Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1946



পরিচয় কলমে:সুমাইয়া মীম

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগীতা_আগষ্ট_২০২০
শিরোনাম :পরিচয়
কলমে:সুমাইয়া মীম
ক্যাটাগরী:কষ্টের গল্প

জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে তাপমাত্রা স্বাভাবিক এর চেয়ে অনেক টা কম থাকে।যা হাড়ে হাড়ে টের পায় শীতের সকালের কর্মব্যস্ত মানুষগুলো।মাঝে মাঝে ২ একটা গাড়ির আওয়াজ রাস্তায়।প্রায় জনমানব শূন্য।শাল,জ্যাকেট,সোয়েটার এর আড়ালেও মানুষ কে কাঁপিয়ে তুলছে হিম শীতল অবাধ্য বায়ু।

এই মানুষগুলোর মধ্যে মীম একজন।যাকে এই শীতের সকাল কে তুচ্ছ করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে প্রাইভেট এর পথে।একটা জায়গায় গিয়ে গাড়ি চেঞ্জ করতে হয়।এক গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে অপেক্ষা করতে হয় অন্য গাড়ির।
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে মীম একটা গাড়ি ও তার বন্ধু খুশির।কুয়াশা ঢাকা প্রকৃতি আর জনমানবহীন রাস্তা-পথ কেমন যেন লাগছে তার।
বারবার হাতে থাকা ঘড়ির দিকে চাইছে।আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি।যেতে গাড়িতে লাগবে তো ৫ মিনিট।গাড়ি পেলে তবেই তো রওনা দিবে।

অপেক্ষা শব্দটা বিরক্তিকর একটা অভিজ্ঞতা।যা সবারই তিতা লাগে।অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সে একটা অটো গাড়ির হর্ণ শোনার জন্য।
হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখে আর মিটমিট হাসে কারণ ঘড়িটা তার প্রিয় ছোট মামুর কিনে দেওয়া।এই ঘড়িটা নিয়েও গল্প আছে,
যেদিন সে এক্সিডেন্ট করেছিল।হাসপাতাল এর বেডে অজ্ঞান অবস্থায় যখন খবর পেয়ে ছোট মামা ছুটে যান, দেখেন হাতে,পায়ে,মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো মেয়েটা অচেতন।প্রায় নিস্তেজ হয়ে যাওয়া দেহটার হাত ঘড়িটা থেমে যায়নি টিকটিক চলছিলো সেটা তার নিজের নিয়মে।
এক্সিডেন্ট! উফ্ আর মনে করতে চায় না মীম।কেমন ছিল এক্সিডেন্ট এর পরের দিনগুলো।X-ray,ঔষধ,ডাক্তার,ফিজিওথেরাপি,ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি কি দূর্বিষহ ছিল।ফুটন্ত মোমের মতো “ওয়াজবার” এর কি যে জ্বালা!

ঘড়ির দিকে বারবার চাওয়া শুধু সময় দেখাই নয়।মামার ভালোবাসা দেখা।নওগাঁ শহরে কোন এক কাজ থেকে আসার সময় ঘড়িটা এনেছিলেন মামা।ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল। ঘুম থেকে টেনে তুলে হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,”পিচ্চু তোর পিংক কালার ঘড়ি।”কি সব পাগলামি।
কারোর গলার আওয়াজে চমকে সামনে তাকায় মীম।রাস্তার অপরপাশে ঠিক তার সামনেই দাড়িয়ে আছে একটা লোক।লোকটার বয়স অনুমান করে অবাক হয় মীম।তার বাবার থেকেও বেশি বয়সী একটা লোকের দৃষ্টিতে এতটা নোংরামি থাকতে পারে কি করে।আর কেনই বা পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে?

অটোগাড়ির হর্ণ এর শব্দে স্বস্তি ফিরে পায় মীম।কিন্তু সমস্যা হলো গাড়ি আসছে দুইটা। কোন গাড়িতে যাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।ভাবতে ভাবতেই গাড়িগুলো কাছাকাছি এসে যায়।
কোথায় যাবেন আপু?
জি, কোর্ট মসজিদ থেকে একটু সামনে যাবো।
আসেন।
সিদ্ধান্ত নিলো অটোভ্যান এ যাবে না অটোগাড়িতেই যাবে।
কিন্তু পেছনের ভ্যানগাড়িতে একটাই লোক ছিলেন।ওনিই বললেন “এটাতে আসো মা”।
মীম থমকে গেলো।এত সুন্দর ডাক উপেক্ষা করে সে কিছুতেই যেতে পারবে না।
ভ্যানগাড়িতেই উঠে বসল সে।

মা ডাকটার বড় সংকট হয়ে গেছে।মানুষ রা ভয়ানক রকমের সভ্য হয়ে গেছে।যেখানে মেয়ের বয়সীদের মা ডাকা উচিৎ সেখানে তারাই নোংরা চোখে তাকায়।

গাড়িতে বসতেই লোকটা নিজের ছালা-বস্তা সরিয়ে জায়গা করে দেয়।
তুমি কি কলেজত পড়েন মা?
জি,আমি কলেজে পড়ি।
হেসে হেসে বললেন,আমার বেটি থাকলে তোমার মতোই কলেজত পড়তো।

হঠাৎ দূর্গন্ধে মীম কিছুটা চমকে। কারণ গন্ধ টা আসছে কোথা থেকে।এত বাজে একটা গন্ধ!
খেয়াল করে দেখে গন্ধ আসছে লোকটার শরীর হতে।
গায়ে ময়লা পুরোনো একটা পাতলা সোয়েটার আর উপরে সেরকমই একটা শাল জড়ানো।
এরকম পোশাক লোকটা গায়ে জড়িয়ে আছে কি করে বুঝে আসেনা মীমের।

আমার বউ নাই মইরা গেছে অনেক দিন হলো।আমার একটা বেটা আর বউমা আছে ওরা ভাত দেয় না আমাক।তুমি আমার বেটি হবে,আমাকে আব্বা বলে ডাকপে?

বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে মীম।এ কেমন খেলা খেলছে বিধাতা তার সাথে।যেখানে সে নিজের পরিচয় ফিরে পাবার জন্য চাতকিনীর ন্যায় চেয়ে থাকে,
সেখানে অপরিচিত একটা লোক তাকে এভাবে আপন চোখে দেখছে!

ডাকপে না আমাকে আব্বা,আমার বাড়িত যাবে?একদিন যাইও।এবার কাম করে টেকা পাইছি মেলা। ল্যাপ বানাই নিছি।ভাবো না শীতের দিন বইলা যাওয়া যাবে না।
তুমি যেদিন যাবে মাছ,গোস্ত সব লিয়া যামু।তুমি রান্না কইরা খিলাবে আমাক,কি পারবে না?

হাতের দিকে চেয়ে বলে, তুমি রাঁনতে পারেন না তাই না?
অবাক হয় মীম।বাহ্ লোকটা জাদুকর নাকি হাত দেখেই অপদার্থ কে চিনে ফেলে!মনে মনে হাসে সে।

আচ্ছা চিন্তা কইরো না আমি শিগিয়ে দিলে পারবে তো।
জি পারবো।
হয়তো যাবে না মীম লোকটার বাসায়।আর কোনদিন দেখাও হবে কিনা তাও জানে না সে।কিন্তু ভুলতে পারবে কি কখনো এই দিন টা,এই পরিচয়?

হয়তোবা পরিচয় এর সঠিক মানে অনেকের ই অজানা। কিন্তু খুব কঠিনভাবে অনুভব করতে পারে পরিচয় এর গুরুত্ব কতটা।জীবনে পরিচয়হীন ভাবে বেড়ে উঠা আর সামনে এগোনোটা বড়ই যন্ত্রণার।যখন সীমিতভাবেও কাওকে পরিচয় দিতে হয় কারোর ক্ষেত্রে সেটা বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার মতোই।যখন কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় মানুষের স্বভাবের কাছে তখন মনে হয় আদৌও কি মূল্য আছে এই কাটাছেঁড়া জীবনের?

লোকটার সাথে অনেক গল্প হয় মীমের। গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে শুধু তার একটাই চিন্তা পদার্থবিজ্ঞান প্রাইভেট আছে তার।দেরি হলেই তো স্যার শোনাবে,”মঙ্গল গ্রহ থেকে আসলে বুঝি মীম বুড়ি?”পদার্থবিজ্ঞানের মতো খসখসে একটা সাবজেক্ট এর মতোই এই স্যার টা ও।বুঝেও না যে শীতের সময় গাড়ি পেতে সমস্যা।

গাড়ি থেকে নেমেই ভাড়া দিয়ে দৌড় লাগায় সে।লোকটা বলে দেখেশুনে যাও,দেখে শুনে যাও।যেন সে তার ছোট্ট মেয়েকে রাস্তা পার হওয়ার কথা বলছে।পেছনে তাকানোর আর সময় পায়নি মীম।রুমে প্রবেশ করার পর সবাই তার দিকে চেয়ে আছে যেন এলিয়েন দেখছে।
হঠাৎ মনে হলো লোকটা কে তো বলে আসা হলোনা কিছু।এমনকি লোকটার ভ্যানভাড়া ও তো সে ই দিতে পারতো।কেন মনে ছিল না?ব্যাগ রেখেই স্যার আসছি বলে আবার ছুট লাগালো বাইরে।
বাইরে গিয়ে দেখে গাড়ি অনেক টা দূরে এগিয়ে গেছে আর লোকটা পিছু ফিরে চেয়েই আছে।তাকে দেখে লোকটার মুখে আবারো হাসি ফুটলো।হাত নাড়িয়ে কি যেন বুঝাতে চাইছেন।হয়তো ফিরে যেতে বলছেন।

পিছন থেকে শিক্ষক হাবিবুর রহমান বললেন লোকটা কে মীম?
হয়তো স্টুডেন্ট এর পাগলের মতো ছুটা দেখে তিনি রুমে থাকতে পারেন নি।তিনিও ছুটে বেরিয়ে এসেছেন।

আমার বাবা।
তুমি কি মরিচীকা দেখছ বুড়ি?
শীতল চোখে তাকাল মীম শিক্ষকের মুখ পানে।
মাথায় হাত রেখে বললেন,”চলো তুমি ক্লাস অনেক টা মিস্ করে ফেলেছো,কিন্তু আমারা তোমার জন্য অপেক্ষা করে এতক্ষন গল্প করেছি হাসি মুখে বললেন স্যার।”
মৃদু হাসি ফুটল মীমের ঠোঁট জুড়ে।

একরাত্রির গল্প – লেখা: মাহমুদা মিনি

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
গল্প: একরাত্রির গল্প
ক্যাটাগরি: রোমান্টিক
লেখা: মাহমুদা মিনি
.
প্রচণ্ড শীতে প্রকৃতির মতোই কাজলা পাড়ের মানুষের দেহগুলোও জীর্ণ হয়ে পড়েছে। গ্রাম্য কুটিরগুলো যেন সকাল-সন্ধ্যা হিমেল বাতাসে থরথর করে কাঁপে। সন্ধ্যা বা ভোরে যখন কুয়াশা নদীর বুক দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ভেসে বেড়ায় তখন জনজীবন থমকে পড়ে। বিশেষ দরকার ছাড়া কেউ তখন ঘর ছেড়ে বেরোতে চায় না। কিন্তু তখনও নদীপাড়ের হতদরিদ্র মানুষগুলোকে কাজের সন্ধানে বেরোতে হয়। গায়ের ছেড়া পোশাক আর খালি পায়ে লাগা শীতকে তখন মানুষগুলো দাঁতে চেপে সহ্য করে নেয়।

মাগরিবের আজান পড়তেই সফির তার একমাত্র ছেঁড়া সোয়েটারটা পরে নিয়ে, গামছা দিয়ে মাথা পেচিয়ে খালি পায়ে ঘর থেকে বেরোতে গেল। ওকে বেরোতে দেখে মা চিৎকার করে বলল,
“এই সন্ধ্যে বেলা কনে যাচ্ছিস বাজান? চারদিকে সাপখোপের আস্তানা। ওদিকে তোর আব্বার অবস্থাডাও ভালো না, উনার কাশি উঠিছে।”
সফির হাতদুটো এক করে তালুতে কয়েকটা ঘষা দিয়ে দাঁতে-দাঁত চেপে বলল,
“জেলেপাড়ায় যাত্রার দল আইছে মা। আমি হাশমতগের সাতে তাই দেখতি যাচ্চি। পুহাতের আগে চইলে আসবানি।চিন্তা করিস নে।”
সফিরের মা খাদেজা বেগম আবারও উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“কতবার কইছি ওসব যাত্রা দেখতি যাতি হবে না। কিডা শোনে কার কতা! এদিকি বাপ যায়-যায়, আর ছাওয়ালে যাত্রা দেকতি যাচ্ছে!”

সফির তার মায়ের কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল। এই জগতে তার যক্ষায় আক্রান্ত বাবা আর এই মা ছাড়া কেউ নেই। নদীতে জাল ফেলে আর পরের ক্ষেতে মজুরি খেটেই তার জীবিকানির্বাহ চলে। তার মা ঘরে বসে ঝুড়ি, চালন বোনে, সেসব বিক্রি করেও সংসারের খরচ কিছুটা চলে। তবে সফিরের মা একটু মুখরা। অকারণে সারাদিন সফির আর ওর বাবাকে গালমন্দ করে। অবশ্য সফির নিজেও জানে তার মায়ের এই অহেতুক মেজাজের কারণ। তিনি চান সফির বিয়ে করুক। সংসার করুক। কিন্তু বিয়ের বয়স হয়ে গেলেও সফিরের কোনো মেয়েকেই পছন্দ হচ্ছে না।

হাশমতের বাড়ির সামনে এসে বড় পুকুরটার সামনে দাঁড়াতেই সফিরের গায়ে কাঁপুনি দিলো। উত্তর দিকের মাঠ থেকে দমকা বাতাস এসে সরাসরি তার গায়ে লাগছে। অগত্যা সে শীত সহ্য করতে হাতের আঙ্গুলগুলো মুঠো পাকিয়ে হাশমতকে ডাক দিলো। বাড়ির ভেতর থেকে জবাব আসলো যে হাশমত অনেক আগেই দলবলসহ জেলে পাড়ায় চলে গিয়েছে।

সফির হতাশ হয়ে পড়লো। সে ভেবেছিল হাশমতের ব্যাটারিচালিত টর্চ লাইটের আলোয় দিব্যি যাত্রার স্থানে পৌঁছানো যাবে। চারদিকে যে সাপের উপদ্রব! কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি পড়তেই চারদিকের অন্ধকার পরখ করে নিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে সামনে এগোতে থাকলো।

গুনগুন করে একটা গান ধরে আনমনে হাঁটতে-হাঁটতে সে জেলেপাড়ায় পৌঁছে গেল। হ্যাচাকের আলো দেখে ফাঁকা মাঠের মতো জায়গাটাতে গিয়ে সে এদিক-ওদিক তাকালো। জায়গাটার মাঝখানে একটা স্টেজ মতো সাজানো হয়েছে। চারদিকে পর্দার বেষ্টনী, মাথার উপর খোলা আকাশ। এতক্ষণ একটানা হাঁটাতে গা গরম হয়ে গিয়েছে। ওদিকে যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি চলছে। তাই সে বেশ উচ্ছ্বাসিত হয়ে হাশমতকে খুঁজতে শুরু করলো। অবশেষে হাশমতকে স্টেজের কাছে এক কোণায় বসে বিড়ি টানতে দেখা গেল। সফির একগাল হেসে ওর পাশে গিয়ে বসতেই হাশমত বলল,
“শুনিচিস সফু? ইবার যে পালা হবে তাতে নায়িকা কিডা? নায়িকা হলো সুরমা। সে নাকি বড়-বড় সব পালা করিছে। দেখতিও হেব্বি সুন্দরী। আমার তো পালা দেহার জন্যি তর সচ্ছে না।”
সফির হঠাৎ চমকে উঠে বলল,
“কী নাম কলি? সুরমা? দেখতি সুন্দরী?”
হাশমত গভীর আগ্রহের সাথে নানান কথা বলে গেল। কিন্তু সফির সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলো না। ওর মনটা কেমন আনচান করছে। এই নামটা যে বড় চেনা…

যাত্রাপালা শুরু হয়ে গেল। বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের পালা চলছে। বেহুলা প্রথমে মুখ ঢেকে রেখেছিল, হঠাৎ মুখের সামনে থেকে আঁচল সরাতেই সফির আঁৎকে উঠল। তার বুকের ভেতর হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকলো। হাশমতরা তখন সুরমার অভিনয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলেছে। পালা দেখতে আসা সমস্ত দর্শক যখন বেহুলার শোক দেখে অশ্রুপাত করছে ঠিক তখনই সফির সবার অলক্ষ্যে ওখান থেকে সরে পড়লো।

খানিকটা দূরে একটা খোলা জায়গাতে এসে সে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে পড়লো। এখন মাথার উপর মস্ত আকাশটা ছাড়া তার সাথে আর কেউ নেই। তার মুখটা নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে। হৃৎস্পন্দন কমেনি, বরং ক্রমশ বাড়ছে।

এই সেই সুরমা। যার বাড়ি সাত ক্রোশ দূরে। সফিরের ফুফু বাড়ির পাশেই ওর বাড়ি ছিল। সফির তখন ফুফুবাড়িতেই থাকতো। সাত বছর আগে সে ফুফুবাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছিল, ফেলে এসেছিল সুরমাকে। অবশ্য সুরমাই একদিন তাকে ডেকে বলেছিল যে সে আর সফিরের মতো সহায়-সম্বলহীন ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না। সে তার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নিবে। সফির যেন তার সুখের পথে বাধা না হয়।

তারপর আর ওদের দেখা হয়নি। আজ হঠাৎ সাতবছর পর দেখা। অবশ্য সুরমা তো আর তাকে দেখেনি। যাত্রা না দেখলেও কী এক টানে যেন সফির যাত্রার স্থানের আশেপাশে অস্থিরভাবে ঘুরঘুর করতে থাকলো।

যাত্রা শেষ হতেই সে স্টেজের পেছনদিকের পথে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা ঘোমটা দেওয়া মহিলার অবয়ব তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই সে কাশি দিলো। মহিলা চমকে উঠে থমকে দাঁড়ালো। সফির কাঁপাকাপা গলায় বলল,
“আমি সফু।”
মহিলাটি আচমকা সফিরের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে ভীত কণ্ঠে বলল,
“মাঝি? তুমি কেবা আছো?”
সফির কী বলবে তা ভেবে কুলকিনারা না পেয়ে বলল,
“আছি বেশ। তুমি কিরাম আছো?”
সুরমা বলল,
“চলো হাঁটতি-হাঁটতি কতা কই। আমি তারিক জুয়াদ্দারের বাড়ি থাকবো। বাড়িটা তো চেনো?”
“হু, চিনি। চলো।”
“তা মাঝি, বিয়েশাদি করছো নাই?”
সফির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ঘর-সংসার আমার দ্বারা হবে নারে সুরু। তোমার খবর কও। বিয়ে কইরে তো শহরে গিছিলে শুনিছিলাম। তারপর তুমি যাত্রার দলে কেন? বর কনে?”
এতক্ষণে সুরমার আটকে রাখা কান্না আর বাঁধ মানলো না। সে আঁচল চাপা দিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললো। তারপর কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ হাঁটলো। রাতের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে সুরমার মৃদু কান্নার আওয়াজ সফিরের ঠিক বুকে এসে লাগছে। তবে এতে সে কষ্টের বদলে সুখ অনুভব করছে। সেই সুরমা, আজ এই নির্জন রাতে তার সাথে কয়েক কদম হাঁটছে। এ কী কম বড় প্রাপ্তি?

কিছুদূর এগিয়ে সুরমা বলতে থাকলো,
“ঐ মিনশে আমারে বিয়ে কইরে শহরে নিয়ে গিছিল। তারপর এক যাত্রার দলের কাছে বেইচে দিয়ে আমারে তালাক দিয়ে কোথায় যেন চইলে গেছে। আর কোনোকালে খোঁজ নেয়নি। আমি সেই যাত্রাদল থেকে পলাইয়ে আইসে এই নতুন দলে যোগ দিছি। আব্বা-মা বাড়ি উঠতি দেয়নি, খাবোটা কী?”
সফিরের বুকচিরে আরেকটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরোলো। সে বলল,
“মন খারাপ করো না। সবই তো কপালের লিখন। তোমার-আমার কিছু করার ছিল না।”
সুরমা চোখমুখ মুছে বলল,
“এসব আমার পাপের ফল। আমি তোমারে ঠকাইছিলাম। বড় লোকের ছেলে দেইখে তোমারে কষ্ট দিছিলাম, তার উপযুক্ত ফল পাইছি। এহন আমার কোনো পথ খুলা নেই। আমি এহন যাত্রার ভাড়াটে নায়িকা। মানুষির মনোরঞ্জন করি।”
সফির আচমকা অন্ধকারে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। সুরমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খপ করে ওর ডানহাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“তুমি আমার হবা সুরু?”
সুরমা জবাব দেবার আগেই আহ্ বলে চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়লো। তারপর চিৎকার করে বলল,
“আমারে সাপে কাটিয়ে মাঝি। আমি আর বাঁচবো না। শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিও।”

রাত প্রায় শেষের দিকে।
সফির নদীর পাড় বেয়ে সুরমার একটা হাত জাপটে ধরে ওকে ওর বাড়ির দিকে নিয়ে আসছে। সুরমার গায়ে তখন যাত্রাদলের দামী একটা বেনারসি। তবে সাপে কাটার পর ধুলোবালি লেগে তার সাজ একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নদীপাড়ের তীব্র শীতল বাতাসেও সফির আর কাঁপছে না, ওর কলিজাও কাঁপছে না। সে তার গামছাটা মাথা থেকে খুলে বহু আগেই সুরমার মাথা ঢেকে দিয়েছে। তীব্র শীত উপেক্ষা করে তার জীর্ণ দেহের শুষ্ক ঠোঁটে একচিলতে হাসি লেগেই আছে। সুরমা হঠাৎ একটা ঘাট দেখে দাঁড়িয়ে বলল,
“মাঝি? আমি একটু হাতমুখ ধোবো? আমারে সম্ভবত বিশ্রী দেখাচ্ছে!”
সফির হেসে বলল,
“তুমি এখনও সুন্দরী আছো সুরু।”

সুরমা মৃদু হেসে মুখ ধুতে বসে গেল। সে সাপে কাটার পরের ঘটনা মনে করে হাসছে। ঐ তো রোগা-পটকা শরীরের মানুষটা! সে ঐ রাতে সুরমাকে কোলে তুলে নিয়ে ওঝার বাড়ি অব্দি কী করে ছুটেছে এটা ভেবেই সে অবাক হচ্ছে। মানুষটা আজও তাকে বড় ভালোবাসে। তাই তো ওঝাবাড়ি থেকে ফেরার পথে হুজুরের কাছে গিয়ে তাকে বিয়ে করে নিয়েছে। সুরমা আপত্তি করেছিল, তবে মানুষটা শোনেনি। সে নাকি সমাজের তোয়াক্কা করে না!…

হাতমুখ ধুয়ে সুরমা স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। সে জানে না যে ওবাড়িতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে, তারা মেনে নিবে কিনা, সমাজ কী বলবে! তবে সে এটা জানে যে এই মানুষটা তাকে কখনও ফেলবে না। তার প্রমাণ সে সাপে কাটার পরই পেয়েছে।

হঠাৎ বাড়ির কাছাকাছি এসে সফির থমকে দাঁড়ালো, তারপর কুয়াশার ভেতর দিয়ে হারিয়ে গেল। মিনিটখানেক পর হাতে একটা টকটকে শিমুল ফুল নিয়ে এসে সুরমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোরে বড় ভালোবাসি সুরু। কখনও সমাজের ভয়ে, লোকলজ্জার ভয়ে আমারে ছাইড়ে যাবি না তো?”
সুরমা মানুষটার পাগলামি দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
“থাক। বুড়োকালে আর ঢং করতি হবে না। আমি আর কোথাও পালাচ্ছি না। ইবার আর সত্যিকারের ভালোবাসারে হাইরে যাতি দেবো না। তোমার সুরু তোমারই হলো। বাড়ি চলো তো!”

কাজলা নদী এবং নদীপাড় তখন আরেকটা সুখী মানুষের উচ্ছ্বাসিত হাসির সাক্ষী হলো। যুগ-যুগ ধরে বয়ে চলা কাজলার বুকে স্মৃতি হয়ে বাঁধা পড়লো আরেকটা নতুন প্রেমকাহিনী…
.
সমাপ্ত

গল্পের নামঃলটারী – লেখায়ঃফাইজা হাবীব

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
গল্পের নামঃলটারী
লেখায়ঃফাইজা হাবীব
বিনোদবাবু মাসের শেষে প্রায়শই এর ওর কাছে টাকা ধার করে সংসার চালায়।পেশায় সরকারি চাকুরী করলেও চতুর্থ শ্রেণির এই চাকুরের মাসের শেষে এই সমস্যা সৃষ্টির কারণ যতো না দারিদ্র্যতা, তার চেয়ে বেশি তার স্বভাব।তার এই স্বভাবের সাথে আশেপাশের লোকজন ভালোই পরিচিত।তাই তো তার নাম লটারীবাবু।এত লটারীর টিকেট কিনলেও একটির রেজাল্ট ও তার ভাগ্যে আসেনি।এই দিকে তার ভাগ্য মন্দ্য হলেও সাংসারিক দিক থেকে সে ভাগ্যবান।চুপচাপ গুণবতী স্ত্রী আর ফুটফুটে একটি ষোড়শী কন্যা নিয়ে নির্ভেজাল জীবন ভালোই কাটছিলো তার।কিন্তু আকষ্মিক এক উল্কাপিন্ডের মতো এক সংবাদ তার নিস্তরঙ্গ জীবনে উত্তাল ঢেউয়ের সঞ্চার করলো।এক ডেভলপার কোম্পানির লটারীর প্রথম পুরষ্কার বিনোদবাবু পেয়ে গেলেন।বিনোদবাবুর এ সৌভাগ্যে আশেপাশের মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হলেন,কিন্তু নিজের আনন্দে বিভোর বিনোদবাবু লক্ষ্য করলেন না এ পরিবর্তন।তার আশেপাশের লোকজনগুলো যে আপাদমস্তক বদলে গেছে তা টের পেলেন যেদিন স্ত্রী নির্মলা দেবী অজ্ঞান হয়ে রান্নাঘরে পড়ে থাকলেন,কিন্তু তার সাহায্যে কেউ এলো না,না অর্থনৈতিক সাহায্য না মানসিক সাহায্য।প্রিয় বন্ধুর বাড়ির দরজা থেকেই ফিরতে হলো এই উত্তরের সাথে লটারী পেয়ে গেছেন সেই টাকায় বড়লোক তিনি,এখনো ভিক্ষে করার স্বভাব গেলো না তার।স্ত্রীর মস্তিষ্কের ছোট্ট টিউমারটি যে কবে কুড়ি থেকে মহীরূহে পরিণত হয়েছে জানতে পারেন নি তিনি,মেয়েকে হাস্পাতালে রেখে ছুটলেন তিনি সেই ডেভলপার কোম্পানিতে,দীর্ঘ অপেক্ষার পর নানাবিধ সইসাবুদ করে ছুটলেন ব্যাংকের উদ্দশ্যে।এদিকে ডাক্তার বললো বিনোদ বাবুর মেয়ে তিতলিকে টাকা না দিতে পারলে রোগী রাখতে দিবে না কতৃপক্ষ।বাবাকে ফোনে না পেয়ে ছুটলো সেই ডেভলপার অফিসের দিকে।অফিসে ঢুকে শুনলো, সমাজসেবী আদিনাথ বাবুর গলা।সেক্রেটারি রমেশ বাবুকে বলছে তাদের বাড়ির জমিটা লটারীর আড়ালে কিনে নিয়েছে,তিতলির বাবাকে ঠকিয়েছে।তিতলি এ কথা শুনে থমকে যায়,দ্রুত পিছাতে গিয়ে টবে ধাক্কা খেয়ে ফেলে,এদিকে আদিনাথ বাবু আর রমেশ তিতলিকে দেখে ফেলে,ষোড়শী মেয়েটির উপর চলে পাশবিক তান্ডব।
এদিকে বিনোদবাবু টাকা নিয়ে এসে দেখে মেয়ে তিতলি হাস্পাতালে নেই, টাকা জমা দিয়ে মেয়েকে খুঁজতে বের হন,সারারাত খোঁজার পর এক জঙ্গলের পাশে মেয়ের লাশ খুঁজে পান।মেয়ের উলঙ্গ শরীর ঢেকে চুপ করে বসে থাকেন মেয়েকে কোলে নিয়ে,এদিকে হাস্পাতাল থেকে ফোন আসে তার স্ত্রী অপারেশন টেবিলেই মারা গিয়েছেন।দুটি লাশ নিয়ে এম্বুলেন্সে করে বাড়ি ফিরে দেখেন তার বাড়ি জবর দখল করে নিয়েছে আদিনাথবাবুর গুন্ডারা।আশেপাশের লোকেরা, সেই পুরাতন প্রতিবেশীরা সবাই দাহকার্যে এগিয়ে আসতে চাইলে বিনোদবাবু সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানান।স্ত্রী আর একমাত্র সন্তানকে দাহ করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়,এই সমাজ চাই না তার যারা নিজেদের হিংসা,কলুষতা,লোভ, নোংরামিতে ভরা। যেখানে মনুষ্যত্ব ভূলন্ঠিত সেখানে মানুষ যে পশুতূল্য নরাধম।

মরে যাওয়ার সুখ – তাসমিন আহমেদ

0

#গল্পপোকা_ছোটোগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০

মরে_যাওয়ার_সুখ
তাসমিন_আহমেদ

মরে যাওয়ার সুখ
– তাসমিন আহমেদ
বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজটা জামিলা খাতুনের ঘুম ভেঙে দিলো। শরীর কুকরে শুয়ে ছিলেন তিনি।ইশ কাথাটা যদি শরীরে থাকতো ঘুমটা ভাঙতো না। এই শান্তির ঘুম খুব কম আসে তার চোখে। সবকিছু ঘোলা ঘোলা। পাকা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে একটা ছোটো খোপা করা। বিছানার পাশের টি টেবিলটার উপর থেকে চশমাটা দুই হাত দিয়ে চোখে দিলো।চশমাটা চোখে দেয়ার সাথে সাথে তার স্বামীর ছবিটা দেখতে পেলো জামিলা খাতুন। শেষ বয়সে তার স্বামী তাকে একা রেখে গেলো এই নিয়ে তার বুকে এক সমুদ্র অভিমান জমে আছে।ছেড়া নরম শাড়িটা ভেজা ভেজা লাগছে।একি! আজও ঘুমের মধ্যে প্রসাব করেছে।বুকটা ভারী হয়ে গেলো।বৌমা দেখলে তো ভীষণ রেগে যাবে এই সব তো সেই পরিষ্কার করে। বৌমাটা বড্ড ভালো মেয়ে এই তো শুধু একটু বোকা ঝোকা করে কাজের মানুষও তো এইসব করতে চায়না আর কয়টা মেয়ে আর এখন শাশুড়ীর প্রসাব পায়খানা পরিষ্কার করে এই বলে নিজেকে শান্তনা দিলো জামিলা খাতুন।ঘরে মিসেস আরিফা ঢুকতেই জামিলা খাতুনের খুব অসস্তি লাগলো।আরিফা বললো কখন থেকে খেতে ডাকছি আপনাকে? অসময়ে ঘুম দেন কেনো? আমি তো বারবার খাওয়া গরম করতে পারবো না ঠান্ডা খাবার খেলেও তো আপনার যত সমস্যা।জামিলা খাতুন চুপ করে ছিলো। একি আপনি আবার বিছানায় প্রসাব করেছেন? আমি কি আপনার দাসী নাকি যে সারাদিন আপনার প্রসাব পায়খানা পরিষ্কার করবো? আজকে আসুক আপনার ছেলে আমি বলে দেবো আমি অত পারবো না সে যেনো অন্য কাউকে ঠিক করে নহে আপনাকে গ্রামে দিয়ে আসে।
ঝুলন্ত কুচকানো চামড়ায় লেগে থাকা চশমা ঠিক করতে করতে জামিলা খাতুন কিছু বলতে চাইলেই মিসেস আরিফা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো । গুজো হয়ে বিছানার চাদরটা তুলে জামিলা খাতুন বাথরুমে চলে গেলোবিছানার চাদরটা ধুয়ে দিতে হবে তো বৌমার উপর আর কত নির্ভর হবো।
কিছুক্ষন পর মি শিমুল রুমে আসলো
কি মা কি বলছে আরিফা এসব? আমিতো তোমাদের বাড়ির ঝামেলা নিয়ে এতো মাথা ঘামাতে পারবো না।তুমি একটু সামলে থাকতে পারো না?তুমি তো জানোই বাড়ির সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার বৌমার উপর।সারাদিন ওকে কত পরিশ্রম করতে হয় অথচ তুমি যদি সারাদিন ওকে এইসবে ব্যস্ত রাখো তাহলেতো আমাদের বাচ্চাদের সামলানো কষ্টকর হবে। তুমি কি চাও আমি তোমাকে বৃদ্ধাশ্রম নহে গ্রামে রেখে আসি? যদি না চাও তাহলে এসব করোনা নিজেকে নিজে সামলাও তোমাদের ব্যাপার নিয়ে আমি চাকুরির সময়ে টেনশন করতে পারবো না।
খোকা আমি তো চেষ্টা করি রে কিন্তু বয়সের জন্যে ঘুমের মধ্যে কিভাবে হয়ে যায় বুঝিনা। তুই বৌমাকে রাগ করতে মানা করিস। আমি পারলে তো আমার কাপড় নিজেই ধুয়ে দেই কিন্তু শরীরে যে কুলায় না খোকা।
দাদী,ও দাদী বাঁচাও দেখো আম্মু আমায় মারছে।
-বউমা, ও বউমা কি হয়েছে ওকে মারো কেনো?
– আপনি চুপ করেন কোনো কথা বলবেন না। মুখ দিয়ে ওকে খারাপ করেছেন। এই বয়সে মায়ের উপর তর্ক করে এই বেয়াদব ছেলে। সাহস কত বড়। এই বয়সে এমন বড় হলে কি হবে?
-ও বৌমা। বাচ্চা মানুষ। আর করবে না রাগ করিও না বৌমা।
– যান তো আপনি রুমে যান।আমার ব্যাপার আমি বাচ্চা কিভাবে মানুষ করবো।

রাতটা ঘন হয়ে এসেছে। জামিলা খাতুনের ঘুম আসছে না। চোখের চশমাটা ঠিক করে হেটে হেটে তার স্বামীর ছবির কাছে গিয়ে দেয়াল থেকে ফ্রেমটা খুলে নিলেন তিনি। এই মানুষটার প্রতি তার বেশ অভিযোগ। সে তো বলেছিলো কখনো একা ফেলে যাবে না। কত সুখ অদল বদল করে নেওয়ার কথা ছিলো আরও। সুখ হোক অথবা দুঃখ কখনো কোনো কিছু সম্মুখীন একা হতে হবে না তাকে এই তো কথা ছিলো তবে কেন অসময়ে ছেড়ে চলে গেলো সে? এই বিছানায় জামিলা খাতুন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকায় তার স্বামী তার কতো সেবা করলো অথচ যাওয়ার বেলায় তাকে সাথে নিলো না। বেশ।বেশ ভালো।বেঁচে থাকাটাই কি সুখ?বেঁচে থাকাটাই সুখ নয় স্বামীর উপস্থিতিতে যেই সুখটা ছিলো তা তো ৩ বছর আগেই সাথে নিয়ে চলে গেলে। অনেক অভিমান জমে আছে। এই অভিমান শেষ হবে না।কোনোদিন শেষ হবেনা। আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিলো সে।
সকাল হতে না হতেই কিছু ভাঙার আওয়াজে জামিলা খাতুনের ঘুমটা ভেঙে গেলো চোখে চশমা দিয়ে চমকে উঠলো জামিলা খাতুন। একি বাসু তুই ফ্রেমটা ভেঙে দিলি?এখন কই পাবো এই ফ্রেম?
-সরি দাদী।ভুল করে বল চলে আসছে তুমি টেনশন করিওনা আব্বুকে বলে আমি দাদার ছবিটা আবার ফ্রেম করে টাঙিয়ে দেবো।
– খোকা কে একটু বলিস রে বাসু।উনার ছবিটা সামনে না থাকলে আমার ভালো লাগে না।সাথে সাথে মি.শিমুল রুমে ঢুকলো। কি ব্যাপার কি ভাঙলো?
– খোকা ওখোকা ভুল করে বাসুর বল লাগে তোর বাবার ছবিটা ভেঙে গেলো যে।তুই একটু আরেকবার ফ্রেম করে ওখানে রাখবি?
– আচ্ছা আমি ফ্রেম করে দেবো সময় হলে। এখন আমি অফিস যাচ্ছি।জামিলা খাতুন গুজো হয়ে কাপতে কাপতে হেঁটে কাচ সরিয়ে ছবিটা তুলে বিছানায় রাখলো।
জামিলা খাতুন কয়েকদিন ধরে বেশ অসুস্থ।হঠাৎ হঠাৎ সবাইকে চিনতে সমস্যা হয় তার। আবার চিনতেও পারে।বিছানা থেকে উঠতেও বেশ সমস্যা হয়।প্রসাব পায়খানা সব বিছানায় করছে।মিসেস আরিফা সেগুলো পরিষ্কার করে তবে খুব বিরক্তিতে। মিসেস আরিফা মি.শিমুলকে বললো – শুনো তোমার মা এবার সুস্থ হলে তুমি তাকে গ্রামে দিয়ে এসো।আমি সারাদিন তোমার মায়ের সেবা করবো নাকি আমার বাচ্চাদের দেখাশোনা করবো?গ্রামে অনেক মানুষ আছে কেউ দেখাশোনা করতে দ্বিধা করবেনা আর যদি না পারো আমাকে বলে দাও আমি আমার মায়ের বাড়ি চলে যাবো।
আহা আরিফা তুমি রাগ করছো কেন? মায়ের দেখাশোনা না করে যদি গ্রামে দিয়ে আসি তবে সবাই তো তখন প্রশ্ন তুলবে। অন্য ভাইয়েরা বলবে আমি এতো টাকা কামাই করি শহরে থাকি অথচ মায়ের দেখা শোনা করতে পারলাম না। বলবে জমি লিখে নেওয়ার জন্যই শুধু শুধু তাকে তাকে আর বাবাকে আমার কাছে রেখেছি।
– তোমার ভাইয়েরা যদি এতো প্রশ্ন তুলে তাহলে তাদের কাছে দিয়ে এসো দেখবো কে সেবা করে।
– তুমি চিন্তা করো না দেখি কি করা যায়। সুস্থ হয়ে উঠলে কাছে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবোভেবেছি।
রুম থেকে ডাক আসলো- খোকা ও খোকা
– কি হয়েছে? চিনতে পারছো আমাকে?
– কেনো পারবো না রে খোকা।ও আমার খোকা তুই তোর বাবার ছবিটা ফ্রেম করে ওখানে রাখে দে না আমার বড্ড ইচ্ছে করে তাকে দেখতে।
– আচ্ছা আচ্ছা রাখবো আমি । তুমি ঘুমাও ডাক্তার বলেছে রেস্ট নিতে।
– একটু জলদি করে রাখিস না রে খোকা।
– আহা বলছি তো রাখবো।
বিরক্তি নিয়ে মি.শিমুল বললো।

একটু পর –
মা দেখো দাদী কেমন করছে।
মিসেস আরিফা দৌড়ে এলো আর বাসুকে বললো তোর বাবাকে ডেকে আনতো।
মি.শিমুল ডাক্তার কে নিয়ে এলো।ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়ায় জামিলা খাতুন ঘুমিয়ে গেলো।৩ ঘণ্টা পর জ্ঞান আসাতে জামিলা খাতুন ঘোলা ঘোলা দেখতে পেলো। বাসু দাদীর চোখে চশমা লাগিয়ে দিয়ে বললো দেখোতো এইটা কি? জামিলা খাতুন তাকায় থাকার পর তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো কাপা কাপা অসুস্থ গলায় বললো একি খোকা ওর বাবার ছবিটা ফ্রেম করে এনেছে? এই বলে উঠে বসতে চাইলে বাসু তাকে ধরে বসালো।বাসু বললো বাবা না আমি করেছি। বাসুরে তুই অনেক ভালো এই বলে জামিলা খাতুন বাসুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।জামিলা খাতুন ছবিটা বুকে চেপে ধরলেন। বাসু বললো দাও টাঙিয়ে দেই।
জামিলা খাতুন বললো দিস পরে।আমি একটু নিয়ে থাকি।জামিলা খাতুন ছবিটা বুকে নিয়ে রাখলো নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো।দুই হাত দিয়ে সেই যে আকড়ে ধরলো আর ছাড়লো না।ছাড়বে কি করে সে তো সুখ পেলো। মরে যাওয়ার সুখ টা। তার স্বামীর ভালোবাসা তাকে স্বামীর কাছে টেনে নিলো। বেঁচে থাকার ব্যথাকে ফেলে সে মরে যাওয়ার সুখ পেলো।

গল্পটি উপন্যাসের নয় লেখিকা: ইশরাত জাহান সুপ্তি

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
ছোটগল্প: গল্পটি উপন্যাসের নয়
লেখিকা: ইশরাত জাহান সুপ্তি

রাতের নিকষ কালো অন্ধকারকে ভেদ করে সামনে এগিয়ে চলা সোহেলের কালো রঙের সাইকেলটি হঠাৎ থেমে গেল।শহর এলাকায় রাত দশটা কিছু না হলেও এই মফস্বল এলাকায় রাত দশটা বলতেই সব নিঝুম।তাছাড়াও এই এলাকা বিশেষ সুবিধার নয়।আর এই রাত্রি বেলা ফাঁকা রেল স্টেশনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একলা একটি মেয়েকে দেখে সোহেল কৌতূহলবশতই সাইকেল না থামিয়ে পারলো না।দু তিনটে টিউশনি শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যেই যাত্রা দিয়েছিল সে।এমনিতে আরো আগেই বাড়ি ফেরে তবে আজ সন্ধ্যা মুখে প্রবল বৃষ্টিতে আটকা পড়েই ফিরতে এতটা রাত হয়ে গেল।বৃষ্টির জন্যই হয়তো আজ স্টেশন এতটা ফাঁকা।সোহেল সাইকেল থেকে নেমে একটি গাছের সাথে দাঁড় করিয়ে ধীর পায়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
মাঝে মাঝে ডেকে উঠা ঝি ঝি পোকার ডাক যেন রাতের নিস্তব্ধতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।গাছের পাতা থেকে টুপটুপ করে ঝড়ে পড়া বৃষ্টির জলের শব্দও যেন কানের গভীরে গিয়ে বারি খাচ্ছে।গা ছমছমে এমন পরিবেশে নিজের দিকে অগ্রসরমান একজন অচেনা পুরুষকে দেখেই হয়তো মেয়েটি অনাকাঙ্ক্ষিত আশঙ্কায় আরো জড়সড় হয়ে রইলো।তবুও মুখভঙ্গিতে তা প্রকাশ করলো না।মেয়েটির দিকে সামান্য এগোতেই সোহেলের চোখে পড়ল মেয়েটির থেকে খানিক দূরত্বে দু তিনটে ছেলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কানাকানি করছে আর এদিকটাতেই টিপটিপ পায়ে এগিয়ে আসছে।সোহেলকে দেখেই তারা থেমে গেল তবে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।ব্যাপারটি সুবিধাজনক না লাগাতে সোহেল গিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলো,

-‘কিছু মনে করবেন না।আপনি এত রাতে এখানে একা একা,যতদূর আমি জানি সন্ধ্যার পর এই স্টেশনে কোনো ট্রেন আসেও না আর ছাড়েও না।আপনার সাথে কি আর কেউ নেই?’

সোহেলের কথায় মেয়েটি একটু চমকে উঠলো।মাথা নিচু করে খানিক কাচুমাচু করে বলল,
-‘জ্বি নেই,মানে…আছে,এখনো আসেনি।’

মেয়েটির কথার কোনো আগা মাথা বুঝতে না পেরে সোহেল কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।তবে এতটুকু ঠিকই বুঝতে পারছে যে মেয়েটি বেশ ঘাবড়ে আছে।বৃষ্টি না থাকলেও এখনো আকাশ মাঝে মাঝে মৃদু গর্জে উঠে চারপাশ মুহুর্তের জন্য ঈষৎ আলোকিত করে দিচ্ছে।সেই আলোতেই সোহেল এতক্ষণে খেয়াল করে বুঝলো মেয়েটি মোটামুটি ভালোই সুন্দরী।মাঝে মাঝে শীতল হাওয়া বয়ে পরিবেশটাকে আরো ঠান্ডা বানিয়ে দিচ্ছে।পাশের ঝোপ থেকে একটি কোলা ব্যাঙ গলা ছেড়ে ডেকে উঠলো আর হঠাৎ করেই ঝোপ টি নড়ে উঠে দ্রুত সেখান দিয়ে কিছু সড়ে যাওয়ার শব্দ হলো।মেয়েটি এতে মৃদু কেঁপে উঠলো।কোলা ব্যাঙটি পরপর কয়েকটা চাপা আতর্নাদের আওয়াজ তুলে নিশ্চুপ হয়ে পড়লো।
-‘আপনার নাম কি?’
-‘তা..তানহা।’
-‘আপনি কি এখানে এই প্রথম এসেছেন?’
মেয়েটি কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো।সোহেল স্পষ্ট বুঝতে পারছে মেয়েটি তার উপর বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না।অপরিচিত কাউকে এত কথা কেই বা বলতে চায়।তবুও আশেপাশে আরেকবার চোখ বুলিয়ে সোহেল আগ বাড়িয়েই বললো,

-‘দেখুন আপনার সাথে যদি কেউ থেকে থাকে তবে তাকে আসতে বলুন।এই জায়গাটা বিশেষ সুবিধাজনক নয়,বিশেষ করে এত রাতে মেয়েদের জন্য।কিছু মনে করবেন না একটা কথা বলবো,আপনাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে আপনি কোনো বিপদে পড়েছেন।’

আগন্তক কাউকে এত কথা জানানো তানহার ভালো লাগছে না।চেনা নেই জানা নেই হুট করে একটা অপরিচিত লোককে গড় গড় করে সব বলে দেওয়াটাও কি ঠিক হবে?তবুও তানহার বিধ্বস্ত মন যেন এই মুহুর্তে তার সকল ভয়,আশঙ্কা কাউকে জানিয়ে একটু হালকা হতেই চায়।গত পাঁচ ঘন্টা ধরে তানহা এই স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে।বিকেলের দিকে তবুও কিছু লোকজন ছিল কিন্তু সন্ধ্যার পর ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগলো।আর বৃষ্টির পর তো পুরোই জনশূন্য।অচেনা এই জায়গায় জনশূন্য রেলস্টেশনে ঝুম বৃষ্টি আর ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকা তানহার ভেতরে যে কি ঝড় বয়ে গেছে তা কেবল সে নিজেই জানে।কিছুক্ষণ আগে নিজের দিকে ঐ বখাটে ছেলেগুলোকে এগিয়ে আসতে দেখে ওর তো প্রাণই যায় যায় অবস্থা।তারপর সোহেলের আগমনে ভয়ের পাশাপাশি কিঞ্চিৎ সাহসও পায়।অন্তত সেই ছেলেদের আগানো বন্ধ দেখেই।জীবনটা যে হুট করে এভাবে মিথ্যা হয়ে গিয়ে এই পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়ে দেবে তা তানহা কখনো কল্পনাও করেনি।
শীতল হাওয়ায় হাত পা গুলো হিম হয়ে আসলেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে।কম্পিত হাতে কপালের ঘাম মুছে একটু ঢোক গিলে আমতা আমতা করে তানহা যা বললো তা থেকে সোহেল যতটুকু জানতে পারলো তা হলো এই,
দুই বছরের সম্পর্কের টানেই ঘর ছেড়ে ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে তানহা আজ পালিয়ে এসেছিল এই দূরদেশের অচেনা জায়গায়।দুপুরের পরেই এই স্টেশনে নামে তারা।ঘন্টা খানিক পর ছেলেটি খাবার কিনতে যাওয়ার নাম করে সেই যে গিয়েছে আর ফেরেনি।তবে যাওয়ার আগে সাথে করে তানহার ব্যাগ যেখানে তানহার এই পর্যন্ত জমানো হাজার খানেক টাকা,কিছু সোনার গয়না আর ফোন ছিলো সেটাও সাথে করে নিয়ে গেছে।
-‘আমার তো মনে হয়ে সে আপনার জিনিসপত্র নিয়ে ভেগে গেছে।আর ফিরে আসবে না।’
কথাটি শোনামাত্রই তানহা একটা বড় রকমের ধাক্কা খাওয়ার মতো দৃষ্টিতে সোহেলের দিকে তাকিয়ে রইলো।সে যে আর ফিরে আসবে না এটা তানহার অবচেতন মনে এতক্ষণে অবগত হলেও পুরোপুরি স্বীকৃতি পাচ্ছিলো না।সোহেলের মুখের কথাটি শুনেই যেনো মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু উলটপালট করে সত্যটা ভয়ংকর ভাবে তানহার মনে ধরা দিল।সাথে সাথে নিরব প্রকট শব্দে একটি জিনিস খুব নিষ্ঠুর ভাবে ভেঙে গেল,বিশ্বাস।
-‘আপনার কি মনে হয়ে সে আসবে?’
-‘হ্যাঁ।’
অবিশ্বাস্য এই শব্দটি কোনোমতে ব্যবহার করে তানহা হঠাৎ ফুফিয়ে কেঁদে উঠল।বিশ্বাস ভাঙা এই কান্না কিছুতেই সে আর দমিয়ে রাখতে রাখতে পারছে না।ছেলেটির নাম ছিল রাকিব।কলেজের যাওয়ার পথে রোজ ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতো তানহাকে শুধু একটিবার দেখার জন্য।একদিন হুট করে সামনে এসে মাথা নিচু করে লাজুক মুখে তার ভালোবাসার কথা বলে।তানহা না করে দেয়।আশেপাশের নিষ্ঠুরতা দেখে আধুনিকতা মাখানো এই ভালোবাসা শব্দটিকে তখন সে আর ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না।তবুও যখন রাকিব দিনের পর দিন কিছু না বলে তার যাওয়ার পথে অহেতুক কাঠ ফাটা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতো তখন তানহাকে একমুহূর্তের জন্য হলেও পিছু ফেরে তা ভাবাতে বাধ্য করতো তারপরও সে নিজেকে সংযত করে এসব ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো।বোন সমতুল্য পাশের বাসার মিনা আপুর একটি কথা কানে খুব বাজতো,’ছেলেরা যখন প্রথম প্রেমে পড়ে তখন সেই প্রেমের জন্য সর্বোচ্চ কষ্টও করতে পারে।কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্যি,হুট করে একদিন সেই প্রেমই ওদের কাছে ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে।সিগারেটে চরম আসক্ত হয়ে পড়া নেশাখোরও কিন্তু পাগলের মতো সিগারেটের তাড়না করে তা হাসিল করে কিছুক্ষণের মধ্যে ধোঁয়া বানিয়ে ছেড়ে দেয়,যতনে রেখে দেয় না।’
এত এত সাবধানতা,সচেতনতার পরেও তানহার মন আর বাধ্য হয়ে থাকতে পারলো না।অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন।বৃষ্টিতে আটকা পড়েই বাড়ি ফেরার নির্দিষ্ট সময়ের থেকে দু ঘন্টা দেরি করে সে কর্দমাক্ত রাস্তায় ছাতা মাথায় ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছিল।রোজকার মতো পথে রাকিবকে সেদিনও দেখে থমকে যায় তানহা।রাকিবের টকটকে লাল চক্ষু দুটিই বলে দিচ্ছিলো তার দীর্ঘক্ষণ ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার কথা।তানহার আর করার কিছু রইলো না।আনমনে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর শীতল স্পর্শ গালে অনুভব হতেই তানহা বুঝে গেলো ভালোবাসা শেষপর্যন্ত তাকে ছুঁয়েই ফেলেছে।
সেই ভালোবাসাই সময়ের সাথে ধীরে ধীরে এতটা গাঢ় হয়ে গেল যে মাত্র দু বছরের সম্পর্কের টানে ঘর ছেড়ে পালাতেও এক বিন্দু দ্বিধা হলো না তার।মাঝে রাকিবের আচরণের পরিবর্তন আর আড়ালে শোনা বিভিন্ন কানাঘুষোও তানহার বিশ্বাসের টানে সবকিছু ছেড়ে রাকিবের সাথে ঘর ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্তকে নড়াতে পারেনি।তানহার বিশ্বাস ছিলো রাকিব আর যাই করুক তানহাকে কখনো কষ্ট দিতে পারবে না।কারণ নিজের ভালোবাসার অভিজ্ঞতা থেকেই তানহা বুঝেছিলো ভালোবাসা ভালো রাখতে শেখায়।ট্রেনে উঠার পরও যখন তানহা রাকিবকে চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করে ‘তারা কোথায় যাচ্ছে?’
তখন রাকিব শুধু তাকে একটা কথাই বলে,’আমাকে বিশ্বাস করো?’
তানহা তখন শুধু মৃদু হেঁসে কোনো জবাব না দিয়ে রাকিবের কাঁধে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে সারা রাস্তা ঘুমিয়ে থাকে।যেই ভালোবাসার উপর বিশ্বাস করে তানহা এতকিছু করলো এখন শুধু তানহার মনে একটিই কথাই ভাসছে,তা কি আদৌ ভালোবাসা ছিলো?
ভেতর থেকে ডুকরে কান্না আসলেও একজন অচেনা ব্যাক্তির সামনে তানহার নিজেকে সামলে অশ্রু মুছে ফেলতে হলো।সোহেল বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।ভালোবাসার মানুষটি এভাবে এই অবস্থায় একা ফেলে চলে যাওয়ার পর সেই মানুষটিকে আর কিভাবে স্বান্তনা দেওয়া যায় তা সোহেলের জানা নেই।পাশের সেই বখাটে ছেলেগুলো আবারও এক দু পা এগোচ্ছে আবার থমকে যাচ্ছে।তাদের মতিগতি ভালো ঠেকছে না।
-‘এখানে যাওয়ার মতো কোথাও জায়গা আছে আপনার?’
অশ্রুসিক্ত চোখে তানহা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না বলল।
-‘আমি এই এলাকায় ছোটোখাটো কয়েকটা টিউশনি করি।সাথে অন্য কাজও টুকটাক করি।পাঁচ ছয় বছর যাবত এখানে আছি,আপনি চাইলে আজকের রাতের জন্য আপনার থাকার ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারি।খানিক এগোলেই আমার এক দূর সম্পর্কের খালার বাড়ি আছে সেখানে।’
তানহা চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।সে সত্যিই জানে না সে এখন কোথায় যাবে।এই রাতের মধ্যে এখান থেকে ফেরত যাওয়ার মতো কোনো পথও নেই।তাছাড়া তানহার হাতে কোনো টাকাও নেই।ভয়ে তানহার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।বাইরের একটি রাতই যে একটি মেয়ের জীবন সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।
-‘কি হলো যাবেন?’
তানহা আগের মতোই নির্বাক হয়ে রইলো।কিছুক্ষণ আগেই মেয়েটির দু বছরের গড়া বিশ্বাস ভেঙ্গেছে আর এখন আবার একজন অচেনা যুবক ছেলের উপর বিশ্বাস করা কি আসলেই সম্ভব!যদিও ছেলেটিকে দেখে ভদ্রই মনে হচ্ছে,তবুও….
সোহেল বুঝতে পারলো মেয়েটি অনিশ্চয়তায় ভুগছে।তাই একটু মৃদু হেঁসে বললো,
-‘সমস্যা নেই,বিশ্বাস করতে পারেন।’
তানহার কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে সোহেল একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তানহা পাশের বখাটে ছেলেগুলোর দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে সোহেলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ধন্যবাদ।’
সোহেল মৃদু হেসে বলল,
-‘সেটা না হয় সাহায্য করার পরই দিবেন।’
রাস্তার কাঁদা পানিতে ছপছপ পায়ের আওয়াজ তুলে সোহেল তার কালো রঙের সাইকেলটি টেনে বাটন ফোনের টর্চের মৃদু আলোতে হেঁটে চলছে।পাশে মুখ কাচুমাচু করে হাঁটছে তানহা।কিছুক্ষণ পর একটি সরু গলির ভেতর ঝুপড়ি দোতলা ঘরের সামনে তানহাকে দাঁড় করিয়ে সোহেল ভেতরে প্রবেশ করলো।খানিকবাদে বেড়িয়ে এসে তানহাকে বলল,
-‘যান,আমি খালাকে সব বলে এসেছি।’
তানহা গুটিগুটি পায়ে ঘরের মধ্যে ঢোকার আগে একবার পেছনে ফিরে সোহেলের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেল।হঠাৎ কর্কশ শব্দ করে সোহেলের বাটন ফোনটা বেঁজে উঠলো।ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরেই সোহেল বলে উঠলো,
-‘কমলা খালা,মালডা কিন্তু কচি আর সুন্দরী।ডিলটা জানি দশ হাজারের নিচে না হয়।’

সমাপ্ত

নীল কষ্ট – কলমে – সুরাইয়া নিপা

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০

#গল্প – নীল কষ্ট
#কলমে – সুরাইয়া নিপা

#মূল গল্প:

ইতু আজ কলেজ থেকে ফিরেছে খুব খুশী মনে। বাড়ি ফিরেও তার মায়ের সাথে খুব ভাল মেজাজে কথা বলছে। ইতুর মা রোকেয়া বেগম মেয়ের হাসিমাখা মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন যে মেয়ের মনে কিছু রঙিন প্রজাপতি উড়ছে। তবে তিনি ইতুকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না কারণ জানেন যে ইতুর বাবা ইসহাক বশির বাড়ি আসার আগে সে মুখ খুলবে না। তাই তিনি চুপ করেই অপেক্ষা করলেন সন্ধ্যায় ইতুর বাবা বাড়ি আসা পর্যন্ত।

ইতু লালমাটিয়া কলেজের ছাত্রী। এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে, উদ্ভিদ বিজ্ঞানে পড়ে। মা বাবার একমাত্র সন্তান সে। ইতুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু তার বাবা। বাবার কাছেই তার রাজ‍্যের আবদার।

সন্ধ্যায় ইসহাক সাহেব বাড়ি ফিরলেন। যথারীতি ইতু ছুটে গিয়ে দরজা খুলে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। সেই ছোট্ট থেকে তার একই অভ‍্যাস। ইসহাক সাহেব জুতো খুলে বেডরুমে গেলেন ফ্রেশ হতে। এদিকে রোকেয়া বেগম খাবার গরম করে টেবিলে পরিবেশন করেন। ইতু তার মা কে সাহায্য করে।

আধাঘন্টা পরে ইসহাক সাহেব টেবিলে খেতে বসলেন। ইতু বসলো বাবার পাশের চেয়ারে। ইতুর মা ওদের সামনে দাড়িয়ে। প্রতিদিন ইতু শুধু বসে থাকে আর ওর মা খাবার তুলে দেন। কিন্তু আজ ইতু নিজে তার বাবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে। ইসহাক সাহেবের মনে হল ইতু তাঁকে কিছু বলতে চায়। ইতুর হাস‍্যোজ্জ্বল চেহারার দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বলবি, মা?” ইতু শুধু একগাল হাসি নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলো। রোকেয়া বেগম তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন ঘটনা জানার জন‍্য। ইসহাক সাহেব আবার বললেন, ” কিছু বলার থাকলে বল। এতো সংকোচ কিসের? ” এবার ইতু মুখ খুললো, ” বাবা, ডিপার্টমেন্ট থেকে কক্সবাজার নিয়ে যাবে। আমি যাব তো?”
” হ‍্যাঁ, যাবি। ব‍্যস, এই কথা?”
” খরচ পাঁচ হাজার। আর বাড়তি কিছু টাকাও লাগবে শপিং এর জন‍্য ”
” ইতুর মা, ইতুর যা টাকা লাগে দিয়ে দিও।”
রোকেয়া বেগম এতক্ষণে কথা বললেন, ” ঠিক আছে, দিয়ে দিব। এই কথাটা ও আমাকেও বলতে পারতো।”
ইতু খুশী মনে খবরটা বান্ধবীকে দিতে গেল।

এর পরের একটা সপ্তাহ ইতু বান্ধবীদের সাথে শপিং করলো এবং সমুদ্রসৈকতে গিয়ে কী কী করবে তার পরিকল্পনা করতে থাকলো। ট‍্যুরের দিন সকাল থেকেই তার গোছগাছ চলে। বিকেলে তারা উপস্থিত হল কলেজ ক‍্যাম্পাসে। সন্ধ্যায় তারা রওনা হল কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে।

পরদিন দুপুরে ওরা পৌঁছালো কক্সবাজার। হোটেলে মালামাল রেখে বেরিয়ে পড়লো সমুদ্রস্নানের জন‍্য। স্নানশেষে সৈকতে হাঁটার সময় ইতুর পায়ে কিছু একটা বাধলো। সে থমকে দাঁড়ালো আর বালু সরিয়ে দেখলো একটা কাঁচের শিশি বালুতে আটকে আছে। শিশির ভেতরে একটা মোড়ানো নীল রঙের চিরকুট আছে। কাগজে লেখা একটা শব্দ ই বোঝা যাচ্ছে, ‘ প্রিয়তমা ‘। কৌতুহলবশত ইতু শিশিটা নিয়ে হোটেলে ফিরলো। ডিনার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে শিশির মুখ খুলে মোড়ানো কাগজটা বের করলো। কাগজটিতে মুক্তাক্ষরে লেখা আছে,
‘ প্রিয়তমা,
মনের মণিকোঠায় আমি রেখেছি যে তোমায়,
দিন গুনি শুধু তোমার অপেক্ষায়
জানিনা তুমি লুকিয়ে আছো কোথায়…
— নীল
মোবাইল : 019** ** ** ** ‘
ইতুর ইচ্ছে হল তখনই নাম্বারটায় কল করতে। কিন্তু আবার ভাবলো যে ফোন করে কী বলবে! কেউ টের পেয়ে গেলেই বা কী বলবে! তাই চিরকুটটা নিজের ব‍্যাগে রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।

আরও একদিন কক্সবাজারে থেকে তার পরদিন বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা হল তারা। বাড়ি পৌঁছে সেই রাতেই ইতু ঐ নাম্বারে ফোন করলো। বেশ কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেল কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করলো না। হতাশ হয়ে ইতু মোবাইল রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। ভ্রমনের ক্লান্তি থাকায় খুব তাড়াতাড়ি গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো সে।

পরদিন সকাল ১০ টার সময় ইতুর ঘুম ভাঙলো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে গিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল তার মা তখন রান্না করছেন এবং বাবা অফিসে চলে গেছেন। মেয়েকে দেখে রোকেয়া বেগম বললেন, “উঠেছিস? যা, হাতমুখ ধুয়ে এসে নাস্তা করে নে। ইতু নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে আবার বিছানায় বসলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো ঐ চিরকুটের নাম্বার থেকে ২ টা মিসড্ কল। সে মনে মনে ভাবলো, ” কখন কল এসেছিল, আমি টেরই পেলাম না!” বেশ উত্তেজিত মনে সে নাম্বারটি ডায়াল করলো। এবার একবারেই ফোন ধরলো ওপারের ব‍্যক্তি,
” হ‍্যালো”
“মনের মনিকোঠায় আমি রেখেছিযে তোমায়
দিন গুনি শুধু তোমার অপেক্ষায়
জানিনা তুমি লুকিয়ে আছো কোথায়।”
“কে?”
” আমি প্রিয়তমা। আপনি কি নীল? ”
” জি, আমিই নীল। আপনি চরণগুলো কোথায় পেলেন?”
” আপনি যেখানে রেখে এসেছিলেন, সেখানে। ভুলে গেছেন নাকি?”
” না, তবে বিশ্বাস করতে পারছিনা। এরকম তো শুধু গল্প বা নাটকেই সম্ভব।”
” জীবণের গল্প তো মাঝে মাঝে নাটককেও হার মানায়।”
” তাই তো দেখছি! আসলে ঘটনা হল, আমি বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। সৈকতে হাঁটছিলাম,হাতে ছিল জুসের বোতলটা। কী মনে করে যেন কাগজে দুইলাইন লিখে বোতলে ভরে ছুঁড়ে দিলাম সাগরে। ভেবেছিলাম ঢেউয়ে ভেসে নিরুদ্দেশে চলে যাবে। তা না গিয়ে ঘুরেফিরে এই সৈকতেই আটকে ছিল!”
” সত‍্যি করে বলেনতো, কোন রূপনগরের রাজকন্যার জন‍্য অপেক্ষা করছিলেন কি?”
” একদম ই না। আসলে ভেবেছিলাম এই ছেলেমানুষী কাজের কোন প্রত‍্যুত্তর কখনো পাব না।”
” আমিও কৌতুহলবশত ফোন করেছি, আমার জীবণে এমন কিছু আমি আগে দেখিনি বা শুনিনিতো তাই। যাইহোক, বিরক্ত করার জন‍্য দুঃখিত।”
” আমি বিরক্ত হইনি, একটু বিস্মিত হয়েছি মাত্র।”
” ঠিক আছে, রাখছি তাহলে।”
এই বলেই ইতু ফোন কেটে দিল। কেন যেন নিজের কাছেই বিষয়টা বিরক্তিকর লাগছে ওর। চিরকুটটা বইয়ের মধ‍্যে রেখে সে ওয়াশরুমে চলে গেল।

দুইদিনের ছুটির শেষে কলেজে ক্লাস শুরু হল। ইতু নিত‍্যদিনের কাজের মধ‍্যে ব‍্যস্ত হয়ে গেল এবং চিরকুট ও নীলের কথা ভুলেই গেল। দিন দশেক পর একদিন সে কলেজ শেষে বাড়ি ফিরছে। পথেই তার মোবাইল রিংটোন বেজে উঠল। ইতু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সেই চিরকুটের নাম্বার থেকেই ফোন। সে ফোন রিসিভ করলো –
” হ‍্যালো ”
” জি, কেমন আছেন?”
” হুম ভালো, আপনি?”
” ভালোই তবে একটু অপরাধবোধে ভুগছি।”
” অপরাধবোধের কারণ?”
” সেদিন আপনি কল করলেন আর আমি কেমন অদ্ভুত আচরণ করলাম। আমি সত‍্যিই দুঃখিত। সেদিনের ঘটনায় এতবেশি অবাক হয়েছিলাম যে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।”
” ঠিক আছে, কোন ব‍্যাপার না।”
” আমরা পরিচিতি তো হতে পারি। আমি নীল, চট্টগ্রামে থাকি। ইংরেজি সাহিত‍্য নিয়ে মাস্টার্স করছি।”
” আমি ইতু। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার, বোটানি।”
এভাবেই শুরু হয় পরিচয় পর্ব। তারপর বন্ধুত্ব। প্রতিদিন কথা হতে থাকে দুজনার। কথায় কথায় সম্বোধন টা আপনি থেকে তুমিতে চলে আসে। একটা বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরী হয় দুজনের মধ‍্যে। একদিন নীল সরাসরি প্রস্তাব দেয় ইতুকে-
” আমরা কি জীবনসঙ্গী হতে পারিনা?”
ইতু অনেক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলে, ” খুব ভয় হয়।”
” কিসের ভয়?”
” তুমি যে নীল, নীল মানেই তো বেদনা, কষ্ট।”
” আকাশের নীলে মুক্তি মেলে
সাগরের নীলে বিশালতা,
প্রশান্তি লুকিয়ে থাকে নীল নয়নের ঝিলে
তবে নীলে কেন শুধু বেদনার প্রগাঢ়তা?”
“তোমার কাব‍্যের কাছে আমি নির্বাক।”
” বেশ, তোমার ভয় দূর করে দিই। জুলাই এর ৪ তারিখ আমার জন্মদিন। সেদিন আমি ঢাকা আসবো, তোমার সাথে কাটাবো সারাদিন। আর সেদিন থেকেই নীল হবে আমাদের ভালোবাসার রং, তোমার বিশ্বাসের রং।”
” সত‍্যিই আসবে? বেশ তবে আমিও সেদিন নীল শাড়ি পরবো। সাথে নীল চুড়ি আর নীল টিপ। তোমাকেও নীল পাঞ্জাবি পরতে হবে।”
” তুমি যা চাও তাই হবে।”

কথামতো ৪ জুলাই নীল সকালে রওনা দিয়েছে ঢাকার পথে। কিছুক্ষণ পরপর ইতুকে ফোন করে জানাচ্ছে কতদূরে আছে। ইতুও কথামতো নীলাম্বরী সাজে নিজেকে সাজাচ্ছে তার নীলের জন‍্য।

বিকেল ৪ টায় ইতু অপেক্ষা করছে হাতিরঝিলে, হাতে সেই চিরকুটটি নিয়ে। সেখানেই নীলের আসার কথা।

এদিকে নীল বাস থেকে নেমেছে আরামবাগে। তার মোবাইল বেজে উঠলো। ইতু ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করবে ঠিক সেই মূহুর্তে কে যেন ছোঁ মেরে তার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে এক নিমিষে উধাও হয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে কোন টেলিফোন বুথ চোখে পড়লোনা যেখান থেকে ইতুকে একটা কল করা যায়, বলা যায়, “এই তো চলেই এসেছি তোমার কাছে।”
ফুটপাত ধরে কিছুটা হেঁটে রাস্তার ওপারে বাস কাউন্টার। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা, দূরে একটা গাড়ি আসছে দেখে নীল জেব্রা ক্রসিং পার হতে রাস্তায় নামলো। কিন্তু সেই দূরের গাড়িটাই দ্রুতগতিতে এসে নীলকে পিষে দিয়ে চলে গেল। তার নীলরঙা পাঞ্জাবীটা লালরঙা রক্ত মিশে কালো হয়ে গেল।

সন্ধ‍্যা সাতটা বাজে। ইতু অনবরত ডায়াল করে যাচ্ছে নীলের নাম্বারে। নাহ্, ফোন বন্ধ বলছে। এক অজানা শংকায় ইতুর হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। তবে কি নীল আজ সারাদিন ইতুর সাথে ছলনা করলো!

ইতু স্থির দাঁড়িয়ে আছে নীল শাড়ি, চুড়ি আর টিপ পরে। তার হাত থেকে চিরকুটটি উড়ে গিয়ে পড়লো ঝিলের জলে। হালকা স্রোতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। ইতু শুধু ঠাঁই দাড়িয়ে রইল ছলছল চোখ আর একবুক নীল কষ্ট নিয়ে।

(সমাপ্ত)

“মমতার অন্তরায়” – লেখা:— মাইশা জাফরীন (ছদ্মনাম)

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
গল্প:— “মমতার অন্তরায়”
লেখা:— মাইশা জাফরীন (ছদ্মনাম)

বিষণ্ন মনে স্কুলের এপ্রান্তে নির্বিকার পায়চারী করছেন এক বিপত্নীক ভদ্রলোক, আশরাফ। ভগ্নহৃদয়ে তার স্ত্রীর স্মৃতিকথা ভাসমান। হঠাৎ ভাবনার ব্যবচ্ছেদ করে সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন এক সুশীলা।

“এখনও বাসায় যাননি?” প্রশ্ন করলেন ভদ্রমহিলা, স্কুলের নতুন শিক্ষিকা। নাটকীয় ভঙ্গিতে একবার পরিচিত হয়েছিলেন।

“না আসলে…।” বলতে গিয়ে প্রত্যুত্তরবিহীন হয়ে গেলেন আশরাফ। তাকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলছেন নাকি দরদমাখা উদারকণ্ঠে জিজ্ঞেস করছেন তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। অবশ্য ভদ্রমহিলার চেহারা ভাবলেশহীন।

“মাফরুহা কে নিয়ে আবারও সমস্যা হচ্ছে? প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম কী বলেছেন?” উত্তর না পেয়ে নিজেই প্রসঙ্গ তুললেন।

“একটা দীর্ঘ নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছেন, শ’খানেক শর্তাবলী আছে। পরবর্তীতে কারো সাথে ঝগড়া হলে বা রেজাল্ট খারাপ হলে কঠোর সিদ্ধান্ত নেবেন।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আশরাফ।

“আপনি কি একটু সময় করে আমাকে ওর সমস্যাটা খুলে বলবেন?” শিক্ষিকার কথায় কিছু ভরসা পেলেন আশরাফ।
তার মেয়ে মাফরুহা প্রতিবন্ধী, প্রায়ই স্কুলের অনেক মেয়েদের সাথে মারামারি করে কারো নাক কারো মাথা ফাটিয়ে লাল তরল ঝরিয়ে দেয়। পরীক্ষার খাতায় একটা শব্দও লেখে না সে। অথচ বাকিসব কাজকর্ম সে নিরালস্য ভাবে করে। বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলী ও মেধাবী মাফরুহা কেবলই মুখ ফুটে বাক্যব্যয় করেনা, কথা বলতে পারে অথচ কোনো ধ্বনি উচ্চারিত হয় না তার মুখে কখনও। তার বিরুদ্ধে নালিশ আর অভিযোগ শুনতে প্রায় ছিয়াশিবার বাবাকে প্রিন্সিপালের মুখোমুখি হতে হয়েছে, আজ লাস্ট ওয়ার্নিং।

“ও আসলে এরকম ছিল না আগে। ওর এক জন্মদিনের রাতে আমি ডিউটিতে ছিলাম। বাসায় মায়ের সাথে ছিল ও। আগুন লেগেছিল ফ্ল্যাটে, বাঁচতে ছাদে উঠে আসে। কিভাবে জানি না কিন্তু ছাদে থাকা সুইমিংপুলে পড়ে মারা যায় তার মা। পাঁচ বছরের মেয়েটার জীবনের চাক্ষুষ ঘটনাটা সামলাতে পারে নি হয়ত। তারপর থেকেই সে বাকহারা, অস্বাভাবিক…।” দীর্ঘশ্বাসের সাথে আশরাফের মুখনিঃসৃত হয় হতাশার না দেখা অনুক্ত কথামালা।

“ফায়ার সার্ভিসে নাইট ডিউটি থাকে আপনার প্রায়ই?” ভদ্রমহিলা আবারও শুধালেন। কেন জানি তাকে এড়িয়ে চলতে গিয়েও আর পারেন না আশরাফ। মাফরুহার বিষয়ে চরম আগ্রহী তিনি।

“জ্বী।” শুধু উত্তরটুকু দিলেন। কেন যেন আশরাফ এই জিজ্ঞাবাদের বিষয়ে একেবারে নির্লিপ্ত।

“আজ রাতেও?”

“হ্যাঁ।”

“আমি কি ওর সাথে রাতে থাকতে পারি? ওকে একটু বুঝাতে পারতাম আরকি!” ইতস্তত করে বললেন শিক্ষিকা।

কিছুটা অপ্রতিভ হলেন আশরাফ। তার বাসায় মেয়ের সঙ্গ দিতে চাচ্ছেন স্কুলের শিক্ষিকা। কেমন আপত্তিকর বিষয়টা! উদীয়মান ভাবনাগুলোর উন্মেষে হতচকিত আশরাফ তাও কি মনে করে সম্মতিসূচক নিরব সায় দিলেন, তা নিজেও ভেবে পান না।

আজ মাফরুহার ষোলোতম জন্মদিন, বাবা চাকরীর খাতিরে থাকতে পারেন নি। অতি আপন এক শিক্ষিকা আছেন। আড়চোখে প্রায়ই মাফরুহাকে খেয়াল করেন। নিরব অভিভাকত্ব পালন করে যাবার ব্যাপারটা মাফরুহা খেয়াল করেছিল। কোনোদিন তাকে কেউ সহ্য না করলেও তিনি করছেন, জন্মদিনের রাতটা তাকে পেয়ে নিঃসঙ্গতা কেটে গেছে মাফরুহার।
বন্ধুভাবাপন্ন শিক্ষিকার সাথে কথা না বললেও একসাথে কার্টুন দেখল, কেক বানালো…।
স্কুলেও নতুন এসে তিনি সবার আগে এই মাফরুহার সাথে পরিচিত হতে চেয়েছেন। মাফরুহা নির্বাক, তাই অন্যকারো নাম তিনি আর পরে জিজ্ঞাসা করেন নি, আড়ালে মেয়েটি কষ্ট যেন না পায়।
পরীক্ষার দিনটাতে প্রায় সারাটা সময় তিনি মাফিরুহার পাশে থেকেছেন, ওকে প্রশ্ন বুঝিয়েছেন, লিখতে বলেছেন, যেন মেয়েটাকে প্রগতিশীল করে গড়ার নিত্য প্রয়াসী নিঃস্বার্থ অভিভাবক তাকে কত দিন ধরেই চেনে। কিন্তু মাফরুহা অটুট, নিজ অবয়বে সেই গাঢ় গাম্ভীর্যের আভায় সামান্য ভাটা ফেলেনি। প্রতীমার মত হলরুমে উপবিষ্ট থেকে কেবলই লগ্ন পেরোবার প্রহর গুনেছিল। কে জানে, সে নির্বোধ না গোঁড়ামির বসে করলো ওকাজ!
ধৈর্যে তবু শিথিলতা এলো না শিক্ষিকার। আবারও প্রতিবন্ধী হতবুদ্ধি মেয়েটার জন্য যেন নিজের ভরাডুবি করেও তিনি ক্ষান্ত নন। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কাছে এবছরেও পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করার প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। তার এই অপচেষ্টার প্রভাব সম্ভবত ক্ষীণ হলেও মাফরুহার মনে জাগরণের আন্দোলন তুলেছিল। নির্বিঘ্নে তো বটেই, বরং বড্ড আহ্লাদে তাই আজ নিঃসংশয়ে একাকী রাতের সঙ্গ করে নিয়েছিল ম্যাডামকে।
মাফরুহাকে অবশ্য তার জনক প্রায়ই বুঝাবার চেষ্টা করেছে, শিক্ষিকার সঙ্গ এড়াতে। কেন যেন তার অবিমৃষ্যকারী এই নারীর উদ্দেশ্য বোধগম্য হয়েছিল। তবু অপ্রকাশ্যে কন্যার সঙ্গ হতে বাধাপ্রদানের কোনো সুযোগ তার হয়ে উঠেনি। নিরুপায় আশরাফ আজ সেই কন্যার চিরকুটে লিখিত প্রতিশ্রুতি – “আজকে অবশ্যই আমার সাথে থেকো বাবা, আমি আজকে একা থাকতে পারবো না” পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করেও যখন সরকার প্রদত্ত প্রহরার বিকল্প করতে পারেন নি, তাই আজ এক প্রকার বাধ্যবাধকতায় অনুমতি দিয়েছেন শিক্ষিকাকে।

“কোন বাসায়?” আগুন লাগার কথা শুনে আশরাফ ঠিকানা জানতে চাইলেন সহকারীর থেকে।
আজকাল আগুন বেশি একটা লাগে না শহরে। অলস সময় পত্রিকা পড়েই কাটান তিনি। সহকর্মীরা কেউ নিরলস নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়ে, কেউ দাবা খেলে…। আশরাফের কোনোটাই ব্যাক্তিগত ভাবে পছন্দ নয়। সিগারেট খাওয়া যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর তার অবহতির লোকের অভাব না হলেও মান্য করার মত লোকের যথেষ্ট অভাব। অন্যতম লোকদের একজন আশরাফ বলে তিনি মান্যকারীর দলে থেকেছেন। আর দাবায় নেশা ধরায়। বড্ড ধর্মপ্রাণ বলেই হয়ত প্রবল ইচ্ছাটাও বুকে পাথর চেপে দমন করতে সক্ষম হয়েছেন আশরাফ।
“১৩ নাম্বার গলির ১৯/৬ ফ্ল্যাট।” উত্তর দিল সহকারী।
“আরে! এটা তো আমার বাসা!” সহসা চকিত ভঙ্গিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ান আশরাফ। দমকল বাহিনীতে কর্তব্যরত অবস্থায় তিনি দ্বিতীয়বার সংবাদটা পেয়েছেন। কে জানে, সূচনালগ্নে হারালেন স্ত্রীকে, নিয়তির নির্মম পরিহাসে যদি মেয়েটাও পটল তুলে অকালেই!
তৎক্ষনাৎ উদ্যত পদক্ষেপে তাড়াতাড়ি দমকল বাহিনী নিয়ে ছুটলেন বাসার দিকে।

আগুন থেকে বাঁচতে ছাদে উঠে আসলো মাফরুহা আর ম্যাডাম। যখন দু’টি প্রাণ নির্মম অনলের গ্রাসকারী আক্রমণ হতে বাঁচতে নিরত, মাফরুহাকে অবাক করে দিয়ে পানি টলমল সুইমিংপুলে পা পিছলে পড়ে গেলেন ম্যাডাম।
তাকে রাতের আঁধারে কালো পানিতে দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে মাফরুহা দেখলো তার বাবা সশরীরে গাড়ি সমেত উপস্থিত। আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন, ওদের ব্যাগ্র চাহনীতে প্রিয় কন্যার সন্ধান করছেন।

চেষ্টা করলো প্রাণপনে, বারো বছরের রুদ্ধ বাকশক্তিকে জাগাবার চেষ্টা করলো মাফরুহা। এদিকে ম্যাডাম মারা যাচ্ছেন, বাবা ওদিকে ব্যস্ত। কারো জীবনের তাগাদায় সে মরিয়া হয়ে উঠলো ডাকবার – “বাবা এসো, ম্যাডাম এখানে। বাঁচাও উনাকে।” লাভ হলো না।
কিন্তু জীবনের অন্তিমদশায় তার বাকশক্তির চেতন হওয়া দরকার। জানান দেয়া দরকার ওরা এখানে আছে।
মাফরুহার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কান্না বিজড়িত অতীত জন্মদিনের কালরাত্রী, তার সাঁতার না জানা জননী তলিয়ে যাচ্ছেন কালো পানির গহ্বরে। সে ডাকছে, “মা ফিরে এসো।”…
মাফরুহা আবারো সর্বাত্মক সচেষ্ট হলো, তার ষোড়শী প্রাণের উদ্দামতা কন্ঠনালীর সরু নলে প্রবেশ করলো সর্বশক্তি ব্যয়ে।
পুনরায় সবটা শক্তিব্যয় করে বলতে পারলো, “মা ফিরে এসো!”… “বাবা! মাকে বাঁচাও।”

পরিশিষ্ট:-
ইচ্ছে করেই বিধবা শিক্ষিকা ঘরে আগুন লাগিয়েছিলেন। সাঁতার জেনেও ডুবে যাবার ভানে মেয়েটার হারানো বোধ ফেরাতে চেয়েছেন তিনি। কারণ, একটা সময় তার পিতৃহীন বাকহারা কন্যা এমনি এক ঘটনায় স্কুল হতে বহিস্কৃত হবার ক্ষোভে আত্মহত্যা করে। মাফরুহাকে অবিকল তার মতই মনে হয়েছে।

গদি চেয়ার – লেখাঃ মালিহা তাবাসসুম

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০

গল্পঃ গদি চেয়ার
লেখাঃ মালিহা তাবাসসুম

মধ্যদুপুরের রোদের তেজ ক্রমশ বাড়ছে।একচালা কুড়ে ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে সে। জীবনের মাঝপথে এসে শত ছিন্ন জীবনে নতুন করে আবার বড় আকারের বিচ্ছিন্নতা দেখা দিল। এতোদিন যাও জোড়াতাড়া দিয়ে চলছিল, এখন আর সেটাও হচ্ছে না। কিন্তু বহুকালের পোড় খাওয়া মানুষ আইজুদ্দিন। মা আদর করে ডাকতো, বাবা আইজু। গত পাঁচ বছর হলো মা মারা গিয়েছেন। এখন আর কেউ এমন আপনার করে ডাকে না, বাবা আইজু! তুমি আইছো?

মার কথা মনে পড়ায় চোখের পলকে সে চলে গেল ছেলেবেলায়।বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ করে মা যখন এসে ভাত বসাত, বালক আইজুদ্দিন তখন ভাতের চুলার পাশে খেলত পাশের ঘরের রইস, মোখলেছ আর আউয়ালের সাথে। কোনোদিন বরফপানি, কোনোদিন ছোঁয়াছুঁয়ি। একদিন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে গিয়ে আউয়াল পড়ে গিয়ে বাম পায়ের আঙুল কেটে ফেলছিল। এতো রক্ত পড়ছিল, আইজুদ্দিনের মা নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে সেখানে বেধে দেয়। সেদিনের ঘটনা যেন! রইস, আউয়াল, মোখলেছ এদেরকে এই জাদুর শহর কই নিয়ে গিয়েছে তা জানা নেই আইজুদ্দিনের।
-আব্বা, এই বড় গদি চেয়ারডা আমার লাইগ্যা রাখবা?
ছেলের কথায় বাস্তবে ফিরে এল সে। আইজুদ্দিনের ছেলে ফরহাদ। বয়স মাত্র ছয়। ছেলে কি বলেছে ঠিক করে শুনতে পায়নি সে। তাই জিজ্ঞেস করল, কি কইলি?
– কইতাছি এই গদি চেয়ারডা আমার লাইগ্যা রাইখ্যা দ্যাও।
-চেয়ার দিয়া কি করবি?
-এই চেয়ারে বইলে আমারে রাজপুত্তুরের লাহান দ্যাহায়। দ্যাহো আব্বা, দ্যাহো!

ছেলের নির্মল হাসি দেখে সহসা খুশি হয়ে উঠলেও কাস্টমারের কাছে বিক্রির জন্য বানানো চেয়ারটা যে ছেলের জন্য রাখা যাবে না সেটা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল তার। মাত্র তিনদিন পর কাঠের ওপর লাগানো বার্নিশটা শুকালেই বিশাল রাজকীয় চেয়ারটা চলে যাবে এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সামাদ চৌধুরীর ঘরে। শুধু এই চেয়ারটাই নয়, এই রকম ছয়টা চেয়ার আর একটা ডাইনিং টেবিলের সেটটার পুরোটাই তাদেরকে দিয়ে দিতে হবে। ছেলের কথায় ভীষণ মায়া লাগলেও করার কিছুই নেই আইজুদ্দিনের। একটা ফার্নিচারের দোকানের কর্মচারী সে।দোকানের নাম দি মুন ফার্নিচারস। তার মতো আরো তিনজন কর্মচারী, দুইজন ফুলমিস্ত্রী আছে দোকানটাতে। ফুলমিস্ত্রী হলো যে কাঠের ফার্নিচারের ওপর ফুল, পাতা এসবের নকশা করে। দোকানের মালিক ইমতিয়াজ খান। নিজের পৈতৃক সম্পদ বড় রাস্তার পাশের জায়গাটুকুতে দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। নিজে দোকানে সামান্যতম কাজ না করেও শুধু মালিক হওয়াতে ফার্নিচার বিক্রির লভ্যাংশের মূল অংশটাই যায় ইমতিয়াজ সাহেবের পকেটে। আইজুদ্দিনের মতো কর্মচারীরা শুধু মাস শেষে একটা নামমাত্র বেতন পায়৷ যে বেতন দিয়ে ছেলে তাহেরের পছন্দের গদি চেয়ার কেনাটা বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়।

অভাবের তাড়নায় ছেলের বয়স মাত্র ছয় থাকতেই তাকে কাঠের দোকানে নিয়ে আসে সে।
বাবার সাথে সাথে সেও কাঠ আনা নেওয়ার মতো টুকটাক কাজ করে। এভাবে একটু আধটু কাজ করতে করতেই শিখে যাবে পুরো কাজ। তখন দুই বাপ বেটা কাজ করলে সংসারে আরেকটু স্বচ্ছলতা আসবে৷ এই ভাবনা থেকে সে যে ছেলেকে দিয়ে সে শুধু যে কাজই করাচ্ছে তা নয়। ছেলেকে একটা প্রাইমারি স্কুলেও দিয়েছে। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে সে বাবার সাথে দোকানে কাজ করে। বিকেল পর্যন্ত কাজ করে দুই বাপ বেটা একসাথে বাড়ি ফিরে। কখনো কাজের চাপ বেশি হলে রাতও হয়ে যায় ফিরতে ফিরতে। বাড়ি এসে খেয়ে দেয়ে ঘুম! সকাল থেকে আবার সেই একই গৎবাঁধা দিন। এভাবেই ভালো মন্দ মিলিয়ে জীবন কেটে যাচ্ছিল কোনোমতে।

কিন্তু হঠাৎ দেশে করোনা সংক্রমন শুরু হলে সারাদেশে লকডাউন করে দেওয়া হয়। মানুষের ইনকামেও এর প্রভাব পড়ে। ফার্নিচার বিক্রিও যায় কমে। আইজুদ্দিনের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য দিনযাপন আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

দিন তিনেক পরে বিকেল প্রায় চারটায় সময় সামাদ চৌধুরী ডাইনিং টেবিল নিতে আসেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী শিরিনকে নিয়ে। শিরিন এখন আগের চেয়ে বেশ সুন্দরী হয়েছে। নিত্য রূপচর্চা আর দুঃখ-দারিদ্র, দুশ্চিন্তাহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওর বয়স যেন দিন দিন কমছেই। অন্য ছেলেদের সাথে কানামাছি খেলার সময় চোখ বাধাবস্থায় ভুল করে শিরিনকে জড়িয়ে ধরেছিল আইজুদ্দিন। ভীষণ লজ্জা পেয়ে এক ছুটে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল শিরিন। সেই শিরিন! এরপর থেকে আইজুদ্দিনের বয়সী ছেলেরা ওকে শিরিনকে নিয়ে ক্ষেপাত। সেই কবেকার কথা। অথচ এখনো মনে পড়লে চাপা একটা অস্বস্তি হয়। এসব ভাবতে ভাবতেই ফরহাদ বলে উঠল, আব্বা, গদি চেয়ারটা..?!
বাকিটুকু কথা আর সে শেষ করল না। এই বয়সেই জীবনের রঙ অনেকখানি চিনে নিয়েছে যে!
ব্যাপারটা শিরিনের চোখ এড়াল না। সে ফরহাদকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, কি হইছে?
ফরহাদ কিছু বলল না। ভীত চোখে একবার বাবার দিকে, একবার চেয়ারের দিকে তাকাল।
আইজুদ্দিনই কথা বলে উঠল, কিছু হয় নাই আফা। পোলাপান মানুষ যা দেখে নিতে চায়।
আফা!! সম্বোধনটা যেন হঠাৎ দূর থেকে কাঁটার মতো বিঁধল শিরিনের। সে বয়সে আইজুদ্দিনের চেয়ে কম করে হলেও চার বছরের ছোট হবে। আর এতো তার আইজু ভাই। সে কেন তাকে আফা ডাকবে! এই সেদিনও চাঁদরাতে তারাবাতি জ্বালিয়েছে একসাথে। দূরের কেউ না তো, আইজুদ্দিন আর শিরিন সম্পর্কে চাচাতো ভাই বোন। সামাজিক অবস্থান দুজন আপন মানুষের সম্পর্ককেও যে কতোটা দূরে ঠেলে দিতে পারে তারই যেন উদাহরণ এটা। অবশ্য এসবে শিরিন অভ্যস্ত। ওর বাপের বাড়িতেও ওর এতো খাতিরযত্ন সেটা তো ওই সামাদ চৌধুরীর বউ হওয়ার কারণেই৷ অন্যরা ওকে সমীহের দৃষ্টিতে দেখছে, এটা শিরিনের কাছে বেশ উপভোগ্য একটা ব্যাপারও বটে! কিন্তু আজ কেন এতো কষ্ট হচ্ছে? শিরিন ভেবে পায় না, শৈশব কৈশোর একসাথে কাটানো নাকি আইজুদ্দিনের জন্য আগে থেকেই যে দুর্বলতা কাজ করত সেটাই ওকে পীড়া দিচ্ছে। ওসব নিয়ে শিরিন আজ আর ভাবতে চায় না। এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও বেশিক্ষণ থাকতে মন সায় দিচ্ছে না তার।

শুধু অনিন্দ্য সুন্দরীই নয়, শিরিন বেশ চালাকও। সে ঠিকই বুঝতে পারল, ফরহাদ কি চাচ্ছে৷ সে সামাদ চৌধুরীকে বলল, আমরা পাঁচটা চেয়ার নেই? ঘরে তো লোক বেশি নেই।শুধু আমি আর তুমি। ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ার কম হলে অসুবিধা হবে না।
সামাদ সাহেব মনে মনে বিরক্ত হলেও একগাল হেসে বললেন, আচ্ছা গো। বাড়িওয়ালি তুমি, তুমি যা বলবে সেখানে তাই হবে।
নিজের বয়স পঞ্চাশে এসেও সতের আঠারো বছরের সুন্দরী স্ত্রী থাকায় সামাদ সাহেব মনে মনে বেশ গর্ববোধ করেন। তার মন রক্ষারও যথাসম্ভব চেষ্টা করেন। শিরিন সেটা টের পায়৷ সেও এজন্য বেশ ভাগ্যবতীই মনে করে নিজেকে৷ সামাদ সাহেবের বয়স নিয়ে মনে যে খুঁতখুঁত লাগার কথা, সেটা বেশ একটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না এজন্য। তাছাড়া না চাইতেই শাড়ি গয়না যখন যা লাগে, তাই সে পেয়ে যায়।
শিরিন ফরহাদকে কাছে ডেকে ওকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, এই চেয়ারটা তোমার জন্য।
ফরহাদ কি করবে প্রথম বুঝে উঠতে পারে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কে এই মহিলা? উনাকে আগে কোথাও দেখেছে কি না তাও মনে করতে পারছে না সে।
শিরিন মনে মনে ভাবে, আইজুদ্দিনের সাথে বিয়ে হলে এই রকম একটা ছেলে কিন্তু তার নিজেরও হতে পারত! পর্যাপ্ত অর্থসম্পদ থাকলেও এই দিক দিয়ে অপূর্ণতা রয়েই গেছে তার৷ হয়তো বাকি জীবনটাও এভাবেই কাটবে। সামাদ সাহেব শিরিনকে কখনো নিজের মুখে বলেননি। কিন্তু শিরিন জানে, সামাদ সাহেব কখনো বাবা হতে পারবেন না। এই নিয়েও ওর মাঝে মাঝে আক্ষেপ হয়, কিন্ত প্রাচুর্যতা সে অভাবকেও ভুলিয়ে দেয় যেন!
এদিকে আইজুদ্দিনের লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা। গরীব হলেও সে কারো করুণা চায় না। আজ এই মুহূর্তে সে যদি এখানে না থাকত? কি এমন হতো যদি আজ শিরিনের সাথে এইভাবে দেখা না হতো?

তাদের অদূরে ওর শখের গদি চেয়ারটায় ফরহাদ বসে আছে। শিরিনকে নিয়ে বিস্ময় বা ওর বাবার চোখ রাঙানির ভয় নেই এখন তার চোখে। তার চোখে এখন খুশির ঝিলিক!

(সমাপ্ত)

অসত্য ও সত্য – লেখা : শঙ্খিনী

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০

অসত্য ও সত্য
লেখা : শঙ্খিনী

সাধারনত শেফার ঘুম ভাঙ্গে বেলা এগারোটার দিকে। বারোটায় থাকে তার ক্লাস, এক ঘণ্টার মধ্যে কোনমতে তৈরি হয়ে রওনা দিতে হয়। কিন্তু অনলাইন ক্লাস হওয়াতে বেশ সুবিধা হয়েছে। ঠিক বারোটার সময় ঘুম থেকে ওঠে সে। অনলাইন ক্লাসে ঢুকে এটেন্ডেস দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পরে।

কিন্তু আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে সে। উঠেছে বললে ভুল হবে, শেফা সারারাত ঘুমাতে পারেনি। নিজের জীবন সম্পর্কে অনেক বড় একটা সত্য জানতে পেরেছে গতকাল।

শেফা খুব ভালো করে জানে তার বাবা রূপক ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। তাই বাবাকে ফোন করল সে।

রূপক ফোন তুললে শেফা শান্ত গলায় বলল, “গুড মর্নিং বাবা।”
রূপক কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “গুড মর্নিং। কী ব্যাপার? আজ এত সকালে।”
“ঘুম ভেঙে গেছে, আমি কী করবো?”
“সকলটা উপভোগ করো! দিনের সবথেকে বেস্ট পার্ট কিন্তু এই সকাল।”
“ঠিক আছে। কী করছিলে তুমি?”
“অফিস ওয়ার্কস। তুমি?”
“জানি না।”
শেফার গলার স্বর সাধারনের থেকে কিছুটা অন্যরকম লাগছে, বুঝতে পেরে রূপক বলল, “শেফা? সব ঠিক আছে তো?”
“হুঁ।”
“তোমার মায়ের সাথে আবার ঝগড়া হয়েছে না-কি?”
“না তো!”
“কেমন আছে তোমার মা?”
“জানি না।”
“হুঁ?”
“আসলে আমি এখন নানিদের বাসায়।”
“সে কী? এরকম একটা ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে তুমি ঘর থেকে বের হলে কেন?”
“মাস্ক পরেই এসেছি, সমস্যা হবেনা।”
“সেখানে যাওয়াটা এত জরুরী হলো কেন?”
“আমি অনেক ভেবচিন্তে ডিসিশন নিয়েছি বাবা। আমার আসলে নানা-নানির সঙ্গেই থাকা উচিত। নানা-নানি কিন্তু নিরপেক্ষ, তোমাকেও সাপোর্ট করে না আবার মাকেও সাপোর্ট করে না। আমি তাদের মতো নিরপেক্ষ হতে চাচ্ছি। আইডিয়াটা ভালো না?”
“শেফা কি বলছো এসব? নিশ্চয়ই তোমার মায়ের সাথে আবার কোনো ঝামেলা হয়েছে!”
“কোনো ঝামেলা হয়নি বাবা। আমার বয়স এখন তেরো এবং আমি নিজের ডিসিশন নিজেই নিতে পারি।”
“খুব পাকা পাকা কথা শিখেছো না?”
“হ্যাঁ শিখেছি। এখন রাখলাম, সকালটা উপভোগ করতে হবে।”

ফোন রেখে শেফা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

শেফার বয়স যখন ছয়, তখন তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যায়। ডিভোর্সের পর শেফা থাকতে শুরু করে তার মায়ের সঙ্গে।

ছোটবেলায় থেকেই শেফার মা রূপা তার মাথায় ঢুকিয়েছে যে, রূপক একজন চরিত্রহীন মানুষ। একাধিক মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারনেই তাকে ডিভোর্স দিয়েছিল রূপা। এ কারনেই তখন থেকে বাবার এক অদৃশ্য ঘৃণা জন্ম নিতে থাকে শেফার মনে। রূপক মাঝে মাঝে শেফার সঙ্গে দেখা করতে এলেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো তাকে।

মেয়েকে খুশি করার হাজারো চেষ্টা করেছিল রূপক। কখনো তার জন্যে অসংখ্য খেলনা এনে, আবার কখনো বা ঘুরতে নিয়ে যেয়ে। কিন্তু ততদিনে রূপকের প্রতি জন্ম নেওয়া ঘৃণা শেফার মনে ছড়িয়ে পড়েছে।

হঠাৎ করেই শেফার ফোনটা বেজে উঠলো। মায়ের নামটা ভেসে উঠেছে মোবাইলের স্ক্রিনে।

শেফা ফোন তুলে ক্লান্ত গলায় বলল, “কী হয়েছে মা?”
রূপা অস্থির গলায় বলল, “তুই কিন্তু আমাকে ভুল বুঝেছিস। আমি তোকে বুঝিয়ে বলতে পারি আসলে কী হয়েছে।”
“আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।”
“তুই যা দেখেছিস, সেটা ভুল।”
“আমি আমার নিজের চোখ দিয়ে ভুল দেখেছি? এটাই বোঝাতে চাচ্ছো?”
“তুই আমার কথাটা শোন…”
“আমি রাখছি।”

শেফা তৎক্ষণাৎ ফোন রেখে দিলো।

গতকাল সন্ধ্যায় নিজের ঘরে বসে অলস সময় কাটাচ্ছিল শেফা। তখন তার ঘরে এসে রূপা কি যেন একটা মেইল পাঠাতে বলল। রূপা তার ফোনটা শেফার হাতে দিয়ে চলে গেল।

শেফা খেয়াল করে, একটা লোক অনবরত তার মাকে এসএমএস পাঠাচ্ছে। মানুষের ব্যাক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর স্বভাব শেফার নেই। তবুও নিজের অজান্তে সেই এসএমএসে চাপ পরে গেল।

নিজের অজান্তে এসএমএসে চাপ পরাটা তার জীবনের সবথেকে বিশ্রী ঘটনা। শেফা দেখল, লোকটা রূপার সঙ্গে তোলা কয়েকটা ছবি আবার রুপাকেই পাঠিয়েছে। সেগুলো কোনো স্বাভাবিক ছবি নয়, আপত্তিকর ছবি। ছবিগুলো এতটাই আপত্তিকর যে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না শেফার পক্ষে।

হঠাৎ তার মনে পরল, ছবিগুলোর নিচে কী লেখা সেটা একবার পড়া উচিত। ছবিগুলোর নিচে লোকটা লিখেছে, “মনে আছে, এই ছবিগুলোর কারনেই তোমার সংসার ভেঙ্গে গেছিল? আমাদের কিন্তু আবার সময় কাটানো উচিত। এখন তো আর তোমার সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার ভয় নেই! হা, হা, হা।”

লেখাগুলো পড়ে শেফার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে, মাথা ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরছে, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।

এরই মধ্যে রূপা এসে বলে, “কিরে, পাঠিয়েছিস মেইল?”

শেফার মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না। ফোনটা বিছানার ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালো সে।

তখন রূপার চোখ পরল ফোনটার স্ক্রিনের দিকে।

সবকিছু বুঝতে পেরে রূপা আতঙ্কিত গলায় বলল, “শেফা, আসলে হয়েছে কি…”
শেফা তাকে থামিয়ে দিয়ে শীতল গলায় বলল, “মা আমি নানির কাছে যাবো।”
“আমার কথাটা শোন আগে।”
“প্লিজ ডোন্ট ইন্সিস্ট মি টু লিভ উইথ ইউ।”

শেফা এখনো দাড়িয়ে আছে বারান্দায়। তার নানির বাসার দারোয়ান হঠাৎ বারান্দায় এসে থমথমে গলায় বলল, “ভাইজান আসছে আপনের লগে দেখা করতে?”
শেফা কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “কোথায় বাবা?”
“নিচে, গাড়িতে বইসা আছে?”

শেফা সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে এলো। বাবার কালো রঙের গাড়িটা দাড়িয়ে থাকতে দেখে অদ্ভুত এক শান্তি কাজ করলো তার মধ্যে।

শেফা গাড়িতে উঠতেই রূপক ব্যস্ত হয়ে বলল, “মাস্ক কই?”
“এইতো হাতে।”
“হাতে কেন? পরো!”
শেফা মাস্ক পরতে পরতে বলল, “নিজেই ড্রাইভ করে আসলে?”
“হুঁ, ড্রাইভার সাধারন ছুটির আগেই বাড়ি চলে গেছে।”
“কতদিন পর বের হলে বাসা থেকে?”
“প্রায় তিন মাসের কাছাকাছি। আমি তো ভয়ে বাসা থেকে বেরই হতে চাই না। তুমি এখানে কী এমন মহৎ কাজ করছো, দেখতে চলে এলাম।”
শেফা ঠোঁটে বিচিত্র হাসির আভাস নিয়ে বলল, “তুমি অনেক ভালো, বাবা।”
“দেখা করতে এসেছি বলে ভালো হয়ে গেলাম না-কি?”
“তা, না। তুমি অল্টুগেদার অনেক ভালো।”
“হঠাৎ এটা মনে হলো কেন?”
“আমাকে সত্যিটা বলোনি কেন?”
“কোন সত্যি?”
“আমাকে এতগুলো বছর মিথ্যার মধ্যে বসবাস করতে দিলে কেন? সত্যকে কখনো গোপন রাখা যায় না, একদিন না একদিন তা সবার সামনে চলে আসেই।”
“তুমি কী বলতে চাইছো শেফা? আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পরছি না।”
শেফা দু চোখের কোণে দু এক ফোঁটা অশ্রু নিয়ে বলল,“তোমাদের ডিভোর্সের কারন তুমি ছিলে না, তাই না?”

শেফার এই প্রশ্ন শুনে রূপক স্তম্ভের আকার ধারন করলো।

বেশ অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, “কিভাবে জানতে পারলে?”
“আগে আমার প্রশ্নটার উত্তর দাও! ডিভোর্সের কারন মা ছিলো না?”
“হুঁ।”
“আগে বলোনি কেন আমাকে? আমি লিটেরালি ঘৃণা করেছি তোমাকে। নিজে জানতে না পারলে হয়তো সারাটা জীবন তোমাকে ভুল বুঝে যেতাম! কেন বলোনি?”
রূপক আহত গলায় বলল, “কারন আমি চাইনি তুমি সারাটা জীবন তোমার মাকে ঘৃণা করো।”
“কিন্তু এখন তো করছি!”
“নিজের মাকে ঘৃণা করার কোনো অধিকার তোমার নেই শেফা।”
“তোমার ইমোশন নিয়ে খেলেছে সে।”
“তাতে তোমার কি? তোমার ইমোশন নিয়ে তো আর খেলেনি। তুমি তাকে ঘৃণা করতে যাবে কেন?”
“এটা তুমি বলছো?”
“হুঁ বলছি। কারন তোমাকে পৃথিবীতে আনার জন্য মানুষ কী পরিমাণ কষ্ট করেছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

শেফা চুপ করে রইলো। চোখ বেয়ে তার অনবরত জল পরছে।

রূপক আবার বলল, “শুধুমাত্র আমার জন্যে তোমার একটা মানুষকে ঘৃনা করার কোনো প্রয়োজন নেই শেফা। তার ওপর আমার তো কোনো রাগ নেই। তুমি কেন অযথা রাগ নিয়ে বসে থাকবে?”
“আমি জানি না কখনো মাকে ক্ষমা করতে পারবো কিনা!”
“তোমাকে ক্ষমা করতে হবে কেন? তোমার সাথে তো আর অন্যায় কিছু হয়নি। যা হয়েছে আমার সাথে হয়েছে।”
“তুমি মাকে ক্ষমা করে দিয়েছ?”
“দিয়েছি।”
“কেন?”
“একটা মানুষের ওপর সারাটা জীবন রাগ পুষে রেখে আমার লাভটা কী?”
“আমার এখন কী করা উচিত?”
“এসব ভুলে যাওয়া উচিত।একে অপরের গুণগুলোকে বড় করে দেখা এবং দোষগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়াই যে যেকোনো সম্পর্কের মূলমন্ত্র।”
“সেই মুহূর্তে তুমি কি দোষগুলো পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলে?”
“না। পাশ কাটিয়ে যেতে পারিনি বলেই তো ডিভোর্সের মতো কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সম্পর্কের এই ছোট ছোট মন্ত্রগুলো যে মেনে চলতে পারে, দিনশেষে সেই কিন্তু প্রকৃত সুখী।”
“আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”
“তোমার আসল বাসায়। এখানে থেকে নিরপেক্ষ হয়ে আর কাজ নেই।”
শেফা হেসে বলল, “নানা-নানি তোমাদের কাউকেই সাপোর্ট করে না। কিন্তু এখন আমি তোমাদের দুজনকেই সাপোর্ট করতে পারি।”
“দ্যাটস এ গুড আইডিয়া!”

বাসায় ফিরে শেফা দেখল, রূপা আহত মুখে ছাদের এক কোণে বসে আছে। শেফা গিয়ে তার বসল। এতে রূপা একটুও অবাক হলো না। যেন এতক্ষন শেফার জন্যেই অপেক্ষা করছিল সে।

রূপা ব্যাথিত গলায় বলল, “আমি অনেক খারাপ না?”
শেফা চুপ করে রইলো।
রূপা বলল, “সাত বছর আগে যখন আমাদের ডিভোর্স হয়, তখন আরও বেশি খারাপ ছিলাম। কিন্তু আমি তো সারাজীবন খারাপ থাকতে চাইনি। একটু একটু করে ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছি। চেয়েছিলাম পৃথিবীর সেরা মা হতে। তোকে সারাজীবন নিজের কাছে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম।”
“এজন্যেই বাবার নামে এতগুলো মিথ্যে বলেছিলে?”
“হুঁ। তোকে হারানোর ভয়টা আমার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু হারিয়ে ফেললাম তো।”
“মা, তুমি কিন্তু আমার বেস্টফ্রেন্ড। বেস্টফ্রেন্ডরা সবসময় বেস্টফ্রেন্ডই থাকে।”
রূপা চমকে উঠে বলল, “এসব ভুলে ক্ষমা করতে পারবি আমাকে?”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শেফা বলল, “পারবো।”

(সমাপ্ত)

পরিতৃপ্তি – লেখকের নাম : মুজিবা সামিহাত

0

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগষ্ট_২০২০

গল্পের নাম : পরিতৃপ্তি
লেখকের নাম : মুজিবা সামিহাত
ক্যাটাগরি : রোমান্টিক

সময়টা ছিলো বর্ষার একটি ম্রিয়মান বিকেল। এ সময় আকাশে মেঘ জমে ছিল। মনে হচ্ছিল সারা আকাশে মেঘের রাজ সমারোহ। পৃথিবীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বৃষ্টি। সারাদিন একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়েছিল। তবে, বিকেলে থেমে গেল বৃষ্টি। তা আমার জন্য খুব ভালোই হয়েছে। আজ সারাদিনই দোলনায় বসে পা দোলানো হয়নি। আমি ঝটপট রান্নাঘরে গিয়ে এক মগ চা বানিয়ে নিলাম। চা আমার এককাপ হলে চলে না। একমগ চা না খেলে চায়ের তৃপ্তি পাইও না। তার উপর আজ আরো দগ্ধ বৃষ্টি। এই সময়টাতে তো চায়ের মজা আরো জমবে।
আমি বারান্দার পাশে রাখা দোলনায় গিয়ে বসলাম। একহাতে একটি বই অপর হাতে চায়ের মগ। এই সময় আকাশ দেখা খুবই আনন্দের। আকাশের মেঘগুলো একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে দৌড়ে বেড়ায়। কিছুটা অন্ধকার হয় আবার কিছুটা আলোয়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বইয়ে মনোযোগ দিলাম। কখন যে আমার পাশে রুসাইফ ভাই এসে দাঁড়িয়েছে নিজেও জানি না। চা যখন শেষ হলো, মগটা রাখতে গিয়েই দেখলাম। দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভেবেই চলেছে। আমি সচরাচর সব বড় ভাইদের ভয় করি। তাদের সামনে যাই না। তেমন কথা বলি না। আমি তাকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে চলে যাচ্ছিলাম।
“শুন মাইরা! কাল মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিবি। কেমন?”
আমার চলে যাওয়া দেখেই রুসাইফ ভাই বলে উঠলেন।
“কেন? আপনি কি আমাদের মাদ্রাসায় জয়েন হবেন নাকি?”
“তোকে এত কথা বলতে হবে কেন? ডেকে নিতে বলেছি নিবি। ব্যাস।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।” রুসাইফ ভাইয়ের কটমট উত্তর দেখে বিরক্তি নিয়ে আমি বাড়ির ভেতর চলে গেলাম।
ঝিরিঝিরি শব্দে বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশটা কালচে রং ধারণ করে আছে। রুসাইফ হাঁটছে আপন মনে। বৃষ্টির পানিতে ভিজেও যাচ্ছে। তবুও, এসবে তার কোনো খেয়াল নেই। সে ভাবছে আগামী দিনের পথচলার কথা। তখন আর এভাবে এলোমেলো হয়ে একা একা হাঁটা যাবে না। পাশে থাকবে তার মনের অপরূপা। নীল শাড়িতে তাকে বেশ লাগবে। খোলা চুলে থাকবে না। খোলা চুল রুসাইফের পছন্দ না। সে থাকবে হিজাব পরিহিতা। মুখটা একদম গোলগাল লাগবে। দেখলেই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হবে। ইশ! ভাবতেই কেমন যেন অনুভুতি হয়। ভাবতে ভাবতে রুসাইফ বাসায় এসে পৌঁছালো। কলিং বেল বাজাতেই রুমা দরজা খোলে দিল। রুমা হচ্ছে রুসাইফের ছোট বোন। রুসাইফের ভাষায় সে একটা দাজ্জাল রাণী। রুমা রুসাইফের অবস্থা দেখে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠে—
“বাহ্ বাহ্ বাহ্! রাজপুত্তুর কী সুন্দর করে ভিজে এসেছে। সকাল সকাল তো একগাদা কাপড় পরিস্কার করলাম। তা এখনের গুলো কে করবে শুনি? কাজের মেয়ে পেয়েছেন আমাকে? হ্যাঁ!
চুপ করে আছেন কেন? উত্তর দেন।”

“আরে আজব তো! বাহির থেকে আসলাম। ভাইটা ক্লান্ত হয়ে আসল। আর তারে বসতে দিবি, রেস্ট করতে বলবি, ফ্রেশ হতে বলবি, তা না করেই উল্টো বকছিস?”

“বয়ে গেছে আমার। মা পুত্রের যা যা ইচ্ছা কর। আমি এর মধ্যে নাই বাবা।”

“করবই তো আপু।”

“একদম আপু বলবি না, যা ভেতরে যা।”

“আমার মিষ্টি আপুটা।” রুসাইফ আদরের সুরে কথাটি বলে দৌড় দিল।

আর রুমা বড় ভাইয়ের আচরণ দেখে হেসেই যাচ্ছে।
রুসাইফের পরিবারে বাবা নেই। মা, রুসাইফ আর রুমা মিলে তাদের ছোট্ট একটি সুখী পরিবার।
সকালের রোদ্দুর চোখে পড়তেই হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি। উফ্ আজ নামাজটাও বাদ গেল। কী যে শয়তানের পাল্লায় পড়লাম কে জানে! রাতে ঘুম আসে না। জানালা দিয়ে রোদের ঝলকানি উপচে পড়ছে। ধানের শিষ গুলো কতই না মুগ্ধকর দেখাচ্ছে। সবুজ সবুজ রূপে সজ্জিত যেন এক সবুজে ঘেরা রূপমহল। তাতে যে বৃষ্টি বিন্দু জড়িয়ে আছে, তা যেন এক একেকটি মুক্তার পাথর।
প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে গেলে মাথার মগজগুলোই পানি হয়ে যাবে আমার। সবকিছুর ভাবনা একপাশে রেখে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম। দেখছি আম্মু নাস্তা রেডি করছে। তাই চুপচাপ গিয়ে টেবিলে বসে পড়লাম। দেরি করা চলবে না আজ। রুসাইফ ভাইকেও ডাকতে যেতে হবে। আরেক ঝামেলা।

“কী রে কী ভাবিস এত?”

“মা তাড়াতাড়ি দাও। আমি খেতে খেতে টিফিন বক্সটাও রেডি করে দাও। আজ সকাল সকাল যেতে হবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। আমি রেডি করছি।

আমি আম্মুর গাল টেনে দিয়ে বললাম-
” ভালো আম্মুটা আমার।”

“হুম আর ঢং করতে হবে না আপনার।”

এই বলে আম্মু টিফিন রেডি করতে চলে গেল।
আর আমি খাচ্ছি আর ভাবছি, আমার মা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মা। অবশ্য পৃথিবীর সব মা’ই ভালো হয়। আমার মা সবার থেকে আলাদা। ভালোবাসে অনেক বেশিই। পৃথিবীতে মা নামক প্রাণীটা না থাকলে বুঝাই যেত না নিঃস্বার্থ ভালোবাসা কাকে বলে!
ভালোবাসার চাদরে সবসময় আগলে থাকুক পৃথিবীর সকল মা’ই। মা-রাই সবসময় নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে তাদের সন্তানদের। কিন্তু আজকাল বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রম নামে এক কীটনাশক সংস্থার প্রচলন আছে। যেখানে বৃদ্ধ বৃদ্ধ বাবা-মাকে সন্তান রেখে আসে। আহ! তাদের বেদনাহত চেহারা দেখলেই চোখ জ্বলে পানি আসে। জ্বলতে থাকে চোখগুলো। ভাবতে থাকে মন, কীভাবে বাবা-মাকে আলাদা করে রাখতে পারে সন্তান। এখানে সবাই প্রযোজ্য নয়। কিছু কিছু সন্তানই এসব কর্মকাণ্ড করে। যাদে নূন্যতম মায়াবোধ আর দয়া নেই। তারা এককথায় আমার ভাষায় বিবেকহীন, অভদ্র সম্প্রদায়। ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখে পানি এসে গেছে টেরও পাইনি।
মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল-
” কীরে কান্না করছিস কেন?”
আমি মাকে খুব করে জড়িয়ে ধরে বললাম-
“মা আমি কোনোদিনও তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না। ভাইয়া যদিও তোমাকে ছেড়ে দেয়, তাহলে তুমি আমার সাথে থাকবা। কেমন?”
” আরে পাগলী মেয়ে আমার। আচ্ছা থাকবো সারাজীবন তোর সাথে। এবার কান্নাকাটি থামিয়ে ড্রেস পড়ে আয়। তোর না আবার রুসাইফকে ডাকতে যাওয়ার কথা?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ভুলেই গেছিলাম। ”
এই বলে রুমে এসে তাড়াতাড়ি ড্রেসটা পড়ে উপরে কালো বোরকাটা জড়িয়ে নিলাম। ছোট স্কার্ফটা মাথায় ঘুরিয়ে পেচিয়ে বেঁধে নিকাবটা পড়ে নিলাম। ব্যাস রেডি!
টিফিন বক্সটা হাতে নিয়ে কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে।
দিগন্ত মাঠ পেরিয়ে বাতাসের হাওয়া খেতে খেতে আপন মনে এসে দাঁড়ালাম রুসাইফ ভাইয়ের বাসার সামনে।
” রুমা আপু, ও রুমা আপু শুনছ?
ভাইয়াকে একটু ডেকে দাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
পিছন থেকে রুমা আপু এসেই কান টেনে দিল। আর বলল-
“ফাজিল, এতক্ষণ পরে তোর আসার সময় হলো? ওই যে আসতেছে। তুই হাঁটা ধর। যাহ।”
“বুঝনা কেন তুমি? একটু আরাম করে করে আসি আরকি। হিহিহিহি। ” বলেই দৌড় দিলাম। না হলে আবারো কানটানা খেতে হতো।
” দুষ্টু একটা।” রুমা আপু এই বলে চলে গেল বাসার ভেতরে।
দিঘির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আমি আর রুসাইফ ভাই। দিঘির স্বচ্ছ জলে নিজের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে। এ দৃশ্য মুগ্ধকর।

কবিরা বলে না, হে মেঘ! কাছে এসে ছুঁয়ে দাও আমায়। কিন্তু আমি তা বলব না। আমি বলবো, হে দিঘির স্বচ্ছ জল! কাছে এসে ছুঁয়ে দাও আমায়। আমি তোমার জলে আমার শরীর মিশাবো। মিতালি গড়বো তোমার সাথে।
” মাইরা! দেখেছ দিঘিটা কত সুন্দর লাগছে। সারা গায়ে যেন নীলের ছোঁয়া। অপরূপে ভরা। ”
রুসাইফ ভাইয়ের আচমকা দিঘির বর্ণনা দেখে আমি থেমে গেলাম।
“কি হলো? থেমে গেলে যে?”
আমি আবার চলতে চলতে বললাম-
“দিঘির গায়ে যদি সবুজের বিচরণ থাকতো তবে তার সৌন্দর্য আরো বাড়তো।”
” মাইরা তুমি সত্যিই অন্যরকম। যেখানে সব মানুষের নীল পছন্দ। সেখানে তুমি সবুজ রঙের সৌরভ খোঁজে বেড়াও!”
হঠাৎ করে রুসাইফ ভাইয়ের তুমি করে বলাটা কেমন যেন লাগলো আমার। কেমন জানি লজ্জাও পাচ্ছিলাম এভাবে পাশাপাশি হেঁটে যেতে। হঠাৎ রুসাইফ ভাই আমার বাম হাতটা ধরলেন। আমি মুহুর্তের জন্য কেঁপে উঠলাম। অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শরীরে। আমি কিছু বলার আগেই রুসাইফ ভাই বলতে শুরু করলেন-
“জীবন আমাদের অদ্ভুত মাইরা। আমরা একান্ত ভাবে যা চাই তা পাই। জানো, তার জন্য অনেক ধৈর্য লাগে। তুমি যখন বড় হয়েছ তখন থেকেই তোমাকে আমার ভালো লাগে। তোমার প্রতিটি কর্মকাণ্ড দেখে আমি প্রতিনিয়তই অবাক হয়। আম্মুকে তোমার কথা বলি। পরে আম্মু তোমার আম্মু আর ভাইয়াকে বলে। আমাদের বিয়েটা আগামী শুক্রবারেই হবে। তোমাকে কিছুই জানানো হয়নি। কারণ তুমি এখনো অবুঝ। বিভিন্ন ধারণা তোমার মাথায় এখন। তাই আমিই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার। মাইরা! আমাকে কি তোমার পছন্দ নয়?”
আমি এতক্ষণ শুনছিলাম রুসাইফ ভাইয়ের কথাগুলো। মনে হচ্ছিল এখনো স্বপ্নের মাঝে আছি। এ স্বপ্ন যেন যেই সেই স্বপ্ন নয়। এখানে আছে একটা রূপদেশ। যেখানে দাড়িয়ে রাজকুমার তার প্রেয়সীকে অনুভব করেই তার মায়াভরা কন্ঠে বলে যাচ্ছে ভালোলাগার পরশ।
এখানে হৃদয়ের ঝরা পালকগুলো শিহরিত হচ্ছে বারবার।
” এই মাইরা! কোথায় হারালে?”
” না না। ঠিক আছি। আমার কেমন কেমন যেন লাগছে রুসাইফ ভাই।”
“ভাই ডাকা লাগবে না আর। ভালোবাসবা খুব। সকল অনুভূতি শেয়ার করবা। ভালোবেসেই একটা নাম দিবা। কেমন?”
” দেরি হয়ে গেছে। হয়তো ক্লাসও শুরু হয়ে গেছে আমার।”
“কিছুই হবে না। চলো আজ ঘুরে আসি!”
“হুম। ”
আমরা দু’জনে মুঠোবন্দী হাতে হাত রেখে হেঁটে যাচ্ছি ঘাসপাতার উপর পা ফেলে। হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। কৃষ্ণচূড়ার সৌরভ ভেসে আসছে রহিম চাচার পুকুর পাড় থেকে।
একজোড়া কোকিল পাখি মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে কুহু কুহু আওয়াজে গানের সুর তোলে।
আমার হাতটা আরো শক্ত করে ধরলেন রুসাইফ।
আমিও একদম আষ্টেপৃষ্ঠে ঝড়িয়ে নিলাম হাতটাকে। কাঁধের উপর মাথা রাখলাম। এ যেন অপরিসীম এক পরিতৃপ্তি।
জীবনের আলো এসেছে। মনের পরিতৃপ্তি জমা হয়েছে। প্রজাপতির ডানার সৌন্দর্য অবলোকন করে আমরা হাঁটছি। দু’জনের চোখে চোখ রেখে হাসছি মাঝেমাঝে। আকাশটাও আজ লজ্জা পাচ্ছে আমার আর রুসাইফের পরিতৃপ্তি অনুভব করে।
আমি গুনগুনিয়ে বলে উঠলাম-
হে আকাশ! আমি তোমার মত করে আমার রুসাইফের ভালোবাসা পেতে চাই।
” হে আকাশ! তুমি জানিয়ে দাও, আমার প্রিয়তমাকে ভালোবাসার জন্য আমি তোমার চেয়ে প্রচেষ্টায় আছি। তুমি নিশ্চিন্তে তাকে আমার বাহুডোরে আসতে বল।”
নিঃশব্দে দু’জনের কপাল এক করলাম।
চোখ বুঝলাম। হারিয়ে গেলাম আবার সেই পঙ্কিলতার দেশে। উড়ন্ত শালিকের বেসে উড়ে বেড়াচ্ছি। দেখছি দু’জনে পরস্পরের মনের আকাশ। পরিতৃপ্তির আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো দেহমনে। আলোকময় হয়ে উঠছে আঁখিযোগল। ঠোঁটে অস্ফুট হাসি।
মৃদুস্বরে রুসাইফ গেয়ে উঠলো-
ভালোবাসা নয় তোমার জন্যে
শুধু আজকের দিনে,
ভালোবাসায় তুমি মিশে আছ
মিশে রবে প্রতিক্ষণে।
আমার মাঝে অন্য রঙে
মন বলছে তাই তোমাকে…..
তুমি ভালোবাসার এক অন্য জগৎ
প্রতিটা বেলায় ভালোবাসার দিবস,
হাসিতে কত সুর বাজে মনে
এতটুকুই বুঝি ভালোবাসার মানে…।