তি আমো পর্ব-২৬+২৭

0
1225

#তি_আমো❤
#পর্ব_২৬
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমি বধূবেশে বসে আছি, চারপাশে মেয়েদের ভীড়। পুরো রুমটা গিজগিজ করছে।মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে আমার সাথে সেলফি তুলে যাচ্ছে। আর আমি জোর করে হাসি দিচ্ছি। মুখে হাসি ভিতরে অস্থিরতা। ভয়ে কাবু হয়ে আছি। যখন কাজী সাহেবের সামনে যাবো, তখন কি হবে? আমি না হয় কোনো উসিলা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রাখলাম। কিন্তু ঈশান? উনাকে দেখে তো কাজী সাহেব ঠিক চিনে ফেলবেন। টেনশনে মাথা ধরে গেছে আমার। আমি বাহিরে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঈশানের সাথে একবার দেখা করা জরুরি। বিছানা ছেড়ে উঠার সময় অনেকেই জিজ্ঞেস করল কোথায় যাই। আমি এক কথার উত্তর দিলাম, বাধরুমে। ঘর থেকে বের হতেই ঈশানকে দেখলাম। উনি কিছুটা দূরে দাড়িয়ে আছেন। অফ হোয়াইট পাঞ্জাবি পড়ে সাদা দাতের ঝকঝকে হাসি মুখে লাগিয়ে কারো সাথে কথা বলছেন।কার সাথে কথা বলছেন সেদিকে খেয়াল করার আগেই উনার দন্তবিকাশের দৃশ্য দেখে বুকের ভেতর ধুম ধারাক্কা ফিল হলো আমার। তার উপর পড়ে আছেন অফ হোয়াইট পাঞ্জাবী। এই পাঞ্জাবিটায় উনাকে এতো সুন্দর লাগছে!উনার শারীরিক আকৃতির সাথে একদম মিশে আছে পাঞ্জাবীটা। আর পাঞ্জাবীর রঙটাও উনার শরীরের রঙের সাথে অদ্ভুতভাবে মানিয়ে গেছে। এই পাঞ্জাবীটা যেন বিশেষভাবে তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র উনার জন্য। অন্য কোনো পাঞ্জাবী পড়লে উনাকে মানাতোই না। কোনো এক অজানা কারণে ঈশানের সামনে গিয়ে দাড়াতে আমার লজ্জা লাগছে। ভীষণরকম লজ্জা। এর থেকে মরে যাওয়াও সহজ মনে হচ্ছে। আমি মাথা নিচু করে আরেকবার তাকালাম। এবার উনার দিকেনা, উনার বরাবর দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। মেয়েটি রিক্তা। আমার সমবয়সী। ঈশানকে শরবত খাওয়ানো নিয়ে তর্ক করছে।ঈশান খেতে চাইছে না, কিন্তু রিক্তা জোর করে খাওয়াবে।

ঈশান হাত ভাজ করে পিলারের সাথে হেলান দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“আচ্ছা জিনিসটা কি? কেমন অদ্ভুত লাগছে দেখতে।”

“এটা শরবত ভাইয়া।খান ভালো জিনিস।”

“আগে তো জানতে হবে কিসের শরবত। নাহলে যে খাওয়া যাচ্ছে না।”

“জরুরি শরবত।”

“হোয়াট?”

রিক্তার পাশে দাড়ানো আরো দুটি মেয়ে এবার খিলখিলিয়ে হাসল। রিক্তাও হাসল, মুখে হাত চেপে হাসি থামিয়ে আবার বলল,

“হ্যা ভাইয়া, এটার নাম জরুরি শরবত। তাই আপনাকে জরুরি ভিত্তিতে খেতে হবে। নিন, খান!”

শরবতের গ্লাস ঈশানের মুখের সামনে ধরল রিক্তা। ঈশান হাত ঠেকিয়ে বাধা দিল। বলল,

“অদ্ভুত স্মেল আসছে। আমি এটা খেতে পারবো না। ”

পেছন থেকে একটা মেয়ে বলল,” আরে কষ্ট করে খেয়েই ফেলুন, এটা আজকে রাতের জন্য এনার্জি ড্রিংক হিসেবে কাজে লাগবে৷”

কথাটা শুনে ঈশান বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। আর মেয়েগুলো লজ্জায় লাল হয়ে হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেল। তাও ঈশানের হাতে শরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে। আমি তখন ঈশানের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ঈশান সামনে তাকিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে দেখে প্রথমেই কিছুটা চমকে উঠলেন। সেই চমকের রেশ বেশিক্ষণ রইল না উনার চোখে। ঘন পল্লবের দৃষ্টি স্থির রেখে হতবিহ্বল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন উনি। আমি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরমুহূর্তে বুঝলাম, উনার সামনে লাল বেনারসিতে একদম পরিপূর্ণ নব বধূরুপে দাড়িয়ে আছি আমি। কথাটা মনে আসতেই লজ্জায় মুখ লাল হওয়ার যোগান। সাথে অস্বস্তিও লাগছে।নিজের এই লজ্জাজনিত অস্বস্তি আর ঈশানের ঘোর কাটাতে আমি ঈশানের হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা কেড়ে নিলাম। গ্লাসের শরবতটুকু পাশের তুলসীর টবে ঢেলে দিলাম। খালি গ্লাসটা ঈশানের হাতে ধরিয়ে বললাম,

“কাজী সাহেবকে দেখেছেন?”

ঈশান ঘোর লাগানো কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “হুম?”

আমি উচ্চ স্বরে বললাম,” কাজী সাহেবকে দেখেছেন আপনি?”

আমার তীক্ষ্ণ শব্দে ঈশান স্বাভাবিক হলেন। নড়েচড়ে বললেন,” হ্যা দেখেছি, কেনো?”

