Wednesday, July 16, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 256



মাতাল হাওয়া পর্ব-১৪+১৫

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক চিত্রলেখার বাসার নীল রঙের লোহার গেইটটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে যাবে কিনা বুঝতে পারছে না। তার এভাবে চলে আসাটা হয়ত উচিত হয়নি। কেনো যে আসতে গেল সে! এভাবে জোকের বশে কাজ তেমন একটা করে না রওনক। কিন্তু আজ কি হলো কে জানে? সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো একবার চিত্রলেখাকে দেখতে পারলে ভালো হয়ত। এখন কেমন আছে কে জানে? শরীরটা আগের চাইতে ভালো না আবার বিগড়ে গেল! শরীর খারাপ করলে যে এই মেয়ে কাউকে বলবে না তা রওনকের বুঝা হয়ে গেছে। এমনকি নিজে থেকে ডাক্তারও দেখাবে না। পুরোপুরি সুস্থ আছে কিনা দেখার তাগাদা অনুভব করে এই পর্যন্ত ছুটে আসা রওনকের। কিন্তু গেইট পর্যন্ত এসে এখন ভেতরে যেতে ইতস্তত লাগছে। মনে হচ্ছে তার এভাবে চলে আসাটা বোকামি হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রওনক। যেই গাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য পেছন ঘুরতে নেয় তখনই চিত্রলেখার বাড়ির নীল লোহার গেইটটা খট করে খোলার শব্দ হয়। রওনক আর গাড়িতে গিয়ে বসতে পারে না। তার আগেই গেইটটা খুলে বেরিয়ে আসে একটা ছেলে। ছেলেটার সাথে রওনকের পরিচয় না থাকলেও চিনতে পারছে সে এটা চিত্রলেখারই ভাই হবে। চেহারায় মিল পাওয়া যাচ্ছে। গেইট খুলে বেরিয়ে রওনককে দেখে একবার তার পেছনে থাকা গাড়িটার দিকে তাকায় চয়ন। এত দামী গাড়ি চড়ে আসার মতো আত্মীয়-স্বজন ওদের নেই। গতকাল রাতে বাড়ি ফিরে চারুর মুখে শুনেছে বড় বোনকে তার অফিসের বস ইয়া মস্তবড় গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে গেছে। যদিও তার নিজের চোখে দেখা হয়নি। তবে এই মুহূর্তে গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে চয়নের মনে হচ্ছে উনি হয়ত চিত্রলেখার বসই হবেন। লোকটার পরনের কাপড়চোপড় দেখেও বুঝা যাচ্ছে বেশ দামী। একবার লোকটার পায়ের দিকে তাকায় চয়ন। এডিডাস ব্রান্ডের একজোড়া বেশ দামী স্নিকার্স পরিধানে। এডিডাস লেখা নকল টি-শার্ট ফুটপাতে বা ভ্যানে পাওয়া যায় দেড়শ বা দুইশ টাকায়। সেরকম বেশ কয়টা টি-শার্ট চয়নের আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার সমানে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক যে কোনো লোকাল বা নকল জিনিস পরেননি তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না ওর। রওনক কিছু বলে না, চুপচাপ তাকিয়ে রশ কেবল। চয়ন নিজেই বলে,

-আপনি কি আপার কাছে এসেছেন?

কেমন কেমন করে যেন তাকায় রওনক। তা দেখে চয়ন নিজের কথা সংশোধন করে বলে,

-আই মিন কাউকে খুঁজছেন?

-চিত্রলেখাকে দেখতে এসেছি।

-আপনার পরিচয়?

হাত বাড়িয়ে দিয়ে রওনক বলে,

-আমি রওনক, রওনক জামান। চিত্রলেখার বস।

-ভেতরে আসুন প্লিজ।

চয়ন মনে মনে যা ভেবেছিল ঠিক তাই হলো। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-এখন চিত্রলেখার শরীর কেমন?

-এসেছেন যেহেতু আপনি নিজের চোখেই দেখে নিন নাহয়।

চয়নের কথাটা কেমন রহস্য রহস্য লাগে রওনকের। কিন্তু সে কথা বাড়ায় না। ততক্ষণে ওরা উঠান পেরিয়ে বারান্দার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এতটুকু এসেই থমকে দাঁড়ায় রওনক চিত্রলেখাকে দেখে। চয়ন একপাশে সরে দাঁড়িয়েছে। চিত্রলেখা এখনো রওনককে খেয়াল করেনি। খেয়াল করবে কীভাবে! সে তো ব্যস্ত নিজের কাজে। হাতে তার এক বালতি কাপড়। দেখে বুঝা যাচ্ছে বালতি ভরা কাপড়গুলো সে মাত্রই ধুয়ে বেরিয়েছে। কপালময় ঘামের ছড়াছড়ি। ওড়নাটা ঘুরিয়ে এনে কোমড়ের কাছে বাঁধা। কামিজের সামনের অংশ অনেকটা পানিতে ভিজে গেছে। আটপৌরে বাঙালি মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বড়মেয়েদের জীবন কেমন হয় এই মুহূর্তে চিত্রলেখাকে দেখলে তার সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যাবে। কিন্তু রওনকের চোখ-মুখ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে মুগ্ধতা। দেখা না করে ফিরে গেলে এমন মনোমুগ্ধকর একটা দৃশ্য তার এই জীবনে দেখা হতো না। ফিরে গেল আজীবনকার আফসোস রয়ে যেত তার। ভেজা কাপড়ের বলতি হাতে বারান্দা পেরিয়ে বাইরে আসার জন্য পা বাড়াতেই মুখ তুলে রওনককে দেখে থমকে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। একবার নিজেকে দেখে নিয়ে আবার রওনকের দিকে তাকায় সে। দৌড়ে ভেতরে চলে যাবে না সামনে এগিয়ে গিয়ে কুশলাদি বিনিময় করবে চিন্তা করে পায় না। পালিয়ে গেলে বিষয়টা লজ্জাকর হয়ে দাঁড়াবে। তবে এই মুহূর্তে কোনোভাবেই নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় এই মানুষটাকে কল্পনায়ও আশা করেনি চিত্রলেখা। কিন্তু তার ভাবনা, কল্পনাকে মিথ্যা করে দিয়ে সত্যি সত্যি মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বালতিটা হাত থেকে নামিয়ে এক কদম এগিয়ে এসে অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে সরাসরি রওনকের চোখের দিকে তাকিয়ে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-আপনি এখানে?

-তোমায় দেখতে এলাম। এখন কেমন আছো তুমি?

-ভালো আছি।

❝আসলেই যে ভালো আছো তা তো তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি মেয়ে। কে বলবে গতকাল এই তুমিই বেহুঁশ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলে। না জানলে কেউ বলতেই পারবে না।❞ কথাগুলো মনে মনে ভাবে রওনক। মুখে আর কিছু বলে না কেবল মুচকি হাসে, হাসার চেষ্টা করে। এমনিতেই চিত্রলেখাকে দেখে তার চোখ হাসছে। সেই হাসি অনেক কষ্টে সংযত করে রেখেছে সে। রওনক চায় না চিত্রলেখা টের পেয়ে যাক তার অজানা এই হাসি খুশির কারণ।

আজ শুক্রবার তাই সবাই বাসায়। এবারে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে চারু। রওনককে দেখে চোখ জোড়া ড্যাবড্যাব করে এগিয়ে এসে বড়বোনকে ঠ্যালা ধাক্কা দিয়ে বলে,

-দেখছো আপা আমি বলছিলাম না তোমাকে?

চারুর কথা শুনে চোখ গরম করে ওর দিকে তাকিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-দিবো একটা কানের নিচে।

-ওমা! আমি তো…

-একদম চুপ।

ধমকে দিয়ে কাপড়ের বালতিটা চারুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আরও বলে,

-কাপড়গুলো মেলে দে।

-মেহমান আসছে আপা। উনার চাইতে কি কাপড় বেশি হয়ে গেল?

-চারু!

বড়বোনের গরম চোখ দেখে চারু আর কিছু বলার সাহস পায় না। পাশ থেকে চয়ন বলে,

-তোমরা আবার শুরু হয়ে গেলা? গেস্ট আসছে এতটুকু তো খেয়াল করো।

-হয়েছে তোকে আর পাকনামো করতে হবে না। যেই কাজে যাচ্ছিলি সেটা কর গিয়ে।

চয়নকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রলেখা রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আপনি ভেতরে আসুন প্লিজ।

চয়ন বেরিয়ে যাওয়ার আগে রওনককে বলে,

-আপনি কিন্তু যাবেন না। আমি ছোট্ট একটা কাজে যাচ্ছি জলদিই ফিরে আসবো। আজ আমাদের সাথে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবেন প্লিজ।

চয়নের আবদার শুনে শুধু রওনক নয়, চিত্রলেখাও খানিকটা অবাক হয়। অবাক হয়ে বলে,

-কি যা তা বলছিস উনি কি আমাদের মতো গরীবের বাসায় খাবেন নাকি?

-বারে আপা উনি খাক বা না খাক তুমি না খাইয়ে ছাড়বে কেন? একদম ছাড়বে না উনাকে বলে যাচ্ছি। এসে যেনো পাই।

চয়ন আর অপেক্ষা করে না যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ ধরেই বেরিয়ে যায়। মূলত এক কেজি গরুর গোশত কিনতে যাচ্ছে সে। চিত্রলেখা এখনো বেতন পায়নি। গতকাল লিখন টিউশনির টাকা পেয়েছে। সেখান থেকেই এক হাজার টাকা বড়বোনকে দিয়ে বলেছে এক কেজি গরুর গোশত আনিয়ে রান্না করতে। গতমাসে একদিনও গরুর গোশত খাওয়া হয়নি। তার আগের মাসে অবশ্য দু’দিন খাওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত মাসে কিছু সাংসারিক টানাটানি থাকায় গরুর গোশত খাওয়ার মতো বিলাসিতা করা হয়নি। চিত্রলেখা হিসাব করে দেখেছে এই মাসে বেতন পাওয়ার পর তার নিজের হাত খরচের জন্য যতটুকু লাগে সেটাও সম্পূর্ণ থাকবে না। প্রথমে গরুর গোশত আনতে তার মন সায় দেয়নি। কিন্তু গোশতের কথা শুনতেই চারু, চয়নের চোখ জোড়াও ঝলমল করে উঠেছিল তা দেখে আর আপত্তি করতে পারেনি সে। নাহয় এই মাসে ১০ দিন পায়ে হেটেই অফিস যাবে তাও ভাইবোনগুলো মাত্র একটা দিন গোশত খাওয়ার শখ করেছে এতটুকু আবদার সে অপূর্ণ রাখতে পারবে না।

রওনক মনে মনে বলে, ❝আমার জায়গায় লাবিব হলে নিশ্চয়ই হাত ধরে টেনে দুপুরের খাবার খাইয়ে ছাড়তে। আমি খেলে তো তোমার জাত চলে যাবে।❞

ভাইবোন দুটোকে বিদায় করে দিয়ে চিত্রলেখা রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,

-আপনি ভেতরে আসুন প্লিজ।

রওনক আর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চিত্রলেখার পেছন পেছন ভেতরে এসে বসে। বন্ধের দিনে একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠে লিখন। আজও দেরি হয়েছে তার। এখন বাজে বেলা সাড়ে এগারোটা। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতেই লিখন বলে,

-এক কাপ চা দাও আপা।

বেরিয়ে এসে ড্রইং রুমে বসা ভদ্রলোককে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকায় লিখন। তা দেখে চিত্রলেখা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,

-আমার বস গতকাল যার কথা বললাম।

এগিয়ে এসে রওনকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে লিখন বলে,

-আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, গতকাল আপার পাশে থাকার জন্য।

লিখনকে কথা শেষ করতে না দিয়ে রওনক নিজেও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলে,

-ইটস ওকে, শি ইজ মাই রেসপন্সিবিলিটি। ইট ওয়াজ মাই ডিউটি টু টেক কেয়ার অব হার।

রওনকের কথা শুনে মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকায় চিত্রলেখা। এই জীবনে কেউ কোনোদিন বলেনি সে তার দায়িত্ব। চিত্রলেখা তো নিজের কাঁধেই ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব বয়ে বেড়াচ্ছে। কেউ তো কখনো এভাবে তাকে বলেনি। অবশ্য মামুন চায় তার দায়িত্ব নিতে, সদা প্রস্তুতও কিন্তু সেই সম্মতি দিতে পারে না। আগবাড়িতে মামুনের পেতে রাখা হাত ধরতে পারে না আজীবনের জন্য। এতে বড় দিধা তার।

চিত্রলেখা বলে,

-তুই বোস এখানে উনাকে সঙ্গ দে, আমি তোদের জন্য চা নিয়ে আসছি।

রওনক বসতে বসতে বলে,

-আমার জন্য ব্যস্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

মুচকি হেসে চিত্রলেখা বলে,

-আমি এক্ষুনি আসছি।

সে চলে যেতেই লিখন বলে,

-আমাদের বাসায় চা সবসময়ই বানানো থাকে। আমরা সবাই আপার হাতে বানানো চা অনেক পছন্দ করি।

মুখে কেবল হাসে রওনক মুখে কিছু বলে না। সে নিজেও চিত্রলেখার চায়ের ভক্ত হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। একবার আশপাশ দেখে নিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-তোমার খালা খালুকে দেখছি না যে? উনারা বাসায় নেই?

-খালুর এক আত্মীয় অসুস্থ তাই খালাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেছে দেখতে। হয়ত বেশিদিন বাঁচবেন না। তাই দেখতে যাওয়া আর কি।

-ওহ!

চিত্রলেখা যত জলদি গিয়েছিল তার চাইতেও বেশি জলদি ফিরে আসে নাস্তার ট্রে নিয়ে। এক কাপ চা রওনকের দিকে এগিয়ে দেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে লিখন জিজ্ঞেস করে,

-আপনি এসে ভালোই হলো আপনাকে সামনাসামনি ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম।

-আবার ধন্যবাদ কেনো?

-গতকাল আপনি আপার জন্য যা করেছেন…

-ওহ প্লিজ নট এগেইন।

-তবুও আমার উচিত আপনার ধন্যবাদ আদায় করা।

-কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কেনো তোমরা দল বেঁধে আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছো। আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি সেটার জন্য কেনো আমায় ধন্যবাদ বলতে হবে?

লিখন হয়ত আরও কিছু বলতো। কিন্তু রওনক আর তাকে সেই সুযোগ দেয় না। বাঁধা দিয়ে বলে,

-আমি তোমাদের থেকে ধন্যবাদ নিতে আসিনি। তাই এই ধন্যবাদের টপিকটার এখানেই সমাপ্তি হলে আমার জন্য ইজি হয়।

রওনকের কথার লেজ ধরেই চিত্রলেখা আবার জিজ্ঞেস করে,

-তা বললেন না এই সময়ে কি মনে করে আসা হলো? অফিসের কোনো কাজে?

-বললাম তো তোমায় দেখতে এসেছি। তুমি কেমন আছো জানতে।

-শুধু আপা দেখতেই নাকি…?

এবারে প্রশ্নটা চারু করে ভেতরে আসতে আসতে। এতক্ষণ সে আঙ্গিনায় কাপড় মেলতে ব্যস্ত ছিল। চিত্রলেখা ধমকে দিয়েছিল বলে নয়ত ও এখান থেকে নড়তই না। এক মুহূর্ত চারুর দিকে তাকিয়ে রওনক বলে,

-শুধু দেখতে না একটা জিনিস দিতে এসেছি।

-কি দিতে?

রাজ্যের আগ্রহ চারুর চোখ মুখে। ও সুযোগ পেতেই বড় বোনকে নানারকম ইশারা করছে। শুধুমাত্র এই মুহূর্তে এখানে রওনক উপস্থিত বলে সে চারুকে বিশেষ কিছু বলতে পারছে না৷ তা নাহলে এতক্ষণে কান মলে দিতো। রওনক বলে,

-ভুলে জিনিসটা গাড়িতে ফেলে এসেছি। এক মিনিট ড্রাইভারকে বলছি দিয়ে যেতে।

রওনক ফোন করে বলতেই ড্রাইভার এসে একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে যায়। ব্যাগটা চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-এটা তোমার জন্য।

ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। রওনকের হাতে কোনো সাধারণ শপিং ব্যাগ নয়। স্যামসাং ব্রান্ডের একটা ব্যাগ৷ ভেতরে কি থাকতে পারে তা চিত্রলেখা সহজেই অনুমান করতে পারছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না ঘুরে ফিরে রওনকই কেন! চিত্রলেখাকে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনক তাগাদা দিয়ে বলে,

-কি হলো নাও, ধরো।

-এটা কি?

-নিয়ে খোলো তাহলেই তো দেখতে পাবে এটা কি।

-এর আসলে কোনো প্রয়োজন নেই।

-প্রয়োজন আছে কি নেই সেটা না দেখা পর্যন্ত কীভাবে বুঝবে?

-দেখতে হবে না, আমি বলছি তো প্রয়োজন নেই। আপনি প্লিজ নিয়ে যান।

শক্ত চোখ করে চিত্রলেখার চোখে চোখ রাখে রওনক। তা দেখে একবার ঢোক গিলে চিত্রলেখা সন্তপর্ণে। আমতা আমতাও করে। রওনক ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

-নাও, খুলে দেখো।

বাধ্য হয়েই ব্যাগটা রওনকের হাত থেকে নেয় চিত্রলেখা। ব্যাগ খুলতেই আরেক দফা বিষম খায় সে। ব্যাগের ভেতর একটা মোবাইল ফোনের বক্স রয়েছে। স্যামসাং গ্যালাক্সি জেড ফ্লিপ তাও লেটেস্ট মডেল। এই ফোনটার বর্তমান মার্কেট ভ্যালিউ সম্ভবত প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি। এত দামী একটা ফোন দেখে মাথার ভেতর চক্কর মেরে ওঠে চিত্রলেখার। একবার ফোনের দিকে তাকায় আরেকবার লিখনের দিকে। সবশেষে রওনকের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোনের বক্সটা নামিয়ে রাখে তা দেখে রওনক বলে,

-তোমার ফোনটা লিফটে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। আমি রিপেয়ার করতে নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু ওটার আয়ু শেষ তাই আর রিপেয়ার না করিয়ে নতুন একটা নিয়ে এলাম তোমার জন্য।

-সরি, আমি এটা নিতে পারব না।

তৎক্ষনাৎই কিছু বলে না রওনক। দু’দন্ড চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করে,

-বাসায় ডাস্টবিন আছে না?

আচমকা ফোনের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ডাস্টবিনের কথা জিজ্ঞেস করায় ভ্যাবাচেকা খায় চিত্রলেখা।

-ডাস্টবিন!

মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে লিখনের। রওনক আবার জিজ্ঞেস করে,

-নেই? তোমরা ময়লা ফেলো না?

এবার জবাবে চিত্রলেখা বলে,

-আছে তো। কিন্তু ডাস্টবিন দিয়ে কি হবে?

ফোনের বক্সটা তুলে বাড়িয়ে ধরে বলে,

-এটা ফেলে দাও।

-মানে!

চিত্রলেখার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে এমন কথা শুনে। লাখ টাকার ফোন ডাস্টবিনে ফেলে দিতে বলছে লোকটা!

-মানেটা খুবই সিম্পল। তোমার জন্য এনেছি যদি তুমি না নাও তাহলে ডাস্টবিনে ফেলে দাও। কারণ তোমার জন্য আনার জিনিস তো আমি ফেরত নিয়ে যাবো না।

-কিন্তু…

-কিন্তুর কিছু নেই। আমি তোমাকে জোর করছি না, করবোও না। তুমি নিতে না চাইলে ফেলে দাও।

বেচারী চিত্রলেখা পড়ে যায় মহা মুশকিলে। এত দামী ফোন তাও সরাসরি বসের কাছ থেকে গিফট হিসেবে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর না নিলে লোকটা ফেলে দেয়ার কথা বলছে। এই কাজটাও চিত্রলেখা করতে পারবে না। তাই দ্রুত চিন্তা করে কীভাবে এর সমাধান করা যায়। চিন্তা ভাবনা করে বলে,

-আপনি নাহয় আমার সেলারি থেকে ফোনটার দাম কেটে রাখবেন।

চিত্রলেখার কথা শুনে ভীষণ রকম হাসি পায় রওনকের। কিন্তু এমন সিরিয়াস মুহূর্তে সে হাসতে চায় না। হেসে দিয়ে মজাটা নষ্ট করতে চায় না। তাই হাসি চেপে গিয়ে বলে,

-তোমাকে কি আমি লাখ টাকা সেলারি দেই নাকি?

মুখটা মলিন হয়ে যায় চিত্রলেখার রওনকের প্রশ্ন শুনে। ডানে বামে মৃদু মাথা ঝাকায় সে। মুখে বলে,

-প্রতিমাসে নাহয় কিছু কিছু করে কেটে রাখবেন।

-তুমি আমার বস না আমি তোমার বস?

-আপনি…

-তাহলে কি করতে হবে না হবে সেটা নাহয় আমাকেই বুঝতে দাও। তোমার কাজ ফোন ইউজ করা তুমি নাহয় ফোন ইউজ করো। টাকার টেনশনটা নাহয় আমার কাছেই থাক।

বলেই নিজের মানিব্যাগ থেকে চিত্রলেখার সিমকার্ডটা বের করে দেয়। যেটা ভাঙা ফোনটায় লাগানো ছিল। নষ্ট ফোনটা ফেলে দেয়ার আগে সিমকার্ডটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে সে।

বেচারী চিত্রলেখা ফোনের বক্সটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগে। এই ফোন নিয়ে সে অফিসে গেলে পরে কে কি বলে সেই চিন্তায় এখনই অস্থির লাগছে তার। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে একবার লিখনের দিকেও তাকায় চিত্রলেখা। এতক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে দু’জনের কান্ড দেখেছে সে। ওদের তামাশায় কোনো ভূমিকা রাখেনি। ভাগ্যিস এই সময়ে চারুটা এখানে উপস্থিত নেই তা নাহলে লিখন কিছু না বললেও চারু ঠিকই উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে বসতো। এসব মুহূর্তে উল্টাপাল্টা কথা বলার ওস্তাদ চারু।

রওনক চেয়েছিল একটা লেটেস্ট আইফোন কিনতে চিত্রলেখার জন্য। শপিং মল গিয়েও ছিল আইফোন কিনতে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মনে হয়েছে চিত্রলেখার হাতে এতদামী ফোন দেখলে অফিসে অনেকেই নানারকম কথা বলতে পারে। এতে অবশ্য রওনকের কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু রওনক এটা ভালো করেই বুঝে ফেলেছে মানুষের কথায় চিত্রলেখার অনেককিছুই যাবে আসবে। মূলত চিত্রলেখাকে যেন খুব বেশি চিন্তা না করতে হয় সেজন্যই আড়াই লাখ টাকা দামের আইফোন না কিনে একটু কম দাম দিয়ে এই ফোনটা এনেছে। সে বুঝে, এমনিতেই চিত্রলেখার চিন্তার শেষ নেই। নতুন করে আরেকটা চিন্তার বোঝা ওর মাথায় চাপিয়ে দিতে চায় না বলেই এতটুকু সেক্রিফাইজ করেছে সে। নয়ত কারো কথার ধার ধারার সময় রওনকের নেই।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

ঘরের কোনো কাজই চিত্রলেখা চারুকে করতে দেয় না। তবুও রাজ্যের অলসতা ওর। শুক্রবার দিনেও ঠেলে গোসলের জন্য পাঠতে হয়। রওনক যখন চিত্রলেখাকে ফোনটা দিলো ভাগ্যিস আগেই চারুকে গোসলের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। কিন্তু এতে বিশেষ লাভ কিছু হয়নি। গোসল সেরে বেরিয়ে এসেই চারু বড়বোনের কাছে আগে জানতে চেয়েছে তার বস তাকে কি উপহার দিয়েছে। এমন জিনিস চিত্রলেখা চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। মোবাইল ফোন দেখে ইয়া বড় বড় চোখ করে বোনের দিকে তাকিয়েছে চারু। বড় করে মুখ খুলেছে কিছু বলতে কিন্তু তার আগেই চিত্রলেখা হাত বাড়িয়ে চারুর মুখ চেপে ধরে চোখ গরম করে বলেছে,

-একটাও বাড়তি কথা বলবি না তুই।

নিজের মুখ থেকে বোনের হাত সরিয়ে দিয়ে চারু বলে,

-আগে কথাটা তো শুনো।

-একদম না, একটা কথা বললে থা প ড়ে তোর সব কয়টা দাঁত ফে লে দিবো আমি।

-আপা!

-চুপ চারু।

তখনই বাজার হাতে বাড়ি ফিরে চয়ন। ঢুকতেই দুই বোনের কথা শুনে এগিয়ে এসে চিত্রলেখার হাতে গোশতের ব্যাগটা দিয়ে বলে,

-তেমাদের এখনো শেষ হয়নি?

চিত্রলেখা কিছু বলে না কেবল চোখ গরম করে কেমন কেমন চাহনিতে তাকায়। ছোট ভাইকে বুঝাতে চায় উল্টাপাল্টা কিছু না বলতে রওনক এখনো তাদের ঘরেই বসা। কিন্তু চয়নকে কিছু বুঝানোর সুযোগ পায় না চিত্রলেখা তার আগেই মুখ খোলে চারু। বলে,

-তুই জানিস আপার জন্য উনার বস কি নিয়ে এসেছে?

-কি?

-এই দেখ।

বলেই ফোনটা বাড়িয়ে ধরে। ফোনটা দেখে চয়ন নিজেও অবাক হয়েছে। এত দামী ফোন! একবার বড়বোনের মুখের দিকে তাকায় কিন্তু কিছু বলে না। বোন যে নিজেই একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে তা বুঝতে পেরে আপাতত ফোন প্রসঙ্গে কোনো কথা না বলে বরং চারুকে বলে,

-গিফট আপার তুই ফালাচ্ছিস কেন?

-আহা তুই একবার ভালো করে দেখ তো।

চারুর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বড়বোনের হাতে দিয়ে বলে,

-আমাদের দেখে এত কাজ নাই। আপারটা আপাই দেখুক। তুই যা তো আমার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।

চারুর কথায় কেউ পাত্তা দিলো না দেখে বেচারীর কিঞ্চিৎ মনটা খারাপ হলো। ও বুঝতে পারে আপাতত ওর কথায় কেউ ভাত দিবে না৷ তাই আর কিছু বলার চেষ্টাও করে না। এই সুযোগে চিত্রলেখাও রান্নাঘরে চলে যায় রান্না চাপাতে। বেলা গড়িয়ে আসছে। একটু পরেই আজান দিয়ে দিবে। তারপর ছেলেরা জুম্মা পড়ে আসলেই তো খাবার দিতে হবে।

বাইরে থেকে ঘেমে ভূত হয়ে এসেছে চয়ন। তাই রওনককে উদ্দেশ্য করে বলে,

-আমি একটু গোসল দিয়ে আসি। এত ঘেমে গেছি যে এই অবস্থায় এখানে বসতে পারব না। আপনি বসেন, আমি আসছি।

আচমকাই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রওনক বলে,

-আমি আর বসবো না। এতক্ষণ তোমার জন্যই ছিলাম। আজকের মতো উঠছি।

-একদম না, আজ আমাদের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর যাবেন। এর আগে কেউ কোথাও যাবে না।

-আজ থাক অন্য একদিন।

-অন্যদিনের টা অন্যদিন দেখা যাবে, আজ আপনি না খেয়ে কোথাও যাচ্ছেন না।

তখনই চয়নের পেছনে এসে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। ওদের কথার শব্দ পেয়েই আবার বেরিয়ে এসেছে সে। এগিয়ে এসে চিত্রলেখা বলে,

-থাক, উনাকে জোর করিস না।

❝আমি তো লাবিব না আমাকে কেন জোর করবা। লাবিবকে ডেকে জামাই আদর করে খাওয়াও।❞ কথাটা মনে মনে বলে রওনক মুখে বলল,

-আসি।

-একদম না।

আবারও বাঁধা দেয় চয়ন। চিত্রলেখাকে বলে,

-তুই কি রে আপা? উচিত তো তোমার উনাকে জোর করে আটকে রাখা তা না করে আমাকে বলছো উনাকে জোর না করতে। এত কথা জানি না উনি আজ আমাদের সাথেই খাবেন।

-কিন্তু উনি তো থাকতে চাইছেন না। উনার হয়ত কোথাও এপয়েনমেন্ট আছে।

-তুমি এখন পর্যন্ত একবারও বলছো উনাকে? জিজ্ঞেস তো করো আগে।

এবার চিত্রলেখা পড়ে যায় মুশকিলে। আসলেই তো জিজ্ঞেস না করেই সে থাকবে না ধরে নেয়াটা অনুচিত হচ্ছে। ইতস্তত করেই চিত্রলেখা বলে,

-ওরা যেহেতু চাইছে আজ দুপুরের খাবারটা নাহয় আমাদের সাথেই খেয়ে যাবেন। আমার হাতের রান্না কোনো ফাইভ স্টার হোটেলের সেফের মতো নয় তবে একদম মন্দও লাগবে না আশা করি।

রওনক কিছু বলে না, পূনরায় বসে পড়ে ফোন লাগায় কাকে যেন। কলটা রিসিভ হতেই সে বলে,

-তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা করো না। আমি আজ বিশেষ এক জায়গায় লাঞ্চ করবো।

লাইনের অন্যপাশ থেকে তানিয়া বলে,

-রওনক মা কিন্তু এখন রাগ করে আছেন। তোমার আজ বাসায় থাকা উচিত।

-আই কান্ট, দিজ ইজ অলসো ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট ফর মি।

-রওনক…

-প্লিজ হ্যান্ডেল হার ফর মি, আই রিকুয়েষ্ট ইউ।

তানিয়া আর কিছু বলতে পারে না। রওনক লাইন কেটে দেয়। চিত্রলেখা আর কিছু না বলে রান্নাঘরে ফিরে যায়। রওনক সত্যি সত্যি থাকতে রাজি হয়ে যাবে সে ভাবেনি।

একে একে লিখন, চয়ন দু’জনেই গোসল দিয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে। তারপর রওনককে নিয়ে ওদের এলাকার বড় মসদিজে গেছে জুম্মা আদায় করতে। অনেক বছর পর রওনক কারো সঙ্গে জুম্মা পড়তে গেল। বাবা বেঁচে থাকতে বড়ভাই সমেত তিনজন একত্রে যেতো কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে রওনক অনেকটা একাই হয়ে গেছে বলা যায়। কখনো কখনো তাদের দুই ভাইয়ের একত্রে যাওয়া হয় তবে সেটা মাসে বা ছয় মাসে এক কি দুইদিন।

ওরা নামাজ পড়তে বেরিয়ে যেতেই শব্দহীন পদক্ষেপে চিত্রলেখার পেছনে এসে দাঁড়ায় চারু। শব্দ না হলেও টের পায় চিত্রলেখা। চারু কিছু বলার আগেই সে জিজ্ঞেস করে,

-কি চাই?

চারু পেছন থেকে বড়বোনকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে,

-আমি তোমাকে বলছিলাম না তুমি বিশেষ কেউ।

-মানে?

ছোটবোনের কথার মানে যেন ধরতে পেরেও বুঝতে পারলো না চিত্রলেখা। হয়ত সে ইচ্ছা করেই বুঝতে চায় না।

-আমি তোমাকে বলছিলাম না তুমি বলেই এত আয়োজন। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হইলে তোমার বস মুখ ফিরায়ও দেখত না।

-তুই আবার তোর এইসব আজাইরা প্যাঁচাল নিয়ে আসছিস? যা তো, আমার কাজ শেষ করতে দে। নামাজ পড়ে আসলেই তো ভাত দেয়া লাগবে।

-এখন না হয় কথা ঘুরায় দিলা আপা কিন্তু এইসব বিষয় চাপা থাকে না। দেইখো একদিন ঠিকই তুমি টের পাবা। তখন বুঝবা আমি ভুল বলি নাই।

-চারু! তুই থামবি?

আপাতত এই বিষয়ে আর কথা বাড়ায় না চারু। এখন যে আর একটা কথা বললে এরপর ওর গালে ঠাস করে পড়বে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

-কি রান্না করছো?

-গরুর গোশত আলু দিয়ে, অর্ধেকটা মুরগী ছিল ওটা বুটের ডাল দিয়ে রান্না করছি। উনি সত্যি সত্যি আমাদের সাথে খাবে জানলে আমি মুরগীও আনাইতাম।

-সাথে আর কিছু করো নাই?

-করছি তো, পাতলা ডালও করি, তিন পদের ভর্তা করছি, চিচিঙ্গা দিয়ে ডিম দিয়ে ভাজি করছি। সঙ্গে সাদা ভাত। ও সালাদাও আছে।

-ভাত কেন করলা আপা পোলাও করতা। এত বড় একজন মানুষকে তুমি ভাত দিবা?

-উনি বড় মানুষ আমি তো আর উনার মতো বড় না। আমি গরীব মানুষ, ঘরে যা আছে তাই করছি। পছন্দ হইলে খাবে না হইলে নাই। তাছাড়া পোলাওয়ের চাল যা আছে ওটুকু দিয়ে সবার হবে না। তাই রান্না করিনি।

-সবার তো পোলাও খাওয়ার দরকার নেই।

-তোদের সামনে আমি শুধু উনাকে পোলাও দিবো?

-হ্যাঁ দিবা, উনি মেহমান মানুষ তাও আবার তোমার বস। উনার জন্য বিশেষ রান্না হওয়া উচিত। পোলাওয়ের চালটা দেও আমি ধুয়ে দেই ওরা আসতে সময় আছে তুমি চট করে রান্না করে ফেলো।

চিত্রলেখার মন সঙ্গে দেয় না। খচখচ করে। ভাইবোনগুলোর সামনে শুধু একজনকে পোলাও দিবে আর ওরা তাকিয়ে থাকবে? চিত্রলেখার জন্য পৃথিবীতে সবকিছুর উর্ধ্বে তার ভাইবোনেরা। চারু চট করেই চালটা ধুয়ে এগিয়ে দিতেই চিত্রলেখা মনের খচখচানি নিয়েই পোলাওটা বসায়।

আজ এখানে থাকা হবে জানলে রওনক হয় পাঞ্জাবি পরে আসতো নয় সঙ্গে করে নিয়ে আসতো। কিন্তু সে তো থাকার বা দুপুরে এখানে খাওয়া দাওয়া করার মতো পরিকল্পনা করে আসেনি। সে তো এসেছিল এক পলক সামনে থেকে নিজ চোখে চিত্রলেখাকে দেখে চলে যাবে। তাই আজ ট্রাউজার, টি-শার্ট পরেই নামাজ পড়তে হয়েছে তাকে। জীবন এমনই পরিকল্পনা করে কখনোই কিচ্ছু হয় না। বরং হয় সেটাই যেটা আমরা ব্যাকআপ হিসেবেও ভাবিনা। জীবন চলে পরিকল্পনার বাইরে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-১২+১৩

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

রওনক বেরিয়ে যাওয়ার পরেও বারান্দার গ্রীল ধরে বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে চিত্রলেখা। শব্দহীন হেঁটে এসে বোনের পাশেই দাঁড়ায় চারু। বোনের দৃষ্টি লক্ষ করে গেইটের দিকে তাকিয়ে তার কাঁধে হাত রাখতে রাখতেই বলে,

-ঘটনা কি বলো তো আপা?

