Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1012



জানালার ওপারে পর্ব-১২

0

#জানালার_ওপারে
||১২তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
অত্যন্ত ভার ভার লাগছে আজকের দিনটা। নিসা যাওয়ার পর থেকে দরজা বন্ধ করে বসে আছি ঘরে। আর ভাবতে পারছি না। দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম।

ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন রাসেল সাহেব ল্যাপটপ নিয়ে। গভীর মনযোগ তার স্ক্রিনটার দিকে। কাজ করছেন হয়তো। ভাবলাম, কফি হলে মন্দ হয় না।

কফি নিয়ে এসে তার পিছনে দাঁড়ালে স্ক্রিনে দেখতে পাই এক মেয়ে অবিকল কোনো পৌরাণিক দেবীর কষ্টিপাথরের মূর্তি যেন। ছবিতে থাকা অঙ্গভঙ্গিমাও মূর্তির মতোন। কালো কাতান মারাঠিদের মতো পরা, চোখে ঘন কাজল, গা ভর্তি স্বর্ণালংকার, চুলগুলো হাত খোপা করা। ক্লাসিকাল নাচের ‘শান্তাম’ পোজে ছবিটি তোলা।

“গার্লফ্রেন্ড না কি অব্যক্ত প্রেয়সী রাসেল সাহেব? না কি বৈরীপ্রিয়া আপনার যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছেন?” ঠাট্টার ছলে টেক্সট করলাম তার ফোনে।

রাসেল সাহেব টেক্সটটা পড়ে আলতো হেসে ল্যাপটপটা বন্ধ করতে করতে উত্তর দিলেন,
“স্ত্রী সে আমার। অব্যক্ত প্রেয়সী এককালে ছিল, এখন নেই।”

একটু চমকিত বোধ করলাম। এতোদিন ধরে এখানে আছি রাসেল সাহেবের স্ত্রী সম্পর্কিত কোনো কথা শুনিনি। অবশ্য মানুষটা স্বল্পভাষী, কিন্তু মিষ্টিভাষী ও হাসি-খুশি ধরনের। পুনরায় টেক্সট দিলাম,

“আপনি ম্যারিড? কখনও বলেননি তো? আর ভাবী কোথায়? বাপের বাড়ি গিয়েছেন?”

“না, একবারে চলে গিয়েছে লন্ডন। মেয়ে আরিশাও তার কাছেই।”

“আ’ম সরি। আপনাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে আমি বুঝতে পারিনি।”

“ডিভোর্স? আমাদের কোনো ডিভোর্স হয়নি। শুধু এক দৃশ্যমান স্থানের ও অদৃশ্যমান মনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে সম্পর্কে।”

“আপনার কথা অনেক ধাঁধাময়! কটু খোলাসা করে বলুন।”

“আমি যখন ঢাকা ম্যাডেকেলে তৃতীয় বছরের ছাত্র তখন একটা অনলাইন ইভেন্টের মাধ্যমে আয়রার সাথে পরিচয়। সে তখন ঢাবিতে ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রী। ছয় মাসের পরিচয়ের পর বিয়ে, অনেকটা ঝোঁকের বশেই আমাদের বিয়ে। আয়রার বাবা-মা দুজনেই ইউকে প্রবাসী। তাদের কিছু জানায় না সে। আপু আমার হুটহাট এমন সিদ্ধান্ত ও কাজে চমকে ঠিকই গিয়েছিল। যদিও সমাদরে গ্রহণ করেছে আমাদের সম্পর্ক।

বিয়ের ছয়মাস গড়াতেই এক্সিডেন্টালি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে আয়রা। এবর্শন করানোর পক্ষে আমরা কখনওই ছিলাম না। আর আয়রার খরচ সে নিজেই সামলাতো, আমাদেরটা আমি এবং আপু মিলে। তাই ফাইনানশিয়াল কোনো প্রবলেমও ছিল না। এবার আয়রা তার মা-বাবাকেও জানালো। বাচ্চাটা গর্ভে আসার তিনমাস পর তার বাবার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ইউকে যাওয়ার কথা বললে আমি না করে দেই। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের মতো আগলে রাখা, বিয়ে অবধি না করা বোনটাকে একা ছাড়তে আমি পারবো না।

রাহা আপু চক্ষুশূল হয়ে উঠলো আয়রার। রোজ রোজ ঝগড়া করতো। আপু আমাকে তার কথা শুনতে বলতো। অবশেষে একদিন সে জানায় সে চলে যাবে একবারের জন্য। এবার হয় সে আর বাবু, না হয় বোন। আমি একটুও রাগ দেখাইনি। বরং শান্ত কণ্ঠ বলেছিলাম, ‘তুমি মেয়ে হওয়ার দায়িত্ব পালন করো, আমি আমার ভাই হওয়ার দায়িত্ব পালন করি। আমার কোনো অভিযোগ নেই। তুমি তালাক দিলেও থাকবে না।’ এই যা। একদম যে যোগাযোগ নেই তা নয়। ফ্রেন্ডলিস্টে আছি, মাঝেমধ্যে বন্ধুসুলভ কথা হয় রাত জেগে। তবে মেয়েকে রোজ দেখি ভিডিওকলে। সেই সুযোগে মেয়ের মাকেও…।”

বুকটা আরও ভারী হলো আমার।
“আপনি আজও তার আশা রাখেন? সে মুভ অন করেনি? এখন তো শুধু ডিভোর্সই বাকি, সুতো তো সব ছিঁড়েই গিয়েছে।”

“বললে না কেন বলি না তার নাম কখনও? আপু অনেক অপরাধবোধে ভুগে এসব মনে পড়লেও। আমি সবসময় হাসি টেনে রাখি মুখে, যাতে আপুর না মনে হয় আমি তার জন্য অসুখী।

আর কখনও কখনও আশার এক সুতোতেও কারো পৃথিবী বাঁচে। আমি আজও প্রহর গুনী তার অপেক্ষায়। একদিন নিশ্চয়ই আবারও আমার আকাশে চাঁদের দেখা দিবে। আমি জানি সেও আমায় ছাড়তে পারবে না। আজও পারেনি। আমিও পারিনি। সে নেই তো কী হয়েছে?

আমি ঘুম থেকে উঠে, ঘুমাতে যাওয়ার সময় আজও তার ছবি দেখি। আমার প্রতিটি শার্ট আমার নয় তার পছন্দের রংয়ের, আমার রুমটার সাজও তার রুচি মোতাবেক। সে আজও আমার কথা রাখতে রোজ রোজ অপছন্দের শাড়ি পরে, হিজাবে ফুলের ব্রুচ পরে। আমরা একসাথে না থেকেও একে অপরের সাথে আছি।

জানো, খুব কম মানুষ এতোটা সৌভাগ্যবান হয় যে ভালোবাসার সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পায়? তবে তারাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যবান হয় যখন পেয়েও সুযোগ হাতছাড়া করে।”

অলক্ষ্যেই এক ফোঁটা জল গড়িয়ে কফিতে মিশে গেল। আমিও কি ঐ সর্বোচ্চ দুর্ভাগ্যবান হতে যাচ্ছি নিজ দোষে? না, আমার সব জানতেই হবে।

“রাসেল সাহেব একটা হেল্প করবেন? আমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন?”

রাসেল সাহেব আলতো হেসে মাথা দুলায়।

নিসাদের বাসার কলিংবেল বাজালে আন্টি এসে দরজা খুলল। আমাকে দেখে অবাক হয়েছ, তা মুখভঙ্গিতেই স্পষ্ট।

“সামু, তুমি? আমাকে তো ভুলেই বসেছো। আসো, ঘরে আসো। তোমার বান্ধুবী তার রুমেই আছে।”

আমি আলতো হেসে নিসার রুমে যেয়ে বসলাম। নিসা রুমে নেই। তবে বাথরুম থেকে গুনগুন আওয়াজ আসছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে আমাকে দেখে বাক্যহারা আমার প্রিয় বান্ধুবী।

“সামু তুই এখানে?”

আমি মোবাইলে টাইপ করলাম,
“আমার আগামীকাল অপেক্ষা করার মতো সবুর নেই। আমাকে এখনই বল যা বলতে চাস, বলতে এসেছিলি। আর বাড়ি আমি সব শুনেই যাব, তাই তা বলিস না।”

মুচকি হাসলো সে। কুমড়োর মতো ধপ করে পাশে বসলো।

“পুরো ঘটনা বলতে গেলে অনেক কিছুই বলতে হয় সামু। তাই অতি সংক্ষিপ্ত ভাবেই বলছি। আচ্ছা, তুই বল, তোর একবারও কি মনে হয়নি একটা কথা? যে মানুষটা তোর গায়ে সামান্য আঁচড় লাগলেও পাগল হয়ে তোর পিছে ছুটে ,সে এতো বড়ো এক্সিডেন্টের পর একবারও আসেনি কেন তোর সামনে?”

আমার মুখ গম্ভীর হলো। এটা কেমন প্রশ্ন আবার? ভালোবাসা ছিল না তাই আসেনি। কারণ প্রেমিকার বোনের প্রতি লোক দেখানো দায়িত্ববোধ থাকে, ভালোবাসার দায়িত্ববোধ না।

“থাক, তোর কিছু বলতে হবে না। আমিই বলছি। আবেগ ভাই তোর এক্সিডেন্ট দেখে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। তিনিই কিন্তু তোকে হাসপাতালে এনেছিলেন। শক্ত, গম্ভীর ছেলেটাও পাগলের মতো কেঁদেছেন। হাসিব এবং আবেগ ভাইয়ের বন্ধুরা তাঁর অশ্রুর সাক্ষী। তিনি আর পাঁচ-দশটা ছেলের মতোন বলে-কয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন না। ঐদিনই কাঁদতে কাঁদতে শপথ নিয়েছিলেন নিজের পরিবার এবং তোর সামনে দাঁড়াবেন না ,যতোদিন না তোর অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারেন।

তুই বিপদমুক্ত শুনে বের হয়ে গিয়েছিলেন তোর জন্য ন্যায়বিচার আনতে। বিশ্বাস কর, একটা দিনও বাড়িতে ফিরেননি তিনি, কোর্ট-কাচারি করে করে তার সময় যেতো। কতো রাত যে কোর্টের বেঞ্চে ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। কখনও বা হলে চলে যেতেন শুধু গোসল করে কাপড় বদলাতে। শুধু বিয়ের শপিংয়ের জন্য এসেছিলেন নিজ হাতে তোর জিনিসপত্র কিনতে, তাও জয় অনেকটা নিশ্চিত করে। এরপর পুনরায় যোগাযোগের বাহিরে চলে যান।

জানিস তো, মতি ব্যপারী কতো বড়ো মাপের ব্যবসায়ী! বড়ো বড়ো লোক, মন্ত্রী-মিনিস্টারদের সাথে তার আনাগোনা। এতোটা সহজ ছিল না মতি মিয়াকে ছাড়া পেতে না দেওয়া। তার বেইল আটকানো। কারণ আর্শির বয়ান নেননি। তুই মানা করায় আবেগ ভাই আর্শিকে এসবের মাঝে টানতে চাচ্ছিলেন না।

এখানে তো কেইসের উপর কেইস বছরের পর বছর পড়ে থাকে। এতো ফাস্ট বিচারকার্য করাটা প্রায় অসম্ভব ছিল। তার উপর একটা কেইস চালাতে খরচ যা লাগে তার ধারণা তোরও খাণিম আছে। নিজের স্টুডেন্ট লাইফের এফডি সহ ভেঙ্গে ফেলসেন তোর জন্য।

তবুও সব অসম্ভব হতো, যদি না ভার্সিটির দুজন বড়ো ভাই, যাদের কি না এজজন বড়ো কর্মকর্তা ও আরেকজন হাইকোর্টের লইয়ার, তারা না সাপোর্ট করতেন। আর তাদের সাপোর্টটাও এমনি এমনি আসেনি। আবেগ ভাইয়ের অনেক রিকুয়েস্টে, পরিশ্রমে তারা হার মেনেছিল। কতোদিন যে তাদের বাড়ির বাহিরে বসে থাকতেন রাত তিনটা-চারটা অবধি!

তবে তিনি তোর রিলিজের পরদিনই বাড়িতে জানিয়ে ছিলেন তোর সাথে বিয়ে ঠিক করতে৷ তুই হয়তো জানিস না, আবেগ ভাই ছোট, তাঁর বড়ো বোন আছে। নানার বাড়িতে স্কুল লাইফ পাড় করায় বাবা-মায়ের সাথে অতো ফ্রী না। এমন একটা ছেলে নিশ্চয়ই তার বাবা-মাকে কল করে বলবে না আমি একজনকে ভালোবাসি, বিয়ে করবো তাকে। বড়ো বোন বা ভাই বা অন্যকাউকে দিয়ে বলাবে এটাই স্বাভাবিক।

আবেগ ভাইও তাঁর আপুকেই তোর কথা বলে। আপুর তোকে একদম পছন্দ ছিল না। তোর নামে একেক ধরনের কথা চলছিল চারদিকে, আর তুই কথা বলতে পারিস না, আর কোনো অজ্ঞাত কারণে তোর চালচলন, কথবার্তা সহ সবই তার চোখের বালি। তবে হাফসাকে বড্ড পছন্দ করতেন তিনি। তাই মস্তিষ্কে ছক আঁকেন হাফসাকে বউ করে আনার।

তিনি আবেগ ভাইয়ের থেকে শুনেছিলেন, তিনি একবারে বিয়ের দিন কোনো এক কাজ সেড়ে বাড়ি ফিরবেন, এতোদিন যোগাযোগ করতে পারবে না পরিবার বা কোনো আত্মীয়ের সাথে, ফোন সুইচড অফ থাকবে। ভেবেছিলেন বিয়ের দিন মান-সম্মান বাঁচানোর জন্য হলেও বিয়ে করবেন। আঙ্কেল-আন্টিকে তোর জায়গায় হাফসার কথা বলেন। তোর বাসায়ও হাফসার প্রস্তাব আসে।

আবেগ ভাইয়ের সাথে বিয়ে অবধি কারো কোনো যোগাযোগ ছিল না। আর শপিংয়ের দিনও আপু খুব চতুর ভাবে এই বিষয়ে একটু মাত্র আঁচ পেতে দেন না।আর তিনি শপিং শেষেই ফিরে গিয়েছিলেন। তাই জানতেও পারেননি।

আর আকদের কাপড় তোর পছন্দের রংয়ের। আবার শুনলাম আবেগ ভাই তোকে নিয়ে জ্বেলাসও ছিল রাসেল সাহেবের প্রতি। এতো মানুষ থাকতে হাফসা আন্টিকে বলে জোর করিয়ে তোকে নিল শপিংয়ে। তাও তুই বুঝিসনি? তুই যে তাঁকে শাস্তি দিচ্ছিস। এখন বল তাঁর দোষটা কোথায়?”

“কিন্তু আমাকে হাফসা যা যা বলল…” ম্যাসেজ পাঠালাম।

“ঐটা তুই ওর থেকেই জেনে নিস। তবে মনে হয় না ও যা বলছে তা সত্য। মেয়েটাকে আমার আগে থেকেই পছন্দ নয়। তোর জিনিসপত্র কেমন নষ্ট করে ফেলতো। আমি তো ওর চোখে হিংসাই দেখতাম, তুই বলতি ভুল করে। তাছাড়া পর কোনো দিন আপন হয় না, সেখানে কোন দুঃসম্পর্কের কাজিন বোন সে তোর।”

আমি নিসার উচ্চারিত প্রতিটি বাক্যে বাক্যে চমকে উঠছি। এও সম্ভব! কেমন যেন নাটকীয় সবকিছু!

অতি বিস্ময়ে যখন হা হয়ে বসে তখন আমাকে আরও বিস্ময় বাড়িয়ে নিসা বলে উঠে,
“আর হ্যাঁ, আবেগ ভাই কিন্তু এখন তোর আইনত স্বামী। ঐদিন হাসপাতালের ডিসচার্জ পেপারের সাথে রিসিপশনিস্ট আর ওয়ার্ড বয়কে টাকা দিয়ে তোর সাইন কাবিননামাতেও নিয়েছিল।

না হলে এদেশে ডিসচার্জ পেপারে কোন হাসপাতাল রোগীর সাইন নেয়, পরিবার থাকতে? এই বিষয়টা সে ছাড়া কেউ জানতো না, অবশ্যই তোর চিঠি পাঠানোর আগ অবধি।”

চলবে…

জানালার ওপারে পর্ব-১০+১১

0

#জানালার_ওপারে
||১০ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“কী হলো আসো মেয়ে!” ধমক দিয়ে উঠলেন তিনি।

কেঁপে উঠলাম আমি। এগিয়ে গেলাম তাঁর টেবিলের দিকে। তবে এই বেশভূষায় আমাকে চেনার কথা নয়। কেউই চিনতে পারেনি।

আমি স্থির হয়ে দাঁড়াতেই তিনি এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন। আমার গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি এতো অবুঝ কেন মেয়ে? একটা বার বললে কী গায়ে ফোস্কা পড়ে যেতো? আর তোমার সাহস কীভাবে হয় এ অসুস্থতা নিয়ে বাসা থেকে পালানোর! You deserve a real big punishment Mayabalika! Do you know?”

আমি চোখ-মুখ খিঁচে ফেললাম ভয়ে এই পরিস্থিতিতে পড়ে। ভয়টা আবেগ ভাইয়ের শাস্তি বা তিনি জড়িত নয়, যে আমার নয় তাঁর প্রতি বিন্দুমাত্রও অনুভূতি আমার কাজ করছে না, করে না। ভয় তো নয়ই। তবে বাবা-মা যদি জানতে পেরে আমাকে নিয়ে যেতে জোর করে এই ভয় কাজ করছে।

“আবেগ তোকে রশিদ স্যার ডাকছেন, ইমারজেন্সি। তাড়াতাড়ি যা।” একজন সিনিয়র এসে ডাক দেন তাঁকে।

“Stand right here. Don’t you dare to move.”

তিনি চলে গেলেন। আমি স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। কফি সমেত ওয়ান টাইম কফির কাপটা হাতে নিয়ে বড় বড় পা ফেলে বের হয়ে গেলাম ক্যান্টিন থেকে।

রাসেল সাহেবও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন ক্যান্টিনের সামনে। রাহা আপুর কড়া আদেশ কোনো ক্রমেই আমাকে একা ছাড়া যাবে না। তাই তাঁর আমাকে পিক করার কথা ছিল ক্যান্টিনের সামনে থেকে।

“সামু চলো।”

আমি সায় জানালাম। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কী মনে করে যেন পিছনে ঘুরি। আবেগ ভাই ভবনের দ্বিতীয় তলা হতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আরও দ্রুত পা চালাই এ দৃশ্য দেখে।


রাস্তা আজ বেশ ফাঁকাই ছিল, আধা ঘণ্টাতেই বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। রাহা আপু এখন হাসপাতালে। আসতে আসতে তাঁর রাত হবে আজ। আমি চুলায় ভাত বসিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এসে দেখি এখনও ভাত হয়নি। তবে কয়েক মিনিটের হয়ে যাবে। চাল হয়তো ভালো পড়েনি, কারণ নাজিরশাইল চাল সিদ্ধ হতে এতো সময় লাগার কথা নয়।

ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল বেজে উঠে। দ্রুতো দরজা খুলে কে আসছে না দেখেই ছুটে আসি রান্নাঘরে। কারণ চুলোয় ভাতের মাড় পড়লে, তা মুছা বেশ কষ্টকর। আর আজ রাহা আপু বা কাজের লোকও নেই। তাড়াতাড়ি পাতিল নামিয়ে ভাতের মাড় ঝরাতে বসাই।

“সামু ডিয়ার, কে এসেছে?” রাসেল সাহেব প্রশ্ন করতে করতে নিজের রুম থেকে বের হন।

আমিও রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বসার ঘরে যাই। সর্বপ্রথম যাকে চোখে পড়ে তিনি হলেন হাসিব ভাইয়া এবং নিশা। আর আমার পাশের সোফায় কপালে হাত দিয়ে শক্ত মুখে বসে আছেন আবেগ ভাই।

চমকে যাই। এতোটাই যে কয়েক মুহূর্ত থমকে যাই আমি। নিশার জড়িয়ে ধরায় ধ্যান ভাঙে আমার।

“কেমন আছিস রে সামু? আমাকে তো ভুলেই গিয়েছিস।”

আমি জোরপূর্বক হাসলাম। রাসেল সাহেবও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে বেমানান ভাবে কাশি শুরু হয় আমার। গতরাতে এক বসায় ৫০০ ml আইসক্রিম শেষ করার ফলাফল হয়তো।

আবেগ ভাই অবিলম্বে উঠে দাঁড়ান পানি আনতে। কিন্তু তাঁর আগেই রাসেল সাহেব এক গ্লাস পানি এনে দেন। এতে অন্যরকম এক আক্রোশ দেখা দিল যেন এই অসভ্য লোকটার চোখে-মুখে। কিন্তু তাঁর কী?

তিনি এসে আমার হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরেন।
“অনেক দেখেছি তোমার কাহিনী মেয়ে। এখনই বাসায় চলো আমার সাথে।”

রাগের সাথে সাথে বিরক্তিও মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। ঝাড়া দিয়ে হাত ফেলে দেই। রাসেল সাহেব প্রথম বারের মতো মুখ খুলেন সবার সামনে।

“আসলে ও যখন যেতে চাচ্ছে না। জোর করছেন ক্যানো? ঠাণ্ডা মাথায় বসে কথা হলে ভালো হয়।”

“দেখুন, মিস্টার। আমি আমার ওয়াইফের সাথে কথা বলছি। দয়া করে আপনি এতে ইন্টারফেয়ার করবেন না।”

আমার বিস্ময়ে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। আমি কি হ্যালুসিনেশন করছি বা ভুল শুনছি? কী বললেন তিনি?

“ওয়েট এ মিনিট, আপনার বিয়ে তো সামুর ছোটো বোনের সাথে… সামু আপনার ওয়াইফ মানে?”

“Who the hell are you? আপনাকে কেন এক্সপ্লেইনেশন দিব আমি? কী হন আপনি আমার বা মায়াবালিকার? আর মেয়ে তুমি কি যাবা আমার সাথে না কি যাবা না? সোজাসুজি বলো।”

কিছুটা ধমকের ছাপ। আমি চোখ অন্যদিকে রেখে মাথা নাড়াই, যার অর্থ না।

“এখানে কি মধু পেয়েছো যে নিজের বাসায় ফিরবা না? ফিরো না আমার সাথে। সবাই তো আমাকে পেয়েছো পাগল বানাতে। একজন আমার ভালো করতে যেয়ে দশ হাত পানির নিচে ঢুকায় দেয়, আরেকজন অনর্থক শাস্তি দেয়। রাখো বানিয়ে পাগল। আমার তো কাজ নেই, সারা দিন তোমার পিছনে টুকটুক করে ঘুরবো।”

একঝাঁক অভিযোগ, তাড়না ও অভিমান প্রকাশ পেল তাঁর কথায়৷ যা বোধ করতে পারলেও প্রতিক্রিয়া দেখানোতে নিষেধ।

পরিস্থিতি বিপরীতে যেতে দেখে নিশা শুধায়,
“ভাইয়া, আপনি একটু সামনের লেক থেকে ঘুরে মাথা ঠাণ্ডা করে আসেন। হাসিব আপনিও যান ভাইয়ার সাথে। অনেকদিন পর দুই বান্ধবীর দেখা হয়েছে, আমরা কথা বলি।”

আবেগ ভাই হনহন করে বের হয়ে গেলেন। পিছন পিছন হাসিব ভাইয়াও চলে গেলেন। আমিও আমার জন্য নির্ধারিত ঘরের এসে পড়লাম। নিশা কাঁধে হাত রাখতেই তাকে জড়িয়ে ধরি শক্ত করে নিজেকে সামলাতে। তবুও এক ফোঁটা জল বেরিয়েই আসে বাধ ভেঙে।

নিশা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রথম যে কথাটা উচ্চারণ করে, তা হলো –
“সামু, আবেগ ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। তিনি তো জানতোও ন…”
|
চলবে…

#জানালার_ওপারে
||১১তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“সামু, আবেগ ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। তিনি তো জানতেনও না তোর সাথে না, হাফসার সাথে বিয়ে। ইভেন শুধু তিনি কেন, আমরা, আমাদের ভার্সিটির বন্ধুমহল, সিনিয়র্স সবাই জানে তোর আর আবেগ ভাইয়ের বিয়ে। তুই যদি সোশিয়াল মিডিয়া আনইন্সটল না করে কারো সাথে একটু কথা বলতি বা ভার্সিটিতে যেতি তাহলেই জল এতোদূর গড়াতো না।”

প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয় আমার। এমন হাস্যকর কথার কোনো অর্থ হয় না কি? যার বিয়ে তিনি জানেন না কনে আমি না, হাফসা, এও সম্ভব? হাতের ইশারায় থামিয়ে দেই নিশাকে।

উঠে খাতা কলম এনে লিখি,
“একদম আজগুবি, হাস্যকর কথা বললি না নিশু! কারো বিয়ে আর তাঁর কাছে সঠিক ইনফরমেশন নাই কার সাথে তাঁর বিয়ে! আচ্ছা, একবারের জন্য মানলাম তিনি জানতেন না। কিন্তু বিয়ের দিন অবধি কারো মুখেও শুনেননি তাঁর বউ কে! এও মানতে বলছিস আমায়?

তোর স্বামীর প্রিয় বন্ধু মানে তোর ভাসুর বলেই কি সাপোর্ট করছিস? আমি তোর স্কুলের বান্ধুবী, কিছু না এখন…? আর সাপোর্ট করলেও সরাসরি বল, এসব আজগুবি কাহিনী বানাইস না প্লিজ। আরও একটা সম্পর্ক থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।”

শক্ত মুখে খাতাটা নিশার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে দেখে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেললো।

“তোকে এভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। তুই বাড়ি চল, ঠাণ্ডা মাথায় সব শুনে তুই নিজেই সিদ্ধান্ত নিস।”

“আমি কোনোক্রমেই বাসায় যাবো না। আর তাছাড়া রাহা আপুও বাসায় নেই, তাঁর সাথে দেখা না করেও কোথায় যাবো না। না আমি তাঁর সাফাইজবাব তোর মুখে শুনতে রাজি।”

পুনরায় খাতা কলম নিয়ে লিখি। আমার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে পার্স থেকে নিজের ফোন বের করে।

কিছুক্ষণ টিপাটিপি করে একটি ভিডিও চালু করে আমার সামনে ধরে। ভিডিওটির টাইটেল ও কন্টেন্ট দেখে আমি থমকে যাই।

একটি সংবাদ চ্যানেল কর্তৃক তৈরিকৃত সংবাদ। টাইটেল হলো ‘কিশোরীকে ধর্ষণ থেকে বাঁচানোর ফলে বিত্তবান ব্যবসায়ীর আক্রোশের শিকার সাহসী তরুণী”। ভিডিওটিতে মতি ব্যাপারীর আদালত থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়ে বের হওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। পরের দৃশ্যে আমার দুই বছর আগের গাউন-হিজাব পরা একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখানো হচ্ছে স্ক্রিনে।

সুদর্শন একজন রিপোর্টার রিপোর্টিং করছেন। বলছেন,
“গল্পটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর। চেহারার মতোই হাসিখুশি, স্নিগ্ধ, শান্তশিষ্ট, পরোপকারী, প্রতিবাদী। আর দশটা মেয়ের মতোই সুন্দর একটা জীবন ছিল তার। কিন্তু তার পরোপকার করার গুণটিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো।

দিনটি আজ থেকে মাস খাণেক আগের পনেরো তারিখ, বুধবার দুপুরের। অন্যান্য দিনগুলোর মতোই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছিল মেয়েটি। মেইন রোডে ট্রাফিক জ্যাম থাকায় পিছনের একটি জনমানবশূন্য গলি দিয়ে বাসার জন্য রওনা হয়। যাত্রাপথেই দেখতে পায় এক গায়ে কাটা দেওয়া দৃশ্য।

বিত্তশালী ব্যবসায়ী মতি মিয়া তার দুজন সহায়ক রনি ও মনির সাথে মিলে একটি বারো বছরের কিশোরী মেয়েকে আটকে রেখে অপকর্ম করার চেষ্টা করছে।” স্ক্রিনে আমার ধারণ করা ঐদিনের ভিডিও ফুটেজটি দেখানো হয়।

❝মেয়েটিও পারতো অন্যান্যদের মতো ভয় পেয়ে চলে যেতে বা এড়িয়ে যেতে। সে ভয় পায়নি এমন নয়, কিন্তু সে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হতে দেয়নি। বরং, তখনই কল করে ১০৯ এ ও নিজের হবু স্বামীকে। বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সে নিজের ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করে তাদের অপকর্মের দৃশ্য। অদম্য সাহসিকতার সাথে প্রতিবাদ করে হায়নাদের বিরুদ্ধে।

পুলিশ কর্মীরা সঠিক সময়ে পৌঁছিয়ে মতি মিয়াকে গ্রেফতার করে। এতেই যেন মতি নামক পশুর আক্রোশের শিকার হয় সে। অর্থের জোরে বেইলে ছাড়া পেতেই হত্যার চেষ্টা করেন এই সাক্ষাৎ ফেরেশতার ন্যায় মেয়েটিকে। সফলও হন অনেকটা। তবে কথায় আছে না, রাখে আল্লাহ, মারে কে? সৃষ্টিকর্তার রহমতে মেয়েটি বেঁচে যায়। তবে হারায় তার বাকশক্তি। এর পর থেকেই তার স্বামীর যুদ্ধ ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য।

অবশেষে আজ সফল হলেন তিনি প্রিয় স্ত্রীকে ন্যায়বিচার দিতে। প্রেয়সীর জন্য তো তাজমহল অনেকেই তৈরি করতে পারেন, তবে ভালোবাসার এ উৎকর্ষ উদাহরণ কত জন হতে পারেন? যারা দুঃসময়েও হাত আগলে রাখতে জানে। আজকের দিনটি এমন অসাধারণ সব ভালোবাসার নামে। বলা বাহুল্য, ভিক্টিমের ও তার পরিবারের অনুরোধে কিশোরী মেয়েটির চেহারা ব্লার রাখা হয়েছে।”

ভিডিও স্টপ করে তাতে করা মানুষের মন্তব্যগুলো একে একে দেখায় আমায় নিশা। যেই আমি কাল পর্যন্ত মানুষের তিরস্কারের শিকার হচ্ছিলাম, সেই-ই আজ এতো ভালোবাসা ও সমর্থনের অধিকারী। চোখে জল চলে আসে আমার। কিন্তু এতো সব কখন বা কীভাবে হলো? আনন্দকে ছাপিয়ে গেল বিস্ময় ও জিজ্ঞেসা। আমি কি সত্যিই ভুল বুঝছি আবেগকে?

প্রিয় বান্ধুবীর হাত ধরে জিজ্ঞেসু চাহনি নিক্ষেপ করতেই সে ম্লান হাসে।

“দেখ, আবেগ ভাইয়ের চেয়ে তুই আমার হাজার গুণ বেশি আপন। কিন্তু তাই বলে তো আমি সত্যকে মিথ্যে মেনে বিচার করতে পারি না। এই যা দেখলি, সবকিছুর পিছনে আবেগ ভাইয়ের হাত। তাঁর একাধিক নির্ঘুম রাত্রি, অক্লান্ত দৌড়াদৌড়ি, পরিশ্রম, এমন কী তাঁর ছাত্রজীবনের সঞ্চিত সকল অর্থের বিপরীতে আজ তোর জন্য ন্যায় এনেছেন। আমি তোকে আজকে ফিরার জন্য বা আমার সাফাই শুনার জন্য জোর করবো না৷ বরং, তুই শান্তিতে ভাব, একটু ভাব। আমি কাল আবার আসবো৷ তুই যদি আমার কথা, তাঁর জবাব শুনতে চাস, তবে আমার সাথে বাড়িতে চলিস। কোনো জোরাজুরি নেই, তোর জীবন, তোর ইচ্ছে।”

আমাকে আরও একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল সে। আমি চুপ করে বসে থাকলাম। প্রকৃতপক্ষেই আমার সময় চাই, নিজের মতো কিছুটা সময়। এতোটা কনফিউজ, দ্বিধান্বিত জীবনের কোনো পর্যায়ে আমি হইনি।

চলবে…

জানালার ওপারে পর্ব-০৯

0

#জানালার_ওপারে
||৯ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“এই মেয়ে মাঝ রাস্তায় কী করছিলে তুমি? পাগল হয়েছো তুমি? আমার কী হতো তোমার কিছু হয়ে গেলে?”

পিটপিট করে চোখ খুলতেই পুরুষালি কণ্ঠ কর্ণগোচর হয়৷ বড্ড অস্থিরতা তার কথায়। মাথাটা ঘুরিয়ে দে পারলাম না, ব্যথায় আর্তনাদ করে চোখ বন্ধ করে ফেলি।

“তুমি ঠিক আছো? বেশি কষ্ট হচ্ছে?”

আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালাম এবার। অবাক আমি। রাসেল সাহেব এখানে কী করছেন? আমিই বা এখানে কেন?

তিনি আমাকে ধরে হেলান দিয়ে বিছানায় বসান৷ এর মধ্যেই রুমে প্রবেশ করে একজন ঊনত্রিশ-ত্রিশ বছর বয়সী নারী। পরনে প্লাজু, লং ঢোলা লেডিস শার্ট, গলায় স্কার্ফ ঝুলানো।

“সামু ডিয়ার, আর ইউ ওকে নাউ? একদম তো ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলে আমাদের। আমাদের তো আজ জেলে যেতে হতো তোমার জন্য।”

আমি অদ্ভুত এক গোলকধাঁধায় পড়ি। এখানে কী করছি আমি? এই নারীটাই বা কে? রাসেল সাহেবের স্ত্রী না কি? কিন্তু জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। ঐ যে আমার প্রতিবন্ধকতা। সে বরাবরের মতোই আমার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

নারীটি হয়তো বুঝতে পারে আমার মনের অবস্থা। আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

“বোনু, আমি হলাম তোমাদের ডক্টর রাসেল সাহেবের বড়ো বোন রাহা। তুমি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমাদের গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল। একটুর জন্য কোনো ক্ষতি হয়নি জাস্ট কপালে একটু কেটে গেছে, আর হয়তো অনেক ক্ষণ ধরে অভুক্ত ছিলে তাই সেন্সলেস হয়ে যাও। I don’t know you want to talk about this or not. কিন্তু আমার যতোটুকু মনে হয় তুমি নিজ ইচ্ছেতেই গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলে।”

মাথা নত করে ফেললাম আমি। তিনি হয়তো বুঝতে পারলেন তাঁর ভাবনাই সত্য।

“এজন্যই আমি তোমার বাসায় রাসেলকে কিছু জানাতে দেইনি। ব্যাগ প্যাক করা দেখেই বুঝেছি। জানো আমার একটা ছোটো বোনের বড্ড সখ ছিল। এসেও ছিল ছোটো বোন রাইসা, রাসালের এক মিনিটের ছোটো। কিন্তু বোনটা দুই বছর বয়সেই অসুস্থ হয়ে মারা গেল। তোমাকে দেখলেই ওর মাসুম মুখটা ভেসে উঠে চোখে। আমি তোমার বড় আপুই। আপু হিসেবে নয়, আরেকজন মেয়ে ভেবেই নিজের কষ্টগুলো শেয়ার করতে পারো।”

ফোন হাতে গুঁজে দিলেন আপু। ইতঃস্তত বোধ করলাম। তবুও অল্প শব্দে ফোনে টাইপ করে সবকিছু জানালাম আমি। রাহা আপু ফোন হাতে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই জড়িয়ে ধরে আমায়।

ফিসফিসিয়ে শুধায়,
“এই মানুষগুলো এতো বেইমান হয় কেন বলো তো? মিথ্যে প্রেমের মায়ায় ফেলে, আলবাত অন্য একজনকে নিয়ে ঘর করে। ভুলে যায় সব ওয়াদা কতো সহজে। অপরজন শুধু ধুঁকে ধুঁকে মরে। তুমি কোথাও যাবে না। আমার সাথে থাকবে।

ঐ পরিবারেরও তোমার প্রয়োজন নেই যারা তোমার অসহায়ত্বে তোমার সাথে দাঁড়াতে পারে না। আমার সামু ডিয়ার তুমি এখন থেকে বুঝলে? আর হ্যাঁ মেয়ে, এই শহরিটা মোটেই ধোঁকাবাজ নয়, এই শহরের মানুষগুলোই শুধু গিরগিটির মতোন রং বদলায়। শহরটা তো নিজ রঙেই স্থির থাকে।”

রাহা আপু আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ললাটে আদর সিক্ত চুমু খেলেন। আমি এখনও বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে আছি। এক দিনের সাক্ষাতে কেউ এতোটা আপন কীভাবে করে নিতে পারে?

“আচ্ছা প্রিয় বালিকা, আমি তোমার জন্য স্যুপ করে আনছি। তা খেয়ে নিবে, ওকে? আর আগামীকাল থেকেই তোমার থ্যারাপি শুরু হবে, বুঝলে? মনে রেখো, তোমায় ঘুরে দাঁড়াতে হবে নিজের জন্য, নিজেকে ভালোবাসবে। অন্যকারো জন্য নয়। জীবনটা এক যুদ্ধ, যে যুদ্ধে যোদ্ধার প্রথম কর্তব্য নিজেকে প্রাধান্য দেওয়া এবং নিজেকে ভালোবাসা ও নিজে নিয়ে ভাবা।”

আমি কৃতজ্ঞ দৃষ্টি তাকিয়ে থাকি। তবে রাসেল সাহেবকে কেমন যেন অন্যরকম দেখা যাচ্ছে। যেন তিনি আশাহত কোনো বিষয় নিয়ে। আমি মাথা ঘামালাম না। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো, তবে সে ইচ্ছে কুরবানি দিলাম। কারণ আমার জন্য কাউকে প্রশ্ন করাও বড্ড ঝামেলার কাজ।

রাহা আপু স্যুপ ও ঔষধ খায়িয়ে দিলে আমি ঘুমিয়ে যাই। রাহা আপুও আমার সাথে শুয়ে পড়েন।


কোরআন তিলাওয়াতের মনোমুগ্ধকর আওয়াজে ঘুম ভাঙে আমার। চোখ মেলতেই রাহা আপুর নুরানি চেহারা দেখতে পাই। অনেকটা ভারতীয় নায়িকা নিধি আগারওয়ালের মতোন মিষ্টি চেহারার অধিকারী তিনি।

আমাকে খেয়াল করতেই মিষ্টি একখানা হাসি দিলেন।
“শুভ সকাল সুইটি। ঘুম ভালো হয়েছে?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম। মাথাটা বরং ভালোই লাগছে এখন। আপু উঠে একসেট থ্রিপিস হাতে দিলেন।

“যাও সামু, ফ্রেশ হয়ে নেও। আমি বাহিরে আছি দরকার হলে দরজায় নক করবা।”

কথা অনুযায়ী গোসল করে নেই আমি। আপু কফি করছেন। ততক্ষণে আমি ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাটটা দেখছি। ধানমণ্ডির বেশ বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। বিশাল বিশাল দুটো লাগোয়া বাথরুম ও বারান্দা সহ বেডরুম, একটা ছোটোখাটো গেস্ট রুম, লিভিংরুম, ডাইনিং স্পেস, কী নেই? তবে রাহা আপুর মা-বাবকে কোথাও দেখছি না।

“সামু বেবি, যাও তো সোনা। একটু রাসেলকে কফিটা দিয়ে আসো। বা’দিকের ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব’ বোর্ড লাগানো রুমটা ওর।”

আমি কফির কাপ হাতে গেলাম তাঁর রুমে। অগোছালো কামরা, বাথরুম থেকে জলের শব্দ আসছে। বুঝলাম স্নান করছে, কফির কাপটা খাটে রেখে বাথরুমের দরজায় করাঘাত করে বেরিয়ে গেলাম।

পাখির কিচির-মিচির শব্দ শুনতে পেলাম আমি। শব্দ অনুসরণ করে পা বাড়ালেই মিনি ট্যারেসে পৌঁছে যাই৷ বিশাল বড়ো এ্যাকোরিয়াম রাখা দেয়াল ঘেঁষে। তাতে বিভিন্ন জাতে মাছ রাখা। দুটো খাঁচা পাখির, এক জোড়া লাভ বার্ড ও এক জোড়া টিয়া পাখি৷ বাকি ট্যারেস জুড়ে বিভিন্ন ফুলের গাছ। তবে কামিনী ফুল ও বেলি ফুলের ভুবান ভুলানো ঘ্রাণটাই টানছে বেশি।

রাহা আপুও পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এর মধ্যে। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
“সুন্দর না আমাদের মিনি ছাদ বাগানটা? সবটাই রাসেলের নিজ হাতে গড়া। ছোটো থেকে তার এসবের প্রতি ঝোঁক বেশি। তখন তো নিজেদের বাড়ি ছিল না, এখন সব হয়েছে। আমি ডাক্তার, রাসেল ডাক্তার।

আব্বা-আম্মার আজীবনের সঞ্চয় আর আমাদের পুঞ্জিত টাকায় গড়া এই সুন্দর দুনিয়া। অথচ, বাবা-মা দেখতেই পারলো না কিছু। আমি মেডিকেলে পড়াকালীনই বাবা-মা মারা যান। অনেক যুদ্ধ করে আমরা এইখানে পৌঁছিয়েছি।

জানো সামু, বাবা-মার ছায়া হারানোর পর যখন সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল প্রিয় মানুষের সঙ্গের তখনই সে হাত ছেড়ে দেয়। আমার মতো চালচুলোহীন এতিম মেয়েকে না কি বিয়ে করে যায় না। সেই থেকে আমাদের যুদ্ধ শুরু সফলতার। ধোঁকা আমিও খেয়েছি, কিন্তু মৃত্যু বা হার মানা কখনওই আমার জন্য অপশন ছিল না। আজ ভাবলে মনে হয় সে ছেড়ে না গেলে আজ এই জায়গায় হয়তো থাকতাম না আমি।”

খুব মন দিয়ে শুনলাম রাহা আপুর কথাগুলো। মানুষটি হাসির আড়ালে কি সুন্দর দুঃখগুলো লুকিয়ে রাখে! এজন্যই হয়তো আপু আমাকে এতোটা আপন করে ফেলেছিলেন। কারণ তিনি নিজেও এই যন্ত্রণার ভুক্তভুগী।

“কী রে! তোমরা এখানে কী করো? আপু, তুই কি মেয়েটাকে বকবক করে পাকাচ্ছিস আমাকে যেমন পাকাস?”

মুখ থেকে বের হতে দেখি শেষ বাক্যটি, আপুর রাসেল সাহেবের কান টানতে না। রাসেল সাহেব কাতরে উঠেন ব্যথায়।

“সরি, সরি, আপু। ছাড় আমাকে।”

আমি হেসে দেই তাদের খুনসুটি দেখে। কতো ভালোই না হতো যদি সব ভাই-বোনের সম্পর্ক তাদের মতো হতো।

ব্রেকফাস্ট করার পর আপু আমায় হাসপাতালে নিয়ে যান স্পিচ-ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজিস্টের কাছে। আপুই আমার চিকিৎসার ভার উঠিয়েছেন ডাক্তার হিসেবে। আপুর পরিচিত একজনই থ্যারাপি দিচ্ছেন আমায় ব্যক্তিগত ভাবে বিনা অর্থে।

দুই সপ্তাহ কেটে গিয়েছে রাহা আপু ও রাসেল সাহেবের সাথে। মিনি ট্যারেসে দাঁড়িয়ে ভাবছি, ঋণের বোঝা দিনে দিনে ভারী হচ্ছে। এতো ঋণ কীভাবে শোধ করবো ভেবে পাচ্ছি না। অর্থের ঋণ না হয় শোধ করা যায়, তাদের ভালোবাসা, যত্ন, সঙ্গ দেওয়ার শোধ কী করে ফিরিয়ে দিব? এতোটা দিন ধরে থাকছি, একদিনও বোধ করিনি আমি এই বাড়ির কেউ নয়।

“এই কন্যা, সকাল সকাল এখানে কী করো? যাও, রেডি হও।”

অবাক হই। কোথাও যাওয়ার কথা তো আজ ছিল না। জিজ্ঞেসু চাহনি আমার।

“আরে বুড়ি, এভাবে ঘরে বসে থেকে পড়া গোল্লায় যেতে দিলে হবে? আজকে ভার্সিটিতে যাবে। ক্লাস করে আসবে বুঝলে। আমি জানি তুমি কী ভাবছো। তবে এসব চিন্তা করে নিজের ক্ষতি করলে হবে না।কারো সাথে দেখা হলে এড়িয়ে যাবা সুন্দর ভাবে, ওকে?”

আমি সায় জানালাম। রাহা আপুর কথা তো আর ফেলা যায় না। কিন্তু সত্যি বলতে আমার মোটেও যেতে ইচ্ছে করছে না, বড়ো বেশি দ্বিধা বোধ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে। যদি কারো সাথে দেখা হয়, যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে…

অনেক ভেবে পাশের ফ্ল্যাটের আন্টির বেশ ঢোলা-ঢালা একটা খিমার পরে বের হলাম রাসেল সাহেবের সাথে। ড্রাইভ করতে করতে তিনি নানা ধরনের গল্প জুড়ে দিলেন একা একাই। আমার তো কথা বলার ক্ষমতা নেই ইচ্ছে থাকলেও। হ্যাঁ-না ইশারা করতে করতেই ভার্সিটিতে এসে পৌঁছালাম।

কোনো দিকে না তাকিয়েই মাথা নত করে ক্লাসে চলে গেলাম। সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। স্যার প্রশ্ন করলেন, “নতুন?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম। ক্লাস শেষে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেলাম। ক্যান্টিনে বসে আছি তখনই সেই বজ্রকণ্ঠের ডাক,
“এই মেয়ে এদিকে আসো।”

আবেগ ভাই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দুই টেবিল সামনে বসে আমাকে দেখছেন। তাঁকে কেমন যেন ছন্নছাড়া দেখাচ্ছে। তাঁকে দেখেই ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যায়। তবে কি আজ ধরা পড়েই যাবো?
|
চলবে…

জানালার ওপারে পর্ব-০৮

0

#জানালার_ওপারে
||৮ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
🌺🥀পৃষ্ঠা- ৯
মাথার উপর সূর্য, খাই খাই রোদ। জীবনে প্রথম এমন পরিস্থিতিতে এসে মাথা ঘুরাচ্ছে আমার। আমি কীভাবে আটকাবো? পারবো এই লোকটার সাথে?

ফাঁকা পথ দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম আমি। দেখতে পাই এক অচেনা মেয়ের হাত ধরে, তাকে বাজে ভাবে ছুঁয়ে দিচ্ছে মধ্যবয়স্ক মতি ব্যাপারী। একটু দূরে তার দোকানের দুটো ছেলেও দাঁড়িয়ে বিশ্রীভাবে হাসছে। দিকভ্রান্ত হয়ে টেক্সট করলাম আবেগ ভাইয়ের নাম্বারে। ১০৯ এও কল করে কোনোরকম তাদের আসতে বললাম।

নিজেকে শান্ত রেখে ক্যামেরা অন করে ভিডিও করতে করতে এগিয়ে গেলাম।
“হাত ছাড় মেয়েটার! তাড়াতাড়ি হাত ছাড় কু*র বাচ্চা।”

মতি ব্যাপারী প্রথমে আমাকে দেখে চমকে গেলেন। যদিও চিনতে পারলেন কি না জানি না। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়েটার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে ব্যঙ্গার্থে হাসলেন।

“আমি হাত ছাড়মু মাইয়া? এখন তোরেও ধরমু। ভালোই এক মাছ ধরতে বড়শি ফেলসিলাম, আরেকটা নিজেই এসে ধরা দিসে। ঐ রনি, মনি ধর।”

“খবরদার এক পাও আগে বাড়াবি না। অলরেডি পুলিশে কল দিসি, আর এই মোবাইলটাতেও লাইভ তোদের অপকর্ম মানুষ দেখছে। আমার ক্ষতি করবি? আমিও দেখি তোদের এই বাপ কীভাবে বাঁচায়, তোদের বাপেরই তো এখন মরণদশা।”

বিচলিত হলো তিনজনই। ছেলে দুটো কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে উলটোপথ ধরে দৌড় দিল। মতি ব্যাপারী ভয়ে তটস্থ হয়ে মেয়েটার হাত ছেড়ে দেয়। কিশোরী মেয়েটি ছুটে এসে ঝাপটে ধরে আমায়। তার গা অনবরয় কাঁপছে। মেয়েটার বয়স কতোই হবে এগারো-বারো, এই মাঝ বয়সে এটুকু মেয়ের মধ্যেও কীভাবে কামনা খুঁজে পায় এসব পিশাচেরা?

মতি ব্যাপারী ভয়ে ভয়ে চলে যেতে নিবে তার পূর্বেই এসে পড়েন বাইকে চড়ে আবেগ ভাই। তাঁর গা ঘামে ঘামে জবজব করছে। আবেগ ভাই লোকটাকে শক্ত করে ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়ান।

আমি মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলি,
“সোনা মেয়ে, কিচ্ছু হয়নি তো। All is well. তুমি তো স্ট্রং গার্ল। ঐ লোকটা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে, তার শাস্তি দিবে না ওয়ান্ডার ওমেনের মতোন? মুখ তুলো এখন সোনা মা।”

ছোট্ট মেয়েটা মুখ তুলে অসহায় চোখে তাকায়। আবেগ ভাই বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করেন,
“আর্শি মামনি, তুমি!”

আমি খাণিকটা বিচলিত হই, তবে কি আবেগ ভাই এই কন্যাকে চেনে? প্রশ্ন করতে তাঁর মুখ পানে তাকিয়ে আঁতকে উঠি। আবেগ ভাইয়ের চোখে, মুখে রাগ তীব্রতর, তাতে যেন অগ্নি জ্বলছে। এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করেন ঐ মানুষ নামক পশুটিকে। তাঁর এমন রুদ্ররূপ দেখে আমিও ভয়ে কুঁকড়ে যাই।

সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি এসে তাদের ছাড়ায়। অনেক কষ্ট থামাই আবেগ ভাইকে। জানতে পারি, আর্শি আবেগ ভাইয়ের বড়ো বোনের একমাত্র মেয়ে। মতি ব্যাপারীর এর মধ্যেই স্থান হয়েছে পুলিশের হেফাজতে। আর্শির হাতে ইচ্ছে মতো চড়-থাপ্পর দেওয়ালাম লোকটাকে।

“আর্শি মামনি, এমন ডিশুম ডিশুম করেই ভিলেইনদের শাস্তি দিতে হবে বুঝলে?” আর্শি হাসলো, তৃপ্তির এক হাসি।

আবেগ ভাই ও পুলিশ অফিসার একটু দূরে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলেন। আমি তাদের কাছে যেয়ে দাঁড়াই।

“আবেগ ভাই, এই ব্যাপারটাতে আর্শির নাম যেন ফ্ল্যাশ না হয়। এটা আর্শির জন্য কোনো লজ্জার কিছু না, বরং ভৎসনা এই জানোয়ারটার জন্য। কিন্তু এই সমাজ তো বারবার বাঁকা চোখে তাকাবে তার দিকে, এই ইনসিডেন্ট মনে করিয়ে দিবে, তার মন-মস্তিষ্কে জোর করে ঢুকিয়ে দিবে এই ভীতি। ওর জীবন এখনও শুরুই হয়নি, এখন বড়ো মানসিক যন্ত্রণা, চাপ তার উপর দিলে হীতে বিপরীত হতে পারে। আর এই ঘটনা জানলে আপুও ওকে স্বাভাবিক ভাবে চলতে দিতে ভয় পাবে।”

ইতঃস্তত ভঙ্গিমায় কথাগুলো বলে চোখ তুলি। আবেগ ভাই গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার পানে। দৃষ্টি নত হয়ে যায় সাথে সাথে। তিনি পুলিশ অফিসারকে কিছু একটা কানে কানে বললে তারা সায় জানিয়ে বিদায় হয়। জিপের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই মতি ব্যাপারীর হিংস্র চাহনি আমার দিকে, ক্যানো যেন গা শিউরে উঠে আমার।

“বাইকে উঠো আর্শিকে নিয়ে।” সরল কণ্ঠ তাঁর।

আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বাইকের ভীতি আছে আমার, তাছাড়া অসভ্য লোকটা প্রিয় হলেও তাঁর সাথে বাইকে চড়ার মতো কমফোর্টেবল নই।

“আমি একা একাই যাই। এত্ত ছোটো বাইকে আপনার সাথে… আমি যাই, হ্যাঁ?”

তিনি ভ্রু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন, পরমুহূর্তেই ঠোঁট কামড়ে হেসে দেন। ইশ! কী এমন হাসির কথা বললাম! মুখ বাঁকিয়ে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম আমি। পাশে শূন্য রাস্তায় ধীর গতিতে বাইক চালিয়ে পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন আমার বিশেষ পাহারাদার।

রাত বাড়লেই নিশা ফোন করে জানায়, আগামী পরশু তাদের বিয়ে। নিশার বাবা এবং হাসিব ভাইয়ের বাবা দুজন বেশ ধার্মিক মানুষ৷ তাঁরা সাধারণ ভাবেই বিয়েটা করাতে চান, যার খরচ বহন করবেন হাসিব ভাই। বিয়ের পরদিন বিকেলেই ইউএসএ চলে যাবে হাসিব ভাইয়ের সাথে।

দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহ। আমার নিশুপাখিটা আমাকে সঙ্গীহারা করে সংসার করছে। প্রথমদিন ল্যান্ড কল করেছিল, আর কথা হয়নি। হয়তো ভিনদেশে সংসার সাজাতে, সামলাতেই বেগ পেতে হচ্ছে তার। ভার্সিটি থেকে একাই ফিরছি। সামনে একটা অনুষ্ঠান আছে, তাই সব সিনিয়ররা ব্যস্ত। বিশেষ করে আমার অসভ্য জনাবটার দর্শনই আজকাল পাওয়া যায় না।

কথাগুলো মস্তিষ্কে আওড়াতে আওড়াতে শূন্য পথে হাঁটছি তখনই একটি মিনি ট্রাক সর্বোচ্চ গতিতে এসে আঘাত করে আমায়। মুহূর্তেই পিচ ঢালা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ি আমি। আধো আধো দৃষ্টিতে দেখতে পাই গাড়ি থেকে নেমে আসছে মতি ব্যাপারী, পশুটার চোখে-মুখে হিংস্র সেই হাসি লেপ্টে আছে।

জ্ঞান ফিরলে নিজেকে খুঁজে পাই শুভ্র এক পরিবেশে, ফিনাইলের তীব্র গন্ধ জুড়ে চারপাশে। আমি হাসপাতালের সাদা বিছানায় ছিলাম, আমার দু’হাতে নাম অজানা সূচ বিঁধে আছে। আমি কাউকে ডাকতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। একটা ধ্বনি নির্গত হতে হতেই শ্বাসকষ্ট বোধ হলো।

নার্স কেবিনে ঢুকে আমাকে খেয়াল করে। একটু পর ডাক্তার সাহেব ও মা প্রবেশ করেন তার সাথে।

“মা রে, ভালো লাগছে তোর এখন?”

উত্তর দিতে পারছিলাম না, তাই আমি ইশারায় হ্যাঁ বললাম। ডাক্তার আমাকে দেখে মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“তিনি এখন সুস্থ আছেন সম্পূর্ণ রূপে। হাতের আর বা’পায়ের ফ্র‍্যাকচারটা খুব দ্রুতই সেরে যাবে। তবে ভোকাল কর্ডের বেশ ভালোই ক্ষতি হয়েছে। তবুও একদম সুস্থ হওয়ার আশা ছেড়ে দেওয়ার মতো বাজে অবস্থা না। থ্যারাপি নেওয়া উচিত হবে।”

আমার সারা দুনিয়া যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। অবিরাম ধারায় অশ্রু ঝরতে শুরু করে। মা আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে নিজেও নীরবে কেঁদে দেয়। দুই দিন পর রিলিজ দেওয়া হয় আমায়৷ সেদিনই বাড়িতে পুলিশও আসেন।

সড়ক দুর্ঘটনা হওয়ায় পুলিশ খুব দ্রুতই জড়িয়ে গিয়েছিল আমার বিষয়টার সাথে। বাসায় আসতে না আসতেই তারা আসে। জানান, মতি ব্যাপারীকে ধরেছেন তারা। সে না কি বলেছে, তার মান-সম্মান নষ্ট করার পরিণাম এটা। ঐদিন রাস্তাত ক্ষতি করতে পারেননি তাই আজ করলেন। আমি ভাবছিলাম, জানোয়ারটা ছাড়া পেল কী করে? মনে পড়লো, এ শহরে টাকার বিনিময়ে সম্ভব তো সবই।

ধীরে ধীরে মতি ব্যাপারীর এই বয়ান গোটা এলাকায় আগুনের মতো ছড়িয়ে যেতে লাগলো। মতি ব্যাপারীকে মেয়েজনিত কারণে জেলে পুরা হয়েছে তা সবাই জানতোই। একে দুইয়ে মিলে সবার ধারণা জন্মালো সেদিন আমার সাথে অসভ্যতা করেছিলেন তিনি। আর এক হাতে তালি না বাজার প্রবাদ তো সবার মস্তিষ্কেই সেভ হয়ে থাকে।

মানুষ নানারকম কথা শুনাতো। তাদের কথা শুনে নয়, বরং প্রতিবাদ না করতে পেরে বুক ভার হতে থাকে আমার। আজকাল মা-বাবাও আমায় নিয়ে বড্ড উদাসীন হয়েছে না কি বিরক্ত কে জানে? খোঁজ নিতে মনে থাকে না তাদের আমার। বরং, আমাকে দেখলেও মুখভঙ্গিতে বিরক্তির এক ছাপ।

তবে সবচেয়ে বেশি ভয় লাগে আবেগ ভাইকে নিয়ে। আমার প্রতিবন্ধকতা তার আর আমার ভালোবাসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কি না… কারণ এতো বড়ো একটা এক্সিডেন্ট হলো, কিন্তু একদিনও আবেগ ভাইকে দেখিনি আসতে, না কোনো দিন কল দিয়েছেন। আমিও দেইনি। লজ্জায় না অভিমানে জানা নেই।

লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে ঠিক করলাম কল দিবই। ফোন হাতে নিয়েছি সে মুহূর্তেই মায়ের গলা শুনতে পাই।

“আবেগের মা আবেগের প্রস্তাব এনেছে। আগে থেকে না কি পছন্দ করতো।”

মন আনন্দে নেচে উঠে আমার। বহুদিন পর মরুভূমিতে বৃষ্টি এলে যেমন সতেজ হয়ে পড়ে গোটা প্রকৃতি, তেমনই সতেজ বোধ হচ্ছে।

“হাফসাও জানে। তাঁরা কোনো বাড়াবাড়ি চান না, কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়ি তুলতে চান হাফসাকে।”

আমি যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ি। ভুল শুনেছি কিছু? এলোমেলো পায়ে বেডরুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াই। না ভুল কিছু শুনিনি। বাবা, মা, ভাই সবাই খুব স্বাচ্ছন্দ্যে হাফসা ও আবেগ ভাইয়ের বিয়ের আলোচনা মেতে। হাফসাও সলজ্জে হাসছে।

আর নিতে পারলাম না। কী হচ্ছে এসব? বেডরুমে এসে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। হাফসা প্রবেশ করলো সেই ক্ষণে। অশ্রু মুছার সময়টুকুও পেলাম না।

“আপু, তুমি কাঁদছে ক্যানো?”

আমি নিজেকে আটকে রাখতে পারি না। তার মোবাইলে টেক্সট লিখে পাঠাই সবকিছু। হাফসা অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় তাকায়।

“আপু তুমি ভুল বুঝেছো। আবেগ ভাই কখনওই তোমায় ভালোবাসেনি। উনি তো আমার কথায় তোমার সাথে জাস্ট ভালো ব্যবহার করছিল আমার জন্য। যাতে তার একটা ভালো ইমেজ হয় তোমার মাইন্ডে। তুমি কি না এটাকে ভালোবাসা ভেব… আপু মাইন্ড কোরো না। তবে আমার দিকে তাকাও, আর তোমার দিকে তাকাও। না তোমার আছে আমার মতো শুভ্র গায়ের রং, না আছে বড়ো চোখ, তীক্ষ্ম নাক, স্মার্ট ভাবেও চলো না আমার মতো। এমন কী হিজাব অবধিও পড়ো একদম ক্ষ্যাত ভাবে। আর তুমি আশা করেছো আবেগ ভাইয়ের মতোন সুদর্শন, শিক্ষিত, বড়োলোক ছেলে তোমা… তুমি ভাবলেই কীভাবে? যাই হোক। তোমার ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আমাদের জন্য দোয়া কোরো আপু। বিয়েতে কারো মন খারাপ থাকুক আমি চাই না।”

আমি বরফের মূর্তির মতো হয়ে গেলাম যেন, যা কি না কিছুক্ষণ পরই একটু একটু করে মাটিতে মিশে যাবে। অনুভূতিহীন চোখগুলো বেয়ে অঝর ধারায় নোনাজল ঝরছে। আমি নিস্তব্ধ, এ যেন ঝড় আসার পূর্বাভাস। আমার হৃদয়ের জমিনে সত্যিই ঝড় উঠছে, বিশাল ঝড়। যা ধ্বংস করে দিচ্ছে সবকিছু।

সত্যিই কি আমার বোঝায় ভুল ছিল? শুধুমাত্র প্রেমিকার কথায় ভালো ইমেজ সাজাতে মানুষ কি এমন আচারণ করে? তবে সেই ঈর্ষা তাঁর চোখে আমায় নিয়ে? বারবার আগলে রাখাটাও বুঝি নাটকীয়তা ছিল?

আবেগ ভাই, কেন এমন করে ভাঙলেন আমায়? আমার যে বেঁচে থাকার শক্তিটুকু ভেঙে গুড়িয়ে দিলেন। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না আবেগ ভাই, মরে যেতে ইচ্ছে করে। বিশ্বাস করেন এ শহর সাপ হয়ে ছোবল মারে আমায়, স্মৃতির বিষ ছড়িয়ে দেয় হৃদয়ে। মনে করিয়ে দেয় এ শহরটা ধোঁকাবাজ, বড্ড বেশি ধোঁকাবাজ। থাকার অযোগ্য। থাকছি না এ শহরে, চলে যাচ্ছি। বহু দূরে চলে যাচ্ছি।

বিদায়ের সওগাত হিসেবে দিয়ে যাচ্ছি, আপনার জানালার ওপারে আমার মনগড়া প্রেমকাব্যটা। একটু খানি সিক্ত যদি হন আমার অনুভূতির পরসে, তবুও সফল আমি হবো আমার মনগড়া কাব্যে আপনার প্রেয়সী হয়ে।

সমাপ্ত হলো অবশেষে। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল পড়ে ছাপ ফেলে দিল গল্পের শেষ পাতায়। যত্ন করে জল মুছে নিলাম। ভোর হয়ে গিয়েছে লিখতে লিখতে। আজই আমার প্রিয় মানুষটির বিয়ে আমার ছোটোবোনের সাথে। তা সহন করার ক্ষমতা আমার নেই। এর পূর্বেই বিদায় জানাতে হবে এ শহরকে।

স্নান করে নিলাম। নীল পাড়ের সোনালী কাতান শাড়ি পরলাম, হাইহিল, সোনালী রঙের কাচের চুড়ি। গায়ে মন মাতানো সুগন্ধি মাখলাম। বিদায় যাত্রায় সুন্দর সাজ হওয়া তো অত্যাবশ্যক, তাই না? বড়ো হাত ব্যাগে ও ব্রিফকেসে গুছিয়ে নিলাম যাবতীয় জামা-কাপড়। নিজের একটি অংশ বা স্মৃতিও এ শহরে ফেলে রাখতে চাই না। মা-বাবাও তো পর হয়ে গিয়েছে।

ব্যাগ গোছানোর পর নিশা টেক্সট দিল বহুদিন পর। ভাবলাম শেষবার কথা বলে নিই।

“কী রে আবেগ ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার সুখে আমার ভুলে গেলি কুত্তি!

” কীসের বিয়ে? বিয়ে তো হাফসার ঠিক হয়েছে আবেগ ভাইয়ের সাথে।”

ওপাশে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হলো জানি না। তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো,
“কী বলছিস এসব আমাকে তো হাসিব বললেন তোদের বিয়… তুই তো আবেগ ভাইকে ভালোবাসিস।”

“উনি তো ভালোবাসেন না। সবটা বানোয়াট ছিল। উনার থেকেই জেনে নিস।”

ফোনের ডাটা বন্ধ করে আবেগ ভাইয়ের চাচাতো বোন বেলিকে টেক্সট করে বাসার নিচে আসতে অনুরোধ করলাম। তার হাতে সযত্নে ডায়েরি খানা দিয়ে তাকে কাগজে লিখে আবেদন করলাম,
“এটা প্লিজ আবেগ ভাইয়ের হাতেই দিবে। অন্যকারো কাছে যাতে না যায়, সে-ই যেন পায়। আর বলবা আমি দিয়েছি, পড়ে নিয়েই বিয়ের পীড়িতে বসতে।”

বেলিকে ছোটো বেলায় একবার স্কুলে র‍্যাগিংয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলাম। সেই থেকে মেয়েটি আমি ভক্ত, তাই বিনা দ্বিধায় মেনে নিল। আমি আলতো হেসে বিদায় জানিয়ে ব্যাগ আর ব্রিফকেস অগ্রসর হলাম আমার যাত্রাপথে।

ফুটপাথ পেরিয়ে পৌঁছালাম ব্যস্ত সড়কটির দিকে। জানা-অজানা অসংখ্য গাড়ি উচ্চ গতিতে ছুটছে নিজ গন্তব্যে। আমারও নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে, এই বিষাক্ত শহর ত্যাগ করে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম।

যেতে যেতে বিড়বিড়ালাম,
“সেদিন তো বাঁচিয়ে ফেলেছিলেন আপনার মায়াবালিকাকে এই ব্যস্ত সড়কের শিকার হওয়া থেকে। আজ তো আপনার মায়াবালিকা নিজেই এসে ধরা দিচ্ছে এই শিকারীর নিকট। বাঁচার কি কোনো উপায় আছে আজ?”
|
চলবে…

জানালার ওপারে পর্ব-৬+৭

0

#জানালার_ওপারে
||৬ষ্ঠ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
🌺🥀পৃষ্ঠা- ৭
চোখ দু’টো অশ্রুতে টলমল করছে। আবেগ ভাই কী করে করে করতে পারলেন এমনটা আমার সাথে? চোখ মুছতে মুছতে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসি।

ইদানীং বড্ড আবেগ পাগল হয়েছি আমি। অপ্রয়োজনেও ভার্সিটিতে যাই তাঁর দর্শন পেতে। বিনা কারণেই ঐ অসভ্য দলের আড্ডাখানা তথা বটতলার আশেপাশে ঘুরঘুর করি, সালামও দেই যেয়ে। এই বাহানায় যদি ব্যক্তিটি কথা জুড়ে দেয়। হোক না সেই কথায় একটু ঝাঁঝ, একটু নোকঝোক, কটাক্ষ; তবুও কথাটা হোক। কিন্তু অসভ্য যে লোকটি আগে খোঁচা দিতে মুখিয়ে থাকতেন, এখন ঠিকভাবে দেখেনও না হয়তো আমায়।

আজও এই ভাবনা মনে নিয়েই বটতলার সামনে গিয়েছিলাম। হাতে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন বইটি। ভাব খানা এমন যেন গভীর ভাবে ডুবে আছি আমি বনলতা সেনের মায়ায়। অথচ, আবেগ ভাইয়ের ফন্দীবাজ মায়াবালিকার মনে অন্যই চিন্তা।

“পিপীলিকা, পিপীলিকা
দলবল ছাড়ি একা
কোথা যাও, যাও ভাই বলি।”
আমাকে দেখে আজকেও হাসিব ভাই কটাক্ষ করতে ভুল করেন না।

দলবল বলতে যে নিশাকে বুঝিয়েছে তা বোধ করতে দেরী লাগেনি। কারণ সাধারণত বেচারি নিশাকেও জোর করে নিয়ে আসি আমি, কিন্তু আজ আমি একাই। এই মানুষটার অদ্ভুৎ সব নাম ডাকাতে বিরক্ত আমি। আর আমিই নয় শুধু, সব জুনিয়াররাই। কাউকে কাঠবিড়ালি তো কাউকে মৌমাছি। বেচারি নিশাকে তো মশা ডাকতে ডাকতে কাঁদিয়ে ফেলেন।

তবুও প্রিয় মানু্ষের প্রিয় বন্ধু। তাই জোরপূর্বক কিঞ্চিৎ হেসে উত্তর দিলাম, “ঘাস কাটতে তো আর যাই না ভাইয়া। হাঁটছি এমনি।”

হাসিব ভাইয়া আরও হাজারটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। অথচ, যার জন্য আসলাম, তিনি আমাকে না চেনার মতোন নির্বিকার ভাবে মোবাইলে ডুবে। ধুপধাপ পা ফেলে চলে আসলাম সেখান থেকে। কল লাগালাম মাকে।

বললাম,
“আম্মু, তুমি পাশের বাড়ির ভাইয়া না কি আমায় পড়াবে। সপ্তাহ শেষ হয়ে গেল একদিনও আসলো না, পরে তো ঠিকই টাকা নিবে।”

আমার কথা বলার ধরনটা বেশ ভালোই কাজে লাগলো বোধহয়। মায়ের মেজাজ ভালোই চটেছে। নিশ্চয়ই এখনই কল দিবে আবেগ ভাইকে। ক্লাস নেই আজ, তাই খুশি মনে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াই যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

পাশে চোখ যেতেই মাথায় হাত। ক্যান্টিনের চাচার বারো বছর বয়সী মেয়ে দুলি বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে। দুলির সাথে আবেগ ভাইয়ের গলায় গলায় খাতির, যদি বলে দেয়… প্রেম-টেম সব বাদ, জীবন নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে।

আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। অতিরিক্ত মধুমাখা কণ্ঠে কিছু বলার আগেই সে কড়া মেজাজে বলে,
“আপনি আবেগ ভাইয়ের নামে এসব কী কইলেন? আমি এহনই যায়া বলতাসি ভাইয়ের কাছে।”

সে যেতে অগ্রসর হয়। আমি দ্রুতো তার হাত আঁকড়ে ধরি। “কাউকে বলিস না প্লিজ। বিনিময়ে তোর চকলেট লাগবে না কি আইসক্রিম না খেলনা? যা চাবি দিব।”

মেয়েটা চুপ থেকে খাণিক ক্ষণ ভাবলো। আমার হৃদয় দুরুদুরু কাঁপছে।

“ঠিক আছে, কিন্তু পাঁচটা কিটক্যাট কিনে দিতে হইবে।”

স্বস্তির শ্বাস ফেললাম, সেই সাথে আফসোসও হলো বড্ড। কারণ আজ রিকশা স্বপ্নীয় বিলাসিতা, বাস দিয়েই বাড়ি যেতে হবে। অতঃপর তার বাবার দোকান থেকেই তাকে চকোলেট কিনে দেই। বালিকা বুদ্ধিমান আছে, বাবার বিক্রিও বাড়ালো, আবার উপহারও পেল।

ঐ অসভ্যটার উপর রাগ লাগছে, তিনি আমার সাথে একটু কথা বললেই আমার টাকাটা বেঁচে যেত।ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পথে যে দৃশ্য দেখি তাতেই কান্না চলে আসে। আবেগ ভাই একজন মেয়ের সাথে গল্পে মেতে আছেন। হাসির ছলে বারবার মেয়েটা তাঁর গায়ে হাত দিচ্ছে। তবে কি মিথ্যে ছিল সব স্বপ্ন, এতো জল্পনা-কল্পনা?

ভার্সিটির বাহিরে যেয়ে কিছু দূর এগিয়ে গেলে আমাকে কেউ ব্যস্ত রাস্তা থেকে ডাক দেয়। তাকিয়ে দেখি রিকশায় বসে থাকা আমার কাজিন আবির ডাক দিচ্ছে। নিঃশব্দে রিকশায় চড়ে বসি। কেন যেন মনে হলো কেউ আমায় ডাকলো, ঐ পরিচিত বজ্রকন্ঠ। পিছনে তাকাতে গিয়েও তাকালাম না। ভাবলাম মনেরই ভুল হবে, ঐ অসভ্য যুবকের সময় কোথায় আমার জন্য?

বাসায় যেয়ে ‘ঘুমাবো’ বলে বেডরুমের দরজা আটকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। আসরের নামাজ শেষ হলে দ্বারে নক করে আবির ভাইয়া।

“কী রে! আর কতো ঘুমাবি!”

আমি তাড়াতাড়ি চোখে-মুখে পানি দিয়ে আসি। আবির ভাইয়ের পছন্দ, চিন্তাধারার সাথে আমার পছন্দ, চিন্তাধারার এক অসম্ভব মিলবন্ধন আছে। তার সাথে গল্পে মজে দুঃখগুলো কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেলাম। অথচ, এক মুহূর্তের জন্যও বোধ করিনি কেউ একজন অগ্নিদৃষ্টিতে দেখছে আমাদের। মাগরিবের আজান অবধি কথোপকথন চলে আমাদের

“আবেগ এসেছে। ড্রইংরুমে চলে যা।”
প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে বড্ড কান্না পেল নামাজ শেষে এ কথা শুনে। ক্যানো এসেছেন তিনি? কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে? অভিমানে ঠোঁট, গাল সবই ফুলালাম। তবে অভিমানটা দেখার মানুষটি কি আদৌ দেখবেন?

মাথায় কাপড় দিয়ে গুটি গুটি পায়ে বই নিয়ে বসার ঘরে যেয়ে বসলাম। অশ্রুর পতন আটকানোর বহু প্রচেষ্টা আমার। আম্মু চা-নাস্তা দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাসায় এ মুহূর্ত তেমন কেউ নেই, সবাই কোনো না কোনো কাজে বাহিরে।

ভুলক্রমেও আবেগ ভাইয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালাম না। তিনি বই নিয়ে একটা পেজ বের করে আমাকে তা দেখিয়ে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“টানা আসর থেকে মাগরিব অবধি বলা এতো কথা পেটের কোন কোণে থাকে মায়াবালিকা? কই আমার সামনে তো কখনও বের হয় না!”

আমি হা হয়ে গেলাম। তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকালাম তাঁর দিকে। এই পুরুষটি জ্বিন না কি গুপ্তচর ? কী করে জানলেন এ বিষয়ে?

আমার দৃষ্টিতে তাঁর চোখজোড়া আরও সংকুচিত হলো। ধমক দিয়ে উঠলেন হুট করে,
“বইয়ের দিকে তাকাও ইডিয়ট। তোমার মা এদিকে সিসিটিভি ক্যামেরার মতো তাকিয়ে আছে। যত্তসব ঝামেলা কোথাকার!”

আড়চোখে রান্নাঘরে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই বলছেন তিনি।
“কেন বলবো? আর আপনার সামনে কীভাবে বের হবে? আপনার কি আমার কথার জন্য সময় আছে? আপনার তো বান্ধবের অভাব নেই, যারা কাঁধে, পিঠে কথায় হাত রেখে আনন্দে মাতিয়ে রাখে। আবির ভাইয়ার আমার জন্য সময় আছে, আপনার মতোন না আমার ভাই।” তীব্র কঠোরতা মিশে আছে আমার বচনভঙ্গিতে।

তাঁর মেঘের আড়ালে ঢাকা চেহারায় সূর্যের মতোন মৃদু হাসি উঁকি দেয়। পরক্ষণেই মুখ খানা গম্ভীর বানিয়ে ফেলেন।

“আমার বড়ো মামাতো বোন ছিলেন, ব্রিটেনে বড়ো হয়েছেন তা-ই একটু বেশিই ফ্রী। তবে সামনে আর হবেন না। আর হ্যাঁ, এসব কাজিন-ফাজিনকে ভাই-টাই আমি মানি না বুঝলে মায়াবালিকা? So stay away girl. Otherwise you would not like the consequences. আর আন্টিকে কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলো আমার নামে। কান ধরে ক্যাম্পাস চক্কর দেওয়াবো বলে দিলাম।” গাম্ভীর্যপূর্ণ তাঁর কণ্ঠ।

উঠে দাঁড়ালেন তিনি। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কী বললেন এসব? একই সাথে কেউ এমন দুই ধরনের ভাবাবেগপূর্ণ কথা বলতে পারে! এই লোকটা আমাকে বিস্মিত করার কোনো সুযোগ ছাড়েন না। আর এই দুলিটাও না! বলেই দিয়েছে সব তাঁকে! তবে সব বাদ দিয়ে অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করছে।

আপন মনেই বিড়বিড় করলাম, “আমার অন্তর খানা যে কাঁপিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সামান্য কথার দ্বারা, তা কি জানেন আবেগ ভাই?”

হৃদয়ের মধ্যখানে শত প্রজাপতির আলোড়ন হচ্ছে। অন্যরকম ভালো লাগা, প্রাপ্তির সুখ। আমার কাঙ্ক্ষিত পুরুষটির মনেও আমায় নিয়ে অনুভূতি আছে, নাহলে আমাকে কেন ব্যাখ্যা করতে গেলেন এতো কিছু? এতোটা চিন্তা, ঈর্ষা কেন আমায় নিয়ে? সারাটা রাত্রি ঘুম হলো না। তাঁর ভাবনায় বিভোর হয়ে রাত কাটালাম, নব নব স্বপ্ন বুনলাম।

এখন কোনো বিষয় না বুঝলে আবেগ ভাই বাসায় আসেন। তিনি তো পড়া বুঝান, আমি শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকি। বিনা কারণেই তাঁর অসভ্য দলের সামনে দিয়ে যাই। তিনি তাঁর তীক্ষ্ম, গভীর দৃষ্টি ফেললে, আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলি। বড্ড প্রেমময় যাচ্ছে আমার দিনগুলো।

___

এতোটুকু লিখেই কলম থামালাম। সুদীর্ঘ এক শ্বাস ফেললাম। কী সুন্দর ছিল দিনগুলো! কিন্তু এর পরের একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা সব ধ্বংস করে দিল! সব! নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। লিখতে বসলাম সেই বিষাক্ত দিনটির কথা।

চলবে…

#জানালার_ওপারে
||৭ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“আমি কথা বলতে পারি না বলেই কি আমাকে ভালোবাসেন না আবেগ ভাই? না কি আপনিও আমাকে অপয়া, অপবিত্র মনে করেন?” কথাটা বলতে চেয়েও পারলাম না। ‘আ’ জাতীয় অস্পষ্ট শব্দ বের হলো শুধু।

সপ্তম পৃষ্ঠা অবধি লিখার পর আর লিখতে পারিনি। মা ঠেলে-ঠুলে হাফসার সাথে পাঠিয়েছে তার বিয়ের, বৌভাতের শপিংয়ে সাহায্য করার জন্য।

গাউসিয়া মার্কেটের সামনে এসে রিকশা থামে। নামতে নামতেই আবেগ ভাই এগিয়ে আসেন। আজ আমার কাতর দৃষ্টি তাকে ছুঁতে পারে না, এক পলক দেখেই চোখ সরিয়ে নেন।

হাসি মুখে হাফসাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেন,
“কেমন আছো হাফসা? আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো।”

আহত হই, চোখের কোণে অশ্রু জমে। প্রকাশ করি হৃদয়ের আর্তনাদ। কিন্তু ঐ যে পালনকর্তা বড্ড বেশিই অসহায় বানিয়েছেন আমায়৷ তাই কোনো কথাই হয় না প্রকাশিত।

“আপু আসো”
বলতে বলতে হাফসা আবেগ ভাইয়ের সাথে গল্প করতে করতে এগিয়ে যাই। আমি একাকী তাদের পিছন পিছন চলি। একটি বিলাসবহুল দোকানে প্রবেশ করি আমরা।

দোকানে আবেগের মা, বড়ো বোন, মামী আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। আমি তাদের দেখে ইশারায় সালাম জানাই। হাফসা ও আবেগ ভাই তাদের সাথে পোশাক চয়ন করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকি।

শত জামা-কাপড়ের ভীড়ে আমার চোখ আটকে যায় সাদা রঙের মাঝে সোনালি জরি কাজের বেনারসি কাতান শাড়ির দিকে, পাড়টা রয়েল ব্লু রঙের। শাড়িটা হাতে নিতেই চোখ পুনরায় নোনাজলে সিক্ত হলো। একদা এমন শাড়ি পরেই আবেগ ভাইয়ের বউ সাজার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি, অথচ আজ সবকিছুই মরীচিকা।

হুহু করে উঠে বুকটা, বউ না হতে পারলাম তাঁর, শাড়িটাই নাহয় হোক তাঁর স্মৃতিগন্ধা। হাফসা হাতে তুলে নেয় শাড়িটি।

“এই শাড়িটা পছন্দ করেছো? তোমার চয়েস আসলেই অস্থির। এটাই নিচ্ছি বিয়ের জন্য।”

আমি আলতো হাসলাম। আমার পছন্দ প্রকৃতপক্ষেই বেশ ভালো, তোর পছন্দনীয়। তাই তো আমার প্রিয় পুরুষটিকেও তোর পছন্দ হলো, তাঁকে নিয়ে নিলি। তা যখন বিনা শর্তে দিতে পেরেছি, এ আর এমন কী?

শাড়িটা নিয়ে সে চলে গেলে আমি পুনরায় কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম মোবাইল নিয়ে। হুট করে শুনতে পেলাম এক পুরুষালি কণ্ঠ,

“এক্সকিউজ মি? আপনি কি…? হ্যাঁ, সামুই তো তুমি। কেমন আছো?”

রেজাউল সাহেবকে দেখে খাণিক চমকে উঠলাম। আমি যে হাসপাতালে ছিলাম, তিনি সেখানে ইন্টার্নি করছেন। প্রায়শয়ই মূল ডাক্তারের পরিবর্তে তিনি উপস্থিত হতেন।

আমি ইশারায় বললাম বোনের বিয়ের শপিং করতে। তিনি মৃদু হেসে আবেদন করলেন,

“ভালোই হয়েছে তোমাকে পেয়ে। তোমার আমার একটা সাহায্য করতেই হবে। আমার বড়ো বোনের জন্মদিন উপলক্ষে তার জন্য শাড়ি নিতে এসেছি কিন্তু পছন্দ করতেই পারছি না। একটু চ্যুজ করে দাও না প্লিজ। না করবে না, প্লিজ। আমি কিন্তু তোমায় সেবা দান করেছি, না করলে পাপ হবে।”

ফিঁক করে হেসে ফেললাম আমি। মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে শাড়ি দেখতে লাগলাম। অবশেষে প্যাস্টেল গ্রিন কালারের একটা হালকা কাজের সিল্ক জামদানি পছন্দ করে দিলাম। কারণ এ রঙটা গাড় রঙ পছন্দ করা মানুষেরও ভালো লাগবে, আর হালকা রঙ পছন্দ করা মানুষেরও।

তিনি বিল দিয়ে চলে যাওয়ার আগে আমার হাতেও একটি ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন, সাথে নিজের কার্ডও। আমি অবাক হয়ে প্রশ্নসূচক চাহনি নিক্ষেপ করি।

“দেখো কন্যা লাবণ্যময়ী, এটা উপহার তোমার জন্য। আমাকে সাহায্য করার জন্য, ঐ হাস্যোজ্জ্বল চাহনিতে আমার দিন সুন্দর করার জন্য, আমাকে নিজের চিকিৎসা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য।”

কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কাচের দরজার বাহিরে চলে গেলেন। অনেকদিন পর পজেটিভ বাক্য শুনে আমার মুখেও কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠে। পিছনে ঘুরতেই কারো দেহের সাথে মাথার সংঘর্ষ।

মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখ তুলতেই মুখশ্রী ম্লান হয়ে যায়। আবেগ ভাই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছেন আমায়। হুট করে আমার হাতের ব্যাগ খানা হাতে নিয়ে নেন। কার্ড বের করে টুকরো টুকরো করে, টুকরোগুলো ব্যাগে ভরে ছুঁড়ে ফেলেন মেঝেতে।

“ব্লাডি বাস্টার্ড একটা! আর তোমাকেও বলি, একটা না একটা ছেলের সঙ্গ লাগবেই তোমার মেয়ে? বলেছিলাম না দূরে থাকতে সবার থেকে!” গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠ তাঁর।

“আপনার কী? আমি যার সাথে ইচ্ছে কথা বলবো? আপনি আপনার বউকে দেখে রাখেন, আমাকে দেখা লাগবে না।” অন্তরের প্রতিবাদ অন্তরেই থেকে গেল। মুখ বলার ক্ষমতা তো নেই।

তিনি ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও গাউসিয়া থেকে বের হয়ে রিকশায় চড়লাম, হাফসাকেও একটা ম্যাসেজ দিলাম চলে যাচ্ছি জানিয়ে।

বাসায় আসতেই মা সহ সবার জেরার মুখোমুখি। উত্তর দিতে না পারায় যা নয় তা শুনলাম। অথচ, উপস্থিত প্রতিটি সদস্য জানতো আমি কথা বলতে অক্ষম। আচ্ছা, আমার দোষটা আমার অক্ষমতা না আমার সাথে ঘটা পূর্বঘটনাটা?

ফ্রেশ হয়ে আবার ডায়ারি কলম নিয়ে বসলাম।

🥀🌺পৃষ্ঠা – ৮

সকাল সকাল টিএসসিতে বসে চা আর বাদাম খাচ্ছি আপনমনে। নিশাটা ক্লাসে। মেয়েটাও এতো পড়া পাগল না! একটা ক্লাসও তার মিস দেওয়া চলবে না।

“কী অবস্থা ভেঁপু?”

আমার শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে উপস্থিত হন হাসিব ভাইয়া। তাঁকে দেখেই বিরক্তিতে আমার মুখ দিয়ে ‘চ’ বোধক শব্দ বের হয়। তবুও বিরক্তি পাশে রেখে উত্তর দেই,

“অবস্থা তো এ পর্যন্ত ভালোই ছিল ভাইয়া। এখন ভালো থাকবে কি না সন্দেহ।”

তিনি মৃদু কণ্ঠে বিড়বিড়ালেন,
“এই মেয়েটাও না একদম ত্যাড়া, ঠিক আবেইগ্যার মতোন। একটা কথাও মাটিত পড়তে দেয় না।”

আমি শুনতে পেরেও না শোনার ভান করলাম।

“দেখো মেয়ে, আমি তোমার সিনিয়র। জুনিয়ার হিসেবে তোমার উচিত আমার সব কাজকে সাপোর্ট করা, কোওপারেট করা, সাহায্য করা। আমি মশা আই মিন নিশাকে আজ প্রপোজ করব, তুমি ওকে ঠিক সাড়ে এগারোটায় বটতলায় নিয়ে আসবে। নাহলে সব সিনিয়রদের এসাইনমেন্ট তোমাকে দিয়ে করাব। মনে থাকে যেন। ঠিক সাড়ে এগারোটা।”

তিনি আমাকে জরুরি কোনো ভাষণদানের মতোন গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে হনহন করে চলে গেলেন। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এদের গোটা ফ্রেন্ড সার্কেলই কি এমন অদ্ভুৎ না কি! কথাটা তো ভালোভাবে বা অনুরোধ করেও বলা যেতো। কিন্তু না, ভাষণের বেশে হুমকি দিয়ে গেলেন। অসভ্যর দল!

তবুও প্রিয় পুরুষের বন্ধু তা-ই সাহায্য তো করতেই হয়। তাছাড়া বান্ধুবী নিশাও তাঁর উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে বহু আগে থেকেই।

কথা মোতাবেক জোরজবরদস্তি করে নিশাকে বটতলায় নিয়ে আসলাম। যেয়ে তো আমার চক্ষু ছানাবড়া। হাসিব ভাই নতুন বরের মতোন নীল রঙের শেরওয়ানি আর ধুতি পরে, কড়া আতর দিয়ে সেজে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে বেলি ফুলের মালা। তাঁর বন্ধুরাও আছে।

“এই মেয়েরা, এদিকে আসো।”

তাঁদের দেখে নিশা উলটোপথ ধরতে নেয়, আমি হাত ধরে ফেলি। কাঁপা কাঁপা গলায় সালাম দেয় সে।

“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়ারা।”

সালামের জবাব পাওয়া গেল না। বরং, আকস্মাৎ করে ফুল হাতে মাটিতে বসে পড়লেন হাসিব ভাইয়া। করলেন এক অদ্ভুৎ ভঙ্গিমায় প্রপোজ।

আজকেও ছড়া কাটলেন,
“তুমি মশা আমি মাছি,
আমি তোমায় ভালোবাসি।”

আমি চোখ কবে যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসে এই অসভ্যদের জন্য। এভাবেও কেউ প্রপোজ করে! আমি হাসি আটকাতে পারি না, শব্দ করে হেসে দেই। মিটমিট করে হাসা তাঁর বন্ধুগুলোও হা হা করে হাসে। হাসিব ভাইকে তাতে একটুও লজ্জা পেতে দেখা যাচ্ছে না। বরং, নিশার লজ্জায় মরি মরি দশা।

হাসিব ভাই ধমকিয়ে উঠলেন,
“এই মেয়ে আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো আমি? তাড়াতাড়ি ফুল হাতে নাও, নাহলে পুরো ক্যাম্পাস কানে ধরিয়ে ঘুরাবো।”

বেচারি নিশা ভয় পেয়ে চটজলদি মালাটা হাতে নেয়।। হাসিব ভাই হাসি মুখে উঠে দাঁড়ান। নিশা আমার হাত আঁকড়ে ধরে চলে যেতে নিলে তিনি গম্ভীর গলায় শুধান,

“আমার সাথে বাসায় যাচ্ছো তুমি আজ, অন্য কারো সাথে না। আর হ্যাঁ, বাসার এড্রেস দিয়ে যাবা। আমার চাকরি হয়ে গেছে। আজকে বিকালেই আম্মু-আব্বু যাবে। চুপচাপ রাজি হয়ে যাবা, ওকে?”

শেষের কথাটা একটু জোরেশোরেই উচ্চারণ করেন। নিশা ভয় পেয়ে দ্রুতো মাথা নাড়ায়। হাসিব নিজের হাত এগিয়ে দেন, নিশাও তা আঁকড়ে ধরে। নিশার মুখে আলতো হাসি, এক তৃপ্তি। ইশ! কী ভালোবাসাময় এক দৃশ্য! অন্যের ভালোবাসা দেখাতেও এক তৃপ্তি আছে। আমার চোখ যায় আবেগ ভাইয়ের দিকে, তাঁর দৃষ্টিও আমাতেই স্থির। কামনা করি, এ দিন আমার জীবনেও আসুক।।

অতঃপর আমি রওনা হই বাসার জন্য। রাস্তায় জ্যাম থাকায় অর্ধেক রাস্তাতেই নেমে যাই। শূন্য পথ ধরে হাঁটতে শুরু করি। কারণ প্রচুর মেইন রোডে ট্রাফিক জ্যাম ও মানুষের ভীড়।

মাঝ দুপুরে ফাঁকা রাস্তায় কিশোরী মেয়েটির হাত চেপে ধরে মতি ব্যাপারী। ভীত মেয়েটি হাত ছাড়াতে জোরাজুরি, চেঁচামেচি করে। ফলাফল শূন্য। নোংরা স্পর্শ লেপ্টে যাচ্ছে তার অসহায় শরীরে। অথচ, কিছু করার নেই আমার। কিছু করার নেই।

চলবে…।

জানালার ওপারে পর্ব-০৫

0

#জানালার_ওপারে
||৫ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
‘মাঝ দুপুরে ফাঁকা রাস্তায় কিশোরী মেয়েটির হাত চেপে ধরে মতি ব্যাপারী। মেয়েটি হাত ছাড়াতে জোরাজুরি, চেঁচামেচি করলেও ফলাফল শূন্য। নোংরা স্পর্শ লেপ্টে যাচ্ছে তার অসহায় শরীরে।’ লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুমেও এই বিষাক্ত দিনের স্মৃতি যেন পিছন ছাড়ছে না। স্বপ্ন হয়েও তাড়া করে যাচ্ছে।।

বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ঐ দিনটি না আসলে হয়তো এমন দুর্দিন দেখতে হতো না আমায়। । গভীর রাত্রি। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে পুনরায় ডায়েরি নিয়ে বসি।

🥀🌺পৃষ্ঠা- ৬
অসভ্য লোকটার নাম আবেগ। এসাইনমেন্ট নিয়ে আজ যাচ্ছি ভার্সিটিতে। সিএনজিতে বান্ধুবী নিশা ও তার ভাইও আছে। যাওয়ার পথে নিশাকে ভার্সিটির সব ঘটনা খুলে বললাম।

“সিরিয়াসলি? তুই আবেগ ভাইয়ের মুখে পানি মেরেছিস! তুই জানিস আবেগ ভাই রাজনীতি করে? টপারও। আর তুই কি না… আমার তো ভয় হচ্ছে উনি কোনো…”

কথার মধ্যেই ফোঁড়ন কেটে তার ভাই বলেম,
“চুপ! ভয় দেখাইস না তো! আবেগ মোটেও কারো ক্ষতি করবে না। ছেলেটা শুধু একটু রাগী। তবে এতো কমে ছেড়ে দিল তোমাকে…”

মুখ বাঁকালাম আমি। একটা এসাইনমেন্ট এতো কম সময়ে শেষ করতে দেওয়া কি কম শাস্তি? ভাইয়া চলে গেলেন আমাদের নামিয়ে।

ক্যাম্পাসে ঢুকে কয়েক কদম আগাতেই অসভ্য লোকটি মানে আবেগ ভাই তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ান।

“সিনিয়রদের দেখলে যে সালাম দিতে হয়, এটাও শিখো নাই না কি তোমরা?”তাঁর বন্ধু হাসিব ভাই ধমক দিয়ে উঠেন।

ধমক খেয়ে নিশা তোঁতা পাখির মতো ঝটপট সালাম দেয়। আমি মুখ বাঁকিয়ে উলটো দিকে তাকাই। বিড়বিড়াই,
“এমন অসভ্যের দলকে সালাম দিতে আমার বয়েই গেছে।”

অসভ্য লোকটার চোখে চোখ পড়তেই শুকনো ঢোক গিলি আমি। তাঁর চাহনি এমন যেন কাঁচা চিবিয়ে খাবেন আমায়।

দ্রুতো এসাইনমেন্ট এগিয়ে দিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে শুধাই, “আপনার এসাইনমেন্ট, আবেগ ভাই।”
তিনি হাতে নিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করার মাঝেই আমি ও নিশা কেটে পড়ি।

নিশার ক্লাস থাকায় আমি একাই একাই ক্যান্টিনে বসে চা পান করছি।

“ভার্সিটিতে উঠতে না উঠতেই যে বফ পাতায় ফেলসো, বাসায় কি জানে না জানাবো?”

চমকে উঠে মুখ থেকে চা পড়ে যায়। রাগ হয়, সীমাহীন বিরক্তিও।

“কী সব বলছেন? পাগল হয়েছে বাসায় জানে না জানাবো?”

আমি উত্তর দিতে না দিতেই তিনি চেয়ার সমেত আমাকে নিজের দিকে ঘুরান। আমি হা হয়ে যাই।

“দেখেছি, তা-ই তো… তা-ই তো বলছি। ঐ ছেলেটা কে মায়াবালিকা?” তাঁর গলা গম্ভীর, তবুও কেমন যেন হৃদয় নাড়া দিল। চোখগুলোর চাহনি আজ এলোমেলো, অস্থির।

অন্যরকম অনুভূতি বোধ হচ্ছে আমার। এই দীর্ঘ কৈশোরে, যৌবনে এমন কখনও লাগেনি। নিজেকে সামলে নিলাম।

“আপনি অযথা ভুল বুঝছেন আবেগ ভাই। ঐটা নিশার ভাই ছিল। ভার্সিটির বিষয়ে বলছিলেন।”

শুনে সুগভীর এক নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর স্বস্তি মাখা তপ্ত শ্বাস আমাকেও ছুঁলো। অতঃপর কিছু না বলেই চলে গেলেন।

ক্লাস করার মন-মানসিকতা না থাকায় খাণিক ক্ষণ পরই বেরিয়ে পড়লাম। নীলক্ষেত থেকে একটা বই কিনতে গবে। তাই সেই উদ্দেশ্যেই হাঁটা ধরলাম।

আগে কখনও একা আসিনি তাই একটু সংকোচ হচ্ছে। ব্যস্ত রাস্তা, ভীষণ ভীড়। রাস্তা পাড় হতে গিয়ে কখন যে চলন্ত বাসের সামনে এসে পড়েছি বুঝিনি। খেয়াল হতেই জমে গেলাম আমি। মৃত্যু বোধহয় অবধারিত আজ। কিন্তু আল্লাহর দূত হয়ে আবেগ ভাই এসে টান দিয়ে সরালেন। মাটিতে পড়ে গেলাম উভয়ে।

“তোমার চোখ কোথায় থাকে! দেখেও ইডিয়টের মতো দাঁড়িয়ে আছো! স্টুপিড মেয়ে!”

তিনি দাঁড় করিয়ে ইচ্ছে মতো ঝাড়লেন। অতঃপর শান্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন,
“নীলক্ষেত যাচ্ছো? তাহলে আমার সাথে চলো, আমিও যাচ্ছি।”

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালাম। পড়ে গিয়ে পায়ে বেশ ব্যথা পেয়েছি। বহু কষ্টে হাঁটছি। মানুষের ধাক্কা থেকে বাঁচার অজস্র প্রচেষ্টা। তবুও পা ব্যথা নিয়ে মুক্তি কোথায়? আমার অবস্থা হয়তো যুবকটি বুঝতে পারলেন। এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে এমন ভাবে আড়াল করে নিলেন যে তাঁর গায়ের সাথেও গা লাগলো না, অন্য কারো সাথেও না।

অসম্ভব ভালো লাগে ছেয়ে গেল মনে। এতো মানুষের ভীড়ে বারবার আমার চোখজোড়া তাঁর উপরই আটকে যেতে শুরু করলো। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলাম যুবকটিএ দিকে। হয়তো অনেক সুদর্শন নয়, তবুও আমার নিকট অসম্ভব সুন্দর। বড়ো চোখের পাপড়ি দ্বারা অলংকৃত বুদ্দিদীপ্ত বাদামী চোখ যেন আমায় বারবার তাতে ডুব যেতে বাধ্য করছে।

বাসায় এসেও তাঁর মুখশ্রী মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। তাঁর সাথে কাটানো প্রতিটি স্মৃতি বারবার আমায় এলেমেলো করে দিচ্ছে। ইশ! কী টক-ঝাল-মিষ্টি অনুভূতি!

বই হাতে নিয়ে তাঁর কথা ভাবছি, আর মুচকি মুচকি হাসছি। আম্মু এসে ব্যাঘাত ঘটালো।

“কী রে! বসে আছিস কেন? যা, তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়।”

কৃত্রিম ঝর্ণার শীতল বারিধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে আমায়। তাও যেন আজ ঐ অসভ্যটার নেশা লাগিয়ে দিচ্ছে। কল্পনার জগতে দেখতে পাচ্ছি আবেগ নামক অসভ্য লোকটিকে। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করছি তা।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি, আমি কি প্রেমে পড়ে গিয়েছি তাঁর? এই অসভ্য লোকটা একদিনের মাঝে কী জাদু করলো আমায়? আমার মন-প্রাণ তো আসক্ত করে দিল তাঁর নেশায়।

ঠিক তখনই দর্পণে ভেসে উঠলো অসভ্য লোকটার ছবি। তাঁর বড় বড় পাপড়িযুক্ত চোখে সেই অম্লান, গম্ভীর চাহনি।

আনমনেই বিড়বিড়ালাম,
“আপনাকে চাই, আবেগ ভাই। আপনাকে চাই। আপনিও কি আমাকে চান? আপনিও কি আমাকে নিয়ে ভাবেন এভাবে? ভাবছেন?”

একবার মনে হলো, সে কী করে আমাকে নিয়ে ভাবতে পারে? আমি ঘায়েল করার মতো সুন্দরী নই, নেই আজকালকার স্মার্ট চালচলন। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম আয়নায়। দেখতে একদম তো ফেলনা তো নই, অযোগ্য নই তাঁর। না আছে কোনো প্রতিবন্ধকতা, তবে তাঁকে কেন পেতে পারবো না?

আর তাঁর মনে যদি আমার জন্য কোনো অনুভূতি না-ই থেকে থাকে, তবে কেন আমার জন্য এতো চিন্তা? কেন এতো কেয়ার করেন? আর তাঁর চোখের সেই অন্যরকম দৃষ্টি! আরো কাউকে তো এভাবে শাসন করেন না, আগলে রাখেন না। না কি মায়ের কথা রাখতেই বা পরিচিত বলেই এমনটা? মন ও মস্তিষ্কের শীতল যুদ্ধ চলমান। মন বলছে এ প্রেমের টান, মস্তিষ্ক বলছে মানবিক দায়িত্ববোধ। বাস্তবতা কী জানি না, তবে ঐ পুরুষটিকে আমি চাই। একান্ত নিজের করে চাই। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও চাই। কিন্তু তিনি কি ভালোবাসবে আমায়?

—-

চলবে…

জানালার ওপারে পর্ব-৩+৪

0

#জানালার_ওপারে
||৩য় পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
🥀🌺পৃষ্ঠা- ৩
কাঠফাটা রোদে খোলা মাঠে কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। প্লাস্টিকের শীর্ণ চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে আছেন সেই আগুন্তক। আস্ত এক অসভ্য লোক! দোষ নিজের সিনিয়দের জেনেও আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন। যদিও ঐ বখাটে সিনিয়র ভাইদেরও ছাড় দেননি। আমার থেকে একটু দূরত্বেই মুরগী হয়ে বসে আছে তারা। সাথে তো চড়-থাপ্পড় ফ্রী আছেই।

রোদের তাপে ঘাম চুয়ে চুয়ে পড়ছে আমার কপাল থেকে। মাইগ্রেনের ভুক্তভোগী আমি, অতিরিক্ত গরম আমার ব্যথার ট্রিগারপয়েন্ট। মাথা ব্যথায় টনটন করতে শুরু করে। মেজাজ চড়ে যায় পঞ্চম আকাশে। ঠাস করে কান থেকে হাত ফেলে দেই। ধপাধপ পা ফেলে চলে যেই লোকটির নিকটে।

কড়া গলায় আঙুল উঁচিয়ে বলি,
“দেখুন জনাব, আমি মোটেও আর কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো না। দোষ আপনার সিনিয়র ছেলেপেলের, আমার না। বুঝলেন?”

তিনি উঠে দাঁড়ান। এতোই দ্রুতো উঠে দাঁড়ান যে তাল সামলাতে না পেরে বেচারা বৃদ্ধ চেয়ারটাও পড়ে গিয়েছে। নিজেকে ঐ চেয়ারের মতো বেচারা মনে হচ্ছে এখন আমার। কী দরকার ছিল লোকটাকে রাগানোর? চুপচাপ দৌড়ে চলে গেলেই তো পারতাম। যদি ঐ সিনিয়র ভাইদের মতোন আমাকেও চড় দেন।

তিনি এক ধাপ এক ধাপ করে আগাচ্ছেন আমার দিকে, কিন্তু আমি গল্পের নায়িকার মতোন পিছাতে পারছি না। আমার পা ভয়ে জমে গিয়েছে। চোখ-মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছি। হুট করে মুখে একঝাঁক মৃদু উষ্ণ বাতাসের আভাস পাই। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে তাকাতেই দেখি সেই ভয়ংকর রাক্ষুসে মুখটি দেখতে পাই। যদিও মুখটি মানুষেরই, দানবীয় নয়। বরং নজরকাড়া বড়ো বড়ো চোখের পাপড়ির অধিকারী। বিষয়টা ভাবতেই ঈর্ষা বোধ হলো।

ভাবনার মাঝেই তিনি আমার কানের নিকটে মুখ এগিয়ে শান্ত কণ্ঠে শুধান,
“মেয়ে, তোমাকে মোটেও আজকের জন্য শাস্তি দেইনি। গতকাল জ্ঞান হারিয়ে আমায় বিপদে ফেলার পঁয়তারা করার জন্য এ শাস্তি।”

“দে-দেখুন…”

“দেখাও, আমি দেখি।”

ঠোঁট কামড়ে হাসেন অসভ্য লোকটি। তাকিয়ে দেখি আশেপাশে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোও হাসছে। আমি দৃষ্টি নত করে দুই ধাপ পিছিয়ে যাই। মনে মনে আক্ষেপ করি, আমার সাথেই কেন এমন হয়? হচ্ছে?

“নাম কী তোমার মেয়ে?”

“আ-আমার নাম…”

“তোমার নাম মায়াবালিকা। আমি তোমায় মায়াবালিকা বলেই ডাকবো, নাম যা-ই হোক।” খাপছাড়া ভাব নিয়ে চলে গেলেন তিনি। আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। এমন নির্বাক করা চরিত্রও বুঝি বাস্তবে মানুষের হয়!

ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম ক্লাসরুমে। আমি বসার কিছুক্ষণ পরই স্যার বেরিয়ে গেলেন, সাথে সকল ছাত্র-ছাত্রীও। অতঃপর তীব্র মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ে মাথা ধরে আমি একাই বসে রইলাম ক্লাসরুমে। হুট করে কেউ চোখের সামনে এক পাতা ঔষধ সহ পানির বোতল ধরলো। তাকিয়ে দেখি ঐ লোকটা। ক্লান্ত আমি আবারও চোখ নামিয়ে ফেলি।

“এই ঔষধটা খাও। ভালো লাগবে।”

খেয়াল করে দেখি ডাক্তারের দেওয়া ঔষধটাই। বিনা বাক্যব্যয়ে সেবন করলাম তাঁর দেওয়া ঔষধ। এক সূক্ষ্ম ভালো লাগার সঞ্চারণ হলো হৃদয়ে। মনে হলো এই মানুষটা একদম খারাপ তো নয়ই। পরক্ষণেই লোকটা এমন কিছু করলো মনে হলো পৃথিবীতে তাঁর চেয়ে বাজে, অসভ্য আর কেউ নয়।

————-

নিজের প্রিয় মানুষের পাশে দেখা সবার সহ্যের বাহিরে, যদি সেই প্রিয় মানুষটির পাশে নিজের বোনকে দেখতে হয়? ডায়েরি লিখা থামিয়ে, আমার রুমে বসে স্পষ্ট দেখছি ছোটোবোন আমার প্রিয়তমের বাড়ি থেকে আসা শাড়ি, গহনা গায়ে লাগিয়ে নেড়েচেড়ে। আমার হৃদয় জ্বলছে, প্রচণ্ড হৃদয় জ্বলছে। যেন কেউ হৃদয় চিড়ে কাঁচা ঘাতে লবণ-মরিচ লাগিয়ে রেখেছে।

ছোটো বোন হাফসা আমাকে টেনে নিয়ে তার এঙ্গেজমেন্টের শাড়িটা তুলে দিয়ে বলল,
“দেখ আপু, কী সুন্দর শাড়ি দিয়েছে! শাড়িটা না কি আবেগ সাহেব পছন্দ করে কিনেছেন!”

চোখের সম্মুখভাগ ঘোলাটে হয়ে এলো। এই অশ্রুগুলোও না! একদম বিদ্রোহী, বাধ মানে না কখনওই। মুখ ঘুরিয়ে কোনোরকম জল মুছে নিলাম। আবেগ ভাই এতো নিষ্ঠুর! কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দিতে আমার প্রিয় সোনালী রঙের শাড়িই পাঠালেন।

আমার এক কাকাতো বোন এলেম, মেহের নাম। তাঁর চেহারা আর মিষ্টি আচার-ব্যবহার বৈকী কিছুই দেখিনি কখনও। কঠোর পর্দাশীল নারী।

তিনি আমায় জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করলেন, “কী গো কাকী, বড়ো মেয়ে রেখে ছোটোটার বিয়ে দিচ্ছেন ভালো কথা! এবার আমাদের এই বুড়ির কথাও ভাবুন।”

“ওকে আর কে বিয়ে করবে? ওর কি এখন আর সে যোগ্যতা আছে! এখন ভাইদের ঘাড়ে বসেই খাবে।”

চোখ জোড়া অসম্ভব রকম জ্বলছে। আর সহ্য করা সম্ভব নয়। আমার গলা ফাঁটিয়ে কাঁদতে হবে, নাহয় আমি মরে যাবো। মরেই যাবো। কেন মৃত্যু হলো না আমার ঐ দিন? এই বিভীষিকাময় দিনগুলোর চেয়ে মৃত্যুটাই হয়তো বেশি কাম্য ছিল আমার।

নিঃশব্দে বেডরুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। অবশ্য শব্দ করার জোরও আমার নেই। মুখ চেপে কাঁদতে হাতে একটা চাকু তুলে নিলাম। আমি হার মেনেছি, নিজের অসহায়ত্বের কাছে হার মেনেছি, প্রেমের কাছে হার মেনেছি, জীবনযুদ্ধ হার মেনেছি। এখন শুধু যুদ্ধ ত্যাগ করা বাকি।

চলবে…

#জানালার_ওপারে
||৪র্থ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
ছুড়িটা হাতের কবজিতে বসাতে গেলেই চোখ গিয়ে পড়ে বাদামি আর্টিফিশায় লেদারের মলাটে আবৃত ডায়েরিটার দিকে। আকস্মাৎ মনে হলো, গল্প সমাপ্ত না করে জীবনের ইতি টানতে পারি না।পরশুদিন শুক্রবার, আমার প্রিয় মানুষটির সাথে ছোটো বোনের আকদ। শুক্রবার আসার আগেই বিদায় জানাতে হবে এ বিষাক্ত শহরকে, সমাপ্ত করতে হবে তাঁর জানালার ওপারে গড়া গল্পকে। ডায়েরি কলম নিয়ে বসে পড়লাম পুনরায়।

——-
🥀🌺পৃষ্ঠা- ৪

“তুমি আমার বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খেলে ক্যানো? ছিঃ! ছিঃ! নষ্ট করে দিলে আমার স্বাদের বোতলটা!”

তিনি মুখটাকে এমন বিকৃত করলেন যেন আমার ঠোঁট লাগায় তাঁর বোতল নোংরা হয়ে গিয়েছে। যদিও আমি নিজেও শুচিবাইগ্রস্তা, তবে তাঁর এমন করায় বেশ রাগ হলো। আবার ঘিনঘিনও লাগছে তাঁর বোতল দিয়ে পান করায়।

তেড়ে উঠে বললাম,
“আমি কি বলেছিলাম আমাকে পানি দিতে? আর আমি কি নোংরা যে একটু মুখ লাগানোতে আপনার বোতল অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”

“আমার বোতল নোংরা করে আবার বাঁকা উত্তর দিচ্ছো মায়াবালিকা!”

আবারও একই কথা বলায় প্রচণ্ড অপমানবোধ হলো, প্রচণ্ড রাগও হলো। ঠাশ করে হাতে থাকা কাচের বোতলের সমস্ত পানি ছুঁড়ে দিলাম তাঁর মুখে।

লোকটা অবাক, বিস্মিত। এতোটাই যে তার প্রভাব পেরিয়ে রাগান্বিত হলো কি না মুখভঙ্গি দ্বারা তা বুঝতে পারলাম না। আমি নিজেও হতবাক। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, কাঁপছি অনবরত। ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় জোরেশোরে এক চাপড় মারি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমদিন এসে এমন সব কাণ্ড কে ঘটায়? কে?

তিনি চোখ ছোটো ছোটো করে যেই না মুখ খুলবে ওমনি আমি দৌড়। কোনো দিকে আমার তাকানোর আর সময় নেই, গেট পেরিয়ে গেলেই আমি থামবো। যদিও বার কয়েক মন চাচ্ছিলো তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখতে, তবে তা উপেক্ষা করলাম সতর্কতার সাথে।

রিকশায় উঠে স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। কিন্তু কেন যেন দমফাটা হাসি পেল ভয়ংকর মানুষটির জলসিক্ত হতবাক চেহারা মনে করে। রিকশাচালক মামাও আমার হাসি দেখে অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে তাকালেন। হয়তো ভাবছেন, মেয়েটি পাগল না কি… কথাটা মাথায় আসতেই চট করে হাসি থামিয়ে শান্ত হয়ে বসলাম।

টিউশনি করিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হলো। গোসল সেরে বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি ড্রইংরুমের আলো জ্বলছে।

না তাকিয়েই মা ভেবে চুল মুছতে মুছতে অনুরোধ করি,
“আম্মু এক কাপ চা করে দাও না, ভার্সিটি থেকে এসে প্রচুর টায়ার্ড লাগছে।”

“হ্যাঁ, অন্যকে বিশেষ করে সিনিয়র ভাইকে চড় মারা, পানি মারা নিঃসন্দেহেই ভীষণ ক্লান্তির কাজ মায়াবালিকা।”

শান্ত সেই বজ্রকণ্ঠ যেন পপ মিউজিকের মতো কানে বাজলো আমার। চোখ বড়ো বড়ো করে সামনে তাকাতেই দেখি সেই অসভ্য লোকটা বসা। আমার মাথায় বাজ, আমি ওড়না ছাড়া এই লোকটার সামনে! ছুটে চলে গেলাম ঘরে।

সঙ্গে সঙ্গেই ফ্ল্যাটের দরজা খুলে আম্মু ঢুকলো। কোক নিয়ে এসেছেন এই অসভ্য লোকটার জন্য।

“শোনো বাবা, আমার মেয়েটাও তোমার বিষয়ে একই জায়গায় ভর্তি হয়েছে। একদম পড়াচোর, ফাজিল। তুমি একটু ওকে মাঝে সাঝে সময় করে পড়িয়ো। তোমার মাকেও বলেছিলাম।”

কথায় আছে ঘরের শত্রু বিভীষণ, এই যেমন আমার মা। ভীষণ রাগ হচ্ছে, এই অসভ্যটার সামনেও মান-সম্মান রাখলো না আমার। কেমন বিটকেলের মতো হাসছেন অসভ্য লোকটা!

“আন্টি এসব নাস্তা দিচ্ছেন কেন? ডায়েরিটা মনে হয় আপনার মেয়ে কলেজে ফেলে এসেছিল। আমি তো শুধু নাম দেখে এই ডায়েরিটা দিতে এসেছিলাম। এখন আসি।”

তিনি চলে গেলেন। আর শুরু হলো আমার মা জননীর বয়ান, যা থামবে কমপক্ষে এক ঘণ্টা পরে। আমি আনমনেই ডায়েরিটা হাতে নিয়ে খুললাম। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখে, ‘একবার বাগে পাই, সিনিয়রকে পানি মারার শিক্ষা তো দিতেই হবে। তাই না মায়াবালিকা?”

গলা শুকিয়ে গেল আমার। কী নিঃসংকোচ হুমকি তাঁর! তাও আমার বাড়িতে এসেই দিয়ে গেল! অসভ্য! আস্ত অসভ্য!

🥀🌺পৃষ্ঠা- ৫
আজ দু’দিন পর ভার্সিটিতে এসেছি, তাও জরুরি প্রয়োজনে। যা কাণ্ড করেছি, এর পর আমার জন্য ভার্সিটিতে আসা বড্ড ভয়ের কাজ।

চোরের মতো ক্যাম্পাসে ঢুকে প্রথমে দরকারী কাজটা করে নেই। ক্লাস থাকায় ক্লাসরুমের বিল্ডিংয়ের দিকে হাঁটি। তখনই একজন এসে জানায়, জুবায়ের স্যার না কি বলেছেন পশ্চিমের ভবনের ৩০৩ নং রুমে ক্লাস হবে আজ।

অবাক হলাম। যতোটুকু আমি জানি ঐ ভবনে আমাদের কোনো ক্লাস হয় না। তবুও বোকার মতোন চললাম৷ ৩০৩ নং রুমের দরজা খোলা, তবে একজনও মানুষ নেই। চমকে উঠি, ভয়ও পাই। বের হতে দ্রুতো পিছনে ঘুরতেই কারো সাথে ধাক্কা খাই।

“আপনি!” এই অসভ্য লোকটির সামনে পড়েছি ভাবতেই ভূমিস্থ হয়ে যেতে মন চাচ্ছে।

“হুম, আমি।”

তিনি এক পা এক পা করে আগাচ্ছেন। রুদ্ধশ্বাস আমার, পিছনে দেওয়াল। কোণঠাসা কণ্ঠে কোনোরকম উচ্চারণ করি,
“প্লিজ, আপনি আর আগাবেন না ভাইয়া।”

“তুমি কি ভয় পাচ্ছো? কেন? গতকাল তো বড্ড বেশিই হেসেছিলে আমাকে পানি মেরে নাস্তানাবুদ করতে পেরে। এখন কোথায় গেল সব সাহস? শাস্তি তো পেতে হবে। আবেগ কাউকে ছাড় দেয় না।”

আমি ঢোক গিললাম। তাঁর কোনো অভিব্যক্তি নেই। তাঁর সর্বদার মতোই গম্ভীর, নির্লিপ্ত, খাপছাড়া ভাব।

“দেখুন, আমি ইচ্ছে করে করিনি কিছু।”

“তুমি তো কিছুই ইচ্ছে করে করো না মায়াবালিকা। তোমার হাত, পা সব স্বতন্ত্রভাবে চলমান। যখন তখন একা একাই বিদ্বেষী হয়ে পড়ে। তাই তোমাকে নয়, তোমার স্বতন্ত্র অঙ্গ হাতকেই শাস্তি দিচ্ছি। এই যে আমার এসাইনমেন্ট, সব ডিটেইলস এই খাতায় দেওয়া আছে। পরশুর মধ্যে আমার চাই।”

আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই বের হয়ে গেলেন তিনি। আমি চোখ-মুখ কুঁচকে তীব্র বিরক্তি ও রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছি। অতঃপর অসহায় আমার নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে দিনরাত কাটিয়ে এসাইনমেন্ট শেষ করতে হয়। মনে মনে হাজারবার বকি। বলি, এই লোকটার সাথে যেন আর একটুও না দেখা হয়।

অথচ, ভবিষ্যৎ হতে চলেছে অন্যরকম। সামনের দিনগুলো বদলে দিতে চলেছে সকল অনুভূতি, আবেগ।
চলবে…

জানালার ওপারে পর্ব-১+২

0

#জানালার_ওপারে
– ঈপ্সিতা শিকদার

একদা যাকে স্বামী রূপে চেয়েছি,তাকে দুলাভাই ডাকবো ভাবতেই গা গুলাচ্ছে। অবশ্য তখন তাঁর যোগ্য ছিলাম, এখন নয়৷ সে জীবনে এসেছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের মতো। এই মনগড়া প্রেমকাব্যটা তেমন বড়ো নয়, তবে অনুভূতির বিচারে ক্ষুদ্রও নয়। তা-ই আজ লিখছি।

🥀🌺পৃষ্ঠা- ১
বিয়ে বাড়িতে গাউনের চেইনটা নষ্ট হয়ে খুলে গিয়ে একরকম বিচ্ছিরী পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছি! দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলা হাসতে হাসতে নানা মন্তব্য করছে। সরেও যেতে পারছি না, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে লজ্জায় চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে।

ঠিক তখনই কারো বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠি আমি। চোখ তুলতেই দেখি এক অচেনা আগুন্তক সেই ছেলেগুলোকে ধমকাচ্ছেন,
“তোদের সাহস তো কম না! এখানে এসে বেয়াদবী! পিঠের ছাল তুলে দিব একদম! আজকেই লাস্ট এর পর যদি দেখেছি কোনো দিন সারা এলাকা ল্যাংটা করে চড়াবো।”

লোকটার ধমকে এই দিকটা মুহূর্তেই জনমানব শূন্য হয়ে গিয়েছে। তিনি আমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে এগিয়ে আসছেন। আমি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়াই।

“দেখে-শুনে জামা পরে আসবে না, মেয়ে? এখন এমন মূর্তির মতো না দাঁড়িয়ে ওড়না দিয়ে গা ঢেকে নেও। আর তুমি কে?”

“আমি আপনাদের পাশের বাড়ির…”

ইতস্তত ভঙ্গিমায় উত্তর দিতে দিতে ওড়নায় হাত রাখতেই তিনি মুখ বাঁকান। কিঞ্চিৎ খোঁচা দিয়ে বললেন,

“আজকালকার জামাগুলোর ওড়না আসলে ওড়না তো নয় যেন মশারির নেট। আমি চোখ বন্ধ করছি আমার সামনে এসে দাঁড়াও। কী হলো দাঁড়াও মেয়ে! দেখো আমার সারাদিন পড়ে নেই! আর না তুমি নায়িকা, না আমি নায়কদের মতো কোর্ট প্যান্ট পরে আছি যে তোমাকে দিব। একমাত্র পাঞ্জাবি তোমায় দিলে মানুষ যা তা ভাববে।”

তাঁর ধমকে আমি তাড়াতাড়ি কোনোরকম অরগাঞ্জার ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াই। তিনি আমার সাথে তালে তাল মিলিয়ে যতোটা সম্ভব আমাকে আড়াল করে হাঁটছেন। অসম্ভব রকমের অস্বস্তি বোধ হচ্ছে কোনো অচেনা ছেলের এতো কাছে আসায়, যদিও ছোঁয়া লাগেনি, তবে দূরত্বও এতোটাই কম যে তাঁর উষ্ণ শ্বাসও আমি বোধ করতে পারছি না।

কমিউনিটি সেন্টারের মানুষের সমারোহ কম থাকা দিক দিয়ে আমাকে একটি বিশালাকার কামরায় নিয়ে আসে, বোঝা যাচ্ছে এটা ড্রেসিং রুম কাম রেস্ট রুম বউয়ের জন্য।

ঢুকে উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেন,
“দেখো মেয়ে, ঐ কর্নারের চেঞ্জিং রুমে আমার বোনের একটা শাল রাখা আছে। প্যাঁচিয়ে নেও। এর চেয়ে বেশি সাহায্য আমার দ্বারা হবে না।”

তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও আমি চিন্তায় বিভোর হয়ে মাথা ঝাঁকাই। অতঃপর আমি চেঞ্জিং রুমে ঢুকি। সেই অচেনা যুবক চলে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতে অগ্রসর হয়।

এমন সময় একজন মধ্যবয়স্ক নারী ‘আরিশা’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে এ ঘরে ঢোকেন। লোকটার এই আওয়াজ শুনে কী হলো কে জানে ছুটে এসে আমার পিছনে চেঞ্জিং রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিলেন।

আমি তখনও তাঁর বোনের ওড়না পরিনি। বরং, নিজের ওড়না বা হিজাবটুকুও গায়ে নেই। আবারও ঢেকে-ঢুকে পরতেই নিচ্ছিলাম তিনি ঢুকেন। আঁতকে উঠে যেই না চিৎকার করে কিছু বলতে যাবে তিনি কাছে এসে মুখ চেপে ধরেন।

“দেখো মেয়ে, আমার মামী এসেছেন। তিনি যদি ভুলেও আমার সাথে এই ছেঁড়া পোশাকের কোনো মেয়েকে দেখে সারা দুনিয়ার সাথে আমার সাদা চরিত্রকে ফুটবল বানিয়ে খেলবেন। দয়া করে চুপ থাকো।”

তিনি হুমকি দিলেন না অনুরোধ করলেন বুঝলাম না। কথাগুলো অনুরোধবাচক হলেও, কণ্ঠের তেজ আর কঠোরতাটা হুমকির মতোই। আমি চুপ করে থাকলাম। তবে আমার বড্ড বেশিই দমবন্ধ লাগছে, অস্বস্তিও হচ্ছে। চেঞ্জিংরুমটা অনেক ছোটো একজন মানুষ দাঁড়ানো জন্যই ঠিক আছে, তাও অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবানদের জন্য নয়। সেখানে ছেলেটা আমার সাথে, ছুঁই ছুঁই দূরত্ব আমাদের।

এ কোন বিপদে পড়লাম আমি! মাথাটা ভনভন করছে আমার। বাহিরে থেকে শোনা যাচ্ছে তাঁর মামীর বিড়বিড় করার শব্দ, পদচারণার আওয়াজ। হুট করেই তিনি চেঞ্জিং রুমের দরজায় ধাক্কা দেন।

“এই চেঞ্জিং রুমের আবার কী হলো? খুলছে না ক্যানো?” আরও জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করেন। ভেঙে হলেও যেন এ দ্বার আজ খোলা অত্যাবশ্যকীয় কর্ম এই নারীর জন্য।

আমার ভয়ে কেঁদে দেওয়ার দশা! বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেটি কড়া চোখে তাকায় আমার দিকে, ইশারায় চুপ থাকতে বলে।

হাসি হাসি মুখ করে শুধায়,
“আরে মামী, আমি এইখানে৷ আমার পায়জামা কীসের সাথে খোঁচা খেয়ে যেন ছিঁড়ে গিয়েছে। চেঞ্জ করছি। আপনার আনা ঐ সুন্দর ধুতি আর পাঞ্জাবি পরছি মামী। কী সুন্দর মামী, পুরাই আপনার মতোন। তবে ডিস্টার্ব কইরেন না। তাহলে কিন্তু সুন্দর হবে না পরা, তা না হলে মানুষ আপনার চয়েসের প্রশংসার জায়গা দুর্নাম করবে।”

লোকটার কথায় মহিলাটি মুহূর্তেই যেন উত্তেজিত এবং আনন্দিত হয়ে উঠেন। খুশিতে গদগদ কণ্ঠে বলে উঠেন,
“ওহ, আবেগ বাবা তুই আমার দেওয়া কাপড় পরছিস! তোকে তো আগেই বলেছিলাম পরতে! যাই হোক আমি তাহলে বাহিরেই বসছি। দেখতে ভালো মতো পরছিস না কি! পরে তো মানুষ আমার পছন্দের দোষ ধরবে!”

তাঁর কথা শুনতেই আমার চোখ গোল গোল হয়ে যায়। আর সাথের মানুষটি তাৎক্ষণাৎ নিজের কপালে জোরালো চাপড় মারেন। চিন্তায় মাথা টনটন করছে আমার, আমার মা বা অন্যকেউ যদি ঘুণাক্ষরেও খবর পায় এ বিষয়ে। তাহলে আমার তো পটল তুলতে হবে।

কোনোকালেই টেনশন মাথায় নিতে পারি না আমি, আজও তাই হলো। ধীরে ধীরে চোখের সামনে অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে। তবে কি নিজের মান-সম্মান আজ ধুলোয় মিশতে চলেছেই?! অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে শুধু একটাই দোয়া করলাম, এ পরিস্থিতি থেকে রেহাই, নিজের মান-সম্মানের রেহাই।

চলবে…

#জানালার_ওপারে
||২য় পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“ভাবী, আপনার মাইয়ার তো বিয়ে হইবো না। যেই কাণ্ড কইরা বইয়া আছে, তার উপর নাই রূপ, গুণ। জামাই পাইবো কইত্তে?” ডায়ারিটা বন্ধ করে ড্রইংরুমে আসতেই শুনতে পাই প্রতিবেশি কাকীর এমন কটাক্ষ।

বেশ রাগ হলো, উত্তর দিতে চাইলাম কিন্তু দিতে পারলাম না। আমি অসহায়, আল্লাহ আমায় অসহায় করেছেন। মাঝে মাঝে খুব করে জানতে ইচ্ছে আমি কি ইচ্ছে করে করেছি নিজের ক্ষতি? কেউ কি নিজে যেঁচে নিজের পায়ে কুড়াল মারে?

নির্বাক আমি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ রাতের খাবার খেতে বসি। কাকী বেরিয়ে যেতে যেতে মুখ বাঁকিয়ে বলেন,
“এমন অবস্থায়ও খাবার গিলে কীভাবে মানুষ!”

আর খাবার খেতে ইচ্ছে করে না। ভাতে পানি ফেলে উঠে যাবো ঐ মুহূর্তে আম্মু এসে বলে,

“হাফসার সাথে আবেগের এঙ্গেজমেন্টের ডেট ফিক্সড হয়ে যাবে। হয়তো সামনের শুক্রবারেই এঙ্গেজমেন্ট। এই মাত্র ফোন করে জানালো।”

হৃদয়ে, মস্তিষ্কে পাহাড় সমান ভার অনুভব হচ্ছে। এলোমেলো পদচারণায় কোনোরকম বিছানায় বসলাম। কেন আপনি আমার হলেন না আবেগ ভাই? কেন আপনার জানালার ওপারেই রয়ে গেলাম আমি আর আমার মনগড়া প্রেমকাব্য? যদি না হওয়ারই হয় তাহলে একবার নাহয় ভুলবশত সাক্ষাৎ হয়েই গিয়েছিল দ্বিতীয়বার এলেন কেন?

ভাবতে ভাবতেই ডায়েরি নিয়ে বসলাম। লিখতে শুরু করলাম সেই আমাদের দ্বিতীয় সাক্ষাতটি।

🥀🌺 পৃষ্ঠা- ২
ভার্সিটিতে প্রথম দিন এসে এভাবে সিনিয়র ভাইকে চড় দিয়ে বসবো এ ব্যাপারটা পুরোই অকল্পনীয় ছিল। এক ঝাঁক বাচ্চা সহ মা মুরগীর দৌড়ানি খেয়েছেন কখনও? আমি খেয়েছিলাম ছোটো বেলায় একবার। আমার এখন তেমনই বোধ হচ্ছে। সিনিয়র ভাইদের ভয়ে আমি লুকিয়ে আছি একটা জনমানবশূন্য ক্লাসরুম।

আচ্ছা, ভাইয়াকে কী কল দিব? কিন্তু সে জানলে আবার কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? আমার কপালে মনে হয় আজ দু’দিন যাবত শনিই নাচছে। কথাটা ভাবতেই শুনতে পেলাম সেই পরিচিত বজ্রকণ্ঠ,

“এই মেয়ে বের হয়ে আসো ওখান থেকে। এখনই বের হয়ে আসো।”

অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে দরজা খুলে একফালি আলোর সাথে প্রবেশ করেছে একজন। আলো-ছায়ার খেলায় তাঁর চেহারা দৃশ্যমান নয়। ভিতরে প্রবেশ করলে দেখতে পাই তিনি তো গতকালের আগুন্তক।

সাথে সাথেউ বিয়ে বাড়ির ঘটনা মনে পড়ে গেল। জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম নিজের বেডরুমে। আমাকে অবাক করে আব্বু-আম্মু তেমন কিছুই আমায় বলল না।

শুধু বলল,
“হতচ্ছাড়া মেয়ে! না খেতে, না খেতে এমন দশা বানিয়েছিস এখন যেখানে সেখানে জ্ঞান হারাস। মানুষ তো মনে করবে আমরা কিপটে। আর যদি খাওয়া নিয়া টালবাহানা করেছিস!”

তারা চলে গেল। আমাদের বাসায় থাকা দুঃসম্পর্কের কাজিন হাফসাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, আমি না কি ওয়াশরুমের সামনে বেহুশ হয়ে পড়েছিলাম। বউয়ের ছোটোবোন না কি আমায় দেখে সবাইকে জানায়।

আমি তাড়াতাড়ি উঠে আমার জামা চেক করলাম। দেখি চেইন খুলা জায়গাটুকু প্রায় পঞ্চাশ-ষাটেক সেফটিপন দিয়ে আটকানো। তখনই নিজের হাতে চোখ গেল আমার। সেখানে যথাসম্ভব ছোটো অক্ষরে লিখা,

“মেয়ে এতোটুকুতে অজ্ঞান হয়ে পড়লে হবে৷ আরেকটু হলো মেয়ে জনিত কাণ্ডে ফেঁসে যেতাম আমি।”

“এই মেয়ে! কই গায়েব হলা?”

তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লোকটি। আমি তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আবারও মুখি খুললেন,

“মেয়ে তোমার সাহস তো কম না, তুমি ভার্সিটিতে আজ প্রথম এসেই সিনিয়রের গায়ে হাত তুলেছো। এতো দুঃসাহস কীভাবে হয়?”

আমি কোণঠাসা কণ্ঠে উত্তর দিলাম,
“দেখুন, আমার কোনো দোষ নেই। তারা আমাকে জোরাজুরি করছিল সিগরেটে মুখ দিতে। আমার অনুমতি ছাড়া আমাকে ছুঁলে বা আমাকে দিয়ে কিছু করাতে চাইলে এমনই হবে।”

তিনি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। যেন খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি আবার যেন গতকালের মতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লাম।

কয়েক মুহূর্ত পর তিনি ফোন বের করে কাউকে কল করে আমার দিকে চোখ রেখেই বললেন,
“হ্যালো কই তুই শফি? ছেলেপেলেগুলাকে নিয়ে আয়, আজ ঠ্যাং ভেঙে শায়েস্তা করেই ছাড়বো!”

তাঁর কথা শুনে আঁতকে উঠলাম আমি। ইচ্ছে করছে দৌড়ে চলে যাই। কিন্তু ভয়ে পা দুটো যেন জমে গিয়েছে। মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছি, প্রার্থণা করছি এদের হাত থেকে মুক্তির।

চলবে…

পুকুরের সেই আতঙ্ক পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0

#পুকুরের সেই আতঙ্ক
৮ম এবং শেষ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

জালালুদ্দিন মাতবর আর রশিদ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ডোবাটার দিকে। এই জঙ্গলের ভেতরে এমন অদ্ভুত একটা ডোবা থাকতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ডোবাটাকে ঘিরে আছে উঁচু ঝোপ আর ঘন গাছের সারি। তাই পথ থেকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না ওগুলোর পরে একটা ডোবা আছে। রশিদ চারদিকে চোখ বুলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে। জালালুদ্দিন মাতবর হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন ঝোপটা দেখে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন একটা মন্ত্র। তারপর এগিয়ে যেতে লাগলেন ঝোপটার দিকে। রশিদ লক্ষ্য করলো ওদিকে গাছের সারি বেশ ঘন। সেও ওস্তাদকে অনুসরণ করলো। দুজনে অনেকটা ঠেলে-ঠুলেই ঝোপটা পার হলো। এরপরই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ডোবাটা। আয়তনে ১৫ ফুট লম্বা, ১০ ফুট পাশের হবে। কিন্তু গভীরতা অনুমান করা যাচ্ছে না।

ডোবার পানির রঙের কারণেই এটাকে অদ্ভুত ডোবা মনে হচ্ছে রশিদের কাছে। এত কালো পানি সে আর কখনো দেখেনি। এটাকে পঁচা পানিও বলা চলে না। কোনো দুর্গন্ধ নেই। উল্টো অদ্ভুত একটা সুভাষ ভাসছে নাকের কাছে দিয়ে। সে কৌতূহলতা নিয়ে বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে তাকালো। তার মুখও সন্দিহান। মুখে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে যাচ্ছে কিছু। রশিদের মনে পড়লো অশুভ শক্তির সম্মোহনের প্রভাব থেকে বাঁচতে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে বা অনুভব করলে মন্ত্রটা উচ্চারণ করে বলেছিলেন তিনি। সেও শব্দহীন ভাবে শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে আওড়াতে লাগলো ওটা। নাকের সামনে থেকে সুভাষটা উবে গেল মুহূর্তেই। উৎকট একটা পঁচা গন্ধ অনুভব করে নাক কুঁচকে ফেলল সে। ডোবাটার চারদিকে ঘুরে এটার খুঁটিনাটি লক্ষ্য করতে লাগলো দুজনেই। ডোবাটার পাড় সামান্য ঢালু হয়ে এরপর কুয়োর মতো সোজাসুজি নীচে নেমে গেছে। ঢালু পাড় থেকে পানি অন্তত ৬ ফুট নীচে। তাই ভালোমতো ডোবার কিনার উপর থেকে দেখা যাচ্ছে না।

কেউ কোনো কথা না বললেও দুজনেই মনে মনে বিশ্বাস করছে এই ডোবাটার সঙ্গে প্রাচীন সেই পুকুর, পুকুরের পিশাচ, ৬টি কিশোরী মেয়ের মৃত্যু জড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। এক অশুভ শক্তির তীব্র অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে দুজনেই। কিনার ঘেষে বসে উঁকিঝুঁকি মেরে ডোবার নিচু অংশটা দেখছিল রশিদ। হঠাৎ তার চোখ কিছু একটায় আটকে গেল। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওদিকে তাকান ওস্তাদ!’ টর্চটা জ্বেলে ডোবার পানি থেকে সামান্য উপরের একটা জায়গায় আলো ফেলল সে। জায়গাটা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি বেরিয়ে আসছে। সেগুলো বেয়ে নীচে নেমে মিশে যাচ্ছে ডোবার পানির সাথে। অবাক হলো দুজনেই।

এখন বৃষ্টির মৌসুম নয়। পানি আসছে কোথা থেকে! একবার অনুমান করলো, সেই প্রাচীন পুকুরটা থেকে আসছে। না, এটা অসম্ভব! পুকুরটা কত , কত দূরে। মাইলের উপরতো হবেই। কোনো সুরঙ্গপথ এতদূর মাটির ভেতর দিয়ে পানি আনতে পারবে না। জালালুদ্দিন মাতবর বললেন ‘পানির পিশাচ ওটা। একবার যদি ওটা পুরো ক্ষমতা পায় তাহলে তার পক্ষে কিছুই করা অসম্ভব নয়।’

রশিদ অবাক হয়ে বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে তাকালো। দুজনের চিন্তার দ্বারা যে একই পথে প্রবাহিত হচ্ছে সন্দেহ নেই। সে বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘সেই প্রাচীন পুকুরটার সঙ্গে এটার পানির সংযোগ আছে বলতে চাইছেন?’

‘পানির সংযোগ নয় শুধু, আমার মনে হচ্ছে এমন একটা পথ আছে যেই পথ দিয়ে স্বয়ং সেই পিশাচটা চলাচল করতে পারে।’ গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন তান্ত্রিক মাতবর।’

‘মানে পিশাচটা কিশোরী মেয়েগুলোর লাশগুলো সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে এখানে নিয়ে আসতো! তাই পুরো পুকুর তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেয়েগুলোকে পাওয়া যেত না! সবই আমাদের অনুমান। কিন্তু মনে হচ্ছে এটাই যুক্তিযুক্ত ঘটনা।’

‘পুরোটা অনুমান নয় রশিদ, ভালো করে জায়গাটা দেখ।’

রশিদ আরেকটু ঝুকে গেল সামনে, টর্চের আলোয় যেখান থেকে পানি চুইয়ে নামছে সেখানে একটা হাতের ছাপ লক্ষ্য করলো। বুকটা ধড়ফড় করে উঠল তার। এমন সময়েই ভূমিকম্প অনুভূত হলো। তার পায়ের নিচ থেকে সামান্য মাটি সরে গেল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে পড়ে গেল ডোবার পানিতে। বুড়ো তান্ত্রিক দ্রুত ছুটে এলো কিনারে। সন্ধ্যা মিলিয়ে গিয়ে রাতের আধারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। আর ডোবার চারপাশে ঝোপ থাকায় জায়গাটা আরও অন্ধকার।

রশিদ প্রায় ডুবে গেল বিচ্ছিরি গন্ধ যুক্ত পানির ভেতর। নাক-মুখ দিয়ে কাঁদা ঢুকে গেছে। কোনোরকম করে মাথাটা পানির উপর তুলে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। পুরোপুরি সোজা হতেই দেখল পানি তার কোমর পর্যন্ত। ডোবাটা বেশি গভীর নয় তাহলে! তার টর্চ আর খুঁজে পেল না। জালালুদ্দিন মাতবর উৎকণ্ঠা নিয়ে তার লাইটের আলো রশিদের উপর ফেলে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে যাবেন এমন সময়, হঠাৎ পানির কুলকুল শব্দ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। রশিদ একটু এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের যে অংশ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে সেদিকে এগিয়ে গেল। একটা ধাক্কার মতো খেল পানির তীব্র স্রোতে সে। মাটি সরে গিয়ে জায়গাটা ফুঁড়ে নলমুখ সৃষ্টি করে হঠাৎ বেরিয়ে আসতে লাগলো পানি। কোথা থেকে আসছে! দেখতে দেখতে তার পাশের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। নড়তে গিয়ে রশিদ অনুভব করলো কাঁদা মাটির সঙ্গে শক্তভাবে আটকে আছে তার পা। তীব্র টানে কিছু একটা আটকে রেখেছে যেন ওকে।

ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যেতে হলো তাকে। পানি প্রায় গলার কাছাকাছি উঠে এসেছে। সে যদি সাঁতরাতে না পারে কতক্ষণ আর দম বন্ধ করে পানির নিচে থাকতে পারবে! আর যে ভয়ানক পানি! জালালুদ্দিন মাতবরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন রশিদকে অভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তবে তার কৌতূহলতা জুড়ে ঝাপাঝাঁপি করছে পানির তোর আসছে কোত্থেকে! সে রশিদকে ওখানে আধারে রেখেই ঝোপ পেরিয়ে মাটিতে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলেন পানির চলার কম্পন। অবাক হতে হলো তাকে। যেখান দিয়ে ডোবাটিতে পানি ঢুকছে। সেই বরাবর লম্বা একটি পথ মাটিতে কান পাতলেই পানির চলার শব্দ আর কম্পন শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ মাটির সামান্য তোলা দিয়ে একটি নালার মাধ্যমে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কিসের নালা, কিভাবে সৃষ্টি হলো এটা, পানির উৎসই বা কোথায়! আর এগোলেন না তিনি। ফিরে এলেন ডোবার কাছে। ওটা প্রায় ভরে এসেছে। কিন্তু রশিদ এখনো উঠতে পারেনি! পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে বেগ পেতে হলো না তাকে। ডুব দিলেন মুহূর্তেই। টর্চটা ডাঙায় রেখে এসেছেন।

আধারেও রশিদকে খুঁজেস3 পেতে কষ্ট হলো না তার। সে দম বন্ধ করে ঝুকে নিজের পা ছোটানোর চেষ্টা করছে। বুড়ো তান্ত্রিক আর তার চেষ্টায় অবশেষে মুক্ত হলো পা। দুজনেই ভেসে উঠল পানির উপরে। ভেজা কাপড় আর টর্চ নিয়ে দুজনেই এবার মাটিতে কান পেতে পেতে এগিয়ে যেতে লাগলো নালার উৎস মুখের সন্ধানে।

আসতে আসতে থমকে দাঁড়ালেন আরেকটা ঝোপের সামনে। একবার তাদের মনে হলো আগের জায়গায় ফিরে এসেছেন কিনা! কিন্তু ঝোপ বেদ করে এগিয়ে যেতেই আবিস্কার করলেন একটা বেদীবিহীন কুয়ো। কুয়োর মুখটা খুবই ছোট, মাটির সঙ্গে মিশে আছে। আনমনে কেউ ঝোপে ঢুকলেই পড়ে যাবে ওটার ভেতর। ভেতরে টর্চের আলো ফেলতেই বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল রশিদের। কুয়োয় উকি দিলে অন্তত ৫-১০ ফুট নীচে পানি আছে ভেবেই তাকায় সবাই। তবে এটার পানি প্রায় মাটি ছুঁইছুঁই!

‘এটার কথাই আমাকে ওরা বলেছিল, এটার খোঁজই আমাদের দরকার ছিল।’ বুড়ো তান্ত্রিকের কণ্ঠে উত্তেজনা।

‘একটি ডোবা, একটি কুয়ো, একটি পুকুর ও একটি দাও পিশাচের সম্পর্ক , রশিদ! সারাদিনে সাধনা করে আমি বিভিন্ন শক্তির কাছে পুকুরের ওই পিশাচটা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম। ওরা নিজেদের প্রজাতি সম্পর্কে খোলাসা করে কিছুই বলে না। শুধু এটুকু বলেছিল জঙ্গল, ডোবা, কুয়ো, পুকুর আর পিশাচ। তখন কিছু না বুঝলেও এখন সব পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। আগেকার সময়ের জলে, স্থলে দুই জায়গাতেই সমান শক্তিশালী আর ভয়ঙ্কর পিশাচ ছিল এই দাও পিশাচরা। এরা পুকুরের দেও থেকে ভিন্ন। মানুষের কাছে না গিয়েও তাকে ধোকায় ফেলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এটার। ওটার ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা বিস্তারিতই জেনে গেছি এতদিনে। মূলত সেই পিশাচগুলোকে বন্ধি করার একমাত্র উপায় ছিল তাদেরই কৌশল ছল এবং ভ্রম।

একটা ডোবা এবং কুয়ো তৈরি করে তন্ত্র বলে, অনেক সময় পিশাচ চলাচলের পথে ডোবা তৈরি করে মৃত মানুষের শরীর ডোবায় ভাসিয়ে ওদেরকে আহ্বান করা হতো। পিশাচ ডোবায় উপস্থিত হলেই পবিত্র পানি, ফল, পাতা ফেলে মন্ত্র উচ্চারিত করা হতো। ডোবার পানি আতঙ্কে পরিণত হতো পিশাচটার। ওটার শরীর যেন আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। ডোবার চারপাশে সুরক্ষা সৃষ্টির কারণে ওটা ডোবা থেকে বাইরে যেতে পারে না। তখন সাধকদের পরিকল্পনা মতো পিশাচটা ঢুকে পড়ে সুড়ঙ্গে। পৌঁছে যায় কুয়োয়। কুয়োর মুখ আগে থেকেই বন্ধ থাকে। এরমধ্যে ডোবা থেকে সুড়ঙ্গটাও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সাধকের দল মাটি ফেলে।

ফলে আটকে পড়তো পিশাচটা চিরদিনের জন্য। এই পিশাচটা সম্পর্কে আমার সাধনা জীবনের শুরুতে অনেক শুনতাম। কিন্তু এটাই যে সেই পিশাচ তা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেললাম। বুঝতেই পারছো রশিদ পিশাচটার জন্য কুয়ো আর ডোবা এমন জায়গায় এমন ভাবে সাধকরা তৈরি করতো যাতে কোনো সাধারণ মানুষ ওটার কাছে গিয়ে শয়তানটাকে মুক্ত করতে পারে। কিন্তু দেখ হয়তো অনেক যুগ কেটে গেছে পিশাচটা এখানে বন্ধি, সাধকেরা আর এটার খোঁজ রাখেননি। বন জঙ্গল উজাড় হতে হতে এটা মানুষের অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে।

দীর্ঘদিন শয়তানটা বন্ধি থাকায় ওটার প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে। হয়তো কিশোরী মেয়ের দল জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই ওটা দূর থেকে কোনো এক ইশারা , ছলের আশ্রয় নিয়ে টেনে এনেছে মেয়েগুলোকে এই কুয়ো মুখের কাছে। মেয়েগুলো কৌতূহল হয়ে পুরোনো কুয়োর মুখ খুলে দিয়েছে। আর মুক্ত হয়ে শয়তানটা নিজের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য নরবলি দিতে থাকে। এই কুয়ো আর ডোবা যেমন পিশাচটাকে বন্ধি করতে পারে। আবার স্বাধীন অবস্থায় এই দুটোই ওটাকে শক্তিও দিতে পারে। কুয়ো এবং ডোবায় পানির স্রোত সৃষ্টি করে একটা অদ্ভুত মায়ার সুড়ঙ্গ ওটা সৃষ্টি করতে পারে যা কিনা শয়তানটাকে সরাসরি এই কুয়ো থেকে কয়েক সেকেণ্ডে সেই প্রাচীন পুকুরে নিয়ে যেতে পারে। এই কুয়ো থেকে ঐ পুকুর পর্যন্ত কিন্তু দীর্ঘ মাটির নিচে দিয়ে সুড়ঙ্গ নেই। এটা স্রেফ এক অলৌকিক পথ বলা যায়। পিশাচটা মেয়েগুলোর লাশ প্রথম এই কুয়োয় এবং পরে ওই ডোবায় এনে রাখতো।’

বিস্ময় নিয়ে জালালুদ্দিন মাতবরের দীর্ঘ বক্তব্য শুনলো রশিদ। অবিশ্বাস্য লাগছে সব কিছু। কিন্তু এই মৃত্যু রহস্যের এর চাইতে আর ভালো ব্যাখ্যা তার নিজের কাছে নেই। বুড়ো তান্ত্রিক যে আন্দাজে এসব কথা বলছে না, তা সে জানে। লোকটা তার পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছে পিশাচ জগৎ নিয়ে। ভালো করে কুয়ো মুখ খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েই লক্ষ্য করলো রশিদ আসলেই ওটার উপরে একটা ঢাকনা ছিল। কিছুক্ষণ চারপাশে খোঁজ করার পর একটা বড় গাছের গোড়ার কাছে সত্যিই একটা ঢাকনা খুঁজে পেল তারা। লোহা কিংবা স্টিলের ওটা! জং ধরে গেলেও অদ্ভুত ভাষায় ওটার উপর যে কিছু লেখা রয়েছে তা দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত , অচেনা কিছু চিহ্নও আঁকা রয়েছে ওটার উপর। জালালুদ্দিন মাতব্বর বললেন, ‘আমাদের দুজনকেই কাজটা শেষ করতে হবে, এবং আজ রাতের মধ্যেই। যত সময় যাবে তত ওটার ক্ষমতা বাড়বে। আমার মনে হয় ৬টি মেয়ের লাশ ওই ডোবাতেই আছে। পানির স্রোত ওটা পাঠিয়েছে লাশগুলোকে নিয়ে যেতে। লাশগুলোকে আমাদের আটকাতেই হবে ডোবার ভেতরে!’

প্রথমেই তারা অপশক্তির বিরুদ্ধে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে ঢাকনাটা কুয়ো মুখের উপর পুনরায় স্থাপন করলো। গাছের ডাল দিয়ে এমন ভাবে ঢাকনাটা চাপা দিল যাতে সহজে না খোলে। এরপর হাজির হলো ডোবাটার কাছে। পুরোপুরি পানিতে ভরে গেছে ওটা। কিন্তু ডোবার মাঝে যে প্রাণীটি ভেসে রয়েছে টর্চের আলোতে ওটার দিকে তাকাতেই দম বন্ধ হয়ে এলো দুজনের। পিশাচটা মাথা বের করে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের দুজনের আসার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। কুৎসিত জিহ্বা নড়ে উঠছে ওটার মুখ থেকে। চুকচুক শব্দ ভেসে আসছে ওখান থেকে। দিশেহারা বোধ করলো রশিদ। হঠাৎ পেছনে পায়ের আওয়াজ শুনতেই আতঙ্কে নিয়ে দুজনেই ঘুরে তাকালো পেছনে। ৬টা মেয়ে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে, ওদের সবার হাতেই ধারালো দা। ওগুলোর গায়ে লেগে আছে রক্ত। যেন সাক্ষী দিচ্ছে অস্ত্রগুলো কারো প্রাণ নেয়ার। মেয়েগুলোর গলার কাছাকাছি কালো দাগের রেখাগুলো ফুটে আছে যেই স্থান থেকে তাদের মাথাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। পিশাচটা পুনরস্থাপন করেছে ওগুলো!

ধারালো অস্ত্রধারী মেয়েগুলো যে অশরীরী নয় তা বুঝতে পেরেই গা হীম হয়ে গেল দুজনের। জ্বলে আর স্থলে দুই দিকেই আতঙ্ক। মেয়েগুলো ভয়ানক ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো তাদের দিকে। ঘুরে পেছনে তাকাতেই দেখল তারা,, পিশাচটাও এগিয়ে আসছে সমানতালে।

দুজনেই সম্মিলিত ভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করে যেতে লাগলো কিন্তু কোনো লাভই হলো না। হঠাৎ থমকে গেল মেয়েগুলো, পিশাচটাও অনেক গুলো মানুষের হাঁটার শব্দ আর কথা বলার শব্দ কানে আসছে। অসম্ভব! গ্রামের লোকেরা তাদের উদ্ধার করতে এসেছে! কাউকেই দেখা যাচ্ছে না যদিও। রশিদ আর জালালুদ্দিন মাতবর দুজনেই চিৎকার করে নিজেদের উপস্থিতির জায়গাটা জানান দিলেন। মেয়েগুলো উল্টোঘুরে মানুষ গুলোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। নিশ্চিত বিপদের মুখে পড়তে চলেছে সবাই। বুড়ো তান্ত্রিক রশিদের হাত চেপে ধরলো, ‘গ্রামের লোকগুলোর ভয়ানক ক্ষতি করতে পারবে এই মেয়ে ৬জন, ডাঙায় পিশাচটার ক্ষমতা এখন পুরোপুরি ফিরে আসেনি। এই কারণে এতদিন ধরে মেয়েগুলোকে একে একে খুন করে ওদের নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ওটা। যাতে ওটার ক্ষমতা লাভের পথে কেউ বাঁধা দিলে ক্ষতি করতে পারে ওরা! আর সময় নেই। পিশাচটাকে বন্ধি করতে হবে। তুমি ডোবার সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে যাও, ওটা তোমাকে কুয়োটায় নিয়ে যাবে। পিশাচটা তোমাকে অনুসরণ করে কুয়োয় পৌঁছুবে আর তখন তুমি ৩য় অলৌকিক সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রাচীন সেই পুকুরে পৌঁছে ওটার মুখে এই কবজগুলো বেঁধে দেবে তাহলে আর ওটা মুখ দিয়ে বের হতে পারবে না।’ এই বলে রশিদের শরীরে সুতোর সঙ্গে বাধা কবজগুলো দেখালেন।

এক মুহূর্ত না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়লো রশিদ ডোবার পানিতে। পিশাচটাকে পাশ কাটিয়ে হাতড়ে হাজির হলো সুরঙ্গটার মুখে। বেশ প্রস্তুত পথ সুরঙ্গটার কুয়ো পর্যন্ত। পানিতে ভরে আছে এটি। এতটা পথ এক নিঃশ্বাসে পাড় হওয়া অসম্ভব। কিন্তু একটা অলৌকিক শক্তিই যেন সাহায্য করলো তাকে দ্রুত কুয়ো পর্যন্ত পৌঁছুতে। জালালুদ্দিন মাতবর দেখলেন পিশাচটাও যেন রশিদের কাজে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। ওকে অনুসরণ করে পানির নিচে ডুব দিল শয়তানটাও।

ভাগ্যের জোর আর দৈব কোনো শক্তিই যেন রাতটাতে সাহায্য করলো তান্ত্রিক দুজনকে। কুয়ো থেকে অন্ধকারেও পানির ঘূর্ণি অনুভব করে অলৌকিক সুড়ঙ্গ ধরে প্রাচীন পুকুরে পৌঁছে গেল রশিদ এবং বন্ধ করে দিল সুড়ঙ্গ পথটা। পিশাচটা সুড়ঙ্গে ঢুকে যেতেই দ্রুত কমতে লাগলো আবার ডোবার পানি। পানির স্তর সুড়ঙ্গ মুখের নীচে নেমে গেল দেখতে দেখতেই। এমন সময় ঝোপ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো পুলিশের দলটা। তান্ত্রিক বিস্মিত হলেন। কিন্তু সময় নষ্ট করলেন না। দ্রূত নেমে পড়লেন ডোবায় এবং নিজের শরীরের সব কবজ খুলে তা সুড়ঙ্গ পথে বেঁধে বন্ধ করে দিলেন ওটার ডোবায় ঢোকার পথটাও।

পিশাচটা কুয়োয় বন্ধি হয়ে যাওয়ার পরেই ৬টি মেয়ের শরীরই নিষ্প্রাণ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। স্থানীয় লোক আর পুলিশের কাছে পরে তারা জানতে পেরেছিল সন্ধ্যার পরই ধারালো অস্ত্রগুলো হাতে মেম্বার বাড়িতে হাজির হয় মৃত মেয়েগুলো। তারা যেন খুঁজছিল কাউকে। সকলে আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি শুরূ করে দেয়। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই আঘাত করেছে দা দিয়ে। তুলিকে জীবিত দেখে তুলির মা ছুটে গিয়েছিল তার কাছে। কিন্তু ৬জন মিলে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তাকে।। এরপর মেয়েগুলো জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পুলিশ এবং গ্রামের লোকেরা অনুমান করে দুই তান্ত্রিক জঙ্গলেই রয়েছে। তাদের হত্যা করতেই মেয়েগুলো মেম্বার বাড়িতে এসেছিল। তারপর তারা সদলবলে জঙ্গলে প্রবেশ করে।

এরপরের কয়েকদিনে মেয়েগুলোকে আবার দাফন করার ব্যবস্থা করা হলো। প্রাচীন পুকুরটা থেকে কুয়োর সুড়ঙ্গ এবং ডোবা থেকে কুয়োর সুড়ঙ্গ শক্ত উপাদান দিয়ে চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো। কুয়োর মুখটা আরও শক্ত লোহার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে তার উপর সিমেন্ট, খোয়ার ঘন প্রলেপ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো। জঙ্গলের ঐদিকটায় প্রবেশ নিষেধ করে সতর্ক করে দেয়া হলো সবাইকে।

তিনদিন পর:
আফসারপুর গ্রাম এখন পিশাচটা থেকে নিরাপদ। রশিদ জালালুদ্দিন মাতবরকে বলল, ‘পিশাচটাকে ধ্বংস করা গেল না। আগে সাধকরা যে কাজ করেছে আমরা তাই করলাম শুধু। তারা যদি ডোবাটা মাটি দিয়ে পূর্ণ করে দিত। তাহলে তো পিশাচটার পক্ষে মুক্ত হয়ে অলৌকিক সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করে প্রাচীন পুকুরে ফিরে যাওয়া সম্ভব হতো না। আমরাও একই কাজ করলাম। সব কিছু বন্ধ করলেও ডোবাটাকে মাটি দিয়ে ভরে ফেলছিনা কেন?’

মুচকি হাসলেন বুড়ো তান্ত্রিক, ‘ওই ডোবাটাই কেবল পিশাচটার স্বাধীনতার পেছনের প্রধান বাধা। ওটা না থাকলে আজ এত সহজে ওটাকে আটকে ফেলতে পারতাম না। আমার বিশ্বাস ওটা যদি আর কোনোদিন মুক্ত হয়, নিজের ক্ষমতা জাহির করার আগে ও এই ডোবাটা বন্ধ করার চেষ্টা করবে!’

• * * * সমাপ্ত * * *

পুকুরের সেই আতঙ্ক পর্ব-০৭

0

#পুকুরের সেই আতঙ্ক
৭ম পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

রশিদ আর জালালুদ্দিন মাতবর ঘন অন্ধকারের মধ্যেও সাঁতরে এক জায়গায় পৌঁছালেন পানির মধ্যে। রশিদ হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘হচ্ছেটা কী এসব?

মাতবরও হাপাচ্ছেন, ‘পিশাচটা ভ্রম সৃষ্টি করে তোমাকে হত্যার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাকে পিশাচ শক্তি এখানে নিয়ে এসেছে নাকি কোনো শুভ শক্তি তোমাকে বাঁচাতে ভ্রম সৃষ্টি করে আমাকে এখানে এনেছে বুঝতে পারছি না।’

‘মানে, ওস্তাদ!’

‘আমাকে এই পুকুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে ৬টি কিশোরী মেয়ের অবয়ব। ওরা আমাকে না নিয়ে এলে তোমাকে একা ওই শয়তান শক্তিটার সঙ্গে লড়াই করতে হতো। তাছাড়া পুকুরে হারিয়ে যাওয়া রক্ষা কবজ গুলোও ওরা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পানিতে যে ৬টি মেয়ে পিশাচটার সাথে ছিল ওদের চেহারা একই রকম হলেও এদেরকে ভিন্ন সত্তা মনে হলো! ওরা আমাদের সাহায্য করতে চায়!’

‘আমার গায়ে কোনো কবজ নেই! এখন আমরা কী করবো। পুকুর থেকে উঠে যাব? শয়তানটা মনে হচ্ছে পানির নিচেই আছে এখনো।’

অন্ধকারে রশিদ অনুভব করলো তার শরীরে কিছু বেঁধে দিচ্ছে বুড়ো তান্ত্রিক। স্পর্শ করে বুঝতে পারলো ওস্তাদ তার শরীরের কবজগুলো খুলে তাকে পরিয়ে দিচ্ছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘একি করছেন? আপনি বিপদে পড়বেন!’

‘আমরা একসঙ্গে থাকলে কোনো বিপদ নেই। এখানেই আমরা ভেসে থাকবো কিছুক্ষণ। দেখি শয়তানটার কী ফন্দি আছে! শুধু ওটাকে তোমার ভেতরে ভ্রম সৃষ্টি করতে দেবে না। ভ্রম সৃষ্টি হয় বিশ্বাস থেকে। এখন থেকে যা কিছু দেখবে সবই সন্দিহান হয়ে দেখবে। তবেই ওটা সম্মোহন করতে পারবে না। চিন্তাগুলোকে বিক্ষিপ্ত রাখবে। মন্ত্রগুলোর শক্তি ভুলে যেও না। ওগুলোর সামনে দুনিয়ার কোনো অশুভ শক্তির দাঁড়ানোর স্পর্ধা নেই এটা বিশ্বাস করবে।’

এমন সময়েই চাঁদের সামনে থেকে ভেসে চলে গেল মেঘ। জোৎস্নার আলোয় দৃষ্টিগোচর হয়ে আসতে লাগলো সবকিছু। পুকুরের সামনের দিকের পাড়ের দিকে তাকাতেই তাদের দুজনের শরীর ঝুরে একটা কাঁপুনি বয়ে গেল। ওখানে মাথাবিহীন ৬টি কিশোরী মেয়ে অন্ধের মতো দুটো হাত সামনে নিয়ে বাতাস হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে আসছে পুকুরের দিকে। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে না ওরা অশরীরী! কারণ ওদের ছায়া মাটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জোৎস্নার সোনালী প্রতিবিম্বও তাদের নগ্ন শরীরে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। ওদের শরীর এভাবে হেঁটে আসছে বিশ্বাস হচ্ছে না রশিদের। নিখোঁজ ৬টি মেয়ের মধ্যে ২টি মেয়ের লাশ গোরস্থানে দাফন করা হয়েছিল আর এই রাতে উদ্ধার হওয়া বাকি ৪টি লাশকে তো পুলিশ থানায়ই নিয়ে গেছে। জালালুদ্দিন মাতবর শক্ত করে চেপে ধরলেন রশিদের হাত। বললেন, ‘ওগুলো অশরীরী নয়! এগুলো ওই মেয়েগুলোর আসল শরীর! কিন্তু ওরা আবার এই অভিশপ্ত পুকুরে ফিরে আসছে কেন! ওরা মৃত, তারমানে ওদেরকে কোনো শক্তি আবার জীবিত করে এখানে পাঠিয়েছে।’

রশিদ আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের কী থামানো উচিত ওদের? হয়তো পিশাচটাই কোনো উদ্দেশ্যে আবার ওদেরকে ডেকে এনেছে এখানে।’

‘আমার মনে হয়…..’

থমকে গেল দুজনেই।মাথাবিহীন ৬টি শরীর প্রায় পুকুরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এমন সময়ই হঠাৎ তাদের চারপাশের পানি অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল। যেন তাদের ঘিরে চক্রাকারে ঘুরছে কিছু। উত্তেজনা অনুভব করলো দুই তান্ত্রিকই। উত্তেজিত হয়ে একে অপরের হাত ধরে এদিক,সেদিক মাথা ঘুরাতে লাগলো দুজনেই। একে একে ৬টি প্রাণহীন মাথা ভেসে উঠল তাদেরকে ঘিরে। কেবল মাথাই ওগুলো, সংযুক্ত শরীর নেই কোনো। চোখ মুদিত এই মাথাগুলোই ওই পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শরীরগুলোর। রশিদ এবং জালালুদ্দিন মাতবর দুজনেই বিশ্বাস করতে চাইছেন এগুলো তাদের ভ্রম। কিন্তু অশুভ শক্তির কোনো আভাস তারা পাচ্ছেন না আর আশেপাশে এখন। পিশাচটা কী খেলা খেলছে তাদের সাথে!

জালালুদ্দিন মাতবর বললেন,’পিশাচটা মেয়েগুলোর মাথাও খায়নি দেখছি। শুধুই শরীর থেকে এগুলো আলাদা করে নিজের কাছে রেখেছিল। এখন আবার ভাসিয়ে দিয়েছে ওগুলো!’

পুকুরের পাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো পানিতে মেয়েগুলোর শরীর। রশিদকে ইশারা করে উল্টো পাশের পাড়ে সাঁতরাতে লাগলো বুড়ো তান্ত্রিক। রশিদ বিভ্রান্ত ভাবে তাকে অনুসরণ করে পাড়ে উঠে এলো! কোনো কিছুই তাদের বাধা দিল না।
দুজনেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে পুকুরের দিকে তাকালেন। কিছুমাত্র অস্বাভাবিকতার চিহ্ন নেই আর ওখানে। একদম শান্ত একটা পুকুর মনে হচ্ছে ওটাকে। মেয়েগুলোর শরীর বা মাথা কোথায় গেল কিছুই বোঝা গেল না! ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত ওখানেই অপেক্ষা করলেন তারা। এরপর ধীরে ধীরে হেটে পথ ধরলেন মেম্বার বাড়ির পথে।

সকাল গাঢ় হতেই তুলি আর নুপুরের কবর ফুঁড়ে উঠে যাওয়া আর পুলিশের ভ্যান থেকে ৪টি মেয়ের লাশ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা পুরো আফসারপুরে ছড়িয়ে পড়লো। আতঙ্কিত মানুষ আরও বেশি আতঙ্ক অনুভব করলো। রশিদ বা জালালুদ্দিন মাতবর তাদের আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিতে না চাওয়ায় রাতে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুমাত্র কাউকে বললো না। শুধু দুই তান্ত্রিকই জানে তারা ভেতরে ভেতরে কতটা দিশেহারা বোধ করছে।

দিনের বাকিটা সময় জালালুদ্দিন মাতবর ঘরের ভেতরেই বন্ধি হয়ে রইলেন। সাধনার সমস্ত উপকরণই তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো। তাই নিয়েই ধ্যানে বসে পড়েছেন তিনি। তন্ত্র-মন্ত্রের শব্দ, উৎকট গন্ধ আর ধুয়োয় ভরে আছে ঘরটা। রশিদ তান্ত্রিকতা কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে পুরোনো সেই শখ গোয়েন্দাগিরির দিকে এগিয়ে গেল। গ্রামে ঘুরে ঘুরে পুকুরে পিশাচটার শিকার ৬টি মেয়ে সম্পর্কেই খোঁজ খবর নিতে লাগলো। তার বিশ্বাস পিশাচটার ওই প্রাচীন পুকুরে উদয় হওয়ার পেছনে এই মেয়েগুলোরই হাত আছে। মেয়েগুলোর সমবয়সী অন্যান্য মেয়েদের বাড়িতে গিয়ে ওদের সম্পর্কে টুকটাক তথ্য নিতে লাগলেন। অবাক হওয়ার মতো বা নতুন কিছুই তারা বলল না।

শেষ বিকেলে গ্রামের এক বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে রশিদ জানতে পারে মেয়ে ৬টিকে নাকি গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরেরই একটি জঙ্গল থেকে বের হতে দেখেছিলেন তিনি। জঙ্গলটা তেমন গহীন নয়। জন্তু জানোয়ার বলতে শেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই। আরও অনেক মানুষই ফল-ফুল, গাছের ডাল আনতে ওখানে যায় মাঝেমধ্যে। জঙ্গলটা দেখেছিল রশিদ। দূর থেকে ওটাকে গভীর কোনো জঙ্গলই মনে হয়েছিলো। ওখানে যে কেউ যেতে পারে অনুমান। করা যায় না। সে মেম্বার বাড়িতে ফিরে এলো। জালালুদ্দিন মাতবরকে জঙ্গলের কথাটি বলল।

বুড়ো তান্ত্রিক বললেন, বেশ কিছু শক্তির সন্ধ্যান তিনি পেয়েছেন ধ্যান ধরে। তাদের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করেছে প্রাচীন পুকুরটার পিশাচটা সম্পর্কে। ওরাও যা ইশারা করেছে পিশাচটার উৎপত্তি, শিকড় ওই জঙ্গলের ভেতরেই। ওই জঙ্গলে ঢুকে কিছু একটা করে নিজেদের মৃত্যু নিজেরাই ডেকে এনেছে মেয়েগুলো। রাত নামতে আর বেশি দেরি নেই। সন্ধ্যা নামার পরই পিশাচটার শক্তি বেড়ে যাবে। ওটা যে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে মেয়েগুলোর খণ্ডিত শরীর আবার পুকুরে এনেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কী উদ্দেশ্য! রশিদ জালালুদ্দিন মাতবরকে একবার বলেছিল দিনের বেলাতেই পুরো পুকুরটা তারা দুজন মিলে ভালো ভাবে তল্লাশি করবে। হয়তো মেয়েগুলোর শরীর এবং মাথা খুঁজে পাওয়া যাবে। ওগুলো তুলে আনলেই হয়তো ওটার শক্তি কমে যাবে। কিন্তু ওস্তাদ নিষেধ করেছে।

ওটার নিশ্চই ওগুলো লুকোনোর জন্য নিজস্ব কোনো জায়গা আছে। ওটাকে নরখাদকও মনে হচ্ছে না। এর আগেও অনেকে অনুসন্ধান করে মেয়েগুলোর শরীর পায়নি। একটা সময় পর আপনা-আপনিই ওগুলো ভেসে উঠছে।

জঙ্গলটা সম্পর্কে মেম্বার এবং বয়স্ক মানুষদের কাছে জিজ্ঞেস করে ধারণা নেয়ার চেষ্টা করলো তারা। বয়োবৃদ্ধরা জন্মের পর থেকেই ওটাকে সাধারণ একটা জঙ্গল হিসেবে চেনে। আগে যদিও অনেক গাছ আর জন্তু জানোয়ার ছিল। এই গ্রামের মানুষদের তেমন একটা ওই জঙ্গলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে কিছু দস্যি ছেলে মেয়ে প্রায়ই সঙ্গী সাথী নিয়ে ওখানে যায়।

দুই তান্ত্রিকই সিদ্ধান্ত নিল জঙ্গলে ঢুকবে এখন তারা। সন্ধ্যা নেমে আসবে কিছুক্ষণ পরেই। টর্চ জোগাড় করে গ্রামের মানুষকে না জানিয়েই জঙ্গলে প্রবেশ করলো তারা দুজন। গা জুড়ে বাধা আছে রক্ষা কবজ। মনে প্রচণ্ড বিশ্বাস যে করেই হোক পিশাচটাকে ধ্বংস করতেই হবে তাদের। ওটা যে সুযোগ পেলে কতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে তা তারা বুঝে ফেলেছে।

জঙ্গলটা আসলেই গহীন না। বাইরের দিকে ঘন হলেও যত ভেতরে এগোনো যায় তত উজাড় হয়ে গেছে গাছ-পালা। হাঁটার পথ আছে। দুজনেই শব্দহীন ভাবে জঙ্গলের ভেতরের দিকে এগিয়ে চললো। ……..
……………………………………
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.