তি আমো পর্ব-৩১+৩২

0
1250

#তি_আমো❤
#পর্ব_৩১
Writer: Sidratul muntaz

🍂
ঈশান আর আমার চোখাচোখির মাঝখানেই একটা মেয়ে হাতে লম্বা ট্রে সহ ভেতরে প্রবেশ করল। মেয়েটার পরনে সাদা ধুতি টাইপ সেলোয়ার। পেস্ট আর ক্রিম কালার মিক্সড কামিজ, ধুসর রঙের ওরনাটা গলায় একদম আটশাট ভাবে ঝোলানো। সিঙারাতে বাদাম যেমন অপ্রয়োজনীয় জিনিস, এই মেয়েটার ওরনাটাও তেমন। অপ্রয়োজনীয়। টি টেবিলে খাবারগুলো রেখে মিষ্টি করে হাসলো মেয়েটি। ন্যাকামি করে চুলগুলো কানে গুজতে গুজতে সাফিন ভাইয়াকে সালাম দিল,

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া! ভালো আছেন?”

সাফিন ভাইয়া মাথা দুলিয়ে বলল, “হ্যা.. ভালো! তুমি ভালো আছো?”

মেয়েটি আড়চোখে ঈশানের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “জী ভালো।”

ঈশানের বাচনভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনি এই মেয়েটির উপস্থিতিতে চরম বিরক্ত। আর মেয়েটা আড়চোখে উনার দিকে তাকিয়ে হাসার পর উনার সেই বিরক্তি ক্ষিপ্ততার রুপ নিয়েছে। নাকের ডগায় গোলাপী আভা জমে উঠেছে উনার। আমি মেয়েটার ছন্দবিশ্লেষণ করতে লাগলাম। দেখতে শুনতে ভালোই। গায়ের রঙ অনেকটা কাজু বাদামের মতো। চোখ তেমন একটা সুন্দর না, আর ঠোটদুটো.. উহুম! এই মেয়ের ঠোটের থেকে আমার ঠোটই বেশি সুন্দর। মেয়েটার চুলগুলো লালচে,সনের মতো। কিন্তু আমার চুল কালো। রেশমের মতো। অবশ্যই আমার চুল সুন্দর। কিন্তু এটা আমি কি করছি? এই মেয়ের সাথে নিজের তুলনা কেনো করছি? এতো লেইম চিন্তাভাবনা আসছেই বা কি করে আমার মাথায়? আজব! হঠাৎ খেয়াল করলাম ভদ্রমহিলা আর মেয়েটা কেমন বিব্রতকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভদ্রমহিলার দৃষ্টি একটু বেশিই আপত্তিকর। আমাকে নিজের মেয়ের দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রমহিলা আবার সন্দেহ করছেন না তো? সামহাউ উনার এটা মনে হচ্ছে না তো যে আমি উনার মেয়ের সাথে লাইন মারছি? তাহলে তো মহা মুশকিল! ছেলেদের সমস্যাগুলো আমি এখন বুঝতে পারছি। স্বাচ্ছন্দ্যে কোনোদিকে তাকানোও যায়না। সবাই শুধু সন্দেহ করে। আমি মাথা নিচু করে রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেটাই বেস্ট অপশন। ভদ্রমহিলা আমাকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে বললেন,

“আমার মেয়ে এইটা। সায়রা। সায়রা ফারজানা।”

উত্তরে আমি কিছু বলতে গেলেই সাফিন ভাইয়া আমার কাধ খামচে ধরলেন। আমি চুপ করে গেলাম। ভদ্রমহিলার বিস্মিত দৃষ্টির উত্তরে সাফিন ভাইয়া হাসার চেষ্টা করে বললেন,

“ঈশানের কাজিন। আশফাক তারিক। আসলে ছেলেটা বাক প্রতিবন্ধী। কথা বলতে পারেনা।”

ভদ্রমহিলা খানিক অবাক হয়ে মায়া জড়ানো কণ্ঠে বললেন,” ও আচ্ছা!”

আমি অবাকচোখে তাকাতেই সাফিন ভাইয়া বিড়বিড় করে বললেন,

“তুমি কথা বললে সবাই বুঝে যাবে না, ছেলে না মেয়ে?”

কথাটা শুনে আমি একদম সাইলেন্ট মেরে গেলাম। এখন খালি মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে গেলেই বিপদ। চরম বিপদ। সায়রা মেয়েটি আবার ন্যাকা ন্যাকা ভাব শুরু করল। ঈশানের সামনে গিয়ে খুব আহ্লাদী কন্ঠে বলল,

“আজকে কখন আসবেন ভাইয়া? সন্ধ্যায় নাকি রাতে?”

ঈশান আড়চোখে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন, “জানিনা।”

বলেই পর্দাটা ঠাস করে সরিয়ে বের হয়ে গেলেন। ঈশানের উত্তরে সায়রা হতাশ হল। সেও বেরিয়ে গেল ঈশানের পেছন পেছন। তাই দেখে ভদ্রমহিলা জোর পূর্বক হেসে বললেন,

“ছেলেটা যে কেনো এমন! সারাখন মেজাজ গরম থাকে।”

সাফিন ভাইয়া উত্তরে মৃদু হাসলেও আমার দৃষ্টি দরজার বাহিরে।ক্রমাগত উঁকিঝুঁকি মারছি আমি। ভদ্রমহিলা আরেকবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি মাথা নিচু করে নিলাম। এই মহিলা হয়তো ভাবছেন আমি উনার মেয়েকে খুজছি। কিন্তু আসলে তো আমি আমার ঈশানকে খুজছি।এইটা কে বোঝাবে উনাকে?ধুর ভাল্লাগেনা! সাফিন ভাইয়া হয়তো আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারলেন। তাই ভদ্রমহিলাকে বললেন,

“আচ্ছা আন্টি আমরা এখন একটু ঈশানের ঘরে যাই।”

ভদ্রমহিলা দ্রুত বললেন, “হ্যা যাও!”

ঈশান জানালা ধরে দাড়িয়ে আছেন। উনার নির্বিকার দৃষ্টি বাহিরের খোলা মাঠে স্থির। আমি বিছানায় বসে আছি। খুব অগোছালো রুম। বিছানার চাদরটা পর্যন্ত এক সাইডে পড়ে আছে। ফ্লোরে সারিবদ্ধভাবে কাচের বোতল সাজানো। গ্লাস কয়েকটা উল্টো হয়ে পড়ে আছে। সেই সাথে পড়ে আছে রঙিন পানি। সাফিন ভাইয়া চেয়ারে বসে কিছু একটা চিন্তা করছিলেন। তারপর হুট করে বলে উঠলেন,

“ঈশান! ও তারিন।”

সাফিন ভাইয়ার কথা শুনে আমি ধক করে উঠলাম। ঈশান জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাফিন ভাইয়ার দিকে ঘাড় ঘুরালেন, কিন্তু তাকালেন না। শুধু বললেন,

“মানে?”

সাফিন ভাইয়া দুইহাত পেতে দিয়ে বললেন, “মানে তারিনকে নিয়ে এসেছি। এইটা তারিন। সারাদিন যার নাম ধরে যিকির পড়িস, প্রতি বাক্যে দশবার করে যার কথা শুনিয়ে কানের পোকা বের করে ফেলিস, যার জন্য জেন্টালম্যান থেকে মাতালম্যান হয়েছিস।এইটাই সে। তারিন।”

ঈশান সাফিন ভাইয়ার দিকে সম্পুর্ন ঘুরে তাকালেন। কিছুক্ষণ সোজামতো দাড়িয়ে রইলেন। সাফিন ভাইয়া হাত উঠিয়ে বললেন,

“তাকায় আছে বোকার মতো। কানে শুনতে পাস না? আরে বেটা তারিন, তারিন! বিয়া-টিয়া কিচ্ছু হয়নাই ওর। তোর শালায় তোরে ঢপ মারছে ঢপ। ধাপ্পাবাজী করছে। বুঝছোস?”

ঈশান কুচকানো ভ্রু নিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি চশমা, পাগড়ি, আর্টিফিশিয়াল দাড়ি, সব খুলতে শুরু করলাম। কালো কোর্টের আড়াল থেকে বেরিয়ে সাদা টি শার্ট পরিহিত অবস্থায় উঠে দাড়ালাম। ঈশান হা করে তাকিয়ে আছেন। যেন কোনো ভুত দেখছেন। চোখেমুখে চরম বিস্ময় উনার। তৃপ্তিভরা বিস্ময়। আমি আবেগে সিক্ত হয়ে কেদে ফেললাম। ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে গিয়ে ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরলাম। আমার ভারে ঈশান কয়েক কদম পিছিয়ে পড়লেন। আমার পা জমিন থেকে কমপক্ষে হাফ ফিট উপরে। কিছু সময় পর উনিও নিজের সাথে মিশিয়ে ধরলেন আমায়। উনার সাপোর্ট পেয়ে আরো একটু উচুতে উঠে ঈশানের দুই গালে, কপালে, নাকে সারামুখে চুম্বন শুরু করলাম। সাফিন ভাইয়ার উপস্থিতি সম্পুর্ণ ভুলে গেছি। যেন দুনিয়াতে ঈশান ছাড়া আর কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। ঈশানের অবস্থাও তাই। আমাকে টেনে তুলে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে শুরু করলেন।চোখ দুটো উনার পিপাসার্ত, অনুভুতিতে সিক্ত। ক্ষুধার্ত এই দৃষ্টি দিয়ে যেন আমাকে ভক্ষণ করছেন উনি। আমি পুনরায় উনার গলা জড়িয়ে ধরলাম। ঈশান প্রশান্তির একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ধীরকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,

“এটা কি স্বপ্ন তারিন? যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে আমি জাগতে চাইনা।চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে থাকতে চাই।”

আমি কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললাম,” স্বপ্ন না, সত্যি। সত্যিই আমি এসেছি ঈশান। সব ছেড়ে, আপনার কাছে চলে এসেছি।বাস্তবে আমি এসেছি। দেখুন আমায়।”

আমি মাথা তুলে তাকালাম। ঈশান কাতর কণ্ঠে বললেন,

“তাহলে আমি আর কখনো ঘুমাতে চাইনা।”

“কেনো?”

“যদি আবার হারিয়ে যাও!”

“আপনি ঘুমালে আমি হারিয়ে যাবো ?”

“সেদিন তো ঘুমের জন্যই হারিয়েছিলাম তোমাকে। এমন আর কোনোদিন হবে না। আর কখনো ঘুমাবোই না আমি! প্রমিস! ”

ব্যাকুল কণ্ঠে ‘প্রমিস’ উচ্চারণ করলেন উনি। ঈশানের পাগলামিতে আমি কান্নারত অবস্থাতেই হাসলাম। উনি আমাকে হারানোর জন্য নিজের ঘুমকে দোষারোপ করছেন!সাফিন ভাইয়া সশব্দে করতালি বাজালেন। চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে বললেন,

“নিজেকে এখন সিনেমার কমেডিয়ান মনে হইতাছে আমার। মানে হাততালি দেওয়া ছাড়া তো আর কোনো কাজ নাই। দেখ তোদের লজ্জা শরমের বালাই নাই-ই থাকতে পারে, কিন্তু আমার তো আছে। তাই আমি যাইগা। বিরিয়ানির এলাচি হইয়া কি লাভ! বায়। তোরা চালায় যাহ!”

সাফিন ভাইয়া হাত নাড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই ঈশান ডাকলেন,

“সাফিন!”

সাফিন ভাইয়া ঘুরে তাকালেন। ঈশান পরিতোষের হাসি দিয়ে বললেন,” থ্যাঙ্কস।”

সাফিন ভাইয়া ‘চিক’ টাইপ শব্দ করে এক চোখ টিপে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলেন।
🍂

চলবে

#তি_আমো❤
#পর্ব_৩২
Writer: Sidratul muntaz

🍂
তারিন, কতদিন দেখিনা তোমাকে। তোমার কণ্ঠস্বর শুনিনা, তোমার চুলের স্পর্শ, মিষ্টি হাসির খিলখিল শব্দ,তোমার শরীরের সুভাষ, গভীর চোখের দৃষ্টি, লজ্জামাখা মুখ, নেশার মতো টানছে আমায়। এই টান আমার ভিতরটা উত্তাল করে তুলছে। বেসামাল জোয়ারের অতল স্রোত ভাসিয়ে দিচ্ছে আমার ভেতরটাকে, ধ্বংসাত্মকভাবে এলোমেলো করে দিচ্ছে সবকিছু। ব্যাকুল হয়ে একটিবার তোমাকে কাছে পেতে বারবার আকুতি জানাচ্ছে এই মন। বুক ভরে শ্বাস আসছে না। আমি হাপিয়ে উঠছি, ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। তুমিহীন এই জীবন বিষের চেয়েও বিষধর লাগছে। দুর্বলতা ঘিরে ধরছে আমাকে। আমি মরে যাচ্ছি তারিন, বাচাও আমাকে। এই বিষাক্ত যন্ত্রণা থেকে বাচাও। কেমন জ্বালা এটা? কেনো মানতে পারছি না আমি, কেনো বুঝতে চাইছি না যে__তুমি আমার নেই! সত্যিই কি আমার নেই তুমি? ভুলে গেছো? বিয়ে করে নিয়েছো? কিভাবে পারলে তারিন! না তুমি এটা করতে পারো না। যে যাই বলুক আমি বিশ্বাস করিনা। এতোটা স্বার্থপর আমার তারিন হতেই পারেনা। এতোবেশি নিষ্ঠুরতা আমার তারিনের মনে থাকতে পারেনা। আমার তারিনের ছোট্ট মনটা যে বড্ড কোমল। সেই কোমল মনে আমি ছাড়া অন্যকারো ঠাই হতেই পারেনা। আমার মিষ্টি পরীটা আমাকেই ভালোবাসো। আমার মতোই ভালোবাসে। তাই না মিষ্টি? বলো তাইনা? তাহলে কেনো ডাকছো না আমাকে? আমি যে তোমাকে খুজে খুজে পাগল হয়ে যাচ্ছি। কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি? নিজে থেকে কেনো ধরা দিচ্ছো না? আমি তো আর কষ্ট নিতে পারছি না। একবার সামনে এসো তারিন, শুধু একবার সামনে এসো। তোমাকে নিজের সাথে এমনভাবে বেধে ফেলবো, যেন আর কক্ষনো হারাতে না হয়। কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। তখন চোখের সমস্ত তৃষ্ণা মিটিয়ে তোমাকে দেখবো।এই কাতর চোখজোড়ার একমাত্র চাহিদা তোমার মায়া ওই জড়ানো মুখ। জানো কি তারিন, চোখের পাতা এক করলেই তুমি আমার কাছে চলে আসো। মিষ্টি মুখের সেই নিষ্পাপ হাসিটা দিয়ে আমার মনের আলোড়ন জাগিয়ে তোলো। আমি আর ঘুমাতে পারিনা। ঘুমাতে চাইও না।অভিশপ্ত ঘুম আর কোনোদিন ঘুমাতে চাইনা আমি। এই ঘুম নামক অভিশাপটাই তো আমার থেকে তোমাকে আলাদা করেছে! প্রচুর আফসোস হয়, সেদিন কেনো ঘুমালাম আমি? যদি না ঘুমাতাম, তাহলে হয়তো এখনো তুমি আমার কাছে থাকতে.. ইচ্ছে হলেই বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতাম তোমাকে। তোমার চুলে মুখ গুজে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতাম। কিন্তু তুমি তো নেই তারিন, কেনো নেই তুমি? ফিরে এসো প্লিজ! একটিবার…

আমি শব্দ করে কেদে ফেললাম, ঈশানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েই নিজের মুখটা দু’হাতে চেপে ধরলাম৷ ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নাটা নিয়ন্ত্রণ করে আবার নজর দিলাম ডায়েরিতে।প্রতিটি ভাজে আরো অসংখ্য লেখা, কিন্তু সবটুকু পড়ার সাহস আমার হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে ডায়েরিটা বন্ধ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে। সশব্দে চিৎকার দিয়ে কাদতে। ঈশানের কষ্টের ভারটা নিজের করে নিতে। আমার অনুপস্থিতি এতোটা পুড়িয়েছে উনাকে?এতোটা কষ্টে কাটিয়েছেন দিনগুলো! আমি মুখ ভেঙে ক্রন্দনরত অবস্থায় ঈশানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিষ্পাপ মুখটা নিগুঢ় নিদ্রায় বিভোর। উনার চেহারায় সেই আগেরমতো চাকচিক্যতা আর নেই। সুন্দর চেহারাটা মলিন হয়ে গেছে, খুব নিষ্প্রাণ লাগে এখন। মাথার চুলগুলো খুব অগোছালো, খড়ের মতো। খোচা খোচা দাড়িগুলোও অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে জট বেধেছে। বেশ জীর্ণশীর্ণ অবস্থা উনার। কিন্তু তবুও, কোনো এক অদ্ভুত কারণে.. ঈশানকে এই রুপেও সুন্দর লাগছে। ভীষণ সুন্দর! এক কথায় দারুণ। আমি আমার চোখমুখ মুছে ঈশানের দিকে ঝুকলাম। মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে উনার কপালে আলতো করে চুমু দিলাম। ইচ্ছে করছে পুরো মুখটাই অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিতে! কিন্তু সেটা সম্ভব না, যদি উনি জেগে যান। অনেকদিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। শান্তিময় ঘুম। এই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে উঠে বসলাম আমি। তখনি দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। আমি ঝড়ের গতিতে মাথার পাগড়িটা পড়ে, চশমা তুলে সম্পুর্ণ প্রস্তুত হয়ে নিলাম। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখলাম সাফিন ভাইয়া এসেছেন। উনাকে দেখে আমি খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। সাফিন ভাইয়া বিছানার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“ঈশান ঘুমাচ্ছে নাকি?”

আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম। উনি আমার হাত ধরে বললেন,

“এসো আমার সাথে। ”

আমি প্রশ্ন না করে এগিয়ে গেলাম৷ বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম দু’জন। সাফিন ভাইয়া দেয়াল ধরে দাড়িয়ে পকেটে হাত রেখে খুব সিরিয়াস একটা ভাব নিয়ে বললেন,

“তারু! এখন আমি তোমাকে খুব জরুরী কিছু কথা বলবো।”

“ঠিকাছে বলুন।”

“এই কয়েক মাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে ।এই ঈশান আর আগের ঈশানের মধ্যে কিন্তু আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সম্পুর্ণ পাল্টে গেছে ঈশান। এমনকি ওর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, পরিবার-পরিজন, সবকিছু পরিবর্তন হয়েছে। এখন ওর জীবনটা অন্যপথে চলছে।”

সাফিন ভাইয়া আমার দিকে ঘুরলেন। হাত ভাজ করে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললেন,

“একটু আগে যে পরিবারটাকে দেখলে, আন্টি-আঙ্কেল, সায়রা.. এরাই কিন্তু এখন ঈশানের আপনজন। ফারায আঙ্কেল ঈশানকে সেপারেট করে দিয়েছেন। ঘটনা শুনেছো নিশ্চয়ই?”

আমি হ্যাসূচক মাথা নাড়লাম। সাফিন ভাইয়াও হালকা মাথা দুলিয়ে বললেন,

” ঈশানকে সেপারেট করার মুল কারণ কিন্তু দুটো। প্রথমটা হল ঈশানের অযাচিত আচরণ। মাঝরাতে বেলেল্লাপণা, ড্রিঙ্ক – ড্রাগস, অগোছালো জীবন-যাপন। ডিপ্রেশনে ঘরবন্দী থাকা। ফারায আঙ্কেল এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেলে ঈশান খুব রুঢ় আর অশালীন উত্তর দিয়েছিল। সে রাতে খুব আপত্তিকর ঘটনায় আঙ্কেল ঈশানকে আঘাত করেছিলেন। বাসা থেকে বের হয়েও যেতে বললেন, তাও খালিহাতে। আর ঈশানও রাগের মাথায় তৎক্ষণাৎ বাসা থেকে বের হয়ে যায়। মোহনা আন্টি মাঝরাতে নিহাকে ফোন করে সব বলার পর আমি ঈশানকে আমার বাসায় নিয়ে আসলাম৷ কিছুদিন থাকার পর ও সেখান থেকেও চলে গেল। কোথায় গেল কেউ জানতাম না। তারপর হঠাৎ একদিন আন্টি মানে সায়রার আম্মু ফারায আঙ্কেলকে ফোন করে বললেন ঈশানকে হসপিটালে পাওয়া গেছে। রাস্তার মাঝখানে পড়েছিল। কারা যেন হসপিটালে দিয়ে গেছে। আর আন্টি তখন সায়রাকে নিয়ে একই হসপিটালে ছিলেন। তাই ফরচুনেটলি দেখা হয়ে যায়। ফারায আঙ্কেল ঈশানের খবর কাউকে জানায় নি। আমাকে জানিয়েছেন কারণ ওই সময় আমি আঙ্কেলের সাথে ছিলাম। এই কথা যেন কাউকে না জানাই সেটা আঙ্কেলেই আমাকে বলেছে। ”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম, “কিন্তু আঙ্কেল এটা কেনো করলেন?”

“কারণটা তোমার মতো আমিও সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারপর উনি যেটা বললেন..”

“কি বলেছেন?”

“মোহনা আন্টি যদি জানতে পারতেন ঈশান সায়রাদের বাসায় আছে, তাহলে তখনি গিয়ে ঈশানকে নিয়ে আসতেন। কিন্তু ফারায আঙ্কেল সেটা চান না। উনি চান, ঈশান সায়রাদের বাসাতেই থাকুক। ”

“কেনো? আঙ্কেল তখনো রেগে ছিলেন ঈশানের উপর? আর ঈশানকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার দ্বিতীয় কারণটা তো বললেন না?”

সাফিন ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকালেন। তারপর বললেন,

“কারণটা তুমি। ”

“আমি?”

“হ্যা। তোমার সাথে ঈশানের বিয়েটা মোহনা আন্টি দিয়েছিলেন তাইনা? আঙ্কেল কিন্তু তখন দেশে ছিলেন না। উনি সুইডেন ছিলেন। বিয়েটা আঙ্কেলের পারমিশন ছাড়াই দেওয়া হয়েছিল। আর মোহনা আন্টি পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি। কারণ আন্টি ভেবেছিলেন, আঙ্কেল তোমাকে দেখলেই মেনে নিবে। কিন্তু আঙ্কেল নিজের ছেলের জন্য অনেক আগে থেকেই মেয়ে পছন্দ করে রেখেছেন। সেটা মোহনা আন্টি জানতো না।”

“মেয়ে পছন্দ করে রেখেছে? কাকে?”

“সায়রাকে।”

আমি আহত দৃষ্টিতে তাকালাম। সাফিন ভাই বললেন,

“সায়রাকে পছন্দ করার একটা বিশেষ কারণ আছে। সাধারণ কারণটা হল, সায়রা ছোটবেলা থেকেই ঈশানকে ভালোবাসে। আর বিশেষ কারণটা হল, সায়রার জন্যই ঈশান বেচে আছে।”

আমি ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম, মানে?

“ছোটবেলায় একবার সায়রা ঈশানের জীবন বাচিয়েছিল। ঈশান তখন ক্লাস এইটে পড়ে। আর সায়রা ক্লাস টুতে। পিচ্চি মেয়েটা নিজের ভরই সামলাতে পারতো না। কিন্তু ঈশানকে ঠিকই সামলে নিয়েছিল। ”

আমি কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছি। সাফিন ভাইয়া আরো খোলাশা করে বললেন,

“ফারায আঙ্কেলের সাথে সায়মন আঙ্কেলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা প্রায় ত্রিশ বছরের। প্রায় এগারো বছর আগে দুজনই পরিবার নিয়ে ট্যুরে গিয়েছিলেন, কোনো এক দ্বীপরাজ্যে। প্রায় একুশদিনের মতো সেখানে অবস্থান করেছিল দুই পরিবার। তখন ঈশানের সাথে সায়রার পরিচয়টা গাঢ় হয়। ঈশান সায়রার অনেক সিনিয়র ছিল, তাই সে ছোটবোনের মতো ট্রিট করলেও সায়রা হয়তো অন্যকিছুই ভাবতো।একদিন ঈশান বালুচরে বসে বেহালার সুর তুলছিল। বেহালা বাজানো ছোটবেলা থেকেই ঈশানের শখ। ও খুব মগ্ন হয়ে বেহালা বাজাতো।সেদিন বেহালা বাজানোর সময় চোরাবালির কবলে পড়ে মাটির সাথে ক্রমান্বয়ে মিশে যেতে লাগল ঈশান। তখন সায়রা ঘোড়ার পিঠে চড়ে সম্পুর্ণ দ্বীপে চক্কর দিচ্ছিল। ঈশানের ওই অবস্থা থেকে ঘোড়ার গলা থেকে দড়িটা খুলে নিয়ে ঈশানের বেহালার সাথে বেধে ফেলে সায়রা। তারপর বেহালার ডাট দিয়ে ঘোড়া পিঠে আঘাত করে। ঘোড়া ছুটতে শুরু করলে ঈশানও গভীর বালুচর থেকে বেরিয়ে যায়। আর ঘোড়ার পেছনে চলতে থাকে, বেহালা হাত থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর ঈশান থেমে যায়। এই ঘটনায় সম্পুর্ণ দ্বীপে মানুষ জড়ো হয়ে যায়। সবাই সায়রার সাহসিকতার প্রশংসা করে। তখনই ফারায আঙ্কেলের মাথায় ভুত চাপে ঈশানের সাথে সায়রার বিয়ে দেওয়ার। আর এখন পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তে উনি অটল। ”

সাফিন ভাইয়া আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নিচু করে আছি। সাফিন ভাইয়া বললেন,

“এতোগুলো বছর কেটে গেছে, সায়রা এখনো ঈশানের জন্য আগের মতোই পাগলামি করে। কিন্তু ঈশানের সেরকম ফিলিংস কখনোই ছিল না। সে শুধু কৃতজ্ঞতার খাতিরে সায়রার সাথে যোগাযোগ রাখতো। সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলতো। ”

আমি চুপ। সাফিন ভাইয়া দীঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“তোমাকে ছেলে কেনো সাজানো হয়েছে জানো? ”

আমি না সুচক মাথা নাড়লাম। সাফিন ভাইয়া উত্তরে বললেন,

“সায়রার পরিবার যেন তোমাকে চিনতে না পারে।”

“চিনতে পারলে কি হবে?”

“আপাতত সায়রার সাথে ঈশানের বিয়ের পরিকল্পনা চলছে। ঈশান যদি সায়রাকে বিয়ে করতে রাজি না হয়, তাহলে ফারায আঙ্কেল বলে দিয়েছে কোনোদিনই ঈশানকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে না। সবকিছু থেকে বঞ্চিত করবে। এ অবস্থায় যদি তোমার ফিরে আসার ব্যাপারটা সায়রা আর তার বাবা-মা জানতে পারে, তাহলে বিয়ে ভেঙে যাবে। তখন সব দায় তোমার উপর এসে পড়বে।”

“তাহলে কি এবার..”

“আমরা এসব কিছুই হতে দিবো না তারু। ঈশান সায়রাকে রিজেক্ট করলে ফারায আঙ্কেল ঈশানকে ত্যাগ করবে। কিন্তু যদি এমনটা হয়, সায়রাই ঈশানকে রিজেক্ট করল? তখন কিন্তু ঈশানের কোনো দোষ থাকবে না। তোমারও কোনো দোষ থাকবে না।আঙ্কেল তোমাদের দুজনকেই মেনে নিতে বাধ্য হবে।”

সাফিন ভাইয়ার কথাটা আমার পছন্দ হল। কিন্তু সায়রা ঈশানকে কেনো রিজেক্ট করবে? সেটা কি আদৌ সম্ভব? আমার ভাবনার মাঝেই খুব জোরে একটা শব্দ হল। ঈশান হয়তো জেগে গেছে। আমি ঘরের দিকে ছুটতে নিলেই সাফিন ভাইয়া আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি অবাকচোখে তাকিয়ে বললাম,

“কি হলো?”

“যেও না এখন।”

“কেনো যাবো না? ঈশান আমাকে বলেছিলেন উনার পাশে বসে থাকতে। কিন্তু আমি চলে এসেছি। সেজন্য উনি রেগে যেতে পারে। আমি যাই।”

“না তারু। কথা শোনো আমার। যেও না। ঈশান মাত্র ঘুম থেকে জেগেছে। এই অবস্থায় ও স্বাভাবিক থাকে না। এখন ও তোমার সাথে রুড বিহেভ করবে। তুমি কষ্ট পাবে।”

“কি বলছেন? কেনো রুড বিহেভ করবে? কিচ্ছু হবে না। আমাকে যেতে দিন প্লিজ।”

আমি সাফিন ভাইয়ার আর কোনো কথা না শুনেই নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে গেলাম।সাফিন ভাইয়া পেছন থেকে নাকেমুখে ডাকছেন, “যেওনা তারু। কথা শোনো।যেওনা…”
🍂

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে