তি আমো পর্ব-২৮+২৯

0
1277

#তি_আমো❤
#পর্ব_২৮
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশান আর রানি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি বিছানার এক কোণে বসে আছি। রাকিবও আমার সাথে জেগে বসে আছে। আমি একটা ইংরেজি উপন্যাসের বই পড়ে শোনাচ্ছি রাকিবকে। বইটা একজন ধনীলোকের কাছে উপহার পেয়েছিল রাকিব। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা ইংরেজি পড়তে জানে না। জানার কথাও নয়। তবে বয়সের তুলনায় যথেষ্ট ম্যাচিউর এই ছেলে। উপন্যাসের প্রতিটি লাইন আমি অনুবাদ করলেও রাকিব যেন অনুধাবন করছে। ছেলেটার মেধা দেখে আমি অবাক। এই ছেলেটা লেখাপড়ার সুযোগ পেলে কতই না ভালো হতো। ভীষণ ভালো লাগছিল রাকিবকে উপন্যাস পড়ে শুনাতে। হঠাৎ আমাদের পিকআপ ড্রাইভার দরজায় কড়া নাড়লেন। টিনের দরজা হওয়ায় বেশ জোরেই আওয়াজ আসলো। আমি কিছুটা ভয় পেলাম। রাকিব আমার ভয় পাওয়া দেখে হেসে দিল। আমাকে অভয় দিয়ে বলল সে দরজা খুলছে। রাকিব দরজা খুলতেই ড্রাইভার হুড়মুড়িয়ে ভিতরে ঢুকলেন। বিচলিত হয়ে বললেন,

“আপু, ভায়ে ফোন করসিল। আপনার সাথে জরুরি দরকার আছে। একবার বাহিরে আসেন।”

আমি ভ্রু কুচকালাম। উনি কি তারিফ ভাইয়ার কথা বলছেন? কিন্তু ভাইয়ার দরকার লাগলে তো আমার মোবাইলেই ফোন করতে পারতেন। ড্রাইভারকে দিয়ে খবর পাঠানোর মানে কি? আমি প্রশ্ন করলাম,

“তারিফ ভাইয়া? কই ভাইয়া তো আমাকে ফোন টোন কিছু করে নি। কি জরুরি দরকার? ”

“জরুরি কথা তো আপু আমারে কয়নাই। খালি কইসে আপনার সাথে কথা বলায় দিতে। আপনি বাহিরে আসেন।”

“বাহিরে কেনো আসতে হবে? আপনি ফোন দেন, আমি এখানে বসেই কথা বলছি।”

“এইখানে নেটওয়ার্ক ডিষ্টাব করবো। আপনি বাহিরে আসেন।”

ড্রাইভার বাহিরে বেরিয়ে গেলেন। রাকিবের হাতে বইটা দিয়ে আমিও বের হলাম। পিকআপের সাথে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন ড্রাইভার। আমি উনার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ড্রাইভার বললেন,

“আপু উঠেন।”

“উঠবো মানে? ”

“মানে গাড়িতে উঠেন।”

“গাড়িতে কেনো উঠবো?”

“দরকার আছে”।

আমার ভয় হলো। অচিরেই মনটা কু ডেকে উঠল। তাই ধীরপায়ে কয়েক কদম পিছিয়ে দৌড় লাগাতে চাইলাম। কিন্তু সফল হলাম না। ওমনি পেছন থেকে আমার মুখ বেধে ফেললেন উনি। শক্ত মোটা দড়ি দিয়ে দুইহাত বেধে গাড়িতে উঠানো হলো আমাকে। আমি শুধু ছটফট করছি। তারপর একসময় জ্ঞান হারালাম।

দীর্ঘ ছয়মাস ধরে আমি একটা অচেনা বাসায় বন্দী। আকাশের আলো পর্যন্ত চোখে পৌছায় না এখানে। আবদ্ধ এই জায়গায় হাসফাস করতে করতে কেটে যাচ্ছে কত রাত, কত দিন। কারো সাথে যোগাযোগের সুযোগটা পর্যন্ত নেই। দিনে তিনবেলা নিয়ম করে খাবার দেওয়া হয় আমাকে। কিন্তু একবেলার বেশি আমি খেতে পারিনা। তবে গত দু’দিন থেকে না খেয়েই আছি। এক ফোটা পানি পর্যন্ত গলা দিয়ে নামেনি। তবুও কিভাবে বেচে আছি আল্লাহ জানে। অবশ্য এই বেচে থাকা আমার কাছে কোনো বেচে থাকা না। এর থেকে মৃত্যু ঢের ভালো। শান্তিময় মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণে যাচ্ছি।প্রিয় মৃত্যু, কবে আসবে তুমি? চোখের পানিটাও যে শুকিয়ে গেছে। এখন চাইলেও চিৎকার করে কাদতে পারিনা। বুকের ভেতরটায় তুমুল গতিতে ঝড় বয়ে গেলেও চেহারায় সেটা আগের মতো প্রকাশ পায়না এখন আর। প্রথম প্রথম ভীষণ কাদতাম। পায়ে লুটিয়ে পড়ে কাদতাম। কাদতে কাদতে ফ্লোরে লুটোপুটি খেতাম, কিন্তু পাথরের মন গলতো না। ফলশ্রুতিতে শুকিয়েছে আমার চোখের সমুদ্র। তবুও প্রতিবাদ জানাতে পারিনি। নির্মম হ্রদয়ের সেই কঠিন মানুষটি যে আমার বড়ভাই।

ফ্লোরে উল্টো হয়ে শুয়ে ছিলাম, দরজার ঠকঠক শব্দে নড়েচড়ে বসলাম। মা এসেছে, হাতে সাদা পানির শরবত। কিসের শরবত কে জানে? আমার চেহারা দেখেই হু হু করে কেদে দিলেন মা। কাদতে কাদতে বিছানায় বসলেন। আমি মায়ের দিকে তাকালাম না। আমার শক্তচোখের দৃষ্টি সামনের সাদা দেয়ালটার দিকে নিক্ষিপ্ত। মা শরবতের গ্লাস ছোট্ট টেবিলটার উপর রেখে কাদতে বসলেন। কিছুসময় কান্নাকাটির পর হঠাৎ আমার কাছে এসে ফ্লোরে বসলেন। আমার এক কাধ ঝাকিয়ে বললেন,

“এই তারু! তারু রে, এইভাবে আর কয়দিন থাকবি? একটু তো স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ কর! অন্তত কথাটা বল? গুম মেরে বসে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে? আচ্ছা আর কতদিন ওই ছেলের কথা চিন্তা করে নিজের জীবন শেষ করবি। এইটা কেমন এক তরফা ভালোবাসা শুনি? এদিকে তুই মানসিক রোগীর মতো জীবন কাটাচ্ছিস, আর ওদিকে ওই ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছে। সে তো তোর কথা একবারের জন্যেও ভাবেনি। তাহলে তুই কেনো ভাবছিস?”

আমার রক্তবর্ণ দৃষ্টি এবার মায়ের দিকে তাক করলাম। স্বাভাবিক কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,

“ঈশান বিয়ে করেনি। আমি বিশ্বাস করিনা।”

মা চোখ বন্ধ করে আক্ষেপী সুরে বললেন,

“করেছে তারু করেছে। ওই ছেলে বিয়ে করেছে। ওদের বাচ্চাও আছে। তারিফ নিজের চোখে দেখেছে সেই বাচ্চাকে।”

আমি তৎক্ষণাৎ উঠে দাড়ালাম। আমার দাড়ানো দেখে মা কথা বলা থামিয়ে দিলেন। আমি চট করে শরবতের গ্লাসটা তুলে ফ্লোরে আছাড় মারলাম। ঝনঝন শব্দ প্রবাহিত হল সারা ঘরজুড়ে। দুনিয়া কাপানো চিৎকার করে আমি উচ্চারণ করলাম,

“বিশ্বাস করিনা, বিশ্বাস করিনা তোমাদের কাউকে আমি বিশ্বাস করিনা। সবাই মিথ্যেবাদী তোমরা এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। আর কখনো আমার চোখের সামনে আসবে না..”

কথা শেষ হওয়ার আগেই সটান করে চড় পড়লো আমার গালে। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। শরীর এতোটাই দুর্বল যে চড়ের ধাক্কাটা পর্যন্ত সহ্য হলোনা। আধখোলা চোখে একবার দেখার চেষ্টা করলাম সামনে দাড়ানো মানুষটিকে। ঝাপসা চোখের দৃষ্টিতে বুড়ির চেহারা ভেসে উঠল। জানতাম বুড়িই চড়টা মেরেছে, মা কখনো এভাবে মারে না আমায়। আমি মুচকি হাসলাম। মাথাটা চিনচিন ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আর কিছু মনে নেই।
🍂

চলবে

( আমার আম্মু আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ। তবুও গল্প ছোট করে দিচ্ছি কারণ লেখার সময় হয়নি। দেখি রাতে আরেক পার্ট দেওয়ার চেষ্টা করবো।😓)

#তি_আমো❤
#পর্ব_২৮(বাকি অংশ)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
চোখ মেলে তাকাতেই মাকে দেখলাম। ছোট্ট বালতিতে রুমাল ভিজিয়ে আমার মাথায় জ্বরপট্টি দিচ্ছে। আমি শরীরে কোনো বশ পেলাম না। মাথাটাও প্রচন্ড ভার লাগছে। বুড়িটা বিছানার পাশে বসে ঘ্যানঘ্যান করছিল। আমার চোখ খুলে তাকানোর বিষয়টা জানতে পেরে উঠে আসলো। মাকে সরিয়ে আমার সামনে বসল। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“কি শুরু করছোস তুই? নাটক? নয়া নাটক? খাওন নাই দাওন নাই শরীলডারে বানাইসোস বেরাইম্মা শরীল। সারাডারাইত তোর মায় ঘুমাইতে পারে নাই। নিজে তো মরবি লগে মাডারেও মারবি। মা’র মুখটাত একবার চায়া কি অবস্থা হইসে। এতোডি মাস দইরা মায়রে কি জ্বালানিডাই না জ্বালাইতাসোস।এহন অন্তত একটু শান্তি দে! তোর কি একটু মায়া হয় না? সব মায়া খালি ওই পোলার লাইগা? দুইদিনের ওই পোলার লাইগা নিজের আপন ভাই, আপনা মা’রে মিথ্যুক বানায় দিলি? ওই পোলায় তোর কাছে সব? আমাগো কথার কোনো দাম নাই?আরে পোলায় বিহাইত্তা! পোলার বউ আছে বাচ্চা আছে। আর কেমনে কইলে বুঝবি?”

