হৃদমাঝারে পর্ব-০৮+০৯

0
1062

#হৃদমাঝারে – [০৮+০৯]
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা
৬„
ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে ফারহান। হাতে তার গিটার। আজ প্রায় ছয় বছর পর নিজের হাতে গিটার তুলে নিয়েছে ফারহান। অন্ধকারে নিমজ্জিত আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে গিটারে সুর তুলল,
সে মানুষ চেয়ে চেয়ে, ফিরিতেছি পাগল হয়ে।
মরমে জ্বলছে আগুন আর নিভেনা, আর নিভেনা।
আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ বিরহে তার প্রাণ বাচে না। দেখেছি রুপসাগরে মনের মানুষ কাচা সোনা।

চোখ বন্ধ করে পুরো গানটাই গাইলো ফারহান। ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো ছয় বছর আগের সেই সময়গুলো। মুনের সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত মনে পরে যাচ্ছিলো তার। কখন যে তার চোখ থেকে দু-ফোটা জল বেড়িয়েছে সেটা সম্পর্কে অবগত নয় ফারহান। কমিশনড স্যারের বলা প্রতিটা কথা ওর কানের কাছে বেজে চলেছে। ফারহান কমিশনড স্যারের বাড়ি গিয়েছিলো বাচ্চাদুটো কে নিয়ে কথা বলতে। তাদের কোথায় রাখবে সেই ব্যাপারে জানতে গিয়েছিলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে মুনকে দেখতে পাবে এটা জানা ছিলো না। ফারহান যখন কমিশনড স্যারকে মুনের সম্পর্কে জিগ্যেস করে তখন তিনি বলেন,

– তোমাদের বলেছিলাম তো, এই কেইস সম্পর্কে তোমরা ছাড়াও আরো দুজন জানে। তাদের মাঝে একজন মুন আর অপর জন রনি, যে নিজেই একজন অপরাধী। তোমরা চাইলে মুনের থেকে সাহায্য নিতেই পারো। তারপর তিনি আরো কিছু কথা বলেন যেগুলো শুনে ফারহান স্তব্ধ হয়ে যায়। কোন রকমে সেখান থেকে চলে আসে।

গান শেষ হলে গিটারটা নিয়েই ফ্লোরে বসে পরে। চোখের সামনে ভেসে উঠে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা একটা মেয়ে। লেয়ার কাট চুলের দুপাশে দুটি ঝুটি করা, হাতে পায়ে সাপের ট্যাটু আর ঠোটে তার প্রাণ উচ্ছল হাসি। ভাবতে থাকে সাত বছর আগের কথা।

বায়োলজি অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ফারহান সাদিক। যেমন ভালো পড়াশুনায় তেমনি খেলাধুলায়। অন্যায় দেখলেই তীব্র প্রতিবাত জানায়। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে বিন্ধুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। এই কারনেই কলেজের প্রতিটা স্যার ফারহানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একই কলেজের ছাত্রী মেহরিমা খান। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। পড়াশুনায় ভালো হলেও মেয়েটা বেশ উদ্ভট টাইপের। ওয়েস্টার্ন ড্রেস, নাইট ক্লাব বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াই তার প্রধান কাজ। তবে সে মারামারি করতেও এক্সপার্ট। মেহরিমা ছোট থেকেই চেয়েছে ডক্টর হতে। তাছাড়া তার বাবা একজন ডক্টর তাদের নিজেদের -ই নার্সিংহোম আছে। যদিও তার বাবা তাকে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু সম্পর্ক তো আর অস্বীকার করা যায় না। ওর শরীরে যে একজন ডাক্তারের রক্ত বয়ছে। মেডিকেল কলেজে না পড়েও মেডিকেল সম্পর্কে ওর ধারনা প্রখর।

বন্ধুদের সাথে কলেজে যাচ্ছে মেহরিমা। ওদের একটাই দোষ, ওরা সবাই বাইক নিয়ে কলেজে যায় আর প্রতিবার যাওয়া আসার সময় রেস করে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাইক রেস করতে করতে কলেজে যাচ্ছে মেহরিমা ও তার বন্ধুরা। কলেজ গেট গিয়ে ডুকতেই একটা গাড়ি এসে পরে মেহরিমার বাইকের সামনে। মেহরিমা তার বাইকটা জোড়ে টেনে একটু সামনে এগিয়ে যায়।আর গাড়িটা থেমে যায়।গাড়ির ভিতরে বসে থাকা লোকটা চিৎকার করে উঠে,

– হে ইউ, অন্ধ নাকি? দেখতো পাওনা কিছু?

