মাতাল হাওয়া পর্ব-৪+৫

0
221

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৪
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

নিজের ডেস্কে এসে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে চিত্রলেখা। লাবিব এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সে খেয়াল করেনি। ডেস্কের উপর দু’বার হাত মুঠো করে ঠকঠক শব্দ করতেই চমকে ওঠে সে। তাকে চমকে যেতে দেখে লাবিব বলে,

-দিনের বেলায় ভয় পেলে যে? রাতে কি ভূত টূত কিছু দেখেছিলে নাকি?

নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্রলেখা বলে,

-না আসলে কিছু ভাবছিলাম তাই আপনাকে খেয়াল করিনি।

-সেটা তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তা কি ভাবছিলেন এত মনোযোগ দিয়ে?

চিত্রলেখা আর লাবিবের কথার জবাব দেয়ার সুযোগ পায় না। লাবিবের পেছন দিয়ে বাতাসের গতিতে হেটে কেবিনে চলে যায় রওনক। তাকে দেখেই আর কথা বলে না চিত্রলেখা। লাবিবও আর দাঁড়ায় না এখানে। আসছি বলে রওনকের পেছন পেছন কেবিনে ডুকে পড়ে। লাবিন হচ্ছে রওনকের পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট। ছয় বছর ধরে এই পোস্টে কাজ করছে সে। আর চিত্রলেখা এখানে এসেছে দেড় মাস চলে। যদিও এই কোম্পানিতে সে চাকরী করছে তিন বছরের উপরে। তবে জয়েন পর থেকে এতদিন সে কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে ছিল। দেড় মাস আগে বলা যায় তার ছোটখাটো একটা প্রোমোশন হয়েছে। পজিশনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কেবল কম্পিউটার ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে তার জায়গায় হয়েছে কোম্পানির সিইও এর অফিসে। জামান টাওয়ারের নয় তলায় রওনকের অফিস। মস্ত বড় কেবিনের বাইরের দিকটা যেমন কাচে মোড়ানো তেমনি ভেতরের দিকটায়ও গ্লাস লাগানো। কেবিনের বাইরে দুইপাশে দুটো ডেস্ক দেয়া। একটায় লাবিব বসে আরেকটায় চিত্রলেখা। এতকাল রওনকের অফিসের সবরকম ডকুমেন্টের কাজ কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টই করেছে। ওখানে চিত্রলেখাসহ মোট ছয়জন কম্পিউটার অপারেটর ছিল। কিন্তু এতে করে কোম্পানির অনেক কনফিডেন্সিয়াল ইনফরমেশন রওনকের নাকের নিচ দিয়েই বাইরে চলে যেত। তাই লাবিবের পরামর্শে দেড় মাস আগে চিত্রলেখাকে এখানে আনা হয়েছে। তার দায়িত্ব কেবল রওনকের কাজ করা। কোম্পানির অন্যসব ডকুমেন্টের কাজের দায়িত্ব কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে থাকা অন্য পাঁচজন অপারেটর করবে। আর এদিকে রওনকের অফিসের সকল কাজের দায়িত্ব চিত্রলেখার একার। এখানে কাজ কম তা নয়। তবে কাজের চাইতে টেনশন বেশি। একটা ইনফরমেশন বাইরে গেলে সরাসরি দোষ চিত্রলেখার উপর বর্তাবে। তাই সবসময় তক্কেতক্কে থাকে সে। একটা কাগজ এদিক সেদিক হতে দেয় না। এমনকি অফিসে তাকে যে কম্পিউটারটা দেয়া হয়েছে সেটার পাসওয়ার্ড সে ছাড়া কেউ জানে না। তার কম্পিউটারে কোম্পানির অনেক জরুরী কাগজ পত্রের ড্রাফ রয়েছে। এসব বাইরে গেলে কোম্পানি হুমকির মুখে পড়তে পারে। এসব কথা এখানে আসার দিনই লাবিব ভালো করে বুঝিয়ে বলেছে চিত্রলেখাকে। অনেকেই তার থেকে ইনফরমেশন বের করার চেষ্টা করবে সে যেন ভুলেও কাউকে কিছু না জানায়। রওনক পার্সোনাল অপারেটর এপয়েন্ট করার দায়িত্বটা লাবিবকে দিয়েছিল। তাই সে বিনা সময় বিলম্ব করে চিত্রলেখাকে ওখানে থেকে এখানে নিয়ে আসে। এতে রওনক আপত্তি করেনি। প্রথমদিন চিত্রলেখা রওনকের সামনে এসে দাঁড়ালে তাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলেছিল,

