Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 259



অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০৮

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( অষ্টম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১৬>
এরপর কোন রকমে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে তুলি ফিরেছিল বাড়ি। নিরুপমা তো সেদিন দরজা খুলে ভীষণ অবাক হয়ে গেল যেন! তুলি আর রঙ্গন তো একসাথে গেছিল পার্টিতে, তাহলে ফিরলো আলাদা আলাদা কেন! কথাটা ভাবতেই তুলি কেমন এলোমেলো হয়ে জিজ্ঞেস করলো ওকে,
——” মা, রঙ্গন ফিরেছে?”
এই প্রশ্নে নিরুপমা কিছু না বুঝতে পেরেই বললো,
——” হ্যাঁ, এই দশ মিনিট আগে ফিরেছে। কিন্তু কি হয়েছে? তুই এইভাবে আলাদা এলি কেন!”
এই প্রশ্নের ঠিক কোন উত্তর দিতে পারলো না তুলি এই মুহূর্তে। ও কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছিল যেন! তাই প্রায় দৌড়েই এসেছিল ঘরে, রঙ্গন এর কাছে।
কিন্তু রঙ্গন সেদিন আর নিজের মধ্যে ছিল না! ওয়াশ রুমের ওই দৃশ্যটা যেন ভাসছিল ওর চোখের সামনে। ঘর অন্ধকার করে তাই বসেছিল একা। ইচ্ছে হচ্ছিল হাতের কাছে যা আছে, সমস্ত কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে! শেষ করে দিতে সব কিছু। তখনই তুলি হঠাৎ ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। আজ তুলি ভীষণ অসহায় গলায় বলে উঠেছিল রঙ্গন কে,
—– ” তুমি বিশ্বাস করো, তুমি যা দেখেছ ভুল দেখেছ আজ। সুপ্রিয় আমাকে জোর করে!”
কথাটাকে ওর শেষ হতে না দিয়েই রঙ্গন এবার খাটের পাশে রাখা নাইট ল্যাম্পটাকে ছুঁড়ে ফেললো মাটিতে খুব জোরে। রাগে, ঘেন্নায় হাত পা কাঁপছিল যেন ওর। তুলি এসব দেখে কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল সেই মুহূর্তে। বুঝতে পারলো রঙ্গন আর কিছু শোনার মতন অবস্থায় নেই এখন।
তবে রঙ্গন এবার ভীষণ কঠিন গলায় বললো তুলিকে,
——” চলে যাও তুমি। জাস্ট লিভ, রাইট নাও..”
কথাটায় তুলির হঠাৎ ধাক্কা লাগল যেন! ও এবার শেষবারের মতন রঙ্গনের হাতটা ধরে ওকে বুঝিয়ে বললো,
——” তুমি ভুল বুঝছো আমাকে! আমি সত্যি কোনোদিন ঠকায়নি তোমাকে! আমি তো তোমাকে ভালো!”
না, এবারও ওর কথাটাকে শেষ হতে না দিয়ে রঙ্গন জোরে হাতটা ছাড়িয়ে নিল নিজের। তারপর ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
——” আর কোন মিথ্যে না! আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। এই জন্য আজ অব্দি তুমি আমাকে নিজের থেকে দূরে রেখেছো! কারণ তোমার তো ওই ছেলেটার ছোঁয়া পছন্দ। আমি তো একটা বাইরের লোক তোমার কাছে!”
কথাগুলো শুনে তুলি আর কিছু বলতে পারলো না যেন! রঙ্গন যে ওকে এতটা নিচে নামিয়ে দেবে, এটা ভাবতে পারছিল না আসলে! কিন্তু রঙ্গন এবার শেষ বারের মতন বলে উঠলো খুব রুক্ষ স্বরে,
——” আমি আর তোমার সাথে থাকতে পারবো না। আর খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমাকে এই বিয়েটা থেকে মুক্তি দিয়ে দেব! নাও জাস্ট লিভ.. চলে যাও তুমি।”
কথাগুলো বলেই রঙ্গন ঘরটা থেকে বেরিয়ে গেল সেই সময়। কিন্তু তুলি কিরকম সব হারিয়ে একটা নিঃস্ব মানুষের মতন দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়। মনে হচ্ছিল যেই তাসের ঘরটাকে এতদিন একটু একটু করে বানিয়েছিল তুলি, সেটা এক ধাক্কায়ই ভেঙে গেল আজ! আর সব শেষ হয়ে গেল চোখের পলকেই।
<১৭>
সেদিন এরপর তুলি আর কিছু বলেনি, কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেনি নিজের হয়ে। কারণ রঙ্গন আর কিছু শোনার মতন অবস্থায় ছিল না। তাই সেই রাতে নিঃশব্দে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ঐ বাড়িটা থেকে। নিরুপমা যদিও শেষ চেষ্টা করেছিল। ও খুব অসহায় হয়ে বলেছিল তুলিকে,
—–” জানি না তোদের মধ্যে কি হয়েছে! কিন্তু এইভাবে চলে যাস না মা! ছেলেটা এখন খুব রেগে আছে, তাই কি বলতে কি বলেছে! সব কথাকে এইভাবে ধরতে নেই। ওর মাথা ঠাণ্ডা হলেই আবার তোর কাছে আসবে।”
কথাগুলো শুনে তুলি ভীষণ থমকে থাকা স্বরে বলেছিল,
—–” ও আর আসবে না আমার কাছে মা। আর আমার এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়াটাই ঠিক।”
কথাটা বলে তুলি নিরুপমা কে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল সেই মুহূর্তে। তারপর ভেজা চোখেই বেরিয়ে এসেছিল দরজার বাইরে।

সেদিন এরপর বৃষ্টি নেমেছিল খুব শহরে। তুলি সেই বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ রাস্তায় বেশ কিছুক্ষণ। ওই নোংরা ছেলেটা আজ ছুঁয়েছে ওকে। জোর করে নিজের পুরো শরীরটা চাপিয়ে দিয়েছে ওর ওপর! কথাটা ভেবেই কেমন গা গুলিয়ে উঠছিল যেন। মনে হচ্ছিল এই বৃষ্টিতে ভিজে যদি ওই নোংরা হাতের স্পর্শটাকে মুছে ফেলা যায়! কথাগুলো ভেবেই এই মুহূর্তে আর সামলাতে পারলো না নিজেকে। কান্নায় ভেঙে পড়লো কেমন। এই বৃষ্টি ভেজা আবছা শহরে কিরকম ছন্নছাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গায়।
তবে সেদিন রঙ্গন এর কথাও মনে হচ্ছিল খুব। রঙ্গন শেষে এইভাবে ভুল বুঝলো ওকে! এতটা খারাপ ভাবলো! একবারও শুনলো না তুলির কথা! ওর ব্যাগ গোছানো দেখেও আটকালো না ওকে! কথাগুলো ভেবে সব কিছু কিরকম মিথ্যে লাগছিল আজ। মনে হচ্ছিল এতদিনের একসাথে থাকা, এত অগুন্তি মুহূর্ত, ভালো লাগা, সব মিথ্যে। আসলে হয়তো ভুলটা ওরই। ‘ ভালোবাসি ‘ এই কথাটা বোঝাতে পারেনি ছেলেটাকে। নিজের জন্য সেই বিশ্বাসের জায়গাটাই তৈরি করতে পারেনি! অনেক ফাঁক রয়ে গেছে। সেই জন্যই আজ এইভাবে এই বৃষ্টি ভেজা শহরে একা দাঁড়িয়ে তুলি।

যাইহোক, সেদিন এরপর অনেক রাতে মা বাবার কাছে গেছিল ও। অশোকবাবু আর ওয়েন্দ্রিলা তো এত রাতে মেয়েকে একা এইভাবে দেখে ঘাবড়ে গেছিল খুব! কি হলো হঠাৎ, যে তুলিকে এইভাবে এই বৃষ্টির মধ্যে আসতে হলো এখানে! কথাটা ভেবেই চিন্তায় ওরা রঙ্গনকে ফোন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তুলি তখনই ওদের আটকে দিয়েছিল ভীষণ দৃর গলায়। ও সেই মুহূর্তে খুব কঠিন হয়ে বলেছিল,
——” কাউকে ফোন করার দরকার নেই। তোমাদের যদি আমাকে থাকতে দিতে অসুবিধা হয়, তাহলে বলো, আমি অন্য কোথাও চলে যাবো। কিন্তু রঙ্গন কে আর জোর কোরো না আমার দ্বায়িত্ব নেয়ার জন্য। আমি চাকরি করি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট। নিজের টা ঠিক চালিয়ে নিতে পারবো।”
কথাটায় তুলির মা বাবা কিরকম থমকে গিয়েছিল যেন। বুঝেছিল খুব বড় কোন ঘটনা ঘটেছে! নইলে তুলি এসব কখনো বলতো না। তাই আর কথা বাড়ায়নি ওরা। আসলে মাঝে মাঝে একটু সময় দিতে হয়। সব প্রশ্ন যখন তখন করা যায় না! আর তুলি ছোট থেকেই ভীষণ অভিমানী। তাই ওকে নিজের মতন কিছুটা সময় দিতেই হবে।

যাইহোক, এরপর তুলি এই বাড়িতেই ছিল নিজের মতন। ও আর রঙ্গন কে ফোন করেনি। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। আর রঙ্গনও একই। সেইদিনের পর তুলিকে আর কোন রকম ফোন বা মেসেজ করেনি। শুধু মায়ের মুখে শুনেছিল তুলি নিজের বাড়িতে আছে, ব্যাস। তবে এর বেশি খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করেনি বিশেষ।
আসলে সেদিনের ওই ওয়াশরুমের দৃশ্যটা, সুপ্রিয়র কথাগুলো, আজও কানে বাজে ওর! তুলি কিস করছিল ছেলেটাকে! পার্টিতে, সবার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে ওই ছেলেটার ঠোঁটে মিশিয়ে দিচ্ছিল নিজের ঠোঁট। কথাটা ভাবলেই রাগে চারিদিকটা অন্ধকার লাগে ওর। মনে হয় ঠকিয়েছে তুলি ওকে, প্রথম থেকে। আসলে এই বিয়েটা করেছিল জাস্ট নিজের মা বাবার চোখে ভালো সাজার জন্য। কিন্তু রঙ্গনকে তো ও কোনদিন একসেপ্ট করতেই পারেনি। তাই কখনো রঙ্গনকে নিজের কাছে আসতে দেয়নি; ভালোবাসেনি! আর রঙ্গন এত বোকা, যে শুধু দিনের পর দিন অপেক্ষাই করে গেছে! একবারও বোঝেনি যে তুলি শুধু লোক দেখানোর জন্য ওর সাথে আছে, আসলে মনে মনে ও প্রত্যেকটা দিন, প্রত্যেকটা মুহূর্ত নিজের পুরনো প্রেমিক সুপ্রিয়র সাথেই ছিল। তাই পার্টিতে ছেলেটাকে একবার দেখে আর সামলাতে পারেনি নিজেকে। শেষ পর্যন্ত সবার আড়ালে গিয়ে ওয়াশ রুমে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরেছে, আঁকড়ে ধরেছে নিজের সর্বস্ব দিয়ে! কথাগুলো ভেবেই এত রাগ আর ঘেন্না হয় ওর যে তুলির নামটাও আর মুখে আনে না নিজে থেকে। এর মধ্যে একদিন গিয়ে লইয়ারের সাথে কথাও বলে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি তুলিকে এই বিয়েটা থেকে মুক্তি দেবে রঙ্গন। নিজে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠাবে তুলির কাছে।
<১৮>
এই মন খারাপের অন্ধকার আর সম্পর্কের কাঁটা ছেঁড়ার মধ্যেই দিন কাটছিল তুলি আর রঙ্গন এর। এর মধ্যে একদিন ডিভোর্সের নোটিশটা সকালে হাতে পেয়েছিল তুলি। ভাগ্যিস সেদিন মা বাবা কেউ বাড়িতে ছিল না, মন্দিরে পুজো দিতে গেছিল! নইলে ওদের সামনে এই কাগজটা আসলে কখনো সাইন করতে দিত না তুলিকে। হয়তো রঙ্গনকে ফোন করে বোঝানোর চেষ্টা করতো! হাতে পায়ে ধরতো ওর তুলির সাথে সংসার করার জন্য! কিন্তু তুলি তো এটা চায় না। যার ওর ওপর এত অবিশ্বাস, যে এত বড় একটা ডিসিশন নেয়ার আগে একবার অন্তত তুলিকে একটা ফোন অব্দি করলো না, তার সাথে তুলি কেন জোর করে থাকবে! কেন নিজের সত্যিটা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে! এতটা সস্তা তো ও করবে না নিজেকে রঙ্গন এর কাছে। কথাগুলো ভেবেই সেদিন নিঃস্তব্ধভাবে সাইন করেছিল ডিভোর্স পেপারে। সেই মুহূর্তে এই ফাঁকা বাড়িতে অভিমানে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল তুলি। এত ঠুনকো ছিল ওদের সম্পর্কটা! এতটা দূর্বল! যে একটা ছোট্ট ঝড়ে ভেঙে গেল এইভাবে!
কথাগুলো রঙ্গনেরও মনে হচ্ছিল এই কদিন ধরে। এই বিয়েটা আসলে শুরু থেকেই হয়ত একটা ভুল ছিল! তাই এইভাবে ভেঙে গেল চোখের পলকে। উকিল একদিন আগে ওকে ফোন করে জানিয়েছে আসলে, যে ডিভোর্স নোটিশ পোস্ট করে দিয়েছে তুলিদের এড্রেসে। আজকের মধ্যে সেটা তুলির হাতে পৌঁছেও যাবে হয়তো! আর তুলি তো ওকে ভালোবাসে না। তাই এই পেপারটা দেখে হয়তো খুশিই হবে আজ।
সেদিন নার্সিং হোমে চেম্বার শেষ করে একা ঘরে এই কথাগুলোই ভাবছিল ও। এখন ঘড়িতে রাত এগারোটা। অন্যদিন হলে অনেক আগেই বাড়ি চলে যেত রঙ্গন। কিন্তু আজকাল আর ওই ফাঁকা ঘরটায় ফিরতে ইচ্ছে করে না যেন! যেদিকেই তাকায়, তুলির মুখটাই ভেসে ওঠে সারাক্ষণ।
যাইহোক, এই ভাবনার ভিড়ে সেদিন হঠাৎ ওর চেম্বারে একজন সিস্টার হন্তদন্ত হয়ে এসে বললো,
——” স্যার একটা হাই প্রোফাইল কেস এসেছে ইমারজেন্সি তে। সুপ্রিয় সেন, ফেমাস সিঙ্গার, উনি গান গাইতে গাইতে স্টেজে সেন্সলেস হয়ে গেছেন চেস্ট পেইন নিয়ে। ওই প্রোগ্রামের অর্গানাইজাররাই এখানে নিয়ে এসেছে ট্রিটমেন্ট এর জন্য। প্লিজ, আপনি একটু চলুন।”
কথাটা শুনে রঙ্গন থমকে গেল কেমন! ওই ছেলেটার মুখ আবার দেখতে হবে ওকে! আর কোন হসপিটাল নার্সিং হোম কিছু পেল না যাওয়ার জন্য! আর এখন তো হার্ট সার্জেন ও ই আছে এভেলেবেল। ডক্টর আচার্য্য তো লিভ এ আছেন। তাই আর কোন উপায় নেই। ওকেই হ্যান্ডেল করতে হবে কেসটা। কথাটা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস আপনাআপনি চলে এলো। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের ইমশনটাকে কন্ট্রোল করে উঠে দাঁড়ালো রঙ্গন, একজন ডাক্তার হিসেবে পেশেন্টের জন্য।

চলবে।

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০৭

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( সপ্তম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
তবে এরপরের দিন রঙ্গন এর ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। তুলি সেদিন কফি নিয়ে ঘরে আসতে দেখেছিল রঙ্গন ফ্রেশ হয়ে ঘরটা অন্ধকার করে শুয়ে আছে চুপচাপ। তুলি এটা দেখে রঙ্গন এর কাছে গিয়েছিল চুপ করে, তারপর আস্তে গলায় জিজ্ঞেস করেছিল,
—–” কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
এই কথায় রঙ্গন কিছুটা ক্লান্ত স্বরে বলেছিল,
—–” মাথাটা খুব যন্ত্রণা করছে। একটু বামটা দেবে প্লিজ। ড্রয়ারে আছে।”
এটা শুনে তুলি তাড়াতাড়ি ড্রয়ার থেকে বামটা নিয়ে গিয়েছিল রঙ্গন এর কাছে। আসলে প্রায় দেড় দিন টানা না ঘুমিয়ে কাজ করেছে ছেলেটা! তাই এরকম যন্ত্রণা হচ্ছে স্ট্রেস থেকে। কথাটা ভেবেই তুলি আলতো করে বামটা নিয়ে রঙ্গন এর কপালে হাত দিয়েছিল। কিন্তু রঙ্গন এই স্পর্শে কিরকম থমকে গিয়েছিল হঠাৎ। তুলির নরম হাতের উষ্ণতাকে ফিল করছিল যেন কয়েক সেকেন্ড। মনে হচ্ছিল তুলিকে খুব নিজের করে পেতে। তবে তখনই সেই ফুলসজ্জার রাতের কথাটা মনে পড়ে গিয়েছিল ওর। মনে পড়ে গিয়েছিল তুলি রঙ্গন কে ভালোবাসে না এখনও! তাই নিজেকে সংযত করে বলে উঠেছিল,
—–” আমাকে দাও। আমি লাগিয়ে নিচ্ছি বাম। তুমিও তো স্কুল থেকে এসেছ কিছুক্ষণ আগে! রেস্ট নাও এখন।”
কথাটা বলেই তুলির হাতটা ধরেছিল ও সরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তুলি সেই মুহূর্তে জোর করেই রঙ্গন কে আটকে বলেছিল,
—–” তুমি চোখটা বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো। আর কিছু ভাবতে হবে না।”
কথাটা শুনে রঙ্গন আর কিছু বলতে পারেনি। আসলে এই স্পর্শ, তুলির আলতোভাবে ওর কাছে আসা, সব কিছুই রঙ্গন এর ভীষণ ভালো লাগছিল এই মুহূর্তে। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল ও হঠাৎ। ক্লান্ত শরীর অবশ হয়ে আসছিল ধীরে ধীরে। মাথার যন্ত্রণাটাও মিষ্টি লাগছিল খুব। তার মধ্যেই ঘুম জড়ানো গলায় ও বলে উঠেছিল,
—–” কি সুন্দর গন্ধ তোমার! এরকম ভাবে কাছে আসো না কেন!”
কথাটা বলেই ঘুমের মধ্যে হারিয়ে গেছিল ও, আর তুলি স্থির হয়ে গেছিল কেমন। খেয়াল করেছিল জানলা থেকে চাঁদের রুপোলি আলো এসে পড়ছে এই মুহূর্তে রঙ্গন এর মুখে। আর ছেলেটা তার মাঝে কেমন শিশুর মতন সরল মুখে ঘুমিয়ে আছে ওর সামনে! কি মায়া লাগছে এখন রঙ্গন কে দেখে ওর! কি দোষ ছিল ছেলেটার! একটু তো ভালোবাসাই চেয়েছিল তুলির কাছ থেকে। তার বদলে তুলি দিনের পর দিন শুধু দূরে সরিয়ে রেখেছে ওকে। কখনো ছেলেটার মনটা বুঝতে চায়নি নিজে থেকে। কথাগুলো ভেবে কেমন চোখটা ভিজে এলো হঠাৎ। খারাপ লাগলো খুব ভেতর থেকে।
তুলি সেই মুহূর্তে রঙ্গন এর কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল আলতো করে। রঙ্গন এর অবচেতনেই আজ প্রথম ভালোবাসলো ছেলেটাকে।

<১৫>
সেদিনের পর থেকে তুলির মনে কিছু একটা বদলে গেছিল! রঙ্গন এর জন্য ফিল করতে শুরু করেছিল ও। তাই ছেলেটার ছোট বড় সমস্ত দরকারের খেয়াল রাখতে শুরু করেছিল নিজে থেকে। রোজ রঙ্গন এর বেরোনোর আগে ওর শার্ট, ওয়ালেট বার করে রাখা, রঙ্গন এর যেটা খেতে ভালো লাগে সেসবের খোঁজ নিরুপমার কাছ থেকে নিয়ে সেগুলো রান্না করা, স্কুলে হাজার কাজের মধ্যেও রঙ্গন কে মেসেজ করে ঠিক সময়ে খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়া, এইসব তুলি ভীষণ মন থেকে করতো। কেন জানে না আজকাল স্কুল থেকে ফিরে ও সারাক্ষণ অপেক্ষা করে থাকতো, রঙ্গন কখন ফিরবে! খুব মন কেমন করতো ছেলেটাকে একবার দেখার জন্য। তারপর রঙ্গন ফিরলে তুলি আজকাল নিজেই কথার ঝাঁপি খুলে বসতো। সারাদিন স্কুলে কি হলো! কেমন কাটলো দিনটা, সব বলতো রঙ্গনকে। আর রঙ্গনও ভীষণ মন দিয়ে শুনতো সব কিছু। আর একটু অবাক হয়ে যেত কখনো কখনো! তুলি নিজের মাপা দূরত্ব নিয়ে আর সরে থাকে না ওর থেকে, এটা বুঝতো ভীষণভাবে। কিন্তু এটা বুঝতে পারতো না এটা ভালোবাসা কি না! আসলে ফুলসজ্জার রাতের কথাগুলো আজও ভোলেনি রঙ্গন। তুলি যে বিয়েটা মা বাবার কথায় করেছিল, ফিল করে না, এটা খুব বড় একটা সত্যি রঙ্গন এর কাছে।
যাইহোক, এইভাবে দুটো মাস কেটে গেছিল ওদের জীবন থেকে। কিন্তু এরপর একটা ঘটনা ঘটলো। রঙ্গন এর বন্ধু অমিওর বিবাহ বার্ষিকীর জন্য একটা পার্টিতে ইনভিটেশন ছিল রঙ্গন আর তুলির। দিনটা সকাল থেকে বেশ ভালোই চলছিল সেইদিন। আজ রঙ্গন এর মেডিক্যাল কলেজের ফ্রেন্ড সার্কেলের সাথে তুলির প্রথম আলাপ হবে। যদিও রিসেপশনে সবাই এসেছিল। কিন্তু সেইভাবে তো কথা হয়নি কারোর সাথে! যাইহোক, সন্ধ্যের সময় তুলি একটা হালকা গোলাপি রঙের পশমিনাতে সেজেছিল। রঙ্গন তো ওকে দেখে প্রথম চোখ ফেরাতে পারছিল না যেন! ও এই শাড়িটা বিয়ের আগে নিজে পছন্দ করে কিনেছিল তুলির জন্য। আর আজ এই শাড়িতে তুলিকে দেখে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল হঠাৎ! তুলি ওর তাকিয়ে থাকা দেখে বুঝেছিল সবটা, আর মনে মনে খুশিই হয়েছিল বেশ। আসলে আজ তো ও রঙ্গন এর জন্যই সেজেছে, ওর চোখ দিয়ে নিজেকে দেখবে বলে! সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই ও রঙ্গন এর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারপর আলতো করে ওর হাতটা ধরে আয়নার কাছে নিয়ে এসেছিল। সেদিন আয়নায় নিজেদেরকে একসাথে দেখে তুলি রঙ্গন এর কানের কাছে গিয়ে এরপর বলেছিল আধো স্বরে,
—–” বেশ মানিয়েছে কিন্তু আমাদের একসাথে! তাই না?”
কথাটায় রঙ্গন যেন ওর এতদিনের অপেক্ষার উত্তর পেয়ে গেছিল হঠাৎ। তুলি কি তাহলে ওকে ভালোবাসে! তুলি কি মন থেকে একসেপ্ট করেছে এই বিয়েটাকে! কথাগুলো যেন নিজের মনেই ভেবে ফেলেছিল রঙ্গন। যদিও তুলিকে ও এইসব বলতে পারেনি সেই মুহূর্তে! শুধু নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, ব্যাস।
যাইহোক এই ভালো লাগার রেশ নিয়েই দুজনে গিয়েছিল সেদিন পার্টিতে। তবে এখানে এসেই তুলি থমকে গেছিল যেন। পার্টিতে সবার ভিড়ে ওই পুরনো মুখটাকে দেখে। সুপ্রিয়! এখানে কি করছে! কথাটা ভাবতেই অমিয়র কাছ থেকে শুনলো সুপ্রিয় হচ্ছে ওর মামাতো ভাই। যদিও এসব শুনেও তুলি সুপ্রিয় কে দেখে অচেনাই ছিল। কিন্তু মনে মনে ভীষণ এলোমেলো লাগছিল ওর। ইচ্ছে করছিল এক্ষুণি এই পার্টি থেকে রঙ্গন কে নিয়ে বেরিয়ে যেতে! তবে রঙ্গন কে তো আর এইসব বলা যাবে না! তাই ভীষণ চুপচাপ ভাবেই দাঁড়িয়েছিল সবার মাঝে। এর মধ্যে সুপ্রিয়ও ওকে খেয়াল করেছিল দূর থেকে, আর ভিতর থেকে ধাক্কা লেগেছিল যেন। শাঁখা পলা সিঁদুরে সেজে একটা অন্য ছেলের হাত ধরে তুলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুপ্রিয়র ভিতরটা জ্বলে উঠেছিল যেন। যেই মেয়েটা একটা সময় শুধু ওকে ভালোবাসতো, সে অন্যের কিভাবে হয়ে যেতে পারে! তুলি কি তার মানে সত্যি ওকে ভুলে গেল! সেই জন্যই একবারের জন্যও আর কোন যোগাযোগ করেনি ওর সাথে! প্রশ্নগুলো কেমন মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল ওর, আর একটা অজানা রাগ, ইগো চেপে ধরছিল সুপ্রিয় কে ভীষণভাবে।
যদিও এই সমস্ত কিছুই অজানা ছিল রঙ্গন এর। ও তো তাই নিজে গেছিল সুপ্রিয়র সাথে কথা বলতে। সুপ্রিয়র গান আসলে খুব ভালো লাগে ওর। আর পছন্দের সিংগার কে সামনে পেয়ে আলাপ না করে কি থাকা যায়! ও তো তুলিকেও বলেছিল সুপ্রিয়র সাথে কথা বলার জন্য সঙ্গে যেতে। কিন্তু তুলি কেন জানে না ভীষণ চুপ ছিল আজ এখানে এসে! ও কারোর সাথেই বিশেষ কথা বলছিল না প্রথম থেকে। তাই রঙ্গন আর বেশি জোর করেনি ওকে।

যাইহোক, এইভাবেই সন্ধ্যেটা এগিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ একজন ওয়েটারের হাত থেকে একটা সফ্ট ড্রিংস এর গ্লাস উলটে পড়লো তুলির শাড়িতে। আর এত সুন্দর শাড়িটায় দাগ পড়ে গেল একটা! তুলি এরপর সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াশ রুমের দিকে গেল শাড়িটা ধুয়ে পরিষ্কার করতে। কিন্তু এখানে এসে পা টা আটকে গেল যেন ওর! সুপ্রিয় এই ফাঁকা ওয়াশ রুমে ওর সামনে দাঁড়িয়ে। যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছে। তুলি এটা দেখেই বেরিয়ে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তে, কিন্তু সুপ্রিয় হঠাৎ ওর হাতটা ধরে ফেললো দরজা আটকে। তুলির এবার ধৈর্য্য টা কেমন শেষ হয়ে গেছিল যেন। ও তাই সমস্ত শক্তি দিয়ে টান মেরে হাত টা ছাড়িয়ে নিল নিজের, তারপর ভীষণ রেগেই বললো,
—— ” তোমার সাহস কি করে হলো আমার হাত ধরার! কি মনে করো কি নিজেকে!”
তুলির কথাটা শুনে সুপ্রিয় একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
——” তাই! আমি কি মনে করি নিজেকে! একটা সময় তো এই হাতটা ধরার জন্যই পাগল হয়ে যেতে! আর আজ বিয়ে হতেই আমি অচেনা হয়ে গেলাম!”
তুলি কথাটা শুনে খুব কঠিন গলায় বললো,
——” হ্যাঁ, তুমি অচেনাই। আর আমি এটা মনেও করতে চাই না যে কোনোদিন আমি তোমাকে চিনতাম!”
এই উত্তরটায় সুপ্রিয় কেমন বেহিসেবী হয়ে বললো,
—–” এত সহজ নয় আমাকে ভুলে যাওয়া! আমি সুপ্রিয় সেন। এই দেশের হাজার হাজার লোক আমাকে চায়। আমার গানকে ভালোবাসে। আর তাদের মধ্যে তুমিও একজন। আর এসব তুমি রাগে বলছো। আসলে তো তুমি এই বিয়েটা করেছিলে কারণ আমি তোমাকে রিজেক্ট করেছিলাম, সেই জন্য। কিন্তু আমি জানি, তুমি আজও মনে মনে আমাকেই ভালোবাসো। আর তুমি আমাকে ছাড়া একটুও ভালো নেই।”
কথাগুলো ভীষণ ইগো থেকে বলেছিল সুপ্রিয়। আসলে তুলির কাছ থেকে এই ব্যবহারটা ও মানতে পারছিল না ঠিক। কোথাও একটা পৌরুষত্বে গিয়ে লাগছিল ওর।
কিন্তু তুলি এসব শুনে ভীষণ অসহ্য হয়ে বলেছিল,
—–” ইউ আর সিক! সেলফ অবসেজড একটা মানুষ। তুমি কারোর ভালোবাসার যোগ্য না। ইউ ডিসর্ভ নথিং… আমার জীবনে আসলে সব থেকে বড় ভুল তুমি। তোমার মতন মানুষের জন্য যে আমি কোনদিন ফিল করেছিলাম, এটা ভেবে আমার নিজেরই লজ্জা হয় এখন।”
কথাগুলো বলেই তুলি চলে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তে, কিন্তু সুপ্রিয় আচমকা ওর হাতটা জোরে টেনে ওকে নিজের কাছে নিয়ে এলো হঠাৎ। পুরো শরীরটা জ্বলছে এখন কেমন অপমানে। আর সেই রাগ নিয়েই সুপ্রিয় কেমন ঝাঁপিয়ে পড়লো তুলির ওপর; জোর করে নিজের ঠোঁটটা চেপে ধরলো তুলির ঠোঁটে। নিজের সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে তুলির আটকে রাখলো নিজের কাছে। আর এই সময়েই ওয়াশ রুমের দরজা খুলে রঙ্গন ভিতরে আসতেই স্থির হয়ে গেল যেন! তুলি অনেকক্ষণ ভিতরে ছিল বলে রঙ্গন চিন্তা করেই এসেছিল এখানে, তবে তুলিকে এইভাবে সুপ্রিয়র সাথে দেখে কেমন পৃথিবীটা থমকে গেল ওর চারিদিকের। শরীরটা ঘেন্নায় গুলিয়ে উঠলো যেন। সুপ্রিয় যদিও ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে তুলিকে রঙ্গনকে দেখে। কিন্তু তুলি ভিতরে ভিতরে কেমন শেষ হয়ে গেল হঠাৎ। রঙ্গন ওকে এই অবস্থায় দেখে কি ভাবলো! ও কি ভুল বুঝলো তুলিকে! কথাটা ভেবেই ও প্রায় কেঁদে উঠে বললো,
—–” রঙ্গন, ও আমায় জোর করছিল! ট্রাস্ট মি! আমি জানতামও না সুপ্রিয় এখানে ওয়াশ রুমে আছে! আমি সত্যি!”
ওর কথাটাকে শেষ না হতে দিয়েই সুপ্রিয় এবার নিজের রাগ আর ইগো থেকে বলে উঠলো,
—— ” জোর! কিসের জোর! যা করেছি তোমার ইচ্ছাতেই করেছি। আর বিয়ের আগে তোমার সাথে আমার এত বছরের রিলেশন এর কথা বলেছো হাজবেন্ড কে? বলেছো আমার পারফিউমের গন্ধ, আমার ঠোঁটের নরম স্বাদ তোমার কত ভালো লাগতো! বলেছো যে তুমি আমাকে পাগলের মতন ভালোবাসো!”
কথাগুলো কেমন তীক্ষ্ণ স্বরে বললো সুপ্রিয়। কিন্তু রঙ্গন এত কিছু শোনার পর আর এক সেকেন্ড দাঁড়ালো না ওখানে। রাগে ঘেন্নায় শরীরটা টলে যাচ্ছে ওর। এই মুহূর্তে কোনভাবে নিজেকে সামলে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে এলো রঙ্গন। তারপর জোরে পা চালিয়ে ওই ফাইভ স্টার হোটেলের অডিটোরিয়াম থেকে নিচে নেমে এলো পার্কিং এ। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং এ হাত দিল। আজ এই ভাঙা চোরা শহরে কোথাও একটা হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হলো ওর, যেখানে কেউ আর কাউকে ঠকাবে না!

তবে তুলি সেদিন সুপ্রিয়কে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরেছিল এরপর। ওর মতন নোংরা মানুষ আর কাউকে দেখেনি তুলি! একটা সময় যে এরকম একটা ছেলেকে ভালোবেসেছিল, এটা ভেবেই নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল ওর। সারা শরীর কাঁপছিল যেন বিতৃষ্ণায়।
কিন্তু যা শেষ হওয়ার সেটা কি শেষ হয়ে গেল! ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে রঙ্গনকে এরপর পার্টিতে দেখতে না পেয়ে তুলির এটাই মনে হয়েছিল। ও কেমন এলোমেলো হয়ে ছুটে এসেছিল এরপর পার্কিং এরিয়ায়। কিন্তু খেয়াল করেছিল রঙ্গন এর গাড়িটা ওকে না নিয়েই খুব জোরে বেরিয়ে গেল সামনে থেকে। তারপর তুলির চোখের পলকে মিলিয়ে গেল দূরে রাস্তায়। তবে তুলির চারিদিকটা সেই মুহূর্তে ভীষণ আবছা হয়ে এলো যেন! তাহলে কি রঙ্গন ওকে বিশ্বাস করলো না! ভুল বুঝলো এইভাবে! প্রশ্নগুলো কেমন কাঁচ বেঁধার মতন মনে এসে বিঁধলো।
আজ রাত নটায় লাইভ থাকবো এই পেজে। সবাই সঙ্গে থেকো কিন্তু। কিছু প্রশ্ন থাকলে, বা নিজের কোনো গল্প বলার থাকলে লিখে ফেলো কমেন্ট সেকশনে। 😊

চলবে।

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০৬

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( ষষ্ঠ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১২>
তবে রঙ্গন এর রূপকথাটা বাস্তবের সাথে ধাক্কা খেল ফুলসজ্জার রাতে। যদিও রঙ্গন এই দুদিনে খেয়াল করেছে তুলি কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে আছে যেন! কোন আনন্দ, কোন উল্লাস নেই ওর এই বিয়েটা নিয়ে। এই দৃশ্য দেখে রঙ্গন এর পুরনো কিছু কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বিয়ের আগের এই দুমাস যতবারই রঙ্গন তুলির সাথে দেখা করেছে, তুলি দরকারের বেশি একটা কথাও বলেনি। কখনো ওকে নিজে থেকে ফোন করেনি। একটা মেসেজ ও করেনি। তখন রঙ্গন এর মনে হতো তুলি হয়তো লজ্জা পাচ্ছে! তবে বিয়ের পর এই দু দিনে রঙ্গন এর কেন জানে না মনে হচ্ছে তুলি এই বিয়েটায় খুশি না! মন থেকে রাজি না। তবে এইসব খেয়াল করলেও বিয়েবাড়িতে এত লোকের ভিড়ে রঙ্গন কিছু আর আলাদা করে জিজ্ঞেস করতে পারেনি তুলিকে। কিন্তু ফুলসজ্জার রাতে রঙ্গন ঘরে ঢুকতেই তুলি ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে ছিল যেন! সেদিন রঙ্গন এসে প্রথম ওর হাতটা ধরেছিল আলতো করে। তবে তুলির জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা দেখে বুঝেছিল ও কম্ফর্টেবল না। সেই মুহূর্তে রঙ্গন কিছুটা সহজ হয়ে বলেছিল,
——” ডু ইউ ওয়ান্ট টু শেয়ার মি সামথিং? তোমার মনে যা আছে তুমি আমাকে বলতে পারো।”
এই কথায় তুলি একটু সময় নিয়ে বলেছিল,
——” আই নিড টাইম.. আসলে আমি এই বিয়েটা আমার মা বাবার কথায় করেছি। মা বাবার তোমাকে খুব পছন্দ ছিল! কিন্তু আমি ওইভাবে ফিল করিনি কখনো তোমার ব্যাপারে।”
কথাটা শুনে রঙ্গন এর কেমন যেন ধাক্কা লাগলো একটা। ও বেশ অবাক হয়েই বললো,
——” এই কথাটা তুমি আমাকে প্রথমে বলোনি কেন? আমি তো প্রথম দিনই জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর তুমি কি জোর করে বিয়ে করেছ আমাকে? নিজের মন থেকে না!”
এই প্রশ্নে তুলি সঙ্গে সঙ্গেই বললো,
——” আমি মানুষ হিসেবে রেসপেক্ট করি তোমাকে খুব, প্রথম দিন থেকেই। তাই যখন বাবা মা এই বিয়ের কথাটা বললো, আমি রাজি হয়ে ছিলাম। কিন্তু কাউকে ভালোবাসার জন্য একটু সময়ের দরকার হয়। সেটা তো হঠাৎ করে হয় না! দ্যাটস হোয়াই আই নিড সম টাইম..”
কথাটা শুনে রঙ্গন আর বেশি কিছু বলতে পারলো না! কারণ এটা তো সত্যি! রঙ্গন ভালোবাসে বলেই যে তুলিও হঠাৎ করে ভালোবেসে ফেলবে, এর তো কোন মানে নেই! তবে খুব ক্লান্ত লাগছিল যেন এই মুহূর্তে ওর। তাই তুলিকে নিজে থেকেই বললো,
——” আমি অপেক্ষা করবো। জানি ভালোবাসা একদিনে হয় না! সময় লাগে। যাইহোক, ঘুমিয়ে পরো। অনেক রাত হলো।”
কথাটা বলে রঙ্গন ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিল এরপর। স্বামী হওয়ার কোন অধিকারই ও ফলায়নি তুলির সাথে। তুলিকে একবারের জন্য না ছুঁয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল নিজের মনে। তবে এই পুরোব্যাপারটাই তুলির মনে একটা দাগ কেটেছিল যেন! কতজন ছেলে পারে একটা মেয়ের কথাকে সম্মান করতে! আজকের দিনেও তাকে না ছুঁয়ে, না ভালোবেসে থাকতে! কিন্তু রঙ্গন কাজটা কত সহজে করলো! কত সহজে তুলির কথা ভেবে তুলির থেকে দূরে সরে থাকলো!
সেদিন এই ভাবনাগুলোর ভিড়েই তুলি অনেকক্ষণ জেগে ছিল সেই রাতে। ঘুমন্ত রঙ্গনকে দেখে মনে হচ্ছিল নিজের মা বাবার কথা ভাবতে গিয়ে এই ছেলেটার প্রতি অন্যায় করলো না তো! এই বিয়েটায় রঙ্গন এর তো কোন দোষ নেই। ও তো ডিসার্ভ করে নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে ভালোবাসা, ফিলিংস। কিন্তু তুলি কি কোনদিন এই ভালো মানুষটাকে ভালোবাসতে পারবে! নিজের অতীতটাকে ভুলে রঙ্গন এর সাথে নতুনভাবে শুরু করতে পারবে! কথাগুলো কেমন ভাবতে ভাবতেই ভোর হয়ে এলো রাত পেরিয়ে। আর একটা নতুন দিন শুরু হলো শহরে।
তবে সামনের দিনগুলোতে রঙ্গন সত্যি ভীষণ নতুন হয়ে ধরা দিল তুলির কাছে। ছেলেটা অষ্টমঙ্গলাতে তুলিদের বাড়ি গিয়ে এত সুন্দর ভাবে মিশে গেছিল সবার সাথে! তুলির বাবার প্রেশার চেক করা থেকে ওর মায়ের হাঁটুর ব্যাথার জন্য একজন চেনা ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করে দেওয়া, নিজে থেকেই করেছিল সব রঙ্গন। বাড়ির কাউকেই বুঝতে দেয়নি তুলির সাথে ওর মনের দূরত্বর ব্যাপারে। তুলি এইসব দেখে সেই রাতে একা ঘরে এসে বলে উঠেছিল,
—–” থ্যাঙ্ক ইউ.. মায়ের জন্য অনেকদিন ধরেই একজন ভালো ডাক্তার খুঁজছিলাম। তুমি খুব হেল্প করলে আজ!”
এই কথায় রঙ্গন খুব সহজভাবেই বলেছিল,
——” এর জন্য থ্যাঙ্ক ইউ বলার কিছু নেই। আমি একজন ডাক্তার, এই ফিল্ডে অনেক চেনা জানা আছে! তাই এপয়নেন্টটা করে দিতে পেরেছি।”

তুলির কথাটা শুনে সেই মুহূর্তে ওদের প্রথম আলাপের দিনটা মনে পরে গেছিল। সেদিনও রঙ্গন নিজে থেকে ওর বাবার এডমিশন করিয়ে দিয়েছিল নার্সিং হোমে। আর তারপর ঠিক এই কথাটাই বলেছিল। ‘ থ্যাঙ্ক ইউ বলার দরকার নেই! এটা আমার ডিউটি..’
তবে সেদিন তুলি জানতো না, এই ছেলেটার সাথেই সারা জীবনের মতন বাঁধা পড়ে যাবে ও!
যাইহোক, এরপর পরের সপ্তাহে রবিবার দিন তুলি বিকেলের দিকে রেডি হচ্ছিল বেরোবে বলে। রঙ্গন সেদিন বাড়িতেই ছিল। ও তুলিকে রেডি হতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,
——” তুমি বেরোচ্ছ কোথাও?”
তুলি এটা শুনে একটু সময় নিয়ে বললো,
——” আসলে আমার বন্ধুর একটা এন. জি. ও আছে। শহরের বস্তির ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করে ওরা। আমি প্রত্যেক রবিবার বিকেলে একটু পড়াতে যাই ওদের। ওই তারাতলার কাছেই বস্তিটা। ওখানেই একটা ঘর ভাড়া করে ক্লাস হয়।”

কথাটা শেষ হতে রঙ্গন কেমন নিস্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
——-” এটা তো খুব ভালো ইনিশিয়েটিভ! আজ আমি ফ্রি.. আমি কি যেতে পারি তোমার সাথে? যদি তোমার কোন প্রবলেম না হয়!”
এই কথায় তুলি বেশ অবাক হয়েই বললো,
—–” তুমি যাবে! আমার কি প্রব্লেম! অবশ্যই চলো।”
সেদিন এই কথা হওয়ার পর তুলি রঙ্গন এর সাথেই গেছিল বস্তিতে। রঙ্গন এরপর নিজে থেকেই আলাপ করেছিল বাচ্চাগুলোর সাথে। তুলি এইসব দেখে সত্যি কেমন চুপ হয়ে গেছিল যেন! এত বড় একজন হার্ট সার্জেন! কিন্তু কিভাবে মাটির সাথে মিশে থাকতে পারে ছেলেটা! কিভাবে সবার জন্য ভাবতে পারে নির্দ্বিধায়! কথাগুলো সেদিন ভীষণভাবে মনে হচ্ছিল তুলির। তখনই রঙ্গন ওর কাছে এসে বললো,
—–” আমি ভাবছি এদের জন্য একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প করার কথা। এই বাচ্চাগুলোকে দেখে বুঝলাম বেশিরভাগই ম্যাল নিউট্রিশন এর পেশেন্ট। ওদের একটা রুটিন চেক আপ খুব দরকার।”
কথাটা শুনে তুলি বলে উঠলো,
—–” হ্যাঁ, জানি। ওরা আসলে সবাই আধ বেলা খেয়ে থাকে। তাই নিউট্রিশন ঠিক মতন পায় না! তবে এন.জি.তে অনেকবারই এই মেডিক্যাল ক্যাম্প অর্গানাইজ করার কথা উঠেছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই টাকার জন্য হয়ে ওঠেনি। আসলে আমাদের এই ‘ স্পর্শ ‘ এন.জি. ও টা তো খুব ছোট। নতুন শুরু হয়েছে। তাই ফান্ডস পায় না অতো!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল তুলি। আর এইসব শুনে রঙ্গন সাথে সাথেই বলে উঠেছিল,
—–” ফান্ডস নিয়ে ভাবতে হবে না! আমার অনেক ডাক্তার বন্ধু আছে। আমি তাদের রিকুয়েস্ট করলে তারা না করবে না। ইভেন কিছু টাকা ডোনেট ও করে দেবে। তুমি শুধু এই স্পর্শ এন.জি.ওর সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দাও। বাকিটা আমি এড়েঞ্জ করে নেব।”
কথাগুলো বলে রঙ্গন আবার সেদিন চলে গেছিল ওই বাচ্চাগুলোর মাঝে। কিন্তু তুলি ভীষণ স্থিরভাবে দাঁড়িয়েছিল এক জায়গায়। নিজের অজান্তেই একটা ভালো লাগা এসে জমছিল মনে। এরকম হিসেবী পৃথিবীতে একজন না হিসেব করা মানুষকে কাছে পেয়ে ভালো লাগছিল খুব।
<১৩>
যাইহোক, এইভাবেই দিনগুলো এগোচ্ছিল। এর মধ্যে নিরুপমা কিছু দিনের জন্য বোনের বাড়ি গিয়েছিল বেড়াতে। বাড়িতে তাই শুধুই তুলি আর রঙ্গন। এর মধ্যে তুলির সেই মাসের তিনটে কষ্টের দিন এসে হাজির। এমনকি ফার্স্ট ডে এতটাই যন্ত্রণা করছিল পেটে, যে তুলি সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। সেই জন্য পরেরদিন ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হয়ে গেছিল। তবে সেদিন ও জেগেই দেখছে রঙ্গন হসপিটালে যাওয়ার জন্য পুরো রেডি। তুলি এটা দেখে তাড়াতাড়ি মোবাইলটা খুলে টাইমটা দেখলো। দশটা বেজে গেছে! তুলি এবার তাড়াহুড়ো করে উঠে গিয়ে বললো,
—–” আশ্চর্য! দশটা বেজে গেছে! তুমি আমায় ডাকোনি কেন? তুমি একটু ওয়েট করো, আমি এক্ষুনি ব্রেকফাস্ট রেডি করে দিচ্ছি। প্লিজ না খেয়ে বেরিও না।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো তুলি। কিন্তু তখনই রঙ্গন ওকে শান্ত করে বললো,
—–” এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু হয়নি! আমি ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ফেলেছি অলরেডি। আর এই টাইমে মেয়েদের কত কষ্ট হয় আমি জানি। তুমি প্লিজ রেস্ট নাও। কাল সারা রাত এমনিতেও ঘুমোতে পারোনি। আর আজ রান্নার মাসি আসবে না বলেছে। তাই অনলাইনে আমি খাবার অর্ডার করে দেবো কিছু দুপুর আর রাতের জন্য। তোমার এই অবস্থায় রান্না করার দরকার নেই।”
কথাগুলো খুব সহজ ভাবে বলেছিল রঙ্গন। কিন্তু তুলি এইসব শুনে কেমন নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে! এতটাও সেনসিটিভ কেউ হয় একটা মেয়ের এই দিনগুলোর যন্ত্রণা নিয়ে! সুপ্রিয় তো কখনো এরকম করে ভাবেনি। মনে আছে একবার পিরিয়ডের যন্ত্রণার জন্য তুলি ওর সাথে দেখা করতে যেতে পারেনি। সুপ্রিয় কি রেগে ছিল তারপর। তিন দিন কথাই বলেনি ওর সাথে! সত্যি, তুলি কি সেই সময় ভালোবাসায় অন্ধ ছিল! এইসব দেখেও ও বোঝেনি সুপ্রিয় কতটা স্বার্থপর! আজকে এই ফাঁকা ফ্ল্যাটে হঠাৎ এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল ওর। আর মনে হচ্ছিল রঙ্গন এর কথা। ছেলেটা সকাল সকাল উঠে ওর জন্য চিকেন স্যান্ডুইচ আর কফি বানিয়েছে। একবারও ঘুম থেকে ডাকেনি ওকে। আবার বলেছে আজকে সন্ধ্যেবেলা তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে, যাতে এই যন্ত্রণা নিয়ে বেশিক্ষণ একা থাকতে না হয় তুলিকে। সত্যি, কথাগুলো যতবার ভাবছে, অবাক হয়ে যাচ্ছে! এতটা ভাবে ছেলেটা ওর জন্য! এতটা কনসার্নড! সেদিন শরীরটা খারাপ না হলে এইসব বোঝাই হতো না তুলির! আর রঙ্গন এর জন্য এতটা মন থেকে ফিল করতে পারতো না ও।

যাইহোক, এরপর একটা মাস কেটে গেছে। এই কদিনে একজন ডাক্তারের জীবন কে খুব কাছ থেকে দেখে বুঝেছিল এই প্রফেশনটা কতটা টাফ! দিন নেই, রাত নেই, ডিউটি দিতে হয়। এত এত পেশেন্ট কে ম্যানেজ করা, তাদের জীবনের দ্বায়িত্ব নিয়ে চলা যে কত বড় রেসপনসিবিলিটি, এটা রঙ্গন কে কাছ থেকে না দেখলে জানাই হতো না! এই যেমন এই সপ্তাহে রঙ্গন এক রাত বাড়িই আসতে পারেনি। একটা বাস এক্সিডেন্ট এর কেস এসেছিল হসপিটালে। তার মধ্যে চার জনের হার্টে ম্যাসিভ ইঞ্জুরি ছিল। রঙ্গনই অপারেট করেছিল ওদের। খবরটা বুধবার রাতে বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিল রঙ্গন। কিন্তু এইসব শুনে নিরুপমার মুখটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। ও তুলিকে আনমনেই বলে উঠেছিল,
——–” ছেলেটা সারা রাত হসপিটাল এ থাকবে! কি যে খাবে কে জানে! আর কোনদিন তো কাজের মধ্যে থাকলে খাওয়ার কথা মনেও থাকে না। একটু যে ক্যান্টিনে গিয়েও কিছু একটা খেয়ে নেবে, সেটাও না।”
কথাগুলো শুনে তুলি একটু ভেবে বলেছিল,
——” মা, আমি যাবো খাবার নিয়ে হসপিটাল?”
এই প্রশ্নে নিরুপমা সাথে সাথেই বলে উঠেছিল,
——” তুই যাবি! এত রাতে?”
এটা শুনে তুলি নিরুপমা কে শান্ত করে বলেছিল,
—–” এত রাত আর কোথায়! মাত্র আটটা বাজে। আমি ট্যাক্সি নিয়ে যাবো। এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবো।”
এই কথায় নিরুপমা কিন্তু কিন্তু করেও রাজি হয়ে ছিল অবশেষে। তারপর তুলি রঙ্গন এর জন্য খাবার প্যাক করে সোজা হাজির হয়েছিল ওদের হসপিটালে। সেদিন একজন নার্সের কাছ থেকে তুলির আসার খবরটা পেয়েছিল রঙ্গন। কথাটা শুনেই রঙ্গন ওয়ার্ড থেকে তাড়াহুড়ো করে নেমে এসেছিল নিচের করিডোরে। তুলিকে সেখানে একটা ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিল হঠাৎ। তুলি সেই মুহূর্তে রঙ্গন এর কাছে গিয়ে বলেছিল,
——-” পনেরো মিনিট হবে তোমার? ”
এই প্রশ্নে রঙ্গন কিছু না বুঝতে পেরেই বলেছিল,
——” হ্যাঁ হবে। কেন?”
এটা শুনে তুলি নিজের হাতের ব্যাগটা দেখিয়ে বলেছিল,
——” খাবার এনেছি তোমার জন্য। তাই।”
তুলির এই কথায় রঙ্গন একটু ইতঃস্তত হয়েই বলেছিল,
—– ” তুমি আবার খাবার আনতে গেলে কেন! আর কিসে করে এসেছো? আর আমি তো ক্যান্টিনে খেয়ে নিতাম।”
এটা শুনে তুলি একটু কঠিন হয়ে বললো,
—–” তাই! খেয়েছ কিছু সকাল থেকে?”
এই প্রশ্নে রঙ্গন আর ঠিক কোন উত্তর দিতে পারলো না! তাই চোখ দুটো নিচে নামিয়ে নিল নিজের। তুলি তখন হঠাৎ করে রঙ্গন এর হাতটা ধরলো। তারপর কেমন অর্ডার করার সুরে বললো,
——” পনেরো মিনিটের জন্য ক্যান্টিনে চলো। খেয়ে এসে তারপর আবার কাজ করবে।”
কথাটা বলে তুলি রঙ্গন এর হাতটা ধরে এগিয়ে গেল ধীরে ধীরে। কিন্তু রঙ্গন এই ছোঁয়ায় কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল! এতটা অধিকার ওর প্রতি তো শুধু তুলিরই থাকতে পারে! তাহলে কি তুলিও আজকাল ওকে নিয়ে চিন্তা করে। নইলে ওর খাবার নিয়ে এই রাত্রিবেলা চলে আসতো না নিশ্চয়ই হসপিটালে!
সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই এরপর রঙ্গন ডিম পোস্ত দিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে পুরেছিল। কিন্তু খাবারটা টেস্ট করতেই ও অবাক হয়ে বলেছিল,
—–” এটা কে রান্না করেছে? রান্নার মাসি তো এরকম রাঁধে না! আর মায়ের হাতের টেস্টও এটা না!”
কথাটা শুনে তুলি একটু চিন্তা নিয়েই বলেছিল,
——” কেন? খারাপ হয়েছে খেতে?”
এই প্রশ্নটা শুনে রঙ্গন নিজের মনেই বলে উঠেছিল,
—–” না না! খারাপ কেন হবে! ভীষণ ভালো টেস্ট। তবে এই রান্না আমি প্রথম খেলাম। আর ডিম পোস্ত তো আমার ভীষণ ফেভারিট।”
এই কথায় তুলি আলতো হেসে ফেলেছিল সেই মুহূর্তে। তারপর আস্তে গলায় বলেছিল,
—–” জানি ফেভারিট।”
এটা শুনে রঙ্গন হঠাৎ বুঝতে পেরেছিল রান্নাটা কার হাতের! ও তুলির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল,
——” তুমি রান্না করেছ এটা! তুমি এত ভালো রান্না জানো?”
তুলি এর উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারেনি! আসলে রান্না জানে এটা ঠিক। কিন্তু সেটা ভালো কি খারাপ সেটা তো যে খাবে সে বলতে পারবে!
তবে এরপর রঙ্গন খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিল খাবারটা। তুলির সেটা দেখে ভীষণ শান্তি হচ্ছিল মনে। আসলে আজ তো রান্নাটা তুলি এই ছেলেটার কথা ভেবেই করেছিল! তারপর যখন শুনলো সারা রাত বাড়ি ফিরতে পারবে না রঙ্গন, তখন তুলির মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছিল কেমন। চিন্তা হচ্ছিল মনে মনে ছেলেটার জন্য! সারাদিন কিছু খেয়েছে তো! সারা রাত কি খালি পেটেই ডিউটি করবে রঙ্গন! এইসব ভাবনার ভিড়েই তো এসেছিল আজ হসপিটালে। তারপর রঙ্গন এর শুকনো, ক্লান্ত মুখটাকে দেখে ও কেমন থমকে গেছিল হঠাৎ। মনে হচ্ছিল যদি আজ রঙ্গনকে নিজের সাথে বাড়ি নিয়ে ফিরতে পারতো! যদি সেই রাতটা ছেলেটা একটু ঘুমোতে পারতো শান্তিতে; তাহলে তুলি নিশ্চিন্ত হতো।

<১৪>
সেদিন ট্যাক্সিতে আসতে আসতেও তুলি সারাটা রাস্তা আনমনে রঙ্গন এর কথাই ভেবেছে। কিন্তু ওদের ফ্ল্যাটের সামনে ট্যাক্সিটা দাঁড়াতেই তুলির যেন ঘোরটা কাটলো! মনে হলো এইভাবে অবচেতনে কেন ভাবছে এত রঙ্গন এর জন্য! কেন এত চিন্তা এসে ঘিরে ধরছে ওকে আজ! এসব কি এমনি অকারণে হচ্ছে; না কি ছেলেটা ধীরে ধীরে ওর মনে জায়গা করে ফেলছে নিজের!

এই ভাবনার ভিড়েই রাতটা কেটেছিল ওর। আজ ঘরটা আসলে একটু বেশিই ফাঁকা লাগছে। অন্যদিন হলে রঙ্গন বেশ রাত অব্দি ল্যাপটপটা খুলে বসে থাকে; নয়ত কোন বই পড়ে! কিন্তু আজ খাটের এক পাশটা কিরকম খালি খালি লাগছে তুলির। সেই জন্য ঠিকভাবে ঘুমও আসছিল না ওর। তখনই মোবাইলে একটা হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ ঢোকার আওয়াজ এলো কানে। তুলি আনমনে মেসেজটা খুলতেই দেখে সেই চেনা নাম্বার; রঙ্গন। এত রাতে কি লিখেছে ছেলেটা! কথাটা ভাবতে ভাবতেই তুলি মেসেজটার দিকে চোখ রাখলো, আর রঙ্গন কয়েকটা শব্দ হয়ে বলে উঠলো,
——” রাতে ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে ঘুমিও আজ। নইলে মাঝে মাঝে তুমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠো। যাইহোক, গুড নাইট.. আর আজ আমাকে একবার দর্শন দেয়ার জন্য থ্যাঙ্ক ইউ..”
কথাগুলো পড়তেই তুলির মুখে হঠাৎ হাসি চলে এলো এই মুহূর্তে। আর মনে পরে গেল সেই রাতটাকে। এই তো তিনদিন আগে, তুলি ভূতের গল্পের বই পড়ে রাতে ঘুমোতে গেছিল। তারপর উল্টো পাল্টা স্বপ্ন দেখে তো চিৎকার করে উঠেছিল ঘুমের মধ্যে। রঙ্গন তখন ওকে জড়িয়ে ধরে কোনভাবে শান্ত করেছিল। তারপর সারা রাত ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়েছিল তুলি। কথাটা ভাবতেই তুলির রঙ্গন কে আরো বেশি করে মনে পড়লো আজ। আর সারাটা রাত কেমন নির্ঘুম অবস্থায়ই কেটে গেল ওর!

চলবে।

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০৫

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( পঞ্চম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৯>
সেদিন তুলি যখন বাড়ি ফিরেছিল, তখন ঘড়িতে রাত দশটা। আসলে ও কেমন নিজের মধ্যে ছিল না ঠিক। এতগুলো বছরের স্মৃতি এসে ভিড় করছিল চোখে। মনে পড়ছিল সুপ্রিয়র সেই স্ট্রাগল এর দিনগুলো! যখন একটার পর একটা অডিশনে ছেলেটা রিজেক্ট হতো, আর মন খারাপ করে তুলির কাছেই আসতো, তুলি সেই দিনগুলোতে সুপ্রিয়কে আগলে রাখতো যেন। সব সময় না বলে ওর পকেটে হাত খরচের টাকা রেখে দিত নিঃশব্দে। এটাই বোঝাতো সারাক্ষণ যে সুপ্রিয় খুব ভালো গান গায়। আর একদিন ঠিক সাকসেস খুঁজে পাবে ও। সেই সময় সুপ্রিয় ওকে বাচ্চাদের মতন আঁকড়ে ধরতো। বার বার বলতো ‘ ভালোবাসি ‘। আর আজ এই সবই মিথ্যে হয়ে গেল! ভালো সময় আসতেই সুপ্রিয় জাস্ট ওকে একটা ইউজলেস প্রোডাক্ট এর মতন ছুঁড়ে ফেলে দিল! এত সস্তা করে দিল ভালোবাসাটাকে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই গঙ্গার ঘাটে বসেছিল অনেকক্ষণ। তারপর কোন রকমে নিজেকে সামলে বাড়ি ফিরেছিল তুলি।

তবে সেদিন দরজা খুলে ওর বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে মা বাবা যেন থমকে গেছিল! আর তুলি এতটা ঝড় পাড় করে বাড়ি এসে নিজের সব থেকে কাছের মানুষগুলোকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল হঠাৎ। কারোর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও যেন বাবাকে আগলে কেঁদে উঠেছিল চিৎকার করে। আসলে এতটা মিথ্যে লাগছিল সব কিছু; এতটা কষ্ট হচ্ছিল বুকের মধ্যে, যে তুলি আর নিজেকে আটকাতে পারেনি।
সেদিন অশোকবাবু মেয়ের এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়েই জিজ্ঞেস করেছিল তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে,
——” কি হলো! কি হলো মা? এইভাবে কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে না কি! কি হয়েছে?”
তুলির মা ও এই সময় পাশে এসে খুব চিন্তা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
——” কি হলো তোর? আর এত রাত অব্দি কোথায় ছিলিস! তুই কাঁদছিস কেন এইভাবে মা?”
এই প্রশ্নে তুলি আর চুপ না থেকে ভাঙা গলায় বলেছিল,
——” ঠকে গেলাম আমি। খুব বেশি করে ঠকে গেলাম! সুপ্রিয় বলেছে ও আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। ও আর ভালোবাসে না আমাকে। সবটা মিথ্যে ছিল! সব কিছু।”
কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা ধরে এলো ওর, কান্নায়। কিন্তু তুলির বাবা মা এইসব শুনে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না! মেয়েটাকে এইভাবে কষ্ট পেতে দেখে ভীষণ খারাপ লাগছিল আসলে। তাই অশোকবাবু তুলিকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরলো। তারপর ধীরে ধীরে ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল কোন রকমে।
সেদিনের পর তুলি যেন কেমন চুপ করে গেছিল হঠাৎ করে। দুদিন তো ঘর থেকেই বেরোয়নি নিজের। সারাক্ষণ কেমন পাথরের মতন স্থির হয়ে বসে ছিল এক জায়গায়। ঠিকভাবে খাচ্ছিল না, স্কুলে যাচ্ছিল না, কথা বলছিল না কারোর সাথে! কিরকম যেন হারিয়ে ছিল ও এই কষ্টটার মধ্যে। সেই জন্য সেই রবিবার নিরুপমাকে গান শেখাতেও যায়নি আর ফ্ল্যাটে। তবে আজ রাতে তুলির ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠেছিল আননোন একটা নাম্বার থেকে। তুলি একটু আনমনেই ফোনটা ধরেছিল সেদিন, আর ওপার থেকে ভেসে এসেছিল একটা ভরাট কণ্ঠ।
—–” হ্যালো, আমি রঙ্গন বলছি। ”
কথাটা শুনে তুলি বেশ অবাক হয়ে ছিল সেই মুহূর্তে। ও একটু সময় নিয়ে বলেছিল,
——” আপনি! হ্যাঁ বলুন, কোন দরকার ছিল?”
এই প্রশ্নে রঙ্গন কিছুটা এলোমেলো হয়ে বলেছিল,
——” আপনি ঠিক আছেন তো? আসলে আজ আপনি এলেন না! মা তাই চিন্তা করছিল।”
এই কথাগুলো শুনে তুলির কেমন আশ্চর্য লাগলো যেন! এই কদিনের আলাপ নিরুপমা কাকিমার সাথে! তাতেই এতটা ভাবে ওকে নিয়ে! আর যাকে তুলি মন থেকে দিনের পর দিন ভালোবাসলো! যাকে নিজের সব থেকে কাছের মানুষটা মনে করলো! সে ই ওকে নিয়ে নিজের সমস্ত ভাবনা থামিয়ে দিল হঠাৎ! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তুলি বললো,
—–” না, আসলে শরীরটা একটু ভালো নেই। তাই যাইনি। নিরুপমা কাকিমা কে চিন্তা করতে বারণ করবেন।”
কথাটা শুনে রঙ্গন এবার বেশ চিন্তা নিয়ে বললো,
—–” শরীর ভালো নেই! কি হয়েছে আপনার? জ্বর? এই সিজন চেঞ্জে অনেকের জ্বর হচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়েছেন তো?”
প্রশ্ন গুলো এক নিঃশ্বাসে করলো রঙ্গন। কিন্তু তুলি এইসব শুনে ওকে শান্ত করে বললো,
—–” না না, সিরিয়াস কিছু না। ঠিক আছি আমি এখন। কাকিমা কে বলবেন নেক্স উইক এসে ক্লাস করিয়ে দেব। যাইহোক, আমি রাখছি। আসলে আমার ফোনে চার্জ একদম শেষ।”
এই শেষ কথাগুলো তুলি বানিয়েই বললো নিজের মনে। আসলে সত্যি আজকাল দরকারের বেশি কথা বলার মতন ইচ্ছে নেই ওর কারোর সাথেই। তাই ফোনটা রাখারই চেষ্টাই করছিল ও। তবে রঙ্গন যদিও এতকিছু বোঝেনি এই মুহূর্তে। তাই কথাগুলোকে সত্যি ভেবে ফোনটা রেখে দিয়েছিল এরপর। কিন্তু ফোন কাটলেও তুলির চিন্তা থেকে নিজের মনকে আটকে রাখতে পারেনি কিছুতেই! আসলে প্রত্যেক রবিবারের মতন আজও তো ও অপেক্ষা করছিল তুলির! তারপর যখন সারা দিন পার করেও মেয়েটা এলো না, তখন একটা মন খারাপের দেওয়াল ঘিরে ধরলো ওকে। জীবনে কাউকে প্রথম খুব মিস করলো রঙ্গন।
<১০>
তবে এই মন খারাপের ভিড়ে দুদিন বাদে মা এসে হাজির। আজ একটা হেস্ত নেস্ত করেই ছাড়বে নিরুপমা! অনেকদিন ঝুলিয়েছে রঙ্গন। আর না। কথাগুলো ভেবেই সেদিন কয়েকটা মেয়ের ছবি নিয়ে হাজির হয়েছিল ছেলের ঘরে। রঙ্গন ল্যাপটপ খুলে বসেছিল সেই মুহূর্তে। নিরুপমা এরপর কিছু না বলেই ওর টেবিলের সামনে মেয়েগুলোর ফটো রেখেছিল একটু আওয়াজ করে। রঙ্গন সেসব দেখে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
——” এসব কি! এগুলো কাদের ফটো!”
নিরুপমা এই প্রশ্নে বেশ রাগি গলায় বলেছিল,
——” এগুলো সব মেয়েদের ফটো। দেখতেই পাচ্ছিস নিশ্চই। আমি পেপার ঘেঁটে ঘেঁটে, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট থেকে খুঁজে খুঁজে এদের বার করেছি। দয়া করে তুই এদের দ্যাখ। কথা বল। বিয়ের ব্যাপারে একটা ডিসিশন নে এবার। নইলে আমার টিকিট কাট আজই হরিদ্বারের। আমি আশ্রমে চলে যাবো। অনেক হয়েছে। আর আমি তোর জন্য চিন্তা করতে করতে জীবনটা কাটাতে পারবো না।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল নিরুপমা। এসব শুনে রঙ্গন মা কে শান্ত করার জন্য বলেছিল,
—–” একটু রিল্যাক্স করো তুমি প্লিজ। আর কে বলেছে আমার জন্য চিন্তা করতে! আমি তো দিব্যি আছি। আর এইভাবে এরেঞ্জ ম্যারেজ আমার দ্বারা হবে না। সত্যি বলছি।”
কথাগুলো শুনে নিরুপমা এবার হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছিল,
—–” বুঝে গেছি। তুই বিয়ে করবি না। যাইহোক, আমি তোর মামাকে বলবো আমার জন্য হরিদ্বারের একটা টিকিট কেটে দিতে। তুই তো এটুকুও করবি না আমার জন্য!”
কথাটা বলেই নিরুপমা এবার বেশ অন্ধকার মুখেই বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে। তখন রঙ্গন কিরকম নিরুপায় হয়েই মা কে আটকে বলে উঠলো,
——” মা, প্লিজ কোথাও যেও না! একচুয়ালি আই লাইক সময়ান! তাই আমি অন্য কারোর সাথেই এনগেজ হতে পারবো না।”
কথাটা শুনে নিরুপমা থমকে গেল যেন! তারপর রঙ্গন এর কাছে এসে ওর হাতটা ধরে বললো আস্তে গলায়,
——” কাকে পছন্দ করিস তুই? এটা তো আগে বলবি আমাকে! আর মেয়েটার সাথে কেন আলাপ করাসনি আমাকে!”
এই প্রশ্নে রঙ্গন ইতঃস্তত হয়েই বলে উঠলো,
—–” মা, আমি শুধু তাকে পছন্দ করি। সে হয়তো ওইভাবে কিছু ফিল করে না আমার ব্যাপারে! আর তাই এই নিয়ে কথা বলার মতনও কিছু নেই।”
এই কথায় নিরুপমা একটু জোর দেখিয়েই বললো,
—–” তুই বলবি আমাকে নামটা? নইলে আমি টিকিট কাটতে বলছি মামাকে হরিদ্বারের।”
এই কথায় রঙ্গন আর কি বলবে ভেবে না পেয়ে আস্তে গলায় বলে উঠলো,
—–” তুলি। হয়েছে শান্তি!”
এটা শুনে নিরুপমা চোখ গুলো বড় বড় করে বললো সঙ্গে সঙ্গে,
—–” তুলি! মানে আমাদের তুলি? মানে তুই আর রবীন্দ্রসঙ্গীত!”
এই কথায় রঙ্গন একটু রেগেই বললো,
—–” এই জন্য আমি বলতে চাইনি কিছু! যাইহোক, এই নিয়ে আর কোন কথা আমি শুনতে চাই না। তুমি যাও এবার। আমার অনেক কাজ আছে!”
কথাটা শেষ হতেই নিরুপমা বেশ উজ্জ্বল মুখে বললো, ——” গুড চয়েজ রে। সত্যি তুলির মতন মেয়ে আমি হাজার খুঁজেও পেতাম না! যাইহোক, আর হরিদ্বার যাওয়ার দরকার হবে না বলে মনে হচ্ছে! আমি আসছি।”
কথাটা বলেই নিরুপমা আর কোন প্রত্যুত্তরের সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কিন্তু রঙ্গন এর বুকটা ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করলো হঠাৎ। মা কে বলে কথাটা ঠিক করলো তো! কোন কেস করে দেবে না তো মা এবার! চিন্তা যেন চেপে বসলো খুব জোর রঙ্গন এর মনে।
কিন্তু অবশেষে রঙ্গন এর চিন্তাটাই সত্যি হলো। মা কেসটা ঘটিয়েই ফেললো। সেই সপ্তাহেই তুলি দের বাড়িতে ফোন করে নিজে সম্বন্ধের কথা বলেছিল নিরুপমা। তুলির মা বাবা তো শুনে পুরো অবাক হয়ে গেছিল! তবে রঙ্গন এর কথা এর আগেও তুলির মুখে শুনেছিল কিছু কিছু সময়। তাই ছেলেটাকে নিয়ে বেশ ভালোই একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল মনে। তবে তুলির বাবা একটা কথাই ভাবছিল, মেয়ের যা এখন মনের অবস্থা, তাতে এই বিয়ের কথা কিভাবে বলবেন উনি! কিভাবে পুরনো সব কিছু ভুলে এত তাড়াতাড়ি নতুন জীবন শুরু করার জন্য জোর করবে তুলিকে! সেদিন সারা দিন এই চিন্তার ভিড়েই অশোকবাবু মুখটা অন্ধকার করে ঘুরছিল বাড়িতে। আর এটা তুলির মা খেয়াল করেছিল। তবে আজ তুলি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর মা নিজে গেছিল ওর কাছে। তারপর একটু শান্ত গলায় বলেছিল,
——-” তোর জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে। ডক্টর রঙ্গন এর মা ফোন করেছিল। রঙ্গন এর জন্য ওনার তোকে খুব পছন্দ।”
কথাটা শুনে তুলি কেমন আকাশ থেকে পড়েছিল! ও অবাক হয়েই বলেছিল,
——” কি! নিরুপমা কাকিমা নিজে বলেছে এইসব!”
এই কথায় তুলির মা আস্তেভাবেই বলেছিল,
——” হ্যাঁ, উনিই বলেছে ফোন করে।”
এটা শুনে তুলি কেমন নিশ্চুপ হয়েছিল যেন। আসলে উত্তর দেয়ার মতন কিছু নেই ওর। সুপ্রিয় এতটা ধাক্কা দিয়েছে তুলিকে যে এই ভালোবাসা, বিয়ে, পুরো ব্যাপারটা থেকেই বিশ্বাস উঠে গেছে তুলির। সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই হারিয়ে ছিল ও, তখনই মা বলে উঠলো,
——-” রঙ্গন খুব ভালো ছেলে তুলি। আর তোর বাবার ওকে খুব পছন্দ। আর কদিন ধরেই তোর বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাও করছে খুব মানুষটা! যদিও আর এই চিন্তার কথা নিজের মুখে তোকে বলবে না কখনো! কিন্তু, আমি তো মা! আমি তোর ভালোটাই চাই। তাই বলছি। আমি জানি, তুই একবার ভালোবেসে খুব কষ্ট পেয়েছিস। কিন্তু একটা ঘটনায়ই তো জীবন শেষ হয়ে যায় না! আরেকটা সুযোগ দিতেই হয় জীবনকে। আর রঙ্গনই হয়ত সেই আরেকটা সুযোগ তোর কাছে! তাই আরেকবার সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু করার চেষ্টা কর তুলি। নিজের জন্য, আমাদের জন্য। প্লিজ…”
কথাগুলো খুব অসহায় গলায় বলেছিল মা ওকে। তারপর আস্তে আস্তে ঘরটা ফাঁকা করে চলে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। কিন্তু তুলি কেমন পাথরের মতন বসে ছিল এক জায়গায়। চোখ দুটো ভিজে এসেছিল ওর জলে। আসলে আজও যে মনের কোণে সেই ছেলেটাই আছে! যাকে কালবৈশাখীর ঝড়ে উস্কো খুস্কো চুলে প্রথম দেখেছিল তুলি! যার গানকে ভালোবেসেছিল ভীষণভাবে। কিন্তু সেই ছেলেটার তো সব কিছুই মিথ্যে! এতদিনের এত ভালোবাসার পর শুধু অপমানই ফেরৎ দিয়েছে সুপ্রিয়। তবে ভুলটা তুলিরই। তুলিই মানুষ চেনেনি। কিন্তু ওর ভুলের মাসুল মা বাবা কেন দেবে! ওরা কি দোষ করেছে! আর এমনিও বাবা হাইপার টেনশন এর পেশেন্ট। আর বাবার এখন একটাই চিন্তা, তুলির বিয়ে। যদিও বাবা কোনদিন ওকে জোর করবে না! কিন্তু মনে মনে সারাক্ষণ মানুষটা চিন্তা করে যাবে। কথাগুলো কেমন মনে এসে ভিড় করলো এই মুহূর্তে। আর চারিদিকটা আরো বেশি আবছা, অসচ্ছ হয়ে ধরা দিল চোখের সামনে।

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০৪

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৭>
কিন্তু তুলির সেদিন বাড়ি ফিরে মনটা কেমন থমকে ছিল যেন। আজ প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল, সুপ্রিয়র সাথে কোন কথা নেই। তিন বছরের রিলেশনটার কি আর কোন দাম নেই ছেলেটার কাছে! মানছে অনেক ব্যাস্ত এখন, ওই টিভির রিয়্যালিটি শো টা জিতে সুপ্রিয় খুব নাম করেছে সিঙ্গার হিসেবে ইন্ডিয়ায়। কিন্তু তুলি তো এই নাম ডাকের অনেক আগে থেকে সঙ্গে ছিল ওর। ভালোবেসেছিল মন থেকে। আর আজ এই রিলেশনটার জন্য পাঁচটা মিনিটও কল করার সময় নেই সুপ্রিয়র! কথাগুলো ভেবেই চোখের কোণ টা চিকচিক করে উঠলো জলে তুলির। আর মনে পরে গেল আজ সকালে বাবার কথাগুলো। মা যদিও কদিন ধরেই পেপারে খুঁজে খুঁজে এই ওই ছেলের সম্বন্ধ দেখাচ্ছে ওকে। কিন্তু তুলি এইসবের হ্যাঁ না কোন উত্তর দিয়ে চুপচাপ এড়িয়ে যাচ্ছিল। তবে আজ বাবা যখন বললো, তখন আর না শুনে থাকতে পারলো না। আসলে ওই এক্সিডেন্টটার পর বাবার শরীর খুব দূর্বল। তাই তুলির বিয়ে নিয়ে আজকাল খুব চিন্তা করে। সেই জন্যই হয়তো খুব স্পষ্টভাবে আজ তুলির কাছে এসে বলেছিল,
—–” মা, আমার তো সামনের বছরই রিটায়ারমেন্ট। আর শরীরটাও আজকাল বেশ ক্লান্ত লাগে কেমন! তাই আমি আর দেরি করতে চাই না। আমি এই বছরের মধ্যেই তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে চাই। আসলে আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়িতে কত টাকাই আর জমানো থাকে বল! তার মধ্যে চাকরিটা থাকতে থাকতে তোর বিয়েটা হয়ে গেলে আমি নিশ্চিন্ত। সেই জন্য মা আর আমি মিলে তোর সম্বন্ধ খুঁজছি। ইন ফ্যাক্ট একটা ছেলেকে তো আমাদের খুব পছন্দ! ব্যাঙ্কে চাকরি করে। তুই রাজি থাকলে ছেলেটাকে ফ্যামিলি নিয়ে আমরা বাড়িতে ডাকতে পারি!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল বাবা। কিন্তু তুলি এইসব শুনে কেমন নিঃস্তব্ধ হয়ে গেছিল যেন! আসলে বাবাকে কোনদিন কোন ব্যাপারে ও মুখের ওপর না বলেনি। তাই আজ খুব অসহায় লাগছিল নিজেকে যেন! কিন্তু ‘ না ‘ তো বলতেই হবে তুলিকে; সুপ্রিয়র জন্য। নিজের ভালোবাসার জন্য। কথাটা ভেবেই তুলি খুব ধীর গলায় বলে উঠলো,
——-” বাবা, আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি। আমার একটা রিলেশন আছে তিন বছরের।”
কথাটা শুনে অশোকবাবু একটু অবাক হয়েই বললো, ——” রিলেশন! কখনো তো বলিসনি কিছু! কে ছেলেটা?”
এই কথায় তুলি একটু ইতঃস্তত হয়ে বললো,
——” তুমি চেন ওকে বাবা। ইন ফ্যাক্ট, তুমি ওর গানের ফ্যানও! আসলে ছেলেটা সুপ্রিয় বোস।”
কথাটা শুনে অশোকবাবু আকাশ থেকে পড়ে যাওয়ার মতন মুখ করে বললো,
—–” সুপ্রিয়! ফেমাস সিঙ্গার সুপ্রিয়! কিন্তু তুই ওকে চিনলি কি করে?”
কথাগুলো একসঙ্গে বললো অশোকবাবু। কিন্তু এর উত্তরে তুলি সেই আস্তে স্বরেই বললো,
——” আমরা একসাথেই রবীন্দ্রভারতী থেকে পড়েছি গান নিয়ে। ও যখন কোন কিছু ছিল না, এমনি আমার মতন একজন সাধারণ এম.মিউজের স্টুডেন্ট ছিল, তখন থেকে আমরা বন্ধু।”
কথাগুলো শুনে অশোকবাবু কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন সেদিন। তারপর নিজেকে একটু সামলে বলে উঠেছিল,
——” বিয়ে করবে ও তোকে? তাহলে আমার সাথে দেখা করতে নিয়ে আসিস এই সপ্তাহে।”
কথাটা শুনে তুলি শুধু ঘাড় নেড়েছিল আলতো করে। হ্যাঁ না কিছুই বলতে পারেনি বাবাকে। আসলে সুপ্রিয়র সাথে কখনো ওর বিয়ে নিয়ে কথা হয়ইনি আজ অব্দি! আর তার ওপরে এখন তো এমনি কথা টুকু বলতেও যেন এপয়েন্টমেন্ট লাগে ছেলেটার সাথে! এতই ব্যাস্ত সিঙ্গার বম্বের! তাই তুলি জোর দিয়ে বাবাকে কোন উত্তর দিতে পারেনি আজ সকালে। আর তারপর থেকে অনেকবার তুলি ছেলেটাকে ট্রাই করে যাচ্ছে ফোনে। কিন্তু প্রত্যেকবারই রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে কলটা। কেউ ফোন ধরা তো দূরে থাক, একবার দেখে কলব্যাক ও করছে না তুলিকে! কথাগুলো ভেবেই ভীষণ কান্না পেয়ে গেল এই মুহূর্তে। আর রাতের অন্ধকারটা আরো গভীর হয়ে ধরা দিল চোখে।

তবে এর দুটো দিন বাদে অবশেষে তুলি দেখা করেছিল সুপ্রিয়র সাথে। সুপ্রিয় কলকাতায় একটা কনসার্টের জন্য এসেছিল এক সপ্তাহের জন্য। আর এসে তুলিকে ফোন করেছিল নিজে থেকেই। তারপর সেই একই এক্সকিউজ দিয়েছিল প্রত্যেকবারের মতন, যে রেকর্ডিং আর কনসার্ট নিয়ে এতই ব্যাস্ত ছিল যে তুলির ফোনটা ধরতে পারেনি কিছুতেই। তবে তুলি আজ একটু গম্ভীর গলায় বলেছিল, ——” আমি দেখা করতে চাই তোমার সাথে। কথা আছে কিছু আমার।”
এই কথায় সুপ্রিয় সাথে সাথেই বলেছিল,
—–” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আজ রাত আটটার সময় চলে এসো ক্যাফে একান্তে তে। আমি রেকর্ডিং শেষ করে চলে যাবো।”
তুলি কথাটা শুনে সেই মুহূর্তে আর কোন কথা না বাড়িয়ে রেখে দিয়েছিল ফোনটা। তবে আজ একটা অদ্ভুত সংশয় হচ্ছিল মনে। সুপ্রিয়র সাথে রিলেশন টা যেই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে বিয়ে কি সম্ভব! না কি ভাঙ্গনটাই শেষ অব্দি সত্যি! কথাগুলো যেন নিজের অজান্তেই মনে এসে ভিড় করলো আজ।
<৮>
সেদিন এরপর সন্ধ্যের দিকে তুলি এসেছিল ক্যাফেতে, সময়ের একটু আগেই। তারপর আধ ঘন্টা অপেক্ষার পর সুপ্রিয় এসেছিল ওর সামনে। তুলি যদিও আজ বেশ চুপচাপ ছিল প্রথম থেকে। নিজের মনের চিন্তাগুলোর সাথে যেন জড়িয়ে ছিল ভিতরে ভিতরে। তবে সুপ্রিয় এসবের খোঁজ না নিয়েই খুব স্বাভাবিক গলায় বলেছিল,
—–” বলো, কি খাবে? এখানকার কাবাব খুব ফেমাস শুনেছি। ওটাই অর্ডার করি?”
প্রশ্নটা শুনে তুলি একটা অন্য কথা বলে উঠেছিল নিজের মনে। ও থমকে থাকা স্বরে বলেছিল,
——” আমি খেতে আসিনি এখানে আজ। বাবা আমার বিয়ে দিতে চায় এই বছরই। আমার জন্য সম্বন্ধ খুঁজছে। আমি এসব শুনে তোমার কথা বলে দিয়েছি বাবাকে। আর সব শুনে বাবা তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে, এই সপ্তাহে।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল তুলি। কিন্তু এইসব শুনে সুপ্রিয় কেমন শক খাওয়ার মতন মুখ করে বলেছিল,
——-” হোয়াট! বিয়ে! তুমি বিয়ের কথা বলবে বলে এসেছো এখানে?”
এই প্রশ্নে তুলির যেন ধাক্কা লেগেছিল একটা। ও ভীষণ স্থির গলায় বলেছিল,
——” বিয়ের কথা শুনে তুমি এতটা চমকে উঠলে কেন! আর তিন বছর হয়ে গেছে আমাদের রিলেশনশিপ এর! তারও কত বছর আগে থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। আর এখন তো তুমিও ওয়েল সেটলড, আর আমিও চাকরি করি। তাহলে বিয়ে করতে প্রব্লেম কোথায়?”
কথাগুলো বলতে বলতে তুলির গলাটা ধরে আসছিল যেন! নিজেকে হঠাৎ খুব ছোট লাগছিল এই ছেলেটার সামনে। মনে হচ্ছিল ভিক্ষা চাইতে এসেছে ভালোবাসার! কথাটা ভাবতেই সুপ্রিয় খুব কঠিন গলায় বলে উঠেছিল,
——” দ্যাখো, কেরিয়ারের এই স্টেজে আমি বিয়ের কথা চিন্তাও করছি না। আর এখন একটা রিলেশন কে দেওয়ার মতন টাইমও নেই আমার কাছে। আর তোমার কাছে বিয়ে করাটাই লাইফের এইম হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে সেটা না। তবে আমি তোমাকে আমার জন্য ওয়েট করতেও বলছি না। বিকজ অনেস্টলি, আমি আর তোমার জন্য সেইভাবে ফিল করি না। আমি ইন্ডিরেক্টলি কথাটা তোমাকে অনেকবার বোঝাতে চেয়েছি, কিন্তু কখনো মুখের ওপর বলতে পারিনি!”
কথাগুলো খুব নির্বিকার গলায় বলেছিল সুপ্রিয়। কিন্তু তুলির যেন কাঁচ বিঁধছিল মনে এইসব শুনে। এতটা অপমান যে ছেলেটা কোনদিন ওকে করবে, ভাবেনি আসলে। এতটা সস্তা দামহিন লাগছে নিজেকে সুপ্রিয়র সামনে! কথাটা ভেবেই তুলি উঠে দাঁড়ালো সেই মুহূর্তে। আসলে মনে হচ্ছে উল্টো দিকে যেই ছেলেটা বসে আছে, সে একটা কঠিন পাথরের মতন! যে খুব সহজে কাউকে কষ্ট দিতে পারে, চোখের পলকে যে পুরনো দিনগুলো, পুরনো সময়, পুরনো মানুষকে ভুলে যেতে পারে। কথাটা ভেবেই তুলি নিজের হাত দুটোকে মুঠো করে ভীষণ কঠিন হয়ে বললো,
—–” আসলাম। এন্ড থ্যাঙ্কস, ফর এভরিথিং. তুমি আজ আমাকে খুব ভালো একটা শিক্ষা দিলে আসলে। কোনদিন কাউকে বিশ্বাস না করার শিক্ষা! আর আজকের দিনটা আমি সারা জীবন মনে রাখবো। ভালো থেকো।”

চলবে।

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০৩

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( তৃতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৫>
তবে এই কালী পুজো পার করে নভেম্বরের শেষটা আসতেই একটা ঘটনা ঘটলো সেই রবিবার। তুলি প্রত্যেক সপ্তাহের মতন আজও গেছিল গান শেখাতে রঙ্গন দের বাড়ি। কিন্তু কলিং বেল বাজানোর দু মিনিট বাদে শিখা মাসি দরজা খুললো, এই বাড়ির কাজের লোক। কিন্তু দরজা খোলার পরই ও বলে উঠলো,
—–” আজ মনে হয় বৌদি গান শিখতে পারবে না। খুব জ্বর!”
এই কথায় তুলি বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেছিল,
—–” জ্বর! কোথায় কাকিমা? কেমন আছে?”
এই প্রশ্নে শিখা সাথে সাথেই উত্তর দিয়েছিল,
—–” ঘরেই শুয়ে আছে। যাও না, গিয়ে দেখা করে এসো।”
কথাটা শুনে তুলি আর অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি নিরুপমার ঘরে গিয়েছিল। তবে ঘরে গিয়ে ও থমকে গিয়েছিল কেমন। নিরুপমার মাথা তুলে তাকানোর মতনও অবস্থা নেই, এত জ্বর! তুলি এটা দেখে নিরুপমার কাছে গিয়ে আলতো করে কপালে হাত ঠেকিয়ে ছিল। গা এই সময় জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! কথাটা মনে হতেই শিখা এসে বলেছিল,
—–” আমি সকালবেলা এসে থেকে দেখছি এই অবস্থা! তার মধ্যে দাদাও নেই বাড়িতে।”
কথাটা শুনে তুলি ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিল,
—–” নেই মানে! কোথায় গেছে? আর কাকিমা এতটা জ্বরের মধ্যে বাড়িতে একা!”
এই প্রশ্নে শিখা একটু এলোমেলো হয়েই বললো,
—–” দাদা তো দুদিন ধরে বাইরে। মনে হয় কলকাতার বাইরে কোন কাজ আছে, সেখানে গেছে! আর আমি তো আজ সকালবেলা এসে দেখছি বৌদির এত জ্বর। কাল অব্দি তো ঠিকই ছিল! আমি তারপর অনেকবার দাদার ফোনে চেষ্টা করেছি, কিন্তু রিং হয়েই যাচ্ছে। দাদা আর ফোন ধরেনি।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল শিখা। কিন্তু এইসব শুনে তুলি আর চুপ করে বসে থাকেনি। নিজেই ফোন বার করে কল করেছিল ওদের ফ্যামিলি ডক্টর চন্দন বাবুকে। তারপর এড্রেস দিয়ে দিয়েছিল রঙ্গনদের বাড়ির।
এরপর তুলি সারাদিন ধরে নিরুপমার মাথার কাছে বসেছিল। ওর কপালে জল পট্টি দেয়া থেকে উল্টোদিকের ওষুধের দোকান থেকে সমস্ত ওষুধ কিনে আনা, তারপর বুঝিয়ে শুনিয়ে সেই ওষুধ নিরুপমা কে সময় মতন খাওয়ানো, সব করেছে নিজে। আসলে নিরুপমার ব্যাবহার, নিজের করে নেওয়ার মতন ক্ষমতার জন্য তুলি এই মানুষটাকে ছেড়ে যেতে পারেনি কিছুতেই! শুধু মনে হচ্ছিল কখন আবার এই হাসি খুশি মানুষটা জেগে উঠবে, কখন সেই আগের মতন কথা বলবে, গল্প করবে ওর সাথে!
সেদিন এই মনে হওয়ার ভিরেই সন্ধ্যে নেমে এসেছিল শহরে। তুলি তবে এখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি। যদিও নিরুপমার টেম্পারেচার এখন আগের থেকে অনেক কম। তবে সকাল থেকে খেয়াল না রাখলে জ্বরটা নামতো না ওর! এর মাঝখানে নিরুপমা জ্বরের ঘোরে ই অনেকবার বলেছিল তুলিকে,
—–” তুই বাড়ি ফিরে যা; কতক্ষণ আর বসবি এইভাবে আমার সাথে! বাড়িতে চিন্তা করবে।”
কিন্তু তুলি প্রত্যেকবারই এই কথায় একই উত্তর দিয়েছে। ও খুব সহজভাবেই নিরুপমা কে বলেছে,
—–” তুমি এইসব নিয়ে একদম চিন্তা কোরো না। আমি বাড়িতে ফোন করে দিয়েছি। কেউ চিন্তা করছে না। আর মা বাবা আমার মুখে তোমার কথা এত শুনেছে, যে ওরা তোমাকে না দেখেও খুব ভালোভাবে চিনে গেছে, বুঝলে। আর জ্বরটা একটু না নামা অব্দি আমি তোমাকে এইভাবে একা ফেলে কোথাও যাচ্ছি না আজ। শিখা মাসিও তো থাকলো না! দুপুরের আগেই চলে গেল! নইলে শিখা মাসি থাকলে তাও একটা ভরসা ছিল।”

কথাগুলো শুনে নিরুপমা আর বারণ করতে পারেনি তুলিকে এরপর। আসলে কেউ যদি এতটা কাছের ভেবে পাশে থাকতে চায়, তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার সাদ্ধি কারোর নেই।
যাইহোক এইসব ভাবনার ভিড়ে ঘড়ির কাঁটা গড়িয়ে আটটার ঘরে পৌঁছেছিল সেইদিন। তুলি এর মধ্যে তিন চারবার রঙ্গন কে ট্রাই করেছে ফোনে। কিন্তু প্রত্যেকবারই ফোনটা রিং হয়ে কেটে গেছে। তবে এখন নিরুপমা অনেকটা বেটার। তুলি ঠিক করেছে নিরুপমা কে ডিনার খাইয়ে ওষুধগুলো দিয়ে ও বাড়ি যাবে। সেই মতন খাবার বেড়ে নিরুপমার কাছে গেছিল ও, কিন্তু সেই মুহূর্তেই কলিং বেলটা বেজে উঠলো ফ্ল্যাটের। তুলি এবার একটু আনমনেই এসে দরজা খুলেছি ল সেদিন। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখলো রঙ্গন দাঁড়িয়ে। পাশে একটা লাগেজ ব্যাগ। রঙ্গনও এই সময়ে তুলিকে বাড়িতে দেখে বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করেছিল,
—-” আপনি এখানে! ”
তুলি এই প্রশ্নে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলেছিল,
——” কাকিমার খুব জ্বর। আজ সকাল থেকেই। আমি গান শেখাতে এসে দেখলাম। আর বাড়িতে কেউ নেই! তাই আমি ছিলাম সকাল থেকে।”
কথাগুলো শুনে রঙ্গন এর যেন ধাক্কা লাগলো একটা! ও কেমন এলোমেলো হয়েই বললো,
—–” কি! মায়ের জ্বর! ”
কথা বলেই ও ব্যাগ ফেলে ছুটলো মায়ের ঘরের দিকে। তবে এই সময়ে নিরুপমা উঠে বসেছিল খাটে। শরীরটা এখন আগের থেকে অনেকটা ই সুস্থ্য লাগছে। এর মধ্যেই রঙ্গন এসে প্রায় হুড়মুড়িয়ে মা কে জড়িয়ে ধরলো। তারপর নিরুপমার কিছু বলার আগেই ও বলে উঠলো,
——” জ্বর হয়েছে তোমার! কিভাবে বাঁধালে? নিশ্চয়ই আমি ছিলাম না বলে ফ্রিজের আইসক্রিম গুলো খেয়েছ। তাই এই অবস্থা!”
কথাটা য় নিরুপমা শান্ত গলায় বললো,
—–” কিছু হয়নি আমার। ঠিক আছি এখন। আর এই সবই তুলির জন্য। তুলি আজ সকাল থেকে এখানে ছিল! ডাক্তার ডাকা থেকে শুরু করে জল পট্টি দেওয়া, মেয়েটা সব করেছে আমার জন্য! আর তোকে তো ফোন করে করেও একবারও পাইনি আজ। তুলি না থাকলে যে কি হতো আমার!”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো নিরুপমা। রঙ্গন এর উত্তরে একটু ইতস্তত হয়ে বললো,
—–” আসলে ব্যাঙ্গালোর এ সেমিনার, তারপর দুটো হসপিটালে ভিজিট, এত কাজ ছিল যে আমার নিঃশ্বাস নেওয়ারও সময় ছিল না! তাই বাড়ি থেকে আসা কোন ফোনই রিসিভ করতে পারিনি। আর এয়ারপোর্ট এ এসে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিল। তাই ফোনটা অফ ছিল। আই এম রিয়ালি সরি মা! আমি বুঝিনি তোমার এতটা শরীর খারাপ ছিল!”
কথাটায় নিরুপমা আস্তে গলায় বলেছিল,
—–” আচ্ছা, হয়েছে। আমি এখন ঠিক আছি! আর ভাবিস না। যাইহোক, তুই তুলির জন্য একটা ট্যাক্সি বুক করে দে এখনি । মেয়েটা সারা দিন ধরে আমার কাছে পড়ে আছে!”
কথাটা শেষ হতেই তুলি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছিল,
——” না না কাকিমা। এত ব্যাস্ত হওয়ার কিছু নেই! আমি চলে যাবো বাসে। ট্যাক্সি বুক করার দরকার নেই।”
তবে এসব শুনে রঙ্গন নিজে থেকে বলেছিল,
——-” প্লিজ! আমি ওলা বুক করে দিচ্ছি। আপনি যা করলেন সকাল থেকে! সিরিয়াসলি থ্যাঙ্ক ইউ..”
এই কথায় তুলি শান্ত গলায়ই উত্তর দিয়েছিল,
——” থ্যাঙ্কস বলার দরকার নেই। যাইহোক, টেবিলে প্রেস্কিপশনে ওষুধগুলোর নাম লেখা আছে। টাইম মতন খাইয়ে দেবেন। আর আপনি তো একজন ডাক্তার, আপনি আমার থেকে আরো ভালো বুঝবেন এইসব।”

কথাটা শেষ করে সেদিন আর তুলি বেশিক্ষণ থাকেনি। তবে বাড়ি যাওয়ার সময় রঙ্গন নিজে থেকেই বলে উঠেছিল,
—- ” আপনি আজকে মায়ের জন্য যেটা করলেন, আমি কোনদিন ভুলবো না! আসলে আমি কাজগুলো নিয়ে এত ব্যাস্ত হয়ে ছিলাম!”
রঙ্গন এর কথাটাকে এবার শেষ হতে না দিয়েই তুলি বললো,
——” আমি এতবার বলার মতন এমন কিছুই করিনি! আসলে কাকিমা এই কদিনে এত নিজের করে নিয়েছে আমাকে; তাই একা ওই অবস্থায় রেখে কখনোই চলে যেতে পারতাম না! তবে আপনাকে একটা কথা বলছি। প্লিজ খারাপ ভাবে নেবেন না! আপনি খুবই ব্যাস্ত জানি, তবে কাকিমারও আপনাকে দরকার হয়। আজ যদি আমি না আসতাম তাহলে ওইভাবেই হয়তো সারাটা দিন পড়ে থাকতো! আর আপনি জানতেও পারতেন না।”
কথাগুলো খুব স্থির গলায় বলেছিল তুলি। তবে রঙ্গন এর কোন উত্তর দিতে পারেনি! আসলে এই প্রথম কেউ একজন বুঝিয়ে দিল ভুলটা। এই ব্যাস্ততায় ভরা জীবন থেকে কিছুটা সময় আলাদা করে নিজের মানুষগুলোর খোঁজ নেওয়া যে কতটা দরকার; এটা আগে কখনো আগে মনে হয়নি। কথাগুলো খুব ভেতর ফিল হলো রঙ্গন এর। তবে তুলি এরপর চলে গেছিল সেদিন। কিন্তু আজ নিজের অজান্তেই ও কেমন রঙ্গন এর মনে একটা স্থায়ী জায়গা করে ফেলেছিল নিজের। আসলে রঙ্গন এর কাছে তুলি ভীষণ আলাদা হয়ে গেছিল এই দিনের পর। হয়তো ও যেই মানুষটার জন্য এতদিন ধরে অপেক্ষা করেছে, তাকেই হঠাৎ খুঁজে পেয়েছিল এই ঘটনার পর। এমন একজন মানুষ, যে ঠিক ভুলের তফাৎটা করতে জানে। যে মন থেকে ভাবে সবার জন্য। যে হিসেব ছাড়াই লোকের পাশে থাকে।
এরপর প্রত্যেকটা রবিবারের জন্য রঙ্গন মনে মনে অপেক্ষা করতো। সেই মেয়েটার মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষা। সেই জন্য যত কাজই থাকুক, রঙ্গন রবিবারের সকাল গুলো ফাঁকা রাখতো। যদিও ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের জন্য তুলির সাথে খুব আলাপ জমিয়ে উঠতে পারত না কোনদিন, কিন্তু তাও নিজে থেকে কিছু কথা শুরু করার চেষ্টা করতো প্রত্যেকবার। এই যেমন ” আপনার বাবার শরীর ঠিক আছে তো?”, ” মা গান ঠিকঠাক করছে তো?”, ” সুর তাল সব ঠিক আছে?” , এই রকম এলোমেলো কথা বলতো হঠাৎ হঠাৎ। তবে এইসব শুনে তুলি অল্প কথায়ই উত্তর দিত। আসলে যে গান জানেই না তাকে কি ই বা বোঝাবে সুর তালের ঠিক ভুলের ব্যাপারে! তবে এইসব দেখে সব থেকে বেশি অবাক হতো নিরুপমা। যেই ছেলে এত গম্ভীর, চুপচাপ, তার হঠাৎ তুলি কে দেখলে কি হয় কে জানে! নিজে থেকে বার বার কথা বলে! আর নিরুপমার গান নিয়েও এখন রঙ্গন কি সিরিয়াস! এই তো সেদিন নিরুপমা নিজে থেকেই বলেছিল সামনের সপ্তাহের গানের ক্লাসটা অফ দেবে। পুরনো কলেজের বন্ধুদের সাথে পিকনিক আছে। কিন্তু তাতে রঙ্গন কেমন প্রতিবাদ করে উঠেছিল যেন! দশ মিনিট ধরে বুঝিয়েছিল গান কত বড় একটা সাধনা! একটা গানের ক্লাসও তাই অফ দেওয়া উচিত না। এইসব শুনে নিরুপমা সত্যি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল। ছেলের ওর গান গাওয়া নিয়ে এত চিন্তা; এটা আসলে আগে কখনো বোঝেনি।
যাইহোক, এইভাবেই দিনগুলো এগোচ্ছিল। তবে সেই ফেব্রুয়ারি মাসের পনেরো তারিখে একটা ঘটনা ঘটলো। সেদিন প্রত্যেক রবিবারের মতন তুলি গান শিখিয়ে বেরোচ্ছিল নিরুপমাদের এপার্টমেন্টটা থেকে, তখনই হঠাৎ পিছন থেকে রঙ্গন এর গলার আওয়াজ। বেশ হন্তদন্ত হয়েই ও তুলির কাছে এসে বলেছিল,
—–” আপনার একটা হেল্প লাগবে। একটু সময় হবে কথা বলার?”
তুলি কথাটা শুনে একটু অবাক হয়ে বলেছিল,
—–” আমার হেল্প! কি ব্যাপারে?”
এই প্রশ্নটায় রঙ্গন সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল,
——” আসলে কাল মায়ের জন্মদিন। আমি মা কে একটা শাড়ি গিফ্ট করতে চাই। কিন্তু আমি আসলে এইসব ব্যাপারে কিছু বুঝি না! তাই আপনি যদি একটু হেল্প করতেন!”
শেষ কথাগুলো বেশ ইতঃস্তত হয়েই বললো রঙ্গন। কিন্তু এইসব শুনে তুলির ভালো লেগেছিল এই মুহূর্তে। তার মানে ছেলেটা নিজের মা কে নিয়ে ভাবে, মা কে স্পেশাল ফিল করাতে চায়! এই কথাগুলো মনে হতেই তুলি বলেছিল,
—-” কাকিমার ফেভারিট কলর কি? জানেন?”
এই প্রশ্ন রঙ্গন একটু হোঁচট খেয়ে বলেছিল,
—–” রামধনুর সাত রঙ! মানে সব কলরই তো পড়তে দেখি, তাই কোনটা ফেভারিট বুঝতে পারি না!”
এই কথায় তুলি অল্প হেসে ফেলেছিল মুখ টিপে। তারপর কিছুটা সময় নিয়ে বলেছিল,
—–” আপনি কখন ফ্রি বলুন, তাহলে কাকিমার জন্য শাড়ি কিনতে যাবো আপনার সাথে।”
কথাটা শুনে রঙ্গন একটুও সময় না নিয়ে বলেছিল,
—–” আজকে সন্ধ্যেবেলা? আমার চেম্বার ও নেই আজ!”
এই কথায় তুলি আর কিছু না বলে নীরবে সম্মতি জানিয়েছিল।
তারপর সেই সন্ধ্যে ওরা দুজন এই দোকান, সেই দোকান ঘুরে ঘুরে অবশেষে একটা আকাশী রঙের শাড়ি পছন্দ করে কিনেছিল নিরুপমার জন্য। শুধু তাই না, একটা বার্থডে কেকেরও অর্ডার দিয়েছিল দোকানে। তবে এরপর রঙ্গন আরেকটা কথা বলে উঠেছিল তুলিকে একটু আস্তে গলায়,
—–” থ্যাঙ্কস আপনি আজ আমাকে এতটা সময় দিলেন। কিন্তু কাল আপনাকে সন্ধ্যেবেলা আসতেই হবে আমাদের বাড়িতে। আমি আসলে মায়ের জন্য একটা সারপ্রাইজ পার্টি রাখছি। মায়ের সব স্কুল কলেজের বন্ধুদের বলেছি। আর আপনি তো মায়ের খুব ক্লোজ! আপনি কাল না এলে সেলিব্রেশনটা কমপ্লিট হবে না।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল রঙ্গন। কিন্তু এইসব শুনে তুলি বেশ স্থির হয়েই বলেছিল,
—–” আপনি যে এত ব্যস্ততার মধ্যেও কাকিমার জন্য এইভাবে টাইম বার করেছেন, এটা দেখে সত্যি খুব ভালো লাগলো। আর আমি নিশ্চয়ই আসবো কাল।”
এই কথায় রঙ্গন এর মুখে একটা মিষ্টি হাসি। আসলে এই সবই যে তুলির জন্যই! তুলি যদি সেদিন ওকে নিজের ভুলটা না বোঝাত, তাহলে আজ হয়তো এইভাবে ভাবতো না রঙ্গন। নিজের ব্যস্ততার ভিরেই ভুলে যেত মায়ের এই জন্মদিনটা!
<৬>
তবে এরপরের দিন তুলি ঠিক সন্ধ্যে সাতটায় এসেছিল রঙ্গনদের বাড়ি। হাতে দুটো সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বই নিয়ে। আসলে কাকিকার মুখে অনেকবার শুনেছে সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর লেখার কত বড় ফ্যান নিরুপমা! তাই আজ স্কুল এর পর কলেজ স্ট্রিট গিয়ে নিজে খুঁজে এনেছে বই গুলো, আর সেটা দেখে নিরুপমার মুখে একটা চওড়া হাসি। ও তো ভালোবেসে জড়িয়েই ধরলো তুলিকে। কিন্তু এই পুরো দৃশ্যটায় রঙ্গন যেন অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল তুলির দিকে! কি করে বোঝে মেয়েটা এইভাবে মনের কথা! কত কম সময়ে মানুষকে নিজের করে নিতে পারে! এরকম একজনেরই তো অপেক্ষায় ছিল রঙ্গন এতদিন। এই মেয়েটাকেই তো খুঁজছিল ও চেতনে অবচেতনে। কথাগুলো এক মনে ভাবছিল সেদিন। তখনই তুলি পাশে এসে নিজে থেকেই বলে উঠলো,
——” কি ভাবছেন এত? কোন পেশেন্টের কথা?”
প্রশ্নটা য় রঙ্গন আলতো হেসে বললো,
—–” ডাক্তার বলে কি সব সময় পেশেন্টের কথাই ভাববো! আমি মায়ের জন্য আপনার আনা গিফ্টটার কথা ভাবছিলাম আসলে।”
এই কথাটায় তুলি একটু অবাক হয়েই বললো,
—-” আমার গিফ্ট এর কথা! কি ভাবছিলেন?”
এই প্রশ্নে রঙ্গন কোন সময় না নিয়ে বললো,
—–” আমি এত বছরে আমার মায়ের ফেভারিট রাইটার কে তার খোঁজ জানি না! কিন্তু আপনি এই কদিনেই জেনে গেলেন! আর আপনি মা কে বেস্ট গিফ্টটা দিয়েছেন জন্মদিনে। এন্ড আই হ্যাভ টু সে দিজ..”
এই কথায় তুলি অল্প হেসে বললো,
—–” না, আমি না, আপনি কাকিমাকে বেস্ট গিফ্ট দিয়েছেন আজকে; নিজের সময়। কাকিমার জন্য এটাই সব থেকে বেশি দরকার।”
সেদিন এসব এলোমেলো কথার ভিড়ে, সবার সাথে গল্প করতে করতে বেশ রাত নেমে এসেছিল শহরে। তাই তুলিকে কিছুতেই একা ছাড়েনি নিরুপমা, রঙ্গন এর ওপর দ্বায়িত্ব দিয়েছিল তুলিকে বাড়িতে ছেড়ে আসার জন্য। যদিও তুলি বার বার বলেছিল ও চলে যাবে ট্যাক্সিতে, কিন্তু রঙ্গন ই তখন জোর দেখিয়ে বলেছিল,
—–” প্লিজ, এত রাত হয়ে গেছে! ট্যাক্সি পেতে অসুবিধা হবে। আমি ছেড়ে দিয়ে আসছি আপনাকে, কোন প্রব্লেম নেই।”
কথাগুলো রঙ্গন বেশ জোর দিয়েই বলেছিল, তাই তুলি আর না করতে পারেনি ওকে। তবে সেদিন গাড়িতে রঙ্গন খেয়াল করেছিল তুলি যেন একটু আনমনা হয়ে গেছে হঠাৎ। মাঝে মাঝেই নিজের ফোনটা চেক করছে! অকারণে মেসেজ বক্স টা খুলছে বার বার। এইসব দেখে রঙ্গন নিজে থেকেই বলে উঠেছিল,
——” কারোর ফোনের অপেক্ষা করছেন না কি? দরকারি কিছু!”
তুলি এই প্রশ্নটা শুনে চিন্তার ঘোরটা কাটিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায়ই বলেছিল সেদিন,
—- ” না, সেরম কিছু না। কারোর অপেক্ষা করছি না।”
এই কথায় রঙ্গন আজ একটা বেহিসেবী কথা বলে উঠেছিল হঠাৎ কিছুটা আস্তে গলায়,
—–” আচ্ছা, আমরা কি বন্ধু হতে পারি? মানে আমি আসলে না ভেবেই বললাম। আই হোপ আপনি মাইন্ড করলেন না! আসলে আপনাকে দেখে আলাদা লাগে সবার থেকে! স্পেশ্যালি আপনি যখন মায়ের সাথে থাকেন। আমার মা খুব কম সময়ে আপনার সাথে এতটা মিশে গেছে! তাই আর কি!”
কথাগুলো কেমন এক নিঃশ্বাসে বললো রঙ্গন। কিন্তু তুলি এর ঠিক কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না! এরকম একজন নাম করা ডাক্তার, যার সাথে এপয়মেন্ট নিয়ে কথা বলতে হয় ভেবেছিল, যার সাথে মাপা দূরত্ব রাখাটাই নিয়ম মনে হয়েছিল, সে নিজে থেকে বন্ধু হবে বলছে! কথাটা ভেবে বেশ অবাক লাগলো ওর। তবে তুলি এই মুহূর্তে একটু নিজেও সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—–” আমরা প্রফেশনালি হয়তো দুজন দু প্রান্তের লোক। একজনের হার্ট বিট নিয়ে কাজ, আর একজনের গানের বিট নিয়ে! তবে আমরা মানুষ হিসেবে হয়তো খুব আলাদা নই। ওই দুটো চোখ, একটা নাক, সেম ফিচার! তাই বন্ধুত্ব করাই যায়! আর এতে মাইন্ড করার মতন কিছু নেই।”
কথাটা শুনে রঙ্গন এর মুখে হাসি। যদিও ততক্ষণে অনেকটা রাস্তাই চলে এসেছে দুজন। তবে রঙ্গন এর এই রাস্তাটা হঠাৎ ভীষণ সুন্দর মনে হলো আজ। মনে হলো কলকাতা শহরে এতগুলো বছর থাকলেও এত সুন্দর রাস্তা আগে পেরোনো হয়নি! আজ সবই নতুন। শুধু তুলির জন্যই।

চলবে।

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০২

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৩>
কিন্তু কিছু ভাবনা মেলে না ঠিক জীবনে। অন্য কিছু আলাদাভাবে অপেক্ষা করে থাকে পরের দিনগুলোতে! এই যেমন রঙ্গন এর সেদিনের ভাবনাটাও মিললো না ঠিক! আরেকবার নতুনভাবে মুখোমুখি হতেই হলো তুলির সাথে কয়েক সপ্তাহ পরে। সেই দিনটা ছিল রবিবার। রঙ্গন আজকের সকালটা অফ রেখেছে পুরোপুরি ভাবে। কাল খুব হেকটিক গেছে আসলে ওর। সকালে কনফারেন্স, তারপর তিনটে ও.টি, চেম্বার! তাই আজ সকালটা রেস্ট নেবে বাড়িতে। এইসব ভেবেই কোন এলার্ম সেট করেনি মোবাইলে। কারণ আজ তো দশটার আগে কোন মতে উঠছে না রঙ্গন! যাইহোক, এই এলোমেলো চিন্তার আড়ালেই বেশ শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল ছেলেটা; কিন্তু হঠাৎ জেগে উঠলো মায়ের চিৎকার এ!
” একো সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্র টি মন
একো কার্যে সপিয়াছি সহস্র জীবন।।”
গানটা বেশ তুমুল চিৎকার করেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছিল রঙ্গন এর মা, যেটা শুনে রঙ্গন প্রায় ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলো! এটার কোন মানে আছে! একটা ছুটির সকাল। আজও মা কে এই চিল চিৎকার করতেই হবে! গেল ঘুমটা নষ্ট হয়ে! কথাটা ভাবতে ভাবতেই রঙ্গন বেশ রেগেই মায়ের ঘরের দরজার দিকে এসেছিল, তারপর কোন কিছু খেয়াল না করেই মা-কে বলেছিল,
—–” প্লিজ মা, সকাল সকাল এই অত্যাচারটা বন্ধ করো একটু! ঘুমের দফা রফা হয়ে গেল! তুমি তো টাইম পাসের জন্য গানের বদলে আঁকাও শিখতে পারো, তাতে অন্তত বাড়িতে একটু শান্তি বজায় থাকে সকাল সকাল!”
কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বললো রঙ্গন। কিন্তু তখনই হঠাৎ মায়ের নতুন গানের টিচার পিছনে ফিরে তাকালো ওর দিকে, তারপর অল্প ইতঃস্তত হয়ে বললো,
—–” আপনার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে কাকিমার গান শুনে?”
কথাটা শেষ হতেই রঙ্গন কেমন থমকে গেল হঠাৎ! সেই মেয়েটা, এখানে! যার সাথে আরেকবার আলাপ করার ইচ্ছা ছিল, সে অবশেষে ওর বাড়িতে এসেই হাজির! কথাটা ভাবতেই ও নিজের মনে বলে উঠলো,
—–” আপনি! আমাদের বাড়িতে!”
প্রশ্নটা য় রঙ্গন এর মা এবার বলে উঠলো,
—–” হ্যাঁ, ও তুলি। আমার নতুন গানের টিচার। কিন্তু তুই কি চিনিস ওকে?”
এর উত্তরে রঙ্গন কিছু বলার আগেই তুলি বলে উঠলো, —–” আসলে আমার বাবার আগের মাসে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। উনি সেই সময় খুব হেল্প করেছিলেন বাবাকে টিউলিপ নার্সিং হোমে এডমিট করানোর জন্য। তাই!”
কথাটা শেষ হতেই রঙ্গন এবার নিজে থেকে বললো,
—-” হাই, আমি জানতাম না আপনি মায়ের গানের টিচার! যাইহোক আপনার বাবা এখন কেমন আছে? আর কোন মেডিক্যাল প্রব্লেম নেই তো?”

এতগুলো প্রশ্ন শুনে তুলি আজ একটু অবাকই হলো! সেদিন যখন তুলি কথা বলতে গেছিল, তখন তো একদম মাপা উত্তর দিয়েছিল। তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো! কথাটা ভেবেই তুলি এবার অল্প কথায় বলে উঠলো,
—-” হ্যাঁ, ভালো আছে বাবা। আর কোন প্রব্লেম নেই এখন। যাইহোক, আপনি যখন গানের জন্য ডিস্টার্বড হচ্ছেন, তাহলে আজ বরং আমি আসি। অন্য একদিন এসে কাকিমাকে গান শিখিয়ে দেব!”
কথাটা বলেই তুলি উঠতে যাচ্ছিল হারমোনিয়াম এর সামনে থেকে, তখনই রঙ্গন বেশ জোর দিয়ে বললো,
—-” না না! প্লিজ.. আপনি যাবেন না! আসলে আমার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেছিল বলে আমি তখন রিয়্যাক্ট করে উঠেছিলাম, এন্ড এম রিয়ালি সরি ফর দ্যাট.. প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড.. আপনি মন দিয়ে গান শেখান, আর মা, তুমিও খুব মন দিয়ে গান করো। আমি আসছি।”
কথাগুলো কোন রকমে বলেই রঙ্গন বেরিয়ে এসেছিল ঘরটা থেকে, মনে একটা ভালো লাগার রেশ নিয়ে। কিন্তু রঙ্গন এর মা কেমন অবাক হয়ে গেছিল ছেলের এই কথায়! গান নিয়ে যে কোন দিন ছেলে ওনাকে উৎসাহ দিতে পারে, সেটা আসলে ধারণার বাইরে ছিল নিরুপমার। আসলে এইসবই সময় কাটানোর জন্য জোর করে করেন উনি, রঙ্গন এর বাবার অকালে চলে যাওয়ার পর। তার ওপরে গলার কোয়ালিটিটা একটু ভাঙা ভাঙা সুরহীন। তাই গান যে খুব একটা ভালো শুনতে লাগে না ওনার গলায়, সেটা নিরুপমা বোঝে। কিন্তু তাও জোর করে চালিয়ে যায় গানটাকে।

তবে এরপর নিরুপমা কে আরো একটু অবাক করে দিয়ে রঙ্গন সেই রাতে ডিনার টেবিলে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
—–” মা, তুমি সপ্তাহের কোন কোন দিন গান শেখ? আমি এত বিজি থাকি, যে এইসব ব্যাপারে কিছু জানিই না!”
প্রশ্নটা শুনে নিরুপমা বেশ বড় বড় চোখ করেই নিজের ছেলের দিকে তাকালো! আজ হঠাৎ কি হলো ছেলেটার! ‘ মা, প্রেশারের ওষুধ খেয়েছ?’, ‘ মা, ইভিনিং ওয়াক এ গেছো?’ এইসব প্রশ্ন ছেড়ে এরকম অন্য রকম কথা বলছে! কথাটা ভেবেই নিরুপমা বলে উঠলো,
—–” তুলি প্রত্যেক শনিবার আসতো বিকেলে। তাই তোর সাথে কখনো দেখা হয়নি! তবে ওর আরেকটা নতুন গানের স্কুল শুরু হয়েছে, তাই টাইম টা বদলে রবিবার সকালবেলা করে দিয়েছে। কিন্তু তোর তো ওই একটাই ছুটির দিন! তোর অসুবিধা হলে বল, আমি ওর গানের স্কুলে গিয়ে গান শিখে আসবো। রবিবার সকাল গুলো কিছু রাখবো না!”
কথাটায় রঙ্গন এবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বললো,
—–” না না, একদম না! ওকে বরং রবিবারই আসতে বল। আর গান তো একটা সাধনা মা, ওটা স্কুলে গিয়ে অতো জনের মাঝখানে ঠিকভাবে শিখতে পারবে না। এখানে যেমন বাড়ি এসে শুধু তোমাকে একা শেখাতে পারবে, তোমার প্রতি নজরটা বেশি দিতে পারবে।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল রঙ্গন। কিন্তু এসব শুনে নিরুপমা একটা ঢোঁক গিলে বলেছিল,
—–” তুই ঠিক আছিস তো বাবা? জ্বর টর কিছু আসেনি তো! মানে এতদিন তো আমার গান কে সাপোর্ট করে এত কথা বলিসনি! উল্টে আমি গান ধরলেই তুই আমাকে থামাতে চলে আসিস। তাহলে আজ কি হলো?”
প্রশ্নগুলো শুনে রঙ্গন কি বলবে ঠিক বুঝতে না পেরে একটু ইতঃস্তত হয়ে বললো,
—–” না মা, আসলে আমার মনে হয়েছে গান নিয়েই তুমি খুশি থাকবে। আর আমিও তো সারা সপ্তাহ কাজের মধ্যেই থাকি! সেখানে রবিবার সকাল গুলো একটু গান বাজনা হলে আমারও ভালো লাগবে। তাই!”
কথাগুলো বলেই রঙ্গন খাওয়াতে মন দিয়েছিল। কিন্তু নিরুপমার মনটা খুব খুশি হয়ে গেছিল এইসব শুনে। অবশেষে রঙ্গন ওর গানের প্রতি ভালোবাসাটা বুঝেছে। এটা ভেবেই ভালো লাগছিল ভীষণ।
<৪>
যাইহোক, এর পরের রবিবারও রঙ্গন দিনটা ফাঁকা রেখেছিল নিজের। কিছুটা ইচ্ছা করেই। তবে আজ বাড়িতে থাকার জন্য তুলির গানের আওয়াজ শুনেই ঘুমটা ভেঙেছিল ওর। আর রঙ্গন কিছুটা মুগ্ধ হয়েই যেন গানটার মধ্যে হারিয়ে গেছিল। তবে আজ মা রঙ্গন এর জন্য স্পেশ্যালি লুচি আলুর দম করেছিল ব্রেকফাস্টে। কিন্তু গান শেখানো শেষ হয়ে যাওয়ার পর নিরুপমা কিছুতেই তুলিকে ছাড়েনি। জোর করে এনে বসিয়েছিল ডায়নিং টেবিলে, ওদের সাথে ব্রেকফাস্ট করার জন্য। যদিও তুলি প্রথম থেকেই না না করছিল, কিন্তু রঙ্গন ও এবার ইনসিস্ট করে বললো,
—-” প্লিজ, খেয়ে যান। মা এত করে বলছে! আর মায়ের হাতের লুচি আলুর দম খেলে আপনি ফ্যান হয়ে যাবেন রান্নার।”
কথাটা শুনে তুলিকে রাজি হতেই হয়েছিল। এরপর খাওয়ার সময় রঙ্গন নিজে থেকে বলে উঠেছিল,
—-” আজ আপনার গান শুনলাম। আপনি সিরিয়াসলি ভীষণ ভালো গান করেন!”
কথাটায় তুলি অল্প হেসে বললো,
—-” না, ওই আর কি!”
কথাটা শুনে রঙ্গন আবার জিজ্ঞেস করে উঠলো,
—–” আপনি কত বছর হলো গান শেখাচ্ছেন? মা বলছিল আপনার না কি দুটো গানের স্কুল ও আছে!”
প্রশ্নটা শুনে তুলি আলতো গলায় বললো,
—-” আমার মিউজিকটাই সাবজেক্ট ছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীত এর ওপর মাস্টার্স করেছি। তারপরই যোগমায়া স্কুলে গানের টিচার হয়ে জয়েন করি। আর উইক এন্ডস গুলোতে স্টুডেন্টস দের গান শেখাই।”
কথাটা য় রঙ্গন সাথে সাথেই বলে উঠেছিল,
—–” ওহ, আচ্ছা। খুব ভালো। আসলে আমাকেও মা ছোটবেলায় গান শেখানোর জন্য ভর্তি করেছিল। কিন্তু আমি দু দিন শিখেই খাটের নিচে ঢুকে বসে থাকতাম স্যার বাড়িতে এলেই। তারপর মা আর চেষ্টা করেনি। আসলে আমার দ্বারা এইসব গান টান হওয়ার ছিল না! অনেক ধৈর্য্য লাগে এসব শিখতে।”
কথাগুলো শুনে তুলি অল্প হেসেছিল এই মুহূর্তে। তারপর একটু কথা সাজিয়ে বলেছিল,
—–” এক এক জনের ইন্টারেস্ট আসলে এক এক দিকে। আপনি গান না শিখতে পারেন, কিন্তু আপনি তো ভালো ডাক্তার হয়েছেন! এই প্রফেশনে আসার জন্যও অনেক কনসেনট্রেশন লাগে!”
কথাটায় রঙ্গন এবার আলতো হেসেছিল তুলির সামনে। তবে এসব দেখে নিরুপমা কেমন আকাশ থেকে পড়েছিল! ওর এই গুরুগম্ভীর ছেলের হলো কি হঠাৎ! এই ছেলে তো যেচে পড়ে কারোর সাথে এত কথা বলে না! এইভাবে নিজে থেকে আলাপও জমায় না! সারাক্ষণ নিজের কাজের মধ্যেই তো হারিয়ে থাকে। তাহলে তুলির সাথে এত সহজভাবে মিশছে কি করে! কথাগুলো কেমন আনমনে মনে হয়েছিল যেন।
তবে এর পরের সপ্তাহে নিরুপমা কে আরো একটু অবাক করে দিয়ে রঙ্গন বলেছিল তুলিকে,
—–” আপনার গানের ক্লাস শেষ? তাহলে চলুন, আমিও বেরোচ্ছি। আপনাকে কিছুটা দূর এগিয়ে দিই। এমনিতেও আজ অটোর স্ট্রাইক চলছে। অসুবিধা হবে আপনার। ”
কথাটা শুনে নিরুপমা তো চোখ বড় বড় করে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়েছিল। কাউকে নিয়ে এরকম মাথা ঘামাতে আজ পর্যন্ত দেখেননি উনি রঙ্গন কে। তবে তুলি প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু করলেও মুখের ওপর না বলতে পারেনি ছেলেটার। আসলে এত নামি একজন ডাক্তার! তার ওপরে তুলিকে সেই বাবার এক্সিডেন্ট এর রাতে যথেষ্ট হেল্প করেছে! এরপর তো ওনার কোন কথায় না বলা যায় না।
যাইহোক, তবে গাড়িতে বসে তুলি আজ নিজে থেকে বলে উঠলো,
—–” পরের সপ্তাহে শনিবার তো কালী পুজো; আপনাদের এপার্টমেন্ট এ সেই উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। কাকিমা সেই প্রোগ্রামে গান গাইবে। এটাই কাকিমার প্রথম স্টেজ পারফরমেন্স।”
কথাগুলো শুনে রঙ্গন বেশ আশ্চর্য হয়ে গেছিল যেন। সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছিল,
—–” মায়ের প্রোগ্রাম আছে! কিন্তু আমাকে তো কিছু বলেনি!”
এটা শুনে তুলি অল্প ভেবে বলেছিল,
—–” হয়তো ভেবেছে আপনি খুব ব্যাস্ত, তাই সময় হবে না প্রোগ্রাম টা এটেন্ড করার! কিন্তু আমি বললাম কথাটা কারণ আই ফিল আপনি সাথে থাকলে কাকিমার কনফিডেন্স টা আরো বেড়ে যাবে! এমনিতেও এই বয়সে নতুন কিছু শিখতে চাইলে লোকে অনেক রকম কথা বলে! এনকরেজ করার বদলে ডিসকরেজ করে দেয়। কিন্তু লোকজন এটা বোঝে না যে শেখার কোন বয়স নেই! ইচ্ছেটাই আসল।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল তুলি। কিন্তু এই মুহূর্তে রঙ্গন বুঝেছিল নিজের ভুলটা। আসলে মায়ের গানটাকে কোনদিন সিরিয়াস ভাবে দেখেনি ও। সব সময় উল্টে ‘ তোমার দ্বারা গান হবে না, বাদ দাও ‘ এইসব কথাই বলেছে বিরক্ত হয়ে। তবে তুলির কথাগুলো শুনে মনে হলো নিজের অজান্তেই হার্ট করে ফেলেছে মা কে! সত্যিই তো, এই বয়সে নতুন কিছু শেখার ইচ্ছা কজনের থাকে! সেখানে মা যে এইভাবে গান শেখার চেষ্টা করে যায় রোজ, সেই চেষ্টায় সঙ্গে থাকা দরকার রঙ্গন এর। কথাগুলো ভেবেই ও বলে উঠলো,
——” আমি থাকবো ফাংশনে সেদিন নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনি কথাটা মা কে বলবেন না এখনি। মায়ের জন্য এটা একটা সারপ্রাইজ থাক।”
এটা শুনে তুলির মুখে হাসি। না, ডাক্তারবাবু কে যতটা গম্ভীর, প্রফেশনাল বলে মনে হয়েছিল, ততটাও না! নইলে নিজের ব্যাস্ত শিডিউল থেকে টাইম বার করে মায়ের ফাংশনে আসার কথা ভাবতে পারতো না। কথাটা আনমনে মনে হলো তুলির।
তবে এরপর কালীপুজোর দিন সন্ধ্যেবেলা নিরুপমা সত্যি ছেলেকে দেখে অবাক হয়ে গেছিল স্টেজের সামনে! রঙ্গন একটা চেম্বার ক্যানসেল করে এসেছিল সেদিন অনুষ্ঠানে। তবে এসে মা কে এতটা খুশি দেখে সত্যিই ভালো লাগছিল নিজের। মনে পড়ে যাচ্ছিল স্কুলের এনুয়াল ডে প্রোগ্রাম এ যখন প্রত্যেকবার রঙ্গন প্রাইজ পেত স্কুলে; স্ট্যান্ড করার জন্য, মা সেই সময় সামনের রো তে বসে কি আনন্দ করে হাততালি দিত। বাবাও তো তখন বেঁচে ছিল! দুজনে এক সঙ্গে যেত স্কুল সেদিন। আজ সামনের রো তে বসে মা কে স্টেজে গান গাইতে দেখে ওই পুরনো কথাগুলোই মনে পড়ে যাচ্ছিল রঙ্গন এর। আর মনে হচ্ছিল এই ভালো লাগার সময়টা পাওয়ার একমাত্র কারণ হলো তুলি। আসলে সেদিন মেয়েটা ওকে ওই সামান্য সময়ের মধ্যেই এমন কিছু কথা বুঝিয়ে দিয়েছে, যেটাকে এর আগে কখনো রঙ্গন গুরুত্ব দিয়ে ভাবেনি ! কথাগুলো কেমন নিজের অজান্তেই মনে এসে ভিড় করলো আজ। আর ওই গভীর কাজল চোখের মেয়েটার প্রতি আলাদা একটা ফিলিংস এসে জমা হলো মনে।

চলবে।

অভিমানী বিকেল শেষে পর্ব-০১

0

#অভিমানী_বিকেল_শেষে ( প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
কলকাতায় ভিড়ে ঠাসা বড়বাজার। নানা রকম দোকানে হাজারটা জিনিস, আর হাজার রকম লোকের ভিড়। তার মধ্যেই তুলি আর তুলির বাবা ঘুরে ঘুরে পুজোর বাজার করছিল। সামনেই তো মা আসছে! শরৎ এর আমেজ চারিদিকে। এর মধ্যে মাসি, পিসি, জ্যাঠতুত বোন, খুর্তুত দিদি সবাইকে পুজোয় কিছু না কিছু তো দিতেই হবে। তারই একটা লম্বা লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়েছে মা কাল রাতে। আর তুলির বাবার পক্ষে তো এতকিছু বুঝে কেনা সম্ভব না! তাই অফিস শেষে তুলিকে ডেকে নিয়েছে বড়বাজারে, মার্কেটিং এ হেল্প করার জন্য। আর তুলিরও স্কুল ছুটি হয়েছে সেই বিকেল চারটে; এরপর আজ আর কোন গানের টিউশনি নেই। তাই বাবার সাথে হাজির হয়েছে এখানে। আর এই বিভিন্ন রকম জামা কাপড় দেখা, তারপর দরদাম করে কেনা, এসব আসলে তুলির বেশ পছন্দের একটা কাজ। তাই বেশ ভালোই কাটছিল বিকেলটা বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে।
কিন্তু সন্ধ্যের দিকে সমস্ত কেনাকাটি শেষ করে যখন ওরা বাড়ি ফিরছে, তখন এই সুন্দর সময়টার তাল কেটে গেল হঠাৎ। তুলি আর তুলির বাবা ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়েছিল বাস ধরবে বলে। কিন্তু আচমকা একটা ট্যাক্সি এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তুলির বাবাকে ধাক্কা মারলো জোরে। আসলে টায়ার ব্লাস্ট করে কন্ট্রোল রাখতে পারেনি কোনভাবে, তাই এই বিপত্তি। কিন্তু এই একটা ধাক্কায় তুলির বাবা ছিটকে পড়লো রাস্তার ওপর। আর মাথাটা জোরে গিয়ে ধাক্কা লাগলো শক্ত পিচের রাস্তায়, তারপর চোখের পলকে তুলির চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে গেল যেন! বাবার মাথা ফেটে সেই মুহূর্তে গলগল করে রক্ত পড়ছে। তুলি হাতের সমস্ত ব্যাগ ফেলে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। নিজের ওরনা দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো সঙ্গে সঙ্গে। তারপর কোন রকমে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে সোজা নিয়ে এলো কাছের টিউলিপ নার্সিং হোমে।
সেদিন এই পুরো ঘটনাটায় তুলি একদম একা ছিল হসপিটালে। আসলে মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গেছিল তুলির, তাই কাউকে কল করতে পারেনি। আর বাবাও ফোনটা আজই বাড়িতে ফেলে অফিস গেছে! কথাটা সেদিন মার্কেটিং করতে করতেই বলেছিল অশোকবাবু তুলিকে। তাই এই বিপদের সময়ে একটা ফোন করারও কাউকে সুযোগ পায়নি মেয়েটা! সেদিন এরপর কোন রকমে ট্যাক্সি ড্রাইভার এর সাহায্যে একটা স্ট্রেচার জোগাড় করে তুলি বাবাকে নিয়ে গেছিল নার্সিং হোম এর ইমারজেন্সিতে। কিন্তু এক্সিডেন্ট কেস যেহেতু, তাই কিছুতেই ওরা এডমিট করতে চাইছিল না অশোকবাবু কে। থানায় ডায়রি করার পরই ভর্তি নেওয়া হবে, বার বার একটা কথাই বলে যাচ্ছিল ডিউটি তে থাকা নার্স। তুলি এই মুহূর্তে প্রায় হাত জোড় করে বলে উঠেছিল অন্তত প্রাইমারী ট্রিটমেন্ট টুকু যেন শুরু করে ওরা! কিন্তু নার্স, নার্সিং হোমের স্টাফেরা, কেউই কোনভাবেই রাজি হচ্ছিল না ওর কথায়।
তবে এই পরিস্থিতিতে একজন হঠাৎ এসে সবটা পাল্টে দিল যেন! ডক্টর রঙ্গন চ্যাটার্জি, কলকাতার একজন নাম করা হার্ট সার্জেন, যিনি এই নার্সিং হোম এ নিয়মিত বসেন। সেই ডক্টর রঙ্গন এই সময় ইমার্জেন্সির পাশ দিয়ে নিজের চেম্বারে যাওয়ার সময় তুলির গলার আওয়াজ শুনেছিল আনমনে। তারপর ইমারজেন্সি রুমে উঁকি মেরে দেখেছিল সব কিছু। তুলির বাবার তো রক্তে পুরো শার্টটাই লাল হয়ে গেছিল! প্রায় কোন সেন্স ছিল না আর! আর তুলি এইসবের মধ্যে শুধু একটাই রিকুয়েস্ট করে যাচ্ছিল ডিউটিতে থাকা নার্সকে, যে কোনভাবে অন্তত সামান্য হলেও ট্রিটমেন্ট শুরু করে ওরা বাবার! এই সময় রঙ্গন এগিয়ে এসেছিল ইমারজেন্সি রুমে। তারপর নিজে নার্সকে ইনস্ট্রাকশন দিয়েছিল এক্ষুণি পেশেন্টকে এডমিট করার করার জন্য। শুধু তাই না, একজন চেনা লোকাল পুলিশ অফিসার কে ফোন করে রঙ্গন তুলির সাথে যোগাযোগও করিয়ে দিয়েছিল, যাতে আর কোন প্রব্লেম না হয়! তুলি এই সময় যেন।আলো খুঁজে পেয়েছিল একটা! আসলে বাবাকে কোনদিন এইভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেনি তো! তাই কেমন মাথা কাজ করছিল না যেন এতক্ষণ! সব কিছু খুব আবছা হয়ে গেছিল চোখের সামনে! এই মুহূর্তে এই অচেনা মানুষটা এসে সাহায্য না করলে তুলি সব কিছু সামলাতে পারতো না! সেদিন এইসব ভাবনার ভিড়েই পুলিশ অফিসার এর সাথে কথা শেষ করেছিল তুলি। তারপর সেই অচেনা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল স্থির গলায়, —–” থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ.. আপনি এই সময় হেল্প না করলে আমি যে কি করতাম!”
কথাটায় রঙ্গন অল্প কথায়ই উত্তর দিয়েছিল,
—–” থ্যাঙ্কস এর কিছু নেই। ইটস মাই ডিউটি এজ আ ডক্টর..”
কথাটা শেষ করেই রঙ্গন ইমারজেন্সি রুমটা খালি করে চলে গেছিল নিজের চেম্বারে। তুলি তবে নিঃস্তব্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক সেকেন্ড! আসলে হঠাৎ মনে হচ্ছিল, যে এত হেল্প করলো এই বিপদে; তার নামটাই জানা হলো না!
তবে এরপর তুলিও বাবার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল ও.টি রুমের দিকে! কয়েকটা সেলাই পড়বে বাবার! আর বেশ কিছু টেস্টও আছে। যতক্ষণ না সুস্থভাবে মানুষটাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, ততক্ষণ শান্তি নেই মনে।
<২>
সেদিন এরপর সাতটা সেলাই পড়েছিল অশোকবাবুর। তবে ইন্টারনাল কোন ইঞ্জুরি নেই। তাই কোন চিন্তার কারণ নেই। কদিন অবজারভেশন এ রেখে ছেড়ে দেবে নার্সিং হোম থেকে। কথাগুলো জেনে যেন তুলি আর ওর মায়ের মনটা একটু স্থির হয়েছিল! আসলে মা ও এই এক্সিডেন্ট এর খবর শুনে কেমন এলোমেলো হয়ে ছুটে এসেছিল নার্সিং হোমে। তুলির তো এইসব দেখে মা কে নিয়েও চিন্তা শুরু হয়ে গেছিল খুব। এমনিতেই হাই প্রেশারের পেশেন্ট! এত স্ট্রেস নিয়ে যদি মায়ের শরীরটা খারাপ হয়ে যায়! তবে সেদিন ডাক্তার এসে বলেছিল ঠিক সময়ে ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছিল বলেই বেশি ব্লাড লস হয়নি। নইলে অবস্থা খারাপের দিকে যেতে পারতো!
এইসব শুনে তুলির সেই মুহূর্তে একজনের কথাই মনে পড়ছিল! ওই হঠাৎ আসা অচেনা মানুষটার কথা। উনি যদি এসে সাহায্য না করতেন তাহলে আজ বাবা ঠিক থাকতো না! তবে সেদিনের পর তুলি নার্সিং হোমে খোঁজ নিয়ে জেনেছে ওই অচেনা মানুষটার ব্যাপারে। ওই শান্ত চেহারার বছর বত্রিশ এর ছেলেটার নাম ডক্টর রঙ্গন চ্যাটার্জি। বেশ নাম হয়েছে এই বয়সেই হার্ট সার্জেন হিসেবে কলকাতায়। তবে মানুষ হিসেবেও খুব হেল্পফুল। অনেক গ্রামে গিয়ে মেডিক্যাল ক্যাম্প করা, বেশ কিছু দাতব্য চিকিৎসালয় এ নিয়মিত ভিজিট করে পেশেন্ট দেখেন উনি। কথাগুলো নার্সের মুখে জেনে তুলির বেশ ভালো লেগেছিল সেদিন। এই হিসেবি পৃথিবীতে এরকম মানুষ তো আসলে খুব একটা দেখা যায় না!
যাইহোক এই ভাবনার দুটো দিন পর তুলি সেদিন সন্ধ্যেবেলা বাবাকে দেখে ফিরছিল নার্সিং হোম থেকে, কিন্তু তখনই দোতলার করিডোরে হঠাৎ তুলি দেখেছিল রঙ্গন কে। অন্য কোন একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলছিল এক মনে ছেলেটা। তবে তুলি আর সেদিন এই মানুষটাকে অদেখা করে চলে যায়নি। ও নিজে থেকে গিয়েছিল আজ রঙ্গনের কাছে। তারপর পিছন থেকে ডেকে উঠেছিল, —–” এক্সকিউজ মি.. ডক্টর রঙ্গন!”
কথাটা শুনে রঙ্গন আনমনে পিছনে ফিরে তাকিয়েছিল, তখন তুলি বেশ হাসি মুখেই বলেছিল, —–” নমস্কার। আপনার আমাকে মনে আছে কি না জানি না, কিন্তু সেদিন আপনি হেল্প করেছিলেন বলেই আমার বাবাকে এই নার্সিং হোম এ এডমিট করতে পেরেছিলাম! কাল পরশুর মধ্যে বাবাকে ডিসচার্জ করে দেবে। আপনি যদি সেদিন হেল্প না করতেন, তাহলে বাবাকে হয়তো ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম না! সিরিয়াসলি, থ্যাঙ্ক ইউ..”
কথাটা সেই মুহূর্তে শেষ হতেই রঙ্গন বললো অল্প কথায়,
—-” বার বার থ্যাঙ্কস দেওয়ার দরকার নেই। আগেও বলেছি, এটা আমার ডিউটি.. যাইহোক, একটু দরকারি কথা বলছিলাম, সো প্লিজ এক্সকিউজ আস..”
কথাটা বলেই রঙ্গন আবার উল্টো দিকে ফিরে কথা বলতে শুরু করলো সেই ডাক্তারটার সাথে, তুলি কে প্রায় অদেখা করে। তুলির তবে একটু খারাপ লাগলো যেন! ডাক্তাররা খুব প্রফেশনাল এটা জানে। কিন্তু তুলি তো কৃতজ্ঞ বলেই কথা বলতে এসেছিল! তবে মনে হয় এদের সময় খুব দামী! এপোয়মেন্ট ছাড়া দরকারের বাইরে এক দুটো কথাও বলা উচিত না এরকম ব্যাস্ত ডাক্তারের সাথে! তুলি তাই আর দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি উল্টো দিকে পা বাড়ালো। সত্যি, যেচে পড়ে কথা বলতে আসাটা ঠিক হয়নি ওর।
যাইহোক, এরপর দুটো দিন কেটে গেছে শহরের ক্যালেন্ডার থেকে। আজ শুক্রবার। রঙ্গন এর আজ বেশ কাজের চাপ। তিনটে জায়গায় চেম্বারের ডেট আজ। তার মধ্যে সকালে একটা ও.টি ও আছে টিউলিপ এ। তাই বেশ তাড়াহুড়ো করেই গাড়িটা পার্ক করলো ও নার্সিং হোমের পার্কিং এরিয়ায়। তারপর বেশ জোরে পা চালিয়ে নার্সিং হোমের দিকে এগিয়ে গেল। যদিও মুডটা আজ খুব একটা ভালো নেই রঙ্গন এর! সকাল সকালই বেরোনোর আগে মায়ের সাথে এক চোট অশান্তি হয়ে গেছে! আসলে মা কদিন ধরে বিয়ে বিয়ে করে মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছে ওর! এক্ষুণি বাড়িতে একটা বৌমা জোগাড় করে না দিতে পারলে শান্তি হচ্ছে না মায়ের! তার ওপর আজ তো আবার দুটো তিনটে মেয়ের ফটো নিয়ে হাজির হয়েছে রঙ্গন এর কাছে। রঙ্গন এর তো এসব দেখেই মাথা গরম! কিছুতেই বোঝাতে পারেনি মা কে যে একসাথে থাকার জন্য একজন ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব দরকার। আর সেটা এইভাবে ফটো দেখে বিচার করা যায় না! কিন্তু এত গভীর কথা মা কিছুতেই মাথায় ঢোকাতে চায়নি। উল্টে হুমকি দিয়েছে যদি ছ মাসে রঙ্গন বিয়ের জন্য হ্যাঁ না বলে তাহলে মা না কি হরিদ্বারে কোন একটা আশ্রমে চলে যাবে কলকাতা ছেড়ে! এইসব শুনে রঙ্গন এর রাগের পারদ আরো চড়েছে। তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে কিছু না খেয়েই বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে আজ। এইসব এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে একটু অন্য মনস্ক হয়েই এগোচ্ছিল নার্সিং হোমের গেটের দিকে, কিন্তু হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো উল্টো দিকের একটা দৃশ্য দেখে। আসলে এই টিউলিপ নার্সিং হোমের গেটের বাইরে একজন বয়স্ক মহিলা বসে থাকে চুপচাপ, ভিক্ষার ঝুলি হাতে। রঙ্গন ওকে যখনি দেখতে পায়, কিছু টাকা দিয়ে দেয়। কিন্তু আজ দেখলো একটা মেয়ে দুটো টিফিন কৌটো নিয়ে হাজির এই মহিলার কাছে। তারপর হাসি মুখে সেই কৌটোতে রাখা খাবার গুলো একটা কাগজের প্লেটে সাজিয়ে দিল ওনাকে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলো মেয়েটা ওনার সাথে। এমনকি এরপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা চাদর বার করে হাতে দিল ঐ বয়স্ক মহিলার। এসব পেয়ে তো ওই মহিলা ভীষণ খুশি। মেয়েটাকে গালে হাত দিয়ে আদর করলো হাসি মুখে। তারপর মেয়েটা ধীরে ধীরে উঠে টিউলিপের ভিতরে চলে গেল নিজের মনে। কিন্তু এই মুহূর্তে রঙ্গন যেন কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়! আসলে এসব দৃশ্য তো রাস্তা ঘাটে খুব কম দেখা যায়! কারণ বেশির ভাগ মানুষই এরকম কাউকে দেখলে অদেখা করে চলে যায়! সেখানে যেভাবে মেয়েটা আন্তরিকতা দেখালো ওই বয়স্ক মহিলাকে, তাতে রঙ্গন এর মনে দাগ কাটলো হঠাৎ! আচ্ছা, এই মেয়েটাকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছে না ওর! কথাটা হঠাৎ মনে হতেই মনে পড়লো সেদিনের ঘটনাটা। এই মেয়েটারই তো বাবার এক্সিডেন্ট হয়ে ছিল কদিন আগে! রঙ্গনই তখন এডমিট করিয়ে দিয়েছিল ওনাকে টিউলিপে! আর এই মেয়েটা তো সেদিন করিডোরে কথাও বলতে এসেছিল নিজে থেকে ওর কাছে! কিন্তু রঙ্গন একটা খুব ইম্পর্টেন্ট কেস নিয়ে আলোচনা করছিল সেই সময় ডক্টর সামন্তর সাথে। তাই আর খুব একটা রেসপন্স করেনি মেয়েটাকে! কথাগুলো এক নিমেষে মনে পড়ে গেল রঙ্গন এর, আর এই মেয়েটার সাথে আর একবার, আরেকটু ভালোভাবে কথা বলার ইচ্ছে হলো মনে হঠাৎ।
যাইহোক, এরপর ও.টি শেষ করে রঙ্গন নিজে এসেছিল রিসেপশনে। কেন জানে না সকালের ওই দৃশ্যটার জন্যই মেয়েটার সাথে আলাপ করার কথা মনে হচ্ছিল ওর! তাই এসে সোজাসুজিই জিজ্ঞেস করেছিল রিসেপশনিস্টকে,
—–” আচ্ছা, আমি চার পাঁচ দিন আগে একজন এক্সিডেন্ট পেশেন্ট কে এখানে এডমিট করিয়েছিলাম! নামটা ওনার ঠিক মনে নেই আমার! আপনি কি বলতে পারবেন একটু চেক করে উনি এখন কোন কেবিনে আছে!”
কথাটা শুনে রিসেপশনিস্ট সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল,
—–” হ্যাঁ স্যার, মনে আছে। আপনি তো নিজে ওনার ফ্রম ফিল আপ করে এডমিট করেছিলেন! তারপর পুলিশেও খবরও দিয়েছিলেন; এক্সিডেন্ট কেস বলে! যাইহোক, ওই পেশেন্টের নাম ছিল অশোক বোস। কিন্তু স্যার, আজ সকালেই তো ওনার ছুটি হয়ে গেছে। ওনার মেয়ে এসে সব ফরমালিটিজ কমপ্লিট করে ডিসচার্জ করিয়ে নিয়ে গেছেন পেশেন্টকে।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল মেয়েটা। কিন্তু রঙ্গন এরপর আর কোন কথা বাড়ালো না! তার মানে ওই মেয়েটার সাথে আর কোনদিনই আলাপ হওয়ার না! কথাটা মনে হতেই রঙ্গন রিসেপশন রুম থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে। তারপর হালকা একটা খারাপ লাগা নিয়েই বাকি দিনের ব্যস্ততায় হারিয়ে গেল রোজের মতন!

চলবে।

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৪০( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#প্রথম_পরিচ্ছদ_অন্তিম_পর্ব
#Raiha_Zubair_Ripti

আচমকা আবহাওয়ার বদল। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। উতালপাতাল বাতাস, থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। বাচ্চাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে চিত্রা। তুষার বাসায় নেই। চিত্রার পাশে নিস্তেজ হয়ে বসে আছে রোমিলা বেগম। তুষার বলে দিয়েছে রোমিলা বেগম তাদের সাথেই থাকবে। রোমিলা বেগম কে এক ধ্যানে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে-
-“ আন্টি ওকে একটু কোলে নিবেন? আসলে আমার পিঠ লেগে আসছে।
রোমিলা বেগমের দৃষ্টি বিচ্যুত হলো। দু হাত দিয়ে বাচ্চা টাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। যেনো খুব অমূল্য কিছু পেয়ে গেলো সে। বাচ্চা টার মুখে চুমু খেয়ে বিরবির করে বলল- আমার রাতুল।
চিত্রার কান অব্দি গেলো না সে কথা। চিত্রার শীত লাগছে শোয়া থেকে আস্তেধীরে উঠে চাদর জড়িয়ে নিলো শরীরে।

তৃষ্ণা খাবার নিয়ে আসলো রুমে। খাবার টা চিত্রা কে খাইয়ে রোমিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ আন্টি খাবে চলো।
রোমিলা বেগম বাচ্চাটার দিকে তাকালো। চিত্রা কে দিতে ইচ্ছে করছে না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাচ্চা টাকে চিত্রার কাছে দিয়ে তৃষ্ণার পিছু পিছু নিচে নামলো। রাফি, তামিম খাঁন, সামির খাঁন, তরিকুল খাঁন বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। রোমিলা বেগম কে দেখে তামিম খাঁন মৃদু করে বলল-
-“ কেমন আছো এখন বোন?
রোমিলা বেগম কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে জবাব দিলো-
-“ ভালো ভাই।
-“ বসো খেয়ে নাও।
রোমিলা বেগম বসলেন না।
-“ আমি আপার সাথে খেয়ে নিবো ভাই।
তানিয়া বেগম যেতে ধরে বসালো রোমিলা বেগম কে। প্লেটে খাবার দিয়ে বলল-
-“ কখন থেকে না খেয়ে আছো খেয়াল আছে? এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
রোমিলা বেগম স্মিত হাসলো। প্লেটে খাবার নাড়াচাড়া করে বলল-
-“ তুষার ফিরলো না কেনো এখনও?
-“ বৃষ্টির জন্য আঁটকা পড়ে আছে। বৃষ্টি টা থামলেই চলে আসবে খালা।
রাফি খাবার মুখে দিতে দিতে কথাটা বলল। রোমিলা বেগম চুপচাপ খাবার খেলো। তামিম খাঁন সামির খাঁন তরিকুল খাঁন খেয়ে দেয়ে চলে যায়। রাফি এঁটো প্লেটে হাত ধুতে ধুতে বলে-
-“ খালা এভাবে ঘরকুনো হয়ে থাকবে না আর। জানি রাতুলের মৃত্যু টা মেনে নিতে পারছো না কিন্তু সত্যি টা তো মেনে নিতেই হবে। তোমার জন্য আমি আছি ব্রো আছে পুরো পরিবার আছে। আমাদের জন্য হলেও একটু মুভ অন করো খালা।

রোমিলা বেগম তাকালো রাফির দিকে। রাফির অনুনয় হয়ে বলা কথাটা খুব নাড়া দিলো মনে। মনের স্মৃতিপটে ভেসে আসলো চিত্রার বাচ্চাটার মুখশ্রী। বাচ্চাটার মাঝে নিজের রাতুল কে খুঁজে নিয়েছে সে।

পার্টি অফিসে বসে আছে তুষার। বৃষ্টি ছাড়ার নামগন্ধ নেই। আর এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানো মোটেও ঠিক না। চেয়ারে বসে অঙ্ক কষছে তুষার। লিমনের পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব নয় একা এতোকিছু করার। হালিম সরকারের বিরুদ্ধে ও কোনো ক্লু পায় নি পুলিশ যে সে এসবে কানেক্টেড ছিলো। আর আকবর কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে বারবার ছেলের নাম ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। এই কয়েকদিন হালিম সরকার ও আকবরের উপর ২৪ ঘন্টা নজর রেখেছিল তুষার। সন্দেহের মতো কিছু তারা করে নি। লিমন টা ম-রে গিয়েও রেখে গেলো এক রহস্যের মধ্যে।

কথাগুলো এক এক করে ভাবতেই হঠাৎ চোখ গেলো ফোনের দিকে। কিছু একটা মনে পড়তেই চট করে ফোন অন করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে। মালদ্বীপ থেকে আসা সেই নম্বরের মেসেজ টা আবার পড়লো। এই মেসেজের কথা সে টোটালি ভুলে গিয়েছি। নম্বর টা একবার দেখে সেটা তার পরিচিত এক ফ্রেন্ড কে পাঠিয়ে বলে নম্বর টার এ টু জেট বের করতে।

এরমধ্যে বৃষ্টি কমে আসলে তুষার বাসার উদ্দেশ্যে চলে যায়। রোমিলা বেগম শুয়ে আছে নিজের রুমে। তৃষ্ণা রাফির রুমে। কথা ছিল রাফি দেশে ফিরলে ধুমধাম করে বিয়ে করবে। কিন্তু বাসার যা পরিস্থিতি তাতে ধুমধাম করে বিয়ের প্ল্যান বাদ। বিয়ে তো হয়েই গেছে তাই আর রাফি বাড়তি ঝামেলা চাচ্ছে না। রাফির বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে তৃষ্ণা। রাফির এক হাত তৃষ্ণার চুলের ভাজে।
-“ হঠাৎ করে সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো তাই না বলুন?
রাফি হুমম বলল।
-“ জানেন অধরা আপু এখনও মুভ অন করতে পারছে না।
-“ এটাই কি স্বাভাবিক নয়? ভালোবাসতো দু’জন দু’জন কে। ধরো আমার যদি কিছু হয়ে যায় তুমি পারবে মুভ অন করতে?
তৃষ্ণা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাফি কে।
-“ ম-রেই যাবো।
-“ অধরা তবুও স্ট্রং আছে। আমি জানি আমার কিছু হয়ে গেলে তোমাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না।

তুষার বাসায় রোমিলা বেগমের সাথে দেখা করে সোজা নিজের রুমে ঢুকে। চিত্রা এক কাত হয়ে শুয়ে আছে বাচ্চা কে ধরে। আস্তেধীরে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাচ্চার কপালে চুমু খেয়ে নিচে নামে ডিনার করার জন্য। তানিয়া বেগম খাবার বেড়ে দিলে তুষার তানিয়া বেগম কে বলে রুমে চলে যেতে। সে খেয়ে দেয়ে খাবার ফ্রিজে রেখে দিবে। তানিয়া বেগম চলে যায়। তুষার খাওয়া দাওয়া শেষ করে খাবার গুলো ফ্রিজে রাখতেই ফোন বেজে উঠে। তুষার ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখে রকির নাম জ্বল জ্বল করছে। যাকে নম্বর দিয়েছিল। তুষার ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে রাফি বলে উঠে –
-“ তুই যেই নম্বর টা দিয়েছিস সেই নম্বর টা মালদ্বীপে থাকা জনস নামের কোনো লোকের। যে এলএম ইন্ডাস্ট্রির মালিক।
-“ শিউর?
-“ হ্যাঁ। দেখ ডকুমেন্টস পাঠিয়েছি কিছু তোর ফোনে চেক কর।
তুষার ফোন টা কেটে চেক করে দেখে রকির বলা কথা গুলো সত্যি। তুষার হোয়াটসঅ্যাপে কল দেয় ঐ মালদ্বীপের নম্বরে। দু বার রিং বাজার পর ফোন রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে ভেসে আসে কর্কশ গলায়-
-“ হু আ’র ইউ ম্যান? হোয়াই ডিস্টার্ব মি?
তুষার ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-
-“ তুষার খাঁন ফ্রম বাংলাদেশ। আর ইউ জনস?
-“ ইয়েশ। ডু ইউ নোও মি?
-“ নো। বাট আই গট এ্যা ম্যাসেজ ফ্রম ইউর ফোন টু মাই ফোন। হোয়াট ইজ দ্যা মিনিং অফ সেন্ডিং সাচ এ্যা ম্যাসেজ?
-“ হোয়াট ম্যাসেজ আর ইউ টকিং এবাউট?
-“ আই এ্যাম সেন্ডিং ইউ দ্যা স্ক্রিনশট অফ দ্যা মেসেজ।
-“ ওকে।

তুষার ফোনটা না কেটেই মেসেজের স্ক্রিনশট টা পাঠিয়ে দেয় জনসের ফোনে।
-“ মিস্টার জনস ডু ইউ সাও দ্যিস স্ক্রিনশট?
-“ ইয়াহ আই সাও ইট।
-“ হোয়াই ইউ সেন্ট মি দ্যিস মেসেজ?
-“ মিস্টার তুষার খাঁন রাইট?
-“ ইয়াহ।
-“ আই ডিড নট সেন্ট ইউ দ্যিস মেসেজ।
তুষার ভ্রু কুঁচকালো।
-“ সো হু সেন্ট দ্যা মেসেজ? দ্যা নাম্বার ইজ ইউরস।
-“ ইয়েশ দ্যা নাম্বার ইজ মাইন। বাট আই ডিড নট সেন্ড ইউ এ্যানি সাচ মেসেজ। ইভেন আই ডোন্ট নও ইউ। সো হোয়াই উড আই সেন্ড ইউ সাচ অ্যা মেসেজ?
-“ আর ইউ শিউর ইউ ডিড নট সেন্ড দ্যা মেসেজ?
-“ ইয়া আই এ্যাম শিউর। আই থিংক মাই সন প্রেস্ড দ্যা ফোন এন্ড ফরওয়ার্ড দ্যা মেসেজ টু ইউ বাই মিসটেক।
-“ ফরওয়াড!
আশ্চর্য হয়ে বলল তুষার।
-“ ইয়েশ ফরওয়ার্ডেড। প্লিজ চেক দ্যা মেসেজ। দ্যা মেসেজ হ্যাজ বিন ফরওয়ার্ডেড টু ইউ,নট টাইপ্ড।

তুষার মেসেজ টা চেক করে দেখলো সত্যি মেসেজ টা ফরওয়ার্ড করে পাঠানো হয়েছে।
-“ ওহ্ ইয়েশ আই সও। আই ডিড নট নোটিশ এ্যাট অল। থ্যাংক ইউ,স্টে ওয়েল।

তুষার ফোন কেটে দিলো। একটু দুশ্চিন্তা মুক্ত হলো। লোকটার কথা শুনে মনে হয় নি মিথ্যা বলেছে। আলতো পায়ে হেঁটে রুমে এসে তন্ময়ের পাশে এসে শুয়ে পড়লো।

অন্ধকার রুম জুড়ে পারফিউমের কড়া সুভাস। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাদা শাড়িতে অপ্সরার মতো লাগছে অধরা কে। পড়নের শাড়িটা রাতুলের কিনে দেওয়া তুষারের বিয়ের সময়। শাড়িটা হাতে দেওয়ার পর একটা কথা বলেছিল রাতুল। কথাটা মনে পড়ছে ভীষণ তার। আলতো পায়ে হেঁটে গেলো বেলকনিতে। শেষ রাতে আকস্মিক আকাশে চাঁদ উঠেছে। অধরা তাকালো চাঁদের দিকে। পুরো বাড়ি এখন এক ঘুমন্তপুরি। অধরা ইজি চেয়ার টায় বসলো। ফোনে রাতুল আর অধরার একটা ছবি বের করে বলল-

-“ আপনার-আমার আবার দেখা হোক,
আপনার-আমার আবার কথা হোক,
আমাদের আবার সব হোক ঐ ইচ্ছেনদীর তীরে,
আমি আবার ও আপনার পড়বো প্রেমে।
জল থৈ থৈ ভালোবাসায় ভাসবো
নদীর জলে, অতি সঙ্গোপিত ভাবে।
ভাবতে পারছেন?
‘আমি’ নামক রমণী সেদিন আবারো আপনার প্রেমে পড়বে।
আবারো আপনার যন্ত্রণাদায় ভালোবাসায় গা এলাবে।
আচ্ছা! তখন কি আমরা দুঃখবিলাস করবো,এ জনমের আমার না হওয়ার জন্য?
নাকি বরাবরের ন্যায় ইচ্ছে বিসর্জন দিবো?
এ জনমে তো আপনি আমার হলেন না,
ইচ্ছে নদীর ঘাটে আপনি বরং আমার হইয়েন।
তখন তো কোন বাস্তবতা ছুঁবে না আপনায়,
আমাকেও ছাড়ার অজুহাত দেখাবেন না অন্য কোনো অজুহাতে।
জানেন? আপনার ভালোবাসা বড্ড পোড়ায়,
আপনার ভালোবাসা বড্ড পীড়া দেয়!
এতো পীড়ার মাঝেও আমি বারবার বলি, “ভালোবাসি! ভালোবাসি আমি আপনাকে। শুনতে পারছেন ভালোবাসি আমি আপনাকে।©Trisha Roy

কথাটা বলে ডুকরে কেঁদে উঠে অধরা।

অন্ধকার কক্ষে চেয়ারে বসে আছে কেউ। পুরো রুম জুড়ে ধোঁয়ার মেলা। থেকে থেকে একজন কেশে চলছে। গড়িতে টুংটাং শব্দ হতেই জানাল দিল রাত ১২ টা বেজে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আগন্তুক। ঐ বিশাল আকাশে থাকা চাঁদ টার দিকে তাকিয়ে চোখ মুখে হিংস্রতা এনে বলল-
-“ সুখে শান্তিতে সংসার করুক কয়েক বছর। ভুলে যাক এদিনের এই অতীত। হঠাৎ একদিন এসে চমকে দিবো ভীষণ। প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বালাতে। আমাকে খুঁজে পাওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। নিজের জীবন বাঁচিয়েছি এতো সহজে ধরা পড়ার জন্য নয়। খুব গোপনে লুকিয়ে রেখেছি এই আমি কে। দূর থেকে দাবার গুটি চালবো এক এক করে। ধ্বংস করে দিব খাঁন পরিবার কে। এক এক করে সবাই ম-রবে।

কথাগুলো বলতেই আগন্তুকের ফোনে মেজের টুং বেজে উঠলো। আগন্তুক মেসেজ ওপেন করলো। গোটা অক্ষরে লেখা-
-“ দাবার চাল পালটে গেছে। সিংহ কে মা-রতে চেয়েছিলেন আমি বাঘ কে কৌশলে মে-রে দিলাম সিংহ কে বাঁচিয়ে। সিংহের প্রাণভোমরা এখন আমার হাতে তাকে তৈরি করবো তার বিরুদ্ধে।

আগন্তুক হেসে উঠলো ভয়েস দিয়ে পাঠালো –
-“ আপনার শহরে আমন্ত্রণের সুযোগ দিয়ে সেই আপনিই শহরে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিলেন! নট ব্যাড। আই লাইক ইট।

ফোনের ওপাশে থাকা আগন্তুক যেনো এমনই এক বার্তার অপেক্ষায় ছিল। বার্তা টা পেয়ে হেঁসে উঠলো।

সমাপ্ত

( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ টায় রহস্য উন্মোচন করা হবে। আগন্তুক এখানে কয়জন হয়তো ধারনা পেয়েছেন। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ টা মূলত তুষারের ছেলে তন্ময় কে নিয়ে শুরু হবে। চরিত্র গুলো একই থাকবে আর ধন্যবাদ আমার পাঠকগণ সব্বাইকে। ভালোবাসা অবিরাম,এতোটা সাপোর্ট করার জন্য। সামনেও সাপোর্ট করবেন আশা করি। ভালো থাকবেন৷ আল্লাহ হাফেজ।)

আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ_২ পর্ব-৩৯

0

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৩৯( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

দীর্ঘ ছয় ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে চিত্রার। হালকা চোখ মেলে তাকাতেই নজরে এলো তুষার তার মাথার কাছে বসে ঝিমাচ্ছে। পেট কা’টার জায়গা টার ব্যাথা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে পেটের উপর হালকা হাত রাখলো। হাত নাড়ানোর সময় তুষারের হাতে স্পর্শ হয় চিত্রার হাত। তুষার ফট করে চোখ মেলে তাকায়। একদিকে রাতুল কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে বাচ্চা কাঁদছে না। আবার চিত্রার ও জ্ঞান ফিরছে না। বিষয় গুলো নিয়ে ভাবতে ভাতে যে কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝতেই পারেনি তুষার। চিত্রা কে চোখ মুখ কুঁচকে থাকতে দেখে খুশিতে চোখ মুখে হাসির আভা আসে। হন্ত হয়ে বলে-
-“ পাখি ব্যাথা করছে খুব?
চিত্রা চোখের ইশারায় জানালো।
-“ ডক্টর ডাকবো?
চিত্রা না করলো। আশেপাশে তাকালো। বাচ্চার কোনো ছিটেফিটে নেই। ধড়াস করে বুকটা ধক করে উঠল। মৃদু শব্দ করে বলল-
-“ আ..আমাদের বাবু কই? ও ঠিক আছে তো?
তুষার চিত্রার মাথায় হাত রাখলো। শীতল কন্ঠে শুধালো-
-“ বাবু ঠিক আছে। তোমার মায়ের কাছে আছে। আসলে আমি ঠিক ভাবে ক্যারি করতে পারছিলাম না।
-“ আমি দেখবো ওকে, ছুবো।
-“ নিয়ে আসছি।
তুষার কেবিন থেকে বের হয়। চয়নিকা বেগম অন্য কেবিনে ছিলো নাতির সাথে। তুষার কেবিনে ঢুকে দেখে রোমিলা বেগম আর সাহেল আহমেদ সোফায় ঘুমিয়েছে। আর দোলনায় বাচ্চা টা ঘুমিয়ে আছে। তুষার চয়নিকা বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-
-“ আম্মা।
চয়নিকা বেগম নড়েচড়ে তাকালো। তুষার কে দেখে ঠিক হয়ে বসে বলল-
-“ চিত্রার জ্ঞান ফিরছে বাবা?
তুষার মাথা ঝাকালো। চয়নিয়া বেগম শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললেন-
-“ বাবু ঘুমিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই তাই শুইয়ে দিয়েছি।

কথাটা বলে চয়নিকা বেগম কেবিন থেকে বের হয়ে মেয়ের কাছে ছুটলেন। তুষার বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলো। বাচ্চা টা নড়েচড়ে উঠলো কিন্তু চোখ মেলে তাকালো না। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বের হলো।

চয়নিকা বেগম চিত্রার মাথার কাছে বসে আছে। পরপর কয়েকটা চুমু খেয়েছে কপালে। চিত্রা বারবার দরজার পানে তাকাচ্ছে মানিক টাকে দেখবে। অধৈর্য্য হয়ে বলল-
-“ মা বাবু কই?
-“ তুষার আনতেছে।
তুষার কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। চিত্রা তাকালো। মুহূর্তে ফুটে উঠলো হাসি। তুষার এগিয়ে এসে চিত্রার পাশে এক হাতের উপর বাবু কে শুইয়ে দিলো। চিত্রা চেয়ে রইলো বাচ্চাটর দিকে। কপালে দু ভাজ পড়ে আছে। মনে হচ্ছে ভীষণ বিরক্ত সে। চিত্রা চুমু খেলো ছেলের মুখে। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো। বাচ্চা টা পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো। চিত্রা বাচ্চাটার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ মা বাবু তাকিয়েছে।
-“ একটু বুকের দুধ খাইয়ে দে। পাশের কেবিনে থাকা এক মহিলার বুকের দুধ নিয়ে খাইয়েছি বেশ অনেকক্ষণ আগে।
চিত্রা মায়ের কথা মতো তাই করলো। বাচ্চাটা চুপচাপ খেতে লাগলো। পাশের কেবিন থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। চিত্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ও কি খুব কেঁদেছে মা?
চয়নিকা মুখ খুললেন কিছু বলার জন্য তার আগেই তুষার বলল-
-“ না কাঁদে নি শান্ত ছেলে আমার।
চিত্রা স্মিত হাসলো। এরমধ্যে ডক্টর এসে দেখে গেলো চিত্রা কে। ডক্টর কেবিন থেকে বের হতে নিলে তুষার ও বের হয় ডক্টরের সাথে।

-“ ডক্টর চিত্রা ঠিক আছে তো?
-“ হ্যাঁ ঠিক আছে।
-“ বাবু তো এখনও কাঁদল না।
-“ অনেক সময় বেবিরা কাঁদে না। দুই তিনদিন দেখুন যদি না কাঁদে তাহলে মনে হয় ও বোবার বধি।

তুষার ভ্রু কুঁচকালো।
-“ বোবা!
-“ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আপনি এক কাজ করুন হালকা চিমটি কেটে দেখুন তো ব্যাথায় কাঁদে কি না। এটা ছাড়া তো উপায় দেখছি না এখন।
-“ ব্যাথা পাবে তো ও।
-“ ব্যাথা পাবে সেজন্যই তো বলেছি। ব্যাথা পেলেই তো কাঁদবে।

তুষার কেবিনে ঢুকলো। চয়নিকা বেগম কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলেন। তুষার বসে রইলো চিত্রার পাশে। বাচ্চাটা খেয়ে আবার ঘুমিয়েছে।
-“ বাকিরা সবাই কোথায়?
-“ বাসায় চলে গেছে।
-“ বাবুর নাম কি রাখলেন?
-“ এখনও রাখি নি।
-“ আমি ভেবেছি।
-“ কি?
-“ তন্ময় শাহরিয়া খাঁন।
তুষার কিছু বলল না। চিত্রার অগোচরে বাচ্চাটার হাতে চিমটি কাটলো। খুব বেশি জোরে দেয় নি। তাতেই বাচ্চাটা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। বাচ্চার আকস্মিক চিৎকারে চিত্রা ভয় পেয়ে যায়। আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তুষার। চিত্রা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বলে-
-“ ও হঠাৎ করে কাঁদছে কেনো?
-“ বুকের দুধ দাও।
চিত্রা দিলো। বাচ্চাটা মুখ সরিয়ে নিচ্ছে। কান্না থামলো না। কান্নার আওয়াজ শুনে চয়নিকা বেগম চলে আসলো। কোলে নিয়ে ঘুরলো তবুও কান্না থামলো না। তবে কান্নার আওয়াজের জোর হাল্কা হয়েছে। তুষার কোলে নিলো চয়নিকা বেগমের থেকে। বাচ্চাটা চুপ হয়ে গেলো। চয়নিকা বেগম কে চিত্রার পাশে বসিয়ে বাচ্চাটা কে চিত্রার পাশে শুইয়ে রেখে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।

পূর্ব আকাশে প্রতিদিনের মতো করে সূর্য উঠেছে। চারিপাশ ঝলমলে করে উঠেছে সূর্যের রশ্মি তে। অধরা জ্ঞান ফিরার পর সেই যে পাথরের মতো বসে আছে তো আছেই। রাফি আর তানিয়া বেগম চিত্রা কে গিয়ে দেখে এসেছে।
রাতুলের বডি খুঁজে পাওয়া যায় নি। তৃষ্ণা অধরাকে পাথরের মত বসে থাকতে দেখে আপু বলে ডেকে উঠে। অধরা সেদিকে তাকায়।
-“ আমাকে একবার নিয়ে যা না ওখানে।
তৃষ্ণা জড়িয়ে ধরলো অধরা কে।
-“ ভাইয়া নিয়ে যেতে মানা করছে।
অধরা অসহায় হয়ে বলে-
-“ প্লিজ একবার।
তৃষ্ণা রাজি হয়। অধরাকে নিয়ে চলে যায় সেই জায়গায়। তুষার পুলিশদের সাথে কথা বলছে। খবরের কাগজ ও টিভিতে একই নিউজ ঘুরপাক খাচ্ছে ঢাকা ১৯ এমপি তুষার খাঁনের সহযোগী রাতুল মর্মান্তিক এক এক্সিডেন্ট মা-রা গিয়েছে। যদিও তার লা-শ এখনও পাওয়া যায় নি তবে পুলিশদের ধারনা রাতুল বেঁচে নেই। লা-শটা হয়তো কোনো রাতে কোনো হিংস্র পশু ছিঁড়ে খে’য়েছে।

রোমিলা বেগম নিউজ টা পেয়েছে গতকাল রাতেই। তুষার সামলে নিয়েছে রাত টা। কিন্তু এখন তাকে সামলানো যাচ্ছে না। কোনো মা বাবাই পারে না নিজের মৃ’ত্যুর আগে ছেলে মেয়ের মৃ’ত্যুর খবর শুনতে। থেকে থেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেরছেন। আবার জ্ঞান ফিরলেই রাতুল বলে পাগলের মতো চিৎকার করেন। এই পৃথিবীতে তো একমাত্র ছেলেটাই ছিলো তার। তবুও সেই ছেলেকেই কেঁড়ে নিলো তার বুক থেকে। তুষার ভেঙে পড়েছে।
অধরা পাথর হয়ে তাকিয়ে আছে ভেঙে চূর্ণ হয়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে। এমন টা তো হওয়ার কথা ছিলো না। সামনেই তো তাদের বিয়ে ছিলো। অধরা সেই দিনটার অপেক্ষায় ছিলো। লোকটাকে ভালোবাসি যে এখনও বলা বাকি আছে। লোকটা ভালোবাসি না শুনেই এভাবে চলে গেলো কেনো? লোকটা নিজে থেকে স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্ন পূরণ না করেই ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। রোজ নিয়ম করে লোকটাকে ভালোবাসতে বলেছিল। এখন কাকে ভালোবাসবে রোজ নিয়ম করে? কার সাথে সেই সন্ধ্যার রাতে টঙের দোকানে চা খাবে? কার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটবে? কার কাছে পদ্ম ফুল চাওয়ার বায়না ধরবে? কার কাছে গিয়ে নিজের অনুভূতি মেলে ধরবে? কে বলবে আমি আছি আপনার পাশে সবসময়? কে বলবে কে?
অধরা ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। ঘন জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল-
-“ কেনো ছেড়ে গেলেন আমায় রাতুল আপনি কেনো ছেড়ে গেলেন? একটা বার ভাবলেন না আপনাকে ছাড়া অধরা কি করে বাঁচবে? স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝ পথে কেনো আমায় একলা করে চলে গেলেন। আপনি কথা দিয়েছিলেন আমার চলার পথের সঙ্গী হবে তাহলে কেনো এমন হলো। বিধাতা আমার সুখ কেনো দেখতে চায় না? আপনি না শুনেই চলে গেলেন। আমি যে ভালোবাসি আপনাকে। ফিরে আসুন না আমার কাছে। আমাদ দম বন্ধ লাগছে রাতুল। একবারে জন্য আসুন না আমার সামনে আর বলুন না আমি আছি তো আপনার পাশে।

তৃষ্ণা অধরার মাথা জড়িয়ে ধরলো।
-“ অধরা স্বান্তনার দেওয়ার ভাষা জানা নেই তার। অধরা জড়িয়ে ধরলো তৃষ্ণা কে। আর বলতে লাগল-
-“ তৃষ্ণা রাতুল কে বল না আমার সামনে আসতে। আমি ভীষণ ভালোবাসি তাকে। তাকে বলা হয় নি আমি ভালোবাসি তাকে। একটু এনে দে না। আমি লোকটাকে ছুঁতে চাই। জড়িয়ে ধরে বলতে চাই ভালোবাসি তাকে। তাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারি না। বোন এনে দে না রাতুল কে।

তুষার দূর থেকে অধরার কান্না দেখলো। সে ছেলে মানুষ সে পারছে না অধরা বা রোমিলা বেগমের মতো কান্না করতে। তার মন মানতে চাইছে না রাতুল আর নেই। কাল দুপুরেও রাতুলের সাথে কাটালো। আর আজ নেই। তুষার তৃষ্ণা কে বলল অধরাকে নিয়ে চলে যেতে। রোমিলা বেগমের কাছে যেতেই রোমিলা বেগম তুষার কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল-
-“ আমার ছেলেটাকে এনে দে না বাপ। আমার তো ও ছাড়া কেউ নাই। ও কি একটা বার ভাবলো না ওর মায়ের কি হবে? একটু এনে দে না খুঁজে ওরে।
তুষার রোমিলা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
-“ তোমার কেউ নেই কে বলেছে? আমি আছি তো খালা। কেঁদো না। শরীর অসুস্থ তোমার।
রোমিলা বেগম শুনলো না পাগলের মতো বিলাপ করলো।

————————-

রাতুলের এক্সিডেন্ট করা গাড়িটা পরীক্ষা নিরিক্ষা করে জানা গেছে এটা কোনো দূর্ঘটনা নয়। বরং জেনেশুনেই গাড়ির ব্রেকফেইল করানো হয়েছে। পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের কাজ শুরু করে দিয়েছে। তুষারের সন্দেহের তালিকায় আছে হালিম সরকার আর আকবর। তবে আকবর কে সন্দেহের তালিকায় রাখতে ইচ্ছে করছে না তুষারের। বাপ হয়ে ছেলেকে মে’রে ফেলবে বিষয় টা কেমন লাগলো। আকবর এতোটা নিচে নামতে পারে না। তবুও বাদ ও দিতে পারলো না। পুলিশ প্রায় সবার থেকে রাতুলের বিষয়ে খোঁজ খবর নিলো। শুধু বাকি রইলো লিমন। কিন্তু লিমন ছেলেটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। ফোন সুইচ অফ বলছে। হঠাৎ ফোন সুইচ অফ তার উপর এমন নিখোঁজ সন্দের তীর টা ক্রমশ লিমনের দিকে যাচ্ছে।

লিমনের লাস্ট লোকেশন ছিলো রেডিও কলোনি। তারপর থেকেই ফোন সুইচ অফ। তুষারের কপালে দু ভাজ পড়লো। লিমন কাজটা করেছে কি না? আর লিমনই বা কেনো রাতুলের এক্সসিডেন্ট করাবে? ওর কি স্বার্থ এতে?

প্রায় তিনদিন পর চিত্রা কে বাসায় আনা হয়। তিনটে দিন ঘরকুনো হয়ে ছিল অধরা। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করে না। এই তিনটে দিন লিমন কে হন্যে হয়ে খুঁজে গেছে পুলিশ কিন্তু দুপুরের পর লিমনের লা’শ মিলেছে এক নদীর ঘাটে। সাথে একটা ভিডিও এসেছে তুষারের ফোনে। যেখানে রাতুল কে খু’ন করার কথা স্বীকার করেছে সে। আর একটা টেক্সট পাঠিয়েছে,, সে বুঝে গিয়েছিল পুলিশের থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় নাই সেই জন্য সে নিজেই আত্মহ’ত্যা করেছে।

তুষার মেসেজ আর ভিডিও টা পড়ে থম মেরে বসেছিল। বিষয় টা কেমন অদ্ভুত লাগছে। লিমন কেনো মা’রলো রাতুল কে। আর মা’রলোই যখন তাহলে সে কেনো আত্মহ’ত্যা করলো?

চিত্রা বাড়ির থমথমে পরিবেশ দেখে তুষারকে জিজ্ঞেস করছিল বাড়ির সবার চোখমুখের এমন অবস্থা কেনো? আর অধরারই বা এমন অবস্থা কেনো? তুষার রাতুলের ব্যাপারে সব জানায়। চিত্রা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে মোটেও এটা আশা করে নি। সে আন্দাজ করেছিল তার এমন অবস্থার জন্য হয়তো এমন থমথমে পরিবেশ। কিন্তু এমন কথা সে শুনবে কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নি। অধরার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে৷ সামনেই দুজনের বিয়ে ছিল। আর এখন এমন এক ঘটনা। মেয়েটা নিজেকে সামলাচ্ছে কি করে?

#চলবে?