আচমকা চারুর কন্ঠ পেয়ে ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে চিত্রলেখা। তা দেখে অবাক হওয়া কন্ঠে চারু আবার জিজ্ঞেস করে,

-কি হলো আপা? এমন ভয় পাইলা কেন?

-কিছু না, তুই ভূতের মতো আইসা ঘাড়ের উপর দাঁড়ালে ভয় পাবো না?

-আমি কখন তোমার ঘাড়ে উঠলাম! আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে বলো তো ক্যাসটা কি?

-কিসের ক্যাস?

-এই যে এত বড় একজন মানুষ নিজে এসে তোমাকে বাসায় দিয়ে গেল। আসল ঘটনা কি বলো তো?

চারুর মাথায় একটা গাট্টা মে রে চিত্রলেখা বলে,

-একদম আমার সাথে পাকা পাকা কথা বলবি না চারু।

মাথা ঢলতে ঢলতে চারু বলে,

-মা র লা কেন আপা?

-এখন মাথায় মা র ছি ছোট করে। এরপর পাকনামি করলে মে রে হা ড্ডি গু ড্ডি ভেঙে ফেলবো। যা ঘরে যা। আমি গোসলে যাচ্ছি এক কাপ লাল চা বানায় দে।

চিত্রলেখা ঘরে যাওয়ার জন্য এক কদম বাড়িয়েও থেমে যায়। চারু দু’হাত মেলে পথ আটকে বলে,

-মা র ছো, মা র খাইছি এখন জবাব দিয়ে যাও।

-কিসের জবাব?

-লোকটা তোমায় বাসায় দিতে আসলো কেন?

-আমি অসুস্থ তাই দিতে আসছে। কি সব আজব প্রশ্ন করতেছিস চারু? আর লোকটা কি? উনার একটা নাম আছে। অন্তত স্যার ডাকতে পারিস।

-সে তোমার স্যার আমার না। ডাকাডাকি বাদ দাও, অফিসের অন্য সবাই অসুস্থ হলেও কি উনি এভাবে পার্সোনালি বাসায় দিয়ে আসে?

-আবার মা র খাবি আলতু ফালতু কথা বললে। উনি কোম্পানির মালিক, সিকিউরিটি গার্ড না যে সবাইকে বাসায় পৌঁছে দিবে।

-কাউকে বাসায় পৌঁছে দেয়া সিকিউরিটি গার্ডের কাজ না আপা। কিন্তু তুমি যাই বলো না কেন আমার মনে হয় তোমার বস শুধু তুমি বলেই বাসায় দিয়ে গেল, অন্যকেউ হলে দিয়ে যাইতো না।

-প্লিজ চারু এখন তুই তোর খেয়ালি পোলাও রান্না করতে শুরু করিস না। মূলত আমি উনার সামনে অসুস্থ হইছিলাম। উনি জানতো না আমার ফোবিয়ার কথা। জোর করে লিফটে নিয়ে গেছিল তাই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। এইজন্যই মনে হয় উনার আমার জন্য খারাপ লাগছে, হয়ত গিল্ট ফিল করছেন তাই বাসায় দিয়ে গেল।

-না রে আপা, এটা শুধু গিল্ট ফিল না। তোমার বস যেমনে তোমার দিকে তাকাইলো, তারপর ঔষধ এনে দিলো এতে পরিষ্কার বুঝা যায় উনি…

চিত্রলেখা চারুর মুখ চেপে ধরে বাঁধা দিয়ে বলে,

-চুপ, একদম চুপ। তুই এক্ষণ আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হবি।

দু’বোনের বাকবিতন্ডার মধ্যেই বাসার গেটটা খোলার শব্দ হতেই দু’জনে সেদিকে তাকায়। মামুন দরজা দিয়ে ঢুকছে। তার হাতে মিষ্টির প্যাকেট। মামুনকে দেখে চারু নিজের মুখের থেকে বড়বোনের হাত সরিয়ে বলে,

-ঐ নেও তোমার মজনু চলে আসছে।

-একদম বাজে বকবি না বলছি।

কড়া করে ধমকে ওঠে চিত্রলেখা চারুকে। ততক্ষণে ওদের কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে মামুন। কাছে এসে এক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলে,

-এখন শরীর কেমন মায়া?

-মামুন ভাই কতদিন না বলেছি আপনাকে আমার নাম মায়া না চিত্রলেখা।

-দুনিয়ার জন্য তুমি যাই হও আমার জন্য তুমি মায়া, আমার মায়া।

চিত্রলেখার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। সে নিজেও বুঝে মামুন নামক মানুষটা তার সবটুকু বিশুদ্ধতা দিয়ে তাকে ভালোবাসে, চায়। এই মানুষটার ভালোবাসা গ্রহণ করতে না পারার অপারগতায় চিত্রলেখার মাথা নুইয়ে আসে।

-আপনার হাতে মিষ্টি কেন মামুন ভাই?

মামুনের হাতে মিষ্টি দেখে জানতে চায় চারু। মুখের হাসি প্রশস্ত করে মামুন বলে,

-মিষ্টি নিয়া আসছি মায়ার জন্য।

-কিন্তু মিষ্টি কোন খুশিতে?

-খুশিতে না তো অসুখে। মায়ার শরীর খারাপ তাই নিয়া আসলাম।

-ওমা এটা কেমন কথা মামুন ভাই? মানুষ অসুস্থ মানুষ দেখতে গেলে ফল নিয়ে যায় আর আপনি আসছেন মিষ্টি নিয়ে!

-যার জন্য আনছি তার পছন্দকেও তো প্রাধান্য দিতে হবে নাকি? আমি জানি তো মায়া ফল তেমন একটা পছন্দ করে না। ফলের মধ্যে ঐ এক আমটাই খায় সে। এটা তো আমের সিজন না। তাই মায়ার পছন্দের রশমালাই নিয়া আসলাম।

-আপনি আপার পছন্দ অপছন্দ সব জানেন তাই না মামুন ভাই?

জিজ্ঞেস করে চারু। হাসি হাসি মুখ করে মামুন বলে,

-যাকে ভালোবাসি তার পছন্দ অপছন্দ না জানলে আর কি ভালোবাসলাম?

মামুনের কথাকে আর প্রশ্রয় না দিয়ে এবারে চিত্রলেখা বলে,

-মামুন ভাই কষ্ট করে আসছেন এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। চারু বানিয়ে দিবেন আপনি ভেতরে এসে বসেন। আমার একটু বিশ্রাম দরকার পরে নাহয় কথা হবে আমাদের।

মিষ্টির প্যাকেটটা সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে মামুন বলে,

-না না আজকে আমি বসবো না। তুমি সুস্থ হও আরেকদিন নাহয় তোমার হাতে চা খাবো। আজকে আমার কাজ আছে।

-আপনার আবার কিসের কাজ? আপনি কোনো কাজ করেন নাকি?

কথাটা বেফাঁস বেরিয়ে যায় চারুর মুখ গলে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার জিহ্বা কাটে সে। চিত্রলেখা চোখ পাকিয়ে তাকায়। মাথা নিচু করে রেখে মামুনের হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা নেয় চারু। হাসি হাসি মুখ করে চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে মামুন বলে,

-আজ আসি মায়া।

-আসুন মামুন ভাই।

চিত্রলেখা আর অপেক্ষা করে না। ভেতরের দিকে যেতে যেতে বলে,

-আমার জন্য এক কাপ লাল চা বানিয়ে দে চারু। সঙ্গে একমুঠ চালও ভেজে দিস তো। চাল ভাজা দিয়ে লাল চা খেতে মন চাইছে। আমি গোসলে যাচ্ছি, এরপর ঘুমাবো। ঘুমানোর আগে চা খাবো। জলদি কর হা করে দাঁড়িয়ে থাকিস না।

বড় বোনের বলে যাওয়া কথা কান দিয়ে শুনলেও চারু তাকিয়ে থাকে মামুনের চলে যাওয়ার পথে। কি মায়া মানুষটার মধ্যে! কত মায়া নিয়ে ভালোবাসে সে চিত্রলেখাকে। বোনের প্রতি মামুনের ভালোবাসা দেখলে চারুরও মায়া হয় মানুষটার জন্য। বুকের ভেতর কেমন যেন হু হু করে ওঠে। চিত্রলেখা যদি কোনোদিন মামুনের ভালোবাসা গ্রহণ না করে তাহলে কী হবে মানুষটার? আনমনে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবে চারু৷ অজানা কষ্ট হয় তার মামুনের জন্য। সবার ভালোবাসায়ই কি এত কষ্ট মিশে আছে? পৃথিবীর সব ভালোবাসাই কি যন্ত্রণা দেয়?

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

সবেই বৃষ্টিদের বাসায় এসে বসেছে লিখন। এখনো ঠিকঠাক পড়ানোও শুরু করতে পারেনি। এরমধ্যেই চারু ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়েছে। বড়বোনের অসুস্থতার কথা জানিয়েছে। মেসেজটা পেয়েই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় লিখন চিন্তিত মুখে। তা দেখে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

-কি হইছে?

-আজকে পড়াইতে পারবো না বৃষ্টি। বাসায় যাইতে হবে এক্ষুনি। খালাম্মাকে বইলো কাল পড়ায় দিবো।

-কিন্তু হঠাৎ কি হইছে সেটা তো বলবেন নাকি?

-আপার নাকি শরীর ভালো না। ওর ফোবিয়া আছে, এট্যাক হইছে। আমাকে এখনই বাসায় যাইতে হবে।

লিখনকে ব্যস্ত হতে দেখে বৃষ্টি ধমকের সুরে বলে,

-চুপচাপ এখানে বসেন।

-আজকে পড়াইতে পারবো না বৃষ্টি।

-পড়াইতে হবে না। এখানে বসে থাকেন। আমি না আসা পর্যন্ত নড়বেন না।

বৃষ্টি তৎক্ষনাৎ ভেতরে গিয়ে একগ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসে লিখনের সামনে রেখে বলে,

-শান্ত হয়ে পানিটা খান।

-পানি খাওয়ার সময় নাই বৃষ্টি। আপা অসুস্থ।

-জানি আপা অসুস্থ। কিন্তু আপনি যা শুরু করছেন এভাবে বাসায় গেলে আপনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন। তখন আপনাকে কে দেখবে? আপনি চুপচাপ শান্ত হয়ে পানিটা খান আমি আসতেছি।

লিখনকে পানি খেতে দিয়ে আবার ভেতরে চলে যায় বৃষ্টি। মিনিট দু’য়েক পড়ে ঠিকঠাক ভাবে ওড়না মাথায় দিয়ে ফিরে আসে। এসেই লিখনকে জিজ্ঞেস করে,

-এখন ঠিক আছেন আপনি?

থমথমে মুখ করে লিখন বলে,

-এখন বেটার লাগছে।

-তাহলে চলেন।

-কোথায়?

-আপনার বাসায় আর কোথায় যাবেন?

-আমি তো বাসায় যাবো কিন্তু তুমি কই যাবা?

-আমিও আপনার বাসায় যাবো, আপাকে দেখতে। এখন কথা বলে সময় নষ্ট না করে চলেন তো।

-কিন্তু খালাম্মা?

-আম্মুকে বলে আমি অনুমতি নিয়ে নিছি।

লিখন আর কথা বাড়ায় না। বৃষ্টিকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি নামক ছোট মেয়েটা বড়দের মতো শাসন করে তাকে। ঠিক যেন প্রেমিকার মতো। বৃষ্টি মেয়েটার আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা সব কিছু অন্যদের খুব সহজেই মুগ্ধ করতে সক্ষম। যদিও লিখন কোনোদিন বৃষ্টিকে অন্য দৃষ্টিতে দেখেনি। একদম বউ ম্যাটেরিয়াল একটা মেয়ে। যার জীবনে যাবে তার জীবনটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিবে সুখ-শান্তিতে।

বিল্ডিং থেকে বেরিয়েই লিখন রিকশা ডাকে। তা দেখে বৃষ্টি বলে,

-এইটুকু রাস্তা যেতে রিকশা লাগে নাকি? হেটেই তো যেতে পারবো।

-হেঁটে যাইতে হবে না। চলো রিকশায় যাই।

বুকের ভেতর অদৃশ্য শব্দ হয় বৃষ্টির। রিকশায় উঠে বসতেই বুকের ভেতরে হু হু করে বৈতে শুরু করা বাতাস যেন ক্রমশ তুফানে রূপান্তরিত হচ্ছে। প্রিয় মানুষের গা ঘেষে রিকশায় বসার প্রথম অনুভূতি বৃষ্টিকে সর্গীয় সুখ দেয়। লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসতে চায়। লিখনের মুখের দিকে তাকানোর সাহস হয় না ওর। রাস্তায় থাকা কুকুরের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আচমকা লিখনের কথায়, কর্মে ভাবনায় ছেদ পড়ে বৃষ্টির। লিখন আচমকা বৃষ্টির হাত ধরে বলে,

-সামনের রাস্তা ভালো না, ভাঙা। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বসো নাহলে পড়ে যাবা।

চমকে গিয়ে লিখনের মুখের দিকে তাকায় বৃষ্টি। কিন্তু নিজের চমকে যাওয়াটা এই মুহূর্তে লিখনের কাছে প্রকাশ করে না ও। সবসময় অল্পে সন্তুষ্ট থাকা বৃষ্টি কখনোই ভাবেনি একসাথে এত সুখানুভূতি এসে তার হাতে ধরা দিবে। অতিরিক্ত সুখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তা টের পেয়ে লিখন বলে,

-তোমার হাত এত ঠান্ডা কেন বৃষ্টি? জ্বরটর আসবে নাকি?

মাথা ঝাঁকায় বৃষ্টি। লিখন সামনের দিকে তাকায়। তাই হয়ত লক্ষ করে না বৃষ্টি তার একবুক ভালোবাসা নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছি।

চারু চা আর চাল ভাজা নিয়ে ঘরে এলে চিত্রলেখা বলে,

-শুন চারু লিখনকে কিছু জানাইস না। একবারে বাসায় আসলে বলবোনি। ততক্ষণে ঘুম দিয়ে উঠলে আমি আরও সুস্থ হয়ে যাবো।

চারু এগিয়ে এসে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-নেও, মা রো।

-ঢং করতেছিস কেন? তোরে মা র বো কেন আমি?

-ভাইয়াকে অলরেডি জানায় দিছি।

ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত দিয়ে ছোট বোনকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আল্লাহ তোরে এত কম ধৈর্য্য কেন দিছে রে? কতদিন বলছি কিছু একটা হইলেই ফট করে সবাইকে বলে দিবি না।

-ওমা আপা! তুমি অসুস্থ এই কথা আমি ভাইয়াকে জানাবো না? পরে ভাইয়া বো ক বে আমাকে কেন জানাই নাই তারে।

-ব ক লে আমি ওরে ব কে দিতাম।

আসামীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে চারু। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চিত্রলেখা আরও বলে,

-এখন বিদায় হ চারু আমি ঘুমাবো।

তবুও যায় না চারু। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তা দেখে চিত্রলেখা আবার বলে,

-দাঁড়ায় আছিস কেন? যাইতে বললাম না তোরে?

এগিয়ে গিয়ে বোনের গা ঘেষে বসে বলে,

-তোমার মাথার চুল নেড়ে দেই আপা?

-যাবি না তাই তো?

মাথা ঝাঁকায় চারু। তা দেখে চিত্রলেখা বলে,

-আচ্ছা চিরুনি নে, চুল আঁচড়ে দে। কিন্তু কোনো কথা বলবি না। এমনি মাথা ভাড় হয়ে আছে। তোর আজাইরা বকবকানি শুনতে মন চাচ্ছে না।

-আচ্ছা কথা বলবো না।

দু’বোনের কথা শেষ হওয়ার আগেই বৃষ্টি সমেত বাসায় এসে উপস্থিত হয় লিখন। এগিয়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-কি হইছে আপা তোর?

-আরে কিছু হয় নাই। আমি ঠিক আছি।

রাগি রাগি চোখ করে চারুর দিকে তাকায় চিত্রলেখা। তখনই পাশ থেকে বৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

-এখন তোমার কেমন লাগছে আপা?

হাত বাড়িয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-একদম ঠিক আছি। তুই কষ্ট করে আসতে গেলি কেন রে বৃষ্টি?

-ওমা তুমি অসুস্থ আর আমি তোমাকে দেখতে আসবো না তা হয় নাকি?

চিত্রলেখা বৃষ্টিকে আলতো করে জড়িয়ে রেখে চারুকে বলে,

-যা বৃষ্টির জন্য মিষ্টি নিয়ে আয়।

বৃষ্টি চারুর হাত থেকে চিরুনি নিয়ে বলে,

-আপা আসো আমি তোমার চুল আঁচড়ে দেই।

বৃষ্টি ও নাঈমকে কয়েক বছর ধরে পড়ানোর সুবাদে বৃষ্টির এই বাড়িতেও আসা যাওয়া আছে। একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে ওদের মধ্যে।

—————————————————————————–

রওনক নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে তানিয়া। কাছাকাছি এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করে,

-ব্যস্ত নাকি?

ল্যাপটপটা বন্ধ করে রওনক বলে,

-সামান্য। কিছু বলবে নাকি?

-আজ সারাদিন অফিসে ছিলে না। কোথায় গিয়েছিলে?

-একটু কাজ ছিল বাইরে।

-সেটা জানি তোমার একটা মিটিং ছিল। মিটিংয়ের পরে তো আর অফিসে ফিরলে না।

-কোনো জরুরী দরকার ছিল নাকি?

-কিছু ডকুমেন্ট দেখানোর ছিল। মেইল করে দিয়েছি চেক করে নিও।

-ঠিক আছে দেখে নিবো।

তানিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে মুখ তুলে তার দিকে তাকায় রওনক। বলে,

-আর কিছু বলবা?

-সারাদিন কই ছিলা তুমি?

-একটু কাজ ছিল বাইরে বললামই তো।

-কি কাজ?

-পার্সোনাল কাজ।

-এত বছরে প্রথম শুনছি রওনক জামান অফিস আওয়ারে পার্সোনাল কাজে বাইরে গেছে। কি এমন পার্সোনাল কাজ জিজ্ঞেস করতে পারি কি?

-আপাতত থাক ভাবী। বলার হলে পরে কোনো এক সময় বলবো নাহয়।

-আচ্ছা ঠিক আছে। অপেক্ষায় থাকলাম।

এগিয়ে এসে রওনকের মুখোমুখি বসে তানিয়া। রওনক বুঝতে পারে তানিয়া হয়ত আরও কিছু বলতে চায়। তা আন্দাজ করে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-মনে হচ্ছে আরও কিছু বলতে চাও।

মাথা ঝাঁকায় তানিয়া। তা দেখে রওনক বলে,

-আজ কি কথার ঝুলি নিয়ে এসেছো নাকি? বলো আর কি বলবা।

-আম্মার সাথে কথা বলছো?

-কোন বিষয়ে?

-তোমার আর সাবার বিষয়ে।

-সাবার সাথে আমার আবার কিসের বিষয়?

-বুঝেও কেনো না বুঝার ভান করতেছো রওনক? আমি তোমাদের বিয়ের কথা বলতেছি।

-যা বলার সেটা তো আমি সবার সামনেই বলছি ভাবী। এরপরে কি আর কোনো কথা থাকতে পারে?

-কিন্তু রওনক আমারও মনে হয় তোমার এবার বিয়েটা করে নেয়া উচিত।

-আবার বিয়ে!

-শুনো রওনক, মানুষের জীবনে একবারই বিয়ে হয় এটা একটা লেইম লজিক। প্রয়োজন হলে মানুষ দু’বার বিয়ে করবে এতে তো দোষের কিছু নেই।

-আমিও দোষের কথা বলছি না ভাবী। কিন্তু আমার তো প্রয়োজন নেই।

-একটা মানুষ সারাজীবন একা থাকতে পারে না রওনক।

-আপাতত আমার সমস্যা হচ্ছে না ভাবী। যদি পরে মনে হয় বিয়ে করা প্রয়োজন তাহলে করে নিবো। এখন তো প্রয়োজন দেখছি না।

-তোমার এখন প্রয়োজন না মনে হলেও আমাদের মনে হয় এটাই উপযুক্ত সময় রওনক।

-ভাবী প্লিজ! আই রিকুয়েষ্ট টু ইউ, এখন তুমিও মায়ের মতো শুরু হয়ে যেও না। বিয়ের বিষয়টা কয়দিনের জন্য সাইডে রাখো প্লিজ।

-অনেক তো সাইডে রাখলাম আর কত?

-আরও কয়টা দিন প্লিজ।

-মনে হয় না এবার তুমি আর বিয়ে এড়িয়ে যেতে পারবে।

-কেন?

-আম্মার সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার আর?

-না তো।

-উনি কিন্তু খাওয়া দাওয়া করছেন না ঠিক মতো।

-ভাবী তুমি একটু মাকে বুঝাও। বলো এসব বাচ্চামো ছেড়ে দিতে। আমি বাচ্চা না যে আমাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিবে। বিয়ে করতে বলবে আর আমি লাফিয়ে বিয়ে করতে চলে যাবো। বিয়েটাই জীবন নয়।

-আমি একটা এডভাইস দেই রওনক?

-বলো শুনছি।

-তুমি যদি একান্তই সাবাকে বিয়ে করতে না চাও তাহলে নিজের পছন্দের কাউকে বিয়ে করতে পারো। যদি তোমার নজরে এমন কেউ থাকে তাহলে তাকেই নাহয় বিয়েটা করে ফেলো। কিন্তু এবার তোমাকে বিয়ে করতেই হবে। সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে তোমার বিয়ে। আম্মা চায় তুমি বিয়ে করো। বিয়েটাই জীবন নয় তবে বিয়ে জীবনের অনেক বড় একটা ফ্যাক্ট। যা চাইলেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

-কিন্তু মা চায় আমি সাবাকে বিয়ে করি।

-তুমি যার সাথে ভালো থাকবে আম্মা তাকেই মেনে নিবে দেখে নিও। আম্মার জন্য তুমি সবচাইতে বেশি জরুরী, সাবা না।

উঠে দাঁড়িয়ে দু’কদম এগিয়ে এসে তানিয়া রওনকের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো। এই সমস্যার এবার একটা সমাধান হওয়া প্রয়োজন রওনক।

রওনককে তার ভাবনার হাতে ফেলে সন্তপর্ণে বেরিয়ে যায় তানিয়া। ভাবী বেরিয়ে যেতেই উঠে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট জ্বালায় সে। সিগারেটটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে ট্রাউজারের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে আজ সকালে চিত্রলেখার তোলা একটা ছবি বের করে। হাসপাতালের বেডে চিত্রলেখা যখন বেহুঁশ হয়ে ঘুমিয়ে ছিল তখন এই ছবিটা তুলেছিল রওনক। কেন তুলেছে তা সে নিজেও জানে না। চিত্রলেখার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে সিগারেটে লম্বা করে আরেকটা টান দিয়ে তানিয়ার বলে যাওয়া কথা ভাবতে লাগে। তার নিজের পছন্দের কেউ কি আছে? আবার কি সে কাউকে পছন্দ করতে পারবে? ভালোবাসতে পারবে? ভালোবাসা কি বসন্তের মতো নাকি? বছর ঘুরে যেমন বসন্ত আসে তেমনি কি মানুষের জীবন থেকে ভালোবাসা হারিয়ে গেলে আবারও নতুন করে ভালোবাসা আসে?

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-১০+১১

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১০
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

প্রায় তিনটার দিকে হাসপাতালে এসে পৌঁছায় লাবিব। ব্যস্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে চিত্রলেখা ঘুমাচ্ছে। অনেকক্ষণ নিঃসঙ্গ হয়ে শুয়ে শুয়ে উপরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ঘুমাতে দেখে আর ডাক দেয় না লাবিব৷ অসুস্থতার ছাপ পড়েছে চোখ-মুখে স্পষ্ট। চিত্রলেখাকে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে দেখে আর ডাকে না। রুমের মধ্যেই শব্দ না করে কিছুক্ষণ পায়চারি করে। চিত্রলেখার অসুস্থতার খবর পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। আজই সকালে তার বাবার চোখের ছানির অপারেশন হয়েছে। তাই খবর পাওয়া মাত্র, তৎক্ষনাৎই আসতে পারেনি। যেই অপারেশন শেষ হয়েছে ওমনি চলে এসেছে দেখতে। এসে দেখার পর এখন কিছুটা স্বস্তি লাগছে তার। কেবিনের অন্যপাশে রাখা সোফায় বসে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সে। গতকাল রাত থেকেই দৌড়াদৌড়ির উপরেই আছে। দু’দন্ড বিশ্রাম নেয়ার সময় হয়নি। সকালে ঠিক করেছিল বাবার অপারেশনটা হয়ে গেলেই বাসায় গিয়ে ঘুম দিয়ে শরীর চাঙা করবে। কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি। খবর পেয়ে ওদিক সামলে ছুটে আসতে হয়েছে চিত্রলেখার কাছে। এখানেও যে সে অনেকটা সময় থাকতে পারবে তাও নয়। তাকে আবার চক্ষু হাসপাতাল যেতে হবে। ওখানে আরও কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। তবে আপাতত জরুরী তলব না পড়া পর্যন্ত সময়টুকু সে চিত্রলেখাকে দিতে পারবে।

এখন অবশ্য লাবিব একা আসেনি। রওনকও এসেছে তার সঙ্গে। দু’জনে একই জায়গা থেকে না এলেও একই সময়ে এসে পৌঁছেছে। আজকের মিটিংটা জলদি শেষ করার চেষ্টা করেছিল সে। যাতে করে দ্রুত চিত্রলেখার কাছে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু তার চেষ্টা বিফলে গিয়েছে। যতই সে জলদি করার চেষ্টা করেছে ততই মিটিং লম্বা হয়েছে। জরুরী না হলে মিটিংটা সে ক্যান্সেলই করে দিতো। এক মুহূর্তের জন্যও তার মন মস্তিষ্ক মিটিংয়ে ছিল না। দেহটা ওখানে থাকলেও বারবার মনের ভেতর শুধু ঘুরপাক খেয়েছে চিত্রলেখার জ্ঞান হারানো মলিন মুখটা। বার দুই মিটিংয়ের মধ্যে বিরতির নাম করে উঠে গিয়ে হাসপাতালে ফোন করে খোঁজও নিয়েছে সে চিত্রলেখা ঠিক আছে কিনা। এখানকার ডাক্তার রেজাউল করিম তার পরিচিত। এক ক্লোজ বন্ধুর বড় ভাই। উনার তত্ত্বাবধানেই রেখে গিয়েছিল রওনক চিত্রলেখা। জানে সেবা যত্নে কোনো ত্রুটি হবে না। তবুও অজানা অস্থিতায় তার বুকের ভেতরটা ছয়লাব হয়েছিল। তাই জলদি ফিরে আসার আপ্রাণ চেষ্টাও করেছে সে। আচমকা এমন হওয়ার কারণ সে নিজেও জানে না। চিত্রলেখার জন্য সে কেন ব্যস্ত হচ্ছে এর কোনো ব্যাখ্যা রওনকের জানা নেই। আপাতত জানার তাগাদাও অনুভব করছে না সে। যা যেমন হচ্ছে হতে থাকুক। এতে তো কারো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।

হাসপাতালে এসেই রওনক চিত্রলেখার কেবিনে না এসে সরাসরি চলে গেছে ডাক্তার রেজাউল করিমের সঙ্গে দেখা করতে। চিত্রলেখার কন্ডিশন সম্পর্কে জানতে। ওকে আর হাসপাতালে রাখতে হবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই ডাক্তার জানায় তাকে আজই রিলিজ করে দেয়া হবে। রওনক বলে গিয়েছিল সে ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন রিলিজ না দেয়া হয়। তাই এতক্ষণ তাকে ডিসচার্জ করা হয়নি। নাহলে জ্ঞান ফেরার পরপরই রিলিজ করে দেয়া হতো। রওনক ডাক্তারকে বলে ডিসচার্জ পেপার রেডি করতে। সে নিজেই নিয়ে যাবে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা সেরে বেরিয়ে আসে চিত্রলেখাকে দেখতে। রওনক কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে চিত্রলেখা ঘুমাচ্ছে। লাবিব কোথায় দেখার জন্য চোখ বুলাতেই দেখে অন্যপাশের সোফায় মাথা হেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। হয়ত তন্দ্রায় চোখে ঘুম নেমে এসেছে তার। ছেলেটা গতরাত থেকে ব্যস্ত সে খবর রওনকের জানা। এমন অবস্থায় সে লাবিবকে ফোন করতো না। কিন্তু চিত্রলেখার বাসার কাউকে সে চিনে না। কোথায় থাকে সেটাও জানে না। যদিও অফিসে ফোন করলেই এসব তথ্য পাওয়া যাবো কিন্তু রওনক ইচ্ছা করেই অফিসের কাউকে না জানিয়ে লাবিবকে ফোন করেছে। সে জানে চিত্রলেখা আর লাবিবের মধ্যে বিশেষ বন্ধুত্ব রয়েছে। ভালো সম্পর্ক না থাকলে নিশ্চয়ই চিত্রলেখা লাবিবের বাইকে উঠতো না। সেই আন্দাজ থেকেই লাবিবকে ফোন করেছিল সে। তার আন্দাজ বৃথা যায়নি। যদিও লাবিবের কাছে চিত্রলেখার বাসার কারো ফোন নম্বর নেই। কিন্তু বাসার ঠিকানাটা সে জানে। তার যাওয়া হয়নি কখনো তবে চিত্রলেখা একদিন বলেছিল তাকে। রায়ের বাজারে বড় মসজিদের গলি নামের একটা গলি আছে। রায়ের বাজারের সব চাইতে বড় মসজিদ ওটা সেজন্য ঐ গলিরটারও নাম পড়ে যায় বড় মসজিদের গলি। সেই গলিতে একটাই একতলা বাড়ি আছে। সেই বাড়িটাতেই থাকে ওরা। কথায় কথায় লাবিব রওনককে এটাও বলে ফেলেছে বাড়িটা চিত্রলেখার খালুর। খালা খালুর কাছেই থাকে ওরা চার ভাই-বোন। ওর খালাই মানুষ করছে ওদের। এমন কথা শুনে রওনক জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল চিত্রলেখার বাবা-মায়ের কথা। সেই কথার জবাবে মুখ মলিন করে লাবিব জানিয়েছে তাদের মৃত্যুর কথা। সঙ্গে এও জানায় দশম শ্রেনী পড়ুয়া চিত্রলেখাই বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ছোট তিন ভাইবোনের জীবনে বাবা-মায়ের ভূমিকা পালন করে আসছে। চিত্রলেখার জীবনের এতটুকু গল্পই যেন রওনকের হৃদয়ের গভীরের অনেকটা পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেলেছে। তার হয়ত ঐ মুখে হাসি না থাকার কারণটা জানা হয়ে গেছে। কেন মেয়েটা নিজের জন্য জুতা না কিনে ছেঁড়া জুতাই সারিয়ে নিয়ে ব্যবহার করছে সেই প্রশ্নের উত্তর রওনক পেয়ে গিয়েছে। ছোট্ট একটা গল্প রওনককে তার না জিজ্ঞেস করা অনেক প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিয়েছে।

রওনক এগিয়ে গিয়ে চিত্রলেখার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্লান্তি জেঁকে বসা মুখটার দিকে অদ্ভুত টানে তাকিয়ে রয় সে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘুম ভেঙে চোখ মেলে চিত্রলেখা। চোখেচোখ পরে দু’জনার। হয়ত তাদের অজান্তেই শুভ দৃষ্টি সম্পন্ন হয়। বেশ কিছুক্ষণ একে-অপরের চোখে চোখ রাখে দু’জনে। জড়তায় চিত্রলেখার ভেতরটা নুইয়ে আসে তাও দৃষ্টি সরাতে পারে না সে। রওনক তো চাইলেও তার আগ্রহ দমিয়ে রাখতে পারছে না। অবশ্য সে সেই চেষ্টাও করছে না। অনেক লম্বা একটা সময় সে নিজেকে সব রকম আবেগ অনুভূতিদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। লম্বা সময় সে বিশেষ দৃষ্টি নিয়ে কারো দিকে তাকায়নি। চিত্রলেখা কখন তার দৃষ্টিতে বিশেষ হয়ে ধরা পড়লো তা সে নিজেও জানে না। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চিত্রলেখা উঠতে চেষ্টা করলে বাঁধা দিয়ে রওনক বলে,

-উঠতে হবে না।

এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে রওনক আরও জিজ্ঞেস করে,

-এখন কেমন লাগছে?

-ভালো।

কথার শব্দ পেয়ে লাবিবের তন্দ্রা কাটে। চোখটা সামান্য লেগে গিয়েছিল ক্লান্তিতে। আচমকা কথার শব্দ কানে আসতেই সেই ঘুম চোখ ছুটে পালায়। উঠে এগিয়ে আসে সে। এগিয়ে এসে চিত্রলেখাকে জিজ্ঞেস করে,

-এখন কেমন লাগছে তোমার?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। লাবিব পাল্টা প্রশ্ন করে,

-হঠাৎ আজ লিফটে উঠতে গেলে কেন তুমি?

চিত্রলেখা একবার রওনকের দিকে তাকায় মুখে কিছু বলে না। জবাব না পেয়ে লাবিবই পাশ থেকে আরও বলে,

-তোমার যে ফোবিয়া আছে তা ভুলে গিয়েছিলেন নাকি?

চিত্রলেখাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রওনক বলে,

-আমি ইনসিসট করায় উঠেছিল। তাছাড়া আমি জানতাম না ওর ফোবিয়া আছে।

-ও আচ্ছা।

লাবিব আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ায় না। তবে রওনক চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেই মনে মনে ভাবে, লাবিব সব জানে তোমার বিষয়ে। ঠিক কতটা গভীর তোমাদের সম্পর্ক? তোমরা কি শুধু ভালো কলিগ, বন্ধু নাকি এর চাইতেও বেশি কিছু? মনে মনে এসব ভেবে আবার নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয় সে। ওরা সম্পর্কে যাই হোক তাতে তার কি! রওনক কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে পেছন থেকে চিত্রলেখা বলে,

-আমি বাসায় যাবো।

কথা শুনে দাঁড়ায় রওনক। পেছন ফিরে তাকালে চিত্রলেখা আরও বলে,

-আমি বলেছিলাম আমাকে ছেড়ে দিতে কিন্তু ওরা দেয়নি। বলল আপনি না আসা পর্যন্ত ছাড়বে না।

ঠান্ডা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থেকে রওনক বলে,

-ডিসচার্জ পেপার রেডি হচ্ছে। একটু পরেই ছেড়ে দিবে তোমাকে।

এই কথা শুনে লাফিয়ে উঠে লাবিব বলে,

-ভালোই হয়েছে। আমি তাহলে তোমায় বাসায় দিয়ে আসবো নাহয়। এই শরীর নিয়ে একা যাওয়া উচিত হবে না।

চিত্রলেখা কিছু বলে না। এক মুহূর্ত সময় নিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে রওনক বলে,

-তুমি তো এমনিও ব্যস্ত আমি না হয়…

রওনককে কথা শেষ করতে দেয় না লাবিব। বলে,

-কোনো সমস্যা নেই স্যার। আপনি একদম ব্যস্ত হবেন না। আমি ওকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।

আর কথা বাড়ায় না রওনক। বলে,

-আমাকে ডিসচার্জ পেপারে সাইন করতে হবে। আমি ওটা করে দিয়ে আসছি।

আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় সে। রওনক বেরিয়ে যেতেই লাবিবের ফোন আসে। ফোনে কথা শেষ হতেই চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে?

-আসলে বাবার সাথে মা একা। আমাকে যেতে হবে।

-আপনি যান।

-কিন্তু তুমি?

-আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি নাহয় একটা সিএনজি নিয়ে চলে যাবো।

-এর চাইতে আমি তোমার জন্য একটা উবার কল করে দিচ্ছে।

-এসব ঝামেলার কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমি এখন একদম ভালো আছি। সিএনজি করে চলে যেতে পারবো। আপনি ব্যস্ত হবেন না প্লিজ।

-কিন্তু তোমাকে একা ছাড়তে মন চাইছে না যে!

-আপনার এখন ওখানে যাওয়াটা জরুরী।

ওদের কথার মধ্যেই ফিরে আসে রওনক। লাবিবের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে জিজ্ঞেস করে,

-এনি প্রবলেম?

-মা ফোন করেছে। বাবার ওখানে সে একলা। ডাক্তার দেখা করতে বলেছেন। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।

-তাহলে তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?

ইশারায় চিত্রলেখাকে দেখিয়ে বলে,

-ওকে একা ছাড়তে মন সায় দিচ্ছে না।

-ওকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না, আমি আছি। নিজ দায়িত্বে যেহেতু হাসপাতালে আনতে পেরেছি, বাসায়ও পৌঁছে দিতে পারবো।

লাবিব আরও কিছু বলার চেষ্টা করলে রওনক তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলে,

-কথা না বলে জলদি যাও তো। কোনো প্রয়োজন হলে অবশ্যই আমাকে জানাবে।

লাবিন আর অপেক্ষা করে না। ব্যস্ত কদম ফেলে বেরিয়ে যায়। বাবার ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে তাকে। লাবিব চলে যেতেই চিত্রলেখা মুখ তুলে তাকায় রওনকের দিকে। মুখ তুলতেই দেখে রওনক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইতস্তত বোধ করে সে। জড়তায় কথা বের হয় না গলা দিয়ে। রওনক নিজেই বলে,

-ডিসচার্জ হয়ে গেছে। হাটতে পারবে নাকি কাউকে বলবো হুইলচেয়ার আনতে?

-তার প্রয়োজন নেই। আমি হাটতে পারবো।

বেড ছেড়ে নামতে নিলেই মাথা হালকা ঝাঁকি দেয় চিত্রলেখার ফলাফল টলে ওঠে সে। তৎক্ষনাৎ হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলে রওনক। আবার চোখে চোখ পরে দু’জনার। নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। রওনকের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেবার চেষ্টা করলে সে হাত ধরে রেখেই বলে,

-একা হাটতে কষ্ট হবে। আমার হাতটা ধরে হাটো তাহলে আর পরে যাবে না। আই উইল হোল্ড ইউ টাইট।

চিত্রলেখা আপত্তি করতে চেয়েও আর আপত্তি করে না। লিফটের সামনে আসতেই রওনক বলে,

-সিড়ি দিয়ে নামি নাহয়।

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। সিড়ি ভেঙে নিচে নেমে রিসিপশন এড়িয়া জুড়ে থাকা ওয়েটিং চেয়ারে চিত্রলেখাকে বসিয়ে দেয় রওনক। বসিয়ে দিয়ে বলে,

-একটু বসো, আমি এক্ষুনি আসছি।

আসছি বলে চিত্রলেখাকে বসিয়ে রেখে প্রথমে সে যায় হাসপাতালের ফার্মেসীতে। সেখান থেকে চিত্রলেখার ঔষধগুলো নিয়ে চলে যায় পাকিংয়ে গাড়ি আনতে। আজ সে সঙ্গে ড্রাইভার আনেনি। নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে। গাড়িটা এনট্রান্সে রেখে দৌড়ে ফিরে আসে চিত্রলেখার কাছে। একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-চলো।

এক মুহূর্ত রওনকের বাড়িয়ে দেয়া হাতের দিকে তাকিয়ে রয় চিত্রলেখা। তা দেখে তাগাদা দিয়ে রওনক বলে,

-কি হলো? এসো।

আর অপেক্ষা না করে রওনকের বাড়িয়ে দেয় হাতটা ধরে উঠে দাঁড়িয়ে চিত্রলেখা বলে,

-আমি চলে যেতে পারবো। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।

রওনক কিছু বলে না। ঠান্ডা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় কেবল। তারপর চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে নিয়ে দ্রুত হেটে বেরিয়ে আসে। গাড়ির সামনের সিটের গেইট খুলে দিয়ে বলে,

-বসো।

-সত্যি আপনাকে কষ্ট করতে হবে না আমার জন্য। আমি একাই চলে যেতে পারবো। একটা সিএনজি করে না হয় চলে যাবো।

রওনক আর কিছু না বলে নিজেই ঠেলে চিত্রলেখাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে নিচু হয়ে ঝুঁকে এসে সিট বেল্টটা বেঁধে দেয়। এতে করে দু’জনে একে-অপরের সবচাইতে বেশি কাছাকাছি আসে। একদম কাছ থেকে একে-অপরকে দেখা হয় তাদের হয়ত কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সিট বেল্ট বাঁধতে গিয়ে রওনকের দৃষ্টি আবার একবার থমকে যায় চিত্রলেখার মুখের উপর। বারি খায় তাদের দৃষ্টি। কিছু কথা হয় তাদের যা অব্যক্ত। চিত্রলেখা নড়ে উঠলে রওনক দরজা লাগিয়ে দিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। গায়ের কোটটা খুলে পেছনের সিটে ছুঁড়ে দিয়ে সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। মোবাইলে লোকেশন বের করে নেয় রায়ের বাজার বর মসজিদের গলির। একবার চিত্রলেখার মুখের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে তাকায় সে। পাশ থেকে চিত্রলেখা আড় চোখে একবার রওনককে দেখার চেষ্টা করে আবার নিজেকে সামলে নেয়।

চলবে….

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখাকে বাসার লোকেশন বলে দিতে হয়নি। জিজ্ঞেস না করেই রওনক একদম সঠিক জায়গায় চলে এসেছে। এটা দেখে ভীষণ রকম অবাক হয়েছে চিত্রলেখা। গাড়িটা এসে বাসার নীল রঙের লোহার গেইটটার সামনে দাঁড়াতেই চিত্রলেখা আর নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

-আপনি আমার বাসা কীভাবে চিনলেন? আমি তো আপনাকে লোকেশন জানাইনি।

রওনক সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বলে,

-তুমি আমার অফিসে চাকরী করো। তোমার বাসার এড্রেস বের করা নিশ্চয়ই আমার জন্য কঠিন কোনো টাস্ক নয়।

চিত্রলেখা মনে মনে ভাবে, এটা অবশ্য ঠিক কথা। তার ঠিকানা রওনকের জন্য জানা আহামরি কোনো ব্যাপার নয়। অফিসে ঠিকানা দেয়াই আছে। হয়ত অফিস থেকে নিয়েছে। চিত্রলেখাকে অন্যমনস্ক দেখে রওনক বলে,

-লাবিব দিয়েছে।

-লাবিব সাহেব?

-হ্যাঁ।

-কিন্তু সেও তো কখনো আসেনি। মুখে মুখে বলেছিলাম একবার।

-সেটাই লাবিব জানিয়েছে আমায়।

আর কিছু বলে না রওনক। বেশি কথা বললে দেখা যাবে আসল কথাটা তার মুখ ফস্কে বেরিয়ে এসেছে। সেই আসল কথাটা হচ্ছে একদিন চিত্রলেখার পেছন পেছন হাটতে হাটতে তারবাড়ি পর্যন্ত এসেছিল রওনক। কেন এসেছিল তা তার জানা নেই। হেটে এসেছিল বলেই রাস্তাটা মনে আছে তার। গাড়ি করে আসলে হয়ত এত পরিষ্কার মনে থাকতো না। তবুও হয়ত তার বোকামি হয়ে গেল। চিত্রলেখাকে জিজ্ঞেস করে না জানার ভনিতা করা উচিত ছিল। সে যাক গিয়ে, যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে।

রওনক গাড়ি থেকে নেমে এসে চিত্রলেখার দরজা খুলে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-হাতটা ধরে নামো।

চিত্রলেখা একবার রওনকের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার আশেপাশে তাকায়। এলাকার মুখ পরিচিত অনেক মানুষজন আশেপাশেই আছে। চিত্রলেখা এখানেই বড় হয়েছে। এলাকায় তার খালুর পরিচিতু আছে। মোটামোটি এলাকার সবাই তাকে চিনে। এত বড় গাড়ি করে বাসা পর্যন্ত এসেছে এতেই না লোকে কত কথা বলা শুরু করে দেয়। এখন যদি সে রওনকের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতর পর্যন্ত যায় তাহলে তো হয়েই গেল। মানুষ বলার জন্য হাজারটা কথা পেয়ে যাবে। চিত্রলেখাকে বসে থাকতে দেখে রওনক তাগাদা দিয়ে বলে,

-কি হলো? নামো।

আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-আমি নিজেই হাটতে পারবো।

-আমি তো তোমায় বলছি না আমার কোলে উঠতে। জাস্ট হাতটা ধরবে।

আগের চাইতে আরও বেশি আমতা আমতা করে চিত্রলেখা বলে,

-আশেপাশের মানুষজন হয়ত বিষয়টা খারাপ ভাবে নিবে।

-কিন্তু তুমি অসুস্থ!

-সে কথা তো সবাই জানে না।

রওনক বিরক্ত হয়ত। এসব ম্যান্টালিটি তার একদম পছন্দ নয়। যারা নিজের কথা বাদ দিয়ে লোকে কি বলবে সেসব চিন্তা বেশি করে তাদেরকেও রওনকের বিরক্ত লাগে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে চিত্রলেখার উপর বিরক্ত হতে পারছে না। লোকে কি বলবে বা ভাববে সেটা ভাবার সময় তার নেই । সে ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চিত্রলেখার হাত ধরে তাকে টেনে গাড়ি থেকে নামায়। যেমন ঠেলে বসিয়েছিল তেমনি টেনে বের করলো। মনে মনে ভাবে, কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শুনে না কেন মেয়েটা? লাবিবের কথাও কি সে একবারে শুনে না? নাকি লাবিবের কথা শিরোধার্য? আমার সাথে গাড়িতে আসতে সমস্যা কিন্তু লাবিবের সঙ্গে বাইকে আসতে কোনো সমস্যা নেই। তখন লোকে কথা বলতো না? এসব আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতেই মনে মনে নিজেকে ঝাড়ি লাগায় রওনক। কিসব ভাবছে সে!

রওনকের চিত্রলেখাকে হাত ধরে টেনে বের করার চিত্র আশেপাশে থাকা অন্যরা লক্ষ না করলেও দুবাড়ি অন্যপাশে টঙ দোকানে বসে থাকা মামুন ঠিকই দেখেছে। এমন দৃশ্য দেখে তার মুখের চা বেরিয়ে এসেছে। অপেক্ষা না করে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে তৎক্ষনাৎ কদম বাড়ায় মামুন চিত্রলেখার দিকে।

বাড়ির গেইটা সচরাচর খোলাই থাকে কিন্তু আজ ভেতর থেকে লাগানো। চিত্রলেখা জোরে জোরে কয়েকবার ধাক্কা লাগায়। এই সময় খালা আর চারু বাসায় থাকে। খালা কখনো কখনো ঘুমায়। কিন্তু চারু ঘুমায় না। কয়েকবার দরজায় জোরে বারি দেয়ার পরেও এখনো কেউ দরজা খুলছে না। ততক্ষণে মামুন এগিয়ে এসেছে। পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে,

-মায়া তুই এই সময় বাসায়?

পাশ ফিরে মামুনকে দেখে খানিকটা চমকে যায় চিত্রলেখা। সে মনে-প্রাণে চাইছিল মামুনের সঙ্গে এখন যেন তার দেখা না হয়। মামুন দেখলেই তাকে জেরা করবে। একশ একটা প্রশ্ন তার দিকে ছুঁড়ে দিবে। তার প্রথম প্রশ্নই হয়ত হবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কে? চিত্রলেখা একদম চায় না রওনক তাকে পৌঁছে দিতে এসে কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পরুক। মামুনকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে দেয়ার সুযোগ না দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-মামুন ভাই আমার শরীরটা ভালো না। আমরা পরে কথা বলি?

চিত্রলেখার শরীর ভালো নেই শুনেই মামুন ব্যস্ত হয়। নিজের জায়গা থেকে এগিয়ে আসে, হাত বাড়ায় চিত্রলেখার কপালে হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা দেখবে বলে। কিন্তু মামুনের হাত চিত্রলেখার কপাল স্পর্শ করার আগেই রওনক তার হাত ধরে টান দিয়ে দু’কদম পেছনে সরিয়ে আনে। ঘটনার আকস্মিকতায় মামুন বা চিত্রলেখা কে কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে বুঝে উঠতে পারে না। চিত্রলেখা অবাক হয় রওনকের কান্ড দেখে। বিস্ময়ে কথা বলতে পারে না সে। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,

-মামুন ভাই আমার জ্বর নেই। এমনি শরীরটা একটু খারাপ।

তখনই চারু ভেতর থেকে লোহার গেইটটা খুলে দেয় ঝনঝন শব্দে। দরজা খুলে বোনকে দেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চারুকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে চিত্রলেখা বলে,

-হা করে দাঁড়ায় আছিস কেন চারু?

নিজেকে সামলে নিয়ে চারু বলে,

-আপা তুমি এই সময়!

-শরীরটা ভালো নেই।

এতক্ষণে চারু বড় বোনকে লক্ষ করেছে। আসলেই মুখটা চুপসে একটুখানি হয়ে গেছে তার। চিত্রলেখার একটা হাত ধরে চারু বলে,

-সকালে তো ঠিকঠাকই গেলা আপা। হঠাৎ কি হলো? আসো, ভেতরে আসো।

রওনকও ওদের পেছন পেছন আসা ধরলে তার খেয়াল হয় চিত্রলেখার ঔষধ গাড়িতেই রয়ে গেছে। সে চিত্রলেখাকে বলে,

-আমি এক্ষুনি আসছি।

রওনক আবার বেরিয়ে যেতেই চারু ফিসফাস করে জিজ্ঞেস করে,

-লোকটা কে আপা?

-আমার বস।

-লাবিব ভাইয়া যার কথা বলো সবসময়? তার এত বড় গাড়ি আছে আগে তো কখনো বলোনি।

-আরে লাবিব না। কোম্পানির মালিক।

-এ্যা!

বিস্ময়ে চারুর মুখ হা হয়ে গেছে। তা দেখে চিত্রলেখা বলে,

-মুখটা বন্ধ কর দেখে ফেলবে তো।

চারু নিজেকে সামলে নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিন্তু কোম্পানির মালিক, এত বড় একজন মানুষ ওর বোনকে ছাড়তে নিজে এসেছে বিষয়টা সহজে হজম হওয়ার মতো নয়।

রওনক ফিরে এসে গাড়ির পেছনের দরজা খুলে চিত্রলেখার ঔষধ ও ব্যাগটা নিয়ে নেয়। সকাল থেকে ব্যাগটা তার গাড়িতেই আছে। চিত্রলেখাকে দেয়া হয়নি। এখন ঔষধ নিতে এসে চোখে পড়লো। ঔষধ, ব্যাগ নিয়ে গাড়ির দরজা লক করে বাড়ির ভেতর ঢোকার জন্য কদম বাড়ালে পাশ থেকে মামুন জিজ্ঞেস করে,

-আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?

মামুন এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল, যায়নি। রওনককে দেখে তার মনে কৌতূহলের জন্ম হয়েছে। তার মায়াকে গাড়ি করে বাড়ি অব্দি নিয়ে এসেছে। মানুষটা কে জানার তাগাদা অনুভব করছে মামুন। প্রশ্ন শুনে থেমে গিয়ে ঠান্ডা দৃষ্টি নিয়ে মামুনের দিকে তাকায় রওনক। জবাব না পেয়ে মামুন আরও জিজ্ঞেস করে,

-মায়ার সঙ্গে একই অফিসে চাকরী করেন বুঝি?

-মায়া কে?

জিজ্ঞেস করে রওনক। প্রশ্ন শুনে শব্দহীন প্রশস্ত হেসে মামুন বলে,

-চিত্রলেখা, ওকে ভালোবেসে মায়া বলে ডাকি আর কি।

আঁড়চোখ করে তাকায় রওনক। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা। মুখ ফস্কে বলেও ফেলে,

-ভালোবেসে?

-জি, খুব জলদি বিয়েও করবো আমরা।

চোখ-মুখ শক্ত হয় রওনকের। সেটা হয়ত মামুন খেয়াল করে না। চিত্রলেখার কথা ভাবার সময় দুনিয়ার অন্য কিছু দেখার সময় পায় না মামুন। সে তার মন-মস্তিষ্ক সবটা দিয়েই চিত্রলেখাকে ভালোবাসে। রওনককে চুপ করে থাকতে দেখে মামুন আবার জিজ্ঞেস করে,

-তা বললেন না আপনারা একই অফিসে চাকরী করেন নাকি?

-সেটা আপনার না জানলেও চলবে।

বলে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না রওনক। দ্রুত কদম ফেলে বাড়ির ভেতর ডুকে যায়। নীল রঙের বড় লোহার গেইটটা দিয়ে ঢুকতেই উঠানের মতো অনেকটা জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। ডান পাশে দুই ভাগ করে বাগান করা। একপাশে সবজি গাছ দেখা যাচ্ছে আরেকপাশে ফুলের গাছ। বাম পাশে একতলা বাড়িটার শুরুতেই বারান্দা। ঢুকার মুখে হাতের ডান পাশে একটা চাপ-কল বসানো। এই বাড়ির মানুষগুলোর জীবনযুদ্ধের গল্প যেন চোখ বুলালেই জানা যাচ্ছে। আশপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভেতরে চলে যায় রওনক। চিত্রলেখা ড্রইং রুমেই বসে আছে। রওনককে বিদায় দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুবে সে। চিত্রলেখার একপাশে নারগিস বেগম বসে আছেন তাকে আলতো জড়িয়ে। চোখে ভিজে আগে তার। চারু এখানে নেই। রওনককে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক বলে,

-ইটস ওকে উঠতে হবে না। কিন্তু এখানে না বসে বিশ্রাম করলে হয়ত বেটার হতো।

-এখন ঠিক আছি আমি।

খালার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-এটা আমার খালা। আর খালা উনি হচ্ছেন আমার বস। উনার কোম্পানিতেই চাকরী করি।

নারগিস বেগম ধন্যবাদ জানায় রওনককে চিত্রলেখার এতোখানি খেয়াল রাখার জন্য। ততক্ষণে চারু নাস্তা নিয়ে এসেছে রওনকের জন্য। বেরিয়ে পড়া উচিত চিন্তা করে বলে,

-আমি আসছি।

বাধা দিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-একটু কিছু মুখে দিন।

রওনক আপত্তি না করে ট্রে তে রাখা শরবতের গ্লাসটা তুলে সবটুকু একটানে খেয়ে নিলে তা দেখে চারু বলে,

-আপা সবসময় বলে একটানে পানি বা শরবত খেতে নেই। শয়তানের কাজ হচ্ছে একটানে খাওয়া।

চারুর বাড়তি কথার বাতিক আছে। পাশ থেকে চিত্রলেখা ধমকের সুরে বলে,

-কি হচ্ছে কি চারু?

-ওমা আপা তোমার থেকে যা শিখেছি তাই তো বললাম।

চিত্রলেখাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রওনক বলে,

-ইটস ওকে, আসলে আমার তাড়া আছে তাই জলদি করে একটানে খেলাম। এরপর থেকে খেয়াল রাখবো। পরেরবার আর একটানে খাবো না।

-আপনি আবার আমাদের বাসায় আসবেন?

জিজ্ঞেস করে চারু। এমন কথায় চিত্রলেখা, রওনক দু’জনেই অপ্রস্তুত হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে রওনক হালকা করে মাথা ঝাঁকায়। তারপর হাতে থাকা ঔষধ ও ব্যাগ চিত্রলেখার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে,

-তোমার ঔষধ। আর ব্যাগটা আমার গাড়িতেই ছিল।

ব্যাগ দেখে চিত্রলেখা মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচে। তার ব্যাগে পনেরো’শ টাকা ছিল। বেতন না পাওয়া অব্দি তাকে এই টাকা দিয়েই চলতে হবে। সে ভেবেছিল ব্যাগের সাথে টাকাগুলোও গেছে। এখন ব্যাগ ফিরে পেয়ে স্বস্তি লাগছে। কিন্তু রওনকের উপস্থিতিতে ব্যাগ খুলে এক্ষুনি দেখতে পারছে না ভেতরে টাকা আছে কিনা। হতেই পারে হাত থেকে ব্যাগ পরে যাওয়ার সময় টাকাটা কোথাও পড়ে গেছে। কিন্তু রওনক না যাওয়া পর্যন্ত চেক করার কোনো উপায় নেই।

চিত্রলেখা তার হাত থেকে ব্যাগ ও ঔষধ নিলেই উঠে দাঁড়ায় রওনক। বিদায় নিতে নিতে বলে,

-কাল পরশু তো এমনি অফিস বন্ধ। যদি মনে করো আরও বিশ্রাম প্রয়োজন তাহলে আমায়…(এক মুহূর্ত থেমে বলে) লাবিবকে জানিয়ে দিলেই হবে। একদম সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত অফিস আসার প্রয়োজন নেই। ইউ টেক রেস্ট এন্ড টেক কেয়ার অফ ইউসেলফ। আজ আসছি।

চিত্রলেখা রওনককে বিদায় দিতে বারান্দা পর্যন্ত এসেছে। নীল লোহার গেইটটা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একবার পেছন ফিরে তাকায় রওনক। আজকের দিনের মতো শেষবার তাদের চোখাচোখি হয়। রওনকের চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয় চিত্রলেখা। আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় রওনক। গাড়িতে বসেই স্টার্ট দেয়। অন্যপাশের টঙ দোকানের ছাউনির তলায় বসে রওনকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে মামুন।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৮+৯

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব- ৮
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখনের বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে ৯ টা বেজে গেল আজ। বাসায় ফিরার সময় দুই কেজি ওজনের একটা বয়লার মুরগী নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। ভাইকে এই অসময়ে মুরগী সমেত বাড়ি ফিরতে দেখে চিত্রলেখা জিজ্ঞেস করে,

-কিরে অসময়ে মুরগী কেন?

-তোমার হাতের চিকেন বিরিয়ানী খাইতে মন চাচ্ছে আপা। তাই নিয়ে আসলাম।

-তুই টাকা কই পাইলি?

-বৃষ্টির আম্মু বেতন দিয়ে দিছে।

-তাও তুই আনতে গেলি কেন? আমাকে ফোন দিয়ে বলতি আমি আসার সময় নিয়ে আসতাম। এতক্ষণে রান্নাও হয়ে যাইতো তাহলে।

-তোমাকে পাইলে না বলবো?

-মানে!

-মানে তোমার ফোন! বন্ধ ছিল কল দিয়ে পাই নাই।

-ওহ! সারাদিন কাজে ব্যস্ত ছিলাম। কখন ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে বলতে পারি না।

-চার্জ শেষ হয়ে গেছে না বইলা বলো তোমার ফোনের চার্জ থাকে না। কতদিন ধরে বলতেছি এই নষ্ট ফোনটারে বাদ দিয়ে একটা নতুন ফোন কিনো।

-দরকার হইলে কিনবো। এখন এটাই ভালো চলতেছে।

-চলতেছে না তুমি জোর করে চালাইতেছো আপা। এই মাসে অন্তত একটা ফোন কিনো। এক মাস নাহয় আমরা একটু কম খাইলাম।

-তুই যা তো গিয়ে ফ্রেশ হ। গোসল কর গিয়ে।

-এখন তো আমাকে ভাগাবাই দরকারী কথা বলতেছি যে।

-হইছে বুঝছি তো।

লিখন চলে যেতে নিয়ে থেমে গিয়ে আরও বলে,

-আপা তোমার কষ্ট না হইলে আজকেই বিরিয়ানি রান্না কইরো। আর আলু দিও বেশি করে।

-আচ্ছা, রানতেছি।

লিখনটা এমনই। প্রতিদিন তিনবেলা তাকে বিরিয়ানি দিলে তার চাইতে খুশি কেউ হবে না। এনড্রয়েডের নামে একটা একদমই নরমাল মোবাইল চালায় চিত্রলেখা। তাও চার বছরের অধিক সময় হয়ে গেছে সে মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করছে। মাঝে একবার ব্যাটারি বদলে নিয়েছিল। আট/দশ হাজার টাকা দামের একটা ফোন কতদিনই বা সার্ভিস দিবে! আরও আগেই বদলে নেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চিত্রলেখা কখনই নিজের প্রয়োজনগুলোকে প্রায়োরেটি দেয়নি। তাই কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। তবে চিত্রলেখা চাইলেই দু/তিন ‘মাস কিছু টাকা সাইড করেই একটা মোটামোটি ভালো ব্রান্ডের ও দামের ফোন কিনতে পারে। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে সে তা করবে না।

বিরিয়ানী দমে বসিয়ে রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে চিত্রলেখা। ড্রইং রুমে নারগিস বেগম সহ বাকিরা সবাই মিলে টেলিভিশন দেখতে ব্যস্ত। চিত্রলেখাকে এগিয়ে আসতে দেখে নারগিস বেগম বলেন,

-আয় মা আমার সাথে বোস।

চিত্রলেখা এগিয়ে গিয়ে খালার পাশে বসতেই তিনি মেয়ের মুখ নিজের আঁচল দিয়ে মুছে দিয়ে বলেন,

-ঘরে বাইরে এত কাজ করলে তো অসুস্থ হয়ে যাবি মা।

-হবো না খালা। আর মাঝেমধ্যে একটু অসুস্থ হইলেও দোষ নাই। কিন্তু তুমি তো জানোই আমি সহজে অসুস্থ হই না।

নারগিস বেগম আরও কিছু বলতেন কিন্তু তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে লিখন চিত্রলেখাকে জিজ্ঞেস করে,

-আপা আজকে কি তোমার মামুনের ভাইয়ের সাথে দেখা হইছিল নাকি?

চিত্রলেখা জবাব দেয়ার আগে নারগিস বেগম জিজ্ঞেস করেন,

-কেন! মামুন আবার কি করলো?

-বাসায় আসার সময় দেখা হইছিল বলল আপার কথা। কি বলছে আপা মামুন ভাই তোমারে?

-ঐ পুরান প্যাঁচালই। নতুন কিছু না।

-বিয়ের কথা?

-হুম।

-তবে আপা একটা কথা কিন্তু সত্যি মামুন ভাই সত্যি সত্যি তোমারে অনেক ভালোবাসে। মামুন ভাই কেবল লেখাপড়াটাই কম করছে তোমার থেকে এছাড়া মানুষ হিসেবে কিন্তু অনেক ভালো।

-তুই হঠাৎ আজ মামুনের প্যাঁচাল শুরু করলি কেন? মতলব কি তোর?

-তুমি চাইলে মামুন ভাইয়ের প্রস্তাবের কথা ভাবতে পারো।

-আর কোনো গান নাই তোদের?

লিখনকে সমর্থন করে নারগিস বেগম বলেন,

-মামুনের মাও তোরে অনেক পছন্দ করে।

-খালা এখন তুমিও শুরু হয়ে যাইও না। আমার অনেক ক্লান্ত লাগতেছে, বিরিয়ানি দমে আছে ওদের খাইতে দিয়ে দিও। আমি গেলাম, ঘুমাবো।

-ঘুমাবো মানে? তুই খাবি না?

-আমার খুদা নাই খালা।

-খালি পেটে ঘুমাবি?

-এই পৃথিবীতে আমি একা না খালা। খোঁজ নিয়ে দেখো গিয়ে হাজার হাজার মানুষ খালি পেটে ঘুমাচ্ছে।

আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চিত্রলেখা নিজের ঘরে চলে যায় বিশ্রাম করতে। সারাদিন অফিসের পর বাসায় এসে একগাধা কাজের পর ভীষণ ক্লান্ত সে।

—————————————————————————–

রওনক আগেরদিন রাতে বেরিয়ে গিয়ে অনেক দেরিতে বাসায় ফিরেছিল। রাতে আর কারো সঙ্গে তার দেখা হয়নি। আজ সকাল সকাল ডাইনিং টেবিলে আসতেই রওনক দেখে সবাই থাকলেও দিলারা জামান নেই। জাহানারা রওনকে চা ঢেলে দিতে থাকলে সে জিজ্ঞেস করে,

-মা কই খালা?

-আপা তো তার ঘরে।

-নাস্তা করবে না?

-ডাকতে গিয়েছিলাম কিন্তু দরজা খুললেন না৷ রাতে তুমি চলে যাওয়ার পর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে বসেছেন। এখনো বের হয়ে আসেননি।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রওনক বলে,

-থাক খালা, মাকে আপাতত ঘাটার দরকার নেই। একা থাকুক মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে।

জাহানারা এই বাড়িতে অনেক বছর ধরে আছেন। রওনক উনার হাতেই বড় হয়েছে। এই বাড়ির সবকিছুর দেখাশুনা জাহানারাই করেন। মূলত দিলারা জামানের দূর সম্পর্কের বোন হয়। যার নিজের বলতে কেউ নেই এই পৃথিবীতে। অল্প বয়সে স্বামী মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করেননি। কোনো সন্তানও নেই। নিঃসঙ্গ জাহানারাকে দিলারা জামান নিয়ে এসেছেন নিজের কাছে। তখন থেকে তিনি এই বাড়িতেই থাকেন। রওনক উনার কাছেই মানুষ হয়েছে। রওনকের বাবাও নিজের বোনের মতোই আদর করতেই জাহানারাকে। রাদিন, তানিয়াও যথেষ্ট সম্মান কারে উনাকে, ভালোওবাসে।
তানিয়া রওনককে জিজ্ঞেস করে,

-বাই দ্যা ওয়ে রাতে কোথায় গিয়েছিলে রওনক?

-বলেই তো গিয়েছিলাম ভাবী ফ্রেন্ডের সাথে প্ল্যান ছিল।

-আগে তো শুনিনি, সাবা আর ওর বাবা-মাকে দেখে সাডেনলি প্ল্যান হয়ে গেল।

এই বিষয়ে আর কথা বাড়ায় না রওনক। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলতে সে এমনিও পছন্দ করে না। নাস্তা শেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।

প্রতিদিনের মতো আজও সময় মতো অফিসে চলে এসেছে চিত্রলেখা। ডেস্কে বসে নিজের প্রায় বন্ধ হয়ে যাই যাই করতে থাকা ফোনটা চার্জে লাগাতে ব্যস্ত হয়। তখনই অফিসে প্রবেশ করে রওনক। নিজের কেবিনে প্রবেশ করতে নিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় সে। পেছন ঘুরে তাকায় চিত্রলেখার দিকে। ডেস্কের নিচের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় তার দেখা জুতটাই আজ চিত্রলেখার পায়ে। তা দেখে রওনকের চোয়াল জুড়ে সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটলো যেন। চিত্রলেখা তখনও রওনককে দেখতে পায়নি। পেছন ফিরে ছিল বলে দেখতে পায়নি। মোবাইল চার্জে লাগিয়ে পেছন ঘুরতেই সে দেখতে পায় রওনক দাঁড়িয়ে আছে তার কেবিনের দরজার ঠিক সামনে। আচমকা রওনককে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। সালাম দিয়ে বলে,

-আজ লাবিব সাহেবের আসতে দেরি হবে।

-জানি।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে রওনক আরও বলে,

-একটু পরে একটা মিটিং আছে আমার। এক কাপ চা খেয়ে বের হবো। লাবিবের আসতে দেরি হবে তাই তুমি চলো আমার সঙ্গে।

-আমি! (অবাক হয় চিত্রলেখা)

-হ্যাঁ তুমি। এনি প্রবলেম?

-না, মানে আসলে আমার গেটআপ মিটিংয়ে যাওয়ার মতো কিনা তাই…

রওনক দু কদম এগিয়ে এসে একবার চিত্রলেখাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে,

-ঠিকই তো আছে।

-আসলে…

-ইউ আর লুকিং ফাই। এক কাপ চা প্লিজ তারপর বের হবো আমরা।

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা আর কিছু বলে না। রওনকও আর না দাঁড়িয়ে নিজের কেবিনে চলে যায়। চিত্রলেখা আরেকবার নিজেকে দেখে নেয়। তার পরনে আহামরি কিছু নয়। প্রতিদিন যেমন সাধারণ পরিধানে আসে আজও তাই। হাতের কাজ করা থ্রি-পিস পরনে। বেশি চিন্তা ভাবনা না করে এগিয়ে গিয়ে চা বানায় রওনকের জন্য।

দশটার দিকে ওরা বেরিয়ে পরে মিটিংয়ের জন্য। লিফটের কাছে আসতেই চিত্রলেখা বলে,

-আপনি লিফটে চলে যান আমি সিড়ি দিয়ে আসছি।

-কেনো?

-না মানে এমনি।

-তুমি লিফট রেখে সিড়ি দিয়ে নামবে তাও নয় তলা থেকে?

মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা।

-সমস্যা কোথায়?

-কোনো সমস্যা নেই।

-অবশ্যই সমস্যা আছে। স্বাভাবিক মানুষ এমনটা করবে বলে আমার মনে হয় না।

-না মানে আসলে…

চিত্রলেখা নিজের কথা শেষ করতে পারে না। তখনই নিচ থেকে লিফট চলে এসেছে। রওনক আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আচমকাই চিত্রলেখার একটা হাত ধরে তাকে টেনে সঙ্গে নিয়ে লিফটে উঠে পড়ে। চিত্রলেখা আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। লিফট নিচে যেতে শুরু করলে চুপচাপ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কতক্ষণে সে লিফট থেকে বের হবে সেই অপেক্ষা। চিত্রলেখার কোনো কিছুতেই কোনো ধরনের সমস্যা নেই কেবল মাত্র দুটো বিষয় ছাড়া। তন্মধ্যে একটা হচ্ছে বন্ধ জায়গার ফবিয়া। বন্ধ জায়গায় এক মিনিটও থাকতে পারে না সে। বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। চিত্রলেখার হয়েছে একই দশা। সে মনে মনে ভাবছে কতক্ষণে লিফন নিচে নেমে দরজা খুলবে আর তখনই দু’ ফ্লোর নামতে না নামতেই আচমকা লিফটটা থেমে যায়। হয়ত কারেন্ট চলে গেছে। অফিস বিল্ডিংয়ে জেনারেটর আছে যেকোনো মুহূর্তেই লিফট আবার চলতে শুরু করবে। কিন্তু আচমকা লিফট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘাবড়ে যায় চিত্রলেখা। ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কি হলো?

-ভয় পাওয়ার কিছু নেই। হয়ত ইলিকট্রিসিটি চলে গেছে এক্ষুনি জেনারেটর অন হয়ে যাবে। ইটস ওকে।

রওনক ইটস ওকে বললেও চিত্রলেখা শান্ত হতে পারে না। অন্ধকারে মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। তাড়াহুড়ো করে নিজের ব্যাগ থেকে ফোন বের করে চিত্রলেখা লাইট অন করতে। এখনো জেনারেটর অন হয়নি। তাড়াহুড়োয় চিত্রলেখার হাত থেকে ফোনটা পরে যায়। অন্ধকারে সে হাতড়েও ফোনটা খুঁজে পায় না। রওনক নিজের ফোন বের করে লাইন জ্বালাতেই দেখতে পায় চিত্রলেখা নিচে বসে তার ফোন খুঁজছে। কিন্তু ফোনটার অলরেডি ব্যাক সাইড খুলে ব্যাটারি বেরিয়ে গেছে। সে লাগানোর চেষ্টা করলে রওনক বলে,

-আমাকে দাও আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।

চিত্রলেখা উঠে দাঁড়ালে রওনক তার দিকে লাইট দিতেই খেয়াল করে এরই মধ্যে চিত্রলেখা ঘেমে গেছে অনেকখানি। এমনকি সে খানিকটা কাঁপছেও। চিত্রলেখার এমন অবস্থা দেখে ব্যস্ত কন্ঠে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-আর ইউ অলরাইট?

-এখনো লাইট আসছে না কেন? কাউকে বলবেন লিফটটা খুলতে।

রওনক টের পায় চিত্রলেখার নিঃশ্বাস নিতে হয়ত কষ্ট হচ্ছে। তাই জিজ্ঞেস করে,

-তুমি ঠিক আছো তো? তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?

-কাউকে বলুন প্লিজ দরজাটা খুলতে আমি শ্বাস নিতে পারছি না। দরজাটা খুলতে বলুন প্লিজ। দরজাটা…

চিত্রলেখা কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই পেছন দিকে ঢলে পরতে নেয়। কিন্তু পরে যাওয়ার আগেই রওনক তাকে ধরে ফেলে। চিত্রলেখার খুলে যাওয়া ফোনটা পকেটে রেখে তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। তখনই জেনারেটর অন হয়ে লিফট চলে শুরু করে। লিফটটা নিচে নামতেই রওনক চিত্রলেখাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। লিফট এসে পার্কিং-এ থেমেছে। বেহুঁশ চিত্রলেখাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে রওনক। ড্রাইভারকে বলে স্কয়ার হসপিটালে যেতে। তখনও জ্ঞান নেই চিত্রলেখার। সে শান্ত হয়ে রওনকের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রওনক চিত্রলেখাকে সিট শুইয়ে দেয় না। পরম যত্নে তার মাথাটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেছে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৯
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখার জ্ঞান ফিরলো প্রায় দুই ঘন্টা পর। জ্ঞান ফিরে চোখ মেলতে একটি আভিজাত্য হাসপাতালের দামী কেবিনের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করে যারপরনাই বিচলিত হলো সে। তৎক্ষনাৎ মনে করার চেষ্টা করলো সে এখানে কীভাবে এসেছে! মস্তিষ্কের উপর চাপ প্রয়োগ করলে খানিকটা অস্বস্তি হলো বটে কিন্তু তৎক্ষনাৎ মনেও পড়ে গেল লিফটে জ্ঞান হারিয়েছিল সে। চোখের সামনে ঘটঘুটে অন্ধকার ছেয়ে গেল, শরীর ছেড়ে দিয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পরছিল সে। তৎক্ষনাৎই একটা হাত জড়িয়ে ধরেছিল তাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে। তারপর আর কিছু মনে নেই। কেবল মনে পড়ছে তার সঙ্গে সিইও স্যার ছিল। কেবিনের চারদিকে একবার চোখ বুলালো চিত্রলেখা কিন্তু এখানে কোথাও মানুষটা নেই। তাহলে সে এখানে কীভাবে এলো? কে নিয়ে এলো তাকে? জ্ঞান হারানোর পর কি হয়েছিল তার সাথে? কিছু মনে পড়ে না চিত্রলেখার। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত প্রেসার দেয়ার ফলে মাথা ব্যথা করতে আরম্ভ করলো যেন। দপদপ করে সেই ব্যথা বাড়ছে টের পেয়ে আপাতত অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনা বাদ দিতে চায়৷ কিন্তু চাইলেই কি এমন চিন্তা ভাবনা বাদ দেয়া যায়! অন্যরা পারলেও চিত্রলেখা পারে না। সে আরও বেশি তাগাদা অনুভব করে জানার কি হয়েছে তার সাথে জ্ঞান হারানোর পর। কিন্তু এখানে তার প্রশ্নের উত্তর করবে এমন কেউ নেই। নিরুপায় হয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই শুয়ে থাকে চিত্রলেখা। চাইলেও উঠতে পারছে না কারণ তার হাতে ড্রিপ লাগানো, সেলাই চলছে। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে দরজার দিকে তাকায় যদি কেউ আসে। কিন্তু কে আসবে? ভাবতে ভাবতেই চিত্রলেখাকে অবাক করে দিয়ে কেবিনের দরজাটা খুলে গেল। দরজা ঠেলে একজন নার্স ভেতরে চলে এলো। ফস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। এখন হয়ত কিছু জানা যাবে। নার্স এগিয়ে এসে চিত্রলেখার জ্ঞান ফিরেছে দেখে জিজ্ঞেস করে,

-এখন কেমন লাগছে আপনার?

হালকা করে মাথা ঝাঁকায় চিত্রলেখা। নার্স ড্রিপটা চেক করে দিয়ে বলে,

-বিশ্রাম করুক ঠিক হয়ে যাবেন।

নার্সটা চলে যেতে নিলে চিত্রলেখা বলে,

-একটু শুনবেন?

থেমে গিয়ে ফিরে এসে নার্স জিজ্ঞেস করে,

-কিছু লাগবে আপনার?

-আমি এখানে কীভাবে এসেছি? কে নিয়ে এসেছে আমাকে?

-সেটা তো আমি বলতে পারছি না।

-কী হয়েছে আমার?

-কেমন গুরুতর কিছু নয়। পাসআইট করেছিলেন। আপনার সম্ভবত কোনো ফোবিয়া আছে বা প্যানিক এ্যাটাক হয়েছে।

-বন্ধ করে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। লিফট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

-সেজন্যই আনা হয়েছে আপনাকে। বিশ্রাম করলেই সেরে যাবেন। চিন্তার কোনো কারণ নেই।

-আপনি কি একটু কষ্ট করে আমাকে জানাবেন কে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে?

-ঠিক আছে, আপনি বিশ্রাম করুন আমি খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি। এই মুহূর্তে আর স্ট্রেস নিবেন না আবার প্যানিক এ্যাটাক হতে পারে।

নার্স বেরিয়ে যায়। চিত্রলেখা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে এই আশায় কখন নার্সটা ফিরে এসে তাকে জানাবে এখানে তাকে কে নিয়ে এসেছে? আজ তো ঐ সময় লাবিব অফিসে ছিল না। তা-না হলে চিত্রলেখা নিঃসন্দেহে ধরে নিতো লাবিবই তাকে নিয়েছে। অফিসে একমাত্র লাবিবের সাথেই তার সখ্যতা আছে। এছাড়া অন্যদের সাথে পরিচয় থাকলেও তেমন কোনো সখ্যতা নেই। কাজের বাহিরে কখনো কারো সঙ্গে তেমন কোনো সখ্যতা গড়ে ওঠেনি তার। চিত্রলেখার মাথার ভেতর রওনক নামটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে এই মুহূর্তে। কোনোভাবে কি মানুষটা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে? কিন্তু এমন হওয়ার সম্ভাবনা কম। তার জরুরী মিটিং আছে। সে নিশ্চয়ই নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে তার মতো সাধারণ একজন কর্মচারীর জন্য সময়ের অপচয় করবেন না। নিশ্চয়ই অফিসের কাউকে দিয়েই পাঠিয়েছেন হবে হয়ত। বাসায় খবর দেয়া হয়েছে? বেডের পাশে থাকা টেলিবে একবার তাকায় চিত্রলেখা। নিজের ফোনটা খুঁজে আনমনে। মনে মনে ভাবে, ফোনটা কোথায় আমার? চিন্তা করতেই মনে পড়ে যায় তার ফোনটা তো লিফটে পড়ে গিয়েছিল। সেটা তুলতেই বসেছিল সে। তারপর সেটা কোথায় গেল? এদিক সেদিক তাকায় চিত্রলেখা নিজের ফোন খুঁজতে কিন্তু দেখা মিলে না। তখনই আবার কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে একটু আগে আসা সেই নার্সটাই। চিত্রলেখার কাছাকাছি এগিয়ে এসে নার্সটা কিছু বলার আগে সে নিজেই জিজ্ঞেস করে,

-আমার ফোনটা কোথায় দেখেছেন? খুঁজে পাচ্ছি না।

-আমরা আপনার সাথে কোনো ফোন পাইনি।

-আমার ব্যাগ! ব্যাগে আছে হয়ত ফোনটা।

-আপনাকে যখন আনা হয়েছিল তখন আপনার সঙ্গে কোনো ব্যাগ ছিল বলে মনে হয় না।

তবু বেডের পাশে থাকা কেবিনেটের ড্রয়ারে একবার দেখে। দেখে নার্স জানায়,

-নেই, থাকলে এখানেই থাকতো। এখানে নেই মানে আওনার সঙ্গে ছিল না।

গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয় চিত্রলেখা। তার ব্যাগ, ফোন সব কোথায় গেল? নিশ্চয়ই এর উত্তর মিলবে যদি জানা যায় তাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে সেটা জানা যায় তো। যে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে তার কাছেই হয়ত আছে ব্যাগ আর ফোন। এই মুহূর্তে জানা খুব প্রয়োজন মানুষটা কে। কে তাকে নিজ দায়িত্বে এখানে নিয়ে এলো! অদ্ভুত এক বুলভলাইয়াতে ডুবে আছে চিত্রলেখা। এর থেকে নিস্তার প্রয়োজন তার।

-মিস্টার জামান আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। পেপার্সে আপনার গার্ডিয়ানের জায়গায় উনার নামই লেখা দেখলাম।

নার্সের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে চিত্রলেখার। চোখ ঘুরিয়ে নার্সের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়া কন্ঠে বলে,

-মিস্টার জামান!

-জি, রওনক জামান।

-আমার গার্ডিয়ান!

-জি, আপনার এডমিশন পেপার্সে এমনটাই লেখা দেখলাম।

কয়েক মুহূর্ত ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা নার্সের মুখের দিকে। তা দেখে নার্সটা বলে,

-আপনি বিশ্রাম করুন।

নার্সটা বেরিয়ের যাওয়ার উদ্যোগ নিলে চিত্রলেখা বলে,

-আমার তো এখন জ্ঞান ফিরে এসেছে। আমি বাসায় যেতে চাই।

-আপনাকে ছেড়ে দেয়া হবে কিন্তু আগে আপনার গার্ডিয়ান আসুক তারপর।

-আমার তো কোনো গার্ডিয়ান নেই। আমি নিজেই আমার গার্ডিয়ান।

-তাহলে যে আপনাকে এখানে ভর্তি করিয়েছে সে! সে কি হয় আপনার?

এক মুহূর্ত নার্সের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। ভাবলেশহীন সেই চাহনী। তারপর শান্ত সুরে বলে,

-কেউ হয় না উনি আমার।

নার্সটা কি বুঝলো বা কি ভাবলো কে জানে! এগিয়ে এসে চিত্রলেখার মাথায় মৃদু হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-হাসপাতালের তো কিছু নিয়ম আছে। পেশেন্ট বললেই আমরা তাকে ছেড়ে দিতে পারি না। তাও দেয়া যেত যদি আপনি নিজে এসে ভর্তি হতেন, তাহলে। কিন্তু আপনাকে তো আরেকজন ভর্তি করিয়েছে। আমাদের জন্য সেই আপনার গার্ডিয়ান। তাই তার অনুমতি ছাড়া আমরা আপনাকে ছাড়তে পারবো না। আপনি বিশ্রাম করুন। উনি চলে আসবেন। তারপর ডাক্তার চেকাপ করে দেখবেন। যদি মনে করেন আপনাকে রাখার প্রয়োজন নেই তাহলে ছেড়ে দিবে।

নার্সের সব কথা চিত্রলেখার মাথায় ঢুকলো না। তার মস্তিষ্ক কেবল ক্যাচ করলো একটা কথা। ❝উনি চলে আসবেন।❞ নার্স যে উনি বলতে রওনক জানামকে বুঝিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার। নার্সের কথা টেনে ধরেই সে বলল,

-উনি আসবেন বলেছেন?

-জি, বলে গেছেন জলদিই চলে আসবেন। আমরা যেন আপনার খেয়াল রাখি।

আবারও কোনো গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয় চিত্রলেখা। তার মস্তিষ্ক জুড়ে একটাই কথা। রওনক জানাম নামক মানুষটা যে কিনা এত বড় কোম্পানির সিইও সে তাকে নিজে এসে এখানে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। আবার যাবার সময় বলেও গেছে সে আবার আসবে। কেন আসবে? তাকে দেখতে? কিন্তু কেন? অন্য কাউকে না দিয়ে সে নিজে কেন তাকে হাসপাতালে নিয়ে এলো? এসব কেন এর উত্তর নেই চিত্রলেখার কাছে তারপরেও মস্তিষ্ক প্রশ্নের জাল বুনেই যাচ্ছে একের পর এক।

রওনক কেবল চিত্রলেখাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েই চলে যায়নি। বরং পাক্কা চল্লিশ মিনিট তার মাথার কাছটাতেই বসেছিল। সেই বসে থাকার দরুন জ্ঞান হারিয়ে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকা চিত্রলেখার একটা হাতও ধরেছিল সে কয়েক মুহূর্তের জন্য। যা হয়ত তার উচিত হয়নি। তবু ধরেছিল সে। মিটিংটা ক্যান্সেল করার কোনো উপায় ছিল না। বিদেশি ডেলিটেকের সাথে মিটিং আজ না হলে আবার লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী মিটিংয়ের ডেট পেতে। তাই দেরি করে হলেও তাকে যেতে হয়েছে। যদিও মিটিং টা বেলা বারো টায় ছিল। ইচ্ছা করেই সে চিত্রলেখাকে নিয়ে আগে ভাগেই বেরিয়ে গিয়েছিল। অথচ নিচে নামার আগেই অসুস্থ হয়ে গেল মেয়েটা। চিত্রলেখা বলেও ছিল লিফটে না উঠে সিড়ি বেয়ে নামবে কিন্তু সে কোনো কথা না শুনেই তাকে লিফটে তুলে নিলো। দেখতে গেলে তার জন্যই মেয়েটা এমন অসুস্থ হয়ে পড়লো। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকা চিত্রলেখার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল রওনক। চোখ ফেরাতে পারেনি সে। এমন মুখোশ্রী থেকে চোখ ফেরানোটাও কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এমনি চিত্রলেখাকে দেখতে তার মনে হয় মেয়েটা এক পৃথিবী কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে নিজের কাঁধে। অসুস্থ হয়ে সেই মুখটা যেন আরও মলিন হয়ে গেছে। অব্যক্ত, বলতে না পারা হাজার টা কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই মুখে যা স্পষ্ট না হলেও আবছা আবছা দেখতে পারছে রওনক। বুঝতে না পারলেও খানিকটা অনুভব করতে পারছে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-৬+৭

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৬
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চারুর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন নারগিস বেগম। সপ্তাহে তিনদিন মাথায় তেল দেয়াটা বাধ্যতামূলক। চিত্রলেখার আদেশ অমান্য করার সুযোগ নেই। মাথায় তেল দিতে দিতেই চারু খালাকে জিজ্ঞেস করে,

-খালা, আপা কি কোনো কারণে চিন্তিত। তুমি কি কিছু জানো?

-কেন? কিছু হইছে?

-কি হইছে জানলে কি আর তোমারে জিজ্ঞেস করতাম?

-কি হইছে মানে কি দেখে তোর মনে হইলো তোর আপা চিন্তিত সেটা তো বলবি নাইলে আমি বুঝবো কেমনে রে মা?

-কাল সারারাত আপা ঠিক মতো ঘুমায় নাই। আমার যতবার ঘুম আলগা হইছে আমি খেয়াল করছি আপা ঘুমায় নাই। বারবার পাশ ফিরছে। মাঝরাতে উঠেও বসেছিল অনেকক্ষণ।

নারগিস বেগমের বুঝতে অসুবিধা হয় না আচমকা ঠিক কোন কারণে চিত্রলেখার রাতের ঘুম উড়ে গেছে। মনে মনে এসব নিয়েই চিন্তা হচ্ছিল উনার। চিত্রলেখা মুখে বলবে না কখনোই। একা একা নিজেই চিন্তা করবে। নিজের চিন্তা সে কারো সাথে ভাগভাগি করে না। ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন নারগিস বেগম। চারু আবার জিজ্ঞেস করে,

-তুমি কিছু জানো খালা?

-চিত্রলেখা তো আমায় কিছু বলে নাই। আজ আসুক কথা বলে দেখবো আমি। তুই চিন্তা করিস না।

—————————————————————————-

রিপাকে ধানমন্ডিতে নামিয়ে দিয়ে লিখন চলে এসেছে রায়ের বাজার। এক্ষুনি বাসায় যাবে না সে। বৃষ্টি ও নাঈমকে পড়াবে তারপর বাসায় যাবে৷ বৃষ্টি আগামী বছর উচ্চমাধ্যমিক দিবে আর নাঈম এবার ক্লাস নাইনে পড়ে। চারবছর ধরে ওদের পড়ায় লিখন। দুই ভাইবোনকে পড়িয়ে মাসে সাত হাজার টাকা পায়। আরও দুটো টিউশনি করে সে। ওদেরকে সপ্তাহের চারদিন পড়াতে হয়। বৃষ্টির মা অনেক ভালো, লিখনকে যথেষ্ট আদর করেন।

লিখন এসে পড়ার টেবিলে বসতেই দেখে নাঈম বইখাতা নিয়ে আগেই হাজির। বৃষ্টি দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে গেছে এখনো আসেনি। ও না আসা পর্যন্ত নাঈমের দিকে নজর দেয় সে। জিজ্ঞেস করে,

-কি পড়ছো?

নাঈম নিজের বইটা এগিয়ে দেয়ার আগে বৃষ্টি এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি লিখনের সামনে রেখে বলে,

-ও পড়তে থাকুক তার আগে আপনি খাবারটা খেয়ে নিন।

মুখের সামনে এক প্লেট চিকেন বিরিয়ান দেখে মুখ তুলে বৃষ্টির দিকে তাকায় লিখন। তা দেখে বৃষ্টি বলে,

-ক্লাস করে আসছেন নিশ্চয়ই কিছু খান নাই। আগে খেয়ে নেন তারপর পড়া শুরু করি।

-আমার আজ পেট ভরা বৃষ্টি।

-এইটুকু খাবার আপনি খেতে পারবেন আমি জানি। তাছাড়া আম্মু বলে পুরুষ মানুষকে একটু বেশি খাইতে হয়। আপনি খাওয়া শুরু করেন আমি আপনার জন্য কোক নিয়ে আসতেছি।

বৃষ্টি কোক আনতে ভেতরে চলে গেলে পাশ থেকে নাঈম বলে,

-খান স্যার। আপু আপনাকে না খাওয়ায় ছাড়বে না। আপনি আলু পছন্দ করেন দেখে বিরিয়ানির সব আলু আপনার জন্য তুলে রাখছে। আমাকেও বেশি দেয় নাই।

নাঈমের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে হাসি পায় লিখনের। কিন্তু হাসে না সে। এটা সত্যি এই বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে বৃষ্টি তার জন্য আলাদা করে রাখে। লিখন আর আপত্তি করে না উঠে গিয়ে হাত ধুঁয়ে আসে। তাছাড়া সে ভালো করেই জানে তার আপত্তি বৃষ্টি শুনবে না। তাকে খাইয়েই ছাড়বে। এসব বিষয়ে বৃষ্টি ভালোই শাসন করে তাকে। তাই মেয়েটা কোক নিয়ে ফিরে আসার আগে হাত ধুয়ে খাবারে হাত দেয় সে।

—————————————————————————–

অফিস ছুটির পর নিচে নামতেই চিত্রলেখার জুতাটা আবার ছিঁড়ে যায়। কিন্তু এবার অন্য পায়েরটা ছিঁড়ে গেছে। আজকের দিনটাই যেন কুফাময়। সকালে আসার সময় এক পায়ের জুতা ছিড়লো, এখন আবার আরেকটা। ছেঁড়া জুতা হাতে নিয়ে একবার ডানে-বামে তাকায় সে। আশেপাশে মুচি আছে কিনা দেখতে। কিন্তু এখানে আশেপাশে কোনো মুচি দেখা যাচ্ছে না। তাকে অনেকখানি হেটে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সকালে আসার সময় যেখান থেকে জুতা সেলাই করেছিল সেখানে যেতে হবে। অফিস বিল্ডিংয়ের পার্কিং থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে রওনক। চিত্রলেখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থামাতে। জুতা হাতে চিত্রলেখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রওনকের বুঝতে বাকি থাকে না ঘটনা কি হতে পারে। সে মনে মনে ভাবে, এই মেয়েটা নিশ্চয়ই এখন মুচি খুঁজছে। রওনক ড্রাইভারকে বলে,

-ঐ মেয়েটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো তো কোনো হেল্প লাগবে কিনা।

ড্রাইভার বেরিয়ে যেতেই নেয় তখনই বাইক নিয়ে পার্কিং থেকে বেরিয়ে আসে লাবিব। চিত্রলেখাকে দেখে তার সামনে বাইক দাঁড় করা সে। তা দেখে রওনক তার ড্রাইভারকে বাঁধা দিয়ে বলে,

-ইটস ওকে যেতে হবে না। হয়ত হেল্প পেয়ে গেছে।

চিত্রলেখাকে জুতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাবিব জিজ্ঞেস করে,

-এনি প্রবলেম?

হাতে থাকা ছেঁড়া জুতা দেখিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-ছিঁড়ে গেল।

-কোথায় যাবা বলো আমি নামিয়ে দেই।

-না না ইটস ওকে, আপনি যান আমি ম্যানেজ করে নিবো। আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না।

-আমার কোনো কষ্ট হবে না। আমি তো আর তোমাকে কাঁধে উঠতে বলছি না বাইকে উঠো নামিয়ে দিচ্ছি। তোমার বাসা তো রায়ের বাজার তাই না?

-আপনার উল্টো পথ হয়ে যাবে। দেরিও হয়ে যাবে অনেক।

-একদিন দেরি হলে কিচ্ছু হবে না। তুমি উঠো তো।

চিত্রলেখা ইতস্তত করে। তা দেখে লাবিব জোর দিয়ে বলে,

-উঠতে বলছি চিত্রলেখা।

আর আপত্তি করে না চিত্রলেখা। লাবিবের বাইকের পেছনে উঠে বসে। চিত্রলেখা উঠে বসতেই টান দেয় লাবিব। ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে রওনক।

সকালে যেখানটায় মুচির থেকে জুতা সারিয়েছিল সেই জায়গায় আসতেই চিত্রলেখা লাবিবকে বাইক থামাতে বলে। নেমে গিয়ে বলে,

-আমি জুতাটা সারিয়ে নিচ্ছি।

-আমি আছি তুমি সারিয়ে আনো।

-তার প্রয়োজন নেই। আপনি চলে যান। আমার আসলে একটু কাজ আছে দেরি হয়ে যাবে।

-আর ইউ সিওর?

-জি।

লাবিব আর কিছু বলে না, চলে যায়। চিত্রলেখা রাস্তা পাড় হয়ে অন্যপাশে চলে যায় জুতা সারতে। বাসায় তার আরও দু’জোড়া জুতা আছে। তাই আপাতত সে জুতা কিনবে না। আপাতত সেলাই করে নিলে বাসায় পৌঁছাতে পারলেই হলো।

রওনকের গাড়িটা স্কয়ার হাসপাতালের সামনে আসতেই জ্যামে আটকায়। যদিও এখানে কোনো সিগনাল নেই। অফিস ছুটির পরে এখানে জ্যাম হওয়াটা প্রতিদিনকার চিত্র। জ্যামে বসে থেকে গাড়ির উইন্ড দিয়ে ডানে তাকাতেই রাস্তার অন্যপাশে দেখতে পায় চিত্রলেখাকে। হেসে ফেলে রওনক। তার ধারনা একদম ঠিক হয়েছে। চিত্রলেখা ছেড়া জুতা সেলাই করাচ্ছে। রওনকের হাতে থাকা ট্যাবটা নামিয়ে রেখে সে গাড়ি থেকে বের হয়। তা দেখে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে,

-স্যার কিছু লাগবে?

-না, তুমি আশেপাশে কোথাও জায়গা দেখে গাড়ি পার্ক করো। আমার একটু কাজ আছে। হয়ে গেলে তোমায় ফোন করব।

আর অপেক্ষা করে না রওনক। রাস্তা পাড় হয়ে অন্যপাশে চলে যায়। যে পাশে চিত্রলেখা আছে। তাকে পাশ কেটে এগিয়ে গিয়ে একটা সুপার শপে ঢুকে সে। সুপারশপ থেকে বের হতেই রওনক দেখে চিত্রলেখা ওখানে নেই। ডানদিকে তাকালেই দেখে চিত্রলেখা হেটে যাচ্ছে সামনের দিকে। রওনকও তার পিছনে হাঁটা ধরে। মোড় পর্যন্ত এসে হিসাব মতো চিত্রলেখার ডানে চলে যাওয়ার কথা কিন্তু সে বামে চলে যায় রাস্তা পাড় হয়ে। ধানমন্ডি লেকের দিকে হাঁটা ধরে সে। তা দেখে রওনকও সেদিকেই হাঁটতে থাকে। চিত্রলেখার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে হাটতে হাটতে ডিঙি পর্যন্ত চলে এসেছে। বেখায়লে হাটছে চিত্রলেখা। দিনদুনিয়ার কোনো কিছুই যেন এখন তার মন-মস্তিষ্কে নেই। সে হেঁটে চলেছে আপন মনে। হাঁটতে হাঁটতে বেখায়লে পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগেই দ্রুত কদমে বাড়িয়ে এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরে টান দিতেই রওনকের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। ভয়ে কলিজা কামড়ে ওঠে তার। পড়ে যাবে ভেবে যতটুকু ভয় পেয়েছিল তার চাইতে বেশি ভয় পেয়েছে এই মুহূর্তে এভাবে রওনককে দেখে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রওনক বলে,

-একটু দেখে হাটতে হয়। এক্ষুনি তো পড়ে যাচ্ছিলে।

এখনো রওনক চিত্রলেখার একটা হাত ধরে রেখেছে। রওনককে দেখে চিত্রলেখা কয়েক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর চোখ নামিয়ে তার ধরে রাখা হাতের দিকে তাকায়। অবাক সুরে বলে,

-আপনি এখানে!

রওনক জবাব না দিয়ে চিত্রলেখার হাত ছেড়ে দিয়ে তার হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

-এটা রাখো।

-কি?

-একজনের জন্য কিনেছিলাম।

চিত্রলেখা ব্যাগটা হাত বাড়িয়ে নিচ্ছে না দেখে রওনকই হাত বাড়িয়ে ওর হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে পেছন দিকে হাঁটা ধরে। চিত্রলেখা একবার শপিং ব্যাগটার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় এক জোড়া জুতা। মুখ তুলে রওনকের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ভাবলেশহীন চাহনি নিয়ে৷ মনে মনে চিত্রলেখার প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, কার জন্য জুতা কিনেছিল সে! অন্যকারো জন্য কেনা জুতা তাকে কেন দিয়েদিলো?

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব- ৭
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

চিত্রলেখা যখন বাসায় ফিরে তখন বাজে রাত আটটা। সাধারণত এত দেরি তার হয় না। এই কোম্পানিতে চাকরী করছে তিন বছরের বেশি সময় ধরে। খুব বেশি দিন তাকে রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়নি। হাতে গোনা কয়টা দিন মাত্র। চিত্রলেখা ঘরে ডুকতেই তাকে দেখে চারু জিজ্ঞেস করে,

-আজকে এত দেরি হলো যে আপা?

শব্দ পেয়ে রান্নাঘর থেকে নারগিস বেগম চেঁচিয়ে বলেন,

-কে আসছে রে চারু? তোর আপা?

-হ্যাঁ খালা।

খালাকে জবাব দেয় চারু। চিত্রলেখার হাত থেকে তার ব্যাগ নিয়ে চারু জিজ্ঞেস করে,

-এই ব্যাগে কি আপা?

ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে চলে এসেছেন নারগিস বেগম। চারু ব্যাগটার ভেতরে জুতা দেখে তা বের করতে করতে বলে,

-এতদিনে জুতা কিনলা? তোমারে কতদিন ধরে বলতেছি এই জুতাটা এবার বাদ দাও যেকোনো সময় ছিঁড়ে যাবে।

-আজকে সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ছিঁড়ে গেছিল।

বলে চিত্রলেখা। তা শুনে পাশ থেকে নারগিস বেগম বলেন,

-সেজন্যই জুতা কিনছিস, নাইলে তুই জুতা কিনতি না। তোরে তো আমরা চিনি।

-আপা তোমার কি জ্বরটর আসছে নাকি?

অবাক সুরে জিজ্ঞেস করে চারু। তা শুনে নারগিস বেগম ব্যস্ত হতে নিলে চারু তাকে জুতার ট্যাগটা দেখায়। দেখিয়ে বলে,

-দেখো খালা আপা নিজের জন্য ২৪০০ টাকা দিয়ে জুতা কিনছে।

-কিরে চিত্রলেখা! তোর এত সুবুদ্ধি কেমনে হইলো? তুই নিজের জন্য এত টাকা খরচ করলি!

জুতার দাম দেখে নারগিস বেগম নিজেও অবাক হয়েছেন। বোন ও খালার এক্সাইটমেন্ট দেখে ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চিত্রলেখা। এরা তাকে ভালো করেই চিনে। সে যে নিজের জন্য এত দাম দিয়ে জুতা কিনবে না এটা সত্যি কথা। চিত্রলেখা জুতাটা বের করে দেখেনি তাই জানেনা এত দামী একজোড়া জুতা পেয়েছে সে। আর লুকোচুরি না করে চিত্রলেখা বলে,

-আমি কিনি নাই।

-তাহলে?

-একজন দিলো।

-কেউ তোরে জুতা কিনে দিলো?

-আমাকে না, অন্য একজনের জন্য কিনছিল তারপরে কাহিনি জানি না। শেষমেশ আমার পায়ে এসে জুটলো।

-কে এমন মানুষ যে তোর জন্য জুতা কিনলো?

-খালা বললাম তো আমার জন্য কিনে নাই।

নারগিস বেগম আর কিছু বলার আগে চারু বলে,

-আপা তোমার জন্য না কিনলেও সাইজটা কিন্তু একদম পার্ফেক্ট হইছে, তোমার পায়ের সাইজ।

জবাবে আর কিছু বলে না চিত্রলেখা। বরং বলে,

-তোর বেশি পছন্দ হইলে তুই রেখে দে। আমার আরও জুতা আছে আমি ওখান থেকে একজোড়া নামায় নিবো।

-পছন্দ তো হইছে তবে আমার সাইজে হবে না আপা। তোমার পায়ের মতো তো আমার পা লম্বা না।

-তো কি হইছে? রেখে দিবি। যখন পায়ে হবে তখন পরবি।

-তোমার মাথা খারাপ আপা? দুই বছর রেখে দিবো?

-রেখে দিবি। তো কি হইছে?

-কোনো দরকার নাই। তোমাকে দিছে তুমিই পরবা। রেখে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই। কেউ ভালোবেসে কিছু দিলে সেটা ভালোবেসে গ্রহণ করতে হয়। বুঝলা আপা?

ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে চিত্রলেখা। মনে মনে কেবল ভাবে, ‘ভালোবাসা!’ কিন্তু মুখে কিছু বলে না। নারগিস বেগম বলেন,

-অনেক হইছে তোদের জুতা প্যাঁচাল এখন যা ফ্রেশ হয়ে আয় কিছু খাবি।

চিত্রলেখা উঠতে উঠতে বলে,

-তুমি রান্নাঘরে কি করতেছিলা খালা?

-ভাত বসাইলাম রাতের জন্য।

-আমার আজকে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। তুমি আর রান্নাঘরে যাইও না। আমি ফ্রেশ হয়ে রান্না চাপাইতেছি।

-তোরে অনেক ক্লান্ত লাগতেছে। আজকে নাহয় থাক আমিই রান্নাটা সারি।

-দরকার নাই খালা, আমিই পারবো।

আর কারো কোনো কথা না শুনে নিজের ঘরে চলে যায় চিত্রলেখা। নারগিস বেগম রান্নাঘরে চলে যান। সবকিছু এগিয়ে দিলে মেয়েটার জন্য সহজ হবে। হাজার ক্লান্ত লাগলেও সেটা মুখে প্রকাশ করবে না সে।

——————————————————————————

রওনক বাসায় ফিরে সরাসরি নিজের ঘরে চলে যায়। যদিও আজ তার জলদি বাসায় ফেরার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বাইরে থাকার মতো কোনো কাজও আপাতত তার হাতে ছিল না। নিজের ঘরে ডুকতেই রওনক দেখে সাবা তার ঘরেই বসে আছে। সাবাকে দেখে রওনক নিজের কোর্টটা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি এখানে?