-তুমি সব বুঝিয়ে দিও, আমার আলাদা করে কিছু বলার নেই।

প্রথম দেখায় এতটুকুই বলেছিল রওনক চিত্রলেখাকে। এছাড়া তাদের তেমন একটা কথা বলা হয় না বললেই চলে। চিত্রলেখাকে যেসব কাজ দেয়া হয় তার বেশিরভাগই লাবিবের মাধ্যমে আসে। সরাসরি তাদের দেখা বা কথা তেমন একটা হয় না বললেই চলে।

লাবিবের চিত্রলেখাকে এখানে আনার পেছনে একটা কারণ অবশ্য আছে। চিত্রলেখা এই কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে আসলে সেদিন লাবিব উপস্থিত ছিল রওনকের প্রতিনিধি হিসেবে। সেদিন যতজন ইন্টারভিউ দিয়েছিল তন্মধ্যে চিত্রলেখার লেখাপড়ার ব্যাকগ্রাউন্ড তুলনামূলক সাধারণ হলেও তার কাজের স্পিড ভালো লেগেছিল লাবিবের। তাকে করা প্রশ্নের জবাব শুনেও ভালো লেগেছিল তার। বলা যায় লাবিবের এপ্রুভালে চিত্রলেখা চাকরীটা পেয়ে গিয়েছিল অন্যথায় তার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে তাকে রাখার কথা ছিল না। জামান গ্রুপ বর্তমান সময়ের অন্যতম নামক করা কোম্পানিগুলোর একটি। মাঝেমধ্যে চিত্রলেখা নিজেও অবাক হয় এতবড় একটা কোম্পানিতে চাকরী করতে পারছে ভেবে। চিত্রলেখার জয়েন পর থেকেই পরিচয় দু’জনার। সময়ের সাথে সখ্যতাও গড়েছে ভালোই। চিত্রলেখার থেকে বছর তিনেকের বড় হবে লাবিব। সময় বয়সী না হলেও তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব আছে বলা যায়। রওনকের অফিসে আসায় চিত্রলেখার জন্য একটা জিনিস ভালো হয়েছে। অসময়ে একটা ইনক্রিমেন্ট হয়েছে তার। বর্তমানে তার সেলারিও ভালোই দাঁড়ায়। কিন্তু তবুও ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়ার খরচ, ছয়জন মানুষের সংসার খরচ চালাতে খানিকটা হিমশিমই খাওয়া লাগে তাকে। মাস শেষে দেখা যায় জমার খাতা শূন্য। বাড়তি ধার দেনা যে হয় না এটাই বেশি।

নিজের ডেস্কে বসে সবেই কম্পিউটার অন করেছে চিত্রলেখা। এর মধ্যেই ব্যস্ত হয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে লাবিব। এসেই চিত্রলেখাকে বলে,

-দ্রুত এক কাপ কফি বানিয়ে দিবে? বসের আজ মাথা গরম।

এক মুহূর্ত লাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চিত্রলেখা বলে,

-তাহলে চা দেই? গরম মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে। বিষে যেমন বিষ কাটে তেমনি গরম চায়ে গরম মাথা ঠান্ডা করে দিবে।

চিত্রলেখার কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয় লাবিব। হেসে দিয়ে বলে,

-কিন্তু অফিসে চা পাবো কোথায়?

চিত্রলেখা নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে চায়ের ফ্লেক্স বের করে দেখিয়ে বলে,

-আমাদের জন্য নিয়ে এসেছিলাম।

-তাহলে তুমি জলদি এক কাপ চা নিয়ে আসো, আমি ভেতরে যাচ্ছি।

মাথা ঝাকায় চিত্রলেখা। লাবিব যেভাবে ব্যস্ত হয়ে এসেছিল ওভাবেই ভেতরে চলে যায়। পেছনে চিত্রলেখা এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে কাজে লেগে পড়ে। কি-বোর্ডে আঙ্গুল চালানো ছাড়া এখানে চিত্রলেখাকে আরেকটা কাজ বাড়তি করতে হয়। সেটা হচ্ছে কফি বানানো। সে এখানে আসার পর থেকে অলিখিত ভাবে তাদের তিনজনের কফি বানানোর দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে। এর পেছনে কারণ আছে অবশ্য। অফিস বয়দের বানানো পাতলা কফি তার একদম ভালো লাগে না। কফির পানিটা ভালো মতো ফুটিয়ে না নিলে সেই পাতলা পানির কফি তার একদম মুখে রুচে না। এভাবেই নিজের জন্য বানাতে বানাতে লাবিব ও রওনকের কফির দায়িত্বটাও সে নিয়ে নিয়েছে।

মিনিট খানিকের মাথায় চিত্রলেখা রওনকের কেবিনে এসে তার সামনে এক কাপ চা রাখে। চা দেখে রওনক একবার চায়ের দিকে তাকায় তারপর চোখ তুলে চিত্রলেখার দিকে তাকায়। সাধারণ দেখতে একটা মেয়ে অথচ রওনকের মনে হয় এই মেয়ের কোনো কিছুই সাধারণ নয়। বরং সাধারণ সব গুণে সম্পন্ন অসাধারণ একটি মেয়ে। চায়ের কড়া ঘ্রাণ এসে রওনকের নাকে লাগছে। দেরি না করে কাপ তুলে হাতে নিয়ে প্রথমে লম্বা করে ঘ্রাণ নেয় সে। তারপর চুমুক বসায়। এক চুমুকেই যেন জিহ্বার শান্তি। অফিসে সবসময় কফি খাওয়া হলেও রওনকের দুধ চায়ের প্রতি আলাদা সফট কর্ণার আছে। চা ছাড়া তার দিনের শুরু হয় না বললেই চলে। সে কোম্পানিতে জয়েন করার পরপর তার জন্য চা বানানো হতো ঠিকই কিন্তু ওসব চা তার মুখে রুচতো না। পানির মতো পাতলা লিকার। তাই অফিসে চা খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছে। আজ অনেকদিন পর মনের মতো এক কাপ চা পেয়ে রওনকের মন মেজাজ ফুড়ফুড়া হয়ে যায় নিমিষেই। চায়ের কাপে পরপর আরও দু’টো চুমুক দিয়ে রওনক জিজ্ঞেস করে,

-চা কোথথেকে এলো?

লাবিব চিত্রলেখাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে,

-চিত্রলখো বাসা থেকে নিয়ে এসেছে।

-ওর ব্যাক্তিগত?

এবারে লাবিব কিছু বলার আগে চিত্রলেখা বলে,

-আমার একার জন্য আনিনি। আমাদের তিনজনের জন্যই এনেছিলাম।

-থ্যাঙ্কিউ, চমৎকার হয়েছে চা-টা।

রওনকের ধন্যবাদের বিনিময়ে মৃদু হাসে চিত্রলেখা। তা দেখে রওনক মনে মনে ভাবে, ❝মেয়েটা কি মন খুলে হাসতেও জানে না নাকি?❞