মেহরিমা তার বাইকটা থামিয়ে মাত্র হেলমেডটা খুলে পিছনে তাকাবে আর একটা বাইক এসে থেমে বলে,

– তুই এগিয়ে যা মেহু। আমরা দেখছি।

মেহরিমা আবার হেলমেডটা পরে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। হেলমেড খুলার পরে যখন ওর লেয়ার কাট ব্রাউন কালারের চুলগুলো বেড়িয়ে আসে তখন লোকটার বুঝতে বাকি থাকে না এটা ছেলে নয় মেয়ে।তবে আশ্চর্যজনক কথা হলো মেয়েটা যখন মাথার হেলমেড খুলে ব্রাউন কালারের চুলগুলো নাড়াচাড়া করছিলো তখন ফারহানের বুকের বা পাশটায় হঠাৎ করে ব্যাথা অনুভব করে। গাড়ির পিছন থেকে একটা মেয়ে নেমে এসে বাইকের সামনে দাঁড়ায় আর ঝাঝালো গলায় বলে,

– কি অস*ভ্য লোকটা? ভুল করেছে সরি টুকুও বলল না। কোন মেনার নাই নাকি?

– হে ইউ? কাকে অসভ্য বলছেন? হেলমেড খুলল অপু। তখর ওর পাশে এসে দাঁড়ালো রাজুর বাইক।পিছনে বসা সুবর্ণা। গাড়ি থেকে আওয়াজ এলো,

– ছেড়ে দে স্নেহা, ওটা একটা মেয়ে ছিলো।

– মেয়ে বলে কি তার অপরাধ ক্ষমা হয়ে যাবে নাকি?
এই শুনো ওই মেয়েটাকে বলো ফারহানকে সরি বলতে।

স্নেহার কথা শুনে গাড়ি থেকে ফারহান বলে উঠলো,

– কাউকে সরি বলতে হবে না। তুই আসবি নাকি আমি চলে যাবো। বলেই গাড়ি স্টার্ট দেয় ফারহান। স্নেহা তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠে বসে। আর অপু রাজু সুবর্ণা চলে যায় কলেজের ভিতরে। এদিকে গাড়িতে বসে স্নেহা প্রশ্ন করে,

– তুই ওদের এমনি এমনি ছেড়ে দিলি?

প্রতিউত্তরে ফারহান কিছু বলে না। মৃদু হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে ড্রাইভ করতে থাকে।

কলেজে আসতে না আসতেই স্নেহা তার বন্ধুদের সবাইকে বলে বেড়ায়, মেহরিমার কথা। আর সবাই মিলে মেহরিমা ও তার বন্ধুদের উপর চটে যায়। তখন সবার মনে শুধু মেহরিমা ও তার বন্ধুদের নিয়ে নেগেটিভ ধারনা আসতে থাকে। আর সিনিয়রদের সাথে বেয়াদবি করার উপযুক্ত শিক্ষা দিবে এটাই ভাবছে এখন তারা। এদিকে ফারহান একা একা বসে আছে লাইব্রেরিতে। চোখের সামনে বই খুলে রেখেছে ঠিক কিন্তু তার মনটা নেই বইয়ের মাঝে। চোখের সামনে বারংবার ভেসে উঠে সেই ব্রাউন কালারের চুলগুলো। মাথা থেকে হেলমেড খুলার দৃশ্যটা যতবার মনে পড়ছে ততবারই ওর বুকটা চিনচিন করছে। বইটা বন্ধকরে দু-হাতে মুখ চেপে ধরলো ফারহান। নাহ্, এসব কি হচ্ছে আমার সাথে। কে এই মেয়েটা? আমার তার জন্যে এমন কেন ফিলিং হচ্ছে। ওহ্।

লাইব্রেরি থেকে দৌড়ে ক্যাম্পাসে চলে আসে ফারহান। ক্যাম্পাসে দুই গ্রুপের মাঝে মারামারি হচ্ছে। ফারহানের এক বন্ধুকে মারছে রনি ও তার দলবল। রনি এই কলেকের ট্রাস্টিজ এর ছেলে। নিজের বাবার ক্ষমতার বড়াইতে সে যা খুশি তাই করে বেড়ায় কলেজে। যদিও তার জন্যে কলেজের প্রায় অর্ধেক মেয়ে পাগল। রনির একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ফারহান। ফারহান ক্যাম্পাসে আসার আগেই রনি ও তার দলবল ক্যাম্পাস থেকে চলে যায়। মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে সুজন। ফারহান ও তার বন্ধুরা দ্রুত সুজনের কাছে চলে আসে।সুজন ঞ্জান হাড়িয়েছে মাথা কেটে রক্ত পরছে। ফারহান হাইপার হয়ে আনিতকে বলল,

– আনিত, গাড়ি বের কর। আমি সুজনকে নিয়ে আসছি। ফার্স্ট আনিত।

আনিত উঠে চলে যায়। ফারহান তার বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে সুজনকে তুলে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। মেহরিমারা তখন ক্যাম্পাসের অন্যপান্তে বসে বন্ধুদের সাথে গল্প করছিলো। হঠাৎ একটা লোককে এভাবে নিয়ে যেতে দেখে সুবর্ণা বলে,

– ওই দেখ মেহু। একটা ছেলেকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত এরা মারামারি করছে। ভালো হয়েছে খুব ভালো হয়েছে। এবার দেখ কেমন লাগে।

– আহ্ বর্ণা, এভাবে কেন বলছিস বলতো। রাজু বলে উঠলো।

মেহরিমা এতক্ষণ ফারহানদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ করেই সে উঠে দাঁড়ায় আর বলে,

– আমি আসছি।

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহরিমা সেখান থেকে চলে আসে। ততক্ষণে ফারহানদের সাথে যুক্ত হয় ওদের আরো দুই বন্ধু স্নেহা আর রিক্তা। ওরা ছেলেটাকে নিয়ে গাড়িতে তুলবে এমন সময় মেহরিমা গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু কেউই মেহরিমার দিকে তাকায় না। সবাই এখন ছেলেটাকে নিয়ে ব্যাস্ত। তাকে হসপিটালে নিতে হবে যে। এমন সময় মেহরিমা বলে উঠে,

– এক্সকিউজ মি! আচ্ছা আমি কি একবার উনাকে একটু দেখতে পারি।

মেহরিমার কথা শুনে সবাই ওর দিকে তাকায়। এমনিতেই সুজনকে নিয়ে ওরা বেশ চিন্তায় আছে তার উপর মেহরিমার এমন কথা। মেহরিমা বেশ উৎসাহ নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আসলে ওদের সিদ্ধান্ত জানতে চায় সে। স্নেহা বলে উঠে,

– ওকে দেখবে তুমি? কেন? তুমি কি ডক্টর নাকি?
ব্যাঙ্গাত্বক হাসি হাসলো।

ফারহান কিছুক্ষণ ওই ব্রাউন কালারের চুলের ঝুটির দিকে তাকিয়ে ছিলো। তারপর বলল,

– তুমি দেখে কি করবে? না মানে ওকে এখন ডক্টরের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। এখন একটা ডক্টরের প্রয়োজন, তুমি তো ডক্টর নও।

– তা ঠিক নই। তবে আমি ওনাকে সুস্থ করে দিতে পারবো।

– এই মেয়ে মাথা ঠিক আছে তোমার? দেখে তো মনে হয় কলেজে নতুন আসছো। বয়স কত তোমার? আনিত প্রশ্ন করলো।

– আহ্ এত প্রশ্ন করছেন কেন বলুন তো? তারপর মেহরিমা ফারহানের সামনে গিয়ে বলে, ওনাকে ওখানে শুইয়ে দিন।

– পাগল নাকি তুমি?

– উহ্ এত কথা না বলে যা বলছি তাই করুন তো। বেশ বিরক্তি নিয়ে বলল মেহরিমা। ওর কথা শুনে ফারহান স্মিত হাসলো। তারপর কিছু ভেবে মেহরিমার কথা মতো ওকে সুজনকে ঘাসের উপর শুইয়ে দিলো। তারপর মেহরিমা সুবর্ণাকে বলে ফাস্টের্ড বক্স নিয়ে সুজনের মাথায় ঔষুদ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। ঠোঁটের কেটে যাওয়া অংশে ঔষুদ লাগিয়ে দেয়। তারপর একটা ইনজেকশন এর নাম লিখে আনিতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, এটা নিয়ে আসুন। আনিত হা করে মেহরিমার দিকে তাকালে মেহরিমা আবার বলে, এভাবে হা করে কি দেখছেন? যান নিয়ে আসুন। আপনার বন্ধুর এখনি ঞ্জান ফিরে আসবে।

তারপর আনিত ইনজেকশন নিয়ে আসলে মেহরিমা সুজনের হাতে সেটা পুশ করে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঞ্জান ফিরে সুজনের। আর এই পুরোটা সময় ফারহান বুকের উপর হাত গুজে তাকিয়ে ছিলো মেহরিমার দিকে। মেহরিমাকে নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো সে। দুধে আলতা গায়ের রং। টিকালো নাক। গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোট। ঘন কালো চোখের পাপড়ি। মাথায় ব্রাউন কালারের চুল তার উপর দুপাশে দুটি ঝুটি করে রাখা। একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে ওকে। তবে ওর ড্রেসটা? এটা ভালো লাগেনি ফারহানের।

সুজনের ঞ্জান ফিরতেই আনিত রাগি গলায় বলল,

– তোকে কতবার বলছি ওই মেয়ের পিছু ছেড়ে দে। ওটা রনির গার্লফেন্ড। তুই রনির পাওয়ার জানিস না?

– আর তুই ভালোবাসার পাওয়ার জানিস না। কথাটা বলেই স্মিত হাসলো সুজন।

#হৃদমাঝারে – [০৯]

৭,
ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে বসে গল্প করছিলো মেহরিমা। এমন সময় রনি তার দল নিয়ে মেহরিমার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেহরিমা রনির দিকে তাকাতেই রনি স্মিত হাসলো। মেহরিমা রাগে কটমট করে ওর দিকে তাকাতেই রনি অন্যদিকে তাকালো আর তখনি একটা ছেলে এসে মেহরিমার দিকে একগুচ্ছ লাল গোলাপ দিয়ে বলে,

– আ- আই লাভ ইউ।

মেহরিমা ছেলেটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর বলল, তুমি আমাকে ভালোবাসো? কিন্তু কেন?

ছেলেটা এবার থতমত খেয়ে গেলো। তারপর বলল,

– না মানে, আমি আসলে,,

– তুমি আসলে কি? উঠে দাঁড়ায় মেহরিমা।

– না আসলে আমি না। ওই সাইম তোমাকে ভালোবাসে। ছেলেটা এবার মাথা তুলে তাকালো মেহরিমার দিকে তাকালো। মেহরিমা ছেলেটার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে সাইমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রনির এই দলটা মেহরিমার আগে থেকেই চেনা তাই সাইমকে চিনতে ওর অসুবিধা হয়নি। মেহরিমা সাইমকে জিগ্যেস করলো,

– এসব কি হচ্ছে সাইম।

সাইম একগাল হাসলো। তারপর বলল,

– কি করবো বলো সুইটহার্ট। তোমাকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। তোমার এই গুলুমুলু চেহারা ওয়েস্টার্ন ড্রেসে তোমাকে যা হ*ট লাগে না। ইশ আমি তো নিজেকে,,

আর কিছু বলতে পারলো না সাইম আর আগেই মেহরিমা বলে উঠলো,

– ভদ্রভাবে কথা বলো সাইম। না হলে কিন্তু

– কি করবে তুমি হ্যাঁ। তুমি জানো এই ছোট ছোট তোমাকে দেখলে আমি ভিবোর হয়ে যাই। নিজেকে সামলাতে আমার কতটা কষ্ট হয়।

সাইমের কথা শেষ হতে না হতেই মেহরিমা ওর গালে সজোরে চড় বসালো। তারপর সাইমের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, আমাকে দেখতে হ*ট লাগে তাইনা। তুই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিস না। আজকের পর নিজেকে আরো ঠিক রাখতে পারবি না। তারপর সাইমকে ইচ্ছেমত মারতে লাগলো। মেহেরিমাকে দেখে অপু রাজু ও বর্ণা ও ওকে মারতে লাগলো। কিছুক্ষণ মারার পর রনি এসে মেহরিমা কে আটকিয়ে বলে,

– কি করছিস মুন। মেরে ফেলবি নাকি?

– ছাড়ো আমায় রনি। একে তো আজ আমি একেবারে মেরে দিবো। বলেই মেহরিমা এক লাথি দিলো সাইমকে। রনি মেহরিমাকে টেনে একটু দূরে নিয়ে বলল, এই মুন থাম এবার। অনেক হয়েছে।
মেহরিমা রনির দিকে তাকিয়ে চক্ষুূ্দ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে বলল,

– এরা তোমার বন্ধু রনি। এর ছেলের সাহস দেখে আমি অবাক হয়েছি। আর রনি, এই ছেলেটা আমাকে এত খারাপ কথা বলল আর তুমি কিছু বললে না।

মুনের দিকে স্মিত হাসলো রনি। মাথা চুলকিয়ে বলল,

– আমি বলেছিলাম তোর কাছে না আসতে কিন্তু সাইম আমার কোন কথা শুনেনি। তাই আমিও আর কিছু বলি নি। ছেলেটা তোর হাতের মিষ্টি আদর পেতে চাইছে তাই আমিও আর না করলাম না। কিন্তু তুই যে এত আদর করবি সেটা ভাবতে পারিনি। আর একটু হলেই মরে যেতো।

– মরে যাক। যাক মরে। রাগে কটমট করে আবার সাইমের দিকে তাকায় মেহরিমা। রনি মেহরিমার হাত ধরে বলল,

– চল এখান থেকে। তারপর রনি মেহরিমাকে টেনে সেখান থেকে নিয়ে যায়। উপর থেকে এই দৃশ্য দেখছিলো ফারহান আর রাগে ফুঁসছিল। হাতের শক্তমুঠি করে বড় বড় করে শ্বাস নিলো কয়েকবার। তারপর দেয়ালে ঘুসি দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো।

কলেজ শেষে সব বন্ধুরা মিলে পার্কিং লটে আসে। রাজু আর অপু ওদের বাইক আনতে গেলে মেহরিমা আর সুবর্ণা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আর তখন ওদের সামনে আসে ফারহান। ফারহানকে দেখে মেহরিমার ভ্রু আপনা আপনি কুঁচকে উঠে। ফারহান মেহরিমার নিকটে এসে পকেট থেকে একটা মার্কার পেন বের করে তারপর মেহরিমার সামনে কিছুটা ঝুকে ওর হাটুর নিজ বরাবর দাগকাটে। ফারহানের এমন কান্ডে হতবম্ব হয়ে যায় দুইজনেই। মেহরিমা দু-পা পিছিয়ে যায়। আর বলে,

– কি, কি করছেন আপনি?

ফারহান সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় আর পেনটা পকেটে পুরে স্মিত হাসে। তারপর বলে,

– কাল থেকে যেন এই দাগটা দেখা না যায়। মানে হাটুর নিচে জামা পরে কলেজে আসবে।

– আপনি কি আমাকে অর্ডার করছেন।

– ধরে নাও তাই।

– কখনোই না। আমি ওসব লং ড্রেস পরি না।

– এখন থেকে পরবে।

– হে ইউ। আপনি কে হুম! আমাকে অর্ডার করার আপনি কে?

– তোমার ভবিষ্যৎ। কথাটা বিরবির করে বললেও মেহেরিমার কর্ণপাত ঠিক-ই হলো। মেহরিমা মাথা তুলে সামনে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ফারহান বলে উঠে,

– না মানে বলছিলাম, এতে ভবিষ্যৎতে তোমারই ভালো হবে।

– আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ফারহান কিছু বলবে তার আগেই অপু আর রাজু বাইক নিয়ে এসে হাজির হয়। মেহরিমা ফারহানের দিকে এক পলক তাকিয়ে বাইকে উঠে বসে। আর ফারহান সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে মেহরিমার চলে যাওয়ার দিকে। মেহরিমা চলে যাওয়ার পর ফারহান মনে মনে বলে উঠে, তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তো আমিই ভাববো মেহুরানি। হুম শুধু আমি।

রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে ফারহান। বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে মেহরিমা সেই শান্ত চেহারা। সেদিন যখন মেহরিমা সাইমকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলো তখন মেহরিমা ছিলো শান্তু। আর আজ যে মেহরিমাকে দেখলো সে, আচ্ছা এই মেহরিমা সেই মেহরিমা-ই তো। কথায় কথায় রেগে যায় কেন মেয়েটা। আচ্ছা কেমন হয় যদি মেহরিমা সবসময় সেদিনের মত শান্ত থাকে। শুয়া থেকে উঠে বসে ফারহান। আমি একটু বেশীই ভাবছি মেহরিমাকে নিয়ে। এত হাইপার কেন হচ্ছি আমি।

পরেরদিন মেহরিমা সেই আগের লুকেই কলেজে আসে। পরনে ওয়েস্টার্ন ড্রেস, ব্রাউন কালারের চুলে দুটো ঝুটি আর ঠোটে গোলাপি লিপস্টিক। ফারহান মেহরিমাকে দেখে দ্রুত ওর কাছে চলে আসে। রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওকে অবলোকন করে নিয়ে শক্ত গলায় বলে,

– এই তোমাকে বলেছিলাম এই ড্রেসে তুমি কলেজে আসবে না।

মেহরিমা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফারহানের দিকে। মেহরিমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহান ওর সামনে তুরি বাজিয়ে বলে,

– এভাবে হা করে কি দেখছো। ফারহান একটু ভাব নিয়ে বলে, মানছি আমি হ্যান্ডসাম, তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকবে নাকি?

ফারহানের কথা শুনে মেহরিমা একগাল হেসে বলে,
– আপনি হ্যান্ডসাম! এই ভুল ধারনা কবে থেকে পুশছেন আপনি?

ফারহান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেহরিমার হাসির দিকে। তারপর আবার নিজের গলার স্বর কঠিন করে বলে,

– কাল তো তোমাকে বলেছিলাম এই ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে কলেজে আসবে না। আমার কথা শুনলে না কেন?

– আমি কেন আপনার কথা শুনবো। তাছাড়া বাসায় আমার ওয়েস্টার্ন ড্রেস ছাড়া অন্য কোন ড্রেস নেই।

মেহরিমার কথা বলা শেষ হতেই ফারহান ওর হাত ধরে বলে,চল আমার সাথে। মেহরিমা নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে, হাত ছাড়ুন আমার। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ফারহান মেহরিমার কোন কথার জবাব না দিয়ে ওকে টেনে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে গাড়ির দরজা লক করে দেয়। মেহরিমা কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতেই ফারহান ওর মুখে আঙ্গুল দিয়ে ওকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলে, একদম মুখ খুলবে না বলে দিলাম। তারপর মেহরিমাকে কিছু না বলে গাড়িতে বসে চুপচাপ ড্রাইভ করতে থাকে। মেহরিমা আড় চোখে ওর দিকে ওর দিকে তাকাচ্ছে আর রাগে ফুঁসছে।

মিনিট দশেক পর ফারহানের গাড়ি এসে থামে একটা শপিংমলের সামনে। ফারহান গাড়ি থেকে নেমে মেহরিমাকে নিয়ে চলে যায় শপিং মলের ভিতরে। তারপর ওকে নিজের পছন্দমত কয়েকটা ড্রেস কিনে দেয়। আর একটা রেড কালারের চুড়িদার মেহরিমার হাতে ধড়িয়ে দিয়ে বলে,

– যাও এটা পরে এসো।

মেহরিমা রাগে কটমট করে ওর দিকে তাকাতেই ফারহান ওকে ধমক দিয়ে বলে,

– এখানো এখানে দাঁড়িয়ে আছো তুমি। যাও এগুলো পরে এসে।

মেহরিমা রাগে গটগট করতে করতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে মেহরিমা লাল চুড়িদার পরে বাহিরে আসে। ফারহান মুগ্ধ হয়ে সে দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মেহরিমার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর বলে,

– সেদিন তুমি সাইমকে মারছিলে কেন?

– কারন, ও আমাকে বাজে কথা বলছিলো।

– সাইমকি কিছু ভুল বলেছে। তুমি ছোট ছোট ড্রেস পরে ছেলেদের ঘুরবে আর ছেলেরা তোমায় কিছু বললেই দোষ হয়ে যায়। একটা নারীর বড় অহংকার হলো সম্মান। নিজের সম্মানকে ধুলিস্সাৎ করো না।

– মা-মানে কি বলতে চাইছেন আপনি?

– ওই ছোটখাটো ড্রেস পরে আর বাহিরে এসো না। নিজের অঙ্গ ঢেকে রাখো। মানুষের ললাসু দৃষ্টি থেকে নিজেকে দূরে রাখো।

মেহরিমা কিছু বলে না। শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

চলবে,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে