Wednesday, July 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1538



তি আমো পর্ব-২২+২৩

0

#তি_আমো❤
#পর্ব_২২
Writer: Sidratul muntaz

🍂
নিহার প্রতি আমার এই বাছবিচারহীন মাইরের শব্দে সাফিন ভাইয়া ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

“কি হলো? কি হলো? আমার বউটিকে এইভাবে মারছো কেনো শালিকা?”

আমি মাথা তুলি সাফিন ভাইয়ার দিকে তাকালাম। দাত কিড়মিড় করে চুল ঠিক করে বিছানায় ধপ করে বসলাম। আর বললাম,

“আপনার বউটি যে কাজ করেছে, ওকে শুধু মাইর কেনো? গলা টিপে মেরে ফেলা উচিৎ। ”

সাফিন ভাইয়া চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,

“হায় হায় কউ কি? বিয়ার পরের দিনই বিধব আমি?”

“বিধব? ”

আমি অবাক হয়ে উচ্চারণ করলাম। সাফিন ভাই দাত কেলানো হাসি দিয়ে বললেন,

“ওই বিধবার মেইল ভারসন আর কি!”

আমি আর কিছু বলার আগেই নিহা শব্দ করল, “দোস্ত আমার একটা কথা শোন।”

আমি চেচিয়ে উঠে নিহার দিকে আঙুল ঘুরিয়ে বললাম,

“তুই আর কথাই বলিস না। যা হচ্ছে সব তোর কথার জন্যই তো হচ্ছে। তুই দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখ।”

নিহা রাগ দেখিয়ে বলল, “আরে আমি কি ইচ্ছে করে করছি নাকি আজিব? তোর ভালোর জন্যই তো করতে যাচ্ছিলাম।”

“আমার ভালোর জন্য? এইটা তুই আমার ভালো করছিস?”

আরেকটা কিল লাগালাম নিহার কাধ বরাবর। সাফিন ভাইয়া এবার চেয়ার থেকে উঠেই আসলেন,

“আরে আবারও মারামারি কেনো?”

নিহা বলল,” সত্যি কথাটা বলে দিলে তখন ভাল্লাগতো?”

আমি তাল মিলিয়ে বললাম,” হ্যা তাই করতি। সত্যিটাই তুই বলে দিতি। মিথ্যে কেনো বলতে গেলি?”

নিহা বিস্ফোরিত চোখে তাকাল,” কি? সত্যিটা বললে মোহনা আন্টি হার্ট ফেইল করতো।”

আমি বললাম, “করলে উনি একা হার্ট ফেইল করতো। আর এবার তো ভাইয়া, মা, বুড়ি, ঈশান, আমি নির্বিশেষে সবাইকে হার্ট ফেইল করাবে।”

সাফিন ভাইয়া বললেন, “কেনো? আজকে কি হার্ট ফেইল ডে নাকি?”

আমি নাক ফুলিয়ে সাফিন ভাইয়ার দিকে তাকালাম,

“না! তবে আপনার বউটির জন্য আজকে থেকে ক্যালেন্ডারের পাতায় এই দিনটি যোগ হবে হার্ট ফেইল ডে নামে। এইটুকু আমি বলতে পারি।”

নিহার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে আসলাম। সাফিন ভাইয়া কৌতুহল নিয়ে নিহাকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কি হয়েছে বলোতো?”

নিহার উত্তর শোনার আগেই আমি সীমান্তের বাহিরে। বাগানের পেছন দিকে ভাইয়া ফোনে কথা বলছিলেন। মা এর ঘরে উকি মেরে দেখে আসলাম মা আর বুড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। নিহার বিদায়ের পর্ব শেষে আমাদেরও বিদায় নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এবার সেটা হয়ে উঠবে কিনা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। মোহনা আন্টিকে যদি কোনোভাবে আটকানো যায়, সেই আশায় ভাইয়ার উপর নজর রাখছি আমি। মোহনা আন্টি এদিকটায় আসলেই যেকোনো বাহানায় আটকাতে হবে। আমি নিহাদের স্টোর রুমের দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে রইলাম। ভাইয়া অনেকটা দূরে গেন্দাফুল গাছের কাছাকাছি দাড়িয়ে। মোহনা আন্টি আচমকাই ভাইয়ার পেছনে এসে দাড়ালেন। ভাইয়া মোহনা আন্টিকে দেখে যতটা না চমকালেন তার থেকেও অধিক আমি চমকে উঠলাম। উনি কোনদিক দিয়ে আসলেন আর কখনই বা আসলেন? দেখলাম না তো! ভাইয়া ফোনটা পকেটে ভরেই কপালে বিরক্তির ভাজ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“কিছু বলবেন?”

মোহনা আন্টি হাত ভাজ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “বলবো বলেই তো এসেছি। খুব জরুরি বিষয়।”

ভাইয়া কপাল কুচকে তাকিয়ে থেকে উচ্চারণ করলেন, “কি জরুরি বিষয়?”

“জরুরি বিষয়টা তোমার বোনের বিয়ে নিয়ে। এই বিয়েটা হচ্ছে না। আমি হতে দিচ্ছি না।”

“আমার বোনের বিয়ে আপনি হতে না দেওয়ার কে?”

“আমি কেউ না! কিন্তু তুমি তো ওর বড়ভাই। যদি সত্যিকার অর্থে বড়ভাই হয়ে থাকো, তাহলে পাত্রের চরিত্র সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর নিজেই বিয়েটা ভেঙে দিতে চাইবে।”

ভাইয়া চরম বিরক্তি আর বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে?”

“মানে যেই ছেলের সাথে তোমার বোনের বিয়ে দিবে বলে ঠিক করেছো, সে একটা অসভ্য, ইতর, বেলেল্লা, চরিত্রহীন, মেয়েদেরকে ইভটিজিং করে, অসম্মান করে, ভীড় জমানো জায়গায় মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করার সুযোগে এক চুলও ছাড় দেয়না। ফালতু, টাউট, ফ্যামিলির কোনো শিক্ষা দীক্ষা বলতে কিচ্ছু নেই। বংশ পরিচয়টা তো আচরণের সাথেই পাওয়া যায়। এই ছেলের আচরণগত কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই। ছি ছি ছি!”

আমি দেয়াল চেপে ধরে মোহনা আন্টির কথা শুনছিলাম। পেছন থেকে ঈশান আমায় ধাক্কা দিলেন। আমি ঘুরে তাকালাম৷ ঈশান ভ্রু কুচকে সামনে ইশারা করে জানতে চাইলেন,

” তারিন, মম কার উপর এতো ক্ষেপলো হঠাৎ? কাকে বকছে এভাবে? ”

আমি কোমরে হাত গুজে বললাম, “আপনার মাম আপনাকেই বকছে।”

ঈশান মুখ কুচকে বলল, “হোয়াট? আমি এরকম?”

ঈশানের থেকে দ্বিগুন শব্দে ভাইয়া উচ্চারণ করলেন,” হোয়াট? ঈশান এরকম?দেখুন ম্যাডাম আপনি এইমাত্র যা কিছু বললেন সেগুলো আপনার একমাত্র ছেলের বিশেষ গুণ। আমার ভাইয়ের না। সে একজন সৎ, দায়িত্ববান, পরিশ্রমী ছেলে। আদর্শ শিক্ষক। আপনার ছেলের মতো লাফরাঙ্গা না। সবাইকে নিজের গোয়ালের গরু ভাববেন না।”

এই কথা শুনে ঈশান বিষম খেলেন। ঘুরে ফিরে সেই একই তো হলো। ভাইয়াও ঈশানকে বকছেন, আন্টিও ঈশানকেই বকছেন। আবার দুজনেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে।

মোহনা আন্টি বললেন, “কি? আমার ছেলে লাফরাঙ্গা? তুমি আমার ছেলের বিষয়ে কতটুকু জানো? ”

ভাইয়াও আঙুল তুলে বললেন,

“আপনি আমার ভাইয়ের বিষয়ে কতটুকু জানেন?”

“আমি জানি বলেই তো বলছি। নিজের কানে শুনেছি তোমার পছন্দের পাত্রের গুণগান। ”

“আমিও নিজের কানেই শুনেছি আপনার ভদ্র ছেলের গুণগান।”

“কি শুনেছো তুমি আমার ছেলের ব্যাপারে? হলফ করে বলতে পারি সব ভুল শুনেছো। কোনো ধারণাই নেই তোমার আমার ছেলে সম্পর্কে। ”

ভাইয়া মাথা দুলিয়ে বললেন, “হ্যা! সেইম আমিও বলতে পারি। আপনিও ভুল শুনে এসেছেন। আমার ভাই সম্পর্কে আপনারও কোনো ধারণা নেই।”

মোহনা আন্টি বললেন, “ঠিকাছে তাহলে ডাকো।”

“কাকে ডাকবো?”

“তোমার পছন্দের পাত্রকে ডাকবে। আমি নিজে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। আর তারিনকেও ডাকো। তারিন কোথায়?”

“হ্যা তাহলে আপনিও নিজের ছেলেকে ডাকুন না। আমারও অনেককিছু জিজ্ঞেস করার আছে।”

“হ্যা ডাকবো প্রবলেম কই? ঈশান? ”

তীক্ষ্ণ শব্দে উচ্চারণ করলেন মোহনা আন্টি। ভাইয়াও উচ্চশব্দে বললেন, ” ঈশান?”

মোহনা আন্টি তাকাতেই ভাইয়া বললেন, “ঈশান আহমেদ। আমার ভাইয়ের নাম।”

মোহনা আন্টি হাত ভাজ করে বললেন, “তারায জোহান ঈশান। আমার ছেলের নাম।”

পেছন থেকে নিহা হুট করে এসে বলল, “ঈশান ভাইয়া আপনার নিজের নাম মনে আছে তো? মানে কার ডাকে সাড়া দেবেন? তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। ”

ঈশান সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছেন। জড়বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের মতো। এদিকে আমার মাথা ঘুরছে।
🍂

চলবে

#তি_আমো❤
#পর্ব_২২(অতিরিক্ত অংশ)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমি নিহার গাল বরাবর থাপ্পড় দিলাম। নিহা গালে হাত রেখে কটমট চোখে বলল, “ওই মারলি কেন? মারলি কেন?”

“সব ভেজাল বাধিয়ে এখন মজা নিতে এসেছিস? মারবো না তো কি করবো? তোকে আরো দুটো থাপ্পর দেওয়া উচিৎ। ”

ধমকানো উত্তর দিয়ে আমি নিহার দিকে এগিয়ে গেলাম। নিহা চটজলদি ঈশানকে পিলার বানিয়ে পেছনে লুকিয়ে পড়ল। ঈশান আমার দুই হাত টেনে ধরে বললেন,

“তারিন কাম ডাউন। সিচুয়েশন টা আগে বুঝতে দাও। মাথায় কিচ্ছু আসছে না। হোয়াটস গোয়িং অন?”

ওদিকে গলা ফাটিয়ে ডাকাডাকির পর ঈশান ওরফে ঈশানের তো কোনো সাড়া পাওয়া গেলোই না উল্টো সুমনা আন্টি, মা, বুড়ি, সাফিন ভাইয়া এক কথায় বাড়ির অর্ধেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। আর আমরা তিনজন স্টোর রুমের ভিতরে ঢুকে উকিঝুকি মারছি। ঈশানকে তো বের করা যাচ্ছে না, আমি বের হলেও আন্টি আর ভাইয়ার গোয়েন্দা টাইপ প্রশ্নের উত্তর দিবে হবে। আর নিহা? ওর কারো সামনে না যাওয়াই মঙ্গল। ভাইয়া মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“মা ঈশানকে দেখেছো?”

মা কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, “না.. সকাল থেকে তো দেখলাম না। ”

ভাইয়া বুড়ির দিকে তাকালেন, “দাদী তুমি দেখেছো?”

“আমি কইত্তে দেহুম? ঘুমেত্তুন উটলামই কতখান আগে। আর উইটটাই শুনি তোগো চিক্কুর চেচামেচি। কিয়ের কেচাল লাগসে মাষ্টররে লইয়া? এই বেডি কিতা কয়?”

মোহনা আন্টি রাগে অগ্নিশর্মা রুপ নিয়ে সুমনা আন্টির দিকে এগিয়ে গেলেন, “ভাবী! ঈশানকে দেখেছো?”

সুমনা আন্টি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উত্তর দিলেন, “হ্যা.. সকালে দেখেছিলাম। ব্রেকফাস্টের সময় সাফিনের সাথে কিচেন সাইটে এসেছিল। তারপর আর দেখিনি। ”

মোহনা আন্টি সাফিন ভাইয়ার দিকে তাকালেন। সাফিন ভাইয়া বিহ্বল হাসি নিয়ে বললেন,

“হঠাৎ ঈশানকে এতো খোজাখোজি?”

মোহনা আন্টি ধমক দিয়ে বললেন,” ঈশান কোথায় আছে জানো কি-না সেটা বলো।”

তারিফ ভাইয়া ভাবলেশহীন ভাবে উচ্চারণ করলেন,

“ছেলেটা গেলো কই? এতো ডাকাডাকির পরেও আসছে না কেনো?”

মোহনা আন্টি গর্জন করে বললেন, “আসবে কিভাবে? এখন তো ধরা পড়ার সময় হয়েছে। তাই আসবে না। ছেলেটা হয়তো তার কু কীর্তির পর্দা ফাস হওয়ার খবর পেয়ে গেছে। আর সেই ভয়েই এখন পালিয়েছে। পার্টির দিনও এমন হয়েছিল। ধরা পড়ার ভয়ে পালিয়ে গেছিল। এই ছেলে ভীষণ চতুর। গভীর জলের মাছ। ”

ভাইয়া বললেন, “এইযে দেখুন! আপনি কিন্তু বেশি বেশি বলছেন। পালাবে কেনো? পালানোর মতো কি এমন করেছে সে? বরং আমি তো বলবো আপনার ছেলে পালিয়েছে। মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে।”

“আমার ছেলে পালিয়েছে? আচ্ছা পালালে পালিয়েছে।ভালো কথা। দিনশেষে তো তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। কিন্তু তোমার ওই ধোকাবাজ প্রিয়পাত্র আর জীবনেও ফিরবে না। যদি ফিরেও আসে তাহলে আমি তাকে ভাড়া করা গ্যাং দিয়ে এমন টাইড দিবো.. তারিনের ‘ত’ টা পর্যন্ত ভুলে যাবে। জীবনে কোনোদিন তারিনের নাম মুখে আনার আগেও আমার কথা হাজারবার চিন্তা করবে। ”

সুমনা আন্টি মায়ের কাধ ধরে বললেন,” মোহনা শান্ত হও! কি শুরু করেছো?”

ভাইয়া তেড়ে এসে বললেন,

“এই এক্সকিউজ মি! কি বললেন আপনি? ভাড়া করা গ্যাং? গুন্ডা? আপনি আমার ভাইকে গুন্ডা দিয়ে মার খাওয়াবেন? আপনার প্রবলেমটা কোথায় বলুন তো? সাইকো নাকি আপনি? আপনার ছেলে যেই কাজ করেছে, আমরা যে এখনো ওর নামে মামলা তুলে বাড়িতে পুলিশ আনি নি এইটাই আপনাদের মা-ছেলের গুডলাক। আসলে কি বলুন তো? আপনার লাফরাঙ্গা ছেলেকে রিজেক্ট করে একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত ছেলের সাথে বোনের বিয়ে দিচ্ছি তো! এইটাই আপনার ইগো তে লাগছে। আর তাই ইনোসেন্ট ছেলেটার নামে এসব বাজে ব্লেম দিয়ে বিয়েটা আটকাতে চাইছেন। ”

মোহনা আন্টি কিছু বলতে নিলে ভাইয়া হাত উঠিয়ে বাধা দিলেন। বললেন,

“বাট আমি এটা হতে দিচ্ছি না। আমার বোনের বিয়ে হবেই। আমি যার সাথে চাইবো তার সাথেই হবে।কেউ বিয়ে আটকাতে পারবে না।”

“তুমি তো আচ্ছা ঘাড়ত্যাড়া ছেলে! এতো করে বুঝাচ্ছি তাও বুঝো না? আরে মেয়েটার লাইফটা নষ্ট হয়ে যাবে।”

“নষ্ট হোক। আমার বোনের লাইফ নষ্ট হবে তাতে আপনার কি?”

“আমার কি মানে? আমি নিজে একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের লাইফ হেল হয়ে যাওয়া দেখবো? সবকিছু জেনেও হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? কক্ষনো না। তারিনের বিয়ে আমি হতে দিবো না, দিবো না, দিবো না!”

“আমার বোনের বিয়ে আমি দিয়েই ছাড়ব, দিয়েই ছাড়ব, দিয়েই ছাড়ব। কি করবেন!”

মোহনা আন্টি কটমট চোখে তাকালেন। মা ভাইয়ার হাত টেনে ধরে বললেন,

“তারিফ! আমার বয়সী একজন মহিলার সাথে এভাবে কিভাবে ঝগড়া করছিস বল তো?”

ভাইয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, “দেখছো না ঈশানের সম্বন্ধে কি উল্টা পাল্টা কথা বলছে? রীতিমতো ইনসাল্ট করছে ছেলেটাকে। ঈশান এসব শুনলে কি মনে করতো?”

আমি ঈশানের দিকে তাকালাম। ঈশান সবই শুনছে। অস্থিরতা নিয়ে পুরো স্টোর রুমে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে।

সাফিন ভাইয়া হঠাৎ মাথা চুলকে বললেন,” আচ্ছা ঈশানকে একটা ফোন করলেই তো হয়। প্রবলেম সোলভড!”

বলেই তুরি বাজিয়ে হাসলেন সাফিন ভাইয়া। নিহা কিছুটা শব্দ করে বলে উঠল,”না!”

আমি নিহার মুখ চেপে ধরলাম। নিহা আমার হাত সরিয়ে বলল, সাফিনকে এখন হাতের কাছে পেলে গুনে গুনে দশটা চড় দিতাম। কি ফালতু আইডিয়া দিল! এবার ধরা পড়ে গেলে?”

আমি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললাম,” তোরা দুটোই এক। অর্ধেক ঝামেলা তো তুই বাধিয়েছিস। এবার বাকিটা সাফিন ভাইয়া বাধাবে। তোদের বর-বউয়ের এই অতি বুদ্ধির কারণে আমার আর ঈশানের জীবন ফানা ফানা। ”

“আচ্ছা এখন কি আমি কিছু করেছি? একটু চুপ থাক না।”

“না তুই তো কিছুই করিস নি। অথচ তোর জন্যই সব হচ্ছে। ”

“আমার জন্য সব হচ্ছে? তোর বুঝি কোনো দোষ নেই? তোরা মিথ্যা বলেছিস কেনো?”

“সেটাও তো তোদের জন্যই বলেছি। সব সমস্যার গোড়া আসলে তোর আর সাফিন ভাইয়ার জুটি। তোরা এ্যাংগেজমেন্টটাই করতে গেলি কেন? বিয়েটাই বা কেন করলি? তোদের বিয়ের জন্য এখন আমাদের বিয়ে হচ্ছে না।”

“ও হ্যালো হ্যালো! আমাদের বিয়ে না হলে তোদের প্রেমটাও হতো না। সেলফিশের মতো এই জিনিসটা ভুলে যাস না।”

ঈশান ধমক দিয়ে বললেন,” প্লিজ চুপ করো তোমরা। এতো কথা কিভাবে বলো আজিব তো!”

মাথার চুলগুলো ঠেলে পেছনে নিয়ে কোমরে হাত রেখে দাড়ালেন ঈশান। বড় বড় শ্বাস ছেড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন উনি। জিহবা দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে নাক, গলার ঘেমে যাওয়া অংশ মুছে নিচ্ছেন। সহজ কথায় টেনশনে বিধ্বস্ত অবস্থা হয়েছে উনার।ভীষণ টেনশন করছেন। আমার তো উনার দিকে খেয়াল রাখা উচিৎ। তা না করে আমি নিহার সাথে ফালতু বকবক করছি ধুর! আমি ঈশানের কাছে গিয়ে উনাকে ধুলিমাখা বেঞ্চটার উপর বসালাম। ঈশান এখনো বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। আমি ওরনা দিয়ে উনার ঘাম মুছে দিয়ে বললাম,

“একটু শান্ত হয়ে বসেন প্লিজ। আর আপনার ফোন?”

ঈশান পকেটের উপর হাত দিয়ে বললেন, “ফোন সাইলেন্ট আছে।”

আমি জানালার দিকে তাকালাম। মোহনা আন্টির সাথে সাথে ভাইয়াও ঈশানকে অবিরত ফোন করে যাচ্ছেন। আর দুজনেই বলছেন, নেটওয়ার্ক বিজি। আমি কপালে হাত রাখলাম। দুইজন মিলে এক নাম্বারে ফোন দিলে নেটওয়ার্ক তো বিজিই হবে। ভাইয়া হঠাৎ অতি চালাকি দেখিয়ে বললেন,

“এই ওয়েট! আপনি আবার আমার ভাইকে কিডন্যাপ করেন নি তো?”

মোহনা আন্টি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,”আমার তো উল্টোটা মনে হচ্ছে। তুমি আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করেছো?”

“আপনার ছেলের মতো কীট কে কিডন্যাপ করে হাত নাপাক করার কোনো ইচ্ছে নেই। তবে একটা কথা বলে দিচ্ছি, আমার ভাইয়ের যদি কিছু হয়.. আপনার ছেলেকে কিন্তু আমি ছেড়ে দেবো না ম্যাডাম।”

আমি ঈশানের বাহু খামচে ধরলাম। পরিস্থিতি ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে। সব জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। এবার কি আমাদের ধরা দেওয়া উচিৎ?
🍂

চলবে

তি আমো পর্ব-২০+২১

0

#তি_আমো❤
#পর্ব_২০
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমি অবুঝের মতো প্রশ্ন করলাম,” সকালে কি হবে?”

ঈশান ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দুশ্চিন্তা দমনের চেষ্টা চালিয়ে বললেন, “কিছু না। তুমি ঘুমাও। চোখ বন্ধ করো। আর কোনো কথা হবে না।”

“তাহলে আলোটা নিভিয়ে দিন?”

“কেনো?”

“আলো চোখে লাগলে আমি ঘুমাতে পারিনা।”

ঈশান বিব্রতবোধ নিয়ে বললেন,

“চেষ্টা করো। লাইট অফ করা যাবে না।”

“তাহলে আমার ঘুমও আসবে না।”

মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে লাইট বন্ধ করলেন ঈশান। সম্পুর্ন ঘর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হল। কালো রঙে নিমজ্জিত হল সবকিছু। ধবধবে ছেলেটাকেও এখন কুচকুচে মনে হচ্ছে। আমি অনুনাদিত কণ্ঠে বললাম,

“ঈশান আমার ভয় লাগছে। এতো অন্ধকার কেনো?”

ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমার প্রতিটা কথাতেই আহত হচ্ছেন উনি। মনের আক্ষেপ প্রকাশ করতেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে হতাশাজনক প্রশ্বাস ছাড়ছেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনের তিক্ত হয়ে উঠার প্রবণতা প্রকাশ পাচ্ছে। আমি গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রইলাম। ঈশান আমার কাছে এসে কপালে চুমু দিলেন। উনার ভারী নিঃশ্বাসের স্রোত প্রবাহিত হলো আমার সারা মুখ জুড়ে। সাথে চিরচেনা পারফিউমের সুভাষটাও প্রখর হয়ে উঠল। আচ্ছা উনি কি পারফিউম মাখেন এটা? একদম নেশা ধরানো সুগন্ধি। মন চায় উনাকে জড়িয়ে ধরে মাতাল স্রোতে ডুবকি লাগাতে। একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে, পারফিউমের ব্র্যান্ড কি? তারপর আমিও ইউজ করবো। তখন মনে হবে, ঈশান সারাখন আমার সাথে জড়িয়ে আছে। কি সুন্দর অনুভূতি! ভাবতেই ভাল্লাগছে। ঈশান আমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,

“ঘুমাও তারিন। ”

আমি চোখ বন্ধ করে স্বর্গীয় আয়েশ উপভোগ করতে ব্যস্ত হলাম। ঘুম আসলেও ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। কারণ ঘুমিয়ে গেলে তো এই আরামটা আর পাওয়া যাবে না। ঈশানকে এতো কাছ থেকে অনুভব করার সুযোগটাও মিস হবে। আমি চোখজোড়ার সাথে যুদ্ধ করে হলেও জেগে থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু বেশিক্ষণ সেটা সম্ভব হলো না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত হতে হল আমায়। ঘুম থেকে যখন জাগলাম তখন মনে হল যেন মাত্র পাচ মিনিটের ঘুম হয়েছে। কিন্তু আসলে ৫/৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। সেই খেয়ালও হয়নি। আমি চোখ মুখ কচলে ডানে বামে তাকাতেই বামদিকে চোখ আটকে গেল। আমার বামদিকে নিগুঢ় নিদ্রায়মাণ ঈশান নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছেন। আমি ঈশানকে ধাক্কালাম। উনি হালকা ভ্রু কুচকে উল্টো পাশে ঘুরলেন।আমি আবার ধাক্কা দিতেই অর্ধখোলা চোখে তাকালেন ঈশান। ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে বললেন,

“প্লিজ ঘুমাতে দাও না তারিন। ডিস্টার্ব করো না।”

আমি গলা খাকারি দিয়ে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

“আমি এখানে কেনো? আর আপনিই বা আমার পাশে কেনো?”

আমার কথা শুনে ঈশান উজ্জল দৃষ্টিতে তাকালেন। এক ঝটকায় উঠে বসে আমার গাল স্পর্শ করে বললেন,

“বলো তো তোমার কেমন লাগছে এখন?”

আমি ঈশানের হাত সরিয়ে নিজেও কিছুটা দুরে সরে বসলাম। ভ্রু কুচকে বললাম,

“জানিনা। অদ্ভুত লাগছে। ”

ঈশান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। নিজের মুখমন্ডল একবার মালিশ করে ঘড়ির দিকে তাকালেন। উনার দেখাদেখি আমিও তাকালাম। সাতটা বেজে দশমিনিট। ঈশান বিছানা থেকে নেমে গেলেন। দরজা খুলে বাহিরের পরিবেশে কয়েকবার চোখ বুলিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“তারিন! তুমি এক দৌড়ে নিহার রুমে চলে যাবে হুম? ডানে-বামে কোনোদিকে তাকাবে না। একদম স্ট্রেইট নিহার রুম। গো।ফাস্ট। এখন কেউ নেই।”

আমি কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি কি বলছে আমার মাথায় ঢুকছে না। যেন শুন্য মস্তিষ্ক নিয়ে বসে আছি। মেমোরি ক্লিন করা হয়েছে আমার। তবে এখন একটা বিষয়ই শুধু মাথায় কুন্ডলী পাকাচ্ছে। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে ঈশান কথা বললে মারাত্মক শোনায়। শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। তার উপর ফোলা ফোলা চোখের লাল লাল দৃষ্টি আর এলোমেলো চুল, সবথেকে বেশি আকর্ষণীয় রুপ উনার। ঈশান আমার স্তব্ধতা দেখে প্রশ্ন ছুড়লেন,

“কি হলো তারিন বসে আছো কেনো? যাও! কেউ দেখে ফেলার আগেই জলদি চলে যাও। নাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে তারিন!”

ঈশান করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমার স্মৃতিশক্তি লোপ পেলেও বিবেকশক্তির তাগিদেই ঈশানের কথামতো উঠে দাড়ালাম। ঈশান ব্যস্ত হয়ে অস্থির গলায় বললেন,

“শোনো! মাঝপথে কারো সাথে যদি বাইচান্স দেখা হয়েও যায়, তাহলে তুমি বলবে তুমি সারারাত নিহার রুমে ছিলে। আর.. আর এখন পানি খেতে বের হয়েছো। ঠিকাছে? ”

আমি মাথা দুলিয়ে সামনে পা বাড়ালাম। ঈশান পেছন থেকে আওরাতে লাগলেন,

“ফাস্ট তারিন ফাস্ট। স্ট্রেইট নিহার রুমে।”

আর কোনো শব্দ আমার কর্ণকুহরে পৌছানোর পুর্বেই আমি নিহার দরজার কাছে স্থির হয়েছি। হাপাতে হাপাতে দরজা ধাক্কাতে শুরু করলাম। ফিসফিস করে ডাকলাম,

“নিহু! নিহু দরজা খোল। আমি তারু। ”

নিহার আড়মোড়া ভাঙানোর আওয়াজ শোনা গেল। যেন গভীর ঘুমের প্রগাঢ় অভিলাষ থেকে জবরদস্তি টেনে তোলা হচ্ছে তাকে। আমি দরজা খোলার অপেক্ষা করলাম। কয়েক মিনিট পর নিহা দরজা খুলে আমার সামনে দাড়াল। চোখ চুলকাতে চুলকাতে বিরক্তি নিয়ে বলল,

“কি হয়েছে?”

আমি নিহার কাধে হাত দিয়ে বললাম,

“সরি দোস্ত। এতো সকালে তোর ঘুমের ডিস্টার্ব করতে চাইনি। আসলে আমি..”

নিহার বিছানার দিকে চোখ যেতেই আমার কণ্ঠনালি স্থবির হয়ে এলো। সোনালি পাঞ্জাবি গায়ে সাফিন ভাইয়া সম্পুর্ণ বিছানা দখল করে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অচিরেই হালকা সংকোচ বাসা বাধল মনে। এই সংকোচ ঠেকিয়ে আমি নির্বোধের মতো জিজ্ঞেস করলাম,

“উনি এখানে কেনো?”

নিহা ঝারি মেরে বলল, ” উনি এখানে কেনো মানে? উনি থাকবে না তো কি তুই থাকবি?”

আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম, “আমারই তো থাকার কথা ছিল।”

তারপর নিহার হাত চেপে ধরলাম। অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করলাম, “এবার আমি কোথায় যাবো দোস্ত?”

“আমি কি জানি? যেখান থেকে এসেছিস ভালোয় ভালোয় সেখানে ফেরত যা। সকাল সকাল ঝামেলা করিস না।”

“নিহা? তুই আমাকে ঝামেলা বলছিস?”

“হ্যা বলছি। কালরাতে কয়বার ডেকেছিলাম তোকে? কয়বার নিষেধ করেছিলাম? আমি না করা সত্ত্বেও ছাদে কেনো উঠেছিলি তুই? ঈশান ভাইয়া! এবার যা ঈশান ভাইয়ার কাছে। ”

আমি গোল গোল চোখে তাকিয়ে থেকে বললাম,

“দোস্ত তোর কথা আমার মাথায় ঢুকছে না।আমার তো নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না তখন। কি করছি কেনো করছি নিজেও বুঝিনি। প্লিজ এতোটা সেলফিশগিরি করিস না। আমারে ভেতরে ঢুকতে দে দোস্ত।”

“তুই কি যাবি? না লাত্থি খাবি? নাকি ঝাড়ুর বারি খাবি? কোনটা? ঝাড়ুটা কিন্তু বিছানার তলাতেই আছে। বাইর করতে বেশি সময় লাগবে না। তার আগেই মানে মানে কেটে পড়। যাহ!”

নিহা নির্দ্বিধায় দরজা আটকে দিল। আর আমি “দোস্ত দোস্ত” বলে চিল্লাতে লাগলাম। যখন বুঝলাম কোনো লাভ নেই, তখন নিজে থেকেই থেমে গেলাম। ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে কাদতে বসতে। এখন আমার মনে একরাশ আতঙ্ক । কেউ যদি আমাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলে, কি জবাব দিবো আমি? ভেতরে নিহা-সাফিন আর বাহিরে আমি। দরজার সামনে দাড়িয়ে। এমন প্রশ্নের কেমন জবাব হতে পারে?ধুর এতো সাত-পাঁচ ভেবে কাজ নেই। আরো কত মেয়েরা আছে। ওদের সাথে গিয়ে শুয়ে থাকলেই হলো। এই ভাবনা নিয়েই সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আমার ছোট্ট আত্মায় কম্পন ধরিয়ে মা আমার সামনে এসে দাড়ালেন। মাকে দেখে আমি এতোটাই আকস্মিক ভয় পেলাম, যে মুখে হাত রেখে আর্তনাদের শব্দ তুললাম। মা আমাকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে মুখ কুচকালেন। আমার বাহু শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে আসলেন রুমে। বিছানায় বুড়ি হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। মা দরজা বন্ধ করলেন। অতঃপর আমার কাছে এসে দাড়ালেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এখনই হয়তো মা চড় বসাবেন আমার গালে। মা আমাকে ভুল বুঝছে সেটা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ঠিকটা বুঝিয়ে বলার সাহসও যোগাড় করতে পারছি না। বুকের ভিতরটা নিভু নিভু করছে। মায়ের মনটা যদি এখন একবার পড়তে পারতাম, একবার জানতে পারতাম মা কি ধারণা করছে আমাকে নিয়ে? খুব ভালো হতো। মা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বিছানার কোণার দিকে হেটে গেলেন। ব্যাগটা উঠিয়ে আমার হলুদ কামিজটা বের করে বললেন,

“চেঞ্জ করে আয়।”

আমি যেন কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কাপা কাপা হাত দিয়ে জামাটা ধরলাম। তাৎক্ষণিক ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। দরজা বন্ধ করে এবার শান্তি। দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে দাড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি আসছে। নিজের থেকে ঈশানের জন্যই বেশি খারাপ লাগছে। আমার সাথে সাথে সবাই উনাকেও ভুল বুঝবে না তো? দরজায় করাঘাতের শব্দে আতকে উঠলাম আমি। বাধরুমের দরজায় না, রুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। ভাইয়ার গলার আওয়াজ পেলাম। হ্রৎপিন্ড দ্বিগুণ গতিতে স্পন্দিত হতে শুরু করল। মা দরজা খুলতেই ভাইয়া জোরালো গলায় বললেন,

“তারুকে পেয়েছো?”

মায়ের উত্তর শোনা গেল না। মা আর ভাইয়া কিছুক্ষণ গুজুরগুজুর করলেন। মা হঠাৎ উচ্চারণ করলেন,

“জলদি বের হো তারু। তারিফ তোর সাথে কথা বলবে।”

আমার আতঙ্ক তীব্র হল। শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছি। কোনো এক গায়েবি শক্তি যেন আমাকে ভেতর থেকে চেপে রেখেছে। আমি পোশাক পাল্টে বাহিরে বের হলাম। ভাইয়া বিছানায় বসে ছটফট করছিলেন। আমাকে দেখে উঠে দাড়ালেন। আমি শুকনো মুখে মূর্তির মতো দাড়িয়ে আছি। ভাইয়া প্রথমেই যে প্রশ্ন করলেন,

“সারারাত কোথায় ছিলি তুই?”

আমি সামনের চুলগুলো কানে গুজলাম। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মাও আমার উত্তরের অপেক্ষায়। আমি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে উত্তর দিলাম,

“ন নিহার ঘরে।”

ভাইয়া হুংকার দিয়ে বললেন,” তুই নিহার ঘরে ছিলি?”

আমি ভয়ে পিছিয়ে গেলাম। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকলো আমার। আরেকবার কম্পিত কণ্ঠনালি নিয়ে উচ্চারণ করলাম, “ন না, না না। নিহার ঘরে নয়। আমি মেঘলা, রিদিতা, তানিশা ওদের সাথে ছিলাম।”

ভাইয়া আগুন গরম দৃষ্টি নিয়ে একবার মায়ের দিকে তাকালেন। মা ও ভাইয়ার চোখাচোখি দেখে মনে হচ্ছে, আমি নিতান্ত অবিশ্বাস্য একটা কথা বলে ফেলেছি। ভাইয়া হাত ভাজ করে সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন। আর বললেন,

“মিথ্যে বলিস না তারু। আমি খবর নিয়েছি। তুই ওদের সাথে ছিলি না। আর ওই পিচ্চি মেয়েটা তখন এমন কথা কেনো বলল?”

ভাইয়ার প্রশ্ন শুনে আমার আর বুঝতে বাকি নেই যে পিচ্চি মেয়েটা আরিশা। ভয়ে প্রাণপাখি আমার ডানা ঝাপটাচ্ছে তবুও অসীম সাহস দেখিয়ে বললাম,

“কোন কথা ভাইয়া?”

ভাইয়া বিব্রত কণ্ঠে বললেন, “মেয়েটা বলছিল, “নিহাআপু আর সাফিন ভাইয়ার মতো ঈশান আর তারিন আপুরও কি আজ স্পেশাল নাইট? ওদেরও কি বিয়ে হয়েছে?””

কথাটা শুনে আমার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। চরম অস্বস্তি থেকে মাথা নিচু করে দাড়ালাম আমি। এমন কথায় কি রিয়েকশন দেওয়া উচিৎ জানা নেই আমার। হঠাৎ দরজায় কেউ টোকা দিল। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম মোহনা আন্টি এসেছেন। ভাইয়া বিরক্তি দৃষ্টি নিয়ে মোহনা আন্টির দিকে তাকালেন। মোহনা আন্টি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন,

“ফ্যামিলি মিটিং হচ্ছে? আমার হুট করে চলে আসা উচিৎ হয়নি। কিন্তু একটা খুব ইম্পোরটেন্ট কথা না বললেই নয়। ”

ভাইয়া মোহনা আন্টির কথায় আগ্রহ দেখালেন না। চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন। যতদূর বুঝলাম, কালরাতে বাসায় সিডর, টর্নেডো, সুনামি সব একসাথে হয়েছিল। আর তারই পরিণাম এখন ভুগতে হচ্ছে। মা জোরপূর্বক হেসে মোহনা আন্টিকে বললেন,

“জী আপা। ভিতরে আসেন।”

মোহনা আন্টি বিভ্রান্তি নিয়েই ভেতরে ঢুকলেন। বিছানায় বসে ইতস্তত দৃষ্টিতে ভাইয়া আর মায়ের দিকে একবার তাকালেন। আমার দিকে তাকাতেই আমি মাথা নিচু করলাম। লজ্জা আর অপমানে মন চাইছে মাটি অথবা দেয়ালের সাথে মিশে যেতে। মোহনা আন্টি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“তোমার নাম তারিফ তো? নাম ধরেই বলি। আমার ঈশানের বয়সী তুমি।”

তারিফ ভাইয়া তীব্র মেজাজি কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,” হুম।”

মোহনা আন্টি বললেন,” দেখো তারিফ, আরিশা একটা বাচ্চা মেয়ে। কি বলতে কি বলে ফেলেছে… ওর কথা ধরে বসে থাকলে হবে? আর তারিন কিন্তু কাল ইচ্ছে করে নেশা করেনি। ওকে নেশা করানো হয়েছে। ওর ইনোসেন্সের সুযোগ নিয়ে কেউ এ কাজ করেছে। ঈশান স্বচক্ষে দেখেছে সেটা। আমাকে বলেছেও। ঈশান শুধু তারিনকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিল। তুমি যদি ভেবে থাকো আমার ছেলে তোমার বোনের অচেতন অবস্থার এ্যাডভান্টেজ নিয়েছে, তাহলে সেটা ভুল।আমার ছেলেকে অনেক ভালো করে চিনি আমি। যদি কেউ বলে ঈশান মানুষ খুন করেছে, তাও আমি বিশ্বাস করতে পারি। কিন্তু মেয়েদের অসম্মান? অসম্ভব! ”

তারিফ ভাইয়া রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, “আপনি কি ছেলের গুণগান করতে এসেছেন? এতোকিছুর পরেও?”

মোহনা আন্টি বললেন,” না! একদমই না। আমি শুধু সত্যিটা বোঝাতে এসেছি। আমার ছেলে নির্দোষ। আর তারিনেরও এখানে কোনো দোষ নেই। আসলে পরিস্থিতিটাই এমন হয়েছিল, যে কারো কিছু করারই ছিল না! কালরাতে তারিনের অবস্থা তো আমি দেখেছি। কমপ্লিটলি আউট অফ মাইন্ড। ওই অবস্থা ও কি বলেছে, কি করেছে নিজেও বুঝেনি।”

ভাইয়া বলে উঠলেন, “আপনার ছেলে তো অবুঝ না। তাহলে সে কিভাবে..”

ভাইয়া নিজে থেকেই থেমে গেলেন। মোহনা আন্টি বললেন,

“আমি বুঝতে পারছি। তবে তারিনের কোনো ক্ষতি হয়নি এ বিষয়ে আমি কনফিডেন্ট। তবুও যদি তোমাদের আমার ছেলের উপর অভিযোগ থাকে, তাহলে আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই। তারিনকে আমার আগে থেকেই পছন্দ। আমি ঈশানের সাথে তারিনের বিয়ে দিব। যদি তোমাদের কোনো আপত্তি না থাকে।”

ভাইয়া ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, “আপনার ক্যারেক্টারলেস ছেলের সাথে আমার বোনের বিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। এতোদূর ভাবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি আসতে পারেন। ”

মা ক্ষীণ কন্ঠে উচ্চারণ করলেন, “তারিফ!”

ভাইয়া হাত উঠিয়ে মাকে চুপ করতে বললেন। মোহনা আন্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালেন। আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে তারিফ ভাইয়াকে বললেন,

“আমি ভালোর জন্যই প্রোপোজ্যাল টা দিয়েছিলাম। আরেকবার ভেবে দেখার.. ”

তারিফ ভাইয়া মোহনা আন্টির মুখের সামনে হাতজোড় করলেন। বললেন,

“আমাদের ভালো না ভাবলেও চলবে ম্যাডাম। ”

মোহনা আন্টি নিরাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলেন। ভাইয়া তখন মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“সবকিছু গুছিয়ে নাও মা। আমরা একটু পরই বের হবো। আর আজকেই ঈশানের সাথে তারুর বিয়ে হবে।”

বলেই চলে গেলেন ভাইয়া। আমি হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছি। কি হলো এটা? ভাইয়া এইমাত্র ঈশানকে রিজেক্ট করলেন। আর এখনি আবার বলছেন ঈশানের সাথে আমার বিয়ে হবে?বেশ কিছুসময় বিষয়টা নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে যা বুঝলাম, ভাইয়া হয়তো ভাবছেন এখানে দুটো ঈশান। একজন মোহনা আন্টির দুশ্চরিত্র ছেলে , আরেকজন আমাদের বাড়ির নিষ্পাপ ভাড়াটে। যদি এমনটাই হয়ে থাকে তাহলে তো কঠিন তালগোল পাকিয়ে গেল। কি হতে চলেছে চিন্তা করতে গেলেও আমার দুনিয়া ঘুরে আসছে।
🍂

চলবে

তি_আমো❤
#পর্ব_২১
Writer: Sidratul muntaz

🍂
নিহাদের ডাইনিং রুমের বিশাল ফিশ পন্ডের কাচের দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। রঙ-বেরঙের মাছগুলোর আপন খেয়ালে ভেসে বেড়ানো পর্যবেক্ষণ করছিলাম মনোযোগের সাথে। কেউ আমার বাম হাত টেনে ধরল। ফিসফিস করে বলল,

“তারিন!”

আমার ভাবনায় ছেদ পড়তেই মাথা তুলে তাকালাম। ঈশান বললেন, “চলো তারিন।”

আমি প্রশ্ন না করে উনার সাথে হেটে গেলাম। উনি আমাকে রুমে এনে দরজা বন্ধ করলেন। নিজে বিছানায় বসলেন। আমাকেও টেনে বসালেন। রাশভারী কণ্ঠে বললেন,

“তারিন, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। খুব বড়সড় একটা ব্লেন্ডার হয়ে গেছে। তারিফের মনে আমার আইডেন্টিটি নিয়ে বিরাট একটা মিস আন্ডারস্টেটিং ক্রিয়েট হয়েছে।”

আমি শান্ত গলায় বললাম,

“কি মিস আন্ডারস্টেটিং?”

ঈশান বড় করে শ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন,

“ডিটেইলস বলছি শোনো। সকালে তারিফ এসেছিল আমার কাছে।তুমি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই.. তোমার খোজ করতে এসেছিল।আমি বুঝালাম যে আমি তোমার বিষয়ে কিছুই জানিনা। তখন সে আমাকে আরিশার কথাগুলো বলল।আরিশার কাছে আমার নাম শুনেও তারিফ কিছুই ধরতে পারেনি। কারণ ডাকনাম এক হলেও, পুরো নাম তো আর এক নয়। সবাই যখন বলছিল ঈশান আরিশার কাজিন, মোহনা সরকারের ছেলের নাম, তখন তারিফ একবারের জন্যও ভাবেনি আমিই সে। তারিফের দৃঢ় বিশ্বাস, আমি কখনো তাকে মিথ্যে বলবো না। সেই বিশ্বাস নিয়েই ও আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। “তারায জোহান ঈশান”কে আমি চিনি কিনা। আমি সত্যিটা স্বীকার করতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু তারিফের কথার জালে ফেসে আমি সেই সৎসাহস দেখাতে পারিনি। তারায জোহান, মানে আমার প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করছিল তোমার ভাইয়া। আমি তখন কিভাবে সত্যিটা বলতাম তারিন? ভয় হচ্ছিল। ঠিক ওই মুহুর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমি যদি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, তাহলেই কেবল তারিফ রিলেক্স হবে। শান্তি পাবে।ও হয়তো এই কথাটাই আমার থেকে প্রত্যাশা করে। আর আমি সেটাই করেছি। কিন্তু এখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। তোমাকে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বিয়ে করলে কি আরো অনেক বড় ধোকা হয়ে যাবে না?”

“আচ্ছা আপনি কি বলতে চাইছেন? “ঈশান আহমেদ”মানে আমাদের বাড়ির আপনি আর “তারায জোহান ঈশান” মানে মোহনা আন্টির ছেলে সেটাও আপনি, এই আপনাকেই ভাইয়া আলাদা দুইজন ভাবছেন?”

ঈশান হতাশাজনক ভাবে মাথা নাড়লেন। আর বললেন,

“হ্যা। ঈশান আহমেদ বলে কেউ নেই। আমার বাস্তব নাম তারায জোহান ঈশান। এই অতি সত্যি কথাটাই আমি বলতে পারছি না তারিফকে।”

“কেনো বলতে পারছেন না?”

“বাস্তব “আমি” কে নিয়ে যে খুব নিকৃষ্ট ধারণা পোষণ করে তোমার ভাই। এই মুহুর্তে তার চোখে তারায জোহান খুব বাজে, ক্যারেক্টারল্যাস, কুরুচিপূর্ণ একজন মানুষ। আর ঈশান আহমেদ মানে ভরসার জায়গা। রাশি রাশি বিশ্বাস। এই বিশ্বাসটা ভেঙে দেওয়ার এ্যাবিলিটি আমার নেই তারিন!! কি করবো?”

“কিন্তু ভাইয়ার তো সত্যিটা জানা দরকার?”

“সেই সত্যি বলার সৎসাহস টাই তো আমার নেই। ভয় হচ্ছে। বড্ড বেশি ভয় হচ্ছে।”

“কিসের ভয়?”

“তোমার আমার দুরত্ব বাড়ার ভয়। তারিফ আমার মিথ্যের উপর এতোটা ভরসা করবে আমি কখনো ভাবিনি। মিথ্যার স্তর এতোই ভারী পড়ে গেছে যে তারিফের চোখের দিকে তাকিয়ে সত্যি বলার সাহসটা পর্যন্ত জমাতে পারছি না আমি। এর থেকে মরে যাওয়া সহজ মনে হচ্ছে। তারিফ যখন জানতে পারবে আমি “তারায জোহান ঈশান”। আর “ঈশান আহমেদ” নামে কেউ নেই তখন হয়তো সে হোপলেস হয়ে পড়বে। হয়তো জীবনে আর কাউকে বিশ্বাসই করবে না! আর সবথেকে বড় কথা আমার থেকে তোমাকে আলাদা করার জন্য উঠে পরে লাগবে। তার উপর তোমার দাদী তো আছেনই।উনি তো আবার পাত্রও ঠিক করে রেখেছেন। তারিফ যদি রাগের মাথায় তোমার বিয়ে দিয়ে দেয়?”

করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন ঈশান। আমি চুপ করে আছি। ঈশান একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে মাথার চুল খামচে ধরলেন। এখনো বুড়ির কথাগুলো উনার মাথা থেকে যায়নি। আমার বিয়ের বিষয়টা নিয়ে এখনো বিষন্নতায় ভুগছেন উনি। বুড়িটা আসলেই একটা কুটনৈতিক। ঈশানকে এখন কদবেলের সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে করছে আমার। উপরের দিকটা শক্ত খোলসে আবৃত হলেও ভিতরটা একেবারে নরম। ভরতা বানানো যায় খুব সহজেই। আমি উনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,

“আপনি এতো চিন্তা কেনো করছেন? হতাশ হবেন না প্লিজ। বিয়েটা তো আমাদের হচ্ছে। আপনি খুশি না?”

“হ্যা খুশি। কিন্তু এতোটাও খুশি হতে পারছি না, যতটা হওয়া উচিৎ। খুব অস্বাভাবিক লাগছে সব। এলোমেলো লাগছে। মমকেও কিছু জানানো যাচ্ছে না। পরে এর জন্য দারুণভাবে সাফার করতে হবে আমি নিশ্চিত। ”

আমি মাথা নিচু করে বললাম,

“আপনিই যদি এতো টেনশন করতে থাকেন তাহলে আমি কি করবো?”

ঈশান শান্তচোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরলেন। কপালের এক পাশে হালকা চুম্বন করে বললেন,

“টেনশন করোনা। এভরিথিং উইল বি ফাইন। ইনশাআল্লাহ।”

আমি হেসে দিয়ে বললাম,

“আচ্ছা আজ কি সত্যিই আমাদের বিয়ে?”

ঈশানের স্পর্শ হালকা হল। আমি মাথা তুলে তাকাতেই উনি মুচকি হেসে আমাকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে বলে উঠলেন,

“পাগল হয়ে যাবো তারিন। ”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম, “কেনো?”

ঈশানের উল্লাসী কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “খুশিতে।”

আমি খিলখিল করে হেসে দিতেই ঈশান আমাকে বিছানায় ফেলে আমার উপর গা এলিয়ে দিলেন। আমি চোখ বড় করে আতঙ্ক নিয়ে বললাম,

“ঈশান কেউ চলে আসবে।”

“কেউ আসবে না মিষ্টি! দরজা বন্ধ।”

আমি সামনে দিকে ইশারা করে বললাম, “একি! আরিশা তুমি জানালায়?”

ঈশান তড়িৎ গতিতে উঠে বসে জানালার দিকে তাকালেন,” কোথায় আরিশা?”

আমি এতোক্ষনে উঠে দরজা খুলে ফেলছি। তাই দেখে ঈশান ক্ষীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,

“দিজ ইজ নট ফেয়ার!”

আমি এক দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। নিহার ঘরের দিকে যাচ্ছি। আর কিছুক্ষণ পরেই নিহার বিদায়বেলা। চলে যাবে বেচারি শ্বাশুরবাড়ি। আমার বিয়েতেও নিহার থাকা হবে না। একথা ভাবতেই ইমোশোনাল হয়ে যাচ্ছি আমি। নিহার রুমের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। তখনই কানে আসল মোহনা আন্টির কণ্ঠ। উনার কথা শুনে আমি স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে দাড়ালাম। কথাটা ছিল,

” তারিনের যে ছেলেটির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার সম্বন্ধে তুমি কিছু জানো নিহা? শুনলাম নাকি ওদের বাসার পেয়িং গেস্ট?”

নিহা হকচকিত হয়ে বলল, “না আন্টি। আমি তো তেমন কিছু জানিনা।”

“জানোনা? তুমি না প্রায়ই ওদের বাসায় যেতে? কখনো দেখোনি ছেলেটাকে? ”

নিহা অপ্রস্তুতি কণ্ঠে মাথা চুলকে বলল,

“হ্যা দেখেছিলাম আর কি। দু একবার চোখের সামনে পড়েছিল।”

“দেখতে কেমন? তারিনের সাথে মানাবে?”

“এতোকিছু তো খেয়াল করিনি আন্টি। ”

“কিছুই খেয়াল করোনি? শর্ট? নাকি হাইট আছে? কালো না ফরসা? চেহারা কেমন?”

“আন্টি আমি ঠিক করে বলতে পারবো না। ছেলে আসলে.. সবসময় মুখোশ পড়ে থাকতো তাই আমি দেখিনি।”

নিহার কথা শুনে কপালে হাত ঠেকালাম আমি। মেয়েটা কি উল্টা-পাল্টা বলে এগুলো?

আন্টি বললেন, “মুখোশ পড়ে থাকতো? এটা আবার কেমন? বাড়িতে কেউ মুখোশ পড়ে থাকে নাকি? মুখে ইনফেকশন নেই তো আবার?”

ভীত কণ্ঠে জানতে চাইল আন্টি। নিহা দ্রুত উত্তর দিল,

“না না! ছেলে আসলে খুব লাজুক। মেয়েদের সামনে মুখোশ পড়ে থাকে।”

মোহনা আন্টি ভ্রু কুচকে হাসলেন,” কি? এইটা আবার কেমন ছেলেমানুষ? নাকি হাফ মেয়ে?আচ্ছা তাই বলে তুমি কিছুই বলতে পারবে না? মুখ বাদ দিয়ে হাইট ওয়েট সম্পর্কে কিছু বলো? কত হবে হাইট? 5.5 এর উপরে হবে?”

“হাইট তো মনে হয় 6 ফিটেরও বেশি। আমি ঠিক বলতে পারছি না আন্টি।”

“6 এরও বেশি? তাহলে তো ঈশানের মতোই? গায়ের রং কেমন বলোতো? সুদর্শন?”

আরো আগ্রহের নিয়ে জানতে চাইলেন মোহনা আন্টি। নিহা আরো বেশি ভড়কে গেল। আমতা-অমতা করে বলল,

“আন্টি আমি আর কিছু বলতে পারবো না..ছেলেটা সবসময় গায়ে কালো কাপড় জড়িয়ে রাখতো। তাই কিছু দেখা যেতো না।”

মোহনা আন্টি চমকে গিয়ে বললেন,” মানে? এটা আবার কেমন?”

নিহা বলল, “জানিনা আন্টি! এমনই।”

মোহনা আন্টি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ আঙুল উঠিয়ে বললেন, “এই ওয়েট! এইটা পার্টির ওই অসভ্য ছেলেটা না তো?”

মোহনা আন্টির প্রশ্নে নিহা চরম বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “মানে? ওই ছেলে হতে যাবে কেনো আন্টি?”

মোহনা আন্টি চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, “হুম ওই ছেলেই হতে পারে। কারণ তারিন প্রথমদিনই বলছিল, ছেলেটা মুখোশ আর কালো কোর্টের মতো কাপড় জড়িয়ে ওকে কিডন্যাপ করতে এসেছে। তুমিও সেইম কথা বললে। কি সাহস ছেলের? আমি তো ভাবতেই পারছি না। দুর্দান্ত পরিকল্পনা করে ওদের বাড়ির পেয়িং গেস্ট হয়ে গেছে? আর এখন বিয়েও করে নিচ্ছে?”

মোহনা আন্টি ফট করে উঠে দাড়ালেন। হুংকার দিয়ে বললেন,

“বিষয়টা এখনি তারিনের ভাইকে জানাবো আমি।”

নিহা এতোক্ষণ হ্যাবলার মতো মোহনা আন্টির কথা শুনছিল, লাস্ট লাইনটা শুনেই চোখ বড় করে চেচিয়ে উঠে বলল,” না আন্টি! পাগল নাকি?”

মোহনা আন্টি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই নিহা কিছুটা নরম সুরে বললে,

“কি দরকার আন্টি ঝামেলা করার? থাক না বাদ দিন। ছেড়ে দিন।”

মোহনা আন্টি দ্বিগুণ তেজ দেখিয়ে বললেন, “ছাড়বো কেনো? সত্যিটা সবাইকে জানাতেই হবে।
আমার ছেলেকে রিজেক্ট করে কেমন ছেলের সাথে বোনের বিয়ে দিচ্ছে তারিফ? আর তাছাড়া এটা তারিনের জীবন-মরণের প্রশ্ন। মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যায়না! আমি অবশ্যই বলবো। আর নিহা? তারিন না তোমার বেস্টফ্রেন্ড? ওর এতোবড় বিপদে তুমি পিঠ বাচিয়ে পালাতে চাইছো? ছি! আমি তোমার কাছে এমন কিছু এক্সপেক্ট করিনি। তারিনকে জোর করে একটা অসভ্যের সাথে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই বিয়ে আটকাতেই হবে। পারলে তুমিও আমার সাথে এসো। ”

শাড়ির কুচি হালকা উচু করে ক্ষিপ্রগতিতে বেরিয়ে আসলেন মোহনা আন্টি। আমি দেয়ালের সাথে মিশে দাড়ালাম। মোহনা আন্টি চলে যেতেই আমি নিহার ঘরে ঢুকে নিহার পিঠে উরাধুরা কিল শুরু করলাম। বলদামির একটা লিমিট থাকা উচিৎ। এই মেয়ে সেই লিমিটও ক্রস করে ফেলেছে।এবার তো মনে হচ্ছে প্রবলবেগে ঘুর্ণিঝড় শুরু হবে বাড়িতে।
🍂

চলবে

তি আমো পর্ব-১৮+১৯

0

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৮
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আরিশা বলল,” চকলেট না পেলে আমি হেল্প করতে পারবো না। বা বায়!”

সামনের দিকে ঘুরে হাটতে লাগল আরিশা।আমি পুনরায় ডাকলাম,

“আরিশা! বেবি আমি তোমাকে চকলেট দিবো তো। প্রমিস। কিন্তু চকলেট টা খুব বড়। জানালা দিয়ে দেওয়া যাবে না। তুমি দরজাটা খুলো, তারপর আমি দিচ্ছি।”

আরিশা কিছু একটা ভেবে বলল,” এতোবড় চকলেট? সত্যি দিবে তো?”( আমার দিকে আঙুল তাক করে)

“হ্যা সত্যি দিবো।”

“ঠিকাছে আমি দরজা খুলছি।”

আরিশা দৌড়ে দরজার দিকে গেল। আমিও দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। দরজা খোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমি কান পেতে রইলাম। কয়েক মিনিট পর আরিশা বলল,

“তারি আপু! আমি খুলতে পারছি না।খুব শক্ত।”

“পারবে আপু। একটু চেষ্টা করো!”

আরো কয়েক মিনিট মোচড়ামোচড়ির পর অবশেষে খুলে গেল দরজা। আমি হালকা নিচু হয়ে আরিশা কপালে চুমু দিলাম। বললাম,

“থ্যাঙ্কিউ বেবি।”

“এবার আমার চকলেট দাও।”

“চকলেট? ওইটা আসলে ঈশানের কাছে আছে। তুমি ওর থেকে নিয়ে নিও কেমন?”

বলেই ডানদিকে ছুট লাগালাম আমি। আরিশা পেছন থেকে কিছু একটা বলছিল, আমি শুনলাম না। বাহিরে আসতেই দেখলাম স্টেজের দিকে গান বাজনা হচ্ছে। নিহা আর সাফিন ভাইয়ার একত্রে স্টেজে বসে আছে। সামনেই চলছে নাচ। আমারও ইচ্ছে করল নাচতে।” লায়লা ম্যায় লায়লা” গানের সাথে উরাধুরা ড্যান্স। ভাবতেই মজা লাগছে। আমি হুট করেই উঠে পড়লাম স্টেজে। আমাকে দেখে বাকিরা নাচ থামিয়ে দিল। ক্যামেরাম্যান ইশারা করল নেমে যেতে। কিন্তু আমি নামবো কেনো? নামার প্রশ্নই আসেনা। গান যেহেতু বাজছেই, আমি নাচ শুরু করলাম। যদিও নাচের অভিজ্ঞতা আমার অত্যন্ত বিপদজনক। তবুও মনের শান্তি বড় শান্তি। সবাই তব্দা লেগে আমার নাচ দেখছে। আমি আমার নাচের সঙ্গীদেরকে ধাক্কাচ্ছি। কারো হাত ধরে ঘুরান্টি মারছি। একজন তো আমার কোমরের ধাক্কায় স্টেজ থেকেই পড়ে গেল। কিন্তু আমি ইচ্ছে করে ফেলিনি। নিহা আসন থেকে উঠে এসে আমার হাত টেনে ধরল। আমি থেমে দাড়ালাম। মাথা ঘুরছে আমার। সামনের দিকে তাকাতেই দেখলাম, সব ছেলেরা হা করে তাকিয়ে আছে। আমার কিছুটা সংকোচ হল। পেছন থেকে একজন ছেলে জোরে শিষ বাজালো। বাজে শব্দ করে হাত তালিও দিচ্ছে কেউ কেউ। অকস্মাৎ আমার হাত ধরে কেউ হেচকা টান দিল। ক্ষণিক সময়ের ব্যবধানেই আমাকে জনসম্মুখ থেকে শান্ত পরিবেশে নিয়ে আসা হল। সামনের মানুষটি ছিল তারিফ ভাইয়া।আমাদের পেছন পেছন মা, বুড়ি, এমনি নিহা পর্যন্ত ছুটে আসলো। আচমকাই আমার গালে চড় বসিয়ে দিল ভাইয়া। আমি ঠাস করে নিচে পড়ে গেলাম। গালে হাত দিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখলাম ভাইয়ার রক্তবর্ণ দৃষ্টি। ভাইয়ার এক হাত কাপছে। আমি গালে হাত রেখে কেদে দিলাম। পেছনে মা শাড়ির আচলে মুখ চেপে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন। মিউজিক থেমে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। পিন পতন নিরবতায় ছেয়ে গেল বিয়ে বাড়ির পরিবেশ। এই নিরবতাকে ছিন্ন করে ভাইয়া বিকট শব্দে উচ্চারণ করলেন,

“ছিঃ! আমার বোন হয়ে তুই নেশা করেছিস? বাজে মেয়েদের মতো জন সমাগমে শরীর প্রদর্শন করে নেচে বেড়াচ্ছিস? আজ থেকে তুই আমার বোন না। তোকে পরিত্যাগ করলাম আমি।”

ক্ষিপ্তবৎ হয়ে চলে গেলেন ভাইয়া। আর আমি মুখ ভেঙে কাদতে বসলাম। মা আর বুড়ি আমাকে কিছু বলল না। বুড়ি মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পরল। মা শুধু নিহার দিকে তাকিয়ে বললেন আমাকে যেন ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। বাইরে বের হতে দেওয়া না হয়। বাহিরে থেকে অনেকেই উঁকিঝুঁকি মেরে ভেতরটায় দেখছে। মা আর বুড়ি বেরিয়ে পড়তেই নিহা দরজা বন্ধ করে দিল। আর আমি শুরু করলাম এলোপাথারি ভাবে বমি করা। পুরো ঘর ভাসিয়ে ফেলেছি বমি করে।

.

.

পুরো রুম চমৎকারভাবে ফুল দিয়ে সাজানো। বিশেষ করে বিছানাটা। সাদা চাদরের উপর লাল গোলাপের ছড়াছড়ি। অত্যুত্তম সুন্দর লাগছে সবকিছু। নিজের দিকে মনোযোগ দিতেই আমি আবিষ্কার করলাম আমার পরনে খুব আপত্তিকর একটা জামা। জামাটা হাটু পর্যন্ত ছোট। চিকন সুতার মতো হাতা। আমি ঘাবড়ে গেলাম। ওয়াশরুম থেকে নিহা বেরিয়ে আসল। নিহাও আমার অনুরূপ একটা জামা পড়ে আছে। তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে নিহা বলল,

“দেখ দেখ। দেখে নে। আমার মতো জিগড়ি দোস্ত আর কয়টা পাবি বল? নিজের বাশর রাত মাটি করে তোর সেবা যত্ন করছি। এমন ঘটনা ইতিহাসে এর আগে কোনোদিন ঘটেছে?”

আমি হাত উচু করলে ঠোট উল্টে বললাম,

“তুই কি ভালো রে নিহু! আয় তোকে একটা চুমু দেই।”

নিহা তোয়ালে টা ঢিল মেরে বিছানায় ফেলল। কোমরে এক হাত রেখে রাগান্বিত হয়ে বলল,

“এখনো নেশা কাটেনি তোর?”

আমি হাহা হিহি করে হাসলাম। বিছানার উপর উঠে লাফাতে শুরু করলাম। নিহা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে এলো। বলল,

“তারু একদম পাগলামি না। অনেক জ্বালিয়েছিস। এবার একটু শান্তি দে প্লিজ।”

আমি লাফাতে লাফাতে হঠাৎ থেমে গেলাম। হালকা নিচু হয়ে নিহার মুখের কাছে ঝুকে ফিসফিস করে বললাম,

“ঈশান কোথায় রে? এখনো কি সামিরার সাথে আছে?”

“না। ঈশান ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। এখন তুইও ঘুমা।”

নিহা আমার হাত ধরতে এগিয়ে আসল। কিন্তু আমি ধরা দিলাম না। এক দৌড়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলে ফেললাম। নিহা অতিষ্ঠ হয়ে বলল,

“তারু একদম বের হবি না কিন্তু। খবরদার বলে দিচ্ছি। আর কোনো তামাশা না প্লিজ।”

আমি নিহার কথার তোয়াক্কা করলাম না। সহসা সবেগে দৌড়াতে দৌড়াতে ড্রয়িং রুমে চলে আসলাম। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ছিল সুমনা আন্টি মানে নিহার মা, মোহনা আন্টি আর নাশফী আপু। আরেকজন ছিল। উনি আরিশার মা। উনারা আলাপ করছিলেন। আরিশার ব্যাপারে। আরিশা নাকি খুব কাদছে। তাই ঈশান ওকে কোলে করে ছাদে ঘুরাতে নিয়ে গেছে। কথাটা শুনে আমার রাগ উঠল। ঈশান আরিশাকে ছাদে নিয়ে যাবে কেনো? আর কোলে করেই বা কেনো নিয়ে যাবে? ওই মেয়ে কি হাটতে পারে না। বেশ তো ডেং ডেং করে হাটতে পারে। আমি উনাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। কোমরে দুইহাত গুজে আরিশার মাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

“আপনি ঈশানের সাথে আরিশাকে ছাড়লেন কেনো? আপনি কি জানেন আপনার ইঁচড়েপাকা মেয়ে আমার ঈশানকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে?”

সবাই অবাকচোখে আমার দিকে তাকাল। যেন কোনো ভুত দেখছে। মোহনা আন্টি কপালে ভাজ নিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে তাকাল। আমি সবার প্রশ্নবোধক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ধাম করে সোফায় বসে পড়লাম। নাশফী আপুর পাশে। নাশফী আপুকে দেখে কালরাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল। সাফনান ভাইয়ার সাথে বাগানের পিছন দিকটায় নিরিবিলি জায়গা বুঝে ইটিশ পিটিশ করছিল। আমি ভ্রু নাচিয়ে মুচকি হেসে নাশফী আপুকে দেখতে লাগলাম। আমার উদ্ভট চাহনি দেখে নাশফী আপু কিছুটা সরে বসল। আমিও কিছু কম যাইনা। আরো এগিয়ে গেলাম নাশফী আপুর কাছে। গা ঘেঁষে বসলাম। শয়তানি হাসি দিয়ে হালকা খোচা মেরে বললাম,

“হুম হুম!! কি!!”

নাশফী আপু বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কি?”

আমি আগের মতোই মুখে হাসি রেখে বললাম,

“কি করছিলে কালরাতে? সাফনান ভাইয়ার সাথে? বাগানের পেছন দিকে? একদম খুল্লামখুল্লা!! ভেবেছো কেউ কিছু দেখবে না? আমি তো সব দেখে ফেলেছি।”

নাশফী আপু হা করে তাকিয়ে আছে। নিহা হাপাতে হাপাতে আমার সামনে এসে দাড়ালো। সুমনা আন্টি নিহাকে বলল,

“এই নিহা। এই মেয়ে কি বলে এসব? খুল্লাম খুল্লা মানে?”

নিহা বলল, “আরে মা! ওর হুশ আছে নাকি? ও কি করছে কি বলছে নিজেও তো জানেনা। বাদ দাও তো ওর কথা। এই তারু তুই চল আমার সাথে।”

আমি নিহা কে জিভ দেখিয়ে সোফার উপর উঠে দাড়ালাম। এক লাফে সোফা থেকে নেমে খিলখিল করে হাসতে হাসতে দৌড়াতে লাগলাম। নিহা নাকেমুখে “তারু থাম, তারু থাম” উচ্চারণ করে আমার পেছন ছুটতে শুরু করল। আমি থামলাম না।আমার নির্দিষ্ট গন্তব্য এখন ছাদ। পূর্ণবেগে ছাদে পৌছাতেই ঈশান আর আরিশা আমার দৃষ্টিগোচর হল। ঈশান হাটু গেড়ে আরিশার সামনে বসে আছে। আরিশার কপালে চুমু দিল ঈশান। আরিশা ঠোট উল্টে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,

“আমার চকলেট?”

ঈশান পেছনের পকেট থেকে বড় চকলেটের প্যাকেট বের করে আরিশার হাতে দিলেন। আরিশার গাল টিপে ঈশান বললেন,

“হ্যাপি?”

আমার ইচ্ছে করছে ঈশানের মাথা বরাবর ঢিল ছুড়তে। কি আদর! আরিশার জন্য চকলেট আনে। কই আমার জন্য তো জীবনে আনল না? আমি কি পানির জলে ভেসে এসেছি? আরিশা চকলেট পেয়ে উৎফুল্লকর হাসি দিল। ঈশানের গালে চুমু দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

“লভ ইউ ঈশান!”

আর আমি? নাকমুখ একসাথে ফুলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই দ্বিতীয়বারের মতো অভিঘানিত হলাম। সামিরা নামক প্যারাটা এখানেও উপস্থিত। আমি চোখ সরু করে কোমরে হাত গুজলাম। আরিশা আমায় দেখে বলল,

“তারি আপু তুমি এখানে?”

আরিশার কথায় ঈশান আমার দিকে তাকালেন। আমায় দেখেই যেন পিলে চমকে উঠল উনার। সামিরাও আমার দিকে ঘুরে তাকাল। আর তাকিয়েই চোখ বড় করে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। ঈশান এতোক্ষণে উঠে দাড়িয়ে গেছে। আরিশা আবার বলল,

“তুমি খুব পচা তারি আপু! তোমার জন্য ঈশান তখন আমাকে খুব বকেছে। তোমাকে দরজা খুলে হেল্প করেছি বলে ঈশান আমার সাথে রুড বিহেভ করেছে। আরেকটু হলেই আমাদের ব্রেকআপ হয়ে যেতো। আর তুমি তখন আমাকে সত্যিটা বলো নি কেনো? আমি যদি আগে জানতাম, তুমি দুষ্টমি করছিলে বলেই ঈশান তোমাকে আটকে রেখেছিল। তাহলে কক্ষনো দরজা খুলে দিতাম না। ঈশান ট্রাস্ট মি! তারি আপু আমাকে কিচ্ছু বলেনি।”

আমি আরিশার কথার উত্তর দিলাম না। ক্ষিপ্রবেগে ঈশানের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। আরিশাকে এক টানে সরিয়ে ঈশানের কাছে এসে হাত উচু করলাম। বললাম,

“আমাকে উঠান। ”

ঈশান ভ্রু কুচকে বলল, মানে?

“বুঝেন নি?উপরে তুলুন আমাকে।”

ঈশান নির্বোধের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার কোমর ধরে উপরে তুললেন। আমি মুচকি হেসে ঈশানের দুই কাধে হাত রেখে সামিরার দিকে তাকালাম। এই মেয়েকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়াই এখন আমার মুল উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যে বিস্ময়ের সর্বাধিক পর্যায়ে পৌছে গেছে সামিরা। সামিরাকে আরো একটু জ্বালানোর উদ্দেশ্যে আমি ঈশানের পেছনের চুলগুলো খামচে ধরে অকস্মাৎ ঈশানের ঠোটে কিস করলাম। সামিরা মুখে হাত দিয়ে বিকট শব্দ উচ্চারণ করল।
🍂

চলবে

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৯
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশান আমাকে সরিয়ে দিয়ে রোষপূর্ণ কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললেন,

“তারিন এসব কি হচ্ছে? আরিশার সামনে…”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আরিশার দিকে তাকালাম। মেয়েটা দুই হাত মুখে ঠেসে দাড়িয়ে আছে৷ আমি পরোয়া করলাম না। ঈশানের গলার পেছনে হাত বেধে বললাম,

‘আমার খুব ঘুম আসছে। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবেন?”

ঈশান আমার হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
“তারিন তুমি এখান থেকে যাও। নিহার রুমে গিয়ে ঘুমাও।”

“না আমি যাবো না। আমি আপনার সাথে ঘুমাবো। আপনার বুকে মাথা রেখে। ”

আমি ঈশানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে সামিরার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম। সামিরার আহত দৃষ্টি আমার মনে পৈশাচিক আনন্দ দিচ্ছে। ঈশান আমাকে টেনে তুললেন। চরম অস্বস্তি নিয়ে বললেন,

“তারিন যাও এখান থেকে। আরিশা সব দেখছে। কি ভাববে ও?”

“যা ইচ্ছা ভাবুক। আমার কি? আমি যাবো না। আপনার কাছে থাকবো। আই লভ ইউ!”

প্রত্যুত্তরে আলিঙ্গন করলাম ঈশানকে। ঈশান খানিক সংকুচিত হয়ে সরে পড়লেন। আরিশা আমার এক হাত টেনে ধরে বলল,

“তারি আপু! কেনো বিরক্ত করছো ঈশানকে?চলে যাও এখান থেকে। আমার ঈশানকে বিরক্ত করবে না।”

আমি এক ঝাড়িতে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। ঈশানের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আরিশাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

“আমার ঈশান।”

ঈশান দাত কিড়মিড়িয়ে উচ্চারণ করলেন,

“তারিন!কি হচ্ছে? তুমি জানো ও নিচে গিয়ে সবাইকে সব বলে দিবে।”

“বলে দিক।”

আমি ঈশানের বুকে মুখ গুজলাম। আর আরিশা? ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করল। তাই দেখে আমার ইচ্ছে হল মেয়েটার গালে থাপ্পড় লাগাতে। সামিরা দ্রুত আরিশাকে কোলে তুলল। কান্না থামানোর চেষ্টায় ছাদের অপর প্রান্তে নিয়ে গেল। আমি মিনমিন করে বললাম,

“বেশ হয়েছে।”

ঈশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে কোলে তুললেন।আমি তো বেজায় খুশি। চোখমুখ উজ্জল করে সামিরার দিকে তাকালাম। মেয়েটা এদিকে দেখছে না। একবার দেখুক।আরো বেশি করে জ্বলুক। কিন্তু সামিরা দেখল না। আমার মনখারাপ হল। ঈশান আমাকে কোলে নিয়েই ছাদ থেকে বের হলেন। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন,

“কি শুরু করেছো এসব? জানো কত ঝামেলা হচ্ছে বাসায়? তারিফ, আন্টি, দাদী তোমার উপর খুব রেগে আছে। কি হবে এবার?”

আমি মুখ গোমরা করে গালে হাত রাখলাম। আহত কণ্ঠে বললাম,

“জানেন। ভাইয়া আমাকে চড় মেরেছে। খুব জোরে।”

ঈশান বললেন, “এবার বুঝতে পেরেছো কেনো তখন আটকে রেখেছিলাম তোমাকে?তারিফ তো শুধু চড় মেরেছে। ওই জায়গায় আমি থাকলে গলা টিপেই মেরে ফেলতাম।”

“আপনি আমাকে গলা টিপে মারতেন?”

“হ্যা মারতাম। স্টেজে উঠেছিলে কেনো ওইভাবে?”

“আমার তো শুধু একটু নাচতে ইচ্ছে করছিল।”

“নাচার এতো শখ? আমার সামনে নাচো। জন সম্মুখে গিয়ে নাচতে হবে?”

“আপনার সামনে নেচে কি মজা? আপনি হাত তালি দিবেন? শিষ বাজাবেন?”

” ও আচ্ছা! হাত তালি দিলে, শিষ বাজালে সেগুলো শুনতে খুব ভালো লাগে?”

“ভালো তো লাগেই। বেশ মজা লাগে।”

“সব ব্লেন্ডার করে দিয়েছো তারিন।তোমার জন্য নিহা-সাফিনের আজকের রাতটা নষ্ট হয়ে গেল। কত মেমোরেবল একটা রাত।”

“সাফিন ভাইয়া আর নিহার থেকে আপনারই মনে হয় বেশি আফসোস হচ্ছে।”

“আফসোস তো হচ্ছেই। আরিশাকেও কাদিয়ে দিলে। এবার ও কাউকে কিছু না বললেই হলো।”

“বললে কি হবে?”

“কি আর হবে? যা হওয়ার তাই হবে।তোমার ভাইয়ের হাতে আমি খুনও হতে পারি।”

“ভাইয়া আপনাকে খুন করবে? আমি থাকতে? কক্ষনো না। আমি হতেই দিবো না”

ঈশান মুচকি হাসলেন। উনার হাসি দেখে আমার খুব খুশি লাগল। ইচ্ছে করল বলতে, ” একটা কিসি দেই?” কিন্তু বলা হলো না। আশেপাশের পরিবেশ দেখে হালকা চমকে উঠলাম। বললাম,

“এই আপনি আমাকে এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? নিহার ঘরের দিকে যাচ্ছি কেনো আমরা?”

“তাহলে কোথায় যাবো?”

“আমি নিহার ঘরে একদম যাবো না। আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন। ”

“পাগলামি করো না তারিন। চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ো।”

“না”

আমি ঈশানকে আকড়ে ধরলাম, “নামাবেন না আমাকে। আমি কিন্তু পালিয়ে যাবো।”

ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে উচ্চারণ করলেন, “উফফ!যা ইচ্ছে করো।”

ঈশান আমাকে নামিয়ে দিলেন। আমার পা জমিন স্পর্শ করতেই আমি বিপরীত দিকে ছুট লাগালাম। ঈশান বিস্ফোরিত চোখে “তারিন, তারিন” বলে আমাকে প্রবল বেগে ধাওয়া করতে শুরু করলেন। আমি নিহাদের বাসার বড় করিডোর দিয়ে দৌড়াচ্ছি। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস। গায়ে কাটা দিয়ে ওঠার মতো শীত লাগার কথা। কিন্তু আমার লাগছে না। অবাধ্য বাতাসের ধাক্কায় স্টোর রুমের ধুলিময় জানালা খুলে গেল। কিছুটা ধুলা আমার চোখেমুখে ঢুকল। আমি চোখ পিটপিট করে স্টোর রুমের ভেতরে নজর দিতেই অদ্ভুত কিছু দেখলাম। বেশ লম্বাচওড়া একটা শরীর সাদা চাদর মুড়িয়ে পড়ে আছে। স্টোর রুমে ছোট্ট চৌকির উপরে খুব আটসাট ভাবে গুটিশুটি মেরে। আমার ভয় হল। শীতে শরীর কাটা না দিলেও ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে হ্রৎস্পন্দন থেমে আসার উপক্রম হল। ঈশান আমার কাছে আসতেই আমি উনার কলার চেপে ধরলাম। বুকে মুখ গুজে কম্পিত শরীর নিয়ে উচ্চারণ করলাম,

“ভ ভুত!”

ঈশান বিস্মিত হয়ে বললেন, “কি? ভুত? কোথায় ভুত?”

আমি আঙুল ইশারা করলাম। ঈশান আমার দিকনির্দেশনা বরাবর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,

“ওইটা তো সাফিন মনে হচ্ছে।”

আমি মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। অবিশ্বাসের সাথে উচ্চারণ করলাম, “সাফিন ভাইয়া?”

“হ্যা সাফিনই তো।”

“উনি স্টোর রুমে কেনো ঘুমাচ্ছেন? উনার না আজ বাশর রাত?”

ঈশান আড়চোখে আমার দিকে তাকাতেই দাত কেলিয়ে হাসলাম আমি। বললাম,

“তাই বলে স্টোর রুমে ঘুমাতে হবে? পুরো বাড়িতে আর কোনো রুম নেই? ”

“সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করো। আমি কিভাবে জানবো?”

“আচ্ছা চলেন না, আমরা উনাকে নিহার ঘরে দিয়ে আসি। তারপর ওই চৌকিটায় আপনি আর আমি ঘুমিয়ে থাকি। খুব মজা হবে!”

“হোয়াট? তোমার ওইখানে ঘুমানোর শখ হলো কেনো?”

আমি মাথা চুলকে অসহায় মুখ করে বললাম “জানিনা। ”

ঈশান ভ্রু কুচকে বিরক্তিভরা মুখে তাকিয়ে থেকে আবার কোলে তুললেন আমাকে। বললেন,

“তারিন তুমি একদমই নরমাল সেন্সে নেই। চলো ঘুমাবে।”

“হ্যা ঘুমাবো।কিন্তু নিহা আর আমি ঘুমাবো না। নিহা আর সাফিন ঘুমাবে। ঈশান আর তারিন ঘুমাবে।”

ঈশান উত্তর দিলেন না। আক্ষেপী নিঃশ্বাস ছেড়ে হাটতে লাগলেন। আর আমি ভাবলেশহীন ভাবে আওরাতে লাগলাম, “নিহা-সাফিন! ঈশান-তারিন!”
ঈশান আমাকে বিছানায় ফেলে দরজা বন্ধ করলেন। আমার মাথার কাছে বসে জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বললেন,

“ঘুমাও।”

আমি দুষ্টু হাসি দিয়ে বললাম,”ঘুমাবো। আগে একটা গান শোনান?”

“এতোরাতে গান শোনানো যাবেনা।সবাই ঘুমাচ্ছে। ডিস্টার্ব হবে।”

আমি ঈশানের কলার ধরে নিজের কাছে আনলাম, “ফিসফিস করে শোনান। আমি ছাড়া কেউ শুনবে না।”

ঈশান আমার হাত ছাড়িয়ে অস্বস্তি নিয়ে বললেন, “প্লিজ ঘুমাও না তারিন। বিরক্ত করো না।”

“কি? আমি আপনাকে বিরক্ত করছি?আমার সবকিছুই আপনার বিরক্ত লাগে না?আরিশা আর সামিরাকে খুব ভাল্লাগে?”

“আচ্ছা তুমি আরিশাকে নিয়েও জেলাস?”

”হ্যা।খুব জেলাস। শুনেন আপনি আর কখনো আরিশাকে কোলে নিবেন না।”

“কেনো?”

“নিবেন না মানে নিবেন না। আবার কেনো কি?সামিরার সাথেও কথা বলবেন না। চোখ তুলে তাকাবেন পর্যন্ত না। যদি কখনো দেখেছি সামিরার দিকে তাকাতে, তাহলে চোখ উপড়ে ফেলে দিবো কিন্তু বলে দিলাম।”

“ওকে। তাকাবো না।”

“শুধু সামিরা কেনো? কোনো মেয়ের দিকেই তাকাবেন না।একদম নিষিদ্ধ।কথা বলাও নিষিদ্ধ। কোনো মেয়ে যদি আপনার গাল টিপে দেয়, তাহলে সেই মেয়ের হাত আর আপনার গাল দুটোই কেটে নিবো আমি। আপনার চুলে অন্য কোনো মেয়ে হাত দিলেও একই কাজ করবো।মাথাভর্তি এই ব্ল্যাক ফরেস্ট কেটে মরুভূমি বানিয়ে দিবো। তারপর বুঝবেন কেমন লাগে।”

“আচ্ছা বুঝেছি। এবার তুমি ঘুমাও।”

“আচ্ছা ঈশান একটা কথা বলবেন?”

”কি?”

“আপনি কি অন্যকোনো মেয়ের সাথে প্রেম করেছেন কখনো?আপনার কি কোনো এক্সগার্লফ্রেন্ড আছে?”

” না নেই।”

” আমি ছাড়া অন্যকোনো মেয়েকে কিস করেছেন কখনো?”

ঈশান মুখ কুচকে তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, “এসব কেমন প্রশ্ন তারিন?”

“সোজাসোজি বলেন না। করেছেন?”

ঈশান বিরক্তি নিয়ে মুখে হাত ঠেকিয়ে উচ্চারণ করলেন, “না!”

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, “তাহলে ঠিকাছে।”

ঈশান মুখ থেকে হাত সরিয়ে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, “করলে কি হতো? ”

আমি উঠে বসে ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, “আমি মরেই যেতাম।”

ঈশান আমার পিঠে হাত রেখে বললেন,
“কিন্তু আমি তো অন্য একটা মেয়েকে কিস করেছি।”

আমি মাথা তুলে ভ্রু কুচকে উৎকণ্ঠা নিয়ে বললাম, “কাকে?”

ঈশান হেসে দিলেন।আমার দুই গাল স্পর্শ করে বললেন, ” আরিশাকে। এবার ঘুমাও।”

আমি রাগান্বিত চোখে তাকালাম,”আরিশাকে কোথায় কিস করেছেন?”

“মানে?”

“ঠোটে নাকি গালে?”

ঈশান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে ধমক দিয়ে বললেন,”কপালে।।এবার শোও তুমি।”

“আপনি আরিশার কপালেও কিস করবেন না।”

ঈশান অবাক হয়ে বললেন,”তারিন ও একটা বাচ্চা।”

আমি হুংকার দিয়ে বললাম,”হোক বাচ্চা। ইঁচড়েপাকা বাচ্চা। আপনি আরিশাকে আর কখনো কিস করবেন না।”

ঈশান হতাশ কণ্ঠে বললেন,” আচ্ছা করবো না। এবার তুমি শোও। ঘুমাও। নাহলে কিন্তু নিহার ঘরে পাঠিয়ে দিবো।”

“আচ্ছা আচ্ছা। ঘুমাচ্ছি।”

আমি কাথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। ঈশান আগের মতোই সামনের দিকে ঘুরে দুই হাত একত্র করে মুখে ঠেকিয়ে বসে রইলেন। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু ঘুম আসছে না। ঈশানের পারফিউমের গন্ধে আমার নাকে সুড়সুড়ি অনুভুত হচ্ছে। হাচির মতো আসতে নিয়েও আসছে না। বিষয়টা খুব বিরক্তিকর। আমি ঈশানের দিকে আমার ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললাম,

“কিসি দেন।”

ঈশান ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, “তুমি কি ঘুমাবে না?”

“ঘুমাবো। আগে কিসি দেন। তারপর।”

ঈশান শক্ত চোখে তাকিয়ে থেকে আমার হাতটা ধরলেন। জোরপূর্বক হাতে ঠোটের হালকা পরশ দিলেন। তারপর ঝারি মেরে ফেলে দিলেন হাত। আমি আবার হাত এগিয়ে দিলাম। বললাম,

“আরো।”

ঈশান চরম বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। খুব কষ্টে মেজাজ দমন করে আমার হাত ধরলেন। দ্রুতগতিতে প্রত্যেকটা আঙুলের ডগায় চুমু দিয়ে বললেন,

“হ্যাপি? এবার ঘুমাও।”

আমি হাসলাম। কাঁথাটা গলা পর্যন্ত টেনে বললাম, “আমি ঘুমিয়ে গেলে আবার আমাকে নিহার ঘরে রেখে আসবেন না তো?”

ঈশান অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন। আমি তৎক্ষণাৎ কাথা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। একটু পর আবার কাঁথা সরিয়ে ঈশানের দিকে উকি দিলাম। উনাকে খুব চিন্তিত লাগছে। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি নিয়ে এতো চিন্তা করছেন?”

ঈশান আমার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখেই বললেন,” সকালে কি হবে তারিন?”

আমি ভ্রু কুচকালাম।
🍂

চলবে

তি আমো পর্ব-১৬+১৭

0

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৬
Writer:Sidratul muntaz

🍁
সকাল থেকেই নিহাদের বাড়ির পরিবেশ রমরমে হয়ে আছে। হাজার হাজার চেনা পরিচিত মানুষের ভীড়।কিন্তু আমি শুধু একটা মুখই খুজে বেড়াচ্ছি। ওই ঘটনার পর থেকে ঈশান আমার সাথে আর একবারও কথা বলেন নি। প্রায় ৬/৭ ঘণ্টা কেটে গেছে। এটুকু সময়েই যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি মেনে নিতে পারছি না উনার অবহেলা। যতবার উনার সামনে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছি উনি নানা অযুহাতে আমাকে এড়িয়ে চলছেন। আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছেন পর্যন্ত না। ব্যাপারটা আমার জন্য চুড়ান্ত কষ্টদায়ক।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা, ঈশান মাহাথি ভাইয়ার সাথে ডেকোরেশনের লিষ্ট বানাচ্ছিলেন। সামিরা, রিদিতা ওরাও সেখানে ছিল। অবশ্য এদের কাজই ঈশানের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করা। সকাল থেকেই দেখছি। আমি সামিরা, রিদিতার পাশে গিয়ে বসলাম। যদিও আমি ইচ্ছে করে যাইনি। ওরাই আমাকে ডেকেছিল। মেহেন্দির ডিজাইন চুজ করার জন্য। আমি ওখানে গিয়ে বসতেই ঈশান মাহাথি ভাইয়ার হাতে লিষ্ট ধরিয়ে চলে গেলেন। ঈশানের হুট করে চলে যাওয়ায় সবাই আমার দিকে তাকাল। যেন আমিই উনাকে ভাগিয়ে দিয়েছি। আমি চরম অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।

একবার আন্টি মানে নিহার মা আমাকে বললেন ঈশানকে পুলসাইট থেকে ডেকে আনতে। জরুরি কাজ আছে। আমিও খুশিমনে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল ঈশানকে একা পেলে সরি বলবো। প্রত্যাশিতভাবে একাই পেয়ে গেলাম উনাকে। একাকি দাড়িয়ে ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলেন উনি। আমি সামনে গিয়ে দাড়াতেই উনার হাসোজ্জল মুখ মেঘে ঢেকে গেল। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলেন। আমি উনার হাতের বাহু টেনে ধরলাম। কান্না জড়ানো কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম, “সরি”। কিন্তু উনি? এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন। আমি জোর গলায় বললাম, ” সুমনা আন্টি আপনাকে খুজছে।” উনি শুনলেন কিনা জানিনা। একটিবার পেছন ফিরে দেখলেনও না।

আমি উপলব্ধি করলাম আমার গাল বেয়ে অশ্রুপাত হচ্ছে। এতোটা কষ্ট এর আগে কখনো হয়নি। কি দোষ ছিল আমার? কেনো এভাবে শাস্তি দিচ্ছেন উনি? আমি তো নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। সরি বলেছি। যদিও তখন এইটা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলনা। উনি যেটা করতে যাচ্ছিলেন সেটাও তো ভুল। তাহলে উনারও কি আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ নয়? ভুল কি শুধু আমি একাই করেছি? উনি নিজেও তো করেছেন। তাহলে কিসের এতো অহংকার উনার। আমি সুইমিংপুলের ভেজা ফ্লোরই বসে পড়লাম। টলটলে পানি পানিতে পা ভিজিয়ে কাদছি। এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকল,

“তারি আপু, তুমি কি কর?”

আমি চট করে চোখের জল মুছে পেছনে তাকালাম। আরিশা কোমরে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটা প্রচুর কিউট। বয়স ৮/৯ হবে। নিহার পিচ্ছি কাজিন। এটুকু বয়সেও কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল মেয়েটার। ফরসা মুখে গাল দুটো টুকটুকে গোলাপী। ঠিক যেন সাদা পুতুল। দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। আমি আরিশার একহাত ধরে কাছে আনলাম। কোলের উপর বসিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে বললাম,

“আনিশা পরি, কেমন আছো তুমি?”

“আমি ভালো আছি। কিন্তু তুমি স্যাড কেনো তারি আপু?”

“কই স্যাড না তো? আমি তো খুব হ্যাপি! এইযে আমি হাসছি।”

আরিশা অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। ঘন পলক ঝাকিয়ে বলল,

“আচ্ছা বুঝেছি। এখন বলো তো ঈশান কোথায়?”

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “ঈশান? ঈশানকে তুমি কেনো খুজছো বেবি?”

আরিশা ভ্রু কুচকে বলল, “ঈশান ইজ এল্ডার দেন ইউ। ইউ শুড কল হিম ভাইয়া। নট অনলি ঈশান।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। আমতা-অমতা করে বললাম, ” হ্যা। ঠিকাছে। কিন্তু ঈশান তো তোমারও বড়। তুমি ভাইয়া বলছো না কেনো?”

আরিশা আমার কোল থেকে উঠে পরল। কোমরে হাত রেখে বলল, ” তুমি আর আমি কি এক হলাম? ঈশান ইজ মাই ফিয়্যান্সে। আই ক্যান কল হিম ঈশান।”

আমি চোখ গোল করে বললাম,” মানে? ঈশান তোমার ফিয়্যান্সে?”

“হ্যা! মাম্মা বলেছে আমি যদি ম্যাথ এক্সামে নাইন্টি পারসেন্ট মারকস পাই, তাহলে ঈশানের সাথে আমার বিয়ে দিবে। ”

কথাটা শুনে আমার হেচকি উঠার উপক্রম। এই ইঁচড়েপাকা মেয়ে বলে কি? আর ওর মা-ই বা এটা কেমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে মেয়েকে? অদ্ভুত! আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,

” কিন্তু আরিশা বেবি! ঈশান তো তোমার ভাইয়া। ভাইয়াকে কি কেউ বিয়ে করে?”

আরিশা মাথা দুলিয়ে বলল, ” করাই যায়! ঈশান তো আমার কাজিন ভাইয়া। মানুষ তো কাজিনকে বিয়ে করেই। মাম্মা এন্ড বাপিও তো কাজিন ছিল। বাট দে আর কাপল নাউ। আমি আর ঈশানও কাপল হয়ে যাবো। ভেরি সুন! তোমাকেও দাওয়াত দিবো বিয়েতে। আমি আমার পারপেল লেহেঙ্গাটা পড়বো। তুমি তো খুব ভালো মেহেন্দি দিতে পারো রাইট? আমাকে বিয়ের দিন দিয়ে দিও?”

আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। আরিশা বলল,

“আচ্ছা এখন বায়। ঈশানকে খুজে দেখি। আমার জন্য চকলেট আনতে বলেছিলাম। যদি না আনে, তাহলে আজকেই ব্রেকআপ।”

লাস্ট লাইনটা শুনে আমার হেচকি উঠেই গেল। মাথায় হাত দিয়ে উচ্চারণ করলাম, ” ষাট ষাট! বালাইষাট! ”

নিহার বেডরুমের বন্ধ দরজার সামনের রুমটায় গোল হয়ে সোফায় বসে আছি আমরা, মানে মেয়েরা। সবাই গল্পে মশগুল থাকলেও আমি নিশ্চুপ। আমাকে নিয়ে কারো তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। তবে নিহা থাকলে এভাবে অবহেলায় পড়ে থাকতে পারতাম না আমি। ঠিকই আমার মনোরঞ্জনের চেষ্টায় নানান কৌশল খাটাতো সে। কিন্তু আজ নিহা ব্যস্ত, বড্ড ব্যস্ত। বাড়িজুড়ে এমন এলাহি অনুষ্ঠানের মধ্যমণি তো সেই-ই।

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আগে নিহাকে মেকআপ করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর সেই মহান কার্য এখনো সিদ্ধি লাভ করেনি। নিহা কিভাবে এতোক্ষণ ধরে শান্ত হয়ে বসে আছে কে জানে? আমার তো অসহ্য লাগছে। তার উপর আবার মেয়েদের ঘ্যানঘ্যানানি। আমার বিরক্তির মাত্রা তীব্র করে তুলছে। সামিরা নামের মেয়েটি আমার মাথা অর্ধেক খেয়ে নিচ্ছে। ঈশানের কথা আমি ভুলে থাকতে চাইলেও এই মেয়েটার জন্য একদমই পারছি না।

প্রত্যকটা বাক্যে কমপক্ষে তিন চারবার করে ঈশানের নাম নিচ্ছে সামিরা। আর বাকিরা খুব মনোযোগ দিয়ে গিলছে তার ফালতু বকবকানি। আচ্ছা ক্রাশ খেয়েছিস ভালো কথা, তাই বলে মুখে এইভাবে খই ফুটতে হবে? মানুষ তো তোকে ছেছড়া ভাববে রে! ঈশানের সাথে সেল্ফি তুলে ইন্সট্রাগ্রামে পিক দিয়েছে। ওই পিকে আবার ঈশান লভ রিয়েক্ট দিয়েছে। এই নিয়ে চলছে আলোচনা।

হঠাৎ মাহাথি ভাইয়ার আগমন ঘটল। উনি সামিরাকে ডাকতে এসেছেন। ঈশান নাকি সামিরাকে খুজছে। কথাটা শুনে সামিরার মুখে পূর্ণিমার চাদের মতো হাসি ফুটে উঠলেও আমার বুকের মধ্যে যেন আগুন জ্বলে উঠল। অন্যসময় হলে এ নিয়ে মাথা ঘামাতাম না আমি। কিন্তু এখন এই সামান্য বিষয়টাও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। যেখানে আমি সকাল থেকে যন্ত্রণায় ছটফট করছি, সেখানে ঈশান কিনা..। প্রচন্ড রাগ লাগছে আমার।

সামিরার মতো মডেল টাইপ সুন্দরী মেয়ে উনার পেছনে ঘুরছে, এতে নিশ্চয়ই উনি খুব আনন্দিত। মনে লাড্ডু ফুটছে! এতো এতো সুন্দরী মেয়ের ভীড়ে আমার কথা মনে না থাকাটাই তো স্বাভাবিক। আমি তো ওদের কাছে ক্ষ্যাত,ব্যাকডেটেড। উনি যখন আমাকে অবহেলা করছে আমি কেনো শুধু শুধু উনার জন্য কষ্ট পেয়ে মরবো? আমারও উচিৎ উনাকে ভুলে থাকা। যেভাবেই হোক ভুলে থাকা।

নিহার বেডরুমের দরজা এতোক্ষণে খোলা হয়েছে। আমি সুযোগ পেয়েই ঢুকে পড়লাম। বেশ কিছু সময় ধরে নিহার সাথে দেখা হচ্ছে না। মনটা আনচান করছিল। আমি ঘরে ঢুকতেই নিহা সর্বপ্রথম যে বাক্যটি উচ্চারণ করল,

“দোস্ত, দেখতো আইল্যাশ টা ঠিক আছে কিনা। চোখে কেমন জ্বালাপোড়া করছে।”

আমি নিহার আইল্যাশ ঠিক করতে এগিয়ে গেলাম। মনে মনে একটা বিষয় চিন্তা করছি, নিহাকে কালরাতের ঘটনাটা জানাবো কিনা। আমার জানানোর প্রয়োজন হলো না। নিহা আমার মনখারাপের কারণ নিজে থেকেই জানতে চাইল। আমিও সংকোচ কাটিয়ে বলে ফেললাম। সব ঘটনা শোনার পর নিহা যেই কথাটা আমায় বলল, সেটা শোনার জন্য আমি মানসিকভাবে একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। নিহা বলল,

“সবই বুঝলাম.. কিন্তু তুই চড় মারতে গেলি কেনো?”

নিহার কথা শুনে আমি চোখ বড় করে বললাম, ” এইটা ছাড়া আমার আর কি উপায় ছিল? তুই আমার জায়গায় থাকলে কি করতি শুনি?”

নিহা বলল, ” না ঠিকাছে। আমি তোর সিচুয়েশনটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তাই বলে চড় মারাটা উচিৎ হয়নি। একটু বেশিই হয়ে গেল না?”

“আর উনি যেটা করেছে সেটা কি কম?”

“দেখ দুজনেরই ভুল আছে। আমি কাউকেই সাপোর্ট করছি না”

“দুজনের ভুল আছে মানে? তুই আমার ভুলটা কোথায় দেখলি?”

“চড় মারাটাই তোর একটা বিরাট ভুল। এবার ঈশান ভাইয়া যে তোর সাথে কথা বলছেন না, যদি ব্রেকআপ করে? তখন কি করবি তুই?”

নিহার প্রশ্নে আমার অন্তরাত্মা কেপে উঠল। এইটা তো আমি চিন্তাই করিনি। উনি কি সত্যিই আমার সাথে ব্রেকআপ করবেন? আমি বিচলিত হয়ে বললাম,

” উনি ব্রেকআপ করবেন? সামান্য একটা চড়ের জন্য ব্রেকআপ?”

” করতেও পারে। মানুষের মন বদলাতে কতক্ষণ? ”

“নিহা তুই এই কথা কেনো বলছিস? তুই তো ঈশানকে খুব ভালো করে চিনিস। উনি কি সত্যিই ব্রেকআপ করবে? বল না!”

“এক্সপেক্টেশন অনুযায়ী যদি সব হতো, তাহলে তো ভালোই ছিল? আচ্ছা ঈশান ভাইয়া কালরাতে যেটা করলেন, সেটা কি প্রত্যাশিত ছিল? কিন্তু হয়েছে। তেমনি আরো অনেক কিছুই হতে পারে। আগে থেকে কি করে বলি?”

আমার মাথায় চিন্তা বাবাজি বেশ ভালোমতোই চেপে বসল। নিহা খুব ভুল কিছু বলেনি। মানুষের মন বদলাতে কতক্ষণ?

অস্থিরভাব নিয়ে বাগানে পায়চারি করছিলাম। হঠাৎ মেইন গেইটের সামনে একটা সি এন জি এসে থামল। সি এন জি থেকে নামছে ভাইয়া, মা আর বুড়িটাও। আমি সবাইকে একসঙ্গে দেখে চমকে উঠলাম। ভাইয়া তো সকালেও বলেছিলেন, বিয়েতে নাকি কেউ আসবে না। বুড়ির নাকি শরীর খারাপ। তাহলে এখন কি বুড়ি সুস্থ হয়ে গেছে? আমার মাথায় পাহাড় সমান চিন্তা ভর করল। ঈশানের সাথে যদি কারো একবার দেখা হয়ে যায়, তাহলে যে সর্বনাশ। দুশ্চিন্তায় যখন আমি বিভোর, ঠিক সেই সময় ভাইয়া উচ্চারণ করলেন,

” আরে ঈশান? তুমি এখানে?”

আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম। ঈশান দ্রুতগতিতে স্টেজের পেছন দিকটায় চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ভাইয়ার ডাকে জোরপূর্বক থেমে যেতে হল উনাকে। ভাইয়া হাসিমুখে ঈশানকে আলিঙ্গন করলেন। পিঠ চাপড়ে বললেন,

” তুমি এখানে কি করছো ভাই?”
🍂

চলবে

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৭
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশান অপ্রস্তুত ভাবে হাসলেন। একহাতের সাথে আরেকহাত ঘষতে ঘষতে বললেন,”বিয়ে তো আমার ফ্রেন্ডের।”

তারিফ ভাই ভ্রু কুচকে মাথার এক সাইড হালকা চুলকে বললেন, ” কোন ফ্রেন্ড? তোমার জামিন করিয়েছিল যে সে নাকি?

ঈশান মুখে হাসি রেখেই মাথা ঝাকিয়ে “হ্যা” উচ্চারণ করলেন। তারিফ ভাইয়া উৎফুল্লকর হাসি দিয়ে মায়ের দিকে তাকালেন। ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

” বাহ! হোয়াট আ কো এক্সিডেন্ট। আমি তো ভাবতেই পারছি না। নিহার তাহলে কপাল আছে। এমন উদারমনের মানুষের সাথে বিয়ে হওয়া কি কম সৌভাগ্যের ব্যপার? আচ্ছা ঈশান ছেলের নামটা কি যেন?”

ঈশান এক আঙুল কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “সাফিন!”

তারিফ ভাইয়াও উচ্চারণ করলেন, “সাফিন, সাফিন!”

অতঃপর ঈশান মায়ের কাছে এসে নিচু হয়ে মায়ের ডান হাত থেকে বড় ব্যাগটা নিলেন আর বললেন,
” আন্টি আমি নিচ্ছি এটা।”

মা অমায়িক হাসি দিয়ে ঈশানের দিকে ব্যাগটা এগিয়ে দিলেন।ঈশান ভাইয়ার দিকে ঘুরে ভাইয়ার হাতের বড় গিফটের প্যাকেট টাও নিলেন। বললেন, ” এগুলো আমি রাখছি তোমরা সামনে চলো।”

বুড়ির কাছে এসে গা ঘেষে দাড়ালেন ঈশান। নিচু হয়ে বললেন, “দাদী আস্তে আস্তে আসুন। এখন শরীরের কি অবস্থা আপনার?”

বুড়ি বিড়বিড় করে ঈশানকে কিছু বলছিল। আর ঈশান নিচু হয়ে শুনছিল। আমি দূর থেকেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঘটনা দেখলাম। সামনে যেতে ইচ্ছে হলো না। আমি সামনে গেলেই ঈশানের হাসিমাখা মুখটা গম্ভীর না হয়ে যায়।

.

মোহনা আন্টিকে আজ অত্যন্ত সুন্দর লাগছে। বেশ জাকজমকপুর্ণভাবে সেজেছেন উনি। রেড কালার সিল্কের শাড়ির সাথে কলারওয়ালা গোল্ডেন ব্লাউজ। তবে স্লিভলেস। এই মহিলাকে আমি স্লিভলেস ব্লাউজ ছাড়া অন্যকোনো ব্লাউজ জীবনে পড়তেই দেখলাম না। কিন্তু মনে হয় যেন এভাবেই উনাকে সবথেকে বেশি মানায়। ঠিক যেন বলিউডের কোনো নায়িকা। আমি মোহনা আন্টির পাশে গিয়ে বসলাম। আন্টি আমায় দেখে আনন্দের হাসি দিলেন। ব্রাউনিশ চুলগুলো এক সাইডে সরাতে সরাতে বললেন, “কেমন আছো তারিন?”

আমার বলতে ইচ্ছে হল, ” আপনার গুণধর ছেলের জন্য ভালো থাকা যায়?” তবে বললাম না। ঠোট প্রসারিত করে হাসলাম। বললাম,” ভালো আছি”
কিছুসময় মোহনা আন্টির সাথে গল্পগুজব হল। কালো করে টি শার্ট পরিহিত একজন মহিলা হঠাৎ মোহনা আন্টিকে ডাকলেন। ডেকেই কুশল বিনিময় শুরু করলেন। আমি উঠে যেতে চাইলাম। কিন্তু একটা কথা শুনে থামতে হল আমায়। কালো করে মহিলাটি জিজ্ঞেস করছে, “আপনার ছেলেটা কই ভাবী?”

মোহনা আন্টি স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন,” ছেলে তো বান্দরবান। ট্যুরে গেছে।”

অমনি কোথা থেকে সুমনা আন্টি মানে নিহার মা এসে বলে উঠলেন, “এই মোহনা! কি আজগুবি কথা বলছো? ঈশান বান্দরবান কখন গেলো? ঈশান তো আজ সারাদিন এখানেই।”

আমি সুমনা আন্টিকে তুমুল গতিতে হাত ইশারা করে থামানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি বলেই দিলেন। মোহনা আন্টি সুমনা আন্টির কথা শুনে বোকা বনে গেলেন। বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ” কি বলেন ভাবি? ঈশান এখানে আসবে কোথ থেকে? ও তো বান্দরবান। ”

সুমনা আন্টি সামনের দিকে ইশারা করে বললেন, “ওইতো ঈশান!”

ঈশান সুমনা আন্টিকে হাত নাড়িয়ে না করছিলেন। কিন্তু মোহনা আন্টি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সেই “না” টা হয়ে গেল” হাই মম!”

মোহনা আন্টি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। ছেলেকে দেখে পিলে চমকে উঠেছে উনার। আমি সুমনা আন্টির কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম,

“আন্টি এটা আপনি কি করলেন? মোহনা আন্টিকে বলে দিলেন কেনো?”

সুমনা আন্টির এতোক্ষণে হুশ ফিরল। হালকা জিভ কেটে বললেন, ” ইশশ! ভুলেই গিয়েছিলাম। ঈশান তো বলতে নিষেধ করেছিল না? আরে… কাজের মধ্যে এতো কথা মনে থাকে বল? তুই তো আমার লক্ষি মা। একটু ম্যানেজ করে নে। প্লিজ!”

আমার থুতনিতে স্পর্শ করে কথাটা বলে সুমনা আন্টি চলে গেলেন। আমি মাথায় হাত ঠেকালাম। আসল সমস্যাটা যদি সুমনা আন্টি জানতো, তাহলে এভাবে বলতো না। আমি ঈশান আর মোহনা আন্টির দিকে নজর দিলাম। মোহনা আন্টি ঈশানের দুই কাধ স্পর্শ করে বললেন,

“কখন এসেছিস তুই?”

ঈশান মাথার পেছন দিকটা চুলকে বলে উঠলেন, ” আজ সকালেই।”

“হঠাৎ? কিছু না বলে আসার কারন কি?”

“নিহার বিয়েটা মিস করতে চাইনি। তাই আর কি।”

মোহনা আন্টি ঈশানের বাহুতে আঘাত করে বললেন, “তাহলে আমাকে জানাস নি কেনো?”

ঈশান আঘাতকৃত স্থান ঘষতে ঘষতে বলল, “সারপ্রাইজ!”

.

আজকে সামিরার পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে আমার খুব একটা ভালো লাগছে না। এই মেয়ের শাড়ি পড়ার ধরণটা মোটেও শালীন না। যদিও সামিরা সবসময় এমন ধাচের জামা-কাপড়ই পড়ে। তবে আজকের ব্যাপারটা একটু বেশিই চোখে লাগছে। আর সবথেকে বেশি চোখে যেটা লাগছে তা হলো সামিরার ঈশানের সাথে মেলামেশা। উঠতে ঈশান, বসতে ঈশান, প্রত্যেকটা কাজকর্মেই শুধু ঈশান আর ঈশান। এই মেয়েকে কলেজের প্রথমদিন থেকেই আমি অপছন্দ করি। আমার জানামতে ঈশানও সামিরাকে অপছন্দ করতো।তাহলে এখন হঠাৎ এতো ঘনিষ্ঠতার কারণ কি? সব আমাকে জ্বালানোর ফন্দি নয়তো?

বরযাত্রীর সামনে লাল ফিতা বেধে দাড়িয়ে আছি সবাই। আমি সামনে দাড়াতে চাইনি, কিন্তু মেঘলার জোরাজোরিতে সামনেই দাড়াতে হল। সামিরা আমার বাম পাশটায় দাড়িয়ে। ওর হাতে শরবত। মেঘলার হাতে বাটিভর্তি রসগোল্লা। এসব দিয়ে বরযাত্রীকে বরণ করা হবে। মেঘলা কাটাচামচ দিয়ে একটা রসগোল্লা তুলে সাফিন ভাইয়ার মুখের সামনে ধরলো। সাফিন ভাইয়া হা করতেই মেঘলা হাত গুটিয়ে নিল। বলল,

“আগে তো পারিশ্রমিক দিতে হবে। তারপরেইনা মিষ্টিমুখ”

রিফাত ভাইয়া তাচ্ছিল্যের সাথে বলল, “পারিশ্রমিক কিসের?”

সামিরা বলল,” বাঃ রে! এতো কষ্ট করে আয়োজন সাজিয়েছি। মিষ্টি, শরবত বানিয়েছি। আর আমাদের পারিশ্রমিক দিবেন না?”

ঈশান বললেন, “আয়োজন তোমরা সাজাও নি। সাজিয়েছে ডেকোরেটরটা। আর মিষ্টি শরবত এসব কিছুই তোমরা বানাও নি। শুধু হাতে নিয়ে দাড়িয়ে থাকলেই পারিশ্রমিক পাওয়া যায়না। যারা আসলেই পরিশ্রম করেছে পারিশ্রমিক কেবল ওরাই পাবে। এবার এসব ঝামেলা সরাও। ভিতরে আসতে দাও নাহলে হামলা হবে।”

ঈশানের সাথে তাল মিলিয়ে সবাই আওয়াজ তুলল, “হ্যা। হ্যা।হ্যা।”

মেঘলা বলল, “ওয়েট, ওয়েট। অবশ্যই শরবত আমি বানিয়েছি। আর মিষ্টি আমাদের তারু বানিয়েছে। আর এই ফিতা, ফুল এইসব কিছু আমরাই অ্যারঞ্জ করেছি। একটা ছেলেও আমাদের দলে আসেনি। মাহাথি ভাইয়াও হেল্প করেনি। আর সেটাও আপনার জন্যই ঈশান ভাইয়া। ”

সামিরা ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “হ্যা। আর তাছাড়া এটাও তো ঠিক না ঈশান। আপনার আমাদের সাইড নেওয়া উচিত। আর আপনি বরপক্ষের সাইড নিচ্ছেন?”

সাফনান ভাইয়া বললেন,” নিবে না কেন? আগে ফ্রেন্ডশিপ তারপর অন্যকিছু।”

মেঘলা হাত ঠেকিয়ে বলল,” সে যাই হোক। আমরা ন্যায্য পাওনা না পাওয়া পর্যন্ত গেইট ছাড়ছি না।”

ঈশান বললেন, “এক মিনিট, মিষ্টি কে বানিয়েছে? ও?”

ঈশান আমার দিকে না তাকিয়েই আঙুল ইশারা করলেন। মেঘলা সামনে চুলগুলো কানে গুজে মুচকি হেসে বলল,

“হুম!”

ঈশান বললেন, “ব্যস! এটা খাওয়ার যোগ্য হবে কিনা সন্দেহ আছে। এসব থার্ড ক্লাস মার্কা জিনিস খেয়ে পেটখারাপ করার প্রশ্নই আসেনা। ”

কথাটা যেন আমার বুকে তীরের মতো আঘাত করল। চোখ টলমল হয়ে আসল আমার। রিফাত ভাইয়া বিষয়টাকে মজা হিসেবে নিয়ে হেসে উড়িয়ে দিলেন। মেঘলা মুখ কুচকে বলল,

“মানে? থার্ড ক্লাস জিনিস?”

ঈশান বললেন, “নো ডাউট।”

আমি ভ্রু কুচকে ঈশানের দিকে তাকালাম।সামিরা ঠোট বাকা করে হাসছে। ঈশানের কথাটায় বেশ মজা পেয়েছে সে। সাফিন ভাইয়া ইতস্তত হয়ে বললেন,

“আচ্ছা এসব কি কথা বলিস ঈশান? ঘরে বানানো মিষ্টি থার্ডক্লাস হবে কেনো? বরং বাহিরে থেকে আনা মিষ্টি থার্ডক্লাস। এটাতো ফার্স্ট ক্লাস। আমার তো এখনি খেতে ইচ্ছে করছে। এই তোমাদের কত পারিশ্রমিক লাগবে? বলে ফেলো বলে ফেলো!”

আমার কান্না চলে আসার আগেই আমি ভীড় ঠেলে দৌড়ে চলে আসলাম সেখান থেকে। সবাই কৌতুহল নিয়ে আমাকে দেখছিল। কেউ কেউ হয়তো ডাকছিল। কিন্তু আমি তোয়াক্কা করলাম না। স্টেজের পেছনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে নিরবে কেদে যাচ্ছি। ঈশান এইভাবে ইনসাল্ট করল আমাকে? তাও আবার সামিরার সামনে? প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার। ভুল তো আমারই। ঈশানের সাথে সম্পর্কে জড়ানোটাই আমার সবথেকে বড় ভুল। ওমন আবেগমাখা চিঠি, মিষ্টি মিষ্টি বুলি সবাই আওরাতে পারে। কিন্তু সত্যিকারভাবে কয়জনই বা ভালোবাসতে পারে? শুধুমাত্র একটা চড়কে কেন্দ্র করে উনি আমার সাথে যা করছেন, সত্যিকারের ভালো বাসলে কখনোই এমনটা করতে পারতেন না। উনার মতো ছেলের জন্য সামিরাই ঠিকাছে। আমি না, আমি তো থার্ড ক্লাস। তাহলে ফার্স্ট ক্লাস নিয়েই ভালো থাকুক। হঠাৎ তারিফ ভাইয়ার হু হা হাসির আওয়াজ শুনলাম। পেছনে উকি মেরে তাকিয়ে দেখলাম সাফিন ভাইয়ার সাথে কোলাকোলি করছে তারিফ ভাইয়া। ঈশান পাশেই দাড়িয়ে আছে। তারিফ ভাইয়া সাফিন ভাইয়ার কাধে হাত রেখে বলছেন,

বন্ধু হিসেবে তুমি একদম পারফেক্ট। খুব ইচ্ছা ছিল তোমাকে দেখার। একটা মানুষ এতোটা নিঃস্বার্থভাবে কারো উপকারে আসতে পারে? জিও ভাই জিও!

সাফিন ভাইয়া বোকার মতো ঈশানের দিকে তাকালেন। আবার তারিফ ভাইয়ার দিকে তাকালেন। বললেন,

“কি এমন করলাম ভাই?”

তারিফ ভাই বললেন,” এই দেখো! আবার জিজ্ঞেস করে কি করেছে। এতোগুলো টাকা দিয়ে বন্ধুকে হেল্প করলে। জামিন করিয়ে আনলে। এটা কি কম বড় উপকার?”

সাফিন চোখ বড় করে তাকালেন। ঈশান সাফিনের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

“ও আসলে এতো মানুষের হেল্প করে, কয়জনের কথাই আর মনে থাকে? তাই হয়তো ভুলে গেছে।”

সাফিন বললেন, “না রে ভুলি নাই। আমার স্পষ্ট মনে আছে। তোরে আমি কবে টাকা ধার দিলাম?উল্টা তুই আমারে চারমাস আগে দশ হাজার টাকা ধার দিছিলি, ওইটাই শোধ দিতে পারলাম না বেটা। মজা লস না?”

ঈশান সাফিন ভাইয়ার পিঠ খামচে ধরলেন। তারিফ ভাইয়া ভ্রু কুচকে বললেন,” মানে?”

ঈশান জোড়পূর্বক হাসলেন। বললেন, “আসলে ও খুব ভালো মানুষ তো। শো অফ একদম পছন্দ করে না। তাই অস্বীকার করছে। ”

তারিফ ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে হাসলেন আর বললেন, “ও!এই ব্যাপার? এইটা তো আরো ভালো গুণ।”

বলেই সাফিন ভাইয়ের কাধে আঘাত করলেন তারিফ ভাইয়া।

সাফিন ভাইয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে তাকালেন। বললেন,

“ওই তুই কি আমারে পচাইতাছোস?”

সাফিন ভাইয়ার কথা শুনে আমার হাসি পাওয়ার কথা। কিন্তু আমি হাসলাম না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

.

সামিরা আর ঈশান পাশাপাশি চেয়ারে বসে তখন থেকে ফিসফাস করছে। আমি ওদের থেকে অনেকটা দূরে বসে আছি বিধায় ওদের কথা আমার কান অবধি পৌছাচ্ছে না। ঈশানকে কিছুটা অপ্রস্তুত দেখালেও সামিরাকে দেখে মনে হচ্ছে আজকে তার ঈদের দিন। প্রায় প্রত্যেকটা কথা বলতে বলতেই ঈশানের হাতের উপর হাত রাখছে। মাঝে মাঝে তো কাধও খামচে ধরছে। সাথে উদ্ভট হাসির বহর তো আছেই। ঈশানকে দেখে মনে হচ্ছে সামিরার কথাগুলো উনি মনোযোগ দিয়ে শুনছেন না, আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুজছেন । কি খুজছেন কে জানে? হঠাৎ রিফাত ভাইয়া আমার পাশের চেয়ারটায় বসলেন। উনার উপস্থিতি টের পেয়ে আমি সোজা হয়ে একটু সংকুচিত ভাবে বসলাম। রিফাত ভাইয়া বললেন,

“কি ব্যপার তারিন? একা একা বসে আছো যে?”

আমি উত্তরে মিষ্টি করে হাসলাম। রিফাত ভাইয়ার হাতে দুটো মাটির ওয়ানটাইম গ্লাস। একটা গ্লাস উনি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “খাবে?”

আমি অনাগ্রহ দেখিয়ে “না” বললাম। উনি কিছুটা জোরপূর্বক আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ” আরে খাও খাও! ভালো জিনিস।”

আমি অগত্যাই হাতে নিলাম। খাওয়ার ইচ্ছে একদমই নেই। আরেকবার সামনের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলাম সামিরা ঈশানের মাথার চুল ঝেড়ে দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমার ভেতরটায় যেন আগ্নেয়গিরির মতো অগ্নুৎপাত শুরু হল। হাতের গ্লাসটা শক্ত করে চেপে ধরে দাত কিড়মিড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম। রিফাত ভাইয়া আমার অবস্থা খেয়াল করে বললেন,” এ্যানিথিং রং?”

আমি আড়চোখে রিফাত ভাইয়ার দিকে তাকালাম। গ্লাসের শরবতটা একটানে শেষ করে উনার হাতে দিয়ে বললাম,

“আরো এক গ্লাস পাওয়া যাবে?”

উনি উৎসাহ নিয়ে হাসলেন। বললেন, “অবশ্যই।”

নিজের গ্লাসটাও আমায় দিয়ে দিলেন। আমি এবারও এক টানে সম্পুর্ন টা শেষ করলাম। বেশ ভালোই লাগছে। মাথাটা হালকা ঘুরছে, মনে হচ্ছে যেন হাওয়ায় ভাসছি আমি। ইশশ কি চমৎকার অনুভূতি! আমি রিফাত ভাইয়ার দিকে ঘুরে বসলাম। দাত কেলিয়ে হাসতে হাসতে উনার দুই গাল টিপে দিয়ে বললাম,

“আমার কিউট ভাইয়া! আরো এক গ্লাস হবে?”

উনি তো হেসে কুটিকুটি। পায়ের উরুতে করাঘাত করে বললেন,

“ডেফিনেটলি। তুমি বসো। আমি নিয়ে আসছি।”

রিফাত ভাইয়া উঠে যেতেই চেয়ারে কারো ছায়া দেখতে পেলাম। চোখটা হালকা ডলে সামনের দিকে তাকাতেই ঈশানকে খুজে পেলাম। রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। আমি গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে হেসে দিলাম। ঈশান আমার এক হাত ধরে টেনে দাড় করালেন আমায়। আমার মনে হল হাতটা যেন ভেঙেই যাচ্ছে। এতো শক্ত করে কেউ ধরে? ঈশান ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,

“কি খেয়েছো তুমি?”

আমি ঘাড় বাকা করে তাকালাম। ভ্রু কুচকে বললাম,

“আপনার কি তাতে? আপনি আপনার মতো থাকেন না। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন। যান তো সামিরার কাছে যান। আপনার থেকে রিফাত ভাইয়া অনেক ভালো।”

আমি রিফাত ভাইয়াকে জোর গলায় ডাকলাম। হালকা টলতে টলতে রিফাত ভাইয়ার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম। ঈশান আমার হাত আরেকবার টেনে ধরলেন। আমি ঝটকা মেরে উনার হাত সরাতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। বরং মনে হল, শরীরের অর্ধেকটা শক্তি অপচয় করলাম। ঈশান আচমকা আমায় কোলে তুলে নিলেন। আর আমি খিলখিল করে হেসে দিলাম। হাসতে হাসতে উনার গলার পেছনে হাত বাধলাম। উনার দিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে বললাম,

আচ্ছা আপনি এতো কিউট কেনো? একটা কিসি দেই?

ঈশান দাত কিড়মিড়িয়ে বললেন, শাট আপ।

আমাকে উনি একটা ছোট্ট রুমে নিয়ে আসলেন। ধাম করে বিছানার উপর আছাড় দিয়ে ফেললেন। আর তারপর? ঘরের দরজা ঠাস করে বাহিরে থেকে আটকে দিলেন। তাই দেখে আমি দৌড়ে দরজার কাছে গেলাম৷ দরজায় জোরে জোরে চপোটাঘাত করতে করতে বললাম,

” এই আপনি আমায় বন্দী করে দিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? দরজা খুলুন বলছি! প্লিজ খুলুন! ”

ঈশান আমার কথার কর্ণপাত করলেন না। চলে গেলেন। আর আমি হতাশ হয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম।এতো খারাপ কেনো উনি? খুব পচা। আমি রিফাত ভাইয়ার সাথে একটু কথা বললাম বলে এমন করলেন আমার সাথে? আর উনি যে সারাদিন ধরে সামিরার সাথে ঢলাঢলি করছেন? সেটা কিছু না? নিজের বেলায় ষোলআনা আর আমার বেলায় কাচকলা? না। তা হবে না তা হবে না। আমি হতে দিব না। ওই সামিরা শাকচুন্নিকে আমি উচিৎ শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব। কিন্তু তার আগে আমাকে এই বন্দী দশা থেকে মুক্ত হতে হবে। কিভাবে মুক্ত হই? জানালার কাছে গিয়ে উকি দিলাম। যদি সাহায্যের জন্য কাউকে পাওয়া যায়। বলবো দরজাটা খুলে দিতে। প্রত্যাশিতভাবে আরিশাকে দেখলাম মাথার লম্বা ঝুটি দুলিয়ে দুলিয়ে হেটে যাচ্ছে। আমি আরিশাকে ডাকলাম।

” আরিশা বেবি?”

আরিশা থেমে দাড়ালো। এদিকে ওদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খুজছে সে। আমি আবার বললাম,

এইযে এদিকে দেখো! আমি তারি আপু।

আরিশা জানালা বরাবর তাকাল। মুচকি হেসে ছোট্ট হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই তারি আপু!”

এদিকে একবার এসো।

আরিশা জানালার কাছে আসল। আমি বললাম,

আরিশা! একটা হেল্প করতে পারবে?

আরিশা ভ্রু কুচকে ঠোটের কোণে আঙুল রেখে বলল,

হেল্প? ওকে। আই ক্যান হেল্প ইউ। বাট ইউ হেভ টু গিভ মি দ্যা রিটার্ন গিফট।

রিটার্ন গিফট?আচ্ছা আমি তোমাকে চকলেট দিবো। আগে তুমি দরজাটা একটু খুলে দাও?

আরিশা বলল, “উহুম! আগে চকলেট দাও।”

আমি চোখ সরু করে তাকালাম।
🍂

চলবে

তি আমো পর্ব-১৪+১৫

0

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৪
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ভয়ে চুপসে আছি, ফোন নম্বর বলা তো দূরে থাক গলা দিয়ে আওয়াজটাও বের হচ্ছে না আমার। এদিকে হলুদ শার্টের ছেলেটা আমার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ভ্রু কুচকে তার বসের দিকে তাকাল। তাকিয়ে বলল,

ভাই! ম্যাডাম তো কথা কয়না।

নীল জ্যাকেটের ছেলেটা আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি আরো ভয়ে কাপতে লাগলাম। তাই দেখে ছেলেটা হাসল। হলুদ শার্টের ছেলেটার গালে চড় দিয়ে বলল,

কথা বলবে কিভাবে? তোকে পছন্দ হয়নি। চল হাট।

নীল জ্যাকেটওয়ালা কলার ঠিক করে আমার কাছে এগিয়ে আসল। আমার কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। ভয়ে অস্থির আমি। কিন্তু এতোটা ভয় পেলে তো চলবে না। শক্ত হাতে সবটা সামাল দিতে হবে। আমি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম। নিজের মনে সাহস যুগিয়ে বললাম,

দেখুন। আমার পথ ছাড়ুন। আমাকে যেতে হবে।

পথ কি ধরে রেখেছি নাকি? অবশ্যই ছেড়ে দিবো। শুধু নম্বরটা বল, ছেড়ে দিচ্ছি।

আমি সুযোগ বুঝে পাশ কাটিয়ে দৌড় লাগাতে চাইলাম তখন ছেলেটা হাত ঠেকিয়ে আটকালো। সম্পুর্ণ ডান হাতটা দিয়ে আমার গলা বরাবর আড়াআড়িভাবে ঠেসে ধরল। আমি চিৎকার দেওয়ার আগেই নিহা আচমকা প্রকান্ড শব্দের চপোটাঘাত করলো ছেলেটির গালে। নিহার হঠাৎ আগমনে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম আমি। স্বস্তি নিয়ে নিহার কাধ চেপে ধরলাম। বিস্ফোরিত চোখে একবার নিহার দিকে আর একবার ছেলেটার দিকে তাকালাম। নিহা রাগে মুখ বিকৃত করে বলল,

আর কোনোদিন যদি দেখি রাস্তাঘাটে মেয়েদের এইভাবে হ্যারেস করতে তাহলে তোর চৌদ্দপুরুষের নাম ভুলিয়ে তোকে জেলের ঘানি টানাবো আমি। মনে থাকে যেন। ফালতু একটা।

পেছন থেকে এক গাদা সাঙ্গু পাঙ্গু হৈহৈ করে ছুটে আসতে নিচ্ছিল। কিন্তু নীল জ্যাকেটওয়ালার হাতের ইশারা পেয়ে থেমে যেতে হলো তাদের। ছেলেটা রক্তাক্ত চোখ আর কম্পিত দেহ নিয়ে গালে হাত চেপে দাড়িয়ে ছিল। নিহা আমায় টেনে নিয়ে আসল চোখের পলকেই। আমি নিরব দর্শকের মতো শুধু ঘটনা দেখে গেলাম। কলেজ গেইটের সামনে আসতেই আমি থমকে দাড়ালাম। নিহার হাত খামচে ধরে ত্রাসিত কন্ঠে বললাম,

দোস্ত কাজটা কি ঠিক হলো? তুই কেনো মারতে গেলি ছেলেটাকে? এবার যদি খারাপ কিছু হয়।

নিহা গর্জিত কন্ঠে উচ্চারণ করল, আমি না আসলে তোর সাথে অনেক খারাপ কিছু হতে পারতো। পাখির মতো আত্মা নিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করিস? এদের সাথে মিয়াও মিয়াও করলে তো আরও বেশি পেয়ে বসবে তোকে। প্রতিবাদ করতে যতদিন না শিখবি উত্যক্ত হতে হবে। থামবে না এই অনাচার।ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়া মানেই কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। এখনো সময় আছে আওয়াজ তোলা শিখ। সবসময় তোর পাশে থাকবো না আমি।

ক্ষিপ্রবেগে কথাগুলো বলে ক্যাম্পাসের দিকে হাটা ধরল নিহা। আর আমি আগের জায়গাতেই দাড়িয়ে আছি। নিরবে নিহার ঝারিগুলো হজম করা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই আমার। আজকে যে সাহস নিহা দেখালো, সেটা কি আমার পক্ষেও সম্ভব? নিহার মতো রোজ বড় গাড়ি করে কলেজে আসি না আমি।আমার পেছনে ছায়ার মতো শক্ত সামর্থ্য ড্রাইভার আঙ্কেল থাকে না। নিহার মতো প্রভাবশালী ক্ষমতাবান বাবাও নেই আমার। তাহলে কিসের ভিত্তিতে প্রতিবাদ তুলবো আমি? কার ভরসায়? আজকে নিহার জায়গায় চড়টা যদি আমি মারতাম, তাহলে হয়তো কালই খবরের কাগজের হেডলাইন হয়ে যেতাম। ধর্ষিত কিংবা এসিড নিক্ষিপ্ত অসহায় এক মেয়ে। যে কিনা প্রতিবাদ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু একটা কথা নিহা বেশ বলেছে। সবসময় আমার পাশে থাকবে না সে। দিনশেষে আমি একা। বড্ড একা।

.

কলেজ ছুটির পর নিহার গাড়িতে উঠতে হয়েছে আমায়। আমাকে বাসায় ড্রপ না করা পর্যন্ত শান্তি হবে না তার। যদিও নিহার বাসার রাস্তা আর আমার বাসার রাস্তা সম্পুর্ণ বিপরীত দিকে। প্রায় দশমিনিটের মাথায় সদর দরজার সামনে গাড়ি থামল। আমি নিহাকে বিদায় জানিয়ে ঘরে প্রবেশের উদ্দেশ্য নিয়ে পা বাড়ালাম। কিন্তু দরজায় তালা লাগানো। আমি খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কোনো এক অবিদিত কারণে মনে শঙ্কা জেগে উঠল। এ সময় তো সবারই বাসায় থাকার কথা।ঠিক এই সময় তারিফের ভাইয়াও লাঞ্চের জন্য আসে। কিন্তু এখন কেউ নেই। অসময়ে ঘরের দরজায় তালা দেওয়া, বিষয়টা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। আমি পাশের বাসার পারবতী আন্টির দরজার টোকা দিলাম। মা উনার কাছে প্রায়সময় ঘরের চাবি দিয়ে যায়। পারবতী আন্টি দরজা খুলে আমায় দেখেই প্রত্যাশিত হাসি দিলেন। বললেন,

তারিন এসেছো?

মনে হচ্ছে আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন উনি। আমি হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। আন্টি বললেন,

এসো ভিতরে এসে বসো।

না আন্টি আমি বসবো না। বাসার সবাই কোথায় গেছে?

শীঘ্রই চলে আসবে। তুমি ভিতরে আসো।

আন্টি কি হয়েছে বলবেন প্লিজ? আমার টেনশন হচ্ছে।

টেনশনের কিছু নেই। ছোটখাটো একটা ঝামেলা হয়েছে। তাই সবাই থানায় গেছে।

থানায়? থানায় কেনো গেছে আন্টি?

তোমাদের বাসায় একটা ফরসা করে ছেলে আছে না? ওই ছেলে আমাদের কমিশনারের ছেলের হাত মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে। তাই নিয়ে কমিশনার মামলা করেছে। সেই ঝামেলা মেটাতেই সবাই থানায় গেছে। আয়েশা আপা বলে গেছে তুমি কলেজ থেকে আসলে আমার ঘরে বসিয়ে রাখতে। তুমি এসো তারিন।

আন্টি দরজা খোলা রেখেই ভেতরের চলে গেলেন। আর আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছি। পা চালানোর শক্তিটকুও অবশিষ্ট নেই। কাধ থেকে অটোমেটিক ব্যাগটা খসে পড়ল। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। কে এই কমিশনারের ছেলে? ওই নীল জ্যাকেটওয়ালা নয়তো? হে আল্লাহ রক্ষা করো। আমি ঘরের চৌকাঠে পা রাখলাম না। মনটায় অস্থিরতা চেপে বসল। ফ্লোর থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়েই দৌড় লাগালাম। একটা রিকশা নিয়ে পুলিশ স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। ঝামেলাটা দেখতেই হবে। পুলিশ স্টেশনের সামনে প্রকান্ড মাপের ভীড়। যেন মুভির শ্যুটিং চলছে। আমি ভীড়ের ঠেলাঠেলিতে এক প্রকার যুদ্ধ জয়ের মতো ভেতরে প্রবেশ করলাম। পুলিশ ইউনিফরম পড়া একজন লোক আমায় আটকালো। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বাধ্য হয়ে বিপরীত পাশের জানালায় উকি দিলাম। সেখানেও মানুষের ঠাসাঠাসি। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জানালা ধরে দাড়াতেই ঈশানকে চোখে পড়ল। মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে ঈশান। হাতে ব্যান্ডেজ। ভাইয়া ঈশানের বরাবর দাড়িয়ে। দেয়াল ঘেঁষে লম্বামতো একটা বেঞ্চিতে বসে আছে ভুড়িওয়ালা সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোক। মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। গালে দাড়ি নেই তবে মুচ আছে। বিরক্তিকর চেহারা। ভদ্রলোকের পাশেই গলা থেকে হাত পর্যন্ত ব্যন্ডেজ নিয়ে বসে আছে এক যুবক। উনিই ব্রীজের সামনের সেই নীল জ্যাকেটওয়ালা, তা বুঝতে বেশি দেরি হল না আমার। কমিশনারের অপর পাশে পুলিশ অফিসার বসে আছেন। আরো একটু ভালোভাবে উকি দিতেই মা আর বুড়িকেও খুজে পেলাম। তারা চেয়ারে বসে আছেন। মা বোরখা পড়া, আর বুড়িটা বোরখার সাথে নিকাব পড়া। মায়ের পাশে বসে আছে বিধায় বুড়িটাকে শনাক্ত করতে সুবিধা হল। কমিশনার সাহেব বেশ গর্জন করে বলে উঠলেন,

হিরোগিরি দেখাও? সুন্দর চেহারা নিয়া হিরোগিরি না? এই কোন কোচিং এর টিচার তুমি? নাম কি কোচিং এর কও তো?

তারিফ ভাই বললেন, সেটা মুল বিষয় না। আমাদের এখানে কেনো ডেকে আনা হয়েছে আর ঈশানের বিরুদ্ধে কেনো অভিযোগ তোলা হয়েছে সেটাই মুখ্য বিষয়।

ভাইয়া ঈশানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঈশান। তুমি কি সত্যিই এই ছেলের হাত ভেঙেছো?

ঈশান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। ভাইয়ার চেহারা কাঠিন্য ভর করল। কড়া গলায় ভাইয়া বললেন,

কেনো?

ঈশান বললেন, কলেজ গেইটের সামনে দাড়িয়ে মেয়েদের টিজ করছিল। বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছিল। আর সবথেকে বাড়াবাড়ি যেটা করেছে, তারিনের গায়ে হাত দিয়েছে।

ভাইয়া আড়চোখে একবার নীল জ্যাকেটওয়ালা ওরফে সাদা ব্যান্ডেজওয়ালার দিকে তাকালো তারিফ ভাইয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে উচ্চারণ করল,

হাত ভেঙে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। হারামজা*র হাত কেটে দেওয়া উচিৎ ছিল।

ঈশান মাথা নিচু রেখেই মুচকি হাসলেন। কিন্তু কমিশনার বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন।
🍂

চলবে

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৫
Writer: Stdratul muntaz

🍂
কমিশনার সাহেব ঈশানকে জেলে ভরে তবেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন সেদিন। তবে বেশিক্ষণ ঈশানকে জেলে রাখা সম্ভব হয়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। এটুকু সময়ের ব্যবধানেই ঈশানের জামিন সম্পন্ন হয়। জামিনের জন্য বেশ পরিমাণ টাকার প্রয়োজন ছিল। ভাইয়া ব্যবস্থাও করেছিলেন। ভেবেছিলেন বাইকটা বিক্রি করে দিবেন। সেই পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই ঈশান হাজির।

টাকার ব্যবস্থা কি করে হল এমন প্রশ্নের উত্তরে ঈশান ফ্রেন্ডের কথা বললেন। সেই ফ্রেন্ড, যে ঈশানকে উবার ড্রাইভিং এর জন্য গাড়ি বন্দক দেয়। ভাইয়ার মনবাসনা হলো ঈশানের সেই অস্তিত্বহীন ফ্রেন্ডকে একটিবার স্বচক্ষে দেখার। কে সেই ভালোমানুষ? ভাইয়ার মতে এমন বন্ধু পেতে কপাল লাগে। আমার বেশ মজাই লাগল ঈশানের মিথ্যে বলার কৌশলগুলো। এমন নিঃসংকোচে কয়জনই বা মিথ্যে বলতে পারে? এই মিথ্যে বলাটাও একটা গুণ। অবশ্যই খারাপ গুণ। কিন্তু খারাপ গুণ বলে কোনো শব্দ হয়না। সেটা তখন হয়ে যায় দোষ। আর এই দোষই আমার পছন্দ। খুব বেশিই পছন্দ।

.

.

নিহাদের বাসার সেই কাঠগোলাপের গাছ ধরে দাড়িয়ে আছি আমি। দেখছি, কি অপূর্ব সুন্দর এই গাছ। গাছের ফুল। আর মন মাতানো মিষ্টি সুভাষ। ছমছমে অন্ধকারে হালকা লাইটের আলোয় নিজেকেই ভালোমতো চোখে লাগেনা। অথচ ঝড়ে পড়া সাদা কাঠগোলাপগুলো সবুজ ঘাসে বিছিয়ে থাকায় মনে হচ্ছে যেন উজ্জল নক্ষত্রের মেলা।

আজরাতটা নিহার বাসায় যাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলাম। নিহার গায়ে হলুদ ছিল আজ।সেই উপলক্ষ নিয়েই ছুটে আসা। আমি একাই, তারিফ ভাইয়া পৌছে দিয়েই চলে গেছেন। বুড়িটার হঠাৎ জ্বর আসায় মাও আসতে পারেন নি হলুদে। ঈশান অবশ্য আমার সাথেই আছেন। কিন্তু সেটা বাসার কেউ জানেনা। সবাই জানে, ঈশান তার কাল্পনিক মা-বাবার সাথে দেখা করতে কিশোরগঞ্জ গেছেন।

কিছুক্ষণ আগেও চারদিকটা বেশ হৈ হুল্লোড়ে মেতে ছিল। কিন্তু এখন সব নিরব। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা বেশ ভালোমতোই ঘিরে রেখেছে নিহাদের বাগানবাড়িটা। মোহনা আন্টি প্রস্থান করেছেন ঘণ্টা দুয়েক আগে। ঈশান আবার খুব লুকিয়ে বাচিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে, মায়ের চোখের আড়ালে থাকার কি চেষ্টা উনার। কখনো ছাদে, কখনো বাগানের পেছন সাইটে, আবার কখনো কখনো তো ওয়াশরুমে গিয়েও অযথা সময় কাটিয়েছেন। অবশেষে মা নামক প্যারা বিদায় হলেন। তবে মোহনা আন্টি যতক্ষণ ছিলেন, বেশিরভাগ সময়টাই আমাকে পাশে রেখেছিলেন। খেতে বসার সময় আমি, হলুদ মাখানোর সময় আমি, স্টেজে নৃত্য দেখার সময়ও আমি। সবকিছুতেই উনার তারিনকে পাশে চাই। ঈশানের নামে গুণগান আর পার্টির মুখোশধারী অসভ্যের নামে বদনাম শুনে শুনেই কেটে গেছে আমার সন্ধ্যা। আর নিহার জন্য যেটা হলুদ সন্ধ্যা।

সবুজ ঘাসের উপর পা ফেলে ভারি আরাম করে বসে ঝি ঝি পোকার ডাক শুনছিলাম। সেই আরামে রং ঢালল মেঘলা। এক বালতি হলুদ মেশানো কাল রং আমার মাথায় ঢেলে দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুট লাগাল ঘরের দিকে। সে কি উল্লাসের হাসি তার। আর আমি তব্দা লেগে দাড়িয়ে আছি। অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে কি করণীয় সেটা বুঝে উঠার আগেই মেঘলা শাকচুন্নি নাগালের বাহিরে।অবশ্য এই সাজাটা আমার প্রাপ্য ছিল। আমিও যে একই কাজ করেছিলাম তার সাথে। কিন্তু সেই শোধটা যে মেঘলা এখন এসে তুলবে তা কি করে বুঝবো? চুপচুপে শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকার চেয়ে রাত বিরাতে শরীর ভিজিয়ে গোসল দিয়ে নেওয়াটাই তুলনামূলক ভালো উপায় মনে হল আমার। ওদিকে নিহা বেচারি বড্ড কাহিল। আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই অবশিষ্ট নেই তার মধ্যে। সাফিন ভাইয়ের সাথে ঘণ্টাখানেকের মতো মেলা বকবক করে এখন দরজা দিয়ে ঘুমের সাগরে ডুবকি লাগিয়েছে। আর আমি ভেজা চুল শুকানোর মহান উদ্দেশ্য নিয়ে কফিহাতে চলে এসেছি ছাদে।

কিন্তু এখানে এসেও শান্তি নেই। গিটারের টুংটাং শব্দ তুলে জোৎস্না ঝরানো নিরব পরিবেশটাকে মাতিয়ে রেখেছেন আমাদের, মানে নিহাদের ভদ্রম্যান। তাকে ঘিরে গোল হয়ে জমেছে মেয়েদের মেলা। কমপক্ষে বিশজনের মতো মেয়ে এইখানে উপস্থিত হবে আমি নিশ্চিত! কিন্তু ঈশান নাকি মেয়েদের সংস্পর্শে যায়না? তার নাকি বিরক্ত লজ্জা দুটোই প্রবল। তাহলে এখন আমি কি দেখছি এটা? ছবি তুলে রাখা দরকার। ভবিষ্যতে প্রমাণ হিসেবে কাজে লাগানো যাবে। এমন চাক্ষুষ প্রমাণ হাতেনাতে তো আর সবসময় পাওয়া যায়না। সুযোগটা মিস হতে দিলাম না।তাই ক্যামেরাবন্দী করে ফেললাম।

ছাদের একপাশে দাড়িয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছি আর নজর রাখছি ঈশানের উপর। বেচারা অবশ্য এখনো আমায় লক্ষ্য করেনি। আমিও নিজেকে আড়াল রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছি। একটা বিষয় নিয়ে আপাতত আমি ভীষণ ক্ষিপ্ত। ঈশান মাঝরাতে ছাদে কেনো আসলেন? উনি কি জানেন না ছাদের সাইড মেয়েদের জন্য বরাদ্দ? নাকি ইচ্ছে করেই এসেছে, কু মতলব নিয়ে। যেখানে অপযিট সাইডে তন্ময়, সাফনান, সিয়াম, রিফাত ভাইয়ারা যত্রতত্র আড্ডায় মশগুল, সেখানে কিনা ঈশানের মতো ভদ্র ছেলে মেয়েদের সাথে ন্যাকামোতে ব্যাস্ত? অদ্ভুত! বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলাম। একটা বিষয় মাথায় নাড়া দিয়ে উঠল। ছেলেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আজরাতে তারা ড্রিংক করার মাস্টারপ্ল্যান সাজিয়েছিল। সেইটা কি তবে সাকসেসফুল? আর সেই সুবাদেই ঈশান এখানে? উনি মদ্যপান করবে না বলে নিজেকে বাচানোর উদ্দেশ্য নিয়ে যদি ছাদে এসে থাকেন, তাহলে ঠিকাছে। কিন্তু মেয়েদের সাথে এমন ন্যাকামি আলাপে মেতে উঠার বিষয়টা একদম ঠিক নেই। আমার তো ইচ্ছে করছে প্রত্যেকটা মেয়ের চুল টেনে টেনে ছিড়তে। তারপর ঈশানের ঘাসের মতো চুলের উপর হামলা চালাতে। কিন্তু কি করার? বেশি সংখ্যক মেয়েই আমার ক্লাসমেট। আর বাকি যারা আছে তারা সিনিয়র। চাইলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না আমি। আর না পারছি সহ্য করতে।

দেয়াল ধরে নিচের দিকে দৃষ্টি দিলাম। এবার যেটা দেখলাম, তাতে আমার চোখ নিয়ে পৃথিবীতে বেচে থাকার ইচ্ছেটাও ঘুচে গেল। নাশফী আপু আর সাফনান ভাইয়ার প্রেমলীলা চলছে। আমি বুঝলাম না এরা কি সত্যিই হলুদের অনুষ্ঠানে এসেছে নাকি হানিমুনে? যে যার মতো যেটা ইচ্ছে করে যাচ্ছে। নিহা বলে না অভদ্র সোসাইটি? এইবার বুঝতে পারছি কেনো বলে। আমি আবার সামনের দিকে ঘুরে তাকালাম। অন্তরা ঈশানের চুল ঝেড়ে দিচ্ছে, সামিরা গাল টিপে দিচ্ছে, রিদিতা সেলফি তুলছে। হে আল্লাহ এসব দেখার চেয়ে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরে যাই তাও ভালো। আমি কফিটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কফি খাওয়া শেষ হলেই চলে যাবো নিহার ঘরে, ঘুমাতে।

রাত চারটা না ভোর চারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে ঘড়ির কাটায় চারটা বাজে। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। কিন্তু ঘুমানোর উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছি না। নিহাকে ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছে হয়নি। তাই ওর ঘরেও যাইনি। হাতে একটা বালিশ নিয়ে ঘুমো ঘুমো চোখে হাটছি। এতোবড় বাড়ি, অথচ আমার মতো ছোটোখাটো মানুষের শোয়ার জায়গা হচ্ছে না। সামিরা, রিদিতারা অবশ্য ওদের সাথে ঘুমানোর অফার করেছিল। আমি ইচ্ছে করেই যাইনি। কারণ খুব ভালো করেই জানি ওদের সাথে আমার ঘুম হবে না।

ড্রয়িং রুমের পেছন দিক থেকে ফ্লাশলাইটের আলো আসছে। মনে হচ্ছে আমাকে উদ্দেশ্য করেই কেউ লাইট মারছে। আমি মুখে চিন্তার ভাজ নিয়ে এগিয়ে গেলাম৷ এগিয়ে যেতেই ঈশানকে খুজে পেলাম। দরজার সামনে সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছেন উনি। আমি কোমরে এক হাত রেখে মুখ ফুলিয়ে বললাম,

কি সমস্যা আপনার? এখনো ঘুমান নি কেনো?

ঈশান উত্তর দিলেন না। আবছা আলোয় উনার মুখের এক্সপ্রেসনটা বুঝতেও অসুবিধা হচ্ছে। আমি আবার বললাম,

ও সরি! আপনি কেনো ঘুমাবেন? আপনি ঘুমিয়ে গেলে মেয়েদের গিটার বাজিয়ে গান শুনাবে কে? ফ্লার্ট কে করবে মেয়েদের সাথে? অসভ্য কোথাকার!

ঈশান এবারও কিছু বলছে না। আমার ভয় হল। সত্যিই আমার সামনে ঈশান দাড়িয়ে তো? নাকি ঈশানের অবয়ব নিয়েই অন্যকেউ? আমি নিজের ফোনের ফ্লাশলাইট টা অন করতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই সামনের মানুষটা আমার হাত ধরে সজোরে টান দিল। আমি রুমে ঢুকে পড়লাম। অতি সামান্য সময়ের মধ্যেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ছেলেটাকে দরজা লাগাতে দেখে আমার শরীর হিম হয়ে আসছে। গোল গোল চোখ করে ধীরপায়ে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। আর সামনের মানুষটা এগিয়ে আসতে লাগল। বিছানার সাথে ধাক্কা খেয়ে ফ্ল্যাট হয়ে পড়লাম আমি। সাথে ছেলেটাও একই গতিতে চেটাল হয়ে পরল আমার উপর। উনার শরীরের ভারে দম আটকে আসার উপক্রম হল আমার। তার উপর ছেলেটা আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরার কারণে নড়াচড়া করারও জো নেই। আমি ঈশানের বুকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,

ঈশান এসব কি হচ্ছে?

ঈশান আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বিহ্বল কণ্ঠে বললেন,

এই মেয়ে। তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও? এই ভেজা চুল, এই স্নিগ্ধ মুখ, আর ঠোট জুড়ে মিষ্টি হাসি। আমাকে মাতাল বানিয়ে দিচ্ছে। এটা কেমন অত্যাচার বলোতো? নিরীহ ছেলেটার বুক আরেকবার ক্ষতবিক্ষত করে দিলে তুমি। এবার কি হবে আমার? বারবার আমাকে এমন পাগল বানিয়ে দিয়ে নির্দ্বিধায় চলে যাবে, তা তো হবেনা। এবার যে শাস্তি পেতে হবে তোমাকে। কঠিন শাস্তি।

আমার বুকটা ধক করে উঠল। পায়ের পাতা ভীষণরকম কাপছে। শীতল হয়ে আসছে শরীর। ঈশানের মাথা ঠিক নেই, নেশা টেশা করেছে নাকি কে জানে? উনার এই পাগলামিকে প্রশ্রয় দেওয়া যায়না। কিন্তু উনাকে ঠেকানোর সাধ্যি কই আমার? আমি ঢোক গিলে বললাম,

ঈশান, প্লিজ ছাড়ুন আমাকে। আমি পেশিতে ব্যাথা পাচ্ছি।

ঈশান এখনো আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে রেখেছেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভয়ে আমার ভেতরে যা কিছু আছে সবটা যেন বমি হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঈশান হালকা শব্দ করে হাসলেন। আমার ভয় তীব্র হল। উনার হাসিটাও সুবিধাজনক লাগছে না এখন। আমার দেহে কম্পন সৃষ্টি করে ঈশান গলাতে ঠোটের পরশ দেওয়া শুরু করলেন। আর আমি ধস্তাধস্তি শুরু করলাম। এর থেকে যদি গলায় ধারালো ছুড়ি চেপে রাখা হতো, তাও অনেক শান্তির ছিল। এমনটাই ধারণা হচ্ছে আমার। এই যন্ত্রণাময় অনুভূতি সহ্য করা দায়। বড্ড দায়।

ঠিক এই মুহুর্তে আশেপাশে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র পেলে ঈশানের দিকে তাক করতেও দু বার ভাবতাম না আমি। ঈশানের অত্যাচার প্রখর হচ্ছে ক্রমশ। আমার চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে আসছে। ঈশান আমার ওরনাটা সরাতেই শব্দ করে কেদে দিলাম আমি। তাই দেখে ঈশানের হোশ ফিরল। মাথা তুলে তাকালেন আমার দিকে। আর আমি? দাত কিড়মিড়িয়ে উনার গাল বরাবর সজোরে চড় বসিয়ে দিলাম।

গালে হাত রেখে উঠে বসলেন ঈশান। আমিও নিজের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।ঝড়ের গতিতে কাপা কাপা হাত দিয়ে দরজা খুলে নিলাম। সেই দরজা ধরেই কাদতে শুরু করলাম আবার।

কিছু সময় পর উপলব্ধি করলাম ঈশান আমার দিকে ওরনাটা এগিয়ে দিচ্ছে। আমি ঈশানের মুখের দিকে তাকালাম। উনার দৃষ্টি অন্যদিকে স্থির। আমি ক্রন্দনরত অবস্থাতেই ওরনাটা হাতে নিলাম। গলায় ওরনা জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে কাদতে দৌড়ে চলে আসলাম ছাদে।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছেমাত্র। আকাশ ভেদ করে সুর্যের অস্পষ্ট আলো উকি দিচ্ছে। আর আমি কেদে চলেছি। বুক ফেটে কান্না আসছে আমার, ভীষণ কান্না। ঈশানকে আঘাত করার জন্য এখন অনুশোচনা হচ্ছে। কি করলাম এটা আমি? কেনো করলাম? এই মনঃকষ্ট নিয়ে কি করে থাকবো আমি?যে হাতে চড় মেরেছি সেই হাতটা পর্যন্ত ব্যাথা করছে, জ্বালাপোড়া করছে হাতে। তার থেকেও বেশি জ্বালাপোড়া করছে আমার মনে। জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছি আমি।
🍂

চলবে

তি আমো পর্ব-১২+১৩

0

#তি_আমো❤
#পর্ব_১২
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ছাদের দরজা ঠেলে উকি দিতেই দেখলাম ঈশান দেয়ালে হাত রেখে দাড়িয়ে আছেন। হয়তো আকাশ দেখছেন। হাতে চায়ের কাপ। অনবহিত ভঙ্গিতে কাপে চুমুক দিচ্ছেন উনি। আকাশে ভেসে উঠা এক ফালি চাদ যেন রুপোর থালার মতো জ্যাতি ছড়াচ্ছে। ছাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন পারিপার্শ্বিক পরিবেশে সেই আনম্র আলো অনেকটাই ব্যাপিত। আমি নিঃশব্দে ঈশানের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। উনি নিজের চিন্তা জগৎ নিয়ে এতোটাই মগ্ন, যে আমার দিকে লক্ষ্য করারও সময় হয়নি। এখনো বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন না তো?আচ্ছা উনাকে কি সত্যিটা বলে দেওয়া উচিৎ? না, সত্যি বলা যাবে না। পরে যদি উনি জানতে চায়, বুড়িটা কেনো এমন করলো? তখন কি বলবো? তার চেয়ে ভালো অপেক্ষা করি।দেখাই যাক উনি কি পদক্ষেপ নেয়। ঈশান আনমনে চায়ের কাপে ঠোট ছোয়াতে যাচ্ছিলেন, সেই মুহুর্তে আমি শব্দ করলাম। ঈশান চমকে উঠলেন। শারীরিক স্পন্দনের দরুন চায়ের কাপে ঠোট ডুবে গেল উনার। ঈশান কুকিয়ে উঠলেন,

আহ!

আমি তড়িঘড়ি করে চায়ের কাপটা হাতে নিলাম।ঈশান চোখ বন্ধ করে ঠোট চেপে ধরলেন। আমি ঈশানের কাধে হাত রাখলাম। বিচলিত হয়ে বললাম,

ঠোট পুড়ে গেছে না? কি দরকার এতো গরম চা খাওয়ার?

ঈশান চোখ তুলে তাকালেন। ঠোটে হাত রেখেই অল্প হাসলেন উনি। আমি ভ্রু কুচকে কাপে চুমুক দিলাম। আর চুমুক দিতেই অবাক হলাম। চা এতোটাও গরম না যে উনার ঠোট পুড়ে গেল। এইটুকু গরম সহ্য করতে পারলেন না?আমি ঈশানের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলাম,

আপনি কি ঢেড়স নাকি? এটুকু গরম সহ্য করতে পারেন না?

ঈশান অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। উনার চাহনিতে আমার চৈতন্যশক্তি জেগে উঠল। এটা কি করলাম আমি? উনার এটোকাঁটা কাপে মুখ দিয়ে দিলাম? এবার উনি আমাকে ম্যানারলেস ভাবছেন না তো? হাসার চেষ্টা করে মাথা নিচু করলাম আমি। বললাম,

সরি। আমার খেয়াল ছিল না। ভুল করে আপনার কাপে মুখ দিয়ে ফেলেছি। থাক, এটুকু আর আপনাকে খেতে হবে না। ফেলে দিচ্ছি।

চায়ের কাপ হালকা কাত করে অবশিষ্ট অংশ টুকু ফেলে দিতে চাইলাম আমি। কিন্তু ঈশান ফেলতে দিলেন না। আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই উনি চায়ের কাপটা ছিনিয়ে নিলেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই কাপে চুমুক দিয়ে সবটুকু অংশ শেষ করলেন। আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। লজ্জায় মুখটা আলোহিত হয়ে আছে আমার। এই লজ্জাঘেরা নিরবতা ঠেকিয়ে ঈশানের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,

আচ্ছা? আপনি এখানে কেনো আছেন? এখান থেকে চলে কেনো যাচ্ছেন না?

কথাটা বলে শেষ করতেই ঈশান আমার বাম হাতের বাহু ধরে টান দিলেন। আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,

আমি চলে গেলে তুমি খুশি?

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, না। খুশি কেনো হবো? কিন্তু আপনার তো এখানে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা? আমি তো আপনার ভালোর জন্যই বলছি।

ঈশান আমার হাত ছাড়লেন। সংশয়াপন্ন কণ্ঠে বললেন,

আমার এখানে থাকতে কষ্ট হচ্ছে? তোমার এমন কেনো মনে হলো?

এমনটাই তো স্বাভাবিক। আপনার পরিবেশ আর এই পরিবেশ সম্পুর্ণ আলাদা। ধরতে গেলে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সবকিছুতে আপনার মানিয়ে চলতে হচ্ছে। কষ্ট তো হচ্ছেই।

ঈশান তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন। বললেন,

জানিনা কোন কষ্টের কথা বলছো। কিন্তু আমার তো মনে হয়, নিজের বাসার থেকে এখানেই বেশি শান্তি। অনেক, অনেক শান্তি।

কিভাবে?

ঈশান আমার দিকে ঘুরে আমার গা ঘেঁষে দাড়ালেন। আর বললেন,

মানুষ যখন কঠিন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়, তখন পৃথিবীর সবকিছুই তার কাছে অসহ্য মনে হয়। মুল্যহীন মনে হয়। শুধু রোগ নিরাময়ের সেই ওষুধটি ছাড়া। সেইরকম একটা ভয়াবহ রোগে যে আমিও আক্রান্ত তারিন!

আমি চোখ বড় করে বললাম, মানে? কি রোগ হয়েছে আপনার?

প্রেমরোগ। যার নিরাময় শুধু তুমি। তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্তও কতটা যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় জানো? এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আমি যা কিছু করতে পারি। পুরো পৃথিবীটাও দিয়ে দিতে পারি বিশ্বাস করো। শুধু একবার এই মায়াবী মুখটা দেখার জন্য। তোমার কাছাকাছি থাকার প্রলোভনই তো আমাকে এখানে টেনে এনেছে। অনেকটা ম্যাগনেটের মতো। এখন যে আমি চাইলেও এখান থেকে চলে যেতে পারবো না। আর না পারবো তোমাকে ছাড়া থাকতে। কি একটা সর্বনাশ হয়ে গেল বলো তো আমার? পৃথিবীর কোনোকিছুই এখন আর ভালো লাগে না। পানসে মনে হয় সব। কাঠগোলাপের সুভাষ টাও এখন আর আকৃষ্ট করতে পারে না আমাকে। তুমি যে মনের সবটুকু জায়গা দখল করে নিয়েছো। তোমার মিষ্টি হাসি, ভেজা চুলের মাদকময় সুভাষ ছাড়া আর অন্যকিছুতে আকৃষ্ট হয়না এ মন। আর অন্য কোনো সৌন্দর্য দেখতে চায়না এই চোখ।সেই ইচ্ছেটাই মরে গেছে।

আমি হাবার মতো তাকিয়ে রইলাম।

ঈশান দুই ঠোট চেপে চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হঠাৎই আমার দুই গাল চেপে ধরে আমার কপালে ঠোটের পরশ দিলেন। আর আমি শিহরিত হলাম। তার থেকেও বেশি কম্পিত হয়ে উঠল আমার শরীর, যখন ঈশান আমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মাথা গিয়ে ঠেকলো উনার বুকে। অনেক বেশি অস্বস্তি লাগার কথা, কিন্তু লাগছে না। বরং এতেই যেন স্বস্তি। আমি অজান্তেই চোখ বন্ধ করে নিলাম। উনার হ্রদস্পন্দনের ছন্দবিন্যাস করতে ব্যস্ত হলাম। ঈশান তখন বললেন,

শুনতে পাচ্ছো তারিন? এই নিস্তেজ হ্রদয়ের আনন্দধ্বনি! তোমার উপস্তিতিই এই নীরস মনের একমাত্র চাহিদা। এখন সেটা ফিল আপ। তাই তো ওরা উৎসবে মেতে উঠেছে। ফিরে পেয়েছে তাদের সজীবতা, প্রাণোচ্ছলতা।

আমার চোখের পানি বেরিয়ে আসল। উনার শার্ট খামচে ধরে কাদতে শুরু করলাম আমি। আমার কান্না দেখে ঈশান আমায় টেনে তুললেন। আমার কাধ চেপে ধরে ভ্রু কুচকে উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন,

কি হলো?

আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না জুড়েছি। নাক মুছে চোখ মুছে কাদতে কাদতে অস্পষ্টভাবে আমি উচ্চারণ করলাম,

আপনি আমার সাথে এসব কথা বলবেন না। আমার কান্না পায়। খুব কষ্ট হয়।

অনেকটা ভ্যা ভ্যা শব্দ করে কেদে দিলাম আমি। আমার কান্না দেখে ঈশান হতবাক হয়ে তাকালেন। অস্থির গলায় বললেন,

ওকে ওকে! আর বলবো না সরি।

আমি আরও জোরে কাদতে লাগলাম। চোখমুখ ডলছি আর কাদছি। নাকের পানি চোখের পানি মিশে একাকার। ঈশান আমার কান্না দেখে হাসতে নিয়েও থেমে গেলেন। আমার কোমড় জড়িয়ে ধরে আমাকে দেয়ালের উপর উঠিয়ে বসালেন। ঠাট্টার ছলে বললেন,

আচ্ছা বলোতো তুমি কাদছো কেনো? আগে তো আমার কথা শুনলে তোমার হাসি পেতো। কি যেন বলতে? মিঃ আবেগচন্দ্র, একটা মিষ্টির দোকান খুলে বসে পড়ুন নাহলে মালি পদে নিযুক্ত হয়ে যান। দারুণ মানাবে আপনাকে। শয়তানি বুদ্ধি মাথা ছেড়ে পালাবে। ফ্রীতে উপদেশ দিয়ে দিতে। আর এখন দারুণ দারুণ উপদেশ গুলো না দিয়ে বোকার মতো কাদছো? কেনো?

আমি কান্না থামিয়ে অসহায় মুখ করে তাকালাম। আরেকবার কান্না শুরুর প্রস্তুতি নিয়ে জোড় গলায় বললাম,

কারণ এখন আমিও আপনাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।

বলেই ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরলাম আমি। দেয়ালের উপর উঠে থাকায় উনার গলা জড়িয়ে ধরতে খুব একটা অসুবিধা হল না। পুনরায় শুরু করলাম আমার তোলপাড় শব্দের কান্না।

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৩(কিছু অংশ)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমার এমন আচরণে ঈশান অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে সোজামতো দাড়িয়ে আছেন। অতিরিক্ত ধাক্কায় জড়তা ভর করেছে উনার শরীরে। উনার নিরবতা দেখে হোশ আসল আমার। আরেকবার লজ্জিত হতে হল নিজের পাগলামির জন্য। ঈশানের গলা ছেড়ে মাথা নিচু করলাম আমি। ইচ্ছে করছে লাফিয়ে পড়তে ছাদ থেকে। আমার ইচ্ছেটা যেন সঙ্গে সঙ্গে কবুল হল। আকস্মিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে পেছন দিকে হেলে পড়তে লাগলাম।সেই মুহুর্তে ঈশান আমার এক হাত টেনে ধরলেন। আমি হেলানো অবস্থাতেই তাকালাম। ঈশান মোহগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আচমকাই তীব্রবেগে ঈশান আমায় নিজের দিকে টানলেন। আমি তুমুল গতিতে ঈশানের কাধ খামচে ধরলাম। চোখ দুটো বর্তুলাকার বানিয়ে ফেললাম মুহুর্তেই। ঈশান মুচকি হাসলেন। উনার হাসি দেখে এক অবিদিত আতঙ্ক
জেগে উঠল মনে। সেই আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়ে ঈশান হঠাৎ আমার ঠোট আকড়ে ধরলেন। আর আমি কেপে উঠলাম। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমি শেষ। কোনোকিছু অনুভব করতে পারছি না। যেন শরীরের স্নায়ুগুলি তাদের যাবতীয় কাজ স্থগিত করে রেখেছে। শুধুই কাপছি আমি। ঈশান তার সবটুকু তৃপ্তি ঢেলে দিচ্ছে আমার ঠোটে। আর আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখছি। নিদারুণ এই স্পর্শানুভূতি আমার মনের অনুনাদ বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি ছটফট করছি। এমন সময় পেছন থেকে আওয়াজ আসল,

এহেম এহেম, ম্যাথ ক্লাস চলছে নাকি?

আমি আর ঈশান এলোপাতাড়িভাবে সরে পড়লাম দুইজন দুই প্রান্তে। যেন বিকর্ষণ বল কার্যত হয়েছে। নিহা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসল। ঈশান কর্ণারে গিয়ে অপ্রস্তুত ভাবে দেয়াল চেপে ধরে দাড়ালেন। নিহা রসিকতাপূর্ণ কন্ঠে বলল,

আমি কি ডিস্টার্ব করলাম ক্লাসে?

নিহার কথা শুনে আমার ইচ্ছে করল মাটির ফাক করে ভেতরে ঢুকে যেতে। ঈশান বললেন,

অবশ্যই। খুব ডিস্টার্ব করেছো তুমি। ইউ শুড পানিশ ফর দিজ।

নিহা মুখে হাত রেখে উচ্চারণ করল, উপপপসস..! সরি! কিন্তু ঈশান ভাইয়া আমি আপনাকে ছোট একটা এডভাইজ দেই কেমন? এভাবে ছাদের উপর খোলামেলা পরিবেশে ক্লাস করাটা ঠিক নয়। তার থেকে ভালো বিয়ে করে নিন।

নিহা আমার কাধে হাত রাখল। ঈশানের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

তখন আর ক্লাসে ডিস্টার্ব হবেনা। মনোযোগের সাথে ম্যাথ করা যাবে। খুব জটিল বিষয় তো! খোলামেলায় হয়না, নিরিবিলি পরিবেশ দরকার। কি ঠিক বললাম না তারু?

আমি চোখ সরু করে দাত কিড়মিড়িয়ে বললাম, তোকে জুতোর বাড়ি দিলে ঠিক ভুল বের হবে দাড়া।

নিহা খিলখিল করে হেসে দিয়ে উল্টো দিকে দৌড় লাগাল। আমিও নিহার পিছনে ছুটলাম। নিহা দরজা পেরিয়ে বাহিরে চলে গেল। আমি দরজার বাহিরে পা রাখতেই থেমে দাড়ালাম। পেছন ফিরে একবার ঈশানের দিকে তাকালাম। উনার হাস্যজ্জল মুখটা দেখে নিয়ে আবার ছুটতে লাগলাম নিহার পেছনে।

.

.

কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। বাহিরে থেকে ভাইয়ার চেচানোর তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যাচ্ছে। কান ঝালাপালা অবস্থা। কৌতুহল নিয়ে উঠানে আসলাম। মা নাশতা বানাচ্ছিলেন। আমি মায়ের পাশে এসে দাড়ালাম। বললাম,

ও মা মা! ওমলেটের জন্য এতো মরিচ নিচ্ছো কেনো? একটু কম ঝাল দেওয়া যায় না?

মা চোখ বড় করে বললেন, কি অদ্ভুত কথা বলিস? আমি ঝাল বেশি দিচ্ছি কই? ঠিকই তো আছে। এর থেকে কম দিলে স্বাদহীন লাগবে।

লাগুক স্বাদহীন। তবুও কম দাও। সবাই কি এতো ঝাল খেতে পারে?

কে ঝাল খেতে পারেনা শুনি?

আছে আছে। তুমি আমাকে দাও তো আমি বানাচ্ছি।

তারু ঝামেলা করিস না তো। সর এখান থেকে। তোর কলেজ আছে না? যা জলদি তৈরি হো। হাতে বেশি সময় নেই।

আমি মুখ ভার করে ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। চোখাচোখি হল ঈশানের সাথে। মুখটা লাল আভাপূর্ণ হয়ে উঠল আমার। সদ্য ঘুম থেকে জাগার কারণে চোখ গুলো হালকা ফুলে আছে উনার। ঘাসের মতো চুলগুলো অগোছালো। ঠিক যেন লম্বা দূর্বা ঘাসের ব্ল্যাক ভারসন। ঘোর লাগানো দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। সেই ঘোর কাটল ভাইয়ার চিৎকারে। সদর দরজার সামনে থেকে ঈশানকে জোর গলায় ডাকছে ভাইয়া। ঈশান এগিয়ে গেলেন। আমি ঘরের দিকে গেলাম। ব্যাগ গুছিয়ে, নিজেকে গুছিয়ে টেবিলে এসে বসলাম। এরই মধ্যে ভাইয়া ঈশানকে বাইক ঠিক করার কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। অপার্থিব লাগছে বিষয়টা। আমাদের বাড়িতে এসে কত কি- ই না করতে হচ্ছে উনাকে। কপাল! মা আমাকে ওমলেটের সাথে পাউরুটি খেতে দিলেন। আমি খাচ্ছি আর মাঝে মাঝে আড়চোখে ঈশানকে দেখছি। বুড়িটা আশেপাশেই ঘুরাঘুরি করছে। হাতে পাউডার নিয়ে মধ্যমা অঙ্গুলি দিয়ে দাত মাজছে। ব্রাশ আর পেস্ট থাকতেও বুড়িটা যে কেন এইভাবে দাত মাজে, সেই কেমিস্ট্রি আজও বুঝলাম না আমি। ভাইয়াকে দেখলাম বাইক স্টার্ট দিচ্ছেন। ঈশান পাশে দাড়িয়ে ঘাম মুছছে। উনার হাতে বাইক ঠিক করার সরঞ্জাম। বাইক স্টার্ট নিতেই ভাইয়া উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,

বাহ! তুমি তো বেশ কাজের ছেলে। এতো জটিল স্ট্রাকচার ঠিক করে দিলে? এই শোনো ঈশান, আমাদের গলির মাথায় একটা গ্যারেজ আছে। তুমি ওখানে পার্ট টাইপ জব করবে?

ভাইয়ার কথা শুনে আমার গলায় খাবার আটকে গেল। কাশতে শুরু করলাম আমি। বুড়িটা দুর থেকে বলল,

ষাট ষাট! বালাইষাট!

মা রান্নাঘর থেকে পানি এনে দিলেন। আমি পানি খেয়ে আবার ভাইয়া আর ঈশানের আলাপ শুনতে ব্যস্ত হলাম। ঈশান আকার- ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইছেন তার পার্ট টাইম জব দরকার নেই। কিন্তু ভাইয়া নাছোড়বান্দা। ঈশানকে বললেন,

আরে বেশিরভাগ সময় তো বাসাতেই থাকো। পার্ট টাইম জব করলে সময়টা কাজে দিবে। আর ইনকামও ভালো হবে। বোকামি করো না। যা বলছি শোনো। ওরা লোক খুজছে। তুমি বললে আমি ব্যবস্থা করবো।

আমি বিরক্ত নিয়ে উঠে দাড়ালাম। ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

আমি কলেজ যাচ্ছি।

তাই শুনে ভাইয়া বললেন, এই তারু! আজ তুই স্যারের সাথে বের হো কেমন? ঈশান? তুমি এখন গাড়ি নিয়ে বের হবে না? তারুকে কলেজ পর্যন্ত পৌছে দিও। বেশি দূর না, এই পাচ দশ মিনিটের রাস্তা। হাইওয়ে তে নেমে যাস্ট সোজা চলে যাবে। মাঝে একটা বাক পড়বে, তারপরই গোল চত্বর। ব্রিজের এক পাশে নামিয়ে দিলেই হবে। ব্রিজ পেরোল কলেজ বুঝেছো?

ঈশান উৎফুল্ল হয়ে বললেন, বুঝেছি।

আমার ইচ্ছে করছে ভাইয়াকে শক্ত হাতে আলিঙ্গন করতে। কি ভালো ভাই হয়েছে আমার।

🍂

#তি_আমো❤
#পর্ব_১৩(বাকি অংশ)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমি গাড়ির সিটের সাথে গা এলিয়ে বসে আছি। বেশ আরাম লাগছে। ঈশান ড্রাইভিং এ ব্যস্ত। মাঝে মাঝে আড়চোখে আমার কান্ড দেখছেন। আর আমি মিটিমিটি হাসছি৷ হঠাৎই ঈশানের কাধে কনুই ঠেকিয়ে উনার মুখের কাছে ঝুকলাম আমি। ঈশান স্টেয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে আমাকে দুরে ঠেলে দিয়ে বললেন,

প্লিজ। এভাবে না। এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।

আমি অবুঝের মতো মুখ করে আহ্লাদী কণ্ঠে বললাম,

আচ্ছা আমরা কি সত্যিই কলেজ যাচ্ছি?

হ্যা! কলেজেই তো যাচ্ছি।

ধুর! আমি আরো ভাবলাম আজকে কলেজ বাংক দিয়ে আপনার সাথে ঘুরতে যাবো। তা না। আপনি আমায় কলেজেই নিয়ে যাচ্ছেন। হাউ আনরোমান্টিক!

ঈশান কাচুমাচু মুখ করে আমার দিকে তাকালেন। অপ্রতিভ স্বরে বললেন,

তুমি কলেজ বাংক দিবে? বাসায় এ্যাবসেন্ট মেসেজ গেলে?

সেইটা নিহা মেনেজ করে নিবে প্রবলেম নেই।

নিহা কিভাবে ম্যানেজ করবে?

আমার হয়ে প্রেজেন্ট দিবে।

আর ধরা পড়ে গেলে?

আমি বাকাচোখে তাকালাম। রোষাবেশ ভাব নিয়ে বললাম,

বুঝেছি। আপনার আসলে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছাই নেই। সেজন্য কলেজে পাঠাতে চাইছেন আমাকে।

না তারিন। ইচ্ছে থাকবে না কেনো। বরং তোমার থেকে অনেক বেশি ইচ্ছে আমার।

সত্যি? তাহলে চলেন আমরা যাই?

আচ্ছা কোথায় যাবে বলো?

আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন।

উমমম… কোনো পার্কে? নাকি ক্যাফেতে?

আমি হেসে দিয়ে বললাম,

ধুর। আমি তো মজা করছিলাম। আমি কলেজেই যাবো।

এটা কি ধরণের মজা? না না আমি মানছি না। বলেছো যখন এবার যেতেই হবে।

পাগল নাকি? কলেজ বাংক দিলে ধরা পড়ে যাবো না? ক্লাস টিচার খুব রুড। বাসায় ফোন দিয়ে দিবে। তাও একদম ভাইয়ার নম্বরে। তারপর বাধবে আরেক ঝামেলা।

ঈশান হতাশ হয়ে ছোট্ট করে উচ্চারণ করলেন, ওহ! তাহলে যাওয়া হবে না?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, উহুম!

উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি মুচকি হেসে এগিয়ে গেলাম৷ ঈশানের গাল চেপে ধরে একটা টাইট কিস দিয়ে আবার নিজের সিটে গুটিশুটি মেরে বসে পড়লাম। ঈশান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি মুখে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলাম,

সরি।

ঈশান গাড়ি থামিয়ে আমার দিকে অগ্রসর হলেন। এক কথায় আমার সিটের উপর হামলে পড়লেন। আর আমি পারলে চিৎকার দিয়ে বসি। বুঝতে পারলাম “ইটস রিভেঞ্জ টাইম”। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম,

ঈশান, কি হচ্ছে?

ঈশান তার দুই হাতের ভাজে আমার কোমড় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেন। সয়ংক্রিয়ভাবে আমার দুটো হাত উনার বুকে গিয়ে ঠেকল। উনাকে দুরে সরানোর চেষ্টায় ধাক্কাচ্ছি আমি।কিন্তু সেই চেষ্টা বিফল করে উনি ক্রমশ আমার কাছে আসছেন, খুব বেশি কাছে। আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম,

ঈশান, মানুষ দেখছে।

নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্য নিজের মনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করি। তার উপর তুমিই যদি এমন করো, তাহলে আমার অবস্থাটা কি হবে একবার ভেবে দেখোতো? হাউ ক্যান আই কন্ট্রোল মাই সেল্ফ?

সরি আর করবো না। এবার প্লিজ ছাড়ুন। আমার কলেজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ! নাহলে কিন্তু কেদে দিবো।

আমার অনুনয়-বিনয় কার্যকর হল। ঈশান নিজের জায়গায় বসে স্টেয়ারিং চেপে ধরলেন। আমি ব্যাগটা কাধে তুলে করুণ দৃষ্টিতে ঈশানকে দেখলাম। আর বললাম,

যাই হ্যা?

ঈশান আমার দিকে তাকালেন না। ইশারা করে বোঝালেন যেতে। আমি ব্যাগের সাইড পকেট থেকে ছোট চিরুনিটা বের করলাম। ঈশানের দুই গাল এক হাতে চেপে উনার মাথার চুলগুলো এক দিকে আচড়ে দিলাম। ঈশান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললাম,

মাথায় ওমন ব্ল্যাক ফরেস্ট নিয়ে ঘুরলে মেয়েরা তো হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাবে। কিউটের ডিব্বা একটা!

বলতে বলতে নাক টিপে দিলাম। উনি কিছু বলার আগেই চটজলদি নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। দ্রুতপায়ে সামনের দিকে হাটা দিলাম। পেছন ফিরে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। ঈশান আমাকে দেখছেন কিনা কে জানে? আমার একমাত্র উদ্দেশ্য এখন কলেজ গেইট অতিক্রম করা। তবে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারলাম না। আপনা-আপনি চলার গতি কমে এলো। আমি স্থির হয়ে দাড়িয়ে গেলাম। ব্রিজের সামনে মোটর সাইকেলে বসে থাকা নীল জ্যাকেট পরিহিত কালো সানগ্লাসওয়ালা ছেলেটার দিকে চোখ আটকালো। ছেলেটার আশেপাশে দাড়িয়ে আছে দশ বারোজন সাঙ্গু পাঙ্গু। কলেজ ড্রেস পড়া মেয়েদের উত্যক্ত করছে তারা। আপত্তিকর ভাষায় বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এইটা ওদের নিয়মিত কাজ৷ প্রায়শই চোখে পড়তো। কিন্তু এড়িয়ে চলতাম। তবে আজ এড়িয়ে চলার জো নেই। কারণ এবার ওদের সামনে দিয়েই হেটে যেতে হবে আমায়। অন্যান্যদিন বাসে আসতাম বলে ব্রিজের ওই পাড়ে নামতে হতো।আজকে এই পাড়ে নেমেই ফেসে গেছি। ইচ্ছে করছে পেছন দিকে ছুট লাগাতে। ঈশান কি এখনো আছে? থাকলে খুব ভালো হতো।আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ঈশানের গাড়ি নেই। ভেতরটা কেপে উঠল আমার। শুকনো গলায় ঢোক গিলে ভাবতে লাগলাম, সামনে যাবো, কি যাবো না? না গিয়েও যে উপায় নেই। যতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবো ততক্ষণ সময় নষ্ট হবে। তার থেকে চলে যাওয়াই ভালো। ওরা আমাকে যাই বলুক আমি কিচ্ছু শুনবো না। শুধু দ্রুতপায়ে ওভারটেক করবো। তাহলেই তো হলো। সাত পাচ না ভেবে এগিয়ে যেতে লাগলাম। অনেকটা কাছে চলে এসেছি। ছেলেগুলো আমায় কিছুই বলছে না। আমি চোখেমুখে গাম্ভীর্য ভাব এনে হেটে চলেছি। যেন ওদেরকে দেখতেও পাচ্ছি না। বাইকে বসা ছেলেটা শুধু সানগ্লাস খুলে আমার দিকে তাকালো।কিছু বলল না। আমি আরো সাহস নিয়ে সামনে এগুচ্ছি। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হলো না। পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠল,

এইযে আপু?

এতো ভদ্র ভাষার ডাক শুনে অটোমেটিক পেছন ফিরে তাকালাম। ওই ছেলেগুলোর মধ্যেই কেউ একজন ডেকেছে। কিন্তু কে ডাকল বুঝতে পারলাম না। মনের মধ্যে একঝাঁক ভয় চেপে বসলেও চেহারায় তা প্রকাশিত হতে দিলাম না। ভ্রু কুচকে বেশ গম্ভীর ভাব নিয়ে আবার সামনের দিকে তাকাতেই নীল জ্যাকেটের ছেলেটাকে খুজে পেলাম। ছেলেটাকে দেখে ভয়ে আতকে উঠে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলাম আমি। ছেলেটা মুচকি হেসে আমার দিকে অগ্রসর হলো। সানগ্লাস টা টি- শার্টে ঘষতে ঘষতে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

নাম কি?

আমি তোতলানো কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম, ত তারিন।

বলেই মুখে হাত রাখলাম আমি। নামটা বলা উচিৎ হয়নি। আমি তো নাম বলতেও চাইনি। তবুও কি করে বলে দিলাম। ভয়ে, আসলে ভয়ে বলে ফেলেছি। ছেলেটা বাকা হেসে বলল,

তারিন? মানে পাহাড়। পাথুরে পাহাড়।

ম মানে?

মানে তারিন নামের অর্থ পাথুরে পাহাড়।

আমি ভয় ভয় দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। এবার আমার চোখেমুখেও ভয়টা স্পষ্ট ভেসে উঠেছে। আমার নামের অর্থ আমি নিজেও জানতাম না। কিন্তু এই ছেলে কি করে জানলো? ছেলেটা আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। যেন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। ঢোক গিলে বোকার মতো বলে উঠলাম,

ভাইয়া আমি যাই?

আমার কথায় যেন ছেলেটা আরো আগ্রহ পেল। উৎসাহী একটা হাসি দিয়ে বলল,

খুব সুন্দর! নামের মতোই। শুনো একটা কথা বলি। বেশি ভণিতা পছন্দ না আমার। টাইম ওয়েস্ট করে লাভ কি? সোজাসোজি বলে দেওয়াই ভালো।

ছেলেটা নিচু হলে আমার মুখের কাছে ঝুকল। মুখে শয়তানি হাসি এটে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। ক্রাশড অন ইউ।

সোজা হয়ে দাড়িয়ে পেছন থেকে কাউকে আঙুলের ইশারায় ডাকল ছেলেটা। হলুদ শার্ট পড়া একটা ছেলে সামনে এসে দাড়াল। বলল, জী ভাই?

নীল জ্যাকেটের ছেলেটা কানের পেছনে আটকানো সিগারেটটা বের করে গলায় ঝুলানো লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালো। কয়েক টান একসাথে টেনে কোমরে হাত রেখে মেইন রাস্তার গাড়ি দেখায় মনোযোগ দিয়ে বলল,

ম্যাডামের ফোন নম্বর নোট কর।

হলুদ শার্টের ছেলেটা অর্ডার পাওয়া মাত্র পকেট থেকে ছোট সাইজের একটা প্যাট আর পেন বের করল। আমার দিকে দাত কেলানো হাসি দিয়ে বলল,

নাম্বার কি ম্যাডাম?
🍂

চলবে

তি আমো পর্ব-১০+১১

0

#তি_আমো❤
#পর্ব_১০
Writer: Sidratul muntaz

🍂
আমার কথা শুনে ঈশান বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,

কি? লাফিং গ্যাস? উনাকে লাফিং গ্যাস খাওয়াতে যাবো কেনো?

প্লিজ! খাইয়ে দিন। রিকোয়েস্ট করছি আপনাকে।

ঈশান খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,

ধুর! পাগল নাকি? বয়স্ক মানুষ। পড়ে সাইড এফেক্ট হলে? খুব ডেঞ্জারাস জিনিস। স্ট্রোকও করতে পারে। রিস্কি।

আমি আড়চোখে একবার বুড়িকে দেখলাম। বুড়ির রসিকতা যুক্ত হাসি দেখে আমার গায়ে জ্বালা ধরছে। তাই ঈশানের কথার উত্তর না দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলাম ছাদ থেকে।

.

.

ঈশানের ঘরের ছোট্ট টেবিলে ঘেষে পাশাপাশি বসে আছি আমি আর ঈশান। ঘরের দরজাটা খোলা হলেও বাহিরের দিকটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে আকাশের দিকে উকি দিলে, একরাশ ঝলমলে তারার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়। লাইটের মৃদু আলো টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে। সেইসাথে ছড়িয়ে আছে বই খাতা। আমার পড়তে আসার ইচ্ছে একদমই ছিল না। কিন্তু মা আর বুড়ির চোখ পাকানো হুমকির অত্যাচারে এক প্রকার বাধ্য হয়েই পড়তে এসেছি। কিন্তু ঈশান? উনি কিন্তু আমাকে ভুলেও পড়াচ্ছেন না। ম্যাথের ফরমুলা শেখানোর বদৌলতে আমাকে উনি আবেগের ফরমুলা শেখাচ্ছেন। যা আমার জন্য চুড়ান্ত বিরক্তিকর। উনার প্রতিটা আবেগমাখানো কথা আমার জন্য বিষের থেকেও বিষধর মনে হচ্ছে। তার মুল কারণ হল যখন তখন যে কেউ পর্দা সরিয়ে ভেতরে চলে আসতে পারে। যার ফল আমাদের জন্য মোটেও সুখকর হবে না। ঈশানের সেই ভয় না থাকলেও আমার মনে ভয়টা প্রবলভাবে নিজের উপস্থিতির আভাস দিচ্ছে। আমি ঈশানের দিকে তাকালাম। উনি আমার ডান হাতটা চেপে ধরে আছেন বেশ কিছু সময় ধরে। হয়তো গবেষণা চালাচ্ছেন। মানুষের হাত নিয়ে কোনো রিসার্চ বুক বের করবেন নাকি? আমি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলাম,

আপনার সমস্যা কি বলুন তো? কি করছেন এসব?

ভাবনার ডুব সাগর থেকে মাথা তুলে তাকালেন ঈশান। ভ্রু উচু করে দুই ঠোট চেপে উচ্চারণ করলেন,

হুম?

বলছি আপনি কি করছেন? এভাবে হাত ধরে রেখেছেন কেনো আমার?

ঈশান মুচকি হাসলেন। উনার হাসি দেখে আমার মনে হল, যেন উনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলেন । আর আমি উনার চিন্তায় ব্যঘাত ঘটিয়ে খুব বড় ভুল করেছি। ঈশান বললেন,

আসলে আমি দেখছি। তোমার হাতের রেখার সাথে আমার হাতের রেখার কোনো মিল আছে কিনা।

মানে?

মানে… মানে আমি তোমার আর আমার ভাগ্যরেখা পরিমাপ করছি।

তাইনা? মিথ্যুক! আমি কিছু বুঝি না মনে করেছেন? আপনি ইচ্ছে করে আমার হাত ধরে রেখেছেন। আর এখন বাহানা সাজাচ্ছেন।

আমার কথায় ঈশান হো হো করে হেসে উঠলেন। ঝকঝকে সাদা দাতের হাসি। উনার দন্তবিকাশের ঝলকে আমার হার্ট ফুলস্পিডে বিট শুরু করে। মনের উপর বয়ে চলা ঝড়কে উপেক্ষা করে আমি রাগী কণ্ঠে বললাম,

দেখুন আপনি যদি এমন করেন তাহলে কিন্তু আমি এখনি বই খাতা উঠিয়ে নিচে চলে যাবো। আর এখানে আসবোও না।

উনি আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমার হাতের আঙুলগুলোর ভাজে উনার নিজের আঙুলগুলো পর্যায়ক্রমে বসিয়ে খুব শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলেন। আর আমি ক্রমশ ভ্রু কুচকাচ্ছি। কি চলছে উনার মাথায় সেটা আন্দাজ করতেও ভয় লাগছে। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করলাম,

ক কি করছেন এটা?

আমার প্রশ্নে উনি পুর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালেন। এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে টেবিলের নিচ থেকে নিজের বাম পা দিয়ে আমার বাম পা চেপে ধরলেন। আর আমি শব্দ করে উঠলাম। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার চোখমুখ কুচকে বন্ধ হয়ে কম্পন সৃষ্টি হল শরীরে। আমার অবস্থা দেখে ঈশান পৈশাচিক হাসি হাসছেন। আমি দাতে দাত চিপে অস্থিরতা নিয়ে উচ্চারণ করলাম,

প্লিজ ছাড়ুন। এমন করবেন না খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু।

ছাড়ব। আগে একটা গান শোনাও। তারপর।

কি? দেখুন আমি কোনো গান পারি না। আর এই অবস্থায় আমি গান কিভাবে গাইবো। আগে ছাড়ুন আমায়।

গান শোনার পর ডিসাইড করবো। ছাড়া যায় কি যায়না। সো গেট স্টারটেড। ফাস্ট।(টেবিলে করাঘাত করলেন)

ইম্পসিবল। আমি গান বলতে পারবো।

ওকে! তাহলে আমিও ছাড়তে পারবো না।

আচ্ছা, ঠিকাছে গান গাইছি। কিন্তু আগে আপনি ছাড়ুন। আমি পায়ে ব্যাথা পাচ্ছি। আর হাতেও।

এতোটাও রাফলি ধরিনি আমি যে তুমি ব্যাথা পাবে। এরপরেও ব্যাথা পেলে আমার কিছু করার নেই। গান না শুনে আমি ছাড়ছি না। দেটস ফাইনাল। শুরু করো।

ক কি গান?

তোমার ইচ্ছা। তবে আমার পছন্দ না হলে ছাড়া পাবে না। এবার তুমিই সিলেক্ট করো। কোন গানটা স্যুইটেবল হবে।

আমি মুখ ফুলিয়ে চিন্তা করলাম। এই মুহুর্তে গান এর “গ” টা পর্যন্ত মাথায় আসছে না। কম্পিত কণ্ঠনালী নিয়ে গান কিভাবে গাইতে হয় আমার জানা নেই। বেশিক্ষণ চিন্তা করার সুযোগ হলো না। ঈশান আবার বলে উঠলেন,

ওকে ওয়েট। তোমার সিলেকশনে প্রবলেম হলে আমি হেল্প করছি। ওমম,, আমি একটা গান শুরু করছি..যেখানে আমি থামব তার পরের লাইন থেকে তুমি শুরু করবে। গট ইট?

আমি কিছু না বুঝেই মাথা দুলালাম। উনি গান আওরাতে লাগলেন,

শাইনিং ইন দ্যা সেটিং সান লাইক পার্ল আপ অন দি ওশ্যান কাম এন্ড ফিল মি… ও ফিল মি!
শাইনিং ইন দ্যা সেটিং সান লাইক পার্ল আপ অন দি ওশ্যান কাম এন্ড হিল মি… ও হিল মি!
থিংকিং এ্যাবাউট দ্যা লভ উই মেকিং এন্ড এ লাইফ উই শ্যায়ারিং কাম এন্ড ফিল মি… ও ফিল মি!
শাইনিং ইন দ্যা সেটিং সান লাইক পার্ল আপ অন দি ওশ্যান কাম এন্ড ফিল মি, কাম অন হিল মি!

এইটুকু বলেই উনি আমার দিকে ইশারা করলেন। আমি মনের সবটুকু আকর্ষণ যুক্ত করে উনার গানের কণ্ঠে ডুবে ছিলাম। উনার পলক ঝাকানো চাহনিতে সেই ঘোর আমার ছিন্ন হল। আমি চোখ বড় করে কাপা কাপা কণ্ঠে গানের পরবর্তী কলি উচ্চারণ করলাম,

হুয়া যো তু ভি মেরা মেরা… তেরা যো ইকরার হুয়া..
তো কিউনা ম্যা ভি কেহদু কেহদু.. হুয়া মুজহে ভি প্যায়ার হুয়া..
তেরা.. হোনে লাগা হু.. হোনে লাগা হু.. যাভ সে মিলা হু..
তেরা.. হোনে লাগা হু..হোনে লাগা হু.. যাভ সে মিলা হু..

গানের পংক্তিগুলি অভিব্যক্তিরত অবস্থায় ঈশানের দিকে দৃষ্টি যেতেই থেমে গেলাম আমি। উনি পরিতোষের দৃষ্টি নিয়ে গালে হাত ঠেকিয়ে আমাকে দেখছেন। আমি জিহবা দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে উনার দিকে তাকালাম। তাই দেখে উনি গাল থেকে হাত সরিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন,

কি হলো থামলে কেনো? বলো!

পেছন থেকে কেউ আওয়াজ দিল, কি কইতো?

ঈশান তৎক্ষণাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দরজা বরাবর তাকালাম। বুড়ি এক হাতে শাড়ির কুচিটা হালকা উচু করে অন্যহাতে ডিশভরতি চায়ের কাপ নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। ঈশান জোরপূর্বক হেসে বুড়িকে সালাম দিলেন,

স্লামালাইকুম দাদী।

বুড়ি লাল দাগাঙ্কিত দাত গুলি বের করে হাসল। টেবিলে চায়ের ডিশটা রেখে বিছানায় বসে পরল। এক হাত হাটুর উপর রেখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে প্রীতিকর হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

কি জিগাইতাছিলা?

ঈশান অপ্রস্তুত কণ্ঠে উচ্চারণ করল, ফরমুলা। ম্যাথের ফরমুলা।

ও! ফরমলা?

জি দাদি।

পড়াশুনা করতাসো না?

জি।

তুমগো পড়াশুনায় অসুবিদা না হইলে আমি একখান কথা কইতে আইসিলাম। একখান আলাপ।

জি দাদি। বলেন কোনো সমস্যা নেই।

ঈশান খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাটা বললেও আমার যে খোটকা লাগছে। কি জরুরি আলাপ করতে এসেছে বুড়িটা? আবার বিয়ের কথা বলে বসবে না তো! বুড়ির বিশ্বাস নেই।
🍂

চলবে

#তি_আমো❤
#পর্ব_১১
Writer: Sidratul muntaz

🍂
বুড়ি বিছানায় আরাম করে বসে দুই হাত হাটুতে ঘষতে ঘষতে বলল,

কথাডা হইলো আমাগো তারু রে লইয়া। হেই ছুডুবেলা থেকা মাইয়াডারে আগলাইয়া রাখতাসি। বাপ মরা মাইয়া। এতিম। হের প্রতি আমার মুহাব্বত একটু বেশিই আছিল। ওহনো আছে, খুব আদর যত্নে বড় করছি তো!মায়া লাগে বহুত। জীবনে কোনোদিন একটা টুকাও লাগতে দেই নাই শরীরে। তারুর বাপে, মরনের আগে আমার কাছেই তারুর দায়িত্ব দিয়া গেছিল। মাইয়াডারে যেন দেইখা রাখি। মেলা আদরের মাইয়া আছিল আমগো তারু। বাপের দুলালি। হেই কথা মনে পরলে এহনো বুকটাত চিলিক দিয়া উডে।

বলতে বলতে চোখের পাতা ভিজিয়ে কেদে উঠল বুড়িটা। আমি অনেকটা বাকশক্তিহীন হয়ে তাকিয়ে আছি। কি এমন হলো? হঠাৎ বুড়ির ওমন ফ্লেশব্যাকে চলে যাওয়ার কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না আমার। এমন আচরণ তো মোটেও সমীচীন নয়। ঈশান বেশ ইতস্ততভাবে বুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। বুড়ি শাড়ির আচল দিয়ে নাকের ডগা মুছে আবার বলতে শুরু করল,

কত স্মৃতি ওহনো চোখে ভাসে। তারু যখন ছোডো আছিল, হেরে গল্প শুনাইয়া ঘুম পাড়াইতাম। গল্প না কইলে ঘুমাইতো না। জিদ কইরা বইয়া থাকতো। আমার পানের বাডা লইয়া মাঝে মাঝে সুপারি কাটতো। লুকায় লুকায় আমি না দেখি যেন। এমনে কয়বার যে হাত কাটছে। মেলা দুষ্টামী করতো। আইজকা এলা কথা কিল্লিগা কইতাছি জানো? বোইনডার আমার বিয়া ঠিক হইছে। আর কয়ডা দিন। তারপর যাইবোগা শশুরবাইত। আর দেখা সাক্কাত কইত্তে? যহন তহন আর ডাকলে ছুইট্টা আইবো না। বুড়ি কইয়া ডাকবো না। তাই আর কি একটু খারাপ লাগতাছে।

কথাটা শুনে যেন আমি হাবা হয়ে গেলাম। নিজেকে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মনে হচ্ছে। ঈশান উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে? কার বিয়ে?

কার আবার? আমগো তারুর!

ঈশান যথেষ্ট অভিঘানিত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আর আমার অবস্থা তো তার চেয়েও দিগুন অভিঘানিত। বুড়িটা ঈশানের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায় গলা খাকারি দিল। বলল,

শুনো ভাই, তুমি আমার তারিফের মতো। আমার নাতির বয়সী। তাই তোমারে কইতাছি। বোইনডার আমার বিয়ার বয়স তো হইছে। এই সতেরোডা বছর ধইরা আমগোর কাছে ছিল। আর ওহন যাইবো একটা অপরিচিত জায়গায়৷ একটা অপরিচিত পরিবেশে। তোমার লগে আলাপ করতে আইছিলাম আর কি পোলার সম্পর্কে। তুমি শিক্ষিত মানুষ। ভালো বুঝবা..

ঈশান বলে উঠলেন,

দাদী এটা তো ঠিক না। যদি আমার অপিনিয়ন চান তাহলে আমি স্ট্রেইট না করবো। মাত্র সতেরো বছর কি বিয়ের বয়স হলো নাকি? এখন তো লেখাপড়ার সময়। বিয়ের জন্য আরও অনেক টাইম আছে। না, দাদী আমি এই বিষয় সহমত হতে পারলাম না।

ঈশান শার্টের কলার ঠিক করছেন। ভীষণ ঘামছেন উনি। ধবধবে নিখুঁত ত্বকে বিন্দু বিন্দু জলের উপস্থিতি আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে উনার চেহারা, গলা, অল্প লোমযুক্ত হাত।

বুড়ি মাথা নিচু করে হতাশাজনকভাবে উচ্চারণ করল,

ওইডা তো জানি। ওহন মাইয়ারা অনেক দুর লেখাপড়া করে, চাকরি বাকরি করে। কিন্তু আমাগো পরিবারটা তো আর হেমন নাই। বুঝোই তো বাপ মরা মাইয়ার বিয়া দেওয়া কি আর সোজা সাপটা ব্যাপার? এহন একটা ভালা সম্বন্ধ আইছে। সবসময় কি আর এমন আয়ে? এই সুযোগ হাতছাড়া করোন ঠিক হইবো কি?

অবশ্যই। ক্যান্সেল করে দিন। কোনো দরকার নেই। মানে আমি বলতে চাইছি যে এখন বিয়ের কি দরকার? পিচ্চি একটা মেয়ে। ও বিয়ে শাদীর কি বোঝে।

আমি সরুচোখে তাকালাম। ঈশান কপালে ভাজ নিয়েই হাসার চেষ্টা করে বললেন,

সময় যখন আসবে, বিয়ে এমনিই হবে। যার নেওয়ার সে এখন হলেও নিবে আর পাচ বছর পরে হলেও নিবে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তারিনের ফিউচার নষ্ট হয়ে যায়, এমন কিছু করবেন না প্লিজ।

বুড়ি বলল, পাচ বছর পর? এমন পোলা কি তামাল পিত্তিবিতে আছে? আমাগো মাইয়ার লাইগা পাচ বছর অপেক্ষা করবো? কি যে কও না! এমন দরদী কেউ নাইগো!

ঈশান বললেন, থাকবে না কেনো? নিশ্চয়ই আছে। হতে পারে আপনাদের আশেপাশেই আছে। কিন্তু আপনারা নোটিস করছেন না।

বুড়ি ঠোট উচু করে হাসল। বলল,

আশেপাশে আছে? কি কও? আমাগো এলাকার পোলারা তো সব মেট্রিক ফেল। কেউ গ্যারজে কাম করে, কেউ দোকানদারি করে, কেউ আবার কাপড়ের দোকানে কাম করে। এমন পোলার কাছে কি বিয়া দেওন যায়?

ঈশান বিরক্তি নিয়ে বললেন, আশেপাশে বলতে কি শুধু এরাই আছে নাকি? আরো ভালো ছেলেও আছে, খুজলেই পাওয়া যাবে।

বুড়ি দুই হাত একত্র করে বলল, ঠিকাছে৷ তাইলে খুইজা দাও দেখি। কত ভালো পোলা পাওন যায়। তোমারে এক সপ্তাহের মতো সময় দিলাম। এর মধ্যে যদি উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান দিতে পারো, তয় এই বিয়া ক্যান্সেল। নাইলে কলাম তারুর বিয়া আমি এইহানেই দিমু। এইডাই আমার শেষকথা। গেলাম ভাই, বোইন গেলাম।

বুড়ি শাড়ির দুই সাইড হালকা উচু করে ধরে ধীর গতিতে হেটে বেরিয়ে গেলো। ঈশান বড় করে হাফ ছেড়ে কপালের ঘাম মুছে নিলেন। ঘাসের মতো লম্বা চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে ডিশ থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিলেন। ঢকঢক করে গিলে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করলেন এক নিমেষে। টেবিলের সাথে গ্লাসের নিম্নতল লাগিয়ে শক্ত ভাবে চেপে ধরে কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। আর আমি? বেশ মনোযোগের সাথে উনার ছন্দোবিশ্লেষণ করছি। ঈশান আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,

বিয়ের কথা আমাকে আগে জানাও নি কেনো?

আমি ঘোর কাটিয়ে জবাব দিলাম। রোষপূর্ণ কণ্ঠে বললাম,

আমি নিজেই তো জানতাম না। আপনাকে কি করে জানাবো?

ঈশান চিন্তিত মুখে উচ্চারণ করলেন, ও আচ্ছা।

আমি বইখাতা গুছাতে গুছাতে বললাম, আচ্ছা এখন নিচে যাই ঠিকাছে? ডিনার টাইম হয়ে গেছে, আপনিও নিচে আসুন।

ঈশান মাথা ঝাকালেন। আমি চটজলদি বইখাতা তুলে নিয়ে নিচে চলে আসলাম। এক দৌড়ে বইখাতা নিজের ঘরে রেখে এসে মায়ের ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই পা বাড়াচ্ছিলাম। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলাম না। তার আগেই বুড়ির উদ্ভট হাসির শব্দ শুনে থেমে দাড়াতে হল আমায়। আমি শুনলাম, বুড়িটা মায়ের সাথে কথা বলছে। আর খুব মজা নিয়ে হাসছে। বলছে,

বুঝছোনি আয়েশা। পোলার মুখের অবস্থাডা যদি দেখতা। ডরে চিমায় আছিল। কয় না না দাদী। বিয়া দেওয়ার দরকার নাইগগা। আরো ভালা পোলা আছে। আমিও কইলাম খুইজা দেহাইতে। এবার খালি অপেক্ষা করো। বিয়ার প্রস্তাব আইলো বইলা।

আমি কোমরে হাত রেখে চোখ সরু করে তাকালাম। তাহলে এই ছিল বুড়ির মনে? ঈশানের যা অবস্থা দেখে আসলাম, টেনশনে টেনশনে পাগল না হয়ে যায়।

.

.

আজ সন্ধ্যায় নিহা এসেছে আমাদের বাসায়। স্বচক্ষে তার ঈশান ভাইকে দেখার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে। বিশাল অট্টালিকার মালিক থেকে ছোট্ট চিলেকোঠার ভাড়াটে হয়ে কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন তাদের অভদ্র সোসাইটির ভদ্রম্যান? অতিরিক্ত ভদ্রতাও যে স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, ঈশান ভাইয়া তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। এমনটাই মতবাদ পোষণ করছে নিহা। তবে নিহাকে দেখেও ঈশানের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর হয়নি। তিনি বেশ ভালো করেই জানে নিহা কখনো উনার গুণকীর্তনের বুলি মোহনা আন্টির কানে পাচার করবে না। তাইতো খুব নিশ্চিন্তে বাড়ির সবাইকে এইটা বুঝানোর তালে আছেন, যে আমার পাশাপাশি উনি নিহারও ম্যাথ স্যার। ফুফাতো ভাই থেকে ম্যাথ স্যার। ঈশান আর তারিফ ভাইয়া ড্রয়িং রুমে বসে কার্ড খেলছেন। ভাইয়ার হু হা হাসির অত্যাচারিত শব্দ কানে ভেসে আসলেও ঈশানের কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু মাঝে মাঝে কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বিয়ের বিষয়টা নিয়ে এখনো বেশ চিন্তিত ঈশান। আমি আর নিহা উঠানের উচু অংশে বসে নিম্নাংশে পা দুলাচ্ছি। আমি অনেকটা ঠাট্টার ছলে নিহাকে জিজ্ঞেস করলাম,

কেমন দেখলি তোদের ভদ্র মিথ্যুকম্যানকে?

নিহা আমার দিকে না তাকিয়ে আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে কপালে ভাজ টেনে বলল,

যা বুঝলাম, ঈশান ভাইয়া তোকে মারাত্মক ভালোবাসেন।

আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলাম। নিহা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

শোন তারু, তুই খুব লাকি। ঈশান ভাইয়ার মতো মানুষ পাওয়া কিন্তু চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। উনার প্রতি বিশ্বাস আর সম্মানটা আমার আগে থেকেই ছিল। আর এখন সেই বিশ্বাস আর সম্মান কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

তাই নাকি? কিভাবে?

নিহার আমার দিকে ঘুরে বসল। আমার কোল স্পর্শ করে বলল,

আচ্ছা তুই এই কথাটা চিন্তা কর। শুধুমাত্র তোকে বাচাতে গিয়ে উনি নিজে কয়টা মিথ্যে কথা বললেন আন্টি আর ভাইয়ার সাথে। যেখানে উনি মিথ্যে কথা বলা সবথেকে অপছন্দ করতেন। আর এখন উনি মিথ্যে বলাটা কি চমৎকার ভাবে আয়ত্ত করে নিয়েছেন। তোর খাতিরে। আচ্ছা নিজের বাড়ি ছেড়ে, একটা ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন জায়গায় নিজেকে খাপ খাওয়ানোটা কি কোনো নরমাল ব্যাপার মনে হয় তোর কাছে? যেখানে উনার পৃথিবী আর তোর পৃথিবী সম্পুর্ণ আলাদা। তুই পারবি নিজের বাড়ি ছেড়ে, ভাইয়া আন্টি কে ছেড়ে ঈশান ভাইয়ার বাড়ি গিয়ে থাকতে? এই কথা চিন্তা করতে গেলেও তো তোর অস্বাভাবিক মনে হয় রাইট?

আমি মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালাম। নিহা বলল,

কিন্তু বিয়ের পর সব মেয়েদের ঠিকই এডজাস্ট করে নিতে হয় ভিন্ন পরিবেশে। এমন ক্ষমতা আল্লাহ প্রদত্ত। শুধু মেয়েদেরই থাকে। আর একটা ছেলের পক্ষে এই সেইম কাজটা যে কতটা কঠিন সেটা তুই আন্দাজও করতে পারবি না। অথচ এই কঠিন কাজটাই ঈশান ভাইয়া করছেন। উনি যে কতটা স্ট্রাগেল করে এইখানে আছেন, সেটা আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝতে পারছি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, নিহা স্ট্রাগেলের কি আছে? মা আর ভাইয়া তো উনার যথেষ্ট যত্ন আদ্দি করছে। উনাকে আমাদের ফ্যামিলির অংশ ভাবছে।

হ্যা বুঝলাম। আন্টি খুব টেক কেয়ার করছে ঈশান ভাইয়ার। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তুই তো ঈশান ভাইয়াদের বাসায় গিয়েছিলি। একবার ভেবে দেখ তো, ওই পরিবেশ আর এই পরিবেশ কতটা আলাদা! বলতে গেলে আকাশ পাতাল তফাৎ। যেখানে উনি এসি ছাড়া এক মুহুর্ত বসতে পারেনা। সেখানে তোদের বাসার টিনের গরমেও উনি ঘর্মাক্ত দেহ নিয়ে নির্দ্বিধায় বসে আছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। ফ্যানের শা শা শব্দটাও উনার সহ্য হয়না। অথচ তোদের ওই চিলেকোঠার ফ্যানের ঘটর ঘটর শব্দ শুনেই উনি রাত্রিযাপন করছেন। আন্টি খাবারে যে পরিমাণে ঝাল দেয়, ঈশান ভাইয়া তো জীবনে এতো মশলাযুক্ত খাবার খায়না। কিন্তু এবার উনাকে তিনবেলা মশলাযুক্ত ঝাল খাবার খেতে হচ্ছে। চা কফিতে উনি জীবনেও ঠোট ছোয়ায় না। ঠান্ডা জুস পেলে উনার শান্তি। আর এখন তোদের বাসায় সকাল বিকাল চা খাচ্ছে কি অবলীলায়। ঈশান ভাইয়ার বাগানের পেছনে পাখির বাসা দেখেছিলি তুই? ওই পাখিগুলো উনার প্রাণ। দৈনিক নিজহাতে দানা খাওয়াতেন পাখিগুলোকে। কতটা যত্নে রাখতেন। আমাদের তো পাখি এরিয়ায় ঢুকতেও দিতেন না। পাখি ভয়ে পালিয়ে যাবে বলে। আর এখন প্রাণপাখিগুলোর মায়া ত্যাগ করে উনি এখানে এসে বসে আছেন। তোদের ওয়াশরুম, বেডরুম, ড্রয়িং রুম। সব জায়গাতে উনাকে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে হাসিমুখে। বোঝাতে হচ্ছে উনি খুব ভালো আছেন। খুব শান্তিতে আছেন। কিন্তু আসলেই কি এখানে উনি কমফোরটেবল? এরপরেও বলবি উনি স্ট্রাগেল করছে না? ভাগ্যিস মোহনা আন্টি এখানে নেই। ছেলের এমন পরিবর্তন দেখলে আন্টি স্ট্রোক করে মারা যেতো। সত্যি ভালোবাসার জন্য মানুষ কিনা পারে! নিজের বাড়ি ছেড়ে ছোট্ট চিলেকোঠার ভাড়াটেও হয়ে যেতে পারে। এমনকি উবার ড্রাইভারও হতে পারে। আর কোচিং এর ম্যাথ টিচারও।

নিহা তার বক্তব্য শেষ করে চায়ে চুমুক দিল। আর আমি চিন্তা করতে লাগলাম, আসলেই তো। উনার এখানে থাকতে যথেষ্ট অসুবিধা হওয়ার কথা। ধরতে গেলে প্রতিটা মুহুর্তেই উনাকে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আর এইটা উনার চেহারায় একদমই প্রকাশ পাচ্ছে না। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে তাকালাম। পর্দার আড়াল থেকে ঈশানের মুখটা দেখা যাচ্ছে। ভাইয়ার সাথে কথা বলতে বলতে আনমনে হাসছেন উনি। প্রাণবন্ত হাসি।
🍂

চলবে

তি আমো পর্ব-০৯

0

#তি_আমো❤
#পর্ব_৯
Writer: Sidratul muntaz

🍂
সকাল দশটা। বিছানায় বসে আছি। কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভাঙল। তাও উদ্ভট শব্দের অত্যাচারে। এতো শব্দ কোথ থেকে আসছে বুঝতে পারছি না। মাথায় অজস্র চিন্তা ভর করে আছে আমার। গতকাল ঈশানের সাথে আলাপের শেষ সিদ্ধান্ত জানা হয়নি। উনি খুব দ্রুতই প্রস্থান করেছিলেন বাসা থেকে। মা-ভাইয়াকে কি বলে মেনেজ করলেন কে জানে? তবে উনার মিথ্যে বলার কৌশল টা ব্যাপক ছিল। এতো নিখুঁতভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে বিষয়টা হ্যান্ডেল করেছেন, যে মা ভাইয়া কিছু বুঝতেও পারেনি। এইজন্য উনাকে একটা ধন্যবাদ তো দেওয়াই যায়। ঈশানকে ধন্যবাদ দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। এরই মধ্যে ফোন বেজে উঠল। মোহনা আন্টির নম্বর। একটু অবাক হলাম। অবাক হয়েই রিসিভ করলাম ফোন। আমি কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে আন্টি উচ্চারণ করলেন,

তারিন! কেমন আছো?

জি আন্টি ভালো। আপনি ভালো আছেন?

ভালো আর থাকলাম কই বলো! ছেলেটা যা শুরু করেছে।

কেনো আন্টি? ঈশান ভাইয়ার কথা বলছেন?

হুম। হুটহাট প্ল্যান করে ফ্রেন্ড দের নিয়ে ট্যুরে যাচ্ছে। বান্দরবান। হোটেলও বুক করে ফেলেছে। আর আমি কিছুই জানিনা। আজ সকালে জানতে পেরে তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছে।

বান্দরবান ট্যুরে যাচ্ছেন? হঠাৎ এমন পরিকল্পনা কেনো?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না মা! কি বাতাস লেগেছে কে জানে? আচ্ছা শোনো, তোমাকে যে কারণে ফোন করেছি। ওই ছেলেটা কি তোমাকে এখনো জ্বালায়?

ক কোন ছেলে আন্টি?

আরে ওইযে, পার্টির ওই অসভ্যটা।

না আন্টি। এখন আর তেমন প্রবলেম করে না।

হুম। কিন্তু করলেও তুমি একদম ভয় পাবেনা। শুধু তোমার এই মোহনা আন্টির কথা একবার মনে করবে।সাথে সাথে আমাকে ফোন করবে। তারপর আমিই ব্যবস্থা করবো। কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দিবো শালাকে। আমার একটা পরিচিত গ্যাং আছে বুঝেছো তারিন? ওদের কাছে গিয়ে কিছু পয়সা খসালেই কাজ হয়ে যাবে। এমন টাইড দিবে, জীবনে আর কোনো মেয়েকে অসম্মান করা তো দূরে থাক। প্রতিটা মেয়েকে বোনের চোখে দেখবে। তোমার ধারে কাছে ঘেষারও আর সাহস পাবে না। বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?

জি আন্টি। বুঝতে পারছি।

ওই ছেলে আর কিছু করলে তৎক্ষণাৎ আমাকে জানাবে। মনে থাকবে?

জী আন্টি। মনে থাকবে।

হুম। গুড গার্ল। মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার এই মিষ্টি মামনিটাকে যে এইভাবে জ্বালায়! তাকে আমি ছেড়ে দিবো ভেবেছো? ওই বদের আসলে একটা শিক্ষা প্রাপ্য।। আচ্ছা তারিন? তুমি কি ওই ছেলেটার নাম- ঠিকানা কিছু জানতে পেরেছো?

জি না আন্টি। সেরকম কিছু তো জানতে পারিনি।

জানতে পারলে ভালো হতো। আমি নিশ্চিত লো ক্লাস ফ্যামিলির কোনো ছেলে হবে। পারিবারিক শিক্ষার অভাবে এই হাল হয়েছে। ছেলের মাকে পেলে না, আমি সবার আগে জিজ্ঞেস করতাম। কিভাবে মানুষ করে এসব ছেলেদের? একেকটা কুলাঙ্গার পয়দা করে সমাজে ছেড়ে দেয়। এসব মা-বাবাকে আসলে সন্তান মানুষ করা শিখিয়ে দেওয়া উচিৎ। মা-বাবার শাসন থাকলে ছেলেমেয়ে এমন হয় বলো? কই আমার ঈশান তো কখনো কোনো মেয়েকে অসম্মান করেনি। তুমি বিশ্বাস করবে না তারিন! এ যুগের ছেলে হয়েও আমার ঈশান আজ পর্যন্ত একটা রিলেশনও করেনি, ২৪ বছর হতে চলল ছেলেটার। আর আজকালকের ছেলেমেয়েরা তো এ বি সি ডি শেখার আগেই প্রেম করা শিখে যায়। কিন্তু আমার ঈশান? সেই তুলনায় যথেষ্ট ভালো। এই যুগের তুলনায় তো হাজার গুণে ভালো। নিজের ছেলে বলে বাড়িয়ে বলছি না। তুমি তো নিজেই দেখেছো। আর নিহার কাছেও নিশ্চয়ই শুনেছো? আমি কি একটুও বাড়িয়ে বলছি?

না আন্টি। একদমই বাড়িয়ে বলছেন না। ঈশান ভাইয়া তো আসলেই খুব ভালো মানুষ।

হুম! এভাবেই মানুষ করেছি ছেলেকে। চ্যারিটি, ম্যানার্স সবই শিখিয়েছি। ঈশান সব আমার গুণ পেয়েছে। আচ্ছা শোনো তারিন, এখন রাখছি হুম? ঈশানকে বিদায় দিতে হবে। ব্যাগপ্যাক করে সব গুছিয়ে ওয়েট করছে হয়তো আমার জন্য। তুমি বাসায় এসো মা?

জী আন্টি। আপনিও আসবেন একদিন আমাদের বাসায়। ঘুরে যাবেন। সত্যি খুব ভালো লাগবে।

মোহনা আন্টি হাসলেন। বললেন,

ঠিকাছে মা! অবশ্যই আসবো। রাখি তাহলে? বায়।

জি আন্টি। আল্লাহ হাফেজ।

আমি ফোনটা কেটে দিলাম। মোহনা আন্টির জন্য মায়া লাগছে। এতো বড় মুখ করে ছেলের গুণগান করলেন। কিন্তু যখন জানতে পারবেন, উনার আদরের ছেলেই নাটের গুরু! তখন কি করবেন আল্লাহ মালুম। অতিরিক্ত শকে স্ট্রোক না করলেই হলো। ছাদের উপর ঠক ঠক শব্দটা বেড়েই চলেছে। কি এমন হচ্ছে জানা দরকার। আমি ওরনাটা গলায় জড়িয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম। চিলেকোঠার ঘরটা মেরামতের কাজ চলছে। কিন্তু হঠাৎ এসব কেন? তাও আবার সকাল সকাল? কৌতুহল মেটাতে ছুটে গেলাম রান্নাঘরে। মায়ের কাছে। মা চুলার পাশে দাড়িয়ে সবজি কাটছিলেন। আমি মায়ের পাশে গিয়ে দাড়ালাম। বললাম,

মা? ছাদে এসব কি হচ্ছে?

কি হচ্ছে?

ঘর মেরামত করানো হচ্ছে হঠাৎ?

ভাড়া দিবো তাই। আজকে নতুন ভাড়াটে আসবে।

মানে?? কাকে ভাড়া দিয়েছো ঘর?

কাকে আবার? তোর স্যারকে! কোচিং এর ম্যাথ স্যার!

মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল আমার। মোহনা আন্টির বলা কথা গুলো এবার বুঝতে পারছি। বান্দরবানে ট্যুর দেওয়া তো শুধু একটা বাহানামাত্র। ভদ্রম্যান আসলে ভদ্রতার সহিত তার মায়ের সাথে মিথ্যে কথা বলে আমাদের বাড়িতে আসছে। এবার কি হবে? পেছন থেকে বুড়ির কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকালাম। দুই হাত কোমরে গুজে বুড়িটা বলছে,

পোলারে এমনে এমনে বেশিদিন বাসায় রাহন যাইবো না। মাইনসে আ- কথা কু- কথা কইবো। তার চেয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিয়াডা আগে সারতে হইবো। তারিফের লগে আলাপ টা পারসিলা?

বুড়ির কথা শুনে আমি বিস্মিতচোখে তাকালাম। মা সবজি কাটা বাদ দিয়ে আপত্তিকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমার সামনে বুড়ি এই কথাটা বলুক, এটা হয়তো চায়নি মা। তার মানে আমার দৃষ্টির অগোচরে আসলে অনেক কিছুই হচ্ছে। আর আমি তো ঘুমিয়ে আছি। ভাইয়াও কি বিয়েতে মত দিয়ে দিলেন? মা বুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,

আমি তারিফের সাথে পরে কথা বলবো মা। তারু? তুই ঘরে যা এখন।

এই মুহুর্তে মাকে অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে আমার। বিষয়টা মহামারী আকার ধারণ করার আগেই সব আটকাতে হবে। প্রয়োজনে মায়ের কাছে সত্যিটা স্বীকার করে নিবো। তাও ভালো।কিন্তু বুড়ির সামনে কিছু বলা যাচ্ছে না। মাকে একলা পেলে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে। এই কথা মাথায় রেখেই টলমল চোখ নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। ঘরে গিয়ে ধপ করে বিছানায় বসতেই ফোনটা বেজে উঠল তীক্ষ্ণ শব্দে। আমি ফোন হাতে নিলাম। নিহার ফোন। রিসিভ করে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,

হ্যালো।

কেমন আছিস?

ভালো। তুই?

আমি তো ভালোই আছি দোস্ত! তুই খবর পেয়েছিস?

কিসের খবর?

ঈশান ভাইয়া তো কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাহিরে যাচ্ছে। ট্রিপে। তোকে বলেনি?

তুই ভুল জানিস। উনি কোনো ট্রিপে যাচ্ছে না। আমাদের বাসায় উপরতলার ভাড়াটে হয়ে আসছেন।

কি??

.

.

ছাদের কার্নিশে হাত রেখে দাড়িয়ে আছি আমি। পেছনে মা আর ভাইয়া ঈশানের সাথে কথা বলছেন। পাশের বাড়ির বুয়া বাসন্তী খালা এসেছেন ঘরটা পরিষ্কার করার জন্য। উনি ডেটল দিয়ে সম্পুর্ন ঘর ধোয়ামোছার কাজ করছেন। আমি দাড়িয়ে দেখছি, মা, ভাইয়া আর ঈশানের আলাপ শুনছি। ভাইয়া ঈশানের কাধে হাত ঠেকিয়ে বলছেন,

দেখো ভাই। তুমি নিজের বাড়ি মনে করে যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারো এখানে। তুমি না আসলে কিন্তু এই ঘরটা আমরা কখনো ভাড়া দিতাম না। তাই তোমার জন্য নির্দিষ্ট কোনো অ্যামাউন্ট ফিক্সড করলাম না। তোমার সুবিধামতো তুমি ভাড়া দিবে। কোনো সমস্যা নেই।

মা বললেন, হ্যা বাবা। আর খাওয়া দাওয়ার বিষয় নিয়ে একদম সংকোচ করবে না। আজ থেকে আমাদের পরিবারের তুমিও একজন। তাই নিজের মায়ের মতো নিঃসংকোচে যখন যেটা লাগবে আমাকে জানাবে।

ভাইয়া বললেন, আর আমি ভাইয়ের মতো। কোনো সাহায্য লাগলে বলবে।

ঈশান বললেন, আন্টি, আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আসলে একা বাসায় থেকে থেকে একাকিত্বের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল। এখানে এসে তাও একটা ফ্যামিলি পেয়েছি। এটা ভেবেই সবথেকে বেশি ভালো লাগছে।

মা বললেন, তোমার মাকে কিন্তু আমার সালাম জানিও। আর এটাও বল, এখন থেকে একটা নতুন মা পেয়েছো। উনার ছেলের দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিয়ে উনি যেন নিশ্চিন্তে থাকেন।

ঈশান বললেন, মা জানলে আসলেই খুব খুশি হবেন।

তারিফ ভাইয়া ঈশানের পিঠ চাপড়ে বললেন, তাহলে তুমি এখন রেস্ট নাও? আমরা আসছি। সন্ধ্যায় নিচে এসো। আড্ডা হবে।

ঈশান উত্তরে একটা হাসি দিল। মা আর ভাইয়া চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বাসন্তী খালাও কাজ শেষ করে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ঘর শুকানোর জন্য পাচ দশমিনিটের মতো অপেক্ষা করতে। বর্তমানে আমি আর ঈশান ছাড়া ছাদে কেউ নেই। আমি ঈশানের দিকে ঘুরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়ালাম। উনি আগে থেকেই আমার দিকে ঘুরে আমার বরাবর সামনের দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে আছেন। আমি ভ্রু নাচিয়ে তাকালাম ঈশানের দিকে। উনি মুচকি হাসলেন। আমি এবার উনার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। বললাম,

আচ্ছা? মিথ্যে বলার সময়, মানুষের তো একটু হলেও ভোকাল কর্ড কাপে। আপনার কি তাও হয়না? আপনি কি দিয়ে তৈরি?

উনি সায় দিলেন না। আশেপাশে তাকিয়ে উত্তর রেডি করছেন। এই সুযোগে আমি আরেকবার বললাম,

কৌশলে মিথ্যে বলার জন্য যদি কোনো খেতাব থাকতো, তাহলে সেই খেতাবে আমি আপনাকেই ভুষিত করতাম সন্দেহ নেই। আপনি আমার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ মিথ্যেবাদী। কিভাবে পারেন এতো সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলতে? ছোটবেলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মিথ্যে বলা শিখেছিলেন বুঝি? আচ্ছা আপনি একটা কাজ করুন না? মিথ্যেবাদীদের জন্য একটা ট্রেনিং সেন্টার খুলে বসুন। নাম হবে ” মিথ্যে বলার তালিম কেন্দ্র”। আর আপনি হবেন মিথ্যেবাদীদের মধ্যপন্থী।

বলতে বলতে ঈশানের দিকে আঙুল তাক করলাম আমি। উনি খপ করে আমার আঙুলটা ধরে ফেললেন। সোজা হয়ে দাড়িয়ে আমার দিকে সরু চোখে তাকালেন। বললেন,

যার জন্য মিথ্যে বলি সেইই বলে মিথ্যেবাদী?

পেছন থেকে গুণ গুণ আওয়াজ শোনা গেল। “বোঝেনা হেতে বোঝেনা। কিল্লাই বোঝেনা??” উদ্ভট কন্ঠের গানের আওয়াজ শুনে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। বুড়িটা ছাদে কাপড় নিতে এসে গান গাইছে।মাঝে মাঝে আমার আর ঈশানের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। তারপর আবার গুণগুণিয়ে বলছে, বোঝেনা, বোঝেনা হেতে বোঝেনা”!

ঈশান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন, কে উনি?

আমি কটমট চোখে ঈশানের দিকে তাকালাম। আর বললাম,

শুনুন! আপনি না, এই বুড়িটাকে লাফিং গ্যাস খাইয়ে দিন প্লিজ!

🍂

চলবে

তি আমো পর্ব-০৮

0

#তি_আমো❤
Writer: Sidratul muntaz
পর্ব- ৮
🍂
বেসিনে দাড়িয়ে দাতব্রাশ করছি। মা আমার আশেপাশেই ঘুরাঘুরি করছে। কালরাতে মা আর বুড়ির আলাপের শেষ সিদ্ধান্ত কি ছিল জানা হয়নি। জানতে চাওয়ার দুঃসাহসও দেখাইনি। তবে মনে হচ্ছে ঈশানকে বাসায় দাওয়াত করার ভুতটা মায়ের মাথা থেকে বিদায় হয়েছে। তাই এই নিয়ে আর কিছু বলে নি মা আমায়। নাহলে তো এতোক্ষণে কান কামড়ে খেতো স্যারের বাসার ঠিকানা চাইতে চাইতে। যাক, ভালোই হয়েছে। আমি মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে বসলাম। শক্ত শক্ত রুটি চিবাচ্ছি। অবশ্য শুক্রবারে শক্ত রুটি ছাড়া কপালে ভালো কিছু জোটে না। এটাও আমার নিজের দোষ। বেলা বারোটায় ঘুম থেকে উঠেও যে নাশতা খেতে পারছি, এইতো অনেক। মা হঠাৎ টেবিলে আমার পাশে এসে বসলেন। মুখটা মলিন করে বললেন,

শোন না মা! তারিফকে একটা মেসেজ পাঠাতে পারবি?

ভাইয়াকে মেসেজ? কেনো? কি হয়েছে ভাইয়ার?

আরে সেই ভোরবেলা বেরিয়েছে। কি বলে জরুরি কাজ ছিল। এখন যে রাস্তা দিয়ে ফিরবে ওই রাস্তায় নাকি এক্সিডেন্টের কারণে বড় গাড়ি চলা বন্ধ। বাস, ট্রাক কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু রিকশা আর কয়েকটা সি এন জি চলে। এখন এতোটা পথ কি রিকশায় আসা সম্ভব? আর সি এন জি তে উঠার মতো ভাড়াও নাকি নেই ছেলেটার কাছে। কি একটা অবস্থা বল তো?

এখন কি তাহলে বিকাশে টাকা পাঠাবে?

হ্যা সেজন্যই ফোন করছি। কিন্তু নেটওয়ার্ক বিজি। তাই মেসেজ পাঠিয়ে একটু জিজ্ঞেস কর তো, বিকাশে টাকা পাঠালে তুলতে পারবে কিনা?

মা আমার দিকে ফোন এগিয়ে দিল। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে বললাম,

আচ্ছা দাড়াও, আমি আরেকবার ফোন করে দেখি। তারপর মেসেজ দিবো।

আমি ফোনই করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ডায়াল লিস্টে ঢোকার আগেই তীক্ষ্ণ হর্নের শব্দ কানে আসলো। শব্দের উৎস বরাবর আমি আর মা সদর দরজার দিকে তাকালাম। বড় একটা গাড়ি দাড়িয়ে আছে। সেই গাড়ি থেকে নামছে ভাইয়া। আমি টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। ভাইয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মাও আমাকে অনুসরণ করে আসলেন। ভাইয়াকে এমন গাড়িতে দেখে প্রথমেই একটু হকচকিত হলাম আমি। তার থেকেও বেশি অবাক হলাম, যখন আবিষ্কার করলাম গাড়ির মালিক ঈশান।ঈশানকে ভাইয়ার সাথে নামতে দেখে আক্কেল গুড়ুম অবস্থা আমার। হা করে তাকিয়ে আছি। ভাইয়া প্রীতিকর হাসি দিয়ে ঈশানকে বলছেন,

ভেতরে আসলে খুশি হতাম। প্লিজ এসো একবার?

ঈশানের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সেও যথেষ্ট বিস্মিত। তারিফ ভাইয়া যে আমার বড়ভাই, এটা হয়তো ঈশান জানতেন না। আর এখন জানতে পেরেই বিস্ময় প্রকাশ করছেন। মা হঠাৎ উচ্চারণ করলেন,

তারিফ, ছেলেটা কি তোর পরিচিত।

হ্যা মা। বলতে পারো আমার বন্ধু। বিপদের বন্ধু। মাঝরাস্তা থেকে নিজের গাড়িতে তুলে বাসা পর্যন্ত পৌছে দিল। তুমি যে কি উপকার করেছো ভাই? তোমাকে আজ লাঞ্চ ট্রিট না দিতে পারলে আমার মন শান্ত হবে না।

তারিফ ভাইয়া বড় করে হাসলেন। ঈশান জোর পুর্বক হাসার চেষ্টা করে ইতস্তত গলায় বললেন,

থ্যাঙ্কস। কিন্তু আজকে মনে হয় তোমার কথাটা আমি রাখতে পারবো না। তবে নেক্সট টাইম অবশ্যই আসবো।

মা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, না। কোনো নেক্সট টাইম না। তুমি সবসময় একই কথা বলো। এবার আর তোমার কথা শুনব না। ভেতরে এসো বাবা।

তারিফ ভাইয়া ভ্রু কুচকে তাকালেন, সবসময় একই কথা বলে মানে? মা তুমি কি ওকে চেনো নাকি?

মা চোখ বড় করে হাসলেন। আর বললেন,

চিনি না মানে? ওইই তো তারুর কোচিং এর স্যার। আমাদের এলাকাতেই তো থাকে। সামনের গলিতে। সেদিন তারুকে বাসায় পৌছে দিল৷ তোকে বলেছিলাম না?

ভাইয়া আরো একটু ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নিচু করে রেখেছি। ঈশান ভাইয়াও যথেষ্ট অপ্রস্তুত বোধ করছেন। ভাইয়া কি একটা মনে করে ঈশান ভাইয়ার কাধে হাত রাখলেন। আরেকবার মুখে অমায়িক হাসি এনে বললেন,

এবার তো তোমাকে ছাড়ার প্রশ্নই আসছে না। বাসায় তোমাকে ঢুকতেই হবে। আমার বোনের স্যার বলে কথা! সম্মান আরেকটু বেড়ে গেলো। চলো ভেতরে গিয়ে কথা বলি।

মা উৎসাহ নিয়ে বললেন,

হ্যা এসো বাবা। তুমি আমার ছেলেমেয়ে দুজনেরই উপকার করেছো। তোমার কাছে তো আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। একবেলা নিজ হাতে রান্না করে না খাওয়াতে পারলে তারিফের মতো আমিও মনে শান্তি পাবো না। ভিতরে চলো।

ঈশান যথেষ্ট দ্বিধা নিয়েই ভেতরে ঢুকলেন। আর আমি দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছি। ভেতরে গিয়ে আর কি কি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কে জানে?

.

.

বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছে ঈশান আর ভাইয়া। মা আমার হাতে ট্রে ধরিয়ে দিলেন। ট্রে তে শরবত আর কিছু মিষ্টি। ঈশানদের কাছে নিয়ে যেতে বললেন। আমি পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকেই ঈশানের দিকে তাকালাম। উনার ঠোটের সেই কাটাচামচের আঘাতটা এখনো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আর এই আচড় টা যেন উনার কিউটনেসের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ট্রে টা টেবিলে রাখলাম। ভাইয়া আমায় জিজ্ঞেস করলেন,

মা কোথায় রে?

রান্নাঘরে।

আচ্ছা ঠিকাছে তুই যা। মাকে আসতে বলিস।

ভাইয়ার শেষ কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর কেমন জানি ধুকপুক করছে। আমি রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের কাছে ভাইয়ার বার্তা পৌছে দিলাম। মা আমাকে চুলায় বসানো মাংসের হাড়িতে নজর রাখতে বলে ড্রয়িং রুমের দিকে ছুটলেন। এদিকে আমার মনও রান্নাঘরে টিকছে না। ওদিকটায় কি নিয়ে আলাপ হচ্ছে সেটা না জানতে পারলে অস্থিরতা কমবে না। শেষমেষ মিথ্যে বলার জন্য ধরা পড়ে যাবো না তো? ঈশান যদি মুখ ফসকে কিছু বলে দেয় তাহলেই যে শুরু হবে এলাহী কান্ড। তার উপর বুড়িটা যদি একবার জানতে পারে সেদিন আমি কোচিং এ না গিয়ে পার্টিতে গিয়েছিলাম, তাহলে তো কালবৈশাখী শুরু হবে। মায়ের সাথে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলার জন্য মাও আমায় আস্তো ছাড়বে না। উফফ,, টেনশনে টেনশনে মাথা ধরে আসছে। আমি আর দাড়িয়ে থাকলাম না। গুটি গুটি পায়ে হেটে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে আছি। এক কথায় আড়ি পাতছি। মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে আসল,

আচ্ছা ঈশান! তুমি যে বাসায় একা থাকো, তোমার খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো অসুবিধা হয়না?

তারিফ ভাইয়া বললেন, ঈশান বাসায় একা থাকে? তোমাকে এই কথা কে বলল?

কেনো তারিন বলেছে। ওর বাবা-মা তো মফস্বলে থাকে। আর ও লেখাপড়ার জন্য এইখানে একা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। কি ঈশান? ঠিক তো?

ঈশান সংকীর্ণ গলায় বললেন, হ্যা। ঠিক।

তারিফ ভাই বললেন, তাহলে তুমি যে তখন ফোনে মায়ের সাথে কথা বলছিলে। জলদি বাসায় ফেরার কথাই তো বলছিলে। সেটা কি ছিল?

হ্যা। আমি বাড়ি ফেরার কথাই বলছিলাম। মফস্বলে।

ও! কোথায় তোমার বাড়ি? কোন জেলায়?

ঈশান আমতা আমতা করে বললেন, তারিন.. যেখানে বলেছে। সেখানেই।

তারিফ ভাই বললেন, তারিন কোনখানে বলেছে?

মা বললেন, তারিন তো জায়গার নাম বলেনি।

ঈশান দ্রুত গলায় বললেন, ও বলেনি? কিশোরগঞ্জ। আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জ।

তারিফ ভাই বললেন, আচ্ছা! তা এখান থেকে বেরিয়ে কি তুমি কিশোরগঞ্জ যাবে?

ঈশান বললেন, হ্যা। প্রত্যেক শুক্রবারেই যাই আর কি। মা বাবার সাথে দেখা করতে।

মা বললেন, এতোটা দুর প্রতি সপ্তাহে যাওয়া আসা করো? খুব কষ্ট হয়ে যায়না?

তারিফ ভাই বললেন, কষ্টের কি আছে? গাড়ি নিয়ে যায়। তাই হয়তো প্রবলেম হয়না।

মা দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন, তোমার নিজের গাড়ি?

ঈশান বললেন, জি? না। আমার নিজের গাড়ি না। গাড়িটা আসলে আমার ফ্রেন্ডের।

তারিফ ভাই বললেন, তোমার ফ্রেন্ডের গাড়ি তুমি চালাও?

ঈশান অনেক বিভ্রান্তি নিয়ে বললেন, হ্যা… আসলে শুধু কোচিং আর টিউশনির টাকায় আমার পোষায় না। দিনশেষে কোনো সেভিংস থাকে না তো!তাই একটু এক্সট্রা ইনকাম সোর্স হিসেবে উবার ড্রাইভিং করি। ফ্রেন্ডের সাপোর্টে।

তারিফ ভাই ঈশানের কাধে হাত রেখে বললেন, ও। তুমি উবার ড্রাইভার? তাহলে তো আমি আজকে তোমার বিরাট লস করে দিলাম ভাই! আমার জন্য তুমি যাত্রী পেলে না।

ঈশান বললেন, না ইটস ওকে। এটা সমস্যা না।

মা বললেন, আহারে। সত্যিই তোমাকে দেখে আমার অবাক লাগছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি এতো কষ্ট কিভাবে করো? আচ্ছা বাবা শোনো তোমাকে একটা অনুরোধ করি।

ঈশান বললেন, জি আন্টি।

মা বললেন, তুমি যদি চাও, তাহলে কিন্তু আমাদের বাসাতেই থাকতে পারো। আমাদের ছাদের উপরে একটা ছোট ঘর খালি আছে। তুমি সেখানে থাকলে আমাদের খুব ভালো লাগবে। খাওয়া দাওয়াটাও না হয় আমাদের সাথেই করলে? নিজের পরিবারের মতো? আর তারিনের জন্যও বাসায় একটা টিচার দরকার।

তারিফ ভাই বললেন, মা তুমি একদম ঠিক বলেছো। ঈশান, প্লিজ তুমি আমাদের সাথে থাকো। এইটা খুব ভালো হয়। তোমারও প্রয়োজন মিটবে, আর আমাদেরও।

ঈশানের উত্তর শোনার আগেই আমি দৌড়ে রান্নাঘরে চলে আসলাম। বেচারা আমার জন্য এইভাবে ফেসে গেল। এখন ইচ্ছে করছে কচু গাছের সাথে গিয়ে নিজের গলায় ফাস লাগাতে। ধুর! একটা মিথ্যাকে ঢাকতে আরো কত শত মিথ্যার জন্ম দিতে হচ্ছে। এই ঘটনাটা একবার শেষ হয়ে যাক, তারপর আর জীবনে মিথ্যা বলবো না।
🍂

চলবে

তি আমো পর্ব-০৭ ( অতিরিক্ত অংশ)

0

#তি_আমো❤
#পর্ব_৭(অতিরিক্ত অংশ)
Writer: Sidratul muntaz

🍂
পড়ার টেবিলে বসে বাংলা সাহিত্য পড়ছি। “বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ”। কবিতাটা অপরুপ সুন্দর। যত পড়ি শুধু পড়তেই ইচ্ছে হয়। যেন কাহিনির মধ্যে হারিয়ে যাই। মেঘনাদের উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ নিয়ে চিন্তা করতে ভালো লাগে। তবে বিভীষণের করা কাজটা ঠিক না বেঠিক সেটা নিয়ে এখনো আমার মনে বেশ বিভ্রান্তি আছে। তার থেকেও বেশি বিভ্রান্তি এখন আমার কবিতাটা পড়তে গিয়ে হচ্ছে। বারবার ঈশানের ঠোট কাটার দৃশ্যটা চোখে ভাসছে। পড়ায় একনিষ্ঠ হতে পারছি না। মা আমাকে পেছন থেকে ডাক দিলেন। ডাক দিয়ে বললেন,

তারিন তুই কি পড়ছিস?

আমি পেছনে না তাকিয়েই জবাব দিলাম,

হ্যা পড়ছি তো মা। কেনো? কোনো কাজ আছে?

না। একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।

আমি মায়ের দিকে ঘুরে তাকালাম৷ তাকিয়ে বললাম,

কি কথা মা?

তোর কোচিং এর ম্যাথ স্যারকে একদিন বাসায় দাওয়াত করবো ভাবছি।

ম্যাথ স্যার? আমাদের কোচিং এ তো কোনো ম্যাথ স্যার নেই? ম্যাডাম আছে।

মা ভ্রু কুচকে তাকাতেই জিভ কাটলাম আমি। ধুর, মিথ্যে কথা বলে কখনো শান্তি পাওয়া যায়না। সত্যিটা মুখ ফসকে বেরিয়ে আসবেই। যেমন এখন আমার হল। তবুও আমতা আমতা করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম,

আসলে ম্যাডাম আগে ছিল। স্যার নতুন এসেছে। কিন্তু উনাকে হঠাৎ দাওয়াত দিতে যাবে কেনো?

মা হেসে বললেন,

একই এলাকায় থাকে। শিক্ষক মানুষ। সম্পর্ক ভালো রাখা উচিত। আর তোকেও তো পৌছে দিল সেদিন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য হলেও একদিন বাসায় ডেকে খাওয়ানো উচিৎ।

আমি মাথায় হাত ঠেকালাম। মাকে বললাম,

দেখো মা। এসবের দরকার নেই।

মা ধমক দিয়ে বললেন, তুই বেশি বুঝিস না? তুই তো সম্মানও দিতে জানিস না মানুষকে। স্যারের সাথে তোমার কথা বলার ধরণ তো দেখলাম কাল। কি ভাববে মানুষ? ভাববে মা- বাবা আদব কায়দা শেখায়নি।

আমি মুখ কুচক মায়ের ধমক হজম করলাম। ঠোট বাকা করে অভিমানের সাথে উচ্চারণ করলাম,

ঠিকাছে তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। আমি কিছু বলবো না।

কিছু বলতেও হবে না। তুই শুধু স্যারের বাসার ঠিকানা দে আমাকে।

হয়ে গেলো তো ঝামেলা? এইটারই ভয় পাচ্ছিলাম। এবার কি বলি? আমি ধৈর্য ধরে মনে কথা সাজাচ্ছি। মিথ্যে কথা। এরই মধ্যে মা আবার বললেন,

কিরে বল? বাসা চিনিস তো? না চিনলেও সমস্যা নেই।এই গলির পরের গলি না? আমি খোজ নিয়ে বের করে ফেলবো। তুই স্যারের নামটা বল।

এইবার তো আমার হার্ট ওভার স্পিডে বিট করছে। মা খোজ নিতে গেলেই তো ধরা পড়ে যাবো। তাই সাত পাচ না ভেবে বলে উঠলাম,

চিনি তো। আমি স্যারের বাসা চিনি। মাঝে মাঝে নোটস এর জন্য যেতে হয়। কিন্তু স্যার বাসায় একা থাকে। তুমি যখন তখন গেলে স্যারকে পাবে না।

একা থাকে? কেনো? ছেলের মা বাবা নেই?

হ্যা আছে। থাকবে না কেনো। উনারা মফস্বলে থাকে। স্যার একা শহরে এসেছে পড়ালেখার জন্য। এবার বুঝেছো?

ও! মফস্বলের ছেলে? একদম বোঝা যায় না দেখলে। কথাবার্তা খুব সাবলীল। সুন্দর। আর দেখতেও তো বেশ।আচ্ছা তারিন? ছেলে কি ফ্ল্যাট বাসায় থাকে।

হ্যা, কেনো?

একা মানুষ, ফ্ল্যাট বাসা নিয়ে থাকার দরকার কি? আমাদের ছাদের ঘরটা তো খালি পড়ে আছে। জিজ্ঞেস করিস তো ভাড়া নিবে নাকি?

কি উল্টা পাল্টা কথা বলো মা? উনি নিজের বাসা ছেড়ে আমাদের চিলেকোঠার মতো ভাঙা ঘরে থাকতে যাবে কেনো? আজিব! মানে কুছ ভি?

বলেই জোরে শ্বাস নিলাম আমি।

ভাঙা ঘরে থাকবে কেনো? তারিফ তো ঘরটা মেরামতের কথা ভাবছে। আর দেয়াল গুলো রং করানো হলে একদম নতুন হয়ে যাবে ঘর। তারপর তো ভাড়া দেওয়াই যায়। আর তোর স্যারের কাছে ভাড়া দিলে তো লাভ আছে। তুই বাসাতেই ম্যাথ পড়তে পারবি। আমরা উনাকে কম টাকা দিয়ে রাখতে পারবো। তার বদলে ঘর ভাড়া নিবো না। কাটাকাটি হয়ে যাবে।

আমি কলমটা চেপে ধরে মায়ের বকবকানি শুনছি। কিছু বলতেও পারছি না। কি বলা উচিৎ জানা নেই আমার। আমি কিছু বলার সুযোগও পেলাম না। বুড়িটা পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। মুখটা পানের রসে টইটম্বুর হয়ে আছে। এমতাবস্থায় বুড়ি উচ্চারণ করল,

ঘর ভাড়া দেওনের দরকার কি? তোমার মাইয়ার লগে মাষ্টরের বিয়া করায় দিলেই তো হয়। তাইলে মাষ্টরের বেতনও দেওন লাগবো না। ফিরি পড়াইবো। আর পোলার যদি নিজের ভিতর আইত্তোসম্মান থাকে, তয় ঘর ভাড়াও পুরাডাই দিবো। এইডাই লাভ বেশি।

বুড়ির কথা শুনে কান আমার খসে পড়তে চাইছে। কি শুনলাম এটা? কুচুটে বুড়ির মাথায় সব কুচক্রীমার্কা বুদ্ধি। শখ কত বুড়ির! এখন মা আবার বুড়ির নাচে ঢোলের বাড়ি না দিলেই হল। আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মা বিভ্রান্তি নিয়ে বললেন,

এটা আবার কেমন কথা বললেন মা। তা কি হয় নাকি?

কে হইবো না কে? পোলা শিক্ষিত। দেখতে শুনতেও তো ভালাই। চান্দের লাহান মুখ। এমন ভালা পোলা কি সহজে পাওন যায়? আমি ভুল কি কইলাম।

তবুও মা। ছেলেমেয়ের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার আছে না?

পোলা মাইয়ার পছন্দ? তোমার মাইয়ার তো নাক সিটকাইন্না রোগ আছে। হের পছন্দ আমি গুরুত্ত দেইনা। পোলায় তোমার মাইয়ারে পছন্দ করে কিনা হেইডা হইলো কথা। পোলাডারে বাসায় ডাকো। আলাপ সালাপ কইরা কথা আগাও। না পারলে আমারে কইও। আমি ব্যবস্তা করুম।

আমি রাগে বাংলা বইটা নিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। ক্ষিপ্রগতিতে বড় বড় কদম ফেলে রুম থেকে বাহিরে চলে আসলাম। উঠানের উপর এসে বসেছি। তাও যদি বুড়ির আজাইরা পেচাল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ভয় লাগছে এখন মাকে নিয়ে। মা এবার কি করবে কে জানে? শেষমেষ ঈশানের সামনে মান সম্মান খোয়াতে হবে না তো?
🍂

চলবে