চিত্রলেখা আর ওখানে দাঁড়ায় না। কেবিনের থেকে বেরিয়ে আসতে হাঁটা ধরে। পেছনে বসে থাকা রওনক চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দেয়ার বাহানায় চলে যেতে থাকা চিত্রলেখার দিকে তাকায়। মূলত ওর জুতার দিকে তাকায়। অফিসে আসার পথে মুচিকে দিয়ে সেলাই করে আনা জুতাটা এখনো তার পায়ে। তা দেখে রওনক আরও ভাবে, ❝এই মেয়ের কি নিজের জন্য ভাবার সময় নেই? জুতা কিনে অফিস আসলে নাহয় কিছুক্ষণ দেরিই হতো। ওর দেরিতে তো কোম্পানির বিশাল কোনো লস হয়ে যেত না।❞ রওনক আপন ভাবনায় আচ্ছন্ন থাকতে থাকতেই চিত্রলেখা কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।

-আপনার আর কিছু লাগবে?

লাবিবের কথায় ভাবনাচ্ছেদ হয় রওনকের। চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে সে বলে,

-অফিসে চা বানানোর ব্যবস্থা করা যায় না?

-এর আগেও তো করা হয়েছিল কিন্তু আপনার পছন্দ হয়নি।

-ওসব চা নাকি? পাতলা পানির মতো। আজকেরটা মতো টেস্ট হলে না কথা ছিল।

লাবিব বুঝার চেষ্টা করে রওনক তাকে কি বলতে চায়। তাকে যদিও বেশি একটা ভাবতে হয় না। তার আগেই রওনক বলে,

-যে প্রতিদিন আমাদের জন্য কফি বানায় এখন থেকে নাহয় চা বানাবে।

-চিত্রলেখা!

মাথা ঝাকায় রওনক।

-ঠিক আছে আমি ওকে বলে দিবো। চিত্রলেখার চা বানানো ভালো হয়। অবশ্য শুধু চা নয় রান্নার হাতও ভালো।

কথা রওনকের ঠোঁটের ডগায় চলে আসে কিন্তু সে চেপে যায়। বলতে চেয়েছিল চিত্রলেখার রান্না লাবিবের এরমধ্যে টেস্ট করাও হয়ে গেছে, কিন্তু বলে না। তার জায়গা থেকে অনেক কথাই সে বলতে পারে না। লাবিব বেরিয়ে গেলে রওনক চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দেয়। আরামে, তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসে তার। চিত্রলেখার হাতে বানানো এক কাপ চা খেয়েই আন্দাজ করতে পারছে এই মেয়ের হাতের রান্না কতখানি ভালো হতে পারে। আবার আফসোসও হয় নিজ অজান্তে। ওসব তার কখনই হয়তো টেস্ট করা হবে না। সবকিছু তো আর সবার জন্য নয়।

চলবে…

#মাতাল_হাওয়া। ইতি চৌধুরী। পর্ব-৫
(দয়া করে কেউ কপি করবেন না)

