“গায়ে হাত দেওয়া আমার পছন্দ না
চোখ মুখ শক্ত করে বলে মিষ্টি। জীম এতোখন আলতো করে হাত ধরেছিলো মিষ্টির কথা শুনে শক্ত করে ধরে।
” আমার আবার খুব ভালো লাগে
জীম বাঁকা হেসে বলে। তিথি বেশ ভালো বুঝতে পারছে মিষ্টি রেগে যাচ্ছে। মিষ্টি রেগে গেলে বাবার কাছে কমপ্লেন করবে আর মিষ্টির বাবা জীমকে উওমমাদ্ধম দেবেন
“জীম ছেড়ে দাও না প্লিজ
তিথি অনুরোধের সুরে বলে। জীম অন্য হাত দিয়ে তিথির মুখের ওপর পড়ে থাকা চুল গুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে মুচকি হেসে বলে
” ছেড়ে দেবো বাট ওকে আমার পাশেই বসতে হবে
মিষ্টি বড়বড় চোখ করে জীমের দিকে তাকায়। জীম বুকের বা পাশে হাত দিয়ে বলে
“কি বলেছিলাম ভুলে গেছিস? এভাবে তাকাতে না করছি। আমার নেশা নেশা লাগে। আর নেশার ঘোড়ে আমি অনেক কিছু করে ফেলতে পারি
বাস আবার স্টাট দেয়। মিষ্টি ধাপ করে আগের জায়গায় বসে। জীমও মিষ্টির পাশে বসে।
জীম মিষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। বাসের জানালা খোলা তাই মিষ্টির চুল গুলো উড়ে জীমের মুখের ওপর পড়ছে। জীম চোখ বন্ধ করে মিষ্টির চুলের ঘ্রান নিচ্ছে।
বাস কন্টাকটার বাসের ভাড়া নিচ্ছে।
মিষ্টি ভাড়া দেয় কিন্তু কন্টাকটার ভাড়া নেওয়া তো দুরে থাক মিষ্টির দিকে তাকাচ্ছেও না
” আজিব তো কখন থেকে টাকা দিচ্ছি নিচ্ছেন না কেন?
“আপনার ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে
” মানেনননন
“ফুলটুসি আমি দিয়ে দিয়েছি
মিষ্টি জীমের দিকে তাকায়। জীম ইশারায় বসতে বলে। মিষ্টি আর কথা বাড়ায় না
এইটুকু সময়ে মিষ্টি যা বুঝেছে জীম সম্পর্কে সেটা হলো জীম কথা শোনার ছেলে না। আর মিষ্টির কথার কেউ দাম না দিলে মিষ্টির ইগোতে বাধে। মিষ্টির মতে মুখের একটা কথার দাম অনেক।
মিষ্টি এসব ভাবছে
” টাকাটা দিয়ে দিতে হবে লোকটাকে। কিন্তু সাধলে তো টাকা নেবে না তাহলে? এতো এখন চোখ বন্ধ করে আছে এখন পকেটে ঢুকিয়ে দেয়
যেই ভাবা সেই কাজ। মিষ্টি টুক করে জীমের পকেটে একশো টাকার একটা নোট ঢুকিয়ে দেয়। ভাড়া হলো বিশ টাকা কিন্তু মিষ্টির কাছে ভাংতি টাকা নাই। তাই একশোই দিলো। যদিও মনের মধ্যে খচখচ করছে আশি টাকার জন্য। চার দিন ভাড়া দিতো পারতো। মিষ্টি মন খারাপ করে বই বের করে।
জীম বুঝতে পেরেছে জীম টাকা দিয়েছে কিন্তু জীম কিছু বললো না। কারণ জীম এটাই চাইছিলো মিষ্টি ওকে টাকা দিক।
কলেজের সামনে এসে বাস থামে। মিষ্টি তারাহুরো করে নামছে
“তিথি তাড়াতাড়ি চল। ক্লাস মিছ হয়ে যাবে
” এই ফুলটুসি পড়ালেখা তো কতোই করলে এবার বখাটেটার দিকে নজর দাও
মিষ্টি বাস থেকে নেমে বলে
“বাপি পারমিশন দিলে নজর দেবো
মিষ্টি মুচকি হেসে চলে যায়।
জীম এই প্রথম মিষ্টির হাসি দেখলো। অপূর্ব লাগে হাসলে মেয়েটাকে। জীবনে অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করোছে কাছ থেকে দেখেছে কিন্তু মিষ্টির মতো কাউকে দেখে নি।
” কি হচ্ছে আমার সাথে এটা? এই ফুলটুসি দেখি আমাকে জাদুটাদু করে ফেলবে।
এসব ভাবতে ভাবতে বাস থেকে নামে।
“মে আই কাম ইন স্যার
ইফাদ মিষ্টির আইসিটি স্যার। আজ মিষ্টির দশ মিনিট লেট হয়েছে। স্যার পড়ানো শুরু করেছে।
” আরে মিষ্টি আজ লেট। কখনো হয় না
মিষ্টি ছিটে বসতে বসতে বলে
“বাসের জন্য লেট হলো
” আচ্ছা
মিষ্টি আর তিথি বসে। স্যার পড়ানো শুরু করে। তিথিও সুন্দর ভাবে পড়া দেয়
পড়া শেষে ক্লাস করে। সব শেষে মিষ্টি দাঁড়িয়ে আছে বসের জন্য বাসায় যাবে। তিথি বফের সাথে মিট করতে গেছে। জীম কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টির থেকে খানিকটা দুরে। বাস আসলে আবার মিষ্টির পাশে বসবে। বাইকটা জীমের সাঙ্গ পাঙ্গদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।
রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে মিষ্টির মোটেও ভালো লাগছে না। কিন্তু বাসের খবর নেই। এখন এতো আমাদের এখানকার বাসের অবস্থা। যখন থাকে দুই তিনটা একসাথে থাকে যখন থাকে না একটাও থাকে না।
জীম কখন এভাবে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে নি। আজ থাকছে মিষ্টির জন্য। কড়া রোদ ও জীমের খুব ভালো লাগছে।
“মিষ্টি
মিষ্টি পেছনে তাকিয়ে দেখে ইফাদ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
” স্যার আপনি
“হুমম চলো ড্রপ করে দিচ্ছি
” না না ইটস ওকে
“বাপি রাগ করবে না বরং খুশি হবে
ইফাদ মুচকি হেসে বলে। মিষ্টি আমতাআমতা করছে
” তাহলে কি তোমার বাপিকে ফোন করবো
ইফাদ পকেট থেকে ফোন বের করতে যায়। মিষ্টি আটকিয়ে বলে
“না না থাক
“তাহলে চলো
ইফাদ মুচকি হেসে ফোন রেখে যায়।
মিষ্টি ইফাদের কাঁধে হাত রেখে বাইকে ওঠে
” যাওয়া যাক
“হুম
মিষ্টি কে একটা ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে জীমের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। তারপর মিষ্টিকে লোকটার বাইকে উঠতে দেখে জীম হাত মুঠ করে ফেলে।
” কাজটা ঠিক করলে না ফুলটুসি। এই ছেলেটারে তো জানে মেরে দেবো।
জীম রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায়।
“মিষ্টি
বাইক চালাতে চালাতে বলে ইফাদ।
” হুম
ইফাদ কিছু বলছে না। একটু আগে কড়া রোদ ছিলো কিন্তু এখন শিতল হাওয়া বইছে। রোদের আঁচ বেশ খানিকটা কমেছে। দুইধারে গাছ মাঝখানে রাস্তা। নির্জন। মাঝেমধ্যে দুই একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে।
ইফাদের খুব ভালো লাগছে। ইফাদের মনে হচ্ছে সময়টা যদি এখানেই থেমে যেতো।
মিষ্টির কেমন কেমন লাগছে। যদিও মাঝেমধ্যেই ইফাদের বাইকে আসে। ইফাদ মিষ্টির বাবার খুব পছন্দের একজন মানুষ। মিষ্টি মনে মনে ভাবছে রাস্তাটা কি আজ একটু বেড়ে গেলো না কি? কখন পৌছাবো আর কখন বাইক থেকে নামবো।
অবশেষে বাড়ি পৌছে যায়। মিষ্টি লাফ দিয়ে নামে
“মিষ্টি বাসায় যেতে বলবে না
ইফাদ লোকটা বেশ খানিকটা গায়ে পড়া। নিজে নিজেই বাড়ি যাওয়ার কথা বলছে। যদিও মিষ্টির ওনাকে বাড়ি নেওয়ার বিন্দু মাএ ইচ্ছে নেই তবুও ভদ্রতার খাতিরে বলে
” কেনো নয় চলুন
ইফাদ হেলমেট বাইকে রেখে চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে হাঁটা শুরু করে। মিষ্টি পেছন পেছন যায়।
লান্স করে ইফাদ চলে যায়।
মিষ্টি রুমে বসে পড়ছিলো কিন্তু কারেন্ট চলে যায়। প্রচন্ড গরম পড়েছে।
“মিষ্টি ছাঁদে গিয়ে পড়ো। এখানে গরম
মায়ের কথায় মিষ্টি দুইটা বই নিয়ে ছাঁদে চলে যায়। বাসা থেকে মুরা নিয়ে যায়। একটা বই রেলিংয়ের ওপর রাখে আর একটা বই হাতে। চুল গুলো ছাড়া। পরনে হালকা গোলাপি টিশার্ট আর কালো স্কার্ট।
মিষ্টি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখে জীম দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। জীমকে দেখে মিষ্টির হাত পা কাঁপছে
“আআআপনি
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে মিষ্টি
” তুই কি ভেবেছিস আমার বাইক নেই? আমার Suzuki বাইক। আমার বাইকের মডেল দেখছোস তুই? শুধু এই এলাকা কেন পুরো দশ বারোটা এলাকায় আমার বাইকের মতো কারো বাইক নেই
জীমের কথা শুনে মিষ্টির ভয়টা অবাকে পরিবর্তন হয়। এই ছেলেটা কি পাগল? আপনাআপনি মনে মনে প্রশ্নটা জাগছে
জীম মিষ্টির সামনে রেলিংয়ের ওপরে বসে পড়ে
“দেখ আমি সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি এবং বলি। আমি সিগারেট খায় মদ খায় গাঁজাও খায় মাঝে মাঝে। সাড়ে নব্বইটা এক্স আছে। পেজেন্ট গফ আছে বারোটা। বাবা আমাকে দেখতে পারে না। সয্য করতে পারে না। পড়ালেখা করি বলতে পাশের ছিটের মেয়েরটা দেখে লিখে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠছি। এখন কথা হলো। আমি তোকে ভালো লাগে। আই মিন আমার তোকে ভালো লাগে। তোর আমার সাথে প্রেম করতে হবে বাট এখন না। তোকে একটু সময় দিলাম। তুই অন্য কোনো ছেলের সাথে কথা বলবি না প্লাস বাইকে উঠবি না। যদি দেখছি তো
মিষ্টি হা করে তাকিয়ে আছে। জীম মিষ্টির মুখের কাছে মুখটা নিয়ে বলে
” তোকে কিছু করবো না। যার বাইকে উঠবি তাকে বাইকসহ উড়িয়ে দেবো
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মিষ্টি। ঘুমের ঘোরেই বুঝতে পারছে কেউ ওকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তাও খুব কাছ থেকে। তার নিশ্বাসের শব্দও মিষ্টি শুনতে পাচ্ছে। তার নিশ্বাসের শব্দেই মিষ্টির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খোলার সাহস পাচ্ছে না মিষ্টি। চোখ খুলে যদি দেখে সত্যিই কেউ আছে এই রুমে তাহলে কি করবে? নিশ্বাসের শব্দটা আরও কাছে আসছে মিষ্টির। ভয়ে ঘামতে শুরু করেছে মিষ্টি।
“ফুলটুসি
লোকটা মিষ্টির গালে হাত দিতেই মিষ্টি লাভ দিয়ে উঠে বসে। চোখ খুলে দেখে সামনে একটা ছেলে। মিষ্টির দুই ঝুঁকে বসে আছে।
” আআআআপনি কে?
আলরেডি মিষ্টির চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে। ভয়ে মিষ্টির হাত পা কাঁপছে।
“আমি? আমি জীম। রাইয়ান রহমান জীম। ওইযে রুমটা দেখছো ওটা আমার। এসল বেপারটা হলো। তুই চোখ মুছ, পানি খা, নরমাল হ, তারপর বলছি
” কককিহ
“দেবো ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় যা বলছি কর।
জীম ধমক দিয়ে বলে। মিষ্টি চোখের পানি মুছে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে ফেলে।
জীম খাটের ওপর আরাম করে বসে
” আমার বাপ একটা চিজ মাইরি। এলাকার মেয়েদের ডিস্টার্ব করি বলে এখানে শিফট হলো। কিন্তু বাপটা তে আর জানে না এখানে একটা ফুলটুসি আছে। আমি তো ভেবেছিলাম এখানে থাকবোই না। কিন্তু রুমে ঢুকে বেলকানিতে দাঁড়িয়ে একটা পরি দেখতে পেলাম। ব্যাস প্ল্যান চেঞ্জ
মিষ্টি হা করে শুনছে
“দেখলাম পরিটা বই পড়ছে। বিরক্তিকর একটা জিনিস। ভাবলাম একটু পড়ে গিয়ে পরিটার সাথে দেখা করে আসবো। তাই বিয়ারের বোতলটায় চুমুক দিলাম। বিয়ার শেষ করে দেখি পরিটা ঘুমিয়ে গেছে। বেলকনি টপকে লাফ দিয়ে পরিটার রুমে চলে এলাম আর ঘুমন্ত পরিটাকে দেখলাম।
মিষ্টি মনে মনে ভাবছে চিৎকার দেবো আবার ভাবছে দৌড় দেবো। কিন্তু মোট কথা মিষ্টি নড়াচড়া করার শক্তিটা পাচ্ছে না।
“আর শোন চেঞ্জ করার সময় জানালা বন্ধ করে নিবি
মিষ্টি এবার বড়বড় চোখ করে জীমের দিকে তাকায়।
” বাহহ তোর চাহনিতেও তো দেখি মদ মেশানো। নেশা নেশা লাগছে। আমার আবার মদে নেশা হয় না। দুই বোতল বিয়ার খেয়েছি। দেখ এখনো নরমাল আছি।
মিষ্টি নিচের দিকে তাকায়।
“আআপনি প্লিজ চলে যান।
মিষ্টি আবার কাঁদছে। হাত পা কাঁপা তো বন্ধই হয় নি
” তো আমি কি থাকতে এসেছি না কি? যাবোই তো। কাঁপছিস কেন? আমি কি তোকে টাচ করেছি না কি বকেছি? কোনোটাই তো করি নি। তাহলে
ওকে ওকে চলে যাচ্ছি
জীম বিছানা থেকে নামে।
“তোর ফোনে আমার নাম্বারটা সেভ করে দিয়েছি। সকালে কল করবো। ওকে
মিষ্টি জীমের কোনো কথায় শুনছে না। ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
” কাঁদুনি ফুলটুসি
জীম আবার বেলকনি টপকে নিজের রুমে চলে যায়।
মিষ্টি বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেয়।
“বাপির রুমে যাবো? না থাক এখন আর যাবো না। বাপি মামনির ঘুম ভেঙে যাবে। কিন্তু কি করবো এখন? ভয় করছে। বই পড়ি তাই আর ভয় করবে না।
মিষ্টি এসব ভেবে চোখ মুছে বই নিয়ে বসে।
বই আর বাপি এই দুটো নিজিস মিষ্টির মন ভালো করতে পারে। ভয় দুর করতে পারে।
সকাল বেলা গোছল করে কলেজ ড্রেস পড়ে চিরুনি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টির মা ব্রেকফাস্ট রেডি করছে। বাবা অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। ভাই বসে বসে গেমস খেলছে।
” ও মামনি চুলটা আচড়ে দাও। লেট হচ্ছে তো
“একটু ওয়েট করো। আমিও তো একটা মানুষ কোন দিকটা সামলাবো। তাজকেও রেডি করতে হবে। আর আমাকেও স্কুলে যেতে হবে।
মিষ্টি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।
” মামনি আমি আচড়ে দিচ্ছি
মিষ্টির বাপি মাথা আচড়ে দেয়। মিষ্টির বাবা পুলিশ অফিসার। মিষ্টির চুল গুলো প্রচুর লম্বা আর ঘনো। প্রায় হাঁটু ওবদি চুল। মিষ্টির চুল গুলো বাবা মা দুজনেরই খুব প্রিয়।
মিষ্টির মা মিষ্টি আর তাজকে খাইয়ে দেয়। মিষ্টি আইসিটি আংক করছে আর খাচ্ছে।
“খাওয়ার সময় মন দিয়ে খাও পড়তে হবে না।
” মামনি পড়া কমপ্লিট হয় নি
মিষ্টি আর মিষ্টির ফ্রেন্ড তিথি। দুইজন একসাথে কলেজ যায়। মিষ্টি তিথির জন্য দাঁড়িয়ে আছে
“ওই ফুলটুসি
মিষ্টি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখে জীম বাইকের ওপর সুয়ে আছে মুখে সিগারেট। মিষ্টি মুখ ঘুরিয়ে নেয়
জীম লাফ দিয়ে বসে। এ্যাশ কালার কামিজ সাদা সেলোয়ার সাদা ওড়না কেচি করা। কাঁধে স্কুল ব্যাগ। বা হাতে ঘড়ি। চোখে কোনো কাজল নেই। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। লম্বা চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। মিষ্টিকে দেখছে জীম।
” ওই ফুলটুসি এখানে আয়
“আআআমাকে বলললছেন?
মিষ্টি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে
” তো আশেপাশে কি আর কেউ আছে না কি?
মিষ্টি আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সত্যি কেউ নেই। মিষ্টি এগিয়ে যায়।
“ববলুন
” আমাকে দেখলেই তোর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায় কেন? আমি কি কিছু করছি
মিষ্টি হাত কচলাচ্ছে। একে কি করে বোঝাবে অচেনা কারো সাথে কথা বলতে মিষ্টি অব্ভস্ত নয়।
“তোর নাম কি?
” মিষ্টি
“কেউ মান জিজ্ঞেস করলে পুরো নাম বলতে হয় শেখায় নি তোর কমিশনার বাবা
” আফরা ইবনাত মিষ্টি
“গুড।
কোন ক্লাসে পড়োস?
” ইন্টার ফাস্ট ইয়ার
“ছেলেদের চুল দেখিয়ে ইমপ্রেস করতে এভাবে চুল ছেড়ে কলেজ যাস বুঝি?
মিষ্টির খুব রাগ হচ্ছে। না জেনে না শুনে একটা মন্তব্য করে দিলো। মিষ্টির কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।
” তোর ফোনে আমার নাম্বারটা সেভ করা। কল দিলে রিসিভ করবি। আর ভুলেও আমার কথা বাপিকে বলবি না। বললে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে চলে যাবো। তোর কমিশনার বাপ তোকে খুঁজেও পাবে না। কাল থেকে একদম চুল না বেঁধে কলেজে যাবি না। যদি দেখেছি তো চুল কেটে দেবো।
” আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মিষ্টি পেছন ঘুড়ে যেতে নেয়।
“জীমমমমমম
মিষ্টি তাকিয়ে দেখে তিথি জীম বলে চেচিয়ে জীমের কাছে যাচ্ছে।
” এর আবার কি হলো? এভাবে ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে কেনো?
“আরে তিথি মাই সুইট ডার্লিং
মিষ্টি শুধু দেখছে। তিথি জীমের হাত ধরে হেসেহেসে কথা বলছে। মনে হচ্ছে অনেকদিনকার কথা জমিয়ে রেখেছে।
” তিথি তোর লেট হলে আমি যাচ্ছি। ক্লাস মিছ হয়ে যাবে নাহলে।
“আমিও যাবো।
জীম বাই পরে কথা হবে
” হুমম
মিষ্টি আর তিথি বাসে উঠে পড়ে।
“তিথি তুই ওনাকে চিনিস
” হুমম
“কি করে? তোর বফ
” আরে না। ইউটিউব চ্যানেল আছে। মোটামুটি গান করে। আর ফেসবুকে এড আছে। & বড় আপুর বফ ছিলো তো একদিন ওদের সাথে ঘুড়তে গেছিলাম। সো চিনি
“ওহহহ। এখন
” ওদের রিলেশন ব্রেকআপ হয়ে গেছে। জীম তো এমনই ছেলে। কারো সাথে সিরিয়াসলি রিলেশনশিপএ জড়ায় না। কয়েকদিন কথা বলে তারপর টাটা বাই বাই। আবার নতুন একটা। আর আমার আপুও এমন
“ওহহহ। আইসিটি প্রোগ্রাম গুলো কম্পিলিট করেছিস
” নাহহহ তুই
“হুমম। নিশ্চয় তুই বুঝিস নাই
” হুমমম
“চল আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি
” ভালো লাগছে না
“এমন করলে তুই তো ফেল করবি। প্লিজ বোঝ আমার থেকে। খুব ভালো করে বোঝাবো।
” ওকে। বোঝা
“মন দিয়ে বুঝবি
” হুম
মিষ্টি তিথিকে বোঝাতে থাকে।
” আমাকেও একটু বোঝাও
একটা ছেলের কন্ঠ শুনে মিষ্টি চমকে ওঠে।
জীম হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তিথি খুশি হয়ে বলে
“তুমি এখানে?
জীম ওদের পাশের ছিটে বসে। বাসের পেছনের ছিটে বসেছে ওরা। তিথি জানালার পাশে তারপর মিষ্টি আর মিষ্টির পাশে জীম।
” তোমার টানে চলে এলাম
“ওহহ রিয়েলি
” হুমমম। তো এ কি তোমার টিচার?
“বলতে পারো। কোচিং থেকে স্যার যা বোঝায় আমি বুঝতে পারি না পরে মিষ্টি বুঝিয়ে দেয়।
” গ্রেড
“হুমম খুব ব্রিলিয়ান্ট ও
” ওয়াও
“তিথি তুই এখানে বস প্লিজ
মিষ্টির কেমন লাগছে জীমের পাশে বসতে। তারপর জীমের মুখ থেকে সিগারেট আর বেয়ার মেশানো বাজে একটা গন্ধ আসছে। যা মিষ্টির খুব বাজে লাগছে।
“ও
তিথি বলার আগেই জীম বলে
” আমার কিন্তু তোর পাশে বসতে দারুণ লাগছে ফুলটুসি
জীম মিষ্টির দিকে একটু ঝুঁকে বলে। মিষ্টির তো জান যায় যায় অবস্থা। হঠাৎ বাস থেমে যায়।
“এই বাসটার আবার কি হলো?
জীম বিরবির করে বলে। এই সুযোগে মিষ্টি উঠতে যায় জীম হাত ধরে
🍂
রেলগাড়ীর ঝিকঝিক শব্দে নতুন জীবন শুরু হওয়ার এক আগমনী বার্তা কানে বেজে উঠছিল বারবার। সেই নতুন জীবনের স্বপ্নজাল বুনতে বুনতে কখন যে গন্তব্য চলে এলো, তার খেয়ালও হয়নি। কেনো জানি দুশ্চিন্তা গুলো নিমেষেই মিলিয়ে যেতে লাগলো, তার বদলে জেগে উঠল একরাশ ভরসা। ঈশানের প্রতি ভরসা। হয়তো ভালোবাসার ভরসা। ট্রেন থেমে গেলে যখন আমরা একে-অপরের হাত ধরে নামলাম, তখনি ঘটল একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি। এমনটা ধারণার বাহিরে ছিল আমাদের। মা, ভাইয়া, বুড়ি, সাফিন ভাইয়া, নিহা, ফারায আঙ্কেল, মোহনা আন্টি আর পিচ্চি মেয়ে কুইন। সবাই একসাথে জড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে। ঈশানের মুঠোয় ধরে রাখা আমার হাতটা আরো একটু শক্ত করে চেপে ধরলেন ঈশান। এমন ঘটনায় মোটেও খুশি হননি তিনি। সেটা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনার। কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা বিরাজ করল সবার মাঝে। হঠাৎই পিচ্চি মেয়েটা দৌড়ে এসে ঈশানের কোলে উঠার জন্য হাত উঠালো। ঈশান বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে বলল,
“রানি! কেমন আছো তুমি?”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম, “রানি?”
ঈশান বললেন, “রাকিবের ছোট্ট বোন। রানি।”
“তাহলে রাকিব কোথায়?”
ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “নেই।”
আমার ভেতরটা হালকা কেপে উঠল। অচিরেই এক অজানা ভার চেপে বসল মনে। ঈশানকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম রাকিব কেনো নেই ? এমন সময় তারিফ ভাইয়া হাত ভাজ করে ঈশানের সামনে এসে দাড়ালেন। আর বললেন,
“এই মেয়েটি তোমার নিজের মেয়ে নয়। এই কথা কেনো বললে না সেদিন?”
ঈশান রানিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, “জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই বলতাম। তুমি জিজ্ঞেসই করোনি।”
তারিফ ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ঈশানের কাধে হাত রেখে বললেন,” যা হওয়ার হয়েছে। এবার বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিৎ তোমাদের।”
ঈশান ফারায আঙ্কেলের দিকে তাকালেন। ফারায আঙ্কেল চোখের ইশারায় ঈশানকে কাছে ডাকলেন। ঈশান কাছে যেতেই মোহনা আন্টি ঈশানের কাধ বরাবর তিনচারটা কিল মেরে বললেন,
“বউ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো? মমের কথা একবারও মনে পড়েনি? কিভাবে থাকবে মম! তুই একটা সেলফিশ ছেলে। ”
ফারায আঙ্কেল বললেন, “সায়রাকে তোমার পছন্দ না সেটা বললেই হতো। হুটহাট বাড়ি ছেড়ে চলে আসার কি মানে?”
মোহনা আন্টি অনেকটা ধমকের সুরে বললেন, “তুমি চুপ করো। তোমার জন্যই হয়েছে সব। প্রথমে ছেলেটা বাড়িও ছেড়েছে, আর এখন শহর ছেড়ে পর্যন্ত চলে যাচ্ছে তোমার স্টুপিড জেদের জন্য।”
মোহনা আন্টি বললেন, “নিষেধ করোনি ঠিকাছে। কিন্তু বাড়ি ফেরার জন্য একবারও ছেলেটাকে বলেছো? আমার ছেলে কি এতোই ফেলনা যে তোমার না বলা সত্ত্বেও বাড়ি এসে পড়ে থাকবে? সেল্ফ রেসপেক্ট আছে না?”
ঈশান আঙ্কেলের দিকে তাকাতেই আঙ্কেল বললেন, “গাড়িতে ওঠো। ”
বলেই সামনের দিকে ঘুরে হাটতে লাগলেন আঙ্কেল। ঈশান আঙ্কেলকে ডাকলেন,
“বাবা! ”
আঙ্কেল ঘুরে তাকাতেই ঈশান বললেন, “সরি। ”
আঙ্কেল মুচকি হেসে চশমা ঠিক করে বললেন, “লেটস কাম।”
ঈশান আঙ্কেলের পেছন পেছন গেলেন। মা আর বুড়ি আমাকে ঘিরে দাড়ালো। মা আমার হাত ধরে বললেন,
“এভাবে কেউ পালায়? ”
বুড়ি আমার কানে ঠুয়া মেরে বললেন,” পাখনা গজাইছে মাইয়ার। বিয়া দিয়া দাও। তয় সব ঠিক হইবো।”
আমি কানে হাত রেখে বিস্ফোরিত চোখে বললাম, “আবার বিয়ে? ”
মা বললেন,” কেনো? হলেই বা কি সমস্যা? দুইবার যখন বিয়ে হয়েই গেছে। তৃতীয়বারও না হয় হবে? আগের কাজী দিয়েই হবে। বেচারা কাজী মিথ্যে বলছিল না।”
আমি কি বলবো উত্তর খুজে পেলাম না। নিহা পেছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে বলল,
“দোস্ত, তোরা এই তৃতীয় বিয়েটা আরো ছয়মাস পরে কর। তাহলে এনিভারসেরি আর বিয়ে একসাথে হয়ে যাবে। আর আমার পুচকুটাও বিয়ে খেতে পারবে।”
বলেই পেটে হাত রাখল নিহা। আমি চোখ বড় করে বললাম,
“নিহু? তোর পুচকু? ”
নিহা উৎফুল্লকর হাসি দিয়ে মাথা ঝাকালো। আমি খুশির চোটে নিহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
.
