Wednesday, September 3, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2038



আংটি পর্ব_৪

0

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০

লেখনীতেঃ- অনামিকা ভট্টাচার্য্য

আংটি পর্ব_৪

আজ কলেজে নবীনবরণ অনুষ্টান।সে উপলক্ষে আলোচনা সভা ও বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে টিচার্সদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে।আলোচনা সভা শেষে ফুল,ডায়েরি ও কলম দিয়ে নবীনদের বরণ করে নেয়া হলো।তারপর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।স্টুডেন্টসদের পারফরম্যান্স শেষে টিচার্সদের পালা।টিচার্সদের পক্ষ থেকে কয়েকজন কবিতা আবৃত্তি করলেন।রিমি গান গাইলো।এক ফাঁকে অরণ্য উপমাকে বললোঃ-
-দেখলেন তো।রিমি কি সুন্দর গান গায়!আমি বলেছিলাম না?
-হুম। তাই তো দেখছি।

এরপরই উপমাকে গান গাইতে ডাকা হলো।অরণ্যের অবাক করা দৃষ্টির সামনে দিয়েই উপমা উঠে মঞ্চে চলে গেলো।উপমা এতো সুন্দর গান গায়।এতো মিষ্টি কন্ঠস্বর ওর।এই স্মরটা তো অরণ্যের খুব চেনা।কোথায় যেন শুনেছে সে।কিছুতেই মনে করতে পারছে না।উফ!কিছুতেই মনে পড়ছে না কেন?কেমন একটা অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ভরে গিয়েছে যেন।চোখ বন্ধ করে আছে অরণ্য।যেন পৃথিবীতে কেউ কোথাও নেই।উপমা গাইছে আর অরণ্য শুনছে।অনন্তকাল কেটে যাক এভাবে।গান শেষে দর্শকদের অগণিত হাততালি আর ওয়ান মোর ওয়ান মোর রিকোয়েস্ট শুনে চোখ খুলে তাকায় অরণ্য।সবার প্রশংসা কুড়িয়ে মঞ্চ থেকে দৃঢ় পায়ে নেমে আসছে উপমা।এসে অরণ্যের পাশের সীটে বসলো।অরণ্যের কেমন লজ্জা লজ্জা করছে।এই মেয়েকে সেদিন বলেছিলো এক্সট্রা কারিকুলামে এক্টিভ থাকলে কি আর পড়াশুনায় ওমন রেজাল্ট করা সম্ভব হতো।তাছাড়া রিমির গানের প্রশংসাও করেছিল খুব।যে মেয়ে নিজেই কোকিল কন্ঠী,তার কাছে বান্ধবীর গানের প্রশংসা করাটা কোন বাহাদুরির কাজ নয়।

-আচ্ছা।আপনি সেদিন বললেন না-তো নিজে এতো ভালো গান করেন।
-এতে বলার কি আছে?
-না বললে মানুষজন জানবে কি করে?
-আজকে যেভাবে জানলেন সেভাবেই জানতো সবাই। তাছাড়া না জানলেও হবে।এটা এমন জরুরী কোন ইস্যু না।
-হাহাহা……আচ্ছা আচ্ছা।

পাশ থেকে উপমা কখন উঠে গিয়েছে খেয়ালই করে নি অরণ্য।গানের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে নৃত্যানুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে।নৃত্যশিল্পী হিসেবে উপমাকে স্টেজে নাচতে দেখে অরণ্য খেয়াল করলো ওর পাশের সীটে অন্য কেউ বসে আছে।আজকাল তো ক্লাসিকাল নৃত্য তেমন একটা কেউ করেই না।উপমার নৃত্যের তালে চারদিকে সুনসান নীরবতা। একে তো ওমন রূপ,তার ওপর উপমার নাচে আছে শৈল্পিক ছোঁয়া।সব মিলিয়ে মুগ্ধ দর্শকরা।নাচ শেষে গ্রীন রুমে গিয়ে ড্রেস পাল্টে আবার দর্শক সারিতে এসে বসে উপমা।অরণ্য গলার স্মর নীচু করে বলেঃ-

-আপনার আর কি কি গুণ আছে বলুন তো ম্যাডাম?

-আকাশে চাঁদ উঠলে,বাগানে ফুল ফুটলে তা কি কাউকে বলে দিতে হয়?
এমনিতেই সবাই দেখতে পায়।

-দারুণ বলেছেন।

-ধন্যবাদ।আসুন আমরা পুরো অনুষ্ঠান টা উপভোগ করি এবার।

**************

রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিরিয়ানির প্যাকেটটা খুলে উপমা।কলেজ থেকে দিয়েছে সবাই কে।খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়।সন্ধ্যায় উঠে চা খেয়ে বাসায় ফোন দেয়।প্রতিদিন নিয়ম করে ওর মায়ের সাথে কথা বলতে হয়।কি খায় না খায় সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন উপমার মা।

-তুই তো অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছিস রে মা।

-না মা।একটুও শুকাই নি।আগেও ৫২ কেজি ছিলাম,এখনো তা আছি।ওয়েট মেশিন কিন্তু তা-ই বলছে।

-কিন্তু চোখমুখ এতো শুকনো লাগছে কেন?

-জানই তো মা আজ কলেজে একটা প্রোগ্রাম ছিলো।তাই হয়তো একটু টায়ার্ড লাগছে।

-দুপুরে কি খেয়েছিস?

-বিরিয়ানির প্যাকেট দিয়েছে কলেজ থেকে।

-রানের পিসটা পেয়েছিলি?

-উফ মা!এতো চিন্তা কেন করছো?রান পাই নি।তবে ভালো একটা পিসই পেয়েছি।কলেজ ক্যান্টিনে রান্না হয়েছিলো।খেয়েছি তৃপ্তি সহকারে।লেবু,সালাদ, ডিম সব ছিলো প্যাকেটে।

-আচ্ছা মা ঠিক আছে।

-বাবাকে বলো আমি পরে কল দেবো।আগামীকালের ক্লাসের জন্য লেকচার শীট রেডী করতে হবে।রাখছি।

উপমার মা উর্মিলা দেবী।সন্তান স্নেহে অন্ধ বলা যায়।কতো সাধনার ধন এই কন্যাটি।উর্মিলা দেবীর সাধনা বিফলে যায় নি।মেয়েকে তিনি সবদিক দিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলতে পেরেছেন।আজ একা একা এতোদূরে পড়ে আছে।মেয়েটা মুরগির রান খেতে খুব ভালোবাসে।মাছের লেজ ওর প্রিয়।উপমা যাবার পর বাসায় মুরগী এলেও রানগুলি তিনি ফ্রিজে জমিয়ে রেখেছেন।তেমনি বড় মাছের লেজও রাখা আছে।মেয়ে ছুটিতে এলে একসাথে খেতে দেবেন।মায়েরা তো এরকমই হোন।

কলেজ লাইব্রেরীতে উপমার সাথে আবার দেখা হয় অরণ্যের।এতোদিন শুধুমাত্র ওর আংটির প্রতিই অরণ্যের সব আগ্রহ ছিলো।এবার উপমার প্রতিও কিছুটা আকর্ষণ বোধ করছে।আংটি সম্পর্কে জানতেই হবে।সেজন্য আগে উপমার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে হবে।এক্ষুনি স্বপ্নের কথা বলা যাবে না।আর বললেও উপমা কখনোই এটা বিশ্বাস করবে না।বরং ভাববে ওকে আকৃষ্ট করার জন্য অরণ্য বানোয়াট গল্প সাজিয়েছে।

-ম্যাডামের উনি কি করেন?
-কার কথা বলছেন?
-মানে আপনার উড বির কথা বলছিলাম আর কি।
-এখনো ঠিক জানি না কি যে করেন।তবে এইটুকু জানি এখনো বিয়ে করেন নি।
-বাহ!বেশ বললেন তো।উনার নাম বুঝি “B” দিয়ে।
-“A” নাকি “B” তা এখনো ঠিক জানিনা।আসলে ঐটা আমার এনগেজমেন্ট রিং নয়।
-কি বলেন! আমি তো আংটিতে বি লেখা দেখে ভেবেছিলাম আপনার হবু স্বামীর নামের প্রথম অক্ষর বোধহয় বি।
-না,না।এই আংটিটা ছোটবেলা থেকেই আমার হাতে আছে।মা বলেছেন কোন এক সাধু বাবা এটা আমাকে দিয়েছেন।তবে এই বি লেখার মানে বুঝিনি।মা-ও ঠিক জানেন না।
-আপনার টাইটেল তো মুখার্জি।উপমা মুখার্জি।তবে তো টাইটেলে অক্ষরও বি নয়।
তাহলে ঐ সাধু বাবা বোধহয় জানতেন আপনি ভবিষ্যতে এই বনগাঁও কলেজের লেকচারার হবেন।তাই এটা আপনাকে দিয়েছেন।
-হাহাহা…….. এভাবে তো ভেবে দেখি নি।
-মজা করে বললাম।যা-ই হোক,”B” for the best.
-সেটাই।
-আংটি টা খুব আনকমন ডিজাইনের।তবে সুন্দর!হয়তো এটা অনেক পুরাতন ডিজাইন।
-এই আংটির একটা স্পেশালিটি আছে।আংটিটা আমি ছাড়া আর কেউ খুলতে পারে না।আবার এরকম আংটি আর কেউ বানাতেও পারে না।আমার এক বান্ধবী বানাতে চেয়েছিলো।বাট কারিগর অর্ডার নিয়ে আবার দু দিন পর না করে দিয়েছে। একটা মজার ব্যাপার হলো,একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে কিছু ছিনতাইকারী আমাকে ধরে।ওরা আমার রিকশা আটকে দেয়।মোবাইল,টাকা সব নিয়ে যখন আংটিটা নিতে চায় তখনি ওরা তিনজন একসাথে সেন্সলেস হয়ে যায় আর অনেক মানুষ জড়ো হয়ে ওদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়।আমি আমার সব জিনিস নিয়ে নির্বিঘ্নে বাসায় চলে আসি।
-ভেরি ইন্টারেস্টিং!আমি এখন ক্যান্টিনে যাবো চা খেতে।আপনিও চলুন একসাথে যাই।
-ঠিক আছে চলুন।
চা-টা খেয়ে যে যার ক্লাসে চলে যায়।উপমা মনে মনে ভাবতে থাকে ও তো সবসময়ই স্বল্পভাষী।চট করে কারো সাথে ফ্রি হতে পারে না।অথচ অরণ্য কে কেমন জানি বন্ধু বন্ধু মনে হয়।এতো কথা অরণ্যের সাথে শেয়ার করলো।এমনকি আংটির বিষয়েও কতোকিছু জানালো।আবার একবার বলতেই চা খেতেও চলে আসলো।তবে কি উপমার জীবনে নতুন কিছু হতে চলেছে।

#চলবে

#পরবর্তী_পর্ব

https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/962952950802091/

আংটি পর্ব ৩

0

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতেঃ- অনামিকা ভট্টাচার্য্য

আংটি পর্ব ৩

ক্লাস শেষে কোয়ার্টারে ফিরে আসে উপমা।কলেজ বিল্ডিং এর পাশেই টিচার্স কোয়ার্টার।কলেজের পিছন দিকে ছোট্ট একটা রাস্তা। রাস্তা মানে সরু গলি।দু পাশে শিমুল,কদম,মেহগনি,কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানো।এই এক ফালি পথটুকু হেঁটে আসতেই ভালো লাগে উপমার।
তারপরই ওর কোয়ার্টার।

উপমার ছেলেবেলা কেটেছে ছোট্ট এক মফস্বল শহরে।ক্লাস এইটে উঠার পর তারা ঢাকায় চলে আসে।তারপর থেকে ঢাকারই স্থায়ী বাসিন্দা তারা।বাবা-মাকে ছেড়ে এই প্রথমই একা একা থাকছে।কোয়ার্টারে উপমা একটা সিঙ্গেল রুমে থাকে,এটাচড ওয়াশরুম।রুমের সাথে ছোট্ট একটা ব্যালকনি।কমন কিচেন।মাজেদা খালা এই কোয়ার্টারের রাঁধুনী।রান্নার পর উপমার ঘরে এনে খাবারটা দিয়ে যায়।যদিও ডাইনিং রুমে অনেকগুলো চেয়ার পাতা আছে।তবু ঘরে বসেই খাবার খেতে পছন্দ করে উপমা।এই মাজেদা খালা মহিলাটাকে ভালোই লাগে উপমার।এই ধরণের মহিলা সাধারণত পান খেয়ে রসিয়ে রসিয়ে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে মজা পায়।ওদের পছন্দের টপিক হলো কোন অবিবাহিত মেয়ে দেখলে তার বিয়ে না হওয়ার কারণ নিয়ে গবেষণা করা।কবে বিয়ে খাবো বলতে বলতে কাউকে বিরক্ত করা কিংবা বিবাহিত হলে বাচ্চা আছে কি-না,কবে হবে,কেন হচ্ছে না আবার বাচ্চাকাচ্চা থাকলে স্বামী-সংসার ফেলে এতোদূরে চাকরি করতে আসছেন কেন এইসব বিষয়ে বার বার বলে বলে মুখে ফেনা তোলা।কিন্তু উপমা দেখলো মাজেদা খালা পানও খান না।আবার ওসব বিষয়ে কখনো কিছু জিজ্ঞেসও করেন নি।নিজের কাজটুকু নিষ্ঠা সহকারে করে যান।বাড়তি কথা খুব একটা বলেন না।রান্নাটাও বেশ ভালোই করেন।সাধারণত এরকম ছুটা বুয়ারা খুব বেশী তেল আর হালকা মসলা দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব রেসিপি রান্না করে।সেই সাথে প্রায় সবাই ম্যাজিক ডাল রান্না করতে বিশেষ পারদর্শী হয়।এই ডালটা এতোটাই পাতলা হয় যে সেটাকে একইসাথে ডাল এবং হাত ধুয়ার জল দুটোই বলা চলে।তাই এই ধরনের ডালকে উপমা মনে মনে নাম দিয়েছে ম্যাজিক ডাল।উপমা নিজে কখনোই বাসার বাইরে না থাকলেও কাজিন এবং বান্ধবীদের হোস্টেলে,মেসে অনেকবার গিয়েছে।তাই উপমা এসকল রান্নার সাথে খুব পরিচিত।তবে মাজেদা খালার রান্না এরকম না।মোটামুটি ভালোই রান্না করেন।সব থেকে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে কোন রান্নাতেই অতিরিক্ত তেল লাগান না।ডালটাও ঠিকঠাক মতোই রাঁধেন।সেজন্য ঘরোয়া একটা আমেজ পাওয়া যায় খাবারে।এছাড়া এই মহিলা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।তাই তৃপ্তির সহিত খাওয়া যায়।সব মিলিয়ে মাজেদা খালাকে ভালোই লাগে উপমার।
উপমা নিজের রুমে রাইস কুকার,ইলেকট্রিক কেটলি,ব্লেন্ডার এগুলো রেখেছে।চা,কফি কিংবা গরম জলের জন্য যাতে কিচেনে যেতে না হয়।কিচেন শেয়ার করতে ভালো লাগে না উপমার।তাই রুমের ভেতরই ব্যবস্থা করে নিয়েছে।রুমের ভেতর আসবাবপত্র বলতে একখানা চৌকি ও একটা সস্তা চেয়ার-টেবিল ছিলো।উপমা নিজে একটা বুকশেলফ আর কাপড় রাখার জন্য একটা প্লাস্টিকের ওয়ারড্রব কিনে এনে রেখেছে।বুকশেলফ ছাড়াও ওয়ারড্রবের একটা ড্রয়ারে বই রাখা আছে।যেহেতু উপমার বই পড়ার খুব নেশা।