লিখন অনেকক্ষন হয় টিএসসিতে বসে আছে। তার ক্লাস শেষ হয়েছে একঘন্টা আগে। এই পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে দুইকাপ চা ও একপিস বাটারবন খেয়েছে সে। আড্ডা শেষ করে বন্ধুরা চলে গেছে লিখন একাই বসে আছে এখন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ লিটারেচারের উপর অনার্স করছে সে। এটা তার ৪র্থ বর্ষ চলছে৷ চা বাটারবন খেয়েও পেটার খুদা পোষে আসছে না তার। আজ দুপুরে পরপর দুটো ক্লাস থাকায় পেট ভরে ভারী কিছু খাওয়ার সময় পায়নি। এখন বাজে সাড়ে চারটা। ভাতের খুদায় পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড় চলছে। বাটারবন দিয়ে এই খুদা নিবারন হবে না। কিন্তু কিছু করার নেই। এখন এখানেই বসে থাকতে হবে তাকে যতক্ষণ রিপা না আসছে। তাছাড়া ভারী কিছু খাওয়ায় নিষেধ আছে তার। রিপা লিখনের প্রেমিকা। একই বিভাগের ২য় বর্ষে পড়ে সে। দু’বছর আগে নবীন বরণের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল তাদের। ব্যস, প্রথম দেখায়ই দু’জনার দু’জনকে পছন্দ হয়ে যায়। মনের কথা জানাতে সময় বিলম্ব করেনি রিপা। বলাবাহুল্য প্রেম নিবেদনটা রিপাই করেছিল। নিজের পরিস্থিতি বিচার করে লিখন প্রেমে জড়াতে চায়নি তবু সামনে থেকে রিপার করা প্রেম নিবেদন প্রত্যাখ্যানও করতে পারেনি। মস্তিষ্ককে চুপ করিয়ে মনকে প্রশ্রয় দিয়েছিল সে। তারপর থেকে গত দুই বছর ধরে প্রেম করছে তারা। যদিও রিপার কথা চিত্রলেখাও জানে। সব বন্ধুরা মিলে লিখনের জন্মদিনে তাকে সারপ্রাইজ দিতে কেক নিয়ে বাসায় গিয়েছিল। তখনই দু’জনার সখ্যতা, একে-অন্যের প্রতি আগ্রহ দেখে যা বুঝার বুঝে নিয়েছিল চিত্রলেখা। বাকিটা লিখনকে জিজ্ঞেস করার পর সে আর বোনের থেকে কিছু লুকায়নি। তবে বলাবাহুল্য রিপার পারিবারিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো। বলা যায় হাই সোসাইটি থেকে বিলং করে সে। রিপার বাবার যেমন টাকা পয়সা আসছে তেমনি সমাজে সম্মানও আছে।

প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সবেই আরও একপিস বাটারবন হাতে নিয়েছে লিখন। ওমনি পেছন থেকে রিপা বলে,

-খবরদার, এটা রেখে দেও।

পেছন ঘুরে রিপাকে দেখে বাটারবনটা পূর্বের জায়গায় রেখে দিয়ে লিখন বলে,

-এতক্ষণে আসার সময় হইলো তোমার? এদিকে খুদায় একটা মানুষ ম*রে যাইতেছে।

এগিয়ে এসে রিপা লিখনের পাশে বসতে বসতে বলে,

-কই তোমাকে তো জ্যান্তই লাগতেছে দেখতে। ম*রে টরে তো যাও নাই। নিঃশ্বাস তো চলছে।

-মশকরা করতেছো তুমি, তাই না?

-বারে আমি কই মশকরা করলাম? মশকরা তো তুমি করতেছো।

লিখন আর কিছু বলে না। সে ক্ষ্যাপে যাচ্ছে বুঝতে পেরে রিপা বলে,

-আচ্ছা বাবা সরি। কি করব বলো আজকে ক্লাস শেষই হয় না।

নিজের ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে লিখনের দিকে এগিয়ে দিয়ে আরও বলে,

-নেও, খাও নাহলে তো ম*রে যাবা। জলদি খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো তো দেখি।

লিখন আর কথা বাড়ায় না। ঝটপট বক্স হাতে নিয়ে খুলতেই দেখে ভেতরে তেহেরি, নতুন আলু দেয়া সঙ্গে। আলু লিখনের ভীষণ পছন্দের জিনিস। তাকে শুধু আলু ভর্তা অথবা ভাজি দিয়ে ভাত দিলেও পেট পুড়ে খেয়ে নিবে বিনা অভিযোগে। এটা জানে বলেই তেহেরিতে বেশি করে আলু দিতে বলেছিল রিপা তার মাকে। এখনো বক্সে গোশতের চাইতে আলুর পরিমান বেশি। লিখন প্রথমে একপিস আলু তুলে মুখে দেয়। তা দেখে পাশে বসে থাকা রিপা হেসে দিয়ে বলে,

-আহারে আমার আলু খোর।

রিপার কথার বিপরীতে কিছু বলে না লিখন। সে আপাতত খাওয়ায় ব্যস্ত। এক তো তার ভীষণ খুদ পেয়েছে দ্বিতীয় রিপার মায়ের হাতের রান্না খুবই মজা হয়। এই দুনিয়াতে লিখনের জীবনে দু’জন মানুষ আছে যাদের হাতের রান্নার কোনো তুলনা হয় না। এক তার বড় বোন আর দুই রিপার মা অর্থাৎ তার হবু শাশুড়ি। কয়েক চামচ তেহেরি পেটে চালান করে দেয়ার পর লিখন জিজ্ঞেস করে,

-তুমি খাবা না?

-তুমি খাও, তুমি খাওয়ার পর থাকলে খাবো না থাকলে নাই। এমনিও আসার সকাল খেয়ে আসছিলাম তাই আমার খুদা নাই আপাতত। পরপর ক্লাস করে মাথা হ্যাং হয়ে আছে। আমি বরং এক কাপ চা খাই। তুমি মন আর পেট ভরে তেহেরি খাও। তোমার জন্য আম্মুকে বলে বেশি করে আলু দেয়াইছি। ইচ্ছা মতো খাও।

লিখন আর কথা বলে না খাওয়ায় মন দেয়। খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে নিয়ে বলে,

-তেহেরিটা সেই ছিল।

-প্রতিবার একই কথা বলো তুমি।

-মজা হইলে আমার কি করার বলো?

-হুম বুঝছি। আচ্ছা এসব বাদ দাও এখন আসল কথা বলো তো।

-কিসের আসল কথা?

-আপার সাথে কথা বলছিলা?

এতক্ষণে লিখন বুঝতে পারে রিপা কোন বিষয়ে কথা বলছে। জবাবে মাথা ঝাকায় সে। তা দেখে রিপা বিরক্ত হয়ে বলে,

-সিরিয়াস সময়ে মাথা ঝাঁকানোর অভ্যাসটা গেল না তোমার।। কীভাবে বললা? শুনে আপা কি বলল? সব বলো আমাকে।

রিপাকে তার বিষয়ে সিরিয়াস হতে দেখে ভালো লাগে লিখনের। পৃথিবীর প্রত্যেকটা প্রেমিকপুরুষই চায় তার প্রেমিকা তার বিষয়ে সর্বোচ্চ সিরিয়াস হোক। এইক্ষেত্রে লিখন ভাগ্যবান বলা যায়। তার প্রতিটা বিষয়ে রিপা ভয়াবহ রকমের সিরিয়াস। এমনকি বাইরে যাওয়ার বিষয়টা রিপাই লিখনের মাথায় দিয়েছে। লিখন কিছু বলছে না দেখে রিপা তাড়া দিয়ে বলে,

-কি হলো বলো?

-তুমি যা বলছো সেটাই বলছি। বলছি আমি গ্রাজুয়েশনের পর পোস্ট-গ্রাজুয়েশনের জন্য বাইরে যাইতে চাই।

-এই কথা শুনে আপা কি রিয়্যাকশন দিলো?

-আপা কি রিয়্যাকশন দিবে? আমি বলছি সে শুনছে। বলছে আচ্ছা সময় হোক তখন দেখা যাবে, গেলে যাবি।

-এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আপার কোনো রিয়্যাকশন নাই?

-আমার বোন এমনই রিপা তা তুমি ভালো করেই জানো। আমাদের রিলেশনের কথা শুনেও কিন্তু আপা কোনো রিয়্যাকশন দেয় নাই।

-তা জানি। আপা জিজ্ঞেস করে নাই হঠাৎ তোমার মাথায় এই বুদ্ধি কে দিলো?

-না, কিচ্ছুই জিজ্ঞেস করে নাই। আমি বলছি সে কেবল শুনছে।

-টাকা পয়সার বিষয়ে কিছু জানতে চায় না?

-শুনো রিপা আমার বোন মুর্খ না, সে জানে কেমন খরচ হইতে পারে।

-আমি কি সেই কথা বললাম নাকি? আজব!

-আচ্ছা রাগ হইতেছো কেন?

-রাগ হচ্ছি না, মাঝেমধ্যে আমার অবাক লাগে আপার কথা ভাবলে। একজন মানুষ এমন অনুভূতি শূন্য কেমনে হয়?

ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে লিখন বলে,

-আমার বোনটা এমনই। ছোটবেলা থেকে আমাদের তিনজনের বাবা-মায়ের ভূমিকা পালন করতেছে। ওর নিজের মাথার উপর ছায়া নাই। আমাদের ছায়া দিতে দিতে নিজে প্রতিমুহূর্ত পুড়ছে সেদিকে আপার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। আমি আপাকে আর কষ্টে দেখতে চাই না। একবার নিজের পায়ে দাঁড়াই বোনটাকে রাজরানী করে রাখবো দেইখো।

-সেজন্য আগে তোমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হবে। ভুলে যাইও না নিজের পায়ে না দাঁড়াইলে তুমি আমার বাবার সামনে গিয়েও দাঁড়াইতে পারবা না।

-সেই কথা কি আর আমার অজানা।

এই বিষয়ে আর কথা বাড়ায় না দু’জনের একজনও। রিপার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে এখনো অনেক সময় বাকি। তাই এখনই এসব ভেবে বর্তমান নষ্ট করতে রাজি নয় ওরা। প্রসঙ্গে ঘুরাতে রিপা জিজ্ঞেস করে,

-আইএলটিএস করতে কবে ভর্তি হবা?

-দেখি, সবে মাসের শুরু এখনো টিউশনির টাকা হাতে পাই নাই। তাছাড়া এই টাকায় হবেও না।

-আপাকে বলো নাই?

-বলছি তো। ও-তো এখনো বেতন পায় নাই। তাছাড়া সংসার খরচ আছে। চয়ন, চারুর লেখাপড়ার খরচ আছে। মাস শেষে আপার হাতে তেমন একটা টাকা থাকেও না। সব জেনে বুঝে এই সময়ে এত্তগুলা টাকা কেমনে চাই বলো?

-তুমি তো আর নষ্ট করার জন্য চাইছো না। সময় থাকতে তোমার আইএলটিএস করাটা জরুরী।

-আমি জানি জরুরী। কিন্তু আপার উপর এত চাপ দিলে কেমনে চলবে বলো? এই মাসটা নাহয় থাক। আমি টিউশনির টাকা থেকে কিছু রেখে দিবো, প্রয়োজনে আপার থেকেও অল্প কিছু নিবো। তারপর যা বাকি থাকবে বাকিটা আগামী মাসে ভরে ভর্তি হয়ে যাবো।

-আর এভাবে তোমার একটা মাস নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া এর মধ্যে যে বাসায় কোনো ইমার্জেন্সি আসবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? দেখা গেল বাসায় কোনো ইমার্জেন্সি হইলো আর ওমনি টাকাগুলো সব খরচ করে ফেললা।

-ইমার্জেন্সি হইলে খরচ তো করা লাগবেই তাই না?

-আমি জানি তো।

-তুমি রাগ করতেছো কেন?

-আমি রাগ করতেছি না। তোমার ফিউচার নিয়ে আমি খুবই সিরিয়াস। কারণ তোমার ফিউচারের সাথে আমার ফিউচারও জড়িত। আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে তোমাকে হারাইতে চাই না লিখন। সেজন্য সময় থাকতে যা যা করা সম্ভব তাই করতে চাই যাতে করে যখন তুমি আমার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবা তখন আমার বাবা যেন আপত্তি না করে সমাদরে তোমাকে গ্রহণ করে। আমার পছন্দকে এপ্রিশিয়েট করে। আমি বলছি না তোমাকে মাসে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করতে হবে। আমি জাস্ট চাই তুমি নিজের পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত করো যাতে আমার বাবা তোমাকে ফিরায় না দিতে পারে। দ্যাটস ইট।

-আমি জানি তো। সেজন্য যা যা করা লাগবে করবো তো।

-এভাবে করবা? এই মাসে না হইলে পরের মাসে, পরে মাসে না হইলে তার পরের মাসে!

-তুমি তো জানোই আমার অবস্থা।

কিচ্ছু বলে না রিপা। ফস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের ব্যাগ থেকে ভাজ করা এনভেলপ বের করে লিখনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

-নেও, ধরো।

-কি এর মধ্যে?

জবাব দেয় না রিপা। লিখন অপেক্ষা না করে এনভেলপের মুখ খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই দেখে রাবার দিয়ে প্যাঁচানো টাকা। দেখে বুঝা যাচ্ছে দুই চার বা পাঁচ হাজার নয় যথেষ্ট ভালো একটা এমাউন্ট আছে এখানে। একনজর দেখে নিয়ে মুখ তুলে রিপার দিকে তাকিয়ে বলে,

-এগুলা কি?

-টাকা।

-সেটা তো দেখতেই পারতেছি। কিন্তু কেন?

-কেন আবার কি? আমি খোঁজ নিয়েছি, তোমার ভর্তির জন্য যা দরকার এখানে আছে। আমরা এখন যাবো তুমি ভর্তি হবা। তারপর আমাকে বাসায় নামায় দিয়ে তুমি বাসায় যাবা।

-অসম্ভব, তুমি ভালো করেই জানো আমি তোমার থেকে এতগুলা টাকা নিতে পারবো না। এমনিতেই তুমি আমার জন্য কম করো না।

-করি তো কি হইছে? আমার প্রেমিকের জন্য আমি করি তাতে তোমার কি?

-এসব মন ভোলানো কথা বলে লাভ নাই রিপা।

-লাভ, ক্ষতির হিসাব আপাতত করতে পারব না তুমি আমার সাথে এখন যাবা কিনা সেটা বলো।

-না।

-সিওর?

-হ্যাঁ।

-ওকে ফাইন, তাহলে আমাদের সম্পর্কের এখানেই শেষ। আজকে থেকে তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়।

বলেই উঠে দাঁড়ায় রিপা। তা দেখে বসে থাকা লিখন রিপার একটা হাত ধরে ফেলে। হাতে বাঁধা লাগায় পেছনের দিকে তাকায় রিপা। উপরের দিকে মুখ তুলে লিখন বলে,

-আমি তোমাকো ছাড়া থাকতে পারবো না।

-তাহলে চলো ভর্তি হবা।

-এতগুলা টাকা আমি নিতে পারবো না, সত্যি বলছি।

-আচ্ছা যাও একেবারে নিতে হবে না। ধার দিলাম তোমাকে। পরে নাহয় দিয়ে দিও।

-ধার?

-হ্যাঁ ধার।

তবুও দ্বিধাবোধ করে লিখন। কি বলবে বুঝে পায় না। রিপা আর তাকে ভাবার সুযোগও দেয় না। হাত ধরে টেনে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলে,

-এত ভেবে কাজ নেই। চলো তো।

লিখন আর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। এই মেয়ে আগেও তার কথা শুনেনি, আজও শুনবে না তা লিখন খুব ভালো করেই জানে। লিখনকে ভর্তি করেই ক্ষ্যান্ত হশ না রিপা। ভর্রির কাজ শেষ করে নীলক্ষেত চলে যায় বই কিনতে। প্রয়োজনীয় বই কিনার পর লিখন রিপাকে ধানমন্ডি ওর বাসার কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে নিজের বাসার দিকে আগায়। লিখন জানে রিপা নামক মেয়েটা তাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। এই ভালোবাসার সঠিক মূল্যায়ন সে করতে পারবে কিনা তা লিখন জানে না। তবে রিপাকে নিজের করে পেতে, সুখে রাখতে যা যায় করণীয় সব করতে চায় সে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে