Tuesday, August 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 256



মাতাল হাওয়া পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আফিফার ছেলে বাবলুটা ভারি লক্ষি। এই বয়সের বাচ্চা সারাদিন পে পু করে কান্নাকাটি করে। কিন্তু বাবলু কেবল খুদা লাগলেই কাঁদে। এছাড়া তার কান্নাকাটি নেই। আফিফার রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দাটা বেশ সুন্দর। বেশি সুন্দর লাগে ফুলের টবগুলোর জন্য। একটা পাশ শখ করে ছোট্টখাট্টো বাগানের মতো করে ফেলেছে সে। ভালো ঠান্ডা পড়ে গেছে আজকাল। একটা ঠান্ডা বাতাস চিত্রলেখাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। আপাতত সঙ্গে কোনো গরম কাপড় না থাকায় ঠান্ডা তাকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। যদিও সঙ্গে একটা পাতলা মতন শোল ধরনের ছোট চাদর ছিল তবে এই মুহূর্তে সেটা বিছানায় রাখা। চিত্রলেখার একদম ইচ্ছা হচ্ছে না গিয়ে নিয়ে আসতে। ঠান্ডা বাতাসে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেই আরাম লাগছে। সেই সঙ্গে চিত্রলেখার কোমড় সমান চুলগুলোও দোলাচ্ছে। পেছন থেকে এগিয়ে এসে আফিফা বলে,

-তোর চুল তো দেখছি আগের চাইতে আরও বড় হয়েছে।

কথার ফাঁকেই চায়ের মগ বাড়িয়ে দেয় আফিফা। প্রিয় বান্ধবীর হাত থেকে চায়ের মগটা নিয়ে ঘ্রান শুকেই চিত্রলেখা বলে, কতদিন ছিলি না বল তো?

-এই তো তিনমাস হবে।

চায়ের মগে একটা লম্বা টান দিয়ে তৃপ্তি সমেত চিত্রলেখা বলে, তুই পাষাণের মতো তিনমাস দূরে থাকলি কি করে বলতো? আমার যে তোকে ছাড়া চলে না জেনেও এতগুলো দিন…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আফিফা বলে, তোর আমাকে দরকার জানি বলেই তো ছুটে এলাম আমার প্রাণ ভ্রমরাকে রেখে। নাইলে কি আর আমি এই কনক্রিটের শহরে ফিরি? যেথায় আমার মন শখা নেই হেথায় আমার কি কাজ বলো সখি?

-হয়েছে আর কবিতা বলতে হবে না।

চিত্রলেখার অভিমান টের পেটে আফিফা তার চিবুকে হাত ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বলে, আচ্ছা বাবা আর রাগ-অভিমান নয়। তোর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আর কোথাও যাচ্ছি না আমি। বাবলুর বাবাকেও বলে দিয়েছি। এই কথা শুনে বাবলুর বাবা বলেছে জলদি যেন তোর বিয়েটা দিয়ে দেই এবারে।

-তুইও সবার মতো বিয়ে নিয়ে শুরু করলি? তুই তো অন্তত সবার মতো কথা বলিস না।

-কেনো বলবো না বলতো? তুই কি আজীবন একা থাকবি?

-থাকতে হলে থাকবো। আমি ছাড়া ওদের কে আছে তুইই বল?

-জানি কেউ নেই। কিন্তু এভাবে তো সারাজীবন যাবে না। একদিন ওরাও নিজ নিজ জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে ওদের জীবনেও কেউ না কেউ আসবে। চারুকে নিশ্চয়ই তুই সারাজীবন ঘরে বসিয়ে রাখবি না। তারপর ওরা যখন নিজ নিজ ব্যক্তিগত জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন তোর পাশে কে থাকবে?

এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে চিত্রলেখা বলে, খালা আছে, তুই আছিস, আমার বাবলু সোনা আছে। আমার আর কি চাই বল?

-এখন গায়ে জোর আছে তো সেজন্য বলতে পারছিস আর কাউকে লাগবে না। বছর পাঁচেক গেলেই বুঝবি জীবনে একান্তই নিজের ব্যক্তিগত একজন থাকাটা কতখানি জরুরী। অবশ্য আমি তোকে এই বোকামি করতেই দিবো না। বিয়ে তো তোকে করতেই হবে। আর আমি করিয়েই ছাড়বো। তুই তো আমায় চিনিস। কিরে চিনিস না?

চিত্রলেখা ভালো করেই জানে সে প্রসঙ্গ পরিবর্তন না করলে আফিফা আজ তার মাথাটাই খেয়ে ফেলবে। তিনমাস পর তাদের দেখা হয়েছে। তিনমাসের যত কথা জমেছে আফিফা আজ একদিনেই সব শেষ করে ফেলতে চাইবে। আর সেসব কথার নব্বই ভাগ হবে বিয়ে নামক ঘ্যানঘ্যানানি। তাই আপাতত এসব কথার হাত থেকে বাঁচতে চিত্রলেখা বলে, আপাতত বিয়েটা থাক তুই আমার কথা শুন। একটা ভীষণ জরুরী কথা আছে।

চিত্রলেখার চোখ-মুখে সিরিয়াস ভাব দেখতে পেয়ে আগ্রহ ভরে আফিফা জানতে চায়, ঘটনা কি বলতো?

চায়ের মগটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখা বান্ধবীর একটা হাত ধরে। তা দেখে তাকে তাড়া দিয়ে আফিফা বলে, ওরে জলদি বল না কি কথা।

-তুই কি শান্ত ভাইকে বলবি আমার জন্য একটা চাকরীর ব্যবস্থা করতে।

-কেন! আগের চাকরীটার কি হয়েছে? ছেড়ে দিয়েছিস? কিন্তু তুই তো চাকরী ছাড়ার মানুষ না। তাহলে কি ওরা তোকে বের করে দিয়েছে? বের করে দিলো কেন? কোনো ঝামেলা হয়েছে?

আফিফার প্রশ্নবাণ বন্ধ হওয়ার নামই নেয় না। তাই তার হাত ছেড়ে মুখ চেপে ধরে চিত্রলেখা বলে, ওরে থাম তুই। আমাকে বলতে দিলে তো বলবো। ওরা আমাকে বের করে দেয়নি। আর আমি নিজেও এখনো চাকরীটা ছাড়িনি তবে ছেড়ে দিবো।

-কিন্তু কেনো?

খানিকক্ষণ ইতস্তত করে চিত্রলেখা। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে তাগাদা দিয়ে আফিফা বলে, কিরে বল চাকরী ছাড়বি কেনো?

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে, তুই তো ছিলি না। তোর পেছনে অনেক কিছু ঘটে গেছে।

-কী হয়েছে চিত্র? আমার সাথে হেয়ালি না করে খুলে বল তো ঘটনা কি। কী হয়েছে?

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিত্রলেখা বলে, আমার বস আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।

আচমকা এমন কথা শুনে একটুর জন্য হাত থেকে চায়ের মগটা পড়ে যায়নি৷ বিস্ময়ে চোখ বড় ও মুখ হয়ে যায় আফিফার। হাত বাড়িয়ে বান্ধবীর হা হওয়া মুখ বন্ধ করে দিয়ে চিত্রলেখা বলে, এমন হা করে থাকিস না প্লিজ। আমার ভীষণ লজ্জা করছে।

-হা করব না? এত বড় একটা ঘটনা আর তুই বলছিস আমি হা করব না? এসব কখন হলো? কীভাবে হলো? তোরা দুইজন…

-১ মিনিট আমরা দুইজন বলতে কিছু নেই। আমার পক্ষ থেকে কিছু নেই আর হবার সম্ভাবনাও নেই তা তুই ভালো করেই জানিস। যদি সম্ভবই হতো তাহলে কি মামুন ভাইয়ের কথা একবারও ভেবে দেখতাম না আমি?

আফিফা মাথায় হাত দিয়ে বলে,

-এই যা! এত কথার মধ্যে তোর মজনুটার কথা তো জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গিয়েছিলাম। আছে কেমন লোকটা? আজকাল কি করছে?

-আর কি করবে? তার তো একটাই কাজ মায়ার পথ চেয়ে বসে থাকা। তবে আজকাল বিয়ের জন্য ভীষণ বিরক্ত করছে। পারলে প্রতি শুক্রবারই তার বাবা-মাকে পাঠায় বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে। আমি রাজি হচ্ছি না বলে কিছু করতে পারছেন না। মামুন ভাই তো আছেনই, আজকাল বাসার সবাইও উনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। জানি না আমার পেছনে সবাই মিলে কোনো বুদ্ধি এটেছে কিনা। নাহলে দল বেঁধে কেন বিয়ে বিয়ে করছে আল্লাহ জানেন।

-বিয়ে বিয়ে করছে কারণ তোর বিয়ের বয়স হয়েছে। এই সময়ে তোর বিয়েটা হয়ে যাওয়া দরকার। চাচা-চাচী বেঁচে থাকলে এতদিনে নিশ্চয়ই তুই ঘরে বসে থাকতি না।

-সেসব বলে কি কোনো লাভ আছে? আমি নিজের কথা ভাবলে ওদের কথা কে ভাববে? আমি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে ওরা তো অথৈ সাগরে ভেসে যাবে। ওদের পায়ের তলার মাটি শক্ত না করে আমি নিজের কথা ভাবি কীভাবে তুইই বল?

-কিন্তু তোর কি মনে হয় না এসব করতে করতে, ওদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। পরে আর তুই নিজের জন্য কিছু করতে পারবি না। সেই সুযোগটা আর তোর হাতে থাকবে না। সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। ওদের জীবন গুছাতে গুছাতে তোর জীবন গুছানোর সুযোগটা যে হাত ছাড়া হয়ে যাবে সেই খবর আছে?

-আমি সবই জানি আফি, সবই বুঝি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি নিজের কথা ভাবলে পরবর্তীতে বাবা-মাকে মুখ দেখাবো কীভাবে বলতো? আমি ছাড়া তো ওদের আগে পড়ে কেউ নেই মাথায় হাত রাখার মতো।

-এত যুক্তি দিয়ে জীবন চলে না চিত্র।

-তোদের মতো শুধু আবেগ দিয়ে ভাবলেও জীবন চলে না, চলবে না। বাস্তবতাকে আমরা চাইলেও উপেক্ষা করতে পারি না। সে ক্ষমতা আমাদের মতো তুচ্ছ মানুষের নেই।

-ঠিক আছে আপাতত এত কথা থাক। তোর বস হঠাৎ তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো কেনো সেটা বল।

-জানি না।

-জানি না মানে?

-আমি আসলেই কিছু জানি না। আচমকা সেদিন আমায় জিজ্ঞেস করলেন আমি উনাকে বিয়ে করব কিনা। আমি ধরেই নিয়েছিলাম কথাটা উনি মজার ছলে বলেছেন। কিন্তু না, আজ আবার বললেন উনি আমায় বিয়ে করতে চায়। আমাকে চিন্তা ভাবনা করতে সময়ও দিলেন। কিন্তু জবাবটা হ্যাঁ তেই চাই উনার।

-মানে!

-মানে আমার না বলার কোনো সুযোগ নেই।

-উনি কি তোকে ভালো টালোবাসেন নাকি?

-তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? এতদিন ধরে এই কোম্পানিতে আছি। কোনোদিন উনি আমাকে দেখেননি। আজ কয়েকমাস ধরে উনার অফিসে উনার আন্ডারে আছি। এতটুকু সময়ে ভালোবাসা হয়ে যাবে? তাও আবার আমার মতো ইমপ্লইয়ের সাথে যার না আছে রূপ না অর্থবিত্ত না বিশেষ কোনো বংশ পরিচয়। আমার মতো জুতার তলা ছিঁড়ে যাওয়া একটা মেয়েকে ভালোবাসেন উনি? এসব হয় গল্প উপন্যাসে আর রূপকথা। অবশ্য সিনেমাতেও হয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে হয় না। বাস্তব জীবনে আমার সীমাবদ্ধ এতটুকুই আমি উনার একজন ইমপ্লইয়। এর বেশি কেউ না, বিশেষ কিচ্ছু না।

-তুই যদি বিশেষ না হয়ে থাকিস তাহলে কেন উনি তোকে বিয়ে করতে চাইবেন? তাও এত ডেস্পারেটলি? জানার চেষ্টা করেছিস?

-যেটা কোনোভাবেই সম্ভব না সেসব জেনে কি লাভ বল তো?

-শুন চিত্র ভালোবাসা মানুষের জীবনে বলে কয়ে আসে না। জাস্ট হয়ে যায়। দাওয়াত করে ভালোবাসাকে নিমন্ত্রণ দিয়ে আনতে হয় না। কখন আমরা কাকে ভালোবেসে ফেলবো তা আমরা নিজেরাও বলতে পারি না। হঠাৎ করেই ভালোবাসাটা আমাদের জীবনে চলে আসে। হতেই পারে উনার তোকে পছন্দ হয়েছে, ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই বিয়ে করতে চান।

-এসব মানুষ শুনলে ভাববে তুই আমি মিলে কোনো বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখছি৷

-তুই একটু সহজ করে ভেবে দেখছিস না কেনো বল তো?

-যার জীবনটা কোনোদিক দিয়ে সামান্য সহজ নয় সে কীভাবে সহজ করে ভাববে বল তো? আমার কি সহজ করে ভাবার উপায় আছে?

-নেই বলছিস?

-না নেই। এসব আমি ভাবতেও চাই না। সব বাদ দিলাম আমাদের সামাজিক অবস্থার দিকে তাকা তুই একবার। আদৌ কি এটা সম্ভব? উনি জামান গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক। শতশত কোটি টাকার কারবার। উনার পাশে কি নাম পরিচয়হীন পথের ভিক্ষারি ধরনের আমাকে মানায়? সহজ ও এককথার উত্তর মানায় না। কোনো ভাবেই মানায় না। যার জীবনটা আপাদমস্তক টাকাপয়সা, অর্থবিত্ত আর ঐশ্বর্যে মোড়ানো তার সাথে কখনোই আমার মতো চালাচুলাহীন একটা মেয়ে সংসার বাঁধার, জীবন বাঁধার, ভালোবাসার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।

চিত্রলেখা থামার সঙ্গে সঙ্গেই আফিফা কিছু বলে না। এক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলে,

-আচ্ছা তোর বসকে না হয় বাদ দিলাম। মামুন ভাই। উনার কথাও কি ভেবে দেখা যায় না? মামুন ভাই তো তোর বসের মতো অর্থ সম্পদে মোড়ানো না। তোরা তো একই সমাজের অংশ। এদিক থেকে তোদের সমাজিক দিকটাও ভিন্ন নয়।

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে চিত্রলেখা। হেসে নিয়ে বলে,

-আমি জানি মামুন ভাই আমাকে ভীষণ রকম ভালোবাসে। কিন্তু কি জানিস ভালোবাসা জিনিসটাই হয়ত আমার জন্য না।

-মামুনে কি সমস্যা?

-মামুন ভাইয়ের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই, তার ভালোবাসায়ও কোনো দোষ নেই। দোষ সব আমার কপালের। এমন কপাল নিয়ে এসেছি যে কপালে ভালোবাসা নামক কিছু নেই। এতে অবশ্য আমর আফসোস নেই।

-হেয়ালি করিস না চিত্র। তুই একটু মামুনের কথা ভেবে দেখ। আমার মনে হয় না তুই মন্দ থাকবি।

-আমিও জানি মামুন ভাইকে বিয়ে করলে মন্দ থাকবো না। কিন্তু আমার ভালো মন্দ নিয়ে তো আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমার ভাই বোনগুলোর ভালো থাকাই সবচাইতে জরুরী।

-সেটা তো বিয়ের পরেও করতে পারবি।

-কীভাবে? মামুন ভাই তো নিজের জন্যই কিছু করেন না। তোর কি ধারণা আমাকে বিয়ে করে উনি পরিবর্তন হয়ে যাবেন? চাকরী-বাকরী বা ব্যবসায় মন দিবেন? যে আমাকে পাবার আশায় নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনে না সে বিয়ের পর পরিবর্তন হবে তার গ্যারান্টি কোথায়? মামুন ভাইকে বিয়ে করে আমাকে উনার বাবার সংসারে থাকতে হবে। সেখানে কি আমার ভাইবোনেরা জায়গা পাবে? তাছাড়া আরও বড় একটা সমস্যা হচ্ছে মামুন ভাইয়ের বাবা মা ছেলের বউদের ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করাটাকে সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন না। এত বাঁধা যেখানে সেখানে আমি নিজের কথা কীভাবে ভাবি তুই বল?

-তুই এত নেগেটিভ কেনো ভাবছিস?

-দুনিয়াটা নেগেটিভিটি দিয়ে ভরা আফি তাই ভাবছি।

-তবুও তুই অন্তত একবার…

আফিফাকে থামিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আর না আফি প্লিজ। এসব বিয়ে নামক যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেতেই তোর কাছে ছুটে এসেছি। এখানেও যদি আমি শান্তি না পাই তাহলে কোথায় যাবো বল। আর কি কোনো জায়গা আছে আমার?

আফিফা আর কিছু বলতে পারে না। থেমে যায়। চিত্রলেখার এসব মায়া ভরা কথা তাকে সবসময় আটকে যায়। চিত্রলেখা নিজেই আরও বলে,

-এসব বাদ দিয়ে আমি যা বললাম তা কর প্লিজ। তুই আজই শান্ত ভাইকে বলবি উনি যেন আমার জন্য একটা মোটামুটি ভালো চাকরীর ব্যবস্থা করে দেন। যদি শহর বদল করতে হয় তাহলেও চলবে আমার।

-কেন? পালাতে চাইছিস? কার থেকে? তোর বসের হাত থেকে?

চুপ করে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারে না। এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলে,

-যদি পালাতে হয় তাহলে তাই সই। আমি পালিয়ে যাবো। তবুও এসব ঝামেলা আমার চাই না।

আফিফা আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ায় না। জোরাজুরিতে কাজ হবে না তা সে ভালো করেই জানে।

চিত্রলেখা আফিফার বাসা থেকে বের হয় ঠিক ৮ টার সময়। যদিও আফিফা ভীষণ করে বলছিল যেন অন্তত আজকের রাতটা থেকে যায়। কিন্তু চিত্রলেখা থাকেনি। পরেরদিন অফিস আছে তার। অন্য একটা চাকরীর জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত এই চাকরীটা সে ছাড়তে পারবে না। বেরিয়ে আসার সময় চিত্রলেখার হাত ধরে আফিফা বলেছিল, ওত চিন্তা করিস না। আমি এখনো আছি। তোরা নাহয় আমার বাসায় উঠলি। পরে আস্তেধীরে কোনো একটা ব্যবস্থা করা যাবে। বান্ধবীর থেকে এতটুকু ভরসা পেয়ে খুশি হলেও চিত্রলেখা কখনোই এমনটা করবে না। অন্যের উপর বোঝা হতে চায় না সে। এমনিতেও আফিফা আর খুব বেশিদিন ঢাকায় থাকবে না। আফিফার হাসবেন্ড শান্ত চাকরী সুবাদে চট্টগ্রাম থাকে। এতদিন কোয়াটার পায়নি বলে মা, স্ত্রী ও সন্তানকে ঢাকাতেই রেখেছে। কিন্তু এই মাসেই খবর পেয়েছে আগামী মাসেই কোয়াটার পেয়ে যাবে। খুব বেশি হলে আর মাস দুই কি তিন ঢাকায় থাকবে আফিফা তারপর চলে যাবে চট্টগ্রাম শান্তর কাছে। এমন একটা সময়ে বান্ধবীকে কোনো ধরনের চিন্তায় ফেলতে চায় না চিত্রলেখা।

কীভাবে কি করবে আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতেই তিনতলার সিড়ি বেয়ে নিচে নামে চিত্রলেখা। বিল্ডিংয়ের কেচি গেইট দিয়ে বেরিয়েই থম ধরে ধারায় সে। তাকে বের হতে দেখে গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রওনক সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সময় বিলম্ব না করে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায় সে চিত্রলেখার। শান্ত দৃষ্টি নিয়ে চোখ ভরে দেখে রওনক চিত্রলখাকে। চোখ-মুখ জুড়ে তার ব্যাকুলতার ছাপ। টাইটা নিচের দিকে টেনে রেখেছে। কোর্টটা হয়ত খুলে রেখেছে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাজ করে তুলে রাখা। আজ পর্যন্ত এভাবে কখনো দেখা হয়নি রওনককে। কোথায় গিয়ে যেন এই দর্শনটা বিধলো, একটা ধাক্কার মতো লাগলো। চিত্রলেখার ইচ্ছা করছে শরীরটা ছেড়ে দিতে। হঠাৎই যেন শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে। কিন্তু পারলো না, শক্ত হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো পাথরের মতো। বেচারি এতটাই অবাক হয়েছে যে কি বলবে বুঝতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, আপনি কীভাবে জানলেন আমি এখানে আছি?

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রওনক বলে, তুমি চাইলেও আমার কাছ থেকে পালাতে পারবে না। যদি না আমি তোমাকে পালাতে দেই। ইউ হেভ টু ফেইস মি।

চিত্রলেখা চুপ করে থাকে। রওনক আরও বলে, বিয়ের প্রপোজাল দেয়াটা কি খুব বেশি অনৈতিক কাজ হয়ে গেছে? আমি কি কোনো অন্যায় করে ফেলেছি যে তুমি এভাবে পালাতে চাইছো?

তবুও চুপ করে থাকে চিত্রলেখা। এবারে রওনক হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার হাত ধরে বলে, কাম উইথ মি।

-কোথায় যাচ্ছি আমরা?

রওনক চিত্রলেখাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে সিট বেল্ট আটকে দিতে দিতে বলে, গেলেই দেখতে পারবে কোথায় যাচ্ছি। ডন্ট ওয়ারি আই উইল নট কিল ইউ। আই ডেয়ার নট টু।

চিত্রলেখা কিছু বলতে পারে না। চুপ করে বসে থাকে। রওনক গাড়িতে উঠে আর একটি কথাও বলেনি। তারা কোথায় যাচ্ছে তা চিত্রলেখা জানে না।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

তুরাগ নদীর পাড়ে গাড়ির বোনাট ঘেষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তারা। গাড়িতে উঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি রওনক চিত্রলেখার সাথে। এমনকি তার মুখের দিকেও তাকায়নি। রওনক হয়ত কিছু বলবে সেই আশায় বারবার পাশ ফিরে তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করেছে চিত্রলেখা কিন্তু অপেক্ষার ফলাফল শূন্য। রওনক কিছুই বলছে না। আর এদিকে সময় ফুরিয়ে রাত গভীর হয়ে আসছে। নদীর পাড় হওয়ায় কোনো মানুষজন নেই। জনশূন্যতার কারণে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে মধ্যরাত নেমে এসেছে। এমনিতেই শীতের সময়। নদীর পাড় হওয়ায় ঠান্ডা বেশি লাগছে। এতদিন শৈত্যপ্রবাহ ছিল না। মনে হচ্ছে এর মধ্যেই শুর হয়ে যাবে। আজ সকালে যখন চিত্রলেখা বাড়ি থেকে বের হয় তখনও এতটা ঠান্ডা অনুভব করেনি যতটা এখন লাগছে। পাতলা মতন একটা শাল নিয়ে বেরিয়েছিল। তা গায়ে জড়িয়ে রেখেও লাভ হচ্ছে না।

বোনাট ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রওনক। ড্রাইভিং সিটের দিকে অগ্রসর হলে পেছন থেকে চিত্রলেখা ইতস্তত ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমরা কি বাসায় যাচ্ছি?

থেমে গিয়ে চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে রওনক বলে, এখানেই দাঁড়াও আমি আসছি।

মনে মনে বাড়ি ফেরার তাগাদা অনুভব করে সে। কিন্তু মুখ ফুটে রওনককে কিছু বলার সাহস হচ্ছে ন। কেনো সাহস হচ্ছে না তাও বুঝতে পারছে না। মুখ খুলতে, একটা কথা বলতেই ভয় লাগছে বেচারীর। মনে হচ্ছে কিছু বললেই হয় কঠিন এক ধমক খাবে না ঠাস করে গালে নামবে চড়। কিন্তু ধমক খাওয়া বা চড় খাবার মতো কিছুই সে করেনি। তবুও কেনো এমন মনে হচ্ছে সেটাই বুঝতে পারছে না। অকারণে একটা লোককে এত কেনো ভয় লাগছে বুঝতে পারছে না চিত্রলেখা। এমনও নয় সে না জানিয়ে অফিস কামাই দিয়েছে। লাবিবকে জানিয়েই এসেছে। লিভ এপ্লিকেশনও জমা দিয়ে এসেছিল। এরপর ভয় পাবার কারণ থাকে না। এমনও নয় মিথ্যা বলে অফিস কামাই দিয়ে বসের হাতে ধরে পড়েছে। সামনের দিকে নদীর পানি দেখতে দেখতে এসব আকাশ কুসুম ভাবতে ব্যস্ত চিত্রলেখার ধ্যান ভাঙ্গে রওনকের উপস্থিতিতে। তবে সে কিছু টের পাবার আগেই রওনক এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের কোটটা পরিয়ে দিতে নিলে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে, এর প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি।

চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে রওনক বলে, ঠান্ডায় কাঁপছো আর বলছো প্রয়োজন নেই? এমন শীতের সময় কেউ এসব পালতা কাপড় গায়ে জড়িয়ে বের হয়?

লজ্জা মাথা নুইয়ে ফেলে চিত্রলেখা। আমতা আমতা করে মিনমিনে সুরে বলে, সকালে এত ঠান্ডা ছিল না।

-আবহাওয়া কি ঠান্ডা হবার আগে তোমার পারমিশন নিয়ে শীত নামাবে? এই সময় যখন তখন ঠান্ডা বাড়তে পারে এটা তো কমনসেন্সের ব্যাপার সঙ্গে ঠান্ডা কাপড় রাখতে হবে।

চিত্রলেখা আর কথাই বলতে পারে না। বেচারী লজ্জায় লজ্জাবতি গাছের মতো জড়িয়ে আসছে। গাছ হলে সত্যি সত্যি নিজেকে জড়িয়ে ফেলত এতক্ষণে। মানুষ বলেই পারছে না।

আবারও বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর চিত্রলেখা বাধ্য হয়েই জিজ্ঞেস করে, আমার বাসায় যেতে হবে।

গাড়ির বোনাটের সঙ্গে হেলান দিয়েই পাশ ফিরে তাকায় রওনক। বলে, We need to talk চন্দ্রলেখা।

চিত্রলেখা নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল। আচমকা রওনকের মুখে নিজের নামের ভুল শুনে তার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি চিত্রলেখা।

-ওকে ফাইন চিত্রলেখা। তুমি জানো আমি তোমার জবাবের অপেক্ষা করছি। ইউ হ্যাভ টু এন্সার মি।

রওনকের চোখের দিকে তাকিয়েই চিত্রলেখা বলে, যার নামটাও ঠিকঠাক জানেন না তাকে বিয়ে করতে চাইছেন?

একবার ডানে নদীর দিকে তাকিয়ে আবার চিত্রলেখার দিকে তাকায় রওনক। নিজের জায়গা থেকে এক কদম এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার কপালের উপর এসে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দেয়। রওনকের আঙ্গুল কপাল স্পর্শ করতেই যেনো সামান্য কেঁপে উঠলো চিত্রলেখা। কাছাকাছি দাঁড়িয়েই রওনক বলল, যাকে বিয়ে করছি তাকে কি নিজের পছন্দে একটা নাম দিতে পারি না?

চিত্রলেখা ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে রওনকের ঐ গভীর চোখে তাকিয়ে থাকে। কি জবাব দিবে বুঝতে পারে না। রওনক নিজেই বলে, এত লুকোচুরি কেনো? কি প্রয়োজন? আমি কি মানুষ হিসেবে খুব বেশি খারাপ? বিয়ে করা যায় না আমায়?

-কথিত কথা আছে। চাদরের আকার দেখে পা ফেলা উচিত। বামন হয়ে চাঁদে হাত দেয়ার দুঃসাহস করতে নেই। তাহলে আমি কীভাবে আমার চাদরের বাইরে পা ফেলি? বামন হয়ে চাঁদ স্পর্শ করার দুঃসাহস কীভাবে করি?

-চাঁদ যদি নিজে থেকে তোমার হাতের মুঠোয় আসতে চায় তাহলে তুমি কেনো চাঁদকে ছুঁয়ে দেখবে না?

-কারণ আমার সেই সাহস নেই। আপনার জন্য আমি কেবল চিত্রলেখা, আপনার অফিসের একজন সামান্য কর্মচারী। আমার সম্পর্কে কিচ্ছু জানেন না আপনি। তাই যা ইচ্ছা হচ্ছে বলছেন। বিয়ে নামক জোক করতে পারছেন।

-ওয়েট এ মিনিট! তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমার সঙ্গে জোক করছিস? I am making fun?

চিত্রলেখা জবাব দিতে হিমশিম খায়। যত যাই হোক এখনো সে রওনকের অফিসে কর্মরত আছে। বেলাইনে কথা বললে চাকরী মুহূর্তেই খোয়া যাবে। যদিও সে নিজেই চাকরী ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কিন্তু আগে অন্য একটা চাকরী জোগাড় করতে হবে। নাহলে তো সবাইকে নিয়ে না খেয়ে দিন যাপন করা লাগবে। চিত্রলেখা চুপ করে থাকায় রওনক নিজেই বলে,

-তোমার কি ধারণা তেমার সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি?

-জানেন তো আমার নাম চিত্রলেখা। আমার লেখাপড়ার ব্যাকগ্রাউন্ড জানেন যা খুব হাই ক্লাস কিছু নয়। আমি তিন বছর ধরে আপনার কোম্পানিতে চাকরী করছি।

চিত্রলেখার কথা শুনে হেসে ফেলে রওনক। হেসে ফেলে বলে, সরি হাসি আটকে রাখতে পারলাম না। এই কথা বলার পর যেন রওনকের হাসি আরও বেড়ে যায়। চিত্রলেখার কি হলো কে জানে রওনকের হাসি ভরা ঐ মুখে তার দৃষ্টি আটকে গেলে। হাসলে দাঁড়ি গোফে ভরাট চেহারাটা খিলখিলিয়ে ওঠে। এর আগে কখনো তাকে এভাবে হাসতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না চিত্রলেখার। এত মধু দৃশ্য! হেসে নিয়ে রওনক বলে,

-এভাবে হেসে ফেলার জন্য দুঃখিত। এখন সিরিয়াস কথা বলি। চিত্রলেখার সম্পূর্ণ জীবনটা তার ভাইবোনদের জন্য। চিত্রলেখার বাবা-মা যখন মারা যায় তখন সে মাত্র দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা-মার পরে চিত্রলেখাই ভাইবোনদের মাথার উপরে ছায়া, মায়া। খালার কাছে বড় হয়েছে। যদিও খালার সংসারেও খুব একটা ভালো নেই সে। কিন্তু চিত্রলেখা কম্প্রোমাইজ করতে জানে। লিখন সামনে গ্রাজুয়েশন শেষ করলে তাকে হায়ার এডুকেশনের জন্য বাইরে পাঠাবে। ছোট দুইজন চারু ও চয়ন তো বিশাল ব্রিলিয়ান্ট। দু’জন মেডিকেলে পড়তে চায়। কিন্তু চিত্রলেখার রাতে ঘুম হয় না এই চিন্তায় একজনকে মেডিকেল পড়ানোর সামর্থ্য তার নেই। সেখানে দু’জনের স্বপ্ন কীভাবে পূরণ হবে? তারপর খালা, উনার কোনো সন্তান নেই। বোনের চার সন্তানকে নিজের কাছে রাখার জন্য সামান্য যেটুকু পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল তাও স্বামীকে লিখে দিয়েছেন অনেক আগেই। কিন্তু আজকাল খালার সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। এরপর আছে মামুন সাহেব। যে চিত্রলেখাকে ভালোবাসে। নিজের মায়ায় বাঁধতে চায়। কিন্তু চিত্রলেখা; সে কি চায়? আরও কিছু বলবো? তুমি চাইলে বলতে পারি।

রওনকের মুখে নিজের পরিবারের অতীত ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনে ভীষণ অবাক হয় চিত্রলেখা। অবাক হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। চিত্রলেখা তোতলে বলে, আপনি এসব কীভাবে জানলেন?

-ভুলে যাচ্ছো আমি রওনক জামান। জামান গ্রুপের মালিক। এত বড় একটা ব্যবসা তো ছুমন্তর বলে চালাচ্ছি না। আমার জীবনে থাকা ইচ এন্ড এভরিওয়ানের ডিটেইলস আছে আমার কাছে। এটা ভিন্ন কথা সবার ডিটেইলস পার্সোনাল ফাইল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। চোখ বুলানো হয় না। কিন্তু তুমি স্পেশাল।

-আমি কেনো?

-তুমি কারণ তুমি, তুমি।

আবেগে ভাসতে চায় না চিত্রলেখা তাই বাস্তবতা পয়েন্ট আউট করে বলে, অলরেডি অফিসে নানারকম গুঞ্জন আছে। এমন কিছু ঘটলে কি হবে ভাবতে পারছেন?

-আমাকে কেনো ভাবতে হবে? ওরা আমার কোম্পানিতে চাকরী করে। বরং আমার ওয়াইফকে নিয়ে কিছু বলার আগে ওদের ভাবতে হবে। আর বলুক না মানুষের বলায় কি আসে যায়?

-আপনার আসে যায় না কিন্তু আমার যায়। হারানোর মতো আমার কিচ্ছু নেই নিজের আত্মসম্মান ছাড়া।

-ট্রাস্ট মি কেউ তোমার আত্মসম্মানে বিন্দুমাত্র আঘাত করতে পারবে না। আই উইল প্রোটেক্ট ইউ।

-তবুও আপনি যেটা চাইছেন সেটা হয় না।

-তুমি হ্যাঁ বললেই হয়।

-আপনার জন্য আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া যতটা সহজ। বিয়ের করার চিন্তা করা যতটা সহজ। আমার জন্য এসব চিন্তা করাটাও ভীষণ কঠিন। আপনি বুঝবেন না। প্লিজ আমাকে এসবে টানবেন না দয়া করে। আমায় মাফ করুন।

রওনক আরও এক কদম চিত্রলেখার কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে বলে, আই এম সরি আর পেছাতে পারবো না।

চিত্রলেখা একদম বুঝতে পারে না রওনক কেনো এমন করছে। না বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করে, আপনার অনেক বেটার অপশন আছে। আমি আপনার কোনো অপশনের মধ্যেই পরি না।

এবারে রওনক হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার বাহু ধরে বলে, ইউ আর মাই ওনলি অপশন। চিত্রলেখার গলা দিয়ে কথা বের হয় না। এমন জবাব আশা করেনি সে। রওনক বলে চলল নিজের মতো, একটু আগে তোমায় চন্দ্রলেখা বলে ডেকেছিলাম?

চিত্রলেখা মাথা ঝাকায়। তা দেখে রওনক বলে, ভুলে গিয়েছি বলে বা ভুল করে ডাকিনি। ইচ্ছা করেই ডেকেছি। তোমাকে আমার ঐ চাঁদের মতোই প্রয়োজন। এই অন্ধকার পৃথিবীর যেমন চাঁদকে প্রয়োজন নিজেকে আলোকিত করতে আমার তেমনি তোমাকে চাই। আই রিয়েলি নিড ইউ।

-আমাকে আপনার প্রয়োজন?

-ভীষণ।

রওনক তানিয়ার বিষয়টা বিস্তারিত খুলে বলে। মীম ও মিশকাতকে নিজের কাছে রাখার জন্য তাকে বিয়ে করতেই হবে। সব শুনে চিত্রলেখা বলে, আপনি তো অন্য যে কাউকে বিয়ে করতে পারেন।

-তুমি যা পারবে অন্যরা সেটা পারবে না।

-কী পারবো আমি?

-যে বাবা-মা মারা যাবার পর নিজের ভাইবোনদের সন্তানের মতো করে মানুষ করেছে আগলে রেখেছে সে আমার বাচ্চাদেরও নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করতে পারবে। আমার চেনা পরিচিত অন্যকেউ সেটা পারবে না।

চিত্রলেখার মস্তিষ্কের ভেতর মাছি ভন ভন করার মতো শব্দ হচ্ছে। বুঝতে পারছে না কি বলবে। রওনক নিজেই আরও বলে, আই নো উই ডোন্ট হ্যাভ এনি মিউচুয়াল ফিলিংস ফর ইচআদার অন্তত আমরা একে অপরের দায়িত্বগুলো তো ভাগাভাগি করতে পারি। তোমার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে আমি তোমায় হেল্প করলাম বিনিময়ে তুমি আমার বাচ্চাগুলোকে মানুষ করতে আমায় সঙ্গ দিলে। আমি তোমার দায়িত্বের ভাগ নিবো আর তুমি আমার।

-বিনিময়ে আপনি আমায় টাকাও দিবেন?

-বউয়ের কি কোনো ফিক্সড সেলারি হয়? আমাদের বিয়ের পর যা আমার তা তোমারও। আমি কখনো জানতে চাইবো না কোথায় কীভাবে কত টাকা খরচ করেছো। লিখনের বিদেশ যাওয়া, চারু, চয়নের মেডিকেল পড়া। সবার সব স্বপ্ন পূরণ করতে আমি তোমার পাশে থাকবে। তুমি শুধু আমায় বিয়ে করে উদ্ধার করো।

চিত্রলেখা চুপ করে থাকে। রওনক আরও বলে, আমি আমার জীবনে কখনো কাউকে রিকুয়েষ্ট করিনি। আজ তোমাকে বলছি রিকুয়েষ্ট করছি প্লিজ হেল্প মি আউট।

-আমার একটু সময় লাগবে। আমাকে একটু ভাবতে দিন প্লিজ।

-ঠিক আছে ভাবো। তবে খুব বেশি সময় নিও না প্লিজ। আর পালানোর অযথা চেষ্টা করো না। আমি পারমিশন না দিলে তুমি পালাতে পারবে না। যদি পাতালেও চলে যাও তোমার পেছন পেছন গিয়ে উপস্থিত হবো। তোমাকে আমার লাগবেই। জানি আমাকে সেলফিশের মতো শুনচ্ছে বাট আই হ্যাভ নো আদার চয়েজ।

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রওনক আরও বলে, চলো তোমার বাসায় নামিয়ে দেই।

চিত্রলেখা কথা বাড়ায় না। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসে। তার মস্তিষ্কের ভেতর সব জগাখিচুরি হয়ে গেছে রওনকের কথা শুনে। এই মুহূর্তে আর কিছু ভাবতে পারছে না সে।

রওনকের গাড়িটা যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। চিত্রলেখা বাড়তি কোনো কথা না বলে চুপচাপ নেমে যায়। রওনক পেছন থেকে ডাকে, চন্দ্রকথা।

রওনকের ডাকে থমকে না দাঁড়িয়ে পারে না চিত্রলেখা। পেছন ফিরে তাকালে রওনক নেমে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, মনে রেখো আই ব্যাডলি নিড ইউ। আর খুব বেশি চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব ঠিক করে দিবো ট্রাস্ট মি।

আবারও চিত্রলেখার কপালের উপরে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে বলে, নিজের খেয়াল রেখো।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখন ও মামুন দু’জনেই লিখনদের বাড়ির গেইটের তাকিয়ে আছে। গলির মোড় দিয়েই এগিয়ে আসছিল দু’জনে। চিত্রলেখার জন্য মেইনরোড পর্যন্ত গিয়েছিল। যাওয়ার সময়ই মামুনের সঙ্গে দেখা হয় লিখনের। একসাথে দু’জন বেশি কিছুক্ষণ মেইনরোডের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছে। তারপর একসাথেই বাড়ির দিকে ফিরে আসছিল। মোড় পর্যন্ত আসতেই থমকে দাঁড়ায় দু’জনে বাড়ির গেইটের সামনে থাকা রওনকের বিএমডব্লিউ গাড়িটা দেখে। চিত্রলেখার গাড়ি থেকে নামা, তার পেছন পেছন রওনকের এগিয়ে আসা সবই দেখেছে তারা দূরে দাঁড়িয়ে। কেবল বুঝতে পারেনি কি কথা হচ্ছিল তাদের মাঝে। ওতখানি দূর থেকে কথা শুনা যায়নি। রওনকের চিত্রলেখাকে নামিয়ে দিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না হলেও তার কপালের চুল কানের পিছনে গুজে দেয়াটা স্বাভাবিক দৃশ্য নয়। পাশে মামুন থাকায় লিখনের নিজেরই ইতস্তত লেগেছে। বলার মতো কিছু খুঁজে পায়নি। তাই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর লিখন বলেছে, অনেক রাত হয়ে গেছে মামুন ভাই। আপাও চলে আসছে, বাড়ি যাই।

-যাও।

-আপনিও বাড়ি যান। আপা তো চলেই আসছে আর চিন্তার কারণ নাই।

-হু।

লিখন আর কথা বাড়ায়নি। মামুন এমনিও কথা বলেনি। তাকে ওখানে রেখেই লিখন বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে।

চিত্রলেখা বাড়িতে ঢুকতেই দেখে ড্রইং রুমে চিন্তিত মুখ করে বসে আছেন নারগিস বেগম। উনার সঙ্গেই বসে আছে চারু ও চয়ন। চিত্রলেখাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, এতক্ষণ কই ছিলি তুই? কয়টা বাজে সেই খেয়াল আছে? ফোন বন্ধ করে রাখছিস কেন?

চিত্রলেখার খেয়ালই ছিল না দিনেরবেলায় ফোনটা বন্ধ করেছিল আর খোলা হয়নি। বাসায়ও কাউকে জানানো হয়নি সে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আফিফার বাসায় ছিল সারাদিন। হঠাৎ আফিফার বিল্ডিংয়ের নিচে রওনককে দেখার পর সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল তার। আর খেয়ালই ছিল না বাসায় জানানোর কথা। বাসায় ফেরার জলদি ঠিকই ছিল কিন্তু বন্ধ ফোনটা অন করে যে একটু জানিয়ে দিবে সেই কথাটা খেয়ালে আসেনি। আসবে কীভাবে? লোকটা যেভাবে কথার খৈ ফুটিয়েছিল ওসব শুনার পর থেকে তো চিত্রলেখার মস্তিষ্কের ভেতর মাছি ভনভন করছে। বাসায় জানানোর কথা মনে আসবে কি করে!

চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে নারগিস বেগম তার হাত ধরে মৃদু ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলেন, কিরে কথা বলছিস না কেন? কই ছিলি তুই?

চিত্রলেখা একবার খালার পাশে কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চারু ও চয়নের মুখের দিকে তাকার। পুনরায় খালার দিকে তাকিয়ে বলে, অফিসের জরুরী কাজে আটকে গিয়েছিলাম খালা। ফোনে চার্জ ছিল না। তাই তোমাদের কিছু জানাতে পারি নাই।

-তোর অফিসে তো আরও ফোন আছে। অন্য কারো ফোন থেকেও তো একটা ফোন করতে পারতি।

মিথ্যা ব্যাপারটাই এমন। একটা মিথ্যা ঢাকার জন্য আরও চৌদ্দটা মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। তবুও এই মুহূর্তে আসল ঘটনা খালাকে বলতে পারে না তাই মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাই চিত্রলেখা বলে,

-আমি অফিসে ছিলাম না। অফিসের বাইরে একটা মিটিং ছিল। মিটিংটাই এত লম্বা হয়ে গেছে যে দেরি হয়ে গেল বাসায় ফিরতে। বসের সঙ্গে ছিলাম। উনাকে তো আর বলতে পারি না উনার ফোন দিতে বাসায় ফোন করব। তাই তোমাদের জানাতে পারি নাই।

পাশ থেকে চারু কিছু বলার চেষ্টা করলে ওকে বাঁধা দিয়ে নারগিস বেগম বলেন, তুই চুপ থাক আপাতত। অনেক কথা হইছে। ফ্রেশ হয়ে আয় ভাত খাবি।

-আমার খুদা নাই খালা তোমরা খেয়ে নাও।

-খুদা নাই মানে?

-আমি তো মিটিং এ ছিলাম। ওখান থেকে খেয়ে আসছি তাই খুদা নাই। গোসল দিয়ে ঘুমাবো।

নিজের ঘরের দিক পা বাড়িয়ে আবার থমকে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। লিখনকে না দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে, লিখন কই খালা?

-ওরে তো আমিই বাইরে পাঠাইলাম। বললাম মেইন রোড পর্যন্ত গিয়ে দেখতে তুই আসতেছিস কিনা। তোরে আগায় আনতে গেলো।

-আমি কি ছোট বাচ্চা খালা যে আমাকে আনতে লিখনরে পাঠাইছো?

-বাচ্চা না জানি। এতরাত তো কোনোদিন করিস নাই তাই ভয় লাগতেছিল।

চিত্রলেখা চয়নের দিকে তাকিয়ে বলে, যা লিখনরে ডেকে নিয়ে আয়। নাইলে একটা ফোন করে বলে দে আমি চলে আসছি।

-ফোন করা লাগবে না আমি চলে আসছি।

বলতে বলতেই পেছন থেকে এগিয়ে আসে লিখন। চিত্রলেখা আর দাঁড়ায় না ভেতরে চলে যায়। নারগিস বেগম রান্নাঘরে চলে যান ওদের রাতের খাবার দিতে। চিত্রলেখা সময় মতো বাড়ি না ফিরায় চিন্তায় কারো খাওয়া হয়নি এখনো।

চিত্রলেখা ও নারগিস বেগম প্রস্থান করলে ওরা তিন ভাইবোন রয়ে যায়। এগিয়ে এসে লিখন জিজ্ঞেস করে, আপার দেরি হইছে কেন কিছু বলছে?

চয়ন বলে, অফিসের মিটিং ছিল সেজন্য নাকি দেরি হইছে।

-আপা কিছু একটা লুকাইতেছে।

লিখনের কথা শুনে চারু বলে, আমারও তাই মনে হয়।

লিখন আরও বলে, আপাকে উনার বস নামায় দিয়ে গেছে দেখলাম।

চয়ন বলে, ঠিকই তো আছে। আপা তো বললই অফিসের মিটিং ছিল বাইরে। রাত হয়ে গেছে দেখেই উনার বস নামায় দিয়ে গেল। এটা তো ভালোই হইছে এতরাত করে আপারে একা আসতে হয় নাই।

মাথা ঝাঁকিয়ে লিখন বলে, সেটা ঠিক আছে তবুও এখানে কোনো একটা কিন্তু আছে।

-দূরো ভাইয়া তুমি যে কি বলো না। কোনো কিন্তু ফিন্তু নাই।

চয়ন আর দাঁড়ায় না ওখানে। নিজের ঘরে চলে যায়। ও চলে যাওয়ায় চারু আরেকটু বড় ভাইয়ের কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে বলে, আপা মিথ্যা কথা বলতেছে ভাইয়া।

অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে চারুর দিকে তাকায় লিখন। চারু মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, আফিফা আপার সঙ্গে কথা হইছে আমার একটু আগে। আপা সারাদিন উনার বাসায় ছিল আজকে। ৮ টার দিকে বাসায় আসবে বলে বের হইছে কিন্তু বাসায় আসে নাই। খালা চিন্তা করবে দেখে বলি নাই এতক্ষণ তোমারেই বললাম।

-না বলে ভালো করছিস। হয়ত আপা কিছু আড়াল করতে চাইতেছে আমাদের থেকে। সে না বলা পর্যন্ত তুই বলিস না কিছু, আমিও বলবো না। আপার নিজস্ব প্রাইভেসি আছে। ভালো মন্দ সে আমাদের থেকে ভালো জানে। তাই আগবাড়ায় কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নাই। আমরা এমন ভাবে থাকবো যেনো আমি কিছু দেখি নাই আর তুই কিছু জানিস না।

-আচ্ছা ভাইয়া।

রওনকের কেবিনে তার মুখোমুখি অন্যপাশে বসে আছে একজন মহিলা। রওনক অফিসে আসার সঙ্গে সঙ্গেই লাবিব জানিয়েছে তার সঙ্গে দেখা করতে একজন মহিলা এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে ওয়েটিং রুমে বসে আছে। এই মুহূর্তে সেই মহিলাই রওনকের সামনে বসা। এখনো কথা হয়নি তাদের। তবে মহিলাকে দেখে চিনতে অসুবিধা হয়নি রওনকের বিন্দুমাত্রও। প্রথমে মহিলা নিজেই পরিচয় দেয়ার ভঙ্গি করে বলেন, আপনি হয়ত আমায় চিনেন না। আমার নাম শবনম আমি আপনার…

শবনমকে বাকি কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক নিজেই বলে, আপনি আমার ভাইয়ের এক্স-গার্লফ্রেন্ড জানি।

মৃদু হেসে শবনম বলে, বয়সে ছোট হবে তাই তুমি করেই বলছি কেমন। তুমি হয়ত জানো তোমার ভাইয়া আর আমি আবার একত্রে আছি।

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রওনক বলে, আমি আপনার দেবর নই যে আমায় তুমি করে বলবেন। অপরিচয় কারো থেকে আপনি শুনতেই প্রেফার করব আমি। আর আমার ভাই বিবাহিত, দুই বাচ্চার বাপ। সেই পুরুষের সঙ্গে পরকীয়া করছেন এটা নিশ্চয়ই গর্ব করে বলার মতো কোনো বিষয় নয়।

রওনকের কথা শুনে শবনমের সমস্ত শরীর যেনো মরিচ পোড়া লাগার মতো জ্বলে উঠলো। তবু শবনম কোনো রিয়্যাক্ট করে না৷ সে একটা বিশেষ কাজে এসেছে। অযথা রেগে গিয়ে কাজ নষ্ট করতে চায় না সে।

রওনক জিজ্ঞেস করে, তা আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন?

-তুমি সরি আপনি তো জানেনই আপনার বড় ভাই আমাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে সেটেল্ড হওয়ার ডিসিশন নিয়েছে।

-তো!

-তার কাছে শুনলাম আমার জন্য আপনার কোনো অফার আছে।

রওনক মনে মনে হাসে। শবনম সম্পর্কে যা ভেবেছিল, যা ইনফরমেশন পেয়েছিল সব একদম মিলে যাচ্ছে। মহিলা ইনিয়েবিনেয় কথা না বলে সরাসরি কাজের কথায় চলে গেছে। এবারে রওনক বলে, অফার আছে না ছিল।

-মানে!

-মানে টা সহজ। আমি আমার ভাইকে একটা চেক অফার করেছিলাম আপনার জন্য কিন্তু আমার ভাই সেটা নেয়নি। তার ধারণা টাকার বিনিময়ে আপনি তাকে ছাড়বেন না। বাট ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন অফারটা আর নেই। আপনি আমার ভাইয়ের সঙ্গে সিঙ্গাপুর সেটেল্ড করবে না আমেরিকা তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। ইউ পিপল আর নট এনিমোর মাই হেডেক।

শবনম কি বলবে ভেবে পায় না। ভেবেছিল বড় মাছ তার বড়শিতে আটকা পড়েছে। কিন্তু না সব পন্ড হয়ে গেছে। চোয়াল শক্ত করে শবনম বলে, ইউ আর ইনসালটিং মি।

-নো, আই এমন নট। বাট বিফর আই স্টার্ট ইনসালটিং ইউ, ইউ মে লিভ প্লিজ।

শবনম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বেরিয়ে যাবার আগে বলে, এই অপমানের শোধ আমি অবশ্যই নিবো।

-আপনার যদি মনে হয় আপনি কিছু করতে পারবেন তাহলে অবশ্যই চেষ্টা করে দেখবেন। আই উইল লুক ফরওয়ার্ড টু সি হোয়াট ইউ কেন ডু।

শাপের মতো ফসফস করতে করতে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় শবনম। এই মহিলার জন্য অফিসে আসার পর চা খাওয়ার সুযোগ পায়নি রওনক। এর সঙ্গে কথা বলে মুখের স্বাদও কেমন হয়ে গেছে। তাই মুখের স্বাদ ঠিক করতে ইন্টার কমে ফোন করে। চিত্রলেখা ফোন রিসিভ না করায় এবারে লাবিবকে ফোন করে। লাবিব রিসিভ করতেই রওনক বলে,

-চন্দ্র… সরি চিত্রলেখাকে বলো আমার জন্য চা নিয়ে আসতে।

-চিত্রলেখা তো অফিসে আসেনি।

-কেনো?

রওনকের কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। লাবিব বলে,

-সকালে আমাকে ফোন করে জানিয়েছে ওর শরীরটা নাকি ভালো না। তাই আসতে পারবে না। আমিও বলেছি আসার প্রয়োজন নেই। বাসায় থেকে বিশ্রাম করুক।

-ভালো করেছো।

-আমি চা…

লাবিবের কথা না শুনেই রিসিভার নামিয়ে রাখে রওনক। তার মুখের বিস্বাদ এখন মন-মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের দিনটাই মনে হয় খারাপ যাবে তার। একবার কি গিয়ে দেখে আসবে কেমন আছে তার চন্দ্রলেখা? পরমুহূর্তেই আবার ভাবে উচিত হবে না। চিত্রলেখা হয়ত গতকাল রাতের কথাই ভাবছে। এমনিও ভাবার জন্য সময় চেয়েছে। এই সময় সে গিয়ে উপস্থিত হলে বিষয়টা চিত্রলেখার জন্য ভালো হবে না। ওকে নিজের মতো ভাবতে সময় দেয়া উচিত তার। আপাতত সে তার চন্দ্রলেখার জবাবের অপেক্ষা করবে। কিছু পেতে হলে অপেক্ষা করতে করতে হয়। বিনা অপেক্ষায় পাওয়া কোনো কিছু পেলে পাওয়ার আসল আনন্দ অনুভব করা যায় না। চন্দ্রলেখার জন্য সে এতটুকু অপেক্ষা করতেই পারে। আবার ইন্টারকমে ফোন লাগায় রওনক। লাবিব রিসিভ করতেই বলে, এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।

এবারে তাকে যথেষ্ট ফুরফুরে শুনচ্ছে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

-আই প্রোপজড হার।

-কি!

বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে নিম্ন সরে জিজ্ঞেস করে লাবিব। রওনক আরও পরিষ্কার করে বলে,

-আমি চিত্রলেখাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।

এমন একটা কথা শুনার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না লাবিব। এমন একটা কথা শুনতে হবে তা সে চিন্তাই করেনি। নিজের কানে শুনা কথা একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। ড্যাবড্যাবে চোখ করে রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। বেচারাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মাথার উপর বজ্রপাত হয়েছে তাই সে জমে গেছে। সেই সঙ্গে কথা বলতেও ভুলে গেছে যেনো।

কয়েক সেকেন্ড সময় নে লাবিব নিজেকে ধাতস্ত করতে। নিজেই উঠে গিয়ে পানি খায় এক গ্লাস। তারপর ফিরে এসে চেয়ার টেনে বসে জিজ্ঞেস করে,

-আবার বলুন তো স্যার আপনি একটু আগে কি বললেন। আমি ঠিক শুনলাম নাকি আপনি ভুল বললেন?

রওনক আহাম্মকের মতো তাকিয়েই থেকেছে কেবল। সে জানে লাবিবের জন্য চিত্রলেখা বিশেষ কেউ। সে এটাও জানে জেনে বুঝে সে লাবিবের মন ভাঙ্গছে। চায়নি রওনক এমন একটা কাজ করতে কিন্তু ঘটনাটা জাস্ট ঘটে গেছে। কিছু কিছু ঘটনার প্রবাহ আমাদের হাতে থাকে না। কেবল ঘটে যায়। অনেক সময়ই আমরা হয়ত চাই না কোনো একটা কাজ করতে তাও করে ফেলি। রওনকও চায়নি চিত্রলেখা ও লাবিবের মাঝে আসতে। সে জানে লাবিব চিত্রলেখার জন্য একটা ভালো চয়েজ। ওরা একত্রে ভালোও থাকবে। এসব জেনে, বুঝেও ওদের মধ্যখানে চলে এসেছে সে। চায়নি তবুও চলে এসেছে। রওনকের কেবল মনে হয়েছে জীবনটা যেহেতু আবার নতুন করে শুরু করতেই হবে। সেই জীবনে তার চিত্রলেখার মতো কেউ নয় বরং চিত্রলেখাকেই চাই। নয়ত আবার জীবনটাকে ভেঙে তছনছ করার জন্য নতুন করে সাজাতে চায় না সে।

রওনক স্থির দৃষ্টি নিয়ে লাবিবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

-তুমি ঠিকই শুনেছো।

-আপনি আসলেই চিত্রলেখাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছেন?

-হ্যাঁ।

-আপনি সত্যি সত্যি ওকে বিয়ে করতে চান?

-হ্যাঁ।

-একদম সত্যি সত্যি?

-লাবিব গেট এ গ্রিপ। মিথ্যে মিথ্যে কি বিয়ে হয়? আই নো নিউজটা তোমার জন্য শকিং। তুমি কষ্ট পেয়েছো। এন্ড আই এম রিয়েলি সরি ফর দ্যাট।

লাবিব নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

-নিউজটা আসলেই আমার জন্য শকিং তবে আমি কষ্ট কেনো পাবো বুঝলাম না।

-আমি চিত্রলেখাকে বিয়ের করতে চাই এটা শুনে তুমি কষ্ট পাবে না?

-কেনো পাবো? বিয়ের নিউজ কি কষ্ট পাওয়ার মতো কিছু? তাছাড়া আমি নিজেও চাই চিত্রলেখার জীবনে একজন ভালো মানুষ আসুক, ভালো মনের মানুষ আসুক৷ ওকে খুব ভালোবাসুক। এতে কষ্ট কেনো পাবো?

এবার লাবিবের কথা শুনে রওনকের মস্তিষ্কের ভেতরকার নিউরনেরা উল্টাপাল্টা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছে। এমন একটা কথা শুনে বেচারা এতখানিই শক খেয়েছে যে উল্টাপাল্টা বকছে। অবাক হওয়া কন্ঠে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-তুমি চিত্রলেখাকে বিয়ে করতে না?

-আমি কেন ওকে বিয়ে করতে যাবো!

রওনকের কথা শুনে ভীমড়ি খায় লাবিব। রওনক জিজ্ঞেস করে,

-কেন বিয়ে করবা মানে? যাকে ভালোবাসো, পছন্দ করো তাকে বিয়ে করবা না?

-হ্যাঁ, অবশ্যই করব। যাকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করতে চাই আমি। কিন্তু চিত্রলেখাকে নয়।

-লাবিব, তুমি চিত্রলেখাকে ভালোবাসো না?

-না। আমি কেনো চিত্রলেখাকে ভালোবাসতে যাবো?

-তাহলে সেদিন যে বললে তুমি একজনকে পছন্দ করো, চাও সেটা চিত্রলেখা নয়?

-একদমই নয়। চিত্রলেখাকে আমি কখনোই সেই নজরে দেখিনি। ও কেবলই আমার একজন ভালো বন্ধু। ভালোবাসার মানুষ নয়।

ফস করে একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে ইজি হয়ে বসে রওনক বলে,

-ম্যান বাঁচালে তুমি আমাকে।

এতক্ষণে সবটা ঠিকঠাক বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখ করে লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-আপনি কি ভাবছিলেন আমি চিত্রলেখাকে ভালোবাসি?

-এমনটাই বলতে পারো।

-সিরিয়াসলি!

মাথা ঝাকায় রওনক। লাবিব আরও জিজ্ঞেস করে,

-এমন কেনো মনে হলো আপনার?

-আমি প্রায়ই নোটিশ করেছি তুমি চিত্রলেখার প্রতি অনেক বেশি কনসার্ন। ওর খুব কেয়ার করো। ওকে খুব কাছ থেকে অবজারভ করো। আর ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানো যা একজন কো-ওয়ার্কারের হয়ত জানার কথা নয়।

রওনকের মুখে এসব কথা শুনে আর না হেসে পারে না লাবিব। আটকে রাখতে না পেরে দাঁত বের করেই হেসে ফেলে সে। হেসে নিয়ে বলে,

-সরি স্যার না হেসে পারলাম না। এটা সত্যি আমি চিত্রলেখার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। এর কারণ আমরা ভালো বন্ধু। সবটা শেয়ার না করলেও চিত্রলেখা নিজের বিষয়ে টুকটাক অনেক কিছুই আমাকে জানিয়েছে। সেই সুবাদেই বলতে পারেন ওর সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। তবে এর বেশি কিছু না। কখনোই আমি ওকে একজন ভালো বন্ধু ব্যতীত অন্যকোনো দৃষ্টিতে দেখিনি। ওকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবিনি।

লাবিবের মুখে এসব কথা শুনে হাফ ছেড়ে বাঁচে রওনক। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো সে তার কাছের একজন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তার পছন্দের মানুষটাকে কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সবকিছু শুনার পর তার ভেতর থেকে একটা মস্তবড় পাথর নেমে গেল মনে হচ্ছে। এতক্ষণ হাসাহাসি করলেও এবারে খানিকটা সিরিয়াস ভাব নিয়েই লাবিব জানতে চায়,

-কিন্তু এসব কখন হলো?

-কোন সব?

-এই যে আপনি আর চিত্রলেখা। কখন আপনারা দু’জন একে-অপরের এত কাছে চলে এলেন? আমি তো কিছু টেরই পেলাম না। চিত্রলেখাও কখনো কিছু জানায়নি আমাকে।

-তুমি যেমনটা ভাবছো তেমন কিছুই না।

-তাহলে কেমন?

-আমাকে বাসা থেকে বিয়ে করার জন্য প্রেসারাইজ করা হচ্ছে।

-সেটা তো জানি।

-বিয়ে আমাকে করতেই হবে। না করার কোনো অপশন নেই।

-হঠাৎ! কি এমন হলো যে আপনি রাজি হয়ে গেলেন?

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রওনক। তারপর বলে,

-তুমি তো ভাইয়া ভাবীর বিষয়টা জানো।

রাদিন যে তানিয়াকে চিট করছে তার লাবিবও জানে। ইনফ্যাক্ট রওনকের অর্ডারে লাবিবই রাদিনের সবরকম খোঁজ-খবর রাখতো, এখনো রাখছে। রওনক বলতে থাকে,

-ভাবী নিজেও সব জানে। সব জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভাইয়াকে ডিভোর্স দিবে। আর আমাকে একটা শর্ত দিয়েছে।

-কিসের শর্ত?

-মিশকাত ও মীমকে যদি আমি নিজের কাছে রাখতে চাই তাহলে আমায় বিয়ে করতে হবে। বিয়ে করলে আমি ওদের দায়িত্ব পাবো। নয়ত ভাবী ওদের সঙ্গে নিয়ে চলে যাবে তাও দেশ ছেড়ে।

-দেশ ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উনি?

-হ্যাঁ।

-আপনি বাঁধা দেননি কেনো?

-ভাবীকে আমি আর বেঁধে রাখতে চাই না। ভাইয়ার সঙ্গে বিয়ে হবার পর থেকে সে নিজের জীবন ভাইয়ার জন্য, আমাদের পরিবারের জন্য বিজনেসের জন্য উৎসর্গ করে গেছে প্রতিমুহূর্ত। আমিও চাই ভাবী ভালো থাকুক। এবার অন্তত জীবনটা নিজের মতো করে কাটাক। নিজের জন্য বাঁচুক। মিশকাত, মীম আমার কাছে থাকলে ভাবী আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারবে। ওরা সঙ্গে থাকলে সে কখনোই নিজের জন্য ভাববে না। নিজের যতটুকু জীবন বাকি আছে সেটুকুও বাচ্চাদের জন্য উজার করে দিবে, যা আমি চাই না।

-সবই বুঝলাম। কিন্তু এসবের মধ্যে চিত্রলেখা কোথা থেকে এলো?

-জানি না কোথা থেকে এলো জাস্ট চলে এসেছে।

-আর সেটা কীভাবে?

-বাসায় আমার জন্য সাবাকে ফাইনাল করা হয়েছে যদিও এতে ভাবীর হাত নেই। ভাবী চায় আমি বিয়ে করি কাকে করি সেটা ফ্যাক্ট নয়। তবে আমি জানি ভাবী নিজেও চায় না সাবা বা সাবার মতো কেউ আমার জীবনে আসুক। আর সারাজীবন বিয়ে না করলেও এই মেয়েকে আমি কেনোদিনও বিয়ে করব না। অবশ্য বিয়ে করতাম না। ভাবীর শর্তটার কাছে হার মানতে হচ্ছে আমায়। সেজন্যই মূলত বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তখনই চিত্রলেখা সামনে পড়ে যায়। ওকে দেখে মনে হলো সি ইজ দ্যা ওনলি পার্ফেক্ট ওয়ান ফর মি। আমার নিজের বউয়ের চাইতে বাচ্চাদের জন্য মায়ের মতো একজন বেশি প্রয়োজন। এর জন্য চিত্রলেখার চাইতে পার্ফেক্ট কেউ হতেই পারে না। সাবা হাই সোসাইটি মেইনটেইন করার জন্য পার্ফেক্ট ওয়াইফ হলেও সি ইজ নট ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল। মিসেস রওনক হবার যোগ্যতা সাবার থাকলেও আমার বউ, বাচ্চাদের চাচী কম মা হওয়ার যোগ্যতা একমাত্র চিত্রলেখার আছে। তাই বলতে পারো আই রিয়েলি নিড হার।

-এসব আপনি চিত্রলেখাকে বলেছেন? জানিয়েছেন সব বিস্তারিত? সব শুনে কি ও রাজি হয়েছে আপনার প্রস্তাবে?

-এসব বলিনি। শুধু বলেছি আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। ভাবতে সময় দিয়েছি। বলেছি চিন্তা ভাবনা করে আমাকে জানাতে তবে জবাবে না শুনবো না। রাজি হবার জন্য চিন্তা-ভাবনা করতে সময় দিয়েছি।

হতাশ দৃষ্টি নিয়ে লাবিব রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,

-মাথায় ব ন্দু ক ঠেকিয়ে যদি কবুল বলতে বলেন তাহলে বেচারি কবুল না বলে কোথায় যাবে?

-ব ন্দু ক তো ঠেকাইনি এখনো।

চোখ বড় বড় করে লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-আপনি কি সত্যি সত্যি ব ন্দু ক ঠেকানোর কথাও ভাবছেন নাকি?

-প্রয়োজন হলে পিছ পা হবো না অবশ্য।

-না না এসব দিয়ে হবে না। এর চাইতে বরং সত্যি টা ওকে জানান। এতে হয়ত রাজি হলেও হতে পারে।

-রাজি হবে না আমি জানি। নিজের ভালো পাগলেও বুঝে। জেনে শুনে কেউ আগুনে ঝাপ দেয় না। তাই সব জেনে চিত্রলেখা কখনোই বিয়ে করতে রাজি হবে না।

-আপনি চিত্রলেখাকে চিনেন না। ওর কর্মকান্ড কখনো কখনো পাগলকেও হার মানায়। আপনি ভাবছেন সব শুনে রাজি হবে না। অথচ এমনও হতে পারে সব শুনে তৎক্ষনাৎই রাজি হয়ে আপনাকে চমকে দিলো।

-তুমি বলছো ওকে সব বলে দিতে?

-হ্যাঁ বলছি।

চিন্তার রেখা স্পষ্ট হয় রওনকের কপালে। কিন্তু আপাতত লাবিব আর এই লাইনে কথা না বাড়িয়ে অনুমতি চেয়ে বলে,

-আপনি অনুমতি দিলে একটা কথা বলি?

-এতকিছু বলার পর অনুমতি চাইছো?

-এখন যা বলবো মনে হলো এই কথাটা বলার জন্য অনুমতি নেয়া প্রয়োজন।

-বলো, পারমিশান গ্রান্টেড।

-একান্তই নিজের প্রয়োজনে একজনকে বিয়ে করবেন এটা কি ঠিক হবে? বিয়ের মাধ্যমে একটা সম্পর্ক তৈরি হবে অথচ সেই সম্পর্কে কোনো ভালোবাসা নেই। এটা কি উচিত?

লাবিবের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো উত্তর নেই রওনকের কাছে। সে নিজেও জানে এটা অন্যায় কিন্তু আপাতত সে নিরুপায়। চিত্রলেখাকে না হলে তাকে সাবাকে বিয়ে করতে হবে যা সে একদমই চায় না। সাবা ও চিত্রলেখা নামক দু’টো অপশনই আছে তার কাছে এই মুহূর্তে। অন্য-কোনো উপায় বের করার মতো সময় তার হাতে নেই। নাহলে চিত্রলেখাকে অপশন হিসেবে কখনোই বিবেচনা করতো না সে। লাবিব আরও বলে,

-চিত্রলেখা আমার খুব ভালো বন্ধু। আপনাকেও চিনি পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে। নিঃসন্দেহে বলতে পারি আপনার সঙ্গে বিয়ে হলে চিত্রলেখা চমৎকার একজন লাইফ পার্টনার পাবে। তবে চিত্রলেখাকে যতটুকু চিনি, জানি তা থেকে এতটুকু বলতে পারি এই মুহূর্তে ওর একজন চমৎকার লাইফ পার্টনারের যতটুকু দরকার একই সঙ্গে ততটুকু একজন ভালোবাসার মানুষও খুব প্রয়োজন। যে প্রতিটা মুহূর্ত ওকে আগলে রাখবে ভালোবাসার চাদরে। এমন নয় ওর জীবনে ভালোবাসার অভাব। ওর পরিবার, ভাইবোনগুলো আমার মতো যে কয়জন কাছের মানুষ আছে আমরা সবাই ওকে ভালোবাসি কিন্তু তারপরেও ওর একজন একান্তই ব্যক্তিগত ভালোবাসার মানুষ প্রয়োজন, ভালো বন্ধু হিসেবে এটা আমি মনে করি। ও নিজে থেকে হয়ত কখনোই কাউকে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস করবে না। তাই কেউ যদি সামনে থেকে ওকে ভালোবাসে, নিজের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখে সেটা মনে হয় সবচাইতে ভালো হবে চিত্রলেখার জন্য।

রওনক কেবল শুনে যায় কিছু বলে না। লাবিব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বসকে এর বেশি ল্যাকচার দেয়াটা হয়ত শোভন দেখাবে না। যতই ওদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক, সুসম্পর্ক থাকুক তবুও ভুলে গেলে চলবে না আদৌতে ওরা সম্পর্কে বস ও এমপ্লয়ি। আর বস হচ্ছে এমন একজন মানুষ যে ভুল হলেও সঠিক। একটা প্রবাদ আছে ❝বসেস আর অলওয়েজ রাইট।❞ বেরিয়ে যাবার আগে লাবিব কথার লেজ টেনে আরেকটু বলে,

-চিত্রলেখাকে সবটা বলবেন কি বলবেন না সেটা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। টেনশন করবেন না, আমি কখনো ওকে এসব কিছুই বলবো না। তবে এতটুকু বলতে পারি যদি ওর বিয়ে আপনার সাথে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে চিত্রলেখা একজন চমৎকার লাইফ পার্টনার পাবে। আর একজন ভালো বন্ধু হিসেবে আমি চাই খুব বেশি কিছু না হলেও চিত্রলেখা অন্তত এতটুকু পাক। আপনার মতো একজন ভালো, চমৎকার পার্টনার ওর জীবনে আসুক। আপনি ওর জীবনে আসুন। ওকে আগলে রাখুন হয় আপনার ভালোবাসা দিয়ে নয় ছায়া দিয়ে তবু আগলে রাখুন। কখনো যদি মনে করেন আমার কোনো হেল্প আপনার প্রয়োজন আই এম অলওয়েজ দেয়ার ফর ইউ বোথ।

লাবিব দরজা পর্যন্ত গিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্য গেইট খুলতেই পেছন থেকে রওনক বলে,

-আপাতত একটু খোঁজ নিয়ে দেখো কোথায় গেল। বাসায় গিয়ে থাকলে ইটস ওকে। ভাবতে ভাবতে তো পথে-ঘাটে ভবঘুরের মতো হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস আছে। গাড়ি একটা মে রে দিয়ে গেলেও টের পাবে না। টের পাবার আগেই ম রে ভূ ত হয়ে যাবে। কি একটা আপদ যে গলায় ঝুলাতে যাচ্ছি তা এক আল্লাহই ভালো জানেন।

লাবিব মুচকি মুচকি হাসে। বেরিয়ে যাবার আগমুহূর্তে বলে,

-ডন্ট ওয়ারি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।

পেছনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রওনক। সে গতকাল থেকেই মনে মনে অনুতপ্ত হয়েছিল লাবিবের জন্য। আজ সব কিছু শুনার পর সত্যিই স্বস্তি লাগছে। লাবিব তার কাছের মানুষ। ওকে কষ্ট দিতে চায় না সে কোনোভাবেই। ওর মনে যে চিত্রলেখাকে নিয়ে অন্য-কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই আপাতত এতটুকু শুনেই হালকা লাগছে রওনকের।

লাবিব নিজের চেয়ার বসে পড়েই আগে এক গ্লাস পানি খায়। চিন্তার ছাপ তার কপালে গাঢ় হয়। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয় লাবিবের মন-মস্তিষ্ক। এমনটা হতে পারে তা সে কখনোই চিন্তা করেনি। রাদিনের অন্য একজনের সাথে সম্পর্কের কথা জানার পর লাবিব অনেক ভেবেছে তানিয়া এসব জানার পর কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে? এটাও ভেবেছে হয়ত ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আবার বাচ্চাদের কথা মাথায় আসলে মনে হয়েছে হয়ত বাঙালী অন্য আর সাধারণ দশটা নারীর মতো বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিবে চুপচাপ। যা লাবিব কখনোই চায়নি। তানিয়া ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুনে যথেষ্টই খুশি হয়েছে সে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেশ ছেড়ে চলে যাবে এমনটা কখনোই আশা করেনি, ওর চিন্তা-ভাবনাতেও আসেনি এমন কিছু হতে পারে। তানিয়ার জায়গায় অবশ্য সে একদম সঠিক। এখানে একটা সম্পর্কের এমন করুন পরিণতির পর তার জন্য এখানে থাকাটা কঠিন হবে বলা যায়। তাছাড়া নতুন করে শুরু করার জন্য সব কিছু ছেড়ে তার দূরে চলে যাওয়াটাই শ্রেয়। কিন্তু লাবিব কি করবে! তানিয়া এভাবে চলে গেলে তার অব্যক্ত অনুভূতিদের কি হবে? সে কি কখনোই তানিয়াকে তার মনের কথা জানানোর সুযোগ পাবে না? তানিয়াকে যে সে এত পছন্দ করে, ভালোবেসে ফেলেছে এই কথাটা কি কখনো বলতে পারবে? বলার সুযোগ পাবে? এতদিন তো কেবল ভেবে এসেছে এই জীবন তার দূর থেকে ভালোবেসেই কাটবে। কিন্তু যখন থেকে রাদিনের পরকীয়ার বিষয়টা জানতে পারলো তখন থেকে লাবিবের নিজের অজান্তেই একটা আশার চারা বোপন হয়েছিল মনের ভেতর। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে চারা টা গাছে পরিনত হবার আগেই মা রা যাবে। এই জীবনে হয়ত লাবিব কখনোই তানিয়াকে নিজের মনের কথা, ভালোলাগা, ভালোবাসার কথা বলতে পারবে না। বলার সুযোগ পাবে না। তাকে পাওয়া তো অনেক দূরের কথা। নিমাই ভট্টাচার্য তার মেমসাহেব উপন্যাসে যথার্থই বলেছিলেন, ❝জীবনে যে ভালবাসা পায়, সে আর কিছু পায় না; যে জীবনে আর সব কিছু পায়, সে ভালবাসা পায় না ।❞ লাবিব এই জীবনে সব না পেলেও অনেককিছুই পেয়েছে তাই ভালোবাসা বুঝি তার কপালে নেই। হতাশা ও হাহাকারে ওর বুকের ভেতরটা তাতিয়ে ওঠে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রিপা অনেকক্ষণ ধরে লিখনের জন্য অপেক্ষা করছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পেয়ে ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিপা বলে,

-এতক্ষণ লাগলো কেন আজ তোমার?

-একটা কাজ ছিল ওটা করতে গিয়েই দেরি হয়ে গেল।

-কি কাজ?

-ছিল একটা কাজ।

-ছিল একটা কাজ আবার কেমন কথা! কি কাজ সেটা বলতে পারছো না?

লিখন এক্ষুনি রিপাকে বলতে চাইছে না কিছু। চাকরীর কথা শুনলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে দুনিয়া মাথায় তুলে ফেলবে এই মেয়ে তা লিখন ভালো করেই জানে। তাই এক্ষুনি না বলে চাকরীর একটা ব্যবস্থা হলে পরে জানাতে চায় সে। লিখনকে চুপ করে থাকতে দেখে রিপা জোর দিয়ে বলে,

-ঘটনা কি খুলে বলো তো। এমন কি কাজ যা তুমি আমাকে বলতে পারছো না। কি আড়াল করছো সত্যি করে বলো তো।

লিখন ভালো করেই জানে পৃথিবীতে দুইজন নারীর কাছ থেকে সে নিজের মনের ভেতরকার অবস্থা আড়াল করতে পারবে না কখনোই। তাদের একজন চিত্রলেখা আরেকজন রিপা। তাই বাধ্য হয়েই লিখন রিপাকে চাকরীর বিষয়টা জানায়। সব শুনে রিপা বলে,

-এই সময়ে তুমি চাকরী করবা? এখন চাকরীতে ঢুকলে যে তোমার ফাইনাল খারাপ হবে এটা তুমি জানো না?

-জানি কিন্তু কিছু করার নাই। আমি স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা দেখে সব দায়-দায়িত্ব আপার ঘাড়ে চাপায় দিতে পারি না।

-আমি তোমাকে বলছিও না সব আপার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে। আমি জাস্ট বলছি যেখানে এতদিন কষ্ট করেছো আর নাহয় কয়েকটা মাস মাত্র। পরীক্ষাটা হয়ে যাওয়ার পর নাহয় ভালো দেখে একটা জব জয়েন করলা। এছাড়া বাইরে চলে গেলে তো পড়ালেখার পাশাপাশি ওখানেও পার্টটাইম জব করতে পারবা।

লিখন মুখ ফিরিয়ে রিপার মুখের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল যা রিপা ধরতে পারেনি। সেই কিছু একটা হচ্ছে অবাক হওয়া। রিপার কথা শুনে অবাক না হয়ে পারে না লিখন। পরিবারের এমন অবস্থায় বিদেশ যাবার কথা ভাবতেই পারে না ও। কীভাবে ভাববে? যেখানে দুইদিন পর একটা চাকরী জোগাড় না করতে পারলে ঘরের অবস্থা হবে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে লিখন কিনা বিদেশ যাবে! কি চিন্তা-ভাবনা করে রিপা এসব বলছে তা লিখন ভেবে পায় না। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো ধরনের তর্ক করার মতো মন-মানসিকতা না থাকায় এই প্রসঙ্গে কথা বলে না ও। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে রিপা নিজেই বলে,

-তুমি বরং একটা কাজ করো মন দিয়ে তোমার পড়ালেখাটাই সারো। এদিক থেকে আমি নাহয় তোমাকে কিছু হেল্প করলাম। কিছু না সবটাই করলাম। তোমার তো চাকরীর অভিজ্ঞতা নেই। এখন যদি তুমি চাকরী পেয়েও যাও দেখা যাবে কত টাকাই বা বেতন পাবা। সেই টাকা টা নাহয় আমি তোমাকে দিলাম। তুমি সেটা আপার হাতে দিয়ে দিও। এতে করে তোমার চাকরী করা লাগবে না আবার তুমি মন দিয়ে পড়ালেখাটাও করতে পারবে।

এবার আগের চাইতে আরও বেশি অবাক হয় লিখন। এমন সব কথা শুনে অবাক না হয়েও পারা যায় না। নিজেকে সামলে নিয়ে লিখন জানতে চায়,

-আর এভাবে কতদিন চলবে?

-যতদিন প্রয়োজন।

-টাকাগুলো আপার হাতে দেয়ার পর আপা যখন জানতে চাইবে এতগুলো টাকা কোথা থেকে আসলো তখন কি বলবো আমি?

-বলবা ফ্রেন্ডের থেকে ধার করেছো।

-প্রতিমাসে ধার করবো? শোধ দেয়া লাগবে না?

-আপাকে বলবা তোমার এই ফ্রেন্ডের পারিবারিক অবস্থা ভালো। বলছে পরে যখন চাকরী করবা তখন শোধ দিলে হবে। এখন শোধ দেয়া লাগবে না।

-আর তোমার মনে হয় আমার বোন এই বাহানা শুনে আমাকে সন্দেহ করবে না বা এই টাকা সে এক্সেপ্ট করবে?

-কেন করবে না? টাকাকে কি কেউ রিফিউজ করে নাকি?

-শুনো রিপা আমার বোন গোল্ড ডিগার না। যদি ওর ধ্যান ধারনায় কেবল টাকা টাই থাকতো তাহলে এতদিনে নিজের অফিসের একজন ভালো ইনকাম করা পয়সাওয়ালা কলিগকে বিয়ে করে আয়েশের জীবন কাটাতো। কিন্তু আমার বোন এমন না। ও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের মানুষ করতে চায়। আমাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চায় তবে নিজের যোগ্যতায় কারো দয়ায় না।

লিখনের কথা শুনে রিপা কিছুটা অপ্রস্তুত হয় সেই সঙ্গে খানিকটা ঘাবড়েও যায়। নিজের কথা দিয়ে ও এমন কিছু মিন করেনি। তাই তৎক্ষনাৎই কারেকশন করে বলে,

-তুমি ভুল ভাবছো লিখন। আমি মোটেও এটা মিন করিনি আপা গোল্ড ডিগার। আমি জাস্ট কথার কথা বললাম। দুনিয়াতে এমন কম মানুষই আছে যারা সামনে থেকে হেটে আসা টাকা রিফিউজ করে।

-আমার বোন সেই কয়জন মানুষেরই একজন রিপা। বরং বলতে পারো এমন যদি পৃথিবীতে একজন থাকে তাহলে সেটা আমার বোন। তুমি তো এখনো আমার বোনকে দেখোনি, ওর সঙ্গে তোমার আলাপ-পরিচয় হয়নি তাই তুমি জানো না ও কেমন। আমার বোনকে মাটি বললেও কম বলা হবে। মাটির চাইতেও নরম, সোনার চাইতেও খাটি যে মানুষটা সেটা হচ্ছে চিত্রলেখা; আমার বোন।

-আমার কথার ভুল মিনিং ধরছো তুমি লিখন। আমি জাস্ট তোমাকে হেল্প করতে চাই আর কিছু না। আমি চাইনা বর্তমানের চিন্তা করতে গিয়ে তোমার ভবিষ্যৎ টা নষ্ট হয়ে যাক। সামনে তোমার অনেক সুন্দর একটা ভবিষ্য অপেক্ষা করছে।

-আপাতত আমার জীবন ডিকশনারিতে ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই। যার বর্তমানের গ্যারান্টি নেই তার আবার কিসের ভবিষ্যৎ?

-সেজন্যই তো আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। তোমার জন্য কিছু করতে চাই। যাতে করে বর্তমানের যাতাকলে পিষতে গিয়ে তুমি ভবিষ্যতের খেই না হারিয়ে ফেলো। সেজন্যই তোমার জীবন নৌকার পাল হতে চাই আমি লিখন।

-আমি সবসময়ই মনে করি আমার ভাগ্য ভীষণ ভালো বলেই তোমার মতো একটা মেয়ে আমার মতো পরিচয়হীন একটা ছেলের জীবনে এসেছে। এতদিনের সম্পর্কে কখনো তোমাকে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে পর্যন্ত খাওয়াতে পারিনি। ঐ সর্বোচ্চ ২০০ টাকার পাস্তা, ৪০০ টাকার পিৎজ্জা ওসবকে ভালো খাওয়া বলেও না আজকাল আর। কিন্তু আমার মতো ছেলের জন্য ওটাই অনেক। আমি নিজেও চাই আমাদের ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর হোক সেজন্য আগে আমাকে বর্তমানের যুদ্ধটা জিততে দাও। এখনই যদি আমি তোমার সাহায্য নিয়ে ফেলি তাহলে ভবিষ্যৎ নামক যুদ্ধ জিতবো কী দিয়ে? আমাদের ভবিষ্যৎ টা যেনো সুন্দর হয় সেই খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব। তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি কেবল আমার পাশে থেকো তাহলেই হবে।

রিপা আর কিছু বলতে পারে না। লিখনের একটা হাত ধরে রাখে শক্ত করে। তাকে বুঝায় সে পাশে আছে সবসময়।

রওনকের কেবিনের দরজায় দু’বার নক করে ভেতরে প্রবেশ করেই লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-আমায় ডেকেছিলেন?

-চিত্রলেখার কোনো খোঁজ পেলে? কোথায় গেছে কিছু জানো?

-ওর ফোনটা বন্ধ।

-বাসায় কাউকে ফোন করে দেখেছিলে?

-ওর ছোট বোনকে ফোন করেছিলাম। সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তবে কথা বলে বুঝলাম চিত্রলেখা বাসায় যায়নি।

রওনকের কপালে চিন্তার রেখা গাঢ় হয়। তা দেখে লাবিব বলে,

-চিন্তা করবেন না। চিত্রলেখা বুদ্ধিমতী মেয়ে নিশ্চয়ই ঠিক আছে।

-হোপ সো।

বেরিয়ে যাবার আগে লাবিব আবার জিজ্ঞেস করে,

-চিত্রলেখাকে কি খুব বেশি প্রয়োজন? আই মিন কোনো জরুরী কাজ থাকলে আমায় বলতে পারেন।

-না ইটস ওকে। কিছু লাগলে তোমায় বলবো।

লাবিব আর অপেক্ষা করে না, বেরিয়ে যায়।

চিত্রলেখা আসার পর থেকে আফিফাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। এর মধ্যে কান্নাকাটিও করেছে কয়েকদফা। চিত্রলেখাকে ওরকম হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে একদমই বাঁধা দেয়নি আফিফা। কিন্তু এতক্ষণ ধরে জড়িয়ে বসে থাকলে তো সমস্যা। অনেকক্ষণ হয়েছে বাবলুকে কিছু খাওয়ানো হয়নি। দুধের বাচ্চা বেশিক্ষণ না খেয়েও থাকতে পারে না। অবশ্য এখন সে ঘুমাচ্ছে তবে আফিফা জানে আর কিছুক্ষণ পরেই বাবলুর ঘুম ভাঙ্গবে। আর ঘুম থেকে উঠেই খাওয়ার জন্য চিৎকার শুরু করবে। তাই বাবলুর ঘুম ভাঙ্গার আগেই চিত্রলেখাকে স্বাভাবিক করতে হবে। সেই চেষ্টায়ই বান্ধবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আফিফা বলে,

-বাকি কান্নাটা নাহয় বিকালে কাঁদিস। এখন বাবলু উঠে যদি দেখে তুই ওর মতো করে কাঁদছিস তাহলে তো আরেক কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এর চাইতে নাহয় তুই আপাতত কান্নাকাটি পজ রাখ বাকিটা বিকালে কাঁদিস বাবলু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর।

আফিফাকে ছেড়ে দিয়ে চিত্রলেখাকে বলে,

-তুই আমার সঙ্গে মশকরা করছিস আফি?

চিত্রলেখার গালে সয়লাব হয়ে থাকা চোখের পানি পরম মমতায় দু’হাতে মুছে দিয়ে আফিফা বলে,

-একদম করছি। তোর সঙ্গে আমি মশকরা করব না তো কে করবে শুনি? এখন আমরা সই কয়দিন পর তোর বিয়ে হবে, একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে হবে। সেই মেয়েকে আমি বাবলুর বউ করে আনবো। তারপর আমরা বেয়াইন হবো। হলো না আমাদের মশকরার সম্পর্ক?

-তুই আবার এসব শুরু করলি? কোনো বাবলু টাবলুর কাছে আমি মেয়ে বিয়ে দিবো না।

আফিফা দুষ্টুমি করে চিত্রলেখার চিবুকে টিপ দিয়ে বলে,

-ভুলে যাইস না তুই নিজেই নামটা দিয়েছিস। তোর এই নাম আমি একটা শর্তেই রাখছি। বাবলু তোর মেয়ের জামাই হবে।

এসব কথপোকথন চলতে থাকে। চিত্রলেখা কান্নাকাটি ভুলে গিয়ে দুই বান্ধবী জোড়ালো হাসিতে মেতে ওঠে। ওদের হাসির শব্দে বাবলুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। বেচারার আরামের ঘুমে ব্যাঘাত ঘুটায় দুনিয়া ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করে দেয়। বাবলুকে বিছানা থেকে তুলে চিত্রলেখার কোলে দিয়ে আফিফা বলে,

-তুই তোর মেয়ের জামাই সামলা আমি ওর ফিডারটা বানিয়ে নিয়ে আসছি এক্ষুনি।

বাবলুকে চিত্রলেখার কোলে দিয়েই ভৌ-দৌড় লাগায় আফিফা। এদিকে চিত্রলেখা ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাবলুর কান্না থাকাতে। অবশ্য তাকে বেশি কসরত করতে হয় না। বাবলু কান্নার ফাঁকে একবার চিত্রলেখাকে দেখেই থেমে যায়। মনে হয় যেনো কান্না করার কথা ভুলে গেছে বেচারা। চিত্রলেখাও নিজের মন কেমন ভুলে গিয়ে বাবলুকে নিয়ে মেতে ওঠে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখন বাড়ি ফিরতেই তার দেখা হলো বৃষ্টির সঙ্গে।তার ঘরেই বসে আছে। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছো বৃষ্টি?

বৃষ্টি লিখনের কথার জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,

-আপনি চাকরী খুঁজছেন?

লিখন মুখ তুলে একবার বৃষ্টির মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। চেয়ার টেনে বসে পরে বৃষ্টির মুখোমুখি। লিখনের থেকে কোনো জবাব না পেয়ে বৃষ্টি আরও জিজ্ঞেস করে,

-চাকরীটা কি খুব বেশি প্রয়োজন?

-আমার হয়ে তুমি কি আঙ্কেলকে একটু বলবা? উনি তো তোমার কথা ফেলেন না কখনো।

-এই সময় চাকরী করলে যে আপনার লেখাপড়া গোল্লায় যাবে সে খবর জানেন তো?

-রেজাল্ট হয়ত আশানুরূপ হবে না তবে ফেইল করব না। তুমি তো জানোই আমি ফেলটুস ছাত্র না।

-সে খবর কি আমার থেকে ভালো কেউ জানে? তবে আমি একটা কথা বলি?

-অন্তত চাকরী করতে নিষেধ করো না অন্য সবার মতো। চাকরীটা আমার ভীষণ প্রয়োজন।

বৃষ্টি মুখ তুলে লিখনের মুখের দিকে তাকায়। এত মায়ামায়া লাগলো ওর কাছে। মন চাইছে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলুক, আপনি একদম ভাববেন না। দেখব সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনার সব স্বপ্ন পূরণ হবে। আর এই কঠিন সময়ে আমি সর্বদা আপনার পাশে আছি। কিন্তু এসব কথা বৃষ্টির মনের ভেতরেই রয়ে যায়। সে জানে লিখন কোনোদিন তার দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকায়নি। হয়ত কোনোদিন তাকাবেও না। বৃষ্টির নিজের মনের ভেতর অনুমতি ছাড়া জন্ম নেয়া এসব অনুভূতির দায় ভার তো লিখনের উপর বর্তায় না। দুম করে বলে দিয়ে লিখনকে সে বিব্রতও করতে চায় না, করবেও না। কিন্তু এই মায়াও সে ছাড়তে পারবে না। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর বৃষ্টি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

-আমি বলছিলাম কি চাকরীর খোঁজ না করে আপনি বরং কোচিং সেন্টার খুলে ফেলুন।

-কোচিং সেন্টার?

-হ্যাঁ, বাড়িতেই নাহয় পড়াবেন। ব্যাচ করে। দেখবেন চাকরী করলে মাস শেষে যা বেতন আসবে ছাত্র পড়িয়ে আপনি আরও বেশ ভালো করছেন।

-কিন্তু আমার কাছে পড়বে কে?

-কে পড়বে না সেটা বলুন? এতদিন বাড়ি গিয়ে পড়িয়েছেন এখন আপনার বাড়ি এসে পড়বে। গিয়ে পড়ালে তো একই সময় ২/১ জনের বেশি পড়াতে পারবেন না। কিন্তু এসে পড়লে একই সময় ৫/৭ জন করেও পড়াতে পারবেন। আমি তো মনে মনে ভেবেও ফেলেছি। আপনি যদি শুধু ইংরেজিটাও পড়ান। একই ব্যাচে ১০ জন করে পড়লে ১ ঘন্টা করে সময় দিলেও মাস শেষে ১০ হাজার টাকা। দিনে ২/৩ টা ব্যাচে যদি ২০/২৫ জনও পড়ান তাহলেই আপনাকে আর চাকরী করতে হবে না। আপনি নিজেও পড়ার সময় পাবেন। আইএলটিএস বাদ দেয়া লাগবে না। আপনার স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হবে না।

বৃষ্টির কথা শুনে লিখন ভারি অবাক হয়। অবাক হওয়ারই কথা। মেয়েটা আজ সকালেও তার সঙ্গে কথা বলেনি। মুখ ফিরিয়ে রেখেছে অভিমানে। অথচ তার বিপদের কথা শুনে দৌড়ে এসেছে তাও খালি হাতে নয়। একটা চমৎকার বুদ্ধি নিয়ে এসেছে। এই মেয়েটা যার জীবনে যাবে তার জীবনে বিপদ হবে সবচাইতে তুচ্ছ বিষয়। কারণ বৃষ্টি নামক চমৎকার মেয়েটা সব সহজ করে দিবে নিজের বুদ্ধি দিয়ে। মনে মনে এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতেই লিখনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তা দেখে বৃষ্টি অবাক হওয়া সুরে জিজ্ঞেস করে,

-হাসছেন কেনো? আমি কি হাসির কথা বললাম?

-না না হাসছি অন্য কারণে।

-আমি কি বললাম বুঝেছেন তো?

-সবই বুঝলাম কিন্তু এত ছাত্র আমি কোথায় পাবো?

-আপনি পড়ানো শুরু তো করুন। বাগানে ফুল থাকলে যেমন মৌমাছি আসবেই তেমন আপনি পড়াতে থাকলে ছাত্র আপনার কাছে আসবেই। আমার ক্লাসের কয়টা বান্ধবী আপনার কাছে পড়ার আগ্রহ জানিয়েছিল। আপনাকে তো আমি বলেও ছিলাম। আপনি না করে দিয়েছিলেন হাতে সময় নেই বলে। আমি ওদের সবাইকে জানাবো। হলে নাহয় ওদের দিয়েই শুরু করুন।

-আর তুমি? তুমি পড়বে না আমার কাছে।

-আমি তো কোচিং করছি আমার কলেজের মাসুদ স্যারের কাছে।

-তুমি না বলেছিলে মাসুদ স্যারের পড়া তুমি বুঝো না।

-যার পড়া বুঝি সে তো মাঝপথেই ছেড়ে দিলো তাই আপাতত মাসুদ স্যারই ভরসা।

-আই এমন সরি বৃষ্টি। ঐ সময়…

-এই প্রসঙ্গটা আপাতত থাক। আমি আজ বাড়ি যাই। ওদের সঙ্গে আলাপ করে আপনায় জানাবো। নাঈমকে দিয়ে খবর পাঠাবো।

-তুমি আসবে না?

-না।

-আমার কোচিং সেন্টারের প্রথম ছাত্র তুমি হলে কোচিং সেন্টার খুলবো আর নয়ত এসব পড়ানো টরানো বাদ। আমি চাকরী খুঁজে নিবো।

বৃষ্টি উঠে দাঁড়ায়। মুখটা কঠিন করে বলে,

-আমি মাঝপথে মাসুদ স্যারকে ছাড়তে পারব না। মাঝপথে ছেড়ে দেবার অভ্যাস আমার নেই।

-তবুও আমি অপেক্ষায় থাকবো। তুমি না এলে কাউকে পড়াবো না। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।

বৃষ্টি বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরও বলল,

-সকালে আপনি আমাদের বাড়ি কিছু খাননি। গতকাল বিরিয়ানি রান্না হয়েছিল। খালার কাছে দিয়েছি। বেশি করে আলু দিয়েছি, খেয়ে নিবেন। আসছি।

আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় বৃষ্টি। পেছনে লিখন বসে থাকে চেয়ারটায়। অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনার দোটানায় অস্থির সে।

বৃষ্টি ঘর থেকে বের হতেই তার দেয়া হয় চয়নের সঙ্গে। মিষ্টি করে হাসি দিয়ে চয়ন জিজ্ঞেস করে,

-অনেকদিন বাদে এলে। কেমন আছো?

-ভালো। তোমার কি খবর? লেখাপড়া কেমন যাচ্ছে?

-ঐ যাচ্ছে ভালোই। তুমি কি বসবে না?

-বসলাম অনেকক্ষণ। আজ বাড়ি ফিরব দেরি হয়ে যাচ্ছে।

-তাহলে তো গল্প করার সুযোগ পেলাম না। আরেকদিন এসো কেমন।

-আচ্ছা আসবো।

বৃষ্টি চয়নকে অতিক্রম করে এগিয়ে গেলে চয়ন পেছন ফিরে বলে,

-বৃষ্টি আপু, তুমি অনেক লক্ষি একটা মেয়ে। এই কথাটা কি কেউ কোনোদিন তোমায় বলেছে?

-চিত্র আপা বলেন সবসময়। যখনই আমাদের দেখা হয় তখনই বলেন। আর আজ তুমি বললে।

-আপা কিন্তু সত্যি বলে। তুমি আসলেই লক্ষি। আমার ভাইয়ের কপাল ভালো।

-মানে!

-ওসব মানে আজ থাক আরেকদিন বলবো। আমার একটু তাড়া আছে।

চয়নের বলা রহস্য নিয়েই বাড়ি চলে যায় বৃষ্টি। মাথার ভেতর কথাটা রয়ে যায়। চিন্তা ভাবনার বিস্ফোরণ ঘটে মস্তিষ্কে। কথাটা দিয়ে চয়ন কি বুঝাতে চাইলো?

লিখন এখনো চেয়ারটাতেই বসে আছে। বৃষ্টি বেরিয়ে যাবার মিনিট খানিকের মাথায় চয়ন প্রবেশ করে। সে এখন কোচিং করতে যাবে। ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করে,

-বৃষ্টি আপুকে নিয়ে তোমার অপিনিয়ন কি?

-কিসের অপিনিয়ন?

-সে তোমাকে পছন্দ করে তুমি জানো না?

চয়নের কথা শুনে থমথমে মুখ করে ভাইয়ের দিকে তাকায় লিখন। তা দেখে চয়ন আরও বলে,

-অবাক হচ্ছো কেন? এতদিন ধরে পড়াও ধরতে পারেনি? তোমার প্রতি তার ভালো লাগা তো চোখ-মুখে ভেসে আছে। যেকেউ বলে দিতে পারবে। তুমি সত্যি সত্যি ধরতে পারোনি নাকি ইচ্ছা করেই বুঝেও না বুঝার ভান করেছো?

লিখন কোনো জবাব করে না। ভাইকে থম ধরে বসে থাকতে দেখে চয়ন কাঁধে ব্যাগ ঝুলাতে ঝুলাতে বলে,

-যাক গিয়ে আমার মনে হলো বলি তাই বললাম।

বেরিয়ে যাওয়ার আগে চয়ন আরও বলে,

-তবে যাই বলো, জীবন সঙ্গী হিসেবে বৃষ্টি আপু কিন্তু চমৎকার একজন মানুষ। তোমার জীবনে সে এলে আমরা সবাই মন্দ থাকবো না। তুমি চাইলে ভেবে দেখতে পারো।

চয়ন আর অপেক্ষা করে না। বেরিয়ে পড়ে কোচিং করতে যাবে। সামনে ওর পরীক্ষা ঘনিয়ে আসছে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-২৮+২৯+৩০

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

পুরোনো গ্রীলের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। মস্তিষ্কের ভেতর তার হাজারখানিক চিন্তা। এখান থেকে চলে যাওয়া মানে সংসার খরচ অনেক বাড়বে। পাঁচজন মানুষ মানে পাঁচটা পেট। এতগুলো মানুষের ভরণপোষণের দায়িত্ব অথচ উপার্জনের মানুষ মাত্র একজন। লিখন সবে মাত্র আইএলটিএসের জন্য ভর্তি হয়েছে। ক্লাস শেষ করে, টিউশনি করে আরেকটা বাড়তি টিউশনি করার সময় ওর নেই। এমতাবস্থায় ওর উপর সংসারের দায়িত্ব কোনোভাবেই দিতে পারবে না চিত্রলেখা। কোনো না কোনো একটা উপায় তো বের করতেই হবে। সবেই চিন্তা-ভাবনা করেছিল লিখনের পরীক্ষাটা হয়ে গেলে ওর বিদেশ যাবার জন্য টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করবে। এর মধ্যে এখন সংসারের দায়িত্ব বেড়ে গেলো। ঠিক মতো সবার জন্য করতে পারবে কিনা এসব ভেবেই ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগছে।

-কি ভাবছো আপা?

আচমকা কারো কন্ঠ পেয়ে খানিকটা ঘাবড়ে ওঠে চিত্রলেখা। পেছন ফিরে তিন ভাইবোনকে দেখে বলে,

-তোরা এই সময় এখানে কেন?

-তুমি এখানে কি করো? সকালে না অফিস আছে। না ঘুমায় অফিস করলে শরীর খারাপ করবে না?

লিখনের কথার জবাবে চিত্রলেখা বলে,

-সবে মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে। একটু পরেই ঘুমাবো। তোরা রাত না জেগে গিয়ে ঘুমা। তোদেরও তো ক্লাস আছে।

আচমকাই ওরা তিনজন এগিয়ে এসে চিত্রলেখাকে জড়িয়ে ধরে। বড় বোন কখনো মুখ ফুটে বলে না তবে ওরা ঠিকই বুঝে তার মনের অবস্থা। এই মুহূর্তে যে মন, মস্তিষ্কের দিক থেকে চিত্রলেখা খুব একটা ভালো নেই তা ওরা ভালো ভাবেই আন্দাজ করতে পারছে। লম্বা সময় নিয়ে ভাইবোনেরা মিলে আলিঙ্গন করার পর চিত্রলেখাকে ছেড়ে দিলে সে নিজের ভরে আসা চোখের কোণ জুড়ে থাকা নোনাজলের অস্তিত্বদের আঙুলের টানে মুছে ফেলে। তারপর বলে,

-অনেক হয়েছে এখন গিয়ে শুয়ে পর।

চলে যাওয়ার বদলে দাঁড়িয়ে রয় ওরা। লিখন বলে,

-তুমি কোনো চিন্তা কইরো না আপা। ঠিকই একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মাত্র তো চারজন মানুষ আমরা। তুমি আর আমি মিলে ঠিক সামলায় নিবো।

লিখনের কথা শেষ হতে না হতেই চয়ন বলে,

-বারে তোমরা দু’জন মিলে কেন সামলাবা? আমরা দুইজন তোমাদের উপর বোঝা হবো ভাবছো? চারু নাহয় সবার ছোট ও ঘরে থাকলো ওর লেখাপড়া নষ্ট হবে কিন্তু আমিও তোমাদের কাঁধে কাঁধ মিলায় সংসারের দায়িত্ব নিবো। আমরা তিনজন ইনকাম করলে টাকার পাহাড় হয়ে যাবে আমাদের দেইখো।

চয়নের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে চারু বলে,

-ও আচ্ছা আমি ছোট, আমার পড়ালেখা নষ্ট হবে। এমন ভাবে বলতেছিস লাগে জানি নিজে অনেক লায়েক হয়ে গেছিস। তোর মাস্টার্স শেষ হয়ে গেছে।

বলেই মুখ ভেংচি কাটে। জবাবে চয়ন বলে,

-ওত বড় না হইলেও আপা আর ভাইয়াকে হেল্প করতে পারবো ওতখানি বড় ঠিকই হইছি।

-তুই পারলে আমিও পারব।

-তোকে কিচ্ছু করতে হবে না।

-তুই করলে আমিও করব।

-বললাম তো তোকে কিছু করতে হবে না।

-আমিও বললাম তো…

চয়ন আর চারু রীতিমতো ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে। ওদের ঝগড়া দেখে চিত্রলেখার হাসি পেয়ে যায়। কিছু বলে না সে। লিখন বাঁধা দিয়ে বলে,

-হচ্ছে কি এসব? তোরা থামবি? এমনিতেই আপা টেনশনে আছে তারমধ্যে তোরা দুইটায় শুরুটা করলি কি? বেক্কল কথাকার।

তৎক্ষনাৎই দু’জনের মুখ চুপসে গেলো। লিখনের ঝাড়ি থেকে দু’জনকে বাঁচাতে চিত্রলেখা বলে,

-থাক ব কি স না আর।

-ব কা তো শুরুই করতে পারলাম না আপা। তুমি আগেই আটকায় দিচ্ছো।

-থাক, হইছে তো।

-আচ্ছা যাও, তোমার জন্য আজ দুইটারে মাফ করে দিলাম।

এবারে চয়ন, চারু দু’জনে একদল হয়ে লিখনকে ভেংচি কাটে। চিত্রলেখা ওদেরকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,

-অনেক হইছে এখন ঘরে গিয়ে শুয়ে পর। রাত বাড়তেছে।

-আর তুমি?

লিখনের প্রশ্নের জবাবে চিত্রলেখা কিছু বলার আগে চারু বলে,

-তোমরা যাও, আমি আপাকে নিয়ে যাইতেছি।

আর কেউ কোনো কথা বাড়ায় না। লিখন ও চয়ন চলে গেলে রয়ে যায় চিত্রলেখা ও চারু। ছোট বোনকে চিত্রলেখা বলে,

-তুইও যা শুয়ে পর। আমি একটু পরেই আসতেছি।

এগিয়ে এসে চিত্রলেখার পাশে দাঁড়িয়ে চারু বলে,

-আমি তোমার সাথে একটু থাকি আপা? একদম বিরক্ত করবো না প্রমিজ।

চিত্রলেখা কিছু বলে না। সে ভালো করেই জানে চারু তাকে কিছু বলতে চায় বলেই রয়ে গেল। নাহলে ঘুম কাতুরে মেয়েটা এই সময় অব্দি জেগে থাকতো না। তাই আর ভনিতা না করে চিত্রলেখা নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-কি বলতে চাস বলে ফেল।

-তুমি কীভাবে বুঝলা আপা?

-আমি কীভাবে বুঝলাম সেটা আর কয়টা বছর পর তুই নিজেই বুঝতে পারবি আমায় বলে দিতে হবে না।

-আমি কি কোনোদিন তোমার মতো করে তোমাদের বুঝতো পারবো আপা?

-পারবি, অবশ্যই পারবি। আমার মতো করে না পারলেও নিজের মতো করে ঠিকই পারবি।

-কিন্তু আমি তোমার মতো করে সবাইকে বুঝতে চাই। আমি তোমার মতো হতে চাই আপা।

-আমরা কেউই কারো মতো হইনা রে। আমরা সবাই নিজের মতো হইতো। আমি চাই আমার চারু অন্যকারো মতো না হয়ে নিজের মতো হোক।

এতটুকু মুখে বলে চিত্রলেখা মনে মনে আরও আওড়ায়, ❝আমি কোনোদিনও চাই না তোর জীবনটা আমার মতো হোক, কখনো চাই না। এই প্রতিমুহূর্ত ম রে যাওয়াটা আমি তোর জন্য চাই না।❞

-একটা কথা বলি আপা?

-বলবি বলেই তো রয়ে গেলি। বল, কি বলবি।

-তুমি মামুন ভাইকে বিয়ে করে ফেলো।

সামনে থেকে মুখ ঘুরিয়ে চারুর মুখের দিকে তাকায় চিত্রলেখা। বলে,

-মামুন ভাই কি রবিন হুড?

-সে তোমাকে অনেক চায় আপা।

-তুই নিজেও তো মামুন ভাইকে পছন্দ করিস।

-আমি তো তাকে পছন্দ করি কারণ সে তোমাকে ভালোবাসে সেজন্য আপা, অন্য কিছু না।

-তোর পছন্দ টা যেমন ভালোবাসা না, তেমন মামুন ভাই আমাকে চায় বলেই যে আমাকে তার পাইতে হবে এমন কোনো কথা নাই।

-কিন্তু মামুন ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে তোমার এত কষ্ট আর থাকবে না আপা।

-আমি কষ্টে আছি কে বলল তোকে?

-আমি জানি।

-কি জানিস তুই?

-তোমার অনেক কষ্ট। মামুন ভাই তোমাকে অনেক সুখে রাখবে আপা।

-সেটা নাহয় রাখলো। বিয়ে করলে আমি তার বউ হবো। আমাকে সুখে রাখা তার দায়িত্ব। কিন্তু তোদের কি হবে তখন?

-মামুন ভাই তো আমাদেরও অনেক পছন্দ করেন, আদর করেন। উনি নিশ্চয়ই আমাদের ফেলে দিবেন না।

-সেটা মামুন ভাই দিবে না তা আমিও জানি। কিন্তু মামুন ভাই নিজেই তো তার বাবার টাকায় খায়। বিয়ে করলে বউকেও তার বাবার টাকাতেই খাওয়াবে। সে কি চাইলেই তোদের দায়িত্ব নিতে পারবে?

-তার আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে না। শুধু তোমাকে সুখে রাখলেই হবে।

-তোর কেন মনে হলো তোদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়ে আমি আরাম-আয়েশের জীবন খুঁজবো?

-তুমি তো কখনই নিজের কথা ভাবো না তাছাড়া…

-তাছাড়া কি?

চারু চুপ করে থাকে। তা দেখে চিত্রলেখা তাগাদা দিয়ে বলে,

-তাছাড়া কি বল?

-এলাকার অনেকেই খালাকে বলে তোমাকে এখন বিয়ে না দিলে পরে তোমার আর বিয়ে হবে না। এমনিতেই তুমি চাকরী করো এটা নিয়েও নাকি অনেক সমস্যা হবে।

-আচ্ছা এতক্ষণে বুঝলাম আসল ঘটনা।

চারুর মাথায় হাত রেখে চিত্রলেখা আরও বলে,

-শুন, লোকের কাজ হচ্ছে কথা বলা। তারা বলুক তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার জন্য তোরা সব কিছুর উর্ধ্বে। এরপর এসব কথা শুনবি না। শুনলেও এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে ফেলবি।

-কিন্তু আপা…

-তোদের একটা ব্যবস্থা না করে আমি কোথাও যাচ্ছি না চারু। তোরাই আমার সব, তোদের ফেলে আমি কোথাও যাবো না। এমনকি ম র বোও না।

-তাই বলে তুমি বিয়ে করবা না?

-বিয়ে যদি আমার নসিবে লেখা থাকে তাহলে সময় মতো এমনিই হবে। আর না হলে বুঝে নিবো আল্লাহ আমার জন্য কাউকে বানায়নি।

চারু আরও কিছু বলতে নিলে ওকে বাঁধা দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-অনেক হইছে চারু এখন আর একটা কথাও না। ঘরে চল ঘুমাবি।

-কিন্তু আপা…

চিত্রলেখা চারুর মুখ চেপে ধরে ওকে টেনে নিয়ে ঘরে চলে যায়। আর কিচ্ছু বলার সুযোগ দেয় না। চিত্রলেখা নিজের দায়িত্ব কখনোই কারো কাঁধে চাপিয়ে দিতে চায় না। ভাইবোনগুলোর জীবন সে নিজের হাতে সাজিয়ে দিতে চায় সুখ, শান্তিতে। শুধু ওরা নিজ নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে গেলেই চিত্রলেখার মুক্তি। তারপর নাহয় খালাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। হয়ত পাহাড়ের কাছাকাছি। চিত্রলেখার ভীষণ পাহাড় পছন্দ কিন্তু কখনো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। ওরা যার যার জীবনে সেটেল্ড হয়ে গেলে নাহয় সে নিজের অবশিষ্ট জীবনটুকু কোনো এক পাহাড়ের কাছাকাছি সবুজে ঘেরা এলাকায় গিয়ে কাটিয়ে দিবে। এতটুকু ইচ্ছাই চিত্রলেখা নিজের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। এর বেশি তার চাই না।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

-তোমার মুখটা এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন মায়া?

মামুনের প্রশ্নের জবাবে দেয়ার মতো উত্তর খুঁজে পায় না চিত্রলেখা। মামুনের জন্য ওর মনে বিশেষ কোনো অনুভূতি আছে কিনা তা সে জানে না। তবে বেচারার জন্য অনেক মায়া হয় ওর। মানুষটার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। বরং মাঝেমধ্যে চিত্রলেখার নিজেকেই অভাগা মনে হয় এমন নিখাদ ভালোবাসা তার দুয়ারে ভিক্ষারির মতো পথ চেয়ে অপেক্ষমাণ কিন্তু হাত বাড়িয়ে সে তা গ্রহণ করতে পারছে না। চাইলেও আফসোস করতে পারে না চিত্রলেখা। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে মামুন বলে,

-কই হারায় গেলা মায়া?

-কিছু না মামুন ভাই।

-কি হইছে আমাকে বলো।

-কিছু হয় নাই মামুন ভাই। আপনার কেন মনে হলো কিছু হয়েছে?

-তোমার চোখ দেখলে আমি বলতে পারি তুমি ভালো নাই।

চিত্রলেখার বুক উপচে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। বলে,

-আমার কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি। আপনি অহেতুকই চিন্তা করছেন।

মামুন আর কিছু বলে না। কেবল ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রয় তার মায়ার মুখের দিকে। তাগাদা দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আজ আসি মামুন ভাই। অফিসের জন্য লেইট হয়ে যাচ্ছে।

মামুন আর আটকায় না। বিনয়ের সঙ্গে বলে,

-আমি তোমাকে অফিসে পৌছায় দেই?

-কোনো প্রয়োজন নাই মামুন ভাই। আমি যেতে পারবো।

মামুনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তাকে পাশ কেটে চলে যায় চিত্রলেখা। প্রতিদিনের মতো মামুন একলা নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে রয়। আশায় বুক বাঁধে একদিন তার মায়া ঠিকই তার ভালোবাসার আহ্বানে সাড়া দিবে। সেই দিন আসা পর্যন্ত হাল ছাড়বে না সে। এই জীবনে সুখী হতে মামুনের আর কিচ্ছু চাই না। কেবল মায়াকে চাই। মায়াকে তার লাগবেই।

মামুন ব্যস্ত তার মায়ার যাবার পথে তাকিয়ে থাকতে। চিত্রলেখা গলির মাথায় গিয়ে ডানে মোড় দিতেই হারিয়ে গেলো। তবুও মামুনের দৃষ্টি সরে না। সে তাকিয়ে থাকে ঐ পথ ধরে। তার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে পেছন থেকে এগিয়ে এসে চারু বলে,

-আপাকে দেখছেন বুঝি মামুন ভাই?

চারুর কন্ঠ কানে আসতেই পেছন ঘুরে মামুন মিষ্টি করে হেসে বলে,

-কই যাও?

-কোচিংয়ে যাচ্ছি। আপনি কি করছিলেন?

-কিছু না।

-আপনার বাইকে করে আমাকে দিয়ে আসবেন?

-আমার পিছনে বসে গেলে লোকে যদি মন্দ বলে?

-বললে বলুক তাতে আমার কি? লোকের কথা এত শুনলে তো সমস্যা। সবার কথা তো শুনা যাবে না মামুন ভাই৷ তাছাড়া এলাকার সবাই জানে আপনি আপাকে পছন্দ করেন, বিয়ে করতে চান। সেই হিসাবে তো আমি আপনার বাইকে উঠতেই পারি। পারি না মামুন ভাই?

-তা অবশ্য পারো।

-তবে আপনি যদি না নিতে চান তাহলে সেটা ভিন্ন কথা।

-না না তেমন কিছু না। তোমার আপাকে বহুবার বলছি সে কখনো উঠে নাই। তার চিন্তা লোকে কি বলবে। তাই ভাবলাম তুমিও তোমার আপার মতোই ভাবো কিনা।

-আপার কথা বাদ দেন তো। আপার মাথায় একশ একটা চিন্তা।

-কিসের চিন্তা?

-আপার চিন্তার কি শেষ আছে?

-শুনি কি এত চিন্তা তোমার আপার।

-যেতে যেতে বলি মামুন ভাই? নাহলে আমার দেরি হয়ে যাবে যে।

-আচ্ছা চলো তোমাকে নামায় দিয়ে আসি। যাইতে যাইতে তোমার আপার কথা শুনবো নাহয়।

মামুন বাইকে উঠে বসে হেলমেট পরতেই চারু তার পেছনে উঠে বসে।

একটু আগেই চিত্রলেখার সামনে দিয়ে নিজের কেবিনে প্রবেশ করেছে রওনক। কথা হয়নি তাদের। এমনকি চোখাচোখিও হয়নি আজ। রওনক মনে হয় তাড়ায় ছিল। ঝড়ের গতিতে নিজের কেবিনে চলে গিয়েছে। চিত্রলেখা ঠিকঠাক টের পাবার আগেই ভেতরে চলে গেছে সে। চেয়ার ছেড়ে ওঠার সময়ও পায়নি। অর্ধেক উঠে ছিল কেবল। পুরোপুরি না দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ে। ওকে অন্যমনস্ক দেখে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে টেবিলের উপর খটখট করে বার দুই শব্দ করে লাবিব। এতে করে অন্যমনা ভাবটা কাটে চিত্রলেখার। চোখ-মুখ তুলে উপরের দিকে তাকায় সে। চিত্রলেখাকে চোখ বড় করে তাকাতে দেখে লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-আর ইউ ফাইন?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। লাবিব বিশ্বাস করে না। বরং জোর দিয়ে জানতে চায়,

-নো, সামথিং ইজ রঙ ফর সিওর। কি হয়েছে বলো তো?

-কিছু হয়নি।

-উঁহু, তোমার চোখ মুখ অন্য কথা বলছে।

-সত্যি তেমন কিছু না। রাতে ঘুম হয়নি ঠিক মতো তাই হয়তো এমন লাগছে।

-সিওর?

-একদম।

-তাহলে বসে আছো যে?

-কিছু করতে হবে?

-স্যার এসেছে চা বানাবে না?

-ও হ্যাঁ চা। এক্ষুনি বানাচ্ছি।

-তুমি হয়তো আমায় বলতে চাইছো না তাই ফোর্স করছি না। তবে কিছু একটা যে হয়েছে এটা কনফার্ম। নাহলে অন্তত সকালের চায়ের কথা আমার তোমায় বলে দিতে হতো না।

চিত্রলেখা আর কিছু বলে না। লাবিব ধরে ফেলেছে। কিন্তু এমন একটা বিষয় ও চাইলেই কাউকে বলতে পারবে না। কি বলবে? বস ওকে জোকের বসে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে। এটা কি আদৌ কাউকে বলার মতো বিষয়? আর যদি বলেও দেয়। লাবিব ভাববে ওরই মাথা নষ্ট হয়েছে সেজন্য উল্টাপাল্টা বকছে। তাই এই বিষয়ে কিছু না বলে সম্পূর্ণটাই চেপে গেলো। উঠে যাবার আগে শুধু বলল,

-চা বানিয়ে আনছি এক্ষুনি।

রওনককে অফিসে সকালের চা-টা প্রতিদিন চিত্রলেখাই দেয়। কিন্তু আজ লাবিব নিয়ে এসেছে। চায়ের কাপটা সামনে নামিয়ে রাখতেই রওনক জিজ্ঞেস করে,

-চিত্রলেখা কোথায়?

-ওর ডেক্সেই আছে। ডেকে দিবো?

-তার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি চা নিয়ে এলে সেজন্য জিজ্ঞেস করলাম।

লাবিব আর কিছু বলে না। বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। লাবিব কেবিন থেকে বের হবার মিনিট খানিকের মাথায় রওনক তার কেবিনের দরজা অর্ধেক খুলে মাথা বের করে বলে,

-চিত্রলেখা একটু ভেতরে আসো।

সে চাইলে ইন্টারকমে কল করেই ডাকতে পারতো। এভাবে ডাকায় লাবিব ও চিত্রলেখা একে-অপরের দিকে তাকায়। এমনকি লাবিব ইশারায় জানতেও চায় ঘটনা কি? চিত্রলেখা জানি না এমন একটা ইঙ্গিত দিয়ে ভেতরে চলে যায়। রওনক তার টেবিলের কোণ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ। চিত্রলেখাকে দেখে সে চায়ের কাপে আরেকটা লম্বা চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখে। পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে দিয়ে বলে,

-বসো।

-ইটস ওকে স্যার।

-নো, ইটস নট ওকে। সিট ডাউন, প্লিজ।

চিত্রলেখা বাড়তি কথা না বলে চুপচাপ বসে পড়ে। রওনক আরেকটা চেয়ার টেনে একদম মুখোমুখি বসে পড়ে। এতে করে চিত্রলেখার অস্বস্তি বাড়ে। ওড়নার নিচে আড়াল করে রাখা হাত মুঠ করে রেখেছে সে। রওনক এক মিনিট চুপচাপ চিত্রলেখাকে অবজারভ করার পর বলে,

-রাতে ঘুম হয়নি তাই না?

রওনকের এমন প্রশ্নে মুখ তুলে তাকায় চিত্রলেখা। সে আরও বলে,

-চায়ে চিনি হয়নি আজ। নিশ্চয়ই চা বানানোতে মন ছিল না তোমার।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করলে রওনক বাঁধা দিয়ে বলো,

-প্লিজ বসো।

-আমি আরেক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি।

-আপাতত আর প্রয়োজন নেই। চিনি কম হলেও চা মন্দ হয়নি। সবসময়ের মতো চমৎকারই হয়েছে।

-তবুও…

-বললাম তো আপাতত প্রয়োজন নেই।

বাধ্য হয়েই শান্ত হয়ে বসার চেষ্টা করে চিত্রলেখা। রওনক আরও মিনিটখানিক চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলে,

-আই এম সরি তোমাকে একটা অকওয়ার্ড সিচুয়েশনে ফেলে দেয়ার জন্য। আই এম রিয়েলি সরি ফর দ্যাট।

চিত্রলেখা কি বলবে খুঁজে পায় না। এই মুহূর্তে আসলে তার কি বলা উচিত জানা নেই তাই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। রওনক আরও বলে,

-তোমাকে আর ঐ বিষয়টাতে ভাবতে হবে না। তুমি ধরে নিতে পারো আমি ঐ কথাটা তোমায় বলিনি। তখন কেনো স্টুপিডের মতো কিছু না ভেবেই তোমাকে ওভাবে কথাটা বললাম আমি নিজেও জানি না। আর সেজন্য আই এম রিয়েলি ভেরি সরি।

এবারে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক আরও বলে,

-সিট ডাউন চিত্রলেখা, লেট মি ফিনিশ।

কিন্তু চিত্রলেখা বসে না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলে,

-ইটস ওকে স্যার। এভরি পিপল মেক্স মিস্টেক। ইটস অলরাইট। ইউ ডন্ট হেভ টু এক্সপ্লেইন মি। আই এম টোটালি ফাইন।

রওনককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় চিত্রলেখা। ও মনে মনে যা ভেবেছিল হলো ঠিক তাই। বিয়ের কথাটা যে রওনক জোকের বসেই বলেছে তা চিত্রলেখা ঠিকই ধরতে পেরেছিল।

মামুনের বাইক থেকে নেমে কোচিংয়ে ডুকার আগে চারু বলে,

-একটা কথা বলি মামুন ভাই?

-বলো।

-আপনি আপাকে বিয়ে করে নিন। আপনাকে বিয়ে করলে আমার আপা অনেক ভালো থাকবে।

-তোমার কেন মনে হইলো আমাকে বিয়ে করলে তোমার আপা ভালো থাকবে?

-কারণ আপনি আপাকে অনেক ভালোবাসেন। ভালোবাসা ছাড়া ভালো থাকা যায় না মামুন ভাই।

মামুনের মনে হলো কথাটা বলার সময় চারু মনের ভেতর অদৃশ্য কষ্ট অনুভূব করেছে। তাই জিজ্ঞেস করলো,

-তুমি কি কাউকে ভালোবাসো চারু?

-জানি না মামুন ভাই। যাই আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।

চারু ভেতরে চলে গেলে মামুন দাঁড়িয়ে রয় ওখানেই কিছুক্ষণ। গভীর কোনো ভাবনায় আচ্ছন্ন হয় সে।

নিজের চেয়ারে ফিরে এসে দু গ্লাস পানি খেয়েছে চিত্রলেখা। জানা নেই কেনো কিন্তু এই মুহূর্তে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে ওর। এমন একটা ফাজলামো ওর সাথে না করলেও পারতো। লাবিব এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে?

-কিছু না।

-কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে…

লাবিবকে কথা শেষ করতে না দিয়েই চিত্রলেখা বলে,

-কিচ্ছু হয়নি। আই এম ফাইন।

লাবিব বুঝতে পারে চিত্রলেখা বিরক্ত হচ্ছে তাই আর ঘাটায় না। নিজের চেয়ারে ফিরে যায়। সবেই চিত্রলেখা আরেক গ্লাস পানি হাতে নিয়েছে আর তখনই তার ইন্টারকমটা বেজে ওঠে। পানির গ্লাসটা নামিয়ে রেখে রিসিভার তুলে কানে দিতেই অন্যপাশ থেকে রওনক বলে,

-আমার কথা শেষ হয়নি চিত্রলেখা। তুমি যদি না চাও আমি লাবিবের সামনে গিয়ে কিছু বলি তাহলে ১ মিনিটের মধ্যে ভেতরে আসো। ইউর কাউন্ট ডাউন স্টার্স্ট নাও।

ফস করে একটা শ্বাস ছেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। ডানে-বামে না তাকিয়ে সোজা রওনকের কেবিনে গিয়ে ডুকতেই চমকে ওঠে। রওনক দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। এই কেবিনটা উপরের কেবিনের মতো নয় তাই বাহির থেকে দেখা যায় না। চিত্রলেখা ভেতরে প্রবেশ করতেই রওনক দরজাটা লক করে দিয়ে দাঁড়ায়। চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে বলে,

-আমি শেষ না করা পর্যন্ত একটা কথাও বলবে না।

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক বলে,

-ওভাবে বলা আমার একদম উচিত হয়নি। বরং আমার বলা উচিত ছিল যদি তোমার আপত্তি না থাকে, যদি তুমি রাজি থাকো, যদি তোমার অনুমতি থাকে তাহলে কি আমি তোমায় বিয়ে করতে পারি?

চিত্রলেখার মাথার ভেতর ভনভন করতে লাগে। এই লোকটা এমন কেনো ভেবে পায় না ও। এর এক কথায় চিত্রলেখার দিন-দুনিয়া ঘুরতে শুরু করে দেয়। রওনক আরও বলে,

-আমাকে কি তোমার নিজের যোগ্য মনে হয় চিত্রলেখা? ইউল ইউ প্লিজ মেরি মি?

চিত্রলেখাকে ভূ ত দেখার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে রওনক আরও বলে,

-এক্ষুনি তোমায় কিছু বলতে হবে না। টেক টাইম এন্ড থিং কেয়ারফুলি। পরে নাহয় জানিয়ে দিও।

এতটুকু বলেই দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় সে। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য চিত্রলেখা নবে হাত রাখতেই রওনক আরও বলে,

-কিন্তু জবাব টা কিন্তু ইয়েসই চাই আমার। যত সময় লাগে নাও তবে নো কিন্তু এক্সেপ্টেবল হবে না। আই ওয়ান্ট এ ইয়েস ফ্রম ইউ। হোয়াইল ইউ টেক এনি ডিসিশান জাস্ট রিমেমবার দ্যাট আই ওয়ান্ট টু মেরি ইউ।

চিত্রলেখার মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। ওর পা দু’টো জমে গেছে মনে হচ্ছে। চোখ সরাতে পারে না ও রওনকের চোখ থেকে। আটকে গেছে কোথায় যেন। খানিকটা হারিয়েও গেছে ঐ চাহনিতে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

বৃষ্টিদের বাসার ড্রইং রুমে বসে আছে লিখন। ও এসেছে খুব বেশি একটা সময় হয়নি, মিনিট পাঁচের মতো হয়েছে। এমন একটা সময় না তো এখন সকালের নাস্তা করার সময় আর না দুপুরের খাওয়ার সময়। দরজা খুলে লিখনকে দেখতে পেয়েই সালেহা বেগম ওকে বসতে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেছে নাস্তা রেডি করতে। তড়িৎ গতিতে ভেতরের দিক চলে যান উনি তাই লিখন আর উনাকে কিছু বলার সুযোগ পায় ন। তাই অগত্যাই ওকে বসে থাকতে হয়েছে অপেক্ষায়, এতে অবশ্য সমস্যা নেই ওর। বৃষ্টি, নাঈম দুই ভাইবোনের একজনও বাসায় নেই তা বেশ আন্দাজ করতে পারছে। অন্তত নাঈম থাকলে বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। ঘর-বাড়ি এমন ঠান্ডা পড়ে থাকতো না। বৃষ্টি না থাকায় অবশ্য বেশ ভালোই হয়েছে লিখনের। চট জলদি কথা সেরে চলে যেতে পারবে। বিদায় নেয়ার দিন বৃষ্টি নিজের ঘরের খিল দেয়ার পর আর বেরিয়ে আসেনি। এমনকি এর মধ্যে নাঈম বেশ কয়দিন কারণে-অকারণে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ওর কাছে গেলেও বৃষ্টি একদিনও যায়নি। এমনকি একদিন একটা ফোনও দেয়নি। পড়া সংক্রান্ত কোনো হেল্পও চায়নি। লিখন পড়ানো বাদ দেয়ার একদিন পরেই তার এক বন্ধু এসেছিল ওদের পড়াতে বৃষ্টি তাকে মুখের উপরেই বলে দিয়েছিল সে পড়বে না। বন্ধুর কাছে এজন্য লজ্জায় পড়তে হয়েছিল লিখনকে খানিকটা। রিপাও দুটো কথা শুনিয়েছিল কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো অসুবিধা হয়নি লিখনের। ও কেবল বৃষ্টির ভালো চায়। মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো তাই চায় না কোনো ভাবে ছিটকে পড়ুক।

মিনিট দশেক পরে ট্রেতে করে পাউরুটি, জ্যাম, ডিম পোজ, চা সহ ফিরে আসেন সালেহা বেগম। নাস্তার ট্রে টা লিখনের সামনে নামিয়ে রেখে বলেন,

-আগে একটু খাওয়া দাওয়া করো বাবা। তারপর নাহয় কথা বলবো।

-আমি কিছু খাবো না খালাম্মা। একটা জরুরী আলাপ করতে এসেছি। কথা সেরেই বেরিয়ে যাবো।

সালেহা বেগম লিখনকে বাঁধা দিয়ে বলেন,

-সব কথা শুনবো কিন্তু পরে আগে তুমি খাও। কতদিন আসো না আমাদের বাসায়। ভালো মন্দ রান্না করলে আমরা তোমারে কত মিস করি বলো তো। সেদিনের পরে তুমি তো একটা দিন আর আসলাও না।

-আসলে খালাম্মা পড়ালেখার চাপে সময় পাই না একদম। কিন্তু নাঈম গিয়েছিল পড়া বুঝতে ওকে আমি বুঝায় দিয়েছি।

-সেই খবর আমি জানি। এখন আগে খাও তো পরে কথা বইলো।

এক ফাঁকে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর বুলিয়ে নিয়ে সালেহা বেগম আরও বলেন,

-তুমি নাস্তা করতে করতে বৃষ্টিও আইসা পরবে।

-বৃষ্টি এই সময় বাসায় আসে?

-হ্যাঁ, কোচিং করে বাসায় আসে তারপর কলেজে যায়।

-ও আচ্ছা।

সালেহা বেগমের জোরাজুরির কাছে হার মেনেই বাধ্য হয়ে লিখন একপিস ব্রেড ও ডিম পোজ অর্ধেকটা খায়। সম্পূর্ণ খাওয়াও হয়নি ওর এর মধ্যেই বৃষ্টি চলে আসে। ড্রইং রুমে লিখনকে দেখতে পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় বৃষ্টি। তারপর নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরে। এসব দেখে সালেহা বেগম পেছন ডেকে বলেন,

-এসব কি বৃষ্টি? লিখন যে বসে আছে। ওকে দেখতে পাস নাই তুই? এটা কোন ধরনের বেয়াদবি কোনো সালাম নাই, আদব নাই। এদিকে আয়।

-রেডি হবো মা কলেজে যাবো। আর উনি নিশ্চয়ই আমার কাছে আসে নাই। তোমার কাছে আসছে। তুমি মেহমানদারি করো। এখন তো আর উনি আমার শিক্ষক না যে দেখার সাথে সাথেই কদমবুসি করা লাগবে।

এতগুলো কথা বলে আর অপেক্ষা করে না বৃষ্টি নিজের ঘরে চলে যায়। পেছনে মেয়ের কান্ডের জন্য লজ্জায় পড়ে যান সালেহা বেগম। কি বলবেন বুঝে পান না। তা বুঝতে পেরে লিখন নিজেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে,

-থাক খালাম্মা ওর না থাকলেও চলবে। আমি আসলেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসছি। কথাটা বলেই চলে যাবো।

-আচ্ছা বাবা বলো আমি শুনছি।

-আমি মূলত একটা অনুরোধ নিয়ে আসছি।

-কি অনুরোধ?

-আপনি কি আঙ্কেলকে একটু বলবেন উনার চেনা জানার মধ্যে আমার জন্য একটা চাকরী দেখে দিতে। উনার তো অনেক লিংক আছে, পরিচয় আছে। উনি চাইলে আমাকে একটা চাকরীর ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।

-সে নাহয় পারবে কিন্তু তুমি আসলেই চাকরী করবা?

-জি খালাম্মা, আমার এই মুহূর্তে একটা চাকরী ভীষণ দরকার।

-কিন্তু তোমার তো সামনে ফাইনাল পরীক্ষা আবার আইএলটিএসের ক্লাসও করতেছো তুমি। এতকিছু সামলে কি আসলেই চাকরী করতে পারবা?

-পারতে হবে খালাম্মা। আপনি একটু আঙ্কেলকে জোর দিয়ে বলুন আমার হয়ে, যেন একটা কিছু ব্যবস্থা করে দেয়।

সালেহা বেগমকে খানিকটা চিন্তিত দেখায়। লিখনের সাথে উনাদের অনেক বছরের সম্পর্ক। অনেকদিন ধরে দেখছেন তিনি ছেলেটাকে। গতমাসেই নিজের পড়ার জন্য টিউশনি ছেড়ে দিলো অথচ আজ এসে বলছে তার চাকরী প্রয়োজন। কিছু না জেনেই সালেহা বেগম যথেষ্ট আন্দাজ করতে পারছেন একান্তই প্রয়োজন না হলে বা বড় ধরনের কোনো সমস্যা না হলে লিখন এভাবে চাকরীর জন্য আসতো না। লিখনকে আশ্বস্ত করতে সালেহা বেগম বলেন,

-তুমি চিন্তা কইরো না বাবা। আমি আজকেই বৃষ্টির বাবার সঙ্গে আলাপ করবো। জোর দিয়ে বলবো যেন জলদিই একটা ব্যবস্থা করেন। তুমি একদম নিশ্চিত থাকতে পারো। তবে আমি তোমারে একটা কথা বলতে চাই।

-বলেন খালাম্মা।

-তুমি চাইলে আবার ওদের পড়াতে পারো। যদি তোমার একান্তই দরকার হয়।

-টিউশন দিয়ে সংসার চালাতে পারবো না খালাম্মা। একটা খুব বেশি ভালো না হলেও মোটামোটি বেতনের চাকরী হলেও আপাতত আমার চলবে।

-আচ্ছা ঠিক আছে।

আর সময় নষ্ট না করে দাঁড়িয়ে পড়ে লিখন। বলে,

-আজ আসি খালাম্মা। আমি পরে ফোন দিয়ে খবর নিবো নাহয়।

-বৃষ্টির সাথে কথা বলবা না যাওয়ার আগে?

বৃষ্টির ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে লিখন বলে,

-ও হয়ত আমার সাথে কথা বলতে চায় না। থাক, ওকে ডিস্টার্ব না করি। অন্য কোনোদিন নাহয় কথা বলবো। আজ আসছি।

বিদায় নিয়ে আর দাঁড়ায় না লিখন। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।

রওনকের ঐ কথা বলার পর থেকে চিত্রলেখা আর এক মুহূর্তের জন্যও কাজে মন বসাতে পারেনি। বেচারী এতখানিই ডিস্টার্ব হয়ে গেছে যে কোনো কিছুতেই মন দিতে পারছে না। এই মুহূর্তে এক কাপ চা খেতে পারলে হয়ত মন ও মস্তিষ্ক এক জায়গায় করতে পারতো। তাই চা বানাবে বলে উঠতে নিলেই ওর ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে ভাসতে থাকা নামটা দেখে একবার স্বস্তি নিঃশ্বাস ছাড়ে চিত্রলেখা। নিজের মন ও মস্তিষ্ককে ঠিক করার ঔষধ পেয়ে গেছে সে।

লাবিব রওনকের টেবিলে একটা ফাইল রেখে ফিরে আসতে নিলেই তাকে পেছন ডেকে রওনক বলে,

-চিত্রলেখাকে একটু পাঠিয়ে দাও তো।

ফিরে এসে লাবিব বলে,

-কি করতে হবে আমায় বলুন করে দিচ্ছি।

রওনক সাদা কাগজে ড্রাফ লিখছিল হাতে। কলম বন্ধ করে মুখ তুলে উপরের দিকে তাকায়। এক পলক লাবিবকে দেখে নিয়ে বলে,

-তুমি না চিত্রলেখাকে পাঠিয়ে দাও।

-চিত্রলেখা অফিসে নেই।

আবার লেখা বন্ধ করে মুখ তুলে লাবিবের দিকে তাকায় রওনক। চেয়ারে হেলান দিয়ে ইজি হয়ে বসে সে।

-অফিসে নেই তো কোথায় গেছে?

-সেটা তো বলতে পারছি না। ঘন্টাখানিক আগে আচমকাই আমাকে আধা বেলার লিভ এপ্লিকেশন ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

-কোথায় গেছে বা কি কারণে গেছে কিছু বলে যায়নি?

-না, আমি বলেছিলাম আপনাকে জানিয়ে বের হতে। বলল ওর বের হওয়াটা জরুরী আমি যেনো সামলে নেই। ও তো কখনো এভাবে ছুটি নেয় না তাই মনে হলো হয়ত জরুরী কোনো প্রয়োজন হবে সেজন্য আর বাঁধা দেইনি।

রওনকের চোখ-মুখে খানিকটা চিন্তিত ভাব ফুটে ওঠে। লাবিব বলে,

-কি করতে হবে আমায় বলুন করে দিচ্ছি এক্ষুনি।

রওনক তার হাতের কাছে থাকা ড্রাফট পেপারটার লাবিবকে দিয়ে বলে,

-এটা টাইপ করে নিয়ে এসো।

লাবিব বেরিয়ে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করে,

-এনি থিং রং? আপনাকে কেমন যেনো লাগছে। কিছু কি হয়েছে?

রওনক উত্তর করে না কেবল তাকিয়ে রয়। তা দেখে লাবিব আরও বলে,

-আপনার বিষয়ে অনেক কিছুই আমি জানি। আমি আপনার পিএ তবুও আপনি নিজের বিষয়ে অনেক কথাই আমার সাথে শেয়ার করেছেন নিজের ইচ্ছায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি কিছু একটা হয়েছে যা আমি এখনো জানি না। আমার অবর্তমানে কিছু না কিছু একটা তো হয়েছেই। চিত্রলেখাকেও সকাল থেকে দেখলাম কেমন উইয়ার্ড বিহেভব করছে। আপনার বিহেভিয়ারও অন্যান্য দিনের মতো নয়। হোয়াট হ্যাপেন? আমাকে কি বলা যায় না? আমি কি জানার এখতিয়ার রাখি না?

লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে রওনক বলে,

-বসো।

তৎক্ষনাৎই চেয়ার টেনে বসে পরে লাবিব। ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রওনক বলে,

-জানি না চিত্রলেখা কোথায় গেছে তবে এটা জানি কেনো গেছো।

-কেনো?

-আমার থেকে পালাতে।

রওনকের কথার মানে ধরতে পারে না লাবিব। যার চাকরি করছে তার থেকে পালাবে কেনো? লাবিব যেন বুঝতে পারে তাই রওনক ক্লিয়ার করে বলে,

-আই প্রোপজড হার।

-কি!

বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে নিম্ন সরে জিজ্ঞেস করে লাবিব। রওনক আরও পরিষ্কার করে বলে,

-আমি চিত্রলেখাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি।

এমন একটা কথা শুনার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না লাবিব। এমন একটা কথা শুনতে হবে তা সে চিন্তাই করেনি। নিজের কানে শুনা কথা একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। ড্যাবড্যাবে চোখ করে রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে রয় লাবিব। বেচারাকে দেখে মনে হচ্ছে তার মাথার উপর বজ্রপাত হয়েছে তাই সে জমে গেছে। সেয়ি সঙ্গে কথা বলতেও ভুলে গেছে যেনো।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-২৫+২৬+২৭

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

আনমনে হেটে আসছিল চিত্রলেখা। দৃষ্টি রাস্তায় থাকলেও মস্তিষ্ক সঙ্গে ছিল না। তাই আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা মামুনকে দেখতে পায়নি।

-কেমন আছো মায়া?

আচমকা মামুনের কন্ঠ শুনতে পেয়ে হদিস হয় চিত্রলেখার। মুখ তুলে তাকায় সে। মামুনকে দেখে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছেন আপনি মামুন ভাই?

-তুমি যেমন রাখছো।

মামুনের কথা কেমন যেন রহস্য রহস্য শুনায় চিত্রলেখার কানে। তার কথা ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

-বুঝলাম না মামুন ভাই।

-কয়দিন হয় তোমারে ঠিকঠাক দেখি না। তোমারে না দেখলে তো আমি ভালো থাকি না তা তুমি জানোই।

-ওহ!

বলে এক কদম পিছ পা হয় চিত্রলেখা নিজের জায়গা থেকে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে। আজ ওর ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাই আপাতত মামুনকে এড়িয়ে যেতে বলে,

-অনেক দেরি হয়ে গেছে মামুন ভাই আজ আসি। অন্য একদিন কথা বলবো।

-মাত্রই দেখলাম তোমারে। এখনই চইলা যাবা?

-দেরি হয়ে গেছে আজ। এর বেশি দেরি হলে খালা চিন্তা করবে।

-আচ্ছা যাও তাইলে। তবে তুমি চাইলে বাকি পথটা আমি তোমারে আমার বাইকে করে আগায় দিতে পারি।

-এর কোনো প্রয়োজন নেই মামুন ভাই। সামান্য একটুই তো পথ বাকি আমি পায়ে হেটেই যেতে পারবো।

পথ ছেড়ে দিয়ে মামুন বলে,

-আচ্ছা যাও তাইলে।

দ্রুত কদম ফেলে চিত্রলেখা মামুনকে অতিক্রম করতেই সে পেছন থেকে আবার ডাক দেয়,

-মায়া শুনো।

মামুনের ডাকে দাঁড়িয়ে পড়ে পেছন ফিরে তাকায় চিত্রলেখা। জিজ্ঞেস করে,

-আরও কিছু বলবেন মামুন ভাই?

-অনেকদিন হয় তোমার হাতের চা খাওয়া হয় না।

-অফিসে কাজের অনেক চাপ যাচ্ছে। এই সপ্তাহে বন্ধের দিন বিকালে বাসায় আসবেন সেদিন আপনাকে চা খাওয়াবো কেমন?

-আচ্ছা আসবোঁ, এবার বাসায় যাও দেরি হইতেছে তোমার।

-আসি মামুন ভাই।

-সাবধানে যাও মায়া।

চিত্রলেখা সামনের দিকে হাঁটা ধরে। ওর গন্তব্য দ্রুত বাসায় পৌঁছানো তাই সে আর পেছন ফিরে তাকায় না। পেছন ফিরলে দেখতে পেতো মামুন তার দৃষ্টি জুড়ে অশেষ ভালোবাসা নিয়ে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে৷ অবশ্য মামুনের অনুভূূতিদের সম্পর্কে চিত্রলেখা সম্পূর্ণই অবগত। এবং মনে প্রাণে এই অনুভূতিদের সম্মানও করে। মামুনের প্রতি চিত্রলেখার কোনো অভিযোগ কখনই ছিল না। সমস্যা ওর নিজের। নিজের জীবনের টানাপোড়েনের জন্যই কখনো মামুনকে নিয়ে সেভাবে ভাবেনি, ভাবার সুযোগ পায়নি। ভাবলে হয়ত আজ ওদের বিষয়টা অন্যরকমও হতে পারতো। কিন্তু চিত্রলেখার জীবনের বাস্তবতা তাকে এই অনুমতি কখনই দেয়নি। হয়ত কখনো দিবেও না।

দিলারা জামানের মাথায় বরফ ধরে দাঁড়িয়ে আছে জাহানারা। এর মধ্যেই বিশাল ক্যাচ্ছা কাহিনি হয়ে গেছে বাড়িতে। সবেই বাসায় ফিরেছে রওনক। বিকালের মিটিংটা লম্বা চলায় দেরি হয়ে গেছে তার। এদিকে তানিয়া বাসায় ফিরেই শাশুড়ির মাথায় এ ট ম বো ম ফাটিয়েছে। ঘটনাটা এই রকম ঘটেছে,

তানিয়া বাসায় ফিরতেই দেখতে পায় তার শাশুড়ি দিলারা জামানা ড্রইং রুমের সোফায় আয়েশ করে বসে ড্রাই ফ্রুটস খাচ্ছেন আর মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রোল করছেন। তানিয়া সময় নষ্ট না করে সরাসরি শাশুড়ির মুখের সামনে এসে বলে,

-মা আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।

দিলারা জামান ফোন দেখতে দেখতেই বলেন,

-বলো শুনছি।

-আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

-বলো শুনি তোমার কঠিন সিদ্ধান্ত।

তখনই তিনি আন্দাজ করতে পারেননি কয়েক মুহূর্ত বাদেই তারউপর একটা বো ম ফাটবে। এর আগেও তানিয়া বহুবার বলেছে সে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তানিয়ার মতে তার নেয়া সব সিদ্ধান্তই কঠিন সিদ্ধান্ত সেটা যদি হয় রাতের ডিনারের মেনু তৈরি করা তার মতে সেটাও কঠিন সিদ্ধান্ত। বউকে চিনে বলেই ওমন কথা শুনেও তেমন একটা ভাবান্তর দেখা যায় না দিলারা জামানের ভেতর। কিন্তু উনাকে চমকে দিয়ে তানিয়া বলে,

-আমি আপনার ছেলেকে ডিভোর্স দিচ্ছি। আর এই সিন্ধান্তের কোনো নড়চড় হবে না। আই উইল ডেফিনিয়েটলি ডিভোর্স হিম।

ছেলের বউয়ের মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে হকচকিয়ে উঠেন দিলারা জামান। মুহূর্তেই উনার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে যায়। মুখ তুলে উপরে তাকান তিনি। মুহূর্তেই মুখটা ফেঁকাসে হয়ে গেছে উনার। চমকিত কন্ঠে প্রশ্ন করেন,

-কি বললা তুমি? আমি কি ভুল শুনলাম?

-না মা আপনি ভুল শুনেননি। একদম ঠিক শুনেছেন। আমি আপনার ছেলেকে ডিভোর্স দিচ্ছি। এডভোকেটের সঙ্গে কথা বলা হয়ে গেছে। কালকের মধ্যেই কাগজপত্র সব তৈরি করে পাঠিয়ে দিবে।

দিলারা জামানা চিন্তা করে পান না কি বলবেন। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকেন। তানিয়া নিজেই বলে,

-এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানতে চাইলে আপনি রওনককে জিজ্ঞেস করে নিয়েন। আমার মনে হলো আপনাকে ডিভোর্সের বিষয়টা জানানো উচিত তাই আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম। বাকিটা বলতে মন চাইছে না। তবে আপনি জানতে চাইলে রওনককে জিজ্ঞেস করবেন। ও সব জানে। আমি ঘরে যাচ্ছি মা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বিশ্রাম করবো।

যাওয়ার আগে তানিয়া জাহানারাকে বলে যায় কাউকে দিয়ে তার ঘরে এককাপ কফি পাঠাতে। কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই একদম আচমকাই ডিভোর্স নামক বো ম টা শাশুড়ির মাথায় ফাটায় তানিয়া। তারপর থেকে প্রেসার হাই হয়ে গেছে দিলারা জামানের। কম করে হলেও একশ ফোন কল করেছেন তিনি রওনককে। অনেকগুলো ফোন করার পর যখন রওনককে লাইনে পাওয়া যায় তখন সে জানায় মিটিংয়ে ব্যস্ত আছে। ফোনে কিছুই বলতে পারবে না। বাসায় ফিরে বিস্তারিত জানাবে। জাহানারা, দিলারা জামানকে হাই প্রেসারের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে তবে ঔষধেও প্রেসার খুব একটা কমেনি। রাগে ফসফস করলেও মুখে কিছু বলতে পারেননি এতক্ষণ তিনি। রওনক আসতেই ছেলেকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠেন। জিজ্ঞেস করেন,

-এসব কি হচ্ছে আমার সংসারে?

-কি হচ্ছে?

-তুই জানিস না কিছু?

-আমি তো সবই জানি। তুমি কোন বিষয়ে কথা বলছো সেটা বুঝতে পারছি না। খুলে বললে হয়ত বুঝতে পারতাম। তোমাকেও জবাব দিতে পারতাম।

-তোর ভাইয়ের বউয়ের মাথায় ভূত চেপেছে। সে নাকি এখন ডিভোর্স নিবে।

-তার যদি মনে হয় এই সম্পর্ক সে আর টানতে পারবে না, এই সম্পর্ক তার জন্য নয়। সে যদি বেরিয়ে আসতে চায় তাহলে তো ডিভোর্সই একমাত্র সলিউশান তাই না?

-এসব তুই কি বলছিস রওনক!

চেঁচিয়ে ওঠেন দিলারা জামান। কিন্তু এতে রওনক একটু হকচকায় না। সে শান্ত কন্ঠেই বলে,

-চেঁচামেচি করে লাভ নেই মা। সম্পর্ক ওদের। তাই ওরা একসাথে থাকবে কি থাকবে না সেই সিদ্ধান্তটাও ওরাই নিবে। ভাইয়া-ভাবীর টা ওদেরকেই বুঝতে দাও। লেট দেম ডিসাইড।

-রাদিন কোথায় রওনক?

-সেই খবর কি আমার রাখার কথা?

-তুই জানিস না বলতে চাচ্ছিস?

-জানি না এমন নয় তবে তোমাকে বলতে চাচ্ছি না।

-হঠাৎ কি এমন হলো যে তানিয়া ডিভোর্স পর্যন্ত চলে গেলো?

এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রওনক বলে,

-তোমার বড় ছেলে অন্য একজন মহিলার সঙ্গে এফেয়ারে জড়িয়েছে। এই মুহূর্তে ভাইয়া ঐ মহিলার সঙ্গেই আছে। এমনকি ঐ মহিলাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর সেটেল্ড হওয়ার পরিকল্পনাও করছে। কিন্তু আনফর্চুনেটলি আমি বিষয়টা জেনে গেছি। এমনকি ভাবীও জানে। আর সব কিছু জেনে ভাবী আর ভাইয়ার সঙ্গে থাকতে চায় না।

ছোট ছেলের মুখে বড় ছেলের এমন অধঃপতনের কথা শুনে থম ধরে যান দিলারা জামান। মা হিসেবে লজ্জায় উনার মাথা নুইয়ে আসছে। রওনক এগিয়ে এসে মায়ের পাশে বসে তার একটা হাত ধরে বলে,

-ওদেরটা ওদেরকে বুঝতে দাও। আমার ভাই যে অন্যায়টা করেছে এরপর ভাবীর মতো এত ভালো একজন মানুষ সে ডিজার্ভ করে না। ভাবী যদিও ভাইয়াকে মাফ করে দিয়ে থেকে যায়ও এর কোনো গ্যারান্টি নেই ভাইয়া আবার তাকে ঠকাবে না। একজন মেয়ে সব মানতে পারলে স্বামীর প্রতারণা নিশ্চয়ই মেনে নিবে না। তুমি নিজেকে তার জায়গায় রেখে চিন্তা করে দেখো তো। আজ ভাইয়ার জায়গায় বাবা থাকলে তুমি কি তাকে মাফ করে দিতে? পারতে এত বড় মনের পরিচয় দিতে? তাছাড়া যে মানুষটা এতগুলো বছর সংসার করার পরেও নিজের স্ত্রীকে ঠকাতে পারে তাকে কি আসলেই মাফ করা উচিত? আমি বা তুমি হয়ত বলতে পারি ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও কিন্তু ভাবীর জায়গা থেকে ভেবে দেখো তো। তার তো একটাই আপনজন। আমরা তো তার কেউ নই। আমাদের সাথে সম্পর্ক হলো যে মানুষটার হাত ধরে সেই মানুষটাই যখন বেঈমানী করে তখন সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এবারে যদি মাফ করেও দেয় এরপর যদি ভাইয়া আবার একই কাজ করে তখন ভাবী কীভাবে নিজেকে সামলাবে? তাই বলছি রিকুয়েষ্ট করছি তোমায়। তুমি ওদের মাঝে কোনো কথা বলো না। ভাবীর সিদ্ধান্তটা ভাবীকেই নিতে দাও। ভাইয়া ভুল করেনি কঠিন অন্যায় করেছে। ওর শাস্তি হওয়াটা প্রয়োজন। আর এইক্ষেত্রে আমি ভাবীকে সম্পূর্ণ সাপোর্ট করবো তুমি আপত্তি করলেও করবো।

মাকে নিজের মতো রেখে উঠে পড়ে রওনক। যাওয়ার সময় কেবল জাহানারাকে ইশারা করে যায় যেন মায়ের খেয়াল রাখে। দিলারা জামাম কিচ্ছু বলতে পারেন না কেবল চুপচাপ বসে থাকেন। তার আসলে বলার মতো মুখ অবশিষ্ট নেই। কীভাবে থাকবে? অপরাধ তো তার নিজের ছেলেই করেছে। তাও কোনো ছোটখাটো অপরাধ নয়। স্বামীর বেঈমানীর মতো অন্যায়, অপরাধের এই পৃথিনীর আইনে কঠিন কোনো শাস্তি নেই। অথচ কঠিন একটা শাস্তি থাকা দরকার ছিল। যে স্বামী স্ত্রী থাকা অবস্থায় পর নারীতে আসক্ত হবে তার শাস্তি হওয়া উচিত ছিল মৃ ত্যু দ ন্ড। কারণ প্রতারণা করা স্বামীর কিছু না গেলে আসলেও প্রতারিত হওয়া স্ত্রী তো বাকিটা জীবন ভেতরে ভেতরে ম রে ই যায়। জীবিত লা শ হয়েই জীবন কাটায় মৃ ত্যু পর্যন্ত। ওসব অবশ্য অন্যরা টের পায় না। বিভৎস ভয়ংকর একটা কষ্ট বুকের ভেতর নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় প্রতারিত হওয়া নারীকে। অথচ এসব প্রতারকদের পৃথিবীর আইনে কোনো শাস্তি নেই। মৃ ত্যু দ ন্ড পাওয়ার মতো কঠিন অন্যায় করেও এরা দিব্যি হাসি-খুশি ভাবেই বেঁচে থাকে। একজন নারীকে ভেতরে ভেতরে সম্পূর্ণ মে রে ফেলার পরেও এরা বিন্দুমাত্র অনুশোচনা করে না। এদের বেঁচে থাকাটাও অন্যায়। অথচ আফসোস পৃথিবীতে এদের কোনো শাস্তি নেই। এদের শাস্তি দেয়ার কোনো আইন নেই।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখা বাড়িতে পা রাখতেই টের পেলো পরিবেশ আজ যথেষ্ট থমথমে। একদম তুফান আসার আগমুহূর্তের মতো৷ আবার এমনও হতে পারে এটা তুফানের পরবর্তী থমথমে পরিবেশ। কিছু হয়েছে কিনা না জানা অব্দি কোনো কিছু সিওর হওয়া যাচ্ছে না আর কি। চিত্রলেখা যখন বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে তখন তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই লিখন ও চয়ন নিজেদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে কানাকানিও করেছে। আবার লিখন যে চারুকে ইশারায় কিছু একটা বলল সেটাও চিত্রলেখার নজর এড়ায়নি। তবে এই মুহূর্তে এসব বিষয়ে কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে যায় সে। এমনিতেই আজ তার মস্তিষ্কের ভেতর সবকিছু আউল লেগে আছে। রওনকের বলা কথাটা কিছুতেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না৷ গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ বেসিনের সাথে লাগোয়া ছোট আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকেই তাকিয়ে রয়েছে ভাবলেশহীন ভাবে। রওনক আচমকা ওকে কেনোই বা এমন একটা কথা বলল এর কোনো কারণ খুঁজে পায় না চিত্রলেখা। অনেক চিন্তা ভাবনা করেও যখন কোনো কারণ খুঁজে পায় না তখন নিজেকে বুঝ দিয়ে বলে,

-উনার সম্ভবত জ্বর এসেছিল তাই উল্টাপাল্টা বকেছেন। অনেকেরই জ্বর এলে উল্টাপাল্টা বলে। চারুর এই রোগ আছে। জ্বর আসতে না আসতেই ওর উল্টাপাল্টা বলা শুরু হয়ে যায়। আর সবচাইতে বেশি যে কথাটা বলে চারু তা হচ্ছে ও নাকি বাবা-মাকে দেখতে পায়। উনারা নাকি দু’জনে এসে ওর মাথার কাছে বসে কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। অথচ বাবা-মা যখন মারা যায় তখন চারু এই এতটুকু বাচ্চা। উনাদের চেহারা ওর ঠিকঠাক মনেই নেই। ছবিতে দেখেছে সেটাই ওর চোখে ভাসে আর জ্বরের ঘোরে ও ভাবে বাবা-মা এসে ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রওনকেরও এমনই কিছু একটা হয়েছিল হয়ত। তারও হয়ত জ্বর হয়েছে সেজন্য এমন একটা উদ্ভট, অসম্ভব কথা বলে ফেলেছেন। জ্বর সেরে গেলে ঠিকই সব ভুলে যাবেন।

এসব হাবিজাবি বলে নিজেকে বুঝ দিলেও চিত্রলেখার মস্তিষ্কে ফের ভাবনার উদয় হয়। ও নিজেই কপালে হাত দিয়ে দেখেছিল রওনকের জ্বর ছিল না কপালে। শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকই ছিল। তবুও চিত্রলেখা নিজেকে বুঝ দেয় বলে,

-উনার হয়ত চোরা জ্বর হয়েছে। ভেতরে ভেতরে ঠিকই জ্বর আছে কিন্তু বাইরে বুঝা যায় না। এটাই হবে। এই কারণেই উল্টাপাল্টা বলছেন।

মানুষ যখন কোনো শক্ত কারণ খুঁজে না পায় তখন নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এমন উদ্ভট ব্যাখ্যা দাঁড় করায় এমনকি এটাকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করার আপ্রাণ চেষ্টাও করে। এসব অযৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে মনকে বোকা বানানো গেলেও মস্তিষ্ককে বোকা বানানো যায় না। বিবেক যুক্তি ছাড়া কথা মানতেই চায় না। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এসব হাবিজিবি ভাবার পর গা ঝাড়া দেয় চিত্রলেখা। তাকে রাতের রান্নাও সারতে হবে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে উদ্ভট সব কথা ভাবলে তার চলবে না। রওনক হয়ত নিছকই মজার ছলে কথাটা বলেছে কিন্তু এই কথা ভেবে ভেবে সময় অপচয় করলে তার চলবে না। আবার ঐ মুহূর্তটা চোখে ভাসলে চিত্রলেখার একটুও মনে হয় না রওনক নিছকই মজার ছলে ওত বড় একটা কথা বলে ফেলেছে। বরং তাকে যথেষ্টই সিরিয়াস মনে হয়েছে। রওনকের দৃষ্টি চিত্রলেখাকে বলেছে সে একটুও মজা করে কথাটা বলেনি। যা বলেছে মন থেকেই বলেছে। এসব ভেবে ভেবে নিজের মাথার চুল চিত্রলেখার নিজেরই ছিড়তে মন চাইছে। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সে জানে না। এসব জানতেও চায় না। ওর জীবনটা এমনিই কাটায় ভরপুর। এই জটিল জীবনটায় আরও বেশি জটিলতা ওর চাই না। ও যেমন আছে ভালো আছে। আর কোনো উটকো ঝামেলা ওর চাই না। তাই রওনক ও রওনকের বলা কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের কাজে মনকে ফোকাস করার চেষ্টায় মত্ত্ব হয় চিত্রলেখা।

তানিয়াকে যথেষ্ট ফুরফুরে দেখাচ্ছে আজ। শেষ কবে তাকে এতখানি রিল্যাক্স দেখেছিল রওনকের ঠিক মনে পরছে না। এই মুহূর্তে ওরা দাঁড়িয়ে আছে রওনকের ঘরের বারান্দায়। তানিয়া আধা খোলা বারান্দার গ্রীল ঘেঁষে চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আর রওনক বারান্দার দেয়াল ঘেঁষে অনেকটা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে থাকা চায়ের কাপে এখন পর্যন্ত একটি চুমুকও বসায়নি সে। তানিয়া এতক্ষণ দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও এবারে পেছন ঘুরে দেবরের মুখোমুখি দাঁড়ায় তবে দূরত্ব কমায় না। যেখানে ছিল ওখানেই থাকে। চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে তানিয়া রিল্যাক্স ও শান্ত ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করে,

-আজকাল কি বিশেষ একজন ছাড়া অন্য সবার হাতের চা খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছো নাকি?

-কই না তো।

-হাতে খাচ্ছো না যে। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তুমি তো ঠান্ডা চা পছন্দ করো না।

-চোখের সামনে নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করছি তো তাই চায়ে কনসেনট্রেট করতে পারি।

-তা কি আবিষ্কার করলে নতুন, আমাকে?

এবারে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া পানসে চায়েই চুমুক বসায় রওনক। ঠান্ডা চা খেতে একদম বিশ্রী লাগে তার। তবুও মুখে নেয়া চা টুকু কষ্ট করে হলেও গিলে ফেলে সে। তারপর তানিয়ার কথার জবাবে বলে,

-বলতে পারো তাই। তোমাকে কখনো এভাবে আয়েশ করে চা খেতে দেখিনি। সবসময় তুমি কফিটাই প্রেফার করেছো। অথচ আজ দিব্যি চা ইনজয় করছো যেনো তোমার ভীষণ পছন্দের জিনিস।

-আর?

-তুমি আজ আচমকাই তোমার জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছো অথচ সেটা নিয়ে তুমি একটুও বিচলিত নও। তোমার ফেইস দেখে বুঝা যাচ্ছে তুমি তোমার নেয়া সিন্ধান্তে হ্যাপি। ইউ আর হ্যাপি ফর ইউরসেলফ।

-আর কিছু?

-উঁহু, আপাতত এতটুকুই।

-প্রথমটা দিয়েই শুরু করি। আমার শুরু থেকেই চা ভীষণ পছন্দের। কিন্তু কি জানো মানুষের পছন্দ পরিবর্তনশীল। সঙ্গ, পরিবেশ, ওঠা-বসা, চলা-ফেরা সব কিছুর প্রভাবে পছন্দটা পরিবর্তন হয়ে যায় কোনো না কোনো ভাবে। বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে দেখতাম রাদিন কফি খায় সবসময় যদিও ওর প্রয়োজন হতো। সে রাত জেগে কাজ করে স্ট্রং কফি ছাড়া তার চলতো না। ওকে সঙ্গ দিতে গিয়েই আমি চা বাদ দিয়ে কফি ধরলাম। রাদিন কিন্তু তা কখনই টের পায়নি। হয়ত কখনো জানার চেষ্টাও করেনি। ওর কেবল নিজের কফির মগটা হলেই চলেছে। সে কখনো জানতে চেষ্টা করেনি তাকে সঙ্গ দেয়া নারী নিজের পছন্দের চা বাদ দিয়ে তার পছন্দের কফিটাকে আপন করে নিয়েছে। সেটা কখনই রাদিনের মাথা ব্যথা ছিল না। আমি গোটা মানুষটাই কখনো তার মাথা ব্যথা ছিলাম না। কারণ আমি অন্য আর দশটা বউয়ের মতো করে কখনো আবদার করে বা অভিমান করে বলিনি আজ আমায় ঘুরতে নিয়ে যাও, বা শপিং করতে নিয়ে যাও, আমাকে আলাদা করে সময় দাও। আমার জন্য সবসময় ও, ওর কাজ, ওর পেইন্টিং, ওর এচিভমেন্ট সবকিছুর উর্ধ্বে ছিল। তখন যদি বুঝতে পারতাম খানিকটা টিপিক্যাল বউদের মতো ওকে যন্ত্রণা দিলে ভালো হতো হয়ত তাহলে ও আমায় নিয়ে ভাবতো, হয়ত তাহলে আমি ওর জীবনের প্রায়োরিটি লিস্টে থাকতাম। আমায় খুশি করতে ও ব্যস্ত হয়ে পড়তে। তাহলে আজ হয়ত সব কিছু অন্যরকম হলেও হতে পারতো। তবে সেসব নিয়ে আর আফসোস নেই। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষগুলো কখনই সামনের বা পাশে থাকা মানুষটার সেক্রিফাইজ দেখতে পায় না। বরং নিজের মতো ভেবে নেয়। ওরা ভাবে আমরা যা করি নিজের স্বার্থে করি। অথচ আমার কাছে যে সবকিছুর উর্ধ্বে ওর স্বার্থ সেটা হয়ত সে কখনই টের পায়নি। না পাক, আর চাইও না ও কিছু জানুক বা বুঝুক। আরও বললে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও আমি বিচলিত নয়ই। ভুল বললে, এই সিদ্ধান্তটা তো আমি আজ নেইনি রওনক। আজ নিলে আমায় তুমি ঠিকই বিচলিত দেখতে, নার্ভাস দেখতে। কত রাত আমি ঘুমাইমি শুধু আকাশ-পাতাল চিন্তাভাবনা করে কাটিয়েছি। কি হলে কি করবো কত শত প্রস্তুতি নিয়েছি মনে মনে। এমন একটা দিন যদি কখনো আসে তখন কি করবো তা যে কত হাজারবার চিন্তা করেছি তা তুমি হয়ত কল্পনাও করতে পারবে না। বেসিক্যালি এই সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই আমি মনে মনে নিয়ে ফেলেছিলাম। কখনো এমন কিছু হলে, আমাকে চরমভাবে ঠকে যেতে হলে কি করবো তা আমি আগেই ভেবে ফেলে ছিলাম। শুধু মাত্র আমি হুটহাট তা প্রকাশ না করে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি তোমার ভাইয়ার সিদ্ধান্তের। তার সিদ্ধান্ত জানলাম তারপর আমি আমার সিদ্ধান্তটা নিলাম। এক্ষেত্রেও কিন্তু আমি তাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছি জীবন বেছে নেয়ার।

এতটুকু বলে অদ্ভুত করে হাসে তানিয়া। তা মুগ্ধ হয়ে দেখে রওনক। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে সে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। তানিয়ার হাস্যজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই রওনক জিজ্ঞেস করে,

-ভাইয়া কি কখনো তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করেছিল?

-তার তো সে প্রয়োজনই পরেনি।

-তোমরা একে-অপরকে না বুঝে এতগুলো বছর একত্রে থাকলে কীভাবে? সংসার করলে কীভাবে?

-একসাথে থাকলেই বুঝি সংসার করা হয়ে যায়? আর একত্রে থাকার জন্য জরুরী নয় অপরজনকে বুঝতে হবে। যদিও আমি প্রতি মুহূর্ত তোমার ভাইয়াকে বুঝতে চেয়েছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি। এমনকি শেষ পর্যন্ত বিফল হইনি অবশ্য। তার সবকিছু আমি বুঝি। শুধু সেই আমাকে বুঝে না আর না কখনো বুঝার চেষ্টা করেছে। তোমার ভাইয়ার মতে আমি লেখাপড়া জানা অতি শিক্ষিত নারী যার জন্য নিজের ক্যারিয়ার সবার আগে। অথচ সে কখনো জানতেই পারেনি আমি সবসময় ঘরকুনো হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। সকাল শুরু হবে তার বাহুডোরে, তারপর সবাইকে নাস্তা করিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে যাবো স্কুলে, রান্নার দায়িত্বটা আমার হাতেই থাকবে। আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকে বেশ ভালো রান্না জানি। বিয়ের পরপর কয়েকবারই এটা সেটা রান্নাও করেছিলাম। কিন্তু কখনো তোমার ভাইয়া এপ্রিশিয়েট করা তো বাদ দাও জানারও চেষ্টা করেনি রান্নাটা কে করেছে। বলতে পারো বাহবার অভাবে আমার রান্নার শখটা কবে জানি ম রা গাছের মতো শুকিয়ে গেল। আমিও পরে আর পানি দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করিনি। কোনো কিছু করতে অনুপ্রেরণা লাগে রওনক যা আমি কখনই তোমার ভাইয়ার কাছে পাইনি। উল্টো আমি যখন অফিস জয়েন করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম তোমার ভাইয়া আমায় বাহবা দিলো। আমিও বোকা ভাবলাম ও হয়ত এমন একজনই পার্টনার চায় যে ঘরে বসে না থেকে তার কাঁধে কাঁধ মিলে হাটবে। আমি হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর আসার পর টের পেলাম যার জন্য আমার এতদূর আসা সে তো অনেক আগেই মোড় বদলে নিয়েছে। আর আমি একলাই এতটা পথ পাড়ি দিয়ে চলে এসেছি। তোমার ভাইয়া আমার জীবনে থাকলেও এই পথ আমায় একলাই চলতে হতো এর চাইতে সে নেই এটা বেশি ভালো হলো না বলো?

তানিয়া থামতেই রওনক বলে,

-আই এমন রিয়েলি হ্যাপি ফর ইউ। অলসো ভেরি প্রাউড অফ ইউ।

কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর তানিয়া নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-তা তোমার চাওয়ালীর কি খবর?

-চাওয়ালী!

রওনক তৎক্ষনাৎই ধরতে পারে না তানিয়া কার কথা বলছে। কিন্তু তাকে রহস্য করে হাতে দেখলে তার বুঝতে সুবিধা হয় না। কিন্তু এতক্ষণে তার কপালে চিন্তার দাগ দেখা দিয়েছে। নিজের চেহারা আদলে গম্ভীর ভাব তুলে এনে রওনক বলে,

-নিজের স্বার্থে কাউকে কাছে টানা বা নিজের সাথে জড়ানোটা ভুল তাই না ভাবী?

-অবশ্যই ভুল। যেকোনো সম্পর্কে দু’দিকের স্বার্থ থাকতে হয় নয়ত মনের মিল থাকতে হয়। একপাক্ষিক কোনো কিছুই ভালো নয়।

হুম বলেই ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রওনক। মনে মনে ভাবে তার ভুল হয়ে গেছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখা রান্না করতে ব্যস্থ। তার পেছনে এসে দাঁড়ায় চারু তাও নিঃশব্দে। ভাইবোন তিনটাই চিত্রলেখার ভীষণ আপন, কলিজার একদম কাছের মানুষ। ওরা নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেও সে টের পায়। চারুর উপস্থিতি টের পেয়ে খুন্তি নাড়তে নাড়তেই চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-এতক্ষণ কই ছিলি?

-পড়তেছিলাম আপা।

-কাল তো তোর কোনো পরীক্ষা নাই হঠাৎ কি মনে করে এই সময় পড়তে বসলি?

-এমনি আপা, কাল না থাকুক সামনে তো পরীক্ষা আছে সিলেবাস শেষ হয় নাই তো সেজন্য পড়া আগায়তেছিলাম।

-তোর সিলেবাস শেষ হয় নাই?

-না।

চিত্রলেখা জানে চারু বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছে। ওর তিনটা ভাইবোনই পড়ালেখায় অনেক সিনসিয়ার। কিছু একটা ঘটেছে তা চিত্রলেখা বাসায় পা রাখতেই টের পেয়েছিল। কিন্তু এই বিষয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। চারু চুপচাপ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকায় চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-কিছু বলবি?

-না।

-খুদা লাগছে?

-না।

-তাইলে গরমের মধ্যে দাঁড়ায় না থেকে ঘরে যা।

চারু তবুও দাঁড়িয়ে রয়। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার পর এগিয়ে গিয়ে বোনকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চিত্রলেখা বাঁধা দেয় না। বরং সময় দেয় ছোট বোনকে নিজেকে সামলে নেয়ার। মিনিট খানিক অতিক্রম হওয়ার পর চিত্রলেখা চুলার আগুন নিভিয়ে দিয়ে চারুকে ছাড়িয়ে পেছন ফিরে ওর মুখোমুখি দাঁড়ায়। ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে বল তো।

-কিছু হয় নাই আপা।

-বলবি না তাই তো? লিখন না করছে বলতে?

-সত্যি কিছু হয় নাই আপা।

-খালা কই?

-উনার ঘরে আছেন।

-এই সময়ে ঘরে কি করে?

-শুয়ে রইছে।

-কেন! শরীর খারাপ।

এবারে চুপ করে রয় চারু। চিত্রলেখা আগেই বুঝতে পেরেছিল বাড়িতে আজ কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু এতক্ষণে বুঝতে পারছে ভয়ংকর কিছু একটা হয়েছে। চারুকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখেই চিত্রলেখা খালার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে পেছন থেকে চারু বলে,

-খালু আজ খালাকে অনেক কথা শুনাইছে আপা।

চিত্রলেখার বাড়ন্ত কদম থমকে যায়। বোনের মুখের দিকে তাকায় সে। চারুর চোখে পানি টলমল করছে কিন্তু কান্নার কোনো শব্দ নেই। চিত্রলেখা এগিয়ে এসে ছোট বোনের বাহু ধরে আবারও জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে চারু?

-খালু চায় না আমরা আর উনার বাড়িতে থাকি।

-খালাকে কি বলছে?

-১ মাসের মধ্যে আমরা বিদায় না হলে খালাকে উনি তালাক দিবে।

সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকায় চিত্রলেখা। চারুকে বলে,

-তরকারিটা আরেকু জাল হবে। ওটা জাল দিয়ে টেবিলে ভাত দে আমি আসতেছি।

-কই যাও আপা?

-খালা নিশ্চয়ই সারাদিন কিছু খায় নাই। ডেকে নিয়ে আসি ভাত খাওয়াবো।

চিত্রলেখা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য আবার কদম বাড়ালে চারুর ডাকে ফের থমকে দাঁড়ায়। অসহায় কন্ঠে চারু জিজ্ঞেস করে,

-আমাদের কি আর যাওয়ার কোনো জায়গা নাই?

-যাদের কেউ নাই, যাওয়ার কোনো জায়গা নাই তাদের আল্লাহ আছে। একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। আল্লাহর দুনিয়াটা অনেক বড়। তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি এখনো বেঁচে আছি ভাবার জন্য।

আর অপেক্ষা না করে চিত্রলেখা বেরিয়ে যায়। পেছনে চারুর চোখে টলমল করতে থাকা পানি গাল বেয়ে পড়ে। সারাদিন নিজেকে আটকে রাখলেও আর এই মুহূর্তে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না বেচারী। মানুষ এত অসহায় কেনো হয়? আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই ওদের এত কষ্ট সহ্য করতে হতো না। চিত্রলেখাকে দিনরাত এত চিন্তার মধ্যে থাকতে হতো না। অল্প বয়স থেকে সবার জন্য করতে করতে ম রে যেতে হচ্ছে কিন্তু দেখার কেউ নেই, সঙ্গ দেয়ার কেউ নেই।

নারগিস বেগম নিজের ঘরেই শুয়ে আছেন। চিত্রলেখা সহজেই আন্দাজ করতে পারছে সারাদিনে উনার কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নারগিস বেগম ঘুমিয়ে আছেন। কিন্তু আর কেউ না জানলেও চিত্রলেখা বেশ ভালো ভাবেই জানে তার খালা ঘুমায়নি। এমনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। এগিয়ে এসে খালার মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর খালার কানের কাছ মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-আমি থাকতে তোমার এত কিসের চিন্তা খালা? আল্লাহ তো আমাকে পাঠাইছেসই তোমাদের সবার জন্য।

চোখ খোলেন না নারগিস বেগম। তার বন্ধ চোখের পাতা গলে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সারাদিন কাঁদেননি তিনি। অল্পে কেঁদে ফেলার স্বভাব উনার নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে আর পারলেন না নিজেকে ধরে রাখতে। চিত্রলেখা খালাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পাশেই শুয়ে পড়ে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

-এত কেন ভাবতেছো তুমি? আমি কি ম রে গেছি? এইসব ভাবাভাবি তো আমার দায়িত্ব। আর কাদের জন্য ভাবতেছো তুমি? আমাদের জন্য তো কম করো নাই সারাজীবন। আর কত করবা বলো তো? তাছাড়া এবার এমনিও সময় হয়েছে তুমি নিজের কথা ভাবো, নিজের সংসারের কথা ভালো। আমরা তো এমনিও তোমার কাছে চিরকাল থাকবো না খালা। টাকা পয়সার ব্যবস্থা হলে বছর খানিকের মধ্যে লিখন বাইরে চলে যাবে। ওর পরে হয়ত চয়নও চলে যাবে। এরপর চারুকে বিয়ে দিয়ে দিবো। ওরা তো সবাই চলেই যাবে। বাকি থাকলাম আমি। আমি নাহয় তোমার ঘরের একটা কোণায় পড়ে রইলাম। তাও যদি নাহয় দূরেই থাকলাম বেশি একটা দূরে না এই আশপাশ দিয়েই থাকবো। দুইবেলা করে দেখা হবে আমাদের। সব তো হয়েই যাবে। তাইলে এত চিন্তা কেন বলো তো?

চিত্রলেখার হাত ছাড়িয়ে পেছন ফিরে বুকে জড়িয়ে নেন মেয়েকে নারগিস বেগম। কথা বলতে নিয়ে গলা ধরে আসে উনার। ধরা গলায়ই বলেন,

-সবার জীবন গুছিয়ে দিবি আর তোর জীবনটা বানের জলে ভেসে যাবে?

মেকি হেসে চিত্রলেখা বলে,

-ভাইবোনদের জন্য যদি বানের জলে ভাসতে হয় তা নাহয় ভাসলাম। এতে মন্দ কই?

-তোকে কেন সবার জন্য করতে হবে? তুই কি ঠেকা নিয়ে রাখছিস সবার জন্য করার?

-ঠেকাই তো খালা। আমারই তো ঠেকা। আমি না করলে কে করবে? আমি বাঁইচা থাকতে ওদের তো আমি ভেসে যাইতে দিতে পারি না। আর ওরা তো আছেই। ওরা তিনজন ঠিক আমাকে আগলায় রাখবে তুমি দেইখো।

-জীবন বড় কঠিন জিনিস রে মা। বাস্তবতার কাছে সম্পর্কগুলো একসময় ঠুনকো হয়ে যায়।

-আমার ভাইবোনেরা কখনো এমন হবে না খালা। ওরা আমাকে অনেক ভালোবাসে। তুমি দেখে নিও একদিন ওরাই আমার মাথার ছায়া হবে। তিন তিনটা বটবৃক্ষ হবে। শেষ বয়সে আমাকে আর কোনো কষ্ট করা লাগবে না।

-ওদের জীবন গুছায় দিবি, সংসার গুছায় দিবি। আর তুই? তোর জীবন কে গুছাবে? তোর সংসার কে সাজায় দিবে?

-সবার কপালে সব থাকে না খালা। ঘর-সংসার করার ওত শখও আমার নাই। কোনোমতে ওদের জীবন গুছায় দিতে পারলেই হয়। আমার নিজের জন্য তোমরা আছো আলাদা করে কিচ্ছু চাই না।

-এমনে বললে হয় না রে মা।

-এমনে বললে হয় না কেমনে বললে হয় সেটা পরেরটা পরে দেখা যাবে। তুমি আপাতত উঠো চলো ভাত খাবা।

চিত্রলেখা বিছানা থেকে নেমে খালাকে তুলে বসায়। হাত ধরে টানে নামানোর জন্য। আরেক হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার হাত ধরে নারগিস বেগম বলেন,

-তোদের সঙ্গে নিবি আমারে?

-তুমি আমাদের সঙ্গে কই যাবা নিজের ঘর-সংসার ফালায়?

-এই ঘর-সংসার আর আমার নাই।

-মানে!

-তোর খালু আবার বিয়ে করবে।

খালার মুখে এমন কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় চিত্রলেখা। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

-তুমি অনুমতি দিয়ে দিলা?

-আর না দিয়ে উপায় কই বল? তার নিজের রক্ত চাই। আমি তো তারে কোনো বাচ্চা দিতে পারলাম না।

-তোমার তো কোনো সমস্যা নাই খালা।

-সমস্যা নাই কিন্তু বাচ্চাও তো হইলো না। বাজাই তো রয়ে গেলাম।

-আমরা চার ভাইবোন থাকতে তুমি কোনোদিন বাজা না।

-তোর খালু কোনোদিন তোদেরকে নিজের সন্তানের মতো দেখে নাই। আর কোনোদিন দেখবেও না। এই আশা আমি অনেক আগেই ছেড়ে দিছি। বহুত হাত-পা ধরছি আর সম্ভব না। তার সন্তান চাই তাই বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে দিছি। তুই আমাকে তোদের সাথে নিয়ে যাইস মা। এই বয়সে আমি সতীনের সংসার করতে চাই না।

বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন নারগিস বেগম। চিত্রলেখা খালার মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

-আমি যেখানেই যাই তুমি আমার সঙ্গেই থাকবা। যা আছে কপালে। আল্লাহ মা র বে না আমাদের তুমি দেইখো।

নারগিস বেগমের কান্নার গতি বাড়ে। এভাবে কাঁদতে চাননি তিনি, ভেঙে পড়তেও চাননি। দীর্ঘ সময় বুকের ভেতর দুঃখ চাপ দিতে দিতে আজ আর ভেতরে জায়গা অবশিষ্ট নেই দুঃখ চাপা দেয়ার। এতকাল আড়াল করে রাখা দুঃখ সব চোখের পানি হয়ে ঝড়তে শুরু করেছে সুযোগ পেয়ে। চিত্রলেখাও বাঁধা দেয় না। বরং খালাকে কাঁদতে দেয়। কাঁদলে মন হালকা হবে। এতদিনের জমিয়ে রাখা কষ্ট মুছে যাবে না তবুও সহনীয় হবে। ও তো আছেই সামলে নেয়ার জন্য, চিন্তা করার জন্য। সময় মতো ঠিক সব সামলে নিবে। আল্লাহ তায়া’লা ওকে সব সামলে নেয়ার অসম্ভব ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সবাইকে সামলে রাখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওর কিন্তু ওকে সামলাবে কে? আল্লাহ কি এমন কাউকে পৃথিবীতে পাঠায়নি যে ওকে সামলাবে? পাঠিয়ে থাকলে সেই মানুষটা কোথায়? কত দূরে আছে? কবে আসবে সে চিত্রলেখার জীবনে? নাকি এমন কাউকে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠায়নি?

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-২৩+২৪

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনকের কেবিনে টেবিলের এপাশ আর ওপাশে মুখোমুখি বসে আছে ওরা দুই ভাই। ছোট ভাইয়ের জরুরী তলবেই বড় ভাই রাদিন এসেছে তার সঙ্গে দেখা করতে। এসেই খানিকক্ষণ এদিক সেদিকের কথা বলে রাদিন জিজ্ঞেস করে,

-তুই হঠাৎ আমায় অফিসে এসে দেখা করতে বললি কেন? এমন কি জরুরী কথা যা এখানেই বলা লাগবে? বাসায়ও তো কথা বলা যেতো নাকি বাসায় বলা যাবে না? কেউ শুনে ফেললে সমস্যা?

-এত অধৈর্য্য হচ্ছো কেন ভাইয়া? আসছো কিছুক্ষণ বসো। আমি যেহেতু তলব করেছি অবশ্যই বলবো কেনো আসতে বলেছি। তুমি তো অফিসে আসোই না। আজ যেহেতু আসছোই কিছুক্ষণ বসো। আমার ছোট্ট একটা কাজ আছে, শেষ করি। ততক্ষণে তোমার জন্য চা দিতে বলি। এক কাপ ওয়াও লেভেলের চা খাও।

-লাল চা আমার জন্য বলিস না। ওসব লিকার ভালো লাগে না।

স্মিত হেসে রওনক বলে,

-চিন্তা করো না গরম পানির লিকার খাওয়াবো না। ওয়ার্ল্ড ক্লাস চা খাওয়াবো আজ তোমায়।

-ওয়ার্ল্ড ক্লাস! বলিস কি? অফিসে এই জিনিস কীভাবে এলো?

-তোমার ছোট ভাইয়ের হাত অনেক বড় জানোই তো। জোগাড় করে ফেলেছি।

-তাহলে বল এক কাপ ওয়ার্ল্ড ক্লাস চা দিতে। খেয়ে দেখি কেমন তোর ওয়ার্ল্ড ক্লাস চা।

আর কথা না বাড়িয়ে ইন্টারকমে ফোন করে রওনক চিত্রলেখাকে বলে দু’কাপ চা দিয়ে যেতে। তারপর নিজের কাজে ব্যস্ত হয় সে। চিত্রলেখা চা দিয়ে গেলে রাদিন বেশ আরাম করেই চা-টা পান করে। আয়েশ করে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বলে,

-তুই তো ঠিকই বলেছিস রে। এতো দেখছি ওয়ার্ল্ড ক্লাস চা। চায়ের কোনো কম্পিটিশন হলে নিঃসন্দেহে এই চা জিতে চ্যাম্পিয়ন হবে।

ভাইয়ের কথার বিপরীতে কিছু না বলে আবার কেবল স্মিত হাসে রওনক। রাদিন হাত ঘড়িতে সময় দেখে। এখানে আসার পর এই পর্যন্ত সাতবার হাত ঘড়িতে সময় দেখেছে সে। তা রওনকের দৃষ্টি এড়ায়নি। শুধু হাত ঘড়ি নয়। দেয়াল ঘড়ির দিকেও তাকিয়েছে বেশ কয়বার। বড় ভাইয়ের যে বিশেষ তাড়া আছে তা রওনক জানে। এবারে মুখ খুলে সে বলে,

-তোমার বুঝি তাড়া আছে বের হবার?

খানিক অপ্রস্তুত হয়ে রাদিন বলে,

-না, ঠিক তা নয়।

-তাহলে বারবার ঘড়ি দেখছো যে! কারো সাথে এপয়েন্টমেন্ট আছে নিশ্চয়ই?

-সামনে একটা এক্সিবিশন আছে। সেই রিলেটেড মিটিং আছে একটা।

-বেশি জরুরী হলে ফোন করে বলে দাও আজ তুমি যেতে পারবে না।

রওনকের কথায় কিঞ্চিৎ অবাক হয় রাদিন। অবাক হওয়াটা তার চোখ-মুখে ফুটে উঠেছে। সে বলে,

-যেতে পারব না কেনো? এখনো তো সারাদিনই পড়ে আছে।

-দিন পড়ে থাকলেও আমার মনে হয় আমি এখন তোমাকে যে কথাগুলো বলবো তা শুনার পর তুমি হয়ত নিজেই আর যাবে না।

রওনকের কথার আগামাথা ধরতে পারে না রাদিন। তাই বলে,

-হেয়ালি না করে স্পষ্ট করে বলতো কি বলতে চাইছিস। তোর কথায় রহস্য টের পাচ্ছি।

-রহস্য তো আছে তবে আমার নয় তোমার।

-আমার রহস্য! আমার আবার কিসের রহস্য?

-তুমি সিঙ্গাপুর যাচ্ছো?

রওনকের প্রশ্নে থতমত খায় রাদিন। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়ার সম্পূর্ণ চেষ্টাও করে। তার সিঙ্গাপুর যাবার বিষয়টা কেউ জানে না। সে এখনো কাউকে জানায়নি। শুধু তানিয়াকে বলেছে তার পেইন্টিংয়ে মন বসছে না তাই হাওয়া বদলের দরকার। কেবল এতটুকুই বলেছে। ভুলেও সিঙ্গাপুর তো দূরের কথা এটাও জানায়নি সে দেশের বাইরে যাচ্ছে। তাহলে এই খবর রওনক কীভাবে জানলো? টিকেটটাও সে নিজে কেটেছে। অন্য কাউকে দিয়ে কাটায়নি যদি বিষয়টা লিক হয়ে যায় এই ভয়ে। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত নামে। রাদিনের ক্ষেত্রে হয়েছে তাই। সে কাউকে না জানিয়ে সিঙ্গাপুর যাবে ভেবেছিল কিন্তু তা মনে হয় আর হলো না। তবে এই মুহূর্তে রাদিনের মাথায় প্রশ্ন ঘুরছে, রওনক কি তানিয়াকে বিষয়টা জানিয়েছে? প্রশ্নটা করতে চেয়েও চেপে যায় সে। ভাইকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক নিজেই বলে,

-অবাক হচ্ছো? অবাক হওয়ার তো কিছু নেই ভাইয়া। এত বড় ব্যবসা যে সামলাচ্ছে তার জন্য কি এতটুকু খবর রাখা খুব কঠিন কিছু?

-তুই কি আমার পেছনে স্পাই লাগিয়েছিস?

-স্পাই লাগানোর কি কোনো প্রয়োজন আছে?

প্রশ্নের বিপরীতে পাল্টা প্রশ্নের তৎক্ষনাৎ জবাব দেয় না রাদিন। দুই সেকেন্ড সময় নেয়, ভাবে, তারপর বলে,

-হ্যাঁ যাচ্ছি, এটা তো নতুন কিছু নয়। এর আগেও কয়েকবার সিঙ্গাপুর গিয়েছি আমি।

-আগের যাওয়া আর এখনের যাওয়াটা যে এক নয় তা তুমিও ভালো করেই জানো ভাইয়া। তুমি সিঙ্গাপুর ঘুরতে যাচ্ছো না। বরং সেটেল্ড করতে যাচ্ছো। তুমি ভাবীকে চিট করছো।

রাদিনের থতমত ভাবটা বেড়ে গেল মুহূর্তেই। নিজেকে সামলে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে সে। কথা ধরে আসছে তার। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

-আমি তানিয়াকে চিট করছি এই কথা তুই বলতে পারলি?

-তুমি করতে পারছো আর আমি বলতে পারবো না? তুমি তোমার প্রাক্তন প্রেমিকার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কে জড়িয়েছো এটা তো মিথ্যা নয়।

নিজের মোবাইল ফোনটা রাদিনের দিকে এগিয়ে দিয়ে রওনক আরও বলে,

-যদি মিথ্যা হয়ে থাকে তাহলে এসব কি?

রওনকের ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে রাদিন ও তার প্রাক্তন প্রেমিকার হাত ধরাধরি করে কক্সবাজারের বিচে হাটাহাটির মুহূর্তের কিছু স্থিরচিত্র। ছবিগুলো দেখে একবার ঢোক গিলে রাদিন। রওনক বলতে থাকে,

-এখন বলো না এসব আগের তোলা। ছবির ডিটেইলসে গেলেই ডেট পাওয়া যাবো ছবিগুলো কোনদিন, কত তারিখে ঠিক কয়টার সময়ে তোলা। তাছাড়া দু’বছর আগের তুমি আর বর্তমান তুমির মধ্যেই বিশাল ফারাক। সেখানে তোমার ইউনিভার্সিটি টাইমের তুমি আর এখনকার তুমির মধ্যে রাতদিন পার্থক্য।

কি বলবে খুঁজে না পেয়ে রাদিন প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরাবার চেষ্টা করে বলে,

-তার মানে তুই সত্যি সত্যি আমার পেছনে স্পাই লাগিয়েছিস!

-এসব কথা বলে তুমি প্রসঙ্গ এড়াতে পারবে না ভাইয়া। এত বড় ব্যবসা সামলাচ্ছি চোখ-কান বন্ধ করে নয় নিশ্চয়ই! শুধু তো ব্যবসাটা না বাবা আমার উপর তোমাদের সবার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। সেসব দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে গেলেও তো খোঁজ-খবর রাখতে হবে তোমরা কে কোথায় কি করছো না করছো।

-তুই কি তানিয়ার পিছনেও স্পাই লাগিয়েছিস?

স্মিত হেসে রওনক বলে,

-ভাইয়া তুমি নিজেও জানো চরিত্রের দিক দিয়ে ভাবী তোমার থেকে ফার বেটার। তোমার মতো তার চারিত্রিক সমস্যা নেই।

-তুই বলতে চাইছিস আমার চরিত্রে দোষ আছে?

-অবশ্যই আছে।

-রওনক!

চেঁচিয়ে ওঠে রাদিন। কিন্তু রওনক শান্ত কন্ঠেই বলে,

-অযথা চেঁচিয়ে লাভ নেই ভাইয়া৷ আমি চেঁচামেচি করলে তুমি টু শব্দ করারও সুযোগ পাবে না। যে লোক ঘরে বউ বাচ্চা রেখে প্রাক্তন প্রেমিকার সাথে অনৈতিক সম্পর্ক রাখে তার চরিত্র নিশ্চয়ই পরিষ্কার নয়। আর তুমি ভাবীর দিকে আঙ্গুল তুলছো নিজের দোষ ঢাকার জন্য। যে মহিলা তোমার জন্য নিজের জীবন সেক্রিফাইজ করলো।

-তানিয়া আমার জন্য সেক্রিফাইজ করেছে?

-করেনি বলছো? তার কি প্রয়োজন কোম্পানির পিছনে গা ধা র খাটনি খাটার? বাড়ির বড় বউ বাসায় থাকবে, আরাম করবে, মন চাইলে শপিং করবে, দেশ-বিদেশ ঘুরতে যাবে, পার্টি করবে। কিন্তু এসব না করে সে কোম্পনির পিছনে দিন-রাত খাটছে। কেনো? তোমার জায়গাটা অপূর্ণ না রাখতে। কেউ যেনো তোমার দিকে আঙ্গুল তুলতে না পারে সেজন্য। কেউ যেনো বলতে না পারে তোমার সাইড থেকে কোম্পানিতে কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই। তোমার হয়ে তোমার কাজটা সে করছে। আর তুমি তাকে চিট করছো। তোমার জন্য এতকিছু করার পর মানুষটা আর যাই হোক এটা ডিজার্ভ করে না। তুমি তাকে ঠকানোর কোনো অধিকার রাখো না। তাছাড়া কার জন্য করছো এসব? তুমি কি মনে করো তোমাকে ভালোবেসে ঐ মহিলা তোমার জীবনে ফিরে এসেছে? যদি এমনটা ভেবেও থাকো তাহলে আমি বলছি শুনো, তুমি খুবই ভুল ভাবছো। ঐ মহিলা শুধু মাত্র তোমার টাকার জন্য এসেছে। আগের হাজবেন্ডের সাথে ডিভোর্সের সময় যেসব টাকা পয়সা পেয়েছিল সব উড়িয়ে শেষ করেছে। তারপর যখন তোমার সঙ্গে দেখা হলো এবং দেখলো তুমি আজও তাকে ভুলে যাওনি তখনই বুদ্ধি আটলো তোমাকে ফাসানোর। তুমি তার জন্য কেবল সোনার ডিম দেয়া হাঁস। এই পর্যন্ত তুমি তার পেছন বিশাল এমাউন্ট খরচ করে ফেলেছো। যার পাই টু পাই হিসাব আমার কাছে আছে। তুমি কি ভেবেছো তোমরা কে কথায় টাকা খরচ করছো সে খবর আমার অজানা? আমার পারমিশন ছাড়া এক পয়সাও কোম্পানি থেকে নিতে পারবে না তোমরা কেউই। শুধু তাই নয় তোমার ধানমন্ডির ফ্ল্যাটটায় ঐ মহিলা থাকছে। তুমি কি ভেবেছো এসব খবর আমার পর্যন্ত আসবে না? আমার নাকের নিচে তুমি কান্ড ঘটনাবে আর আমি টের পাবো না তা তুমি ভাবলে কীভাবে ভাইয়া? সবার কাছ থেকে আড়াল করতে পারলেও আমার থেকে আড়াল করতে পারবে না এটা সিওর থাকো।

কথার এই পর্যায় রওনক থামলে রাদিন জিজ্ঞেস করে,

-তানিয়া এসব জানে?

-তুমি বলতে লজ্জাবোধ করলে আমি বলতে পারি সমস্যা নেই।

আমতা আমতা করে রাদিন। তা দেখে রওনক বলে,

-তুমি নিজেও ভালো করে জানো, তুমি যে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছো সেটা শুধুমাত্র তোমার ইনকাম দিয়ে সম্ভব নয়। আর এটাও জানো আমি বললে কোম্পানি থেকে যে শেয়ার তুমি পাও সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। কোম্পানির একটা টাকাও যেনো তুমি না পাও সেই ব্যবস্থা করার ক্ষমতা আমার আছে। তখন কিন্তু তোমার প্রেমিকা তোমাকে ছাড়তে দুইদিন সময়ও অপচয় করবে না।

-তুই কি আমায় হুমকি দিচ্ছিস?

-তুমি ভালো করেই জানো ভাইয়া আমি হুমকি ধামকি দেয়ায় বিশ্বাসী নই। সবসময়ই আমার কাজ কথা বলেছে। তাই তোমাকেও সরাসরি বলছি। তোমার আমার পরে এই সব বিষয়-সম্পত্তির মালিক হবে মিমি, মিশকাত। অহেতুক তোমার পেছনে এক পয়সা অপচয় করার পক্ষে আমি নই। বরং যাদেরটা তাদের জন্যই সংরক্ষিত হবে। সময় মতো বুঝিয়ে দেয়া হবে আসল উত্তরাধিকারীদের। তবে ভাইয়া তোমার জন্য আমার একটা অফার আছে।

রাদিনের চোখে-মুখে কৌতুহল। কৌতুহলী কন্ঠে সে জিজ্ঞেস করে,

-কিসের অফার?

একটা চেক এগিয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-তিন কোটি টাকার চেক লিখে দিলাম। তোমার প্রেমিকা তার প্রাক্তন স্বামীর থেকে ডিভোর্সের সময় মাত্র পঞ্চাশ লাখ টাকা পেয়েছিল। এটা সেই তুলনায় কয়েকগুণ। চেকটা দিয়ে সম্পর্কের ইতি টেনে নিজের সংসারে মন দাও। আর তোমার প্রেমিকাকে এটাও বলো আরও টাকার প্রয়োজন হলে যেনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তোমাকে বিরক্ত না করে।

এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে রওনক আরও বলে,

-আমি জানি তুমি মনে মনে কি ভাবছো। তুমি ভাবছো তোমার প্রেমিকা চেকটা নিবে না। তবে এটা তোমার ভুল ধারনা। চেকটা সে নিবে তা আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। তবে যদি না নেয় অর্থাৎ আমি ভুল প্রমাণিত হই তাহলে নাহয় তুমি তোমার প্রেমিকাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যেও। এদিকটা আমি সামলে নিবো। তবে গ্যারান্টেড আমি একটুও ভুল নই। চাইলে বাকিটা তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পারো। আমার আর কিছু বলার নেই ভাইয়া। তুমি আসতে পারো। তোমার পরবর্তী সিন্ধান্তের উপর সব কিছু নির্ভর করছে আমি কোন স্টেপটা নিবো। তবে এটা মাথায় রেখো আমার জন্য তোমার চাইতে মিমি, মিশকাত মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। তোমার হাত ছাড়তে আমার দু’সেকেন্ডও লাগবে না কিন্তু জীবন থাকতে আমি মিমি, মিশকাতকে ছাড়বো না। আমি থাকতে ওরা ওদের বাবার চিটের পরিণাম ভোগ করবে না।

ছোট ভাইয়ের কথার পিঠে আর কিছু বলার মতো মুখ নেই রাদিনের। তাই আর কোনোরকম প্রতিউত্তর না করেই বেরিয়ে যায় সে। কিন্তু যাবার সময় চেকটা নিয়ে যায়নি।

রাদিন চলে যাবার এক মিনিটের মাথায় রওনক এগিয়ে গিয়ে তার কেবিনের বাথরুমের দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে তানিয়া। তাকে দেখতে স্বাভাবিক লাগছে। মনে হয় যেনো সবকিছু তার আগে থেকে জানা নয়ত এমন কিছুর জন্য আগে থেকেই সে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে রেখেছিল। রওনক কিছু জিজ্ঞেস করে না। তানিয়া নিজেই বলে,

-আমি তোমার ভাইয়াকে ডিভোর্স দিবো রওনক। সে আমাকে ছাড়বে কিনা জানি না তবে আমি সত্যি সত্যি আমার জীবনে তার চ্যাপ্টার ক্লোজ করছি। এই সম্পর্কটার ইতি টানার সময় হয়ে গিয়েছে। আমাদের পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও বিয়ের প্রথমদিন থেকেই আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু বিনিময়ে তোমার ভাইয়ার সেই উষ্ণ ভালোবাসা কখনই পাইনি। তবুও আফসোস করিনি কখনো। কারণ আমি জানতাম মানুষটা একান্তই আমার। কিন্তু সেই মানুষ নিজেই নিজের ভাগ আরেকজনকে দিয়েছে তাও আমার বর্তমানে। তাই সেই ভাগ হয়ে যাওয়া মানুষটাকে আমি আমার জীবনে আর চাই না।

-আই এম অলওয়েজ উইথ ইউ ভাবী ইন ইউর এভরি ডিসিশন।

বেরিয়ে যাবার আগে তানিয়া আরও বলে,

-ডিভোর্সের পর আমি এখানে থাকবো না রওনক। যার হয়ে দায়িত্ব পালন করছি সেই মানুষটাই যেহেতু জীবনে থাকবে না তাই তার হয়ে আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে চাই না। রাতেই আমার রিজায়েন লেটার তোমায় মেইল করে দিবো। ডিভোর্সের পর আমি আমেরিকা চলে যাবো। তুমি চাইলে মিমি, মিশকাতকে রাখতো পারবে তবে আমার একটা ছোট্ট শর্ত আছে।

-কি শর্ত?

-তোমাকে বিয়ে করতে হবে। মা না থাকুক, মায়ের মতো কাউকে প্রয়োজন হবে ওদের সবসময়। তুমি নাহয় বাবার জায়গাটা পূর্ণ করলে। মায়েরা বাবার অভাব পূরণ করতে পারলেও পৃথিবীর কোনো বাবাই মায়ের অভাব পূরণ করতে পারে না। তাই মায়ের জায়গায় মায়ের মতো কাউকে লাগবেই। সেজন্য তোমাকে বিয়ে করতে হবে যদি তুমি মিমি, মিশকাতকে নিজের কাছে রাখতে চাও।

রওনকের কপালে চিন্তার সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। তা দেখে তানিয়া আরও বলে,

-চিন্তা নেই। আমি মায়ের মতো বলবো না তোমায় সাবাকেই বিয়ে করতে হবে। আমি শুধু বলছি বিয়ে করতে। তুমি যাকে চাও তাকেই করবে, যার জন্য তোমার মন পোড়ে তাকে আপন করে নাও। যার হাতের চায়ের খুব করে প্রশংসা করলে চাইলে তাকেও করতে পারো সেটা একান্তই তোমার ব্যাপার। তবে আমার শর্ত বহাল থাকবে। তুমি নিজেও ভালো করে জানো আমি বেঁচে থাকতে মামলা করেও তুমি ওদের দু’জনকে নিজের কাছে রাখতে পারবে না। তোমার কাছে একমাত্র ও সহজ পথই হচ্ছে আমার শর্তটা মেনে নেয়া। ভেবে দেখো কি করবে, আমি আসছি।

বলেই বেরিয়ে যায় তানিয়া। পেছনে রওনকের কপালের দুশ্চিন্তার ছাপ গাঢ় হয়।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

তানিয়া বের হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই রওনকের কেবিনের দরজায় নক করে চিত্রলেখা। নক করেই দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখতে পায় টেবিলের কার্ণিশ ঘেঁষে খানিকটা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রওনক। তার চোখ-মুখে ছড়িয়ে আছে বিধ্বস্ত ভাব। তা দেখে ওখানে দাঁড়িয়েই চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-ইজ এভরিথিং অলরাইট?

চিত্রলেখাকে দেখে কিঞ্চিৎ সোজা হয়ে দাঁড়ায় রওনক। বলে,

-কাম ইন।

চিত্রলেখা ভেতরে প্রবেশ করে দরজাটা ছেড়ে দিতেই চৌম্বকের টানে তা লেগে যায়। এগিয়ে এসে রওনকের মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। দু’হাত পরিমাণ দূরত্ব দু’জনের মাঝে। রওনক হাত তুলে সামনের দিকে ইশারা করে বলে,

-টু স্টেপ সামনে এসো।

রওনকের আদেশ মতো দু’কদম সামনে আগায় চিত্রলেখা। রওনক আবারও বলে,

-ওয়ান মোর স্টেপ।

এবারে কেমন কেমন করে তাকায় চিত্রলেখা তবুও কিছু করার নেই বসের আদেশ বলে কথা। তাছাড়া আরেক কদম আগে গেলেও সামনে জায়গা থাকছে তাই প্রশ্ন না করে আরও এক কদম আগায় সে। এবারে দু’জনের মাঝে দূরত্ব এক হাতও নেই। আপাতত রওনক আর কিছু বলছে না। তার দৃষ্টি চিত্রলেখার মুখের উপর সীমাবদ্ধ। এমন কঠিন নীরবতায় চিত্রলেখার সাহস হয় না কিছু জিজ্ঞেস করার। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে তারা দু’জনে আবার লিফটে আটকা পড়েছে। এক্ষুনি মাথা ঘুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে সে। এবারে একদম সোজা হয়ে দাঁড়ায় রওনক। চিত্রলেখাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়ে বাম হাত বাড়িয়ে ওর ডান হাতটা ধরে ওকে নিজের আরও খানিকটা কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-বিয়ে করবে আমায়?

চিত্রলেখার মনে হলো ওর মাথার উপরে কঠিন একটা বজ্রপাত হয়েছে। বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে ও হয়ত ভুল শুনেছে কানে। চিত্রলেখাকে ওমন হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধরে রাখা হাতটা সামান্য ঝাঁকিয়ে রওনক আবারও জিজ্ঞেস করে,

-করবে আমায় বিয়ে?

তৎক্ষনাৎ চিত্রলেখার কি হলো কে জানে! সে রওনকের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার কপাল স্পর্শ করে আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো,

-আপনার কি জ্বর হয়েছে?

কিন্তু কপাল স্পর্শ করতেই চিত্রলেখার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। তাকে ছুঁয়েই টের পেলো কোনো জ্বর টর হয়নি। রওনক চিত্রলেখার চোখে চোখ রেখে বলল,

-আমায় দেখে কি মনে হয় জ্বর হয়েছে?

রওনকের কপাল স্পর্শ করে থাকা চিত্রলেখার হাতটা আবার নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় সে। এবারে যেনো সাপ দেখার মতো জমে গেল বেচারি। রওনকের মুখে আবোলতাবোল কথা শুনে ও নিজেও ঘেটে ফেলেছে হাত বাড়িয়ে জ্বর দেখে। চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক বলে,

-আমি কিন্তু জবাব পাইনি।

কিছু না বলে রওনকের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায় চিত্রলেখা। রওনক আর বাঁধা দেয়নি, পেছনও ডাকেনি। একলা দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানেই জবাবের অপেক্ষায়। তবে জানা নেই আদৌ সে জবাব পাবে কিনা। খুব বেশি একটা আশা রাখছে না যদিও।

আজকের মতো পড়ানো শেষ করে বেরিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে লিখন বলে,

-একটু খালাম্মাকে ডাক দিয়ে দেও।

নাইম এক দৌড় লাগায় মাকে ডাকতে। বৃষ্টি ওর খাতা কলম গুছাতেই ব্যস্ত। যদিও খাতা কলম গুছানোটা বাহানা কেবল। লিখন যতক্ষণ থাকে বৃষ্টি আশেপাশেই থাকে কোনো না কোনো বাহানায়। বৃষ্টি, নাইমের মা সালেহা বেগম এগিয়ে এসেই জিজ্ঞেস করেন,

-তুমি নাকি আমাকে ডাকছো বাবা?

-জি খালাম্মা। একটু বসেন কথা আছে।

একটা চেয়ার টেনে বসেন সালেহা বেগম। লিখনকে ইতস্তত করতে দেখে নিজেই বলেন,

-তোমার কি বাবা টাকা পয়সা কিছু লাগবে? এই মাসের বেতনটা আগাম দিয়ে দিবো?

-না না খালাম্মা টাকা পয়সা লাগবে না। আসলে আমি অন্য একটা কথা বলতাম।

-বলো শুনি।

-মানে আসলে খালাম্মা…

লিখনকে মানে আসলে করতে দেখে খানিকটা উঁচু স্বরেই বৃষ্টি বলে,

-এত মানে মানে করতেছেন কেন? ঝেড়ে কাশেন তো। আমার মা বা ঘ না যে আপনাকে খে য়ে ফেলবে। বলেন তো দেখি কি বলতে চান।

লিখন এক মুহূর্তের জন্য বৃষ্টির দিকে তাকায়। মেয়ের কথা শুনে ওকে ধমকে সালেহা বেগম বলেন,

-এসব কি বৃষ্টি! শিক্ষকের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?

লিখন বাঁধা দিয়ে বলে,

-থাক খালাম্মা আজ আর ওকে কিছু বইলেন না।

-এই তোমার আদরেই এত লাই পেয়ে মাথায় উঠছে বেয়া দব মেয়েটা।

-থাক না খালাম্মা।

-আচ্ছা বলো তুমি কি বলতে চাও।

লিখন আরও একবার বৃষ্টির দিকে তাকায়। ওর চোখে স্পষ্ট আগ্রহ ও কৌতূহল। পারছে না মায়ের ভয়ে আবার বলতে, ❝জলদি বলেন তো কি বলবেন।❞ তবে এবারে আর সময় অপচয় না করে লিখন বলেই ফেলে আসল কথাটা। ছোট্ট করে বলে,

-কাল থেকে আমি আর ওদের পড়াতে পারব না।

-কেন বাবা? কোনো সমস্যা হইছে?

-কোনো সমস্যা হয়নি। জানেনই তো আমার এটা ফাইনাল ইয়ার। নিজের পড়ালেখার চাপ তো আছেই তাছাড়া আমি আইএলটিএসের কোর্সে ভর্তি হইছি। কাল থেকে ক্লাস শুরু। ইউনিভার্সিটির ক্লাসের পর কোর্সের ক্লাস করে ওদের পড়াতে পারবো না। এমনিই সপ্তাহে চারদিন পড়াই সেটাও যদি ঠিক মতো সময় না দিতে পারি তাহলে কীভাবে হয় বলেন! সেজন্যই আর কি ভাবছি আমি পড়ানোটা বাদ দিয়ে দিবো। এই মাসটা পড়াতে চাইছিলাম কিন্তু আমার সিডিউল এত টাইট যে সময় হবে না একদমই।

সব শুনে ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে সালেহা বেগম বলেন,

-জানোই তো বৃষ্টির সামনে পরীক্ষা। তুমি এই সময় না পড়াইলে ওকে নিয়ে সমস্যায় পড়ে যাবো মনে হচ্ছে। মাঝামাঝি সময়ে ভালো টিচার কই পাই বলো তো।

-ওটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আমার কয়েকজন ফ্রেন্ডকে বলছি। ওদের মধ্যে যার সময় হবে সে পড়ায় দিবে। আমি কালকের মধ্যেই একজন কনফার্ম করে ফেলবো। আর বৃষ্টির পরীক্ষায় তো এখনো সময় আছে। আমার কোর্সটা শেষ হয়ে গেলে পরে নাহয় আমিও ওকে পড়া দেখায় দিবো। আপনি একদম চিন্তা করবেন না।

-আচ্ছা তুমি যেহেতু দেখেতেছো তাহলে আর কোনো চিন্তা নাই। তোমার ভবিষ্যতের ব্যাপার তাই আমি আর তোমাকে আটকাবো না। অন্য ব্যাপার হইলে ছাড়তাম না। আমার জন্য তো তুমি আর ওরা আলাদা না। তবে তুমি শুধু দেইখো তোমার মতো যত্ন করে পড়াবে এমন কাউকে দিও। আর তুমিও একটু খোঁজ-খবর রাইখো বাবা।

-আপনি একদম চিন্তা করবেন না খালাম্মা আমি সবসময় টাচে থাকবো।

-তাহলে আমি নিশ্চিত হইলাম।

এতক্ষণ চুপচাপ পাশে বসে থেকে দু’জনের কথা শুনেছে বৃষ্টি। এবারে উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,

-কোনো দরকার নাই আম্মু কাউকে কষ্ট দেয়ার। যে পড়াবে না তার তো দায় পড়ে নাই টিচার ঠিক করে দেবার। মাথা যার ব্যথাও তার। আমার পড়ালেখার ব্যবস্থা আমিই দেখে নিবো।

-মানে! টিচার না রাখলে পড়বি কেমনে?

জিজ্ঞেস করেন সালেহা বেগম। জবাবে বৃষ্টি বলে,

-যাদের বাসায় টিচার আসে না তারাও লেখাপড়া করে আম্মু। তাছাড়া এখন আর সেই আদি যুগ নাই যে বাসায় এসে গৃহশিক্ষক ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াবে। সবাই ব্যাচে পড়ে আমিও ব্যাচেই পড়বো অন্যদের মতো। টিচার তো আর রেজাল্ট আইনা দিবে না। রেজাল্ট ভালো করার দায়িত্ব আমার। নাইমকেও ব্যাচেই ভর্তি করায় দিবো। তুমি আর উনাকে কষ্ট দিও না। সে দায় মুক্ত হতে চায় তাকে দায় মুক্ত করলাম। এখান থেকে আমার পড়ালেখার ব্যাপার আমিই বুঝবো।

আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে ভেতরের দিকে অগ্রসর হয় বৃষ্টি। পেছন থেকে লিখন একবার ডাকে ওকে।

-বৃষ্টি।

লিখনের ডাকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে বৃষ্টি বলে,

-ভালো থাকবেন, আসসালামু আলাইকুম।

এতটুকু বলে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। পেছনে বেচারা লিখনের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। এভাবে মাঝপথে ছাত্রীর হাত ছেড়ে দেয়ার অপরাধবোধ জেঁকে বসেছে তাকে।

সালেহা বেগম বলে,

-তুমি একটু বসো বাবা এই মাসের বেতন টা দিয়ে দেই।

-দরকার নেই খালাম্মা, এই মাসে পড়ালামই তো মাত্র কয়টা দিন। এখনো আধা মাসও হয় নাই।

-তো কি হইছে? আমি কি তোমাকে সামান্য কয়টা টাকা খালা হিসেবে দিতে পারি না? তাছাড়া তোমার খালু যদি শুনে তোমাকে খালি হাতে বিদায় দিয়েছি তাহলে আমার সাথে অনেক রাগ করবেন। তুমি বসো আমি আসতেছি।

লিখনকে দেবার জন্য টানা আনতে ভেতরে চলে যান সালেহা বেগম। এতক্ষণ নাইমও চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে মুখ খুলে বলে,

-আপনি সত্যি সত্যি আর আমাদের পড়াবেন না?

-কাছে আসো।

লিখনের ডাকে নাইম তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে সে বলে,

-পড়ায় কোথাও কোনো সমস্যা ফেইস করলে বন্ধের দিন বই খাতা নিয়ে আমার বাসায় চলে যাবা কেমন? আমি পড়ায় দিবো।

-আচ্ছা।

বলে মাথা ঝাঁকায় নাইম। লিখন আরও বলে,

-তোমার আপুকেও বলবা আমি বলছি বন্ধের দিন বাসায় গিয়ে যা যা সমস্যা আমার থেকে যেনো দেখে আসে।

-আচ্ছা বলবো।

পাশ কেটে একবার বৃষ্টির ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকায় লিখেন। তার বুক উপচে একটা অপরাধবোধের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কিন্তু এই কাজটা করা ছাড়া ওর নিজেরও কোনো উপায় ছিল না। সম্ভব হলে পড়ানোটা ও ছাড়তো না। উপায় নেই বলেই এই পদক্ষেপ নেয়া। বৃষ্টিটা যে অভিমান করেছে তা বেশ বুঝতে পারছে লিখন। তবে সে এটাও জানে বৃষ্টি বুদ্ধিমতী মেয়ে। খানিক সময় পর ঠিকই বুঝতে পারবে তারপর নিজেই সামলে উঠবে। ওকে আর আলাদা করে বুঝাতে হবে না। তখন নিজে গিয়েই দেখা করে আসবে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-২১+২২

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

বারান্দার গ্রীলের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে চিত্রলেখা। যদিও এটা চৈত্রমাস নয় তবু তার মনের ভেতর চৈত্রের খড়া। তৃষ্ণায় ভেতরটা খা খা করছে। তবে এই তৃষ্ণা পানির নয়। কিসের তা জানতে চায় না চিত্রলেখা। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। সেই সঙ্গে চিত্রলেখার খোলা চুলও উড়ছে। বাতাসের মৃদু ধাক্কায় ওড়নাটাও একদিক সেদিক করছে। মস্তিষ্কের ভেতরে তার হাজারটা চিন্তা ভাবনার ছড়াছড়ি। এসব চিন্তা ভাবনার শুরু আছে কিন্তু কোনো শেষ নেই। নেই কোনো মানে। তাও ভাবনা মস্তিষ্কের ভেতর শেকড় গজিয়েছে।

হাই তুলতে তুলতে চোখ ডলে বোনের পাশে এসে দাঁড়ায় চারু। চিত্রলেখার কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বলে,

-তুমি এখানে দাঁড়ায় আছো কেন আপা?

বলতে বলতেই আবার হাই তুলে। চিত্রলেখা চারুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,

-তুই উঠে আসলি কেন?

-ঘুম ভেঙে গেল। তাকায় দেখি তুমি নাই। তাই দেখতে আসলাম তোমাকে।

-তোর চোখে অনেক ঘুম। যা ঘুমায় পর।

-তুমি ঘুমাবা না?

সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-ঘুম আসছে না।

-কেন আপা? কারো কথা ভাবতেছো?

❝কারো কথা ভাবতেছো?❞ জিজ্ঞেস করায় বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে চিত্রলেখার। প্রশ্নটা কোথায় গিয়ে যেনো বিঁধে। কারো কথা ভাবার অবকাশ কি ওর আছে? হু হু করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায় চিত্রলেখার বুক চিঁড়ে। সেসব দীর্ঘশ্বাস আড়াল করতে গিলে ফেলে সে। বোনকে ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে চারু আরও বলে,

-একটা প্রশ্ন করি তোমারে আপা?

-কর।

-তোমার কি কখনো কাউকে ভালোবাসতে মন চায় না? কখনো কারো প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করে না? শুনেছি প্রেম, ভালোবাসা নাকি স্বর্গীয় সুখ দেয়।

এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-না।

-কেন?

ব্যাখ্যা চায় চারু। জবাবে চিত্রলেখা বলে,

-প্রেম, ভালোবাসা অপাত্রে হলে জীবনটা বিষের মতো লাগে। ভালোবাসা যতখানি সুন্দর, অপাত্রে সেই ভালোবাসাই কাটার মতো বিষাদময়। ভালোবাসা তখনই সুন্দর যখন তা সুপাত্রে হয়। অপাত্রে ভালোবাসা হয়ে গেলে জীবন শেষ হয়ে যায়।

-অপাত্র! ভালোবাসার মানুষ কি কখনো অপাত্র হয়?

-হু, অপাত্র হয়। যাকে ভালোবাসবো সে যে সুপাত্রই হবে তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? দিতে পারবে কেউ গ্যারান্টি? মানুষ চিনা কি খুব সহজ?

বড় বোনের কথা ভাবায় চারুকে। জীবন নিয়ে চিত্রলেখার চিন্তাভাবনা শুধু বাস্তবিক নয়, কঠিন বাস্তবিক। আবেগে সে কখনোই গা ভাসায়নি। মূলত তার জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাকে সেই সুযোগ, অনুমতি কখনোই দেয়নি। তা চারুর অজানা নয়। আপাতত এইসব কঠিন বাস্তবিক চিন্তা ভাবনা হাতে ঠেলে চারু বোনের হাত টেনে ধরে বলে,

-চলো আপা ঘুমাবা।

-আমার ঘুম আসছে না, তুই ঘুমায় পর।

-আসো তোমার চুল টেনে দেই আরাম লাগবে, ঘুমও আসবে।

চিত্রলেখার মন চাইছে না ঘরে গিয়ে বিছানায় মাথা রেখে চোখ বন্ধ করতে। চোখের পাতা মিলালেই সেখানে কারো অবয়ব ভেসে উঠছে। কারো চলে যাওয়ার দৃশ্য। চোখ বন্ধ করে ওসব দেখার চাইতে মুক্ত আকাশ দেখতে ভালো লাগছে। কিন্তু চারুর জোরাজোরিতে ফিরে যেতে হয় বিছানায়।

বন্ধের দু’দিন বাসায় কাটিয়ে আজ আবার অফিসে এসেছে চিত্রলেখা। যদিও রওনক তাকে বলেছিল চাইলে আরও ২/১ দিন বাসায় থেকে বিশ্রাম করতে পারে। কিন্তু চিত্রলেখা নিজেই বাসায় থাকেনি। এমনও আহামরি কোনো শরীর খারাপ হয়নি যার জন্য বাসায় বসে ছুটি কাটাতে হবে। বরং এই দু’দিন বাসায় থেকেই অনেকটা হাপিয়ে উঠেছে বেচারী। ভাই-বোনদের অতিরিক্ত আদর-যত্নে আর আরামে বিরক্ত ধরে গেছে খানিকটা। তাই স্বাভাবিক হতে অফিস চলে এসেছে। অহেতুক ছুটি কাটানোর পক্ষে চিত্রলেখা কখনোই নেই। অফিস বিল্ডিংয়ে ডুকতেই রিসিপশনের মেয়েটা চিত্রলেখাকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে আসে ওকে ডাক দিয়ে।

-চিত্রলেখা ম্যাম।

মেয়েটার ডাকে দাঁড়িয়ে পড়ে চিত্রলেখা। অপারেটর ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রোমোশন হয়ে রওনকের অফিসে যাওয়ায় এই একটা সুবিধা হয়েছে। এখন অফিসের অনেকেই তাকে ম্যাম বলে ডাকে। আগে অনেকেই নাম ধরে ডাকতো, কেউ বা এই ঐ বলেই সম্বোধন করতো। কিন্তু যেদিন থেকে প্রোমোশন হয়ে রওনকের সঙ্গে কাজ শুরু করলো সেদিন থেকে অনেকেরই আচরণ বদলে গেছে। বেশির ভাগই ম্যাম বা ম্যাডাম বলেই সম্বোধন করছে। মেয়েটা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছেন?

-আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?

-ভালো আছি ম্যাম। আপনার নাকি শরীর খারাপ করেছে। এখন কেমন আছেন?

❝এই খবর অফিসে জানাজানি হয়ে গেছে!❞ মনে মনে ভাবে চিত্রলেখা। মুখে কেবল হেসে বলে,

-এখন ভালো আছি।

-আপনি স্যারের অফিসে যাচ্ছেন?

-অফিসেই তো যাবো। আর কোথায় যাবো?

-আপনাকে কষ্ট করে টপ ফ্লোরে যেতে হবে না।

-মানে? বুঝলাম না।

-সিইও স্যারের অফিস এখন সেকেন্ড ফ্লোরে।

-সেকেন্ড ফ্লোরে!

-হ্যাঁ, উপর থেকে নামিয়ে তিন তলায় অফিস সিফট করা হয়েছে।

-হঠাৎ ফ্লোর চেঞ্জ কেনো?

-সেটা তো আমি বলতে পারছি না ম্যাম। আমাকে বলা হয়েছিল সবাইকে জানিয়ে দিতে। আপনাকেও ফোন করতে বলা হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম আপনি আজ আসবেন না। একটু পরেই ফোন করতাম আপনাকে। কিন্তু এর আগেই আপনি চলে এলেন।

আর কথা বাড়ায় না চিত্রলেখা। সময় নষ্ট না করে উপরে উঠে যায়। হঠাৎ রওনকের ফ্লোর পরিবর্তন করার কারণ কি হতে পারে তা ভাবায় তাকে। তবে কারণ যাই হয়ে থাকুক না কেনো চিত্রলেখার জন্য ভালোই হয়েছে। এখন আর কষ্ট করে এত্তগুলো সিড়ি বেয়ে উঠতে হবে না তাকে। তবে চিত্রলেখার অবচেতন মন তাকে এটাও জানায় কোনোভাবে সে নিজেই ফ্লোর পরিবর্তনের কারণ নয় তো? এমন কি হতে পারে তার জন্যই রওনক উপর থেকে নিচে নেমে এসেছে? তার ফোবিয়ার কথা জানতে পেরে। এসব ভাবতে ভাবতেই তিন তলায় নতুন অফিসে এসে পৌঁছায় চিত্রলেখা।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক কেবিনে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরেই একবার নক করে ট্রে হাতে ভেতরে প্রবেশ করে চিত্রলেখা। ওকে প্রবেশ করতে দেখে মোবাইলে কিছু দেখতে ব্যস্ত রওনক একবার চোখ তুলে তাকায়। তারপর আবার নিজ কাজে মনোযোগ দেয়। চিত্রলেখা ট্রে থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি, এক কাপ চা ও একটা বাটি নামিয়ে রেখে ট্রে নিয়ে ফিরে যেতে নিলেই বাঁধা দিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-এটা কি?

দাঁড়িয়ে পড়ে চিত্রলেখা বলে,

-পায়েস।

-পায়েস কি উপলক্ষে?

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা। ইতস্তত করে বলে,

-না মানে সেদিন আপনি এমন সময় বাসায় গিয়েছিলেন যে দুপুরের রান্না সেরে আমি আর সময় পাইনি যে আপনার জন্য মিষ্টি কিছু বানাবো। আমার মা সবসময় বলতো শুনেছি অতিথিকে কখনো মিষ্টিমুখ না করিয়ে বিদায় দিতে নেই। অথচ আপনাকে মিষ্টিমুখ না করিয়েই বিদায় জানাতে হয়েছিল। সেদিন পারিনি তাই আজ বানিয়ে নিয়ে এলাম। বাকিটুকু আর বাকি রাখলাম না।

-কিন্তু এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি তো খাওয়া দাওয়া করতে যাইনি সেদিন। তাছাড়া আমি কোনো ধরনের মিষ্টি খাবার খাই না। আমার জন্য অযথাই কেউ ব্যস্ত হোক সেটা আমার পছন্দ নয়।

এত শক্ত কথা আশা করেনি তাই রওনকের বলা কথা শুনে তৎক্ষনাৎই চিত্রলেখার মুখটা চুপসে পানি হয়ে যায়। এমনিতেই ইতস্তত লাগছিল বেচারীর এখন আরও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। কি করবে দ্রুত চিন্তা করে হাত বাড়িয়ে পায়েসের বাটিটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য কদম বাড়ায়। রওনক হাত থেকে ফোনটা নামিয়ে রেখে ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সবেই চিত্রলেখা কেবিনের দরজার নবে হাত রেখেছে তখনই সে পেছন থেকে ডেকে বলে,

-দাঁড়াও চিত্রলেখা।

ওমনি আবার দাঁড়িয়ে পরে চিত্রলেখা। কোনো অজ্ঞাত কারণে চোখ টলমল করছে ওর। দাঁড়িয়ে পড়লেও পেছন ফিরে রওনকের দিকে তাকায় না। মাথা নিচু করেই রাখে। লজ্জা লাগছে এভাবে অনুমতি ছাড়া কিছু বানিয়ে আনা একদম উচিত হয়নি। এটা অনধিকারচর্চা হয়ে গেল। কখনো চিত্রলেখা এই ধরনের আহাম্মকি কারবার করেনি। আজ কঠিন একটা ভুল হয়ে গেল ওর। হয়ত চারুর বলা কথায় অবচেতন মনই ওকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছে, অন্যথায় চিত্রলেখা এমন নয়। রওনক চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। যদিও রওনক চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু ও বেচারী আজ ফ্লোর থেকে চোখ না তুলার পন করেছে মনে মনে। সামনের দিকে হাত পেতে রওনক বলে,

-বাটিটা দাও তো দেখি।

আচমকাই মুখ তুলে তাকায় চিত্রলেখা। ওমনি চোখে টলমল করা পানি এক চোখ গলে বেরিয়ে গেল হুড়মুড়িয়ে। চিত্রলেখার গালে চোখ বেয়ে পরা পানি দেখে বুকের ভেতর অদৃশ্য কিছু নিজের অনুভূতির জানান দেয় রওনককে। ব্যস্ত হয়ে ওঠে সে। বাম হাত বাড়িয়ে চিত্রলেখার ডান গাল বেয়ে পরা পানি মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো?

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। রওনক জিজ্ঞেস করে,

-তাহলে কাঁদছো কেনো?

-কাঁদছি না, চোখে হয়ত কিছু গিয়েছে তাই…

এবারে আগের চাইতে আরও বেশি ব্যস্ত হয় রওনক। এক কদম কাছাকাছি এগিয়ে যায় সে। চিত্রলেখার গাল হাতে স্পর্শ করে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে গিয়ে চোখে ফু দিয়ে দেয়, কিছু গিয়েছে কিনা দেখার চেষ্টা করে। রওনকের দেয়া ফু চিত্রলেখার চোখ, গাল স্পর্শ করতেই বেচারীর বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড় ওঠে। শরীর অবস লাগে। মনে হয় এই বুঝি এক্ষুনি মাথা চক্কর দিয়ে মাটিতে লুটিরে পরবে সে। বার দুই/তিনেক চিত্রলেখার চোখে ফু দিয়ে রওনক ওর গাল স্পর্শ করে রেখেই জিজ্ঞেস করে,

-এখন ঠিক লাগছে কি?

আবারও মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক আরও জিজ্ঞেস করে,

-সিওর? তুমি আমার সঙ্গে বাথরুমে এসো চোখে পানি দিয়ে দেই।

রওনককে এতখানি ব্যস্ত হতে দেখে তৎক্ষনাৎই নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-এখন ঠিক আছি। পানি দেয়া লাগবে না।

-চোখটা লাল হয়ে আছে একটু পানি দিলে ভালো লাগবে।

-আমি বাইরে গিয়ে দিয়ে নিবো।

রওনক ছাড়তে চায় না তবুও আর জোর করে না। চিত্রলেখার হাত থেকে পায়েসের বাটিটা নিয়ে এক চামচ মুখে দিয়ে বলে,

-চমৎকার হয়েছে।

-কিন্তু মিষ্টি বেশি হয়েছে। আর আপনি মিষ্টি খান না।

-ইটস ওকে, একদিন এতটুকু মিষ্টি খেলে আমি ম রে যাবো না।

চিত্রলেখা আর কিছু বলে না। রওনককে ওখানে রেখেই কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। চিত্রলেখা বেরিয়ে যেতেই পায়েসের বাটি সমেত চেয়ার ফিরে আসে সে। বাটিটা নামিয়ে রেখে আবার মোবাইলটা হাতে নেয়। অফিসে আসতে না আসতেই তার ফোনে একটা ডকুমেন্ট এসেছে। সেই ফাইলটাই দেখছি রওনক তখন। ফাইলটা দেখে তার মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। সেই বিগড়ে যাওয়া মেজাজের বিরক্তি নিজের অজানতে চিত্রলেখার উপরেই ঝেড়ে ফেলেছে। ভাগ্যিস তৎক্ষনাৎই সামলে নিতে পেরেছে।

রিপা সামনে এসে দাঁড়াতেই লিখন জিজ্ঞেস করে,

-এত দেরি করলা কেন? কখন থেকে ওয়েট করতেছি জানো না?

-জানি তো।

-তাহলে?

-মাথা বিগড়েছিল। গরম মাথায় তোমার সামনে আসতে মন চাইতেছিল না তাই মাথায় এত্তগুলা পানি দিয়ে মাথা ঠান্ডা করে তারপর বের হলাম।

-বাহ! আর এদিকে রোদের মধ্যে দাঁড়ায় থেকে আমার যে চান্দি গরম হয়ে গেল এটার কি হবে?

-তোমার চান্দি ঠান্ডা করার ঔষধ আছে আমার কাছে?

-কি?

-আগে একটা রিকশা ডাকো তারপর বলতেছি কি।

লিখন দেরি না করে একটা রিকশা ডেকে দু’জনে চেপে বসতেই রিপা নিজের ব্যগ থেকে একটা বক্স বের করে এগিয়ে দেয়। তা দেখে লিখন বলে,

-বিরিয়ানি রান্না করছো?

-না, আব্বু কাচ্চি নিয়ে আসছিল সুলতানের। জানোই তো আব্বু কিছু আনলে এত বেশি আনে যা বলার বাহিরে। আমরা খেয়েও অর্ধেক শেষ করতে পারিনি। সেখান থেকেই তোমার জন্য গরম করে নিয়ে আসছি। তোমার তো এসব বিরিয়ানি, কাচ্চি বেশি পছন্দ। আলুও এনেছি বেশি করে।

-চামচ আনো নাই?

ফিক করে হেসে ফেলে রিপা। হেসে নিয়ে ব্যাগ থেকে একটা চামচ বের করে দিতেই লিখন আর সময় অপচয় না করে খাওয়া শুরু করে। খেতে খেতে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-হঠাৎ তোমার মাথা গরম কেন? তুমি তো সহজে রাগ হও না কখনো।

-রাগ হই না কিন্তু চোখের সামনে অন্যায় দেখলে রাগ লাগে আমার।

-কে আবার কি অন্যায় করলো?

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রিপা। সকাল সকাল বোনের সাথে ঝামেলা হয়েছে ওর। নতুন কোনো বিষয়ে নয়। সেই রওনকের সঙ্গে সাবার বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়েই। রিপাও ছাড়েনি উচিত কথা শুনিয়ে দিয়েছে। সাবা ছোট বোনের ঠাস ঠাস করে বলা উচিত কথা হজম করতে না পেরে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করেছে। এনিয়েই দুই বোনের মধ্যে সকাল বেলায় বাদানুবাদ হয়েছে।

-কিছু না তুমি খাও। ঠান্ডা হয়ে গেলে মজা পাবা না।

লিখনও আর ঘাটে না। ও ভালো করেই জানে রিপার যেটা বলার সেটা সে নিজে থেকেই বলবে তাকে জিজ্ঞেস করতে হয় না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। আরও কয়েক চামচ খাওয়ার পর রিপা জিজ্ঞেস করে,

-কাল থেকে তো তোমার আইএলটিএস এর ক্লাস শুরু, তাই না?

-হু।

-কোনটা ছাড়বা কিছু ভাবছো?

এই বিষয়ে প্রশ্ন করতেই চামচটা নামিয়ে রাখে লিখন। রিপা জবাবের আশায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভ্রু নাচিয়ে তাগাদা দেয় জবাব দিতে। শীতল কন্ঠে লিখন বলে,

-ভাবছি।

-ভাবছি মানে কি? কাল থেকে তোমার ক্লাস শুরু আর তুমি এখনো ভাবছো? ফোনে না বললা দুই ভাইবোনকে যে পড়াও কি যেন নাম মেয়েটার! ওহ বৃষ্টি হ্যাঁ ওদের বাদ দিয়ে দিবা বললা না।

-ভাবছিলাম তো আন্টিকে বলবো ওদের আর পড়াতে পারব না। কিন্তু…

-আবার কিন্তু কি? টিউশনি একটা তোমাকে বাদ দিতেই হবে লিখন। নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে হবে।

-সেটা তো বুঝতেছি কিন্তু ওদের কীভাবে বাদ দেই বলো। আন্টি অনেক স্নেহ করে আমাকে। তাছাড়া বৃষ্টির সামনে পরীক্ষা।

-সিলেবাস নাকি শেষ করে ফেলছো। তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা না।

-পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত সমস্যার শেষ নাই রিপা। পড়ালেখা কি আর এতই সহজ জিনিস। পড়লাম আর হয়ে গেল? পড়তে পড়তে জান জীবন বের হয়ে যায় তাও কতমানুষ কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট করতে পারে না। সেজন্য প্রস্তুতি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিতে হয়।

সঙ্গে সঙ্গে জবাব না দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রিপা বলে,

-এক কাজ করো।

-কি কাজ?

-তোমার সার্কেলের কাউকে দিয়ে দাও পড়াক। পরে পরীক্ষার সময় লাগলে তুমিও দেখায় দিও। এমনিও মেয়েটার বোর্ড পরীক্ষা হয়ে গেলে তখন তো তুমি আর পড়াবা না। ভর্তি কোচিংয়েই যাবে। তুমি নাহয় কয়মাস আগে থেকেই বাদ দিলা। আপাতত পরিচিত ভালো কাউকে দিয়ে দাও পড়াক তোমার জায়গায়।

-এভাবে হয় না রিপা।

-কেন হয় না?

-তুমি বলতেছো তাই তোমার কাছে পানির মতো সহজ লাগতেছে। বিষয়টা এতখানিও সহজ না। ওর বাবা মা আমাকে ভরসা, বিশ্বাস করে। অনেক বছর ধরে পড়াই বলে নিজের ছেলের মতো আদর-স্নেহ করে আমাকে। একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। এমন হুট করে ছেড়ে দিলে উনারা মনে কষ্ট পাবে। বৃষ্টিও কষ্ট পাইতে পারে। সামনে ওর পরীক্ষা এখন মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমাকে ওর প্রয়োজন এই মুহূর্তে।

-লিখন! তুমি এমন ভাবে বলতেছো যেন মেয়েটা তোমার…

-রিপা প্লিজ এমন কিছু বইলো না যেটা অশোভন শুনায়। বৃষ্টি আমার ছাত্রী। দুই চারদিন ধরে ওকে আমি পড়াই না। অনেক বছরের সম্পর্ক আমাদের। খুব ভালো, সুন্দর ও অনেস্ট একটা সম্পর্ক। কোনো আজাইরা খাতির না।

রিপা ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর বলে,

-তাহলে অন্য দুইটার একটা ছাড়ো।

-ওগুলা ছাড়া যাবে না। দুইটারই এসএসসি পরীক্ষা।

-তাহলে অপশন এই একটাই। আর তুমি এটাই ছাড়তেছো ফাইনাল। কীভাবে কি করবা আমি এত কিছু জানি না। আজকেই না করে দিবা। বলবা তুমি কাল থেকে আর পড়াতে পারবা না। নিজের সমস্যার কথা ভেঙে বলবা। যেহেতু তোমাকে অনেক স্নেহ করেন, অনেকদিনের সম্পর্ক নিশ্চয়ই উনারা বুঝবেন তোমার বিষয়টা।

মুখটা কালো হয়ে যায় লিখনের। রিপা তাগাদা দিয়ে বলে,

-বলবা তো?

-আর তো অপশন নাই, বলতেই হবে।

-গুড, আজকেই বাদ দিয়ে আমাকে জানাবা। আমি কিন্তু আর কোনো বাহানা শুনবো না বলে রাখছি।

এবারে আর মুখে কিছু না বলে কেবল মাথা ঝাকায় লিখন। মনে মনে সে অনেক দ্বিধাগ্রস্ত। বৃষ্টির মাকে কীভাবে বলবে ছেড়ে দেয়ার কথা সেটাই মাথায় আসে না ওর। কিন্তু একটা না একটা উপায় তো করতেই হবে কিছু করার নেই। এখন সময় হয়েছে লিখনের সব কিছু ছাপিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবার, নিজের জন্য কিছু করার। কিন্তু তবুও মন সায় দেয় না বৃষ্টিকে ছেড়ে দিতে। মেয়েটা হয়ত দিশেহারা হয়ে যাবে এমন কথা শুনলে। বৃষ্টির কথা ভেবেই বেশি মন কেমন করছে লিখনের। মন বলছে সে পারবে না ছাড়তে। তার দ্বারা হবে না।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-১৮+১৯+২০

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সাবা নিজের ঘরে বসে আরাম করে কাজের মেয়েকে দিয়ে হাতে পায়ে নেইলপালিশ লাগাচ্ছে। আজ সন্ধ্যার পর রওনকদের বাসায় যাবে সে। উদ্দেশ্য রওনকের সাথে দেখা করা। বন্ধের দিন রওনক যে বাসায় আছে তা ভালো করেই জানে সাবা। তাই যাওয়ার আগের প্রস্তুতি চলছে। রুমের দরজা খোলা থাকায় আর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করে না সাবার ছোট বোন রিপা। এগিয়ে এসে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রিপা জিজ্ঞেস করে,

-শুনলাম তোমার নাকি বিয়ে ঠিক হচ্ছে?

সাবা মাথা তুলে তাকায় না। তার মনোযোগ নিজের পায়ের দিকে। যদি সে মুখ তুলে তাকালে নেইলপেইন্ট নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তো তাকে দেখতে সুন্দর লাগবে না। তাই বোনের দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে মনোযোগ ধরে রেখেই সাবা জবাব দেয়। বলে,

-ঠিক হচ্ছে না বল ঠিক হয়ে গেছে।

এবারে বিছানায় বসে পড়ে রিপা জিজ্ঞেস করে,

-তা পাত্র কে রওনক জামান?

ছোট বোনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সাবা বলে,

-আস্তে বোস রিপা, এক্ষুনি তো আমার নেইলপেইন্টটা নষ্ট হয়ে যেতো।

বড় বোনের এসব হেঁয়ালিপনায় পাত্তা না দিয়ে রিপা আবার জিজ্ঞেস করে,

-বললে না পাত্র কে? রওনক ভাই?

-আর কে হবে? রওনক ছাড়া কার এত যোগ্যতা আছে আমায় বিয়ে করবে?

-কেন? তোমাকে বিয়ে করতে যোগ্য লাগবে নাকি?

-অবশ্যই লাগবে। আমি তো যাকে নয় তাকে বিয়ে করব না। আমি সাবা, সাবা আহমেদ। দি আশরাফ আহমেদের মেয়ে।

-বাবার পরিচয় ছাড়া আহামরি বিশেষ কোনো তোপ তো তুমি নও আপু।

এবারে মুখ তুলে কেমন কেমন করে তাকায় সাবা। তার এই মুহূর্তে একদম মন চাইছে না ছোট বোনের সঙ্গে অযাচিত তর্ক করতে। কিন্তু জবাব না দিয়ে ছেড়ে দেয়ার পাত্রী সাবা নয়। হোক কথার তর্ক বা কোনো কম্পিটিশান তাকে জিততেই হবে। হারতে সাবা শিখেনি। তাই চোখ-মুখ শক্ত করে জবাব দেয়,

-আলাদা করে আর কোনো পরিচয়ের তো প্রয়োজন নেই। আমার বাবার পরিচয়ই যথেষ্ট। আর তুই এমন আমাকে জেরা করছিস কেন?

-করছি কারণ আমি যতটুকু বুঝি রওনক ভাই তোমাকে পছন্দ করে না। যা করে সেটা সমিহ তাও বাবার জন্য। তুমি বাবার মেয়ে না হলে তোমাকে সে মুখও লাগাতো না। তাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখা তো দূরের কথা।

-শুন রিপা আমি সাবা দিনে জেগে স্বপ্ন দেখি না। আমি যেটা বলি সেটাই হয়। রওনককে আমি বিয়ে করে ছাড়বোই বাই হুক ওর বাই কুক। হি উইল বি ওনলি মাইন।

-জোর করে সম্পর্ক হয় না আপু। সম্পর্কে একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা থাকাটা জরুরী। ভালোবাসা না থাকলে সংসারে সুখ আসবে কীভাবে?

-তোকে আমাদের বিষয়ে না ভাবলেও চলবে। আমার মতো সুন্দরী বউ যার চোখের সামনে দিনরাত ঘুরঘুর করবে সে এমনি খুশিতে টগবগ করবে। বরং আমায় বিয়ে না করলেই রওনক আফসোস করবে। বিউটি হাত ফসকে বেরিয়ে গেলো। এটা ওর ভাগ্য বিবাহিত হয়েও আমার মতো অবিবাহিত সুন্দরী বউ পাচ্ছে।

-এমন ভাগ্য যা হয়ত সে চায়ই না।

-রওনক আমায় চায় কি চায় না সেটা আমি বুঝে নিবো। তুই আপাতত এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বেরিয়ে যা। আমার মুডটা যথেষ্ট ভালো আছে। তোর সঙ্গে কথা বলে আমি আমার মুড নষ্ট করতে চাই না।

রিপা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আরও বলে,

-তাড়াহুড়ো করো না আপু। জীবনটা কোনো ছেলে খেলা নয় যে নামযশ, ব্যাংক ব্যালেন্সের কাছে নিজের সব বাজি লাগিয়ে দিবে। যাই করো একটু ভেবে চিন্তে তারপর করো। যাতে করে একটা সময় পরে তোমাকে না আফসোস করতে হয়। পুরুষমানুষের কি আছে? এক বউ গেলে আরও ১০০টা বিয়ে করতে পারবে। বয়স হলেও পুরুষের যৌবন যায় না। কিন্তু মেয়েদের নামের পাশে একবার ডিভোর্সের তকমা লেগে গেলেই জীবন শেষ। তাছাড়া মেয়ে মানেই কুড়িতে বুড়ি। তুমি তো বহু আগেই কুড়ি পেরিয়েছো।

রিপার এমন কথায় অনেকটা ক্ষেপে যায় সাবা। চেঁচিয়ে বলে,

-এই তুই আজকাল কাদের সাথে চলা ফেরা করছিস বলতো। তোর কথা এমন বস্তিদের মতো কেন হয়ে গেছে? বড় বোনের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় সেই আদবও ভুলে গেছিস নাকি?

-আমি আমার আদব ঠিকই জানি আপু। তুমি হাইপার হয়ে যাচ্ছো। ঠান্ডা মাথায় ভাবো তাহলে দেখবে আমি একটা কথাও ভুল বলিনি। তোমার ভালো চাই বলেই বলছি। তুমি তো আমার সৎ বোন নও, আপন বোন, একই মায়ের পেটে আমাদের জন্ম। আমি কি কখনো তোমার মন্দ চাইতে পারি? পারি না বলেই তোমার চিন্তায় এতকিছু বললাম। বাকিটা তুমি ভেবে দেখো।

বেরিয়ে যাওয়ার আগে রিপা আরও বলে,

-আমার কথাগুলো অবশ্যই ভেবে দেখো কিন্তু।

রিপার কথায় ইতোমধ্যে সাবার মস্তিষ্কের ভেতর আ গু ন ধরে গেছেৃ রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে ওর। গলা ফা টি য়ে চিৎকার করতে পারলে হয়ত হালকা লাগতো। কিন্তু আপাতত সে এই কাজ করবে না। একটু পরেই সে রওনকের সঙ্গে দেখা করতে যাবে তাই এই মুহূর্তে চিৎকার চেঁচামেচি করে সময় নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সাবা আবার পায়ের দিকে তাকায় কাজের মেয়েটা নেইলপেইন্ট ঠিকঠাক লাগাচ্ছে কিনা দেখতে। কিন্তু পায়ের দিকে তাকিয়েই সাবার মস্তিষ্কে নিভে যাওয়া আ গু ন টা আবার জ্ব লে ওঠে। পায়ের এক আঙ্গুলের নেইলপেইন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। এটা হয়েছেও ওর নিজের দোষেই। রিপার সঙ্গে বাকবিতন্ডা করতে গিয়েই নড়েছিল সে। কিন্তু এদিক সেদিক না তাকিয়েই ঠাস করে মেয়েটার গালে একটা থা প্প র বসিয়ে দেয় সাবা। চেঁচিয়ে বলে,

-একটা কাজও ঠিকঠাক করতে পারিস না ছোটলোকের জাত। সারাদিন শুধু গান্ডেপিন্ডে গিলা চাই এদের। মুছ, মুছে আবার ঠিক করে লাগা।

কাজের মেয়েটার চোখে পানি টলমল করছে। যা সাবা দেখেও দেখে না। এসব দেখার মানসিকতা ওর নেই। ছোট বোন কিছু কঠিন বাস্তব কথা শুনিয়ে গেছে তাকে যা সহ্য করতে না পারায় সেই তেজটাই অসহায় মেয়েটার উপর ঝেড়ে দিলো।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনকের মুখোমুখি বসে আছে লাবিব। তাদের দু’জনের সামনেই কফি রাখা তারা দু’জনেই বসে আছে একটা কফি শপে। রওনক এখনো নিজের কফির কাপে চুমুক বসায়নি। তবে লাবিব অর্ধেকটা শেষ করে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। ওর বাবা হাসপাতালে থাকায় ওখানে দৌড়াদৌড়ি করে বেচারা বড্ড ক্লান্ত। ক্লান্তি তার চোখ মুখেও প্রকাশ পাচ্ছে খানিকটা৷ রওনককে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে এবারে লাবিব নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করে,

-এনিথিং রঙ বস?

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রওনক বলে,

-তুমি কি কাউকে পছন্দ করো? তোমার জীবনে কেউ আছে?

আচমকা রওনকের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে খানিকটা ভরকে যায় লাবিব। একটুর জন্য গরম কফি তার হাত ছলকে পড়ে যায়নি, সে সামলে নিয়েছে। কাপটা হাত থাকে নামিয়ে রেখে বলে,

-হঠাৎ এমন প্রশ্ন?

-তুমি বলতে না চাইলে ইটস ওকে।

-আসলে না বলতে চাওয়ার মতো কিছু নয়। আপনি তো কখনো পার্সোনাল লাইফ নিয়ে আগ্রহ দেখাননি। আজ আচমকা জিজ্ঞেস করায় সামান্য অবাক হয়েছি।

সামান্য থেমে লাবিব আরও বলে,

-আছে একজন যাকে খুব পছন্দ করি। পার্মানেন্ট করে জীবনে আনতে চাই। যদিও এখনো তাকে কিছু বলা হয়নি।

-বলোনি কেনো?

-সাহস করতে পারিনি। যদি ফিরিয়ে দেয় সেই ভয়ে। তবে খুব বেশিদিন আর অপেক্ষা করব না।

-কি করবে?

-সে হ্যাঁ বলুক বা না আমি তাকে নিজের পছন্দের কথা জানিয়ে দিবো।

রওনক মনে মনে ভাবে, ❝ফিরিয়ে দিবে না। জামাই আদর করার জন্য এমনিই বসে আছে। বলেই দেখো ঝাঁপিয়ে পরবে।❞ মুখে আর কিছু বলে না রওনক। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-তা বললেন না হঠাৎ আজ কি হলো যে আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ইন্টারেস্ট জাগলো।

-কিছু না এমনি।

রওনক নিজেকে সামলে নিয়েছে। এমনিও খুব সহজে বিচলিত হওয়াটা তার স্বভাবে নেই। কিন্তু লাবিবের মনপুত হয় না রওনকের জবাব। তাই সে বলে,

-কিছু একটা তো হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়া জিজ্ঞেস করার লোক আপনি নন। বলা যায় কি হয়েছে?

রওনক আবারও ফস করে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বাড়িতে যে তার আবার বিয়ের পরওয়ানা জারি হয়েছে সেই ঘটনার সবটা বিস্তারিত ভেঙে বলে। সব শুনে বিজ্ঞের মতো কিছুক্ষণ রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে লাবিব। সে বুঝতে পারে না এখানে আপত্তির কি আছে। সবকিছু শুনার পর বলে,

-আপনার আপত্তি টা ঠিক কোন জায়গায় বলুন তো। আবার বিয়েতে তো আমি দোষের কিছু দেখছি না। তাছাড়া এটাও তো ঠিক অতীতে হওয়া একটা এক্সেডিন্টের জন্য আপনি নিজের জীবন থামিয়ে রাখতে পারেন না।

-ডন্ট টক লাইক দেম লাবিব। দ্যাট ওয়াজ নট এনি স্টুপিট এক্সিডেন্ট ফর মি। আই ওয়াজ ম্যারেইড উইথ হার। সি ওয়াজ মাই ওয়াইফ। এই সহজ বিষয়টা তোমরা বুঝো না কেন? আমি মরে গিয়েছি না ও মরে গিয়েছে যে সবাই মিলে আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়কে, মানুষকে এক্সিডেন্ট বানিয়ে দিচ্ছো?

লাবিব বুঝতে পারে রওনকের কথাটা পছন্দ হয়নি। এমনিতেই বেচারা বিরক্ত এখন সেও যদি অন্যদের মতো করেই কথা বলে তাহলে তো হচ্ছে না। তাই নিজেকে কারেকশন করে নিয়ে বলে,

-লেট মি কারেক্ট মাই সেলফ। মানলাম ওটা এক্সিডেন্ট ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের অতীত ফেলে এগিয়ে যেতে হয় ভবিষ্যতের দিকে। আর সেজন্য কখনো কখনো অতীতকে এক্সিডেন্ট নামক তকমা লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হয়, জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। এতে মন্দ কিছু নেই। এসব আপাতত বাদ দেই। আগে বলুন তো বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?

-আই ডোন্ট নো।

-সমস্যা বিয়েতে নাকি যে পাত্রী দেখা হচ্ছে তাতে? আপনার নিজের কোনো পছন্দ আছে?

রওনক এবারে সরাসরি তাকায় লাবিবের চোখের দিকে। ওর করা প্রশ্নের উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করে ওরই প্রশ্নের ভেতর। কিন্তু উত্তর মেলা ভার।

সাবা বাসায় এসে সরাসরি দিলারা জামানের ঘরেই এসেছে। সাবাকে দেখে আহ্লাদে গদগদ হোন তিনি। বুকে জড়িয়ে নেন তৎক্ষনাৎই। ব্যস্ত কন্ঠে সাবা জিজ্ঞেস করে,

-আপনাকে এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেনো আন্টি? আপনার কি শরীর খারাপ করেছে?

-না তো শরীর খারাপ করেনি।

-তাহলে কি আমি আসায় আপনি খুশি হোননি? আপনার মুখে হাসি নেই কেনো?

-ওমা খুশি হবো না কেনো? অবশ্যই খুশি হয়েছি। তুমি আসবে আর আমি খুশি হবো না তা কি হয়?

আরেকদফা আহ্লাদে গদগদ হোন দিলারা জামান। এদের দু’জনের আহ্লাদিপনার মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করে জাহানারা। তার হাতে এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস। সাবা এই বাসায় এলেই আগে তাকে এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস দিতে হয়। ওর ভাষ্যমতে বাইরে অনেক গরম যদিও সে এসি গাড়ি করেই আসে। তাও গরম তাকে কাবু করে ফেলে। তাই বাইরে থেকে এলে আগে তার এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস খাওয়া চাই। এই কথা জানার পর দিলারা জামান জাহানারাকে বলে দিয়েছেন সাবা এই বাসায় এলে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেন তাকে অরেঞ্জ জুস দেয়া হয়। তবে সেটা কেবল অরেঞ্জ জুস নয়, অর্গানিক অরেঞ্জ জুস ছাড়া সাবা খায় না। সেই অর্গানিক অরেঞ্জ জুস নিয়েই হাজির হয়েছে জাহানারা। হাত থেকে জুসের ট্রেটা নামিয়ে রেখে নাস্তার ব্যবস্থা দেখার জন্য ফিরে আসতে নিলে তাকে ডাক দিয়ে দাঁড় করান দিলারা জামান। বলেন,

-রওনককে বলো আমার ঘরে আসতে।

-রওনক তো বাসায় নেই আপা।

-বাসা নেই মানে? কোথায় গেছে?

-সেটা তো বলে যায়নি।

-কখন গেলো?

-এই আধাঘন্টা হবে বেরিয়েছে।

-আমি তো ওকে বললাম সাবা আসবে, বিকালে যেন কোথাও না যায়। আজ দুপুরেও বাসায় ছিল না। ছেলেটা আজকাল করছে কি?

-সেই খবর তো আমি দিতে পারছি না।

-আচ্ছা তুমি যাও, সাবার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করো। আমি দেখছি রওনক কোথায় গেলো।

জাহানারা বেরিয়ে যেতেই দিলারা জামান তার বেড সাইড টেবিলে থাকা মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ছেলের নম্বর ডায়েল করেন। রিং হয়ে হয়ে কল কেটে যায়। কিন্তু রওনকের সাইডে কলটা রিসিভ হয় না। প্রথমবার কেটে যাওয়ায় আরও একবার কল মিলায় দিলারা জামান। কিন্তু পরপর কয়েকবার কল দিয়েও লাভের লাভ কিছু হয় না। রওনক কল রিসিভ করে না। এই ছেলেটাকে নিয়ে উনার হয়েছে জ্বালা। কোনোভাবেই কথা শুনাতে পারছেন না। খুব বেশি কিছু তো উনি চাইছেন না। যা চাইছেন তাও ছেলের ভালোর জন্যই। এদিকে সাবার হাস্যোজ্বল মুখে আমাবস্যা নেমে এসেছে। তা দেখে ফোনটা নামিয়ে রেখে দিলারা জামান সাবার চিবুক স্পর্শ করে হাতে চুমু খেয়ে বলেন,

-তুমি একদম মন খারাপ করো না। ওর হয়ত জরুরী কোনো কাজ পরেছে তাই বেরিয়ে গেছে। দেখছো না জানিয়ে যাওয়ার সময়টাও পায়নি। কাজ না থাকলে নিশ্চয়ই যেতো না। ও জানে তো তুমি আসছো। তোমার সাথে দেখা করার চাইতে জরুরী কিছু আছে নাকি? কিন্তু কি বলো তো এত বড় ব্যবসাটা তো ওকে একাই দেখতে হচ্ছে তাই জরুরী কাজ পরে গেলে ইগনোর করতে পারে না। কাজ না পরলে নিশ্চয়ই ও বাসায় থাকতো তোমার জন্য।

দিলারা জামানের কথা শুনে সাবার অমাবস্যা নামা মুখ আবার খিলখিলিয়ে ওঠে। উনি আরও বলেন,

-তুমি একদম মন খারাপ করো না। ও ফোন রিসিভ না করা পর্যন্ত আমি ওকে কল করবো।

এবারে খানিকটা আহ্লাদ দেখিয়ে সাবা বলে,

-ইটস ওকে আন্টি। আপনি আর ওকে ডিস্টার্ব করবেন না আমার জন্য। তাছাড়া আমি তো আপনাকে দেখতে এসেছি। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

আরও একবার সাবার চিবুক স্পর্শ করে হাতে চুমু খেয়ে দিলারা জামান বলেন,

-সোনা মেয়ে আমার। আমি মনে হয় জানি কোথায় ফোন করলে রওনককে পাওয়া যাবে। আরেকটা কল দেই একটু ওয়েট করো।

এবারে দিলারা জামান লাবিবকে কল মিলায়। টেবিলের উপর থাকা লাবিবের ফোনটা বেজে উঠতেই স্ক্রিনে মিসেস এস ডট জামান নামটা ভেসে ওঠে। লাবিব কিছু বলার আগেই রওনক জিজ্ঞেস করে,

-মা নিশ্চয়ই?

মাথা ঝাকায় লাবিব। সে বুঝতে পারে না কি করবে। কল রিসিভ করার জন্য ফোনটা তুলতে নিলেই রওনক বলে,

-আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি কোথায় আছি তা তুমি কিছু জানো না।

-মিথ্যা বলবো?

-বলতে না চাইলে কল রিসিভ করার প্রয়োজন নেই।

বেচারা লাবিব পড়ে যায় ঝামেলায়। কল রিসিভ করলে মিথ্যা বলা লাগবে তাই কল রিসিভ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। রিং হয়ে কলটা কেটে যায়।

দিলারা জামান আবারও কল দিতে নিলে সাবা তার হাত টেনে ধরে বলে,

-ইটস ওকে আন্টি। আমি সত্যি সত্যি আপনার জন্যই এসেছি। রওনকের সঙ্গে নাহয় পরে কোনো সময় দেখা করে নিবো।

দিলারা জামান ফোনটা নামিয়ে রাখেন। মুখে এই কথা বললেও মনে মনে যথেষ্ট বিরক্ত হয় সাবা। সে এত সুন্দর করে সেজে, তৈরি হয়ে এলো অথচ যার জন্য এত আয়োজন তারই দেখা নেই। এখন নাকি ওকে এই বয়স্ক মহিলাটার সঙ্গে বসে গল্প করতে হবে। আড় চোখে একবার দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায় সে। কখন আসবে রওনক!

রওনককে আবারও চুপ করে বসে থাকতে দেখে লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-এভাবে এভয়েড করলে কি প্রবলেম সল্ভ হবে?

-এভয়েড করছি না। এভয়েড যেন না করা লাগে সেই সলিউশান খুঁজছি।

-খুঁজে পেলেন কিছু?

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রওনক। দাঁড়িয়ে বলে,

-এখনো খুঁজছি। খুঁজে পেলে অবশ্যই তোমাকে জানাবো। আজ উঠছি। তোমার ব্যস্ত সময়ের মধ্যে আমাকে সময় দেয়ার জন্য থ্যাঙ্কিউ লাবিব।

-ইটস অলরাইট। ইনফ্যাক্ট আপনি আমায় স্মরণ করেছেন আমি এতেই কৃতজ্ঞ।

রওনক আর অপেক্ষা করে না। লাবিবকে রেখেই বেরিয়ে যায়। লাবিব পেছনে বসে থাকে একা। রওনকের অতীত সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে সে। সম্পূর্ণ না হলেও কিছু আন্দাজ করতে পারছে কেন রওনক এখন পর্যন্ত মানসিকভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারছে না। রওনককে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আচমকাই চিত্রলেখার কথা মনে পড়ে যায় লাবিবের। এখন কেমন আছে কে জানে। বাবাকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে খোঁজ নেয়ার সময় পায়নি। হাত ঘড়ি দেখে সে। এখনো কিছুটা সময় আছে তার হাতে। চট করে একবার চিত্রলেখাকে দেখে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই উদ্দেশ্যেই চিত্রলেখার নম্বর ডায়েল করতে করতে বেরিয়ে পড়ে।

রওনক যখন বাসায় ফিরে তখন রাত সাড়ে নয়টা বাজে। বন্ধের দিনে জরুরী কোনো কাজ না থাকলে বাসার বাইরে তেমন একটা থাকে না সে। কিন্তু আজ ইচ্ছা করেই দেরি করে ফিরেছে। নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই রওনক দেখে তার বেডের উপর আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আছে সাবা। তাকে দেখতে পেয়েই কোমড় দুলিয়ে এগিয়ে আসে। এগিয়ে এসে ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। রওনক জিজ্ঞেস করে,

-তুমি এখানে কেনো?

-তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

-আমাদের কি এপয়েন্টমেন্ট ছিল কোনো?

-দু’দিন পর যার সাথে আমার বিয়ে হবে তার সঙ্গে দেখা করতে বুঝি এপয়েন্টমেন্ট লাগবে?

-লিসেন সাবা, আই থিং আমি আমার পয়েন্টটা অলরেডি বলে দিয়েছি।

এবারে সাবা বেহায়াপনার সীমা অতিক্রম করে আরও দু’কদম এগিয়ে এসেছে রওনকের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

-তুমি যাই বলো না কেনো আমি পিছনে সরছি না। বিয়ে তো আমাদের হবেই।

চট করে মাথাটা বিগড়ে যায় রওনকের। তবুও সে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে তার গলায় জড়িয়ে থাকা সাবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

-পেছনে দরজা আছে, নাও প্লিজ এক্সকিউজ মি। আই এম টায়ার্ড, আই নিড টু রেস্ট৷

সাবা হাত বাড়িয়ে রওনকের গাল স্পর্শ করে বলে,

-ওকে, ইউ টেক রেস্ট। আজ আর তোমায় বিরক্ত করছি না। দেখা হয়েছে আপাতত এতটুকুই ইনাফ। কথার কি আছে! কথা তো সারাজীবনই বলতে পারবো।

সাবা বেরিয়ে গেলে রওনক নবের লকটা লাগিয়ে দেয়। মূলত এই ইরিটেটিং মেয়েটাকে এভয়েড করতেই এত দেরি করে বাসায় ফিরেছে সে। কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা হয় আর কি। আজ হয়ত রওনকের কপাল মন্দ তাই চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। ফস করে একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াশরুম চলে যায় সে। একটা কোল্ড শাওয়ার না নিলে মাথা ঠান্ডা হবে না তার।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আট তলার উপরে সম্পূর্ণটা নিয়ে ডুপেক্স সিস্টেমে বানানো হয়েছে। রওনকের বাবা অনেক বছর আগে এদেশের নামকরা এন্টিরিয়র ডিজাইনার দিয়ে সম্পূর্ণ বাসা ডিজাইন করিয়েছেন, সাজিয়েছেন। রওনকের বারান্দা থেকে ভিউটা চমৎকার সুন্দর দেখায়। দক্ষিণ মুখী হওয়ায় বাতাসের অভাব হয় না। শান্ত চিত্তে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকতে ব্যস্ত রওনক। সম্ভবত তার মস্তিষ্কের ভেতর কিছু চলছে। গভীর কোনো ভাবনায় আচ্ছন্ন সে। তাই তো তানিয়ার প্রবেশ টের পায়নি। পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ঝেড়ে কাশে তানিয়া। কাশির শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় রওনক। তানিয়াকে দেখে উদ্বিগ্ন না হয়ে শান্ত ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করে,

-কখন এলে তুমি?

-এই তো যখন তুমি কারো ভাবনায় গভীর পর্যন্ত ডুবে ছিলে।

নিজের কথার সঙ্গে আরও যোগ করে তানিয়া। বলে,

-তোমার রুমের দরজা আনলক ছিল, তুমি রুমে ছিলে না তাই অনুমতি ছাড়াই চলে এলাম। রাগ করোনি নিশ্চয়ই?

সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে সামনের দিকে তাকায় রওনক। অস্বীকার করে না তাই তানিয়া ধরেই নেয় রওনক সত্যি সত্যি কাউকে নিয়ে ভাবছিল। বিকালে মায়ের ঘর থেকে বের হবার সময় যখন চায়ের বিষয়টা বলে তখনই বুঝতে পেরেছিল দেয়ার ইজ সামথিং রঙ্গ। রওনকের জীবনে হয়ত কারো আগমন ঘটেছে। নয়ত এমনি এমনি কারো প্রসংশা করার মানুষ সে নয়। ও মুখ সহজে কারো নাম যপে না, প্রসংশা করে না, খুব সহজে কাউতে মুগ্ধ হয় না। সেই মানুষটাই যেহেতু কারো প্রসংশা করেছে আগবাড়িয়ে তার মানে নিশ্চয়ই মনের ঘরে কারো আগমনের আয়োজন চলছে। কোনো ভনিতা না করে তানিয়া সরাসরি প্রশ্ন করে,

-তোমার জীবনে আজকাল ঠিক কি চলছে বলো তো রওনক।

তামিয়ার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বরং পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় রওনক। জিজ্ঞেস করে,

-এই অসময়ে ভাইয়াকে রেখে তুমি আমার ঘরে কেন ভাবি?

-প্রসঙ্গ পাল্টাতে আমার প্রশ্নের জবাবে আমাকেই প্রশ্ন করা হচ্ছে?

-যে বিষয়টা আমি নিজেই জানি না সেটা তোমায় কি করে বলি বলো তো?

-আচ্ছা বুঝলাম।

তানিয়া জোর করে না। সে ভালো করেই জানে জোর করলেই রওনক কিছু বলে দিবে না। তার যেটা বলার সেটা তাকে জিজ্ঞেস না করলেও বলবো। আর যা সে বলতে চায় না সেটা হাজারবার জিজ্ঞেস করলেও মুখ খুলবে না। তাছাড়া রওনক তার জীবনের পার্সোনাল স্পেসে কারো হস্তক্ষেপ করাটা একদম পছন্দ করে না। সিগারেটে পরপর ফুক দিয়ে তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রওনক আবার জিজ্ঞেস করে,

-বললে না ভাইয়াকে রেখে তুমি এখানে কেনো?

-তাকে রেখে নয় বরং বলো আমাকেই দেয়ার মতো সময় আজকাল তার নেই।

-কেনো?

-ভুলে গেলে আমি তার জীবনে পেইন্টিং এর পরে আসি।

-নতুন কিছু আঁকছে নাকি?

-হ্যাঁ, তোমার ভাইয়ার ভাবে মনে হচ্ছে জলদিই সে নিরুদ্দেশ হবে।

-তাই নাকি?

-হু, গতকালই বলছিল চার দেয়ালের ভেতর নাকি তার চিত্রের রঙ ফুটে উঠছে না। মনোনিবেশ করতে পারছে না ঠিকঠাক।

-এক কাজ করলে কেমন হয় বলো তো ভাবী।

-কি কাজ?

-ভাইয়াকে ২৪ ঘন্টা ফলো করার জন্য একজন লোক হায়ার করলে কেমন হয়? তার কাজই হবে ভাইয়া কোথায় যাচ্ছে কি করছে সেই খবর রাখা। আমাদের আপডেট করা।

-এর কি কোনো প্রয়োজন আছে?

-প্রয়োজন নেই বলছো?

-কি প্রয়োজন?

-প্রয়োজন না থাকলে তুমি কেনো ডিটেকটিভ হায়ার করেছো?

রওনকের কথায় বিন্দুমাত্রও বিচলিত হয় না তানিয়া। দু’বছর ধরেই তানিয়া একজন ডিটেকটিভ হায়ার করে রেখেছে। যার কাজ কেবল রাদিন কখন কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে দেখা করছে সেই খবরটা তানিয়া অব্দি পৌঁছে দেয়া। তবে এই বিষয়টা সে রওনককে জানায়নি তবুও সে জানে শুনে একটু ঘাবড়ায় না তানিয়া। রওনক যে কোনো ভাবে বিষয়টা জানতে পারবে এই বিষয়ে ধারনা ছিল তানিয়ার। তার মতো বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিক যে। যার চারিদিকে এত জানাশুনা। তার কাছ থেকে কিছু গোপন রাখাটা সহজ নয়। যদিও গোপন করাটা শুরু থেকেই তানিয়ার ইনটেনশনে ছিল না। প্রয়োজন হয়নি বলেই বলা হয়নি।

রওনক আরও জিজ্ঞেস করে,

-তুমি কি ভাইয়াকে সন্দেহ করো ভাবী?

-তোমার ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ের আগে তার নিজের ক্লাসমেটের সাথে প্রেম ছিল সেই খবর তো তুমিও জানো রওনক।

মাথা ঝাকায় রওনক। তানিয়া আরও বলে,

-দু’বছর আগে খবর পেয়েছি তোমার ভাইয়ের প্রাক্তন প্রেমিকার তার হাসবেন্ডের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে।

-এই খবর ভাইয়া জানে?

-জানে।

-ভাইয়া কি…

রওনককে কথা শেষ করতে না দিয়ে তানিয়া নিজেই বলে,

-যে সন্দেহ থেকে আমি ডিটেকটিভ হারায় করেছি আলহামদুলিল্লাহ আজ পর্যন্ত আমার সন্দেহ সত্যি প্রমানিত হয়নি। তবে যতবার তোমার ভাইয়া পেইন্টিং এর বাহানা দিয়ে বাসার বাইরে থেকেছে ঐ ডিউরেশনে সে তার প্রাক্তনের সঙ্গে একবার হলেও দেখা করছে। এই পর্যন্ত তোমার ভাইয়া বেশ বড় এমাউন্ট তাকে দিয়েছে। ফিনানশিয়ালি সাপোর্ট করতে।

-হু, তুমি অবাক হও নি বিষয়টা আমি জানি শুনে?

-না।

-কেনো?

-আমি আগে থেকেই জানতাম কোনো না কোনো ভাবে তুমি বিষয়টা জানতে পারবে।

-কি করবো বলো শুধু ব্যবসার নয় তোমাদের সবার দায়িত্ব আমার উপর। তাই কে কি করছো খোঁজ রাখতে হয়।

-তোমার জানা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই রওনক। আমিই বরং তোমায় বলতাম। যেহেতু নিজেই হ্যান্ডেল করতে পারছিলাম তাই আর বলার প্রয়োজন হয়নি।

রওনক আর কিছু বলে না। তানিয়া চুপ করে দাঁড়ায়। তানিয়া ইচ্ছা করেই রওনককে জানায়নি গতকালই সে রাদিনের ফোন চেক করে পেয়েছে তার আন্ডারে দু’টো সিঙ্গাপুরের টিকেট কাটা হয়েছে। শতভাগ সিওর না হলেও তার মন বলছে রাদিন তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়েই সিঙ্গাপুর যাচ্ছে। কেনো যাচ্ছে তা অবশ্য সে জানে না। তবে জলদিই জেনে যাবে। মেয়েদের সন্দেহ অনেকাংশেই সত্যি হয়ে যায়। তবে তানিয়া চায় না তার সন্দেহটা সত্যি হোক। রাদিনের সঙ্গে তার প্রেমের বিয়ে না হয়লেও তার জীবনে ভালোবাসার ব্যাখ্যায় কেবল রাদিনই আছে। এই জীবনে ভালোবাসার মানুষের কাছে সে প্রতারিত হতে চায় না। এখন তো নাই যখন তাদের জীবনের সঙ্গে দু’টো সন্তানের জীবনও জড়িয়ে আছে। তানিয়াকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-আর কিছু বলবে ভাবী?

-আমি এলাম তোমার খোঁজ খবর নিতে তুমি উল্টো আমার খোঁজ নিয়ে নিলে।

স্মিত হাসে রওনক। তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-কি সিদ্ধান্ত নিলে?

-আপাতত কিছুই না। তোমরা যা চাইছো এই মুহূর্তে আমার পক্ষে এমন কিছু করা সম্ভব না। সাবা হোক বা অন্যকেউ এই মুহূর্তে বিয়ে নামক চ্যাপ্টার টা রি-ওপেন করার মতো সময় হাতে নেই ভাবী। প্রচন্ড ব্যস্ত আছি। ব্যবসাটা এত ছড়িয়েছে যে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে ফোকাস করার সময় নেই আমার।

-ব্যস্ততা তো থাকবেই রওনক। তাই বলে তুমি ব্যক্তিগত জীবনকে তোয়াক্কা করবে না?

-ভেবে দেখেছি ভাবী এই মুহূর্তে কোনোভাবেই সম্ভব না।

তানিয়া আরও কিছু বলতে চেষ্টা করে কিন্তু তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে রওনক বলে,

-ভাইয়াকে বলো আমার তার সঙ্গে জরুরী কথা আছে। তার কখন সময় হবে?

-আচ্ছা বলবো।

-গুড নাইট ভাবী।

-গুড নাইট।

তানিয়া সন্তপর্ণে বেরিয়ে যায়। বুঝতে পারে রওনক আর কথা বলতে চাইছে না। তাই তাকে আর না ঘেটে বেরিয়ে যায়। তানিয়া চলে যেতেই রওনক আরেকটা সিগারেট জ্বালায়। চলে আসার সময় পেছন ফিরে চিত্রলেখার মুখটা দেখেছিল সে, সেই চেহারাই তার চোখের পাতায় ভাসছে। মেয়েটা মুখে কিচ্ছু বলে না৷ অথচ তার চোখ ভর্তি কথার ঝুলি। সে জানতে চাইলে কি চিত্রলেখা তাকে নিজের মনের কথা বলবে অকপটে?

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-১৬+১৭

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখাদের বাসায় একটা ডাইনিং টেবিল আছে তবু আজ ড্রইং রুমের ফ্লোরে চাদর বিছানো হয়েছে খাওয়া দাওয়ার জন্য। চিত্রলেখা সপ্তাহে দু’দিন বাসায় দুপুরের খাবার খায়। তাই বন্ধের দু’টো দিন সে ভাইবোন খালাকে নিয়ে এভাবেই আয়োজন করে পিকনিকের মতো খাওয়া দাওয়া করে। টুকটাক ভালোমন্দ রান্না করার চেষ্টা করে, আজও তাই করেছে। চিত্রলেখা ফ্লোরে চাদর বিছাতেই তাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে লিখন বলে,

-আজ নাহয় ডাইনিং টেবিলেই খাবার দিতা।

-কেন?

আমতা আমতা করে লিখন। রওনকের উপস্থিতিতে ইতস্তত লাগে ওর। তা বুঝতে পেরে চিত্রলেখা বলে,

-সমস্যা নেই আমরা সবাই নিচে বসে পড়বো, উনার খাবার টেবিলেই দিয়ে দিবো।

রওনক বুঝতে পেরে বলে,

-আমি আলাদা বসবো কেন? আমার তো সবার সাথে একত্রে খাওয়ার কথা তাই না? তাহলে আমি আলাদা কেনো?

লিখন বলে,

-আসলে আপা যেদিন যেদিন বাসায় থাকে ঐদিনগুলো আমরা এভাবেই মাটিতে বসে খাই।

-ভালো কথা।

বলতে বলতেই রওনক উঠে এসে মাটিতে পাতা চাদরে বসে আরও বলে,

-আমিও এখানে বসেই খাবো, তোমাদের সাথে।

রওনকের আচরণ মুগ্ধ করে চিত্রলেখাকে। অজানা, অদেখা ভালো লাগায় ভেতরটা ছেয়ে যায় ওর। চিত্রলেখা আর চারু ব্যস্ত রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে। এর মধ্যেই কলিংবেল বেজে ওঠে। এই অসময়ে কে আসতে পারে ভেবে ওরা একে-অপরের মুখ চাওয়া চাই করে। চিত্রলেখার হাতে থাকা তরকারির বাটি নামিয়ে রেখে দরজা খোলার জন্য যেতে নিলে লিখন তাকে বাঁধা দিয়ে বলে,

-আমি দেখতেছি আপা।

লিখন দরজা খুলে ফিরে আসতেই তাকে দেখে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-কে রে?

লিখন জবাব দেয়ার আগে তার পেছন থেকে এগিয়ে আসে মামুন। এমন সময়ে এই লোকটাকে মোটেও আশা করেনি চিত্রলেখা। অবাক হয়ে জানতে চায়,

-মামুন ভাই আপনি এই সময়?

চিত্রলেখার মুখে মামুন নামটা শুনেই একবার মাথা তুলে তাকায় রওনক। আগেরদিন এই লোকটাকে দেখেছে সে। তার বলা কিছু কথাও মনে পড়ে যায়। এগিয়ে এসে মামুন বলে,

-অনেকদিন তোমার হাতের রান্না খাওয়া হয় নাই তাই ভাবলাম আজ তোমাদের বাড়িতেই খাবো।

অন্য কেউ কিছু বলার আগে চারু বলে,

-ভালো করছেন মামুন ভাই। আজকে আপা গরুর গোশত রান্না করছে আলু দিয়ে, মুরগী করছে বুটের ডাল দিয়ে আপনার পছন্দের আইটেম।

-না আসলে তো বিশাল মিস হয়ে যাইতো। (মামুন বলে)

ওদের কথোপকথন শুনে মনে মনে রওনক আওড়ায়, ❝বাহ! আমাকে খাওয়ানোর জন্য আরেকজনের পছন্দের আইটেম রান্না হয়েছে। কেন? আমি কি পছন্দ করি সেটা জিজ্ঞেস করে নেয়া যেতো না? খাবো না এসব আইটেম, লবণ দিয়ে ভাত খাবো আজ আমি। লবণই আমার প্রিয় আইটেম।❞

মামুন রওনককে দেখেও কিছু বলে না। সে আজ ইচ্ছা করেই এসেছে। বড় মসজিদ থেকে লিখন ও চয়নের সাথে রওনককে বের হতে দেখেছে সে। তখনই বুদ্ধি আটে দুপুরে আজ এবাড়ি খাওয়া দাওয়া করবে সে। মূলত ভেতরে কি চলছে সেটা দেখতেই আসা তার খাওয়া দাওয়া হচ্ছে বাহানা মাত্র।

চারু চিত্রলেখার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,

-দেখছো আপা আমি তোমাকে দিয়ে পোলাও টা রান্না করায় কত ভালো কাজ করছি।

চিত্রলেখা মুখে কিছু বলে না। আপতত সে মহা চিন্তায় আছে। মামুনের কথা বার্তার লাগাম নেই। রওনকের উপস্থিতিতে কি বলতে কি বলে ফেলবে তার নেই ঠিক। সে চায় না মামুন বা চারু কেউ উল্টাপাল্টা কিছু বলুন। চিত্রলেখার দম গলার কাছটায় আটকে আছে। যতক্ষণ না রওনক বিদায় হচ্ছে ততক্ষণ তার শান্তি হবে না। চারুর কথা শুনে যেটুকু চাল ছিল তা দিয়েই পোলাও করেছে সে। তা দিয়ে দু’জন ভরপেট খেতে পারলেও তিনজনের হবে না। বাকিদের জন্য সাদা ভাত। চিত্রলেখা নিজেই সবার ভাত বেড়ে দিয়েছে এমনকি রওনক ও মামুনকেও। রওনকের প্লেটে তরকারি দিতে নিলে সে বাঁধা দিয়ে বলে,

-আমার প্লেটে পোলাও ওদের প্লেটে ভাত কেনো?

রওনকের প্রশ্নের জবাবে কি বলবে ভেবে পায় না চিত্রলেখা। বাসায় পোলাওয়ের চাল ছিল না কথাটা বলতে ভীষণ লজ্জা করছে তার। চিত্রলেখাকে বাঁচিয়ে দিয়ে লিখন বলে,

-আমরা কেউ আজ পোলাও খাবো না আপাকে আগেই বলেছি তাই শুধু আপনার জন্য পোলাও করা হয়েছে।

লিখনের কথা শুনে শুকনো কাশে পাশে বসা মামুন। নিজের উপস্থিতি জানানোর প্রচেষ্টা আর কি।

-আই সি।

বলেই রওনক নিজের প্লেটটা চারুকে দিয়ে ওর ভাতের প্লেটটা নিয়ে বলে,

-আমিও পোলাও খাবো না। রিচ ফুড একটু এভয়েড করছি।

চারু একবার বোনের দিকে তাকায় আরেকবার রওনকের দিকে। পোলাও করার বুদ্ধিটা তারই ছিল। যার জন্য করা সেই যদি না খায় তাহলে তো রান্না করে কোনো লাভ হলো না। ভাত, পোলাওয়ের বিষয়ে আর কেউ কোনো কথা বলে না। চিত্রলেখাই সবার প্লেটে খাবার তুলে দেয়। গরুর গোশতের বড় টুকরোগুলো বুঝি রওনকের প্লেটেই তুলে দিয়েছে। নিজের প্লেটে হাত দেয়ার আগে রওনক একবার সন্তপর্ণে আড় দৃষ্টিতে সবার প্লেটেই চোখ বুলায়। চিত্রলেখা সবার প্লেটে গোশত তুলে দিলেও নিজের প্লেটে নেয়নি।

এখনো চিত্রলেখা নিজের প্লেটের ভাতে হাত দেয়নি। যেই হাত বাড়ায় ওমনি আরও দু’টো হাত তার প্লেটের কাছে এসে পৌঁছায়। রওনক, মামুন দু’জনেই নিজের প্লেটের গোশতের টুকরো চিত্রলেখার প্লেটে তুলে দেয়। এমন কান্ডে উপস্থিত সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খায়। চিত্রলেখা পড়ে যায় মহামুশকিলে। জীবনে এর আগে এত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সে কখনো পড়েনি। আজকের দিনটা না এলেই বুঝি ভালো হতো। মুখ তুলে একে একে দু’জনের দিকেই তাকায় সে। মামুন তার হাতের গোশতের টুকরোটা চিত্রলেখার প্লেটে দিয়ে বলে,

-ভাগ করে খাইলে মহব্বত বাড়ে, খাও মায়া।

এতটুকু বলেই সে নিজের খাওয়ায় ব্যস্ত হয়। অন্যরা তাকিয়ে আছে রওনকের মুখের দিকে। সে কি বলে হয়ত তা শুনতে। পরিস্থিতি সামাল দিলে রওনক বলে,

-আমি মিট খাই না, এলার্জি আছে।

একথা বলে নিজের প্লেটের সবটুকু গোশতের তরকারি তুলে চিত্রলেখার প্লেটে দিয়ে দেয়। আর মনে মনে বলে, ❝বাহ! আমার সামনে বসে আরেকজনের মহব্বত বাড়ানো হচ্ছে। গা ধা কোথাকার! এই মেয়ের জীবনে এত গা ধার ছড়াছড়ি কেন? এক লাবিব তো কম ছিল না এখন আবার এই গা ধা টাও যুটেছে।❞

চিত্রলেখা রওনকের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমাকে তো সবটাই দিয়ে দিলেন। আপনি খাবেন কি দিয়ে?

-কেন? এত কিছু রান্না করেছো একটা আইটেম না খেলে কম পড়বে না আমার।

-কি দিবো আপনাকে? মুরগী দেই?

মনে মনে চিত্রলেখা নিজের উপস্থিত বুদ্ধির জন্য নিজেই নিজের প্রশংসা করে। ভাগ্যিস তখন মুরগীটা নামিয়ে রান্না করেছিল। ও তো জানেই না রওনকের এলার্জির কথা। মুরগী না করলে এখন কি শুধু ভর্তা, সবজি দিয়ে ভাত খেতো মানুষটা!

-না মুরগী না, ওটা কি?

চিত্রলেখার কাছাকাছি থাকা একটা বাটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে রওনক। জবাবে চিত্রলেখা বলে,

-এটা গুড়া কাঁচকি মাছের চচ্চড়ি।

-ওটা দাও আমায়।

-এটা আপনি খেতে পারবেন না।

-কেনো?

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-বাসি তরকার, গতকাল রান্না করেছিলাম ফ্রিজে ছিল।

-এতে কি হয়েছে? পঁচে তো যায়নি।

-তবুও, বাসি তো।

-তুমি খেতে পারছো তাহলে আমি খেলে দোষ কোথায়? এদিকে দাও দেখি।

চিত্রলেখা বাধ্য হয়েই বাটিটা এগিয়ে দেয়। সবাইকে বিশেষ করে চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে রওনক আগের দিনের রান্না করা গুড়া কাঁচকি মাছের চচ্চড়ি ও ভর্তা, সবজি দিয়েই ভাত খেয়ে ফেলল। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে যথেষ্ট তৃপ্তি করেই খেয়েছে। হয়ত বহুদিন এভাবে আরাম করে ভাত খায়নি সে। খাওয়া দাওয়া শেষে শরীর টানছে তার। একটু বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া প্রয়োজন আলসি কাটানোর জন্য।

খাওয়া দাওয়ার পর লম্বা ঢেকুর তুলে মামুন বলে,

-তোমার হাতের রান্না বরাবরই চমৎকার হয় মায়া।

চিত্রলেখা চাইছে না মামুন আর এক মুহূর্ত এখানে থাকুক। এই লোক বিদায় হলেই ও বাঁচে। তাই ওকে বিদায় করতে বলে,

-আপনি কি আরও কিছুক্ষণ বসবেন মামুন ভাই?

-তুমি বললে অবশ্যই বসবো। আমার জীবনে তো তোমার উর্ধ্বে কিচ্ছু নাই।

-আজকে তো ছুটির দিন বাসায় খালাম্মা হয়ত আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ নাহয় আপনি বাড়ি যান।

-চলে যাইতে বলতেছো? এক কাপ চা খাওয়াও তারপর নাহয় যাই।

মনে মনে ফস করে একটা শ্বাস ছেড়ে চিত্রলেখা বলে,

-বাসায় চায়ের পাতি নাই মামুন ভাই। নাহলে অবশ্যই আপনাকে চা বানায় খাওয়াতাম। আরেকদিন নাহয় খাওয়াবো।

-ওহ!

পেছন থেকে চারু এগিয়ে আসতে আসতে বলে,

-আপা চা পাতি আছে তো।

পেছন ঘুরে চারুকে চোখ গরম দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-ওগুলো চা পাতি না কালোজিরা।

চারু বেচারী চোখের ধমক খেয়েই চুপসে যায়। মামুন বলে,

-আমি নাহয় চা পাতি নিয়ে আসি?

-আজ চা বানাতে পারব না মামুন ভাই। আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, বিশ্রাম করবো।

মামুন আর গা করে না। সে নিজেও বুঝতে পারে চিত্রলেখা তাকে বিদায় করতে চাইছে। সে আচমকা চলে আসায় যে বেচারী বিব্রত হয়েছে সেটা টের পেয়েই আপাতত খ্যন্ত দেয়। বলে,

-আচ্ছা আজ তাহলে আসি। আজকের চা-টা পাওনা থাকলো। আরেকদিন দু’কাপ চা খাবো।

-আরেকদিন আপনাকে চা না খাইয়ে আমিও যেতে দিবো না মামুন ভাই।

আর কথা না বাড়িয়ে আপাতত বিদায় হয় মামুন। এতে করে হাফ ছেড়ে বাঁচে চিত্রলেখা। মামুন বেরিয়ে যেতেই রওনকও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

-আমি আজ যাই তাহলে।

অন্য কেউ কিছু বলার আগে চিত্রলেখাই বলে,

-আপনি বসুন প্লিজ, আমাদের সাথে এক কাপ চা খাবেন তারপর না হয় যাবেন।

-তোমার ক্লান্ত লাগছে।

-এতক্ষণ লাগছিল, এখন আর লাগছে না।

পাশ থেকে চয়ন বলে,

-বসুন, আপা আপনাকে চা না খেয়ে যেতে দিবে না, আমরাও দিবো না। আমরা সবাই দুপুরে খাওয়ার পর আপার হাতের এক কাপ চা খাই বন্ধের দিনে। বাকি দিন তো আপা বাসায় থাকে না।

চিত্রলেখা চা বানাতে রান্নাঘরে এলে চারুও তার পেছন পেছন আসে। এসে বলে,

-তুমি না বললা বাসায় চা পাতি নাই।

-মামুন ভাইয়ের জন্য বলছি।

-এটা কি ঠিক কাজ হইলো আপা? মানুষটা এক কাপ চা খাইতে চাইলো তুমি তাকে এক কাপ চা খাওয়াইলা না?

পেছন ঘুরে চারুর দিকে তাকায় চিত্রলেখা। বড়বোনের চাহনি দেখে চারু বলে,

-এক কাপ চা-ই তো চাইছিল মানুষটা।

-এক কাপ চায়ের সাথে সে আমার মাথাটাও চাবায় খেয়ে ফেলতো যদি বিদায় না করতাম।

-তুমি মামুন ভাইকে দুই চোক্ষে দেখতে পারো না আপা।

-দেখতে পারার মতো কোনো কাজ সে করে নাই।

-মানুষটা কত ভালো।

-তুই আজকাল একটু বেশিই মামুন মামুন করিস ঘটনা কি চারু?

-কোনো ঘটনা নাই আপা। সহজ সরল একজন মানুষ তোমাকে কত ভালোবাসে তাই বড় মায়া হয়।

-তুই এখান থেকে বিদায় হ তো। আমাকে শান্তিতে চা বানাইতে দে। তোর কথা শুনতে বিরক্ত লাগতেছে। এক্ষণ বিদায় হ।

চারু আর কিছু বলে না। চুপচাপ বিদায় হয়ে যায়।

চা খাওয়ার পর আর বসেনি রওনক। একটু দেখতে এসে অনেকটা সময় থাকা হয়ে গেছে তার। এর বেশি চিত্রলেখাকে বিরক্ত করতে চায় না সে। অন্যরা ঘরের ভেতর থেকে বিদায় দিয়ে দিলেও চিত্রলেখা বারান্দার গেইট পর্যন্ত এসে আঙিনায় চলে এসেছে দু’জনে। বিদায় নেয়ার জন্য পেছন ঘুরে চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ায় রওনক। এতক্ষণ থাকার জন্য মনে মনে লজ্জা লাগছে তার আবার এই মুহূর্তে চলে যেতে হচ্ছে ভেবেও কেমন যেন লাগছে। অনুভূতিদের এমন আমূল-পরিবর্তন ভাবায় রওনককে। কিন্তু এসব ভাবনার কূলকিনারা খুঁজে পায় না সে। বিদায় নেয়ার ভঙ্গিতে বলে,

-গুড়া মাছের চচ্চড়িটা মজা ছিল।

-আপনি বাসি তরকারি খাবেন আমি ভাবিনি।

-কেন আমাকে কি মানুষ মনে হয় না?

-না তা নয়, আসলে…

চিত্রলেখাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক বলে,

-সবার জন্য করতে করতে নিজেকে ভুলে যেও না। একটু বিশ্রাম নিও, নিজের খেয়াল রেখো।

চিত্রলেখা মুখ তুলে তাকায়। রওনকের চোখে চোখ পড়ে তার। আজ আর রওনক নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়নি। চিত্রলেখার ভেতরে ভাঙচুর হয়। পেটর ভেতর সব গুলিয়ে আসে। মাথার ভেতর ভনভন করে। এভাবে কেউ কখনো তাকে নিজের খেয়াল রাখতে বলেনি। তাহলে কি চারুই ঠিক! সত্যিই কি সে রওনকের জন্য বিশেষ কেউ? কিন্তু কীভাবে? অফিসের একজন সাধারণ এমপ্লই কেন বসের জন্য বিশেষ হবে?

চিত্রলেখাকে চুপ করে থাকতে দেখে রওনক নিজেই বলে,

-ফোনটা ইউজ করো, ফেলে রেখো না। আসছি।

আর অপেক্ষা করে না সে বেড়িয়ে যেতে কদম বাড়ায়। চিত্রলেখা আপন ভাবনাতে হারিয়ে গেছে। সে কিছুতেই কোনো কিছুর হিসাব মিলাতে পারছে না। মনে মনে ভাবে একবার চারু ওকে বলেছি কেউ যদি সত্যি কাউকে চায় তাহলে যাওয়ার পথে বারবার ফিরে তাকায় ততক্ষণ যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। চিত্রলেখা মনে মনে ভাবলো, আমি যদি সত্যি বিশেষ হয়ে থাকি তাহলে উনি পিছন ফিরে তাকাবে। চিত্রলেখার কথাটা ভাবতে দেরি হলো কিন্তু রওনকের পেছন ফিরতে সময় লাগলো না। ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই ওকে অবাক করে দিয়ে নীল লোহার গেইটটার কাছে গিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে পেছন ফিরে তাকায় রওনক। তৎক্ষনাৎই চিত্রলেখার বুকের ভেতর বিকট শব্দ হলো। রওনক হাত উঁচু করে নেড়ে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল। চিত্রলেখা কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। মাথার ভেতর সব ডালে চালে খিচুড়ি হয়ে গেছে তার। এমন একটা বিষয় ভাবাই ওর উচিত হয়নি। না ও ভাবতো আর না রওনক পেছন ফিরে তাকাতো। এখন নিজেকে স্টুপিট ব ল দ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না চিত্রলেখার।

চিত্রলেখার বাড়ি থেকে বের হতেই গেইটের বাহিরে রওনকের আবার দেখা হয় মামুনের সঙ্গে। তার গাড়ি আসেনি এখনো। বেরিয়েই আগে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের বক্স বের করে একটা সিগারেট জ্বালায় সে। তাতে লম্বা করে টান দেয়। এগিয়ে এসে মামুন রওনকের পাশে দাঁড়ায়। জিনিস করে,

-অনেক দেরি হয়ে গেল আপনার বের হতে। একেবারে বিশ্রাম করেই বের হলেন বুঝি।

সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে রওনক বলে,

-বিশ্রাম করা হয়নি বাসায় গিয়েই করব।

রওনক বুঝতে পারে মামুনের মনে কৌতূহল তার এতক্ষণ পর বের হওয়ার কারণ জানতে চাওয়ার। এর মধ্যেই তার গাড়িটা চলে এসেছে। মামুনের কৌতূহলে আ গু ন জ্বালিয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-একেবারে চা খেয়ে বের হলাম।

এতটুকু বলেই রওনক গাড়িতে উঠে যায়। পেছনে মামুনের মস্তিষ্কের ভেতরের কৌতূহল বেড়ে যায় চা কোথা থেকে এলো জানতে। গাড়িতে উঠে বসে গ্লাস নামিয়ে রওনক আরও বলে,

-চিত্রলেখা ও সরি আপনি তো মায়া বলে ডাকেন। মায়াই চা বানিয়েছে আমার জন্য।

এতটুকু বলে আর অপেক্ষা করে না রওনক, মামুনকে কিছুর বলারও সুযোগ দেয় না। তার গাড়িটা মামুনের চোখের সামনে দিয়ে সাই করে টান দিয়ে বেরিয়ে যায়। পেছনে মামুনের মুখটা হয়েছে দেখার মতো চায়ের কথা শুনে। লিকার ঠিক না হলে চা যেমন পানসে লাগে মামুনের মুখটাও এই মুহূর্তে সেরকম পানসে দেখাচ্ছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সেদিন সাবার বাবার সাথে ওভাবে কথা বলার পর ঐ বিষয়ে রওনক আর মায়ের মুখোমুখি হয়নি। তার করা ব্যবহার যে মা সহজ ভাবে নিবে না সেটা রওনক খুব ভালো করেই জানে। মাকে এক্সপ্লেইন করার মতো কিছু নেই তার কাছে সেজন্য ইচ্ছা করেই মাকে এড়িয়ে গেছে সে। কিন্তু তানিয়ার জন্য এই কাজটা আর কন্টিনিউ করতে পারছে না। দিনরাত তানিয়া তার কানের কাছে একটা প্যাঁচালই পারছে সে যেন মায়ের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু কি কথা বলবে সেটা বুঝে পায় না রওনক। কারণ মা তার কাছে যা চায় সেটা রওনক করতে পারবে না। তার ভাগ্যে যদি আবার বিয়ে করা লেখা থাকে তাহলে সেটা সে কেন কেউ ঠেকাতে পারবে না কিন্তু এই মুহূর্তে না তো মানসিকভাবে আর না মন থেকে কোনোভাবেই সে আবার বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। তাছাড়া সবচাইতে বড় কথা সাবাকে রওনক কখনই বিয়ে করার কথা ভাবেনি হয়ত কখনো ভাবতেও পারবে না। এই সহজ বিষয়টা রওনক তার মা দিলারা জামানকে বুঝাতে পারছে না। মোদ্দা কথা হচ্ছে কেউ নিজে থেকে বুঝতে না চাইলে সহজে কেউ কাউকে বুঝাতে পারে না।

রওনক বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে নিয়েছে একেবারে। আসতে আসতে ভেবেছিল এসেই একটু ঘুমিয়ে নিবে কিন্তু আসার পর আর ঘুমাতে মন চায়নি। বরং শাওয়ার দিয়ে এক কাপ কড়া কফি খেতে পারলে ভালো হয়। মায়ের ঘরে যাওয়ার জন্য নিজের ঘর থেকে বের হতেই রওনকের দেখায় হয় জাহানারার সঙ্গে। তাকে দেখেই রওনক দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-মা কোথায় খালা?

-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় হলো তাহলে?

জাহানারার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রওনক বলে,

-আমার জন্য মায়ের ঘরে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিবে প্লিজ?

-তুমি যাও আমি নিয়ে আসছি।

দিলারা জামানের দরজা খোলাই ছিল। নবে হাত ঘুরাতেই দরজাটা খুলে যায়। একবার দরজায় নক করে ভেতরে উঁকি দিয়ে রওনক বলে,

-ভেতরে আসছি মা।

ছেলের কন্ঠ শুনতে পেলেও জবাব করেন না দিলারা জামান৷ ছেলের উপর থেকে এখনো উনার রাগ পরেনি। পরবেই বা কীভাবে? ছেলে তো তার মান ভাঙাতেই আসেনি। তবে ভালো খবর হচ্ছে দেরিতে হলেও ছেলের মায়ের মান ভাঙানোর কথা মনে পড়েছে। অভিমানে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছেন দিলারা জামান। রওনক এগিয়ে এসে মায়ের পাশেই বসে। তার একটা হাতে নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছো মা?

মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে দিলারা জামান বলেন,

-আমার থাকা না থাকায় তোদের কারো কিছু যায় আসে নাকি?

-এভাবে বলছো কেনো?

-তো আর কীভাবে বলবো? আমার মান-সম্মানের কোনো মূল্য আছে তোর কাছে?

-নেই বলছো?

-থাকলে তুই লোক ভর্তি ঘরে আমাকে ওভাবে ছোট করতে পারতি না। তাও আবার আমার দাওয়াত কথা মেহমানের সামনে।

-আমি কখন তোমাকে ছোট করলাম?

-ছোট করিসনি বলছিস?

-আমি কি তোমাকে কখনো কারো সামনে ছোট করতে পারি?

-দেখ রওনক আমার সঙ্গে হেয়ালি করবি না। আমি হেয়ালি পছন্দ করি না।

-আর তুমিও ভালো করেই জানো আমি হেয়ালি করি না। যেটা আমার কাছে ভ্যালিড আমি সেটাই করি। তোমার এত রাগ করার কারণটা কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না আমি। এদিকে তুমি রাগ করে মুখ ফুলিয়ে রেখেছো আর ওদিকে তোমার টেনশনে ভাবী, খালা দু’জনের প্রেসার হাই হয়ে আছে। আমাকে সারাদিন অফিসের হাজারটা সমস্যা দেখতে হয়, ডিল করতে হয়। এখন যদি ঘরের সমস্যাও আমাকেই দেখতে হয় তাহলে কীভাবে হবে বলো তো?

-সেজন্যই তো বলছি বিয়েটা করে ফেল। সাবা বউ হয়ে এসে নাহয় ঘরের সমস্যাগুলো দেখবে। তোকে আর ঘর নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

-আমাদের বাড়িতে বউ আছে মা।

-তানিয়া নিজেও তো অফিস নিয়ে বিজি। অফিসের পর দুইটা বাচ্চাও আছে ওর দেখাশুনার। এরপর আর কতদিক সামলাবে বেচারি? ওরও তো সাপোর্টের জন্য কাউকে চাই।

-ভাবির সাপোর্ট লাগলে এসিস্ট্যান্ট হায়ার করে দিবো।

-এসিস্ট্যান্ট দিয়ে কি ঘর সংসারের কাজ হয় নাকি?

-তুমি কি চাও মা?

-তুই বিয়ে কর। আমি সাবার বাবা মাকে খবর দিচ্ছি।

-এক মিনিট মা, শান্ত হয়ে বসো তো প্লিজ। তুমি তো দেখছি আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো।

-তো উঠে পড়ে লাগবো না? তোর কি নষ্ট করার মতো সময় বা বয়স আছে? এখন বিয়ে না করলে আর কবে করবি?

-আবার কেন বিয়ে করতে হবে আমায়? তুমিই বলো মানুষ জেনেশুনে একই ভুল কয়বার করে?

-তুই বিয়ের মতো পবিত্র ফরজ কাজকে ভুল বলে আখ্যা দিচ্ছিস কেন?

-কারণ আমার ক্ষেত্রে ভুল। আর যেটা ভুল আমি সেটাকে ভুলই বলবো তা যত পবিত্র কাজই হোক। ফরজ আমার আদায় করা হয়ে গেছে। তাই আবার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।

-ইচ্ছে নেই বললে তো হবে না। তোর অতীতে যা হয়েছে ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। একটা এক্সিডেন্টের জন্য তুই বিয়ে করবি না তা হয়?

-তোমরা যেটাকে জাস্ট এক্সিডেন্ট বলে খুব সহজেই উড়িয়ে দিচ্ছো আমার জন্য কিন্তু তিলত্তমা কেবল একটা এক্সিডেন্ট ছিল না। আই ইউজড টু লাভ হার। শি ওয়াজ মাই ওয়াইফ। আমাদের নসিবে সংসার করা লেখা ছিল না তাই হয়নি। যেটা ভাগ্যে ছিল না সেই দোষ তো কাউকে দিয়ে লাভ নেই। ও যেমনই ছিল, যাই ছিল আর যাই করেছে সেজন্য আমি ওকে অসম্মান করতে পারি না। ও নিজে নিজের সম্মান হারিয়েছে তাই বলে তো আমি ওকে অসম্মান করতে পারবো না, করা উচিতও না। ভুলে গেলে হবে না শি ওয়াজ মাই ওয়াইফ। ওয়ান অব দ্যা মোস্ট রেসপেক্টেড লেডি ইন মাই লাইফ আফটার ইউ। এটা ঠিক এখন আর ওকে ভালোবাসি না তাই বলে অসম্মানও তো করতে পারবো না। তোমাদের মতো জাস্ট এক্সিডেন্ট বলে জীবনের এত বড় একটা চ্যাপ্টার আমি চাপা দিয়ে ফেলতে পারব না মা সরি, আই এম রিয়েলি ভেরি সরি ফর দ্যাট।

-যেটা হয়ে গেছে সেটা হয়ে গেছে রওনক। ওসব অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকলে চলবে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে।

-তোমাদের সবার সেই ঘুরে ফিরে একই কথা। তেমাদের কেন মনে হয় আমি অতীত আঁকড়ে পড়ে আছি। আই এম হ্যাপি ইন মাই লাইফ রাইট নাও। আই এম লিভিং মাই লাইফ ইন মাই ওয়ে।

-এটাকে লিভিং বলে না রওনক।

-তাহলে কোনটাকে বলে? কি করব আমি বলো তো?

-সাবাকে বিয়ে কর।

রওনক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে চায় কিন্তু ছাড়ে না, চেপে যায়। দিলারা জামানের কথার সুই ঘুরে ফিরে ঐ বিয়েতেই আটকে আছে।

-একটা কথা বলো তো। তুমি কি চাও? আই মিন কোনটা চাও? আমি বিয়ে করি নাকি সাবাকেই বিয়ে করি। কোনটা?

দিলারা জামান তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারেন না। উনি চান উনার ছেলে বিয়ে করুক। তবে সাবাকেও উনার ভীষণ পছন্দ। মেয়ে উনার ভীষণ বাধ্যগত। এই মুহূর্তে উনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না ছেলেকে কি জবাব দিবেন। উনি কি বলবেন তুই সাবাকেই বিয়ে কর নাকি ছেলেকে বলবেন তোর কানা, ল্যাংরা, বোবা যা ভালো লাগে তুই তাকেই বিয়ে কর, তাও বিয়েটা অন্তত কর। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না দিলারা জামান। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রওনক বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে,

-তুমি আগে নিজে সিদ্ধান্ত নাও আসলে তুমি কোনটা চাও। তারপর নাহয় আমাকে জানাবে।

বেরিয়ে যাওয়ার আগে রওনক আরও বলে,

-আরেকটা কথা, প্লিজ আর এভাবে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখো না। ভাবী, খালা দু’জনেরই তোমার টেনশনে প্রেসার হাই হয়ে আছে। তাছাড়া তুমি ঘরবন্দী হয়ে বসে থাকলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধানের জন্য ইউ হেভ টু ফাইট। ইউ হেভ টু কনভেন্স মি। ভাবো, ভালো মতো ভাবো আসলে তুমি কি চাও। তারপর নাহয় আমাকে জানাও। তবে যাই ভাবো একটু ভেবে চিন্তে ভেবো কেমন! হতেই পারে তোমার ভাবনার উপর আমার সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।

দিলারা জামানকে কথার প্যাঁচে ফেলে বেরিয়ে যায় রওনক। মায়ের ঘরের বাইরেই তার দেখা হয় ভাবীর সঙ্গে। তানিয়ার হাতে কফির মগ। তা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কথা হলো মায়ের সঙ্গে?

ভাবীর হাত থেকে কফি নিয়ে রওনক তাতে একটা চুমুক দিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে বলে,

-হলো হলো, বেশ কথা হলো।

-তা কি বললে? মান ভাঙাতে পারলে? কে হারলো মা না তুমি?

কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে রওনক বলে,

-হার জিত আপাতত পেন্ডিং আছে। তুমি বরং ভেতরে যাও, গিয়ে তোমার শাশুড়িকে উদ্ধার করো। সে এই মুহূর্তে গভীর চিন্তা ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তুমি গিয়ে আমার বেচারি মাকে চিন্তার সাগরে ডোবা থেকে বাঁচাও।

-কি এমন বললে তুমি?

-যাকে বলেছি তার থেকেই শুনো নাহয়।

-আচ্ছা আমি দেখছি।

তানিয়া শাশুড়ির ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে রওনক তার পথ আগলে বলে,

-থ্যাংকিউ, কফিটা সবসময়ের মতো ভালো হয়েছে। তবে কেউ একজন আছে যার হাতের বানানো চা এই পৃথিবীর সবচাইতে বেস্ট চা। তোমার এই বেস্ট কফির চাইতেও হাজারগুন বেস্ট।

এতটুকু বলেই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় রওনক। তানিয়াকেও একটা গোলকধাঁধা ধরিয়ে দিয়ে গেল সে। জানতে চাইলেও সে তানিয়াকে এই বিষয়ে আর কিচ্ছু বলবে না। আচমকা সবার সঙ্গে এমন লুকোচুরি খেলতে ভালোই লাগছে রওনকের। জীবন হরহামেশাই আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। তাই সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যে জীবনের সঙ্গেও লুকোচুরি খেলা উচিত।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সেদিন সাবার বাবার সাথে ওভাবে কথা বলার পর ঐ বিষয়ে রওনক আর মায়ের মুখোমুখি হয়নি। তার করা ব্যবহার যে মা সহজ ভাবে নিবে না সেটা রওনক খুব ভালো করেই জানে। মাকে এক্সপ্লেইন করার মতো কিছু নেই তার কাছে সেজন্য ইচ্ছা করেই মাকে এড়িয়ে গেছে সে। কিন্তু তানিয়ার জন্য এই কাজটা আর কন্টিনিউ করতে পারছে না। দিনরাত তানিয়া তার কানের কাছে একটা প্যাঁচালই পারছে সে যেন মায়ের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু কি কথা বলবে সেটা বুঝে পায় না রওনক। কারণ মা তার কাছে যা চায় সেটা রওনক করতে পারবে না। তার ভাগ্যে যদি আবার বিয়ে করা লেখা থাকে তাহলে সেটা সে কেন কেউ ঠেকাতে পারবে না কিন্তু এই মুহূর্তে না তো মানসিকভাবে আর না মন থেকে কোনোভাবেই সে আবার বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। তাছাড়া সবচাইতে বড় কথা সাবাকে রওনক কখনই বিয়ে করার কথা ভাবেনি হয়ত কখনো ভাবতেও পারবে না। এই সহজ বিষয়টা রওনক তার মা দিলারা জামানকে বুঝাতে পারছে না। মোদ্দা কথা হচ্ছে কেউ নিজে থেকে বুঝতে না চাইলে সহজে কেউ কাউকে বুঝাতে পারে না।

রওনক বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে নিয়েছে একেবারে। আসতে আসতে ভেবেছিল এসেই একটু ঘুমিয়ে নিবে কিন্তু আসার পর আর ঘুমাতে মন চায়নি। বরং শাওয়ার দিয়ে এক কাপ কড়া কফি খেতে পারলে ভালো হয়। মায়ের ঘরে যাওয়ার জন্য নিজের ঘর থেকে বের হতেই রওনকের দেখায় হয় জাহানারার সঙ্গে। তাকে দেখেই রওনক দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-মা কোথায় খালা?

-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় হলো তাহলে?

জাহানারার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রওনক বলে,

-আমার জন্য মায়ের ঘরে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিবে প্লিজ?

-তুমি যাও আমি নিয়ে আসছি।

দিলারা জামানের দরজা খোলাই ছিল। নবে হাত ঘুরাতেই দরজাটা খুলে যায়। একবার দরজায় নক করে ভেতরে উঁকি দিয়ে রওনক বলে,

-ভেতরে আসছি মা।

ছেলের কন্ঠ শুনতে পেলেও জবাব করেন না দিলারা জামান। রওনক এগিয়ে এসে মায়ের পাশেই বসে। তার একটা হাতে নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কেমন আছো মা?

মুখ বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে দিলারা জামান বলেন,

-আমার থাকা না থাকায় তোদের কারো কিছু যায় আসে নাকি?

-এভাবে বলছো কেনো?

-তো আর কীভাবে বলবো? আমার মান-সম্মানের কোনো মূল্য আছে তোর কাছে?

-নেই বলছো?

-থাকলে তুই লোক ভর্তি ঘরে আমাকে ওভাবে ছোট করতে পারতি না। তাও আবার আমার দাওয়াত কথা মেহমানের সামনে।

-আমি কখন তোমাকে ছোট করলাম?

-ছোট করিসনি বলছিস?

-আমি কি তোমাকে কখনো কারো সামনে ছোট করতে পারি?

-দেখ রওনক আমার সঙ্গে হেয়ালি করবি না। আমি হেয়ালি পছন্দ করি না।

-আর তুমিও ভালো করেই জানো আমি হেয়ালি করি না। যেটা আমার কাছে ভ্যালিড আমি সেটাই করি। তোমার এত রাগ করার কারণটা কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না আমি। এদিকে তুমি রাগ করে মুখ ফুলিয়ে রেখেছো আর ওদিকে তোমার টেনশনে ভাবী, খালা দু’জনের প্রেসার হাই হয়ে আছে। আমাকে সারাদিন অফিসের হাজারটা সমস্যা দেখতে হয়, ডিল করতে হয়। এখন যদি ঘরের সমস্যাও আমাকেই দেখতে হয় তাহলে কীভাবে হবে বলো তো?

-সেজন্যই তো বলছি বিয়েটা করে ফেল। সাবা বউ হয়ে এসে নাহয় ঘরের সমস্যাগুলো দেখবে। তোকে আর ঘর নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

-আমাদের বাড়িতে বউ আছে মা।

-তানিয়া নিজেও তো অফিস নিয়ে বিজি। অফিসের পর দুইটা বাচ্চাও আছে ওর দেখাশুনার। এরপর আর কতদিক সামলাবে বেচারি? ওরও তো সাপোর্টের জন্য কাউকে চাই।

-ভাবির সাপোর্ট লাগলে এসিস্ট্যান্ট হায়ার করে দিবো।

-এসিস্ট্যান্ট দিয়ে কি ঘর সংসারের কাজ হয় নাকি?

-তুমি কি চাও মা?

-তুই বিয়ে কর। আমি সাবার বাবা মাকে খবর দিচ্ছি।

-এক মিনিট মা, শান্ত হয়ে বসো তো প্লিজ। তুমি তো দেখছি আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছো।

-তো উঠে পড়ে লাগবো না? তোর কি নষ্ট করার মতো সময় বা বয়স আছে? এখন বিয়ে না করলে আর কবে করবি?

-আবার কেন বিয়ে করতে হবে আমায়? তুমিই বলো মানুষ জেনেশুনে একই ভুল কয়বার করে?

-তুই বিয়ের মতো পবিত্র ফরজ কাজকে ভুল বলে আখ্যা দিচ্ছিস কেন?

-কারণ আমার ক্ষেত্রে ভুল। আর যেটা ভুল আমি সেটাকে ভুলই বলবো তা যত পবিত্র কাজই হোক। ফরজ আমার আদায় করা হয়ে গেছে। তাই আবার বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।

-ইচ্ছে নেই বললে তো হবে না। তোর অতীতে যা হয়েছে ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। একটা এক্সিডেন্টের জন্য তুই বিয়ে করবি না তা হয়?

-তোমরা যেটাকে জাস্ট এক্সিডেন্ট বলে খুব সহজেই উড়িয়ে দিচ্ছো আমার জন্য কিন্তু তিলত্তমা কেবল একটা এক্সিডেন্ট ছিল না। আই ইউজড টু লাভ হার। শি ওয়াজ মাই ওয়াইফ। আমাদের নসিবে সংসার করা লেখা ছিল না তাই হয়নি। যেটা ভাগ্যে ছিল না সেই দোষ তো কাউকে দিয়ে লাভ নেই। ও যেমনই ছিল, যাই ছিল আর যাই করেছে সেজন্য আমি ওকে অসম্মান করতে পারি না। ও নিজে নিজের সম্মান হারিয়েছে তাই বলে তো আমি ওকে অসম্মান করতে পারবো না, করা উচিতও না। ভুলে গেলে হবে না শি ওয়াজ মাই ওয়াইফ। ওয়ান অব দ্যা মোস্ট রেসপেক্টেড লেডি ইন মাই লাইফ আফটার ইউ। এটা ঠিক এখন আর ওকে ভালোবাসি না তাই বলে অসম্মানও তো করতে পারবো না। তোমাদের মতো জাস্ট এক্সিডেন্ট বলে জীবনের এত বড় একটা চ্যাপ্টার আমি চাপা দিয়ে ফেলতে পারব না মা সরি, আই এম রিয়েলি ভেরি সরি ফর দ্যাট।

-যেটা হয়ে গেছে সেটা হয়ে গেছে রওনক। ওসব অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকলে চলবে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে।

-তোমাদের সবার সেই ঘুরে ফিরে একই কথা। তেমাদের কেন মনে হয় আমি অতীত আঁকড়ে পড়ে আছি। আই এম হ্যাপি ইন মাই লাইফ রাইট নাও। আই এম লিভিং মাই লাইফ ইন মাই ওয়ে।

-এটাকে লিভিং বলে না রওনক।

-তাহলে কোনটাকে বলে? কি করব আমি বলো তো?

-সাবাকে বিয়ে কর।

রওনক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে চায় কিন্তু ছাড়ে না, চেপে যায়। দিলারা জামানের কথার সুই ঘুরে ফিরে ঐ বিয়েতেই আটকে আছে।

-একটা কথা বলো তো। তুমি কি চাও? আই মিন কোনটা চাও? আমি বিয়ে করি নাকি সাবাকেই বিয়ে করি। কোনটা?

রওনক বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে,

-তুমি আগে নিজে সিদ্ধান্ত নাও আসলে তুমি কোনটা চাও। তারপর নাহয় আমাকে জানাবে।

বেরিয়ে যাওয়ার আগে রওনক আরও বলে,

-আরেকটা কথা, প্লিজ আর এভাবে নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখো না। ভাবী, খালা দু’জনেরই তোমার টেনশনে প্রেসার হাই হয়ে আছে। তাছাড়া তুমি ঘরবন্দী হয়ে বসে থাকলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধানের জন্য ইউ হেভ টু ফাইট। ইউ হেভ টু কনভেন্স মি। ভাবো, ভালো মতো ভাবো আসলে তুমি কি চাও। তারপর নাহয় আমাকে জানাও। তবে যাই ভাবো একটু ভেবে চিন্তে ভেবো কেমন! হতেই পারে তোমার ভাবনার উপর আমার সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।

দিলারা জামানকে কথার প্যাঁচে ফেলে বেরিয়ে যায় রওনক। মায়ের ঘরের বাইরেই তার দেখা হয় ভাবীর সঙ্গে। তানিয়ার হাতে কফির মগ। তা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কথা হলো মায়ের সঙ্গে?

ভাবীর হাত থেকে কফি নিয়ে রওনক তাতে একটা চুমুক দিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে বলে,

-হলো হলো, বেশ কথা হলো।

-তা কি বললে? মান ভাঙাতে পারলে? কে হারলো মা না তুমি?

কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে রওনক বলে,

-হার জিত আপাতত পেন্ডিং আছে। তুমি বরং ভেতরে যাও, গিয়ে তোমার শাশুড়িকে উদ্ধার করো। সে এই মুহূর্তে গভীর চিন্তা ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তুমি গিয়ে আমার বেচারি মাকে চিন্তার সাগরে ডোবা থেকে বাঁচাও।

-কি এমন বললে তুমি?

-যাকে বলেছি তার থেকেই শুনো নাহয়।

-আচ্ছা আমি দেখছি।

তানিয়া শাশুড়ির ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে রওনক তার পথ আগলে বলে,

-থ্যাংকিউ, কফিটা সবসময়ের মতো ভালো হয়েছে। তবে কেউ একজন আছে যার হাতের বানানো চা এই পৃথিবীর সবচাইতে বেস্ট চা। তোমার এই বেস্ট কফির চাইতেও হাজারগুন বেস্ট।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-১৪+১৫

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক চিত্রলেখার বাসার নীল রঙের লোহার গেইটটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যাবে কিনা বুঝতে পারছে না। তার এভাবে চলে আসাটা হয়ত উচিত হয়নি। কেনো যে আসতে গেল সে! এভাবে জোকের বশে কাজ তেমন একটা করে না রওনক। কিন্তু আজ কি হলো কে জানে? সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো একবার চিত্রলেখাকে দেখতে পারলে ভালো হয়ত। এখন কেমন আছে কে জানে? শরীরটা আগের চাইতে ভালো না আবার বিগড়ে গেল! শরীর খারাপ করলে যে এই মেয়ে কাউকে বলবে না তা রওনকের বুঝা হয়ে গেছে। এমনকি নিজে থেকে ডাক্তারও দেখাবে না। পুরোপুরি সুস্থ আছে কিনা দেখার তাগাদা অনুভব করে এই পর্যন্ত ছুটে আসা রওনকের। কিন্তু গেইট পর্যন্ত এসে এখন ভেতরে যেতে ইতস্তত লাগছে। মনে হচ্ছে তার এভাবে চলে আসাটা বোকামি হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রওনক। যেই গাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য পেছন ঘুরতে নেয় তখনই চিত্রলেখার বাড়ির নীল লোহার গেইটটা খট করে খোলার শব্দ হয়। রওনক আর গাড়িতে গিয়ে বসতে পারে না। তার আগেই গেইটটা খুলে বেরিয়ে আসে একটা ছেলে। ছেলেটার সাথে রওনকের পরিচয় না থাকলেও চিনতে পারছে সে এটা চিত্রলেখারই ভাই হবে। চেহারায় মিল পাওয়া যাচ্ছে। গেইট খুলে বেরিয়ে রওনককে দেখে একবার তার পেছনে থাকা গাড়িটার দিকে তাকায় চয়ন। এত দামী গাড়ি চড়ে আসার মতো আত্মীয়-স্বজন ওদের নেই। গতকাল রাতে বাড়ি ফিরে চারুর মুখে শুনেছে বড় বোনকে তার অফিসের বস ইয়া মস্তবড় গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে গেছে। যদিও তার নিজের চোখে দেখা হয়নি। তবে এই মুহূর্তে গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে চয়নের মনে হচ্ছে উনি হয়ত চিত্রলেখার বসই হবেন। লোকটার পরনের কাপড়চোপড় দেখেও বুঝা যাচ্ছে বেশ দামী। একবার লোকটার পায়ের দিকে তাকায় চয়ন। এডিডাস ব্রান্ডের একজোড়া বেশ দামী স্নিকার্স পরিধানে। এডিডাস লেখা নকল টি-শার্ট ফুটপাতে বা ভ্যানে পাওয়া যায় দেড়শ বা দুইশ টাকায়। সেরকম বেশ কয়টা টি-শার্ট চয়নের আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার সমানে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক যে কোনো লোকাল বা নকল জিনিস পরেননি তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না ওর। রওনক কিছু বলে না, চুপচাপ তাকিয়ে রশ কেবল। চয়ন নিজেই বলে,

-আপনি কি আপার কাছে এসেছেন?

কেমন কেমন করে যেন তাকায় রওনক। তা দেখে চয়ন নিজের কথা সংশোধন করে বলে,

-আই মিন কাউকে খুঁজছেন?

-চিত্রলেখাকে দেখতে এসেছি।

-আপনার পরিচয়?

হাত বাড়িয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-আমি রওনক, রওনক জামান। চিত্রলেখার বস।

-ভেতরে আসুন প্লিজ।

চয়ন মনে মনে যা ভেবেছিল ঠিক তাই হলো। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-এখন চিত্রলেখার শরীর কেমন?

-এসেছেন যেহেতু আপনি নিজের চোখেই দেখে নিন নাহয়।

চয়নের কথাটা কেমন রহস্য রহস্য লাগে রওনকের। কিন্তু সে কথা বাড়ায় না। ততক্ষণে ওরা উঠান পেরিয়ে বারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এতটুকু এসেই থমকে দাঁড়ায় রওনক চিত্রলেখাকে দেখে। চয়ন একপাশে সরে দাঁড়িয়েছে। চিত্রলেখা এখনো রওনককে খেয়াল করেনি। খেয়াল করবে কীভাবে! সে তো ব্যস্ত নিজের কাজে। হাতে তার এক বালতি কাপড়। দেখে বুঝা যাচ্ছে বালতি ভরা কাপড়গুলো সে মাত্রই ধুয়ে বেরিয়েছে। কপালময় ঘামের ছড়াছড়ি। ওড়নাটা ঘুরিয়ে এনে কোমড়ের কাছে বাঁধা। কামিজের সামনের অংশ অনেকটা পানিতে ভিজে গেছে। আটপৌরে বাঙালি মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বড়মেয়েদের জীবন কেমন হয় এই মুহূর্তে চিত্রলেখাকে দেখলে তার সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যাবে। কিন্তু রওনকের চোখ-মুখ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে মুগ্ধতা। দেখা না করে ফিরে গেলে এমন মনোমুগ্ধকর একটা দৃশ্য তার এই জীবনে দেখা হতো না। ফিরে গেল আজীবনকার আফসোস রয়ে যেত তার। ভেজা কাপড়ের বলতি হাতে বারান্দা পেরিয়ে বাইরে আসার জন্য পা বাড়াতেই মুখ তুলে রওনককে দেখে থমকে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। একবার নিজেকে দেখে নিয়ে আবার রওনকের দিকে তাকায় সে। দৌড়ে ভেতরে চলে যাবে না সামনে এগিয়ে গিয়ে কুশলাদি বিনিময় করবে চিন্তা করে পায় না। পালিয়ে গেলে বিষয়টা লজ্জাকর হয়ে দাঁড়াবে। তবে এই মুহূর্তে কোনোভাবেই নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় এই মানুষটাকে কল্পনায়ও আশা করেনি চিত্রলেখা। কিন্তু তার ভাবনা, কল্পনাকে মিথ্যা করে দিয়ে সত্যি সত্যি মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বালতিটা হাত থেকে নামিয়ে এক কদম এগিয়ে এসে অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে সরাসরি রওনকের চোখের দিকে তাকিয়ে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-আপনি এখানে?

-তোমায় দেখতে এলাম। এখন কেমন আছো তুমি?

-ভালো আছি।

❝আসলেই যে ভালো আছো তা তো তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি মেয়ে। কে বলবে গতকাল এই তুমিই বেহুঁশ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলে। না জানলে কেউ বলতেই পারবে না।❞ কথাগুলো মনে মনে ভাবে রওনক। মুখে আর কিছু বলে না কেবল মুচকি হাসে, হাসার চেষ্টা করে। এমনিতেই চিত্রলেখাকে দেখে তার চোখ হাসছে। সেই হাসি অনেক কষ্টে সংযত করে রেখেছে সে। রওনক চায় না চিত্রলেখা টের পেয়ে যাক তার অজানা এই হাসি খুশির কারণ।

আজ শুক্রবার তাই সবাই বাসায়। এবারে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে চারু। রওনককে দেখে চোখ জোড়া ড্যাবড্যাব করে এগিয়ে এসে বড়বোনকে ঠ্যালা ধাক্কা দিয়ে বলে,

-দেখছো আপা আমি বলছিলাম না তোমাকে?

চারুর কথা শুনে চোখ গরম করে ওর দিকে তাকিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-দিবো একটা কানের নিচে।

-ওমা! আমি তো…

-একদম চুপ।

ধমকে দিয়ে কাপড়ের বালতিটা চারুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরও বলে,

-কাপড়গুলো মেলে দে।

-মেহমান আসছে আপা। উনার চাইতে কি কাপড় বেশি হয়ে গেল?

-চারু!

বড়বোনের গরম চোখ দেখে চারু আর কিছু বলার সাহস পায় না। পাশ থেকে চয়ন বলে,

-তোমরা আবার শুরু হয়ে গেলা? গেস্ট আসছে এতটুকু তো খেয়াল করো।

-হয়েছে তোকে আর পাকনামো করতে হবে না। যেই কাজে যাচ্ছিলি সেটা কর গিয়ে।

চয়নকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রলেখা রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আপনি ভেতরে আসুন প্লিজ।

চয়ন বেরিয়ে যাওয়ার আগে রওনককে বলে,

-আপনি কিন্তু যাবেন না। আমি ছোট্ট একটা কাজে যাচ্ছি জলদিই ফিরে আসবো। আজ আমাদের সাথে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবেন প্লিজ।

চয়নের আবদার শুনে শুধু রওনক নয়, চিত্রলেখাও খানিকটা অবাক হয়। অবাক হয়ে বলে,

-কি যা তা বলছিস উনি কি আমাদের মতো গরীবের বাসায় খাবেন নাকি?

-বারে আপা উনি খাক বা না খাক তুমি না খাইয়ে ছাড়বে কেন? একদম ছাড়বে না উনাকে বলে যাচ্ছি। এসে যেনো পাই।

চয়ন আর অপেক্ষা করে না যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরেই বেরিয়ে যায়। মূলত এক কেজি গরুর গোশত কিনতে যাচ্ছে সে। চিত্রলেখা এখনো বেতন পায়নি। গতকাল লিখন টিউশনির টাকা পেয়েছে। সেখান থেকেই এক হাজার টাকা বড়বোনকে দিয়ে বলেছে এক কেজি গরুর গোশত আনিয়ে রান্না করতে। গতমাসে একদিনও গরুর গোশত খাওয়া হয়নি। তার আগের মাসে অবশ্য দু’দিন খাওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত মাসে কিছু সাংসারিক টানাটানি থাকায় গরুর গোশত খাওয়ার মতো বিলাসিতা করা হয়নি। চিত্রলেখা হিসাব করে দেখেছে এই মাসে বেতন পাওয়ার পর তার নিজের হাত খরচের জন্য যতটুকু লাগে সেটাও সম্পূর্ণ থাকবে না। প্রথমে গরুর গোশত আনতে তার মন সায় দেয়নি। কিন্তু গোশতের কথা শুনতেই চারু, চয়নের চোখ জোড়াও ঝলমল করে উঠেছিল তা দেখে আর আপত্তি করতে পারেনি সে। নাহয় এই মাসে ১০ দিন পায়ে হেটেই অফিস যাবে তাও ভাইবোনগুলো মাত্র একটা দিন গোশত খাওয়ার শখ করেছে এতটুকু আবদার সে অপূর্ণ রাখতে পারবে না।

রওনক মনে মনে বলে, ❝আমার জায়গায় লাবিব হলে নিশ্চয়ই হাত ধরে টেনে দুপুরের খাবার খাইয়ে ছাড়তে। আমি খেলে তো তোমার জাত চলে যাবে।❞

ভাইবোন দুটোকে বিদায় করে দিয়ে চিত্রলেখা রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,

-আপনি ভেতরে আসুন প্লিজ।

রওনক আর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চিত্রলেখার পেছন পেছন ভেতরে এসে বসে। বন্ধের দিনে একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠে লিখন। আজও দেরি হয়েছে তার। এখন বাজে বেলা সাড়ে এগারোটা। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতেই লিখন বলে,

-এক কাপ চা দাও আপা।

বেরিয়ে এসে ড্রইং রুমে বসা ভদ্রলোককে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকায় লিখন। তা দেখে চিত্রলেখা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,

-আমার বস গতকাল যার কথা বললাম।

এগিয়ে এসে রওনকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে লিখন বলে,

-আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, গতকাল আপার পাশে থাকার জন্য।

লিখনকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক নিজেও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলে,

-ইটস ওকে, শি ইজ মাই রেসপন্সিবিলিটি। ইট ওয়াজ মাই ডিউটি টু টেক কেয়ার অব হার।

রওনকের কথা শুনে মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকায় চিত্রলেখা। এই জীবনে কেউ কোনোদিন বলেনি সে তার দায়িত্ব। চিত্রলেখা তো নিজের কাঁধেই ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব বয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ তো কখনো এভাবে তাকে বলেনি। অবশ্য মামুন চায় তার দায়িত্ব নিতে, সদা প্রস্তুতও কিন্তু সেই সম্মতি দিতে পারে না। আগবাড়িতে মামুনের পেতে রাখা হাত ধরতে পারে না আজীবনের জন্য। এতে বড় দিধা তার।

চিত্রলেখা বলে,

-তুই বোস এখানে উনাকে সঙ্গ দে, আমি তোদের জন্য চা নিয়ে আসছি।

রওনক বসতে বসতে বলে,

-আমার জন্য ব্যস্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

মুচকি হেসে চিত্রলেখা বলে,

-আমি এক্ষুনি আসছি।

সে চলে যেতেই লিখন বলে,

-আমাদের বাসায় চা সবসময়ই বানানো থাকে। আমরা সবাই আপার হাতে বানানো চা অনেক পছন্দ করি।

মুখে কেবল হাসে রওনক মুখে কিছু বলে না। সে নিজেও চিত্রলেখার চায়ের ভক্ত হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। একবার আশপাশ দেখে নিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-তোমার খালা খালুকে দেখছি না যে? উনারা বাসায় নেই?

-খালুর এক আত্মীয় অসুস্থ তাই খালাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেছে দেখতে। হয়ত বেশিদিন বাঁচবেন না। তাই দেখতে যাওয়া আর কি।

-ওহ!

চিত্রলেখা যত জলদি গিয়েছিল তার চাইতেও বেশি জলদি ফিরে আসে নাস্তার ট্রে নিয়ে। এক কাপ চা রওনকের দিকে এগিয়ে দেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-আপনি এসে ভালোই হলো আপনাকে সামনাসামনি ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম।

-আবার ধন্যবাদ কেনো?

-গতকাল আপনি আপার জন্য যা করেছেন…

-ওহ প্লিজ নট এগেইন।

-তবুও আমার উচিত আপনার ধন্যবাদ আদায় করা।

-কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কেনো তোমরা দল বেঁধে আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছো। আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি সেটার জন্য কেনো আমায় ধন্যবাদ বলতে হবে?

লিখন হয়ত আরও কিছু বলতো। কিন্তু রওনক আর তাকে সেই সুযোগ দেয় না। বাঁধা দিয়ে বলে,

-আমি তোমাদের থেকে ধন্যবাদ নিতে আসিনি। তাই এই ধন্যবাদের টপিকটার এখানেই সমাপ্তি হলে আমার জন্য ইজি হয়।

রওনকের কথার লেজ ধরেই চিত্রলেখা আবার জিজ্ঞেস করে,

-তা বললেন না এই সময়ে কি মনে করে আসা হলো? অফিসের কোনো কাজে?

-বললাম তো তোমায় দেখতে এসেছি। তুমি কেমন আছো জানতে।

-শুধু আপা দেখতেই নাকি…?

এবারে প্রশ্নটা চারু করে ভেতরে আসতে আসতে। এতক্ষণ সে আঙ্গিনায় কাপড় মেলতে ব্যস্ত ছিল। চিত্রলেখা ধমকে দিয়েছিল বলে নয়ত ও এখান থেকে নড়তই না। এক মুহূর্ত চারুর দিকে তাকিয়ে রওনক বলে,

-শুধু দেখতে না একটা জিনিস দিতে এসেছি।

-কি দিতে?

রাজ্যের আগ্রহ চারুর চোখ মুখে। ও সুযোগ পেতেই বড় বোনকে নানারকম ইশারা করছে। শুধুমাত্র এই মুহূর্তে এখানে রওনক উপস্থিত বলে সে চারুকে বিশেষ কিছু বলতে পারছে না৷ তা নাহলে এতক্ষণে কান মলে দিতো। রওনক বলে,

-ভুলে জিনিসটা গাড়িতে ফেলে এসেছি। এক মিনিট ড্রাইভারকে বলছি দিয়ে যেতে।

রওনক ফোন করে বলতেই ড্রাইভার এসে একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে যায়। ব্যাগটা চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-এটা তোমার জন্য।

ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। রওনকের হাতে কোনো সাধারণ শপিং ব্যাগ নয়। স্যামসাং ব্রান্ডের একটা ব্যাগ৷ ভেতরে কি থাকতে পারে তা চিত্রলেখা সহজেই অনুমান করতে পারছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না ঘুরে ফিরে রওনকই কেন! চিত্রলেখাকে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক তাগাদা দিয়ে বলে,

-কি হলো নাও, ধরো।

-এটা কি?

-নিয়ে খোলো তাহলেই তো দেখতে পাবে এটা কি।

-এর আসলে কোনো প্রয়োজন নেই।

-প্রয়োজন আছে কি নেই সেটা না দেখা পর্যন্ত কীভাবে বুঝবে?

-দেখতে হবে না, আমি বলছি তো প্রয়োজন নেই। আপনি প্লিজ নিয়ে যান।

শক্ত চোখ করে চিত্রলেখার চোখে চোখ রাখে রওনক। তা দেখে একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা সন্তপর্ণে। আমতা আমতাও করে। রওনক ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

-নাও, খুলে দেখো।

বাধ্য হয়েই ব্যাগটা রওনকের হাত থেকে নেয় চিত্রলেখা। ব্যাগ খুলতেই আরেক দফা বিষম খায় সে। ব্যাগের ভেতর একটা মোবাইল ফোনের বক্স রয়েছে। স্যামসাং গ্যালাক্সি জেড ফ্লিপ তাও লেটেস্ট মডেল। এই ফোনটার বর্তমান মার্কেট ভ্যালিউ সম্ভবত প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি। এত দামী একটা ফোন দেখে মাথার ভেতর চক্কর মেরে ওঠে চিত্রলেখার। একবার ফোনের দিকে তাকায় আরেকবার লিখনের দিকে। সবশেষে রওনকের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোনের বক্সটা নামিয়ে রাখে তা দেখে রওনক বলে,

-তোমার ফোনটা লিফটে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। আমি রিপেয়ার করতে নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু ওটার আয়ু শেষ তাই আর রিপেয়ার না করিয়ে নতুন একটা নিয়ে এলাম তোমার জন্য।

-সরি, আমি এটা নিতে পারব না।

তৎক্ষনাৎই কিছু বলে না রওনক। দু’দন্ড চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করে,

-বাসায় ডাস্টবিন আছে না?

আচমকা ফোনের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ডাস্টবিনের কথা জিজ্ঞেস করায় ভ্যাবাচেকা খায় চিত্রলেখা।

-ডাস্টবিন!

মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে লিখনের। রওনক আবার জিজ্ঞেস করে,

-নেই? তোমরা ময়লা ফেলো না?

এবার জবাবে চিত্রলেখা বলে,

-আছে তো। কিন্তু ডাস্টবিন দিয়ে কি হবে?

ফোনের বক্সটা তুলে বাড়িয়ে ধরে বলে,

-এটা ফেলে দাও।

-মানে!

চিত্রলেখার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে এমন কথা শুনে। লাখ টাকার ফোন ডাস্টবিনে ফেলে দিতে বলছে লোকটা!

-মানেটা খুবই সিম্পল। তোমার জন্য এনেছি যদি তুমি না নাও তাহলে ডাস্টবিনে ফেলে দাও। কারণ তোমার জন্য আনার জিনিস তো আমি ফেরত নিয়ে যাবো না।

-কিন্তু…

-কিন্তুর কিছু নেই। আমি তোমাকে জোর করছি না, করবোও না। তুমি নিতে না চাইলে ফেলে দাও।

বেচারী চিত্রলেখা পড়ে যায় মহা মুশকিলে। এত দামী ফোন তাও সরাসরি বসের কাছ থেকে গিফট হিসেবে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর না নিলে লোকটা ফেলে দেয়ার কথা বলছে। এই কাজটাও চিত্রলেখা করতে পারবে না। তাই দ্রুত চিন্তা করে কীভাবে এর সমাধান করা যায়। চিন্তা ভাবনা করে বলে,

-আপনি নাহয় আমার সেলারি থেকে ফোনটার দাম কেটে রাখবেন।

চিত্রলেখার কথা শুনে ভীষণ রকম হাসি পায় রওনকের। কিন্তু এমন সিরিয়াস মুহূর্তে সে হাসতে চায় না। হেসে দিয়ে মজাটা নষ্ট করতে চায় না। তাই হাসি চেপে গিয়ে বলে,

-তোমাকে কি আমি লাখ টাকা সেলারি দেই নাকি?

মুখটা মলিন হয়ে যায় চিত্রলেখার রওনকের প্রশ্ন শুনে। ডানে বামে মৃদু মাথা ঝাকায় সে। মুখে বলে,

-প্রতিমাসে নাহয় কিছু কিছু করে কেটে রাখবেন।

-তুমি আমার বস না আমি তোমার বস?

-আপনি…

-তাহলে কি করতে হবে না হবে সেটা নাহয় আমাকেই বুঝতে দাও। তোমার কাজ ফোন ইউজ করা তুমি নাহয় ফোন ইউজ করো। টাকার টেনশনটা নাহয় আমার কাছেই থাক।

বলেই নিজের মানিব্যাগ থেকে চিত্রলেখার সিমকার্ডটা বের করে দেয়। যেটা ভাঙা ফোনটায় লাগানো ছিল। নষ্ট ফোনটা ফেলে দেয়ার আগে সিমকার্ডটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে সে।

বেচারী চিত্রলেখা ফোনের বক্সটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগে। এই ফোন নিয়ে সে অফিসে গেলে পরে কে কি বলে সেই চিন্তায় এখনই অস্থির লাগছে তার। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে একবার লিখনের দিকেও তাকায় চিত্রলেখা। এতক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে দু’জনের কান্ড দেখেছে সে। ওদের তামাশায় কোনো ভূমিকা রাখেনি। ভাগ্যিস এই সময়ে চারুটা এখানে উপস্থিত নেই তা নাহলে লিখন কিছু না বললেও চারু ঠিকই উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে বসতো। এসব মুহূর্তে উল্টাপাল্টা কথা বলার ওস্তাদ চারু।

রওনক চেয়েছিল একটা লেটেস্ট আইফোন কিনতে চিত্রলেখার জন্য। শপিং মল গিয়েও ছিল আইফোন কিনতে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনে হয়েছে চিত্রলেখার হাতে এতদামী ফোন দেখলে অফিসে অনেকেই নানারকম কথা বলতে পারে। এতে অবশ্য রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু রওনক এটা ভালো করেই বুঝে ফেলেছে মানুষের কথায় চিত্রলেখার অনেককিছুই যাবে আসবে। মূলত চিত্রলেখাকে যেন খুব বেশি চিন্তা না করতে হয় সেজন্যই আড়াই লাখ টাকা দামের আইফোন না কিনে একটু কম দাম দিয়ে এই ফোনটা এনেছে। সে বুঝে, এমনিতেই চিত্রলেখার চিন্তার শেষ নেই। নতুন করে আরেকটা চিন্তার বোঝা ওর মাথায় চাপিয়ে দিতে চায় না বলেই এতটুকু সেক্রিফাইজ করেছে সে। নয়ত কারো কথার ধার ধারার সময় রওনকের নেই।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

ঘরের কোনো কাজই চিত্রলেখা চারুকে করতে দেয় না। তবুও রাজ্যের অলসতা ওর। শুক্রবার দিনেও ঠেলে গোসলের জন্য পাঠতে হয়। রওনক যখন চিত্রলেখাকে ফোনটা দিলো ভাগ্যিস আগেই চারুকে গোসলের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। কিন্তু এতে বিশেষ লাভ কিছু হয়নি। গোসল সেরে বেরিয়ে এসেই চারু বড়বোনের কাছে আগে জানতে চেয়েছে তার বস তাকে কি উপহার দিয়েছে। এমন জিনিস চিত্রলেখা চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। মোবাইল ফোন দেখে ইয়া বড় বড় চোখ করে বোনের দিকে তাকিয়েছে চারু। বড় করে মুখ খুলেছে কিছু বলতে কিন্তু তার আগেই চিত্রলেখা হাত বাড়িয়ে চারুর মুখ চেপে ধরে চোখ গরম করে বলেছে,

-একটাও বাড়তি কথা বলবি না তুই।

নিজের মুখ থেকে বোনের হাত সরিয়ে দিয়ে চারু বলে,

-আগে কথাটা তো শুনো।

-একদম না, একটা কথা বললে থা প ড়ে তোর সব কয়টা দাঁত ফে লে দিবো আমি।

-আপা!

-চুপ চারু।

তখনই বাজার হাতে বাড়ি ফিরে চয়ন। ঢুকতেই দুই বোনের কথা শুনে এগিয়ে এসে চিত্রলেখার হাতে গোশতের ব্যাগটা দিয়ে বলে,

-তেমাদের এখনো শেষ হয়নি?

চিত্রলেখা কিছু বলে না কেবল চোখ গরম করে কেমন কেমন চাহনিতে তাকায়। ছোট ভাইকে বুঝাতে চায় উল্টাপাল্টা কিছু না বলতে রওনক এখনো তাদের ঘরেই বসা। কিন্তু চয়নকে কিছু বুঝানোর সুযোগ পায় না চিত্রলেখা তার আগেই মুখ খোলে চারু। বলে,

-তুই জানিস আপার জন্য উনার বস কি নিয়ে এসেছে?

-কি?

-এই দেখ।

বলেই ফোনটা বাড়িয়ে ধরে। ফোনটা দেখে চয়ন নিজেও অবাক হয়েছে। এত দামী ফোন! একবার বড়বোনের মুখের দিকে তাকায় কিন্তু কিছু বলে না। বোন যে নিজেই একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে তা বুঝতে পেরে আপাতত ফোন প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলে বরং চারুকে বলে,

-গিফট আপার তুই ফালাচ্ছিস কেন?

-আহা তুই একবার ভালো করে দেখ তো।

চারুর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বড়বোনের হাতে দিয়ে বলে,

-আমাদের দেখে এত কাজ নাই। আপারটা আপাই দেখুক। তুই যা তো আমার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।

চারুর কথায় কেউ পাত্তা দিলো না দেখে বেচারীর কিঞ্চিৎ মনটা খারাপ হলো। ও বুঝতে পারে আপাতত ওর কথায় কেউ ভাত দিবে না৷ তাই আর কিছু বলার চেষ্টাও করে না। এই সুযোগে চিত্রলেখাও রান্নাঘরে চলে যায় রান্না চাপাতে। বেলা গড়িয়ে আসছে। একটু পরেই আজান দিয়ে দিবে। তারপর ছেলেরা জুম্মা পড়ে আসলেই তো খাবার দিতে হবে।

বাইরে থেকে ঘেমে ভূত হয়ে এসেছে চয়ন। তাই রওনককে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আমি একটু গোসল দিয়ে আসি। এত ঘেমে গেছি যে এই অবস্থায় এখানে বসতে পারব না। আপনি বসেন, আমি আসছি।

আচমকাই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রওনক বলে,

-আমি আর বসবো না। এতক্ষণ তোমার জন্যই ছিলাম। আজকের মতো উঠছি।

-একদম না, আজ আমাদের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর যাবেন। এর আগে কেউ কোথাও যাবে না।

-আজ থাক অন্য একদিন।

-অন্যদিনের টা অন্যদিন দেখা যাবে, আজ আপনি না খেয়ে কোথাও যাচ্ছেন না।

তখনই চয়নের পেছনে এসে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। ওদের কথার শব্দ পেয়েই আবার বেরিয়ে এসেছে সে। এগিয়ে এসে চিত্রলেখা বলে,

-থাক, উনাকে জোর করিস না।

❝আমি তো লাবিব না আমাকে কেন জোর করবা। লাবিবকে ডেকে জামাই আদর করে খাওয়াও।❞ কথাটা মনে মনে বলে রওনক মুখে বলল,

-আসি।

-একদম না।

আবারও বাঁধা দেয় চয়ন। চিত্রলেখাকে বলে,

-তুই কি রে আপা? উচিত তো তোমার উনাকে জোর করে আটকে রাখা তা না করে আমাকে বলছো উনাকে জোর না করতে। এত কথা জানি না উনি আজ আমাদের সাথেই খাবেন।

-কিন্তু উনি তো থাকতে চাইছেন না। উনার হয়ত কোথাও এপয়েনমেন্ট আছে।

-তুমি এখন পর্যন্ত একবারও বলছো উনাকে? জিজ্ঞেস তো করো আগে।

এবার চিত্রলেখা পড়ে যায় মুশকিলে। আসলেই তো জিজ্ঞেস না করেই সে থাকবে না ধরে নেয়াটা অনুচিত হচ্ছে। ইতস্তত করেই চিত্রলেখা বলে,

-ওরা যেহেতু চাইছে আজ দুপুরের খাবারটা নাহয় আমাদের সাথেই খেয়ে যাবেন। আমার হাতের রান্না কোনো ফাইভ স্টার হোটেলের সেফের মতো নয় তবে একদম মন্দও লাগবে না আশা করি।

রওনক কিছু বলে না, পূনরায় বসে পড়ে ফোন লাগায় কাকে যেন। কলটা রিসিভ হতেই সে বলে,

-তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা করো না। আমি আজ বিশেষ এক জায়গায় লাঞ্চ করবো।

লাইনের অন্যপাশ থেকে তানিয়া বলে,

-রওনক মা কিন্তু এখন রাগ করে আছেন। তোমার আজ বাসায় থাকা উচিত।

-আই কান্ট, দিজ ইজ অলসো ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট ফর মি।

-রওনক…

-প্লিজ হ্যান্ডেল হার ফর মি, আই রিকুয়েষ্ট ইউ।

তানিয়া আর কিছু বলতে পারে না। রওনক লাইন কেটে দেয়। চিত্রলেখা আর কিছু না বলে রান্নাঘরে ফিরে যায়। রওনক সত্যি সত্যি থাকতে রাজি হয়ে যাবে সে ভাবেনি।

একে একে লিখন, চয়ন দু’জনেই গোসল দিয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে। তারপর রওনককে নিয়ে ওদের এলাকার বড় মসদিজে গেছে জুম্মা আদায় করতে। অনেক বছর পর রওনক কারো সঙ্গে জুম্মা পড়তে গেল। বাবা বেঁচে থাকতে বড়ভাই সমেত তিনজন একত্রে যেতো কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে রওনক অনেকটা একাই হয়ে গেছে বলা যায়। কখনো কখনো তাদের দুই ভাইয়ের একত্রে যাওয়া হয় তবে সেটা মাসে বা ছয় মাসে এক কি দুইদিন।

ওরা নামাজ পড়তে বেরিয়ে যেতেই শব্দহীন পদক্ষেপে চিত্রলেখার পেছনে এসে দাঁড়ায় চারু। শব্দ না হলেও টের পায় চিত্রলেখা। চারু কিছু বলার আগেই সে জিজ্ঞেস করে,

-কি চাই?

চারু পেছন থেকে বড়বোনকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,

-আমি তোমাকে বলছিলাম না তুমি বিশেষ কেউ।

-মানে?

ছোটবোনের কথার মানে যেন ধরতে পেরেও বুঝতে পারলো না চিত্রলেখা। হয়ত সে ইচ্ছা করেই বুঝতে চায় না।

-আমি তোমাকে বলছিলাম না তুমি বলেই এত আয়োজন। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হইলে তোমার বস মুখ ফিরায়ও দেখত না।

-তুই আবার তোর এইসব আজাইরা প্যাঁচাল নিয়ে আসছিস? যা তো, আমার কাজ শেষ করতে দে। নামাজ পড়ে আসলেই তো ভাত দেয়া লাগবে।

-এখন না হয় কথা ঘুরায় দিলা আপা কিন্তু এইসব বিষয় চাপা থাকে না। দেইখো একদিন ঠিকই তুমি টের পাবা। তখন বুঝবা আমি ভুল বলি নাই।

-চারু! তুই থামবি?

আপাতত এই বিষয়ে আর কথা বাড়ায় না চারু। এখন যে আর একটা কথা বললে এরপর ওর গালে ঠাস করে পড়বে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

-কি রান্না করছো?

-গরুর গোশত আলু দিয়ে, অর্ধেকটা মুরগী ছিল ওটা বুটের ডাল দিয়ে রান্না করছি। উনি সত্যি সত্যি আমাদের সাথে খাবে জানলে আমি মুরগীও আনাইতাম।

-সাথে আর কিছু করো নাই?

-করছি তো, পাতলা ডালও করি, তিন পদের ভর্তা করছি, চিচিঙ্গা দিয়ে ডিম দিয়ে ভাজি করছি। সঙ্গে সাদা ভাত। ও সালাদাও আছে।

-ভাত কেন করলা আপা পোলাও করতা। এত বড় একজন মানুষকে তুমি ভাত দিবা?

-উনি বড় মানুষ আমি তো আর উনার মতো বড় না। আমি গরীব মানুষ, ঘরে যা আছে তাই করছি। পছন্দ হইলে খাবে না হইলে নাই। তাছাড়া পোলাওয়ের চাল যা আছে ওটুকু দিয়ে সবার হবে না। তাই রান্না করিনি।

-সবার তো পোলাও খাওয়ার দরকার নেই।

-তোদের সামনে আমি শুধু উনাকে পোলাও দিবো?

-হ্যাঁ দিবা, উনি মেহমান মানুষ তাও আবার তোমার বস। উনার জন্য বিশেষ রান্না হওয়া উচিত। পোলাওয়ের চালটা দেও আমি ধুয়ে দেই ওরা আসতে সময় আছে তুমি চট করে রান্না করে ফেলো।

চিত্রলেখার মন সঙ্গে দেয় না। খচখচ করে। ভাইবোনগুলোর সামনে শুধু একজনকে পোলাও দিবে আর ওরা তাকিয়ে থাকবে? চিত্রলেখার জন্য পৃথিবীতে সবকিছুর উর্ধ্বে তার ভাইবোনেরা। চারু চট করেই চালটা ধুয়ে এগিয়ে দিতেই চিত্রলেখা মনের খচখচানি নিয়েই পোলাওটা বসায়।

আজ এখানে থাকা হবে জানলে রওনক হয় পাঞ্জাবি পরে আসতো নয় সঙ্গে করে নিয়ে আসতো। কিন্তু সে তো থাকার বা দুপুরে এখানে খাওয়া দাওয়া করার মতো পরিকল্পনা করে আসেনি। সে তো এসেছিল এক পলক সামনে থেকে নিজ চোখে চিত্রলেখাকে দেখে চলে যাবে। তাই আজ ট্রাউজার, টি-শার্ট পরেই নামাজ পড়তে হয়েছে তাকে। জীবন এমনই পরিকল্পনা করে কখনোই কিচ্ছু হয় না। বরং হয় সেটাই যেটা আমরা ব্যাকআপ হিসেবেও ভাবিনা। জীবন চলে পরিকল্পনার বাইরে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-১২+১৩

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক বেরিয়ে যাওয়ার পরেও বারান্দার গ্রীল ধরে বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা। শব্দহীন হেঁটে এসে বোনের পাশেই দাঁড়ায় চারু। বোনের দৃষ্টি লক্ষ করে গেইটের দিকে তাকিয়ে তার কাঁধে হাত রাখতে রাখতেই বলে,

-ঘটনা কি বলো তো আপা?

আচমকা চারুর কন্ঠ পেয়ে ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে চিত্রলেখা। তা দেখে অবাক হওয়া কন্ঠে চারু আবার জিজ্ঞেস করে,

-কি হলো আপা? এমন ভয় পাইলা কেন?

-কিছু না, তুই ভূতের মতো আইসা ঘাড়ের উপর দাঁড়ালে ভয় পাবো না?

-আমি কখন তোমার ঘাড়ে উঠলাম! আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে বলো তো ক্যাসটা কি?

-কিসের ক্যাস?

-এই যে এত বড় একজন মানুষ নিজে এসে তোমাকে বাসায় দিয়ে গেল। আসল ঘটনা কি বলো তো?

চারুর মাথায় একটা গাট্টা মে রে চিত্রলেখা বলে,

-একদম আমার সাথে পাকা পাকা কথা বলবি না চারু।

মাথা ঢলতে ঢলতে চারু বলে,

-মা র লা কেন আপা?

-এখন মাথায় মা র ছি ছোট করে। এরপর পাকনামি করলে মে রে হা ড্ডি গু ড্ডি ভেঙে ফেলবো। যা ঘরে যা। আমি গোসলে যাচ্ছি এক কাপ লাল চা বানায় দে।

চিত্রলেখা ঘরে যাওয়ার জন্য এক কদম বাড়িয়েও থেমে যায়। চারু দু’হাত মেলে পথ আটকে বলে,

-মা র ছো, মা র খাইছি এখন জবাব দিয়ে যাও।

-কিসের জবাব?

-লোকটা তোমায় বাসায় দিতে আসলো কেন?

-আমি অসুস্থ তাই দিতে আসছে। কি সব আজব প্রশ্ন করতেছিস চারু? আর লোকটা কি? উনার একটা নাম আছে। অন্তত স্যার ডাকতে পারিস।

-সে তোমার স্যার আমার না। ডাকাডাকি বাদ দাও, অফিসের অন্য সবাই অসুস্থ হলেও কি উনি এভাবে পার্সোনালি বাসায় দিয়ে আসে?

-আবার মা র খাবি আলতু ফালতু কথা বললে। উনি কোম্পানির মালিক, সিকিউরিটি গার্ড না যে সবাইকে বাসায় পৌঁছে দিবে।

-কাউকে বাসায় পৌঁছে দেয়া সিকিউরিটি গার্ডের কাজ না আপা। কিন্তু তুমি যাই বলো না কেন আমার মনে হয় তোমার বস শুধু তুমি বলেই বাসায় দিয়ে গেল, অন্যকেউ হলে দিয়ে যাইতো না।

-প্লিজ চারু এখন তুই তোর খেয়ালি পোলাও রান্না করতে শুরু করিস না। মূলত আমি উনার সামনে অসুস্থ হইছিলাম। উনি জানতো না আমার ফোবিয়ার কথা। জোর করে লিফটে নিয়ে গেছিল তাই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। এইজন্যই মনে হয় উনার আমার জন্য খারাপ লাগছে, হয়ত গিল্ট ফিল করছেন তাই বাসায় দিয়ে গেল।

-না রে আপা, এটা শুধু গিল্ট ফিল না। তোমার বস যেমনে তোমার দিকে তাকাইলো, তারপর ঔষধ এনে দিলো এতে পরিষ্কার বুঝা যায় উনি…

চিত্রলেখা চারুর মুখ চেপে ধরে বাঁধা দিয়ে বলে,

-চুপ, একদম চুপ। তুই এক্ষণ আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হবি।

দু’বোনের বাকবিতন্ডার মধ্যেই বাসার গেটটা খোলার শব্দ হতেই দু’জনে সেদিকে তাকায়। মামুন দরজা দিয়ে ঢুকছে। তার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। মামুনকে দেখে চারু নিজের মুখের থেকে বড়বোনের হাত সরিয়ে বলে,

-ঐ নেও তোমার মজনু চলে আসছে।

-একদম বাজে বকবি না বলছি।

কড়া করে ধমকে ওঠে চিত্রলেখা চারুকে। ততক্ষণে ওদের কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে মামুন। কাছে এসে এক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলে,

-এখন শরীর কেমন মায়া?

-মামুন ভাই কতদিন না বলেছি আপনাকে আমার নাম মায়া না চিত্রলেখা।

-দুনিয়ার জন্য তুমি যাই হও আমার জন্য তুমি মায়া, আমার মায়া।

চিত্রলেখার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। সে নিজেও বুঝে মামুন নামক মানুষটা তার সবটুকু বিশুদ্ধতা দিয়ে তাকে ভালোবাসে, চায়। এই মানুষটার ভালোবাসা গ্রহণ করতে না পারার অপারগতায় চিত্রলেখার মাথা নুইয়ে আসে।

-আপনার হাতে মিষ্টি কেন মামুন ভাই?

মামুনের হাতে মিষ্টি দেখে জানতে চায় চারু। মুখের হাসি প্রশস্ত করে মামুন বলে,

-মিষ্টি নিয়া আসছি মায়ার জন্য।

-কিন্তু মিষ্টি কোন খুশিতে?

-খুশিতে না তো অসুখে। মায়ার শরীর খারাপ তাই নিয়া আসলাম।

-ওমা এটা কেমন কথা মামুন ভাই? মানুষ অসুস্থ মানুষ দেখতে গেলে ফল নিয়ে যায় আর আপনি আসছেন মিষ্টি নিয়ে!

-যার জন্য আনছি তার পছন্দকেও তো প্রাধান্য দিতে হবে নাকি? আমি জানি তো মায়া ফল তেমন একটা পছন্দ করে না। ফলের মধ্যে ঐ এক আমটাই খায় সে। এটা তো আমের সিজন না। তাই মায়ার পছন্দের রশমালাই নিয়া আসলাম।

-আপনি আপার পছন্দ অপছন্দ সব জানেন তাই না মামুন ভাই?

জিজ্ঞেস করে চারু। হাসি হাসি মুখ করে মামুন বলে,

-যাকে ভালোবাসি তার পছন্দ অপছন্দ না জানলে আর কি ভালোবাসলাম?

মামুনের কথাকে আর প্রশ্রয় না দিয়ে এবারে চিত্রলেখা বলে,

-মামুন ভাই কষ্ট করে আসছেন এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। চারু বানিয়ে দিবেন আপনি ভেতরে এসে বসেন। আমার একটু বিশ্রাম দরকার পরে নাহয় কথা হবে আমাদের।

মিষ্টির প্যাকেটটা সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে মামুন বলে,

-না না আজকে আমি বসবো না। তুমি সুস্থ হও আরেকদিন নাহয় তোমার হাতে চা খাবো। আজকে আমার কাজ আছে।

-আপনার আবার কিসের কাজ? আপনি কোনো কাজ করেন নাকি?

কথাটা বেফাঁস বেরিয়ে যায় চারুর মুখ গলে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার জিহ্বা কাটে সে। চিত্রলেখা চোখ পাকিয়ে তাকায়। মাথা নিচু করে রেখে মামুনের হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা নেয় চারু। হাসি হাসি মুখ করে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে মামুন বলে,

-আজ আসি মায়া।

-আসুন মামুন ভাই।

চিত্রলেখা আর অপেক্ষা করে না। ভেতরের দিকে যেতে যেতে বলে,

-আমার জন্য এক কাপ লাল চা বানিয়ে দে চারু। সঙ্গে একমুঠ চালও ভেজে দিস তো। চাল ভাজা দিয়ে লাল চা খেতে মন চাইছে। আমি গোসলে যাচ্ছি, এরপর ঘুমাবো। ঘুমানোর আগে চা খাবো। জলদি কর হা করে দাঁড়িয়ে থাকিস না।

বড় বোনের বলে যাওয়া কথা কান দিয়ে শুনলেও চারু তাকিয়ে থাকে মামুনের চলে যাওয়ার পথে। কি মায়া মানুষটার মধ্যে! কত মায়া নিয়ে ভালোবাসে সে চিত্রলেখাকে। বোনের প্রতি মামুনের ভালোবাসা দেখলে চারুরও মায়া হয় মানুষটার জন্য। বুকের ভেতর কেমন যেন হু হু করে ওঠে। চিত্রলেখা যদি কোনোদিন মামুনের ভালোবাসা গ্রহণ না করে তাহলে কী হবে মানুষটার? আনমনে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবে চারু৷ অজানা কষ্ট হয় তার মামুনের জন্য। সবার ভালোবাসায়ই কি এত কষ্ট মিশে আছে? পৃথিবীর সব ভালোবাসাই কি যন্ত্রণা দেয়?

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সবেই বৃষ্টিদের বাসায় এসে বসেছে লিখন। এখনো ঠিকঠাক পড়ানোও শুরু করতে পারেনি। এরমধ্যেই চারু ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়েছে। বড়বোনের অসুস্থতার কথা জানিয়েছে। মেসেজটা পেয়েই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় লিখন চিন্তিত মুখে। তা দেখে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে?

-আজকে পড়াইতে পারবো না বৃষ্টি। বাসায় যাইতে হবে এক্ষুনি। খালাম্মাকে বইলো কাল পড়ায় দিবো।

-কিন্তু হঠাৎ কি হইছে সেটা তো বলবেন নাকি?

-আপার নাকি শরীর ভালো না। ওর ফোবিয়া আছে, এট্যাক হইছে। আমাকে এখনই বাসায় যাইতে হবে।

লিখনকে ব্যস্ত হতে দেখে বৃষ্টি ধমকের সুরে বলে,

-চুপচাপ এখানে বসেন।

-আজকে পড়াইতে পারবো না বৃষ্টি।

-পড়াইতে হবে না। এখানে বসে থাকেন। আমি না আসা পর্যন্ত নড়বেন না।

বৃষ্টি তৎক্ষনাৎ ভেতরে গিয়ে একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসে লিখনের সামনে রেখে বলে,

-শান্ত হয়ে পানিটা খান।

-পানি খাওয়ার সময় নাই বৃষ্টি। আপা অসুস্থ।

-জানি আপা অসুস্থ। কিন্তু আপনি যা শুরু করছেন এভাবে বাসায় গেলে আপনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন। তখন আপনাকে কে দেখবে? আপনি চুপচাপ শান্ত হয়ে পানিটা খান আমি আসতেছি।

লিখনকে পানি খেতে দিয়ে আবার ভেতরে চলে যায় বৃষ্টি। মিনিট দু’য়েক পড়ে ঠিকঠাক ভাবে ওড়না মাথায় দিয়ে ফিরে আসে। এসেই লিখনকে জিজ্ঞেস করে,

-এখন ঠিক আছেন আপনি?

থমথমে মুখ করে লিখন বলে,

-এখন বেটার লাগছে।

-তাহলে চলেন।

-কোথায়?

-আপনার বাসায় আর কোথায় যাবেন?

-আমি তো বাসায় যাবো কিন্তু তুমি কই যাবা?

-আমিও আপনার বাসায় যাবো, আপাকে দেখতে। এখন কথা বলে সময় নষ্ট না করে চলেন তো।

-কিন্তু খালাম্মা?

-আম্মুকে বলে আমি অনুমতি নিয়ে নিছি।

লিখন আর কথা বাড়ায় না। বৃষ্টিকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি নামক ছোট মেয়েটা বড়দের মতো শাসন করে তাকে। ঠিক যেন প্রেমিকার মতো। বৃষ্টি মেয়েটার আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা সব কিছু অন্যদের খুব সহজেই মুগ্ধ করতে সক্ষম। যদিও লিখন কোনোদিন বৃষ্টিকে অন্য দৃষ্টিতে দেখেনি। একদম বউ ম্যাটেরিয়াল একটা মেয়ে। যার জীবনে যাবে তার জীবনটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিবে সুখ-শান্তিতে।

বিল্ডিং থেকে বেরিয়েই লিখন রিকশা ডাকে। তা দেখে বৃষ্টি বলে,

-এইটুকু রাস্তা যেতে রিকশা লাগে নাকি? হেটেই তো যেতে পারবো।

-হেঁটে যাইতে হবে না। চলো রিকশায় যাই।

বুকের ভেতর অদৃশ্য শব্দ হয় বৃষ্টির। রিকশায় উঠে বসতেই বুকের ভেতরে হু হু করে বৈতে শুরু করা বাতাস যেন ক্রমশ তুফানে রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রিয় মানুষের গা ঘেষে রিকশায় বসার প্রথম অনুভূতি বৃষ্টিকে সর্গীয় সুখ দেয়। লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসতে চায়। লিখনের মুখের দিকে তাকানোর সাহস হয় না ওর। রাস্তায় থাকা কুকুরের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আচমকা লিখনের কথায়, কর্মে ভাবনায় ছেদ পড়ে বৃষ্টির। লিখন আচমকা বৃষ্টির হাত ধরে বলে,

-সামনের রাস্তা ভালো না, ভাঙা। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বসো নাহলে পড়ে যাবা।

চমকে গিয়ে লিখনের মুখের দিকে তাকায় বৃষ্টি। কিন্তু নিজের চমকে যাওয়াটা এই মুহূর্তে লিখনের কাছে প্রকাশ করে না ও। সবসময় অল্পে সন্তুষ্ট থাকা বৃষ্টি কখনোই ভাবেনি একসাথে এত সুখানুভূতি এসে তার হাতে ধরা দিবে। অতিরিক্ত সুখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তা টের পেয়ে লিখন বলে,

-তোমার হাত এত ঠান্ডা কেন বৃষ্টি? জ্বরটর আসবে নাকি?

মাথা ঝাঁকায় বৃষ্টি। লিখন সামনের দিকে তাকায়। তাই হয়ত লক্ষ করে না বৃষ্টি তার একবুক ভালোবাসা নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছি।

চারু চা আর চাল ভাজা নিয়ে ঘরে এলে চিত্রলেখা বলে,

-শুন চারু লিখনকে কিছু জানাইস না। একবারে বাসায় আসলে বলবোনি। ততক্ষণে ঘুম দিয়ে উঠলে আমি আরও সুস্থ হয়ে যাবো।

চারু এগিয়ে এসে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-নেও, মা রো।

-ঢং করতেছিস কেন? তোরে মা র বো কেন আমি?

-ভাইয়াকে অলরেডি জানায় দিছি।

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত দিয়ে ছোট বোনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আল্লাহ তোরে এত কম ধৈর্য্য কেন দিছে রে? কতদিন বলছি কিছু একটা হইলেই ফট করে সবাইকে বলে দিবি না।

-ওমা আপা! তুমি অসুস্থ এই কথা আমি ভাইয়াকে জানাবো না? পরে ভাইয়া বো ক বে আমাকে কেন জানাই নাই তারে।

-ব ক লে আমি ওরে ব কে দিতাম।

আসামীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে চারু। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চিত্রলেখা আরও বলে,

-এখন বিদায় হ চারু আমি ঘুমাবো।

তবুও যায় না চারু। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তা দেখে চিত্রলেখা আবার বলে,

-দাঁড়ায় আছিস কেন? যাইতে বললাম না তোরে?

এগিয়ে গিয়ে বোনের গা ঘেষে বসে বলে,

-তোমার মাথার চুল নেড়ে দেই আপা?

-যাবি না তাই তো?

মাথা ঝাঁকায় চারু। তা দেখে চিত্রলেখা বলে,

-আচ্ছা চিরুনি নে, চুল আঁচড়ে দে। কিন্তু কোনো কথা বলবি না। এমনি মাথা ভাড় হয়ে আছে। তোর আজাইরা বকবকানি শুনতে মন চাচ্ছে না।

-আচ্ছা কথা বলবো না।

দু’বোনের কথা শেষ হওয়ার আগেই বৃষ্টি সমেত বাসায় এসে উপস্থিত হয় লিখন। এগিয়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-কি হইছে আপা তোর?

-আরে কিছু হয় নাই। আমি ঠিক আছি।

রাগি রাগি চোখ করে চারুর দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তখনই পাশ থেকে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

-এখন তোমার কেমন লাগছে আপা?

হাত বাড়িয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-একদম ঠিক আছি। তুই কষ্ট করে আসতে গেলি কেন রে বৃষ্টি?

-ওমা তুমি অসুস্থ আর আমি তোমাকে দেখতে আসবো না তা হয় নাকি?

চিত্রলেখা বৃষ্টিকে আলতো করে জড়িয়ে রেখে চারুকে বলে,

-যা বৃষ্টির জন্য মিষ্টি নিয়ে আয়।

বৃষ্টি চারুর হাত থেকে চিরুনি নিয়ে বলে,

-আপা আসো আমি তোমার চুল আঁচড়ে দেই।

বৃষ্টি ও নাঈমকে কয়েক বছর ধরে পড়ানোর সুবাদে বৃষ্টির এই বাড়িতেও আসা যাওয়া আছে। একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে ওদের মধ্যে।

—————————————————————————–

রওনক নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে তানিয়া। কাছাকাছি এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করে,

-ব্যস্ত নাকি?

ল্যাপটপটা বন্ধ করে রওনক বলে,

-সামান্য। কিছু বলবে নাকি?

-আজ সারাদিন অফিসে ছিলে না। কোথায় গিয়েছিলে?

-একটু কাজ ছিল বাইরে।

-সেটা জানি তোমার একটা মিটিং ছিল। মিটিংয়ের পরে তো আর অফিসে ফিরলে না।

-কোনো জরুরী দরকার ছিল নাকি?

-কিছু ডকুমেন্ট দেখানোর ছিল। মেইল করে দিয়েছি চেক করে নিও।

-ঠিক আছে দেখে নিবো।

তানিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে মুখ তুলে তার দিকে তাকায় রওনক। বলে,

-আর কিছু বলবা?

-সারাদিন কই ছিলা তুমি?

-একটু কাজ ছিল বাইরে বললামই তো।

-কি কাজ?

-পার্সোনাল কাজ।

-এত বছরে প্রথম শুনছি রওনক জামান অফিস আওয়ারে পার্সোনাল কাজে বাইরে গেছে। কি এমন পার্সোনাল কাজ জিজ্ঞেস করতে পারি কি?

-আপাতত থাক ভাবী। বলার হলে পরে কোনো এক সময় বলবো নাহয়।

-আচ্ছা ঠিক আছে। অপেক্ষায় থাকলাম।

এগিয়ে এসে রওনকের মুখোমুখি বসে তানিয়া। রওনক বুঝতে পারে তানিয়া হয়ত আরও কিছু বলতে চায়। তা আন্দাজ করে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-মনে হচ্ছে আরও কিছু বলতে চাও।

মাথা ঝাঁকায় তানিয়া। তা দেখে রওনক বলে,

-আজ কি কথার ঝুলি নিয়ে এসেছো নাকি? বলো আর কি বলবা।

-আম্মার সাথে কথা বলছো?

-কোন বিষয়ে?

-তোমার আর সাবার বিষয়ে।

-সাবার সাথে আমার আবার কিসের বিষয়?

-বুঝেও কেনো না বুঝার ভান করতেছো রওনক? আমি তোমাদের বিয়ের কথা বলতেছি।

-যা বলার সেটা তো আমি সবার সামনেই বলছি ভাবী। এরপরে কি আর কোনো কথা থাকতে পারে?

-কিন্তু রওনক আমারও মনে হয় তোমার এবার বিয়েটা করে নেয়া উচিত।

-আবার বিয়ে!

-শুনো রওনক, মানুষের জীবনে একবারই বিয়ে হয় এটা একটা লেইম লজিক। প্রয়োজন হলে মানুষ দু’বার বিয়ে করবে এতে তো দোষের কিছু নেই।

-আমিও দোষের কথা বলছি না ভাবী। কিন্তু আমার তো প্রয়োজন নেই।

-একটা মানুষ সারাজীবন একা থাকতে পারে না রওনক।

-আপাতত আমার সমস্যা হচ্ছে না ভাবী। যদি পরে মনে হয় বিয়ে করা প্রয়োজন তাহলে করে নিবো। এখন তো প্রয়োজন দেখছি না।

-তোমার এখন প্রয়োজন না মনে হলেও আমাদের মনে হয় এটাই উপযুক্ত সময় রওনক।

-ভাবী প্লিজ! আই রিকুয়েষ্ট টু ইউ, এখন তুমিও মায়ের মতো শুরু হয়ে যেও না। বিয়ের বিষয়টা কয়দিনের জন্য সাইডে রাখো প্লিজ।

-অনেক তো সাইডে রাখলাম আর কত?

-আরও কয়টা দিন প্লিজ।

-মনে হয় না এবার তুমি আর বিয়ে এড়িয়ে যেতে পারবে।

-কেন?

-আম্মার সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার আর?

-না তো।

-উনি কিন্তু খাওয়া দাওয়া করছেন না ঠিক মতো।

-ভাবী তুমি একটু মাকে বুঝাও। বলো এসব বাচ্চামো ছেড়ে দিতে। আমি বাচ্চা না যে আমাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিবে। বিয়ে করতে বলবে আর আমি লাফিয়ে বিয়ে করতে চলে যাবো। বিয়েটাই জীবন নয়।

-আমি একটা এডভাইস দেই রওনক?

-বলো শুনছি।

-তুমি যদি একান্তই সাবাকে বিয়ে করতে না চাও তাহলে নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করতে পারো। যদি তোমার নজরে এমন কেউ থাকে তাহলে তাকেই নাহয় বিয়েটা করে ফেলো। কিন্তু এবার তোমাকে বিয়ে করতেই হবে। সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে তোমার বিয়ে। আম্মা চায় তুমি বিয়ে করো। বিয়েটাই জীবন নয় তবে বিয়ে জীবনের অনেক বড় একটা ফ্যাক্ট। যা চাইলেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

-কিন্তু মা চায় আমি সাবাকে বিয়ে করি।

-তুমি যার সাথে ভালো থাকবে আম্মা তাকেই মেনে নিবে দেখে নিও। আম্মার জন্য তুমি সবচাইতে বেশি জরুরী, সাবা না।

উঠে দাঁড়িয়ে দু’কদম এগিয়ে এসে তানিয়া রওনকের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো। এই সমস্যার এবার একটা সমাধান হওয়া প্রয়োজন রওনক।

রওনককে তার ভাবনার হাতে ফেলে সন্তপর্ণে বেরিয়ে যায় তানিয়া। ভাবী বেরিয়ে যেতেই উঠে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট জ্বালায় সে। সিগারেটটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে ট্রাউজারের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে আজ সকালে চিত্রলেখার তোলা একটা ছবি বের করে। হাসপাতালের বেডে চিত্রলেখা যখন বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে ছিল তখন এই ছবিটা তুলেছিল রওনক। কেন তুলেছে তা সে নিজেও জানে না। চিত্রলেখার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে সিগারেটে লম্বা করে আরেকটা টান দিয়ে তানিয়ার বলে যাওয়া কথা ভাবতে লাগে। তার নিজের পছন্দের কেউ কি আছে? আবার কি সে কাউকে পছন্দ করতে পারবে? ভালোবাসতে পারবে? ভালোবাসা কি বসন্তের মতো নাকি? বছর ঘুরে যেমন বসন্ত আসে তেমনি কি মানুষের জীবন থেকে ভালোবাসা হারিয়ে গেলে আবারও নতুন করে ভালোবাসা আসে?

চলবে…

error: ©<b>গল্পপোকা ডট কম</b>