ব্যালকনিটা নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছে উপমা।একপাশে টবে কয়েকজাতের ফুল লাগিয়েছে।একপাশটা খালি রেখেছে।খালি পাশটায় ইচ্ছে হলেই ছোট্ট শীতলপাটি বিছিয়ে বই নিয়ে বসে যায় উপমা।সাথে থাকে চা কিংবা কফি।দেয়ালের সাথে বালিশ লাগিয়ে রাখে।বালিশে পিঠ দিয়ে পড়তে ভালো লাগে উপমার।

আজ শুক্রবার।ছুটির দিন।সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।উপমা রাইস কুকারে চাল-ডাল বসিয়েছে।খিচুড়ি আর ডিমভাজি দিয়ে লাঞ্চ করবে আজ।খিচুড়ি বসিয়ে হাতে এক কাপ চা নিয়ে ব্যালকনিতে আসে উপমা।বৃষ্টি ভেজা সবুজ প্রকৃতি দেখতে ভালোই লাগছে উপমার।গাছগুলো যেন একসাথে স্নান করছে সব।কানে হেডফোন গুঁজে দিয়েছে উপমা।রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছে।

“এসো নীপবনে,ছায়াবিথী তলে এসো
করো স্নান নবধারা জলে এসো,নীপবনে”।

হঠাৎ ঐ সরু গলিটার দিকে চোখ পড়ে উপমার।দেখে অরণ্য বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কদম ফুল কুড়াচ্ছে।সাথে কয়েকটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে।সবুজ টি-শার্ট আর সাদা-কালো ট্রাউজারে অরণ্য কে দেখতে কলেজ স্টুডেন্টদের মতোই লাগছে।কে বলবে অরণ্য এই কলেজের সিনিয়র লেকচারার।মনে মনে ভাবে উপমা।কলেজ ক্যাম্পাসের কথা মনে পড়ে উপমার।বৃষ্টি ভেজা ক্যাম্পাসটা নিশ্চয়ই সবুজ কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে।শুক্রবার থাকায় কলেজের এই স্নিগ্ধ রূপটা দেখতে পারলো না উপমা।ছাতা মাথায় দিয়ে মাজেদা খালা হেঁটে আসছেন।খালাকে জানাতে হবে আজ দুপুরে ওর জন্য খাবার না দিতে।
নতুন চাকরি,নতুন কর্মস্থল,নতুন বাসস্থান,কিছু অপরিচিত নতুন মানুষ।সব মিলিয়ে এই নতুন জীবনটাকে উপভোগ করছে উপমা।

****************
সন্ধ্যাবেলা নিজ রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো অরণ্য।এমন সময় ওর মা ফোন করলেনঃ-
-হ্যাঁ মা বলো।

-আমি আর কি বলবো বাবা।বলবি তো তুই। তোর নীলিমা আন্টি একটু আগে কল করেছে।গতকাল জানানোর কথা ছিলো।অথচ আজো আমরা জানাতে পারলাম না।তুই তো এখনো কিছু বললি না।

-পছন্দ হলে নিশ্চয়ই বলতাম মা।কিছু যখন জানাই নি তার মানে তো তোমরা বুঝে নিতে এখানে আমার মত নেই।

-তোর অমতের কারণটা বল।

-ওসব বড়লোকের ন্যাকা ন্যাকা মেয়ে আমার একদম পছন্দ না মা।দেখার দিন দেখলে না কেমন ন্যাকামো করলো।রান্নার কথা জিজ্ঞেস করতেই কেমন উত্তর দিলো!ও নাকি পড়াশুনা নিয়েই বিজি ছিলো।তাই রান্নাঘরের ধারে কাছেও যায় নি।এটা কোন কথা হলো!যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না।

-দেখ বাবা,আজকালকার মেয়েরা এমন একটু হয়েই থাকে।এসব কোন ব্যাপার না।তাছাড়া আমার একমাত্র ছেলের বৌ।আমি ওকে রান্না করতে দেবোই বা কেন?আমি এটা বলছি না ঐ মেয়েকেই তোর বিয়ে করতে হবে।কিন্তু কাউকেই তো তোর পছন্দ হয় না।আমার কি ইচ্ছে করে না ঘরে বৌমা আনতে।তোর বাবার কতো শখ বৌমাকে নিয়ে।আর কতো অপেক্ষা করবো বল তো।

-অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় মা।আর বোধহয় বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবে না।এখন রাখছি।আগামীকাল আমাদের কলেজে নবীনবরণ অনুষ্টান আছে।এখন এটা নিয়ে একটু কাজ করছি।পরে কথা হবে।

ফোন রেখে আবার কাজে লেগে যায় অরণ্য।হঠাৎ করে কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব আসে।তখনি সেই স্বপ্নটা আবার দেখে।একটা ছেলে একটা মেয়েকে আংটি পরিয়ে দিচ্ছে।তারপর ঐ মেয়েটার সীঁথি তে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছে।যদিও কারোরই চেহারা দেখা যায় নি।শুধু হাত আর কপাল দেখেছে।তখনই স্বপ্নটা ভেঙে যায়।ধড়ফড়িয়ে উঠে অরণ্য।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।তারপর একগ্লাস পানি খেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ভাবতে থাকে এ স্বপ্নের মানে কি!এতো বছর তো শুধু আংটি পরানোই দেখতো।আজকে সিঁদুর দান দেখলো।আংটি টা তো একই আছে।উপমার হাতে যেটা থাকে।তবে কি ক্রমশই খুলবে এই রহস্যের জট।অপেক্ষায় থাকে অরণ্য।

#চলবে

#পরবর্তী_পর্ব

https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/962773780820008/

আংটি পর্ব_২

0

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতেঃ- অনামিকা ভট্টাচার্য্য

আংটি পর্ব_২

বনগাঁও সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের লেকচারার অরণ্য চ্যাটার্জী।ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস,ঐতিহ্যের প্রতি খুব আগ্রহ তার।পুরাতন জমিদার বাড়ি,ভাঙা রাজপ্রাসাদ,প্রসিদ্ধ মন্দির,পুরাকীর্তি এগুলো ওকে খুব টানে।ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় অরণ্য ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পেয়ে জেলা পর্যায়ে ফার্স্ট আর সারা বিভাগে মধ্যে ফোর্থ হয়েছিল।স্বভাবতই সবাই ভেবেছিলেন অরণ্য সায়েন্স নিয়ে পড়বে।কারণ কেউ পড়াশুনায় ভালো হলেই আমরা ধরে নেই যে সে হয় ডাক্তার নয়তো ইঞ্জিনিয়ার হবে।অথচ রবি ঠাকুর, নজরুল ইসলাম,জয়নুল আবেদিন ওদের কারোরই যে সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো না এটা কারোরই মনে থাকে না।

যা-ই হোক,অরণ্য নাইনে উঠে মানবিক শাখায় ভর্তি হওয়াতে সবাই খুবই অবাক হয়েছিলেন।অনেকেই উপযাচক হয়ে অনেককিছু বুঝালেন।কিন্তু কারো কথায়ই কোন কাজ হয় নি।অরণ্যের এক কথা।হয় মানবিকে পড়বে,নয়তো পড়াশুনা ছেড়ে দেবে।একমাত্র ছেলের জিদের কাছে বাবা-মা হেরে যান।তারপর ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিসিএস পাস করে এই বনগাঁও সরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে পাঁচ বছর ধরে কর্মরত আছে।

আজ এই কলেজে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন একজন লেকচারার এসে জয়েন করবেন।সেটা নিয়ে সবাই খুব বিজি।যদিও এটা বাংলা ডিপার্টমেন্টের বিষয়,তবু নতুনকে নিয়ে সবারই আগ্রহ আছে।তার ওপর প্রথমবারেই বিসিএসে ঠিকে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।তাই নতুন অতিথি কে দেখার জন্য সবাই অপেক্ষায় আছেন।

সকাল দশটায় উপমা এসে কলেজে পৌঁছায়।পরনে নীল জামদানি শাড়ী।থ্রী কোয়ার্টার ডিজাইন করা ব্লাউজ।চুলে লম্বা বেনী করা।কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ।ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। ম্যাচিং কানের দুল।সবমিলিয়ে উপমাকে আজ অন্যরকম লাগছে।বাংলা বিভাগের স্টুডেন্টরা ওকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়।প্রথম দিন হওয়ায় একটু নার্ভাস লাগছিলো উপমার।কিন্তু সবার আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ উপমা।স্টুডেন্টদের জন্য চকলেট নিয়ে এসেছিল উপমা।এক এক কার্টুন করে এক এক ইয়ারে পিয়নকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হলো।নতুন ম্যাডামকে দেখে তো ছাত্র-ছাত্রীরা ফিদা হয়ে যায়।এতো সুন্দরী ম্যাডাম!কি মিষ্টি হাসি।সবচেয়ে ফাঁকিবাজ ছাত্রটাও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এই ম্যাডামের ক্লাস কিছুতেই মিস করবে না।ছাত্রীদের মধ্যে ম্যাডামের শাড়ী,স্টাইলিশ ব্লাউজ,ম্যাচিং কানের দুল এগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হলো।সবচেয়ে অবাক হলো ম্যাডামের ফাঁকা সীঁথি দেখে।তবে ম্যাডামের সাহস আছে বলা যায়।নইলে এতোদূরে একা একা চলে আসেন।

নিজ বিভাগে পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর প্রিন্সিপাল স্যার নিজে উপমাকে নিয়ে গিয়ে সব ডিপার্টমেন্টের টিচার্সদের সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন।সবার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো উপমার।অনেক সিনিয়র জুনিয়র কলিগরা আছেন।যদিও প্রতিটা ডিপার্টমেন্টেই স্যারদের সংখ্যাই বেশী,তবু ম্যাডামরাও একেবারে কম নয় সংখ্যায়।সবশেষে আসলেন ইতিহাস বিভাগে।একে একে সবার সাথে পরিচয় শেষে এবার অরণ্যের পালা। অরণ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার পর উপমা নমস্কার জানালো।ঠিক তখনি অরণ্যের মাথাটা ঘুরে গেলো।কোনমতে নমস্কারের প্রতিউত্তর দিয়ে ক্লাস আছে বলে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো অরণ্য।ব্লু চেক-শার্ট আর কালো ফরমাল প্যান্ট পরা অরণ্যর আচরণ বেশ অদ্ভুত লাগলো উপমার কাছে।

ক্লাসে সর্বদা মনোযোগী অরণ্য স্যারকে আজ বেশ উদাসীন দেখাচ্ছে।যেটা ছাত্রদের চোখে পড়েছে।আসলে ক্লাসের মাঝেও উপমার কথা মনে হতে লাগলো অরণ্যর।উপমা বলতে উপমার হাতের ঐ আংটিটার কথাই ভাবতে লাগলো অরণ্য।এটা কি করে সম্ভব।ঐ আংটিটা দেখেই মাথা ঘুরে যায় অরণ্যের।অরণ্য ছোটবেলা থেকে প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখে।একটা ছেলে একটা মেয়েকে আংটি পরিয়ে দিচ্ছে।এই একই স্বপ্ন সে বার বার দেখে।মাকে বলার পর মা বলেছে স্বপ্নের কোন ব্যাখ্যা হয় না।বড় হবার পর বন্ধুদের সাথেও বিষয়টা শেয়ার করেছে।বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলেছে ও নাকি মনে মনে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে আছে।তাই এমন স্বপ্ন দেখে।অথচ এই কথাটা একদম ঠিক নয়।বিয়ে শাদী নিয়ে অরণ্যের মাঝে কোন ফ্যান্টাসি নেই।বিয়ে দূরে থাক, আজ পর্যন্ত একটা প্রেমও করে নি অরণ্য।অথচ স্বপ্নে দেখা সেই আংটিটাই আজ উপমার হাতে দেখলো অরণ্য।স্বপ্ন সত্যি হলো কি করে!কিন্তু পুরোটা তো সত্যি হয় নি।কিছুটা গড়মিল রয়েছে।এই রহস্যটা যেভাবেই হোক ভেদ করতে হবে অরণ্যকে।মাথায় কেমন একটা যন্ত্রণা হচ্ছে।না,আজ আর ক্লাস নিতে পারবে না অরণ্য।

কয়েকদিন পরের ঘটনা।কলেজ লাইব্রেরীতে বসে বই পড়ছে উপমা।ওকে দেখেই এগিয়ে আসছে অরণ্য।এই তো উপমার বাঁ হাতের অনামিকায় বসানো আছে সেই আংটিটা।এই আংটি অরণ্যের খুব চেনা।স্বপ্নে দেখেছে একটা ছেলে একটা মেয়েকে এই আংটিটা পরিয়ে দিচ্ছে।কিন্তু ছেলে-মেয়ের চেহারা কখনোই স্বপ্নে দেখে নি অরণ্য।শুধু হাত দুটোই দেখেছে।স্বপ্নে দেখা সেই হাতের সাথে উপমার হাতের কোন মিল নেই।সেই দুইখানি হাত হলো শ্যামলা রঙের অতি সাধারণ হাত।আর উপমার হাত হচ্ছে টকটকে ফর্সা।খয়েরী রঙের নেইলপালিশ আঙুলের শোভাবর্ধন করেছে।অবিকল সেই আংটি।কি বলবে না বলবে মনে মনে ঠিক করে নিলো অরণ্য।যদিও অরণ্য খুব মিশুকে স্বভাবের ছেলে।যে কারো সাথে সহজেই বন্ধুত্ব করে নিতে পটু সে।তবু আজ কেমন জানি একটু একটু টেনশন হচ্ছে।তবু মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেলো উপমার দিকে।অরণ্য মুখোমুখি চেয়ারে বসে বললোঃ-

-যা-ই হোক,আমার মতো আর একজন তো পেলাম যে কিনা এতো ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট নিয়েও আর্টসে পড়াশুনা করেছেন।

-হাহাহা…….আমি আসলে ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যানুরাগী।আপনি যেমন অতীতকে ভালোবেসে ইতিহাসকে সঙ্গী করে নিয়েছেন,আমার ক্ষেত্রেও তা-ই।
-আমার খবর কি করে জানলেন?

-আমাদের বিভাগের রিমি ম্যাডাম বলছিলেন সেদিন।উনি তো আপনার ক্লাসমেট।

-ও হ্যাঁ।রিমি কি বললো?আমার রেকর্ডস ভেঙে যাওয়ার কথা?

