Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1947



রাতের গহীনে – লেখনীতে – তাসমিয়া আলম খান

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট _২০২০

ছোটগল্প – রাতের গহীনে
লেখনীতে – তাসমিয়া আলম খান
ক্যাটাগরি – ভৌতিক গল্প

জীবনের একটি রহস্যময় প্রহর হচ্ছে রাত। রাতের প্রহরে এমন কিছু ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে যায় যেটা কিছু ক্ষেত্রে অমিমাংসিত থাকে। আবার কিছু ক্ষেত্রে ভয়ানক হয়ে থাকে।এমনি কিছু ভয়ানক ব্যাপার ঘটে গেছে গল্পের নায়িকা রোদেলার সাথে।
রোদেলা বাবা মায়ের ছোট মেয়ে।
রোদেলা যখন ১০ ম শ্রেনীতে পরে তখন থেকে তার সাথে অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটে যাচ্ছিলো।
রোদেলা জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ছিল নুপুর এর শব্দ। হঠাৎ করে সে প্রায় রাতে নুপুরের শব্দ শুনতে পেতো।
রোদেলা যখন তাদের নতুন বাসায় আসে, তখন থেকেই তার সাথে এ ঘটনা গুলো ঘটা শুরু করে। প্রায় রাতে রোদেলার ঘুম ভেঙে যেতো। তখন সে ফিল করতো তার আশেপাশে কেউ আছে। আর নুপুরের শব্দ তো রয়েছে। আর তাছাড়া রোদেলার মনে হতো রান্নাঘরে কেউ থালা বাসোন ধুইতেছে। আবার মঝে মাঝে শিলপাটা দিয়ে মসলা বাটার শব্দ সে শুনতে পেতো। এইসব ঘটনা সে প্রায় রাতেই শুনতে পায়।
রোদেলাদের নতুন বাসাটা খুব সুন্দর। বাসাটা প্রায় অনেক বড় জায়গা নিয়ে ছিল।
ডুপ্লেক্স বাসার সামনে ফুলের সুন্দর একটা বাগান। বাড়ির পিছনে রয়েছে আম ও কাঁঠালের ছোট একটা বাগান। আর তাছাড়া বাসার আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে। আর বাসার সামনের গেইটের এক কোনে একটা শিউলি ফুলের গাছ রয়েছে।
একদিন রাত ২.০০ টা বাজে রোদেলা বসে পড়ছিল। কারন তখন তার এস.এস.সি পরীক্ষা চলছিল। তখন হঠাৎ করে তার কানে ঘন্টার শব্দ ভেসে আসলো। ঘন্টার শব্দ পেয়ে সে বেলকনিতে গেল দেখার জন্য শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে। বারান্দায় গিয়ে সে বুঝতে পারলো শব্দটা ঠিক তাদের বাসার পছন দিক থেকে আসছে। সে এটাও বুঝতে পারলো শব্দটা প্রখর হয়ে তার কাছেই আসছে। সে খেয়াল করলো সাদা একটা ঘোড়া ওর বারান্দার কাছে এসে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো।ঘোড়াটাকে দেখে মনে হলো সেটা ওর দিকে রাগান্বিত ভাবে তাকিয়ে আছে। ঘোড়াটা তার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে আবার হাটা দিলো এবং ওদের বাসার কোনায় থাকা শিউলি ফুলের গাছটার কাছে গিয়ে গায়েব হয়ে গেল। এই ঘটনাটা দেখে রোদেলা খুব ভয় পেয়ে গেল এবং সে এক দৌড়ে রুমে চলে গেল। রুমে গিয়ে দোয়া দূরুদ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পরলো।
পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে সবাই নাশতা করছিল। তখন রোদেলা গত কাল রাতে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি সবার কাছে খুলে বলে।কিন্তুু সবাই সেটাকে তার হ্যালোসিনেশন বলে ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেয়। কিন্তুু রোদেলার দাদু ওর কথাটা শুনে বেশ চিন্তায় পরে যায়।
আপনাদের তো একটা কথা বলা হয়নি। রোদেলার দাদু ওদের বাসায় কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। তিনি তার বড় ছেলের সাথে নিজেদের বাড়ি সিলেট থাকেন।
রোদেলার দাদু খুব পরহেজগার একজন মানুষ। তিনি কিছুদিনের জন্য ওদের এখানে বেড়াতে এসেছে।
রোদেলার ব্যাপার উনার চিন্তিতো হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তিনি এখানে আসার পর থেকে প্রতিদিন কিছু না কিছু ফিল করতেন। তিনি এটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন রোদেলা কোন মিথ্যা কথা বলছে না।
তাই তিনি ওর রোদেলার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরের দিন উনার পরিচিত একজন হুজুরের সাথে কথা বলে উনাকে তাদের বাসায় আসতে বলে।ভাগ্যক্রমে তিনি তখন চট্টগ্রামে ছিলেন।
হুজুর যখন রোদেলাদের বাসায় এলেন, তখন থেকে তার কেমন যেন লাগছিলো। ওদের বাসায় এসে তিনি রোদেলার সাথে কথা বলে সব শুনে নিলেন।
তারপর হুজুর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “রোদেলার উপর কোন খারাপ একটা কিছুর দৃষ্টি রয়েছে। যাকে বলা হয় দৃষ্টিদোষ। সেই খারাপ জীনটা প্রায় সময় তার কাছে আসার চেষ্টা করে। রোদেলার সাথে দেখা করার চেষ্টা করে। কিন্তুু কোন একটা কারনে সে রোদেলার কাছে আসতে পারে না।তাই সে দূর থেকে ওর উপর সবসময় নজর রাখে।আবার মাঝে মাঝে রোদেলা কে দেখা দেয়। বিশেষ করে ও যখন একা থাকে বা রাত জেগে কোন কাজ করে। তখন সে বিভিন্ন বাহানায় তার দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করে”। সবাই হুজুরের এই কথা শুনে একটু ভয় পেয়ে যায়। হুজুর সেটা বুঝতে পেরে সবাইকে অভয় দিয়ে বলে।” ভয় পাবার কিছু নেই। আমি রোদেলাকে কিছু আমল দিয়ে যাবো। সেগুলো যদি সে নিয়মিত ভাবে করে যায় তাহলে তার কোন সমস্যা হবেনা ইনশা আল্লাহ”। এই বলে হুজুর ওকে আমল করার নিয়ম গুলো বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
এই ঘটনার আজ প্রায় চার বছর হয়ে গেছে এর মাঝে রোদেলার আর কোন সমস্যা হয় নাই।
রোদেলা এবার অনার্স ২য় বর্ষে পরে। কয়দিন বাদে রোদেলার বিয়ে। বাড়ির সবাই তার বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যাস্ত। এর মাঝে একদিন মাঝ রাতে হঠাৎ করেই রোদেলার ঘুম ভেঙে যায়। সে পানি খাওয়ার জন্য উঠে। তখন সে তার মাথার কাছে রাখা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে দেখে বোতলে পানি নেই। তাই সে বোতলটা হাতে নিয়ে পানি নেয়ার জন্য নিচে ডাইনিং রুমে চলে আসে। যখন সে পানি নিয়ে উপরে তার রুমে আসতে যাবে তখন সে অনুভব করলো তার পেছনে কেউ দারিয়ে আছে। তখন রোদেলার মনে হলো তার ঘাড়ের উপরে কারো নিঃশ্বাস পড়ছে। সে এটাতে কিছুটা ঘাব্রে গেল। আর পরক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়ে সে পিছনে ঘুরে তাকালো। কিন্তুু সে সেখানে কাউকে দেখতে পেলোনা।শুধু একটা ছায়া কে তার কাছ থেকে সরে যেতে দেখলো। সেই ছায়ামূর্তিটাকে সে তার দাদুর রুমের দিকে চলে যেতে দেখলো। সে এই বিষয়টা বুঝার জন্য এক পা, দুই পা করে রুমটার দিকে এগোতে লাগলো। ঘরের দরজার সামনে গিয়ে সে দেখলো তার দাদুর মত কেউ বিছানায় বসে আছে। সে এই দৃশ্যটা দেখে খুব ভয় পেয়ে গেল। সাথে অনেক অবাক হলো। সে তার চোখকে মোটেও বিলিভ করতে পারছে না। বার বার তার এটাই মনে হতে লাগলো এটা কেমন করে হতে পারে। দাদু তো ছয় মাস হলো মারা গিয়েছেন। তাহলে এটা কে? এই বলে সে সিওর হওয়ার জন্য ঐ ছায়ামূর্তিটার দিকে আরো এগিয়ে গেল। এগিয়ে সে যেটা দেখলো তাতে তার চোখে ছানাবরা হয়ে গেল। আর ভয়ের ছাপ তার মুখে স্পষ্ট ভেসে উঠলো। আর ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। সে দেখলো ছায়ামূর্তিটা আর কেউ নয় তার দাদু। তখনেই সেই ছায়ামূর্তিটা বিছানায় বসা অবস্থায় তার ঘারটাকে এমনভাবেই ঘোড়ালো যে, তার পিঠের সাইডে মুখটা আর বুকের সাইডে তার মাথার পিছনের অংশটা ছিলো। আর রোদেলা সেইটা দেখার সাথে সাথেই সেখানেই সেন্সলেস হয়ে গেলো।
পরদিন সকালে যখন রোদেলার সেন্স ফিরলো তখন সে নিজেকে তার রুমে বিছানায় আবিষ্কার করলো। তখন সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দূপুর একটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। আর তার পাশে ওর মা বসে আছে। রোদেলার সেন্স ফিরতে দেখে ওর মা তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু খেল।
রোদেলার মা তাকে জিজ্ঞেস করলো তোর কি হয়েছিল মা। আমি যখন সকালে ঘুম থেকে উঠলাম তখন দেখি তুই তোর দাদুর ঘরের মেঝেতে পরেছিলি। কি হয়েছিলো মা আমাকে বল।
রোদেলা মা এর কথা শুনে গতরাতের সব ঘটনা খুলে বললো।
মা রোদেলার কথা শুনে সাথে সাথেই হুজুরকে ফোন দিয়ে সব ঘটনা খুলে বললো। হুজুর সব ঘটনা শুনে বললেন, “আমি ওকে যে আমল গুলো করতে দিয়েছিলাম হয়তো কোন কারনে সেই আমলে কোন ত্রুটি হয়েছিলো।তাই সেই জীনটা তাকে দেখা দিয়েছিল।”
“তাছাড়া কিছুদিন পর আপনার মেয়ের বিয়ে। সেজন্য সে চাইবে আপনার মেয়ের ক্ষতি করতে।গত রাতে সে সেই চেষ্টা করেছিলো।”
রোদেলার মা, তাহলে এখন আমরা কি করবো।
হুজুর, “আপনারা কোন চিন্তা করবেন না, আমি এর একটা ব্যাবস্থা করছি।”
রোদেলার মা, জি ঠিক আছে হুজুর। এই বলে সালাম দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো।
পরদিন সকালে হুজুর রোদেলার আম্মুকে ফোন দিয়ে বললো,
“আপনার মেয়ে যেই রুমে থাকে, সেই রুমের বিছানার বালিশের নিচে হাত দিয়ে দেখেন একটা কাপড়ের ছোট থলে রয়েছে। সেই থলেটার ভেতরে একটা তাবিজ ও সুতা রয়েছে। সেটা আপনার মেয়ের বাম হাতে পরিয়ে দিবেন।”
এই কথা শুনে রোদেলার মা বালিশের নিচে হাত দিয়ে দেখে যে আসলেই একটা থলে আছে। তিনি সেটা দেখে কিছুটা অবাক হলো আবার ভয় পেলো।
হুজুর, ওপাশ থেকে বললো “এই বিষয়ে আপনার অবাক বা ভয় পাওয়ার কোন দরকার নেই। এই থলেটা এখানে কিভাবে আসলো, কখন আসলো সেটা আপনার না জানলেও চলবে। আমি আপনাকে যেটা বললাম আপনি এখন সেটা করুন।” “আর একটা কথা, এই তাবিজটা আপনার মেয়ে যেন বিয়ের এক বছর পর্যন্ত সামলে রাখে। তা না হলে ওর অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে।”এই বলে হুজুর রোদেলার মা’কে সালাম দিয়ে ফোনটা রেখে দিলো।
ওর মা কোন কথা চিন্তা না করে রোদেলাকে তাবিজটা পরিয়ে দিয়ে হুজুরের বলা কথাগুলো তাকে বুঝিয়ে বললেন।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর রোদেলার বিয়ে হয়ে গেল। কোন বাধা বিঘ্ন ছাড়াই ওর বিয়ে হয়ে গেল। রোদেলার হাজবেন্ড এর নাম ডাঃ রায়হান চৌধুরী। সে পেশায় একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
আজ রোদেলা আর রায়হানের বিয়ের ৩ বছর হলো। রোদেলা আজ জানতে পারলো সে প্রেগন্যান্ট। এই খবরটা শুনে তাদের দুই পরিবার তো খুশিতে গদগদ। কিন্তুু এই খবর শুনে রোদেলার মা যতটানা খুশি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি চিন্তিতো হয়ে পরলেন। কিন্তুু ঠিক কি কারনে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না।
দেখতে দেখতে তিনটা মাস কেটে গেলো। আর ঠিক তখন থেকেই অনুভব করতে লাগলো তাকে যেন কেউ দেখছে। তার তখন থেকেই অসস্থি হতে লাগলো। প্রায় সময় তার সাথে টুকটাক ছোট ছোট অনেক ঘটনা ঘটতে লাগলো। সে এই সব ঘটনা ওর হাজবেন্ড রায়হানকে বললো। কিন্তুু রায়হান সেগুলোকে সিরিয়াসলি না নিয়ে হেসে উড়িয়ে দিতো। তারপর থেকেই কোন ঘটনা ঘটলেও সে রায়হানকে বলতো না।
এভাবেই তার দিনগুলো যেতে থাকলো। দেখতে দেখতে সাত মাস হয়ে গেল। আর তখন তার সাথে এ যাবত অব্দি যত গুলে ঘটনা ঘটেছিলো তার থেকে সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটি ঘটে গেলো।
একদিন রাতের বেলা অযথাই তার ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে দেখে রায়হান তার পায়ের কাছে থ হয়ে বসে আছে। সে রায়হানকে এমন ভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলে, “এই তুমি এতরাতে এভাবে বসে আছো কেন? কোন সমস্যা হয়েছে কি? কিছু লাগবে তোমার?” কিন্তুু সে সেভাবেই বসে আছে। তার কোন হ্যাল দোল নেই। বরং সে তার কথার কোন উওর না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে রোদলার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা তার তাকানো দেখে কিছুটা ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
” এই তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কি হলো আমার কথার কোন উওর দিচ্ছো না কেন?”
তখনি পাশে শুয়ে থাকা রায়হানের হাতটা রোদেলার শরীররের উপর পরলো। তখন সে চমকে উঠে পাশ ফিরে দেখে রায়হান তার পাশেই শুয়ে আছে। রোদেলা এই দৃশ্য দেখে প্রচন্ড রকম ভয় পেয়ে যায়। তখন সে একবার পাশে শুয়ে থাকা রায়হানের দিকে তাকায় আবার পায়ের কাছে বসে থাকা রায়হানের দিকে তাকায়।ভয়ে তার গা শিউরে ওঠে আর তার গলা শুকিয়ে কাঁঠ হয়ে আসলো। এমন অবস্থায় সে কি করবে, তার মাথা কাজ করছিলো না। হঠাৎ তার একটা কথা মনে পরলো। তাই সে মনে সাহস সঞ্চয় করে সাথে সাথেই সেই কাজটা করে বসলো। সে পায়ের কাছে বসে থাকা রায়হানকে বা পা দিয়ে সজোড়ে এক লাথি দিল এবং তাৎক্ষনিক সে আর কিছুই দেখতে পেলো না। তখন সে অনুভব করতে পারলো তার গা বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। সে তখন রায়হানকে ডাক দিলো। রোদেলার ডাক শুনে রায়হান চমকে ঘুম থেকে উঠে পরলো। সে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে? এসি থাকা সত্তেও তুমি এভাবে ঘামছো কেন? ভয় পেয়েছো নাকি।
রোদেলা বললো,”শরীরটা খারাপ লাগছে। আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারবা?” রায়হান কোন কথা না বলে পানি আনতে চলে গেলো। রোদেলা ইচ্ছে করেই তার সাথে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি রায়হানকে বলে নি। কারন তার কথা রায়হান কোন ভাবেই বিলিভ করবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই রায়হান পানি নিয়ে চলে আসে। সে পানিটা খেয়ে কোন কথা না বলে শুয়ে পরলো। রায়হান পানির গ্লাসটা রেখে রোদেলার পাশে এসে শুয়ে পরলো।
পরদিন সকালে রোদেলা নিজেই হুজুরের কাছে ফোন দিল। আর এই পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললো। তারপর হুজুর সব রিচুয়েল মেনে রোদেলার শরীর বন্ধ করে দিলো। আর সেই সাথে তার বাসাও বন্ধ করে দিলো। এরপরে আর কখনোই তার সাথে আর কোন ধরনের অপ্রিতিকর কোন ঘটনা ঘটেনি।

৷৷৷ সমাপ্ত ৷৷৷

এটা কে শুধু মাত্র একটা গল্প মনে করে উরিয়ে দিবেন না। এই গল্পের কিছু ঘটনা বাস্তব থেকে নেয়া।

প্রিয় পাঠকগন আশা করি গল্প টা আপনাদের ভালো লাগবে।

উইজা বোর্ড লেখনীতে : তাপসী দাশ

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগীতা_আগস্ট_২০২০

গল্পের নাম : উইজা বোর্ড
লেখনীতে : তাপসী দাশ
ক্যাটাগরি : থ্রিলার

“সুমু ওঠো প্লিজ! অলরেডি তিনটে বেজে গেছে, কখন রেডি হবো, কখন পৌঁছাবো বল তো? যেতেই তো লাগবে দেড় ঘন্টা!”

রক্তিম দুপুরবেলায় বিছানায় সিঁটিয়ে থাকা সুমাহেরাকে ডেকে চলেছে নিঝুম । দু’চোখে ঘুম না থাকা সত্ত্বেও বিছানার সাথে লেপ্টে আছে সে । আড়মোড়া ভেঙে নিঝুমের দিকে ফিরে বললো,

“প্লিজ নিঝুম! আমি যাবো না । তোমার বন্ধুদের গেট টুগেদার পার্টিতে যেতে একদমই ভালো লাগে না আমার । কেমন যেন সবাই!
সো বোরিং! ”

“দিস্ ইজ নট ট্রু সুইটহার্ট !
সবাই কত ফ্রিলি মিশে তোমার সাথে! ইভেন আমাকে তো বার বার বলে দিল তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে ।
রিশাদ কি বলেছে জানো? ও বলেছে, বৌ ছাড়া গেলে আমার দাঁত ভেঙে দেবে ।”
বলে নাক টেনে দিল সুমুর ।

ভীষণ বিরক্ত হলো সুমু । রিশাদের তাকানোর স্টাইলটা একদম ভালো লাগে না ওর । বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত উঠে বসলো ।

এই মানুষটার আবদার অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। এক বছরের সংসারজীবন তার সকল অপূর্ণতাকে ভুলিয়ে দিয়েছে । জন্মের সময় মায়ের মৃত্যুর পর বাবা পূুনরায় বিয়ে করলেও সেই সংসারে জায়গা হয়নি সুমাহেরার । নানুর কাছে থাকার জায়গাটুকু পেলেও মামা-মামীর চক্ষুশূল হওয়ায় তাচ্ছিল্য মনোভাব সহ্য করেই বড় হয়েছে ।

অন্যদিকে ইউএসটিসি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা নিঝুৃম তখন ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে বিপর্যস্ত প্রায় । সুমুর মামীর বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলে সে। ছেলের বেগতিক অবস্থায় বোনের কথার বিরুদ্ধে গিয়ে সুমুকে তিনি ভরসা করে পুত্রবধু করে ঘরে তোলেন।
সুমুর কেয়ার ভালোবাসায় নিঝুম স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে আর সুমু পায় ভালোবাসায় ঘেরা তার আকাঙ্ক্ষিত সংসার ।
এসব ভাবতে ভাবতে মুচকি হেসে নিঝুমের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় সে। নিঝুম হেসে ওকে টেনে নামিয়ে কোমর আঁগলে একটা প্যাকেট তুলে দিল হাতে। তারপর বললো,

“আজকের ড্রেসকোড অনুযায়ী সবাই ওয়েস্টার্ন পড়ছে। তাই তোমার জন্যেও দারুণ একটা গাউন এনেছি । এটা পড়ে ঝটপট রেডি হয়ে এসো, কেমন! ” বলে হাতের উল্টোপিঠে আলতো ছুঁয়ে দিল গালটা ।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্যাকেটটা হাতে তুলে নিলো সুমু । প্রায় একঘন্টা সময় কাটিয়ে একটা কালো জামদানীর সাথে শাশুড়ির দেয়া রুবির চারলহর খানদানি মালাটা গলায় ঝুলিয়ে ড্রেসিংরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো । নিঝুৃমের চোখ পড়তেই মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে কিছু না বলেই গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে । গাড়িতে উঠে বসতে নিঝুম কালক্ষেপণ না করে দ্রুত গতিতে রওনা হল । নিঝুমের মুখের কাঠিন্যতা দেখে মুচকি হেসে সুমু বললো,

” তোমাদের ওয়েস্টার্ন পার্টিতে আজ আমি না হয় বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করি। কি বলো? ”

নিঝুমের নির্লিপ্ততায় গালে হাত রেখে ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে আবার বললো,
“এমন হাইনেক গাউনে আমার অস্বস্তি হয় সুইটহার্ট। একটু বোঝ!”
একথা শুনে নিঝুম ফিরে গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সুমাহেরার দিকে।
ঠিক সেই সময় একটা কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়লো গাড়িতে। নিঝুম তৎক্ষণাৎ ব্রেক করে গাড়ি থেকে নামতে চাইলে হাত ধরে আটকে দিল সুমু। কুকুরটা গাড়ির নিচ থেকে বেড়িয়ে লাফিয়ে রাস্তার পাশে খাদের দিকে নেমে গেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো দুজন। তারপর আবার স্টার্ট করে এগিয়ে চললো গন্তব্যের দিকে । কিন্তু সুমুর মনটা কেমন যেন অস্থির হয়ে কু ডাক দিচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক করতে জানালার বাইরে প্রকৃতির মাঝে নিবিষ্ট হতে চাইল সে।

গোধুলির রঙিন আভা ছড়িয়ে পড়ার আগেই ওরা পৌঁছে গেল পার্টি সেন্টারে । গাজিপুরের সবুজের চাদরে ঘেরা একটি রিসোর্টে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। শানবাঁধানো পুকুরঘাট, পাখির কলকাকলি, বিভিন্ন গাছগাছালির মেলা সব মিলে প্রাণ জুড়ানো পরিবেশ । ওদের দেখে রিশাদ, ইভানা ও তানভির এগিয়ে এলো । গাড়ি থেকে নামতেই ইভানা সুমুকে জড়িয়ে ধরলো। একটু চঞ্চল ও প্রাণবন্ত আপুটাকে বেশ ভালোই লাগে ওর। সেও জড়িয়ে ধরে,

“কেমন আছো আপু?”

জিজ্ঞেস করতেই ওপাশ থেকে রিশাদ বলে ওঠে,

“দিস ইজ নট ডান!
শুধু একজনকেই জড়িয়ে ধরবে? আমরা কি দোষ করলাম বলো তো?”

“কেন রে? তোকে তোর বিলাতি বিলাই সারাদিন চিপকায় তাও শখ মেটে না? শালা বান্দর!”

বলে পিঠে একটা কিল দিয়ে ইভানা সুমুর হাত ধরে এগিয়ে চলে। বন্ধুমহলে রিশাদ সবসময় এমন লাগামহীন কথাবার্তা বলায় ওর কথায় তেমন কেউ গুরুত্ব দেয় না।

সুইমিংপুলের পাশে আসতেই রায়হান, সাফি ও রিশাদের বিদেশী বৌ এমির দেখা মিললো। রায়হান বসে বারবিকিউর আয়োজন করছিল, অন্যদিকে সাফি ও এমি হাস্যরসে লিপ্ত । এমির ডার্ক ব্লু মিনি স্লিভল্যাস ফ্রকটা হাঁটুর বেশ উপরে হওয়ায় কলমিলতার মত ফর্সা পা দুটো ফুটে উঠেছে । সবমিলে বেশ আকর্ষনীয় লাগছে তাকে।

নিঝুৃমকে দেখেই সাফি বলে উঠলো,

“তোমার হানিমুন এতক্ষণে শেষ হইলো মামা? আমরা এদিকে মাছি তাড়ায়ে বেড়াচ্ছি । ”

“হুম! মাছি তাড়াচ্ছিস নাকি মৌমাছি হয়ে ঘুরতেছিস সব দেখতেছি মামা।”

বলে হেসে সাফির পেটে ঘুসি দেয় নিঝুম।

” আরে আমার হানি তো এমনই । ফ্রিলি সবাইকে আপন করে নেয়।”

রিশাদ তার চলমান গার্লফ্রেন্ড এমির কোমর জড়িয়ে এ কথা বলার পর এমি রিশাদের চোখে নেশাচ্ছন্ন দৃষ্টি রেখে বললো,

“ইউ মিন সো মাচ টু মি, ডার্লি!
আ’ম সো গ্লেড ইউ আর ইন মাই লাইফ!
টুডে দিস মোমেন্ট আই স্পেন্ড উইথ ইউ…ইজ লাইক বিউটিফুল ড্রিমস কাম ট্রু।”

রায়হান উঠে এসে বললো,

“হবে হবে সব ভালোবাসাবাসি হবে, পুকুর পারে কটেজে ইচ্ছামত প্রেম করতে পারবি চাইলে বারান্দায় যাইয়া জ্যোৎস্না বিলাস করিস।
তবে আজকে আমাদের পার্টির আয়োজন ঢাকার বাইরে করার পিছনে একটা কারন আছে। আজকে আমরা প্লেনচেট করবো। মানে আত্মার সাথে মিট করবো । আমি উইজা বোর্ড সাথে নিয়ে আসছি। ”

“হুয়াট! আর ইউ ম্যাড? এসব আজাইরা গেইমে আমি নাই দোস্ত।”
বলে নিঝুম একটা চেয়ার টেনে বসলো তানভিরের পাশে। তখন রিশাদ ব্যঙ্গাত্বক স্বরে বলে উঠলো,

“তুই কি কোন কারনে ভয় পাচ্ছিস? ”

“আরে ধুর!
আমরা কি বাচ্চা? কী সব প্লেনচেট গেইম! ছাত্র পড়াইতে পড়াইতে নিজেই ছাত্র হইছে।” বলে হেসে তানভীরের দিকে তাকালে ও বললো,

“আরে কিছু হবে না দোস্ত । জাস্ট মজা নিব।”

“ওকে ওকে পরেরটা পরে দেখা যাবে। আগে আমরা আমাদের পার্টি শুরু করি”- বলে ইভানা ড্রিংকস ও
চিকেনের ট্রে এগিয়ে দিল সবাইকে। রায়হান ড্রিংকসের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে সবার উদ্দেশ্য বলে উঠলো,

“আজকে এই গেট টুগেদার পার্টি আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ড তুশিতার উদ্দেশ্যে ।” বলে একটু দম নিল । তারপর চিৎকার করে বললো,
” উই লাভ ইউ তুশি…
এন্ড টু মাচ মিস ইউর স্মাইল, কেয়ার, লাফ্ এভ্রিথিং ইয়ার!”

রায়হানের কথায় সিক্ত হয়ে উঠলো সবার চোখ । নিরবতা জেঁকে বসে সবার মাঝে । নিঃশব্দে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্মৃতিরোমন্থন করে চলেছে একে একে সবাই । সুমাহেরা নিঝুমের হাতটা শক্ত করে চেঁপে ধরতেই জল গড়িয়ে পড়লো নিঝুমের গাল বেয়ে । তুশিতার ভালোবাসা হারানোর ব্যথাটা এখন তীব্রভাবে জানান দিচ্ছে ।
অন্যদিকে রিশাদ পুরো ড্রিংকস গলায় ঢেলে এমির কাছ থেকে সরে সুইমিংপুলের কিনারায় ল্যাম্পপোষ্টে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলো।

পরিস্থিতি হালকা করতে তানভির বলে উঠলো,

” আরে সবাই এমন মন খারাপ করে থাকলে তুশি তো নিজেই কষ্ট পাবে । আরে আমাদের তুশি কেমন জানিস না? কাওকে কষ্ট পেতে দেখলে নিজেই কেঁদে দিত!”

শেষ কথাটা বলার সময় গলাটা কেঁপে উঠলো তারও। তারপর ইভানার চোখের জলটা মুছে দিয়ে গান প্লে করে আরও নানান কথায় ফ্রি করতে থাকলো ।

আাড্ডা, ডান্স ও ডিনার শেষ হতে হতে রাত প্রায় এগারোটা ছুঁই ছুঁই । রায়হান কটেজ থেকে উইজা বোর্ডটা নিয়ে বাইরে আসলে সবাই কর্নারের টেবিলটার কাছে জড়ো হয়ে গোল করে বসে পরে।

রায়হান বোর্ডটি টেবিলে বিছিয়ে দিলে সবাই লক্ষ্য করে এতে ইংরেজি ২৬টি লেটার ও ০-৯ পর্যন্ত সংখ্যা দেয়া আছে । এছাড়া মাঝখানে একটি স্টার্ট বাটন ও তার দুইপাশে দুটি ইয়েস ও নো লিখা বাটন রয়েছে । সবার নিচে একপাশে এন্টার অন্যপাশে কুইট লেখা দুটি বাটনও আছে ।
ছোট চাকাযুক্ত ত্রিভুজাকৃতির গাড়ির মত একটা কাঠের টুকরো দিয়ে এই খেলা পরিচালিত হয় ।

রায়হান কাঠের ছোট গাড়িটা এন্টারে রেখে তারপর সবাইকে ওতে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করতে বললো । তারপর সে যখন আত্মা ডাকতে শুরু করলো সবাই চমকে তাকিয়ে শুনলো সে তুশিতার আত্মাকে আসার আহ্বান করছে !

সবার মধ্যে কিছুটা উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হতেই সুমাহেরা বলে উঠলো,

” বার বার কেন ডাকছিস আমাকে? ”

ঠিক ওই মুহূর্তে ওরা সবাই খেয়াল করলো কাঠের টুকরাটা কখন যেন এন্টার থেকে স্টার্টে চলে এসেছে । ইভানা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলে রায়হান ইশারায় শান্ত করে তাকে । তারপর একে একে প্রশ্ন করতে থাকে সে ।

“তুই কি এসেছিস তুশি?”

কাঠের টুকরোটা ইয়েস বাটনে গিয়ে আবার স্টার্টে ফেরত আসলো । তারপর বললো,

“আমাদেরকে তোর মনে পড়ে না?”

কাঠের টুকরোটা আবার ইয়েস বাটনে গিয়ে স্টার্টে ফিরে আসার পর সুমাহেরা ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। রায়হান কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় সুমাহেরা বলে উঠে,

“আমার অনেক কষ্ট হয়। তোরা কেউ আমাকে ভালোবাসিস না। কেউ না ” বলে হু হু শব্দ করে কেঁদে উঠে। ”

রায়হান বললো,

“আমরা সবাই তোকে খুব ভালোবাসি । খুব মিস করি দোস্ত! কী থেকে কী হয়ে গেল!
তোর গাড়িতে কিভাবে আগুন লেগেছে জানাবি না আমাদেরকে?”

কথাটা শোনামাত্র লাফিয়ে টেবিলের উপর উঠে বসে রিশাদের গলা চেঁপে ধরে সুমাহেরা। চিৎকার করে বলতে থাকে,

“এই কুত্তারবাচ্চা! সব করছে এই কুত্তারবাচ্চা!”

সবাই প্রচন্ড অবাক হলেও রিশাদের গলা থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করছে সুমাহেরাকে । কিন্তু ওর জোরের সাথে না পেরে রায়হান বললো,

“রিশাদ প্লিজ বাঁচতে হলে বল কী করছিস তুই?”

“আমি বলতেছি,সব বলতেছি প্লিজ ছাড়তে বল তুশিরে! তুশি দোস্ত প্লিজ ছাড়!”

দোস্ত শব্দটা শোনার সাথে সাথে কষে থাপ্পড় দিল তুশি রিশাদকে। থাপ্পড় খেয়ে ঝিঁ ঝিঁ করে উঠলো রিশাদের কান। তারপর ভয় পেয়ে বলতে থাকলো তুশিতার মৃত্যু রহস্য!

” নিঝুমের জন্মদিনে যাওয়ার জন্য আমাকে পিক করে ইভানার বাসার দিকে যাচ্ছিলো তুশি। শুনশান একটা জায়গায় হঠাৎ গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলে তুশি আর আমি বেড়িয়ে চেক করি গাড়িটা । তখন আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল নিরিবিলিতে তুশিকে শর্টস পড়া দেখে । আমি গাড়ির ভেতরে ওকে জোর করে ঢুকিয়ে মুখ বেঁধে রেপ করতে থাকি। ”
বলে মাথা নিচু করলো সে। এটুকু শুনে নিঝুম,

” হুয়াট!
স্কাউন্ড্রেল!
আই’ল কিল ইউ ডেম ইট!” বলে চিৎকার করে উপর্যুপরি ঘুষি মারতে থাকে রিশাদকে ।
তানভির দ্রুত গিয়ে নিঝুমকে পেছন থেকে টেনে ধরে নিয়ে আসে। তারপর রায়হান চাপ দিলে আবার বলা শুরু করে রিশাদ।

” এরপর কাজ শেষে আমি ওর হাত পা বেঁধে পেছনের সিটে রেখে গাড়ি স্টার্ট করার চেষ্টা করি। স্টার্ট হলে ওর রুমালটা পেট্রোলে ডুবিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সরে পড়ি। কয়েক সেকেন্ডে ব্লাস্ট করে গাড়িটা। এর সাথে তুশিও পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। ”

এমি এরপর বললো,

“একইভাবে তুমি সুজানকেও মেরেছিলে তাই না?”

ইভানা বিস্ময়ে, ” মানে?” জিজ্ঞেস করতেই এমি বলল,

” গত বছর ও কানাডা আসার পর আমার বড়বোন সুজানের সাথে রিলেশনে জড়ায়। তারপর একইভাবে সুজানকেও হত্যা করে সে। পার্থক্য শুধু গাড়িটা গাছের সাথে লাগিয়ে ব্লাস্ট করে। রিশাদের মুখটা ঢাকা থাকলেও সিসিটিভি ক্যামরায় ওর জ্যাকেট দেখে আমি চিনতে পারি ওকে । তারপর এদেশে এসে প্রমান জোগার করার জন্য সম্পর্ক গড়ে তুলি । রায়হানের সাথে আলাপকালে একসময় তুশিতার ব্যাপারে জানতে পারি আমি । তারপর দুজনে মিলে এই গেট টুগেদার প্ল্যান করে প্রমাণ রেকর্ড করেছি আমরা ।”

বলে রেকর্ডার বের করে টেবিলে রাখলো। তারপর আগে থেকেই লুকিয়ে থাকা পুলিশকে কল করে ডেকে ধরিয়ে দিল রিশাদকে।

এমি এসে সুমুর কাঁধে হাত রেখে বললো,

“থেংকস এ্য লট সুমাহেরা। দূর্দান্ত এক্টিং করেছো তুমি! তোমার সাহায্য না পেলে হয়তো আমরা আমাদের প্ল্যানে সাকসেস হতাম না।”

সুমাহেরা এমির কথার উত্তর না দিয়ে নিঝুৃমের সামনে দাড়িয়ে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো । তারপর মৃদু হেসে ঢলে পড়লো নিঝুমের বুকে ।

(সমাপ্ত)

অপরাজিতা – লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০

ছোটগল্প: অপরাজিতা
লেখনীতে: ফাতিমা আক্তার অদ্রি
ক্যাটাগরি: কষ্টের গল্প
শব্দ সংখ্যা:১৯৯৮

ডাক্তার যখন আমার দিকে ঝুঁকে বললেন,
‘অপরাজিতা! পরাজয় তোমার জন্য নয় বরং জয়ই তোমার মাথার মুকুট।’

আমি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম ডাক্তারের মুখের দিকে। ভাবছিলাম, আমার নাম তো ঝুম। মা মাঝেমধ্যে আদর করে ঝুম বৃষ্টি বলে ডাকেন। আমার জন্মের সময় না-কি ঝুম বৃষ্টি হয়েছিল তাই। কিন্তু এই ভদ্রলোক আমাকে অপরাজিতা বলে ডাকছেন কেন? সেটাই তো বুঝলাম না! আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ খুলতে যাব ঠিক তখনই একটা তীব্র ব্যথা যেন নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। আমি কথা বলতে পারছি না। আমার পুরো শরীরে এক অসহনীয় ব্যথা অনুভব করছি। সাথে সাথে চোখ বুজে ফেললাম। আমি আর এই কষ্টটা নিতে পারছি না।

‘অপরাজিতা! ইউ আর আ ব্র্যাভ গার্ল। ডোন্ট লুজ ইওর স্ট্রেন্থ। নেভার এভার ইন ইওর লাইফ!’ কথাটা বলার সময় ডাক্তারের কণ্ঠে আকুতি ঝরে পড়ছিল। কণ্ঠটা যেন কেঁপে উঠল ক্ষণিকের তরে। যেন তিনি নিজেই ধর্ষিত হয়েছেন! যেন তার মুখের উপরেই এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে!

কী আশ্চর্য! আমার নামটা তো ভুল বলছেন। আমার জিজ্ঞাসু চাউনি দেখে ডাক্তার আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘তোমার এই নামটা আমি দিয়েছি। এই নামটাই এখন থেকে ধারণ করবে তুমি, তোমার সমস্ত সত্তা দিয়ে।’ এটুকু বলেই তিনি ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলেন।

তারপর বাবা, মা আর রাফি এসে ঢুকল আমার কেবিনে। সবার চোখেই যেন বর্ষার অথৈ জল। আমার খুব করে উঠে বসতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছি না। সমস্ত যন্ত্রণাগুলো যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর জুড়ে এক অসহনীয় যন্ত্রণা! মুখের উপর এক দুর্জ্ঞেয় অনুভূতি অনুভব করছি। মনে হচ্ছে ঝলসানো কোনো কিছু দলা পাকিয়ে আছে! এই কষ্ট থেকে রেহাই পেতে হলেও আমার নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করছে। অন্তত এক বারের জন্য হলেও। মা আমার কপালে তার হাতের মমতাময়ী আলতো স্পর্শ দিয়ে কান্না ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা আছি তো মা তোর পাশে। তোর কিচ্ছু হবে না। তোর কোনো কষ্ট হবে না। আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে সব ভুলিয়ে দেব।’

বাবা কঠিন হবার ব্যর্থ চেষ্টা করে কম্পিত গলায় বললেন, ‘ঝুম মা! তুই একদম টেনশন করিস না। তোর পড়ালেখা আমি আর বন্ধ করতে চাইব না। একবার সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আয়। তারপর তোর সমস্ত ইচ্ছে পূরণ করব।’

রাফি কান্নার দমকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ‘ঝুম আপু! আমি তোমার ব্যাগ থেকে আর কখনও না বলে টাকা নিব না। আর কখনও দুষ্টামি করব না। তোমাকে বিরক্ত করব না। নীল শাড়ি তোমার খুব পছন্দের। তাই না? আমার মাটির ব্যাংকে জমানো টাকাগুলো দিয়ে তোমার জন্য একটা সুন্দর দেখে নীল শাড়ি কিনব। কেমন?’

একজন মানুষকে দেখার জন্য আমার চোখ জোড়া উৎসুক হয়ে আছে। তাকে দেখার অসুখ যে আমার আছে। সেটা বোধহয় আরও বেশি জেঁকে বসেছে। আমার মনে পড়ে গেল আজ থেকে দশ দিন আগের ঘটনা।

টিউশন থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রতিনিয়ত এলাকার বখাটেদের হেনস্তার শিকার হতে হয়। এই হেনস্থার শিকার কেবল আমি নই, বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই। এই হেনস্থার শিকার বোরখা পরা মেয়েরাও। নাবিল নামের এক বখাটে প্রতিনিয়ত তার সস্তা প্রেমের ডায়লগ ঝাড়বে আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করবে। এটা আমাদের এলাকার এক তিক্ত অথচ ধ্রুব সত্য। অথচ এটা নিয়ে যেন কারো কোনো মাথাব্যথা নেই বা থাকলেও কেউ কখনো সোচ্চার হয়ে উঠে না। আমি এই মাস্তানের প্রস্তাব নাকচ করতেই আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়ে বসে। সেদিন আমি নিজের রাগ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিই। সেটাই আমার এই ছোট্ট সুন্দর জীবনে করা মস্ত বড়ো ভুল ছিল। তার দিন পাঁচেক পরে, টিউশন থেকে ফিরছিলাম। সেদিন রাত হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাদের পরীক্ষা তাই নিজের সমস্যার কথা না ভেবেই অতিরিক্ত সময় ধরে পড়িয়েছি। অথচ এর মাশুল আমি নিজের অস্তিত্ব দিয়ে দিয়েছি। শুধু তাই নয়, এই সমাজের নাবিল নামক নোংরা কীট নিজের শরীরের খায়েশ মেটানোর পরে এসিড ছড়িয়ে দেয় আমার মুখের উপর। তারপর শার্টের কলার উঁচিয়ে দাপট দেখিয়ে চলে গেল আমার চোখের সামনে থেকেই। আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলাম। আমার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়েছিল অগণিত অসহায়ত্বের জল।

কী বোকাই না আমি! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমি যে অপবিত্র হয়ে গেছি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমি আমার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছি। তবে কেন আসবে কেউ আমাকে দেখতে! কেন? এতক্ষণে প্রিয়ম নিশ্চয়ই সবটা জেনে গেছে!

নারী! তুমি তো সৌন্দর্যের রানী
পুরুষ সে তো সৌন্দর্যের পূজারী!
পূজার নিমিত্তে কিংবা
তার অশুদ্ধ খায়েশ মেটাতে;
যদি হয় তোমার সৌন্দর্য কিংবা সতীত্বের বিনাশ।
তবে জেনে রাখো, তোমার সৌন্দর্য বিনষ্টকারীর
নেই কোনো পাপ, নেই পঙ্কিলতা!
সতীত্বহীন তুমি! হবে না গৃহীত এই সমাজে।
হবে অবহেলিত, হবে লাঞ্ছিত বারেবারে!
তবুও রবে না কোনো প্রতিবাদের স্বর।
মিলবে না কোনো মুক্তি, নিষ্কৃতি, নিস্তার!
মিলবে শুধু অপমান, মিথ্যে অপবাদ, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা।

আজ জীবন নামক ছোট্ট শব্দটিকে পৃথিবীর সবচাইতে ভারী শব্দ বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। ইশ! কেন যে ওই নরপশুটা আমাকে জানে মেরে ফেলল না! কেন? যদি মেরে ফেলত তবে আজ আমাকে এভাবে জীবন কাটাতে হতো না। এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা অনুভব করতে হতো না।

‘কী হলো, ঝুম?’ মা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, ‘কিছু তো বল মা।’

আমি করুণ চোখে তাকালাম। শরীরের ক্ষত কিছুটা সেরে গেলেও আমার ভেতরটা রিক্ত, ধূ ধূ প্রান্তরের মতো । মস্তিষ্কের মধ্যে সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। আমার কিছুই থাকল না। না সৌন্দর্য! না সতীত্ব! তবে এই বেঁচে থাকার মানেটা কী!

হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার আগ মুহূর্তে ওই ডাক্তার ভদ্রলোক আবারও এলেন। বিনম্র কণ্ঠে বললেন, ‘অপরাজিতা মামণি! আমি বিশ্বাস করি তুমি হারবে না। তুমি হারা মানে আমার হার। তুমি নিশ্চয়ই তোমাকে ভালোবাসে এমন কোনো একজন পিতৃতুল্য মানুষকে হারিয়ে দিতে পছন্দ করবে না?’

আমি প্রত্যুত্তরে সেদিন কিছুই বলিনি। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম ওই মুখের দিকে, আকুতি ভরা চোখের দিকে। কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার বলা কথাগুলো। আমি উনাকে অনেক প্রশ্ন করতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার মনের ভেতরের সমস্ত শব্দেরা কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল । আমি বাকরুদ্ধ হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে দেখছিলাম মানুষটার দিকে। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি ডাক্তার ওয়াহিদুল ইসলামই আমার অপারেশন করেছেন। আমার যত্ন নিয়েছেন নিজের বাচ্চার মতো করে। আমাকে এসব কিছুই বিচলিত করতে পারলো না। কারণ , এখন পৃথিবীর কোনোকিছুই আমাকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা রাখে না। অনুপ্রেরণা শব্দটা আমার জন্য ধনীদের বিলাসিতা করার সামিল। আমি ঘরকুনো হয়ে পড়লাম। কোথাও বের হই না। কারও সাথে কথা বলি না। আমার নিজের রুমের ড্রেসিং টেবিলটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যদি আমার সাথে প্রকৃত এই আমার সাক্ষাৎ হয়ে যায় সেই ভয়ে! আমার তাতেও কোনো আভিযোগ নেই। আমি আর কখনোই নিজের মুখোমুখি হতে পারব না। আমি কারো দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি না। মানুষের চোখের আয়নাতেও আমার নিজেকে দেখতে ভীষণ ভয় হয়।

আমার শহরটা ছিন্নভিন্ন, এক উটকো ঝড়ে।
সবকিছু হয়ে গেল বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত !
আমার শহরটাতে সুখপাখিরা,
ভুল করেও আসে না ডানা ঝাপটাতে!

আমার চোখ দিয়ে শ্রাবণের বারিধারা বয়ে যাচ্ছে। মুছে ফেলার ইচ্ছে নেই, যেভাবে বয়েছে সেভাবেই শুকিয়ে যাবে, কোনো এক সময়।

মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশীরা বাসায় আসে আমাকে দেখতে। আমি তাদের কারও সাথেই দেখা করি না। যারা ভুলেও এ মুখো হতো না তারাও আজ আমাকে দেখতে আমাদের বাড়ির পথ মাড়ায়! সময়, মানুষকে দিয়ে কতো কিছু করায়! আমি দরজা বন্ধ করে থাকাতে কেউ আমার সাথে দেখা করতে পারে না। এ নিয়ে তারা বেজায় দুঃখী। তবে ধীরে ধীরে বোধহয় আমিও মেনে নিতে শিখেছি। পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ মানিয়ে নেওয়া। এই কাজটা সবাই পারে না, আবার পারলেও আশেপাশের মানুষ তাকে পারতে দেয় না। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হলো। ব্যতিক্রম প্রজাতিকে কেউ টিকতে দেয় না, যারা টিকে যায় তারাই স্থায়ী হয়, উদাহরণ হয়।

একদিন পাশের বাসার আন্টি হুট করে আমার রুমে ঢুকে পড়লেন। আমি আচমকা পায়ের শব্দ শুনে তার দিকে তাকাতেই তিনি ভুত দেখার মতো করে চিৎকার করে উঠলেন। পরক্ষণেই চিনতে পারার ভান করে বললেন, ‘ঝুম! তুই এত কুৎসিত হয়ে গেছিস?’

আমি স্তব্ধ, নির্বাক, হতভম্ব। আমি তো নিজেকে এখনও দেখিনি। এই তো কয়েক মাস আগেও ওই আন্টিই আমার সাথে তুলনা করতে করতে নানান বিদেশি প্রসাধনী ব্যবহার করতেন। অথচ আজ তিনি আমাকে এ কী বললেন! আসলেই কী আমি দেখতে এতটা কুৎসিত হয়ে গেছি! মনুষ্যসৃষ্ট এসিড কি তবে মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে এমন বিকৃত করে দিয়েছে?

আমার বেঁচে থাকার আর কোনো ইচ্ছে অবশিষ্ট নেই! সেদিন অনেকেই এলো আমাকে দেখতে। আন্টি পুরো পাড়া করেছেন ব্যাপারটা। আমার মধ্যে আর বিন্দুমাত্র সাহস নেই এইসব মানুষের দৃষ্টি সহ্য করার। তাই আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। কঠিন কারণ ইসলাম তা সমর্থন করে না। আমার সামনে সত্যিই আর কোনো পথ খোলা নেই। আমাকে এবার এই পথেই এগুতে হবে।

জীবনের কাছে আমি হারিনি!
আমি হেরেছি, সমাজের কাছে!
সমাজের কিছু মনুষ্য নামক কীটের কাছে।

এই ভর দুপুরে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এটাই মোক্ষম সময় আমার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের। ঘরে ইঁদুর মারার ওষুধ আছে। এটা খেলেই নিশ্চিত মৃত্যু কোনোপ্রকার রক্তারক্তি ছাড়াই । তাই এটাই সবচাইতে সহজ মনে হলো। হঠাৎ মনে পড়ল, ‘কারো জেতার কারণ তুমি নাইবা হলে হারার কারণ হয়ো না। আমি কি এই প্রতিশ্রুতি পেতে পারি অপরাজিতা?’

আমার চিন্তাশক্তি থমকে গেল। আমার পৃথিবীও থমকে গেল। বাতাসের আণুবীক্ষণিক কণিকাগুলোতে ভেসে ভেসে এই বাক্যদ্বয় আমার কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমি পরাস্ত হলাম মৃত্যুর পথ বেছে নিতে গিয়েও।

আমি হন্যে হয়ে ভাবতে লাগলাম সমস্তকিছু। বারংবার প্রশ্ন করলাম নিজের বিবেককে। উত্তর এলো, ‘তবে এবার না হয় একটা বারের জন্য হলেও অপরাজিতা হয়ে দেখাও। কুৎসিত আর অপবিত্র যাই হও না কেন একটাবার অন্তত অপরাজিতা হয়ে দেখাও।’

আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। অপরাজিতা! অপরাজিতা ! অপরাজিতা! হুম, আমি অপরাজিতাই হব। এর পরের গল্পটা ভিন্ন। রাস্তাটা দুর্গম আর পঙ্কিল।

আমি শত বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে আমার পড়াশোনা শেষ করলাম। পাশাপাশি আমাদের জেলার সকল এসিড নিক্ষেপ ও ধর্ষণের শিকার মেয়েদের নিয়ে নতুন উদ্যমে এক নতুন অধ্যায় রচনাতে মনোযোগ দিলাম।

পাঁচ বছর পর…

ধর্ষণ ও এসিড নিক্ষেপের শিকার হওয়া নারীদের স্বাবলম্বী করার প্রয়াসে আমাকে সম্মাননা দিতে এক বিশাল আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আজ আমার আর কোনো আক্ষেপ নেই, নেই কোনো হতাশা, গ্লানি কিংবা পিছুটান।

আত্মহত্যা থেকেই না হয় শুরু হোক আমার বক্তব্য। হুম, আমি চেয়েছি, বহুবার চেয়েছি, নিজেকে হত্যা করতে। কিন্তু ডাক্তার সাহেবের বলা সেই কথাটা আমার ততবার মনে পড়ত। কথাটা ছিল, ‘কারো জেতার কারণ তুমি না-ই-বা হলে হারার কারণ হয়ো না। আমি কি এই প্রতিশ্রুতি পেতে পারি অপরাজিতা?’

আমার চিন্তা করার কোনো অবকাশ ছিল না। যখনই এই কথা মনে হতো আমি দিশেহারা হয়ে পড়তাম। তবে এই কথাটাই আমাকে বারবার আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিল। তারপর আমি ভেবেছি, দীর্ঘসময় ভেবেছি, আমি কেন আত্মহত্যা করতে চাই?

উত্তর এলো, কষ্ট কমাতে, কেউ তো আমায় আর ভালোবাসে না, কেউ কেউ করুণা করে, কেউ কেউ তার আসল মুখোশটা আমার অপারগতায় উন্মোচন করেছে। কিন্তু মৃত্যু কি কষ্ট কমাতে সক্ষম? উত্তর এলো, ‘না’। মৃত্যু বড়োজোর দেহ থেকে আত্মার পৃথকীকরণ করতে পারে, তবে কষ্ট কমাতে সক্ষম নয়।

হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, ‘ঝুম! রূপই কি তোমার বেঁচে থাকার এক মাত্র কারণ? ঝুম বৃষ্টি হয়ে কি পারো না অবহেলিতের কষ্ট ঘুচাতে?’

অবশেষে বুঝতে পারলাম নিজেকে হত্যা করতে গিয়ে আমার বিবেক জাগ্রত হয়ে গেছে। তারপর আবার ডাক্তার ওয়াহিদুল ইসলামের সাথে দেখা করলাম।

‘সৌন্দর্যই কি সব? প্রগাঢ় কণ্ঠে বললেন , ‘সৌন্দর্য তো দৃষ্টিতে থাকে। এই যে আমি কতো মিষ্টি একটা মেয়েকে দেখছি। কই আমার চোখে তো কোনো খুঁত ধরা পড়ছে না।’

ডাক্তারের কথা শুনে আমার চোখে সেদিন পানি চলে এলো। আমি সেদিন সারারাত ভাবলাম। সেই রাতটা আমার জীবনের সবচেয়ে ক্লান্তিকর, কষ্টকর রাত ছিল। কারণ সেই রাতে আমি আমার মতো ধর্ষণ ও এসিডের শিকার হওয়া অন্য মেয়েদের কষ্ট, বঞ্চনা, অবহেলা, আত্মহত্যা সমস্ত অনুভব করেছিলাম আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, আমি এই অবহেলিত মানুষগুলোকে নিয়ে কাজ করব।

‘আপনি ততক্ষণ বুঝবেন না যতক্ষণ না আপনি সেই একই কষ্টের শিকার হচ্ছেন। এদের সমব্যথীর দরকার নেই, সমদুঃখীর দরকার।’ মঞ্চের সামনে বসা সকলকে উদ্দেশ্য করে বললাম।

ছয় মাস পর…

আরহান মনোযোগ দিয়ে শুনল ঝুমের অতীতের সমস্ত কথা। অবশেষে সে মুখ খুলল, ‘ভাগ্যিস! ডাক্তার ভদ্রলোক তোমাকে অপরাজিতা বলে ডেকেছিলেন। নয়তো এই অপরাজিতাকে আমি কখনও খুঁজেই পেতাম না। আর সমাজে আরও অসংখ্য অপরাজিতা স্বাবলম্বী হতে পারত না।’

‘শুধু আমাকে না উনার সকল পেশেন্টকেই একইভাবে ট্রিট করেন। এই রহস্য জানতে আমাকে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।’

‘কী!’ আরহান অবাক হয়ে বলল।

‘হুম।’ ছোট্ট করে বলল, ঝুম।

‘তবে আপনি কেন আমাকে বিয়ে করলেন সেটা বুঝতে পারলাম না।’ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল ঝুম।

‘সব কিছু বুঝতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই।’

‘এটা শুধু বোঝা না আমার জানাও প্রয়োজন।’

‘যদি বলি ভালোবাসি বলে?’

‘বিশ্বাস করতে বলছেন?’ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল ঝুম।

‘বিশ্বাস করার মতো নয় কি?’ পাল্টা প্রশ্ন আরহানের।

‘করতে মন চাইছে ভীষণ। তবে পারছি না করতে।’ বিপন্ন দেখাল ঝুমকে।

‘মনের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দাও তবে।’ ঝুমের হাতের উপর একটা হাত রেখে বলল আরহান।

‘জানতে তো পারি। তাই না?’

‘না জানলে কি খুব অসুবিধা হবে?’

‘জানলে সুবিধা হতো বুঝতে। এই কুৎসিত চেহারা কারো ভালোবাসা পাওয়ার কি কোনো যোগ্যতা আদৌ রাখে?’ ছলছল চোখে তাকিয়ে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ঝুম।

‘সৌন্দর্য দেখার দৃষ্টির উপর নির্ভর করে।’ ঝুমের চোখের জল মুছে দিয়ে প্রদীপ্ত কণ্ঠে বলল, আরহান।

আচমকা ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বারান্দায় বসেছিল দু’জন পাশাপাশি, খুব কাছে। বৃষ্টির ছাঁট ওদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে দুটো হৃদয়ে। ঝুম, আরহানের কাঁধে মাথা রেখে ঝুম বৃষ্টি দেখছে।

“অপরাজিতারা হেরে গিয়েও জিতে যায়। হয়তো তাই অপরাজিতা ফুলের গাঢ় নীল রঙ কষ্টের প্রতীক হয়েও সকলের নিকট আকাঙ্ক্ষিত!”

সমাপ্ত

একজন বাবার একাকিত্বের গল্প। – ফারাবী হাসান

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
একজন_বাবার_একাকিত্বের_গল্প।
ফারাবী_হাসান

জামান সাহেব গত একমাস ধরে যেন ঝড়ের ভিতরে বসবাস করছে।এ ঝড় যেন তার মাথার উপর দিয়ে তীব্র বেগে ঝরে তার সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে।কারন হলো তার স্ত্রী সামিয়ার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে।স্ত্রী আইসিইউ রুমে।বাড়িতে বৃদ্ধ মা,ছোট ছোট দু’জন ছেলেমেয়ে। মেয়ে শিলা জামান,বয়স আট,দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।ছেলে রিয়াদ জামান, বয়স মাত্র পাঁচ।খুব সুন্দর আর সুখী পরিবার সব মিলিয়ে।জামান সাহেবের নিজস্ব ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা আছে।টাকা পয়সা মোটামুটি খারাপ না।কিন্তু এই টাকা পয়সা দিয়ে স্ত্রী কে বাঁচাতে পারবে বলে মনে হয় না।ডক্টররা বলেছেন,একদম শেষ স্টেজে নিয়ে এসেছেন,বাঁচার সম্ভাবনা ২০%। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবো।আল্লাহ যদি রেখে যায়, সমস্ত শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে।
মেয়েদের এই একটা সমস্যা, শরীরে রোগ নিয়ে ঘুরবে কিন্তু কাউকে কিচ্ছুটি বলবেনা।এই না জানানোটা যেন তাদের মহত্ত্ব।রোগটা যদি হয় শরীরের সংবেদনশীল স্থানে তাহলে তো ভুল করেও জানাবে না। এই না বলে চেপে যাওয়াটা যে জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় বুঝতে পারেনা।
বাংলাদেশে ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য হসপিটাল যেমন সীমিত, ঠিক তেমনি ডাক্তারের সংখ্যাও হাতেগোনা। জামান সাহেব স্ত্রী কে চিকিৎসা করার জন্য সবথেকে ভালো হসপিটালেই নিয়ে গেল।নিয়ে গেলেই বা আর কী হবে,একদম শেষ স্টেজে নিয়ে গিয়েছে।শুরুতেই যদি চিকিৎসা করানো হয় তাহলে ঠিক হয়ে যায়।তারপরেও ডাক্তারা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছেন।আর সামিয়া আইসিইউ তে জীবনের সাথে যুদ্ধ করছে।
ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে দু’টোর মুখের দিকে জামান সাহেব তাকাতে পারে না।কলিজা কেঁপে ওঠে,সমস্ত পৃথিবী মূহুর্তে আঁধার হয়ে যায়।সামিয়ার কিছু হলে সন্তানদের কি হবে এটা জামান সাহেব ভাবতে পারে না।
জামান সাহেব সামিয়ার পাশে টোলে বসে আছে।সামিয়া ওর একটা হাত ধরে রেখেছে।সামিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে জামান কান্না করে ফেললো। বাচ্চাদের মত করে কান্না করছো কেন?এখনও ত আমি বেঁচে আছি।মা,শিলা,রিয়াদ ওরা কেমন আছে?জামান কান্না গিলে উত্তর দিলো, ভালো।তুমি আমার কাছে ওদের নিয়ে আসবে?মনে হচ্ছে হাজার বছর ধরে দেখি না।বিকালে নিয়ে এসো ওদের প্লিজ। জামান সম্মতিতে মাথা নাড়লো।আর আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাই,তুমি ব্যবস্থা কর।সুস্থ হও তারপর নিয়ে যাব।এরই মধ্যে নার্স এসে বললো ভিজিটিং আওয়ার শেষ। জামান সামিয়াকে বললো,একদম চিন্তা করো না,আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।আমি বিকালে সবাইকে নিয়ে আসব।এই বলে জামাধ বেরিয়ে আসলো।
জামান বাড়িতে আসতেই ছেলেটা দু’হাত বাড়িয়ে দিল।জামান ছেলেকে কোলে নিয়ে চুমু খেল।বাবা,বাবা,আম্মু কোথায়?তুমি একা এসেছো কেন,আম্মুকে নিয়ে আসোনি কেন?জামান সাহেব যেন কিছু বলতে পারেনা।শুধু এটাই বলল, বাবা আমার কান্না করে না,বিকালে আম্মুর কাছে নিয়ে যাব।শিলা এসে বাবার কাছে মন খারাপ করে দাঁড়ায়।জামান এক হাতে মেয়েকে কাছে টেনে নিল। মন খারাপ করো না আম্মু,বিকালে আম্মুর কাছে যাব কেমন।শিলা মাথা নাড়ালো।অন্যদিকে জামানের মাও পাশে দাঁড়িয়ে কান্না করছেন।মা তুমি যদি কান্না করো তাহলে ওদের কে সামলাবে?বাবারে আমার যে কোন মেয়ে নাই,ওরে যে আমি মেয়ে বলে জানি,ওর কিছু হলে যে সহ্য করতে পারবোনা।সারাটা দিন একসাথে থাকতাম কিন্তু মেয়েটা যে এত বড় রোগ নিয়ে ঘুরতেছে একবারও বুঝি নাই।মা আল্লাহ কে ডাকো,তিনি যেন সব ঠিক করে দেন।
বিকালে জামান বাচ্চা দুটো আর মা কে নিয়ে হসপিটালে যায়।বাচ্চা দুটো মা কে দেখে একছুটে মায়ের কাছে চলে যায়।সামিয়াও ওদের দেখে চোখের পানি ছেড়ে দিল।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
এ যেন মা তার সন্তানদের হাজার বছর পর কাছে পেয়েছে। মেয়েটা চোখের পানি মুছে দিল।কেমন আছো আম্মু?আম্মু ভালো আছি।তোমরা কেমন আছো?ছেলেটা বললো,আম্মু আমি তোমার সাথে থাকব।মেয়েটা বললো,তুমি কখন বাসায় যাবে?এইতো খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো। মা কান্না করবেন না একদম।আমার মা-বাবা চলে যাওয়ার পর আপনাকেই মা বলে মানি।মা আপনাকে একটা কথা বলব?হুম বলো মা।মা আমি যদি না থাকি,আপনে আমার ছেলে-মেয়ে দু্টোকে আগলে রাখবেন।আমার অবর্তমানে ওরা যেন আপনাকে পায়।মারে এভাবে বলো না,সুস্থ হয়ে ঘরের মেয়ে ঘরে যাবে।জানেন মা আমার মনে হয় আমি আর থাকবোনা।এমন অলক্ষুণে কথা মুখে নিয়ো না।কিছু হবে না,আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।আর আমার নাতি নাতনিকে আমার জীবন দিয়ে আগলে রাখবো।ছেলেমেয়ে দুটো মাকে চুমু খেল।সামিয়া হাত দিয়ে ওদের গালে আদর করে দিলো।সামিয়ার শাশুড়ী রুম থেকে শিলা আর রিয়াদকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।তারপর জামান রুমে গেল।জামান পাশে বসলো।এমন সময় সামিয়া তার হাতে হাত রেখে বলল, একটা কথা দিবে?হুম বলো।আমার যদি কিছু হয়ে যায়,আমি বলব না যে তুমি বিয়ে করো না।শুধু দেখো আমার অবর্তমানে বাচ্চাদের যেন কোন অবহেলা না হয়।তুমি ওদের কখনো কষ্ট পেতে দিয়ো না।বুঝতে দিয়ো না যে ওদের মা পৃথিবীতে নেই।এমন ভাবে দেখে রাখবে ,ওরা যেন মায়ের অভাব বুজতে না পারে।সামিয়া কি পাগলামি হচ্ছে?কিচ্ছু হবে না তোমার।ভিজিটিং আওয়ার শেষে জামানও বেরিয়ে যায়।
সে রাতেই সৃষ্টি কর্তার ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমায় সামিয়া।পুরো পরিবার সামিয়ার শোকে পাথর হয়ে যায়।সামিয়ার মৃত্যু যেন পুরো পরিবারকে শোকের ছায়ায় ডুবিয়ে দিয়ে যায়।তারপরেও যারা বেঁচে আছে তাদের যে বেঁচে থাকার লড়াই টা চালিয়ে যেতে হবে।
ছোট রিয়াদ আর শিলাকে ওর দাদিমা ই দেখে রাখে।প্রথম দিকে রিয়াদকে সামলাতে অনেক কষ্ট হয়েছে।জামান প্রায় অনেকদিন কাজে বের হয়নি।ছেলেটার সাথে সাথে থেকেছে।জামানের মা বয়স্ক মানুষ, তাই জামান একটা কাজের বুয়ার ব্যবস্থা করলো।জামান চেষ্টা করে ছেলে মেয়ে দুটোকে আদর,যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে মায়ের অভাব পূরণ করতে।
নাহ!! জামান আর কোন বিয়ে করেনি।কারণ ছেলে মেয়ে দুটো ওর পৃথিবী। এছাড়াও সামিয়াকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলো।তাই কিছুতেই সামিয়ার জায়গা অন্য কাউকে দেয়া সম্ভব না।অবশ্য পাড়া- পড়শী দেখা হলে যে খোঁচা দেয় না তেমন না।কতজন বলে কি মিয়া এভাবে আর কতদিন থাকবা,যে চলে যাওয়ার সে চলে গিয়েছে,আবার বিয়ে করে নাও।জামান তখন কিছু না বলে নীরবে চলে আসে।
শিলা আম্মু ,
ভাই কোথায়?
ভাই ঘুমিয়েছে।তুমি পড়তে বসেছিলে,হোম ওয়ার্ক ঠিক মত করেছো তো?
হুম বাবা করেছি।দাদিমা কি করে?
নামাজ পড়ে।বিকালে কিছু খেয়েছো? চকলেট আছে না শেষ? হুম খেয়েছি,চকলেট আছে।
কী হলো আম্মু তোমার মন খারাপ?বাবাকে বলো কি চাই,বাবা এক্ষুনি এনে দিব।বাবা আম্মু কেন আমাদের নিয়ে যায়নি?আম্মুর জন্য আমার খুব কষ্ট হয়।আম্মু কি জানতো না,আম্মুকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে।আম্মু তোমার আম্মু তারাদের দেশে গিয়েছে, উপর থেকে আমাদের সবসময় দেখে।তুমি যদি মন খারাপ করো,তাহলে আম্মুরও যে মন খারাপ হবে।তোমার আম্মুরও যে কষ্ট হবে।তুমি কি চাও তোমার আম্মু কষ্ট পাক?
শিলা চুপ করে আছে।জামান কুলে নিয়ে আদর করে দিলো।জামান জানে এসব যে মন ভুলানো কথা,কিন্তু কিছু যে করার নাই।জামানেরও যে খুব কষ্ট হয়।
কারন তার অর্ধেক পৃথিবী জুড়ে রয়েছিল সামিয়া ।
জামান যতক্ষণ বাসায় থাকে ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়েই থাকে।আর যখন থাকেনা তখন দাদিমার সাথে থাকে।খারাপ সময়গুলো এক এক করে চলে যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে শিলা আর রিয়াদও বড় হচ্ছে। শিলা ছোট ভাইকে আগলে রাখতে শিখে গিয়েছে।দু’জন দু’জনকে চোখে হারায়।জামানও ওর সাধ্যমত চেষ্টা করে বাবা-মায়ের ভালোবাসা একসাথে দিতে।
কপাল খারাপ হলে যা হয়,সামিয়া মারা যাওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় জামানের মাও আজ মারা গেল।জামানও এখন আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে।এতদিন তো মা বাচ্চা দুটোকে আগলে রেখেছে, ও নিশ্চিন্তে ব্যবসার কাজে ছুটোছুটি করতে পেরেছে। এখন যে একবারে একা হয়ে পড়েছে।যদিও শিলা এখন রিয়াদকে দেখে রাখতে পারে।শিলা ক্লাস সেভেনে আর রিয়াদ ক্লাস থ্রি তে পড়ে।জামান যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে,সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে। তারপর ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে থাকে।
বাবা,বাবা।হুম আম্মু বলো।বাবা ভাইয়ের জ্বর হয়েছে।কি বলো,চলো দেখি।জামান ছেলের শরীরে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর অনেকটাই বেশি।আম্মু তুমি কি পানি নিয়ে আসতে পারবে?হুম বাবা নিয়ে আসছি।শিলা পানি এনে দিল।জামান ছেলের মাথায় পানি ঢেলে, হালকা খাবার খাইয়ে তারপর ওষুধ খাইয়ে দিলো।রিয়াদ বাবা,ঘুমিয়ে যাও।ঘুম থেকে ওঠে দেখবে তুমি একদম ফিট।আম্মু চলো,রাতের খাবার খাবে।
জামান ব্যবসা আর ছেলেমেয়েদের সমানতালে সামলে যাচ্ছে। শিলা আর রিয়াদ এখন বড় হয়েছে।শিলা এখন একজন পরিপূর্ণ ডাক্তার, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ । আর রিয়াদ সিএসই তে প্রথম বর্ষের ছাত্র।জামান সাহেবের বয়স এখন শেষের দিকে।সেই কবে যে তার প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী তাকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়ে ছিল।ছেলে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে জীবন পার করে দিয়েছেন ।দ্বিতীয় বিয়ে তো দুরের কথা,সামিয়া ছাড়া তার জীবনে আর কাউকে ভাবতেই পারে না।আজ বড্ড অভিমান হচ্ছে তার সামিয়ার উপর।

হঠাৎ তুমি – লেখকের নাম : মুহতাছিম ফুয়াদ

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগষ্ট_২০২০
গল্পের নাম : হঠাৎ তুমি
লেখকের নাম : মুহতাছিম ফুয়াদ
ক্যাটাগরি : রোমান্টিক

প্রতিদিনের ন্যায় আজও সকাল থেকে নিজস্ব চেম্বারে রোগী দেখছেন ডা.হিমা। ডাবল ডজন খানেক অপেক্ষমান রোগীর সিরিয়াল ভেদ করে ফাহিম রহমান ডাক্তারের কক্ষে প্রবেশ করলেন!

অন্য সকল রোগীর মতো ফাহিম রহমানও তার পুরাতন প্রেসক্রিপশন আর নিজের সমস্যার কথা আটকা আটকা কন্ঠে ডা.হিমাকে বর্ণনা করলেন।
প্রচণ্ড মদ্যপ অবস্থায় থাকার কারণে ফাহিমের দু’পাটির দাঁত হয়তো এক করা সম্ভব হচ্ছিল না!আচমকাই ঠোঁট গুলো নড়ে উঠছিল! তাই কথা গুলো ছিল অস্পষ্ট!

দামী দামী সব অ্যালকোহলের ভয়ংকর গন্ধ আর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন দেখে ডা.হিমা মনে মনে ধরে নিয়েছে বড় লোকের সন্তান বটে!

তবে তখনো রোগীর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখা হয় নি ! অসংখ্য রোগীর ভিড়ে একজন ফাহিম রহমানের দিকে তাকিয়ে দেখার তেমন কোন প্রয়োজনও বোধ করেন নি, ডা.হিমা!

অ্যালকোহলের মারাত্মক গন্ধ ডা. হিমাকে বিরক্ত করে তুলছে।তবুও নাক-মুখ বন্ধ করেই রোগীর হৃদস্পন্দন মাপার জন্য বুকে স্টেথোস্কোপ রেখে ডাক্তার যখন কিছু বুঝার চেষ্টা করছে,ঠিক তখন ফাহিম রহমান ডা.হিমার স্টেথোস্কোপ সংবলিত সেই নরম হাতটিকে চাপটে ধরে বুকের বা’পাশে নিয়ে বলছে,”এখানটাই, ঠিক এখানটাই ব্যথা!এখানেই শূল বিঁধে আছে!”

ডা.হিমা দ্রুত হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে রাগান্বিত চোখে যখন স্পষ্ট করে ফাহিম রহমানের দিকে তাকাল তখন চমকে ওঠে বলল,”ফাহমিদ,হঠাৎ তুমি!”

সত্যিই ফাহমিদ তো! তাই হৃদয়ের চিত্রপটে থাকা ফাহমিদের সাথে এই ফাহিম রহমানকে একটু মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা!

“এখনো আগের মতোই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি পার্থক্য শুধু বর্ণে।বয়সের বার্তা দিতে কালো দাঁড়ি শুধু সাদা হয়েছে এমনটা কিন্তু নয়! আগের মতো মাথা জুড়ে ঝাঁকড়া চুল আর নেয়,মাথার দু’পাশের অনেক গুলো চুল বুঝি হতাশা অকালেই কেড়ে নিয়ে গেছে! এখনো ঠিক আগের মতোই চোখে কালো ফ্রেমের চশমা পরিবর্তন শুধু লেন্সের পুরুত্বে! অর্থাৎ রোগে,শোকে আর অযত্নে ফাহমিদের চোখের ক্ষমতা এখন শূন্যের কোটায়। ঠোঁট গুলোও আর আগের মতো নেয়,কখনো সিগারেটের গন্ধ না নেওয়া ফাহমিদের মুখে এখন দামী দামী অ্যালকোহলের গন্ধ !”

মাঝে পরিবর্তন হয়েছে পনেরটি ক্যালেন্ডারের অর্থাৎ প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় দেয়াল থেকে খুলে ফেলা হয়েছে গত হয়ে যাওয়া পরেনটি ক্যালেন্ডার!

দীর্ঘ এই সময়ে ফাহমিদের চোখ গুলো আরো ঘোলাটে হয়েছে! বিবর্ণ হয়েছে প্রতিটি অঙ্গ, তবুও ডা.হিমা চিনতে কোন ভুল করেনি।তাই তো অনেকটা কৌতূহলের বশে জিজ্ঞেস করেছে,”প্রেসক্রিপশনে ফাহিম রহমান লেখানোর কারণ কি?”
ফাহমিদ কিছু বলার আগেই ডা.হিমা মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের প্রেসক্রিপশনে চোখ বুলিয়ে দেখে,এখানে ঠিকই ‘ফাহমিদ’ লেখা!

ফাহমিদ চুপ করে বসে থাকলেও, ডা.হিমা মনে মনে ধরে নিয়েছে, ” নিজেকে গোপন রেখে এতো বছর পর আমার হৃদস্মৃতির পরীক্ষা নিতেই তার এই হঠাৎ আগমন!”

এতো বছরের সংকোচ আর অভিমান ভেঙে মুহূর্তেই জড়সড় ভাব!
পনের বছর আগে ফাহমিদের দেওয়া কথাটি মিলিয়ে নেওয়ার জন্য প্রথমেই ডা.হিমা জিজ্ঞেস করে বসল,

~ ডা.হিমা : তোমার ছেলে মেয়ে কয় জন?
~ ফাহমিদ : একজন ছেলে,একজন মেয়ে!
~ ডা.হিমা : আলহামদুলিল্লাহ!
( কিন্তু মনে মনে বলছে,”কথা রাখনি!”তুমি তো কথা দিয়েছিলে,”আমাকে ছাড়া কখনো বিয়ে করবে না!”)

পনের বছর আগে হিমা নিজেই সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে ফাহমিদকে অন্ধকার জগতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল!তবুও ফাহমিদের উপর এক অদৃশ্য অধিকার বলে মনে মনে ধরে নিয়েছিল, “ফাহমিদ তাকে ছাড়া কখনো বিয়ে করবে না!”

অনেকটা আফসোসের সুরে ডা.হিমা এবার জিজ্ঞেস করলো,
~ ডা.হিমা : ছেলে-মেয়ে কোথায় পড়াশোনা করে?
~ ফাহমিদ : দু’জনেই অবসরপ্রাপ্ত!
~ ডা.হিমা : ঘটনা কি?
~ ফাহমিদ : ছেলে আমার বাবা আর মেয়ে আমার মা!
তাদেরকে নিয়েই আমার সংসার।
~ ডা.হিমা : তাহলে তুমি এখনো বিয়ে কর নি?
~ ফাহমিদ : না! পনের বছর আগে দেওয়া প্রতিটি কথা
আজও আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।
~ ডা.হিমা : সত্যি! ( বিস্ময়ের সুরে হয়তো নিজের
অজান্তেই ডা.হিমা উচ্চারণ করে ফেলেছে)

হঠাৎ দু’জনেই চুপ হয়ে গেল।গলায় ঝুলিয়ে রাখা স্টেথোস্কোপটি খুলে টেবিলের উপর রাখে দিল ডা.হিমা।
অন্য দিকে চেম্বারের বাহিরে অপেক্ষমান রোগীর চাপ বাড়ছে!
কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে ডা.হিমার ব্যক্তিগত সহকারী দরজায় নক করে বলছে,”ম্যাডাম,বাহিরে রোগীর চাপ বেশি!”
এতক্ষণে ডা.হিমার হুঁশ ফিরেছে! ফাহমিদও ইতস্ততায় পরে বলছে,”তোমার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত,আজ উঠি!”
ফাহমিদ যখন ওঠে দাঁড়াবে তখন ডা.হিমা ফাহমিদের হাত আটকে বলছে,”এখন তুমি যেত পার না!”

