করে বাবার জন্য লেগে আছে। ঔষধপত্র আনা, কেবিনে দেয়ার পর সবসময় খেয়াল রাখা সব একা হাতে সামলাচ্ছে। নাজমা কাঁদতে কাঁদতে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দু’জন রোগীকে রাত্রি একা হাতে সামলাচ্ছে। আয়ান আর আরও কয়েকজন কলিগ এসে একদিন দেখে গেছে। আয়ান দেখল রাত্রি একা হাতেই সব সামলাচ্ছে। যাবার সময় আয়ান বলল,

রিলিজের দিন আমি আসব।

রাত্রি বলল,

আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, আমি পারব।

তবে আয়ান রিলিজের দিন খোঁজ নিয়ে এলো। সবটা আয়ান সামলে নিলো। তবে বাসা পর্যন্ত আর গেলো না। এম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেয়া পর্যন্ত থাকল।

এতদিন রাত্রি কিছু বুঝতে পারেনি। বাসায় এসে বুঝতে পারল কতটা ক্লান্ত ও। দুচোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসছে। পুরো শরীরে ব্যথা । ক্ষুধাও পেল ভীষণ।

এ কয়দিনের টেনশনে গোধূলির বিষয়টা কেউ আর তোলেনি। তবে নাজমার কান্না শুধু স্বামীর অসুস্থতার জন্য না। মেয়েটা কোথায় গেছে,কেমন আছে এই চিন্তা তাকে পাগল করে দিচ্ছিল। তিনি সেই ঘটককে দিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে সাব্বির ছেলেটাও বাড়িতে নেই সেদিন থেকে যেদিন থেকে গোধূলিকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি। নানা দুঃশ্চিন্তা কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে।

রাত্রি খেতে এসে ডাইনিং এ মাকে ডুকরে কাঁদতে দেখল। ও সরে এলো। মনটা খারাপ লাগছে। খেতে ইচ্ছে করছেনা আর। তবে একটু গোসলের দরকার। ওয়াশরুমে গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে নিলো রাত্রি। বাবাকে খাবার ঔষধ খাইয়ে ঘুমালে নিজের ঘরে এলো ও।

ঘরে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো ও। আর সাথে সাথেই গোধূলির কথা মনে হলো। গোধূলি যখন হলো তখন রাত্রি ক্লাস ফোরে পড়ে। কাপড়ে মোড়ানো ছোট একটা পুতুলের মতো শিশু ওর মায়ের পাশে শোয়ানো। রাত্রি খুব খুশি হয়েছিল সেদিন। এখন থেকে বোনের সাথে ও খেলবে। সেই থেকে যতটা সময় পেত বোনকে সময় দিত।

বড়বেলায় দু’বোনের কত স্মৃতি। গোধূলিটা একা ঘুমাতে ভয় পায়। ঘুমের ভেতর গায়ের ওপর পা তুলে দেয়। এসব মনে পড়তেই বাঁধ ভেঙে গেল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল রাত্রি। কোথায় চলে গেল তার বোনটা।

রাত্রি স্কুলে এসেছে পাঁচ দিন পর। এই কয়দিন হাসপাতালে থাকাতে এসে ছুটি নিতে পারেনি। ফোন করে হেডস্যারকে জানিয়েছিল । আজ আসতেই কলিগরা সবাই বাবার খবর জানতে চাইল। রাত্রি জানালো যে বাবাকে এখন বাড়িতে আনা হয়েছে। মোটামুটি ভালো আছে।

আয়ানকে দেখা গেলো না। রুহিয়া একপাশে বসে কি যেন লিখছিল।

রাত্রি ক্লাসে যাবার সময় করিডোরে দেখা হলো আয়ানের সাথে। আয়ান এগিয়ে এসে বলল,

আপনি এসেছেন,আজকে ছুটিতে থাকতে পারতেন।

না কয়দিন তো ছুটি নিলাম।‌ মাতো আছেন। সমস্যা হবে না।

আঙ্কেল এখন কেমন আছেন?

এখন ভালো। তবে বাবাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না।

হুম স্বাভাবিক । আপনাকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে ভীষণ। না হয় বাড়ি চলে যান।

না,ঠিক আছে।‌ সমস্যা হচ্ছে না আমার।

আচ্ছা,ঠিক আছে। আমার পরিচিত একজন কার্ডিওলজিস্ট আছেন। আপনি চাইলে দেখাতে পারেন আঙ্কেলকে। আমি এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখব।

দু’দিন যাক। এই ঔষধগুলো শেষ হোক।

হুম,ঠিক বলেছেন। আচ্ছা যান, ক্লাসের দেরী করিয়ে দিলাম।‌ স্টুডেন্টরা তাদের প্রিয় ম্যামকে মিস করেছে একয়দিন।

রাত্রি মুচকি হাসল। এ কয়দিনে এই প্রথম একটু হাসল ও।

লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে রুহিয়া এসে রাত্রির টেবিলে বসল।

রাত্রি খাচ্ছিল। রুহিয়া বলল,

কি অবস্থা?

হুম ভালো।

ভালো যে তাতো জানি। বাসায় বাবা অসুস্থ আর আপনি এখানে কত সুন্দর সময় কাটাচ্ছেন গল্প গুজব করে।

মানে!

আয়ান ছেলেটা ভালো। বড়লোকের ছেলে। কি বলেন? এতো বড় হলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি, অথচ ছেলেদের বশ করতে শিখলাম না। অথচ মানুষ কত সহজেই ছেলে পটাতে পারে।

রাত্রি আর কথা বাড়ালো না। মেয়েটার নোংরা ইঙ্গিত বুঝতে সমস্যা হলো না। খাওয়া রেখেই উঠে পড়ল ও।

সকালে ঘুম ভেঙ্গে গোধূলি দেখল সাব্বির অঘোরে ঘুমাচ্ছে। গোধূলি উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো।‌ বাইরে বেরিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখল তনিমা নাশতা তৈরি করছে। শাড়ির আঁচল সরে গিয়েছে বুক থেকে । ওর ঠিক সামনে বসে আছে এই বাসায় থাকা সাব্বির এর আরেক বন্ধু হাসান । ইনি তনিমার বর না। হেসে হেসে কি যেন বলছে লোকটা। গোধূলির কাছে দৃষ্টি কটু লাগল বিষয়টা। গোধূলিকে দেখে একটু যেন চমকে উঠল দুইজন। তনিমা চট করে আঁচল ঠিক করে নিলো। হাসান বলল,

কি ভাবি ঘুম কেমন হলো?

এইতো ভালো।

ভালো হয়েছে? সাব্বির ঘুমাতে দিয়েছে? যা সব বলছিল কাল।

তনিমা অবাক হবার ভান করে বলল,
কি! তোমরা একঘরেই ছিলে!

হাসান বলল,

কি যে বলেন আপনি! সাব্বির তো পাগল হয়ে গেলো বৌয়ের কাছে ঘুমাতে যাবার জন্য। সাব্বির টার কপাল। আগে থেকেই তো ওর মেয়েভাগ্য ভালো। বৌও পাইল একদম খাসা। আর আমাদের দেখেন। প্রেম হলোনা ঠিকঠাক। আবার বৌ বাপ মা পছন্দ করে আনছে। গায়ের মেয়ে।‌ রংঢং কি যদি একটু বুঝত। কামের সময় মনে হয় স্টাচু অব লিবার্টি হয়ে যায়।

আহা! এভাবে বলে নাকি। ভাবিতো খুব সুন্দর।

আর সুন্দর। শুধু সুন্দর দিয়ে কি পুরুষ মানুষের মন ভরে। আরো কিছু জানতে হয়।

তনিমা বলল,

সাব্বির ভাই ওঠেনি? কেনাকাটা করতে হবে তো বিয়ের। অবশ্য বাসর হয়ে গেলে ছেলেদের আর বিয়ে নিয়ে আগ্রহ থাকে না।

উঠে পড়বে ভাবী। আমি কিছু করে দেব?

না থাক, বিয়ের কনে তুমি। এখন কিছু করতে হবে না ভাই।

গোধূলি ওখান থেকে চলে আসল। হাসান আবার আস্তে কি যেন বলল আর তনিমা খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।

সাব্বির উঠল বেলা বারোটায়। নাশতা খেয়ে আবার ঘরে ঢুকে গোধূলিকে ডাকল,

গোধূলি এদিকে একটু আসোতো।

গোধূলি ঘরে ঢুকতেই দরজা লাগিয়ে ওকে জাপটে ধরে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিলো।

এই সবাই কি ভাববে বলেনতো।

কিছু ভাববে না। সবাই বুঝছে আমার কি অবস্থা।

কিন্তু বিয়েটা কখন হবে?

বিয়ে করব তো।‌ এতো অস্থির হচ্ছো কেনো। আমিতো পালিয়ে যাচ্ছিনা। গতকাল জার্নি করে এসেছি। একটু বিশ্রাম নিয়ে বের হব। কেনাকাটা আছে বিয়ের। একটু এনার্জি দরকার।

তো আপনি থাকেন। আমি দেখি ভাবী কি করছে।

আরে তুমি না থাকলে তো হবে না।‌ কাছে আসো।

উঁহু,এখন না।

সাব্বির গোধূলিকে শুনলোইনা। দ্রুত হাতে গোধূলিকে নগ্ন‌ করতে শুরু করল।

দুপুরের পরপর ঘটকের ফোন এলো সাব্বিরের কাছে। গোধূলির বাবার অসুস্থতার খবর জানাল লোকটা।‌সেইসাথে গোধূলি কোথায় জানতে চাইল সাব্বিরের কাছে।‌ সাব্বির হ্যালো হ্যালো বলে কেটে দিল ফোন। এরপর নাম্বার অফ করে দিলো।

তবে গোধূলিকে কিছুই জানালো না।‌ শুনলে হয়তো কান্না শুরু করবে,এখুনি ফিরতে চাইবে।

ঐদিনও আর কোথাও যাওয়া হলো না। রুমের ভেতরেই সময় কেটে গেলো। সন্ধ্যায় সবাই বসার ঘরে তাস খেলতে বসল। তনিমাও খেলছে। গোধূলি সাব্বিরের পাশে বসল। একটু পর সাব্বির সবার‌ সামনেই গোধূলির কোমড় জড়িয়ে ধরে চিমটি কাটল। গোধূলি ব্যথায় উফ করে উঠল। তনিমা বলল,

কি হলো?

গোধূলি বলল,

না কিছু হয়নি।

সাব্বির খেলা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
মাথাটা ভীষণ ধরেছে।‌ গোধূলী একটু‌ ঘরে এসোতো।‌

বলেই গোধূলিকে হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল।

বিয়ে নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছিল গোধূলির তবে সাব্বিরের পাগলাটে আদর নিতে খারাপ লাগছিলো না। তাই ও বাঁধা দেবার বদলে সাড়া দিয়ে গেল।

পরদিন সকালে বিয়ের কথা বলতেই সাব্বির হঠাৎ ভীষণ রেগে গেল।
কি শুরু করলা? এমনিতেই এতোটা টেনশনে আছি। তোমার বাবা নাকি অপহরণ মামলা করবে বলেছে। না জানি কি হয়।‌ আর তুমি এদিকে বিয়ে বিয়ে করে মাথাটাই খারাপ করে দিচ্ছে।

গোধূলি সাব্বির এর এমন মূর্তি দেখে কেঁদে ফেলল। এবার সাব্বির একটু নরম হলো। গোধূলিকে কাছে টেনে বলল,

আমি সরি জান। আসলে কেসের কথা শুনে মাথা ঠিক ছিলো না।

গোধূলি ভাবল সত্যিতো,টেনশন হবারই তো কথা। ও আদুরে বেড়ালের মতো সাব্বির এর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল।
সত্যিই তো বাসায় এতোটা বাড়াবাড়ি করছে কেনো। কি এমন হয়েছে। বিয়ে করবে বলেই তো নিয়ে এসেছে সাব্বির ওকে। বাসায় রাজী হলেতো এভাবে পালাতে হতো না। বাবার সবটাতে বাড়াবাড়ি করা স্বভাব। কেস করে কি করতে পারবে। ও কিছুতেই আর ফেরত যাবে না।

বিকেলের দিকে হুজুর ডেকে গোধূলিকে বিয়ে করল সাব্বির। গোধূলির বয়স আঠারোর নীচে। তাই রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে সম্ভব না। আরো ছয়মাস অপেক্ষা করতে হবে তার জন্য।

কেনাকাটা বলতে একটা কাতান শাড়ি আর কিছু কসমেটিকস কেনা হলো গোধূলির জন্য।‌ সাব্ব্বির এর জন্য পাঞ্জাবি কেনা হলো। সাব্বির বিয়ের পর রাতে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়ালো সবাইকে।

বিয়ের পরদিন সাব্বির বলল,

গোধূলি আজ চারটায় ট্রেন।‌ রেডি হয়ে নাও।‌ ঢাকা যাব আমরা।

এমা, কক্সবাজার যাওয়ার কি হবে?

বাসা থেকে কল করেছিল। আমার আব্বা অসুস্থ। কক্সবাজার পরে সময় করে যাব।

ও আচ্ছা।

ঢাকায় ফিরে গোধূলিকে সেই কাজিনের বাসায় নিয়ে গেল সাব্বির।
গোধূলি বলল,

এখানে কেনো, বাসায় যাবো না?

বাবা অসুস্থ হয়ে গেছেন। এমন অবস্থায় তোমাকে নিয়ে বাসায় তুললে খারাপ কিছু হয়ে যাবে। তখন আজীবন দোষী হয়ে থাকতে হবে।

কিন্তু আমি এখানে কতদিন থাকব এভাবে?

দু’তিনদিন থাকো। আমি একটা বাসা ঠিক করে ফেলব এর মধ্যে।

গোধূলি একটু খুশিই হলো, যাক কাউকে আপাতত ফেস করতে হবে না। নিজের মতো সংসার করবে ও। শুধু ওরা দুইজন‌ থাকবে একান্তে।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-০৭

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৭
(১৮+)

গোধূলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত হেঁটে সোজা বড় রাস্তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এসময় ওদের পাড়ার লতিফ চাচা রিকশা থেকে নেমে গোধূলির সামনে দাঁড়ালেন। গোধূলির বুকটা ধক করে উঠল। ওর কেবল মনে হচ্ছে সবাই বুঝতে পারছে ও পালিয়ে যাচ্ছে। লতিফ চাচা গোধূলিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

কি ব্যাপার গোধূলি মা, কোথায় যাচ্ছো?

গোধূলি আমতা আমতা করতে করতে বলল,

এইতো আঙ্কেল স্কুলে।

এখন‌ স্কুলে!

না মানে স্কুলে কোচিং করতে যাব।

ও,তা বাসায় সবাই ভালো আছে তো?

জ্বি সবাই ভালো আছে।

তুমি এই রিকশায় চলে যাও। এখন রিকশা পাবে না সহজে।

গোধূলি দ্বিধায় পড়ে গেল। সেতো যাবে নিউমার্কেট। এই রিকশায় গেলেতো চাচার সামনে বলতে হবে। রিকশাওয়ালা বলল,

আপা ওঠেন। কোন স্কুলে যাইবেন?

গোধূলি উঠে বসে বলল,

পি এন স্কুল।

রিকশা জোরে ছাড়তেই ও পেছনে ফিরে দেখল লতিফ চাচা চলে যাচ্ছেন।

ও রিকশা ওয়ালা কে বলল,

ভাই, স্কুল না, নিউমার্কেট চলেন।

রিকশাওয়ালার পেছনে ঘুরে বলল,
স্কুলে যাবেন না?

না,একটু নিউমার্কেট দরকার আছে। ওদিকে চলেন।

গোধূলির আবারও মনে হলো রিকশা ওয়ালা বুঝে ফেলেছে যে ও পালিয়ে যাচ্ছে।

নিউমার্কেট পৌঁছে গোধূলি ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল। চারপাশে খুঁজতে লাগল সাব্বিরকে। কোথাও দেখা যাচ্ছে না। একটা বড় কসমেটিক এর দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নাহ, সাব্বির কোথাও নেই। তবে কি ও আসবে না?

এমন হলে গোধূলি ফিরে যাবে।‌ আর মিনিট দশেক দেখে ও বাসায় চলে যাবে। মাতো এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই। যাই হোক, গিয়ে হয়তো একটু বকা খেতে হবে। ও বলবে যে কোচিং এ যেতে বের হয়েছিল।

এসব ভাবতে ভাবতেই সাব্বির কে দেখতে পেল। একটা সাদা রঙের কার থেকে বাইরে বের হয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে খুঁজছে। গোধূলি এগিয়ে গেল।

তুমি কখন এসেছ?

এইতো দশ মিনিট হলো।

কোনো সমস্যা হয়নি তো?

না।

আচ্ছা উঠে বসো গাড়িতে।

গোধূলি গাড়িতে উঠে বসতেই সব টেনশন দূর হয়ে গেল। এতক্ষণ শুধু মনে হচ্ছিল কেউ বুঝি দেখে ফেলল। এখন নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়ির ভেতরে বসল। সাব্বির উঠে ড্রাইভারকে বলল,

রেলস্টেশনে যাও।

গোধূলি বলল,

স্টেশন কেন?

আমরা চট্টগ্রাম যাব। ওখানে এক বন্ধুর বাড়িতে উঠব। সেখানে থেকে কক্সবাজার। একেবারেই হানিমুন সেরে আসব।

আর বিয়ে?

আরে পাগল বিয়ে করেতেইতো বন্ধুর ওখানে উঠব। তা না হলেতো সোজা কক্সবাজার চলে যেতাম। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না তাই না? মনে করছ তোমার সাথে সময় কাটিয়ে ধোকা দেব।

আরে না,এমন কিছু না।

ভয় পেওনা। আজ থেকে তুমি আমার বৌ।

একথা বলেই সাব্বির গোধূলিকে কাছে টেনে নিল। গোধূলির একটু অস্বস্তি লাগল। ড্রাইভার এর সামনেই গোধূলির শরীর অশ্লীল ভাবে ছুঁতে শুরু করল সাব্বির। লুকিং গ্লাসে ড্রাইভার আড়চোখে সব দেখল।

নাজমা গোসল শেষে বাইরে বের হবার জন্য দরজা খুলতে গেলে দরজা খুলল না। নাজমা দরজা ধরে ঝাঁকা ঝাঁকি করতে থাকলেন। নাহ দরজার আবার কি হলো। নাজমা এবার গোধূলিকে ডাকতে লাগলেন নাম ধরে,

ও গোধূলি, গোধূলি মা, দরজাটার কি হলো দেখতো মা। কোথায় যেন আটকে গেছে।

বেশ ক’বার ডাকার পরেও কোনো সাড়া না পেয়ে নাজমা ভাবলেন গোধূলি হয়তো ছাদে গেছে। তিনি জোরে জোরে ধাক্কা দিলেন। প্রায় আধঘন্টা পরেও যখন কোনো সাড়া পেলেন না, তখন তার মাথায় এলো বিষয়টা। তিনি আঁচ করলেন কি ঘটেছে। সাথে সাথে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো নাজমার। জ্ঞান হারিয়ে বাথরুমের মেঝেতে পড়ে গেলেন তিনি।

ট্রেনে উঠেও কেমন ভয় করতে লাগল গোধূলির। ওর শুধু মনে হচ্ছে এই বুঝি বাবা এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলবেন,

কোথায় যাচ্ছিস গোধূলি, নাম বলছি এখুনি।

এসব ভাবতে ভাবতেই দেখল সাব্বির প্লাটফর্মে দাড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। ভীষণ ম্যানলি লাগছে ওকে। স্মোক করা ছেলেদের ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগে গোধূলির কাছে। সাব্বির ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গোধূলির ভীষণ ভালো লাগছে। সব চিন্তা দূর হয়ে গেল মূহুর্তে। সাব্বির এগিয়ে এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বলল,

কিছু খাবে?

গোধূলি বলল,

নাহ,এখন ক্ষিধে নেই।

টেনশন হচ্ছে।

এখন আর হচ্ছে না।

আচ্ছা আমি আসছি।

সাব্বির চোখের আড়ালে চলে গেল। একটু পরেই হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন দুলে উঠল। গোধূলি জানালায় তাকিয়ে সাব্বিরকে খুঁজতে লাগল। ট্রেনের গতি বাড়ছে। কিন্তু সাব্বিরকে দেখতে পেলো না কোথাও। গোধূলির টেনশনে হাত ঘামতে শুরু করেছে। মাথার দু’পাশে দপদপ করছে। ট্রেন পুরোদমে চলতে শুরু করলে ও দাঁড়িয়ে পড়ল। প্লাটফর্ম পেরিয়ে বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে ট্রেন। ঠিক এমন সময় সাব্বিরকে আসতে দেখে বসে পড়ল গোধূলি।
সাব্বির এসে বসল পাশে।

আপনি কোথায় গিয়েছিলেন। ট্রেন ছেড়ে দিল, আমিতো ভয় পেয়ে গেছিলাম।
সাব্বির একটা জুসের বোতল ওর হাতে দিয়ে বলল,

আমাকে নিয়ে এখন থেকেই এত ভয় তোমার?

হবে না! আপনি দৌড়ে ট্রেনে উঠেছেন তাই না?

হুম।

যদি পড়ে যেতেন।

পড়ে গেলে মরে যেতাম।

এমন করে বলে কেউ!

কেনো,আমি মরলে তুমি কষ্ট পেতে?

গোধূলি মাথা নিচু করে বলে,

হুম।

সাব্বির মুখটা এগিয়ে এনে বলে
লজ্জা পেলে তোমায় অনেক সে*সি লাগে। ইশ! এখন মনে হচ্ছে বাই রোডে গেলেই ভালো হতো। একটু আগে খাওয়া সিগারেটের গন্ধ পায় গোধূলি। ওর ভালো লাগে গন্ধটা। সেইসাথে সাব্বিরের বুনো চাহুনি দেখে নেয় এক নজর।

গোধূলি মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু ওর হাসিমুখ সাব্বির ঠিক দেখতে পায়।

চট্টগ্রামে যখন ওরা নামল তখন রাত প্রায় নয়টা। গোধূলির ক্ষিধে পেয়েছে। এই প্রথম চট্টগ্রাম এসেছে গোধূলি। সম্পূর্ণ অচেনা শহরে আধচেনা এক পুরুষের সাথে এসেও ভয় করছে না ওর। সাব্বির একটা সি এনজি ঠিক করল। ওরা এসে পৌঁছাল সাব্বিরের এক বন্ধুর বাসায়। ঠিক বাসা বললে ভুল হবে। ফ্লাট বাসাটার একটা রুমে ওর এক বন্ধু বৌসহ থাকে। আরেক পাশে দুইজন ব্যাচেলর থাকে মেসের মতো। পরিবেশটা কেমন হোটেল হোটেল।

সাব্বিরের বন্ধুর বৌ তনিমা এলো ওদের সাথে কথা বলতে। বয়স ২৪/২৫ হবে। ভীষণ মিষ্টি দেখতে। ছেলেপুলে নেই। একবছর হয় বিয়ে হয়েছে। বাসাটা ওরা নিয়ে দুই বন্ধুকে সাবলেট দিয়েছে।

সাব্বির ওদের আলাপ করিয়ে দিলে তনিমা গোধূলিকে তার ঘরে নিয়ে গেল। রুমে ঢুকেই বলল,

পালিয়ে এসেছো?

না মানে,,,

বুঝতে পেরেছি। তোমার বয়স কত মেয়ে? দেখেতো মনে হচ্ছে অনেক ছোট।

ক্লাস টেনে এবার।

এমা! মাত্র টেন।

জি।

মানিয়ে নিতে পারবে বরের সাথে?
বয়সের এতো ফারাক।

পারব।

আমারও লাভ ম্যারেজ। তবে পালাতে হয়নি। বাড়িতে প্রেসার দিয়েছিলাম ।পরে মা বাবাই বিয়ে দিয়েছেন। তবে তুমি কিন্তু ভারী সুন্দর ভাই। ছেলেদের কচি সুন্দরী মেয়ে হলে আর কিছু লাগে না। এমন বৌকে ওরা মাথায় তুলে রাখে। আমার তো ক্লাসমেটের সাথে বিয়ে হয়েছে। সমবয়সী বলে কদর কমতে সময় লাগেনি। কত কি যে করতে হয় বরের মন রাখতে।

গোধূলি বুঝল এই মহিলা একটু মুখপাতলা মানুষ। কোনো রাখঢাক করতে জানে না।

সাব্বির এসেই বাইরে গিয়েছে। গোধূলি ফ্রেশ হয়ে তনিমার সাথে কিছু সময় গল্প করল। সেসবের বেশিরভাগ আজকালকার প্রেম নিয়ে। ‌গোধূলিকে বলল,

বিয়ে হয়ে গেছে?

না এখনো হয়নি।

বলো কি! বিয়ে ছাড়াই চলে এলে? আজকাল কত কি হচ্ছে। আমার এক বান্ধবীর কি হয়েছে শুনবে? বিয়ের নাম করে ওর বয়ফ্রেন্ড ওকে রাঙামাটি নিয়ে গিয়ে একটা রিসোর্টে তিনদিন তিনরাত থেকে ওকে রেখে উধাও হয়ে গেছে।

গোধূলির ভালো লাগছে না কথা বলতে। এই মহিলা তাকে ভয় দেখাচ্ছে। সাব্বির যে কখন আসবে। সাব্বির আসল দু’ঘন্টা পর। গোধূলি ভেতরের একটা রুমের বারান্দায় বসেছিল।‌ সাব্বির বিরিয়ানি কিনে এনেছে‌ সবার জন্য। তনিমা টেবিলে সাজিয়ে গোধূলিকে ডেকে আনল।

গোধূলি এসে দেখল টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে।‌ সাব্বির খাওয়া শুরু করেছে। ওকে রেখেই খেতে বসে গেছে সাব্বির। ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল।

তনিমা ওকে ডেকে বলল,

এসো ভাই, খেয়ে নাও। তোমার বর আনিয়েছে বিরিয়ানি।

গোধূলি তনিমার পাশে বসে পড়ল।
রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়ে গেল। এতক্ষণ এসব নিয়ে অনেক কথা বললেও তনিমা গোধূলিকে নিজের ঘরে না রেখে ওদের দুইজনের জন্য আলাদা ঘর দিলো।

তনিমা ওর বরসহ ঘুমিয়ে পড়েছে। গোধূলি একটা ঘরে একা বসে আছে।‌ সাব্বির পাশের ঘরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। গোধূলিকে বলে গেছে একটু পরেই চলে আসব।
গোধূলি শুয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি। হঠাৎ ভারি কিছুর চাপে ওর ঘুম ভাঙল।

শরীরের ওপর হামলে পড়েছে একটা পুরুষ শরীর। অন্ধকারে ঠিক দেখা যাচ্ছে না। উৎকট গন্ধ আসছে মুখ থেকে। গো গো আওয়াজ বের হচ্ছে মুখ থেকে। গোধূলি ভয়ে বলে উঠল,

কে আপনি?

আমি সাব্বির। তোমার বর।

এমা কি করছেন এসব, ছাড়ুন।

তুমি তো আমার বৌ।

এখনো তো বিয়ে হয়নি।

কালকেই তো বিয়ে করছি আমরা। এমন করে না ডার্লিং।‌ সেই কখন থেকে তোমাকে আদর করার জন্য পাগল হয়ে আছি।

কাল এসব করবেন। আজ না।

আরে কি এমন ক্ষতি হবে। আজ, আজকেই হবে। কোনো কিছুই শুনতে চাই না। এতো সময় তোমার কাছে থেকে পাগল লাগছে আমার। তোমাকে চাই এখুনি।

কি খেয়েছেন আপনি?

ঐ ওরা জোর করে,,,,

গোধূলি ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু সাব্বিরের শক্তির সাথে পারলো না। আর কোনো উপায় নেই। আর তাছাড়া ওর এখন একটু একটু ভালো লাগছে। সাব্বির হয়ত নেশা করেছে। কেমন জড়ানো কন্ঠে কথা বলছে। শেষে গোধূলিও দুইহাতে সাব্বির কে আঁকড়ে ধরল। সাব্বির সর্বশক্তি দিয়ে গোধূলির শরীর নিয়ে খেলায় মেতে উঠল।

রাত্রি বাড়ি ফিরল পাঁচটার পরে। বাইরে টুকটাক কেনাকাটা ছিলো। তাই একটু দেরি হয়ে গেছে। বাড়িতে ফিরে দেখল বাইরের দরজা খোলা। ও মাকে ডাকল,
মা মা, কোথায় গেলে।

কোনো সাড়া নাই। হাতের ব্যাগ রেখে ভাবল মা হয়তো পাশের কোনো বাড়িতে গেছে। কিন্তু এভাবে দরজা খুলে তো যায়না কখনো। রাত্রি মায়ের ঘরে উঁকি দিলো। এমন সময় গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেল। বাথরুম থেকেই আসছে। রাত্রি জলদি গিয়ে দরজা খুলে দেখল নাজমা মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছেন।

রাত্রি চিৎকার করে উঠল,

তোমার কি হয়েছে মা? পড়ে গেলে কিভাবে!

রাত্রি মাকে ধরে তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলো।

নাজমা হাপাতে হাপাতে বলল
গোধূলি কোথায়?

আশেপাশে সব জায়গায় খোঁজা হলো কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলো না। গোধূলি কোচিং সেন্টারে, বন্ধুদের বাসায় কোথাও যায়নি।

তরফদার সাহেব বাসায় ফিরে চুপচাপ বসে রইলেন ঝিম ধরে। কারো সাথে কোনো কথা বললেন না। দশটার দিকে বুকে ব্যথা শুরু হলো ওনার। আধঘন্টা পর একপাশে কাত হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে এডমিট করতে হলো। ডাক্তার জানালেন অতিরিক্ত টেনশনে স্ট্রোক করেছেন।

(চলবে)