বিছানায় শুয়ে একনিষ্ঠতার সাথে বই পড়ছিলাম। হঠাৎই শরীরে খুব ভারী কিছুর আবেশ অনুভব হল। বইটা মুখের সামনে থেকে সরাতেই ঈশানের মুখটা দেখতে পেলাম। প্রথমেই ভয়ে বুকের ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।ঈশান ছোট্ট করে আমার গালে একটা চুমু দিয়েই আমার হাত থেকে বইটা ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,
“কি বই এটা?”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম, “উপন্যাস। দিন আমাকে। এটা আমি পড়ব।”
ঈশান বইটা দিলেন না। টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বললেন,
” এখন উপন্যাস পড়া যাবেনা। আর সামনে না তোমার এক্সাম? এসব উল্টা-পাল্টা বই পড়ে সময় নষ্ট করবে কেনো? কাল থেকে মেইন বই পড়বে তুমি। পড়তে বসবে বুঝেছো!”
বলেই আমার নাক টিপে দিলেন ঈশান। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
“মানে? আপনাকে কে বলল আমার এক্সাম? অলরেডি আমার নাম এটেন্ডেন্সের খাতা থেকে কাট। পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে আমার?”
“কাট মানে? কি কাট? কে কাটবে তোমার নাম?”
“ক্লাস টিচার। ফাহমিদুল স্যার।”
“ওই বেটার এত্তোবড় সাহস যে আমার বউয়ের নাম কাটবে! বরং আমি তার হাতের সবকয়টা আঙুল কেটে দিবো। ”
“তাই নাকি?”
“অবশ্যই। ”
“আচ্ছা আপনি একটা কথা বলেন তো।”
“কি কথা?”
“রাকিব কোথায়?”
“রাকিব! সে তো চলে গেছে।”
“কোথায় গেছে?”
“আমেরিকা।”
“মানে?”
“ছেলেটা খুব ব্রিলিয়ান্ট বুঝেছো! ইন্টারন্যাশনাল ডিবেট কম্পিটিশনে অডিশন দিয়েছিল। সিলেক্ট হয়ে গেছে। তাই আমিও ব্যবস্থা করে আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়েছি। চার বছরের ইংলিশে একটা কোর্স করবে। তারপর চলে আসবে। ওর সমবয়সী আরো বাচ্চারা আছে সেখানে। ভালো না?”
“ভালো মানে? খুব ভালো। কিন্তু আপনি তখন এমনভাবে বললেন, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
ঈশান “চিক” টাইপ শব্দ করে লাইট অফ করতে যাচ্ছিলেন।কিন্তু আমি বাধ সাধলাম,
“লাইট অফ করবেন না। আজকে আমরা লাইট জ্বালিয়েই ঘুমাই প্লিজ!”
“সিওর?”
“হুম।”
“তুমি সিওর আমরা লাইট জ্বালিয়েই ঘুমাবো।”
“হ্যা! সিওর।কেনো?”
“ওকে। আমার তো কোনো প্রবলেম নেই। ”
বলতে বলতে আমার কোমর দুইহাতের বাহুডোরে জড়িয়ে নিলেন উনি। আমি চোখ বড় করে বললাম,
“লাইট অফ করে দিন প্লিজ।”
“কেনো? তুমিই তো বললে লাইট জ্বালিয়ে রাখতে। ”
“না! আমি কিন্তু চিৎকার দিবো প্লিজ লাইট বন্ধ করেন।”
ঈশান ভুবন কাপানো হাসিতে মত্ত হলেন। আর আমি আতঙ্কে জড়োসড়ো।কয়েক মিনিটের মধ্যেই আলো নিভে গেলো। কিন্তু অন্ধকার নামলো না। চাঁদের আলোটাও আজ নির্লজ্জের মতো জ্যাতি ছড়াচ্ছে। সর্বানাশা এই জোৎস্নার আলোটাও কি নিভিয়ে দেওয়া যায়না! মুহুর্তেই আমার শরীর স্থবির হয়ে আসলো। অসীম ভালোবাসায় ঘেরা এক মৃদু মধুর উষ্ণতা প্রবাহিত হতে লাগল সম্পুর্ণ শরীর জুড়ে। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। এবার তো সব অন্ধকার….
🍂
ঈশান শার্টের কলার ঠিক করতে করতে গলা খাকিয়ে সায়রাকে বললেন,
“কি ব্যাপার তুমি? আবার কেনো এসেছো?”
“ভাইয়া, ব্রেকফাস্ট করবেন না?আমি আপনার জন্য বিরিয়ানি বানিয়েছি। আন্টি একবার বলেছিল, আপনার নাকি খুব ফেভারিট। তাই।”
“আমি বিরিয়ানি খাবো না। তুমি যাও।”
“আরে ভাইয়া! দরজা বন্ধ করছেন কেনো? আমি সেই কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে আপনার জন্য এতো আয়োজন করে রান্না করলাম, আর আপনি কিনা বলছেন খাবেন না? আবার মুখের উপর দরজাও দিয়ে দিচ্ছেন? হাউ রুড!”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“তাহলে কি খেতে ইচ্ছে করছে বলুন? আমি না হয় সেটা….”
ঈশানের চোখ গরম দৃষ্টি দেখে চুপ মেরে গেল সায়রা। খানিক চুপ থেকে বলে উঠল মেয়েটি,
“ঘুমাচ্ছে? এখনো ঘুমাচ্ছে? সকাল এগারোটা বাজে। এখনো কেনো ঘুমাচ্ছে? শরীর খারাপ করেনি তো! সরুন দেখতে দিন আমাকে।”
“কোনো শরীর খারাপ করেনি। তোমাকে দেখতে হবে না। দেখার জন্য আমি আছি। ইউ ক্যান গো?”
“কি? আপনি আছেন দেখার জন্য? ”
সায়রা হেসে দিল৷ হাসতে হাসতেই বলল,
“যার নিজের উপরই কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকেনা,সময়-অসময় ফ্লোরে উল্টো হয়ে পড়ে থাকে, সে আবার আরেকজনকে কি দেখবে? বলি আপনাকে দেখার জন্যই তো আলাদা একজন লাগে।”
“কি বললে তুমি?”
“সরি ভাইয়া.. আমি আসছি। আর বিরিয়ানিটা খুব কষ্ট করে বানিয়েছি তো। আপনি না খেলেও তারিক ভাইকে দিয়ে দিয়েন। বা বায়!”
বিরিয়ানির প্লেট ঈশানের হাতে ধরিয়ে ছুট লাগাল সায়রা। ঈশান সমস্ত মেজাজ ঝাড়লেন দরজাটার উপর। ঠাস করে দরজায় একটা লাথি মেরে বজ্রপাতের আওয়াজে দরজাটা আটকালেন।
বারান্দাতে মৃদু আলোয় দাড়িয়ে আছি আমি আর সায়রা। আমার কথা বলার সুযোগ না থাকলেও মেয়েটা তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছে। একটু বেশিই কথা বলে মেয়েটা। অপ্রয়োজনীয় কথা খুব বেশি বলে। যদিও তার এই অপ্রয়োজনীয় কথায় আমি তেমন কর্ণপাত করছি না। শান্ত দৃষ্টি আমার আকাশ দেখায় ব্যস্ত। খন্ড মেঘের এক গুচ্ছ সমাবেশ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে, কি নিরানন্দে! খুব ধীরগতিতে, অসার হয়ে, আচ্ছা মেঘের খন্ড গুলো কি শুধুই বাষ্প? যদি এগুলো কারো কাছে প্রেরিত চিঠিপত্র হতো? এমন যদি হতো, কোনো মৃত ব্যাক্তির কাছে বার্তা পাঠানোয় এক টুকরো মেঘ ব্যবহার করা যেতো! কি মজার ব্যাপার হতো, প্রতিটি মেঘের খন্ড পেয়ে যেতো এক নির্দিষ্ট গন্তব্য, এক নির্দিষ্ট অর্থ। তখনও কি মেঘগুলো এমন অসার বেগে চলতো? হয়তো ক্লান্তিহীন ভেসে বেড়াতো, কেউ ডানে, কেউ বামে, আপন গন্তব্যে পৌছানোর নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টায়। সায়রা আমার কাধ ঝাকাতেই আমি ভাবনার রেশ কাটিয়ে জবাব দিলাম,
“হু?”
বলেই থমকে গেলাম আমি। আমার তো কথা বলা নিষেধ। সায়রা আমার কথাটা শুনতে পেল না। সে বলল,
“কখন থেকে ডাকছি ভাইয়া, কথা শুনেন না? মানে কথা তো বলতে পারেন না, শুনতে পারেন তো?”
আমি মাথা দুলিয়ে হ্যা বললাম। সায়রা বলল,
“আচ্ছা আমরা তো লিখেও কথা বলতে পারি তাইনা? মানে আমি প্রশ্ন করলাম, আর আপনি লিখে উত্তর দিলেন। আবার আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলেও, আপনি লিখে জিজ্ঞেস করলেন। আর আমি মুখে উত্তর দিলাম। আইডিয়াটা কেমন?”
আমি মুচকি হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়লাম। বুঝালাম, আইডিয়া ভালো। কিন্তু এই মেয়ের কথা বলার এতো শখ কেনো আমি বুঝতে পারছি না। সায়রা খাতা কলম নিয়ে আসল। আমার হাতে খাতা-কলম ধরিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করল,
প্রশ্ন শুনেই আমি অর্ধেক কাত। আবার উত্তর কি লিখব? কেনো পাগড়ি পড়ি সেইটা তো বলা যাচ্ছে না।ইমিডিয়েটলি কোনো একটা মিথ্যে কথা বানিয়ে ফেলতে হবে। সায়রা তাড়া দিয়ে বলল,
“কি হলো ভাইয়া লিখছেন না কেনো? জলদি লিখুন? আরো অনেক প্রশ্ন আছে তো! একটা লিখতেই এতো দেরি করলে বাকিগুলো কখন লিখবেন? ”
আমার গলা শুকিয়ে আসল। আবার কি উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করবে কে জানে? পেছন থেকে কেউ শব্দ করল,
“সায়রা! ”
আমরা দু’জনেই ঘুরে তাকালাম। ঈশান এসেছেন। উনার হাতে সবুজ মলাটের একটা ভারী বই। বইটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে ঈশান বললেন,
“টেবিলে এসো সায়রা। ”
সায়রার মুখটা মুহুর্তেই পূর্ণিমার চাদের মতো ঝলকানি দিয়ে উঠল। খুশি যেন আর ধরে না তার। আপাতত আমার ইন্টারভিউ নেওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ভদ্র মেয়ের মতো পড়ায় মনোযোগী হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে।আমি আবারও আকাশ দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। টুকরো টুকরো মেঘের নিরব গতিবিধি পরিমাপ করে চলেছি একনিষ্ঠ ভাবে। মাঝে মাঝে ঈশানের ভারী কণ্ঠের টুকটাক ধমক কানে আসছে। এই হারে ধমকানো হলে তো ছাত্রী পড়ার সাথে সাথে লেখাটাও ভুলে যাবে। যেমন এইমাত্র আমি ভুলে গেলাম, যে কি নিয়ে চিন্তা করছিলাম। আন্টি মানে সায়রার আম্মু হঠাৎ হাসিমাখা কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
“শুভসন্ধ্যা! ”
সায়রা হাসোজ্জল মুখ করে বলল,
“শুভসন্ধ্যা আম্মু! ”
ঈশান গম্ভীর কণ্ঠে হালকা হেসে বললেন, “শুভসন্ধ্যা।”
আন্টিও সায়রার মতো অনেকটা খুশিতে গদগদ হয়ে নাস্তার প্লেট টেবিলে রাখলেন। অতঃপর বিছানায় আরাম করে বসতে বসতে বললেন,
“একটা জরুরী আলাপে এসেছিলাম। পড়াশুনায় ডিস্টার্ব না হলে বলি?”
ঈশান শান্তভঙ্গিতে জবাব দিলেন, “জি আন্টি, বলেন।”
এই দৃশ্য দেখে মুহুর্তেই আমার ভেতরটা গোমট হয়ে আসল। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বুড়ির কথাটা খুব করে মনে পড়ছে আজ। আন্টি এখন ইনিয়েবিনিয়ে সায়রার সাথে ঈশানের বিয়ের কথা বলবেন না তো? বলতেই পারেন, ঈশান এখন সম্পুর্ণ সুস্থ। এই দিনটির জন্যই তো অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন সবাই। আমার ধারণা সঠিক হল। আন্টি আমতা-আমতা করতে করতে বললেন,
“সামনেই তো মেয়েটার ইয়ার ফাইনাল। এই ঝামেলা শেষ হলেই আমি আর সায়রার বাবা মিলে ঠিক করেছি, আরেকটা ঝামেলা বাধিয়ে বসবো। ঘর থেকে আপদ বিদায় করবো।”
ঈশান ভ্রু কুচকে বললেন, “মানে আন্টি? ঠিক বুঝলাম না।”
“আরে বোকা ছেলে। আমি সায়রার বিয়ের কথা বলছি।”
ঈশান অবাক হয়ে বললেন, “বিয়ে? ”
ঈশান অবাকচোখে একবার সায়রার দিকে তাকিয়ে আবার আন্টির দিকে তাকালেন। আর বললেন,
“আন্টি সায়রার এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। যদিও আপনাদের পারসোনাল ব্যাপার, তবুও আমার মনে হয় ওকে আরেকটু সময় দেওয়া উচিৎ। অন্তত ভারসিটি পর্যন্ত..”
আন্টি বললেন, “সেসব নিয়ে আমরা এখন একদম চিন্তা করছি না। তুমি তো আছোই। আর ফারায ভাই তো অনেক আগে থেকেই দায়িত্ব নিয়ে রেখেছেন সায়রাকে ভারসিটিতে ভর্তি করানোর। উনি কি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার মানুষ?আমাদের আর চিন্তা কোথায়? ”
ঈশানের মুখটা মুহুর্তেই অন্ধকার হয়ে আসল। সেইসাথে একরাশ দুশ্চিন্তা ভর করল উনার মুখে। বিয়ের ব্যাপারে উনি কিছু জানতেন ন মনে হচ্ছে। কিন্তু এবার কি হবে? উনি এখন কেমন রিয়েক্ট করবে ভাবতেই ভয় লাগছে আমার।
🍂
ঈশান তড়িৎ গতিতে সম্পুর্ণ ঘরের ডানে বামে ছুটোছুটি করছেন। অস্থিরতার সাথে তীব্র রাগেই নিয়ম করে পাল্লা দিয়ে কাপছে উনার শরীর। রাগটা নিজের বাবার উপর। আর অস্থিরতাটা এ বাড়ি ছেড়ে প্রস্থানের তাগাদা। হন্তদন্ত হয়ে নিজের সমস্ত নিজের জামা-কাপড় গুলো এলোমেলো ভাবেই ব্যাগে ভরছেন উনি। আবার ওয়্যারড্রোপ থেকে কাপড় তুলছেন। আমি ঈশানের সামনে গিয়ে হাত ভাজ করে তাকালাম। ঈশান দৃষ্টি লাল করে ধমকের সুরে বললেন,
“সামনে থেকে সরো তারিন।”
আমি ঈশানকে বুঝানোর চেষ্টা করে বললাম,” বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?”
“কিচ্ছু ঠিক হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি এ বাসায় আর কোনোভাবেই থাকবো না। আজকে এবং এখনি যাবো। আর তুমিও আমার সাথে যাবে।”
“তাই? কোথায় যাবো আমরা? আঙ্কেল আমাদের বাসায় ঢুকতে দেবেন?”
“ওই লোক মানে? কাকে ওই লোক বলছেন আপনি? উনি আপনার বাবা।”
ঈশান তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন। আমি ঈশানের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আদুরে গলায় বললাম,
প্লিজ আমার কথাটা শুনুন। এভাবে হুটহাট বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে কারো কিছুই যায় আসবে না। বরং আমরা নিজেরাই বিপদে পড়ব। কোথায় গিয়ে থাকবো আমরা বলতে পারেন?
ঈশান সরুচোখে বললেন,” কেনো? তোমাকে নিয়ে যদি রাস্তায় গিয়ে নামি, ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাখি, থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা না করতে পারি, তাহলে থাকবে না আমার সাথে? ধরবে না এই হাত? ছেড়ে চলে যাবে? ”
আমি ঈশানের মুখ থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালাম। মাথা নিচু করে নিলাম। মুহুর্তেই আমার চোখ দুটো টলমলে হয়ে আসল। ঈশানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কিছুটা অভিমানী সুরে বললাম,
“আপনি আমাকে এই চিনলেন? আপনার সাথে তো জাহান্নামে চলে যেতেও কোনো আপত্তি নেই আমার। ”
ঈশান আমার দুই বাহু ধরে টেনে তুললেন। তারপর বললেন,
“তাই যদি হয়, তাহলে এতো দ্বিধা কিসের? চলো আমার সাথে?”
“আপনার সাথে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু রাগের মাথায় এমন..”
ঈশান আমার ঠোটে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, “কোনো কিন্তু না। তুমি শুধু চলো।”
আমি সামনের দিকে ঘুরে নিজের জিন্সের পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। মিনমিন করে বললাম,
সাফিন ভাইয়াকে আগে ফোন করে সবটা জানাই। দেখি উনি কি বলে। তারপর না হয় একটা সিদ্ধান্তে..
আমাকে বিস্ময়ের চরম শীর্ষে তুলে ঈশান আমার হাত থেকে খপ করে ফোনটা কেড়ে নিলেন। শুধু তাই নয়, ঠাস করে মোবাইলটা জানালা বরাবর ছুড়ে মারলেন। বিকট শব্দ তরঙ্গ বেজে উঠল নিমেষেই। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ। ঈশান ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,
“ওই শালা আরেক বেইমান। সবকিছু জানার পরেও আমাকে কিচ্ছু জানায় নি সে। ওই লোকটার সাথে মিলে আমার অগোচরে প্ল্যানিং করেছে। তুমি ভাবলে কি করে এতো সহজে আমি ওকে মাফ করে দিবো?”
আমি তব্দা লেগে তাকিয়ে আছি। বলার মতো কোনো উত্তর খুজে পাচ্ছি না। শুধু একটা কথাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে আমার।” এতো রাগ ভালো না ঈশান! একদমই ভালো না”
ঈশানের জেদের কাছে হার মেনে বাধ্যগতভাবেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে আমাদের। আন্টি,আঙ্কেল, সায়রা কারো কাছে এই ব্যাপারে কোনোরকম জবাবদিহি করেননি উনি। আর আমার তো জবাব দেওয়ারও সুযোগ নেই। বর্তমানে ঈশানের কাধে মাথা ঠেকিয়ে ট্রেনে বসে আছি। ঈশান সিটের সাথে মাথা ঠেসে গভীর ঘুমে মগ্ন। রেলগাড়ীটা ছুটে চলেছে আপনগতিতে। এর গন্তব্য কোথায় জানা নেই আমার। জানার প্রয়োজনও মনে করছি না। যেখানেই যাই, অন্তত ঈশান পাশে থাকবেন। আর কি লাগে? আমি জানালা বরাবর তাকাতেই একঝাঁক ক্ষুদ্র আলোর সমাবেশ খুজে পেলাম। বুঝতে পারলাম এখানে জোনাকি পোকাদের মেলা বসেছে। আমি জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিলাম। ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি আমার চোখমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। অম্লান লাগছে এই শিহরণ। সবুজ ঘাসের উপর কয়েক ফোটা শিশিরের ছোয়া যেন মুক্তরুপে ফুটে উঠেছে। ঠান্ডা পরিবেশে থমথমে নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই শহর, সাথে প্রকৃতির আনম্র সৌন্দর্য্যময় স্পর্শ, মনে হচ্ছে যেন এক নতুন জীবনের হাতছানি। পুরনো সব ব্যর্থতা উপেক্ষা করে এক নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এই যাত্রা আমাদের! কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে?
🍂
🍂
ঈশান তড়িৎ গতিতে সম্পুর্ণ ঘরের ডানে বামে ছুটোছুটি করছেন। অস্থিরতার সাথে তীব্র রাগেই নিয়ম করে পাল্লা দিয়ে কাপছে উনার শরীর। রাগটা নিজের বাবার উপর। আর অস্থিরতাটা এ বাড়ি ছেড়ে প্রস্থানের তাগাদা। হন্তদন্ত হয়ে নিজের সমস্ত নিজের জামা-কাপড় গুলো এলোমেলো ভাবেই ব্যাগে ভরছেন উনি। আবার ওয়্যারড্রোপ থেকে কাপড় তুলছেন। আমি ঈশানের সামনে গিয়ে হাত ভাজ করে তাকালাম। ঈশান দৃষ্টি লাল করে ধমকের সুরে বললেন,
“সামনে থেকে সরো তারিন।”
আমি ঈশানকে বুঝানোর চেষ্টা করে বললাম,” বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?”
“কিচ্ছু ঠিক হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি এ বাসায় আর কোনোভাবেই থাকবো না। আজকে এবং এখনি যাবো। আর তুমিও আমার সাথে যাবে।”
“তাই? কোথায় যাবো আমরা? আঙ্কেল আমাদের বাসায় ঢুকতে দেবেন?”
“ওই লোক মানে? কাকে ওই লোক বলছেন আপনি? উনি আপনার বাবা।”
ঈশান তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন। আমি ঈশানের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে আদুরে গলায় বললাম,
প্লিজ আমার কথাটা শুনুন। এভাবে হুটহাট বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে কারো কিছুই যায় আসবে না। বরং আমরা নিজেরাই বিপদে পড়ব। কোথায় গিয়ে থাকবো আমরা বলতে পারেন?
ঈশান সরুচোখে বললেন,” কেনো? তোমাকে নিয়ে যদি রাস্তায় গিয়ে নামি, ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাখি, থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা না করতে পারি, তাহলে থাকবে না আমার সাথে? ধরবে না এই হাত? ছেড়ে চলে যাবে? ”
আমি ঈশানের মুখ থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালাম। মাথা নিচু করে নিলাম। মুহুর্তেই আমার চোখ দুটো টলমলে হয়ে আসল। ঈশানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কিছুটা অভিমানী সুরে বললাম,
“আপনি আমাকে এই চিনলেন? আপনার সাথে তো জাহান্নামে চলে যেতেও কোনো আপত্তি নেই আমার। ”
ঈশান আমার দুই বাহু ধরে টেনে তুললেন। তারপর বললেন,
“তাই যদি হয়, তাহলে এতো দ্বিধা কিসের? চলো আমার সাথে?”
“আপনার সাথে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু রাগের মাথায় এমন..”
ঈশান আমার ঠোটে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, “কোনো কিন্তু না। তুমি শুধু চলো।”
আমি সামনের দিকে ঘুরে নিজের জিন্সের পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। মিনমিন করে বললাম,
সাফিন ভাইয়াকে আগে ফোন করে সবটা জানাই। দেখি উনি কি বলে। তারপর না হয় একটা সিদ্ধান্তে..
আমাকে বিস্ময়ের চরম শীর্ষে তুলে ঈশান আমার হাত থেকে খপ করে ফোনটা কেড়ে নিলেন। শুধু তাই নয়, ঠাস করে মোবাইলটা জানালা বরাবর ছুড়ে মারলেন। বিকট শব্দ তরঙ্গ বেজে উঠল নিমেষেই। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ। ঈশান ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,
“ওই শালা আরেক বেইমান। সবকিছু জানার পরেও আমাকে কিচ্ছু জানায় নি সে। ওই লোকটার সাথে মিলে আমার অগোচরে প্ল্যানিং করেছে। তুমি ভাবলে কি করে এতো সহজে আমি ওকে মাফ করে দিবো?”
আমি তব্দা লেগে তাকিয়ে আছি। বলার মতো কোনো উত্তর খুজে পাচ্ছি না। শুধু একটা কথাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে আমার।” এতো রাগ ভালো না ঈশান! একদমই ভালো না”
ঈশানের জেদের কাছে হার মেনে বাধ্যগতভাবেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে আমাদের। আন্টি,আঙ্কেল, সায়রা কারো কাছে এই ব্যাপারে কোনোরকম জবাবদিহি করেননি উনি। আর আমার তো জবাব দেওয়ারও সুযোগ নেই। বর্তমানে ঈশানের কাধে মাথা ঠেকিয়ে ট্রেনে বসে আছি। ঈশান সিটের সাথে মাথা ঠেসে গভীর ঘুমে মগ্ন। রেলগাড়ীটা ছুটে চলেছে আপনগতিতে। এর গন্তব্য কোথায় জানা নেই আমার। জানার প্রয়োজনও মনে করছি না। যেখানেই যাই, অন্তত ঈশান পাশে থাকবেন। আর কি লাগে? আমি জানালা বরাবর তাকাতেই একঝাঁক ক্ষুদ্র আলোর সমাবেশ খুজে পেলাম। বুঝতে পারলাম এখানে জোনাকি পোকাদের মেলা বসেছে। আমি জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিলাম। ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি আমার চোখমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। অম্লান লাগছে এই শিহরণ। সবুজ ঘাসের উপর কয়েক ফোটা শিশিরের ছোয়া যেন মুক্তরুপে ফুটে উঠেছে। ঠান্ডা পরিবেশে থমথমে নিস্তব্ধতা আর অন্ধকারে আচ্ছন্ন এই শহর, সাথে প্রকৃতির আনম্র সৌন্দর্য্যময় স্পর্শ, মনে হচ্ছে যেন এক নতুন জীবনের হাতছানি। পুরনো সব ব্যর্থতা উপেক্ষা করে এক নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এই যাত্রা আমাদের! কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে?
🍂
🍂
ঈশানের চোখজোড়া মাত্রতিরিক্ত লাল, সদ্য ঘুম ভাঙার কারণে ফুলে ফেপে আছে চোখ দুটো। দেখতে কিছুটা ভয়ংকর লাগছে উনার মুখ। আমি সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। ঈশান এতোক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়িয়েছেন। আমি উনার সামনে গেলেও আমাকে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করলেন উনি।যেন আমাকে দেখছেনই না।আশেপাশে কিছু একটা হন্যি হয়ে খুজছেন উনি। কিন্তু কি খুজছেন? ঈশানের হাত-পাও কাপছে। যেন শিরা-উপশিরা গুলো বাকিয়ে যাচ্ছে উনার। আমি ভয়ে তটস্থ হয়ে উনার কাছে গেলাম। অস্থির গলায় জানতে চাইলাম,
“কি হয়েছে আপনার? ”
ঈশান ভারী টেবিলের জিনিসগুলো উলট পালট করে খুজে যাচ্ছেন। লন্ড ভন্ড করে ফেলছেন সবকিছু। কিচ্ছু খুজে না পেয়ে টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাড়ালেন উনি। বাম হাতটা দিয়ে মাথার চুলগুলো খামচে ধরলেন। আমি আবার একঝাক আতঙ্ক নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“ক কি হয়েছে ঈশান? কি খুজছেন?”
ঈশান কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
“ক কোথায়? কোথায় ওটা? কোথায়??”
চেচিয়ে উঠলেন ঈশান। আমি চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম ঈশান নিজের গলায় মালিশ করছেন। যেন খুব কষ্ট হচ্ছে উনার। দাড়িয়ে থাকতে পারছেন না ঠিকমতো। আমি বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। ভয়ে আমার আত্মাটা ক্রমান্বয়ে ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। ঈশান ফ্লোরে বসে কাপতে শুরু করলেন। মারাত্মক কাপুনি দিচ্ছে উনার শরীর। চোখমুখ অস্বাভাবিক ভাবে উল্টে যাচ্ছে। আমার আতঙ্ক, অস্থিরতা দ্বিগুণ হয়ে উঠল এবার। আমিও বসে পড়লাম ফ্লোরে। ঈশানের পিঠে হাত রেখে উনাকে সামলানোর চেষ্টা করলাম৷ বললাম,
“কি হলো ঈশান? কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার বলুন?”
আমার কথায় কর্ণপাত না করে উনি ফ্লোরে হাতড়াচ্ছেন। প্রত্যাশিত সেই জিনিসটি এখনো তন্নতন্ন করে খুজছেন। আবার মাঝে মাঝে নিজের চুল খামচে ধরছেন। আর্তনাদ করে উঠছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“দাও। প্লিজ একটু। একটু দাও।”
আবার একই কান্ড পুনরায় করতে লাগলেন। গলায় মালিশ করে করে বললেন,
“কোথায়? দাও না! পাচ্ছি না কেনো? একটু, একটু লাগবে।”
আমার কান্না চলে আসল। মুখে হাত দিয়ে কাদতে শুরু করলাম। এমন সময় সাফিন ভাইয়া আমার নাম ধরে ডাকলেন,
“তারু।”
সাফিন ভাইয়াকে দেখে আমি তড়িঘড়ি করে উঠে গেলাম, কাছে গিয়ে কাদতে কাদতে বললাম,
“দেখেন না, কি হয়েছে উনার? উনি এমন করছে কেনো? কি খুজছেন এভাবে? কি চাইছেন!”
সাফিন ভাইয়া আক্ষেপী সুরে বললেন,” ও ড্রাগস চাইছে।”
সাফিন ভাইয়ার উত্তর শুনে দৃষ্টি বিস্ফোরিত হয়ে এলো আমার। মুখে হাত ঠেকিয়ে খুব অবাক হয়ে উচ্চারণ করলাম,
“ড্রাগস?”
সাফিন ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়্যারড্রোপের ড্রয়ার থেকে একটা প্যাকেট বের করলেন। প্যাকেট টা আমাকে এগিয়ে দিয়ে ঈশানের দিকে ইশারা করে বললেন,
“দাও ওকে।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
“মানে কি? এটা সত্যি সত্যি উনাকে দিবো? এটা খুব খারাপ জিনিস। আমি উনার হাতে এসব তুলে দিতে পারবো না।”
“তারু এটা না পেলে ঈশান ঠান্ডা হবে না। তোলপাড় করে ফেলবে সবকিছু। কেয়ামত শুরু হয়ে যাবে। তার থেকে ভালোয় ভালোয় দিয়ে দাও, শান্ত হয়ে যাক।”
আমি তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠে বললাম,
“কিছুতেই না। আমি ঈশানকে এটা জীবনেও দিবো না। আর আপনাকেও দিতে দিবো না।”
আমি সাফিন ভাইয়ার হাত থেকে প্যাকেটটা ছো মেরে নিয়ে নিলাম। এক ঢিলে জানালার বাইরে ফেলে দিতে নিলেই ঈশান সশব্দে উচ্চারণ করলেন,
“তারিন!”
আমি ঢিল ছুড়তে নিয়েও থেমে গিয়ে ঈশানের দিকে তাকালাম। উনি উঠে দাড়িয়েছেন। গলায় মালিশ করতে করতে কম্পিত হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“দাও। প্লিজ দাও! ”
আমি মাথা নেড়ে না বললাম। ঈশানের চোখ শক্ত হয়ে আসলো।খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে। আর আমি পিছাতে লাগলাম। প্যাকেটটা হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে পেছনে লুকিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেসে দাড়ালাম আমি। ঈশান আমার অনেকটা কাছে চলে এসেছেন। সাফিন ভাইয়া ফিসফিস করে অনুরোধ জানালেন,
“দিয়ে দাও তারু! ঝামেলা করো না প্লিজ।”
ঈশান আমার পেছনে থাকা হাতটা খামচে ধরলেন। আমি ব্যথায় কুকিয়ে উঠলাম। ঈশানের চেখেমুখে হিংস্রতা। দাত কিড়মিড়িয়ে উনি বললেন,
” দাও বলছি।”
আমি এবারও ভয়ে ভয়ে না সুচক মাথা নাড়লাম। কড়া গলায় বললাম,
“দিবো না। মরে গেলেও না।”
ঈশান তীক্ষ্ণ স্বরে গর্জে উঠলেন। এক হাত মুষ্টি করে ডানপাশের জানালায় সজোরে আঘাত করলেন উনি। সম্পুর্ণ জানালা কেপে উঠল।জানালায় থকে থকে সাজানো ফুলের টবগুলোর সাথে অন্যান্য জিনিসগুলোও ঝনঝনিয়ে পড়ে যেতে লাগল। মুহুর্তেই যেন ছোটখাট ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল ঘরে। এমতাবস্থায় বাহিরে থেকে কেউ আওয়াজ দিল,
“শিট! আন্টি চলে আসছে মনে হয়। তারু তুমি এখানেই থাকো। বের হবে না কিন্তু। আমি বাহিরে গিয়ে দেখি ম্যানেজ করতে পারি কিনা।”
সাফিন ভাইয়া দরজাটা ভিতর থেকে লক করে বাহিরে চলে গেলেন। আর ঈশান?আগের মতোই একই বুলি আওরাতে লাগলেন,
“দাও তারিন দাও। খুব কষ্ট হচ্ছে দিয়ে দাও প্লিজ!”
আমি প্যাকেটটা জানালা দিয়ে ঠাস করে ফেলে দিলাম। ঈশান অগ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দুই কাধ চেপে ধরলেন। তীব্র ক্রোধ নিয়ে উচ্চারণ করলেন,
“এইই! কি করলে এটা তুমি..”
উনি আর কিছু বলার আগেই আমি উষ্ণ পরশে থামিয়ে দিলাম। নিমেষেই এক ফালি স্বর্গীয় সুখের আনম্র শীহরণ প্রবাহিত হতে লাগল সম্পুর্ণ ঘর জুড়ে…
হাতে কফি মগ নিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে আছি। ভেজা চুল নিঃসৃত টুপ টুপ পানি আধভেজা করে তুলছে আমার পিঠের অর্ধাংশ। আমার দৃষ্টি নিচের দিকে। ভোর সকালে শহুরে মানুষের ব্যস্তজীবন পর্যবেক্ষণ করছি। হঠাৎ পেছন থেকে আমার শীতল শরীরে উষ্ণ দুটো হাতের স্পর্শ পেলাম। ঈশান আমার ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে বেশ খানিক সময় দাড়িয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠলেন,
“এসব কি তারিন? জামাটা পেছন থেকে অর্ধেক ভিজে আছে। চেঞ্জ করো যাও। ”
আমি মুচকি হেসে ঈশানের দিকে ঘুরলাম। কফি মগটা এক পাশে বারান্দার গ্রিলের স্ট্যান্ডে উঠে দাড়ালাম। এবার ঈশান আর আমি সমান সমান। আমি ঈশানের মুখে আর চুলে হাত বুলিয়ে বললাম,
“একটু পর চেঞ্জ করবো। দেখি তো, আপনার জ্বর কমেছে মনে হচ্ছে। ”
ঈশান দুই হাত দিয়ে আমাকে কাছে এনে বললেন,
“কমেনি। একদম ভ্যানিশ হয়ে গেছে। ইটস ম্যাজিক। তারিনের ম্যাজিক।”
আমার মুখ হালকা লাল হয়ে আসল। প্রসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে আমি বললাম,
“শুনুন, সাফিন ভাইয়া আন্টির সাথে কথা বলে আমাকে এখানে রেখে গেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে পারবো এ বাসায়। যখন তখন যে কেউ ঘরে চলে আসতে পারে। তাই আমাকে আগের মতো পাগড়ি, চশমা লাগিয়ে ঘুরতে হবে। খুব সাবধানে থাকতে হবে।”
“আরে ধ্যাত! এসব কিছুই করতে হবে না। আন্টি আঙ্কেল খুব ভালোমতোই জানে আমি রুম থেকে বের হইনা। আর রুমে কাউকে ঢুকতেও দেইনা। এতো টেনশনের কি আছে?”
“আপনি ঘর থেকে বের না হলেও আমাকে বের হতে হবে। আমিও যদি সারাদিন আপনার মতো ঘরবন্দী থাকি, সবাই তো অন্যকিছু মিন করবে।”
“অন্যকিছু কি?”
কথার মাঝখানেই দরজায় ঠকঠক শব্দ বেজে উঠল। এই সকাল সকাল কে এসেছে? আমি চটজলদি ঈশানকে ছেড়ে নেমে গেলাম।
🍂
“ভাইয়া.. শুনলাম আপনার নাকি জ্বর এসেছিল রাতে? এখন কি অবস্থা দেখি?”
“আ.আ! কিছু হয়নি। আই এম ফাইন।”
“শরীর তো এখনো হালকা গরম মনে হচ্ছে।আচ্ছা ভাইয়া, মা আপনার জন্য এই লিকার চা পাঠিয়েছে। প্রাকৃতিক জড়িবুটি দিয়ে তৈরি। খালি পেটে খেলে অনেক রোগের উপশম হয়। একটু খেয়ে নিন না প্লিজ!”
“আন্টি হোমিওপ্যাথি বানানো কবে থেকে শুরু করলেন?”
সায়রা আগে হাসল। তারপর বলল,
“হোমিওপ্যাথি না ভাইয়া। মা এটা আপনার জন্য ইউটিউব দেখে বানিয়েছে। ”
ঈশান হালকা হাসি জড়ানো কণ্ঠে বললেন,
“ও আচ্ছা। ঠিকাছে দাও খাচ্ছি।”
ঈশান দুই ঢোকে শেষ করে দিলেন। সায়রা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে অবাক স্বরে বলল,
“ভাইয়া আপনার শরীর সত্যিই ঠিকাছে তো?”
“হ্যা! আমি ফিট। একদম ঠিকাছে। ”
সায়রা আবার ঈশানের কপালে হাত দিল। ঈশান হালকা বিরক্ত হয়ে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললেন,
“বললাম তো ঠিকাছি। ”
সায়রা হা করে তাকিয়ে ঈশানকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা শুরু করল। তারপর বলল,
“উহুম! টাটকা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। কিছু তো একটা গর্ভর আছেই। ভাইয়া, এই প্রথমবার আপনি আমার সঙ্গে হেসে কথা বললেন! আমি তো ভাবতেই পারছি না,স্বপ্ন মনে হচ্ছে আমার। জানেন মা যখন এই চায়ের কাপ আমার হাতে ধরিয়ে বলল আপনাকে দিয়ে আসতে, আমি মনে মনে দরুদ শরীফ পড়ছিলাম। হাত-পা হিম হয়ে আসছিল আমার। কারণ এই চা নামক জিনিসটা ভুলেও আপনার পেটে যাওয়ার কথা ছিলনা বরং আমার মাথায় পড়ার কথা ছিল। আর কাপটাও আস্তো থাকার কথা না। ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়ার কথা। সকাল সকাল ঘরের মধ্যে ছোটখাটো একটা সাইক্লোন বয়ে যাওয়ার কথা ছিল।কিন্তু সেসব কিছুই হচ্ছে না? একরাশ রুক্ষ মেজাজী ধমকের বদলে আমি কিনা সকাল সকাল একটা কিউট হাসি উপহার পেলাম? আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে ভাইয়া! তাও আবার কোন গানের সাথে জানেন? ”
“কোন গান?”
“বেত্তোমিজ ইয়ে দিল, বেত্তোমিজ ইয়ে দিল, মানে না মানে না! এই গানটার সাথে এখনি উরাধুরা ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে ইয়াহ!”
“এতো ডান্স দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। তুমি এখন যেতে পারো।”
সায়রা চুপসানো গলায় বলল,” চলে যাবো?”
হ্যা, অবশ্যই যাবে।
“ঠিকাছে যাচ্ছি।”
মিনমিনিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করে হঠাৎ খুব উৎসাহের সাথে সায়রা বলল,
“কিন্তু ভাইয়া আপনি তো এখন সুস্থ। আজকে পড়াতে আসবেন আমাকে?”
“প্লিজ ভাইয়া আসবেন। অনেকদিন হল আপনি আসেন না। আর সামনে তো আমার ইয়ার ফাইনাল! অথচ আমি এখনো কিছুই পারিনা। প্লিজ আসবেন ভাইয়া৷ প্লিজ প্লিজ?”
“ঠিকাছে আসবো। এবার তুমি যাও।”
“ওকে ভাইয়া। যাই। ”
দরজা লাগানোর আওয়াজ পেয়ে আমি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। ঈশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে ঘুরলেন। আমাকে এক নজর দেখেই সাথে সাথে আবার উল্টোদিকে ঘুরে বিড়বিড় করে বললেন,
“শেষ! আই এম ডান। ”
আমি ভ্রু কুচকে ঈশানের কাছে গেলাম। আর বললাম,
“কি হলো?”
ঈশান আমাকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে সম্পুর্ণ আমার দিকে ঘুরলেন। তারপর বললেন,
“মাথায় হলুদ পাগড়ির সাথে সাদা টি-শার্ট পড়ার আইডিয়া কে দিয়েছে তোমাকে?”
আমি মৃদু স্বরে বললাম, “সায়রা চলে এসেছিল বলে আমি আগের মতো তৈরি হতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনি ওকে চলে যেতে বললেন দেখে আমি আর সম্পূর্ণ তৈরি হইনি। পাগড়ী আর টি শার্ট পড়েই চলে এসেছি। কেনো খারাপ লাগছে দেখতে? তাহলে খুলে ফেলি পাগড়ীটা।”
আমি মাথায় হাত দিয়ে পাগড়ী খুলতে গেলাম। তখন ঈশান আমায় আটকালেন। আমার হাত দুটো ধরে নিচে নামিয়ে আমার মুখের কাছে ঝুকে বললেন,
“আস্তো একটা কাঠগোলাপ লাগছে। একদম হলুদ-সাদার নেশা ধরানো মিশ্রণ। এতোটা সুন্দর! আমি তো পাগল হয়ে যাবো তারিন!”
আমি নিম্নাংশে নিবদ্ধ দৃষ্টি ঈশানের দিকে তাক করতেই এক জোড়া ঘোরমাখা চোখ খুজে পেলাম।ঈশানের ক্ষুদ্র দৃষ্টি দেখে আমার চোখ দুটো ডিম্বাকৃতি হয়ে উঠল। ঈশান আগের মতোই মৃদু কণ্ঠে বললেন,
“ফায়ার!”
আমি ঈশানের পেট বরাবর জোরে আঘাত করতেই উনি সরে দাড়ালেন। পেটে হাত রেখে অবাক স্বরে বললেন,
“কি হলো এটা?”
“আমাকে ফায়ার বলার শাস্তি এটা।”
ঈশানের কৌতুহলী দৃষ্টি মুহুর্তেই তীক্ষ্ণ হয়ে এলো। এক ভ্রু উচু করে উনি আমার ডানহাতটা টেনে ধরলেন। আমি ধমকের সুরে বললাম,
“কি হচ্ছে?”
ঈশান একটানে আমাকে ঘুরিয়ে আলমারির সাথে চেপে ধরলেন। আর আমার ডানহাতটা আমারই পিঠের সাথে লাগিয়ে শক্ত করে মিশিয়ে রাখলেন। আমি কিছুটা ব্যাথা পেয়ে শব্দ করলাম,
“আহ! ”
ঈশান বললেন, “ফায়ার বলার জন্য আমার শাস্তি যদি এমন হয়, তাহলে ফায়ার হওয়ার জন্য তোমার কেমন শাস্তি হওয়া উচিৎ? একটু ইমাজিন করো তো!”
আমি মুখ কুচকে আর্তনাদ করলাম, “ঈশান আমার ব্যথা লাগছে।”
কথাটা শেষ করার সাথেই সাথেই ঈশান আমায় ছেড়ে দিলেন। আর আমি এক লাফে বিছানায় উঠে বালিশ হাতে নিয়ে হাসতে লাগলাম। ঈশান কোমরে হাত রেখে কিছুক্ষণ আমার কান্ড দেখলেন। তারপর ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন। আমি পেছন থেকে ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,
“সত্যিই ব্যাথা পেয়েছি কিন্তু। এখনো ব্যাথা করছে।”
“তাই? দেখি কোথায় ব্যাথা করছে।”
ঈশান আমার দিকে ঘুরলেন। আমি ডানহাতটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,
“এইযে এখানে। কনুইয়ের জয়েন্টে ব্যাথা করছে।”
ঈশান আমার ডানহাতটা উনার দুই হাতের সাথে জড়িয়ে ফট করে একটা টান দিলেন। অদ্ভুত একটা শব্দ হতেই আমি চেচিয়ে উঠলাম। ঈশান বললেন,
“আস্তে! বাহিরে থেকে শোনা যায়।”
আমি ডানহাত ডলতে ডলতে বললাম,” এইমাত্র এটা কি করলেন আপনি?”
ঈশান মুচকি হেসে বললেন, “এখনো ব্যথা করছে?”
আমি কুচকানো ভ্রু নিয়েই মাথা নাড়লাম। মানে ব্যথা করছে না। ঈশান হো হো করে হাসলেন। আমি বোকার মতো তাকিয়ে বললাম,
“আপনি আমার হাত ভেঙে দেন নি তো?”
ঈশানের হাসি থামতে গিয়েও আবার শুরু হল। হাসতে হাসতেই উনি বললেন,
“ভাঙিনি বোকা। টেনে ঠিক করেছি।পেশি বেকে গিয়েছিল হয়তো। সেটাই ঠিক করেছি বুঝেছো? ”
বলতে বলতে আমার নাক টেনে দিলেন উনি। আমি মাথা চুলকে বললাম,
“তারিন! আমারও না একটা জায়গায় খুব ব্যথা করছে। ব্যাথাটা ভ্যানিশ করে দিবে?”
“কোথায় ব্যথা করছে?”
“এইযে, ঠিক এইখানটায়।”
বুকের বামপাশে হাত রাখলেন ঈশান। আমি ভ্রু উচু করে ঠোটে হালকা হাসি জমিয়ে বললাম,
“এই ব্যথা আমি কিভাবে ভ্যানিশ করবো শুনি?”
“কেনো? কালরাতের মতো!”
আমি মুখ হা করে সরুচোখে তাকালাম। আর বললাম,
“ঈশান! আপনি একটা, আপনি একটা..”
“আমি একটা?”
“আপনি একটা সাদা গোল্লা।”
বলেই দুম করে ঈশানের কোলে চড়ে উনার ঠোটের উপর হামলে পড়লাম আমি। আমার আচরণে ঈশান সম্পুর্ণ বাকরুদ্ধ। আমি নিজেও মোটামোটি অবাক। এই কাজ করার সাহস আমার কিভাবে হল সেই হিসেব নিজেও মিলাতে পারছি না। শুধু ঈশানের ঠোটের সাথে নিজের ঠোট দুটো মিলিয়ে চলেছি অবলীলায়। খানিক সময় পর ঈশানও আমায় খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। চুম্বনরত অবস্থাতেই আমায় বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন উনি। আমার মাথার পাগড়ীটা খুলে ভেজা চুলগুলো উন্মুক্ত হলো। নিজের চুলের গাঢ় সুভাষটা বেশ ভালোই উপলব্ধি হচ্ছে আমার। আর ঈশান? উনার পাগলামি যেন আরো কয়েক ধাপ বেড়ে গেছে। সম্পুর্ণ শরীরের ভার আমার উপর তুলে দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরলেন উনি । আমি ব্যথা পেয়ে উনার ঠোট ছেড়ে দিলাম। কিন্তু ঈশান ছাড়লেন না। ঠোটের পাশাপাশি আমার সম্পুর্ণ মুখে, গলার চারিপাশে সর্বানাশা সেই উষ্ণ পরশ ঢেলে দিতে লাগলেন। আমি বিছানার চাদর খামচে ধরলাম। ইচ্ছে করছে মরে যেতে, তাও যদি এই যন্ত্রণাময় প্রশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এই অবস্থায় আরেকবার দরজাটা ঠকঠকিয়ে বেজে উঠল। ঈশানের সেই উপলব্ধি নেই। আমি চাপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,
“ঈশান! কেউ এসেছে..”
ঈশান মাথা তুলে তাকাতেই বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে উঠে বসলাম আমি। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছি। ঈশান গিয়ে দরজা খুললেন। আর আমি সাদা কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখলাম। আবার সেই সায়রা মেয়েটা এসেছে। এবার কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে কে জানে? রুমের ভিতর ঢুকে পড়লে তো সর্বনাশ!
🍂
🍂
ঈশান আর আমার চোখাচোখির মাঝখানেই একটা মেয়ে হাতে লম্বা ট্রে সহ ভেতরে প্রবেশ করল। মেয়েটার পরনে সাদা ধুতি টাইপ সেলোয়ার। পেস্ট আর ক্রিম কালার মিক্সড কামিজ, ধুসর রঙের ওরনাটা গলায় একদম আটশাট ভাবে ঝোলানো। সিঙারাতে বাদাম যেমন অপ্রয়োজনীয় জিনিস, এই মেয়েটার ওরনাটাও তেমন। অপ্রয়োজনীয়। টি টেবিলে খাবারগুলো রেখে মিষ্টি করে হাসলো মেয়েটি। ন্যাকামি করে চুলগুলো কানে গুজতে গুজতে সাফিন ভাইয়াকে সালাম দিল,
মেয়েটি আড়চোখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “জী ভালো।”
ঈশানের বাচনভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনি এই মেয়েটির উপস্থিতিতে চরম বিরক্ত। আর মেয়েটা আড়চোখে উনার দিকে তাকিয়ে হাসার পর উনার সেই বিরক্তি ক্ষিপ্ততার রুপ নিয়েছে। নাকের ডগায় গোলাপী আভা জমে উঠেছে উনার। আমি মেয়েটার ছন্দবিশ্লেষণ করতে লাগলাম। দেখতে শুনতে ভালোই। গায়ের রঙ অনেকটা কাজু বাদামের মতো। চোখ তেমন একটা সুন্দর না, আর ঠোটদুটো.. উহুম! এই মেয়ের ঠোটের থেকে আমার ঠোটই বেশি সুন্দর। মেয়েটার চুলগুলো লালচে,সনের মতো। কিন্তু আমার চুল কালো। রেশমের মতো। অবশ্যই আমার চুল সুন্দর। কিন্তু এটা আমি কি করছি? এই মেয়ের সাথে নিজের তুলনা কেনো করছি? এতো লেইম চিন্তাভাবনা আসছেই বা কি করে আমার মাথায়? আজব! হঠাৎ খেয়াল করলাম ভদ্রমহিলা আর মেয়েটা কেমন বিব্রতকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রমহিলার দৃষ্টি একটু বেশিই আপত্তিকর। আমাকে নিজের মেয়ের দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রমহিলা আবার সন্দেহ করছেন না তো? সামহাউ উনার এটা মনে হচ্ছে না তো যে আমি উনার মেয়ের সাথে লাইন মারছি? তাহলে তো মহা মুশকিল! ছেলেদের সমস্যাগুলো আমি এখন বুঝতে পারছি। স্বাচ্ছন্দ্যে কোনোদিকে তাকানোও যায়না। সবাই শুধু সন্দেহ করে। আমি মাথা নিচু করে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেটাই বেস্ট অপশন। ভদ্রমহিলা আমাকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে বললেন,
“আমার মেয়ে এইটা। সায়রা। সায়রা ফারজানা।”
উত্তরে আমি কিছু বলতে গেলেই সাফিন ভাইয়া আমার কাধ খামচে ধরলেন। আমি চুপ করে গেলাম। ভদ্রমহিলার বিস্মিত দৃষ্টির উত্তরে সাফিন ভাইয়া হাসার চেষ্টা করে বললেন,
“ঈশানের কাজিন। আশফাক তারিক। আসলে ছেলেটা বাক প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারেনা।”
ভদ্রমহিলা খানিক অবাক হয়ে মায়া জড়ানো কণ্ঠে বললেন,” ও আচ্ছা!”
আমি অবাকচোখে তাকাতেই সাফিন ভাইয়া বিড়বিড় করে বললেন,
“তুমি কথা বললে সবাই বুঝে যাবে না, ছেলে না মেয়ে?”
কথাটা শুনে আমি একদম সাইলেন্ট মেরে গেলাম। এখন খালি মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে গেলেই বিপদ। চরম বিপদ। সায়রা মেয়েটি আবার ন্যাকা ন্যাকা ভাব শুরু করল। ঈশানের সামনে গিয়ে খুব আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“আজকে কখন আসবেন ভাইয়া? সন্ধ্যায় নাকি রাতে?”
ঈশান আড়চোখে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন, “জানিনা।”
বলেই পর্দাটা ঠাস করে সরিয়ে বের হয়ে গেলেন। ঈশানের উত্তরে সায়রা হতাশ হল। সেও বেরিয়ে গেল ঈশানের পেছন পেছন। তাই দেখে ভদ্রমহিলা জোর পূর্বক হেসে বললেন,
“ছেলেটা যে কেনো এমন! সারাখন মেজাজ গরম থাকে।”
সাফিন ভাইয়া উত্তরে মৃদু হাসলেও আমার দৃষ্টি দরজার বাহিরে।ক্রমাগত উঁকিঝুঁকি মারছি আমি। ভদ্রমহিলা আরেকবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি মাথা নিচু করে নিলাম। এই মহিলা হয়তো ভাবছেন আমি উনার মেয়েকে খুজছি। কিন্তু আসলে তো আমি আমার ঈশানকে খুজছি।এইটা কে বোঝাবে উনাকে?ধুর ভাল্লাগেনা! সাফিন ভাইয়া হয়তো আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। তাই ভদ্রমহিলাকে বললেন,
“আচ্ছা আন্টি আমরা এখন একটু ঈশানের ঘরে যাই।”
ভদ্রমহিলা দ্রুত বললেন, “হ্যা যাও!”
ঈশান জানালা ধরে দাড়িয়ে আছেন। উনার নির্বিকার দৃষ্টি বাহিরের খোলা মাঠে স্থির। আমি বিছানায় বসে আছি। খুব অগোছালো রুম। বিছানার চাদরটা পর্যন্ত এক সাইডে পড়ে আছে। ফ্লোরে সারিবদ্ধভাবে কাচের বোতল সাজানো। গ্লাস কয়েকটা উল্টো হয়ে পড়ে আছে। সেই সাথে পড়ে আছে রঙিন পানি। সাফিন ভাইয়া চেয়ারে বসে কিছু একটা চিন্তা করছিলেন। তারপর হুট করে বলে উঠলেন,
“ঈশান! ও তারিন।”
সাফিন ভাইয়ার কথা শুনে আমি ধক করে উঠলাম। ঈশান জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাফিন ভাইয়ার দিকে ঘাড় ঘুরালেন, কিন্তু তাকালেন না। শুধু বললেন,
“মানে?”
সাফিন ভাইয়া দুইহাত পেতে দিয়ে বললেন, “মানে তারিনকে নিয়ে এসেছি। এইটা তারিন। সারাদিন যার নাম ধরে যিকির পড়িস, প্রতি বাক্যে দশবার করে যার কথা শুনিয়ে কানের পোকা বের করে ফেলিস, যার জন্য জেন্টালম্যান থেকে মাতালম্যান হয়েছিস।এইটাই সে। তারিন।”
ঈশান সাফিন ভাইয়ার দিকে সম্পুর্ন ঘুরে তাকালেন। কিছুক্ষণ সোজামতো দাড়িয়ে রইলেন। সাফিন ভাইয়া হাত উঠিয়ে বললেন,
“তাকায় আছে বোকার মতো। কানে শুনতে পাস না? আরে বেটা তারিন, তারিন! বিয়া-টিয়া কিচ্ছু হয়নাই ওর। তোর শালায় তোরে ঢপ মারছে ঢপ। ধাপ্পাবাজী করছে। বুঝছোস?”
ঈশান কুচকানো ভ্রু নিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি চশমা, পাগড়ি, আর্টিফিশিয়াল দাড়ি, সব খুলতে শুরু করলাম। কালো কোর্টের আড়াল থেকে বেরিয়ে সাদা টি শার্ট পরিহিত অবস্থায় উঠে দাড়ালাম। ঈশান হা করে তাকিয়ে আছেন। যেন কোনো ভুত দেখছেন। চোখেমুখে চরম বিস্ময় উনার। তৃপ্তিভরা বিস্ময়। আমি আবেগে সিক্ত হয়ে কেদে ফেললাম। ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গিয়ে ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরলাম। আমার ভারে ঈশান কয়েক কদম পিছিয়ে পড়লেন। আমার পা জমিন থেকে কমপক্ষে হাফ ফিট উপরে। কিছু সময় পর উনিও নিজের সাথে মিশিয়ে ধরলেন আমায়। উনার সাপোর্ট পেয়ে আরো একটু উচুতে উঠে ঈশানের দুই গালে, কপালে, নাকে সারামুখে চুম্বন শুরু করলাম। সাফিন ভাইয়ার উপস্থিতি সম্পুর্ণ ভুলে গেছি। যেন দুনিয়াতে ঈশান ছাড়া আর কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। ঈশানের অবস্থাও তাই। আমাকে টেনে তুলে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে শুরু করলেন।চোখ দুটো উনার পিপাসার্ত, অনুভুতিতে সিক্ত। ক্ষুধার্ত এই দৃষ্টি দিয়ে যেন আমাকে ভক্ষণ করছেন উনি। আমি পুনরায় উনার গলা জড়িয়ে ধরলাম। ঈশান প্রশান্তির একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ধীরকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
“এটা কি স্বপ্ন তারিন? যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে আমি জাগতে চাইনা।চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে থাকতে চাই।”
আমি কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললাম,” স্বপ্ন না, সত্যি। সত্যিই আমি এসেছি ঈশান। সব ছেড়ে, আপনার কাছে চলে এসেছি।বাস্তবে আমি এসেছি। দেখুন আমায়।”
আমি মাথা তুলে তাকালাম। ঈশান কাতর কণ্ঠে বললেন,
“তাহলে আমি আর কখনো ঘুমাতে চাইনা।”
“কেনো?”
“যদি আবার হারিয়ে যাও!”
“আপনি ঘুমালে আমি হারিয়ে যাবো ?”
“সেদিন তো ঘুমের জন্যই হারিয়েছিলাম তোমাকে। এমন আর কোনোদিন হবে না। আর কখনো ঘুমাবোই না আমি! প্রমিস! ”
ব্যাকুল কণ্ঠে ‘প্রমিস’ উচ্চারণ করলেন উনি। ঈশানের পাগলামিতে আমি কান্নারত অবস্থাতেই হাসলাম। উনি আমাকে হারানোর জন্য নিজের ঘুমকে দোষারোপ করছেন!সাফিন ভাইয়া সশব্দে করতালি বাজালেন। চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে বললেন,
“নিজেকে এখন সিনেমার কমেডিয়ান মনে হইতাছে আমার। মানে হাততালি দেওয়া ছাড়া তো আর কোনো কাজ নাই। দেখ তোদের লজ্জা শরমের বালাই নাই-ই থাকতে পারে, কিন্তু আমার তো আছে। তাই আমি যাইগা। বিরিয়ানির এলাচি হইয়া কি লাভ! বায়। তোরা চালায় যাহ!”
সাফিন ভাইয়া হাত নাড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই ঈশান ডাকলেন,
সাফিন ভাইয়া ‘চিক’ টাইপ শব্দ করে এক চোখ টিপে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলেন।
🍂
চলবে
#তি_আমো❤
#পর্ব_৩২
Writer: Sidratul muntaz
🍂
তারিন, কতদিন দেখিনা তোমাকে। তোমার কণ্ঠস্বর শুনিনা, তোমার চুলের স্পর্শ, মিষ্টি হাসির খিলখিল শব্দ,তোমার শরীরের সুভাষ, গভীর চোখের দৃষ্টি, লজ্জামাখা মুখ, নেশার মতো টানছে আমায়। এই টান আমার ভিতরটা উত্তাল করে তুলছে। বেসামাল জোয়ারের অতল স্রোত ভাসিয়ে দিচ্ছে আমার ভেতরটাকে, ধ্বংসাত্মকভাবে এলোমেলো করে দিচ্ছে সবকিছু। ব্যাকুল হয়ে একটিবার তোমাকে কাছে পেতে বারবার আকুতি জানাচ্ছে এই মন। বুক ভরে শ্বাস আসছে না। আমি হাপিয়ে উঠছি, ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। তুমিহীন এই জীবন বিষের চেয়েও বিষধর লাগছে। দুর্বলতা ঘিরে ধরছে আমাকে। আমি মরে যাচ্ছি তারিন, বাচাও আমাকে। এই বিষাক্ত যন্ত্রণা থেকে বাচাও। কেমন জ্বালা এটা? কেনো মানতে পারছি না আমি, কেনো বুঝতে চাইছি না যে__তুমি আমার নেই! সত্যিই কি আমার নেই তুমি? ভুলে গেছো? বিয়ে করে নিয়েছো? কিভাবে পারলে তারিন! না তুমি এটা করতে পারো না। যে যাই বলুক আমি বিশ্বাস করিনা। এতোটা স্বার্থপর আমার তারিন হতেই পারেনা। এতোবেশি নিষ্ঠুরতা আমার তারিনের মনে থাকতে পারেনা। আমার তারিনের ছোট্ট মনটা যে বড্ড কোমল। সেই কোমল মনে আমি ছাড়া অন্যকারো ঠাই হতেই পারেনা। আমার মিষ্টি পরীটা আমাকেই ভালোবাসো। আমার মতোই ভালোবাসে। তাই না মিষ্টি? বলো তাইনা? তাহলে কেনো ডাকছো না আমাকে? আমি যে তোমাকে খুজে খুজে পাগল হয়ে যাচ্ছি। কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি? নিজে থেকে কেনো ধরা দিচ্ছো না? আমি তো আর কষ্ট নিতে পারছি না। একবার সামনে এসো তারিন, শুধু একবার সামনে এসো। তোমাকে নিজের সাথে এমনভাবে বেধে ফেলবো, যেন আর কক্ষনো হারাতে না হয়। কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। তখন চোখের সমস্ত তৃষ্ণা মিটিয়ে তোমাকে দেখবো।এই কাতর চোখজোড়ার একমাত্র চাহিদা তোমার মায়া ওই জড়ানো মুখ। জানো কি তারিন, চোখের পাতা এক করলেই তুমি আমার কাছে চলে আসো। মিষ্টি মুখের সেই নিষ্পাপ হাসিটা দিয়ে আমার মনের আলোড়ন জাগিয়ে তোলো। আমি আর ঘুমাতে পারিনা। ঘুমাতে চাইও না।অভিশপ্ত ঘুম আর কোনোদিন ঘুমাতে চাইনা আমি। এই ঘুম নামক অভিশাপটাই তো আমার থেকে তোমাকে আলাদা করেছে! প্রচুর আফসোস হয়, সেদিন কেনো ঘুমালাম আমি? যদি না ঘুমাতাম, তাহলে হয়তো এখনো তুমি আমার কাছে থাকতে.. ইচ্ছে হলেই বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতাম তোমাকে। তোমার চুলে মুখ গুজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতাম। কিন্তু তুমি তো নেই তারিন, কেনো নেই তুমি? ফিরে এসো প্লিজ! একটিবার…
আমি শব্দ করে কেদে ফেললাম, ঈশানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েই নিজের মুখটা দু’হাতে চেপে ধরলাম৷ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নাটা নিয়ন্ত্রণ করে আবার নজর দিলাম ডায়েরিতে।প্রতিটি ভাজে আরো অসংখ্য লেখা, কিন্তু সবটুকু পড়ার সাহস আমার হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে ডায়েরিটা বন্ধ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে। সশব্দে চিৎকার দিয়ে কাদতে। ঈশানের কষ্টের ভারটা নিজের করে নিতে। আমার অনুপস্থিতি এতোটা পুড়িয়েছে উনাকে?এতোটা কষ্টে কাটিয়েছেন দিনগুলো! আমি মুখ ভেঙে ক্রন্দনরত অবস্থায় ঈশানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিষ্পাপ মুখটা নিগুঢ় নিদ্রায় বিভোর। উনার চেহারায় সেই আগেরমতো চাকচিক্যতা আর নেই। সুন্দর চেহারাটা মলিন হয়ে গেছে, খুব নিষ্প্রাণ লাগে এখন। মাথার চুলগুলো খুব অগোছালো, খড়ের মতো। খোচা খোচা দাড়িগুলোও অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে জট বেধেছে। বেশ জীর্ণশীর্ণ অবস্থা উনার। কিন্তু তবুও, কোনো এক অদ্ভুত কারণে.. ঈশানকে এই রুপেও সুন্দর লাগছে। ভীষণ সুন্দর! এক কথায় দারুণ। আমি আমার চোখমুখ মুছে ঈশানের দিকে ঝুকলাম। মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে উনার কপালে আলতো করে চুমু দিলাম। ইচ্ছে করছে পুরো মুখটাই অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিতে! কিন্তু সেটা সম্ভব না, যদি উনি জেগে যান। অনেকদিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। শান্তিময় ঘুম। এই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে উঠে বসলাম আমি। তখনি দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। আমি ঝড়ের গতিতে মাথার পাগড়িটা পড়ে, চশমা তুলে সম্পুর্ণ প্রস্তুত হয়ে নিলাম। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখলাম সাফিন ভাইয়া এসেছেন। উনাকে দেখে আমি খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। সাফিন ভাইয়া বিছানার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ঈশান ঘুমাচ্ছে নাকি?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম। উনি আমার হাত ধরে বললেন,
“এসো আমার সাথে। ”
আমি প্রশ্ন না করে এগিয়ে গেলাম৷ বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম দু’জন। সাফিন ভাইয়া দেয়াল ধরে দাড়িয়ে পকেটে হাত রেখে খুব সিরিয়াস একটা ভাব নিয়ে বললেন,
“তারু! এখন আমি তোমাকে খুব জরুরী কিছু কথা বলবো।”
“ঠিকাছে বলুন।”
“এই কয়েক মাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে ।এই ঈশান আর আগের ঈশানের মধ্যে কিন্তু আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সম্পুর্ণ পাল্টে গেছে ঈশান। এমনকি ওর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, পরিবার-পরিজন, সবকিছু পরিবর্তন হয়েছে। এখন ওর জীবনটা অন্যপথে চলছে।”
সাফিন ভাইয়া আমার দিকে ঘুরলেন। হাত ভাজ করে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন,
“একটু আগে যে পরিবারটাকে দেখলে, আন্টি-আঙ্কেল, সায়রা.. এরাই কিন্তু এখন ঈশানের আপনজন। ফারায আঙ্কেল ঈশানকে সেপারেট করে দিয়েছেন। ঘটনা শুনেছো নিশ্চয়ই?”
আমি হ্যাসূচক মাথা নাড়লাম। সাফিন ভাইয়াও হালকা মাথা দুলিয়ে বললেন,
” ঈশানকে সেপারেট করার মুল কারণ কিন্তু দুটো। প্রথমটা হল ঈশানের অযাচিত আচরণ। মাঝরাতে বেলেল্লাপণা, ড্রিঙ্ক – ড্রাগস, অগোছালো জীবন-যাপন। ডিপ্রেশনে ঘরবন্দী থাকা। ফারায আঙ্কেল এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেলে ঈশান খুব রুঢ় আর অশালীন উত্তর দিয়েছিল। সে রাতে খুব আপত্তিকর ঘটনায় আঙ্কেল ঈশানকে আঘাত করেছিলেন। বাসা থেকে বের হয়েও যেতে বললেন, তাও খালিহাতে। আর ঈশানও রাগের মাথায় তৎক্ষণাৎ বাসা থেকে বের হয়ে যায়। মোহনা আন্টি মাঝরাতে নিহাকে ফোন করে সব বলার পর আমি ঈশানকে আমার বাসায় নিয়ে আসলাম৷ কিছুদিন থাকার পর ও সেখান থেকেও চলে গেল। কোথায় গেল কেউ জানতাম না। তারপর হঠাৎ একদিন আন্টি মানে সায়রার আম্মু ফারায আঙ্কেলকে ফোন করে বললেন ঈশানকে হসপিটালে পাওয়া গেছে। রাস্তার মাঝখানে পড়েছিল। কারা যেন হসপিটালে দিয়ে গেছে। আর আন্টি তখন সায়রাকে নিয়ে একই হসপিটালে ছিলেন। তাই ফরচুনেটলি দেখা হয়ে যায়। ফারায আঙ্কেল ঈশানের খবর কাউকে জানায় নি। আমাকে জানিয়েছেন কারণ ওই সময় আমি আঙ্কেলের সাথে ছিলাম। এই কথা যেন কাউকে না জানাই সেটা আঙ্কেলেই আমাকে বলেছে। ”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম, “কিন্তু আঙ্কেল এটা কেনো করলেন?”
“কারণটা তোমার মতো আমিও সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারপর উনি যেটা বললেন..”
“কি বলেছেন?”
“মোহনা আন্টি যদি জানতে পারতেন ঈশান সায়রাদের বাসায় আছে, তাহলে তখনি গিয়ে ঈশানকে নিয়ে আসতেন। কিন্তু ফারায আঙ্কেল সেটা চান না। উনি চান, ঈশান সায়রাদের বাসাতেই থাকুক। ”
“কেনো? আঙ্কেল তখনো রেগে ছিলেন ঈশানের উপর? আর ঈশানকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার দ্বিতীয় কারণটা তো বললেন না?”
সাফিন ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকালেন। তারপর বললেন,
“কারণটা তুমি। ”
“আমি?”
“হ্যা। তোমার সাথে ঈশানের বিয়েটা মোহনা আন্টি দিয়েছিলেন তাইনা? আঙ্কেল কিন্তু তখন দেশে ছিলেন না। উনি সুইডেন ছিলেন। বিয়েটা আঙ্কেলের পারমিশন ছাড়াই দেওয়া হয়েছিল। আর মোহনা আন্টি পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি। কারণ আন্টি ভেবেছিলেন, আঙ্কেল তোমাকে দেখলেই মেনে নিবে। কিন্তু আঙ্কেল নিজের ছেলের জন্য অনেক আগে থেকেই মেয়ে পছন্দ করে রেখেছেন। সেটা মোহনা আন্টি জানতো না।”
“মেয়ে পছন্দ করে রেখেছে? কাকে?”
“সায়রাকে।”
আমি আহত দৃষ্টিতে তাকালাম। সাফিন ভাই বললেন,
“সায়রাকে পছন্দ করার একটা বিশেষ কারণ আছে। সাধারণ কারণটা হল, সায়রা ছোটবেলা থেকেই ঈশানকে ভালোবাসে। আর বিশেষ কারণটা হল, সায়রার জন্যই ঈশান বেচে আছে।”
আমি ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম, মানে?
“ছোটবেলায় একবার সায়রা ঈশানের জীবন বাচিয়েছিল। ঈশান তখন ক্লাস এইটে পড়ে। আর সায়রা ক্লাস টুতে। পিচ্চি মেয়েটা নিজের ভরই সামলাতে পারতো না। কিন্তু ঈশানকে ঠিকই সামলে নিয়েছিল। ”
আমি কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছি। সাফিন ভাইয়া আরো খোলাশা করে বললেন,
“ফারায আঙ্কেলের সাথে সায়মন আঙ্কেলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা প্রায় ত্রিশ বছরের। প্রায় এগারো বছর আগে দুজনই পরিবার নিয়ে ট্যুরে গিয়েছিলেন, কোনো এক দ্বীপরাজ্যে। প্রায় একুশদিনের মতো সেখানে অবস্থান করেছিল দুই পরিবার। তখন ঈশানের সাথে সায়রার পরিচয়টা গাঢ় হয়। ঈশান সায়রার অনেক সিনিয়র ছিল, তাই সে ছোটবোনের মতো ট্রিট করলেও সায়রা হয়তো অন্যকিছুই ভাবতো।একদিন ঈশান বালুচরে বসে বেহালার সুর তুলছিল। বেহালা বাজানো ছোটবেলা থেকেই ঈশানের শখ। ও খুব মগ্ন হয়ে বেহালা বাজাতো।সেদিন বেহালা বাজানোর সময় চোরাবালির কবলে পড়ে মাটির সাথে ক্রমান্বয়ে মিশে যেতে লাগল ঈশান। তখন সায়রা ঘোড়ার পিঠে চড়ে সম্পুর্ণ দ্বীপে চক্কর দিচ্ছিল। ঈশানের ওই অবস্থা থেকে ঘোড়ার গলা থেকে দড়িটা খুলে নিয়ে ঈশানের বেহালার সাথে বেধে ফেলে সায়রা। তারপর বেহালার ডাট দিয়ে ঘোড়া পিঠে আঘাত করে। ঘোড়া ছুটতে শুরু করলে ঈশানও গভীর বালুচর থেকে বেরিয়ে যায়। আর ঘোড়ার পেছনে চলতে থাকে, বেহালা হাত থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর ঈশান থেমে যায়। এই ঘটনায় সম্পুর্ণ দ্বীপে মানুষ জড়ো হয়ে যায়। সবাই সায়রার সাহসিকতার প্রশংসা করে। তখনই ফারায আঙ্কেলের মাথায় ভুত চাপে ঈশানের সাথে সায়রার বিয়ে দেওয়ার। আর এখন পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তে উনি অটল। ”
সাফিন ভাইয়া আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নিচু করে আছি। সাফিন ভাইয়া বললেন,
“এতোগুলো বছর কেটে গেছে, সায়রা এখনো ঈশানের জন্য আগের মতোই পাগলামি করে। কিন্তু ঈশানের সেরকম ফিলিংস কখনোই ছিল না। সে শুধু কৃতজ্ঞতার খাতিরে সায়রার সাথে যোগাযোগ রাখতো। সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলতো। ”
আমি চুপ। সাফিন ভাইয়া দীঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“তোমাকে ছেলে কেনো সাজানো হয়েছে জানো? ”
আমি না সুচক মাথা নাড়লাম। সাফিন ভাইয়া উত্তরে বললেন,
“সায়রার পরিবার যেন তোমাকে চিনতে না পারে।”
“চিনতে পারলে কি হবে?”
“আপাতত সায়রার সাথে ঈশানের বিয়ের পরিকল্পনা চলছে। ঈশান যদি সায়রাকে বিয়ে করতে রাজি না হয়, তাহলে ফারায আঙ্কেল বলে দিয়েছে কোনোদিনই ঈশানকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে না। সবকিছু থেকে বঞ্চিত করবে। এ অবস্থায় যদি তোমার ফিরে আসার ব্যাপারটা সায়রা আর তার বাবা-মা জানতে পারে, তাহলে বিয়ে ভেঙে যাবে। তখন সব দায় তোমার উপর এসে পড়বে।”
“তাহলে কি এবার..”
“আমরা এসব কিছুই হতে দিবো না তারু। ঈশান সায়রাকে রিজেক্ট করলে ফারায আঙ্কেল ঈশানকে ত্যাগ করবে। কিন্তু যদি এমনটা হয়, সায়রাই ঈশানকে রিজেক্ট করল? তখন কিন্তু ঈশানের কোনো দোষ থাকবে না। তোমারও কোনো দোষ থাকবে না।আঙ্কেল তোমাদের দুজনকেই মেনে নিতে বাধ্য হবে।”
সাফিন ভাইয়ার কথাটা আমার পছন্দ হল। কিন্তু সায়রা ঈশানকে কেনো রিজেক্ট করবে? সেটা কি আদৌ সম্ভব? আমার ভাবনার মাঝেই খুব জোরে একটা শব্দ হল। ঈশান হয়তো জেগে গেছে। আমি ঘরের দিকে ছুটতে নিলেই সাফিন ভাইয়া আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি অবাকচোখে তাকিয়ে বললাম,
“কি হলো?”
“যেও না এখন।”
“কেনো যাবো না? ঈশান আমাকে বলেছিলেন উনার পাশে বসে থাকতে। কিন্তু আমি চলে এসেছি। সেজন্য উনি রেগে যেতে পারে। আমি যাই।”
“না তারু। কথা শোনো আমার। যেও না। ঈশান মাত্র ঘুম থেকে জেগেছে। এই অবস্থায় ও স্বাভাবিক থাকে না। এখন ও তোমার সাথে রুড বিহেভ করবে। তুমি কষ্ট পাবে।”
“কি বলছেন? কেনো রুড বিহেভ করবে? কিচ্ছু হবে না। আমাকে যেতে দিন প্লিজ।”
আমি সাফিন ভাইয়ার আর কোনো কথা না শুনেই নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে গেলাম।সাফিন ভাইয়া পেছন থেকে নাকেমুখে ডাকছেন, “যেওনা তারু। কথা শোনো।যেওনা…”
🍂
🍂
বিছানার দেয়াল ঘেষে টেবিল ল্যাম্পটা হাল্কা ছুয়ে বসে আছি আমি। রুমটা মোহনা আন্টির। আমার সামনে বসেও আছেন তিনি। কেমন আছি,চেহারার এই হাল কেনো ইত্যাদি টুকটাক প্রশ্ন করছেন। আমি তেমন কোনো উত্তর দিতে পারছি না। শুধু কাদছি। নিহা ভেতরে এসেই আমাকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিল। এক ঢোকে সম্পুর্ণটা শেষ করলাম। তারপর আবার কাদতে গিয়ে বিষম খেলাম। মোহনা আন্টি আমার মাথা হাত রাখলেন, দুই-একটা চাপড় দিলেন। আমি শান্ত হয়ে বসলাম। আন্টি বললেন,
“সাবধানে খেতে হয় তো মা! এতো অস্থির হলে চলে? কি হাল করেছো বলোতো চেহারাটার? চেনাই যাচ্ছে না। আমি তো প্রথম দেখে চিনতেই পারিনি তোমাকে।”
আমি মাথা নিচু করলাম। নিহা বলল,
“ফিরতে অনেক দেরি করে ফেলেছিস তারু। খুব বেশিই দেরি হয়ে গেছে। যদি আর দুইটা মাস আগে আসতি না..”
মোহনা আন্টি হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“কিচ্ছু দেরি হয়নি। ঈশান যদি শুধু একবার জানতে পারে যে তারিন ফিরে এসেছে, তাহলে সেও ফিরে আসবে। যেখানেই থাকুক ফিরে আসবেই। এই নিহা, সাফিনকে একটা ফোন করো না। বলো বাসায় আসতে। তারিনকে দেখে যাক সেও।”
“ফোন করেছি আন্টি। ও আসছে।”
“তাহলে তো খুব ভালো।তুমি একটু অপেক্ষা করো তারিন। সাফিন আসলেই ঈশানের খবর পাওয়া যাবে। আচ্ছা নিহা, তুমি তারিনের সাথে বসে কথা বলো। আমি কুইনকে দেখে আসছি।”
“আচ্ছা আন্টি। ”
মোহনা আন্টি চলে যাওয়ার পর নিহা আমার সামনে বরাবর বসল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কেমন আছিস?”
আমি উত্তর না দিয়ে আবার মরাকান্না জুড়লাম। নিহাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলাম। কান্নাময় ককষ্টগুলো বিসর্জন দেওয়ার পালা এবার। বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর নিহা টেনে তুলল আমায়। আমি চোখমুখ মুছলাম। নিহা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“কাদিস না থাক। শান্ত হো এবার।”
আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললাম, “ঈশান কোথায়?”
নিহা নাসূচক মাথা নেড়ে বলল, “জানিনা। ফারায আঙ্কেল বের করে দিয়েছে। অনেক ঝামেলাও হয়েছে এসব নিয়ে। বিরাট ঝামেলা।”
“কি এমন করেছে উনি? যে বের করে দিলেন?”
“বললে বিশ্বাস করবি না।”
“বল না আগে!”
“ড্রাগস নিতো।”
“কি?”
“হুম। সব তো তোর জন্যই তারু। তোর বিয়ের খবর শুনে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন উনি। প্রথম কিছুদিন স্বাভাবিক থাকলেও দিন যত বাড়ছিল ততই অগোছালো আর বেসামাল হয়ে পড়ছিলেন উনি। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কিচ্ছু ঠিক চলছিল না। সবথেকে বেশি সাফার করেছে মোহনা আন্টি। ঈশান ভাইয়া কি যে পাগলামি গুলো করতেন। গাড়ি নিয়ে এক্সিডেন্ট করেছে কয়বার জানিস? ফুলস্পিডে হাইওয়ে তে নেমে গাড়ি চালাতেন। কয়বার যে এর জন্য থানায় যেতে হয়েছে। সারাদিন বাহিরে বাহিরে ঘুরতেন, বারে থাকতেন। মাঝে মাঝে পার্কের বেঞ্চিতে অতপ্রোতভাবে খুজে পাওয়া যেতো। সাফিন ধরে নিয়ে আসতো। প্রতিদিন রাতে এসব নিয়ে গেঞ্জাম হতো বাসায়। ঝগড়া হতো। ফারায আঙ্কেল তো থাপ্পড়ও দিয়েছিলেন ঈশান ভাইয়াকে। আর তাতেও উনার কোনো মতিভ্রম হয়নি। বরং ড্রিংক করে তিনদিন বিছানায় বেহুশ হয়ে ছিলেন। তবুও ফারায আঙ্কেলের ধৈর্য ছিল, ভেবেছিলেন ঈশান ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখন ড্রাগসের ব্যাপারটা জানাজানি হল, তারপর আর সহ্য করতে পারেন নি আঙ্কেল। সেদিনই এক কাপড়ে ঈশান ভাইয়াকে বের করে দিয়েছেন বাসা থেকে। ফোনটা পর্যন্ত নিতে দেন নি। সাথে একটা পয়সাও না, সম্পুর্ণ খালিহাতে।”
আমি হাটু জড়িয়ে বসে আছি। চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম,
“তারপর?”
নিহা চোখের কোণ মুছে বলল,” তারপর আমি আমার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে রেখেছিলাম ক’দিন। মা উনাকে খুব পছন্দ করেতেন।সেখানেও আগের মতোই সারাদিন এক ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকতেন। প্রায় রাতেই জ্বর আসতো। আমি জ্বর পট্টি দিতে যেতাম। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করতেন তোর কথা। এমন কোনো দিন নেই যে তোর নাম উচ্চারণ করে নি উনি। উঠতে বসতে শুধু তারিন, তারিন আর তারিন। মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলেন। উনার চেহারা দেখলেই কান্না পেতো আমার।এতোটা অসহায় ছিলেন, তারপর হঠাৎ একদিন কি হলো জানিস? সকাল সকাল লাপাত্তা হয়ে গেলেন বাসা থেকে। কোথায় গিয়েছেন, কেমন আছেন কিচ্ছু জানিনা। এখন পর্যন্ত কোনো খোজ পাইনি। তবে সাফিনের সাথে নাকি দেখা হয়েছিল একবার।”
আমি উৎকণ্ঠা নিয়ে বললাম,” সাফিন ভাইয়া জানে উনি কোথায় আছে?”
“জানিনা দোস্ত! আমাকে কিছু বলেনা এই ব্যাপারে। ও আসলে তুই জিজ্ঞেস করিস। তোকে অবশ্যই বলবে।”
কথার মাঝখানেই একটা পিচ্চি মেয়ে ভেতরে ঢুকল। মেয়েটার হাতে একটা টুথপেষ্ট আর ব্রাশ। টুথপেষ্ট টা হাতের মুঠোয় রেখে ব্রাশ দিয়ে দেয়াল ঘষছে সে। আমি বললাম,
“এমন করো না। নোংরা হয়ে যাবে তো ওইটা। ”
আমার কথা শুনে মেয়েটা তৎক্ষণাৎ দেয়াল থেকে ব্রাশ টা সরিয়ে মুখ দিয়ে দিল। আমি আরো জোরে শব্দ করলাম,
“ছি! ময়লাটা মুখে দিচ্ছো কেনো?”
নিহা হেসে দিয়ে বাচ্চাটার কাছে গেল। ব্রাশআর পেষ্ট হাত থেকে নিয়ে পিসি টেবিলে রাখল। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“ও এমনই। এতোবড় হয়ে গেছে এখনো ঠিক করে কথা বলতে পারে না জানিস? শুধু যাকে তাকে ধমক দিতে পারে। শুপ! শুপ করে দাও তো আপুকে একটা। ”
মেয়েটা নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে থেকে আঙুল উঠিয়ে উচ্চারণ করল, “শুপ!”
নিহা জোরে হাসল। আর মুচকি হেসে জানতে চাইলাম,
“কে ও?”
নিহা মেয়েটিকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলল,” কুইন।”
আমি মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকালাম। চেনা চেনা লাগছে। আচ্ছা এই মেয়েটাই কি তখন ঈশানের ফোন ধরেছিল? নিহা বলে উঠল,
“তারু, সাফিন চলে এসেছে। তুই কথা বলবি না?”
আমি সামনে তাকালাম। সাফিন ভাইয়া দরজায় দাড়িয়ে। আমি তাকাতেই দীর্ঘ হাসি দিলেন উনি। এগিয়ে এসে বললেন,
“হায় তারিন।এমন হাড্ডিসার রোগীর মতো অবস্থা কেন তোমার? চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে এখনি বেরিয়ে আসবে। ধরো ধরো ধরো!”
বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন উনি। আমি ভয় পেয়ে বললাম,
“কি ধরবো?”
“তোমার চোখ।”
নিহা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ধুর, ইয়ার্কি করো না। ও মরছে ওর টেনশনে.. আচ্ছা ঈশান ভাইয়ার কোনো খবর জানো?”
সাফিন ভাইয়ার উৎফুল্লকর হাসি এবার চিন্তাময় হাসির রুপ নিলো। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে “হুম” উচ্চারণ করলেন উনি। যার অর্থ “হ্যা’ও হয়ে পারে আবার ‘নাও’ হতে পারে।
নিহা বলল,” আচ্ছা ঠিকাছে। তাহলে তুমি তারুর সাথে কথা বলো। আমি কুইনকে নিয়ে যাই। এসো কুইন!”
আমি পরম উৎসাহী কণ্ঠে বললাম, “তাহলে আমাকে নিয়ে চলেন না। আমি যাবো সেখানে। প্লিজ!”
🍂
#তি_আমো❤
#পর্ব_৩০(অতিরিক্ত)
Writer: Sidratul muntaz
🍂
বর্তমানে সাফিন ভাইয়ার সাথে গাড়িতে বসে আছি। উনি আমায় নিয়ে যাচ্ছেন প্রত্যাশিত গন্তব্যে। যেখানে ঈশান আছেন। কিন্তু সেখানে পৌছানোর আগে আমায় অদ্ভুত একটা শর্ত পালন করতে হয়েছে। নিজ সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে এক অচেনা রুপে সজ্জিত হয়েছি আমি। আমাকে ছেলে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঈশানের কাছে। কালো কোর্ট, চোখে ক্লাসিক চশমা, মাথায় পাগড়ি, গালভরা আর্টিফিশিয়াল দাড়ি, এমনকি হাতের উপরেও অদ্ভুত স্কিন কালার টাইডস পড়তে হয়েছে।যেন আমার হাত-পা দেখেও বোঝার উপায় না থাকে যে আমি একজন মেয়ে। ঈশানের কাছে কেনো এই রুপ নিয়ে যেতে হচ্ছে সেই কারণটা সাফিন ভাইয়া আমায় এখনো বলেনি। আমিও জানার জন্য খুব একটা আগ্রহ দেখাই নি। আপাতত আমার একমাত্র কৌতুহল ঈশানকে দেখা, চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখা, এর বেশি কোনোকিচ্ছুতে আগ্রহ নেই। শুধু ঈশানের কাছে পৌছাতে পারলেই হলো।এবার সেজন্য ছেলে, বুড়ো, যাই সাজতে হোক, আমার কোনো দ্বিধা নেই। উত্তেজনায় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার। কখন দেখবো ঈশানকে?মনের ভিতরটা হাসফাস করছে।সাফিন ভাইয়া আমাকে ডাকলেন,
“তারিন!”
“হুম?”
“আশফীয়া তারিন রাইট?”
“হ্যা।”
“আজকে থেকে তোমার নাম আশফাক তারিক। মনে থাকবে?”
আমি নিঃসংকোচে মাথা নাড়লাম। তারপর ভ্রু কুচকে বললাম,
“আচ্ছা সাফিন ভাইয়া, আমরা কি কোনো মেসে বা ব্যাচেলার হোস্টেলে যাচ্ছি?”
সাফিন ভাইয়া মুচকি হেসে ধীরে মাথা ঝাকিয়ে বললেন, “বলছি বলছি। সব জানবে। আগে চলো।”
বহুতল ভবনের সামনে গাড়ি থামল। গাড়ি থেকে নেমে লিফটে ওঠা পর্যন্ত আমাদের মধ্যে তেমন কোনো কথা হলো না। লিফট থেকে নামার পর শুধু সাফিন ভাইয়া বললেন ঈশানের সামনে গিয়ে আমি যাতে কোনো ওভার রিয়েক্ট না করি। সম্পুর্ণ নরমাল থাকি। আর কথাও যেন না বলি। আমি বাধ্য মেয়ের মতো সব মেনে নিলাম। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ঈশানকে একবার দেখতে চাই। এতেই আমার শান্তি। দরজা খুললেন একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক। সাফিন ভাইয়াকে দেখে প্রথম কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চেনার চেষ্টা করে বড় হাসি দিলেন উনি। আর বললেন,
“আরে তুমি ঈশানের বন্ধু না?”
সাফিন ভাইয়া হেসে বললেন,
“জী আঙ্কেল। ঈশান বাসায় আছে?”
“হ্যা আছে আছে। এসো।”
দরজা থেকে সরে ভিতরে ঢুকতে ইশারা করলেন ভদ্রলোক। সাফিন ভাইয়া আমাকে প্রথমে ঢুকতে বললেন। লোকটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন,
“এটা কে?”
সাফিন ভাইয়া আমার কাধ চাপড়ে বললেন, “ভাই, ছোট ভাই।”
“ও আচ্ছা এসো বাবা ভেতরে এসো।
আমরা সোফায় বসতেই একজন মধ্যবয়স্কা মহিলাও বেরিয়ে আসলেন। গায়ে খয়েরী রঙের শাড়ি। ইনি হয়তো ভদ্রলোকের পত্নী। আমি অভ্যাস অনুযায়ী সোফা থেকে দাড়িয়ে সালাম দিতে চাইলাম। ওমনি সাফিন ভাইয়া আমায় আটকালেন। আমিও চুপ মেরে গেলাম। ভদ্র মহিলা সাফিন ভাইয়ার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
ভদ্রমহিলা চিন্তিত মুখে বললেন,” হ্যা, সেটা অবশ্য আমি আগেই বুঝেছি। ছেলেটা দিন দিন আরো বেশি একগুঁয়ে হয়ে যাচ্ছে। তোমরা বিয়ের কথা ভাবছো না কেনো ঈশানের? বিয়ে করিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবে।”
“বিয়েই কি সব সমস্যার সমাধান আন্টি?”
“হ্যা অবশ্যই। বিয়ে হলে দায়িত্ব হবে, সংসার হবে, একটা বাকে বাধা পড়বে জীবন। তবেই না অতীত ভুলে যাওয়া সম্ভব। সারাদিন ঘরে গুম মেরে বসে থেকে কি অতীত ভোলা যায়? ছেলেটা তো এখনো সেই অতীতেই পড়ে আছে। জীবনটা তিলে তিলে শেষ করছে। আর ওই মেয়েটা সুখে শান্তিতে ঘর-সংসার করছে। মেয়ে কি মনে রেখেছে ওর কথা? দুনিয়া বড়ই স্বার্থপর।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা। সাফিন আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে ভদ্রমহিলাকে বললেন,
“ঈশানকে ডাকুন আন্টি। অনেকদিন দেখা হয়না।”
“হ্যা আসছে। সায়রার আব্বু ডাকতে গেছে। ওর তো আবার দরজা খুলতেও দশমিনিট সময় লাগে। কি যে করে সারাদিন একা একা!”
ভদ্রমহিলার কথা শেষ হতেই ঈশান চলে আসলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়ালাম। হ্রৎস্পন্দনটা ইতিমধ্যেই মাত্রাতিরিক্ত বেগলাভ করে কম্পিত হচ্ছে। ঈশান চোখমুখ ছোট করে তাকালেন। চোখগুলো টকটকে লাল, নির্বিকার দৃষ্টি। যেন অনুভূতিহীন মানব। মুখটা হাল্কা ফোলা। চুল-দাড়ি বেড়ে অনেকটা জেলখানার আসামীর মতো অবস্থা। সহজ কথায়, কবির সিং ইন রিয়েল লাইফ।খুব বেশি অসহায় লাগছে, প্রাণবন্ত ঘাসের মতো চুলগুলোও যেন আগাছার রুপ নিয়েছে। সবকিছু মুষড়ে গেছে। যেন পৃথিবীর সবথেকে অসহায় ব্যক্তিটি উনিই। আমি নিষ্পলক তাকিয়ে আছি। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল। চশমাটা ঝাপসা হয়ে আসছে। সাফিন ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে বসালেন।চোখের ঈশারায় দিয়ে বুঝালেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে। আমি বসে পড়লাম, এখনো নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছিনা। কাজটা এতো কঠিন হবে ভাবিনি। ঈশান বললেন,
“সাফিন! তুই কেনো এসেছিস এখানে?”
ভদ্রমহিলা বললেন, ” এটা কেমন কথা বাবা? তোমাকে দেখতে এসেছে! শত হলেও বন্ধু তো।”
ঈশান ভ্রু কুচকে বললেন,” সাথে এটা কে?”
ভদ্রমহিলা এবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর সাফিন ভাইয়াকে বললেন, “ও হ্যা.. এইটা কে সাফিন?”
সাফিন ভাইয়া অপ্রস্তুত ভাবে বললেন,” ভাই। ঈশানের ছোট ভাই। ”
ভদ্রমহিলা মুখ কালো করে বললেন,” ছোটভাই? তাহলে ঈশান চিনতে পারছে না যে?”
ঈশান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই তেড়ে আসলেন আমার দিকে। এক টানে আমাকে সোফা থেকে উঠিয়ে দুই গাল চেপে ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে অস্থির গলায় বললেন,
“কে তুমি? কে?”
ঈশানের আচরণে সাফিন ভাইয়ার সাথে ভদ্রমহিলাও উঠে দাড়ালেন। সাফিন ভাইয়া দ্রুতগতিতে আমাকে টেনে সরালেন।আমি সাফিন ভাইয়ার পেছনে লুকিয়ে গেলাম। ঈশান উঁকিঝুঁকি মেরে আমাকে দেখছেন। আমিও সাফিন ভাইয়ার পেছন থেকে উকি মেরে উনার দিকে তাকালাম। ঈশান এগিয়ে আসতে নিলে সাফিন ভাইয়া হাত দিয়ে আটকালেন। খুব ইতস্ততভাবে বললেন,
“ঈশান! তুই চিনতে পারছিস না ওকে? ও তারিক।”
ঈশান বিরক্তি নিয়ে বললেন,” কে তারিক?”
ভদ্রমহিলা ঈশানের উত্তরে ভ্রু কুচকালেন।
সাফিন ভাইয়া ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললেন,
“আসলে আন্টি, অনেকদিন পর দেখা তো। ও হয়তো চেহারা ভুলে গেছে। তাই চিনতে পারছে না।”
ভদ্রমহিলা হেসে বললেন,” বুঝতে পেরেছি। এইটা নতুন কিছুনা। মাঝে মাঝে তো আমাকেও চিনতে পারেনা ও। ওর ঘরে গিয়ে দরজা ধাক্কালে মাঝে মাঝে দরজা খুলেই জিজ্ঞেস করে, কে আপনি?”
সাফিন ভাইয়া হেসে দিলেন। ভদ্রমহিলাও হাসলেন। আমি আর ঈশান নিশ্চুপ। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছি।
🍂
🍂
ঈশান আর রানি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি বিছানার এক কোণে বসে আছি। রাকিবও আমার সাথে জেগে বসে আছে। আমি একটা ইংরেজি উপন্যাসের বই পড়ে শোনাচ্ছি রাকিবকে। বইটা একজন ধনীলোকের কাছে উপহার পেয়েছিল রাকিব। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা ইংরেজি পড়তে জানে না। জানার কথাও নয়। তবে বয়সের তুলনায় যথেষ্ট ম্যাচিউর এই ছেলে। উপন্যাসের প্রতিটি লাইন আমি অনুবাদ করলেও রাকিব যেন অনুধাবন করছে। ছেলেটার মেধা দেখে আমি অবাক। এই ছেলেটা লেখাপড়ার সুযোগ পেলে কতই না ভালো হতো। ভীষণ ভালো লাগছিল রাকিবকে উপন্যাস পড়ে শুনাতে। হঠাৎ আমাদের পিকআপ ড্রাইভার দরজায় কড়া নাড়লেন। টিনের দরজা হওয়ায় বেশ জোরেই আওয়াজ আসলো। আমি কিছুটা ভয় পেলাম। রাকিব আমার ভয় পাওয়া দেখে হেসে দিল। আমাকে অভয় দিয়ে বলল সে দরজা খুলছে। রাকিব দরজা খুলতেই ড্রাইভার হুড়মুড়িয়ে ভিতরে ঢুকলেন। বিচলিত হয়ে বললেন,
“আপু, ভায়ে ফোন করসিল। আপনার সাথে জরুরি দরকার আছে। একবার বাহিরে আসেন।”
আমি ভ্রু কুচকালাম। উনি কি তারিফ ভাইয়ার কথা বলছেন? কিন্তু ভাইয়ার দরকার লাগলে তো আমার মোবাইলেই ফোন করতে পারতেন। ড্রাইভারকে দিয়ে খবর পাঠানোর মানে কি? আমি প্রশ্ন করলাম,
“তারিফ ভাইয়া? কই ভাইয়া তো আমাকে ফোন টোন কিছু করে নি। কি জরুরি দরকার? ”
“জরুরি কথা তো আপু আমারে কয়নাই। খালি কইসে আপনার সাথে কথা বলায় দিতে। আপনি বাহিরে আসেন।”
“বাহিরে কেনো আসতে হবে? আপনি ফোন দেন, আমি এখানে বসেই কথা বলছি।”
ড্রাইভার বাহিরে বেরিয়ে গেলেন। রাকিবের হাতে বইটা দিয়ে আমিও বের হলাম। পিকআপের সাথে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন ড্রাইভার। আমি উনার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ড্রাইভার বললেন,
“আপু উঠেন।”
“উঠবো মানে? ”
“মানে গাড়িতে উঠেন।”
“গাড়িতে কেনো উঠবো?”
“দরকার আছে”।
আমার ভয় হলো। অচিরেই মনটা কু ডেকে উঠল। তাই ধীরপায়ে কয়েক কদম পিছিয়ে দৌড় লাগাতে চাইলাম। কিন্তু সফল হলাম না। ওমনি পেছন থেকে আমার মুখ বেধে ফেললেন উনি। শক্ত মোটা দড়ি দিয়ে দুইহাত বেধে গাড়িতে উঠানো হলো আমাকে। আমি শুধু ছটফট করছি। তারপর একসময় জ্ঞান হারালাম।
দীর্ঘ ছয়মাস ধরে আমি একটা অচেনা বাসায় বন্দী। আকাশের আলো পর্যন্ত চোখে পৌছায় না এখানে। আবদ্ধ এই জায়গায় হাসফাস করতে করতে কেটে যাচ্ছে কত রাত, কত দিন। কারো সাথে যোগাযোগের সুযোগটা পর্যন্ত নেই। দিনে তিনবেলা নিয়ম করে খাবার দেওয়া হয় আমাকে। কিন্তু একবেলার বেশি আমি খেতে পারিনা। তবে গত দু’দিন থেকে না খেয়েই আছি। এক ফোটা পানি পর্যন্ত গলা দিয়ে নামেনি। তবুও কিভাবে বেচে আছি আল্লাহ জানে। অবশ্য এই বেচে থাকা আমার কাছে কোনো বেচে থাকা না। এর থেকে মৃত্যু ঢের ভালো। শান্তিময় মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণে যাচ্ছি।প্রিয় মৃত্যু, কবে আসবে তুমি? চোখের পানিটাও যে শুকিয়ে গেছে। এখন চাইলেও চিৎকার করে কাদতে পারিনা। বুকের ভেতরটায় তুমুল গতিতে ঝড় বয়ে গেলেও চেহারায় সেটা আগের মতো প্রকাশ পায়না এখন আর। প্রথম প্রথম ভীষণ কাদতাম। পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাদতাম। কাদতে কাদতে ফ্লোরে লুটোপুটি খেতাম, কিন্তু পাথরের মন গলতো না। ফলশ্রুতিতে শুকিয়েছে আমার চোখের সমুদ্র। তবুও প্রতিবাদ জানাতে পারিনি। নির্মম হ্রদয়ের সেই কঠিন মানুষটি যে আমার বড়ভাই।
ফ্লোরে উল্টো হয়ে শুয়ে ছিলাম, দরজার ঠকঠক শব্দে নড়েচড়ে বসলাম। মা এসেছে, হাতে সাদা পানির শরবত। কিসের শরবত কে জানে? আমার চেহারা দেখেই হু হু করে কেদে দিলেন মা। কাদতে কাদতে বিছানায় বসলেন। আমি মায়ের দিকে তাকালাম না। আমার শক্তচোখের দৃষ্টি সামনের সাদা দেয়ালটার দিকে নিক্ষিপ্ত। মা শরবতের গ্লাস ছোট্ট টেবিলটার উপর রেখে কাদতে বসলেন। কিছুসময় কান্নাকাটির পর হঠাৎ আমার কাছে এসে ফ্লোরে বসলেন। আমার এক কাধ ঝাকিয়ে বললেন,
“এই তারু! তারু রে, এইভাবে আর কয়দিন থাকবি? একটু তো স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ কর! অন্তত কথাটা বল? গুম মেরে বসে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে? আচ্ছা আর কতদিন ওই ছেলের কথা চিন্তা করে নিজের জীবন শেষ করবি। এইটা কেমন এক তরফা ভালোবাসা শুনি? এদিকে তুই মানসিক রোগীর মতো জীবন কাটাচ্ছিস, আর ওদিকে ওই ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছে। সে তো তোর কথা একবারের জন্যেও ভাবেনি। তাহলে তুই কেনো ভাবছিস?”
আমার রক্তবর্ণ দৃষ্টি এবার মায়ের দিকে তাক করলাম। স্বাভাবিক কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,
“ঈশান বিয়ে করেনি। আমি বিশ্বাস করিনা।”
মা চোখ বন্ধ করে আক্ষেপী সুরে বললেন,
“করেছে তারু করেছে। ওই ছেলে বিয়ে করেছে। ওদের বাচ্চাও আছে। তারিফ নিজের চোখে দেখেছে সেই বাচ্চাকে।”
আমি তৎক্ষণাৎ উঠে দাড়ালাম। আমার দাড়ানো দেখে মা কথা বলা থামিয়ে দিলেন। আমি চট করে শরবতের গ্লাসটা তুলে ফ্লোরে আছাড় মারলাম। ঝনঝন শব্দ প্রবাহিত হল সারা ঘরজুড়ে। দুনিয়া কাপানো চিৎকার করে আমি উচ্চারণ করলাম,
“বিশ্বাস করিনা, বিশ্বাস করিনা তোমাদের কাউকে আমি বিশ্বাস করিনা। সবাই মিথ্যেবাদী তোমরা এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। আর কখনো আমার চোখের সামনে আসবে না..”
কথা শেষ হওয়ার আগেই সটান করে চড় পড়লো আমার গালে। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। শরীর এতোটাই দুর্বল যে চড়ের ধাক্কাটা পর্যন্ত সহ্য হলোনা। আধখোলা চোখে একবার দেখার চেষ্টা করলাম সামনে দাড়ানো মানুষটিকে। ঝাপসা চোখের দৃষ্টিতে বুড়ির চেহারা ভেসে উঠল। জানতাম বুড়িই চড়টা মেরেছে, মা কখনো এভাবে মারে না আমায়। আমি মুচকি হাসলাম। মাথাটা চিনচিন ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আর কিছু মনে নেই।
🍂
চলবে
( আমার আম্মু আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ। তবুও গল্প ছোট করে দিচ্ছি কারণ লেখার সময় হয়নি। দেখি রাতে আরেক পার্ট দেওয়ার চেষ্টা করবো।😓)
🍂
চোখ মেলে তাকাতেই মাকে দেখলাম। ছোট্ট বালতিতে রুমাল ভিজিয়ে আমার মাথায় জ্বরপট্টি দিচ্ছে। আমি শরীরে কোনো বশ পেলাম না। মাথাটাও প্রচন্ড ভার লাগছে। বুড়িটা বিছানার পাশে বসে ঘ্যানঘ্যান করছিল। আমার চোখ খুলে তাকানোর বিষয়টা জানতে পেরে উঠে আসলো। মাকে সরিয়ে আমার সামনে বসল। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“কি শুরু করছোস তুই? নাটক? নয়া নাটক? খাওন নাই দাওন নাই শরীলডারে বানাইসোস বেরাইম্মা শরীল। সারাডারাইত তোর মায় ঘুমাইতে পারে নাই। নিজে তো মরবি লগে মাডারেও মারবি। মা’র মুখটাত একবার চায়া কি অবস্থা হইসে। এতোডি মাস দইরা মায়রে কি জ্বালানিডাই না জ্বালাইতাসোস।এহন অন্তত একটু শান্তি দে! তোর কি একটু মায়া হয় না? সব মায়া খালি ওই পোলার লাইগা? দুইদিনের ওই পোলার লাইগা নিজের আপন ভাই, আপনা মা’রে মিথ্যুক বানায় দিলি? ওই পোলায় তোর কাছে সব? আমাগো কথার কোনো দাম নাই?আরে পোলায় বিহাইত্তা! পোলার বউ আছে বাচ্চা আছে। আর কেমনে কইলে বুঝবি?”
আমি একটা কথারও উত্তর দিলাম না। মা বুড়ির কাছে এসে কান্না জড়ানো গলায় বললেন,
“থাক মা। কথা বইলেন না ওর সাথে। ও এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।”
বুড়ি মুখ বাকিয়ে বলল,” ডং। সব ডং এডি। অভিনয়।ওই পোলার কাছে যাওনের বাহানা এডি সব।এহনো সময় আছে আয়েশা, মাইয়ার বিয়া দিয়া দাও। সব আপনা আপনিই ঠিক হইয়া যাইবো।”
” আচ্ছা মা আপনি দয়া করে এখন যান।শরীর ঠিক নেই মেয়েটার। ওর সামনে এসব কথা এখন বলবেন না।”
বুড়ি আরো কিছুক্ষণ বকবক করে বেরিয়ে গেল। মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“খাওয়া-দাওয়া করবি না? ঔষধ খাওয়ার জন্য হলেও অন্তত একটু খা। চেহারার কি অবস্থা হয়েছে তোর। এভাবে কি মানুষ বাচে?”
“আমি খাবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
“কি শর্ত বল? যদি বলিস আমার কলিজা সিদ্ধ করে দিতে তাও দিবো। তবুও তুই সুস্থ হয়ে ওঠ।”
আবার কান্না শুরু করল মা। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
“কাদতে হলে বাহিরে গিয়ে কাদো। আমার সামনে ফ্যাচফ্যাচ করবে না। অসহ্য লাগে।”
“আচ্ছা কাদবো না। এইযে দেখ, চোখের পানি মুছে ফেলেছি। এইবার বল, কি করলে খাবি?”
“আমাকে ফোন এনে দিতে হবে। আমি শুধু একটিবার নিহার সাথে কথা বলতে চাই।”
“আবার নিহা? ওই বাড়ির কারো সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা যাবে না। তারিফ জানতে পারলে তোকে মেরেই ফেলবে।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “আমি বেচে আছি বুঝি? এটাকে কি সত্যিই বেচে থাকা বলে? শুধু দমটাই চলছে আমার। ভিতরে তো আমি মৃত।যেখানে মনের মৃত্যু অনেক আগেই হয়ে গেছে, সেখানে দৈহিক বাচা-মরাতে কি আসে যায় মা?”
“এইভাবে কথা বলিস না তারু। আমার কষ্ট তুই কিভাবে বুঝবি? তোর এসব কথা শুনলে ভিতরটা আমার ছিড়ে যায় রে মা। আমার হাসি-খুশি, চঞ্চলাবতী মেয়েটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে মুষড়ে আছে। এসব চোখের সামনে কিভাবে সহ্য করি বল?”
“যদি চাও আমি সুস্থ হয়ে উঠি, তাহলে শুধু একবার নিহার সাথে কথা বলতে দাও। আমি প্রমিস করছি মা, যা বলবে তাই শুনবো। শুধু একটিবার ফোনটা এনে দাও।”
মা কিছুক্ষণ চুপ মেরে থেকে হঠাৎ নরম সুরে বললেন,
“আচ্ছা দেখি, আজরাতে তারিফ ঘুমিয়ে গেলে তোকে ফোন এনে দিবো। কিন্তু শুধু একবারই।আমার সামনে দাড়িয়ে কথা বলতে হবে। তারপর সেই সিম আমার সামনেই ভেঙে গুড়ো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিবি। ওই বাড়ির কেউ যেন কোনোভাবেই আমাদের খোজ না পায়।”
“যা বলবে তাই হবে।”
“ঠিকাছে। তাহলে এখন কিছু খেয়ে নে ওঠ।”
“সত্যিই ফোন এনে দিবে তো?”
“হ্যা দিবো। এবার ওঠ।”
ঘড়িতে রাত ১টা বাজে। মা ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। মায়ের এক্সট্রা সিমওয়ালা ফোন আমার হাতে ধরিয়ে খুব সাবধানে বললেন সময় পাচ মিনিট। আমি মাথা দুলিয়ে রাজী হলাম। কাপা কাপা হাতে নিহার নাম্বার ডায়াল করছি। কতদিন কথা হয়না, দেখা হয়না। কেমন আছে ওরা কে জানে? প্রথমবার রিং বাজতে বাজতে কেটে গেলেও দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। নিহার ঘুমজাড়ানো কণ্ঠ শুনলাম,
“হ্যালো.. কে বলছেন?”
আমি তটস্থ হয়ে বললাম, “নিহা আমি তারু।”
“কে?”
“আমি তারু।”
“তারু? আচ্ছা একটু ধর।”
ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ আসলো না। আমিও চুপ করে রইলাম। কয়েক সেকেন্ড পর নিহা উচ্চারণ করল,
“তারু! কোথায় আছিস তুই? আর এতোদিন পর মনে পড়ল যে নিহা নামের কেউ আছে? ভুলেই তো গিয়েছিলি।”
“ঈশান কেমন আছে?”
“কি বললি ? আরেকবার বল তো!”
আমি কেদে দিলাম। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললাম, “আমার ঈশান কেমন আছে নিহা?”
“আরেকবার ওই নাম উচ্চারণ করলে তোকে থাপ্পড় দিবো আমি। লজ্জা করেনা? এতোবড় ধোকা দিয়ে, এইভাবে মানুষটাকে ঠকিয়ে এখন ন্যাকামি করছিস?”
“আমি উনাকে কিভাবে ঠকালাম?”
“ও! ঠকাস নি তুই উনাকে? তাহলে বিয়ে করেছিস কেনো? কেনো বিয়ে করেছিস বল? একবারও মনে পড়লো না ঈশান ভাইয়ার কথা! এতোটা সেলফিশ কি করে হতে পারলি তুই? তুই তো এমন ছিলি না তারু।”
“আমি বিয়ে করেছি মানে? কবে বিয়ে করলাম আমি? তোকে কে বললো এই কথা।”
“তারিফ ভাইয়া বলেছে। তুই নাকি বিয়ে করে হাসব্যান্ডের সাথে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছিস? ঈশান ভাইয়ার মুখও নাকি দেখতে চাস না তুই? তাহলে কেনো শুধু শুধু ভালোবাসার নাটক করলি বল তো! মানুষটাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলি। উনি তো হাসতেও ভুলে গেছে।”
“নিহা! নিহা শোন, বিশ্বাস কর আমার বিয়ে হয়নি। আমি কাউকে বিয়ে করিনি। সব আন্দাজী কথা। বানোয়াট। বরং আমাকে তো বলা হয়েছে ঈশান বিবাহিত। আমার সাথে বিয়ের আগেও উনার আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। উনার নাকি তিন চার বছরের একটা বাচ্চাও আছে।”
“হ্যা আছে, তো?”
“মানে?”
“মানে ঈশান ভাইয়ার বেবি আছে। আগে বিয়েও হয়েছে। তাতে তোর কি? তুই যেমন উনাকে ঠকিয়েছিস, উনিও তোকে ঠকিয়েছে। শোধবোধ।”
আমার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল। দেয়াল ধরে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। এতোদিন তো ভাবতাম মা,ভাইয়া, বুড়ি সবাই আমায় মিথ্যে বলছে। ঈশানের থেকে আমাকে আলাদা করার জন্য এটা ওদের একটা ফাঁদ। কিন্তু নিহাও কি মিথ্যা বলছে? আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসলো। ইশশ, সবকিছু এতো অন্ধকার কেনো? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,, ভীষণ!
🍂
🍂
চোখ মেলে তাকাতেই মাকে দেখলাম। ছোট্ট বালতিতে রুমাল ভিজিয়ে আমার মাথায় জ্বরপট্টি দিচ্ছে। আমি শরীরে কোনো বশ পেলাম না। মাথাটাও প্রচন্ড ভার লাগছে। বুড়িটা বিছানার পাশে বসে ঘ্যানঘ্যান করছিল। আমার চোখ খুলে তাকানোর বিষয়টা জানতে পেরে উঠে আসলো। মাকে সরিয়ে আমার সামনে বসল। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“কি শুরু করছোস তুই? নাটক? নয়া নাটক? খাওন নাই দাওন নাই শরীলডারে বানাইসোস বেরাইম্মা শরীল। সারাডারাইত তোর মায় ঘুমাইতে পারে নাই। নিজে তো মরবি লগে মাডারেও মারবি। মা’র মুখটাত একবার চায়া কি অবস্থা হইসে। এতোডি মাস দইরা মায়রে কি জ্বালানিডাই না জ্বালাইতাসোস।এহন অন্তত একটু শান্তি দে! তোর কি একটু মায়া হয় না? সব মায়া খালি ওই পোলার লাইগা? দুইদিনের ওই পোলার লাইগা নিজের আপন ভাই, আপনা মা’রে মিথ্যুক বানায় দিলি? ওই পোলায় তোর কাছে সব? আমাগো কথার কোনো দাম নাই?আরে পোলায় বিহাইত্তা! পোলার বউ আছে বাচ্চা আছে। আর কেমনে কইলে বুঝবি?”
আমি একটা কথারও উত্তর দিলাম না। মা বুড়ির কাছে এসে কান্না জড়ানো গলায় বললেন,
“থাক মা। কথা বইলেন না ওর সাথে। ও এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।”
বুড়ি মুখ বাকিয়ে বলল,” ডং। সব ডং এডি। অভিনয়।ওই পোলার কাছে যাওনের বাহানা এডি সব।এহনো সময় আছে আয়েশা, মাইয়ার বিয়া দিয়া দাও। সব আপনা আপনিই ঠিক হইয়া যাইবো।”
” আচ্ছা মা আপনি দয়া করে এখন যান।শরীর ঠিক নেই মেয়েটার। ওর সামনে এসব কথা এখন বলবেন না।”
বুড়ি আরো কিছুক্ষণ বকবক করে বেরিয়ে গেল। মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“খাওয়া-দাওয়া করবি না? ঔষধ খাওয়ার জন্য হলেও অন্তত একটু খা। চেহারার কি অবস্থা হয়েছে তোর। এভাবে কি মানুষ বাচে?”
“আমি খাবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”
“কি শর্ত বল? যদি বলিস আমার কলিজা সিদ্ধ করে দিতে তাও দিবো। তবুও তুই সুস্থ হয়ে ওঠ।”
আবার কান্না শুরু করল মা। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
“কাদতে হলে বাহিরে গিয়ে কাদো। আমার সামনে ফ্যাচফ্যাচ করবে না। অসহ্য লাগে।”
“আচ্ছা কাদবো না। এইযে দেখ, চোখের পানি মুছে ফেলেছি। এইবার বল, কি করলে খাবি?”
“আমাকে ফোন এনে দিতে হবে। আমি শুধু একটিবার নিহার সাথে কথা বলতে চাই।”
“আবার নিহা? ওই বাড়ির কারো সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা যাবে না। তারিফ জানতে পারলে তোকে মেরেই ফেলবে।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “আমি বেচে আছি বুঝি? এটাকে কি সত্যিই বেচে থাকা বলে? শুধু দমটাই চলছে আমার। ভিতরে তো আমি মৃত।যেখানে মনের মৃত্যু অনেক আগেই হয়ে গেছে, সেখানে দৈহিক বাচা-মরাতে কি আসে যায় মা?”
“এইভাবে কথা বলিস না তারু। আমার কষ্ট তুই কিভাবে বুঝবি? তোর এসব কথা শুনলে ভিতরটা আমার ছিড়ে যায় রে মা। আমার হাসি-খুশি, চঞ্চলাবতী মেয়েটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে মুষড়ে আছে। এসব চোখের সামনে কিভাবে সহ্য করি বল?”
“যদি চাও আমি সুস্থ হয়ে উঠি, তাহলে শুধু একবার নিহার সাথে কথা বলতে দাও। আমি প্রমিস করছি মা, যা বলবে তাই শুনবো। শুধু একটিবার ফোনটা এনে দাও।”
মা কিছুক্ষণ চুপ মেরে থেকে হঠাৎ নরম সুরে বললেন,
“আচ্ছা দেখি, আজরাতে তারিফ ঘুমিয়ে গেলে তোকে ফোন এনে দিবো। কিন্তু শুধু একবারই।আমার সামনে দাড়িয়ে কথা বলতে হবে। তারপর সেই সিম আমার সামনেই ভেঙে গুড়ো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিবি। ওই বাড়ির কেউ যেন কোনোভাবেই আমাদের খোজ না পায়।”
“যা বলবে তাই হবে।”
“ঠিকাছে। তাহলে এখন কিছু খেয়ে নে ওঠ।”
“সত্যিই ফোন এনে দিবে তো?”
“হ্যা দিবো। এবার ওঠ।”
ঘড়িতে রাত ১টা বাজে। মা ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। মায়ের এক্সট্রা সিমওয়ালা ফোন আমার হাতে ধরিয়ে খুব সাবধানে বললেন সময় পাচ মিনিট। আমি মাথা দুলিয়ে রাজী হলাম। কাপা কাপা হাতে নিহার নাম্বার ডায়াল করছি। কতদিন কথা হয়না, দেখা হয়না। কেমন আছে ওরা কে জানে? প্রথমবার রিং বাজতে বাজতে কেটে গেলেও দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। নিহার ঘুমজাড়ানো কণ্ঠ শুনলাম,
“হ্যালো.. কে বলছেন?”
আমি তটস্থ হয়ে বললাম, “নিহা আমি তারু।”
“কে?”
“আমি তারু।”
“তারু? আচ্ছা একটু ধর।”
ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ আসলো না। আমিও চুপ করে রইলাম। কয়েক সেকেন্ড পর নিহা উচ্চারণ করল,
“তারু! কোথায় আছিস তুই? আর এতোদিন পর মনে পড়ল যে নিহা নামের কেউ আছে? ভুলেই তো গিয়েছিলি।”
“ঈশান কেমন আছে?”
“কি বললি ? আরেকবার বল তো!”
আমি কেদে দিলাম। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললাম, “আমার ঈশান কেমন আছে নিহা?”
“আরেকবার ওই নাম উচ্চারণ করলে তোকে থাপ্পড় দিবো আমি। লজ্জা করেনা? এতোবড় ধোকা দিয়ে, এইভাবে মানুষটাকে ঠকিয়ে এখন ন্যাকামি করছিস?”
“আমি উনাকে কিভাবে ঠকালাম?”
“ও! ঠকাস নি তুই উনাকে? তাহলে বিয়ে করেছিস কেনো? কেনো বিয়ে করেছিস বল? একবারও মনে পড়লো না ঈশান ভাইয়ার কথা! এতোটা সেলফিশ কি করে হতে পারলি তুই? তুই তো এমন ছিলি না তারু।”
“আমি বিয়ে করেছি মানে? কবে বিয়ে করলাম আমি? তোকে কে বললো এই কথা।”
“তারিফ ভাইয়া বলেছে। তুই নাকি বিয়ে করে হাসব্যান্ডের সাথে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছিস? ঈশান ভাইয়ার মুখও নাকি দেখতে চাস না তুই? তাহলে কেনো শুধু শুধু ভালোবাসার নাটক করলি বল তো! মানুষটাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলি। উনি তো হাসতেও ভুলে গেছে।”
“নিহা! নিহা শোন, বিশ্বাস কর আমার বিয়ে হয়নি। আমি কাউকে বিয়ে করিনি। সব আন্দাজী কথা। বানোয়াট। বরং আমাকে তো বলা হয়েছে ঈশান বিবাহিত। আমার সাথে বিয়ের আগেও উনার আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। উনার নাকি তিন চার বছরের একটা বাচ্চাও আছে।”
“হ্যা আছে, তো?”
“মানে?”
“মানে ঈশান ভাইয়ার বেবি আছে। আগে বিয়েও হয়েছে। তাতে তোর কি? তুই যেমন উনাকে ঠকিয়েছিস, উনিও তোকে ঠকিয়েছে। শোধবোধ।”
আমার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল। দেয়াল ধরে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। এতোদিন তো ভাবতাম মা,ভাইয়া, বুড়ি সবাই আমায় মিথ্যে বলছে। ঈশানের থেকে আমাকে আলাদা করার জন্য এটা ওদের একটা ফাঁদ। কিন্তু নিহাও কি মিথ্যা বলছে? আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসলো। ইশশ, সবকিছু এতো অন্ধকার কেনো? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,, ভীষণ!
🍂
চলবে
#তি_আমো💔
#পর্ব_২৯
Writer:Sidratul muntaz
🍂
দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে গুম মেরে বসে আছি সেই কখন থেকে। সারারাত এক ফোটা ঘুমও হয়নি। ভেতরটা যেন অনুভূতি শুন্য হয়ে পড়েছে আমার। কষ্ট হচ্ছে, নাকি রাগ হচ্ছে তাও উপলব্ধি করতে পারছি না। তবে ভীষণ অস্থির লাগছে, এই অস্থিরতার পরিমাণ পাহাড় সমান। দরজা ঠেলে কেউ ভেতরে ঢুকল। সেই শব্দ টের পেয়ে শুকিয়ে থাকা চোখের পানি মুছে নিলাম। সোজা হয়ে বসলাম। রাইসা এসেছে। মেয়েটা আমাদের পাশের বাসায় থাকে। প্রায় সমবয়সী আমার। মাঝে মাঝে কথা হয়। বেশ লাগে মেয়েটির সাথে কথা বলে সময় কাটাতে। রাইসা আমার দিকে কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিছানায় বসে পড়লো। রাশভারী কণ্ঠে বলল,
“আন্টির কাছে শুনলাম, তুমি নাকি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছো?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুইচোখে মালিশ করতে করতে বললাম,” হুম।”
“তাহলে ঈশান? ঈশানের কি হবে?”
আমি মুচকি হাসলাম, “কি আর হবে? সে তো তার ঘর সংসার নিয়ে সুখেই আছে। তাহলে আমি কেনো ওর জন্য ধুকে ধুকে মরবো? আমারও উচিৎ মা-ভাইয়ার কথামতো বিয়ে করে নেওয়া।”
“ঈশানের কি সত্যিই বিয়ে হয়েছে?”
“হ্যা। কালরাতে নিহার সঙ্গে কথা হয়েছিল।”
“ও! নিহাই কি বলেছে? ঈশানের বিয়ের আসলেই বাচ্চা আছে?”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। সবকিছু বিস্তারিত শোনার পর রাইসা বলল,
“আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে নিহা মিথ্যে বলছে। হয়তো রাগের মাথায়?”
“এতোটা নিশ্চিত হয়ে গেলে? আগে তো এই কথাগুলো শুনতেও চাইতে না। কারো কথাই বিশ্বাস করোনি। শুধু ঈশানকে বিশ্বাস করতে। দিনরাত এক করে শুধু কাদতে। ঈশানের জন্য এতো উতলা ছিলে,আর এখন এক রাতের মধ্যেই এতো পরিবর্তন? ঈশানকে ভুলে একদম বিয়েতে রাজি হয়ে যাচ্ছো? শুধুমাত্র নিহার কথা শুনে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক?”
“ঠিক-ভুল জানিনা। শুধু এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চাই। আর এভাবে সম্ভব না। আচ্ছা রাইসা? শুনেছি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেলে নাকি মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়। সেই মৃত্যুকে বলে সুইট ডেথ। কারণ তাতে কষ্ট হয়না। হলেও খুবই সামান্য। অন্তত আমার কষ্টের থেকে তো সামান্য। আমাকে পটাশিয়াম সায়ানাইড এনে দিতে পারবে?”
“বোকার মতো কথা বলো না তারিন। মরে যাওয়া মানে তো জীবনের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া। আর বিয়ে করে নেওয়া মানে ভালোবাসার কাছে পরাজিত হওয়া। তুমি কেনো হেরে যেতে চাও? অন্তত একবার হলেও ঈশানের সামনে গিয়ে দাড়ানো উচিৎ না? তারিন অন্যকারো কথায় প্রভাবিত না হয়ে শুধু নিজের মনের কথাটা শোনো। সবাই ধোকা দিলেও মন কখনো ধোকা দেয়না।”
“নিহার সাথে কথা হওয়ার পর আমি ঈশানের নাম্বারে ফোন করেছিলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে ফোন ধরেছে। ”
“ঈশানের মেয়ে?”
“জানিনা। কিন্তু যুক্তি তো তাই বলে। মেয়েটার কণ্ঠ শুনেই আমি ফোন কেটে দিয়েছি। তারপর মেসেজ করেছি নাম্বারে। আমার বাসার এড্রেস লিখে পাঠিয়েছি। ঈশান যেন আমাকে এখান থেকে নিয়ে যায়। ৯ঘণ্টা সাতচল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই দশঘণ্টা পুর্ণ হবে। কিন্তু ঈশানের কোনো খোজ নেই। একটিবার কল ব্যাকও করলো না।”
“হয়তো মেসেজ দেখেনি। কিংবা ব্যস্ত আছে।”
“আমি আর পজিটিভলি নিতে পারছি না রাইসা। এখন আমার মনে হচ্ছে শ্বাস আটকে মরে যাবো আমি। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আর একটুও সহ্য হচ্ছে না আমার। একটুও না।”
“রিলেক্স! আমি বলছি তারিন, আরেকবার ট্রাই করো। ঈশানকে ফোন করো। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে সব মিথ্যা। বড় কোনো ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। এমন কিছু করে ফেলো না যাতে পরে আফসোস করতে হয়। সো প্লিজ..”
মা’র পদধ্বনির শব্দ কানে আসতেই চুপ মেরে গেল রাইসা। মা পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকেই বলতে শুরু করল,
“তারু। চট করে গোসল সেরে তৈরি হয়ে নে। অন্তু এসেছে। তোকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে আজকে। দেরি করিস না শিগগির যা। আমি রান্না বসিয়েছি, দু’জন খেয়ে বেরিয়ে পড়বি কেমন? রাইসা তুমিও কিন্তু এখানেই লাঞ্চ করবে আজ। তোমার বাসায় বলে রাখা হয়েছে।”
“আচ্ছা আন্টি। ”
মা চলে যেতেই রাইসা বলল,
“অন্তুটা কে?”
“যার সাথে বিয়ে হচ্ছে। ভাইয়ার পছন্দের পাত্র।”
“এর মধ্যে পাত্রও ঠিক হয়ে গেল?”
আমি তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললাম,
“পাত্র তো সেই কবে থেকে ঠিক হয়ে আছে। শুধু আমার রাজি হওয়ার অপেক্ষা ছিল।অবশ্য আমি রাজি না হলেও বিয়েটা হতোই। আমার ইচ্ছের কদর কেউ করেনা এ বাসায়।”
“ছেলে কি করে?”
“তোমাকে তো বলেছিলাম, আমাদের পাড়ার কমিশনারের ছেলের ব্যপারে।”
“ঈশান যার হাত ভেঙে দিয়েছিল?”
“হুম। ইনিই সে।”
“এই ছেলেটার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? ভাইয়া সবকিছু জানার পরেও এটা কেনো করলেন?”
“ব্রেইনওয়াশ রাইসা। ভাইয়ার ব্রেইনওয়াশ করে দিয়েছে। হাত ভাঙার প্রতিশোধটাই হয়তো এভাবে নিচ্ছে। কি ভয়ংকর প্রতিশোধ! জীবনটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার। সেদিনের পর থেকে একটা রাতও আমার শান্তিতে কাটেনি। চরম যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে প্রতিটি মুহুর্ত পার করছি আমি। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জমে গেছে এবার। সেইরাতের কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে উঠি আমি। আমার জীবনের সবথেকে বাজে রাত। ”
“কোনরাত তারিন?”
“যে রাতে ঈশানের থেকে আলাদা করা হয়েছিল আমাকে। খুব কৌশলে। আমরা সেদিন বাচ্চা দুটোর সাথে সময় কাটানোয় ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের পিকআপ ড্রাইভার হঠাৎ মাঝরাতে এসে বললেন ভাইয়ার ফোন এসেছে। আমার সাথে জরুরি কথা বলবে ভাইয়া। ঈশান তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। ড্রাইভার এর কথামতো বাহিরে বের হতেই উনি আমায় কিডন্যাপ করলেন। তাও কার নির্দেশে? আমার আপন বড়ভাই। ভাইয়া সেদিন সব সত্যি জেনে গিয়েছিল। কিভাবে জেনেছিল জানো? অন্তুর কাছে। দীর্ঘদিন ধরে ঈশানের পেছনে পরেছিল সে। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল। শুধু সুযোগ খুজছিল আমাকে আর ঈশানকে আলাদা করার। সে সফলও হয়েছে।ভাইয়ার মনে ঈশানের জন্য রাশি রাশি বিশ্বাস ভেঙে দিয়ে নিজে সেই জায়গাটা দখল করতে পেরেছে। ”
“তাহলে তুমি কেনো ওকে সফল হতে দিচ্ছো ? তুমি এই বিয়েটা করলে তো সে জিতে যাবে। এটাই তো য়ার মেইন পয়েন্ট..”
রাইসার কথার মাঝখানেই ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করলেন। দুজনেই চুপ মেরে গেলাম আমরা। আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাইয়া রাইসাকে চলে যেতে বললেন। রাইসা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। ভাইয়া বিছানার কাছে চেয়ার এনে হাটুর উপর হাত রেখে বসলেন। গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
“এতোদিন পর সুবুদ্ধি হয়েছে তোর। আমি এই দিনটিরই অপেক্ষায় ছিলাম তারু। কবে তুই বুঝবি। কালরাতে নিহার সাথে কথা বলেছিস। মায়ের কাছে শুনলাম সব। আমাদের কথা বিশ্বাস না করলেও নিহার কথা শুনে নিশ্চয়ই সত্যিটা তোর কাছে পরিষ্কার?”
আমি নিশ্চুপ। আমার নিরবতায় ভাইয়া আবার বললেন,
“শোন তারু, বিশ্বাস করে শুধু তুই একলা ঠকিস নাই। আমরা সবাই ঠকেছি। আমিও কি কম বিশ্বাস করতাম ওকে বলতো?সবসময় অন্ধের মতো প্রতিটা কথা যাচাই-বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করে গেছি। দিনের পর দিন আমার চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলে গেছে ওই ছেলে। যে এইভাবে নিরবচ্ছিন্ন মিথ্যে বলতে পারে, সে সব করতে পারে। পৃথিবীর যেকোনো খারাপ কাজ তার দ্বারা সম্ভব।”
“সেটা আমি তোর ভালোর জন্যই করেছি। তোকে সেইফ রাখার জন্য এটুকু মিথ্যে আমি বলতেই পারি।নাহলে ওই তারায জোহান তোর পিছু কোনোদিন ছাড়তো না।”
“ঈশানও একই কারণে মিথ্যে বলেছিল ভাইয়া। মিথ্যের শুরুটা তো আমিই করেছিলাম। ”
“তোর মিথ্যে বলা আর ওর মিথ্যে বলা এক জিনিস না তারু। তুই আমাদের ঠকানোর জন্য মিথ্যে বলিস নি। কিন্তু ওই ছেলে ইনটেনশনালি আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছে। এমনকি তোকে পর্যন্ত ঠকিয়েছে। মোহনা সরকার কেনো নিজের ছেলের সাথে তোকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিল সেটা আমি এখন বুঝতে পারি।”
“যা হওয়ার হয়েছে ভাইয়া। এখন এসব কথা বলে কি লাভ? আমি তো রাজি হয়েছি বিয়েতে।”
“তুই একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। অন্তু ওই তারায জোহানের থেকে শতগুণে ভালো। ”
“ভালো-খারাপ আপেক্ষিক বিষয় ভাইয়া। তোমার কাছে যে ভালো, অন্যকারো কাছে হয়তো সে পিশাচের থেকেও ভয়ংকর।”
ভাইয়া হাসলেন, “কে জানে? সব জায়গায় তো আর ভালো হওয়া চলে না। কিছু কিছু জায়গায় খারাপ হওয়াও জায়েজ। তাছাড়া, অতিরিক্ত ভালো মানুষী দুর্বলতার কারণ।”
মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ভাইয়া। আমি টেবিলের ল্যাম্প ক্লকটা দেয়াল বরাবর ছুড়ে মারলাম।
.
মাঝরাস্তায় রিকশা দাড় করিয়ে সুপার শপে ঢুকেছে অন্তু। তাও আমার জন্য। এই প্রথম আমি তার কাছে চকলেট খাওয়ার বিশেষ আবদার করেছি। বেচারা খুশিতে এতোটাই আত্মহারা, যে আমাকে রিকশায় একা রেখে যাওয়ার বিষয়টা খেয়ালও করেনি। ইচ্ছে করলেই তো আমি পালিয়ে যেতে পারি এখন। আর আমার পালিয়ে যেতেই ইচ্ছে করছে। দীর্ঘদিন পর বাহিরের জগতের ঘ্রাণ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছে। ইচ্ছে পাখি। ইচ্ছে পূরণের দায়েই রিকশা ঘুরিয়ে রওনা হলাম সেই চিরচেনা গন্তব্যে।
বর্তমানে দাড়িয়ে আছি মোহনা আন্টি আর ফারায আঙ্কেলের সামনে। সমান তালে জেরা চলছে আমার উপর। এতোদিন পর কোথ থেকে আসলাম, কোথায় ছিলাম, আমার বিয়ে হয়নি তার প্রমাণ কি, আর ভাইয়াই বা মিথ্যে কেনো বলেছেন আরো কত শত প্রশ্ন। বেশিরভাগ প্রশ্ন ফারায আঙ্কেলই করছেন। মোহনা আন্টি প্রায় নিশ্চুপ। তেমন কিছুই বলছেন না। আমার ফিরে আসায় উনাকে খুশি মনে হলেও ফারায আঙ্কেল মানে ঈশানের বাবা খুব একটা খুশি হন নি বলেই বোধ হচ্ছে আমার। কিন্তু এসবে আমার কিছুই যায় আসে না। আমি শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর খুজতে এসেছি।বেশ কিছু সময় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকার পর হঠাৎই মাথা তুলে ফারায আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লাম আমি,
“ঈশান কোথায়?”
আমার প্রশ্নে উনি খানিক চুপ থেকে ভারী গলায় বললেন,
“ঈশানের সাথে কি দরকার?”
কথাটা তীরের মতো বিধল আমার মনে। কিছুটা অপমানবোধ হল। এমন সময় পেছন থেকে পরিচিত কারো কণ্ঠ ভেসে আসল,
“তারু!”
আমি ঘুরে তাকাতেই নিহাকে আবিষ্কার করলাম। নিহা হাত ভাজ করে বলল,
“ঈশান ভাইয়া এখানে থাকে না। উনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।”
🍂
🍂
আমি বধূবেশে বসে আছি, চারপাশে মেয়েদের ভীড়। পুরো রুমটা গিজগিজ করছে।মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে আমার সাথে সেলফি তুলে যাচ্ছে। আর আমি জোর করে হাসি দিচ্ছি। মুখে হাসি ভিতরে অস্থিরতা। ভয়ে কাবু হয়ে আছি। যখন কাজী সাহেবের সামনে যাবো, তখন কি হবে? আমি না হয় কোনো উসিলা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখলাম। কিন্তু ঈশান? উনাকে দেখে তো কাজী সাহেব ঠিক চিনে ফেলবেন। টেনশনে মাথা ধরে গেছে আমার। আমি বাহিরে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঈশানের সাথে একবার দেখা করা জরুরি। বিছানা ছেড়ে উঠার সময় অনেকেই জিজ্ঞেস করল কোথায় যাই। আমি এক কথার উত্তর দিলাম, বাধরুমে। ঘর থেকে বের হতেই ঈশানকে দেখলাম। উনি কিছুটা দূরে দাড়িয়ে আছেন। অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি পড়ে সাদা দাতের ঝকঝকে হাসি মুখে লাগিয়ে কারো সাথে কথা বলছেন।কার সাথে কথা বলছেন সেদিকে খেয়াল করার আগেই উনার দন্তবিকাশের দৃশ্য দেখে বুকের ভেতর ধুম ধারাক্কা ফিল হলো আমার। তার উপর পড়ে আছেন অফ হোয়াইট পাঞ্জাবী। এই পাঞ্জাবিটায় উনাকে এতো সুন্দর লাগছে!উনার শারীরিক আকৃতির সাথে একদম মিশে আছে পাঞ্জাবীটা। আর পাঞ্জাবীর রঙটাও উনার শরীরের রঙের সাথে অদ্ভুতভাবে মানিয়ে গেছে। এই পাঞ্জাবীটা যেন বিশেষভাবে তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র উনার জন্য। অন্য কোনো পাঞ্জাবী পড়লে উনাকে মানাতোই না। কোনো এক অজানা কারণে ঈশানের সামনে গিয়ে দাড়াতে আমার লজ্জা লাগছে। ভীষণরকম লজ্জা। এর থেকে মরে যাওয়াও সহজ মনে হচ্ছে। আমি মাথা নিচু করে আরেকবার তাকালাম। এবার উনার দিকেনা, উনার বরাবর দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। মেয়েটি রিক্তা। আমার সমবয়সী। ঈশানকে শরবত খাওয়ানো নিয়ে তর্ক করছে।ঈশান খেতে চাইছে না, কিন্তু রিক্তা জোর করে খাওয়াবে।
ঈশান হাত ভাজ করে পিলারের সাথে হেলান দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“আচ্ছা জিনিসটা কি? কেমন অদ্ভুত লাগছে দেখতে।”
“এটা শরবত ভাইয়া।খান ভালো জিনিস।”
“আগে তো জানতে হবে কিসের শরবত। নাহলে যে খাওয়া যাচ্ছে না।”
“জরুরি শরবত।”
“হোয়াট?”
রিক্তার পাশে দাড়ানো আরো দুটি মেয়ে এবার খিলখিলিয়ে হাসল। রিক্তাও হাসল, মুখে হাত চেপে হাসি থামিয়ে আবার বলল,
“হ্যা ভাইয়া, এটার নাম জরুরি শরবত। তাই আপনাকে জরুরি ভিত্তিতে খেতে হবে। নিন, খান!”
পেছন থেকে একটা মেয়ে বলল,” আরে কষ্ট করে খেয়েই ফেলুন, এটা আজকে রাতের জন্য এনার্জি ড্রিংক হিসেবে কাজে লাগবে৷”
কথাটা শুনে ঈশান বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। আর মেয়েগুলো লজ্জায় লাল হয়ে হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেল। তাও ঈশানের হাতে শরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে। আমি তখন ঈশানের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ঈশান সামনে তাকিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে দেখে প্রথমেই কিছুটা চমকে উঠলেন। সেই চমকের রেশ বেশিক্ষণ রইল না উনার চোখে। ঘন পল্লবের দৃষ্টি স্থির রেখে হতবিহ্বল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন উনি। আমি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরমুহূর্তে বুঝলাম, উনার সামনে লাল বেনারসিতে একদম পরিপূর্ণ নব বধূরুপে দাড়িয়ে আছি আমি। কথাটা মনে আসতেই লজ্জায় মুখ লাল হওয়ার যোগান। সাথে অস্বস্তিও লাগছে।নিজের এই লজ্জাজনিত অস্বস্তি আর ঈশানের ঘোর কাটাতে আমি ঈশানের হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা কেড়ে নিলাম। গ্লাসের শরবতটুকু পাশের তুলসীর টবে ঢেলে দিলাম। খালি গ্লাসটা ঈশানের হাতে ধরিয়ে বললাম,
“কাজী সাহেবকে দেখেছেন?”
ঈশান ঘোর লাগানো কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “হুম?”
আমি উচ্চ স্বরে বললাম,” কাজী সাহেবকে দেখেছেন আপনি?”
আমার তীক্ষ্ণ শব্দে ঈশান স্বাভাবিক হলেন। নড়েচড়ে বললেন,” হ্যা দেখেছি, কেনো?”
আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম। উনি কেনো বলছে কেনো?কাজী সাহেবকে দেখেও চিনতে পারেন নি নাকি? ঈশান কপালে এক আঙুল ঠেকিয়ে বললেন,
“ওহ শিট! আমি ভুলে গেছিলাম। তোমাকে একটা ইম্পোর্টেন্ট কথা বলার আছে তারিন।”
“সেই ইম্পোর্টেন্ট কথাটা কি কাজী সাহেবকে নিয়ে? আমি জানি। দেখেছি উনাকে। কিন্তু এবার কি হবে?”
“সেটা বলতেই এসেছি। ভিতরে মেয়েরা ছিল বলে যেতে পারছিলাম না। এখানে দাড়িয়ে ছিলাম। আচ্ছা শোনো তারিন, তোমাকে যখন বিয়ের আসনে নিয়ে যাওয়া হবে তুমি সামহাউ যেকোনো এক্সকিউজ দিয়ে মাথায় বড় ঘোমটা টেনে রাখবে। যেন চেহারা দেখা না যায়।”
“আমি না হয় এমনটা করলাম, আর আপনি? ”
ঈশান এদিক-ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে পেছনের পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করলেন। রুমালটা ভাজ করে মুখের সামনে ধরে বললেন,
“দেখো তো ঠিকাছে নাকি?”
আমি হেসে দিলাম। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললাম,
“পারফেক্ট। কিন্তু কেউ যদি কারণ জিজ্ঞেস করে?”
“বললাম তো। এক্সকিউজ দিতে হবে! ”
“ওকে। তাহলে আমি এখন যাই।”
“বেস্ট অফ লাক।”
“আপনাকেও বেস্ট অফ লাক।”
.
কাজী সাহেবের বরাবর আমি আর ঈশান। আমার পিছনে মা আর বুড়ি। ঈশানের পাশে বসেছেন ভাইয়া। আশেপাশে মোটামোটি মানুষের ভীড়। মা আমাকে বারবার একটা কথাই জিজ্ঞেস করছে।মাথায় ঘোমটা কেনো টেনে রেখেছি৷ আর আমি একেক সময় একেক রকম উত্তর দিচ্ছি। কখনো বলছি মাথা ব্যাথা, লাইটের আলোতে প্রবলেম হচ্ছে, কখনো বলছি বমি আসছে, তাই মুখে কাপড় চেপে রেখেছি। আবার কখনো বলছি খুব কান্না পাচ্ছে, তাই মুখ ঢেকে কাদছি। এতো এক্সকিউজ শোনার পরেও মা একটু পরই পরই বলছে, ঘোমটা নামিয়ে নে৷ মানুষ কি ভাববে? জানিনা নিজের কমফোর্টজোনের বাহিরে গিয়ে মানুষের ভাবাভাবি নিয়ে চিন্তা করা কতটা যুক্তিযুক্ত। কাজী সাহেব আমাকে তেমন একটা সন্দেহ না করলেও ঈশানকে খুব সন্দেহ করছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। বারবার সরুচোখে ঈশানকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছেন। হতে পারে কাজী সাহেবের এমন সন্দেহের কারণ ঈশানের সেই বিখ্যাত চুল। আমার ভাষ্যমতে ব্ল্যাক ফরেস্ট। মাথায় একটা টুপি পড়ে নিলেও হতো। কাজী সাহেব সন্দেহ করতেন না। হঠাৎই কাজী সাহেব ঈশানকে বললেন,
ঈশান বললেন,” আসলে আমার এলার্জির প্রবলেম। অতিরিক্ত লাইটিং আর মানুষের ভীড়ে বেশিক্ষণ থাকলেই অস্বস্তি লাগে। চোখমুখ লাল হয়ে যায়। অদ্ভুত দেখতে লাগে। তাই এভাবে আছি।”
ভাইয়া চিন্তিত হয়ে বললেন,” এটা কেমন রোগ? ডাক্তার দেখিয়েছো?”
“হ্যা দেখিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছে এভাবে সাদা কাপড় জড়িয়ে রাখলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
ভাইয়া ঈশানের কাধে হাত বুলিয়ে বললেন,” আচ্ছা আচ্ছা! ”
তারপর ভাইয়া কাজী সাহেবের দিকে তাকালেন, “ছেলেটা আসলে অসুস্থ।”
কাজী সাহেব বললেন, “কাপড়টা কি একটুও সরানো যাবে না?”
কাজী সাহেব আর কথা বাড়ান নি। বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। কিন্তু বিপত্তি ঘটল তখনি, যখন পাত্রীর নাম বলা হলো। আমার নাম শুনেই কাজী সাহেব কিছুটা হকচকিত হয়ে বললেন,
“আচ্ছা মেয়ের বাবার নাম কি?”
ভাইয়া স্বাভাবিক ভাবে বললেন, “মরহুম তাজউদ্দীন সাঈদ।”
কাজী সাহেব চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালেন। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“মেয়ের মায়ের নাম কি? ”
ভাইয়া বললেন, “আয়েশা তালুকদার। ”
এবার যেন কাজী সাহেবের চোখ কোটরাগত হওয়ার উপক্রম। একবার ঈশান আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে কাজী সাহেব বললেন,
“আচ্ছা ছেলের নাম কি সত্যি ঈশান আহমেদ?”
ভাইয়া বললেন, “হ্যা!”
কাজী সাহেব ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার নাম ঈশান আহমেদ নাকি তারায জোহান ঈশান একটু ঠিক করে বলুন তো?”
ভাইয়া উঠে দাড়ালেন, “মিথ্যে কথা বলার জায়গা পান না? আপনাকে মোহনা সরকার পাঠিয়েছে তাইনা? আমার বোনের বিয়ে ভাঙার জন্য? আমার তো মনে হচ্ছে আপনি নকল কাজী।”
“কি আবোল তাবোল বকছেন আমি নকল কাজী হতে যাবো কেনো?”
“আপনি অবশ্যই নকল কাজী।”
“দেখুন না জেনে কথা বলবেন না। আমার বিষয়ে খোজ নিয়ে দেখবেন। তিনশোরও বেশি বিয়ে পড়িয়েছি আমি।”
“আর এমন মিথ্যে বলে বিয়ে ভেঙেছেন কয়টা?”
“আস্তাগফিরুল্লাহ! মিথ্যে বলা আর বিয়ে ভাঙা কোনোটাই আমার ধাচে নেই।”
“আপনার ধাচে কি আছে সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানবে না। আপনি মোহনা সরকারের দালালি করেন। কি ঠিক বললাম তো? ”
“এইটা কি ধরণের কথা আমি উনার দালালি কেনো করতে যাবো?”
মা বললেন,” তারিফ তুই কি বলছিস এসব? আন্দাজের উপর ভিত্তি করে কাউকে কিছু বলা কি ঠিক?”
ভাইয়া বললেন, “আন্দাজের উপর না মা। আমি একশো পারসেন্ট সিওরিটি দিতে পারি এ ব্যাপারে। এই কাজী বিয়ে দিতে আসেনি, বিয়ে ভাঙতে এসেছে।”
কাজী সাহেব রুক্ষভাষায় বললেন, “দেখেন আমি শুধু সত্যিটা বলেছি। আপনি মানতে না চাইলে কি হবে?এটা মোহনা সরকারের ছেলে। চিনতে আমার একটুও ভুল হচ্ছে না।”
ভাইয়া বললেন, “আপনার সত্যি আপনার কাছে রাখেন। আর ভালোয় ভালোয় বিদায় হোন এখান থেকে। আপনার মতো দালালকে দিয়ে বিয়ে পড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”
“এইযে দেখুন আপনি আমাকে আরেকবার দালাল বলবেন না। আমার একটা সম্মান আছে। আর এই বিয়ে তো আমি এমনিতেও পড়াবো না। কারণ এদের দুজনের বিয়ে আগেই হয়েছে। আপনার বোন তো আপনাকে না জানিয়েই বিয়ে করেছে।”
ভাইয়া হুংকার দিয়ে বললেন, “আবার মিথ্যে বলে? আমার বোনের ব্যাপারে আমার থেকে ভালো আপনি জানেন নাকি? এই আপনি যান তো। এখনি বের হোন এখান থেকে। মাথা গরম করবেন বা আমার। চাই না পরিবেশটা নষ্ট হোক।”
বিয়ে বাড়ির পরিবেশে আমূল পরিবর্তন আসল। সবাই বিষয়টা নিয়ে কানাঘুষা শুরু করল। ভাইয়া কোনোকিছুর তোয়াক্কা করলেন না। প্রথম কাজীকে বিদায় করে নতুন কাজী নিয়ে আসলেন বিয়ে পড়ানোর জন্য। ঈশান আর আমার প্রতি ভাইয়ার এমন অগাধ বিশ্বাস দেখে কান্না পেয়ে গেল আমার। এই মানুষটিকেই এইভাবে ঠকাচ্ছি আমরা? ভাইয়া যখন সত্যিটা জানতে পারবে, তখন মেনে নিতে পারবে তো!
বিয়ে নামক ঝামেলা বেশ ভালো ভাবেই মিটে গেল। কিন্তু বিদায়বেলার সময় ঘটল আরেক ঘটনা। তখন রাত ১১টা। ভীড় খুব একটা নেই। বাহিরে শুধু ভাইয়ার দু একজন বন্ধু, ঈশান, আমি আর বুড়ি দাড়িয়ে আছি। মা কাদতে কাদতে ভিতরে চলে গেছে। আমার বিদায়ের দৃশ্যটা সহ্য করতে পারবে না হয়তো। কিছুক্ষণ আগেও হাউমাউ করে কান্না আসছিল। চোখমুখ ফুলে একাকার। কিন্তু ভাইয়ার কথা শুনে সেই কান্না দূর আকাশে হারিয়ে গেল। ভাইয়া বললেন,
“শোনো ঈশান। রাত অনেক হয়েছে, এই অবস্থায় তোমাদের জার্নি করে কিশোরগঞ্জ যাওয়া ঠিক হবে না। তাই তোমাকে বলছিলাম আজরাতটা এখানে পার করে সকালে যাও। কিন্তু তুমি তো শুনছো না। তাই আমি একটা বিশেষ ব্যবস্থা করেছি।”
ঈশান বললেন, “কি ব্যবস্থা?”
“তোমাদের জন্য একটা পিকআপ ভাড়া করেছি। সোজা কিশোরগঞ্জ পৌছে দিবে। সারারাত কষ্ট করে ড্রাইভ করতে হবে না তোমাকে। ভালো হয়েছে না?”
কথাটা শুনে অন দ্যা স্পট ঈশান কাশতে শুরু করলেন। আর আমি কান্নার সাথে হেচকি তুলতে লাগলাম। ভাইয়ার এতো ভালো না ভাবলেও চলতো। এবার কিশোরগঞ্জ গিয়ে আমরা করবো টা কি?
🍂
চলবে
#তি_আমো❤
#পর্ব_২৭
Writer: Sidratul muntaz
🍂
ঈশান হালকা কেশে বললেন, “পিকআপ এর কি দরকার? আমি ম্যানেজ করে নিবো। ড্রাইভিং তো আমার প্যাশন। ড্রাইভ করতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। পিকআপ টিকআপের প্রয়োজন নেই। ক্যান্সেল করে দাও।”
ভাইয়া হাল্কা ধমক দিয়ে বললেন, “ধুর! কি বলো এসব? ৫০০০ টাকা দিয়ে ভাড়া করেছি কি ক্যান্সেল করার জন্য নাকি? নব দম্পত্তি এতোটা পথ জার্নি করে যাবে, সু ব্যবস্থা না থাকলে হয়? আর তুমি নতুন জামাই হয়ে সারারাত ড্রাইভ করবে এটাও কি কোনো কথা হলো? ”
ঈশান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথার পেছন দিক চুলকালেন। ভাইয়া ঈশানের কাধে হাত রাখলেন,
“গাড়ি সুন্দরমতো ফুল দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রেডি আছে। তোমরা আর দেরি করো না, রওনা দিয়ে দাও। রাত তো কম হয়নি।”
ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন, “বোনকে কি খালি হাতে পাঠানো যায়?”
ভাইয়ার কথা শুনে ঈশান হতভম্ব হয়ে হলেন। বোঝাই যাচ্ছে ব্যাপারটায় উনি যথেষ্ট অসন্তুষ্ট এবং অপ্রস্তুত। এমন কিছু আশাই করেন নি। ভাইয়া ইতস্ততভাবে আবার বললেন,
“বেশি কিছু না। এই তোমার বাবা-মায়ের জন্য কিছু উপহার, কয়েক পদের মিষ্টি, দই, ফলমুল। এসবই।”
ঈশান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “এসব কি খুব বেশি জরুরি ছিল? আমাকে আগে জানানো হলে আমি অবশ্যই না করতাম। কাজটা ঠিক হয়নি তারিফ। এট লিস্ট আমাকে একবার হলেও জানানো উচিৎ ছিল।”
ভাইয়া ঈশানকে জড়িয়ে ধরলেন। আর বললেন,
“আরে ব্যাপার নাহ। তোমার মা-বাবাকে আমার সালাম দিও। ”
ভাইয়া ঈশানকে ছাড়তেই ঈশান রোষপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,
“বাবা-মা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে। ভুল করেছো।”
ভাইয়া অনবহিত ভাবে বললেন, “আরেহ! বলে দিও আমাদের বাড়ির নিয়ম।”
ঈশান শক্তমুখে বললেন, “খুব বাজে নিয়ম।”
ভাইয়া হেসে দিলেন। বুড়িও হেসে ঈশানের কাছে আসলো। ঈশানের এক হাত ধরে একথা সেকথা বলে সাত-পাচ বুঝানোর চেষ্টা করলো। এতে ঈশান ঠান্ডা হলেন কিনা বোঝা গেল না।
.
.
গাড়ি চলতে শুরু করেছে প্রায় দশমিনিট। আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় ভাইয়ার চোখটা টলমল করছিল। আমি গাড়িতে উঠার পর হয়তো কেদেও ফেলেছিলেন ভাইয়া। প্রথম প্রথম খারাপ না লাগলেও গাড়িটা যখন চলতে শুরু করল আর আমি জানালা দিয়ে ভাইয়ার ক্রন্দনরত দৃশ্য দেখলাম, অচিরেই বুকটা হু হু করে উঠল। কেমন একটা শুন্যতা ভর করল সারা বুক জুড়ে। গাড়ি যত সামনে এগুচ্ছে, এই শুন্যতার ভার যেন ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। কান্না আসছে ভীষণ, ইচ্ছে করছে সবকিছু থামিয়ে আবার ফিরে যেতে। দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরতে।মায়ের কোলে মাথা রেখে কাদতে। আর বলতে, তোমাদের ছেড়ে আমি কিভাবে থাকি? আসলেই তো! কিভাবে থাকবো আমি?
“তারিন!”
ঈশানের ডাকে মাথা তুলে তাকালাম। চোখের পানি মুছে ঠোট উল্টো রেখেই বললাম,
“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ঈশান। মা, ভাইয়া, বুড়ি সবাইকে খুব মিস করবো। ওদের ছাড়া আমি একটাদিনও থাকতে পারিনা। সেখানে সারাজীবন কিভাবে থাকবো? আমি পারবো না। অসম্ভব! ”
ঈশান চুপচাপ আমার কথাটা শুনলেন। আমি ঈশানের বাম হাতের উপর হাত রেখে আবার বললাম,
“আচ্ছা ঈশান এমনকি হয়না? ধরুন, এক মাসে তো ত্রিশ দিন তাইনা? প্রথম ১৫ দিন না হয় আমি আপনার সাথে আপনার বাসায় থাকবো। আর শেষ ১৫ দিন আপনি আমার সাথে আমার বাসায় থাকবেন। এভাবে প্রত্যেক মাসে আমরা এটা রিপিট করবো। তাহলে আমাদের মধ্যে কেউই কারো ফ্যামিলিকে মিস করবে না। সমান সমানভাবে আমরা ফ্যামিলির সাথে সময় কাটাতে পারবো। আইডিয়াটা ভালো না?”
ঈশান শান্তচোখে তাকিয়ে আছেন। উনার কোনো ভাবাবেগ না দেখে আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
“বলেন না? ভালো আইডিয়া না? দেখুন আমি কিন্তু মা-ভাইয়াকে না দেখে কিছুতেই থাকতে পারবো না। তাদের ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে গেলেও কান্না পায় আমার!”
আরেক দফা কাদলাম আমি। ঈশান এবারও কোনো উত্তর দিলেন না। বরং ভয়ানক একটা কান্ড করলেন। হুট করে আমার কোমর চেপে ধরে আমাকে উনার কোলের উপর বসিয়ে আচমকাই ঠোটে চুম্বন করলেন। বেশ কিছু সময় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা পার করতে হলো আমাকে। হঠাৎ ঈশান নিজে থেকেই ছেড়ে দিলেন আমার নিষ্পাপ ঠোট দুটোকে। কিন্তু আমাকে ছাড়লেন না। আগের মতোই কোলে বসিয়ে রাখলেন। আমি এতোক্ষণ শুধু ছটফট করছিলাম। এখন বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছি। মনে হচ্ছে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড ওইভাবে থাকলে দম আটকে মরেই যেতাম। আমার অবস্থা দেখে ঈশান মৃদু হেসে বললেন,
“কান্না থেমে গেছে রাইট? ”
আমি বড় বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,” মানে?”
“চেষ্টা করে দেখো। এখন আর চাইলেও কান্না আসবে না। ইটস ম্যাজিক থেরাপি। কান্না থামানোর ম্যাজিক থেরাপি। আর কখনো যদি আমার সামনে কাদো, তাহলে এভাবেই ম্যাজিক থেরাপি দিয়ে কান্না থামাবো। সো বি কেয়ারফুল।”
উনার কথায় আমি বাকরুদ্ধ। কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে দুই হাত দিয়ে ইচ্ছেমতো ঈশানের কাধে থাপরাতে শুরু করলাম। ঈশান হো হো করে হাসলেন। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
“কান্না থামানোর কৌশল এটা? নাকি বাহানা।”
ঈশান আমার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। শান্ত গলায় বললেন,
“বাহানা।”
তারপর আমার মুখের কাছে ঝুকে আবার বললেন, “কাদো কাদো মুখটা তোমার এতো কিউট লাগছিল, আমি কন্ট্রোলই করতে পারলাম না।”
আমার মুখ লজ্জায় লাল।না চাইতেও মুচকি হেসে দিলাম আমি। আমার হাসি দেখে ঈশান একবার আমার ঠোটের দিকে তাকালেন। হুট করেই আমার মাথার পেছনে হাত রেখে আমার কপাল উনার নিজের কপালের সাথে ঠেসে ধরলেন। ফিসফিস করে অনেকটা ঘোর লাগানো কণ্ঠে বললেন,
“প্লিজ এভাবে হেসো না। তাহলে কিন্তু সব কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবো।”
ঘটনার আকস্মিকতায় আমার চোখ গোলাকার হয়ে গেল, এবং সেভাবেই তাকিয়ে রইলাম আমি। ঈশানের চোখ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। ভারী ভারী নিঃশ্বাস নিচ্ছেন উনি। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে ঈশানের কোল থেকে নেমে গেলাম। একদম জানালার সাথে মিশে বসলাম। হ্রৎপিন্ডটা তুমুল গতিতে কাপছে। এই যন্ত্রণাময় অনুভূতি থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় আমার জানা নেই।
🍂
বলেই হাসতে হাসতে ফোন কেটে দিল নিহা। আমি উত্তরে ঝাড়ি টাইপ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ততক্ষণে লাইন কাট। ঈশান বলে উঠলেন,
“কি বলে নিহা?”
“মোহনা আন্টি টেনশন করছে সেটাই বলে। আচ্ছা এখন কি আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যেতে পারিনা?”
“ঝামেলা হবে তারিন। ”
“কিসের ঝামেলা?”
“আমরা মাঝপথে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে গেলে সেই খবর কি তারিফের কাছে পৌছাবে না?ড্রাইভার নিজেই তো বলবে।”
“বলুক। সত্যিটা আজ বাদে কাল ভাইয়া জানবেই।”
“সন্দেহ করে জানা আর আমাদের থেকে জানা সম্পুর্ণ অালাদা বিষয় তারিন। আমি চাইনা আমরা কিছু জানানোর আগেই তারিফ আমাদের সন্দেহ করুক।”
“তাই বলে এখন আমরা বিনা কারণে এতো মাইল পথ পেরিয়ে কিশোরগঞ্জ ঘুরে আসবো?”
“তাছাড়া আর কোনো অপশন আছে? সব কিন্তু ঠিকঠাকই হচ্ছিল। মাঝখানে ঝামেলা পাকালো তোমার ভাই। কত সুন্দর আমরা বাসায় চলে যেতাম! কিন্তু শালা কোথ থেকে পিকআপ ভাড়া করে এনেই জট লাগিয়ে দিল। ”
“ওয়েট ওয়েট! আপনি শালা কাকে বললেন?”
“ভেবে দেখো। তোমার ভাই আমার শালাই তো হয়।”
আমি অপ্রস্তুত গলায় বললাম, “হ্যা বুঝলাম শালা হয়। কিন্তু তাই বলে আপনি শালাই বলবেন?”
“আজব তো! শালাকে শালা বলবো না তো আর কি বলবো?”
“আমি অত শত বুঝিনা। আপনি আমার ভাইকে শালা বলতে পারবেন না ব্যস!”
ঈশান হেসে আমার নাক টিপে দিয়ে বললেন,
“তাহলে কি শালিকা বলবো?”
আমি চোখ বড় করে ক্রুদ্ধ স্বরে বললাম,
“আপনি খুব খারাপ।”
ঈশান হু হা করে হাসলেন। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললেন,
“আচ্ছা তারিন, একটা কাজ করলে কেমন হয়?”
আমি উনার দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,” কি?”
“ড্রাইভারকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য ঘুষ দিলে কেমন হয়?”
আমি ঈশানের দিকে তাকালাম। কপালে ভাজ টেনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম,
“ভালো হয়। কিন্তু এই ড্রাইভারও যদি আবার ওই কাজী সাহেবের মতো অতিমাত্রায় ভদ্রলোক হয়? যদি ঘুষ নিতে রাজি না হয়?”
ঈশান আত্মবিশ্বাসী হাসি হেসে বললেন,
“আরে হবে হবে। শালা পাচহাজার দিয়েছে, আমি না হয় দশহাজার দিলাম। ইজিলি ম্যানেজ হয়ে যাবে।”
“আবার শালা?”
ঈশান বাকা হেসে এক চোখ টিপে বললেন, “চলো ট্রাই করে দেখি।”
আমি ভ্রু বাকা রেখেই বললাম, “হুম।”
আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী ড্রাইভারের সাথে চুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় হুট করেই গাড়ি থামানো হলো। আমি আর ঈশান বিস্মিত দৃষ্টিতে চোখাচোখি করলাম। ঈশান সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কি হয়েছে ভাই? কোনো সমস্যা? ”
ড্রাইভার আক্ষেপী স্বরে বললেন,
“সমস্যা তো বাইধা গেছে ভাই।”
ঈশান বললেন, “কি হয়েছে?”
“সামনে রাস্তা বন্ধ। আগানের উপায় নাই। আবার গাড়ি ঘুরাইতে গেলে এক ঘণ্টার রাস্তা।”
ঈশান ফিসফিস করে আমাকে বললেন,” বাহ! এ তো দেখি মেঘনা চাইতেই বৃষ্টি। দারুণ ব্যাপার! ”
আরেকবার সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে ঈশান বললেন, “তাহলে ভাই বাদ দেন। আমাদের যাওয়া এতো ইম্পোর্টেন্ট না। গাড়ি ঘুরান, ঢাকায় ফিরে যাই।”
“কি কন ভাই? সিউর?”
“হ্যা হ্যা সিওর। যাওয়া ক্যান্সেল।”
“আইচ্ছা আমি তাইলে ভায়েরে একটা ফোন দিয়া জানায় লই। ভায়ে আবার কইসিলো কোনো অসুবিধা হইলে যেন ফোন করি।”
ঈশান আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলেন,
“বলেছিলাম না? এইখানে একটা মশা মারা হলেও সেই খবর শালার কাছে পৌছে যাবে।”
আমি সরু চোখে তাকালাম, “আবার?”
ঈশান মুচকি হাসলেন। ড্রাইভার গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে ভাইয়াকে ফোন করার উদ্দেশ্যে। আমি জানালাটা হাল্কা খুলে চোখমুখ ভালোমতো ধুয়ে নিলাম। পানির বোতলটা সিট পকেটে রেখে রুমালে দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছি, এমন সময় ঈশান বললেন,
“এই এক মিনিট। ”
আমি উনার দিকে ঘুরে তাকাতেই উনি আমার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলেন। নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন,
“আই এম ডান।”
বলেই বুকের বামপাশে হাত রাখলেন। আমি ভ্রু কুচকে বললাম,” মানে?”
আমি হেসে দিতেই উনি আমার দুই গাল চেপে ধরলেন। আমার হাসি থেমে গেল। চোখজোড়া বর্তুলাকার বানিয়ে তাকালাম। ঈশান আমার নাকের সাথে নিজের নাক স্পর্শ করিয়ে বললেন,
“একবার বলেছি না এইভাবে হাসবে না! বারবার ঘায়েল করতে চাও আমাকে? এই মিষ্টি হাসিটাই যে আমার একমাত্র নেশা, সেটা কি বোঝো না তুমি? ভদ্র ছেলেটাকে এভাবে নেশায় আসক্ত বানিয়ে দিচ্ছো। এটা কি ঠিক?”
আমি ঠোট চেপে হেসে বললাম, “ভদ্রম্যান যদি নিজের ইচ্ছাতেই অভদ্রোচিত আচরণ করে, সেটাও কি আমার দোষ?”
আমার কথার মাঝখানেই জানালার গ্লাসে কেউ একজন টোকা দিল। ঈশানের পেছন দিকের জানালাটায়। ঈশান সোজা হয়ে বসলেন। ছোট একটা হাত দেখা যাচ্ছে। আমি আর ঈশান একবার চোখাচোখি করে জানালার কাচ নামালাম। একটা বাচ্চা ছেলে, বয়স ৭/৮ হবে। হলদে দাতের হাসি দিয়ে বলল,
“আমি রাকিব। আমার ছোটবোন রানীর আজকে জন্মদিন। আমাগো আব্বা-আম্মা নাই। তাই আজকের দিনেও ওর মনটা খুব খারাপ।”
ঈশান হয়তো ভাবলেন বাচ্চাটা টাকা চাইছে। তাই উনি ওয়ালেট বের করলেন। পাচশ টাকার একটা কচকচে নোট এগিয়ে দিয়ে বললেন,
ঈশান ওয়ালেট থেকে একটা সবুজ কালির কলম বের করলেন। পাচশ টাকার নোটের উপর লিখলেন, “Happy Birthday Rani. Have a Good-day”
ছেলেটার দিকে নোট টা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এবার ঠিকাছে?”
“হয় ঠিকাছে। তয় আপনারা যদি নিজে গিয়া ওরে উপহারটা দেন, ওয় আরো বেশি খুশি হইবো।”
আমি আর ঈশান দুজনই হাসলাম। আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,
“ঠিকাছে চলো। দেখে আসি তোমার বোনকে। ”
সম্পুর্ন ঘরটা টিনের তৈরি। ঘরের পেছনেই ময়লার স্তুপ। সেখান থেকে বিকট গন্ধ আসছে ক্রমাগত। এক মিনিটও বসে থাকা দায়। টিনের চালে অজস্র ফুটো থাকায় বৃষ্টির পানি অনবরত গড়িয়ে পড়ছে। ছোট্ট ঘরটায় শুধু একটা চৌকি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে এমন ঘরে বসবাস করা খুব একটা সম্ভবপর না। অথচ ছেলেমেয়ে দুটো এখানেই স্বাচ্ছন্দে দিনের পর দিন কাটায়। বাচ্চা মেয়ে রানির বয়স তিন কি চার। একরোখা গায়ের গড়ন, তবে ফরসা। শরীরে একটু স্বাস্থ্য থাকলেই বেশ লাগতো দেখতে। আমরা ঘরে ঢুকতেই ঈশান মাটিতে আরাম করে বসে পড়লেন। উনার দেখাদেখি আমিও বসলাম। রাকিব প্রফুল্লচিত্তে হাসল। রানিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
রানি মাথা উচু করে রাকিবের দিকে তাকাল। তারপর আমাকে আর ঈশানকে নিষ্পলক দেখতে দেখতে আধো আধো পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। ঈশান অধৈর্যের ন্যায় রানির এক হাত ধরে টেনে আনলেন। নিজের কোলের উপর বসালেন। রুক্ষ, শুষ্ক, জটবাধা চুল গুলোতে আলতো হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিলেন। উনার নিঃসংকোচ আদর দেখে আমার চোখ ঝলমল করছে। ঈশান বিছানাটার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,
আমি বিছানার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম কয়েকটা স্বল্প পাতার বই খুব যত্নে এক কোণে গুছিয়ে রাখা। রাকিব আর রানির সাথে বেশ কিছুসময় আড্ডা দেওয়া হলো। রাকিব টং এর দোকানে কাজ করে। ইট ভাঙা, ভারী জিনিস উপরে তোলা এসব কাজ অপশনাল হিসেবে করে। তবে টং এর দোকানের কাজটা পারমানেন্ট। আজকে বৃষ্টির কারণে এক্সট্রা ইনকামের সুযোগ হয়নি তার। ছোটবোনের জন্মদিনেও বাড়িতে কোনো খাবার নেই। বাচ্চা দুটো সারাদিন ধরে উপোস করেছে। প্রায়ই উপোস করে থাকতে হয় তাদের। কিন্তু আজকের দিনের পরিকল্পনাটা হয়তো অন্যরকম ছিল। বিছানার নিচে ইস্পাতের থালার উপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে নুড়িপাথর। হয়তো খাবারের শান্ত্বনা হিসেবে ছোট্টবোনকে বুঝিয়ে রেখেছে ছোট্ট ভাইটি। তাদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন দেখে হতাশার নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। এরকম আরো কত পথশিশু আছে, কয়জনের সন্ধানই বা পাই আমরা? দিনশেষে ক্ষুধা নামক অসুখের কাছে হার মেনে তাদের জীবনের উজ্জল শিখাটাও নিভে যায়। ঈশানের বুদ্ধিতে রানির জন্মদিন টা বেশ জাকমজমকপুর্ণ ভাবে পালন করা হলো। ভাইয়ার পাঠানো খাবারগুলোর এর থেকে সুন্দর ব্যবহার আর হতে পারে না। বলা চলে,, আজকের রাতটা আমার জীবনের সেরা রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাসর রাত এমন সুন্দরভাবে কাটানোর সৌভাগ্য কয়জনের হয়? এর থেকে সুন্দর আর হতেই পারেনা। অসম্ভব। রাতটা আমাদের রাকিব-রানির সঙ্গে হাসি আনন্দেই কাটল। কিন্তু সকালের উজ্জল আকাশের সূর্য কন্যাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হলো না। তার আগেই সব শেষ..
🍂
🍂
মোহনা আন্টি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন, প্রফুল্লকর একটা হাসি দিয়ে ঈশানকে বললেন,
“তারিন এখানে?”
বলেই আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। আমিও এগিয়ে গেলাম৷ উনি এক হাত দিয়ে আমার বাহু চেপে ধরলেন। আমার মাথার এক সাইডে হাত বুলিয়ে ঢোক গিলে কান্না থামালেন। আর বললেন,
“ভয় পেয়ো না তারিন। তোমার বিয়ে আমরা কিছুতেই হতে দিবো না। ঈশান আছে না, ও ঠিকই বিয়ে আটকে দিবে। ভেঙে দিবে বিয়ে। টেনশন করো না হ্যা? ”
কথাগুলো বলতে বলতে ঈশানের দিকে তাকালেন, “ঈশান, তুই তারিনের বিয়েটা আটকাতে পারবি তো? তোকে কিন্তু পারতেই হবে। প্রয়োজন হলে ওই অসভ্য ছেলেটাকে পিটিয়ে আধমরা বানিয়ে দিবি। হাত পা ভেঙে গুড়ো করে দিবি। বিয়ে করার অবস্থাতেই যেন না থাকে। দরকার হলে হসপিটালে এডমিট করে দিয়ে আসবি। খরচপাতি আমি বুঝে নিব। তারপর দেখবো বিয়ে কিভাবে হয়। পাত্র না থাকলে কার সাথে কিভাবে বিয়ে দিবে তোমার ভাই?”
ঈশান এগিয়ে এসে বললেন,” আচ্ছা আচ্ছা মা! তুমি আগে নরমাল হও। কাম ডাউন।”
আন্টির দুই কাধ স্পর্শ করে আন্টিকে বেঞ্চের উপর বসালেন ঈশান। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,
নিহা মাথা ঝাকিয়ে বলল, “আমার বেডরুমে আছে। আমি এখনি নিয়ে আসছি। ”
নিহা চলে যেতেই মোহনা আন্টি আবার শুরু করলেন,
“ঈশান,চল চল না আমরা এক কাজ করি? আমরা তারিনকে নিয়ে বাসায় চলে যাই। ওর ভাই ওকে খুজেও পাবে না। বিয়েও দিতে পারবে না। ঠিকাছে না তারিন? তুমি চলো আমাদের বাসায়। যাবে?”
ঈশান বললেন, “আচ্ছা যাবে।কিন্তু তুমি এখন সাইলেন্ট থাকো। কথা বলবে না। প্রেশার বেড়ে গেছে নাকি আল্লাহ জানে। এতো হাইপার হলে চলে মম? ”
আন্টি জোরে মাথা নাড়লেন। ঈশান আমার দিকে ইশারা করতেই আমি ছোট ফিল্টারের উপর সাজানো ওয়ানটাইম গ্লাস দিয়ে পানি আনলাম। ঈশান আন্টিকে ধরে ধরে পানি খাওয়ালেন। আন্টির হাত পা থরথর করে কাপছে। আমার মনে হয়, উনার হয়তো হুটহাট রেগে যাওয়ার মতো মারাত্মক কোনো রোগ আছে। কোনোকিছু নিজের খেয়ালখুশি মতো না হলেই এই রোগটা প্রকাশ পায়। তাহলে তো ঈশানের বাবা মানে আঙ্কেলের জন্য আমার সিমপ্যাথি লাগছে। চব্বিশ বছর ধরে কিভাবে জেদী বউ সামলেছেন কে জানে? নিহা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ঈশান শুরু করলেন ট্রিটমেন্ট। সাথে প্রেশার মাপার সরঞ্জামও আছে। ঈশান ব্যান্ডেজ শেষে ব্লাড প্রেশারটাও মেপে নিলেন। প্রেশার রিডিং আসলো, ১৪০/৯০ mm Hg। মানে হাই। সাথে ঈশানের মেজাজও হাই। উড়ুম দুড়ুম ধমকাচ্ছেন আন্টিকে। কিন্তু আন্টি নিঃশব্দে বসে আছেন। ঈশানের একটা কথাও উনি কর্ণকুহরে তুলছেন না সেটা ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ঈশান তবুও আওরাচ্ছেন,
“বসে আছো কেনো? চিল্লাও। আরো জোরে জোরে চিল্লাও। কোনো দরকার নেই কন্ট্রোল করার।
হান্ড্রেড টাইমস ওভার আমি তোমাকে নিষেধ করেছি মাথা গরম করবে না। কন্ট্রোলে থাকবে। নরমালি সবকিছু হ্যান্ডেল করবে। ইটস হাই টাইম। এভাবে চলতে থাকলে কিভাবে হবে আমাকে বোঝাও। যেকোনো সময় বাজে কোনো ইন্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে। তারপর নিশ্চয়ই শান্তি তোমার? আচ্ছা তুমি কি জীবনেও হাইপার টেনশন নিয়ন্ত্রণ করা শিখবে না? বাচ্চা তুমি? আর কিভাবে বুঝাবো তোমাকে? খুব ডেঞ্জারাস বিষয় কিন্তু মম। ইগনোর করলে চলবে না। ডাক্তার কি বলেছিল তোমাকে? সব কি ভুলে গেছো?”
কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে হঠাৎ আন্টি বলে উঠলেন,
“আচ্ছা তারিনের বিয়ে ভাঙার কি প্ল্যান?”
উত্তরের বদলে মায়ের পাল্টা প্রশ্ন শুনে হতাশ হলেন ঈশান। মুখে হাত ঠেকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে নিহার দিকে তাকালেন,
“নিহা! তোমাকে আরেকবার কষ্ট করে উপরে যেতে হবে। আমার রুমের টেবিলের ড্রয়ারে..”
নিহা ঈশানকে থামিয়ে বলল, “ডার্ক চকলেট? আমি এনেছি। জানতাম এটা লাগবে।”
ঈশান বিস্মিত হলেন, “কি? এক্ষুনি না বললে বিয়ে ভাঙতে হবে? আর এখন বলছো বিয়ে করতে হবে? ”
আন্টি অকুণ্ঠে বললেন, “দুটোই। বিয়ে ভাঙতেও হবে। বিয়ে করতেও হবে। ”
আমি আর ঈশান চোখাচোখি করলাম। নির্বোধের মতো দুজনেই বললাম,” মানে কি?”
আন্টি আমার দিকে একবার তাকিয়ে ঈশানকে বললেন,
“তোদের দু’জনকে বিয়ে দিবো আমি। আজকে এবং এক্ষুণি। নিহা? ফয়সাল ভাইকে বলো গাড়ি বের করতে। বাসায় ফিরবো আমরা।”
নিহা তব্দা লেগে মুখে গোল হা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মোহনা আন্টির আরেকটা ধমকে টনক নড়লো তার।
“কি হলো যাও?”
“জ জী আন্টি যাচ্ছি।”
নিহা বের হয়ে যাওয়ার পর মোহনা আন্টি উঠে দাড়ালেন। দৃপ্ত পায়ে হেটে দরজার সামনে গিয়ে থামলেন। পেছন না তাকিয়েই বললেন,
“কাম অন ঈশান! মায়ের চোখ ফাকি দেওয়া এতোটাও ইজি না। মা সব জানে, সব বুঝে।”
বলেই মোহনা আন্টি দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেলেন। আমি ঈশানের দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে বললাম,
“আন্টি কি বললেন এটা?”
উত্তরে ঈশান বললেন,
“মম আমাদের রিলেশনের বিষয়টা ধরে ফেলেছে।”
আমি মুখে হাত রাখলাম। মুহূর্তেই মুখটা আমার লাল আভাপূর্ণ হয়ে উঠল।
.
.
আমি আর ঈশান গাড়ির পশ্চাত আসনে বসে আছি। তবে পর্যাপ্ত দুরত্ব বজায় রেখে। ঈশান বামপাশের জানালার সাথে মিশে আছেন, আর ডানপাশের জানালার সাথে। সামনে আন্টি আর ড্রাইভার ফয়সাল আঙ্কেল। আমাদের গন্তব্য এখন ঈশানদের বাসা। নিহাদের বাসার কাউকে কিছু না বলেই মোহনা আন্টি আমাদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। ভাইয়া হয়তো এতোক্ষণে আমাদের হন্যি হয়ে খুজছে। আন্টির সামনে কিছু বলতেও পারছি না। ঈশানও কিছু বলছেন না। ভীষণ ইচ্ছে করছে ঈশানকে একবার জিজ্ঞেস করতে এ বিষয়ে। কিন্তু এই আবদ্ধ গাড়িতে যেখানে নিঃশ্বাসের শব্দটা পর্যন্ত স্পষ্ট, সেখানে ফিসফিস করে কথা বলার চেষ্টাও নিতান্ত বোকামি। তাই ঈশানকে মেসেজ করলাম আমি।
” ঈশান, কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
ঈশান ফোনের ভাইব্রেন্সি টের পেয়ে আমার দিকে তাকালেন, আমি ঈশারা করে বুঝালাম মেসেজ দেখতে। ক্ষণিক সময় পর উত্তর আসল, “বাসায়।” মেসেজের রিপ্লাই দেখে আমার ইচ্ছে করল ফোনটা ঈশানের মাথা বরাবর ছুড়ে মারতে। আমি আবার লিখলাম,
“বাসায় যাচ্ছি সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু আন্টি আমাদের বাসায় কেনো নিয়ে যাচ্ছেন? সত্যিই কি বিয়ে দিবে আমাদের?”
“আমি জানিনা। মম জানে।”
ঈশানের এই উত্তর দেখে আমি সরুচোখে তাকালাম। আমার চাহনি দেখে ঈশান নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন,” কি?”
ঈশানের স্বাভাবিক কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দটা বেশ জোরেই শোনা গেল। সামনে থেকে আন্টি জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?”
আমি হাসার চেষ্টা করলাম, “না আন্টি। কোনো প্রবলেম না।”
আন্টি বললেন, “ওকে!”
আমার আবার ঈশানকে মেসেজ করলাম,” ওদিকে ভাইয়া আপনাকে আর আমাকে খুজতে খুজতে পাগল হয়ে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। আমাদের কি ভাইয়াকে সবটা জানানো উচিৎ না?”
ঈশান লিখলেন, “না। পরে বলছি।”
আমি আরো কিছু লিখতে নিলাম,” তখনই আন্টি বললেন, আচ্ছা তারিন তোমার এইজ কত? আঠারো হয়েছে?”
আমি অসামাল কণ্ঠে উত্তর দিলাম, “জী না আন্টি, আঠারো হয়নি?”
আন্টি একটু অপ্রসন্ন হয়ে বললেন,” হয়নি? তাহলে কত?”
“সতেরো বছর চার মাস।”
“ওহহো! ”
মাথায় হাত ঠেকালেন আন্টি। কি একটা চিন্তা করে আবার বললেন, “আমি ভেবেছিলাম তুমি প্রাপ্তবয়স্ক। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারবে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে ঝামেলা হয়ে যাবে। আচ্ছা তাতেও প্রবলেম নেই, আমি মেনেজ করে নিব। ”
আমি আন্টি জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, কি মেনেজ করার কথা বলছেন উনি। এমন সময় আসলো নিহার ফোন। আমি দ্রুত রিসিভ করলাম। নিহা বেশ অস্থিরতা নিয়ে বলল,
“তারু! কোথায় তুই?”
“আমি তো গাড়িতে।”
“ও! আচ্ছা শোন, মোহনা আন্টি তোকে কখন ছাড়বে তার ঠিক নেই। এদিকে আমি আর সাফিনও বেরিয়ে পড়েছি। তারিফ ভাইয়া মাত্র ফোন করেছিলেন। তোর কথা জিজ্ঞেস করতে।”
“তুই কি বলেছিস?”
“শোন আমি বলেছি তুই আমাদের সাথে আছিস। কিন্তু অন্য গাড়িতে। আর তোর ফোন আমার ব্যাগে। তাই তোকে ফোনে পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যার দিকে তোকে গাড়ি করে বাসায় পৌছে দেওয়া হবে। এভাবেই হেন-তেন বলে মেনেজ করে নিয়েছি।”
“ভাইয়া কিছু বলেনি?”
“প্রথমে একটু মেজাজ দেখিয়েছিলেন, সবাইকে না জানিয়ে তোকে কেনো নিয়ে গেলাম সেজন্য। কিন্তু পরে বললেন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যেতে। আর ঈশান ভাইয়াকে বল, উনি যেন তারিফ ভাইকে ফোন দিয়ে বাকিটা মেনেজ করেন। তোরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় চলে যাস ঠিকাছে?”
“আচ্ছা ঠিকাছে।”
“হুম রাখছি। আপডেট বলিস।”
“হুম।”
নিহা বলল,” বেস্ট অফ লাক।” সাথে চাপা হাসির শব্দ পাওয়া গেল। আমি বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিলাম। এই মুহুর্তে শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে, “কারো পৌষ-মাস তো কারো সর্বনাশ।”
.
.
আমি ঈশানের রুমের উত্তর-দক্ষিণ ক্রমাগত পায়চারি করছি। ঈশান মাথায় হাত ঠেকিয়ে বিছানার একপাশে বসে আছেন। টেনশনে দুজনেই অস্থির। তবে ঈশান অস্থিরতা টা প্রকাশ করছেন না। আর আমি প্রকাশ না করে থাকতে পারছি না। বারবার আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখছি। আয়নার বিপরীত বরাবর কাচের দেয়াল থাকায় হাজার হাজার প্রতিবিম্ব তৈরি হয়েছে আমার। এই সব আমিকে যদি এই মুহুর্তে বের করা যেতো, তাহলে সবাই মিলে পরামর্শ করে একটা ভালো উপায়ও বের করে ফেলা যেতো। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। কতই না ভালো হতো। ঈশান আমায় ডাকলেন,
“তারিন।”
আমি ভাবলেশহীন ভাবে উচ্চারণ করলাম,” হুম!”
“এভাবে হাটাহাটি করছো কেনো? একটু ঠান্ডা হয়ে বসো!”
“পারছি না ঈশান। আমি পারছি না। আর টেনশনও নিতে পারছি না। ভীষণ ইচ্ছে করছে সবাইকে সবকিছু জানিয়ে দিতে। তারপর যা হবে দেখা যাবে। অন্তত এভাবে টেনশনে থাকতে হবে না।”
“আমি জানাতে চেয়েছিলাম তারিন। কিন্তু দেখলেই তো মমের অবস্থা। একটুতেই প্রেশার বাড়িয়ে ফেলেছে। সবকিছু জানার পরে কি হবে আল্লাহ মালুম।”
আমি চেয়ার ধরে বসে পড়লাম। হতাশ হয়ে বললাম,” হ্যা, আমি সেটা বুঝতে পেরেছি ঈশান। কিন্তু বিষয়টা দিন দিন শুধু ঘোলাটে হচ্ছে। একটা ছোট্ট মিথ্যা কত বিশাল ঝামেলা হয়ে দাড়িয়েছে আমাদের জীবনে। পরে সবকিছু কিভাবে ঠিক হবে ঈশান? এখন আন্টি আর ভাইয়া যেমন আমাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছেন, সত্যিটা জানার পর উনারাই আবার ডিভোর্স করানোর জন্য উঠে পরে লাগবে না তো?”
আমি বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। ঈশান নখে কামড় দিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে বলে উঠলেন,
“তারিন, টেনশন করলে তোমার মুখটা পুরো রেড পেস্ট্রির মতো লাগে।”
আমি টেবিলের উপর পাফ বলটা নিয়ে ঈশানের মাথা বরাবর ছুড়ে মারলাম। আর ঈশান হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি বুঝতে পারছি না এইরকম একটা পরিস্থিতিতেও উনার হাসি কিভাবে আসছে?
🍂
চলবে
#তি_আমো❤
#পর্ব_২৫
Writer: Sidratul muntaz
🍂
ঈশান আর আমি পাশাপাশি সোফায় বসে আছি। আমাদের ঠিক বরাবর মোহনা আন্টি পায়ের উপর পা তুলে বসেছেন। বাম হাতটা হাটুর উপর রেখে ক্রমাগত আঙুল নাড়াচ্ছেন। রাগে কটমট চোখে কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছেন। ড্রাইভার ফয়সাল আঙ্কেল কাজী সাহেবের পাঞ্জাবীর কলার আকড়ে রেখেছেন। কাজী সাহেব ভয়ে কাচুমাচু। উনার অপরাধ হলো, এই সময় অন্য জায়গায় বিয়ে পড়ানোর আমন্ত্রণ ছিল। সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে উনি আমাদের বিয়ে পড়াতে নাকচ করেছেন। তাই মহামান্য কাজী সাহেবকে এক প্রকার জবরদস্তি তুলে আনা হয়েছে। মোহনা আন্টি বেশ রুঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,
“ওরা আপনাকে কত এডভান্স দিয়েছে? আমার থেকেও বেশি? প্রয়োজন হলে ওদের ডবল দিবো আমি।”
কাজী সাহেব নিচু স্বরে বললেন,
“ম্যাডাম কিছু মনে করবেন না। কিন্তু পয়সা বড় কথা না ম্যাডাম। আমার কাছে মুখের জবান বড় কথা। আমি তাদের কথা দিয়েছি। এখন কিভাবে আমি সেটা প্রত্যাখ্যান করি?”
“কি বললেন? পয়সা বড় ব্যাপার না? আরে টাকার থেকে বড় আর কি হতে পারে? পুরো দুনিয়া টাকার উপর। টাকা না থাকলে জবান দিয়ে কি হবে শুনি? জবান রক্ষার জন্য করতে ওদের কাজ করতে গেলে ওরা আপনাকে কি এক্সট্রা কোনো অ্যামাউন্ট দিবে? আপনার জবানের মুল্য হিসেবে? দিবে না! কিন্তু জবান ভেঙে আমার কাজ করলে আপনি পারিশ্রমিকের তিনগুণ পাবেন। না তিনগুণ না, যত বায়না করবেন তত দিব। এবার বলুন জবান ঠিক রেখে লাভ? নাকি জবান ভেঙে লাভ? চয়েস ইউরস!”
ভ্রু নাচিয়ে কথাটা বলেই টেবিলের উপর রাখা কফি মগটা তুলে চুমুক দিলেন মোহনা আন্টি। অতঃপর কাজী সাহেবের দিকে তাকিয়ে উনার উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলেন। কাজী সাহেব খানিক চুপ থেকে ইতস্তত গলায় বললেন,
“মাফ করবেন ম্যাডাম। আমাকে যেতে হবে। আপনি অনুমতি দিলে আমি অন্য কাউকে বলে ব্যবস্থা করাচ্ছি।”
মোহনা আন্টি প্রত্যাশিত উত্তর না পেয়ে ভ্রু কুচকালেন। ফয়সাল আঙ্কেল উচ্চ স্বরে বললেন,
“আপনাকে আমার ভালো লেগেছে কাজী সাহেব। আপনার পারসোনালিটি ভালো লেগেছে। সচরাচর এমন দেখা যায়না। কিন্তু কি বলুন তো? আমার যাকে ভালো লাগে, আমি যে তাকে ছাড়ি না! কাজটা আপনাকেই করতে হবে। এবং এখুনি করতে হবে। আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে রাজি নই। ”
মোহনা আন্টি তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, “যতই ঘাড়ত্যাড়া হোক। ওই ত্যাড়া ঘাড় নিয়েই রাজি হবে দেখবেন। ”
ঈশান বললেন,” মম। ফরগেট হিম। অন্য কাউকে দিয়েও তো কাজটা করানো যায়। আদারওয়াইজ.. আজকেই কেনো করাতে হবে? কালকে না হয়..”
মোহনা আন্টি চোখ বড় করে বললেন,” আর ইউ সিরিয়াস ঈশান? তারিনের ভাই কাল পর্যন্ত বসে থাকবে নাকি? বাসায় ফিরলেই তো ধরে বেধে বিয়ে দিয়ে দিবে ওর। এই রিস্ক নেওয়া যাবে না।”
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। মাথা নিচু করে আছি। মনের মধ্যে ঘুর্ণিঝড় হচ্ছে আমার।
কাজী সাহেব ইতিমধ্যে ফিরে এসেছেন। হাসিমুখে বললেন,
“আর কোনো সমস্যা নেই ম্যাডাম। ওরা সময় পিছিয়েছে। তাই এখন আপনাদের কাজ করতে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু তিনগুণ পারিশ্রমিক লাগবে না ম্যাডাম।শুধু ন্যায্য টা দিবেন। তাহলেই হবে।”
মোহনা আন্টি সন্তোষজনক হাসি দিলেন। বললেন,
“ন্যায্য পাওনা অবশ্যই দিবো। সাথে বাকি যেটা দিবো.. বকশিশ। গ্রহণ করতেই হবে।”
কাজী সাহেব হেসে দিলেন। আর বললেন, “ঠিকাছে ম্যাডাম।”
শুরু হলো বিয়ে পড়ানোর আয়োজন। কাজী সাহেব বড় খাতা খুলে বসেছে। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন,
“ছেলের নাম?”
ঈশান বললেন,” তারায জোহান ঈশান।”
“মেয়ের নাম?”
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম,” আশফীয়া তারিন।”
“ছেলের বাবার নাম?”
মোহনা আন্টি বললেন,” ফারায জোহান ইসহাক।”
“ছেলের মায়ের নাম?”
“মোহনা সরকার ইশা।”
“মেয়ের বাবার নাম?”
আমি বললাম, “মরহুম তাজউদ্দিন সাঈদ।”
“মায়ের নাম?”
“আয়েশা তালুকদার। ”
“দেনমোহর কত ধার্য হবে?”
মোহনা আন্টি কিছু একটা ভেবে বললেন, “বিশ লাখ।”
আমি চোখ বড় করে ঈশানের দিকে তাকালাম। ঈশান জোর পুর্বক হাসলেন। মোহনা আন্টি আবার দ্রুত গলায় বললেন,
“না না! পঞ্চাশ লাখ। ”
এবার ঈশানের জোর পুর্বক হাসিটাও মিলিয়ে গেল। কিন্তু আমার হাসি পাচ্ছে খুব। তারপর সময় আসলো কবুল বলার। এই একটা শব্দ উচ্চারণ করা যতটা সহজ আমার আগে মনে হতো, তার চেয়েও হাজার গুণ কঠিন সেটা আমি এখন বুঝতে পারছি। যেন অদ্ভুত এক শক্তি গলার ভিতরটা চেপে ধরে রাখে। সম্পুর্ণ জীবনের মোড়টাই উল্টো দিকে ঘুরে যায় এই একটা শব্দের দরুণ।
.
.
আমি আর ঈশান গাড়িতে বসে আছি। ঈশান মনোযোগের সহিত ড্রাইভ করছেন, আর আমি মনোযোগের সহিত টেনশন। শেষ বিকালটা সন্ধ্যার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। আমার মাথায় ঘুরছে অনেকগুলো প্রশ্ন। বাসায় গিয়ে কি আরেকবার বিয়ে করতে হবে আমাদের? ডাবল রেজেস্ট্রি হবে? তাও আবার মিথ্যে উপর ভিত্তি করে? তারপর যখন সত্যিটা সবার সামনে চলে আসবে, তখন ডাবল ডিভোর্স হয়ে যাবে না তো? আমি ঈশানের দিকে তাকালাম। ঈশান সামনের দিলে দৃষ্টি স্থির রেখেই জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু বলবে তারিন?”
“ভয় লাগছে।”
“ভয় কিসের?”
“কিসের আবার? আচ্ছা আপনি বলেন তো এভাবে কতদিন?টেনশনে মরে যাচ্ছি তো।”
আমি বিস্মিত হয়ে সরুচোখে তাকালাম, “আচ্ছা ঈশান আপনার কি একটুও টেনশন হচ্ছে না? আপনি আসলে ধারণাই করতে পারছেন না ভাইয়া সত্যিটা জানতে পারলে কি কি করবেন। সম্পুর্ণ বিপক্ষে চলে যাবেন আমাদের। এখন আপনার সঙ্গে ঠিক যতটা ভালো বিহেভ করছেন, তখন তার চেয়েও খারাপ বিহেভ করবে। হিংস্র হয়ে উঠবে ভাইয়া।”
ঈশান ভাবলেশহীন হয়ে বললেন,” তাই নাকি? তাহলে সত্যিটা না জানানোই বেটার।”
“সত্যি চেপে রাখা যায়না ঈশান। একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই। আর তাছাড়া মোহনা আন্টিকেই বা আপনি কিভাবে ম্যানেজ করবেন শুনি? আন্টি তো আমাদের পাঠিয়েছেন ভাইয়াকে সবকিছু জানিয়ে বিয়েটা ভাঙার জন্য। এখন যদি আমরা ভাইয়ার কাছে গিয়ে আবারও বিয়ে করতে বসি, তাহলে সবটা ওলট-পালট হয়ে যাবে না? আপনি বাসায় কিভাবে ফিরবেন? আপনাকে তো থাকতে হবে আমাদের বাড়িতে। মোহনা আন্টিকে তখন কি কৈফিয়ত দিবেন? কয়দিন ম্যানেজ করবেন?”
“আমি আইডিয়া ভেবে রেখেছি মিষ্টি! তারিফকে বলবো তোমায় নিয়ে কিশোরগঞ্জ ফিরে যাচ্ছি, আর মমকে বলবো তোমার ভাইয়া বিয়েটা মেনে নিয়েছে। তাই তোমাকে আমার সাথে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছে। সিম্পল!”
“বাহ! কি দুর্দান্ত! ”
আমি ঠাট্টা করে তালি বাজালাম। তালি বাজিয়ে বললাম, “তারপর আন্টি যদি ভাইয়ার সাথে কথা বলতে চায়? আমার বাসার সবাইকে নিয়ে গেট টুগেদার এ্যারেঞ্জ করে? তখন? আন্টি তো বলেছেন এটা করবেন।”
“এইটাই তো মেইন পয়েন্ট! তখন সবাই সবকিছু জানবে। কিন্তু কেউ কিছু বলবে না।”
“কেনো কিছু বলবে না কেনো?”
“দেখো তারিন, মম আমাদের বিয়েটা এক প্রকার হুটহাট করে দিয়েছে। সো আমরা এই এক্সকিউজ দিতেই পারি যে মম আমাদের বলার সুযোগ দেয়নি। আর তারিফ, সেও এখন রাগের মাথায় আমাদের তাড়াহুড়ো করেই বিয়ে দিবে। তখনো আমরা সেইম এক্সকিউজ দিবো। আমাদের কিছু বলার সুযোগ হয়নি। তারপর আমরা ঠিক করেছি, সবাইকে একত্র করে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। ব্যাস! প্রবলেম সোলভ। ”
“ওয়েট ওয়েট! সবকিছু এতোটাও ইজি না যতটা আপনি ভাবছেন।”
“ঈজি ভাবলেই ইজি। গাড়ি থেকে নামো। চলে এসেছি। ”
ঈশান গাড়ি থেকে নামলেন। আমিও আর কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। বাসায় ঢুকতেই দেখলাম চারদিকে লাইটিং করে, প্যান্ডেল টানিয়ে মোটামোটি জাকজমকভাবেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। আমরা ভিতরে ঢুকতেই অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র বাজতে শুরু করল। আসলে অদ্ভুত না। এগুলো বিয়ের বাজনা। কিন্তু টেনশনের কারণে অদ্ভুত শোনাচ্ছে। মা আমাদের দেখতে পেয়েই দ্রুত ছুটে আসলেন। আমার এক হাত ধরে বললেন,
“এতো দেরি করলে চলে?কাজী সাহেব পর্যন্ত এসে বসে আছেন, বর- কনে আসার নাম নেই।আয়,আয়! ”
মা আমাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে ঈশানকে বললেন,
“ঈশান, বাবা তুমি তারিফের ঘরে চলে যাও। ”
ঈশান ভাইয়ার ঘরের দিকেই যাচ্ছিলেন। আমি সেই বরাবর উকি দিতেই দেখলাম কাজী সাহেব ভিতরে বসে আছেন। কাজী সাহেবের চেহারা দেখে পিলে চমকে উঠল আমার। আমি অনায়েসে দাড়িয়ে পড়লাম। এই কাজীই তো একটু আগেই আমাদের বিয়ে পড়িয়েছেন। এখন আবার এখানেও আমাদের বিয়ে উনিই পড়াবেন নাকি? মা তীক্ষ্ণ শব্দে বললেন,
“কি হলো তারু দাড়িয়ে গেলি কেনো? চল! আরে তৈরি হতে হবে তো। হাতে বেশি সময় নেই। ”