আমি ভ্রু কুচকে তাকালাম। উনি কেনো বলছে কেনো?কাজী সাহেবকে দেখেও চিনতে পারেন নি নাকি? ঈশান কপালে এক আঙুল ঠেকিয়ে বললেন,

“ওহ শিট! আমি ভুলে গেছিলাম। তোমাকে একটা ইম্পোর্টেন্ট কথা বলার আছে তারিন।”

“সেই ইম্পোর্টেন্ট কথাটা কি কাজী সাহেবকে নিয়ে? আমি জানি। দেখেছি উনাকে। কিন্তু এবার কি হবে?”

“সেটা বলতেই এসেছি। ভিতরে মেয়েরা ছিল বলে যেতে পারছিলাম না। এখানে দাড়িয়ে ছিলাম। আচ্ছা শোনো তারিন, তোমাকে যখন বিয়ের আসনে নিয়ে যাওয়া হবে তুমি সামহাউ যেকোনো এক্সকিউজ দিয়ে মাথায় বড় ঘোমটা টেনে রাখবে। যেন চেহারা দেখা না যায়।”

“আমি না হয় এমনটা করলাম, আর আপনি? ”

ঈশান এদিক-ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে পেছনের পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করলেন। রুমালটা ভাজ করে মুখের সামনে ধরে বললেন,

“দেখো তো ঠিকাছে নাকি?”

আমি হেসে দিলাম। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললাম,

“পারফেক্ট। কিন্তু কেউ যদি কারণ জিজ্ঞেস করে?”

“বললাম তো। এক্সকিউজ দিতে হবে! ”

“ওকে। তাহলে আমি এখন যাই।”

“বেস্ট অফ লাক।”

“আপনাকেও বেস্ট অফ লাক।”

.
কাজী সাহেবের বরাবর আমি আর ঈশান। আমার পিছনে মা আর বুড়ি। ঈশানের পাশে বসেছেন ভাইয়া। আশেপাশে মোটামোটি মানুষের ভীড়। মা আমাকে বারবার একটা কথাই জিজ্ঞেস করছে।মাথায় ঘোমটা কেনো টেনে রেখেছি৷ আর আমি একেক সময় একেক রকম উত্তর দিচ্ছি। কখনো বলছি মাথা ব্যাথা, লাইটের আলোতে প্রবলেম হচ্ছে, কখনো বলছি বমি আসছে, তাই মুখে কাপড় চেপে রেখেছি। আবার কখনো বলছি খুব কান্না পাচ্ছে, তাই মুখ ঢেকে কাদছি। এতো এক্সকিউজ শোনার পরেও মা একটু পরই পরই বলছে, ঘোমটা নামিয়ে নে৷ মানুষ কি ভাববে? জানিনা নিজের কমফোর্টজোনের বাহিরে গিয়ে মানুষের ভাবাভাবি নিয়ে চিন্তা করা কতটা যুক্তিযুক্ত। কাজী সাহেব আমাকে তেমন একটা সন্দেহ না করলেও ঈশানকে খুব সন্দেহ করছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। বারবার সরুচোখে ঈশানকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছেন। হতে পারে কাজী সাহেবের এমন সন্দেহের কারণ ঈশানের সেই বিখ্যাত চুল। আমার ভাষ্যমতে ব্ল্যাক ফরেস্ট। মাথায় একটা টুপি পড়ে নিলেও হতো। কাজী সাহেব সন্দেহ করতেন না। হঠাৎই কাজী সাহেব ঈশানকে বললেন,

“আপনাকে আমার চেনা চেনা লাগছে। রুমালটা একটু সরান তো আপনাকে দেখবো।”

কাজী সাহেবের কথায় ভাইয়া ঈশানের দিকে তাকালেন। খানিক বিরক্তি নিয়ে বললেন,

“আচ্ছা ভাই তুমি আবার মুখে এটা কেনো দিয়ে রেখেছো? ”

ঈশান বললেন,” আসলে আমার এলার্জির প্রবলেম। অতিরিক্ত লাইটিং আর মানুষের ভীড়ে বেশিক্ষণ থাকলেই অস্বস্তি লাগে। চোখমুখ লাল হয়ে যায়। অদ্ভুত দেখতে লাগে। তাই এভাবে আছি।”

ভাইয়া চিন্তিত হয়ে বললেন,” এটা কেমন রোগ? ডাক্তার দেখিয়েছো?”

“হ্যা দেখিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছে এভাবে সাদা কাপড় জড়িয়ে রাখলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

ভাইয়া ঈশানের কাধে হাত বুলিয়ে বললেন,” আচ্ছা আচ্ছা! ”

তারপর ভাইয়া কাজী সাহেবের দিকে তাকালেন, “ছেলেটা আসলে অসুস্থ।”

কাজী সাহেব বললেন, “কাপড়টা কি একটুও সরানো যাবে না?”

ঈশান রুঢ় কণ্ঠে বললেন, “না যাবেনা।”

ভাইয়া হেসে বললেন, “আচ্ছা মুখ দেখাটা জরুরি? নাকি বিয়ে পড়ানো জরুরি? আগে বিয়ে পড়ান।”

কাজী সাহেব আর কথা বাড়ান নি। বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। কিন্তু বিপত্তি ঘটল তখনি, যখন পাত্রীর নাম বলা হলো। আমার নাম শুনেই কাজী সাহেব কিছুটা হকচকিত হয়ে বললেন,

“আচ্ছা মেয়ের বাবার নাম কি?”

ভাইয়া স্বাভাবিক ভাবে বললেন, “মরহুম তাজউদ্দীন সাঈদ।”

কাজী সাহেব চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালেন। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন,

“মেয়ের মায়ের নাম কি? ”

ভাইয়া বললেন, “আয়েশা তালুকদার। ”

এবার যেন কাজী সাহেবের চোখ কোটরাগত হওয়ার উপক্রম। একবার ঈশান আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে কাজী সাহেব বললেন,

“আচ্ছা ছেলের নাম কি সত্যি ঈশান আহমেদ?”

ভাইয়া বললেন, “হ্যা!”

কাজী সাহেব ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার নাম ঈশান আহমেদ নাকি তারায জোহান ঈশান একটু ঠিক করে বলুন তো?”

কাজী সাহেবের প্রশ্নে ঈশান আটকে গেলেও ভাইয়া আঙুল উঠিয়ে বললেন,

“এই এটা কার নাম নিলেন আপনি? শুভকাজের সময় এটা কার নাম নিলেন? ওই বদের নাম কেনো নিলেন?”

কাজী সাহেব আরো এক দফা চমকে বললেন,” বদ কে?”

“এই মাত্র যার কথা বললেন সে।”

“তাহলে বোনের বিয়ে দিচ্ছেন কেনো?”

“মানে?”

“মানে উনিই তো তারায জোহান ঈশান। মোহনা সরকারের ছেলে।”

ঈশান চুপ আমিও চুপ। ভাইয়াও কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ কাজী সাহেবকে বললেন,

“আপনি কে?”

কাজী সাহেব বললেন,” জী মানে?”

ভাইয়া বললেন, “মানে আপনি কে? পরিচয় কি আপনার?”

“আমি কাজী! ফখরুদ্দিন আহমদ।”

ভাইয়া উঠে দাড়ালেন, “মিথ্যে কথা বলার জায়গা পান না? আপনাকে মোহনা সরকার পাঠিয়েছে তাইনা? আমার বোনের বিয়ে ভাঙার জন্য? আমার তো মনে হচ্ছে আপনি নকল কাজী।”

“কি আবোল তাবোল বকছেন আমি নকল কাজী হতে যাবো কেনো?”

“আপনি অবশ্যই নকল কাজী।”

“দেখুন না জেনে কথা বলবেন না। আমার বিষয়ে খোজ নিয়ে দেখবেন। তিনশোরও বেশি বিয়ে পড়িয়েছি আমি।”

“আর এমন মিথ্যে বলে বিয়ে ভেঙেছেন কয়টা?”

“আস্তাগফিরুল্লাহ! মিথ্যে বলা আর বিয়ে ভাঙা কোনোটাই আমার ধাচে নেই।”

“আপনার ধাচে কি আছে সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানবে না। আপনি মোহনা সরকারের দালালি করেন। কি ঠিক বললাম তো? ”

“এইটা কি ধরণের কথা আমি উনার দালালি কেনো করতে যাবো?”

মা বললেন,” তারিফ তুই কি বলছিস এসব? আন্দাজের উপর ভিত্তি করে কাউকে কিছু বলা কি ঠিক?”

ভাইয়া বললেন, “আন্দাজের উপর না মা। আমি একশো পারসেন্ট সিওরিটি দিতে পারি এ ব্যাপারে। এই কাজী বিয়ে দিতে আসেনি, বিয়ে ভাঙতে এসেছে।”

কাজী সাহেব রুক্ষভাষায় বললেন, “দেখেন আমি শুধু সত্যিটা বলেছি। আপনি মানতে না চাইলে কি হবে?এটা মোহনা সরকারের ছেলে। চিনতে আমার একটুও ভুল হচ্ছে না।”

ভাইয়া বললেন, “আপনার সত্যি আপনার কাছে রাখেন। আর ভালোয় ভালোয় বিদায় হোন এখান থেকে। আপনার মতো দালালকে দিয়ে বিয়ে পড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”

“এইযে দেখুন আপনি আমাকে আরেকবার দালাল বলবেন না। আমার একটা সম্মান আছে। আর এই বিয়ে তো আমি এমনিতেও পড়াবো না। কারণ এদের দুজনের বিয়ে আগেই হয়েছে। আপনার বোন তো আপনাকে না জানিয়েই বিয়ে করেছে।”

ভাইয়া হুংকার দিয়ে বললেন, “আবার মিথ্যে বলে? আমার বোনের ব্যাপারে আমার থেকে ভালো আপনি জানেন নাকি? এই আপনি যান তো। এখনি বের হোন এখান থেকে। মাথা গরম করবেন বা আমার। চাই না পরিবেশটা নষ্ট হোক।”

বিয়ে বাড়ির পরিবেশে আমূল পরিবর্তন আসল। সবাই বিষয়টা নিয়ে কানাঘুষা শুরু করল। ভাইয়া কোনোকিছুর তোয়াক্কা করলেন না। প্রথম কাজীকে বিদায় করে নতুন কাজী নিয়ে আসলেন বিয়ে পড়ানোর জন্য। ঈশান আর আমার প্রতি ভাইয়ার এমন অগাধ বিশ্বাস দেখে কান্না পেয়ে গেল আমার। এই মানুষটিকেই এইভাবে ঠকাচ্ছি আমরা? ভাইয়া যখন সত্যিটা জানতে পারবে, তখন মেনে নিতে পারবে তো!

বিয়ে নামক ঝামেলা বেশ ভালো ভাবেই মিটে গেল। কিন্তু বিদায়বেলার সময় ঘটল আরেক ঘটনা। তখন রাত ১১টা। ভীড় খুব একটা নেই। বাহিরে শুধু ভাইয়ার দু একজন বন্ধু, ঈশান, আমি আর বুড়ি দাড়িয়ে আছি। মা কাদতে কাদতে ভিতরে চলে গেছে। আমার বিদায়ের দৃশ্যটা সহ্য করতে পারবে না হয়তো। কিছুক্ষণ আগেও হাউমাউ করে কান্না আসছিল। চোখমুখ ফুলে একাকার। কিন্তু ভাইয়ার কথা শুনে সেই কান্না দূর আকাশে হারিয়ে গেল। ভাইয়া বললেন,

“শোনো ঈশান। রাত অনেক হয়েছে, এই অবস্থায় তোমাদের জার্নি করে কিশোরগঞ্জ যাওয়া ঠিক হবে না। তাই তোমাকে বলছিলাম আজরাতটা এখানে পার করে সকালে যাও। কিন্তু তুমি তো শুনছো না। তাই আমি একটা বিশেষ ব্যবস্থা করেছি।”

ঈশান বললেন, “কি ব্যবস্থা?”

“তোমাদের জন্য একটা পিকআপ ভাড়া করেছি। সোজা কিশোরগঞ্জ পৌছে দিবে। সারারাত কষ্ট করে ড্রাইভ করতে হবে না তোমাকে। ভালো হয়েছে না?”

কথাটা শুনে অন দ্যা স্পট ঈশান কাশতে শুরু করলেন। আর আমি কান্নার সাথে হেচকি তুলতে লাগলাম। ভাইয়ার এতো ভালো না ভাবলেও চলতো। এবার কিশোরগঞ্জ গিয়ে আমরা করবো টা কি?
🍂

চলবে

#তি_আমো❤
#পর্ব_২৭
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশান হালকা কেশে বললেন, “পিকআপ এর কি দরকার? আমি ম্যানেজ করে নিবো। ড্রাইভিং তো আমার প্যাশন। ড্রাইভ করতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। পিকআপ টিকআপের প্রয়োজন নেই। ক্যান্সেল করে দাও।”

ভাইয়া হাল্কা ধমক দিয়ে বললেন, “ধুর! কি বলো এসব? ৫০০০ টাকা দিয়ে ভাড়া করেছি কি ক্যান্সেল করার জন্য নাকি? নব দম্পত্তি এতোটা পথ জার্নি করে যাবে, সু ব্যবস্থা না থাকলে হয়? আর তুমি নতুন জামাই হয়ে সারারাত ড্রাইভ করবে এটাও কি কোনো কথা হলো? ”

ঈশান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মাথার পেছন দিক চুলকালেন। ভাইয়া ঈশানের কাধে হাত রাখলেন,

“গাড়ি সুন্দরমতো ফুল দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রেডি আছে। তোমরা আর দেরি করো না, রওনা দিয়ে দাও। রাত তো কম হয়নি।”

ভাইয়া উচু গলায় ডাকলেন, “এই বাদল, অন্তু! সব মাল উঠানো হয়েছে?”

দুর থেকে আওয়াজ আসল,” সব ক্লিয়ার।”

ঈশান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,” মাল কিসের?”

ভাইয়া মৃদু হেসে বললেন, “বোনকে কি খালি হাতে পাঠানো যায়?”

ভাইয়ার কথা শুনে ঈশান হতভম্ব হয়ে হলেন। বোঝাই যাচ্ছে ব্যাপারটায় উনি যথেষ্ট অসন্তুষ্ট এবং অপ্রস্তুত। এমন কিছু আশাই করেন নি। ভাইয়া ইতস্ততভাবে আবার বললেন,

“বেশি কিছু না। এই তোমার বাবা-মায়ের জন্য কিছু উপহার, কয়েক পদের মিষ্টি, দই, ফলমুল। এসবই।”

ঈশান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “এসব কি খুব বেশি জরুরি ছিল? আমাকে আগে জানানো হলে আমি অবশ্যই না করতাম। কাজটা ঠিক হয়নি তারিফ। এট লিস্ট আমাকে একবার হলেও জানানো উচিৎ ছিল।”

ভাইয়া ঈশানকে জড়িয়ে ধরলেন। আর বললেন,

“আরে ব্যাপার নাহ। তোমার মা-বাবাকে আমার সালাম দিও। ”

ভাইয়া ঈশানকে ছাড়তেই ঈশান রোষপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,

“বাবা-মা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে। ভুল করেছো।”

ভাইয়া অনবহিত ভাবে বললেন, “আরেহ! বলে দিও আমাদের বাড়ির নিয়ম।”

ঈশান শক্তমুখে বললেন, “খুব বাজে নিয়ম।”

ভাইয়া হেসে দিলেন। বুড়িও হেসে ঈশানের কাছে আসলো। ঈশানের এক হাত ধরে একথা সেকথা বলে সাত-পাচ বুঝানোর চেষ্টা করলো। এতে ঈশান ঠান্ডা হলেন কিনা বোঝা গেল না।

.

.

গাড়ি চলতে শুরু করেছে প্রায় দশমিনিট। আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় ভাইয়ার চোখটা টলমল করছিল। আমি গাড়িতে উঠার পর হয়তো কেদেও ফেলেছিলেন ভাইয়া। প্রথম প্রথম খারাপ না লাগলেও গাড়িটা যখন চলতে শুরু করল আর আমি জানালা দিয়ে ভাইয়ার ক্রন্দনরত দৃশ্য দেখলাম, অচিরেই বুকটা হু হু করে উঠল। কেমন একটা শুন্যতা ভর করল সারা বুক জুড়ে। গাড়ি যত সামনে এগুচ্ছে, এই শুন্যতার ভার যেন ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। কান্না আসছে ভীষণ, ইচ্ছে করছে সবকিছু থামিয়ে আবার ফিরে যেতে। দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরতে।মায়ের কোলে মাথা রেখে কাদতে। আর বলতে, তোমাদের ছেড়ে আমি কিভাবে থাকি? আসলেই তো! কিভাবে থাকবো আমি?

“তারিন!”

ঈশানের ডাকে মাথা তুলে তাকালাম। চোখের পানি মুছে ঠোট উল্টো রেখেই বললাম,

“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ঈশান। মা, ভাইয়া, বুড়ি সবাইকে খুব মিস করবো। ওদের ছাড়া আমি একটাদিনও থাকতে পারিনা। সেখানে সারাজীবন কিভাবে থাকবো? আমি পারবো না। অসম্ভব! ”

ঈশান চুপচাপ আমার কথাটা শুনলেন। আমি ঈশানের বাম হাতের উপর হাত রেখে আবার বললাম,

“আচ্ছা ঈশান এমনকি হয়না? ধরুন, এক মাসে তো ত্রিশ দিন তাইনা? প্রথম ১৫ দিন না হয় আমি আপনার সাথে আপনার বাসায় থাকবো। আর শেষ ১৫ দিন আপনি আমার সাথে আমার বাসায় থাকবেন। এভাবে প্রত্যেক মাসে আমরা এটা রিপিট করবো। তাহলে আমাদের মধ্যে কেউই কারো ফ্যামিলিকে মিস করবে না। সমান সমানভাবে আমরা ফ্যামিলির সাথে সময় কাটাতে পারবো। আইডিয়াটা ভালো না?”

ঈশান শান্তচোখে তাকিয়ে আছেন। উনার কোনো ভাবাবেগ না দেখে আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

“বলেন না? ভালো আইডিয়া না? দেখুন আমি কিন্তু মা-ভাইয়াকে না দেখে কিছুতেই থাকতে পারবো না। তাদের ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে গেলেও কান্না পায় আমার!”

আরেক দফা কাদলাম আমি। ঈশান এবারও কোনো উত্তর দিলেন না। বরং ভয়ানক একটা কান্ড করলেন। হুট করে আমার কোমর চেপে ধরে আমাকে উনার কোলের উপর বসিয়ে আচমকাই ঠোটে চুম্বন করলেন। বেশ কিছু সময় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা পার করতে হলো আমাকে। হঠাৎ ঈশান নিজে থেকেই ছেড়ে দিলেন আমার নিষ্পাপ ঠোট দুটোকে। কিন্তু আমাকে ছাড়লেন না। আগের মতোই কোলে বসিয়ে রাখলেন। আমি এতোক্ষণ শুধু ছটফট করছিলাম। এখন বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছি। মনে হচ্ছে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড ওইভাবে থাকলে দম আটকে মরেই যেতাম। আমার অবস্থা দেখে ঈশান মৃদু হেসে বললেন,

“কান্না থেমে গেছে রাইট? ”

আমি বড় বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,” মানে?”

“চেষ্টা করে দেখো। এখন আর চাইলেও কান্না আসবে না। ইটস ম্যাজিক থেরাপি। কান্না থামানোর ম্যাজিক থেরাপি। আর কখনো যদি আমার সামনে কাদো, তাহলে এভাবেই ম্যাজিক থেরাপি দিয়ে কান্না থামাবো। সো বি কেয়ারফুল।”

উনার কথায় আমি বাকরুদ্ধ। কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে দুই হাত দিয়ে ইচ্ছেমতো ঈশানের কাধে থাপরাতে শুরু করলাম। ঈশান হো হো করে হাসলেন। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,

“কান্না থামানোর কৌশল এটা? নাকি বাহানা।”

ঈশান আমার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। শান্ত গলায় বললেন,

“বাহানা।”

তারপর আমার মুখের কাছে ঝুকে আবার বললেন, “কাদো কাদো মুখটা তোমার এতো কিউট লাগছিল, আমি কন্ট্রোলই করতে পারলাম না।”

আমার মুখ লজ্জায় লাল।না চাইতেও মুচকি হেসে দিলাম আমি। আমার হাসি দেখে ঈশান একবার আমার ঠোটের দিকে তাকালেন। হুট করেই আমার মাথার পেছনে হাত রেখে আমার কপাল উনার নিজের কপালের সাথে ঠেসে ধরলেন। ফিসফিস করে অনেকটা ঘোর লাগানো কণ্ঠে বললেন,

“প্লিজ এভাবে হেসো না। তাহলে কিন্তু সব কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলবো।”

ঘটনার আকস্মিকতায় আমার চোখ গোলাকার হয়ে গেল, এবং সেভাবেই তাকিয়ে রইলাম আমি। ঈশানের চোখ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। ভারী ভারী নিঃশ্বাস নিচ্ছেন উনি। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে ঈশানের কোল থেকে নেমে গেলাম। একদম জানালার সাথে মিশে বসলাম। হ্রৎপিন্ডটা তুমুল গতিতে কাপছে। এই যন্ত্রণাময় অনুভূতি থেকে নিস্তার পাওয়ার উপায় আমার জানা নেই।
🍂

#তি_আমো❤
#পর্ব_২৭(অতিরিক্ত অংশ)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার কাচে স্নিগ্ধ বৃষ্টির ফোটা মিশে একাকার। আমি ডানহাতটা জানালার পাশে রেখে হাতের উপর চিবুক ঠেকিয়ে বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিলাম। হাত-পা এখনো কিছুটা কাপছে। বেশিরভাগই শীতের কারণে। ভিতরে এসি, বাহিরে বৃষ্টি। ঠান্ডায় কাপুনি ওঠার যথেষ্ট কারণ।ঈশান পাশেই গাড়ির সিটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। বেশ কিছু সময় নিরব কাটল। হঠাৎ খুব তীক্ষ্ণ শব্দ করে বেজে উঠল ফোন। নিহার ফোন। আমি ফোনটা কানে তুলতেই নিহা অস্থির গলায় বলল,

“হ্যালো হ্যালো?”

“হ্যা বল। ”

“তারু! কোথায় তুই?”

“আমি.. আমি গাড়িতে।”

“বাসায় যাচ্ছিস?”

নিহার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আটকে গেলাম আমি। কারণ আমরা কোথায় যাচ্ছি নিজেরাও তো জানিনা। ফোনটা হাল্কা নামিয়ে ঈশানকে ডাকলাম। ঈশান অর্ধখোলা চোখে তাকিয়ে উচ্চারণ করলেন,

“হুম?”

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

ঈশান কাধ ঝাকিয়ে ঠোট উল্টালেন। যার অর্থ- “আমি কি জানি!” আমি ভ্রু কুচকে ফোনটা কানে নিয়ে বললাম,

“নিহু! একটা ব্লেন্ডার হয়ে গেছে।”

“ব্লেন্ডার তো শুরু থেকেই হচ্ছে। আবার নতুন করে কি হলো শুনি?”

“ভাইয়াকে বলেছিলাম না, ঈশানের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ? এখন ভাইয়া তো পিকআপ ভাড়া করে আমাদের তুলে দিয়েছে। গাড়ি কিশোরগঞ্জ যাচ্ছে। আমরাও সেখানেই যাচ্ছি।”

“কিহহ! ”

ফিক করে হেসে দিল নিহা। হাসতে হাসতে বলল, “তোরা কিশোরগঞ্জ গিয়ে কি করবি?”

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম, “জানিনাহ!”

“আর ওদিকে মোহনা আন্টি তোদের জন্য হাপিত্যেশ করে মরছে । আমাকে কমপক্ষে ২০ বার কল করে ফেলেছে। আর ঈশান ভাইয়ার ফোন বন্ধ কেনো?”

“বন্ধ? কই জানিনা তো!”

আমি ঈশানের দিকে তাকালাম, “এই আপনার ফোন বন্ধ কেনো?”

আমার প্রশ্ন শুনে ঈশান পকেট থেকে ফোন বের করলেন। ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে হাল্কা জিভ কেটে বললেন,

“ব্যাটারি লো। তাই অফ হয়ে গেছে।”

আমি কপালে হাত ঠেকিয়ে নিহাকে বললাম, “ব্যাটারি লো।”

“হাইরে! মোহনা আন্টি টেনশনে স্ট্রোক না করে। তুই এক কাজ কর, মোহনা আন্টিকে ফোন দিয়ে বল।”

“কি বলবো?”

নিহা খানিক চুপ থেকে চিন্তিত গলায় বলল,

“ও হ্যা.. সেটাও তো কথা। কি বলবি? আচ্ছা আমি দেখছি ম্যানেজ করতে পারি কিনা। ”

“কি বলে ম্যানেজ করবি তুই?”

“কি আর বলবো? বলবো তারিফ ভাইয়া অতি যত্নে তোদেরকে নিজের বাসায় সাজিয়ে রেখেছে। তোরা সকালে ফিরবি। তাহলেই তো হবে না?”

“হ্যা হ্যা। সেটাই বল।”

“আচ্ছা ঠিকাছে। রাখছি। আর হ্যাপি ফুলশয্যা নাইট, উপপস সরি! গাড়িশয্যা নাইট।”

বলেই হাসতে হাসতে ফোন কেটে দিল নিহা। আমি উত্তরে ঝাড়ি টাইপ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ততক্ষণে লাইন কাট। ঈশান বলে উঠলেন,

“কি বলে নিহা?”

“মোহনা আন্টি টেনশন করছে সেটাই বলে। আচ্ছা এখন কি আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যেতে পারিনা?”

“ঝামেলা হবে তারিন। ”

“কিসের ঝামেলা?”

“আমরা মাঝপথে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে গেলে সেই খবর কি তারিফের কাছে পৌছাবে না?ড্রাইভার নিজেই তো বলবে।”

“বলুক। সত্যিটা আজ বাদে কাল ভাইয়া জানবেই।”

“সন্দেহ করে জানা আর আমাদের থেকে জানা সম্পুর্ণ অালাদা বিষয় তারিন। আমি চাইনা আমরা কিছু জানানোর আগেই তারিফ আমাদের সন্দেহ করুক।”

“তাই বলে এখন আমরা বিনা কারণে এতো মাইল পথ পেরিয়ে কিশোরগঞ্জ ঘুরে আসবো?”

“তাছাড়া আর কোনো অপশন আছে? সব কিন্তু ঠিকঠাকই হচ্ছিল। মাঝখানে ঝামেলা পাকালো তোমার ভাই। কত সুন্দর আমরা বাসায় চলে যেতাম! কিন্তু শালা কোথ থেকে পিকআপ ভাড়া করে এনেই জট লাগিয়ে দিল। ”

“ওয়েট ওয়েট! আপনি শালা কাকে বললেন?”

“ভেবে দেখো। তোমার ভাই আমার শালাই তো হয়।”

আমি অপ্রস্তুত গলায় বললাম, “হ্যা বুঝলাম শালা হয়। কিন্তু তাই বলে আপনি শালাই বলবেন?”

“আজব তো! শালাকে শালা বলবো না তো আর কি বলবো?”

“আমি অত শত বুঝিনা। আপনি আমার ভাইকে শালা বলতে পারবেন না ব্যস!”

ঈশান হেসে আমার নাক টিপে দিয়ে বললেন,

“তাহলে কি শালিকা বলবো?”

আমি চোখ বড় করে ক্রুদ্ধ স্বরে বললাম,

“আপনি খুব খারাপ।”

ঈশান হু হা করে হাসলেন। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বললেন,

“আচ্ছা তারিন, একটা কাজ করলে কেমন হয়?”

আমি উনার দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,” কি?”

“ড্রাইভারকে মুখ বন্ধ রাখার জন্য ঘুষ দিলে কেমন হয়?”

আমি ঈশানের দিকে তাকালাম। কপালে ভাজ টেনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম,

“ভালো হয়। কিন্তু এই ড্রাইভারও যদি আবার ওই কাজী সাহেবের মতো অতিমাত্রায় ভদ্রলোক হয়? যদি ঘুষ নিতে রাজি না হয়?”

ঈশান আত্মবিশ্বাসী হাসি হেসে বললেন,

“আরে হবে হবে। শালা পাচহাজার দিয়েছে, আমি না হয় দশহাজার দিলাম। ইজিলি ম্যানেজ হয়ে যাবে।”

“আবার শালা?”

ঈশান বাকা হেসে এক চোখ টিপে বললেন, “চলো ট্রাই করে দেখি।”

আমি ভ্রু বাকা রেখেই বললাম, “হুম।”

আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী ড্রাইভারের সাথে চুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় হুট করেই গাড়ি থামানো হলো। আমি আর ঈশান বিস্মিত দৃষ্টিতে চোখাচোখি করলাম। ঈশান সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“কি হয়েছে ভাই? কোনো সমস্যা? ”

ড্রাইভার আক্ষেপী স্বরে বললেন,

“সমস্যা তো বাইধা গেছে ভাই।”

ঈশান বললেন, “কি হয়েছে?”

“সামনে রাস্তা বন্ধ। আগানের উপায় নাই। আবার গাড়ি ঘুরাইতে গেলে এক ঘণ্টার রাস্তা।”

ঈশান ফিসফিস করে আমাকে বললেন,” বাহ! এ তো দেখি মেঘনা চাইতেই বৃষ্টি। দারুণ ব্যাপার! ”

আরেকবার সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে ঈশান বললেন, “তাহলে ভাই বাদ দেন। আমাদের যাওয়া এতো ইম্পোর্টেন্ট না। গাড়ি ঘুরান, ঢাকায় ফিরে যাই।”

“কি কন ভাই? সিউর?”

“হ্যা হ্যা সিওর। যাওয়া ক্যান্সেল।”

“আইচ্ছা আমি তাইলে ভায়েরে একটা ফোন দিয়া জানায় লই। ভায়ে আবার কইসিলো কোনো অসুবিধা হইলে যেন ফোন করি।”

ঈশান আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলেন,

“বলেছিলাম না? এইখানে একটা মশা মারা হলেও সেই খবর শালার কাছে পৌছে যাবে।”

আমি সরু চোখে তাকালাম, “আবার?”

ঈশান মুচকি হাসলেন। ড্রাইভার গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে ভাইয়াকে ফোন করার উদ্দেশ্যে। আমি জানালাটা হাল্কা খুলে চোখমুখ ভালোমতো ধুয়ে নিলাম। পানির বোতলটা সিট পকেটে রেখে রুমালে দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছি, এমন সময় ঈশান বললেন,

“এই এক মিনিট। ”

আমি উনার দিকে ঘুরে তাকাতেই উনি আমার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলেন। নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন,

“আই এম ডান।”

বলেই বুকের বামপাশে হাত রাখলেন। আমি ভ্রু কুচকে বললাম,” মানে?”

ইশান আগেরমতোই নেশা ধরানো কণ্ঠে বললেন,

“অর্ধভেজা কাজল,ঠোট জুড়ে আধরঙা লিপস্টিক, এলোমেলো চুল, স্তিমিত মুখের এই অপরুপ স্নিগ্ধতা.. উফফ! পাগল হয়ে যাবো তো তারিন। সিরিয়াসলি বলছি পাগল হয়ে যাবো আমি।”

আমি হেসে দিতেই উনি আমার দুই গাল চেপে ধরলেন। আমার হাসি থেমে গেল। চোখজোড়া বর্তুলাকার বানিয়ে তাকালাম। ঈশান আমার নাকের সাথে নিজের নাক স্পর্শ করিয়ে বললেন,

“একবার বলেছি না এইভাবে হাসবে না! বারবার ঘায়েল করতে চাও আমাকে? এই মিষ্টি হাসিটাই যে আমার একমাত্র নেশা, সেটা কি বোঝো না তুমি? ভদ্র ছেলেটাকে এভাবে নেশায় আসক্ত বানিয়ে দিচ্ছো। এটা কি ঠিক?”

আমি ঠোট চেপে হেসে বললাম, “ভদ্রম্যান যদি নিজের ইচ্ছাতেই অভদ্রোচিত আচরণ করে, সেটাও কি আমার দোষ?”

আমার কথার মাঝখানেই জানালার গ্লাসে কেউ একজন টোকা দিল। ঈশানের পেছন দিকের জানালাটায়। ঈশান সোজা হয়ে বসলেন। ছোট একটা হাত দেখা যাচ্ছে। আমি আর ঈশান একবার চোখাচোখি করে জানালার কাচ নামালাম। একটা বাচ্চা ছেলে, বয়স ৭/৮ হবে। হলদে দাতের হাসি দিয়ে বলল,

“আমি রাকিব। আমার ছোটবোন রানীর আজকে জন্মদিন। আমাগো আব্বা-আম্মা নাই। তাই আজকের দিনেও ওর মনটা খুব খারাপ।”

ঈশান হয়তো ভাবলেন বাচ্চাটা টাকা চাইছে। তাই উনি ওয়ালেট বের করলেন। পাচশ টাকার একটা কচকচে নোট এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“নাও রাকিব। তোমার ছোটবোনের জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা। হ্যাপি বার্থডে টু রানি।”

ছেলেটার হাসিমাখা মুখ গুমরে গেল। খানিক চুপ থেকে বলল,

“ভিক্ষার জন্য আসি নাই। দোয়া নিতে আসছি। মন থেকে দোয়া করবেন আমার বোনের জন্য। তাহলেই হবে।”

ঈশান হেসে বললেন,” ভিক্ষা কোথায় দিচ্ছি? এইটা তো উপহার। আচ্ছা এক মিনিট..”

ঈশান ওয়ালেট থেকে একটা সবুজ কালির কলম বের করলেন। পাচশ টাকার নোটের উপর লিখলেন, “Happy Birthday Rani. Have a Good-day”

ছেলেটার দিকে নোট টা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এবার ঠিকাছে?”

“হয় ঠিকাছে। তয় আপনারা যদি নিজে গিয়া ওরে উপহারটা দেন, ওয় আরো বেশি খুশি হইবো।”

আমি আর ঈশান দুজনই হাসলাম। আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,

“ঠিকাছে চলো। দেখে আসি তোমার বোনকে। ”

সম্পুর্ন ঘরটা টিনের তৈরি। ঘরের পেছনেই ময়লার স্তুপ। সেখান থেকে বিকট গন্ধ আসছে ক্রমাগত। এক মিনিটও বসে থাকা দায়। টিনের চালে অজস্র ফুটো থাকায় বৃষ্টির পানি অনবরত গড়িয়ে পড়ছে। ছোট্ট ঘরটায় শুধু একটা চৌকি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে এমন ঘরে বসবাস করা খুব একটা সম্ভবপর না। অথচ ছেলেমেয়ে দুটো এখানেই স্বাচ্ছন্দে দিনের পর দিন কাটায়। বাচ্চা মেয়ে রানির বয়স তিন কি চার। একরোখা গায়ের গড়ন, তবে ফরসা। শরীরে একটু স্বাস্থ্য থাকলেই বেশ লাগতো দেখতে। আমরা ঘরে ঢুকতেই ঈশান মাটিতে আরাম করে বসে পড়লেন। উনার দেখাদেখি আমিও বসলাম। রাকিব প্রফুল্লচিত্তে হাসল। রানিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“দেখো রানি। কারা আইসে। ওরা তোমার জন্মদিনের মেহমান। ”

রানি শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ঈশান দীর্ঘ হাসি দিয়ে বললেন,

“হায় রানি! এসো এদিকে এসো। কোলে?”

রানি রাকিবকে জড়িয়ে ধরে দাড়ালো। যার অর্থ হতে পারে সে ভয় পাচ্ছে। রাকিব বলল,

“কিচ্ছু হইবো না রানি। ওরা ভালো মানুষ। তোমার লাইগা উপহার আনসে।”

রানি মাথা উচু করে রাকিবের দিকে তাকাল। তারপর আমাকে আর ঈশানকে নিষ্পলক দেখতে দেখতে আধো আধো পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। ঈশান অধৈর্যের ন্যায় রানির এক হাত ধরে টেনে আনলেন। নিজের কোলের উপর বসালেন। রুক্ষ, শুষ্ক, জটবাধা চুল গুলোতে আলতো হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিলেন। উনার নিঃসংকোচ আদর দেখে আমার চোখ ঝলমল করছে। ঈশান বিছানাটার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,

“স্কুলে যাও তোমরা?”

রাকিব বলল, “আমি যাইনা। তয় রানি যাইবো। ওর লাইগাই বইখাতা কিনা রাখসি।”

আমি বিছানার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম কয়েকটা স্বল্প পাতার বই খুব যত্নে এক কোণে গুছিয়ে রাখা। রাকিব আর রানির সাথে বেশ কিছুসময় আড্ডা দেওয়া হলো। রাকিব টং এর দোকানে কাজ করে। ইট ভাঙা, ভারী জিনিস উপরে তোলা এসব কাজ অপশনাল হিসেবে করে। তবে টং এর দোকানের কাজটা পারমানেন্ট। আজকে বৃষ্টির কারণে এক্সট্রা ইনকামের সুযোগ হয়নি তার। ছোটবোনের জন্মদিনেও বাড়িতে কোনো খাবার নেই। বাচ্চা দুটো সারাদিন ধরে উপোস করেছে। প্রায়ই উপোস করে থাকতে হয় তাদের। কিন্তু আজকের দিনের পরিকল্পনাটা হয়তো অন্যরকম ছিল। বিছানার নিচে ইস্পাতের থালার উপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে নুড়িপাথর। হয়তো খাবারের শান্ত্বনা হিসেবে ছোট্টবোনকে বুঝিয়ে রেখেছে ছোট্ট ভাইটি। তাদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন দেখে হতাশার নিঃশ্বাস ফেললাম আমি। এরকম আরো কত পথশিশু আছে, কয়জনের সন্ধানই বা পাই আমরা? দিনশেষে ক্ষুধা নামক অসুখের কাছে হার মেনে তাদের জীবনের উজ্জল শিখাটাও নিভে যায়। ঈশানের বুদ্ধিতে রানির জন্মদিন টা বেশ জাকমজমকপুর্ণ ভাবে পালন করা হলো। ভাইয়ার পাঠানো খাবারগুলোর এর থেকে সুন্দর ব্যবহার আর হতে পারে না। বলা চলে,, আজকের রাতটা আমার জীবনের সেরা রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাসর রাত এমন সুন্দরভাবে কাটানোর সৌভাগ্য কয়জনের হয়? এর থেকে সুন্দর আর হতেই পারেনা। অসম্ভব। রাতটা আমাদের রাকিব-রানির সঙ্গে হাসি আনন্দেই কাটল। কিন্তু সকালের উজ্জল আকাশের সূর্য কন্যাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হলো না। তার আগেই সব শেষ..
🍂

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে