গদি চেয়ার – লেখাঃ মালিহা তাবাসসুম

0
620

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০

গল্পঃ গদি চেয়ার
লেখাঃ মালিহা তাবাসসুম

মধ্যদুপুরের রোদের তেজ ক্রমশ বাড়ছে।একচালা কুড়ে ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে সে। জীবনের মাঝপথে এসে শত ছিন্ন জীবনে নতুন করে আবার বড় আকারের বিচ্ছিন্নতা দেখা দিল। এতোদিন যাও জোড়াতাড়া দিয়ে চলছিল, এখন আর সেটাও হচ্ছে না। কিন্তু বহুকালের পোড় খাওয়া মানুষ আইজুদ্দিন। মা আদর করে ডাকতো, বাবা আইজু। গত পাঁচ বছর হলো মা মারা গিয়েছেন। এখন আর কেউ এমন আপনার করে ডাকে না, বাবা আইজু! তুমি আইছো?

মার কথা মনে পড়ায় চোখের পলকে সে চলে গেল ছেলেবেলায়।বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ করে মা যখন এসে ভাত বসাত, বালক আইজুদ্দিন তখন ভাতের চুলার পাশে খেলত পাশের ঘরের রইস, মোখলেছ আর আউয়ালের সাথে। কোনোদিন বরফপানি, কোনোদিন ছোঁয়াছুঁয়ি। একদিন ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে গিয়ে আউয়াল পড়ে গিয়ে বাম পায়ের আঙুল কেটে ফেলছিল। এতো রক্ত পড়ছিল, আইজুদ্দিনের মা নিজের শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে সেখানে বেধে দেয়। সেদিনের ঘটনা যেন! রইস, আউয়াল, মোখলেছ এদেরকে এই জাদুর শহর কই নিয়ে গিয়েছে তা জানা নেই আইজুদ্দিনের।
-আব্বা, এই বড় গদি চেয়ারডা আমার লাইগ্যা রাখবা?
ছেলের কথায় বাস্তবে ফিরে এল সে। আইজুদ্দিনের ছেলে ফরহাদ। বয়স মাত্র ছয়। ছেলে কি বলেছে ঠিক করে শুনতে পায়নি সে। তাই জিজ্ঞেস করল, কি কইলি?
– কইতাছি এই গদি চেয়ারডা আমার লাইগ্যা রাইখ্যা দ্যাও।
-চেয়ার দিয়া কি করবি?
-এই চেয়ারে বইলে আমারে রাজপুত্তুরের লাহান দ্যাহায়। দ্যাহো আব্বা, দ্যাহো!

ছেলের নির্মল হাসি দেখে সহসা খুশি হয়ে উঠলেও কাস্টমারের কাছে বিক্রির জন্য বানানো চেয়ারটা যে ছেলের জন্য রাখা যাবে না সেটা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল তার। মাত্র তিনদিন পর কাঠের ওপর লাগানো বার্নিশটা শুকালেই বিশাল রাজকীয় চেয়ারটা চলে যাবে এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সামাদ চৌধুরীর ঘরে। শুধু এই চেয়ারটাই নয়, এই রকম ছয়টা চেয়ার আর একটা ডাইনিং টেবিলের সেটটার পুরোটাই তাদেরকে দিয়ে দিতে হবে। ছেলের কথায় ভীষণ মায়া লাগলেও করার কিছুই নেই আইজুদ্দিনের। একটা ফার্নিচারের দোকানের কর্মচারী সে।দোকানের নাম দি মুন ফার্নিচারস। তার মতো আরো তিনজন কর্মচারী, দুইজন ফুলমিস্ত্রী আছে দোকানটাতে। ফুলমিস্ত্রী হলো যে কাঠের ফার্নিচারের ওপর ফুল, পাতা এসবের নকশা করে। দোকানের মালিক ইমতিয়াজ খান। নিজের পৈতৃক সম্পদ বড় রাস্তার পাশের জায়গাটুকুতে দোকান তুলে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। নিজে দোকানে সামান্যতম কাজ না করেও শুধু মালিক হওয়াতে ফার্নিচার বিক্রির লভ্যাংশের মূল অংশটাই যায় ইমতিয়াজ সাহেবের পকেটে। আইজুদ্দিনের মতো কর্মচারীরা শুধু মাস শেষে একটা নামমাত্র বেতন পায়৷ যে বেতন দিয়ে ছেলে তাহেরের পছন্দের গদি চেয়ার কেনাটা বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়।

অভাবের তাড়নায় ছেলের বয়স মাত্র ছয় থাকতেই তাকে কাঠের দোকানে নিয়ে আসে সে।
বাবার সাথে সাথে সেও কাঠ আনা নেওয়ার মতো টুকটাক কাজ করে। এভাবে একটু আধটু কাজ করতে করতেই শিখে যাবে পুরো কাজ। তখন দুই বাপ বেটা কাজ করলে সংসারে আরেকটু স্বচ্ছলতা আসবে৷ এই ভাবনা থেকে সে যে ছেলেকে দিয়ে সে শুধু যে কাজই করাচ্ছে তা নয়। ছেলেকে একটা প্রাইমারি স্কুলেও দিয়েছে। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে সে বাবার সাথে দোকানে কাজ করে। বিকেল পর্যন্ত কাজ করে দুই বাপ বেটা একসাথে বাড়ি ফিরে। কখনো কাজের চাপ বেশি হলে রাতও হয়ে যায় ফিরতে ফিরতে। বাড়ি এসে খেয়ে দেয়ে ঘুম! সকাল থেকে আবার সেই একই গৎবাঁধা দিন। এভাবেই ভালো মন্দ মিলিয়ে জীবন কেটে যাচ্ছিল কোনোমতে।

কিন্তু হঠাৎ দেশে করোনা সংক্রমন শুরু হলে সারাদেশে লকডাউন করে দেওয়া হয়। মানুষের ইনকামেও এর প্রভাব পড়ে। ফার্নিচার বিক্রিও যায় কমে। আইজুদ্দিনের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য দিনযাপন আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

দিন তিনেক পরে বিকেল প্রায় চারটায় সময় সামাদ চৌধুরী ডাইনিং টেবিল নিতে আসেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী শিরিনকে নিয়ে। শিরিন এখন আগের চেয়ে বেশ সুন্দরী হয়েছে। নিত্য রূপচর্চা আর দুঃখ-দারিদ্র, দুশ্চিন্তাহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওর বয়স যেন দিন দিন কমছেই। অন্য ছেলেদের সাথে কানামাছি খেলার সময় চোখ বাধাবস্থায় ভুল করে শিরিনকে জড়িয়ে ধরেছিল আইজুদ্দিন। ভীষণ লজ্জা পেয়ে এক ছুটে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল শিরিন। সেই শিরিন! এরপর থেকে আইজুদ্দিনের বয়সী ছেলেরা ওকে শিরিনকে নিয়ে ক্ষেপাত। সেই কবেকার কথা। অথচ এখনো মনে পড়লে চাপা একটা অস্বস্তি হয়। এসব ভাবতে ভাবতেই ফরহাদ বলে উঠল, আব্বা, গদি চেয়ারটা..?!
বাকিটুকু কথা আর সে শেষ করল না। এই বয়সেই জীবনের রঙ অনেকখানি চিনে নিয়েছে যে!
ব্যাপারটা শিরিনের চোখ এড়াল না। সে ফরহাদকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, কি হইছে?
ফরহাদ কিছু বলল না। ভীত চোখে একবার বাবার দিকে, একবার চেয়ারের দিকে তাকাল।
আইজুদ্দিনই কথা বলে উঠল, কিছু হয় নাই আফা। পোলাপান মানুষ যা দেখে নিতে চায়।
আফা!! সম্বোধনটা যেন হঠাৎ দূর থেকে কাঁটার মতো বিঁধল শিরিনের। সে বয়সে আইজুদ্দিনের চেয়ে কম করে হলেও চার বছরের ছোট হবে। আর এতো তার আইজু ভাই। সে কেন তাকে আফা ডাকবে! এই সেদিনও চাঁদরাতে তারাবাতি জ্বালিয়েছে একসাথে। দূরের কেউ না তো, আইজুদ্দিন আর শিরিন সম্পর্কে চাচাতো ভাই বোন। সামাজিক অবস্থান দুজন আপন মানুষের সম্পর্ককেও যে কতোটা দূরে ঠেলে দিতে পারে তারই যেন উদাহরণ এটা। অবশ্য এসবে শিরিন অভ্যস্ত। ওর বাপের বাড়িতেও ওর এতো খাতিরযত্ন সেটা তো ওই সামাদ চৌধুরীর বউ হওয়ার কারণেই৷ অন্যরা ওকে সমীহের দৃষ্টিতে দেখছে, এটা শিরিনের কাছে বেশ উপভোগ্য একটা ব্যাপারও বটে! কিন্তু আজ কেন এতো কষ্ট হচ্ছে? শিরিন ভেবে পায় না, শৈশব কৈশোর একসাথে কাটানো নাকি আইজুদ্দিনের জন্য আগে থেকেই যে দুর্বলতা কাজ করত সেটাই ওকে পীড়া দিচ্ছে। ওসব নিয়ে শিরিন আজ আর ভাবতে চায় না। এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও বেশিক্ষণ থাকতে মন সায় দিচ্ছে না তার।

শুধু অনিন্দ্য সুন্দরীই নয়, শিরিন বেশ চালাকও। সে ঠিকই বুঝতে পারল, ফরহাদ কি চাচ্ছে৷ সে সামাদ চৌধুরীকে বলল, আমরা পাঁচটা চেয়ার নেই? ঘরে তো লোক বেশি নেই।শুধু আমি আর তুমি। ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ার কম হলে অসুবিধা হবে না।
সামাদ সাহেব মনে মনে বিরক্ত হলেও একগাল হেসে বললেন, আচ্ছা গো। বাড়িওয়ালি তুমি, তুমি যা বলবে সেখানে তাই হবে।
নিজের বয়স পঞ্চাশে এসেও সতের আঠারো বছরের সুন্দরী স্ত্রী থাকায় সামাদ সাহেব মনে মনে বেশ গর্ববোধ করেন। তার মন রক্ষারও যথাসম্ভব চেষ্টা করেন। শিরিন সেটা টের পায়৷ সেও এজন্য বেশ ভাগ্যবতীই মনে করে নিজেকে৷ সামাদ সাহেবের বয়স নিয়ে মনে যে খুঁতখুঁত লাগার কথা, সেটা বেশ একটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না এজন্য। তাছাড়া না চাইতেই শাড়ি গয়না যখন যা লাগে, তাই সে পেয়ে যায়।
শিরিন ফরহাদকে কাছে ডেকে ওকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, এই চেয়ারটা তোমার জন্য।
ফরহাদ কি করবে প্রথম বুঝে উঠতে পারে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কে এই মহিলা? উনাকে আগে কোথাও দেখেছে কি না তাও মনে করতে পারছে না সে।
শিরিন মনে মনে ভাবে, আইজুদ্দিনের সাথে বিয়ে হলে এই রকম একটা ছেলে কিন্তু তার নিজেরও হতে পারত! পর্যাপ্ত অর্থসম্পদ থাকলেও এই দিক দিয়ে অপূর্ণতা রয়েই গেছে তার৷ হয়তো বাকি জীবনটাও এভাবেই কাটবে। সামাদ সাহেব শিরিনকে কখনো নিজের মুখে বলেননি। কিন্তু শিরিন জানে, সামাদ সাহেব কখনো বাবা হতে পারবেন না। এই নিয়েও ওর মাঝে মাঝে আক্ষেপ হয়, কিন্ত প্রাচুর্যতা সে অভাবকেও ভুলিয়ে দেয় যেন!
এদিকে আইজুদ্দিনের লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা। গরীব হলেও সে কারো করুণা চায় না। আজ এই মুহূর্তে সে যদি এখানে না থাকত? কি এমন হতো যদি আজ শিরিনের সাথে এইভাবে দেখা না হতো?

তাদের অদূরে ওর শখের গদি চেয়ারটায় ফরহাদ বসে আছে। শিরিনকে নিয়ে বিস্ময় বা ওর বাবার চোখ রাঙানির ভয় নেই এখন তার চোখে। তার চোখে এখন খুশির ঝিলিক!

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে