Wednesday, September 3, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2039



প্রয়োজন পর্ব: ২৪

0

#গোল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২৪
লেখায়: তানিয়া তানু

অনেক্ষণ এই রুমে থাকায় নিশ্বাস আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। উনি মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় গেলেন? এই চিন্তায় মাথা ঘামাচ্ছি। অবশেষে সহ্য করতে না পেরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

“ফুপি, দিবুর সারপ্রাইজে সত্যি আমি ভারি অবাক হয়েছি। আপনারা যে আসবেন, সেটা তো কল্পনার বাইরে ছিলো।”
“সব হলো দিবিয়ার জন্য।ওর জন্যই এখানে আসা। বলেছিলামই তো ওর বাঙালী ছেলে ভীষণ পছন্দ। বিয়ের বয়স তো হয়ে গেল তাই ওর জন্যই তোমার কাছেই আসা।”

উনাদের কথোপকথন এক পর্যায়ে বুঝলাম মহিলা মেয়ের বিয়ে উনার সাথে দিতে এসেছেন। আচ্ছা সত্যি কী এই মেয়ের সাথে উনার বিয়ে হবে? উনি কী আমাকে আর ভালোবাসেন না? সহ্যের সীমা অতিক্রম করায় চলে গেলাম রুমে। ব্যাগ নিয়ে চলে যাওয়ার সময় দরজায় দেখলাম উনি দাঁড়িয়ে আছেন।

“শুনুন, সকালের নাস্তা খেয়ে যাবেন প্লিজ।” এই কথা বলেই বাথরুমের কিসের একটা পোষাক নিয়ে গেলেন। ভালো করে দেখিনি সেটা। উনার ভিন্ন রকমের ব্যবহার আমি রুষ্ট। কী সুন্দর করে বিদায় করে দিচ্ছেন! তাও আবার নাস্তা করে যেতে বললেন। এগুলো ভাবতেই ধপ করে বিছানায় বসে গেলাম। চোখ দিয়ে যেন প্রবল বৃষ্টি পড়ছে।

“আপনি এখনো নিচে যাননি। সেখানে আমার ফুপি আছে। প্লিজ যান। ফুপি আজ রান্না করে আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন।উনি আপনাকেও ডেকেছেন।”

অশ্রু পূর্ণ চোখ নিয়ে তাকালাম উনার দিকে। উনি ভ্রুক্ষেপ না করে আয়নায় গিয়ে চুল ঠিক করছেন। উনার পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম।
“আপনার জ্বর মনে হয় কমেনি। আজই অফিসে চলে যাবেন?” চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলাম। আয়না দিয়ে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন,
“অনেক দিন কামাই করেছি। আর নয়।আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। আর হ্যাঁ খেয়েদেয়ে চলে যাবেন।”

নীরব হয়ে মেঝেতে খানিক তাকিয়ে রইলাম।

“নিয়ন, এই নিয়ন,উঠ। ফুপিরা চলে এসেছে।” নিয়নকে জাগানোর চেষ্টা করছেন। নিয়ন আড়মোড়া হয়ে ভাইয়ের কথা শুনে ধড়পরিয়ে উঠলো। খুশির ঝলক যেন সারামুখে বিস্তৃত হলো। উঠেই ফ্রেশ হুওয়ার জন্য বাথরুমে গেল।

“আমার নাস্তা খাওয়ার প্রয়োজন নেই। ধন্যবাদ।” অনেক কষ্টে এই কথা বললাম।
কিন্তু উনি কিছুই বলছেন না দেখে ব্যাগ নিয়ে দরজার কাছে চলে গেলে আকস্মিক শুনতে পেলাম উনি বলছেন,
“চলেই যাচ্ছো তাহলে?”
উনার কথায় যেন মস্ত বড় নদীর বাঁধ ভেঙে গেল। দৌড়ে দু হাত দিয়ে আকঁড়ে ধরলাম উনাকে। এদিকে উনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। যান্ত্রিক মানবের মতো হয়ে আছেন। অন্যদিকে আমি কান্না করে উনার ইউনিফর্ম ভিজয়ে দিচ্ছি। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,
“নিজেই তো বললেন চলে যেতে।”
“রাতের মতো অধিকার খাটিয়ে বলা যায় না বুঝি?”
“কোন অধিকারের থাকবো?”
“আমার জীবনসঙ্গী হয়ে।”
উনার এই কথায় মাথা তোলে তাকালাম। জ্বরে শুকিয়ে যাওয়া হাস্য উজ্জ্বল চেহারা।

“ভালোবাসি।” টুপ করে কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়ে বহু আকাঙ্ক্ষিত কথাটি বললেন। উনার ঠোঁটের স্পর্শে সারা শরীরে ঠান্ডার মতো এক শিহরণ বেয়ে গেল। লজ্জায় মুখ নামিয়ে রাখলাম। উনি দু হাত দিয়ে এবার আমাকে জরিয়ে মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে চেপে রাখলেন। উনার বুকের প্রতিটি হৃদাস্পদনের শব্দ আমার বুকের মাঝে তুমুল ঝড় তুলছে। কিন্তু পরক্ষণে দিবিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। উনাকে দিবিয়ার সম্পর্কে বললে উনি বলেন,
“উনারা কয়েকদিন আগেই এখানে এসেছেন দিবিয়ার বিয়ের পাত্র খোঁজার জন্য। আবার আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। কিন্তু কাজের জন্য এতদিন সারপ্রাইজ দিতে পারেননি। আর আমিও নিলার বিয়েতে ছিলাম। গতকাল বিকেলে আসার কথা ছিলো কিন্তু বৃষ্টি হওয়ায় আসতে পারেননি। তাই ভোর সকালেই এলেন। শুধু উনি নয় আমাদের ড্রাইভার শুদ্ধ সবাই চলে এসেছে।জানো, ফুপি সব রান্না করেছে। আমার নিচে যেতে দেরী হচ্ছে বলেই।দিবু এসেছিলো উপরে। এসে আমাদের এইভাবে দেখে। কিন্তু বুঝ দিয়ে ফেলছি।

উনার হাত ছাড়িয়ে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বললাম, কী করে বুঝিয়েছেন?”
উনিও টোল পড়া হাসি দিয়ে বললেন, “বলেছি ঐ যে বিছানায় মেয়েটাকে দেখে এলে ও তোমার হবু ভাবি।”

“ও রাগ করেনি?”
“কেন?”
“কারণ ওর তো বাঙালী ছেলে পছন্দ। আপনিও তো বাঙালী।”
“ধুর বোকা, বাঙালী ছেলে ফুপির পছন্দ কিন্তু দিবুর নয়। তবে বাংলাদেশের একটা ছেলেকে ভালোবাসায় ওর মাকে এই কথা বললো। বাংলাদেশের ছেলেকে পছন্দ হওয়ায় বাঙালীও এখন পছন্দ হয়ে গেল।”
“এই দেশের ছেলেকে ভালোবাসে?”
“হ্যাঁ,ফেসবুকে নাকি একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। আর কথা বলতে বলতে এক সময় ভালোবাসা। কিন্তু ফুপিকে এই বিষয়ে বলতে লজ্জা করে বলেই আমার মাধ্যমে ও বলতে চায়। তাই আমার কাছে ফুপিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসা।তাই একটু আগে ফুপিকে ছেলের সম্পর্কে বলে এসেছি। তিনি ভেবেচিন্তে পড়ে জানাবেন বলেছেন।

উনার কথা শুনে মনে মনে হাজার শুকরিয়া জানালাম সৃষ্টিকর্তার প্রতি।

“চলো নিচে যাই।” এই বলেই আমার হাত উনার হাতের মাঝে মুষ্টিবদ্ধ করলেন। আঙ্গুলে আঙ্গুলে খেলায় ছলে নিচে নিয়ে গেলেন। সেখানে নিয়ন, দিবিয়া মেয়েটাও তার মা বসা আছেন। নাস্তা এখনো করেনি। উনার জন্য মনে হয় অপেক্ষা করছিলেন।

“এসো দীপ্তি, তোমার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম।
মনে মনে, আমার জন্য? বলে উনার দিকে তাকালাম। উনি ইশারায় উনার পাশে বসতে বললেন। উনার কথায় আন্টির পাশে গিয়ে বসলাম। মহিলার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চুলে সুন্দর করে খোপা করা। দেখতেও মাশাল্লাহ। তবে দিবিয়া বেশি সুন্দর। পুরো শেতাঙ্গের মতো। তাই তো শুরুতে হিংসে হয়েছিলো।

“মা,এবার তাহলে তুমি এই দেশে দুটো বিয়ে খেতে পারবে। কত বছর আগে খেয়েছিলে!”

উনার পাশে বসার পরপরই দিবিয়া মেয়েটি এই কথা তার মাকে ইঙ্গিত দিয়ে বললো। আন্টি শুধু মুচকি হাসলেন। এনাদের কান্ডে বেশ লজ্জা পেলাম। একটু অবাকও হলাম। মেয়েটা কী সুন্দর নিজের বিয়ের কথা বলে গেল! নিশ্চয় ওর মা রাজি হয়ে গেছে।
” অয়ন শুনো, আগামীকাল দীপ্তির বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। মেয়েটার এমন কেয়ারফুল আচরণ আমার ভারি ভালো লাগলো। নিয়ন তো গত রাত্রের ঘটনা বললো। আমি চাই না বেশিক্ষণ দেরী করতে।”
আন্টির কথায় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করতে গেলে তড়িৎগতিতে মাথা উঁচু করলাম। কারণ মা-বাবার কথা মনে পড়ে গেল। নিশ্চয় দুশ্চিন্তা করছে। একরাত মেয়ে বাড়িতে নেই। এই নিয়ে মনে হয় এতক্ষণে পাড়া-পড়শী কুৎসা রটিয়েছে। ভাবতেই বুকটা ধড়ফড় করছে।
“আন্টি আমাকে বাড়িতে যেতে হবে। কাল যে এখানে ছিলাম। সেটা উনারা জানেন না।”চঞ্চল হয়ে চেয়ার থেকে উঠে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কথাটা বললাম।

“কীহ? তোমার মা-বাবা জানেন না।”অবাক হয়ে বলায় আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।
“তাহলে এখুনি যাও।তারা এতক্ষণে অনেক টেনশন করছেন নিশ্চয়। অয়ন ও কে ড্রপ করে দিয়ে এসো।”

উনার কথায় তাড়াতাড়ি বললাম, “না আন্টি, আমি একাই যেতে পারবো। আমার সাথে উনাকে দেখলে মানুষ আরো বেশি কিছু এড করে নানান কথা বলবে। ওরা ভারি নীচু মনের। এক কথায় হাজার কথা বানিয়ে বলে ফেলে। এদেরকে এক লাইন দিয়ে ভাবসম্প্রসারণ করতে বললে রচনাও বানিয়ে ফেলতে পারে।”

আন্টির মেয়ে দিবার মুখ হা হয়ে গেল আমার কথা শুনে। আন্টি আচ্ছা বলায় আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু উনি কিছুই না বলায় হতাশ হলাম।

সদর দরজায় পার হতেই উনি ডাকলেন। পিছন ফিরে দেখি ক্রমশ উনি আমার দিকে এগুচ্ছেন।
এসে দু হাত দিয়ে দু গাল ধরে মুখ উঁচু করে কপালে আবারো ভালোবাসার পরশ দিয়ে বললেন, যাও, কেউ যদি তোমাকে কিছু বলে তবে আমাকে বলিও।দেখিও তাদের কী হাল করি! আমি উনার কথায় মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলে চলে আসতে একটা কথা মনে হওয়ায় বললাম,
“আন্টিকে কী আপনি আমার সম্পর্কে বলেছেন?”
উনি মৃদু হেসে বললেন, সবার আগে দিবিয়া বলেছে। তারপর আমি। শেষে তোমার গুনগান নিয়ন করেছে। আশ্চর্য হলাম উনার কথায়। কিন্তু দেরী হওয়ায় মুখ মলিন হাসি বজায় রেখে চলে আসলাম। দিবিয়ার কথা মনে পড়লো। দুজনই কী বুদ্ধিমান! দুজনের স্বার্থে দুজন লড়ে গেছে।

এই মূহুর্তে হাঁটা মানে বেশি দেরী করা। তাই না হেঁটে বাড়ির মোড়টায় নামিয়ে দেওয়ার জন্য একটা রিক্সা ডাকলাম।

রিক্সা থেকে দু কদম হাঁটার পরই আমাদের বাড়ি। আজকে এত বেলা হলো তবুও চারপাশে যেন পিনপতন নীরবতা। ক্রমশ বাড়ির দিকে এগুচ্ছি আর হৃদস্পদন দ্বিগুন আকারে বেড়ে যাচ্ছে।

বাসার বাইরে অনেক মানুষের জটলা পেকেছে। বুকটা অজানা ভয়ের আশঙ্কায় ছ্যাঁত করে উঠলো। এত মানুষের ভীড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকাই যাচ্ছে না। হঠাৎ দুলাভাইকে দেখে আটকে গেলাম। এতদিন পর! মনের মধ্যে দুর্ভাবনা যেন গেঁথে বসলো ভীড় ঠেলে ঢুকলাম বাড়ির ভিতর। আমাকে দেখে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো সবাই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। প্রতিবেশিরা শুরু করেছে তাদের বলাবলি।
” না জানি মেয়ে কোন ছেলের সাথে ঘুমিয়ে এসেছে। নষ্ট হয়ে গেছে মেয়েটা!”
“অভাবে তো নষ্ট হবেই। অভাবীদের তো শরীর ছাড়া কিছুই নেই। সেটাই কাজে লাগিয়েছে।”
উনাদের কথায় প্রচুর কষ্ট লাগলেও সেদিকে আমার নজর একদমিই নেই। আমার পুরো নজর আমার মায়ের দিকে। এলোমেলো অবস্থায় উঠোনে পাথর হয়ে বসে আছেন। যেন এই পাথরে কোনো প্রাণ নেই। আপা ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসলো। খানিক পর অনুভব করলাম এলোমেলো কয়েকটা থাপ্পড় আমার গালে পড়লো।
“ছিহঃ দীপ্তি, ছিহঃ তুই এমন কাজ করতে পারলি। আজ শুধুমাত্র তোদের জন্য,,,,” থাপ্পড় মেয়ে এই কথাগুলো বলে একদলা থুথু আমার সামনে ফেলে দিয়ে কান্না করতে করতে অন্যত্র চলে গেল। কিন্তু আপু কেন মারলো? আর এরাই বা আমাদের বাড়িতে কেন? এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার এদের কর্মকান্ডে আমার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।

” লাশ ধুয়ে ফেলেছি। এখনই কী খাটিয়ায় রেখে দিবো।”

চলবে„„„„„„„„

প্রয়োজন পর্ব:২৩

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব:২৩
লেখায়:তানিয়া তানু

“দীপ্তি শুনো, তুমি এখানে আজকে থাকতে পারো। কিন্তু প্লিজ আমাকে ডিস্টার্ব করো না। আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।”
উনার উত্তর শুনে গগন বিদায়ী হাসি দিয়ে বললাম,
“তা ধলাচাঁন, এখন ক্যান লাইনে আইছো।”
“প্লিজ দীপ্তি,চুপ করো। মাথা ব্যথাটা ভীষণ কিন্তু!
উনার এমন মাপ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলায় একটু মায়া হলো।তাই বললাম,
“শুন ভাই, আমি ডাক্তার-ফাক্তার নই। শুধু জানি মাথা ব্যথা হলে নাপা এক্সট্রা খাইলেই চইলা যায়। তাই বলতাছি ওষুধ কী আছে?”

“হ্যাঁ,আপু আছে। ঐ বক্সে ভাইয়ার সব ওষুধ আছে। এখন সব খাইয়ে দিতে পারো। ভাইয়া রাত্রের ওষুধ খায়নি।”টেবিলের দিকে ইশারা করে বলায় আমিও সেদিকে তাকালাম। একটা সাদা বক্স পড়ে আছে। ঐটায় উনার সব ওষুধ।
ওষুধের বাক্স খুলে দেখি অনেক ওষুধ সেখানে। গ্লাসে পানি নিয়ে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য উনার কাছে গেলেই উনি মুখ ঘুরিয়ে নেন। উনার এমন ভাব দেখে আবারো রাগ হলো।
“ঐ ছ্যামরা, এমন ভাব নিচ্ছিস ক্যান?”
“আমি কোনো ভাব নিচ্ছি না।”
“তাইলে মাথা ঘুরাইছত ক্যন?”
“ওষুধ খাবো না তাই।”
“খাবি না মানে,, এই বলে উনার মাথা ঘুরিয়ে মুখ চেপে ধরতে চাইলে গ্লাস হাত থেকে জোর করে নিয়ে নেন। তারপর বলেন,
“এইসব ওষুধ খাওয়ার পর খেতে হয়। পূর্বে নয়।”
“আমি তো সেটা জানিই।”
“তাহলে তো হলোই।
” হুম হলো। এই নে এখন খা।” আবারো ওষুধ মুখের কাছে নিলে রাগ দেখিয়ে বললেন,
“দীপ্তি, আমি এখনো কিছু খাইনি।”
“আমিও খাইনি।”পিছন থেকে উনার সাথে নিয়নও এই কথায় বলায় খানিক অবাক হলাম। দুই ভাই খায়নি। ঘড়ির দিকে তাকালে দেখতে পেলাম রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। বুঝলাম এখন তারা খাবে মনে হয়। তাই নিয়নকে তাড়া দিয়ে বললাম,
“যাও নিয়ন, উনার জন্য খাবার নিয়ে এসো।”
নিয়ন আমার কথা শুনে মুখ কাছুমাছু করে বললো,
“খাবার রান্না করা হয়নি।”
ভ্রু কুচকে নিয়নকে বললাম, কেন? উত্তরে বললো, শান্তা আন্টি চলে যাবার পর মকবুল চাচা রান্না করতেন। কিন্তু উনিও দুপুরে চলে যাওয়ায় রান্না করা হয়নি।
“রান্না করে রেখে যাননি?”
“এসে রান্না করবেন বলেছিলেন।”
“তো এখন?”
“আপু তুমি গিয়ে রান্না করো না। খুব ক্ষিধে পেয়েছে।প্লিজ!”
নিয়নের কথা শুনে অবাক হলাম। কিন্তু নিজেরও পেটেও ইদুর মশাই দৌড়াচ্ছে দেখে আচ্ছা বলে রান্নাঘরের দিকে গেলাম।

রান্নাঘর বেশ বড়। সব কিছু কত সুন্দর করে সাজানো! এগুলো মনে হয় শান্তা আন্টি সাজিয়ে রেখেছেন। সে যাইহোক এখন আমার মূল কাজ রান্না করা সৌন্দর্য দেখা নয়। তাই ঝটপট উড়না কোমরে ভাঁজ করে নেমে গেলাম রান্নায়। রেফ্রিজারেটর খুলে দেখলাম মাছ মাংস সবই আছে। নরমালে পচে যেতে পারে এমন সবজিও সংরক্ষণ করা। তাই সেগুলো দিয়ে দু পদের তরকারি ও ভাত রান্না করলাম। একা তো আর সব উপরে নেওয়া সম্ভব না। তাই নিয়নকে ডেকে দুজনে উনার রুমে নিয়ে গেলাম।

উনি চোখ বুজে শুয়ে আছেন। তাই আবারো কপালে হাত দিয়ে দেখলাম আগের থেকে এখন শরীর প্রচুর গরম। জ্বরের পরিমাণ বেড়েছে। আমার হাতের স্পর্শে চোখ পিটপিট করে খানিক তাকিয়ে বললেন,
“বার বার কপালে হাত দিয়ে কী কর?”
“জ্বরের পরিমাণ কতটুকু তা দেখি।”
“থার্মোমিটারের যুগ কী চলে গেছে?”
আমাকে হিটলামি করেই যে এমন কথা বুঝলাম। তাই উনার কথা না শুনার ভান করে চটজলদি নিয়কে বললাম তোমার ভাইকে খাইয়ে দাও। নিয়ন নিজে প্রথম ভাতের লোকমা মুখে তোলার সময়ই এই কথা বললাম। সে আচ্ছা বলে ভাইকে ভাত খাওয়াতে আসছে। অন্যদিকে ভাত দেখে খাওয়ার লোভ জাগছে। কিন্তু এটা আমার বাড়ি নয় বলে খেতে পারছি না। খেলেই বলবে কী পেটুক মেয়েটা!

সোফায় বসে নিয়নের খাওয়ানো দেখছি। পিচ্চি পিচ্চি হাতে সে ভাইকে খাওয়াচ্ছে। উনি শোয়া থাকায় নিয়ন খাওয়াতে তেমন সুবিধা পাচ্ছে না। মুখে পড়ে একটা বিছানা য় পড়ে দশটা ভাতের দানা। নিয়ন খাওয়াতে পারছে না দেখে ধমক দেখিয়ে বিদায় করে দিলো। নিরুপায় নিয়ন! তারই বা দোষ কী?

এদের এমন কান্ড দেখে নিজেই সিন্ধান্ত নিলাম উনাকে খাওয়াবো। যেমন সিদ্ধান্ত তেমন কাজ। কিন্তু উনি আমার হাত দিয়ে খাবেন না। পুনরায় রাগ যেন আমার মাঝে চলে আসলো উনার কথায়। তাই রণচণ্ডীর রূপ পুনরায় নিজের মাঝে ধারণ করলাম।

“খাবি না মানে? তুই না খাইলে তোর বাপ খাইবো।”
“না খাইলে কী করবে?”
“রণচণ্ডীর নৃত্য দেখাবো।”
“আচ্ছা দেখাও। কতদিন ধরে নাচ দেখিনি।”
আমি কীভাবে কথাটা বললাম। আর উনি কীভাবে কথাটা নিলেন। তাই পানির গ্লাস এনে উনার কাঁথা এক রকম গা থেকে সরিয়ে বললাম,
“এখানে পানি ঢেলে নাচবো। ঢেলে দেই।”
উনি আমার কথা শুনে যারপরনাই অবাক। বার বার কাঁথা ধরে টানছেন। গেঞ্জি টেঞ্জি কিছুই পড়েন নাই। লোমশ বুক যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেদিকে নজর না দিয়ে উনাকে কথাটা আবারো বলায় খেতে রাজি হয়েছেন। নয়তো এই জ্বরে ঠান্ডা পানি উনার শরীরে লাগতো।যার ফলে শীত বুড়ির মতো টকটক করে কাঁপতেন। যদিও এটা ভণিতা ছিলো।

লজা-শরম ভুলে উনাকে খাওয়ানো শুরু করলাম। প্রত্যেক লোকমাতে উনাকে খাওয়ানোর ফলে আমার হাত অটোমেটিক উনার ঠোঁট স্পর্শ করে। সেই স্পর্শে নতুন এক অনুভূতির রাজ্যে আমাকে টেনে নিয়ে যায়। যদিও এই স্পর্শ আগেও পেয়েছি।

খাওয়ানোর শেষে উনাকে ওষুধ খাইয়ে দিলাম। এদিকে নিয়ন খেয়েই ভাইয়ের পাশে ঘুমিয়ে গেল। অন্যদিকে আমার পেটের অবস্থা করুন।রাত দশটা বেজে গেল। না হলো খাওয়া। আর না হলো বাসায় যাওয়া। তবুও অপেক্ষায় আছি ওরা কখন আসবে। জানি আসবে না। এই প্রবল বৃষ্টিরময় হাওয়ায় কে আসবে ঝড় পেরিয়ে। জানের মায়াতো সবারই আছে।

“তোমাকেও কী এখন খাইয়ে দিতে হবে?”
ভাবনার অতল সমুদ্রে ডুব দিয়েছিলাম। কিন্তু উনার কথায় সাঁতার দিয়ে আবারো ডাঙায় ফিরে এলাম।
“আমি কী বলেছি? আমাকেও খাইয়ে দিন।”
“তাহলে খাচ্ছো না কেন?”
“খাবোই তো।”
উনার এমন কথা শুনে মনে লাড্ডু ফুঁটলো। যাক বাবা মানবতা তাহলে মরেনি। এখনো জীবিত আছে। কিন্তু এমন ত্যাড়াভাবে না বললেও চলতো।

খেয়েদেয়ে আবারো কপালে হাত দিলাম।জ্বরের তাপমাত্রা যেন ক্রমশ বাড়ছে।পিটপিট করে তাকিয়ে চোখ বুজে নিলেন। মনে হলো উনি আর ঝগড়া করতে চাইছেন না। জ্বরের পরিমান প্রচুর হওয়ায় এবার তিনি শান্ত হলেন। কিন্তু আমি এত জ্বর দেখে জলপট্টি দিতে চাইলাম। সুতি কাপড়ের টুকরায় জলপট্টি দিলে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে উনি চোখ খুললেন। কিন্তু বাধাঁ দিলেন না। আমিও জলপট্টি দেয়াওয়ার কর্মে নিযুক্ত হলাম। মাঝে মাঝে আধবোজা চোখে তাকাচ্ছিলেন। চোখে ছিলো অদ্ভুত এক মায়ার খেলা। সেই চোখে তাকালে কেমন জানি অনুভব করি। তাই না তাকিয়ে নিজের কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে লাগলাম।

“এই কে আপনি? অয়নের রুমে কী করছেন?”
আচমকা কারোর শব্দে আধবোজা করে তাকানোর চেষ্টা করলাম। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। কারোর হাত আমার শরীরে। তাকিয়ে দেখি দিনের আলো কাঁচের জানালা ভেদ করেও রুমে এসে উপচে পড়ছে। গতরাত্রে উনাকে জলপট্টি দিচ্ছিলাম। এই কথা মনে পড়তেই বিছানা উঠে বসলাম।আমি বিছানায় ঘুমে ছিলাম! কিন্তু আমি তো চেয়ারে বসে জলপট্টি দিচ্ছিলাম। এখানে এলাম কী করে?পাশে নিয়ন ঘুমের বিভোর। কিন্তু অয়ন নেই। বলতে গেলে সারা রুমেই নেই। দরজায় দাঁড়ানো এক মানবী। সমবয়সী হবে হয়তো। দু হাত কোমরে রেখে রাগান্বিত হয়ে মেয়েটা তাকিয়ে আছে। ফ্রান্সের হলেও বেশভূষায় সভ্যই মনে হলো। ও হয়তো দিবিয়া। নিয়নের ফুপির মেয়ে।যে বিয়ের জন্য এখানে এসেছে। বিয়ের কথা মনে পড়তেই এক পলক মেয়েটার দিকে তাকালাম। বেশ সুন্দরী! আমার থেকেও দ্বিগুন। তাহলে তো হলোই। এই মেয়ের সাথেই মনে হয় উনার বিয়ে,,। ভাবতেই পারছি না। বুকের মধ্যে যেন একরাশ।শূন্যতা এসে ভীড় করেছে।

বাথরুমের দরজায় ক্র‍্যাচ করার শব্দে আমি আর ঐ মেয়েটি দুজনই সেদিকে তাকালাম।উনি মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে আসছেন। এই মাত্র গোসল সেরেছেন। কিন্তু এত জ্বরে নিয়ে ভোর সকালে গোসল করলেন কেন?পাশের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা দশটা বেজে গেল। ইয়া আল্লাহ! বাড়িতে আমার টেনশনে না জানি কী হচ্ছে!

“দিবু,তুমি এখানে? কখন আসলে?”
“সব উত্তর পরে দিব। আগে বলো, উনি কে? তোমার বিছানায় উনি কী করছেন?
দুজনের দিকে ভ্যবলাকান্তের মতো তাকিয়ে আছি। নিশ্চুপ কোনো যন্ত্র মানবী হয়ে।
“দিবু,তুমি আসো তো আমার সাথে।” এই বলেই ঐ মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেলেন। উনার দিবু বলা ডাকটায় যেন আমার কষ্ট লুকিয়ে আছে।যতবার এই আদুরে সুরে ডাকা হয় ততবার যেন ডাকটা বুকের মধ্যে তীড়ের মতো বিঁধছে।

চলবে„„„„„

প্রয়োজন পর্ব: ২২

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২২
লেখায়: তানিয়া তানু

“ভাই, ওরা বলতে তুমি কাদের বুঝিয়েছো?”
নিয়ন মাথা তোলে বললো,
“আমাদের ড্রাইভার স্বপন ভাই, তিনজন দারোয়ান ভাই, আর বয়স্ক মকবুল চাচা,আর ফুপি ও ফুপির মেয়ে আপু।”
নিয়নের কথা শুনে অবাক হলাম। তাহলে এই মুহূর্তে এই বাসায় কেউ নেই। এই দুই ভাই ছাড়া। উনি তো অসুস্থ। নিয়ন তাহলে একলা। এই কারণেই নিয়ন ভয় পেয়ে আছে। কিন্তু ওরা সবাই এক সাথে কোথায় গেল? এই প্রশ্ন নিয়কে করলে।উত্তরে সে বললো,
“শান্তা আন্টির স্বামী আজ দুপুরে মারা গেছে। বিকেলে জানাযা হবে। কিন্তু আন্টির তেমন আত্মীয় নেই। আমরা ছাড়া। কিন্তু ভাইয়া অসুস্থ তাই ওরা সবাই গেল।”
“ইন্নালিল্লাহ,,।আচ্ছা ওনার কোনো সন্তান নেই?”
“ছিলো। দুই মেয়ে ছিলো। এক মেয়ে মারা গেছে। আর অন্য মেয়ে স্বামীর বাড়িতে আছে। কেন জানি ওনাকে তারা দেখাশোনা করছে না!”
মহিলার পোড়া কপাল! নয়তো এভাবে সব আপনজনদের খোয়াতে হয়। মেয়ে বোধয় মা-বাবাকে বোঝা মনে করেছে। তাই তাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
” ওনার স্বামীকে জানাযা কোথায় করা হচ্ছে।আর ওরা আসতেই বা কতক্ষণ সময় লাগবে?”

“ওনাদের গ্রামে। আসতে কতক্ষণ সময় লাগবে তা জানি না।”
“আর তোমার ফুপি ও তার মেয়ে কখন আসবে?”
“উনাদের তো আজ আসার কথা ছিলো। কিন্তু আসবেন না মনে হয়।”
“অহ। উনাদের তো পূর্বে কখনো দেখিনি তাই না?”
“হ্যাঁ আপু, আমি নিজেও পাঁচবছর আগে দেখেছিলাম।”
” পাচঁ বছর আগে। আচ্ছা উনারা মনে হয় তোমার ভাইয়ার অসুস্থ বলেই আসছেন?”
“হ্যাঁ, আপু পাচঁ বছর আগে। কারণ উনারা বিদেশে থাকেন। পাঁচ বছর আগে একবার এসেছিলেন। উনারা ভাইয়ার অসুস্থের জন্য নয় বিয়ের জন্য আসছেন। আর ভাইয়া তো জানেই না। শুধু আমি জানি। দিবিয়া আপু তো সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আসছেন।সেই জন্য ভাইয়াকে বলতে না করেছেন।” বিয়ের জন্য শুনে মনটা কেমন খঁচ করে উঠলো। তবে সেটাকে এখন পাত্তা দিচ্ছি না।
“উনারা কোন দেশে ছিলেন?”
“ফ্রান্সে। সেখানে ফুফার ব্যবসা।”

আযান পড়ে গেল। আমি আর নিয়ন বিছানায় বসে আছি। এদিকে বৃষ্টি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। তার সাথে ঝড়ও ভীষণ গতিতে হচ্ছে। বাবাকে ফোন করেছিলাম কিন্তু নেট নেই বলেই কথা বলতে পারলাম না। বাবাকে জানানো হলো না, আজ যে আমার দেরী হবে। মা বোধয় খুব চিন্তা করছেন। জানালাদিয়ে বৃষ্টি তেড়ে আসছে। তাই জানালা লাগিয়ে দিলাম। এদিকে পরিবেশও অন্ধাকরে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।জানালা লাগানোর ফলে এখন পুরো রুমে নিবিড় অন্ধকার বিরাজ করছে। কারণ এইমাত্র লোডশেডিং হলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এত বড় বাড়িতে আইপিএস এর সিস্টেম নেই! তাই নিয়নকে জিজ্ঞেস করলাম,

“ভাই রুম তো মিশমিশে কালো হিয়ে গেল। আমারও খুব ভয় করছে। কোনো টর্চ বা মোমবাতি হবে?”

“টর্চ কোথায় সেটা জানি না। মোমবাতিও নেই। তবে ভাইয়ার রুমে আইপিএস পাওয়ার সিস্টেম আছে। ওখানে আলোও আছে।”
“এই রুমে তো তুমি থাকো। তাহলে এই রুমে আলো নেই কেন?”
অদ্ভুত লাগছিলো নিয়নের কথা। তাই এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে ও বললো,
“এই রুমে তো প্রয়োজন নেই। কারণ আমি ভাইয়ার রুমে থাকি। আর এটা পরিষ্কার করা হয়েছে তাই এখনো লাগানো হয়নি।।ভাইয়ার মনোযোগ এটাতে মনে হয় ছিলো না।”
“কয়েকদিন আগে পরিষ্কার করা হয়েছে কেন?”
“বারে, আপনি পড়াতে আসার কারণেই। অন্য টিচার্সরা ভাইয়ার রুমেই পড়াতো। কিন্তু আপনি পড়াবেন বলেই আলাদা রুম পরিষ্কার করা হলো।”

নিয়নের কথায় আমি যারপরনাই অবাক।কিন্তু আমাকে আলাদা রুমে দিলেন কেন?

দুজনই গুটি গুটি পায়ে উনার রুমে হাজির হলাম। নকশীকাঁথা শরীরে জড়ানো। মুখ হাত দিয়ে ঢাকা। সম্ভবত জানালা দিয়ে তেড়ে আসা প্রবল বৃষ্টির বেগ উনার চোখে মুখে পড়ছিলো। কিন্তু অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠতে পারছেন না। তাই বড় হাঁটা দিয়ে জানালা লাগিয়ে পর্দাটা মেলে দিলাম। যাতে সামান্যতম বৃষ্টিও উনাকে ছুঁতে না পারে।

“ভালো করেছিস। এতক্ষণ বৃষ্টির ফোঁটা এসে ধুয়ে দিচ্ছিলো।”কাঁপা কাঁপা গলায় আস্তে আস্তে কথাগুলো বললেন। নিয়নকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিলেন।

হাত দিয়ে মুখের পানিগুলো মুছতে শুরু করলেন। আশেপাশে সুতি কাপড় না পেয়ে কাভার্ড খুলে সেখান থেকে সুতি কাপড় এনে উনার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছি। চেহারায় মায়াভাব এখন প্রচুর ফুঁটে উঠেছে। জ্বরে চেজেরা শুকিয়ে গেছে। এক চেহারায় বুঝা যায় না উনার আসল রাগী চেহারা। উফ কত রাগ উনার!

“তুই আবার এত কেয়ারফুল হলি কী করে? শুধু তো দাঁড়িয়ে থাকতেই পারিস?কোনো কিছু বললেও করিস না। কিছু বললেই বলিস, তোমার শরীর কী গরম! আমার ভয় করে। এখন করছে না?”

উনার কথা শুনে অবাক হলাম। কারণ উনার কথা পুরোপুরি মিলে গেল।
নিয়ন এখনও দরজায়ন ঠায় হয়ে দাঁড়িয় আছে। কাছে আসছে না। কিছু বলছেও না।

“কীরে, কথা বলছিস না কেন?আচ্ছা তোর টিউটর আপা কী চলে গেছে। ও কে আমার অসুখের কথা বলেছিস?”

“বলেছি।” দরজার কাছ থেকে আমার পাশে এসে বসতে বসতে ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিলো।
“কেন বললি? দেখলি তো আমি অসুস্থ জেনেও একটু দেখতে এলো না। বড্ড স্বার্থপর মেয়েটা!”

“ওহ আমি স্বার্থপর না! তাহলে আপনি কী!আপনি তো একটা ছাগল, সারাক্ষণ ম্যা ম্যা করেন।” এতক্ষণ ধরে দিনরাত্রী ভুলে এখানে বসে আছি। আর উনি কীনা স্বার্থপর উপাধি দিচ্ছেন। তাই রাগেই কথাটা বললাম।

“তুমি!”
বেশ অবাক হয়ে গেলেন আমার কন্ঠস্বর শুনে। চোখ পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু আলোর কারণে তাকাতে পারলেন না।

“তুমি এখনো যাওনি। আর এতক্ষণ ধরে তুমি আমার মুখের পানি মুছে দিচ্ছিলে। তোমার সাহস হয় কী করে?” আবারো রাগ দেখিয়ে আমার হাত থেকে কাপড় নিয়ে দূরে ফেলে দিয়ে কথাগুলো বললেন।

“আমার পাশ থেকে সরে বস। তুই আমার সামনে এসেছিস কেন? আমাকে এমনভাবে যত্ন নিচ্ছিস মনে হচ্ছে আমি তর স্বামী। এগুলো গিয়ে অন্য ছেলের সাথে কর। আমার সামনে না। যাহ্ ভাগ এখান থেকে?” এতগুলো কথা বলেই কাঁথা দিয়ে মুখ ডেকে ফেললেন।

পুরোনে কথা মনে হওয়ার কারণেই মনে হয় এই ভাষায় কথাগুলো বললেন। এদিকে এতগুলো অপমানজনক কথা শুনে আমার চোখ টলমল করলো। কান্না যেন দলা পাকিয়ে আসছে। বুকের মধ্যেও চাপা কষ্ট অনুভব হচ্ছে। এ যেন বসন্তের ফুল ফুঁটার পূর্বে ঝড়ো হাওয়ায় ঝরে গেল। অকালে তার মৃত্যু হলো।

বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। নাহ্ এই বাসায় এক মুহূর্তও থাকা যাবে না। নিয়ন একনাগাড়ে আমাকে যেতে মানা করছে। কিন্তু পিচ্চির কথায় আমি পাত্তা দিচ্ছি না। দরজার পাশে এসে যাবার পূর্বে এক পলক দেখলাম উনাকে। উনার এখনো মুখ কাঁথা দিয়ে ঢাকা। একবারো মানা করলেন না। এই রাত্রে ঝড় বৃষ্টিতে একলা একটা মেয়ে কীভাবে যাবে?

দরজা খুলে যাবার সময় আকস্মিক এক বজ্রপাত হলো। এর গর্জনে নিয়ন দূরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, প্লিজ আপু, যেও না।আমার খুব ভয় করছে। আমি ওকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললাম, ধুর বোকা, এই সামান্য বিজলির চমাকানিতে কেউ ভয় পায় নাকি? এইগুলোতে যারা ভয় পায় তারা এক্কেবারে ভীতু। আমি ওগুলোতে ভয় পাই না। তুমিও পেয়েও না। যাও, ভাইয়ার পাশে গিয়ে বসো।”

নিয়ন আমার কথা ভালো ছেলের মতো শুনে ভাইয়ার কাছে বসলো। আচমকা আবারো মেঘ এমন প্রচন্ড জোদে গর্জে উঠলো যে মনে হলো বিল্ডিং ভেঙে ফেলছে। আর এই গর্জে উঠার শব্দ এতটা ভয়ংকর ছিলো যে যার কারণে আমি দৌড়ে নিয়নের মতো অয়নের কাঁথার ভেতর ঢুকে গেলাম। শুধু মাত্র জড়িয়ে ধরাই বাকি রইলো। এক মরা লাশ থুক্কু এক অসুস্থ ব্যক্তির নিকট সাহায্যের জন্য যাচ্ছে দুই ব্যক্তি। অদ্ভুত!

“তোকে না বললাম চলে যেতে। তুই এখনো যাসনি। এত বেহেয়া কেন তুই? যাহ্ ভাগ। তোর তো দেখি লজ্জাও নেই। একটা অবিবাহিত ছেলের পাশে এভাবে গা ঘেঁষে ঘুমিয়েছিস। ছিহঃ আর তুই না বললি এগুলো তুই ভয় পাস না। তাহলে এখন কেন পেলি।” কাঁথা থেকে মুখ বের করে এতগুলো কথা বললেন।
আবারও চোখ থেকে জল আসার উপক্রম আসলো। কিন্তু শুয়া থেকে উঠে হাটু ভেঙে বিছানায় বসলাম। তবে এবার মনে মনে ভাবলাম যাবো না। যতই অপমানিত হই। এই বৃষ্টিস্নাত রাত্রিরে একা কীভাবে যাবো?তাও আবার হেঁটে! অসম্ভব! কিন্তু একটু ভাব নিয়ে বললাম,

“চলে যাচ্ছি। কিন্তু শুনে রাখুন।” বিছানা থেকে উঠে।
“কীহ?”
“আমি এখন এখান থেকে বের হবো। বৃষ্টির ঝড়ো হাওয়া এসে আমার ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ছাতাবিহীন এই আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবো। বৃষ্টির পানির কারণে আমার জামা ভিজে লেপ্টে থাকবে শরীরে। বখাটে ছেলেরা খারাপ নজর দিবে। তারপর তারা আমার সম্পদ নষ্ট করবে। কোনো ছেলে আমায় বিয়ে করবে না। আমার সম্পদ নেই দেখে। তখন আমি দৌড়ে আপনার কাছে ছুটে আসবো। বলবো, বিয়ে করেন, বিয়ে করেন। আপনি আমার সম্পদ নষ্ট হওয়ার মূল কারণ হওয়ায় বিয়ে করবেন। কিন্তু একটা ধর্ষিতা মেয়েকে। সারাক্ষণ আমার ফ্রেন্ডরা আপনাকে নিয়ে ট্রল করবে। শুধু ফ্রেন্ড নয় পুরো সমাজ। বুঝলেন?

“হুম। এবার যাহ্।”
ভাবের আশায় গুড়ের বালি ঢেলে দিলেন এই কথায়। কিন্তু আমি তো এখান থেকে এক পাও নড়বো না। তাই জেদ দেখিয়ে বলি,
“হাত সরান তো। দেখি কতটুকু জ্বর হয়েছে।” নিজেই হাত সরিয়ে কপালে হাত দিলাম। গায়ে কী উত্তাপ। মনে হয় জ্বরে পুরো শরীর পুড়ে যাচ্ছে।খুব কষ্ট হচ্ছে।

“এত খারাপ কেন তুই? আর কতবার বলবো যা এখান থেকে।” কপাল থেকে হাত সরিয়ে।

উনার এমন আচরণ বুকের মধ্যে তীড়ের মতো বিঁধছে। সত্যি চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এবার যা ভাবার তা ভেবে পেলেছি।কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতোই এবার আমিও আচরণ করবো।

“কী ভাবছিস? যাচ্ছিস না কিসের জন্য?”

“ক্যান যাইতাম। না গেলে তুই কিতা করবি, হুনি? তোর মুরুদই বা কতখান? আয় দেখি।” বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল নাচিয়ে নাচিয়ে এই কথাগুলো বললাম। এটাও বুঝলাম উনি ভারি অবাক হলেন। কারণ উনার চোখ এত বড় হগেছে যা বলার মতো না।

“তুই আমার সাথে এমন ব্যবহার করলি? তোর সাহস তো কম নয়?তোকে তো আমি,,,,” বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অসুস্থ শরীর এই ভার সহ্য করতে পারলো না। তাই বিছানায় আবার পড়ে গেলেন। রাগে গিজগিজ করছেন। কিন্তু আমি জানি তো যত গর্জে তত বর্ষে না। তাই আমার সাহসও দ্বিগুন পরিমাণ বেড়ে গেল।

“দেহি ধলাচান তোর কপালডা দেহি?” বিছানায় বসে আবারও ভাব নিয়ে কাছে গেলাম।

“এই আঞ্চলিক ভাষায় কেন কথা বলছিস। একবার তো দেখলি। আবার কেন দেখিব?”
“একশবার দেখবো। যতবার আমার ইচ্ছে হবে।” কপালে হাত দিয়ে জ্বরের পরিমাণ অনুভব করে সরে আসলে হাত ধরে মুচড়িয়ে বললেন, “এবার তোর কী হাল করি সেটা দেখ।” উনার কথা শুনে বিটলামির হাসি দিলাম। তারপর উনার হাত মুচড় দিলাম। উনি আহ করে হাত বিছানায় ফেলে দিলেন। উনার শরীরে শক্তি নেই বললেই নেই! একেবারে হাত অবশ! তাই আমার শক্তিও দেখিয়ে দিলাম।

“দীপ্তি শুনো, তুমি এখানে আজকে থাকতে পারো। কিন্তু প্লিজ আমাকে ডিস্টার্ব করো না। আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।”
উনার উত্তর শুনে গগন বিদায়ী হাসি দিয়ে বললাম,,,,,,,,,,,,,

চলবে,,,,,,,

প্রয়োজন পর্বঃ ২১

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ২১
লেখায়: তানিয়া তানু

দুপুর বেলায় বৃষ্টি কমেছে। তবে আকাশে এখনো মেঘ জমেছে। আবারো বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা দ্বিগুন। নতুন বর্ষা। তাই তেজও বেশি। নয়তো এত বৃষ্টি কী আর হয় নাকি! একেবারে ঝুম বৃষ্টি। সকালবেলায় তো খুব করে ইচ্ছে হচ্ছিলো এই ঝুম বৃষ্টিতে একটুখানি ভিজি। কিন্তু মায়ের চোখের শাসন আর বাবার জ্বর বেড়ে যাওয়ায় এই সিন্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এলাম। তবে মায়ের শাসন থেকে বের হতে পারিনি। যেই না বেলা ১২ টা বাজা শুরু হলো সেই থেকেই প্রশ্ন করলেন, “হে রে দীপ্তি, তুই বিকেলের টিউশনিতে যাস না ক্যান?” মায়ের এই প্রশ্নের উত্তরে ভালো লাগছে না বললেও কিছুক্ষণ পরপর এসে একই কথা জিজ্ঞেস করলেন। সম্ভবত মায়ের সন্দেহ হয়েছে। মা আমার প্রিয় সইয়ের মতোই ছিলো। তাই নিজের সব কিছু ভাগ করি। তবে ডিপলি নয়। টিউশনিতে দুই ভাইয়ের একাকীত্ব আর নিয়নের দুষ্টুমির কথা বলেছি। এই কারণেই তিনি সন্দেহে ডুব দিলেন।

বিকেল বেলায় মায়ের মায়ের বার বার প্রশ্ন আর সন্দেহের তালিকায় না পড়ার জন্য বেরিয়ে পড়লাম নিয়নকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে। তবে বেশ ভয় হচ্ছে না জানি নিয়নের ভাই আমাকে দেখে কী প্রতিক্রিয়া দেখায়! এই টেনশনে তো সারারাত ঘুমও হয়নি।

রাস্তাঘাটের অবস্থা ভারি শোচনীয়। পানি আর কাদায় মিশ্রিত হয়ে আছে। কয়েক জায়গায় হাটু পরিমাণ পানি। সালোয়ার তোলে জুতা হাতে নিয়ে সে জায়গা পার হতে হয়। আবার কয়েক জায়গায় পিছলে যাবার সম্ভবনা। ধীর গতিতে সাবধানে যেতে হয়। এত ঝামেলা হচ্ছে দেখে গ্রামের রাস্তা দিয়ে না হেঁটে মেইন রোডে হাঁটা শুরু করলাম। এইখানে তেমন খারাপ পরিস্থিতি নেই। বেশ কয়েক জায়গায় খানিক পানি জমে আছে। তবে সুন্দরভাবে চলাচল করা যায়। কিন্তু সমস্যা এই রোড দিয়ে অনেক জায়গা হাঁটতে হবে। আর তা করছিও।

রাস্তাঘাটের মানুষ আর প্রকৃতি দেখেই হাঁটছি। কিন্তু আকস্মিক নিলার কথা ভাবনায় এলো। আসার সময় ফোন করলো। তার বৌভাতে না ফিরাযাত্রাও না, এমন কী একদিন যে সে এক্সট্রা বাপের বাড়ি থাকলো তাও তাকে কেন দেখতে গেলাম না। উত্তরগুলো অনেক বাহানা দিয়ে বুঝেছি। বুঝলেও সে যে অভিমান করছে তা বুঝতে আমার আর বাকি রইলো না। ওদের বাসায় না যাওয়ার কারণ মূলত তিনটি। প্রথমত চারদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো। কিছুক্ষণ থামছিলো। কিন্তু আবারো হচ্ছিলো। দ্বিতীয়ত, শাহেদা আন্টির কাছে আমি আর পড়তে চাই না। উনি দু হাত মেলে আগলে রাখুক উনার সোনার ছেলেকে। তৃতীয়ত আকাশ ভাইয়ার কাছে পড়তে চাই না। কারণ টাকাটা ফেরত দেওয়ায় তার মনের কোণায় অনেক প্রশ্ন জমেছে। আমাকে পেলেই সব প্রশ্ন বন্যার মতো ঢেলে দিবে।

বহুক্ষণ হাঁটার পর গন্তব্যে আসায় বড়সড় এক শ্বাস ফেললাম। কিন্তু শ্বাস পুরোপুরি শেষ হবার পূর্বে নজর পড়লো গেইটে। দারোয়ান নেই! তবে বাইরে আছে মনে হয়। নিজেই গেইট খুলে ঢুকলাম। সদর দরজায় ঢুকে আরো অবাক হলাম! পরিবেশে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। নিয়নের রুমেও সে নেই। চাপা গলায় নিয়ন বলে কয়েকবার ডাক দিলে পাশের রুম থেকে সে জবাব দিলো “আসছি আপু”। পাশের রুম নিয়নের ভাই। খুব ইচ্ছে হলো উনাকে এক নজর দেখি। আচ্ছা উনি কী আছেন? নিশ্চয় আছেন। তা না হলে নিয়ন কেন ঐ রুমে থাকবে। তাই উঁকি দিয়ে উনাকে দেখবো বলে বাইরে পা রাখছলাম। কিন্তু উনাকে দেখার ইচ্ছে দমে গেল নিয়নের ফ্যাকাসে মুখ দেখে। তবে তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না।

পড়ার সময় শেষ হওয়ার বাকি সময় হচ্ছে ১৫ মিনিট। এই ১৫ মিনিটেই প্রতিদিন ওকে নতুন খেলা শিখাই। আজও একটা নতুন খেলা নিয়ে হাজির হয়েছি। যেগুলো ছোটবেলায় শিখেছিলাম তার একটা।

“নিয়ন, আজ এই পর্যন্তই।” নরমস্বরে এই কথাটা বলায় প্রত্যুত্তরে এলো আচ্ছা।ওর আচ্ছা বলার নমুনা দেখেই বুঝলাম পিচ্চর খেলায় আগ্রহ নেই।কিন্তু প্রতিদিন আমি বলার পূর্বে নিয়ন খেলার কথা বলতো। আজ কেন বলেনি? উনি না করে দেননি তো?

“নিয়ন, চলো, আজ তোমায় আরো নতুন একটা খেলা শিখাই।” এতক্ষণ ওর নজর বইয়ের দিকে ছিলো। আমার কথায় মাথা তুলে অসহায়ের দৃষ্টিতে বললো, সরি আপু! আজ খেলায় মুড নেই। তাই খেলতে পারবো না! ওর কথায় কিছুটা অপমানবোধ করলাম। হয়তো মুখের উপর না বলাতেই। কিন্তু কেন ও খেলবে না?

“ভাই, তোমার কী কিছু হয়েছে?”
ভাই বলায় ওর মুখ অন্য ধরণের হলো। চোখে পানি টলমল করছে। ওর এমনতর চাহনি দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে।

“আপু, আমার কিছু হয়নি। তবে ভাইয়ার হয়েছে।”
অয়নের কিছু হয়েছে শুনে বুকটা মোচড় দিলো। কেমন এক হাহাকারে আক্রান্ত হচ্ছে হৃদয়পট। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ” উনার কী হয়েছে?”উত্তরে নিয়ন বললো, জ্বর হয়েছে। প্রচুর! ডাক্তার দেখিয়েছি। ওষুধও ভাইয়া খাচ্ছে। কিন্তু এখনো জ্বর কমেনি। আমার খুব ভয় করছে আপু।”এই কথা বলেই কেঁদে দিলো। আমারও মন ব্যথিত হলো। কাছে টেনে চোখের জল মুছে বললাম, ধুর বোকা। কাঁদিস কেন! কিচ্ছু হবে না উনার।” এই কথা বললেও পরক্ষণে মনে হলো জ্বর কী করে হলো? যেই ভাবা সেই বলা। উত্তরে নিয়ন খানিক রাগ দেখিয়ে বললো, “সব দোষ ভাইয়ার। কত করে বললাম ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজো না। অসুখ হবে। উলটো আমাকে ধমক দিয়ে রোমান্টিক মুড নিয়ে হাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজলো। যত্তসব! আই হেট রেইন। উঠাতে শুধু অসুখ হয়। ”
নিয়নের কথায় হেসে বললাম,”নিয়ন বৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহর দান। এটাতে নিয়ামত থাকে। ঘৃণা করতে নেই ভাই।” এই কথা বলেই পুনরায় চলে গেলাম নিয়নের কথায়। এই নতুন বর্ষায় ভিজলেন কেন? তাও আবার রোমান্টিক মুড নিয়ে। অথচ আমি দেখেনি। মিস হয়ে গেল। ইশ আমি যদি বৃষ্টি হতাম।

তোমার জন্য আমি
বাদল দিনে ঝরা বৃষ্টি হতে চাই,
তুমি যখন,
বৃষ্টিস্নাত দিনে,
খোলা মাঠের প্রান্তরে
এক বুক ভালোবাসা নিয়ে
দু হাত মেলে বৃষ্টিকে আপন করে
ভিজবে মনের সুখে
তখন আমি আমার জন্মানো সার্থক মনে করে,
অঝোরে ঝরবো মেঘ জমানো সীমাহীন আকাশ থেকে।

মনে মনে নিজের ইচ্ছা নিয়ে কবিতা লিখে ফেললাম। শুধুমাত্র উনার জন্যই আমি বৃষ্টি হতে চাই।

“আপু কোথায় গেলেন?”
ওর কথায় ভাবনা জগত থেকে বের হয়ে মনে মনে প্রশ্ন উত্তর ভাবনা জগতে হলেও উত্তরে বললাম, “কোথাও না।” সময় হয়ে গেলো যাবার জন্য ব্যাগ নিলাম। নিয়ন শুধু চেয়ে আছে। বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। তাই তাড়া দিয়ে বললাম, আসি, ভাই। নিয়ন উড়না ধরে বললো,
” আপু আরেকটু থেকে যাও না।”
“বৃষ্টি হচ্ছে ভাই। পরে যেতে কষ্ট হবে। আসি কেমন!”
“আপু প্লিজ আরেকটু থেকে যাও না। ভাইটার কথা একটু রাখো।”
ভাই বলায় বুকের মধ্যে লাগলো। ভাই থাকলে নিশ্চয় এমন কাতর সুরে ডাকতো। তাই ওর কথায় ঘন্টা খানেক থাকলাম। কিন্তু বৃষ্টি কমার বদলে প্রচন্ড জোরে বাতাস দিয়ে প্রবল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে। যেতে পারবো। কারণ ব্যাগে ছাতা আছে। কিন্তু ও যেতে দেবে কী না? সেটাই এখন ভাববার বিষয়। বেজে গেল। নাহ এবার যেতেই হবে। খানিক পর তো আযান দিয়ে দিবে। সন্ধ্যার অন্ধাকার নেমে আসবে ধরণীর বুকে। তাই আর দেরী না করে বাইরে যাবার তাগাদা দিয়ে নিয়নকে বললাম, “আর নয় ভাই। আসি।”
বিছানায় বসা ছিলো এতক্ষণ। আমার কথা শুনে দৌড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“প্লিজ আপু যেও না। আমার খুব ভয় হচ্ছে। ভাইয়ার কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাবো। মৃত্যু নিয়ে আমি খুব ভয় পাই আপু। তুমি প্লিজ যেও না। ওরা এলে তুমি চলে যেও। ওরা এলে না হয় তোমাকে আমাদের গাড়ি দিয়ে পৌছে দিয়ে আসবো। এখন যেও না আপু।”।
ওর কথা শুনে ভারি অবাক হলাম। বুঝলাম অয়নের মৃত্যু হতে পারে ভেবে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। কিন্তু ওর মৃত্যু! এই কথা ভেবেই বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। নিয়নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। কিন্তু নিয়ন ওরা বলতে কাদের বুঝিয়েছে?এই ঝুম বৃষ্টিতে কারা আসবে?
“ভাই, ওরা বলতে তুমি কাদের বুঝিয়েছো?”

চলবে„„„„„

প্রয়োজন পর্ব: ২০

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২০
লেখায়:তানিয়া তানু

চার বছর শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রশ্ন করেছিলাম আমাকে কীভাবে চিনেন?
উত্তরে যা বললেন তা শুনে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়েছিলাম।

একটু শান্তস্বরে বলেছিলেন, “তোমাকে প্রথম দেখি তোমাদের স্কুলে জেএসসি পরীক্ষা ফলাফলের সময়। আমি কাছেই ছিলাম সেদিন। তুমিও এক পলক দেখেছিলে। কিন্তু সেদিন আমাদের পরিচয় হয়নি। তুমি টেনশনে ছিলে তোমার রেজাল্টের জন্য। আমি আর আকাশ বাইরে ছিলাম। তুমি নিলাকে নিয়ে একবার ক্লাসরুমে তো আরেকবার নোটিশবোর্ডের কাছে আসো। তোমার এই টেনশন দেখে মনে মনে অনেক হাসছিলাম। তারপর এলো তোমার বহু কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট। রেজাল্টে তোমার প্লাস এলো। তোমার সেই খুশি আর আনন্দ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মুচকি হাসিতে কিছুক্ষণ মেতে থাকলেও পরক্ষণে শব্দ করা হাসিতে মেতে ছিলে। তোমার সেই হাসির শব্দ আজো মনের মাঝে টুংটাং করে বাজে। যেটায় তোমার জন্য ভালোবাসায় পরিণত করেছিলো। তারপর তুমি আর কোনোদিন আমাকে দেখোনি। কারণ তোমার সামনে আমি আর যাইনি। আকাশ গেলেও আমি ব্যস্ত দেখিয়ে সেখান থেকে চলে এসে আড়ালে সারাক্ষণ তোমাকে দেখতাম। একদিন তুমি স্কুলে না আসায় প্রচন্ড কষ্টবোধ করছিলাম। দম বন্ধের মতো অস্বস্তিজনক অবস্থায় ছিলাম। পরে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম তোমায় ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। প্রাণভোমরা হয়ে গিয়েছিলে তুমি। প্রতিদিন লুকিয়ে তোমাকে দেখা নেশা হয়ে গিয়েছিলো। তাই তো তুমি স্কুলে না এলে তোমার বাসার পাশে নুরু মিয়ার দোকানে চা খেতে খেতে তোমার বাইরে আসা যাওয়া গণনা করি। একবার দেখলে তৃষ্ণা মেটে না। বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। দোকানে সারাক্ষণ বসে থাকি। অপেক্ষা করি কখন তুমি বাইরে আসবে? টিউশনি করে বাসায় ফিরবে। টিউশনিতে গেলে সেখানে পিছু নেই। তার পূর্বে খোঁজ নেই টিউশনির সদস্য সংখ্যা। তাদের কোনো খারাপ ব্যাকগ্রাউন্ড আছে কীনা? সেখানে ছেলেরা আছে কীনা? থাকলে তারা বিবাহিত তো? এগুলো না হলে প্রত্যেক টিউশনিতে আমার কনস্টেবল পাঠিয়ে তাদের মানা করে দেই। তোমার বাড়ির খোঁজও আমার এক মহিলা কনস্টেবল দিয়েছিলো। সে যাইহোক, তুমি বলবে তোমার মতো মধ্যবিত্ত মেয়েকে কেন পছন্দ করেছি? তার উত্তরে বলবো,তোমার হাসি, তোমার চাঞ্চল্যতা, তোমার চোখের শাসন এগুলোই ছিলো আমার ভালোবাসার মূল উপাদান। এগুলো থেকে বড় উপাদান ছিলো তুমি খুব সহজে মিশতে পারতে। তুমি সব ভালোবাসাকেই যথেষ্ট মর্যাদা দিতে। ছেলেদের দিকে কোনো আকর্ষণ ছিলো না। তাই পরকীয়া নিয়ে ভয় ছিলো না। কারণ আজকাল অনেক কেস আসে যেগুলোতে স্ত্রী পরকীয়া করে স্বামীকে খুন করেছে বা বাচ্চা রেখে পালিয়ে গেছে অন্য পুরুষের হাত ধরে। এগুলো দেখে মন সারাক্ষণ ব্যথিত হতো। তোমায় দেখে ভরসা করার মতো জায়গা পেয়েছিলাম।তোমার আচরণ দেখে বুঝেছিলাম তুমি ঐরকম মেয়ে হবে না। এই কারণে খুব বেশি করে ভালোবেসেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার একলা দেশের সঙ্গী হিসেবে তুমিই উপযুক্ত। আমি সঙ্গী নির্বাচনে বেশ সতর্ক থেকেছিলাম। কলেজ লাইফে কারোর দিকে তেমন নজরে তাকায়নি। কারণ আমার একলা দেশে যে সঙ্গী হবে সে হবে আমার একমাত্র সুখী থাকার কারণ। তোমায় আমি সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বেছে নেওয়াটা ভুল ছিলো।”

নির্বাক শ্রোতা হিসেবে প্রত্যেক কথাই মনোযোগ সহাকারে শুনছি। এত বছর ধরে উনি আমায় ভালোবাসেন। আমাকে আড়ালে দেখেন। তার সাথে টিউশনিও। তার জন্যই তো বলি, টিউশনি কেন এভাবে হাতছাড়া হচ্ছে। পিছনে যে উনি খেলার দান চালছেন সেটা তো জানা ছিলো না।কিন্তু একটা বিষয়ে ভাবালো, আমাকে এত বছর ধরে এত ভালোবাসেন। তাহলে বললেন না কেন? যেই ভাবা সেই উনাকে বলা। তাই উনাকে বললাম,

“ছেলেরা তো কাউকে ভালোবাসলে ঠাস করে বলে দেয়। যেমনটা আমি ছোট থেকেই দেখে আসছি। আপনি কেন বললেন না?

“ঐ যে তুই বললি না মধ্যবিত্ত মেয়েদের কেউ ভালোবাসে না। এর জন্যই বলি না। তরে প্রস্তাব সেদিন দিলে তো তুই তোর ক্লাসমেট শাওনের সাথে আমাকে তুলনা করতি। তারপর শাওনের মতো আমাকেও আকাশ ভুল বুঝে স্টিক দিয়ে মারতো।”

উনার তুই-তুকারি ভাষায় বেজায় মন খারাপ হলো। ভালোই তো তুমি করে বলছিলেন। তুই তে কেন নামলেন? উনার কী তবে রাগ বেড়েছে আবার? সে যাইহোক, শাওন আমার ক্লাসমেট। ক্লাস নাইনে ও আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলি। যেদিন প্রস্তাব দিয়েছিলো সেদিনের পরদিন আকাশ ভাইয়া কী মারটাই না মারলো! ভাইয়াকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন, “তুই বেশ ছোট। তোরে ক্যান প্রস্তাব দিবো। শুন, কেউ তোরে ডিস্টার্ব করলে আমায় বলবি।” সেদিন মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলে চলে এসেছিলাম।

শাড়ি থেকে লেগে থাকা বালু ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়ালাম। বিরক্তি না থাকলেও উনার কাছ থেকে আরো কিছু জানার আছে। তাই কৌতূহলী হয়ে অপেক্ষায় আছি কখন প্রশ্ন করার সুযোগ পাবো। কারণ এইবারো উনি মাথায় হাত দিয়ে চুল টান দিচ্ছেন। বুঝা যাচ্ছে বেশ রেগে আছেন।

চুল থেকে হাত সরিয়ে আচমকা আমার কাছে এসে গলা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল হারখানা। ব্যথায় আহ করে উঠলেও নিজে সেটাকে পাত্তা দিলাম না। ব্যথা সরিয়ে উনার এহেন কার্যে ভারি অবাক হলাম। হারখানা নিয়ে যেতে যেতে বললেন, “নিকৃষ্ট মনের অযোগ্য মানুষকে উপহার বস্তু মানায় না।”
এতক্ষণ নির্বাক থাকলেও এখন থাকতে না পেরে কিছু বলতে চাইলে দেখলাম তিনি চোখের আড়াল হয়ে গেছেন। মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এই কাজটা উনি কেন করলেন? এমনভাবে বললেন যেন এটা উনি দিয়েছেন। আচ্ছা উনি সেই শুভাকাঙ্ক্ষী নয় তো?

“দীপ্তি, তুই এখানে?”
আকাশ ভাইয়ার কথা সহুনে হাতের তালু দিয়ে চোখে জল মুছে নিলাম। নিয়িনের ভাইয়ের প্রত্যেক কথাই বুকের মধ্যে তীরের মতো বিঁধছিলো। তাই না চাইতেও জলগুলো উপচে পড়লো গন্ডদেশ বেয়ে।

“ভাইয়া আমাদের দুবোনকে এই মূহুর্তে তোমার কার দিয়ে বাড়িতে পৌছে দিতে পারবে।” এখানে এক মূহুর্তও থাকতে ইচ্ছুক নই। বড্ড অস্বস্তিতে ভুগছি। খুব কষ্টও হচ্ছে।

“এত রাত্রে তুই কেন যেতে চাচ্ছিস? কোনো সমস্যা হয়েছে কী?”

“আমি খুব অসুস্থবোধ করছি।”

“বাসায় কেন ডাক্তারের কাছে যাবি, চল?”

ভাইয়ার প্রশ্নে বিরক্তি হয়ে বললাম,”প্লিজ বাসায় ড্রপ করে দিবা কী না বলো। না হলে আমরা নিজেরাই যেতে পারবো।”
এই বলে সেখান থেকে চলে আসলে ভাইয়া বলেন সে আমাদের ড্রপ করে দিবে।

বেবলি অনেকবার জিজ্ঞেস করলো কেম চলে যাচ্ছি। বৌভাতে কী আমরা আসবো। উত্তরে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। তবে এই বাড়িতে আর আসবো না এইটা নিশ্চিত।

গাড়ি থেকে নেমেই ভাইয়াকে টাকা দিলাম। বলে আসলাম আর কোনোদিন যাতে আমাদের টাকা না দেন। আমাদের থেকে আরো গরীব মানুষ আছে। তাদের যাকাত হিসেবে দিলে বেটার হবে। টাকা নিতে চাইলেন না। কিন্তু সিটে রেখে এলাম। অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার চোখ রাঙানো দেখে মুখে কুলুপ আটলেন।

“দীপ্তি তুই খাবি না?”
দীর্ঘ ভাবনায় হুঁশ এলো মায়ের কথায়। আমাদের রুমের মোমবাতি ফুরিয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে এতক্ষণ অতীতে বিচরণ করছিলাম। মায়ের হাতে মোমবাতি এনে বললাম, “এখন আর খাবো না।”
“খাবি না কেন? আয়।”
“জেদ ধরো না মা। যাও তো।” বিরক্তিকরভাব নিয়ে মাকে এই কথা বললাম।
“আচ্ছা যাচ্ছি। দে বাতি দে।”
“এটা আমার দরকার আছে।” বলেই মাকে তাড়া দিলাম চলে যাওয়ার জন্য। তিনিও চলে গেলেন।

অন্ধকারে ক্ষীণ আলোয় চারপাশে সব কিছুর অবস্থান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি বস্তু নয় মানুষ দেখছি। তার গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাসি দিলে গালে টুল পড়া দৃশ্য। বার বার দেখায় ভালো লাগলেও বড্ড অস্বস্তিতে পড়ছি। তাই জানালা দিয়ে অন্ধকারে থাকা কালো আকাশটাকে দেখছি। কিন্তু আফসোস! সেখানেও দেখা যাচ্ছে সেই মানুষটিকে। অসহ্যকর ভাব নিয়ে বিছানায় এসে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ দিলে হৃদয়পটে তার হাসিমাখা মুখ, চশমা ঠিক করার দৃশ্য, বার বার চুলে হাত দিয়ে চুল ঠিক করা দৃশ্য ভেসে উঠছে। খুব জ্বালাতন করছে এই বিষয়গুলো। মানুষটাকে মনে করলেই বুকের ভেতর হাহাকার শুরু হচ্ছে। নদীর মতো উতাল পাতাল ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে মন। কী করে অয়নকে দূরে সরাবো? কয়েদিন না দেখে খুব করে জ্বালাচ্ছে। হৃদয়ে অনুভব করছি শূন্যতার জ্বালা।

এসব থেকে মুক্তি পেতে আলমারি থেকে একটা ব্যাগ বের করলাম। এই ব্যাগে অনেক জিনিস আছে। সবই শুভাকাঙ্ক্ষীর দেওয়া। সাজিয়ে রাখলে মায়ের চোখে পড়তে পারে তাই ভেবে আলামারিতে সযত্নে তুকে রেখেছিলাম। আজ বহুদিন পর ব্যাগ খুললাম। শেষবার শুভাকাঙ্ক্ষীর দেওয়া গিফট ছিলো শুধুমাত্র একটা চিঠি। ঐ চিঠিতে সে উল্লেখ করেছে ওর দেওয়া কোনো গিফটই আমি আজ পর্যন্ত ব্যবহার করিনি। ভেবেছিলো একবার না একবার আমি ব্যবহার করবো। তাই দিনের পর সিন সে কানের দুলের মতো ছোট বস্তু থেকেও শাড়ি পর্যন্ত গিফট করেছে। কিন্তু আমি একটাও ব্যবহার করিনি। এতেই সে ক্ষিপ্ত হয়েছে। চিঠিতে বলে দিয়েছে একদিন পূর্ণ অধিকার নিয়ে চাইবে তার দেওয়া জিনিসগুলো পড়ি। সে সময় নাকি তার কথা ফেরাতে পারবো না।

একটার পর একটা জিনিস খুলে উলটে পালটে দেখলাম। বেশ দামী উপহারই দিয়েছলো।দেখতে দেখতে চোখে ঘুম তলিয়ে এলো। তাই আবারো সযত্নে আলমারিতে তোলে রাখলাম।

চলবে,,,,,,,,,
বিঃদ্রঃ কেমন চলছে এই গল্পটা। জানাবেন প্লিজ। এতে ভীষণ অনুপ্রাণিত হবো।

প্রয়োজন পর্বঃ ১৯

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ১৯
লেখায়ঃ তানিয়া তানু

বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।আবার ঝড় যেন সহযোগে এসে হানা দিয়েছে এই দেশে। বার বার আকাশ গর্জে ওঠায় আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠিছে। বৃষ্টির গতিবেগ দক্ষিণ দিকে হওয়ায় জানালা দিয়ে তেড়ে এসে পড়ছে। তাই জানালার কপাট লাগাতে গেলে এক পশলা বৃষ্টি এসে ছুঁয়ে দিয়েছে আমায়। শিউরে উঠলাম। ঠিক যেমনভাবে নিয়িনের ভাইয়ের ছোঁয়ায় উঠেছিলাম।

“আপা, তুই তো ভিজে যাচ্ছিস!
সম্বিত ফিরে এলো বেবলির কথায়। উড়না দিয়ে পুরো মুখ মুছে বসলাম বিছানায়।এই ঘুটঘুটে অন্ধাকরময় পরিবেশে বন্ধ ঘরে বসে আছি বেবলি ও আমি। দুইজনই অপেক্ষায় আছি মোমবাতি নিয়ে মা কখন আসবে? বাবাও এখনো আসেননি। সেই দুপুরে বের হয়েছিলেম। বৃষ্টির কারণে এখন মনে হয় এই রাত্রেই কোনো ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছেন।

“আমার হয়েছে এক মরণ জ্বালা। কবে যে মরবো তার ঠিক ঠিকানা নেই।”
আচমকা মায়ের আগমণ আর কথায় নজর পড়ে মায়ের দিকে। তিনি মোমবাতি টেবিলে রেখে বিরক্তিকরভাব নিয়ে কথাগুলো বলছেন। কিন্তু পূর্বে তো ভালোই ছিলেন। হঠাৎ করে কী হলো।

“কে কী করেছে? কিছু হয়েছে কী?”
আমি প্রশ্ন করার পূর্বে বেবলি আমার বলতে চাওয়া কথাটাই বললো।
বেবলির এমন প্রশ্ন শুনে বিরক্তি আর রাগ নিয়ে মা বললেন,
“যা করবার আছে সে তো তো তোদের বুইড়া বাপই করছে।”

“কেন? বাবা কী করেছে?”
“এই ঝড়মুখো বৃষ্টির দিনে তোদের বাপ এক দল অসুখ নিয়ে এসেছে। জ্বর তো মাঝরাত্রে আইবো। এখন দেখ, বুকে নাকি ব্যথা। আবার মাঝে কয়েকটা কাশিও দিচ্ছে। এই নতুন বর্ষায় ভিজলে তো জ্বর আইবোই। ”

মায়ের কথা শুনেই দুই বোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। উদ্বিগ্নের ভাঁজ দুজনের কপালে।

“বুকে তেল মালিশ করার জন্যই তো এত্ত দেরী অইলো। শুন,মোমবাতি তো একটাই। শেষ অইবার আগে খাইয়ালো তোরা।”
“এখন না পরে খাবো।”
“বাতি শেষ অইলে। দেখবনে কেমনে খাছ তোরা।” এই কথা বলেই রাগ করে।চলে গেলেন। কিছুটা ক্ষোভও মিশ্রিত ছিলো।

ঝরঝর বৃষ্টিতে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় সারা দেহে প্রানের সঞ্চার করে। তাই তো মুগ্ধ হয়ে শব্দ শুনার জন্য কান পেতে আছি।

“আপা, আয়, খেয়ে ফেলি।” বেবলির কথায় মনে হলো ও খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু আমার তো এখন খেতে ভালোই লাগছে না। তাই বললাম,
“তুই গিয়ে খেয়ে আয়। আমি পরে খাবো।”
“আপা আয় না। দেখ,বাতিও তো ফুরিয়ে যাচ্ছে”
“বললাম তো পরে খাবো। তুই যা।”
রাগ নিয়ে সেও হনহন করে ছুটলো রান্নাঘরের দিকে।

খানিক পর বেবলি খেয়ে এসে সটান গা বিছানায় এলিয়ে ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। কিন্তু আমি সেই এক ধ্যানে বৃষ্টিকে মুগ্ধ হয়ে দেখছি। তবে এখন আর বৃষ্টি প্রবল নয়। তাই জানালা খুলে দৃষ্টি দিলাম নীলক্ষা নীল আকাশে। অন্ধকারময় আকাশে মাঝে বিজলির দাগ কাটা আলোয় এক ধরণের ভয় সৃষ্টি করছে। আকাশ দেখে মনে হলো আকাশের আজো মন খারাপ। আকাশ মন খারাপেই সুন্দর। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে তার সৌন্দর্য্য দেখতে পারছি না। মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে পারছি না দৃষ্টিপাত করতে। মেঘের মন খারাপ মনে হতেই বাতি নিয়ে চলে গেলাম আয়নার কাছে। নিজের মুখে বাতির আলো দিয়ে দেখতে লাগলাম পুরো মুখ। আমায় নাকি মেঘের মতো মন খারাপেই সুন্দর লাগে। কিন্তু আয়নার নিজের সৌন্দর্য ঠাওর করতে পারলাম না। যদি তুলনা করার জন্য পাশে কেউ থাকতো তবে বেশ পারতাম। ওর মন খারাপের সাথে আমার মন খারাপের তুলনা করতাম। নিয়নের ভাইয়ের বলা আরেকটা কথা মনে হলো। আমার হাসি বুঝি ভারি সুন্দর? তাই এই অন্ধকারময় ক্ষীন আলোর পরিবেশে না চাইতেও জোর করে একটা হাসি দিলাম। দেখতে চাইলাম কেমন সুন্দর সে। কিন্তু আমার কাছে নিচক বিদঘুটে হাসি ছাড়া কিছুই বোধগম্য হলো না। আচমকা নিজের অজান্তে হাত চলে গেল গালে। এই গালেই তো সেদিন উনি,,! ইশ ভাবতে পারছি না। ভাবলেই কষ্ট হয়। তাই মন খারাপের গল্প নিয়ে আবারো জানালায় মাথা রাখলাম। এক চিন্তায় চিন্তিত হলে আরো হাজার চিন্তা ভিড় জমায়। তেমনি সেদিনের ঘটনা খুব করে মনে পড়ছে স্মৃতি নামক হৃদয়পটে।

আমি ফাঁদের কথা বলার পর উনি আর কিছুই বলেননি। বার বার এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। বুঝলাম না এদিক সেদিক তাকানোর কী আছে! আমি যেটা ভাবছি সেটা নয় তো! ইয়া আল্লাহ! রক্ষা করো তোমার এই পাপী বান্দীকে!

আচমকা গাড়ির ছাড়ার শব্দ শুনলাম। ছাদ থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলাম বরযাত্রী চলে যাচ্ছে। হায় কপাল! নিলাও তাহলে চলে গেল। একবারও কী আমার খোঁজ নেয়নি। খুব কষ্ট হচ্ছে। একমাত্র বান্ধুবিকেও বুকে জড়িয়ে কেঁদে বিদায় দিতে পারিনি। ভাবলেই কষ্টগুলো কান্নায় পরিণত হচ্ছে।

“দীপ্তি, আমি কেন তোমায় ফাঁদে ফেলবো? বলতে পারো?

কথার মালা উনি যেন খুঁজে পেলেন। তাই আচমকা আর এই কষ্টের সময়ই এই কথাটা উনি বললেন। কিন্তু একদিকে বান্ধুবি চলে যাওয়ায় কষ্ট আর অন্যদিকে এতক্ষণ বন্ধী থাকায় বিরক্তিভাব। দুটোর সংমিশ্রণে আমার ভিতরে ক্রোধ জন্মালো। ক্রোধের সহিত বললাম,

“কিসের জন্য বুঝতে পারছেন না? এত পিচ্চি সাজেন কেন?”

“সরি?”
সরি বলায় ক্রাধের আগুনে যেন ঘি ঢালা হলো। তাই তেজও বাড়লো। সেই পূর্ণ তেজ নিয়েই বললাম
“ফাঁদে পেলে আপনি যে আমাকে ভোগ করতে চাইছেন। এটা আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি। কিন্তু কান খুলে শুনে রাখুন, আমি কখনোই আপনার পাতানো ফাঁদে পা দিবো না। আর ভালোবাসা তো তিনশ হাত দূরে। পথ ছাড়ুন।”

আবারো আটকালে পুরো ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। উনি বার বার বলছেন যে আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু এগুলো শুনতে ইচ্ছুক নই। তাই চলে যেতে চাইছি।কিন্তু উনিও আমাকে যেতে দিবেন না। আর আমিও এই মূহুর্তেই চাওয়ায় জন্য ইচ্ছুক। দম বন্ধ হয়ে আসছে। যতই খোলা আকাশের নিচে হোক। বিরক্তিভাব যেখানে থাকে সেখানে শ্বাসরুদ্ধ একটা ভাবও থাকে। উনি আমাকে দুই হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা চালালে চিল্লিয়ে বললাম,
“এত ভালোবাসা ভালোবাসা কেন করছেন? আমার মতো মধ্যবিত্ত মেয়ের কাছে কী এমন আছে?শুধুমাত্র এই শরীর ছাড়া। সেটাই তো আপনি চাইছেন। তো এত ভালোবাসার অভিনয় কেন করছেন? প্রেমের অভিনয় করে আমার সম্পদ নষ্ট করে বিয়ে না করলেও আমি কিছুই করতে পারবো না। কারণ আপনি পুলিশ। আপনার ক্ষমতা অনেক। তো এখানেই শুরু করুন না। ভোগই যখন মূল।

আচমকা মাথা যেন ঘুরে গেল। প্রচন্ড জ্বালা অনুভব করলাম গালে। নিচে পড়ে আছি আমি। তাও গালে হাত দিয়ে। বুঝতে পারলাম পুরুষালী হাতে আমার গালে চড় পড়েছে।

“তুই না ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই না। শুধু আমার নয়। কোনো পুরুষজাতির ভালোবাসার যোগ্য তুই না। আর হ্যাঁ, তোর ভাবনা চিন্তা যে এত নিম্নমানের তা পূর্বে জানলে কখনোই ভালোবাসতাম না। চিন্তা দ্বারা পালটা নয়তো ছেলে পাবি না।”

উনার এমন ব্যবহারে আমি যারপরনাই অবাক। এত অপমান! অঝোরে মেঘ জমানো চোখ থেকে বৃষ্ট পড়ছে। কিন্তু তাতে উনার ভ্রুক্ষেপ নেই। উনি তো তুই তুকারি করতেই আছে।

“আর হ্যাঁ, তুই বলছিলি না দুদিনের ভালোবাসা। এটা দুদিনের ছিলো না। চার চারটা বছরের জমানো সমস্ত ভালোবাসা ছিলো। ভেবেছিলাম নিলার বিয়ে হয়ে গেলে তোকেও বিয়ের প্রস্তাব দিবো। আমার জমানো সমস্ত ভালোবাসা তোকে উজার করে দিবো। কিন্তু আফসোস! তুই আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই হলি না।”

“চার বছরের ভালোবাসা মানে? কীভাবে চিনেন আমায়? আমি তো আপনাকে কোনোদিন দেখি নাই?

চলবে,,,,,,,,,,,,

প্রয়োজন পর্বঃ ১৮

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ১৮

পরক্ষণে মনে মনে ভাবলাম মানুষ তো সামনে অনেক। তারা আমার দিকে কেমন তরে তাকিয়ে আছে তা দেখার জন্য মাথা উঁচু করতেই প্রথমে চোখের সামনে ভেসে উঠলো মেয়েদের জটলার মধ্যে কেন্দ্রবিন্দু নিয়নের ভাইয়ের দিকে। অপলক চাহনিতে চেয়ে আছে। তবে এমনভাবে তাকানোর কী আছে সেটা ভাবে পেলাম না!সিঁড়ি দিয়ে নামার প্রতিটি পদেই একবার করে আড়চোখে দেখতে লাগলাম উনাকেও। এখনো একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। অদ্ভুত!

বরযাত্রী এলো বলে সবাই চলে গেল গেইটে। মূলত সেখানে গেইট অবরুদ্ধ করবে মেয়েরা। পূর্বে এগুলোতে বেশ ভালো লাগলো। দুষ্টুমিপূর্ণ ছেলেদের কথায় প্রচুর হাসতাম। কিন্তু নিউজ পেপারের এক কনটেন্ট পড়ে এগুলো থেকে নিজেকে দূরে সরে রেখেছি। কারণ বিয়ের মতো এমন সমাগম জায়গায় বিভিন্ন সম্পর্কের রেশ ধরে এক ধরণের ছেলেরা নতুন সম্পর্ক তৈরি করে। সেই সম্পর্কতে খাঁটি কিছু সম্পর্ক থাকলেও বেশিরভাগই নকল সম্পর্ক। পরবর্তীতে এর কারণে অনেক মেয়েরা এমনতর ছেলেদের পাল্লায় পড়ে তাদের মূল্যবান সম্পদ বলি দিয়ে ফেলছে। সমাজে এখন সেই নিকৃষ্ট ছেলেদের বদলে মেয়েরা হয়েছে শতদিক দিয়ে দোষী। যাইহোক, বর এসেছে শুনে বেবলিকে বললাম উপরে চলে যেতে। মুখ ভ্যাংচি দিয়ে গাল-মুখ ফুলিয়ে ড্যাংড্যাং করে চলে গেল। মূলত সে উপরে যেতে নারাজ। তার মর্জি ছিলো ঐ আড্ডাখানায় যেতে। বাঁধা দেওয়াতে এমনতর কাজ করলো।

“চলে যাচ্ছেন যে? যাবেন না বর দেখতে? বেবলির পিছন পিছন আমিও চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু উনার কথায় থেমে গেলাম। আচ্ছা উনি কেন আমার কাছে এলেন? বেশ তো ভালো ছিলেন এক ঝাঁক মেয়েদের মাঝে। খোশগল্পে ব্যস্ত ছিলেন।

“ওগুলো আমার অপছন্দের বিষয়। আর বরকে তো সব সময়ই দেখতে পারবো। এত ভীড়ে এই মূহুর্তে দেখার প্রয়োজনবোধ করছি না।” এক ধরনের ভাব নিয়েই কথাটা বললাম।

“আপনাকে আজ ভারি সুন্দর লাগছে। বিশেষ করে হারটায়।”
কথার মোড় ঘুরানোর জন্যই মনে হলো এই কথা বললেন। তবে প্রশংসা কিছুটা পাওয়ায় লজ্জায় কুণ্ঠিত হলাম। কিন্তু গলার হারকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় বললাম,

“সুন্দর তো লাগবেই। প্রিয়জন দিয়েছে বলে কথা। শুভাকাঙ্ক্ষী তো আর অপ্রিয় নয়। প্রিয় হিসেবেই তাকে উপস্থাপন করলাম।

“কে সেই প্রিয়জন?”
আহারে! এই প্রিয়জন কে সেটাতো আমি নিজেও জানি না। কিন্তু লোকটার বলার ভঙ্গি দেখে মনে খুব হাসলাম। কারণ অসহায় হয়ে বলছে। মনে হচ্ছে প্রিয়জনের নাম শুনেই সে ভেঙে পড়ে যাবে। এই লুচুটা যাতে আমার সাথে অসভ্যতা করতে না পারে তার জন্য বললাম,
“আমার প্রিয়জন, আমার উনি, আমার হবু স্বামী! ”
হবু স্বামী শুনেই উনার চোখ কুঠরি থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম চলছে। ভীষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। কিন্তু আমার মনে শান্তি এলো। এখন আর এই লোকটা লুচ্চামী করতে পারবে না।

“বাই দ্য ওয়ে, আমি কিন্তু হবু স্বামীকে দেখার অপেক্ষায় আছি ।”
কোনো কিছু বলছেন না দেখে উপরে চলে আসছিলাম। কিন্তু পিছনে উনার কথা শুনে একটু থমকে গিয়ে আচ্ছা বলে চলে আসলাম। তবে মনে মনে আমিও অপেক্ষায় আছি।

কাজী সাহেব নিলাকে বার বার বলছেন তুমি কী রাজি মা? রাজি হলে কবুল বলো। কিন্তু নিলা সেই যে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলো। এখনোও খুলছে না। আমি সহ্য করতে না পেরে বললাম,
“তুই যদি না বলিস তবে আমি বলে দিবো।”
জোরে পেটে চিমটি দিয়ে বলার জন্য আহ করে শব্দ করে উঠলো কাজী ভেবে নিলো নিলা হ্যাঁ বলেছে। কিন্তু আমি থামিয়ে বললাম এখনো সে বলে নাই। কাজী হতাশ হয়ে নাকের ডগায় আসা চশমা আবারো চোখে দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে অপেক্ষায় করলো।
আবারো নিলাকে চিমটি দিতে গেলে হাত বাঁধা দিয়ে আস্তে আস্তে বললো, “এত তাড়াতাড়ি বলে দিলে বলবে মেয়ে বিয়ের জন্য পাগলা। তাই তো এমন দেরী করছি। বুঝস না ক্যান।”
ওর এই কথা শুনে আমি যারপরনাই অবাক। তাই বলে এত দেরী!

বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে নিলা কবুল বললো। কাজীর মুখেও হাসি ফুঁটলো। আমিও এক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিলা এখন অন্যের ঘরে যাবে। সংসারে ব্যস্ত থাকবে। কাজের পাহাড়ে দেখা করতে পারবে না। ফুচকার দোকানে ফুচকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলবে না। নান্টু দোকানিকে বউ পাগলা বলে চ্যাঁতানো যাবে না। এইভেবেই কষ্টের রাজা চলে আমার আমার রাজ্যে। কোনো এক নির্জন জায়গায় একাকী থেকে বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলবার জন্য মনে মনে জায়গা খুঁজলাম। পরক্ষণে ভাবনায় এলো সবাই এখন বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। ছাদে কেউ যাবে না। তাই সেখানে যেতে চাইলে শাড়ির আঁচল দিয়ে আটকায় নিলা। ওর চোখের কান্নার আভাস। ইশারায় এখান থেকে যেতে না বলছে। কিন্তু আমার তো যেতেই হবে। নাহলে ওর কান্না দেখে আমিও বেশ কাঁদবো। তাই একটু পর আসছি বলেই আঁচল টেনে চলে গেলাম ছাদে। কেউ নেই সেখানে। একলা আকাশে প্রচুর কথা ভাগ করা যাবে।

অনেকক্ষণ কাঁদার পর চলে যেতে চাইলে কারোর হ্যাচকা টানে দেয়ালে লাগিয়ে শরীর চাপ অনুভব করলাম। মাথার তোলে তাকিয়ে দেখলাম আবারো নিয়নের ভাই। উফ, অসহ্য। এই লোকটা এমন কেন?বার বার শুধু উনার দিকে টানে। যত্তসব লুচ্চামী!

“নিলার জন্য কাঁদছিলে বুঝি?দুহাত গালে দিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো।
আবেগের বশে লোকটার স্পর্শে নিজ অজান্তেই চোখ বন্ধ করে দিলাম।
“সব মেয়েদেরই বিয়ে হয়। তাই কাঁদতে নেই। কেঁদো না। দোয়া করো নিলা যাতে সুখী হয়।”
লোকটার কথা শুনে অবাক। একবার আপনি তো আরেকবার তুমি। দুই বেলায় দুই রকম মুড নিয়ে যেন আমার সাথে কথা বলে।

“আপনার মতলবটা কী বলুন তো? কোন অধিকারে এভাবে স্পর্শ করে কথা বলছেন?” হাত সরিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললাম।

“মতলব কিছু নেই। আবার আছেও। অধিকার চাওয়ার জন্যই এই মূহুর্তে এখানে আসার কারণ।” এক হাত দেয়ালে ঠেকিয়ে বললেন।

উনার প্যাঁচানো কথায় কিছুই বোধগম্য হলো না। তবে রাগ দেখিয়ে বললাম,
“আচ্ছা আন্টি ও নিলার কাজিনরাও কাঁদছে। যান না ওদের গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছে দিয়ে ঐ কথাগুলো বলুন। এখানে কেন এসেছেন? কোন সম্পর্কের রেশ ধরে এসেছেন?”

“সব মেয়েদের সাথে তোমার তুলনা করবে না, দীপ্তি। তুমি ও ওরা এক নয়। ওদের সাথে তো তেমন সম্পর্ক নেই আমার।”

“ও আমার সাথে আছে বুঝি। একজন টিউটর আর স্টুডেন্টের বড় ভাইয়ের সম্পর্কে এমন হয় বুঝি? আজব!”

“আমি এই সম্পর্কের নতুন নাম দিতে এসেছি।”

“সম্পর্কের নাম! তা কী শুনি?” একটু টিজ করেই কথাটা বললাম।
“দীপ্তি, আমি তোমাকে চাই।”
“কীহ? এটা কেমন ধারার কথা। আপনি আমাকে চান মানে?”
খানিক আমতা আমতা করতে লাগলো। মনে হলো কথাগুলো সাজাতে পারছে না। হা হুতাশ করে পাঞ্জাবির বোতাম কয়েকটা খুলে দিলো। কিন্তু ঠান্ডা পরিবেশে এই লোকের এমন অবস্থা দেখে মনে হলো লোকটা গ্রীষ্মের খরতাপে ভুগছে।

“দীপ্তি, আমি তোমাকে ভালোবাসি।” অনেক্ষণ এদিক সেদিন চেয়ে বেফাঁস বলে দিলো। এই কথা শুনে অবাক হলাম না। কারণ কয়েকদিনের অসভ্যতায় বুঝিতে পেরেছিলাম। তাই ভেবেছিলাম এড়িয়ে যাবো। এখন ঠিক সেটাই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হাত দিয়ে পথ রোধ করে বললো,
“আমার উত্তর কোথায়?”
“প্রশ্ন করছিলেন বুঝি?”
“প্রশ্ন নয়। আমি তোমার কাছ থেকে মতামত শুনতে চাচ্ছি।”
“যদি মতামত শুনতে চান তবে বলবো এতে আমার ঘোর আপত্তি। তাই অনর্থক কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। পথ ছাড়ুন।”( চোখে রাঙিয়ে)

“এভাবে কী করে মতামত দেওয়া হয়। তুমি না হয় ভাবো। আমার সম্পর্কে খোঁজ নাও। কিন্তু প্লিজ ওভাবে ছেড়ে দিয়ো না। আমি যে তোমায় ভীষণ ভালোবাসি। হয়তো তোমাকে ছাড়া বাঁচত পারবো কিন্তু আমার জীবন যে তোমায় ছাড়া ছন্দহীন কবিতার মতো হয়ে যাবে।”

“কী অবলীলায় আপনি বলে দিলেন ভালোবাসি। অথচ খেয়াল করে দেখুন আমাদের পরিচয় দুদিনে। এই দুদিনে ভালোবাসা নয় ভালোলাগা হতে পারে।”
“দীপ্তি আমি দুদিন ধরে তোমায় ভালোবাসিনি।”
“দুদিন নয়! আজব তো! এটাতো কথায় কথায় বললাম। গুণে দেখতে গেলে ১৫ দিনের মতো হবে। এই এতটুকু পরিচয়ে ভালোলাবাসা নয় ভালোলাগা হয়। আর এই দুটোতে না বিস্তার তফাৎ।”

কিছুক্ষণ মাথার উপর বিশাল ছাদের দিকে তাকিয়ে বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“দীপ্তি, তোমার আর আমার বয়সের কয়েক বছরের পার্থক্য। এই পৃথিবীর অনেকাংশ আচরণ আমার জানা। তো কোনটা ভালো লাগা আর ভালোবাসা সেটা আমার খুব করেই বুঝতে পারি। তাই তোমায় ভালোলাগা,,,,,

পুরো কথা না শুনেই চলে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু আবারো হ্যাচকা টানে নিয়ে গেলেন উনার বুকে। কেমন এক অদ্ভুত ফিলিংসের মাঝে আছি। তা নিজেও বুঝতে পারছি না। একদিক দিয়ে রাগে পুরো শরীর জ্বলছে। অন্যদিকে এগুলো কথায় কর্ণপাত করতে না চাইলেও সেদিকেই মন চলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেক কথাই আমার কাছে ছলে ভুলানো মিষ্টি কথা মনে হলো। তাই রাগত কন্ঠে পূর্ণ শক্তি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় বলতে লাগলাম,
“ছাড়ুন আমায়। এই লুচ্চামী আমার সাথে নয়। অন্য মেয়ের সাথে করুন। যে আপনার ফাঁদে সহজেই পা দিতে পারবে।”

“আমার ভালোবাসায় ফাঁদ কোথায় দেখলে?”
“এখানে ভালোবাসা ছিলো কোন সময়। এতক্ষণ তো জোরাজুরিতে ব্যস্ত ছিলেন। আমাকে মিষ্টি কথায় ভুলানো হচ্ছে তো। কিন্তু আমি বোকা নই। কখনো আপনার ফাঁদে পা দিবো না।”

চলবে„„„„„

প্রয়োজন পর্বঃ ১৭

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ১৭
লেখায়ঃ তানিয়া তানু

সারাদিন আমেজপূর্ণ হয়েই কাটলো।দিনে বিয়ে বাড়িতে কৃত্রিম আলো না থাকায় ঝলমল না করলেও অতিথিদের আনাগোনায় উজ্জ্বলিত করলো পরিবেশটাকে। সারাদিন নিলার সাথেই কাটিয়েছি। প্রথমে ভয় ছিলো না জানি কী পরিমাণ রাগ করবে? কিন্তু সময়ের পালায় সেই রাগ গলে গেল। চলে যাবে বলে অনেক্ষণ কাঁদলো। আর আমিও যে কাঁদেনি। তা কিন্তু নয়! এতদিনের বন্ধুত্বের মধ্যে আজ প্রথম এত বড় বিচ্ছেদ। দুই মেরুতে বাস করবো আমরা দুই বান্ধুবি। এই ভেবে মনের মাঝে চাপা কষ্ট অনুভব করছিলাম। মনে যেন ভারী এক পাথর বসানো হয়েছে।

বেবলি তো সারাদিন নিয়নের সাথে দুষ্টুমিতে মেতে ছিলো। দুইজনই এক সাথে সারাক্ষণ এদিক সেদিন ঘুরলো। ওদের দেখে মনে হলো ওরা বেশ পরিচিত। আচমকা বিকেল বেলায় নিয়ন ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসি দিয়ে বললো,”আপু একটা কথা বলি।”
হঠাৎ করে এখানে তাও আবার আমার কাছে ওর আগমণে বেশ সন্দেহ লাগলো। বিশেষ করে ওর অনুমতি চাওয়ার এমন ভঙ্গি দেখে। কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে স্মিতহাস্যে বলতে বললাম।

“আপু ঐ যে নীল সালোয়ার কামিজ পড়া মেয়েটা কী আপনার বোন?”
আমার জানা মতে ও পূর্ব থেকেই জানতো বেবলি আমার বোন। কারণ বেবলির সাথে পরিচয়ের বেলায় অভিভাবক হিসেবে আঙ্গুল দিয়ে বেবলি আমাকে দেখিয়েছিলো। কিন্তু জেনেও এমন প্রশ্ন করায় একটু হচকিয়ে গেলাম। তবুও বললাম,”হ্যাঁ, কোনো দরকার ভাই?”
হ্যাঁ বলার পরক্ষণে নিয়নের চোখেমুখে লজ্জার ভাব ফুঁটে উঠলো। কিন্তু এখানে লজ্জার কী আছে তা আমি বুঝতে পারলাম না।
পরক্ষণে লজ্জায় হুলো বিড়াল হয়ে বললো,
“আপু, আপনার বোনকে না আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। খুব ভালোবেসে ফেলেছি।”
ওর এহেন কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ। মুখে যেন কলুপ এঁটে রেখেছি। কিন্তু মনে মনে বলছি এত ছোট ছেলে বলে কী? ভালোবাসা? কেমনে সম্ভব? তাই খানিক রাগ দেখিয়ে বললাম,”জানো ও কিসে পড়ে?”
“ওহ হো স্মৃতির থেকে তো এই বিষয়টা জানা হলো না। ওয়েট এ মিনিট, আমি এক্ষণি জেনে আসছি।”
জেনে এর পর আমার কাছে আসবে। এই আসা যাওয়ায় টাইম ওয়েস্ট করার থেকে মনে হলো আমার বলাটাই বেটার হবে। তাই তাড়া দিয়ে বললাম, “শুন ভাই,তোমার যাওয়া লাগবে না। আমিই বলছি।”
ও দরজার কাছ থেকে এসে কান একটু বাড়িয়ে দিলো। বুঝলাম পিচ্চি শুনতে চায়। তাই বললাম,”ও ক্লাস এইটে পড়ে। তোমার থেকে কয়েক বছরের বড়।”
এইটা শুনে ওর মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। এহেন কথা শুনে পরক্ষণে সে বললো,”তো।”
কাছে এসে এই কথা বলায় যারপরনাই অবাক হলাম। ও কী বুঝলো না আমি কী বলতে চাইছি? হয়তো বুঝেনি। তাই বুঝানোর জন্য বললাম, “তো মানে তুমি ওরে ভালোবাসতে পারবে না। আর বিয়েও করতে পারবে না। তোমাদের বয়সের পার্থক্য অনেক। তো এই ভালোবাসা দূরে রাখো।”

“আচ্ছা আপু। আপনি কী নিলাপুকে বিয়ে করবেন?”
ওর প্রশ্নে আমি অবাক। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে। কেমনে কী!
“মানে?”
“আপনারা দুজন দুজনকে ভালোবাসেন?”
এই প্রশ্ন খুব ভালো লাগলো। তাই বললাম, হ্যাঁ, খুব ভালোবাসি।”
“তাহলে বিয়ে করছেন কবে?”
“আরে বোকা। এই ভালোবাসাতে কোনো বিয়ে টিয়ে হয় না। এটা বন্ধুতের ভালোবাসা। প্রেমিক-প্রেমিকার নয়।”
“ওরে বোকা মহিলা আপু। আমিও যে আপনার বোনকে বন্ধুত্বপূর্ণ ভালোবাসি।
আসি। আর হ্যাঁ ডিমডাম খাবেন বেশি।”
ওর এই অপমানজনক কথায় বেশ লজ্জা পড়লাম। সত্যি কী আমি বোকা! না হলে ভালোবাসি বললেই ওমন সম্পর্কে আগে মাথায় ঢুকে কেন? ইশ, বেশি করে ডিম মনে হচ্ছে খেতেই হবে।

দিনে অনেকবার চেষ্টা করলাম ভাইয়াকে টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্য কিন্তু যতবার দেওয়ার চেষ্টা করেছি ততবারই ব্যর্থ হয়েছি। কারণ শাহেদা আন্টি। যতবার ভাইয়ার কাছে উনি আমাকে দেখেছেন ততবার ভাইয়ার ডাল হয়েছে সামনে দাঁড়িয়েছেন। এহেন কর্মে আমি বোধ করলাম ভাইয়া হয়তো কোনো রাক্ষসীর পাল্লায় পড়েছে। যার কারণে উনি বার বার রক্ষা করছেন। তবে উনার মতে আমি সেই রাক্ষুসী। শেষ বার হতাশ হয়ে যখন ভাইয়া বলে ডাক দিলাম তৎক্ষণাৎ উনিও আকাশ বলে ডাক দিলেন। ভাইয়া পড়লে দ্বিধায়। কার ডাকে সাড়া দিবেন? তবে শেষে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে মায়ের সাথে কথায় জমে উঠে নিচে গেলেন। আমিও আশাহত হয়ে ফিরে আসলাম। তবে ভাইয়া সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকালেন। অদ্ভুত লাগলো সেই চোখের চাহনি। তবে অনুভূতিহীন হয়ে গেলাম। প্রতিবার এইরকম কিছু ফেস করলে আনন্দ হতো। সারা শরীর শিউরে উঠতো। এখন যেন অনুভূতীর মা মারা গেছে।

উপর নিচ আসা যাওয়ায় বার কয়েক নিয়নের ভাইয়ের গতিবেগ পর্যবেক্ষন করতে পারলাম। লোকটা ভারি অসভ্য। আড়চোখে বার বার যে আমায় পরখ করে তা বেশ বুঝতে পেরেছি। এক চোর তো আরেক চোরকে চিনবেই না। কিন্তু আমি তো দেখেছিলাম উনি আমার দিকে তাকান কীনা। উনিও কী এই কারণেই তাকিয়েছিলে?

রাত্রে বিয়ের বাড়ির সমাগম বাড়তে লাগলো। রেডি হওয়ার ব্যস্ততা সব জায়গায়। বেবলি অনেক আগেই বিউটিশিউয়ান দ্বারা সেজেছে। বার কয়েক দরজায় ঠুকা দিয়ে আমার সাজার কতক্ষণ সময় লাগবে তা জিজ্ঞেস করলো। ওরা সবাই বোধয় ভাবছে আজ আমি ভারি সুন্দর করে সাজবো।বিউটিশিউয়ানদেরও চমকে দেবো। বলবো, দেখো তোমাদের থেকে অনেক সুন্দর করে নিজেকে সাজিয়েছি। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকলো না। কারণ সেই শুরু থেকে শাড়ি পড়াতেই আমি আটকে আছি। একদিক দিয়ে কুচি ঠিক করছি তো অন্যদিক দিয়ে শাড়ির অন্য ভাঁজ অনায়সে খুলে যাচ্ছে। হায় কপাল! ইহাই কী মোর ললাটের লিখন ছিলো?
আবারো দরজায় ঠুকা পড়লে কে বলে প্রশ্ন করলে বেবলি উত্তরে বললো, “আপা, আমি। তোর কী শেষ হলো? বরযাত্রী এই এলো বলে।”
বেবলির এমন তাড়ামূলক কথায় তড়িঘড়ি করে অগোছালো কুচি দিয়ে ঠিক করে নিলাম বহু আকাঙ্ক্ষিত শাড়িটাকে। শেষে শাড়ি পরিহিতা নারী হিসেবে আয়নায় দেখে মনে হলো রাস্তায় গণধোলাই খাওয়া পাগলী। ইশ, কী বিচ্ছিরি লাগছে! আনমনেই কথাগুলো বললাম।
বিয়ে বাড়িতে শুধু শাড়ি পড়লে হয় নাকি। আমায় দেখে মানুষ বলবে মশলাপাতি ছাড়া তরকারি। ছিহঃ অখাদ্য কোথাকার!
গলায় পরে নিলাম শুভাকাঙ্ক্ষীর দেওয়া সেই গলার সেটখানা। এটা পড়ে চেহেরায় বেশ মায়া মায়া ভাব ফুঁটে উঠলো। মনে হলো শাড়ি সুন্দর করে পড়তে পারিনি তো কী হয়েছে গলার সেটটাতো পেরেছি। হেহেহেহে!

পটের বিবি সেজে বের হলাম বাইরে। বেশ জাঁকজমক পরিবেশটা। দরজার পাশেই নিচে নামবার সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে কুচি ঠিক করার সময় অবাধ্য চুলগুলো সামনে আসায় পড়লাম বেকায়দায়। কোনটা ঠিক করবো এই নিয়েও বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লাম। পরক্ষণে মনে মনে ভাবলাম মানুষ তো সামনে অনেক। তারা আমার দিকে কেমন তরে তাকিয়ে আছে তা দেখার জন্য মাথা উঁচু করতেই প্রথমে চোখের সামনে ভেসে উঠলো মেয়েদের,,,,

চলবে„„„„„„„„

প্রয়োজন পর্বঃ ১৬

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ১৬
লেখায়ঃ তানিয়া তানু

“দৌড়াচ্ছি কী আর সাধে! এক পাগলের হাত থেকে বাঁচার জন্যই তো আরেক পাগল হয়ে দৌড়াচ্ছি।”এই কথাগুলো মনে মনে বললেও মুখে বললাম,
“তোমায় কী বলতে হবে, ভাইয়া? আর তুমিই বা কে?”
“বিরক্ত হচ্ছিস নাকি?”

বিরক্ত না হওয়ার কী আছে? আলবত বিরক্ত হবো। তোমায় যত বার আমার সামনে দেখি। ততবার মনে হয় তুমি ভীষণ ব্যস্ত। রাজ্যের যত ভার সব এসে তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়েছে। তোমাকে সব কাজ এখন একলাই করতে হবে। কিন্তু আমি আড়াল হলেই দেখি, কী সুন্দর রামিসার সাথে আড্ডায় মত্ত হচ্ছ। এই তো ফটো তুলার সময় রামিসার সাথে হাসিমুখে ছবি তুললে। দেখতেও কাপলদের মতো লাগছিলি। কই একবারও আমায় বললে না আয় তুই আর আমি ফটো তুলি? তো বিরক্ত হবো না তো কী হবো?

“কীরে, বল? আচ্ছা তুই কী কাঁদছিলি? চোখের এই অবস্থা কেন? একেবারে লাল হয়ে আছে!

ভাইয়ার কথায় ভাবনা জগত থেকে বের হলেই আবারো ঢুকে গেলাম। কথায় এমন ভাব। বুঝা যাচ্ছে যে, আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। আমাকে কেন দেখছো? ঐ রামিসাকে দেখো। ও আজ আমার মতো এই রকম মধ্যবিত্তের মতো সাজেনি। ওর ড্রেসাপে বুঝা যায় ও কতটা উচ্চবিত্ত। ওকে গিয়ে দেখো।
“দীপ্তি।”
ধাক্কা দিয়ে কথা বলায় একেবারের জন্য জ্ঞান ফিরলো। কিন্তু ক্রোধের আগুন ধপ করে জ্বলে উঠলো।

“ধাক্কা দিলে কেন, ভাইয়া? কথায় কী বলা যায় না। এভাবে শরীরে হাত দিয়ে কেন বলতে হবে। আমি তোমার সম্পদ নই যে এইভাবে গাঁয়ে হাত দিবে। আর আমি রামিসাও নই যে শরীরে হাত দিবে। এগুলো আমার পছন্দ নয়।”

আমার কথাশুনে ভাইয়ার চোখমুখ লাল হয়ে গেল। হয়তো আমার কাছে থেকে এমন কিছু আশা করেননি। কিন্তু এ ছাড়া আমারও কিছু করার ছিলো না। কিছু বলছে না দেখে পরক্ষণে আমিই রাগ নিয়ে
বললাম,
“তা কী বলবে শুনি?”
“দুঃখিত। এমনভাবে ধাক্কা দেওয়া মনে হয় আমার উচিত হয়নি। তবে তেমন স্পর্শকাতর জায়গা নয় কাঁধে হাত দিয়েছিলাম। সে যাইহোক, একদিন ঠিক আমার সম্পদ করে নেবো। মনে রাখিস। ”
এই বলেই হাতের তালু দিয়ে অবাধ্য জল মুছে নিয়ে চলে গেলেন অন্যত্র। আমি এখনো ঠায় হয় দাঁড়িয়ে আছি। সম্পদ তুমি আমায় না রামিসাকে করবে ভাইয়া সেটা তো আমিও দেখতে চাই?

নিলার রুমে গিয়ে দেখলাম এলোমেলোভাবে কয়েকজন ঘুমিয়ে আছে। বেবলিও তারপাশে ঘুমে বিভোর। একটু পড়েই ভোর হবে। সবাই ঘুমিয়েছে ভালোই করেছে।কিন্তু নিলা ঘুমে নেই। ও হাতে মেহেদী দিয়ে চেয়ারে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।আমাকে দেখেই রাগত স্বরে বললো,
“এলি কেন? যে জায়গায় ছিলি সে জায়গায় থাক না বাপু।”
“রাগলি বুঝি?”
“রাগবো না তো কী করবো শুনি? এলি আমার বিয়েতে। সারাদিন আমার পাশে থাকবি। কাল তো চলেই যাবো। আজ দুজনে আড্ডা দিবো। তা না করে তুই আমার থেকে ছয় ফুট দূরে থাকছিস। কিসের জন্য শুনি?”
ওর এত প্রশ্নের উত্তর আমার ঝুলিতে থাকলেও মুখের উত্তর পুরোপুরিই শূন্য। যে কান্ড আমি ঘটালাম সেটা বলে নিজের ইচ্ছায় অপমানিত হওয়ার কোনো সাধ নেই। নিলাকে বললে সে না জানি কী বলবে! হয়তো আবার নিয়নের ভাইয়ের মতো ট্রল করবে আমায় নিয়ে। এর থেকে নিজের ঘটনা নিজের মাঝেই থাক।

“তোরা বাড়িটা কী সুন্দর সাজিয়েছিস! সারাদিন এগুলোই দেখতেই মন চায়। তাই তোর কাছে আর যাইনি।”

“ও হো। এত সুন্দর সাজিয়েছি! তা সাজানোটা বুঝি স্টেজের পেছন থেকে দেখতে হয়।”
“মানে?”
“ভাইয়া বললো তুই নাকি স্টেজের পিছন থেকে নাচ দেখছিলি।”

আকাশ ভাইয়ার কথা মাথায় আসতেই মনে পড়লো একটু আগে ঘটানো আমার ঘটনা। ভাইয়ার লাল চেহারা। ইশ, এত কঠোর কথা না বললেও পারা যেত। এখন যেন অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি। তাই তো দৌড়ে আবারও চলে গেলাম ভাইয়ার খুঁজে। পিছন থেকে শুনতে পেলাম নিলা জোরে জোরে বলছে, তুই আবার চললি? এমন ব্যবস্থা করবো আর কোনোদিন আমাদের এখান থেকে যেতে পারবি না।

ভাইয়াকে তন্নতন্ন করে খুঁজে না পেয়ে শেষে ছাদে গেলাম। তিনি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাশ থেকেই নিকোটিন যুক্ত কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। সম্ভবত এটা সিগারেট। কিন্তু আজ পর্যন্ত ভাইয়াকে আমি কখনো সিগারেট খেতে দেখিনি। প্রথম দেখায় বেশ অদ্ভুদ লাগলো। পরক্ষণে খারাপও লাগলো আমি কীনা এরকম একটা ছেলেকে অপমান করায় অনুশোচনায় ভুগছিলাম। সেই স্থান ত্যাগ করতে পিছন ফিরলেই দীপ্তি বলে ভাইয়া ডাক দিলো। আমিও ঘৃণার চোখে তাকালাম।

“এসেছিলি কেন?”
“ছাদে দাঁড়িয়ে ভোর সকালে স্নিগ্ধ হাওয়া খেতে।
বেশ ভালো করেই মিথ্যেটা বললাম।
“তো চলে যাচ্ছিলি কেন?
“হাওয়া নষ্ট হয়ে গেছে তো তাই।”
“ওহ। আমি চলে যাচ্ছি। আর হাওয়াও কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে।”
চলে যেতে চাইলে বাঁধা দিয়ে বললাম,
“এটা তোমার বাড়ি। এখানে আনাচে-কানাচে আসা যাওয়া তোমার মানায়। তুমি কেন চলে যাবে। বেশ তো ধোঁয়া ছাড়ছিলে। ছাড়ো। আমিই চলে যাচ্ছি।”

“এটা আমার বাড়ি হলেও আমি আমার শহরে একজনের আনাগোনা বেশ চাই। তাই তাকে আসতে দিতে হলে এই বাড়িতে থাকে পূর্বে মর্যাদা দিতে হবে।”
” মানে?”
“সিগারেট খেলে নাকি বুকের যন্ত্রণা ভুলে থাকা যায়। তাই খাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন সব জ্বালাতন শেষ। তাই আর খাবো না।”

এই কথার উপরে আমি কিছু বললাম না।নীরব থাকলাম।ভাইয়াও খানিক এদিক সেদিন তাকালো। কিছুক্ষণ পাশে থেকে আমাকে পরখ করলো। শেষে বুঝতে পারলো কথা আর জমাতে পারবে না। তাই তো আবারো এক পলক চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে নিচে।

ভোর সকালে সূর্য যখন হালকা উঁকি দেয়। তখন সেই উঁকিতেই ফুঁটে উঠে নতুন দিনের নতুন রূপ। চারদিকে আলোর খেলা। আধারকে সরিয়ে আলোর আনাগোনা চলে পৃথিবী নামক গ্রহে। নতুন উদ্যমে মানুষ ঘর থেকে বের হয় কাজের সন্ধানে। তবে এখন সবাই সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে ব্যস্ত। আমিও হতাম। কিন্তু বিয়ের এক পরিবেশের জন্য অজুহাত দিতে হলো।
ভাইয়ার ছড়ানো ধোঁয়ার গন্ধ এখন আর নেই। চলে গেলো। ভাইয়ার মতোই। পূর্বের মতো ভাইয়াকে দেখলে এখন আর সেই অনুভূতি হয় না। অনুভূতিরা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল শুধুমাত্র ভাইয়ের বেলায়। কিন্তু কেন? নতুন কারোর আগমণে কী? নাকি অবহেলায়। অবহেলায় তো লোহায় জং ধরে। তবে আমার বেলায় নয় কেন? সেটাই বোধয় হয়েছে। আগে তো বেশ কথা হতো। এই বাড়িতে আসলেই কথার পাহাড় জমতো। কিন্তু এখন সব কেমন হারিয়ে গেল। সত্যি কী হারিয়ে গেছে নাকি আমার দিক দিয়ে তা মন হচ্ছে? সব কিছু তো অজানা। সময়ই না হয় সব কিছু বলে দেবে। পথের প্রতিটি পদক্ষেপ তো সেই বলে দেয়।

চলবে„„„„„„„„

প্রয়োজন পর্বঃ ১৫

0

গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ১৫
লেখায়ঃ তানিয়া তানু

উনাকেও ফোনের স্ক্রীনে আমার সাথে দেখা যাচ্ছে। দুইজনই কাপলদের মতো করে মনে হচ্ছে সেলফি তুলছি। এই ভাবনা মনে হতে দূরে সরে যেতে চাইলেই কোমর ধরে কাছে টেনে বললেন,
” এখনই চলে যেতে চাইছো যে? আমার তো পুরো কথা এখনো শেষ হয়নি। যতক্ষণ শেষ না হয়। ততক্ষণ তুমি এখান থেকে এক চুলও নড়তে পারবে না। ফোনে তাকাও। একটা সেলফি তোলে নেই।”
এমন ধরণের কথা শুনে সত্যি আমি বাকরুদ্ধ। পৃথিবীর যত ভয় সব যেন আমার কাছে এসেছে। সাহস করে কিছু বলতেও পারছি না। পারছি না বলতে, আপনার এত সাহস কী করে হয়? এভাবে নির্জন স্থানে একটা মেয়েকে এইভাবে স্পর্শ করে তাকে টিজ করার। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার!

” কী হলো তাকাও।”
ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে ফোনে তাকালে উনি ক্লিক করে সেলফি তোলে নিলেন। মনে এসে ত্রাস জমলো। আজকাল তো ছবি দিয়ে খারাপ কিছু করা হয়। না জানি আমার ছবি দিয়ে উনি কী করবেন!

“ডোন্ট ওয়ারি। এই ছবি দিয়ে আমি তেমন কিছুই করবো না। তবে তোলাটা দরকার ছিলো। কোনো একদিন কাছে পেলে না হয় বলবো।”
উনার কথা শুনে স্বস্তি পেলাম।কিন্তু উনি কী করে মনে কথা বুঝলেন। হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছেন। সে যাইহোক উনাকে পরক্ষণে বললাম,
“আমি তো এখন আপনার কাছেই আছি।”
“এটাকে শরীরের দিক দিয়ে কাছে হয়। এই কাছে আর আমার বলার কাছের মানে এক নয়।”
“মানে?”
“আন্ডা।”
খানিক নীরব থেকে চারপাশের পরিবেশ একবার চোখ বুলিয়ে উনার দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“প্লিজ, এখন অন্তত ছেড়ে দিন। জনগণ আমাদের এভাবে এসে দেখলে আমাকে নিয়ে কুৎসা রটাবে। প্লিজ, ছেড়ে দিন। আমি আর কোনোদিন আপনার পাপড়ি ছিঁড়বো না।”
উনি আমার কথা শুনে আমাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ রাখলেন। দুজনের উষ্ণ শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। পরিবেশ যেন এক অদ্ভুত মায়াজালে আটকে রাখলো আমায়। উনাকে কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছি না। উনার অবাককান্ড অবাক হয়ে দেখছি। উনার চোখে অদ্ভুত এক খেলা চলছে। কিছুক্ষণ এইভাবে চললে নিশ্চিত এই লোকের সাথে আমার কিছু হয়ে যাবে। খানিক পর মৃদু হেসে উনি নিজেই বললেন,
“তোমাকে পাপড়ি ছিঁড়তে বারণ করিনি। ছিঁড়বে তবে ভালোবাসা দিয়ে। এভাবে ছিঁড়লে তো বুকে বেশ লাগে। জ্বলে ছারখার হয়ে যায়(আমার হাত বুকে দিয়ে) দেখিয়ে)”
আমি এখনো নীরবতা পালন করছি। তবে উনার লোমশ বুকে আমার হাত পৌঁছায় কেমন জানি শিহরিত হচ্ছি। অজানা ঘোরে উনার লোমশ বুকে আমার হাতের বিচরণ করছে।

“তুমি এমন করলে তো আরো পাগল হয়ে যাবো, দীপ্তি।”
উনার কথায় হুঁশ এলে মনে পড়লো আমি এতক্ষণ কী করছিলাম?নিজেই নিজেকে বকা দিলাম। ছিহঃ তুই এমন থার্ড ক্লাস মেয়েদের মতো এই কাজটা করতে পারলি। ছিহঃ

“পাপড়িগুলো ছিঁড়লে কেন? বেশ তো রোমান্সের মুডে ছিলাম। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত মায়াজাল সৃষ্টি করছিলাম। এভাবে মায়াজাল ছিঁড়লে কেন?
উনার প্রশ্নের উত্তরে নীরব হয়ে রইলাম। বলার মতো তেমন শব্দ মাথায় আসছে না। সব গুলো শব্দ একে অপরের সাথে জট লেগে অগোছালো ভাব সৃষ্টি করেছে। তাই নীরবতা ছাড়া কোনো কর্মই সাধাওণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।

“কী হলো? বলো, পাপড়ি ছিঁড়লে কেন? একটু আগে এমন করে চোখ বন্ধ করে কী করছিলে। পাপড়িই বা হাতের পিঠে রেখেছিলে কেন?”

উনার এমন চিৎকারমূলক প্রশ্নে আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“পাপড়ি দিয়ে আল্লাহর কাছে চাওয়াগুলো চাইবো। তাই আপনার পাপড়ি ছিড়েছিলাম। এখন দোয়া করতে চাইছিলাম। কিন্তু তার পূর্বেই আপনি বাধাঁ দিলেন।”

আমার কথা শুনে আর উনার মুখ দেখে বুঝা গেল তিনি প্রচুর অবাক হলেন। কিন্তু কপালে রাগের ভাঁজে এটাও বুঝা যাচ্ছে তিনি আমার কথায় ভারি রাগ করছেন। রাগান্বিত হয়ে পরক্ষণে বললেন,
“এগুলো তোমায় কে বলেছে?”
“ছোটবেলায় এক ক্লাসমেট বলেছিলো।”
“এখনো তুমি সেটা বিশ্বাস করছো। এগুলো জাস্ট কুসংস্কার ছাড়া কিছুই না।”

উনার কথায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললাম,
“আরে নাহ। ও বলেছে ও যেগুলো ছেয়েছে সেগুলো পূর্ণ হয়েছে।”
“ও রিয়েলি।”
“হুম।”
“আমি প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করি না। কারণ আমি এস আই পুলিশ অফিসার অয়ন মাহমুদ। প্রমাণ দাও।

অসহায় হয়ে বললাম,
“প্রমাণ কী করে দিবো?
উনাকে খুব ভাবুক দেখা গেল। খানিক চিন্তা ভাবনা করেই মনে হয় কিছুক্ষণ পর বললেন,
“তুমি আমার সামনে একটা পাপড়ি দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দাও। তারপর যেটা চাইবে সেটা আমাকে বলবে। আমি মিলিয়ে দেখবো। তোমার চাওয়া পূরণ হয় কী না?”
উনার কথামতো ব্যাগ থেকে কাগজটা এনে খুললাম। খুলার পর একটা পাপড়ি নিলেই উনি অবাক হয়ে বললেন,
“বাপরে, তুমি আমার এত্তগুলা পাপড়ি ছিড়লা। তাই তো বলি আমার চোখের এত পাপড়ি গেলো কই? আর এত জ্বলছিলো কেন? সব উত্তর যে এখন পেলাম। মেয়ে তোমার বড্ড সাহস। এখনই ইচ্ছে করছে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেই।”
উনার কথা শুনে ভয়ে ভীত হয়ে গেলাম। কথা বলতে পারছি না। তবুও আমতা আমতা করে বললাম,
“শ্বশুর বাড়ি মানে? প্লিজ, আমার বিয়ে দিয়েন না।আমি এখন বিয়ে করবো না।

আমার কথা শুনে অট্টহাসিতে মেতে উঠলেন। উনার হাসির শব্দ আমার কানে যেন বিষের মতো বেজে উঠলো। রাগত স্বরে বললাম,
“আপনি এভাবে হাসছেন কেন? জানেন না কারোর কষ্টে এভাবে হাসতে নেই।”
“তোমার আবার কষ্ট কিসের?”
“ঐ যে আপনি বললেন, আমার বিয়ে দিয়ে দিবেন। কিন্তু আমি তো বিয়ে করতে চাইছি না।ঐ টাই আমার কষ্ট। বুঝেছেন?”

“বেশ বুঝেছি। আর এটাও বুঝেছি তুমি খুবই বোকা। এত বোকা যে তোমায় নোবেল দিতে ইচ্ছে করছে।”
“আমি মোটেও বোকা নই। আর এখানে তো বোকামির কিছু করিনি।”
“তুমি আলবাত বোকা। নাহলে কী এইভাবে কেউ বলে?”
“কী বলেছি আমি?
” বিয়ে নিয়ে যে সব কথা।”
“ওগুলো তো আপনি বলেছেন।”
“আমি বলেছি তোমায় শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতে ইচ্ছা করছে অর্থাৎ জেল হাজতে।আর তুমি কী বুঝলে?”
উনার এই কথায় নিজের বুঝার ভুল বুঝতে পারলাম। ইচ্ছে করছে কোথাও এই মুখটা লুকাই। ছিহঃ আমি কী ভেবেছিলাম। কিন্তউ একটা কথায় সন্দেহ হলো। তাই বললাম,
“হাজতে বলতে তো মামার বাড়ি বুঝায়। শ্বশুর বাড়ি নয়।”
“এটা শ্বশুর বাড়িই বুঝায়। কারণ মামার বাড়িতে মধুর হাড়ি থাকে। শ্বশুর বাড়িতে লবণে। সেখানে মারামারি ছাড়া কিছুই পাবে না। বাদ দাও সেসব কথা। এখন হাতে পিঠে পাপড়ি নিয়ে তোমার চাওয়া চাও।”
উনার কথামতো তাই করলাম। ফু দিয়ে উড়িয়ে উনার দিকে তাকালে মৃদু হেসে বললেন,
” তো কী চাইলে?”
“হে আল্লাহ, এই মুহূর্তে আমায় একটু শান্তি দাও।”
“মনে হয় না শান্তি পাবে।”
“কেন?”
“কারণ এখন আমি তোমায় আরো বেশি করে জ্বালাবো।”
এত অবাক হলাম যে তা বলার মতো নয়। লোকটা এত অসভ্য। কিন্তু আমারও কোনো কিছু করার ছিলো না। একে তো এই বাড়ির মহাত্মীয়। তার উপরের আবার পুলিশ। অভিযোগ করলে আমার শরীরে দাগ লাগবে কিন্তু উনার কিছুই হবে না। সমাজে যত দোষ সব নারীর। না পেলেও খুটিয়ে খুটিয়ে দোষ বার করবে এই সমাজ। কারণ সমাজে ছেলেদের বড্ড অভাব। ওদের সম্মান করাই যে সমাজের মহৎ কাজ। উনার আচরণে এতই কষ্ট হচ্ছে যে কাঁদোকাঁদো স্বরে বললাম,
“প্লিজ আমায় ছেড়ে দিন। আমি আর কোনো দিন আপনার সামনেও আসবো না।”
“আরে, তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? আমি খারাপ ছেলে নই। আমার আচরণ তোমার কাছে বাজে মনে হলো আ’ম রিয়েলি সরি। প্লিজ এবার অন্তন্ত শান্ত হও।আর হ্যাঁ পাপড়ি নিয়ে কুসংস্কার বিশ্বাস করবে না। যদি এগুলো অবিশ্বাস করো তবে এখান থেকে যেতে পারো। আমি বাঁধা দিবো না।”

এই কথাগুলো বলেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমিও খাঁচার পাখির মতো হঠাৎ দরজা খোলা পাওয়ায় দৌড়ে চলে আসলাম। মনে মনে খুব করে আচ্ছা বললাম। এগুলো আর কোনোদিনই বিশ্বাস করবো না। আসার পথেই আবারও কারোর সাথে ধাক্কা খেলে হুমড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ি মেঝেতে।
“ও হ্যালো, দেখেশুনে চলতে পারেন না নাকি?”
একে তো কোমরে কী ব্যথাটাই না পেলাম। তার উপর এই ছেলের চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। রাগত স্বরে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
“নিজে দেখে,,,,,,,,”
পুরো কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই দেখলাম আবারো আমার সামনে আকাশ ভাইয়া পড়েছেন।
“কীরে, এভাবে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছিস কেন?”
“দৌড়াচ্ছি কী আর সাধে! এক পাগলের হাত থেকে বাঁচার জন্যই তো আরেক পাগল হয়ে দৌড়াচ্ছি। এই কথাগুলো মনে মনে বললেও মুখে বললাম,,,,,

চলবে,,,,,,,,,,,,