“মমতার অন্তরায়” – লেখা:— মাইশা জাফরীন (ছদ্মনাম)

0
465

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
গল্প:— “মমতার অন্তরায়”
লেখা:— মাইশা জাফরীন (ছদ্মনাম)

বিষণ্ন মনে স্কুলের এপ্রান্তে নির্বিকার পায়চারী করছেন এক বিপত্নীক ভদ্রলোক, আশরাফ। ভগ্নহৃদয়ে তার স্ত্রীর স্মৃতিকথা ভাসমান। হঠাৎ ভাবনার ব্যবচ্ছেদ করে সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন এক সুশীলা।

“এখনও বাসায় যাননি?” প্রশ্ন করলেন ভদ্রমহিলা, স্কুলের নতুন শিক্ষিকা। নাটকীয় ভঙ্গিতে একবার পরিচিত হয়েছিলেন।

“না আসলে…।” বলতে গিয়ে প্রত্যুত্তরবিহীন হয়ে গেলেন আশরাফ। তাকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলছেন নাকি দরদমাখা উদারকণ্ঠে জিজ্ঞেস করছেন তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন। অবশ্য ভদ্রমহিলার চেহারা ভাবলেশহীন।

“মাফরুহা কে নিয়ে আবারও সমস্যা হচ্ছে? প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম কী বলেছেন?” উত্তর না পেয়ে নিজেই প্রসঙ্গ তুললেন।

“একটা দীর্ঘ নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছেন, শ’খানেক শর্তাবলী আছে। পরবর্তীতে কারো সাথে ঝগড়া হলে বা রেজাল্ট খারাপ হলে কঠোর সিদ্ধান্ত নেবেন।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আশরাফ।

“আপনি কি একটু সময় করে আমাকে ওর সমস্যাটা খুলে বলবেন?” শিক্ষিকার কথায় কিছু ভরসা পেলেন আশরাফ।
তার মেয়ে মাফরুহা প্রতিবন্ধী, প্রায়ই স্কুলের অনেক মেয়েদের সাথে মারামারি করে কারো নাক কারো মাথা ফাটিয়ে লাল তরল ঝরিয়ে দেয়। পরীক্ষার খাতায় একটা শব্দও লেখে না সে। অথচ বাকিসব কাজকর্ম সে নিরালস্য ভাবে করে। বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলী ও মেধাবী মাফরুহা কেবলই মুখ ফুটে বাক্যব্যয় করেনা, কথা বলতে পারে অথচ কোনো ধ্বনি উচ্চারিত হয় না তার মুখে কখনও। তার বিরুদ্ধে নালিশ আর অভিযোগ শুনতে প্রায় ছিয়াশিবার বাবাকে প্রিন্সিপালের মুখোমুখি হতে হয়েছে, আজ লাস্ট ওয়ার্নিং।

“ও আসলে এরকম ছিল না আগে। ওর এক জন্মদিনের রাতে আমি ডিউটিতে ছিলাম। বাসায় মায়ের সাথে ছিল ও। আগুন লেগেছিল ফ্ল্যাটে, বাঁচতে ছাদে উঠে আসে। কিভাবে জানি না কিন্তু ছাদে থাকা সুইমিংপুলে পড়ে মারা যায় তার মা। পাঁচ বছরের মেয়েটার জীবনের চাক্ষুষ ঘটনাটা সামলাতে পারে নি হয়ত। তারপর থেকেই সে বাকহারা, অস্বাভাবিক…।” দীর্ঘশ্বাসের সাথে আশরাফের মুখনিঃসৃত হয় হতাশার না দেখা অনুক্ত কথামালা।

“ফায়ার সার্ভিসে নাইট ডিউটি থাকে আপনার প্রায়ই?” ভদ্রমহিলা আবারও শুধালেন। কেন জানি তাকে এড়িয়ে চলতে গিয়েও আর পারেন না আশরাফ। মাফরুহার বিষয়ে চরম আগ্রহী তিনি।

“জ্বী।” শুধু উত্তরটুকু দিলেন। কেন যেন আশরাফ এই জিজ্ঞাবাদের বিষয়ে একেবারে নির্লিপ্ত।

“আজ রাতেও?”

“হ্যাঁ।”

“আমি কি ওর সাথে রাতে থাকতে পারি? ওকে একটু বুঝাতে পারতাম আরকি!” ইতস্তত করে বললেন শিক্ষিকা।

কিছুটা অপ্রতিভ হলেন আশরাফ। তার বাসায় মেয়ের সঙ্গ দিতে চাচ্ছেন স্কুলের শিক্ষিকা। কেমন আপত্তিকর বিষয়টা! উদীয়মান ভাবনাগুলোর উন্মেষে হতচকিত আশরাফ তাও কি মনে করে সম্মতিসূচক নিরব সায় দিলেন, তা নিজেও ভেবে পান না।

আজ মাফরুহার ষোলোতম জন্মদিন, বাবা চাকরীর খাতিরে থাকতে পারেন নি। অতি আপন এক শিক্ষিকা আছেন। আড়চোখে প্রায়ই মাফরুহাকে খেয়াল করেন। নিরব অভিভাকত্ব পালন করে যাবার ব্যাপারটা মাফরুহা খেয়াল করেছিল। কোনোদিন তাকে কেউ সহ্য না করলেও তিনি করছেন, জন্মদিনের রাতটা তাকে পেয়ে নিঃসঙ্গতা কেটে গেছে মাফরুহার।
বন্ধুভাবাপন্ন শিক্ষিকার সাথে কথা না বললেও একসাথে কার্টুন দেখল, কেক বানালো…।
স্কুলেও নতুন এসে তিনি সবার আগে এই মাফরুহার সাথে পরিচিত হতে চেয়েছেন। মাফরুহা নির্বাক, তাই অন্যকারো নাম তিনি আর পরে জিজ্ঞাসা করেন নি, আড়ালে মেয়েটি কষ্ট যেন না পায়।
পরীক্ষার দিনটাতে প্রায় সারাটা সময় তিনি মাফিরুহার পাশে থেকেছেন, ওকে প্রশ্ন বুঝিয়েছেন, লিখতে বলেছেন, যেন মেয়েটাকে প্রগতিশীল করে গড়ার নিত্য প্রয়াসী নিঃস্বার্থ অভিভাবক তাকে কত দিন ধরেই চেনে। কিন্তু মাফরুহা অটুট, নিজ অবয়বে সেই গাঢ় গাম্ভীর্যের আভায় সামান্য ভাটা ফেলেনি। প্রতীমার মত হলরুমে উপবিষ্ট থেকে কেবলই লগ্ন পেরোবার প্রহর গুনেছিল। কে জানে, সে নির্বোধ না গোঁড়ামির বসে করলো ওকাজ!
ধৈর্যে তবু শিথিলতা এলো না শিক্ষিকার। আবারও প্রতিবন্ধী হতবুদ্ধি মেয়েটার জন্য যেন নিজের ভরাডুবি করেও তিনি ক্ষান্ত নন। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কাছে এবছরেও পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করার প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। তার এই অপচেষ্টার প্রভাব সম্ভবত ক্ষীণ হলেও মাফরুহার মনে জাগরণের আন্দোলন তুলেছিল। নির্বিঘ্নে তো বটেই, বরং বড্ড আহ্লাদে তাই আজ নিঃসংশয়ে একাকী রাতের সঙ্গ করে নিয়েছিল ম্যাডামকে।
মাফরুহাকে অবশ্য তার জনক প্রায়ই বুঝাবার চেষ্টা করেছে, শিক্ষিকার সঙ্গ এড়াতে। কেন যেন তার অবিমৃষ্যকারী এই নারীর উদ্দেশ্য বোধগম্য হয়েছিল। তবু অপ্রকাশ্যে কন্যার সঙ্গ হতে বাধাপ্রদানের কোনো সুযোগ তার হয়ে উঠেনি। নিরুপায় আশরাফ আজ সেই কন্যার চিরকুটে লিখিত প্রতিশ্রুতি – “আজকে অবশ্যই আমার সাথে থেকো বাবা, আমি আজকে একা থাকতে পারবো না” পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করেও যখন সরকার প্রদত্ত প্রহরার বিকল্প করতে পারেন নি, তাই আজ এক প্রকার বাধ্যবাধকতায় অনুমতি দিয়েছেন শিক্ষিকাকে।

“কোন বাসায়?” আগুন লাগার কথা শুনে আশরাফ ঠিকানা জানতে চাইলেন সহকারীর থেকে।
আজকাল আগুন বেশি একটা লাগে না শহরে। অলস সময় পত্রিকা পড়েই কাটান তিনি। সহকর্মীরা কেউ নিরলস নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়ে, কেউ দাবা খেলে…। আশরাফের কোনোটাই ব্যাক্তিগত ভাবে পছন্দ নয়। সিগারেট খাওয়া যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর তার অবহতির লোকের অভাব না হলেও মান্য করার মত লোকের যথেষ্ট অভাব। অন্যতম লোকদের একজন আশরাফ বলে তিনি মান্যকারীর দলে থেকেছেন। আর দাবায় নেশা ধরায়। বড্ড ধর্মপ্রাণ বলেই হয়ত প্রবল ইচ্ছাটাও বুকে পাথর চেপে দমন করতে সক্ষম হয়েছেন আশরাফ।
“১৩ নাম্বার গলির ১৯/৬ ফ্ল্যাট।” উত্তর দিল সহকারী।
“আরে! এটা তো আমার বাসা!” সহসা চকিত ভঙ্গিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ান আশরাফ। দমকল বাহিনীতে কর্তব্যরত অবস্থায় তিনি দ্বিতীয়বার সংবাদটা পেয়েছেন। কে জানে, সূচনালগ্নে হারালেন স্ত্রীকে, নিয়তির নির্মম পরিহাসে যদি মেয়েটাও পটল তুলে অকালেই!
তৎক্ষনাৎ উদ্যত পদক্ষেপে তাড়াতাড়ি দমকল বাহিনী নিয়ে ছুটলেন বাসার দিকে।

আগুন থেকে বাঁচতে ছাদে উঠে আসলো মাফরুহা আর ম্যাডাম। যখন দু’টি প্রাণ নির্মম অনলের গ্রাসকারী আক্রমণ হতে বাঁচতে নিরত, মাফরুহাকে অবাক করে দিয়ে পানি টলমল সুইমিংপুলে পা পিছলে পড়ে গেলেন ম্যাডাম।
তাকে রাতের আঁধারে কালো পানিতে দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে মাফরুহা দেখলো তার বাবা সশরীরে গাড়ি সমেত উপস্থিত। আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন, ওদের ব্যাগ্র চাহনীতে প্রিয় কন্যার সন্ধান করছেন।

চেষ্টা করলো প্রাণপনে, বারো বছরের রুদ্ধ বাকশক্তিকে জাগাবার চেষ্টা করলো মাফরুহা। এদিকে ম্যাডাম মারা যাচ্ছেন, বাবা ওদিকে ব্যস্ত। কারো জীবনের তাগাদায় সে মরিয়া হয়ে উঠলো ডাকবার – “বাবা এসো, ম্যাডাম এখানে। বাঁচাও উনাকে।” লাভ হলো না।
কিন্তু জীবনের অন্তিমদশায় তার বাকশক্তির চেতন হওয়া দরকার। জানান দেয়া দরকার ওরা এখানে আছে।
মাফরুহার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কান্না বিজড়িত অতীত জন্মদিনের কালরাত্রী, তার সাঁতার না জানা জননী তলিয়ে যাচ্ছেন কালো পানির গহ্বরে। সে ডাকছে, “মা ফিরে এসো।”…
মাফরুহা আবারো সর্বাত্মক সচেষ্ট হলো, তার ষোড়শী প্রাণের উদ্দামতা কন্ঠনালীর সরু নলে প্রবেশ করলো সর্বশক্তি ব্যয়ে।
পুনরায় সবটা শক্তিব্যয় করে বলতে পারলো, “মা ফিরে এসো!”… “বাবা! মাকে বাঁচাও।”

পরিশিষ্ট:-
ইচ্ছে করেই বিধবা শিক্ষিকা ঘরে আগুন লাগিয়েছিলেন। সাঁতার জেনেও ডুবে যাবার ভানে মেয়েটার হারানো বোধ ফেরাতে চেয়েছেন তিনি। কারণ, একটা সময় তার পিতৃহীন বাকহারা কন্যা এমনি এক ঘটনায় স্কুল হতে বহিস্কৃত হবার ক্ষোভে আত্মহত্যা করে। মাফরুহাকে অবিকল তার মতই মনে হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে