Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 258



অমানিশা পর্ব-০৬

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৬

রাত্রি ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাদের কাগজের প্রজাপতি বানিয়ে হাতে হাতে দিয়ে গান গাইছিল। রুহিয়া ক্লাসে ঢুকে বলল,

এখন কি ক্লাস?

বাংলা।

তো বাংলা ক্লাসে আপনি প্রজাপতি বানিয়ে সময় নষ্ট করছেন যে।

আসলে এটা নিয়ে ছড়া আছে ওটাই পড়াচ্ছি। তাই ওরা আনন্দ পাবে তাই বানিয়ে দিচ্ছি।

ওদের আনন্দ দেবার জন্য আপনাকে বেতন দেয়া হয়না মিস রাত্রি। ঠিকমতো না পড়িয়ে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন।

আপনি ভুল বললেন। আনন্দ পেলেই ওরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পড়াশোনা করবে।

আমি ঠিক না ভুল সেটা আপনি বিচার করতে আসবেন না। চাচা আমাকে সবদিক নজর রাখতে বলেছেন। এমন চললে আমি ওনাকে জানাতে বাধ্য হব।

রুহিয়া কথাগুলো বলেই বের হয়ে গেল। রাত্রি ওর মতো করে ক্লাস চালিয়ে গেল।

স্কুলে টিচার্স রুমে বসেছিল রাত্রি। আয়ান এসে ঢুকল এমন সময়। রুহিয়া একপাশে বসে ছিল। ওর পাশে চেয়ার ফাঁকা ছিল। হাত নেড়ে আয়ানকে বসতে ইশারা করল। আয়ান গিয়ে চেয়ারটা নিয়ে রাত্রির পাশে এনে বসে পড়ল। রুহিয়া ভীষণ রেগে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। আয়ানের এই মেয়েটার প্রতি এতো আগ্রহ,মেলামেশা ওর কাছে অসহ্য লাগছে।

আয়ান এসেই জোরে জোরে বলল,

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মিসেস রাত্রি।

রাত্রি জিভ কেটে বলল,

এমা ! কি বলেন এসব,আমি মিসেস নই।

আয়ান মনে মনে খুশি হলো। ও বলল,

ও আচ্ছা,সরি। তবে আপনাকে ধন্যবাদ।

কিন্তু ধন্যবাদ কিসের জন্য?

এই যে আপনি কি সুন্দর করে বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন। আমার না মনে হয়েছে যে শিশুদের শুধু পড়ার জন্য চাপে না রেখে ওদের মতো করে ওদের সাথে মেশাটাই একজন শিক্ষকের‌ বিশেষ গুন। আর আপনি এই কাজটা এতো চমৎকার ভাবে করলেন। আমার খুব খুব ভালো লেগেছে ব্যাপারটা। সত্যি আপনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে।

কোন ক্লাসের কথা বলছেন?

ঐ যে প্রজাপতি বানিয়ে ক্লাস নিলেন।

কি যে বলেন। আপনি বেশি বেশি বলছেন। ওটাতো ওদের পড়ার একটা অংশ।

কিন্তু সবাইতো এসব করে না।

আমি চেষ্টা করি। এই স্কুলের সবাই খুব আন্তরিক।

আয়ান দেখল রুহিয়া উঠে চলে যাচ্ছে।

আয়ান সেদিকে একবার দেখে বলল,

আপনি কারো কথায় কিছু মনে করবেন না। আসলে আমাদের এক একজনের চিন্তা ভাবনা এক এক রকম। আর ভালো কিছু করতে গেলে বাঁধা আসবেই।

আমি কিছুই মনে করিনি।

কিন্তু আমি মনে করব। আপনি যদি এখন আমার লাঞ্চটা শেয়ার না করেন।

আমিওতো লাঞ্চ এনেছি।

তা জানি। ওটা থাক। আসলে মা এই এতোটা বিরিয়ানি দিয়ে দিয়েছেন। আমি একা খেতে পারি না। খাওয়ার সময় গল্প করতে না পারলে আমার গলা দিয়ে কিছু নামে না। আর তাছাড়া আমার মায়ের হাতের বিরিয়ানি ভীষণ মজা হয়। আপনাকে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। আপনি খেয়ে প্রশংসা করবেন সেটা আমি আবার মাকে গিয়ে জানাব। মা অনেক খুশি হবেন।

রাত্রি হেসে বলল,

আচ্ছা চলুন।

তরফদার সাহেব বসে আছেন ছোট মেয়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের রুমে। স্যার একটু কড়া কথাই শুনিয়ে দিলেন। বাঁকা করেই বললেন,

এই বয়সে মেয়েকে ফোন দিয়েছেন। আপনার মতো সচেতন মানুষের কাছে এটাতো আশা করিনি।

তরফদার সাহেব প্রথমে কিছু বুঝলেন না। অবাক হয়ে বললেন,

মানে কি হয়েছে একটু পরিস্কার করে বলবেন কি?

আপনার মেয়ে গোধূলি মোবাইল ফোন এনেছে স্কুলে। আপনি তো জানেন এই স্কুলে নিয়ম কানুন কতটা কড়াকড়ি ভাবে মানা হয়।‌ অথচ আপনার মেয়ে মোবাইল নিয়ে এসেছে।‌ এটা আবার সে কমনরুমে গিয়ে সবার সামনেই ব্যবহার করছে। কতবড় সাহস! এভাবে তো অন্যরাও নিয়ম ভাঙতে উৎসাহিত হবে। ভাগ্য ভালো ওর এক ক্লাসমেট বিষয়টা ইনফর্ম করেছে আমাদের।

কি বলছেন এসব! ও মোবাইল এনেছে? আচ্ছা স্যার,আমি দেখছি বিষয়টা। ওকেতো ফোন দেয়া হয়নি। বাসার কারোটা নিয়ে এসেছে হয়তো। আমি কথা দিচ্ছি আর এমন হবে না।

আচ্ছা আপনি বলছেন তাই ওকে কিছু বললাম না। এরপর এমন হলে টিসি দিতে বাধ্য হবো।

তরফদার সাহেব ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন। জীবনে কখনো কেউ তাকে এভাবে তাচ্ছিল্য করে কথা শোনাতে পারেনি। তিনি বরাবরই মেয়েদের সুশৃঙ্খল ভাবে বড় করতে চেয়েছেন। বড় মেয়েকে খুব সুন্দর করে মানুষ করেছেন। কিন্তু গোধূলির বেলায় নানাসময় নানা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। মেয়ের এমন আচরণে তিনি ভীষণ রেগে গেলেন।‌ কিছু দিন থেকেই কিসব উলটা পালটা কান্ড করছে এই মেয়ে । বড় মেয়েকে যেই ছেলেটা দেখতে এলো তারসাথে যোগাযোগ করেছে। আজ আবার এই কান্ড।

কিন্তু তার মেয়ে মোবাইল কোথায় পেল। তাও আবার স্মার্ট ফোন। এটাতো বাড়ির কারো ফোন না। আগেও পাড়ার পরিচিত লোকজন গোধূলি সম্পর্কে নানা বিচার দিয়েছে। তবে সেসব এতো বড় কিছু ছিলো না। হয়তো কোনো বন্ধুর সাথে কোথাও দেখেছে কেউ। তবে গত ক’দিন এর ঘটনায় তিনি অবাক হয়ে যাচ্ছেন। পড়াশোনায় একদম ভালো করতে পারছে না মেয়েটা। অথচ আজেবাজে কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

গোধূলি বাবার সাথে বাড়িতে ঢুকল ভয়ে ভয়ে । পুরো রাস্তায় বাবা কিছু বলেনি। বাসায় গিয়ে কি করবে আল্লাহ জানেন। তবে কি কৈফিয়ত দেবে মনে মনে সেটা ঠিক করে ফেলল ও। বাবা নিশ্চয়ই খুব রেগে আছেন।

তরফদার সাহেব বাড়িতে এসেই বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে বসে পড়লেন। ওনার কেমন অস্থির লাগছে। একটু পানি চাইলেন নাজমার কাছে। গোধূলি একপাশে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। নাজমা বলল,

আপনি এসময় আসলেন আর গোধূলিকে কোথায় পাইলেন। তিনি গোধূলিকে চোখ দিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলেন। গোধূলি চুপ করে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে থাকল। তরফদার নাজমাকে বললেন,

তোমার গুনধর মেয়ের স্কুলে ডাক পড়েছিল।

কেনো,স্কুলে ডেকেছে কেনো?

এতো সবে শুরু। আরো কত কি যে দেখবা।

এই কি হয়েছে গোধূলি,তোর বাবাকে কেনো ডেকেছে?

ও কি বলবে? তোমার মেয়ে স্কুলে মোবাইল নিয়ে গেছে।

কি বলেন? ও মোবাইল পাবে কোথায়?

সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করো। তোমার এই মেয়ে বিপথে চলে গেছে নাজমা। আমার মান সম্মান কোথায় যে নিয়ে ফেলবে।

তরফদার সাহেব মোবাইল নাজমার কাছে দিয়ে বললেন,

এই দেখো,এই মোবাইল তোমার মেয়ে নিয়ে গেছে।

এই তুই মোবাইল কই পাইছিস?

আমার মোবাইল না।

তো তোর কাছে আসল কিভাবে? মিথ্যা বলছিস তুই।

আমি নিয়েছিলাম এক বন্ধুর কাছে।

ও মিথ্যা বলছে কিভাবে দেখেছ? ও অনেক চালাক হয়ে গেছে। মা বাবার সাথে চালাকি করছে তোমার মেয়ে।
আমি সত্যিই বলছি বাবা, বিশ্বাস করো। শখ করে ছবি তুলতে নিয়েছিলাম।

আমিতো তোমার মোবাইল দেখেছি। সাব্বির নামের ঐ ছেলের সাথে তোমার মেয়ে রীতিমতো যোগাযোগ রেখেছে। গতকাল একটা আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে আমার ফোনে। তোমার মেয়ে ঐ সাব্বিরের‌ সাথে এখানে সেখানে ঘুরতে যায় এসব জানিয়েছে আমাকে। আমি ভেবেছিলাম কেউ মিথ্যা করে বাড়িয়ে বলছে। আর আজকেই তোমার মেয়ের স্কুল থেকে ডাক পড়ল। আমি এই মোবাইলেও সব মেসেজ দেখেছি। এই মেয়ে যে কি করতে যাচ্ছে ও ভালো জানে।

গোধূলি চুপ করে রইল।

নাজমা মেয়েকে মারতে মারতে বললেন,

কোথায় পেয়েছিস এই মোবাইল। বল শিগগির। বদমাইশ মেয়ে কোথাকার!

মারতে মারতে মেয়েকে মাটিতে ফেলে দিলেন। পা দিয়ে লাথি দিলেন অনবরত।

তরফদার বললেন,

নাজমা ওর স্কুলে যাওয়া বন্ধ। পড়ালেখা করতে গিয়ে যদি এসব করে তাহলে পড়াশোনা না করাই ভালো। বাসায় পড়ুক। আমি বাসায় টিচার ঠিক করে দেব। পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবে।

গোধূলি এবার মুখ খুলল। চিৎকার করে বলল,
এটা করতে পারো না তোমরা,আমি কি ক্রিমিনাল যে বন্দি করে রাখবা? আমাকে এভাবে আটকে রাখতে পারবে না তোমরা।

নাজমা আবারও মেয়েকে মারতে শুরু করলেন।

আমরা যা বলছি তাই হবে। পরিবারের মান সম্মান নিয়ে খেলবি তুই। কোথাও যাওয়া হবে না। বেশি পাখনা গজাইছে। পাখনা কিভাবে কাটা লাগে আমার জানা আছে ভালো করে। সব বন্ধ আজ থেকে।

গোধূলির স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। বাড়িতে একজন টিচার এসে পড়াতে লাগলেন। ওর মোবাইল নিয়ে নেয়া হয়েছে, তাই সাব্বিরের সাথে যোগাযোগ বন্ধ থাকল। গোধূলির সব রাগ গিয়ে পড়ল রাত্রির ওপর। গোধূলি বোনের সাথে কথা বন্ধ করে দিলো।

আজ রাত্রিদের স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত্রি শাড়ি পরেছে। এমনিতেই শাড়ি পরা হয় না কখনো। ওর তাই লজ্জা লাগছে। হাঁটতে চলতেও সমস্যা হচ্ছে বেশ।

ছেলেরা সবাই পাঞ্জাবি পরেছে। আয়ান একটা অফহোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পরেছে। ওকে অন্যদিনের থেকে আলাদা লাগছে বেশ। না চাইতেও কয়েকবার আয়ানের দিকে চোখ গেল রাত্রির। আর প্রতিবারই চোখাচোখি হয়ে গেল।

আস্তে আস্তে কুচি ধরে হেঁটে টিচার্স রুমে যাচ্ছিল রাত্রি কোথা থেকে আয়ান এসে পড়ল।

আপনার শাড়িটা কিন্তু সুন্দর।

হুম,সবাইতো একরকম শাড়ি কিনেছি।

তবে আপনার শাড়িটা একটু বেশি সুন্দর।

রাত্রি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই আয়ান হাসিমুখে আস্তে করে বলল,

শাড়িটা একটু উঁচু করে পরুন, হাঁটতে আর সমস্যা হবে না।

রাত্রি বুঝল ওর যে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে আয়ান ওটা খেয়াল করেছে। সত্যিতো শাড়িটা বেশ নীচু হয়ে গেছে পরাটা। রাত্রি কমনরুমের দিকে এগুলো। আয়ানের এই কেয়ারিং এটিচিউড ভালো লাগল ওর।

এখন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। একটু পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। রাত্রির একটা আবৃত্তি আছে। ছোটদের পরিবেশনা শেষ হলেই শিক্ষকদের পারফরম্যান্স হবে।

রুহিয়াকে আয়ানের আশেপাশেই দেখা যাচ্ছে। হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলেই চলেছে। আয়ান অবশ্য এদিক ওদিক দেখছে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আগে আগে আয়ান রাত্রির কাছে এলো,

একটা কথা বলব?

হুম। বলে ফেলুন।

আপনার হাতের চুড়ি আর গলার মালাটা কি খুলে ব্যাগে রাখা যায় কিছু সময়ের জন্য?

রাত্রি একটু অবাক হলো। এটা আবার কিরকম কথারে বাবা।

আয়ান বলল,
না থাক,সমস্যা হলে থাক।

আয়ান চলে গেল। রাত্রি একটু পর কি মনে করে চুড়ি আর মালা খুলে হাতব্যাগে রেখে দিল।

একটু সময় পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। ছোটদের একটা দলীয় নাচ হচ্ছে। এরপর রাত্রির আবৃত্তি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছে আয়ান আর রুহিয়া। রাত্রির নাম বলতে গিয়ে আয়ান মিষ্টি মেয়ে উপাধি জুড়ে দিলো।

রাত্রি আবৃত্তি করল জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সবাই খুব প্রশংসা করল।

প্রতিষ্ঠান প্রধান বললেন,

আপনিতো বেশ ভালো আবৃত্তি করেন। এতোদিন এই প্রতিভা লুকিয়ে রেখেছিলেন কেনো। এখন থেকে বাচ্চাদের আবৃত্তি ক্লাস আপনি নেবেন। আমি রুটিন করে দেব নতুন করে।

এরপর আরও কিছু পারফরম্যান্স হলো।‌ সবশেষে গান গাইতে উঠল আয়ান। রাত্রি জানতোইনা আয়ান যে গান গাইবে। গিটার হাতে মঞ্চে উঠতেই চারিদিক হাততালিতে মুখরিত হলো। অল্প সময়ে আয়ান সব স্টুডেন্টদের কাছে পপুলার হয়ে উঠেছে।

আয়ান উঠেই শুরু করল,

‘হাত খালি গলা খালি কন্যার নাকে নাকফুল’

রাত্রি বুঝল কেনো ওকে ওসব খুলতে বলেছে আয়ান। গানটা ওকে নিয়েই গাইছে। আয়ান তাকিয়ে আছে ওর দিকেই ।লজ্জামাখা আবেশে গানের সাথে ঠোঁট মেলাল রাত্রি। ভীষণ এক ভালো লাগা আচ্ছন্ন করল ওকে।

চারদিন পর গোধূলি সুযোগ পেলো সাব্বিরকে ফোন করার। ছুটির দিন তাই রাত্রি বাসায় ছিল। ও গোসলে ঢুকলে ওর মোবাইল নিয়ে সাব্বির কে ফোন করে ছোট করে সব ঘটনা জানাল।‌

সাব্বির বলল,

দেখি আমি দু’দিন এর মধ্যে সব ব্যবস্থা করে রাখব। তুমি পরশু একবার কল দিও যেভাবেই হোক।

গোধূলি লুকিয়ে স্কুলের ব্যাগে কিছু কাপড় আর টুকটাক দরকারি জিনিস নিয়ে রেখেছে। স্কুল ব্যাগে নিয়েছে যেন কেউ দেখলে ভাববে স্কুলে যাচ্ছে। মায়ের আলমারিতে একটা গলার হার,একজোড়া বাউটি আছে। ওটাও নেবে ঠিক করে রেখেছে।

এভাবে পালিয়ে গেলে এ বাড়িতে কেউ মানবে না। আর কিছু পাওয়ার আশাতো দূর, কোনদিন বাড়িতেই হয়ত ঢুকতে পারবে না। তাই ও ঠিক করল যা কিছু পারবে সাথে করে নিয়ে নেবে। মেয়ে হিসেবে ওরতো অধিকার আছে সবকিছুতে। এভাবে নিলেও অন্যায় কিছু হবে না।

গোধূলির গলাতে একটা দশ আনার চেইন আছে। একজোড়া ছোট্ট কানের দুল। এগুলো তো আছেই। মায়ের আলমারিতে তালা দেয়া থাকে না। বাড়িতে বাইরের লোক নেই তাই তালা দেওয়ার দরকার হয় না। মা গোসলে ঢুকলে ঐ সময় বাড়ি একদম ফাঁকা থাকে। তখন আলমারি থেকে নিতে হবে জিনিসগুলো। আর সব জিনিস গোছানোই আছে। টুক করে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে।

সকালে রাত্রির ফোন থেকে কথা হয়েছে সাব্বিরের সাথে। সাব্বির সব ঠিক করে রেখেছে। গোধূলি বলে রেখেছে আজ দুপুরের পর বের হবে। সাব্বির সুপার মার্কেট যেতে বলেছে ওকে। ঐখানে অপেক্ষা করবে গোধূলির জন্য।

গোধূলির ভয় করছে না একটুও। বরং ভালোই লাগছে। একটু এডভেঞ্চার লাগছে বিষয়টা। আর এসব পড়াশুনা করতে হবে না। এতো কড়া শাসনে থাকতে হবে না। শুধু সাব্বির আর ও। সাব্বির নিশ্চয়ই বাবার মতো এতো রুড হবে না। মন দিয়ে সংসার করবে ও। ভালো বরতো পাচ্ছেই। মা বাবা থাকুক ওনাদের আদরের রাত্রিকে নিয়ে। ওরাও বুঝুক যে গোধূলি ফেলনা না। রুপ থাকলে আর কিছু লাগে না। এতো পড়াশোনা করেওতো আপার জন্য আনা বর ওকেই পছন্দ করল। ও কম না কোনো দিক থেকেই। শুধু এ বাড়ির লোকজন ওর কদর করলো না।

নাজমা কাজ শেষ করে শুয়ে পড়লেন। একটু পর গোসলে যাবেন। খুব ক্লান্ত লাগছে। বাড়িতে কেউ নেই এসময়। গোধূলি আছে, কিন্তু ঐদিনের পর থেকে তেমন কথাবার্তা বলে না।‌ সারাদিন নিজের ঘরে শুয়ে বসে কাটায়।

গোধূলি একবার মার ঘরে উঁকি দিলো। মা এখনো গোসলে যায়নি। ঘুমিয়ে পড়লে সমস্যা। আপার আসার সময় হয়ে যাবে। গোধূলি একটু পর আবার এলো ঘরে। এ কয়দিন মায়ের সাথে কথা বলেনি তেমন। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

মা ঘুমাও?

না শুয়ে আছি। কিছু বলবি?

বেলা হয়ে গেলো আর তুমি শুয়ে আছো। খুব ক্ষুধা পেয়েছে। তুমি গোসল করলে একসাথে খাব।

নাজমা উঠে বসলেন। এই কয়দিন মেয়ের সাথে ভালো করে কথা বলা হয়নি। মেয়েটা চুপচাপ ছিলো। আজ নিজে থেকে এসেই কথা বলছে। একসাথে খেতে চাইছে। ওনার খুব ভালো লাগছে।

আসলে সংসারে একজন যদি রাগ করে থাকে তাহলে সবার মনেই অশান্তি চলতে থাকে। বাবা মা সন্তানের ভালোর জন্য শাসন করেন এটা ঠিক, কিন্তু সন্তানের গায়ে হাত তুলতে কার ভালো লাগে?

এই যে মেয়েটা দোষ করল,ওকে বকতে মারতে ওনার কি ভালো লেগেছে? যত রাগই হোক ভেতর ভেতর মেয়ের জন্য তার খুব কষ্ট হয়। এই যে মেয়ে ভালো করে কথা বলছে কি যে শান্তি লাগছে। তিনি নিজেও হয়তো একটু বেশি খারাপ ব্যবহার করেছেন। এভাবে এতো শাসন না করে বুঝিয়ে বললেও তো পারতেন।

তিনি গোধূলিকে পাশে ডেকে বসালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে ডুকরে উঠলেন।

আমার সোনা মা,কেনো এমন করিস মা। তুই আর রাত্রি ছাড়া আমাদের আর কে আছে বল। তুই ভালো করে পড়াশোনা কর। তারপর তোর যাকে পছন্দ হয় তার সাথেই বিয়ে দেব দেখিস। আমরাতো তোর শত্রু না, একমাত্র মা বাবাই নিঃস্বার্থ ভাবে সন্তানের ভালো চায়। তোদের খারাপ কিছু হলে তোর বাবা মরেই যাবে। মানুষটা সবসময় শুধু তোদের কথাই ভাবে।

আচ্ছা ঠিক আছে,বুঝেছি আমি। এখন যাওতো গোসল করে এসো। এসে আমাকে খাইয়ে দিবে আজ।

নাজমা বললেন,

তুই বস,আমি এখুনি গোসল করে আসছি।

আচ্ছা যাও। তাড়াহুড়ো করতে হবে না। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। তুমি আরাম করে গোসল সারো।

নাজমা গোসলে ঢুকতেই গোধূলি বাইরে থেকে বাথরুমের দরজার ছিটকিনি আস্তে করে লাগিয়ে দিলো। তারপর আলমারি খুলল। ড্রয়ার খুলেই গয়নাগুলো নিয়ে নিল। ড্রয়ারে একটা খাম চোখে পড়ল। খামটা হাতে নিয়ে দেখল এক বান্ডিল টাকা। টাকা কিসের গোধূলি বুঝলো না। বাবা তুলে এনেছেন বোধহয়। সাধারণত এতো টাকা আলমারিতে থাকে না। গোধূলি একটু ভেবে খামটা নিয়ে নিলো। জলদি করে গোছানো ব্যাগ আর জিনিসপত্র নিয়ে বের হয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-০৫

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৫

দ্বিতীয় পিরিওডের পর রাত্রি দেখল টিচার্স রুমে হেডস্যার মিটিং বসিয়েছেন। ওকেও ডাকা হয়েছিল। একটু দেরি করে ফেলেছে। নতুন দু’জন শিক্ষক এসেছেন। তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। চা নাস্তার আয়োজন হয়েছে। নতুন শিক্ষকদের একজন পদার্থ বিজ্ঞান আর একজন চারুকলার।

বেসরকারি হলেও এই স্কুলটা অল্প সময়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। যেকোনো নামিদামি স্কুলের সাথে পাল্লা দিতে পারার মতো সব রকম কোয়ালিটি আছে। এখানে শিশুদের প্রতি শিক্ষকরা খুব যত্নশীল। তাই রেজাল্ট ভালো। প্রধান শিক্ষক আর পরিচালনা পর্ষদ খুব কড়াকড়ি নিয়মে সবকিছু তদারকি করার ফলেই এতো সুন্দর একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো সম্ভব হয়েছে।

পদার্থ বিজ্ঞান এর শিক্ষক এর নাম আয়ান। একটা নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছে। দেখতে শুনতে বেশ। আর চারুকলার যিনি উনি একজন মেয়ে। বয়স দেখে বোঝার উপায় নেই যে পড়াশোনা শেষ ওনার। এখনো স্কুল কলেজের ছাত্রী হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে।

নবাগতরা নিজেদের পরিচয় দিলেন। চা নাশতা খেতে খেতে আলাপ হলো টুকটাক। রাত্রি চুপচাপ বসে ছিল। চা পর্ব শেষে সবাই যার যার ক্লাসে গেল। রাত্রির এই সময়টা লিজার । আয়ান এগিয়ে এসে বলল,

আপনার মন খারাপ?

রাত্রি নড়েচড়ে বলল,

না তো।

না অনেক ক্ষণ দেখছি চুপ করে আছেন।

এমনই চুপ আছি।

আপনি কতদিন হয় এখানে আছেন?

মাস চারেক হলো।

ও আচ্ছা। আমি আয়ান। আপনার নামটা।

আমি রাত্রি।

বাহ,নামটাতো বেশ সুন্দর।

কমন নাম।

কমন হলেও মিষ্টি।

ক্লাস নেই এখন?

না এই পিরিওয়ডটা লিজার আমার।

ভালোই হলো। আপনার সাথে কথা বলে সময়টা কাটবে।
এ সময় নতুন মেয়েটা এগিয়ে এলো। রুহিয়া নাম। রুহিয়া আয়ানকে বলল,

আপনি চা খেয়েছেন?

আমি তো চা খাই না।

ও আচ্ছা। আমার তো চা ছাড়া দিন শুরু হয় না। তা আপনি এখানে কেনো এলেন ? এতো ভালো রেজাল্ট আপনার।

চেষ্টা করছি। কিন্তু ততদিনে এখানে একটু থাকার ইচ্ছা। ছোটদের সাথে সময় কাটাতে আমার ভালো লাগে।

তাই! আমারতো মাথা ধরে যায়।

তবে তো এখানে জয়েন করা ঠিক হয়নি।

দেখি ক’দিন থাকি। বেশি দিন থাকার ইচ্ছা নাই। এই স্কুলের পরিচালক রহমান সাহেব আমার চাচা। উনি বললেন যতদিন বাসায় আছি একটু যেন সময় দেই।

আয়ান রাত্রিকে দেখিয়ে বলল,

ইনি রাত্রি,আলাপ হয়েছে?

না, আপনি কোথায় থেকে পড়েছেন?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ওহ! তাহলে ভালো করেছেন এখানে জয়েন করে। পরে চাকরি হবে কি না হবে।

রাত্রি বুঝল ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তাই এভাবে বলল মেয়েটা। ও একটু হেসে বলল,

আমার তো ভালোই লাগে এখানে। খারাপ মনে হয় না। ছোটদের মাঝে থাকলে মনটা ভালো হয়ে যায়। আর তাছাড়া শিক্ষক হিসেবে ভাবলে মনটা গর্বে ভরে ওঠে।

এসব বুকিশ কথাবার্তা।‌ বাস্তবতা অনেক কঠিন। আমি অবশ্য বেশিদিন থাকবো না।‌ সময় কাটানোর জন্য এখানে জয়েন করলাম। ভালো কিছু হলে ছেড়ে দেব।

রুহিয়া এবার আয়ানকে বলল,

আপনার বাসা কোথায়?

মিরপুর ১।

ওহ,আমিও তো ওদিক হয়ে আসি। একসাথে আসা যাবে।

আমিতো মাঝে মাঝে পাঠাও রাইডে আসি। আবার বাসেও আসি কখনো কখনো। আপনি আমার সাথে আসতে গেলে আপনার ঝামেলা হয়ে যাবে।

কিছু ঝামেলা হবে না।

আচ্ছা দেখা যাক।

চলুন স্কুলটা ঘুরে দেখি।

আচ্ছা চলুন। রাত্রি, আপনিও আসুন না।

ওনিতো দেখেছেন। উনি না গেলেও হবে।

না উনি ঘুরিয়ে দেখালে ভালো লাগবে।

রুহিয়ার বোধ হয় বিষয়টা পছন্দ হলো না।

রাত্রি বলল,

আমার ক্লাস আছে, আপনারা দেখুন।

আয়ান বলল,

তাহলে পরে দেখি।

নতুন ম্যাম মনে হয় মন খারাপ করল। তার আয়ানের জন্য একটু বাড়তি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। রাত্রি মনে মনে হাসল।

সাব্বির ছবিগুলো খামে ঢুকিয়ে রাখল। এখুনি গোধূলিকে এসব দেখানো ঠিক হবে না। ও গোধূলিকে মেসেজ দিল।

কি করো? দেখা করতে পারবে?

গোধূলি মেসেজ দেখল ঘন্টা খানেক পর। ও স্কুলে ফোন নিয়ে গেছে। কমনরুমে ঢুকে বুকের ভেতর থেকে ফোন বের করে অন করল। সাথেই সাব্বির এর মেসেজ ঢুকল।

গোধূলি রিপ্লাই দিল,

আচ্ছা ছুটির পরে।

সাব্বির একটা চুমুর ইমোজি এঁকে দিল। লিখল,

আজ একটু বেশি সময় রাখব তোমায়।

গোধূলি লাভ সাইন দিল।

এমন সময় তরু এসে ঢুকল কমন রুমে। গোধূলি ফোন লুকাতে গেল কিন্তু তরু দেখে ফেলল।

কিরে কি লুকাচ্ছিস।

কই কিছু না।

আচ্ছা ঠিক আছে লুকিয়ে ফেল। আমি চোখ বন্ধ করছি।
না কিছু না। চোখ বন্ধ করতে হবে না।

বলতে বলতেই ফোন লুকিয়ে ফেলল গোধূলি। তরু রিয়াদের বোন তাই ওকে ফোন দেখানো ঠিক হবে না।

ছুটির পরে সাব্বির এসে অপেক্ষা করছিল গেটে। তরু কোনো দিকে না দেখে উঠে পড়ল। সাব্বির ওকে নিয়ে চলে গেল একটা এপার্টমেন্ট এর সামনে। গোধূলিকে নামতে বলল।

গোধূলি বলল,

এখানে কেনো?

আসো সমস্যা নেই। এটা আমার এক কাজিনের বাসা।

কিছু মনে করবেন না উনি?

না,আমি বলে রেখেছি।

গোধূলি সাব্বিরের সাথে গেল। তিন তলায় গিয়ে লিফট থেকে নামল ওরা।‌ সাব্বির বা দিকের ফ্লাটে বেল টিপলে একটা ছেলে দরজা খুলে দিল। সাব্বির বলল,

এসো।

বেশ গোছানো একটা বাসা। একটা মেয়ে এলো ভেতর থেকে। আয়ানকে বলল,

কেমন আছো ভাইয়া?

হুম ভালো। তোর বর কোথায়?

ওতো অফিসে।

ও আচ্ছা,এ হলো গোধূলি। আর গোধূলি ও আমার চাচাতো বোন মনি।

গোধূলি সালাম দিল।

ওয়ালাইকুমুস সালাম। বেশ মিষ্টি তো দেখতে তুমি। তোমরা বসো। আমি রান্না বসিয়েছি। খেয়ে যাবে। গোধূলি বলল,

দেরি হয়ে যাবে তো।

কিছু দেরি হবে না। আমি পৌঁছে দেব। সাব্বির আশ্বস্ত করল।
মেয়েটা ভেতরে গেলে সাব্বির গোধূলির কাছে গিয়ে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল।

গোধূলি বাধা দিলো না।

সাব্বির গোধূলির ঘাড়ে নাক ঘষল। তারপর ওর গালে গলায় ঠোঁটে চুমু খেল। সাব্বিরের হাত ঘুরতে থাকল গোধূলির পুরো শরীর জুড়ে। এর আগেও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে গোধূলির। ও সাড়া দিতে থাকল।

কিছু সময় পরে খেয়ে বেরিয়ে এলো ওরা। বাইকে যেতে যেতে সাব্বির বলল,

রিয়াদ ছেলেটা কে?

গোধূলি চমকালেও সামলে নিয়ে বলল,

আর বলবেন না। বন্ধুর বড় ভাই। কেন কি হয়েছে।

না কিছু না। দেখা হলো স্কুল গেটে।‌ জানতে চাইল তোমাকে কিভাবে চিনি।

খুব বিরক্ত করে। পছন্দ করে আমাকে। আমি অবশ্য এড়িয়ে চলি।

ও আচ্ছা।

গোধূলি বাড়িতে ঢুকলে নাজমা বলল,

এতো দেরি হলো যে, কোথায় গিয়েছিলি?

একটা নোট নিতে গেছিলাম তরুর বাড়িতে। আন্টি না খাইয়ে আসতে দেবে না। তাই দেরি হলো।

নাজমা বললেন,

কি নোট দেখি।

গোধূলি ব্যাগ থেকে গণিতের একটা শিট বের করে দেখালো।
নাজমা বললো আচ্ছা ঠিক আছে। হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।
গোধূলি ভেতরে চলে গেল।

নাজমা মনে মনে এই ভেবে নির্ভার হলেন,যাক মেয়েটা ভুল বুঝতে পেরেছে। পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছে।

পরদিন স্কুলে গিয়ে টিফিন পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। টিফিন এর পরে হেড স্যারের রুমে ডাক পড়ল গোধূলির। গোধূলি বুঝলো না হঠাৎ স্যার কেনো ডাকলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখল স্যারের রুমে আরো দু’জন ম্যাডাম আছেন। একজন ওদের ক্লাস টিচার শাহিন ম্যাডাম। গোধূলি রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে একপাশে দাঁড়াল।

শাহিন ম্যাডাম বললেন,

তুমি কি মোবাইল এনেছো?

না তো।

মিথ্যা বলোনা।‌ এনে থাকলে দিয়ে দাও।

আনিনি ম্যাডাম।

হেডস্যার বললেন,

আচ্ছা তোমার ব্যাগ চেক করা হবে।

গোধূলি ভয় পেল।

আয়া গিয়ে ক্লাস থেকে গোধূলির ব্যাগ আনল। কিন্তু কিছু পেলো না। শাহিন ম্যাম বললেন,

আমার সাথে এসো তুমি?

গোধূলির ম্যাম ওকে কমনরুমে নিয়ে ভালো করে চেক করে বুকের মধ্যে রাখা মোবাইল পেল।

হেডস্যার এর রুমে আবার গেলো ওরা। গোধূলির বাবাকে ফোন দিলেন স্যার।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-০৪

0

গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৪

তরফদার সাহেব হতবাক হয়ে চেয়ে আছেন ছোট মেয়ে গোধূলির দিকে। তার মাথায় আসছেনা গোধূলি কেনো সাব্বিরের বাইকে করে বাসায় এসেছে। আর যেখানে উনি সাব্বিরের সাথে কোনোরকম সম্পর্ক হবে না বলেই দিয়েছেন তাহলে ঐ ছেলে কি উদ্দেশ্যে গোধূলির সাথে যোগাযোগ করছে।

তিনি থমথমে গলায় জানতে চাইলেন,

সাব্বির ছেলেটাকে কোথায় পেলে?

আমার স্কুলের সামনে এসেছিল।

তুমি ওর সাথে কথা বললে কেনো?

উনি এসে কথা বললেন আমি কি করব। দৌড়ে পালাব?

কেনো, মানা করলে না কেন। তুমি তো জানো ঐ ছেলে কি করেছে। আর তুমি তার বাইকে চেপে বাসা পর্যন্ত চলে এলে একেবারে!

উনি বললেন এদিকে আসবেন তাই বাইকে উঠেছি।

তুমি কি সত্যি বোঝো না নাকি না বোঝার ভান ধরে থাকো গোধূলি। তোমার বড় বোনকে যেই ছেলেটা রিজেক্ট করল তার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করাটা কি উচিত?

আমি বুঝতে পারিনি। আর তাছাড়া উনিতো খারাপ কিছু বলেননি।

নাজমা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। এবার আর রাগ সামলে রাখতে পারলেন না। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন মেয়ের গালে।

তুমি আমাকে মারলে কেনো মা। ঐ ছেলে কি এমন করেছে। আমাকে পছন্দ করেছে,এইতো। এতেতো দোষের কিছু নাই।

নাজমা এবার চুলের মুঠি ধরে বললেন,

তোকে চড় মারাটা ঠিক হয়নি। মেরেই ফেলবো আজ। যেখানে আমরা চাইছিনা ঐ ছেলের সাথে কোনোরকম কোনো সম্পর্ক করতে সেখানে তোর সাহস হয় কিভাবে ওর সাথে ঘুরে বেড়াতে। বেহায়া নির্লজ্জ কোথাকার। তোর বোনকে দেখতে এসে তোকে পছন্দ করল। ঐ ছেলের চরিত্র কেমন হবে বোঝাই যায়। তুই কোন সাহসে ঐ ছেলের সাথে কথা বললি। আবার এখানে দাঁড়িয়ে মুখে মুখে তর্ক করা হচ্ছে।

আমাকে মারবে না বলে দিচ্ছি। একদম ভালো হবে না।

কত বড় সাহস দেখছ। কি খারাপ করবি তুই বল।

নাজমা এলোপাথাড়ি মেয়েকে মারতে শুরু করলেন।

রাত্রি এসে নাজমাকে আটকালো।

মা কি করো। ও ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। ছাড়ো ওকে।

না,কারো কোনো কথা শুনবো না। এই মেয়ে এই বয়সে কম কান্ড করেনি। এর ওর মুখে নানা কথা শুনতে হয় এর জন্য। মান সম্মান কিছু রাখবে না এই মেয়ে আমাদের।

নাজমার রাগ আরো বেড়ে গেল কারণ গোধূলি জেদ ধরে রেখেছে। একটাবার বলছে না যে আমার ভুল হয়ে গেছে। বরং চুপ করে থেকে মার খেয়ে যাচ্ছে।

রাত্রি হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিলো নাজমাকে। তরফদার সাহেব বললেন,

এটা নিয়ে চিৎকার করে আর লোক জানিওনা নাজমা। গোধূলি, আমি সাফ বলে দিচ্ছি যেইটা আজ করেছো হয়ত না বুঝে ভুলে করেছ। আর যেন এমন না হয় কখনো।

রাতে খাবার টেবিলে আসেনি গোধূলি। নিজের ঘরে শুয়ে রইল। নাজমা বা তরফদার কেউই মেয়েকে ডাকলেন না।

কিন্তু রাত্রি খেতে বসলো না। ও বোনকে ডাকতে এলো।

গোধূলি খেতে আয় আপুনি।

গোধূলি জবাব দিলো না।

রাত্রি গিয়ে পাশে বসে মাথায় হাত রাখল।

চল মনি, তোকে খাইয়ে দিব।

যাওতো আপা। বিরক্ত করো না।

এমন করিস না। মা বাবার ওপর রাগ করে না খেয়ে থাকবি? তোর ভালোর জন্যই তো শাসন করল।

আমি কি খারাপ করেছি। ঐ ছেলে আমাকে পছন্দ করল এটা কি দোষের কিছু?

তোরতো এখনো বিয়ের বয়স হয়নি এজন্যই বাবা মা রাগ করেছেন।

আসলে সেটা না, তোমাকে পছন্দ না করে আমাকে পছন্দ করেছে এটার জন্যই রাগ ওনাদের। ছোট থেকেই তো দেখছি তোমাকে সবাই সবসময় বেশি আদর করে। আমার জন্য কারো কোনো মায়া নেই। সবাই আমাকে হিংসা করে।

এসব কি বলিস। তুই ছোট, এখনো নিজের ভালোমন্দ বুঝিসনা। তাই সবাই একটু শাসন করে।‌ সব মা বাবাই ছেলেমেয়েদের ভালো চায়। তোর ভালোর জন্যই মা বাবা চিন্তা করছে। আর এজন্য তুই যেন কোনো ভুল না করিস তাই বকা দিয়েছে। তোর এখন লেখাপড়া করার বয়স। বিয়ে-শাদি ,পছন্দ-অপছন্দ এসব নিয়ে এখন ভাবিস না।

শোন আপা, আমি এতোটাও ছোট না যে নিজের ভালো মন্দ বুঝতে পারবো না। আসলে তোর হিংসা হচ্ছে। তোকে পছন্দ না করে আমাকে পছন্দ করেছে এটাই হলো আসল সমস্যা। এতো ভালো একটা ছেলে তোমাকে পছন্দ না করে আমাকে পছন্দ করল খারাপ তো লাগার কথাই।

রাত্রি বুঝল এখন গোধূলি রেগে আছে। ছোট মানুষ,বুঝজ্ঞান কম। তাই উলটা পালটা বলছে। রাগ কমলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ও বলল,

এমন কিছুই না,তুই এখন ঘুমা। আমি মা বাবাকে বুঝিয়ে বলব। এসব নিয়ে যেন অযথা রাগারাগি না করেন। মা মেরেছে বলে তুইও ভুলভাল ভাবছিস। রাগ কমলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

রাত্রি ওয়াশরুমে চলে গেল। নামাজ পড়ে তারপর ঘুমাবে। এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না।

গোধূলি উঠে বসল।‌ আপার মোবাইলটা বিছানায় রাখা। ও উঁকি দিয়ে দেখল বাথরুমের দরজা লাগানো। চট করে সাব্বিরের দেয়া নাম্বারে মেসেজ দিল।

কাল ছুটির পরে স্কুল গেটে আসবেন। এটা আপার নাম্বার। রিপ্লাই দেবার দরকার নেই।

মেসেজ সেন্ড করে সেন্ড অপশনে গিয়ে ডিলিট করে ফোনটা জায়গায় রেখে শুয়ে পড়ল গোধূলি। রাত্রি বুঝতেই পারলো না কিছু।

পরদিন ছুটির পরে সাব্বির আসল স্কুল গেটে।

গোধূলি এগিয়ে এসে বলল,

চলুন কোথাও গিয়ে বসে কথা বলি।

সাব্বির বাইক দেখিয়ে বলল,

উঠে বসো।

সাব্বির একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে নামল।

গোধূলি শুরুতেই বলল,

কাল বাসায় অনেক ঝামেলা হয়েছে।

কি হয়েছে?

আপনি নামিয়ে দিলেন।‌ বাসায় জেনে গেছে। আমাকে ভীষণ মারধর করেছে।

কি বলো। গায়ে হাত তুলেছে?

হুম। আর বাবা বলেছে আমাকে বাড়িতে রাখবে না। মামার ওখানে পাঠিয়ে দেবে।

তাহলেতো সমস্যা হয়ে গেল?

এখন কি করব।

হুম দেখছি কি করা যায়‌।

আসার সময় সাব্বির একটা প্যাকেট দিলো গোধূলির হাতে।

এটা রাখো।

কি এটা?

খুলে দেখো।

গোধূলি খুলে দেখল একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল।

এটা কেন। আর তাছাড়া বাসায় কি বলব?

