Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1011



মনোহারিণী পর্ব-০৯+১০

0

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৯)+(১০)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।)

বাদ্য-বাজনা ছাড়াও অল্প সময়ে, অল্প খরচে পবিত্র বন্ধনের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা যায়, যদি পাত্র-পাত্রী এমনকি পরিবারের কারও দিকে কোনো সমস্যা দেখা না দেয়! বর্তমান সময়ে বিয়েসাদী মানেই হৈ-হুল্লোড়, আমোদ-ফুর্তি, গান-বাজনা ছাড়াও জম্পেশ খানাপিনার আয়োজনকেই বুঝায়! অথচ বিয়ে পবিত্র বন্ধন! এখানে যেমন মনের মিল জরুরী তেমনি জরুরী পারিবারিক মিল-মহব্বত! তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো মোহরানা! এই মোহরানা নিয়ে তো এই সময়ে প্রচুর প্রতিযোগতা হচ্ছে। অথচ মোহরানা হবে পাত্রের আয়ের উপর নির্ভর করে। পাত্র-পাত্রী দু’জনের সম্মতিতেই একটা সংখ্যা তুলে মোহরানা দেয়া উচিত! লক্ষ, লক্ষ টাকা মোহরানা শুধু নামেই কাবিননামা উঠে, নগদে আসে না! কুরআন হাদিস, এই ফাঁকিবা’জিকে সমর্থন করে না। সামর্থ অনুযায়ী মোহরানা নগদেই পরিশোধ করা উচিত!

অনিকও এই মোহরানার ব্যাপারটা নিয়ে আগেই আলাপ করে নিয়েছিল, যার কারণে মাইসারা কিংবা কারও কোনো আপত্তির আসেনি আর! আকদের পুরো কাজ শেষে মসজিদের ভেতরে আগত অতিথিকে খেজুর আপ্যায়নের মাধ্যমে বিয়ের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা হয়! এরজন্য অবশ্য মাইসারাকে মসজিদে আসতে হয়নি, বরং তার দিকটা বাড়িতেই সামলে নেয়া গেছে!

*চিকিৎসাবিজ্ঞান অবশ্য রক্ত সম্পর্কের বিবাহকে বেশি উৎসাহ দিতে রাজি নয়। বলা হয় ফার্স্ট কাজিনদের (সরাসরি খালাতো, মামাতো, চাচাতো বা ফুফাতো ভাইবোন) জিনগত মিল প্রায় সাড়ে বারো শতাংশ, অর্থাৎ তারা বংশপরম্পরায় অনেক জিন একইভাবে বহন করে চলেছেন। এ কারণে যেসব রোগবালাই তাদের বংশে রয়েছে, সেসব তাদের সন্তানদের মধ্যে আরো প্রকটভাবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।

নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের কারণে সন্তানের যেসব ঝুঁ’কি বাড়ে তা হলো :
১. গ’র্ভপা’ত, মৃ’ত সন্তান প্রসব।
২. শারীরিক ত্রুটিসং’বলিত শিশুর জন্ম স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি হয়।
৩. প্রথম বছর বয়সে শিশুর অস্বাভাবিক মৃ’ত্যু।
৪. হঠাৎ অজানা কারণে শিশুমৃ’ত্যু।
৫. যথাযথভাবে শিশুর বৃদ্ধি না হওয়া।
৬. শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি ও বুদ্ধি প্রতিব’ন্ধিতা।
৭. মৃ’গী রোগ।
৮. অজানা রোগ।
৯. নানা রকমের রক্তরোগ যেমন সি’কেল সেল ডি’জিজ ও বি’টা থ্যালা’সেমিয়া। (সূত্র : গুগল)*

বিয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দুঃশ্চিতার চরম শিকড়ে পৌঁছে গিয়েছিল মাইসারার ছোট্ট মন! বার বার দু’চোখের সামনে উঁকিঝুঁকি মারছিল নানান কথাবার্তা! একটা সুস্থ সন্তান জন্ম দেয়ার পরেও তার বাবা-মা তাকে ফেলে গেছে, সেখানে যদি একটা অসুস্থ সন্তান তার কোলে আসে তখন অনিক সেই মুহূর্ত কীভাবে ফেইস করবে? এই ভয়টাই তাকে রীতিমতো দিশেহারা অবস্থায় ফলে দিয়েছিল! কারণ তারা কাজিন! আর বিজ্ঞানের তথ্যানুযায়ী কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হলে, পরবর্তীতে সন্তান অসুস্থ থাকে। যেকোনোভাবে চার সন্তানের মধ্যে এক সন্তানের শারিরীক সমস্যা হতে পারে! ভয়, আত’ঙ্ক, দুঃশ্চিন্তা যখন পুরোদমে তার মনকে দুর্বল করে দিচ্ছিলো, তখনই অনিকের ছোট্ট একটা ম্যাসেজ হাজারও ব্যথা-বেদনায় ঔষধের মতো কাজ করেছে!

হাতের মোবাইলটা তখনো তার হাতে। স্ক্রিনের আলো জ্বলজ্বল করছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ত্বোয়া। দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিচ্ছে। মাইসারার মামা-মামি, মামাতো ভাই-বোনেরা এসেছে আজকে। বোন মিমিও পাশে বসে সামিল হয়েছে। কখনো গল্প করছে, কখনো কাঁদছে, আবার কখনো হাসছে! বহুদিন পর মাইসারা টের পেল, এই ম্যাসেজটা আরও আগে আসা উচিত ছিল! যদি আসতো, তবে সে কখনো ভুল মানুষের জন্য চোখের জল ফেলতো না! ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলালো আবারও। তাতে স্পষ্ট লেখা আছে,

-“জীবনটা খুব ছোট্ট সারা। এই ছোট্ট জীবনই আমাদের আনন্দ দেয়, বেদনা দেয়, দেয় সুখ-দুঃখের ছোটো ছোটো স্মৃতি! এই স্মৃতিটুকু আমাদের উপলব্ধি করায়, জীবন এগোয় সামনের দিকে। পিছনের অধ্যায় যেমনই হোক, হাসির হোক কিংবা বেদনার, কখনো তাকে স্মরণ করে বর্তমানকে দূরে সরিয়ে দিস না! আমি জানি না, সামনের গন্তব্য আলোর নাকি আঁধারের। তবে যাই থাকুক, তোর সামনের পথ কখনো একার হবে না। ছায়া ভাব, নতুবা সঙ্গী, এই আমিটা একান্তই তোর দুঃখ কমানোর আশ্রয় হবো! তাই বলছি, মিছেমিছি সব ভয় দূরে সরিয়ে দে। কেননা, ভবিষ্যৎ তখনই অন্ধকার হবে, যখন বর্তমানটা ভুল সময়ে ভুল মানুষকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিবে! আমি যে সঠিক মানুষ তা বলছি না, ভুল আমারও হয়। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখ; যতক্ষণ আমি আছি ততক্ষণ তুই একা নোস! ভবিষ্যতে যদি তেমন কোনো পরিস্থিতি আসে, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তা ফেইস করবো। কখনো, নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে পালিয়ে যাব না। বরং যে আসবে সে যদি অ’ন্ধও হয়, জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া হিসেবে তাকে আগলে নিব! আমি চাই সে দেখুক, বাবা-মা সর্বাবস্থায় সন্তানদের আগলে রাখতে জানে। আমায় সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবি সারা? একটা সুযোগ দিবি তোর হাসিকে সারাজীবন বাঁচিয়ে রাখার?”

কতটা যত্ন, ভালোবাসা মিশে আছে এই টুকরো কথাতে, তা বিন্দুমাত্র জানা নেই তার। শুধু জানে, এই মানুষটাকে তার প্রয়োজন! খুব করে প্রয়োজন! যে বাঁচতে শেখায়, যে সাহস জোগায়, যে আগামীর স্বপ্ন দেখায় তাকে হারিয়ে ফেললে যে, জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে তার। জেনেশুনে কেউ কীভাবে তা হারিয়ে ফেলতে পারে? মাইসারাও পারেনি। তাই সমস্ত দ্বিধার দেয়াল দূরে সরিয়ে চিরদিনের জন্য এই সুতোয় বাঁধা পড়েছে দু’জন। বাধ্য হয়ে নয়, নিজের ইচ্ছে এবং মনের ডাকে সাড়া দিতেই, মন থেকে ‘আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল’ শব্দটি উচ্চারণ করে পবিত্র সম্পর্কে গ্রহণ করে নিয়েছে।

*****

বিয়েতে যত মেহমানরা এসেছিলেন একে একে সবাই বিদায় নিলেন। মাইসারার মামা-মামীও যাওয়ার আগে দু’জনকে দো’আ করে গেলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর বাড়িটা ফাঁকা হলো! চিন্তিত চেহারায় নিজের সাজপোশাক পাল্টাচ্ছে ফারজানা! দু’দিন ধরে তার মন-মেজাজ ভালো নেই। দরকারি জিনিসটা কোথায় যে রাখলো, আর তা পাওয়া গেল না। বাড়ির লোকজন কাউকে জিজ্ঞেস করারও সাহস নেই। এসব লুকানো কথা প্রকাশ্যে আনা মানেই কার্য সম্পাদনের আগেই হে’রে যাওয়া। এত দ্রুত নিজের হা’র মানতে রাজি নয় সে। কিছু তো একটা করবেই। কিন্তু কী করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে। আগামীকাল বিকেলেই মাইসারা চলে যাবে তার দৈনন্দিন জীবনে! তাকে আর চাইলেও হাতের সামনে পাওয়া যাবে না। তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলেই তো ফেঁ’সে যাবে। অথচ হাতে সময় একদমই নেই। কী ভেবে যেন রুম ছেড়ে বেরোলো সে! হাঁটতে হাঁটতে ড্রয়িংরুমের সামনে এলো। সেখানে দুই ভাই জমিয়ে গল্প করছে, মাইসারা কিংবা ত্বোয়া কেউ-ই সেখানে নেই। বুদ্ধি করেই মাইসারার কাছে গেল সে।

পরনের ভারী লেহেঙ্গা ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে মাইসারা! সুন্দর একটা কাতান থ্রি-পিস পড়েছে। যা-সব নামিরার নামে কেনা হয়েছিল, সবই তার জন্য! এই ব্যাপারটা সহজে মাথায় ঢুকাতে পারছে না সে। এইযে এত শাড়ি, ড্রেস কেনা হলো, সবই তার। অথচ সে জানতো, এগুলো নামিরার। ভাগ্য কাকে কোথায় এনে দাঁড় করাবে জানা নেই কারও। সে-ও জানতো না, এইভাবে হুটহাট জীবনের মোড় ঘুরে যাবে। সবকিছু গুছিয়ে রাখতে ত্বোয়া পাশে বসে হাতে হাত লাগাচ্ছিল। ফারজানা ভেতরে ঢুকেই বলল,

-“তোদের শেষ হলো? সবার জন্য একটু চা-নাশতা করলে ভালো হতো না? শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে। হাড়গোড় ব্যথা! ত্বোয়া, পারবি কিছু নাশতা তৈরী করতে?”

শুকনো মুখের এমন কথাতে গলে গেল দু’জনে। সারাদিন ধরেই ফারজানার দৌড়টা দেখেছে দু’জনে। এতজন বাড়তি লোকের খাবার-দাবারের মেন্যু সামলে রাখা চারটে খানে কথা নয়! কাজের লোকজন সাহায্য করেছিল বলে, কিছুটা চা’প কমেছে। তবুও ক্লান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক তার জন্য। মাইসারা সামনে এসে বলল,

-“তুমি যাও ভাবী। বিশ্রাম নাও। আমি সামলে নিব!”

-“না না, তা কী করে হয়! সবে বিয়ে হলো আজ, এক্ষুণি রান্নাঘরে ঢুকবি? আচ্ছা দেখি, আমি যাই।”

মলিন মুখে বেরিয়ে যেতে চাইলো ফারজানা। মাইসারা তাকে আটকে বলল,

-“যাও তো, বিশ্রাম নাও। ত্বোয়া, তুই আয়। আমরা বরং একসাথেই কাজ করি। এখন তো ওতো ঝা’মে’লা নেই। হয়ে যাবে দ্রুত।”

ফারজানা চলে যাওয়ার পর হাতের কাজ সেরে রান্নাঘরে আসলো দু’জনে। কয়েক ধরনের সবজি ঝটপট কে’টে নিল মাইসারা। কুচি কুচি করে কা’ট’লো। এরপর তাতে প্রয়োজনীয় মশলা, সামান্য ময়দা দিয়ে মাখা মাখা করে নিল। ত্বোয়াকে আর কোনো কাজ করতে হলো না। এসব নাশতার নানা রেসিপি তৈরীতে মাইসারার হাত চলে দ্রুত। তাই সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেল। খানিকক্ষণ পর গ্যাস অন করে কড়াই বসিয়ে দিল। তেল ঢেলে তা গরম হওয়ার অপেক্ষা না করে সেই ফাঁকে চায়ের ক্যাটলিতে পানি এনে বসিয়ে দিল চুলায়। ত্বোয়া কাপ, পিরিচ সবকিছু পরিষ্কার করে ট্রে’তে সাজিয়ে রাখছিল।

কড়াইতে পকোরা ভাজতে গিয়েই খেয়াল করলো সিলিন্ডারের মুখে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে! সেই আগুনের তাপ সরাসরি তার শরীরে এসে লাগছে! হাতের কাছে নেভানোর জন্য কোনোকিছুই পাচ্ছে না সে। ধীরে ধীরে আগুনটা বাড়তে দেখেই চিৎকার দিল মাইসারা! সেই চিৎকারে সবাই ছুটে এলো। ভয়ে কেঁপে উঠলো ত্বোয়া নিজেও। হাত থেকে কাপ-পিরিচ সব নিচে পড়ে ঝনঝন শব্দ হলো। এক ছুটে রান্নাঘর ছেড়ে বাইরে চলে আসলো দু’জনে। অনিক দ্রুত শুকনো একটা কাপড় এনে সিলিন্ডারটা পেঁ’চি’য়ে নিল। রেগুলেটর বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে এলো।

ধীরপায়েই মাইসারার দিকে এগোলো সে। মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে তখনো। ত্বোয়াও যথেষ্ট ভয় পেয়ে গেছে। সোফায় একে-অন্যকে স্বান্তনা দিচ্ছে। এমন কিছু হবে, তাদের কারোরই ধারণাতে ছিল না। মাইসারা বার বার পিঠে হাত দিচ্ছে! খানিকটা তাপ লেগেছিল বলে, জ্বালাপো’ড়া শুরু হয়েছে! তার এই হাত নাড়াচাড়া দেখে অনিক জানতে চাইলো,

-“বেশি লেগেছে?”

-“সামান্য!”

কেঁপে কেঁপে জবাব দিল মাইসারা! অনিক রাগী চোখে তাকালো। তার চোখেমুখে ভয়ের ছা’প স্পষ্ট। এমন ভয়ানক চিৎকার শুনলে যে কারও প্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। আর সে যদি হয় কাছের মানুষ, তবে তো কথা নেই। তবুও নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বলল,

-“কে বলেছিল এখন রান্নাঘরে যেতে? মাত্রই ঝা’মে’লা শেষ হলো! এক্ষুণি ওইদিকে না গেলে হতো না তোর?”

মাইসারা জবাব দিল না। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো। পিঠে যতটুকু জ্ব’ল’ছে তা সামান্যই। এতে এতটা ঘাবড়ানোর কিছু নেই। হুট করে আগুন দেখেই ভয় পেয়েছিল সে! ভাবেনি তার সেই চিৎকারে মানুষটা এত ভয় পাবে। জানলে এত জো’রে চিৎকার দিত না। ততক্ষণে আরমান সাহেবও বেরিয়ে এসেছেন। সবার এই চিৎকার চেঁচামে’চি শুনে বুঝলেন, সিলিন্ডারের মুখে আগুন লেগেছে! তবে কারও কোনো ক্ষতি হয়নি, এটা শুনে যথেষ্ট রিল্যাক্স হলেন তিনি। তাও অনিক তখনো চোখ গরম করে মাইসারার দিকে তাকিয়ে আছে। মাইসারার চোখ পড়তেই কিছু একটা বিড়বিড় করলো অনিক। তা দেখে নববধূ মুচকি হেসে চলে গেল!

*****

পর পর দুটো ঘটনা কাকতালীয় নাকি একই সূত্রে গাঁথা, আর কোনো হিসাব পাচ্ছে না অনিক। রান্নাঘরে পা রাখলেই একটা না একটা দুর্ঘটনার জড়িয়ে পড়ছে মাইসারা! কেন? আগে তো এমন হয়নি। এ ঘরের প্রতিটা কোণায় কী থাকে সবই তার মুখস্থ। তবুও এমন সব দুর্ঘটনা ঘটছে, তা ভাবনায় আনাও দুষ্কর। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ভেবেছিল রাতের সময়টা বিশ্রাম নিবে, অথচ অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা তার ক্লান্তি, দুঃশ্চিন্তা দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই রুমের ভেতরে চোখ বুলালো অনিক। মাইসারা মাত্রই রুমে এসেছে। খাওয়া, দাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে রাখতেই দেরী হয়েছিল তার। গ্যাসের ধারেকাছেও যায়নি আর। মাটির চুলাতেই রান্নার বাকি কাজ সামলে নিয়েছে ফারজানা।

ভেতরে ঢুকে খুব স্বাভাবিকভাবেই দরজা আটকে দিল সে। ভয় কিংবা জড়তা কোনোকিছুই তার চেহারায় নেই৷ অথচ এই দিনে বর-কনে দুজনই নার্ভাস থাকে! নতুন সম্পর্ক নিয়ে কতশত চিন্তাভাবনার খেলা চলে মাথায়। সেদিক থেকে মাইসারা নির্বিকার। নিত্যদিনের মতো অভ্যস্ত হাতে এটা-সেটা গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আসতেই থমকে গেল সে। গোলাপ ফুলে সাজানো সাদা বিছানার চাদরে, বালিশের উপর পা রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে অনিক। একপাশে শুয়ে দু’পা লম্বা করে বালিশের উপর রেখেছে। অন্যপাশে যাওয়ার রাস্তাটাও নেই! মাইসারা তার পা নাচানোর ভাবভঙ্গি দেখে বলল,

-“পা সরাও!”

-“পরে। আগে মালিশ কর।”

-“কী? এতরাতে? কী হয়েছে পায়ে?”

-“মনে হচ্ছে, ব্যথা করছে!”

দাঁত কেলিয়ে জবাব দিল অনিক। তার বলার ধরন দেখে ভ্রু কুঁচকে নিল মাইসারা। ড্রেসিংটেবিলের সামনে থেকে ব্যথার মলমটা এনে বিছানার কোণে বসলো। পা’দুটো নিজের হাতে তুলে বলল,

-“কোন জায়গায় ব্যথা?”

-“এইযে, এইদিকে। গোড়ালিতে!”

-“কীভাবে ব্যথা পেলে? হোঁচ’ট খেয়েছো কোথাও?

দু’জনের ভাবভঙ্গি এমন যে, এই মুহূর্তটা তারা ইগনোর করতে চাইছে। যেমন মাইসারা, তেমনি অনিক। কেউ-ই নিজেদের নার্ভাসনেস প্রকাশ করতে চাইছে না। দূরত্ব নেই, আবার কাছেও নেই। কেমন যেন একটা গা-ছাড়া ভাব চলছে এই সম্পর্কে! যদিও এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। হুট করে কেউ-ই চাইবে না, মন দেয়া-নেয়ার আগে কিছু হোক। তবুও এটা এখন অন্যসব সম্পর্কের মতো না। এই সম্পর্ক অনেক দামী। তাই সম্পর্ককে দু’জনেরই আগলে রাখা উচিত।

কিছুক্ষণ পায়ে মালিশ করলো মাইসারা। অনিক দু’চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইলো। যখন পুরো রুমে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করলো, অনিকের গাঢ় নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ কানে আসলো তখনই হুঁশ ফিরলো মাইসারার। পা দু’খানা জায়গা মতো রেখে ব্যথানাশক মলম সরিয়ে নিল। পাতলা নকশিকাঁথা পায়ের কাছে রেখে বাতি নিভিয়ে দিল। হলদেটে, অস্পষ্ট আলোয় ভরে গেল পুরো রুম। ধীরপায়েই জানালার পর্দা সরালো সে। একপাশের কাঁ’চ খুলে বাইরে দৃষ্টি দিল! দূরের ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ, জ্যোৎস্নার একফালি আলো আর বাতাসের মৃদু বয়ে চলাতে রাত্রির নিস্তব্ধতা তাকে আঁকড়ে ধরলো পুরোটাই!

অনেকক্ষণ কে’টে গেল। মাইসারা তবুও বিছানায় এলো না। দু’চোখে আজ ঘুম নেই। তার ভেতরের তুফান সামলাতে ব্যস্ত সে! কেন এমন হয়? এত কীসের দ্বিধাদ্বন্দ্ব তার? সহজ সম্পর্ক, সহজ সবকিছু, অথচ কোথাও গভীর এক দেয়াল তৈরী হয়েছে। যে দেয়াল ভে’ঙে চাইলেও ছুটে যাওয়া যায় না। অথচ গত দু’দিনে সে টের পেয়েছে, অনিকের না বলা কথা! কিছু গোপন কথা মুখের বলাতে নয়, চোখের আদান-প্রদানেই বুঝে নেয়া যায়। সে-ও বুঝেছে। যত্নে বেড়ে ওঠা অনুভূতি সে গোপনেই আগলে রেখেছে। প্রকাশ করেনি, আর করবেও না। গ্রিলে মাথা ঠে’কি’য়ে বাইরের পরিবেশটাকেই উপভোগ করছিল সে। খেয়াল করলো, অনিক এক পাশ থেকে অন্যপাশ ফিরে শুয়েছে! হয়তো চোখে রাজ্যের ঘুম। নয়তো মানুষটা একজনকে নির্ঘুম রেখে কীভাবে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে পারে? এটা কি শুধু এই মুহূর্তটা এড়ানো? এমনই চলবে?

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১০)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

মন খারাপের পরমুহূর্ত বোধহয় মানুষ নীরবতাকেই সবচেয়ে আপন, বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বেছে নেয়। রাত্রির এই নিস্তব্ধতাকে আলিঙ্গন করতে পেরে খুব বেশি খারাপ লাগছে না মাইসারার। চোখে ঘুম নেই আজ! মাঝেমধ্যেই তার এমন হয়! অকারণ নির্ঘুম রাত কা’টা’তে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। কখনো কখনো ডিউটির ফাঁকে রিপার সাথে চায়ের কাপে আড্ডা জমতো। সেই আড্ডা চলতো ভোররাত্রি পর্যন্ত। আজও যদি আড্ডার মধ্য দিয়ে রাত পেরিয়ে ভোরকে স্পর্শ করা যেত, তবে মন্দ হতো না। সময়টা আরও বেশি উপভোগ্য হতো, যদি পাশাপাশি কেউ থাকতো। একাকী জীবন অতিবাহিত করতে গিয়ে সে অনুভব করেছে, আসলে সে একা নয়! তার পিছনে এই যে কিছু মানুষের এতটা ভালোবাসা, যত্ন, খেয়াল, খুশি জড়িয়ে আছে তাতে কোনোভাবেই প্রমাণ হয় না সে একা। আজ তো জীবনটা পুরোপুরি ঘুরে গেল। তার ভরসা হয়ে কেউ একজন জড়িয়ে গেল জীবনে, চাইলেও এই মানুষটার চোখের আড়াল সে কখনোই হবে না। একাকীত্ব আসা সে তো অনেক দূরের চিন্তাভাবনা!

কত-শত আজেবা’জে চিন্তায় ডুবেছিল সে। ঘোর ভাঙ’লো কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে। অনিক পিছনে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,

-“রাত জেগে অকারণ দুঃশ্চিন্তা করিস না, সারা। অসুস্থ হয়ে পড়বি। ডাক্তারদের অসুস্থ হওয়া সাজে না। তাদের সবসময় ফিট এন্ড স্ট্রং থাকতে হয়! নয়তো, অন্যদের তারা সামলাবে কী করে?”

-“ঘুম আসছে না!”

অনিক হয়তো বুঝলো, তার ঘুম না আসার কারণ। তাই কথা ঘুরাতে বলল,

-“রিটার্ন টিকিট কে’টে এসেছিলি?”

মাইসারা মাথা নাড়লো। পরমুহূর্তেই চমকে গেল পুরোটাই! আচমকাই নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করে ভয়ে কেঁ’পে উঠলো! দু’হাতে টি-শার্ট আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। অনিক বাঁধা দিল না। আলগোছে তাকে বিছানায় শুয়ালো। চুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে বলল,

-“চোখ বন্ধ কর। ঘুম আসবে। আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি!”

অনেকদিন পর মাইসারা টের পেল সে ছোটো বাচ্চার মতো আবেগী, আহ্লাদী হয়ে গেছে! তার পাশে বটবৃক্ষের ন্যায় বিশাল সাইজের ছায়া পড়েছে। সে ছায়া তাকে আগলে রাখছে, যত্ন নিচ্ছে, দুঃখ-সুখের ভাগিদার হচ্ছে। যার সংস্পর্শে এখন সে পুরোটাই নিরাপদ! হাত উলটে আঙুলের ভরে চোখের পানি মুছে নিল সে। সামান্যতম উষ্ণ স্পর্শের জন্য, শান্তিতে মাথা গুঁজে দু’চোখে প্রশান্তির ঘুম টে’নে আনতে খানিকটা এগোলো সে। যেভাবে টি-শার্ট আঁকড়ে ধরেছিল, সেভাবে আবারও আঁকড়ে ধরে পরম শান্তির জায়গায় মাথা ঠে’কা’লো। বলল,

-“আমি এখানে ঘুমাই?”

মাইসারার দিকে দৃষ্টি দিল সে। তার চোখের চাহনি বলে, এটা ছোটোখাটো কোনো আবদার নয়। সারাজীবন ভরসা করার, পাশে থাকার সহজ অথচ নীরব স্বীকারোক্তির কথা শুনবে বলেই নিশ্চুপে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। ভরসা হওয়া উচিত তো তার। এখন তো আর তাদের সম্পর্ক দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর নয়, বরং সানন্দে তা গ্রহণ করার সময়। এই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটার জন্যই বুঝি, এতদিন ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনেছিল সে। বুঝতে পেরে অনিক জবাবটা মুখে আট’কে নিল। নির্দ্বিধায় অধর ছুঁইয়ে দিলো কপালে! স্পর্শের গভীরতা দিয়ে বুঝিয়ে দিল, কতখানি অনুভূতি বাঁচিয়ে রেখেছিল সে। পরক্ষণেই দু’হাতের বাঁধনে বুকে আগলে নিল। ক্ষীণস্বরে বলল,

-“এইখানে মাথা রাখার অধিকার শুধু তোর! সারাজীবন থাকবি, যত্নে!”

-“দূরে সরিয়ে দিবে না তো? বাবার মতো…!”

-“সবাই এক হয় না সারা! মানুষে মানুষে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যের জন্যই ভালো-মন্দের সৃষ্টি হয়েছে! সবাই যদি খা’রা’প হয়, ভালোর তালিকাতে কাদের নাম উঠবে?”

-“এই পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র ব্যক্তি, যাকে আমি নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি! আমি জানি, আমার সব ভুল তুমি ক্ষমা করে দিবে। সানভিও আমার অল্প সময়ের ভুল ছিল। বড্ড দেরী করে ফেলেছি না? আরও আগে বুঝা উচিত ছিল! কেন বলোনি তুমি? কেন গোপন রেখেছিলে সব কথা? যাকে বিশ্বাস করি, ভরসা করি, তার অনুভূতিগুলো জানার পরেও তাকে ফিরিয়ে দিতাম বুঝি?”

-“মেয়েদের চোখ তো সব বুঝতে পারে। ছেলেদের দৃষ্টি কী বলে, সেটাও ধরতে পারে! তবে তুই পারিসনি কেন?”

-“তুমি সেভাবে তাকাওইনি! সবসময় মুরব্বিদের মতো শাসন করেছো, বকেছো, আবার বুঝিয়েছো। অনুভূতি প্রকাশ করেছো কখনো? করোনি। তাছাড়া আমি তো তখন উলটোপথে হাঁটছিলাম, বুঝিনি কার অনুভূতির গভীরতা কতটা বেশি!”

-“তবুও তোর বুঝা উচিত ছিল!”

মাইসারা জবাব দিল না। কথা বলতে ভালো লাগছে না তার। শুধু এই সুখকর সময়টাকে উপলদ্ধি করতে ইচ্ছে করছে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, এই মানুষটার সাথে। সবসময়ই কি বলতে হবে ভালোবাসি? থাক না কিছু কথা গোপনে, তবুও তো জানে মানুষটা তাকে কতখানি যত্নে আগলে নিয়েছে। এই ছোটো ছোটো কথাবার্তাতেই না বলা কথা বুঝা হয়ে গেছে তার। থাকুক এসব এভাবেই। এমনই। অনুভূতিকে তো এভাবেই বাঁচিয়ে রাখে মানুষ! তারাও রাখবে, জীবন্ত, সুন্দর, সুখস্মৃতি হিসেবে! এতগুলো বছর কা’টলো না পাওয়ার হিসাব কষতে কষতে, এবার থেকে নাহয় প্রাপ্তিগুলোর হিসাব কষা হবে। দেরীতে হলেও মাইসারা উপলব্ধি করলো এই সময়টা তো সুন্দর, একান্তই দু’জনার, পাশাপাশি থাকার, ভরসা হওয়ার।

*****

হুটহাট যদি জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত সুখ এসে ধরা দেয়, তখন ব্যক্তি নিজেকে সুখী এবং পরিপূর্ণ ভাবে! মাইসারার আজকের সকালটাও তেমন। সুখে, প্রাপ্তিতে পরিপূর্ণ। কোথাও কোনো ফাঁক নেই সেটা সে জানে কিন্তু তারপরেও জীবনের হিসাবগুলো ঘুরে যাবে। প্রতিনিয়ত হসপিটালের সময়টা রোগীর পিছনে কাটাতে হতো, তখন প্রয়োজন ছাড়া অনিকের সাথে কিংবা বাড়ির কারও সাথে আলাপ হতো না, ব্যস্ততায় দিন কা’ট’তো তার। অথচ এখন সময়ে, অসময়ে এই মানুষটার খোঁজ নিতে হবে তাকে। যে তার ভালো-মন্দের দায়িত্ব নিয়েছে, তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব তো এবার তারই নেয়া উচিত। সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি, ভরসা আর বিশ্বাসকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যেন দু’জনের মাঝখানে আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তি না আসে! চোখ মেলে তাকিয়ে এসব চিন্তাভাবনার খেয়ালে মজে ছিল মাইসারা। দু’দিকে হাত প্রসারিত করে হাই তুলে ঘুম ঘুম ভাবটাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলো। বহুদিন পর, ঘুমটাও তাকে প্রশান্তি দিয়েছে। হুট করেই মনে হলো, গতকাল রাত্রের ঝা’মে’লার পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে নামাজ পড়া হয়নি। অথচ বিবাহিত দম্পতির নতুন জীবনের সূচনার আগে এই নামাজটা জরুরী! কষে একটা চ’ড় নিজের গালে মা’র’তে পারলে শান্তি পেত বোধহয়। বিছানা ছাড়তে ছাড়তেই অনিকের পিঠে আলতো করে হাত রাখলো। নাম ধরে ডাকতেও সংকোচ হচ্ছে আবার ভাইয়া ডাকতেও রুচিতে বাধছে। একরকম বিস্ময়কর অনুভূতিকে সঙ্গী করে খানিকটা ঝুঁকে গেল সে। চুলে হাত রেখে মুঠো পাকিয়ে খুব জো’রে টা’ন মা’র’লো। অনিকের প্রায় চিৎকার দেয়ার জোগাড় হলো। ধড়ফড়িয়ে উঠে সোজা হয়ে বসলো। ততক্ষণে খিলখিল হাসিতে পুরো ঘরকে প্রাণবন্ত করে ফেলেছে মাইসারা! চোখমুখ কুঁচকে বলল,

-“তুই আমার চুল ছিঁ’ড়ে ফেলবি মনে হচ্ছে। আর কিছু পাস না? চুলে ব্যথা দিস ক্যান! ফা’জি’ল।”

-“তো কী করবো? রাতের নামাজটা যে বাদ গেল, তার কী হবে। চলো ফ্রেশ হও। একসাথে নামাজ পড়বো।”

-“শুধু নামাজ পড়লেই হবে না, আমার অন্যকিছু চাই।”

অনিকের চোখমুখ বলছে সে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে কিছু বুঝাতে চেয়েছে। মাইসারাও তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,

-“অন্যকিছু আবার কী! নামাজ মিস হয়েছে তাই সেটা আদায় করে নিলেই হবে।”

-“শুধু নামাজ মিস হয়নি, অন্যকিছুও মিস হয়েছে। বাসররাতে কি নির্দিষ্ট নামাজ আর দো’আ পড়ে? আর কিছু করে না?”

কথা শেষ করে ঝটপট ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো অনিক। মাইসারার মনে হলো, অনিকের না তার নিজেরই চুল ছিঁ’ড়া উচিত হবে এখন। কেন যে যেচে বাঁদরা’মি করতে গেল, কে জানে! কী দিয়ে মূল্য চোকাবে সেটা ভেবেই অস্থির হওয়ার দশা হলো তার।

নামাজে বসে দু’জনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো। এই সম্পর্কটাকে অটুট রাখার জন্য শত বাসনা পেশ করলো। দিন-দুনিয়ার মালিক যদি তা কবুল করেন, তবে এই সম্পর্কটায় আর কোনো কিন্তু থাকবে না। নামাজ শেষেও গুটিসুটি মে’রে জায়নামাজে বসে রইলো মাইসারা! তার ভেতরে অনিকের কথাখানি বাজছে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে সে। যদিও সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার তবুও মনে ভয়, পাছে এই মানুষটা অদ্ভুত আবদার না করে বসে। মাইসারা তখনো ভাবনায় বিভোর! খেয়ালই করেনি, কখন যে ফাঁক পেয়ে অনিক রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ পর যখন দু’কাপ ইন্সট্যান্ট কফি এনে চোখের সামনে বাড়িয়ে ধরলো অনিক, তখনই হুঁশ ফিরলো মাইসারার। সে বসে থাকা অবস্থাতেই ইলেকট্রিক ক্যাটলিতে পানি ফুটিয়ে কফি তৈরী করে নিয়েছে তার জীবনসঙ্গী। চমকে গিয়ে কফির কাপ দেখে মুচকি হাসলো মাইসারা। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-“তুমি বানিয়েছো?”

মাথা নাড়লো অনিক। হাতে এনে তাতে চুমুক দিল দ্রুত। বলল,

-“পারফেক্ট!”

-“হবে না কেন? শুধু পানি ফুটিয়েছি। এরপর প্যাকেট ছিঁ’ড়ে মগে মিশিয়ে নিয়েছি। ব্যস, তৈরী হয়ে অনিকের জা’দুর হাতে ছোঁয়া এই স্পেশাল কফি। এক চুমুকেই তৃপ্তি আসতে বাধ্য।”

প্রশান্তির হাসি ফুটালো মাইসারা। তার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। অনিক যে শুধু মজা করেই তখনকার কথা বলেছে, এটা বুঝতে দেরী হলো না তার। আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল সে। চোখে সুখের জল জমা হলো৷ গড়িয়ে পড়ার আগেই অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। অনিক তা দেখেও না দেখার ভান করে বলল,

-“চল ছাদে যাই। ভোরের দৃশ্যটা একসাথে উপভোগ করি। বিকেলেই তো চলে যাবি। এভাবে আর একসাথে বসা হবে না। এই মুহূর্তটা মিস করতে চাইছি না।”

নির্ভয়ে মাথা নাড়লো মাইসারা। জায়নামাজ ভাঁজ করে জায়গামতো রেখে অনিকের হাতটা ধরলো। সজ্ঞানে, এই প্রথম স্বচ্ছ এক চাওয়া-পাওয়াকে আলিঙ্গন করেই হাতের বাঁধনটা শক্ত করলো আবারও। মনে হলো, এই ছোটো ছোটো ইচ্ছেগুলোর মূল্য দেয়া উচিত। কিছু সুন্দর মুহূর্তকে ছুঁয়ে দেয়া উচিত। ভালোবাসা আজ না হোক, কাল তো নিশ্চয়ই হবে। যেহেতু ভরসা দিব্যি আছে। সেখানে এই অহেতুক জড়তাকে কেন প্রশ্রয় দিবে। এই ইচ্ছেগুলোর মাধ্যমেই সম্পর্কটা আরও সহজ হোক দু’জনার।

*****

নিজের রুমে এসে আলনার কাপড়গুলো ইস্ত্রি করছিল মাইসারা! পরক্ষণেই তা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিচ্ছে ঝটপট। আর কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে পড়বে সে। ফের কবে আসবে ঠিক নেই। তবে একেবারে কোর্স শেষে বাড়ি ফিরবে এমনটাই সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে। ব্যাগ হাতড়াতে গিয়েই ট্রেনের টিকিটটা হাতে আসলো তার। কী মনে করে সেটা ছিঁ’ড়ে কুচি কুচি করে ফেললো। জানালার পর্দা সরিয়ে আলগোছে বাতাসের সাথে উড়িয়ে দিল দূরে। এরপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লো, কাপড় গোছানোর কাজে।

আরমান সাহেবের পাশে বসে অনেকক্ষণ চোখের পানি ফেললো মাইসারা। তিনি মাথায় হাত রেখে ভরসা হয়ে বললেন,

-“এত কাঁদিস না মা। এখন তো এই ঘর, এই ঘরের মানুষ সবাই তোর আপন। আগের তুলনায় আরও বেশি আপন। যখন মন টানবে চলে আসিস!”

-“আর ছুটি পাব না চাচ্চু!”

ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। আড়ালে তিনিও চোখের পানি মুছলেন। ত্বোয়াও সুযোগ পেয়ে গা কাঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। তার সেই কান্না দেখে রেগে গেল অনিক। মাথায় গা’ট্টা মে’রে বলল,

-“ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদিস না তো। একেবারেই যাচ্ছে না। আবারও ফিরবে। ফিরতে হবে তো!”

অনিকের এই কথাটা মাইসারার কানে গেল। অভিমানী চোখে তাকালো শুধু। হাত বাড়িয়ে নাহিয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে, গালে অসংখ্য চুমু খেয়ে বলল,

-“একদম দুষ্টামি করবে না। গুড বয় হয়ে থাকবে। বাবা-মায়ের কথা শুনবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। ফুপ্পি আবার আসবো৷ তখন অনেক মজা করবো।”

সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফারজানার কাছে গেল। সে চলে যাবে অথচ ফারজানা সামনেও আসছে না। যদিও এই ব্যাপারটা খুব একটা প্রভাব ফেলে না মাইসারার উপর, তবুও কোথাও যেন মন খারাপের জন্ম হলো হঠাৎ। দরজায় নক করে রুমে ঢুকলো। তখন আলিফও পাশে ছিল। বিয়ের উছিলায় স্কুল থেকে ক’টাদিন ছুটি নিয়েছিল সে। এজন্যই ফাঁক পেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। ব্যস্ততায় রোজ রোজ বিশ্রাম নেয়া হয় না। সকাল, বিকেল এমনকিও রাতেও ব্যস্ততা থাকে। মাইসারাকে দেখে ঠোঁট বাঁ’কা’লো ফারজানা। মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল,

-“চলে যাচ্ছিস তবে? আর দুটোদিন থেকে গেল হতো না?”

-“হসপিটালটা আমার নিজস্ব মতামতে চলে না ভাবী। তাদের রুলস মেনেই চলতে হয়। থাকলে বরং তোমাদেরই অসুবিধা হবে। অযথা অসুবিধার কী দরকার!”

আলিফ কিছু বলতে চাইছিলো। ইশারায় তাকে তা বলতে নিষেধ করলো মাইসারা। আলিফ সব বুঝেও চোখ গ’র’ম করে তাকালো। সেটা দেখে অনুরোধের সুরে বলল,

-“প্লিজ!”

পক্ষান্তরে মাথা ঝাঁকালো আলিফ। মাইসারা ম্লানমুখে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমে এসে কাঁধে ব্যাগ তুলতেই হাতে বাঁধা পড়লো। চুঁ মে’রে নিজের হাতেই ব্যাগটা টে’নে নিল অনিক। দ্রুত পায়ে বাইরে গিয়ে বাইকের পিছনে শক্ত করে আট’কে দিল সেটা। ত্বোয়াকে সাথে নিয়ে উঠোনে আসলো মাইসারা। বাইকে ব্যাগ দেখে অবাক হয়ে বলল,

-“ব্যাগ ওখানে রেখেছো কেন? গাড়ি ডাকোনি? আমি একা যেতে পারবো।”

-“চুপচাপ বস!”

অযথা কথা বাড়ালেই ঝগড়া বাঁধাবে দু’জন। যাওয়ার বেলা কোনো প্রকার মনমালিন্য চাইছে না মাইসারা। বাধ্য মেয়ের মতোই পিছনে বসলো। ত্বোয়া আবারও এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। বলল,

-“আবার কবে আসবি?”

-“ঠিক নেই। ভালো থাকিস। ভাবীর সাথে ত’র্কে যাস না। চাচ্চু মনে আঘাত পান এমন কোনো কাজ করিস না। যথাসম্ভব সাবধানে থাকবি আর নিজের যত্ন নিবি!”

ত্বোয়া মাথা নাড়লো। বাইক স্টার্ট করে ধীরে ধীরে দূরের পথে এগিয়ে গেল তারা। এলাকা পেরিয়ে মূল রোডে এসে অনিক নিজেই বলল,

-“শুধু শুধু টিকিট ছিঁ’ড়’লি। আমাকে বললেই পারতি! এতদূর একা ছাড়তাম?”

মাইসারা জবাব দিল না। আসলেই সে চেয়েছিল, আজকের এই দূরের পথটা একান্তই দু’জনার হোক। মুখে বলতে পারবে না দেখেই টিকিট ছিঁ’ড়ে ফেলেছিল। অথচ সেটা অনিকের চোখে পড়ে গেছে। কতদিকে যে খেয়াল রাখে এই মানুষটা! সেটা ভেবেই নিজেকে সুখী আবিষ্কার করলো মাইসারা। কাঁধে হাত রেখে শক্ত করে চে’পে ধরলো। অন্য হাতে চোখের পানি মুছে পেটের কাছটায় জড়িয়ে ধরলো। পিঠে মাথা ঠে’কি’য়ে বলল,

-“যেতে ইচ্ছে করছে না!”

কান্নার ভারে শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। অনিক সেটা সহ্য করতে পারছে না। একেই তো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য দূরত্ব, তার উপর এই ইমোশনাল কান্না। মেজাজটাই খিচড়ে যাচ্ছে তার। রাগ দেখিয়ে চোখমুখ গরম করে বলল,

-“কান্না থামা নয়তো অ্যাক্সিডে’ন্ট হবে। মাথাটাথা ফা’ট’লে তখন আর আমাকে দোষতে আসবি না। চ’ড় মে’রে গাল লাল করে দিব, স্টুপিড!”

-“বকো না প্লিজ।”

চেহারার কাঠিন্যতা ধরে রাখলো অনিক। বলল,

-“এতদিন তো বাড়িতে আসতে চাইতি না, এখন এসে যেতে চাইছিস না। তোর সমস্যাটা কি বলবি? আমার এত চেষ্টা, এত ধৈর্য, সবকিছুকে বিফল করে দিবি! আরতো মাত্র কয়েকটা মাস সারা, দেখতে দেখতে কে’টে যাবে। এত আপসেট হোস না।”

রগরগে মেজাজে নিজের দুর্বলতাকে দূরে সরিয়ে রাখলো অনিক। মাইসারা সেসব কথা কানেও তুললো না। হাতের বাঁধন শক্ত করে ওভাবেই লেপটে রইলো সাথে। বিড়বিড় করে বলল,

-“তুমি খুব খারাপ!”

-“হ্যাঁ! তুই অনেক ভালো। ভালো হয়েই থাক। আবেগকে প্রশ্রয় দিস না। এই দূরত্বটা ক্ষণিকের। শীঘ্রই আবারও একসাথে হবো আমরা! তখন তোর চেহারায় কোনো ইমোশনকে দেখতে চাই না। একজন জয়ী, সাবলম্বী, পরিপূর্ণ ডাক্তারকে দেখতে চাই, যার মধ্যে থাকবে প্রচুর মনোবল আর আত্মবিশ্বাস। যা তোকে প্রতি পদে পদে বুঝাবে, কখনো আবেগী হয়ে সবকিছুকে বিচার করতে নেই। বিবেক-বুদ্ধি এবং ধৈর্যকেই পুঁ’জি করে জয়কে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে হয়!”

কথাগুলো আবারও হৃদয়ে তৃপ্তি এনে দিল তার। গভীর করে শ্বাস টানলো মাইসারা। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে যেভাবে এগিয়েছে, সেভাবেই জয়কে ছি’নি’য়ে আনতে হবে হাতের মুঠোয়। ততদিন দুর্বল হওয়া চলবে না তাকে। শত বাধা-বিপত্তিকে পিছনে ফেলেই এগোতে হবে সামনে। যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে, সুন্দর এক রৌদ্রজ্বল দিন!

*****

চলবে…

মনোহারিণী পর্ব-০৭+০৮

0

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৭)+(৮)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

পরিবার! সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ ভাগ করে নেয়ার এক প্রধান ধারক ও বাহক! যেখানে প্রতিটা সদস্য বাঁচে একে-অন্যের জন্যে। বিপদে পাশে দাঁড়ানো ছাড়াও জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে একটা মানুষকে পরিপূর্ণভাবে আগলে রাখে এই পরিবার। প্রত্যেকটা পরিবারেরই নির্দিষ্ট নিয়মনীতি থাকে! পরিবারের অভিভাবকরা সবসময়ই চায়, ছোটোরা সানন্দে বেড়ে উঠুক সেখানে। হাসুক, খেলুক, কাঁদুক একে-অন্যের জন্য। তারজন্য তাদের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেয়া হয়! স্বাধীনতার মানে এই নয় যে, উচ্ছৃ’ঙ্খল জীবনযাপন করা! স্বাধীনতা মানে, নিজেকে বুঝা, অন্যকে বুঝা, শুধু নিজের মতো করে বাঁচাকেই স্বাধীনতা বলে না! এখানেও ঠিক তাই। আরমান সাহেব তার সন্তানদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। তাদের জীবন চিনিয়েছেন, বুঝিয়েছেন কীভাবে জীবনটাকে উপভোগ করতে হয়! কীভাবে অন্যদের মূল্যায়ন করতে হয়!

প্রতি সপ্তাহের শেষদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার এই পরিবারের পারিবারিক আড্ডার দিন। পরদিন ছুটির দিন হিসাবে আগের দিন দুইভাই বেশ সময় নিয়ে বাবার সঙ্গ উপভোগ করে। পরিবারের অন্যান্য দিকও আলোচনা হয় তখন! সমস্যা থাকলে তা সমাধানের পথ খুঁজে নেন! আজকের এই পারিবারিক আড্ডায় উপস্থিত মাইসারাও। বহুদিন পর বাড়ি এসে আড্ডার সময়টা পেয়েছে সে। আগামী রবিবারই বিয়ের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হবে! এই ফাঁকে যত আলোচনা আছে, বুঝাপড়া আছে সবই প্রয়োজন! কে কীভাবে কোনদিক সামলাবে সেসবও জানা জরুরী, বুঝা জরুরী।

ড্রয়িংরুমের একটা টি-টেবিলে ক্যারামবোর্ড রাখা! গুটি আর স্ট্রাইকের ধুমধাম শব্দ হচ্ছে সেখানে। অনিক আর ত্বোয়া জমিয়ে ক্যারাম খেলছে। আলিফ খাতা, কলম হাতে নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু খসড়া তৈরী করছে। কতটা লাগবে, কী পরিমাণ জিনিসপত্র লাগবে সবটাই টুক টুক করে লিখছে সে। সেটা আবার আরমান সাহেবকে পড়ে শুনাচ্ছে। যদিও তিনি চোখে দেখেন তবে মাঝেমধ্যে ছেলেদের মুখে এমন টুকরো টুকরো হিসেব শুনে আনন্দ পান! তাদের ভাবনাচিন্তার গভীরতা তাঁকে তৃপ্তি দেয়। মাইসারা চায়ের ট্রে হাতে ড্রয়িংরুমে পা রাখলো! দুই ভাই-বোনের পাশ কে’টে অন্য টি-টেবিলটায় চায়ের ট্রে’টা রেখে দিল!

অনিকের সামনে লাল গুটি’টা! সে মনোযোগ দিয়ে তাকে ভেতরে ফেলার জন্য নিশানা ঠিক করছে! মাইসারা যখন চায়ের কাপটা আলিফকে দিয়ে বলল,

-“ভাইয়া আগে চা খাও, পরে হিসাব দেখো!”

সঙ্গে সঙ্গে অনিকের দৃষ্টিটা সেদিকে গেল! আজ সারাদিনে এই কেবল মাইসারাকে দেখলো! মাথা নুইয়ে চা ঢালছিল সে! অমনি সমস্ত চুল এসে তার মুখটা ঢেকে দিল! মনে হলো, শখের কোনো শো-পিসের সামনে কেউ এসে আগলে দাঁড়িয়েছে, যার জন্য শত চেষ্টায়ও হরিণী চোখ, মায়াবী হাসি তার দেখা হচ্ছে না! তবুও দৃষ্টি সরালো না সে। ডানহাতে কানের পাশে চুল গুঁজে আবারও চা ঢালতে মনোযোগী হলো মাইসারা। অনিকের ঠোঁটের কোণের হাসিটা চওড়া হলো এবার। অজান্তেই হাসলো সে। হাতের স্ট্রাইকটার দিকে দৃষ্টি না থাকায় হাত ফসকে অন্যদিকে সরে গেল সেটা! ত্বোয়া ভাইয়ের এই কাণ্ড দেখে মিটিমিটি হেসে বলল,

-“নজর কই তোমার! গুটিটা ভুল জায়গায় ফেললে! দাঁড়াও, এই গেমটা আমিই জিতবো!”

ঘাড় ফিরিয়ে ত্বোয়ার মাথায় ঠো’কা মা’র’লো অনিক! রাগ দেখিয়ে বলল,

-“সরা এসব সামনে থেকে! কাজের সময় কীসের খেলা! পড়াশোনা নাই? দিনরাত শুধু গল্পগুজব! যা পড়তে বস।”

এমন উপুর্যুপরি ব’কা’র ধরন দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো ত্বোয়া! নিজের দান ফেলতে ফেলতে ফিসফিস করে বলল,

-“তুমি দৃষ্টি অন্যদিকে দিবা, আর আমি বললে দোষ! সারার চোখে পড়লে খবর আছে। ভালো করেই জানো, তার মনের রাজ্যে কার বসতী!”

হাসিখুশি পরিবেশে এমন একটা কথা হ’জ’ম হলো না অনিকের! মনে হলো এক প্লেট সাজানো গোছানো সুস্বাদু বিরিয়ানির মধ্যে কেউ এক মুঠো তিক্ত স্বাদের লবণ ঢেলে দিয়েছে! যার কারণে পুরো বিরিয়ানি তার স্বাদ হারিয়ে ফেলেছে। তেমনি সুখের মুহূর্তটাও মুহূর্তের মধ্যে বেদনার গাঢ় নীলে রূপান্তরিত হয়েছে। বুকছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার! দৃষ্টি সরিয়ে এবার খেলায় পুরো মনোযোগ ঢেলে দিল! বলল,

-“সে থাকুক তার মতো, আমি নাহয় আমার জন্য আলাদাভাবে অনুভূতি তৈরী করে নিব!”

-“পারবে?”

-“তাকে ভালো রাখার দায়িত্ব যখন নিচ্ছি, তখন অনুভূতি তৈরীর দায়িত্বটাও নিব! দেখা যাক, কতদূরে গিয়ে তার উপলব্ধি আসে, জীবনে সঠিক মানুষটা কে!”

এবার আর লাল গুটিটা হাতের নাগালে আসলো না। সাদা গুটি ব্যাগে ফেলে আবারও দৃষ্টি দিল পাশে! মাইসারা নিজেও তখন খসড়াটা দেখছে! গোপনে এই লুকোচুরি নজর কতটা তীব্র অনুভূতি জাগায় এটা বোধহয় এই মুহূর্তে অনিক ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারছে না! না চাইতেও আজ দৃষ্টি বার বার বেয়া’দবি করছে। এই বেয়া’দবি সহ্য করা যাচ্ছে না আবার উপেক্ষা করাও যাচ্ছে না। কী কঠিন পরিস্থিতি এটা?

তোকে একার দেখার লুকিয়ে কী মজা!
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না।
তোকে চাওয়ারা পাওয়ারা নয় রে সোজা!
সে তো আমি ছাড়া কেউ জানে না।

*****

আঞ্জুমান আরা মারা গেছেন দু’দিন হলো। আগামীকাল তিনদিন হবে। শরিয়ত অনুযায়ী তিনদিন পর উপযুক্ত মেয়ের বিয়ের আয়োজনে কোনো বাধার বিধান নেই! এর কারণে এই পুরো ব্যাপারটা গভীরভাবে ভেবেছেন আরমান সাহেব! তিনি চান না, কেউ এই নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা তুলুক। যেহেতু বিয়ের আরও দু’দিন বাকি। তাই এখানে শরিয়তে বিধানও অমান্য হলো না, মাইসারার মনটাও বিক্ষি’প্ত হলো না। কে জানতো হুটহাট অসময়ে আঞ্জুমান আরা এই পৃথিবী ত্যা’গ করে মেয়েকে চিরতরে একা করে দিবেন! অথচ মাইসারা আগেও একা ছিল, এখনও একা। তিনি চান না, মেয়েটার আগামীর পথ কঠিন হোক! সে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে সানন্দে হাঁটুক, যেন কোনো বাঁধা বিপত্তি তাকে ঠে’কা’তে না পারে!

বিয়েটা মসজিদে পড়ানো হবে! যদিও সেন্টার বুকিংটা নামিরাদের বাড়ি থেকে করা হয়েছিল, তাই এদিকে তাদের আর চা’প নেই। তবে ওইদিন কমিউনিটি সেন্টারে নামিরা আর তানভীরের বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হবে। মসজিদে পড়ানোর কারণ, অতিরিক্ত ঝা’মে’লা এড়ানো! সুন্নাত মোতাবেক অল্প মোহরানার এই আয়োজনে শুধু গ্রামের মানুষই উপস্থিত থাকবেন৷ এছাড়াও থাকবেন মাইসারার নানাবাড়ির আত্মীয়স্বজন! তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা বাড়িতেই হয়ে যাবে। এরজন্য কমিউনিটি সেন্টার বুকিংয়ের প্রয়োজন নেই!

এসব টুকটাক আলাপের ফাঁকে অনিক আর ত্বোয়ার চায়ের কাপটা রেখে দ্রুত সরে পড়েছে মাইসারা। অনিকও তার অবা’ধ্য, বেয়া’দব, বেহা’য়া মনকে নানারকমভাবে স্বান্তনা দিয়ে থামিয়ে রেখেছে! যেন ভুলবশত চোখ না পড়ে, চোখাচোখি না হয়! নইলে অকারণ অস্বস্তি শুরু হবে মেয়েটার। তবে দু’জনের লুকোচুরি আর একে-অন্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সময়টুকু ভীষণভাবে উপভোগ করছিল ত্বোয়া! উচ্চস্বরে হাসতেও পারছিল না, আবার হাসি চেপে রাখতেও পারছিল না। মাইসারা সরে যাওয়ার পর পেটে হাত চে’পে অনেকক্ষণ প্রাণখোলা হাসি হাসলো সে। তা দেখে অনিক রীতিমতো রেগে গেল! ক্যারামের সব গুটি এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

-“যা, সামনে থেকে সর। তোকে অকারণ হাসার চাকরি দেইনি আমি। ফা’জি’ল মেয়ে!”

-“আজিব! আমি হাসতেও পারবো না? হাসার জন্য তোমার অনুমতি নিতে হবে নাকি?”

অনিক জবাব দিল না। চায়ের কাপ নিয়ে ফটাফট নিজের রুমে গিয়ে ঢুকলো! ত্বোয়া সবগুলো গুটি বাক্সে ঢুকিয়ে বোর্ডটা যথাস্থানে রেখে চায়ের কাপ সঙ্গে নিয়ে মাইসারার কাছে গেল। তখন রুমের ভেতরে চা খেতে খেতে রিপার সাথে ফোনে কথা বলছিল সে। কথা বলা শেষে ফোন রেখে ত্বোয়াকে দেখে বলল,

-“কিছুক্ষণ আগে নাকি একটা ডেলিভারি হয়েছিল! পেশেন্টকে হসপিটালে নিয়ে আসতে দেরী হয়েছিল বলে বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না!”

ত্বোয়া তার মুখভারের কারণটা বুঝতে পারলো। দশমাস, দশদিন গ’র্ভে বাচ্চাকে লালন-পালন করে মৃ’ত সন্তানের জন্ম দেয়া, এই আ’র্তচিৎকারে একটা মায়ের ভেতর যে কতখানি পু’ড়ে সেটা মাইসারা উপলব্ধি করেছে প্রতি পদে পদে। রোজ কত শিশুর জন্ম হয় হসপিটালে, কেউ বাঁচে, কেউ ম’রে। কখনো সন্তান মৃ’ত আবার কখনো মা! একটু সচেতনতার অভাবেই অকালে অধিক প্রাণের বি’না’শ ঘটছে। দেশ উন্নত হচ্ছে, চিকিৎসা উন্নত হচ্ছে অথচ মানুষ সচেতন হচ্ছে না! সামান্য অসচেতনতা কে’ড়ে নিচ্ছে হাজারও মানুষের প্রাণ!

এসেছিল চা খাওয়ার ফাঁকে সন্ধ্যার আড্ডাটা জমিয়ে তুলবে, অথচ মাইসারার শুকনো, মলিন, মনম’রা চেহারার এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘট’নার খবর শুনে মুখের হাসিটা উবে গেল তৎক্ষনাৎ! আড্ডাও হলো না, হাসিঠাট্টাও হলো না, উলটে মন খারাপের এই ক্ষণটাকে নীরবতা দিয়েই ঢেকে দিল দু’জনে!

*****

পরদিন সকালেই বাড়িতে মেহমানদের আগমন ঘটলো। একগাদা মিষ্টান্নদ্রব্যসহ ফলমূল নিয়ে হাজির হলো নামিরা আর তানভীর! আরমান সাহেব প্রশস্তচিত্তে তাদের আগমনের সময়টাকে গ্রহণ করলেন। খাবার-দাবারের আয়োজন শুরু হলো রান্নাঘরে! একসঙ্গে তিনজনে মিলে রান্নার কাজটা সামলাচ্ছে! ফারজানার চেহারায় রাগ নেই, বরং হাসিমুখেই এই সময়টাকে উপভোগ করছে সে। মাইসারা এটা-সেটা এগিয়ে দিচ্ছিলো। তখন ফারজানা বলল,

-“উপর থেকে দারুচিনি, এলাচির বৈয়ামটা দিবি সারা, আমি সরে গেলে তো মশলা পু’ড়ে যাবে! ত্বোয়া, তুই যা। হাতমুখ ধুয়ে নামিরার সাথে গল্প কর। এদিকটা আমরা সামলে নিব!”

কাজ আর বেশি ছিল না তাই ত্বোয়া ফ্রেশ হওয়ার জন্য সুযোগ পাওয়াতে মাথা নেড়ে চলে গেল নিজের রুমে। মাইসারা বৈয়ামটা আনতে গিয়েই মসিবতে পড়লো! পাশাপাশি অনেকগুলো বৈয়াম রাখা। সাথে তেলের মোটা টিনটাও! খানিকটা উঁচু হওয়াতে উঁকি মেরে বৈয়ামটা আনতে গেল মাইসারা অমনি হাত লেগে তেলের পুরো টিন উলটে মাইসারার মাথায় পড়লো! ঢাকনাটা সরে যাওয়াতেই বিপ’ত্তিটা ঘটলো। গড়গড়িয়ে সবটুকু তেল তার সারা গায়ে লেপটে গেল! ব্যথায় আর্ত’নাদ করে উঠলো সে! ফারজানা সেটা দেখে ক্ষ্যা’পে গেল! হাতের কাজ ফেলে দ্রুত ছুটে গেল ঠিকই! সেইসাথে সামান্য ধাক্কায় মাইসারাকে সরিয়ে তেলের টিনটা তুলে রাখলো। বলল,

-“পারবি না যখন বলতি! কতটা তেল নষ্ট করলি বলতো! জানিস তেলের কত দাম? প্রতিমাসে কয় লিটার তেল লাগে তার খোঁজ রাখিস? ইশ, ইশ অনেকটা তেল জলে গেল! এখন এই নতুন করে তেলটা কে আনবে! সর এখান থেকে! তোকে আর অকাজ করতে হবে না! কাজ যখন পারবি না, তখন না বলতে পারিসনি? শুধু শুধু হয়রানি। তেলের টিনটা উপরে রেখেছিস কেন? ওটা কি ওখানে থাকে? আশ্চর্য সারা, মাত্র একটা রাত তোকে ঘর সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তাই বলে এই কোণার জিনিস ওই কোণায় রাখবি? এভাবে ঘর সামলানো যায়?”

মুখের উপর এতগুলো কথা শুনবে ভাবতেও পারেনি মাইসারা! টপটপ করে তার গা বেয়ে যেমন তেল গড়িয়ে পড়ছে, তেমনি চোখ থেকে ঝরছে পানি। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, এই তেলের টিনটা উপরে গেল কী করে! গতকাল রাতেও সে নিচে রেখেছিল। মাথাটা ব্যথায় টনটন করছে! ডানহাতে ব্যথার জায়গাটা ভালোমতো ঘষে বলল,

-“আমি খেয়াল করিনি ভাবী। বিশ্বাস করো, তেল আলাদা বোতলে সরিয়ে টিনটা রাতেই আমি নিচে রেখেছি, এটা উপরে গেল কীভাবে সেটাই তো বুঝতে না!”

-“হয়েছে আর কৈফিয়ত দিতে হবে না!”

ফারজানার গলার এমন ভয়া’নক আওয়াজে তড়িঘড়ি করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো ত্বোয়া! ইচ্ছেমতো মাইসারাকে ব’কে যাচ্ছে। সে-ও বকা হজম করছে চুপচাপ কোনো কথা বলছে না! হাত ধরে টে’নে তাকে বাইরে বের করে বলল,

-“ব্যথা পেয়েছিস কোথাও? এই অবস্থা হলো কী করে! সারা শরীর তো তেলে ডুবে আছে মনে হচ্ছে! জলদি গোসল করে জামা পালটা! সারা যা এখান থেকে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিস কেন তুই? বলতে পারিস না, প্রতি মাসে টাকা কোথায় যায়! এভাবে চলতে থাকলে তো চুপ করে থাকা যাবে না দেখছি! সব জানাবো বড়ো ভাইয়াকে! প্রতিবাদ করতে পারছি না দেখে যা ইচ্ছে তাই বলে পার পেয়ে যাবে! এমনটা তো কখনোই হবে না! আর চুপ থাকবো না। হয় সংসার, বাড়ি দুটো আলাদো হোক, নয় তোর ভাগ নিয়ে তুই যেদিকে পারিস চলে যা! এই জা’হা’ন্না’মে থাকলে ম’রে যাবি!”

ত্বোয়ার কথাটা কাজে দিল! ফারজানা চুপ থেকে কথা শুনলো কিন্তু কোনো জবাব দিল না। তার ভাবনায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, তেলের টিনটা উপরে গেল কী করে? ওখানে তো অন্যকিছু ছিল! কে সরালো? ভাবতে পারলো না সে কিছু! তবুও ত্বোয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

-“এটাই পারবি! কথায় কথায় জায়গা সম্পত্তি আলাদা করা ছাড়া আর কোনো বাহা’দুরি আছে তোদের? বাড়িতে মেহমান, নয়তো এই অপ’মান আমি চুপ থেকে হ’জ’ম করতাম না।”

-“বেশ! মেহমান চলে যাক! আমি ভাইয়ার কানে সব কথা ঢালবো। সংসারের কর্ত্রী হয়েছো, তাইবলে আমাদের মাথা কিনে নাওনি নিশ্চয়ই! যখন-তখন যেভাবে পারছো, ব্যবহার করছো! নেহাৎ ভদ্রতা রক্ষার্থে, সংসার বাঁচাতে চুপ থাকি। নয়তো তোমার মতো মেয়ের যে কোনো যোগ্যতা নেই, আমার ভাইয়ের বউ হওয়ার তা হা’রে হা’রে বুঝিয়ে দিতাম। বেশি বা’ড়া’বা’ড়ি করলে নিজের কপালই পু’ড়া’বে! নাহিয়ানটার জন্য তোমার মুখোশটা টে’নে খুলতে পারছি না, নয়তো সারার মতো নাহিয়ানের জীবনটাও তো বি’ষিয়ে যাবে! চল এখান থেকে।”

দাঁতে দাঁত চে’পে অনেকগুলো কথা হ’জ’ম করলো ফারজানা! অগ্নিদৃ’ষ্টি নিক্ষেপ করে দু’জনের দিকে তাকালো। ত্বোয়া বিজয়ীর হাসি ফুটিয়ে তুললো ঠোঁটের কোণে। মাইসারার হাত ধরে তাকে রান্নাঘর ছেড়ে রুম অবধি নিয়ে আসলো। আলনা থেকে জামাকাপড় হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে বলল,

-“শান্তিমতো গোসলটা শেষ কর! এই মহিলা আগামী এক সপ্তাহ চুপ থাকবে।”

মাইসারা তখনো মাথায় হাত বুলাচ্ছে! ত্বোয়া সেটা লক্ষ্য করে বলল,

-“অনেকটা কে’টে গেছে! শ্যাম্পু করতে পারবি, নাকি আমি আসবো? চুলগুলো তো আঠালো হয়ে গেছে!”

-“তুই যা, আমি সামলে নিব!”

ত্বোয়া চলে গেলেও তার ভাবনার দৌড় থামছে না। বুঝতেই পারছে না, তেলের টিনটা নিচ থেকে উপরে উঠলো কী করে! তার স্পষ্ট মনে আছে, গতকাল রাতে রান্না শেষে আলাদা বোতলে তেল সরিয়ে টিনটা নিচের দিকের কর্ণারে রেখেছিল! সেখান থেকে কে সরালো? তেল তো বের করার প্রয়োজন হয়নি! তবে? তিনজন মেয়ে ছাড়া আর তো কেউ রান্নাঘরে ঢুকে না! কে করলো এই কাজ?

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৮)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

অনেক সময় মানুষ যা ভাবে, যা চায়, হয় তার ঠিক উলটো! আশানুরূপ ফল যদি না মিলে ব্যক্তি যেমন মনের অশান্তিতে পড়ে তেমনি তার মন-মেজাজের পাল্লাটাও তখন মারাত্ম’ক আকার ধারণ করে! বিশেষ করে হিং’সাত্মক মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি যখন কার্য সম্পাদনে গাফি’লতি টের পায় তখনই তার হিং’স্র রূপ সে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে! যদিও ব্যক্তি চায় না তার ভেতরের রাগ, ক্ষো’ভ প্রকাশ করে উদ্দেশ্য সফল হওয়ার আগেই ধরা পড়ে যেতে, তবুও ভেতরে যে একটা উৎকণ্ঠা, দুঃশ্চিন্তা শুরু হয়, তা বোধহয় শত চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। কারণ তার সেই দুঃশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠার রেখা কাজকর্ম এমনকি চেহারার ভাবভঙ্গিতে ফুটে উঠে প্রতি পদে পদে। নানারকম পেরেশানিতে পড়তে হয় তাকে।

এই মুহূর্তে ফারজানার অবস্থাও হয়েছে সেরকম! শেলফের উপরে যে দরকারী জিনিসটা সে রেখেছিল, সেটা হাওয়া! সেখানে তেলের টিন থাকার কথাই না। সে খুব গোপনে, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাথে প্ল্যানটা তৈরী করেছিল, অথচ সব মাটি! মাঝখান থেকে কতগুলো তেল নষ্ট হলো। অবশ্য এ নিয়ে তার আফসোস নেই, দুঃশ্চিন্তাও নেই। তার চিন্তার দৌড় এখন কেবল সেই টের পাচ্ছে। রান্নাঘরের কাজ শেষ করে আড্ডা দেয়া তো দূর, সে হাহু’তাশ করে রুমের ভেতরেই হাঁটাহাঁটি করছে। ড্রয়িংরুম থেকে রুমে আসার পরেই ব্যাপারটা চোখে পড়েছে আলিফের! স্ত্রীর এই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ, মলিন চেহারা তার খুব একটা ভালো লাগছে না। তাই কিছুক্ষণ চেয়ে বুঝতে না পেরে বলল,

-“বাড়িতে মেহমান রেখে তুমি অকারণ হাঁটাহাঁটি করছো কেন এখানে? যাও ওদের কী লাগে দেখো! কী সারাদিন ভাবো এত?”

ঠোঁট বাঁ’কা’লো ফারজানা! দৌড়ের উপর রুমের প্রত্যেকটা কোণা খুঁজছে সে। এবার মেজাজটা বেশিই চ’ড়ে গেল আলিফের! রাগ দেখিয়ে বলল,

-“কী খুঁজছো তখন থেকে!”

-“মাথা গরম করিও না তো! আমাকে আমার কাজ করতে দাও। বাড়িতে আর লোক নেই? মেহমানদের তারা কি আপ্যায়ন করাতে পারে না? সবসময় আমাকেই কেন লাগবে?”

অগ্নিমূ’র্তির ন্যায় চোখ দু’টোকে রাঙিয়ে ফেললো ফারজানা। ঠোঁটে ঠোঁট চা’পলো। ক’ড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সামনের মানুষটাকে বুঝিয়ে দিল, তার মেজাজ কতটা গরম হয়ে আছে। যে মেয়ে সংসারের যাবতীয় দিক নিয়ে দিনরাত ভাবে তার মুখে এমন কথা বড্ড বেমানান শুনালো। মুচকি হেসে স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে বলল,

-“শান্ত হও! চেঁচিয়ে কথা বলো না। তোমার যদি শরীর খারাপ লাগে বিশ্রাম নাও। নিজে থেকেই সংসারের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছো! চাইলেও তোমার অনুমতি ছাড়া ওরা কিছু করতে পারে না। তোমাকে কতটা সম্মান করে বুঝতে পারছো?”

-“দরকার নেই এত সম্মানের। যাওতো সরো! ত্বোয়াকে গিয়ে বলো, চা-নাশতার ব্যবস্থা করতে! আমি একটু পর আসছি।”

আলিফ ঘাড় নেড়ে চলে গেল! ঝটপট মোবাইল বের করে নিজের মা’কে ফোন করলো ফারজানা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নারীকণ্ঠে ভেসে এলো,

-“কীরে, কাজ হলো?”

-“না, মা! খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় যে গেল!”

-“খুঁজে পাচ্ছিস না, মানে কী! ভালো করে দেখ, কোথায় রেখেছিস!”

-“আমি তো ওখানেই রেখেছিলাম মা। ভেবেছিলাম সারার হাত লেগে জিনিসটা ওর উপরেই পড়বে। কিন্তু ওখানে তো তেলের টিন ছিল! বোতলটা ছিল না।”

-“তার মানে কেউ সরিয়ে দিয়েছে!”

-“কী যা তা বলছো! আমরা মেয়েরা ছাড়া রান্নাঘরে কেউ প্রবেশ করে না!”

-“তবে তেলের টিন কি পাখা গজিয়ে আপনা-আপনি উপরে উঠলো?”

-“বুঝতে পারছি না।”

-“ভালো করে খোঁজ। আর দু’দিনের ভেতর কাজে লাগা। মনে রাখিস, এটা কারও চোখে পড়লে তোর সংসারটা ভা’ঙ’তে বেশিদিন লাগবে না।”

-“ভয় দূর করতে তোমাকে ফোন করলাম, তুমি আরও ভয় পাইয়ে দিচ্ছো। রাখো ফোন, খুঁজে দেখি; পাই কি-না!”

ফোন কে’টে মায়ের কথাগুলো একমনে ভেবে চলেছে ফারজানা। গতকাল বাইরে বের হওয়ার অজুহাতে মায়ের সাথে দেখা করে জিনিসটা এনেছিল। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে শেলফের উপরে তুলে রেখেছিল সেটা। উদ্দেশ্য ছিল, মাইসারার ক্ষ’তি করা। অথচ তার রাখা জিনিসটা মাত্র কয়েক ঘণ্টায় হাওয়া! এই ব্যাপারটাই পুরোপুরি বোধগম্য হচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে। অতি সুক্ষ্মভাবে কাজ করতে গিয়ে মারাত্ম’ক ভুল করে ফেলেছে সে। এই ভুল শোধরানোর কোনো উপায় তার জানা নেই। যদি বাড়ির কারও চোখে পড়ে, তবে মাইসারার বিদায় হওয়ার বদলে তারই বিদায় ঘণ্টা বেজে যাবে। ভয়ে, আতঙ্কে রীতিমতো অন্তরাত্মা কাঁপছে তার। তবুও মনে পড়ছে না কিছু!

*****

শুক্রবার থাকায় পুরুষরা সবাই একসঙ্গেই জুম’আর সালাত আদায়ে মসজিদে চলে গেলেন। এরমধ্যে অনিকের সাথে মাইসারার কথা হয়নি, দেখাও হয়নি! সেই যে লুকোচুরি খেলা চলছে দু’জনার মাঝে, এই লুকোচুরি খেলাটাকেই বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে যেন দু’জনে। মাইসারা তো কাজের ছুঁতোয়ও সামনে আসে না। অনিকও কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না। তবে একটা বিষয় খুশির যে, মাইসারা অমত করেনি! অনিক প্রথমে ভেবেছিল, সানভির কারণে কোনোভাবে না বলতে পারে। কিন্তু যখন কনের দিক থেকে কোনো প্রকার অসম্মতিসূচক বাক্য আসলো না তখন কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলো সে। বুঝতে পারলো, অতীতের ভুল থেকে সে পা’লা’তে চাইছে। কতটা পারবে কে জানে! তবে অনিক তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে, মেয়েটাকে ভালো রাখার।

বয়ঃস’ন্ধিকাল সময়টা বড্ড অবুঝ! এই সময় কারও ম্যাচিউরিটি বাড়ে, আবার কেউ কেউ আবেগী হয়ে ভুল পথে এগোয়! সময় পেরোনের সাথে সাথে মানুষ বুঝে সে ভুল পথে হাঁটছিল, জীবন তাকে সঠিক মানুষ চিনায়নি। চিনায়নি সঠিক ভালোবাসা! তাই একটা সময় মনের ডাকেই মন দেয়া-নেয়ার পথে নেমেছিল সে। যখন মানুষটা চলে গেছে, তখনই বিবেক তাকে বুঝিয়েছে, স্বার্থ যতক্ষণ বেঁচে থাকে ততক্ষণ ভালোবাসাও থাকে। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে অনুভূতিরাও ফিঁকে হয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া এই সমস্ত অনুভূতি মানুষকে প্রতি পদে পদে যন্ত্রণা দেয়! মাইসারাকেও দিয়েছিল। যে যন্ত্রণা আড়ালে থেকেই অনুভব করতো অনিক! অথচ প্রশ্ন করতো না, জানতে চাইতো না! শুধু উপলব্ধি করতো, ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা, একাকীত্বের যন্ত্রণা মানুষকে কতখানি নীরব, পাথর, নিষ্প্রাণ বানিয়ে দেয়! এতসব উপলদ্ধি মনের কোথাও জাগ্রত হওয়ার পর, মাইসারাকে হরদম বুঝাতো অনিক! প্রয়োজনে নিজের জন্য বাঁচো, নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য বাঁচো, তবু কখনো অতীতের জন্য আফসোস করো না। একটা মানুষের মনকে শক্ত করতে তাকে বকাঝকা করে নয়, যত্ন করে বুঝাতে হয়! আজও অনিকের চোখে ভাসে, সেদিনের সেই কান্নামাখা মুখশ্রী! কী হৃদ’য়বিদা’রক মুহূর্ত ছিল সেটা! চাইলেও ভুলা যায় না! ভুলতে পারে না সে। পারবেও না কোনোদিন!

এইসব টুকরো টুকরো মুহুর্তের স্মৃতিকথা ভাবতেই লজ্জা এসে ভর করে তার সর্বাঙ্গে। যার কারণে অনিকের সামনা-সামনি আসতে পারে না মাইসারা! চোখে চোখ রাখা যাবে না যে! নয়তো মানুষটা মুহূর্তেই টের পেয়ে যাবে, ভাঙ’নের তীব্র আঘা’ত আজও তার হৃদয়ে কাঁ’টা’র মতোই আট’কে আছে! নিজের একাকীত্ব সময়ের খণ্ডাংশ ভাবতে ভাবতেই ব্যথার জায়গায় ঔষধ লাগাচ্ছিল মাইসারা! না চাইতেও মনে পড়ে গেল, সেদিনের সেই দুর্ঘটনা! যেদিন প্রথম অনিকের বাইকে চড়ে কলেজের ক্যাম্পাসে এসেছিল! ফেরার পথেই অ্যাক্সি’ডেন্ট হয়! সড়কে মাথা ঠু’কে অনেকটা ব্যথা পায় মাইসারা। সেই ব্যথা নিয়েও উড়াধু’ড়া লা’তি মে’রে’ছিল বাইকে! বলেছিল,

-“ভে’ঙে ফেলো এটা! ঠিকঠাক চলে না। কতটা ব্যথা পাইয়ে দিল। আর জীবনেও যদি তোমার এই ভাঙাচো’রা বাইকে উঠি!”

ব্যথাতে তার দৃষ্টি নেই, কষ্ট নেই, অথচ রাগ ছিল শুধুমাত্র বাইকের উপর। অনিক সেই দৃশ্য দেখে মারাত্ম’ক ভ্যা’বাচে’কা খেয়ে গিয়েছিল! কী পরিমাণ বাচ্চামো করেছিল মেয়েটা! অথচ আজ সব স্মৃতি। শুধুই স্মৃতি! তবুও এসব স্মৃতিই সুন্দর, জীবন্ত! এরপর মাইসারাকে নিয়ে সোজা হসপিটালে গিয়ে প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্টও করিয়েছিল! সেই ঘটনার পর থেকেই বাইকে উঠতে ভয় পায় মাইসারা। ভাবনারত চেহারা নিয়েই আনমনে হাসলো সে! সামনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। নামিরা তার হাসিমাখা মুখ দেখে বলল,

-“একা একা হাসছো যে! মনের পর্দা সরিয়ে কেউ উঁকি মে’রেছে বুঝি?”

-“কী যা তা বলছো!”

লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল মাইসারা! ভাবনাতে সে এতটাই মগ্ন ছিল, ঘরের ভেতর যে কেউ আসতে পারে এটাই ভুলে গিয়েছিল! কোনোমতে ঔষধ লাগিয়ে ফার্স্টএইড বক্সটা তুলে রাখলো। নামিরা বিছানায় বসে চারপাশে চোখ বুলালো। পরিপাটি, সাজানো-গোছানো ঘর দেখে বলল,

-“তুমি কি বরাবরই এমন?”

-“কেমন?”

বুঝতে না পারায় প্রশ্ন করলো মাইসারা! নামিরা চোখের ইশারায় পুরো রুমের দিকে ইঙ্গিত করে বলল,

-“একদম শান্ত অথচ খুব পরিপাটি! মনে হচ্ছে, সবকিছু অনেক যত্ন করে সাজিয়েছো। একটা সংসার যেভাবে মেয়েরা যত্ন করে সাজায়, সেরকম।”

-“আমি এমনই! পরিপাটি থাকতে পছন্দ করি। একটা সত্যি কথা বলবে?”

নামিরা ঘাড় নাড়লো! মাইসারা তার পাশে এসে বসলো। কোনো দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই প্রশ্ন করলো,

-“যা তোমার হওয়ার কথা, তা আমাকে কেন দিচ্ছো? আমি কি তাকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখি?”

নামিরাও কম যায় না। কথার ভাববাচ্যে মাইসারা যে অনিকের কথা বুঝিয়েছে তা বুঝতে দেরী হলো না তার। সে-ও একইভাবে জবাব দিল,

-“তোমার স্বপ্ন বাঁচানো, তোমাকে সুন্দর একটা পরিবার দেয়া! একজন মানুষ, যে তোমার একমাত্র ভরসা! যাকে ছাড়া তুমি প্রতিটা পদক্ষেপে একা। যে একান্তই তোমার, তাকে কে’ড়ে নিয়ে অভিশা’প গ্রহণ করবো নাকি?”

-“সে আমার?”

হাজারও কৌতূহল, অজানা ভয়, দুঃশ্চিন্তা, বেদনা এসে ভর করলো মাইসারার চোখেমুখে! প্রশ্নটা করেই চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে সে। নামিরা তার এই গভীর ভাবনারত চেহারা দেখে গালে হাত রাখলো। মাথা নেড়ে বলল,

-“হ্যাঁ! সে তোমার! সবসময়ের জন্য। শুধু তুমি উপলব্ধি করতে পারছো না।”

-“মানে?”

মাইসারার ভেতরটা কেঁপে উঠলো! অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো সে। নামিরা বলল,

-“বোকা মেয়ে! সব কথা মুখে বলতে হয়? তুমি নিজেই অনুভব করো। তাকে হারিয়ে যেতে দিও না! আঁকড়ে ধরো, দেখবে সে তোমাকে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিয়েছে!”

তাকে ঘিরে অনিকের এতদূর এগিয়ে আসাটা যেন একটা কথাকেই ইঙ্গিত করে। কতটা যত্নের সাথে অনিক তাকে এই অবধি এনে দাঁড় করিয়েছে, তা উপলব্ধি করেই তো হৃদস্পন্দন থেমে যাচ্ছে তার। এখানে শুধু দায়িত্ব কর্তব্য নেই, বিশাল অথচ স্বচ্ছ, সুন্দর এক অনুভূতি ঘিরে আছে! আসলেই কি তাই? যদি হয়, তবে অপ্রকাশ্য কেন? কেন সেসব অনুভূতি গোপন রেখেই নামিরাকে জীবনে জড়াতে চেয়েছিল সে? কেন? এতগুলো প্রশ্নের কি আদৌ আছে?

*****

দুপুরের খাবার শেষ করে সবাই বেশ জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে! দু’জন মেয়ে একসাথে হলেই কথার খই ফুটে তাদের মুখে। অথচ বাড়িতে এই মুহূর্তে চারজন মেয়ে। যেখানে এতগুলো মেয়ে আছে, সেখানে আড্ডা হবে না, তা-ও হয়? একেক জনের একেকটা হাসির গল্প, দুঃখ, কষ্ট সবই টুকটাক শেয়ার করা চললো। ফারজানাও সেই সময়টা তাদের সাথেই কা’টালো। যদিও ভেতরে তার মারাত্ম’ক অস্থিরতা ছিল, তবুও সেটাকে গোপন রেখেই আড্ডার পরবর্তী সময়টাকে উপভোগ করলো সকলের সাথে। অনেকদিন পর বাড়িতে এমন আড্ডা আর হৈচৈ’য়ে পুরো সময়টা যেন আনন্দের জোয়ারে ভে’সে গেল! বিকেলবেলা দু’জনে বিদায় নিয়ে চলে গেল! সেই থেকে মাইসারা ফাঁক খুঁজছে, অনিকের সাথে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলার জন্য। যদিও সামনে যেতে, মুখোমুখি দাঁড়াতে সংকোচ হচ্ছে তার, তবুও ভেতরটা ছটফট করছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কেন সে জেনেশুনে আ’গু’নে ঝাঁ’প দিতে যাচ্ছে?

একটা মানুষ আর কত পারে, নিজেকে আ’ড়া’ল করে রাখতে! যার বাইরের আচরণে কোনোদিনও প্রকাশ পায়নি তার ভেতরের অনুভূতি, হুটহাট তার সম্পর্কে এমন কিছু জানলে অস্থিরতা তো বাড়বেই, সেইসাথে বাড়বে দুঃশ্চিন্তা! অনিক যে সব জানে! সানভির সাথে রিলেশনে জড়ানোর পর থেকে প্রতিটা কথাই অনিক আর ত্বোয়ার সাথে শেয়ার করতো সে। ধারণা ছিল না, সানভিও তার বাবার জায়গায়ই নিজেকে দাঁড় করাবে! যদিও সেটা কেবল ভালোবাসাই ছিল, সেখানে ঘর বাঁধতেই হবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না। তবুওতো, মন যাকে একবার ভালোবেসে ফেলে তাকেই তো সারাজীবনের সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। সে-ও তাই চেয়েছিল। অথচ তার সব চাওয়া দূরত্বের কাছে হে’রে গেল। মিথ্যে হয়ে গেল সব। মিথ্যে হয়ে গেল, প্রিয়জনকে ঘিরে মনের কুঠিরে বাঁচিয়ে রাখা শত স্বপ্নের গল্প!

মাইসারা শত চেষ্টাও অনিকের সামনে দাঁড়াতে পারছে না। একদিকে মুখোমুখি হওয়া, চোখাচোখি হওয়ার ভয়, অন্যদিকে কিছু অকারণ দুঃশ্চিন্তা। সব মিলিয়ে মারাত্ম’ক চা’পে সময় কাটাচ্ছে সে। একবার মনে হচ্ছে, আলোচনাটা করা উচিত! আবার মনে হচ্ছে, হোক না যা হতে যাচ্ছে! ক্ষ’তি কী? ভরসা করার মতো কে আছে আর? যত সহজ করেই ভাবতে চায়, ততই সব কঠিন হয়ে যায়। তবুও কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না! রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে অনেক চেষ্টার পর সামান্য সাহস সঞ্চয় করে পা টিপে টিপে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোলো সে। আরমান সাহেব তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফারজানা, নাহিয়ান, আলিফ কেউ-ই নেই সেখানে। তবে ত্বোয়া আর অনিক রিমোট নিয়ে রীতিমতো যু’দ্ধ শুরু করেছে। একজন দেখবে রিয়েলিটি শো, অন্যজন দেখবে খেলা! দু’জনের এই ঝগ’ড়া আর রিমোট টানাটানির দৃশ্য দেখে সামনে দাঁড়িয়ে রইলো সে। এক সময় সে-ও ত্বোয়ার সাথে রিমোট নিয়ে যু’দ্ধ করেছে। হোস্টেলে যাওয়ার পর এই দৃশ্য এবং সময় দুটোই খুব মিস করে সে। দু’জনের এই ঝগ’ড়া দেখে সহ্য হলো না তার।

চিল যেমন সুযোগ পেলে মোরগছানা নিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে পালায় তেমনি করে আচমকা টা’নে রিমোটটা নিজের কাছে নিয়ে আসলো মাইসারা! সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশন অফ করে সবগুলো সুইচ বন্ধ করে রিমোট জায়গামতো করে কোমরে হাত রেখে দু’জনের দিকেই রাগী চোখে তাকালো! ত্বোয়াকে ইশারায় বুঝালো,

-“তুই এখান থেকে যা, আমার দরকারি কিছু কথা বলার আছে!”

ঠোঁট চেপে হাসলো ত্বোয়া! মুখে হাত রেখে হাই তুলতে তুলতে সোফা ছাড়লো। মাইসারার গলা জড়িয়ে টুপ করে গালে চুমু খেয়ে বলল,

-“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে ভাইয়া। শুভরাত্রি! তুমিও বেশি রাত জেগো না। সকালেই তো মেহমানরা আসতে শুরু করবেন। কত কাজ বলো তো!”

খোঁ’চাটা নীরবে হজম করলো মাইসারা! তবে মুখে কিছু বললো না। ত্বোয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিকও উঠে দাঁড়ালো! পা বাড়ানোর আগেই পিছন থেকে একটা মিষ্টি আওয়াজ শুনে থেমে গেল তার পা। ভীরু চোখে তাকিয়ে মাইসারা বলল,

-“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল! শুনবে?”

অনিক মাথা নাড়লো! পিছু ফিরে আবারও সোফায় বসলো! মাইসারাও দূরত্ব বজায় রেখে আলাদা সোফায় বসে নিজেকে পুরোদমে গুছিয়ে নিল। আপ্রাণ চেষ্টা করলো, নার্ভাস না হওয়ার। তবুও কণ্ঠস্বরে জড়তা নেমে এলো তার। অনিকের চোখ তা এড়ালো না, বরং খুব দ্রুতই সে ধরতে পারলো মেয়েটার নার্ভাসনেস! বলল,

-“সানভির ব্যাপারে কিছু বলতে চাস?”

-“না!”

-“তবে? ঘাবড়াচ্ছিস কেন?”

উপরে সিলিংফ্যান চলছে। তবুও মাইসারা ঘেমে গেছে পুরোটা। চুলের গুড়িতে জমে থাকা ঘাম কপাল বেয়ে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে পড়ছে। উড়না দিয়ে আলগোছে ঘাম মুছে নিল সে। বলল,

-“আমরা তো কাজিন তাই না?”

-“তোর কি মনে হয়?”

-“উঁহু, আসলে কাজিনদের বিয়ে মানে সাইন্স বলে, সরাসরি কাজিনদেরকে বিয়ে করা উচিত নয়! এতে ফিউচারে…!”

-“ফিউচারে কী হয়?”

কথার মাঝখানেই প্রশ্ন করলো অনিক! মাইসারার তখন হাউমাউ করে কাঁদার অবস্থা। একেই তো কথাটা বের হচ্ছে না, তার মধ্যে সরাসরি প্রশ্নের জা’লে ফেঁ’সে যাওয়াতে নিজের উপর রীতিমতো ক্ষু’ব্ধ সে! দাঁত কিড়মিড় করে উঠে দাঁড়িয়ে সোফায় থাকা কুশনটা অনিকের দিকে ছুঁ’ড়ে মা’র’লো। রাগ মেটাতে ভুলবশতই সামনে থাকা চুলগুলো টে’নে ধরলো! বলল,

-“ফিউচারে আমার মাথা হবে! মাথামো’টা, স্টু’পিড, ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানে না! যাও, নিজের রুমে যাও। ঘুমানোর আগে গুগলটা ঘে’টে ঘুমাও!”

-“আরে ছাড়, চুলে ব্যথা পাচ্ছি তো!”

-“ওহ, সরি! খেয়াল ছিল না।”

অনিকের মনে হলো, বহুদিন পর এমন একটা দিন উপভোগ করছে সে! মাইসারার আসল কথা সে ধরতে পেরেছে। গুগল ঘা’টার প্রয়োজন হবে না। এই সম্পর্কে ধারণা আছে তার। তবুও মেয়েটার মুখ থেকে শুনতে আগ্রহী শ্রোতার মতো তাকিয়ে রইলো। কেমন লজ্জায় লাল হয়ে গেছে সে। যেন তার ফর্সা গালে কেউ ঠো’কা মে’রে’ছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঝটপট সরে গেল মাইসারা। দৌড়ে পালালো রুমে। পিছন থেকে অনিক বলল,

-“ওসব নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করিস না সারা! যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। ফিউচারে যা হবে, নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে! আর খারাপ হলেও আমাকে তো তুই চিনিস! আমি আমার দায়িত্ব, কর্তব্য থেকে এক-পা’ও সরবো না।”

ফিরে তাকানোর সাহস পেল না মাইসারা! ভয়ে হাত-পা কাঁ’প’ছে তার। দ্রুত রুমে ঢুকে দরজা আট’কে দিল। অনিক কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেললো! সে বুঝতে পেরেছে, কী বলতে এসে ফিরে গেছে মাইসারা। কী হবে ওতো ভবিষ্যতের চিন্তা করে, যদি কারও বর্তমানটাই ভালো না কা’টে! তবুও ভয় পাচ্ছে সে! সব ভুলে মেয়েটা ভালো থাকবে তো? এই একটাই দুঃশ্চিন্তা উঁকি মা’র’লো মনে। তাকে ভালো রাখার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভবিষ্যতে যা হয় হোক, তবু কেউ অতীত ভুলে বর্তমানকে নিয়ে ভালো থাকুক! আপাতত এইটুকু চেষ্টা সে মনে-প্রাণে করবে। বাকিটা ছেড়ে দিবে সময়ের উপর!

*****

চলবে…

মনোহারিণী পর্ব-০৫+০৬

0

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৫)+(৬)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ। চাইলে শেয়ার করতে পারেন।)

যেকোনো আচার-অনুষ্ঠান শুরুর আগে পারিবারিক বৈঠক হয়! এই বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমেই একটা অনুষ্ঠানের যাবতীয় বিষয় উঠে আসে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল! এই বৈঠকটারও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যে থমথমে ভাব বজায় রেখেছে তা দেখে অনিকের ভ্রু কুঁচকে আছে! বিয়েসাদীর আয়োজন, টাকা-পয়সা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তার বাবার চেহারা বলছে অন্য কথা! আজ সারাদিন মাইসারা রুমের বাইরে বের হয়নি! দুপুরের পর অনিক, আলিফ, আরমান সাহেব তিনজনই আঞ্জুমান আরা’র জানা’যায় উপস্থিত ছিলেন। মাশফিকে দেখে তার খোঁজখবরও নিয়ে এসেছেন। তারমধ্যে একবার শুধু মাইসারার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলেছে সে! ভাইকে স্বান্তনার বাণী শুনানো ছাড়া ওই মুহূর্তে আর কিছুই করার ছিল না তার। তবুও নিজে শক্ত থেকে অবুঝ ভাইকে স্বান্তনা দিয়েছে! বলেছে, হোস্টেলে গেলে দেখা করবে! মাশফি এতে যথেষ্ট খুশিও হয়েছে।

বড়োদের এই বৈঠকে সবাই উপস্থিত থাকলেও মাইসারা আর ত্বোয়া সেখানে নেই। দুই বোন এক রুমে বসে অযথাই সময় পার করছে! যতক্ষণ না অনুমতি আসছে ততক্ষণ বড়োদের সামনে যাওয়া বেয়াদবি। তাই বসে বসে অযথা সময় অতিবাহিত করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তাদের। রাতের এই সময়ে নাহিয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে! আলোচনার বিস্তারিত তুলে ধরার উপযুক্ত সময় এটাই! আরমান সাহেব যথেষ্ট চিন্তিত! কারণ এই মুহূর্তে তিনি যা বললেন তা ঠিক প্রভাব ফেলবে অনিকের উপর সেটা ভেবেই একটু কঠিন সময় পার করছেন তিনি। তবুও তো বলা উচিত। বিয়ের সময়টাও এগিয়ে এসেছে। এখনই আলোচনা না হলে, পরে সময় পাবেন না। নামিরাও হয়তো অপেক্ষা করবে না! গভীর চিন্তার ভার দূরে সরিয়ে দুই ছেলের থেকে তাকালেন। তাদের উৎসুক দৃষ্টি দেখে মুচকি হাসলেন। ফারজানার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“নামিরা মেয়েটাকে তোমার কেমন লাগে?”

ফারজানা হাসলো। এই বাড়িতে দ্বিতীয়জন আসা মানে কতটা ঝা’মে’লা সেটা সে জানে। কিন্তু না এনেও তো উপায় নেই। দুই ভাই যেহেতু, বউও দু’জন হবে নিশ্চয়ই। সে একাই যে রাজত্ব করতে পারবে সেটা তো তার ভুল ধারণার একটা। গতকাল যখন নামিরা এসেছিল তখনই সে তাকে বলেছিল,

-“আমরা এখানে দুই বোনের মতোই থাকবো।”

পক্ষান্তরে নামিরা শুধু হেসেছিল। কোনো জবাব দেয়নি। যদিও ফারজানার জানা নেই জবাব না দেয়ার কারণ। তবুও ভেতরে একটা দুঃশ্চিন্তা অকারণ উঁকি মা’র’লো তার। মুরব্বি মানুষটার মুখের উপর নিজের চাওয়া-পাওয়ার ভা’র দিতে পারলো না। চাইলেও তো আর স্বর্গ হাতে পাওয়া যায় না। এই সম্পত্তি, ভাগাভা’গি এসবও এরকমই। ধৈর্য ধরে, বুদ্ধি দিয়ে আদায় করতে হয়! মিথ্যে হাসির আড়ালে নিজের অস’ৎ চিন্তাভাবনা লুকিয়ে বলল,

-“ও অনেক ভালো বাবা। নম্র, ভদ্র, শান্তশিষ্ট! আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে! ও এই ঘরে আসলে ঘরটা পরিপূর্ণ হবে!”

ফারজানার এই কথা সত্য! নামিরা যথেষ্ট শান্ত। অযথা ত’র্ক করে না, ঝ’গ’ড়া করে না এমনকি রা’গারাগিও করতে দেখা যায় না তাকে। এই বাড়িতে প্রায়শই আসা-যাওয়া আছে তার। এজন্য তার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে সবার। আরমান সাহেব এই জবাবে সন্তুষ্ট হলেন। সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। বললেন,

-“সারাকে কেমন লাগে?”

প্রচণ্ড ধাক্কা খেল ফারজানা! ঠোঁটমুখ বাঁকিয়ে দ্রুত ভ্রু কুঁচকে নিল সে। বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব বজায় রেখে বলল,

-“মানে! এখানে সারার কথা আসছে কেন?”

-“যা বলছি তার উত্তর দাও!”

ফারজানা জবাব দেয়ার আগেই অনিক এই কথার মাঝখানে আসতে বাধ্য হলো। বাবার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,

-“তুমি সারার কথা জিজ্ঞেস করছো কেন? আলোচনাটা নামিরাকে নিয়ে হবে। এখানে সারা কেন আসছে?”

আরমান সাহেব মুচকি হাসলেন! ফারজানার দিকে আবারও দৃষ্টি রেখে বললেন,

-“তোমাকে যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও!”

বড্ড দু’টানায় পড়লো ফারজানা। ভদ্রলোকের চিন্তাভাবনার দৌড় জানা নেই তার। আইডিয়ার ভেতরেও নেই। এই মুহূর্তে কোনো ত’র্কে বা ঝামে’লায় যাওয়াটাও বিপজ্জনক। নিশ্চুপে অনিকের দিকে তাকালো সে। অনিক নিজেও বিস্মিত বাবার এই অহেতুক আচরণে! বুঝা গেল, সে-ও কিছু বুঝতে পারেনি! কিছুক্ষণ ভেবে ফারজানা বলল,

-“সারা কেমন তা কি আমরা জানি না বাবা! ওর মতো মেয়ে হয় নাকি!”

-“গুড! বুঝে বলছো তো বৌ’মা?”

-“হ্যাঁ! বুঝেই বলছি। আমরা তো সারাকে ভালোমতো জানি! আপনি কি ওর বিষয়ে কিছু ভাবছেন বাবা?”

আরমান সাহেব মাথা নাড়লেন। বললেন,

-“যদি মানিয়ে নিতে পারো, তাহলে পরের মেয়ে টে’নে আনার প্রয়োজন নেই। দু’দিন পর নামিরার সাথে নয়, সারার সাথে অনিকের বিয়ে হবে। আমি আশা করবো আমার এই সিদ্ধান্ত তোমরা খুশিমনেই গ্রহণ করবে। আর যদি কারও কোনো আপত্তি থাকে সেটাও জানাতে পারো। তবে আমি কারও আপত্তি শুনবো না। আমি চাইবো, আমার মেয়েটা সারাজীবন আমার চোখের সামনে থাকুক! আলিফ, তোর যদি কিছু বলার থাকে আমাকে বলতে পারিস! অনিক, তুই আমার সাথে আয়। জরুরী কথা আছে!”

অসময়ে এমন কথা ফারজানা আর অনিক এই দু’জনের মাথায় বা’জ ফেলে দিল! অবিশ্বাস্য চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো দু’জন। শুধু আলিফ প্রশান্তির হাসি ফুটালো! যেন এটাই সে চেয়েছিল! তার সেই হাসিতে বুঝা গেল, মাইসারাকে সে-ও চিরদিনের জন্য এই বাড়িতে রাখতে রাজি! একগাল হেসে বলল,

-“আমার কোনো আপত্তি নেই বাবা! সারা এখানে থাকলেই আমি খুশি হবো!”

*****

রাগে দু’চোখে আ’গুন জ্বলছে ফারজানার! অকারণ রুমের ভেতর হাঁটাহাঁটি করছে সে! ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার পেপার দেখছে আলিফ। ফাঁকে ফাঁকে স্ত্রীর চিন্তিত চেহারার দিকে তাকাচ্ছে! মনে মনে তার এমন চক কষার ধরণ টের পেয়ে দু’দিকে মাথা নাড়লো সে! আবারও মনোযোগ দিল পেপারে! দু’চারটে পেপার দেখে সেগুলো ভাঁজ করে তুলে রাখলো নির্দিষ্ট একটা জায়গায়! ফারজানার হাত ধরে তাকে পাশে বসালো! খানিকটা বিরক্তই হলো মেয়েটা। ঝা’ড়ি দিয়ে বলল,

-“কী, হয়েছেটা কী তোমার? অযথা বিরক্ত করছো কেন?”

-“অকারণ চিন্তা তো করছো তুমি!”

-“বাবা কী এটা ঠিক করলেন? বিয়ের দাওয়াত দেয়া শেষ। কার্ড বিলি হয়ে গেছে। কমিউনিটি সেন্টার বুকিং হয়ে গেছে! রাত পোহালেই আত্মীয়স্বজনের ঠে’লাঠেলি শুরু হবে বাড়িতে। তারমধ্যে সবাই যখন জানবে পাত্রী বদল হচ্ছে তখন সম্মান কি আর থাকবে? তাছাড়া সারা এখনো পড়ছে। ও কি প্রস্তুত বিয়ের জন্য? ওর মতামত না নিয়েই এতটা বাড়াবা’ড়ি কেন করছেন তিনি?”

আলিফ জবাব দিল না। সে আসলেই বুঝতে পারছে না ফারজানার এই অহেতুক চিন্তাভাবনার কারণ! আরমান সাহেব না বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ নন। তিনি বরাবরই চেয়ে এসেছেন সারা এখানেই থাকুক। কিন্তু যখন নামিরাদের পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসলো, অনিককেও সেদিকে পজেটিভ দেখা গেল তখন আর মাইসারার বিষয়টা তুলে ধরতে পারেননি তিনি। ভেবেছেন, ছেলের সিদ্ধান্তকে সম্মান দিয়ে তার ইচ্ছের মূল্য দিবেন। এটাই হয়েছিল! অনিকের না বলার কোনো কারণ ছিল না। তারা দু’জন একে-অপরকে যতটা বুঝে ততটা অন্য কেউ বুঝবে না কোনোদিন, হয়তো এ কারণেই অনিকও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নামিরাকেই বিয়ে করবে, অর্ধাঙ্গিনীর সম্মান দিয়ে এই বাড়িতে এনে তুলবে! কী এমন হলো যে, হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো! পুরো বিষয়ের একমাত্র এই দিকটাই বুঝতে পারছে না আলিফ! তবে তার মনে হচ্ছে, আরমান সাহেবের সিদ্ধান্ত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ! তিনি সবদিক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন!

-“সারার আপত্তি করা উচিত! পড়াশোনা ছেড়ে এক্ষুণি বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলা উচিত হবে না ওর! ভালো ডাক্তার হলে পাত্রের কী অভাব পড়বে নাকি? অনিককেই কেন ওর দায়িত্ব নিতে হবে?”

ফারজানার এমন রু’ক্ষ মেজাজের কথা হজম হলো না আলিফের! ক’ড়া চোখে তাকালো সে স্ত্রীর দিকে। বলল,

-“আমার ভাই কি খুব খারাপ? ওর সাথে মানাবে না? তোমার সমস্যাটা কোথায়? কেন মানতে পারছো না? এটা তো ভালোই যে, দূরে কোথাও যেতে হলো না সারাকে। সবসময় আমাদের চোখের সামনেই থাকলো!”

ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ ভাবলো ফারজানা। মুচকি হেসে বলল,

-“তুমি শুধু সারার কথা ভাবছো, নামিরার কথা ভাবছো না! মেয়েটার সম্মানে আঙুল উঠবে না?”

এই কথায় যথেষ্ট যুক্তি টের পেল আলিফ। আসলেই তাই। বিয়ের আসরে পাত্রী বদল হওয়া ঠিক কতটা অসম্মানের সেটা টের পেতে দেরী হলো না তার। তবুও বলল,

-“গতকাল তো নামিরা এসেছিল! বাবার সাথে কিছু কথাও বলেছে। নিশ্চয়ই তার নিজেরই এই বিয়েতে আপত্তি আছে!”

ভ্রু’যুগল কুঞ্চিত করে আলিফের দিকে তাকালো ফারজানা। এমনভাবে তো ভাবেনি সে। গতকাল নামিরা এসে আরমান সাহেবের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছে, এমনকি সবগুলো শপিংব্যাগ ত্বোয়ার আলমারিতে রেখে গেছে। কেন? তবে কি এসব নামিরার ইচ্ছেতেই? ভাবনারা একত্রিত হতেই রাগ বেড়ে গেল ফারজানার। মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিল! যেভাবে হোক, এই বিয়ে থাকে আটকাতেই হবে। নয়তো বিয়ের পর সংসারের অর্ধেক দায়িত্ব চলে যাবে মাইসারার হাতে! কেউ তখন তাকে আর গুরুত্ব দিবে না। ফেল’না মনে করে ঘরের এক কোণে ঠে’লে দেবে সবাই।

*****

আরমান সাহেবের পাশে বসে আছে অনিক। তার চেহারায় যথেষ্ট চিন্তার ছা’প! হুট করে বাবার এরকম সিদ্ধান্তের কোনো যুক্তিই দাঁড় করাতে পারছে না সে। আজ সারাদিন নামিরাও কল করেনি! কাল যখন শেষ রাতে ফোন করে বলেছিল, আঞ্জুমান আরা মা’রা গেছেন তখন সব শুনে ওপাশ থেকে নামিরা শুধু বলেছিল,

-“তোমার উচিত সারার পাশে থাকা! কোথাও তুমি তোমার দায়িত্ব অবহেলা করছো না তো অনিক?”

অনিক অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করেছিল! কিন্তু বিস্তারিত কোনো কথাই বলেনি সে। শুধু বলেছে, সময় আসুক সব বলবো! অনিকের মনে হলো, নামিরা এমন কিছু বলতে চায় যা সে জানে না! কিন্তু কী? সেটাই তো ভেবে পাচ্ছে না সে। দু’জনার বন্ডিং এতই ভালো যে, কেউ কারও থেকে আজ অবধি কোনো কথা লুকোয়নি! তবুও অনিকের মনে হচ্ছে, আসলেই নামিরার সম্পর্কে সে সব জানে না! তবে কি বাইরের সব আচরণ ভুল? ভেতরে অন্যকিছু ছিল? বুঝতে পারছে না অনিক। এমন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে জানলে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলতো না সে! তবে কি হ্যাঁ বলেই ভুল করে ফেলেছে? আরও গভীরভাবে ভেবেচিন্তে এগোনো উচিত ছিল কী? কতশত ভাবনায় ডুবে আছে অনিক। তার সেই ভাবনা থামলো বাবার হাতের স্পর্শে! তিনি খুব যত্নে ছেলের ডানহাতটা ধরে রেখেছেন! এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে ছোটো বাচ্চার জায়গায় আবিষ্কার করলো অনিক! বুঝতে পারলো, বাবা তাকে কিছু বলতে চান! সহনীয় নাকি অসহনীয় সেটা বোধগম্য হলো না তার। তবে হাতের বাঁধনটা মজবুত করে বলল,

-“বলো কী কথা বলতে চাও! আমি সব শুনবো।”

আরমান সাহেব তৃপ্তির হাসি ফুটালেন ঠোঁটে! বললেন,

-“এমন পরিস্থিতি আসবে আমরা কেউ-ই তা বুঝিনি! গতকাল নামিরা যা বললো তাতে মনে হলো, ওর ভাবনাটা ঠিক! ও যেভাবে ভেবেছে, সেভাবে আমরা ভাবিনী। ফলস্বরূপ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি!”

-“ভুল? বুঝতে পারছি না কিছু!”

-“আমাকে একটা কথা বল! সারার অগোচরেই তার সব দায়িত্ব তুই পালন করছিস! বিয়েটা কেন নামিরাকে করতে চাইছিস? সারাকে কেন নয়? ও কি তোর স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখে না? অপ্রকাশ্যে যে কাজটা করতে দ্বিধা আসছে না, প্রকাশ্যে তা করতে কেন আপত্তি তোর?”

এই কথার কোনো জবাব খুঁজে পেল না অনিক! সারার দায়িত্ব নিতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু আপত্তি অন্য জায়গায়! কিন্তু এখন এসব কথা কেন আসছে সেটাই বুঝলো না সে? নামিরা কী এমন বললো, যার কারণে আরমান সাহেব এত দ্রুত এমন সিদ্ধান্ত নিলেন! অনিকের মনে হলো, দ্রুত নামিরার সাথে কথা বলা উচিত! জানা উচিত, ঠিক কী কথা হয়েছে দু’জনার! ছেলের চেহারার এমন গুরুগম্ভীর ভাব, নীরব হয়ে বসে থাকা চিন্তিত চেহারা দেখে বললেন,

-“আমি সবসময়ই চেয়েছি সারা এখানে থাকুক! কিন্তু তুই যখন বললি, নামিরার সাথে তোর বন্ডিং ভালো তখন বুঝলাম সারা সঠিক পাত্রী নয়! কিন্তু এখন সবদিক বিবেচনা করে এইটুকুই মনে হচ্ছে, সারার জন্য উপযুক্ত যদি কেউ থাকে তবে সেটা তুই! আমি তোকে জো’র করবো না। তোকে ভাববার সুযোগ দিব! তুই বরং ভাব! প্রয়োজনে সারার সাথে কথা বল! যদি দু’জনের আপত্তি থাকে তবে আমি এগোবো না! কিন্তু বিয়ের দিন নামিরা এই বাড়িতে আসার প্রস্তুতি নিবে না!”

-“কেন?”

চমকে উঠলো অনিক! এত আয়োজন, এত ছোটাছুটি সবকিছু কি তবে মিথ্যে? হুট করে কেনই’বা সব এলোমেলো হচ্ছে! তবে কি নামিরা অন্য কাউকে ভালোবাসে? এমনটা হলে সে নিশ্চয়ই জানতো! কীসের জন্য সিদ্ধান্ত বদলালো মেয়েটা সেটাই তো পুরোপুরি পরিষ্কার হলো না! সারাকে নিয়েও তো এমন ভাবনা তার আসেনি! কারণ সে সারার মনের খবর জানে! জানে বলেই, নিজের লিমিট সে বুঝেই চলে। যতটুকু দায়িত্ব নেয়া প্রয়োজন মনে হয়েছে ততটুকুই সে পালন করছে! তবে এখন? এখন কেন পুরো জীবনের দায়ভা’র চলে আসছে তার কাঁধে! অবশ্য দায়িত্ব নিতে কোনোকালেই তার আপত্তি ছিল না, এখনও নেই। সমস্যা তো অন্য জায়গায়! এটা জানলে সারা তো ভীষণ কষ্ট পাবে! কী করা উচিত তার? কী করবে এখন? ভাবতে ভাবতেই বাবার হাতটা আরও শক্ত করে ধরলো অনিক!

-“তুমি যেমন আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করো, আমিও তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। কিন্তু আমার ওদের দু’জনের সাথেই কথা বলতে হবে! জানতে হবে, কী কারণে নামিরা তার সিদ্ধান্ত পাল্টালো! এটাও জানতে হবে, আমাকে নিয়ে সারা কতটা পজেটিভ। কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানো, কখনো ভাবিনী, সারার সব দায়িত্ব নিতে এই পথটাকেই বেছে নিবে তুমি!”

-“তুই এই সিদ্ধান্তে অখুশি?”

-“এমনটা নয় বাবা! সমস্যাটা অন্য জায়গায়! তবে তুমি নিশ্চিত থাকো, আমি তোমার ইচ্ছের মর্যাদা দিব!”

দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে সব গোপন কথাকে থামিয়ে দিল অনিক! দ্রুত ছুটে আসলো নিজের রুমে। মোবাইল হাতে তুলে ঝটপট ডায়াল করলো নামিরার নাম্বারে। কিন্তু ওপাশের নাম্বারটা তখন সুইচড অফ শুনালো। পর পর কয়েক বার একই কথা শুনে বিরক্ত হয়ে গেল সে। ফোন রেখে রওনা দিল মাইসারার রুমের দিকে! যা কথা হওয়ার এখনি হোক, নয়তো পরে মাইসারা অভি’যোগ দিয়ে বসবে, অনিক সব জেনেও কেন বিয়েতে অমত করলো না!

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৬)

যানবাহনে আরোহণের পর সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর ব্যাপার হচ্ছে হুটহাট চলন্ত গাড়ির থেমে মাঝপথে তৈরী করা জ্যাম! সামনে, পিছনে, ডানে, বায়ে সব জায়গায় যখন চলন্ত গাড়ি থেমে গিয়ে মানুষজনের কপালে বিরক্তির ভাঁজ সৃষ্টি করে। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর সময় পেরিয়ে সেই অনির্দিষ্ট সময়ের জ্যামটা তখন সহজ কাজের বাঁধা মনে হয়! একটা নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার আগে কোনো ব্যক্তিকে কেউ যদি মারাত্মকভাবে হয়রানিতে ফেলে তবে সেটা হলো, এই মাঝরাস্তার হুটহাট জ্যাম! ঠিক এরকমই একটা তাড়াহুড়োর সময়ে বিরক্তি নিয়ে বাইকে বসে আছে অনিক! বার বার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফাঁকফোকর খোঁজার চেষ্টা করছে, যদি কোনোভাবে বেরোনো যায়। অথচ কোনো ফাঁকই তার সামনে নেই। খানিক পর পর ঘড়ি দেখছে সে! ফোন চেক করছে! আবার নামিরাকে অপেক্ষা করতে রিকুয়েস্ট করছে। মেয়েটা হয়তো এতক্ষণে মহাবিরক্ত হয়ে বসে আছে। বিরক্ত হওয়ারই কথা! অহেতুক বসে থাকতে কারই’বা ভালো লাগবে?

আধঘণ্টা পর জ্যাম থেকে মুক্তি মিললো অনিকের। অপেক্ষা করতে করতে কাঠফাটা রোদে ঘেমে-নেয়ে একাকার সে! ক্যাফেতে ঢুকে ঝটপট দু’তলায় চলে এলো। কর্ণারের একটা টেবিলে তখন নামিরাকে দেখা গেল। অনিককে দেখতে পেয়ে হাত তুলে ডাকলো নামিরা। দ্রুত সেই টেবিলের কাছে গিয়ে পাশের চেয়ারে বসলো। নামিরার সাথে থাকা ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে। বলল,

-“হাই! আ’ম তানভীর! আপনি অনিক! আপনার কথা অনেক শুনেছি ওর কাছে। কেমন আছেন আপনি?”

খুব স্বাভাবিকভাবে তাকালো অনিক! নামিরা তার কথা সবার সাথে আলোচনা করে এটা সে জানে! কিন্তু এই ছেলেটা…। হাত উলটে নামিরার দিকে তাকালো। মিষ্টি হেসে তানভীরের হাতটা শক্ত করে ধরলো সে। বলল,

-“আমরা বিয়ে করেছি দোস্ত! প্লিজ, কোনো রাগ চে’পে রাখিস না! আমার কেন জানি না মনে হলো, আমি তানভীরকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তারজন্য…!”

চারপাশে চোখ ঘুরালো অনিক। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো তানভীরের সাথে! ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। ওয়েটার তখন অর্ডারকৃত কফি নিয়ে আসলো। অনিক নির্দ্বিধায়, বিনা দুঃশ্চিন্তায় তাতে চুমুক দিল! বলল,

-“এটা আগে বললেই পারতি! শুধু শুধু সবাইকে হয়রানি!”

-“সরি!”

কানে হাত দিয়ে নরম কণ্ঠে সরি শব্দটা উচ্চারণ করলো নামিরা! অনিক ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো! বলল,

-“তানভীরকে বিয়ে করবি ঠিক আছে! বিয়ে ভাঙ’বি সেটাও ঠিক আছে! মাঝখানে সারাকে টে’নে আনলি কেন?”

নামিরা এবার স্বাভাবিক হয়ে বসলো। কপিতে চুমুক দিতে দিতে নিজেকে গুছিয়ে নিল পুরোটা! তারপর ধীর ধীরে বলল,

-“তুই তো জানিস, সারা কতটা একা! আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমাদের মাথার উপর ভরসার হাত আছে। সেটা হোক বাবা-মা কিংবা স্বামী! কিন্তু ওর সেরকম কেউ নেই। আন্টি মা’রা যাওয়ার কথা শুনে সত্যিই খুব খারাপ লেগেছে! তখন আমি ভাবলাম, আমার সাথে তোর বিয়ে না হলে খুব একটা ক্ষ’তি নেই। কিন্তু সারাকে বিয়ে করলে ওর একটা খুঁটি তৈরী হবে। তুই তো জানিস তোর ভাবীর ব্যবহার, যদি সারা ওই ঘরে পার্মানেন্ট হয়ে যায় তাহলে উনি আর খারাপ ব্যবহার করতে পারবেন না ওর সাথে! অন্তত ওর ক্ষ’তি করার আগে দু’বার ভাববেন। এখন ঘা’ড়ের বোঝা ভাবছেন, কিন্তু পরবর্তীতে ঘরের একজন ভাবতে বাধ্য হবেন। এতে ওর থাকার কোনো ক্ষ’তি হবে না, আবার পড়াশোনাটাও ঠিকঠাক এগোবে।”

নামিরার এই কথাটা ফেলে দেয়ার নয়! যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়ে বলছে মেয়েটা। পুরোটা শুনে উপরনিচ মাথা ঝাঁ’কা’লো অনিক। তারপর বলল,

-“কিন্তু সারা তো রাজি হবে না!”

-“তুই যা ভাবছিস, সেরকম না-ও হতে পারে! আমি আংকেলের সাথে সব শেয়ার করেছি! এমনকি ত্বোয়ারও সাপোর্ট ছিল! সারার সব কথাই সে জানে। ভয় পাস না। তুই একবার কথা বলে সবকিছু কনফার্ম করেনে। হাতে সময় তো বেশি নেই।”

-“মাত্রই আন্টি মা’রা গেলেন। এই মুহূর্তে ওর সামনে এসব তুলে ধরা কি ঠিক হবে? রাতে কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছিল দেখে ঘুম ভা’ঙাইনি! আমি আসলে অন্য বিষয়টা নিয়ে কনফিউজড! একটু ভয় লাগছে, আবার দুঃশ্চিন্তাও বাড়ছে! তবে হ্যাঁ, তোর উপর রাগ, অভি’যোগ কিছুই নেই। আগেই বলে ফেলেছিস, এতেই ভালো হয়েছে। নয়তো বিয়ের দিন মা’রাত্মক ঝা’মেলা হতো!”

সবকিছু আলাপ-আলোচনার পরেও অনিকের দুঃশ্চিন্তা কমলো না। সে একমনে কিছু ভেবে চলেছে! অবশ্য দুঃশ্চিতার কারণটা অতি সাধারণ, অথচ অনিক সেটা নিয়ে রীতিমতো আপসেট! কেন যে এত ভয় পাচ্ছে সে, সেটাই বোধগম্য হলো না তার। হাত বাড়িয়ে অনিকের হাতটা শক্ত করে ধরলো নামিরা। বলল,

-“চিন্তা করিস না! সব স্বাভাবিকভাবেই হবে!”

-“তুই বুঝতে পারছিস না, এই ব্যাপারটা কতটা প্রভাব ফেলবে সারার উপর! হয়তো আমাকে খা’রাপও ভাবতে পারে।”

-“ফা’ল’তু কথা বলিস না তো! তুই তাকে বাঁচাতে চাইছিস এটা জেনেও সে তোকে খা’রা’প কেন ভাববে? বাদদে, তোকে কিছু বলতে হবে না, যা বলার আমিই বলবো। কাল আমরা আসছি! সব সমস্যার সমাধান করে দেব!”

আরও কিছুক্ষণ আড্ডা চললো। ক্ষণিকের মধ্যে তানভীরের সাথে অনিকের এতটা গভীর ভাব তৈরী হলো যে, যেন এরা একে-অপরকে কতদিন ধরে চেনে, জানে! অথচ মাত্রই তাদের পরিচয় হলো! হাসি, আনন্দ আর আড্ডাতে পরবর্তী এক ঘণ্টা খুব দ্রুত চলে গেল। সন্ধ্যার আগে আগে দু’জনকে বিদায় দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল অনিক।

*****

ফেরার পথে সানোয়ারের সাথে দেখা হলো অনিকের। সেদিনের মতো একগাদা হাঁসের দল নিয়ে পুকুর থেকে খামারের দিকে ফিরছিল সে। ছোটাছুটিতে হাঁসগুলো বাইকের উপর পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। অনিক দ্রুত ব্রেক কষে বাইক থামিয়ে পথের একপাশে দাঁড়ালো! সানোয়ার পাশে এসে বলল,

-“দিচ্ছিলি হাঁসের বারোটা বাজিয়ে! সেদিন তো সারার দৌঁড়ানি খেয়ে চারটে হাঁস হারিয়ে ফেললাম। কোনদিক যে গেল…!”

মন খারাপের সুরে গলায় আফসোস নিয়ে বললো সানোয়ার। অনিক অবাক হয়ে বলল,

-“বলিস কী! খুঁজে পাসনি?”

-“সারা গ্রাম খুঁজেছি ভাই। তা-ও পাইনি।”

অনিক ততক্ষণে পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে সানোয়ারের দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল,

-“এই টাকা দিয়ে হাঁস কিনে নিস! তবু সারাকে বকিস না দোস্ত!”

টাকা দেখে তার বন্ধু অবাক চোখে তাকালো। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ব্যাপারটা বুঝে বাঁ’ধা দিয়ে বলল,

-“আরে দূর, টাকা লাগবে না। সারাদিন ওগুলোর সাথে সময় কা’টে। হারিয়ে গেলে কষ্ট লাগে, এইজন্যই একটু মন খারাপ হয়! ওকে বকবো কেন!”

অনিক মুচকি হাসলো। বন্ধুর খারাপ লাগা বুঝে তার কাঁধে হাত রাখলো। বলল,

-“বেকার থাকার চেয়ে এই কাজটাই বা কম কীসের বল! ভিক্ষাবৃ’ত্তি আর চু’রি-ডাকা’তির চেয়ে সৎ পথে উপার্জনের পঞ্চাশ টাকারও অনেক মূল্য আছে!”

সানোয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেললো! বলল,

-“দু’জনে একসাথে পড়ালেখা করলাম! অথচ কপালের দো’ষে ফেল করে আজ…!”

-“মন খারাপ করিস না। তুই তো কোনো অন্যায় পথে টাকা ইনকাম করছিস না। নিশ্চয়ই আল্লাহ চেয়েছেন বলে এই ব্যবস্থাটা হয়েছে!”

-“আচ্ছা যাই, পরে কথা হবে।”

মন খারাপের ঢালি নিয়ে কথা এড়িয়ে যেতে চাইলো সানোয়ার। অনিকের দৃষ্টিতে তা এড়ালো না। সে দিব্যি বন্ধুর মনের অবস্থা আয়ত্তে আনতে পারছে। কাঁধে হাত রেখে বাইক স্টার্ট করলো আবার। বলল,

-“বিয়েতে আসিস!”

-“শুনলাম সারাকে বিয়ে করছিস! সত্য?”

সানোয়ারের কথার অর্থ ধরতে পেরে উপরনিচ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো অনিক! সানোয়ার হাসলো। বলল,

-“বাহ্!”

-“আসবি কিন্তু। অপেক্ষায় থাকবো!”

ফাঁকে জোরপূর্বক বন্ধুর পকেটে টাকা ঢুকিয়ে দিল অনিক। সানোয়ার সহজে টাকা নিবে না। প্রয়োজনে মাথার ঘাম পায়ে পেলে উপার্জন করবে তবুও কারও কাছে হাত পাতবে না। তার এই সততা আর সাহসের ধরনটা ভীষণ ভালো লাগে অনিকের। এজন্য সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যে বন্ধুকে সাহায্য করা থেকে পিছিয়ে আসে না সে। এই খামারটাই তো তার ভরসা! মাইসারা নাহয় দুষ্টামি করে না বুঝে এই অন্যায়টা করে ফেলেছে, কিন্তু সে তো জানে। তাই জেনেশুনে বন্ধুর ক্ষ’তি হতে দিতে পারলো না। এজন্যই অল্পস্বল্প সাহায্যের মাধ্যমে তাকে বুঝানো, এই টাকাটা তার হক্ব! বিনা হক্বে সে কারও থেকে পাঁচ আনাও নিবে না! ভাগ্যিস মাইসারার অজুহাতে দেয়া গেল। এতে সানোয়ারের মনটাও ছোটো হবে না, বরং উপলব্ধি হবে তার শ্রমটা কোনো অংশে কম নয়! সানোয়ার হাঁস নিয়ে ওই সীমানা ত্যাগ করলে কম স্পীডে বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরলো অনিক! তার চেহারায় এখন আর দুঃশ্চিন্তা নেই। বরং নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে যথেষ্ট সৎ, অপকট, নির্ভীক!

*****

ফোনের স্ক্রিনে একটা মেইল শো করছে। মেইলটা এসেছিল আজ থেকে এগারো মাস আগে। প্রায় বছর ঘুরে যাচ্ছে অথচ আর কোনো মেইল আসেনি। এটাই শেষ মেইল ছিল! এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে দু’চোখ ঝাপসা অনুভব করলো মাইসারা! ঝটপট চোখের পানি মুছে নিল। এই মেইলটার কথা প্রায় ভুলে গেছে সে। অথচ আজকেই, হঠাৎ করেই আবারও পুরনো সবকিছু চোখের সামনে ঝকঝকে আয়নার মতো ভেসে বেড়াতে লাগলো তার। চাইলেও মুছে ফেলা যায় না এসব যন্ত্রণাময় স্মৃতি! থেকে থেকে সেসব হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়, বুঝিয়ে যায়, পৃথিবীতে কেউ কথা দিয়ে কথা রাখতে জানে না। সে-ও রাখেনি! বলেছিল ফিরবে, ফিরেনি। উলটে উচ্চ ডিগ্রী গ্রহণ করতে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছিল, তখন সারা সবে মেডিকেলের প্রথম ধাপের ছাত্রী। সেখানে গিয়েও টুকটাক খোঁজখবর নিয়েছিল মানুষটা। একটা সময় যোগাযোগ বন্ধ হওয়া শুরু হয়। শেষ একবার ফোন করে বলেছিল, আমেরিকাতেই সেটেল্ড হবে। বিদেশিনী ম্যামের ভালোবাসার জা’লে জড়িয়ে সানভি শেষ মেইলে স্বান্তনার বাণী শুনিয়ে বলেছিল,

-“আমাকে ভুলে যাও সারা! নতুন করে আবারও জীবন শুরু করো তুমি! আমি আর ফিরবো না। অহেতুক অপেক্ষার প্রহর গুণে নিজের সুন্দর জীবন নষ্ট করো না। গুছিয়ে নিও নিজেকে। ভালো থেকো সবসময়! আল্লাহ হাফেজ!”

ব্যস এইটুকুই! এই সামান্য ম্যাসেজ যে হৃদয়ে কতখানি ক্ষ’ত তৈরী করেছে তা কেবল মাইসারাই উপলব্ধি করতে পেরেছিল সেদিন। নীরবে, গোপনে দিনের পর দিন অশ্রু বিসর্জন দিয়ে এখন সে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, নির্জীব, নিষ্প্রাণ শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেছে। বিশ্বাস ভা’ঙা’র শব্দ যদি কাউকে শুনানো যেত, তাহলে পার্শ্ববর্তী মানুষও বোধহয় সেই আওয়াজটা শুনতে পেত। বুঝতে পারতো, কারও মন ভে’ঙেছে। বিশ্বাস ভে’ঙেছে। অথচ এই ভা’ঙ’নের কোনো আওয়াজ হয় না। খুব গোপনে, বিনা আওয়াজেই হঠাৎ করে ভে’ঙে যায়। কেউ তা টেরও পায় না, জানতেও পারে না। অদ্ভুত হলেও অনিক ঠিকই এই ভা’ঙ’নের শব্দ উপলব্ধি করেছিল সেদিন! কারণ অজান্তে, নিঃশব্দে তারও মনটা ভে’ঙে’ছিল কোথাও! যা সে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি কাউকে, বুঝতে দেয়নি কোনোদিন! প্রকাশও করেনি লুকানো অনুভূতির তীব্র জ্বা’লাময়ী যন্ত্র’ণা! সে বুঝে গিয়েছিল, কিছু অনুভূতি অপ্রকাশ্যই জীবন্ত! তাই তাকে প্রকাশ করতে ভয় ছিল তার।

আনমনেই আঙুলের টাচে মেইলটা ডিলেট করে দিল মাইসারা! যে মানুষটা জীবনে নেই, আসবে না কোনোদিন, তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন বাঁচিয়ে রাখাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়! আসলেই নিজেকে গোছানো উচিত, তাই বলে অনিকের সাথে বাঁধা পড়বে সে? এমনটা তো কল্পনাতেও আসেনি কখনো! অনিক কীভাবে এই ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিবে? সে তো জানতোই, মাইসারা কাউকে ভালোবাসে! জেনেশুনে কেন সে আগু’নে ঝাঁ’প দিচ্ছে? যেখানে মনটা ভে’ঙেচুড়ে তছন’ছ হয়ে গেছে, সেখানে পুনরায় ভালোবাসার চাষ করা কি আদৌ সম্ভব? কতশত কঠিন ভাবনা, এসব ভাবনার নির্দিষ্ট কোনো সমাধানও জানা নেই তার।

মাইসারার সব ভাবনায় জটিল আরেক ভাবনার উদয় হলো! তার মধ্যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কিছু ভয়ানক তথ্য ভেসে বেড়াতে লাগলো! মনে হলো, এসব কথা শীঘ্রই অনিকের সামনে তুলে ধরা উচিত। নয়তো তাদের একটা ভুল, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অভিশা’প হয়ে দাঁড়াবে! কিন্তু এসব তথ্য, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়েই চরম লজ্জার মুখোমুখি দাঁড়াবে সে! অনিকই বা ব্যাপারটা কীভাবে নিবে! নিজেকে শক্ত করলো মাইসারা! দ্রুত রুম ছেড়ে বেরোলো। যেভাবে হোক, লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে সবকিছু অনিককে বুঝাতে হবে! সে তো একজন ডাক্তার! আর ক’দিন পরই চেম্বার খুলে বসবে! তখন রোগীদের সাথে কতশত বিষয় নিয়ে খোলামে’লা আলাপ করতে হবে! এভাবে লজ্জা পেয়ে গুটিয়ে গেলে চলবে না। মনে সাহস নিয়ে বুঝাতে হবে!

এমনিতেও সকালবেলা পাশের বাড়ির এক ভদ্রমহিলা এসে মাইসারা চেহারা দেখে গালে হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে বলেছিলেন,

-“মাশা’আল্লাহ্! আমাদের সারা তো অনেক রূপবতী! ভাই সাহেব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! তুই চিরকাল এ ঘরেই থাক মা। তোকে দূরে দিয়ে এই বাড়ির কেউ শান্তিতে থাকবে না!”

তখন থেকে লজ্জায় আর কারও সামনে বেরোয়নি। এরইমধ্যে গ্রামের সবাইকে দাওয়াত দেয়ার কাজটাও শেষ হয়ে গেছে। দাওয়াত দেয়ার দায়িত্বে যে লোক নিয়জিত থাকে, তাকেই সকালে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছেন আরমান সাহেব! অবশ্য এর আগে সারার সাথে টুকরো কথার ঝুড়ি খুলে বসেছিলেন তিনি! সারা শুধু সব শুনেছে কোনো জবাব দেয়নি। ওই মুহূর্তে জবাব আসেনি তার। শুধু বলেছিল, তিনি যা ভালো বুঝেন। কিন্তু এখন সে টের পাচ্ছে, কোথাও কিছু একটা গণ্ডগো’ল আছে! নয়তো নামিরা এত সহজে কীভাবে সরে দাঁড়ালো? আজকাল মানুষ এত ভালো হয় নাকি! সবাই-ই মুখো’শের আড়ালে ভদ্রবে’শী অ’ভদ্র!

*****

রান্নাঘরে ফারজানার সাথে কাজে হাত লাগাচ্ছে মাইসারা। গতকাল থেকে কেমন থম মে’রে কাজ করছে ফারজানা। মাইসারা সেটা টের পেলেও সাহস হচ্ছে না কিছু বলার! আগ বাড়িয়ে কথা বলতেও দ্বিধা তৈরী হচ্ছে মনে। রান্নার মাঝখানে বার বার চেয়েও মুখ খুলতে পারেনি সে। সবকিছু গুছিয়ে ফারজানা নিজেই বলল,

-“খাবারটা তুই-ই দিস। এখন থেকে তো তুই এই ঘরের কর্ত্রী! সবার খেয়াল রাখিস কেমন?”

ফারজানার কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন শুনালো। রু’ক্ষ মেজাজ! খটখটে আওয়াজ! চোখের ভাবভঙ্গিতেও যথেষ্ট রাগ! সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে মাইসারা তার হাত ধরলো। বলল,

-“আমার উপর কেন এত রাগ তোমার?”

-“ওমা! রাগের দেখলি কী! আমি তো এমনই! এভাবেই কথা বলি! মাথাটা ভীষণ ধরেছে, আজ আর শরীর মানছে না আমার! তুই থাক, আমি গেলাম।”

অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ফারজানার চলে যাওয়া টের পেতে দেরী হলো না মাইসারার। কেন যে এই নারী তাকে সহ্য করতে পারে না সেটা সে আজও জানে না! বাড়তি লোক বলেই কি শুধু, নাকি অন্য কোনো কারণ? ঠিক সেই মুহূর্তে ত্বোয়া এসে রান্নাঘরে উপস্থিত হলো। মাইসারাকে চিন্তিত দেখে বলল,

-“দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস বলতো!”

চমকে গেল মাইসারা! খানিকটা কেঁপে উঠলো তার শরীর! চোখমুখে ভয়ের আভাস ছড়িয়ে পড়লো মুহূর্তেই! ত্বোয়াকে দেখে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটের চারপাশ ভিজিয়ে ভয় দূর করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো! আমতা আমতা করে বলল,

-“ওহ, তুই! ভয় পাইয়ে দিয়েছিস তো।”

-“কী ভাবছিস? ভাইয়া চা খাবে! দু’জনই ড্রয়িংরুমে বসে বাবার সাথে গল্প জমিয়েছে! কাজ শেষ হলে তুইও আয়! অনেকদিন একসাথে বসা হয় না। বাই দ্য ওয়ে, তুই কি কোনো কারণে লজ্জা পাচ্ছিস?”

-“ন না তো!”

থেমে থেমে উচ্চারণ করলো মাইসারা! ত্বোয়া তার দু’কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিয়ে বলল,

-“ভাবিনী, আমার চাওয়াটা এইভাবে পূরণ হয়ে যাবে! খুব খুশি লাগছে জানিস! তোকে বলে বুঝাতে পারবো না, তুই এ ঘরের বউ হলে কতটা আনন্দিত হবো আমি! একটা বন্ধু, যাকে আমি চিরকাল পাশে চেয়েছি সেটা কেবল তুই! ভাবী হোস কি বোন, তুই চিরকাল আমার কাছে যেমন ছিলি তেমনই থাকবি! আদরের, আবদারের, কান্নাহাসির একমাত্র মাধ্যম হয়ে!”

মাইসারা এতক্ষণ এসব ভেবে ভয় পায়নি, তবে ত্বোয়ার কথাতে এখন খানিকটা ভয়ই পাচ্ছে সে। চা নিয়ে কীভাবে অনিকের মুখোমুখি দাঁড়াবে সেই ভয়ই তাকে জড়ো করে ফেলছে নিজের জায়গায়। স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে হাতের নখ কা’মড়াচ্ছে সে। ত্বোয়া সেটা দেখে মুচকি হাসলো। বলল,

-“একটা কথা কি জানিস সারা, তোর স্বপ্ন পূরণের পথে এই পর্যন্ত যতটুকু সহায়তা এই বাড়ি থেকে হয়েছে সবই ছোটো ভাইয়া আর বাবা করেছে। তুই মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে এখন অবধি ভাইয়া একাই এগিয়ে গেছে! যেন তোর পড়াশোনার ক্ষ’তি না হয়! এই কারণে বড়ো ভাবী রোজ ভাইয়াকে কথা শুনায়! সেদিন তো তোকেও বলল, ছোটো ভাইয়া নাকি নিজের স্বা’র্থ মে’পে চলে। অথচ তোর আর পড়াশোনা এগোতোই না, যদি না ছোটো ভাইয়া এগিয়ে আসতো! চলার পথে এমন একজন মানুষ যদি সঙ্গী হয়, তবে সে পথ কখনো পিছু হটে না। সামনের দিকে এগিয়ে যায়! তুই পিছনেরটা ভুলে যা সারা! সামনের দিকে এগো। স্বপ্ন পূরণ হতে, আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। এরপর তুই চাইলে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরেও যেতে পারিস! তোর সব পদক্ষেপে তুই ভাইয়াকে পাশে পাবি।”

মাইসারা জবাব খুঁজে পেল না! যতটুকু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভেতরে ছিল সবই বিলীন হয়ে গেছে! তবে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে, এতকিছু অনিক কেন করছে? শুধু কি দায়িত্ব ভেবে? নাকি অন্যকিছু? তবুও অস্ফুটস্বরে বলল,

-“এজন্যই কি বড়ো ভাবী এরকম আচরণ করে? আমি যতদূর বুঝলাম, সংসারে বড়ো ভাইয়া টাকা ঢালছে! অথচ সকালে ভাবীর হাতে চাচ্চু নিজে এই মাসের খরচ হিসেবে পনেরো হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন! যদি বড়ো ভাইয়া টাকা দেয়, তবে চাচুর টাকা কোথায় যায়? ক্ষেতের ধান আছে, শাকসবজি আছে, মাছেরও অভাব নেই। তবে এত টাকা কোথায় খরচ হয়?”

ত্বোয়া নিশ্চুপ রইলো! এই ব্যাপারটা যে মাইসারার চোখে পড়বে ভাবেনি সে। এজন্যই ফারহানকে সহ্য হয় না তার। প্রতিবার এখানে আসার পর যাওয়ার পথে ফারজানা লুকিয়ে হলেও ভাইয়ের হাতে টাকা ধরিয়ে দিবে! গতদিনও তাই করেছে। বাড়তি যে একাউন্ট আছে, সেখানেই প্রতি মাসে টাকাগুলো গচ্ছিত রাখে সে। মূলত এটা নাহিয়ানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই! অথচ এই কথা আলিফ আজও জানে না! এসব কিছু তারই আড়ালে, অগোচরে হচ্ছে। প্রতি মাসে কত টাকা খরচ হচ্ছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে বিনা খেয়ালেই মাস শেষে টাকা ধরিয়ে দিচ্ছে, যেন সংসারে অভাব অনটন না আসে!

চলবে…

মনোহারিণী পর্ব-০৩+০৪

0

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৩)+(৪)

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ভোরের যে অপরূপ সৌন্দর্য্য আছে তা উপভোগ করার ভাগ্য হয়তো সকলের হয় না। খুব ভোরে যারা ঘুম থেকে উঠে তারাই কেবল সেই স্নিগ্ধ সকালের মিষ্টি, মোলায়েম সময়টা উপভোগ করতে পারে। ফজরের আযানের পর যখন পাখির কলকাকলি পরিবেশটা ভরিয়ে তুললো তখনই ঘুম ভাঙলো মাইসারার। রাতে অনেক দেরী হয়েছিল ঘুমাতে! ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস হওয়াতে, রাতে ঘুমোতে দেরী হলেও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম তার ভাঙবেই! আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিছানা ছেড়ে ঝটপট ওঠে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে। অজু করে ফজরের নামাজটা আদায় করে নিল! উড়না ভালোমতো পেঁচিয়ে ত্বোয়াকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে শুরু করলো! একটা সময় বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে চলে আসলো দু’জন!

এই গ্রামের শেষপ্রান্তে মনু নদী অবস্থিত! ছোটোবেলা মায়ের সঙ্গে এই নদীর পাড়ে কত ছোটাছুটি করেছে, অথচ আজ সেসব স্মৃতি! মা কাছে নেই, পাশেও নেই, হয়তো মনেও নেই! স্বা’র্থের কাছে সম্পর্ক আজ বড্ড তুচ্ছ হয়ে গেছে! পা ছড়িয়ে নদীর পাড়ে বসলো মাইসারা। টুকরো টুকরো মাটির দলা নদীর মাঝখানটায় ফেলতে শুরু করলো। মন ভালো করার সামান্যতম চেষ্টা চালানো বৈ বেশি কিছু নয়! ত্বোয়া নীরবে বোনকে লক্ষ্য করলো! কাঁধে হাত রাখতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। দু’হাঁটুর ভাঁজে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলো। ত্বোয়া বাঁধা দিল না। কিছুক্ষণ কাঁদলে মনটা হালকা হবে! তাই এখন তাকে কাঁদতে দেয়াই যুক্তিযুক্ত! কান্নার ভার কমাতে একটা সময় মুখ খুললো মাইসারা! বলল,

-“আমি তাদের কাছে বোঝা ছিলাম তাই না? দু’জন দুই প্রান্তে দিব্যি সুখে আছে। মাঝখানে আমার জীবনটা ঝুলন্ত সেঁতুর মতো হয়ে গেছে। সামনের পথটা এতটাই দূরে যে, একাকী গন্তব্যে পৌঁছানোর মতো সাহস নেই। আবার পিছনের পথটাও ভাঙাচো’রা! কোনদিকে যাব আমি?”

-“নিজেকে তুই দুর্বল ভাবলে সামনের পথে একাকী হাঁটতে পারবি না! তারা না থাকুক, আমরা তো পাশে আছি! বাবা, ছোটো ভাইয়া এই দুটো মানুষ যতক্ষণ তোর পাশে আছে ততক্ষণ তুই নিজেকে একা ভাববি না! তুই আমার থেকেও সাহসী, আমি এটা জানি। আগামীর পথ হয়তো কঠিন, তবে সাফল্য খুব বেশি দূরে নয়! এজন্য পিছনের সব কথা মন থেকে মুছে ফেলতে হবে! শুধু সামনের দিনগুলোতে কী করবি, কীভাবে চলবি সেটা ভাববি! অযথাই মনটাকে ভার করছিস তুই!”

আচমকাই ফোনের রিংটোনটা বেজে উঠলো! স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে দেখলো পরিচিত নাম্বার! কতদিন কল আসে না, কথা হয় না ওপাশের মানুষটার সাথে! অভিমানে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে সে। এতদিন পর কী মনে করে ফোন করলেন তিনি সেটাই ভেবে পেল না মাইসারা! দ্বিধাদ্ব’ন্দ্বে ভোগে একটা সময় ফোনটা রিসিভ করলো! ওপাশে আতঙ্কিত কণ্ঠস্বরে এক কিশোরের গলা ভেসে এলো!

-“আপু, একবার আসবে! শুনলাম তুমি নাকি বাড়ি এসেছো! মা খুব অসুস্থ! একবার দেখা করে যাও!”

বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে সেই সৎ মায়ের সন্তান সৎ ভাই হয়! কিন্তু মা দ্বিতীয় বিয়ে করলে সেই ঘরের সন্তান কি আপন ভাই হয় না? নাকি সে-ও সৎ হয়! অন্য এক পুরুষের ঔরসজাত সে! এখানেই কি পার্থক্য? হিসেবটা বড্ড কঠিন মাইসারার কাছে। এত কঠিন হিসাবেও সে পা রাখতো না, যদি না এই ছেলেটা তাকে মায়ায় জড়িয়ে নিত! হোস্টেলে প্রতি মাসে তিন থেকে চার বার এই ছেলেটা তাকে এক নজর দেখার বাহানায় ছুটে যাবে। আপু বলে জড়িয়ে ধরবে। চাইলেও দূরে ঠে’লে দিতে পারে না সে! কিন্তু তার বাড়ি আসার খবর মাশফি জানলো কী করে! অনিক বলেছে? নাকি আরমান সাহেব নিজে! ভাবনা মিলাতে পারছে না সে। ওপাশ থেকে আবারও ভেসে এলো,

-“প্লিজ আপু! একবার আসো! মা সত্যিই খুব অসুস্থ!”

-“সময় পেলে যাব! রাখি?”

-“মায়ের সাথে কথা বলবে না?”

-“না! ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রতিশ্রুতি দেননি তো তিনি। মেয়েটা বাড়তি চা’প ছিল কিনা! সামনের পথের বাঁ’ধা যে, তাকে তো খুব যত্নেই দূরে সরিয়ে দিয়েছেন! দূরত্ব যেখানে চিরস্থায়ী সেখানে দেখা করে কী লাভ ভাই! তবুও চেষ্টা করবো! যদি মন থেকে সায় পাই, যাব। নয়তো না। তাকে দেখার আফসোস যখন ছিল, তখন দেখতে পাইনি। কাছে ছুটে যেতে পারিনি। মা বলে জড়িয়ে ধরার অধিকার পাইনি। এখন কীসের টানে যাব বলবি?”

ফোন কে’টে আবারও ফুঁপিয়ে উঠলো মাইসারা। বাবা-মায়ের সেপারেশনেও এতটা কাঁদেনি সে। দূরত্ব আর আদর যত্নের অভাব এখন তাকে বুঝাচ্ছে, ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হয়ে সমাজের উঁচু স্থানে আরোহণ করা কতটা কঠিন! শৈশব, কৈশোর থেকে একাকীত্ব, ল’ড়া’ই যার নিত্যদিনের সঙ্গী সে কীভাবে জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ উপলব্ধি করবে? যেখানে শৈশবেই দুই প্রান্তের দুটো হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চলা মানুষগুলো দুদিকে চিরদিনের জন্য ছিঁটকে পড়েছে! মা তো সামান্য হলেও মাশফির মাধ্যমে খোঁজ রাখেন। জন্ম দিয়েছেন বলেই হয়তো নাড়িছেঁ’ড়া ধনকে অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু বাবা! তিনি কি পারতেন না, মেয়েটার একটা খোঁজ রাখতে? কতশত প্রশ্ন, অভিমান, অভি’যোগ এসে ভিড় জমায় দু’চোখের পাতায়। একটা সময় ভারি আকার ধারণ করে অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে মাটির বুকে। কেউ দেখে না তা। টেরও পায় না। একাকী কতটা যন্ত্র’ণা লালন করে দিন অতিবাহিত করছে সে।

*****

নাশতা শেষে দুই ভাই যে যার কর্মক্ষেত্রে চলে গেল! মাইসারা তার চাচ্চুর রুমে বসে জায়গাজমির হিসাবনিকাশ দেখছিল! সেই দশ বছরের ছোট্ট মেয়েকে ফেলে বিলেত পাড়ি জমিয়েছিলেন তার বাবা। শুধু বিলেতে গিয়েই ক্ষান্ত দেননি! সেখানে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে দ্বিতীয় সংসার শুরু করেন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। বাড়িতে জানানোর পর এই বিষয়টা ভয়া’নক প্রভাব ফেলে আঞ্জুমান আরা’র মনে। তিনি সেটা মানতে পারেননি সহজে। কোনো নারীই পারে না স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মন থেকে গ্রহণ করতে, পারে না সতীনের সংসার করতে! অভিমানে বাবার বাড়ি চলে যান তিনি। সেবার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু বেশিদিন সামলে রাখতে পারেননি। একরকম রাগে, জে’গে, অভিমানে সংসারে ভা’ঙ’ন টে’নে আনেন। ডিভোর্সের কাজকর্ম কমপ্লিট হওয়ার বেশ কিছু মাস পর মাইসারার নানাভাই তার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন করেন। বাচ্চা মেয়েটাকে ফেলে আবারও নতুন সংসার সাজান তিনি। বাধ্য হোন মেয়েকে দূরে সরিয়ে দিতে। এতে করে বাচ্চা মেয়েটার পড়াশোনায় প্রচণ্ড ক্ষ’তি হওয়া শুরু হয়। এসব পরিস্থিতির নানা ঝা’মে’লা দেখে আরমান সাহেব একদিন মাইসারাকে দেখতে সেখানে যান। বাবা-মা ছাড়া নানা-নানুর সংস্পর্শে কয়েকটা মাস বেশ অসুখের সাথেই কাটিয়েছে সে। তাঁকে দেখে যখন রক্ত আপনা হতেই কোলে এসে আশ্রয় নিল, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই মেয়েটাকে আগলে রাখবেন। এরপর থেকে মাইসারা তার বড়ো মায়ের ভালোবাসা পেয়েই বড়ো হয়েছে। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন আদরের ভাগে একফোঁটাও কম পড়েনি। তাঁর মৃ’ত্যুর পরেই যতসব কষ্ট উঁকি মা’রছে জীবনে!

কাগজপত্রের হিসাব আর জমিজমার ভাগ বেশ যত্ন সহকারে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তিনি। কারণ তিনি জানেন, তার ভাই আর কোনোদিন বাড়িতে পা রাখবে না। এজন্য তার ভাগের সম্পত্তিটুকু মাইসারার নামেই লিখে দিতে চান। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে এখন, মেয়েটার নিজস্ব শক্ত, পাকাপোক্ত একটা আশ্রয় দরকার! নইলে সামনের পথে অনেক বাঁ’ধা আসবে তার। সব কাগজের দাগ, সীমা আর হিসাব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাইসারা। বলল,

-“ভাবীকে রাগাতেই ওসব বলেছি চাচ্চু! আমার কোনো সম্পত্তি চাই না। শুধু তোমরা পাশে থেকো।”

-“আমি বুঝিরে মা! কিন্তু তারপরেও তোর ভাগটা তোর নামে পুরোপুরি রেজিস্ট্রি করে নিতে পারলে ভালো। ভবিষ্যতে কোনো ঝা’মে’লা আসবে না আর অংশীদারও আসবে না।”

-“থাকুক সব তোমার নামেই। এমনিতেও আমার পড়াশোনার পিছনে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। মনে আছে, শেষবার টাকা জমা দিতে গিয়ে জমি বিক্রি করতে হয়েছিল? দরকার নেই এত ভাগের! আমার জন্য অল্প রেখে দিও, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই! বেশি কিছু লাগবে না চাচ্চু! তুমি বরং ত্বোয়ার একটা ব্যবস্থা করো। ওর জন্য ভালো পাত্র…!”

কথার মাঝখানে থেমে গেল মাইসারা। কী মুরব্বিদের মতো পাকা পাকা কথা বলছে সে। লজ্জায় দ্রুত মুখ নামিয়ে নিল। আরমান সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-“সে তো দেখবোই। তার আগে তোর জন্যও তো ভালো পাত্রের খোঁজ দরকার!”

-“আমি এখনো ওসব নিয়ে ভাবছি না চাচ্চু! আমার অনেক দূর এগোনো বাকি! আমি পৃথিবীকে দেখিয়ে দিব বাবা-মায়ের সাপোর্ট ছাড়াও সফলতাকে আঁকড়ে ধরা যায়!”

কথা শেষ করে নাহিয়ানকে সাথে নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিল মাইসারা। ত্বোয়া ভার্সিটিতে চলে গেছে। ফিরবে দুপুরের পর। এতটা সময় ঘরে একাকী বসে থাকা ভীষণ চা’পের তার জন্য। তাছাড়া অনেকদিন পর গ্রামের আলো-বাতাসকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছে সে। স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মেখে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখা বাকি! এটাই সুযোগ, নাহিয়ানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তার পুরনো সইয়ের বাড়িতে যাবে সে। বাড়িটা এই গ্রামেই। স্কুলে যাওয়ার পথেই পড়ে।

নাহিয়ান মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ে। রোজই কেউ এসে তাকে স্কুলে দিয়ে যায়, আবার বাড়ি নিয়ে যায়। আজ সেই দায়িত্বটা মাইসারাই নিল। ক্লাসে তার পরিচিত বন্ধুর পাশে তাকে বসিয়ে সইয়ের বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো সে। পাশের খামার থেকে তখন একগাদা হাঁস নিয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে বড়ো পুকুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামের এক যুবক সানোয়ার! হাঁস দেখে মাইসারা সেগুলোর পিছু পিছু ছুটলো। ইচ্ছামতো এদিক-সেদিক দৌঁড়িয়ে হাঁসের দলকে এলোমেলো করে দিল। সানোয়ার হাতে থাকা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে তে’ড়ে আসলো মাইসারার দিকে! তা দেখে চঞ্চল তরুণীর মতো লাফঝাঁপ মে’রে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সইয়ের বাড়িতে ঢুকে পড়লো সে। পিছন থেকে সানোয়ার বলল,

-“আজকে যদি আমার একটা হাঁস হারায় না সারা, তোর খবর আছে!”

-“ক’চু করবা তুমি আমার! ধ’রো তো আগে!”

তাকে বু’ড়ি আঙুল দেখিয়ে জিব বের করে ভেঙ’চি কে’টে দৌড়ে পালালো মাইসারা। সানোয়ার তড়িঘড়ি করে হাঁসের হিসাব করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঠিকঠাক না হলে আবারও প্রথম থেকে হিসেব করছে সে। বার বার মনে হচ্ছে, কোথাও ভুল পথে তার দু’চারটে হাঁস হারিয়ে গেল কিনা! মাইসারার দিকে তার আর খেয়াল রইলো। দ’স্যি মেয়েটা দিব্যি নাচতে নাচতে ততক্ষণে তার সইয়ের বাড়িতে পৌঁছে গেছে!

*****

ব্যাংক থেকে ফিরে অনিক আর ফ্রেশ হয়নি, দু’জনকে তাড়া দিয়ে ঝটপট বের হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। যাতায়াতের জন্য সবসময়ই বাইক ব্যবহার করে অনিক, কিন্তু দু’জনকে একসাথে বাইকে তোলা রিস্ক। তাছাড়া মাইসারা ভুল করেও আর অনিকের বাইকে উঠে বসবে না। একবারই উচিত শিক্ষা হয়ে গেছে তার। সেই ঘটনা কোনোদিনও ভুলতে পারবে না সে! বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক’পা হাঁটলেই মূল রাস্তা। যার জন্য খুব একটা কষ্ট হয় না এই এলাকার মানুষের। এসবে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা অভ্যস্ত! অভ্যস্ত অনিক, মাইসারা, ত্বোয়াও! হাঁটতে হাঁটতেই মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিল অনিক। আজই, হঠাৎ করেই একটা প্রাইভেট গাড়ির অভাব টের পেল তার মন।

হিসাবটা দাঁড় করিয়ে সিদ্ধান্ত পাকা করলো, কয়েকদিনের ভেতরেই একটা গাড়ি কিনবে। ব্যাংকে যা টাকা আছে তাতে হয়ে যাবে নিশ্চিত! নাহলে বাবা তো আছেনই! তবুও এই বয়সে বাবার কাছে চাইতে ভীষণ লজ্জা লাগে অনিকের। বুঝ হওয়ার পর থেকে নিজের পকেট খরচা সে নিজেই চালায়! পড়াশোনার ফাঁকে প্রচুর টিউশনি করিয়েছে। অল্পস্বল্প টাকা ব্যাংকে জমিয়েছে। মাইসারা আজও জানে না, তার ডাক্তারি পড়াশোনার পিছনে এই পর্যন্ত যত টাকা ব্যয় হয়েছে, সবই অনিক একা ঢালছে। এটা অবশ্য অনিকের ব্যাংকে জব হওয়ার পর থেকেই। এর আগ পর্যন্ত আরমান সাহেবই মাইসারার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এরপর সেটা অনিকই দেখাশোনা করতো! যেন বাবার কাঁধটা কিছুটা হালকা হয়! কিন্তু মেয়েটা জানে জমি বিক্রির টাকাতেই তার পড়াশোনা এগোচ্ছে, অথচ জমিটা বিক্রি হওয়ার আগেই মাঝপথে আটকে দিয়েছিল অনিক। যদিও মাইসারার বাবা প্রতি মাসে মেয়ের জন্য টাকা পাঠান। অভিমানে সেই টাকাতে হাতও দেয়নি মেয়ে, দিবেও না কোনোদিন। মাসে মাসে টাকা পাঠালেই কি মেয়ের প্রতি বাবার সব দায়িত্ব পালন হয়ে যায়? আর কোনো দায়িত্ব নেই? রক্তের টান নেই? পিতৃত্বের অধিকার নেই? সবই কি তবে তুচ্ছ? এজন্যই তার ক্রেডিট কার্ডটা সে আজও অনিকের কাছেই গচ্ছিত রেখেছে! ভুলবশত সেই কার্ডের কথা মাথায়ও আনে না মাইসারা। কতশত ভাবনায় ডুবেছিল অনিক! মূল রাস্তায় এসে উভার পেয়ে যাওয়াতে বড্ড সুবিধা হলো। তিনজনে সেই উভারে উঠে মূল শহরে এসে উপস্থিত হলো। যেখানে আসতে তাদের আধঘণ্টা সময় ব্যয় হয়েছে মাত্র!

শপিংমলের কাছেই নামিরা ওদের সবার জন্য অপেক্ষা করছিল! তিনজনকে দেখে হাত বাড়িয়ে দুইবোনকে আগে জড়িয়ে ধরলো সে। অনিক তখনো নিজস্ব ভাবনাতে বিভোর ছিল! তার টুকরো টুকরো ভাবনায় অতীতের ছোটো ছোটো ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছে! বহুদিন পর অনুভব করলো, আজ সে মা’রাত্মক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। আদৌ বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তো? হাজারও চিন্তাভাবনার দৌড় থামলো নামিরার হাতের চি’মটি খেয়ে! রাগ হলো। অস্ফুটস্বরে ধমক দিল। বলল,

-“ফা’জি’ল!”

নামিরার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙানোর চেষ্টা করলো অনিক! মেয়েটার হাসি দেখে সব রাগ উবে গেল তার। এই মেয়েটার উপর একফোঁটাও রাগ আসে না তার। তবুও মাঝেমধ্যে রাগ প্রকাশ করা উচিত মনে করে সে। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,

-“কখন এলে?”

-“বেশিক্ষণ হয়নি! আগে কি কোথাও বসবো? নাকি মলে ঢুকবে?”

হাত উলটে ঘড়ি দেখলো অনিক। বলল,

-“শপিং শেষ করো আগে! তোমাদের তো পছন্দ করতে গিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুরিয়ে যাবে! তবুও কেনাকাটা শেষ হবে না। আড্ডা পরেও চলবে। কিন্তু আমার দরকারি কাজ আছে! আমি বোধহয় বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবো না।”

বকবক করতে করতেই শপিংমলের ভেতরে প্রবেশ করলো চারজনে। ত্বোয়া গলা নামিয়ে কিছু একটা আলাপ করছে নামিরার সাথে। মাইসারা পাশে থাকলেও তার সেদিকে দৃষ্টি নেই। সে একমনে কিছু ভাবছে। একটা সময় জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নামিরা! মাইসারাও শাড়ি, জামা বেছে বেছে নামিরার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। কখনো তার গায়ে লাগিয়ে দেখছে ঠিকঠাক মানাচ্ছে কি-না! ওদের এসব পছন্দ করার ফাঁকে সামান্য দূরে সরে গেল অনিক। চুপিচুপি একটা নাম্বারে ফোন করলো। ফোনে হাত চেপে রেখে ফিসফিস করে বলল,

-“তুমি কয়েকটা মিনিট অপেক্ষা করো, আমি আসছি!”

ওপাশ থেকে কল কে’টে গেল। অনিক দ্রুত তিনজনের কাছে গিয়ে দেখলো একগাদা শপিং হয়ে গেছে। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিল মিটিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে নামিরাকে বলল,

-“তুমি ত্বোয়াকে নিয়ে বাড়ি যেতে পারবে না? আমার একটু কাজ ছিল!”

-“কিন্তু তোমার সাথে আমার জরুরী কিছু কথা ছিল!”

-“পরে শুনবো। প্লিজ, লেট মি গোও! সারা তুই আমার সাথে আয়! কুইক…!”

নামিরা হতাশ হয়ে তাকালো! ত্বোয়া তার হাতে চাপ দিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-“যা বলার তুমি বাবাকে বলো। আমার মনে হয় না ভাইয়াকে বলে কোনো লাভ হবে! শুনলে রাগও ঝা’ড়’তে পারে। চলো আমরা যাই!”

নামিরা ঘাড় নাড়লো। আসলেই জরুরী কথা বলার ছিল! কিন্তু তা আর হলো কই! অনিকের এত তাড়াহুড়োর কারণ খুঁজে পেল না সে। কয়েক সেকেন্ডে এত দ্রুত মাইসারার হাত টে’নে এই সীমানা ক্রস করেছে অনিক, যা দেখে অবাক হওয়া ছাড়া আর উপায় রইলো না তার। প্রত্যেকটা টার্নিং পয়েন্ট বেশ সাবধানেই পেরিয়ে আসছে সে। মাইসারার হাতটা তখনো তার হাতে আগলে আছে। মনে হচ্ছে, বেশ তাড়ায় আছে সে। কিন্তু এত তাড়া কীসের!

কয়েক মিনিটে মূল রাস্তা পেরিয়ে একটা উঁচু ভবনের নিচে আসলো। আবারও ফোন করলো কাউকে! উপরের নেমপ্লেটে লেখা নাম দেখে চমকে গেল মাইসারা। আতঙ্কিত চেহারায় বলল,

-“আমরা এখানে কেন?”

-“ভেতরে আয়, বলছি।”

খুব দ্রুততার সাথে তার হাত ধরেই সিঁড়ি টপকাচ্ছে অনিক। একটা সময় পাঁচতলায় এসে দাঁড়ালো। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো বারান্দায় জানালা দিয়ে একজন কিশোর বাইরের দৃশ্য দেখছে। তার চোখমুখে বেদনার চাপ যথেষ্ট! এক মুহূর্তের জন্য ভরকে গেল অনিক। ভয় ঢুকে গেল! দ্রুত তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখতেই পিছু ঘুরে সেই কিশোরটা ঠোঁট চেপে কান্না আটকে জড়িয়ে ধরলো অনিককে। স্বান্তনা দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সে। বলল,

-“এখন কী অবস্থা?”

ছোটো বাচ্চাদের মতো হাত উলটে চোখের পানি মুছলো মাশফি। মাইসারা স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো! ওদের দু’জনার কথাবার্তা কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। পা দুটো তরতর করে কাঁপছে। রীতিমতো টলতে শুরু করেছে সে। তবুও জোরপূর্বক গুটি গুটি পায়ে তাদের দু’জনকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল সে। মাশফি বোনের দিকে তাকালো! মাইসারা কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলল,

-“কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই? হসপিটালে কেন এসেছিস? মা কি খুব বেশিই অসুস্থ? কোথায় মা, বল না ভাই!”

-“ডাক্তার হা’ল ছেড়ে দিয়েছে আপু! মা ভীষণ ছটফট করছে! বার বার তোমাকে দেখতে চাইছে। এজন্য সকালে তোমাকে বলেছিলাম, একবার আসার জন্য। আমি জানি তুমি আসবে না, তাই ভাইয়াকেই ম্যানেজ করতে হলো!”

মাইসারা জবাব দিল না। অভিমানে হাজারও বেদনা এসে ভর করলো তার চেহারায়। দু’হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। খুব বেশি দেরী হয়েছে কি ফিরতে? কতটা দেরী? জন্মদাত্রী মা আর কতক্ষণ পৃথিবীর বুকে শ্বাস টানবেন জানা নেই মাইসারার। শুধু সে জানে, মাকে দেখা প্রয়োজন! শেষবারের জন্য হলেও মা বলে ডাকা প্রয়োজন!

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (৪)

অপরাধবোধ যখন একজন ব্যক্তির সর্বস্বে অনুভূতির সঞ্চার করে, তখন ব্যক্তি বেঁচে থেকেও মৃ’ত প্রায় হয়ে যায়! প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ তার অপরাধবোধ তাকে বুঝিয়ে দেয়, জীবনে সকল সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক হয় না! অনেক সময় জে’দ আর অহমি’কার ব’শে ব্যক্তি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। সেই ভুল সিদ্ধান্তই তারা গোটা জীবনের অভিশা’প হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্যাপারটাই এখন পুরোপুরি মিশে গেছে আঞ্জুমান আরা’র শিরা-উপশিরায়! তিনি চাইলেও আর পিছনের দৃশ্যকে ফিরে পাবেন না, চাইলেও ভুল শোধরানোর সুযোগ ফিরে আসবে না আর। যে ভুল একবার অতীতে হয়ে যায় এবং তা যখন বর্তমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, অনুশো’চনা আর দূরত্বের দেয়াল তৈরী করে, তখন বিবেক তাকে বুঝায়, একমাত্র ক্ষমাই মুক্তির মাধ্যম! যদি মন থেকে মেয়ে আজ মা’কে ক্ষমা না করে তবে কি মায়ের অপরাধবোধ লাঘব হবে? এই অপরাধবোধ নিয়েই কি তিনি পরপারে পাড়ি জমাবেন?

দ্বিতীয় বিয়ের পর মাইসারার সাথে তার দূরত্ব তৈরী হলেও স্বামী সংসারে তিনি সুখের দেখা পান। সেই সুখের সংসারে হয়তো বাড়’তি জঞ্জা’ল মনে হয়েছিল তার প্রথম পক্ষের সন্তানকে। হয়তো প্রতিশোধের নে’শা’য় তিনি না চাইতেও অন্যা’য় করে ফেলেছেন নিজের নাড়িছেঁ’ড়া ধনের প্রতি। তবুও তো তিনি একজন মা! তাকে তো শত চাইলেও অস্বীকার করা যায় না।

ধীরপায়েই মায়ের কেবিনের ভেতর প্রবেশ করলো মাইসারা! ভদ্রমহিলা তখন নিশ্চুপ! দু’চোখ তার বন্ধ নয়, তবে দৃষ্টিও দরজার দিকে নয়! তিনি একদৃষ্টে জানালার ফাঁক দিয়ে খোলা আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ছুটে চলা দেখছেন। হসপিটালের এডমিট হয়েছেন এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে সময়ে শরীর উন্নতির দিকে না এগিয়ে অবনতির দিকে প্রবলভাবে ধা’বিত হয়েছে। মস্তিষ্কে প্রচুর চাপ পড়েছে তার কারণ গত সপ্তাহেই মা’রাত্মক স্ট্রোক হয়েছিল তার। সেই স্ট্রোকে হাত-পা প্যারালাই’জড হয়ে গেছে! কণ্ঠস্বর থেমে গেছে শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ না জবাবটাই দিতে পারেন! নাকের মধ্যে একটা নল ব্যবহার করা হয়েছে এবং নলের সাহায্যেই তরল খাবার খেতে পারেন তিনি। কর্তব্যরত নার্স নয়তো মাশফি এই দু’জনেই খাওয়ানোর দিকটা ভালোমতো নোটিশ করেন!

আধশোয়া হয়ে বেডে ছিলেন তিনি। গুটি গুটি পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। একটা স্নিগ্ধ, ঝলমলে আলোর মতো স্বচ্ছ, মায়াবী মুখটা চোখে পড়লো তার! ফ্যালফ্যাল করে গভীর দৃষ্টিতে সেই মুখবয়বখানি দেখলেন। মাশফির কাছে শুধু ছবিই দেখেছেন। সেই পনেরো বছর আগের নিষ্পাপ চেহারাখানি চোখে ভাসলো তার। চেহারায় কিঞ্চিৎ পার্থক্য টের পেলেন। আগে বাচ্চা ছিল এখন যুবতী! তার চোখদুটো টকটকে লাল! বুঝতে পারলেন, অভিমানী মেয়েটা কেঁদে বুক ভাসিয়েছে তবু মায়ের কাছে ছুটে আসতে পারেনি! হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকবেন সেই শক্তিটুকুও আজ তার নেই। মাত্র এক সপ্তাহে জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে এটা ভেবেই দমব’ন্ধ অনুভূতির মুখোমুখি দাঁড়ালেন। মাইসারা চুপচাপ বেডের পাশে বসলো! কোনো কথা বললো না! কয়েক মিনিট বসে থেকে ডানহাতটা শক্ত করে ধরলো! টের পেল, মায়ের হাতের শক্তিটা অনুপস্থিত! তখন মাশফি ভেতরে প্রবেশ করলো! ভাইয়ের দিকে তাকাতেই মাইসারা ছোট্ট শব্দে উচ্চারণ করলো,

-“প্যারালাই’জড!”

মাশফি উপরনিচ মাথা নাড়লো! ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নিল মাইসারা! মায়ের হাতটা টে’নে গালে স্পর্শ করালো! বলল,

-“তুমি কাছে ডাকলে আমি নিশ্চয়ই ছুটে আসতাম মা! কেন ডাকোনি?”

আঞ্জুমান আরা জবাব দিতে পারলেন না। প্রতুত্তরে শুধু চোখের পানি ফেললেন। মাইসারা হাতের স্পর্শে মায়ের চোখের পানি মুছে দিল। দু’হাতে জড়িয়ে বুকে মাথা রাখলো। বলল,

-“একদম চিন্তা করো না। তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। আমরা আরও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। প্রয়োজনে থে’রাপির ব্যবস্থাও করবো!”

বোনের কথা শুনে মাশফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবিনের বাইরে চলে গেল! এই এক সপ্তাহে সে অনেক ছোটাছুটি করেছে। তার বাবা, মামা কোনো হসপিটাল বাদ রাখেননি। এমনকি সিলেটের দামী হসপিটালেও উন্নত মানের ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করেছেন তবুও লাভ হয়নি! থেরাপিতে হাত-পা সচল হওয়ার কথা অথচ সেসব কিছুই হয়নি! উলটে শরীর দিনদিন দুর্বল হচ্ছে, খাওয়া-দাওয়া কমে যাচ্ছে! শুধু জুস, দুধ খেয়েই দিন কাটাচ্ছেন তিনি। প্রথম যখন স্ট্রোক হয় তখনই হসপিটালে নিয়ে আসা হয়, এখানকার ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সিলেটে রেফার করে দেন। যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেও দ্বিতীয়বার স্ট্রোক হয়! একসঙ্গে দু’বার শরীর এই ঝাঁ’কু’নি সামলাতে পারেনি। রিকোভার না করে শেষমেশ প্যারালা’ইজড হয়ে যায়! ডাক্তার তখনই বলে দিয়েছেন, এভাবে যতদিন তিনি বেঁচে থাকেন, সেভাবেই সব চলুক।

*****

রাত তখন দুটো! মাইসারা মায়ের পাশেই বসে আছে! তিনি এখন ঘুমাচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগেই অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ঘুম পাড়াতে পেরেছে সে। মেয়েকে কাছে পেয়ে ঘুম দূরে ঠে’ল’তে চেয়েছেন কিন্তু অসুস্থ দেখে জো’র করে মাইসারাই তাকে ঘুমাতে বললো। মাশফির বাবা এসে একবার দেখে গেছেন মাঝখানে তবে মাইসারার সাথে কথা হয়নি! যে লোকটা তার থেকে তার শেষ আশ্রয় কে’ড়ে নিয়েছে সেই লোকের সাথে কোনো কথা থাকতে পারে না! আলগোছে একপাশে সরে পড়েছিল সে। ভদ্রলোক ডাক্তারের সাথে টুকটাক কথা বলে চলে গেছেন। হাসপাতালে এখন শুধু তারা দুই ভাই-বোন! অনিককে রাতেই বাড়ি চলে যেতে বলেছে সে। যদিও অনিক থাকতে চেয়েছিল! অসুস্থ রোগীকে ফেলে যেতে মন সায় দিচ্ছিলো না তার। তবুও অযথা ভিড় এড়াতে চলে যায় সে। যাওয়ার আগে কয়েক মিনিট আঞ্জুমান আরা’র পাশে বসে যায়!

তিনি হয়তো কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয়নি! যতদিন তিনি ওই বাড়িতে ছিলেন, ততদিন অনিকের কাছে তার ছোটো মা হিসেবেই ছিলেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে অনিকও আর ছোটো মা বলে ডাকে না। আন্টি বলেই সম্বোধন করে! সেদিনই তিনি বুঝলেন, শুধু মেয়ে হা’রাননি! আরেকটা ছেলেও হা’রিয়ে ফেলেছেন। এই আফসোস, অনুশোচনা আর দুঃশ্চিতার ভা’রে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এছাড়াও তার হাই প্রেশার, ডায়বেটিস এর সমস্যা ছিল বেশি। যার ফলে তিনি বছরের বেশিরভাগ সময়েই অসুস্থ থাকতেন! পারিবারিক সব সুখ পেলেও শারিরীক এবং মানসিক অসুস্থতা তাকে কা’বু করে ফেলে। দিনশেষে তবুও তিনি কোথাও অসুখী ছিলেন! তার সামান্য সিদ্ধান্তে মেয়েটা বাবার পাশাপাশি মায়ের স্নেহ-মায়া থেকে বঞ্চিত হলো! এই বোধটাই তাকে দ্বিগুণ অসুস্থ করে তুললো।

ফজরের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘুম ভে’ঙে যায় আঞ্জুমান আরা’র। চোখ মেলে দেখলেন কেবিনের অন্য বেডে মাশফি আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। পাশ ফিরে তাকাতেই চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। জায়নামাজে বসে একমনে প্রার্থনা করছে মাইসারা। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিটা বুঝিয়ে দিচ্ছে কতখানি আকুল হয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে মায়ের জীবন ভিক্ষা চাইছে সে। কিছুক্ষণ আগেই সবগুলো রিপোর্ট দেখিয়েছে মাশফি! তাতেই মাইসারা বুঝে গেছে, ডাক্তারদের হাল ছেড়ে দেওয়ার কারণ! তবুও একজন আছেন, যার উপর জীবন মৃ’ত্যুর ভা’র ঠে’লে দেয়া যায়। একমাত্র তিনিই পারেন, জীবন দিতে এবং জীবন নিতে!

মায়ের দিকে চোখ পড়তেই কাছে আসলো মাশফি! মাইসারাও মোনাজাত শেষ করে পাশে এসে বসলো! কিছু খেতে চান কিনা জানতে চাইলো সে। তিনি মাথা নাড়লেন। খাবারের জন্য দুধ তৈরী করে আনতেই দু’দিকে মাথা নাড়লেন তিনি! দুধ খাবেন না বুঝালেন! ইশারায় পানির বোতলটা দেখালেন! মাইসারা সেটাই তুলে আনলো। নলের মুখে অল্প অল্প পানি ঢেলে খাওয়ানোর চেষ্টা করলো! পানি পান করা শেষে কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।

আচমকাই অস্বস্তি শুরু হলো তার! চোখদুটো বড়ো বড়ো করে ঠোঁট নাড়াতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না! মায়ের এই অবস্থা দেখে মাশফি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল ডাক্তারের কাছে! সার্জারীর পেশেন্টের জন্য রাতে এই হসপিটালে কয়েকজন ডাক্তার নিয়মিত থাকেন। তাই রোগীদের অসুবিধা দেখলে ছুটে আসতে দেরী হয় না তাদের! মাইসারা দু’হাতে মা’কে ধরে রাখলো। জানতে চাইলো,

-“কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার বলো!”

এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে চরম অসহায় অনুভব করলো সে! মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই চোখ উ’ল্টিয়ে শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিলেন তিনি! ততক্ষণে ডাক্তার নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছে মাশফি! স্টেথোস্কোপ দিয়ে চেক করে দেখলেন হৃদপিণ্ড তার স্পন্দন থামিয়ে দিয়েছে! নাকের কাছে হাত রেখে শ্বাস-প্রশ্বাসের আনাগোনা অনুভব করার চেষ্টা করলেন! সেখানেও ব্যর্থতা টের পেয়ে দু’দিকে মাথা নেড়ে উলটে যাওয়া চোখদুটো হাত দিয়ে বন্ধ করলেন! বললেন,

-“সি ইজ নো মোর!”

স্তব্ধ, নীরব কেবিনটায় শোকের মাতম ছড়িয়ে পড়লো! চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে মাইসারা কিন্তু গলা দিয়ে সেই জোরটাও আসছে না। নীরবে ঠোঁট চেপে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের মৃ’তদেহটা বেডে শুইয়ে দিল! বেডশিট টেনে মুখ ঢেকে দিল! পরমুহূর্তে ভাই-বোন একে-অন্যকে জড়িয়ে কান্নায় বুক ভাসালো!

*****

আঞ্জুমান আরা’র মৃতদেহ যখন অ্যাম্বুলে’ন্সে তোলা হলো তখন হসপিটালে সিঁড়ির একপাশের দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নীরবে অশ্রু বি’সর্জন দিচ্ছে মাইসারা! মায়ের জন্য এতগুলো বছর কেঁদেছে, সব লুকানো একাকী, নিঃসঙ্গ মুহূর্তের কান্না ছিল! কেউ সে কান্না কোনোদিন দেখেনি, বুঝেনি। মা হা’রা’নো মেয়ের হৃদয়ের আর্ত’নাদ কতখানি তীব্র কেউ খোঁজ নেয়নি। অবুঝ বয়স থেকে কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার দিয়ে কান্নার আওয়াজটা আর আসে না। নীরব কান্নাতেই বেদনার গাঢ় মুহূর্ত উপলব্ধি হয়! মুখ ফুটে বলা যায় না, আবার সহ্য করাও যায় না। এই নীরব কান্নার নীরব আকুতি অনিকের দৃষ্টিকেও স্তব্ধ করে দিয়েছে! সিঁড়ির অন্যপাশে বসে মাইসারার কাঁধে হাত রাখলো অনিক। বলল,

-“ওনাদের সঙ্গে যাবি?”

মাইসারা দু’দিকে মাথা নাড়লো। বলল,

-“আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও! ওখানে গেলে দমব’ন্ধ হয়ে যাবে আমার।”

লা’শ অ্যাম্বুলে’ন্সে তোলার পর মাশফির বাবা মাইসারার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাত জো’র করে বললেন,

-“তোমার মা’কে ক্ষমা করে দিও। হয়তো তিনি তোমার কাছে অপরা’ধী! তুমি চাইলে আমি তোমার দায়িত্ব নিতে পারি। তোমরা দুই ভাই-বোন একসঙ্গে থাকবে! যাবে, মা?”

মাইসারা আবারও দু’দিকে মাথা নাড়লো! সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের হাত দু’খানি ধরে বলল,

-“আমার কারও উপর কোনো অভি’যোগ নেই! অভি’যোগটা সময়ের উপর! আমার অতীতের সময়টা আমার সঙ্গে ছিল না, আমার সাথে বেঈমানী করেছে, মায়ের সাথে বেঈমানী করেছে। অভিমান যা ছিল, তা মুছে গেছে। মাঝেমধ্যে মা’য়ের কব’র জেয়ারত করতে চাচ্চুকে নিয়ে যাব! তখন তাড়িয়ে দিবেন না আমাদের! ভাইয়ের সাথে তো দেখা এমনিতেও হবে। তার আর আমার সম্পর্ক যেমন ছিল তেমনি থাকবে! ভালো থাকবেন!”

ভদ্রলোক মাইসারার মাথায় বুলিয়ে দিলেন। বললেন,

-“তোমার যখন মন চায় যেও! শুধু কোনো অভি’যোগ রেখো না মা।”

বিদায় নিয়ে অ্যাম্বুলে’ন্সে উঠলেন তিনি! মাশফি তখনো ভেতরে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে! তার সে কান্নায় মাইসারারও অন্তর পু’ড়ছে কিন্তু কোথাও সে আট’কে আছে। চাইলেও সম্পর্ককে সহজ ভেবে কাছে যেতে পারছে না। হয়তো অভিমানটা যেমন ছিল, তেমনি রয়ে গেছে! অ্যাম্বুলে’ন্সের সামনে গিয়ে মাশফির সামনে দাঁড়ালো অনিক। বলল,

-“জানা’যার সময়টা জানিয়ে দিও! আমি বাবাকে সাথে নিয়ে আসবো!”

মাশফি মাথা নাড়লো! মায়ের মৃতদেহকে বিদায় দিয়ে অনিকের সঙ্গে বাড়ির পথে রওনা দিল মাইসারা! মৃ’ত্যু’র খবর শুনে এক মিনিটও অপেক্ষা করেনি সে। ফুল স্পীডে বাইক চালিয়ে ছুটে এসেছে! চাবি ঢুকিয়ে মাইসারার দিকে তাকালো অনিক। স্পষ্ট বুঝা গেল, এই বাইকে উঠতে ভয় পাচ্ছে সে। পুরনো দিনের কথাটা দু’চোখে ভেসে উঠলো তার। তার ভেতরটা আন্দাজ করতে পেরে হেলমেট বাড়িয়ে দিল। বলল,

-“তখন নতুন নতুন বাইক চালানো শিখেছিলাম। তাই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। এখন আর ভয় নেই! তোকে একা তো ছাড়তে পারবো না। শেষ একবার ভরসা কর!”

মাইসারা জবাব দিল না। হেলমেটটা মাথায় সেট করে ধীরেসুস্থে বাইকে উঠলো। পিছনের ক্যারিয়ার শক্ত করে ধরে বসলো! বলল,

-“ভাঙাচো’রা গাড়ি দিয়ে একবার মাথা ফা’টিয়েছো! এজন্যই ভয় হয়! তোমার এই নড়বড়ে বাইক চড়ে আবার না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে!”

-“বললাম তো শেষ বারের মতো ভরসা কর! আর এমন কিছু হবে না।”

মুখে কোনো জবাব দিল না মাইসারা তবে মনে মনে ঠিকই ভরসার শেষ আশ্রয় হিসেবে এই মানুষটাকেই বেছে নিয়েছে মন! যার সাহায্যে সে এতদূর এগিয়ে এসেছে, তাকে ভরসা না করলে আর কাকে ভরসা করবে সে!

*****
চলবে,,

মনোহারিণী পর্ব-০১+০২

0

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (১)+(২)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

-“আমি সময়মতো পৌঁছে যাব চাচ্চু! তুমি অযথা টেনশন করো না। স্টেশনে কাউকে পাঠিয়ে দিও!”

আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের বিয়েসাদীর অনুষ্ঠানে খুব একটা আয়োজন করে যাওয়া হয় না মাইসারা’র। জমকালো অনুষ্ঠান, বাদ্য-বাজনা, মানুষের ভিড় ঠে’লাঠে’লি এসব অকারণ ঝামেলা মনে হয় তার কাছে। অথচ তার বড়ো চাচ্চু খুব করে তাকে এই আয়োজনে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। শত হলেও ছোটো ভাইয়ের একমাত্র ওয়ারিশ সে। বাড়ির একটা অনুষ্ঠানে থাকবে না, সেটা তো হয়ই না। লোকে শুনলে তো পাঁচ কথা শুনাবে। অথচ তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই বাড়িতে যাওয়ার। একে তো পড়াশোনার চাপ, তার উপর ইন্টার্নশিপ কোর্স! এই মুহূর্তে ছুটি নেওয়াটাও খুব ঝুঁকির হয়ে গেছে তার জন্য। তবুও কিছু করার নেই। কাজিনের বিয়ে খাওয়ার ঝামেলায় বেশিদিন জড়ালেই পড়াশোনায় ঘা’প’লা মা’রবে নিশ্চিত। এতটা পথ অতিক্রম করে শেষে এসে থেমে যাওয়ার পাত্রী সে নয়! এজন্যই মন খুঁতখুঁত করছে তার। সেই সকাল থেকে গড়িমসি করে নিজের ব্যাগপত্র গুছাতে শুরু করে সে। অবিরত ফোনের আওয়াজ তাকে যথেষ্ট বিরক্ত করছিল, তাছাড়া বাবা-মা কেউ-ই নেই! শুধু নেই নয়, বেঁচে থেকেও ওনারা তার কাছে মৃ’ত হয়েই আছেন! অথচ তারা থাকা সত্ত্বেও মাইসারার পুরো দায়িত্বটাই আরমান সাহেব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। অন্তত মুরব্বি মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু তো ছাড় দেয়াই যায়। এজন্যই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। সোজা জানিয়ে দিয়েছে, মাত্র এক সপ্তাহ থাকবে সেখানে, ওয়ালিমা শেষে যথারীতি হোস্টেলে ফিরে আসবে। এসব ঝামেলায় তার বেশি না জড়ানোই উচিত। শেষে নিজেকে গড়ে তোলার সঠিক লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাবে।

এক সপ্তাহের জন্য যাবে, এজন্যই বেছে বেছে চার-পাঁচটে জামা ব্যাগে ঢুকিয়েছে মাইসারা। সবকিছু চেক করে রুমমেট রিপার থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনে চলে আসলো। কাউন্টার থেকে পারাবাত ট্রেনের একটা টিকিট কে’টে নিল। ট্রেন আসলো খানিকক্ষণ পরই। তাতে আরোহন করে নিজের সিট খুঁজে নিল। ব্যাগ উপরে রেখে সিটে বসে আরমান মাহমুদকে জানিয়ে দিল, সে ফিরছে! ভদ্রলোকের খুশি আর ধরে না। কতদিন হলো মেয়েটাকে দেখেননি। হাতে তুলে খাবার খাইয়ে দেননি! অবশেষে মেয়েটা তার বাড়ি ফিরছে, এই আনন্দ কীভাবে প্রকাশ করবেন তিনি ভেবে পাচ্ছেন না! ফোন রেখে দ্রুত বাড়ির বাইরে চোখ বুলালেন।

ছেলে-মেয়েদের মধ্যে একজনকেও বাড়ির আঙিনায় দেখা গেল না। কোনদিকে যে পালিয়েছে সবক’টা কে জানে! বাড়ির পুরো আঙিনা খুঁজতে খুঁজতে পুকুরপাড়ে আসলেন। সেখানেই বড়শী হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে মাছ তোলায় ব্যস্ত আছে অনিক! যদিও ব্যাংকের সবাই তাকে ইমতেহান মাহমুদ হিসেবেই চিনে। আত্মীয়স্বজন আর পরিবারের লোকেরা অনিক নামেই ডাকে। ছেলেকে দেখে একপ্রকার চিৎকার করে বললেন,

-“মাছ যখন তুলছিস, বড়ো দেখে রুই, কাতলা তুলিস। কতদিন পর সারা বাড়ি আসছে! হোস্টেলে ডালভাত খেয়ে বাচ্চাটার দিন যাচ্ছে। মুখ ফুটে বলেও না, চাচ্চু আমি এখানকার খাবার খেতে পারছি না। তুই তো পারিস, মেয়েটার একটু খেয়াল রাখতে! সারাদিন কী এমন হালের ব’ল’দ টানিস যে, আমার একমাত্র ভাতিজীর কোনো খোঁজখবরই রাখিস না? বিয়ে করে বউ পালতে পারবি তো বাপ?”

-“বিয়ের জন্য আমি পা’গ’ল হইনি। যা পা’গ’লা’মি করার তোমরা করছো। আর শোনো, তোমার ভাতিজী কচি খুকি না যে ডালভাত হজমে তার অসুবিধা হবে! স্বপ্ন পূরণের জন্য হোস্টেলে যেতে হয়েছে তাকে, কেউ ঠেলে পাঠায়নি। বিয়ের জন্য কি দেরী করলে হতো না? ওর পড়াশোনায় চা’প দেয়ার দরকার ছিল না। কী এক লাফঝাঁপ শুরু করেছো তোমরা!”

অনিকের চেহারায় কোনো হেলদোল নেই। গাম্ভীর্য ধরে রেখে কথা বললেও বাবার দিকে ফিরেও তাকায়নি সে! বড়শীর দিকে তাকিয়ে বাবাকে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে একমনে। আরমান সাহেব খানিকটা বিরক্তই হলেন। বললেন,

-“অক’র্মার ঢেঁ’কি একেকটা! একটা সন্তানও যদি ঠিকঠাক মানুষ হোক। সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বলি, মেয়েটা আমার বা’নের জলে ভে’সে যাচ্ছে না যে, তোমরা তাকে এইভাবে অবহেলা করছো!”

-“বাবা, কী বা’জে কথা বলছো তুমি! কে সারাকে অবহেলা করে বলো তো? বাড়ির সবাই-ই যথেষ্ট ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে, নয়তো কবেই ভেসে যেত!”

-“আগলে রাখলে কীসের জন্য বাড়ি ছেড়েছে সে? তাছাড়া বড়ো বউমাও তো ভালো ব্যবহার করছে না তার সাথে!”

ভাইয়ের বউ সম্পর্কে একটাও বা’জে কথা বলা কিংবা তড়িৎ সেকথা নিয়ে কোনো আলাপ তোলার আগ্রহ পেল না অনিক! একবার যদি ব্যাপারটা ফারজানার কানে যায় তবে আর রক্ষে নেই! তাছাড়া আলিফও জানে না নিজের স্ত্রীর এই বা’জে স্বভাবের কথা। শেষে দু’দিন খুশিতে কাটানোর বদলে চোখের জলকে সঙ্গী করেই কাটবে মাইসারা’র। আপাতত মুখ কুলুপ এঁটে বসে থাকাই শ্রেয়! তবুও কথা ঘুরাতে বলল,

-“বাবা একটু বুঝো, সারা মেডিক্যালের স্টুডেন্ট। কতটা চাপ ওর উপর। ঠিকমতো পড়াশোনা না করলে ভালো ডাক্তার হতে পারবে না। আমাদের গ্রামের যা অবস্থা, তাতে প্রতি ঘরে ঘরে ভালো একজন ডাক্তার দরকার। ভেবে দেখো, এখানে থাকলে ওর পড়াশোনায় অনেক ঝামেলা হতো। না নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারতো, আর না সফলতাকে আঁকড়ে ধরার জন্য সহজ পথ খুঁজে পেত!”

আরমান সাহেব আর কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। আসলেই তাই! গ্রামের যা পরিবেশ, তাতে এখানে থেকে ওতো দূরে রোজ যাতায়াত করা অনেক কঠিন হয়ে যেত মাইসারা’র জন্য। তাই তার স্বপ্ন পূরণের পথকে সহজ করতেই অনিক তাকে দূরে পাঠিয়েছে। এমন না যে, সে মাইসারার খোঁজখবর নেয় না। মাঝেমধ্যে ফোন করে যখন যা প্রয়োজন সেটা তো সে-ই পাঠায়। আরমান সাহেব আদৌ কি সে খবর জানেন?

*****

মাইসারা স্টেশনে নেমেই চারপাশের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ দেখে চমৎকার করে হাসলো! ট্রেনের বগি থেকে কাঁধে ব্যাগটা ঝুলাতেই ত্বোয়া দু’হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। এই মেয়েটা তার বোন কম বন্ধু বেশি! বয়সের পার্থক্য হলেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণটাই বেশি। একসাথে যত মজার স্মৃতি আছে, দুঃখ এবং সুখের স্মৃতি আছে সবই এই ত্বোয়ার সাথেই! কাঁধের ব্যাগটা টে’নে নিজের কাছেই আনলো সে। বলল,

-“অবশেষে তুই আসলি! বাড়িটা কত ফাঁকা লাগে জানিস? মা চলে যাওয়ার পর থেকে ভাবীটাও পর হয়ে গেছে! কত যে কথা শোনায় রোজ! থাক ওসব কথা, ভালো আছিস তো? পড়াশোনা ঠিকঠাক চলছে?”

মাইসারা ম্লানমুখে হাসি ফুটালো! বাড়ি থেকে হোস্টেলে যাওয়াতে ভালোই হয়েছে বোধহয়! নয়তো রোজ ক’টুভাষীর ক’টুকথায় কান পঁচে যেত তার। শুধু যে কান পঁচতো তা নয়, মন নষ্ট হতো! মস্তিষ্ক চাপ নিতে নিতে দুর্বল হয়ে যেত। এত কষ্টের পড়াশোনা তার, স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই ভে’ঙে যেত। হাঁটতে হাঁটতেই স্টেশনের সীমানা পেরিয়ে মূল গেটের কাছে আসলো। বলল,

-“আমি তো ভালো আছি! তোর পড়াশোনার কী খবর? এবার তো ছোটো ভাইয়াও সংসারী হয়ে যাবে। শুধু তুই-ই পড়ে থাকবি!”

-“তুই বুঝি সারাজীবন আইবুড়ো থাকবি? আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, আমি তোকে চিরদিনের জন্য বাড়িতেই রেখে দিতাম! এই ঘর-সংসার এক নায়ক তন্ত্রের হাতে চলে গেছে! তার ইচ্ছেতেই সব! জানি না, ছোটো ভাইয়া এই বিয়েতে সুখী হবে কিনা! তবে খুব করে চাই, ছোটো ভাইয়া সুখী হোক!”

তখনই অনিক এসে সামনে দাঁড়ালো। ত্বোয়া চমকে গিয়ে কথা মাঝখানে থামিয়ে দিল! ব্যাগটা গাড়িতে তুলে মাইসারার দিকে তাকালো সে। চোখমুখের মলিনতা টের পেয়ে বলল,

-“কী রে, মুখ ওমন শুকনো লাগছে কেন? খাওয়া-দাওয়া করিস না? নাকি বরের শো’কে কা’ত’র হয়ে দেবদাসের পারবতী সাজার পণ করেছিস?”

হাস্যরসের এমন কথা শুনে খিলখিল করে হাসলো মাইসারা! আগ বাড়িয়ে অনিকের কাঁধে চিমটি দিয়ে বসলো! ব্যথায় সামান্য আর্তনাদ করলো অনিক। বলল,

-“গায়ে তো শক্তি ঠিকই আছে। তবে মুখ এমন রসকষহীন কেন তোর? শোন, সারাক্ষণ হাসবি। যেন বাবা টের না পায় যে, তাঁর ভাতিজী কোনো না কোনোভাবে মনের ভেতর ভারি চাপ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে! আর একটা কথা শুনে রাখ, যাই হয়ে যাক নিজের স্বপ্ন পূরণের পথ থেকে এক’পা-ও পিছাবি না। কথাটা মাথায় রেখে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর!”

মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে মাইসারাকে। আইটেম, কার্ড, টার্ম, প্রফ ( প্রফেশনাল এক্সাম)। আইটেম হলো ক্লাস টেস্ট টাইপের পরীক্ষা। মূলত মৌখিক পরীক্ষা। আইটেম পাশ করার কতগুলো আইটেমের পড়া নিয়ে কার্ড হয়। কার্ড এ উত্তীর্ণ হওয়ার পর টার্ম, যেখানে রিটেন, ভাইভা, প্র‍্যাক্টিক্যাল সবই ছিল। সব গুলো টার্ম উত্তীর্ণ হওয়ার পর আসলো পেশাগত বা প্রফেশনাল পরীক্ষা। পেশাগত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে একজন মেডিকেল স্টুডেন্টের জন্য পরের ইয়ারে উত্তীর্ণ হওয়া সহজ। এমবিবিএস এর এই পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করে এখন ইন্টার্নিশিপ কোর্স করছে সে। এই কোর্সটাতে পুরোপুরিভাবে উত্তীর্ণ হতে পারলে অধরা স্বপ্ন দু’হাতের মুঠোয় চলে আসবে তার। এতটা পথ এগিয়ে আসার পিছনে একমাত্র ভরসা ছিল অনিক। প্রতি পদে পদে অনিকের সহযোগিতাই তাকে এই অবধি নিয়ে এসেছে। তবে এখানে তার মেধাও ছিল প্রখর। যার জন্য শত আ’ঘা’তেও দমে যায়নি মাইসারা।

পুরো বাড়িতে সবার থেকে এই মানুষটাই তাকে সব বিষয়ে সাপোর্ট করে! এমন দায়িত্বশীল পুরুষ আজকাল চোখে দেখা যায় না। কতদিকে নজর তার! বিয়ে করে যখন বউয়ের আঁচল খুঁজে পাবে তখন কি সে একইভাবে মাইসারা’র খেয়াল রাখবে? নাকি পর করে দিবে চিরদিনের জন্য? উত্তর জানা নেই তার, শুধু জানে স্বপ্ন পূরণের পথে এই মানুষটার মতো ভরসা আর সহানুভূতি দেখানোর কেউ নেই! তবে কি তার স্বপ্নগুলো অধরাই দেখে যাবে? পূর্ণতা পাবে না? বিয়ে করলে যে সব পুরুষ পর হয়ে যায়! যেমনটা পর হয়েছে আলিফ, তেমনটা যদি অনিকের বেলায়ও হয়! তবে? অন্তহীন এই ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল মাইসারা! সম্বিত ফিরে পেল অনিকের ডাকে।

-“কী রে, ওঠ গাড়িতে। বাবা অপেক্ষা করছে তোর জন্য!”

-“আসছি!”

এইটুকু বলে চোখের কোণে আসা পানিটা যত্ন করে মুছে নিল মাইসারা! পিছনে বসে ত্বোয়ার সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করলো! অযাচিত যত চিন্তাভাবনা আসছে মনের গোপন কুঠরিতে, সবকিছুকে দুরেই ঠে’লে দিল। মনে মনে বিড়বিড় করলো,

-“আমার জন্য আর কোনো চা’প নিতে হবে না কাউকে! এবার থেকে নিজের জন্য নাহয় নিজেই ভাববো!”

যাকে তার বাবা-মা একাকী ফেলে চলে গেছে, তাকে আগলে নিয়ে কত চা’পের মুখের পড়েছে অনিক সেটা মাইসার’র অজানা নয়! তবুও ভয় হয়, জীবনে একাকী বাঁচা, একাকী স্বপ্ন পূরণের পথে এগোনো অনেক কঠিন! সে এখনি টের পাচ্ছে, অধরা স্বপ্ন দূর থেকেই তাকে ডাকছে। কাছে ভিড়ছে না। হয়তো ভিড়বেও না। সবার সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। কিছু স্বপ্ন অজীবন অপূর্ণ থেকে যায়। হয়তো তার বেলায়ও এমনটাই ঘটবে। স্বপ্নগুলো অপূর্ণই থাকবে। তবুও সে চেষ্টা করবে। আত্মসম্মান নিয়ে নিজেকে গড়ে তোলার কঠিন পথে একাকী নামবে! ডাক্তার যে তাকে হতেই হবে!

*****

-“কেমন আছো ভাবী?”

হাসিমাখা মুখে প্রশ্ন করলো মাইসারা। বাড়িতে পা রাখতেই ফারজানা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো তার দিকে। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে, চুলে খোঁপা বেঁধে পুরো ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলো সে। অনিক তখনো পা রাখেনি সেখানে। ভাড়া মেটাতেই পিছনে পড়ে গেছে বেচারা। ত্বোয়া যখন মাইসারাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো তখনই হাতের কাজ থামিয়ে দিল সে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালোমতো দেখে বলল,

-“দিন দিন তুই খুব মুটিয়ে যাচ্ছিসরে! কম করে খেতে পারিস না? যা ফ্রেশ হো জলদি। বাড়িতে কত কাজ জমেছে জানিস? ভালোই হয়েছে তুই এসেছিস, বিয়েসাদীর ঝা’মে’লা ওসব আমি একা সামলাতে হিমশিম খেতাম খুব। ওমা, হা করে দেখছিস কী! যা…! কানে কি তালা দিয়েছিস?”

নীরবে তাকিয়ে রইলো মাইসারা। কোনো জবাব দিল না। ত্বোয়া আলতো করে তার হাতে চাপ দিয়ে দু’দিকে মাথা নাড়লো। মাইসারা চুপ থাকতে না পেরে ফের হেসে বলল,

-“তোমার কাজের চাপ কমানোর জন্য দ্বিতীয়জন তো আসছেই ভাবী! দুই জা মিলে সবকিছু সামলে রাখবে! এমনিতেও আমি এ ঘরের বাড়তি লোক! মাস ছ’য়েক পরে আসি, ক’টা নিন্দেমন্দ হ’জ’ম করে দু’চার দিন অতিবাহিত করি! এরপর আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাই। কী করবো বলো, যাওয়ার তো জায়গা নেই। অপমান করো, লা’তি মা’রো, ঘুরেফিরে আমাকে তো সেই এখানেই আসতে হবে। নয়তো চাচ্চু কেঁদে বুক ভাসাবে। নেহাৎ মুরব্বি মানুষটার মুখের উপর না বলতে পারি না…!”

এইটুকু বলেই থেমে গেল মাইসারা। ত্বোয়া মুখ টিপে হাসলো। দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে অনিকের কাছ থেকে নিজের ব্যাগটা এনে রুমের দিকে এগোলো। তখন পিছন থেকে ফারজানা আবারও বলল,

-“ভালোই কথা শিখেছিস দেখছি! মুখে মুখে ত’র্ক করিস! আলিফ যদি এসব বেয়া’দবি শুনে..!”

-“আমিও বলবো, রাতবিরেতে তুমি কী করো!”

পালটা হেসে জবাব দিল মাইসারা। ফারজানা ঢুক গিলে ভীতিগ্রস্ত চোখে তাকালো। তবুও নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ পেতে দিল না। উলটে মেজাজ ধরে রেখে বলল,

-“ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

-“কেন? আমার ঘরে!”

-“ওখানে আমার ভাই থাকবে। আমি ওর জন্যই রুমটা গুছিয়েছি! তুই বরং ত্বোয়ার রুমটা শেয়ার করেনে। আছিস তো মাত্র এক সপ্তাহ। মানাতে খুব একটা অসুবিধা হবে না!”

অনিক ততক্ষণে নিজের রুমে চলে গেছে তাই এই দু’জনের কথা কা’টা’কা’টির দৃশ্যটা তার চোখ এড়িয়ে গেছে। দরজার সামনে থেকে ফিরে আসলো মাইসারা! বলল,

-“আমার অনুমতি না নিয়ে, তুমি কীভাবে আমার রুমে অন্য কাউকে জায়গা দেয়ার কথা ভাবতে পারো? আগামী এক সপ্তাহ আমি ওই রুমেই থাকবো। তুমি তোমার ভাইকে কোলে নিয়ে বসে থাকো, নয়তো যা খুশি তাই করো, আমার তাতে কী!”

দায়সারাভাবে জবাব দিল মাইসারা। ব্যাগ হাতে নিয়ে ঝটপট নিজের রুমে ঢুকলো। পিছন থেকে ফারজানা রীতিমতো গ’র্জে উঠলো। বলল,

-“অতি বার বেরো না, ঝড়ে পড়ে যাবে। তোর অবস্থাও তেমন হয়েছে। আসুক আজ তোর ভাই, আমিও দেখে ছাড়বো তুই কীভাবে ওই রুমে থাকিস!”

অনেকদিন পর নিজের রুমে ঢুকে প্রশান্তি অনুভব করলো মাইসারা। চারপাশে হেঁটে হেঁটে রুমের ভেতরটা ভালো মতো দেখলো। ত্বোয়া পাশে থেকে বলল,

-“তুই একটু বিশ্রাম নে। আমি দেখি, দুপুরের খাবার হলো কী না!”

-“তুই কী করে হ’জ’ম করিস এসব? আমার তো ইচ্ছে করছে এক্ষুণি ওই দু’মুখো সা’পে’র মাথাটা অ’র্ধেক করে ফেলি! শুধু চাচ্চুর জন্য…!”

ত্বোয়া মৃদু হাসলো। বলল,

-“কিছুক্ষণ পেরোক, বুঝবি। কেন আমি হ’জ’ম করে পড়ে আছি! নিজের যদি সামর্থ্য থাকতো, এই বাসস্থান কবেই ত্যাগ করতাম।”

বলতে বলতে চোখের পানি মুছলো ত্বোয়া। শান্তস্বরে বলল,

-“তুই বেঁচে গেছিস হোস্টেলে থেকে। নয়তো প্রতিনিয়ত মেয়ে হওয়ার যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে হতো! নিজের ঘরেই আমরা স্বাধীনতা পাচ্ছি না, পরের ঘরে গেলে কী হবে সেটা ভেবেই দমব’ন্ধ লাগে সারা! বিশ্বাস কর, এই জীবনের যে এত যন্ত্র’ণা আগে জানলে মায়ের সাথে আমিও দুনিয়া ত্যাগ করতাম।”

রুম ছেড়ে বাইরে বের হয়ে গেল ত্বোয়া। মাইসারা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাপড়চোপড় গুছানো শুরু করলো। তখনই বাহির ছেড়ে হাঁক ছেড়ে আদরমাখা একটা ডাক ভেসে এলো! সেই ডাকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল সে। ডাকটা একাধারে ভেসে আসছিল, যা তাকে রীতিমতো দিশেহারা করে ফেলেছে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে। আরমান সাহেব আহ্লাদী কণ্ঠে আবারও ডাকলেন,

-“কই? আমার মা কোথায় গেল? বাড়ি এসে বুঝি মা তার সন্তান ভুলে যায়! সারা, ও মা কই গেলি! আয় দেখি একবার!”

ছোটো বাচ্চাদের মতো আদরের লোভে দ্রুত আরমান সাহেবের সামনে উপস্থিত হলো মাইসারা। দৌড়, আর খুশির আতিশয্যে এখনো তার হাত-পা মৃদু কাঁপছে! একছুটে ভরসার জায়গাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো সে। বুকের সাথে লেপটে থেকে বলল,

-“এইতো চাচ্চু আমি! তোমার কাছেই আছি।”

আরমান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন তিনি। কতদিন পর মেয়েটাকে চোখের সামনে দেখলেন। কিছুক্ষণ পর চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হলেন তিনি। বললেন,

-“কতদিন একসাথে খাওয়া না রে মা। আজ আমি তোকে নিজ হাতে খাইয়ে দিব! ওখানে খেতে খুব অসুবিধা হয় না? অনিকটা যে কী! কত করে বলি, তোর একটু খেয়াল রাখার জন্য! তাও কেমন গা’ছাড়া ভাব দেখিয়ে চলে!”

আরমান সাহেবের ভালোবাসার প্রখরতা টের পেয়ে প্রাপ্তির হাসি ফুটালো মাইসারা। বলল,

-“তুমি শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করো আমার জন্য। এত ভেবো না। জীবনে শ্রেষ্ঠ স্থানে আরোহন করতে হলে একটু স্ট্রাগল করতেই হবে! সব যদি হাত পাতলেই পেয়ে যাই, তবে যে দামী সম্পদটাও ফেলনা মনে হবে। সং’গ্রাম করে যদি অল্প হলেও প্রাপ্তি জুটে, তবে তাতেও সুখ আছে চাচ্চু!”

আরমান সাহেব হাসলেন। সময়ের স্রোতে কতগুলো বছর জীবন থেকে পেরিয়ে গেছে! সেই ছোট্ট মেয়েটা বুঝতে শিখেছে! জীবনের কঠিন মুহূর্তকে উপলব্ধি করতে শিখেছে! হয়তো এভাবেই একদিন স্বপ্ন পূরণের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাবে সে। পেয়ে যাবে তার আসল ঠিকানা! যেখানে শুধু তারই আধিপত্য বিস্তার হবে সর্বদা। যেখানে কেউ তাকে নিয়মের ক’ড়া শা’স’নে আটকে রেখে সীমা পরিসীমার ব্যাখ্যা বুঝাবে না। যেখানে সে পুরোটাই হবে স্বাধীন! মুক্ত! ঠিক ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা পাখির ন্যায়!

*****

চলবে…

❝মনোহারিণী❞
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
পর্ব : (২)

(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ!)

ছাদের একপাশে থাকা রঙবেরঙের ফুল গাছের পাশেই আচারের বৈয়ামগুলো রেখেছিল ত্বোয়া! যেকোনো ফলের সিজন আসলে নিত্য নতুন মশলা মিশিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের বিভিন্ন ফলের আচার তৈরী করে সে। একপাশের বৈয়ামে ছিল সাতকরা, আম এবং অড়বড়ইয়ের আচার। অন্যপাশে ছিল, বড়োই, জলপাই, লেবু ছাড়াও আরও অন্যান্য ফলের আচার। সাতকরার আচারটা মাইসারার ভীষণ রকমের পছন্দের। প্রতিবার এখানে আসলে ত্বোয়া দুটো করে বৈয়াম ধরিয়ে দেয় হাতে। হোস্টেলে বসে পড়ালেখার ফাঁকে বোনের এই জাদুর হাতে ছোঁয়া টক, ঝাল, মিষ্টি আচারের সাথে দারুণ সময় উপভোগ করে সে। এখনো সেটাই করছে। একটা বৈয়াম খুলে চামচ দিয়ে এক পিস বাহিরে টেনে এনে সেটা মুখের ভেতর নিয়ে উহুম শব্দ উচ্চারণে আচারের স্বাদটা প্রকাশ করছে। তখন ছাদের অন্যপাশে দাঁড়িয়ে হবু বউ নামিরার সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল অনিক!

বিয়েটা পারিবারিকভাবে ঠিকঠাক হলেও দু’জনে পূর্ব পরিচিত ছিল। তাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা না জন্মালেও বন্ধুত্বের একটা সুক্ষ্ম টান বিদ্যমান। যা একে-অন্যকে বুঝার পাশাপাশি দায়িত্ব, কর্তব্য পালনেও দক্ষতা বজায় রেখেছে। তাদের দু’জনার এক মিনিট কথা হলে দুই মিনিট ঝগড়া হয়! একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা করার পাশাপাশি ভাগ্যক্রমে একই ব্যাংকেই জব হয়ে যায় দু’জনার। সেই থেকে এদের বন্ডিংটা ভীষণরকম মজবুত। বিয়ে ঠিক হওয়ার আগে দু’জনে তুই বোধক সম্বোধনে অভ্যস্ত ছিল! এই ক’দিন ধরেই তুমিতে নেমে এসেছে তারা। বিয়ে বন্ধনটা যেমন সম্মানের সেখানে সম্বোধনটাও তেমনি হোক! দু’জন দু’জনকে তুইতোকারি করবে এটা ঠিক মানতে পারে না নামিরা। এজন্যই তাদের তুমিতে নেমে আসা! মাইসারার আচার খাওয়ার ভাবভঙ্গি দেখে সেদিকে দৃষ্টি ফেরালো অনিক। দূর থেকে তাকিয়ে মেয়েটার পা’গ’লা’মি দেখে মুচকি হাসলো। এখনও বাচ্চাই আছে। বড়ো হয়নি! ফোনে নামিরা কিছু বলছে, যা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে সে, কিন্তু দৃষ্টি তার অন্য এক জায়গায় থমকে গেছে!

তখন গোধূলির আকাশে সূর্যাস্তের শেষ সময়টা এসে উপস্থিত হয়েছে। ত্বোয়া বৈয়ামগুলো হাতে নিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছে অথচ মাইসারা ব্যস্ত আচার খাওয়াতে! পিছন দিকে আকাশের কিনারে ডুবে যাওয়া এক টুকরো সূর্যের অলোকছটা এসে হাসিমাখা মুখে উপস্থিত হলো। সেই আলোটা চোখে-মুখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্নিগ্ধ অথচ চঞ্চল এক হরিণীকে চোখের সামনে আবিষ্কার করলো অনিক! ফোন কানে রেখে বিড়বিড় করলো,

-“সর্বনাশ! এটা কী হলো!”

ওপাশে নামিরার গলার আওয়াজ থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর একরোখা কণ্ঠে বলল,

-“অনিক, তুমি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা!”

কিছুটা গম্ভীর অথচ তীক্ষ্ণ আওয়াজটা কানে আসতেই চোখের পলক ফেলে গভীর করে শ্বাস টানলো অনিক। বলল,

-“হ্যাঁ! বলো।”

-“কাল দেখা করবো তো আমরা? আসবে কিনা সেটা তো বললে না!”

-“আসবো। কখন আসতে হবে?”

-“বিকেলে! আমরা কিছু কেনাকাটা করবো আর জরুরী আলাপটাও সারবো।”

-“আচ্ছা!”

-“ত্বোয়া আর সারাকেও নিয়ে এসো।”

-“ওদেরকে আবার টে’নে নিব কেন? কাবাবের হা’ড্ডি একেকটা!”

খিলখিল করে হাসলো নামিরা! সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ যেভাবে হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে প্রেমিকার সাথে ডেটিংয়ে যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আটকাতে রগরগে মেজাজ ধরে রেখে কথা বলে, অনিকের কথাও অনেকটা সেরকমই শুনালো। মেয়েটার হাসি কানে আসাতেই নিজের অসহায় অবস্থা টের পেল অনিক! চোখমুখ কুঁচকে বলল,

-“রাখো তো ফোন! মেজাজটাই নষ্ট করে দিয়েছো!”

-“অনিইইইইক!”

আদুরে আওয়াজে হার্টবিট থামার জোগাড় হলো অনিকের। কণ্ঠ নামিয়ে বলল,

-“শুনছি তো বাবা!”

-“আসবে তো ওদের নিয়ে? প্লিজজজ…!”

-“আচ্ছা!”

-“থ্যাংক য়্যু সো মাচ্! লাভ য়্যু! টা টা।”

দিনে অসংখ্যবার এই মেয়ে লাভ য়্যু শব্দটা উচ্চারণ করে। আগেও এমন করতো। এখনও করে। আগামীতেও করবে এই বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই তার। নামিরা ফোন কেটে দিলেও অনিকের চেহারার যে আশ্চর্যের রেখা ফুটে উঠেছিল সেটা তখনো তার চোখেমুখে বিদ্যমান! দৃষ্টি স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ সে। মনের কোথাও গোপন ব্যথার হাজারও সুর এসে উপস্থিত হয়েছে। বিরহ, বেদনা ভর করেছে চারিপাশে। কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে তার সবকিছু! দুঃশ্চিন্তায় ভরা মাথা নিয়ে মাইসারার দিকে এগোলো সে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হাতের চামচটা কে’ড়ে নিয়ে বৈয়াম থেকে সাতকরার একটা পিস বের করে মুখে দিয়েই মুখটা হা হয়ে গেল তার। তড়িঘড়ি করে সেটা মুখ থেকে ফেলে চামচটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-“এই তেতো আচার খাচ্ছিস কী করে! মুখের ভাবভঙ্গি এমন যে, বহু সাধনার জিনিস পেটে ঢুকাচ্ছিস! অসুস্থ হয়ে পড়বি তো! রেখে দে আর খেতে হবে না!”

হাতের টানে বৈয়ামটা ত্বোয়ার হাতে ধরিয়ে দিল সে। মাইসারা পেট ফা’টা হাসি হাসতে গিয়েও থেমে গেল। অনিকের চিন্তিত চেহারা দেখে বলল,

-“ভাবী কী বললো?”

-“তোর সাথে দেখা করতে চায়!”

-“সত্যিই?”

-“হ্যাঁ! যাবি আগামীকাল বিকেলে?”

-“অবশ্যই! ত্বোয়াকে নিব?”

-“তোদের দু’জনকেই যেতে বলেছে!”

চিন্তিত চেহারায়ই জবাব দিল অনিক! মাইসারা খুশিতে হাস্যজ্বল কিশোরীর মতো দুরন্ত হয়ে গেল! ‘ইয়াহু’ বলে চিৎকার দিয়ে পুরো ছাদে দৌড়াতে শুরু করলো! ত্বোয়া হাসতে হাসতে নিচে নামলো। পিছনে অনিকও আসলো। ফেরার আগে পিছু ঘুরে মাইসারাকে বলল,

-“সন্ধ্যে হচ্ছে, ঘরে আয়। নয়তো ভূ’ত, প্রে’তের নজর লাগবে!”

খুব স্বাভাবিক কথা! অথচ কেমন আদেশ, অনুরোধ মিশেছিল কণ্ঠস্বরে! ত্বোয়া ফের হাসলো। মাইসারার তখন দু’ঠোঁটের ফাঁকে আঙুল খাড়া করে রাখা। গভীর ধ্যানে অনিকের কথাকে রিপিট করছে সে। ‘ভূ’ত, প্রে’তের নজর লাগবে!’ সত্যিই লাগবে? লাগতেও পারে! একটা সময় ঠোঁট উলটে ‘দুচ্ছাই’ বলে দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে এলো! যেন এই কথার ব্যাখ্যা তার কাছে অস্পষ্ট!

*****

রাতে খাবারের আয়োজনের আগ মুহূর্তে ব্যাগপত্র ছাড়া খালি হাতেই বোনের বাড়িতে হাজির হলো ফারহান। বিয়ের দাওয়াত পেলেও বেশ জানে সকালেই চলে যেতে হবে। বোন তো জানে না, তার ভাই তার থেকেও বড়ো সেয়ানা। শুধু আলিফের কথা রাখতেই আসা। নয়তো এখানে পা-ও ফেলতো না সে। অসময়ে মেহমানকে দেখে কেউ বিরক্ত না হলেও ত্বোয়াকে খানিকটা বিপর্যস্ত দেখালো! চোখমুখ কুঁচকে খাবারের প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বলল,

-“আমি রুমেই খেয়ে নিব!”

মাইসারা সন্দিহান চোখে তাকালো। ত্বোয়া এক ছুটে নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে দিল! বুকের ভেতর এখনো ধড়ফড় করছে তার। নিজেও জানে না, কেন! ফারহানকে দেখলেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় এসে জড়ো হয় চোখমুখে! হয়তো সেটা তার চোখের ভাবভঙ্গির জন্যই! কেমন যেন চেহারা! অদ্ভুত, আকর্ষণীয়! তাকালেই ভয় পায় সে। কারণে, অকারণেই ভয় এসে জমা হয় ভেতরে। তখন দূরে সরে যাওয়াতেই মুক্তি খুঁজে নেয় দ্রুত!

খাওয়া-দাওয়া শেষে ভাইয়ের জন্য মেহমানদের জন্য থাকা বাড়তি রুমটাই গুছিয়ে দিল ফারজানা। মাইসারা মুচকি হেসে বলল,

-“নালিশ দিলে না যে! এত ভদ্রতা তোমাকে দিয়ে মানায় না ভাবী!”

তখন খাবার টেবিলের কাছে বাকিরা কেউ ছিল না! ফারজানার ছোট্ট বাচ্চা নাহিয়ানকে কোলে তুলে ভাত খাওয়াচ্ছিলো মাইসারা। সবার খাওয়া শেষ হলেও তার খেতে খানিকটা সময়ই লাগছে। ছোটো বাচ্চা দ্রুত গিলতেও পারে না, চিবোতেও পারে না। এজন্য ধীরে ধীরে সময় নিয়েই তাকে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে সে। আলিফের সামনে ফারজানার এমন শান্তশিষ্ট চেহারা দেখে বড্ড মজা নিচ্ছে মাইসারা। তার এমন হাসি দেখে বলল,

-“ফড়ফড় করে যেমন উড়ছিস, ডানা ভা’ঙা’র সাথে সাথে ফট করে নিচে পড়ে যাবি! নিজেকে এত সুখী ভাবিস না! পরের অন্ন ধ্বংস করছিস তো, টের পাচ্ছিস না। সামান্য ক’টা টাকা উপার্জন করতে মাথার ঘা’ম পায়ে ফেলে তোর ভাই! অনিকও সুবিধাবা’দী! নবাবজা’দা বিয়ে করবে ঠিকই কিন্তু সংসারে খরচ করবে না!”

-“কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো! তোমার আমার উপর রাগ থাকতে পারে। আমাকে ঘৃ’ণা করো, বা’জে বকো অসুবিধা নেই। খামাকা ছোটো ভাইয়াকে এখানে টানছো কেন!”

-“গায়ে লাগে খুব? তোর ভাই যে শুধু নিজের স্বার্থ দেখে চলে সেদিকে নজর যাচ্ছে তোর? এই সংসারের পিছনে আমি একাই শ্রম দিচ্ছি! ঘর-সংসারের সব কাজ আমাকে সামলাতে হয়! মাস শেষ হলে আলিফ পকেট ফাঁকা করে টাকা দেয়! যাবতীয় খরচ সে চালায়…! আর তোরা পায়ের উপর পা তুলে আরামসে সেই খাবার গিলিস! গলায় আটকায় না তোদের?”

মাইসারা শান্ত চোখে তাকালো। এর কোনো জবাব নেই তার কাছে। এজন্যই ত্বোয়া দিনের বেলা বলেছিল, কিছুক্ষণ পেরোক, বুঝবি! দিন গড়িয়ে রাত নামার সাথে সাথে যে ফারজানার বাড়তি রূপটা সামনে আসবে জানা ছিল না তার! নাহিয়ানের মুখে খাবার তুলে দিয়ে মেকি হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে বলল,

-“আমার ভুল হয়েছে ভাবী! এবারই শেষ। আর এখানে আসবো না। এই সম্পত্তিতে আমারও অধিকার আছে। ফসলি জমির ভাগও আছে। চাচ্চুকে বলবো, আমারটা আমাকে বুঝিয়ে দিতে। আমি চলে যাব। তখন আর তোমাকে এত ভাবতে হবে না। সংসারের মানুষও কমবে, চাপও কমবে!”

খাবার শেষে এঁটো থালাবাসন নিজেই ধুয়েমুছে তুলে রাখলো মাইসারা। ফারজানা ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর বাহানায় রুমে চলে গেল। রান্নাঘর থেকে বেরোতে গিয়েই অনিকের মুখোমুখি পড়লো সে। দু’জনার এমন তর্কাত’র্কির আওয়াজটা কানে আসতো না, যদি না প্রয়োজনীয় কথা বলতে বাবার রুমের দিকে এগিয়ে আসতো সে। মাইসারার মলিন চেহারা দেখে বলল,

-“সম্পত্তি আলাদা করতে চাস?”

-“এছাড়া উপায় কী!”

নির্বিকার ভঙ্গিমায় জবাব দিল মাইসারা! অনিক ম্লান হাসি ফুটিয়ে বলল,

-“চাচ্চুর করা ভুল আজ তোর জীবনটা নষ্ট করছে। আমাদের তো চলে যাবে যেকোনোভাবে! তোর কী হবে? একা বাঁচা সহজ মনে করছিস?”

-“কঠিন না তো! যার কেউ নেই সে তো একাই! আমারও কেউ নেই! থাকলে কি আর এভাবে কথা শুনতে হতো? হতো না।”

-“আন্টি ফোন করেছিলেন আর?”

-“ছ’মাস ধরে কথা হয় না! আমার ঘুম পাচ্ছে! আমি যাই।”

আর এক মিনিট এখানে থাকা মানেই পুরনো আলাপ-আলোচনার দিকে এগিয়ে যাওয়া। মাইসারা কোনোভাবেই চায় না, বাবা-মা নামক দুই ব্যক্তিকে নিয়ে তার জীবনে আর কোনো কথা আসুক! এজন্যই এড়িয়ে যাওয়া। অনিকও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কথা বাড়ালো না। শুধু শান্তস্বরে বলল,

-“ভয় পাস না সারা! এসব টুকরো টুকরো ঝা’মে’লা সব পরিবারেই হয়ে থাকে। তুই নিজেকে দুর্বল ভাববি না! সাহস রাখ! তোর আগামীর পথটা অনেক সুন্দর! যখন সেই সুন্দর পথ ধরে হেঁটে বেড়াবি, তখন দেখবি আজকের সময়ে যে বা যারা তোকে নি’ন্দে ব’কছে তারাই সেই তোকে মাথায় তুলে নাচবে! তুই দেখে নিস, সেই সুন্দর পথ আর মাত্র কয়েক’পা এগোলেই! খুব সামনে। শুধু ধৈর্যের সাথে এগোনো বাকি! এতদূর এগিয়ে মাঝপথে থেমে যাস না প্লিজ!”

অনিকের কথাটা কাজে দিল। মাইসারা নির্ভরশীল হাসি ফুটিয়ে শুভরাত্রি বলে নিজের রুমে চলে গেল! অনিক ভাবতে লাগলো, ঠিক কীভাবে পারিবারিক এই সমস্যার সমাধান করা যায়! যদিও পরিবারের পিছনে আলিফের চেয়ে অনিকের অবদানই বেশি। তবে সেটা প্রকাশ্যে নয়, অপ্রকাশ্যে! যা কেবল আরমান সাহেবই জানেন!

*****

মাইসারা সম্পত্তি আলাদা করার কথা ভাবছে, এই কথাটা মাথায় আসলেই সমস্ত চিন্তাভাবনা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে ফারজানা, তবুও দুঃশ্চিন্তার ভারে ঘুম এসে ধরা দিচ্ছে না চোখে। শান্তির ঘুমও পালিয়ে গেছে তার। সম্পত্তি ভাগ হওয়া মানে অর্ধেক মালিকানা মাইসারার হাতে চলে যাওয়া। মনে মনে অসম্ভব বলে লাফিয়ে উঠলো সে। বিছানা ছেড়ে নেমে রুমের ভেতরেই পায়চারি শুরু করলো! ভাবতে লাগলো, ঠিক কীভাবে শ’ত্রু বি’না’শ করা যায়। এমন কিছু করতে হবে, যাতে সা’পও ম’রে লা’ঠিও না ভা’ঙে। কিন্তু করবেটা কী! একমনে ভাবতে ভাবতে রুম ছেড়ে বেরোলো সে। সোজা চলে গেল ভাইয়ের কাছে। এতরাতে বোনের গলার মৃদু আওয়াজে যথেষ্ট বিরক্ত হলো ফারহান! হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে বলল,

-“এইজন্যই আসতে চাই না। শান্তির ঘুমটাও অশান্তির হয়ে যায় এখানে আসলে!”

দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা আট’কে দিল সে। বিছানায় বসে ভাইয়ের হাত টেনে ধরে তাকেও পাশে বসালো। ফারহান ঢুলুঢুলু চোখে বোনের দিকে তাকালো। বলল,

-“আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আপু, সকালে কথা বলি!”

-“দরকারি কথা ভাই! আগে শোন!”

দু’হাতে চোখ ভালোমতো কচলে নিল ফারহান। সোজা হয়ে বসে বোনের আতঙ্কিত চেহারা দেখে ঠোঁট বাঁ’কা’লো। বলল,

-“প্লিজ আপু এসব বাদ দে। শুধু শুধু পরের ক্ষ’তি করতে চাইছিস তুই! মেয়ে দুটো যথেষ্ট ভালো। তোর কপাল অনেক ভালো যে, এরকম একটা সংসার পেয়েছিস! তাও কেন অসুখী তুই?”

ফারজানা মুখ ঘুরিয়ে নিল! বলল,

-“সুখী না ছাঁই। তোকে যা বলেছিলাম, তা করেছিস? তাবি’জ কোথায়?”

-“আমি কোনো তাবি’জ নিয়ে আসিনি!”

-“মা তাবি’জ দেয়নি!”

-“দিয়েছিল! আমি সেগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছি!”

-“কী করলি হা’রা’ম’জা’দা! আমার এত চেষ্টাকে তুই জলে ফেলে দিলি! তুই কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবি। এই বাড়িতে আর আসবি না!”

হনহনিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল ফারজানা। বোনের অসহায় ফেসটা দেখে মুচকি হাসলো ফারহান! দু’জনের ক্ষ’তি করার অনেক চেষ্টাই সে করছে, কিন্তু সফল হচ্ছে না। একটার পর একটা বাঁধা তৈরী করছে ফারহান! অবশ্য এখানে তাদের মায়ের হাতটাই বেশি। একমাত্র উনিই যত বা’জে বুদ্ধি মেয়ের মাথায় দিয়ে সংসারে ভা’ঙ’ন ডেকে আনার চেষ্টা করছেন। প্রতিবার এখানে আসার বাহানা খুঁজে তার হাতে তা’বি’জ, পানি পড়া ধরিয়ে দেন তিনি। ফারহান সঙ্গে আনে ঠিকই কিন্তু মাঝরাস্তায় সেটা ফেলে দেয়! যেন বোনের হাত অবধি এসব না পৌঁছায়। এই নিয়ে তিন বার হা’র মানলো সে। তবুও ছাড় দিচ্ছে না। একটার পর একটা চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কিন্তু তাতে লাভ কিছুই হচ্ছে না! যে তা’বি’জ গুলো ঘরে পুঁ’তে রাখার কথা, যে পানিটুকু মাইসারা আর ত্বোয়াকে খাওয়ানোর কথা, সে পানি আর তা’বি’জের বারোটা সে বাজিয়ে দেয় অতি সুক্ষ্ম বুদ্ধির জুড়ে। শেষবার এই কথাগুলো ত্বোয়ার সাথে গোপনে শেয়ার করেছে ফারহান, যার কারণে ত্বোয়া পুরোটাই তাকে ইগনোর করতে শুরু করে। আগে টুকটাক কথা বললেও এখন সেটাও বলে না। দেখলেই গা ঘিনঘি’ন একটা ভাব এসে উপস্থিত হয় তার মাঝে! অবুঝ মনের কোথাও হয়তো গেঁথে গিয়েছে, ভাই-বোন দু’জনেই তাদের ক্ষ’তি চায়!

রুমে এসে আলিফকে ধা’ক্কাতে ধা’ক্কাতে তার ঘুম ভাঙালো ফারজানা! ঘুম ঘুম চোখে বউয়ের এমন দিশেহারা মলিন চেহারা দেখে চোখমুখ কুঁচকে গেল তার। হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁলো। জ্বরহীন সুস্থ স্বাভাবিক শরীর দেখে বলল,

-“জ্বর তো নেই। এত রাতে ঘুম ভা’ঙা’লে কেন? সকালে ক্লাস আছে আমার!”

-“হ্যাঁ! এসবই করো। ওইদিকে তোমার বোন সম্পত্তি ভাগ করতে চাইছে। আমরা তাকে খাওয়ার দেই না, তাকে থাকতে দেই না! কীসের জন্য জায়গা-সম্পত্তি আলাদা করবে সে? সারাদিন শুধু দৌড়ের উপর থাকো, ঘরের কোন খোঁজটা রাখো তুমি?”

-“আশ্চর্য! মাঝরাতে এসব বলতে ঘুম ভা’ঙি’য়েছো! তুমিও না পারোও বটে! এই সংসারটা ভা’ঙা’র নয়! আর সম্পত্তি ভাগ হবে কেন? যৌথ পরিবারে ভাগ হয় নাকি? শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা! শুনো যদি ভাগ হয় কখনো তখন তোমার খাওয়াপড়া নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না। তোমার জন্য আমি আছি তো নাকি! ঘুমাও তো!”

হাত ধরে টে’নে স্ত্রীকে পাশে শুয়ালো আলিফ! হাতের বেষ্টনী পেঁ’চি’য়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

-“সংসার সুখী হয় রমনীর গুণে! যদি গুণে না পারো, দো’ষে কিছু করো না। একটা সংসার ভে’ঙে গেলে তাকে গড়ে তোলা অনেক কঠিন! ভাবো তো, যদি ভা’ঙ’নটা তোমার আর আমার মাঝে আসে, তখন? সইতে পারবে তো বউ…?”

রাগে হাতের কনুই দিয়ে আলিফকে গুঁ’তো মারলো সে। বলল,

-“আমি তো গড়তেই চাই! কিন্তু সারা বলেছে বাবাকে বলবে, ওর ভাগ যেন আলাদা করে দেয়!”

আলিফ হাসলো। স্ত্রীর হিসাবটা ধরতে খুব একটা দেরী হলো না তার। তবুও শান্তস্বরে বলল,

-“করলে করুক। এই বাড়ির অর্ধেকের মালিক তো সারা! অর্ধেক আমরা দুই ভাই আর ত্বোয়ার! তার জায়গা সে চাইতেই পারে, এতে তোমার তো সমস্যা হওয়ার কথা না!”

ফারজানা দমে গেল। আর একফোঁটা বাড়তি কিছু বললেই আলিফ ধরে ফেলবে তার ভাবনার দৌড়। এভাবে সে কিছুই করবে না। আরও গভীর করে ভাবতে হবে তাকে। তার আগে মাইসারাকে চিরদিনের জন্য তা’ড়াতে হবে, এরপর সম্পত্তির ভাগ থেকে বা’তি’ল করতে হবে। তার জন্য একটু গভীর ভাবনার প্রয়োজন আছে বৈ কী! তাড়াহুড়ো করলে চলবে না, খুব গোপনে ধীরস্থিরভাবে এগোতে হবে। যেন কাক পক্ষীতেও টের না পায় তার পরবর্তী চিন্তাভাবনা!

*****

চলবে…

জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

1

#জানালার_ওপারে
||শেষ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
দমবন্ধকর লাগে প্রতিটি দিন। আমার ঘুম ভাঙার আগেই আবেগ ভাই চলে যান অফিসে। উঠে তাঁর ছায়াটাও পাই না। এটাই প্রায় সপ্তাহ তিনেক ধরে চলমান। আজও তেমনই হলো। উদাস মনে পানি বসালাম চুলায়। অসহ্যকর তাপে টগবগ করে ফুঁটতে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে অগোছালো হয়ে পড়া সমীকরণগুলোতে মেলানোর চেষ্টা করছি। কখনও ব্যর্থ হয়ে নিজেকে বোঝাচ্ছি। এসব কিছু তো ভ্রান্ত ধারণা মাত্র, মুখে বললেই কি শুধু ভালোবাসার প্রকাশ হয়? আবার নিজের যুক্তিতে আবার নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করছি।

চা কোনোরকম গলাধঃকরণ করে টুকটাক জরুরি জিনিসপত্র একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিলাম। প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করছে, ভালো লাগছে না বদ্ধ ঘরে। ভাবছি, দিন দুয়েক নিজেদের বাসায়ই কাটাবো।

কেমন যেন অদ্ভুৎ লাগছে নিজের বাসায় যেতেই। ঐ যে বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় আম্মু জরুরি তলবে ডেকে আবেগ ভাই বাসায় কাজে হেল্প করে এই ব্যাপার নিয়ে, আর ভাবী ইচ্ছে মতো কথা শোনায় মাকে নীরব পেয়ে। তারপর থেকেই যাই না, গেলেও ঐ বসার ঘরে ঘণ্টা খাণেক বসে চলে আসি। রাগ-ক্ষোভ ধরে রেখেছি বা কথা বলি না এমন নয়। তবে আগের মতো আপন মনে হয় না। তীব্র কিংবা অতীব্র এক অদৃশ্য তিক্ততা তো তৈরি হয়েছে পরিবারের সাথেই, তা মানি।

দরজা খুলে আমাকে দেখে হাসি মুখে ঘরে তোলে মা। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠায় আমি অসম্ভব হাঁপিয়ে গিয়েছি, কথাও বলতে পারছি না। মা পানি নিয়ে আসলে ডগডগিয়ে এক গ্লাস পানি পান করে ফেলি।

“ভালো লাগছে রে এখন সামু? এতো কষ্ট করে আসতে গেলি কেন? কোনো দরকার হলে আমাকে বললে আমিই তো যেতাম।“

“বেড়াতে এসেছি।“

মা কেমন যেন চমকালো। ভাবীর কপালে দৃশ্যমান ভাঁজ। তারা কি অখুশি আমার আগমনে? ঠাট্টার ছলে একদিন থাকবো বলেছিলাম তখনও কিছুটা বিচলিত হতে দেখেছিলাম ভাই-ভাবীকে। বিয়ের পর বুঝি সত্যিই পিতৃগৃহ বলতে কিছু থাকে না নারীদের। তবে আল্লাহ যে অংশীদার করলো নারীকে পিতৃগৃহ, স্বামীগৃহ উভয়েরই। অথচ, সমাজ করেছে দুই দিক থেকেই বঞ্চিত। সমাজ কি আর মানে কোনো ধর্ম?

“থাকতে এসেছিস? আচ্ছা, ভালো করেছিস। ভাত চুলোয় বসানো, আমি দেখে আসি একটু।“

মা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আমিও উঠে লাগেজ নিয়ে নিজের রুমের দিকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলাম। ভাবী বাধা দিলেন।

“ঐ রুমে কোথায় যাচ্ছো? খাট নেই তো। তুমি তো আর নেই, সাব্বিরের স্টাডি রুম বানিয়ে দিয়েছি ঐটাকে। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িই শুধু নিজের বাড়ি, সেখানেই থাকা ভালো।“

আমি শক্ত ধরনের নারী হলেও কান্না আটকানো বড়োই কষ্টসাধ্য আমার নিকট। তবুও প্রাণপণ চেষ্টা করে চোখের জল চোখেই স্থির রাখি।

মুখে কোনোরকম বললাম, “নিজেও মেনো!“

“বেয়াদব মেয়ে! আমার স্বামীর বাড়িতে এসে আমাকে কথা শোনানো! আসুক তোমার ভাই!”

“বাড়িটা আমার বাবার।“

মাও ইতিমধ্যে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছে। ভাবীর চোখে এক মুহূর্তেই জলের ফোয়ারা নামতে শুরু হয়ে গিয়েছে।

“মা আমি শুধু বলেছি স্বামী-সংসারে ভালো ভাবে করতে। তাতেই দেখুন না, আপনার মেয়ে আসতে না আসতেই আমাকে খোঁটা দিচ্ছে। আমি না কি আপনাদের সেবা-যত্ন করি না, সারা বছর বাপের বাড়ি পড়ে থাকি। এমন কী এটা নিজের বাবার বাড়ি বলেও খোঁটা দিল।“

“মাশিয়াত! মেয়েটা মাত্র এসেছে, এমন না করলেই কি নয়! আর তোকেও বলি মেয়ে, আসতে না আসতেই ভাবীর সাথে ঝগড়া শুরু করেছিস! বেয়াদব মেয়ে!”

এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম না। লাগেজ হাতে বেরিয়ে গেলাম। মা কয়েকবার ডাকলো বোধহয়। সত্যি বলতে, ভাবীর চেয়ে মায়ের কথাগুলোই বেশি গায়ে লেগেছে।

বাসায় ফিরতে মন চাচ্ছে না। তবুও রাস্তায় রাস্তায় তো ঘুরে বেড়াতে পারি না। ঐ দমবন্ধকর ফ্ল্যাটটাতেই ফিরে গেলাম।

সারা দিন আর মুখে কিছু উঠলো না আমার। হৃদয় ভর্তি সব হতাশা, তিক্ততা সেখানে পেটে আর কী করে খাবার ঢোকে।

নিয়মমাফিক রাত হলো, আবেগ ভাই বাড়ি ফিরলেন। ফ্রিজের খাবার গরম করে দিলে চুপচাপ খেয়ে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমিও ধীরেধীরে নিদ্রায় ডুবলাম। তন্দ্রাহীন থেকেও বা লাভ কি? আগামীকালও তো সব নিয়মমাফিক চলবে, ভোরের আগেই তাঁর অফিস, সারা দিন আমার একাকী থাকা।

শুক্রবার বেলা এগারোটা।

ঘুম ভাঙতেই চোখ কপালে আমার। আজ আবেগ ভাই বাসায়, আবার নাস্তা বানানোও বাকি। তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে উঠলাম। এমনিতেই আমার গর্ভাবস্থার প্রথম থেকে রক্তশূন্যতা আর অপুষ্টির সমস্যা আছে, তার উপর বিগত মাস খাণেক নিজের প্রতি অবহেলায় দু’কদম চলতেই ঢলে পড়তে নিলাম। আবেগ ভাই ধরায় এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। তিনি বেডে এনে বসালো।

“ঠিক আছো তুমি মায়াবালিকা? হঠাৎ এমন হলো কেন? কালই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এক মিনিট তোমার মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন? তুমি কি খাওয়া-দাওয়া করো না ঠিক মতো?”

আবেগ ভাইয়ের এই কেয়ারিং কথাগুলো শরীরে সূচের মতো ফুঁটছে। তাচ্ছিল্য জেগে উঠছে হৃদয়ে।

“আপনি কি আসলেই পরোয়া করেন? প্লিজ, আবেগ ভাই আর কতো অভিনয় করবেন? এর চেয়ে অবহেলাটা বরং বেশি মেনে নিত পারবো আমি।“

তিনি অবাক হলেন মনে হলো। তবে অবাক হওয়ার মতো সত্যিই কিছু বলেছি কি?

“এসব কী বলছো মায়াবালিকা? তুমি কি কিছু নিয়ে রেগে আছো আমার উপর? দেন আ’ম সরি। বাট এভাবে কথা বোলো না। আমি অভ্যস্ত নই তোমার এমন আচারণে।“
বলতে বলতেই আমার মুখ দু’হাতের মাঝে নিয়ে নিলেন। আমি সরে আসলাম তাঁর থেকে।

“প্লিজ, আবেগ ভাই এই কেয়ারিং স্বামী বা প্রেমিক হওয়ার নাটক করবেন না। বাস্তবতা তো এটাই করুণার থেকে বিয়ে করেছিলেন আমায়, তাই তো সময়ের সাথে ধৈর্য্য, যত্ন সব ফুঁড়িয়েছে। কখনও তো ভালোবাসেননি আমায়।“

আবেগ ভাই এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর মুখ খানা থমথমে। কেমন যেন বিধ্বস্ত, অপ্রস্তুত, হতাশ দেখালো তাঁকে। আমি বুঝেও অবুঝ হয়ে রইলাম। কারণ আমার মতে বাস্তবতাই ব্যক্ত করেছি।

তিনি ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আমি ভালোবাসি না তোমায়?”

“না। বাসেননিও কখনও।“

“আমি সত্যি ভালোবাসি না তোমায়? সত্যিই তোমার এটা মনে হয়? এতোটা পথ তোমায় আগলে পাড়ি দেওয়ার পর, তোমার জন্য এতো যুদ্ধের পর, এতো ভালোবাসার পরও আমার ভালোবাসার প্রমাণ পেলে? আমি ব্যর্থ, সত্যিই ব্যর্থ প্রেমিক। ব্যর্থ প্রেমিকদের বেঁচে থাকাও মৃত্যুতুল্য।“

তিনি বদ্ধ উন্মাদের ন্যায় দু’হাতে চুল আঁকড়ে কথাগুলো শুধাতে শুধাতে বের হয়ে গেলেন।

আমার চোখ বেয়ে বিরামহীন ভাবে নোনাজল বেয়ে চলেছে। অপারাধবোধ কোথাও তীব্র ভাবে আঘাত করে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে আমাকে। অথচ, মুখ্য ভাবে মনে হচ্ছে আমি ভুল কিছু বলিনি।

হঠাৎ করেই ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠে। চোখের জল মুছে আমি যেয়ে ধরি।

“হ্যালো, আমি হীমা বলছি আবেগ। ফোন বন্ধ কেন তোর? ট্রিট দিবি, বস তোর প্রজেক্ট এপ্রুভ করেছে।“

“আসসালামু আলাইকুম, আমি তাঁর স্ত্রী বলছি। তিনি তো নেই।“

“আপনিই আবেগের মায়াবালিকা! সত্যিই আপনাকে দেখার অনেক ইচ্ছে ছিল। বড্ড কপাল আপনার আবেগের মতো হাজব্যান্ড পেয়েছেন। গত কয়েকটা মাস গাধার মতো খেটেছে আপনার স্বামী, শুধুই আপনার ডেলিভারির সময়টা আপনার সাথে থাকার জন্য।“

“মানে? বুঝলাম না কী বললেন?”

“আপনাকে আবেগ বলেনি ভাবী? আসলে আমাদের বড়ো একটা প্রজেক্ট ছিল আমেরিকান কোম্পানির সাথে। যেটার জন্য আবেগকে আপনার ডেলিভারির টাইমে মাস খাণেকের জন্য আমেরিকা যেতে হতো। আবেগ প্রথমে বসকে ডিলে করতে বা অন্যকাউকে রিপ্রেজেন্ন্টেটিভ হিসেবে পাঠাতে রিকুয়েস্ট করে। কিন্তু তিনি কোনো কথা শুনেন না কারণ আবেগের থেকে বেটার কেউ হবে না এ কাজের জন্য এবং ডিলটিতে লাভ প্রচুর কোম্পানির। চাকরিচ্যুত করার হুমকিও দেন। আবেগ পরে রিকুয়েস্ট করে সে এই প্রজেক্টটার সমস্ত কাজ কিছু সময়ের মধ্যে করে দিলে তার আমেরিকার ট্রিপটা যেন আগে নিতে দেওয়া হয়। কারণ আপনিও তাহলে সাথে যেতে পারবেন। বসও শর্ত দেন তিনি যোগ্য মনে করে এপ্রুভ করলেই রিকুয়েস্ট কমপ্লিট হবে। আবেগ সত্যিই সাত-আট মাসের কাজটা মাত্র আড়াই মাসে কমপ্লিট করে দিয়েছে দিন-রাত এক করে। সত্যিই সৌভাগ্যবতী আপনি।“

নারীটির কথা শুনে আমি খুশি হবো কোথায়? আমার হাত-পা, হৃদয়, কণ্ঠ অনবরত কম্পিত হচ্ছে। আরেক দফা এতো বাজে ভাবে ভুল বুঝলাম তাঁকে! কী করে ক্ষমা চাইবো? কী করে তাঁর সামনে এই মুখটি নিয়ে দাঁড়াবো? তাঁর কয়েক মাসের ব্যস্ততাও মেনে নিতে পারলাম না? কাজ করা পুরুষের কাজের ব্যস্ততা অস্বাভাবিক কিছু না, এ কথা একবারও মাথায় আসলো না?

কোনোরকম বিদায় জানিয়ে টেলিফোনটা রাখলাম। নিজেকে অসংখ্যবার বকে যাচ্ছি। বারবার কল করছি আবেগ ভাইকে, কিন্তু ফোন বন্ধ। এতো অভিমান! এতো অভিমানের দেয়াল কী করে পাড় করবো আমি? তৃষ্ণার্ত পাখির মতো অপেক্ষা করতে থাকি।

আসরের নামাজ শেষ করে তসবিহ পড়ছি এমন সময়ে মোবাইলে কল রিংটোন বেজে উঠে। আমি তাড়াহুড়ো করে জায়নামাজ থেকে উঠে কল রিসিভ করি। অতঃপর যে দু’টি বাক্য কর্ণগোচর হয় তা আমার পুরো পৃথিবী ধ্বংস করতে যথেষ্ট ছিল।

“হ্যালো, এই মোবাইলটি যার তিনি এক্সিডেন্ট করেছেন। ‘নর্থ ইস্ট’ (ছদ্মনাম) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।“

আমি সামলাতে পারি না নিজেকে। “আল্লাহ” বলে জোরালো এক চিৎকার দিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ি। মোবাইলটাও ছিটকে পড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খায়।

আমার চিৎকার শুনে আবেগের মা, বাবা, বোন ছুটে আসে। আমার আর হুশ নেই কোনো। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করি।

শাশুড়ি মাও ভয় পেয়ে যান। “কী হয়েছে বউ? এভাবে কাঁদছো ক্যানো?”

“মা, আবেগ ফোন… এক্সিডেন্ট করেছেন। মা আমার আবেগ…” আর কিছু মনে নেই আমার। চোখের সামনে ঘোর অমাবস্যা।

জ্ঞান ফিরলে নিজের মাকে দেখতে পাই সামনে। মাও আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছে। আবেগ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে।

“মা, আবেগ ভাই কোথায়? তিনি কেমন আছেন? আমি হাসপাতালে যাবো।“ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করি।

“আম্মু, তুই শান্ত হ। আবেগ সুস্থ হয়ে যাবে। তুই শান্ত হ।“

“না, না, আমি আবেগ ভাইয়ের কাছে যাবো।“

আমার পাগলামিতে আব্বু, আম্মু বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়ে সেই মুহূর্তে হাসপাতালে যায়। তখন আইসিইউতে আবেগ ভাই। কাঁচের গ্লাস হয়ে তাঁর নিথর দেহ খানা দেখে যেন আমার হৃদয় টুকরো টুকরো হচ্ছে অনবরত।

আমি পাগল হয়ে নার্স-ডাক্তারের কাছে বারবার জানতে চাচ্ছি তাঁর অবস্থা। তাঁদের একটাই উত্তর, “আল্লাহকে ডাকেন বেশি বেশি।“

অবশেষে রাতের দিকে আবেগ ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে। প্রথমেই একজন পুলিশ অফিসার ভিতরে যান রিপোর্ট তৈরি করতে আমরাও দরজায় দাঁড়িয়ে শুনি। পুলিশটির বারবার জিজ্ঞেস করার পরও তিনি তীব্র ভাবে নাকোচ করেন যে ট্রাক ড্রাইভারের ভুল নেই। তিনিই মাঝ রাস্তায় এসে পড়েন।

তাঁরা বের হয়ে যেতেই নার্স এসে জানায়,
“মায়াবালিকা কে? রোগী বারবার এই নাম জপছে। তিনি প্লিজ আসুন আমার সাথে।“

আমি তাড়াতাড়ি উঠে গেলাম নার্সের সাথে। আবেগ ভাইয়ের শোচনীয় দশা দেখেই মুখ চেপে গুমড়ে কেঁদে উঠলাম।

আবেগ ভাই বহু কষ্ট করে শুধালেন, “মায়াবালিকা তোমার অশ্রু আমার কাছে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকেও বহু গুণ বেশি কষ্টতুল্য। কেঁদো না দয়া করে।“

আমি জোরপূর্বক কান্না থামাই। তিনি আবারও মুখ খুলেন।

“সদ্য কলেজ কাল থেকে, যখন তোমার বয়স কিশোরী হতেও আরও এক কাঠি উপরে উঠতে বাকি… বিশ্বাস করো, তখন থেকে আমি নিজের সর্বস্ব দিয়ে তোমায় ভালোবেসেছি। আমি ছোটো বেলা থেকেই… এমন, মুখে অনুভূতির প্রকাশে…. অসক্ষম। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র খাদ… নেই। জানি না কোথায় কমতি থেকে গেছে যে তুমি আজও আমার… আমার ভালোবাসা বোধ করোনি। আমার ব্যর্থতা, ব্যর্থ পুরুষ, ব্যর্থ প্রেমিক আমি। কিন্তু অন্ততপক্ষে মৃত্যুর আগে তোমায় বিশ্বাস…. বিশ্বাস করাতে চাই, আমি সত্যিই, সত্যিই ভালো…“

তিনি কথা বলতে পারছেন না। বারবার শ্বাস আটকে আসছে, কষ্ট হচ্ছ, থামতে হচ্ছে। তাও অনবরত কথা বলে যাচ্ছেন। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না।

অনুরোধ করলাম,
“থামুন, প্লিজ থামুন, আপনার কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি আপনার মতো করে ভালো আমাকে কেউ বাসতে পারবে না। এমন কী আমার ভালোবাসাও আপনাকার ভালোবাসার কাছে তুচ্ছার্থক। লোকে ঠিকই বলে আমিই আপনার যোগ্য নেই। ব্যর্থ আপনি নয়, আমিই। এমন খাঁটি প্রেম উপলব্ধি করার জ্ঞান যার নেই, তার গোটা জীবনই ব্যর্থ। আপনি এবার সুস্থ হয়ে উঠুন, সারা জীবন আপনার পদতলে দাসী হয়ে কাটাবো।“

মলিন মুখেও ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। যদিও চোখে বেয়ে পানি পড়ছেই।

“মায়াবালিকা আমার শাহাজাদি, দাসী তো কখনও দুঃস্বপ্নতেও হ.. হতে পারবে না আমার। সেই সুযোগই দিব না আমি।“

উত্তর দিলাম না। তাঁর একদিনেই শীর্ণ হয়ে পড়া হাত কপালে ঠেকিয়ে আঁখিজল ফেলতে লাগলাম। অতঃপর গভীর নীরবতা…

আকাশটা ঘোলাটে, এই যেন নামবে অশ্রু। ভরা দুপুর, তবে সন্ধ্যা মনে হচ্ছে। প্রকৃতিরও কতো রকম লীলাখেলা। সকালবেলাও এক চোট বৃষ্টি হয়েছে। ইকবাল রোডের বাইতুস্ সালাম জামে মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছি, সামনেই আবেশের স্কুল। বড়ো বড়ো ইমারতগুলো পেরিয়ে উঁকি দিচ্ছে ছাদে, বারান্দায়, প্রাঙ্গনে লাগানো বৃষ্টি স্নাত বাগানবিলাস, কদম, দোলনচাঁপা, জুঁই ফুল৷ সারা বাতাস মৌ মৌ করছে জুঁই ফুল, স্পাইডার লিলি সহ নানা ফুলের ঘ্রাণে। শহরে ভেজা মাটির ঘ্রাণ তেমন একটা না পাওয়া গেলেও বড়ো বড়ো অট্টালিকার ভীড়ে ফুলের সমারোহের অভাব হয় না। মানুষের সচেতনাতা না সৌখিনতা এর পিছনে কে জানে?

ফুলে সজ্জিত গাছের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেই আমি। অথচ, একদা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম এসব গাছ, ফুল দেখলে। আবেগ ভাই সবসময় বলতেন আমাকে একটা বিশাল বাগান করে দিবেন। কীভাবে যেন করা আর হয়ে উঠেনি। ব্যস্ততায় হয়তো, আবার আমরা সময়ই বা কতোটুকু পেয়েছিলাম একে অপরের সাথে?

ভাবনার মাঝেই নিশা ডাক দেয়। নিশার ছেলে নিহামও একই স্কুলে পড়ে, আবেশের থেক দুই ক্লাস নিচে। এগিয়ে গেলাম তার দিকে।

“কোথায় যাচ্ছিস? আবেশেদের আজকে এক্সট্রা ক্লাস হবে। আর যেই ভীড়! চল কোথাও বসি।“

“হু।“

স্ট্রাইকার মাঠের সামনে বসে আছি। নিশা নিজের মতো কথা বলে যাচ্ছে। আমার তাতে ধ্যান নেই, নিজের হাস্যরসিক আচারণ হোক বা প্রাণখোলা হাসি সব তো কবেই হারিয়েছি।

“তুই শুনছিস আমার কথা?”

চমকিত হলাম মৃদু। শঙ্কিত চোখে নিশার দিকে তাকালাম।

নিশা আমার কাঁধে হাত রাখলো। “এভাবে আর কয়দিন? আবেগ ভাই চলে গিয়েছে সাত বছর হতে চলেছে এখন তো সামলা নিজেকে।“

হৃদয়টা মুচড়ে উঠলো আমার। হ্যাঁ, আবেগ ভাই সেদিন রাতের গভীর নীরবতায় আমার সকল সুখ-অনুভূতির ভার নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে তাঁর যেই ভালোবাসায় আমি এতো অবিশ্বাস ও শঙ্কা রেখেছিলাম সেই ভালোবাসার আরেক দফা প্রমাণ দিয়ে গিয়েছিলেম।

সেদিন তাঁকে হারিয়ে আমার ছয় মাস অবধি দিন-দুনিয়ার কোনো হুশ ছিল না। পাথুরেমূর্তি বনে গিয়েছিলাম, কথা বলাও ভুলে গিয়েছিলাম। কেউ খাবার মুখে তুলে দিলে খেতাম, নাহয় না। এতোটাই শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম কাঁদাও যেন ভুলে গিয়েছিলাম।

সর্বক্ষণ ভাবতাম, আমার কণ্ঠটা না ফিরলে কতোই না ভালো হতো। না শব্দের বাণ ছুঁড়ে ফেলতাম, না আবেগ ভাই ঐ ক্ষণে রাস্তায় থাকতো। প্রিয় পুরুষের মৃত্যুর শোক বড়োই কঠিন! তার উপর পরদিনই মা-বাবা এসে আমায় নিয়ে যায়, আমাদের স্মৃতির রাজ্য তথা ফ্ল্যাটটা থেকে।

হুশ আসে সেদিন যেদিন ভাই তার এক বিপত্নীক বন্ধুর সাথে বিয়ের প্রস্তাব তুলে। আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম বাবা-মা, ভাইয়ের কথাবার্তায়। প্রত্যাখ্যান করি, তারা অনর্থক বোঝায়, ভবিষ্যতের ভয় দেখায়, কিন্তু আমাকে আর বোঝে না। সেই থেকে আর তাদের সাথে তেমন একটা সম্পর্ক নেই।

প্রিয় বন্ধুর শোকে কাতর হয়ে হাসান ভাই নিশাকে নিয়ে দেশে দুই সপ্তাহের মাঝেই সব গুছিয়ে দেশে ফিরে। আমাকে যা জানায় তাতে আমি স্তম্ভিত হয়ে ছিলাম।

বহুদিন ধরেই আবেগ ভাইকে মতি ব্যাপারীর ছোটো ভাই বহুদিন যাবত হুমকি দিচ্ছিল তাঁকে হত্যার। জেলে তিনি ঢুকিয়েছেন জেনে তাঁর উপরই মূলত ক্ষোভটা ছিল। নেতা মানুষ মারুফ ব্যাপারী। এদেশে টাকা এবং শিক্ষার জোর উভয়ই ক্ষমতার জোরের কাছে সদা পরাজয়স্বীকার করে। তাই চুপ ছিলেন আবেগ ভাই। আমাকেও জানাননি, হয়তো দুশ্চিন্তা করবো ভেবে। এই কারণেও আবেগ ভাই আমেরিকার কোম্পানির প্রজেক্টের ঝামেলাতেও চাকরি ছাড়েননি। তাঁর মতো পাগলাটে মানুষের চাকরি ত্যাগই অধিক মানানসই ছিল। কিন্তু চুক্তিটা পাকা হলে প্রমোশন পেয়ে আমাকে নিয়ে এই ঝামেলা হতে দূরে আমেরিকায় সেটেল হতে চেয়েছিলেন তিনি। এর আগেই মারুফ ব্যাপারীর লোকেরা তাঁকে হত্যা করে। ঐ জায়গার সিসিটিভি ফুটেজেও বোঝায় এটা সাধারণ কোনো এক্সিডেন্ট। কিন্তু আবেগ ভাইয়ের মুখের বাণীই সব গোলমাল করে দিয়েছে।

কিন্তু কেন মিথ্যে বললেন তিনি? উত্তর অনুধাবণ করতে সময় লাগেনি। তা হলো – আমাকে বাঁচাতে পারিবারিক, সামাজিক লাঞ্ছনা থেকে। দোষী অন্য কেউ হলেও আবেগের মা-বাবা, পাড়া-পরশি তো আমাকেই দোষী করতো, আবার শত্রুতাও বাড়তো। সত্যিই তাঁর ভালোবাসায় কোনো খাঁদ নেই, খাঁদ তো আমার ভালোবাসায়, বোধশক্তিতে ছিল।

প্রতিশোধের জ্বলন্ত আগুন নিয়ে যখন খোঁজে বের হয়েছি, তখন দেখি কার থেকে প্রতিশোধ নেব? আবেগ ভাইয়ের মৃত্যুর তিন দিন পরই গ্রামের বাড়িতে বাজ পড়ে মারা গিয়েছে, ভয়ংকর এক মৃত্যু ছিল! কথায় তো আছেই, আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর।

বর্তমানে আবেগ ভাইয়ের কোম্পানিতেই তাঁর তুলোনায় ছোটো একটা পোস্টে চাকরি করি। শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে থাকি অফিসের পাশে এক ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে। একসময় মেয়ের কথায় তাঁরাও বের করে দিয়েছিলেন, শুধুমাত্র আবেগ ভাইয়ের আমাদের সন্তানের জন্য রাখা সঞ্চিত অর্থ তাঁদের হাতে তুলে দেইনি বলে। কিন্তু ঐ যে তাঁরা মানুষ হিসেবে একদম খারাপ তো নয়। যখন মেয়ে সকল সম্পত্তি নিজের নামে লিখে দিতে জোর করলো আবেশকে বঞ্চিত করে সেখানেই তাঁদের বিবেক জেগে উঠলো। নাতির কাছে ছুটে আসেন দাদা-দাদী। এই দ্বন্দ্বে মেয়ের সাথে আজও সুসম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তবে দুলাভাই মাঝে মাঝে আসেন আর্শিকে নিয়ে।

আজকাল আমার শাশুড়িও আমায় কিছুটা বোঝে। প্রায় শুধান, “ভাগ্য গুনে এমন বউ জুটেছে আমার আবেগের”। আমি ভাবি, কথাটা হয়তো উলটো হবে।

তবে একটা বিষয় আল্লাহ দেখিয়েছে। আপন যে সদাই আপন থাকবে তা না, পরও আপনের চেয়ে আপন হয়। এই নিশা আর হাসান ভাই আমাদের মা-ছেলের জন্য চাকরিতে বদলি নিয়ে দেশে চলে এসেছে। নিজের ছেলের চেয়ে কম আদর করেন না তারা। জীবিত দু দুটো পরিবার থাকতেও আমার ডেলিভারির সময় শুধু এই দু’টো মানুষই দিন-রাত আমার পাশে ছিল। তাদের কথা মনে পড়লো নিজেকে প্রকৃতপক্ষে ভাগ্যবতী মনে হয়।

খারাপ নেই আমি৷ শ্বশুর-শাশুড়ি, চাকরি, ফুটফুটে সন্তান, স্বচ্ছলতা সবই আছে। নিঃসঙ্গ বোধ করার মতোও একাকী সময় নেই আমার প্রতিদিনের রুটিনে। তবে ভালো কি আছি? না, নেই। এ প্রশ্নই তো ব্যর্থ, যেখানে উত্তর একবারে নির্ধারিত, অপরিবর্তনীয়।

“কী হলো? কথা বলছিস না ক্যানো? দোস্ত প্লিজ মুভ অন কর, আমি জানি তোর কষ্ট বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। তবুও তোকে এভাবে দেখে আমার মোটেও ভালো লাগে না।“

আমি হাসলাম। মনে পড়ে গেল সুফিয়া কামালের ‘তাহারেই পড়ে যে মনে’ কবিতার শেষ কিছু চরণ। আপন মনেই আওড়ালাম,

“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”

“যার স্বামী বিরহের কবিতা আবৃতি করলি না, তিনি নিজেও এবং আরও বহু নারী-পুরুষ কিন্তু জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছিল অন্যকারো সাথে। আর কোনো ভুলও নেই এতে, বরং ভালো।“

“হুম নেই। কিন্তু আবেগ ভাই তো আমায় বিরহ দেননি সাদা খামে মুড়িয়ে, না আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছে। তিনি আর তাঁর ভালোবাসাটা শুধু আমার জানালার ওপারে, দিন-দুনিয়ার দায়ের পাঠ চুকিয়ে ঐ জানালার ওপারে পা রাখলেই তো তাকে পাবো। ততদিন শুধু তাকিয়ে থাকবো তৃষ্ণার্ত প্রেয়সীর মতোন জানালার ওপারে।“

__সমাপ্ত__

জানালার ওপারে পর্ব-১৬

0

#জানালার_ওপারে
||১৬তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আমাদের ছোটো বসার ঘরটা মানুষে গিজগিজ করছে। গত কিছুদিন ধরে গরম বেড়েছে দ্বিগুণ হারে, এতোটাই যে রাত বাড়লেও গরম যায় না। আর এখানে তো ছোটো জায়গায় এতো ভীড়। সবাই-ই ঘেমে যাচ্ছে। আবেগ ভাই আমার পাশে গম্ভীর মুখে বসা, মনে হচ্ছে তাঁর নিজের সাথেই যুদ্ধ চলমান নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। অবশেষে হাফসার মাও বিরক্তিমাখা মুখে আমাদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো।

আবেগ ভাই তাঁর ক্রুব্ধ দৃষ্টি আমার দিকে ফেলেন। যদিও খুব বেশি সঙ্গ পাইনি এই মানুষটির, তবুও তাঁর চোখের ভাষা অল্প হলেও বোধগম্য হয় আমার। আমি উঠে যেয়ে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চড় লাগাই হাফসার গালে। ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে হাফসা। কেমন যেন এক দাম্ভিকতা বোধ হয় কারণ নিজেকে কোনো একশন ফিল্মের নায়িকা মনে হচ্ছে। অবশ্য আমার হাত দেখতে বেশ কোমল, মোলায়েম মনে হলেও খাণিকটা শক্ত ছেলেদের মতোন। উত্তেজনা ও ক্ষোভে তাকে ফ্লোর থেকে তুলে আরেক দফা চড় বসিয়ে দিলাম।
আমার হাত টান দিয়ে সরালেন হাফসার মা। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তিনি ক্ষুব্ধ, বাকিরা রুষ্ট ও অবাক চেহারা দেখেই অনুধাবন করতে পারছি।

(গল্প পড়ার পূর্বে কিছু কথা—- হাতে গণে গণে দীর্ঘ দু’মাস হতে পাঁচ দিন কমের পর আবার এই শহরে পা দিলাম। আসলে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোতে এতোটা হাপিয়ে উঠেছিলাম কিছুদিনের জন্য সবকিছু থেকে হারিয়ে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে জন্মেছিল। তবে এর চেয়েও ফিরে আসিনি মূলত প্রচণ্ড খেদ বা অনুতাপ থেকে আপনাদের এতোটা অপেক্ষা করানোর। নিজেকে গুছিয়ে গুছিয়ে নিতে নিতে দেখি মাস খাণেক হয়ে গিয়েছে বিরতি নেওয়ার, কিছুটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম মাঝে মাঝেই এমন পাঠকদের অপেক্ষা করানোর থেকে লেখালেখি থেকে বিদায় নেওয়াই বরং ভালো হবে। তারপর ঘনঘন অসুস্থতার গল্প তো এখনও চলছেই। এই অসুস্থতার কারণে কলেজে দুটো দিন ঠিকমতো যেতে পারিনি, জীবনে প্রথমবারের মতো পরীক্ষা মিস দিলাম। শিক্ষকদেরও বোধহয় বিরূপ ধারণা জন্ম নিয়েছে আমার প্রতি। যাই হোক এই বছরটা হয়তো আমার জন্য ছিল না। ফিরে আসবো না ভেবেও আপনাদের অসংখ্য ম্যাসেজ পেয়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। যদিও ভীতিটা প্রচুর, এতো অপেক্ষার পর আপনাদের প্রতিক্রিয়ার তাও… আর হ্যাঁ, আপনাদের টেক্সট সাড়া ফেলেছে ম্যাসেঞ্জারে, হৃদয়ে। সময় পাইনি বা ফেসবুকে আসিনি বললে ডাহা মিথ্যে ছাড়া আর কিছুই হবে না। পেয়েছি কিন্তু দেখিনি, সত্যি বলতে দেখার মন-মানসিকতা বা ইচ্ছেশক্তি কোনোটাই আমার ছিল না। তবে আপনাদের বিরামহীন এতো ম্যাসেজ পেয়ে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। বিরতিটা মোটেই প্ল্যান্ড ছিল না বুঝতেই পারছেন, তাই ক্ষমার আবেদন। বকা দিলেও রাগ করবো না, এর যোগ্য যে। তবে একটা গুড নিউজ বলি লেখালেখিটা আমার অভ্যাস, নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি ইতি টানার মানসিকয়া সত্ত্বেও। যারা চন্দ্রপুকুর সিজন 2 চাচ্ছিলেন, তাদের জন্য আরও রহস্যময় ফ্যান্টাসি, সামাজিক থ্রিলার ধর্মী প্লট সাজানো ও সূচনা পর্ব লিখে ফেলেছি। তবে কন্টিনিউ করবো না কি তা নিয়ে একটু দ্বিধায় আছি)

হাফসার মা তো রাগে, ক্ষোভে চিৎকার করে উঠেন, “আপনার মেয়ের গলার সাথে সাথে কি মাথাটাও গেছে না কি! কীভাবে রাক্ষসের মতো মারলো আমার মেয়েটাকে! দস্যি মেয়ে!”

কথাটা বলার সাথে সাথেই আবেগ ভাই সপাৎ করে এক চড় দিলেন হাফসার গালে। তাঁর রক্তচক্ষুর কেন্দ্রবিন্দু এবার হাফসার মা।

“ছোটোলোকের বাচ্চা, তোর সাহস কী করে হয় আমার বউয়ের নামে এগুলা বলার! দোষ করে আবার বড়ো গলা করছিস! তোর মেয়ের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিলো এমন নষ্টামি কার থেকে শিখলো? এখন বুঝছি যার মা একটা নষ্টা, সে তো হবেই আরেক নষ্টা। আর বড়োলোকের ছেলের বিছানায় যাওয়ার এতো লোভ তাহলে রাতে রাস্তায় দাঁড় করাতে পারেন। আমি তো সামান্য মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত, কিন্তু সেখানে একদম খানদানি বড়লোক পাবেন, আবার পার ডে ইনকাম।“

মুখে তাঁর সূক্ষ্ম হাসি স্থির। কণ্ঠস্বর গম্ভীর ও সাবলীল। দেখে মনেই হচ্ছে না এতো তিক্ত বাণী উচ্চারণ করছেন তিনি। যত্তসব অসভ্য লোক! তবে হ্যাঁ, এই অসভ্য লোকটা আমার ভীষণের চাইতেও ভীষণ প্রিয়। কারণ তিনি শুধু আমার ক্ষেত্রেই অসভ্য।

আমি মিটমিট হাসছি, প্রাণপণ চেষ্টায় নিজের মুগ্ধতাকে বাঁধার চেষ্টা করছি হৃদ মাঝে। হাফসা আর তাঁর মায়ের চোখ জোড়া থেকে বয়ে চলেছে নোনাজল। আর যাই হোক আমাদের পরিবার বেশ বড়োসড়ো ঝটকা খেয়েছেন আবগে ভাইয়ের মুখের বচন শুনে। আয়েশা তো একটু বেশিই।

“কীসব বলছিস মেয়েটাকে, আবেগ!”
এতোটুকু বলেই নিঃশ্চুপ হয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন।

আমি ঠোঁট কামড়ে আমার অসভ্য লোকটার দিকে তাকালাম। মানে এই লোকটা শুধু আমাকেই চুপ করানোর মাঝে সীমাবদ্ধ নন। আবেগ ভাই নিজের ফোন ঘেটে ভয়েস ম্যাসেজটা অন করতেই হাফসার বলা সব কথা কর্ণগোচর হয় সকলের। ঐ সময় ভুলক্রমে কথাগুলো ভয়েস ম্যাসেজ হিসেবে আবেগ ভাইয়ের আইডিতে চলে গিয়েছিল।

“আমার আর মনে হয় না এখন কোনো এক্সপ্লেইনেশনের দরকার আছে আমাদের।“

আমার বাবা হুংকার দিয়ে উঠে,
“ছিঃ! ছিঃ! ইচ্ছে করছে থুঃথুঃ দিতে তোমাদের মুখে! হাফসার বাবা হিমেল ছিল মাটির মানুষ, আত্মার সম্পর্ক ছিল আমাদের। সেই সম্পর্কের খাতিরেই ওর মৃত্যুর পরপরই তোমার মেয়ের দায় কাঁধে নিয়েছিলাম। কারণ চারদিন না পেরুতেই তুমি তোমার পুরান প্রেমিকার গলায় ঝুলে গিয়েছিলে। তোমার মেয়ের উপর বাবার ছায়া হয়ে থেকেছি আমি, আমার পরিবার কখনও তাকে সামান্যতম কটু কথাও বলেনি। আমার স্ত্রীও কখনও আপত্তি করেনি। এর বিপরীতে তোমরা এই প্রতিদান দিলে? আর আমার মেয়ে…! সে তো ছোটো বোনের মতো ভালোবেসেছে, আগলে রেখেছে, ভাগ দিয়েছে সব জিনিসে সব জিনিসে চাইতেই। আর তোমার মেয়ের চাইতে চাইতে এমনই চক্ষু লজ্জা নিচে নেমেছে যে এখন তার ভালোবাসা আর স্বামীরও ভাগ চাইছে! আগে জানলে তোমাদের মা-মেয়েকে সাহায্য করা তো দূরে থাক মুখে চুনকালি মাখিয়ে লাথি দিয়ে বের করতাম।“

“তুমি ওদের কি বলছো সামুর বাপ? আমি তো তোমাকে কতোবার বলেছিলাম এই মহিলার মেয়েকে ঘরে তুলো না। যেই মহিলা বিয়ের পরও প্রেমিকের সাথে পরকীয়া চালিয়ে গেছে, সেই কষ্ট স্বামীটা হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেও শিক্ষা হয়নি, সেই মহিলার রক্ত আর যাই হোক ভালো না। তাও যখন জায়গা দিয়েছিলে বন্ধুর মেয়েকে, মানলাম। এই মহিলার সাথে সম্পর্ক রাখতে দিলে কেন? বাচ্চা হিসেবে তো হাফসাও ফুলের মতোই সাফ মনের ছিল। কিন্তু ঐ যে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। এখানের শরীরের রক্ত আর মায়ের সঙ্গ দুইটাই খারাপ। আগে তো আমার সন্দেহ ছিল এইটা হিমেল ভাইয়ের মাইয়া না কি মায়ের পাপের ফল? এখন তো মনে হচ্ছে এমন মেয়ে কোনোদিনও হিমেল ভাইয়ের হতে পারে না।”

আমি আবেগ ভাইয়ের পিঠে খোঁচা দিলাম। ইশারায় বুঝালাম সবাইকে থামান আমি কিছু বলতে চাই। তিনি তা-ই করলেন। সবার জিজ্ঞেসু দৃষ্টি এবার আমার দিকে।

আমি ইশারায় বললাম, “এতো কথা বলে লাভ নাই। সোজা কথা আপনি আপনার মেয়ে নিয়ে এই মুহূর্তে এক কাপড়ে আমাদের বাসা ছাড়বেন। কারণ আপনার মেয়ের যাবতীয় কাপড়-চোপড় আমাদের দেওয়া। আর হ্যাঁ, আমার বাবার থেকে স্ট্যাম্প করে যে টাকা নিয়েছিলেন, ঐটা তো মাফ করা হয়েছিল ঐ টাকাও ফেরত দিবেন্। আমার চললে তো আমি আজকের দিন পর্যন্ত আপনাদের পিছনে আমাদের প্রতিটা পয়সা ফেরত দিতাম। কিন্তু এতোও জালিম নই তো আমি!”

হাফসার মা ও হাফসা অনেক হাতে-পায়ে ধরেন। কারণ হাফসার মায়ের নতুন স্বামী বা তাঁর ভাইয়েরা কোনো দিন হাফসাকে বাড়িতে স্থান দিবে না। আর হিমেল চাচার তো কেউ নেই-ই। আমি ভেবেছিলাম তাঁদের এতো আকুতি ও ক্ষমা জানানোর পর আমার নরম হৃদয়ের মা-বাবা কখনওই তাঁদের ফেরাতে পারবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে আজ তাঁদের পাথরের মতো পাষণ্ড হৃদয়। পুড়তে পুড়তে মোমও শক্ত হয়। হাফসারা বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই বিব্রত ভঙ্গিমায় বেরিয়ে গেল।

আমাদের প্রতিটি দিনকে সুখময় কাটছে এখন। আবেগ ভাইয়ের মতো এতোটা কেউ কখনওই আগলে রাখেনি। নিজেদের কোনো প্রেমকাব্যের রাজা-রানি মনে হয়। প্রেমিক রাজা তাঁর সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আগলে রেখেছিল নিজের প্রেয়সীকে, তেমনই আমাকে আগলে রাখে, প্রতিনিয়ত নতুন করে বাঁচার, নিজের জন্য ভাবার প্রেরণা দেন আবেগ ভাই। আর আমাদের এই ছোট্ট এক কামরার ফ্ল্যাটটিও কোনো রাজভবন থেকে কম নয় আমার জন্য।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে ভূমির বুকে। কী শীতল চারিপাশ! যেন শীতকাল সময় ছাড়াই এসে চমকে দিয়েছে। অথচ, আজ সকালেই কিন্তু ভ্যাপসা গরমে অসুস্থ করে তুলছিল আবহাওয়া। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিনা কারণেই মিটমিট করে হাসছি। মনটা আজকাল বড়ো বেশিই ভালো থাকে আমার। কয়েক মুহূর্ত পরই আমার কোমড় জুড়ে এক জোড়া উষ্ণ হাতের বিচরণ। আমি কম্পিত হলাম। সম্পর্কটার বয়স সাত মাস পনেরো দিন ছাড়ালেও তিনি এবং তাঁর স্পর্শ আজও আমার নিকট সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো সতেজ ও নব্য।

“আবেগ ভাই, ছাড়েন তো। ভালো লাগে না।“ দূরে সরে ইশারায় বললাম। কপট রাগ আমার চোখে-মুখে।

তিনি ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। মুখটা আরও একটু এগিয়ে টুপ করে নাকের উপরে আলতো এক কামড় বসালেন। তিনি জানলেনও না এটুকুতেই রন্ধ্রে রন্ধ্রে জ্বালা ধরিয়ে দিলেন।
“মায়াবালিকা, শেষবারের মতোন বলছি আমার ডিস্টার্বেন্স পছন্দ না জরুরি কাজের মাঝে। ফার্দার যেন বলা না লাগে।“ আমি ভেঙচি কাটলাম। এসবও না কি মানুষের জরুরি কাজ হয়।

“চুপ করে না থাকে এখন যেয়ে পড়ার টেবিলে বসো। আমি একটু পর আসছি। আর এই এক্সামে যদি টপে তোমার নাম না থাকে তাহলে… বুঝে নিও।“

পড়াশোনার ক্ষেত্রে বরাবরই আমি তেমন সচেতন নই, তবে একদম অমনোযোগীও নয়। কিন্তু রেজাল্টে প্রথম সাড়িতে থাকা আমার জন্য ভাবনাতীত। তার উপর পূর্বের বেশির ভাগ দিনগুলোতে মানসিক অশান্তিযাই হোক এই অসভ্য শিক্ষকের কথা তো আর অমান্য করা যায় না। চুপচাপ যেয়ে বই নিয়ে বসলাম।

বই খুলে কিছুক্ষণ পাতা নড়াচড়া করতেই, মনে হলো কতো পড়ে ফেলেছি আজ। অথচ, ঘড়ি মশাই বলছেন সবে মাত্র পাঁচ মিনিট হলো। বিরস মনে নোটগুলোতে ডুবার চেষ্টায় আমি তৎপর, তবে এ যেন মৃত সাগরে ডুবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। উপন্যাস কিংবা গল্পের বই হলে ভিন্ন কথা ছিল।

“মায়াবালিকা, বই-টই গুছিয়ে ফেলে রেডি হয়ে নেও। হাসপাতালে যাবো রিপোর্ট দিবে।“

আমি স্বভাবগতই প্রচণ্ড অলস ধাঁচের মেয়ে। যেখানে আমার বয়সী মেয়েদের ঘোরাঘুরি বেশ পছন্দনীয় কাজ, সেখানে আমার জন্য তা এক অঘোষিত বিরক্তি। হাসপাতাল তো আরও বিরক্তিকর জায়গা, আর এখন ভাগ্যদোষে প্রায় রোজ রোজই সেই হাসপাতালের দর্শন করতে হয়। কিন্তু আজ তো আমার ভার্সিটি, হাসপাতাল সবকিছু থেকেই ছুটি ছিল। আজকের দিনটা আমি কিছুতেই হাসপাতালের ফিনাইলের গন্ধে, কৃত্রিমতার মাঝে কাটাবো না। কিছুতেই না।

ইশারায় বুঝালাম আমাকে আজ বম মেরেও তিনি হাসপাতালে নিতে পারবেন না। তাতে খুব বেশি লাভ হলো বা পাত্তা দিলেন বলে মনে হলো না। বরং, তিনি তাঁর মতো টিশার্ট, গ্যাবার্ডিং প্যান্ট নামালেন। আমিও কম জেদি নই জন্মগত ভাবেই। বই-খাতা কোনোরকম রেখে ফোন নিয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এর পূর্বে এই শীতেও পূর্ণ গতিতে ফ্যান চালু করতে ভুললাম। এ এক শব্দহীন বার্তা আবেগ ভাইয়ের জন্য। তিনি খুব ভালো করেই জানেন আমি এভাবেই ঘুমাই।

চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নাই তাই ফোনে কম সাউন্ডে দ্য আজাইরা লিমিটেড এর বেশ পুরোনো একটা ভিডিও ছাড়লাম। তাদের ভিডিওতে হাসি না দিয়ে থাকা বেশ কঠিন। হাড় কাঁপিয়ে হাসি পেল, দমন করার কঠোর পরিশ্রম ব্যর্থ করে খিলখিল করে হেসে উঠলাম।
আবেগ ভাই কোনো বিলম্ব ব্যতীতই হাত শক্ত করে ধরে টেনে উঠালেন আমায়। সচকিত হয়ে মুখ থেকে কাথা সরালাম আমি। সবসময়কার মতোন গম্ভীর তাঁর মুখশ্রী।

“এগুলো কোন ধরনের ঘাড় ত্যাড়ামো মায়াবালিকা? হাসপাতালে যেতে হবে তো ডাক্তার ইমারজেন্সি ডাকিয়েছে। দেখো মেয়ে তোমার রাহা আপুও কিন্তু যেতে বলেছেন। আমি যাচ্ছি রিপোর্ট আনতে। উনি তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবো, তুমি উনার সাথে দেখা করতে চাও না বলে আসোনি।”
একটু ভাঙলাম, তবুও মচকালাম না। মানে বিচলিত হলেও শক্ত থাকলাম। কয়েক মুহূর্ত বিরক্তি ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। আমি অনুধাবন করলাম, এবার বোধহয় হার মেনেছেন। কিন্তু তা আর কোথায়?

আমার মোটাতাজা দেহটা কয়েক মুহূর্তেই আবদ্ধ করে নিলেন নিজের মাঝে। বুঝি না, এতো শক্তি কোথায় পায় অসভ্য লোকটি!

আমি ছাড়ার জন্য ছোটাছুটি করছি। তাঁর ধরে রাখতে সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু ছাড়ার পাত্র তিনি তো নন।
“তুমি যাবে। আমার সাথেই যাবে। এখনই যাবে মায়াবালিকা!”

আমি মাথা নাড়িয়ে না, না বুঝাচ্ছি৷ চিৎকার করছি, কিন্তু মুখ দিয়ে অদ্ভুৎ রকমের শব্দ বের হচ্ছে।

“তুমি যাবে, বলেছি না! জাস্ট স্টপ ইট!”

আবেগ ভাই বারবার একই কথা বলেই যাচ্ছেন। আমিও বারবার না বলছি ইশারায় ও শব্দে, য

“না!” শব্দটা উচ্চারণ করে আমি নিজেই শকড। আবেগ ভাইও মুখটা মুরগির ডিমের সাইজের খুলে আমার পানে তাকিয়ে আছেন। তবে সেদিকে আমার ধ্যান নেই, আমি বিচার-বিবেচনা করতে ব্যস্ত যে যা হলো তা কী সত্যিই হলো না কি কোনো স্বপ্ন বা হ্যালুসিনেশন।

ভাবনার মাঝেই নিজেকে ভারশূন্য, চরকিতে ঘুরছি মনে হলো। সেকেন্ড কাটতেই বোধগম্য হলো আমি প্রকৃতপক্ষে আবেগ ভাইয়ের কোলে অবস্থান করছি। তিনি এমন ভাবে আমায় কোলে নিয়ে ঘুরাচ্ছেন, লাফাচ্ছেন যেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো সুসংবাদটা কর্ণগোচর হয়েছে।

মেয়েদের পাগল করা খিলখিল হাসি, মুক্তঝরা হাসি নিয়ে বহু লেখক-কবি কাহিনী রচনা করেছেন। পুরুষদের সাথে না কি এ শব্দগুলো যায় না। কোথায় যায় না? এই যে এই মানুষটি খিলখিল করে হাসছেন, তাঁর হাসিতে মুক্ত নয় অজস্র হিরাই বরং ঝরছে। আমি নির্নিমেষ চাহনিতে দেখছি। আমার রন্ধ্র রন্ধ্র কম্পিত হচ্ছে, উন্মাদনা ছড়িয়ে যাচ্ছে দেহ-মনে।

বারবার একটা কথাই ঘুরে-ফিরে ভাবছি, – এই হাসিটা এতো সুন্দর, এতো ঘায়েল করা! কোথায়? ধারণা ছিল না তো! একদমই ধারণা ছিল না! এতো পাগল করা হাসি বলেই কি তিনি লুকিয়ে রাখতেন হাসিকে? কে জানে? জানা নেই। তবে মনে হচ্ছে, এই পাগল করা হাসিটার জন্যই, তাঁর এই সীমাহীন আনন্দ দর্শনের জন্যই না হয় আল্লাহ আমার কণ্ঠ ফিরিয়ে দেক।

আবেগ ভাইয়ের জোরাজুরিতে যথাসময়েই হাসপাতালে পৌঁছে যাই। ডাক্তারের কেবিন থেকে বের হয়ে করিডোরে পা রাখতেই রাহা আপু সঙ্গে সঙ্গে এসে আমায় জড়িয়ে ধরেন। আমি আলতো হাসি।

হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করি, “তুমি কেমন আছো? রাসেল সাহেব কেমন আছে? সবাই ভালো তো?”

“একদম ভালো। তুই তো ভালোই, ইনশা আল্লাহ এবার আগের মতোও হয়ে যাবি। ডক্টোর আহসানউল্লাহ স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে আগেই। আল্লাহর রহমতে তোর ভোকাল কর্ড আগে থেকে অনেকটাই রিকোভার করেছে। আর তোর সিচুয়েশন না কি প্রথম থেকেই অতোটাও বাজে ছিল না। সুস্থ হওয়ার যোগ্য। জানি না তোদের তোর অপারেশন করা ডক্টোর ভুল বা এমন হতাশাজনক তথ্য কেন দিয়েছে। তবে আরও ভরসার বিষয় স্যারের হাতে আসা তোর মতো সিমিলার সব কেইসগুলোতে ৮০%ই সুস্থ হয়েছে।“

“ইনশা আল্লাহ আপু। মায়াবালিকাও শীঘ্রই আগের মতো হয়ে যাবে। আল্লাহ ভরসা।“ আবেগ ভাইও সায় দেন।

জীবনে প্রথমবারের মতো নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এতো ভালোবাসার অধিকারী হলে কার না মনে হবে? তবে শুনেছি অতিরিক্ত সুখও না কি কপালে সয় না। আমার কপালে সহ্য হবে তো?

দেখতে দেখতে আরও একটি বছর ঝরা পাতার মতো উড়ে গেছে। আমি পুরো দমে গৃহিণী না হলেও বেশ কিছু অংশে কর্মের ঢেঁকি হয়েছি। এই যেমন ফজরের নামাজ পড়তে উঠে আবেগ ভাইকে উঠানো হোক বা ঘর-দোয়ার গুছিয়ে রাখা হোক বা দুপুরের রান্না, বিকালের নাস্তা হোক এসব কিছুতে পারদর্শী বা পারফেক্ট না হলেও আমি চেষ্টা করি রোজ রোজ। সকালের নাস্তাটা অবশ্য আবেগ ভাইয়ের ডিপার্টমেন্ট, আমি শুধু মাঝেসাঝে হেল্পার। রাতেরটায় দু’জনের ভাগাভাগি কাজ। কাপড় ধোয়াটা বা রোদ দেওয়াটাও তেমনই।

অবশ্য আমার মা একবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আবেগ ভাইকে সকাল সকাল কাপড় রোদে দিতে দেখেছিলেন, সাথে ভাবীও ছিল। এর পর তাঁদের কথার ঝাঁঝে বহুবার অনুরোধ কিংবা বলা হয়েছে একরোখা মানুষটিকে সব ডিপার্টমেন্টে আমায় প্রধান করতে, কিন্তু এই বালক কি আর বদলে গিয়ে কারো কথা মানতে পারেন? যদিও আমি নিজেও চাই না এই মানুষটি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হোক।

অসভ্য, একরোখা লোকটা আজকাল বড্ড বেশি দিশেহারাও হচ্ছে আমার কারণে। অবশ্য আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার মাঝে একটু একটু করে বেড়ে উঠা পুচকুটার। তার যে কী অদ্ভুৎ অদ্ভুৎ আবদার! রাত দেড়-দু’টো বাজে কসা মুরগি বা ঘুমন্ত দুপুরে কামালের বিরিয়ানী খাওয়ার লোভ কিংবা ঝাল করে ঘরে তৈরি হাক্কা নুডুলসের জন্য অস্থির প্রাণ।

সবমিলিয়ে আমাদের সম্পর্কটা এখনও ভোরে সদ্য ফুটন্ত বেলি ফুলের মতোই। আমার লজ্জা কিংবা তাঁর আগলে রাখা বা শাসন এখনও বেলির সৌরভের মতো দৃঢ়, আর তাঁর স্পর্শ আমার গায়ে যেন বেলির গায়ে লাগা প্রথম মুহূর্তের বাতাসের দোলা।

তবে হ্যাঁ, ছোটো একখানা আক্ষেপ আছে। চিনির দানার চাইতেও ক্ষুদ্র একটি মাত্র আক্ষেপ। তিনি আমাকে ভালোবাসি বলেননি, সরাসরি আজও প্রেম নিবেদন করেননি। যদিও তাঁর প্রতিটি বচন, কর্ম, শাসন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তবুও একটি বার এই অসভ্য পুরুষটির মুখে ভালোবাসি শোনা কি আর চাট্টিখানা কথা এই মায়াবালিকার জন্য!

“বউ! বউ! কোথায় গেলে তুমি? এদিকে আসো।” আমের আচারের বয়াম বেতের চেয়ারে ফেলে ছুটলাম দরজা খুলতে। শাশুড়ি মায়ের বাজখাঁই গলা শুনে কোন মেয়েই বা বসে থাকতে পারে।

“আ-আসেন।“ খাণিকটা কষ্ট করে উচ্চারণ করলাম। বলা বাহুল্য এখন দুয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারি।

“হুম, বুঝেছি। গরুর গোশতের পিঠালি এনেছি। আবেগকে বলেছিলাম অফিসে যাওয়ার পথে নিয়ে যেতে বা তোমাকে পাঠাতে। আমার মেয়েটা ভাইয়ের জন্য চুলার তাপে পুড়ে কতো কষ্ট করে রান্না করলো, ছেলেটাকে ফোন দিল কতোবার ধরলো না। ম্যাসেজ দিল কতোবার, সিন করে রেখে দিল। কী যে হলো ছেলেটার! পরের কথায়, পরের জন্য মায়ের পেটের বোনকে পর করে দিল। আল্লাহ।“

আমার রাগের অগ্নি মুহূর্তে জ্বলে উঠলো, অন্য কেউ হলে বা নিজের বাবা-মা হলে এতোক্ষণে কান ভর্তি শব্দের বিষ ঢেলে দিতাম। নিজেকে শান্ত করে পিঠালি ঢেকে রাখতে রাখতে ফোনে টাইপ করে ভয়েসে কনভার্ট করে করলাম। কারণ মুখে বলা জাগ্রত স্বপ্ন আমার জন্য।

“মা, আপনার ছেলে কোনো ছোটো বাচ্চা নয় বা বোকাও নয় তাহলে দেশের নামধারী পাবলিক ভার্সিটির একজন ব্রাইট ছাত্র হতো না। সেখানে পরের কথায় চলা তো স্বপ্নেও ভাবার বিষয়। আর পরের জন্য বা পরের কথায় না হলেও নিজের বোধশক্তি আর সঠিক-বেঠিক বুঝ থেকে করতে পারে। তা চা খাবেন মা? করে দেই। বাসায় তো এক দণ্ড রেস্ট পান না, আয়েশা আপুর মেয়ে থেকে শুরু করে রান্না টু ঘর সামলানো সব তো আপনিই করেন। আপা তো ফোনে ব্যস্ত থাকে। আই মিন ফোনে কাজে ব্যস্ত থাকে।“

শাশুড়ি মা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। নিচু কিন্তু স্পষ্ট ভাবেই “বেয়াদব” শব্দটা উচ্চারণ করে দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে বের হয়ে গেলেন। আমি বিরক্তিমাখা শ্বাস ফেললাম। এই মানুষটি আমাকে যে তেমন একটা পছন্দ করে না তা আমি প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছি, তবে সত্য বলতে একদম অপছন্দও করেন তাও নয়৷ বরং, মন তাঁরও বেশ ভালোই। আমি বাড়িতে একা থাকি বলে এটা-ওটার বাহানায় বারবার চলে আসেন আমি ঠিক আছি কি না দেখতে।
এই তো পাঁচ-সাড়ে পাঁচ মাস আগে চিকুনগুনিয়ার আক্রমণে কাতর। আমার মা-বাবাও উমরা হজ্জে দেশের বাহিরে। ভদ্রমহিলা এক পাও নড়েননি আমার পাশ থেকে। খেতে পারতাম না বলে টক-ঝাল আঁচারি মুরগি থেকে মজাদার পাঁচমিশালী নিরামিষের মেল বসিয়েছিলেন। ডাবের পানি তো প্রতিদিন খায়িয়েই দম ফেলতেন।

আমি মায়ের সাথে তাঁর তুলোনা করবো না, মা তো নয় আমার। এতে যেমন আশা বাড়ে, তেমন মন ও সংসারের অশান্তি। তাঁর থেকে মায়ের মতো আরাম-আহ্লাদ আশা করি না, আর না তেমন মমতা, না নিজে মায়ের মতো স্থান দিব বলি, তবে মানি তাঁর দায়িত্বও আমার। যদি কোনোদিন অসুস্থতায় একমুঠো ভাত রান্না করে খাওয়ায়, তাতেও আমি কৃতজ্ঞ বটে।
যতোটুকু বুঝেছি খারাপ নয় তিনি। তাঁর অসন্তুষ্টি বা ক্রোধ বা ক্ষোভটাও একদম অস্বাভাবিক নয়। কোন মা সহ্য করবে পরের মেয়ের জন্য নিজের সন্তানদের মাঝে দ্বন্দ্ব। যতোই সেই মেয়ে সন্তানের স্ত্রী হোক না কেন। আমিও ব্যতিক্রম কেউ হবো না হয়তো এক্ষেত্রে।

বস্তুত, আবেগ ভাই যে আয়েশার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন না, এতে আমারও নীরব সম্মতি আছে। আমি ভেবেছিলাম সব জানার পর হয়তো সে অনুতপ্ত হবে, ক্ষমা চাইবে, নরম হবে আমার প্রতি। কিন্তু এই বিশাল পৃথিবীতে কিছু মানুষের হৃদয় পিপীলিকার দেহ হতেও ছোটো, তাঁরা নিজের ভুল স্বীকার করতে বা নত হতে একদমই শিখেনি। ক্ষমা তো দূরেই থাক, তার ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে সামান্যতম স্নেহ বা সম্মান করে না। মুখোমুখি হলে এমন একটা ভান করে যেন আমি খুব তুচ্ছ কেউ, খোঁচা মারা তো আছেই। আবেগ ভাই আমাকে তাই ঐ ফ্ল্যাটে যেতে একদম মানা করেছেন, নিজেও খুব কম যান। কারণ আয়েশার স্বামী বিদেশ থাকায় সে প্রায় সারা বছরই শ্বশুরালয় ছেড়ে পিতৃগৃহে পড়ে থাকে।

মাঝে মাঝে স্বার্থপরের মতো ভাবি সে না থাকলে কতো ভালো হতো। সবার সাথে থাকা যেতো, শ্বশুর মশাইয়ের সাথে সাথে হয়তো শাশুড়িও এবার মায়ের না হোক খালার স্নেহটাই দিতেন।

এসব ভাবতে ভাবতে ফোনে একটা কল আসে। আননোন নাম্বার, খাণিক বিরক্ত হলাম। এই সময়টা অসভ্য লোকটার কলের জন্য বরাদ্দ, বিরক্ত হওয়ার কথাই তাই।

“আমার পঁচিশ হাজার টাকার অনেক প্রয়োজন। মা চাচা-চাচীকে কল দিয়েছিল, ধরছে না। চাচা রে বইলো কালকের মধ্যে দিতে।“ ফোনের অপরপাশ থেকে হাফসার কথা শুনে ঠাঁটিয়ে চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছে। কল কেটে দিলাম।

টেক্সট পাঠালাম,
-তোর মায়ের আর তোর লজ্জা-শরম নাই? এতো কিছুর পরও আবার টাকা চাইছিস! তুই তো ছেলে ফাঁসানোর টেকনিকে একদম সিদ্ধ মানবী, আবেগ ভাইকে তো ফাঁসাতে পারিসনি। নতুন মুরগী খোঁজ। কবি তো বলেছেনই, একবার না পারিলে, দেখো শতবার।

আবারও কল আসলো। কেটে দিলাম। এই মানুষগুলোকে দেখে আসলেই অবাক হই, এমন কেন এরা? পরপর চারবার কল দিলেও রিসিভ করলাম না। আবেগ ভাইকে কল করলাম। আজ কী হলো মানুষটার এখন অবধি কল দিলেন না।চারবার রিং হতেই কণ্ঠের তৃষ্ণা মিটলো।

“কী হয়েছে? কল করেছো কেন? কোনো কাজ আছে?” খাণিকটা অদৃশ্য ধাক্কা খেলাম। আবেগ ভাইয়ের চড়া গলা, বিরক্তির রেশ স্পষ্ট। নিজেকে সামলে নিলাম দ্রুতোই।
“এ-এমনি।“
“আচ্ছা, রাখো তাহলে। আর এভাবে বিনা নোটিশে কল দিবা না প্লিজ। মিটিং ছেড়ে আসতে হলো।“

হৃদমাঝে চিনচিনে এক ব্যথার সঞ্চার হলো। কোনো রকম ‘হু’ উচ্চারণ করে কল কেটে দিলাম। অলক্ষ্যেই কপোল গড়িয়ে এক ফোঁটা অশ্রু যেয়ে মিশে গেল শাড়ির আঁচলে।

টুং করে এক আওয়াজ হলো ফোনে। হাফসা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
-খুব উড়ছিস না আবেগের বউ হয়ে, তাই না? আবেগ আসলেই কি তোকে ভালোবাসে? হাউ ফানি! তুই আসলেই বোকা না নিজেকে বৃথা আশা দিচ্ছিস? আরে মেয়ে তুই ওর ভাগ্নীকে সেভ করতে গিয়ে বলি হয়েছিস, এজন্য জাস্ট তোকে কাঁধ দিতে বিয়ে করেছে সহানুভূতি দেখিয়ে। ভালোবেসে না। এখন তো বিয়ের মাত্র কয়েকদিন, আর কিছু সময় কাটুক এই মোহ-মায়া কেটে যেয়ে বিরক্তের নাম হবি তুই।

অন্য সময় হলে এ ধরনের কথাগুলোতে হয় রেগে যেতাম, নয় এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু আজ কেন যেন বিচলিত হচ্ছি। সত্যিই তো আবেগ ভাই কখনও ভালোবাসি বলেননি। আজ আবার হুট করে এমন বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ। পরক্ষণেই নিজেকে বোঝালাম। হতে পারে অফিসে সত্যিই কোনো ঝামেলা বা কাজ ছিল সেই চাপেই হয়তো না করেছে। আর একবার তো আবেগ ভাইকে কষ্ট দিয়েছিই তার কথা বিশ্বাস না করে, এই মেয়ের প্ররোচনায় পা দিয়ে। আর না। সামনে ইনকোর্স পরীক্ষা, সব ভাবনা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় ডুব দিলাম।

আবেগ ভাই চিকেন চাপ খেতে খুব ভালোবাসেন, তবে নান বা তন্দুররুটির সাথে নয়। অদ্ভুত ভাবে হলুদ ছাড়া পোলাও দিয়ে করা ঝরঝরা খিচুরির সাথে তাঁর চাপ পছন্দ, সাথে মরিচ ভাঁজা আর মিক্স সালাদ হলে তো কথাই নেই। কোমড়ে আঁচল গুঁজে রান্নায় লেগে পড়লাম। হতে হতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেল। আমিও ঘেমে নেয়ে গিয়েছি, প্রচণ্ড গরম আর অস্থির লাগছে তাই তাড়াতাড়ি ঢুকলাম ওয়াশরুমে।
বের হয়ে দেখি আবেগ ভাই গভীর মনযোগ সহকারে বিছানায় হেলান দিয়ে ফোনে কিছু একটা করছে। আমি চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে গেলাম কাপড়-চোপড় এবং তোয়ালেটা রোদ দিতে। এবার ঘোর ভাঙলো তাঁর।

“এটা কোনো সময় মায়াবালিকা গোসল করার! যদি জ্বর-ঠাণ্ডা বা কিছু একটা হয়! তার উপর কতোক্ষণ লাগিয়ে গোসল করেছো।“ সেই পুরোনো গম্ভীর দৃষ্টি, রাগান্বিত কণ্ঠ। আমি এসবে বড়োই অভ্যস্ত। তাই কিছুটা কম্পিত হলেও পাত্তা দিলাম না।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আঁচল ভাজ করে নিতে নিতে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছি। আগের থেকে পেট কিছুটা ফুলে উঠে একজনের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। সাধারণত বোঝা যায় না, তবে এই ফিনফিনে পাতলা জরজেটের শাড়িতে স্পষ্ট।

“মায়াবালিকা তুমি কিন্তু বড্ড বেড়েছো। কথা কানে যাচ্ছে না!”
এবার বিছানা ছেড়ে একদম আমার পিঠে বুকে ঘেঁষিয়ে দাঁড়ান আবেগ ভাই। আলতো ভাবে গালটা চেপে ধরলেন। আমি কিছু না বলেই হাতটা গাল থেকে ছাড়িয়ে উদরে এনে রাখলাম।
“আমাদের।”

তাঁর ভাবমূর্তি বদলালো। শুধালেন,
“আমার, আমাদের!”

আমি নিবিড়ভাবে মিশে গেলাম তাঁর বক্ষপিঞ্জরে। অবশেষে আজ বলেই ফেললাম, “ভালোবাসি” লজ্জায় রাঙা হয়ে। এই প্রেম কাহিনী প্রেম নিবেদনটা নাহয় আমার থেকেই শুরু হোক। উত্তর দিলেন না তিনি। পূর্বের মতোই গম্ভীরতার রেশ ধরে নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমার সকল অনুভূতি সেকেন্ডেই যেন মাটিতে মিশে গেল। বহুদিন পর এই মানুষটির দ্বারা আহত হলাম আমি, যেমন তেমন আহত নয়, গভীর ভাবে আহত।

ধীর ভাবে সরে আসলাম। থমথমে মুখ খানা নিয়ে বের হয়ে গেলাম শয়নগৃহ ছেড়ে। তিনিও পিছন পিছন আসলেন।

আমার মাথাটা যেন হ্যাং হয়ে গিয়েছে, এলোমেলো ভাবনাগুলো মস্তিষ্ক জুড়ে৷ অথচ, কিছুই প্রসেস হচ্ছে না৷ নিঃশব্দে, কাঠপুতুলের মতোন রান্নাঘর থেকে খাবারের হাড়ি এনে রাখলাম। প্লেট, গ্লাস, সালাদ সব সাজিয়ে, প্লেটে তুলে দিলাম কোনো এক ঘোরেই৷

“বাব্বাহ! আজ তো শুক্রবারও না, না কোনো ওকেশন, তাও… যাক আমারই ভালো। কী হলো? তুমি খাচ্ছো না ক্যানো মায়াবালিকা?”

“হু!” চমকে উঠে অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় হাসলাম।

কোনো রকম দুয়েক গ্রাস মুখে তুলেই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম৷ আবেগ ভাই ল্যাপটপ নিয়ে বসলেন, কোন প্রজেক্ট না কি আছে। যে মানুষটা আমায় প্রতিটি মুহূর্ত আগলে রাখে, এতোটা ব্যস্ততা তাঁর আজ কষ্টদায়ক। বড়োই কষ্টদায়ক!

নয়নযুগল বন্ধ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, কতো বার পিঠ বদল হলো, তবুও নিদ্রার আগমন আর ঘটলো না। এলেমেলো চিন্তার ভারে, অদম্য এক যন্ত্রণায় পুড়লাম আমি গোটা রাত্রি। অবশেষে আবেগ ভাই শেষ রাতের দিকে বিছানায় এসে নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরলে ঘুম ধরা দিল চোখে।

চলবে…

জানালার ওপারে পর্ব-১৫ | বাংলা রোমান্টিক ভালোবাসা গল্প

0

#জানালার_ওপারে
||১৫তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
রাত যতো নামছে, আমার হার্ট বিট তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে। আমি ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমার ভয়ের কারণের দিকে। যা আর কেউ নয়, অবলা বেডটি। কী সুন্দর অবলা, অসহায়ের মতো এক জায়গায় স্থির। অথচ কী চমৎকার ভাবে আমার ব্লাড প্রেশার, টেনশন সব বাড়িয়ে দিচ্ছে।

জীবনের বাইশটা বছর পুরুষবিহীন বিছানায় দিবারাত্রি যাপন করে কী করে সম্ভব আবেগ ভাইয়ের সাথে এক বিছানায় শোয়া? তীব্র অস্বস্তি, অতিরিক্ত চিন্তা, ভীতি সব যেন আমায় জড়িয়ে নিয়েছে।

“মায়াবালিকা! না পড়ে বেডের দিকে তাকিয়ে আছো কেন! পড়া চোর কোথাকার! আইবুড়ো হয়েও পড়া নিয়ে হেলাফেলা!”

বইয়ের দিকে চোখ নামিয়ে ইচ্ছেমতো বকছি অসভ্য লোকটি! তখন তাঁর ঐ ফালতু কথা না শোনায় শাস্তি স্বরূপ আমাকে বারোটা অবধি পড়তে বলেছে। আচ্ছা, এতোটা চিন্তা, বাড়ন্ত হার্টবিটস, ভয় নিয়ে কেউ পড়তে পারে? আমি তো একদমই পারছি না।

‘জোরে জোরে পড়ো মেয়ে! সামনে এক্সাম, ফেইল করে আমার নাম না ডুবাও তুমি ভার্সিটিতে!” পুনরায় তাঁর ধমক।

কী আর করার জোরে জোরে পড়তে শুরু করলাম। তিনিও বসে টপিক্সগুলো বুঝিয়ে দিলেন। পড়তে পড়তে ঘুমে ঢলে পড়ছি। তাও অসভ্যটা ছাড়া দেয় না আমায়। অতঃএব চোখে অঢেল ঘুম নেমে পড়ে, আমিও হারিয়ে যায় নিদ্রায়।

সকাল সকাল ঘুম কিছুটা ভাঙতেই মাথার নিচে শক্ত অনুভব হচ্ছিলো। আমি কিছুটা চমকে যাই। চোখ খুলতেই অসভ্য লোকটার নগ্ন বুকের মাঝে নিজেকে পাই। বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠি আমি।

আবেগ ভাই ধড়পড় করে উঠে বসেন। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করেন,
“কী হয়েছে? কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছো কেন মায়াবালিকা?”

আমি হাতের ইশারায় উত্তর দেই,
“অনেক কিছু হয়ে গেছে। আপনি এখানে কী করছেন? আর আপনার জামা-কাপড় কোথায়? লাজ-লজ্জার বালাই নেই আপনার মধ্যে একটা মেয়ের সাথে কাপড় না পরে শুয়ে আছেন।”

তিনি ঠোঁট কামড়ে আমার দিকে তাকান। আমি চোখ নামিয়ে ফেলি তখনই। কী তীক্ষ্ম দৃষ্টি! ক্ষোভ, রাগও তাতে স্পষ্ট।

“সিরিয়াসলি মায়াবালিকা! তুমি এই সামান্য কারণে আমার ঘুম নষ্ট করে ফেললে! তুমি জানো আমি কয় রাত পর রাতে ঘুমালাম আজ?

আর কী বললে? আমি তোমার সাথে শুয়েছি কেন? আরে মেয়ে তুই আমার বউ, তোর সাথে শুবো না তো পাশের বাড়ির জরিনার সাথে শুবো।

আর আমি কাপড় না পরে শুয়ে ছিলাম? তো এই প্যান্ট কি অদৃশ্য? চোখে পড়ে না তোমার? ঠিক আছে। চোখেই যখন পড়ে না, তখন এই প্যান্ট রেখে আর কী করবো খুলেই ফেলি!”

তাৎক্ষণাত তিনি প্যান্টের বাটনে হাত দিলেন। আমি তেমন একটা পাত্তা দিলাম না। জানি, ভয় দেখাতে করছেন। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল করে তিনি বাটন খুলে চেইনে হাত দিতেই চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম আমি।

হাতজোড় করে অনুরোধ করলাম ইশারায়। মুখের ভাব খানা এমন আমার যে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’।

“হয়েছে, হয়েছে, চোখ খুলো মায়াবালিকা। কিছুই হয়নি, সব যার যার জায়গাতেই আছে। তবে এর পর থেকে বুঝে-শুনে কথা বলবা, নাহলে অনেক কিছুই জায়গায় থাকবে না। তা তোমারও, আমারও। এখন যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। সোজা রান্নাঘরে আসবা, ব্রেকফাস্ট বানানো লাগবে।”

আমি ভেঙচি কেটে উঠে গেলাম বিছানা থেকে। হাত-মুখ ধুয়ে আসলাম। প্রচণ্ড গরম পরেছে, তাই লাগেজ থেকে একটা শর্ট টপ ও পালাজু নামিয়ে পরে নিলাম। বাসায়ও গরমে এগুলোই পরতাম, তবে এখানে কেমন যেন একটা দ্বিধা বোধ হচ্ছে

আমি রান্নাঘরে পৌঁছাতেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন আবেগ ভাই। তাঁর চোখ সরছেই না আমার উপর থেলে। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হলাম আমি। অনর্থক চুল হাত দিয়ে ঠিক করলাম, মুখ মুছলাম, ওড়না আরও ভালোভাবে পরে নিলাম।

“এতো অস্বস্তি বোধ হওয়ার কিছু নেই মায়াবালিকা। আমি তোমাকে এই অবস্থায় প্রথম দেখছি না। বাই দ্য ওয়ে তোমাকে ভীষণ রকমের এট্রাক্টিভ লাগছে বর্তমানে, আমি কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ছি বলতে গেলে।”

এমন নির্লজ্জের মতো দ্বিধাহীন ভাবে একবার পলকও না ফেলে কেউ এমন বাণী উচ্চারণ করতে পারেন? তাও কি না গম্ভীর কণ্ঠে! আমাকে হয়তো তাঁর হতে দূরে থাকার শাস্তি স্বরূপ পদে পদে লজ্জা দেওয়ার শপথ নিয়েছেন না কি? কিন্তু আমাকে এ অবস্থায় আগে দেখেছেন অর্থ কী? আমি তো বাহিরে হিজাব, ঢিলাঢালা, লম্বা জামা-কাপড় ছাড়া বাহিরেই যাই না।

যাই হোক আমি লজ্জা চাপিয়ে কপোট রাগ আনলাম চেহারায়। ইশারায় শব্দহীন ক্রোধ প্রকাশ করলাম।

“চুপ করুন তো! এসব কী লাগামছাড়া কথা বলছেন, হু?”

“আমার তোমার উপর পূর্ণ অধিকার আছে। তাই আমার তাকিয়ে থাকতে মন চাইলে আমি এভাবেই তাকিয়ে থাকবো। তাই যতো দ্রুতো সম্ভব আমার চাহনি, স্পর্শে, লাগাম ছাড়া কথাবার্তায়ও নিজেকে মানিয়ে নেও মায়াবালিকা। তাই-ই তোমার জন্য বেটার। এখন আসো আমাকে রান্নায় হেল্প করো।”

আমার চোখ রাঙিয়ে তাকানোতেও লাভ হলো। তিনি নির্বিকার ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর ইশারা করলেন।

“চা বানাতে পারো? আর ব্রেড, চিজ, বাটার, জ্যাম, ম্যাগি আছে ঘরে। ফ্রীজে কিছু সবজিও আছে হয়তো। আর গতকালের ডিনারের জন্য আনা কিছু চিকেন ফ্রাই রয়ে গিয়েছে। আমি তা দিয়ে কিছু একটা করছি।”

নিজের বানানো চায়ের স্বাদ মনে পড়তেই মুখটা বিদঘুটে হয়ে গেল আমার। তবে সরাসরি তো নিজের পরাজয় স্বীকার করা যায় না, মান-সম্মানের একটা ব্যাপার আছে।

“নাস্তা বানানো তো বেশ বড়ো কাজ। তা বরং আমি করি। চা তো ছোটো বাচ্চাও বানাতে পারে। সেটাই আপনি করে দিলে অনেক।” ইশারায় বুঝালাম।

আবেগ ভাই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। বুঝে গেল না কি আবার অসভ্য লোকটা! আমাকে স্বস্তি দিয়ে তিনি চুপচাপ চা বানাতে লেগে পড়লেন।

আমিও নাস্তা বানাতে শুরু করলাম। ফ্রীজ খুলে দেখলাম ফ্রোজেন কাটা সবজি আছে। বেশি করে পানি দিয়ে সবজি সিদ্ধ করতে দিলাম। হালকা সিদ্ধ হতেই ম্যাগি নুডুলস এবং এক চিমটি জিরা গুঁড়ো ও ধনিয়া গুঁড়ো দিয়ে দিলাম। তারপর ম্যাগির মশলা দিয়ে পানি শুকিয়ে নামিয়ে নিলাম। গতকাল রাতের চিকেন ফ্রাইগুলো ভালো করে হাড় থেকে ছাড়িয়ে স্লাইদ করে নিলাম। চিকেন স্লাইস, গাজর, শসা মায়োনিজ দিয়ে মিক্স করে স্যান্ডউইচের পুর বানিয়ে নিলাম। আধঘণ্টার মধ্যেই সব হয়ে গেল।

তবে জীবনে প্রথম বারের মতো রান্নার যুদ্ধে নেমে আমি ঘেমে নেয়ে গিয়েছি। আবেগ ভাই চা করে ফ্লাস্কে রেখে রুমে চলে গেছেন কিছুক্ষণ আগেই। হয়তো তৈরি হতে গেছেন। আজ থেকে তাঁর অফিসে জয়েনিং।

আমি ডাইনিংরুমে সব এনে ফ্যান ছেড়ে বসলাম। ওড়নাও খুলে এক পাশে রেখে দিলাম। আবেগ ভাই কালো প্যান্ট ও কালো চেক শার্ট, উপরে ধূসর রঙের ব্লেজার পরে চলে আসলেন কিছুক্ষণ পরই। আমি তাড়াতাড়ি ওড়না জড়িয়ে নিলাম গায়ে।

তিনি গলায় টাই লাগাতে লাগাতে বললেন,
“আমার সামনে এতো ফর্মালিটি দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই মায়াবালিকা। আমি স্বামী তোমার, পরপুরুষ নই। আর ওভাবেই বরং বেশি মানাচ্ছিলো তোমায়।”

এই লোকটাকে শুধু অসভ্য নাম দেওয়াটা ভুল হয়েছিল। সাথে ফাজিল, লুচু, অভদ্র নামও তাঁর প্রাপ্ত। আর কী করার? চুপচাপ মিস্টার অভদ্রের সাথে খেতে বসে পড়লাম।

আবেগ ভাই অফিসে চলে গেছেন। আমি কাজের অভাবে নিজের আর তাঁর গোছানো কাপড় আবার গুছিয়ে রাখলাম। ঠিক কাজের অভাবে নয়, তাঁর অনুপস্থিতিতে বোধ হওয়া অস্বাভাবিক শূন্যতা ভুলে থাকতে।

তা শেষ করে বারান্দার দরজা খুললাম। এখন অবধি আমি এই ফ্ল্যাটের বারন্দায় আসিনি। অবাক হলাম এই বারন্দাটি তো একদম আমাদের বাসার বারান্দার মুখোমুখি বারান্দাটা। এখানে কখনও কোনো মানুষ দেখিনি। মাঝে মাঝে শুধু রুমের লাইট জ্বলতো। তবে কখনও মনে হতো বারান্দার দেয়ালে থাকা জানালার আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এখন বুঝতে পারলাম তিনি কীভাবে আমাকে দেখেছেন।

আবেগ ভাইকে ভয়েস টেক্সট দেওয়ার জন্য আইকনে আঙুল ধরে বারান্দার দরজার পাড় হতেই হাফসার কণ্ঠ কর্ণগোচর হলো,

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আম্মা। আমি চেষ্টা করতাসি আবার সবার মন যোগাতে। কই মাছের জীবন মেয়েটার! এতো কিছুর পরও বেঁচে রইলো। আমি তো হাসপাতালে ভাবসিলাম, মরবোই। আমিও একদম হাতে হাতে আবেগ রে পায়া যাবো। সাত কপালের ভাগ্য হবে আমার, কতো বড়োলোকের ছেলে ও! আমার সেই কবের তে পছন্দ ছেলেটা রে! আমাদের কোচিংয়ে পড়াইতো। কতোবার চেষ্টা করছি পটানোর! পটেই না। শুনসিলাম ওর বড়ো বোন আয়েশার কথার কদর বেশি ঐ পরিবারে। সব ছেড়ে তাই উনাকে পটাতে লেগেছিলাম। সময় পাইলেই যেয়ে আড্ডা দিতাম তার সাথে। বানায়া বানায়া নিজের দুঃখের, সবার অত্যাচার করার কাহিনী শুনাইতাম, কাঁদতাম, পর্দা কইরা, ভালো আচারণের সহিত চলতাম। এতো পরিশ্রম শেষে মহিলা পছন্দও করেছিল।

অথচ, সামুটা কি না ভার্সিটিতে উঠতে না উঠতেই এমনিতেই আবেগটার মন পাইলো। তুমি যে আমারে বকছো, আমি কি কম করসি না কি আবেগকে পাওয়ার জন্য? আর সামুর থেকে আলাদা করার জন্য? আমি তো শুরু থেকাই সব টের পাইসিলাম তাদের বিষয়ে। তাই তো আয়েশার মন মিথ্যে মিথ্যে বদনাম দিয়ে বিষায় ফেলসিলাম একদম। বলতাম, ও খারাপ মেয়েদের সাথে মিশে, সাথে সিগারেটের গন্ধ আসে, অনেক ছেলে বন্ধু, কয়দিন পর পর প্রেমিক বদলায়। আমি কতো বুঝাই দ্বীনের পথে চলতে শুনেই না। আপু তো আবেগ ভাইয়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কল দেয়। আমারই বুদ্ধি ছিল পুরোটা। আমিই বলেছিলাম, যদি এমন একটা মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করা যেতো যাতে আবেগ ভাই না বুঝতে পারে সামু নয় অন্যকারো সাথে তার বিয়ে হচ্ছে। বিয়ে হওয়ার দিন দেখলেও মান-সম্মানের ভয়ে বিয়ে করে নিতো। আর এমন মেয়ে আমি ছাড়া আর কে ছিলাম? কারণ আমাকে সবাই এই বাড়ির, সামুর বাপের ছোটো মেয়ে হিসেবেই চিনে।

তাও যা হওয়ার তা তো হইসেই, আর কী করার? কিন্তু আম্মা, আমিও ঠিক করসি ঐ সামুকেও আমার চেয়ে ভালো স্বামী পেয়ে সুখে থাকতে দিব না। এখন তো শুধু ওর ননাসের কানে বিষ ঢেলেছি। আস্তে আস্তে শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, কাউকেই বাদ রাখবো না। আচ্ছা, আম্মা রাখি এখন। কে যেন আসছে।”

চলবে…

জানালার ওপারে পর্ব-১৪

0

#জানালার_ওপারে
||১৪তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আব্বু-আম্মু আবেগ ভাইয়ের জেদ ও জোরাজুরির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। অবশেষে সবার সামনে দিয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে চলে গেলেন আমায়। আমি বাধা দিতে অসফল, না আছে মুখে বলার জোর, না আছে কিছু বলার মুখ।

শুধু এক দৃষ্টিতে তাঁর উজ্জ্বল শ্যামা মুখখানার দিকে তাকিয়ে আছি৷ সত্যিই লোকটার শরীর ভীষণ রকমের ভেঙে পড়েছে। তার দীঘল পাপড়িযুক্ত চোখ দু’টোতে অনিদ্রার ফলে কালো গর্ত হয়ে গিয়েছে, চুলগুলো বড় হয়েছে, এলেমেলো, চাপা ভেঙে গিয়েছে গালের, তবে তা আড়াল করছে খোঁচা খোঁচা দাড়িরা। আগে কখনওই দাড়ির বালাই ছিল না তার মুখে। হয়তো এতো ঝামেলাতে সময় করে উঠতে পারেননি শেভিংয়ের। যদিও এভাবেই বরং তাঁকে মানাচ্ছে।

আমার বড্ড ইচ্ছে ছিল তাঁকে দাড়িতে দেখার, তবে সম্পর্কের স্পষ্টতা না থাকায় কখনও এ আবদার করা হয়ে উঠেনি৷ তবে এখন আমি তাঁর স্ত্রী, অধিকার নিয়ে বলবো দাড়ি রাখতে।

আমার এসব আজে-বাজে ভাবনার মাঝেই একটি ফ্ল্যাটের দ্বারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। দুশ্চিন্তার ক্ষীণ ভাঁজ আমার ললাটে একদম স্পষ্ট৷ এই অসভ্য লোকটি এতোটা অবুঝ কেন? তিনি কি বুঝেন না আমি প্রস্তুত নই এই পরিস্থিতির বা তার পরিবারের মুখোমুখি হতে।

আবেগ ভাই পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার লক খুলে আমার হাত ধরে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সারা ফ্ল্যাট অন্ধকার। তবে কি আবেগের বাড়ির লোক কোথাও গিয়েছে এখন?

তিনি আলো জ্বালাতে যান, আমি এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। ফ্ল্যাটটি বেশ ছোটো আকারের। বসার ঘর এবং ডাইনিংরুম একত্রে, একটা দরজা দেখা যাচ্ছে হয়তো একটা বেডরুম। তাহলে কি আবেগ ভাই একা থাকেন? ড্রইংরুমের ফ্রন্ট দেয়ালে বিশাল বড়ো একটা এলিডি, দেয়ালের সাথে লাগোয়া বেশ কিছু শোপিজে ভর্তি শেলফ। তার ঠিক বিপরীতে সোফা রাখা। সোফার বামে ডিভান আর ডানে একটি গোটা দেয়াল জুড়ে লাগোয়া শেলফ, একদম উপরের দিকের শেলফে বিভিন্ন পুরস্কার, সার্টিফিকেট, নিচের দিকে সেজে আছে নানা ধরনের বইয়ে।

ফিল্টারের পানির ধারার শব্দে ঘোর ভাঙে আমার। ফিল্টার থেকে এক গ্লাস পানি ভরে নিজে অর্ধেক খেয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমি শুচিবাইগ্রস্তা, আমার গ্লাস সবসময়ই আলাদা করা। যতোটুকু জানি তিনিও এমন। সেদিন ভুলে-ভালে হয়েছিল তা অন্য ব্যাপার কিন্তু তাই বলে আজ জেনে-শুনে।

“এমন খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে পানিটা মুখে নেও৷ ডাক্তার বেশি বেশি পানি পানি পান করতে বলেছে শুনো নাই?”

আমি শুকনো একখানা হাসি দিয়ে কোনোরকম গ্লাসটা দুই হাত দিয়ে ধরলাম৷ আবেগ ভাই ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ালেন। ক্ষিপ্ত দুটি আঁখি তাঁর। ধীর পায়ে এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে৷

এরপর যা করলেন, তাতে আমার জ্ঞান হারানোর দশা। তা আর না-ই বা বলি। লজ্জাবতী লতিকার ন্যায় নুয়ে গেলাম আমি।

তিনি গাম্ভীর্য যুক্ত গলায় ফিসফিস করে বললেন,
“এবার আমার মুখ লাগানো গ্লাসে পানি খেলেই কী, আর না খেলেই কী মায়াবালিকা! যা হওয়ার চিন্তা ছিল, তা তো হয়েই গিয়েছে।”

এমন সময়ও কেউ কি মুখে, কণ্ঠে গাম্ভীর্যতা রাখতে পারে মাত্রাতিরিক্ত অদ্ভুৎ না হলে? আমার গাল দু’টো গরম হয়ে উঠছে। তবে কি সে বুঝতে পারছে আমি লজ্জা পাচ্ছি? ভাবতেই আরও নুয়ে পড়লাম যেন। লজ্জা এড়াতে তাড়াতাড়ি এক নিঃশ্বাসে পানি টুকু গিলে তাড়াতাড়ি যেয়ে ধপ করে বসে পড়লাম সোফায়।

আবেগ ভাই আমার দিকে একপলক তাকিয়ে বেডরুমে চলে গেলেন। কোনো কাজ না থাকায় আমি চুপচাপ ফোন নিয়ে বসে থাকলাম। অনেকক্ষণ হলো তিনি আসছেন না বলে বোর হচ্ছিলাম। কতোদিন বইয়ের গন্ধ নেই না, হাত বুলাই না, পড়ি না! শেলফটা বড়ো বেশিই নিজের দিকে টানছে আমাকে। আর শান্ত থাকতে পারলাম না, উঠে এগিয়ে গেলাম বইয়ের দিকে।

কোন বইটা পড়বো ভাবতে ভাবতে একটি ট্রান্সপারেন্ট খামে ভরা বই দেখতে পেলাম৷ খামের দুই সাইডই একটা টাইপ করা কার্ড লাগানো থাকায় বইয়ের নাম দেখা যাচ্ছিলো না।
সামনের কার্ডে লিখা-
“বিয়ের উপহার, সবচেয়ে কাজের উপহার 😜
– হাসিব”

আমাদের এমন আজব বিয়েতেও হাসিব ভাইয়া উপহার দিয়েছেন। খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলাম উপহার প্রিয় আমি। বইটা নিয়ে সোফায় চলে গেলাম, বেশ উত্তেজনা নিয়ে খুললাম খামটা।

বইয়ের নাম পড়ে আমি আরেকদফা হোঁচট খেলাম। অতিমাত্রা রোমান্টিক লিখার জন্য জনপ্রিয় এল এ জেমসের “ফিফটি শেডস অব গ্রে”। ভিনদেশি বই পড়ার ও রিভিউ পড়ার সুবিধার্থে জানা আছে এই বই কেমন ধাঁচের। নিজের বন্ধুকেও বিয়েতে কেউ এসব দেয়! আবেগ ভাইয়ের বন্ধুগুলোও একদম তাঁর মতো অসভ্য! অসভ্যের দল!

“মায়াবালিকা, গোসল করে নেও! লাঞ্চ করতে যেতে হবে আবার।”

এর মাঝেই আবেগ ভাই চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন ইতিমধ্যেই। আমি স্তব্ধ, কোথায় লুকাবো এই বই, আর কোথায়ই বা লুকাবো এই চোখ ভর্তি লাজ।

তিনি বড়ো বড়ো চোখে আমাকে আর হাতের বইটিকে দেখছেন।
“ছিঃ! ছিঃ! মায়াবালিকা, তুমি আমার অনুপস্থিতির ফায়দা তুলে তুমি এইসব বাজে বই পড়ছো। আমি কখনও ভাবতেও পারিনি তুমি এমন কাজ করবা।”

আমি তেঁতে উঠলাম। ইশারায় শুধাই,
“আমাকে দোষারোপ করছেন কেন? এটা তো আপনার বই। আমি কি জানতাম খামের ভিতরে এটা দিয়েছেন উপহার?”

“হয়েছে, হয়েছে, আর হাতের এনার্জি লস করা লাগবে না। জানি আমি, আপনি কোন উদ্দেশ্যে নিয়েছেন বইটা। আসলে সামনে এমন পুরুষ থাকলে, মেয়েদের মনে এমন রোমান্টিকতার রংধনু উঠেই। এখন যাও, যাও, গোসল করতে যাও।”

“যাবো না আমি। আপনি যখন বলেছেন আমি পড়ার উদ্দেশ্যে নিয়েছি। এখন আমি এটা পড়েই ছাড়বো।” ইশারায় কথাটা প্রকাশ করতেই চমকে উঠেন তিনি।

ছিনিয়ে নেন আমার হাত থেকে বইটি।
“মায়াবালিকা, শেলফ ভর্তি বই। এটা তোমার পড়ার যোগ্য নয়, অন্য বই পড়।”

আমি তো নাছোরবান্দা, এই বই আমি পড়বোই। আমাকে তিনি বললেন কেন তখন ঐ কথা? আমি বই নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছি, তিনি দিবেনা বলে বই রাখা হাতটি উঁচু করে রেখেছেন। এসবের মাঝে কখন যে আমাদের মাঝের দূরত্ব শূন্যের কোঠায় যেয়ে পৌঁছিয়েছে টেরই পাইনি।

“খাবার খেতে চলেন ভাইজান, চাচী ডাকে আপনাগো।” দরজা লক করা হয়নি বিধায় অতি সহজেই দরজা খুলে ঢুকে গেল আবেগদের বাসার কেউ একজন। আমরা ছিটকে দূরে সরে গেলাম।

“আল্লাহ গো। কী দেখলি রে চুমকি!” সে ছুটে চলে গেল।

বয়স মেয়েটার কতোই হবে, সতেরো বা আঠারো৷ বেশভূষায় বাড়ির কেউ তো মনে হচ্ছে না, হয়তো কাজ করে।

আড়চোখে আবেগ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। তাঁর এবার গম্ভীরমুখ।

“বেডে কাপড়-চোপড়, সব রাখা আছে। গিয়ে গোসল করে আসো। এন্ড নট এ সিঙ্গেল ওয়ার্ড নাউ!”

তাঁর শীতল কণ্ঠের হুমকিতে তরতর করে বেডরুমে চলে গেলাম আমি। অনেকদিন পর খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে গোসল করছি। এতোদিন গোসল খানার সংকীর্ণ চার দেয়ালের মাঝে আসলেই পুরোনো স্মৃতির জন্য হৃদয় দহনে তড়পাতাম আমি।

—-

ভেজা চুলগুলোর উপর ওড়না টেনে আবেগ ভাইয়ের হাত ধরে তাঁর বাবা-মায়ের ফ্ল্যাটের দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছি। আবেগ ভাইয়ের ফ্ল্যাটের বিপরীত পাশের ফ্ল্যাটটিতেই আবেগের পরিবার থাকে।। চুমকি মেয়েটি এসে দরজা খুলে দাঁড়ালো।

“আল্লাহ গো ভাবী, আপনি আইছেন। আজ চাচী যে কতো খুশি! সব নিজের হাতে রানসে, আমারে ধরতে পর্যন্ত দেয় নাই।”

হাসির রেখা টানলাম মুখশ্রীতে। পরিস্থিতি হয়তো আল্লাহর কৃপায় আমার ভাবনার মতো অতো জটিলও নয়। আবেগ ভাইয়ের হাত আঁকড়েই এগিয়ে গেলাম।

“বউমা, এসেছো তুমি? বসো, বসো, মা।”

আবেগ ভাইয়ের সাথে চেহারায় তীব্র মিল থাকায় বুঝতে বাকি নেই তিনি আমার শ্বশুর বাবা। ইশারায় সালাম জানালাম। অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসেছি তখনই আবেগ ভাইয়ের বড়ো বোন আয়েশা আপু বসার ঘরে আসেন।

তাকে দেখেই মুখ খানা ক্রোধে ছেয়ে যায় আমার। হাত-পা খিঁচে বসে রইলাম শুধু না। এই মানুষটির প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধা নেই আমার ননাস হিসেবে। যে আমাকে সম্মান করে না, তাকে আমি কেন সম্মান করবো?
আর সেও আমাকে দেখে যে খুশি নয়, তাও বুঝতে পারছি।

“দেখেছিস আয়েশু, আমার বউমা এসে পড়েছে। এখন থেকে আমার পাল্লা ভারি তোর মায়ের থেকে।”

“উফঃ! বাবা, তুমিও যাকে তাকে নিয়ে তামাসা লাগিয়ে দাও। এসব আদিখ্যেতা আমাকে দেখিয়ো না। আর তোমার সুপুত্রকে এও জিজ্ঞেস করো, কোথায় ছিল এই মেয়ে এতো দিন? পরপুরুষের ঘরে দিন কাটিয়ে এসেছে, যুদ্ধ জয় করে না।”

মেয়ের গলায় আমার শাশুড়ি মাও বেরিয়ে এসেছেন রান্নাঘর থেকে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে করছে দুয়েক কথা শুনিয়ে দেই, কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। তাই ফোন হাতে ট্রান্সলেটরে যেয়ে মনের কথাগুলো টাইপ করছি, যাতে ভয়েসে কনভার্ট করতে পারি।

“আমার বউকে কোথা থেকে নিয়ে এসেছি, সেটা নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আমার মানুষটাকে আমি খুব ভালোভাবেই চিনি, এর জন্য আপনার প্রয়োজন। আর যাই হোক আমার বউ আপনার মতো অকৃতজ্ঞ আর কৃতঘ্ন নয়। আসলে এক দিক দিয়ে আপনার কথাই ঠিক, অনেক বড়ো ভুল করেছে ও। তা হলো আপনার মেয়েকে বাঁচিয়ে। নাহলে আজ ওর কণ্ঠ হারাতে হতো না, আপনার জন্য নিজের বাড়ি ছাড়তে হতো না, আপনি ওর চরিত্র নিয়ে কথাও বলতে পারতেন না। আপনি এতো কৃতঘ্ন হবেন আর এমন অপরাধ ওর সাথে করবেন জানলে সেদিন ওর বার্তা পাওয়ার সাথে সাথে ওকে চোখ বন্ধ করে নিজের বাড়ি চলে যেতে বলতাম।”

আয়েশা রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠলো। কী একটা বলতে গিয়েও থেমে হনহন করে চলে গেল। হয়তো বা বলার মতোন কিছুই পাচ্ছে না। আমি বিস্মিত হব না কি মুগ্ধ বুঝতে পারছি না। মা হয়তো মিথ্যে বলেনি। আল্লাহ আমাকে আমার কণ্ঠের বিপরীতে অনেক দামী উপহার দিয়েছেন।

এর মাঝেই আবেগ ভাই আমার হাত ধরে সোফা থেকে টেনে দাঁড় করালেন।

“ছাগলের মতোন বসে আছো কি আরও কিছু শুনতে? চলো এখান থেকে। আর মা-বাবা ভাত গিলার সময়ে এমন অপমান না গিলালেও পারতে।”

বুঝলাম না কোথায় অপমান গিললেন তিনি। কথা শুনালো তো আমাকে, আবার যা শুনালো তার চেয়ে দ্বিগুন অপমান তো তিনি করে দিলেনই। শুধু শুধু চলে যাওয়ার দরকার কী? আমি সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলেন। মা, বাবা বেশ কয়েকবার ডাকলেন, কিন্তু তিনি তো তিনিই। ফিরেও তাকালেন না একবার।

বর্তমানে খাটে দুই গালে দুই হাত দিয়ে বসে আছি। আবেগ ভাই বিষাক্ত নাগের মতোন ফণা তুলতে তুলতে এই কোণা থেকে ঐ কোণা পায়চারি করছেন। মাঝে মাঝে আমায় বকছেন। অদ্ভুত ভাবে এখনও তার চেহারা ও কণ্ঠ উভয়ই শীতল ও গম্ভীর, অথচ তাঁর দ্রুতো উঠানামা করা শ্বাস-প্রশ্বাসে রাগ পরিস্কার।

“হাসিব তোমাকে ঠিক নামই দিয়েছিল, তুমি একটা পিপীলিকাই। আমার সামনেই খালি জঙ্গলের বিলাইয়ের মতোন জঙ্গলিপনা দেখাইতে পারো। অন্যদের সামনে মূর্তির মতো বসে বসে বাজে কথা গিল। আর কথা না বলতে পারো ইশারায় থামতে বলতে, কষিয়ে এক চড় তো দিতে পারতে, তাই না? যত্তসব গর্ধব আমারই মনে ধরে!”

কয়বার একই ভৎসনা শোনা যায়। মানে নতুনত্ব তো আনতে পারে, তাই না? না, আর শুনতে পারছি না এসব আমি। এয়ার ফোন তো নেই। হঠাৎ বেডের পাশে চোখ গেলেই দেখতে পাই আবেগ ভাইয়ের এয়ারবার্ডস পড়ে আছে। ধীরেধীরে তা তুলে সতর্কতার সাথে কানে লাগাই, ওড়নায় কান ঢেকে ফেল। আহ! মোবাইলে আশিষ চাঞ্চালানির একটা ভিডিও ছাড়ি। কয়েক মিনিট যেতেই পেট ফেঁটে হাসি পায়। শব্দ করে হেসে দিলাম আমি।

টের পেয়ে গেল অসভ্য লোকটা। এমন ভাবে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে যে কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে আমার। এখন আমার কী হবে?

চলবে।

জানালার ওপারে পর্ব-১৩

0

#জানালার_ওপারে
||১৩তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি। বর্তমানে নিশার সাথে বাড়ি ফিরছি। কেমন যেন অদ্ভুৎ রকমের অনুভূতি হচ্ছে। যদিও ঐ বাড়িটি আমার, ঐ বাড়িটিতেই আমার বেড়ে উঠা। আমার খুব করে বিশ্বাস হচ্ছে আবেগের উপর, তবুও কোথায় একটা কিন্তু, মনের খচখচানি।

রিকশা থামলো। অন্যদিকে ধ্যান থাকায় পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলিয়ে নিলাম।

কলিংবেলের সুইচটা চাপ দিতেও যেন আজ বহু খানি সাহস সঞ্চার করা লাগছে। বেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজটা বুকের ঢিপঢিপ শব্দটা আরও বাড়িয়ে দিল। দরজা খুলতেই মায়ের অতিপরিচিত মুখশ্রী দৃশ্যমান হলো। তাতে ভীষণ রকমের ক্লান্তি ও দুঃখের ছাপ।

আমাকে দেখে অনতিবিলম্বেই তার চোখ জোড়ায় অশ্রুর ভর। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। জড়িয়ে ধরলেন মা শক্ত করে।

“হাতির পাঁচ পা দেখেছিলি যে বাড়ি ছাড়ার মতো কলিজা হয়ে গেছে! বিপদ-আপদের হাত-পা আছে? একটা কিছু হয়ে গেলে কোথায় পেতি জীবন?” মায়ের অশ্রুসিক্ত কণ্ঠের বকাগুলো কেমন যেন শান্তি লাগছিল।

কিন্তু এখন এতো যত্ন-আত্তি কেন? যখন এ বাড়িতে ছিলাম তখন তো ভুলেই বসেছিল আমাকে। হারিয়ে যাওয়ার ফলেই বুঝি এমন গুরুত্ব দেওয়া?

বসার ঘরে ছোট্ট বাবুই খেলছে। আমাকে দেখে চিৎকার করে ‘মাম্মা’ ডেকে জড়িয়ে ধরে। ইতিমধ্যে আব্বু সহ সকলেই আমাকে দেখে চমকে উঠেছে।

আব্বু চোখের কিনারায় আসা নোনাজল অতি যত্নে আড়াল করে ফেললেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“কী খাবি আম্মু? তোর পছন্দের কাবাব-লুচি নিয়ে আসি?”

আমি মাথা নাড়িয়ে আলতো হাসলাম। আব্বু খুশিমনে বেড়িয়ে গেলেন। একে একে বাসার সবাই হালকা বকা দিলেন।

আমি ও নিসা নিজের বেডরুমে গেলাম। সাজানো-গোছানো, পরিস্কার। তবে জিনিসপত্র একচুল জায়গা থেকে নড়েনি।

হাসিব ভাই আশেপাশেই কোথাও এসেছেন। তাঁর কল পেয়ে নিসা চলে গেল আমাকে বিদায় জানিয়ে।

একা বসে রইলাম নিজের ঘরে। কেমন এক সুখ, উত্তেজনা বোধ হচ্ছে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ঘুরে ঘুরে নিজের ঘরটিকে দেখছি, যেন কতো নতুন এ ঘর আমার জন্য।

কিছুক্ষণ পর আম্মু ঘরে আসলো ওড়নায় ঘাম মুছতে মুছতে। আমার হাতটি নিজের হাতে নিলেন।

“কেন চলে গিয়েছিলি? একবার আমাকে সব বলেই দেখতি তুই। মনে হয়নি মা আমাকে ছাড়া কী করবে।”

আমি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে উত্তর দিলাম,
“আমি যাওয়ায় তো তোমাদের ভালোই হয়েছিল। তোমাদের তো বোঝা, বিরক্তি মনে হতো শুরু করেছিল আমাকে। তাই তো আমার সাথে কথা বলা, কেয়ার করা বন্ধ করে দিয়েছিলে। খালি বকাই দিতে। এমন কী কেউ আমাকে কোনো বাজে কথা বললেও কিছু বলতে না। ঐদিন হাফসার মা মেহের আপুকে বলল আমাকে কে বিয়ে করবে, ভাইদের ঘাড়ে বসে খাব। কই? তাকে তো কিছু বললা না। মানে তোমরাও তা-ই মনে করতে, করো।”

মা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে মাথায় আলতো হাতে বারি দিল।
“সারাজীবন বলদই থেকে গেলি মেয়ে! তোকে বকবো না তো কী করবো? কী একটা কথা বলা বন্ধ হলো, তাই বলে সব ছেড়ে-ছুড়ে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হয়ে গেলি। পড়াশোনা, হাসি, আনন্দ, সখ-আহ্লাদ, সবকিছু গোল্লায় দিয়ে, তাই না? তোকে কতো বোঝাতাম বাহিরে চল, ভার্সিটিতে যা, ছাদে যেয়ে একটু হাঁটাহাটি কর। শুনতি? এমন কী ডাক্তার যে থ্যারাপি নিতে বলেছিল তাও নিতিস না।

জোর করলে হতাশ হয়ে বলতি, টাকা নষ্ট হবে শুধু, আমি আর ঠিক হবো না। আরে মেয়ে, আশায় বাঁচে চাষা। কাকে কোন উসিলায় সুস্থ করে আল্লাহ কে জানে! এই দুঃখে, রাগেই কথা বলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর মানুষের বাঁকা কথার উত্তর দেইনি, আগে দিতাম কেউ তোকে কিছু বললে? না, কারণ তুই-ই নিজের জন্য যথেষ্ট। আমরা চাচ্ছিলাম তুই-ই নিজের হয়ে প্রতিবাদ কর, নিজের নীরবতাকে দুর্বলতা না হতে দিয়ে। আর তুই তো দরজা আটকে বসে পড়েছিলি। কিন্তু বল তো, হাফসার মাকে আর দেখেছিলি এই বাড়িতে? তোর বাপ-ভাই তাকে ঘর বিদায় দিয়েছিল তোর আড়ালে।”

মায়ের বুকে মাথাটা এড়িয়ে দিলাম। একদিকে আনন্দ অনুভূতিরা রংধনু এঁকে দিচ্ছে মনের আকাশে, অপরদিকে কেমন একটা জমাট দুঃখও অনুভব হচ্ছে।

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুধালো,
“আল্লাহ তোর থেকে তোর কণ্ঠ নিয়ে নিলেও বেশ দামী উপহার দিয়েছে। তা হলো আবেগ। আমরা যতোটা কেঁদে মরেছি তোর চিন্তায়। ততোটা ঐ পরের ছেলেটাও। পাহাড়ের মতো ছেলেটা কেমন মুর্ছে গেছিলো। ভবঘুরে হয়ে ঘুরতো তোর খোঁজে। ওর মাও এসে কাঁদতেন আমাদের এখানে। এই যে এই সময়টা পাড় করছিস মা এতো বড়ো প্রতিবন্ধকতা নিয়ে এটাও একটা পরীক্ষা। ভালো সময় যেমন শেষ হয়ে যায়, খারাপ সময়টাও শেষ হয়ে যায়, যাবে। দিনের পর রাত আসবেই, আর রাতের পর দিনও আসবেই। মনে রাখবি এ কথা, কখনও মনে ঐ বাজে ভাবনা আনবি না আর।”

মা দুপুরের খাবার বসাতে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আকদের দিনের সম্পূর্ণ ঘটনাও খুলে বললেন।

আকদের দিন না কি আবেগ ভাই বাসায় এসেছিলেন কাবিনের লগ্নের দেড়-দু ঘণ্টা আগে৷ তাড়াতাড়ি শেরওয়ানি পরে তৈরি হয়ে কাজির সামনে যাওয়ার জন্য বের হলেই বেলি ডায়েরিটি ধরিয়ে দেয়।

বলে,
“সামু আপু দিয়েছে। আর এটা পড়েই বিয়ের পিঁঢ়িতে বসার অনুরোধ করে গেছে।”

আবেগ ভাই অবাক হন। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও বিয়েতে বিলম্ব করে বেডরুমে পুনরায় ঢুকেন ডায়েরি নিয়ে।

পনেরো-বিশ মিনিট পরেই জোরালো আঘাতে দরজা খুলেন তিনি। বসার ঘরে যেয়ে বধূ বেশে বসে থাকা হাফসার হাত ধরে উঠে দাঁড় করান। একটানে মাথার ওড়না ফেলে দেন।

মুখের উপর ভারি ডায়েরিটা ছুঁড়ে মেরে হুংকার দিয়ে উঠেন,
“এই মেয়ে, তোমার সাথে কোন কালে আমার প্রেম ছিল? Bloody jerk! তুমি কী বলছি, তোর সাহস কীভাবে হয় মায়াবালিকাকে এসব বলার?”

হাফসা উত্তর কী দিবে, থরথর কাঁপছিল ভীতিতে। হাটে এসে এভাবে হাড়ি ভাঙবে বিষয়টা ধারণাতীত ছিল। উপস্থিত মানুষগুলোর বিস্ময়ে হা করে দাঁড়িয়ে। তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। শুধু একজনের মাথা নত, সে হলো আবেগের বড়ো বোন আয়েশা।

আবেগ ভাই উত্তর না পেয়ে ক্রোধে এক ধাক্কায় মেঝেতে ফেলে দেয় তাকে। এবার তাঁর ক্রোধানল উপচে পড়ে তাঁর বড়ো বোনের উপর।

“বড়োপা তোমাকে তো আমি স্পষ্ট বলেছিলাম সামুর জন্য প্রস্তাব পাঠাবে। ব্যাপারটা হাফসা অবধি গেল কীভাবে?”

আয়েশা ঘাবড়ে গেলেও হার মানে না। বরং, কপট কঠোরতা আনে গলায়।

“দেখ, তুই এখনও ছোটো। আমি তোর বড়ো। তোর জন্য ভালো কোনটা, মন্দ কোনটা, তা তুই না বুঝলেও আমি বুঝি। হাফসা অনেক ভালো মেয়ে। সামু বাজে…”

“Just shut up! মুখের কথা মুখেই রাখো, বাহিরে বের হলো পরিণাম ভাবনার বাহিরে হবে। বড়ো বোন দেখে বেঁচে গেলে, নাহলে… আর তোমার অর্থ তো একটাই দাঁড়াচ্ছে। তুমি ইচ্ছে করে এসব প্যাঁচ লাগিয়েছো, আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে। How could you do this! Bloody betrayer! Backstabber!”

“আবেগ তুই বুঝতে পারছিস না। মেয়েটা ভালো নয়। একে তো বোবা। আবার কী কোর্ট-কাচারির ঝামেলা তার পিছনে! বল, ভালো মেয়ে হলে কী আর কোনো আধবুড়া ব্যাটা ওর পিছে লাগতো! এতো মেয়ে থাকতে ওর ক্ষতিই কেন করলো মতি মিয়া, ওকেই কেন চোখে পড়লো উত্তর দে একটা বার?”

“Oh really! তাহলে তো সবার আগে তোমার গর্ভের মেয়ে মানে তোমার ভাষায় বাজে মেয়ে আর্শিকে এই প্রশ্ন করা উচিত!”

“আবেগ! পরের জন্য নিজের মেয়ে সমান বোনঝিকে এভাবে বললি!”

“চিৎকার কোরো না আপু। আমি যা বলছি ঠিকই বলছি। সেদিন পনেরো তারিখ বুধবার দুপুরবেলা আর কেউ নয় তোমার মেয়ে আর্শিকেই বাসায় যাওয়ার পথে আটকায় মতি মিয়া। যেসব ঝামেলা কথা বলে মেয়েটাকে বদনাম করছো সেসবের ভয় করলে এখন তোমার মেয়ে ঐ আধবুড়োর কামনার বলি হয়ে মর্গে পড়ে থাকতো।” মোবাইল সুইচ অন করে সেদিনের ভিডিওটি চালু করে সবাইকে দেখায়।

ভিডিওটি শেষ হওয়ার পূর্বেই ধপ করে বসে পড়ে আয়েশা। তখনই কল আসে ফোনে, হাসিব ভাইয়ের কল। তিনি নিসার কাছে আমার বলা কথা তথা হাফসার সাথে বিয়ে শুনে সকাল হতেই কল করছিলেন। কিন্তু আবেগে ভাইয়ের ফোন বন্ধ থাকায় তা পৌঁছায়নি।

আবেগ ভাই চিন্তিত ভঙ্গিমায় তাক র সাথে কথা বলতে বলতে বের হয়ে গিয়েছিলেন। মা জানালো তাঁর অবস্থা না কি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল আমার খোঁজে। নাওয়া-খাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলেন, বাসায়ও আসতেন না। ভার্সিটিতে পড়ে থাকতেন বা হলে, যদি দেখা পান আমার এই আশায়।

মা মিথ্যে বলবে না এটুকু ভরসা আছে। সেই ভরসাতেই আবেগ ভাইয়ের উপরও পুরোপুরি ভরসা করতে যতোটুকু দ্বিধা ছিল তাও কেটে গেল। তবে তাঁর সামনে যেতে বড্ড দ্বিধা বোধ হচ্ছে। তাঁর সামনে যাব বা যেতে হবে ভাবতেই হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ হারে।

প্রিয় অসভ্য পুরুষটির পছন্দের শুভ্র রংয়ের এক সেট থ্রিপিস নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। বের হলে কেমন একটা জোর গলায় কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পেলাম।

দরজার সামনে যেয়ে দাঁড়ালে শুনতে পাই আবেগ ভাইয়ের স্পষ্ট উক্তি,
“আমার বউকে আমি এখনই নিজের বাড়ি নিয়ে যাব। এখনই মানে এখনই!”

আমি আঁতকে উঠলাম। এতোকিছুর পর আমি এখনও প্রস্তুত নই তাঁর সামনে যেতে।

চলবে…