-আজ আন্টি আমাদের ডিনারের জন্য ইনভাইট করেছে জানো না?

-শুনেছি তবে আমার প্রশ্ন এটা ছিল না।

রওনকের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে সাবা ন্যাকামির সুরে জিজ্ঞেস করে,

-কি ছিল যেন তোমার প্রশ্নটা?

-আমি জিজ্ঞেস করেছি তুমি এখানে আমার রুমে কেন?

-তোমার রুমে কি আসতে মানা নাকি?

-আমার এবসেন্সে আমি কারো আমার ঘরে আসাটা পছন্দ করি না।

-সবাই আর আমি তো এক নই রওনক। তুমি জানো আজ আন্টি কেনো আমাদের ডিনারে ইনভাইট করেছে? জানলে নিশ্চয়ই এমন কথা বলতে না।

-সবাই আর তোমার মধ্যে বিশেষ আলাদা কিছু নেই সাবা। সবাই যেমন মানুষ, তুমিও মানুষ। আর ডিনারে যেহেতু আমার মা ইনভাইট করেছে তুমি বেটার তার ঘরে গিয়েই বসো নাহয়। আমি এখন ফ্রেশ হবো। আই নিড সাম প্রাইভেসি। ইউ মে লিভ নাও প্লিজ।

রওনক আর দাঁড়ায় না। বাথরুমের দিকে চলে যায়। পেছনে দাঁড়িয়ে সাবা নিজে নিজেই বলে,

-তুমি যতই আমার থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করো না কেন এতে বিশেষ লাভ হবে না রওনক। ঘুরেফিরে তোমায় আমার কাছেই ফিরতে হবে। এই সাবা তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবে না, কোত্থাও না।

সাবা আর দাঁড়িয়ে না থেকে রওনকের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

দিলারা জামান কিচেনে এসে দেখে নেন সব আয়োজন ঠিকঠাক মতো হচ্ছে কিনা। কিচেনের আয়োজন দেখে বড় বউ তানিয়ার ঘরের দিকে যান তিনি। তানিয়ার ঘরে এসে দেখে সে ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে আছে। তা দেখে দিলারা জামান বলেন,

-তুমি এখনো তৈরি হওনি?

শাশুড়িকে দেখে ল্যাপটপটা নামিয়ে রেখে তানিয়া বলে,

-একটু কাজ করছিলাম মা। এটা শেষ করে তারপর তৈরি হবো।

-কাজ সবসময়ই হবে। এখন জলদি তৈরি হয়ে একটু কিচেনে যাও। আমরা খেয়াল না রাখলে তো কিছুই ঠিকঠাক মতো হবে না।

-জাহানারা খালা কোথায়?

-কিচেনেই আছে।

-তাহলে আপনি আর কিসের চিন্তা করছেন? সব হয়ে যাবে সময় মতো ডন্ট ওয়ারি।

-চিন্তা কি আর এমনি এমনি করি? আজ এত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন অথচ কারো কোনো হেলদোল নেই। রওনকটা মাত্র বাসায় ফিরলো।

-রওনক ফিরেছে?

-মাত্রই ফিরলো।

-তাও ভালো ফিরেছে। আমি তো ভেবেছিলাম আজ হয়ত ও বাসায়ই ফিরবে না।

-ওকে একটু বুঝাও প্লিজ। এবার ওকে বিয়ে করতেই হবে। ওর আপত্তি আর শুনবো না আমি।

তানিয়া নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে দিলারা জামান তাকে তাগাদা দিয়ে বলে,

-আর বসে থেকো না। তৈরি হয়ে নিচে আসো। সাবা অলরেডি চলে আসছে। উনারাও যেকোনো সময় চলে আসবে।

-আপনি নিচে যান আমি আসছি।

তানিয়াকে জলদি করার তাগাদা দিয়ে প্রস্থান করেন দিলারা জামান। শাশুড়ি প্রস্থান করতেই তানিয়া বলে,

-সবই ঠিক আছে কিন্তু এমন গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়েকে রওনক বিয়ে করবে বলে আমার মনে হয় না।

আর চিন্তায় মগ্ন না হয়ে তানিয়া ল্যাপটপ বন্ধ করে চেঞ্জ করতে চলে যায়। মেহমান আসার আগে সে উপস্থিত না থাকলে পরে আবার তার শাশুড়ি গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে।

সাবার বাবা-মা চলে এসেছে অনেকক্ষণ কিন্তু এখনো রওনক নিচে নামেনি। সবাই যখন ড্রইং রুমে আড্ডায় মশগুল তখনই তৈরি হয়ে উপর থেকে নিচে নামে রওনক। শাওয়ার নিয়ে কাপড় বদলে নিয়েছে সে। সারাদিনের ফর্মাল কাপড় বদলে প্যান্টের সাথে হাফ হাতার টি-শার্ট পরেছে। চুলগুলো বেকব্রাশ করে জেল দিয়ে সেট করে নিয়েছে। ডান হাতে রোল্যাকসের দামী ঘড়ি। চাপ দাঁড়ি ও হালকা মোচ ওয়ালা ফর্সা চেহারাটা দেখতে আরও ফ্রেশ লাগছে। নিচে নেমেই ড্রইং রুমে উপস্থিত সাবার বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে সালাম দেয় সে। এগিয়ে এসে সাবার বাবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে। দিলারা জামান তাকে বসতে বললে রওনক বলে,

-সময় নেই মা, আমি বসবো না।

-সময় নেই মানে? কোথাও যাচ্ছিস নাকি?

-বাইরে যাচ্ছি একটু। সাদমানের সাথে প্ল্যান আছে।

-বাসায় মেহমান রেখে তুই বাহিরে যাচ্ছিস!

-তোমার গেস্ট তুমি এটেন্ড করো। আমার আগে থেকে প্ল্যান ছিল ক্যান্সেল করতে পারব না।

-উনারা তোর আর সাবার জন্য এসেছে রওনক। আমি ইনভাইট করেছি উনাদের।

আর ভনিতা না করে রওনক সরাসরি সাবার বাবা আশরাফ আহমেদকে বলে,

-সরি আঙ্কেল আমাকে বের হতে হবে। মা আপনাদের কেন ডেকেছে আমি বলতে পারছি না। ক্যাজুয়াল ডিনার হলে ওকে ফাইন বাট যদি আমার আর সাবার বিয়ের বিষয়ে হয়ে থাকে তাহলে আই এম রিয়্যালি সরি। আমি বিয়ে করার বিষয়ে আপাতত কিছু ভাবছি না। বলতে পারেন এক্ষুনি বিয়ে করার কোনো প্ল্যান নেই আমার। আমি আসছি, আমার ফ্রেন্ড ওয়েট করছে।

দিলারা জামানকে অবাক করে দিয়ে বেরিয়ে যায় রওনক। পেছনে রাগে পারেন না ভাঙ্গচুর শুরু করেন তিনি। মেহমানের উপস্থিতিতে আপাতত নিজেকে সামলে নেন। রওনক বেরিয়ে যেতেই আশরাফ আহমেদ বলেন,

-আমি বলি কি ভাবি আমরা কথাবার্তা বলার আগে আপনি রওনকের সাথে ভালো মতো কথা বলুন। ও কি চায় সেটা জানার চেষ্টা করুন। আমরা জোর করে দেয়ার চাইতে দেরিতে হোক তবু যারা বিয়ে করবে তাদের ইচ্ছায় হোক সেটা বরং বেশি ভালো হয়।

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আশরাফ আহমেদ আরও বলেন,

-আজ আমরা আসছি ভাবি। ডিনারটা নাহয় অন্য কোনোদিন হবে। আজ থাক।

আর অপেক্ষা করেন না আশরাফ সাহেব। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যান। উনারা বেরিয়ে যেতেই হাতের সামনে থাকা একটা কাঁচের গ্লাস তুলে আছাড় মারেন দিলারা জামান। তারপর নিজের রুমে চলে যান। পেছনে তানিয়া একা বসে থাকে ড্রইং রুমে। তার মুখের দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকেন জাহানারা।

চলবে….

মাতাল হাওয়া পর্ব-৪+৫

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

নিজের ডেস্কে এসে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে চিত্রলেখা। লাবিব এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সে খেয়াল করেনি। ডেস্কের উপর দু’বার হাত মুঠো করে ঠকঠক শব্দ করতেই চমকে ওঠে সে। তাকে চমকে যেতে দেখে লাবিব বলে,

-দিনের বেলায় ভয় পেলে যে? রাতে কি ভূত টূত কিছু দেখেছিলে নাকি?

নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-না আসলে কিছু ভাবছিলাম তাই আপনাকে খেয়াল করিনি।

-সেটা তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তা কি ভাবছিলেন এত মনোযোগ দিয়ে?

চিত্রলেখা আর লাবিবের কথার জবাব দেয়ার সুযোগ পায় না। লাবিবের পেছন দিয়ে বাতাসের গতিতে হেটে কেবিনে চলে যায় রওনক। তাকে দেখেই আর কথা বলে না চিত্রলেখা। লাবিবও আর দাঁড়ায় না এখানে। আসছি বলে রওনকের পেছন পেছন কেবিনে ডুকে পড়ে। লাবিন হচ্ছে রওনকের পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট। ছয় বছর ধরে এই পোস্টে কাজ করছে সে। আর চিত্রলেখা এখানে এসেছে দেড় মাস চলে। যদিও এই কোম্পানিতে সে চাকরী করছে তিন বছরের উপরে। তবে জয়েন পর থেকে এতদিন সে কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে ছিল। দেড় মাস আগে বলা যায় তার ছোটখাটো একটা প্রোমোশন হয়েছে। পজিশনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কেবল কম্পিউটার ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে তার জায়গায় হয়েছে কোম্পানির সিইও এর অফিসে। জামান টাওয়ারের নয় তলায় রওনকের অফিস। মস্ত বড় কেবিনের বাইরের দিকটা যেমন কাচে মোড়ানো তেমনি ভেতরের দিকটায়ও গ্লাস লাগানো। কেবিনের বাইরে দুইপাশে দুটো ডেস্ক দেয়া। একটায় লাবিব বসে আরেকটায় চিত্রলেখা। এতকাল রওনকের অফিসের সবরকম ডকুমেন্টের কাজ কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টই করেছে। ওখানে চিত্রলেখাসহ মোট ছয়জন কম্পিউটার অপারেটর ছিল। কিন্তু এতে করে কোম্পানির অনেক কনফিডেন্সিয়াল ইনফরমেশন রওনকের নাকের নিচ দিয়েই বাইরে চলে যেত। তাই লাবিবের পরামর্শে দেড় মাস আগে চিত্রলেখাকে এখানে আনা হয়েছে। তার দায়িত্ব কেবল রওনকের কাজ করা। কোম্পানির অন্যসব ডকুমেন্টের কাজের দায়িত্ব কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে থাকা অন্য পাঁচজন অপারেটর করবে। আর এদিকে রওনকের অফিসের সকল কাজের দায়িত্ব চিত্রলেখার একার। এখানে কাজ কম তা নয়। তবে কাজের চাইতে টেনশন বেশি। একটা ইনফরমেশন বাইরে গেলে সরাসরি দোষ চিত্রলেখার উপর বর্তাবে। তাই সবসময় তক্কেতক্কে থাকে সে। একটা কাগজ এদিক সেদিক হতে দেয় না। এমনকি অফিসে তাকে যে কম্পিউটারটা দেয়া হয়েছে সেটার পাসওয়ার্ড সে ছাড়া কেউ জানে না। তার কম্পিউটারে কোম্পানির অনেক জরুরী কাগজ পত্রের ড্রাফ রয়েছে। এসব বাইরে গেলে কোম্পানি হুমকির মুখে পড়তে পারে। এসব কথা এখানে আসার দিনই লাবিব ভালো করে বুঝিয়ে বলেছে চিত্রলেখাকে। অনেকেই তার থেকে ইনফরমেশন বের করার চেষ্টা করবে সে যেন ভুলেও কাউকে কিছু না জানায়। রওনক পার্সোনাল অপারেটর এপয়েন্ট করার দায়িত্বটা লাবিবকে দিয়েছিল। তাই সে বিনা সময় বিলম্ব করে চিত্রলেখাকে ওখানে থেকে এখানে নিয়ে আসে। এতে রওনক আপত্তি করেনি। প্রথমদিন চিত্রলেখা রওনকের সামনে এসে দাঁড়ালে তাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলেছিল,

-তুমি সব বুঝিয়ে দিও, আমার আলাদা করে কিছু বলার নেই।

প্রথম দেখায় এতটুকুই বলেছিল রওনক চিত্রলেখাকে। এছাড়া তাদের তেমন একটা কথা বলা হয় না বললেই চলে। চিত্রলেখাকে যেসব কাজ দেয়া হয় তার বেশিরভাগই লাবিবের মাধ্যমে আসে। সরাসরি তাদের দেখা বা কথা তেমন একটা হয় না বললেই চলে।

লাবিবের চিত্রলেখাকে এখানে আনার পেছনে একটা কারণ অবশ্য আছে। চিত্রলেখা এই কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে আসলে সেদিন লাবিব উপস্থিত ছিল রওনকের প্রতিনিধি হিসেবে। সেদিন যতজন ইন্টারভিউ দিয়েছিল তন্মধ্যে চিত্রলেখার লেখাপড়ার ব্যাকগ্রাউন্ড তুলনামূলক সাধারণ হলেও তার কাজের স্পিড ভালো লেগেছিল লাবিবের। তাকে করা প্রশ্নের জবাব শুনেও ভালো লেগেছিল তার। বলা যায় লাবিবের এপ্রুভালে চিত্রলেখা চাকরীটা পেয়ে গিয়েছিল অন্যথায় তার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে তাকে রাখার কথা ছিল না। জামান গ্রুপ বর্তমান সময়ের অন্যতম নামক করা কোম্পানিগুলোর একটি। মাঝেমধ্যে চিত্রলেখা নিজেও অবাক হয় এতবড় একটা কোম্পানিতে চাকরী করতে পারছে ভেবে। চিত্রলেখার জয়েন পর থেকেই পরিচয় দু’জনার। সময়ের সাথে সখ্যতাও গড়েছে ভালোই। চিত্রলেখার থেকে বছর তিনেকের বড় হবে লাবিব। সময় বয়সী না হলেও তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব আছে বলা যায়। রওনকের অফিসে আসায় চিত্রলেখার জন্য একটা জিনিস ভালো হয়েছে। অসময়ে একটা ইনক্রিমেন্ট হয়েছে তার। বর্তমানে তার সেলারিও ভালোই দাঁড়ায়। কিন্তু তবুও ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়ার খরচ, ছয়জন মানুষের সংসার খরচ চালাতে খানিকটা হিমশিমই খাওয়া লাগে তাকে। মাস শেষে দেখা যায় জমার খাতা শূন্য। বাড়তি ধার দেনা যে হয় না এটাই বেশি।

নিজের ডেস্কে বসে সবেই কম্পিউটার অন করেছে চিত্রলেখা। এর মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে লাবিব। এসেই চিত্রলেখাকে বলে,

-দ্রুত এক কাপ কফি বানিয়ে দিবে? বসের আজ মাথা গরম।

এক মুহূর্ত লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চিত্রলেখা বলে,

-তাহলে চা দেই? গরম মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে। বিষে যেমন বিষ কাটে তেমনি গরম চায়ে গরম মাথা ঠান্ডা করে দিবে।

চিত্রলেখার কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় লাবিব। হেসে দিয়ে বলে,

-কিন্তু অফিসে চা পাবো কোথায়?

চিত্রলেখা নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে চায়ের ফ্লেক্স বের করে দেখিয়ে বলে,

-আমাদের জন্য নিয়ে এসেছিলাম।

-তাহলে তুমি জলদি এক কাপ চা নিয়ে আসো, আমি ভেতরে যাচ্ছি।

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। লাবিব যেভাবে ব্যস্ত হয়ে এসেছিল ওভাবেই ভেতরে চলে যায়। পেছনে চিত্রলেখা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে কাজে লেগে পড়ে। কি-বোর্ডে আঙ্গুল চালানো ছাড়া এখানে চিত্রলেখাকে আরেকটা কাজ বাড়তি করতে হয়। সেটা হচ্ছে কফি বানানো। সে এখানে আসার পর থেকে অলিখিত ভাবে তাদের তিনজনের কফি বানানোর দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। এর পেছনে কারণ আছে অবশ্য। অফিস বয়দের বানানো পাতলা কফি তার একদম ভালো লাগে না। কফির পানিটা ভালো মতো ফুটিয়ে না নিলে সেই পাতলা পানির কফি তার একদম মুখে রুচে না। এভাবেই নিজের জন্য বানাতে বানাতে লাবিব ও রওনকের কফির দায়িত্বটাও সে নিয়ে নিয়েছে।

মিনিট খানিকের মাথায় চিত্রলেখা রওনকের কেবিনে এসে তার সামনে এক কাপ চা রাখে। চা দেখে রওনক একবার চায়ের দিকে তাকায় তারপর চোখ তুলে চিত্রলেখার দিকে তাকায়। সাধারণ দেখতে একটা মেয়ে অথচ রওনকের মনে হয় এই মেয়ের কোনো কিছুই সাধারণ নয়। বরং সাধারণ সব গুণে সম্পন্ন অসাধারণ একটি মেয়ে। চায়ের কড়া ঘ্রাণ এসে রওনকের নাকে লাগছে। দেরি না করে কাপ তুলে হাতে নিয়ে প্রথমে লম্বা করে ঘ্রাণ নেয় সে। তারপর চুমুক বসায়। এক চুমুকেই যেন জিহ্বার শান্তি। অফিসে সবসময় কফি খাওয়া হলেও রওনকের দুধ চায়ের প্রতি আলাদা সফট কর্ণার আছে। চা ছাড়া তার দিনের শুরু হয় না বললেই চলে। সে কোম্পানিতে জয়েন করার পরপর তার জন্য চা বানানো হতো ঠিকই কিন্তু ওসব চা তার মুখে রুচতো না। পানির মতো পাতলা লিকার। তাই অফিসে চা খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছে। আজ অনেকদিন পর মনের মতো এক কাপ চা পেয়ে রওনকের মন মেজাজ ফুড়ফুড়া হয়ে যায় নিমিষেই। চায়ের কাপে পরপর আরও দু’টো চুমুক দিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-চা কোথথেকে এলো?

লাবিব চিত্রলেখাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে,

-চিত্রলখো বাসা থেকে নিয়ে এসেছে।

-ওর ব্যাক্তিগত?

এবারে লাবিব কিছু বলার আগে চিত্রলেখা বলে,

-আমার একার জন্য আনিনি। আমাদের তিনজনের জন্যই এনেছিলাম।

-থ্যাঙ্কিউ, চমৎকার হয়েছে চা-টা।

রওনকের ধন্যবাদের বিনিময়ে মৃদু হাসে চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক মনে মনে ভাবে, ❝মেয়েটা কি মন খুলে হাসতেও জানে না নাকি?❞

চিত্রলেখা আর ওখানে দাঁড়ায় না। কেবিনের থেকে বেরিয়ে আসতে হাঁটা ধরে। পেছনে বসে থাকা রওনক চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দেয়ার বাহানায় চলে যেতে থাকা চিত্রলেখার দিকে তাকায়। মূলত ওর জুতার দিকে তাকায়। অফিসে আসার পথে মুচিকে দিয়ে সেলাই করে আনা জুতাটা এখনো তার পায়ে। তা দেখে রওনক আরও ভাবে, ❝এই মেয়ের কি নিজের জন্য ভাবার সময় নেই? জুতা কিনে অফিস আসলে নাহয় কিছুক্ষণ দেরিই হতো। ওর দেরিতে তো কোম্পানির বিশাল কোনো লস হয়ে যেত না।❞ রওনক আপন ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকতে থাকতেই চিত্রলেখা কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

-আপনার আর কিছু লাগবে?

লাবিবের কথায় ভাবনাচ্ছেদ হয় রওনকের। চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে সে বলে,

-অফিসে চা বানানোর ব্যবস্থা করা যায় না?

-এর আগেও তো করা হয়েছিল কিন্তু আপনার পছন্দ হয়নি।

-ওসব চা নাকি? পাতলা পানির মতো। আজকেরটা মতো টেস্ট হলে না কথা ছিল।

লাবিব বুঝার চেষ্টা করে রওনক তাকে কি বলতে চায়। তাকে যদিও বেশি একটা ভাবতে হয় না। তার আগেই রওনক বলে,

-যে প্রতিদিন আমাদের জন্য কফি বানায় এখন থেকে নাহয় চা বানাবে।

-চিত্রলেখা!

মাথা ঝাকায় রওনক।

-ঠিক আছে আমি ওকে বলে দিবো। চিত্রলেখার চা বানানো ভালো হয়। অবশ্য শুধু চা নয় রান্নার হাতও ভালো।

কথা রওনকের ঠোঁটের ডগায় চলে আসে কিন্তু সে চেপে যায়। বলতে চেয়েছিল চিত্রলেখার রান্না লাবিবের এরমধ্যে টেস্ট করাও হয়ে গেছে, কিন্তু বলে না। তার জায়গা থেকে অনেক কথাই সে বলতে পারে না। লাবিব বেরিয়ে গেলে রওনক চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দেয়। আরামে, তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসে তার। চিত্রলেখার হাতে বানানো এক কাপ চা খেয়েই আন্দাজ করতে পারছে এই মেয়ের হাতের রান্না কতখানি ভালো হতে পারে। আবার আফসোসও হয় নিজ অজান্তে। ওসব তার কখনই হয়তো টেস্ট করা হবে না। সবকিছু তো আর সবার জন্য নয়।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখন অনেকক্ষন হয় টিএসসিতে বসে আছে। তার ক্লাস শেষ হয়েছে একঘন্টা আগে। এই পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে দুইকাপ চা ও একপিস বাটারবন খেয়েছে সে। আড্ডা শেষ করে বন্ধুরা চলে গেছে লিখন একাই বসে আছে এখন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ লিটারেচারের উপর অনার্স করছে সে। এটা তার ৪র্থ বর্ষ চলছে৷ চা বাটারবন খেয়েও পেটার খুদা পোষে আসছে না তার। আজ দুপুরে পরপর দুটো ক্লাস থাকায় পেট ভরে ভারী কিছু খাওয়ার সময় পায়নি। এখন বাজে সাড়ে চারটা। ভাতের খুদায় পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড় চলছে। বাটারবন দিয়ে এই খুদা নিবারন হবে না। কিন্তু কিছু করার নেই। এখন এখানেই বসে থাকতে হবে তাকে যতক্ষণ রিপা না আসছে। তাছাড়া ভারী কিছু খাওয়ায় নিষেধ আছে তার। রিপা লিখনের প্রেমিকা। একই বিভাগের ২য় বর্ষে পড়ে সে। দু’বছর আগে নবীন বরণের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল তাদের। ব্যস, প্রথম দেখায়ই দু’জনার দু’জনকে পছন্দ হয়ে যায়। মনের কথা জানাতে সময় বিলম্ব করেনি রিপা। বলাবাহুল্য প্রেম নিবেদনটা রিপাই করেছিল। নিজের পরিস্থিতি বিচার করে লিখন প্রেমে জড়াতে চায়নি তবু সামনে থেকে রিপার করা প্রেম নিবেদন প্রত্যাখ্যানও করতে পারেনি। মস্তিষ্ককে চুপ করিয়ে মনকে প্রশ্রয় দিয়েছিল সে। তারপর থেকে গত দুই বছর ধরে প্রেম করছে তারা। যদিও রিপার কথা চিত্রলেখাও জানে। সব বন্ধুরা মিলে লিখনের জন্মদিনে তাকে সারপ্রাইজ দিতে কেক নিয়ে বাসায় গিয়েছিল। তখনই দু’জনার সখ্যতা, একে-অন্যের প্রতি আগ্রহ দেখে যা বুঝার বুঝে নিয়েছিল চিত্রলেখা। বাকিটা লিখনকে জিজ্ঞেস করার পর সে আর বোনের থেকে কিছু লুকায়নি। তবে বলাবাহুল্য রিপার পারিবারিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো। বলা যায় হাই সোসাইটি থেকে বিলং করে সে। রিপার বাবার যেমন টাকা পয়সা আসছে তেমনি সমাজে সম্মানও আছে।

প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সবেই আরও একপিস বাটারবন হাতে নিয়েছে লিখন। ওমনি পেছন থেকে রিপা বলে,

-খবরদার, এটা রেখে দেও।

পেছন ঘুরে রিপাকে দেখে বাটারবনটা পূর্বের জায়গায় রেখে দিয়ে লিখন বলে,

-এতক্ষণে আসার সময় হইলো তোমার? এদিকে খুদায় একটা মানুষ ম*রে যাইতেছে।

এগিয়ে এসে রিপা লিখনের পাশে বসতে বসতে বলে,

-কই তোমাকে তো জ্যান্তই লাগতেছে দেখতে। ম*রে টরে তো যাও নাই। নিঃশ্বাস তো চলছে।

-মশকরা করতেছো তুমি, তাই না?

-বারে আমি কই মশকরা করলাম? মশকরা তো তুমি করতেছো।

লিখন আর কিছু বলে না। সে ক্ষ্যাপে যাচ্ছে বুঝতে পেরে রিপা বলে,

-আচ্ছা বাবা সরি। কি করব বলো আজকে ক্লাস শেষই হয় না।

নিজের ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে লিখনের দিকে এগিয়ে দিয়ে আরও বলে,

-নেও, খাও নাহলে তো ম*রে যাবা। জলদি খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো তো দেখি।

লিখন আর কথা বাড়ায় না। ঝটপট বক্স হাতে নিয়ে খুলতেই দেখে ভেতরে তেহেরি, নতুন আলু দেয়া সঙ্গে। আলু লিখনের ভীষণ পছন্দের জিনিস। তাকে শুধু আলু ভর্তা অথবা ভাজি দিয়ে ভাত দিলেও পেট পুড়ে খেয়ে নিবে বিনা অভিযোগে। এটা জানে বলেই তেহেরিতে বেশি করে আলু দিতে বলেছিল রিপা তার মাকে। এখনো বক্সে গোশতের চাইতে আলুর পরিমান বেশি। লিখন প্রথমে একপিস আলু তুলে মুখে দেয়। তা দেখে পাশে বসে থাকা রিপা হেসে দিয়ে বলে,

-আহারে আমার আলু খোর।

রিপার কথার বিপরীতে কিছু বলে না লিখন। সে আপাতত খাওয়ায় ব্যস্ত। এক তো তার ভীষণ খুদ পেয়েছে দ্বিতীয় রিপার মায়ের হাতের রান্না খুবই মজা হয়। এই দুনিয়াতে লিখনের জীবনে দু’জন মানুষ আছে যাদের হাতের রান্নার কোনো তুলনা হয় না। এক তার বড় বোন আর দুই রিপার মা অর্থাৎ তার হবু শাশুড়ি। কয়েক চামচ তেহেরি পেটে চালান করে দেয়ার পর লিখন জিজ্ঞেস করে,

-তুমি খাবা না?

-তুমি খাও, তুমি খাওয়ার পর থাকলে খাবো না থাকলে নাই। এমনিও আসার সকাল খেয়ে আসছিলাম তাই আমার খুদা নাই আপাতত। পরপর ক্লাস করে মাথা হ্যাং হয়ে আছে। আমি বরং এক কাপ চা খাই। তুমি মন আর পেট ভরে তেহেরি খাও। তোমার জন্য আম্মুকে বলে বেশি করে আলু দেয়াইছি। ইচ্ছা মতো খাও।

লিখন আর কথা বলে না খাওয়ায় মন দেয়। খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে নিয়ে বলে,

-তেহেরিটা সেই ছিল।

-প্রতিবার একই কথা বলো তুমি।

-মজা হইলে আমার কি করার বলো?

-হুম বুঝছি। আচ্ছা এসব বাদ দাও এখন আসল কথা বলো তো।

-কিসের আসল কথা?

-আপার সাথে কথা বলছিলা?

এতক্ষণে লিখন বুঝতে পারে রিপা কোন বিষয়ে কথা বলছে। জবাবে মাথা ঝাকায় সে। তা দেখে রিপা বিরক্ত হয়ে বলে,

-সিরিয়াস সময়ে মাথা ঝাঁকানোর অভ্যাসটা গেল না তোমার।। কীভাবে বললা? শুনে আপা কি বলল? সব বলো আমাকে।

রিপাকে তার বিষয়ে সিরিয়াস হতে দেখে ভালো লাগে লিখনের। পৃথিবীর প্রত্যেকটা প্রেমিকপুরুষই চায় তার প্রেমিকা তার বিষয়ে সর্বোচ্চ সিরিয়াস হোক। এইক্ষেত্রে লিখন ভাগ্যবান বলা যায়। তার প্রতিটা বিষয়ে রিপা ভয়াবহ রকমের সিরিয়াস। এমনকি বাইরে যাওয়ার বিষয়টা রিপাই লিখনের মাথায় দিয়েছে। লিখন কিছু বলছে না দেখে রিপা তাড়া দিয়ে বলে,

-কি হলো বলো?

-তুমি যা বলছো সেটাই বলছি। বলছি আমি গ্রাজুয়েশনের পর পোস্ট-গ্রাজুয়েশনের জন্য বাইরে যাইতে চাই।

-এই কথা শুনে আপা কি রিয়্যাকশন দিলো?

-আপা কি রিয়্যাকশন দিবে? আমি বলছি সে শুনছে। বলছে আচ্ছা সময় হোক তখন দেখা যাবে, গেলে যাবি।

-এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আপার কোনো রিয়্যাকশন নাই?

-আমার বোন এমনই রিপা তা তুমি ভালো করেই জানো। আমাদের রিলেশনের কথা শুনেও কিন্তু আপা কোনো রিয়্যাকশন দেয় নাই।

-তা জানি। আপা জিজ্ঞেস করে নাই হঠাৎ তোমার মাথায় এই বুদ্ধি কে দিলো?

-না, কিচ্ছুই জিজ্ঞেস করে নাই। আমি বলছি সে কেবল শুনছে।

-টাকা পয়সার বিষয়ে কিছু জানতে চায় না?

-শুনো রিপা আমার বোন মুর্খ না, সে জানে কেমন খরচ হইতে পারে।

-আমি কি সেই কথা বললাম নাকি? আজব!

-আচ্ছা রাগ হইতেছো কেন?

-রাগ হচ্ছি না, মাঝেমধ্যে আমার অবাক লাগে আপার কথা ভাবলে। একজন মানুষ এমন অনুভূতি শূন্য কেমনে হয়?

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে লিখন বলে,

-আমার বোনটা এমনই। ছোটবেলা থেকে আমাদের তিনজনের বাবা-মায়ের ভূমিকা পালন করতেছে। ওর নিজের মাথার উপর ছায়া নাই। আমাদের ছায়া দিতে দিতে নিজে প্রতিমুহূর্ত পুড়ছে সেদিকে আপার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। আমি আপাকে আর কষ্টে দেখতে চাই না। একবার নিজের পায়ে দাঁড়াই বোনটাকে রাজরানী করে রাখবো দেইখো।

-সেজন্য আগে তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হবে। ভুলে যাইও না নিজের পায়ে না দাঁড়াইলে তুমি আমার বাবার সামনে গিয়েও দাঁড়াইতে পারবা না।

-সেই কথা কি আর আমার অজানা।

এই বিষয়ে আর কথা বাড়ায় না দু’জনের একজনও। রিপার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে এখনো অনেক সময় বাকি। তাই এখনই এসব ভেবে বর্তমান নষ্ট করতে রাজি নয় ওরা। প্রসঙ্গে ঘুরাতে রিপা জিজ্ঞেস করে,

-আইএলটিএস করতে কবে ভর্তি হবা?

-দেখি, সবে মাসের শুরু এখনো টিউশনির টাকা হাতে পাই নাই। তাছাড়া এই টাকায় হবেও না।

-আপাকে বলো নাই?

-বলছি তো। ও-তো এখনো বেতন পায় নাই। তাছাড়া সংসার খরচ আছে। চয়ন, চারুর লেখাপড়ার খরচ আছে। মাস শেষে আপার হাতে তেমন একটা টাকা থাকেও না। সব জেনে বুঝে এই সময়ে এত্তগুলা টাকা কেমনে চাই বলো?

-তুমি তো আর নষ্ট করার জন্য চাইছো না। সময় থাকতে তোমার আইএলটিএস করাটা জরুরী।

-আমি জানি জরুরী। কিন্তু আপার উপর এত চাপ দিলে কেমনে চলবে বলো? এই মাসটা নাহয় থাক। আমি টিউশনির টাকা থেকে কিছু রেখে দিবো, প্রয়োজনে আপার থেকেও অল্প কিছু নিবো। তারপর যা বাকি থাকবে বাকিটা আগামী মাসে ভরে ভর্তি হয়ে যাবো।

-আর এভাবে তোমার একটা মাস নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া এর মধ্যে যে বাসায় কোনো ইমার্জেন্সি আসবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? দেখা গেল বাসায় কোনো ইমার্জেন্সি হইলো আর ওমনি টাকাগুলো সব খরচ করে ফেললা।

-ইমার্জেন্সি হইলে খরচ তো করা লাগবেই তাই না?

-আমি জানি তো।

-তুমি রাগ করতেছো কেন?

-আমি রাগ করতেছি না। তোমার ফিউচার নিয়ে আমি খুবই সিরিয়াস। কারণ তোমার ফিউচারের সাথে আমার ফিউচারও জড়িত। আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে তোমাকে হারাইতে চাই না লিখন। সেজন্য সময় থাকতে যা যা করা সম্ভব তাই করতে চাই যাতে করে যখন তুমি আমার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবা তখন আমার বাবা যেন আপত্তি না করে সমাদরে তোমাকে গ্রহণ করে। আমার পছন্দকে এপ্রিশিয়েট করে। আমি বলছি না তোমাকে মাসে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করতে হবে। আমি জাস্ট চাই তুমি নিজের পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত করো যাতে আমার বাবা তোমাকে ফিরায় না দিতে পারে। দ্যাটস ইট।

-আমি জানি তো। সেজন্য যা যা করা লাগবে করবো তো।

-এভাবে করবা? এই মাসে না হইলে পরের মাসে, পরে মাসে না হইলে তার পরের মাসে!

-তুমি তো জানোই আমার অবস্থা।

কিচ্ছু বলে না রিপা। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের ব্যাগ থেকে ভাজ করা এনভেলপ বের করে লিখনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

-নেও, ধরো।

-কি এর মধ্যে?

জবাব দেয় না রিপা। লিখন অপেক্ষা না করে এনভেলপের মুখ খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখে রাবার দিয়ে প্যাঁচানো টাকা। দেখে বুঝা যাচ্ছে দুই চার বা পাঁচ হাজার নয় যথেষ্ট ভালো একটা এমাউন্ট আছে এখানে। একনজর দেখে নিয়ে মুখ তুলে রিপার দিকে তাকিয়ে বলে,

-এগুলা কি?

-টাকা।

-সেটা তো দেখতেই পারতেছি। কিন্তু কেন?

-কেন আবার কি? আমি খোঁজ নিয়েছি, তোমার ভর্তির জন্য যা দরকার এখানে আছে। আমরা এখন যাবো তুমি ভর্তি হবা। তারপর আমাকে বাসায় নামায় দিয়ে তুমি বাসায় যাবা।

-অসম্ভব, তুমি ভালো করেই জানো আমি তোমার থেকে এতগুলা টাকা নিতে পারবো না। এমনিতেই তুমি আমার জন্য কম করো না।

-করি তো কি হইছে? আমার প্রেমিকের জন্য আমি করি তাতে তোমার কি?

-এসব মন ভোলানো কথা বলে লাভ নাই রিপা।

-লাভ, ক্ষতির হিসাব আপাতত করতে পারব না তুমি আমার সাথে এখন যাবা কিনা সেটা বলো।

-না।

-সিওর?

-হ্যাঁ।

-ওকে ফাইন, তাহলে আমাদের সম্পর্কের এখানেই শেষ। আজকে থেকে তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়।

বলেই উঠে দাঁড়ায় রিপা। তা দেখে বসে থাকা লিখন রিপার একটা হাত ধরে ফেলে। হাতে বাঁধা লাগায় পেছনের দিকে তাকায় রিপা। উপরের দিকে মুখ তুলে লিখন বলে,

-আমি তোমাকো ছাড়া থাকতে পারবো না।

-তাহলে চলো ভর্তি হবা।

-এতগুলা টাকা আমি নিতে পারবো না, সত্যি বলছি।

-আচ্ছা যাও একেবারে নিতে হবে না। ধার দিলাম তোমাকে। পরে নাহয় দিয়ে দিও।

-ধার?

-হ্যাঁ ধার।

তবুও দ্বিধাবোধ করে লিখন। কি বলবে বুঝে পায় না। রিপা আর তাকে ভাবার সুযোগও দেয় না। হাত ধরে টেনে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলে,

-এত ভেবে কাজ নেই। চলো তো।

লিখন আর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। এই মেয়ে আগেও তার কথা শুনেনি, আজও শুনবে না তা লিখন খুব ভালো করেই জানে। লিখনকে ভর্তি করেই ক্ষ্যান্ত হশ না রিপা। ভর্রির কাজ শেষ করে নীলক্ষেত চলে যায় বই কিনতে। প্রয়োজনীয় বই কিনার পর লিখন রিপাকে ধানমন্ডি ওর বাসার কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে নিজের বাসার দিকে আগায়। লিখন জানে রিপা নামক মেয়েটা তাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। এই ভালোবাসার সঠিক মূল্যায়ন সে করতে পারবে কিনা তা লিখন জানে না। তবে রিপাকে নিজের করে পেতে, সুখে রাখতে যা যায় করণীয় সব করতে চায় সে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-২+৩

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-২
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

নাস্তা বানানো শেষ করে রান্নাঘর গুছিয়ে, মাথায় পেঁচিয়ে রাখা গামছাটা বাইরের বারান্দায় মেলে দিয়ে আসে চিত্রলেখা। আসার সময় হাতে করে টোস্টের ডিব্বা নিয়ে আসে। সকাল সকাল তাদের খালা-ভাগ্নির চা আর টোস্ট খাওয়ার অভ্যাস অনেকদিনকার।

চিত্রলেখা এসে খালার পাশে বসতেই নারগিস বেগম বলেন,

-আমার কাছে আয় হাতে নেড়ে চুলগুলো শুকিয়ে দেই।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে খালার সামনে নিচে বসে যায় চিত্রলেখা। কোমড় পর্যন্ত লম্বা মোটা গোছার চুল মাথা ভর্তি। খুব আহামরি ফর্সা সুন্দর দেখতে না হলেও চিত্রলেখার চুলের জন্য সবসময় সবার কাছে প্রশংসিত সে। এই চুলটাই যেন ওর সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। চিত্রলেখার মাথার চুল হাতে নাড়তে নাড়তে নারগিস বেগম বলেন,

-সবার জন্য দিনরাত এক করে চিন্তা করিস। নিজের জন্য কবে ভাববি তুই?

-নিজের জন্য আলাদা করে ভাবার কি আছে?

-ওমা! ভাবার কিছু নাই কে বলল? তোর বয়স হচ্ছে বিয়ে দিতে হবে না?

-তুমি আবার আমার বিয়ের কথা ভাবতেছো?

-তো ভাববো না? বয়ত কত হইছে সেই খেয়াল আছে তোর?

-আমি বিয়ে করে অন্যের ঘরে চলে গেলে এই সংসার কেমনে চলবে খালা?

-সেই চিন্তা এখন তোকে আর না করলেও চলবে। লিখন বড় হইছে। সংসারের দায়িত্ব এখন ও নিবে। তুই তো এতকাল কম করিস নাই।

-তুমি কি পাগল হইছো খালা? লিখনের উপর দায়িত্ব দিয়ে দিলে সংসার রসাতলে যাবে গা। তাছাড়া ওর পড়ালেখাও শেষ হয় নাই। আগে পড়ালেখা শেষ করবে, ভালো চাকরী পাবে তারপরে গিয়ে দেখা যাবে। চারু আর চয়নও তো আছে। ওদের দায়িত্ব কে নিবে? ওদের দু’জনের লেখাপড়া করাইতে হবে। আমার চয়নটা মেডিকেলে পড়তে চায়। আমি জানি চারু কোনোদিন মুখ ফুটে বলবে না ও নিজেও মেডিকেলে পড়তে চায়। আমার সামর্থ্য নাই বলেই কখনো মুখ ফুটে বলে না। ওরা জানে না, ওরা না বললেও আমি ওদের মনের সব খবর রাখি। আল্লাহ আমাকে আরেকটু তৌফিক দিলে কি হইতো খালা?

কষ্টে বুক ভার হয়ে আসে চিত্রলেখার। তবু নিজেকে সামলে নেয় সে। খালার সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু না চাইলেও নারগিস বেগম বুঝে জান। মেয়ের মতো ভাগ্নির জন্য উনারও হৃদয় পোড়ে। উনার সামর্থ্য থাকলে চিত্রলেখাকে কোনোরকম কষ্ট করতে দিতেন না তিনি।

-তুই চিন্তা করিস না। কম তো করছিস নাই। বাকিটাও হয়ে যাবে।

-আর বাকিটা। কপাল জোরে এত বড় কোম্পানিতে চাকরীটা পেয়েছিলাম বলে, নাহলে কি হতো ভাবতে পারো? ভাগ্যিস তখন ইউনিভার্সিটিতে ফ্রি কম্পিউটার কোর্সের সুযোগ পেয়ে সেটা লুফে নিয়েছিলাম। নাহলে এত বড় কোম্পানির কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে একজন এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরী পাওয়া তাও আমার মতো ন্যাশনালে পড়া ছাত্রীর জন্য দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছুই না খালা।

-তুই এভাবে ভাবতেছিস কেন?

-সত্যি বলতেছি খালা। কম্পিউটার কোর্সটা না জানা থাকলে এই চাকরী আমি জীবনেও পাইতাম না। তুমি জানো অন্য আরও যে ৬ জন আছে ওরা তো ভালো ভালো ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছে। সে জায়গায় আমি কিছুই না।

নারগিস বেগম কিছু বলতে নেন কিন্তু তখনই চোখ ডলতে ডলতে চারু এসে উপস্থিত হয়। চিত্রলেখার কোল ঘেষে বসে বলে,

-আমাকে ডাকো নাই কেন আপা? একা একা সব কাজ করছো কেন?

চারুকে বুকে জড়িয়ে, বোনের চাদিতে চুমু খায় চিত্রলেখা। নারগিস বেগম আর কিছু বলেন না। দুইবোনকে দেখে চোখ জুড়ান।

সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে বসে রওনক প্রথমেই চায়ের কাপে চুমুক দেয়। তা দেখে পাশে বসে থাকা তার মা দিলারা জামান খেঁকিয়ে ওঠেন। ছেলেকে ধমকের সুরে বলেন,

-তোর এই বাজে অভ্যাস কবে পরিবর্তন হবে রওনক? কতদিন বলেছি খালি পেটে চা খেতে হয় না৷ এসিডিটির সমস্যা হবে।

মায়ের ধমকের সাথে সাথে পরপর আরও দুই চুমুক চা খায় রওনক৷ তারপর চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলে,

-তুমি জানো এটা আমার অনেক পুরোনো অভ্যাস। চাইলেও ছাড়তে পারবো না। তবু প্রতিদিন এক বিষয় নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে ভালো লাগে তোমার? এত এনার্জি কোথায় পাও তুমি?

ছেলের কথা শুনে ইতোমধ্যেই রেগে গেছেন দিলারা জামান। কিন্তু আপাতত এই বিষয়ে আর রা করেন না তিনি। ছেলের সাথো ঝামেলা করতে চান না। আজকের দিনটা সুন্দর হোক এমনটাই চান তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,

-তোরা আজ জলদি চলে আসিস।

তোরা বলতে যে দিলারা জামান রওনক ও উনার বড় ছেলের বউ তানিয়াকে বুঝিয়েছেন তা বুঝতে অবশ্য কারো কোনো অসুবিধা হয়নি। এই বড়িতে দুইজন মানুষই অফিস করেন তারা হচ্ছে রওনক জামান এই বাড়ির ছোট ছেলে, জামান গ্রুপের বর্তমান সিইও আর তানিয়া রহমান রওনকের বড় ভাই রাদিন জামানের বউ। তানিয়া কোম্পানির ফাইনান্স ডিপার্টমেন্ট হেড। চমৎকার ক্যারিয়ার ফোকাসড একটা মেয়ে। দিলারা জামানের দুইটাই ছেলে। রাদিন ও রওনক। ওদের বাবা মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। রওনকের বাবা বেঁচে থাকতে এই কোম্পানি তিনিই সামলাতেন। আচমকা একদিন হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান পাঁচ বছর আগে। তখন থেকেই বাবার পজিশনে কোম্পানি সামলে আসছে রওনক। জামান কোম্পানির সাথে কেবল নামে জড়িত রাদিন। এছাড়া ব্যবসার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই তার। কিন্তু এর মানে এই নয় সে সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকে। রাদিক একজন সফল আর্টিস্ট। তার আঁকা চিত্রকর্ম দেশে এমনকি বিদেশেও অনেক খ্যাতি পেয়েছে। তার ধ্যানজ্ঞান সবটাই কেবল চিত্রকর্মের প্রতি, বাকি দুনিয়ার অন্যসব কিছুর সাথে তার সম্পর্ক ফর্মাল। এমনও হয়েছে মনের মতো ছবি আঁকতে সে দিনের পর দিন নিজেকে ঘর বন্ধি করে রেখেছে। কখনো বা কাউকে না জানিয়েই নিরুদ্দেশ হয়েছে। কাজ শেষে আবার ফিরে এসেছে কখনো পনেরোদিন পর বা মাস শেষে। এনিয়ে অবশ্য বাসার কেউ কখনো আপত্তি করেনি। আবার এমনও নয় বড় ভাইয়ের আগ্রহ নেই বলে রওনক জোরপূর্বক নিজের ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিয়ে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছে। ইনফ্যাক্ট বলা যায় ছোটবেলা থেকেই সে তার বাবার মতো একজন সফল ও সুখ্যাতি প্রাপ্ত ব্যবসায়ী হতে চেয়েছে। বলাবাহুল্য গত পাঁচ বছরে কঠিন পরিশ্রম ও মেধা খাটিয়ে রওনক নিজেকে প্রমাণও করেছে। তার বাবা বেঁচে থাকতে কোম্পানির শেয়ারের যে ভ্যালু ছিল তা রওনকের বদৌলতে তিনগুন হয়েছে এখন।

দিলারা জামানের কথার বিপরীতে রওনক কিছু জিজ্ঞেস করার আগে তানিয়া জিজ্ঞেস করে,

-আজ কি বিশেষ কিছু মা?

-অবশ্যই বিশেষ কিছু, সেজন্যই তো বলছি।

-আজ কিসের অকেশান? আমাদের কারো জন্মদিন তো নয়।

-না না ওমন কিছু না। সাবাদের দাওয়াত করেছি ডিনারে।

-হঠাৎ সাবাদের দাওয়াত করার অকেশান কি?

-অকেশন তো কিছু একটা আছেই।

এবারে রাদিন বলে,

-সেটাই তো আমরা জানতে চাই মা। এত ভনিতা না করে আসল কারণ টা বললেই পারো।

দিলারা জামান ছোট ছেলে রওনকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন,

-আমি আজ সাবার বাবা-মায়ের সাথে সাবা আর রওনকের বিয়ের কথা আলোচনা করবো। উনাদের মতামত জানতে চাইবো আর কি। আর উনাদের জানাবো আমি সাবাকে আমার রওনকের বউ করে আনতে চাই।

সাবার নাম শুনেই রওনক বুঝে গিয়েছিল এরপর তার মা কি বলবে। তাই সাবা প্রসঙ্গ উঠতেই তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সকাল সকাল নাস্তার টেবিলে রওনক কোনো ধরনের সিন ক্রিয়েট করতে চায় না বলে এই বিষয়ে কথা বলে না। সবেই একটা চালের রুটি হাতে নিয়েছিল সে কিন্তু আজ আর খাওয়া হবে না তার। চায়ের কাপে আরেকটা চুমু দেয় সে। শাশুড়ির কথা শুনে তানিয়া একবার রওনকের মুখের দিকে তাকায়। তারপর শাশুড়িকে বলে,

-উনাদের এভাবে ইনভাইট করার আগে একবার রওনকের সাথে কথা বলে নিলে ভালো হতো না?

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দিলারা জামান বলেন,

-ওকে আবার আলাদা করে কি জিজ্ঞেস করবো? আর কতদিন আপত্তি করবে ও? এভাবে কি সারাজীবন একা কাটিয়ে দিবে নাকি?

তানিয়া হয়তো আরও কিছু বলতে নিয়েছিল কিন্তু রওনক চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ায় সে আর কিছু বলে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রওনক মিমি ও মিশকাতকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-তোমরা জলদি নাস্তা করে আসো, আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।

মিমি, মিশকাত দু’জনেই বাধ্য বাচ্চার মতো মাথা নেড়ে বলে,

-ওকে ছোটপাপা।

এরা দুইজন হচ্ছে এই পরিবারের জান। রাদিন ও তানিয়ার ছেলেমেয়ে। রওনকের কলিজার টুকরো দু’জনেই। প্রতিদিনের রুটিন সকালে রওনক ওদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে তারপর অফিসে যায়। ওদের স্কুল শেষ হলে রওনকের ড্রাইভার বাসায় নিয়ে আসে। বাড়িতে আরও তিনটা গাড়ি থাকা স্বত্বেও ওরা দু’জন রওনকের গাড়ি ছাড়া অন্যকোনো গাড়িতে করে স্কুলে যাওয়া আসা করে না। এমনকি ঘুরতে, বেড়াতেও যেতে চায় না। ওরা দু’জনই রওনকের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই ওদের যেকোনো আবদার সে মেনে নেয় বিনা বাক্য ব্যয় করে। রওনক নাস্তা না করেই চলে যেতে চাচ্ছে দেখে দিলারা জামান বলেন,

-সে কি রওনক তুই নাস্তা না করে চলে যাচ্ছিস কেন?

এই মুহূর্তে সে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চায়নি কিন্তু কিছু না বলেও পারছে না। জবাব না দেয়াটাও বেয়াদবি। তাই বাধ্য হয়েই চেয়ারে বসে পরে বলে,

-আমি তোমাকে আগেও নিষেধ করেছি এমন কিছু করতে।

-এটা কেমন কথা রওনক? আমি তোর মা, তোর ভালো-মন্দ দেখা আমার দায়িত্ব। তাছাড়া আমি তো সারাজীবন বাঁচবো না। একদিন আমিও তোর বাবার মতো মরে যাবো। তখন কে দেখবে তোকে?

-আমি নিজেই নিজেকে দেখবো মা। যখন তুমি থাকবা না তখনেরটা তখন দেখা যাবে এখন কেন এসব কথা আসছে। আমার কাউকে প্রয়োজন নেই আর কতবার বললে বুঝবা তুমি?

-দেখ রওনক, এবার তোকে বিয়ে করতেই হবে।

ফস করে জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে রওনক চোয়াল শক্ত করে বলে,

-আমি আগেও বলেছি, এখন আবারও বলছি, আমি আর বিয়ে করবো না। সো এসব পাগলামি করার কোনো মানে হয় না।

নিজের কথায় বিরতি না দিয়ে, মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রওনক তানিয়াকে বলে,

-আমি বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছি ভাবী।

আর অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় সে। রওনক বেরিয়ে যেতেই তানিয়া পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে বলে,

-এসব করার আগে আপনি আমাকে অন্তত একবার বলতেন মা। রওনক চায় না তাহলে কেন ওকে ফোর্স করছেন?

-তুমিও ওকেই সাপোর্ট করছো বউমা? এভাবে কতদিন একা থাকবে ও? তোমার তো উচিত ওকে বুঝিয়ে বলা। তা না করে উল্টা তুমি আমাকে বুঝাচ্ছো।

-আপনি আপনাকে বুঝাচ্ছি না মা। আমি জাস্ট বলতেছি এভাবে কাজ করলে রওনক কোনোদিনও রাজি হবে না। ওর সাথে কথা বলতে হবে ঠান্ডা মাথায়। ও প্রচন্ড জেদি তা তো আপনি ভালো করেই জানেন। ওর সাথে জেদ দেখালে পারবেন না।

বউকে সমর্থন করে রাদিন বলে,

-এমন করলে রওনক কোনোদিনও আবার বিয়ে করতে রাজি হবে না মা।

-ছয় বছর তো কম সময় না। অতীত ধরে বসে থাকলে কীভাবে সামনে আগাবে ও?

-আপনি ভুল ভাবছেন মা। আপনার ছেলে অতীত আঁকড়ে ধরে বসে রয়নি। ওর শুধু সময় প্রয়োজন।

-আমি বুঝি না তোমাদের এসব কথা। আর বুঝতেও চাই না। তোমরা আসলে আসবা, না আসলে নাই। আমি আজ সাবার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবো আর এটাই ফাইনাল।

তানিয়া আর কিছু বলে না। সে ভালো করেই জানে তার শাশুড়ি উচ্চ লেভেলের ঢিট মানুষ। সহজ কথায় একে বুঝানো সম্ভব নয়। আপাতত আর চেষ্টাও করে না। এর চাইতে ভাবে অফিসে গিয়ে রওনকের সাথে কথা বলবে এই বিষয়ে। এটাও ঠিক ইটস হাই টাইম রওনকের আবার বিয়ে করা উচিত। এভাবে সারাজীবন একজনের পক্ষে একা থাকা সম্ভব নয়, এটা রওনককে বুঝতে হবে।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৩
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

সাড়ে আটটা নাগাদ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে চিত্রলেখা। দশটায় অফিস কিন্তু দশ/পনেরো মিনিট আগেই উপস্থিত থাকে সে সবসময়। শুধু চিত্রলেখা একা নয়। অফিসের সবাই পনে দশটার মধ্যে ইন করে।

বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মাথায় আসে চিত্রলেখা। মেইনরোডে এসে বাসে উঠবে বলে। প্রতিদিনের মতো আজও গলির মাথায় আসতেই তার পথ আগলে দাঁড়ায় মামুন। এটা এখন রোজকার নিয়ম হয়ে গেছে। শুক্র, শনি বাদে সপ্তাহের বাকি পাঁচদিনই মামুন এই কাজ করে। হোক শীত, গ্রীষ্ম বা বসন্ত একদিনও বাদ যায় না। এই এলাকার স্থানীয় ছেলে সে। চিত্রলেখার খালুর বাড়ির ঠিক ডান পাশের পাঁচতলা বাড়িটা মামুনদের। চার ভাইয়ের মধ্যে মামুন তিন নম্বর। মাধ্যমিক পাশ করার পর আর লেখাপড়া করেনি। পড়তে তার ভালো লাগে না। শুধু পড়ালেখা নয় কিছুই করতে তার ভালো লাগে না। মামুনের বাবা এলাকার প্রভাবশালীদের একজন। এই এলাকায় ওদের অবস্থা উচ্চপর্যায়ে। তিনটা বাড়ি আছে, বাজারে দোকান আছে আট কি দশটা। এছাড়াও কেরানীগঞ্জে মামুনের বাবার একটা কারখানা আছে। কিসের কারখানা সেটা অবশ্য চিত্রলেখা জানে না। কখনো জানার আগ্রহ হয়নি৷ ছোটবেলা থেকে চোখের সামনে চিত্রলেখাকে বড় হতে দেখেছে মামুন। আর দেখতে দেখতে কখন ভালোবেসে ফেলেছে তা সে নিজেও জানে না। এই পর্যন্ত কম করে হলেও শ’খানেক বার মামুন চিত্রলেখাকে তার মনের কথা জানিয়েছে কিন্তু প্রতিবার সে তা ভদ্রভাবে প্রত্যাখান করেছে। এতে মামুন কখনো উচ্চবাচ্য করেনি। হুমকি ধামকিও দেয়নি। বরং বেহায়ার মতো দু’বার তার মাকে পাঠিয়েছে চিত্রলেখার খালার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে। সেই প্রস্তাবও নাকচ করেছে সে। সুন্দরভাবেই বুঝিয়ে বলেছে ছোটভাইবোন-দের যার যার পায়ে দাঁড় না করিয়ে তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। মামুনটা ছোটবেলা থেকেই অলস, ভবঘুরে ধরনের। সহজ ভাষায় এলাকার লোকজন তার পিছনে তাকে ভাদাইম্মা বলে ডাকে। এই খবর মামুন জানে তবু কানে নেয় না। জীবনে কোনো কাজ সিরিয়াসভাবে করেনি সে কেবল একটা কাজ ব্যতীত আর তা হচ্ছে চিত্রলেখাকে ভালোবাসা। এই একটা কাজই সে মন-প্রাণ দিয়ে করেছে। শেষপর্যন্ত চিত্রলেখা তার হবে কিনা তা না জেনেই নিজের সবটুকু ভালোলাগা, ভালোবাসা মামুন চিত্রলেখার নামেই লিখে দিয়েছে।

চিত্রলেখা গলির মাথায় এগিয়ে আসতেই টঙ দোকানে বসে চা খেতে থাকা মামুন হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে আসে। অন্যপাশেই তার বাইট পার্ক করা আছে। দূর থেকে সেটা আগেই দেখে ফেলেছিল চিত্রলেখা। বাইক দেখে আন্দাজ করে ফেলেছিল বাদরটা আশেপাশেই আছে। তবু চেষ্টা করেছিল মামুন তাকে দেখে ফেলার আগে হটকে পড়তে। প্রতিদিন এই লোকটার সাথে দশ/পনেরো মিনিট ঘ্যানঘ্যান করে দেরি হয়ে যায় তার। সেজন্যই সাড়ে আটটায় বাসা থেকে বের হয় সে। নয়ত নয়টায় বের হলেও ঠিক সময় মতো পৌঁছাতে পারে। কিন্তু নিয়ম করে মামুন পথ আটকায় বলে বাধ্য হয়ে চিত্রলেখাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। এভাবে প্রতিদিন দুইটা বাস মিস হয় তার।

মামুন পথ আটকে দাঁড়িয়ে কিছু বলার আগে চিত্রলেখা নিজেই বলে,

-মামুন ভাই আপনার কি কোনো কাজ নাই?

-আপাতত তো তোমার পথ দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। তুমি চাইলে আমাকে একটা কাজ দিতে পারো।

-কিন্তু আপনাকে দেয়ার মতো কোনো কাজ আমার কাছে নাই।

-একটা কাজ আছে তুমি চাইলে আমি করতে পারি।

-কী কাজ?

-তোমাকে প্রতিদিন অফিসে দিয়ে আসা আর নিয়ে আসার কাজ। তোমাকে কষ্ট করে বাসে ঝুলে যাওয়া আসা করা লাগবে না। বাইকে সময়ও কম লাগবে।

-আপনার অনেক ধন্যবাদ মামুন ভাই কিন্তু আমি এমনি ভালো আছি। আমার কোনো বিশেষ সার্ভিসের প্রয়োজন নাই। আপনি শুধু দয়া করে আমার পথ আটকানো বন্ধ করেন। আপনার জন্য আমার প্রতিদিন দেরি হয়।

-তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেই তো আমি আর পথ আটকে দাঁড়াই না। আব্বা-আম্মা বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছে মায়া।

-আপনি আবার আমায় মায়া বলে ডাকলেন?

-আমি সারাজীবনই তোমায় মায়া বলে ডাকবো।

চিত্রলেখা হাত ঘড়িতে সময় দেখে। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই পাগলের সাথে কথা বলতে থাকলে এসব কথা শেষ হবে না। তাই কথার ইতি টানার চেষ্টা করে চিত্রলেখা বলে,

-আপনার বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলুন মামুন ভাই। আমার আশায় থাকলে আপনাকে একাই বুড়ো হতে হবে।

চিত্রলেখার দেরি হচ্ছে দেখে পাশ কেটে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে মামুন আর বাঁধা দেয় না। পেছন থেকে শুধু বলে,

-খালাম্মাকে বলে রাইখো শুক্রবার আব্বা-আম্মা তোমাদের বাড়ি যাবে।

এবার চিত্রলেখাই দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছন ঘুরে মামুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমি আগেও বলেছি আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না। আপনি দয়া করে চাচা-চাচীকে পাঠাবেন না। প্রতিবার আমি উনাদের মুখের উপর না করতে পারবো না মামুন ভাই।

চিত্রলেখা কিছু বুঝতে পারার আগে মামুন হাত বাড়িয়ে তার একটা হাত ধরে বলে,

-এবার না করো না মায়া৷ চলো আমরা বিয়েটা করে ফেলি। আমি সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

মামুনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি না। দয়া করে আমাকে আর বিপদে ফেলবেন না। চাচা-চাচীকে পাঠিয়ে আমায় আর অপমানের মুখোমুখি করবেন না অনুরোধ করছি।

মামুনকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না চিত্রলেখা। সোজা হাটা ধরে অফিসের দিকে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে একা মামুন। মনে মনে ভাবে, ❝একদিন তুমি ঠিকই আমাকে ভালোবাসাবা মায়া।❞ চিত্রলেখাকে মায়া বলে ডাকে মামুন। এই নামটা তারই দেয়া। চিত্রলেখাকে দেখলেই নাকি তার মায়া পায়, ভালোবাসা পায়। একপৃথিবী উজার করা মায়া দেখতে পায় সে চিত্রলেখার মুখে। তাই ভালোবেসে, ভালোবাসার মানুষকে মায়া নাম দিয়েছে সে।

—————————————————————————-

মিমি মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে, তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে আর ম্যাশকাত পড়ে ডিআরএমসি-তে, পঞ্চম শ্রেনীতে। রওনকের অফিস পান্থপথে হওয়ায় প্রতিদিন শ্যামলী থেকে অফিস যাওয়ার পথে দু’জনকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায় সে। কখনো এই নিয়মের পরিপন্থী হয় না। আজও ওদের নামিয়ে দিয়ে অফিস যাওয়ার পথে কলাবাগান মোড়ে সিগনালে পড়ে সে। পেছনের সিটে বসে গ্লাস না নামিয়ে বাইরে তাকালে, ঠিক তার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাস থেকে চিত্রলেখাকে নামতে দেখে রওনকের দৃষ্টি ওখানেই স্থির হলো বুঝি। সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ফাঁক গলে ফুটপাতে উঠে যায় মেয়েটা। জোর পায়ে হেঁটে চিত্রলেখা সামনে এগিয়ে গিয়ে বামে মোড় নিয়ে হাওয়ায় হয়ে যায়। এখান থেকে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামনের দিকে তাকায় রওনক। সিগনাল কখন ছাড়বে সেই আশায়। কয়েক সেকেন্ড বাদেই সিগনাল ছেড়ে দিলে গাড়িটা ঠিক সেই পথ ধরেই আগায় যে পথ ধরে একটু আগে চিত্রলেখা নামক ছিমছাম দেখতে মেয়েটা হেঁটে গেছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। ওকে দেখলেই মনে হয় ওর দুই কাঁধে রাজ্যের সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যেসব দায়িত্বের ভারে দিনকে দিন মেয়েটা হাসতে ভুলে যাচ্ছে। গাড়িটা স্কয়ার হাসপাতাল অতিক্রম করতেই রওনক আবার চিত্রলেখাকে দেখতে পায়। দূর থেকে দেখলেও চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তার। চট করেই ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থামাতে। বাম পাশে গাড়িটা দাঁড় করালে নেমে গিয়ে ফুটপাতে দাঁড়ায় রওনক। অনেক খানিক দূরত্ব তাদের মাঝে। চিত্রলেখা হয়ত লক্ষই করেনি দূরে দাঁড়িয়ে কেউ একজন দেখছে তাকে। দেখবে কীভাবে সে তো ব্যস্ত নিজের ছেঁড়া জুতা ঠিক করতে। কলাবাগান সিগনালে বাস থেকে নেমে অফিস পর্যন্ত হেঁটে আসে সে। আজ আসার পথে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে জুতাটা ছিঁড়ে গেছে। সেই ছেঁড়া জুতাই মুচির কাছে দিয়ে সেলাই করে নিচ্ছে। আপাতত হাতে সময় নেই জুতা কিনতে যাওয়ার। হয়ত লাঞ্চ টাইমে নয়ত অফিসের পরে কিনে নেয়া যাবে। আজকের দিনটা চালাতে পারলেই হলো। জুতা সেলাই করে নিয়ে আবার সামনের দিকে হাটা ধরে চিত্রলেখা ব্যস্ত ভঙ্গিতে। দশটা বাজতে খুব বেশি সময় নেই। জলদি পৌঁছাতে হবে তাকে। পেছনে দাঁড়িয়ে চিত্রলেখার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে রওনক। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় যতখানি রাগ হয়ে বেরিয়েছিল এই মুহূর্তে আর ততখানি রাগ অনুভব করছে না সে। অনেকটাই হালকা লাগছে নিজেকে। রওনককে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ড্রাইভার নেমে এসে জিজ্ঞেস করে,

-স্যার কি আজ অফিস যাবেন না?

-যাবো, কারো অফিস পৌঁছানোর খুব তাড়া। সে পৌঁছানোর পর যাবো।

-কার কথা বলছেন স্যার?

-তুমি চিনবে না?

আরও খানিকক্ষণ সামনের পথের দিকে তাকিয়ে থাকে রওনক। যতক্ষণ চিত্রলেখাকে দেখা যায় ততক্ষণ। এই তাকিয়ে থাকার, দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ তার জানা নেই। মেয়েটার মধ্যে অদৃশ্য কোনো শক্তি আছে। তা মাস দেড় আগেই টের পেয়েছে রওনক, যেদিন তারা প্রথম একে-অপরের মুখোমুখি হয়েছিল। কিছু একটা মুগ্ধ করেছিল তাকে অজান্তে।

চলবে…

মাতাল হাওয়া পর্ব-০১

0

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-১
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

ভোরের দিকে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে গোসল সেরে একবারে ছয়টা নাগাদ রান্নাঘরে ডুকে চিত্রলেখা। এটা তার প্রতিদিনকার রুটি। প্রথমে রান্নাঘরে ডুকেই চায়ের পানি চুলায় চাপিয়ে দেয়। তারপর শুরু করে সবার জন্য সকালের নাস্তা বানানো। ছয় সদস্যের সংসারের সকালের নাস্তা বানাবোর দায়িত্বটা অলিখিত ভাবে চিত্রলেখাই পালন করে। শুধু সকালের নাস্তা নয়। সারাদিন অফিসে খাটাখাটনি করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রাতের ও পরেরদিন দুপুরের খাবারটাও রান্না করে ফেলে। এত খাটাখাটনি করলেও চিত্রলেখার কপালে ক্লান্তি বা মন খারাপের কোনো রেখা দেখা যায় না কখনো। বরং এই মানুষগুলোর জন্য করতে তার ভালোই লাগে। বেঁচে থাকাটাই তো এদেরকে ঘিরে তাহলে এদের জন্য করতে কষ্ট হবে কেন! এটা চিত্রলেখার ভাব না। প্রথমেই আলু কেটে পেয়াজ, কাঁচা মরিচ, তেল, লবণ দিয়ে মাখিয়ে চুলায় চাপিয়ে দিয়েছে ভাজি রান্না করে। এক চুলায় ভাজি, আরেক চুলায় চায়ের পানি বলক আসতে আসতে এদিকে রুটির জন্য আটা ময়ান দিতে ব্যস্ত চিত্রলেখার পাশে এসে দাঁড়ান নারগিস বেগম। খালাকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে একবার শব্দহীন হাসি বিনিময় হয় দু’জনার। তারপর চিত্রলেখাই আগে বলে,

-তুমি এত সকাল সকাল উঠতে গেলা কেন খালা? কতদিন বলছি নাস্তা রেডি করে আমি তোমারে ডাকবো। ততক্ষণ একটু ঘুমাইলেই পারো। এত সকাল সকাল উঠার কি দরকার? বয়স হইতেছে একটু বেশি বিশ্রাম করবা তা না সকাল সকাল চলে আসো এইখানে।

-তুই একলা একলা আর কত করবি বলতো?

-যতদিন বেঁচে আছি ততদিন করবো। মরে গেলে তো আর করার সুযোগ থাকবে না।

-এসব কি রে মা? সকাল সকাল তুই বাঁচা মরার কথা বলতেছিস!

-জীবন, মৃত্যু এসবই তো জীবনের আসল সত্যি খালা। বাকি সব তো ক্ষণস্থায়ী।

-কি হইছে তোর? সকাল সকাল এমন কথা বলতেছিস কেন? মনটা খারাপ?

