Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1013



পুকুরের সেই আতঙ্ক পর্ব-০৬

0

#পুকুরের সেই আতঙ্ক
৬ষ্ঠ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

জালালুদ্দিন মাতবর বিস্ময় নিয়েই রশিদের পিছু নিয়েছিলেন। এতরাতে কোথায় চলেছে ছেলেটা তার রক্ষা কবজগুলো খুলে! চাঁদের মিহি আলো, মধ্যরাতের স্নিগ্ধ বাতাস, গাছ ঢাকা এই পথ শুন-শান নীরবতার মধ্যে দিয়েও যেন এক আতঙ্কের আভাস দিচ্ছে। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো এগিয়ে যাচ্ছে এখনো রশিদ। ভারী কণ্ঠে তাকে কয়েকবার ডেকেও সাড়া পাননি জালালুদ্দিন মাতবর। অথচ রশিদ অতটাও দূরে নয় যে তার ডাক শুনবে না। আবার তিনি যত দ্রুত রশিদের দিকে এগোচ্ছে তত সে বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। চিন্তার গাঢ় ছায়া পড়েছে বুড়ো তান্ত্রিকের মনে। তার গায়েও কোনো রক্ষা কবজ নেই। তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ায় পরা হয়নি। কী একটা যেন তার অজানায় ঘটে চলেছে! থমকে দাঁড়ালেন তিনি।

হঠাৎ করে হাঁটা থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে রশিদ। ঘুরে তাকালো বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে। দূর থেকে দেখেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে রশিদের চেহারায়। এ যেন ভেলকি! সামান্য সময়ের মধ্যে রশিদের চেহারা বদলে হয়ে গেল একটা কিশোরী মেয়ের শরীর। শূন্য থেকেই যেন মেয়েটার পাশে উদয় হলো আরও ৫জন কিশোরী। এরা যে কারা তা চিনতে সময় লাগলো না তান্ত্রিকের। তার মানে এতক্ষণ তিনি রশিদকে নয় অনুসরণ করছিলেন ভয়ঙ্কর সেই পিশাচটার সৃষ্টি করা ভ্রমকে। তার মনে খটকা লাগছিল আগে থেকেই। তিনি কী কোনো ফাঁদে পড়েছেন! রশিদ কোথায়! সেও নিশ্চই ভ্রমের শিকার হয়েছে। তাদের দুজনের যদি কোনো ক্ষতি করে ওটা, তাহলে ওটার দ্বারা অসম্ভব আর কিছু নেই। এটার ভ্রম সৃষ্টি এবং সম্মোহনী ক্ষমতা অনুভব করেই রশিদকে বলেছিল তাদের এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। এমন আরও কয়েকজন তান্ত্রিককে খবর দেয়া দরকার যাতে তাদের কোনো ক্ষতি হলে আফসারপুরের মানুষদের ওই পিশাচটার হাত থেকে রক্ষা করতে আসে। ওটার লক্ষ্য শুধু ৬জন মেয়ে নয় আরও বড় কিছু তা তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু আর যাওয়া হলো না বুঝি!

৬টি মেয়েই মুচকি মুচকি হাসছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। বুড়ো তান্ত্রিক খেয়াল করলেন প্রাচীন সেই পুকুরটার দিকেই ভ্রমটা তাকে টেনে এনেছে। আর দুই মিনিট হাঁটলেই হয়তো ওটার পাড়ে পৌঁছে যাবেন তিনি। কিন্তু মেয়েগুলো তাকে পুরো স্বাধীন করে দিয়ে রাস্তার পাশের কয়েক সারি গাছের ফাঁকা অংশ দিয়ে অন্য পথ ধরলো। এটা পুকুরের দিকে যায় না। এই প্রথম এতটা দিশেহারা অনুভব করলেন জালালুদ্দিন। তিনি কী মেম্বার বাড়িতে ফিরে গিয়ে রশিদ আছে কিনা খোঁজ করবেন, নাকি পুকুর পাড়ে যাবেন। নাকি অনুসরণ করবেন কিশোরীর দলটাকে! কিশোরীর দল না বলে ভ্রমও বলা যায় ওদেরকে। কিন্তু ওটাই সবচেয়ে বেশি টানছে তাকে। এ যেন ভ্রমটা তাকে পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিয়ে তার চোখের সামনে কেবল একটি সুন্দর পথ খুলে সেদিকে তাকে চলতে ত্বরান্বিত করছে!

মেয়েগুলোর পিছুই নিলেন তিনি। ওরা হাঁটছে আর বার বার আড়চোখে বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। হাসিটা যেন তার বুকে আঘাত করছে। বিশেষ করে ওদের চোখ গুলোর দিকে তাকাতেই শরীর ঝাড়া দিয়ে ওঠে যেন। কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করতে চাইছে তার মনের ঘুমন্ত দিক। কিন্তু জিহ্বা সাহায্য করছে না। পা দুটো শুধু চলছে সামনের দিকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা তাকে! একি! মেয়েগুলো কোথায় গেল! তিনি উত্তেজিত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলেন। না, পুরোই শূন্যে মিলিয়ে গেছে। মুহূর্তেই যেন তার মধ্যে সমস্ত চেতনা ফিরে এলো। কেন তিনি ভয় পাচ্ছেন! কেন ওটাকে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে দিচ্ছেন!

ছুটতে লাগলেন তিনি সামনের দিকে। তিনি যেই পথ ধরে ছুটে এসেছেন সেই পথ ধরে কোনো ভাবেই পুকুরের কাছে তার পৌঁছনোর কথা না। কিন্তু তিনি স্পষ্ট তার সামনে পুকুরটাকে দেখতে পাচ্ছেন। পুকুরের উল্টো পাশে তিনি আধো অন্ধকারেও একটা লোককে দাড়িয়ে থাকতে দেখতে পাচ্ছেন। রশিদ! পুকুরের পানিতে রশিদের দিকে মুখ ফিরে সেই ৬টি মেয়ে ভেসে রয়েছে। জালালুদ্দিন মাতবরের দৃষ্টি আটকে গেল মেয়েগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অদ্ভুত আকৃতির অবয়বটার দিকে। স্বয়ং শয়তান যেন দাঁড়িয়ে আছে। মহা বিপদ অপেক্ষা করছে রশিদের ভাগ্যে। চিৎকার করে রশিদকে ডাকতে যাবেন হঠাৎ পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলেন। শরীর মুচড়ে উঠলো তার। ৬টা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে বড়জোর ৫ ফুট দূরে। ভন করে ঘুরে পুকুরের দিকে তাকালেন আবার। সেখানেও ৬টি মেয়ে ওই শয়তানটার সাথে রয়েছে। মানে ১২টি মেয়ে কী করে হলো!

তবে মেয়েগুলো আর হাসছে না। কেমন করুন মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু ওদের চোখগুলোর দিকে তাকাতেই আতঙ্কের শিহরণ অনুভব করলেন তিনি। মেয়েগুলো একসাথে তাদের বাম হাত তুলে বুড়ো তান্ত্রিকের পায়ের দিকে নির্দেশ করলো। জালালুদ্দিন অজানা ভয় নিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকালেন। গতরাতে পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল যে রক্ষা কবজগুলো ওগুলো তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। কী করে! ওরা কী তাকে সাহায্য করতে চাইছে! ভাববার সময় নেই!

দ্রুত ওগুলো নিজের শরীরে জড়িয়ে নিয়ে চেচাতে চেচাতে লাফিয়ে পড়লেন তিনি পুকুরে!

রশিদ অনুভব করলো তার শরীরে কোনো রক্ষা কবজ নেই,মন্ত্র উচ্চারণ করার জন্য জিহ্বা নড়তে রাজি নয়, পাও জেদ ধরেছে একটু এদিক সেদিক। যাবে না। সেই কুৎসিত হাতটা এগিয়ে আসছে ওটার শরীরকে দূরে রেখেই বাহু প্রসারিত করে, মেয়েগুলো যেন তাকে চিবিয়ে খাবার জন্য দাঁত কটমট করছে। কী আছে ওই চোখগুলোতে! একটা শক্ত হাত চেপে ধরলো তার পা। শেষ বুঝি সব! এমন সময় একটা পরিচিত কণ্ঠের চিৎকার ধ্বনি শুনে কলজে লাফিয়ে উঠল তার। ওস্তাদ! পুকুরের ওপার থেকে লাফিয়ে পড়লো পুকুরে কেউ! ঐতো সাঁতরে এদিকে আসছে! হ্যা, তার বুড়ো তান্ত্রিকই। শক্ত হাতটা ছেড়ে দিল তার পা। মেয়েগুলোর হাসিও থেমে গেল। ডুব দিল একসাথে তারা পানিতে। সেই জন্তুটার মুখ শুধু ঘুরে গেছে জালালুদ্দিন মাতবরের দিকে। নিঃশব্দে ওটায় ডুব মারলো পানিতে। বুড়ো তান্ত্রিক সাঁতরে এগিয়ে আসছেন।

ওরা যে তান্ত্রিককে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়নি তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো রশিদ। গভীর রাতে এই পুকুরের সমস্ত রাজত্বই শয়তান পিশাচটার। ওস্তাদের কপালে ভয়ানক খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। আর কিছু ভাববার নেই। যেসব মন্ত্র, উপকরণ ছাড়া শরীর রক্ষা করার নিয়ম শিখেছিল সব আওরাল কয়েক মুহূর্ত। এরপর ঝাঁপিয়ে পড়লো পুকুরে সেও। মেঘ চাঁদকে ঢেকে দিয়ে নিজের অলিখিত সীমানা দখল করে নিল সেই মুহূর্তেই। পুরো চারপাশ অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে গেল। শুধু দুজন লোকের সাঁতার কাটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাদের চিৎকার আর কথাগুলো অস্পষ্ট!

পাহারাদার হারুন অপলক দৃষ্টিতে সাপটার দিকে তাকিয়ে আছে। কী সাপ এটা! প্রায় রাতেই গোরস্থানের পাশে এটার দেখা পায় সে। কেমন অদ্ভুত দেখতে সাপটা। টর্চের আলো সরাসরি ওটার উপর ফেলল সে। তার বিশ্বাস কোনো একটা কবরের ভেতর ওটার বাসা। বিরক্ত করছে ওটাকে যাতে ওটা ওর আবাসে ফিরে যায় আর সে দেখতে পায় কার কবরে বাসা বেঁধেছে ওটা। হঠাৎ তার গা টা শিরশির করে উঠল। মেঘের আড়ালে চাঁদটা চলে যাওয়ায় হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেল যেন! সাপটা গোরস্থানে ঢুকে পড়েছে। কৌতূহলতা নিয়ে টর্চের আলো ফেলে ওটার পিছু পিছু এগিয়ে চললো হারুন। ঠিকই আন্দাজ করেছিল সে। একটা কবরের উপরে সৃষ্ট হওয়া গর্তে ঢুকে গেল ওটা। কবরটা চিনতে পেরে বুকটা আবার ধক করে উঠল তার। নুপুরের কবর ওটা। ওর মাথাবিহীন লাশটার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। কী বীভৎস! হঠাৎ মনে হলো কবরটা কেঁপে উঠল যেন। না, এত জোরে সাপের পক্ষে মাটি কাঁপানো সম্ভব! আবার কেঁপে উঠল কবরের মাটি। আৎকে উঠে পিছিয়ে গেল সে। ভয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর আতংক নিয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। একটু দূরে আরেকটা কবরের মাটি কেঁপে উঠল। টর্চ দ্রুত সেদিকে ঘোরালো হারুন। ওটা তুলির কবর! নুপুরের পরে ওর মাথাবিহীন লাশই পুকুরে ভেসে উঠেছিল! একি! কবর ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এলো কিছু! একটা হাত!

চিৎকার করে উল্টো ছুটতে গিয়েই পা হড়কে পরে গেল সে। টর্চটা ছিটকে গিয়ে পড়লো কবর দুটির মাঝখানে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নুপুরের কবর ফুঁড়েও বেরিয়ে এসেছে এক জোড়া হাত। তুলির কবর ফুরেও এরমধ্যে বেরিয়ে এসেছে ওপর হাত। দুটো হাত খাবলে সরিয়ে ফেলছে কবরের উপরের মাটি। পাথর হয়ে পড়ে রইলো হারুন যতক্ষণ পর্যন্ত না কবর দুটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো দুটি মাথাবিহীন মেয়ের শরীর। এক ফোটাও পচন ধরেনি ওগুলোয়। কোনোমতে উঠে উল্টো ঘুরে পাগলের মতো ছুটতে থাকলো সে। অনুভব করছে প্রতি মুহূর্তে তার পিছে রয়েছে মাথা বিহীন দুটো মেয়ের কবর ফুঁড়ে ওঠা লাশ! ……………………………………..
………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.

পুকুরের সেই আতঙ্ক পর্ব-০৫

0

#পুকুরের সেই আতঙ্ক
৫ম পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

মধ্যরাতে গ্রামের মানুষ আর তান্ত্রিক বুড়োর নিষেধ না মেনে চারটা মেয়ের লাশ পুলিশ ভ্যানে তুলে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার আগে পুলিশের দলটা কল্পনাও করতে পারেনি মাঝপথে মাথাবিহীন এই চার কিশোরীর লাশ জীবিত হয়ে উঠবে। কিন্তু যখন তা ঘটলো তখন ভয়ঙ্কর আতঙ্কে শিহরিত হয়ে পালানো ছাড়া আর কোনো চিন্তা তার মাথায় এলো না। এমন একটা দৃশ্য যে তারা দেখেছে তা শুনে অন্য মানুষ কী বিশ্বাস করবে পুলিশের দলের লোকেরাই বিশ্বাস করতে পারছে না। যে দুজন কনস্টেবল লাশগুলোকে জেগে উঠতে দেখে গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়েছিল তারা বেশ আহত হয়েছে। ড্রাইভার আর অফিসার দম থাকা পর্যন্ত দৌড়েছে।

একসাথেই তারা চারজন সকাল হওয়ার অপেক্ষায় এক জায়গায় আশ্রয় নিল। ভোরের আলো ফুটলেই গাড়ির কাছে পৌঁছে স্থির হলো তারা। দিনের আলোয় ভয় কেটে গেছে অনেকটাই। মৃত মানুষের ভয়ে পালানোর জন্য উল্টো লজ্জাই লাগছে তাদের এখন। গাড়ি, আশেপাশের পথ তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাশগুলোর চিহ্ন মাত্রও তাদের নজর কারলো না। মানে কী এর! পুকুরে মেয়েগুলোর মৃত্যু যে অস্বাভাবিক, অলৌকিক কিছুর প্রভাবে ঘটেছে এটা এর মধ্যে তারা বিশ্বাস করছে। কিন্তু চারটা মেয়ের লাশ গাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে নেমে চলে গেছে এটা তাদের মাথাতেই ঢুকছে না। লাশগুলোকে পেলে অন্তত রাতের ঘটনাটা ভুলে যাওয়া যেত। একেবারেই স্তম্ভিত হয়ে গেল তারা। হতাশ হয়ে গাড়ি নিয়ে আবার ফিরতে লাগলো আফসারপুরের দিকে।

রশিদ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রাচীন পুকুরটারর পানির দিকে। ভোরের হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে। মৃদু বাতাস বইছে চারদিকে। এত সুন্দর লাগছে জায়গাটা! এই পুকুরে যে অশুভ কিছু থাকতে পারে তা কল্পনাও যেন করা যায় না। কিন্তু পুকুরে যেই অশুভ শক্তিই থাকুক না কেন ওটা যে ভয়ঙ্কর কোনো ক্ষমতাবান শক্তিমান আতঙ্ক এতে তার কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ করে গত রাতে জালালুদ্দিন মাতবর তাকে যা বললেন তারপর সেও কিছুটা আতঙ্ক অনুভব করছে। গতরাতে চারটি মেয়ের লাশ যখন তারা উদ্ধার করতে নেমেছিল পুকুরে তখন জালালুদ্দিন তার পায়ে একটা শক্ত হাতের স্পর্শ পান। আতঙ্কিত না হয়ে উল্টো পুকুরের পানিতে ডুব দেন তিনি। এরপর তিনি দেখেন অদ্ভুত একটা জন্তুকে। জন্তুটার শারিরীক বর্ণনা তার বিন্দুমাত্র মনে নেই। এর কারণ ওটার অদ্ভুত চোখ।

ঘোলা পানিতেও জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল ওগুলো। কেমন এক বীভৎস তুচ্ছ হিংস্রতা বিরাজ করছিল দৃষ্টিতে। কিলবিল করে ভাসছে ওটার মাথার চুল। ভয়ে দম আটকে মারা যাবেন যেন তিনি। পরমুহূর্তেই চোখদুটো অদৃশ্য হয়ে গেল। ওখানে উদয় হলো ৬টি ছোট মেয়ের মুখ। মেয়েগুলোকে এই প্রথম দেখলেও বুড়ো তান্ত্রিক বুঝতে পারলেন ওরাই সেই সব কিশোরী যারা এই পুকুরে মারা গিয়েছে। করুণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। কী একটা সাহায্য চাইতে এসেছে যেন। পানির ভেতরেও কী সাবলীল কণ্ঠে একটা মেয়ে মায়া ভরা কণ্ঠে অনুনয় করলো, ‘আমাদের বাঁচাও দাদু, ওই রাক্ষসটা আমাদের অনেক কষ্ট দিচ্ছে। আমাদের সঙ্গে চলো নীচে, ওটাকে মারার উপায় আমরা বলে দিচ্ছি! তার আগে তোমার শরীরের ওসব নোংরা জিনিস খুলে ফেল।’

এক মুহূর্তে সম্মহিত হয়ে গেল তান্ত্রিক। সম্মোহিত হওয়ার পর হাজার বছরের সাধনা, হাজার বছর ধরে নিজের মস্তিষ্কে জমা করা জ্ঞানও কোনো কাজে আসে না। তখন সে হয়ে যায় দাস। জালালুদ্দিন মাতবর ধীরে ধীরে খুলে ফেলল তার সব রক্ষা কবজ। মেয়েগুলোর করুণ মুখগুলো হঠাৎ করে বদলে বিদ্রুপ হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলতে লাগলো। এক মুহূর্তের জন্য সম্মোহন ছুটে গেল তার। সবগুলো মেয়ের আলোকোজ্জ্বল মুখের উপর দিয়ে চোখ ঘোরালেন তিনি। বিস্মিত হয়ে দেখলেন সবার চোখ দেখতে একই রকম, শুধু মুখায়ব গুলো ভিন্ন। চোখটা সেই প্রথম দেখা অদ্ভুত জন্তুর! এক মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল আবার ৬টি মেয়ের মুখ সেখানে উদয় হলো সেই হিংস্র দৃষ্টির জন্তুটি।

এক মুহূর্ত কিছু না ভেবেই তিনি শরীর বাকিয়ে মন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে মাথা উঠিয়ে দিলেন পানির উপর। শক্ত করে চেপে ধরলেন রশিদের শরীর। থরথর কাঁপছেন তিনি। আতঙ্ক নিয়ে রশিদের সাহায্যে লাশগুলোকে বেঁধে পাড়ে তুললেন।

হতভম্ব হয়ে জালালুদ্দিন মাতবর থেকে ঘটনাটা শুনলো রশিদ। মেম্বার বাড়ির ঘরটির মধ্যে মৃদু আলো জ্বলছিল। সেই আলোতে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে প্রথম খেয়াল করলো আসলেই তার শরীরে কোনো কবজ নেই। ‘পিশাচ’ ‘দেও’ ‘প্রেত’ এদের অসংখ্য শক্তি থাকলেও মানুষকে সম্মোহন করে কিছু করানোর শক্তি এদের থাকে না। হয়তো সর্বোচ্চ মোহে আটকে ফেলতে পারে। কিন্তু প্রাচীন পুকুরের এই শক্তির এই ক্ষমতা আছে। সে নিশ্চই সম্মোহিত করেই পুকুরের কাছে টেনে নিয়ে গেছে পরের ৫জন। কিশোরী মেয়েকে। এবং তান্ত্রিক মাতবরের মতো সম্মোহন করে হত্যা করে ফেলতে পারবে যে কাউকে। কিন্তু ওটার উদ্দেশ্য কী! তান্ত্রিক জালালুদ্দিন মাতবরেরইবা উদ্দেশ্য কী!

এতটুকুই শুধু ওস্তাদ তাকে বলেছে। এইটুকুতেই যে বড় তান্ত্রিক ভয় পেয়ে এই আফসারপুর ছেড়ে চলে যেতে চায় এটা বিশ্বাস হয় না রশিদের। হয়তো আরও কিছু আছে যা তাকে বলেনি ওস্তাদ। এরপর আধো ঘুম আর জাগরণের মধ্যেই কেটে গেছে সময়। তাই ভোরে সেই রহস্যময় পুকুরপাড়ে এসে হাজির হয়েছে রশিদ। দিনের আলোয় হয়তো ওটার শক্তি থাকে না। আবার হয়তো থাকে। ওটার আকর্ষণ হয়তো কেবল কিশোরী মেয়েদের মাথা। আবার ওটার শিকারের পথে কেউ বাধা দিলে তারাও যে ওটার শিকার হতে পারে এও অসম্ভব কিছু নয়।

হঠাৎ পেছনে পদধ্বনি শুনে ঘুরে তাকালো রশিদ। মেম্বার বাড়ি থেকে পুকুরটা বেশ তফাতে। ওস্তাদ ঘুমিয়ে ছিল বলে ডেকে বলে আসেনি সে। জালালুদ্দিন মাতবর তাকে দেখতে না পেয়ে অনুমান করেই হয়তো এখানে চলে এসেছেন। রশিদের কাঁধে হাত রাখলেন তিনি। অনেকটা ফুরফুরে মেজাজের লাগছে তাকে। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘সাহস দেখছি তোমার খুব বেশি! একা একাই চলে এসেছ!’

মুচকি হাসলো রশিদও। মাতবর বললেন, ‘আমার গতরাতের ধারণা অতিরঞ্জিত ছিল রশিদ। পানির ভেতরে আমি যা দেখেছি পুরোটাই আমার কল্পনা ছিল। কল্পনার মোহে পরেই কবজ গুলো খুলে ফেলেছিলাম। রাতে মাথা গিট মেরে ছিল, তাই নিজেও ভয় পেয়ে ছিলাম আর তোমাকেও ভয় দেখাচ্ছিলাম। এখন সব পরিস্কার লাগছে। ওটা একটা পিশাচই।’

কিছুটা অবাক হলো রশিদ। তারপর বলল, ‘এখন কী করবেন?’

‘মেম্বারের কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছি যে ৬জন মেয়ে মারা গেছে ওরা নাকি খেলার সাথী ছিল। এবং প্রতিটা মেয়েই নিখোঁজের আগের রাতে নাকি তাদের মৃত সাথীদের ঘরের আশেপাশে দেখেছে। আর ভয় পেয়ে চিৎকার করেছে। তারা নাকি তাকে পুকুরের দিকে আহ্বান করেছিল।’

‘মানে কী! তাহলে ওদের পরিবারের লোকেরা কেন কাউকে সতর্ক করে দেয়নি! তাহলে হয়তো বাকি মেয়েগুলোকে পাহারায় রাখা যেত!’

‘ সেটাই! তারা কেউই প্রতিটা মেয়ের নিখোঁজের পেছনে যে তাদের অন্য মৃত মেয়েরা দায়ী তার মিল করতে পারেনি এবং বিষয়টাকে হালকা করে নিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে পিশাচটার লক্ষ্যই ছিল ওই ৬জন মেয়ে। তার লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এবং ওটা এখন অনেকদিন আর নতুন কাউকে শিকার করবে না। অর্থাৎ পুকুরে আর ওই পিশাচটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। ওটা আবার কখন তার শিকার বানায়। তখনই বোঝা যাবে ওটা কেন এতগুলো মেয়েকে খুন করেছে। আমরা আজই চলে যাব। ‘

‘কিন্তু আপনি অনুমান করে এত নিশ্চিত ভাবে কথাগুলো কিভাবে বলছেন? আমার মনে হয় না গত রাতে আপনি যা কিছু বলেছেন তা সব আপনার কল্পনা। বরং এখন যা কিছু বলছেন তাই উদ্ভট লাগছে আমার কাছে!’

রশিদের কথাটা শুনে কেমন একটা ক্রোধ ভর করলো জালালুদ্দিন মাতবরের দৃষ্টিতে। এক মুহূর্তের জন্য রশিদের মনে হলো তার সামনে মাতবর নয়। অন্য কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলো জালালুদ্দিন মাতবর পুকুরের দিকে। বিস্ময়ের সীমা রইলো না রশিদের। ওস্তাদের মুখে কেমন একটা ক্রুর পৈশাচিক হাসি। এখন ভোর, মিনিটে মিনিটে প্রকৃতি আলোকিত হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে পুরো চারপাশটা আঁধারে ডুবে গেল। আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত সামান্য আলো ছাড়া আর কিছুই নেই। মানে এখনো আধার রাত্রি। তার মানে এই সমস্ত কিছুই তার মায়া ছিল! অন্ধকার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো জালালুদ্দিন মাতবর। একি! মুহুর্তে পানির নিচে তলিয়ে গেলেন তিনি।

চোখ-কপালে উঠে এলো রশিদের দৃশ্যটা দেখে। পানি ফুঁড়ে উঠে এসেছে ৬জন কিশোরী মেয়ে। রশিদের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। পা জমে গেছে তার। এরমধ্যেই দেখল মেয়েগুলোর পেছনে আরেকটা মাথা উঠে এসেছে। এই জগতের কোনো প্রাণ ওটা নয় যেন! ওটার চোখই বলে দিচ্ছে এটাকেই ওস্তাদ পানির নিচে ডুব দিয়ে দেখেছিলেন। একটা হাতকে শুধু পানি থেকে উপরে উঠতে দেখল সে। কী বীভৎস দেখতে তা!

জালালুদ্দিন মাতবর আৎকে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠলেন। তার মনে হলো এতক্ষণ যেন তার বুকের উপর ভারী কিছু চেপে বসেছিল। বাইরে তাকিয়ে দেখল এখনো অনেক রাত। মেঝেতে বিছানা করে ঘুমিয়েছিল রশিদ। সেখানে ওকে দেখতে না পেয়ে খোলা দরজার দিকে চোখ গেল তার। অশুভ এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল । ভালো করে রশিদের শোয়ার জায়গায় চোখ বোলাতেই আশঙ্কার কারণটা অনুভব করতে পারলেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সেখানে রশিদের রক্ষা কবজগুলো। সজ্ঞানে ও ওগুলো খুলবে না কখনোই। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ঐতো রশিদ অনেকটা দূরে চলে গেছে, এত রাতে দ্রুত হেটে কোথায় যাচ্ছে সে! দ্রুত হেঁটে তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন বুড়ো তান্ত্রিক। যতই দ্রুত হাঁটছেন নাগাল পাচ্ছেন না ওর।……………….
………………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

পুকুরের সেই আতংঙ্ক পর্ব-০৪

0

#পুকুরের সেই আতংঙ্ক
৪র্থ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

আফসারপুরের প্রাচীন পুকুর ঘিরে যে আতঙ্ক এতদিন বিরাজ করছিল মানুষের মাঝে, একসাথে সেখান থেকে ৪টি মাথাবিহীন কিশোরীর লাশ ভেসে ওঠায় তা মহা আতঙ্কে রূপ নিল। সন্ধ্যার পরে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। পুকুরের পাড়ে কেউ এসে দাঁড়ালেই ফকফকে চাঁদের আলোয় পুকুরের মাঝামাঝি পাশাপাশি চারটি লাশ দেখতে পাচ্ছে। পুকুরের পানিও আজ অদ্ভুত রকম ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে। কেউই পুকুরে নামার সাহস পাচ্ছে না। পুলিশের লোকগুলোও পুকুরের কিছুটা দূরে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিখোঁজ যাওয়া কিশোরীর পরিবারের লোকেরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। সকলেই দিশেহারা বোধ করছে। কিন্তু সকালের আগে কিইবা করার আছে তাদের! সময় পেরিয়ে যেতে থাকে, এই বীভৎস দৃশ্য দেখার জন্য মানুষের ভিড় ক্রমশ বেড়েই চলেছে। একবার লাশগুলোকে দেখেই অবশ্য ভয়ে ছিটকে দূরে সরে যাচ্ছে।

হঠাৎ একটা সি.এন.জি এসে থামলো পুকুরের কাছাকাছি ভিড়ের কাছে। ওটা থেকে দুজন আরোহী নেমে এলো। দুজনেরই গায়ে গেরুয়া পোশাক, মাথায় লম্বা চুল, শরীরে অসংখ্য সুতোর মতো কিছু বাধা। আশেপাশের লোকজন সব কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসলো এদিকে। সি.এন.জির ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ওটা চলে গেল। পুলিশের অফিসার এগিয়ে গেলেন লোক গুলোর কাছে। এরা নিশ্চই তান্ত্রিক!

জালালুদ্দিন মাতবর এবং রশিদ দুজনেই ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে আছেন। এত মানুষের ভিড় পুকুরটার দিকে বাড়ছে দেখেই অনুমান করতে পারছিলেন পুকুরে আবার কিছু একটা ঘটেছে। তারমধ্যে কিছু মানুষের মুখ থেকে বের হওয়া লাশ শব্দ তাদের কানে পৌঁছেছে। নিজেদের পরিচয় দিয়ে তারা পুকুরের দিকে এগিয়ে চললেন। প্রতি মুহূর্তে দুজনেই অনুভব করলেন পুকুর থেকে কিছু একটা চাইছে না তারা সামনে বাড়ুক। পায়ে কেমন একটা জড়তা!

চারদিকে কোনো বাতাস নেই। অথচ পুকুরের পানি কোনো একটা উত্তাল নদীর পানির মতোই কাঁপছে। পুকুরের মাঝামাঝি চারটি বাচ্চা মেয়ের লাশ অভাবে দেখে দুজনেরই দম বন্ধ হয়ে এলো যেন। দূর থেকে দেখেও বোঝা যাচ্ছে ওদের মাথা দাঁড়ালো দাঁত দিয়ে কামড়ে কেউ আলাদা করে ছিড়েছে। রাশেদ জালালুদ্দিন মাতবরের মুখের দিকে তাকালো। ওটা শক্ত হয়ে গেছে। কী একটা ক্রোধে যেন কাঁপছে। তার চোখ দুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে পুকুরের ভেতরে থাকা এমন কিছু যা কারও চোখেই ধরা পড়ছে না। সেও অস্বাভাবিক কিছু একটা যে এই পুকুরে আছে তা অনুধাবন করতে পারছে। হঠাৎ তার মনে হলো লাশগুলোর পাশ থেকে কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন আৎকে উঠল সে।

দুজনেই ঘুরে এলাকার লোকগুলোর কাছে গেল। জালালুদ্দিন বললেন, লাশগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব তুলে ফেলা উচিত। সকলেই কেমন আমতা-আমতা করতে লাগলো। এটাই স্বাভাবিক, সকলে ভয় পেয়ে আছে। পুকুরে যেই অশুভ শক্তিই থাকুক ওটা লাশ গুলোকে নিয়ে কোনো একটা খেলা খেলছে। লাশ যতক্ষণ পুকুরে থাকবে ওটারই লাভ। কেউ পুকুরে এই মুহূর্তে নামতে রাজি নয় বুঝতে পেরে তিনি বললেন আমরা দুজন নামবো। সকলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তান্ত্রিক লোক এরা সাহসী তো হবেই। তবুও কিছুটা আতঙ্কে সকলেরই মন চঞ্চল হয়ে উঠল। এদের কিছু হয়ে গেলে তাদের এই আতঙ্ক থেকে উদ্ধার পাওয়ার ভরসা করার আর কিছুই রইবে না।

গেরুয়া পাঞ্জাবি খুলে এখন তাদের পরনে শুধু লুঙ্গি। নেমে পড়লো দুজনে পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে। গলা-হাত আর কোমরে জড়িয়ে আছে রক্ষা কবজ। রশিদকে সতর্ক করে দিলেন ওস্তাদ, পানির নিচ থেকে কোনো হাতের স্পর্শ বা টান অনুভব করলে উত্তেজিত হবে না। মন্ত্রই রক্ষা করবে তোমাকে। জানে সে। তবুও কিছুটা উত্তেজনা মনে চেপেই রয়েছে।

সাঁতরে পুকুরের মাঝামাঝি চলে গেলো দুজনে লাশ চারটির পাশে। লাশ গুলোর শরীর কাছ থেকে দেখতে আরও ভয়ঙ্কর। শরীর স্পর্শ করতেই রশিদ অনুভব করলো কোনো কারণে শরীরগুলো একটু বেশিই পিচ্ছিল হয়ে আছে। ওস্তাদের দিকে তাকালো, তিনি চোখ ইশারা করে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে পানিতে ডুব দিলেন। বুক ধক করে উঠল তার। প্রায় দুই মিনিট পর জালালুদ্দিন মাতবর পানির উপর ভেসে উঠল। তার কণ্ঠ কাঁপছে, রশিদ দ্রুত লাশগুলোকে নিয়ে পাড়ের দিকে চলো। সঙ্গে দড়ি দিয়ে ছিল লোকগুলো। ওগুলো দিয়েই লাশ চারটির শরীর আটকে দিল তারা দুজন। এরপর একজন সামনে থেকে আরেকজন পেছন থেকে ভেলার মতো করে লাশগুলোকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো পাড়ের দিকে।

পুকুরের কম্পিত পানির স্রোতে খুব একটা কষ্ট করতে হলো না তাদের। তাদের এমন কাজ দেখে অনেকের মনেই সাহস ফিরে এসেছে। ওরা পাড় থেকে লাশগুলো টেনে উপরে তুলতে সাহায্য করলো। পাড়ে তুলে দ্রুত কলা পাতা দিয়ে নগ্ন লাশগুলোকে ঢেকে দেয়া হলো।

ভিজে চুপসে গেছে দুজনেই। সঙ্গে আনা পুটলি থেকে গামছা বের করে গা মুছে পোশাক পাল্টে নিল। উত্তেজিত মানুষের একটা অংশ লাশগুলোকে ঘিরে ভিড় করছে। আর বাকিরা দুই নবাগত সাহসী তান্ত্রিককে। এদের এই কাজটুকুই তারা যে ভণ্ড তান্ত্রিক নয় তার দলিল হিসেবে প্রকাশ পেল সকলের কাছে। জালালুদ্দিন মাতবর বললেন, ‘আমরা দুজন খুবই ক্লান্ত, একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেন। আর লাশ গুলোকে দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করেন।’

তান্ত্রিকদের মুখে লেগে থাকা আতংক সকলেই খেয়াল করলেন। পুলিশ জানালেন ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলো নিয়ে যাবেন তারা। জালালুদ্দিন নিষেধ করলেন, বললেন, কোনোই লাভ নেই। আর নিয়ে গেলেও সকালের আগে লাশ গুলোকে যাতে কোথাও না নিয়ে যাওয়া হয়। দাফন করে ফেলাই ভালো। রাতের আঁধারে ওরা বিপদজনক। কিন্তু পুলিশের লোকেরা কিছুতেই তার কথা শুনলেন না। এমনিতেই এই কেসটায় তারা অসংখ্য ব্যর্থতার নমুনা দেখিয়েছেন। তার উপর ভুতের ভয়ে সারারাত লাশ ফেলে রেখেছে দেখলে সকলের কাছে অপদার্থ খ্যাতি পেতে হবে তাদের। দুই তান্ত্রিককে এলাকার মেম্বারের হাতে তুলে দিয়ে বিদায় দিয়ে লাশগুলোকে শাড়ি কাপড়ে মুড়িয়ে পুলিশ ভ্যানে তোলা হলো। দুজন কনস্টেবল, ভ্যান ড্রাইভার এবং অফিসার চারজন। প্রায় মধ্যরাতে চারটি লাশ নিয়ে রওনা দিলেন থানার উদ্দেশ্যে।

দুই কনস্টেবল পা জড়সড় করে বসে আছেন পাশাপাশি গা লাগিয়ে। এতটা ভয় তারা এই জীবনে আর পায়নি। লাশ চারটিকে পুকুরে ভেসে থাকতে দেখেই তাদের কলজে শুকিয়ে গিয়েছিল। তার উপরে যখন অফিসার বললেন, পুকুরে নেমে লাশগুলোকে তুলে আনতে তখন দুজন প্রায় কেঁদেই দিয়েছিল। হাত জোড় করে অনুনয় করে বলেছিল তাদের ছেলে-মেয়ে আছে বাসায়। এখন পানিতে নামলে নিশ্চিত মৃত্যু হবে। অফিসার বিরক্ত হলেও জোরাজুরি করেনি। ভাগ্যিস তান্ত্রিক দুজন সময় মতো এসেছিল। কিন্তু ভাগ্য কী আর এত ভালো!

ওদের নিষেধ সত্যেও গোয়ার্তুমি করে অফিসার এই রাতে মেয়েগুলোর পরিবারের লোক, গ্রামের মানুষের সাথে ঝগড়া করে পুলিশ ভ্যানে তুলেছে লাশগুলো। আর ওগুলোর পাহাড়া দিচ্ছে তারা দুজন! গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে অফিসার বেটা কী আরামে বসে আছে। চোখ পড়েই যাচ্ছে লাশগুলোর দিকে। শাড়ির পেচের ভেতর থেকেও স্পষ্ট শরীরের আকৃতি বোঝা যাচ্ছে ছোট মেয়েগুলোর। চারটি লাশের একটিরও মাথা নেই ভাবতেই গা গুলিয়ে যাচ্ছে দুজনের। গাড়ি যত এগোচ্ছে তত তাদের আতংক বেড়েই চলেছে। এই মনে হচ্ছে লাশগুলো নড়ে উঠবে। বাইরে থেকে আসা বাতাসে কাঁপছে সত্যিই কাপড়ের খোলা অংশগুলো। ওগুলোর হাত চেপে ধরবে যেন তাদের পা। তারপর! ভাবতেই গা রিরি করে উঠছে।

দুজনে ওরা বাচ্চা ছেলের মতো একে ওপরের হাত চেপে রয়েছে। হঠাৎ ১ম কনস্টেবল আৎকে উঠলেন। তার মনে হলো একটা ঠাণ্ডা হাত তার ঘাড় স্পর্শ করলো। ২য় জনও ঘাড়ের কাছে একটা শীতল স্পর্শে চমকে উঠলেন। এরপরেই তাদের কানে ভেসে এলো কয়েকজন মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দ। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে হাসির শব্দটাও তাদের সঙ্গে চলছে। চমকে পেছনে তাকালো দুজনে। ভ্যানের পাশের দিকটা কাপড়হীন। গিরিলের রেলিং এর ওপাশে তাদের প্রায় মুখোমুখি তিনটা মেয়ের মুখ। তিনজনই খিলখিল করে হাসছে। কিছু দস্যি মেয়ে যেন চলন্ত গাড়িতে লাফিয়ে উঠেছে। কিন্তু সময়টা যে এখন রাত। ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলো ওগুলো স্রেফ মাথা। মাথার নীচে কোনো শরীর নেই।

আৎকে প্রায় লাফিয়ে পিছিয়ে গেল দুজনে আর্তনাদ করে। মুহূর্তেই তাল হারিয়ে পড়ে গেল লাশ গুলোর উপরে। এবার উল্টো দিকের গিরিলের ওপাশে উদয় হলো আরও তিনজন অপরিচিত মেয়ের মাথা। দুপাশ থেকে ৬জন কিশোরী মেয়ে খিলখিল করে হাসছে। শরীরে রক্ত পানি হয়ে গেল। হঠাৎ অনুধাবন করলো মাথা বিহীন লাশগুলো নড়ে উঠছে তাদের শরীরের নীচে। দ্রুত তারা উঠে পিছিয়ে গেল বাইরের দিকে। ভয়ঙ্কর ভাবে নড়ছে লাশগুলো। একি! তারা কল্পনায় দেখছে নাকি! মাথাবিহীন ৪টি লাশ ধীরে ধীরে উঠে বসে পড়েছে। ওগুলোর শরীর থেকে সরে গেছে কাপড়। ৪টি লাশই তাদের হাত গুলো বাড়িয়ে দিয়েছে কনস্টেবল দুজনের দিকে। প্রথমে মনে হলো ডাকছে তাদের। পরে আবার মনে হলো ঝাঁপিয়ে পড়বে লাশ গুলো ওদের উপর। ভয়ংকর এই পরিস্থিতির সাথে তাদের কান নষ্ট করে দিচ্ছে গাড়ির বাইরের দুপাশ থেকে ভেসে আসা মেয়েগুলোর হাসির শব্দ। গাড়ি চলছে তার গতিতেই। চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে কনস্টেবল দুজন। গাড়ি থামাচ্ছে না কেন! আর কোনো উপায় আরেকটু ঘুরে পেছনে গিয়ে দুজনেই লাফিয়ে নেমে গেল চলন্ত গাড়ি থেকে।

পুলিশ অফিসার আর ড্রাইভার দুজনেই চমকে একে অপরের দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছে কেউ পেছন থেকে চিৎকার করছে। ইশারা পেয়ে গাড়ি ব্রেক কসলেন ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নেমে প্রায় ছুটে গাড়ির পেছনে চলে এলেন। যা তারা দেখলেন এই পরিবেশে গভীর রাতে, গাছ-গাছালি ঢাকা পথের মাঝখানে কেউ দেখতে চাইবে না। কনস্টেবল দুজন কোথায়! গাড়ির পেছনে মাথাবিহীন চারটি মেয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। ওদের হাতদুটো সামনের দিকে তাক করা। অন্ধকার হাতড়ে এগিয়ে আসছে যেন এদিকে। অফিসার এবং ড্রাইভার আর্তনাদ তুলে উল্টো ঘুরে আফসারপুরের দিকে ছুটতে লাগলেন পেছনের দিকে যতক্ষণ পর্যন্ত না পেছনের খিলখিল হাসির শব্দ মিলিয়ে গেল।

মেম্বার বাড়ির একটা ঘরেই ঘুমোতে দেয়া হয়েছে তান্ত্রিক ওস্তাদ আর শীর্ষকে। ঘুম নেই কারো চোখেই। জালালুদ্দিন মাতবর তাকে যা বললেন এরপর আর ঘুমানো যায় না। রশিদ অবাক কণ্ঠে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলো, ‘আমরা কালই চলে যাব মানে কী! আপনিইতো বলেছিলেন এটি কোনো প্রাচীন ভয়ঙ্কর ‘দেও’ এর কাজ। তাহলে! এখন আপনার ভাষায় এই ৬টি কিশোরীর হত্যা যদি কোনো ভূত-প্রেত, পিশাচ কিংবা পুকুরের দেও এর না হয়, তাহলে কার? কোনো মানুষের? তা কী করে হয়? আপনি এত ভয় পেয়ে আছেন কেন? দুই মিনিট পুকুরের ভেতর ডুব দিয়ে কী এমন বুঝলেন যে এমনটা বলছেন?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন জালালুদ্দিন মাতবর।…….
……………………………………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.

পুকুরের সেই আতঙ্ক পর্ব-০৩

0

#পুকুরের সেই আতঙ্ক
৩য় পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

পুকুরের একদম পাড় ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা-মা। আঁখি ভয়ে ভয়ে ডাকতে লাগলো তাদের।
একি! চমকে উঠতে হলো তাকে। ওখানে বাবা-মা কই! তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তুলি আর নুপুর। ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। পুকুরের মাঝামাঝি কী একটা যেন ভেসে উঠলো। চুক চুক একটা শব্দ ভেসে আসছে তার কানে। কী একটা ভয়ানক মুখ ভেসে উঠল পানির উপরে। জ্ঞান হারালো সে। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু দেখতে পেল বিদ্যুৎ গতিতে নুপুর আর তুলি ছুটে এসে তার দুটো হাত শক্ত করে চেপে ধরলো।

পরদিন তুলি আর নুপুরের নিখোঁজের পর যেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল আঁখিকে খুঁজে না পেয়ে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটলো গ্রামে। প্রথমে কেউই বুঝতে পারলো না মেয়েটা কোথায় গেল! আঁখির বাবা একটা পায়ের ছাপ খুঁজে পায়। ওটা গেছে পুকুরের দিকে। তারমানে রাতে পুকুরের দিকে গিয়েছে আঁখি। এরমানে যে কী কারও বুঝতে বাকি রইল না। কী এমন জিনিস যা অমন ভয়ের একটা পুকুরেও একটা মেয়েকে অমন রাতে টেনে নিয়ে যায়! অভাবনীয় বিষয় সকলের কাছে। আঁখির পরিণতি যে নুপুর আর তুলির ব্যাতিক্রম নয় তা সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল সারাদিন ভরে তাকে খুঁজেও কোথাও না পেয়ে। পুকুরে নেমেও কয়েকজন খোঁজ চালালো তার লাশের। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।

গ্রামের সকলে আতঙ্ক নিয়ে আঁখির মাথাবিহীন লাশটি পুকুরে ভেসে ওঠার জন্য ৩ দিন অপেক্ষা করতে লাগলো। তিন দিন, এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। আঁখির লাশের কোনো হদিসই মিলল না। লাশ ভেসে উঠল না দেখে সকলে অবাকই হলো। সে কী মারা গেছে নাকি বেঁচে আছে তাও কেউ অনুমান করতে পারছে না। এরপর আরও বেশ কিছুদিন কেটে গেল আঁখির কোনো খোঁজ আর পাওয়া গেল না।

পুকুর থেকে দুটো কিশোরীর মেয়ের নিখোঁজ হওয়াটা গ্রামের মানুষের কাছে যেমন বিস্ময়কর। তারচেয়ে বিস্ময়কর তিনদিন পর তাদের মাথাবিহীন লাশ পুকুরে ভেসে ওঠা। এখন আরেকটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে আঁখির উধাও হওয়ার মধ্য দিয়ে। এর পেছনে কে বা কী আছে তা কেউই অনুমান পর্যন্ত করতে পারছে না এখন পর্যন্ত। পুকুরে সেদিন শেষ দুপুরে যে ৬জন কিশোরী মেয়ে গোসল করতে নেমেছিল তারা সবাই যে একে একে পুকুর থেকে নিখোঁজ হচ্ছে এই সূত্রটাও কেউ ধরতে পারছিল না। ধরতে পারলে হয়তো তাদের উপর নজরদারি করে এই রহস্যের সামান্য কিনারা হলেও খুঁজে পেত। ৬জন কিশোরীর বাড়িই এই প্রাচীন পুকুরটাকে ঘিরে খানিকটা তফাতে। এরমধ্যেই তাদের তিনজন পুকুরের অজানা আতঙ্কের শিকার হয়েছে। দুজনের লাশ খুঁজে পেলেও আঁখিরটা পাওয়া যায়নি।

এরপর কেটে গেছে ৭ মাস। আফসারপুর গ্রাম এখন আতঙ্কের গ্রাম। প্রাচীন সেই পুকুরের আশেপাশে যাওয়া সবার জন্য নিষিদ্ধ। নুপুর, তুলি, আখি এর পর তাদের বাকি তিন খেলার সঙ্গী আসমা, রেখা, মুক্তাও নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে এক মাস, দেড় মাস বিরতিতে। বলাই যায় তুলি আর আঁখির সংঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে তাদের সাথেও। হয়তো আপন চেহারার রূপ নিয়ে আসা কিছুই ওদের পুকুরে নিয়ে গিয়েছিল গভীর রাতে। কিন্তু গ্রামের মানুষ তার আঁচও করতে পারেনি। নিখোঁজ হওয়ার পর পুলিশ, স্থানীয়রা বাড়ি থেকে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে নিশ্চিত হয়েছে যে মেয়েটা পুকুরের দিকেই গেছে রাতে। খুঁজে পাবে না জেনেও পুকুরে অনুসন্ধান চালানো হয়। গ্রামে গ্রামে খোঁজ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করে থাকে পুকুর থেকে যেকোনো এক অবস্থাতে লাশটা ভেসে উঠবে। কিন্তু দিনের পর দিন চলে যায়। আঁখির পর বাকি তিনজন মেয়েও উধাও হয়ে যায় কিন্তু তাদের লাশ আর কেউ খুঁজে পায় না।

তখন গ্রামের মানুষ এবং পুলিশ একটি সূত্র অনুধাবন করে বিস্মিত হয়ে পড়েন। যে ৬জন সেদিন দুপুরে গোসল করতে নেমেছিল তারাই কেবল এই কয়দিনে নিখোঁজ হয়েছে। গ্রামের অন্য আর কেউ এই আতঙ্কের শিকার হয়নি। তাছাড়া এই ৬জনই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল একে অপরের। সকলেই প্রায় সমান বয়সের। গ্রামের কারো সন্দেহ নেই যে কোনো পিশাচ কিংবা অশুভ শক্তির কাজ এটি। যার বাস ওই পুকুরে। পুলিশের লোকেরা মুখে বলতে না পারলেও হাবভাবে তাদের সাথে একমত প্রকাশ করছেন। কোনো মানুষের পক্ষেই প্রথম দুটো খুন করা অসম্ভব। এটার সমাধান করা যে তাদের পক্ষে সম্ভব না তাও বুঝতে পারছেন।

এর সমাধান করবার জন্য গ্রামের লোকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন তারা ডাকবেন কোনো তান্ত্রিককে। যে এইসব অশুভ শক্তি থেকে বাঁচাতে পারবে তাদের সকলকে। ভেদ করতে পারবে এই হত্যা আর নিখোঁজের রহস্য।দেখা যাক তিনি এই পুকুরে অশুভ কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পায় কিনা! আজকাল এইসব অঞ্চলে জালালুদ্দিন মাতবর নামের একজনের নাম বেশ শোনা যায়। লোকটা নাকি এক প্রকার পিশাচ বিশেষজ্ঞ। তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই এই অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়াই করে কাটিয়েছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেশ কষ্ট করতে হলেও যোগাযোগ করা গেছে।

পুকুরে শেষ যে মেয়েটি মারা গিয়েছে তারপর ২ মাস কেটে গেছে। এরমধ্যে না পাওয়া গেছে শেষ নিখোঁজ হওয়া ৪জন মেয়ের লাশ আর না ঘটেছে নতুন আর কোনো দুর্ঘটনা। আফসারপুরের মানুষ পুরোপুরি আতঙ্কিত হওয়ায় এবং একজন নিযুক্ত চৌকিদার এর পাহারার কারণে প্রাচীন পুকুরটি এখন প্রায় পরিত্যাক্ত। কেউই এদিকে খুব একটা আসে না।

সন্ধ্যার প্রায় কাছাকাছি। চৌকিদার আলম মিয়া পুকুরটার আশেপাশের জায়গা চক্কর দিচ্ছেন। নুপুর আর তুলির লাশ যখন পুকুর থেকে তোলা হয় তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন। পুকুরের যেই দানবটারই কাজটা হোক না কেন ওটার ভয়াবহতা বুঝতে তার বাকি নেই। পরের ৪জন মেয়েও যে দানবটার খাবারের শিকার হয়েছে তা নিয়েও তার মনে সন্দেহ নেই। বাচ্চা ৬টি মেয়ের জন্য তার মন খুবই খারাপ হয়েছিল। আর পিশাচটার জন্য রাগ আর ক্ষোভ।

তারও একটা ১৫ বছরের মেয়ে পুকুরে নেমে সাপের কামড় খায়, এরপর বাড়িতে ছটফট করতে করতে মারা যায় অনেক বছর আগে। সে নিজ থেকেই তাই সুপারিশ করে পুকুরের এই পাহারাদারীর কাজটা নেয়। ৬জনের পর আর একজনকেও নিখোঁজ হতে দেবে না সে। দিন-রাত নজর রাখে পুকুরটার দিকে। কোনো অল্প বয়সী মেয়ে আশেপাশে আসলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। আজ রাতটা চাঁদের রাত হবে। বিকেলের শেষ আলোয় পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন আলম মিয়া। চারদিকে এত গাছ তবুও বাতাস নেই।

হঠাৎ খেয়াল করলেন পুকুরের মাঝখানের এক স্থানের পানি বেশ জোরে কেঁপে পুরো পুকুরে ছড়িয়ে পড়ছে, জায়গাটা থেকে এবার পানির বুদবুদ উঠছে। পুরোই অস্বাভাবিক ঘটনা। পুরো পুকুরের পানিতে ভয়ানক তাণ্ডব শুরু হলো। পানি ফুলে ফুলে উঠছে।পাড়ে পানির ঢেউ আছড়ে পড়ছে। পুকুরের মাঝামাঝি জায়গায় পানি চক্রাকারে ঘুরছে। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। অথচ পুকুর! হঠাৎই শান্ত হয়ে উঠল আবার পানি। পুকুরের পানি ভেদ করে পুকুরের মাঝামাঝি জায়গায় ভেসে উঠল ৪টা মেয়ের লাশ। মাথাবিহীন লাশ! কয়েক মুহূর্ত মাথা ঝিম মেরে রইলো আলম মিয়ার। এরপরই চিৎকার করে ছুটতে লাগলেন গ্রামের দিকে। আফসারপুরকে গিলতে শুরু করলো পুকুরের সেই আতঙ্ক। রাত নেমে আসছি।

রাত ৯টার কিছু বেশি হবে। একটা সি.এন.জি এসে থামলো আফসারপুরের শেষ মাথায়। সি.এন.জির ড্রাইভার তর্ক করছেন দুজন আরোহীর সঙ্গে। ড্রাইভার লোকটা রাগে ফুঁসছে আর বলছে আর ভেতরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। এদিকে কিছুই চেনে না সে। রাতে ফিরতে ঝামেলা হবে তার। সি.এন.জির ভেতরে বসা কিছুটা বয়স্ক যাত্রী বার বার বলছেন আর ১০ মিনিটের পথ কেবল। তিনি চেনেন। এখানে নামিয়ে দিলে হেঁটে যেতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে তাদের। ড্রাইভার কিছুতেই যাবে না। তর্ক থামছেই না। লোকটা ভাবছে, লোক দুটোকে দেখেই পাগল মনে হয়েছিল তার। কেন যে গাড়িতে তুলতে গেল। চেলা-গুরু মনে ওরা। কেমন তান্ত্রিকের মতো গেরুয়া পোশাক পরা অদ্ভুত সাজ-সজ্জার লোক দুজনেই। কথা-বার্তার ধরনও উল্টা-পাল্টা।

যাত্রীর ২য় জন বয়সে কম, লোকটা এবার খেঁকিয়ে উঠল, ‘যা বেটা, নেমে যাচ্ছি। এই নে তোর ভাড়ার টাকা! আমাদের তুই চিনতে পারিসনি, দেখবি কেমন ভূত লেলিয়ে দেই তোর পেছনে! চলেন নেমে যাই ওস্তাদ।’ এমন পরিবেশে এমন কথা শুনে ভয়ে মুষড়ে গেল ড্রাইভার। ফিরতে হলেও দীর্ঘ নির্জন একটা পথ দিয়ে ফিরতে হবে তাকে। ‘নামতে হইবো না, যাইতাছি!’ আর তর্ক না করে এগিয়ে চললো সে সামনের দিকে। মনে মনে বংশ উদ্ধার করে দিচ্ছে দুজন যাত্রীর।

জালালুদ্দিন মাতবর বিরক্ত হয়ে রশিদের দিকে তাকালো। তান্ত্রিকের কাজ হচ্ছে মানুষের মন থেকে ভূত-প্রেত, পিশাচের ভয় দূর করা। রশিদকে এতদিন শেখানো তন্ত্র শিক্ষার কোনই ফল নেই। ও তান্ত্রিক হয়ে উল্টো মানুষকে ভূত লেলিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়! অবশ্য এটা করা ছাড়া ড্রাইভারও আর এগোত কিনা সন্দেহ।

এসব চিন্তার চাইতে বড় চিন্তা তারা যে কারণে আফসারপুরে এসেছেন সেটা। প্রাচীন একটা পুকুরে ৬জন কিশোরী নিখোঁজ হয়েছে গত এক বছরে। সাধারণ কারো কাজ হলে নিশ্চই তাদের ডাকা হতো না। অশুভ শক্তি! কিন্তু একটা প্রাচীন পুকুরে এটা হঠাৎ উদয় হলো কেন! আর কিশোরী বয়সের মেয়েদেরই নিয়ম মেনে নিজের শিকার বানাচ্ছে কেন! ৬জনের ৪জনের লাশ নাকি খুঁজেই পাওয়া যায়নি! গ্রামের দিকে যতই গাড়ি এগোচ্ছে তাদের চোখে ভিড় আর লোকের চঞ্চলতা ধরা পড়লো। আজ আবার কিছু হয়েছে নাকি! ………………………………………………
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.

পুকুরের সেই আতঙ্ক পর্ব-০২

0

#পুকুরের সেই আতঙ্ক
২য় পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

শক্ত হাতটা টেনে নিয়ে যেতে থাকে তুলিকে পুকুরের দিকে। সর্বশক্তি দিয়ে সে চেঁচাচ্ছে আর হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো লাভই হচ্ছে না। একদম পুকুরের পাড়ে নিয়ে এসেছে ওকে নুপুর। আতঙ্কে চোখ মুখ বিকৃত হয়ে এলো তুলির। হচ্ছেটা কী এসব! চিৎকার জুড়ে দিল সে সাহায্যের জন্য। দূর থেকে হৈচৈ এর শব্দ কানে আসছে। তার চেঁচামেচি শুনে ছুটে আসছে গ্রামের লোকেরা। মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল নুপুরের। বলল, ‘চল আমার সাথে তুলি, একসঙ্গে মিলেমিশে খেলবো আমরা।’

তুলি কান্নায় ভেঙে পড়লো। এই মুহূর্তে এই পুকুরের পানির থেকে ভয়ানক কিছু যেন তার কাছে আর নেই। সে জানে এই গভীর রাতে নুপুরের প্রেতাত্মা একবার এই পানিতে তাকে নিয়ে গেলে তার আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই। কেউ এখনো এসে পৌঁছাচ্ছে না কেন! হঠাৎ করেই নুপুরের হাত নরম হয়ে এলো। সে ছেড়ে দিল তুলিকে। একাই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তুলি ভেবেছিল তাকেও পুকুরে ফেলে দেবে সে। কিন্তু নুপুর একা ঝাঁপিয়ে পড়তে কিছুটা অবাক হলো সে। দেখতে দেখতে পানির নিচে তলিয়ে গেল মেয়েটা। স্তম্ভিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো তুলি। ধীরে ধীরে সেখানে ভেসে উঠলো একটা মাথা। কিন্তু নুপুর কোথায়! এমন বীভৎস, ভয়ঙ্কর চোখ আর মুখ এর আগে কখনো দেখেনি সে। চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ওটার তুলির দিকে তাকিয়ে। হিসহিস করে উঠলো ওটা। ওটার মুখ থেকে যেন একটা সাপের মাথা বেরিয়ে এসে আবার ঢুকে গেল ভেতরে। এটা যে ওটার জিহ্বা তা বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো তুলির। হচ্ছেটা কী! ঝাপসা আলোতে পুরোপুরি বোঝা না গেলেও এটা যে কোনো মানুষ নয় এতে তুলির সন্দেহ নেই এখন! ভয়ে কাঁপতে লাগলো তুলি। চিৎকার থেমে গেছে তার অনেক আগেই। এখন শুধু ফোঁপাচ্ছে।

ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁপছে পুকুরের পানি। বীভৎস প্রাণীটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওটার একটা হাত লম্বা হয়ে এগিয়ে আসছে তুলির দিকে পানির নিচ দিয়ে। মুহূর্ত পরেই তুলি অনুভব করলো শক্ত এক জোড়া হাত চেপে ধরেছে তার দুটি পা। আতঙ্কে গলার সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। এক মুহূর্ত শুধু তার চিৎকার ভারী করে ফেলল পরিবেশকে। তারপরেই তীব্র টান অনুভব করলো সে পায়ে। পানিতে পড়ে গেল সে। পুকুরের মাঝামাঝি টেনে নিয়ে গেল হাতটা তাকে। মুখোমুখি হলো সে ভয়ঙ্কর বীভৎস প্রাণীটির। চুকচুক শব্দ বেরিয়ে আসছে ওটার মুখ থেকে। চিৎকার করার শক্তি আর যোগাচ্ছে না শরীর। বড় বড় চোখ করে নিজের মৃত্যু মুহূর্ত অনুভব করতে পারলো কিশোরী মেয়েটি। এই মেরেছিল তার খেলার সাথীকে। সত্যিই নুপুরের কাছে চলে যাবে সে। কিন্তু এই অদ্ভুত দেখতে প্রাণীটি কী তাই শুধু বুঝতে পারলো না!

ওটার মুখ বিশাল হা হয়ে গেল। খপ করে তুলির ধড়ের উপর থেকে মাথাটা ঢুকিয়ে নিল নিজের মুখে। এরপর তুলিকে নিয়ে ডুব দিল পুকুরের গভীরে।

টর্চ,লাঠি, হারিকেন হাতে ৫-৬জন লোক ছুটে চলে এলো পুকুরের পাড়ে। একটা মেয়ের আর্তনাদের শব্দ শুনেই তারা ছুটে এসেছে। তারা পুকুরপাড়ে পৌঁছে শুধু দেখল পুকুরের মাঝামাঝি জায়গা থেকে একটা মেয়ে পুকুরের পানির নিচে তলিয়ে গেল। বুদবুদ উঠছে সেখান থেকে! একি! টর্চের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না কিছু। তবে মনে হচ্ছে ওইটুকু জায়গা কারও রক্তে লাল হয়ে গেল। ভয় পেয়ে গেল সবাই। পুকুরে নামার সাহস হলো না কারও এই রাতে।

দিনের আলো ফুটলে জানা গেল তুলিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকলেই অনুমান করলো রাতে যেই মেয়েটাকে পুকুরে তলিয়ে যেতে দেখেছিল কয়েকজন ওটাই তুলি। কিন্তু এত রাতে মেয়েটা পুকুরে কেন নেমেছিল! যেখানে নুপুরের ভয়ংকর মৃত্যুর পর থেকে দিনের বেলাতেই অনেকে এখানে আসতে সাহস করে না! অনেক লোক একত্রে মিলে তল্লাশি চালায় পুকুরে। পুলিশ খবর পেয়ে আবার ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে অনুমান করে বিশেষ ডুবুরি দল দিয়ে সারা পুকুর তল্লাশি করায়। কিন্তু তুলির কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। আফসারপুর সহ আশেপাশের সব জায়গায় খোঁজ চললো তার।

আফসারপুর গ্রামের মানুষের ভেতর আতঙ্ক বেড়েই চললো। সেই আতঙ্ক মনে গভীর ভাবে গেঁথে ফেলতেই আবার নিখোঁজের তিন দিন পর পুকুরে ভেসে উঠলো মাথাবিহীন একটা কিশোরীর নগ্ন দেহ। অবিকল নুপুরের লাশের মতো পরিণতি ঘটেছে এটার। এটা যে তুলির লাশ তাও বুঝতে অসুবিধা হলো না কারো। গ্রামের সকলকে স্তম্ভিত করে দিল এই দ্বিতীয় অদ্ভুত মৃত্যুটি।

আফসারপুর সহ আশেপাশের সব গ্রামেই পুকুরে এই ভয়ঙ্কর দুটি মৃত্যুর ঘটনা ছড়িয়ে পড়লো। নিত্যদিনের কাজে এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতেই হয় সকলকে। তবুও যাদের পক্ষে সম্ভব হলো গ্রামের প্রাচীন এই পুকুরটিকে ত্যাগ করলো। পুলিশ আর গ্রামের মাতবর শ্রেণীর লোকেরা পড়লো বড় বিপদে। সকলেই এই বিপদের সমাধান চাচ্ছে তাদের কাছে। কিন্তু ঘটনার আগা-মাথা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না তাদেরও।

এরপর পেরিয়ে গেল প্রায় মাস খানেক। পুকুরটাতে এরমধ্যে আর কেউ নিখোঁজ হয়নি। একদিন। গ্রামে গভীর রাত। সেদিন শেষ দুপুরে যে ৬জন কিশোরী পুকুরে গোসল করতে নেমেছিল তাদের আরেকজন আঁখি। এখনো ঠিকমতো রাতে ঘুমাতে পারে না সে। চোখ মুদলেই ভেসে ওঠে নুপুর আর তুলির মাথাবিহীন শরীর দুটো। কী ভয়ঙ্কর অনুভূতি জাগে সারা মনে। ভাবে কেন যে সেদিন পুকুরে গোসল করতে নেমেছিল তারা! আর বড়দের নিষেধ শর্তেও কেন লাশ দুটো লুকিয়ে দেখতে গিয়েছিল!

একটা ঘরেই বাবা-মার সাথে ঘুমায় সে। তার জন্য আলাদা বিছানা রয়েছে। আজও ঘুমিয়ে রয়েছে সে। তার গভীর ঘুম ভেঙে গেল ফিসফিস একটা ডাক শুনে, ‘আখি, এই আখি, এত ঘুমাইস কেন? উঠ বেটি!’ কন্ঠটা আঁখির পরিচিত। সে চমকে উঠে চোখ মেললো। টিনশেড ঘরের খোলা জানলায় গিয়ে চোখ আটকে গেল তার। জোৎস্নার আলোয় তুলির মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুচকি মুচকি হাসছে মেয়েটা। তুলি আবার বলল, ‘বাইরে আয় আঁখি, তোর সাথে কথা আছে, দেখ, আমার সাথে কে আসছে। জানালার একদিকে সামান্য সরে গেল সে। তারপাশে উদয় হলো আরেকটা মাথা। নুপুর! মিষ্টি হাসি লেগে আছে নুপুরের মুখেও। আঁখিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কিরে, এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি আমাদের, আমরা একসাথে কত খেলা করেছি, কত ঘুরেছি, আর আজ কতদিন দেখা হয় না। বাইরে আয়না হতচ্ছাড়া! আমাদের সাথে চল।’

আঁখি বিভ্রান্ত হয়ে বিছানায় উঠে চোখ ডলতে লাগলো। কী দেখছে সে! বাবা-মার দিকে তাকিয়ে দেখল দুজনেই ঘুমিয়ে আছে। আবার জানলার দিকে তাকালো। নুপুর আর তুলি দুজন হাসিহাসি মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেল জানলার দিকে। যতই সামনে এগোচ্ছে অজানা একটা আতঙ্কে তার বুকের ধকপকানি বেড়েই চলেছে। একেবারে জানলার কাছে চলে এলো আঁখি। মুহূর্তেই উড়ে গেল নুপুর আর তুলির মুখের মিষ্টি হাসি। একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে ক্রুর হাসি হাসলো তারা। ভয় পেয়ে গেল সে। এতক্ষণ যেন সে ঘুমের ঘোরে ছিল। হঠাৎ অনুধাবন করতে পারলো নুপুর আর তুলি তো মারা গেছে অনেকদিন আগে। তারা এতরাতে এখানে কী করে আসবে!

কৌতূহলতায় জানলার দিকে আরেকটু ঝুঁকে গেল সে। পিছিয়ে গেল তুলি আর নুপুরের মাথা। একি! শরীর কোথায় ওদের! দুটো কাঁটা মাথা এখন জানালার ওপাশে তার মুখোমুখি। গলার নিচ থেকে শরীরের নিচের অংশ অদৃশ্য ওদের। খিলখিল করে হেসে উঠলো ওরা। আতঙ্কে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললে আঁখি। কণ্ঠের সব শক্তি খরচ করে চিৎকার জুড়ে দিল সে।

বাবা-মা ধড়ফড় করে উঠে তার কাছে চলে এলো। ভয়ে তোতলাচ্ছে আঁখি আর ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে জানলার বাইরে দেখাচ্ছে। কিন্তু ওখানে এখন কিছুই নেই। আঁখির কথাগুলোকে গুরুত্বের সাথে নিল না তার বাবা-মা। বলল, সপ্ন দেখেছে সে। দোয়া-দরুদ পড়ে ভরসা দিল তাকে। এত বাস্তব ছিল সব কিছু কী করে এটা স্বপ্ন হয়! সেও কী মারা যাবে তাদের মতো। ভয়ে মুষড়ে পড়লো সে।

এরপর কেটে গেল কয়েকদিন। রাতে ঘুমিয়ে আছে আঁখি। তার শরীরে কারও ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ মেলেই দেখল একটা মুখ তার মুখের উপর ঝুকে রয়েছে। তার মা! সে বিছানায় উঠে বসলো। মা বলল, ‘চল আঁখি, তোকে একটা জিনিস দেখাই, আয় আমার সাথে বাইরে।’ এই বলেই আঁখির মা ঘরের বাইরে চলে গেলেন। ঘরে আর কেউ নেই। বাবা কোথায় গেল! খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই মনে হলো, এখনো রাত। বিভ্রান্ত হয়ে সে বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। হ্যা, রাতইতো! চাঁদের আলোয় যদিও পরিবেশ তেমন ঝাপসা নয়। ঐতো বাবা আর মা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোথায় যাচ্ছেন তারা! একে অপরের দিকে তাকিয়ে এমন মুচকি মুচকি হাসছেন কেন! হাত ইশারা করে তারা দুজন আঁখিকে ডাকলেন। বিস্মিত হয়ে তাদের অনুসরণ করে চললো সে।

সে যতই দ্রুত হাঁটছে ততই তার বাবা-মা এর চলার গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছুতেই ধরতে পারছে না তাদের। অনেক ডাকার পরেও পেছনে ফিরে তাকাচ্ছেন না তারা। তুলির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি! একটা সময় পর আঁখি বিস্মিত হয়ে অনুধাবন করল, সে আর তার বাবা-মা সেই ভয়ঙ্কর প্রাচীন পুকুরের কাছাকাছি চলে এসেছে যেখানে নিখোঁজ হয়েছিল তার দুই সাথী। পুকুরের একদম পাড় ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা-মা। সে ভয়ে ভয়ে ডাকতে লাগলো তাদের।

একি! চমকে উঠতে হলো তাকে। ওখানে বাবা-মা কই! তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তুলি আর নুপুর। ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। পুকুরের মাঝামাঝি কী একটা যেন ভেসে উঠলো। চুক চুক একটা শব্দ ভেসে আসছে তার কানে। ……………………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.

পুকুরের সেই আতঙ্ক পর্ব-০১

0

#পুকুরের সেই আতঙ্ক
১ম পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

শেষ দুপুরে আফসারপুর গ্রামের খুব পুরাতন এই পুকুরে গোসল করতে নেমেছে ৬জন কিশোরী মেয়ে। সবার সঙ্গে হৈচৈ করে গোসল করছে নুপুর। হঠাৎ সে অনুভব করলো পানির নিচ থেকে একটা শক্ত হাত চেপে ধরলো তার পা। সে আতঙ্কে নিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখল তার সাথীদের সবার মাথাই উপরে। তাদের কেউ দুষ্টমি করছে না তার সাথে। শক্ত হাতটা তার পা টেনে তাকে পানির নিচে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অন্য কেউ কী আগে থেকে পানিতে ডুব দিয়েছিল তাদের ভয় দেখানোর জন্য! হাতটার চাপ হঠাৎ খুব বেড়ে গেল। একটানে তার সালোয়ার খুলে নিল ওটা। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। পাশের সাথীরা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালো। এক মুহূর্তের জন্য শুধু নুপুরের আতঙ্কে ভরা মুখটা দেখতে পেল সবাই। এরপরেই তলিয়ে গেল সে পানির নিচে।

সকলে আতঙ্কে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল। আশেপাশের লোকেরা ছুটে এলো। পুরো দিন ভরে সারা পুকুরে খোঁজ করা হলো মেয়েটাকে। কিন্তু তার বিন্দুমাত্র চিহ্নও খুঁজে পাওয়া গেল না । গ্রামের সকলের ভেতর সৃষ্টি হলো অদ্ভুত এক ভয়। এই পুকুর খুব প্রাচীন হলেও এমন দিনে-দুপুরে পুকুর থেকে একটা মেয়ের নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটার মতো ঘটনা এর আগে কখনোই ঘটতে শুনেনি কেউ। প্রায় তিন দিন কেটে গেল। নুপুরের পরিবার এবং খেলার সাথীরা তার শোকে প্রায় পাগল হয়ে এলো। এক সকালে পুকুরে চাল ধুতে এসে আসমা নামের এক মহিলা আবিস্কার করে মাথা বিহীন একটা মেয়ের নগ্ন লাশ ভেসে রয়েছে পুকুরের মাঝ বরাবর। ভয়ে চিৎকার শুরু করলে অনেক মানুষ চলে আসে সেখানে। এটা যে নুপুরের লাশ তা মাথা না দেখেও কারো বুঝতে আর বাকি থাকে না। কিন্তু কে মারলো এমন বীভৎস ভাবে মেয়েটাকে! কেউই কিছু বুঝতে পারছে না।

পুলিশ এমন বীভৎস মৃত্যুর খবর পেয়ে হাজির হলো সেদিনই। লোক দিয়ে পুকুর থেকে তুলে নিয়ে যায় নুপুরের মাথা বিহীন লাশটা ময়নাতদন্তের জন্য। নুপুরের পুরো শরীর রক্তশূন্য অবস্থায় পায় তারা। কিছু একটা যেন কিশোরী মেয়েটার মাথা দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিড়ে ফেলেছে, ধারালো দাঁতের চিহ্ন পাওয়া গেল ধড় থেকে মাথা যেখানে ছিড়ে গেছে সেই কাটা অংশে। এরপর কেউ যেন শুষে নিয়েছে মেয়েটার শরীরের সব রক্ত। কিন্তু কী ওটা! কোনো মানুষের কাজ যে এটা নয় ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। এই পুকুরে কুমির থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া তন্নতন্ন করে খুঁজেও যেখানে পুকুরে মেয়েটার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি সেখানে তিন দিন পর কী করে লাশটা ভেসে উঠল! এমন শত প্রশ্ন মনে জাগলেও কোনো উত্তর পেল না কেউ। পুলিশের উপস্থিতিতে সপ্তাহ খানেক পর গ্রামের গোরস্থানে দাফন করা হয় মেয়েটার লাশ।

এরপর কেটে গেল কয়েক সপ্তাহ। গ্রামের অনেকেই সেই প্রাচীন পুকুরটিকে ত্যাগ করলো। বিশেষ করে কম বয়সী মেয়েরা।

তুলি তার ছোট ভাইয়ের সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়ে রয়েছে রোজকার মতো। হঠাৎ চকিটা কেঁপে উঠতেই তার ঘুম ভেঙে গেল। গাঢ় অন্ধকারে মৃদু করে জ্বেলে রাখা হারিকেনটা ঝাপসা আলো দিচ্ছে। সেই আলোতে সে ছোট ভাইয়ের দিকে পাশ ফিরে শুতে গিয়েই চমকে উঠল। তার ছোট ভাই নেই। তার জায়গায় শুয়ে আছে অন্য একটা মেয়ে। তার মুখোমুখি হয়ে সেই মুখটা বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটাকে চিনতে পেরে শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠল তার। নুপুর! কিন্তু! নুপুর একটু হেসে বলল, কিরে তুলি, কেমন আছিস? তুলি পুরো শরীরে ভয়ানক শিহরণ অনুভব করলো। নুপুর তো মারা গেছে সেদিন। সে কী ভুল দেখছে! তার ভাই কোথায়! ভয়ে ভয়ে সে নুপুরের শরীরের একটু নিচের দিকে তাকাতেই দেখল কাঁধ থেকে নুপুরের শরীরের নিচের অংশটি নেই। তার সাথে শুয়ে আছে নুপুরের কাটা মাথা। যাতে কিনা প্রাণ আছে! সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। ধড়ফড় করে বিছানা থেকে নেমে গেল। ঘুরে সোজা হলো কাটা মাথাটা। করুণ দৃষ্টিতে তাকালো তুলির দিকে, অবিকল নুপুরের কণ্ঠে বেরিয়ে এলো, ‘খুব কষ্টে আছিরে তুলি, তুই কেন সেদিন আমাদের গোসল করাতে নিয়ে গেলি! এবার বাঁচা আমাকে! একা আর আমার ভালো লাগে না!’

চেচাতে চেচাতে ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তুলি। বাবা-মা ছুটে এলেন। কিন্তু তারা ঘরে বড় বাতি জ্বেলে তুলির ছোট ভাই ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেলেন না। তুলিকে বোঝাতে লাগলেন, এটা কেবল একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। কিন্তু অজানা এক আতংক অনুভব করে তুলি। তার বিশ্বাস এটা কিছুতেই স্বপ্ন হতে পারে না! ভোর পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় তার ঘুম হলো না।

সেদিন পার হলো। নেমে এলো রাত। ভাইকে নিয়ে এক বিছানায় ঘুমিয়ে রয়েছে তুলি। মাঝরাতে খট করে দরজা খুলে যাওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো সে। পাশে ছোট ভাই নেই। দেখল তার ছোট ভাই দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে হাঁটছে যেন ও। দ্রুত চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে সে বুঝলো এখন গভীর রাত। তার ছোট ভাইয়েরতো ঘুমের ভেতর হাঁটার অভ্যাস নেই! এত রাতে তাকে না ডেকে একা একা কোথায় যাচ্ছে! আৎকে উঠে বিছানা থেকে ভাইকে ডাকতে লাগলো তুলি, পেছন থেকে। ভাই বোধ হয় কিছুই শুনলো না। দ্রুত ঘর থেকে বের হলো সে, অবাক হয়ে দেখল এত কম সময়ে অনেকটা দূর চলে গেছে ভাই। ঝাপসা আলোয় ভাইকে ডাকতে ডাকতে তার পিছু নিল তুলি। যতই দ্রুত ছুটছে সে ভাই যেন আরও দূরে চলে যাচ্ছে। নাগাল পাচ্ছে না সে কিছুতেই।

প্রায় ১৫ মিনিট সে ঝাপসা আলোতে মনে আতংক আর ভয় নিয়ে ভাইকে অনুসরণ করে চললো। এত জোরে সে ডাকছে যে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এতক্ষণে তন্দ্রা জেরে পেছনে ঘুরে তাকাতো। আর এত ক্ষিপ্র গতিতে হাঁটছে কী করে ছেলেটা! হঠাৎ খেয়াল করলো সে , হাঁটতে হাঁটতে সেই প্রাচীন পুকুরের কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। ভয়ে সমস্ত শরীর আরেকবার মোচড় দিয়ে উঠল তার। নুপুরের লাশ সেদিন দেখার পর থেকে আর এদিকে আসেনি সে। তাছাড়া গত রাতের সেই ঘটনাটা! তার ভাই একদম পুকুরের পাড়ে চলে গিয়েছে। কেঁদে ফেলল তুলি। ‘ভাই আর যাসনে, ফিরে আয়!’ সে আর এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

হঠাৎ পুকুরের পাড় থেকে একটা মেয়ের হাসির শব্দ যেন ভেসে এলো। আচমকাই খেয়াল করলো তুলি, পুকুরের পাড়ে তার ভাই নয় , একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওই হাসছে। নুপুর! পরনে সেই ডুবে যাওয়ার দিনের জামা। তার ভাই কোথায় গেল! ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে। নুপুর ঘুরে তাকালো তুলির দিকে। তুলি চিৎকার করে উল্টো ঘুরে দৌড় দেয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো। কিন্তু! এত দ্রুত কিছু চলতে পারে! এক মুহূর্তে তার মুখোমুখি চলে এলো নুপুর। শক্ত করে চেপে ধরলো তার হাত, বলল, ‘কিরে তুলি, আমাকে ভয় পাস কেন তুই? এই পুকুরে কত গোসল করেছি আমরা এক সাথে, এখন আমাকে একা করতে হয়। আয় আমার সাথে। দেখবি কত মজা হয়!’

শক্ত হাতটা টেনে নিয়ে যেতে থাকে তুলিকে পুকুরের দিকে। সর্বশক্তি দিয়ে সে চেঁচাচ্ছে আর হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো লাভই হচ্ছে না। একদম পুকুরের পাড়ে নিয়ে এসেছে ওকে নুপুর। আতঙ্কে চোখ মুখ বিকৃত হয়ে এলো তুলির। হচ্ছেটা কী এসব! চিৎকার জুড়ে দিল সে সাহায্যের জন্য। দূর থেকে হৈচৈ এর শব্দ কানে আসছে। তার চেঁচামেচি শুনে ছুটে আসছে গ্রামের লোকেরা। মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল নুপুরের। বলল, ‘চল আমার সাথে তুলি, একসঙ্গে মিলেমিশে খেলবো আমরা।’……………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.

গল্পটা তুমিময় পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0

#গল্পটা_তুমিময়💕
#পর্বসংখ্যা_৪ (শেষ পর্ব)
#মৌরিন_আহমেদ

বিয়ের কয়েক দিন পরেই সূর্য নামক মানুষটা হাত ধরে ইউকের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালাম আমি। বাবা-মা, পরিবার-পরিজন সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে এসে পড়লাম অজানা, অচেনা এক রাজ্যে! যেখানকার মানুষগুলো আমার অপরিচিত, এমনকি স্বজাতীয় নয়! কী যে কষ্ট হয়েছিল মানিয়ে নিতে!

চলে আসার দিনও অভিমানে কথা বলতে চাই নি বাবা-মায়ের সাথে। বাবা কাছে ডেকে বলেছিলেন,

— “আমি জানি এই বিয়েটার জন্য তুমি আমাদের উপর রাগ করে আছো। বিয়েটা মন থেকে মানতে পারো নি। তারপরও আমি বলবো বিয়েটা মেনে নাও। তুমি আর সূর্য দুজন দুজনকে ছোটবেলা থেকে চেন। একজন আরেকজনের সম্পর্কে অনেককিছুই জানো। তোমার বিয়েটা যদি আমি অন্য কোথাও দিতাম তুমি তখন এতোটা স্বাভাবিক থাকতে পারতে না যতটা এখন আছ। আমার ধারণা আমি বিয়েটা দিয়ে অবশ্যই ভুল করি নি। সেটা তুমি আজ না স্বীকার করলেও একদিন করবে। সেটা সময়ের অপেক্ষা।.. আমি সবসময় দোয়া করবো তোমাদের সুখের জন্য। ভালো থেকো।”

এখানকার স্থানীয় কারও সাথে কথা বলতে হলে ইংরেজির আশ্রয় নিতে হতো, যার সাথেই কথা বলি, যেটাই বলি, সব ইংরেজীতে! আমার প্রিয় বাংলার ঠাঁই নেই কোত্থাও! এখানে এসে এই ভাষার কষ্টটা অনুধাবন করলাম খুব! বুঝলাম, মাতৃভাষার মর্যাদা ঠিক কতখানি! তাই এখানে এসে পারতপক্ষে বাইরের কারো সাথে কথাই বলতাম না আমি। সারাদিন চুপচাপ, একলা, একলা হয়ে থাকতাম।

আমি স্বভাবতই ঘরকুনো। চিরজীবন ঘরে বসে থেকে উপন্যাসের পাতায় মুখ গুঁজে দেয়া সেই আমিটাও এই সুদূর প্রবাসে বই পড়তে ভুলে গেলাম। সারাদিন অ্যাপার্টমেন্টে নিজের ব্যক্তিগত রুমের জানালায় মাথা এলিয়ে বসে থাকি। এদিকে বাংলা উপন্যাসেরও খোঁজ খুব একটা নেই। আসার সময় লাগেজ ভর্তি করে যতগুলো বই এনেছি, সেগুলোই সম্বল। পড়তে হলে ইংরেজি নোভেল পড়তে হয়! কী যে খারাপ লাগে না আমার!

তবে অবাক কর বিষয় হলো, আমাকে এই দেশে আনার পর আমার প্রতি ব্যবহার বদলে গেল সূর্যের। যেই ছেলেটা আমাকে সবসময় বিরক্ত করতো, কারণে-অকারণে খোঁচাতো, সেই ছেলেটাই হুট করে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। সারাদিন কারও সাথে কথা না বলতে পেরে, যে খারাপটা আমার লাগতো সেগুলো মেটানোর জন্যই তার সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। কখন সে আসবে, কখন কিছু বলবে, আমি প্রতি উত্তর করবো! কিন্তু সে যেন কোনো কিছুতেই কোনো কথা বলতো না! আগের যে মিষ্টি মিষ্টি ঝগড়া গুলো করতাম, চুল টা:না-টা:নি মা:রা-মা:রি করতাম, সেগুলোর কিছুই আর হতো না। সে ব্যস্ততার দোহাই দেখাতো, না কি আমাকে শা’স্তি দেবার চেষ্টা করতো জানি না!

একসময় অতিষ্ট হয়ে উঠলাম আমি। একদিন রাতে চরম একটা ঝগড়া করার প্রস্তুতি নিয়ে জেগে রইলাম অনেকক্ষণ। রাত বারোটার দিকে সূর্য এলেন। আমাকে এতরাতে জেগে থাকতে দেখে খানিক চমকালেন। আমি সাধারণত এতরাত জাগি না। সাড়ে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে যাই। তাই সে রাত করে এলে দেখা হওয়ার সুযোগও থাকে না। কিন্তু তারপরও যেন কিছুই বললেন না। চুপচাপ ফ্রেশ হতে চলে গেলেন।

আমাকে উপেক্ষা করছে দেখে রাগে গা জ্বলে উঠলো আমার। উনি বেরোতেই তড়াক করে সামনে দাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

— “সমস্যা কী আপনার?”

— “মানে?” ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে।

— “মানে হলো আপনার সমস্যা কী? কী চাইছেন কী আপনি? কেন এমন করছেন?” রাগে চিৎকার করে উঠলাম আমি।

— “কী করছি আমি? আশ্চর্য!.. পাঁচফোড়ন ক্লিয়ার করে বল্ তো একচুয়ালি তুই কি বলতে চাইছিস?”

‘পাঁচফোড়ন’ এই নামটা যেন বহুদিন পর শুনলাম। অদ্ভুত ভাবে আজ এটা শুনে রাগ হলো না। পরিচিত কিছুর সংস্পর্শে এসে মন যেন অজানা আনন্দে আনন্দিত হলো। তবুও ক্ষেপে উঠে বললাম,

— “ন্যাকা! যেন কিচ্ছুটি বোঝে না।.. দেখুন, আমার সঙ্গে আলগা ঢং দেখাবেন না। যা বলার ক্লিয়ারলি বলবেন।.. বলেন আপনার সমস্যাটা কি? কেন আপনি আমার সাথে কথা বলেন না? কেন একই অ্যাপার্টমেন্টে থেকেও আমরা দুই জন দুই গ্রহের প্রাণীর মতো বিচ্ছিন্ন? বলেন, কেন? কেন? কেন?”

কথা বলতে বলতে কখন যে তার শার্টের কলার চেপে ধরেছি সে হুশ নেই। সে বোধ হয় হঠাৎ এমন আচরণ দেখে অবাকই হলো। ভ্রূ কুঁচকে বললো,

— “তুই কি কখনো আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলি? যে আমি বলবো?”

— “না, বলি নি!.. প্রত্যেকটা দিন আপনার সাথে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকি আমি, অপেক্ষায় থাকি কখন আসবেন। আর আপনি? আসেন তো মেলা রাত করে! কথাও বলেন না!”

অভিমানে গলা ধরে আসতে লাগলো আমার। হুট করে কোত্থেকে যে এই আবেগ নামক বস্তুটা চলে এলো কে জানে! মনকে সামাল দিতে না পেরে অভিমানে জলকণা কপোল বেয়ে ঝরলো। কান্নায় গাল ভিজিয়ে, নাক টেনে সরে এলাম সামন থেকে। যে ভয়ঙ্কর ঝগড়া করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম সব নশ্চাত হয়ে গেছে! যে ভাবে কান্নার বেগ বাড়ছে তাতে আর কিছুক্ষণ এর সামনে থাকলেই হেঁচকি উঠে যাবে আমার! ছোট বেলা থেকেই নিজের অশ্রু আর আবেগ, এই দুটো নিয়ন্ত্রনে আমি খুব অপটু। একবার কোনো কারণে কান্না শুরু হলে থামতেই চায় না!

আমি ক্রমাগত রোদন থামানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বাঁ হাতে চোখ মুছে হাঁটা ধরেছি রুমের দিকে। এখন আর পেছনে ফিরবো না আমি! একটুও না!

রুমে ঢুকেই ‘ঠাস’ করে দরজা লাগিয়ে দিলাম আমি। না, সিটকিনি লাগাই নি। সে অভ্যাস নেই। ফলোস্রুতিতে দরজাটা ‘দুম’ করে শব্দ করে আবারো ফিরে এলো। কান্না থেমে গিয়ে রাগ উঠলো খুব! আবারো জোরে ধাক্কা মারতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো! দরজাটা না লেগে, উল্টো ‘ক্যাচ’ ‘ক্যাচ’ করতে করতে ফিরে এলো। মাথার ভেতর ক্রোধের অনল তখন দাউ দাউ করছে! ইচ্ছে করছে, এই দরজাটা খুলে আছার মেরে ভেঙে ফেলি! কিন্তু দরজা না ভেঙে সিটকিনি লাগিয়ে দিলেই যে ঝামেলা শেষ হয়ে যায় সে বুদ্ধি তখন আর নেই!

পরপর দু’ বার শব্দ শুনে সূর্য বললেন,

— “দরজাটা ভাঙতে চাচ্ছিস নাকি! এমন করে বারি দিচ্ছিস কেন?

— “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ! ভেঙে ফেলবো আমি! ভেঙে ফেলবো এই দরজা, এই অ্যাপার্টমেন্ট, এই বিল্ডিং, অ্যান্ড আপনাকে! ভেঙে চুরমার করে দেব!”

বলেই দরজার উপর আরও একটা বারি দিয়ে চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মেজাজ খারাপ খুব, গায়ে আগুন জ্বলছে যেন! সারা শরীরে রাগ চিড়বিড় করে উঠছে। সূর্য নামের ফালতু ছেলেটাকে তুলে আছার মারতে মন চাইছে। সব এর ষ’ড়’য’ন্ত্র! ইচ্ছে করে বিয়ে করে এখানে এনে ফেলেছে আমাকে! যেন তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে মা:রা যাই আমি! নিজে কথা বলবে না, আবার কথা বলতে চাইলে ঢং করবে!

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল অনেকটা সময়। আমি নিশ্চুপ হয়ে বিছানার সাথে ল্যাপটে আছি। ঘুম ধরা দেয় নি চোখের পাতায়। তাই নিরব-নিস্তব্ধ-নিঝুম-নিশুতি রাতের আঁধারে অক্ষিগোলকের মনিটা সারা ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। খানিক্ষণ পর পর পাশ বদলাচ্ছি, তবুও অবস্থার পরিবর্তন নেই। একসময় ক্লান্ত হয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলাম। চিৎ হয়ে শুয়ে মনে মনে ফিবোনাক্কি সংখ্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। এটা একটা ঘুম আনার টেকনিক। মনে মনে কোনো সংখ্যা নিয়ে হিসেব কষতে শুরু করলে খুব দ্রুতই মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে আসে। অবসাদ নেমে আসে শরীরে আর মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। আর ম্যাথে একটু কাঁচা বলে ম্যাথ সংক্রান্ত যেকোনো কিছু ভাবলেই আমার ঘুম পায়। কিন্তু আজকে আমার দ্বারা সেটাও সম্ভব হলো না। একের পর এক ট্রিক পাল্টাচ্ছি, এটা ছেড়ে ওটা, ওটা ছেড়ে আরেকটা, কিন্তু ঘুম ধরা দিচ্ছে না!

হঠাৎ অনুভব করলাম অন্ধকারের ভেতরে নিঃশব্দে কে যেন ঘরে ঢুকছে আমার। এতো রাতে ঘরে কে ঢুকতে পারে সেটা ভেবেই শিউরে উঠলাম আমি! এই দমবন্ধ ফ্ল্যাটে কখনো চোর জাতীয় লোকের অনুপ্রবেশ ঘটা সম্ভব নয়, আসলে সূর্যই আসবেন। কিন্তু সে কখনোই এ ঘরে পা ফেলবে না। কারণ এই বাসায় এভাবেই আমরা থাকি দুই জন দুই দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে। তার রুমের আশেপাশে আমি যাই না আর আমার রুমের আশেপাশে সে আসে না! তাহলে আজ হঠাৎ?

হুট করেই খুব ভয় পেয়ে গেলাম। মোটামুটি ভীরু স্বভাবের মেয়ে আমি, তাই এই মুহূর্তে এমনই যেন ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। সূর্য ভাই এগিয়ে এসে আমার বিছানার কাছে হাঁটু মুড়ে বসলেন।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না। ভয়ে চুপে করে শুয়ে থাকলাম। সে কিছু না বলে হঠাৎ করেই আমার খুব কাছে চলে এলো। হাতের আলতো ছোঁয়ায় ছুঁয়ে দিতে লাগলো আমার মুখশ্রী। খুব সংগোপনে একটা ঢোক গিলে ফেললাম। কী করতে চাইছে কী সে? হুট করেই আরেকটা কান্ড করলো সে। মুখের কাছে মুখ নামিয়ে এনে টুপ করে চুমু এঁকে দিলো ললাটে। আমি এবার সত্যিই কেঁপে উঠলাম। অন্ধকারে ব্যাপারটা তার দৃষ্টিগোচর হলো কী না জানি না তবে সে মুচকি হাসলো বুঝতে পারলাম। হাসির মৃদু একটা শব্দ কানে এসে বাজলো আমার।

সে আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে আমার লম্বা লম্বা চুলগুলো নিয়ে এলোমেলো করতে লাগলো। চুল এনে মুখের উপর দিয়ে আবার সরিয়ে নিয়ে শুরু করলো খেলা। এবার সত্যিই বিরক্ত হলাম।। করছে কী এ? সমস্যা কি? জ্বীন-টিন কিছু ধরছে নাকি? আজব!

তুমুল বিরক্তি নিয়েই ঘুমিয়ে গেলাম। সে তারপর কখন ঘর থেকে চলে গেছে জানি না।
____________________________

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি পুরো অ্যাপার্টমেন্ট ফাঁকা। সূর্য অনেক আগেই অফিসে চলে গেছে। এলোমেলো মন নিয়ে হেলতে দুলতে নাস্তা সারলাম। রুমে গিয়ে বসেছি হঠাৎ কাল রাতের কথা মনে পড়লো। সূর্য কাল রাতে সত্যি সত্যিই অদ্ভুত ব্যবহার করেছিল! যেটা সে আগে কখনো করে নি!

কী যেন ভেবে বিছানা থেকে নামলাম। ধীর পায়ে হেঁটে তার ঘরের সামনে এলাম। দরজাটা আলগা করে বন্ধ করে রাখা। সে ঘরে না থাকলেও এটা এভাবেই থাকে। আমি কখনোই তার ঘরের আশেপাশে আসি না, ঢোকা তো দূর!

আলতো হাতে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের ভেতর পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ ম ম করছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমার মস্তিষ্কে একটা কথাই ঘুরলো,

“এই ছেলে কি গোসল করে না? এতো পারফিউম ব্যবহার করে কেন? আজব। আমি মেয়ে হয়ে পারফিউম ইউজ করি না আর সে! যত্তোসব ঢং! পারফিউমের সৌরভে সুরভিত ঘরে বেশিক্ষণ থাকলে আমার পাগল পাগল লাগবে। মাতাল হয়ে যাবো! বাপ রে!”

বিছানার ওপর পড়ে আছে একটা ডায়েরী। বালিশের পাশে যত্নে রাখা। আমি কৌতূহলী হয়ে ডাইরিটা হাতে নিলাম। কালো রঙের একটা ডায়েরী। কাভার পেজ উল্টাতেই ভেসে উঠলো সূর্যের লেখা,

” তুমি আমার অব্যক্ত অনুভূতি, মৌপাখি!”
নীচে তার সিগনেচার।

আমি অবাক হয়ে পৃষ্ঠা উল্টালাম। একটার পর একটা পৃষ্ঠা। লেখায় লেখায় পূর্ন সেসব।

— “তুই এতো কেন জেদি, মৌপাখি? এতো জেদ আর এতো কেন রাগ তোর? তোর এই রাগেই যে আমার সর্বনাশ হয়েছে, জানিস তুই? সেই ছোট্টবেলা থেকে তোর এই রাগ আর জেদ দেখে দেখে আমি দূর্বল হয়েছি তোর প্রতি। তুই জানিস, তোর অভ্যাস, তোর ঝগড়াটে আচরণ, প্রতিবাদী ভাবনা, রাগে লাল হওয়া মুখ, ঠোঁটের কোণের দুষ্টুমি হাসি, আনন্দে উচ্ছ্বসিত হওয়া চেহারা আমাকে কতটা টানে?

তুই জানিস, আমি কেন তোকে এতো জ্বালাই? কেন এত চোখে চোখে রাখি? কারণ আমি তোকে ভালোবাসি। যখন বুঝতে শিখেছি ‘ভালোবাসা’ কি তখন থেকেই আমি তোকে ভালোবাসি। কিন্তু কোনোদিন বলি নি। আমি চাই নি তোর অবুঝ বয়সেই তোকে আমার ভালোবাসার শিকল পড়িয়ে বন্দী করে ফেলতে। তোকে ছেড়েছি তোর মতো করে। যেন কোনো ভূল করে না ফেলিস তাই সবসময় তোকে নজরে নজরে রাখতাম। ভেবেছিলাম কোন একটা সময় এসে তোকে আমার মনের কথা বলবো।

কিন্তু আমার ভালোবাসার কথা জানানোর আগেই তুই বদলে গেলি, সম্পর্কগুলো বদলে গেল। তুই আগের থেকেও বেশী রাগী, একগুঁয়ে আর জেদি হয়ে উঠলি। উচ্ছৃংখল হয়ে উঠলি। তোকে শাসন করলাম, তুই শোষণ ভেবে নিয়ে দূরে সরে গেলি আমার। জানিস, তখন তোর ওই অবহেলাটা আমার জন্য কতটা যন্ত্রনাময় হয়ে উঠেছিল? কতোটা পোড়াতো তোর ঘৃণাটা? আমি জানতাম তোর দোষ ছিল না কিন্তু তোকে ভালোবাসতাম বলেই তোর দ্বারা কোনো ভুল হয়ে যাক সেটা চাই নি। মিথ্যে বলে আটকে ফেলেছিলাম তোকে। সময় বদলালো, সম্পর্কটাও আগের মতো হয়ে উঠলো।

আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলাম তোকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেয়ার জন্য। সারপ্রাইজ প্ল্যানিং করলাম, কিন্তু মাঝখান থেকে কোত্থেকে যেন উদয় হলো অর্ণবের। সেদিন তোর ভার্সিটিতে যেতেই কানে আসলো তোদের প্রেম কাহিনী! রাগে শরীর জ্বলে উঠলো। আমার ভালোবাসা কেন আমার না হয়ে অন্য কারো হবে? তোকে ডেকে সাবধান করলাম। অর্ণবকে বেনামি চিঠি দিলাম। তোরা যেন পাত্তাই দিলি না! রাগে আরও বেশি ক্ষেপে গেলাম। সেদিন হকিস্টিক নিয়ে গেছিলাম অর্ণবকে সামান্য ভয় দেখাতে। ব্যাটার সাহস বোধ হয় একটু বেশিই ছিল! তোর মতোই ঘাড় ত্যাড়া জাতের! সোজা কথার উল্টা মিনিং করলো। ক্ষেপে-টেপে গিয়ে দিলাম ঠ্যাংয়ের উপর একটা বারি! কে জানতো তাতে ওর পা ভেঙে যাবে? পা তো ভাঙলো, সাথে সাথে ছেলের সাহসও গেল হারিয়ে। ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে বললো,

— “সরি ভাই! মাফ করে দেন!”

তখন ওর মুখ দেখে কী যে হাসি পেয়েছিল আমার! যে ছেলে একটু আগে এত বড় বড় কথা বললো, তোকে কখনোই ছাড়বে না বললো, সেই ছেলে শুধু হকিস্টিকের একটা বারি, জাস্ট একটা বারি খেয়ে পল্টি খেল? পাঁচফোড়ন তুই আমাকে পল্টিবাজ বলিস, কিন্তু তোর সেই প্রেমিক পুরুষ যে কি পল্টিবাজ সেটা আমিই বুঝেছিলাম! হা হা হা!

এরপর ভাবলাম তোকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। কিন্তু কীভাবে করবো ভেবে পেলাম না। এরমধ্যে বাড়িতে তুই বিয়ের বায়না লাগিয়ে দিয়েছিস। একে তোর উপর মেজাজ খারাপ, তার উপর..

তখন আমি কি করতাম বল্ তো? তাই রাগে জেদে বিয়েটা করেই ফেললাম। আমার বাড়িসহ তোর বাড়ির সবাইকে বললাম আমরা প্রেম করছি। আমাদের বাসায় এই নিয়ে কোনো কথা হলো না। সবাই বিশ্বাস করে নিলো। কিন্তু বিশ্বাস করলো না আন্টি! আমি তাকে যতটা বোকা ভেবেছিলাম সে কিন্তু আদৌ বোকা নয়! সবসময় তোর নামে নালিশ করলে সে নির্দ্বিধায় সব বিশ্বাস করতো কিন্তু এখানে এসেই করলো না!

আন্টি ঠিক বুঝেছিল আমার মিথ্যেটা। আমাকে একলা ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল ঘটনাটা। আমি বাধ্য হয়েই সবটা স্বীকার করেছি। সাথে একটা মিথ্যেও! বলেছি অর্ণব নামে একটা বাজে ছেলের সাথে তোর দীর্ঘদিনের রিলেশন। তোর যদি এখনই বিয়ে না দেয় তাহলে বড় রকমের অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারিস! শত হোক, মেয়ের মা বলে কথা! যতোই বুদ্ধিমতী হোক, আন্টিও এ ব্যাপারটার ভয়ে শঙ্কিত ছিলেন। তাই আর কথা বাড়ান নি। আমার সাথেই তোর বিয়েটা হয়ে গেল।

আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস। তুই আমাকে না বললেও আমি জানি। অথচ তুই? ভাঙবি তবু মচকাবি না। তোর মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনবো বলে তোকে এতো দিন ধরে এমন ঘরবন্দী করে রেখেছিলাম। আটকে রেখেছিলাম আমার কাছে। ইচ্ছে করেই তোর সাথে কথা বলি নি। কষ্ট দিয়েছি। ভেবেছিলাম তাতে অন্তত তোর পরিবর্তন হবে। স্বেচ্ছায় কাছে আসবি তুই। অথচ তুই? একা একা থেকেছিস, গুমরে গুমরে থেকেছিস কিন্তু তবুও তুই আমার কাছে আসিস নি। আজ এতদিন পর যখন সেই পুরোনো রূপে ফিরে গেলি আমি ভাবলাম আমার এতোদিনের সাধনা বোধ হয় সত্যিই হলো। বরাবরের মতো এবারও আমি ব্যর্থ। আমি জানি আমি খুব খারাপ, মৌপাখি! খুবই খারাপ। সেজন তুই আমাকে সহ্য করতে পারিস না। কিন্তু তারপরও তুই আমাকে ভালোবাসিস তাই না? তাহলে কি ক্ষতি হয় সেই কথাটা মুখে স্বীকার করলে? কী হয় তোর একটু নরম হলে? কী হয় আমাকে একটু ভালোবাসলে? কী এমন ক্ষতি হয় তোর?

যদি ভালোবাসা পাই
আবার শুধরে নেব
জীবনের ভুলগুলি

যদি ভালোবাসা পাই
ব্যাপক দীর্ঘপথে
তুলে নেব ঝোলাঝুলি।

যদি ভালোবাসা পাই
শীতের রাতের শেষে
মখমল দিন পাবো।

যদি ভালোবাসা পাই
পাহাড় ডিঙাবো আর
সমুদ্র সাঁতরাবো।

যদি ভালোবাসা পাই
আমার আকাশ হবে
দ্রুত শরতের নীল।

যদি ভালোবাসা পাই
জীবনে আমিও পাব
মধ্য- অন্তমিল।

যদি ভালোবাসা পাই
আবার শুধরে নেব
জীবনের ভুলগুলি।

যদি ভালোবাসা পাই
শিল্পদীর্ঘপথে
বয়ে যাবো কাঁথাগুলি… ”

[ কবিতা: যদি ভালোবাসা পাই__ রফিক আজাদ]

ডায়েরীটা পড়ে থমকে গেলাম। এসব কী লিখেছে সে? এসব আসলেই সত্যি? সূর্য সত্যি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে? এমন চরম সত্যটা জেনে সত্যিই চমকে গেলাম। ডায়েরীটা আগের জায়গায় রেখে শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।

তব্দা মেরে বসে রইলাম অনেক্ষণ। বাকিটা সময় কীভাবে কেটে গেল জানি না। নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া করলাম। আমার সারাটা জীবনের হিসেব করে দেখলাম সেখানে সূর্য ভাইয়ের জায়গাটা ঠিক কোথায়! আমার প্রত্যেকটা গল্পেই সে মিশে আছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে। কখনো বকেছে, কখনো মেরেছে। শাসন করেছে। ভালো কি বেসেছে? কেয়ার নিয়েছে, যদিও সেটা ধমকের আড়ালে! কিন্তু নিয়েছে তো?

এখন আমার কী করা উচিত? সবটা মেনে নেয়া? আচ্ছা, আমিও কি তাকে ভালোবাসি না? এই যে এই নিস্তব্ধ একাকী সময়গুলো আমি একা একা বসে কাটাই তখন আমি কার কথা ভাবি? সূর্যের কথাই নয় কী? আগের দুষ্টু-মিষ্টি ঝগড়াটে সম্পর্কটাকে মিস করি না আমি? চাই না যে সম্পর্কগুলো আবার আগের মতো হোক? একশো বার চাই! কারণটা কী? আমি কি তবে তাকে ভালোবাসি?

দুপুর হয়ে এলো। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। বৃষ্টি হবে নিশ্চয়!

সূর্য ফিরে এলো আজ খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু আমার আশেপাশেও এলো না। অবশ্য সে কখনোই আসে না। যাই হোক, তাকে আসতে দেখে কেমন উতলা হয়ে উঠলো মন। গোসল সেরে সুন্দর একটা শাড়ী পড়লাম। চোখে কাজল দিলাম। ব্যালকনি থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজলাম।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি সেজেগুজে তার ঘরের দরজায় এসে দাড়ালাম। ঘর ফাঁকা, সে এখানে নেই। আমি দৌড়ে গিয়ে ব্যালকনিতে দাড়ালাম। এটাকে ঠিক ব্যালকনি বলা যায় না, মিনি ছাদের মতো অনেকটা। অর্ধেকটার ছাদ আছে অর্ধেকটা খোলা মেলা। কাঁচের রেলিং দিয়ে ঘিরে রাখা ব্যালকনি। একসাইডে কয়েকটা ট্রেডস্ক্যান্টিয়া (tradescantia), ওয়াক্স বেগোনিয়া (wax begonia), নীল রঙের মর্নিং গ্লোরি (morning glory) গাছ লাগানো। খুব সুন্দর গোছানো একটা ব্যালকনি। মানুষটার মতোই পরিপাটি, নির্মল, সুন্দর!

সূর্য উল্টো ঘুরে দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। সে নিশ্চুপ, নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার আকাশপানে। হাত দুটো প্রসারিত করে ব্যালকনির রেলিংয়ে রাখা। আমি ছুটে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। সে অবাক হলো, চমকালো। আমি পাত্তা দিলাম না। দু’ হাতে তার বলিষ্ঠ শরীরটা আকঁড়ে ধরে পিঠে মুখ গুঁজে দিয়ে বললাম,

— “ভালোবাসি!”

সূর্য এক ঝটকায় পেছনে ফিরে তাকালো। আমার দিকে তাকাতেই নিজের অজান্তেই চোখের কোণা দিয়ে বয়ে গেল অশ্রুজল! সে অবিশ্বাসে অস্পষ্ট স্বরে বললো,

— “কি বললি?”

— “ভালোবাসি!”

বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। জানি না কেন কাঁদছি। তবুও কাঁদতে ভালোলাগছে। সে খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে হঠাৎই জড়িয়ে ধরলো আমায়। কারো আদুরে ছোঁয়া পেয়ে আরও বেশি আহ্লাদে কান্না পেল আমার। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বললাম,

— “আপনি মহা পল্টিবাজ সূর্য ভাই, মহা পল্টিবাজ! অ’স’ভ্য, অ’ত্যা’চা’রী, ব্রিটিশ! আপনি জেনে বুঝে এতদিন ধরে আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। আপনার নামে আমি মামলা দিবো। জেলে দেব আপনাকে!..”

আমার কঠিন হুঁশিয়ারি শুনে সে হাসলো। হেসে আমার নাক টেনে দিয়ে বললো,

— “ঠিক আছে, দিস। আপত্তি নেই। তবে জেলে পাঠালে বরের সাথে তার বৌকেও পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করিস! নয় তো বৌ পাগলা বর আবার বৌয়ের টানে হাজত থেকে পালাবে! ”

বলেই হাসতে লাগলো সে। আমি লাজুক হেসে তার বুকের উপর মাথা এলিয়ে দিলাম। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছি দুজনে। সে খেয়াল নেই। মৃদু গলায় বললাম,

— “আপনি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন?”

— “জানি না। হয় তো হ্যাঁ।”

— কেন বাসেন?”

— “তুমিময় গল্পগুলোতে ‘তুমি’কে ভালো না বাসলে সেটা গল্প হয় না। আমার গল্পটা যে পুরোটাই তুমিময়। তুমিময় আসক্তি, তুমিময় ঝগড়া, তুমিময় ভালোবাসা, তুমিময় প্রেম। গল্পটাই যখন তুমিময় তখন সেই ‘তুমি’কে ভালো না বেসে থাকা যায়? তাই আমি এই ‘তুমি’কে ভালোবাসি!”

প্রেমিকের কাব্যিক কথা আমার কোনোকালেই ভালো লাগতো না। কিন্তু আজ লাগলো। ভয়ঙ্কর ভাবে মন ছুঁয়ে গেল তার কথা! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কারণটা অবশ্য জানা নেই। সম্ভবত প্রেমের হাওয়া লাগলে সবারই এমন হয়!

এমন মুগ্ধময় পরিস্থিতিতে একটা ভয়ঙ্কর কান্ড করে বসলাম। টুপ করে চুমু খেয়ে বসলাম তার গালে। সে স্তম্ভিত চাহনিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,

— “তুই আজকেও ব্রাশ করিস নি, পাঁচফোড়ন? ছিঃ! হাউ নোংরা!”

আমি চমকালাম। এই রোমান্টিক ওয়েদারে, এই রোমান্টিক মুড টাইমেও কেউ এমন কথা বলতে পারে আমি জানতাম না! দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললাম,

— “ইয়ে মানে.. আপনাকে জ্বীনে-টিনে ধরলো নাকি সেই টেনশনে ব্রাশ করতে ভুলে গেছি! হি হি। সরি!”

— ” তুই আমাকে ব্রাশ না করেই চুমু খেয়ে ফেললি? ছিঃ!.. তোর সরির আমি খেতা পুরি! দুপুর হয়ে যাচ্ছে এখনো ব্রাশ করে নি, গ্যাদরা কোথাকার! যা ব্রাশ করে আয়!.. ছিঃ ছিঃ! আমার ভাবতেই বমি পাচ্ছে। ওয়াক ওয়াক!”

রাগে মুখ লাল হয়ে উঠলো। সামান্য একটা ব্রাশ না করে চুমুর জন্য এতো কথা? তোকে আর জীবনেও চুমু খেলে বলিস! যত্তোসব ফাউল! কোথায় খুশি হয়ে আরেকটা চুমু দিবে তা না। ন্যাকার ষষ্ঠী!

— “কি হলো? এখনো যাচ্ছিস না কেন?.. ইসস তোর মুখের গন্ধে আমার বমি বমি পাচ্ছে। প্রেগনেন্ট মহিলা লাগছে নিজেকে। এই যা বলছি, যা!”

ভয়ঙ্কর রাগ নিয়ে ধুপধাপ পায়ে হেঁটে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ব্যা’টা ব’দ! ব্রাশ খোঁজার জন্য ওয়াসরুমে যাচ্ছি তখন শুনলাম সে চেঁচাচ্ছে,

— “ইয়ে, মানে.. পাঁচফোড়ন! শোন একটা কথা.. ব্রাশ করে আমার ঘরে আসিস তো! একটা চুমু খাবো। আমি তো তোর মতো নোংরা না, ব্রাশ করা আছে। আসিস প্লীজ!..”

কী সাবলীল তার ভঙ্গি! তবুও খোঁচা মারা। কিন্তু কথাটা কি ছিলো? ভাবতেই লজ্জা লাগলো আমার। ইসস! এতো কেন লজ্জা লাগছে আমার? আড়ষ্ট হয়ে এগিয়েছি তখন আবারো শুনতে পেলাম,

— “না আসলে কিন্তু তোর খবর আছে বলে দিলাম। কান ধরে লন্ডনের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখবো! বি কেয়ারফুল!”

ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি! লজ্জায় দৌড়ে গিয়ে ঢুকলাম ওয়াসরুমে। আমি আর তার সামনে যাবো না। একদমই না। তাতে যদি লন্ডনের রাস্তায় কান ধরে দাঁড় হতে হয় তো হবো। তবুও ওর সামনে যাবো না।…

অতঃপর? অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল! প্রেমে প্রেমে পূর্ন হইয়া উঠিল তাহাদের আলয়! প্রিয়জনের ভালোবাসায় সিক্ত হইয়া কাটিয়া গেল তাহাদের বাকি জীবন!

———- সমাপ্ত ———–

গল্পটা তুমিময় পর্ব-০৩

0

#গল্পটা_তুমিময়💕
#পর্বসংখ্যা_৩
#মৌরিন_আহমেদ

বর্তমানে সূর্য ভাইয়ের সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি আমি। অবস্থান তার ঘরে। সে তখন থেকেই আমাকে ঝেড়ে যাচ্ছে! চলছে রিমান্ড! আমি মাথা নিচু করে তার ঝাড়ি শুনছি। ইচ্ছে করছে কানে তুলা দিয়ে বসে থাকি। কিন্তু আশেপাশে তুলা নেই। আচ্ছা, সূর্য ভাইকে বলবো না কি, “একটু তুলা বা টিস্যু দেন? কানে গুঁজতাম আর কি…”

না, থাক! আবার এটা বলতে গিয়ে কী কান্ড করবে কে জানে! এমনিতেই একটু আগে দাবাং একটা থাপ্পড় দিয়ে আমার গালটার জিওগ্রাফি বদলে ফেলেছে! ভয়ঙ্কর জ্বালা করলেও মুখ দিয়ে টু শব্দ করার পারমিশন নেই! সে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে,

— “তোর এত সাহস হয় কী করে? বিয়ে করতে চাস না ভালো কথা, পালাতে গিয়েছিলি কোন সাহসে? একবার ভেবেছিলি তুই পালিয়ে গেলে আন্টি-আংকেলের কী হতো? তোর বাপ যে হাইপার টেনশনে রোগী সেটা তো আমার থেকে তুইই ভালো জানিস! তারপরও.. তারপরও কেমন করে.. তোর যে কমন সেন্স কম জানতাম, কিন্তু একেবারেই নেই সেটা জানতাম না।.. আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না তুই এমন কিছু করতে যাচ্ছিলি! ধারণা করেছিলাম এমনটা করতে পারিস কিন্তু তাই বলে সত্যি সত্যিই!… তুই মানুষ হইলি না! উফ্!

— “আমি তো মানুষই সূর্য ভাই! না তে কী গ’রু-ছা’গ’ল?”

মিনমিন করে বললাম। যেন তা তার কান অবধি না পৌঁছায়। সে থামছে না। তার মতো করে ঝাড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছে! মেইল ট্রেনের গতিতে ছুটছে তার বকা-ঝকা। বলছে,

— “তুই কি ভেবেছিস পালিয়ে গেলেই সব মিটে গেল? তুই আমার হাত থেকে বেঁচে গেলি? জ্বি না! এত্ত সোজা না! বিয়েটা তোকে আমাকেই করতে হবে। হবে মানে হবেই! আর পালিয়ে গিয়েছিলি সেই শাস্তিও তুই পাবি। সময় মতোই দিবো। যাই হোক, এখন আর কথা বাড়াতে চাইছি না। বাসায় যা। আমি আন্টি-আঙ্কেলকে এখনো বলি নি তুই পালিয়ে যাচ্ছিলি। এটা জানলে তারা কষ্ট পাবেন। তাই বলছি ভদ্র মেয়ের মতো বাড়ি যাবি। এই হিয়া!..”

দরজার ওপাশে দাড়িয়ে ছিল হিয়া। সূর্য ভাইয়ের ডাক শুনে ভেতরে ঢুকে নম্র হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

— “জ্বি, ভাইয়া বলেন।”

— “তোমার এই পাবনা ফেরৎ পাগলী বান্ধবীকে বাসায় নিয়ে যাও। ও যে পালিয়ে গিয়েছিল সেটা কাউকে বলো না। পরে আমি জানাবো সবাইকে। আপাদত শুধু দেখ, নতুন করে কোনো আকাম যেন না করতে পারে! তেনার মাথার আবার অনেক বুদ্ধি তো!.. অবশ্য মাথায় না, বুদ্ধি সব হাঁটুর নিচে!..”

শেষ কথাটা তাচ্ছিল্য করেই বললো। আমি মনে মনে ক্ষেপে গেলেও কিছু বললাম না। এখন কিছু বলা মানেই আমার অপর গালেরও হাড্ডি চ্যাপটা করে ফেলা! দরকার নাই আর চ’ড়-থা’প্প’ড় খাওয়ার! আপাদত বাড়ি যাই। গিয়ে হিয়ার ক্লাস যদি না নিয়েছি তো!..

তারপর আর কোনো কথা না বলেই বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলাম।

আসলে তখন গলির মোড়ে হিয়ার সাথেই দেখা হয়েছিল আমার। তখন এতবার করে কল দিলাম ফোন বন্ধ অথচ ও কি না আমার বাসাতেই আসছিল। কেন আসছিল? সূর্য মারফৎ সেও খবর পেয়েছে আমার বিয়ে! তাই খুশির ঠেলায় নাচতে নাচতে বান্ধবীর বিয়ে খেতে আসছিল।

আমি যখন ওকে দেখেও না দেখার ভান ধরে রিকশায় উঠছি তখন হঠাৎ দৌড়ে এলো ও। হন্তদন্ত হয়ে বললো,

— “মৌরি, কোথায় যাচ্ছিস তুই? আজ না তোর বিয়ে?”

আমি মোটামুটি অবাক হয়েছিলাম। কারণ যে বোরকা টা পরেছি সেটা বর্তমান হাল ফ্যাশনের নয়। বলা চলে আদিম কালের আদিম ট্রেন্ডের। এমন পুরোনো আমলের বোরকা সাধারণত থুত্থুড়ি বুড়িরাই পরে! যাই হোক, এমন বোরকা পরনে, নাক-মুখ-চোখ ঢাকা। তবুও ও আমাকে চিনলো ক্যামনে? তারপর আবার বিয়ের বুলিও আওড়াচ্ছে! চিন্তায় পড়ে গেলেও কথা ঘুরিয়ে বললাম,

— “ইয়ে.. আপনার বোধ হয় কোথাও ভুল হচ্ছে…”

— “মিথ্যা বলছিস কেন? তুই কি ভাবছিস তোর কণ্ঠ আমি চিনি না? নাক দিয়ে কথা বললেই কি তোর কণ্ঠ চেঞ্জ হয়ে যাবে?”

ভ্রু কুঁচকালো হিয়া। আমি পাত্তা না দিয়ে রিকশায় চড়ে মামাকে বললাম,

— “মামা, চলেন।”

কিন্তু মামা প্যাডেল ঘুরানোর আগেই হিয়া হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাকে রিকশা থেকে নামালো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

— “তুই বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছিস! ছি মৌরি, ছি! বিয়ের দিন কেউ বাসা থেকে পালায়? তুই চলে গেলে কি হবে ভেবে দেখেছিস? ছিঃ ছিঃ! তুই এমন কাজ করবি আমি চিন্তাও করি নি। আমার সাথে চল্ এক্ষুণি!”

এবার আর ভনিতা করলাম না। হিয়ার সাথে চালবাজি করে লাভ নেই। এই মেয়ের শরীরের গিঁটে গিঁটে বুদ্ধি! ঠিক ঠিক, আমাকে দেখার সাথে সাথেই আসল কাহিনী বুঝে ফেলেছে! তাই নরম গলায় বললাম,

— “তুই আমার সিচুয়েশনটা জানিস না, হিয়া! আমি এই বিয়েটায় রাজী নই। এই বিয়ে করলে আমার লাইফটা হেল হয়ে যাবে। প্লীজ আমাকে যেতে দে! দেখ, আমি কিন্তু পালিয়ে যাচ্ছি না। শুধু দু’ তিন দিনের জন্য মামার বাড়ি যাচ্ছি। বাসার সবার মাথা থেকে বিয়ের ভুত নামলেই আমি কাম ব্যাক করবো!”

কিন্তু হিয়া আমার কথা শুনলো না। সে শুনলো ভুট্টো সাহেবের আই মিন সূর্য ভাইয়ের কথা। সূর্য ভাই তাকে বলেছিল আমার উপর নজর রাখতে। তাই সে তাড়াতাড়ি করে আমার বাসায় আসছিল। পথেই দেখেছে আমি পালানোর পাঁয়তারা করছি অমনই ‘কপ’ করে ধরে ফেলেছে! তারপর বহুত ঝাড়ি-ঝুড়ি মেরে, জ্ঞানের পসরা সাজিয়ে, কোরবানির গরুর মত করে টেনে হিঁচড়ে হাজির করেছে সূর্য ভাইয়ের সামনে!

আমার বন্ধু মহলে হিয়া হলো সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে। নিজের সম্পর্কে তার ধারনা হলো সে খুব লয়াল! তার উপর কেউ কোনো দায়িত্ত্ব দিলে সে সেটা জান দিয়ে পালন করার ট্রাই করে। আর আজ ওর লয়ালিটির জন্য ধরা খেয়ে গেলাম আমি! এই মুহূর্তে কান ধরে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘বান্ধবী বানাইলে হাঁদা টাইপের বানাবো, গাধা, হ্যাবলা দেখে, কিন্তু তোর মতো লয়াল ফ্রেন্ড আমার লাগবো না! তোর লয়ালিটির চক্করে আমার জীবনডা শ্যাষ!”– যাই হোক, এগুলো পাগলের প্রলাপ। আমি এখনো পাগল হই নি আর বিয়েও এখনো হয় নি। সো সময় আছে। এর মধ্যে কিছু একটা করতে হবে!

বাসায় ঢোকার পর আমাকে দেখে মা অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো কোথায় গিয়েছিলাম কিন্তু মনের দুঃখে সে কথার জবাব দিলাম না। রাগে গজগজ করতে করতে রুমের দিকে ছুটলাম। হিয়া মাকে কি বলেছে আমি জানি না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই হিয়ার বাবা-মা, নিরা আর ওর ফ্যামিলিও চলে আসলো। নিরা আসতেই হিয়া রসিয়ে রসিয়ে বলতে শুরু করলো আমার পালিয়ে যাওয়ার কাহিনী। ক্যামনে পালালাম, ক্যামনে সে আমাকে ধরলো! লাইক– আমি একটা কোরবানির গরু। হাঁট থেকে কিনে নিয়ে যাওয়ার সময় পালাচ্ছিলাম, আর অমনই হিয়া এসে বীর পালোয়ান হয়ে ধরে ফেলেছে!

সেইসব গল্প শুনে নিরা তো হেসেই খুন। দুজনে মিলে কানের কাছে বসে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে। তাদের হাসি তাদের প্রেমিকের দৃষ্টিতে খুবই সুন্দর। খিলখিল করে হাসে তারা। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের অসম্ভব সুন্দর হাসিও আমার কাছে হাঁসের প্যাক প্যাক মনে হচ্ছে। এরা এভাবে হাসছে কেন? আজব!

হাসি থামিয়ে নিরা বললো,

— “আহারে আমাদের মৌরি বেচারি! বিয়ের দিনে বরের হাতে দাবাং চড় খেয়ে গাল আর কপালে বারি লাগিয়ে কপাল ফাটিয়ে ফেলেছে! বিয়ের পিঁড়িতে বসে ফাটা কপাল নিয়ে সে বলবে, ‘কবুল!’ আহারে! কী দুঃখ!”

— “ঠিক বলেছিস। দেখ না, কপালটা ফেটে দু’ ভাগ হয়ে গেছে! বেচারি!”

— “আহা গো, সোনা গো আমার!”

দুজনে আবারো সেই খ্যাঁক খ্যাঁক মার্কা হাসিতে মেতে উঠলো। রাগে দুঃখে আমার তখন সাধ জাগছে আমার প্রাণ প্রিয় দুই বান্ধবীর গ:লা টি:পে দেই! হা:রা:মী কোথাকার!

রাগে ফেটে যখন হনহন করে নিজের ঘরে ঢুকতে এসেছি তখন অসাবধানতা বশত দরজার সাথে তুমুল একটা বারি খেয়ে কপালটা ফেটে গেছে! কপাল থেকে রক্ত ঝরছে! মুহুর্তেই ফুলে একাকার! ভয়ঙ্কর রাগে তখন আমার মুখ রক্তিম হয়ে উঠেছে। পেছন থেকে সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে হিয়ার হাসি আর কে দেখে! পাগলির মতো হা হা, হো হো, হি হি করেই যাচ্ছে। তারপরই এলো নিরা। আর শুরু হলো এদের বকবকানি!

কাঁদো কাঁদো মুখ করে বসে আছি আর হিয়া কপালে ব্যান্ডেজ করছে। নিরা শাড়ী গবেষণায় ব্যস্ত। তখনই ঘরে অনুপ্রবেশ ঘটলো আমার জেঠাতো বোনের, ফিহাপু। পেছন পেছন তার প্রেমিক, আমার মামাতো ভাই রুদ্র। এরা দুজনেই সূর্য ভাইয়ের ব্যাচ মেট। আমাকে বসে থাকতে রুদ্র ভাইয়া দেখেই বললো,

— “কি রে, বিয়ের কনে! কী অবস্থা! কপাল ফাঁটলো কীভাবে?”

— “বাথরুমে উষ্ঠা খেয়েছিলাম।”

নির্বিকার হয়ে মিথ্যেটা বলে দিলাম। ফিহাপু হেসে বললো,

— “দুনিয়াতে আর জায়গা পেলি না? বাথরুমে গিয়ে হোঁচট খেলি? হা হা হা!”

এই যে আরেকটা ভুল করে বসলাম। মিথ্যে বলতে গিয়ে এমন মিথ্যে বললাম যে এখন হাসির পাত্র হয়ে উঠতে হচ্ছে! আহা রে! এই দুঃখ আমি কই রাখি!

তারপর চললো ওদের হাসি-ঠাট্টা। আমি লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখলাম। একটা কথাও বলতে পারলাম না। এরা আমাকে এমন ভাবে ঘিরে ধরে রাখলো আমি আর পালানোর কোনো রাস্তাই খুঁজে পেলাম না! বিশেষ করে নিরা আর হিয়া তো চিপকু গামের মতো করে চিপকে রইলো সারাটা সময়! বিয়ের ভারী বেনারসি আর গয়না পরে ওয়াসরুমে যাচ্ছি তখনও হিয়া সন্দেহের চোখে বললো,

— “ওয়াশরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে আবার পালাবি না তো?”

মানে কি ভাই? আমারে কি তোদের এতোই ব;ল:দ মনে হয়? অবশেষে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম। কাজী এসে যখন কবুল বলতে বললো, তখন ভাবছিলাম বলবো কি বলবো না। একদিকে বাবা-মায়ের সম্মান, অন্য দিকে আমার সারাটা জীবন! ঠিক ওইসময়ে নিরা কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

— “সূর্য ভাই বলেছেন, তুই কবুল না বললে উনি বরের আসর থেকে উঠে এসে তোকে একটা চড় মারবে!”

সূর্যের চামচা! সূর্যের শা:লী! রাগে দুঃখে গড়গড় করে বললাম,

— “কবুল, কবুল, কবুল!”

ব্যস! বিয়েটা হয়েই গেল!
_____________________

বাড়ির ছাদে সূর্যের একটা চিলেকোঠার ঘর আছে। সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছি এই ঘরটায় সে থাকে। বাসার ভেতরে একটা রুম থাকলেও সে এই ঘরটায় অধিকাংশ সময় কাটায়। কিন্তু কোনদিন এই ঘরটায় সে আমাকে ঢুকতে দেয় নি। ইগোষ্টিক পাবলিক কী না তাই!

কিন্তু আজকে এই ঘরেই সাজিয়েছে সে বাসর! বা:স:র? আজকে এই বাসর রাতে তোর অবস্থা আমি এমন করবো না তুই টের টা পাবি, মৌরি কী চিজ! মনে মনে শ:য়:তা:নি হাসি দিয়ে দুধের গ্লাসটা বেড সাইড টেবিলের উপর রাখলাম। আজকে হবে মজা! হা হা হা।

সূর্য ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটা বাঁশের বেত। সেটা দেখেই আমি আঁতকে উঠলাম! সর্বনাশ! এই ছেলের হাতে এই জিনিস কেন? মারবে না কী? শেষ পর্যন্ত বাসর রাতে বরের হাতে মা:ই:র? সারাজীবনে কী কম পিটানো পিটাইছে? আজকেও মারবে? সকালেও তো থা:প্প:ড় দিলো! মা গো মা! এই জন্যই বলছিলাম ‘আমি বিয়া করতাম না।’ কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না।

আতঙ্কে শিউরে উঠলাম যেন। ভ্যাবলা কান্ত হাসি দিয়ে বললাম,

— “সূর্য ভাই, হাতে বেত নিয়েছেন কেন? নৈশ বিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়েছিলেন না কি?”

— “যাই নি তবে যাবো এখন। তোর ক্লাস নিবো।”

— “বাসর রাতে কী স্বামী স্ত্রীর ক্লাস নেয়, ভাই? এইটা কোনো কথা?” মেকি হাসি দিলাম।

— “বা:স:র রাত? বাহ্! ভুতের মুখে রাম নাম। ওপস! সরি, পেত্নীর মুখে রাম নাম? ঘটনা কি রে?”

বলেই হঠাৎ কাছে এগিয়ে এলো আমার। আমি ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে বুকে থুথু ছিটালাম। ঢোক গিলে বললাম,

— “এমন করে আগাচ্ছেন কেন, হ্যাঁ? সমস্যা কী আপনার?”

— “তেমন কিছু না। সমস্যা শুধু আমার বৌকে নিয়ে। সে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল কী না..”

‘খাইছে আমারে! এই পোলায় দেখি সেই কথা এখনো মনে রাখছে! এখন তাহলে কি উপায়?’ ভীত মুখে তার দিকে তাকাতেই দেখলাম মুচকি মুচকি হাসছে। এই হাসির মানে আমি জানি। মানে হলো আমার কপালে দুঃখ আছে! বহুত দুঃখ!

একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বললাম,

— “ইয়ে.. সূর্য ভাই.. আসলে হয়েছিল কী.. তখন না আমি..”

— “আগে ভাই ডাকা বন্ধ কর!”

বাঘের মতো গলা। যদিও আমি বাঘের গলায় কোনোদিন হুংকার ছেড়ে কথা বলতে শুনি নি। তবুও এই গলাকে বাঘের কণ্ঠই বলা যায়! বুকে সাহস যুগিয়ে বললাম,

— “ভাই ডাকবো না তো কি জান ডাকবো? ঠিক আছে, আপনি মা:ই:র না দিলে তাই ডাকবো।.. আসলে তখন না আমি.. ইয়ে মানে.. তখন শ্যাম্পু কিনতে গিয়েছিলাম। বুঝেনই তো, জীবনে একবার বিয়ে করবো। চুলে শ্যাম্পু না দিলে হয়? তাই আর কি.. তখন ভয়ে বলতে পারি নাই। হে হে হে..”

— “তা শ্যাম্পু কিনতে রিকশায় চড়ে কই যাচ্ছিলি তুই? কোন রেয়ার শ্যাম্পু ইউজ করিস তুই যে মোড়ের দোকানে সেটা পাওয়া যায় না?..”

সূর্য ভাই ঠিকই বলে। আই অ্যাম আ ডাফার! একটা মানানসই মিথ্যেও যদি বলতে পারতাম। উফ্! দুঃখের ঠেলায় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলাম,

— “আপনি আমাকে মারবেন, সূর্য ভাই? বাসর রাতে বৌ পিটাবেন?.. ”

তারপর হঠাৎ কি যেন মনে হতেই বললাম,

–“ঠিক আছে, মারেন। সমস্যা নাই। বিয়ে তো হয়ে গেছে। তো.. কাল সকালেই আমি কোতোয়ালি থানায় মামলা দিবো। বলবো আপনি নারী নি:র্যা:তন করেন। বৌ পি:টা:ন। তখন যদি পুলিশ আপনার কোমড়ে দড়ি বেঁধে থানায় না নিয়ে যায় তো..”

— “আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস?”

— “ভয় না। যা সত্যি তাই বলছি। মে:রেই দেখেন না কেন? এতোদিন মা’র কাছে বিচার দিয়েছি, লাভ হয় নি। এখন সরকারের কাছে বিচার দিবো। দেখে নিয়েন!”

— “হাঁসের মতো এত প্যাক প্যাক করিস না তো, পাঁচফোড়ন! যা বলছি তাই কর। কান ধরে একশো বার উঠবস কর। নে ফটাফট শুরু কর!”

— “সূর্য ভাই!” করুন সুরে ডাকলাম।

— “ভাই ডাকা বন্ধ করতে বলেছি!”

কি করি, কি করি, করতে করতে হঠাৎ দুধের গ্লাসটার কথা মনে হলো। সুর বদলে, রোম্যান্টিক রোম্যান্টিক মুড নিয়ে এক পা দু পা এগোলাম। সে ততক্ষণে বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রোল করতে ব্যস্ত হয়ে গেছে! আমি এগিয়ে যেতেই বললো,

— “কি রে, শুরু কর?”

আমি পাত্তা দিলাম না। রোম্যান্টিক ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ালাম। সে ফোন রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমি কিছু না বলে পাঞ্জাবির কলারে আঁকিবুঁকি শুরু করলাম। দুষ্টু হেসে বললাম,

— “আজকের রাতে কি কান ধরাটা মানায়? বলেন তো? আজ রাতে তো…”

— “আজ রাতে কী করে?..”

— “কি করে, সেটা পরে বলছি। আগে এটা খান তো!”

বলেই টেবিল থেকে গ্লাসটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিলাম। সে সন্দিহান চোখে চেয়ে বললো,

— “এত্তো সোহাগ?”

— “এখানে সোহাগের কি দেখলেন আপনি? আমাকে এটা দিতে বলেছে দেখেই তো দিলাম। তাছাড়াও আপনি খুব ক্লান্ত। এই সময় এই দুধটা খেলে আপনার ভালো লাগবে। বিয়ের জন্য কতো পরিশ্রম গেছে না?.. নিন, ধরুন।”

— “এটা কে দিয়েছে?”

— “আমার শাশুড়ি আম্মা!”

— “আম্মু দিয়েছে? তাহলে ঠিক আছে। খাওয়া যায়। কিন্তু তোর হাত দিয়ে? তাহলে অসম্ভব!”

গ্লাসটায় ঠোঁট ছুঁইয়েও শেষ পর্যন্ত খেল না। হুট করে আমাকে টেনে ধরে বললো,

— “আমি তো ক্লান্ত নই পাঁচফোড়ন! ক্লান্ত তো তুই। আফটার অল বিয়ের দিনে পালিয়েছিলি, আবার জোর করে ধরে এনেছি। সাজগোজ করেছিস। যত ধকল সব তো তোর উপর দিয়ে গেছে! এই নে এটা তুই খা!”

বলেই আমার মুখ টিপে ধরে খাইয়ে দেয়ার প্রয়াস চালালো। আমি ছিটকে সরে গিয়ে বললাম,

— “নাহ্! আমি খাবো না। আপনি জানেন না, আমি ওইসব খাই না।..”

সে সন্দিহান চোখে তাকাতেই বললাম,
— ” না মানে আমার বমি পায়। হি হি.. আপনিই খান না?”

— “আরে খা তো! একদিন খেলে কিছু হয় না। এদিকে আয়, কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছি। আয়, আয়!..”

— “এই না!”

আমি দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেই আমাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ধরে ফেললো সে। হাত দুটো পেছনে মুড়ে ধরে বললো,

— “আমি তো তোকে খাওয়াবোই পাঁচফোড়ন! হা কর.. তাড়াতাড়ি!”

খুব জোড়ে ধমকে উঠল। আমি ভয়ে কেঁপে উঠলেও মুখ খুললাম না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,

— “বল্, কি মুশিয়েছিস এখানে? একদম কথা ঘুরাবি না.. তাহলে..”

— “জ.. জামাল গোটা।”

— “কিহ্?”

আমি চুপ করে রইলাম। সেও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ ডেভিল স্মাইল দিয়ে বললো,

— “আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম। তুই যে ঠিক কেমন সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? হা হা হা। এখন এই দুধ তুই খাবি, তোকেই খাওয়াবো আমি!”

বলেই আমাকে চেপে ধরলেই আমি আঁতকে উঠলাম। পড়েছি এখন মাইনকার চিপায়! বের তো হইতেই পারছি না উল্টো প্যাঁচ লাগাচ্ছি বেশি বেশি করে! অসহায় গলায় বললাম,

— “প্লিজ, এবারের মতো ছেড়ে দিন। ওই জিনিস খেলে আজকে আর আমার ঘুম হবে না। বাথরুম দৌড়াতে দৌড়াতে আমার ঘুম হারাম হয়ে যাবে। প্লিজ! এইবার মাফ করেন!..”

— “আমি তো সেইটাই চাই। নে, হা কর!”

— “আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত, সূর্য ভাই! একটু ঘুমাতে চাচ্ছি। আজকের মতো ছেড়ে দিন, প্লিজ?”

আমার স্বকরুণ চেহারা দেখে হয় তো মায়া হলো ব:দ:টা:র! গ্লাসটা রেখে দিয়ে বললো,

— “ঠিক আছে, ঘুমা।”

আমি কোনো কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
_____________________

পরদিন সকালে খুব বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম। উঠেই দেখি ঘরে সূর্য ভাই নেই। কী রকম খারাপের খারাপ! বিয়ে-টিয়ে করে পরের দিন সকালে বৌকে রেখে চলে গেছে? শা’লা বিয়ে করেছিস কোন দুঃখে? যদি বৌকে সাথে করে বাড়ির সবার সামনে না যেতে পারিস? মনে মনে ফুঁসতে ফুঁসতে আগের শাড়িটা বদলে নতুন আরেকটা শাড়ী পরে নিলাম। মাথায় একহাত লম্বা ঘোমটা টেনে নববধূ স্টাইলে লজ্জা লজ্জা ভাব করে নিচে গেলাম।

এমন নয় যে আমি এ বাড়ি চিনি না। চিনি খুব ভালো করেই চিনি, বাড়ির প্রতিটা কোণা আমার চেনা। তবুও নতুন বৌ বলে একটা কথা আছে না? তাই লাজুক লাজুক ভাব করে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে অন্তুআন্টির গা ঘেঁষে দাড়ালাম। আশেপাশে সবাই আমার পরিচিত। তাও একেবারই অপরিচিতদের মতো আড়ষ্ট হয়ে থাকলাম। অন্তুআন্টি মানে সূর্য ভাইয়ের মা আমাকে আসতে দেখে বললেন,

— “কি রে! তুই এখন রান্নাঘরে কী করছিস?”

— “না মানে এমনই..”

— “মায়ের বাড়ি থাকতে তো কোনোদিন রান্নাঘরের ধারে কাছেও যাস নি। বিয়ে হতে না হতেই শ্বশুর বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকছিস যে?.. শোন, আমার সাথে পাকামো করবি না। আগেও তুই এবাড়ির মেয়ে ছিলি, এখনও থাকবি। তাই চুপচাপ দাড়িয়ে না থেকে রুৎবার কাছে যা। গল্প কর গে!”

আমি ভদ্র মেয়ের মতো রূতবার কাছে গিয়ে থাকলাম। সেদিন সারাদিন রুতবার কাছে থাকলাম। খা’টা’স’টা’র সাথে দেখা হয় নি। রাতের বেলা ঘুমনোর জন্য যখন ঘরে ঢুকলাম তখন সেখানে কেউ নেই। সূর্য বাড়িতেই আছে। নিশ্চয় চিলেকোঠায়! কিন্তু আমি কি সেখানে যাবো?

ধীর পায়ে হেঁটে ছাদে উঠে দেখি সে ছাদের এক কোণায় দাড়িয়ে আছে। চুপচাপ নিশ্চুপ। আমি চুপি চুপি গিয়ে পেছনে দাড়ালাম। মজা করে বললাম,

— “আপনার গার্লফ্রেন্ডের কথা মনে পড়ছে, সূর্য ভাই? এখন বুঝি এই বিয়েটা করার জন্য আফসোস হচ্ছে?”

সে আমার দিকে করুন চোখে তাকালো। হুট করেই আমার হাত টেনে ধরে বললো,

— “ভালোবাসি মৌপাখি! তোকে আমি খুব ভালোবাসি! কিন্তু তুই বুঝিস না। কেন আমি তোকে বিরক্ত করি, কেন এতো জ্বালাই, কেন এতো রাগারাগি করি, সেসব কিচ্ছুটি তুই জানিস না। কারণ তুই আমাকে বুঝিস না। বোঝার চেষ্টা করিস না। কিন্তু আজ থেকে তুই আমাকে বুঝবি, আর আমাকে আমার মতই ভালোবাসবি!”

শেষ কথাগুলো কেমন যেন জোর দিয়ে বললো। শুনেই হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। খিটমিট করে বললাম,

— “যদি তা না হয়?”

রাগে গজগজ করতে করতে প্রশ্ন ছুঁড়লাম আমি। এহ! ভালোবাসা দেখাচ্ছে! ঢং! যেন আমি কিচ্ছুটি বুঝি না! ওই বদ’টা যে চালাকি করে বিয়েটা করেছে ঠিকই আমি বুঝেছি। এই বিয়েটা করেছে সে আমাকে অত্যাচারের জন্য। সারাজীবন জ্বালিয়েছে, আর বাকী জীবনটাও যেন জ্বালাতে পারে সেজন্যই এই বন্দোবস্ত! নয় তো, অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলে ব্যাটার অত্যাচার থেকে বেঁচে যাবো না আমি? আর আমাকে না জ্বালালে এর পেটের ভাত হজম হবে? কক্ষণো না। এসব হচ্ছে ষড়যন্ত্র! গভীর ষড়যন্ত্র! বুঝি আমি, সব বুঝি! হুহ!

— “হবে তো অবশ্যই। আর না হয়েই বা যাবে কোথায়? বিয়ে যেহেতু করেছিস ভালো তুই আমাকেই বাসবি!”

— “থাকুন আপনি আপনার দিবাস্বপ্ন নিয়ে! আমি গেলাম ঘুমোতে। হুহ!”

বলেই দেমাগ দেখিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকলাম। যাই হোক, এর ঘরটা বেশ চমৎকার! গতকাল ঘরটা ভালো করে দেখা হয়ে ওঠে নি। বর পছন্দ না হোক, ঘর আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ব্যা’টা’র রুচিবোধ আছে। পুরো রুমটাই বেশ পরিপাটি। আর সবচেয়ে অবাককর বিষয় হলো রুমের বেড সাইড টেবিলের উপর আমার একটা সিঙ্গেল ছবি লাগানো। আমার কিশোরী বয়সের ছবি। বুঝলাম না, ছবিটা কি আজই লাগিয়েছে? না আগে? আগে কখনো এই ঘরে আমাকে ঢুকতে দেয় নি সূর্য। তাই জানি না। কিন্তু এটাতে কি প্রমাণ করতে চায় সে? সত্যি সত্যিই আবার ভালোবাসে না কি আমাকে? ধুর, কিসব ভাবছি! এই ছেলে আর ভালোবাসা? তাই কি সম্ভব? এর মতো ইগোস্টিক, অ্যারোগেন্ট ছেলেরা ভালোবাসতে জানে না কি? এরা জানে মানুষকে অত্যাচার করতে! ব্যাটা ব্রিটিশ!
_____________________

এরপরের দিন গুলো ঠিক আগের মতোই কেটে গেল। আগের মতো ঝগড়া-মা’রা’মা’রি করে। নিত্য নতুন বিষয় নিয়ে শুরু হলো ঝামেলা। এই তো সেদিন আমি ঘরের ভেতর চুপ করে বসে আছি। হঠাৎ কোত্থেকে যেন উদয় হলো সূর্যের। পেছন থেকে এসে আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,

— “ঢেঁপসি মেয়ে! সারাদিন ঘরে বসে পোল্ট্রি মুরগির মতো ঝিমাস! কাজ কর্ম করতে পারিস না?”

— “কি বললেন আপনি? আমি পোল্ট্রি মুরগি? আমি ঢেঁপসি?..”

— “ভুল কিছু বলেছি না কি? সারাদিন ঘরে বসে থাকিস। ওদিকে আমার মা সারাদিন রান্নাঘরে কাজ করতে ব্যস্ত। রাঁধতে না পারিস, হেল্প তো করতে পারিস?”

— “আপনি কি আমাকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য বিয়ে করেছেন?”

— “না তে কী তোকে বসিয়ে রাখার জন্য?”

ওও! এইবার বুঝছি। সব বুঝছি। শা:লা খা:টা:সে:র খা:টা:স এই ছিল তোর মনে? মন খারাপ করে বললাম,

— “অন্তু আন্টি নিজেই আমাকে নিষেধ করেছে। তাই যাই নি..”

— “সে তো নিষেধ করবেই। কিন্তু তোর কমনসেন্স নেই? নিজে থেকে কিছু করতে পারিস না?”

রাগে খিটমিট করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এলাম।

বিয়ের পর অভিমান করে আর আমাদের বাসায় যাই নি। যদিও তারা এসেছিল কিন্তু আমি সাথে যাই নি। দু’ একটা কথা বললেও মন খুলে কথা বলা আর হয় নি। এখন ছাদ থেকে প্রায়ই মায়ের সাথে দেখা হয়। বাড়ির উঠানে বাবা আর মা দুজনকেই প্রায় দেখি। কিন্তু কথা বলি না। তারা আমার সাথে এমনটা না করলেও তো পারতো! ভাবতেই মন খারাপ হয়।

কিন্তু সে মন খারাপও বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। সূর্য দি গ্রেট খা:টা:স হুটহাট এসে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। বিয়ের পর ঝগড়াটা বেড়ে গেছে চক্রবৃদ্ধি হারে! সেদিন যে গা:ঞ্জা খেয়ে ভালোবাসার কথা বলেছিল সেটা আমি ড্যাম সিউর! নয় তো এরপর তার মুখে আর প্রেমের বুলি আওড়াতে দেখি নি। যখনই দেখা হয়, তখনই শুধু ঝগড়া! তাও আবার খুব ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আর বেশি কিছু বললে ধুমধাম মা:রা:মা:রি শুরু করে। আমিও যে ছাড় দেই তা নয়। আমাকে একটা মারলে আমি তিনটা মারি! হুহ!

#চলবে——-

গল্পটা তুমিময় পর্ব-০২

0

#গল্পটা_তুমিময়💕
#পর্বসংখ্যা_২
#মৌরিন_আহমেদ

ভাবতে ভাবতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে আমি এখন ছুটছি সূর্য ভাইদের বাড়ির দিকে। কলিং বেল বাজাতেই রুৎবা দরজা খুলে দিলো। আমাকে দেখেই চাপা হাসি দিয়ে বললো,

— “আরে মৌরিপ্পি! বিয়ে না হতেই শ্বশুর বাড়ি চলে এলে? বাহ্ ভালো তো! আরেকটু অপেক্ষা করতে বিকেলের জন্য। একেবারে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ তুলে আনতাম!”

বলেই দুষ্টু হাসলো। সে কথায় বিরক্ত হলেও প্রকাশ করলাম না। ক্ষোভ মিশ্রিত হাসি দিয়ে বললাম,

— “কি আর করবো বলো? তোমরা এমন মানুষ যে বিয়ের কনেকে না বলেই তার বিয়ে-টিয়ে ঠিক করে ফেলেছ! ভাগ্যিস সকালে জানলাম, নয় তো দেখা যেত বিকেলে একেবারে বিয়ের আসরে কাজী এসে বলতো বলো, ‘কবুল!’ তখন কি হতো ভাবো তো?”

রুৎবা আমার কথা শুনে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো। সে আমার কথার আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকা ক্ষোভ টা ধরতে পারে নি। আমার কাঁধে চাপড় মেরে বললো,

— “তখনই তো আসল মজাটা হতো, আপ্পি! হেবি একটা সারপ্রাইজ হয়ে যেত তোমার জন্য!”

— ” বলেছে তোমায়! দেখা যেত, ভয়ে আমার হার্ট এ্যাটাক-ফ্যাটাক কিছু একটা হয়ে যেত! হুহ!”

আমি গাল ফুলালেই রুতবা হেসে হেসে আমাকে টেনে ধরে রুমে নিয়ে চললো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে বললো,

— “কিন্তু আপ্পি! আমি কিন্তু তোমার উপর খুব রাগ করেছি!”

— “কেন?” ভ্রু কুঁচকে শুধোলাম।

— “এই যে তুমি আর ভাইয়া, লুকিয়ে লুকিয়ে এতোদিন ধরে প্রেম করেছো। কই আমাকে তো বলো নি? আমি আরও ভেবেছিলাম তুমি যখন প্রেম করবা তখন জিজুর কাছ থেকে আচ্ছা সে টাকা হাতিয়ে নিবো। ওদিকে ভাইয়ার জন্য ভেবে রেখেছিলাম ওর নামে নালিশ দিয়ে ভাবির কাছে একবার টাকা নিবো, আবার ভাবির ভয় দেখিয়ে ওর কাছ থেকে আরেকবার নিবো। আর তোমরা দুজন কী করলে? আমার তিন পাশ দিয়ে টাকা আসার রাস্তা ফুরুৎ করে নষ্ট করে দিয়ে একেবারে বিয়ের কথা বললে? এইটা কি ঠিক হলো, বলো আপ্পি? তুমি আমার সাথে এইটা করতে পারলে?”

রূতবা কেমন দুঃখী দুঃখী মানুষের গলায় বলে আমার দিকে তাকালো। আমি অবাক হয়ে ওর কথা শুনলাম। ও এসব কি বললো? প্রেম করেছি? তাও আমি আর সূর্য? আমি কী বাংলাদেশে না মহাকাশে? ওরে, কে কোথায় আছিস ধর রে আমায়! আমার মাথা চক্কর দিচ্ছে!

ওকে কোনোমতে সামাল দিয়ে চুপিচুপি সূর্য ভাইয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। দরজা বন্ধ না, ভেজিয়ে রাখা। আলতো হাতে টোকা দিতেই খুলে গেল। বিছানায় সূর্য ভাই শুয়ে আছেন। গায়ের উপর একটা কাঁথা এলোমেলো করে ছড়িয়ে রাখা। সে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘরে ঢুকতে অস্বস্তি লাগলো আমার। কিন্তু ঘরে তো ঢুকতেই হবে! এই বিয়ের একটা হেস্তনেস্ত না করে তো আমি বাড়ি যেতে পারি না! সো যে করেই হোক আমাকে যেতে হবে।

অস্বস্তি নিয়েই রুমে ঢুকে পড়লাম। বিছানার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে মৃদু গলায় ডাক দিলাম,

— “সূর্য ভাই! সূর্য ভাই! ওঠেন প্লীজ! আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে!”

ভালো করেই ডাকলাম কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব দিলো না। আমি আরও একবার একই ভাবে ডাকলাম। তাতেও যখন সাড়া দিলো না তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে ডাকলাম,

— সূর্য ভাই! শুনছেন? ও সূর্য ভাই!”

— “কানের কাছে সারাদিন ‘ভাই’ ‘ভাই’ বলে বলে জ্বালাস না তো! যা এখান থেকে!”

সে ঘুমঘুম কণ্ঠেই জবাব দিলো। চোখ এখনোও মেলে নি তাহলে কি সজ্ঞানে বললো? কিন্তু আমি তো সারাজীবন সূর্য ভাই বলেই ডেকে এসেছি। কোনদিন কিছু বলে নি তাহলে হঠাৎ? সে যাক গে! আমি আবারো ডাকলাম,

— “আপনি কি উঠবেন প্লীজ? দেখেন, আমি কিন্তু আজাইরা প্যাঁচাল পারতে আসি নি। আপনি একটু উঠেন, আমার কথা শুনেন। তারপর আমি চলে যাচ্ছি। ওঠেন, প্লীজ!”

কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমগঘুম চোখ কচলাতে কচলাতে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে চশমা তুলে নিলো। সেটা চোখে পরতে পরতে বললো,

— “তুই? এত সকালে? আমার ঘরে? কোন দুঃখে?”

কণ্ঠে তার হাজারো বিরক্তি। আমিও বিরক্ত হয়েই বললাম,

— “গুরুত্বপূর্ন কথা বলতে এসেছি। না হয় আমার ঠ্যাকা পড়ে নি..”

— “লম্বা ভূমিকা না বলে আসল কাহিনী বল্। বলে ফুট এখান থেকে! আমার ঘুমটা..”

ঢং দেখে মনে হচ্ছে যেন তাকে এইসময় ডাকতে এসে মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছি আমি! ন্যাকা! নিজে যে আমার ঘুম, শান্তি, সব হারাম করে বসে আছে তার বেলা? রাগ হয়ে তার দিকে একেবারই ঝুঁকে পড়লাম আমি। মুখের কাছে মুখ এনে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

— “খবরদার, একদম ন্যাকামো করবেন না! আমি তো শুধু আপনার ঘুম ভাঙিয়েছি.. আর আপনি? ঘুম থেকে উঠেই মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে! এসব শুরু করেছেন আপনি, হ্যাঁ? কীসের বিয়ে.. কীসের কী..”

আমার কথা শেষ করতে দিলো না সে। চোখ মুখ কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

— “সকালে ব্রাশ করেছিলি তুই?”

সিরিয়াস মোমেন্টে এই আজিব কোয়েশ্চেন শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল আমার! খিটমিট করে উঠলাম,

— “নাহ্!”

— “এই জন্যই! এই জন্যই এই বিচ্ছিরি গন্ধটা আসছে! ছিঃ পাঁচফোড়ন, ছিঃ! তুই ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ না করেই আমার বাসায় এসেছিস? ছিঃ, গন্ধে আমার বমি আসছে! ওয়াক থু!”

বলেই মুখটা বিকৃত করলো। সকালে ব্রাশ করি নি কথা সত্যিই, কিন্তু গন্ধ তো হওয়ার কথা না। কিন্তু এ এরকম করছে কেন? হঠাৎ নিজের কাছে নিজেই বিব্রত হয়ে গেলাম। ডান হাতটা মুখের কাছে এনে ভাপটা বোঝার চেষ্টা করলাম। কই না তো! তাহলে?

কিছুক্ষণ আবালের মতো চেয়ে থাকতে থাকতেই ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো। এই পল্টিবাজ ছেলে এখন পল্টি মারার জন্য কথা ঘুরাচ্ছে। চেষ্টা করছে আজাইরা কথা বলে আমার মাথা থেকে আসল কথাটা বের করে দিতে। সবসময় এমন আজাইরা কাজ করে সে! সবটা সময়! ভাবতেই মুহূর্তেই চিড়বিড় করে উঠলো রাগটা। বললাম,

— “একদম মিথ্যে বলবেন না! আমি রাতের বেলায় ব্রাশ করেছি। মুখে কোনো গন্ধই নেই। আজাইরা প্যাঁচাল পেরে কথার টপিক চেঞ্জ করার ট্রাই করবেন না। আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি আপনার চালাকি!..”

— “এই চুপ কর! ছিঃ কী গন্ধ! পাঁচফোড়ন, আল্লাহ ওয়াস্তে তুই ওয়াশরুম যা, অন্তত কুলি করে আয়! প্লীজ! তোর মুখের বিশ্রী গন্ধের ঠ্যালায় আমাকে পটল তুলতে বাধ্য করিস না!”

তার অ্যাক্টিং দেখে রাগটা তুঙ্গস্পর্শী হলো। আমি আরও এগিয়ে এসে কলার চেপে ধরে বললাম,

— “একদম ঢং করবেন না। আমি কাল রাতে ঘুমানোর আগেই ব্রাশ করেছি। মুখে কোনো গন্ধই নেই। বিশ্বাস না হলে এই দেখুন!.. ”

বলে ইচ্ছে করেই তার মুখের কাছে এগিয়ে ক্লোজ আপ অ্যাডের স্টাইলে ভাপ ছেড়ে দিলাম। সে ‘ওয়াক থু’ বলে একঝাপে পেছনে সরে গেল। নাক মুখ সিঁটকে বললো,

— “তুই, তুই, এতো নোংরা হলি কবে থেকে, পাঁচফোড়ন! ছিঃ ছিঃ! এতো গ্যাদরা টাইপের একটা কাজ ক্যামনে করলি? ওয়াক ওয়াক!..”

— “ঠিক হয়েছে! যা করেছি, বেশ করেছি! বেশি ন্যাকামো করেন আপনি। বললাম তো রাতে ব্রাশ করেছি আমি। এখন কি ঘুম থেকে উঠেই আবার ব্রাশ করতে হবে? আজব! এখনো কিছুই খাই নি আমি। নাস্তা খাবো তারপর না…”

— “তোর কাছে কী আমি তোর ব্রাশের ফিরিস্তি শুনতে চেয়েছি? এতো বেশি পকপক করিস কেন তুই? আর একটা কথাও বলবি না। যা, ওয়াশরুম। এক্ষুণি যা। কুলি না করে যদি এসেছিস সত্যি কথা, তোর আজকে খবর আছে!..”

ভয়ঙ্কর একটা হুঁশিয়ারি শুনেও চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। এতক্ষণ ধরে আমি যা করেছি ইচ্ছে করেই করেছি। মুখের গন্ধ নিয়ে যে সে এতো ওভার রিয়েক্ট করলো সেটার জন্যই এটা করেছি। সোজা ভাষায় tit for tat!

— “কি হলো? দাড়িয়ে আছিস যে?.. যা বলছি! দেখ পাঁচফোড়ন তুই যদি এইমুহুর্তে না যাস আই সয়ার তোর কপালে আজকে দুঃখ আছে। এমনই সক্কাল সক্কাল তুই আমার আরামের ঘুমটা হারাম করে দিয়েছিস! মেজাজ এমনই বিগড়ে গেছে তার মধ্যে তোর এই বিশ্রী, উদ্ভট কার্যক্রমে আমার মেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে। যা বলছি!”

শেষ কথাটা আরও বেশি ধমকে উঠে বললো। যতোই ত্যাড়ামো করি না কেন বরাবরের মতোই এবারও তার ধমক খেয়ে আমার সব সাহস ফুস করে উবে গেল! মেজাজ রাগে টগবগ করে উঠলেও চুপচাপ সামন থেকে বেরিয়ে গেলাম। পেছন থেকে আবারো ডাক পড়লো,

— “ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস? ওয়াসরুমটা যে এদিকে চোখে পড়ে না?”

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওয়াসরুমে ঢুকলাম। মেজাজ দেখিয়ে মুখে পানি ছিটাতে গিয়ে ওড়না আর চুলের অর্ধেক ভিজিয়ে ফেললাম। এমনই মেজাজ খারাপ তারমধ্যে আরও বেশি খিটমিট করে উঠলাম। সূর্য ভাই সত্যিই বলে, আই অ্যাম অ্যা ডাফার! একটা কাজও যদি ঠিকঠাক মতো করতে পারতাম! ধ্যাত!

ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই মুখের সামনে নিজের টাওয়াল ঝুলিয়ে দিলো সূর্য ভাই। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— “একটা কাজও ঠিক করে করতে পারিস না! মুখ ধুতে গিয়ে গোসল করে এসেছিস! আক্কামা একটা!.. ধর, মুখ মোছ!”

বলেই আমার মুখের উপর টাওয়েলটা টা চটকা দিলো। রাগে কটমট করে তাকিয়ে সেটা হাতে নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে মারলাম। বললাম,

— “আমার কি গামছার অভাব পড়েছে? আপনার জিনিস নিবো কেন আমি, হ্যাঁ?”

— “আপনার গামছাটা কি এইখানে আকাশ থেকে পড়বে? না বাড়ি গিয়ে মুখ মুছবি? ঠিক আছে, যেতে পারিস। সমস্যা নাই, বাইরে যখন আমার আত্মীয়-স্বজনরা জিজ্ঞেস করবে মুখ ভেজা কেন তখন বলিস, তোর বর তোকে পানিতে চুবিয়ে ধরেছিল!”

তার উদ্ভট কথা শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেল। কাজের কথা নেই, হুদায় ফ্যাচ ফ্যাচ করে খালি! তাকে সম্পূর্ন উপেক্ষা করে এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ারের উপর থেকে টিস্যুর বক্সটা তুলে নিলাম। এক টান দিয়ে একেবারে চার পাঁচটা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছতে শুরু করলাম। আমার কান্ডকারখানা দেখে লাফিয়ে উঠে হাত থেকে বক্সটা কেড়ে নিলো সূর্য ভাই। খিটমিট করে উঠে বললো,

— “অমন জলহস্তীর মতো করে টিস্যু নিচ্ছিস কেন? জীবনে টিস্যু দেখিস নি?

— “একদম কথা ঘুরাবেন না! একদম না!.. অলরেডি আমি কি কী বলতে এসেছিলাম সব ভুলে গেছি। আর একটা কথাও বলবেন না.. এখন যা বলার আমিই বলবো!”

মোটামুটি কঠিন গলায় কথাটা উচ্চারণ করলাম। সে যেন পাত্তাই দিলো না! গালের উপর হাত রেখে ঢং দেখিয়ে আমার সামনে এসে বসলো। ন্যাকা ন্যাকা কণ্ঠে বললো,

— “মাননীয় স্পিকার, এখন বলুন আপনি। কি বলিতে চান?”

— “বিয়ে নিয়ে কী করতে চাইছেন? আমার বাসায় কী বলেছেন? কেন সবাই বলছে আজ আমার বিয়ে?..”

রাগ লাগলেও ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম। সে নির্বিকার চিত্তে বললো,

— “বারে! তোর বিয়ে হলে সবাই বলবে না তোকে? কি সব বলিস না তুই?..”

— “কাম টু দ্যা পয়েন্ট! কোনরকম হাংকি-পাংকি করবেন না। ডিরেক্ট যা জিজ্ঞেস করেছি তাই বলবেন! বাড়তি কথা না।.. বিয়েটা কি আপনার কাছে ছেলেখেলা মনে হচ্ছে? আপনার সাথে কী আমার ভালোবাসা-বাসির সম্পর্ক? যে আমরা বিয়ে করবো?.. আর রুতবাকে কি বলেছেন? আমরা প্রেম করতাম? আস্ত মিথ্যুক একটা!”

— “তুই মিথ্যুক! আমি যা বলার তাই বলেছি। ইভেন শুধু রুতবাকে না আমি সবাইকেই বলেছি আমরা দুজন প্রেম করছি। ওটা না বললে তোর সাথে আমার বিয়েটা দিতো না।..”

তার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে গা জ্বলে উঠলো আমার। সাথে হতাশও হলাম। মিইয়ে যাওয়া গলায় বললাম,

— “এমনটা কেন করছেন, সূর্য ভাই? আমি জানি আপনি সবটা রিভেঞ্জের জন্য করছেন। কিন্তু এটার জন্য প্লীজ আমার লাইফটা শেষ করে দিবেন না! প্লিজ!..”

— “এক্সাকটলি! আমি রিভেঞ্জের জন্যই করছি। তোকে পইপই করে বারণ করে দেয়ার পরও তুই আমার পেছনে লেগেছিস! খুব শখ ছিল না আমার বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার? নে, এখন বৌ সেজে নিজের বিয়ের দাওয়াত খা!”

— “সূর্য ভাই! এমনটা করবেন না প্লীজ! আমি আর এমন করবো না..”

অসহায় হয়ে বললাম। কিন্তু পাত্তাই দিলো না! উল্টো ভাব দেখিয়ে বললো,

— “সেটা তোর আগে ভাবা উচিত ছিল! যেহেতু তখন ভাবিস নি সেহেতু এখন আর ভাবতে হবে না!..”

— “বিয়েটা তো ছেলেখেলা নয়! দুইটা মানুষের সারাজীবনের ব্যাপার!.. আপনি কেন শুধু শুধু রিভেঞ্জের জের ধরে.. আই রিকোয়েস্ট ইউ, প্লীজ ডোন্ট ডু ইট! প্লীজ!.. বিয়েটা আটকান!”

— “উহুম! সম্ভব না!.. যা হবার হয়ে গেছে। আগে যদি বলতি তাও হতো। এখন আর হবে না। অলরেডি আমার বিয়ে উপলক্ষে আমার দাদী, কাকা-কাকিমারা চলে এসেছেন। পাড়ার লোকে জেনেছে আজ আমার বিয়ে। এই বিয়ে ভাঙলে আমার আর বিয়ে হবে ভেবেছিস? পাত্রী পক্ষ আসলেই তো বলবে ছেলের আগে বিয়ে ভেঙেছিল।.. তখন.. তখন.. মেলা ঝামেলা। আমি ওসবের মধ্যে নেই।..

তুই যা তো এখন এখান থেকে! বাড়ি গিয়ে সাজগোজ কর। আফটার অল বিয়ে আমি একবারই করছি। সো আমার বৌ পেত্নীমার্কা সাজে থাকবে সেটা কিছুতেই মেনে নিবো না আমি। ক্যামেরা ম্যান আসবে। ফটোশুট হবে। যা গিয়ে সাজগোজ কর!.. আর শুন, বাড়ি গিয়ে ব্রাশ করবি। খবরদার! ব্রাশ না করে যদি বিয়ের পিড়িতে বসিস তো!..”

আজাইরা প্যাঁচালের ডালি সবসময় আজাইরা প্যাঁচাল পারে! এই বিয়ে ভাঙলে নাকি তার আর বিয়েই হবে না! এহহ! কোথায় আমি পাত্রী হয়ে বসে বসে ভাবছি বিয়ে ক্যামনে আটকাবো, বিয়ে ভাঙলে আমার কি হবে সেটা নিয়ে কোনো চিন্তাই করছি না, আর সে কি না ভাবছে এই বিয়ে ভাঙলে আর বিয়ে হবে না! যত্তোসব ঢংয়ের আলাপ। হুহ!

এতসব কথার পর ঠিকঠাক বুঝে গেলাম বিয়ে নিয়ে এই ব’দ’টা’কে কিছু বলে লাভ নেই। ‘ধুপধাপ’ পায়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম। যা করার আমিই করবো! বাড়ি যাই আগে! আসার আগে শুধু দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,

— “বেশ! বিয়ে করার যখন শখ জেগেছে করেন বিয়ে! আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো! বিয়ে যদি সত্যি সত্যিই হয়ে যায়, আপনার জীবন আমি ত্যানা-ত্যানা করে যদি না ছেড়েছি!..”

— “কে কার লাইফ ত্যানা-ত্যানা বানায় না ছেঁড়া-ছেঁড়া বানায় দেখা যাবে!”
______________________

বাড়ীতে ফিরে দেখি ফ্ল্যাটের দরজা হাঁট করে খোলা। যেমনটা রেখে গিয়েছিলাম। ভেতরে ঢুকেই জোরে শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। শব্দ শুনে ছুটে এলো মা। রাগী রাগী কণ্ঠে বললো,

— “আরেকটু জোরে শব্দ করতে পারিস নি? আরেকটু জোরে করতি! লোকে জানতো আমার বাড়ীতে তোর মত একটা ডাকাত মার্কা মেয়ে আছে!..”

— “পারলে আরও জোরেই করতাম। এমন জোরে করতাম যেন এই দরজা ভেঙে দুই খন্ড হয়ে যায়!.. ”

— “কোথায় গিয়েছিলি তুই? খাওয়া দাওয়া না করে কোন রাজকার্যে গিয়েছিলি শুনি?”

কথার প্রসঙ্গ বদলালো মা। আমি সে কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। সোজা পায়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছি তখনই মা আরেকবার বললো,

— “যত যাই কর, বিয়েটা আজকেই হচ্ছে!.. আমি জানি সূর্যের সাথে তোর প্রেম-ট্রেম নেই। ও মিথ্যে বলেছে, কিন্তু তারপরও এই বিয়েটা হচ্ছে। তাই এতো গাল ফুলিয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। বুঝেছিস?.. ডাইনিংয়ে খাবার আছে খেয়ে নে!..”

বলেই আর দাড়ালেন না। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি মোটামুটি অবাক হয়ে শুনলাম তার কথা। মা জানে সূর্য ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক নেই, তবুও কেন? সেই কথা ভাবতে গিয়েই মনে হলো আমার ভয়ঙ্কর খিদে পেয়েছে! লোকে বলে, চরম দুঃখের সময় খিদের কষ্ট মানুষের মনে থাকে না। কিন্তু আমার? মাথার উপর যখন বিয়ের হাজার টেনশন তখনো খিদেয় পেট অস্থির! উফ্! কেন এই খাওয়ার সিস্টেমটাই পৃথিবী থেকে ঊঠে যায় না?

খাওয়া দাওয়া সেরে রুমে এসে বসেছি। ফোন হাতে নিয়ে নিরাকে কল লাগালাম। নিরা আর হিয়া আমার দুই বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার লাইফের যেকোনো সমস্যায় এদের আমি পাশে পেয়েছি। যদিও পরিচয় বেশিদিনের না! ভার্সিটিতে উঠার পর পরই বন্ধুত্ব। তবুও ওরা খুব ভালো।

প্রথমবার কল রিসিভ হলো না। ব্যস্ত হয়ে অনলাইনে মেসেজ দিলাম। ফেসবুক, ইনস্ট্রা, হোয়াটস অ্যাপ– সবজায়গায় টেক্সট পাঠালাম। নো রেসপন্স! বাধ্য হয়ে হিয়ার কাছে কল দিলাম। এর তো আরও খবর নেই! ফোন বন্ধ করে রেখেছে! উফ্! আমার এই চরম বিপদের সময় এরা লাপাত্তা হলো কেন!

ঠিক দশ মিনিট পর নিরা কল ব্যাক করলো। ফোন রিসিভ করতেই চরম বিশ্রী কিছু গালি উপহার দিয়ে বললো,

— “বজ্জাত মাইয়া! বিয়ের দিনে বর রে কল দেয়া বাদ দিয়া আমারে কল দেস ক্যান? আজব! একটু শান্তিতে ঘুমাবো তোর জ্বালায় তাও হবে না! এমনিতেই কাল রাতে ঘুমাই নাই..”

— “তোরে কী আমি ঘুমাইতে নিষেধ করছিলাম? আমারে দোষ দিস ক্যান?.. আর বিয়ার কথা তোরে কে কইলো?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম।

— “কে আবার! আমার হ্যান্ডসাম জিজু বলেছে! তুই যে কিপটার কিপটা তাতে তো মনে হয় না দাওয়াত দিতি! যাই হোক, সূর্যভাই দিয়া দিছে। আমি সময় মতো চলে আসবো, সমস্যা নাই!”

নিরার কথা শুনে ঠিক কী রিয়েকশন দিবো ভেবে পেলাম না। ইচ্ছা করলো চড় দিয়ে ফাজিলটার দাঁতগুলো সব ফেলে দেই। সাথে রাগ উঠলো সূর্য ভাইয়ের উপর! যদি একবার বাগে পাইতাম! উফ্!

এখন এসব রাগারাগি করে লাভ নেই। এখন এই বিয়েটা ভাঙার জন্য হেল্প লাগবে আমার। আর সেটা নিরাই করতে পারবে! তাই সুর বদলে নরম গলায় বললাম,

— “নিরা শোন, তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে। তুই কি একটু আমার বাসায় আসতে পারবি? প্লীজ দোস্ত, একবার আয়?”

— “আরে আসবো তো! তোর বিয়েতে আমি না আসলে হয়?.. একটু পরেই চলে আসবো। কেবল তো ঘুম থেকে উঠলাম। একটু ফ্রেশ হয়ে, নাস্তা সেরে তারপর আসি?”

— “তুই বুঝতে পারছিস না, ইয়ার! আমি যথেষ্ট প্যারার মধ্যে আছি। তুই এখন না আসলে বলে বোঝাতে পারবো না।”

— “প্যারার মধ্যে থাকবি না তো কি? বিয়ের কনের প্যারা থাকবে না? ফেসিয়াল, সাজগোজ, খাওয়া-দাওয়া কতকিছু!.. শোন, টেনশন নিস না। সুন্দর করে ফেসপ্যাক লাগিয়ে বসে থাক। গোসল করে, শ্যাম্পু দিয়ে ভালো করে চুল ধো। তারপর ওয়েট কর। আমি আসতেছি, একসাথে পার্লার যাবো। বুঝছিস? হিয়ারেও আনতেছি.. আর পারলে এখনই সারাদিনের খাওয়া খেয়ে নে। পার্লারে ছোটাছুটি করতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া কিছুই হবে না। অবশ্য সমস্যা নাই। বিয়ের দিন কনে না খেয়ে থাকলে কিছুই হয় না। রাতের বেলা বরের আদর খেলেই… ”

নিরার কথা শেষ করার আগেই কলটা কেটে ফোনটা চটকা মেরে দিলাম। কপাল করে এমন বান্ধবী পেয়েছি! যে কি না, বিপদে বন্ধুর সাহায্য করা বাদ দিয়ে উল্টো আজাইরা কথা নিয়ে বসে আছে! রাগে হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে! বিছানার ওপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে মনের দুঃখে আফসোস করতে শুরু করলাম,

— “আহারে! এই জীবন, এই জীবন দিয়া আমি কি করমু? আমি মইরা যামু রে! মইরা যামু!”

বসে বসে দুঃখবিলাস করছি। হঠাৎ মাথার ভেতর একটা বুদ্ধি যেন উঁকি দিলো! মোটু-পাতলু কার্টুনের পাতলুর মতো করে আইডিয়ার একশো ওয়াটের বাল্ব জ্বলে উঠলো। লাফিয়ে উঠে নিজে নিজেই বললাম,

— “আরে আমি কি জরিনা, ছকিনা নাকি? যে আমারে ধইরা বিয়া দিতে চাইলেই আমি বিয়া করমু?.. অসম্ভব! আই অ্যাম মৌরি। এই মৌরি ভাঙবে তবু মচকাবে না! দরকার হয় পালিয়ে যাবো। ইয়েস! আমি পালিয়েই যাবো! যাবো মানে যাবোই।”

ভেবেই লাফ দিয়ে উঠে আলমারির কাছে গেলাম। কিছু কাপড় -চোপড় নিয়ে একটা ব্যাগে ভরে নিলাম। সাথে টাকাও। সুতি একটা থ্রি পিচ পড়ে ফেললাম। এটা পড়েই যাবো। কিন্তু এখন একটা বোরকা দরকার! বোরকা পাই কোথায়?

চুপিচুপি পায়ে মায়ের ঘরে উঁকি দিলাম। মা কিংবা বাবা একজনও ঘরে নেই। মা সম্ভবত রান্নাঘরে আর বাবা বাজারে-টাজারে কোথাও একটা গেছে। আমি কোনো কিছু না ভেবেই আলমারির ভেতর থেকে মায়ের আদিম কালের একটা বোরকা বের করলাম। যেটা মা এখন আর ইউজ করে না। সাথে একটা শাড়ীও নিয়ে নিলাম, সেটাও পুরোনো। কারণ, নতুন জিনিসের খোঁজ মানুষ নেয়, পুরোনোটার নয়। মা যদি এটাও খোঁজ করে যে আমি কি পরে পালিয়েছি সেটাও বলতে পারবে না।

রুমে এসে একটা কাগজে চিরকুট লিখলাম। তিন বাক্যের ছোট্ট একটা চিরকুট,

— “আমি এই বিয়েটা কিছুতেই করতে পারি না, বাবা-মা। তাই পালিয়ে যাচ্ছি। যদিও আমার কাছে মনে হচ্ছে না আমি কোনো অপরাধ করছি। তবুও আমি ক্ষমাপ্রার্থী! পারলে মাফ করে দিও।”

বোরকা পরে, হাতে শাড়িটা নিয়ে গেস্ট রুমের ব্যালকনিতে চলে এলাম। এই ব্যালকনি দিয়ে সোজা বাড়ির পেছনের রাস্তায় নামা যায়। গেস্ট রুমের দরজা লাগিয়ে ব্যালকনির রেলিংয়ের সাথে শাড়িটা বাঁধলাম। নিজেকে এখন ফিল্মের হিরোইন হিরোইন লাগছে! লাইফটা সিনেমাটিক হয়ে গেল না? বাবা-মা জোর করে মেয়ে বিয়ে দিতে চাইছে, মেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পথে নিশ্চয় ফিল্মের হিরোর এন্ট্রি হবে। দেখা হবে, প্রেম হবে! আহা! কী গল্প! ভাবতেই কেমন মজা মজা লাগছে! মনে হচ্ছে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়াটাও বুঝি ইন্টারেস্টিং!

আমার ভাগ্য খুব ভালো যে আমাদের বাসার একটা ব্যালকনির রেলিংও কোমড়ের চেয়ে উঁচু না। উপরে কোনো গ্রিলও নেই। এই নিয়ে মায়ের কাছে বাবা কত কথা শুনেছে! বলেছে,

“গ্রিল ছাড়া ব্যালকনি তোমার কোন দরকারে আসবে? এদিক দিয়ে চোর-টোর এসে বাড়িঘরের সব চুরি করে নিয়ে যাবে। তখন দেখবে!..”

বাবা হেসে বলতেন, “আসবে আসবে, এই ব্যালকনিও একদিন কাজে আসবে! তুমি দেখে নিও!”

এসব ভেবে আমি মনে মনে মুচকি হাসি হেসে ভাবলাম,

“তুমি ঠিকই বলেছলে বাবা। তোমার গ্রিল ছাড়া ব্যালকনিই আজ আমার কাজে আসবে! আই অ্যাম সরি, বাবা। পারলে মাফ করে দিও!”

হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে উঠলো। আমি আর যাই করি তাদের মান-সম্মান নষ্ট হোক এমন কিছু তো করতে চাই নি! কিন্তু তবুও তারা… ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে!

নাহ্, আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। আর কিছুক্ষণ থাকলেই ইমোশনাল হয়ে পড়বো। তখন দেখা যাবে, পালিয়ে যাবার আগেই ধরা পড়ে যাবো! তখন এই আফসোস আমার কোনোদিন শেষ হবে না!

খুব ধীরে ধীরে শাড়ী ধরে নীচে নেমে এলাম। আহ্! শান্তি লাগছে খুব! ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আপাদত ফোন টোন অফ! কেউ কল দিলেও আর পাবে না! হা হা হা।

কিন্তু গলির মোড়ে এসে যার সাথে দেখা হলো তাতেই পিলে চমকে উঠলো আমার। ভেতরে ভেতরে টেনশনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলেও নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রেখে হাঁটতে লাগলাম। সে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল দেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সে গলির ভেতর ঢুকে গেল দেখে এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশা ঠিক করলাম। বাস স্ট্যান্ডে যাবো এখন। ভাড়া ঠিক করে রিকশায় উঠবো এমন সময় পেছন থেকে ভেসে এলো পরিচিত কন্ঠস্বর,

— “মৌরি তুই?”

আতঙ্কে জমে গেলাম যেন। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলাম ব্যক্তিটি দাড়িয়ে আছে। সে যায় নি! উল্টো ঘুরে ফিরে এসেছে! কী করবো ভেবে পেলাম না। মাথার ভেতর একটা কথাই ঘুরলো আমার এত কষ্টও শেষ পর্যন্ত সার্থক হলো না! এই দুঃখ আমি কই রাখবো? আহা রে!

#চলবে————-

গল্পটা তুমিময় পর্ব-০১

0

#গল্পটা_তুমিময়💕
#পর্বসংখ্যা_১
#মৌরিন_আহমেদ

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো আমার। চোখ মেলতেই মা রাগী গলায় বললেন,
— “আজ তোর বিয়ে, আর তুই এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস? ওঠ, বলছি, ওঠ!”

সকাল বেলা ঘুম থেকে তোলার জন্য বিয়ের কথা বলাটা মোটেও নতুন কিছু না আমার জন্য। তাই অবাক হলাম না। আরও ভালো করে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে বললাম,

— “বেশ তো। যাও তোমার জামাইবাবাজী কে রুমে পাঠায় দাও। কোলবালিশ বানায়া ঘুমাই।”

মা যেন এই কথায় আরও বেশি ক্ষেপে উঠলেন। ঝাড়া মেরে গায়ের কাঁথাটা সরিয়ে দিয়ে বললেন,

— “আমার কথাকে তোর কাছে ফাজলামি মনে হচ্ছে? বললাম না আজ তোর বিয়ে, কথা কানে যায় নি? উঠ, বলছি!”

— “উফ্! মা! থামো তো তুমি। আজকে শুক্রবার, ভার্সিটি-টিউশনি কিচ্ছু নাই। কোথায় একটু আরাম করে ঘুমাতে দিবে তা না, উল্টো বিয়ে নিয়ে জোক মারছো! যাও তো তুমি! আমাকে একটু ঘুমাতে দাও!”

বলেই তার হাত থেকে কাঁথাটা উদ্ধার করে গায়ে মুড়িয়ে আরাম করে শুয়ে থাকলাম। মা কিছুক্ষণ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন,

— “তুই তাহলে উঠবি না?.. আচ্ছা, বেশ। তোর বাপ এসে দেখুক আগে। তারপর হচ্ছে.. এই আমি গেলাম। আর একবারও ডাকতে আসবো না।”

বলেই মা দ্রুত পদক্ষেপে প্রস্থান করলেন। তার চলে যাওয়ার পর পরই চরম বিরক্তি নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি। চোখ মুখ কুঁচকে বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখলাম। সবে সাতটা বাজে! তাতেই কী না এমন চিল্লাপাল্লা করে ঘুম থেকে তোলা? এরচেয়ে প্রতিদিনই তো আরাম করে ঘুমাতে পারি। রোজ উঠি নয়টায়, আর আজ! ধ্যাত!

— “মৌরি! ওঠো নি তুমি এখনো?”

ড্রয়িং রুম থেকে বাবার আওয়াজ কানে আসতেই বিরক্তিটা রাগে পরিণত হলো আমার। মা গিয়ে ঠিক ঠিক বাবার কাছে কথাটা বলেছে! এরা আমার আরামের ঘুম হারাম না করে ছাড়বেই না! উফ্! অসহ্য!

হুড়মুড় করে বিছানা থেকে নেমে ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। বাবাকে দেখে চেহারার রাগ-বিরক্তি ধুয়ে মুছে স্বাভাবিক ভাবে বললাম,

— “আমাকে ডেকেছো বাবা?”

— “এখনোও ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হও নি? শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও কী এমন করবে না কি তুমি? সংসার তখন টিকবে তো?”

বাবা যেন ব্যঙ্গ করলেন। আমিও প্রতি উত্তরে মৃদু হাসলাম। বাবার জোকস টা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বললাম,

— “এতো সহজে তো তোমাদের ঘাড় থেকে আমি নামছি না! অন্তত আরও চার পাঁচ বছর তোমাদের হাড় জ্বালিয়ে তারপর বিদায়!..”

বলেই হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে থাকলাম। অন্য দিন হলে বিনিময়ে বাবাও একগাল হাসতেন। আমাকে প্রশ্রয় দিয়ে আরো কিছু বলতেন। আমরা বাবা-মেয়ে তখন হাসতাম আর মা তখন সেটা দেখে রেগে বোম হয়ে থাকতেন! কিন্তু আজ তেমন কিছুই হলো না। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার কথা শুনে বাবার চেহারাটা কেমন যেন গম্ভির হয়ে উঠেছে। উনি রাশ ভারী আওয়াজে বললেন,

— “তোমার মা তোমাকে কিছু বলেন নি?”

মা আবার কি বলবে? কিছু না বুঝে ব্যাপারটা নিয়ে বাবাকে বলতে যাবো তার আগেই রান্নাঘর থেকে মা ছুটে এলো। হাতের বেলুনটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললেন,

— “বলবো আর কেমন করে! আমি যা বলি, সবকিছুই তো তার কাছে ফেলনা মনে হয়। যেন আমি একটা জোকার ওর সঙ্গে জোকস মারতে বসেছি!”

এদের কথাবার্তার আগামাথা বোধ গম্য হলো না আমার। মা যে আমার নামে বিচার দিচ্ছেন সেটা বুঝেই ভোলাভালা চাহনি দিয়ে বললাম,

— “মা কিন্তু আমার নামে অহেতুক বিচার দিচ্ছে বাবা! আমি এই বদনামের জন্য ভেটো দিচ্ছি। আই ফরবিড, আমি মানি না!”

বলেই সংসদীয় স্টাইলে হাত নাড়িয়ে নিজের পক্ষের সমর্থনের চেষ্টা করলাম। বাবা আমার দিকে একপলক তাকিয়ে মার দিকে ফিরে বললেন,
— “ওকে এখনো কিছুই বলো নি?”

মা মাথা নাড়ালেন। আমি উজবুকের মতো তাকিয়ে থেকে বললাম,
— “তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো, বলো তো?”
— “আজ তোমার বিয়ে!”

বাবা থমথমে মুখে বললেন। কথাটা শুনেই যেন বাজ পড়লো মাথায়। আশ্চর্য হয়ে বললাম,

— “কীহ? ক্ক..কার সাথে?”
— “সূর্যের সাথে। আর সেটা আজকেই। দুপুরে হলুদ, বিকেলে বিয়ে।”

ব্যস এটুকু বলেই বাবা উঠে গিয়ে নিজের রুমের ভেতর ঢুকে গেলেন। মাও নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করলেন। আর আমি স্তম্ভিত চাহনিতে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। বাবার কথাটা পুরোটাই মাথার উপর দিয়ে গেছে! উনি এসব কি বললেন? বিয়ে মানে? তাও আবার সূর্যের সাথে? ওই উজবুক ব্যাটার সাথে? ক্যামনে কি? মাথা যেন হ্যাং হয়ে গেল আমার।

হুশ হতেই তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলাম মার কাছে। উনি রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমি ছুটে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,

— “এসব কি শুনছি, মা? আমার বিয়ে মানে? এসব কী কথা? আর ওই সূর্যের সাথে..”
— “যা শুনেছ, ঠিকই শুনেছ। সূর্যের সাথেই তোমার বিয়েটা হচ্ছে।”
— “কিন্তু মা, ওনাকে আমি..”

কথা শেষ করতে পারলাম না আমি। তার আগেই মা বললেন,

–“এটা আমার সিদ্ধান্ত নয়, তোমার বাবার। কিছু বলতে হলে তাকে গিয়ে বলো!”

মা সহজ ভাবে নিজের দায়িত্ব শেষ করলেন। বাবার কাছে ঘটনা শুনতে পাঠিয়ে নিজে বেঁচে গেলেন। কথা শেষ করে নিজের মতোই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কাজে। আমি কিছুক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৌড় লাগালাম বাবার কাছে।

— “তোমাদের কথার তো কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, বাবা! এসব কী কথা তোমাদের? আমার বিয়ে ঠিক করেছ আমাকে না বলে, না জানিয়ে.. এখানে আমার মতামতের তো একটা ব্যাপার আছে, তাই না? কিন্তু তা না করে..”

— “তোমার মতামত নেয়ার সময় ছিল না, মৌরি। সূর্যের অফিস থেকে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে। খুব দ্রুতই ইউকে যেতে হবে ওকে। আর তোমার আন্টিরা চাইছিলেন এরমধ্যে বিয়েটা দিয়ে দিতে। সূর্য তোমাকে নিয়েই ইউকে যাবে..”

— “কিন্তু তোমরা তো আমাকে কিছুই জানাও নি, বাবা! আমাকে তো জিজ্ঞেসও করো নি আমি এই বিয়েতে রাজি আছি কী না। আর ইউকে যাওয়া.. সে তো বহুদূরের কথা! আমি তো..”

— “বললাম তো জানানোর সময় ছিল না। এখন জানালাম, ব্যস! আর তোমাকে এতোদিন মানুষ করার পর নিজের পছন্দের পাত্রের সাথে বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে থাকা কি অমূলক? বাবা হিসেবে এটা কি আমার একেবারেই অনুচিত? বলো? তাহলে এতদিন ধরে তোমাকে মানুষ করলাম কেন আমি?…”

বাবা যেন হুট করেই রেগে গেলেন। আমি থতমত খেয়ে গেলাম তার কথার যুক্তি শুনে। ধীরে ধীরে বললাম,

— “কথা তো সেটা নয় বাবা! আমি ওটা বলছি না..”

— “তুমি যেটাই বলো, আখেরে এটাই দাড়ায়। যদি সেটা না বলতে চাও। তো বিয়েটা করে নাও! আর কোনো কথা নয়!..”

এ কথার পর আর কোনো কথা খাটে না। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ হেঁটে নিজের ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘুম থেকে উঠেছি দাঁত মাজা, খাওয়া-দাওয়া কিছুই হয় নি। সব ছেড়ে বিয়ে ভাঙার ধ্যান করতে বসলাম। এই বিয়ে আমাকে ভাঙতেই হবে! যে করেই হোক!

আমি মৌরি। একটা পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ছি। কয়েকদিন আগেই অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম শেষ করেছি। এখন আপাদত ফ্রি। খাওয়া দাওয়া ঘুম, দু’ একটা টিউশনি, এই আমার ডেইলি রুটিন। তারমধ্যে কোত্থেকে যেন মা বাবা এই বিয়ের ভূত চাপিয়ে দিতে চাইছেন মাথায়! ধুর! ভাল্লাগে না।

এবার আসি, ওই বদ ছেলেটার পরিচয়ে। নাম হলো ওয়াসিফ হাসান। নিক নেইম সূর্য। বহুত মেধাবী ছাত্র হলেও আমার দৃষ্টিতে খাটাসের খাটাস একজন! আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ইরেটেটিং ছেলে হলো এই। কেন? বলছি..

আমার বাবা এবং এই সূর্য মহাশয়ের বাবা দুজনে বাল্যবন্ধু। গ্রামের বাড়িও পাশাপাশি। একসাথে বেড়ে উঠেছেন, একই সঙ্গে জবে জয়েন করেন। পড়ে অবশ্য আঙ্কেল জব ছেড়ে বিজনেসে ঢুকে যান, সে যাই হোক। আমাদের বাসাও পাশাপাশি। একেবারেই দেয়ালের এপাশ আর ওপাশ। তো আঙ্কেলের দুই ছেলেমেয়ে। সূর্য আর রুতবা। স্বাভাবিকভাবেই ওদের সাথে আমাদের ওঠাবসা সেই ছোট্ট বেলা থেকে। রুতবার সাথে আমার খাতিরও খুব! কিন্তু সমস্যা একখানে.. অ্যান্ড ইট ইজ সূর্য!

ছোট বেলা থেকে খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হিসেবে নাম করেন সূর্য ভাই। সেজন্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই ছেলের উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে আমাকে। আমি কোন টিচারের কাছে পড়বো, কোন গাইড ইউজ করবো সবকিছুতেই অনুকরণ করতে হবে সূর্যকে! সে মহা ব্রিলিয়ান্ট, তাকে ফলো করলে আমারই সুবিধা হবে এই এক্সকিউজে।

কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এই অনুকরণীয় ছেলেটাই আমার জীবনে সবচেয়ে বিরক্তিকর লোক হয়ে দাড়ালো। সে বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। আমি ছোট থেকেই নিজের মতো করে চলতে পছন্দ করি, কাউকে ফলো করাটা কিংবা কারো দেখে দেখে সেটাই করতে হবে এসব আমার মধ্যে নেই। তাই সূর্য ভাইকে যখন উদাহরণ হিসেবে বলা হতো আমি বিরক্ত হতাম খুব। মানতে চাইতাম না।

তার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সে কখনো আমাকে আমার নাম ধরে ডাকতো না! মৌরি না ডেকে অলয়েজ ‘পাঁচফোড়ন’ বলে চিল্লাতো! কারণ হিসেবে বলতো, মৌরি মানেই পাঁচফোড়ন! আমি চরম বিরক্ত হয়ে রাগ দেখাতাম, ঝগড়া করতাম। কিন্তু কোনকিছুতেই কোনো লাভ হতো না। সে যেখানে সেখানে, যখন তখন, ইচ্ছে মতো গলা ছেড়ে হাঁক ছাড়তো, “পাঁচফোড়ন শুনে যা!” মা বাবাকে এই নিয়ে কত নালিশ করেছি! কিন্তু কোথাও কোনো সুফল পাই নি। সে তার মতই ডেকে যেত ‘ পাঁচফোড়ন’! আমাদের বেশির ভাগ ঝগড়া বোধ হয় এই ডাকাডাকি নিয়েই লাগতো! তাছাড়া আমার নিত্যদিনের অবাধ্যতা আর ত্যাড়ামো তো ছিলই!

সূর্য ভাই শহরের সবচেয়ে ভালো স্কুল থেকে পাশ করেছেন। তাকে ফলো করতে গিয়ে তার পিছু পিছু ওই স্কুলে আমাকেও অ্যাডমিট করা হয়েছিল। এটা ঠিক ছিল, যে ওরা আমার ভালোর জন্যই ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছে। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়।

স্কুলে সবসময় নজরদারির ভেতর ছিলাম আমি। কখন কী করতাম, সবকিছুর হিসেব রাখতেন সূর্য ভাই। মাঝে মাঝে কিছু কাজ করতে মানা করতেন, কিন্তু আমি ঘাড় ত্যাড়ামো করে শুনতাম না। ওই যে বলেছি, কাউকে ফলো করাটা আমার পছন্দ নয়! তাই প্রথম থেকেই এই অসহ্য ছেলেটাকে সহ্য হতো না আমার! তার সব কথাকে অগ্রাহ্য করার জন্য এই একটা যুক্তিই আমি খাটাতাম। ফলস্রুতিতে সে মহাশয়ও ক্ষেপে গিয়ে তুলকালাম করতেন। মায়ের কাছে আমার নামে অহেতুক নালিশ করে বিচারের পসরা সাজাতেন। আগেই বলেছি মা আমার সূর্যের কথা খুব বিশ্বাস করেন! তাই যখনই একটা নালিশ পেতেন, তা ঠিক হোক বা ভুল ফল ভোগ করতে হতো আমাকেই!

এই ছেলে থাকতে স্কুল লাইফটা আমার ত্যানা ত্যানা বানিয়ে রেখেছিল! এরপর সে যখন কলেজ পাশ করে ঢাবিতে ভর্তি হয়ে রংপুর থেকে বিদায় নিলো তখন খুব খুশি হলাম আমি। তখন ক্লাস নাইনে উঠেছি। বড়দের ভাষায় পাখা গজানোর সময় যাকে বলে! পরিচিত গণ্ডির বাইরে এসে নিজের খেই হারিয়ে ফেললাম। এতদিনের ভদ্র, শৃঙ্খলে আবদ্ধ পাখিটি যখন ছাড়া পেল একেবারই উড়াল দেয়ার চেষ্টা চালালো আকাশে! আকাশে ডানা মেলে দিয়ে পুরো আকাশটাকেই আয়ত্বে আনতে চাইলো!

বন্ধু-বান্ধবী জুটলো অনেকগুলো। নতুন-পুরোনো বন্ধু মিলিয়ে আমার তখন অনেক সহচর! না লেখাপড়ায় গাফিলতি হয় নি, তবে বন্ধুদের সাহচর্যে এসে খুব উশৃঙ্খল হয়ে উঠেছিলাম। এমন চললে লেখাপড়াকেও আর সামলে উঠতে পারতাম না সেটা মনে মনে বুঝেছিলাম। কিন্তু বন্ধুদেরকে ছাড়তে পারি নি। মানুষ অভ্যাসের দাস। আর সে অভ্যাসটা বদ হলে তা ছাড়ানো আরও যন্ত্রণার! তাই আগের মতো হবো হবো করেও আর হয়ে উঠতে পারছিলাম না।

দু’ তিন মাসের ব্যবধানে আমি হয়ে গেলাম ফাজিলের চূড়ান্ত! যদিও বাসায় কিংবা পরিচিত কারো সামনে নয়, উশৃঙ্খলতার সীমাটা তখনো বন্ধু বান্ধবদের সামনেই রাখতাম। কিন্তু কী করে যেন টের পেয়ে গেল সূর্য ভাই। ছুটিতে ঢাকা থেকে এসে আমার এক্কেবারে ক্লাস নিয়ে ছাড়লো! নানান ধরনের ধমকি-ধামকি, এমনকি দুইটা চড়ও মেরেছিলেন সেদিন! সঙ্গে আরও যে কতো জাতের অপমান!

আমি ভয় পেয়েছিলাম। ক্লাসে গিয়ে ব:দ:মা:শ হয়ে যাচ্ছি এটা যদি মাকে বলে দেয়? আশ্চর্যের কথা হলো এই, সূর্য ভাই আমাকে যতোই নিজের আয়ত্বের ভিতর রাখার চেষ্টা করতেন যতোই জোর খাটাতেন আমি ঠিক ততটাই অবাধ্য হতাম। তার প্রত্যেকটা কথার প্রেক্ষিতেই কথা বলতাম। ঝগড়া করতাম। ঘটনা বেগতিক না হওয়া পর্যন্ত আমি ত্যাড়ামো করেই যেতাম! কিন্তু সেদিন! সেদিন যখন সে আমাকে গালে থা:প্প:ড় কষিয়ে অপমানিত করলেন তখন আমি কিছুই বলতে পারলাম না। তিনি খুব রাগারাগি করে শেষ পর্যন্ত থ্রেট দিলেন বেশি বাড়াবাড়ি করলে মাকে অবধি জানিয়ে দিবে! সেই প্রথমবার, হ্যাঁ, সেই প্রথমবারের মতোন সূর্য ভাইয়ের কথা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলাম আমি। এবং এটাই বোধ হয় আমাদের প্রথম ঝগড়া ছিল যেটার রেশ বাড়ির ভেতর অবধি আসে নি!

উনি চলে আসার পর আবারো আগের মতো হয়ে গেলাম আমি। উশৃঙ্খল বান্ধবদের সাহচর্য ত্যাগ করলাম। আগের মতো নিশ্চুপ-নিস্তব্ধ-একাকী হয়ে গেলাম। পড়ুয়া বাচ্চার মতো পুরোপুরি লেখাপড়ায় ফোকাস করলাম।

এসএসসি পরীক্ষার পর আবারও পাখা গজালো আমার! কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নিজেকে যেন নতুন রূপে আবিষ্কার করলাম। নিজের পুরাতন অভ্যাস, একাকীত্ব, ঘরকুনো স্বভাব ছেড়ে মিশুক হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। পুরাতন কে ভেঙে নতুন করে গড়ে নিতে চাইলাম আমার সবটুকু! তবে এবার নিজের সীমাটা ভুললাম না। মানুষ এক ভুল দুইবার করে না। সূর্য ভাই তখনও ঢাবিতেই পড়ছেন।

কিন্তু আবারো সেই ঝামেলা লেগে গেল। তখনো নিত্য নিত্যই সূর্য ভাইয়ের সঙ্গে ক্যাচাল করছি আমি। পাশে নেই তো কী হয়েছে? ফোন আর ইন্টারনেটের যুগে ঝগড়াটাও আমাদের ডিজিটাল হয়ে উঠলো। এমনই এক দিনে..

সেদিন কলেজ থেকে ফিরছিলাম। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বোধ হয় বৃষ্টি শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সঙ্গে ছাতা ছিল না। তাই তড়িঘড়ি করে হাঁটছিলাম। কলেজ থেকে বাসায় আমি হেঁটেই যাতায়াত করি।

হঠাৎ পার্কের সামনে আসতেই একটা উটকো ছেলে এসে পথ আগলে দাড়ালো আমার। তাকে আগে দেখেছি কী না মনে নেই। হবে কোনো বখাটে-টখাটে! আমি পাত্তা না দিয়ে এগোচ্ছি হুট করেই সে আমার হাত টেনে ধরলো। আমি আতঙ্কে শিউরে উঠে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালালাম। সূর্য ভাইয়ের মতো কঠিন ছেলেকে আমি ভয় পাই না, কিন্তু এমন রাস্তার বখাটেদের তো অবশ্যই ভয় পাই! তারমধ্যে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ দুটো লাল! আমাকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে দাঁত বের করে হাসলো। হলুদ রঙের বিশ্রী সে দাঁতের ঝলকানি আর তার মুখভঙ্গি দেখে যেন কলিজা শুকিয়ে এলো আমার। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। আমি ক্রমাগত হাত মুচড়াতে লাগলাম। বলতে লাগলাম, “হাত ছাড়, হাত ছাড়!”

কিন্তু ছেলেটা ছাড়লো না। বরং বিশ্রী হাসি দিয়ে নিজেকে জয়ী বলে প্রমাণ করলো। আমি ভয়ে আশেপাশে তাকালাম। আকাশের বাজে অবস্থা দেখে রাস্তা আগেই ফাঁকা হয়ে গেছে। কেউ নেই সেখানে!

চারপাশ দেখে শঙ্কিত মন বারবার অশনি সঙ্কেত দিচ্ছিলো। ছেলেটা আমাকে একটা দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। আমি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে চিৎকার করলাম। তখন দেখি একটা রিকশা যাচ্ছে ওই পথ দিয়ে। আচমকা চিৎকার করতে দেখে ছেলেটা মুখ চেপে ধরলো আমার। ভয়ে-দুশ্চিন্তায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। সাহসী মৌরিও তখন অসীম ভয়ের জগতে ঢুকে গেছে! সেখান থেকে সহজে বেরোনোর উপায় নেই!

যখন কোনোকিছুই করতে পারছিলাম না তখন মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। “লা ইলাহা ইন্না আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনাজ জোয়ালিমিন।”– ক্রমাগত আউরে যাচ্ছিলাম। যখন দেখলাম রিকশাটা চলে যাচ্ছে তখন আরও জোড়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। ছেলেটা তখন দুই হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরেছে, ব্যাপারটা ধস্তাধস্তির পর্যায়ে চলে গেল। হঠাৎ!..

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন এসে ছেলেটাকে টান দিয়ে সরিয়ে দিলো আমার থেকে। আমি মুক্ত হয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকালাম সামনে দাড়ানো ব্যক্তিটির দিকে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সূর্য ভাই রক্তিম মুখে দাড়িয়ে আছেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ সশব্দে চড় পড়লো গালে! আমি নির্বাক দৃষ্টিতে গালে হাত ঠেকালাম। ছেলেটা এসে সূর্য ভাইয়ের শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মা:স্তা:নি করতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা চড়ের শব্দ তে স্তব্ধ হলো সব! আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম ছেলেটাকে একটার পর একটা চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি মেরে যাচ্ছেন সূর্য ভাই। ছেলেটা প্রতিরোধের চেষ্টা করছে কিন্তু সূর্য ভাইয়ের কঠিন মা:ই:রে:র কাছে ও যেন কিছুই না!

পাঁচ দশমিনিট পর ছেলেটাকে পিটিয়ে পার্কের কাছে অচেতন করে রেখে আমার হাত ধরে টেনে আনলেন সূর্য ভাই। একটা রিকশায় এনে ধাক্কা দিয়ে তুললেন। ভয়ে-বিস্ময়ে আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। নির্বাক চাহনিতে তার মুখের দিকে তাকালাম। সে রাগে কাঁপছে যেন। রিকশায় আগে থেকেই একটা লাগেজ আর ব্যাগ রাখা ছিল। বুঝলাম সূর্য ভাই আজই, এখনই ঢাকা থেকে ফিরছেন। হয় তো পথে আমাকে দেখে..

উনিও রিকশায় ওঠার পর পরই মামা প্যাডেল ঘুরালেন। রিকশা চলতে লাগলো আর আমি মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। সূর্য ভাই আমাকে কিচ্ছুটি বললেন না, জিজ্ঞেস করলেন না ঘটনা কি ছিল, কিচ্ছু জানতে চাইলেন না। শুধু তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,

— “না:গ:র জুটিয়েছিস ভালোই! কলেজ ছেড়ে পার্কে বসে অসভ্যতামি! নেশাখোর-মাতালের সাথে! হাহ্!”

আমি চুপ করে রইলাম। জবাব দেয়ার মত পরিস্থিতি আমার তখন ছিল না।
বাসায় এসে চুপচাপ ঘরে চলে এলাম। জানি না এই ব্যাপার নিয়ে সূর্য ভাই মায়ের কাছে কী কী বলেছেন! কিন্তু এর পরিণতি খুব ভয়াবহ ভাবে প্রভাব ফেললো আমার জীবনে। মা-বাবা দুজনেই রেগে আগুন হয়ে রইলেন। মা তো সরাসরি এসে মে’রে ঘরবন্দী করে ফেললেন আমাকে! বাবা মা’রা’মা’রি করেন নি ঠিকই তবে কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। আমায় ডেকে বলেছিলেন,

— “আমার সারাজীবনের দেয়া শিক্ষার এই মূল্য দিবে তুমি! ভাবি নি কখনো!”

আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে চলে এসেছিলাম। বাবার কথাটা গায়ে লাগে নি, বুকে এসে লেগেছিল। ইচ্ছে করছিল বাবার পা ধরে বলি, “আমি কিছুই করি নি বাবা! বিশ্বাস করো!” কিন্তু বলি নি, বলতে পারি নি। অজানা একটা অভিমানে মন ভারী হয়ে এসেছিল। সেটা কার উপর জানি না!

কেউ কিছু না বললেও আমি জেনে গিয়েছিলাম সেদিন ওখানে আমাকে আর ওই ছেলেটাকে দেখে সূর্য ভাই খারাপ কিছু ভেবেছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলেটা আমার প্রেমিক। তাই হয় তো বাসায় এসে যা নয় তাই বলেছেন! সবটা মিথ্যে জেনেও প্রতিবাদ করতে পারি নি আমি। কারণ সেটা বিশ্বাস যোগ্য হতো না কারো কাছে। আর সূর্য ভাইয়ের উপরও একটা ক্ষোভ জন্মালো আমার। আমরা ঝগড়া করতাম, মা’রা’মা’রি করতাম কিন্তু তাই বলে কি সে আমাকে এতোটা খারাপ ভাবলো? সে তো আমাকে একটু বেশিই চিনতো। আমি কোথায় কি করতাম সব জানতো! তাহলে?

এ ঘটনার পর একেবারই বদলে গেলাম আমি। একেবারে নিস্তব্ধ-নিঝুম-নির্জন দ্বি প্রহরের মতো শান্ত হয়ে রইলাম। প্রায় একমাস ঘরবন্দী থাকলাম। অহেতুক-অকারণ মায়ের সামনে যেতে ভয় পেতাম। নিজেকে গুটিয়ে ফেললাম পুরোপুরি ভাবেই।

সেই ঘটনার পর হঠাৎ কেন যেন আর সূর্য ভাইকে সহ্যই করতে পারতাম না আমি। সে আমাকে বাঁচালো সেজন্য কৃতজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু বাড়িতে এসে সে যেটা করলো তারপর আর প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ অবশিষ্ট রইলো না। বরং চরম ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম। সময়ের সাথে সাথেই সবার সাথে সম্পর্ক ভালো হয়ে গেল আগের মতো। কিন্তু সূর্য ভাইয়ের সঙ্গে ভুলেও কথা বলতাম না আমি। অভিমান না ঘৃণায় জানি না। তবে কথা বলতে ইচ্ছে করতো না।

একদিন বিকেলে ছাদের উপর একা বসে থাকার সময় সূর্য ভাই এলেন। খানিক্ষ্ন চুপ করে থেকে সরি বললেন। আমি মুখ ফেরালাম। সে পুরোনো কথাটা তুলে, ঘটনার আদি-অন্ত বললো। নিজের ভুলটা দেখিয়ে মাফ চাইলো। সহজে না মানলেও একসময় মেনে নিলাম। সম্পর্কটাও ধীরে ধীরে আগের মতো হয়ে এলো। আগের মতো ঝগড়া-ঝাটি, মা:রা-মা:রি! নিত্যদিনের অভ্যাস।

আবারো আমার লাইফে হস্তক্ষেপ শুরু করলো সে। Hsc পাশের পর পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেলাম। ভর্তি হলাম। ততদিনে তার লেখাপড়া শেষ। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে। সম্পর্ক আগের মতোই সাপে-নেউলে! কেউ কাউকে দেখতে পারি না। কথা হচ্ছিল তার পি এইচ ডি নিয়ে। সে ব্রিটেন থেকে পি এইচ ডি করার জন্য যাবে। ফর্মালিটিস কমপ্লিটের আগে একমাসের জন্য ইউকে তে গেলেন।

আমি আবারো ছাড়া পেলাম। আবারো ঝামেলায় জরিয়ে গেলাম। এটা আমার এক্সামের কয়েকদিন আগের কথা। এক সিনিয়র ভাই নাকি আমাকে পছন্দ করে এরকম বলছিল আমার বান্ধবীরা। ছেলেরটার নাম হলো অর্ণব। তার বাচ্চাদের মতো কিউট ফেসটা দেখলে মনেই হয় না সে মাস্টার্সে পড়া ছেলে। ব্যবহারেও সে খুব মার্জিত, খানিকটা লাজুক। তো এই লাজুক লাজুক ছেলেটা নাকি আমাকে পছন্দ করে! বান্ধবী মারফত এ খবর সে নিজেই জানিয়েছে! সামনাসামনি কিছু বলে নি। ডিরেক্ট যেহেতু কিছু বলে নি তাই আমিও আর পাত্তা দেই নি। কিন্তু হুট করে এসেই হাতে একটা গোলাপ আর একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে দৌড় দেয় ছেলেটা। আমি অবাক হয়ে কাগজের ভাঁজ খুলতেই দেখি ছোট্ট একটা প্রেমপত্র। রসবোধে ভরা। ঠিক রাজি না হলেও ছেলেটার সঙ্গে দু’ একদিন চা আর ফুসকা খেয়েছিলাম আমি। ছেলেটাকে সব জিজ্ঞেস করার পর সে শুধু বলেছিল বন্ধু হতে চায়। আমিও তাই না করি নি। কিন্তু কে জানত তাতে এমন কিছু হবে?

ভার্সিটিতে তখন মোটামুটি ভালো রকমের একটা গুঞ্জন উঠে গেছে যে আমি আর অর্ণব প্রেম করছি। কিন্তু ঘটনা বাড়ি পর্যন্ত আসবে ভাবি নি। সূর্য ভাই যে তখনো আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছেন তা কী আমি জানতাম? ফিরে এসেই আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেভাবে জিজ্ঞেস করলেন না কিছুই। শুধু ধমক দিয়ে বললেন,

— “ভার্সিটিতে কী প্রেম করতে যাস, ছা’গ’ল? এত্তোগুলো বাঁশ খেয়েও সাধ মিটলো না!”

আমি গাল ফুলিয়ে বলেছিলাম,

— “বাঁশটা তো আপনিই দিয়েছিলেন! সেখানে কি কোনো দোষ ছিল আমার?”

সে কথার জবাব না দিয়ে বলেছিল,
— “তুই আর ওই অর্ণবের সামনে অবধি যাবি না। যদি গিয়েছিস তো..”

— “তো?”

— “আঙ্কেলকে বলে রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেব তোর!”

— “ইহ! বললেই হলো! বিয়ে কি এত্ত সোজা? করবো না আমি বিয়ে। আর অর্ণবের সাথেই প্রেম করবো। আপনি দেখে নিয়েন!”

— “দেখা যাবে!”

ঝগড়ার পরি সমাপ্তি ঘটিয়ে যে যার কাজে চলে যাই। আমি তার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বরাবরের মতো ত্যাড়ামো করলাম। ভার্সিটিতে গিয়ে অকারনেই অর্ণবের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতাম। ফুসকা, চটপটি খেয়ে বেড়াতাম। উদ্দেশ্য ছিল সূর্য ভাইকে রাগিয়ে দেয়া!

কিন্তু সূর্য ভাই যে কি সাংঘাতিক সেটা আগে বুঝি নি। সে কী করলো? প্রথমে অর্ণবকে বেনামি চিঠি দিয়ে থ্রেট দিলো। তারপর হঠাৎ করেই একদিন অন্ধকারে পি’টি’য়ে পা ভেঙে দিলো! আমি খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি, হসপিটালের বেডের উপর ঠ্যাং ঝুলিয়ে পড়ে আছে অর্ণব। কাতরাচ্ছে একটু পর পর। জিজ্ঞাসা করলাম, “কি করে হলো?”

সে মাথা নাড়িয়ে বললো, “বন্ধুর বাইকে যাচ্ছিলাম, অ্যাকসিডেন্ট করেছি!”

বিশ্বাস না হলেও করলাম। অর্ণবের প্রতি প্রেম দেখিয়ে, সেবা করতে গেলেই ছিটকে সরে গেল সে। আতঙ্কে লাফিয়ে উঠে বললো,

— “এই এই! এসো না তুমি! যাও এখান থেকে!”

আমি অবাক হয়ে আরও কাছে ঘেঁষতেই সে একপ্রকার ভয়েই সিটিয়ে গেল দেয়ালের সাথে। নেহাত পা ভাঙা, নয় তো ছুটেই পালাতো নিশ্চয়!

আমি কিছু বলার আগেই সে কাটকাট ভাষায় বললো,

— “তোমার সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই আমার, মৌরি! আমি ব্রেক আপ করছি!”

আমি অবাক হলাম। সম্পর্ক তো কিছু ছিলই না। সে তবে ব্রেক আপের কথা কেন বলছে? ঠিক তখনই তার অ্যাক্সিডেন্টের কথা বিশ্বাস করতে গিয়েও করলাম না। বুঝলাম, ভেতরে ভেতরে কলকব্জা কেউ নাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই ব্যক্তিটি সূর্য ছাড়া আর কেউ নয়!

রাগে ছুটে গেলাম সূর্য ভাইয়ের কাছে। কঠিন ভাষায় শুধোলাম অর্ণবকে পি’টি’য়ে’ছে কে? সে নীরব, নির্বিকার থেকে বললো,

— “আমি তার কি জানি? ও আমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে যে আমি ওর পা ভাঙবো?”

— “সত্যিই পি’টা’ন নি? তাহলে আপনাকে কে বললো যে অর্ণবের পা ভেঙেছে?”

সরু চোখে তাকালাম। সে একটুও না ঘাবড়ে জবাব দিলো,

— “তুই হয় তো ভুলে গেছিস তুই আর তোর অর্ণব, কে কোথায় যায়, সব হিসাবই আমার কাছে থাকে! তাই কার ঠ্যাং ভেঙেছে আর কার মন সেটা আমি ভালো করেই জানি!”

বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো। আমি রাগে কটমট করে তাকিয়ে রইলাম। সে ব্যাপারটায় পাত্তা না দিয়ে বললো,

— “বাই দ্যা ওয়ে, মন তো ভাঙছে। নিশ্চয় ব্যথাও করছে? একটা কাজ করিস এই নে, প্যারাসিটামল। প্যারাসিটামল দুই বেলা, মন ভাঙার আগে একবার, পরে একবার!”

শেষ কথাটা মোশারফ করিম স্টাইলে বলে আমার হাতের মুঠোয় একটা প্যারাসিটামলের পাতা ঢুকিয়ে দিল। আমি চরম রাগে ভাষা হারিয়ে ফেললাম। চুপ করে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার পরবর্তী কার্যকলাপ দেখতে লাগলাম। সে হেসে হেসে বললো,

— “সরকারি হসপিটালের প্যারাসিটামল, বুঝেছিস? কাজ করবে ভালো। এর জন্য দশ টাকার টিকেট কেটে হসপিটালে রোগীর লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শুধু তোর জন্য! আফটার অল আমার পাঁচফোড়ন ছ্যাকা খেয়ে মন ভেঙে ফেলেছে! তাই আর কি!”

দাড়িয়ে থেকে তার আজাইরা প্যাঁচাল শুনতে আর ভালো লাগলো না। হাতের প্যারাসিটামলের পাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে এলাম। আসার সময় শুনতে পেলাম সে চিৎকার করছে,

— “আমার এতো কষ্টের তুই মূল্যই দিলি না, পাঁচফোড়ন? আমি এতো খাটাখাটনি করে, দশ টাকা খরচ করে হসপিটাল গিয়ে তোর জন্য প্যারাসিটামল আনলাম আর তুই? ভালাই কি কই জামানাই নেহি!”

কিছু বললাম না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে এলাম।
_______________________

সূর্য ভাই ফিরে আসতেই তার বাড়ির সবাই তার বিয়ের জন্য তাগাদা দিতে লাগলো। কিন্তু সে সাফ সাফ না করে দিয়ে বসে রইলো। ঘটনা যখন এই, তখন তাদের বাড়ীতে দিয়ে আন্টির কান ভাঙানি দিয়ে এলাম আমি নিজেই। বললাম,
“ছেলে বিদেশে যাচ্ছে, বিয়ে শাদী করে নি, কোনো বিদেশি মেয়েকে দেখে পটে গেলে? তখন আর দেশে ফিরবে? তখন তোমরা বাসায় বসে বসে শুধু ছেলের কথা ভেবে দুঃখবিলাস করো! আর কিছু করতে হবে না!”

আমার এই কথাতেই বোধ হয় কাজ হয়ে গেল! আন্টি একেবারে নাছোড়বান্দার মতো জেদ ধরলেন সূর্য ভাইকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন! খবর শুনে তখন আমি খুশিতে নাচছি। এতোদিন পর সূর্য নামক ব’দ’টা আমার ঘাড় ছেড়ে নামবে! মনে মনে অভিশাপ দিলাম, “বিয়ে কর না কর! খুঁজে খুঁজে এমন বৌ আনবো যে তুই আর দম নেয়ার সময় পাবি না। বৌ যদি তোকে নাকে দড়ি দিয়ে না ঘুরায়.. তো..” ইত্যাদি ইত্যাদি। নানা ভাবনা ভেবে নিজে নিজেই আনন্দিত হলাম। কিন্তু তলে তলে যে কী কলকাঠি নাড়লো সে! আল্লাহ ভালো জানেন! দু’ দিন আগে আমাকে ডেকে থ্রেট দিয়েছিল,

— “তুই আমার আম্মুর কাছে গিয়ে কী কথা লাগিয়েছিস? যে সে আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠলো?”

আমি খুশিতে দাঁত কেলিয়ে বলেছিলাম,

— “কী যে বলেন না সূর্য ভাই! আমি তো শুধু বলেছি ছেলে বড় হয়েছে বিয়ে দিয়ে দাও! ভুল কিছু বলেছি নাকি? আপনার তো আরও খুশি হওয়ার কথা। বিয়ে করছেন, ঘরে বৌ আসছে, কয়দিন পর বাচ্চাকাচ্চা হবে! আহা!…”

— “খুব মজা না? আমাকে ফাঁসিয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে?.. ঠিক আছে। আমিও দেখবো, কোথাকার জল, কোথায় গড়ায়…”

বলেই গটগট করে হেঁটে স্থান করলো। আর আমিও খুশিতে নাচতে নাচতে নিজের বাসায় এলাম।

এর ঠিক দুই দিন পর, আজ, আমার বাসায় বিয়ের কথা চলছে। বলা হচ্ছে আমার বিয়ে নাকি ওই ব’দ’টা’র সাথে! আর আমি এতো সহজেই সেটা মেনে নেব? কেউ না জানুক আমি তো জানি, এই বদ ছেলেটার পেটে পেটে কী বুদ্ধি! সে যে রিভেঞ্জের জন্যই বিয়ে করছে সেটা আমি ভালো মতনই বুঝতে পারছি। অর্ধেক জীবন আমার উপর দিয়ে শোষণের রোলার কোস্টার চালিয়ে সাধ মেটে নি, বাকি জীবনও জ্বালাতে চাচ্ছে! হুহ্!

এতকিছুর পরও কি এর মতো হাড়ে বজ্জাত ছেলেকে বিয়ে করা যায়? ওর মতো ইরেটেটিং, ডিসগাস্টিং ছেলেকে বিয়ে করে কে নিজের পায়ে কুড়োল মারতে চাইবে? আমি তো অবশ্যই নই! সো, এই বিয়েটা আমাকে ভাঙতে হবে। বাই হুক অর ক্রুক!

#চলবে—– কী?