Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1014



হৃদমাঝারে পর্ব-২২+২৩(শেষ পর্ব)

0

#হৃদমাঝারে – [২২+২৩]

১৫,
অর্ণার বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। দূর দূরান্ত থেকে মেহমান আসতে শুরু করে দিয়েছে। মাঝে আর দুটো দিন তারপর পরেই অর্ণা আর রওনার শুভ বিবাহ। মুন ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো ওর মোবাইলটা বেজে চলেছে। বিছানার কাছে এসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো আকাশ কল করেছে। মুন কলটা রিসিভ করে বলল,

– কোথায় তুই?

– আমি তো পৌঁছে গেছি তুই কোথায়?

– আমি এখুনি বাসা থেকে বের হবো।

– হোয়াট। আমাকে তাড়া দিয়ে এখন ম্যাডাম নিজেরই কোন খবর নাই। আমি ওয়েট করছি কিন্তু মুন।

– আচ্ছা রাগ করিস না। আমি আসছি।

নবদিগন্ত ফ্যাশন হাউজের সামনে এসে গাড়িটা ব্রেক করলো মুন। গাড়ি থেকে নামতেই দেখতে পেল আকাশ ওর গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুন আকাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশ একটু রাগী চোখে ওর দিকে তাকাতেই মৃদু হাসলো। এক হাতে কান ধরে বলল, সরি।

– ঠিক আছে। এত ফরমালিটি করতে হবেনা, এবার চল ভিতরে যাওয়া যাক।

– হুম।

দুজনে মিলে নব-দিগন্ত ফ্যাশন হাউজের ভিতরে প্রবেশ করে। ফ্যাশন ডিজাইনার অনন্যার ডিজাইন করে কিছু লেহেঙ্গা দেখছে মুন। ডিজাইনার হিসেবে অনন্যা অনেক নাম শুনেছি। আজ নব-দিগন্ত এসে সেটা নিজের চোখে দেখে দেখেও নিলো। প্রত্যেকটা লেহেঙ্গার ডিজাইন ইউনিক। মুন নিজের পছন্দমত তিনটা লেহেঙ্গা নিয়ে নিল একটা নিজের জন্য আর অন্যটা অর্ণার জন্যে। ফ্যাশন হাউজ থেকে বের হয়ে মুন আকাশকে নিয়ে চলে যায় রনি ফ্লাটে। অনন্যা এখন মিষ্টি কে নিয়ে আলাদা একটা ফ্ল্যাটে থাকে ফ্যাশন ডিজাইনিং তারা এখন প্রফেশনাল কাজ। মেয়েটার ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ফ্যাশন ডিজাইনার হবে আর আজ সে দেশের অন্যতম নামকরা একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। কলিং বেল বাজাতে অনন্যা এসে দরজা খুলে দেয় দরজার ওপাশে মুনকে দেখে বেশ অবাক হয়ে অনন্যা, সাথে বাকরুদ্ধ। উৎফুল্লতার সাথে জিজ্ঞেস করে,

– আপু তুমি এখানে? তুমি আমার বাসা হঠাৎ কি মনে করে! আসো আসো ভিতর আসো। দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়ায় অনন্যা। মুন আর আকাশ ভিতরে প্রবেশ করে। ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখতে পেলো মিষ্টি বল নিয়ে খেলা করছে। মুনকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে ওকে জাপটে ধরলো মিষ্টি। মুন মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ওকে আদর করতে লাগলো। তারপর মিষ্টির গাল দুটো টেনে বলল,

– কেমন আছো মামনি?

– আগে বল তুমি এতদিন আসো নি কেন? জানো আন্টি পাপাও আমার কাছে আসে না। আন্টি তুমি আমার পাপাকে বকে দিবে। আর বলবে আমি তাকে খুব মিছ করচি। মিষ্টির কথা শুনে মুন আর অনন্যা একে অপরের দিকে তাকায়। অনন্যা চোখের ইশারায় বলে, মেয়েটা আর পাপাকে ছেড়ে একদমই থাকতে পারে না। মুন মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ঠিক আছে মামনি আমি তোমার পাপাকে বকে দিবো।

– তুমি খুব ভালো আন্টি। মিষ্টু আবারও মুনকে জড়িয়ে ধরে।

ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছে আকাশ মুন আর অনন্যা। মিষ্টি এখন ওর রুমেই আছে। কথার ফাকে অনন্যা জিগ্যেস করলো, আচ্ছা আপু বললে না তো হঠাৎ কি মনে করে তুমি আমার বাসায় আসলে?
মুন একটা শপিং ব্যাগ অনন্যার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, দেখো এটা পছন্দ হয়েছে কি না? অন্যনা শপিং ব্যাগ থেকে লেহেঙ্গা বের করে অবাক হয়ে মুনের দিকে তাকায়। মুন অনন্যার দৃষ্টি বুজতে পেরে বলে, নিজের ডিজাইন করা লেহেঙ্গা উপহার পেয়ে অনুভূতি কেমন হচ্ছে। অনন্যা লেহেঙ্গাটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে বলে, খুব খুব খুব ভালো লাগছে।

– আচ্ছা শুনো তাহলে, পরশু অর্ণার বিয়ে। তুমি কিন্তু কাল সকালে আমাদের বাড়ি চলে আসবে।

– কালকেই? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অনন্যা।

– হ্যাঁ, কেন তোমার কোন প্রবলেম আছে?

– না ঠিক তা নেই। কিন্তু,,,,,

– কোন কিন্তু নয়। কাল সকালে তুমি মিষ্টিকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসছো ব্যাস।

অনন্যার ফ্লাট থেকে বেড়িয়ে মুন সোজা ওর বাড়ি চলে যায়। আকাশও আসে সাথে। মুন আকাশকে নিয়েই বাড়ি এসেছে। কিন্তু বাড়িতে এসে যখন দেখলো ফারহান রওনাক আরো একটা ছেলে এসেছে ওদের বাসায় তখন মুনের মাথাটা গরম হয়ে যায়। গত কাল রাতে ফারহান কল করে মুনকে। প্রথম দুইবার কল রিসিভ করে না মুন। তারপরেও যখন ফারহান কনট্রিনিউ কলটা করেই যায় বিরক্ত হয়ে মুন কল রিসিভ করে। আর তখনি ফারহান মুনের উপর চেঁচিয়ে উঠে। কল রিসিভ করতে দেরী হয়েছে কেন সেই কইফিয়ত চায়। এতে মুন রেগে যায় আর সে উল্টো ফারহানের উপর চেঁচামেচি শুরু করে। মুনকে রাগাতে পেরে মৃদু হাসে ফারহান।ফারহান ইচ্ছে করে মুনকে রাগিয়ে দিয়েছে যাতে একটু বেশি সময় ধরে মুনের সাথে কথা বলতে পারে।একদিকে মূন রাগে ফুঁসছে আর অন্য দিকে মিটমিট করে হাসছে ফারহান। এভাবে প্রায় অনেকক্ষণ কেটে যায় তারপর হঠাৎ করে ফারহান বলে উঠলো,

– আই লাভ ইউ মুন। প্লিজ আর রাগ করে থেকো না আমার উপর। আমি আমাদের এই দূরত্ব আর নিতে পারছি না। তুমি যা শাস্তি দিবে আমি সেটাই মাথা পেতে নিব। প্লিজ ফিরে এসো আমার কাছে। প্লিজ, প্লিজ কাম ব্যাক।

মুহূর্তে শান্ত হয়ে যায় মুন। শক্ত চোয়ালগুলি ধীরে ধীরে নরম হতে থাকে। অস্ফুটভাবে ভাবে বলে,

– ফারহান, আপনি আবার এসব বলছেন। কতবার বলছি আপনি আমাকে কল করবেন না। রাখছি, এরপর কল করলে আপনি আপনার নামে ইভ টিজিং এর মামলা করবো।

– আমি একজন সৈনিক মেহরিমা। আর তুমি আমার নামে ইভ টিজিং এর মামলা করলেই যে পুলিশ সেটা গ্রহন করবে সেটা নয়। আমরা সাধারণ পাবলিকের নিরাপত্তা দেই।

-বলবো নিজের ক্ষমতার সুযোগ নিচ্ছেন। এখন তো আবার সবাই রক্ষকের নামে ভক্ষক।

– মুন।

– রাখছি।

-ওয়েট। তুমি এখন কলটা কাটবে না আমার কথা আছে তোমার সাথে। আমার কথার অবাধ্য হলে কিন্তু আমি তোমার বাড়ি চলে আসবো।

– আপনি যা খুশি তাই করেন এবার আমি কলটা রাখছি। বলে শেষ করে কল কেটে দেয় মুন। বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পরে।

রাগী দৃষ্টিতে কটমট করে ফারহানের দিকে তাকাতেই ফারহান চোখটিপ দিয়ে ফ্লাইং কিছ ছুড়ে দেয়। আর চোখের ইশারায় বলে, বলেছিলাম না বাড়িতে চলে আসবো। যেটা দেখে মুন ক্ষেপে যায়। আর ওর নানুভাইকে ডেকে বলে, এরা এখানে কি করছে? রওনাক এসে মুনের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, আরে কুল শালিকা। এত হাইপার কেন হচ্ছো। আসলে আমার মামাতো ভাই এসেছে তো তাই ওকে নিয়ে আসলাম অর্ণার সাথে পরিচয় করাবো বলে। তুমি বসো না এখানে আমরা একসাথে আড্ডাদেই। তারপর আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হাই আমি রওনাক। আকাশ রাওনাকের সাথে হ্যান্ডসেক করে বলল, আমি আকাশ, মুনের বেস্টফ্রেন্ড।

নিজের রুমে বসে পাইচারি করছে আর একা একা বকে চলেছে মুন। দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বুকের উপর হাত ভাজ করে মুনকে দেখে চলেছে ফারহান। মুনকে প্রান ভরে দেখছিলো। মুনকে দেখতে পেয়ে ফারহানের তৃষ্ণার্থ চোখদুটো যেন শান্ত হয়ে আসছ ক্রমশ। মনে ভীতরে জমে থাকা ভালোবাসার পাহাড় যেন গলে গলে পড়ছিলো। ঠোঁটের কোন মলিন হাসি নিয়ে দেখে যাচ্ছে রাগি মুনকে।

কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে আতকে উঠে মুন। কিন্তু মুনের নানুভাইকে দেখে অধোরে হাসি ফুটিয়ে বলে,কি বলবে নানুভাই?

-বলছি এভাবে দূর থেকে দেখে কি শান্তে পাও বলতো।

– কি করবো বলো, তোমার নাতনীটা তো আমাকে তার কাছে যেতে দিচ্ছে না।

– সে খুব অভিমানি এভাবে ধরা দিবে না। তুমি ওকে বাধ্য করো যাতে সে নিজে তোমার কাছে ছুটে আসে।

– মান,, ভ্রু কুকচে প্রশ্ন করে ফারহান।

#হৃদমাঝারে -[২৩এবং শেষ]

মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম কেটে যায় মুনের। ঘুমঘুম চোখে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসছে। মুন তাড়াতাড়ি করে কলটা রিসিভ করে। ডক্টরদের এক এক প্রবলেম, কখন যে কোথা থেকে কল আসে বুঝা মুশকিল।

– হ্যাঁ, ডঃ মেহরিমা খান বলছি।

– ম্যাম, আপনি একটু তাড়াতাড়ি আমাদের ব্রাঞ্চে আসতে পারবেন। আমাদের স্যারের এক্সিডেন্ট হয়েছে। প্লিজ ম্যাম যদি দয়া করে আপনি একটু আসতেন। স্যারের মাথা থেকে প্রচুর ব্লাডিং হচ্ছে।

– ব্রাঞ্চ, স্যারের এক্সিডেন্ট! এই আপনি কে বলছেন বলুন তো। আর কোন ব্রাঞ্চের কথা বলছেন?

– ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে পলাশ বলছি। আমাদের স্যার মানে ক্যাপ্টেন ফারহান সাদিকের একটা এক্সিডেন্ট হয়। এত রাতে কোথায় নিয়ে যাব কিছু বুঝতে পারছিলাম না তাই ব্রাঞ্চেই নিয়ে চলে আসলাম। প্লিজ ম্যাম একবার একটু আসেন।

পলাশের আর কোন কথাই মুনের কান পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। ফারহানের নামটা শুনার সাথে সাথে ওর কান থেকে মোবাইলটা পরে গেছে। থো মেরে বসে আছে মুন। ফারহানের এক্সিডেন্ট হয়েছে! কতটা ক্ষতি হয়েছে। আচ্ছা এখন কেমন আছে ফারহান? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার মধ্যে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি উঠে উড়না দিয়ে মাথাটা পেঁচিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পরে মুন।

উঁচু বিল্ডিং এর সামনে এসে গাড়ি ব্রেক করে মুন। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে চলে যায় বিল্ডিং এর ভিতরে। কলিং বেল বাজাতেই পলাশ এসে দরজা খুলে দেয়। মুন হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। পলাশ দরজা আটকে দিয়ে চলে যায় ফ্লাটের বাইরে। মুন প্রথমেই ফারহানের কেবিনে ডুকে কিন্তু সেখানে ফারহান নেই। পাশের রুম ড্রয়িং লিভিং কোন জায়গাতেই নেই ফারহান। মুনের উত্তেজনা আরো বেরে যায়। এক্সিডেন্ট অবস্থায় কোথায় গেলো ফারহান। পালাশ কে কয়েকবার ডাকলেও কোন সারা মেলে না। ফারহানের বেড রুমে এসে বিছানায় বসে পরে মুন। চোখের কোনে অশ্রুর ভীড়। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে বলে উঠে,

– কোথায় তুমি ফারহান। প্লিজ একটা বার আমার ডাকে সারা দাও। আমি আর তোমার থেকে দূরে যাব না। প্লিজ ফারহান, আমি তোমার কাছে থাকতে চাই।

আচ্ছা একবার ছাদে যাব, না অসুস্থ শরীর নিয়ে কি ও ছাদে যাবে। পলাশ বলছিলো প্রচুর ব্লাডিং হচ্ছে তাহলে এই অবস্থায় কোথায় গেলো। ছাদে গিয়ে দেখে আসবো একবার। যদিও জানি ফারহান ছাদে নেই। তবুও মনের শান্তির জন্যে তো যেতেই পারি। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মুন। দু-হাতে চোখের জল মুছে বেড়িয়ে পরে।

শিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় কানে টিংটং গিটারের শব্দ আসলো। থমকে দাঁড়িয়ে পরে মুন। গিটারের আওয়াজ, কিন্তু এত রাতে ছাদে গিটার বাজাচ্ছে কে? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো মুন। আর তখনি ওর কানে ভেসে এলো একটা গানের লাইন। মুহূর্তেই মুনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এই কন্ঠ এই সুর এটা যে চিরচেনা। ওর চিরচেনা সেই মানুষটার গলার স্বর এটা। দ্রুত শিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। ছাদে পা রাখতেই দেখতে পায় ফারহান ছাদের কার্নিশ ঘসে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে ঝুলানো গিটারে টুংটাং আওয়াজ করে
গান গাইছে। মুন নিষ্পলক তাকিয়ে রইল ফারহানের দিকে তারপর ছুটে গিয়ে ফারহানকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠল ফারহান পরক্ষণেই সে আবার থমকে যায়। এতদিন পর হঠাৎ এমন মুনর স্পর্শে ওর শিরায়-উপশিরায় শিহরণ বয়ে যায়। হার্ট দ্রুত বিট করতে শুরু করে। ভালো লাগায় ছেয়ে যায় মনটা সাথে শরীরটাও। মুন ফারহানের পিঠে মাথা রেখে কান্নারত গলায় বলে উঠে,

-কিভাবে অ্যাক্সিডেন্ট হল তোমার।কোথায় লেগেছে? কোথায় ব্যথা পেয়েছ তুমি ফারহান। প্লিজ দেখাও আমাকে দেখাও। ফারহানকে ছেড়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ায় মুন। ফারহান ততক্ষনে গিটার টা পাশে রেখে মুনর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। তারপর দৃঢ় স্বরে প্রশ্ন করে,

-কেন এসেছো? আমার এক্সিডেন্ট হোক যা খুশি হোক তাতে তোমার কি? তুমি তো চাও আমি তোমার থেকে দূরে থাকি চাওতো। তাহলে আমি মরি বাচি তাতে তোমার কি যায় আসে।

– আমার যায় আসে। হুম আমার যায় আসে বুঝেছো তুমি।

– কেন?

– কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি। সাত বছর আগে যতটা ভালোবাসতাম ঠিক ততটাই ভালো এখনো বাসি। তোমার থেকে ছয়বছর দূরে থেকেও তোমাকে ভুলতে পারিনি আমি। কারন তুমি আছো আমার হৃদমাঝারে। তোমায় ভুলিবো বলো কি করে।

ফারহান দু-পা এগিয়ে মুনের একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দু-হাতে মুনের গাল ধরে ওর মুখটা একটু কাছে এনে বলে, তাহলে এতদিন কেন কষ্ট দিলে আমায়?

– কারন আমি রেগে ছিলাম তাই। তাছাড়া তুমিও তো আমায় কষ্ট দিয়েছো তার বেলা।

– আচ্ছা বাবা ঠিক আছে সরি। এই দেখো আমি কান ধরছি। আর কখনো তোমায় কষ্ট দিবোনা। তোমাকে অবিশ্বাস করবো না।

– হয়েছে কান ছাড়ো আর ঢং করতে হবে না।

– আমি ঢং করি। বলেই মুনের কোমড় জড়িয়ে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ফারহান। আমি ঢং করি হুম। বলো বলো। ফারহান শক্তকরে মুনের কোমড়টা চেপে ধরে। মুন কোন প্রতিক্রিয়া না করে শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,

– বললে না তো, কিভাবে এক্সিডেন্ট হলো। আচ্ছা তোমার খুব লেগেছে তাইনা।

– না, আমার কোন এক্সিডেন্ট হয়নি। আসলে তোমারকে কিছুতেই মানাতে পারছিলাম না তো তাই একটা ছলনা করতে হলো।

ফারহানের কথা শুনে মুন বিস্ফারিত চোখে তাকায় ওর দিকে। আর খুব রাগী গলায় বলে উঠে তাই বলে এভাবে এত রাতে। আমি কি জানতাম না কি আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনলে তুমি এত রাতে পাগলের মতো ছুটে আসবে। আর তাছাড়া আমি পলাশকে না করেছিলাম যেন এত রাতে তোমায় খবর না দেয়। পালশও আমার কথা শুনল না আর তুমিও এক্সিডেন্টের কথা শুনে পাগলের মতো ছুটে চলে এলে। এই তুমি এতটাই ভালোবাসো আমায়। কথাগুলো বলার সময় ফারহানের চোখ-মুখে দুষ্টু হাসির দেখা দেখা গেলো। মুন রাগি গলায় বলল, এই একদম হাসবে না বলে দিলাম। ওকে আর হাসবো না। বলেই ফারহান মুনকে তার বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো। আর মুন সেই তার ভালোবাসার মানুষটার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর,

– মুন,

– বলো।

– উইল উই ম্যারি মি?

ফারহানের বুক থেকে মুখ তুলে সামনে তাকায় মুন। চোখের অশ্রুর ভীড় ঠোটে হাসি। এভাবেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। ফারহান ও মুনের দিকে তাকিয়ে আছে মুন কি এ্যানসার দেয় সেইটা জানার জন্যে। মুন উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সুচক জবাব দেয়।ফারহার খুশি হয়ে মুনকে ঝাপটে ধরে বলে, থ্যাংকস মুন। এত আমরা একে অপরের থেকে দূরে থেকে দুজনেই কষ্ট পেয়েছি। আর নয়।এবার আমরা এক হবো। আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। আমরা একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবো।

পরেরদিন ছিলো রওনাক অর্ণার গায়ে হলুদ আর সেদিন ফারহান সবাইকে বলে সেও বিয়ে করতে চায়। আর রাওনাকের সাথে ওর ও সেদিনই বিয়ে হবে। ফয়সাল শিকদার পাত্রীর কথা বললে ফারহান বলে সে মুনকে বিয়ে করবে। তখন আমেনা বেগম বাধা হয়ে দাঁড়ায় আর বলে, আমরা তোর বিয়ে পরে দিবো। এখন রওনাকে বিয়েটা হয়ে যাক তারপর ধুমধাম করে তোর বিয়ে দিবো। এতেও ফারহানের আপত্তি। তার এক কথা সে যখন বলেছে বিয়ে করবে তখন বিয়ে করবেই। আর সবাইকে বলে, তোমরা আমার সিদ্ধান্ত মেনে না নিলে আমি একা বিয়ে করে নিবো। কি আর করার ফারহানের জেদের কাছে হার মেনে রওনার আর অর্ণার সাথে ফারহান ও মুনের বিয়েও হলো।

ফারহান রুমে ডুকতেই দেখতে পেলো মুন বিছানায় মন মরা হয়ে বসে আছে। ফারহার মুনের কাছে এসে পাশে বসে হাতটা ধরতে গেলে মুন এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলে, একদম ছুবে না আমায়। ফারহান বুঝতে পারলো মুনের অভীমান হয়েছে। না সে বোনের বিয়েতে আনন্দ করতে পেরেছে আর না নিজের বিয়েটা অনুভব করতে পেরেছে। ফারহান মুখ টিপে বলে, তাহলে চলে যাবো।

– হ্যাঁ যাও।

ফারহার কিছু না বলে নিঃশব্দে প্রস্থান করে। মুন বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে একটা হাতাকাটা স্লিপলেস ব্লাউজ পরে পাতলা সাদা শাড়ি পরে নেয়। তারপর এসে বিছানায় শুয়ে পরে। কিছুক্ষণ পর রুমে আসে ফারহান। বিছানার দিকে তাকাতেই স্মিত হাসে সে। তারপর মুনের কাছে গিয়ে পাশে শুয়ে মুনের কোমড়ে হাত রাখে। ফারহানের হাতটা মুনের শাড়ির বেদ করে উন্মুক্ত পেটে গিয়ে পরে। হালকা কেপে উঠে মুন। ফারহান মুনের কোমড় ধরে টেনে ওকে নিজের সাথে মুনকে।

– এখনো রেগে আছো?

কোন জবাব দেয়না মুন।

– আচ্ছা তুমি খুশি হওনি এই বিয়েতে।

– আমি রেগে নেই।

– কি করে বুঝবো তুমি রেগে নেই।

মুন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ফারহানের মুখের দিকে। ফারহানের মুখের অভিব্যক্তি বেশ উৎসুক। মুন জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাসে। আর তারপর ফারহানের ঠোটেট ভাজে নিজের ঠোট বসিয়ে দেয়। ফারহান দু-হাতে মুনকে কাছে টেনে। মুনের হাত বিচরণ করছে ফারহানের পুরো পিঠজুড়ে। ধীরে ভালোবাসর উষ্ণতায় ভরে উঠে দুজন। হাড়িয়ে যায় ভালোবাসায়।

অপরদিকে রওনাক আর অর্ণার চিত্রটাও প্রায় একরকম। তারাও একে অপরকে ভালবাসতে ব্যাস্ত। এই ভালোবাসা ময় রাতে একটা অন্ধকার ঘরে বসে সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে আকাশ। চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরছে। ছোটবেলার বন্ধু থেকে কখন যে প্রেমিকাতে পরিনিত হয়েছে মুন সেটা বুঝতেও পারেনি আকাশ। যখন বুঝতে পারলো তখন মুন ফারহানকে মন দিয়ে বসেছে। তাই আর আকাশের মনের কথাটা প্রকাশ করা হলো না। আর আজ সেই ভালোবাসার মানুষটা তার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছে। চোখের সামনে নিজের ভালোবাসা অন্যার হতে দেখে সত্যিই খুব কষ্টের। আধোখাওয়া সিগারেটটা নিচে ফেলে দিলো। ওয়ালেট বের করে সেখানে রাখা মুনের ছোটবেলার ছবিতে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,

– ভালোবাসি তোকে মুন। খুব বেশী ভালোবাসি। জানি তুই অন্যকারো কিন্তু আমার পক্ষে তোকে ভুলা সম্ভব না। আমি না হয় তোকে দূর থেকে ভালোবাসবো। কাছে এসে স্পর্শে ভালোবাসা প্রকাশ করলেও ভালোবাসাটা বেড়ে যায় না। দূরে গেলে ভালোবাসার প্রখরতা বুঝতে পারা যায়। যেমনটা আজ আমি বুঝেছে। আমি তোকে এভাবেই আজিবন ভালোবেসে যাবো। কারন তুই তো আছিস আমার #হৃদমাঝারে।

মুনকে বিদায় দেওয়ার পর থেকেই মিষ্টি খুব কান্না করেছে। বারবার বাবার কথা বলছে। আজ অনন্যার ও মনে পরছে রনির কথা। লোকটা যতই খারাপ হোক সে কিন্তু খারাপ স্বামি নয়। অনন্যাকে তো সেও খুব ভালোবাসতো। মিষ্টিকে বিছানায় শুইয়ে বারান্দায় চলে আসে অনন্যা। রনির সাথে কাটানো কিছু মুহূর স্মৃতিচারণ করলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুন। কি হবে সেদিন, যখন রনি জেল থেকে ছাড়া পারে। অনন্যা কি রনিকে ভালোবসে কাছে টেনে নিবে নাকি খুনি ভেবে ওকে দূরে সড়িয়ে দিবে।

সমাপ্তি,,,,,

হৃদমাঝারে পর্ব-২০+২১

0

#হৃদমাঝারে -[২০+২১]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

প্রায় অনেক্ষন ধরে অফিসার শিমুলকে দেখা যাচ্ছে না। মুন এদিক ওদিক খুজেও পেলো না তাকে। বাধ্য হয়েই ফারহানকে জিগ্যেস করা হলো। মাথা গম্ভীর গলায় বলল, একটু অপেক্ষা করো দেখতে পারবে। ফারহানের গলার গম্ভীরতার কারন বুঝতে পারলো না মুন। তবে এটা লক্ষ করেছে ফারহান বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ চুপচাপ বসে আছে। আড় চোখে মুনকে দেখে যাচ্ছে। ব্যাপারটা প্রথমে পাত্তা না দিলেও এখন মুন ফারহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

– আপনি ঠিক আছেন? ফারহানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো মুন। প্রতিউত্তরে ফারহান মুনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে বলে, আমার আবার কি হবে? ঠিক আছি আমি। মুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফারহান থানার ভিতরে অন্য একটা রুমে ডুকে গেলো। চেয়ার টেনে বসে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে বড় বড় করে শ্বাস নিতে লাগলো সে। এইভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর আবার উঠে দাঁড়ায় ফারহান। দরজার সামনে এসে মুনের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলে,

– আমি তোমার চোখে চোখ রাখতে পারছি না মেহরিমা। অপরাধবোধে আমার ভিতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমি ভুল করেছি, হ্যাঁ আমি অন্যায় করেছি তোমাকে বিশ্বাস না করে। তুমি ক্ষমা করবে তো আমায়।

শিমুলকে দেখতে পেয়ে মুন দ্রুত ওর সামনে আসার জন্যে পা বাড়ায়। কিন্তু পরক্ষণেই তার পা থমকে যায়। শিমুলের পিছনে আসা লোকটা দেখে চমকে উঠে মুন। মিঠু এতক্ষণ চুপচাপ বসে সবটা দেখলও এবার আগন্তুককে দেখা মাত্রই সেও উঠে দাঁড়ায়। তারপর তার সমনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

– একি রনি ভাইয়া! তোমাকে কেন পুলিশ এরেস্ট করলো? কি করেছো তুমি?

মিঠুর প্রশ্নের জবাবে রনি কিছু বলেনা শিতল দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে মুনের দিকে। মুনের চোখ-মুখে এখনো বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। ওর কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না রনিকে পুলিশ কেন গ্রেফতার করেছে। তখনি এখানে আসলো ফারহান। ফারহানকে দেখে রনি মাথা নিচু করে নিলো। আর ফারহান রনির দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। শিমুল কনেস্টবলকে নির্দেশ করলো রনিকে লকাপে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। শিমুলের কথায় কনেস্টবল রনিকে লকাপে নিয়ে যায়। মুন আর মিঠু এখনো বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিমুলের দিকে। মিঠু আর অপেক্ষা করতেই পারলো না সে শিমুলকে জিগ্যেস করলো,

– রনি ভাইয়া কি করেছে অফিসার? তাকে কেন এরেস্ট করেছেন?

– রনি ছিলো তোমার বাবার ডান হাত। শিমুল ফারহানের দিকে ঘুরে তাকায়। তারপর গলার স্বর শক্ত করে বলে, সিনিয়র পুলিশ কমিশনার ফাহাদ শিকদারের খুনি। যদিও সে খুনটা করেছিলো তোমার বাবার কথাতেই।

শিমুলের কথা শুনে মিঠু আর মুন দুজনেই চমকে উঠে। আর বাকি সবার মুখটা স্বাভাবিক। তারা হয়তো আগে থেকেই সবটা জানে। মুন মাথা ঘুরিয়ে ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহান এখনো শ্রীঘরের দিকে তাকিয়ে আছে।

১৪,
সেদিনের পর কেটে গেছে প্রায় এক মাস। এই এক মাস ফারহান মুন এনআর নার্সিংহোমকে ঘিরে ব্যাস্ত ছিলো। ডক্টর ইমরান খান আর তার দুই সহযোগী এবং রনিকে হাইকোটে তুলা হয়। সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ইমরান খান ও তার দুই সহযোগীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও রনিকে দুই লক্ষ টাকা জরিমানা ধরে ছয় বছর জেল দেয়। সেদিন রনির স্ত্রী অনন্যা রনির বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষী প্রদান করে। এনআর নার্সিংহোম এখন পুলিশের দখলে। কেউ নার্সিংহোমের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। অগত্যা মুনের এখন কাজ বন্ধ। সে ট্রাই করছিলো অন্য কোন নার্সিংহোমে জয়েন করার জন্যে কিন্তু অর্ণার জন্যে পারে নি। সামনেই অর্ণার বিয়ে। তাই সে বলেছে এতদিন তো নিজের সাথে অনেক লড়াই করেছিস এবার একটু রেস্ট নি। তারপর বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে অন্যকোন নার্সিংহোমে জয়েন করবি। মুনের আর কি করার একমাত্র বান্ধুবির কথা মেনে সে বাসায় বসে আছে। এদিকে আসি ফারহানের কথায়, এনআর নার্সিংহোমের কাজ শেষে সে নিজের প্রফেশনাল লাইফে ফোকাস করেছে। সকাল থেকে বিকাল অব্দি তার সেনানিবাসেই কাটে। বিকালে ফিরে একটা ঘুম আর তারপর রাত জেগে কাজ করা। সপ্তাহে দুদিন তার ছুটি তবে এই দুইদিন সে তার ব্রাঞ্চের কাজে থাকে। আপাদত তাদের ব্রাঞ্চে এখন কোন কাজ নেই। তবুও সেখানে তাকে যেতে হয়। নিজের স্বপ্নের ব্রাঞ্চ বলে কথা। তবে এসবের মাঝে সে চেষ্টা মুনের সাথে যোগাযোগ করার। মুনকে সে সরি বলেছে কয়েকবার কিন্তু সে শুনেনি। প্রতিবার ফারহানকে এড়িয়ে চলেছে। এতে ফারহান বেশ রেগে গেলেও মুখে কিছু বলতে পারেনা কারন ভুলটা যে ওর নিজের। ফারহান চেষ্টা করছে মুনের মান ভাঙানোর। প্রতিদিনের মতো আজও অফিস থেকে ফিরে ঘুমিয়েছে ফারহান। মুখের উপর তরল কিছু পড়তেই ঘুম কেটে যায় ফারহানের। চট করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় রওনার ওর সামনে দাঁড়িয়ে বত্রিশ পাটি বের করে রেখেছে। ফারহানের চোখে বিরক্তি রেখা ফুটে উঠে। একহাত মুখে রাখে, তারপর রাওনাকের থেকে চোখ নামতেই ওর দৃষ্টি পড়ে রওনাকে হাতে। একটা জগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রওনাক। ফারহানের মুখে তরল কি পরেছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না ওর। দাত কটমট করে উঠে বসে। রওনাকে দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

– এই সময় আমার রুমে কি করছিস। বেড়িয়ে যা বলছি।

– বেড়িয়ে যাবো মানে কি? তুই ভুলে গেছিস আজ আমাদের বের হওয়ার কথা? মরার মতো শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছিস। উঠ, উঠ বলছি। না-হলে এবার শাওয়ার এনে তোর মাথায় ধরবো বলে দিলাম।

– আমি কোথায় যাচ্ছি না তুই যা-না। তোর বিয়ের শপিং, সাথে আবার তোর উডবি, আমি তোদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হতে যাব কেন?

– কেমন জানি পুড়া পুড়া গন্ধ পাচ্ছি। নাক সিটকে বলল রওনাক।

– এটা বেড রুম রান্নাঘর নয় যে কিছু পুড়ে যাবে।

– সে আমিও জানি। তবে আমার সিক্সস্যাান্স বলছে এটা মব পুড়া গন্ধ। রওনাকে ফারহানের দিকে ঝুকে দাঁড়ায়। অতঃপর বলে, কি ভাই পুড়ছে নাকি তোর মনটা।

– এরকম কিছুই না।

-সত্যিই তাই।

– হুম।

– তাহলে চলে। এবার লেট হয়ে যাবে। তারপর দু-বোন মিলে আমার বারোটা বাজাবে। রওনাক উঠে দাঁড়িয়ে ফারহানকে তাড়া দিতে লাগলো। ফারহান ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে রওনাক আবার বলল, অর্ণা আর মুন দুজনেই আসছে। রাওনাকের কথা শুনে ফারহান মনে হয়ে হাতে চাঁদ পেলো। তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না। স্মিত হেসে বলল, আমাকে যেতেই হবে। হুম। মাথা নাড়িয়ে বলল রওনাকে। ফারহান আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায়।

পুরো শপিংমল ঘুরা শেষ অথচ এখনো অর্ণা বিয়ের শাড়ি পছন্দ করতে পারলো না। মুন একবার বলেছিলো লেহেঙ্গা নিতে কিন্তু অর্ণা জেদ ধরে বসেছে সে বিয়েতে শাড়িই পরবে। মুন অর্ণার পিছন পিছন ঘুরে হাপিয়ে উঠেছে। রওনাক আর ফারহান দুজনে অনেক আগেই শপিংমল থেকে বেড়িয়ে গেছে। ফারহান যাওয়ার আগে শুধু এইটুকুই বলেছে, তোমাদের মতো আমাদের পা এতটা স্ট্রং নয় তাই তোমাদের মতো করে এত হাটতে পারবো না। তোমাদের শেষ হলে একটা কল দিও আমরা এসে নিয়ে যাবো। তারপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওরা চলে যায়।

জলপাই কালারের একটা বেনারসি দেখছে অর্ণা। এপর্যন্ত যতগুলো বেনারসি সে দেখেছে তার মধ্যে এটাই তার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগছে। অর্ণা মুনকে কিছু বলতে যাবে তখনি দেখলো মুন একমনে সামনে তাকিয়ে আছে। অর্ণা মুনের দৃষ্টি অনুসরণ করে দৃষ্টি রাখতে দেখতে পেলো মুন একটা লাল বেনারসি দেখছে। অর্ণা মুনের হাত স্পর্শ করে বলে,

– কিরে কোথায় হাড়িয়ে গেছোস? তুই কি ওই লাল বেনারসিটা নিবি?

– আমি কেন বেনারসি নিবো। বিয়েটা তোর তুই ওটা নিতে পারিস।

– কে বলতে পারে যদি সেদিন তোর বিয়েটাও হয়ে যায়।

– এমনটা কখনো হবে না। তুইকি এই বেনারসিটা নিবি।

– না, আমি আমার বিয়ে লাল বেনারসি পরলো না।

– প্রবলেম কি তোর? সবাইতো বিয়েতে লাল বেনারসি-ই পরে।

– আমি পড়বো না। কারন। লাল রং বিপদের সংকেত, দুর্ঘটনা, উষ্মা, ক্রুরতা ও যুদ্ধের প্রতীক হিসেবেই বেশি পরিচিত। আর আমি কিনা বিয়েতে লাল বেনারসি পরবো। কখনো না। মুখ ঘুড়িয়ে অন্য দিকে তাকালো অর্ণা। মুন হা করে তাকিয়ে রইলো অর্ণার দিকে। এই মেয়ে বলে, কতদূর পর্যন্ত ভেবে রেখেছে। এসব তো কখনো ওর মাথাতেই আসেনি।

#হৃদমাঝারে – [২১]

রওনাক অর্ণাকে কল করলে সে অর্ণা বলল ওদের কেনাকাটা শেষ। ফোনের ওপাশ থেকে রওনাক যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল, এরা শপিং করতে আসে নাকি জিনিসপাতির সত্যতা যাচাই করতে আসে। এমন ভাবে সব জিনিস খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে মনে হয় যেন এরা এগুলো পর্যবেক্ষণ করে পরে রিভিউ দিবে। কি এত ভাবছো রওনাক? অর্ণার কথায় রওনাকে ঘোর কাটে। না কিছু ভাবছি না। বলছি কখন বের হবে? প্রশ্ন করে রওনাক। আমরা এখুনি বের হচ্ছি। কোথায় আছো তোমরা দুজনে। বাহিরে আসো দেখতে পাবে। বলেই কল কেটে দেয় রওনাক।

অর্ণা আর মুনকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে একেবারে ডিনার শেষ করে বাড়ি ফিরে রওনাক আর ফারহান। ফেরার সময় মুনের সাথে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছে ফারহান কিন্তু মুন ওকে সব সময় এড়িয়ে চলেছে। ফারহান যখন মুনের সাথে কথা বলতে যায় তখনি মুনের মনে পরে ফারহানের দেওয়া শর্তের কথা। কখনো আমার সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করবে না। সুযোগ পেলেও না। অভিমানে দূরে সরে যায় মুন। ফারহানকে এত কাছ থেকে দেখেও ওর থেকে দূরে থাকতে হচ্চে ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। আড় চোখে ফারহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুন যে ভালো নেই। আর পারছে না নিজেকে সামলাতে।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে মুন। ঘুম কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না দু চোখের পাতায়। মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে। বাবাকে হাড়িয়ে মা একেবারে ভেঙে পরেছে। সত্যিটা মানতে পারছে না। মা আর মিঠু দুজনেই এখন নানার বাড়িতে থাকে। মিঠু এখন সবটা সামলাচ্ছে। ওই ঘটনার পর নার্সিংহোম, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সবই সরকারের আওতায় চলে গেছে। বাড়িটাও নিলামে উঠেছে। শুধুমাত্র একটা ফ্ল্যাট ছাড়া। মায়ের কথা মনে পড়তেই মুন বিছানা ছেড়েন
উঠে। মোবাইলে একবার ঘড়ির টাইমটা দেখে নেয়। রাত এখন বারোটা ছুঁইছুই। কাবার্ড থেকে একটা উড়না বের করে মাথায় পেঁচিয়ে চলে আসে ছাদে। রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের ওই রুটির গোলাকার দেখতে চাদটার দিকে তাকিয়ে থাকে। চাঁদমামা যেন আজ নিজের সবটা জুড়ে আলোকিত করেছে শহরটাকে। মুন মৃদু হাসলো। তাহলে কেন মনে হয় আমার জিবনে কোন আলো নেই। আর না আছে কোন রং। এমন বেরঙিন কেন হলো আমার জিবনটা। জিব কাটে মুন। ইশ্ কি হচ্ছে। আমি এসব কেন ভাবছি। আচ্ছা আমি কি কোন ভাবে ফারহানকে নিয়ে কিছু ভাবছি। না- না এটা হতে পারেনা। আমি আর ওকে নিয়ে ভাবতে চাইনা। যে আমাকে বিশ্বাস করে না। কথায় কথায় অপমান করে তাকে নিয়ে আমি ভাবতে চাইনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুন।

-ভাবতে চাইনা বলে কি তুই ফারহানকে নিয়ে ভাববি না আর মুন। ফারহান যতই তোকে অপমান করুক তুই তো ওকে ভালোবাসিস। তাহলে কেন অস্বীকার করছিস। কথাগুলো শুনে চমকে উঠে সামনে তাকায় মুন। সামনে তাকাতেই দেখতে পায় ওর মতোই দেখতে একটা মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে মুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঠোঁটের কোনে তার অদ্ভুত হাসি। মাথার চুলগুলো হাওয়ায় ভাসছে। মুন অবাক সুরে জিগ্যেস করলো,

– কে তুমি?

– নিজেকেই চিনতে পারছো না তুমি। আমি তোমার ভিতরের মানুষটা, যাবে তুমি কাঠিন্য আবরণে মোড়ক পড়িয়ে রেখেছো। কেন অস্বীকার করতে চাইছো ফারহানকে। কেন এত কষ্ট দিচ্ছো নিজেকে। তুমি তো জানো, আজও তুমি ফারহানকেই ভালোবাসো। দূরত্ব তোমার মন থেকে ফারহানকে দূরে সড়াতে পারে নি। বরং #হৃদমাঝারে সুপ্ত হয়ে গেঁথে গেছে ফারহান। সম্পর্কে দূরত্ব থাকবেই তাই বলে ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যায় না।

– ফারহান তো আমাকে ভালোবাসে না। ও আমাকে ঘৃনা করে। কথায় কথায় অপমান করে। বিশ্বাস করে না আমাকে।

– সেটা তো পরিস্থিতি ছিলো মুন। তুমি একবার নিজেকে প্রশ্ন করো, তুমি যদি ওই অবস্থায় ফারহানকে অন্য কোন মেয়ের সাথে দেখতে তাহলে তুমি কি করতে? ফারহান তো তোমাকেই ভালোবাসতো। তোমাকে হাড়িয়ে ও কষ্ট পায় নয় কি? কেন শুধু নিজের কথা ভাবছো তুমি।

– চুপ করো তুমি। ফারহান আমাকে ভালোবাসে না। ও আমাকে শর্ত দিয়েছে যাতে আমি সংস্পর্শে কখনো না আসি।

– সে তো তুমিও ওকে এড়িয়ে চলছো। ভুল তুমি করছো না কি? ফারহান তোমাকে কয়েকবার কথা শুনিয়ে দিলো আর তুমি দেশ ছেড়ে চলে গেলে?

– তখন আমার পরিস্থিতি অন্যরকম ছিলো। সব দিক থেকে ভেঙে পরেছিলাম আমি। একটা আশ্রয়ের দরকার ছিলো আমার। আর সেই সময়ই ফারহান আমাকে ভুল বুঝে দূরে সড়িয়ে দিলো। আমি কখনো ফিরে যাব না ওর কাছে।

– সে তুমি যা ভালো বুঝো সেটাই করো। নিজেকে কষ্ট দিয়ে যদি শান্তি পাও তাহলে যেওনা ফারহানের কাছে।

– হুম যাব না। যাব না ফিরে বুঝেছো তুমি। প্লিজ চলে যাও এখান থেকে। চলে যাও বলছি। দু-হাতে কান চেপে ধরে চিৎকার করে বলল মুন।

এখানে তো কেউ নেই মেহরিমা, তুমি কাকে চলে যেতে বলছো? মুনের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে, মুনের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলল ফারহান। হঠাৎ করেই ফারহানের গলার আওয়াজ পেয়ে আতকে উঠে মুন। দু-হাতে চোখ বন্ধকরে নেয়। বিড়বিড় বলে, না মুন, ফারহান এখানে আসেনি তুই ওকে নিয়ে বেশী ভাবছিস, ফারহার তোর ভাবনায় এসেছে মাত্র,,,,,

– আমি তোমার ভাবনাতেও বিরাজ করি। ফারহানের কথা শুনে চট করে চোখ খুলে মুন। সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো ফারহান একদম ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে অধোর চেপে হাসছে। মুনের ভ্রু কুঁচকে যায়। নিজের নিজের হাতের উপর চিমটি কাটে। উহ্ এটা স্বপ্ন নয় তাহলে। কিন্তু ফারহান এত রাতে এখানে আসবে কি করে।

– আ্ আপনি এখানে?

ফারহান মুনের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে মুনের দিকে। কিছুক্ষণ পর হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকায়। ওষ্ঠযুগলে হাসির রেখে টেনে বলে উঠে,

– হ্যাপি বার্থডে মেহরিমা। ম্যানি ম্যানি হ্যাপি রিটার্ন অফ দ্যা ডে। একগুচ্ছ লাল গোলাপ মুনের সামনে ধরে হাটু গেরে বসে বলে উঠে, শুভ জন্মদিন, মেহু। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, তুমি আমার কাছে তোমার দিনটিকে ততটাই বিশেষ করে তুলবে, এবং আমি তোমার বছরটিকে আরও বেশী বিশেষ করে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ! শুভ জন্মদিন মেহু। মুগ্ধ চোখে মুনের দিকে তাকিয়ে থাকে ফারহান। মুন অবাক চোখে ফারহানকে দেখছিলো।এটা যে ওর বার্থ নাইট সেটা ওর মনেই ছিলো না। মুন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ফারহানের দিকে। তারপর অতি সন্তর্পণে ফুলের গুচ্ছ হাতে নিয়ে নিরবে সেখান থেকে প্রস্থান করতে নিলে ফারহান মুনের হাত ধরে। থমকে দাঁড়িয়ে যায় মুন। ওর সারা শরীর জুড়ে হীম শীতল শিহরণ বয়ে যায়। হাত কাপছে। ফারহান এক টানে মুনকে আবার আগের জায়গায় দাঁড় করায়। মুন মাথা নিচু করে রেখেছে দেখে ফারহান মুনের চিবুক ধরে ওর মাথাটা উচু করে নেয়। মুনের চোখে চোখ রেখ নিঃপলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মুন ফারহানের হাত সড়িয়ে চলে যেতে নিলে ফারহান আবার ওকে বাধা দিয়ে দু-গালে হাত রাখে। কপালে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে বলে উঠে,

– আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না মেহু।

মুন ফারহানের থেকে নিজেকে সড়িয়ে নিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। দু-হাত শক্ত মুঠি করে চোখ বন্ধ করে। বড় করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে আরো শক্ত করে নেয়। না, ফারহানের সামনে সে কিছুতেই দূর্বল হবে না। মুখশ্রীতে কাঠিন্য ফুটিয়ে বলে উঠে,

– ক্ষমা, কিসের ক্ষমা চাইছেন আপনি? কি অপরাধ করেছেন! আর আমার কাছেই বা কেন ক্ষমা চাইছেন আপনি?

একনাগাড়ে মুনের এতগুলা প্রশ্ন শুনে ফারহান অসহায় মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার বলে,

– কেন এমন বিহ্যাভ করছো তুমি মেহু। মেহু, আমি আর পারছি না তোমার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে। প্লিজ আর রাগ করে থেকো না। আর কত শাস্তি দিবে আমায়! ছয় বছর কি কম সময় ছিলো? বিশ্বাস করো মেহু, এই ছয় বছরে একটা বারের জন্যেও তোমাকে ভুলতে পারিনি। তোমার উপর রাগটা কবে যে ভালোবাসায় পরিণিত হয়েছে বুঝতেই পারিনি। #হৃদমাঝারে ছিলে তুমি। এই লং ডিসটেন্স তোমার মন থেকে তোমাকে দূরে সরাতে পারেনি। বরং সময় অনুক্রমে আরো বেশী ভালো বেসেছি তোমায়। মেহু, হয় তুমি আমাকে শাস্তি দাও আর না হয় ক্ষমা করে দাও। এই দূরত্ব আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

মুন কিছু বলছে না শুধু তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। ফারহান উঠে দাঁড়িয়ে মুনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুন কি জবাব দেয় সেই প্রত্যাশায়। কিন্তু মুন কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে। ফারহান কিছু বলবে তখনি ওর কলটা বেজে উঠে, মুনের থেকে চোখ সড়িয়ে জিহ্বা দিয়ে অধোর ভিজিয়ে বুক পকেট থেকে মোবাইল বের করে কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে রওনাক বলে উঠে,

– কিরে ভাই আর কত সময় নিবি এবার তো নিচে আয়। আমরা সকলে অপেক্ষা করছি।

– আসছি। কলটা কেটে মুনের দিকে তাকিয়ে বলে, নিচে সবাই আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। মুনের দিকে এক পলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর সেখন থেকে প্রস্থান করে।

ড্রয়িংরুমে আসতেই অর্ণা মিঠু দুজনে ঝাপিয়ে পরে মুনের উপর। তারপর একে একে বাড়ির সকলে ওকে বার্থডে ওয়িশ করে। মুন সকলের সাথে হাসি মুখে কথা বলছে। ফারহান এক সাইডে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে মুন কে। মুনের হাসি মুখ দেখে বলে উঠলো, এখন কত খুশি। সবার সাথে কত হেসে হেসে কথা বলছে আর আমি থাকলেই ম্যাডামের মন খারাপ হয়।

চলবে,,,,,,

হৃদমাঝারে পর্ব-১৮+১৯

0

#হৃদমাঝারে -[১৮+১৯]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

ডিনার শেষে অর্ণা আর রওনাক দুজনে প্ল্যান করলো ওরা লং ড্রাইভে যাবে। কিন্তু এখন প্রবলেম হলো মুনকে নিয়ে। মুনকে একা এভাবে রেখে অর্ণা কিছুতেই রাওনাকের সাথে যাবে না। যদিও মুন বারবার বলছে ওদের চলে যেতে কিন্তু অর্ণা শুনতে নারাজ। অর্ণার এক কথা সে এত রাতে কিছুতেই মুনকে এখানে একা রেখে যাবে না। দরকার হলে অর্ণা রাওনাকের সাথে না গিয়ে মুনের সাথে বাড়ি ফিরে যাবে। পরক্ষনেই মনে হলো এখানে ফারহান আছেই। ফারহান এতক্ষণ ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো। কথা বলা শেষ করে ওদের কাছে এসে দাঁড়ালো। অর্ণা আর রওনাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারহানের ভ্রুযুগলে কিঞ্চিৎ ভাজ পরলো। মুনের দিকে এক পলক তাকিয়ে অর্ণাকে জিগ্যাসা করলো,

– এ্যানি প্রবলেম?

অর্ণা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল, আসলে আমি আর রওনাক লং ড্রাইভে যেতে চাইছি। কিন্তু মুন এখানে একা থাকবে। ও তো তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই ভালো করে চিনে না। তাই বলছিলাম,,

– আমি মেহরিমাকে ড্রপ করে দিবো। উম্ যদি কারো প্রবলেম না থাকে। অর্ণাকে থামিয়ে দিয়ে বলল ফারহান।

– উম্, প্রবলেম কেন থাকবে। মুনের দিকে তাকিয়ে বলে, তোর কোন প্রবলেম নেই তো মুন।

– নো নিড। আমার কারো হেল্পের প্রয়োজন নেই। আচ্ছা অর্ণা আমি কি ছোট্ট বাচ্চা নাকি হুম। আমি একা চলে যেতে পারবো। তুই যাতো। কথাটা বলেই সামনের দিকে পা বাড়ায় মুন। ফারহান একবার অর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমরা যাও এদিকটা আমি দেখছি। ফারহান লম্বা পা ফেলে মুনের পিছনে চলে যায়। অর্ণা মৃদু হাসে। রওনাক ওর দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

– এই এদের কেসটা কি বলতো?

– সময় হলেই জানতে পারবে। এখন চলতো আমাদের লেট হচ্ছে। অর্ণা রাওনাকের হাত ধরে টেনে ওকে বাহিরে নিয়ে যায়।

রেস্টুরেন্ট থেকে কিছুটা দূরে পিছনের সাইডে এসে দাঁড়িয়ে আছে মুন। চারিদিকে নিস্তব্ধ, ঘন কালো অন্ধকার। কোথাও কোন জন মানবের ছিটাও নেই। মাঝে মাঝে দু একটা প্রাইভেট গাড়ি যাচ্ছে। পাখিরা সব নিড়ে ঘুমাচ্ছে। মোবাইলের আলোতে চারিদিকটা পরখ করে নিলো মুন। উহ্ কেন যে পিছনের দিক দিয়ে আসতে গেলাম কে জানে? ভয় লাগছে এখন। শরীরের লোমগুলো কাটা দিয়ে উঠছে। ভয়ে ভয়ে সামনের দিকে পা ফেলছে মুন। মনে হলো কেউ ওকে ফলো করছে। কিছু পিছনে ঘুরে তাকানোর সাহস পেল না সে। থমকে দাঁড়িয়ে আয়াতুল কুরসি পাঠ করতে শুরু করলো। এমন সময় কেউ করে কাধে আলতো করে হাত
রাখে। ভয়ে কেপে উঠে মুন। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। শব্দগুলো গলায় এসে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। ভয়ার্ত গলায় বলল,

-ক্ – কে?

আগন্তুকের কোন শব্দ না পেয়ে মুন আবার বলে, ক্- কে আপনি? এবার কোন শব্দ পেল না। তবে সে অনুভব করলো তার কাধে গরম হওয়া ভয়ছে। ভয়ে মুনের হাত থেকে মোবাইলটা পরে যায়। চিৎকার করে উঠে আর তখনি কেউ তার মুখটা চেপে ধরে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

– নো সাউন্ড, আমাকে গন ধুলাই খাওয়ার হচ্ছে তাইনা। মৃদু স্বরে বলা কথাগুলো কানে আসতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুন। দিশেহারা মনে এক চিলতে আসার আলো খুজে পায়। মনে মনে বলে উঠে, ফারহান। ফারহান নিজের হাত ছাড়িয়ে নিচে পরে থাকা মুনের মোবাইলটা তুলে ওর হাতে দিয়ে বলে,

– এতই যখন ভয় পাও তাহলে এই রাস্তায় এসেছো কেন?

মুন কোন জবাব দেয়না। নিচের দিকে তাকিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে শুধু। আচ্ছা আজ যদি ফারহানের জায়গায় অন্য কেউ থাকতো তাহলে! তাহলে কি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো মুন। মুনকে এভাবে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারহান আর কোন কথা বাড়ায় না। বুঝতে পারছে মুন ভয় পেয়েছে। ফারহান মুনের হাতটা শক্তকরে ধরে ওকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়।

-আমি যাবনা আপনার গাড়িতে। গাড়ি থেকে নামতেই যাবে মুন তখনি ফারহান ওর আঙ্গুলটা মুনের ওষ্ঠের উপর রেখে বলে,

– হুস। কোন সাউন্ড হবে না। পাকনামো করতে একা এসেছিলে না এ দিকটায় দেখলে তো কি হলো। এখন বেশী,কথা বললে এই নির্জন রাস্তায় তোমাকে একা ছেড়ে দিয়ে যাবো। আর যাওয়ার আগে তোমার মাথায় কয়েকটা তেলাপোকা ছেড়ে দিয়ে যাবো। তাদের অত্যাচারে যদি তোমার মাথার জেদের পোকা কমে।

মুনকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয় ফারহান। মুন ফারহানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারপর সামনের দিকে তাকায়। ফারহান সামনের দিকে তাকিয়ে এক মনে ড্রাইভ করছে। ফাকা রাস্তা পেড়িয়ে বড় রাস্তায় উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফারহান। মুনের দিকে তাকিয়ে দেখে সে এখনো বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহান গাড়ির গতি কমিয়ে নেয়। সামনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

– মেয়েটা কে ছিলো?

– আমার ফ্রেন্ড।

– আই নো। বন্ধুর সাথে গেইম কেন খেলছো সেটাই জানতে চাইছি।

মুন বড় বড় করে ফারহানের দিকে তাকায়। এতে ফারহানের ভ্রুক্ষেপ হলো না। সে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

– কি বলতে চাইছেন আপনি?

– এর মানেও তোমাকে বুঝাতে হবে মেহরিমা। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কি বলতে চাইছি। ওকে ফাইন আমি বলছি, ওই মেয়েটাকে ত
তোমাদের বাড়িতে কাজের লোক করে রেখেছো কেন?

ফারহানের কথা শুনে চমকে উঠে মুন। জিগ্যেসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ফারহান ওর দিকে ঘুরে মৃদু হেসে বলে,

– আই নো আমি ভেরী স্মার্ট, তাইবলে তুমি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কথাটা বলেই চোখটিপ দেয় ফারহান। মুন তাড়াতাড়ি করে ওর চোখ নামিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

– ম্ মোটেও না। এসব ভুল ধারনা মন থেকে বের করে দিন।

– কোনটা ভুল ধারনা?

– এই যে, আপনার নিজেকে ইউনিক ভাবা।

– ওহ্ রিয়েলি!

– হুম।

– কে যেন একসময় আমাকে বলেছিলো তুমি ইউনিক। তোমার এই বাদামী চোখ সবার থেকে আলাদা যেটাতে আমি ডুবে যাই বারংবার। থাক বাদ দাও এসব। এখন বলতো, তুমি তোমার ফ্রেন্ডকে কেন কাজের লোক সাজিয়ে রেখেছো?

– আপনি কি করে জানেন এসব?

ফারহান গাড়িটা থামিয়ে দেয়। সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে যায়। তারপর মুনকে টেনে গাড়ির বাইরে বের করে দাঁড় করায়। ফারহান মুনের দিকে ঝুকে বলে,

– আই নিড ইউর হেল্প মেহরিমা।

স্মিত হাসে মুন। তারপর বলে, কি এমন হলো যে ক্যাপ্টেন ফারহানের আমার হেল্পের প্রয়োজন হলো।

– ঘটেছে তো অনেক কিছুই। যেটা তোমার অজানা নয়। আমি তোমার বাবার সম্পর্কে জানতে চাই। জানতে চাই কেন তুমি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলে? জানতে চাই কেন তুমি রনিকে শাস্তি দিচ্ছো মা এখনো। আর এটাও জানতে চাই, তুমি এখনো চাও তোমার বাবা শাস্তি পাক। সবশেষে একটা প্রশ্ন, সবকিছু জেনেও কেন তুমি এনআর নার্সিংহোমে জনেয় করলে। প্লিজ এ্যানসার মি মেহু। আমি জানি সব প্রশ্নের উত্তর তোমার কাছে আছ। প্লিজ টেল মি।

মুন এতক্ষণ অবাক হয়ে ফারহানের কথা শুনছিলো আর ভাবছিলো এতকিছু ফারহান কি করে জানলো। ফারহানের চোখে চোখ রাখে মুন। ফারহান এখনো ওর দিকেই ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে। মুন ওকে ধাক্কাদিয়ে সড়িয়ে দিতে চাইলে ফারহান মুনের দুপাশে হাত রাখে ওর দিকে আরো একটু ঝুকে দাঁড়ায়।,

– যতক্ষণ না তুমি আমার সব প্রশ্নের এ্যনসার দিচ্ছো ততক্ষণ তুমি এখানে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে মেহুআ।

– দে্ দেখুন, অনেক রাত হয়েছে আমাকে যেতে দিন।

– আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

– কিসের জবাব দিবো আমি। আমি কিছু জানি না।

– তাহলে আমি মনে করিয়ে দেই। ফারহান ঝুকে আরো কাছে আসে মুনের।

– কি্ কি মনে করিয়ে দিবেন আপনি?

– তুমি নিজে প্রমান জোগাড় করে তোমার বাবার মানে থানায় ডাইরি করেছিলে।

– আপনি এসব কি করে জানলেন? অবাক দৃষ্টি মুনের।

– কমিশনড স্যারের কাছ থেকে জেনেছি। কমিশনড স্যার আমার চাচার বন্ধু। সিনিয়র পুলিশ কমিশনার ফাহাদ শিকদার। নামটা শুনেছো নিশ্চয়?

– পাচ বছর আগে কার এক্সিডেন্টে যে পুলিশ কমিশনার মারা যায় সেটা আপনার কাকা?

– হুম। আর একটা কারন বলছি, এই কেইসের ইনভেস্টিগেশন আমি করছি। সো তোমায় সবটা বলতেই হবে।

– আপনি? আপনি কি করে ইনভেস্টিগেশন করেন। আপনি তো সৈনিক।

– হুম। তবে আমার একটা এনজিও আছে। ক্রাইম ব্রাঞ্চ। সেটার হলেই ইনভেস্টিগেশন করছি। আচ্ছা এখনো কি তুমি আমাকে হেল্প করবে না। তুমি চাওনা তোমার বাবা তার অন্যায়ের শাস্তুি পাক।

মুন কিছু বলে মা শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফারহানের মুখপানে।

#হৃদমাঝারে – [১৯]

১৩,
জাল ঔষুদ ও ড্রাগস এর কারবারি, বেনামে ঔষুদ পাচার ও হসপিটালে গরীব মানুষের অরগান বিক্রির অপরাধে ডক্টর ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করেছ পুলিশ। গতকাল রাতে ড্রাগস সহ কিছু ঔষুদের গাড়ি আটক করেছে পুলিশ। তদন্তে জানা গেছে এইসব ঔষুদের কারবার চলে এনআর নার্সিংহোমে।

টেলিভিশনের নিচে লাল অক্ষরে লেখা ব্রেকিং নিউজের পর এই লেখাগুলো ভেসে আসছে। প্রতিটা চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ এটা। খাবার খেতে খেতে টেলিভিশনে গান দেখছিলো মুন আর তখনি নিচের লেখাগুলো ওর চোখে পরে। মুন চ্যানেল ঘুরিয়ে নিউজ চ্যানেলে দেয়। ভলিয়মটা একটু বাড়িয়ে ড্রাইনিং এর দিকে তাকায়। সবাই ড্রাইনিং এ বসে গল্প করছে আর খাচ্ছে।

ঠিক কতবছর ধরে চলছে ডক্টর ইমরান খানের এমন দুর্নীতি। কত মানুষের মানুষের প্রাণ নিয়েছেন তিনি। ডক্টর ইমরান খান কি তার কৃতকর্মের শাস্তি পাবে? নাকি ক্ষমতার জোড়ে সে বাইরে বের হয়ে আসবে। কি বলছে পুলিশ প্রশাসন। জানতে হলে দেখতে থাকুন শুনতে থাকুন পথের দিশারী। মামুনুর রহমানের ক্যামেরায় আমি তামান্না।

সবাই খাওয়া বাদদিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের দিকে। এসব কি দেখাচ্ছে টিভিতে কারো বোধগম্য হচ্ছে না। মুনের মামা ওর মুনের দিকে শান্ত দৃষ্টি রাখতেই মুন মাথা নাড়ে। অর্ণা এসে মুনের কাঁধে হাত রেখে বলে,

– টিভিতে এসব কি দেখাচ্ছে রে মুন। খালু সত্যিই এরকম জঘন্য কাজ করেছে।

– প্রমান তো সেটাই বলছে রে বোনু। মুন উঠে দাঁড়ায়। ওদের বাড়ির সকলে ব্যাস্ত হয়ে পরে ডক্টর ইমরান খানের বাড়ি যাওয়ার জন্যে। না জানি মুনের মা ও মিঠুর অবস্থা এখন কেমন। মুন সবার দিকে এক পলক তাকালো সবাই কেমন অস্থির হয়ে গেছে। মুন সবাইকে উপেক্ষা করে উপরে নিজের রুমে চলে আসলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো ফারহানের নাম্বার থেকে দুটো মিসড কল। মুন তাড়াতাড়ি করে কল ব্যাক করলো। রিং হতেই ওপাশ থেকে ফারহান কল রিসিভ করে বলে,

– থ্যাংকস মেহরিমা। থ্যাংক এ লট। তোমার সাহায্য না পেলে আমরা এই কেইসটা এত তাড়াতাড়ি সলভ করতে পারতাম না। তুমি যদি কাল রাতে খবরটা না দিতে তাহলে,,,

– এত ফর্মালিটির প্রয়োজন আছে কি? আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। আচ্ছা আমার লেপটপটা! ওটা খুজে পেয়েছেন?

– হ্যাঁ । ডক্টর ইমরান খানের পারসোনাল লকার থেকে একটা লেপটপ পাওয়া গেছে। আমাদের ব্রাঞ্চেই আছে। তুমি একবার দেখে নিও ওটা তোমার কি না।

– ওকে ঠিক আছে। রাখছি।

মুন হসপিটালে যাওয়ার জন্যে রেডি হয়ে নিচে নেমে আসতেই শুনতে পেলো, প্রায় দশ বছর যাবৎ এনআর নার্সিংহোমে এসব কারবারি চলছিলো। কত মানুষ প্রান হাড়িয়েছে, কত যুবকের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। এনআর নার্সিংহোমের দরজা বন্ধ, পুলিশ চারিদিক থেকে হসপিটালটিকে ঘিরে রেখেছে।

ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে পরে মুন। মুনের মামা বলে উঠে, কোথায় যাচ্ছিস? হসপিটালে তো যেতে পারবো না কাজেই এখন আমাকে থানায় যেতে হবে। একবার দেখে আসি ডক্টর ইমরানের কেমন সমাদর চলছে। টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে বলে মুন। তারপর ওর মামার দিকে তাকিয়ে বলে, আজ আর আমার মনে কোন আক্ষেপ নেই মামা। আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। এখন ওই ডক্টর রুপি কশাইটা সঠিক সাজা পেলেই হবে। আমি আসছি মা। বলেই বেড়িয়ে যায় মুন।

থানার সামনে শত মানুষের ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যায় মুন। সব মানুষের মুখে একটাই কথা ইমরান খানের শাস্তি চাই। কেউ কেউ ব্যানারে ইমরান খানের ছবি একে তাতে কালি লাগিয়েছে কারো হাতে জুতা কারো হাতে ঝাড়ু। মুন সকলের দিকে একপলক তাকিয়ে হাসলো। তারপর সে সোজা চলে যায় থানার ভিতরে। সেখানে আগে থেকে ফারহান ও তার টিম ছিলো। মুন ফারহানের দিকে তাকিয়ে দু পা এগিয়ে যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। থানার ভিতরে মিঠু মাথা নিচু লরে করে বসে আছে। মুন দ্রুত পায়ে মিঠুর সামনে গিয়ে বসে দু-হাতে মিঠুর মাথা তুলে সামনে দিকে করে তুলে। মিঠুর মাথায় কিছুটা কেটে সেখানে রক্ত জমাট বেধে আছে। মনে হয় অনেক আগেই কেটেছে। মুন মিঠুর মাথার কাটা স্থানে হাত রেখে বলল,

– কি হয়েছে ভাই? মাথায় কাটলো কি করে? বল কি হয়েছে?

মিঠু কিছু বলে না। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে মুনের দিকে। তখন ফারহান ওদের সামনে হাটু গেরে বসে বলল, তোমার ভাই হিরোগিরি দেখাতে গিয়ে জনগণের সাথে রামধোলাই খেয়েছে। মানে! প্রশ্ন করে মুন। মানে হলো গিয়ে, পাবলিককে বুঝাতে গিয়েছিলো যে তোমার বাবা নির্দোষ, আর পাবলিক সেটা মানতে না পেরে ওর উপর এ্যটাক করে। ফারহানের কথা শুনে মুন মিঠুর দিকে তাকিয়ে বলে, তুই এখানে কেন এসেছিস ভাই? জানিস তো এখন বাড়ির বের হলেই তোদের বিপদ বাড়বে তাহলে কেন এসেছিস তুই এখানে? আর আম্মু কোথায়? আম্মুকে বাড়তে একা ফেলে চলে এসেছিস তুই? বাড়ি যা মিঠু, মা-কে সামলাতে হবে তো। জানি নানুর বাড়ির সবাই এখম আম্মুর কাছে আসে তবুও সাধারন পাবলিক আর মিডিয়ার লোকদের কম্প্লিমেন্ট সামলাতে পারবে না কেউ। ভাই তুই যা। আম্মুর কাছে ফিরে যা। উঠে দাঁড়ায় মুন সাথে ফারহানও। মুন ফারহানের দিকে ঘুড়ে দাঁড়িয়ে বলে,
মিঠুকে বাড়ির ফেরার ব্যাবস্থা করে দিতে পারবেন?

– যথা আজ্ঞা ম্যাডাম। ফারহান পলাশের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমরা মিঠুকে বাড়ির দিয়ে আসার ব্যাবস্থা করো। আর হ্যা ভুলেও যেন মিঠু পাবলিকের সামনে না পরে। ফারহান শিমুলের টেবিল থেকে একটা লেপটপ হাতে নিয়ে মুনকে উদ্দেশ্য করে বলে, দেখতো এটাই তোমার সেই লেপটপ কি না? মুন ফারহানের হাতে থাকা লেপটপের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্লতার সাথে বলে উঠলো,

– হুম এটাই আমার লেপটপ। কোথায় পেলেন এটা?

– তোমার বাবার সিক্রেট ড্রয়ারে।

মুন আর কিছু না বলে টেবিলের উপর লেপটপটা রেখে সেটা অপেন করতে লাগলো। পাশেই দাঁড়িয়ে মিঠু সবটা লক্ষ করছিলো আর ভাবছিলো কি থাকতে পারে এটাতে। আর এটা মুনের লেপটপ। এটা তো সে তার বাবার হাতে দেখেছিলো। তার বাবা মাঝে মাঝেই এই লেপটপটা নিয়ে কিছু একটা করতো। তবে এই নিয়ে সে তার বাবাকে কিছু জিগ্যেস করে নি। কিছুক্ষণ পর মুন একটা ভিডিও অপেন করলো। যেটাতে স্পষ্ট দেখা এনআর নার্সিংহোমের ভিতরে কয়েকটা লোক কিছু পার্সেল খুলে ঔষুদের প্যাকেট বের করে সেটাতে ড্রাগস ডুকিয়ে দিচ্ছে। আর তাদের দিছু কথোপকথন শুনতে পেলো। সব শুনে ফারহান স্মিত হাসলেও মিঠু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মুনের দিকে। তারপর বলে,

– আপু, তুই আগে থেকেই সবটা জানতিস?

– হুম।

– তাহলে আমাদের আগে কেন জানাস নি? আর সব জেনেও ওই নার্সিংহোমেই কেন নিজের চেম্বার নিলি। মুন এবার মিঠুর দিকে ঘুরে তাকায়। তারপর দৃঢ় স্বরে বলে, ডক্টর ইমরান খান যে প্রমান লোপাট করেছে সেগুলোর জন্যে এনআর নার্সিংহোমে আমার চেম্বার নিয়েছি। মিঠু আরো কিছু বলবে তখনি ফারহানের কলটা বেজে উঠে, ফারহান কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল যেটা শুনে ফারহান হাসলো। চাপা স্বরে বলে উঠলো, এবার সবার খেল খতম।

– আবার কি হলো? বেশ উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করলো মুন। ফারহান মুনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তবে আজ ওর দৃষ্টিতে নেই কোন মুগ্ধতা। আজ ফারহানের দৃষ্টি রয়েছে শুধু অনুতাপ। অপরাধবোধ।
ফারহান বেশীক্ষণ দৃষ্টি রাখতে পারলো না ওর মুখের দিকে। ভিতরটা তার ভেঙে চুরমার হয়ে আসছে। নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে নিজের। এমনটা একটা নিঃপাপ মেয়েকে সে কতভাবে অপমান করেছে। কতটা খারাপ ব্যাবহার করেছে তার সাথে। রাগে নিজের হাতের শক্ত মুঠি করে নেয়। মুন ভ্রু কুচকে ফারহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

– এই আপনার আবার কি হলো? কার খেল খতম বললেন না তো?

– একটু পরেই জানতে পারবে। বলেই একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো ফারহান। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখদুটো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে তার।

মুন ব্যাস্ত তার লেপটপটা নিয়ে। পলাশ এগিয়ে এসে মিঠুর সামনে দাড়িয়ে বলল, এবার আমাদের যাওয়া উচিৎ। না আমি কোথাও যাচ্ছি। মিঠু ও একটা চেয়ারে বসে পড়লো।

চলবে,,,,,

হৃদমাঝারে পর্ব-১৬+১৭

0

#হৃদমাঝারে – [১৬+১৭]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

নার্সিংহোমে নিজের কেবিনে বসে অতিতের কথা ভাবছিলো মুন। চোখ দিয়ে অনর্গল জল পড়ছে তার। সে মুখে যতই বলুক না অতীতকে ভুলে গেছে আসলে চাইলেই কি আর অতীত ভুলা যায়। তাছাড়া সেদিন রনি কেন ওর সাথে এমনটা করলো? শুধুই কি ফারহানের দুশমন বলে! নাকি অন্য কোন কারন আছে। কেন যে সেদিন,,,মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে মুন। কিছু ভাবতে ভালো লাগছে না মুনের। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর ওর মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। মাথা তুলে মোবাইলের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো অর্ণার নাম জ্বলমল করছে। কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে অর্ণা বলে উঠে,

– কিরে আজ কি নার্সিংহোমে রাত কাটানোর ইচ্ছে আছে নাকি? কটা বাজে সে খেয়াল আছে।

অর্ণার কথা শুনে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই। ঠোট দিয়ে জিহ্বা ভিজিয়ে বলে,

– উহ্, আমি ভুলেই গিয়েছি। আচ্ছা আমি আসছি।।

কল কেটে নিজের সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। একটা নার্সকে ডেকে কয়েকজন পেশেন্টের খেয়াল রাখতে বলে মুন নার্সিংহোম থেকে বেড়িয়ে যায়।

পরেরদিন যথাসময়ে বাড়ি থেকে বের হয় মুন। গন্তব্য তার নার্সিংহোম। রাস্তায় এসে রিক্সার জন্যে দাঁড়াতেই কিছুক্ষণের মধ্যে সে একটা রিক্সা পেয়েও যায়। তারপর সে রিক্সা নিয়ে নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথিমধ্যে আবার দেখা হয় মিষ্টির সাথে। তবে আজ ওর সাথে রনি কিংবা অনন্যা নেই। মিষ্টির সাথে আজ একটা অর্ধবয়স্ক মহিলা আছে। মুন রিক্সা থামিয়ে মিষ্টির কাছে যায়। মুনকে দেখে মিষ্টি ওকে জড়িয়ে ধরে। মুনও মিষ্টির গাল টেনে ওকে আদর করে। এমনি সময় সেই অর্ধবয়স্ক মহিলাটি ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

– এই মিষ্টি চল এবার আমরা বাড়ি ফিরে যাই। তোমার বাবা চিন্তা কিন্তু এবার বকবে।

– পাপা কিছু বলবে না। এই আন্টি তুমি চল না আমাদের বাসায়। পাপা মাম্মা অনেক হ্যাপি হবে।

– না সোনা। আজ হবে না। আমাকে হসপিটালে যেতে হবে। তুমি বরং তোমার পাপা আর মাম্মাকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এসো। আমরা অনেক অনেক গল্প করবো।

– তুমি ডক্টর? অর্ধবয়স্ক মহিলাটি প্রশ্ন করে মুনকে।

– হ্যাঁ।

-কোথায় চেম্বার তোমার?

– এনআর নার্সিংহোম।
এনআর নার্সিংহোম নামটা শুনে মহিলাটি চমকে উঠে যেটা মুনের চোখ এড়ালো না। মুন এবার মহিলাটিকে আপাদমস্তক দেখে নিল। এতক্ষণ মিষ্টির সাথে কথা বলতে গিয়ে তার দিকে খেয়াল করে নি। অর্ধবয়স্ক এই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকে মুন। তাকে বেশ চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটাই মনে করতে পারছে না সে। তাকে সরাসরি জিগ্যেস ও করতে পারছে না যদি কিছু মনে করে।

– আপনি কে? আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। মিষ্টির কি হোন আপনি?

– আমি মিষ্টির নানির মতো বলতে পারো। ছোট থেকে মিষ্টি আমার কাছেই বড় হয়েছে। আমার নাম আনোয়ারা শিকদার। আনোয়ারা শিকদার নামটা শুনেই চমকে উঠে মুন। এই কি সেই আনোয়ারা, এনআর নার্সিংহোমের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত যে ছিলো। তাকে চেনা চেনা লাগছে। কেন উনি? মাথার মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রশ্নগুলো দমিয়ে রাখতে পারছে না মুন। ইনি যদি আনোয়ারা শিকদার হোন তাহলে তো ওনি সবটা জানেন। মুন প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,

– এনআর নার্সিংহোমের চেয়ারম্যান পদে যে আনোয়ারা শিকদার নিযুক্ত ছিলো সেই কি আপনি।

মুনের প্রশ্ন শুনে হচকচিয়ে উঠে মহিলাটি। আমতা আমতা করে বলে,

– আমি মানে, না আমি কেন এনআর নার্সিংহোমের চেয়ারম্যান হবো। আমি তো। আর কিছু বলল না সে। মুনের দিকে একপলক তাকিয়ে মিষ্টিকে জোড় করে চলে গেলো। তার চলে যাওয়া দেখে মনে হলো সে পালিয়ে গেলো। এই নিয়ে মুন বেশী মাথা ঘামালো না। আর কাউকে এই কেইসে ইনভল্ব করবে না মুন। কমিশনড আংকেল যখন দায়িত্ব নিয়েছে তখন সেই এই কেইসের ফয়সালা করবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নার্সিংহোমের দিকে চলে যায়।

কেবিনে বসে নিজের কাজ করছে মুন।একের পর এক রোগী দেখছে তাদের সাথে কথা বলছে। যাওয়ার সময় তাদের হাতে একটা প্রেশকিপশন ধড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবেই সকাল থেকে দুপুর অব্ধি চলে যাচ্ছে তার। এখন একটা রোগী দেখছে এরপর আর একটা রোগী তাই আজ তার রোগীদেখার কাজ শেষ। বিকালে দুটো ওটি আছে। তারপর আবার যেতে হবে কমিশনড স্যারের বাসায়। এই আকাশটাও না, কি দরকার ছিলো ওকে বাড়িতে ডাকার। এখন আবার যাও ওদের বাসায়।

শেষ পেশেন্ট এসে মুনের সামনে বসে। মুন নিচের দিকে তাকিয়ে একমনে একটা পেশেন্টের এক্সরে রিপোর্ট দেখছিলো। শেষের পেশেন্ট এসে মুনের সামনে বসতে মুন রিপোর্ট-টা রেখে প্রেশকিপশন করার জন্যে কাগজ হাতে নেয়। সামনের দিকে না তাকিয়েই জিগ্যেস করে,

– আপনার নাম?

– ফারহান সাদিক। সরি শিকদার ফারহান সাদিক।

নাম এবং কন্ঠশ্বর দুটোই বেশ চেনা মুনের। সামনে তাকিয়ে চমকে উঠে। এতো ফারহান। ভ্রু কুঁচকে উঠে মুনের।

– আপনি? আপনি এখানে কেন এসেছেন?

– মানুষ ডক্টরের কাছে কেন আসে!

– মানে। কি বলতে চাইছেন আপনি?

– তোমার সাথে আমার কথা আছে মেহরিমা। উঠে দাঁড়ায় ফারহান। মুনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, উঠ আর চল আমার সাথে।

– মানে কি? আর কোথায় যাব? আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। আপনি এখন আসতে পারেন। কথাটা বলেই আর এক্সরে রিপোর্ট হাতে নেয় মুন। ফারহান রিপোর্টের দিকে একপলক তাকিয়ে মুনের হাত ধরে ওকে দাঁড়া করিয়ে বলে, তুমি কখনোই ভালো কথা শুনার মানুষ নও। চল আমার সাথে। মুন কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফারহান মুনের অধোরে নিজের আঙ্গুল চেপে ধরে আর বলে, স্টপ। মুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওকে টেনে নার্সিংহোমের বাহিরে নিয়ে আসে।
পার্কিং লটে নিজের গাড়ির কাছে এসে মুনকে গাড়িতে বাসিয়ে দেয়। মুন চলে যেতে চাইলে ফারহান ওকে ধমক দিয়ে গাড়ির দরজা লক করে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

গাড়ি চলছে তার নিজ গতিতে। গাড়ির ভিতরে দুজনেই চুপচাপ। একজন বাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতি এই রং বদলের খেলা দেখতে ব্যাস্ত আর অপরজন সামনে দিতে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যাস্ত। কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে থামলো একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। ফারহান গাড়ি থেকে নেমে মুনকেও বাহিরে বের করে ওর হাত ধরে টেনে রেস্টুরেন্টের ভিতরে নিয়ে গেলো।

দুজনেই মুখোমুখি বসে আছে। একজন মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে আর অপর তাকিয়ে আছে মুনের এই শান্ত মুখের দিকে। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো প্রশ্ন কিন্তু মনে চলছে মুনকে কাছে পাবার চির বাসনা। মাথা ও মনের সাথপ লড়াই চলছে ফারহানের। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না মুনকে আগে কি প্রশ্ন করা উচিৎ। কিছুক্ষণ নিজের মাথা ও মনের ধন্ধ কাটিয়ে বলল,

– এনআর নার্সিংহোমের মালিক তোমার বাবা?

ফারহানের প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে সামনে তাকায় মুন। উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক জবাব দেয়।

– তাহলে তুমি নিশ্চয় জানো কি কি হয় এই নার্সিংহোমে। প্লিজ মেহরিমা আমার থেকে কিছু লুকাবে না। আমরা সবটা জানা প্রয়োজন।

– কেন? এতদিন পর আবার এসব কেন? শেষের কথাগুলো বিরবির করে বলল মুন।

– তুমি কি চাওনা তোমার বাবা শাস্তি পাক। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ফারহান। মুনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, উহ্ সরি। তুমি কেন চাইবে ডক্টর ইমরান খান শাস্তুি পাক। সে তো তোমার বাবা।

– আপনি ভুল ভাবছেন ক্যাপ্টেন ফারহান সাদিক। আমি চাই অপরাধী তার শাস্তুি পাক। আর সে যেই হোক না কেন? কিন্তু আপনি কেন এসব কথা আমাকে জিগ্যেস করছেন।

– দুটো কারনে।

– কি কারন?

– এক. আমি ও আমার টিম এই কেইসের দায়িত্ব নিয়েছি আর দুই. আজ থেকে চার বছর সাত মাস আগে এই কেইসের তদন্ত করতে গিয়ে আমার চাচা মারা যায়। সরি মারা যায় না সে খুন হয়। ফারহানের কথ শুনে আতঙ্কিত কন্ঠে ওর দিকে তাকায় মুন। অস্ফুটভাবে বলে,

-তা-তার মানে, সি-সিনিয়র পুলিশ ক-কমিশনার ফুয়াদ শিকদার আপনার চাচা।

– তুমি চেনো তাকে? প্রশ্ন করে ফারহান।

– হ্যাঁ। আমার কথা শুনে কমিশনড আংকেল তার বন্ধু সিনিয়র পুলিশ কমিশনার ফুয়াদ শিকদারের সাথে এনআর নার্সিংহোমের ব্যাপারে কথা বলে। আর সে এখানে শিফট করে। তারপর এনআর নার্সিংহোমের উপর তদন্ত শুরু করে। অনেক প্রমানও পেয়ে যায় সে আর তারপরেই তাকে খুন করা হয়। কথাগুলো বলেই মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো মুন।

#হৃদমাঝারে – [১৭]

১২,
অর্ণার বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপরেই অর্ণার বিয়ে। শিকদার বাড়ি জুরে খুশির আমেজ। আজ রাতে রওনাক তার বন্ধুদের মিলে ডিনারপার্টির আয়োজন করেছে। কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে ডিনার করবে আজ। অর্ণা রেডি হচ্ছে, কিছুক্ষণ পর রওনাক ওকে নিতে আসবে। নীল কালারের শাড়ি, গলায় কানে সামান্য জুয়েলারি। মাথার চুলগুলো খোলা আর দু-হাতে নীল চুড়ি। চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে পিংক কালারের লিপস্টিক। মাশাআল্লাহ বেশ লাগছে অর্ণাকে। আয়না নিজেকে আরো একটা পরিদর্শন করে বিছনা থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাওনাকের নাম্বারে কল করলো,

– হ্যাঁ রওনাক, কতদূর তুমি?

– এইতো পৌঁছে গেছি। তুমি বাসার সামনে এসো।

কল কেটে দেয় অর্ণা। তারপর মুনের নাম্বারে ডায়াল করে। পরপর দুইবার রিং হয়ে যাওয়ার পরেও যখন মুন কল রিসিভ করলো না তখন বিরক্ত হয়ে মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিকর শব্দ বের করে। মোবাইলটা হ্যান্ড পার্সের ভিতরে রাখতে রাখতে বলে,

– এই মেয়েটার কোনদিনও কান্ডঞ্জান হবে না। আরে ভাই সারাক্ষণ কি শুধু পেশেন্ট আর নার্সিংহোম নিয়ে পরে থাকলে হবে। নিজেরও তো একটা লাইফ আছে। নিজের সখ আহ্লাদ বন্ধুই সব বাদ দিয়ে কি শুধু পেশেন্ট নিয়ে পরে থাকলে হবে। নিজের মনে বকবক করতে করতে চলে যায় অর্ণা।

বাসার সামনে এসে দাঁড়াতেই একটা রেড কালারের গাড়ি এসে থামে ওর সামনে। অর্ণা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাড়িটার দিকে। গাড়ি থেকে একটা সুদর্শন যুবক বের হয়ে আসে। সাদা শার্টের উপর নীল কালারের কোট। মাথায় স্পাইক করা চুল হাতে ব্যান্ডের ঘড়ি। অর্ণা যুবকটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যুবকটাও অর্ণার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। দুজন যেন দুজনের চোখে হাড়িয়ে যায়। ঘোরের মাঝে কখন যে যুবকটা অর্ণার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা বুঝতেই পারে নি। যুবকটা অর্ণার খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। তার উত্তাপ নিঃশ্বাস পরছে অর্ণার মুখে। হুস ফিরে অর্ণার। পরপর কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে আমতা আমতা করে বলে,

– ভিতরে যাবে না তুমি রওনাক?

– আজ নয়, একেবারে বর সেজে তোমার বাসায় যাব আর তোমাকে নিয়ে পালাবো। স্মিত হেসে বলে রওনাক।

রাওনাকের কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায় অর্ণার গালদুটো। লজ্জারাখা মুখ করে বলে, কি যে বলো না তুমি রওনাক।

– তোমাকে নিয়ে পালাতে চাইছি তাই এতো লজ্জা পাচ্ছো। অর্ণা, এখনি এত লজ্জা পেও না। কিছু তো রেখে দাও আমাদের বাসর রাতের জন্যে। অর্ণার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দেয় রওনাক। আর অর্ণা লজ্জায় নিজের মুখ লুকাতে ব্যাস্ত।

নিজেদের ব্রাঞ্চে বসে কাজ করছিলো ফারহান। আজকাল ওর কাজের প্রেশার একটু বেশী। এনআর নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে প্রায় সব প্রমান হাতে পেয়েগেছে। এখন শুধু ডক্টর ইমরান খানকে এরেস্ট করার পালা। পলাশ এসে দাঁড়ালো ফারহানের সামনে। ফারহান লেপটপে চোখ রেখে বলল,

– কিছু বলবে পলাশ?

– স্যার, এনআর নার্সিংহোমের চেয়ারম্যান ডঃ আনোয়ারা শিকদার বেচে আছে।

– হোয়াট?? পলাশের দিকে মুখ করে তাকায় ফারহান। তুমি কি বলছো জানো?

– জ্বি স্যার। আর এটাও জানি সে এখন কোথায়?

– ওকে। তাহলে তাকে নিয়ে এসো।

পলাশ চলে যাওয়ার জন্যে সামনের দিকে পা বাড়াতেই পিছন থেকে ফারহান ডেকে উঠে। পলাশ ফারহানের দিকে ঘুরে তাকাতেই ফারহান বলে,

– আমি একটু বাহিরে যাব, তুমি যাবে আমার সাথে?

– কোথায় স্যার?

– ডিনারে।

– স্যার আপনি যাবেন ডিনারে। একা? না মানে আপনি তো আবার মেয়েদের থেকে দূরে থাকেন তাই বলছি গার্লফেন্ড তো নাই তাই আমাকে নিয়ে যাবেন। সরি স্যার, আমরা তো সেইম লিঙ্গ, আমি কোম্পানি দিলে এটা আপনার ভালো লাগবে না।

– পলাশ। ধমকে উঠে ফারহান। তোমাকে যেটুকু বলেছি সেটাই করো। সব সময় এত বেশী বকো কেন? রওনাক ডিনারের আয়োজন করেছে।

– ওকে স্যার। চলুন তাহলে।

সবাই একটা রেস্টুরেন্টে এসে একত্রিত হয়। রওনাক ফারহান পলাশ ফারহানের দুই কাজিন। শুধু মুনই আসে নি। ফারহান এদিক ওদিক তাকাচ্ছে তো আবার আড় চোখে অর্ণার দিকে তাকাচ্ছে। আচ্ছা মুন আসছে না কেন? তাহলে কি ম্যাডাম আসবেন না। অর্ণাকে জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সরাসরি জিগ্যেস করতেও পারছে না। তখনি রওনাকে বলে উঠলো,

– এই তোমার বোনটা এখনো আসছে না কেন? মুনকে একটা কল করো তো?

রওনাকে কথামতো অর্ণা মুনের নাম্বারে কল করে। রিং হতেই ওপাশ থেকে মুন কলটা রিসিভ করে। অর্ণা বলে উঠে,

– তুই কখন আসছিস? দেখ আমরা সবাই কিন্তু পৌঁছে গেছি। শুধু তোর জন্যে খাবার অর্ডার করতে পারছি না।

– সরি বোন। আমি আসতে পারবো না রে। একটা জরুলি কাজে আটকে গেছি।

– আসতে পারবি না মানে কি? তুই তো বললি সময়মতো পৌঁছে যাবি।

– আমার একটা জরুলি কাজ পরেগেছে তাই আসতে পারবোনা।

অর্না আর কিছু না বলে কলটা কেটে দেয়। কলটা এতক্ষণ লাউডস্পিকারে ছিলো তাই সবাই সবটা শুনতে পেয়েছে। ফারহান নিজের মনে মনে বলে উঠে,কি এমন জরুলি কাজ ম্যাডামের যে আসতেই পারবে না। তাকে একপলক দেখার জন্যে আমি সব কাজ ফেলে চলে আসলাম আর সেই আসবে না।

রওনাক খাবার অর্ডার করলে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে যায় তারপর সবাই মিলে একসাথে খাওয়া শুরু করে। খাওয়া প্রায় শেষ এমনি সময় পলাশের চোখ পরে রেস্টুরেন্টের গেটের দিকে। মুন আসছে সাথে আরো একটা মেয়ে। পলাশ খাওয়া বাদ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। না মুনের দিকে নয় সে তাকিয়ে থাকে মুনের সাথে থাকা মেয়েটার দিকে। টপ আর জিন্স প্যান্ট পরা মেয়েটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। পলাশকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহান ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। তারপর ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় ফারহান। অস্ফুটভাবে বলে, মেহরিমা।

– এভাবে কি দেখছো ফারহান? খাবারটা শেষ করো?

– মেয়েটা!

– হুম মেয়েটা সুন্দর স্মার্ট সেটা আমিও দেখতে পাচ্ছি। তাই বলে তুমি এভাবে তাকিয়ে থাকবে নাকি? আগে খাবারটা শেষ করো। চাপা গলায় বলল ফারহান।

– না স্যার। ফারহানের আরো কাছে গিয়ে বসলো পলাশ। তারপর ফিসফিস করে বলল, স্যার আমি ওই মেয়েটাকে দেখছিলাম। আপনি জানেন স্যার এটাই সেই মেয়ে! ডক্টর ইমরান খানের বাড়িতে যে আমাদের হেল্প করছিলো।

– তুমি তো বলেছিলে সে একটা কাজের লোক ছিলো।

– সেটাই তো আমিও ভাবছি। বাড়িতে কাজের লোক আর এখানে মালকিন! আশ্চর্য, স্যার আমার মাথায় কিছুই ডুকছে না।

– তোমার এই ছোট মাথায় এত চাপ নিপ না পলাশ। আমি দেখছি। তুমি খাও তো এবার।

পলাশ আবার খাওয়া শুরু করে। ফারহান রওনাককে উদ্দেশ্য করে বলে,

– হেই রওনাক তুই এখানে বসে ডিনার করবি আর তোর শালিকা ওখানে একা বসে থাকবে ব্যাপারটা খারাপ দেখায় না বল?

ফারহানের কথা শুনে সবাই মুনের দিকে তাকায়। অর্ণা তো রেগে একাকার। টিসু দিয়ে হাত পরিষ্কার করে মুনের সামনে গিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে,

– এই তোর ইম্পরট্যান্ট কাজ।

অর্ণার কথা শুনে পাশ ফিরে তাকায় মুন। তারপর আমতা আমতা করে বলে, না আসলে, হয়েছে কি?

– কি হয়েছে বল। আমাকে কেন মিথ্যে বললি।

– অর্ণা আমি এখানে একটা কাজে এসেছি। তুই যা না তোর নিজের কাজ করো। প্লিজ অর্ণা এখানে সিনক্রিয়েট করিস না।

মুনের কথা শুনে অর্ণা রেগে সেখান থেকে চলে যায়। তারপর মুন দু-কাপ কফি অর্ডার করে মেয়েটার সাথে কথা বলতে থাকে। ফারহান ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলার ফাঁকেফাঁকে আড় চোখে মুনের দিকে তাকাচ্ছিলো। এদিকে মুনের কথা বলা শেষ হলে মেয়েটা চলে যায় আর মুন এসে দাঁড়ায় অর্ণার সামনে। মুনকে দেখে অর্ণা অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়।

চলবে,,,,,,,

হৃদমাঝারে পর্ব-১৪+১৫

0

#হৃদমাঝারে – [১৪+১৫]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

নিজের প্রিয়জনদের কথা ভাবতেই মেহরিমার বুকটা হা হা করে উঠলো। একদিকে এতগুলা মানুষের জিবন আর অপর দিকে নিজের প্রিয়জনদের জিবন। কোন ছেড়ে কোনটা বেছে নিবে মেহরিমা তা ঠাউর করতে পারছে না সে। ফ্লোরে বসে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে কাঁদছে মেহরিমা। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে ফারাহানের মুখটা।

– আর কত সময় নিবে মুন। ভিডিওটা দিয়ে দাও।

মুখ থেকে হাত সড়িয়ে সামনে তাকায় মেহরিমা। ডক্টর ইমরান খানের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলে,

– আপনি কি করে পারেন এতগুলা মানুষের জিবন নিয়ে খেলতে।

মেহরিমার কথার কোন জবাব না দিয়ে ব্যাঙ্গাত্বক হসি হাসে সে। তারপর বলে,

– তুমি ভিডিওটা দিবে নাকি এখনি ওদের কল করবো। শুধু একটা কলের অপেক্ষা। আমি একটা কে করবো আর সাথে সাথে তিনটা লাশ পরে যাবে।

– না। চিৎকার করে মেহরিমা। তারপর নিজের মোবাইলটা তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলে, এই নিন এটাতে আছে আর অপকর্ম। ডক্টর ইমরান তড়িৎগতিতে মোবাইলটা হাতে নেয়। যেন ওনি ওনার প্রান ফিরে পেল। ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে তার দুজন সহচারীকে ডেকে বলল, এই মেয়েকে তোরা আমার সামনে থেকে নিয়ে যা। আর হ্যাঁ এর সাথেও তোরা যা খুশি করতে পারিস। ডক্টর ইমরান খানের কথা শুনে লোক দিকে ললাসু দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকাতেই মেহরিমা কেপে উঠে। তার চোখে বিরাজ করছে ভয় আতঙ্ক। অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ডক্টর ইমরান খানের দিকে কিন্তু সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। সে তো এখন মেহরিমার মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত। ডক্টর ইমরান খান রুম থেকে বেড়িয়ে যেতেই লোকদুটো হাতের তালু ঘসে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে মেহরিমার দিকে এগিয়ে আসে। ভয়ে মেহরিমার কুকড়িয়ে উঠে। না, না আমার কাছে আসবে না বলছি। কাছে আসবে না। না হলে আমি তোমাদের মেরে দিবো। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলে মেহরিমা। যদি ও হাতের কাছে কিছু পেয়ে যায়। যে করেই হোক ওকে তো বাচতে হবে। কিন্তু লোকদুটো ওর দুকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। মেহরিমা এবার চোখ গেলে টেবিলের উপর থাকা ছুড়িটার দিকে। দ্রুত উঠে গিয়ে ছুড়িটা হাতে তুলে নেয়। আর তাদের দিকে তাকা করে বলে, আমার কাছে আসবে না বললাম। মেরে দিবো। তোমাদের দুজনকেই মেরে দিবো। কিন্তু কে শুনে কার কথা। একটা লোক পিছন থেকে মেহরিমার হাত ধরলো অপর জন ওর হাত থেকে ছুড়িটা নিয়ে নিলো তারপর ওকে নিয়ে চলল বাড়ির বাহিরে। নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে ছটফট করতে থাকে মেহরিমার। ততক্ষণে লোকদুটো ওকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। মুখের উপর শীতল কিছু পড়তেই চোখ বন্ধকরে নেয় মেহরিমার। তবে কি শেষ হয়ে যাবে ও।

চোখ খুলে নিজেকে একটা অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করে মেহরিমা। ধপ করে উঠে চারিদিকে চোখ বুলায়। বুঝতে বাকি রইলো না এটা ওদের-ই খামার বাড়ি। তখনি দরজা খোলার আওয়াজ শুনতে পেলো। মেহরিমার বুঝতে বাকি রইলো না কেউ ভিতরে আসছে। মেহরিমা আবার আগের ন্যায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। একটা লোক ভিতরে এসে দেখলো মেহরিমা এখনো অঞ্জান হয়ে আছে সে বলে উঠলো,

– এই মেয়েটার কখন যে ঞ্জান ফিরবে। আমার তো আর অপেক্ষা ভালো লাগছে না। এই শরীরের উপর আমার নেশা লেগে গেছে। উহ্ মেয়েটার ঞ্জান কেন ফিরছে না।

লোকটার কথাগুলো জড়ানো ছিলো। মেহরিমার বুঝতে অসুবিধা হলো না লোকটা নেশাক্ত। নেশার ঘোরে বলছে কথগুলো। মেহরিমা যতটা সম্ভব নিজেকে শক্ত করে নিলো। যে করেই হোক এই বিপদ থেকে তাকে বের হতেই হবে।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যখন দেখলো মেহরিমা সাড়া দিচ্ছে না তখন লোকটা ফিরে যায়। আর যাওয়ার আগে নেশালো কন্ঠে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে চলে গেলো।

লোকটা চলে যেতেই মেহরিমা উঠে বসে। নিঃশব্দ চরণে সামনে পা ফেলে এগোতে থাকে। বাড়ির পিছনে এগোতেই দেখলো কয়েকজন লোক মিলে গরুর ঘর পরিষ্কার করছে। মেহরিমা ঘরের পিছনের দিক দিয়ে নিঃশব্দে চলে আসে খামার বাড়ির বাহিরে। সরু চিকন রাস্তা ধরে সামনে দিকে দৌড়ে আসছে মেহরিমা। মাথাটা ভিষন ব্যাথা করছে তার। মাঝে মাঝে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে দৌড়াচ্ছে। কিছুসময় পর মেইন রাস্তায় এসে পৌছায় সে। মেইন রাস্তায় এসে এদিক ওদিকে তাকাতেই পিছনে হট্টগোলের শব্দ শুনতে পেলো। পিছনের দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল কয়েকজন লোক দৌড়ে ওর দিকেই আসছে। মেহরিমার আর বুঝতে বাকি রইলো না লোকগুলো কারা? কোন কিছু না ভেবে সামনের দিকে দৌড়াতে লাগলো। এদিকে মাথা ব্যাথাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছ যে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ দেখতে পেলো সামনের দিকে একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে ওর দিকে। একবার মাথা ঘুড়িয়ে পিছনের দিকে তাকালো মেহরিমা। পিছনে লোকগুলো এখনো আসছে। মেহরিমার একবার মনে হলো এই লোকগুলোর হাতে পরার চেয়ে গাড়ির নিচে চাপা পরাটা ওর জন্যে ভালো হবে। তাই আর কোন কিছু চিন্তা না করে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আর তখনি গাড়িটা দ্রুত ব্রেক করলো। ঘটনাক্রমে গাড়ির ভিতরের সবাই সামনের দিলে ঝুকে পরে। আর মেহরিমা এখনো চোখ বন্ধ করে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ভিতর থেকে দুজন লোক এসে মেহরিমার সামনে এসে দাঁড়াতেই তারা অবাক চোখে মেহরিমাকে দেখে বলে,

– মুন। এই মুন কি হয়েছে তোর?

চোখ খুলে সামনে তাকায় মেহরিমা। চোখের সামনে আকাশ ও তার বাবাকে দেখে মেহরিমার মুখে হাসির ঝলক দেখা যায়। মুখে হাসি ফুটলেও চোখে তার আতঙ্ক। তড়িৎগতিতে আকাশের বুকে ঝাপিয়ে পরে মেহরিমা। আর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। আকাশ মেহরিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আকাশের বাবা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওদের দুজনের দিকে।

সুফার চুপচাপ বসে আছে মেহরিমা। মেহরিমার পাশে বসে ওর এক হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে আকাশের মা। ওর সামনে বসে আছে আকাশ ও তার বাবা। মেহরিমা মাথা নিচু বসে আছে। আকাশে বাবা ওকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে উঠলো,

– কি হয়েছে মুন? এভাবে হই রোডে দৌড়াচ্ছিলে কেন?

মেহরিমা মাথা তুলে আকাশের বাবার দিকে তাকায়। মেহরিমার চোখ-মুখে আতঙ্ক। এটা দেখে আকাশের বাবা আবারও বলে উঠলো,

– কিসের এত ভয় পাচ্ছো মুন। ভুলে যেওনা আমি একজন সিনিয়র কমিশনড অফিসার। আমাকে তুমি সবটা বলতে পারো।

মেহরিমা বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে। মনে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বলতে শুরু করলো। ওর বাবা ও তার করা কাজের ব্যাপার এমনকি সেই ভিডিওটার ব্যপারে সবটা বলল। সব শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। আকাশ ওর বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– হ্যাঁ বাবা মুন ঠিক বলেছে। শিশু পাচার ওরগান বিক্রি স্মগলিং এমনি ড্রাগস সহ আরো অনেক অপকর্মের সাথে যুক্ত ইমরান আংকেল। আমি আর মুন মিলে থানায় একটা ডাইরি করে এসেছি।

– কিন্তু ওই পুলিশ ও বাবার টাকার কেনা গোলাম। মুন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল।

আকাশের বাবা মুনের মাথায় হাত রেখে বলল, আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি মা। আমি দেখছি ব্যাপারটা। আমার একটা বন্ধু আছে। সে সিনিয়র পুলিশ কমিশনার। ওর সাথে এই ব্যাপারে আলোচনা করবো আর যত দ্রুত সম্ভব ইমরানকে ওর করা পাপের শাস্তি দিবো। তবে মুন আকাশ আমি চাইনা তোমরা এই বিষয়ে বাহিরে আলোচনা করো। তাতে তোমাদের বিপদ-ই বাড়বে বৈ কমবে না। নিজের খেয়াল রেখো মুন।

আকাশের বাবার কথা শুনে মুন এক টুকরো আশার আলো খুজে পেলো। এত চিন্তার মাঝেও তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো হাসি। অতঃপর বলল,

– আমরা কাউকে কিছু বলবো না আংকেল। তুমি তোমার বন্ধুর সাথে এই বিষয়ে কথা বল। আর যত দ্রুত সম্ভব ইমরান খানকে শাস্তুি দাও।

১১,
আজ দুদিন হলো মেহরিমার সাথে কোন যোগাযোগ নেই ফারহানের। মেহরিমা কলেজে আসছে না। কল করলে ফোন সুইচ অফ বলছে। ফারাহান মেহরিমার বাড়ির ঠিকানাটাও জানে না আর না আছে ওর বাড়ির কারো নাম্বার। মেহরিমাকে দেখতে না পেয়ে প্রায় পাগল হয়ে গেছে সে। সারাক্ষণ মেহরিমার চিন্তায় মগ্ন সে। পার্কিং লটে গাড়ির উপর চিৎ হয়ে শুয়ে মুখের উপর ক্যাপ দিয়ে রেখেছে ফারহান। মেহরিমার কথাই ভাবছে সে এখন। কি হয়েছে মেহরিমার? ওর নাম্বারটা বন্ধ কেন? আচ্ছা মেহরিমা ঠিক আছে তো! এরকম আকাশ পাতাল চিন্তা করছে সে। তখন ওর এক বন্ধ সুজন বলে উঠলো, ওই তো মেহরিমা আসছে।

#হৃদমাঝারে – [১৫]

দূর থেকে মেহরিমাকে এক নজর দেখে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায় ফারহান। মনের মাঝে জমেছে একরাশ অভিমান। মেহরিমা কেন তার সাথে কোন যোগাযোগ রাখে নি। ও কি জানেনা ওর সাথে একদিন কথা বলতে না পরলে ফারহানের রাতে ঘুম হয়না। মেহরিমার মুখখানা না দেখলে ফারাহানের বুকে অশান্তির ঝড় বয়ে যায় তাহলে কেন মেহরিমা তার সাথে এই দুদিন কোন যোগাযোগ রাখে নি। অভিমানে অন্যদিকে ঘুরে তাকায় ফারহান। মেহরিমা ধীর পায়ে ফারাহানের কাছে আসলে সুজন সেখান থেকে চলে যায়। ফারহান এখনো অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে বসে আছে। মেহরিমা বড় কর শ্বাস ত্যাগ করে বলে,

– রেগে আছো আমার উপর?

ফারহান এবার ও কোন জবাব দেয় না। মেহরিমা বুঝতে পারলো ফারহানের অভিমানটা গাঢ় হয়ে আছে।স্মিত হাসলো মেহরিমা তারপর আবার বলল,

– এই দেখো ফারহান আমি কান ধরছি। এবার তো আমার দিকে তাকাও। কানে হাত রাখে মেহরিমা। কি হলো ফারহান তাকাও আমার দিকে। প্লিজ ফারহান। ফারহান এবার গাড়ি থেকে নেমে আসে। আর মেহরিমার সামনে এসে দাঁড়ায়। মেহরিমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ তারপর মেহরিমার কান থেকে হাত ছাড়িয়ে নিজের হাতে মুষ্ঠিতে আবদ্ধ করে মেহরিমার হাত। অতঃপর বলে,

– কোথায় ছিলে তুমি। তোমার ফোন সুইচ অফ কেন? তুমি জানো তোমার চিন্তায় পাগল হয়ে গেছি আমি। ফারহান মেহরিমার গালে হাত রেখে ওর কপালে নিজের ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দেয়। ভালোবাসার পরশে নিজের চোখদুটি বন্ধকরে নেয় মেহরিমা। ফারহান মেহরিমার দুইগালে চুমু খায়। মেহরিমা দু-হাতে ফারাহানের শার্ট খামচে ধরে। তারপর ফারহান নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে মেহরিমার অধোরে স্লাইড করতে থাকে। মেহরিমা বারবার কেপে উঠছে আর ঘনঘন শ্বাস ত্যাগ করছে। ফারহান একমনে তাকিয়ে থাকে মেহরিমা গোলাপি কাপা ঠোটের দিকে। নেশায় মাতোয়ারা সে। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে মেহরিমাকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায় সে। দাঁত দিয়ে অধোর চেপে ধরে বড় বড় করে শ্বাস নিতে থাকে। এটা কি করতে যাচ্ছিলো সে। এটা অন্যায়। অপরদিকে মেহরিমা চোখ খুলে সামনে ফারহানকে দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকায়। ফারহানকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহরিমা ওর পাশে দিয়ে দাঁড়ায়। ফারহান মেহরিমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে বলে,

– সরি মেহরিমা। আই রিয়্যলি সরি।

– ইটস্ ওকে ফারহান। তাছাড়া তোমার স্পর্শ আমার খারাপ লাগে না। আমার মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলো তোমার ভালোবাসায় প্রাণ ফিরে পায়। ফারহানের হাতে নিজের হাত ডুবিয়ে বলে মেহরিমা। ফারহান মেহরিমার হাত শক্তকরে ধরে ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তখন দূর থেকে কেউ মুন মুন বলে চিৎকার করে ডাকে। মেহরিমা পিছনের দিকে ঘুরে রনিকে দেখে একগাল হাসলো। তারপর ফারাহানের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে রনির কাছে চলে আসলো।

সেদিন রনির সাথে নাইট ক্লাবে যায় মেহরিমা। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও রনির কথায় অতিরিক্ত ড্রিংক করে ফেলে যার ফলে নিজের ভারসাম্য হাড়িয়ে যায়। নেশা হয়ে যায় তার। নেশার ঘোরে রনিকে ফারহান ভাবতে শুরু করে।

থাই গ্লাসের কাচ বেদ করে সূর্যের লাল রশ্নি এসে মুখে পরতেই ঘুম ভাঙে মেহরিমার। ঘোমের ঘোরে সে অনুভব করলো কেও তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। কারো বাহুবন্ধনে আবদ্ধ সে। চট করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই মাথা কাজ করা বন্ধকরে দেয়। আপনাআপনি তার হাত মাথায় চলে যায়। তখনি মনে পরে কাল রাতে তো ও রনির সাথে ছিলো। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। অশ্রুসিক্ত নয়নে সামনে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বলল,

– র-রনি। আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছিস তুই। কি করেছিস আমার সাথে।

রনি কোন জবাব দিচ্ছে না দেখে মেহরিমা সজোরে ওকে ধাক্কা দেয়। টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায় রনি। চমকে উঠে মেহরিমার দিকে তাকায়। ততক্ষণে মেহরিমার চোখ দিয়ে জল পরতে শুরু করেছে। নিজের মনে হাসলো রনি। সেটাতার মুখে প্রকাশ পেলো না। মেহরিমার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে উঠে আবার গিয়ে মেহরিমার পাশে বসে।মেহরিমার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

– এখন কাঁদছিস কেন? কাল রাতে তো,,,

– চুপ কর। কেন করলি তুই আমার সাথে এরকমটা। রনির কলার চেপে ধরে মেহরিমা। রনি দু-হাতে মেহরিমার হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, কেন আবার? তোর মতো একজন হ*ট মেয়ের উপর যে কোন ছেলের-ই লোভ থাকতে পারে। আমারও ছিলো। তোর শরীরের উপর আমার অনেক দিনের লোভ ছিলো তাই আজ সুযোগ পেয়েছি আর কাজে লাগিয়েছি। তাছাড়া তুই তো জানিস মেয়েদের শরীর নিয়ে খেলা আমার একটা নেশা।

মেহরিমা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় রনির দিকে। এটা কি সেই রনি যাকে ও এতদিন ধরে চিনতো। না এটা সে রনি নয়। রনি ওকে সব সময় প্রটেক্ট করতো। তাহলে আজ এমন কেন করছে রনি। মেহরিমা রনিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই করতালির শব্দ শুনতে পায় দুজনে। শব্দের সোর্স সন্ধানের সামনে তাকাতেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরে মেহরিমার। ফারহান করতালি বাজিয়ে ওর দিকেই আসছে। মেহরিমা নিঃপলক তাকিয়ে রইলো ফারহানের মুখের দিকে। মাথায় এলোমেলো চুল। চোখদুটো লাল হয়ে গেছে। নাকের মাথাটা লাল আর সেটা মাঝে মাঝে ফুলে উঠছে। ধীর পায়ে মেহরিমার সামনে এসে দাঁড়ায় ফারহান। ওর দিকে তাকিয়ে তাছিল্যের হাসি হাসে সে। তারপর রনির দিকে তাকিয়ে বলে,

– ধন্যবাদ রনি। এই থার্ডক্লাস মেয়ের আসল রুপটা আমার সামনে আনার জন্যে। আমার চোখ খুলে দেওয়ার জন্যে তোকে ধন্যবাদ। কথা বলতে পারছে না ফারহান। কথাগুলো বারবার গলায় আটকিয়ে যাচ্ছে। চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে। মেহরিমা ফারাহানের সামনে গিয়ে জড়ানো গলায় বলে,

– এসব তুমি কি বলছো ফারহান। একবার আমার কথাটা শুনো। তুমি ভুল বুঝছো ফারহান। প্লিজ একটা বার,,,

– আর কি শুনাবে তুমি আমাকে। নিজের চোখেই তো সবটা দেখলাম।

– তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।

– আমার ভুল হচ্ছে। হ্যাঁ আমার-ই তো ভুল। তোমাকে ভালোবাসাটা আমার ভুল। তোমাকে বিশ্বাস করটা আমার ভুল। নিজের চোখে যেটা দেখলাম সেটাও ভুল। আচ্ছা তাহলে তুমিই বলো, সারারাত ধরে কি করছো এই হটেলে? আর তোমার পরনে ওয়েস্টার্ন ড্রেস কেন? তুমি তো আমাকে কথা দিয়েছিলে বাহিরে খোলামেলা পোষাক পরে ঘুরাফেরা করবে না। বলো কোনটা মিথ্যে আর কোনটা সত্যি। চিৎকার করে উঠে ফারহান। ফারহানের চিৎকারে কেপে উঠে মেহরিমা। মেহরিমা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই ফারহান ওকে থামিয়ে বলে, ব্রেকআপ। তোমার মতো একটা অসভ্য থার্ডক্লাস মেয়ের সাথে আমার কোন রিলেশন নেই। আর কখনো আমাকে তোমার এই নোংরা মুখ দেখাবে না।

– না, তুমি এমনটা করতে পারো না ফারহান। কেঁদেকেঁদে বলে মেহরিমা। তারপর দু-হাতে ফারহানের হাত ধরে বলে, এসব মিথ্যে, আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি। ফারহান মেহরিমার কথা শুনে কিছু বলে না। ঠোট কামড়ে হাসার চেষ্টা করে। তখন পাশ থেকে রনি বলে,

– সত্যি, সব সত্যি। আর এটাও সত্যি যে তোর সাথে আমার ফিজিক্যাল রিলেশন আরো আগে থেকে আছে। তাছাড়া তুই শুধু আমার সাথে নয় আরো অনেক ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে তোর। তার প্রমান ও আছে আমার কাছে। রনি ওর পকেট থেকে মোবাইল বের করে কয়েকটা ছবি দেখায় ফারহানকে যেখানে আকাশ আর মেহরিমা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিগুলো দেখে ফারহান ঘৃনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেহরিমার দিকে। তার ওকে আরো অনেক খারাপ কথা বলে চলে যায়। মেহরিমা সেখানেই হাটু গেরে বসে কাঁদতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর চোখের পানি মুখে উঠে দাড়ায় মেহরিমা। রনির কাছে গিয়ে ওর কলার চেপে ধরে বলে,

– কেন করলি আমার সাথে এমনটা। আমি জানি তুই আমার সাথে খারাপ কিছুই করিস নি। যদি আমার সাথে খারাপ কিছু হলো তাহলে আমি সেটা ফিল করতে পারতাম। তাহলে ফারহানকে মিথ্যে কেন বললি।

– বেশ করেছি। মিথ্যে বলেছি বেশ করেছি। এত এত ছেলে থাকতে তুই কেন ফারহানের সাথেই প্রেম করলি। শালা, ওকে আমি একদম সহ্য করতে পারিনা। আমার সামনে তোর সাথে প্রেম করে বেড়াবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো সেটা তো হয়না। মেহরিমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রনি। তারপর বলে, তুই সত্যি বলেছিস আমি তোর সাথে কিছু করিনি। শুধু ফারহানকে দেখিয়ে তোকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলাম।

তারপর মেহরিমা ফারহানের সাথে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ফারহান ওকে সব সময় এড়িয়ে চলেছে। মেহরিমার কোন কথাই সে শুনেনি। তারপরেই মেহরিমা কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপর আর কোনদিন তাদের দেখা হয়নি।

১১,
ফেলে আসা অতীতের কথা মনে পড়তে চোখদুটো থেকে জল গড়িয়ে পরলো। গিটারটা শক্তকরে ধরে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসে পড়লো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

– আমি তো তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম, তাহলে কেন তুমি আমাকে ঠকালে। আমাকে ছাড়া তো তুমি দিব্যি ভালো আছো শুধু আমিই ভালো থাকতে পারিনি। ভেবেছিলাম দূরে সরে গেলে তোমাকে ভুলতে পারবো কিন্তু না। আমি ভুল। তোমাকে ভুলতে পারিনি বরং, দূরত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে তুমি আমার #হৃদমাঝারে আছো।

চলবে,,,,,

হৃদমাঝারে পর্ব-১২+১৩

0

#হৃদমাঝারে – [১২+১৩]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

১০,
কেটে গেছে আরো দুইদিন। মেহরিমা নার্সিংহোম থেকে তার নানুভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরে যায়। সবাই এটা নিয়ে প্রশ্ন করলে মেহরিমা প্রশ্নগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।এনআর নার্সিংহোমের যত ঔষুদ আছে সব নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। আর তার নানুভাইয়ের জন্যে বাহিরের অন্য এক ফার্মেসী থেকে ঔষুদ দিয়ে বলল,

– মামা, তুমি নানুভাইকে এখন থেকে এই ঔষুদগুলো দিবে।দেখবে নানুভাই খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ মামা, তোমাকে একটা কথা দিতে হবে।

– কি কথা? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো মেহরিমার মামা।

মেহরিমা একটা আমতা আমতা করে বলল,
– না মানে, না মানে, আসলে আমি যে ঔষুদগুলো বদলে দিয়েছি সেটা তুমি কাউকে বলবে না।

– মানে!

– পরে আমি তোমাকে সবটা বলবো। এখন আমার হাতে সময় নেই মামা। আমাকে বের হতে হবে। উঠে দাঁড়ায় মেহরিমা।

– কোথায় যাবি তুই এই অবেলায়?

– পুলিশস্টেশনে।

মেহরিমার কথা শুনে ওর মামা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। ততক্ষণ মেহরিমা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। দরজার সামনে অর্ণার মুখোমুখি হতেই মেহরিমা অর্ণার কাঁধেও হাত রেখে বলল, নানুভাইয়ের খেয়াল রাখিস। তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

নিজের রুমে এসে বিছানায় লেপটপ নিয়ে বসলো মেহরিমা। পকেট থেকে মোবাইল বের করে বিছানার উপর রেখে দিলো। মোবাইলে থাকা ভিডিওটা লেপটপে নিজের নামে একটা ফাইল তৈরী করে সেটাতে রেখে দিলো।

পুলিশস্টেশনে সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিমা। এখানে আসার আগে সে আকাশকে কল করে বলে দিয়েছে পুলিশস্টেশনে আসতে আর এখন সে এখানে দাঁড়িয়ে আকাশের জন্যেই অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর মেহরিমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে স্কিনে দেখতে পেলো একটা অচেনা নাম্বার। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও কলটা রিসিভ করলো মেহরিমা। কানের কাছে মোবাইটা ধরতেই ওপাশ থেকে কর্কশ গলায় বলে উঠলো,

– কোথায় তুমি মেহরিমা? কলেজে আসছো না কেন? তুমি জানো দুদিন ধরে তোমার খোঁজ না পেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি।

ফোনের ওপাশে থাকা লোকটাকে চিনতে না পেরে বলে উঠলো,
– কে আপনি? আর আমাকে খুঁজে আপনি পাগল হচ্ছেন মানে কি? হু আর ইউ?

– ফারহান। ফারহান সাদিক আমি। মেহরিমা কোথায় তুমি? তুমি জানো কোথায় কোথায় খুঁজেছি তোমাকে, তোমার কোন ধারনা আছে?

ফারহানের কথা শুনে মেহরিমা স্মিত হাসলো। তারপর বলল,
– কেন খুঁজছেন আমাকে?

– তুমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারো না মেহু। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফারহান।

– আমি আমার বাড়িতে এসেছি। আসলে হঠাৎ নানুভাই অসুস্থ হয়ে পরেছে তো তাই।

– ওহ। এখান ঠিক আছে তোমার নানুভাই।

– আগের থেকে বেটার।

– কবে ফিরবে?

– খুব তাড়াতাড়ি ফিরবো। আচ্ছা আমি এখন রাখছি কেমন। পরে তোমার সাথে কথা বলবো। তারপর ফারহানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয় মেহরিমা।

কিছুক্ষণ পর আকাশ আসে পুলিশস্টেশনের সামনে। আকাশ আসতেই দুজনে এক সাথে ভিতরে যায়। থানার ভিতরে ডুকেই ওরা সোজা চলে যায় ও সি সাহেবের রুমে। তারপর তাদের মাঝে কথা হয়। মেহরিমা ওসি সাহেবকে ভিডিওটা দেখাতেই তিনি চমকে উঠে। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,

– তুমি, তুমি এই ভিডিওটা কোথায় পেলে?

– এনআর নার্সিংহোমে।

মেহরিমার জবাব শুনে থানার ওসি কিছুটা আতকে উঠে। আর বলে,
– এই মেয়ে তুমি এনআর নার্সিংহোমে পৌঁছালে কি করে। মেহরিমা আর আকাশ দুজনেই তার দিকে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি আবার বলে উঠে,
না মানে বলছিলাম যে, ওখানে তো অনেক রিক্স তুমি কি করে সেখানে গেলে।

– ওনাকে অনেক রিক্স সেটা আপনি কি করে জানলেন? প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আকাশ।

– দেখুন মিস্টার,,

– আকাশ, আকাশ আমার নাম।

– হ্যাঁ, মিস্টার আকাশ। বলছিলাম যে যারা এই ধরনের কাজ করে তারা খুব ডেঞ্জারাস হয় এই আর কি।

– আপনি হয়তো জানেন না ডক্টর ইমরান খান আমার বায়োলজিক্যাল বাবা। হ্যাঁ ডক্টর ইমরান খানের মেয়ে আমি। তাই আমি এনআর নার্সিংহোমের প্রতিটা কোনে আমি পৌঁছাতে পারি।

মেহরিমার কথা শুনে কিছুটা চমকে উঠে,ওসি সাহেব। তারপর বলে,

– ঠিক আছে তুমি ভিডিওটা এখানে রেখে যাও আমি দেখছি।

– দেখছি মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি? আকাশ কিছুটা রেগে উঠে। নিজের ওষ্ঠদ্বয় দাত দিয়ে চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করে বলে, দেখুন আমরা এখানে ডক্টর ইমরান খানের বিরুদ্ধ কমপ্লেন করতে এসেছি। ওনার নার্সিংহোমে এরকম বেআইনি কারবার হয়। তাছাড়া ডক্টর ইমরান খানের আরো অনেক কুকৃত্রি আছে যেগুলোর প্রমান আমাদের কাছে নেই। আপনার খুজে বের করুন। আর অপরাধীকে তার কৃতকর্মের শাস্তি দিন।

আকাশ আর মেহরিমার কথা শুনে ওসি সাহেব কিছুটা ঘাবড়ে যাবে। তবে কি করার, কমপ্লেইন করতে এসেছে সেটা তো করতেই হবে।

ডিনার শেষ বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মেহরিমার মনে পরে ফারহানের কথা। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে ফারহানের নাম্বারটা দেখে নেয়। একগাল হেসে নাম্বারটা মোবাইলে সেইভ করে নেয়। তারপর ডায়াল করে ফারহানের নাম্বারে। রিং হতেই ফারহান কল রিসিভ করে বলে,

– এতক্ষণে মনে পড়লো তাহলে!

– হুম। তা আপনি বুঝি আমার কলের অপেক্ষা করছিলেন।

– হ্যাঁ, করছিলাম -ই তো। আচ্ছা মেহরিমা, আমি কিন্তু আমার এ্যনসারটা এখনো পেলাম না।

– কোন এ্যনসার। ভ্রু কুঁচকায় মেহরিমা।

– সত্যিই বুঝতে পারছো না তুমি?

– না বুঝতে পারছিনা। আপনি বলুন তো কিসের এ্যানসার?

– ভা-ভালোবাসো আমায়?

কোন জবাব দেয় না মেহরিমা। স্মিত হেসে বলে,
– না, ভালোবাসি না আপনাকে।

– সত্যি বলছো?

– হুম, সত্যিই বলছি।

– তাহলে এত রাতে কল কেন করেছো।

– আমার ভুল হয়ে গেছে। এত রাতে আপনাকে কল করা, আমার ভুল হয়ে গেছে। রাখছি। বলেই কল কেটে দেয় মেহরিমা। কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে স্কিনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে। তারপর বলে উঠে, ভালোবাসি তো আপনাকে, খুব ভালোবাসি।

মোবাইলটা পাশে রেখে ঘুমিয়ে পরে মেহরিমা। পরেরদিন সকালে রাজুর ফোনে ঘুম ভাঙে মেহরিমার। ঘুম ঘুম চোখে কলটা রিসিভ করে বলে,

– কিরে রাজু, এত সাতসকালে কেন কল করেছিস?

– এখানো সকাল। একটু শক্ত গলায় বলে রাজু। ঘড়ি দিকে তাকিয়ে দেখ কটা বাজে।

– সেটা জেনে আমার লাভ নাই রে। কেন কল করেছিস সেটা বল।

– কাল বায়োলজির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস আছে সেটা কি তুই ভুলে গেছিস মেহু।

– ওহ হো। মাথায় হাত রাখে মেহরিমা। আমি একদম ভুলে গেছিরে। আসলে এখানে এসে এত বাজে ভাবে ফেসে গেছি না সব গোলমাল হয়ে গেছে আমার।

– কি হয়েছে রে মেহু। তুই ঠিক আছিস তো।কি- কি গোলমাল হয়েছে? উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে রাজু।

– আমি একদম ঠিক আছি। তুই কোন চিন্তা করিস না। রাখছি কেমন। এই বলে কল কেটে দেয় মেহরিমা। মোবাইলটা বিছানার উপর রেখে হাতের নোখ কামড়াতে থাকে আর ভাবতে থাকে এখন তার কি করা উচিৎ। এদিকে নিজের বাবার নামে পুলিশে কমপ্লেন করেছে আর অপর দিকে তার ক্লাস। দুটোই তার জন্যে ইম্পরট্যান্ট। ডক্টর ইমরান খানের মুখোশ খুলতেই হবে। তা না হলে আরো কত অসহায় নিরহের প্রাণ যাবে তার কে জানে। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর ওর মাথায় একটা নামই আসে, আকাশ। সাথে সাথে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে মেহরিমার। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আকাশের নাম্বারে কল দেয় মেহরিমা। তারপর ওকে বলে,

– হ্যাঁ আকাশ। আমার সাথে একটু দেখা করতে পারে।
ওপাশের কথা শুনে দুঠোট প্রসারিত করে হাসে মেহরিমা তারপর ঠিক আছে বলে কল কেটে দেয়। মোবাইলটা বিছানায় রাখতেই সেটা আবারও বেজে উঠলো। বেশ বিরক্তি নিয়ে মোবাইলের দিকে তাদকাতেই মুখটা চুপসে যায় মেহরিমা। স্কিনে জ্বলমল করছে বাবা নামটা। কাপাকাপা হাতে মোবাইলটা ধরতে গিয়েও হাত নামিয়ে নেয় মেহরিমা। কি বলবে ও। কি বা বলার আছে। যে ওকে এই পৃথীবিতে এনেছে তার নামেই ও পুলিশে কমপ্লেন করেছে। আচ্ছা বাবা যদি জিগ্যেস করে তাহলে কি জবাব দিবো। ভাবতেই কেপে উঠে মেহেরিমা। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে মোবাইলের দিকে।

#হৃদমাঝারে – [১৩]

কাপাকাপা হাতে মোবাইলটা নিয়ে কলটা রিসিভ করে মেহরিমা।

– হ্যাঁ, হ্যাঁ ডক্টর খান বলুন। কথাটা বলা শেষ মাত্রই মেহরিমার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে। ওপাশ থেকে শুনতে পেল ডক্টর ইমরান খানের কঠিন কন্ঠশ্বর।

– কমপ্লেনটা তুলে নাও।

– কখনো না।

– যদি নিজের ভালো চাও তাহলে কমপ্লেনটা তুলে নাও আর তোমার কাছে থাকা ভিডিওটা আমাকে দিয়ে দাও। না হলে তোমাকেও,,,

ডক্টর ইমরান খানের কথা শুনে দাঁত চেপে হাসে মেহরিমার। তারপর বলে,
– উহ্, আপনি কখনোই এই ভিডিওটা পাবেন না। এবার লোকসম্মুকে আপনার ভালো মানুষের মুখোশ খুলে দিবো। ডক্টর ইমরান খান, অনেক অপরাধ করেছেন আপনি এবার আপনার শাস্তি পেতেই হবে।

– তুমি ভুল করছো?

– আমার জিবনটাই তো ভুল ডক্টর ইমরান খান। জন্মের দিন নানা মারা যায় আর তার পরেই দাদি। ওহ্ সরি দাদিকে তো আপনি মেরেছেন। কি ঠিক বললাম তো?

ডক্টর ইমরান খান কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। যবে থেকে এই মেয়েটা পৃথীবিতে এসেছে তখন থেকেই তিনি একটা একটা ঝামেলায় সম্মুখীন হচ্ছে। যার কারনে নিজের মা-কেও খুন করেছেন ডক্টর ইমরান খান। এবার এই মেয়েটার একটা ব্যাবস্থা করতেই হবে। খুব বেড়েছে এই মেয়েটা। কেন যে সেদিন এই মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে সে। এখন আফসোস হয় ডক্টর ইমরান খানের। ডক্টর ইমরান খান তার চোয়াল শক্ত করে বলে,

– তুমি ভিডিওটা আমাকে দিবে। আর আজকের মধ্যেই কমপ্লেইনটা তুলে নিবে। না হলে এর ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে।

ডক্টর ইমরান খানের কথা শুনে স্মিত হাসে মেহরিমা। অধোর চেপে বলে, ঠিক আছে, আমিও দেখি আপনি আর কি কি করতে পারেন। কথাটা বলে কল কেটে দেয় মেহরিমা। বড় করে শ্বাস ত্যাগ ও ভাবেই বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

পরেরদিন সকালেই মেহরিমা রওনা দেয় কলেজের উদ্দেশ্যে। কলেজ গেটের কাছে আসতেই ফারহান এসে মেহরিমার হাত ধরে টেনে ওর গাড়িতে বসিয়ে দেয়। মেহরিমা কিছু বলতে যাবে তখন ফারহান ওর ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দেয়। তারপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে থামে একটা নির্জন জায়গায়। ফারহান গাড়ি থেকে নেমে মেহরিমার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়েই মেহরিমাকে জড়িয়ে ধরে। ঘটনার আকস্মিক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে মেহরিমা।

– কি করে পারো তুমি আমাকে এত কষ্ট দিতে।

মেহরিমা কিছু বলে না। আসলে ও বুঝতে পারছে না ওর এখন কি বলা উচিৎ। আস্তে আস্তে মেহরিমা ওর হাত উঠায় ফারহানের পিঠে। মেহরিমার হাত বিচরণ করছে ফারহানের পুরো পিঠ জুড়ে। কিছুক্ষণ পর ফারহান মেহরিমাকে ছেড়ে ওর দুই গালে হাত রেখপ বলে উঠে,

– ভালোবাসি মেহু। খুব ভালোবাসি।

– আমিও তোমাকে ভালোবাসি ফারহান।

মেহরিমার জবাব শুনে ফারহানের চোখমুখ উজ্জল হয়ে যায়। অধোরে হাসি ফুটে উঠে তার। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ফারাহানের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আসলে মেহরিমা যে এখন তাকে ভালোবাসার কথা বলবে সেটা বুঝতে পারে নি ফারহান। তাই সে বুঝতে একটু সময় নিচ্ছে। মেহরিমা ফারহানের হাতের উপর হাত রাখে। অতঃপর বলে,

– তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলা তখনি আমি হাড়িয়ে গিয়েছিলাম তোমার ওই বাদামি চোখে। তোমার কাছে থাকে আমার অদ্ভুত এত ফিলিং হয়। আমি জানিনা সেই ফিলিংক্স এর নাম। তবে এটু বলতে পারি আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। সারাটা জিবন তোমার সাথে কাটাতে চাই ফারহান। আই লাভ ইউ।

– আই লাভ ইউ টু। বলেই ফারহান মেহরিমা কপালের সাথে তার নিজের কপাল ঠেকিয়ে নেয়। আর তখনি মেহরিমা টুপ করে ফারহানের ওষ্ঠে কিছু করে। মেহরিমা ফারহানের থেকে সরে আসতে চাইলে ফারহান এক হাতে মেহরিমার কোমড় জড়িয়ে ধরে। আর বলে,

– ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছ কেন? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো আর আমাকে একটু শ্বাস নিতে দাও। ফারহান মেহরিমার নাকের সাথে ওর নাকটা ঘষতে থাকে। মেহেরিমা মৃদু হেসে ফারহানের কলার চেপে ধরে।

১০,
মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে ডক্টর ইমরান খান। ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে তার শয়তানি হাসি। মোবাইলের স্কিনে জ্বলজ্বল করছে মেহেরিমা ও ফারহানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সময় টুকু। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। আর এটা দেখেই শয়তানি হাসি হাসছে ডক্টর ইমরান খান আর মনে মনে প্ল্যান করছে। কিছুক্ষণ পর একটা নাম্বারে ডায়াল করলে সে। টিটটিট শব্দ হতেই ওপাশ থেকে কেউ কলটা রিসিভ করে। তখন ডক্টর ইমরান খান বলতে শুরু করে,

– ছেলেটা কে?

ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল। যেটা শুনে ডক্টর ইমরান খান স্মিত হেসে বলে,

– তুমি ওদের উপর নজর রাখো। সময় হলে আমি জানিয়ে দিবো কি করতে হবে। আর হ্যাঁ, আমার কিন্তু টাইম টু টাইম আপডেট চাই।

ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনে অট্টহাসিতে ভেঙে পরে ডক্টর ইমরান খান। তারপর সে কল কেটে দেয়। মোবাইলের স্কিনের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সেটা বিছানায় ছুঁড়ে মারে। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় তার। দাঁত চেপে বলে,

– আমার নামে থানায় কমপ্লেন করেছো তুমি মুন। তোমার জিবনটা আমি নরকে পরিণিত করে দিবো।
আমার ভাবতেই অবাক লাগছে তোমার শরীরে আমার রক্ত বয়ছে।

সেদিন আর ক্লাস করা হলো না মেহরিমার। সারাদিন ফারাহানের সাথেই কাটিয়ে দিলো। গল্প আড্ডা খাওয়া আর রোমাঞ্চে ভরপুর ছিলো দিনটি। পরেরদিন ক্লাস করছে মেহরিমা এমন সময় আকাশ কল করে। আর বলে, পুলিশ ওকে ডাকছে। ডক্টর ইমরান খনের এরেস্ট ওয়ারেন্ট এসে গেছে। তার জন্যে মেহরিমার একটা সই লাগবে। তাই সেদিন কোনমতে ক্লাস শেষ করে মেহরিমা ফিরে তার নিজ বাড়িতে। মিঠুর সেদিন ক্লাস ছিলো না সেও বাসায় ছিলো। বাড়ি ফিরতেই ডক্টর ইমরান খান আবার দেখা করে মেহরিমার সাথে। রাত তখন এগারোটা বাজে ছুঁইছুঁই।

– ভিডিওটা আমাকে দিয়ে দাও মুন।

– কখনোই না। আমি আপনাকে এই ভিডিওটা দিবো না। একটু পর পুলিশ আসছে আপনাকে গ্রেফতার করতে তৈরী থাকুন। আপনি যে অপরাধ করেছে তাতে আপনার বাকি জিবনটা হয়তো ওই শ্রীঘরেই কেটে যাবে।

মেহরিমার কথা শুনে অট্টহাসিতে ভেঙে পরে তার বাবা। দু-হাতে মেহরিমার গাল চেপে ধরে বলে,

– দুদিনের একটা মেয়ে হয়ে আমাকে জেলের ঘানি টানাবি। এতটাও বড় হসনি এখনো। একদম মেরে ফেলে দিবো।

– ছাড়ুন আমাকে। লাগছে। মেহরিমা জোর করে তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। দাত কটমট করে ডক্টর ইমরান খানের দিকে তাকিয়ে বলে,

– আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমার শরীরে আপনার রক্ত বয়ছে। তাই রাগ বলেন আর জেদ দুটোই আপনার থেকে কম নয়। আপনি যেমন নিজের অপকর্ম ঢাকতে মানুষের প্রাণ নিতে পারেন ঠিক তেমনি আমিও অন্যায়ের প্রতিবাত করতে নিজের প্রাণ দিতে পারি। নিজের জিবনের পরোয়া আমি কখনোই করি না। আমার ঘৃনা হচ্ছে আপনাকে বাবা বলতে। অবশ্য কখনো ডাকি তো তার একটু শান্তিও লাগছে। আপনার মতো একজন দেশদ্রোহীর রক্ত বয়ছে আমার শরীরে ভাবতেই নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাইছে। আমি মরতে ভয় পাই না ডক্টর ইমরান খান।

– আচ্ছা, নিজের প্রাণের ভয় তুই করিস না। কিন্তু ওর আপনজনেরা! তাদের প্রাণের ভয় তো করিস। তোর মা আর মিঠুর প্রাণের ভয় করিস না তুই। আর কি যেন তোর লাভারের নাম, ও হ্যা, ফারহান। তার প্রাণের ভয় করিস না।

– আপনি এমনটা করতে পারেন না। চিৎকার করে বলে উঠে মেহরিমা। আমার মা আপনার ওয়াইফ মিঠু আপনার ছেলে। আপনি তাদের সাথে এমনটা করতে পারেন না।

– আমি সব পারি। নিজের হাতে আমার মাকে খুন করেছি আমি।

– নাহ। আপনি এমনটা করবেন না।

– করবো। আমি এমনটাই করবো। প্রুভ দেখবে। মোবাইলটা মেহরিমার সামনে এনে ধরে। মেহরিমা মোবাইলের স্কিনের দিকে তাকিয়ে থো হয়ে যায়। ওর মা আর মিঠু ঘুমিয়ে আছে। আর এখানে দুজন লোক তাদের মাথায় বন্ধুক ধরে আছে।

দু-হাতে মুখ চেপে ধরে বসে পরে মেহরিমা। তখন ওর সামনে আরেকটা ভিডিও অন করে। যেটাতে একটা লোক ফারহানের গাড়ির বোম লাগাচ্চে।

– আপনি এরকমটা করবে না। চিৎকার করে কেধে উঠে মেহরিমা। আ- আমি আপনার স-সব কথা শুনবো। প্লিজ ওদের কোন ক্ষতি করবেন না।

চলবে,,,,,

হৃদমাঝারে পর্ব-১০+১১

0

#হৃদমাঝারে – [১০+১১]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

০৮,
মেহরিমা এখন আর ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে না। জিন্স কুর্তি চুড়িদার এগুলো পরেই কলেজে আসে। ফারহানের সাথে ওর বেশ ভাব হয়েছে। ফারহান তো মেহরিমার প্রেমে রিতিমত হাবুডুবু খাচ্ছে। তবে এখনো সে মেহরিমাকে নিজের মনের কথা বলতে পারে নি। বলতে চেয়েছে কয়েকবার কিন্তু পেরে উঠে নি। মেহরিমার সামনে গেলেই ওর সব কথা গুলিয়ে যায়।

ক্যাম্পাসে বাস্কেটবল বল খেলছে রনি ও তার দলবল। ক্যাম্পাসের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো মেহরিমা ও সুবর্ণা। খেলার মাঝে হঠাৎ রনির চোখ যায় মেহরিমার দিকে। রনি খেলা থামিয়ে চলে আসে মেহরিমার কাছে।

– হেই মুন। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল রনি।

মেহরিমা দাঁড়িয়ে পরে। কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,

– তোমাকে কতবার বলেছি কলেজে আমাকে মুন বলে ডাকবে না। কলেজে আমি মেহরিমা। এই নামেই ডাকো আমায়।

– ঠিক আছে। তারপর মেহরিমার হাত ধরে বলল, চল। সামনের দিলে পা বাড়াতেই মেহরিমা ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

– কোথায়?

– বাস্কেটবল খেলবো।

বাস্কেটবলের নাম শুনেই মেহরিমার চোখ গোল হয়ে যায়। আর উত্তেজিত হয়ে বলে,বাস্কেটবল, আর আমি? না!! সামনের দিকে পা বাড়ায় মেহরিমা। তখন সুবর্ণা ওর হাত ধরে বলল,

– তুই এখনো বাস্কেটবল খেলতে ভয় পাস মেহু। আমিও খেলবো বাস্কেটবল চল।

– বর্ণা। আমার কথা শোন। তুই খেল আমি খেলবো না। প্লিজ বোন আমার আমাকে জোড় করিস না। মেহরিমার করুন চোখ।

মেহরিমার কথা শুনে সুবর্ণা আর রনি দুইজনেই অট্টহাসিতে ভেঙে পরে। আর মেহরিমা সেদিকে তাকিয়ে করুন সূরে বলে,

– তোরা হাসছিস!

– বাহ্ মুন। তোর এখনো সেই ভয়টা আছে। ইশ কি অবস্থা হয়েছে রে তোর। আমার তো হেড স্যারের কথা মনে পড়লেই হাসি পায়। বেচারার কি অবস্থা না হয়েছিলো।

– তুমি একদম ঠিক বলেছো রনি। হেড স্যার একটু বেশীই রুড ব্যাবহার করেছিলো।

মেহরিমা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নেয়। ওর এখনো মনে আছে সেদিনের কথা। স্কুলে বাস্কেটবল কম্পিটিশনের ফাইনালের দিনের কথা। ওদের টিমের ক্যাপ্টেন ছিলো মেহরিমা। মেহরিমা ছিলো বাস্কেটবলের চ্যাম্পিয়ন। সেদিন ছিলো ওদের ফাইনাল খেলা। যেহেতু রনির বাবা স্কুলের ট্রাস্টিজ তাই রনি ও রনির বাবা সেদিন উপস্থিত ছিলেন অতিথি হিসাবে। খেলা চলছে তার নিয়মে। বিপক্ষ দলের চেয়ে চার পয়েন্ট এগিয়ে ছিলো মেহরিমার টিম। মেহরিমা লোনাকে বল পাছ করছে তখন কেউ ওর চোখে ঝাল জাতীয় কিছু ছুড়ে মারে। মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে সব কিছু অস্পষ্ট হয়ে আসে। দু-হাতে চোখ চেপে ধরে বসে পরে মেহরিমা আর বল গিয়ে লাগে হেড স্যারের মাথায়। এমনিতেই স্যারের ছিলো টাক মাথা তার উপর বলটা স্পিডে গিয়ে লাগছিলো। স্যার সাথে সাথে মাটিতে লুটে পরে।

সেই ঘটনার পর স্যার ওকে দলের ক্যাপ্টেন পদ থেকে বহিষ্কার করে। মেহরিমা স্যারকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে কোন লাভ হয়নি তাতে। স্যারের একটাই কথা, ভরা মাঠে সেদিন স্যারের মাথায় বলটা লেগেছিলো। স্যারের ইগোতে লেগেছিলো ওটা। সেই ঘটনার পর মেহরিমা বাস্কেটবল খেলাই ছেড়ে দেয়। যদিও রনির কথা শুনে স্যার ওকে ওর পদ দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু মেহরিমা আর ফিরে যায়নি। আসলে ছোট থেকে মেহরিমা ওভর স্মার্ট কিনা।

সূবর্না ও রনি দুজনেই জোড় করে মেহরিমাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে যায়। তারপর মেহরিমা আবার খেলতে শুরু করে। দুই বছর পর খেললেও মেহরিমা আগের মতোই খেলেছে। উপর থেকে এই দৃশ্য দেখছে আর রাগে ফুঁসছে ফারহান। মেহেরিমাকে রনির সাথে ও একেবারে সহ্য করতে পারে না। খেলা শেষে মেহরিমা পা বাড়ায় ক্লাসের দিকে।

ক্লাসের সামনে আসতেই কেউ ওকে টেনে একটা ফাকা রুমের ভিতরে নিয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিক ফ্যালফ্যাল নয়য়ে সে তাকিয়ে থাকে সামনের মানুষটার দিকে।

– আপনি, আমাকে এখানে নিয়ে আসলেন কেন? মেহরিমার কন্ঠ বেশ কঠিন।

– রনিকে কি করে চিনো তুমি? কি সম্পর্ক তোমার ওর সাথে? পাল্টা প্রশ্ন করলো ফারহান।

– এখন আমি কার সাথে মিশবো না মিশবো সেটাই কি আপনি ঠিক করে দিবেন নাকি?

– হ্যাঁ দিবো। রনির থেকে দূরে থাকবে। ও কিন্তু ভালো ছেলে নয়। আর যেন ওর সাথে তোমাকে মিশতে না দেখি। মাইন্ড ইট। রাগে গটগট করতে করতে চলে যায় ফারহান।

– রনির থেকে দূরে তাকবে? আমি কেন তোমার কথা শুনবো। এখন তো আরো বেশী করে মিশবো। স্মিত হাসে মেহরিমা।

সেদিন রাতে মেহেরিমা রনিকে কল করে, তারপর ওকে সাথে করে নিয়ে নাইট ক্লাবে যায়। আর সেদিন মেহরিমার পরনে ছিল ওয়েস্টার্ন ড্রেস। ক্লাবের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে মেহেরিমা। আর রনি সেই ড্রিঙ্কস করে হেলেদুলে নাচে। মেহেরিমা আজকে ভালো লাগছে না বেশ বিরক্ত লাগছে নিজের মনে মনে বলে উঠলো,

-কেন যে রাক্ষসটার উপরে রাগ করে ক্লাবে চলে আসলাম। এখন কিছু ভালো লাগছেনা। রেড ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিয়ে সেটাতো চুমুক দিবে মাত্র আর অমনি কেউ এসে মেহরিমার হাত ধরে ফেলে। সামনে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে মেহেরিমা। অস্ফুটভাবে বলে,

– ফারহান, আপনি এখানে ?

স্মিথ হেসে মাথা নাড়ায় ফারহান। তারপর মেহরিমার হাত থেকে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে সেটা পাশে রেখে দেয়। আর ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে’ চলো’ আমার সাথে। মেহেরিমা কিছু বলে না শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে। ফারহান মেহেরিমা হাতটা ধরে ওকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর ফারহানের গাড়ি এসে থামে একটা বাংলোর সামনে। ফারহান আগের মতোই মেহরিমার হাত ধরে ওকে বাংলোর ভিতরে নিয়ে যায়। এই বাংলোতে আছে দুটো বেড রুম একটা গেস্ট রুম। আর একটা কিচেন। ফারহান মেহরিমাকে নিজের রুমে নিয়ে আসে। তারপর বলে,

– এটা আমার বাংলো। বার্থডে তে বাবা আমাকে এটা গিফ্ট করেছে।

মেহরিমা কিছু বলে না। সৈজন্যসূচক মাথা নাড়িয়ে স্মিত হাসে। তারপর ফারহান ওকে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। বারান্দায় বেশ অন্ধকার, তাই ও একটা মোম জ্বালিয়ে দিলো। মোমের নিভু নিভু আলোতে মেহরিমার মুখটা বেশ মায়াবী লাগছে। ফারহান সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর নিজেকে যতটা সম্ভব সংযোত করে বলে,

– কোন আলোটা ভালো লাগছে তোমার কাছে। অন্ধকারের বুকে এক পালি নিভু নিভু আলো নাকি ক্লাবের ওই লাল নীল আলো টা।

– এটা ভিষন ভালো লাগছে।মৃদু হাসলো মেহরিমা। তারপর সেও তাকালো ফারহানের মুখ পানে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেরই হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। ওরা যেন একে অপরের চোখে হারিয়ে যাচ্ছে। দুইজনের অনুভূতিগুলো কি এক। দুজনের মধ্যেই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ফারহান তার চোখ নামিয়ে নিল। একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে ইতঃস্তত বোধ করলো। তারপর বললো,

– কিছু খাবে তো তাইনা। অনেক খিদে পেয়েছে। রাতে কিছু খাওয়া হয়নি। তারপর সে নিজেই চলে গেলো কিচেনে। ফারহানের পিছন পিছন মেহরিমাও গেলো। ফারহান এখানে মাঝে মাঝেই আসে। তাই প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যাদি এখানে থাকে। তাছাড়া কেয়ার টেকার সব দেখেশুনে রাখে। একমাত্র নুডলুস ছাড়া আর কিছু রাধতে জানে না ফারহান। তাই সে নুডলুস রান্না করার কাজে লেগে পড়লো। সমস্য হলো পেয়াজ কাটতে গিয়ে। পেয়াজটা টেবিলের উপর রেখে ওটার উপর ছুড়ি চালাতে গেলে মেহরিমা চিৎকার বলে,

– এই আপনি পেয়াজটা কাটছেন নাকি খুন করছেন?

ফারহান করুন চোখে ওর দিকে তাকায়। মেহরিমা স্মিত হেসে বলে,

– সরুন আমি দেখছি।

নুডুলস রান্না শেষ হলে একটা প্লেটে নুডলুস নিয়ে আবার বারান্দায় চলে যায় ফারহান আর মেহরিমা।বারান্দায় বসে দুজনে কথা বলছে আর কথা বলার ফাকে ফারহান মেহরিমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মেহরিমা একমনে খেয়ে যাচ্ছে। ক্ষিদে পেয়েছে খুব সেই কোন দুপুরে খেয়েছিলো তারপর আর কিছু খাওয়া হয়নি। মেহরিমা আর ফারহান কথা বলায় এতটাই ব্যাস্ত যে ফারহান খাচ্ছে কি না সেটা খেয়ালই করে নি। খাওয়া শেষ হলে ফারহান মেহরিমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। মেহরিমা সেটা খেয়াল করতেই স্তব্ধ হয়ে যায়। কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে। ফারহানের বুঝতে বাকি থাকে না মেহরিমা ইতস্তত বোধ করছে। তাই প্রসঙ্গ বদলাতে ফারহান বলে উঠলো,

– কোন জায়গাটা বেশী ভালো লাগছে, নাইট ক্লাব নাকি এই নিরিবিলি বাংলোটা।

মেহরিমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ফারহানের দিকে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে হতেই লজ্জামখা হাসি হাসলো। তবে এটা মেহরিমার ঠোঁটে ফুটে উঠলো না। মৃদু হেসে জবাব দিলো,

– এই মুহূর্তটা আমার কাছে সত্যিই স্পেশাল। উঠে দাঁড়ালো মেহরিমা। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ওর চোখের কোন জ্বলজ্বল করে অশ্রু। ফারহান মেহরিমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর বলে,

– আমি ঠিক এমন রুপেই দেখতে চাই তোমাকে। ওয়েস্টার্ন ড্রেস, নাইট ক্লাব, ড্রিংক এসব তোমাকে মানায় না মেহরিমা। মেয়েদের ঘরেই মানায়। তোমরা এই লাইফটা ছেড়ে দাও মেহরিমা। তুমি তো এমন স্ট্রোং নও।

– আমি এমনি। আর আপনি আমায় নিয়ে কেন এত ভাবছেন বলুন তো। রাগী কন্ঠ মেহরিমার।

– কারন আমি তোমাকে,,

– আমাকে কি?

– ভা-ভালোবাসি। কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি।

ফারহানের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় মেহরিমা। কিছুক্ষণ পর বলে,

– আমি আপনাকে ভালোবাসি না।

– আমার কোন প্রবলেম নেই। এখন ভালোবাসো না তবে খুব শীঘ্রই তুমিও আমাকে ভালবাসবে।

– আমি বাড়ি যাবো। মেহরিমা বারান্দা থেকে চলে আসে।

#হৃদমাঝারে – [১১]

৯,
এনআর নার্সিংহোমের একটা কেবিনে বসে আছে মেহরিমা। ওর সামনেই বেডে শুয়ে আছে ওর নানুভাই। তার অপর পাশে বসে আছে অর্ণা। সকালে কলেজে যাওয়ার সময় অর্ণার কল আসে। ওর নানুভাই আবার অসুস্থ হয়ে পরেছে, কথাটা শুনার সাথে সাথে মেহরিমা সোজা চলে আসে ওর মামার বাসায়। তারপর ওর নানুভাইকে নিয়ে এনআর নার্সিংহোমে চলে আসে। ডক্টর ওনাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। হাতে থাকা প্রেশকিপশন আর ঔষুদের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেহরিমা লক্ষ করতেই বলে উঠে,

– আংকেল, কি হয়েছে? কোন গুরুতর সমস্যা।

ডক্টর মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর প্রেশকিপশন আর ঔষুদগুলো বেডের উপর রেখে দেয়। মেহরিমার প্রশ্ন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলে উঠে,

– কবে ফিরলে?

– এইতো আজ সকালে।

ডক্টর আর কিছু বলে না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তাড়াতাড়ি করে সেখান থেকে চলে আসে। ডক্টরের মতিগতি মেহরিমার সন্ধেহ হলো। ইনি তো কখনো এমন করেন না। তাহলে আজ কি হলো? কেন সে মেহরিমার প্রশ্ন উপেক্ষা করলো। নাকি ওর নানুভাইয়ের বড় কোন প্রবলেম হলো। মেহরিমা অর্ণার দিকে একপলক তাকিয়ে দেখলে মেয়েটা কেঁদেকেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলছে। অর্ণাকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে।মেহরিমা সেখান থেকে বেড়িয়ে যায়। ডক্টরের পিছু যায় সে। কিছুপথ যাওয়ার পর মেহরিমার পা থেমে যায়। ডক্টর তার নিজের কেবিনে না গিয়ে সে যাচ্ছে ডক্টর ইমরান খানের কেবিনে। ব্যাপারটা ভালো লাগে না মেহরিমার। ডক্টর চলে যায়। মেহরিমা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ইমরান খানের কেবিনে তার যাওয়াটা কি ঠিক হবে। মেহরিমাকে দেখতে পেয়ে ডক্টর ইমরান খান যদি আবার রেগে যায়। তিনি তো মেহরিমাকে একদম সহ্য করতে পারে না। মনের মাঝে হাজারো দ্বিধা ধন্ধ কাটিয়ে সে পা বাড়ায় ডক্টর ইমরান খানের কেবিনের উদ্দেশ্যে। দরজার নক করবে এমন সময় ডক্টর ইমরান খানের কথায় থমকে যায় মেহরিমা।

– আপনি কি বলতে চাইছেন ডক্টর বিশ্বাস। উনি আমার শ্বাশুড়ি বলেই কি আমার হসপিটালের নিয়ম ভেঙে দিবো নাকি। এটা আমার হসপিটাল, এবং আমার নিয়মেই চলবে। বাহির থেকে কোন ঔষুদ ভিতরে আনা হবে না।

– আপনি কেন বুঝতে পারছেন না ডক্টর খান। আপনার শ্বাশুড়ির অবস্থা দিন দিন ক্রিটিক্যাল হয়ে পরছে। এখন যদি ওনাকে সঠিক ঔষুদ না দেওয়া হয় তাহলে কিছু দিনের মধ্যে ওনিও পরলোকগমন করবেন।

– ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। আমার কোম্পানির ঔষুদ-ই চলবে এখানে। কে বাচলো আর কে মরলো তাতে আমার কিছু যা আসে না।

– কিন্তু আমার যায় আসে ডক্টর খান। আমি একজন ডক্টর কসাই নই যে মানুষের প্রান নিবো।

– সেটা এনআর জয়েন করার আগে ভাবা উচিৎ ছিলো আপনার ডক্টর বিশ্বাস। এখন আমি যা বলবো আপনাকে সেটাই করতে হবে। শয়তানি হাসি হাসে ডক্টর ইমরান খান। তারপর আবার বলে, আরে ওনি তো আমার শ্বাশুড়ি! আমি আমার নিজের মা-কে পর্যন্ত ছাড়িনি। নিজের হাতে খুন করেছি ওনাকে। আমার কথা যে অমান্য করবে তাদের সকলের একটাই শাস্তুি, মৃত্যু।

ডক্টর বিশ্বাস ইমরান খানের কথা শুনে চমকে উঠে। একটা মানুষ কতটা খারাপ হয়ে সে নিজের মা-কে মারতে পারে। বাহিরে দাঁড়িয়ে সব কথাই শুনছিলো মেহরিমা। তার চোখ দিয়ে জল পরছে। এতদিন ভাবতো তার বাবা একজন রাগী মানুষ তবে একটা ভালো ডক্টর। ছোট থেকেই সে তার বাবার মতো একজন ডক্টর হতে চেয়েছে। মেহরিমার চোখের জল যেন আজ ভাধ মানছে না। অঝড় ধারায় বয়ে চলেছে। আবার ওর নানুভাইয়ের কেবিনের দিকে পা বাড়ায় মেহরিমা।

মেহরিমার নানুভাই অচেতন অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে। তার একটা হাত ধরে অর্ণা পাশে বসেই ঘুমিয়ে পরেছে। মেহরিমা এখান থেকে এক ঔষুদের প্যাকেট নিয়ে চলে গেলো বাহিরে। বাহিরে ফার্মেসী থেকে একই ঔষুদ কিনে নিলো। তারপর দুটো ঔষুদ খুলে সেগুলো মিলাতে লাগলো। কিন্তু কোন পার্থক্য পেলো না। দুটো ঔষুদ-ই আলাদা আলাদা করে নাকের কাছে ধরে গন্ধটা শুকে নিলো। এবার বেশ অবাক হয় মেহরিমা। দুটো ঔষুদের আলাদা আলাদা স্মেল। মেহরিমা ঔষুদগুলো নিয়ে একটা দোকানে যায়। তারপর দুটো পাত্র কিনে নেয়। পাত্র দুটিতে পানি দিয়ে সেখানে দুটো ওষুদ ছেড়ে দেয়। একটা ঔষুদ পানিতে দেওয়ার সাথে সাথে পানির রং বদলে যায় আর ঔষদটা গলে যায়। অপরটা পানিতে মিশতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নেয় তবে দুগন্ধটা আর নেই। মাথায় হাত রেখে চিন্তা করতে থাকে মেহরিমা। তার বাবা ডক্টরের মুখোশের আড়ালে একজন ক্রিমিনাল। যে সবাই জাল ঔষুদ
দেয়। কিছুই ভাবতে পারছে না সে। মানুষকে সেবা করার নামে যে তার বাবা সবাইকে আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাথায় হাত রেখে ভাবছে এখন কি করা যায়। তার দৃষ্টি স্থির সামনের দুটো পাত্রের দিকে। তখনি কেউ এসে মেহরিমার কাধে হাত রাখে। নিজের কাধে কারো উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেতেই কেপে উঠে মেহরিমা। তাড়াতাড়ি পিছন দিকে তাকায়। পিছনে তাকাতেই ওর চোখমুখ খুশিতে ভরে উঠে। আকাশ, কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ায় মেহরিমা আর সামনে থাকা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে।

আকাশ আর মেহরিমা দুজনেই পাশাপাশি বসে আছে। দুজনের মুখে হাসি লেগে আছে। আকাশের চোখ পরে সামনে তাকা পাত্র দুটির উপর। তারপর পাত্র দুটোকে ভালো করে দেখে বলে,

– এগুলো কি মুন। ডাক্তারি পড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন কি গবেষক হতে মন চাইছে নাকি?

– না রে। আসলে আমি ঔষুদ দুটো দেখছিলাম।

– মানে!

– তোকে পরে সবটা বলবো। এখন বল আংকেল আন্টি কেমন আছে? আর তোরা দেশে ফিরলি কবে?

-সবাই খুব খুব ভালো আছে। বেশ কিছুূদিন আগেই দেশে ফেরা হয়েছে।

– ওহ। মেহরিমা আরো কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। ওকে যে এখন যেতে হবে। আকাশকে শুধু বলল, সরি আকাশ। আমাকে এখন যেতে হবে। আসলে আমার একটু তাড়া আছে। তুই বাসায় আসিস তারপর আমরা সারাদিন গল্প করবো কেমন? ইনোসেন্ট মুখ মেহরিমার। আকাশ মৃদু হেসে জবাব দেয়, ঠিক আছে। আর শোন সাবধানে যাবি কেমন। মাথা নাড়ি হ্যাঁ সুচক জবাব দেয় মেহরিমা। তারপর আকাশকে বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসে সোজা নার্সিংহোমে। নার্সিংহোমে ডুকতেই ডক্টর ইমরান খানের সামনে পরে মেহরিমা। ডক্টর ইমরান খান একটা স্টাফের সাথে কিছু কথা বলছিলো। মেহরিমা সেদিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। কিছুটা দূরে আসার পর মেহরিমা ভাবতে থাকে, সাধারণ একটা স্টাফের সাথে বাবার এত কিসের কথা থাকতে পারে। এই লোকটা কে? মেহরিমা আবার পিছনের দিকে ঘুরে ওদের কাছে আসে। ডক্টর ইমরান খান লোকটাকে কিছু বলে চলে গেলেন। আর লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে চলে গেলে নার্সিংহোমের পশ্চিম প্রান্তে। মেহরিমা বেশ অবাক হলো। কারন এদিকে সচরাচর কেউ আসে না। এখানে সাধারণ এমআরআই করানো হয়। তবে সেটাও একটা কেবিনে। বাকি রুম গুলাতো বন্ধ,তাহলে কোথায় যায় লোকটা? মেহরিমা লোকটার পিছু করতে থাকে।

নার্সিংহোমের একদম পশ্চিম প্রান্তে একটা দেয়ালের কাছে এসে লোকটা এদিক ওদিক তাকায়। মেহরিমা তখন পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পরে। দেয়ালের সামনে ঝুলে থাকা পর্দাটা সড়িয়ে ভিতরে ডুকে লোকটা। লোকটা ভিতরে যেতেই মেহরিমা পর্দার আড়ালে থেকে বেড়িয়ে আসে। তারপর সেও চলে যায় ভিতরে। ভিতরে ডুকতেই সামনে আরো একটা দরজা পরে। ভাগ্যিস এখন দরজার কাছে কেউ নেই তাই অনায়াসে ভিতরে যেতে পারে মেহরিমা। ভিতরে ডুকতেই অবাক হয় সে। বড় বড় পার্সেল সাজানো এখানে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এগুলোর ভিতরে ঔষুদ। মেহরিমা কিছু বুঝতে পারছে না। ঔষুদের পার্সেল এখানে কেন? এগুলো রাখার জন্যে ফার্মেসী আছে। সামনের দিকে এগিয়ে সবটা দেখতে থাকে সে। হঠাৎ সে এমন কিছু দেখতে পায় যেটা থেকে মেহরিমা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর পকেট থেকে মোবাইল বের করে সবটা ভিডিও করতে থাকে।

চলবে,,,,,,

হৃদমাঝারে পর্ব-০৮+০৯

0

#হৃদমাঝারে – [০৮+০৯]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা
৬„
ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে ফারহান। হাতে তার গিটার। আজ প্রায় ছয় বছর পর নিজের হাতে গিটার তুলে নিয়েছে ফারহান। অন্ধকারে নিমজ্জিত আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে গিটারে সুর তুলল,
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে, ফিরিতেছি পাগল হয়ে।
মরমে জ্বলছে আগুন আর নিভেনা, আর নিভেনা।
আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ বিরহে তার প্রাণ বাচে না। দেখেছি রুপসাগরে মনের মানুষ কাচা সোনা।

চোখ বন্ধ করে পুরো গানটাই গাইলো ফারহান। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো ছয় বছর আগের সেই সময়গুলো। মুনের সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত মনে পরে যাচ্ছিলো তার। কখন যে তার চোখ থেকে দু-ফোটা জল বেড়িয়েছে সেটা সম্পর্কে অবগত নয় ফারহান। কমিশনড স্যারের বলা প্রতিটা কথা ওর কানের কাছে বেজে চলেছে। ফারহান কমিশনড স্যারের বাড়ি গিয়েছিলো বাচ্চাদুটো কে নিয়ে কথা বলতে। তাদের কোথায় রাখবে সেই ব্যাপারে জানতে গিয়েছিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে মুনকে দেখতে পাবে এটা জানা ছিলো না। ফারহান যখন কমিশনড স্যারকে মুনের সম্পর্কে জিগ্যেস করে তখন তিনি বলেন,

– তোমাদের বলেছিলাম তো, এই কেইস সম্পর্কে তোমরা ছাড়াও আরো দুজন জানে। তাদের মাঝে একজন মুন আর অপর জন রনি, যে নিজেই একজন অপরাধী। তোমরা চাইলে মুনের থেকে সাহায্য নিতেই পারো। তারপর তিনি আরো কিছু কথা বলেন যেগুলো শুনে ফারহান স্তব্ধ হয়ে যায়। কোন রকমে সেখান থেকে চলে আসে।

গান শেষ হলে গিটারটা নিয়েই ফ্লোরে বসে পরে। চোখের সামনে ভেসে উঠে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা একটা মেয়ে। লেয়ার কাট চুলের দুপাশে দুটি ঝুটি করা, হাতে পায়ে সাপের ট্যাটু আর ঠোটে তার প্রাণ উচ্ছল হাসি। ভাবতে থাকে সাত বছর আগের কথা।

বায়োলজি অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ফারহান সাদিক। যেমন ভালো পড়াশুনায় তেমনি খেলাধুলায়। অন্যায় দেখলেই তীব্র প্রতিবাত জানায়। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে বিন্ধুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। এই কারনেই কলেজের প্রতিটা স্যার ফারহানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একই কলেজের ছাত্রী মেহরিমা খান। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। পড়াশুনায় ভালো হলেও মেয়েটা বেশ উদ্ভট টাইপের। ওয়েস্টার্ন ড্রেস, নাইট ক্লাব বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াই তার প্রধান কাজ। তবে সে মারামারি করতেও এক্সপার্ট। মেহরিমা ছোট থেকেই চেয়েছে ডক্টর হতে। তাছাড়া তার বাবা একজন ডক্টর তাদের নিজেদের -ই নার্সিংহোম আছে। যদিও তার বাবা তাকে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু সম্পর্ক তো আর অস্বীকার করা যায় না। ওর শরীরে যে একজন ডাক্তারের রক্ত বয়ছে। মেডিকেল কলেজে না পড়েও মেডিকেল সম্পর্কে ওর ধারনা প্রখর।

বন্ধুদের সাথে কলেজে যাচ্ছে মেহরিমা। ওদের একটাই দোষ, ওরা সবাই বাইক নিয়ে কলেজে যায় আর প্রতিবার যাওয়া আসার সময় রেস করে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাইক রেস করতে করতে কলেজে যাচ্ছে মেহরিমা ও তার বন্ধুরা। কলেজ গেট গিয়ে ডুকতেই একটা গাড়ি এসে পরে মেহরিমার বাইকের সামনে। মেহরিমা তার বাইকটা জোড়ে টেনে একটু সামনে এগিয়ে যায়।আর গাড়িটা থেমে যায়।গাড়ির ভিতরে বসে থাকা লোকটা চিৎকার করে উঠে,

– হে ইউ, অন্ধ নাকি? দেখতো পাওনা কিছু?

মেহরিমা তার বাইকটা থামিয়ে মাত্র হেলমেডটা খুলে পিছনে তাকাবে আর একটা বাইক এসে থেমে বলে,

– তুই এগিয়ে যা মেহু। আমরা দেখছি।

মেহরিমা আবার হেলমেডটা পরে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। হেলমেড খুলার পরে যখন ওর লেয়ার কাট ব্রাউন কালারের চুলগুলো বেড়িয়ে আসে তখন লোকটার বুঝতে বাকি থাকে না এটা ছেলে নয় মেয়ে।তবে আশ্চর্যজনক কথা হলো মেয়েটা যখন মাথার হেলমেড খুলে ব্রাউন কালারের চুলগুলো নাড়াচাড়া করছিলো তখন ফারহানের বুকের বা পাশটায় হঠাৎ করে ব্যাথা অনুভব করে। গাড়ির পিছন থেকে একটা মেয়ে নেমে এসে বাইকের সামনে দাঁড়ায় আর ঝাঝালো গলায় বলে,

– কি অস*ভ্য লোকটা? ভুল করেছে সরি টুকুও বলল না। কোন মেনার নাই নাকি?

– হে ইউ? কাকে অসভ্য বলছেন? হেলমেড খুলল অপু। তখর ওর পাশে এসে দাঁড়ালো রাজুর বাইক।পিছনে বসা সুবর্ণা। গাড়ি থেকে আওয়াজ এলো,

– ছেড়ে দে স্নেহা, ওটা একটা মেয়ে ছিলো।

– মেয়ে বলে কি তার অপরাধ ক্ষমা হয়ে যাবে নাকি?
এই শুনো ওই মেয়েটাকে বলো ফারহানকে সরি বলতে।

স্নেহার কথা শুনে গাড়ি থেকে ফারহান বলে উঠলো,

– কাউকে সরি বলতে হবে না। তুই আসবি নাকি আমি চলে যাবো। বলেই গাড়ি স্টার্ট দেয় ফারহান। স্নেহা তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠে বসে। আর অপু রাজু সুবর্ণা চলে যায় কলেজের ভিতরে। এদিকে গাড়িতে বসে স্নেহা প্রশ্ন করে,

– তুই ওদের এমনি এমনি ছেড়ে দিলি?

প্রতিউত্তরে ফারহান কিছু বলে না। মৃদু হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে ড্রাইভ করতে থাকে।

কলেজে আসতে না আসতেই স্নেহা তার বন্ধুদের সবাইকে বলে বেড়ায়, মেহরিমার কথা। আর সবাই মিলে মেহরিমা ও তার বন্ধুদের উপর চটে যায়। তখন সবার মনে শুধু মেহরিমা ও তার বন্ধুদের নিয়ে নেগেটিভ ধারনা আসতে থাকে। আর সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি করার উপযুক্ত শিক্ষা দিবে এটাই ভাবছে এখন তারা। এদিকে ফারহান একা একা বসে আছে লাইব্রেরিতে। চোখের সামনে বই খুলে রেখেছে ঠিক কিন্তু তার মনটা নেই বইয়ের মাঝে। চোখের সামনে বারংবার ভেসে উঠে সেই ব্রাউন কালারের চুলগুলো। মাথা থেকে হেলমেড খুলার দৃশ্যটা যতবার মনে পড়ছে ততবারই ওর বুকটা চিনচিন করছে। বইটা বন্ধকরে দু-হাতে মুখ চেপে ধরলো ফারহান। নাহ্, এসব কি হচ্ছে আমার সাথে। কে এই মেয়েটা? আমার তার জন্যে এমন কেন ফিলিং হচ্ছে। ওহ্।

লাইব্রেরি থেকে দৌড়ে ক্যাম্পাসে চলে আসে ফারহান। ক্যাম্পাসে দুই গ্রুপের মাঝে মারামারি হচ্ছে। ফারহানের এক বন্ধুকে মারছে রনি ও তার দলবল। রনি এই কলেকের ট্রাস্টিজ এর ছেলে। নিজের বাবার ক্ষমতার বড়াইতে সে যা খুশি তাই করে বেড়ায় কলেজে। যদিও তার জন্যে কলেজের প্রায় অর্ধেক মেয়ে পাগল। রনির একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ফারহান। ফারহান ক্যাম্পাসে আসার আগেই রনি ও তার দলবল ক্যাম্পাস থেকে চলে যায়। মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে সুজন। ফারহান ও তার বন্ধুরা দ্রুত সুজনের কাছে চলে আসে।সুজন ঞ্জান হাড়িয়েছে মাথা কেটে রক্ত পরছে। ফারহান হাইপার হয়ে আনিতকে বলল,

– আনিত, গাড়ি বের কর। আমি সুজনকে নিয়ে আসছি। ফার্স্ট আনিত।

আনিত উঠে চলে যায়। ফারহান তার বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে সুজনকে তুলে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। মেহরিমারা তখন ক্যাম্পাসের অন্যপান্তে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করছিলো। হঠাৎ একটা লোককে এভাবে নিয়ে যেতে দেখে সুবর্ণা বলে,

– ওই দেখ মেহু। একটা ছেলেকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত এরা মারামারি করছে। ভালো হয়েছে খুব ভালো হয়েছে। এবার দেখ কেমন লাগে।

– আহ্ বর্ণা, এভাবে কেন বলছিস বলতো। রাজু বলে উঠলো।

মেহরিমা এতক্ষণ ফারহানদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ করেই সে উঠে দাঁড়ায় আর বলে,

– আমি আসছি।

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহরিমা সেখান থেকে চলে আসে। ততক্ষণে ফারহানদের সাথে যুক্ত হয় ওদের আরো দুই বন্ধু স্নেহা আর রিক্তা। ওরা ছেলেটাকে নিয়ে গাড়িতে তুলবে এমন সময় মেহরিমা গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু কেউই মেহরিমার দিকে তাকায় না। সবাই এখন ছেলেটাকে নিয়ে ব্যাস্ত। তাকে হসপিটালে নিতে হবে যে। এমন সময় মেহরিমা বলে উঠে,

– এক্সকিউজ মি! আচ্ছা আমি কি একবার উনাকে একটু দেখতে পারি।

মেহরিমার কথা শুনে সবাই ওর দিকে তাকায়। এমনিতেই সুজনকে নিয়ে ওরা বেশ চিন্তায় আছে তার উপর মেহরিমার এমন কথা। মেহরিমা বেশ উৎসাহ নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে ওদের সিদ্ধান্ত জানতে চায় সে। স্নেহা বলে উঠে,

– ওকে দেখবে তুমি? কেন? তুমি কি ডক্টর নাকি?
ব্যাঙ্গাত্বক হাসি হাসলো।

ফারহান কিছুক্ষণ ওই ব্রাউন কালারের চুলের ঝুটির দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর বলল,

– তুমি দেখে কি করবে? না মানে ওকে এখন ডক্টরের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। এখন একটা ডক্টরের প্রয়োজন, তুমি তো ডক্টর নও।

– তা ঠিক নই। তবে আমি ওনাকে সুস্থ করে দিতে পারবো।

– এই মেয়ে মাথা ঠিক আছে তোমার? দেখে তো মনে হয় কলেজে নতুন আসছো। বয়স কত তোমার? আনিত প্রশ্ন করলো।

– আহ্ এত প্রশ্ন করছেন কেন বলুন তো? তারপর মেহরিমা ফারহানের সামনে গিয়ে বলে, ওনাকে ওখানে শুইয়ে দিন।

– পাগল নাকি তুমি?

– উহ্ এত কথা না বলে যা বলছি তাই করুন তো। বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল মেহরিমা। ওর কথা শুনে ফারহান স্মিত হাসলো। তারপর কিছু ভেবে মেহরিমার কথা মতো ওকে সুজনকে ঘাসের উপর শুইয়ে দিলো। তারপর মেহরিমা সুবর্ণাকে বলে ফাস্টের্ড বক্স নিয়ে সুজনের মাথায় ঔষুদ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। ঠোঁটের কেটে যাওয়া অংশে ঔষুদ লাগিয়ে দেয়। তারপর একটা ইনজেকশন এর নাম লিখে আনিতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, এটা নিয়ে আসুন। আনিত হা করে মেহরিমার দিকে তাকালে মেহরিমা আবার বলে, এভাবে হা করে কি দেখছেন? যান নিয়ে আসুন। আপনার বন্ধুর এখনি ঞ্জান ফিরে আসবে।

তারপর আনিত ইনজেকশন নিয়ে আসলে মেহরিমা সুজনের হাতে সেটা পুশ করে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঞ্জান ফিরে সুজনের। আর এই পুরোটা সময় ফারহান বুকের উপর হাত গুজে তাকিয়ে ছিলো মেহরিমার দিকে। মেহরিমাকে নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো সে। দুধে আলতা গায়ের রং। টিকালো নাক। গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোট। ঘন কালো চোখের পাপড়ি। মাথায় ব্রাউন কালারের চুল তার উপর দুপাশে দুটি ঝুটি করে রাখা। একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে ওকে। তবে ওর ড্রেসটা? এটা ভালো লাগেনি ফারহানের।

সুজনের ঞ্জান ফিরতেই আনিত রাগি গলায় বলল,

– তোকে কতবার বলছি ওই মেয়ের পিছু ছেড়ে দে। ওটা রনির গার্লফেন্ড। তুই রনির পাওয়ার জানিস না?

– আর তুই ভালোবাসার পাওয়ার জানিস না। কথাটা বলেই স্মিত হাসলো সুজন।

#হৃদমাঝারে – [০৯]

৭,
ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে বসে গল্প করছিলো মেহরিমা। এমন সময় রনি তার দল নিয়ে মেহরিমার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেহরিমা রনির দিকে তাকাতেই রনি স্মিত হাসলো। মেহরিমা রাগে কটমট করে ওর দিকে তাকাতেই রনি অন্যদিকে তাকালো আর তখনি একটা ছেলে এসে মেহরিমার দিকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ দিয়ে বলে,

– আ- আই লাভ ইউ।

মেহরিমা ছেলেটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর বলল, তুমি আমাকে ভালোবাসো? কিন্তু কেন?

ছেলেটা এবার থতমত খেয়ে গেলো। তারপর বলল,

– না মানে, আমি আসলে,,

– তুমি আসলে কি? উঠে দাঁড়ায় মেহরিমা।

– না আসলে আমি না। ওই সাইম তোমাকে ভালোবাসে। ছেলেটা এবার মাথা তুলে তাকালো মেহরিমার দিকে তাকালো। মেহরিমা ছেলেটার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে সাইমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রনির এই দলটা মেহরিমার আগে থেকেই চেনা তাই সাইমকে চিনতে ওর অসুবিধা হয়নি। মেহরিমা সাইমকে জিগ্যেস করলো,

– এসব কি হচ্ছে সাইম।

সাইম একগাল হাসলো। তারপর বলল,

– কি করবো বলো সুইটহার্ট। তোমাকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। তোমার এই গুলুমুলু চেহারা ওয়েস্টার্ন ড্রেসে তোমাকে যা হ*ট লাগে না। ইশ আমি তো নিজেকে,,

আর কিছু বলতে পারলো না সাইম আর আগেই মেহরিমা বলে উঠলো,

– ভদ্রভাবে কথা বলো সাইম। না হলে কিন্তু

– কি করবে তুমি হ্যাঁ। তুমি জানো এই ছোট ছোট তোমাকে দেখলে আমি ভিবোর হয়ে যাই। নিজেকে সামলাতে আমার কতটা কষ্ট হয়।

সাইমের কথা শেষ হতে না হতেই মেহরিমা ওর গালে সজোরে চড় বসালো। তারপর সাইমের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, আমাকে দেখতে হ*ট লাগে তাইনা। তুই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিস না। আজকের পর নিজেকে আরো ঠিক রাখতে পারবি না। তারপর সাইমকে ইচ্ছেমত মারতে লাগলো। মেহেরিমাকে দেখে অপু রাজু ও বর্ণা ও ওকে মারতে লাগলো। কিছুক্ষণ মারার পর রনি এসে মেহরিমা কে আটকিয়ে বলে,

– কি করছিস মুন। মেরে ফেলবি নাকি?

– ছাড়ো আমায় রনি। একে তো আজ আমি একেবারে মেরে দিবো। বলেই মেহরিমা এক লাথি দিলো সাইমকে। রনি মেহরিমাকে টেনে একটু দূরে নিয়ে বলল, এই মুন থাম এবার। অনেক হয়েছে।
মেহরিমা রনির দিকে তাকিয়ে চক্ষুূ্দ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে বলল,

– এরা তোমার বন্ধু রনি। এর ছেলের সাহস দেখে আমি অবাক হয়েছি। আর রনি, এই ছেলেটা আমাকে এত খারাপ কথা বলল আর তুমি কিছু বললে না।

মুনের দিকে স্মিত হাসলো রনি। মাথা চুলকিয়ে বলল,

– আমি বলেছিলাম তোর কাছে না আসতে কিন্তু সাইম আমার কোন কথা শুনেনি। তাই আমিও আর কিছু বলি নি। ছেলেটা তোর হাতের মিষ্টি আদর পেতে চাইছে তাই আমিও আর না করলাম না। কিন্তু তুই যে এত আদর করবি সেটা ভাবতে পারিনি। আর একটু হলেই মরে যেতো।

– মরে যাক। যাক মরে। রাগে কটমট করে আবার সাইমের দিকে তাকায় মেহরিমা। রনি মেহরিমার হাত ধরে বলল,

– চল এখান থেকে। তারপর রনি মেহরিমাকে টেনে সেখান থেকে নিয়ে যায়। উপর থেকে এই দৃশ্য দেখছিলো ফারহান আর রাগে ফুঁসছিল। হাতের শক্তমুঠি করে বড় বড় করে শ্বাস নিলো কয়েকবার। তারপর দেয়ালে ঘুসি দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো।

কলেজ শেষে সব বন্ধুরা মিলে পার্কিং লটে আসে। রাজু আর অপু ওদের বাইক আনতে গেলে মেহরিমা আর সুবর্ণা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আর তখন ওদের সামনে আসে ফারহান। ফারহানকে দেখে মেহরিমার ভ্রু আপনা আপনি কুঁচকে উঠে। ফারহান মেহরিমার নিকটে এসে পকেট থেকে একটা মার্কার পেন বের করে তারপর মেহরিমার সামনে কিছুটা ঝুকে ওর হাটুর নিজ বরাবর দাগকাটে। ফারহানের এমন কান্ডে হতবম্ব হয়ে যায় দুইজনেই। মেহরিমা দু-পা পিছিয়ে যায়। আর বলে,

– কি, কি করছেন আপনি?

ফারহান সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় আর পেনটা পকেটে পুরে স্মিত হাসে। তারপর বলে,

– কাল থেকে যেন এই দাগটা দেখা না যায়। মানে হাটুর নিচে জামা পরে কলেজে আসবে।

– আপনি কি আমাকে অর্ডার করছেন।

– ধরে নাও তাই।

– কখনোই না। আমি ওসব লং ড্রেস পরি না।

– এখন থেকে পরবে।

– হে ইউ। আপনি কে হুম! আমাকে অর্ডার করার আপনি কে?

– তোমার ভবিষ্যৎ। কথাটা বিরবির করে বললেও মেহেরিমার কর্ণপাত ঠিক-ই হলো। মেহরিমা মাথা তুলে সামনে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ফারহান বলে উঠে,

– না মানে বলছিলাম, এতে ভবিষ্যৎতে তোমারই ভালো হবে।

– আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ফারহান কিছু বলবে তার আগেই অপু আর রাজু বাইক নিয়ে এসে হাজির হয়। মেহরিমা ফারহানের দিকে এক পলক তাকিয়ে বাইকে উঠে বসে। আর ফারহান সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে মেহরিমার চলে যাওয়ার দিকে। মেহরিমা চলে যাওয়ার পর ফারহান মনে মনে বলে উঠে, তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তো আমিই ভাববো মেহুরানি। হুম শুধু আমি।

রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে ফারহান। বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে মেহরিমা সেই শান্ত চেহারা। সেদিন যখন মেহরিমা সাইমকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলো তখন মেহরিমা ছিলো শান্তু। আর আজ যে মেহরিমাকে দেখলো সে, আচ্ছা এই মেহরিমা সেই মেহরিমা-ই তো। কথায় কথায় রেগে যায় কেন মেয়েটা। আচ্ছা কেমন হয় যদি মেহরিমা সবসময় সেদিনের মত শান্ত থাকে। শুয়া থেকে উঠে বসে ফারহান। আমি একটু বেশীই ভাবছি মেহরিমাকে নিয়ে। এত হাইপার কেন হচ্ছি আমি।

পরেরদিন মেহরিমা সেই আগের লুকেই কলেজে আসে। পরনে ওয়েস্টার্ন ড্রেস, ব্রাউন কালারের চুলে দুটো ঝুটি আর ঠোটে গোলাপি লিপস্টিক। ফারহান মেহরিমাকে দেখে দ্রুত ওর কাছে চলে আসে। রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওকে অবলোকন করে নিয়ে শক্ত গলায় বলে,

– এই তোমাকে বলেছিলাম এই ড্রেসে তুমি কলেজে আসবে না।

মেহরিমা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে। মেহরিমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহান ওর সামনে তুরি বাজিয়ে বলে,

– এভাবে হা করে কি দেখছো। ফারহান একটু ভাব নিয়ে বলে, মানছি আমি হ্যান্ডসাম, তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকবে নাকি?

ফারহানের কথা শুনে মেহরিমা একগাল হেসে বলে,
– আপনি হ্যান্ডসাম! এই ভুল ধারনা কবে থেকে পুশছেন আপনি?

ফারহান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেহরিমার হাসির দিকে। তারপর আবার নিজের গলার স্বর কঠিন করে বলে,

– কাল তো তোমাকে বলেছিলাম এই ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে কলেজে আসবে না। আমার কথা শুনলে না কেন?

– আমি কেন আপনার কথা শুনবো। তাছাড়া বাসায় আমার ওয়েস্টার্ন ড্রেস ছাড়া অন্য কোন ড্রেস নেই।

মেহরিমার কথা বলা শেষ হতেই ফারহান ওর হাত ধরে বলে,চল আমার সাথে। মেহরিমা নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে, হাত ছাড়ুন আমার। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ফারহান মেহরিমার কোন কথার জবাব না দিয়ে ওকে টেনে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে গাড়ির দরজা লক করে দেয়। মেহরিমা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতেই ফারহান ওর মুখে আঙ্গুল দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে, একদম মুখ খুলবে না বলে দিলাম। তারপর মেহরিমাকে কিছু না বলে গাড়িতে বসে চুপচাপ ড্রাইভ করতে থাকে। মেহরিমা আড় চোখে ওর দিকে ওর দিকে তাকাচ্ছে আর রাগে ফুঁসছে।

মিনিট দশেক পর ফারহানের গাড়ি এসে থামে একটা শপিংমলের সামনে। ফারহান গাড়ি থেকে নেমে মেহরিমাকে নিয়ে চলে যায় শপিং মলের ভিতরে। তারপর ওকে নিজের পছন্দমত কয়েকটা ড্রেস কিনে দেয়। আর একটা রেড কালারের চুড়িদার মেহরিমার হাতে ধড়িয়ে দিয়ে বলে,

– যাও এটা পরে এসো।

মেহরিমা রাগে কটমট করে ওর দিকে তাকাতেই ফারহান ওকে ধমক দিয়ে বলে,

– এখানো এখানে দাঁড়িয়ে আছো তুমি। যাও এগুলো পরে এসে।

মেহরিমা রাগে গটগট করতে করতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে মেহরিমা লাল চুড়িদার পরে বাহিরে আসে। ফারহান মুগ্ধ হয়ে সে দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মেহরিমার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর বলে,

– সেদিন তুমি সাইমকে মারছিলে কেন?

– কারন, ও আমাকে বাজে কথা বলছিলো।

– সাইমকি কিছু ভুল বলেছে। তুমি ছোট ছোট ড্রেস পরে ছেলেদের ঘুরবে আর ছেলেরা তোমায় কিছু বললেই দোষ হয়ে যায়। একটা নারীর বড় অহংকার হলো সম্মান। নিজের সম্মানকে ধুলিস্সাৎ করো না।

– মা-মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?

– ওই ছোটখাটো ড্রেস পরে আর বাহিরে এসো না। নিজের অঙ্গ ঢেকে রাখো। মানুষের ললাসু দৃষ্টি থেকে নিজেকে দূরে রাখো।

মেহরিমা কিছু বলে না। শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

চলবে,,,,,

হৃদমাঝারে পর্ব-০৬+০৭

0

#হৃদমাঝারে – [০৬+০৭]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

ফারহান মুনের দুই বাহু শক্তকরে চেপে ধরে ওর দিকে কটমট করে তাকায়। কিছু বলতে যাবে তখনি মুন ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠে। আহ, চোখ বন্ধ করে নেয় মুন। আকস্মিক ফারহান ওকে ছেড়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে বলল,

– সরি, তোমার লেগেছে খুব। ফারহানের চোখ-মুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। সে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুনের দিকে। ফারহানের এমন কান্ডে অবাক হয়ে যায় মুন। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফারহানের চোখের দিকে। বেশ ভালো লাগছে মুনের। ফারহান ওকে নিয়ে এখনো ভাবে। না হলে মুনের একটু ব্যথায় ফারহান এভাবে রিএক্ট করত না। মুনের চোখের কোনে অশ্রুর ভীড় জমে যায়। ফারহান এখনো তাকিয়ে আছে মুনের চোখের দিকে। দুজন যেন দুজনের চোখে হাড়িয়ে গেছে। ফারহানের ধ্যান ভাঙ্গে ওর মোবাইলের রিংটোনের শব্দে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো স্কিনে মিদুলের নামটা জ্বলমল করছে। ফারহান কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে কি বলল বুঝতে পারলো না মুন। তবে লোকটার কথা শুনে যে ফারহান অবাক হয়েছে সেটা বুজতে বাকি রইলো না। ফারহান বলল,

– আমি আসছি। আর তুমি সবাইকে নিয়ে পৌঁছে যাও। সাবধানে যেও।

কথাটা বলেই কল কেটে দেয় ফারহান। তারপর আবার অন্য একজনকে কল করে। মুন অবাক হয়ে সবটা দেখে যাচ্ছে। কিন্তু ফারহান সে একেবারে জন্যেও মুনের দিকে তাকাচ্ছে না। ওর সামনে যে মুন দাঁড়িয়ে আছে সেটা হয়তো ফারহান ভুলেই গিয়েছে। এবার ফারহান কথা বলতে লাগলো,

– স্যার, আমার পুলিশ ফোর্স লাগবে। ইমারজেন্সি। তারপর কথা বলতে বলতে চলে যায় ফারহান। যাওয়ার আগে একবারও সে মুনের দিকে তাকায় নি। মুন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ফারহানের চলে যাওয়ার দিকে।

নিচে এসে ফয়সাল সাদিককে জানিয়ে সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরে। গাড়িতে বসে আগে নিজের গায়ের কোটটা খুলে পাশের সিটে রাখে। পলাশ আর মিদুলকে কল করে সে তার গাড়ি স্টার্ট দেয়। ফুল স্পিডে গাড়ি চলছে ফারহানের। এই শহরের প্রতিটা অলিগলি চেনা ফারহানের তাই গাড়ি হাই স্পিডে চললেও ওর কোন অসুবিধা হচ্ছে না। গড়িটা এমন ভাবে চলছে মনে হচ্ছে, নাম মাত্র মাটি ছুয়ে উড়ে যাচ্ছে গাড়িটা। প্রায় আধঘণ্টা ড্রাইভ করার পর গাড়ি এসে থামলো একটা চলন্ত ট্রাকের সামনে। এক্সিডেন্টের ভয়ে ট্রাকটাও থামিয়ে দেয় ট্রাক ডাইভার। তারপরেই ট্রাকের পিছনে এসে থামে আরো দুটো গাড়ি। একটা পুলিশের গাড়ি। একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে ট্রাকের কাছে আসতেই দেখলো ট্রাক ড্রাইভার নেই। সে পালিয়েছে। মিদুল ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– স্যার, ড্রাইভার পালিয়েছে?

কথাটা শুনে ফারহান দৌড়ে ট্রাকে উঠে। ড্রাইভারকে না পেয়ে রাগে গাড়িতে পরপর কয়েকটা লাথি মারে।উহ্ শিট। তারপর গাড়ির পিছনে উঠে। আর সেখান থেকে সতেরো জন শিশুকে উদ্ধার করে। তার মধ্যে দুজন একেবারেই ছোট। সদ্য হাটতে শিখেছে এমন শিশু। পুলিশ সবাইকে গাড়ি থেকে বের করে। আর শিশু দুটোকে নিয়ে ফারহানের সামনে আসে। বাচ্চাদুটোকে দেখে ফারহানের বুক কেপে উঠে। ছুয়ে দেখার জন্যে হাত বাড়ালে ওর হাতটা কেপে উঠে। নামিয়ে নেয় হাতটা। অজান্তেই চোখের কোনে জল এসে যায়।

– মানুষ কতটা হা*রামি। কি করে পারে এই শিশুদের অন্যদেশ পাচার করতে। মিদুলের কথায় তাল মিলিয়ে পলাশ বলে উঠে,

– এরা মানুষ নাকি। এরা একেকটা কু*ত্তা*র বাচ্চা। কু*ত্তা*র রক্ত বয়ছে ওদের শরীরে। তাইতো এমন কাজ করতে পারে। মানুষের বা*চ্চা হলে এমক কাজ করার কথা জিবনেও ভাবতে পারতো।

– হুম রে এরা মানুষ নয়। (মিদুল)

ফারহানকে এভাবে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিদুল ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

– স্যার এনি প্রবলেম?

ফারহান মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়। স্বস্তির শ্বাস ফেলে মিদুল। ফারহান মিদুলকে জিগ্যেস করে,

– গাড়িটা কোথা থেকে ছেড়েছে?

– স্যার, এটা বেনামী গাড়ি। সোর্স দেওয়া না।

– গাড়ির মালিককে খুজে বের করো। তারপর সে নিজেই গাড়ির নাম্বারটা দেখে পুলিশকে বলে গাড়িটা পুলিশস্টনে নিয়ে যেতে সাথে বাচ্চাদের ও। শিমুল সব বাচ্চাদের নিয়ে যায় পুলিশস্টেশনে। মিদুলের মোহনা পলাশা আর দিয়া চলে যায় ক্রাইম ব্রাঞ্চে। সেখান থেকেই যা করার করতে হবে। সবাই চলে যাওয়ার পর ফারহান গাড়ি নিয়ে সোজা চলে যায় ঝিলের ধারে। ফারহানের মাখ খারাপ থাকে সে এখানে এসে বসে থাকে। ঝিলের ধারে বসে একের পর এক ঢিল ছুড়ে মারছে পানিতে। যার ফলে একটু শব্দ হয়ে পানিতে তরঙ্গের সৃষ্টি হচ্ছে। ফারহানের মাথায় নানা প্রশ্ন লঘুপাক খাচ্ছে। কে করছে একমন জঘন্যতম কাজ। তাছাড়া শিশুদুটো ওরাই বা কারা? এত ছোট বাচ্চা-ই বা বিদেশে কেন পাচার করা হচ্ছে? তাছাড়া যত বেআইনি কাজ কারবার তো সব তো রাতের আধারে হয়ে থাকে তাহলে দিনের আলোয় এই ট্রাকটা কি করছে? এর পিছনে কে আছে? বাচ্চাদের কথা মনে পড়তেই ফারহানের বুকটা কেপে উঠে। কিছুক্ষণ পর পলাশ কল করে। ফারহান কলটা রিসিভ করে গম্ভীর গলায় বলে,

– কিছু জানতে পারলে?

– স্যার, আমরা গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার চেক করেছি। কিন্তু স্যার, গাড়িটা এই শহরের কারো নয়।

– মানে?

– রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী গাড়ির মালিক আতাউর রহমান। যে একটা গ্রামে বাস করে।

– মিদুক আর মোহনাকে সাথে নিয়ে সেই গ্রামে চলে যাও। গাড়ির মালিকের খোজ নাও। ড্রাইভারকে খুজে বের করো।

– ওকে স্যার।

তারপর আরো কিছুক্ষণ ঝিলের পাড়ে বসে থেকে সে ফিরে যায় মুনদের বাসায়। ওখানে যে আজ ওর ভাইয়ের আকদ। আপাদত ফারহান সব ভুলে অনুষ্ঠানে মন দিয়েছে। অর্ণা আর রওনাকের যখন আংটি পড়ানো হচ্ছিলো তখন মুন ও ফারহান দুজনেই একে অপরের দিকে তাকায়। একজনের চোখে অনুতাপ আর অন্যজনের চোখে ছিলো হাজারো অভিযোগ। মুনের এই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ফারহান সেখান থেকে চলে আসে বাহিরে। গাড়িতে বসে গাড়ির স্টিয়ারিং এ জোরে পাঞ্চ মারে। বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে নিজেই বলে উঠে,

– নাহ্ ফারহান নাহ্। এটা তুই ঠিক করছিস না। এই মেয়েটা তোকে ঠকিয়েছে। এ কাউকে ভালোবাসতে পারে না। এ তো শুধু জানে,,, আচ্ছা তুই কেন এত ভাবছিস? তোর মনে ওই মেয়েটার জন্যে কোন অনুভূতি নেই।

স্টিয়ারিং এ মাথা রেখে চুপচাপ বসে থাকে ফারহান। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ওর ওই বাচ্চা গুলোর কথা মনে পড়ে। আর সাথে সাথে পকেট থেকে মোবাইল বের করে শিমুলকে একটা কল দেয়। শিমুল কল রিসিভ করতেই ফারহান বলে উঠলো,

– বাচ্চাগুলো কি খবর?

– সবাইকে তাদের পরিবারে কাছে পৌছে দেওয়া হয়েছে। আসলে আশেপাশে থানারা এঅব্দি যতগুলো মিছিং ডাইরি ছিলো তাদের সবাইকে থানায় আনা হয়েছিলো। আর তারা সবাই তাদের নিজনিজ সন্তানকে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু, শিমুলের গলাটা ভাড়ি। ওই শিশু বাচ্চাদুটোর পরিবারের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।

ফারহান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। চোখ বন্ধ করতে বাচ্চাদুটোর চেহারা ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে।চট করে চোখ খুলে তারপরেই বলে উঠলো,

– আশেপাশে যতগুলো হসপিটাল নার্সিংহোম আছে সব কটা জায়গায় খোজ নাও। কোন ভালো খবর পেলেও পেতে পারো।

– আপনি একবার থানায় আসবেন?

– ওকে আসছি।

ফারহান কলটা কেটে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। আর এদিকে দুটো চোখ যে ওকে খুজে চলেছে কখন থেকে। মুন প্রায় পুরো বাড়ি ওকে খুজে নিয়েছে কিন্তু কোথাও ফারহানের দেখা মিলছে না। মুনকে এমন উসকোখুসকো দেখে আকাশ ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসিয়ে নিজেও বসে। তারপর মুনের হাত ধরে বলে,

– কি হয়েছে মুন? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

– ফা-ফারহানকে কোথাও দেখতে পারছি না। আমি চোখে চোখে অভিমান দেখেছি। আচ্ছা আমার উপর রাগ করে ফারহান অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে গেল নাকি? মব খারাপ মুনের।

আকাশ কিছু বলে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আর তাকিয়ে থাকে মুনের মুখপানে।

#হৃদমাঝারে – [০৭]

পুলিশস্টেশনে গিয়ে বাচ্চাদুটোর সাথে কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে ফারহান। আজ ওর মনটা বেশ ক্লান্ত। শারীরিক ক্লান্তি তো বিশ্রাম নিয়ে দূর করা যায় মনের ক্লান্তি কি করে দূর করবে সে। কোন কাজে মন বসাতে পারছে না ফারহান। বিছানায় হেলান দিয়ে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে বসে ছিলো ফারহান। এমন সময় রওনাক ওর রুমে আসে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারে নি বলে রওনাক একটু চটে যায়। পরে ফারহান ওকে শান্তু করে শিশু পাচারের ঘটনাটা বলে। সব শুনে রওনাক তো হা। সে অবাক হয়ে বলে,

– মানুষ এত নিকৃষ্ট ও হয়।

কিছু বলে না ফারহান। শুধু তাকিয়ে থাকে।

রওনাকে চলে যাওয়ার পর ফারহান শাওয়ার নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায় ফারহান।

পরেরদিন সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে আগে পিটি জয়েন করে ফারহান। তারপর বেড়িয়ে আসে সেনানিবাস থেকে। এদিকে মুন নার্সিংহোম এসে রানার সাহায্য নিয়ে হসপিটালের কিছু ফাইল নিয়ে নিজের কেবিনে যায়। কাল রাতে আকাশের বাবা কল করে বলেছিলো হসপিটালের পুরনো ফাইলগুলো দেখা দরকার। ফাইল ঘেটে তেমন কিছুই পেল না মুন। তাই সেগুলো আবার আগের জায়গায় রেখে দেয়।

নিয়য় অনুযায়ী নিজের কেবিনে বসে রোগী দেখছে মুন এমনি সময় ইমারজেন্সি থেকে কল আসলো। মুন কোন রকমে নিজের কাল সামলে ইমারজেন্সিতে চলে যায়। আর সেখানে গিয়ে বেশ অবাক হয় মুন। ইমারজেন্সিতে ফারহান বসে আছে আর ওর হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে। মুন একদৃষ্টিকে ফারহানের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকটা কেপে উঠছে মুনের। আর ফারহান সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ঠোঁটের কোনে ঝুলে আছে এক রহস্যময় হাসি। মুন ফারহানের দিকে তাকিয়ে আবার ওর পাশে তাকালো। ওর পাশেই দুটো ছেলে বসে আছে। এদের কাউকেই চেনে না মুন। মুন কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

– ডঃ মনোজকে ডেকে বলুন ওনার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে। আমার পেশেন্ট অপেক্ষা করছে। মুন চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই পিছন থেকে আওয়াজ এলো,

– ডঃ মনোজ হসপিটালে নেই।

– তাহলে অন্য কোন ডক্টরকে ডেকে নিন।

– সবাই এখন ব্যাস্ত।

– তো আমি কি করবো। একটা নার্সকে ডেকে বলুন ওনার হাতের ব্যান্ডেজটা করে দিতে।

মুন চলে যাওয়ার জন্যে সামনে পা বাড়াতেই ফারহানের কথা শুনে থেমে যায়।

– আপনাদরে এখানে মনে হয় পেশেন্টদের এভাবেই ট্রিট করা হয়। আমার হাতটা কেটেছে, কোথায় তাড়াতাড়ি করে ঔষুদ লাগিয়ে দিবে সেটা না করে আপনারা কি করছেন। উহ্ হাতটা ভিষন জ্বালা করছে। এই পলাশ চল আমরা বরং অন্য নার্সিংহোমে যাই।

ফারহান পলাশ ও মিদুল উঠে দাঁড়াতেই মুন ওদের দিকে এগিয়ে আসে। একটা নার্সকে ডেকে ফাস্টের্ড বক্স আনতে বলে। আর ফারহানকে বেডের উপর বসতে বলে।

বেশ যত্ন সহকারে ফারহানের হাতে ব্যান্ডেজটা করে দিচ্ছে মুন। মুনের স্পর্শে বারবার কেপে ইঠছে ফারহান। স্বভাবত মুন জিগ্যেস করলো,

– কিভাবে কেটেছে হাত?

– স্যার তো নিজেই কাচে,,, আর কিছু বলতে পারলো না পলাশ। ফারহান তার পা দিয়ে পলাশের পায়ে আঘাত করে ওকে থামিয়ে দেয়। তারপর মৃদু হেসে জবাব দেয়,

– আপনি ডক্টর পুলিশ নয়। তাই এত ইনভেস্টিগেশন করার কোন প্রয়োজন নেই।

মুনও আর কিছু বলে না। চুপচাপ ফারহানের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে কয়েকটা ঔষুদ লেখে দিলো। আর ফারহান মুনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তার চোখ নামিয়ে নিলো। মনে মনে বলল, এটা কি করছিস তুই ফারহান। পাগল হয়ে গেছিস তুই। এই মেয়েকে দেখার জন্যে তুই নিজের কাজ ফেলে চলে এলি। পাগল হয়ে যাব আমি।কি হচ্ছে আমার সাথে। কেন বারবার মুনকে দেখতে চাই। না এমটা কিছুই হবে না। আমি মুনের থেকে দূরে থাকবো। এই মেয়েকে আর বিশ্বাস করবো না। এ শুধুই কষ্ট দিতে জানে। ভালোবাসা কি সেটা বুঝেই না।

এদিকে পলাশ কেবলার মতো তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। এর আগে তো ফারহান কখনো এমনটা করে নি। নিজের গাড়ির কাচে ঘুসি দিয়ে নিজের হাত কেটে হসপিটালে আসলো। ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিস থেকে এনআর নার্সিংহোমে আসতে না হলে চারটা নার্সিংহোমকে ক্রশ করে আসতে হয়। তাহলে স্যার এখানেই আসলো কেন? ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। পলাশ তোকে কিন্তু চোখ কান সবটা খুলে রাখতে হবে। আর এই ফুলপরি, ফুলপরিকে স্যার আগে থেকেই চিনে। তাহলে সেদিন আমাকে লাইন মারতে বলল কেন? মাথাটা ঘুরছে পলাশের। এত চাপ ওর ছোট মাথায় দেওয়া চলবে না। তবে ব্যাপারটা একটু ঘেটে দেখতে হবে।

৫,
বিকাল বেলা ফারহান তার টিম মেম্বারদের নিয়ে আতাউর রহমানের গ্রামে যায়। আতাউর রহমানের বাড়িটা অনেক বড়। বাড়ির চারদিকে চারটা টিনের ঘর। দক্ষিণ পাশের ঘরটাতে সে গরুর রাখে। উত্তর আর পূর্ব পাশেরটা তাদের নিজেদের আবাসস্থল। পশ্চিম পাশের ঘরটাতে তাদের দ্রব্যসামগ্রী রাখে। আমরা যেটাকে বলি গুদামঘর। বারান্দায় বসে ঝিমুচ্ছে আতাউর রহমান। চোখ-মুখে তার দুশ্চিন্তা। আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে কিছু ভেবে যাচ্ছে এমন সময় তার সামনে হাজির হলো পঞ্চমানব। তাদের মধ্যে একজন ছিলো ফারহান। ইন্সপেক্টর শিমুল। ও ফারহানের সহযোগী পলাশ মিদুল আর মোহনা। ওদের পাঁচজনকে দেখে আতাউর রহমান ভাবুক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকায়। মিদুল প্রশ্ন করে,

– আপনি আতাউর রহমান?

লোকটা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। শিমুল পকেট থেকে নিজের কার্ড দেখিয়ে বলে,

– সাব ইন্সপেক্টর, শিমুল।

বাড়িতে পুলিশ দেখে আতাউর রহমান একটু অবাক হয়। সে তো থানায় কোন ডাইরি করে নি তাহলে তার বাড়িতে পুলিশ কেন? আতাউর রহমানের স্ত্রী এগিয়ে আসে। অতঃপর পলাশ সুধায়?

– VF 00 47 এই গাড়িটা আপনার তো?

গাড়ির কথা শুনে চমকে উঠে আতাউর রাহমান। তড়িৎগতিতে বলে,

– হো। কনে আমার গাড়ি। তোমরা জানো কত দিন ধইরা আমি আমার গাড়িটারে খুজবার লাগছি।

– খোজছেন মানে? আপনি জানেন না আপনার গাড়ি কোথায়?

– এসব কি কউ? জানলে আমি গাড়ি খোঁজুম ক্যা?

– আপনার গাড়ি খোঁজে পাননা কবে থেকে?

– এই ধরো সপ্তাহ খানেকের মতো?

– আপনার যে গাড়ি হাড়িয়েছে তারজন্যে থানায় মিছিং ডাইরী করেছেন? [পলাশ]

– যেডা চুরি অইছে হেইডা কি আর পাওন যাইবো? তাইলে খালি খালি টাহা খরচ করে পুলিশরে জানিয়া লাভটা কি অইবো। পুলিশ তো আবার টাহা ছাড়া কতা কয়না।

আতাউর রহমানের কথা শুনে শিমুল রেগে গিয়ে কিছু বলতে চাইলে ফারহান ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

– কনট্রোল ম্যান, কনট্রোল।

– তুমি কিভাবে নিজেকে কনট্রোল করতে বলছো ফারহান। এই চাচা তো সমগ্র পুলিশ জাতিকে অপমান করছে।

ফারহান আতাউর রহমানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

– আপনাকে আমাদের সাথে পুলিশস্টেশনে যেতে হবে। না ভয় নেই। আপনাকে কিছু জিগ্যাসা করা হবে তাই।

আতাউর রহমান একবার ফারহানের দিকে তাকায় তো আরেকবার তার স্ত্রীর দিকে তাকায়।

শিমুল আতাউর রহমানকে নিয়ে পুলিশস্টেশনে চলে যায়। ফারহান পলাশ মিদুল আর মোহনা ওরা এক গাড়ি করে কমিশনড স্যারের বাসায় যাচ্ছে। ফারহান ড্রাইভ করছে আর ওর পাশের সিটে বসে আছে পলাশ। মিদুল আর মোহনা বসে আছে পিছনে। পলাশ ফারহানকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,

– স্যার, আপনার কি মনে হয়না এই আতাউর রহমান মিথ্যে বলছে।

– আমার মনে হয় ওনি সত্যিই বলছে।

– কেন স্যার?

– জানিনা রে পলাশ। তবে আমার মনে হয় উনি সত্যি বলছে।

– আমারও তাই মনে হয়। [মোহনা]

গাড়ি এসে কমিশনড স্যারের বাসার সামনে পার্ক করতেই সবাই এক এক করে গাড়ি থেকে নেমে যায়। বাড়ির ভিতরের দিকে এগোতে যাবে তখন দেখতে পায় কমিশনড স্যারের বাসা থেকে মুন বের হচ্ছে। ফারহান সেখানেই থেমে যায়। আর ভাবতে থাকে মুন এখানে কি করছে।

চলবে,,,,,

হৃদমাঝারে পর্ব-০৪+০৫

0

#হৃদমাঝারে – [০৪+০৫]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা

৪,
কফিশপে একটা মেয়েকে দেখে হা হয়ে যায় পলাশ। গালে হাত রেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। ওর সামনে বসে আছে ফারহান। ফারহান কফি খাচ্ছে আর মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। খানিকক্ষণ বাদে মোবাইল থেকে মাথা তুলে যখন পলাশের দিকে তাকায় ফারহান তখন লক্ষ্য করে পলাশ অবাক হয়ে কিছু দেখছে। পলাশের দৃষ্টি অনুসরণ করে ফারহান ও তাকায় সেদিকে। তখন ওর দৃষ্টি পরে একটা মেয়ের উপর। দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। ফারহানের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো মেহরিমা।
– স্যার, আপনি চিনেন এই ফুলপরিকে?

– ফুলপরি। একটু অবাক হয়েই জিগ্যেস করলো ফারহান।

-হ্যা। ওকে দেখে তো আমার দিলে প্রেমের রেডিও বেজে উঠেছে। স্যার একটু লাইনটা করে দিননা।

পলাশের কথা শুনে অধর চেপে হাসে ফারহান। অতঃপর বলে,

– তুমি চাইলে লাইনটা করতেই পারো। তবে এতে আমার কোন সাহায্য পাবে না। আর আমি তোমাকে মানাও করবো না। তারপর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে,

-এবার আমাদের যাওয়া উচিৎ। তুমি চাইলে থাকতে পারো। আড় চোখে মুনের দিকে তাকিয়ে বলল ফারহান। পলাশের এই দৃষ্টি বুঝতে অসুবিধা হলো না। সে স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়ে মুনের দিকে তাকালো। আর ফারহান সে ততক্ষণাৎ সেখান থেকে প্রস্থান করলো। পালশ উঠে মুনের দিকে পা বাড়াবে তখনি একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো ওর সামনে। ছেলেটাকে দেখে মুনের ঠোঁটে আপনাআপনি হাসি ফুটে উঠে। আর সে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে। ছেলে মুনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

– কেমন আছিস পাগলী?

মুন ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

– তোকে ছাড়া ভালো থাকি কেমনে বলতো।

তারপর দুজনে দুই চেয়ারে বসে কথোপকথন করতে লাগলো। আর এদিকে ছেলেটাকে দেখে পলাশ দাড়িয়ে পরেছে। ওর মাথায় এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ছেলেটা কে? এদিকে ছেলেটার সাথে মুন হেসে কথা বলছে। হঠাৎ ছেলেটার একটা কথায় মুনের হাসি থেমে যায়।

– বাড়ি ফিরছিস কবে?

– কোন বাড়ি?

– তোর নিজের বাড়ি।

– আমার কোন বাড়ি নেই। আমি একজন আশ্রিতা। যে অন্যের আশ্রয়ে বেঁচে আছে।

– এভাবে কেন বলছিস তুই।

– তুই কেন বুঝতে পারছিস না আমি ও বাড়িতে যেতে পারবো না। যতদিন না ওই লোকটাকে আমি শাস্তুি দিতে পারবো। ওনার ভালোমানুষি মুখোশ আমি সবার সামনে খুলে ফেলবো। তারপরেই আমি ও বাড়িতে পা রাখবো। যদিও আমার যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই।

– এভাবে কেন বলছিস মুন। বারবার ওই লোকটা বলে সম্বোধন কেন করছিস। বাবা হয় তোর।

– বাবা, তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো মুন। তারপর বলল, কবে সে আমার বাবা ছিলো। বলতে পারবি, বাবা হওয়ার কোন দায়িত্বটা পালন করেছে ওই লোকটা। উনি কারো বাবা হতে পারেন না। না হতে পেরেছে ভালো বাবা আদর্শবান স্বামী এবং সুসন্তান। কি করেন না ওনি। মেয়ে পাচার থেকে শুরু করে জাল ওষুধের ব্যবসা। নিজের কুকর্ম ঢাকতে গিয়ে নিজের মাকে খুন করলেন। অথচ উনার সব কুকীর্তির দায় এসে পড়লো আমার গায়ে। একটা নবজাতক কি করে কারো প্রান নিতে পারে। একটা কেউ ভাবে নি। এমনকি যে আমাকে জন্মদিলো সেও ভাবে নি। আমি ইমরান খানের শেষ দেখেই ছাড়বো। রাগে হাত দুটো মুষ্টি বন্ধ করে নিল মুুন। অপর পাশে থাকা ছেলেটা মুনের হাতের উপর হাত রাখল অতঃপর বলল,

– ওকে, ওকে কাম ডাউন। এত হাইপার কেন হসছিস।

মুন তার চক্ষুদ্বয় বন্ধকরে নিলো। বেশ জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে এখনি ঝড় উঠে আসবে। ছেলেটার দিকে চোখ মেলে তাকাতেই সে বলে উঠলো,

– আংকেল, ভদ্র মুখোশের আড়ালে থাকা একটা শয়তান।

– তুই বিশ্বাস করিস আমাকে?

– নিজের থেকেও বেশী।

মুন আর কিছু বলে না সে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। আর ছেলে মুনের একহাত জড়িয়ে ধরে মুনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর এদিকে পলাশ ভাঙা মন নিয়ে বুকের পা পাশে তার হাতটা রেখে চেয়ারে বসে পরে। নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানায়। এই তুই নাকি বসন্তের প্রতীক। তাহলে তোর জিবনে বসন্তের আগমের আগেই কেন গ্রীষ্মের কালবৈশাখী ঝড়ের আভাস এলো। কে এই ছেলেটা। ফুলপরির সাথে ছেলেটার সম্পর্ক কি? কেন তারা একে অপরের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে। না আর কিছু ভাবতে পারছে না পলাশ। স্যারকে জানাতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ফারহানকে কল করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

– স্যার, মাই হার্ড ইজ ব্রোকেন।

– মানে?

– স্যার ফুলপরির বয়ফেন্ড আছে। সে এখন তার সাথেই আছে। আমি কি করবো?

– ওয়েট আমি আসছি। কল কেটে দেয় ফারহান। আর পলাশ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকে মুন আর সেই ছেলেটা দুইজনেই কফি খাচ্ছে। ছেলেটা এবার বলে উঠলো,

– এত নার্সিংহোম থাকতে আংকেলের নার্সিংহোমে তোকে জয়েন করতে হলো। তুই ভালো করেই জানিস ওখানে তোর বিপদ অনিবার্য।

– পারবে না। ইমরান খান আমার কোন ক্ষতি করবে না। আমার কাছে যতদিন ওই ভিডিওটা আছে ততদিন সে আমার কোন ক্ষতিই করবে না।

– সাবধানে থাকিস। আমার তো খুব ভয়ই হচ্ছে তোকে নিয়ে।

– ধর পাগল আমার কিচ্ছু হবে না। তাছাড়া আংকেল ও তার দলবলতো আছেই। তারা আমাকে ঠিক প্রটেক্ট করবে।

– আমারও বাবার উপর বিশ্বাস আছে।

এদিকে ছেলেটার সাথে মুন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কখন যে ফারহান এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই নেই কারোর। ফারহান তখন মুনকে দেখে কফিশপের বাইরে চলে গিয়েছিলো। আবার পলাশের কল পেয়ে ভিতরে আসে। মুনের সাথে ছেলেটাকে দেখে স্মিত হাসে সে। তারপর তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। মুনের যখন মনে হলো কেও ওদের দেখছে তখন সে পাশ ফিরে তাকায়। আর ফারহানকে দেখে বড়সড় শক খায়। ছেলেটাও ওকে দেখে বেশ অবাক হয়। অধোরে স্মিত হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে হাতটা বাড়িয়ে দে হ্যান্ডশেক করার জন্য। কিন্তু ফারহান সে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থাকে মুনের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তাচ্ছিল্যের হাসি হাসি অতঃপর বলে,

– এখনো সত্যিটা স্বীকার করবে না। অবশ্য তোমাদের কাছ থেকে সত্যি কথা আশা করাই ভুল। মিস্টার আকাশ তালুকদার কোথায় ছিলে এতদিন? নাকি মেহরিমার সাথে সাথে তুমিও লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিলে।

– তুমি ভুল করছো ফারহান। এখনো সময় আছে সত্যিটা তুমি নিজে খুজে বের করো।

– কোন সত্যি কিসের সত্যি হ্যা। কি খুজে বের করবো। আমার রুচি এতটাও খারাপ নয় এরকম একটা থার্ড ক্লাস চরিত্রহীন মেয়ের বিষয়ে জানার কোনো আগ্রহ নেই আমার। কথাগুলো বলেই মুনের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে যায় ফারহান। আর পলাশ হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ফারহানের চলে যাওয়ার দিকে।

– এটা ফারহান? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে আকাশ।

– এটা ক্যাপ্টেন ফারহান। গ্রামে আমার সেই ফারহান আর আজ ক্যাপ্টেন ফারহানের সাথে আকাশ পাতাল তফাৎ। বড় করে শ্বাস ফেলে মুন। আর আকাশ তাকিয়ে থাকে মুনের মুখের দিকে।

রাতে বেলকনিতে বসে চাঁদ দেখছে মুন। বেশ অস্বস্তি লাগছে তার। ফারহানের এমন রুড আচরন সে মানতে পারে না। ও কথাগুলো যে মুনকে কতটা পুড়ায় সেটা কি জানে না সে। তাহলে কেন? কেন ফারহান ওকে এতটা কষ্ট দেয়। হ্যা মানছে আমার ভুল হয়েছে তাই বলে কত শাস্তুি দিবে। ছয় বছর কি কম সময় ছিলো। কেন ফারহানের রাহ কমেনা। আকাশ পানে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নিলো মুন। রাতের আধার নামার সাথে সাথে ক্লান্ত শহর টা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। মাথার উপরে থাকা চাঁদ ও তাকে ঘিরে থাকা চন্দ্র গুলোর আলোয় আলোকিত হচ্ছে যেন পুরো শহর। বেলকনি ছেড়ে উঠে দাঁড়াবে আর তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্কিলে আকাশের নাম দেখে একটু হাসার চেষ্টা করলো সে। বন্ধুরা বোধহয় এমনি হয়। সবাই ছেড়ে চলে গেলে বন্ধু হয়ে বন্ধুর পাশে থাকে। মুন কলটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো একটা মিষ্টি সুর।

– মন খারাপ করে বসে আছিস তাইতো?

– নারে। ভাল্লাগছে না কিছু।

– ফারহানকে সত্যিইটা জানিয়ে দেয়।

– ও বিশ্বাস করবে না আমায়। বলবে আমি আবার নাটক করছি। আবার অপমান করবে।

ওপাশ থেকে কিছু বলল না। দুজনেই চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর আওয়াজ এলো,

– কাল নার্সিংহোমে যাচ্ছিস?

– হুম।

– তাহলে দেখা হচ্ছে। এখন রাখি।

আকাশ কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। আর মুনের ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া ওর বুকের মাঝে একরকম ঝড় তুলে দিয়েছিল। তাই তাড়াতাড়ি কলটা কেটে দিলো।

পরেরদিন নার্সিংহোমে আকাশ আসে। মুন ওর সাথে প্রায় সারাটাদিন কাটিয়ে দেয়। হঠাৎ ওর একটা কাজ পরে যাওয়ায় ও চলে যায়। দিন শেষে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছে মুন। এমন সময় একটা গাড়ি ওর সামনে দিয়ে ফুল স্পিডে চলে যায়। যার ফলে রাস্তায় জমে থাকা ময়লা পানি গিয়ে পরে মুনের গায়ে। মুন চিৎকার করে উঠলে গাড়িটা ব্রেক করে। গাড়িয়ে ভিতর থেকে একটা যুবক নেমে আসে যাকে দেখে মুনের রক্তচক্ষু নিমিষেই শীতল হয়ে যায়।

#হৃদমাঝারে – [০৫]

ফারহানকে এগিয়ে আসতে দেখে মুনের চক্ষু শীতল হয়ে যায়। সে নির্বিকায় তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে। ফারহান মুনের কাছে এসে পকেটে হাত গুজে দাঁড়ায়। তারপর মুনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। মুন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে। তবে কি ফারহান ইচ্ছে করেই ওর গায়ে কাদা ছিটিয়ে দিয়েছে। মুন মৃদু সূরে বলল,

– আপনি এখানে?

ফারহান মুনের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না ওকে পা থেকে মাথা অব্দি অবলোকন করে মৃদু হেসে প্রস্থান করে। ফারহানের মনে আজ কিছুটা হলেও শান্তি মিলেছে। মুন শুধু তাকিয়ে থাকে ফারহানের চলে যাওয়ার দিকে। এটা কি ফারহান নাকি অন্যকেউ?

রনি তার মেয়ে ও বউকে নিয়ে মার্কেটে এসেছে। অনেক দিন হলো অনন্যার কিছু কেনা হয়না। আসলে রনি সময় খুব একটা পায়না। ভালো কাজ করলে মানুষ সময় পায় কিন্তু যারা অন্যায় করে ভুল পথে উপার্জন করে তাদের প্রতিটা কাজই রিক্স, সময় স্বল্প। সময়ের অভাব। আবার সে অনন্যাকে একা ছাড়তেও ভয় পয়। যদি অনন্যা তাকে ছেড়ে চলে যায়। অনন্যাকে যে ভালোবেসেছে রনি। কিন্তু অনন্যা সে দিন দিন রনি ওর মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ভালোই ছিলো পাচ বছর আগে যখন অনন্যার সাথে রনির বিয়ে হয়। গ্রামের মেয়ে অনন্যা। চাকরির সন্ধানে সে এসেছিল শহরে আর সেই সূত্রেই দেখা হয় রনির সাথে। তারপর দুজনের মধ্যে প্রনয়ের সম্পর্ক ও বিয়ে। বিয়ের প্রথম বছর ভালই কাটছিল তাদের জিবন। মিষ্টি আসে তাদের কোল জুড়ে। খুব খুশি ছিল প্রথম ছয় মাস খুব ভালো কাটছিল তাদের সংসার। কিন্তু তারপর থেকে বদলে যেতে লাগল রনি। রোজ রাতে ড্রিংক করে বাড়ি ফেরা অন্য মেয়েদের সংস্পর্শে যাওয়া। অনন্যা রনির হঠাৎ বদলে যাওয়া মেনে নিতে পারছিল না বারবার জানতে চেয়েছিল কেন হঠাৎ করে বদলে গেল রনি। কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে ওর সামনে এমন কিছু সত্য আসে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় অনন্যা। ঘৃণা করতে শুরু করে রনিকে। রনির থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইলেও সেটা হতে দেয় না রনি। যেহেতু মিষ্টি রনির অংশ নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। রনির বাবা মা অনন্যার এই ব্যাপার নিয়ে কথা বললে সে তাদের সোজাসাপ্টা বলে দেয়, অনন্যাকে নিয়ে কোন কথা বললে তবে সে তার বউ বাচ্চা নিয়ে এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। শাড়ির দোকানে চুপচাপ বসে আছে অনন্যা আর রনি মিষ্টি দুজনে মিলে শাড়ি চুজ করছে। কিন্তু মিষ্টির কোন শাড়িই পছন্দ হচ্ছে না। তাই সে তার বাবাকে নিয়ে অন্য দোকনে চলে যায়। অনন্যা এখানে একা বসে থাকে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরেই যখন রনি ফিরছিলো না তখন অনন্যা বাহিরে গিয়ে হাটতে থাকে। আর তখনি তার সাথে দেখা হয় একটা মেয়ের। জিন্স প্যান্ট আর কুুর্তির পরে গলায় উড়নাটা পেচিয়ে রেখেছে। কাঁধে ব্যাগ আর হাতে এপ্রোন। তার পাশেই আছে একটা ছেলে যে মেয়েটার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসছে। অনন্যার মনে হলো এরা দুজন ভালেবাসার মানুষ। তাই তার চোখটা ছলছল করে উঠলো। রনির সাথে যে তার এমনও হাজর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পরক্ষনেই মনে হলো রনি তাকে ঠকিয়েছে। চোখ বন্ধকর কোন রকমে চোখের জল আটকে নেয় অনন্যা। ছেলেমেয়ে দুটো এদিকেই আসছিলো। হঠাৎ অনন্যার মুখোমুখি হতেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে যায়। আসলে অনন্যার এমন নিঃপাপ মুখের মায়ার পরে যায় মেয়েটা। তারপর স্মিত হেসে মেয়েটা চলে যায়। অনন্যা শুধু তাকিয়ে থাকে মেয়েটার চলে যাওয়ার দিকে।

– বলছিতো আমার কিছু লাগবে না, তবুও কেন এত জেদ করছিস আকাশ?

– লাগবে না মানে কি? রোজ রোজ তো এই একই জামাকাপড় পরে হসপিটালে যাস।

আকাশ মুনের জন্যে টপজিন্স আর কয়েকটা শার্ট বেছে নিলো।

– এগুলো কার জন্যে নিচ্ছিস তুই?

– তোর জন্যে। এগুলোতেই তোকে বেশী ভালো লাগে। ওয়েস্টার্ন ড্রেসে আরো ভালো লাগে।

– আকাশ। চোখ রাঙালো মুন। তারপর আকাশের হাত থেকে ওগুলো নিয়ে নিজের পছন্দমতো কয়েকটা কুর্তী আর চুড়িদার কিনে নেয়।

দোকান থেকে বের হতেই আবার অনন্যার সাথে দেখা হয় মুনের। মুন পাশ কাটিয়ে চলে আসতে সামনের দিকে পা বাড়াতেই থমকে যায়। রাগে হাতদুটি মুষ্টিবদ্ব করে নেয়। সামনে থাকা আগন্তুক ও মুনকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। অতঃপর বলে,

– তুই এখানে? কবে ফিরলি?

– আজকাল আমার খোজ রাখতে ভুলে যাস নাকি। তাচ্ছিল্যের হাসি মুনের মুখে। মুনের কথা শুনে ছেলেটাও স্মিত হাসলো। তারপর ওর সামনে এগিয়ে এসে বলল,

– খুজার সুযোগ দিলি কোথায়? তার আগেই তো সামনে এসে হাজির। দেশে ফিরে ভালো করেছিস, এবার অন্ততপক্ষে আমাদের কাজটা হবে।

মুন কিছু বলল না শুধু হাসলো। যে হাসির অর্থ তোদের কাজের জন্যেই তো আমাকে ফিরে আসতে হলো। তারপর রনি মুনকে অনন্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। অনন্যাকে দেখে মুন বলেই ফেলল,

– গোবরে পদ্মফুল।

– হুম বলতে পারিস এটা।

মুন ভ্রু কুচকে অনন্যার দিকে তাকালো। এরকম একটা মেয়ে কি করে রনির সাথে সংসার করছে। মেয়েটাকে দেখে ভালোই মনে হচ্ছে তাহলে এ রনির সাথে কি করে নিজেকে মানিয়ে নিলো।

৪,
আজ শিকদার বাড়ি থেকে মেহমান আসবে মুনদের বাসায়। অর্ণা আর রওনাকের বিয়ের ডেট ফিক্সড করার জন্যে। আবার আজই ওদের আকদ। সেই হিসাবে বাড়ি আজ পুরো জমজমাট। মুনের বাবা মা আসছে। মুন একবারও তাদের সামনে যায়নি। তারাও মুনকে ডাকে নি। তবে মুনের ছোট ভাই মিঠুর সাথে মুনের খুব ভাব। আজ প্রায় সারাটাদিন দুই ভাইবোন এক সাথে কাটিয়েছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে শিকদার ফয়সাল সাদিকের পুরো পরিবার চলে আসে ওদের বাসায়। ড্রইংরুমেই সকলের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর অর্ণাকে নিয়ে আসা হল ওদের সামনে। অর্ণা আজ আকাশী কালারের একটা শাড়ি পরেছে। মুন নিজের হাতে অর্ণাকে সাজিয়েছে।অর্ণা কে সাজিয়ে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে মুন এবার নিজে রেডি হচ্ছে। এদিকে সিকদার পরিবারের সবাই যখন খাওয়া-দাওয়া করছিল ঠিক তখন মিঠুর হাত লেগে ফারহানের গায়ে দই পরে যায়। ফারহান প্রথমে রেগে গেলে পরে পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে শান্ত করে নেয়। মিঠুর বাবা ইমরান খানের নির্দেশে মিঠু ফারহানকে নিয়ে ওপরে নিয়ে যায়। উপরে তিনটা রুম। একটা অর্ণার একটা মুনের আর একটা ফাকা পরে থাকে। মিঠু ফারহানকে নিয়ে ফাকা রুমটায় যায়। তারপর ওকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়। ওয়াশরুম থেকে ফেরার সময় কারো গুণগুণ করে গানের আওয়াজ আসে ফারহানের কানে। আওয়াজ এতটাই কম ছিলো যে গানের ভাষা বুঝতে পারছে না ফারহান। আচ্ছা গান গাইছে কে? কয়েক পা এগিয়ে একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ায় ফারহান। দরজাটা হালকা ভেড়ানো ছিলো হাত দিতেই সেটা খুলে যায়। সামনে এগিয়ে আসে ফারহান। তার চোখ আটকে যায় ড্রেসিংটেবিলের সামনে থাকা একটা রমণীর দিকে। হোয়াইট ব্লাউজের সাথে নীল শাড়ি। একটা আশ্চর্য হলো ফারহান। কিন্তু তার চোখ শুধু দেখেই চলেছে আয়নাতে প্রতিবিম্ব এই রমণীটিকে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও থমকে যায় ফারহান। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। মুন ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খোপায় বেশী ফুলের মালা লাগানোর চেষ্টা করছে। কিছুতেই ঠিকমতো পেরে উঠছে না। এদিকে ফারহান কখন যে মুনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পরেছে সে খেয়ালই নেই। মুনের হাত থেকে মালাটা নিয়ে নেয়। মুন নিজের সাথে ফারহানের স্পর্শ পেয়ে কেপে উঠে। শরীর জুড়ে এক হীম শীতল শ্রোত বয়ে যায় তার। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। শরীরের রক্ত চলাচল মনে হয় বন্ধ হয়ে গেছে। হাত শক্ত মুঠি করে ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে সে। ফারহান একমনে মুনের মাথায় বেলী ফুলের মালা পড়িয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর খোপায় মালা লাগানো শেষ হলে ফারহান মুনকে সামনের দিকে ঘুড়িয়ে নেয়। তারপর সে তাকিয়ে থাকে মুনের চোখের দিকে। মুন ফারহানের চোখে হাড়িয়ে যেতে চাইলেও পারলো না। সে মাথা নিচু করে নিলো। তারপর ওর থেকে কয়েকপা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ফারহান ভ্রু কুচকে ফেললো।অতঃপর বলল,

– হোয়াট হ্যাপেন্ড?

– আমি কিন্তু আপনার সংস্পর্শে যাইনি, আপনি এসেছেন। মাথা নিচু করে বলল মুন।

মুনের কথা শুনে ফারহানের কপালে কয়েকটা ভাজ পড়লো। পরক্ষনেই মনে হলো, সে এখন কোথায়? এখানে আসলো কি করে? ফারহানের এতক্ষণের দৃষ্টি আচরণ নিমিষেই বিলিন হয়ে চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠে। তারপর মুনের কাছে গিয়ে ওর হাত শক্তকরে চেপে ধরে।

চলবে,,,,,