-না তো। কিছু হয় নাই আমার। তুমি অহেতুকই ভাবতেছো।

নারগিস বেগম ভালো করেই জানেন হাজার সমস্যা বা কষ্ট হলেও তা মুখফুটে বলবে না চিত্রলেখা। নিজের কষ্টগুলো ভেতরে চেপে রাখে সবসময়। মুখে না বললেও মায়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে নারগিস বেগম ঠিকই অনুভব করতে পারেন মেয়ের কষ্ট। মা হয়ে লালন পালন করেছেন এতটুকু তো চিনেনই তিনি। তাই আপাতত আর এসব মন খারাপের প্রসঙ্গে কথা বলে মেয়েটার মন আরও ভেঙে দিতে চান না তিনি। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,

-দে আমি রুটি বেলে দেই।

-একদম না। যেখানে দাঁড়ায় আছো, চুপচাপ ওখানেই দাঁড়ায় থাকো। নাইলে এককাজ করো, তুমি গিয়ে ড্রইং রুমে বসো। চা বলক এসে পড়ছে আরেকটু লিকারটা গাঢ় হলেই তোমাকে চা দিচ্ছি।

এসব কাজ চিত্রলেখা একাই করে। কাউকে হাত লাগাতে দেয় না। গিয়ে বসতে বলার পরেও খালাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার বলে,

-কি হইলো খালা যাও?

-আচ্ছা থাক আমি কিছু করতে চাইবো না। এখানে তোর পাশে দাঁড়ায় থাকি।

-চুলা জ্বলতেছে তোমার গরম লাগবে।

-নভেম্বর শুরু হয়ে গেছে, শীত পড়তে শুরু করছে। এই সময়ে আবার কিসের গরম? থাকি না একটু। তোর সাথে গল্প করি। একটু পরেই তো বের হয়ে যাবি সারাদিনের জন্য। আমার কথা বলারও কেউ থাকে না।

-কেন চারু তো সারাদিনই তোমার কাছে থাকে।

-ওর তো ক্লাস থাকে। বিকালে প্রাইভেটেও যায়। ওর এত সময় কই আমার সাথে বসে আজাইরা গল্প করবে।

খালার কথা শুনে হাসে চিত্রলেখা। কিন্তু হাসিটা যেন সম্পূর্ণ পরিস্ফুটিত হয় না তার চোখ-মুখে। বরং দেখে মনে হচ্ছে জোরপূর্বক নিজেকে খালার সামনে হাসিখুশি রাখতে হাসছে। আবার রুটি বেলায় মন দেয় চিত্রলেখা। নারগিস বেগমও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। কোনো একটা বিষয় ভেবে খানিকটা চিন্তিত তিনি৷ কিন্তু এই মুহূর্তে এসব কথা বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছেন না তাই মনে মনে ছটফট করছেন। রুটি বেলতে বেলতেই চিত্রলেখা বলে,

-কি বলতে চাও খালা বলো তো শুনি।

এমনটা সবসময়ই হয়। চিত্রলেখার কাছ থেকে কোনো কথা বা চিন্তা কোনোটাই আড়াল করতে পারেন না তিনি। ধরা পড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলেন,

-না মানে আসলে…

-এসব মানে, আসলে বাদ দিয়ে আসল কথাটা বলো। আমার রুটি বানানো প্রায় শেষ। ওদের সবাইকে খাওয়ার জন্য ডাকতে হবে। এর মধ্যে তোমার জরুরী কথাটা চট করে সেরে ফেলতো।

-একটা না দুটো কথা আছে।

-ঠিক আছে, একটা একটা করে বলো আমি শুনছি।

-কোনটা আগে বলবো বুঝতে পারতেছি না যে!

রুটি বেলা এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করে খালার দিকে তাকায় চিত্রলেখা তারপর বলে,

-তোমার মন যেভাবে সায় দেয় তুমি সেভাবেই বলো। যেটা আগে বলতে মন চায় সেটা আগে বলো।

দু’মুহূর্ত চুপ করে থেকে মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নেন নারগিস বেগম। তারপর বলেন,

-লিখনের সাথে রাতে কি কোনো কথা হইছে তোর?

-হইছে তো।

-কিছু বলছে ও তোরে?

-বলছে, বিদেশ যাইতে চায়।

-হুম।

-তুমি এইটা নিয়া চিন্তা করতেছো? রাতেই কথা হইছে ওর সাথে আমার। সব বলছে ও আমারে।

-কিন্তু কীভাবে কি করবি? ওর কথায় তো মনে হইতেছে ও খুবই সিরিয়াস।

-তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না তো খালা। এখনো এক বছর সময় আছে হাতে। ওর ফাইনাল পরীক্ষাটা শেষ হোক। ততদিনে একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

-কি ব্যবস্থা?

-হয় ওর মাথা থেকে বিদেশ যাওয়ার ভূত নামবে নয় টাকার জোগাড় হবে।

-এত টাকা কই থেকে জোগাড় করবি তুই?

-তা তো এখন জানি না খালা। ভবিষ্যতের চিন্তা এখন করে লাভ আছে বলো? পরেরটা পরে দেখা যাবে। তুমি এখন থেকেই এসব চিন্তা করে প্রেসার বাড়াইতেছো কেন?

-তোর জন্য আমার চিন্তা হয় রে মা। সবার জন্য এত করিস কিন্তু নিজের জন্য কোনোদিন কিছু করিস না।

হাসে চিত্রলেখা জবাব দেয় না। নারগিস বেগমও জানেন এসব কথাবার্তা এড়িয়ে চলে সে। ওর জীবনটাই এমন। সবার জন্য করতেই হয়তো ওর জন্ম হয়েছে। যেখানে ওর নিজস্ব চাওয়া পাওয়া বলতে কিচ্ছু নেই। জীবনের এই কঠিন সত্যিটা অনেক আগেই মেনে নিয়েছে সে। তাই আর কোনো আক্ষেপ নেই। এই বিষয়ে আর কিছু না বললেও চিত্রলেখা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে,

-দুইটা কথা বলার ছিল তোমার। একটা তো আমি জানিই আরেকটা কি বলো তো শুনি।

এবারে আগের চাইতে আরও বেশি ইতস্তত করে নারগিস বেগম বলেন,

-তোর খালু বলতেছিল গ্রামের বাড়িতে দুইটা বাছুর কিনবে।

-কত টাকা লাগবে?

-বলল সব মিলায় সাত হাজার।

-আচ্ছা, এই মাসের বেতন আসলে দিয়ে দিবো।

লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসে নারগিস বেগমের। নিজের স্বামীর কৃতকর্মের জন্য তিনি সারাজীবনই লজ্জিত। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই উনার। হাত-পা বাঁধা বলেই উনাকে উনার স্বামীর এসব অন্যায় আবদার মানতে হয়। খালার অবস্থাটা চিত্রলেখা বুঝে তাই সবসময় নিজের সাধ্য মতো করার চেষ্টা করে। এই মানুষটা না থাকলে আজ সে ও তার ছোট ছোট ভাইবোনগুলো কোথায় থাকতো আল্লাহই জানে। অসময়ে বাবা-মা মারা যাওয়ায় অকালেই কঠিন এই দুনিয়ার বুকে এতিম হয়ে গিয়েছে চিত্রলেখা। তখন দশম শ্রেনীর ছাত্রী চিত্রলেখা। চার ভাইবোনের মধ্যে ওই বড়। তারপর লিখন ওর থেকে চার বছরের ছোট। চার ভাইবোনের মধ্যে ছোট চারু ও চয়ন। ওরা দু’জন যমজ। চিত্রলেখার বাবা-মা মারা যাওয়ার সময় ওরা দু’জন কোলের ছিল। বাবা-মায়ের কথা স্পষ্ট মনেও নেই ওদের। আজও মনে আছে সেই দিনটার কথা চিত্রলেখার। বাড়িতে কিছু জমিজমার কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে। জরুরী কাজ একদিনের জন্য যাবেন তাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নেয়নি। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে সকাল সকাল রওনা হয়ে গিয়েছেন। একটা দিন থেকে কাগজ-পত্রে স্বাক্ষর করে পরেরদিনই চলে আসবেন। কিন্তু সেই যাওয়া আর হয়নি। যাওয়ার পথে লঞ্চ ডুবে মারা যায় চিত্রলেখার বাবা-মা। দু’জনেরই লাশ পাওয়া গিয়েছিল। অসহায় পৃথিবীতে বাবা-মা দু’জনকে একত্রে হারিয়ে নিঃসঙ্গ, এতিম হয়ে পড়ে ওরা চার ভাইবোন। তখন চিত্রলেখার একমাত্র খালা এই নারগিস বেগমই ওদের বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করেছেন। নারগিস বেগম মমতা ভরে ওদের বুকে আগলে নিলেও উনার স্বামী জামশেদ আলীর ক্ষেত্রে তা নয়। প্রথমে উনি রাজি হতে চাননি। নারগিস বেগমের কোনো সন্তান নেই। কিন্তু তার শত আকুতিতেও মন গলেনি জামশেদ আলীর। নিজের স্বামীকে ভালো মতো চিনেন বলেই উনাকে উনার ভাষাতেই রাজি করিয়েছেন শেষপর্যন্ত।

শুনতে খারাপ শুনালেও এটাই সত্যি জামশেদ আলী লোভী প্রকৃতির মানুষ। নিজের স্বার্থ ব্যতীত কিছুই বুঝেন না। চরম পর্যায়ের স্বার্থপর একজন মানুষ। শুরুতে ওদের চার ভাইবোনকে নিজেদের কাছে রাখার পক্ষে ছিলেন না। বসিয়ে বসিয়ে চারজন মানুষ খাওয়ানোর পক্ষে তিনি ছিলেন না কখনোই। বয়স কম হলেও ঐসময় সবকিছু বুঝার মতো বয়স চিত্রলেখার হয়েছিল। তাই খালুর বলা কথাগুলো ঠিকই বুঝেছে। শেষমেশ নারগিস বেগম বাধ্য হয়ে উনার ও চিত্রলেখার মায়ের অর্থাৎ দু’বোনের বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি স্বামীর নামে লিখে দেওয়ার কথা জানালে উনি আর আপত্তি করেননি ওদের নিজের কাছে রাখতে। লোভ এমন এক কঠিন ব্যধি যা মানুষের মনুষ্যত্ব ধ্বংস করে ফেলে। যার উদাহরণ সয়ং জামশেদ আলী। কতটুকু নীচু হলে সম্পত্তির লোভে এতিম বাচ্চাগুলোকে নিজেদের কাছে রাখতে রাজি হয় একজন মানুষ। অন্যদিক থেকে চিন্তা করলে সম্পত্তির লোভে হলেও জামশেদ আলী তো রাজি হয়েছেন কিন্তু অপরপক্ষে চিত্রলেখার চাচা ফুপিরা কেউ ওদের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি। এমনকি ওর বাবার সম্পত্তির অংশও বুঝিয়ে দেয়নি। ওরা ছোট বলে এড়িয়ে গেছেন। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর চিত্রলেখা আর চাচাদের দারে যায়নি। যারা অসময়ে মাথার উপর ছায়া হতে পারেনি পরবর্তীতে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর রুচি হয়নি ওর। কোটিকোটি টাকা সম্পত্তি পাবে তেমনটা নয়। অল্প কিছু অংশের অংশীদার ছিল চিত্রলেখার বাবা। যা ওর চাচারা বলতে গেলে মেরে খেয়েছে। এসব প্রসঙ্গ উঠলে নারগিস বেগম সবসময় বলেন, ❝কারো হক মেরে কেউ গিলতে পারবে না। হয় দুনিয়ায় নয় আখিরাতে এর হিসাব দিতেই হবে।❞ এসব নিয়ে চিত্রলেখার কোনো আক্ষেপ নেই। জীবনের এতগুলো বছর বাবা-মায়ের ছায়া, আদর, ভালোবাসা ছাড়া কাটিয়ে দিয়েছে। সেখানে বাবার নামে সামান্য কিছু সম্পদ না পেলেও এই জীবন কোনোরকমে চলেই যাবে চাক্কার হাওয়া বের হয়ে যাওয়া লক্কর ঝক্কর রিকশার মতো।

খালার মন ভার হয়ে আছে তা বুঝতে পেরে চিত্রলেখা দু’কাপ চা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

-তুমি চা নিয়ে গিয়ে বসো। আর মাত্র ২ পিস রুটি সেকা বাকি। শেষ করে আসতেছি আমি। চা খেতে খেতে আজকে অনেক গল্প করবো দু’জনে।

নারগিস বেগম আর কথা বাড়ান না। চায়ের কাপ হাতে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ান।

রায়ের বাজারের এই একতলা বাড়িটা জামশেদ আলীর। তার বাবার করে দেয়া অবশ্য। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে তিনি। অথচ উনার নিজের কোনো সন্তান নেই। এমনকি উনার ঘরে থাকা এতিম ছেলেমেয়েগুলোর দিকে কোনোদিন মায়া ভরা দৃষ্টিতে একবারের জন্যও তাকাননি। বাড়িটা নিজের হওয়ায় সুবিধা এতটুকুই হয়েছে এতগুলো মানুষের মাথা গুজার ঠাই হয়েছে। তা নাহলে মাস শেষে মোটা অংকের ভাড়া গুনতে হতো। যা এখন দিতে হয় না। ঢাকার শহরে ভাড়া থাকা অনেক কঠিন। কিন্তু বাড়ি ভাড়া না গুনতে হলেও সংসারের অন্যান্য খরচ ঠিকই চিত্রলেখাকে দিতে হয়। বলা যায় এতগুলো মানুষের খাওয়ার খরচের সবটাই ও একা হাতে সামলায়। সংসার খরচের পাশাপাশি, ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া, আবদার সব দিকেই খেয়াল রাখতে হয় চিত্রলেখাকে। জীবনটা অনেক কঠিন ওর জন্য তবু এই জীবন নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। দিনশেষে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য ওর জন্য। হোক টুকটাক তবু ভাইবোনগুলোর খেয়াল রাখতে পারছে, আবদার পূরণ করতে পারছেই এতেই খুশি সে। মাঝেমধ্যে আফসোস হয় ভাইবোনদের সকল চাহিদার জোগাড় করতে পারে না ভেবে।

চলবে….

অমানিশা পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
শেষ পর্ব

গোধূলি বাসায় এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। ভীষণ কান্নার দমকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল ওর। সাব্বির এতো নীচ এটা ও ভাবতেও পারেনি। ওর সাথে এতো খারাপ আচরণ কিভাবে করতে পারল। ও ভেবেছিলো ওকে দেখে হয়তো ভয় পাবে। কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করবে। আর গোধূলী ওসব কিছুই শুনবে না এবার। ওর মুখোশ খুলে দিয়ে সরে আসবে। কিন্তু সাব্বির উলটো ওকেই ফাঁদে ফেলল। এখন কি করবে গোধূলী। বাড়িতে কিভাবে বলবে যে ওর ভালোবাসার মানুষটা ওকে এভাবে ঠকিয়েছে।

কিনে আনা বিষটা হাতে নিলো ও। এখুনি এই কলঙ্কিত জীবনটা শেষ করে দেবে ও। ঔষধটা নাকের কাছে আনতেই বমি চলে আসল। নাক চেপে ধরে মুখে নিয়ে নিলো কালো রঙের পাউডারটা।‌ সাথে সাথেই জিহ্বায় প্রচন্ড জলুনি শুরু হলো। সাথে উৎকট গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উলটে আসতে লাগল। গোধূলি ছুটে বাথরুমে ঢুকে গেলো। বেসিনে দাঁড়িয়ে হরহর করে বমি করে ফেলল। জলদি করে পানি মুখে নিয়ে কুলি করে ফেলতে লাগল।

এটা কি করতে যাচ্ছিলো ও। আর একটু হলেই জীবনটা হারাতে বসেছিল। ভীষণ একটা ভয় আঁকড়ে ধরল ওকে। কিছুতেই মরতে পারবে না ও। সাব্বিরের মতো শয়তানের জন্য ও কেনো মরতে যাবে। বরং সাব্বিরের কাছ থেকে কিভাবে মুক্তি পাবে সে চেষ্টাই করতে হবে ওকে।

মনে মনে ঠিক করল এখন কিছুদিন আপাতত চুপচাপ থাকবে ও। সাব্বিরের যেমন খুশি চলুক। ও আর এসব বিষয়ে নাক গলাতেও চায় না। যে ওকে রেখে অন্য কারো কাছে চলে গেছে তাকে নিজের করে রাখার কোনো ইচ্ছে নেই ওর। এখন শুধু সাব্বিরের কাছে থাকা ঐসব ছবি ভিডিও উদ্ধার করার চেষ্টা করবে ও।
সাব্বির বাড়ি ফিরল পরদিন। ফিরেই গোধূলীর ওপর চড়াও হলো।

তোর সাহস হলো‌ কিভাবে ঐ বাসায় যাওয়ার। আমার পেছনে গোয়েন্দা গিরি করার মজা বোঝাব আজ।

গোধূলিকে উলটা পালটা কিলঘুষি মারতে থাকল। গোধূলি দাঁতে দাঁত চেপে থাকল।

মারতে মারতে একসময় ক্লান্ত হয়ে সাব্বির ছেড়ে দিলো ওকে।

আর যদি কখনো এমন ভুল হয় তোকে খুন করে ফেলব।

গোধূলি বলল,

আর কখনও এমন হবে না।

রামিসার বাবা দেশের বাইরে থাকেন বছরের বেশিরভাগ সময়। গত সপ্তাহে দেশে ফিরেছেন। উনি থাকেন বারিধারার ফ্লাটে। স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ কয় বছর হলো। একমাত্র ছেলে দেশের বাইরে সেটেলড। এক বিদেশিকে বিয়ে করেছে। আর মেয়ে রামিসা সংসার করতে পারেনি। ওনার দেয়া একটা ফ্লাটে একাই থাকে। উনি বারিধারার এই বাসায় থাকতে বলেছিলেন।‌কিন্তু মেয়ে এখানে থাকতে চায় না। ওর একলা জীবন পছন্দ।

মেয়ে সম্পর্কে নানা কথা কানে আসে ওনার। কিন্তু ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে ছোটকালের মতো আর শাসন মানে না। পিতা-মাতার শাসনকে তখন তারা শেকল মনে করে। সারাজীবন তিনি টাকার পেছনে ছুটেছেন। সংসারের দিকে তাকানোর সময় হয়নি। অথচ এসব কিছুই তিনি করেছেন সন্তানদের জন্য। আজ সন্তানেরা নিজেদের মতো করে জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যে কোনো তৃপ্তি নেই। সবার ছন্নছাড়া জীবন।

তার ছেলে কানাডাতে নিজের মত জীবন যাপন করছে। পরিবার থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন বলা চলে। মেয়েটা এখানে নিজের ইচ্ছায় চলাফেরা করছে।

তবে এতটা অধঃপতনে গেছে এটা তিনি ভাবেননি। মেয়েটা এডিক্টেড হয়ে গেছে। তার দেয়া টাকা-পয়সা বেহিসেবি উড়াচ্ছে নেশার পিছনে। আজেবাজে ছেলেদের সাথেও সময় কাটাচ্ছে। ফ্লাটে ছেলে নিয়ে থাকে। ওখানের কিছু পরিবার অভিযোগ দিয়েছে রামিসার নামে। ও নাকি এপার্টমেন্টে নোংরা কাজ কারবার করে।

তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেয়েকে কোনোরকম কোনো হাতখরচ দেবেন না। যা কিছু লাগে উনি কেনাকাটা করে দেবেন।টাকা না পেলে এসব করতে পারবে না আর।

বাবার এই সিদ্ধান্ত রামিসা ভীষণ খেপে গিয়েছে। বারিধারায় এসেছে বাবার সাথে কথা বলতে।

রামিসার বাবা নাশতা করছিলেন। রামিসা বলল,

তুমি আমার খরচ বন্ধ করেছো কেনো?

তুমি যা করে বেড়াচ্ছো তাতে তোমাকে টাকা দেয়াতো দূর, বাড়িতে বন্দি করে রাখাটাই ঠিক হবে।

আমাকে তুমি বন্দি করতে চাও। কেনো তোমার লাইফেতো আমি কোনো বাগড়া দেইনি। তুমি নিজের মতো করে চলছো। তোমার অবহেলার জন্য আমার মা চলে গেছে।

আজেবাজে কথা বলে কোনো লাভ নেই। তোমার মা রোগেভুগে এই পৃথিবী ছেড়েছেন। আর দায়ী যদি কেউ হয় তবে সেটা তুমি। তোমার জন্য ভাবতে ভাবতেই অসুস্থ হয়েছিল রিমা।

সব মিথ্যা। নিজেকে বাঁচাতে তুমি এসব কথা বানানো বন্ধ করো। বিদেশ গিয়ে তুমি কি করো না করো কে দেখছে। আমি আমার মতো চলছি, তোমার কোনো সমস্যা তো করছি না।

মুখ সামলে কথা বলো রামিসা। আমি কি করি মানে! যত যাই বলো এখন থেকে আর একটা টাকাও তুমি পাবে না।

আমার সম্পত্তি আমাকে দিয়ে দাও। তোমার থেকে কোনো টাকা চাইবো না আর।

তোমার বলতে কিছু নেই। আমি যতদিন বেঁচে আছি সব আমার। আর তুমি যদি না শোধরাতে পারো তাহলে এমন ব্যবস্থা করতে বাধ্য হব যেন আমার মৃত্যুর পর এক কানা কড়িও তুমি না পাও।

হাতের কাছে একটা দামি শোপিস রাখা ছিল। ওটা আছড়ে ভেঙে ফেলল রামিসা। তারপর গালিগালাজ করতে করতে বের হয়ে এলো।

বেরিয়েই সাব্বিরকে কল করল।

তুমি কোথায়?

এইতো অফিসে।

এখুনি একবার দেখা করতে পারবা?

অফিসের পরে আসি?

না,এখুনি আসো।

আচ্ছা দেখছি কি করা যায়।

সাব্বির অফিস থেকে বেরিয়ে রামিসার ঠিকানা দেয়া কফিশপটায় গেলো।

রামিসাকে খুব অস্থির লাগছে।

কি হয়েছে জান। কোনো সমস্যা?

হুম,বাবা টাকা দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

সেকি,কেনো!

কে যে কি বলেছে। কিছুই বুঝলাম না।

আমার মনে হয় সব ঐ চয়ন হারামজাদার কাজ।

আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে।

তোমার সাথে আমার সম্পর্ক সহ্য করতে পারছে না।

আচ্ছা বাদ দাও। ওকে পরে দেখে নেব। আপাতত হাজার পনেরো টাকা ম্যানেজ করো।

আমি?

হুম তুমি।

আমি হঠাৎ করে টাকা কোথায় পাব।

সেটা বললে হবে নাকি। এতদিন আমি তোমাকে চালিয়েছি। এখন আমার দিনকাল খারাপ যাচ্ছে আর তুমি এমন বললে হবে নাকি।

আচ্ছা আচ্ছা দেখছি কি করা যায়।

এখন খাওয়াও কিছু। এখনো কিচ্ছু খাইনি।

সাব্বির অর্ডার দিতে গেল। রামিসা মেনুকার্ড নিয়ে নিজেই অর্ডার করল।

বিল দিতে গিয়ে সাব্বিরের পকেট ফাঁকা হয়ে গেলো।

সাব্বির একটু ঝামেলায় পড়ে গেলো। এখন রামিসাকে ওর চালাতে হলেতো তো বিপদ। ওর মতো মেয়ের যা খরচের হাত। সাব্বিরের পুরো মাসের স্যালারি এক নিমিষেই শেষ করে ফেলবে ও।

তবুও কয়টা দিন কষ্ট করে হলেও রামিসাকে খুশি রাখতেই হবে। বড়লোকের দুলালী।‌ বাবা ক’দিন আর টাকা না দিয়ে থাকতে পারবে। কিছুতেই ওকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।

বাসায় ফিরে সাব্বির গোধূলীকে ঘরে ডেকে নিয়ে কাছে টানল। ওর ঘাড়ে নাক ঘষে দিতে দিতে বলল,

তোমার কাছে বিশ হাজার টাকা হবে?

টাকা! আমার কাছে টাকা কোথায়।

প্লিজ একটু দেখো না। তুমি চাইলেই জোগাড় করতে পারবে।

আমি এক টাকাও দিতে পারবো না।

পারবে পারবে। তোমার ভিডিওগুলো অবশ্য ভালো দামে বিক্রি করা যাবে।

কিসব বলছেন!

হুম,টাকা না দিলে ভিডিও সব তোমার পরিবার আর আত্মীয় স্বজনের ফোনে চলে যাবে।

আপনি এমন কিভাবে করছেন আমার সাথে। একটুও কি মায়া হয় না আমার জন্য। আমি সবাইকে ছেড়ে শুধু আপনার কথায় ঘর ছেড়েছি।

তাহলে বোঝো তুমি কতটা স্বার্থপর। অচেনা একটা ছেলের জন্য বাড়ির লোকদের ধোকা দিয়েছ। তোমার মতো মেয়েরা আসলেই স্বার্থপর। এই যে এতদিন ধরে আমার ঘাড়ে বসে খাচ্ছো তার খরচ কত কোনো ধারণা আছে? আমি এত কথা শুনতে চাইনা। আমার টাকাটা লাগবেই লাগবে। আর পুলিশের কাছে গিয়ে লাভ নেই। এইটা তখন অন্য কেউ ছড়িয়ে দেবে।

গোধূলি ভেবেছিল যা হবার হবে। চুপচাপ ভালো থাকার অভিনয় করে যাবে। এভাবে একদিন ওর ওসব ছবি,ভিডিও পেয়ে গেলে সরে যাবে। কিন্তু এ কোন নতুন বিপদে পড়ল ও। টাকা না দিলে সাব্বির ভিডিও ফাঁস করে দেবে। পুলিশের কাছে গেলে হয়ত ওকে ধরবে কিন্তু তার আগেইতো ওর ভিডিও সবার হাতে হাতে পৌঁছে যাবে।

মরতেও ভীষণ ভয় ওর। কিছুতেই মরতে পারবে না ও।

রাত্রি আপাকে কি সব খুলে বলবে। দেখা যাক আপা হয়ত কিছু একটা বুদ্ধি বের করতে পারবে।

পরদিন বাবার বাড়িতে গেল গোধূলী। আপা খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরে বের হচ্ছে। আপা কত সুখী এখন। আর ও, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে।
কেমন একটা ইগো ঘিরে ধরল ওকে। সবার কাছে ছোট হবে কিভাবে! কিছুই বললো না ও আপাকে। উলটো টাকার কথা বলল,

আপা একটা কথা ছিলো।

এখুনি বলবি?

হুম। তোমার কাছে বিশ হাজার টাকা হবে?

হবে। কিন্তু টাকা দিয়ে কি করবি তুই। কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি।

গোধূলি বানিয়ে বলল,

আমি কোচিং এ ভর্তি হব। তার ফি লাগবে। সাব্বির পরে দিয়ে দেবে।

ও আচ্ছা। তুই থাক। আমি বিকেলে দেব।

গোধূলি হাফ ছেড়ে বাঁচল। তবে যেভাবেই হোক সাব্বিরের কাছে থাকা ওর ভিডিও পেতে হবে ওকে। নাহলে এভাবে দিনের পর দিন ওকে ব্লাকমেইল করতেই থাকবে সাব্বির।

রাতে সাব্বির টাকা পেয়ে ভীষণ খুশি হলো। গোধূলিকে জড়িয়ে বলল,
যাক, এতদিনে মনে হচ্ছে তোমাকে বিয়ে করাটা বৃথা যায়নি। এমন লক্ষী থাকলে আর কি চাই। জীবনটা সুন্দর লাগে খুব।

আমি কিন্তু আর কোনো‌ টাকা দিতে পারবো না।

সেটা পরে দেখা যাবে।

সাব্বির তখুনি বেরিয়ে গেলো। রামিসার বাসায় গিয়ে ওর হাতে দশহাজার টাকা দিলো। রামিসা বলল,

মাত্র দশ!

হুম, আপাতত এটাই পেয়েছি।

ধূর,এটা দিয়ে কি হবে?

আরে আপাতত এটা দিয়ে চলি। আঙ্কেল কতদিন আর রাগ করে থাকবেন। ঠিকই আবার তোমাকে টাকা দেবেন।

রামিসা মুখে হুম বললেও ভীষণ বিরক্ত হলো। সাব্বিরের মুরোদ জানা হয়ে গেলো ওর। এই ছেলেকে দিয়ে চলবেনা সেটা বুঝে গেলো। তবে মুখে আর কিছু বললো না।

ঐদিন রামিসার বাড়িতে ইয়াবার আসর বসল। সারারাত দু’জন এনজয় করল।

এভাবে সময় কাটতে লাগল। গোধূলি সাব্বিরের ফোন থেকে ওর কোনো ভিডিও খুঁজে পায়না। ফোন লক করে রাখে সাব্বির। একদিন আড়চোখে লকের প্যাটার্ন দেখে ফোন আনলক করেও কিছু পায়নি। ওসব অন্য কোথাও রেখেছে হয়ত।

এদিকে দিন দিন রামিসা যোগাযোগ কমিয়ে দিলো।

এক নাইট ক্লাবে রামিসার সাথে পরিচয় হলো এক শিল্পপতির ছেলের, নাম পরাগ। রামিসা একা বসে ছিল। পরাগ এসে রামিসার সাথে আলাপ করল। ড্রিঙ্কস অফার করল। রামিসা মাতাল হয়ে গেলো। এক পর্যায়ে মাতাল রামিসাকে জড়িয়ে আলো আঁধারের মাঝে চুমু খেল পরাগ। রামিসা ওর ফাঁকা ফ্লাটে পরাগকে নিয়ে আসে। সারারাত উদ্দাম আনন্দ করে ওরা দু’জন।

সাব্বিরের সাথে যোগাযোগ একেবারেই কমিয়ে দিলো রামিসা।

সাব্বির এখন রামিসাকে যখন তখন ফোনে পায় না। ফোন করলেই বেশিরভাগ সময় রামিসা ফোন কেটে দেয়। রিসিভ করলেও বলে,

আজ দেখা করতে পারবো না। পরে জানাব।

সাব্বিরের কেমন একটু খটকা লাগে। রামিসা কি ওকে এভয়েড করছে। আরো দু’দিন একই ঘটনা ঘটার পর সাব্বির সোজা চলে যায় রামিসার ফ্লাটে। দাড়োয়ান বাঁধা দেয়। কিন্তু সাব্বির সোজা দৌড়ে ওপরে উঠে আসে।

বেল বাজাতেই দরজা খোলে রামিসা।

ঘরটা ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আছে।

তুমি এখন?

কেনো,কি সমস্যা।

এভাবে না বলে চলে আসছ কেনো? আমিতো ডাকিনি তোমাকে।

কি আশ্চর্য! আমার তোমার এখানে আসতে অনুমতি লাগবে কেনো।

সাব্বির রামিসাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে পরাগকে দেখতে পেল। অর্ধনগ্ন হয়ে বেডে আধশোয়া হয়ে আছে।

সাব্বির বলল,
ও এই তাহলে কারণ। নতুন ভাতার।

মুখ সামলে কথা বলো।

ইউ ব্লাডি বিচ। কি মুখ সামলাব। তোর মতো মা*র সাথে আবার কিভাবে কথা বলতে হবে।

খবরদার যদি উলটা পালটা বকছো। ছোটলোক কোথাকার।

আমি ছোটলোক দাঁড়া দেখাচ্ছি এখুনি।

রামিসাকে রেগে গিয়ে ধাক্কা মারল সাব্বির।

ছিটকে গিয়ে কাঁচের টেবিলে মাথা লেগে অনেকটা কেটে গেল রামিসার। গলগল করে রক্ত বেরুতে থাকল। পরাগ উঠে এসে সাব্বিরকে ধরে ফেলল। ওর চিৎকার শুনে আশেপাশের ফ্লাট থেকেও লোকজন বেরিয়ে আসল। পরাগ চিৎকার করে বলতে থাকল,

কেউ একজন পুলিশ ডাকুন। এই লোক রামিসাকে খুন করেছে।

সাব্বির পালাতে পারলো না। পুলিশ এসে ওকে এরেস্ট করে নিয়ে গেলো।

গোধূলি যখন খবরটা পেলো তখন সোজা বাসায় চলে গেলো। এটাই সঠিক সময় । সব ইগো ভুলে রাত্রিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

কি হয়েছে গোধূলী। কাঁদছিস কেনো?

গোধূলি রাত্রিকে সব খুলে বলল।
আয়ানসহ বোনকে নিয়ে থানায় গেল ওরা।

সাব্বির গোধূলীকে দেখেই কাঁদত থাকল।

গোধূলি আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি জানতাম তুমি আমার এত বড় বিপদ জেনে ঠিক আসবে। আমাকে একটাবার বের করার ব্যবস্থা করো। আমি আর এসব করবো না।

গোধূলি বলল,

আমিতো এসেছিই আপনার এই বিপদের কথা জেনে। কিন্তু কি বলেনতো কর্মফল ভোগ করতেই হয়। আমি যেমন আমার কর্মের ফল ভোগ করেছি, আপনাকেও করতে হবে।

কি বলছো এসব। ঠিক আছে আমাকে যা শাস্তি হয় দিও। এখন আমার জন্য একটা উকিল ব্যবস্থা করো প্লিজ।

আপনার মা আপনার জন্য যা করার করবে। আমি শুধু আমার সাথে যে অন্যায় হয়েছে তার বিচার চাইতে এসেছি।

সাব্বির হুংকার করে উঠল,

আমাকে কি আজীবন আটকে রাখতে পারবে নাকি। বের হয়েই তোর ভিডিও ভাইরাল করে দেব।

হুম সেটা জানি বলেইতো এসেছি। যেন আমার ভিডিওর ভয় দেখিয়ে ভবিষ্যতে কখনো আমাকে ব্লাকমেইল করতে না পারেন।

জেল হাজতে প্রকাশ্যে এই হুমকির কথা সবটাই রাত্রি ভিডিও করল আড়ালে থেকে। তারপর নারী নির্যাতন মামলা ঠুকে দিলো। সেইসাথে ব্লাকমেইল করে চাঁদাবাজির অপরাধের মামলা করল।

সাব্বির সবদিক থেকেই ফেঁসে গেলো। ওর মা উকিল ধরল কিন্তু ছেলেকে বাঁচাতে পারলো না। রামিসা বেঁচে গেলেও ওর বাবার করা এটেম টু মার্ডার মামলায় আর গোধূলীর করা আলাদা আলাদা মামলায় ওর সাজা হয়ে গেলো।

গোধূলি এই ভয়াবহ জীবন থেকে বেরিয়ে পুরোপুরি বদলে গেছে। ও ওরসব ভুল বুঝতে পেরেছে। মা বোনের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। আবার পড়াশোনা শুরু করেছে । রাত্রির সাথে আয়ানের ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছে। রাত্রি শশুর বাড়িতে গেছে। গোধূলি দক্ষ হাতে সংসার আর মায়ের দেখাশোনা করছে সাথে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। মা আর বোনকে কত কষ্ট দিয়েছে সেসব মনে হলে এখনও অপরাধী লাগে নিজেকে। তবে মায়া আর ভালোবাসা দিয়ে সেসব ভুল শুধরে নিয়েছে ও।

অমানিশা কেটে এক আলোকিত জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে গোধূলী।

(সমাপ্ত)

অমানিশা পর্ব-২১+২২

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব ২১

সাব্বির সারাদিন বাইরে কাটাল। গোধূলিকে একটাবারও কল করেনি। মনমেজাজ আসলেও খারাপ হয়ে আছে ওর। ভেবেছিল গোধূলিকে ম্যানেজ করে একটা ভালো এমাউন্ট হাতে আসবে‌ কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ এমন পলটি নেবে বোঝেনি। এদিকে হাতেও তেমন টাকা নেই। নেশার পেছনে বেতনের প্রায় পুরোটাই চলে যায়।
বেশ কিছু ধার দেনা হয়ে আছে। তার ওপর নওমির পেছনে অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে একটা হ য ব র ল অবস্থা।

অফিসে থাকতেই বন্ধু চয়ন ফোন দিলো। চয়নের বৌ থাকে বাবার বাড়িতে। ওখানে চাকরি করে। চয়ন দুই রুমের একটা বাসা নিয়ে থাকে। ওর বৌ আসে ছুটির দিনে। ঐ বাসাতেই আড্ডা দেয় ওরা। কিন্তু বেশ কিছু দিন হলো যায় না সাব্বির। আগের দু’বারের নেশা করার টাকা পায় চয়ন। তাই ফোন রিসিভ করলো না। একটু পর চয়নের মেসেজ এলো।

দোস্ত আজ বাসায় আসতে পারবি? টাকা পয়সা নিয়ে ভাবিস না। একজন ট্রিট দেবে।

মেসেজ পেয়ে সাব্বির কল করল।

বন্ধু তোর টাকাটা সামনের মাসে পাবি।

আরে দিসতো, আজকে আয় আগে।

কে ট্রিট দেবে?

আমার এক কাজিন।

আচ্ছা ছুটির পর আসছি তাহলে।

চয়নের ওখানে একজন মেয়েকে দেখে একটু চমকালো সাব্বির। মেয়েটার ঠোঁটে সিগারেট। পরনে জিন্স আর টি শার্ট। বয়স ২৩/২৪ হবে।

দোস্ত এর কথাই বলছিলাম । এই সুন্দরী হলো আমার কাজিন রামিসা। আজকের পার্টির হোস্ট।

রামিসা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,

হাই,আমি রামিসা। চয়ন বাদরটা একটু বেশি বেশি বলে।

হ্যালো,আমি সাব্বির। আপনি কিন্তু সত্যি অনেক সুন্দর।

তাই না!

সাব্বির মুগ্ধ হয়ে গেলো। এমন একটা মেয়ে এখানে থাকবে ও ভাবতেই পারেনি। রামিসা একটু সরে গিয়ে সাব্বির কে পাশে জায়গা করে দিলো।

বসুন। আপনার জন্য আসর থেমে আছে। চয়ন বলছে দুইজনে ঠিক জমে না। তাই আপনার জন্য অপেক্ষা। এবার তবে শুরু করা যাক।

চয়ন ফয়েল পেপার এগিয়ে দিলো। রামিসা ছোট একটা গোলাপী বড়ি ফয়েল পেপারে রেখে লাইটার জালালো। অনেক দিন পর কোনো মেয়ের সাথে নেশার আসরে বসা হলো। ওর মনটা চনমনে হয়ে গেলো। একে একে তিনজনই নেশা করল।

তিনজনের বেশ নেশা হয়ে গেছে। চয়ন রামিসার গায়ে হেলে পড়ছে। ওর হাত রামিসার শরীর জুড়ে ঘুরছে। রামিসা উপভোগ করছে বোঝা যাচ্ছে। চয়ন ওকে জড়িয়ে চুমু খেলো। তারপর দু’জনে পাশের ঘরে চলে গেলো।
সাব্বির সবটা দেখল। চয়নকে ভীষণ হিংসে হচ্ছে ওর। পাশের ঘরের আওয়াজ এঘর পর্যন্ত আসছে। রামিসার নেশাতুর চিৎকার সাব্বিরের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।

বেশ খানিকটা সময় পরে চয়ন বেরিয়ে আসল। টেবিলে রাখা রামিসার পার্স থেকে বেশ কয়েকটা হাজারের নোট সরিয়ে ফেলল।

সাব্বির বুঝল রামিসাকে ভালোই ভাঙাচ্ছে চয়ন।

রামিসা আরও কিছু সময় পর বের হলো। চয়ন বলল,

আজ থেকে যেতে পারতি।

নারে,বাসা ছাড়া রাতে ভালো লাগে না।

আচ্ছা যা। সাবধানে যাস।

সাব্বির বলল,

আমিও উঠব।

রামিসা বলল,

আপনি কোথায় যাবেন?

মালিবাগ।

ও আমিও তো ঐদিকে যাচ্ছি। আমার সাথে গাড়ি আছে। আপনাকে ড্রপ করে দেব।

সাব্বির খুশিই হলো। রামিসাকে কিছু সময় একা পাওয়া যাবে।

যেতে যেতে রামিসার কথা জানল। চয়ন ওর দূর সম্পর্কের কাজিন। রক্তের কেউ না। বাসা এক এলাকায় এই সূত্রে পরিচিত।

রামিসা চৌধুরী। বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। একবার বিয়ে হয়েছিল সেই ঘর টেকেনি।
এখন বাবার দেয়া ফ্লাটে একাই থাকে। দেদারসে টাকা ওড়ায়, নেশা করে,নাইট ক্লাবে যায়। জীবনটা এনজয় করছে পুরোদমে।

সাব্বির মনে মনে ভাবল এমন একজন পার্টনারই তো সে খুঁজছিল। এভাবে পেয়ে যাবে ভাবেনি। তবে চয়নের কাছ থেকে রামিসাকে আলাদা করতে হবে। নামার সময় হেসে বলল,

আবার কি দেখা হবে?

রামিসা এক ঝটকায় তুমিতে নেমে এলো।

দেখা হোক সেটা চাও?

এমন সুন্দরীকে আবার না দেখলে আফসোসে মরে যাব।

আচ্ছা তোমার নাম্বার দাও।

সাব্বির নাম্বার দিয়ে বলল,

তোমারটা?

আমারটা লাগবে না। আমিই কল দেব তোমাকে।

সাব্বির একটু হতাশ হলো। যদি কল না দেয় এটা ভেবে।

বাড়িতে ফিরে দেখল গোধূলী বাসাতেই আছে। সাব্বির ভেবেছিল হয়ত বাবার বাড়িতে চলে যাবে। কিন্তু যায়নি। আজ তেমন কথা বলছে না। সাব্বির কিছু খেলো না। মা বাবা শুয়ে পড়েছে। গোধূলি কিছু খেয়েছে কিনা জানতেও চাইলো না।

দরজা লাগিয়ে আলো নিভিয়ে দিলো।
শুয়েই গোধূলিকে কাছে টানল। গোধূলি ছাড়িয়ে নিতে চাইল নিজেকে। কিন্তু সাব্বির সেসবের পরোয়া করলো না। জোর করল ও। রামিসাকে ভেবে ভেবে মাথা গরম হয়ে আছে ওর। গোধূলি অন্য দিনের মতো সাড়া দিলোনা। কিন্তু সাব্বির সেসব খেয়াল করলো না। নিজের দরকার মিটিয়ে সরে গেলো।

রামিসা কল করল পাঁচ দিন পর। সাব্বির বাসায় ছিল। একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসল। রিসিভ করতেই রামিসা বলে উঠল,

এটা কি হ্যান্ডসাম সাব্বিরের নাম্বার?

সাব্বির রামিসার কন্ঠ শুনে পুলকিত হলো।

জ্বি রামিসা ম্যাডাম। এটা সেই সাব্বিরের নাম্বার যে আপনাকে দেখার পর পাগল হয়ে গেছে।

আচ্ছা,কতটা পাগল হয়েছো দেখতে চাই।

কখন দেখবে?

কাল বিকেলে সময় হবে?

কি যে বলো। তুমি ডাকছো আর আমার সময় হবে না মানে?

চয়নের ওখানে?

এই না না,অন্য কোথাও। তোমার সাথে একা দেখা করতে চাই।

আচ্ছা আমার বাসায় এসো।

ঠিকানা টেক্সট করে দিও।

হুম।

সাব্বির পরদিন বিকেলেই পৌঁছে গেলো রামিসার দেয়া ঠিকানায়।
গার্ডকে বলাই ছিলো। সাব্বিরের ঢুকতে সমস্যা হয়নি। নাম বলতেই দারোয়ান বলল,

সেভেন বি। লিফটের ডানে স্যার।

আলিশান এক ফ্লাটে একাই থাকে রামিসা। ভীষণ সুন্দর করে সাজানো। রামিসাকে আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে। ইচ্ছা করেই ফিনফিনে শিফনের শাড়ি পরেছে,সাথে ডিপ নেকের ব্লাউজ। সাব্বির হা করে তাকিয়ে আছে,চোখ সরাতে পারছে না। রামিসা বুঝতে পারল। চোখ দিয়ে ইশারা করল। সাব্বির ঠোঁট চাটল।

কি হলো, সমস্যা?

হুম,বিরাট প্রবলেম।

রামিসা মিষ্টি হেসে সাব্বিরের হাত ধরে বেডরুমে নিয়ে গেলো।

রামিসার সাথে সম্পর্ক ভালোই চলছে সাব্বিরের। যখন তখন ওর ফ্লাটে চলে যায়। মাঝে মাঝে রাতেও থেকে যায়। চয়নের ওখানে আর যাওয়া হয় না। রামিসার নতুন পার্টনার এখন সাব্বির। মেয়েটার দারুণ খরচের হাত। নেশা, ঘোরাঘুরি সব টাকা নিজেই খরচ করে। সাব্বিরকে এর মাঝেই বেশ কয়বার কেনাকাটা করে দিয়েছে। এমন একটা সম্পর্কই চেয়েছে সাব্বির। এতোদিন পর মনের মতো একটা জায়গা হলো ওর। গোধূলি এখন চুপচাপ হয়ে গেছে। সাব্বিরও ওকে ঘাটায়না।

সামনে রামিসার জন্মদিন। ওকে দামি কিছু দেয়া দরকার। ভালো কিছুর জন্য কিছু ইনভেস্ট করতে হয়। সাব্বির ভাবছে কি দেবে,টাকা কোথায় পাবে। ঠিক এমন সময় ভাগ্য ওর সহায় হলো। আলমারিতে একটা টিশার্ট খুঁজতে গিয়ে একটা সোনার গলার হার পেয়ে গেলো। এটা গোধূলির। রাত্রির আকদ্ এর দিন পরেছিল। সাব্বির ছবিতে দেখেছে। ও ভেবেছিল সিটি গোল্ডের হয়তো। কিন্তু এভাবে কাপড়ের ভেতর থেকে পেয়ে সন্দেহ হলো। নিশ্চয়ই এটা স্বর্ণের। তা না হলে এভাবে লুকিয়ে রাখতো না গোধূলী। ভীষণ সেয়ানা মেয়ে। একটা আস্ত সোনার হার লুকিয়ে রেখেছে।

জিনিসটা সরিয়ে ফেলল ও। জুয়েলারিতে ওজন করিয়ে দেখল আসলেই সোনার। সোয়া দুই ভরি আছে। সাব্বিরের মন খুশি হয়ে গেলো। ভালো দামে বিক্রি করে দিলো ওটা।

সকালে আলমারি খুলে গোধূলির একটু খটকা লাগল। সবকিছু কেমন অগোছালো হয়ে আছে। কিন্তু আলমারি তো গোছানো ছিল। এলোমেলো করল কে!

ও যেখানে গলারটা রেখেছিল সেখানে খুঁজে দেখল। হারটা নেই।
গোলাপি শাড়ির ভাঁজে রেখেছিল। শাড়িটা বের করে ঝাড়া দিল। সব কাপড় বের করে নিচে ফেলতে লাগল। হারটা পেলো না।

সাব্বির বিছানায় ঘুমুচ্ছে।

গোধূলি ধাক্কা দিয়ে বলল,

এই যে শুনছেন। উঠুনতো।

কি হলো। এভাবে ডাকছ কেনো সকাল সকাল।

আপনি আলমারি ধরেছিলেন?

হুম। কেনো আলমারি ধরা কি নিষেধ।

আমার একটা জিনিস পাচ্ছি না।

তো আমি কি করব,খুঁজে দেখো পাবে।

খুজেছি, কোথাও নেই।

কি সেটা?

আমার গলার একটা সেট।

ঐদিন যে কিনলাম সেটা?

না, সোনার হার।

সাব্বির অবাক হবার ভান ধরে বলল,

তুমি সোনার হার কোথায় পেলে?

মা দিয়েছিলেন আপার বিয়েতে পরতে।

বলোনিতো। আমি দেখিনি। তুমি কোথায় রেখেছ মনে করে দেখো।

আমার মনে আছে। আলমারিতে রেখেছি।

তাহলে ওখানেই আছে।

উহু,নেই। আপনি সত্যি করে বলেন কি করেছেন আমার হার।

কি বলতে চাইছো?

আপনি নিয়েছেন ওটা।

সাব্বির উঠে বসল।

কি বলতে চাও,আমি চোর?

এত কিছু জানি না। আপনি ভালোয় ভালোয় বের করে দেন নাহলে কিন্তু খারাপ হবে।

এই কি বলতে চাইছিস মা*।

মুখ খারাপ করবেন না। যেটা নিয়েছেন বের করেন জলদি।

না দিলে কি করবি?

পুলিশের কাছে যাবো।

কি, আমার খেয়ে আমার পরে আমার সাথে শত্রুতা করছিস?

খবরদার গায়ে যদি হাত দিছেন তো সত্যি পুলিশের কাছে যাব। নারী নির্যাতন এর মামলা করব।

সাব্বির একটু দমে গেলো। এমনিতেই হারটা সরিয়েছে। এখন আর বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। ও নরম হয়ে বলল,

আমি নেইনি। আমিতো জানিই না তোমার হার আছে।

গোধূলি কি বলবে বুঝতে পারছে না। ও নিশ্চিত যে হারটা সাব্বিরই নিয়েছে। কিন্তু স্বীকার করছে না। গোধূলি দুহাতে মাথা চেপে বসে পড়ল। অন্যায়ভাবে ও নিয়েছিল ওর বোনের হার,সেটা সেভাবেই হারিয়ে ফেলল।

(চলবে)

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব: ২২

রাত্রি চুপচাপ বসে আছে। আয়ানের সাথে আজ সারাদিন কথা হয়নি। রাত্রি মেসেজ দিয়েছে কিন্তু আয়ান সিন করেনি। সন্ধ্যা থেকে কয়েকবার কল দিলো। কিন্তু প্রতিবার কেটে দিয়েছে আয়ান।

রাত্রির মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। গতকাল থেকেই এমন করছে আয়ান। গতরাতে রাত্রি ফোন দিলো নিজ থেকে। আয়ান একটু কথা বলেই বলল,

আচ্ছা রাখছি ঘুম পাচ্ছে ভীষণ।

রাত্রি সাথে সাথেই কেটে দিয়েছে। ও যে অভিমান করে কেটে দিল অথচ আয়ান সেটা বুঝলোই না। কল ব্যাকও করেনি।

রাত্রির মনটা একটু বেশি খারাপ কারণ আজ ওর জন্মদিন । ও ভেবেছিল আয়ান দিনটা খেয়াল করবে। কিন্তু ও একবার কথাও বললো না ঠিক করে।

মা আজ সকালে পায়েস করেছেন। দুপুরে পোলাও ,রোস্ট। আজ ছুটি নিতে বলেছিলেন,রাত্রি নেয়নি।

গোধূলিকে ডেকেছিল রাত্রি কিন্তু ও আসেনি। আজকাল একদম আসে না মেয়েটা। এলেও আগের মতো আর ঝগড়া করে না। চুপচাপ বসে থাকে। কিছু একটা হয়েছে ওর। রাত্রি ঠিক করল এবার গোধূলী এলে ওর সাথে খোলাখুলি কথা বলবে। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে গোধূলীর।

স্কুলে সারাদিন ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটল। এফবিতে অনেকেই উইশ করেছে ওকে। কি আশ্চর্য আয়ান তো ওর সাথে এড আছে। ও কি খেয়াল করেনি।

স্কুলে কলিগরা উইশ করল। রাত্রির মনটা ভালো হলো কিন্তু পুরোপুরি উপভোগ করতে পারলো না। কোথায় যেন একটা মনখারাপ ওকে আচ্ছন্ন করে রাখছে।

প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বাজে। আয়ান একটা মেসেজ দিয়েছে।

কি অবস্থা?

রাত্রি জবাব দেয়নি রাগে। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে পোলাও খেয়েছিল একটু। পেটটা ভরেই আছে। রাতে আর তেমন কিছু খেলো না ও। বারান্দায় বসে বাইরের জোসনা দেখছিল। হঠাৎ কানের কাছে একটা ছোট ফু দিলো যেন কেউ। রাত্রি একটু চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখল লাল টকটকে গোলাপের ইয়া বড় একটা তোড়া হাতে আয়ান দাড়িয়ে আছে। হাসিমুখে বলল,

শুভ জন্মদিন মাই ডিয়ার ওয়াইফ।

রাত্রির চোখে পানি চলে আসল।

এই যে, এখন আবার কি কান্না করবা। উহু,একদম কান্না হবে না। আমরা বের হবো এখন।

কোথায়?

চলোইনা। গেলেই দেখবে। আর এই শাড়িটা তোমার জন্য।

খুব সুন্দর একটা ময়ূরকণ্ঠী রঙের মসলিন এর শাড়ি এনেছে আয়ান। রাত্রির ভীষণ পছন্দ হলো।

রাত্রি রেডি হলো। আয়ানের দেয়া শাড়িটা পরল। সাথে খোঁপায় বেলির মালা দিলো। মালাও আয়ান এনেছে। নাজমাকেও যেতে বলল আয়ান কিন্তু নাজমা বললেন,

তোমরা যাও বাবা। আমি এখন আর বাইরে যাবো না।

রাত্রিকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল আয়ান। ওখানে আয়ানের কাজিনরা সব আগে থেকেই আছে। একটা ফ্লোর বুকিং করেছে। সুন্দর করে ডেকোরেট করা হয়েছে। রাত্রির জন্মদিন উপলক্ষ্যে পার্টি রেখেছে আয়ান।

রাত্রি কেক কাটল। সবাই উইশ করল ওকে। গান বাজনার একটা দল আনা হয়েছে। চমৎকার কিছু গান গাইল ওরা। আয়ান নিজেও গাইল।

আনন্দে রাত্রির চোখে পানি চলে আসল।

দারুণ একটা সন্ধ্যা কাটল ওর। আগে কখনও এত চমৎকারভাবে জন্মদিন উদযাপন করা হয়নি।

আয়ান বলল,

তুমি কি ভেবেছিলে আমি ভুলে গেছি?

হুম।

আমার কি মাথা খারাপ। আমার একমাত্র বৌয়ের জন্মদিন ভুলে যাব!

কাল থেকে তো কথাই বললেন না।
আমি পুরোনো হয়ে গেছি।

কিহ! এখনো তো বাসর করা হলো না। এখনো তুমি একদম নতুন আমার কাছে।

তারমানে পরে পুরোনো হয়ে যাব।

একদম না। দুষ্টুমি করেছি। এসব নতুন পুরাতন কি ? তুমি আমার জীবনসঙ্গী। আজীবন আমার প্রিয়।

আয়ান আর রাত্রিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওর কাজিনরা সব চলে গেল।
নাজমার জন্য বাইরে থেকে খাবার প্যাক করে এনেছে। নাজমাকে নিজে বসে থেকে খাওয়ালো আয়ান।

রাতে শোবার আগে রাত্রি গোসল করে নিল। ঘরে ঢুকে দেখল আয়ান চোখের ওপর হাত দিয়ে শুয়ে আছে। ও ভাবল
বেচারা ক্লান্ত। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত্রি ভেজা চুল মুছে আয়ানের পাশে এসে বসল। কাথাটা নিয়ে আয়ানের গায়ে দিয়ে দিল। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পেলো আয়ান। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। একটানে রাত্রিকে বুকে টেনে নিল।

ওর ভেজা চুল সরিয়ে কানের নীচে ঠোঁট ছোয়ালো। রাত্রি কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে আয়ানকে আঁকড়ে ধরল। দুটো মনের ভালোবাসা মন থেকে শরীর ছুঁলো এই প্রথম।

চয়নকে রামিসা পাত্তা দিচ্ছে না আজকাল। বাসায় ডাকে না। টাকা পয়সাও দেয়না। ফোন দিলে কেটে দেয়।

চয়ন তাই আজ রামিসার বাসায় চলে এসেছে।

কিরে আজকাল কোথায় থাকিস, তোকে পাওয়াই যায়না।

এইতো বাসাতেই তো।

ফোন দিলে ধরিস না।

একটু প্যারায় আছি। কি খবর বল।

অনেক দিন হয় আসর হয় না। আজ হবে নাকি?

নারে। আজ না।

চয়ন উঠে গিয়ে রামিসার কাছে বসে। একহাতে জড়িয়ে চুমু খেতে যায়।

রামিসা সরে গিয়ে বলে,

আজ না। শরীর খারাপ লাগছে।

তুই কি কোনো কারণে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস?

আরে দূর। সত্যিই খারাপ লাগছে। তুই বস। আমি নাশতা দিতে বলছি।

রামিসা উঠে ভেতরে গেলো। ফোনটা রেখে গেছে। একটু পরেই কল এলো। চয়ন উঁকি দিয়ে দেখল সাব্বির এর নাম আর নাম্বার ভেসে আছে স্ক্রিনে।
কল বেজে বেজে কেটে গেল।
রামিসা ঢুকল নাশতার প্লেট হাতে। নুডুলস করে এনেছে।‌ সাথে জুস।

আবার কল এসেছে।

রামিসা ফোন নিয়ে ঘরের সাথে লাগোয়া বেলকনিতে চলে গেল।
চয়ন কান পেতে রইল।

হুম, আচ্ছা কাল বিকেলে চলে এসো।

চয়নের রাগ লাগল। তারমানে সাব্বিরের সাথে সময় কাটাচ্ছে রামিসা।

চয়ন সুন্দর মতো নাশতা করল।

রামিসাকে বলল,

কিছু টাকা হবে? হাতটা খালি যাচ্ছে।

রামিসা ভেতরে গিয়ে একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলো।

চয়ন মনে মনে ভাবল,

খাল কেটে নিজেইতো কুমির এনেছে।সাব্বিরকে পেয়ে এখন এই চয়নকে ফকিরের ভিক্ষা দেয়া হচ্ছে। আমিও দেখি কতদিন থাকে এই সম্পর্ক।

চয়ন জানে রামিসার মতো মেয়েকে চার্জ করে লাভ নেই। বড়লোকের উড়নচণ্ডী মেয়ে। যখন যেটা ভালো লাগে করে। চয়ন ওর কাছে কিছুই না।এক পুরুষে আটকে থাকা স্বভাববিরুদ্ধ ওর। ওর সাথে লেগে পেরে উঠবে না চয়ন। সাব্বিরের ওপর মেজাজ খারাপ হয়। এভাবে ওকে ওভারটেক করে বল নিজের কোর্টে নেবে সেটা চিন্তাও করেনি। কিন্তু সাব্বিরকে কিছুই বলে না। ও জানে এখন কিছু বলে লাভ নেই। সোনার ডিম পাড়া হাঁস পেলে কে আর বন্ধুর কথা ভাবে।

চয়ন গোধূলির নাম্বার জোগাড় করে মেসেজ দিলো।

আপনার স্বামী সাব্বিরের রামিসা নামের একজনের সাথে অবৈধ সম্পর্ক চলছে। হাতেনাতে ধরতে চাইলে আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে এই ঠিকানায় চলে আসবেন।

গোধূলি ওয়াশরুমে ছিল। ফিরে এসে দেখল ফোনে একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।

ওই নাম্বারে কল করল। কিন্তু বন্ধ দেখাচ্ছে।

রামিসা নামের একজনের সাথে সাব্বিরের সম্পর্ক চলছে। এটা অসম্ভব কিছু না। সাব্বির কেমন এতদিনে ও বুঝে গেছে। এখনতো মনে হচ্ছে নওমির বিষয়টাও সত্যি ছিলো। ওর সাথেও অবৈধ রিলেশন ছিল।

গোধূলির ইচ্ছে করে এসব ছেড়ে চলে যেতে মায়ের কাছে। কিন্তু একটা দ্বিধা ওকে আটকে রাখে। ওদের যদি সব বলে দেয় নিজেই তো ছোট হয়ে যাবে। সাব্বির গায়ে হাত তোলার পর দু’দিন ঐ বাসায় গিয়ে বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। নিজের ভুল স্বীকার করাটা বেশ কঠিন লাগে ওর জন্য। আপার কাছেও‌ হেরে যেতে মন চায় না। আজ না হোক কাল ওরা ঠিকই খোঁটা দেবে,

যেমন নিজে নিজে বিয়ে করেছ,তেমন উচিত শিক্ষা হয়েছে।

কিন্তু আজকের এই মেসেজ পেয়ে গোধূলির মন অন্য কথা বলছে। ও ঠিক করেছে এই ঘটনা সত্যি হলে সব ছেড়ে ছুড়ে বাবার বাসায় ফিরে যাবে। মা বোনের কাছে দরকার হলে ক্ষমা চাইবে।

সাব্বির আজকেও ফিরল বেশ রাত করে। তবে আজ গোধূলীর সাথে তেমন কথাবার্তা বললো না। অবশ্য বেশ কিছুদিন থেকেই এমন চলছে। সাব্বির এখন ওকে তেমন কাছে টানে না। কথাও বলে খুব কম। হয়তো অন্য কারো সাথে ইনভলভ বলেই এমন আচরণ করছে।

ফোনেও সবসময় কি যেন করে। কার সাথে চ্যাটিং করে। ফোনটাও লক করা। চাইলেও গোধূলি চ্যাটলিস্ট দেখতে পারে না। একদিন ফোন চাইলে সাব্বির দিল। কিন্তু মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে আবার আলাদা করে লক করা। তাই কিছু দেখতে পায়নি।

এই মেসেজ কে পাঠিয়েছে। সত্যি কি এই ঠিকানায় গেলে সব জানা যাবে। নাকি ও কোনো বিপদে পড়বে। আজকাল কতরকম ঘটনাই তো ঘটে। এমন নাতো যে ওকে এভাবে ওখানে নিয়ে গিয়ে আটকে দেবে কেউ। এমন নানারকম দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটল ওর।

পরদিন বিকেল যত এগিয়ে আসল গোধূলী ততই অস্থির হয়ে পড়ল। ওখানে যাবে কি যাবে না একটাই ভাবনা। বিকেলে সাব্বিরকে কল করল,
দুবার রিং হবার পর ও কল রিসিভ করল।

হ্যালো,কি হয়েছে?

আপনি কোথায়?

কেনো কি হয়েছে?

আজ একটু বের হতাম আপনার সাথে।

আজ হবে না। জরুরী একটা কাজ আছে আমার।

কি কাজ?

আজবতো, তোমাকে কি সব বলতে হবে এখন? বাইকে আছি।‌ পরে কল দেব।

সাব্বির কেটে দিলো।

গোধূলি ঠিক করল ও ঐ ঠিকানায় যাবে।

সাব্বির রামিসার বাসায় পৌঁছে দেখল রামিসা খুব সেজেছে আজ। ওকে শাড়িতে কখনো দেখেনি। আজ শাড়ি পরেছে। সাব্বির একেবারে হামলে পরল ওর ওপর। কোলে নিয়ে সোজা বেডরুমে চলে গেলো।

মেসেজে দেয়া ঠিকানায় পৌঁছাতে ঘন্টা খানেক পেরিয়ে গেলো। গোধূলি পৌঁছে দেখল বিশাল এক এপার্টমেন্ট। গেটে দাড়োয়ান দাঁড় করিয়ে নাম পরিচয় জানতে চাইল।

গোধূলি বলল,

রামিসা ম্যাডাম আসতে বলেছেন।
দাড়োয়ান লোকটা ইন্টারকমে কল করল। কিন্তু কেউ মনে হয় রিসিভ করলো না।

গোধূলি বলল,

আমাকেতো আসতে বলেছিলেন এই সময়। ওনার পরিচিত আমি। আপনি না হয় চলুন আমার সাথে।

দাড়োয়ান বলল,

কিন্তু গেটতো খালি রেখে যাওয়া যাবে না।

গোধূলি একটু ভেবে বলল,

একটু আগে যে সাব্বির নামের লোকটা এসেছে উনি আমার কাজিন।

অনুমানে কথাটা বলল ও। যদি কাজ হয় আর কি।

ও আচ্ছা। আপনি তাহলে সাব্বির সাহেবের কাজিন। আচ্ছা সমস্যা নাই,যান।

গোধূলি লিফটে উঠে নির্ধারিত ফ্লোরে নেমে বেল টিপল।

বেশ কিছু সময় পর গেট খুলে দিলো রামিসা।

ভীষণ সুন্দরী একটা মেয়ে। যেমন দেখতে তেমনি সুন্দর ফিগার। ছেলেদের মাথা নষ্ট করতে যথেষ্ট। গোধূলি ওর তুলনায় কিছুই না।
রামিসার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল।

কাকে চাই?

সাব্বির আছে?

আপনি কে?

আমি ওর ওয়াইফ।

রামিসা বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

ও।

তারপর নাম ধরে সাব্বিরকে ডাকল,

এই সাব্বির ,এদিকে এসোতো।

সাব্বির পিছে এসে উপস্থিত হলো।

গোধূলিকে দেখে অবাক হয়ে বলল,

তুমি এখানে কিভাবে এলে?

আপনি কি ভেবেছিলেন আপনি যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবেন আর আমি জানবো না।

জেনেছ তো কি হয়েছে । তাই বলে এখানে চলে আসতে হবে। তোমার এতো সাহস হয় কিভাবে এখানে আসার?

আমি কি অপরাধী যে ভয় পাবো।

এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে একজন উঁকি দিলো।

রামিসা বলল,

তোমার বৌকে চিৎকার করতে নিষেধ করো। এটা ভদ্রলোকেদের জায়গা।

ওরে আমার ভদ্রলোক। তা এতোই যখন ভদ্রলোক তখন অন্য একজনের স্বামীকে নিয়ে বাসায় তুলেছেন কেনো!

খবরদার কোনো সিনক্রিয়েট করবা না। এখুনি চলে যাও।

চলেতো যাবোই। আপনার এসব নোংরামি দেখব নাকি বসে বসে? ঘরে বৌ থাকতে এসব বাজে মেয়েদের সাথে সময় কাটাতে লজ্জা করেনা?

সাব্বির এই মেয়েকে থামাও শিগগির। হাউ ডেয়ার শি টকস লাইক দ্যাট!

আমার বরকে নিয়ে শোবার সময় লজ্জা করে না,এখন কথা শুনতে খারাপ লাগছে নাকি?

শোনো মেয়ে নিজের স্বামীকে ধরে রাখার মুরোদ নেই তোমার। আমাকে কেনো দোষ দিচ্ছো।

আপনার মতো কালনাগিনীরাইতো বিষাক্ত করে ফেলে পবিত্র সম্পর্ক।

সাব্বির এবার হাত ধরে ওকে ভেতরে টেনে নিয়ে বলল,

শোন মাগি তোকে আর আমার একটুও ভালো লাগে না। রামিসার পায়ের নখের যোগ্য তুই না। ওর বাসায় এসে ওকে অপমান করার সাহস হলো কিভাবে! আর একটা কথা না বাড়িয়ে এখানে থেকে চলে যা। আমার যা খুশি আমি করব। বাঁধা দিতে আসলে তোকে লাথি দিয়ে বের করে দেব।

এত সহজ! আমি আপনার বিয়ে করা বৌ। আমার সাথে এমন প্রতারণা করতে পারেন না। ঘরে বৌ রেখে বাইরে এসে ঢলাঢলি করছেন কিভাবে!

রামিসা বলে উঠল,

বুলশীট!

সাব্বির বলল,

কিসের বিয়ে, কিসের বৌ। কোনো প্রমাণ আছে তোর কাছে যে তুই আমার বৌ।

ধর্ম সাক্ষী রেখে বিয়ে হয়েছে আমাদের।

ধর্ম ধুয়ে পানি খা তুই। কাগজপত্র আছে নাকি। বিয়েতো রেজিস্ট্রেশন হয়নি।

এতো বড় ধোঁকাবাজ আপনি! আমি মামলা করব আপনার নামে।

আমি ধোঁকাবাজ না। তুই নিজেই আমাকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করেছিস। তোকে বিয়ে করে আমি ফেসে গেছি।একটুও যদি বাড়াবাড়ি করছিস তো তোর যেসব ছবি ভিডিও আছে সব ছড়িয়ে দিব।

কিসের ছবি ভিডিও! আপনার কাছে আমার এমন কিছুই নেই। মিথ্যা ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না।

সাব্বির হো হো করে হাসতে থাকল।

এই বুদ্ধি নিয়ে আমার পেছনে গোয়েন্দা গিরি করতে এসেছিস তুই? তোর মতো মেয়ে যেকোনো সময় নেকামি করতে শুরু করবে এটা বুঝেই আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছি। এই দেখ।

মোবাইল এগিয়ে দিলো সাব্বির।

গোধূলির মাথা ঘুরে উঠল। নগ্ন অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে সেসময়ের,গোসলের সময়ের কিছু ভিডিও আর ছবি। অজান্তে এসব কখন করেছে শয়তান টা।

এখন চুপচাপ এখান থেকে চলে যাবি আর আমার বাসায় যাবি। বাবার বাড়িতে ভুলেও যাবি না।

এখুনি বের হয়ে যা। খুব খারাপ কাজ করছিস আজ এখানে এসে। এই ভুলের মাশুল তোকে দিতে হবে।

গোধূলি বুঝল এখানে থাকলে শুধু ক্ষতিই হবে। এদের তো মান সম্মান নেই। আর গোধূলীর সম্মান এখন সাব্বিরের হাতের মুঠোয়।

গোধূলির চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। এ কোন ফাঁদে পড়ল ও। ভেবেছিল সব ছেড়ে মায়ের কাছে ফিরবে কিন্তু সাব্বির নামের বহুরূপী ওকে কোন ঝামেলায় ফেলবে আল্লাহ জানে।

ও রাস্তায় নেমে আসল। কিছু সময় এলোমেলো হাঁটল তারপর একটা কীটনাশকের দোকানে গিয়ে ইঁদুর মারা বিষ নিয়ে বাড়ি ফিরল।

(চলবে)

error: ©<b>গল্পপোকা ডট কম</b>