উপমা প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে মিষ্টি করে হাসলো শুধু।

-আসলে কি জানেন তো ম্যাডাম।এতোদিন পর্যন্ত সকল টিচার্সদের মধ্যে আমার একাডেমিক রেজাল্ট ছিলো সবার ওপরে।আপনি সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন।রিমি তো সবসময়ই বলে,রেজাল্ট নিয়ে এতো লাফালাফি করিস না।দিনরাত পড়ার টেবিলে মুখ গুজে বসে থাকলে ওমন রেজাল্ট সবাই করতে পারে।পড়াশুনা ছাড়া তো আর কোন কর্মই পারিস না।আমাদের মতো মাল্টি ট্যালেন্ট হলে বুঝতি।আপনিই বলুন, অন্যদিকে মন দিলে পড়াশুনায় বিঘ্ন ঘটতো না?এমন রেকর্ডস মার্কস পাওয়া কি সম্ভব হতো?আপনি এসবের মর্ম বুঝবেন।ও হ্যাঁ,রিমি কিন্তু খুব ভালো গান গায়।সামনেই তো নবীনবরণ অনুষ্ঠান আছে।তখন শুনতে পাবেন।
-ওহ,আচ্ছা।এখন আমার একটা ক্লাস আছে।উঠছি তবে।বলেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো উপমা।

অরণ্য বসে বসে ভাবছে।যাক,বাবা!আসল কথাই তো জানা হলো না।আংটির ব্যাপারে কথা বলার জন্যই তো এতোক্ষণ কথা বললো।থাক।সমস্যা নেই। একই কলেজে যখন আছে,অারো অনেকবারই তো দেখা হবে।অন্য কোনদিন জেনে নেয়া যাবে।

#চলবে

#পরবর্তী_পর্ব

https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/962498257514227/

আংটি পর্ব_১

0

আংটি পর্ব_১

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতেঃ- অনামিকা ভট্টাচার্য্য

এ গল্পের নায়িকার নাম হচ্ছে উপমা।নামের মতোই সুন্দর সে মেয়ে।যাকে বলে একেবারে রূপে লক্ষী,আর গুণে সরস্বতী।বিধাতা অতি যত্ন করে রূপে-গুণে সাজিয়েছেন মেয়েটাকে।দুধে-আলতা গায়ের রঙ।স্বচ্ছ দীঘির মতোই টলমল করছে টানা টানা চোখ দুটি।ডালিম ফলের মতো রাঙা দুটি ঠোঁট।মায়াবী চেহারা!মাথা ভর্তি দীঘল কালো চুল পিঠ ছাড়িয়ে গেছে।লম্বা, ছিপছিপে গড়নের মেয়ে।

এতো গেলো রূপের বর্ণনা।এবার গুণের কথায় আসি।সর্বদা স্বল্পভাষিণী,সুহাসিনী,মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে উপমা।বিদ্যা দেবীর কৃপায় জীবনের কোন পরীক্ষায় ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয় নি সে।মা সরস্বতী ওকে কন্ঠ ভরা সুর দিয়েছেন।নটরাজের আশীর্বাদ আছে উপমার মাথার ওপর।তাই তো সে নাচে-গানে সমানভাবে পারদর্শী।

বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে উপমা।আমাদের দেশে যেখানে কলেজের গন্ডি পেরোনোর আগেই অধিকাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়,সেখানে উপমার মতো মেয়ে এখনো অবিবাহিত।এটা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়!
উপমা দু বছর আগে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে।সাহিত্যের ছাত্রী ছিলো সে।মধুসূদন বাবুর মতোই বাংলা ভাষার অমৃত সুধা পান করেছে সে।তাই তো ভাষা কে ভালোবেসেই অন্য সব সাবজেক্ট বাদ দিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাকেই বেছে নিয়েছিলো।শুরু থেকেই শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ ছিলো।সেভাবেই প্রিপারেশন নিয়েছে।প্রথমবারেই সফলতার সহিত বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।এখন পোস্টিং এর অপেক্ষায় আছে।
এর মাঝেই উপমার বিয়ের জন্য অনেকগুলি প্রপোজাল এসেছে।কিন্তু কথায় আছেঃ-

“অতি বড় সুন্দরী না পায় বর
আর অতি বড় ঘরণীর না হয় ঘর”।

উপমার ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে।একটার পর একটা বিয়ের সম্মন্ধ আসে।আবার কোন এক অদৃশ্য কারণে সেটা ভেঙেও যায়।এই তো গতবছর ওই ডাক্তার ছেলে যে কি-না কোন এক বান্ধবীর বিয়েতে উপমাকে দেখে পছন্দ করেছিলো।তার পরিবার নিজে থেকেই এসে উপমাকে আশীর্বাদ করে যান।খুব আগ্রহ ছিলো উনাদের।বিয়ের দিন-তারিখও প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিলো।অবশেষে পাত্রের বাবা ফোন করে সবকিছু বাতিল করে দেন।।উপমা উড়ো উড়ো শুনেছে সেই ছেলে নাকি মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট করে ছয়মাস হসপিটালাইজড ছিলো।কোনমতে বেঁচে ফিরেছে।এরকম ঘটনা আরো কয়েকবার ঘটেছে।উপমাকে দেখে যাবার পরই নাকি পাত্রপক্ষের পরিবারে কোন না কোন অঘটন ঘটে।তা-ই বিয়ে বাতিল হয়ে যায়।

উপমা আধুনিক যুগের শিক্ষিত মেয়ে।এসব বিষয় খুব একটা পাত্তা দেয় না।বিয়েটাই ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।বিয়ে হলে হবে,না হলে নাই।তার থেকে ও ক্যারিয়ারের বিষয়েই বেশী কনশাস।উপমার বাবা-মা কিছুটা চিন্তিত হলেও কোথাও একটা স্থির বিশ্বাস আছে উনাদের মেয়ের বিয়ে খুব ভালোভাবেই হবে।শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।কিছু আত্মীয়স্বজন,বন্ধু-বান্ধব আকারে ইঙ্গিতে বুঝাতে চান উপমা একটা অপয়া মেয়ে।
হায়রে আমাদের সমাজ!একদিন যারা উপমাকে নিয়ে গর্ব করতো,নিজেদের সন্তানদের কাছে উপমাকে আইডল সাজাতো।তারাই আজ উপমাকে অপয়ার অপবাদ দিচ্ছে।এখনো এ সমাজে বিয়েটাই যেন একটা মেয়ের যোগত্যার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি।অবশ্য উপমার বাবা-মা কখনোই তা বিশ্বাস করেন না।উনাদের কাছে মেয়ে আগের মতোই আছে।মেয়ের জন্মের পর বাবার ব্যবসা দিন দিন বেড়েই চলেছে।ছোটবেলা থেকেই কতো সুনাম কুড়িয়ে এনেছে মেয়েটা।

এরমাঝেই একদিন সুখবরটা আসে।উপমার পোস্টিং হয়েছে কোন এক উপজেলা শহরে।আগামী সপ্তাহেই জয়েন করতে হবে।উপমার এতোদিনের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।এতে ওর বাবা-মাও খুব খুশী।কিন্তু মেয়ের এতোদূরে পোস্টিং হওয়ায় মনটা কিছুটা খারাপ।একটা অচেনা অজানা জায়গায় মেয়েটা চাকরি করতে যাবে।তাও বিবাহযোগ্য সুন্দরী কন্যা।তাছাড়া মেয়েটাকে না দেখে থাকবেন কিভাবে।কিন্তু উপমা ওদেরকে বুঝায় যে বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে না দেখে থাকার কিছু নেই।ভিডিও কলে রোজ দেখতে পাবেন মেয়েকে।আর এখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব উন্নত।যে কোনদিন মেয়েকে দেখতে যেতে পারবেন।আর উপমাও তো ছুটি পেলেই বাড়িতে আসতে পারবে।তাতে বাবা-মা কিছুটা আশ্বস্ত হোন।যেহেতু আগামী সপ্তাহেই জয়েন করতে হবে,তাই উপমা সবকিছু গুছগাছ করা শুরু করে দেয়।কিছু টুকিটাকি শপিং করতে হবে।কয়েকটা শাড়ী,দুটো শীতের পোশাক,একটা রেইনকোট,একটা ফার্স্ট এইডেড বক্স আর কিছু কসমেটিকস কিনে নেয় উপমা।এরপর ব্যাগ প্যাক করে নিতে হবে।

তারপর একদিন সকালবেলা অচেনা কর্মস্থলের উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়ে যায় সে।যদিও উপমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছিলো বাসা ছেড়ে যেতে।ছেলেবেলার কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাসায়।ছাদের ওপর উপমার বসার একটা আলাদা জায়গা আছে।নিজের রুমের বেড,চেয়ার,টেবিল, বুকশেলফ,আলমারি, আয়না, সবকিছুর ওপরই মায়া লেগে আছে।তবু বাবা-মার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মন খারাপ ভাবটাকে দূরে স্মরিয়ে রাখলো উপমা।হাসিমুখে বিদায় নিলো।বাসা থেকে বের হতেই মনে হলো এই চেনা গলি,পরিচিত মুদির দোকান,ফ্ল্যাক্সি লোডের দোকান,পাড়া প্রতিবেশী সবকিছুই মিস করবে ভীষণ রকম।

বাবা স্টেশনে ছেড়ে দিলেন ওকে।বাসে বসে ম্যাগাজিন পড়া শুরু করলো উপমা।কিছুক্ষণ পর টিফিনবক্স টা বের করলো।মা রুটি-চিকেন বানিয়ে দিয়েছেন।পরিচিত হাতের রান্নার সুগন্ধ নাকে এলো।আর বহুদিন মায়ের হাতের রান্না খেতে পারবে না।বাবা ফল কিনে দিয়েছেন।বাবা-মায়ের আদরগুলি ব্যাগে ভরে নিয়ে নতুন জায়গায় যাচ্ছে উপমা।জানিনা নতুন জায়গায় কি অপেক্ষা করে আছে উপমার জন্য।

বাসায় এসে মেয়ের জন্য খুব মন খারাপ হয় উত্তম বাবুর।ঘন্টায় ঘন্টায় মেয়েকে ফোন করেন।মেয়েটা নিরাপদে পৌঁছাতে পারলেই বাবা নিশ্চিন্ত হোন।

লং জার্নি শেষে গন্তব্যে এসে পৌঁছে উপমা।এখানে কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থা আছে।স্টেশনে নেমে সিএনজি ভাড়া করে নিজের বাসস্থানে পৌঁছে যায়।এখানকার কেয়ার টেকার রুস্তম চাচা ওর রুম দেখিয়ে দেন।এসেই স্নান সেরে নেয় উপমা।তারপর বাবা-মার সাথে কথা বলে লম্বা একটা ঘুম দেয়।ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা খায়।রাতের খাবার রুমে এসে দিয়ে যায় এক মহিলা।আগামীকাল কলেজে জয়েন করবে।এটা নিয়ে খুব বেশী এক্সাইটেড উপমা।রাতে ভালো ঘুম হয় না।খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়।ঘুম ভাঙতেই মায়ের কথা খুব মনে পড়ে উপমার।প্রতিদিন এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙতো ওর।এলার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে যেতো ও।মা এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেন।সকালের মিষ্টি রোদ এসে ঘরে ঢুকতো।মা ওকে আদর করে ডেকে তুলতেন ঘুম থেকে।ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে পড়তে বসতো সে।রুটিন করে গানের রেওয়াজ করতো।মা তখন আদা-চা বানিয়ে দিতেন।রাত জেগে পড়লেও মা ফ্লাস্কে চা বানিয়ে রাখতেন মা।মাঝে মাঝে অকারণেই মায়ের সাথে রাগারাগি করতো।মা সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিতেন।আগে এসব নিয়ে কখনো ভাবে নি উপমা।এখন দূরে এসে কেবল মনে পড়ছে কেন যে মায়ের সাথে এতো রাগ দেখাতো।আর কখনো এমনটা করবে না।এসব ভাবতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো উপমার।চাকরি পাবার পর এতো খুশী হয়েছিল উপমা।তখন বুঝতে পারে নি একা থাকতে এতোটা কষ্ট হবে।যা-ই হোক,উপমা খুব বাস্তববাদী মেয়ে। কিছুতেই ভেঙে পড়বে না সে।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে আট টা বেজে গিয়েছে।স্নান করতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।

#চলবে

#পরবর্তী_পর্ব

https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/962284550868931/

প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)

1

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
লেখায়: তানিয়া তানু

আজ আমার বিয়ে। তবে বিয়ের আয়োজন তেমন জাঁকজমক নেই। খুব সাদামাটা। এই বিয়েতে শুধুমাত্র ঐ বাড়ির আর এর বাড়ির লোকরাই থাকবে। তার সাথে নিলাদের পরিবারও। আপাকে বার বার ফোন করা হয়েছে। কিন্তু ফোন ধরেনি। ভেবেছিলো কোনো প্রয়োজনে ফোন করেছি।

পার্লার থেকে বিউটিশিউয়ান অয়ন আনিয়েছে। ওর মতে বাইরের জাঁকজমক না থাকলেও চলবে। কিন্তু আমার প্রেয়সীকে আমি সাজিয়েই নেবো। আমিও আর দ্বিমত পোষণ করিনি। বিয়ে নিয়ে সবারই একটা ইচ্ছা থাকে। তাই সেজেছি। বর্তমানে সাজুগুজু সব শেষ। উনার অপেক্ষায় কনে সেজে বসে আছি ।

“আপা, নিলা আপা এসেছে।”
বিথীর কথায় ভাবনা জগত থেকে ফিরে দেখলাম নিলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় আমার বিয়ে নিয়ে তেমন আনন্দ দেখলাম না। নিলা ঘরে আসতেই দেখলাম রামিসাও তার সাথে এসেছে। তবে ওরে নিয়ে আর কোনো রাগভাব নেই। কারণ আমি চাই আকাশ ভাইয়াও সুখী হোক।

“ওহ হো দীপ্তি, সেজে তো তোকে পুরো বান্দর লাগছে।” আমার কাছে এসেই এই কথাটা বললো।

নিলার এমন কথায় অবাক হলাম। পরক্ষণে মজা করেছে বলে মলিন হাসি দিলাম।

“আচ্ছা, তোর মনে হয় না,বাদরের গলায় মানে তোর গলায় মুক্তোর মালা পড়েছে।”

নিলার অপমানজনক কথা শুনে চোখে জল চলে এলো। ছলছল চোখে না বুঝার ভান করে ওর দিকে তাকালাম।

“তুই না কোনোদিন সুখী হবি না। দেখিস, এটা আমার অভিশাপ রইলো।”
ওর এমন কথা শুনে বললা,
“কী হয়েছে নিলু? অভিশাপ দিচ্ছিস কেন?”

“চুপ কর দীপ্তি। আমকে নিলু বলে ডাকবি না। অবশ্যই তোর মুখ থেকে আমি একটা কথাও শুনতে চাই না।বিকজ আই হেইট ইউ দীপ্তি। আই হেইট ইউ। শুধু তোর জন্য আজ ভাইয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আই হেইট ইউ। আর হ্যাঁ, আমাদের বন্ধুত্ব আজ থেকে এখানেই শেষ। আর এটাই তোর কাছে আসার শেষ দিন।” এতটুকু বলেই কাঁদতে কাঁদতে নিলা চলে গেল।

এদিকে ওর কথা শুনে বুক ধক করে উঠলো। আকাশ ভাইয়ার কী হয়েছে? আমাকে এমনভাবে তিরস্কার করারই বা কারণ কী? আমি কী করেছি?

নিলা চলে যাবার পর রামিসা আমার পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “খুব সুন্দর লাগছে। আমিও এমন সাজে সাজবো কয়েকদিন পর। এমাসে আমারও বিয়ে। এসো কিন্তু। যাইহোক, দীপ্তি তুমি কি জানো, মেয়েদের ছয়টা ইন্দ্রিয় থাকে। তারা এটা দিয়ে অনেক কিছু বুঝতে পারে। কিন্তু তুমি বুঝলে না।”

“কী বুঝিনি?”

“একটা ছেলে সেই ছোটবেলা থেকে তোমাকে এত ভালোবাসে। অথচ বলে নাই বলেই আজ তার ভালোবাসার মানুষ অন্য কারোর হতে চলেছে। জানো,আকাশ অনেক কষ্টে আন্টিকে রাজি করিয়েছে। শেষে একমাত্র ছেলে বলে তোমাকে বাড়ির বৌ বানাতেও রাজি হয়েছিলো। এতে কী খুশিটাই না আকাশ হয়েছিলো! কিন্তু আজ কী থেকে কী হয়ে গেল! ভালোবাসা পেলো না বলেই মা, বাবা আর বোনকে ছেড়ে বিদেশ চলে গেছে।”

ওর এই কথা শুনে জলে পূর্ণ হলো আমার চোখ। তার মানে এতদিন আকাশ ভাইয়া আমাকে ভালোবাসতেন।

“আসি। সুখী হও। আর।হ্যাঁ, আমার বিয়েতে এসে কিন্তু। জানো আমার আর আমার বয়ফ্রেন্ডকে এক করতে আকাশ অনেক কিছু করেছে। আজ সেই বন্ধুই আমার বিয়েতে থাকতে পারবে না।”
এই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ থেকে বললো, “এই নাও আকাশ তোমাকে এটা দিয়েছে। এই বলেই একটা গিফট দিয়ে মলিন মুখ নিয়ে চলে গেল।

গিফট বক্স খুলে দেখলাম নীল চুরি। সেবার ক্লাস সেভেনে থাকতে এক মেলায় ভাইয়া আমার জন্য এই চুরি কিনেছিলেন। আমি কত করে বললাম এইটা এখন দাও। কিন্তু ভাইয়া বলতো, সময় হলেই দেবো। আজ বোধয় তার সময় হলো। আকাশ ভাইয়া এতই যখন ভালোবাসতে তখন বললে না কেন? তাহলে তো আজ,,,,
নাহ আকাশ ভাইয়ার কথা আমি ভাববো না। সে যেহেতু বলেই নাই। তাহলে তার কথা ভেবে কী লাভ? আমার মনে তো একখন শুধু উনিই আছেন। উনাকে রেখে অন্য কাউকে নিয়ে ভাবা ঠিক না।

কবুল বলার সময় গলা আটকে যাচ্ছে। কোনো কথাই বের হচ্ছে না। না জানি কিসের জন্য! আজ আমার ভিতর আর বাহিরের মালিকের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়ার জন্যই বহুক্ষণ পর কবুল বললাম।

এক গাড়িতে আমি আর উনি। অন্য গাড়িতে উনার আত্মীয়। আর আরেক গাড়িতে আমার পরিবার। এই বাড়ির সব স্মৃতি তালা মেরে বন্ধ করে দিয়ে এলাম। গাড়ি চলছে উনার বাড়ির দিকে। কিন্তু মনে হচ্ছে বেবলি আমাকে ডাকছে। আমার গাড়ি ধরার জন্য দৌড় দিতে দিতে বলছে, আপা যাস না। তোদের ছাড়া বাবা আর আমি থাকবো কীভাবে? এই আপা, আপা,,
ডাক দেওয়ায় পিছনে থাকালাম। সেখানে উড়ন্ত ধুলাবালি ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমি মাথা বের করে সেই বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। যতক্ষণ না আড়াল হয়।

আচমকা কারোর শীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘুরে উনাকে দেখে ঝাপিয়ে পড়লাম উনার বুকে।কেঁদে কেঁদে উনার বুক ভাসিয়ে দিচ্ছি। উনি হাত বুলিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

রাত্রে আবারও নতুন করে দিবিয়া সাজিয়ে দিলো। ওর বিয়ে এ মাসেই ঠিক হয়েছে। পরের মাসে চলে যাবে। এখন এই সাজানো রুমে বসে আছি। বেলীফুলের সুবাসে পূর্ণ হলো ঘর। মনের মধ্যে আনন্দের জোয়ার। একটা মনের মানুষ পেলাম। পেলাম একটা সংসার। পেলাম প্রয়োজন ভাগ করার মানুষ।

স্নিগ্ধময় সকালে পর্দায় ভেদ করার খানিক সূর্যের আলোয় ঘুম ভাঙলো। কিন্তু মহাশয় এখনো ঘুমে বিভোর। পর্দা আর জানালা খুলে দিলে সূর্যের পূর্ণ আলো উনার চোখে মুখে এসে পড়ছে। উনি হাত দিয়ে মুখ ডেকে বললেন,
“কী হলো? এমন করছো কেন? ঘুমোতে দাও না। কাল তো ভীষণ জ্বালিয়েছো।”
উনার এই কথা শুনে কোমরে হাত দিয়ে রাগি চোখে তাকিয়ে বললাম, কাল আমি না আপনি আমাকে জ্বালিয়েছেন।”
“তাই নাকি। তাহলে এখন দেখা যাক কে জ্বালায়? যে এখন জ্বালাবে সে রাত্রেও জ্বালিয়েছে মনে হবে।”
এই বলেই কাছে আসলে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে চলে আসলাম বাইরে। ড্রয়িংরুমে নিয়ন আর বোনেরা খেলছে। দিবিয়া ফেসবুকিং। মা আর ফুপি রান্না ঘরে ব্যস্ত। এদের এমন দেখে মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেল। আনন্দে শিহরিত হলো মন। তবে মনের কোণায় স্মৃতি আর বাবার জায়গাটা এখনো অপূর্ণ রয়ে গেল।
এমন সুখময় দিনে আপার কথাও বেশ মনে পড়লো। কত ফোন করলাম! কিন্তু একটাও রিসিভ করেনি। তাই এবার ভাবলাম চিঠি লিখে নেই। কুরিয়ারে দিয়ে দিলে গিফট হিসেবে আনন্দে গ্রহন করবে। কোনো প্রকার বাঁধা দিবে না। চিঠির খামে শুভাকাঙ্ক্ষী লিখে দিবে। ভিতরে নিজের কথা। যেই ভাবা সেই কাজ। উনি বাথরুমে যাওয়ার সুযোগে খাতা কলম নিয়ে বসে গেলাম।

প্রিয় আপা

ফোন তো ধরলি না তাই চিঠি লিখতে বাধ্য হলাম। সে যাইহোক, আশা করি দুলাভাই আর সংসার নিয়ে খুব ভালোভাবে জীবনযাপন করছিস। সুখেই আছিস। আমিও সুখে আছি। জানিস আপা, তুই চলে যাবার পরপরই না আমার জীবন বদলে গেছে। বিষাদময় দিনের কালো আঁধারে ঢাকা মেঘ সরে এক চিলতে রোদ হিসেবে এসেছে অয়ন। তবে ও বহু পূর্বে মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছিলো। সময় বুঝে ঠিক বৃষ্টির নামার খানিক পর রোদ্দুরে বৃষ্টি হয়ে এসেছে। এমন বৃষ্টিমুখর দিনে রোদের আলো দিয়ে সব প্রয়োজন মিটিয়ে দিয়েছে। তুই তো পূর্বে থেকেই জানিস, মায়ের শখ ছেলেদের মুখে মা ডাক শুনা। তাই পাঁচ মেয়ের জামাইকে নিজের সন্তান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলো। কিন্তু তোর জামাই অর্থাৎ স্বার্থপর দুলাভাই নিজের প্রয়োজনে আমাদের প্রিয়জন হয়েছে। তাই তো এমন দুঃসহ সময়ে কেটে পড়েছে। কিন্তু অয়ন ঐ যে পুলিশ ছেলেটা ও মায়ের বোনদের এমনকি আমার প্রয়োজনও মিটিয়েছে। কিছুটা অর্থ দিয়ে তবে বেশিরভাগ অংশই ভালোবাসা দিয়ে। যেটা তুই আর দুলাভাই করতে পারিস নাই। সে সময় অর্থের বেশ প্রয়োজন ছিলো না রে। প্রিয়জনের প্রয়োজন ছিলো। ছিলো এক টুকরো সান্ত্বনার। আপা জানিস, মানুষের প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না। প্রয়োজন আসে। বার বার আসে। তবে ভিন্ন রূপে। আমারও আসবে। সে যাইহোক,তোকে একটা কথা জানাচ্ছি, কাল আমার বিয়ে উনার সাথে হয়ে গেছে। মা,বিথী ও দ্যুতি বর্তমানে উনার বাড়িতেই আছে। ঐ বাড়ি বন্ধ। তবে চিরতরে নয়। কিছুদিনের জন্য। কারণ যখনই স্মৃতির আর বাবার কথা মনে পড়বে তখনই ঐ বাড়িতে যাবো। শুন, পারলে একবার দেখা করে যাস।

চিঠিটা এখানেই সমাপ্ত করছি। কারণ তোর সাথে বেশিক্ষণ কথা বলে লিখতে ইচ্ছে করছে না। তুই যে বড্ড স্বার্থপর আপা। ভালো লাগে না তোকে। জানি না কেন এমন করছিস। এত ফোন করলাম তাও ধরলি না। হয়তো এর আড়ালে তোর জীবনের অনেক কাহিনী লুকিয়ে আছে। যেটা বলবো বোন হিসেবে একদিন আমার কাছে ভাগ করিস। সান্ত্বনা না হয় এক আকাশ ভালোবাসা দিবো।
ভালো থাকিস। সুখে থাকিস।

ইতি তোর
অপ্রয়োজনীয় বোন

চিঠিটা লিখেই বালিশের তলায় রেখে জানালার কাছে গেলাম। এখান থেকে শহরের ব্যস্ততাময় মানুষের কাজ কর্ম খানিক দেখা যায়। যেগুলো খোলামেলা কাজ। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি আমার বাবাকে খুঁজছি। এই শহরের তিনি গাড়ি চালাতেন। এই বাড়ির অন্যদিক অনেক নিরিবিলি। সেদিকে গাড়ি চলাচল নেই। এটা সদর দরজার পাশে।

আচমকা কারোর শীতল হাতে স্পর্শ পেলাম। পিছন থেকে কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। গাঢ় নিশ্বাস পেলে কাঁধে মুখ গুজেছে। তবে এটা অয়ন সেটা বুঝতে বাকি নেই। এই ছেলেটার স্পর্শ চেনা আমার।

আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উনি বললেন, দীপ্তি,আমার কিন্তু ছোট্ট দীপ্তির প্রয়োজন!

_____সমাপ্ত_____

বিঃদ্রঃ অবশেষে ত্রিশ পর্বে সমাপ্ত হলো আমার প্রয়োজন উপন্যাস। সামাজিক উপন্যাস হিসেবেই লিখেছি। জানি না কতটুকু সামাজিক হয়েছে। তাই বলবে শেষে পুরো গল্প নিয়ে আপনার কিছু মন্তব্যে দিয়ে পরের গল্প লেখার অনুপ্রেরণা দিবেন। আর হ্যাঁ, ভুল তো আমার আছে। অনেক হয়েছেও। তাই বলবো সমালোচনা দিক দিয়ে যা মনে হয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলে দিবেন। শুধু বানান ছাড়া। কারণ অভ্র টাইপে তাড়াতাড়ি দুই পর্ব করে লিখতে গিয়ে অনেক ভুল হয়েছে। অনেক আপু তা বলে দিয়েছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা। বানান ছাড়া অন্য কোনো ভুল হলে তা অবশ্যই বলবেন।

বিঃদ্র ০২ঃ এই গ্রুপ থেকে অনেক ভালো পাঠক পেয়েছি। মূলত পাঠক হিসেবে ধরবো না। তাদের নিজের আত্মার আত্মীয় হিসেবেই ধরবো। তাদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা,কৃতজ্ঞতা অবশেষে ভালোবাসা দিয়েই সমাপ্ত করলাম।

প্রয়োজন পর্ব: ২৯

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২৯
লেখায়: তানিয়া তানু

ধর্ষণের পর হাজারটা শাহিন হাজারটা খুন করলেও তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে না।যদি তারা নাবালক হয়। শাহিনের বয়সও আঠারো বছর পেরোয়নি। তাই ওরও সর্বোচ্চ শাস্তি হবে না। বোনের এত কষ্টের মৃত্যু হলো। অথচ ওর অপরাধী তিন চার বছর পর ঠিকই বুক ফুলিয়ে রাস্তায় হাঁটা চলা করবে। ভাবতেই কান্নার দলা যেন পাকিয়ে আসছে।

“আপা, শুনো।”
সহসা বিথীর ডাক শুনে পিছনে তাকালে ও আমাকে অন্য জায়গায় আসতে বলে। এমনভাবে বলছে যেন কোনো গোপন কথা আমাকে বলতে যাবে। তাই যাতে কেউ না শুনে নিরিবিলি জায়গায় যাওয়া জন্য বললো। আমিও গেলাম। ওর দু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে অনেক কথাই বড় আপার সমন্ধে বললো। যা শুনে অবাক হলাম। আপা আর দুলাভাইয়ের কথোপকথন ও আড়াল থেকে শুনেছে। সেখান থেকেই বললো, আপার কাছে মা নাকি কাপনের কাপড় আর আরো টুকটাক জিনিসের জন্য টাকা খুঁজছিলো। এই টাকা দেওয়াতে নাকি ওদের দুজনের সমস্যা হয়েছে। বাবা মারা যাওয়ায় এখন সব প্রয়োজন নাকি এদের মিটাতে হবে। বাকি তিন বোনের বিয়ে, পড়ালেখার খরচ এদের ওপর নাকি দায়িত্ব বর্তাবে। তাই ওরা দায়িত্ব নেওয়ার আগেই এখান থেকে কেটে গেছে। তবে আপা নাকি বলেছিলো, বেবলিকে শেষবারের মতো দেখে যেতে। কিন্তু দুলাভাই এতে নারাজ।

এতক্ষণ আমি আর বিথী আমার ঘরেই কথা বলছিলাম। মায়ের কান্না শুনে দৌড়ে গেলাম সেখানে। বেবলিকে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু মা দিতে চাচ্ছেন না। এবারও বলছেন,” আমি আমার কোল খালি করবো না। আমার সন্তান আমার কাছে থাকবে। কেউই মাকে সান্ত্বনা দিতে পারছে না। এক প্রকার জোরাজুরি অবস্থা চলছে সেখানে।মায়ের এই অবস্থা দেখে আমি আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লাম।

কাঁদতে কাঁদতে আমি মায়ের কাছে যাবার পূর্বে উনি মায়ের সামনে হাটু ভেঙে বসে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললেন, জানেন, আপনার মতো আমিও এমন মৃত্যু দেখেছি। আপনি বুঝদার মানুষ। কিন্তু আমি যখন এমন মৃত্যু দেখেছি তখন আমার বয়স তেরো ছিলো। আমার ছোট ভাইয়ের বয়স ছয় বছর ছিলো। তখন একটা এক্সিডেন্টে আমার ছোট বোন যে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিলো। যার জন্যই বাবা-মা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার সময় একটা বাস তাদের ধাক্কা দেয়। পুরো গাড়ি ভেঙে টুকরো হয়ে যায়। ওদের সাথে না শেষ সময়ও কথা বলতে পারিনি। কারণ ওরা এক্সিডেন্টের সময়ই মারা যায়। জানেন, ওদের চেহারায় পুরো রক্তাক্ত ছিলো। মুখ।বিভৎস হয়ে গিয়েছিলো। সে সময় না আমি লুকিয়ে কেঁদেছি। কখনো সেই ভাইটার সামনেও কাঁদেনি। কাউকে বুঝতেই দেয়নি আমি আমার মা-বাবা আর সেই ছোট্ট বোনটাকে হারিয়েছি। নিজেকে বুঝ দিয়েছি। বলেছি, আমাকে সবল হতে হবে। ভাইকে সামলাতে হবে। আপনিও দেখুন না এইভাবে কাঁদার পর তারা নিজেদের কান্না আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজেদের দুর্বল করে দিয়েছে। ঐ পিচ্চি দুটোকে দেখুন আপনার এমন কান্না দেখে কেমন করে কাঁদছে। স্মৃতিকে যেতে দিন। ওর এখন আপন জায়গায় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
এতটুকু বলেই উনি থেকে গেলেন। এক দৃষ্টিতে মায়ের ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন। মা তো সেই বোন দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের কাছে ডেকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। শেষে চোখ মুছে ওদের ঘরে যেতে বলায় ওরাও চলে গেল। মা এবার উনার দিকে তাকালেন। উনি এবার জোরে দম নিয়ে বললেন, জানেন, আমি আর আমার ভাই সেই কবে থেকে আমা ডাকি না! মায়ের মমতা পাইনি। ফুপির পেলেও তিনি এক বছর পরই বিয়ে করে বিদেশ চলে যান। আমাদের দায়িত্ব দিয়ে যান আমাদের বাড়ির এক আত্নার আত্মীয়কে। আমাদের কাজের লোক মকবুল চাচাকে। উনি বাবার দায়িত্ব কিছুটা পালন করতে পারলেও মায়েরটা পারেননি। মা ছাড়াই আমরা বড় হয়েছি। সেই মায়ের প্রয়োজন এখনো আমাদের আছে। আপনি কী আমাদের মা হবেন?”

উনার এই কথা শুনে মা অবাক হলেন। তার সাথে উনার কথার মর্মও বুঝতে পারলেন না। উনি একটু থেকে আবাও মাকে বললেন,
“আমি দীপ্তিকে বিয়ে করতে চাই। আপনাকে মা ডাকতে চাই। দুটো পিচ্চি বোনকে পেয়ে আমার মৃত বোনের প্রয়োজন মিটাতে চাই।”

উনার কথায় মায়ের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটলো। মা আনন্দে কেঁদে দিলেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। আমিও মায়ের মতো অনেক খুশি।

মা উনার গাল দুটোতে হাত রেখে বললো, “তুই আমার ছেলে হবি। আমাকে মা মা বলে ডাকবি। জানিস, বড় মেয়ের জামাই না আমাকে বেশি মা ডাকেই না। আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। আমি না চাই। কোনো ছেলে সারাক্ষণ আমাকে মা মা বলে ডাকুক। আমার ছেলের প্রয়োজন মিটাক। তুই মিটাবি। আমার ছেলে হবি।”

উনিও কেঁদে কেঁদে মাথা নাড়ালেন। উনার মায়ের প্রয়োজন আর মায়ের ছেলের প্রয়োজন মিটলো আজ।

ওদের দিকে চেয়ে অন্যদিকে মনেই রইলো না বেবলিকে অনেক আগেই নিয়ে গেছে। আর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ভাইয়া। উনি মায়ের কাছে এগিয়ে মাকে কী বলবে তা ভেবে পেলো না। ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”খালা আমি জানাজায় যাচ্ছি।”
উনি আকাশ ভাইয়াকে দেখে বলল, দোস্ত,দাঁড়া আমিও যাবো।”
মা বললো, “তুই এতক্ষণে এলি।”
“খালা তুমি তো আমাকে বলোনি। আর খবরের কাগজে পড়েই আমি হতবাক হয়ে এখানে এসেছি। আর অয়ন তুই একটু পর আয়। আমার একটা কাজ আছে। ওটা খুব প্রয়োজন করার।
এই বলেই দৌড়ে চলে গেলেন।

উনি মায়ের দিকে এবার তাকিয়ে বললেন, “পাঁচ দিনের শিন্নির পরপরই আমি ফুপিকে পাঠিয়ে দেবো। এখানে আমি সব সময় আসবো। শুধু থাকবো না।”

এটুকু বলে চলে গেলেন।
রাত্রে আমার রুমে আমি, মা,বিথী, ও দ্যুতি জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়েছি। বেবলির সাথে আর ঘুমানো হবে না বলে অনেক কেঁদেছি। সাথেও মায়ের কান্নাও পুরো রাত জুড়ে শুনলাম।

বিষাদময় কেটে গেল ছয় দিন
এই ছয় দিনে অনেক কিছু ঘটেছে। বাবার পাওনাদাররা এসে বারবার বিরক্ত করেছে। এই জ্বলায় বাবার কথামতো গাড়ি বিক্রি করতে চাইলে উনি কিনে নেন। মা উনার কাছে বিক্রি করতে চাইলেন না। বললেন, এটা তোমাদের বিয়ের যৌতুক। উনি না করলে মা বলেন, লাগবে না কেন, বাবা?বড় মেয়ের বিয়েতেও দিয়েছি। তার জন্যই তো এত পাওনাদার।”
উত্তরে উনি সেদিন বলেছিলেন, মা, আমি তোমার ছেলে হই। আর যৌতুক আমি ঘৃণা করি। ওগুলোতে আমার সংসার পূর্ণ হবে না। তাই নেবোও না।
“ছেলেই যখন তাহলে বাবার গাড়িটা কিনতে চাইছিস কেন?”
“বাবার গাড়িটা কিনতে চাই নিজের জন্য। আর ঐ টাকা দিয়ে তোমরা পাওনাদারদের দিয়ে দিবে।”

“তুই তো বাবা পুলিশ। গাড়ি দিয়ে কী করবি?”
“মা, এটা দিয়ে সপ্তাহে একদিন তোমাদের সকলকে নিয়ে ঘুরতে যাবো।”

উনার এই কথায় মা অনেক খুশি হলেন। নিয়নও সেদিন মাকে মা বলে ডেকেছিলো। মা তো দু দুটো ছেলে পেলেন। তাই খুশিতে তিনি আত্মহারা।

বাড়ি রঙ করা হয়েছে। উনার ফুপি আর দিবিয়া শিন্নির দিন এসেছিলো। পুরো শিন্নীর আয়োজনে তিনি থাকলেও আকাশ ভাইয়া আর কোনোদিন আসেনি। নিলাও না। এতে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। কেন ওরা আসেনি।

দিবিয়া আর ফুপির এমন সুন্দর ব্যবহারে মা এক্কেবারে অবাক। তিনি ভাবতেই পারেননি ওনাদের ব্যবহার এত সুন্দর হবে। এত শ্রদ্ধা করবে। মা তো আমাকএ রাজ কপালী হিসেবে উপাধি দিয়ে দিয়েছেন। উনারা বিয়েটা ঘটা করে আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাতে রাজি নই। কারণ চাই না বড় করে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান হোক। নাচ-গান হোক। এতে যে বেবলির ইচ্ছা গুলো খুব কাঁদায়। আচ্ছা কেন এমন হলো? কী দোষ বেবলির ছিলো?

ঠিক হলো সাতদিন পরই আমাদের বিয়ে। আর এই বিয়েতে কয়েকজন আত্মীয় ছাড়া আর কেউই থাকবে না। শ্বশুরবাড়িতে শুধু আমি নয় আমআর পুরো পরিবার যাবে। কারণ এই বাড়িতে থাকলে অতীত বার বার হৃদয়ে হানা দেব।

চলবে„„„„„

প্রয়োজন পর্ব: ২৮

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২৮
লেখায়: তানিয়া তানু

শানুদের গাড়ি থামলো নদীর পাড়ে। বেশ নির্জন জায়গা। শহর থেকে বহু দূরে। এখানে মানুষ তো দূরের কথা কোনো প্রানীই আছে কী না তাতে সন্দেহ। শুনশান পরিবেশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনা যায়। কিছুক্ষণ পর দূর থেকে দেখলাম ওরা কিছু একটা বের করে নদীর পাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা এমন নির্জন স্থানে কী ফেলছে? আমরাও তাদের সাথে নদীর পাড়ে যাচ্ছি। ওরা যখনই নদীতে জিনিসটা ফেলবে তখনই উনি টর্চের আলো ওদের মুখ ফেলেন। শানু আর শাহিন টর্চের আলোর সহ্য করতে না পেরে মুখ হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই শুনশান জায়গায় আমাদের দেখে তার থেকে বেশি উনাকে দেখে আঁতকে যায়। দৌড় দিয়ে পালাতে চাইলে দুজন কনস্টেবল ওদের ধাওয়া করে। ওরা চলে যাবার পর টর্চের আলো সেই জিনিসটার দিকে দিলেন। এটা একটা বস্তা ছিলো।

ওদের দুজনকে ধরে আনা হলে উনি জিজ্ঞেস করেন এতে কী আছে?ওরা ভয়ার্ত চেহারায় নিয়ে তাকিয়ে আছে। এমন ঠান্ডাময় পরিবেশে ওরা দুজন ঘামে ভিজে গেছে। কিন্তু তাও কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”ওতে ময়লা আছে। আমাদের ওখানে ময়লা পেলবার জায়গা নেই দেখেই এই জায়গায় নিয়ে এসেছি।” শানুর সাথে তাল মিলিয়ে শাহিন বললো, “দেখুন না ময়লার থেকে কী গন্ধ বের হচ্ছে।”

আমি এতক্ষণ দূরে ছিলাম। কিন্তু ওদের কথা শুনে আগ্রহ নিয়ে একটু কাছে গেলে তেমন গন্ধ পেলাম না। তবে আরো কাছে গেলে কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ পেলাম। এই গন্ধে গা ঘুলিয়ে এলো।

“ময়লা! তা কী এমন ময়লা আছে? তা তো আমাদের দেখা দরকার।”
উনি এই কথা বলে একজনকে ইশারা করলেন বস্তার বাঁধন খুলার জন্য। কিন্তু কনস্টেবল ময়লা বলে বাঁধন খুলতে রাজি হলো না। কিন্তু পরক্ষণে উনার অগ্নিচোখ দেখে হাতে গ্লাভস পড়ে বাঁধন খুলা ইয়াক থু বলে দূরে সরে গেল।

বাঁধন খুলার পর উনি টর্চ সেখানে মারলে একটা মৃতদেহের মাথার চুল দেখা যায়।তবে এইটুকু চুলে মেয়ে কীনা ছেলে তা বুঝা যাচ্ছে না। ভালো করে দেখার আগেই তিনি আলোটা সরিয়ে নিলেন। তবে এইটুকু দেখেই ভয়ে কাঁপতে শুরু করলাম। তাই কিছুটা দূরে সরে আসলাম। না জানি কার লাশ এইটা!

উনি শাহিনের দিকে এগিয়ে একটা নাক বরাবর জোরে ঘুষি দিয়ে রাগি কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, কার লাশ?

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শাহিন বললো, “বেবলির।”

ওর এই কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠলো। অঝোরে ঝরছে চোখের পানি। কিছু বলতেও পারছি না। ঠায় হয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমার বোন! সে কীনা এখন লাশ হয়ে গেল! সে আর কোনোদিন আমাকে আপা বলে ডাকবে না। এসব ভাবতেই চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা দেখতে পেলাম। পৃথিবী ঘুরছে না আমি ঘুরছি কিছুই বুঝতে পারছি না। এক সময় চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে যাবার আগে কারোর মুখে আমার নাম উচ্চারণের শব্দ শুনলাম।

চোখের আলো পড়ায় ঠিক মতো চোখ খুলতে পারছি না। তিরতির করে কাঁপা চোখ এক সময় খুললে দেখতে পেলাম আমি আমার ঘরে আছি। কিন্তু আমি তো নদীর পাড়ে ছিলাম। এখানে এলাম কীভাবে? আস্তে আস্তে নদীর পাড়ে ঘটে যাওয়া কাহিনীগুলো মনে হতে লাগলো। আচ্ছা এগুলো সপ্ন নয়তো। আমার বোনের সত্যি কিছু হয়নি। আমি গত রাত্রে এগুলো স্বপ্ন দেখছিলাম।

আচ্ছা উনি বেবলির খোঁজ পেয়েছেন কী? উনাকে একটা ফোন করতে হবে। ফোন করার জন্য সারা ঘরে খোঁজেও পেলাম না। অবশেষে আপার ফোন আনার জন্য বাইরে বেরুলেই শুনতে পেলাম মানুষের হাহাকারের শব্দ। কান্না করছে অনেকে। কিন্তু কেন?
বারান্দায় গেলে দেখতে পেলাম এক ঝাঁক মানুষ গোল হয়ে আছে কিছু একটার প্রতি ঘিরে। মা কান্না এখনো নীরবে করছেন। আপা আঁচলে বার বার চোখ মুছছে। দুলাভাই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। দুই পিচ্চি বোন অনবরত কেঁদে চলেছে। তাই এক প্রকার দৌড়ে ভীড় ঠেলে গেলাম।

মেঝেতে শুয়ে আছে আমার বোন বেবলি। আমাদের অবুঝ বোন। শরীর ডাকা একটা কাপড় দিয়ে। ঠোঁটের কোণে রক্ত লেগে আছে। ঠোঁটের দুই পাপড়ি ভীষণ ফুলা। চোখের কোণে এখনো জলের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। সারামুখে নখের খাবলা। এগুলো দেখে জোরে কেঁদে দিলাম। সারামুখে আদর করতে লাগলাম। এই বোনকে আর আদর করতে পারবো না। বাবার আনা জিনিসগুলো নিয়ে আর টানাটানি করতে পারবো না। ঝগড়া করতে পারবো না। এসব মনে হতেই জোরে জোরে বিলাপ করে কান্না শুরু করে দিলাম।

হঠাৎ কতগুলো লোক ও রে নিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু আমি আমার বোন দিবো না। এই বলে জোরে চিৎকার দিলাম। কিন্তু ওরা না নিয়ে যাবে না বলছে। আর আমিও না দেওয়াতে টানা হেচড়া শুরু হলে আচমকা উনি এসে আমার হাত ধরে অন্যত্র নিয়ে গেলেন।

আমি তৎক্ষণাৎ উনার পায়ে ধরে বলি, প্লিজ,”স্মৃতিকে ময়নাতদন্ত করবেন না।আমি চাই না আমার বোনকে কাটা ছেড়া করা হোক।”
কেঁদে কেঁদে বলায় হয়তো মায়া জন্মালো। তাই তো উনাদের না বললেন। এক সময় কিছু মহিলা ওরে গোসল করাতে নিয়ে গেল। বাবার গোসল সাড়ার সেই জায়গায়।

“তোমার বোনকে শাহিন ধর্ষণ করেছে। আর তাতে হেল্প করেছে শানু।”
আচমকা এই কথা শুনে হতবাক হলাম। এক মেয়েকে ধর্ষণ করতে অন্য মেয়ে সাহায্য করেছে। হায়রে অবাক পৃথিবী!

“ও হেল্প করলো কেন?আর এতো মেয়ে থাকতে ঐ পিচ্চির প্রতি নজর দিলো কেন? এতই যখন মেয়েদের দিকে ওর নজর তাহলে ও বিয়ে করলেই পারে।” কেঁদে কেঁদে এই প্রশ্নগুলো করলাম।

“দীপ্তি,তোমার মাথা গেছে। এটুকু বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয় ছেলেদের নয়। ছেলেদের আরো অনেক অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু অনেক ছেলে খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে যৌন বিষয়ে জেনে আগ্রহ বেড়ে যায়। যার ফলে এই ছোট বয়সেই এমন কাজ করতে তেমন ভয় পায় না। যেমনটা শাহিনের ক্ষেত্রে হয়েছে। তোমার বোনের প্রতি নজর পড়ার কারণ হলো ওর অবুঝ মন। আর বয়ফ্রেন্ড চাওয়ার ইচ্ছে। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই নাকি শানুকে বলে বয়ফ্রেন্ড খোঁজে দেওয়ার কথা। ওর এই কথা শাহিন শুনে যায়। যার ফলে প্রতিদিন বয়ফ্রেন্ড সাজে। একদিন ওর বাবা মা নানা বাড়িতে আর শানু মার্কেটে চলে যাওয়ায় সে সাহস পায় স্মৃতির দিকে নজর দেওয়া। সেই সময় ও নিজের কার্যাসিদ্ধি করে। ঝাপিয়ে পড়ে তোমার বোনের প্রতি। স্মৃতির বাঁধা দেওয়ায় ও কে মারা শুরু করে। বলতে গেলে একেবারে নিষ্টুর হয়ে গিয়েছিলো শাহিন। শানুর হাতে ডুপ্লিকেট চাবি থাকায় মার্কেট থেকে ফিরে বেবলির এমন অবস্থা দেখলে ভয় পেয়ে যায়। শাহিনকে মারতে শুরু করে। সবাইকে বলে দিবে বলেছিলো।কিন্তু একমাত্র ভাইয়ের অনুরোধে সে বেবলিকে বস্তায় ভরতে ও নদীর পাড়ে লাশ পালানোর জন্য সাহায্য করে। হূমায়ূন আহমেদ স্যারের একটা কথা মনে আছে তো?পুরুষরা হচ্ছে সোনার চামচ, সোনার চামচ বাঁকা হলেও ভালো। তাই একমাত্র ভাইয়ের জন্যই এই বড় অপরাধ করতে সাহায্য করা হলো।”

এতক্ষণ নির্বাক শ্রোতা হিসেবে মনোযোগ দিয়ে উনার সব কথা শুনছিলাম। আমার বোনের প্রতি এত নির্যাতন হয়েছে ভেবে কান্না করতে লাগলাম তবে উনাকে বেবলি যে বয়ফ্রেন্ড চায় সে কথা বললে উনি বলেন, স্মৃতি যেদিন বয়ফ্রেন্ড খুঁজেছিলো শানুর দেখায় সেদিন তোমার সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো। বুঝা উচিত ছিলো এই বাসায় গিয়ে তোমার বোনের ধারণা নষ্ট হচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে আমি তোমাদেরও দোষারোপ করব। শুধু তোমার বোন নয় এভাবে কোনো মেয়েরই ক্ষেত্রে কিছু অসঙ্গতি দেখে দিলে সেখান থেকে দূরে থাকা উচিত বা দূরে রাখা উচিত। যেটা তোমরা করোনি।”

উনার এই কথা শুনে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হলো। তাই এক ধ্যানে চোখের পানি ছেড়ে চেয়ে রইলাম সেই পর্দার দিকে।

“আচ্ছা আপনি কী করে বুঝলেন শানুদের বাসায় কোনো গন্ডগোল আছে?”
“শানু যে কথাগুলো আর ওর মা বাবা বাসায় নেই। এতে কোনো সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু ওদের বাসায় যাবার পর সারা ঘরে সেন্টের ঘ্রাণ আসছিলো। তারপর এই এত সেন্ট কেন দিয়েছিলো তা জিজ্ঞেস করলে বলে পচা মাছের গন্ধ বেরুচ্ছে। কিন্তু সারা রান্না ঘর খোঁজেও মাছের কোনো চিহ্ন না পাওয়ার সন্দেহ হলো। আর শাহিনের কথাবার্তায় বুঝলাম ও খুব টেনশনে আছে। আবার যাবার সময় ওরা দরজা লাগানোর পর আমি আবারও কান পেতে শুনলাম ওরা কাল রাত্রে কিছু একটা ফেলবার কথা বলছিলো। সেই থেকেই বুঝলাম স্মৃতির কিছু একটা হয়েছে।

ওনার মুখে এমন কথা শুনে কান্নারত অবস্থায় বললাম, “আমি ওদের কঠিন শাস্তি চাই।”
আমার কথা শুনে মৃদু হেসে বলেন, তেমন শাস্তি হবে না। বড়জোড় চার-পাঁচ বছর কারাদন্ডে থাকতে হবে। কারণ ওদের বয়স ১৮ পেরোয়নি।
ওদের শাস্তি ভয়াবহ হবে না শুনে কেঁদে দিলাম।

আচমকা একটা শব্দে সিঁড়ি দিয়ে আসলে সেদিকে সবাই তাকালাম। দেখলাম বড় আপা তার ব্যাগ নিয়ে দুলাভাইসহ নিচে নামছে। নিচে নেমেই মায়ের উদ্দেশ্য বললো, মা, শ্বশুরবাড়ির সব প্রয়োজনে আমাকে ডাকা হয়। এমনকি ওদের সাংসারিক কাজেও আমাকে প্রয়োজন। কিন্তু এখানে তো আমার প্রয়োজন নেই। এখানে শুধু কান্নাকাটি করাই দরকার। এগুলো আমার কাছে অযথা। তাই আমি আজই চলে যাচ্ছি।পাঁচদিনে শিন্নিতেও আসবো না।
এই বলেই আপা আঁচলে চোখ মুছে দুলাভাইকে নিয়ে চলে গেল। মা আর বাকি সবাই অবাক চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আপা এইটা কী করলো? ওর মতে বোন হারানোর শোক অযথা। এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমারও তো এগুলো প্রয়োজন নেই। তবে বাবা আর বেবলিকে আবারও আমাদের মাঝে ফিরে পাওয়ার খুব প্রয়োজনবোধ করছি।

চলবে,,,,,,,,

প্রয়োজন পর্ব: ২৭

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২৭
লেখায়: তানিয়া তানু

দোকানিকে থানায় নিয়ে চলে যাবার পরপরই উনি আমার কাছে এসে বললেন, “দীপ্তি, আর কাউকে সন্দেহ হয় তোমার?”
আমি সন্দেহজনক লোক বের করবো কীভাবে? কারণ সন্দেহভাজন ব্যক্তি খোঁজা তো মাথায় নেই। মাথায় শুধু একটা জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছে। না জানি এখন কী হয়! এর কারণ হলো উনি এই কথা তুমি করে বলায় মানুষ এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তাদের চাঁদ বৃত্তের মতো গোলাকার সেই চোখ দিয়ে আমাকে খেয়ে ফেলবে। সবার এক প্রশ্ন উনার সাথে আমার পরিচয় কী? যদিও তারা এই প্রশ্ন করছে না। কিন্তু তাদের অদ্ভুত চাহনিতে এই ধারণাই বলে দিচ্ছে। আচমকা একজন ভুলবশত না হয় ইচ্ছে করেই বলে দিয়েছে, “কীরে, এই পুলিশ ব্যাটায় এমনে কথা কয় কেমনে? লাগে না তা কি কিছু?”
উনি এই কথা শুনে ওদের দিকে তেড়ে যেতেই উনার হাত ধরে ইশারায় না করে বললাম,”আমার বোনকে খোঁজে দিন,প্লিজ।”

উনি এবার থেমে গিয়ে শান্তসুরে বললেন, দীপ্তি, সন্দেহভাজন ব্যক্তি আছে?”

না বলতে যখনই যাবো তখন একটা ছেলের উপর নজর পড়লো। সে আর পাঁচটা মানুষের মতোই আমাদের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।ও হচ্ছে সুজনের চ্যালা। তাই উনাকে সুজনের শিস বাজানোর কথা আর আমার বোনকে উত্যক্ত করার কথা বললাম। সুজনের কথা উনাকে বলার সাথেই দেখলাম ওর চ্যালা দৌড়ে গেল ওর কাছে। তৎক্ষণাৎ উনাকে এই কথা বললে দুজন কনস্টেবল পাঠিয়ে দেয় চ্যালার পিছনে।

খানিক উনার দিকে চাওয়ার পর আকস্মিক হাতে কারোর হ্যাচকা টান অনুভব করলাম। আপা আমাকে হাতে টান দিয়ে অন্যত্র নিয়ে গেলেন। সন্দেহের তীক্ষ্ণ বিষাক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, অফিসারের গা ঘেঁষে কী এমন কথা বলছিলি? চিনিস নাকি?
আপার কথার উত্তর দেওয়ার আগেই দুলাভাই উনার প্রশ্ন জোড়ে দিলেন। বললেন, ওরা জিডি করলো কেমনে? তোমার কাছে তো পর্যাপ্ত টাকা ছিলো না।”
দুলাভাইয়ের প্রশ্ন দেওয়ার সময় চলে এলো সুজন। দুজন কনস্টেবল গলার কলার ধরে ও কে নিয়ে এসেছে। ও তো মিনি বেড়াল হয়ে গেছে। যেন কিছুই সে বুঝে না।

“কী স্যার? এমনভাবে ধরে আনলেন ক্যান?আপনার লোকেরা তো বড্ড অসভ্য। আমারে তো একটু সম্মানও দিলো না। পাছায় যখন বারি খাবে তখন চিনবে আমি কার ছেলে। কীভাবে আমারে সম্মান দেওন লাগে।”
ওর এমন কথায় উনার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ক্রোধের সহিত বললেন

“তোরে তো এখন সম্মান দিবোই। কেমন সম্মান দিবো তা তুই দেখতে পারবি তখন যখন ওদের পাছায় না তোর পাছায় বারি পড়বে।”

“আরে স্যার, আমি তো কোনো দোষ করছি না। মারবেন ক্যান? কিতা করছি আমি?”

“স্মৃতি কোথায়? ”
” সেটা আমি জানমু কেমনে? ইলা কী আমারে কইয়া গেছলো না তা? এমনভাবে কইতাছুইন যে,ইলা দেখা যায় কইয়া গেছলো, আমি ঐখানে যাইতাছি, পুলিশ আইলে আমার কথা কইয়ো সুজন ভাই। ”

ওর এমন ভাব মূলক কথা শুনে আমরা সবাই হতবাক। কিন্তু উনি একটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন, “তুই ও করে দেখে শিস দিছলি কেন? উত্যক্ত কেন করছিলি?”

“শিস তো স্যার সবাই রে দেই।যারে পাই তারে দেই। হেইদিন স্মৃতিরে পাইছিলাম। তাই দিছিলাম। আর হ্যাঁ,স্যার বখাটে আমি। খারাপ আমি। সেইটা সবাই জানে। তাই মনে হয় আপনার সন্দেহ সবার আগেই গেছে। তবে একটা কথা, এই সুজন মেয়েদের উত্যক্ত করে ঠিকই। কিন্তু গুম করে না। ”
“উত্যক্ত করিস কেন?”রাগে এই কথা সুজনের উদ্দেশ্য বললেন।
“স্যার আপনিও উত্যক্ত কইরা দেখবেন। কী মজা! ওদের বিরক্ত করলেই ওরা যে ভয়ার্ত চেহেরা নিয়ে তাকায় দেখলে নিজেকে পুরুষ পুরুষ মনে হয়। খুব ভাল্লাগে।
এই কথায় উনি ওর ঠোঁট বরাবর একটা ঘুষি দিন। আবার জিজ্ঞেস করলে তাও যখন সে উত্তর দিলো না। তখনো বেদরম মারতে থাকেন। নাক-মুখ চটকে যায় রক্তে। শেষে কেঁদে কেঁদে সুজন বাঁচার আকুতি করলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এবার উনি বলার পূর্বে আমি নিজেই বললাম আর কাউকে সন্দেহ হয় না আমার। উনিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিলেন। তখনই উনার শুরুতে পাঠানো পুলিশ আসে।

“স্যার, এদিকে কারোর কথায় কোনো ক্লু পাইনি। আমরা ইতোমধ্যে নিকটস্থ থানায় স্মৃতির ছবি দিয়েছি। ওরা কোথাও পেলে শীঘ্রই আমাদের জানাবে বলছে। আর হ্যাঁ স্যার,স্মৃতিকে সবাই শেষবার শানুদের বাসায়ই দেখেছে। আর কোথাও দেখেনি।

“হুম শেষবার। আচ্ছা শানুদের বাসায় গিয়েছিলে।”
“যাইনি স্যার। তবে ওই পরিবারের মেয়ে শানুর সাথে বাইরে কিছু কথা হয়েছে। ওর ভাষ্যমতে, “প্রতিদিন যে সময় বের হয় তার অনেক আগেই স্মৃতি বের হয়ে গেছে।”

“অনেক আগে কেন বের হলো?”
“তা জিজ্ঞেস করায় কোনো উত্তর মেলেনি। শানু সেটা জানে না।”

“ওদের বাসায় কে কে আছে?”
“জিজ্ঞেস করেনি,স্যার।”
“তাহলে চলো আবার ঘুরে আসি। এবার আমিও যাবো।ওদের বাবা-মার সাথে কথা বলতে।”

ওনারা নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চালালে নির্বাক শ্রোতা হিসেবে আমিসহ আমাদের পড়শীরা শুনছি। আচমকা উনার উদ্দেশ্য একজন প্রতিবেশী বললো, ওদের মা-বাবা তো বাড়িতে নেই, স্যার।”
উনি এই কথা শুনে ভ্রুযুগল খানিক সংকোচ করে বললেন, “তাহলে এখন কারা আছে?”
“শানু আর শানুর ভাই শাহিন?”
“শাহিন কী করে?”
“শাহিন তো এবার নতুন কলেজে উঠছে।”

উনি এই কথা শুনে তেমন উত্তর না দিয়ে শানুদের বাসায় যেতে চাইলে বলেন, তুমি এখানেই থাকো। পেলে আমি তোমাকে জানাবো।”

হতাশ হয়ে অসহায়ের দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে রইলাম। উনি চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে চলে গেলেন।

শাহিন এবার ইন্টার প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট। ওর মতো এত ছোট ছেলে আমার বোনকে কিডন্যাপ করতে পারে না। ও তো খুব ভালো ছেলে। দেখা হলেই সালাম দিয়ে সব সময় হাসিমুখে কথা বলে।

উনি চলে যাবার পরপরই মানুষের কানাঘুষা শুরু হলো। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেলাম মায়ের কাছে। মা এখনো এক ধ্যানে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো চেতনা নেই। এতক্ষণ যে এতকিছু হলো মনে হয় না মা কোনোকিছু শুনেছে। দুলাভাই আর আপা এসেছিলো আবারও প্রশ্ন করতে কিন্তু আমার অগ্নিচোখে তাকানো দেখে আর এগুলো না। মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে অনেক বার মা মা বলে ডাকলেও কোনোকিছু বলেননি। নীরব হয়ে এখন শুধু অশ্রু ফেলছেন। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর মাথায় কারোর হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। চেয়ে দেখলাম মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

“আমার ঝগড়ার সাথী চইলা গেল। আর কোনোদিন এই বাড়িত ঝগড়ার শব্দ শুনবনা। কেউ ঝগড়া আর করতো না।”

মায়ের থেমে থেমে বলা দুঃখের কথায় আমিও কেঁদে দিলাম। বাবা মায়ের সব কিছুর সাথী ছিলো। আজ বাবা নেই। বাড়িটা যেন কেমন হয়ে গেল। মায়ের কাছ থেকে কান্না লুকানোর জন্য চলে আসলাম নিজের ঘরে। তারপর অতীতের শহরে পা দিলাম। যেখানে বাবা, আমি, বেবলি, মা আর বড় আপা ছিলো।

সন্ধ্যে হয়ে গেল। সবাই যার যার কাজ থেকে ফিরছে। এমন সময় বাবা আর বেবলিও আসে। তাই তো জানালা ধরে পথের দিকে চেয়ে রইলাম। কবে ওরা আসবে? একজন তো আর আসবে না জানি। কিন্তু বেবলির জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
এদিকে পেটের মধ্যে ক্ষিধা। আবার তার থেকেও অন্তরে বেশি ক্ষিধা। দুই ক্ষিধায় অন্তর আর বাহির পুরো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কোনো মতেই শান্তি পাচ্ছি না। তাই মায়ের ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ালেই বিছানায় পড়ে থাকা ফোনের রিংটোন আমার পথে বাঁধা দিলো। ফোনে আননোন নাম্বার ভেসে উঠলো। তবে এটা আর আননোন নাম্বার না। কারণ কয়েকবছর আগ থেকেই এই নাম্বারটা আমার বেশ জ্বালাতান করতো। বার বার ফোন করতো ঠিকই।কিন্তু কথা বলতো না। যত্তসব ফালতু কোথাকার! এবার রাগ নিয়ে কতগুলো কথা শুনানোর জন্য ফোন ধরে কানে নিতে গেলে শুনতে পেলাম,
“দীপ্তি,তুমি আজ রাত্রে বারোটায় তোমাদের বাড়ির রাস্তায় এসো।”
উনার কণ্ঠ শুনে অবাক হয়ে বললাম আপনি, “এতকাল আমাকে ফোন করেছেন?
উনি সেসব পাত্তা না দিয়ে আবারও একই কথা বললেন। উনার এমন অদ্ভুত কথা শুনে না উচ্চারণ করতে গেলেই আবারও বলে উঠলেন, তোমার ইচ্ছা হলে আসো। কারণ আমি মনে করেছি এই সময় তোমার থাকা দরকার।”
এবারের কথায় আচ্ছা বলে বললাম, “আপনি আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?” উত্তরে বললেন, “তোমার নাম্বার অনেক আগেই নিলার নাম্বার থেকে নিয়েছিলাম।”

বিষাদময় রাত্রে পড়শী দেওয়া খাবার খেয়ে সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাতের আঁধারে চললাম রাস্তায়। পূর্ণ চাঁদের আলোয় দেখলাম উনি দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে অনেক পুলিশও। সবাইকে এক সাথে দেখে মনের ভেতর ভয় ঢুকলো। না জানি কী হবে!

আমরা শানুদের বাসার সামনে আছি। তাও আবার লুকিয়ে। কিন্তু কেন? তা জিজ্ঞেস করলেও উত্তরে মেলেনি। রাত যত গভীর হচ্ছে বুকের ভেতর ভয় তত বাড়ছে। হৃদস্পন্দনও ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

আচমকা নজর পড়লো শানুদের বাড়ির নিচে। ওখানে দুজন মানুষ গাড়িতে কিছু একটা ঢুকাচ্ছে। ভয় হচ্ছে। প্রচুর! কিন্তু ওরা এত রাত্রে কী কাজ করার জন্য বের হলো?গাড়িতে উঠে গাড়ি ছেড়ে দিলো। সাথে সাথে উনিও আমার হাত টেনে গাড়িতে নিয়ে বসালেন।
দুই গাড়ির এমন অবস্থা দেখে চোর-পুলিশের খেলা খেলছি বলে মনে হলো। গাড়িতে কারা ছিলো তা এখনো বুঝতে পারছি না। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ফলো করার পর সেই গাড়ি এক জায়গায় থামলো।

চলবে„„„„„

প্রয়োজন পর্ব: ২৬

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২৬
লেখায়: তানিয়া তানু

“দীপ্তি, তুমি এখানে?”পাশে দাঁড়ানো পরিচিত মানুষকে দেখে অবাক হলাম।কিন্তু উনার ইউনিফর্ম দেখে অবাকের শীর্ষে থেকে ফিরে এসে ম্লান মুখে বললাম, “আপনাকে বলতে হবে নাকি?” উনি আমার কথার বলার ভঙ্গি দেখেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আমি যে রাগ করেছি।
“দীপ্তি, রেগে যাচ্ছো কেন? আমি তো তেমন রেগে যাওয়ার মতো প্রশ্ন করিনি।”

“আপনি রাগের প্রশ্ন না করলেও আপনার জন্যই আজ আমার এমন অবস্থা হয়েছে। তাই দয়া করে আমায় বিরক্ত করবেন না। দয়া করে এখান থেকে যান।”

“আমার জন্য এমন অবস্থা হয়েছে মানে? আর তুমিই বা এইখানে কী করছো? প্লিজ দীপ্তি সব বলো আমায়। কী হয়েছে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে ক্রোধের সহিত বললাম,”কী বলবো আপনাকে? এই যে কাল আমি বাড়িতে না যাওয়ার ফলে বাবা টেনশনে স্টক করে মারা গেছেন। ছোট বোন গতকাল থেকে নিখোঁজ। এখানে এসেছি জিডি করতে। আর কিছু জানবেন? বলুন এবার কী আপনাকে বলতে হবে পাড়া-পড়শীর কাছ থেকে কত কথা শুনেছি? বলতে হবে কী বড় বোনের কাছ থেকে চড় খেয়েছি? নাকি এইটা বলতে হবে আমি কী পরিমাণ কেঁদে চোখের পানি বের করেছি? বলুন কী কী জানতে চান আপনি?”

“দীপ্তি, সেদিন আমি নিজে ডেকে অসুখ আনিনি। আর তোমাকেও থাকতে বলেনি। আমি নিজেও জানতাম না এই দিনেই তোমার এমন খারাপ পরিস্থিতে ডেকে আনবে। আমি জানি এখন তোমার খারাপ অবস্থা। মন মেজাজ কোনোটাই ভালো না। হয়তো সব দোষ আমারই। তাই তুমি দোষারোপ করতে দ্বিধা করোনি। যেহেতু আমি দোষী। তাই বলবো যা ইচ্ছে তা শাস্তি দিতে পারো।”

উনার কথা শুনে মন আরো খারাপ হয়্র গেল। তাই বললাম, প্রথমত আপনি নিজে ডেকেই অসুখ এনেছেন। কী দরকার ছিলো এই নতুন বর্ষায় ভিজা? দ্বিতীয়ত, আমাকে থাকতে না বললেও চলে গেলে স্বার্থপর বলতেন। কিন্তু আমি স্বার্থপর নই। তাই ভেবেছিলাম খানিক আপনার পাশে থাকি। ওরা আসলেই চলে যাবো। হ্যাঁ, ওরা আসার পরই আমি চলে এসেছি। তবে সেটা রাতে নয় সকালে। তৃতীয়ত, দয়া করে আপনি আমার সামনে থেকে যান। সহ্য করতে পারছি না আপনাকে।”

“চলে যাচ্ছি, যাওয়ার আগে বলছি জিডি করতে এসো। আর আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”এই বলেই মলিন মুখে থানার ভেতর ঢুকে গেলেন। এতে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। তবে কষ্ট হচ্ছে। ত্রিমুখী কষ্ট। প্রত্যেক দিক দিয়ে তীর আমার শরীরে ঢুকছে। ব্যথায় জর্জরিত করছে। কিন্তু জোরে কাঁদতে পারছি না। এই কান্নায় ব্যথা দূর হয়। কিন্তু চাপা কান্নায় কষ্ট দ্বিগুন হয়।

দুলাভাই যে গেল তার আসার তো কোনো চিহ্ন দেখি না। জানাযা কী এখনো শেষ হয়নি। বাবাকে কী ঐ অন্ধকার কুঠিরের মধ্যে রাখা হয়নি। যেখানে বসত করে হাজারও ভিন্ন রকমের পোকামাকড়। আচ্ছা বাবা বলতেন তো আমরা হচ্ছি তাঁর জান্নাত। তিনি কী জান্নাত পাবেন? আল্লাহই ভালো করে জানেন।

“এক্সকিউজ মি।”
এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে সামনের ফুকের বাগান দেখতে দেখতে ভাবনা জগতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আচমকা এমন ইংলিশ টাইপের কথা শুনে পিছনে ঘুরে জিডি লেখার অফিসারকে দেখে বিস্ময়ের রাজ্যের কিছুক্ষণের জন্য চলে গেলাম। বাকরুদ্ধ আমি! যে লোক আমাদের থেকে তাড়া দিয়ে পালিয়েছিলো সে এখন আমার সামনে। অদ্ভুত!

“ম্যাম,প্লিজ জিডি লিখাতে আসুন। জিডি লেখার পরপরই একদল পুলিশ আপনার বোনের খোঁজে বের হয়ে যাবে।”

এই লোকের সম্মানজনক কথা শুনে আবারও ইচ্ছে হলো অবাক মেঘের বাড়িতে যাই। কিন্তু না যেয়ে ভ্রুযুগল কিঞ্চিত সংকোচ করে বললাম,
“আপনি হঠাৎ এমন সম্মান দিচ্ছেন কেন? আর আমার কাছে এখনও টাকা আসেনি। তাই জিডি এখন লিখিবো না। দুলাভাই আসুক তারপর লিখবো।”

“টাকা লাগবে না ম্যাম। আর আপনি হচ্ছেন আমাদের স্যারের হবু ওয়াই,,,,”

“এই দাঁড়ান। আমি যে আপনার স্যারের হবু ওয়াইফ তা কে বললো?”

“আমাদের স্যারই তো বললেন।”

অফিসারের কথায় বুঝলাম উনি আমার কথা বলে দিয়েছেন। তাই তো আমাকে এখন স্বজনপ্রীতি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আমি এই স্বজনপ্রীতি একদমই পছন্দ করি না। তাই অফিসারকে চলে যেতে বলি। কিন্তু সে অনেকবার বলায় তাকে ধমক দিয়ে দেই। অপমানে সারামুখ লাল হলেও পরক্ষণে বেহায়ার মতো এবার আমার হাত ধরে টানাটানি করে। ওর এই অসভ্যতা দেখে সহ্য করতে না পেরে গালের মধ্যে চড় বসিয়ে দেই। এই চড়টা তেমন বড় না হলেও আশপাশের পুলিশ এইটাকে বড় করে উনার কানে নিয়ে তুললো। উনি এসে মুখ গোমরা করে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, কী দীপ্তি, তুমি ও কে চড় মারলে কেন? লোকটার কী দোষ ছিলো? তার দোষ সে তোমাকে জিডি লিখাতে বলছে। এইটাই তো?

উনার কথা শুনে যারপরনাই অবাক হলাম। উনি কিছু না দেখেই এই পুলিশের পক্ষ নিলেন। উনার এমন আচরণে অভীমান জমলো। কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। কিন্তু তাও বললাম,
“উনি আমার হাত ধরে টানাটানি করছিলেন। জিডি লিখার জন্য। কিন্তু আমার কাছে টাকা ছিলো না বলে যাইনি। কিন্তু সে টাকা না লাগলে বুঝলাম এখানে স্বজনপ্রীতি দেখানো হবে। তাই গেলাম না। জোরাজুরি করায় চড় মারলাম।”

“টাকা!”
অবাক হয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা বললাম, “হ্যাঁ,টাকা। এক হাজার টাকা। যা বর্তমানে আমার কাছে নেই।”

“থাপ্পড় না ঐ অফিসারকে না তোমাকে দিতে ইচ্ছে করছে। বেকুব মেয়ে! জিডি লিখাতে আবার টাকা লাগে নাকি। ঐ পুলিশ তোমার কাছ থেকে টাকা আদায় করার চেষ্টা করছিলো।”

উনার এমনতর কথা শুনে অফিসারের দিকে তাকালাম। সে তো মাথা নিচু করে আছে।

“এই যে আপনার কাল থেকে থানায় আসার দরকার নেই।”

“স্যার, আমি আর কোনোদিন এমন কাজ করবো না। এবারের মতো মাফ করে দিন।”

উনার চাকরি খাবে দেখে হাত জোর করে এমন কথা বললো। উনিও ইশারায় উনাকে এখান থেকে চলে যেত বললো। বাধ্য অফিসার হয়ে তিনি অন্যত্র চলে গেলেন।

“কেউ তার জিডি লিখে দাও।”
“জিডি লেখার অফিসাররা তো নেই।
“টোমরাও চাকরি হারাতে চাও নাকি। জিডি লিখাতে পুলিশের ভাগ কাগে বুঝি।”
সবাই থম মেরে রইলো উনার কথা শুনে। উনি পরক্ষণে সবার সামনে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ভিতরে। তারপর বেবলির সমন্ধে অনেক প্রশ্ন করলে তা ম্লান মুখে উত্তর দিয়ে দেই। শেষমেষ ছবি চাইলে তাও দেই।কিন্তু এবার তিনি অবাক হয়ে বললেন,
“এই মেয়েটা তোমার বোন!নিলার বিয়েতে ওর সাথে আমার খানিক কথা হয়েছে। খুব সহজ-সরল টাইপের মেয়েটা! “আমিও হ্যাঁ বলে মাথা নাড়িতে নেই। পরক্ষণে কনস্টেবল দিয়ে তাড়াতাড়ি বলেন গাড়ি বের করতে। আমি উনার এমন কান্ডে অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
আচমকা উনি হ্যাচকা টানে বাইরে নিয়ে গেলেন। সেখানে এক কারে আমাকে বসালেন। তারপর হলো শুরু গাড়ি চলা। পিছনে আবার জিপ গাড়িতে পুলিশের বাহার। তারাও আমাদের পিছনে আসছে।

অভীমান করায় কোনো কথাই বলছি না। চেয়ে চেয়ে শুধু রাস্তাঘাটের অবস্থায় মন দিচ্ছি। বেবলির কথা মনে পড়তেই কান্নাটা দলা পাকিয়ে আসছে। বেবলির বাচ্চা বাচ্চা কথা মনে পড়লো কান্নার মাঝে হেসে দিচ্ছি।
“দীপ্তি”
উনার ডাকে উনার দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে তাকালাম।

“দেখো, স্মৃতি কিন্তু অনেক অবুঝ। ওর সাথে অনেক খারাপ কিছুই হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। এটা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তবে বলবো ও নিজ থেকে নিখোঁজ হয়নি। ও কোনো বাজে অবস্থায় আছে বোধয়। তাই বলবো তোমার কাউকে সন্দেহে হয়।

সন্দেহ মনে হতেই নুরু দোকানির কথা মনে পড়লো। উনাকে নুরু দোকানির প্রেমপত্রের কথা বললে উনি বলেন, ঐ ত্রিশ-বত্রিশ বছরের ছেলে কী করে এই পিচ্চিকে প্রেমপত্র দিতে পারে। বিবেক আজ এমনভাবে লোপ পাচ্ছে কেন?

উনার প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বললাম না। আবারও গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে স্মৃতির দেশে চলে গেলাম। যেখানে ছোট থেকে আছে শুধু স্মৃতির স্মৃতিময় জীবন।

গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। আমাদের নামার সাথে সাথে পড়শীরা ভীড় জমালো। একদল পুলিশ উনার ইশারায় কোথায় চলে গেল। ওরা চলে যাবার পর উনি বাড়িতে না ঢুকে দোকানির কাছে গেলেন। দোকানি আরাম আয়েশে চা-পান বানিয়ে দিচ্ছে খদ্দেরদের।

আচমকা দোনাকির কলার টেনে বাইরে এনে দাঁড় করালেন। দোকানি উনার এমিন আচরণে হচকিয়ে গেল। সে ভীত মুখে বললো, “কী ভাই, ইতা কেরে করতাছুইন। আপনে তো আমার ডেইলি কাশটমার। চা দিতামনি। খাইবাইননি।”

উনি কোনো ভণিতা করে সোজাসুজি বললেন,”স্মৃতি কোথায় বল?”
“ইশরিতি কই আমি কেমতে জানমু। জানলে তো আর আন্নেরে আওন লাগলো না নে। আমিও খালারে কইলাম নে।”

হঠাৎ জোরে এক থাপ্পড় দিলেন। থাপ্পড়ের চোটে দোকানি মাটিতে পড়ে গেল। আবারো তিনি থাপ্পড় মেরে বললেন, “তুই না জানলে কে জানবে? প্রেমপত্র তো তুই দিছিলি।”
“হ স্যার।।পেরেমপতরো মুই দিছিলাম। কিন্তু হেইডা তো ইলারে আমি ভালা পাইয়া দিছলাম।ইশরিতিরে আমি আইজো ভালা পাই স্যার। ওরে আমি পাইলে করুম।ঈর লাইগা মোর কইলজা খান জ্বলতাছে।”

আবারও আরেকটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন, “এই পিচ্চি অবুঝ মেয়েকে তোর বিয়ে করা শখ অইছে না। দাঁড়া তর শখ মিটাচ্ছি। ঐ ওরে রিমান্ডে নিয়া পিটাইয়া সত্য কথা বের করো।” এই কথা বলার পরপরই দুজন পুলিশ অফিসার দোকানিকে নিয়া গেল। দোকানি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

চলবে„„„„„

(স্মৃতিকে কেউ গুম করেছে বা অন্যকিছু। কিন্তু কেউ তো করেছে। কারণ না করলে তো ওর আর নিখোঁজ হয় না। তাহলে বলুন ঠিক কে স্মৃতিকে নিখোঁজ করে দিয়েছে।আন্দাজ করুন।)

প্রয়োজন পর্বঃ ২৫

0

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্বঃ ২৫

লেখায়ঃ তানিয়া তানু

” লাশ ধুয়ে ফেলেছি। এখনই কী খাটিয়ায় রেখে দিবো।”

“হ্যাঁ, এখুনি রেখে দাও। এই কেউ কাপনের কাপড় আনো তো।”

লাশ শুনেই দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। নীরব নিস্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। মায়ের মতো আমিও পাথর হয়ে গেছি। তবে জানার জন্য উৎসুক হয়ে আছি। কার লাশের কথা পাড়ার চাচারা বলাবলি করছেন?

কাপনের কাপড় নিয়ে একজন ঢুকলো পর্দা আবৃত এক জায়গায়। আমাদের কলতলার পাশে বেশ খানিক জায়গা নিয়ে পর্দা আবৃত করা হয়েছে। সম্ভবত এখানেই লাশ ধুয়া হয়েছে। কিন্তু কার লাশ?

আচমকা নজর পড়লো কয়েকজন মানুষের দিকে। তারা একজন লম্বা মানুষকে ধরে-সরে খাটিয়ায় রাখছেন। মুখের কিছু অংশ দেখে বুকে শূন্যতা ঘিরে ধরেছে। হাহাকারে জর্জরিত হচ্ছে অন্তর। হ্যাঁ,আমার বাবা এখন লাশ হয়ে গেছে। আমাদের ভালোবাসা,আমাদের ছায়াতল আর নেই। ভাবতেই বুকটা বার বার কেঁপে উঠছে।

আবারও বেশ কিছু কথা কানে আসছে। পাশে কয়েকজন মহিলা তীর্যক কথাবার্তা বলছে। তবে সেটা আমার গত রাত্রে না আসা নিয়ে নয়। আমি কেন এখনো বাবার কাছে যায়নি তা নিয়ে কথা বলছে। আবার আমাকে কয়েকশ খারাপ উপাধি দেওয়াও হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কী করে এই মুখটা শেষবারের মতো মৃত দেখবো। এই মুখটা তো আমি সন্ধ্যেবেলা টিউশনি করে ফিরে এসে হাসিখুশিতে দেখি। বিছানায় বাবা বাবা বলে ছোটবোনের সাথে খেলিতে দেখি। কী হাসিমুখেই নআ বাবা আমাদের সাথে কথা বলতেন। আজ পর্যন্ত পাওনাদের বিষয় নিয়ে কথা বলেননি। এমনকি একদিন টাকা দিতে না পারায় মানুষের সামনে চড় খেয়েছিলেন। সেটাও কাউকে বলেননি। আমি তো পাড়ার এক বান্ধুবির কাছ থেকে জেনেছিলাম।
এগুলো ভাবতেই অশ্রু পূর্ণ চোখ হয়ে গেল। অশ্রুতে চোখ ভরে যাওয়ায় চারপাশ কেমন ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। ঝাপসায় নজর পড়লো বিথীর দিকে। ও বার বার হাতের উলটো পিঠে চোখের পানি মুছছে। সারা চোখ ফুলে গেছে। অনেকক্ষণ কাঁদায় এমন হয়েছে। দ্যুতিকে খোঁজা শুরু করলে দেখলাম ও আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে খাটিয়ার দিকে।আমিও ধীর পায়ের ওর পথ অনুসরণ করে চলছি।

“বাবা, ও বাবা,তুমি এত্তো ছকালে ঘুমাইছো কেরে? ও বাবা,ওঠো। ওঠো না, আমি দোকানো যাবো তো।” দ্যুতি এই কথাগুলো বলেই বাবাকে ধাক্কানো শুরু করছে। দ্যুতির কথায় আকস্মিক মাও হেচকি তুলে জোরে বিলাপ করে কান্না শুরু করে দিয়েছেন। মায়ের কান্না দেখে বিথীও চিল্লিয়ে বাবা বাবা বলে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি এদের সবার এমন কান্না দেখে। নিজের কান্নাকে আটকাতে পারছি না। ঠোঁটে কামর দিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছি। বিলাপ করতে করতে মা এক সময় বলে ফেললেন, “আমি তোমারে কইছে এরারে খুঁজতে যাইয়ো না। এরা আইবো। চিন্তা কইরো না। তুমি আমার কথা না হুইনা বাইর অইয়া ঘরে চিন্তা লইয়া আইছো। বৃষ্টিত ভিইজা আইছো। কেরে আমার কথা হুনলানা?”

“কেমনে মরছে গো, আন্টি?”
“স্টক করছে বে। কিতাই বা করতো। সেয়ান সেয়ান পুইরাইন যদি সারারাত বাইরে থাকে। টেনশনে তো মরবোই।”
নতুন একজন এলে বাবার মৃত্যু কথা বলাবলি করছে দুজন পড়শী। এদের কথা শুনে ধপ করে পড়ে গেলাম মেঝেতে। এবার পূর্ণ নজর দিলাম আমাদের অন্ধের নড়িকে। হাস্য উজ্জ্বল চেহারা আর নেই! সেই চেহেরায় ধারণ করেছে শুকনো কাঠ হয়ে যাওয়া চেহারা। চোখের কোণে এখনো দুশ্চিন্তার চাপে গর্ত হয়ে গেছে। ঠোঁট শুকিয়ে চামড়া পেকে গেছে। এগুলো দেখতে দেখতে আমি জোরে কান্না শুরু করে দিলাম। বাবা বাবা বলে আমিও এবার চিৎকার দিলাম। কেউ এসে সান্ত্বনা দিলো না। কারণ আমি যে ছায়াতল হারাবার একমাত্র কারণ।

বাবার সারামুখে কান্না করতে করতে হাত দিয়ে আদরের মতো বুলিয়ে বলছি।
“বাবা ওঠো, দেখো আমি এসেছি। চিন্তা করছিলে না আমার জন্য। দেখো আমি এসেছি। তোমার সব চিন্তা শেষ বাবা। তোমায় তো ফোন করেছিলাম। একটু ঘর থেকে বের হতে। নেট পেয়ে আমার কথা শুনতে। আচ্ছা তুমি তো জানতে আমি টিউশনিতে গেছি। তাহলে এমন টেনশন করলে কেন বাবা? তুমি তো জানো টেনশনে তোমার বুকের ব্যথা বেড়ে যায়। ও বাবা, কথা বলছো না কেন? ও বাবা একটু চোখ খুলে দেখো আমি এসেছি। এবার তোমার সব চিন্তা শেষ তো।”

“চিন্তা কী করে শেষ হলো?” আচমকা আপা আমার সামনে এসে এই কথা বললে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললাম, “শেষ তো হলোই। আমি তো এলাম। আর কিসের চিন্তা?”
“তুই এলি। বেবলি তো আসে নাই।”
বেবলির কথা বলতেই মনে হলো এতক্ষণ হলো আমি তারে এখনো দেখিনি। সবাই তো এই উঠানেই।আপাকে প্রশ্নবোধক জিজ্ঞাসায় বললাম,”মানে? উত্তরে রুষ্ট হয়ে বললো, সেও তোর মতো দুপুর থেকে নিখোঁজ। তুই তো সকাল হয়েও এলি। কিন্তু সে এখনো এলো না।” আপার কথায় যারপরনাই অবাক হলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে অবাক চোখে আপার দিকে তাকিয়ে তাকলাম। বেবলি নিখোঁজ মন থেকে সেটা মানতেই পারছিলাম না। অসহায় হয়ে বললাম, “তোরা ভালো করে খুঁজেছিস তো।”

“ও তো শানুদের বাসায় ছিলো। সেখান থেকে নাকি বিকেল বেলায় বাইর হয়ে গেছিলো। কিন্তু এখনো আসেনি। বাবা নাকি অনেক জায়গা খুঁজেছেন। আজ সকাল থেকে তোর দুলাভাইও তো অনেক জায়গায় খুঁজলো। দেখ ওর চিন্তা দেখ। মনে হচ্ছে নিজের বোন হারিয়ে গেছে।”

শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছি। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। একদিকে বাবা অন্যদিকে বেবলি। না বাবা এই পৃথিবীতে নেই তো কী হয়েছে। ওনার জান্নাতগুলার দায়িত্ব তো আমার হাতে রেখেছেন। আমাকে এখন বেবলিকে খুঁজতে হবে। মনে মনে এগুলো বলে সাহস এনে হাতের উলটো পিঠে চোখের পানি মুছে দাঁড়ালাম। আচমকা মা এসে আমার গলা জড়িয়ে বিলাপ করতে করতে বলেন, ও দীপ্তি রে,আমার সিতুরে এনে দে। ও কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচুম না রে। আমার অবুঝ মাইটারে আইনা দে। আর বকতাম না। মারতাম না। এখন আইনা দে। (মা।রাগে বেবলি বললেও সব সময় সিতু বলে ডাকেন)।

মায়ের কান্না দেখে নিজেও কান্না করে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমি এনে দেবো তোমার সিতুরে। তুমি চিন্তা কইরো না মা।
মায়ের থেকে বাঁধন ছাড়িয়ে বাইরে চলে আসলাম। ভেতরটা কেমন গরম। সেখানে কতগুলো মলিন মুখের কান্না দেখে সহ্য করা যায় না। প্রাণটা এতক্ষণ ধরে শ্বাস নেওয়ার জন্য ছটফট করছিলো।

বেবলিকে খুঁজতে হবে। এই চিন্তা নিয়ে দু কদম পা ফেললেই শুনতে পেলাম পিছন থেকে দুলাভাই ডাকছেন। দাঁড়িয়ে পড়লাম। দুলাভাই এসে বললো, “দীপ্তি, তুই আর খোঁজে পাবি না। আমাদের থানায় জিডি করতে হবে।” দুলাভাইয়ের কথায় মতামত দিয়ে হ্যাঁ বললাম। দুজনে চলে যেতে মনে হলো ছবি নেওয়া দরকার। মানুষের ভীড় টেলে আবারো কতগুলো গরম নিশ্বাসের ভেতর ঢুকে গেলাম। এ্যালবাম থেকে একটা ছবি বের করে খানিক তাকিয়ে রইলাম। বেবলি দুই চুলের বেনীতে মাথা ত্যাড়া করে হাসি দিয়ে ছবি তুলেছে। হাসিতে কী অপরূপা লাগছে! আমার বোন। আমার বেবলি। এই বলেই ছবিতে এলোমেলো চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিলাম।বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে মনে হলো টাকার চাপে বোনটাকে কতদিম জড়িয়ে ধরা হয়নি। এবার পেলেই অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরবো।

পুলিশ স্টেশনে গেলেই সেখানে দেখতে পেলাম ফাইল দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে কর্মরত অফিসাররা। ভাইয়া আর আমি লম্বা সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বলছি, ভাইয়া আমরা নিজেরা জিডি লিখবো না কী উনারা লিখবেন?”
“আমরা লিখে ভেজাল বাড়িয়ে লাভ নেই।ওরাই লিখুক দেন।”

কাঠের দরজা খুলেই ঢুকে পড়লাম পুলিশের জিডি লেখার ওখানে। সেখানে গেলে জিডি লিখবো বলে একজন এখান থেকে সেখানে পাঠায়। এদের এমন ব্যবহারের রুষ্ট আমি। কিন্তু এদের সহায়তা অনেক প্রয়োজন বলেই চুপ করে আছি। অবশেষে ঠিক জায়গায় গেলে জিডি লিখাতে বললাম। সে হারিয়ায় যাওয়া শুনে বললো,” মাত্র একদিন হলো। দু তিন-দিন যাক। তারপর না হয় লিখেন। চলে আসবে। বয়ফ্রেন্ডের সাথে দুদিন মস্তি করেই চলে আসবে।”
পুলিশের এমন ব্যবহার শুনে রাগ প্রচন্ড বেড়ে গেল। তবুও নিজেকে সংযত করে বললাম, ও একটা অবুঝ মেয়ে। খুব ছোটও। বয়ফ্রেন্ড নেই ওর।”
পুলিশ অফিসার আমার কথা শুনে ঠোঁট উলটিয়ে বললো, “অবুঝ। যা বিবরণ তাতে অবুঝ মনে হয় না। ক্লাস এইটে পড়ে। বয়ফ্রেন্ড থাকতেই পারে। সে যাইহোক জিডি যেহেতু লিখাতে এসেছেন তাহলে এক হাজার টাকা দিন। জিডি লিখাতে টাকা লাগে।”

টাকা শুনেই দুলাভাই আর আমি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। বর্তমানে আমার ব্যাগে দশ টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই। ভাইয়ার দিকে তাকালে বলেন, আমার ওয়ালেটে পাঁচশ হবে।”

হঠাৎ তখনি কতগুলো পুলিশ এসে বললো, স্যার এখন এমপি মহোদয় বাইরে ভাষণ দিতে যাবেন। আমরা কারা কারা যাবো?”
পুলিশ এই শুনে উতলা হয়ে ওদের কাছে চলে গেল। তারপর ওদের বাইরে নিয়ে গেল।
ভালোই হলো। টাকা তো নেই আমাদের কাছে চলে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে।

বাইরে আমি আর দুলাভাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আপা ফোন করায় জানাযায় যাবার জন্য চলে গেলেন তিনি।

আকাশে দীর্ঘশ্বাসের বায়ু ছেড়ে পরিবেশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কত বড় পুলিশ স্টেশন! অবাক চোখে তাকালাম কতক্ষণ।

“দীপ্তি, তুমি এখানে?”

চলবে„„„„„„„„