ডা.হিমা টেবিলের উপর রাখা কলিং বেলে কয়েকবার ক্লিক করতেই ব্যক্তিগত সহকারী দরজায় এসে হাজির!
“ইয়েস ম্যাডাম!”
~ ডা.হিমা : “আজকে আর রোগী দেখব না!”

প্রেসক্রিপশনের দিকে আরেক দফা তাকিয়ে ডা.হিমা বলছে,”তোমার হৃদরোগ হয়েছে বুঝি!”

“জানি না ঠিক কি হয়েছে! তবে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের ডাক্তাররা বলেছে,”ভালোবাসা নামক এক মরণব্যাধি রোগে আমি আক্রান্ত!” তবে এই মরণব্যাধি রোগের ঔষধ আছে! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রতিটি ব্যক্তির জন্য এই ঔষধ আলাদা ভাবে নির্ধারিত! তাই তো মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে তোমার কাছে রেফার্ড করা হয়েছে! এই ঔষধ গুলো সাধারণত অর্থের কাছে বিক্রি হয় না,তবে কখনো যদি অর্থের কাছে বিক্রি হয় তবে একপক্ষ ভালোবাসা নামক মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত হয়!”

ডা.হিমা হতভম্ব!

“তোমার হাতের এই স্টেথোস্কোপ যদি হৃদয়ের সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারত তবে আমার বুকের ভেতর শকুনির শক্ত চঞ্চুর ঠুকরানোর শব্দ তুমি নিশ্চয়ই শুনতে পেতে!”

ডা.হিমার হাত পা বরফ হয়ে আসছে।ফাহমিদের প্রতিটি কথা ডা.হিমার কানে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে! ডা.হিমা নিজেকে সামলে কিছু বলে উঠার আগেই ফাহমিদ বলে উঠছে,

“এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। আমরা তো সস্তা মেসেজে বিক্রি করিনি আবেগ! চড়া মূল্য দিয়ে চিঠির অক্ষরে লিখেছি এক একটি হৃদয় বাণী!”

“যে ভালোবাসা নামক ঔষধের সন্ধানে তোমার কাছে এসেছি, সেই ঔষধ আজ থেকে পনের বছর আগেই বিক্রি করে দিয়েছ!তবুও এসেছি।কারণ আমি বাঁচতে চাই! আরো অনেক বছর তোমাকে দেখতে চাই, কখনো নিশ্বাস সমান দূরত্বে দাঁড়িয়ে আবারও কখনো বা দূর অজানায় হারিয়ে! ”

“আজও রাত জেগে কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠি লিখি,ভোরের আলো ফুটার আগেই শব্দের বুননে তৈরি হওয়া আবেগ গুলো খাকি খামে বন্দী করে কবুতরের গলায় বেঁধে উঠিয়ে দেই!”

“বাঁচতে চাই,আরো লিখতে চাই,আরো ভালোবাসতে চাই!”

একজন মা – ফারহানা তাবাসসুম

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
একজন_মা
ফারহানা_তাবাসসুম

বিয়ের পর যখন প্রথম পিরিয়ড মিসিং হয়। তার কয়েক দিন পর প্রেগন্যান্সি টেস্ট করি। আর প্রেগন্যান্সি টেস্ট যখন পজিটিভ হয়। তখন প্রথম খুশির মুহুর্ত এনেছিলি তুই।তোর বাবা আমাকে সেইদিন হোটেলে নিয়ে গিয়ে পেট ভরে মিষ্টি খাইয়ে ছিল তুই আমার গর্ভে আসছিস শুনে। তারপর থেকে তোর বাবা আমাকে অনেক কেয়ার করতো।কারন তোকে এই পৃথিবীতে আনতে হবে যে আমাকে। আমাকে অনেক আদরে রাখতো তোর বাবা যেন তোর কোন ক্ষতি না হয়।প্রথম প্রথম অনেক খারাপ লাগতো কিছু খেতে পারতামনা। সব বমি করেছি।প্রায় ৬ মাস যখন হয় ঠিক তখন থেকেই ব্যথা পেতাম পেটে । কিন্তু অনেক খুশি আমাদের পরিবারের সবাই। যে আমার প্রথম সন্তান আসবে কিছুদিন পর এই পৃথিবীতে। আমার পেটে তোর অবস্থানটা বুঝতে পারতাম। তোর বাবা আমার পেটে কান দিয়ে তোকে ডাকতো আর তুই তখন নড়ে উঠতি।আর তোর বাবা খুব খুশি হতো আর আমাকে বলতো দেখেছো আমার সন্তান এত সকালেই আমার কথা শোনে। মাঝে মাঝে তুই আমার পেটে পা দিয়ে লাথি মারতি,অনেক ব্যথা পেতাম। কিন্তু তোকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য এই ব্যথাটাকে সামান্য মনে করেছি।এভাবে প্রায় ১০ মাস পর একদিন প্রচন্ড প্রসব ব্যথা উঠে। এত ব্যথা যে আমি সহ্য করতে পারি না। অনেক চিৎকার করেছি কিন্তু গ্রামের মানুষ বলেছিল যে সন্তান প্রসব করতে নাকি এই ব্যথা কিছুই না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যে আমি বিষ খেয়ে মরে যাই। সেই ব্যথা এতটাই অসহ্য ছিল যে আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম। এভাবে প্রায় ২-৩ ঘন্টা পরও যখন বাচ্চা প্রসব হয়নি। তখন সাথে সাথে আমাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে।
ডা: আমাকে দেখেই বলে সিজার করতে হবে।তোর বাবা ডা: কে বলেছে যত টাকাই লাগুক না কেন আমার স্ত্রী সন্তানকে বাঁচান। আমি ইঞ্জেসন সুঁচ ভয় পেতাম। কিন্তু সেইদিন তোকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য যেন কোন ভয়ই লাগেনি আমার। আমাকে সিজার রুমে নিয়ে যায়। সেখানে অনেক ধরনের কাচি আর ব্লেড ছিল দেখেই ভয় লাগে।কিন্তু তোর জন্য যেন মনে হচ্ছিল আমি মারা গেলেও যেন তুই ভালভাবে এই পৃথিবীতে আসিস।আমাকে অজ্ঞান করে রাখে। প্রায় ২ ঘন্টা পরে আমার জ্ঞান ফেরে। তারপর আমি সবাইকে বলি আমার সন্তান কই।আমি তোকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যাই।
কিছুক্ষন পর তোর মুখটা দেখে যেন আমার সব ব্যথা আর কষ্ট দূর হয়ে গিয়েছিলো।তোকে দেখার পর মনে হচ্ছিল যেন আমি পৃথিবীতে একমাত্র সুখী মানুষ। আমার মত খুশি আর কেউ নেই। তোকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনি। তোর বাবা আমাদের এলাকার সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায়।আমি কয়েকদিন হাঁটা চলা করতে পারিনি। এমনকি ডা: আমাকে ভারি কাজ করতে বারন করেছে।তুই ছোট ছিলি বিছানায় প্রস্রাব- পায়খানা করতি সেগুলো পরিস্কার করেছি।তোর ৩ বছর না হওয়া পযন্ত আমি একদিনও ঘুমাইনি ভাল ভাবে। একটু পর পর জেগে উঠতাম। তোর যখন অসুখ হতো আমি ঘুমাতাম না। তোকে সারা রাত কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। একদিন ঠিক রাত ১২ টার দিকে তোর পেট ফুলে যায় হঠাৎ করে। আমি আর তোর বাবা সেই রাতেই তোকে নিয়ে যাই হাসপাতালে। সেই রাতে ঘুমাই নাই আমি আর তোর বাবা। যখন ঈদ আসতো তোকে আমরা ঈদের জন্য অনেককিছু কিনে দিতাম। একবার তোকে শুধু ১ টি-শার্ট দিয়েছিলাম সে জন্য আমাদের অনেক মন খারাপ ছিল।এমনকি আমরা সেই ঈদে বাড়ি থেকে বাহির হইনি পর্যন্ত। তোকে আর কিছু দিতে পারিনি বলে। এভাবে চলছিল আমাদের জীবন। এর মাঝে এই পৃথিবীতে চলে আসলো তোর ছোট বোন।এদিকে তুইও বড় হলি। তোর বোন ও আস্তে আস্তে বড় হলো। যে দিন তুই একজন নামিদামী ব্যাবসায়ী হয়েছিলি। সেইদিনে যে কত্তটা খুশি লাগছিলো তোকে বুঝাতে পারবো না। তুই আমার ছেলে তাই গর্ব হয়েছিল। তোর বোনের বিয়েটা তো তুই দিয়েছিলি অনেক ভালকরে। তোকেও বিয়ে করিয়েছি তো অনেক ভালোভাবে। তুই তো ভালই সুখে চলছিলি। হঠাৎ তোর বাবা মারা যাওয়ার পর আমি কেন তোর কাছে বোঝা হয়ে গেলাম রে বাবা। আমার এখন বয়স হয়েছে তাই তেমন কাজ করতে পারি না। তাই বলে কি আমি তোদের সাথে থাকতে পারি না। আমি কি তোর আর তোর বউ এর সাথে থাকার যোগ্য না।আজ তুই দেশ জুড়ে নাম করেছিস,কত নতুন আত্মীয় হয়েছে কত দাস-দাসী লালন পালন করিস তোর বাড়িতে কতজনকে দিয়েছিস ঠাই। শুধু আমার হল ঠাই এই বৃদ্ধাশ্রমে।এই বুড়ির ঠাই তোর ওই বড় অট্টালিকাতে হলোনা। কেন তুই আমাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেলি। আমি যে তোকে না দেখে থাকতে পারি না।কই তুই যখন আমাকে কষ্ট দিছিলি তখন তো আমি তোকে কোন জায়গায় রাখি নি।বরং বুকে জড়িয়ে রাখতাম তোই যেন কষ্ট না পাস। তাহলে আমাকে তোর আড়ালে রাখলি কেন। তুই হয়তো বুঝবি না এই বুড়ির মনটা যে নাতিদের সাথে খেলাধুলা করতে মন চায়। তুই আমার এই মনের কথা বুঝলিনা বাবা।তবুও ভাবি যে আমার ছেলেটা আমাকে ছাড়া ভালো আছে। থাকুক না ভালই।কারন তুই ভালো থাকলে তাতেই আমি অনেক খুশি থাকি। তবে মাঝে মাঝে একটু আমার সাথে দেখা করে যাস।তুই খুশিতে থাকলে যে তোর মা ও খুশি থাকে বাবা। কিন্তু শুনে রাখ বাবা।দোয়া করি তুই আরো বড় হবি।আর তোকে যেন তোর ছেলে মেয়েরা এই রকম না করে। না হলে যে তুই সহ্য করতে পারবি না বৃদ্ধাশ্রমের কষ্ট। আর তুই কষ্টে থাকলে যে আমিও কষ্টে থাকবো বাবা মরে গেলেও। আর আমি মারা গেলে যেন আমাকে মাটি দেওয়ার জন্য হইলেও আসিস বাবা।আর বউ মাকে বলিস যেন ভাল থাকে, সবসময় যেন তোকে ভালবাসে।আর আমি যে দিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবো সেইদিন যেন বউমা আমাকে গোসল করিয়ে দেয়। কারন বউমা সেইদিন যদি বুঝে আমার ভিতরের কথা।তবে ভালোবাসি তোকে আমারে নিয়ে ভাবিস না, তুই ভালো থাকলে বুঝবি আমি ভালো আছি।
.
(বৃদ্ধাশ্রমের একজন মায়ের কষ্টের কথা বুঝি তার সন্তান দেখতে পাই নি।কিন্তু যে ডাইরিতে লেখেছিলো এই কথা গুলো। তখন সেই ডাইরিটাও হয়তো চোখের পানি আটকে রাঁখতে পারে নি)
.
হে সন্তান বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার আগে
মায়ের দুধের দামটা দিয়েই রেখে এসো।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

স্বপ্নে মাতোয়ারা – লেখকের নাম : মাসুদ রানা তাসিন

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগষ্ট_২০২০
গল্পের নাম : স্বপ্নে মাতোয়ারা
লেখকের নাম : মাসুদ রানা তাসিন
ক্যাটাগরি : রোমান্টিক

চৈত্রের দুপুরের প্রচণ্ড রোদে এক পশলা ইলশে বৃষ্টির আনাগোনা। বেলকনির কার্ণিশ জুড়ে অসংখ্য ফুলের সমাহার। কাশফিয়া সেই ফাঁক দিয়ে তাকিয়েছে মেঘের দিকে। অবাক নয়নে মুগ্ধ হয়ে দেখছে, সৃষ্টিকর্তার নৈস্বর্গিক সৃষ্টি।

মেঘের আড়ালে তো ঢাকা পড়ে যায় চাঁদ, সূর্য, তারা! অভিমানের আড়ালে হারিয়ে যায় নতুন স্বপ্নের সূচনা! অপমানের প্রতিশোধের নেশায় আসক্ত হলে ধ্বংস হয় সকল মান, অভিমান, সম্ভ্রম। এসব ভাবতে ভাবতেই পুরো দুপুর কাটিয়ে দিল কাশফিয়া।

পড়ন্ত বিকেলে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ভাবছে। পৃথিবীর রূপ বৈচিত্র্য কত ভিন্ন, কত মানুষ সৃষ্টি করেছে সৃষ্টিকর্তা। তবে সবচেয়ে বড় অধম করে সৃষ্টি করেছে কাশফিয়াকে। তখন ঘর থেকে উড়ে আসে এক টুকরো কাগজ। কাগজের ভাঁজ খুলে দেখে তার দেওয়া শেষ চিহ্ন। এক টুকরো শিরোনাম বিহীন চিঠি।

তুমি,

আজও স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে যাই তোর জন্য। আজও বিভোর হই তোর সাথে কাটানো ভ্যাপসা স্মৃতি গুলো নিয়ে। হয়তো চিঠির প্রথমে প্রিয় দিয়ে শুরু করিনি। প্রিয় একদিন অপ্রিয় হয়ে যায়, তুই তো আছিস আমার হৃদয়ের গভীরে, যেখানে থাকে শুধু আত্মা নামক ছোট জিনিসটি। তোর সময় হবে না ফিরে আসার। বেশি কিছু লিখব না, চলে আয় আমার কাছে। তোকে ছাড়া শূন্য মনে হয় নিজেকে। তাইতো ডুবে থাকি তোর স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে।

ইতি,
তোর মন

কফির মগ রেখে অতীত নামক স্মৃতির ক্যানভাসে ডুব দিল কাশফিয়া। অতীত স্মৃতি বিজড়িত ঘটনাগুলো সর্বদা মনে বিষাদ সৃষ্টি করে। যাতে অজস্র অভিমান চাপা পড়েছে অপমানের চাদরে। সুখ নামক আপেক্ষিক তত্ত্ব কোনোদিন ধরা দেয়নি কাশফিয়ার কাছে। জন্ম থেকে আজ অবধি শুধু দুঃখ, যাতনা ও অপমান সহ্য করে আসছে।

আকাশমনি গ্রামের ছোট্ট একটি পরিবারে জন্ম হয় কাশফিয়ার। চার বোনের পর জন্ম হয়, পরিবারের কেউ খুশি নয় কাশফিয়ার জন্মে। সবাই একটা ছেলের আশায় বুক বেঁধেছিল। ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়ে এসেছিল কাশফিয়া। তখনই জন্ম যেন আজন্মের বড় অপরাধ হয়ে গেছিল।

তিন বছর বয়সী কাশফিয়া চারপাশে তাকিয়ে দেখত। মা ছাড়া কেউ কাছে আসে না। সবাই একসাথে থাকত কিন্তু সবার থেকে আলাদা করে রাখতো তাকে। তখন ছোট অবস্থা কিছু বুঝতে পারেনি।

চার বছর বয়সে যেইবার প্রচুর পরিমাণে জ্বর বাঁধল শরীরে। প্রচণ্ড জ্বরে তখন কাউকেই কাছে পায়নি। জীবনের প্রথম ধাক্কাটা সেদিন পায়।

কাশফিয়ার যখন বয়স পাঁচ বছর, তখন কাশফিয়ার মা আবারো সন্তানসম্ভবা। সবার মুখে একটাই কথা, “এবার ছেলে না হলে তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে।”
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
তখন থেকে মুখে একটাই বুলি ছিল সারাদিন। একটা পুত্র দে আল্লাহ, একটা পুত্র দে। কামাই খাবার আশা নাই মোর মাটি দিবে কে। অন্যবারের চেয়ে আল্লাহ এবার মুখ তুলে তাকিয়েছে। ছেলে হয়েছে, বিনিময়ে কাশফিয়া পেয়েছে একরাশ হতাশা, শূন্যতা, একাকীত্ব। ঠাঁই হয়েছে বোনদের ঘরে, তবে বিছানায় নয়। মাদুর বিছিয়ে বালিশ ছাড়া। তবুও কারো কিছুতে সে কিছু বলত না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মেনে নিয়েছে।

ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল তখন। বড় আপু পাশের বাড়ির ফারহান ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরেছিল। সেটা দেখে অবুঝ মনে বাবাকে বলে দিয়ে ছিল। বাবা আপুকে বকাবকি না করে সেদিন কাশফিয়াকে প্রচুর মেরেছিল। বলেছিল “তুই ভালো না, তুই এখানে থাকলে আমি শান্তিতে বাঁচব না। তোকে কালই বাড়ি ছাড়া করবো। তার দুইদিন পর ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

ফুপুর বাড়িতে আসার এক মাসের বেশি হয়েছে। এক মাসের ভেতর বাবা শুধু এসে বই খাতা গুলো দিয়ে গেছেন। বলেছেন এখানে কাজ শেষ করে যদি পড়াশোনার সময় হয় তাহলে পড়াশোনা করতে। সেদিন বুঝেছিল ফুপু কাজ করতে দেরি হলে গায়ে হাত তুলতো কেনো।

সেদিনের পর থেকে ফুপুকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেইনি। ভাগ্যটা তো মেনে নিয়েছিল। কাজ করেই নিজেকে চালিয়ে নিতে হবে। বারো বছর বয়সী একটা মেয়ে অবলীলায় অস্ত্র বিহীন যুদ্ধ শুরু করে।

সারাদিন সমস্ত কাজ মিটিয়ে, রাতের বেলা পড়তে বসে। লক্ষ্য অনেক বড় কিছু করতে হবে। সেই চিন্তায় অবিচল অটুট থাকে।

নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে আসে নতুন একটি ভোর, একটা সাফল্য। তবুও সাফল্যের মাঝেও নেমে আসে ঘনকালো অন্ধকার।

একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখে নতুন মানুষ। যাকে ছবিতে দেখেছিল, এখন সামনে চাক্ষুষ দেখছে। রিমন ভাই! কাশফিয়ার রিমন ভাই। এতো দিন বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য ছিল। রিমন কাশফিয়ার চেয়ে গুণে গুণে বারো বছরের বড়।

কাশফিয়ার রিমন ভাই একটা নীল টি শার্ট ও সাদা প্যান্ট পরে, কুশন কভার কোলে নিয়ে সোফায় বসে আছে। যেন বলিউডের অভিনেতা শাহরুখ খানের মতো। কাশফিয়া চোখ সরাতে পারছে না। যেন নতুন কোন স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে গেছে সে।

রিমন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে। পুঁচকি একটা মেয়ে, মাথায় অর্ধেক চুল ঝুঁটি করা। অর্ধেক চুল বাতাসে উড়ছে। গায়ে সাদা রঙের স্কুল ড্রেস, চিবুকে টোল, হাসির ফাঁকে বেরিয়ে আসছে গজ দাঁত। রিমন যেন একটা মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। বয়সের কথা ভাবছে না, রঙিন প্রজাপতির ডানায় ভর করে, কাশফিয়ার স্বপ্নে মাতোয়ারা হয়ে পড়ছে।

দু’জনের ধ্যান ভাঙে ফুপু রাইনা বেগমের ডাকে।

– রিমন বাবা মা হাত মুখ ধুয়ে আয়, অনেক দিন নিজ হাতে খাওয়াই না।
– যাচ্ছি মা, অনেক দিন তোমার হাতে খাবার খাই না।

কাশফিয়ার উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলো ” কিরে নবাবজাদী তোকে কি আলাদা করে দাওয়াত করতে হবে? যা কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরের কাজ সামলা। ”

কাশফিয়া নীরবে স্থান ত্যাগ করলো। থাকলে ফুপু গায়ে হাত তুলতে পারে। যদিও এটা অভ্যেস হয়ে গেছে।

সেদিন রিয়ানের বিরুদ্ধে নালিশ করেছে বলে খুব মারলো। রিয়ান বাজে ভাবে শরীরে হাত দেওয়ার বিচার দিয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এমন হচ্ছে। নয়তো অন্দর বাহিরে কিছু মানুষরূপী রিয়ানের মতো জানোয়ারের জন্য নারীরা সঠিক ভাবে চলতে পারে না।

রিমন আসার পর থেকেই কাশফিয়ার উপরে অত্যাচার করতে পারে না। দেখতে দেখতে কাশফিয়া এইচ এস সি শেষ করে। আঠারো বছর বয়স হয়ে গেল।

বসন্তের আগমনে মুখরিত কাশফিয়ার হৃদয় আঙিনা। আঠারো বছর বয়সটা যে এমনই। সব সময় হৃদয়ে দোলা দেয়। বারো বছর বয়স থেকে হাজারো ঝড়ে, প্রতিনিয়ত ভাঙা গড়ার স্বপ্নে সাথে থেকেছে যেই মানুষটি বন্ধুর মতো। সেই মানুষটি দোলা দেয় হৃদয় নীড়ে।

বয়স দেখে কোনোদিন প্রেম হয় না যার বাস্তব প্রমাণ কাশফিয়া। রিমন চোখের আড়াল হলে হৃদয় ভেঙে যায়। কাশফিয়া নিজেকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করছে। কোন অবস্থাতেই তবুও ভুলতে পারছে না রিমন। ছোট বেলায় যে কাশফিয়া রিমন ভাই ডাকত! আজ সে ডাকে মন বলে।

কাশফিয়া ও রিমনের কর্মকাণ্ড গুলো সবার চোখ এড়ালেও রাইনা বেগমের চোখ এড়ায় না। তখনই ধরে ফেলে রিমনের বিয়ে না করার কারণ। রাইনা বেগমের সব দিক পছন্দ হলেও কাশফিয়াকে পছন্দ নয় তার।

রাইনা বেগম ভেবেই নেয় যত দ্রুত কাশফিয়াকে বাইরে বের করা।

বিকেলে কফির মগে চুমুক দিয়ে রিমন কাশফিয়ার খোলা চুলে ডুবে আছে। ভাবছে কেমন করে প্রোপজ করবে। জীবনের ত্রিশটি বসন্তেও কাউকে মুখ ফুটে বলেনি। মেয়েদের দিকে তাকানো তো দূর।

জীবনানন্দের বনলতা কবিতা আবৃত্তি শুরু করে এসময়। ” চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য “। কাশফিয়া উপরে তাকিয়ে দেখে রিমন তাকিয়ে আছে তার দিকে। কাশফিয়া লজ্জানত মুখ নিয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটলো।

বসন্তের সন্ধ্যের আকাশে ইলশে বৃষ্টি। ছাদের কার্নিশের উপর পা তুলে বসে আছে কাশফিয়া। চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। সাদা পোশাকে আবৃত কাশফিয়াকে পরীর থেকে কম লাগছে না। কাশফিয়া সে তো আকাশ বিলাসে ব্যস্ত। একজন যে তার দিকে তাকিয়ে আছে একটা হৃদয় ছোঁয়া দৃষ্টি নিয়ে। এসেছে এক পশলা ভালোবাসা নিয়ে।

একগুচ্ছ মহুয়া ফুলের তোড়া ও মালা নিয়ে কাশফিয়ার সামনে বসে পড়লো। কাশফিয়া যেনো আকাশ থেকে পড়ল। আজ নতুন রিমন কে দেখছে সে! রিমন সে তো তার হৃদয় অন্তরালের মোহিনীকে দেখতে ব্যস্ত।

দীর্ঘ অনেকক্ষণ পর রিমন কাশফিয়ার উদ্দেশ্যে বলা শুরু করলো। কাশফিয়া যেনো নীরব দর্শক ও শ্রোতার মতো শুনে যাচ্ছে। রিমন বলেই যাচ্ছে পলকহীন চোখে কাশফিয়ার কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে।

” বসন্তের মহুয়া ফুলে মাতাল হইনি কখনো। শুধু তোমাকে কল্পনা করেছি। নিজেকে নিজের মাঝে ডুবিয়েছি বার বার। আমি মগ্ন হয়েছি নিজেতে, আমি নেশা গ্রস্থ হয়ে উঠিনি মৃদু মলয়ে। আমি উদাসীন হয়েছি বারে বারে, করেছি রাগ ক্ষণে ক্ষণে। শুধু তোমায় আমার অভ্যন্তরে বলা কথাগুলো বলতে না পেরে। ”

” কী কথা লুকিয়ে রেখেছ মন? আমিও শুনতে চাই সব। বল তুমি সকল কিছু ফেলে তাড়াতাড়ি কাজ আছে আমার না হলে হবে দেরি। ”

” বসন্তের আগমনে মুখরিত চারদিক। তোমাকেও দেখেছিলাম বসন্তের এক দুপুরে। তখন ছিলে ছোট পিচ্চি। যখন আমাদের বাড়িতে এলে তখন চঞ্চলময়ী। আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলে। একটু একটু করে জায়গা নিতে শুরু করলে। জানি না কখন বসেছ আমার হৃদয় নীড়ে সবটা জুড়ে। ততটা পেঁচিয়ে বলতে পারি না। বলছি বসন্তের মহুয়া ফুলে নয় মাতাল হতে চাই তোমাতে। কল্পনায় নয় বারবার ডুব দিতে চাই তোমার মাঝে। আমি উদাসীন হতে চাই শুধু তোমার সাথে থেকে। ভালোবাসি তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি। তাইতো জীবনের ত্রিশ বসন্তেও কাউকে আপন করিনি। তোমায় আপন করবো বলে। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি! আমার হৃদয়ের গভীর থেকে, সবটা জুড়ে সকল আস্তরণে মিশে। ভালোবাসবে কি তুমি আমাকে? ”

কাশফিয়া এই কথাগুলো শুনে কেঁদে দিয়েছে একেবারে। কোন উত্তর দিতে পারছে না। সে যে ভালোবাসে এটা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। রিমন উত্তরের অপেক্ষা না করে বলা শুরু করলো।

” কি হল বলছো না কেন? ভালোবাসো কি না বল? তাহলে বারবার ফিরে আসবো না তোমার কাছে? ”

” সব কথা বলে না হৃদয়, কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। ”

রিমন যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল। কাশফিয়াকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, কারো ছুটানোর সাধ্য নেই। ধরেছে এমন ভাবে যেন কাশফিয়াকে ছেড়ে দিলে চলে যাবে।

কেটে গেছে কয়েক দিন।

সবার অলক্ষ্যে চলছে মধুময় প্রেম কাহিনী। কিন্তু ঐ যে বাংলায় প্রবাদ আছে “অভাগী যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়।” কাশফিয়ার বেলা ঠিক তাই হলো।

রাইনা বেগম ও রিয়ানের বৌ আফরা দু’জনে মিলে গল্প করে। কাশফিয়া ও রিমনের আচরণ সবার সুবিধার ঠেকছে না। প্রতিদিন সন্ধ্যে বেলায় ছাদে উঠে। এসব নিয়ে আলোচনা ও কাশফিয়াকে কেমন করে বাড়ি থেকে তাড়ানো যায়।

মায়ের সব কথা শুনে ফেলে রিমন। মনে মনে বুদ্ধি করে নেয়। সন্ধ্যেটা দুজনের ছাদে কাটে। রিমন কাশফিয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠে।

” পিচ্চি পাখি আমার সাথে যেতে হবে তোমায় কাল, তুমি পারবে যেতে?”

“পারবো তোমার সাথে সাত সমুদ্র তের নদী পেরোতে পারবো। তুমি যে আমার সকল ভরসার জায়গা।”

” তাহলে কাল থেকে নতুন জীবন শুরু হবে তোমার।”

“আমি প্রস্তুত আমার মন।”

এশারের আজানের ধ্বনি শুনে নিচে নেমে গেলো দু’জনে। সারারাত দু’জনের এপাশ ওপাশ করে কেটে যায়। রিমনের হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে। কাশফিয়া নতুন কিছুর সন্ধান করতে। অস্ত্র ছাড়া জীবন যুদ্ধ করতে করতে যে ক্লান্ত কাশফিয়া।

পরের দিন দুপুরে রিমন ও কাশফিয়া কাজী অফিস থেকে বিয়ে সেরে বের হয়েছে। সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিমনের বন্ধু ও তার বউ। আজ থেকে কাশফিয়া যেন এক নতুন রুপ ধারণ করলো।

প্রথা অনুযায়ী আজ দু’জনের বাসর রাত। প্রত্যেক ছেলে ও মেয়ের স্বপ্ন থাকে এই রাত নিয়ে।

কাশফিয়া রিমনের ঘরে সেদিন সবাইকে লুকিয়ে। কাশফিয়ার জীবনের প্রথম কোন ছেলের সংস্পর্শে আসা। এটা যেন এক অজানা অনুভূতি।

রিমন কাশফিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ যে মানস প্রিয়াকে কাছে পাওয়ার দিন। আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো কাশফিয়া।

দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নতুন জীবনের সূচনা করলো। নামাজের পাটিতে কাশফিয়ার হাতে তুলে দিল ব্যাংকের চেক। যাতে রিমনের অবর্তমানে কোন ভোগান্তিতে পড়তে না হয়।

নামাজের স্থান ছেড়ে উঠে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকল কাশফিয়া। ভয় ও শিহরণ মিশ্রিত চেহারায় নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। রিমন কাশফিয়ার কাছে গিয়ে খোঁপা খুলে দিল। আর বলল ” যতক্ষণ আমার সামনে থাকবে ততক্ষণ চুল যেন বাঁধা না থাকে।” বলেই কোলে তুলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে রাইনা বেগমের চিৎকারে, পুরো পরিবারের সবাই রিমনের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রিমন ও কাশফিয়া চমকে গেছে। কাশফিয়াকে চরিত্রহীন উপাধি দেয়া হয়েছে। রিমন যেন পাথর মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কারণ সে যে মায়ের ওয়াদা ও কসমের কষাঘাতে জর্জরিত। মা যদি বলে এখানে একটা কথা বললে মরা মুখ দেখবি! সেখানে সন্তানের কিইবা বলার থাকে।

খারাপ চরিত্রের মানুষ হিসেবে সেদিন, বেরিয়ে আসে কাশফিয়া। বাবার বাড়িতে যার স্থান ছিল না। সেখানে সে যাবে কেমন করে। অনেক সংগ্রাম করেছে।

আজ সে একজন উকিল। নারীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার।

চোখের জল আড়াল করে বিষাদময় অতীত থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসলো।

রাতের আটটা বেজে গেছে। পাঁচটায় বসেছে অতীতের স্মৃতির ক্যানভাসে। এখন সময় আমার এটাই নিয়তি।

আট বছরের মেয়েটাকে নিয়ে কাশফিয়ার সংসার। রিনফিয়া সব সময় ছুটাছুটি করে। আজ স্কুল শেষ করে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কাশফিয়া শরীরে হাত দিয়ে দেখে। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেল। জরুরী বিভাগে ভর্তি করলো। জরুরী বিভাগে বাইরের কাউকে এলাও করে না, তাই বাহিরের বসার জায়গায় বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে।

সামনে কারো উপস্থিতি পেয়ে, উপরে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে রাইনা বেগম। নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে রাইনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো কাশফিয়া।

রাইনা বেগম লজ্জানত মুখ নিয়ে বলল, সেদিন নিজের অধিকার নিয়ে কেন থাকলি না পাগলী? আমি যে তোর প্রতিবাদী চেহারা দেখতে চেয়েছি প্রতিবার। কিন্তু আমাকে ছেলের কাছে অপরাধী করে চলে গেলি। যা তোর মনের কাছে। আমি আমার নাতনির কাছে থাকছি।

রিমনের বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কাশফিয়া। রিমন তার অর্ধাঙ্গিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বলছে “তুমি নাহয় দূরে ছিলে, কিন্তু আমাদের দু’জনের কাটানো সময়গুলো এক ছিল। দু’জনে দুজনের স্বপ্নে মাতোয়ারা ছিলাম।”

কাশফিয়া নিচু স্বরে বলছে আমার তো এখনো মনে হচ্ছে, আমি এখনো তোমার ” স্বপ্নে মাতোয়ারা। “

স্মৃতির আড়ালে – যাকারিয়া হাসান

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
_স্মৃতির আড়ালে
_যাকারিয়া হাসান

সবাই চুপ করে বসে আছে। বছরের প্রথম ক্লাস। এরা সবাই ভার্সিটিতে নতুন। লেকচার দিচ্ছেন জনাব রশিদ সাহেব।তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রধান। ছাত্রদেরকে বিভিন্ন উপদেশমূলক কথাবার্তা বলছেন। পাশে কয়েকজন স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন, ছাত্রদের মনোযোগ তার দিকে নয়, দরজার দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, একটি ছেলে দরজায় দাড়িয়ে আছে। ভার্সিটির প্রথম ক্লাসে অনেকেই আসেনা। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ দেরী করে আসে, এটা রশিদ সাহেবের জীবনে প্রথম। তিনি ছেলেটাকে ভিতরে ডাকলেন।
-নতুন ভর্তি হয়েছ?
_জি।
-কী নাম?
_শ্রাবণ।
– ক্লাস শুরু হওয়ার কথা কয়টায়?
_সকাল আটটা।
-তাহলে দেরী করলে কেন? এখন ক্লাস থেকে বের করে দেই?
এরপরের ঘটনার জন্য রশিদ সাহেব কেন, ক্লাসের কেউই প্রস্তুত ছিল না । শ্রাবণ উত্তর না দিয়ে মুখ তুলে উপরের দিকে তাকাল । মুখাবয়ব শান্ত, ভাবলেশহীন । ক্লাসে পিনপিন নীরবতা বিরাজ করছে ।রশিদ সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। কী অদ্ভূত আচরণ!
_”এক সপ্তাহ হয়ে গেল,একটাবার কথাও বলল না, ছেলেটার ভাব দেখলে গা জ্বলে যায়।“ মেঘলা ক্রমেই রেগে উঠছে। নাবিল বলল,
-আমার মনে হয়, বিষয়টা এরকম না, ছেলেটাকে দেখলে খুবই ভদ্র মনে হয়। বাকী সবাই তো আর একরকম হয়না। কারো জীবন বন্ধু ছাড়া অচল। আবার কেউ একা থাকতেই পছন্দ করে।
_ফালতু কথা বলবি না। ও মেধাবী, তাই এত দেমাগ।
-তুই কি করে জানলি যে শ্রাবণ মেধাবী?
_চেহারা দেখলেই বুঝা যায়।
-বাহ! তুই দেখি জ্যোতিষ ও ! তা বল দেখি, আমাকে দেখলে কী মনে হয়?
_আস্ত একটা রামছাগল !!
-আচ্ছা যখন আয়নায় নিজেকে দেখিস, তখন?
মেঘলা এমনভাবে তাকাল, যেন নাবিলকে আস্ত গিলে ফেলবে। অবন্তিকা চুপচাপ বসে বই পড়ছে। ভার্সিটির পড়ায় অবন্তিকা যতটা মনোযোগী, তার চেয়ে অধিক আগ্রহী সাহিত্যের প্রতি। নাবিল বলল,
-“অবন্তিকা, তোমার কী মনে হয়?” অবন্তিকা বই থেকে মুখ তুলে চাইল।
_কাহার সম্বন্ধে?
মেঘলা বলল,
-এতক্ষণ যে আমরা কথা বললাম, তোর কানে কি গুটি দেওয়া ছিল?
_শোন বৎস, জ্ঞান হইল অথৈ সাগর। তাহাতে নিমজ্জিত হইলে অতি সুস্বাদু পোলাও – কোরমাও বিস্বাদ। আর তোমাদের আলোচনা! সে তো অতি তুচ্ছ !!!
-শ্রাবণ ও কি অতি তুচ্ছ ?
_ সাধু! সাধু! অবয়ব যেন রজনীর চাঁদ , হাসি যার দোলা দিয়ে যায় সহস্র তরুণীর হৃদয় কানন, সে কেন তুচ্ছ হইবে? সে তো ……।“ হঠাৎ অবন্তিকার মুখে ভেসে উঠল আনন্দের হাসি।
-অদৃষ্ট তোমাদের প্রতি করুণা করিয়াছে। দেখো, সহস্র আঁখির কামনার ফুল তোমাদের দিকে আসিতেছে।“ মেঘলা তাকিয়ে দেখল, শ্রাবণ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সাথে মাসরুর। শ্রাবণ সামনে এসে মেঘলার মুখোমুখি দাড়াল।
-“আমি মানুষটা একটু অন্যরকম। অনেকেই হয়তো ভাবছে, আমার অনেক হ্যাডম। আমি অনেক মেধাবী, তাই কারো সাথে কথা বলিনা। বিষয়টা আসলে এরকম না। আমি মানুষের সাথে মিশতে পারিনা। এটা আমার চারিত্রিক দোষ।“ শ্রাবণ কথা শেষ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘলার মেজাজ আরও চড়ে গেল।
_”তা আদরের দুলাল, মাসরুরের সাথে এত মিশলেন কী করে? ওর বাবাও কি আপনার বাবার মত ধনকুবের?” শ্রাবণ মুখ তুলে তাকাল মেঘলার দিকে।মেঘলা আবিষ্কার করল, এ একটু আগের শ্রাবণ নয়। চোখ-মুখ ঠিকরে যেন আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে । মেঘলার কেমন যেন ভয় করছে। কিন্তু না! কোন উত্তর না দিয়েই হেটে চলে গেল শ্রাবণ।
কয়েকদিন পর। মাঠের এক কোনে শ্রাবণ আর মাসরুর বসে আছে। মাসরুর বলল, ”শ্রাবণ ,তুই এই ঝামেলাটা না করলেও পারতি। রফিক ভাই পলিটিক্স করে। ওনার অনেক ক্ষমতা। চাইলেই তোর ক্ষতি করতে পারে।“
শ্রাবণ মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। দূর দিগন্তে টুকরো কিছু মেঘ বাতাসের ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছে। যেন নীল সমুদ্রের বুকে বয়ে চলা ছোট্ট তরী।
_কী করবে? মেরেফেলবে? শোন, মানুষ বেঁচে থাকতে চায় কিছু অর্জনের জন্য। প্রতিবাদ করেনা হারানোর ভয়ে। আমার জীবনে অর্জনের কিছু নেই। হারানোর প্রশ্ন এখানে অবান্তর।“
দূর থেকে মেঘলা, নাবিল, অবন্তিকার চেহারা দেখা যাচ্ছে। ওরা এদিকেই আসছে। মেঘলা একদম সামনে এসে বলল, “বসতে পারি?” শ্রাবণ আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মাস্রুর বলল“বস! “
মেঘলা শ্রাবণের পাশ ঘেঁষে বসল। শ্রাবণ চোখ নামিয়ে বলল,”ক্ষমা চাইতে এসেছেন? আমি মানুষের প্রতি কষ্ট রাখিনা।“ মেঘলা মাথা নিচু করে বসে আছে।
-“একটা গল্প শুনবেন?” শ্রাবণ উত্তরের অপেক্ষা করল না।
_”আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। বাবা-মার একমাত্র সন্তান। আর্থিক দিক দিয়ে যথেষ্ট সচ্ছল ছিলেন বাবা। না চাইতেই সব এসে পড়তো আমার জন্য। জীবনটা সুখেই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ভাগ্যে মনে হয় খুব বেশিদিন সুখ লেখা ছিলনা। হঠাৎ নানা মারা গেলেন। আম্মুরা ছিলেন দুই ভাই একবোন। আম্মু সবার ছোট। বড় মামা ছিলেন গ্রামের মাতব্বর টাইপের লোক। মামাদের সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিলনা। আমরা নানা বাড়িতে গেলে ওনারা খুব বেশি কথা বলতেন না।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

নানার সহায়–সম্পত্তি ছিল প্রচুর। নানা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি মারা গেলে তার মেয়ে সম্পত্তির কিছুই পাবেনা। তাই তিনি জীবদ্দশায় নিজের বাড়ি লিখে দিয়েছিলেন ছোট মেয়ের নামে। কিন্তু এই বাড়িই কাল হয়েছিল আমার মায়ের জন্য। নানা মারা যাওয়ার পর দুই মামা উঠে পড়ে লাগলেন মায়ের পিছনে। বাবা ছিলেন শান্ত প্রকৃতির লোক। তিনি মাকে বোঝালেন“আমাদের জীবন তো ভালই চলছে। ওনারা প্রভাবশালী লোক, চাইলেই অনেক কিছু করতে পারে। ছেড়ে দাওনা ঐ বাড়িটা!” কিন্তু মা ছিলেন সিদ্ধান্তে অনড়। তিনি তো আর জোড় করে দখল করেননি। তা ছাড়া বাবার দেয়া স্মৃতি তিনি ছাড়বেন ই বা কেন? এটা নিয়ে দিন দিন ঝামেলা বাড়তে লাগল। বাড়িতে প্রতিনিয়ত লোকজন আসত। হটাৎ একদিন খবর এল, বড়মামা স্ট্রোক করেছেন। বড় মামার আগ থেকেই হার্টের অসুখ ছিল। মা-বাবা তাড়াহুড়া করে রওয়ানা হলেন নানা বাড়ি। সেই শেষ!মা আর কোনদিন ফিরেননি!!
সবাই চুপ করে বসে আছে। মেঘলা চশমা খুলে চোখ মুছল। শ্রাবণ বলা শুরু করল –
-“বাবা ঐ রাত্রেই ফিরে এসেছিলেন। ঘরে নগর টাকা যা ছিল, তা সাথে নিয়ে আমাকে সঙ্গে করে বের হয়ে পড়লেন। শুরু হলো নতুন জীবন। বাবা অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করলেন কিন্তু কোথাও স্থির হতে পারছিলেন না। সবশেষে আমরা ঢাকা চলে আসলাম। কয়েকটা রাত রাস্তায় কাটালাম। আমার কাছে ভালই লাগছিল। মাঝেমধ্যে মনে হতো মা থাকলে আরও মজা হতো। এক রাতে বৃষ্টি এল। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। হঠাৎ দেখলাম, বাবা কাঁদছেন। ভাবলাম, হয়তো আমার মতো বাবারও মাকে মনে পড়ছে। বাবা কোন একটা ব্যবস্থার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু অচিন শহর অচেনার মতই আচরণ করল।এদিকে নগদ অর্থ-কড়িও প্রায় শেষ। শেষমেষ বাবা রিকশা চালানো শুরু করলেন। রিক্সার গ্যারেজেই থাকতাম আমরা। গ্যারেজের সবাই আমাকে খুব আদর করতো। মাঝে মধ্যে আমার জন্য এটা সেটা নিয়ে আসতো। দিনশেষে বাবা যখন গ্যারেজে ফিরতেন, আমি আর বাবা হোটেলে খেতে যেতাম। বাবা শুধু ডিম দিয়ে ভাত খেতেন। আমি ইচ্ছেমত মাছ,মুরগী যা মন চায় খেতাম। মাঝেমধ্যে বাবার উপর রাগ হত। মনে মনে ভাবতাম, দেশে ফিরে গেলেই তো সব ঠিক হয়ে যায়। এত বড় বাড়ি, পুকুর ভর্তি মাছ, যায়গা,জমি কী নেই আমাদের! কিন্তু পরক্ষণেই মনে হত, এবার যদি ওরা বাবাকেও নিয়ে যায়!! এক পর্যায়ে বাবা আমাকে একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। প্রতিদিন ছুটি হলেই দেখতাম, বাবা রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রঙিন গাড়িগুলো দেখে ছোট্ট হৃদয়ে প্রায়ই অভিমান হতো। একদিন বাবাকে বলেই ফেললাম,
-”আমাদের একটা গাড়ি থাকলে খুব মজা হত, তাইনা বাবা?”
বাবা রাস্তার একপাশে রিকশা থামালেন। মায়াভরা চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
_যাদের গাড়ি আছে, তাদের বাবা কি তাদের প্রতিদিন নিতে আসে?
আমি মাথা নেড়ে “না” উত্তর দিলাম।
_তোর বাবা কি প্রতিদিন তোকে নিতে আসে?” বাবার চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল। উত্তর না দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। ঘামে ভেজা বাবার শার্ট আমাকেও খানিকটা ভিজিয়েছিল। কোমল হৃদয়ে সেদিন অনুভব করেছিলাম, আমি আর বাবা মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ অভিন্ন এক সত্ত্বা! ধীরে ধীরে কেটে গেল বহু সময়। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। বাবা এক রুমের ছোট একটা বাসা নিলেন। সেদিন আমার কী যে আনন্দ হয়েছিল! দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল আরো পাঁচটি বছর। বাবার স্বপ্ন পূরণ করে এসএসসি তে গোল্ডেন A+ পেয়েছিলাম । বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কোন কলেজ পছন্দ আছে কিনা। আমি চুপ করে রইলাম। মনে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু রঙিন ঘুড়ি তো আর গরিবের জন্য নয়! কয়েকদিন পর বাবা হাতে কিছু কাগজ দিয়ে বললেন,
-দেখে নে, শনিবার থেকে ক্লাস শুরু।“ খুলে দেখলাম ঢাকা সিটি কলেজের কাগজপত্র। আমি তো অবাক! এত টাকা বাবা কোথায় পেলেন! রাত্রে খেতে বসে বাবাকে বলে বসলাম,
_বাবা, এতগুলো টাকা খরচ করে ভর্তি হওয়ার কি দরকার ছিল! নরমাল কলেজে ভর্তি হলেই পারতাম!”বাবাবললেন,
-তুই যখন বড় ইঞ্জিনিয়ার হবি, তখন আমার টাকা আমাকে শোধ করে দিস!” বলেই হেসে উঠলেন বাবা।
শনিবার। সকাল 9 টায় ক্লাস শুরু। বাবা সকাল সকাল বের হয়ে গেছেন। আটটার দিকে বাসা থেকে রওনা হলাম। কিছুদুর যেতেই রহিম চাচার সাথে দেখা। রহিম চাচা সেই ঐতিহাসিক গ্যারেজের মালিক, যাতে আমার জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে। ওনার সাথে বাবার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। সালাম দিলাম। তিনি আমাকে দেখে কেমন যেন চুপ হয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-কলেজে যাইতাছ?
_জ্বি চাচা, আজ প্রথম দিন। “তিনি থমথমে গলায় বললেন ,
-ভাল কইরা পড়া-লেখা কইরো,তোমার বাপ তোমার লেইগা অনেক কষ্ট করছে।“ এরপর তিনি যা বললেন, শুনে আমার মনে হল, পৃথিবীটা কেমন যেন থমকে দাড়িয়েছে। আমি বজ্রহাতের ন্যায় দাড়িয়ে রইলাম। রহিম চাচা ঝরঝর করে কাঁদছিলেন। বাসায় ফিরে এলাম।সারাটা দিন কাঁদলাম একাকী। রাতে বাবা এসে দেখলেন আমি শুয়ে আছি।
-কিরে,কলেজে প্রথম দিন কেমন লাগল? নিশ্চয় বন্ধু-বান্ধব জোগাড় করে ফেলেছিস? জানিস,আমি ভার্সিটির প্রথম ক্লাসে দেরী করে গিয়েছিলাম, স্যার এমন রাগ করেছিলেন! কিরে! তুই কথা বলছিস না কেন? কলেজ পছন্দ হয়নি?” আমি উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলাম।
_তুমি কেন এমন করলে?
আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বাবা বললেন,
“জানিস, তোকে নিয়ে তোর মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। তোর মা বলত,”শ্রাবণ যেদিন প্রথম বেতন পাবে, সেদিনই আমরা একটা গাড়ি কিনবো। সেই গাড়ি দিয়ে আমি আর আমার ছেলে সারাদেশ ঘুরে বেড়াব।“ আমি বলতাম, আমায় নেবে না? “তুমি তো ড্রাইভার থাকবে” বলেই তোর মা হেসে উঠতো।“ সেদিন কাঁদতে কাঁদতেই বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
শ্রাবণ চুপ করে আছে। মেঘলা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল
_”কী করেছিল আপনার বাবা?”
-শুনবেন? খুব বেশি কিছু না, সামান্য শরীরের রক্ত বিক্রি করেছিলেন!!”
অবন্তিকার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মেঘলার চোখ লাল হয়ে গেছে।
_এখন কোথায় আছেন আপনার বাবা?” শ্রাবণ হাসল।
-“আমার সাথে!” বলেই মুখ তুলে আকাশে তাকাল শ্রাবণ। মুখাবয়ব শান্ত। শ্রাবণের চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তাই সে দেখতে পেলনা, আরও চার জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। শূন্য,নির্বিকার দৃষ্টিতে!!!

মায়া – লেখিকা অন্তরা ইসলাম

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট২০২০
#গল্প_মায়া
#লেখিকা_অন্তরা_ইসলাম

আমি পানি দেখলে খুব ভয় পাই।কিন্তু আজ জীবনের মায়া কাটিয়ে উঠতে পানি ব্যতীত অন্য কিছুর কথা মাথায় আসলো না।তাই জীবনের প্রথমওশেষবারের মতো নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি।অদুর জলরাশি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।আমি শেষবারের মতো ফেলে আসা অতীতটাকে একবার স্মরণ করে নিতে চাই।তাই চোখ বন্ধ করে মনে করতে শুরু করি……..

আমার নাম নীলা।এক ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। কিন্তু বাবা-মায়ের আদর, স্নেহ, ভালোবাসা এগুলো কখনোই পাইনি। কারন বাবা-মা দুজনেই চাকরি করে। আমার জন্য তাদের কাছে সময় কই…তারা ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত।আমি সারাদিন কাজের মেয়ের সাথেই থাকতাম। বাবা-মায়ের সাথেতো সপ্তাহে একবার দেখা হতো। কারন সকালে যখন তারা চলে যায় আমি ঘুমে বিভোর। আর রাতেও তাদের অপেক্ষায় থেকে ঘুমিয়ে যেতাম।আমাদের সংসারে অভাব ছিল না তারপরেও বাবা-মা রোজ রোজ ঝগড়া করত। যা আমার ভালো লাগত না অথচ একসমসয় এরা একে অপরকে ছাড়া একমুহূর্তের জন্যও থাকতে পারত না।আমি সবেমাত্র প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। তার কিছুদিন পরেই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। তারা লিগালি একে অপরকে ডির্বোস দিয়ে দেয়।আমাকে অনিচ্ছা সত্বেও বাবার সাথে যেতে হয়।আমি বাবাকে অবশ্য অনেক ভালোও বাসি কিন্তু তা না বলা কথা…..

আমার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয় আমাকে দাদু বাড়িতে রেখে আসেন।কখনো কথা বলেন না বা দেখতে যান না বাবা।কারন সে তার নতুন স্ত্রীকে নিয়ে সুখে আছে।আমি তার সংসারে উটকো ঝামেলা। শুধু পড়াশোনার খরচটা দিত।কিন্তু তাও কপালে সইল না।ছোট চাচ্চু বিয়ে করলো।তার বউ আমাকে মোটেও সহ্য করতে পারতো না।তাই নানা ভাবে কষ্ট দিতে থাকে। খেতে দিত না, আমার জামা কাপড় নিয়ে নিত,অনেক কাজ করাতো।শেষ পর্যন্ত তাদের আচরণ আমাকে নিশ্চুপ বানিয়ে ফেলে।একটা ডানপিটে মেয়ে হঠাৎ করে চুপ করে যায়। প্রয়োজনের বাইরে একটা কথাও বলেনা।ঘর থেকে বেরোয়না।কারো সাথে মেশে না।আর সবচেয়ে বড় কথা এখন বাবা চাইলেও তার সাথে কথা বলিনা।বাবা বলে ডাকিনা।কিভাবে ডাকবো এই ক’বছরে তার প্রতি থাকা ভালোবাসা ঘৃণার রূপ নেয়। আমি বুঝতে পারি তার পরকিয়া সম্পর্কের জন্যই আমাদের সংসারটা ভেঙে গেছে। আমার এমন আচরনে সবাই অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলেনা।যখন কোন অত্যাচারই আমাকে তাড়াতে পাড়লনা।তখন একদিন হঠাৎ করে আমার বাবা আসলেন।রাত তখন ১১টা। এসেই আমাকে ডাকলেন আমি একটু অবাক হলাম। কারণ আমাকে রেখে যাওয়ার তিন বছর পরে আজ সে এসেছে। আর এসেই আমাকে ডাকছে।আমি গেলাম,তিনি আমাকে চলে যেতে বললেন।আমি যাবোনা বলায় সে আমাকে সজোরে একটা চড় মারে।আমি বিছানার উপর পড়ে যাই।সে পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে আমাকে চেপে ধরেন।কেউ আমাকে বাচাঁতে এগিয়ে আসেনি।চেচাঁমেচি শুনে আসা পাশের বাড়ির আপু আমাকে প্রানে বাঁচান।আমি বাবার সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে চিরতরে বেড়িয়ে আসি।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মাঝরাত আমি একা একটা মেয়ে কোথায় যাব? কি করব? কিছুই বুঝতে পারছি না।জোরে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু মুখ থেকে কোন শব্দ বেড়োতে চায় না।যেন নির্বাক হয়ে গেছি।পুরো রাস্তা ফাঁকা। কোথাও যেন একটা কাক পাখিও নেই।খুব ভয় হচ্ছে। একটা বাস স্টপেজ এ বসে নিঃশব্দে কান্না করছি।হঠাৎ কেউ একজন পাশ থেকে বলে উঠে, এই যে ম্যাম কাঁদছ কেন?এটা শুনে কিছুটা অবাক হলাম। তাকিয়ে দেখি একটা ছেলে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাব। আমি কোন জবাব না দেওয়ায় সে আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে অন্য হাতে আমার হাত ধরে হাটতে লাগলো। একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। ভিতরে একজন বৃদ্ধা মহিলা তাহাজ্জুদ নামাজে ব্যস্ত।ছেলেটি আমাকে একটা রুমে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে আমার জন্য খাবার নিয়ে এলো।আমি খেতে অস্বীকার করি।সে আমার চোখ থেকে ঝরতে থাকা জলগুলো মুছিয়ে দিয়ে বলে,তুমি ভয় পেয় না। আমার নাম আকাশ। তোমার নাম কি?আমি তাকে বলি,নীলা। কিন্তু সে নীল বলে উঠে। আর আমাকে খাইয়ে দিতে থাকে। রাতে আর কথা হয়না আকাশের সাথে। সকালে জানতে পারি ওই মহিলা আকাশের মা।আকাশ আমাকে আম্মুর বাসায় পৌঁছে দেয়।এর মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয় আমাদের। আকাশ আম্মুর বাসা থেকে ফেরার আগে আমাকে বলে,তুমি কি আমার আকাশ রঙিন করার জন্য রং হবে?বিশ্বাস করো ওই নীল আকাশের মতো এই আকাশ ও নীল ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমি তাতে সম্মতি জানাই।তারপর আকাশ চলে যায়।

আম্মুর বাসায় ভালোই লাগছিল। শুধু আমাকে টাইম না দিয়ে ফোনকে টাইম দেওয়াটা ভালো লাগছিল না।আমি তো এখনো বাড়িতে ঘটে যাওয়া কথা গুলো আম্মুকে বলতে পারি নি।তবুও সুখেই তো আছি।খাবার পাচ্ছি, জামা পাচ্ছি।আর কি চাই?থাক না আম্মুর সাথে আগের মতো দুরত্ব। আকাশ তো আছে।একদিন একজন ভদ্রলোক আসলেন।আমি তাকে চিনি না।কলিং বেলের শব্দে আমি দরজা খুলে দেই।সে বাসায় ঢুকেই আমাকে প্রশ্ন করে, তুমি এখানে এসেছো কেন?ফিরে যাবে কবে? আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই সে আম্মুর রুমে চলে যায়। একটু পরেই তার সাথে আম্মুর ঝগড়া হয়।সে আম্মুকে চড় মারে আর বলে আমি তোমাকে বিয়ে করেছি অন্যের ঝামেলা সাথে নিয়ে আসার জন্য না।তোমার যদি মেয়ের জন্য এত মায়া থাকে তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন? আমি দরজার সামনে দাড়ানো ছিলাম তাই সবটা শুনতে পাই।আমার আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। দৌড়ে রুমে এসে দরজা লক করে দেই।খুব কান্না পাচ্ছে। ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার অন করে দেই চোখের জল যেন বাধা মানছে না।কিছুক্ষণ পর আবার ব্যাগ গুছিয়ে আম্মুর বাসা থেকে ও বেড়িয়ে আসি। খুব কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে,আম্মু ও মুখ ফিরিয়ে নিল।

আকাশকে কল দিলাম আমার শেষ ভরসা।কিন্তু সে ও সবটা শুনে মুখ ফিরিয়ে নিল।আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই শেষ পর্যন্ত নদীর পাড়েই আসতে হলো। এগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে নোনাপানির স্রোত চলে এসেছে। আমি আর মায়া বারাতে চাই না।তোমাদের মুক্ত করে দিলাম।থাক না কিছু না বলা কথা যা আজও হয়নি বলা,
ভালোবাসি তোমাদের বাবা-মা………..
আর বলা হলোনা তার আগেই নদীর শান্ত পানিকে অশান্ত করে দিয়ে নীল চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল। সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছিল সবাইকে ছেড়ে যেতে।আর বারবার আম্মু তোমার হাসি মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে…….
আর মনে হচ্ছিল আমি তো এটা চাইনি তাহলে এমন কেন হলো????কেন???

একা – লেখা ফাহমিদা আঁখি

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০

#ছোটগল্প_একা
#ক্যাটাগরি_স্যাড_এন্ডিং
#লেখা_ফাহমিদা_আঁখি

আধঘণ্টা যাবত আমি এবং আমার বান্ধবী নন্দিতা, বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। তবুও বাস আসার নাম নেই। নন্দিতা খুব বিরক্ত হচ্ছে। বিড়বিড় করে বাসের ড্রাইভারকে বকা দিয়ে তার গুষ্ঠি উদ্ধার করছে। কিন্তু আমার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার উৎসুক চোখদুটো তখন, এদিকওদিক কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আর ঠিক তখনই দেখতে পেলাম, চায়ের স্টলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটি। যে রোজ আমার কলেজ ছুটির পর, এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আর একটু পরপর আড়চোখে আমাকে দেখে। ছেলেটিকে দেখে আমার ঠোঁটে হাসি ফুটল। কেন, তা আমি জানি না। নন্দিতা আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,

-কী ব্যাপার বল তো? ওই ছেলেটা বারবার তোর দিকে তাকাচ্ছে কেন?

আমি কিছু না বুঝার ভান করে বললাম,

-কোন ছেলেটা?

নন্দিতা আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,

-আমাকে কি তুই বোকা মনে করিস? আমি জানি, ওই ছেলেটা রোজ এখানে তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। বল ঠিক কি না?

নন্দিতার চোখকে ফাঁকি দেয়া কঠিন। তাই হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললাম,

-হুম।

নন্দিতা মুচকি হেসে, আমার বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,

-কি সুন্দরী, ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে?

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম,

-যাহ!, কী যে বলিস না। তুই যেমন ভাবছিস, তেমন কিন্তু নয়। ছেলেটি রোজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আর আড়চোখে আমাকে দেখে। আমি শুধু সেটা উপভোগ করি। এর বাহিরে আর কিছুনা।

নন্দিতা আমার দিকে বেশ অবাক চোখে তাকালো। ইতোমধ্যে বাস চলে আসায়, আমরা আর কথা না বাড়িয়ে বাসে উঠতে গেলাম। তখনই কেউ একজন ডেকে উঠলো,

-বিভাবরী?

আমি চমকে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম, সেই ছেলেটি। আমাকে পেছন ফিরতে দেখে, হঠাৎ ছেলেটি আমার দিকে একটা নীল রঙের খাম এগিয়ে দিল। বিস্ময়ে আমার তখন কোনো হুস ছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আর ভাবছিলাম, কারো গলার স্বর বুঝি এত সুন্দর হয়? নন্দিতা আমাকে তাড়া দিয়ে বলল,

-বিভা, তাড়াতাড়ি কর। এক্ষুণি বাস ছেড়ে দেবে।

তখনো আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। নন্দিতা আবারও আমাকে তাড়া দিয়ে বলল,

-বিভা, নিয়ে নে খামটা। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।

এতোক্ষণে নন্দিতার কথা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো। আমি হাত বাড়িয়ে খামটা নিয়ে এক মুহূর্তেই বাসে উঠে পড়লাম। আমার খুব ইচ্ছে করছিল, একবার পেছন ফিরে দেখি, ছেলেটি এখনো কি আমার পানে চেয়ে আছে?

বাড়ি ফেরার পর, একছুটে নিজের ঘরে গিয়ে কোনোমতে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার বুকটা দুরু দুরু কাঁপছিল। ভয়ে, উত্তেজনায় আমি ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিলাম। হাতের মুঠোয় ধরে রাখা এই নীল খামের ভেতরে কী আছে? ভালোবাসার চিঠি? নন্দিতা তো তেমনটাই বলছিল। আর দেখার জন্যও খুব জোর করছিল। কিন্তু আমার কেমন সংকোচ হচ্ছিল।

খামের ভেতরে একটা ধবধবে সাদা কাগজ খুব যত্নে ভাঁজ করে রাখা। আমি ভাঁজ খুলে দেখলাম, তাতে লেখা___

“বিভাবরী,

তোমাকে রোজ দেখি। আর বুকের ভেতর তোমার জন্য শতশত অনুভূতি জমিয়ে রাখি। এই অনুভূতির নাম কী জানো? এই অনুভূতির নাম ভালোবাসা। তুমি কি আমার জমিয়ে রাখা সেই অনুভূতির ডাকে সাড়া দেবে? সাড়া দেবে বিভাবরী?

ইতি
তোমার উত্তরের অপেক্ষায়
সেই ছেলেটি

চিঠিটা পড়ে আমার সারা শরীরে কাঁপন শুরু হলো। এমন সময় মায়ের গলা শুনতে পেলাম।

-বিভা, তোর হাতে ওটা কী?

আমি চমকে উঠলাম। মায়ের প্রশ্নে আমার গলা শুকিয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ চিঠিটা মায়ের চোখের আড়াল করে ক্ষীণ স্বরে বললাম,

-কই, কিছু না তো।

মা আমাকে কিছুক্ষণ গোয়েন্দার মতো পর্যবেক্ষণ করে বলল,

-কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ না হয়ে, দরজা বন্ধ করে বসে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। টেবিলে খাবার দিয়েছি সেই কখন!

মা চলে গেল। আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।

সারারাত আমার ঘুম এলো না। আধো ঘুমে আধো জাগরণে শুধু সেই ছেলেটির কথাই ভাবতে লাগলাম।

পরদিন সকালবেলা, আমার যখন ঘুম ভাঙলো, তখন ঘড়িতে নয়টা বেজে কুড়ি মিনিট। আমি ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। এত বেলা হয়ে গেছে। অথচ আমাকে কেউ ডাকেনি কেন? আমি এখন কলেজে যাব কী করে? ঘর থেকে বের হতেই মা বলল,

-বিভা, তোকে আজ কলেজে যেতে হবে না। যা তুই ফ্রেশ হয়ে নে। পারলে গোসলটাও সেরে ফেল। আর ভালো দেখে একটা জামা পরবি।

মায়ের কথা আমি কিছুই বুঝলাম না। সব আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল। আমি বললাম,
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
-মা, আজ হঠাৎ আমি কলেজে যাব না কেন? আর তুমি এসব কী বলছো? ভালো দেখে একটা জামা পরবো মানে?

-যা বললাম, তাই কর। তোর এত প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দিতে পারবো না। সময় হলেই সব জানতে পারবি।

আমার মনের ভেতর খচখচ করতে লাগলো। কলেজে যেতে না পারায় অস্থিরতায় ছটফট করতে লাগলাম।

বেলা এগারোটা নাগাদ আমি জানতে পারলাম, আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। আমার অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এরমধ্যেই পাত্রপক্ষ এসে হাজির। ক্ষাণিক পরে, আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে পাত্রপক্ষের সামনে হাজির করানো হলো। চোখের পলকে সবটা কেমন বদলে যেতে লাগলো।

পাত্রপক্ষ আমাকে পছন্দ করেছে। আর আজকেই তারা বিয়ে পড়িয়ে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে চায়। আমার বাবা তাদের এই প্রস্তাবে এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন। বাবা খুব রাগী এবং একগুঁয়ে স্বভাবের মানুষ। বাড়ির কেউ তার মতের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। এমনকি মাও নন। তবুও আমি মাকে কাকুতিমিনতি করে বললাম,

-মা, তুমি বাবাকে একবার বলো, আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। প্লিজ! একবার বাবাকে বলো।

মা আমার কথায় কান না দিয়ে বলল,

-মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস। তখন বিয়ে তো করতেই হবে। তা একটু আগে হোক কিংবা পরে। আর তোর বাবাকে বলার কথা বলছিস? তুই তো জানিস, তোর বাবা কেমন। সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। তাই তুই আর অমত করে অশান্তি করিস না। আমরা আগেই খবর নিয়ে দেখেছি। ছেলে খুব ভালো। ঢাকায় চাকরি করে। দেখিস, তুই খুব সুখী হবি।

আমার বুক ভেঙ্গে কান্না এলো। কেউ আমার মন বুঝল না। নিজের ভেতরটা কেমন অনুভূতি শূন্য মনে হলো। কী করবো আমি? এখন আমার কী করা উচিত? পালিয়ে যাব? কিন্তু কোথায় যাব? তাছাড়া পালিয়ে গেলে বাবার সম্মানের কী হবে?

ধীর পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে, বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। আমার মনের মাঝে লুকানো অনুভূতিগুলো আমি আমার মনের মাঝেই চিরদিনের জন্য কবর দিয়ে, পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। নিজের মনকে প্রবোধ দিলাম এই ভেবে যে, মানুষের জীবনে সব চাওয়া পাওয়া কখনো পূরণ হয় না।

সেদিন রাতেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিদায়বেলায় মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আমার ভেতরটা তখন অন্তঃসার শূন্য। চেষ্টা করেও দু’চোখে একফোঁটা জল আনতে পারলাম না।

বিয়ের প্রথম রাতেই আমার স্বামী আমাকে বললেন,

-শোনো, এ বাড়িতে আমার বাবা-মা যা বলবেন, সেটাই তোমাকে মেনে চলতে হবে। এই কথাটা খুব ভালো করে মনে রাখবে। তাদের কখনো অসম্মান করবে না।

আমি বুঝতে পারলাম, আমার স্বামী বাবা-মার খুব একনিষ্ঠ এবং বাধ্য ছেলে। আমি তার কথা মেনে নিলাম। আমার অতীত অনুভূতি ভুলে আমি তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। তার কী ভালোলাগে, কী ভালোলাগে না এসব নিয়ে মেতে উঠলাম। কিন্তু দিনশেষে, সে পাশে থাকলেও আমি সেই আমার কাছেই পড়ে রইলাম। তার মনের কাছে পৌঁছাতে পারলাম না। আমার চারপাশ নিঃসঙ্গতায় ছেয়ে যেতে লাগলো।

আমার স্বামী খুব গম্ভীর স্বভাবের একজন মানুষ। সে কখনো আমার সঙ্গে হেসে কথা বলে না। উল্টো আমাকে হাসতে দেখলে বলে, ‘এভাবে হাসছো কেন? এ বাড়িতে এসব হাসাহাসি কেউ পছন্দ করে না।’ তার কথা শুনে আমার হাসি কর্পূরের মতো উবে যেত। আর কখনো হয়তো আমার হাসির শব্দ কেউ শুনতে পাবে না।

চাকরি সূত্রে আমার স্বামীকে ঢাকায় থাকতে হয়। মাঝেমাঝে ছুটিতে আসে। কিন্তু তার ছুটিতে আসা আমার একাকীত্ব দূর করতে পারে না। বেশিরভাগ রাত পার করি না ঘুমিয়ে। কারণ, ঘুম আসতেই চায় না। কখনো যদি ঘুমিয়েও যাই, মাঝরাতে হঠাৎ জেগে উঠি। তখন জানালা খুলে আকাশ পানে চেয়ে থাকি। আর আমার ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলি, ‘এমন জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে কেউ এভাবে ঘুমিয়ে কাটায়?’ ঘুম থেকে তাকে জাগিয়ে তুলে যদি বলি,

-চলুন না একটু ছাদে যাই।

তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন,

-রাতের বেলা ছাদে গিয়ে কী হবে? অদ্ভুত কথাবার্তা। ঘুমাও এখন।

আমি তাকে কিছুতেই বুঝাতে পারি না, আমার একাকীত্বের কথা।

একদিন তাকে বললাম,

-আমার এখানে খুব একলা লাগে। আমি কি আপনার সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে থাকতে পারি না?

তিনি আমার কথায় কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,

-একলা লাগার কী আছে? তুমি তো এখানে একা থাকো না। মা আছেন, বাবা আছেন।

আমার সব চাওয়া পাওয়া তার যুক্তির কাছে হার মেনে যায়।

মাস খানিক পর, আমার বড় ভাই প্রথমবার আমার শ্বশুরবাড়িতে এলো। বিয়ের সময় সে বিদেশে ছিল। থাকলে হয়তো আমার জীবনটা এমন হতো না। কতগুলো বছর পর তাকে দেখতে পেলাম। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-কেমন আছিস বিভা?

আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ভাইয়া আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

-এই পাগলি, কাঁদছিস কেন?

আমি অভিমানী গলায় বললাম,

এতদিন পর আমার কথা মনে পড়লো? তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছো।

ভাইয়া হেসে বলল,

-ভুলেই যদি যেতাম, তাহলে আজ তোকে দেখতে এলাম কেন?

তারপর ভাইয়া, আমার হাতে একটা বড় প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-এই নে, তোর বিয়ের উপহার। বিয়ের সময় তো ছিলাম না। তাই আজ দিলাম।

আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বললাম,

-কি আছে এতে?
-তোর প্রিয় বইগুলো।

এ কথা শুনে খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে গেলাম। এরমধ্যেই আমার স্বামী এবং আমার শ্বশুরমশাই এসে হাজির হলেন। ভাইয়ার সঙ্গে তারা কুশল বিনিময় করলেন। তারপর আমার শ্বশুর নিজের ঘরে যাওয়ার আগে আমার স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,

-হাসান, বউমাকে বলে দিও। এ বাড়ির মেয়ে, বউরা ওসব গল্প, উপন্যাসের বই টই পড়ে না।

আমি বুঝতে পারলাম, তিনি পরোক্ষভাবে কথাগুলো আমাকে বলে গেলেন। আমরা ভাইবোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। ভাইয়া হয়তো বুঝতে পারলো, এ বাড়িতে আমি কেমন আছি। ঠিক কতটা ভালো আছি। মুখ ভার করে সে বইগুলো নিয়ে চলে গেল। হয়তো আর কখনো এ বাড়িতে আসবে না। আমার মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল।

কিছুদিন পর, আমার বান্ধবী নন্দিতা এলো আমাকে দেখতে। আমি ভাবতেই পারিনি, নন্দিতা আমাকে এভাবে চমকে দেবে। ওকে পেয়ে ক্ষণকালের জন্য আমি আমার একাকীত্ব ভুলে গেলাম। নন্দিতা এখন বিবাহিত। আমার বিয়ের কিছুদিন পরেই ওর বিয়ে হয়ে যায়। বিবাহিত জীবন নিয়ে দুজনে বেশ গল্পসল্প করলাম। বেশিরভাগ ওই বলল। আমি শুধু শুনে গেলাম। ওর স্বামী ওর প্রতি খুব যত্নশীল। ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারে না। এক কথায় ওকে চোখে হারায়। আমার হঠাৎ সেই ছেলেটির কথা মনে পড়লো। যে বাসস্টপে আমাকে দেখার জন্য রোজ দাঁড়িয়ে থাকতো। আমার একবার ইচ্ছে হলো, নন্দিতাকে বলি, সেই ছেলেটিকে আর কখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল কি না। কিন্তু বলতে পারলাম না। নন্দিতা হয়তো সেসব কথা ভুলেই গেছে।

নন্দিতা চলে গেল। ও চলে যাবার পর, আমার শাশুড়ি মা বললেন,

-মেয়েটা হিন্দু না কি?

তার কথা বলার ধরণ দেখে বুঝলাম, নন্দিতার এ বাড়িতে আসা তিনি পছন্দ করেননি। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

বাবা-মা আমার অমতে বিয়ে দিয়েছিল বলে, বিয়ের পর আমি একদিনের জন্যও বাবার বাড়িতে যাই নি। কিন্তু এ বাড়িতে আমার মন আর টিকতে পারছিল না। তাই সবার অনুমতি নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে এলাম। আমাকে দেখে বাবা-মার চোখ থেকে অানন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভাইয়া বাড়িতে নেই। আবারও বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। আমি চুপচাপ নিজের ঘরে গেলাম। ঘরে গিয়ে দেখলাম, ভাইয়ার দেওয়া বইগুলো আমার বুকশেলফ এ সুন্দর করে সাজানো। আমি পরম আবেশে সেগুলো ছুঁয়ে দেখলাম। একসময় এই বইগুলোই ছিল আমার বন্ধু, আমার অবসরের সঙ্গী। হঠাৎ কেউ আমার মাথায় হাত রাখলো। আমি তাকাতেই দেখলাম, মা। মা আমাকে বলল,

-কেমন আছিস মা?

আমি জানালার দিকে তাকিয়ে বললাম,

-জানি না মা। ও বাড়িতে আমার নিজেকে খুব একলা লাগে।
-প্রথম প্রথম সব মেয়েরই এমন হয়। কিছুদিন পর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
-ও বাড়িতে উচ্চস্বরে কথা বলা বারণ, প্রাণ খুলে হাসা বারণ। এভাবে কি থাকা যায় বলো?

মা আমাকে বুঝানোর স্বরে বলল,

-সব পরিবারেরই নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম থাকে। পরিবারের সদস্য হিসেবে তোর এসব মেনে চলা কর্তব্য। তাহলেই সংসারের শান্তি বজায় থাকবে। তাছাড়া তোর শ্বশুরবাড়িই তো এখন তোর নিজের বাড়ি।

আমি মাকে আর কিছু বললাম না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘যে বাড়িতে সবাই থাকা সত্ত্বেও নিজেকে একলা লাগে, সেই বাড়ি কী করে নিজের বাড়ি হয় মা?

বাবার বাড়িতে থাকাকালীন আমি বুঝতে পারলাম, আমি মা হতে চলেছি। তখন আমার মনে হলো, এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হলাম আমি। আমার মা হবার সংবাদ শুনে আমার স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজন কতটা খুশি হয়েছে, তা আমি জানি না। শুধু জানি, এবার আমার একলা থাকার পালা শেষ হবে। আমি আমার অনাগত সন্তানের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘শুনছিস, তুই আমার একলা প্রহরের সঙ্গী হবি। তোর ছোট ছোট হাতের আঙুলের পরশে ভুলে যাব জীবনের সব নিঃসঙ্গতা, নির্জনতার কথা।’

এক একটা দিন কেটে যেতে লাগলো। আর আমি অনুভব করতে লাগলাম, আমার ভেতরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে এক নতুন প্রাণ। মনে মনে বললাম, আর তো মাত্র কটা দিন। তারপর আমার একাকীত্ব দূর হবে। কিন্তু একদিন, আমার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলো। ডেলিভারির তখনো অনেক দেরি। প্রচণ্ড ব্যথায় আমি জ্ঞান হারালাম। আর যখন আমার জ্ঞান ফিরলো, তখন জানতে পারলাম, আমি এক মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছি। এ কথা আমার বিশ্বাস হলো না। অদূরে দাঁড়িয়ে আমার মা তখন নীরবে চোখের জল ফেলছিল। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম, ‘হে পরম করুণাময়, তুমি আমার জীবনের বিনিময়ে আমার সন্তানকে কেন বাঁচিয়ে রাখলে না? ওকে ছাড়া আমি যে আবারও একলা হয়ে গেলাম।’

সন্তান হারানোর শোকে আমি যখন বিপর্যস্ত। তখনো আমার স্বামীকে আমার পাশে পেলাম না। আমাদের মাঝে দূরত্বটা আরও দ্বিগুণ হলো। আমি অনুভব করলাম, আমি আমার চিবুকের কাছেও বড্ড একা। হয়তো জীবনের বাকী প্রহরগুলোও আকাশের ওই নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের মতো কাটাব একা একা।

সমাপ্ত