এটা দিয়ে আমার সাথে কথা বলবে, মেসেজ দিবে,ভিডিও কল করবে। আর বাসায় বলবে না। লুকিয়ে রাখবে।

এমা! একটা আস্ত ফোন লুকিয়ে রাখা যায়?

বেশিদিন রাখতে হবে না। খুব জলদি আমরা বিয়ে করব।
সত্যি!

হুম, তোমাকে তো কাল বললাম যে নিজেরাই বিয়ে করব। তারপর তোমাকে আর ঐ বাসায় থাকতে হবে না। তুমি এখন থেকেই তৈরি থেকো। আমি সব ব্যবস্হা করছি। আমি বললে বের হতে পারবেতো?

হুম পারব।

গুড। এখন সোজা বাসায় যাও। সবাইকে বলবে তুমি বুঝতে পারোনি। ভুল হয়েছে। আর কখনও এমন কিছু করবে না। মাফ চাইবে।

মাফ চাইব কেনো!

আরে নাহলে সন্দেহ করবে তো।

ও ঠিক বলেছেন।

আর এমন আপনি আপনি করলে কি হবে? তুমি করে বলতে হবে আমাকে।

আচ্ছা ধীরে ধীরে হবে।
সাব্বির মিটমিট করে হেসে বলল,

কত ধীরে।

ফোনে বলব।

আচ্ছা মানলাম।

গোধূলি বাসায় গিয়ে কাউকে কিছু বললো না। নিজের মতো চুপচাপ থাকল। ওকেতো আর সত্যি সত্যি মামার ওখানে পাঠানোর কথা হয়নি। ও নিজেই বানিয়ে বলেছে সাব্বিরকে। একটু জলদি যেন বিয়ের চেষ্টা করে ছেলেটা।

পরদিন স্কুলে ঢোকার মুখে রিয়াদ গোধূলির পথ আটকালো।

কি অবস্থা,কেমন আছো?

এইতো ভালো।

হুম ভালো তো থাকার কথাই। নতুন মাল জোগাড় করছো দেখলাম। বাইকে করে রোজ হুস করে হাওয়া হয়ে যাচ্ছো রোজ রোজ। আর আমি বললে সময় হয়না তোমার।

একদম বাজে কথা বলবে না। এসব কি ভাষা?

ও তুমি একজনকে ব্লাফ দিয়ে আরেকজনের সাথে ঢলাঢলি করছো আর মানুষ বলতেও পারবে না?

উনি আমার আত্মীয়।

হুম জানি তো। বড় বোনের সাথে বিয়ের কথা চলছিলো কিন্তু মালটা তোমাকে পছন্দ করছে। হাজার হোক কচি জিনিস তুমি।

একটা বাজে কথা বললে তোমার বোনের কাছে বিচার দেব।

ওহ হো ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তা তোমার নতুন না*ঙ আমার কথা জানে না?

তোমার কথা আবার কি জানবে। তোমার সাথে আমার কি এমন সম্পর্ক যে সেটা সবাইকে জানাতে হবে। তুমি শুধু আমার বন্ধুর বড় ভাই। আর আমারো ভাইয়ের মতো।

ও এখন আমি ভাই হয়ে গেলাম। নতুন ভাতার পেয়ে আমাকে ভাই বানিয়ে ফেললা।

তুমি বারবার অপমান করছো। উনার সাথে কিছু নাই আমার। বড় আপার সাথেই বিয়ের কথা চলছে ওনার সাথে।

ও তাহলেতো ভাইরা ভাইয়ের সাথে পরিচিত হতেই হবে।

এসব করতে হবে না। আমি পরিচয় করিয়ে দেব সব ঠিক হলে।

তাহলে আজ আমার সাথে চলো বাইরে।

আজ না। অন্য দিন।

অন্য দিন আর হবে না তোমার। ঠিক আছে যাও।

গোধূলি চট করে চলে গেল স্কুলের ভেতর।

রাতে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সাব্বিরের দেয়া ফোন অন করল গোধূলি। অন হতেই দেখল সাব্বির মেসেজ পাঠিয়েছে।

বৌ কি করছ। ফোন অন করে কল দিও।

গোধূলি মেসেজ পড়ে লজ্জায় লাল হলো।

ও মেসেজ দিলো।

সাব্বির সাথে সাথে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিল। হঠাৎ রিং বেজে ওঠায় গোধূলি ফোন অফ করে দিল।

সাব্বির আগেই ঐ নাম্বারে আইডি খুলে সব সেট করে রেখেছে। গোধূলি জানতো না। একটু পর আবার ফোন অন করে সাইলেন্ট মুডে দিয়ে কল দিলো। ওপাশ‌ থেকে রিসিভ করেই সাব্বির একটা চুমু খেলো গোধূলিকে। তারপর বলল,

আমার ঘুম আসছে না। শুধু তোমাকেই মনে পড়ছে সবসময়। খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে হবে। না হলে পাগল হয়ে যাব আমি।

গোধূলি শুধু হাসল। আস্তে করে বলল,

তুমি একটা পাগলই।

সাব্বির ইয়াহু করে উঠল তুমি ডাক শুনে। তারপর বলল,

এখন তোমাকে কাছে পেলে কি হতো জানো?

কি হতো?

তোমাকে কাছে টেনে,,

এমন সময় রাত্রি বাইরে থেকে বলে উঠল,

এই গোধূলি বাইরে আয়,এত সময় বাথরুমে কি করছিস।
গোধূলি বাই বলে ফোন রেখে দিল।

ফোনটা বুকের ভেতর লুকিয়ে বাইরে এলো গোধূলি। তারপর চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

পরদিন সাব্বির অফিসে কাজ করছিল। অনেকগুলো হিসাব পেন্ডিং হয়ে আছে। আজকের মধ্যে সব মিলিয়ে দিতে হবে। এমন সময় পিওন এসে ওর দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিল।

এটা কি?

একজন আপনার নাম করে দিয়ে গেল।

কুরিয়ার এর অফিস থেকে?

না,এমনি একটা ছেলে দিয়ে গেল।

সাব্বির ভাবল কে আবার এমনি হাতে করে ওর জন্য খামে কিছু দিয়ে যাবে।

আছে এখনও?

না চলে গেছে সাথে সাথেই।

নাম জানতে চাওনি?

না,খুব তাড়াতাড়ি দিয়েই চলে গেল।

আচ্ছা ঠিক আছে।

পিওন চলে গেলে সাব্বির জলদি খামটা খুলল। কোনো চিঠি হবে হয়তো। খাম খুলতেই কয়েকটা ছবি বেরিয়ে পড়ল।

সেসবে গোধূলির সাথে একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। দু’জন কোথাও একটা রেস্টুরেন্টে খুব কাছাকাছি বসে আছে। একটা ছবিতে ছেলেটা পেছনে থেকে গোধূলিকে জড়িয়ে আছে। আরেকটায় গোধূলিকে একহাতে জড়িয়ে ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-০৩

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ৩

সাব্বিরের বাবা জামশেদ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। মা সাবেরা হেলথে চাকরি করেন। বাড়িতে সাব্বির তার পছন্দের কথা বলা মাত্রই সবারই মনমেজাজ খারাপ। সাব্বিরের বাবা ছেলেকে কিছু বললেন না। কিন্তু বৌয়ের ওপর রাগ দেখালেন।

কি এক ছেলের জন্ম দিয়েছ। সারাজীবন শুধু মান সম্মান খেলো আমার। সবসময় সবজায়গাতেই ছোট হতে হয় তোমার ছেলের জন্য। সারাটা জীবন শুধু চাকরি চাকরি করেই কাটিয়ে দিলে। ছেলেকে ঠিকঠাক মানুষ করতে পারলে না।

হুম আমি চাকরি করেতো নিজের একার জন্য সব করেছি। তোমার অল্প আয়ে কিভাবে সংসার চালাতে যদি না আমার বেতনটা হাতে পেতে।

আল্লাহ্ ঠিকই দিন পার করত। কিন্তু টাকা টাকা করে ছেলেটাই মানুষ হলো না। শুধু শিক্ষিত হলেই হয় না, সুশিক্ষিত হতে হয় বুঝলে।‌ ছেলে পড়ালেখা করেছে ঠিকই কিন্তু সত্যিকারের শিক্ষাটা পায়নি।

হুম এখন সব দোষ আমার। ভালোই বলেছ।

ছেলের জন্য ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বেশ মনকষাকষি হলো। জামশেদ ঘটকের কাছে শুনেছেন মেয়ের বাবা যা তা বলেছেন এইরকম করার কারণে। তিনি যে ফোন করে সরি বলবেন সেটাও করা হয়নি। শুধু শুধু একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো।

সাব্বিরের মায়ের মনটাও খারাপ হয়েছে। ওনার খুব ইচ্ছে ছিল চাকরিজীবি মেয়ে দেখে ছেলেকে বিয়ে দেবেন।‌ সাবেরার বোনের মেয়ে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তার সাথে বিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সাব্বিরের বাবার একদম মত নেই নিজেদের ভেতর বিয়ে দেবার। ওনার ইচ্ছাতে মেয়ে দেখা শুরু করা হয়েছে।

রাত্রি মেয়েটা খুব একটা খারাপ ছিলো না।‌ ছবিতে দেখেছেন উনি। তাছাড়া মেয়েটা জব করে।‌ সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। ইনশাআল্লাহ সরকারি চাকরি হয়েও যাবে। এমন মেয়ে বৌ হলে সমস্যা ছিল না।

অথচ তার ছেলে কিনা ঐ মেয়ের ছোট বোনকে পছন্দ করে বসে আছে। মেয়ে পড়ে মাত্র টেনে। বিয়ের পরে পড়াশোনা কতদূর কি করবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই মেয়ে বৌ হয়ে আসলে কিভাবে যে এডজাস্ট করবে আল্লাহ জানেন। সবাইকে বড়মুখ করে কি বলবেন বৌমা কি না পড়ে সবে মাত্র ক্লাস টেনে।

বিষয়টা নিয়ে সাব্বিরের সাথে কথাকাটাকাটি হয়ে গেলো সাবেরার।

এইটা কি হলো। এত বড় হয়ে এমন অবিবেচক এর মতো কাজ কেউ করে। তুমি কি সারাজীবন শুধু জালিয়েই যাবে। শেষ বয়সে এসেও একটু শান্তি দিবেনা আমাদের?

এখানে অশান্তির কি হলো মা, বিয়ে করে সংসার করব আমি তাই আমার যাকে পছন্দ তাকেই কি বিয়ে করা উচিত নয়? আর সবসময় খোঁটা দাও কেনো। পুরোনো কাসুন্দি ঘেটে কি শান্তি যে পাও তোমরা! এখন আমি আর ছোট না যে যখন যা খুশি তাই বলবা? একটু বুঝে শুনে কথা বলতে পারো না?

তুমি লোক হাসানো কাজ করবে, আর বুঝেশুনে কথা বলতে হবে আমাকে! বড়বোনকে দেখতে গিয়ে ওর কমবয়সী ছোট বোনকে পছন্দ করেছো। এটা শুনলেতো সবাই হাসাহাসি করবে। তোমার অভিভাবকরা সবাই দেখে এলো । তুমিও ছবি দেখেইতো যেতে রাজি হলে। তাহলে এখন এমন করলে মুখ থাকে? কি ভাবল লোকগুলো! ছিঃ!

এতো কিছু জানি না। আমার ঐ মেয়েকে পছন্দ হয়নি।‌ হয়েছে ছোটজনকে। বিয়ে করলে ঐ ছোট মেয়ের সাথেই হবে। না হলে ওখানে কথা বলার দরকার নাই। আর এবার থেকে তোমরা দেখার আগে আমি মেয়ের সাথে আগে কথা বলব।

এইটা কেমন কথা। এইটুকু একটা মেয়ের সাথে তোমার এডজাস্টমেন্ট হবে? তোমার ভালো চাই আমরা বুঝেছ, তোমার শত্রু না।

এডজাস্টমেন্ট কেন হবে না। তোমার সাথে বাবার কি সংসার হয়নি?

আগের দিনের কথা বাদ দাও। তোমরা এ যুগের ছেলে মেয়ে। আর তাছাড়া মোহে পড়ে কিছু করোনা। বাস্তব জীবনটা অনেক কঠিন।

এতো কথার কি দরকার বলো।‌ আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। নিজের ভালো মন্দ বুঝতে পারি। তোমাদের মেয়ে দেখতে বলাটাই ভুল হয়েছে। যা করার আমিই করব। তোমাদের আর আমার বিয়েশাদী নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।

কথা শেষ করে নিজের ঘরে ঢুকে ঠাশ করে দরজা লাগিয়ে দিল সাব্বির।

সাবেরা বুঝলেন, ছেলের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তার এই ছেলে ছোট থেকেই জেদি। যা বলবে তাই করে ছাড়বে। ছোট থেকেই নানা রকম অঘটন ঘটিয়ে চলেছে। শুধু তাদের চেষ্টায় পড়াশোনা করেছে। তা নাহলে যে কি করে বেড়াত।

সাব্বিরের বাবা বললেন,

সাবেরা,ছেলে বড় হয়েছে। এখন আর জোর করে ওর ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না। যখন শাসন করার সময় ছিল তখন ছেড়ে রেখেছ। লতোমার ছেলে কোন কালে আমাদের কথা শুনেছে । তার থেকে চুপচাপ থাকো। অযথা তর্ক করতে যেও না। সময়ের কাজ সময়ে না করলে এমনটাই হয়।

সাবেরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কথা সত্য, তিনি সময়মতো ছেলের রাশ টেনে ধরেননি। এখন কিছু হাতে নেই।

সাব্বির ভেবেছিল ঘটককে দিয়ে বলে কয়ে সম্বন্ধটা করতে পারবে। দরকার হল এখন আপাতত আকদ করা থাকবে। পরে পরীক্ষার পর তুলে নেবে। কিন্তু মেয়ের বাবা একেবারেই না করে দিলেন। আর তাছাড়া ওর নিজের বাবা মাও বিষয়টা সহজভাবে নেয়নি।

সাব্বিরের এখন গোধূলির বিষয়টা একটা চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে। পাত্র হিসেবে সে প্রথম শ্রেণীর। তারমতো ছেলে টেনে পড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে এটাতো ঐ পরিবারের ভাগ্য।‌ অথচ মেয়ের বাবা সরাসরি না বলে দিয়েছে। শুধু তাই না নানারকম কটু কথাও বলেছে তার সম্পর্কে ঘটককে। ঘটক বলে দিয়েছে এই বাড়িতে আর তার বিয়ের কথা বলা সম্ভব না। অন্য কোনো মেয়ে দেখাবে। কিন্তু সাব্বিরের এখন আরও বেশি জেদ চেপে গেছে।‌ এই মেয়েকে বিয়ে করবে যেভাবেই হোক। তাই আজ গোধূলির সাথে দেখা করতে এসেছে। মেয়েকে একবার বাগে আনতে পারলে আর কাউকে লাগবে না। আর তারমতো ছেলেকে কোনো মেয়ে সহজে রিফিউজ করতে পারবে না।

দেখা করতে এসে সাব্বির গোধূলির মুখ দেখেই বুঝল যে এই মেয়ে রেগে নেই। বরং ওর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। না হলে দাঁড়িয়ে কথাই বলতো না।

সাব্বির গোধূলির কাছে এসে বলল,

কেমন আছো গোধূলি?

আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনি এখানে! কোনো সমস্যা?

হুম, সমস্যা তো আছে। বাসায় যাচ্ছো?

না, প্রাইভেট আছে, ওখানে যাব।

আজ না গেলে হবে না? তোমার সাথে একটু বসা দরকার।

কেনো?

তুমি শুনেছো তো আমার কাকে পছন্দ হয়েছে।

গোধূলি লজ্জা পেয়ে গেল। বলল,

জ্বি শুনেছি।

তোমার বাসায় সবাইতো ভীষণ ক্ষেপে আছে আমার ওপর। তুমিও কি রেগে আছো আমার ওপর?

না,আমি রাগ করিনি।

তাহলে চলো কোথাও একটু বসে কথা বলি।

গোধূলি একটু ভেবে বলল,

আচ্ছা চলেন।

বাইকে উঠতে সমস্যা নেইতো?

গোধূলি হেসে সাব্বিরের বাইকে উঠে বসল।

ওর ভালো লাগছে। সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সাব্বির এভাবে দেখা করতে আসবে ও ভাবতেও পারেনি। আজ সাব্বিরকে আরও বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে। একটা সাদা টিশার্ট আর নীল জিন্স পরেছে ও। চোখে সানগ্লাস, চুলগুলো এলোমেলো।

সাব্বির বলল,

কাঁধে হাত দিতে হবে। নাহলে পড়ে যেতে পারো।

গোধূলি আলতো করে সাব্বিরের কাঁধে হাত রাখল।

ওরা বসল একটা কফিশপে। সাব্বির গোধূলির পাশেই বসল। গোধূলিকে বলল,

কি খাবে?

একটা কিছু হলেই হবে।

এখানে ভালো কলিজা সিঙ্গারা বানায়। ওটা বলি?

আচ্ছা।

সাব্বির সিঙ্গারা আর কফি দিতে বলে গোধূলির দিকে ফিরল। কোনো ভনিতা ছাড়াই সরাসরি বলল,

বিশ্বাস করো আমার কোনো দোষ নেই। সেদিন তোমাকে দেখেই আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল।এত মিষ্টি একটা মুখ, তোমার হাসি,চোখ সবটা আমাকে পাগল করে দিয়েছে গোধূলি। আমি জানি তুমি অনেক ছোট। কিন্তু আমার মন সেসব ভাবেনি। আমি শুধু তোমার মাঝে হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। বলো এটা কি আমার দোষ?

সাব্বির এর মুখে এসব শুনে গোধূলির মাঝে অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল। ওর ভীষণ ভালো লাগছে। এমন সুপুরুষ কারো মুখে এভাবে নিজের সৌন্দর্যের কথা শুনতে অন্যরকম লাগছে। এই এতো বড় একটা মানুষ কিনা তার জন্য পাগল হয়ে গেছে।

গোধূলিকে চুপ দেখে সাব্বির বুঝল তার কথায় কাজ হচ্ছে। সে আবারো বলতে শুরু করল,

ন্যায় অন্যায় উচিত অনুচিত কিছুই কাজ করছে না আমার। শুধু তোমাকেই ভাবছি সবসময়। আচ্ছা আমি কি বেশি বুড়ো, তোমার পাশে কি এতোটাই বেমানান?

একটুও না। আপনি অনেক হ্যান্ডসাম।

গোধূলির প্রশ্রয় পেয়ে সাব্বির ওর হাত দুটো ধরল।

প্লিজ গোধূলি,এখন সব তোমার ওপর নির্ভর করছে। তোমার আমার বাসায় কেউ চায় না তোমাকে আমি বিয়ে করি। এখন তুমি বললেই আমরা নিজেরাই কিছু করতে পারি। তুমি যদি বলো তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাব। তোমাকে এতো সুখে রাখব তুমিও শুধু আমাকেই চাইবে।

গোধূলির ইচ্ছে করছে রাজী হয়ে যেতে। কিন্তু এতো সহজেই হ্যা বলাটা ঠিক হবে না। একটু ভাব ধরে রাখতে হবে। তাই গোধূলি বলল,

আচ্ছা আপনি বাসায় এসে বাবাকে সরাসরি বলতে পারেন তো।

উনি মানবেন না।‌ ঘটক আমাকে বলেছে।

তাহলে?

তোমার আমাকে পছন্দ হয়নি?

হয়েছে।

তাহলে সমস্যা কোথায়।‌ চলো আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি।

একা বিয়ে করব!

গোধূলি ইচ্ছে করেই অবাক হবার ভান করল। আসলে সে নিজেও এমন কিছু শুনতে চেয়েছিল।

হুম,তবে আমার বন্ধুরা থাকবে। তোমার কেউ থাকলে তাকেও আনতে পারো।

কিন্তু বাবা কখনো মানবে না। মেরেই ফেলবে। এটা করাটা একদম ঠিক হবে না।

একবার তুমি আমার বৌ হয়ে যাও,তারপর তোমাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না। তখন তুমি শুধু আমার।

আমিতো ছোট। বড়দের না জানিয়ে এত বড় কাজ করা ঠিক হবে না। নিজের ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয়নি এখনও।

এবার সাব্বির আর একটু কাছে এসে গোধূলির কানের পাশের চুল সরিয়ে দিয়ে মুখটা কানের কাছে নিয়ে বলল,

একবার কবুল বলো, তোমাকে বড় বানিয়ে দেবার সব দায়িত্ব আমার।

সাব্বির এতো কাছে চলে আসায় গোধূলি কেঁপে উঠল। সাব্বির গোধূলির হাতদুটো তুলে নিয়ে চুমু খেলো আলতো করে।

বাইকে করেই গোধূলিকে বাসায় নামিয়ে দিলো সাব্বির।
একই সময়ে গোধূলির ফুফাতো ভাই তমাল ওদের বাড়িতেই আসছিল। সে গোধূলিকে সাব্বিরের সাথে দেখে ফেলল।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-০২

0

অমানিশা

পর্ব : ২

রাত্রির বাবা ভীষণ রেগে গেলেন। একদিন এসে মুরুব্বিরা মেয়েকে দেখে পছন্দ করে গেলেন। আবার ছেলে রাত্রির ছবি দেখে পছন্দ করেছে। তারপরেও দেখতে এসে বড় মেয়েকে রেখে ছোট মেয়েকে পছন্দ করেছে ছেলে। তার ছোট মেয়ের এখনও বিয়ের বয়সই হয়নি। কি একটা বিশ্রী ঘটনা। সব রাগ উনি ওনার বোনের ওপর ঝাড়লেন,

কিসব ছেলের সম্বন্ধ আনো তুমি রেবু। কত বড় বেয়াদব ছেলে! একজনকে দেখতে এসে আরেকজনকে পছন্দ করে ছবি দেখার পরেও। আর তার ওপর বয়সে এত বড় হয়ে, শিক্ষিত হয়ে একটা নাবালিকা মেয়েকে পছন্দ করেছে!

রাত্রির ফুফু রেবু বলল,

আমার কি দোষ। আমাকেও তো ঘটক খোঁজ দিয়েছে ছেলের। অল্প জানাশোনা দিয়ে কি মানুষের ভেতরটা কেমন তা বোঝা যায় ভাইজান? আমিতো ভালো ভেবেই এগিয়েছি।

এসব ঘটক দিয়ে আসলে হবে না।‌ সব খালি টাকার ধান্দায় থাকে।

তো এখন কি করবেন?

কি করব মানে! এই বেয়াদব ছেলের সাথে আর কোনো কথা নাই। অন্য জায়গায় ছেলে দেখব। তোর ঐ ঘটকের আনা ছেলে আর দেখার দরকার নাই। এবার থেকে নিজে খোঁজ না নিয়ে মেয়ে দেখাবো না আমি।

আমিও সেটাই বলি। নিজেরা খোঁজ নিয়ে এগোতে হবে। এভাবে কতবার আর মেয়েকে ছেলেপক্ষের সামনে বসাব। আমাদের মেয়েতো আর ফেলনা না। ছিঃ ছিঃ! এ যুগেও এমন কেউ করে নাকি। বড়টাকে রেখে ছোটজনকে পছন্দ করেছে। আর তাছাড়া গোধূলি বাচ্চা মেয়ে। বয়স হলে না হয় মানা যেত।

নাজমা বললেন,

উহু বড় হলেও মানা যেতো না।‌ এই ছেলের নিয়ত আসলে খারাপ। ছবি দেখল তারপরেই না দেখতে আসছে। এখানে এসে আরেকজনকে দেখে মত পালটে ফেলল। বিয়ে হলে দেখা যেত পরে আবার অন্য কাউকে দেখে বৌকে আর ভালো লাগছে না।

ঠিকই বলেছো ভাবি। ঘটককে সোজা না করে দিচ্ছি আমি।

হুম তাই দাও। মেয়েতো আর পানিতে পড়েনি যে যার তার সাথে বিয়ে দিতে হবে।

যার মন বেশি খারাপ হবার কথা সেই রাত্রি একদম স্বাভাবিক আছে। ও ভাবল ভালোই হয়েছে। এমনতো হতেই পারে। এভাবে সময় চলে যাক। একটা সরকারি চাকরি পর্যন্ত বিয়েটা আটকে থাকুক। আর গোধূলিকে পছন্দ করেছে এটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু না। গোধূলিকে দেখে ওর বয়স সম্পর্কে আন্দাজ করা যায় না। বয়সটাই এমন যে একটু সাজলেই বড়দের মতো দেখায়।

নাজমা ভাবলেন মেয়ের মনে হয় মন টন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তাই উনি রাত্রির কাছে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

আজ স্কুল যাবি ?

হুম যেতে হবে। কালতো ছুটি নিলাম। কেনো কি হয়েছে?

না,আজ রেস্ট নিতি। তোর ফুফুর ওখানে যা বরং। মন ভালো হবে।

আমার মনতো খারাপ হয়নি। শুধু শুধু ছুটি নিবো কেনো!

আমি জানি তুই ছোট থেকেই এমন। খুব চাপা স্বভাবের। কষ্ট পাসনা মা। ঐ ছেলে আসলে ভালো না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।

হুম। তবে আমি কষ্ট পাচ্ছি না মা। তুমি টেনশন করিও না তো।

নাজমা ভাবলেন মেয়ে হয়তো তার কাছে বলছে না কিন্তু খারাপ তো লাগাটাই স্বাভাবিক। ওকে রেখে ছোট বোনকে পছন্দ করেছে।‌ এটা ভালো লাগার মতো কোনো বিষয় না। বরং অপমানজনক। মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানালেন যে বাজে মানসিকতার এই ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়েটা হয়নি । এটাই ভালো হয়েছে। এরপর থেকে ছেলেপক্ষের সামনে গোধূলিকে যেতে দেবেন না এটাও ঠিক করলেন।

গোধূলিকে গতরাতেই খুব করে বকেছেন নাজমা।

সব দোষ এই মেয়ের। কে বলেছিল আগ বাড়িয়ে ঐ ছেলের সাথে কথা বলতে। আর এতো সাজগোজ করার কি দরকার ছিল। সবসময় সবকিছুতে পাকনামো না করলে হয় না তোমার?

আমি আবার কি করলাম। শুধু শুধু আমাকে কেনো বকছো মা?

শুধু শুধু বকছি? তোর জন্য কত বাজে একটা কাহিনী হলো। তোকে না দেখলেতো এসব কিছু হতো না।

আমাকে আগেই বলে দিতা,তাহলেইতো আমি যেতামনা ওদের সামনে।

সেটাই ভুল হয়েছে আমার।

মায়ের বকা খেলেও গোধূলির মন কিন্তু অতটা খারাপ হলো না। পাত্র যে আপাকে পছন্দ না করে ওকে পছন্দ করেছে এটা বরং ও উপভোগ করছে। বিষয়টা একটু অন্যরকম হলেও গোধূলির কিন্তু বেশ ভালো লাগল। সাব্বির ছেলেটা দেখতে শুনতে বেশ ভালো।‌ বয়স একটু বেশি কিন্তু এই বয়সের ছেলেরা অন্যরকম সুন্দর। এতদিন যাদের‌ সাথে সম্পর্ক করেছে তারা সবাই ছেলে ছোকরা টাইপ। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটু ভারী বয়সে ছেলেদের আসল পুরুষ মনে হয়। এতদিন এইভাবে কখনো ভাবেনি গোধূলি কিন্তু যখন থেকে শুনেছে যে সাব্বির আপাকে না, ওকে পছন্দ করেছে তখন থেকেই সাব্বিরকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।

সাব্বিরের কথা,হাসিমুখ,ওর কাছে কোন ক্লাসে পড়ে সেটা জানতে চাওয়া সবদৃশ্য নতুন করে কল্পনায় দেখছে। আর এখন মনে পড়ছে বেশ‌কয়বার সাব্বির ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।‌ দু’জনের চোখাচোখি হয়েছে। তখন না বুঝলেও এখন বেশ বুঝতে পারছে যে ছেলেটা ওকেই দেখছিল। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো ওর সেসব খারাপ না লেগে ভালো লাগছে।‌ মনের মধ্যে অজানা এক অনুভূতি দোলা দিয়ে যাচ্ছে।

খুব গোপনে ও ভেবেও নিয়েছে যে বাবা বিয়েতে রাজি হয়ে গেছেন। ওর সাথে সাব্বির ছেলেটার বিয়ে হচ্ছে। পুরো বাড়িতে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনে বাড়িটা গমগম করছে। সুন্দর একটা লেহেঙ্গা পরেছে ও। পার্লার থেকে টুকটুকে বৌ সেজে এসেছে।‌সবাই খুব প্রশংসা করছে নতুন বৌয়ের।‌ সাব্বির বাসর ঘরে ওর ঘোমটা তুলে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। আরো অনেক কিছু ভেবে ভেবে ভীষণ ভালো লাগায় শিহরিত হচ্ছে গোধূলি।

অথচ বাসায় সবাই এমন রেগে আছে মনে হয় যেন ওকে পছন্দ করে মহাপাপ করে ফেলেছে ছেলেটা। ও কি পছন্দ করার মতো মেয়ে না। আপার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর ও। বয়স একটু কম কিন্তু আগেকার দিনে তো বর বউয়ের বয়স অনেক কমবেশি হতো। ওর দাদির যখন বিয়ে হয় তখন ওনার বয়স ছিল মাত্র বারো,আর তখন ওর দাদার বয়স ছিল ত্রিশ। তখন যদি এমন হতে পারে তাহলে এখন হলে দোষ কোথায়। আর তাছাড়া ওতো এতোটাও অবুঝ না। সব বোঝে,সব জানে। নারী পুরুষের সম্পর্কের গভীর,গোপন সবটাই জানা ওর।‌ ওর সব বান্ধবীদের কাছেই স্মার্ট ফোন আছে।‌ সেসবে সবকিছুই দেখা যায়। একদিন তনিমা লুকিয়ে ওর ফোন এনেছিল প্রাইভেটে। সেখানে ওরা কয়জন মিলে একটা এডাল্ট সাইটে ঢুকে কিছু ভিডিও দেখেছে।

গোধূলির পড়াশোনাতে একদম মন বসে না। মুখস্থ করতে সবথেকে বেশি বিরক্ত লাগে। ইশ! বিয়ে হলে অন্তত এসব পড়াশুনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। ওর সাথে পড়ত রিয়া নামের এক মেয়েরতো এইট পাশ করেই বিয়ে হয়ে গেলো নিজের চাচাত ভাইয়ের সাথে। রিয়া এখন সংসার করছে। পড়াশোনা আর করছে না। বেশ ভালোই আছে।

আসলে বাবা মার সমস্যা হলো আপাকে পছন্দ করেনি এখানেই। এখন এই ছেলেকে খারাপ বলছে। অথচ আপাকে পছন্দ করলেতো এর সাথেই বিয়ে দিতো আয়োজন করে।‌ সবসময় ওর সাথে এমন হয় এ বাড়িতে।

রাত্রি ভীষণ স্বাভাবিক আছে। গোধূলি ভেবেছিল আপা ওর ওপর রেগে আছে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। সকালে রাত্রি খেতে বসে গোধূলিকে ডেকে বলল,

এই তোর পরীক্ষা কবে? পড়াশোনা কর ভালো করে।

পড়ছি আপা।

কোনো বিষয় বুঝতে সমস্যা হলে আমাকে বলিস।

ঠিক আছে।

আজ স্কুল নেই?

আছেতো।

চল তোকে নামিয়ে দিয়ে যাব।

আচ্ছা চলো। আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।

দুই বোনকে একসাথে বেরুতে দেখে নাজমা হাফ ছাড়লেন। যাক সবকিছু ঠিক আছে। ওনার বড় মেয়েটা ভীষণ লক্ষী একটা মেয়ে। কোনো কিছু নিয়ে কখনো অশান্তি করেনা। সুন্দর করে ম্যানেজ করে নেয় । গোধূলি ছোট তাই একটু জেদী। একটু বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। বড় বোনের কাছে কিছু হলেও তো শিখবে দেখতে দেখতে। তিনি মনে মনে বললেন,

আলহামদুলিল্লাহ সবকিছুর জন্য।

গোধূলিকে স্কুলগেটে নামিয়ে হাতে একশ টাকার একটা নোট দিলো রাত্রি।

কিছু খেয়ে নিস টিফিনে।

টিফিন নিয়েছিতো।

আচ্ছা ঠিক আছে।‌ ছুটির পর বাইরে থেকে ফুচকা খাস বন্ধুদের নিয়ে।

ঠিক আছে আপা।

রাত্রি রিকশা নিয়ে চলে গেল। ওর মনটা আজ হালকা লাগছে। এখুনি বিয়ে হলে অনেক নতুন নতুন ঝামেলা পোহাতে হবে। এই মুহূর্তে বাবার বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না ওর। যদিও বাবা মায়ের কথায় বিয়ে করতে রাজি হয়েছে কিন্তু পাত্রপক্ষের সামনে বসলেই কেমন একটা মানসিক চাপ কাজ করে। এই বুঝি সব ঠিক হয়ে বিয়েটা হয়ে যাবে।
ওর জন্য গোধূলি বেচারিকে কাল মায়ের বকা খেতে হলো। ওর নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে। তাই আজ বোনকে সাথে করে স্কুলে দিয়ে গেলো ও। যদিও এখন অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে ওকে। গোধূলির স্কুল একদিকে আর ওর স্কুল অন্য একদিকে।

রিয়াদ স্কুলের একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। রাত্রি চলে যেতেই ডাকল গোধূলিকে,

এই গোধূলি,এই।

অন্যদিন হলে গোধূলির ভালো লাগত কিন্তু আজ একটু বিরক্ত লাগল রিয়াদকে দেখে।

রিয়াদ কাছে এসে বলল,

তোমার আপা নামিয়ে দিলো আজ হঠাৎ!

এমনিই এসেছে।

এই আজ স্কুল বাদ দাও। চলো একটা জায়গায় যাব।

আজ না। অন্য একদিন যাব।

আজ কি সমস্যা?

সমস্যা নাই।

তাহলে আজকেই চলো।

গোধূলির একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। ও বানিয়ে বলল,
আপা নিতে আসবে দুই ক্লাস পরে।

কেনো, কোথাও যাবে?

বাসায় একটু কাজ আছে।

ও আচ্ছা। ঠিক আছে যাও। কাল সময় দিও।

আচ্ছা দেখি।

গোধূলি আর দাঁড়ালো না। তাড়াতাড়ি করে গেটে ঢুকে পড়ল।
ক্লাসে গিয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে গতকালের ঘটনা খুব খুশি মনে খুলে বলল। ছেলে যে ভীষণ হ্যান্ডসাম,ওকেই বিয়ে করতে পাগল হয়ে গেছে এভাবে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলল। এটা যে এতো ফলাও করে বলার মতো বিষয় না সেটা ওর মাথায় এলো না। ব্যাগ থেকে সাব্বিরের ছবি বের করে দেখালো বন্ধুদের। রাত্রিকে যেই ছবি দেয়া হয়েছিল ওটা গতরাতে সরিয়ে রেখেছে ও।

সবাই দেখে খুব প্রশংসা করল। একজন বলল,

ওমা! সত্যি তো ছেলেটা হেব্বি দেখতে। কিন্তু বয়স তো বেশি।

আরেকজন বলল,

আরে স্টাবলিশ ছেলেদের বয়সতো বেশিই হবে একটু।

গোধূলির ভীষণ ভালো লাগল। ছুটির পর বাইরে এসে রিকশায় উঠবে এমন সময় পেছন থেকে কারো ডাক শুনে থামল গোধূলি। অবাক হয়ে দেখল সাব্বির একটা বাইকে বসে আছে। মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসছে গোধূলির কাছে।

(চলবে)

অমানিশা পর্ব-০১

0

ধারাবাহিক গল্প
অমানিশা
পর্ব : ১

আজ ছেলেপক্ষ আসবে রাত্রিকে দেখতে। ছেলেপক্ষ বলতে ছেলে তার দু’জন বন্ধু সহ আসবে।‌ ছেলের বাবা, বড় বোন, দুলাভাই,মামা আগে একদিন এসে দেখে গেছে । মেয়ে পছন্দ হয়েছে ওনাদের। ছেলে সেবার ছুটি পায়নি বলে আসতে পারেনি। আজ ছেলে মেয়ে দু’জন দু’জনকে দেখে নিলে কথা এগোবে। দিনতারিখ ঠিক করা হবে।

ছেলে অবশ্য বাইরে কোথাও বসতে চেয়েছিল। কিন্তু রাত্রির বাবার সেসব পছন্দ না। উনি মেহমানদের বাড়িতেই আসতে বলেছেন। মা গতকাল রাতে যখন রাত্রিকে বললেন,

কাল ছুটি নিস। কাল সাব্বির আসবে তোকে দেখতে।

রাত্রি অবাক হয়ে বলল,

কোন সাব্বির?

আরে ঐযে তোর বিয়ের কথাবার্তা চলছে যার সাথে।

ছেলের নাম যে সাব্বির এটাই রাত্রি জানতো না। একবার শুনেছে কিন্তু ওর মনেই নেই। এদিকে মা এমন করে নাম ধরে বলছেন মনে হয় কতদিনের চেনা এই ছেলে।

রাত্রি মাথা নেড়ে শুধু বলেছে,

ও আচ্ছা,আচ্ছা ছুটি নেব।

এই মুহূর্তে বিয়ে নিয়ে খুব একটা আগ্রহ নেই রাত্রির।
একটা নামকরা বেসরকারি স্কুলে ম্যাথের টিচার হিসেবে জয়েন করেছে মাস তিনেক হলো। মাস্টার্স শেষ হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করছে। এর মাঝেই বাসা থেকে বিয়ের জন্য ছেলে দেখা চলছে। এ পর্যন্ত চারবার পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হয়েছে। নানা কারণে সেসব সম্পর্ক এগোয়নি। বাসায় সবাই চাইছে বিয়েটা দিয়ে দিতে। বয়স বেড়ে চলেছে।‌ এই দেশে মাস্টার্স পাস করলেই মেয়েদের বুড়ি মনে করা হয়। রাত্রির মাস্টার্স শেষ হয়েছে প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। ওর ইচ্ছে একটা ভালো কোনো জব হলে তারপর বিয়ের কথা ভাববে। কিন্তু মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছে । জীবনে কখনো মা বাবার ইচ্ছের বাইরে কিছু করেনি । মা বাবার লক্ষী মেয়ে হিসেবে বরাবরই ভীষণ আদরের ও।

এই সম্বন্ধটা এনেছে রাত্রির ফুফু। এই পাড়ার উত্তর দিকে বড় রাস্তার ওপাশেই ওর ফুফুর বাসা।

রাত্রির বাবা তরফদার হোসেন একজন কৃষি কর্মকর্তা। তার চাকরি প্রায় শেষ দিকে। মা নাজমা হোসেন গৃহিণী। রাত্রিরা দু’বোন, রাত্রি বড়। ছোট বোন গোধূলি ওর নয় বছরের ছোট। নাটোর জেলা শহরে প্রায় আট শতাংশ জমি কিনে তিন বেডরুমের একটা একতলা বাসা করেছেন তরফদার হোসেন। পেনশনে গেলে দোতলার কাজে হাত দেবেন। মেয়েদের বিয়ের জন্য আলাদা করে টাকা রাখা আছে ব্যাংকে। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার।

আজ যেই ছেলেটা আসবে সে একটা বেসরকারি কলেজের একাউন্টেন্ট। দেখতে শুনতে বেশ ভালো।

ঘটকের দেয়া ছবি দেখেছে রাত্রি। প্রথম দেখাতেই ভালো লাগার মতো দেখতে।

অবশ্য রাত্রিও দেখতে বেশ মিষ্টি। হাইট ভালো। আজকাল বাঙালি মেয়েদের হাইট এতো ভালো হয় না।

নাজমা হোসেন রান্নাঘরে ব্যস্ত। মেহমানদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করতে হবে। শুধু নাশতা পানি দিয়ে মেহমান বিদায় করতে নারাজ উনি। ওনার কথা হলো বিয়ে হোক বা না হোক সেটা পরের কথা। ওনারা মেহমান। ওনাদের যেন আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি না হয়।

রান্না মোটামুটি শেষ। শুধু পোলাওটা বাকি আছে। মেহমান আসলে পরে ওটা বসাবেন।

গোধূলিও আজ বাড়িতে আছে। মুখে চন্দন লাগিয়ে ঘুরছে। রাত্রির থেকেও ওকে বেশি খুশি মনে হচ্ছে। লেখাপড়ার থেকে সাজগোজের দিকে বেশি ঝোঁক গোধূলির। যেকোনো ছুতো পেলেই হলো।‌

গোধূলি ক্লাস টেনে উঠেছে এবার। একেবারেই পেছনের সারির ছাত্রী। পড়াশোনায় একদম অমনোযোগী। বান্ধবী তরীর কলেজ পড়ুয়া বড় ভাই রিয়াদের সাথে রিলেশন চলছে আজকাল । সিরিয়াস কিছু না। ঐ যে আজকাল একটা রিলেশনে থাকতে হয় সেইরকম কিছু। এর আগে দু’জনের সাথে ব্রেক আপ হয়েছে।

নাজমা বেগম এর মাঝেই দু’বার ধমক দিয়েছেন মেয়েকে।
তোকে এত সাজতে কে বলেছে। এসে আমার সাথে একটু কাজ কর।

গোধূলি মুখ বাকায়ে বলেছে,

বাসায় লোকজন আসবে আর আমি কি ফকিরের মতো ঘুরব নাকি?

তোমাকে দেখতে তো আসছে না। খালি পাকনামো। আর আজকে ওসব জিন্স ফিন্স পরবি না বলে দিচ্ছি। একটা ভদ্র মতো কিছু পরবি।

জিন্স অভদ্র পোশাক তোমাকে কে বলল।

শুধু মুখে মুখে কথা। যা বলছি তাই কর।

নাজমা বেগমের মেজাজ খারাপ হলো।‌ কিন্তু চুপ করে গেলেন। মেজাজ খারাপ হলে ওনার রান্না খারাপ হয়। তার এই মেয়ে হয়েছে অন্যরকম। সবসময় তিনি যা বলবেন তার বিপরীত কিছু করাই যেন গোধূলির কাজ। তিনি যদি ডানে বলেন তো মেয়ে যাবে বামে। বড় মেয়ের বেলায় এত ঝামেলা পোহাতে হয়নি।‌ কিন্তু এই মেয়ে তাকে জ্বালিয়ে মারছে।
নাজমা বেগম রান্নায় মন দিলেন।

গোধূলির মুড খারাপ হয়ে গেল। ছোট থেকেই মা রাত্রি আপুকে বেশি ভালোবাসে। এ বাড়িতে সবসময় বড় আপার গুনগান চলে। কোনো কিছু করতে গেলেই বাবা বড় আপার মত নেয়। অথচ ওকে কেউ দাম দেয় না। নিজের পোশাকটাও ইচ্ছে মত কিনতে পারে না গোধূলি। পড়াশোনায় না হয় একটু খারাপ তাই বলে সবসময় ওকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কেনো সবাই। বড় আপার সাথে তুলনা করে ওকে বোঝানো হয় যে ও একটা অপদার্থ।

যাকগে এসব নিয়ে মনখারাপ করে থেকে লাভ নেই। গোধূলি বড় আপার কাছে গেল।

আপা তুই সাজতে যাবি না?

কোথায় যাব?

পার্লারে।

কি যে বলিস। পার্লারে যেতে হবে কেনো!

এখনতো সবাই যায়। হালকা মেকআপ নিলে ভালো লাগবে।

শোন,আমি যেমন তেমনটাই যদি পছন্দ হয় সেটাই ভালো না? শুধু শুধু কৃত্রিম ভাবে সুন্দর সেজে কি লাভ,আমিতো স্টার জলসার সিরিয়ালের মতো রাতদিন সাজগোজ করে বেড়াবোনা বিয়ের পর। তাছাড়া সেজেগুজে কাউকে ইমপ্রেস করতে আমার মন সায় দেয়না।

গোধূলির ইচ্ছে ছিল আপার সাথে পার্লারে গিয়ে ও একটু মেকাপ করবে। তারপর কোনো একটা ছুঁতোয় ঘন্টাখানেকের জন্য রিয়াদের সাথে ঘুরতে বের হবে। এভাবে সেজে কখনো দেখা করেনি। সবসময় স্কুল এর পোশাক পরেই বের হয়েছে। রিয়াদ অবশ্য এমনিতেও ওর জন্য পাগল। একটু খাই খাই ভাব আছে। সেজে সামনে গেলে আরও পাগল হবে। এসব ভালোই লাগে গোধূলির। ছেলেটা অবশ্য একটু ছোঁক ছোঁক স্বভাবের। শুধু শরীরে হাত দিতে চায়। ওর অবশ্য খারাপ লাগে না সেসব। বরং আরো বেশি কিছু ইচ্ছে করে।

দেখতে দেখতেই বিকেলে হয়ে গেল। রাত্রি একটা তাঁতের শাড়ি পরল। হালকা কাজল আর পাউডার দিয়ে নিলো। এটুকুই ব্যস।

সাব্বির ওর দুই বন্ধুসহ এসেছে। রাত্রির ফুফুও এসেছে একটু আগে। নাশতা পর্ব শেষ করে ফুফু বললেন,

তোমরা বসে কথা বলো। আমি দেখি খাওয়া দাওয়ার অবস্থা কতদূর কি হলো।

সাব্বির আর ওর বন্ধুরা, গোধূলি আর রাত্রি রয়ে গেল বসার ঘরে। নামধাম জিজ্ঞেস করার পর টুকটাক আলাপ চলতে লাগল। সাব্বিরের বন্ধুরাই এটা ওটা জানতে চাইছে। আর সাব্বির আড়চোখে বেশ কয়বার রাত্রিকে দেখতে গিয়ে গোধূলির দিকেই চোখ গেল। বেশ চটপটে মেয়েটা। পোশাক আশাকেও বেশ স্মার্ট । রাত্রি ভীষণ চুপচাপ। কিন্তু সাব্বিরের একটু চটপটে মেয়েই বেশী পছন্দ। এরা বেশ মিশুক হয়। সব জায়গায় মাতিয়ে রাখতে পারে।

একটু পর খাবার টেবিলে ডাক পড়লে সবাই ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল। খাওয়া শেষ‌ হলে সাব্বির হাত ধুতে যাবে এমন সময় গোধূলি বলল,

আসুন আমার সাথে।

সাব্বির উঠে গোধূলির পিছে পিছে গেল।

বেসিনে হাত ধুতে ধুতে সেখানে টুক করে বলল,

আপনি কিসে পড়ছেন?

এমা! আপনিতো কিছুই শোনেননি তাহলে। একবার বললামতো।

ও খেয়াল করিনি। সরি।

না ঠিক আছে। ক্লাস টেনে এবার। আর আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।

আচ্ছা। কোন স্কুল?

পি এন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।

ওহ।

খাওয়া শেষে আর কিছু সময় বসে ওরা বেরিয়ে পড়ল।
রাতে ঘটক ফোন করে জানালো ছেলে রাত্রিকে নয়, গোধূলিকে পছন্দ করেছে।

(চলবে)

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
তুলি, নিরুপমা এই সব কিছুই খেয়াল করছিল কদিন ধরে। কিন্তু রঙ্গন কে কিভাবে বুঝিয়ে আবার আগের মতন স্বাভাবিক করবে, বুঝতে পারছিল না! আসলে যেই ঘটনাটা ঘটেছে, তার জন্য শুধু রঙ্গন এর শরীরে না, মনেও দাগ কেটেছে ভীষণ। সেই জন্যই ছেলেটা আজও রাতে ঠিকভাবে ঘুমোতে পারে না! আঁতকে আঁতকে ওঠে স্বপ্নের মধ্যে। তুলিকে সেই সময় খুব ভয়ের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ও। তুলি বুঝতে পারে, ছেলেটার শরীর দিয়ে ঘাম নেমে এসেছে ঘুমের ঘোরেই। তুলি সেই সময় রঙ্গন এর গায়ে হাত বুলিয়ে, জল খাইয়ে, ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এমনকি এই সময় রঙ্গন এর একটা নার্ভের প্রব্লেম অব্দি শুরু হয়ে গেছে! খুব বেশি স্ট্রেস হলেই এরপর নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যেতে পারে ওর। সেদিনের ঘটনাটা আসলে এতটাই স্পষ্ট আজও রঙ্গন এর কাছে, যে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় ওই দিনটাকে, খালি ঘরে শুনতে পায় লোকগুলোর গলার আওয়াজ, চিৎকার, ভাঙচুরের শব্দ।
যাইহোক, এর মধ্যেই তুলি এসেছিল একদিন ওর কাছে। হাতে একটা পেপার ছিল। তাতে লেখা ছিল, —–” ডক্টর রঙ্গন চ্যাটার্জি কে নিগ্রহ কাণ্ডে গ্রেপ্তার করা হলো অভিযুক্তদের। ইউটিউবের ভাইরাল ভিডিওতেই পুলিশ প্রশাসনের এই পদক্ষেপ।”
লাইনটা পড়ে রঙ্গন থমকে গেছিল সেদিন! তুলি যদিও ওকে কদিন আগে দেখিয়েছিল ইউটিউবের ভিডিওটা। সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজে ঘটনাটা খুব পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। সাথে অনেক ডাক্তারই পাশে দাঁড়িয়েছিল ওর, এই ঘটনার নিন্দা করেছিল ভীষণভাবে! কিন্তু এই ভিডিওটা যে সবাই এত শেয়ার করবে! আর প্রশাসনের কানে গিয়ে পৌঁছবে সবটা, এটা রঙ্গন ভাবেনি আসলে। তাই এই নিউজটা দেখে ও নির্বাক হয়ে গেছিল যেন। মনে হয়েছিল তুলির চেষ্টায় একটা উত্তর অন্তত দিতে পারলো এই গোটা সিস্টেমকে। সেই মানুষগুলোকে, যাদের কাছে ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলাটা খুব সহজ, খুব সস্তা একটা ব্যাপার।
<২৫>
কিন্তু কিছু ঘটনা জীবনে এতটা তীব্র হয় যে মানুষ চাইলেও নিজেকে সামলাতে পারে না সহজে। রঙ্গনও যেমন পারেনি। ও এই ঘটনার এক মাস বাদে হসপিটালে জয়েন করেছিল আবার। কিন্তু সার্জারি রুমে গিয়ে সবটা ঝাপসা হয়ে এসেছিল যেন। সেই আগের কনফিডেন্সটা ছিল না আর। সেইদিনের অতো লোকের চিৎকার, ভাঙচুরের আওয়াজ, ওকে মারা চর থাপ্পড়গুলোর প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাচ্ছিল এই নিঃস্তব্ধতার মাঝে। তাই হাতটা কাঁপতে শুরু করেছিল ওর। শরীরটা হালকা হয়ে এসেছিল হঠাৎ। তারপর চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে গেছিল কয়েক সেকেন্ডে।
এরপর সেদিন বেশ কিছুক্ষণ বাদে ওর সেন্স এসেছিল। ততক্ষণে তুলি হসপিটালে চলে এসেছে খবর পেয়ে। রঙ্গন চোখ খুলে দেখেছিল তুলি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বসে আছে সামনে। রঙ্গন এই সময় বুঝতে পারছিল না যে কিভাবে ও সার্জারি রুম থেকে এখানে এলো! সেদিন তুলি ওকে থমকে থাকা গলায় উত্তর দিয়েছিল,
——” ডাক্তার বলেছে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল তোমার! সেই জন্য এইভাবে হঠাৎ করে সেন্সলেস হয়ে গেছিলে।”
কথাগুলো শুনে রঙ্গন আর কিছু বলতে পারেনি। শুধু মনে হচ্ছিল সব হয়তো শেষ হয়ে গেল! আর সম্ভব না নতুন করে শুরু করা। সেদিনের সেই অপমান, গালাগালি, মারগুলো ডাক্তার হিসেবে কখনো ভুলতে পারবে না আসলে। আর সেই ঘটনাটার ভয়টাকে পুরোপুরি মুছে ফেলে পেশেন্টদের ট্রিটমেন্ট করতে পারবে না রঙ্গন। সেদিন এসব ভাবনার ভিড়ে কিরকম চুপ করে গেছিল ও। তবে তুলিও আজ স্তব্ধ হয়ে গেছিল ভীষণ। রঙ্গন অপারেশন থিয়েটারে সেন্সলেস হয়ে গেল! তার মানে এতটা ভেঙে পড়েছে ও মন থেকে যে নার্ভ গুলোও নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে! কথাটা ভেবেই কেমন অস্থির লাগছিল যেন। একটা ছেলে এইভাবে চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে! হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে! না, তুলি এটা মানতে পারছে না কিছুতেই। রঙ্গনকে যেভাবেই হোক সেইদিনটা ভুলতে হবে। মুছে ফেলতে হবে ওই ঘটনার স্মৃতিগুলো। কথাগুলো ভেবেই তুলি সেই রাতে রঙ্গন এর কাছে গেছিল। চুপ করে থাকা রঙ্গন এর হাতটা আগলে বলেছিল,
——” তুমি খুব পাহাড় ভালোবাসো না? মায়ের কাছে শুনেছি।”
রঙ্গন এই প্রশ্নে একটু অবাক হয়েই বলেছিল,
—–” হ্যাঁ। কেন? হঠাৎ পাহাড়?”
তুলি এটা শুনে নিজের মোবাইল থেকে বার করে কিছু ছবি দেখিয়েছিল ওকে। নর্থ বেঙ্গল এর ছোট্ট একটা গ্রাম তাবাকোশি। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রংবং নদী। আর তার সামনে দোতলা কাঠের বাড়ি, ছোট্ট বাগান। ছবিগুলো দেখে রঙ্গন কিরকম হারিয়ে গেছিল যেন। এত সুন্দর জায়গা! কথাটা ভাবতেই তুলি বলে উঠেছিল,
——-” যাবে এখানে আমার সাথে? এটা বাবার বন্ধু শিভম তামাং এর হোম স্টে। বাবা যখন প্রথম নর্থ বেঙ্গলে একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছিল, তখন থেকে বন্ধুত্ব। তারপর বাবা চাকরি চেঞ্জ করে কলকাতা চলে আসে; কিন্তু বন্ধুত্বটা রয়েই গেছে।”
কথাগুলো শুনে রঙ্গন একটু ভেবে বললো,
——” কিন্তু তোমার স্কুল? ছুটি নেই তো এখন।”
এটা শুনে তুলি আলতো হেসে বললো,
—–” ওটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। তুমি শুধু হ্যাঁ বলো।”
এই কথায় রঙ্গন একটা শব্দেই বললো অল্প হেসে,
—–” হ্যাঁ।”
<২৬>
মেঘ পাহাড় আর বৃষ্টির দেশ তাবাকোশি। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা গ্রাম। রঙ্গন এর এখানে এসে জায়গাটাকে দেখেই মুখে কেমন হাসি ফুটে গেল! মিরিখের চা বাগান পাড় করে বেশ কিছুটা আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করেই এখানে আসতে হয়। আর এই পুরো সময়টা রঙ্গন এর সঙ্গী ছিল ওর ক্যামেরা। গাড়ির কাঁচ ভেদ করে কখনো পাহাড়, কখনো নিচে পরে থাকা টুকরো টুকরো শহর আর গ্রামগুলোর ছবি, তো কখনো সবুজ চা বাগানকে নিজের ক্যামেরা বন্দী করছিল ছেলেটা। আর এইসব দেখে তুলির মুখেও আলতো হাসি ছিল আজ। ঠিক এই কারণের জন্যই কলকাতা ছেড়ে কদিনের জন্য এখানে আসা। তুলি জানে, ওই শহরে আজকাল দম বন্ধ হয়ে আসে রঙ্গন এর। খোলা আকাশ এখন খুব দরকার এই ছেলেটার। তাই তাবাকোশি।
যাইহোক, সেদিন যখন ওরা তাবাকোশি পৌঁছলো তখন ঘড়িতে দুপুর বারোটা। শিভম তামাং নিজে গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল ওদের ওয়েলকাম করার জন্য। মাঝারি হাইটের রোগা চেহারার হাসি খুশি একটা লোক। রঙ্গন এর প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গেল কেমন! আর তুলি তো ছোট থেকেই চেনে। তাই এই মানুষটার জন্য ভালো লাগাটা ছোট থেকেই। যাইহোক, কাঠের এই ছোট্ট কটেজের সামনে দিয়েই রংবং নদী বয়ে যায়। রঙ্গন আর তুলি এই নদীর সামনে এসে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল যেন! দূরে সারী দিয়ে সাজানো পাহাড়, সামনে বয়ে চলা নদী, দূরে একটা ছোট পাহাড়ি ব্রিজ, সবটা মিলিয়ে ওরা যেন কেমন স্থির হয়ে গেছিল প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা এই ছবির সামনে। মনে হচ্ছিল কত শান্তি এই জায়গায়!

সেদিন বিকেলটা তো ওই কটেজের ব্যালকনিতে বসেই কেটে গেল দুজনের! সঙ্গে কফি, আর স্টিমড মোমো। আর সাথে নদীর কলকল শব্দ। রঙ্গন এই মুহূর্তে তুলিকে হঠাৎ বলে উঠলো,
—– ” থ্যাঙ্কস.. আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য। সিরিয়াসলি থ্যাঙ্ক ইউ..”
এই কথায় তুলি এবার একটু ভ্রু কুঁচকে বললো,
——” একটু বেশিই ফর্ম্যালিটি হয়ে যাচ্ছে না? আমি এখানে তোমাকে থ্যাঙ্কস বলার জন্যও নিয়ে আসিনি!”
রঙ্গন কথাটা শুনে সাথে সাথেই বললো অল্প হেসে,
——” তাহলে কি বলার জন্য নিয়ে এসেছো? আই লাভ ইউ?”
কথাটা ও তুলির চোখের দিকে তাকিয়েই বললো হঠাৎ। তুলি এটা শুনে ঠিক কি বলবে ভেবে পেল না! তাই অল্প লজ্জা জড়ানো গলায় একটু হেসে বললো,
——” কি যে সব বলছো! ধুর।”
কথাটা বলেই ও চলে যাচ্ছিল, কিন্তু রঙ্গন হঠাৎ ওর হাতটা শক্ত করে ধরে টেনে নিল তুলিকে নিজের কাছে। তারপর খুব আলতো গলায় বললো,
——” কেন? ঠিকই তো বলছি। আই লাভ ইউ.. আজ থেকে না! যখন তুমি রোজ আমাদের বাড়িতে আসতে গান শেখাতে; তখন থেকে। অনেস্টলি, তার আগে সুর তাল মিউজিকের ব্যাপারে আমার অতো ইন্টারেস্ট ছিল না! কিন্তু তুমি আসার পর, তোমার গান না শুনলে রোববারগুলো আমার কমপ্লিট হতো না! সেই জন্য ইচ্ছে করে বাড়ি থাকতাম আমি ওই দিনগুলোতে। সেই সময় থেকে ভালোবাসি তোমায়। খুব ভালোবাসি।”
কথাগুলো খুব মন থেকে বললো আজ রঙ্গন। তুলি এই মুহূর্তে কোন শব্দ খুঁজে পেলো না যেন! শুধু চোখ দুটো ওর ভিজে এলো হঠাৎ। এই সময় রঙ্গন কিছু না বলে ওর গালে নিজের ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিল। তারপর খুব শক্ত করে তুলিকে জড়িয়ে ধরলো নিজের মধ্যে। তুলিও এরপর এই পাহাড়ি বিকেলে আর চুপ থাকলো না! রঙ্গন এর কানের কাছে এসে বললো আলতো স্বরে,
—– ” আমিও ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি, তোমাকে। ”
সেই মুহূর্তে হঠাৎ মেঘ ডেকে উঠলো আকাশে। বিদ্যুৎ এর ঝলকানিতে আবছা ভাবে ভেসে উঠলো সামনের পাহাড় আর রংবং নদী। আর তার মাঝে বৃষ্টিতে ভিজলো তাবাকোশি। আর সেই বৃষ্টির জল এসে ভিজিয়ে দিল তুলি আর রঙ্গনকেও।
<২৭>
সেদিনের পর যেই নতুন দিনটা শুরু হয়েছিল এই পাহাড়ি গ্রামে, সেটা ছিল রোদ মাখানো ঝকঝকে একটা দিন। তুলির সকালে উঠেই তাই মনটা খুব খুশি হয়ে গেছিল। তবে আজ ও রঙ্গনকে সকাল থেকে একটুও চুপচাপ বসে থাকতে দেয়নি। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে গ্রাম ঘোরাতে, চা বাগানে। যদিও রঙ্গনও খুব এনজয় করছিল জায়গাটা! তাবাকোশির চা বাগান, পাহাড়ি বেঁকে যাওয়া এলোমেলো রাস্তা, কমলা লেবুর বাগান, ঝর্না, একটা ছোট্ট প্রাইমারি স্কুল, সব কিছুই কিরকম একটা ভালো লাগা নিয়ে আসছিল মনে। কিন্তু এইসবের ভিড়েও একটা চিন্তা, একটা সংশয় সব সময় কাজ করছিল মনে। নিজের কাজ নিয়ে সংশয়। তাই সেদিন চা বাগানের বেঞ্চটায় বসে থাকতে থাকতে রঙ্গন তুলিকে হঠাৎ বলে উঠেছিল,
——” আমি মনে হয় আর ডাক্তারিটা করতে পারবো না! সেই কনফিডেন্সই নেই আর আমার মধ্যে।”
কথাটা শুনে তুলি একটু হতাশ মুখেই বললো,
——” তুমি আবার ওইসব কথা ভেবে যাচ্ছো! এরকম একটা জায়গায় এসেও! প্লিজ, এইসব চিন্তা বাদ দাও এখন। ”
রঙ্গন এই কথায় খুব অন্ধকার মুখেই বললো,
——” চাইলেও বাদ দিতে পারছি না যে! সিরিয়াসলি কলকাতায় গিয়ে করবোটা কি!”
তুলি এটা শুনে হঠাৎ একটা অন্য কথা বলে উঠলো অল্প চিন্তা করে,
——” অনেক কিছুই করতে পারো! আমার কাছে গান শিখে গানের টিচার হয়ে যেতে পারো! মায়ের কাছে দারুণ দারুণ রান্না শিখে শেফ হয়ে যেতে পারো! একচুয়ালি এই আইডিয়াটাই ভালো। আমরা একটা হোম ডেলিভারি খুলবো। বাঙালিরা আর কিছু না হোক, খেতে খুব ভালোবাসে। তোমার ব্যাবসাটা দারুণ চলবে! ভালো আইডিয়া না?”
শেষ কথাটা বেশ হেসে বললো তুলি। তবে রঙ্গনও এসব শুনে আর গম্ভীর থাকতে পারলো না! ও তুলির কথায় তাল মিলিয়ে আরো একটু ওপরে উঠে বললো,
—— ” বাঙালিদের খাদ্য প্রেমের ব্যাপারেই যখন বলছো, তাহলে তো লিস্টে ফুচকা সবার ওপরে! ভাবছি কলকাতায় ফিরে ফুচকাওলা হয়ে যাবো। গলির সামনে দোকান দেব একটা। আর তুমি হবে আমার এসিসস্টেন্ট। কেমন আইডিয়া? চলবে?”
তুলি এই প্রশ্নে মুখে অনেক বড় একটা হাসি নিয়ে বললো, —–” না, দৌড়বে। ”
কথাটা বলেই ও রঙ্গন এর হাতটা জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখলো। আসলে এই হাসি খুশি ছেলেটাকেই ফিরে পেতে চায় ও, যেভাবেই হোক। আর তুলি জানে, নতুন সময় ঠিক আসবে আবার, যেদিন রঙ্গন ঘুরে দাঁড়াবে। নতুন করে শুরু করবে।

তবে সেই সময়টা আসতে খুব বেশি দেরি হলো না আর! সেই দিনটা পেরিয়ে রাত নামলো তাবাকোশি তে। পাহাড়ে সবাই আগে আগে খেয়ে নেয়। তাই রঙ্গনরাও ওই সাড়ে আটটার দিকে ডিনার করে দশটার আগেই ঘুমের দেশে চলে গেছিল। কিন্তু হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল মাঝরাতে, দরজা ধাক্কানোর শব্দে। তুলি আর রঙ্গন তো এই আওয়াজে প্রথমে ঘাবড়েই গেছিল। তারপর একটু ঘুমের ঘোরটা কাটতে বুঝলো শিভম তামাং এর গলার আওয়াজ। কিন্তু এত রাতে উনি হঠাৎ ডাকছেন কেন! আর এদিকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাবাকোশিতে। দরজা জানলা বন্ধ থাকলেও মেঘ ডাকার আওয়াজ, বৃষ্টির আওয়াজ স্পষ্ট আসছে কানে। কিন্তু এরকম ঝড় জলের মধ্যে উনি কেন এলেন হঠাৎ! ব্যাপারটা বুঝতে না পেরেই রঙ্গন আর তুলি উঠে দরজা খুলেছিল ঘরের। কিন্তু তখনই শিভম তামাংজি খুব ঘাবড়ে বলেছিল,
—–” সরি, এত রাতে দরজা ধাক্কাছি। আসলে আমাদের গ্রামে তুহিন বলে একজনের বুকে খুব ব্যাথা উঠেছে হঠাৎ! তারপর কিরকম সেন্সলেসের মতন হয়ে গেছে! আর এখানে তো কোন হসপিটাল , ডাক্তার কিছু নেই! আর মিরিখ নিয়ে যেতেও সময় লাগবে এই বৃষ্টির মধ্যে। তাই বাধ্য হয়েই তোমার কাছে এলাম রঙ্গন। অশোকের কাছে শুনেছি তুমি হার্টের ডাক্তার! একটু হেল্প করবে বাবা! ছেলেটার দুটো ছোট ছোট বাচ্চা আছে। কিছু হয়ে গেলে ওরা অনাথ হয়ে যাবে!”
কথাগুলো ভীষণ অসহায়ভাবে বলেছিলেন উনি। কিন্তু রঙ্গন হ্যাঁ না কিছুই বলছিল না যেন! কিরকম একটা চিন্তায় হারিয়েছিল। ওই সেদিনের ঘটনাটা আবছা হয়ে ভাসছিল চোখের সামনে। তবে তুলির ডাকে হঠাৎ ঘোরটা কাটলো ওর। তুলি খুব দৃর হয়ে বললো ওকে,
——” তুমি এইভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন! তুমি জানো না এরকম কিছু হলে এক একটা সেকেন্ডও কতটা ইম্পর্টেন্ট! চলো, যাই আমরা শিভম আঙ্কেলের সাথে!”
কিন্তু এই কথায় রঙ্গন কেমন অস্থির হয়ে বললো,
——” কিন্তু আমি! আবার! আমি কি পারবো?”
এই প্রশ্নে তুলি খুব শক্ত হয়ে বললো,
——” তুমিই পারবে। এরকম অনেক কেস হ্যান্ডেল করেছো তুমি! আর এত এত পেশেন্ট কলকাতায় তোমার একটা এপয়েন্টমেন্টের জন্য ওয়েট করে থাকে। কারণ তারা সবাই বিশ্বাস করে তোমাকে। ভরসা করে তোমার ট্রিটমেন্টের ওপর। আজ যেমন শিভম আঙ্কেল করছে! তাই এত রাতে ছুটে এসেছে তোমার কাছে। এন্ড ইউ কান্ট লেট হিম গো এলোন..”
কথাগুলো কিরকম নিস্পলক ভাবে শুনেছিল রঙ্গন, আর নিজেকে স্থির করেছিল মনে মনে। সত্যি, আর বেশি সময় নেই! আর দেরি করা যাবে না। কথাটা ভেবেই বেরিয়ে এসেছিল কটেজের বাইরে, অন্ধকার ঘেরা তাবাকোশিতে। তারপর বেশ জোড়ে পা চালিয়ে পৌঁছেছিল শিভম তামাং এর সঙ্গে একটু দূরের ছোট্ট কাঠের বাড়িটায়। আধো অন্ধকার, আধো আলো ঘেরা ছোট্ট একটা ঘর। তাতে গ্রামের অনেক লোকরাই এসে ভিড় করেছে। তার মাঝে একটা বছর ছত্রিশ কি সেই ত্রিশের ছেলে বিছানায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ছোট্ট দুটো বাচ্চা, আর একজন অল্প বয়স্ক মহিলা। রঙ্গন এইসব দেখে তাড়াতাড়ি ঘরটা খালি করে দিতে বললো এয়ার সার্কুলেশন এর জন্য। তারপর যেহেতু স্টেথোস্কোপ নেই, তাই ছেলেটার বুকে কান রেখে শুনলো হার্ট বিট। ভীষণ স্লো চলছে। যেকোন সময় কোল্যাপস করে যেতে পারে! হসপিটাল হলে অনেক ইকুইপমেন্টস থাকতো, কিন্তু এখন যেহেতু কিছু নেই, তাই রঙ্গন হাত দিয়ে ছেলেটার হার্ট পাম্প করার চেষ্টা করলো জোরে জোরে চাপ দিয়ে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে পেশেন্টের চেস্ট কমপ্রেশন করলো প্রায় চার পাঁচ মিনিট ধরে। আর অবশেষে ছেলেটা সাড়া দিল। হঠাৎ জোড়ে শ্বাস নিয়ে উঠলো ও। যেন হার্ট বিট ফিরে পেল আবার! ততক্ষণে বাইরে গাড়ি চলে এসেছে, মিরিখের হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য! তবে ছেলেটার সেন্স চলে এসেছিল এরপর। যাইহোক, গ্রামের লোকেরা এবার ধরাধরি করে ওকে গাড়িতে তুললো। ততক্ষণে সবাই যেন একটু স্বস্তি পেয়েছে। তুহিন যে চোখ খুলে তাকিয়েছে, এটা দেখে।
সেদিন গ্রামের লোকেরা, তুহিনের বউ, দুটো বাচ্চা রঙ্গন কে প্রায় হাত জোড় করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল! এইভাবে যে একজন ডাক্তার খুঁজে পাবে ওরা, এত রাতে; এটা আসলে ভাবতে পারেনি কেউ! শিভম তামাংও এই সময় রঙ্গন এর হাত দুটো ধরে খুব মন থেকে বলেছিল,
——” থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ! আজ যদি তুমি না আসতে, তাহলে হয়তো তুহিনকে বাঁচানো যেত না! পুরো ফ্যামিলি টা শেষ হয়ে যেত আজ।”
কথাগুলো শুনে রঙ্গন অনেকদিন বাদে সেই পুরনো কথাটা বলে উঠলো ওকে, খুব শান্ত গলায়,
——” প্লিজ থ্যাঙ্কস বলবেন না। এটা আমার ডিউটি, এজ আ ডক্টর..”

যাইহোক, সেদিন তুলিও দাঁড়িয়েছিল বাইরে, গ্রামের লোকেদের সঙ্গে। রঙ্গন এই মুহূর্তে ভিড়ের মধ্যে খেয়াল করেছিল সেটা। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেছিল তুলির কাছে সেদিন। এরপর নিঃশব্দেই জড়িয়ে ধরেছিল ওকে ভেজা চোখে। কিরকম যেন মনে হচ্ছে সবটা ফিরে পেয়েছে আবার! সেই পুরোনো বিশ্বাস, নিজের মধ্যে। তাই খুব আলতো স্বরে বলেছিল তুলিকে,
——” আমি পেরেছি। আমি আবার পেরেছি। ”
তুলি এই কথাটা শুনে নিজেও ভেজা চোখে বলে উঠেছিল, —–” আমি জানতাম। এন্ড আই ট্রাস্ট ইউ.. তুমি একজন খুব ভালো ডাক্তার রঙ্গন। আর একটা ঘটনার জন্য সব কিছু শেষ হয়ে যায় না! এতদিনের এক্সপিরিয়েন্স, প্র্যাকটিস, সবের একটা দাম আছে।”
কথাগুলো বলে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিল ও রঙ্গনকে। তারপর নতুন স্বপ্ন শুরু হয়েছিল আবার জীবনে। আসলে বৃষ্টির ফোঁটা পেয়ে যেমন শুকনো গাছের পাতারা আবার গাঢ় সবুজ হয়ে যায়! সেরকম আজ এই বৃষ্টির রাতে রঙ্গন আর তুলির জীবনেও রুক্ষ্মতা, শুষ্কতা কেটে নতুন একটা রং এসে ধরা দিয়েছিল হঠাৎ। যেই রং পুরনো খারাপ স্মৃতিগুলোকে মুছে আরেকবার বাঁচতে শিখিয়েছিল, প্রাণ ভোরে নিঃশ্বাস নিতে শিখিয়েছিল, নতুন করে। এই বৃষ্টির দিনে। এই পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট গ্রামে।
————< সমাপ্ত >———-

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-১১

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( একাদশ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
এই মুহূর্তে তুলির বাবা, নিরুপমা এসেও রঙ্গনকে দেখে গিয়েছিল। কিন্তু ওরাও কিরকম নিশ্চুপ হয়ে গেছিল এই অবস্থায় ছেলেটাকে দেখে। তবে তুলি আজ বুঝেছিল রঙ্গন এর ওপর দিয়ে একটা ঝড় চলে গেছে হঠাৎ। এরপর ওর সামলাতে অনেকটা সময় লেগে যাবে হয়তো!

তুলির ভাবনাটা কিরকম সত্যি হয়ে গেছিল যেন। রঙ্গন এই ঘটনাকে একসেপ্ট করতে পারেনি কিছুতেই। তুলি সেটা প্রথম বুঝেছিল সেদিন রাত্রে। রঙ্গন স্বপ্নের ঘোরে বার বার বলছিল, —–” আপনারা এরকম করবেন না! প্লিজ! আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম। প্লিজ এরকম করবেন না!”
কথাগুলো বলতে বলতেই ও ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠে বসেছিল হঠাৎ।
সেই মুহূর্তে রঙ্গন এর চিৎকার শুনে তুলির ঘুমটাও ভেঙে গেছিল। ও ছেলেটাকে এইভাবে ছটফট করতে দেখে ঘাবড়ে গেছিল কেমন। তাড়াতাড়ি ঘরের আলো জ্বালিয়ে রঙ্গনকে ডেকেছিল কোনভাবে। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলেছিল,
—–” কিছু হয়নি। কেউ নেই এখানে! কেউ আসবে না।”
সেই মুহূর্তে তুলির গলার আওয়াজ শুনে রঙ্গন এর ঘুমের ঘোরটা কেটেছিল। ও হঠাৎ ওই অতো লোকের ভিড়, চিৎকার, আওয়াজ থেকে তুলির কাছে ফিরে এসেছিল যেন স্বপ্ন ভেঙে। তাই কিরকম বাচ্চাদের মতন জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। যেন একটা আশ্রয় খুঁজছিল এতক্ষণ! যাকে আঁকড়ে ধরা যায়। তারপর তুলির চোখের সামনেই কিরকম নিস্তেজ হয়ে গেছিল ওর বুকে মাথা রেখে। তুলি এবার রঙ্গন এর শরীরের উষ্ণতাটা ফিল করেছিল হঠাৎ। ও ঘাবড়ে গিয়ে ছেলেটার কপালে, গালে হাত ঠেকিয়ে দেখেছিল জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে রঙ্গন এর। তুলির এবার চারিদিকটা সত্যিই অন্ধকার হয়ে এসেছিল কেমন। এতটা জ্বর কখন এলো! আর তুলি বুঝতেও পারলো না কিছু। কথাটা চিন্তা করতে করতেই ও রঙ্গনকে কোনভাবে শোয়ালো। তারপর নিজেই জল পট্টি দিয়ে, ওষুধ খাইয়ে, সারা রাত জেগে বসে থেকে কোনভাবে জ্বর কমানোর চেষ্টা করলো ছেলেটার। এই পুরো সময়টা রঙ্গন তুলির হাতটা শক্তভাবে নিজের কাছে ধরেছিল! কিরকম তুলিকে নিজের মধ্যে জড়িয়ে ছিল যেন মন থেকে। তুলির এইসব দেখে নিজের ওপরই রাগ হচ্ছিল কেমন। কেন এই ছেলেটার ওপর রেগে ছিল এতদিন! কেন একবারের জন্যও কথা বলেনি নিজে থেকে! রঙ্গন তো কত চেষ্টা করছিল নিজের ভুলটাকে ঠিক করার। কত দিন সময়ে অসময়ে ওদের বাড়ি যেত। বস্তির স্কুলটাতে গিয়ে বসে থাকতো। কত ফুল, চকলেট, কার্ড তুলিকে পাঠিয়েছে, ওর একবার ফিরে তাকানোর অপেক্ষায়! একবার কথা বলার অপেক্ষায়। কিন্তু তুলি চুপ থেকেছে সব সময়। রঙ্গন এর কাছে যাওয়া তো দূরে থাক, ওর দিকে তাকায় অব্দি নি ঠিক করে।
সেদিন এসব ভাবনার ভিড়েই ভোর হয়েছিল। থার্মোমিটারে তখন রঙ্গন এর শরীরের উষ্ণতা দেখাচ্ছিল একশ এক। তার মানে জ্বরটা কমেছে কিছুটা। কাল রাতে তো একশ তিন উঠে গেছিল! কথাটা ভেবে তুলি খেয়াল করলো রঙ্গন এর ক্লান্ত মুখটা। কেমন ফ্যাকাসে চেহারায় ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা! এই একদিনেই কতটা বদলে গেছে যেন! কথাগুলো কেমন আনমনে মনে হয়েছিল ওর।

তবে সেদিন একটু বেলা বাড়তে তুলি ডাক্তারকে কল করেছিল। রঙ্গন এর আবার জ্বর এসেছে আসলে। তুলি, নিরুপমা বুঝতে পারছে না কি হলো ছেলেটার! নিরুপমা তো ঘুম থেকে উঠে ছেলেকে এই অবস্থায় দেখেই চিন্তায় অর্ধেক হয়ে গেছিল। আর তুলি সারাটা রাত জেগে সব সামলালো! একবারও ওকে ডাকলো না ঘুম থেকে! কথাগুলো কিরকম অগোছালো হয়ে বলেছিল ও। তুলি তখন খুব শান্ত গলায় উত্তর দিয়েছিল,
—-” তোমার এমনিই হাই প্রেশার। তার ওপরে কাল সারাদিন কম টেনশন তো করোনি! এরপর রাত্রিবেলা ঘুম ভাঙিয়ে এসব বললে আর তুমি ঠিক থাকতে!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল তুলি। কিন্তু নিরুপমা কিরকম আদর মাখা চোখে দেখেছিল ওকে! এই মেয়েটা কোন্ দিন যে নিজের মেয়ে হয়ে গেছে; বুঝতেই পারেনি ঠিক।
যাইহোক, তবে সেদিন ডাক্তার এসে রঙ্গনকে দেখে বলেছিল এই জ্বরটা মেন্টাল স্ট্রেস আর ট্রমা থেকে এসেছে ওর। কালকের ঘটনাটা খুব বেশিভাবে এফেক্ট করেছে ওকে। তাই মনের সাথে শরীরও এই ধকলটা নিতে পারেনি! কথাগুলো শুনে তুলির চারিদিকটা আবছা হয়ে গেছিল যেন। চোখে জল জমেছিল হঠাৎ। আর যারা রঙ্গন এর এই অবস্থা করলো তাদের কি কোন শাস্তি হবে না! একজন এত ব্রাইট একটা ডাক্তারকে এইভাবে অপমান করে, মেরে ধরে সবাই ছাড়া পেয়ে যাবে! কথাগুলো ভেবেই ও পুলিশ স্টেশনে গেছিল সেদিন। কাল তো একটা এফ. আই.আর করা হয়েছিল। তারপর কি কেউ গ্রেপ্তার হলো! কথাগুলো জানার জন্যই গেছিল আজ। কিন্তু ওখান থেকে থানার ও.সি খুব অল্প কথায়ই বলেছিল,
—–” যারা আপনার হাজবেন্ড কে মেরেছে, তারা পার্টির লোক! খুব ইনফ্লুয়েন্স আছে ওদের। সেই জন্য এরেস্ট করা যায়নি। প্লিজ আর থানায় ফোন করে বিরক্ত করবেন না আমাদের। যা হয়েছে মিটে গেছে। এই নিয়ে আর আমাদের কিছু করার নেই!”

কথাগুলো খুব সহজভাবে বলে উনি অন্য কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু এসব শুনে তুলির ধৈর্য্যের সীমা শেষ হয়ে গেছিল যেন। তবে ও জানতো পলিটিকাল কনেকশন আছে বলেই খুব সহজে ছাড় পেয়ে যেতে পারে ছেলেগুলো। তাই আজ খুব সাবধানে নিজের হাতের আড়ালে ফোনটাকে ধরে ভিডিও ক্যামেরাটা অন রেখেছিল ও। আর সেদিন ও.সির বলা প্রত্যেকটা কথা রেকর্ড করেছিল নিজের ফোনে। এরপর থানা থেকে বেরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিল ওর স্কুলের বন্ধু তন্ময়কে। তন্ময় এখন খুব নাম করা একজন ইউটিবার পশ্চিমবঙ্গের। তুলি জানতো, অন্য কোন মিডিয়ার কাছে গেলে হয়তো কোন লাভ হবে না। একমাত্র সোশ্যাল মিডিয়াই সাধারণের কথা শোনে। তাই তন্ময়কে ফোন করে জানিয়েছিল সবটা। হোয়াটস অ্যাপ করেছিল থানার ও.সির ভিডিও ফুটেজ, কালকের হসপিটালের সিসিটিভি ফুটেজ, আর রঙ্গন এর রক্তাক্ত চেহারা, চোট গুলোর ছবি। তন্ময়কে ও এরপর নিজে থেকেই বলেছিল সাহায্যের জন্য।
<২৩>
সেদিন তন্ময় সব কিছু শুনে না করেনি তুলিকে। বরং এক রাতের মধ্যে এই সমস্ত ফুটেজ, ছবি দিয়ে একটা ভিডিও শেয়ার করেছিল ইউটিউব ফেসবুকে। সেই ভিডিওতে তুলি নিজে একটা বাইট দিয়ে বলেছিল রঙ্গন এর কথা। বলেছিল কত বছর দিন রাত পড়াশোনা করে, খেটে, পরিশ্রম করে রঙ্গন একজন ডাক্তার হয়েছে! কলকাতার নাম করা হার্ট সার্জেন। কত পেশেন্ট ওর ট্রিটমেন্ট এ নতুন জীবন পেয়েছে! কত গ্রামে বস্তিতে গিয়ে রঙ্গন নিজের উদ্যোগে মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছে, চেম্বার করেছে। অনেক সময় আটচল্লিশ ঘণ্টার ওপর ডিউটি করে পেশেন্টদের সঙ্গে থেকেছে। আর আজ তাকেই এইভাবে মারা হলো! এতগুলো লোক মিলে হামলা করা হলো কিছু না জেনে, না বুঝে। একবারও কেউ এটা দেখলো না যে পেশেন্টের অলরেডি এর আগে দুবার হার্ট এটাক হয়ে গেছে! হার্টের অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল সেই কারণে। এই পরিস্থিতিতে একজন ডাক্তারের হাতে বেশি কিছু থাকে না করার মতন, তাও যেখানে হার্ট এ্যাটাকের অনেকটা সময় পার করে হসপিটালে আনা হয়! কথাগুলো আসলে সেদিন পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পর, হসপিটালে গিয়ে অন্য ডাক্তারদের থেকে জেনেছিল তুলি। রঙ্গন এর জন্য হসপিটালের বাকি ডাক্তারদের মনেও খুব ক্ষোভ ছিল! আসলে আজ যেটা রঙ্গন এর সাথে হয়েছে, কাল তো সেটা বাকি ডাক্তারদের সাথেও হতে পারে! ইভেন কত কত ডাক্তার এই হ্যারাসমেন্ট অলরেডি ফেস করেছে এইভাবে! ফিজিক্যালি এসল্টেড হতে হয়েছে। তাই তুলির রিকুয়েস্ট এ রঙ্গন এর বন্ধু, কলিগ, হসপিটালের বাকি ডাক্তাররাও বাইট দিয়েছিল নিজেদের ওই ভিডিওতে। যাইহোক, এরপর এই ভিডিওটা রাতারাতি ভাইরাল হয়ে গেছিল ইউটিউব ফেসবুকে। সাধারণ মানুষ জেনেছিল রঙ্গন এর দিকের ঘটনাটা। ফিল করেছিল ডাক্তার হিসেবে ওর যন্ত্রণাটা।
তবে এই সবই রঙ্গন এর অজানা ছিল সেইদিন। তুলি সারাদিন পুলিশ স্টেশন, হসপিটাল ঘুরে যখন বাড়ি পৌঁছেছিল, তখনও দেখেছিল ছেলেটা জ্বরের ঘোরে আছে! নিরুপমা ছেলের পাশে কিরকম ভেজা চোখে বসেছিল সেই মুহূর্তে। তুলি এবার নিরুপমার কাছে গিয়ে বলেছিল,
——” মা, তুমি এবার একটু রেস্ট নাও। আমি তো এসে গেছি। আমি বসছি ওর কাছে।”
নিরুপমা এর উত্তরে খুব এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
—–” আমি আর দেখতে পারছি না ছেলেটাকে এইভাবে! সুস্থ ছেলে আমার কাল হসপিটাল গেল; আর এ কি অবস্থা হয়ে ফিরে এলো! ডাক্তার হওয়ার জন্য এরকম শাস্তি পেতে হলো ছেলেটাকে! এই জানলে তো এই প্রফেশনে আসতেই দিতাম না ওকে। কত ভালো রেজাল্ট ছিল জয়েন্টে। চাইলে ইঞ্জিনিয়ারিংও পড়তে পারতো! কিন্তু আমি বলেছিলাম মেডিক্যাল পড়তে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভুল করেছিলাম।”
কথাগুলো খুব কষ্ট থেকে বললো নিরুপমা। তুলি এই মুহূর্তে ঠিক কি উত্তর দেবে, ভেবে পেল না যেন! আসলে রঙ্গনকে এরকম নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে ওরও চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে আজ। মনে হচ্ছে যেভাবেই হোক, আবার ছেলেটাকে আগের মতন সুস্থ, হাসি খুশি করে তুলতে হবে। তুলি এইভাবে রঙ্গনকে ভেঙে পড়তে দেবে না!
যাইহোক, এইসব ভাবনার ভিড়ে তুলি সেই রাতটাও জেগে কাটিয়েছিল প্রায় রঙ্গন এর কাছে। বার বার জল পট্টি দেয়া, টেম্পারেচার চেক করা, ওষুধ দেওয়া, সব করেছিল নিজে। তারপর ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটেছিল শহরে। তুলিরও এবার শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিল। চোখ দুটোতে কান্তি নেমে এসেছিল কেমন। তাই রঙ্গন এর বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল আজ।
তবে সকালে রঙ্গন এর জ্বরটা নেমে গেছিল। তাই নিজে থেকেই ঘুমটা ভেঙে গেছিল ওর। কিন্তু চোখ খুলতেই দেখেছিল তুলিকে! ওকে আঁকড়ে ধরে কিরকম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে এই মুহূর্তে। দেখে মনে হচ্ছিল সরল, নিষ্পাপ একটা মুখ! যে কোন জটিলতা বোঝে না। যে বেহিসেবী ভাবে ভালোবাসে, আগলে রাখে! কথাগুলো ভেবেই মনে পড়ে গেছিল নিজের সেই দিনের ব্যবহারটা। এই মেয়েটাকেই ও সন্দেহ করেছিল! কত খারাপ কথা বলেছিল! এমনকি বাড়ি থেকেও চলে যেতে দিয়েছিল! কথাগুলো মনে হতেই কিরকম চোখটা ভিজে এলো ওর, নিজের ভুলের জন্য। তাই কিছু না ভেবেই আজ তুলিকে ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিজের মধ্যে। ঘুমন্ত তুলির মাথায় কপালে আদর করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল আলতো করে। তুলির অবচেতনেই ওকে ভালোবাসলো ভীষণভাবে।
<২৪>
সেদিন এরপর যখন তুলির ঘুম ভেঙেছিল, ঘড়িতে তখন সকাল দশটা! রঙ্গন ইচ্ছে করেই তুলিকে ডাকেনি আসলে। ওর জন্য দু রাত জেগেছে মেয়েটা। এরপর যদি তুলির শরীর খারাপ হয়!

কিন্তু সেদিন তুলি ঘুম থেকে উঠে রঙ্গন কে জেগে থাকতে দেখেই ঘাবড়ে গিয়েছিল! ও তাড়াতাড়ি রঙ্গন এর কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেছিল,
——” জ্বর নেই তো তোমার? শরীর ঠিক আছে?”
রঙ্গন এই প্রশ্নে শান্ত গলায় বলেছিল,
—–” ঠিক আছি আমি।”
তুলি এবার তাড়াতাড়ি উঠে বসেছিল। কিন্তু ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই কেমন আঁতকে উঠেছিল নিজে! এত দেরি হয়ে গেছে! কথাটা ভেবেই ও বলেছিল রঙ্গনকে,
—– ” এতক্ষণ ধরে ঘুমোচ্ছি! আর তুমি ডাকোনি আমাকে!”
রঙ্গন এই কথায় সেই শান্ত ভাবেই বলেছিল,
—–” তোমার আরো ঘুম দরকার। দু রাত জেগে তুমি!”
এই উত্তরে তুলি আর বেশি কথা বাড়ায়নি। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে গেছিল। ছেলেটাকে কিছু খেতে দিতে হবে এখন। এই জ্বরের জন্য তো ঠিকভাবে খায়ওনি কাল!
তবে সেদিন খাবার নিয়ে এসেও তুলি খেয়াল করলো রঙ্গন চুপ করে বসে। যাইহোক, তুলির জোরাজুরিতে একটু খেয়েছিল তারপর ছেলেটা। কিন্তু অল্প খাওয়ার পরই কিরকম অন্ধকার মুখে বলেছিল,
——” আমি আর খাবো না। ইচ্ছে করছে না! পেট ভরে গেছে।”
কথাটায় তুলি বুঝেছিল রঙ্গনের মন আজও খারাপ। সেই জন্যই এইভাবে থমকে আছে সারাক্ষণ। খেতেও চাইছে না ঠিকভাবে। তাই ও একটু জোর দেখিয়ে বলেছিল,
—— ” ডাক্তার তো তুমি! নিশ্চয়ই জানো, যে এতটা জ্বর থেকে ওঠার পর, এত এত ওষুধ খাওয়ার পর ঠিকভাবে খাবার খাওয়াটা কতটা দরকার! তাই ইচ্ছে না হলেও খেতে হবে।”
কথাটা বলে তুলি নিজের হাতে একটা রুটির টুকরো ছিঁড়ে রঙ্গন এর মুখের কাছে ধরলো। কিন্তু রঙ্গন এই মুহূর্তে ওর দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে বললো,
—- ” তুমি খেয়েছ কিছু কাল রাত থেকে?”
এই প্রশ্নে তুলি একটু এলোমেলো হয়ে বললো,
—– ” না, মানে! আমি!”
রঙ্গন তখন নিজে তুলির হাত থেকে রুটির টুকরোটা নিয়ে ওর কাছে গিয়ে বললো,
——” জানি কাল কিছু খাওনি। আর সারা রাত জেগেও ছিলে। তাই আমার সাথে তোমার খাওয়াটাও দরকার। বুঝলে।”
কথাগুলো শেষ করে রঙ্গন নিজে ওকে খাইয়ে দিল এই মুহূর্তে। তুলিও আর কিছু ঠিক বলতে পারলো না! শুধু নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। যার নিজের ওপর দিয়ে এতটা ঝড় গেছে, যার শরীর এত খারাপ, সেই অবস্থায়ও ছেলেটা ওর কথাই ভাবছে! ও খেয়েছে কি না সেই নিয়ে চিন্তা করছে! কথাগুলো যেন আনমনে মনে হলো হঠাৎ। আর চারিদিকটা গোলাপি আভায় ছেয়ে গেল তুলির! ভালোবাসার রঙ এসে ধরা দিল মনে।

তবে এই দিনগুলোতে রঙ্গন কেমন বদলে গেছিল যেন। খুব চুপচাপ থাকতো সারাক্ষণ। দরকার ছাড়া কথা বলতো না! মোবাইলটা অর্ধেকের বেশি সময় অফ রাখতো। নিজের বেশিরভাগ পেশেন্ট কে ই অন্য ডাক্তারদের কাছে রেফার করে দিয়েছিল। হসপিটালে যাওয়া তো দূরে থাক, ঘর থেকে ছাদ টুকু অব্দিও যেত না রঙ্গন।

চলবে

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-১০

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( দশম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
তবে পরেরদিন আবার সেই ছেলেটার মুখোমুখি হতেই হলো তুলিকে! সেদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখেছিল রঙ্গন ওদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে। লজ্জায় ও তুলির মা বাবার সামনে যেতে পারেনি আজ! তবে ওকে এই বিকেলবেলা শুকনো মুখে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুলি থমকে গেল যেন! আসলে দুপুরে চেম্বার শেষ করে ও আর বাড়ি যায়নি খেতে। তুলির জন্য কিরকম অস্থির লাগছিল আজ! তাই কিছু না ভেবেই এখানে চলে এসেছে; তুলিকে একবার দেখবে বলে।
তবে তুলি এই মুহূর্তে রঙ্গনকে দেখে আর এড়িয়ে চলে যেতে পারলো না! ও এবার নিজে থেকে এসেই জিজ্ঞেস করলো,
—–” তুমি এখানে? কেন এসেছ? কাল তো সব কথা হয়ে গেছে আমাদের!”
কথাগুলো একটু কঠিনভাবেই বললো ও। তবে রঙ্গন এর কোন উত্তর দিতে পারলো না যেন! বলতে পারলো না যে নিজের ভুলের দাম আর এইভাবে দিতে পারছে না দূরে থেকে! কথাগুলো ভাবতেই হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল কেমন! রঙ্গন টাল সামলাতে না পেরে নিজের গাড়ির দরজাটা ধরে নিল সেই মুহূর্তে। তবে এটা দেখে তুলির মনে পড়ে গেল রঙ্গন এর তো লো বিপির প্রব্লেম আছে! ওর কি কষ্ট হচ্ছে কোন! কথাটা ভাবতেই তুলি জিজ্ঞেস করে উঠলো,
—–” তোমার শরীর ঠিক আছে তো! আর তুমি খেয়েছো কিছু?”
এই প্রশ্নে রঙ্গন একটু এলোমেলো হয়ে বললো,
—–” ঠিক আছি আমি! আসলে সকাল থেকে কাজের এত প্রেশার ছিল যে খাবার টাইম পাইনি!”
এই কথায় তুলি বেশ উত্তেজিত হয়েই বললো,
—–” কি! খাওনি! তাহলে তুমি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো?”
এই প্রশ্নের আবার কোন উত্তর দিতে পারলো না রঙ্গন। আসলে এত ভুলের পর আর সত্যিই তো কিছু বলার নেই! তখন তুলিই বললো কিছুটা ব্যাস্ত হয়ে,
—–” আচ্ছা, ঠিক আছে! ওপরে চলো। কিছু খেয়ে নেবে।”
কিন্তু এই কথায় রঙ্গন সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো,
—–” না প্লিজ! আমি ওপরে যাবো না! আমি যা করেছি, তারপর মা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও লজ্জা হয় আমার! আমি খুব হার্ট করেছি ওদের।”
কথাটা শুনে তুলি চুপ করে গেল যেন! এর ঠিক কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না! তবে রঙ্গন কে না খাইয়ে তো ছাড়া যাবে না! এমনিতেই ছেলেটার মাথা ঘুরছে। এই অবস্থায় ড্রাইভ করে বাড়ি যাবে কি করে! কথাটা ভেবেই তুলি একটু সময় নিয়ে বললো,
—–” এই গলির শেষেই একটা ছোট ক্যাফে আছে। ওখানে চলো।”
কথাটা বলেই তুলি এর দাঁড়ালো না। এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। তবে রঙ্গন খুব অবাক হয়ে গেল মনে মনে! তার মানে তুলি আজও ওকে নিয়ে এত চিন্তা করে!
তবে সেদিন ক্যাফেতে গিয়েও রঙ্গন খাচ্ছিল না ঠিকভাবে। কিরকম থম মেরে ছিল যেন! আসলে সরি বলারও মুখ নেই ওর! আর রঙ্গন জানে, সব খারাপ লাগা একটা শব্দতেই শেষ হয়ে যায় না! তবে সেদিন ক্যাফে থেকে বেরিয়ে তুলি বলেছিল নিজে থেকে খুব শান্ত গলায়,
—–” প্লিজ আর এখানে এসো না! আমাদের মধ্যে সহজ কথাগুলো সব শেষ হয়ে গেছে। আর খাওয়াদাওয়াটা ঠিকভাবে কোরো। ঠিক রেখো শরীরটা।”
কথাগুলো বলেই তুলি চলে যাচ্ছিল, কিন্তু রঙ্গন এর ডাকে স্থির হয়ে গেল আবার! রঙ্গন এই মুহূর্তে তুলিকে খুব নিঃস্ব হয়েই বলেছিল ভেজা চোখে,
—– ” আই এম সরি তুলি! ফর এভরিথিং!”
কিন্তু তুলি এই কথায় কিরকম স্থির হয়েই উত্তর দিয়েছিল, খুব আস্তে স্বরে,
—–” ইটস নট ওকে..”
তারপর আর না দাঁড়িয়ে খুব জোড়ে পা চালিয়েছিল নিজের, রঙ্গন এর কাছ থেকে দূরে যাওয়ার জন্য।
<২১>
তবে দূরে যেতে চাইলেই তো আর দূরে থাকা যায় না! যে ফিরে পেতে চায়, সে তো কাছে আসবেই। যেমন রঙ্গন; তুলির কথা শুনেও শোনেনি। ও এরপর ফ্ল্যাটের বাইরে দাঁড়িয়ে না থাকলেও ওই বস্তির স্কুলটায় আসতো প্রত্যেক রবিবার। তুলিকে একবার দেখবে বলে! তুলি যদিও নিজে থেকে কথা বলতো না! তবে রঙ্গন বাচ্চাগুলোর সাথে আলাপ জমিয়ে নিয়েছিল খুব। ওদেরই হাত দিয়ে কখনো ফুল, কখনো চকলেট, কখনো সরি লেখা একটা কার্ড, এসব পাঠাতো তুলিকে। নিজের মনের ফিলিংস গুলোকে বোঝানোর জন্য।

এর মধ্যে তুলির মা বাবার কাছে এসেও সাহস করে একদিন ক্ষমা চেয়ে গেছে রঙ্গন। আসলে এই মানুষ দুটো তো খুব ভরসা করতো ওকে! তাই রঙ্গন এর খুব গিল্ট হতো নিজের মনে। তবে তুলির মা বাবা তুলির মতন কঠিন হয়ে থাকতে পারেনি রঙ্গন এর সামনে। ছেলেটাকে তো ওরা নিজের সন্তানের চোখেই দেখে! তাই ওর ভুলটাকে আর মনে রাখেনি।
এরপর তুলি খেয়াল করতো রঙ্গন মাঝে মাঝেই আসতো ওদের বাড়ি। কখনো তুলির মা কে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া, তো কখনো তুলির বাবার জন্মদিনের ডিনারে, রঙ্গন বাড়ির ছেলের মতনই যাতায়াত করতো বার বার। তবে তুলি প্রথমে এই ছেলেটাকে দেখে যতটা কঠিন হয়ে থাকতে পারতো, পরে সেই কাঠিন্যটা দেখাতে পারতো না ঠিক! রঙ্গন এর বার বার এই বাড়ি আসা, বস্তিতে যাওয়া, তুলির সাথে কথা বলার চেষ্টা, সমস্ত কিছুই যেন বুঝিয়ে দিত ছেলেটা রিপেন্ট করছে খুব। তবে সেই এক মাস রঙ্গন এর পুরোপুরিভাবে যোগাযোগহীন হয়ে থাকা, ডিভোর্সের নোটিশ পাঠানো, এই ঘটনাগুলো তুলি চাইলেও ভুলতে পারে না আজও। আসলে কিরকম একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে ওর আর রঙ্গন এর মধ্যে। আর সেটা ভেঙে তুলি কোনভাবেই রঙ্গন এর কাছে যেতে পারে না আর! সহজভাবে কথা বলতে পারে না নিজে থেকে।
যাইহোক, এসবের মাঝে দু মাস কেটে গেছে। কিন্তু এরপর হঠাৎ এই ব্যাস্ত শহরে তাল কাটলো যেন! সেদিনও সকাল থেকে খুব বৃষ্টি ছিল কলকাতায়। একটা সাইক্লোন শুরু হয়েছিল ভোর থেকে। তাই তুলিদের স্কুলে রেনি ডে হয়ে গেছিল। সেই জন্য সকাল থেকে বাড়িতেই ছিল ও। কিছু না করে সারাদিন ধরে বৃষ্টি পড়া দেখছিল চুপচাপ। এই কালো মেঘ, এই বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ আসলে ভীষণ প্রিয় তুলির। তবে এর মাঝে সেদিন বিকেলে হঠাৎ তুলির বাবা ড্রইং রুম থেকে চিৎকার করে ডাকলো ওকে। তুলি সেই সময় বারান্দায় ছিল। হঠাৎ বাবার ডাকে তাড়াতাড়ি করে ড্রইং রুমে যেতেই থমকে গেল যেন! সারাদিন এত ঝড় হচ্ছিল, বাজ পড়ছিল বলে টিভি খোলা হয়নি। বিকেলে ওয়েদার টা একটু ঠিক হতে অশোকবাবু নিউজ খুলে বসেছিল। কিন্তু নিউজ খুলতেই দেখলো রঙ্গন দের ‘ কেয়ার হোম ‘ হসপিটালের ছবি, আর রঙ্গন এর মার খাওয়া বিদ্ধস্ত চেহারা। খবরে বলছে এম.এল.এ রমাপদ সিকদারকে আজ সকালে হার্ট এটাকের জন্য ভর্তি করা হয়েছিল হসপিটালে। কিন্তু ভর্তি করার আধ ঘণ্টার মধ্যেই উনি কোলাপস করেন। আর এই পুরো কেসটাই দেখছিল ডক্টর রঙ্গন। কিন্তু রমাপদবাবু মারা যাওয়ার পরই পার্টির ছেলেরা চড়াও হয় হসপিটালের ওপর। রিসেপশন ভাঙচুর, রঙ্গন এর ওপর হামলা, মারধোর, এইসব হয় আধ ঘণ্টা ধরে। তারপর পুলিশ এসে কোন রকমে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এই ঘটনার জন্য কলকাতার ডক্টরস এসোসিয়েশন থেকে প্রচণ্ড ভাবে নিন্দা করা হয়েছে। রঙ্গন এর মতন একজন ইয়ং ট্যালেন্টেড হার্ট সার্জনকে এইভাবে হেনস্তা, অপমান, মারধোর করাটা যে কত বড় অন্যায়, সেটা প্রেশকে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন এসোসিয়েশন এর হেড।
খবরটা শুনে তুলি যেন থমকে গেছিল সেইদিন। রঙ্গন এর মতন এত ভালো একজন ডাক্তারকে এইসব ফেস করতে হলো! এত অপমান! কথাটা ভেবেই কেমন দিশেহারা লাগছিল ওর। তখনই তুলির মোবাইলটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নিরুপমার নাম্বার। তুলি কিছুটা এলোমেলো হয়েই ফোনটা ধরলো, তখনই নিরুপমা বলে উঠলো ভাঙা গলায়,
——” তুই শুনেছিস খবরটা?”
প্রশ্নটা শুনে তুলি সাথে সাথেই বললো,
——” এই দেখলাম নিউজে! আসলে সারাদিন টিভি খোলা হয়নি আজ। রঙ্গন কেমন আছে মা? কোথায় ও?”
কথাটা য় নিরুপমা খুব অস্থির হয়ে বললো,
——” ও এই কিছুক্ষণ আগে বাড়ি এসেছে। কিন্তু এসে থেকে কোন কথা বলছে না আমার সাথে! নিজের ঘরে কিরকম চুপ করে বসে আছে। খুব চোট লেগেছে ছেলেটার। খুব বাজেভাবে মেরেছে ওরা!”
কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো নিরুপমা। কিন্তু তুলি এই সময় নিজের এতদিনের সমস্ত দূরত্ব শেষ করে নিজে থেকেই বলে উঠলো,
—–” প্লিজ তুমি কেঁদো না মা! আমি আসছি। আমি এখনি আসছি রঙ্গন এর কাছে।”
কথাগুলো বলেই তুলি আর দেরি করেনি। ওই বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিল অশোকবাবুর সাথে। যত তাড়াতাড়ি হোক রঙ্গন এর কাছে পৌঁছতে হবে আজ! ছেলেটাকে এই অবস্থায় একা হতে দেবে না তুলি। কোনভাবেই ওর হাতটা ছাড়বে না।
<২২>
তবে সেদিন রঙ্গন এর সামনে গিয়ে তুলি থমকে গেছিল যেন! ছেলেটাকে এই অবস্থায় দেখবে আসলে ভাবেনি কখনো। এলোমেলো চুল, ছেঁড়া জামা, মাথার কাছে রক্ত জমাট বাঁধা! কিরকম জড়োসড়ো হয়ে সেই অবস্থায় বসে আছে রঙ্গন। তুলি সেই মুহূর্তে দরজা থেকে প্রায় দৌড়ে ওর কাছে গেল। তারপর রঙ্গন এর কাঁধে হাত রেখে আস্তে গলায় ডেকে উঠলো ওকে। রঙ্গন এই সময় যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল! তুলির ডাকে ওর স্তম্ভিত ফিরলো হঠাৎ। ও খুব থমকে তাকালো এবার। কিন্তু কিছু ঠিক বলতে পারলো না যেন। তবে তুলি এই মুহূর্তে নিজেকে আর আটকাতে পারলো না! রঙ্গন কে কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরলো খুব শক্ত করে। কিছুতেই এরকম ছন্নছাড়া ভাবে ছেলেটাকে শেষ হয়ে যেতে দেবে না ও! বরং নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবে রঙ্গন কে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও বলে উঠলো,
—–” এইভাবে মাটিতে বসে আছো কেন! প্লিজ ওঠো, চলো, খাটে বসবে। প্লিজ।”
কথাগুলো বলতে বলতে তুলি কেঁদে ফেললো হঠাৎ। রঙ্গন এবার নিজেও ভেঙে পড়লো তুলির সামনে। কিরকম এলোমেলো হয়েই বললো,
——” নিজের ডাক্তারি জীবনে এত অপমান পাবো; আমি কোনদিন ভাবিনি! আমার কলার ধরে আমাকে কেবিন থেকে বাইরে নিয়ে এলো! তারপর মাটিতে ফেলে মারতে শুরু করলো। চর থাপ্পড় লাথি!”
কথাগুলো শুনতে শুনতে তুলি কিরকম শেষ হয়ে যাচ্ছিল যেন। তবে রঙ্গন নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল, —–” পেশেন্ট এর বয়স সেভেন্টি সিক্স ছিল। হসপিটালে নিয়ে আসতেও দেরি করে ফেলেছিল ওরা! তাও আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম! কিন্তু একটা সময়ের পর ডাক্তারদের হাতে কিছু থাকে না! সত্যি থাকে না।”
কথাগুলো বলতে বলতে রঙ্গন কিরকম অসহায়ের মতন কেঁদে ফেলেছিল ওর সামনে। তুলি এই মুহূর্তে আরেকবার খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল রঙ্গন কে। তারপর কোন রকমে ওকে মেঝে থেকে তুলে খাটে বসিয়েছিল। সেই সময় খেয়াল করেছিল রঙ্গন এর কপালে, ঠোঁটে, হাতে কেটে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তুলি এটা দেখে তাড়াতাড়ি ফার্স্ট এড বক্সটা নিয়ে এসেছিল রঙ্গন এর কাছে। তারপর আলতো করে শার্টটা খুলেছিল ওর, আর আঁতকে উঠেছিল কেমন! শুধু কপালে, হাতেই না; পিঠেও একটা দগদগে ঘা, যেখান থেকে এখনও চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে! সেদিন এসব দেখে তুলি কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল যেন। এইভাবে মেরেছে একজন ডাক্তার কে! যে রাত দিন জেগে মানুষের জন্য কাজ করে, নিজের সমস্তটা দিয়ে একজন পেশেন্ট কে বাঁচানোর চেষ্টা করে; তাকে এরকম রাস্তার চোর ডাকাতের মতন মেরেছে! এতটা অপমান, এতটা হেনস্তা এরা কিভাবে করতে পারে একজন ডাক্তারকে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও আস্তে আস্তে রঙ্গন এর চোট গুলো পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্যে ছেলেটা কিরকম নিস্তেজ হয়ে গেছিল যেন। কোন কথা বলছিল না আর।

চলবে।

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০৯

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( নবম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
সুপ্রিয়র মাইল্ড এটাক হয়েছিল সেইদিন। হার্টে ব্লকেজ ছিল। স্টেন্ট বসাতে হয়েছে তাই। রঙ্গনই করেছিল ওর অপারেশন। যদিও সুপ্রিয়র মুখটা দেখে মাঝে মাঝেই সেইদিনের দৃশ্যটা মনে পরে যাচ্ছিল। কিন্তু রঙ্গন নিজেকে স্থির রেখে অপারেশনটা করেছিল।
এরপর পরেরদিন সকালে সেন্স এসেছিল সুপ্রিয়র। সেদিন বাড়ির লোকেদের কাছে জানতে পেরেছিল প্রথম যে ওর অপারেশন করেছে ডক্টর রঙ্গন চ্যাটার্জি। কথাটা শুনেই কেমন ধাক্কা লেগেছিল যেন। রঙ্গন চ্যাটার্জি! মানে তুলির হাজবেন্ড রঙ্গন চ্যাটার্জি! যদিও শুনেছিল সেদিন পার্টিতে যে রঙ্গন এই শহরের একজন নাম করা হার্ট সার্জেন; কিন্তু সুপ্রিয়কে যে একদিন ঘুরে ফিরে এই মানুষটার কাছেই আসতে হবে নিজের জীবনের জন্য, সেটা ভাবেনি একবারও। কথাগুলো ভেবেই চোখটা কিরকম ঝাপসা হয়ে এলো ওর। সেদিন নিজের অহংকারে, নিজের ইগোকে স্যাটিসফাই করার জন্য এত নোংরা কাজ করেছিল ও তুলির সাথে! কথাটা মনে হতেই লজ্জায় কিরকম চোখটা নেমে গেল নিচে। আসলে এইসব করে তো ও রঙ্গন আর তুলির রিলেশনটা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু এত কিছুর পরও রঙ্গন ওর অপারেশন করলো! ওকে একটা নতুন জীবন দিল! কথাটা ভাবতেই কিরকম এলোমেলো লাগছিল আজ। মনে হচ্ছিল রঙ্গনকে সামনে পেয়েই সবার আগে ওকে সত্যি কথাগুলো বলতে হবে সেদিনের। নইলে নিজের দিকে কখনো চোখ তুলে তাকাতে পারবে না আয়নায়। এত খারাপ একজন মানুষ ও! এত বেশি অহংকার নিজেকে নিয়ে! যদি মৃত্যু এত সামনে থেকে এসে ছুঁয়ে না যেত, তাহলে নিজের এই অন্ধকার দিকটা কোনোদিন বোঝাই হতো না সুপ্রিয়র! কথাগুলো ভীষণ ভাবে মনে হচ্ছিল আজ।
যাইহোক, এই ভাবনার ভিড়ে সেদিন দুপুরবেলা রঙ্গন কেবিনে এসেছিল ওর চেক আপের জন্য। সুপ্রিয় সেই মুহূর্তে রঙ্গনকে দেখে প্রথমে চোখ তুলেও তাকাতে পারেনি। রঙ্গনও ভীষণ প্রফেশনাল হয়ে রিপোর্টগুলো চেক করে নার্সকে বলেছিল,
—–” আর তিনদিনের মধ্যে রিলিজ করে দেয়া যাবে পেশেন্টকে। আর বাকি যা টেস্ট আছে, আর পোস্ট অপারেটিভ মেডিকেশন, সব আমি পেশেন্টের বাড়ির লোককে জানিয়ে দেব।”
কথাগুলো বলেই রঙ্গন চলে যাচ্ছিল, কিন্তু সুপ্রিয় আর চুপ না থেকে ডেকে উঠলো ওকে। তারপর ভীষণ রিকোয়েস্ট করে বললো,
——” প্লিজ, একটু দাঁড়ান, আপনার সাথে কিছু কথা আছে আমার, তুলিকে নিয়ে।”
কথাটা শুনে রঙ্গন কিরকম ধৈর্য্যহীন হয়ে গেল যেন! ও খুব বিরক্ত হয়ে বললো,
——” এটা আমার কাজের জায়গা। এখানে আমি পার্সোনাল কোনো কথা শুনিও না, বলিও না। আর তোমার আর তুলির ব্যাপারে আমি লিস্ট ইন্টারেস্টেড.. তাই নতুন করে তোমাদের আফেয়ারের ব্যাপারে আমার কিছু জানার নেই!”
কথাটা বলেই রঙ্গন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু সুপ্রিয় এবার ওই শরীরেই স্যালাইনের চ্যানেল নিয়ে উঠতে যাচ্ছিল ওকে থামানোর জন্য। রঙ্গন সেটা দেখে থমকে গেছিল এক সেকেন্ড। নার্সও সঙ্গে সঙ্গে এসে সুপ্রিয়কে ধরে ফেলেছিল। সেই মুহূর্তে সুপ্রিয় খুব অসহায় গলায় বলেছিল,
——” প্লিজ ডক্টর চ্যাটার্জি, একবার শুনুন আমার কথা। আপনি আমার জন্য তুলিকে ভীষণ ভাবে ভুল বুঝেছেন।”
কথাটায় রঙ্গন এবার স্থির না হয়ে পারলো না। ও তুলিকে ভুল বুঝেছে! কথাটা ভেবেই রঙ্গন নার্সকে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যেতে বললো কেবিন থেকে, তারপর খুব কঠিন গলায় সুপ্রিয়র সামনে এসে বললো, —-” আর কি বলার আছে তোমার? সেদিন তোমাদের লাভ স্টোরির ডিটেলসটা কি কিছু কম ছিল! যে আজ নতুন কিছু শোনাবে?”
কথাগুলো শুনে সুপ্রিয় কেঁদে ফেলেছিল এবার অপরাধবোধে। ও খুব থমকে থাকা গলায় বলেছিল,
——” আপনি সব কিছু ভুল জানেন। শুরু থেকে শেষ অব্দি ভুল। হ্যাঁ, তুলির সাথে বিয়ের আগে আমার একটা রিলেশন ছিল ঠিকই, কিন্তু তিন বছর সম্পর্কটা রেখে আমি ওকে শেষে বিয়ের জন্য না বলে দিয়েছিলাম। তিন বছরের রিলেশনটা একদিনে শেষ করে দিয়েছিলাম স্বার্থপরের মতন। আসলে হঠাৎ করে খুব ফেমাস হয়ে গেছিলাম মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। তাই সব কিছুকে খুব সস্তা মনে হতো। যেই মেয়েটা আমার স্ট্রাগল এর দিনগুলোতে প্রত্যেকটা সময় আমার সাথে ছিল, তাকে নিজের লাইফ থেকে বাদ দিতে এক সেকেন্ড ও ভাবিনি। তবে তুলি সেদিনের পর আমার সাথে একবারের জন্যও যোগাযোগ করেনি আর। কখনো একটা ফোন অব্দি করেনি। তারপর পার্টিতে যখন আমি তুলিকে আপনার সাথে দেখলাম, তখন কোথাও একটা মেল ইগো হার্ট হলো আমার! আমাকে ছেড়ে যে তুলি এত সহজে অন্য একজনের হাত ধরেছে, এটা আমি একসেপ্ট করতে পারিনি সেইদিন। একসেপ্ট করতে পারেনি যে তুলি এতদিন বাদে আমাকে দেখেও চিনলো না একবারও সবার সামনে! তাই ওয়েটারকে টাকা দিয়ে আমি তুলির শাড়িতে সফ্ট ড্রিঙ্কটা ফেলতে বলেছিলাম। তারপর ওয়াশ রুমে ওকে একা পেয়ে, আই মলেস্টেড হার.. খুব নোংরামি করেছিলাম সেদিন ওর সাথে ড্রিঙ্ক করে। তারপর আপনাকে দেখেও ইচ্ছে করে ওইসব কথা বলেছিলাম, যাতে আপনার আর তুলির রিলেশনটা শেষ হয়ে যায়! তুলি তো আমাকে ঘেন্না করে। ও আমার সাথে রিলেশন রাখা তো দূরে থাক, আমার মুখও দেখতে চায় না কখনো! আমি সেদিন যা বলেছি, সব মিথ্যে বলেছি, ট্রাস্ট মি.. আর এত বড় ভুল করেও কোন রিয়ালাইজেশন ছিল না আমার! যদি না এই হার্ট এটাকটা হতো। প্লিজ ডক্টর চ্যাটার্জি, আমার মতন একটা নোংরা লোকের জন্য তুলির সাথে নিজের সম্পর্কটা খারাপ করবেন না! প্লিজ!”
শেষ কথাগুলো সুপ্রিয় হাত জোড় করে বলেছিল রঙ্গনকে। কিন্তু রঙ্গন এই মুহূর্তে কিরকম স্তব্ধ হয়ে গেছিল যেন! এটা কি করলো ও! সেদিন তুলিকে মলেস্ট করা হয়েছিল, তারপরও রঙ্গন তুলিকে এত খারাপ কথা বললো! এত অপমান করলো! এমনকি ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললো! একবারও তুলির কথাটা শোনার প্রয়োজন বোধ করলো না! এমনকি প্রায় এক মাস হতে চললো, ও তুলিকে একটা ফোন অব্দি করলো না! এতটা ভুল বুঝেছে মেয়েটাকে রঙ্গন! কথাগুলো ভেবেই কেমন শেষ হয়ে যাচ্ছিল নিজে! প্রচণ্ড রাগ আর লজ্জা হচ্ছিল হঠাৎ নিজের ওপরই। কেমন নিজেকেই একটা চর মারতে ইচ্ছে করছিল আজ!
সেই মুহূর্তে রঙ্গন আর দাঁড়ালো কেবিনে। এই ছেলেটার মতনই খারাপ মানুষ মনে হলো আজ নিজেকে। সত্যি! সুপ্রিয়র সাথে ওর কি তফাৎ! সুপ্রিয় একটা নোংরা কাজ করেছে, আর রঙ্গন তার থেকেও বেশি খারাপ করেছে তুলির সাথে। ও এতগুলো দিন তুলির সঙ্গে থেকেও ওকে সামান্য বিশ্বাস টুকু অব্দি করতে পারেনি! ওই রাত্রিবেলা তুলিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছে! তারপর একবারের জন্য খোঁজ অব্দি নেয়নি মেয়েটার। কথাগুলো ভেবে রঙ্গন আর সেদিন স্থির থাকতে পারলো না। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে! এবার ওকে তুলির কাছে যেতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে তুলিকে যেভাবেই হোক নিজের কাছে।
<১৯>
সেদিন এসব ভাবনার ভিড়েই তুলিদের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে হাজির হয়েছিল রঙ্গন। আজ খুব ইতঃস্তত হয়েই কলিংবেলটা বাজিয়েছিল এরপর। তবে তুলির বাবা দরজা খুলে খুব অবাক হয়ে গেছিল যেন ওকে দেখে! আসলে তুলি এতদিন এখানে এসে আছে, কিন্তু রঙ্গন তো একবারও দেখা করতে আসেনি এই বাড়ি! তাই বেশ আশ্চর্য হয়েই বলেছিল,
—–” তুমি! এখানে?”
রঙ্গন এর এই প্রশ্নে কেমন মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল এখন। সত্যি তুলির মা বাবা ওকে কি ভাবছে কে জানে! কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবছে হয়তো! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তুলির বাবা এবার দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললো,
—-” ভিতরে এসো। ”
এই কথায় রঙ্গন কিছুটা এলোমেলো হয়েই ভিতরে ঢুকলো। তারপর ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—–” তুলি আছে বাড়িতে?”
এই প্রশ্নে অশোকবাবু অল্প কথায়ই বললেন,
——” ও মায়ের সাথে একটু বাজারে গেছে। ফেরেনি এখনও। তুমি চাইলে অপেক্ষা করতে পারো।”
কথাটা শুনে রঙ্গন নিজে থেকেই বললো,
—–” আমি ওর ঘরে গিয়ে বসছি। ”
অশোকবাবু এই কথায় একটু সময় নিয়ে একটা অন্য কথা বলে উঠলো হঠাৎ। আজ উনি বেশ ভারাক্রান্ত গলাতেই বললেন,
—–” আমি জানি না তোমাদের মধ্যে ঠিক কি হয়েছে! আসলে আমার মেয়ে খুব কষ্ট পেলে এরকম চুপ করে যায়। কিছু বলে না আর! তবে আমি তোমার থেকে এটা আশা করিনি রঙ্গন। একবার অন্তত তুমি তুলির খোঁজ নিতে পারতে! অন্তত একটা ফোন করে হলেও।”
কথাগুলো বলে উনি আর দাঁড়ালেন না। ঘরটা খালি করে চলে গেলেন সেই মুহূর্তে। কিন্তু রঙ্গন এর ভীষণ খারাপ লাগলো হঠাৎ নিজের ওপরই। কিভাবে পারলো এতটা ইন্সেন্সিটিভ হতে! অন্তত একবার তুলির জন্য ভাবতে পারলো না!

যাইহোক, সেদিন এই খারাপ লাগার মাঝেই ও অপেক্ষা করছিল তুলির ঘরে মেয়েটার জন্য। এরপর প্রায় আধ ঘন্টা বাদে হঠাৎ নিঃস্তব্ধ ঘরে সেই মেয়েটার চেনা স্বর কানে এলো! তুলি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভীষণ থমকে থাকা গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,
——” তুমি এখানে! কোন দরকার ছিল?”
এই প্রশ্নে রঙ্গন পিছনে ফিরে তাকিয়েছিল তুলির দিকে, আর কেমন কথা হারিয়ে ফেলেছিল যেন। এতদিন বাদে ঠিক কোন মুখে ওর সামনে কথা বলবে! এতটা ভুল বুঝে, এত অপমান করে আজ সত্যিই আর কি বলার আছে নিজের হয়ে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও ভিজে চোখে দূর থেকেই বলেছিল,
——” বাড়ি চলো। প্লিজ!”
এই কথায় তুলি কিরকম নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক জায়গায়। হঠাৎ এতদিন বাদে রঙ্গন এসে ওকে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে কেন! কথাটা বুঝতে পারছিল না কোনোভাবে।
রঙ্গন তখন নিজের চোখ দুটো নিচে নামিয়ে খুব আস্তে গলায় বলেছিল,
——” সুপ্রিয়র হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল একটা কাল; ওকে আমাদের হসপিটালেই নিয়ে এসেছিল তারপর। আর আমিই ওর ট্রিটমেন্ট করেছি। তারপর ওর সেন্স ফিরে আসতে নিজের গিল্ট থেকে সমস্ত সত্যিটা একসেপ্ট করেছে আমার কাছে!”
কথাটায় তুলি এই মুহূর্তে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারলো না! এত ভুল বোঝা, একাকীত্ব, অপমানের পর কেউ ওর সত্যিটা বললেই কি কিছু বদলে যাবে! সব আবার আগের মতন হয়ে যাবে! কথাটা ভাবতেই রঙ্গন এবার উঠে দাঁড়িয়ে ভীষণ অসহায়ভাবে প্রায় হাত জোড় করে বললো ওর সামনে,
——” প্লিজ বাড়ি চলো তুলি! আমি জানি আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি! আমার একবার অন্তত তোমার কথা শোনা উচিত ছিল। আমি জানি না আবার সব কিছু কিভাবে ঠিক করবো! কিন্তু প্লিজ বাড়ি চলো তুলি। প্লিজ!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল রঙ্গন। কিন্তু তুলি এই মুহূর্তে খুব স্থির গলায় উত্তর দিয়েছিল,
——” এটা আর সম্ভব না। আসলে আমি তোমাকে খুব আলাদা ভাবতাম! কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তুমিও সবার মতনই! নইলে সেদিন অতো রাতে বৃষ্টির মধ্যে আমাকে একা বেরিয়ে আসতে হতো না রাস্তায়। আর ভুলটা হয়তো আমারই। আমিই নিজের জন্য সেই বিশ্বাসের জায়গাটা তৈরি করতে পারিনি তোমার কাছে! যাইহোক, ইউ ডিসার্ভ সমওয়ান বেটার..”
কথাটা বলেই ও পাশের টেবিলে রাখা পেপারটা রঙ্গন এর দিকে এগিয়ে দিয়ে খুব শান্ত গলায় বলেছিল, ——” এই যে। যেই ডিভোর্স পেপারটা পাঠিয়েছিলে সেটাতে সাইন করে দিয়েছি আমি। দেখে নিও সব ঠিক আছে কি না?”
কথাটা শেষ করে তুলি আর থাকলো না রঙ্গন এর কাছে। কোন প্রত্যুত্তর শোনার আগেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে তখনই। কিন্তু রঙ্গন এর কিরকম চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে এলো যেন! এটা কি করেছিল ও! রাগের মাথায় নিজেই তো উকিলকে দিয়ে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিল তুলির কাছে! এরপর আর কোন মুখে ফিরে যাওয়ার কথা বলবে তুলিকে! কিভাবে বোঝাবে যে ‘ ভালোবাসি ‘! কথাটা ভাবতেই কিরকম শেষ হয়ে গেল ভিতরে ভিতরে। নিজের ভুলের মধ্যেই খুব বেশি করে জড়িয়ে গেল আজ কেমন!
<২০>
তবে সেদিন তুলি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা গেছিল এপার্টমেন্টের ছাদে। আসলে এখন কেমন দম বন্ধ করা কষ্ট হচ্ছে বুকে। রঙ্গনকে ভালোবেসে ফেলেছিল যে ও! ভীষণ মন থেকে। কিন্তু তার কাছ থেকেই যে একদিন এত অবিশ্বাস, অপমান ফেরৎ পাবে, এটা ভাবেনি! আর সব কিছুর শেষ ছিল ওই ডিভোর্স পেপারটা! রঙ্গন নিজে থেকে যদি ওই পেপারটা না পাঠাতো, তাহলেও হয়তো ছেলেটার একটা ডাকে তুলি ফিরে যেত আবার! কিন্তু ডিভোর্সের নোটিশে সাইন করার পর সেটা আর সম্ভব না। তুলি আর কক্ষনো যাবে না রঙ্গন এর কাছে। কোনভাবেই না।
সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই ও অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছিল ছাদে। তারপর খুব ক্লান্ত মন নিয়ে যখন ঘরে এসেছিল, তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে শহরে। কিন্তু এই মুহূর্তে ঘরে এসে তুলি স্থির হয়ে গেছিল হঠাৎ। ডিভোর্সের নোটিশটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে ওর বইয়ের টেবিলে! তাহলে কি রঙ্গন এটা করেছে! কিন্তু এইভাবে কাগজ ছিঁড়ে ও কি প্রমাণ করতে চায়! যে এই ডিভোর্সটা ও আর চায় না! কিন্তু রঙ্গন এর সব চাওয়ার দাম তো আর তুলি দিতে পারবে না। সেই রাতে রঙ্গন চেয়েছিল বলে তুলি ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। এরপর রঙ্গন কোন যোগাযোগ রাখতে চায়নি বলে তুলি কখনো একটা ফোন করেও বিরক্ত করেনি ওকে। তারপর এই ডিভোর্স এর নোটিশ! সেটাও তো তুলিকে একবারও না জিজ্ঞেস করেই পাঠিয়েছিল রঙ্গন। তুলি এরপরও কিছু বলেনি। কিন্তু আর না! আর রঙ্গন এর ইচ্ছের দাম দেওয়া তুলির পক্ষে সম্ভব না। আর যে বিশ্বাসই করে না; তার কাছে ফিরে যাবে কেন! কথাগুলো ভেবেই তুলি কঠিন হলো আজ ভীষণ।

চলবে।