আমি একটা কথারও উত্তর দিলাম না। মা বুড়ির কাছে এসে কান্না জড়ানো গলায় বললেন,

“থাক মা। কথা বইলেন না ওর সাথে। ও এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।”

বুড়ি মুখ বাকিয়ে বলল,” ডং। সব ডং এডি। অভিনয়।ওই পোলার কাছে যাওনের বাহানা এডি সব।এহনো সময় আছে আয়েশা, মাইয়ার বিয়া দিয়া দাও। সব আপনা আপনিই ঠিক হইয়া যাইবো।”

” আচ্ছা মা আপনি দয়া করে এখন যান।শরীর ঠিক নেই মেয়েটার। ওর সামনে এসব কথা এখন বলবেন না।”

বুড়ি আরো কিছুক্ষণ বকবক করে বেরিয়ে গেল। মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“খাওয়া-দাওয়া করবি না? ঔষধ খাওয়ার জন্য হলেও অন্তত একটু খা। চেহারার কি অবস্থা হয়েছে তোর। এভাবে কি মানুষ বাচে?”

“আমি খাবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

“কি শর্ত বল? যদি বলিস আমার কলিজা সিদ্ধ করে দিতে তাও দিবো। তবুও তুই সুস্থ হয়ে ওঠ।”

আবার কান্না শুরু করল মা। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

“কাদতে হলে বাহিরে গিয়ে কাদো। আমার সামনে ফ্যাচফ্যাচ করবে না। অসহ্য লাগে।”

“আচ্ছা কাদবো না। এইযে দেখ, চোখের পানি মুছে ফেলেছি। এইবার বল, কি করলে খাবি?”

“আমাকে ফোন এনে দিতে হবে। আমি শুধু একটিবার নিহার সাথে কথা বলতে চাই।”

“আবার নিহা? ওই বাড়ির কারো সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা যাবে না। তারিফ জানতে পারলে তোকে মেরেই ফেলবে।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “আমি বেচে আছি বুঝি? এটাকে কি সত্যিই বেচে থাকা বলে? শুধু দমটাই চলছে আমার। ভিতরে তো আমি মৃত।যেখানে মনের মৃত্যু অনেক আগেই হয়ে গেছে, সেখানে দৈহিক বাচা-মরাতে কি আসে যায় মা?”

“এইভাবে কথা বলিস না তারু। আমার কষ্ট তুই কিভাবে বুঝবি? তোর এসব কথা শুনলে ভিতরটা আমার ছিড়ে যায় রে মা। আমার হাসি-খুশি, চঞ্চলাবতী মেয়েটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে মুষড়ে আছে। এসব চোখের সামনে কিভাবে সহ্য করি বল?”

“যদি চাও আমি সুস্থ হয়ে উঠি, তাহলে শুধু একবার নিহার সাথে কথা বলতে দাও। আমি প্রমিস করছি মা, যা বলবে তাই শুনবো। শুধু একটিবার ফোনটা এনে দাও।”

মা কিছুক্ষণ চুপ মেরে থেকে হঠাৎ নরম সুরে বললেন,

“আচ্ছা দেখি, আজরাতে তারিফ ঘুমিয়ে গেলে তোকে ফোন এনে দিবো। কিন্তু শুধু একবারই।আমার সামনে দাড়িয়ে কথা বলতে হবে। তারপর সেই সিম আমার সামনেই ভেঙে গুড়ো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিবি। ওই বাড়ির কেউ যেন কোনোভাবেই আমাদের খোজ না পায়।”

“যা বলবে তাই হবে।”

“ঠিকাছে। তাহলে এখন কিছু খেয়ে নে ওঠ।”

“সত্যিই ফোন এনে দিবে তো?”

“হ্যা দিবো। এবার ওঠ।”

ঘড়িতে রাত ১টা বাজে। মা ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। মায়ের এক্সট্রা সিমওয়ালা ফোন আমার হাতে ধরিয়ে খুব সাবধানে বললেন সময় পাচ মিনিট। আমি মাথা দুলিয়ে রাজী হলাম। কাপা কাপা হাতে নিহার নাম্বার ডায়াল করছি। কতদিন কথা হয়না, দেখা হয়না। কেমন আছে ওরা কে জানে? প্রথমবার রিং বাজতে বাজতে কেটে গেলেও দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। নিহার ঘুমজাড়ানো কণ্ঠ শুনলাম,

“হ্যালো.. কে বলছেন?”

আমি তটস্থ হয়ে বললাম, “নিহা আমি তারু।”

“কে?”

“আমি তারু।”

“তারু? আচ্ছা একটু ধর।”

ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ আসলো না। আমিও চুপ করে রইলাম। কয়েক সেকেন্ড পর নিহা উচ্চারণ করল,

“তারু! কোথায় আছিস তুই? আর এতোদিন পর মনে পড়ল যে নিহা নামের কেউ আছে? ভুলেই তো গিয়েছিলি।”

“ঈশান কেমন আছে?”

“কি বললি ? আরেকবার বল তো!”

আমি কেদে দিলাম। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললাম, “আমার ঈশান কেমন আছে নিহা?”

“আরেকবার ওই নাম উচ্চারণ করলে তোকে থাপ্পড় দিবো আমি। লজ্জা করেনা? এতোবড় ধোকা দিয়ে, এইভাবে মানুষটাকে ঠকিয়ে এখন ন্যাকামি করছিস?”

“আমি উনাকে কিভাবে ঠকালাম?”

“ও! ঠকাস নি তুই উনাকে? তাহলে বিয়ে করেছিস কেনো? কেনো বিয়ে করেছিস বল? একবারও মনে পড়লো না ঈশান ভাইয়ার কথা! এতোটা সেলফিশ কি করে হতে পারলি তুই? তুই তো এমন ছিলি না তারু।”

“আমি বিয়ে করেছি মানে? কবে বিয়ে করলাম আমি? তোকে কে বললো এই কথা।”

“তারিফ ভাইয়া বলেছে। তুই নাকি বিয়ে করে হাসব্যান্ডের সাথে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছিস? ঈশান ভাইয়ার মুখও নাকি দেখতে চাস না তুই? তাহলে কেনো শুধু শুধু ভালোবাসার নাটক করলি বল তো! মানুষটাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলি। উনি তো হাসতেও ভুলে গেছে।”

“নিহা! নিহা শোন, বিশ্বাস কর আমার বিয়ে হয়নি। আমি কাউকে বিয়ে করিনি। সব আন্দাজী কথা। বানোয়াট। বরং আমাকে তো বলা হয়েছে ঈশান বিবাহিত। আমার সাথে বিয়ের আগেও উনার আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। উনার নাকি তিন চার বছরের একটা বাচ্চাও আছে।”

“হ্যা আছে, তো?”

“মানে?”

“মানে ঈশান ভাইয়ার বেবি আছে। আগে বিয়েও হয়েছে। তাতে তোর কি? তুই যেমন উনাকে ঠকিয়েছিস, উনিও তোকে ঠকিয়েছে। শোধবোধ।”

আমার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল। দেয়াল ধরে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। এতোদিন তো ভাবতাম মা,ভাইয়া, বুড়ি সবাই আমায় মিথ্যে বলছে। ঈশানের থেকে আমাকে আলাদা করার জন্য এটা ওদের একটা ফাঁদ। কিন্তু নিহাও কি মিথ্যা বলছে? আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসলো। ইশশ, সবকিছু এতো অন্ধকার কেনো? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,, ভীষণ!
🍂

#তি_আমো❤
#পর্ব_২৮(বাকি অংশ)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
চোখ মেলে তাকাতেই মাকে দেখলাম। ছোট্ট বালতিতে রুমাল ভিজিয়ে আমার মাথায় জ্বরপট্টি দিচ্ছে। আমি শরীরে কোনো বশ পেলাম না। মাথাটাও প্রচন্ড ভার লাগছে। বুড়িটা বিছানার পাশে বসে ঘ্যানঘ্যান করছিল। আমার চোখ খুলে তাকানোর বিষয়টা জানতে পেরে উঠে আসলো। মাকে সরিয়ে আমার সামনে বসল। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“কি শুরু করছোস তুই? নাটক? নয়া নাটক? খাওন নাই দাওন নাই শরীলডারে বানাইসোস বেরাইম্মা শরীল। সারাডারাইত তোর মায় ঘুমাইতে পারে নাই। নিজে তো মরবি লগে মাডারেও মারবি। মা’র মুখটাত একবার চায়া কি অবস্থা হইসে। এতোডি মাস দইরা মায়রে কি জ্বালানিডাই না জ্বালাইতাসোস।এহন অন্তত একটু শান্তি দে! তোর কি একটু মায়া হয় না? সব মায়া খালি ওই পোলার লাইগা? দুইদিনের ওই পোলার লাইগা নিজের আপন ভাই, আপনা মা’রে মিথ্যুক বানায় দিলি? ওই পোলায় তোর কাছে সব? আমাগো কথার কোনো দাম নাই?আরে পোলায় বিহাইত্তা! পোলার বউ আছে বাচ্চা আছে। আর কেমনে কইলে বুঝবি?”

আমি একটা কথারও উত্তর দিলাম না। মা বুড়ির কাছে এসে কান্না জড়ানো গলায় বললেন,

“থাক মা। কথা বইলেন না ওর সাথে। ও এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই।”

বুড়ি মুখ বাকিয়ে বলল,” ডং। সব ডং এডি। অভিনয়।ওই পোলার কাছে যাওনের বাহানা এডি সব।এহনো সময় আছে আয়েশা, মাইয়ার বিয়া দিয়া দাও। সব আপনা আপনিই ঠিক হইয়া যাইবো।”

” আচ্ছা মা আপনি দয়া করে এখন যান।শরীর ঠিক নেই মেয়েটার। ওর সামনে এসব কথা এখন বলবেন না।”

বুড়ি আরো কিছুক্ষণ বকবক করে বেরিয়ে গেল। মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“খাওয়া-দাওয়া করবি না? ঔষধ খাওয়ার জন্য হলেও অন্তত একটু খা। চেহারার কি অবস্থা হয়েছে তোর। এভাবে কি মানুষ বাচে?”

“আমি খাবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

“কি শর্ত বল? যদি বলিস আমার কলিজা সিদ্ধ করে দিতে তাও দিবো। তবুও তুই সুস্থ হয়ে ওঠ।”

আবার কান্না শুরু করল মা। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

“কাদতে হলে বাহিরে গিয়ে কাদো। আমার সামনে ফ্যাচফ্যাচ করবে না। অসহ্য লাগে।”

“আচ্ছা কাদবো না। এইযে দেখ, চোখের পানি মুছে ফেলেছি। এইবার বল, কি করলে খাবি?”

“আমাকে ফোন এনে দিতে হবে। আমি শুধু একটিবার নিহার সাথে কথা বলতে চাই।”

“আবার নিহা? ওই বাড়ির কারো সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা যাবে না। তারিফ জানতে পারলে তোকে মেরেই ফেলবে।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “আমি বেচে আছি বুঝি? এটাকে কি সত্যিই বেচে থাকা বলে? শুধু দমটাই চলছে আমার। ভিতরে তো আমি মৃত।যেখানে মনের মৃত্যু অনেক আগেই হয়ে গেছে, সেখানে দৈহিক বাচা-মরাতে কি আসে যায় মা?”

“এইভাবে কথা বলিস না তারু। আমার কষ্ট তুই কিভাবে বুঝবি? তোর এসব কথা শুনলে ভিতরটা আমার ছিড়ে যায় রে মা। আমার হাসি-খুশি, চঞ্চলাবতী মেয়েটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে মুষড়ে আছে। এসব চোখের সামনে কিভাবে সহ্য করি বল?”

“যদি চাও আমি সুস্থ হয়ে উঠি, তাহলে শুধু একবার নিহার সাথে কথা বলতে দাও। আমি প্রমিস করছি মা, যা বলবে তাই শুনবো। শুধু একটিবার ফোনটা এনে দাও।”

মা কিছুক্ষণ চুপ মেরে থেকে হঠাৎ নরম সুরে বললেন,

“আচ্ছা দেখি, আজরাতে তারিফ ঘুমিয়ে গেলে তোকে ফোন এনে দিবো। কিন্তু শুধু একবারই।আমার সামনে দাড়িয়ে কথা বলতে হবে। তারপর সেই সিম আমার সামনেই ভেঙে গুড়ো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিবি। ওই বাড়ির কেউ যেন কোনোভাবেই আমাদের খোজ না পায়।”

“যা বলবে তাই হবে।”

“ঠিকাছে। তাহলে এখন কিছু খেয়ে নে ওঠ।”

“সত্যিই ফোন এনে দিবে তো?”

“হ্যা দিবো। এবার ওঠ।”

ঘড়িতে রাত ১টা বাজে। মা ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। মায়ের এক্সট্রা সিমওয়ালা ফোন আমার হাতে ধরিয়ে খুব সাবধানে বললেন সময় পাচ মিনিট। আমি মাথা দুলিয়ে রাজী হলাম। কাপা কাপা হাতে নিহার নাম্বার ডায়াল করছি। কতদিন কথা হয়না, দেখা হয়না। কেমন আছে ওরা কে জানে? প্রথমবার রিং বাজতে বাজতে কেটে গেলেও দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। নিহার ঘুমজাড়ানো কণ্ঠ শুনলাম,

“হ্যালো.. কে বলছেন?”

আমি তটস্থ হয়ে বললাম, “নিহা আমি তারু।”

“কে?”

“আমি তারু।”

“তারু? আচ্ছা একটু ধর।”

ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ আসলো না। আমিও চুপ করে রইলাম। কয়েক সেকেন্ড পর নিহা উচ্চারণ করল,

“তারু! কোথায় আছিস তুই? আর এতোদিন পর মনে পড়ল যে নিহা নামের কেউ আছে? ভুলেই তো গিয়েছিলি।”

“ঈশান কেমন আছে?”

“কি বললি ? আরেকবার বল তো!”

আমি কেদে দিলাম। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললাম, “আমার ঈশান কেমন আছে নিহা?”

“আরেকবার ওই নাম উচ্চারণ করলে তোকে থাপ্পড় দিবো আমি। লজ্জা করেনা? এতোবড় ধোকা দিয়ে, এইভাবে মানুষটাকে ঠকিয়ে এখন ন্যাকামি করছিস?”

“আমি উনাকে কিভাবে ঠকালাম?”

“ও! ঠকাস নি তুই উনাকে? তাহলে বিয়ে করেছিস কেনো? কেনো বিয়ে করেছিস বল? একবারও মনে পড়লো না ঈশান ভাইয়ার কথা! এতোটা সেলফিশ কি করে হতে পারলি তুই? তুই তো এমন ছিলি না তারু।”

“আমি বিয়ে করেছি মানে? কবে বিয়ে করলাম আমি? তোকে কে বললো এই কথা।”

“তারিফ ভাইয়া বলেছে। তুই নাকি বিয়ে করে হাসব্যান্ডের সাথে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছিস? ঈশান ভাইয়ার মুখও নাকি দেখতে চাস না তুই? তাহলে কেনো শুধু শুধু ভালোবাসার নাটক করলি বল তো! মানুষটাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিলি। উনি তো হাসতেও ভুলে গেছে।”

“নিহা! নিহা শোন, বিশ্বাস কর আমার বিয়ে হয়নি। আমি কাউকে বিয়ে করিনি। সব আন্দাজী কথা। বানোয়াট। বরং আমাকে তো বলা হয়েছে ঈশান বিবাহিত। আমার সাথে বিয়ের আগেও উনার আরেকটা বিয়ে হয়েছিল। উনার নাকি তিন চার বছরের একটা বাচ্চাও আছে।”

“হ্যা আছে, তো?”

“মানে?”

“মানে ঈশান ভাইয়ার বেবি আছে। আগে বিয়েও হয়েছে। তাতে তোর কি? তুই যেমন উনাকে ঠকিয়েছিস, উনিও তোকে ঠকিয়েছে। শোধবোধ।”

আমার হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল। দেয়াল ধরে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। এতোদিন তো ভাবতাম মা,ভাইয়া, বুড়ি সবাই আমায় মিথ্যে বলছে। ঈশানের থেকে আমাকে আলাদা করার জন্য এটা ওদের একটা ফাঁদ। কিন্তু নিহাও কি মিথ্যা বলছে? আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসলো। ইশশ, সবকিছু এতো অন্ধকার কেনো? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,, ভীষণ!
🍂

চলবে

#তি_আমো💔
#পর্ব_২৯
Writer:Sidratul muntaz

🍂
দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে গুম মেরে বসে আছি সেই কখন থেকে। সারারাত এক ফোটা ঘুমও হয়নি। ভেতরটা যেন অনুভূতি শুন্য হয়ে পড়েছে আমার। কষ্ট হচ্ছে, নাকি রাগ হচ্ছে তাও উপলব্ধি করতে পারছি না। তবে ভীষণ অস্থির লাগছে, এই অস্থিরতার পরিমাণ পাহাড় সমান। দরজা ঠেলে কেউ ভেতরে ঢুকল। সেই শব্দ টের পেয়ে শুকিয়ে থাকা চোখের পানি মুছে নিলাম। সোজা হয়ে বসলাম। রাইসা এসেছে। মেয়েটা আমাদের পাশের বাসায় থাকে। প্রায় সমবয়সী আমার। মাঝে মাঝে কথা হয়। বেশ লাগে মেয়েটির সাথে কথা বলে সময় কাটাতে। রাইসা আমার দিকে কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিছানায় বসে পড়লো। রাশভারী কণ্ঠে বলল,

“আন্টির কাছে শুনলাম, তুমি নাকি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছো?”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুইচোখে মালিশ করতে করতে বললাম,” হুম।”

“তাহলে ঈশান? ঈশানের কি হবে?”

আমি মুচকি হাসলাম, “কি আর হবে? সে তো তার ঘর সংসার নিয়ে সুখেই আছে। তাহলে আমি কেনো ওর জন্য ধুকে ধুকে মরবো? আমারও উচিৎ মা-ভাইয়ার কথামতো বিয়ে করে নেওয়া।”

“ঈশানের কি সত্যিই বিয়ে হয়েছে?”

“হ্যা। কালরাতে নিহার সঙ্গে কথা হয়েছিল।”

“ও! নিহাই কি বলেছে? ঈশানের বিয়ের আসলেই বাচ্চা আছে?”

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। সবকিছু বিস্তারিত শোনার পর রাইসা বলল,

“আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে নিহা মিথ্যে বলছে। হয়তো রাগের মাথায়?”

“নিহা রাগের মাথায় মিথ্যা বলেনি রাইসা। ঈশান আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি। উনি সত্যিই বিবাহিত।”

“এতোটা নিশ্চিত হয়ে গেলে? আগে তো এই কথাগুলো শুনতেও চাইতে না। কারো কথাই বিশ্বাস করোনি। শুধু ঈশানকে বিশ্বাস করতে। দিনরাত এক করে শুধু কাদতে। ঈশানের জন্য এতো উতলা ছিলে,আর এখন এক রাতের মধ্যেই এতো পরিবর্তন? ঈশানকে ভুলে একদম বিয়েতে রাজি হয়ে যাচ্ছো? শুধুমাত্র নিহার কথা শুনে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া কি ঠিক?”

“ঠিক-ভুল জানিনা। শুধু এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চাই। আর এভাবে সম্ভব না। আচ্ছা রাইসা? শুনেছি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেলে নাকি মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়। সেই মৃত্যুকে বলে সুইট ডেথ। কারণ তাতে কষ্ট হয়না। হলেও খুবই সামান্য। অন্তত আমার কষ্টের থেকে তো সামান্য। আমাকে পটাশিয়াম সায়ানাইড এনে দিতে পারবে?”

“বোকার মতো কথা বলো না তারিন। মরে যাওয়া মানে তো জীবনের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া। আর বিয়ে করে নেওয়া মানে ভালোবাসার কাছে পরাজিত হওয়া। তুমি কেনো হেরে যেতে চাও? অন্তত একবার হলেও ঈশানের সামনে গিয়ে দাড়ানো উচিৎ না? তারিন অন্যকারো কথায় প্রভাবিত না হয়ে শুধু নিজের মনের কথাটা শোনো। সবাই ধোকা দিলেও মন কখনো ধোকা দেয়না।”

“নিহার সাথে কথা হওয়ার পর আমি ঈশানের নাম্বারে ফোন করেছিলাম। একটা বাচ্চা মেয়ে ফোন ধরেছে। ”

“ঈশানের মেয়ে?”

“জানিনা। কিন্তু যুক্তি তো তাই বলে। মেয়েটার কণ্ঠ শুনেই আমি ফোন কেটে দিয়েছি। তারপর মেসেজ করেছি নাম্বারে। আমার বাসার এড্রেস লিখে পাঠিয়েছি। ঈশান যেন আমাকে এখান থেকে নিয়ে যায়। ৯ঘণ্টা সাতচল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরেই দশঘণ্টা পুর্ণ হবে। কিন্তু ঈশানের কোনো খোজ নেই। একটিবার কল ব্যাকও করলো না।”

“হয়তো মেসেজ দেখেনি। কিংবা ব্যস্ত আছে।”

“আমি আর পজিটিভলি নিতে পারছি না রাইসা। এখন আমার মনে হচ্ছে শ্বাস আটকে মরে যাবো আমি। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আর একটুও সহ্য হচ্ছে না আমার। একটুও না।”

“রিলেক্স! আমি বলছি তারিন, আরেকবার ট্রাই করো। ঈশানকে ফোন করো। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে সব মিথ্যা। বড় কোনো ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। এমন কিছু করে ফেলো না যাতে পরে আফসোস করতে হয়। সো প্লিজ..”

মা’র পদধ্বনির শব্দ কানে আসতেই চুপ মেরে গেল রাইসা। মা পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকেই বলতে শুরু করল,

“তারু। চট করে গোসল সেরে তৈরি হয়ে নে। অন্তু এসেছে। তোকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে আজকে। দেরি করিস না শিগগির যা। আমি রান্না বসিয়েছি, দু’জন খেয়ে বেরিয়ে পড়বি কেমন? রাইসা তুমিও কিন্তু এখানেই লাঞ্চ করবে আজ। তোমার বাসায় বলে রাখা হয়েছে।”

“আচ্ছা আন্টি। ”

মা চলে যেতেই রাইসা বলল,

“অন্তুটা কে?”

“যার সাথে বিয়ে হচ্ছে। ভাইয়ার পছন্দের পাত্র।”

“এর মধ্যে পাত্রও ঠিক হয়ে গেল?”

আমি তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললাম,

“পাত্র তো সেই কবে থেকে ঠিক হয়ে আছে। শুধু আমার রাজি হওয়ার অপেক্ষা ছিল।অবশ্য আমি রাজি না হলেও বিয়েটা হতোই। আমার ইচ্ছের কদর কেউ করেনা এ বাসায়।”

“ছেলে কি করে?”

“তোমাকে তো বলেছিলাম, আমাদের পাড়ার কমিশনারের ছেলের ব্যপারে।”

“ঈশান যার হাত ভেঙে দিয়েছিল?”

“হুম। ইনিই সে।”

“এই ছেলেটার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? ভাইয়া সবকিছু জানার পরেও এটা কেনো করলেন?”

“ব্রেইনওয়াশ রাইসা। ভাইয়ার ব্রেইনওয়াশ করে দিয়েছে। হাত ভাঙার প্রতিশোধটাই হয়তো এভাবে নিচ্ছে। কি ভয়ংকর প্রতিশোধ! জীবনটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার। সেদিনের পর থেকে একটা রাতও আমার শান্তিতে কাটেনি। চরম যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে প্রতিটি মুহুর্ত পার করছি আমি। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জমে গেছে এবার। সেইরাতের কথা মনে পড়লে এখনো শিউরে উঠি আমি। আমার জীবনের সবথেকে বাজে রাত। ”

“কোনরাত তারিন?”

“যে রাতে ঈশানের থেকে আলাদা করা হয়েছিল আমাকে। খুব কৌশলে। আমরা সেদিন বাচ্চা দুটোর সাথে সময় কাটানোয় ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের পিকআপ ড্রাইভার হঠাৎ মাঝরাতে এসে বললেন ভাইয়ার ফোন এসেছে। আমার সাথে জরুরি কথা বলবে ভাইয়া। ঈশান তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। ড্রাইভার এর কথামতো বাহিরে বের হতেই উনি আমায় কিডন্যাপ করলেন। তাও কার নির্দেশে? আমার আপন বড়ভাই। ভাইয়া সেদিন সব সত্যি জেনে গিয়েছিল। কিভাবে জেনেছিল জানো? অন্তুর কাছে। দীর্ঘদিন ধরে ঈশানের পেছনে পরেছিল সে। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছিল। শুধু সুযোগ খুজছিল আমাকে আর ঈশানকে আলাদা করার। সে সফলও হয়েছে।ভাইয়ার মনে ঈশানের জন্য রাশি রাশি বিশ্বাস ভেঙে দিয়ে নিজে সেই জায়গাটা দখল করতে পেরেছে। ”

“তাহলে তুমি কেনো ওকে সফল হতে দিচ্ছো ? তুমি এই বিয়েটা করলে তো সে জিতে যাবে। এটাই তো য়ার মেইন পয়েন্ট..”

রাইসার কথার মাঝখানেই ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করলেন। দুজনেই চুপ মেরে গেলাম আমরা। আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাইয়া রাইসাকে চলে যেতে বললেন। রাইসা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। ভাইয়া বিছানার কাছে চেয়ার এনে হাটুর উপর হাত রেখে বসলেন। গলা খাকারি দিয়ে বললেন,

“এতোদিন পর সুবুদ্ধি হয়েছে তোর। আমি এই দিনটিরই অপেক্ষায় ছিলাম তারু। কবে তুই বুঝবি। কালরাতে নিহার সাথে কথা বলেছিস। মায়ের কাছে শুনলাম সব। আমাদের কথা বিশ্বাস না করলেও নিহার কথা শুনে নিশ্চয়ই সত্যিটা তোর কাছে পরিষ্কার?”

আমি নিশ্চুপ। আমার নিরবতায় ভাইয়া আবার বললেন,

“শোন তারু, বিশ্বাস করে শুধু তুই একলা ঠকিস নাই। আমরা সবাই ঠকেছি। আমিও কি কম বিশ্বাস করতাম ওকে বলতো?সবসময় অন্ধের মতো প্রতিটা কথা যাচাই-বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করে গেছি। দিনের পর দিন আমার চোখে চোখ রেখে মিথ্যে বলে গেছে ওই ছেলে। যে এইভাবে নিরবচ্ছিন্ন মিথ্যে বলতে পারে, সে সব করতে পারে। পৃথিবীর যেকোনো খারাপ কাজ তার দ্বারা সম্ভব।”

“কথাটা তো তাহলে আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ভাইয়া। মিথ্যে তো আমিও বলেছি। তোমাকে,মাকে, বুড়িকে সবাইকে মিথ্যে বলেছি। এমনকি তুমি নিজেও তো মিথ্যে বলেছো ভাইয়া! নিহাদের বাড়িতে আমার বিয়ের মিথ্যে খবর প্রচার করেছো।”

“সেটা আমি তোর ভালোর জন্যই করেছি। তোকে সেইফ রাখার জন্য এটুকু মিথ্যে আমি বলতেই পারি।নাহলে ওই তারায জোহান তোর পিছু কোনোদিন ছাড়তো না।”

“ঈশানও একই কারণে মিথ্যে বলেছিল ভাইয়া। মিথ্যের শুরুটা তো আমিই করেছিলাম। ”

“তোর মিথ্যে বলা আর ওর মিথ্যে বলা এক জিনিস না তারু। তুই আমাদের ঠকানোর জন্য মিথ্যে বলিস নি। কিন্তু ওই ছেলে ইনটেনশনালি আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছে। এমনকি তোকে পর্যন্ত ঠকিয়েছে। মোহনা সরকার কেনো নিজের ছেলের সাথে তোকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিল সেটা আমি এখন বুঝতে পারি।”

“যা হওয়ার হয়েছে ভাইয়া। এখন এসব কথা বলে কি লাভ? আমি তো রাজি হয়েছি বিয়েতে।”

“তুই একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। অন্তু ওই তারায জোহানের থেকে শতগুণে ভালো। ”

“ভালো-খারাপ আপেক্ষিক বিষয় ভাইয়া। তোমার কাছে যে ভালো, অন্যকারো কাছে হয়তো সে পিশাচের থেকেও ভয়ংকর।”

ভাইয়া হাসলেন, “কে জানে? সব জায়গায় তো আর ভালো হওয়া চলে না। কিছু কিছু জায়গায় খারাপ হওয়াও জায়েজ। তাছাড়া, অতিরিক্ত ভালো মানুষী দুর্বলতার কারণ।”

মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ভাইয়া। আমি টেবিলের ল্যাম্প ক্লকটা দেয়াল বরাবর ছুড়ে মারলাম।

.

মাঝরাস্তায় রিকশা দাড় করিয়ে সুপার শপে ঢুকেছে অন্তু। তাও আমার জন্য। এই প্রথম আমি তার কাছে চকলেট খাওয়ার বিশেষ আবদার করেছি। বেচারা খুশিতে এতোটাই আত্মহারা, যে আমাকে রিকশায় একা রেখে যাওয়ার বিষয়টা খেয়ালও করেনি। ইচ্ছে করলেই তো আমি পালিয়ে যেতে পারি এখন। আর আমার পালিয়ে যেতেই ইচ্ছে করছে। দীর্ঘদিন পর বাহিরের জগতের ঘ্রাণ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছে। ইচ্ছে পাখি। ইচ্ছে পূরণের দায়েই রিকশা ঘুরিয়ে রওনা হলাম সেই চিরচেনা গন্তব্যে।

বর্তমানে দাড়িয়ে আছি মোহনা আন্টি আর ফারায আঙ্কেলের সামনে। সমান তালে জেরা চলছে আমার উপর। এতোদিন পর কোথ থেকে আসলাম, কোথায় ছিলাম, আমার বিয়ে হয়নি তার প্রমাণ কি, আর ভাইয়াই বা মিথ্যে কেনো বলেছেন আরো কত শত প্রশ্ন। বেশিরভাগ প্রশ্ন ফারায আঙ্কেলই করছেন। মোহনা আন্টি প্রায় নিশ্চুপ। তেমন কিছুই বলছেন না। আমার ফিরে আসায় উনাকে খুশি মনে হলেও ফারায আঙ্কেল মানে ঈশানের বাবা খুব একটা খুশি হন নি বলেই বোধ হচ্ছে আমার। কিন্তু এসবে আমার কিছুই যায় আসে না। আমি শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর খুজতে এসেছি।বেশ কিছু সময় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকার পর হঠাৎই মাথা তুলে ফারায আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লাম আমি,

“ঈশান কোথায়?”

আমার প্রশ্নে উনি খানিক চুপ থেকে ভারী গলায় বললেন,

“ঈশানের সাথে কি দরকার?”

কথাটা তীরের মতো বিধল আমার মনে। কিছুটা অপমানবোধ হল। এমন সময় পেছন থেকে পরিচিত কারো কণ্ঠ ভেসে আসল,

“তারু!”

আমি ঘুরে তাকাতেই নিহাকে আবিষ্কার করলাম। নিহা হাত ভাজ করে বলল,

“ঈশান ভাইয়া এখানে থাকে না। উনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।”
🍂

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে