#অন্যরকম তুই💘
#পর্বঃ০৮_৯
#লেখিকাঃDoraemon
অহনার রাগ এবার প্রচুর বেড়ে যায়। অনন্তের এসব অপমান অহনা সহ্য করতে না পেরে অহনা অনন্তের কাছে ধীরে ধীরে এসে অনন্তের গালে ক্লাসের সবার সামনে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দেয়। অহনার এমন আচরণে ক্লাসের সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। অনন্ত অহনার এমন আচরণে কিছু বলল না৷ বরং অনন্ত একটা হাসি দিয়ে অহনার দিকে তাকিয়ে আছে। অহনা খুব রেগে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–জীবনে অনেক খারাপ মানুষ দেখেছি কিন্তুু আপনার মতো খারাপ মানুষ দেখি নি৷ আমি আপনাকে ঘৃণা করি। আপনাকে আমি মরে গেলেও ক্ষমা করব না৷
অহনা এটা বলেই কাঁদতে কাঁদতে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যায়। অনন্তের চোখের কোণে পানি টলমল করতে থাকে। অনন্তের হাতে থাকা মার্কারটাও নিচে পড়ে যায়। অনন্ত আর নিজেকে আঁটকে রাখতে না পেরে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে অহনার পিছু নিতে থাকে। অহনা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়াচ্ছে। তারসাথে অনন্তও অহনার পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছে। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং কলেজের অন্যান্য স্যাররা অনন্তের এবং অহনার কান্ড দেখে অবাক। অনন্ত অহনাকে চিতকার করে ডাকতে থাকে
–অহনা এই অহনা দাঁড়া বলছি।
কিন্তুু অহনা অনন্তের কোনো কথা না শুনে দৌড়াতে দৌড়াতে কলেজ থেকে বেরিয়ে এক নির্জন গলিতে ঢুকে পড়ে যেখানে কোনো মানুষ যায় না। অনন্তের মনে অহনাকে হারানোর ভয় কাজ করতে থাকে। অনন্ত মনে মনে বলতে লাগল
–এটা আমি কি করলাম! আমি মনে হয় অহনার সাথে আজ একটু বেশী করে ফেলেছি। না না আমার অহনার কিছু হতে আমি দিব না। কিছু হতে দিব না৷
একসময় অহনার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে অনন্ত অহনার কাছে এসে অহনার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। অহনা অনন্তের কাছ থেকে নিজের হাতটা ছুটাতে চায় কিন্তুু পারল না। অহনা চিতকার করে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে
–আমার হাতটা ছেড়ে দিন স্যার। না না না আপনি স্যার না। আপনি স্যার নামের একটা দানব৷ আপনি আমার জীবনটাকে নরক বানিয়ে দিয়েছেন। আপনি খুব পঁচা খুব, বাজে, খুব…..
অহনাকে কিছু বলতে না দিয়ে অনন্ত অহনার কোমড় জড়িয়ে অহনাকে নিজের কাছে এনে অহনার ঠোঁটজোড়া নিজের দখলে করে করে নিল। অনন্তের এ কাজে অহনা পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল । কিন্তুু আজ অহনার অনন্তের স্পর্শে কালকের মতো কোনো ব্যথা অহনা পাচ্ছে না। আজ অনন্তের স্পর্শে অহনা অন্য কিছু উপলব্ধি করতে পারছে। অনেক্ষণ পর অনন্ত অহনার ঠোঁটজোড়া ছাড়ল। মুহূর্তের মাঝেই অহনা অনন্তকে জোরে ধাক্কা দিল যার ফলে অনন্ত কিছুটা হলেও পেছনে সরে যায়। অহনা রাগী গলায় অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আপনার সাহস হয় কি করে আমাকে স্পর্শ করার? আপনি কি চান আমি মরে যাই? আপনি শেষে কিনা ক্লাসের সবার সামনে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বললেন? আবার আমার পরীক্ষার খাতায় ফেল করে দিলেন! কেন স্যার আমি কি ক্ষতি করেছিলাম আপনার বলুন?
–আমি তোকে যা বললাম তুই তাই বিশ্বাস করে ফেললি অহনা?
–মানে কি! আপনি কি বলতে চাইছেন?
–তুই যথেষ্ট ভালো নাম্বার পেয়েছিস অহনা। আমি শুধু তোকে কস্ট দিতে একটু মিথ্যা কথা বলেছিলাম।
আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস অহনা। আমি তোর সাথে আজ একটু বেশী অন্যায় করে ফেলেছি। কেন তুই আমার ভালোবাসা মেনে নিতে চাস না অহনা? কেন?
অনন্ত মাটিতে বসে কাঁদতে থাকে। অহনার কেন জানি না অনন্তকে কাঁদতে দেখে সহ্য হলো না। ছেলেরা নাকি সহজে কাঁদে না কিন্তুু যখন তার ভালোবাসার মানুষ তার থেকে দূরে সরে যায় তখনই ছেলেরা কাঁদে যেমনটা আজ অনন্ত অহনার ভালোবাসার পাওয়ার জন্য কাঁদছে।
–আপনি এত মেয়ে থাকতে আমাকেই কেন এত ভালোবাসলেন স্যার? আপনার ভালোবাসার আগুনে আজ আমি জ্বলে পুড়ে যাচ্ছি তা কি আপনি বুঝতে পারছেন না? আপনার ভালোবাসা যে আমার কাছে ভীষণভাবে ভয়ংকর লাগছে!
অনন্ত এবার অহনার দিকে অশ্রু মাখা চোখগুলো দিয়ে তাকিয়ে অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আমি যে তোকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি অহনা৷ তাই নিজের অজান্তেই তোর সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। আমি সত্যি নিজের ভালোবাসাটা ঠিক করে প্রকাশ করতে পারি নি।
–আমার জন্য আপনি এই শিক্ষক পেশা ছেড়ে দিতে পারবেন স্যার?
অনন্ত অহনার কথা শুনে হাসতে হাসতে অহনাকে বলল
–হ্যা অহনা তোর জন্য আমি সব কিছু ছেড়ে দিতে রাজি আছি৷ এমনকি নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি।
–তাহলে আমি আপনাকে ভালোবাসব স্যার।
অনন্ত খুশি হয়ে অহনাকে বলল
–সত্যি অহনা তুই আমাকে ভালোবাসবি ?
— হ্যা হ্যা হ্যা সত্যি আপনাকে আমি ভালোবাসব।
অনন্ত খুশি হয়ে মাটিতে বসা থেকে উঠে অহনাকে দৌড়ে এসে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অনন্ত কাঁদতে কাঁদতে অহনাকে বলল
–আমি জানতাম অহনা তুই আমাকে ভালোবাসবি৷ আমার ভালোবাসা কখনো বিফলে যেতে পারে না৷ কখনো না৷
।
।
।
#চলবে….
[অহনা কি সত্যি অনন্তকে ভালোবাসল?! আপনাদের কি মনে হয় প্রিয় পাঠক/ পাঠিকা?🙂]
#অন্যরকম তুই💘
#পর্বঃ০৯
#লেখিকাঃDoraemon
অনন্ত অহনাকে তার বাসায় পৌছে দিল৷ এবং ঠিক সেদিনই অনন্ত কলেজে গিয়ে তার শিক্ষক পেশাটা ছেড়ে দিল। প্রিন্সিপাল অনন্তকে অনেক জোর করেছিল চাকরিটা না ছাড়তে কিন্তুু অনন্ত শুনে নি। প্রিন্সিপাল ছিল অনন্তের বাবার ভালো বন্ধু। সব স্যারদেরও অনন্তকে চাকরিটা ছাড়তে নিষেধ করে কিন্তুু অনন্ত কারও কথা শুনল না। অনন্তের চাকরি ছাড়ার সংবাদ শুনে অধিকাংশ মেয়েই কেঁদে দিল। কারণ তারা অনন্তকে ভীষণ ভালোবাসত৷ অনন্তের বাবার কাছে প্রিন্সিপাল খবরটা দিল যে অনন্ত চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। অনন্তের বাবা খুশি কারণ এখন সে ছেলেকে ব্যবসার সবকিছু বুঝিয়ে নিজে আরাম করবে। আজ অনন্তকে বেশ মুক্ত লাগছে। বাসায় গিয়ে অনন্ত বেডরুমের সোফায় বসে পড়ে। আজ অনন্তের মনটা খুব হালকা লাগছে। হঠাৎই অনন্ত পাগলের মতো হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে অনন্ত নিজে নিজেই বলতে লাগল
–আমি জানি অহনা তুই আমাকে এখনোও মন থেকে মেনে নিতে পারিস নি। আমার ভালোবাসার পরীক্ষা চাইছিস তুই। দেখ অহনা আজ আমি আমার শখের পেশাটাও তোর জন্য খুব অনায়াসেই ছেড়ে দিলাম। কারণ বড্ড ভালোবাসি যে তোকে। কি করব আমি বল আমি যে নিজের ভালোবাসাটা ঠিক করে প্রকাশ করতে পারি না। তাই নিজের অজান্তেই তোকে ভয়ংকর শাস্তি দিয়ে নিজেকেই এর থেকেও ভয়ংকর শাস্তি দিতাম। যদি কোনো একদিন আসে যে তুই আমার জীবনটা চাস আমি তোকে আমার জীবনটাও দিয়ে দিতে পারব। কিন্তুু তোকে আমি আমার কাছ থেকে কখনোও দূরে যেতে দিব না। তুই চাইলেও আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবি না অহনা। একমাত্র আমার মৃত্যু হলে তুই আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবি তার আগে না।
তারপর অনন্ত কাঁদতে লাগল।
অনন্তের মা দরজার আড়াল থেকে সব শুনে ফেলল। অনন্তের মা ভিতরে এসে অনন্তের মাথায় হাত রাখল। অনন্তের মা অনন্তকে দেখে চমকে উঠল। তারপর তাড়াতাড়ি অনন্ত নিজের চোখের পানি মুছে নিল। অনন্তের কান্না দেখে অনন্তের মায়ের চোখেও পানি। অনন্তের মা অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–বাবা তুই কাঁদছিস কেন? একটু আগে খবর পেলাম তুই নাকি তোর চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিস? কেন করলি তুই এটা?
অনন্ত একটা হাসি দিয়ে অনন্তের মাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–মা তুমিও না কি যে বল! আমি এবার থেকে বাবার বিজনেসটায় দেখাশোনা করব। বাবার এতগুলো বিজনেসের চাপ বাবা কি একা সামলাতে পারে! তাই তো নিজে থেকে চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। এবার থেকে বাবার ব্যবসার কাজে আমি খুব মন দিব।
–কিন্তুু আমার তো এটা মনে হচ্ছে না বাবা। তুই তো তোর বাবার টাকায় চলতে চাস নি। তুই তো নিজের পায়ে দাঁড়াবি বলেই তোর পছন্দের পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করলি। তাহলে হঠাৎই তোর বাবার বিজনেসের কাজে! আমার ব্যাপারটা কেমন সন্দেহ লাগছে। তুই কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস? বল না বাবা কি হয়েছে? মাকে বলবি না?
–মা আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আজ আমি ভীষণ ক্লান্ত।
অনন্তের মা অনন্তকে আর কিছু না বলে চলে গেল। অনন্ত আবারও হাসতে লাগল। পাগলের মতো হাসতে লাগল। অনন্ত মনে মনে বলতে লাগল
–কেন আমার সাথে তুই ছলনা করছিস অহনা? আমি এতটাও বোকা নই যে তোর ছলনা ধরতে পারব না। তুই আমার কাছ থেকে মুক্তি পেতেই আমাকে কলেজ থেকে বিদায় করাতে চাইলি। কিন্তুু তুই জানিস না এই অনন্ত তোর জন্য সব করতে পারে। আর এটাতো সামান্য একটা চাকরি! আমার মনে তো আমি সেদিনই তোকে জায়গা দিয়েছি যেদিন আমি তোকে প্রথম দেখেছি। ভালোবাসাটা না বড়ই অদ্ভুত একবার মনে আসলে সেটা আর সহজে মন থেকে যায় না।
অনন্ত একটা গিটার নিয়ে মনের ভিতর থেকে গান গাইতে থাকে
“🎶আমার মনের মাঝে এসেছিস যে তুই,, কিভাবে নিজের থেকে দূরে রাখব তোকে 🎶
🎶হৃদয়ের ভিতর, গহীন মাঝে,,
রেখেছি যে আমি তোকে যতন করে🎶
🎶ভীষণ ভালোবাসি তোকে,,ভালোবাসি তোকে🎶
🎶আমার কাছে যে অন্যরকম তুই,, আমার মনের খাঁচায় রাখবো তোকে,, নিজের কাছ থেকে কখনো তোকে দূরে যেতে দিব না🎶
🎶শেষ নিস্বাস অবধি ভালোবেসে যাবো তোকে,, একদিন তুই বুঝতে পারবি আমি কি ছিলাম🎶
🎶আমার কাছে যে সবার থেকে আলাদা তুই,, একদম অন্যরকম তুই🎶
🎶তোর দু চোখে তাকালে আমি নিজের শান্তি খোঁজে পাই🎶
🎶আমার কাছ থেকে তোকে কখনো দূরে যেতে দিব না🎶
🎶আমার কাছে অন্যরকম তুই,, সবার থেকে তুই অন্যতমা🎶
অনন্ত অহনার একটা ছবি বুকে নিয়ে নিজের অজান্তেই চোখের জল ফেলে ঘুমিয়ে পড়ল৷
ঐদিকে অহনা বাসায় এসে নিজের রুমের ঘরের দরজা বন্ধ করে মনের আনন্দে নাঁচানাঁচি করছে। অহনার কাছে খবর আসে অনন্ত চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। অহনা হাসতে হাসতে চিতকার করে বলতে থাকল
— আমি পেরেছি ঐ শয়তান দানবটার হাত থেকে মুক্ত হতে। এখন কলেজে কেউ আমাকে অপমান করবে না। কেউ আমাকে আর জালাতন করবে না। হা হা হা ঐ শয়তান দানবটা কত বোকা! কি করে দানবটা বিশ্বাস করল যে এত অপমানের পর আমি তাকে ভালোবাসব! এ জীবন থাকতেও কোনোদিন আমি ঐ দানবটাকে ভালোবাসব না। কোনোদিনও না।
।
।
।
#চলবে…
#অন্যরকম তুই💘
#পর্বঃ০৭
#লেখিকাঃDoraemon
অহনা না চাইতেও অনন্তের ঠোঁটের স্পর্শের কথা বার বার মনে পড়তে থাকে। সেই ভয়ংকর অনুভূতির কথা মনে ভাবতেই অহনার রাতে আর ঘুম হলো না৷ সারারাত অহনা নির্ঘুম অবস্থায় কাটিয়ে দেয়। কারণ প্রথম ঠোঁটের স্পর্শ কেউ ভুলতে পারে না তেমনি অহনাও কিছুতেই ভুলতে পারছে না। অজানা ভয় অহনার মনে বিরাজ করছে। শুধু ভোর বেলায় অহনার চোখটা একটু লেগে যায়। সকালে অহনা ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির কাটায় দেখতে পেল অহনার আজ ঘুম থেকে উঠতে ভিষণ দেড়ি হয়ে গেছে। কলেজের ঘন্টা দিতে আর ১০ মিনিট বাকি৷ অহনা নিজে নিজে বলতে লাগল
–এটা কি হলো! আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি! আমার আজ কলেজে যেতে অনেক দেড়ি হয়ে যাবে!
অহনা কোনোরকমে ৫ মিনিটে রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে দিল এক দৌড়। কোনোরকম একটা রিকশা নিয়ে অহনা শেষমেষ কলেজে পৌছাল৷ সিড়ি দিয়ে অহনা এতই দ্রুত উঠছিল যে ঠাস করে একটা ছেলের সাথে অহনা ধাক্কা খেলো৷ যখন অহনা নিচে পড়ে যেতে নিল তখন ছেলেটি অহনার কোমড় জড়িয়ে একটান দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। ঘটনাটা এতই দ্রুত ঘটল যে অহনা নিচে পড়ে যাওয়ার সময় ছেলেটার মুখটাও দেখতে পারে নি কারণ ছেলেটা তাড়াতাড়ি অহনার কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়৷ ছেলেটি আর কেউ নয় সে হলো অনন্ত। যখন অহনা অনন্তের বুক থেকে নিজেকে ছাড়াল তখন একটু উপরে তাকিয়েই অহনা দেখতে পেল যে সে ভুল মানুষের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। কারণ এটা যে অনন্ত স্যার। অনন্তকে দেখেই অহনা ভয়ে কেঁপে উঠে। একেই তো অহনা গতকাল অনন্তের গালে কষিয়ে থাপ্পড় দিয়েছিল। আজ যে অহনার কপালে শনি আছে সেটা অহনা ভালো করেই বুঝতে পারছে৷ অনন্ত অহনার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অহনার ভয়ে হাত পা কাঁপা-কাঁপি করছে। অনন্ত অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–ছেলেদের সাথে ধাক্কা খেতে তোর খুব ভালো লাগে তাই না অহনা? তো আর কাউকে পেলি না! শেষমেষ আমার মতো একটা সুদর্শন ছেলের সাথেই তোর ধাক্কা খেয়ে পড়তে হলো!
অনন্তের এমন কথা শুনে অহনা রাগী দৃষ্টিতে অনন্তের দিকে তাকিয়ে আছে। অনন্তের দিকে তাকানোর সময় অহনার হঠাৎ করে কালকের ঠোঁটের স্পর্শের কথা মনে পড়ে যায় যা অনন্ত ভয়ানকভাবে অহনার ঠোঁটে দিয়েছিল। কিন্তুু সাথেসাথেই অহনার মনে পড়ল যে অনন্ত তার শিক্ষক। তাই অহনা একটু বিনয়ের সাথে মাথা নিচু করে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–স্যার আ..আ আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। আসলে আমার কলেজে পৌঁছাতে একটু দেড়ি হয়ে গেছে তাই….
অহনাকে বলতে না দিয়ে অনন্ত অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তাই তুই আমার শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে আমার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লি।
–স্যার আপনি এসব কি বলছেন? আমি পড়ে যেতাম তো যেতামই আপনি আমাকে ধরলেন কেন? আমি তো আপনাকে ধরতে বলি নি। আপনিই তো….
–আমি তো কি? তুই নিজে আমাকে ইচ্ছে করে ধরেছিস। ভবিষ্যতে আমার আশপাশে যদি তোকে ঘেঁষাঘেঁষি করতে দেখি তাহলে তোর খবর আছে। এখন যা ক্লাসে যা। একটু পরেই তো তোর সাথে আমার আবার দেখা হবে। তো নিজেকে তৈরি করে রাখিস৷
এ কথা বলেই অনন্ত সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে চলে গেল৷ অহনা এখনও সিড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ অহনা অবাক হয়ে মনে মনে বলতে লাগল
–আমি তো উনার সাথে ধাক্কা লাগতে চাই নি! উনিই তো কোথা থেকে উড়ে এসে আমার সাথে ধাক্কা লাগলেন ! শয়তান, লুচু, দানব। তোর সাহস হয় কি করে হয় আমায় এতগুলো কথা বলার! নিজেই তো আমার শরীরে হাত দিলি আবার নিজেই নিস্পাপ সাজার নাটক করিস! কিন্তুু দানব স্যারটা কি যেন বলল! আমি কিসের জন্য তৈরি হবো?
অহনা আর কিছু না ভেবে দৌড় দিয়ে ক্লাসের কাছে পৌঁছাল৷ অনেক আগেই ক্লাসে স্যার ঢুকে গেছে। কিন্তুু অহনার ভাগ্য ভালো ছিল আজ অহনার প্রথম টিচার অহনাকে কিছু বলে নি। ক্লাসে কোনো বেঞ্চ খালি নেই দেখে অহনা একদম পেছনের বেঞ্চটায় বসল। অহনা বেঞ্চে বসার সাথে সাথেই অহনার সাথে বসা পাশের মেয়েটি অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–অহনা তোমার ঠোঁট দুটো এমন লাল হয়ে এবং ফুলে আছে কেন? ঠোঁটের পাশে তো অল্প কেটেও গেছে! এমন কি করে হলো?
মেয়েটির কথা শুনে অহনার গতকালকের সেই অন্ধকার ক্লাসে অনন্তের দেওয়া ভয়ংকর লিপ কিসের কথা মনে পড়তে থাকে। অহনা এটা ভাবতেই ভয়ে কেঁপে উঠল। অহনার ভয় পাওয়া চেহারা দেখে মেয়েটি অহনাকে বলল
–কি হলো অহনা তুমি এভাবে ভয় পাচ্ছো কেন? কি হয়েছে তোমার?
অহনা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আমার কি… কি… কিছু হয় নি।
মেয়েটিও অহনাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না৷ স্বাভাবিকভাবেই অহনা তিনটি ক্লাস করতে লাগল। কিন্তুু ক্লাসগুলোতে অহনা কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিল না। অহনার ঠোঁটে এখনও ভীষণ ব্যথা করছে। অহনা নিজের ঠোঁটে নিজে হাত দিলেই ভয়ংকরভাবে কেঁপে যায়। অহনা হাই বেঞ্চের উপর হাত ঠেকিয়ে নিজের কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। অহনার মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা করছে। তিনটি ক্লাস শেষ। এখন অনন্তের উচ্চতর গণিত ক্লাস। একটুপর অনন্ত ক্লাসে ঢুকল। সবাই অনন্তকে দাঁড়িয়ে সালাম দিল এবং অহনাও কাঁপা কাঁপা পায়ে অনন্তকে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। তারপর সবাই বেঞ্চে বসে পড়ল। আজ অনন্তের মুখে রাগী ভাব স্পষ্ট। অনন্তের রাগী চেহারাটা দেখেই অহনা বুঝতে পারল যে এটা ঝড়ের পূর্বাবাশ। অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–অনন্ত স্যারকে কাল রাগে যেভাবে কষিয়ে থাপ্পড়টা দিয়েছিলাম তাতে তো উনি আমায় জীবনেও ক্ষমা করবেন না৷ আগের শাস্তিগুলোর থেকেও ভয়ংকর শাস্তি মনে হয় এবার আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
অহনা ভয়ে কাঁপতে লাগল।
অনন্তের ক্লাস অনেক্ষণ চলতে থাকল৷ ক্লাসে অনন্ত অহনাকে কিছু বলছে না দেখে অহনা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হলো। কিন্তুু হঠাৎই অহনাকে চমকে দিয়ে অনন্ত অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–অহনা তুই দাঁড়া।
অনন্তের এমন রাগী কন্ঠে ডাক শুনে অহনার বুকের আত্মাটা কেঁপে উঠল। অহনার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসল৷ অহনা কাঁপা কাঁপা হাত পা নিয়েই দাঁড়াল। অহনার মুখে কোনো কথা নেই। অহনা শুধু নিজের মাথাটা নিচু করে আছে৷
–সারাদিন কয়টা ছেলের সাথে তুই ফূর্তি করিস অহনা?
অনন্তের এমন বাজে কথা শুনে অহনা স্তব্ধ হয়ে অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরো ক্লাসটাই এখন স্তব্ধ। ক্লাসের অন্যান্য ছেলে মেয়েরাও অনন্তের এমন কথা শুনে অবাক। কিন্তুু অনন্তকে সবাই ভয় পায় বলে কেউ কিছু বলছে না।
অহনার মুখে কোনো কথা বের হচ্ছে না। অহনা অনন্তের কাছে এমন ব্যবহার মোটেও আশা করে নি। অহনার চোখের কোণে পানি টলমল করছে। আরেকটু হলেই অহনার চোখের জল টুপ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়বে। অহনা মনে বলতে লাগল
–অনন্ত স্যার ক্লাসের সবার সামনে আমাকে এসব কি বলছে! শেষে কিনা স্যার আমাকে চরিত্রহীন উপাধি দিয়ে দিল!
–কিরে অহনা বলছিস না কেন? কয়টা প্রেমিক আছে তোর যাদের সাথে তুই ফূর্তি করিস?
অহনা আর সহ্য হলো না। এবার অহনা সাহস করে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–স্যার আপনি আমাকে এসব কি বলছেন? স্যার আপনার কি কোনো ধারণা আছে আপনি কি বলছেন?
–হ্যা আমি জানি তো আমি তোকে কি বলছি অহনা। তা তুই যে এবারের উচ্চতর গণিত পরীক্ষায় ডাবল শূন্য পেয়েছিস তা কি তুই জানিস অহনা? আমার বিষয়ে তুই ছাড়া সবাই পাশ করেছে।
অনন্তের কথা শুনে অহনা অবাক থেকে অবাক হচ্ছে৷ অহনার অনন্তের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়৷ অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–এটা কি করে সম্ভব! আমি কি করে উচ্চতর গণিতে ফেল করতে পারি! আমিতো পাশ করার মতো যথেষ্ট লেখা লিখেছিলাম।
অনন্তের কথা শুনে অহনার চোখের কোণের পানি টপ করে নিচে পড়ে যায়। অহনার এ অবস্থা দেখে আজ সবারই মায়া হচ্ছে। আজ কারও মুখেই কোনো হাসি নেই। অহনার মন খারাপ দেখে আজ সবারই মন খারাপ। কিন্তুু ভয়ে কেউ অনন্তকে কিছু বলতে পারছে না। অনন্ত আবারও অহনাকে বলল
–সারাদিন পড়াশোনা বাদ দিয়ে যদি ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি করিস তাহলে তো পরীক্ষার অবস্থা এমনই হবে। সত্যি তোর জন্য আমার ভীষণ মায়া লাগছে অহনা। শেষে কিনা তুই আমার বিষয়ে ফেল করলি! অহনা এবার মনে সাহস রেখে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–স্যার আপনি এসব কি বলছেন?আমি আজ অবধি কোনোদিনও কোনো বিষয়ে ফেল করি নি৷ স্যার আমি তো পাশ করার মতো খাতায় অংক লিখেছিলাম! আর আপনি এসব কি বলছেন যে আমি নাকি ছেলেদের সাথে এমন…! ছিহ্ স্যার আপনার মুখে কি একবারও এসব আটকালো না? আপনি কি করে আপনার ছাত্রীকে এসব বলতে পারেন?
–নারে অহনা আমার মুখে একটুও আটকালো না। কারণ তোর মতো ফালতু মেয়েদেরকে তো এসব বলাই মানায়। তাই তো বলছি প্রেমিকদের সাথে ঘুরাফেরা করা বন্ধ করে পড়াশোনায় মনোযোগ দে। তাহলে তোর ভবিষ্যৎে কাজে লাগবে। আর তুই যেন কি বললি? তুই পাশ করার মতো খাতায় লিখেছিস! হা হা হা একটু পরেই তোর খাতা তোকে দিয়ে দিব তখন ভালো করে খাতাটা দেখে নিস৷
অনন্তের এসব কথা শুনে অহনার মাথা আগুন হয়ে যায়। অহনার মুখে আর কোনো কথা নেই। অহনার চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছে। অহনার চোখে জল দেখে অনন্তের বুকের ভিতরটা কস্টে ফেটে যাচ্ছে। অনন্তের মনে হচ্ছে অনন্ত তার নিজের কলিজায় আঘাত দিচ্ছে।
অনন্ত মনে মনে বলতে লাগল
–তোকে কস্ট দিতে আমিও চাই নি অহনা। তুই আমার গালে থাপ্পড় দিয়েছিস তাতে আমি কিছু মনে করে নি অহনা৷ তুই চাইলে আমি আমার জীবনটাও তোকে দিতে পারব। কিন্তুু তুই কাল আমার ভালোবাসাকে যেভাবে অপমান করেছিস তার জন্য তো তোকে শাস্তি পেতেই হবে। তোর কাছে আমি আগের করা ভুলগুলোর জন্য ক্ষমা চেয়েছিলাম কিন্তুু তুই আমাকে ক্ষমা করলি না। বরং তুই আমাকে আরও অপমান করেছিস। আমাকে তুই আরো কঠোর হতে বাধ্য করেছিস। ভালোবাসার জন্য যদি আমাকে আরো খারাপ, কঠোর, ভয়ংকর, এমনকি পাগলও হতে হয় তাহলে আমি তাই হবো। আমি যেমন তোকে নিজের থেকে বেশী ভালোবাসি তেমন তোকে নিজের করার জন্য তোকে যথেষ্ট আমি শাস্তিও দিতে পারি। তোকে অনেক ভালোবাসতে চেয়েছিলাম কিন্তুু তুই আমার ভালোবাসাকে অবহেলা করলি। এবার আমিও দেখব তুই কতদিন আমাকে অবহেলা করে থাকতে পারিস। ভালোবাসা না দিয়ে হলেও কস্ট দিয়ে হলেও আমি তোকে আমার ভালোবাসার কথা তোর মনে স্মরণ করিয়ে দিব। হতে পারে সেই ভালোবাসার প্রকাশটা অন্যরকম। আমার কাছেই যে অন্যরকম তুই।
।
।
।
#চলবে……
#অন্যরকম তুই
#পর্বঃ০৫+০৬
#লেখিকাঃDoraemon
অনন্তের পায়ের এ অবস্থা দেখে অহনা কিছুটা কৌতুহল হয়ে পাশের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল কিন্তুু অনন্তের দেওয়া ভয়ানক শাস্তির কথা মনে পড়তেই অহনা আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। অহনা মনে মনে বলল
–এই দানব স্যারের যা মন চায় তাই হোক তাতে আমার কি? এসব ফালতু স্যার মরে যাক। বেশ হয়েছে পায়ে আঘাত পেয়েছে। এই বদমাশ স্যারটার জন্যই আমার পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। এবার বুঝ অন্যকে কস্ট দিলে কেমন লাগে হুহ্।
আজকে অনন্তকে দেখতে একটুও রাগী লাগছে না। অনন্ত তার বেন্ডেজ হাত পা নিয়েই বোর্ডে অংক করাচ্ছে। অহনার এই বেন্ডেজ ওয়ালা টিচারকে দেখে মনে হচ্ছে এ কোনো সাদা ভালুক। অহনা অনন্তের ক্লাসের অংক খাতায় করতে লাগল। অনন্তের ক্লাস যখন প্রায় শেষের দিকে তখন অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–আজকে এই দানব, শয়তান, বদমাশ, লুচু স্যারটা কি আমাকে শাস্তি দিবে? দেখে তো মনে হচ্ছে না আজ আমাকে শাস্তি দিবে। কিন্তুু তাও আমার মনের মধ্যে সন্দেহ বিরাজ করছে। এই স্যার কলেজে আমার মান সম্মান বিন্দু মাত্র রাখল না। সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।
অনন্তের ক্লাস শেষ। অনন্ত যখন ক্লাস থেকে যেতে নিল তখন অহনা তো মহাখুশি৷ কিন্তুু অহনাকে অবাক করে অনন্ত ফিরে এসে অহনার কাছে এসে অহনাকে বলল
–তুই আজ ছুটির পর একা কলেজের সব ক্লাসরুম ঝাড়ু দিবি। কোনো রুমে যেন একটুও নোংরা না থাকে। বুঝতে পেরেছিস? যদি কোনো রুমে একটু পরিমাণ নোংরা আমি পাই তাহলে তোর অবস্থা কি হবে তুই নিশ্চয় বুঝতে পারছিস অহনা?
অনন্তের কথা শুনে অহনা অবাক।
এর থেকেও কঠিন শাস্তি অহনা পেয়েছে কিন্তুু অনন্তের এই শাস্তির কথা শুনে অহনা মনে মনে বলল
–শেষে কিনা আমি ঝাড়ুওয়ালি হবো! তাও কিনা কলেজের সব ক্লাসের ঝাড়ুওয়ালি! সবার সামনে এত বড় অপমান করল আমাকে এই ফালতু স্যারটা। এই স্যারটা আমার সাথে এমন করছে কেন?
–কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
–ইয়ে মানে স্যার আমি একা কলেজের সব ক্লাসরুম ঝাড়ু দিব? আমার সাথে আর কেউ ঝাড়ু দিবে না? আমি একা কি করে এতগুলো ক্লাস ঝাড়ু দিব স্যার?
–তোর সাথে আর কেউ ঝাড়ু দিবে না। তুই একাই ঝাড়ু দিবি। আমার সাথে বেশি কথা বাড়াবাড়ি করবি তো কঠিন শাস্তি ভোগ করবি তুই৷
অহনার এখন ইচ্ছে করছে এই স্যারকে গুলি করে মারতে কিন্তুু কি আর করার ক্লাসরুম পরিস্কার না করলে যে অহনার কপালে আরও ভয়ংকর শাস্তি থাকবে সেটা অহনা ভালো করেই বুঝতে পারছে।
প্রত্যেকটা স্যারের ক্লাস অহনা মনোযোগ সহকারে করল। এবার ছুটি মানে সবাই বাসায় চলে যাবে কিন্তুু অহনা যেতে পারবে না। কারণ অনন্ত অহনাকে ছুটির পর কলেজের সব ক্লাসরুম ঝাড়ু দিতে বলেছে। অহনাও বাধ্য হয়ে একটা ঝাড়ু নিয়ে সবার আগে নিজের ক্লাসরুমটা ঝাড়ু দিল। একেরপর এক সব ক্লাসরুম অহনা ঝাড়ু দিতে লাগল। অহনা হাঁপিয়ে যাচ্ছে। অহনার শরীর থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে। এবার অহনা যে ক্লাসরুমটা ঝাড়ু দিবে সেটা হলো ঘন অন্ধকার ক্লাসরুম৷ অহনা ভীষণ ভয় পেতে লাগল। অহনা মনে মনে বলল
–এই ক্লাসটায় কোনো স্যার পড়ায় বলে তো মনে হয় না৷ কি ভয়ানক অন্ধকার! আমি এমনিতেও অন্ধকারে ভয় পাই তার উপর এই ক্লাস ঝাড়ু দিব কি করে! কিন্তুু দানব স্যারটা বলেছিল কলেজের একটা ক্লাসও যেন বাদ না থাকে। উফ কি আর করার ক্লাসটায় ঢুকতে তো হবেই৷ আমার যে আর কিছু করার নেই৷ নাহলে যে শাস্তি পেতে হবে
অহনা হাতে ঝাড়ুটা নিয়ে এক পা দু পা করে ক্লাসরুমটায় প্রবেশ করল। ক্লাসরুমে সব ভাঙা বেঞ্চ রাখা। দেয়ালে একটা ভাঙা ব্লাকবোর্ড। অহনা মনে একটু সাহস নিয়ে ঝাড়ুটা নিয়ে ক্লাসরুমটা ঝাড়ু দিতে লাগল। ক্লাসরুমটায় এতটাই ধুলাবালি যে ঝাড়ু দেওয়ার সময় অহনার ভীষণ কাশি পাচ্ছে। হঠাৎ ক্লাসরুমটার দরজাটা কেউ ঠাস করে বন্ধ করে দিল৷ অহনা বুঝতে পারছে ক্লাসরুমের ভিতরে কারও আগমন ঘটেছে। অহনা ভয়ে ভয়ে বলতে লাগল
— ক.. ক.. কে ওখানে?
অহনা কোনো সাড়াশব্দ পেল না। কিন্তুু পায়ের শব্দ অহনা ঠিকই শুনতে পাচ্ছে। পায়ের শব্দটা ধীরে ধীরে অহনার কাছেই আসছে।
অহনা ভয়ে ভয়ে বলল
–কে ওখানে? বলুন না? আমার যে খুব ভয় লাগছে। এমনিতেও অন্ধকারে আমি খুব ভয় পাই।
হঠাৎ অহনার দু বাহু ধরে টেনে কেউ দেয়ালে চেপে ধরল। অহনা ভয়ে কেঁপে উঠল। অহনা আ করে চিতকার দিতে নিলে কেউ ওর মুখটা চেপে ধরল। তারপর অহনার মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলতে লাগল
–অহনা তুই চুপ থাক। একদম চিল্লাচিল্লি করবি না। আমাকে তুই চিনতে পারছিস না অহনা?
অহনার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এই কন্ঠটা অহনার খুব চেনা। অহনা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
–অনন্ত স্যার আপনি?
–হ্যা আমি। তোর অনন্ত স্যার।
ঐদিকে তীব্র বাতাসে ক্লাসরুমের একটা জানালা খুলে যায়। এর ফলে বাইরের আলো ক্লাসরুমের ভিতরে আসতে লাগল। পুরো রুমটা একটু আলোকিত হলো। তার সাথে বাইরের তীব্র আলো অনন্তের মুখে পড়ল। অহনা তো অনন্তকে দেখতে পেয়ে ভয়ে কেঁপে যায়। অহনার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। অহনা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–স্যার আমার হাতটা ছেড়ে দিন প্লিজ। আমার খুব ব্যথা লাগছে।
–তোর তো হাতে ব্যথা লাগছে আর আমার যে বুকের মধ্যে ব্যথা লাগছে তা কি তুই বুঝতে পারিস না অহনা?
অনন্তের এমন অদ্ভুত কথার মানে অহনা বুঝতে পারল না। অহনা অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আপনি কি বলতে চান স্যার? আপনার বুকে ব্যথা মানে?
–আমাকে কেন তুই এত অবহেলা করিস অহনা? কেন তুই আমার দিকে ঠিকমতো তাকাস না? আমার উপর তোর খুব অভিমান। এতই অভিমান যে তুই বুঝিস না আমি তোকে কেন এত কস্ট দেই?
–আপনার উপর তাও আবার আমার অভিমান! হা হা হা আমাকে হাসালে আপনি। আমি আপনাকে অভিমান না স্যার, আমি আপনাকে ঘৃণা করি৷ আমি আপনাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করি৷ আগে আমি আপনাকে যথেষ্ট সন্মান করতাম কিন্তুু এখন শুধু আমি আপনাকে
ঘৃণা করি। আপনি প্রতিদিন যেভাবে আমাকে সবার সামনে অপমান করেছেন তার জন্য আমি আপনাকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারব না৷
— আমাকে একটু ভালেবাসা দিবি অহনা? আমাকে একটু তোর মনে জায়গা দিবি?
অনন্তের এমন কথায় অহনা স্তব্ধ হয়ে অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর অহনা রেগে গিয়ে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আপনাকে যতই দেখছি ততই আমার আপনার প্রতি ঘৃণা আরও বাড়ছে৷ আপনি একজন শিক্ষক হয়ে আপনার ছাত্রীকে ভালোবাসার কথা বলেন! এসব বলতে আপনার লজ্জা করে না স্যার?
— আমার লজ্জা করে না। কেন রে আমি কোন দিক দিয়ে খারাপ যে তুই আমাকে মেনে নিতে পারিস না? সব মেয়েরা আমার জন্য পাগল। আর তুই যে কিনা আমাকে সবসময় অবহেলা করিস। কেন রে তোর আর আমার বয়সের মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধান৷ তোর বয়স ১৮ আর আমার বয়স ২৪৷ তাহলে সমস্যাটা কি? আমরা কি পারফেক্ট কাপল হতে পারি না?
–না পারি না কারণ আপনি আমার শিক্ষক৷ আর সবচেয়ে বড় কথা আমি আপনাকে ঘৃণা করি।
–কেন এত ঘৃণা করিস তুই আমাকে অহনা? যেদিন কলেজে আমি নতুন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হই সেদিন আমার প্রথম করা ক্লাসে সবাই আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর তুই কিনা আমার দিকে ভালো করে তাকাসও নি। যেটা আমার কাছে অপমানজনক লাগে। সব মেয়েরা ক্লাসে কথাবার্তা বলছিল আর তুই চুপ করে ছিলি৷ আমি ভালই বুঝতে পেরেছিলাম তোর কোনো বন্ধু-বান্ধবী নেই। তুই একদম চুপচাপ, একদম শান্ত, আর হ্যা সবথেকে বোকাও তুই। একদম #অন্যরকম তুই৷ তাই সেদিনই আমার তোর প্রতি ভালোলাগা কাজ করে। তোকে যতই দেখেছি ততই আমি তোর প্রেমে পড়েছি৷ হ্যা হ্যা হ্যা আমি তোকে ভালোবাসি অহনা। তাই আমার প্রতি তোর অবহেলার জন্য তোকে আমি এতটা শাস্তি দেই। তুই যতটা কস্ট পাস তার থেকেও হাজারগুণ কস্ট আমি নিজেকে দিয়েছি৷ শুধু যে আমার হাত কেটেছি তা কিন্তুু নয় অহনা। দেখ অহনা আমার হাতে ছুরি দিয়ে আমি তোর নামও লিখেছি৷
অহনা দেখল অনন্তের ডান হাতের একটু উপরে অহনার নাম লেখা৷ তাও আবার দাঁড়াল ছুরি দিয়ে লেখা। এসব দেখে অহনার মনে ভয় কাজ করতে লাগল৷ অহনার মুখে কোনো কথা নেই। শুধু চুপ করে অনন্তের কথা শুনছে অহনা। অনন্ত অহনাকে আবারও বলতে লাগল
–জানিস অহনা সেদিন তোকে খালি পায়ে পুরো ২০ বার কলেজ চক্কর দিতে আমি চাই নি। কিন্তুু তুই যাতে পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হোস তাই আমি তোকে এই শাস্তিটা দিয়েছি। তোর পায়ে যতটা আমি রক্ত জরিয়েছি তার থেকে দ্বিগুণ আমি আমার পায়ে রক্ত জরিয়েছি অহনা। দেখতে পারছিস আমার দু পায়ে বেন্ডেজ। আমি কাঁচের গ্লাস ভেঙে সেখানে দুই পা রেখেছিলাম৷ আমার অহনাকে কস্ট দিব আর আমি নিজেকে ঠিক রাখবো সেটা কি করে হয় অহনা! আর তুই জানিস তোকে আমি কেন তুই করে বলি? কারণ আমি তোকে ভালোবেসে তুই করে বলি। তুই যে আমার কাছে সবচেয়ে আলাদা, #অন্যরকম তুই৷
অহনার মুখে কোনো কথা নেই। অহনা এখনও চুপ করেই আছে।
।
।
।
#চলবে….
#অন্যরকম তুই💘
#পর্বঃ০৬
#লেখিকাঃDoraemon
অহনার নিস্তব্ধতা দেখে অনন্তের বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব হতে লাগল। অনন্ত কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তার ভালোবাসার মানুষ এভাবে চুপ করে আছে। অনন্ত অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–কি হলো অহনা তুই চুপ করে আছিস কেন? আমি তোকে এতটা ভালোবাসি, আমার ভালোবাসার কথা শুনে কোনো উত্তর তুই কেন দিচ্ছিস না?
অহনা এখনো চুপ করে আছে। অনন্ত এবার অহনার দু বাহু ছেড়ে অহনার দু গালে আলতো করে হাতের স্পর্শ দিয়ে অহনাকে বলল
–অহনা প্লিজ তুই এভাবে চুপ করে থাকিস না! আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি তুই আমাকে ক্ষমা করে দে অহনা। তুই শুধু আমাকে একবার বল তুই আমাকে ভালোবাসিস তাহলে আমি আর কোনোদিনও তোকে কস্ট দিব না অহনা। তুই আমাকে একটু ভালেবাসা দে অহনা৷
অহনা এবার অনন্তের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে খুব রেগে অহনা অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–এজন্যই ছেলেদের দেখলে আমার শরীরে এলার্জি হয়। আমি এ কারণেই ছেলেদের বিন্দু মাত্র সহ্য করতে পারি না। আচ্ছা আপনি কি ভাবেন? ভালোবাসা বাজারের কোনো পণ্য যে চাইলেই টুপ করে পেয়ে যাবেন। আপনি এত সুন্দরী মেয়ে ছেড়ে শেষে কিনা আমাকে ভালোবাসবেন সেটা নেহাতই হাস্যকর। শুনেছিলাম আপনি বিদেশ থেকে খুব অল্প বয়সেই পড়াশোনা করে দেশে ফিরে শিক্ষক পেশাতে নিয়োগ হয়েছিলেন। তো বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে কি আপনি ছাত্রীর সাথে অসভ্যতা করার শিক্ষা শিখে এসেছিলেন? আপনাদের মতো ছেলেদের শিক্ষক হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই। বাবার টাকার ক্ষমতা, নিজের সুন্দর চেহারা আর নিজের রাগ আর দম্ভ দিয়ে আপনি সব মেয়েদের ভালোবাসা কিনতে পারলেও আমার মনে আপনার জন্য এক টুকরোও ভালোবাসা পাবেন না। কারণ আমি আপনাকে ঘৃণা করি। আপনি আমার সাথে এতদিন যা যা অন্যায় করেছেন তার জন্য আমি আপনাকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারব না, আর ভালোবাসা তো দূরের কথা।
অনন্ত এতক্ষণ অহনার কথা চুপচাপ শুনছিল। অহনার বলা কথাগুলোতে অনন্তের মাথায় রক্ত উঠে যায়৷ অনন্ত এখন অহনার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনন্তের ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে অহনা ভয়ে চুপসে যায়। অনন্ত অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তুই যেন কি বললি অহনা তুই আমাকে ভালোবাসিস না! তুই আমাকে ঘৃণা করিস?
–হ্যা হ্যা আমি আপনাকে ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা…..
অহনাকে আর বলতে না দিয়ে অনন্ত অহনার কোমর জড়িয়ে একহাতে অহনার পেছনের চুল আঁকড়ে ধরে অহনার ঠোঁট নিজের ঠোঁটের সাথে মিলিয়ে নেয়।
অনন্তের এমন আচরণে অহনা অবাক হয়ে যায়। অহনা ভাবতেও পারে নি অনন্ত এমন করবে। অহনা অনন্তের পিঠে কিল ঘুষি দিচ্ছে তো দিচ্ছে কিন্তুু অনন্তকে কিছুতেই অহনা ছাড়াতে পারছে না। অনন্ত অহনার ঠোঁটজোড়া এত জোরেই আঁকড়ে ধরেছে যে অহনার ঠোঁটে ভিষণ ব্যথা হচ্ছে৷ অহনার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। অনেক্ষণপর অনন্ত অহনার ঠোঁটজোড়া ছেড়ে অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–অহনা আমি এক বছর ধরে শিক্ষকতা করছি৷ বাবা চেয়েছিলেন
আমি বাবার বিজনেস দেখাশোনা করি কিন্তুু আমি তা শুনি নি। কিন্তুু এখন যদি তুই চাস আমি এই শিক্ষক পেশা থেকে নিজেকে বের করে আনব। তোর জন্য আমি আমার জীবনটাও দিতে পারি অহনা৷ তুই আমাকে একটু ভালেবাসা দে অহনা। আমি যে তোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি।
অহনা এবার খুব রেগে গিয়ে অনন্তের গালে ঠাসসস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। অনন্ত এত রাগী যে কোনোদিনও কাঁদে নি৷ কিন্তুু অহনার থাপ্পড়ে অনন্তের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল৷
অহনা খুব রেগে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আমার মনে হয় আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ। নাহলে কোনো সুস্থ শিক্ষক তার ছাত্রীর সাথে এমন অসভ্যতা করতে পারত না। আপনি নিজের মানসিকতা ঠিক করেন স্যার৷
এটা বলেই অহনা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেল৷ অনন্ত এখনোও সেখানেই দাড়িয়ে আছে৷ অনন্ত নিজের গালে হাত দিয়ে বলতে লাগল
–আমি ভাবতেও পারি নি অহনা তুই আমাকে এভাবে অপমান করবি! এভাবে তুই আমার গালে থাপ্পড় দিবি৷ আমার ভালোবাসাকে এভাবে তুই অবহেলা করবি।অনন্ত আহমেদকে কেউ কোনোদিন থাপ্পড় দেওয়ার সাহস পায় নি। কিন্তুু তুই আজকে সেই সাহস দেখালি। এর শাস্তি তো তোকে পেতেই হবে।
অহনা বাসায় গিয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে হাঁপাতে লাগল। অহনা ভাবতেও পারছে না যে সে অনন্ত স্যারকে থাপ্পড় দিয়েছে৷ অহনার মনে ভীষণ ভয় কাজ করছে। অহনা মনে মনে বলতে লাগল
— এটা আমি কি করলাম! শেষে কিনা আমি ঐ শয়তান দানব স্যারটাকে থাপ্পড় মারলাম! আমার মনে এত সাহস কোথা থেকে আসল! এরপর আমার আর রক্ষা নেই৷ আমি চাইলেই স্যারের ক্লাসটা না করতে পারি কিন্তুু আমি যে কারও কাছে প্রাইভেট পড়ি না! আমার যে প্রাইভেট পড়ার টাকাও নেই। কারণ আমার পরিবার যে ভীষণ গরীব। অনন্ত স্যার অনেক ভালো অংক বুঝায় তাই শত অপমান করা সত্তেও আমি তার ক্লাসটা করি। কিন্তুু এবার যে আমাকে স্যারের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। কিন্তুু অবশ্য উনার সাহস হয় কি করে আমার ঠোঁটের সাথে এমন কাজ করার!
অহনা আয়নায় গিয়ে দেখল অহনার ঠোঁটটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। অনন্তের ঠোঁটের স্পর্শের কথা মনে পড়তেই অহনা ভয়ে কেঁপে উঠে।
।
।
।
#চলবে…
অনন্তকে অন্যান্য দিনের মতো আজ রাগী লাগছে না। খুব শান্ত হয়েই বোর্ডে অনন্ত অংক করাচ্ছে৷ হাতে বেন্ডেজ বাঁধা অবস্থাতেই খুব নিখুঁতভাবে অনন্ত বোর্ডে অংক করাচ্ছে। সব মেয়েরা অনন্তের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তুু অহনা অনন্তের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। অহনা শুধু অনন্তের বোর্ডের লেখার দিকে তাকিয়ে আছে। বোর্ডে লেখা শেষ হলে অনন্ত সবার অংক ঘুরে ঘুরে চেক করছে। অহনা ভেবেছিল অনন্ত আজ তাকে কিছু বলবে না। অহনাও সবার মতো স্বাভাবিকভাবে অনন্তের বোর্ডে দেওয়া অংক খাতায় লিখছিল। অহনার হাতের ব্যথা এখনও যায় নি তবুও অহনা ব্যথা হাতে খুব মনোযোগ দিয়েই অংক লিখছিল।
–ওড়নাটা বুকের আরেকটু উপরে তুলে দিতি তাহলে আরো ভালো করে সব ছেলেরা উপভোগ করতে পারতো।
এমন বাজে কথা শুনে অহনা চমকে পাশে ঘুরে দেখল অনন্ত তার পাশেই দাড়িয়ে আছে।
অহনার বুঝতে আর বাকি রইল না অনন্তই তাকে এ কথাটা বলেছে। এদিকে ক্লাসে ইতিমধ্যেই হাসাহাসি শুরু হয়ে গেছে৷ অহনা নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যি ওড়নাটা বুকের উপরে উঠে গেছে। লেখতে লেখতে অহনার খেয়াল ছিল না। তাই কোনোমতে তাড়াতাড়ি ওড়নাটা ঠিক করে পড়ে নিল। অহনা মুখে কিছু বলল না। কিন্তুু অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–এই ফালতু স্যারের কি খেয়ে দেয়ে আর কোনো কাজ নেই! বেটা লুচু তোর এতদিকে চোখ যায় কেন উফ অসহ্য। লেখতে লেখতে কখন যে ওড়নাটা উপরে উঠে গিয়েছিল টের পাই নি৷ দুর ভালো লাগে না৷ এই স্যারটাকে আমার একদম অসহ্য লাগে। ফালতু স্যার একটা।
অনন্ত নিজের ক্লাসের পড়া বুঝিয়ে চলে গেল। অহনার সবগুলো ক্লাস করার পর যখন অহনা কলেজ থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটছিল। তখনই কেউ একজন পেছন থেকে অহনাকে ডাক দিতে লাগল
–অহনা… এই অহনা.. দাঁড়া।
অহনার কন্ঠটা চেনা চেনা মনে হলো তাই যখন অহনা পেছনে ফিরল তখন অহনা চমকে উঠল। এ যে আর কেউ নয় অনন্ত। অহনা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অনন্তকে বলল
–স্যা স্যা স্যার আ আ আপনি?!!
–তোর হাতটা দেখি তো।
–কেন স্যার! আমার হাত দেখে আপনি কি করবেন?
–আহ্ বেশী কথা বলছিস কেন? হাতটা দেখা বলছি।
–না স্যার আমার হাত দেখতে হবে না। আমি এখন আসি স্যার।
এটা বলেই অহনা চলে যেতে নিলে অনন্ত রাগী কন্ঠে অহনাকে বলল
–তুই কি দাঁড়াবি নাকি কালকে কলেজে কঠিন শাস্তি পাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করবি?
মুহূর্তেই অহনা নিজের চোখ মুখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবতে থাকে
–না না না এ হতে পারে না! অনেক অপমান অনেক শাস্তি এই দানবটার কাছ থেকে আমি পেয়েছি আর নয়। তার চেয়ে ভালো নিজের হাতটা দেখিয়েই ফেলি।
অহনা পেছন থেকে ফিরে এসে অনন্তকে নিজের বাম হাতটা দেখাল। এটা দেখে অনন্ত খুব রেগে অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আমি কি তোকে বাম হাতে মেরেছি যে বাম হাত দেখাচ্ছিস? তোর ডান হাতটা দেখা।
অহনা বাধ্য হয়ে ডান হাত দেখাল। অনন্ত পকেট থেকে একটা মলম বের করে অহনার হাতটা ধরে মলম লাগাতে লাগল। অনন্তের এই কান্ড দেখে অহনা মুহূর্তেই তার চোখ রসগোল্লা করে ফেলল।
–স্যার আপনি রাস্তায় আমার হাত ধরে মলম লাগাচ্ছেন! কেউ যদি এটা দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে স্যার! প্লিজ আমার হাতটা ছাড়ুন আমার হাতে আর ব্যথা নেই।
–তুই একদম চুপ থাক৷ সেদিন রাগটা আমার এতই উঠেছিল যে নিজের উপর কনট্রোল রাখতে পারি নি। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস অহনা।
অনন্তের কথা শুনে অহনা অবাক থেকে অবাক হচ্ছে। অহনা অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–না স্যার আপনি ক্ষমা চেয়ে আমাকে অপরাধী করবেন না। আপনি আমার শিক্ষক তাই আমি ভুল করলে আপনি আমাকে শাস্তি দিতেই পারেন। এতে ক্ষমা করার কিছুই নেই।
–অহনা তুই আমার দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলছিস কেন? আমি কি দেখতে এতটাই খারাপ?
অনন্তের এসব অদ্ভুত প্রস্নের উত্তর কি দিবে অহনা বুঝতে পারছে না৷ অহনার মুখে কোনো কথা নেই কিন্তুু অহনা মনে মনে ঠিকই বলল
–ইসস শখ কতো! কেন রে তোর দিকে তাকাতে আমার বয়েই গেছে ব্যাটা লুচু। মেয়েরা তো তোর দিকে খালি ক্রাশ খায়। আমি কচুও খাব না হুহ্।
–কিরে কিছু বলছিস না কেন?
–স্যার আমি এখন আসি।
এটা বলেই অহনা অরণ্যের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে গেল। অনন্ত অহনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এখনও অনন্ত রাস্তায় দাড়িয়ে আছে। অনন্ত মনে মনে বলল
–একবারও তুই জিজ্ঞেস করলি না অহনা আমি কেন হাতটা কাটলাম! আমাকে তুই এত ঘৃণা করিস!
…..
…….
[চলবে…..]
গল্প – অন্যরকম তুই
পর্ব – ০৪
লেখিকা – ডোরেমন
অহনা বাসায় ফিরে বিশ্রাম নিয়ে তারপর পড়ার টেবিলে পড়তে বসল। কিন্তুু পড়াতে একদম মনোযোগ দিতে পারছে না অহনা। অহনা ঠোঁটের কাছে কলম লাগিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল
–আচ্ছা অনন্ত স্যার এমন কেন? স্যারের কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? সবসময় আমার পেছনেই লেগে থাকে! আমাকে শাস্তি দিল আবার আমার ব্যথা হাতে মলম লাগাল! ব্যাপারটা আমার মোটেও ভালো লাগছে না। স্যার নিজেকে ভাবে টা কি? যখন মন চায় তখন অপমান করবে, যখন মন চায় তখন শাস্তি দিবে আবার যখন মন চায় তখন মলম লাগাবে! একদম অসহ্যকর। এই দানব স্যারটাকে তো মাঝে মাঝে মন চায় গলা টিপে মেরে ফেলি হুহ্। না না না আমি এসব ভাবা বন্ধ করে পড়ায় মনোযোগ দেই নাহলে দানবটা আবার কালকে আমাকে পড়া না পারার অজুহাতে শাস্তি দিবে।
অহনা খুব মন দিয়ে পড়ল। পড়তে পড়তে যখন খুব রাত হয়ে যায় তখন অহনা ঘুমিয়ে পড়ল। পরেরদিন সকালে উঠে অহনা কলেজ গেল। তিনটা ক্লাস অহনা মনোযোগ সহকারে করল। এবার চতুর্থ ক্লাস মানে অনন্তের ক্লাস। অহনা এবার ভয় পেতে লাগল। অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–অংক তো খুব ভালো করেই করেছিলাম কিন্তুু এই লুচু দানবটা যদি আবার আমাকে বোর্ডে অংক করতে বলে তখন যদি আমি ভয়ে ভুলে যাই। না না না আমি অনেকবার অংক চর্চা করেছি। কিছুতেই ভুলব না আমি।
অনন্ত ক্লাসে চলে আসল। সবাই অনন্ত স্যারকে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। অহনাও দাড়িয়ে সালাম দিল। তারপর সবাই নিজের সিটে বসে পড়ল। অনন্ত ক্লাসে এসেই বই নিয়ে বোর্ডে অংক করাতে লাগল। এটা দেখে অহনা তো মহা খুশি। অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–যাক বাবা! স্যার আজ আমাকে পড়া ধরবে না! ভাবতেই মনটা খুশি খুশি লাগছে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। ইয়াহুু !
কিন্তুু অহনার এই খুশি বেশিক্ষণ থাকল না। অহনার ভাবনায় এক বালতি জল দিয়ে অনন্ত বোর্ডে অংক করা শেষ করে অহনার কাছে এসে অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–অহনা আজ তুই পড়া শিখে এসেছিস? অংক করতে দিলে পারবি তো?
অনন্তের কথা শুনে অহনা আকাশ থেকে পড়ল। ভয়ে বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অহনা অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–জ্বি স্যার পা.. পা.. পারব।
–সত্যি তুই অংক করতে পারবি তো অহনা? যদি তুই অংক করতে না পারিস তাহলে তোর কপালে যে শনি, রবি, সোম, মঙ্গল সব নাচছে তা কি তুই বুঝতে পারছিস?
–জ্বি স্যা.. স্যা.. স্যার ।
–তাহলে যা বোর্ডে গিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ের ৫ নং অংকটা ঝটপট করে ফেল দেখি।
–স্যার বোর্ডে অংকটা না লিখে আমি অংকটা খাতায় লিখি?
অহনার কথা শুনে অনন্ত রাগী দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকাল। অহনা অনন্তের ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে ভয়ে চুপসে গেল। অনন্ত অহনাকে রাগী গলায় বলল
–তুই কি আমার কথার অবাধ্য হচ্ছিস অহনা? তুই জানিস এর ফল তোর জন্য কি হতে পারে?
–না না না স্যার৷ আমি এক্ষুণি বোর্ডে অংকটা করছি।
অহনা বাধ্য হয়েই হোয়াইট বোর্ডে অংক করতে গেল। ভয়ে অহনার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। অহনা হাতে মার্কার নিল। কিন্তুু যখন অহনা অংক করতে নিল তখন অহনার অংক আর মনে পড়ল না। অহনার মাথার মস্তিস্ক আর কাজ করল না। এদিকে অনন্ত অহনার পাশেই দাড়িয়ে আছে৷
–কি হলো অহনা অংক করছিস না কেন? এখন নিশ্চয়ই তুই বলবি যে ভুলে গেছিস।
–স্যার সত্যি আমি অংকটা ভুলে গেছি। কিন্তুু স্যার আপনি বিশ্বাস করুন আমি কাল সারাদিন অংক করেছি। কিন্তুু এখন মনে পড়ছে না।
অহনার কথা শুনে ক্লাসের ছেলে মেয়েরা হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। এদিকে অনন্ত রাগী দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকিয়ে আছে। অনন্ত রাগী দৃষ্টিতে চিতকার করে অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আমাকে কি তুই বোকা মনে করিস অহনা? তুই বলবি আর আমি বিশ্বাস করে নিব। তুই ক্লাস থেকে এখনি বেরিয়ে যা এবং খালি পায়ে কান ধরে ২০ বার কলেজ চক্কর দিয়ে আসবি।
অনন্তের কথা শুনে অহনা স্তব্ধ হয়ে গেল। অহনার চোখের পানি টলমল করতে লাগল। অহনা অনন্তকে অনুরোধ করে বলল
–স্যার আপনি আমাকে যা শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে নিব। কিন্তুু এমন শাস্তি আমাকে দিবেন না স্যার প্লিজ? এইটুকু দয়া করুন স্যার।
অহনার চোখের পানি অনন্তের মন গলাতে পারল না। অনন্ত খুব রাগী গলায় অহনাকে বলল
–তুই কি আমার আদেশ মানবি নাকি আমি তোকে কলেজ থেকে চিরতরে বের করার ব্যবস্থা নিব?
অনন্তের এমন কথায় অহনার বুক ফেটে কান্না আসছে। ক্লাসের সব ছেলে মেয়েরা অহনার কস্ট উপভোগ করছে। অহনা বাধ্য হয়েই ক্লাস থেকে বেরিয়ে খালি পায়ে কান ধরে ২০ বার কলেজ চক্কর দিতে লাগল। কান ধরে কলেজ চক্কর দেওয়ার মুহূর্তে অহনা খুব কান্না করেছে। খালি পায়ে হাঁটার কারণে ইটের ছোট ছোট টুকরো অহনার পায়ে লেগেছে৷ অহনা অনেক ব্যথাও পেয়েছে এবং পা দিয়ে রক্তও পড়েছে । চোখ দিয়ে অনবরত জল ফেলেছে অহনা। অন্যান্য স্যাররা অহনাকে এ অবস্থায় দেখে খারাপ লাগলেও অনন্তকে কিছু বলতে পারে নি। কারণ অনন্তের বাবার অনেক ক্ষমতা। তাই কোনো স্যার সাহস করে অনন্তকে কিছু বলতে পারে নি। অহনা ধীরে ধীরে রক্তমাখা পায়ে ক্লাসে গিয়ে ব্যাগটা নিয়েই সোজা কলেজ থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে বাসায় চলে গেল। বাসায় গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে অহনা প্রচুর কান্না করল। অহনার মা বাবা কিছু জানতে চাইলে অহনা তাদের বলে রিকশা থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। অনন্তের কঠিন শাস্তি অহনা আর পেতে চায় না। তাই অহনা তার মা বাবাকে কিছু বলে নি। অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–স্যার আপনি আজকে আমাকে যেভাবে অপমান করলেন, যেভাবে শাস্তি দিলেন তা আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না৷ কোনোদিনও না। আমি আপনাকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারব না।
অহনা দুই দিন কলেজ গেল না। অহনা তার রক্তাক্ত পায়ে দুইদিন মলম লাগালো কিন্তুু তবুও ব্যথা কমল না। দুইদিন পর অহনা ব্যথা পা নিয়েই কলেজ গেল এবং ক্লাস করতে লাগল। কিন্তুু অহনার মনটা খুব খারাপ। চতুর্থ ক্লাসে অনন্ত আসল। অনন্তকে দেখে অহনার খুব রাগ হচ্ছে।সবাই অনন্তকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম করল। অহনা দাঁড়াতে চায় নি কিন্তুু তবুও সবাই দাড়িয়েছে দেখে অহনা দাঁড়াল। কিন্তুু একি দেখছে অহনা! অনন্তের দুই পায়ে বেন্ডেজ। বেন্ডেজের উপর রক্ত জমাট বাঁধা। অনন্তকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে হাঁটতে অনন্তের ভীষণ কস্ট হচ্ছে। অহনা অনন্তের এ অবস্থা দেখে অবাক হয়ে মনে মনে বলতে লাগল
–এই দানবটার আগে হাত কেটেছিল আবার এখন দেখি দুই পায়ে বেন্ডেজ! তারমানে দানবটার দুই পায়েই আঘাত পেয়েছে। কিন্তুু দানব স্যারটার পা কাটলো কিভাবে?
…..
…….
[চলবে…..]
সিড়ি দিয়ে ক্লাসরুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উপরে উঠছিল অহনা। তখনই কেউ অহনার পেছনের ওড়না ধরে টান দেয়। আকস্মিক এমন ঘটনায় বুকটা কেঁপে উঠে অহনার। অহনা পেছনে ঘুরে যাকে দেখে তা দেখে অহনার বুকটা ধুক করে কেঁপে উঠল। অহনার ওড়না পেছন থেকে যে টান দিয়েছে সে আর কেউ নয় অহনার কলেজের টিচার। তার নাম হলো অনন্ত আহমেদ। অনন্ত দেখতে খুব সুন্দর যে কিনা সব মেয়েদের ক্রাশ কিন্তুু অহনার ক্রাশ নয়। অহনা ছেলেদের দিকে তাকায় না। তাকালেই মনে হয় অহনার এলার্জি হয়। ঠিক তেমনই অনন্তও কোনো মেয়েকেই পাত্তা দেয় না৷ সবসময় রাগী লুক নিয়ে থাকে। অহনার উচ্চতর গণিত ক্লাসটা অনন্ত নেয়। আর শুধু তাই নয় ক্লাসে কারণে অকারণে অহনাকে সবার থেকে সবচেয়ে বেশী শাস্তি দেয় অনন্ত। সেটা পড়া পারলেও কিংবা না পারলেও। অহনা খুব ভিতু, বোকা, বাচ্চা স্বভাব, ও গরীব ঘরের মেয়ে। অহনা দেখতে অতটা সুন্দরীও নয়। কোনোরকম টেনে টুনে কলেজে পড়ে৷ অন্য কোনো ছেলে অহনার সাথে এমন করলে অহনা হয়তো বকা দিত আর নাহলে টিচারদের কাছে বিচার দিত। কিন্তুু এ কাকে দেখছে অহনা! কলেজের মেয়েদের সপ্নের নায়ক আর সবচেয়ে রাগী ও ভয়ংকর যদি কোনো শিক্ষক থেকে থাকে তা হলো অনন্ত। বাবার প্রচুর টাকা থাকা সত্তেও নিজের সপ্ন ছিল একজন শিক্ষক হওয়া তাই অনন্ত শিক্ষক পেশাকেই বেছে নেয়। অহনার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অনন্ত স্যারকে উদ্দেশ্য করে বলল
— স্যা স্যার আ আ আপনি! আমার ওড়নাটা ছেড়ে দিন স্যার।
–যদি ওড়নাটা না ছাড়ি তাহলে তুই কি করবি?
অনন্তের কথা শুনে অহনার বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল। আজ অহনা কলেজে পৌঁছাতে খুব দেড়ি করে ফেলেছে সব শিক্ষকরা ক্লাস নিতে ব্যস্ত আর অহনা এখন পড়েছে মহা বিপদে। অনন্ত স্যারকে কি বলবে অহনা বুঝতে পারছে না৷
–স্যার আমার ওড়নাটা ছেড়ে দিন প্লিজ আমি ক্লাসে যাবো।
অনন্ত অহনার ওড়নাটা ছেড়ে অহনার হাত ধরে টানতে টানতে একটা ফাঁকা ক্লাসে অনন্ত অহনাকে নিয়ে দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দেয়। অহনার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বুকটা রীতিমতো কাঁপা-কাঁপি করছে। অনন্ত অহনার কাছে এসে অহনার দু বাহু ধরে দেয়ালের সাথে শক্ত করে চেপে অনন্ত দাঁতে দাঁত চেপে অহনাকে বলল
–নিজেকে খুব স্মার্ট ভাবিস তাই না অহনা। আমার থেকে সবসময় মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখিস। আমাকে অবহেলা করিস তুই। বড্ড অভিমান তোর আমার উপর তাই না!
অনন্তের কোনো কথা অহনার মাথায় ঢুকছে না। অনন্ত এসব কি বলছে! শিক্ষক হলো সম্মানিয় ব্যক্তি যদিও অনন্তের বয়স খুব কম তবুও তো উনি শিক্ষক। অনন্তের কথা শুনে অহনা মনে মনে বলতে লাগল
–স্যার কি পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি! কিসব বলছে এসব!
–কিরে আমার কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন? উত্তরটা দে?
ফাঁকা রুমে অনন্ত অহনার হাতটা খুব শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে যার কারণে অহনার হাতে খুব ব্যথা লাগছে। অহনার সাহস হচ্ছে না অনন্তকে কিছু বলার কিন্তুু তবুও অহনা অনন্তকে বলল
–স্যার আমার হাতে খুব ব্যথা লাগছে আমার হাতটা ছেড়ে দিন প্লিজ?
–তোকে ছাড়বো। অবশ্যই ছাড়বো আগে তুই বল সব মেয়ে আমাকে পাওয়ার জন্য রাত জেগে সপ্ন দেখে আর তুই কিনা আমার দিকে ঠিক মতো তাকাসও না। কেন রে আমি কোন দিক দিয়ে খারাপ?
–ছিহ স্যার আপনি এসব কি বলছেন! আপনি একজন শিক্ষক। আপনি আমার সাথে এমন আচরণ করতে পারেন না।
অহনার কথায় অনন্তের ধ্যান ফিরল এবং অনন্ত কিছুটা স্বাভাবিক হলো। অনন্ত অহনার হাত ছেড়ে দিয়ে খুব রাগী গলায় অহনাকে বলল
–যা ক্লাসে যা। তোকে তো আমি ক্লাসে দেখে নিব।
অগ্নি দৃষ্টিতে অনন্ত অহনাকে এই কথা বলাতে অহনা ভয়ে চুপসে যায়। আর এক মুহূর্তেও দেরি না করে অহনা ফাঁকা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ক্লাসরুমে দেরি করে আসাতে টিচার অহনাকে বাইরে কান ধরে দাড় করিয়ে রেখেছে। ক্লাসের সব ছেলে মেয়েরা অয়নার কান ধরে থাকাটা উপভোগ করছে৷ আরেকজনও খুব উপভোগ করছে৷ অহনা যখন কান ধরে দাড়িয়ে থাকে তখন অহনা মুখটা পাশ ফিরাতেই দেখে অনন্ত বেশ কিছু দূরত্বে অহনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ক্লাসরুমে ঢুকে যায়। অহনার এটা দেখে খুব রাগ হচ্ছে। অহনা মনে মনে বলল
–এই শয়তান স্যারটার জন্য আজ আমার এই অবস্থা। নিজে তো অনেক শাস্তি দেয় অন্য টিচার দিয়েও শাস্তি দিল। কিন্তুু আজ স্যার আমার সাথে এমন আচরণ কেন করল?
…..
…….
[চলবে…..]
গল্প – অন্যরকম তুই
পর্ব – ০২
লেখিকা – ডোরেমন
প্রায় ৩০ মিনিট বাইরে কান ধরে দাড়িয়ে থাকার পর টিচার অহনাকে ক্লাসে ঢুকতে দিল। অহনা মাথা নিচু করে ক্লাসে ঢুকল। আর চারপাশে হাসাহাসির শব্দও অহনার কানে পৌছাল। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল অহনার। সবার পেছনের বেঞ্চে বসে পড়ল অহনা। রাগে অহনার মাথা ব্যথা করছে৷ অহনা মনে মনে বলল
–আমার সাথে এমন আচরণ করে অনন্ত স্যার কি শান্তি পান একমাত্র উনিই জানেন। অন্যান্য টিচারদের কাছ থেকেও শাস্তি পেতে হলো!
আমার তো মনে হয় সব থেকে বেশী শাস্তি আর অপমানটা উনি আমার ভাগ্যেই রাখেন। ক্লাসের সবাইকে তুমি বলে কথা বলে আর আমাকে তুইতোকারি করে কথা বলে যা আমার কাছে একদম অসহ্যকর।
তিনটি ক্লাস সম্পন্ন হলো। এখন চতুর্থ ক্লাস অনন্ত নেবে যার ফলে অহনার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। অহনা মনে মনে বলল
–হায় আমার খোদা এখন তো দানব স্যারটা আসবে। ঐ শয়তানটার জন্য আজ কত অপমানিত হলাম এখন ক্লাসে এসে তো আমায় অনবরত অপমান করবে। আমাকে ফাঁকা ক্লাসে নিয়ে যেভাবে হুমকি দিয়েছিল! আজ আমার রক্ষা নেই৷
কিছুক্ষণ পর অনন্ত ক্লাসে আসল। সাথে সাথে সবাই দাড়িয়ে অনন্তকে সম্মান জানাল। অহনাও দাড়িয়েছে কিন্তুু ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। হাত পা রীতিমতো কাঁপা-কাঁপি করছে। কয়েকটা মেয়ে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–স্যার আজকে আপনাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। সিনেমার নায়করাও আপনার কাছে হার মানাবে৷
অনন্ত রাগী দৃষ্টিতে মেয়েগুলোর দিকে তাকাল সাথে সাথে মেয়েগুলো ভয়ে চুপসে গেল।
সবাই তারপর বেঞ্চে বসল। অহনা যেহেতু পেছনের বেঞ্চে তাই মুখ লুকিয়ে বসে ছিল। অহনা ভেবেছিল অনন্ত তাকে দেখবে না কিন্তুু অনন্তের চোখ তা এড়াতে পারে নি।
অনন্ত সামনে থেকেই বলে উঠল
–অহনা তুই দাঁড়া তো!
অহনার ভয়ে এবার কাঁপাকাঁপা পায়ে দাড়াল। অহনার বুকের ধুকপুকানিও দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
–জ্বি স্যার।
–আজকে সব পড়া শিখে এসেছিস? অংক হোয়াইট বোর্ডে করতে দিলে করতে পারবি তো?
–পা পারব স্যার।
–তাহলে তো তুই গুড গার্ল। আয় সামনে আয়।
অহনা সামনে যেতে লাগল।ক্লাসের সবাই অহনার শাস্তি দেখতে ব্যাকুল। তারা দর্শক হিসেবে আজ উপভোগ করছে।
–এই নে মার্কার। এবার তুই প্রথম অধ্যায়ের ৩নং অংকটা করে দেখা। আশা করি তুই এত সহজ অংকটা করতে পারবি।
অহনা হাতে মার্কার নিয়ে হোয়াইট বোর্ডে লিখতে নিল কিন্তুু অহনার কোনো অংকই মনে পড়ছে না। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। বোর্ডে কি লেখবে তাও বুঝতে পারছে না।
অনন্ত রাগী দৃষ্টিতে অহনার দিকে তাকিয়ে অহনাকে বলল
–কিরে অংকটা পারিস না?
–স্যা স্যার আ আমি ভুলে গেছি।
–ওহ্ তাই নাকি? যা বাইরে দাড়িয়ে ৫০ বার কান ধরে ওঠবস কর৷
অনন্তের কথা শুনে অহনা স্তব্ধ। অহনার বুকে চাপা কস্ট অনুভব হতে লাগল। তবুও অহনা সাহস করে অনন্তকে উদ্দেশ্য করে বলল
–স্যার আজকে প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি ওয়াদা করছি স্যার কালকে আমি অবশ্যই পড়া শিখে আসব।
অহনার আকুল করা কন্ঠে মিনতি করাও অনন্তের কানে পৌছাল না। অনন্ত খুব রাগী গলায় বলল
–আমার ক্লাসে যে পড়া শিখে আসে না তার জন্য আমি কঠিন শাস্তি বরাদ্দ করে রাখি। আমার মুখের উপর কথা বলার তোর সাহস হয় কি করে? তুই হাত পাত।
–স্যার আর কোনোদিন করব না।
–তুই হাত পাতবি নাকি কঠিন মার খাবি?
অহনা ভয়ে হাত পাতল। অনন্ত একটা স্টিলের স্কেল দিয়ে খুব জোরে অহনার হাতে আঘাত করল যার ফল স্বরূপ অহনার হাত লাল টকটকে হয়ে ফুলে একাকার হয়ে গেল। সবাই অনন্তের এমন আচরণে ভয় পেয়ে যায়। অহনার খুব কান্না পাচ্ছে তবুও অহনা কান্না দমিয়ে নিজের বেঞ্চে বসতে গেলে অনন্ত বলল
–দাড়া তুই। আমি কি তোকে বেঞ্চে বসতে বলেছি?
–স্যার আপনি তো আমায় শাস্তি দিলেনই তাহলে?
–তোকে আমি বাইরে ৫০ বার কান ধরে ওঠবস করতে বলেছি। যা বাইরে দাড়িয়ে কান ধরে ওঠবস কর!!
অনন্তের কথা অনুযায়ী অহনার ক্লাসের বাইরে দাড়িয়ে ৫০ বার ওঠবস করল একই তো ব্যথা হাত তার উপর ৫০ বার ওঠবস করার ফলে অহনার পা ব্যথা হয়ে যায়। যখন অহনা ওঠবস করার পর ক্লাসে পা বাড়ায় তখন অহনা হুঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিলে অনন্ত এসে অহনাকে ধরে ফেলে। অহনা অনন্তের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এই দৃশ্য দেখার পর কিছু মেয়ের প্রচুর রাগ হয়। অনন্ত অহনাকে নিজের বুক থেকে ছাড়িয়ে সোজা করে দাড় করিয়ে অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তোর পা কি নরম তুলো যে সামান্য কান ধরে ওঠবস করতে গিয়ে পড়ে যাস নাকি পড়ে যাওয়ার নাটক করলি কোনটা?
অনন্তের এমন কথা শুনে অহনা মাথা নিচু করে ফেলে। অহনা নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসল। অহনার ভীষণ কান্না পাচ্ছে কিন্তুু সবাই কান্না দেখে ফেলবে বলে কাঁদছে না। (পরবর্তী পর্বগুলো আমার আইডিতে দেয়া আছে)
এভাবেই অনন্তের ক্লাস আজকে সম্পন্ন হয় যায়। অনন্ত কিছু পড়া সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যায়।
অহনা বেঞ্চের মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে মনে মনে বলল
–স্যার আপনি আমায় শাস্তি দিবেন আমি জানতাম কিন্তুু এতটা কঠিন শাস্তি দিবেন তা আমি আশা করি নি। আমার হাত পায়ে অসম্ভব ব্যথা হচ্ছে৷
অহনা তিনদিন ধরে আর কলেজ গেল না। হাতে পায়ে অসম্ভব ব্যথা থাকার কারণে বাসায় থেকে গেল।
তিনদিন পর যখন অহনা কলেজ গেল তখন স্বাভাবিকভাবে চতুর্থ ক্লাসে অনন্ত আসল। কিন্তুু অহনা দেখতে পেল অনন্তের এক হাতে বেন্ডেজ করা। বেন্ডেজের উপর রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। এটা দেখে অহনা তার পাশে বসে থাকা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল
–এই শুনো স্যারের হাতে এভাবে বেন্ডেজ বাঁধা কেন?
অহনার প্রস্নের জবাবে মেয়েটি অহনাকে বলল
–তিনদিন তো তুমি কলেজ আসো নি। গত তিনদিন আগে অনন্ত স্যারের হাত কেটে যায়৷ হাতটা দেখে মনে হচ্ছে অনেক রক্ত বের হয়েছে এবং খুব জোরে আঘাত পেয়েছে কিন্তুু অনন্ত স্যারকে কেউ জিজ্ঞেস করলে অনন্ত স্যার বলে এমনি হাত কেটে গেছে।
অহনা মেয়েটির কথায় অবাক হলো। অহনা মনে মনে বলল
–এমনি এমনি কি কারও হাত কেটে যায়! স্যারের এভাবে হাত কাটল কিভাবে?
…..
…….
[চলবে…..]
মাঝেমধ্যে যখন অতীতের ছোটো অধ্যায় কিংবা এক টুকরো অনুভূতির ফেলে আসা দিন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়, ব্যক্তি তা সামলাতে বড্ড হিমশিম খায়। কেউ কখনোই চায় না, তার ছোট্ট অতীত সুন্দর বর্তমানকে এসে প্রশ্নবিদ্ধ করুক। বর্তমানের সাজানো, গোছানো মুহূর্তগুলোকে ভে’ঙে তছনছ করে দিক। তবুও কিছু সময়, অতীত মানুষের বর্তমানে চলে আসে। ভুল হোক কিংবা সঠিক, অতীত এসে জাগিয়ে দেয় কিঞ্চিৎ দুর্বলতা! মাইসারার আজকের সুন্দর দিনটায়ও হুট করেই অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ের আবির্ভাব ঘটলো। তাকে পুরোপুরি কাঁপিয়ে দিল। বুঝিয়ে দিল, মানুষ চলে গেলেও বার বার ফিরে আসে। কিন্তু কেন আসে?
ইন্টার্নিশিপের নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে গেছে। সেই হিসেবে আজকের দিনটা বিশেষ একটা দিনে পরিণত হওয়ার কথা। সুন্দর এক আলোচনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেরা তিনজনকে স্পেশাল পুরষ্কার দেয়ার পাশাপাশি লিগ্যাল সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে। এতে তারা বাংলাদেশের যেকোনো হসপিটালেই প্রেকটিস করার সুযোগ পেয়ে যাবে। এখানে যেমন বেশি মেধার ছাত্রছাত্রী আছে, তেমনি কম মেধারও আছে। তবে প্রত্যেকেরই মনের জোর ছিল প্রখর। ফলস্বরূপ আজকের এই সফলতা।
“ইন্টার্নশিপ সার্টিফিকেট প্রদান অনুষ্ঠান” চলাকালীন সময়ে সেরা তিনজন শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ শুভেচ্ছা স্মারক প্রদান করা হয়। যাদের মধ্যে মাইসারার নামটাও ছিল। যখন তিনজনের হাতে ক্রেস্ট আর সার্টিফিকেট তুলে দেয়া হয়, সেই সময়টা গোটা জীবনের সবচেয়ে দামী মুহূর্ত হিসেবে অনুভব করে সকলে। অনুষ্ঠান থেকে একজন পুরো সময়টা ফেইসবুকে লাইভে ছেড়ে দেয়। ফলে গোটা দেশ সাক্ষী হয়ে যায় একটি সুন্দর সফলতার।
অনুষ্ঠান শেষে উৎফুল্ল মনে নিজের সবকিছু গোছগাছ করছিল মাইসারা। আজকেই বাড়ি ফিরবে এমনটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আগে। সব গোছানো প্রায় শেষ। অনিককেও জানিয়ে দিয়েছে খুশির খবরটা। লাগেজ নিয়ে যখন হোস্টেল ছেড়ে বের হলো তখনই রিপা আসলো। জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল একে-অন্যের থেকে। মুচকি হেসে বলল,
-“তোর জন্য একজন অপেক্ষা করছে!”
-“কে?”
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো মাইসারা। অনিক এত দ্রুত চলে এসেছে তবে! কেমন খাপছাড়া লাগলো। ঘণ্টা খানেক আগেই মাত্র জানিয়েছে, আজ বাড়ি ফিরবে। এরমধ্যেই তো চলে আসার কথা না। রিপা পক্ষান্তরে জবাব দিল,
-“ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছে! আজই তো চলে যাবি। আর আমাদের দেখা হবে না!”
-“যোগাযোগ তো হবেই। সাবধানে থাকিস। আল্লাহ্ হাফেজ।”
ফের রিপাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল মাইসারা। ভাবনারত চেহারা নিয়েই ক্যানটিনের ভেতরে প্রবেশ করলো। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে পরিচিত কাউকেই দেখতে পেল না। পিছু ঘুরে চলে আসতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো। হাতের ঠিক ডানপাশে বসে থাকা যুবক হুট করে দাঁড়িয়ে সৌজন্যতাবোধ প্রকাশে হাত বাড়িয়ে বলল,
-“হাই সারা! কেমন আছো?”
ঠিক এই মুহূর্তে কী জবাব দেয়া উচিত ভেবে পেল না মাইসারা। সেই একটা মেইল, এরপর আর কোনো খোঁজ নেই। আজ এতগুলো বছর পর এসে সানভি জানতে চাইছে, সে কেমন আছে! প্রশ্নটা অদ্ভুত শোনালো। তবুও মাইসারা নিজেকে সামান্যতম বিচলিত হতে দিল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হাত না বাড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
-“সৃষ্টিকর্তা খুব ভালো রেখেছেন। তুমি এখানে কেন এসেছো, কতখানি ভে’ঙে গুড়িয়ে গেছি সেটা দেখতে?”
-“তোমার সাথে দেখা করতে!”
-“দেখা করার কথা ছিল আমাদের?”
সানভি এই প্রশ্নে পুরোটাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আসলেই কি ছিল? কেন এলো সে? এতগুলো বছর পর কীসের আর টান জন্মাতে পারে? কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
-“দেশে ফিরে তোমার অনেক খোঁজ করেছি সারা, তোমাদের বাড়িতেও গিয়েছি। ভেবেছিলাম বিয়ের প্রস্তাব দিব, কিন্তু তোমার ওই কাজিন রীতিমতো ঘাড় ধা’ক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে আমাকে! আজকের ফেইসবুক লাইভেই দেখলাম, তুমি এই হসপিটালে। বাধ্য হলাম এখানে আসতে।”
বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মাইসারা। কেন যেন সানভির সাথে কথা বলার আগ্রহ আসছে না তার। রাগ লাগছে নিজের উপর। কেন ভুল মানুষকে মন দিয়েছিল সে? কেন অতীতটা আজ সামনে সে দাঁড়ালো? কী উপায়ে তাকে এড়িয়ে যাবে সে? কোনো উত্তরই খুঁজে পেল না তৎক্ষনাৎ। তবুও ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। সানভি আবারও বলল,
-“আমি আসলে তোমাকে কিছু কথা বলতে এসেছি! ভেবেছিলাম তোমার মতো মিডি’লক্লাস মেয়েরা স্বপ্ন পূরণের জন্য আমার মতো হাই সোসাইটির লোকজনকে বেছে নিবে। সে কারণে দেশের বাইরে গিয়ে আমি আর যোগাযোগ রাখতে চাইনি।”
-“তুমি কী ভেবেছিলে? তুমি ছেড়ে চলে গেলে আমি ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবো? সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবো না? নিজের লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাব? এতটাই দুর্বল ভেবেছিলে আমাকে?”
-“এটাই ভেবেছিলাম! কারণ তোমার মাথার উপর ছাদ ছিল না। এমনকি ভরসা দেয়ার মতোও কেউ ছিল না। কিন্তু তুমি তা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছো। দেশ ছেড়ে বাইরে যাওয়ার আগে তোমার কাজিনের সাথে খুব ঝামেলা হয় আমার!”
-“কীসের ঝামেলা?”
চমকে উঠলো মাইসারা। অনিকের সাথে সানভির তবে অনেক আগেই দেখা হয়েছে। ঝামেলাও হয়েছে। ঠিক কী নিয়ে? এতগুলো বছর পর, এসব কথা সানভি কেনই-বা জানাতে এসেছে? সে তো আর যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন মনে করছে না। ভুল মানুষ একবারই করে, বার বার নয়! সে-ও একবারই করেছে, আর করবে না।
*****
ফ্ল্যাশব্যাক :
___________
তখন মাইসারার মেডিকেল জীবনের মাত্র শুরু। সানভির সাথে রিলেশনের প্রায় কয়েক মাস পরের ঘটনা। মাইসারার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আর টাকা দিতে হোস্টেলে এসেছিল অনিক। ঠিক এই ক্যানটিনে এসেই অপেক্ষা করছিল। সেই মুহূর্তে সানভির সাথে আলাপ হয় তার। সেটা শুধু সৌজন্যসাক্ষাৎ ছিল না রীতিমতো ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল দু’জনার। প্রথমে অনিক একপলক দূর থেকেই দেখছিল সানভিকে। মাইসারার মুখে শুনেছিল দু’জনার রিলেশনে জড়ানোর কথা। হোয়াটসঅ্যাপে ছবিও দেখেছিল। খারাপ লাগলেও মন থেকে চেয়েছিল, মাইসারা সেই খুশিতে খুশি থাকুক। অথচ তার সেই ভাবনাকে তুড়ি মে’রে উড়িয়ে দিয়েছিল সানভি। এক পরিচিত বন্ধুর সাথে আলোচনা করছিল সে। বলছিল,
-“শা’লা এমন মিডি’লক্লাস একটা মেয়েকে ভালোবাসলাম, যার চালচুলো কিছুই নেই।”
অপরপাশে থাকা ছেলেটা জবাবে বলেছিল,
-“নিজের ইচ্ছেতেই তো রিলেশনে জড়িয়েছিলি। এখন এত ভাবছিস কেন? কিছু থাকুক বা না থাকুক, তুই তো আছিস। মানিয়ে নিবি দু’জনে।”
-“আমার বাপের এত সম্পত্তি! যদি শুনে এমন একটা মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়েছি আমাকে ত্যা’জ্যপুত্র করবে। তাছাড়া মা আমার কাজিনের সাথে বিয়ে ঠিক করে রেখেছে। মেয়েটা আমেরিকাতে থাকে। ভাবছি উচ্চ ডিগ্রির কথা বলে এখান থেকে চলে যাব। ওখানে গিয়ে কাজিনকে বিয়ে করে সুখী জীবন কাটাবো।”
-“তবে তোর গার্লফ্রেন্ডের কী হবে?”
-“চুলোয় যাক সে। তার রূপ ধুয়ে কি পানি খাব আমি? আমার নখেরও যোগ্য নয় মাইসারা!”
-“এতদিন যে মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখালি! সব স্বপ্ন ভে’ঙে দিবি?”
-“আমি তো বলিনি তাকে স্বপ্ন দেখতে! সে অনেক বুদ্ধিমতি। আমার ঘাড়ে ভর দিয়ে এই সুযোগটা লুফে নিতে চাইছিল। বড়ো হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। ডাক্তার হবে। না আছে টাকা-পয়সা, আর না আছে স্ট্যাটাস! কীভাবে এই কঠিন পথ অতিক্রম করবে সে?”
হাসিঠাট্টায় খুব বা’জে বা’জে কথা বলছিল সানভি, যার প্রত্যেকটা কথা মাইসারাকে অপমান করে বলা হচ্ছিলো। অনেকক্ষণ চুপ থেকে তার পুরো প্ল্যানটাই শুনে ফেলেছিল অনিক। মুখোমুখি জবাব দিতে সোজা তার সামনে এসে পাশের চেয়ারে বসেছিল। বলেছিল,
-“দারুণ চিন্তাভাবনা! একটা মেয়ের অনুভূতি নিয়ে খেলতে লজ্জা লাগে না? তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সেই প্রতিশ্রুতি ভা’ঙ’তে বুক কাঁপে না? এই ছিল বিশ্বাস আর ভরসার মূল? মানুষকে না চিনে, না বুঝে তাকে অপমান করতে বিবেকে বাঁধেনি আপনার? মনে হয়নি, যদি একবার মেয়েটা এই সত্যি জানে, কতখানি কষ্ট পাবে?”
-“ওসব মেয়েদের আমার চেনা আছে। এই দু’হাতে কত মেয়েকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছি!”
-“সারাকেও ঘুরাতে চান?”
-“মেয়েটা তো ঘুরছেই। পা’গলের মতো ঘুরছে। অথচ জানেই না, এসব মিথ্যে অভিনয়। এমন দু’চারটা মেয়ে যদি না পটাতে পারি, তবে পুরুষ মানুষ হয়ে জন্মালাম কেন?”
-“ওহ, যারা মেয়ে পটাতে পারে না তারা বুঝি হিজ’ড়া?”
-“ওদেরকে তো কাপু’রুষ বলে।”
-“তুই কি জানিস তুই কুকু’রের চেয়েও অধম?”
আপনি থেকে তুই-তে নেমে আসলো অনিক। মাইসারার অপমানটা হজম করতে পারছিল না সে। ততক্ষণে অনিকের দুটো হাত সানভির শার্টের কলার চেপে ধরেছে। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কখন যে নাকমুখ ফা’টি’য়ে ফেলে ঠিক নেই। আচমকা এই আচরণে রীতিমতো হকচকিয়ে যায় সানভি। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনিকের দিকে তাকায় সে। রাগে হিসহিসিয়ে বলে,
-“আপনার সাহস হয় কী করে আমার কলার চে’পে ধরার?”
-“তোর সাহস হয় কী করে, আমার সামনে আমার কাজিনকে অপমান করার! তোর ভাগ্য অনেক ভালো যে, যে মুখে এসব কথা বলেছিস ওই নোংরা মুখটা আমি এখনো থেত’লে দেইনি!”
-“ছাড়ুন আমার শার্ট! যেমন ক্লাস তেমন তার আচরণ!”
-“তোদের মতো হাই সোসাইটি বুঝি একটা মেয়েকে অপমান করার শিক্ষা দেয়! বাবা-মা সঠিক শিক্ষা দিয়ে বড়ো করেনি দেখেই মেয়েদের মন বুঝার মতো মানসিকতা জন্ম হয়নি। মনে রাখিস, তোর মতো কুৎসিত মনের মানুষকে ফের যদি সারার পিছনে ঘুরঘুর করতে দেখি, তোর দুটো চোখ আমি উপ’ড়ে ফেলবো!”
সানভির বন্ধুরা সেদিন টেনেটুনে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। অনিক সেসব কথা ইচ্ছে করেই মাইসারাকে জানায়নি। জানলেই মেয়েটা পুরোপুরি ভে’ঙে পড়তো। সানভি চলে যাওয়ার বহুদিন পর যখন তার বিয়ের খবর সে মেইল করে পাঠায় সেদিন থেকে মাইসারা একটু একটু করে ভা’ঙ’তে থাকে। সেই ভে’ঙে যাওয়া মানুষটাকে আবারও সোজা হয়ে দাঁড় করাতে কতখানি কষ্ট করেছিল অনিক, সেটা মাইসারার অজানা নয়। প্রতি পদে পদে অনিক ভরসা হয়ে এগিয়ে এসেছিল। বুঝিয়েছিল,
-“কেউ কিছু হারিয়ে ফেললে গোড়া থেকে ভে’ঙে পড়ে না, বরং সেখান থেকে নিজেকে একটু একটু করে আবারও সোজা করে দাঁড় করায়। মানুষ সবসময় তার নিজের জন্যই বাঁচে। ভালোবাসা একবার হারিয়ে যাওয়া মানে এই নয় যে, আর তা ফিরে আসবে না। বরং তার দ্বিগুণ সুখ নিয়ে জীবনটাকে আবারও সুখে ভরিয়ে দিবে। দুর্বল হোস না সারা, এখনও অনেকটা পথ অতিক্রম করা বাকি!”
মাইসারা সেদিন বুঝেনি অনিকের এতসব কথার মর্ম। এখন বুঝতে পারছে, নিজের প্রিয়জনকে কতখানি অপমানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও শক্ত মনে আবারও সাহস সঞ্চার করে সামনের পথকে সহজ করে দিয়েছিল সে। বুঝিয়েছিল, যত ঝড় আসুক সে থাকবে, সবসময়। ভরসা আর বিশ্বাস হয়ে। আগলে রাখবে সারাজীবনের জন্য।
*****
-“সারা যা হয়েছে ভুলে যাও। চলো না দু’জনে একসাথে বাঁচি!”
সানভির এই কথা আচমকাই প্রচণ্ড হাসি পেল মাইসারার। খিলখিল করে কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর বলল,
-“তুমি কী ভাবছো, আমি এখনো তোমার অপেক্ষায় বসে রয়েছি?”
-“আমি জানি, তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো। তোমাকে শা’স্তি দিতে গিয়ে আমি নিজেও অনেক শা’স্তি পেয়েছি। যাকে বিয়ে করে সুখী হতে চেয়েছিলাম, সেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তা-ও অন্য একজনের হাত ধরে। এখন তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও, তবে আমি যে নিঃস্ব হয়ে যাব।”
-“ঠিক তাই। তুমি চলে যাওয়ার পর আমারও নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়েছিল। ভে’ঙে পড়েছিলাম আমি। অবিশ্বাসের অতল গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিল আমার এক চিলতে বিশ্বাস। সেই ভে’ঙে যাওয়া আমিটাকে আবারও যত্ন করে গড়ে নিয়েছে একজন। যার কারণে আজকের এই মাইসারা হাসানের জন্ম হয়েছে। হয়তো সেদিনই আমার দৌড় থেমে যেত, যদি না সেই মানুষটা আমাকে সাহস আর মনোবল দিত।”
-“কে সে? যার কারণে আজকের এই তুমি?”
-“জীবনসঙ্গী!”
-“তুমি বিয়ে করেছো? তুমি তো বলেছিলে, আমার জন্য অপেক্ষা করবে। তবে?”
-“ভুল ছিল তোমার মতো কা’পুরুষকে ভালোবাসা। ভুল পথে নিজের সচ্ছ অনুভূতিটুকু বিলিয়ে দিয়েছিলাম আমি। তুমি ভাবলে কী করে, আমি সেই মানুষটাকে ছেড়ে আবারও তোমার হাত ধরবো? ভালোবাসা তোমার কাছে সস্তা পণ্য মনে হয়? যখন ইচ্ছে হলো ছুঁড়ে ফেললাম, আবার যখন ইচ্ছে হলো কুড়িয়ে নিলাম। ভালোবাসা তো পবিত্র একটা অনুভূতি। এই চিরন্তন সত্য অনুভূতিটুকু কেবল যোগ্য মানুষটার জন্যই হওয়া উচিত। তোমার মতো চি’প মেন্টালিটির মানুষের জন্য ভালোবাসার জন্ম হয়নি! যাও আমার সামনে থেকে, আর কখনো তোমার ওই মুখ নিয়ে আমার সামনে আসবে না। যদি দেখি আমার পায়ের জু’তো খুলে তোমার গা’লে বসিয়ে দিব স্টুপিড!”
-“প্লিজ সারা আমাকে শেষবারের মতো সুযোগ দাও। আমেরিকা থেকে ফিরেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু সেদিন তোমার কাজিন আমাকে পথ থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, তুমি নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছো।”
-“ভালোই করেছিল। তোমার মতো রাস্তার কুকু’রের সাথে এরকমটাই করা উচিত। তুমি এসবেরই যোগ্য!”
অনেকক্ষণ ধরে বেশ সাবধানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে মাইসারা। আর পারলো না। যখন দেখলো সানভি অকারণ ঝামেলা তৈরী করার চেষ্টা করছে তখনই ক্যানটিন ছেড়ে বেরোতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো। অনিককে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে ভীষণ চমকালো। দেড় থেকে দু’ঘণ্টার পথ, এত দ্রুত কীভাবে আসলো সে! ভয়ে ঢুক গিললো মাইসারা। সামনে বর্তমান আর পিছনে অতীত। কীভাবে সামলানো উচিত বুঝতে পারলো না কিছুই। কোনোমতে কেঁপে কেঁপে উচ্চারণ করলো,
-“তুমি? সেই কখন তোমাকে আসতে বললাম! এতক্ষণ লাগলো?”
-“চলে আয় এখান থেকে!”
যেভাবে হুট করে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই ঝড়ের বেগে বাইরে বেরিয়ে গেল অনিক। মাইসারা থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইলো। কোথাও অনিক তাকে ভুল বুঝলো না তো! কিছু ভাববারও সুযোগ পেল না আর। হাতের ট্রলিটা নিয়ে ঝটপট অনিকের পিছু ছুটলো।
*****
মূল গেইটের সামনে এসে দ্বিতীয়বারের মতো চমকালো মাইসারা। একটা প্রাইভেট কারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিক। তার উদাসী চেহারায় যেন অনেকখানি বেদনা লুকিয়ে রয়েছে। বহুদিনের তৃষ্ণা মেটাতে প্রিয়জনের হাসিমাখা মুখ দেখতে চেয়েছিল সে, অথচ অনিকের এই বিষণ্ণতায় ভরা থমথমে ভাবটা তাকে ক্ষণিকের জন্য মারাত্ম’ক ভয় পাইয়ে দিল। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,
-“সানভি এখানে আসবে আমি বুঝতে পারিনি!”
-“এই টপিক নিয়ে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই আর। গাড়িতে উঠ। সবাই অপেক্ষা করছে।”
কেমন নিষ্প্রাণ শুনালো তার কণ্ঠস্বর। মাইসারার মনে হলো, এক্ষুণি মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে ভুল ভা’ঙিয়ে দিক। সবসময় চোখের দেখা সত্য হবে এমন তো কোনো কথা নেই। এখানে নেগেটিভ না ভেবে পজেটিভটা কেন ভাবছে না সে? কেন ভুলকে সঙ্গী করে রাগকে অকারণ দূরত্বের কারণ হিসেবে বেছে নিয়েছে? আজকের দিনে এমন বিচ্ছি’রি কাণ্ড কেন ঘটলো? কেন অসময়ে সানভি এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিল? ভাবতে ভাবতেই গাড়ির দরজার সামনে গেল সে। অনিক দরজা খুলে পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ চেহারা বলছে, সে ভালো নেই। আড়চোখে চারপাশে চোখ বুলালো মাইসারা। যত মানুষের আনাগোনা ছিল, প্রায় সবাই-ই চলে গেছে। হাতে গোনা কয়েকজন রেস্তোরাঁয় বসে খোশমেজাজে গল্প করছে, কেউবা চা-নাশতা পান করছে। লোকজনের নজর এদিকে আছে বলে মনে হলো না তার। আলগোছে অনিকের ডানহাতটা শক্ত করে ধরলো। আলতো স্পর্শে হাতের উপরিভাগে অধর ছোঁয়ালো। খানিকটা কাছাকাছি এগিয়ে চেহারাটা নিজের দিকে ঘুরালো। বলল,
চমকে তাকালো অনিক। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ততক্ষণে অর্ধাঙ্গিনী তার কেঁদে ফেলেছে। হাত ছাড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিল। বলল,
-“ওই চ্যাপ্টারটা ক্লোজ। দ্বিতীয়বার আর কোনো কথা হবে না। আমি তো ভেবেছি, তুই আমাকে ভুল বুঝতে পারিস। কারণ আমার সাথে সানভির দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে রাগারাগি হয়েছে এতসব কথা আমি তোকে লুকিয়ে গেছি। এখন সে এসে তোকে সব বলে দিয়েছে। মনে হলো, হয়তো তুই এখন বলবি, আমি কেন লুকোলাম!”
-“আমি সেদিনই বলেছিলাম, তোমাকে বিশ্বাস করি। আমি এটাও বুঝতে পেরেছিলাম, সানভির সাথে দেখা হওয়া এসব কথা লুকোনোর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল! যার কারণে তুমি চাওনি, সে দ্বিতীয়বার আমাকে আর অপমান করুক।”
-“তার মানে তুই সব জানতি?”
-“হ্যাঁ! নামিরা আপু বলেছে।”
-“তবে এতদিন জানতে চাসনি কেন?”
-“ওসব পাগ’ল, ছা’গলের কথা কেন জানতে চাইবো? ভালোই করেছো, তাড়িয়ে দিয়েছো। আমার তো ইচ্ছে করছিল, পায়ের জুতো খুলে ঠা’স করে ওর গা’লে বসিয়ে দেই।”
অনেকক্ষণ পর ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো অনিক। অকারণ দুঃশ্চিন্তা ঘাড় থেকে নামলো। যত্ন করে হাত ধরে অর্ধাঙ্গিনীকে গাড়িতে তুললো সে। সোজা সামনের সিটে বসালো। খানিকটা ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো নিজে। মাইসারা অবাক হয়ে বলল,
-“এটা কবে কিনলে?”
-“এক সপ্তাহ আগে! ভাবলাম তোকে সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু এখানে এসে তো আমিই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।”
-“কী বুঝলে?”
-“অনেককিছু!”
মাঝেমধ্যে ভালোবাসি কথাটা মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না। প্রিয়জনের আচার-আচরণে বুঝে নেয়া যায়, সঙ্গী/সঙ্গিনী একে-অন্যকে কতখানি সম্মান করে, ভালোবাসে। আজকের পরিস্থিতিটাও তেমন। মাইসারা আর সানভির কথা কাটাকা’টি সম্পূর্ণ শুনেছে সে। এতেই পুরো বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভুল বুঝা কিংবা ভুল ভাবারও প্রয়োজন পড়েনি। বরং সে চেয়েছিল, আরও খানিকক্ষণ মাইসারা ওই পাগ’লটাকে ইচ্ছামতো বকুক। বুঝিয়ে দিক, জীবন কখনো কারও জন্য থেমে থাকে না। তার জীবনও সে থামিয়ে রাখেনি, গুছিয়ে নিয়েছে নিজের মতো করে! ভরসার কাঁধ পেয়েছে, বিশ্বাস পেয়েছে, পেয়েছে ভালোবাসাও। ভাবনা থামিয়ে খানিকটা ঝুঁকে প্রিয়তমার কপালে উষ্ণ স্পর্শ ছুঁইয়ে দিল অনিক। দু’চোখ বন্ধ করে সেই স্পর্শটুকু যত্ন করে আগলে নিল মাইসারা। ফিসফিস করে বলল,
-“তোমার তিনটে বউকে তাড়িয়ে দিয়েছো তো? এখন শুধু আমার রাজত্ব চলবে। আমি ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাববে না।”
-“তুই ভোরের আলো নোস যে, বিকেল গড়ানোর সাথে সাথে আঁধারে নিজেকে আড়াল করে নিবি। তুই আমার ছোট্ট হৃদয়ের গভীর এক অনুভূতি। আঁধারে হোক কিংবা আলোতে, যা আমার তা আমি চিরকাল আমার করেই রাখবো। পৃথিবীর রঙ পাল্টাক, বর্ষপঞ্জিকা তার ঋতু পাল্টাক, খরস্রোতা নদী শুকিয়ে আরও খটখটে হয়ে যাক, সময় যতই হাওয়ার বেগে পালিয়ে যাক, আমার অনুভূতিটুকু আমি সবসময় তোর জন্যই গচ্ছিত রাখবো। যদি তুই হাতটা ধরিস, বাকি জীবন আমি হাসতে হাসতে তোর নামে লিখে দিতে পারবো। যে ঘর বেঁধেছি আমি ভালোবাসায়, সে ঘর ভা’ঙবো না কভু অবহেলায়! আমৃ’ত্যু আমার প্রতি তোর বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখিস সারা, তোর কাছে আমার শুধু এতটুকুই চাওয়া!”
মানুষ অভ্যাসের দা’স! যে স্থানে বসতী গড়ে তুলে সে স্থান ছেড়ে চলে আসতে গেলেই মন কাঁদে। হোক তা কোনো প্রিয় জায়গা কিংবা কর্মক্ষেত্র অথবা নিজের বাড়িঘর। একটা সময় বাড়ি ছেড়ে বাহিরে থাকতে মন কেঁদে উঠতো মাইসারার। আজ মন কাঁদছে প্রিয় কর্মক্ষেত্রের জন্য। প্রতিটা কাজের সময়ে যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে, বুঝিয়েছে, শিখিয়েছে, এই পর্যন্ত গড়ে উঠতে সাহস জুগিয়েছে সবাইকে খুব মিস করছে সে। গাড়ির সিটে বসে ফেলে আসা জায়গার স্মৃতিচারণে মগ্ন ছিল মাইসারা। হুঁশ ফিরলো গাড়ি থামার পর। দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো অনিক। পিছন থেকে ট্রলিটা বের করলো। পাশের দরজা খুলে হাত বাড়ালো অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। মুচকি হেসে যত্ন করে সেই হাতে ভরসা খুঁজলো প্রিয়জন। দু’পা হেঁটে সামনে এগোতেই অনিক তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
-“এটা তোর প্রেমকুঞ্জ। তোর স্বপ্ন পূরণের দ্বার! এখান থেকেই আবারও নতুন স্বপ্নের শুরু করবি। সাজাবি নিজের সংসার। দু’হাতে আগলে নিবি স্বপ্নকে, আপন, পর সবাইকে। উপলব্ধি করবি, প্রিয়জনের সংস্পর্শ আর ভালোবাসাকে। দিনশেষে একমুঠো সুখ এনে ভরে দেব তোর আঁচল! জীবনের আরও একটা অধ্যায়কে আঁকড়ে ধরতে পারবি না, সারা?”
মুখে কোনো জবাব আসলো না তার। শুধু চোখের পলক ফেলে আশ্বস্ত ভঙ্গিতে নীরবে মাথা নাড়লো। ভেতরে পা রাখতেই নাহিয়ান ছুটে আসলো কাছে। দু’হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে তুলে নিল মাইসারা। আদুরে মাখা তুলতুলে গালে অজস্র চুমুর স্পর্শ দিল। বুকের সাথে আগলে নিয়ে বলল,
-“ভালো আছো তুমি?”
-“খুব ভালো আছি। তুমি এত দেরী করে আসলে! সেই সকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”
মাইসারা কিছু বলার আগেই অনিক ফোড়ন কে’টে বলল,
-“অনেক দূরের পথতো বাবা! তাই তোমার ফুপ্পির ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল।”
ভাবুক চেহারা নিয়ে তাকিয়ে রইলো নাহিয়ান। হয়তো এই দূরত্বের সংজ্ঞা, কিংবা সীমা পরিসীমা তার জানারও বাইরে। তাই ছোটো মাথায় ওতো চাপ আর নিল না। ঘাড় নাড়িয়ে শুধু দূরে ছিল, এইটুকু বুঝেছে বলে মাথা নাড়লো। মাইসারা হেসে ফেললো। ড্রয়িংরুমে এসে নাহিয়ানকে রেখে আরমান সাহেবকে জড়িয়ে ধরলো সে। অনেকদিন পর আবারও ছোটো বাচ্চার মতো কাঁদলো। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ভরসা দিয়ে বললেন,
-“কাঁদিসনে মা। তোকে তোর লক্ষ্যে পৌঁছাতেই এভাবে দূরে সরিয়ে দিয়েছি! আজ আমাদের কত আনন্দের দিন জানিস? সেই ছোটো ছোটো পা ফেলে হাঁটতে শেখা তুই, নিজের একটা পরিচয় গড়ে তুলতে পেরেছিস। এখন আর কেউ বলবে না, ‘বাবা-মা ছেড়ে চলে গেছে বলে, এই মেয়ের জীবন এখন অভি’শপ্ত!’ বরং সবাই গর্ব করে বলবে, ‘এই গ্রামে এক নতুন ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটেছে! যে কিনা নিজের জন্য নয়, পরের জন্য নিজেকে তৈরী করেছে।’ পারবি না মা, এই গ্রামের অসহায় মানুষগুলোর পাশে থাকতে?”
-“পারবো চাচ্চু। তোমরা পাশে থাকলে আমি সব কঠিন পথ সহজেই অতিক্রম করতে পারবো।”
-“যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। জমিয়ে গল্প করবো।”
মাইসারা উঠে দাঁড়ালো। চোখের পানি মুছে রুমে না গিয়ে চুপিচুপি রান্নাঘরে গেল। সেখানে ত্বোয়া আর ফারজানা রান্নাবান্না সামলাচ্ছে। পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি মা’রলো। অমনি ত্বোয়ার নজরে পড়ে গেল। চিৎকার দেয়ার আগেই ত্বোয়ার মুখে হাত রেখে তাকে থামতে নিষেধ করলো। জবাবে ঘাড় নাড়লো সে। মাইসারা আবারও ধীরপায়ে ফারজানার পিছনে দাঁড়ালো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আমরা তো সবই বুঝি। আমাদের এত অবুঝ ভাবিস না। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আয়, একসাথে খাব। আর শোন, আলমারিতে একটা শাড়ি রাখা আছে, ওটা পরিস।”
সুযোগ পেয়ে দৌড়ে পালালো মাইসারা। বাকি দু’জন আবারও উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। লজ্জা হোক কিংবা অনিচ্ছা, কোনো এক কারণে অনিকের নামটা চেয়েও বলতে পারেনি সে। এটা দিব্যি বুঝে নিয়েছে এই দু’জন। থাক না কিছু নাম উহ্য, অপ্রকাশ্য। যারা বুঝার তারা ঠিকই বুঝে নেবে। যেমনটা ত্বোয়া আর ফারজানাও বুঝে নিয়েছে নিমিষেই।
*****
মাঝেমধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু উপহার পেতে বড্ড আনন্দ লাগে। অবিশ্বাস্য মনে হয়, কেমন অদ্ভুত সুখ আর স্বপ্ন মনে হয় সবকিছু। আলমারিতে শাড়ি খুঁজতে গিয়ে নতুন একটা কাতান শাড়ি পেল মাইসারা। রঙটা ভীষণ রকম সুন্দর। খুব একটা ঝকঝকেও না, আবার আঁধারও না। তার নিজের গায়ের সাথে বেশ মানানসই। গোল্ডেন কারুকাজ হলেও মূল শাড়িটা পার্পল কালার। দু’হাতে মেলে তার সৌন্দর্য দেখছিল মাইসারা। অনিক আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছিল। অর্ধাঙ্গিনীর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মৃদু হাসি চোখ এড়ালো না তার। ওভাবে বসে থেকেই বলল,
-“এটা ভাবী এনেছে। পছন্দ হয়েছে?”
-“ভীষণ সুন্দর! চাওয়ার থেকেও বিরাট কিছু পাওয়া। এই প্রাপ্তি যে অনেক দামী। তোমাকে কী করে বুঝাই বলো তো!”
দু’হাতে যত্ন করে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরলো শাড়িখানা। আনন্দে চোখে বৃষ্টি নামতে চাইছে। চোখের পানিকে বহু কষ্টে দমিয়ে রাখলো মাইসারা। আর সে কাঁদবে না। একজীবন কান্না থাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। তার কাঁদার দিন অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। যেদিন থেকে অনিক নামক বটবৃক্ষ থাকে প্রখর রোদে ছায়া দিয়েছে, ঝুম বৃষ্টিতে ছাতা হয়েছে, অশান্ত মনকে শান্ত করতে দু’হাত ভরতি ভালোবাসা কুড়িয়ে এনেছে, দু’চোখে তৃপ্তির ঘুম জড়াতে প্রশস্ত বক্ষ মেলে দিয়েছে সেদিনের পর থেকে দুঃখের কান্না তার জীবন থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে।
শাড়ি, ব্লাইজ, পেটিকোট, প্রয়োজনীয় সেফটিপিন সবকিছু বিছানার উপর রাখলো মাইসারা। অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কী ভাবছো এত?”
-“তুই আমার কাছে সুখী তো সারা? আমি কি পেরেছি তোর সব দুঃখ দূর করে দিতে? তোর কি মনে হয় না, তুই আরও ভালো কিছু ডিজার্ভ করিস?”
অভিমানী চোখে তাকালো মাইসারা। কখনও সে এমনটা ভাবেওনি। বরং সে নিজে অনিকের যোগ্য কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় তার মনে। ভুল পথে পা ফেলেছিল যে! তার সেই ভুলই তাকে সঠিক মানুষের সংস্পর্শে আসতে অনেক দেরী করিয়ে দিল। দূরে না থেকে কাছে এসে বসলো সে। দু’হাতে গাল ছুঁয়ে অধর ছুঁইয়ে দিল কপালে। নিঃশব্দে বুকে মাথা রাখলো। বলল,
-“ভুল করেও নিজেকে ছোটো ভাববে না। যতক্ষণ তুমি আমার পাশে আছো, ততক্ষণ আমার আর কোনোকিছু চাই না। হয়তো তোমার মনে হচ্ছে, আমি আরও ভালো কিছু ডিজার্ভ করি, কিন্তু যে দামী সম্পদটা আমি পেয়েছি তার কাছে অন্য সবকিছু তুচ্ছ। স্রষ্টার কাছে এইটুকু চাওয়া, তিনি যেন সারাজীবন আমাকে তোমার পাশেই রাখেন। এভাবেই রাখেন। তুমি পাশে থাকলে, কুঁড়ে ঘরও আমার জন্য স্বর্গ হয়ে যাবে। তাই অনুরোধ করবো, এমন কথা আর কখনো বলবে না।”
দামী সম্পদ বলতে এখানে মাইসারা যে তাকে বুঝিয়েছে, উদাহরণ হিসেবে জীবনসঙ্গীকে টে’নে এসেছে, সেটা বুঝতে দেরী হলো না অনিকের। কিছু বলার আগেই দরজায় নক পড়লো। ওপাশ থেকে ত্বোয়া গলা উঁচিয়ে বলল,
-“ছোটো ভাইয়া, তুমি একটু বাইরে যাও। আমি ভাবীকে শাড়ি পরাবো।”
অসময়ে শাড়ি পরতে হবে, এই ব্যাপারটা মানতে পারলো না অনিক। কতদিন পর দু’জনে কাছাকাছি আসার সুযোগ পেল, এখনই যত বাঁধা সব আসতে হলো। অগত্যা বিছানা ছাড়তে হলো তাকে। যাওয়ার আগে মাইসারার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
-“এই শাড়ি পরলে তোকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগবে। যে রূপ স্বচক্ষে দেখলে নয়ন জুড়ে শুধু মাদ’কতা বিরাজ করবে! তুই কি আবারও আমাকে তোর রূপের মায়ায় চু’বি’য়ে মা’রতে চাস?”
মাইসারা জবাব খুঁজে পেল না। লজ্জায় হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিইয়ে গেল। নতজানু হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লজ্জায় লাল হওয়া তুলতুলে চিবুকে অধরের উষ্ণ স্পর্শ ছুঁইয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে পালালো অনিক। তারপরই ভেতরে আসলো ত্বোয়া।
*****
শাড়ি পরানোর সময়ই মাইসারার ফোনটা কেঁপে উঠলো। ফোন আসলো না, কিন্তু ওপাশ থেকে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ আসলো। আড়চোখে ম্যাসেজের দিকে চোখ বুলালো মাইসারা। ত্বোয়ার সে সময় নজর পড়লো সেখানে। ম্যাসেজ দেখে মিটিমিটি হাসলো সে। তাকে লজ্জায় ফেলতে ইচ্ছে করেই ম্যাসেজটা সাউন্ড নিয়ে উচ্চারণ করলো ত্বোয়া। বলল,
-“শাড়ি পরছিস ভালো কথা, দোহাই; তোর মুখে কোনো রঙচঙ মাখবি না৷ ঠোঁটে লিপস্টিকও দিবি না। শান্তিতে চু’মু খাওয়া যায় না। শুধু চোখে কাজল দিবি, ব্যস।”
ত্বোয়ার বলার ঢং দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো মাইসারা। আলতো করে চ’ড় মা’র’লো গালে। বলল,
-“করছিসটা কী? আস্তে পড়। কেউ শুনে ফেলবে!”
-“কী হবে মুখে মেকাপ দিলে, ঠোঁটে লিপস্টিক দিলে? চু’মু খাওয়া ওতো জরুরী কেন? একদিন চু’মু না খেলে কী ক্ষ’তি হয়? বলো না আমায়!”
বুঝেও না বুঝার ভান ধরে মুখ বাঁ’কি’য়ে জানতে চাইলো ত্বোয়া। উদ্দেশ্য মাইসারাকে জ্বা’লা’নো। আজকাল সে তাকে তুমি বলে সম্বোধন করে। আবার ভাবী বলেও ডাকে। এই মুহূর্তটা তাকে আনন্দ দেয়। সুখ দেয়। বুঝিয়ে দেয়, সম্পর্ক উন্নতির দিকে এগিয়ে গেছে। মাইসারার দিক থেকে কোনো জবাব পেল না সে। আবারও বলল,
-“ভাইয়া এখনো তোমার সাথে তুইতোকারি করে? বারণ করতে পারো না?”
-“তোর ভাই আমাকে যেভাবে ডাকে, যে নামে ডাকে সে শব্দেই আমি ভালোবাসা খুঁজে পাই। হোক তা, তুই, তুমি কিংবা আপনি! তার কণ্ঠে সে এই শব্দে যতখানি ভালোবাসা মিশিয়ে রাখে তা অন্য কোনো শব্দে হয়তো আসবে না। আমি চাই, চিরকাল ও এমন থাকুক। এভাবেই ডাকুক, ভালোবাসুক। শুধু সেটা উপলব্ধি করবো আমি।”
থামতে বাধ্য হলো ত্বোয়া। এদের ব’কে বুঝিয়েও লাভ নেই। তারা নিজেরা, নিজেদের যেভাবে বুঝতে আগ্রহী, জানতে আগ্রহী, ভালোবাসতে আগ্রহী, তাদের সম্পর্ক এমনই থাকুক। এভাবেই ভালোবাসার গভীরতা বাড়ুক, তবু দু’জনার মাঝে দূরত্ব না আসুক আর। দিনকেদিন দু’জনে যেভাবে একে-অপরের ভরসা হয়ে উঠেছে, সেভাবে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিক।
খাওয়ার টেবিলে আজ সবাই একসাথেই রাতের খাবার খেতে বসলেন। পুরো টেবিল খাবার দিয়ে সাজিয়ে রাখা। যে চেয়ারে রোজ আরমান সাহেব বসে খাবার খান, মাইসারা নিজ হাতে ধরে এনে তাঁকে সেখানে বসিয়ে দিল। পাশাপাশি ডানে-বামে বসলো অনিক আর আলিফ। এরপর যার যার সঙ্গীর পাশে মাইসারা, ফারজানা। ত্বোয়া আর নাহিয়ান অপজিটের চেয়ারে। অনেকদিন পর ভদ্রলোক টের পেলেন তার সংসারটা সুখে পরিপূর্ণ। তৃপ্তির সাথে খাবার খেলেন। দুই বউকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“যখন আমি থাকবো না, তখনো সবাই এভাবেই সংসারকে আগলে রাখবে। আজ যেভাবে সবাই একসাথে আছো, আগামীকাল এমনকি, জীবনের বাকি দিনও এভাবেই কাটাবে। সময় হয়তো বদলাবে, দায়িত্ব বাড়বে, সংসারে চাপ বাড়বে, হয়তো অভাব-অনটন আসবে কিন্তু তবুও কেউ কাউকে দোষারোপ করে সংসারটাকে ভে’ঙে ফেলার মতো ভুল কাজ করবে না। তোমাদের মধ্য থেকে যদি কেউ অন্যায় করে ফেলো, তবে অপরজন তাকে বুঝাবে, পাশে থাকবে, ভরসা দিবে, সাহস জোগাবে, তবু দোষ ধরিয়ে বলবে না আলাদা হও। এই সমাজে যৌথ পরিবারগুলো দিনদিন কেন ভা’ঙ’ছে জানো? একে-অপরকে দোষারোপ করা, অপমান করা, ছোটো করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্য। সবাই নিজের দোষ ঢেকে অন্যের দোষ খুঁচিয়ে বের করতেই ওস্তাদ, কেউ কারও পাশে থাকতে নারাজ, ভালোবাসতে নারাজ। আমি তোমাদের ভরসা করি, বিশ্বাস করি, আমি জানি আমার ছেলেমেয়েরা কখনো এই সংসারে ভা’ঙ’ন ডেকে আনবে না। তোমরা সবাই একে-অপরকে ঘিরে বাঁঁচবে। মনে থাকবে?”
পক্ষান্তরে মাথা নাড়লো সকলে। অনিকও বাবাকে ভরসা দিয়ে বলল,
-“তুমি চিন্তা করো না বাবা, আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে সংসারটাকে রক্ষা করার। তবে তোমার বউ’মাদের বলে দাও, তারা যদি কখনো অন্যায় করে তবে তার জন্য তাদেরকে শা’স্তি পেতে হবে। তাদেরকে বলে দাও, গুরুজনদের কথা যেন তারা অমান্য না করে।”
-“শা’স্তি দিবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কখনো তাদেরকে শারিরীক অত্যাচা’র করবে না। মেয়ে মানুষের গায়ে আঘাত দিয়ে শাসন করা ইসলামে নেই। আমি জানি, আমার দুই বউমা-ই বুদ্ধিমতি। তারা কেউ-ই এমন কোনো কাজ করবে না, যার কারণে তাদের শা’স্তি পেতে হয়! তাই যা করবে বুঝে-শুনে করবে। না বুঝে ধড়াম করে হাত তুলবে না।”
আরমান সাহেবের কথা শুনে মুচকি হাসলো মাইসারা। সে বুঝতে পেরেছে অনিক ইচ্ছে করেই খুঁচিয়ে এই কথা বলেছে। বার বার তার দিকে তাকাচ্ছে আর রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। মাইসারার এমন হাসি দেখে অনিক আবারও ঠোঁট চেপে মৃদুস্বরে বলল,
-“বারণ করেছিলাম না? আজ তোর ঠোঁটটা যদি সে’লাই না করেছি তবে আমার শান্তি নেই দেখিস…!”
-“বেশ করেছি। খুব সাহস হয়েছে না? তোমার লজ্জা করে না, ছোটো বোনের সামনে উল্টাপাল্টা ম্যাসেজ পাঠাও?”
অনিক চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। জবাবে ভ্রু নাচিয়ে ভেংচি কাটলো মাইসারা। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে এঁটো থালাবাসন নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। রান্নাঘরের সমস্ত কাজ শেষে ত্বোয়া নিজের ফোন নিয়ে পারিবারিক কয়েকটা ছবি তুললো। মাইসারা আর ফারজানার পরনের শাড়ি একই রঙ, একই ডিজাইনের ছিল। দু’জনকে একসাথে বেশ মানিয়েছেও। মনে হচ্ছিলো অনেকদিন পর দুই বোন একসাথে। একে-অপরকে যেভাবে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলছে, তাতে মনেই হবে না কখনো দু’জনার মাঝে ঝগ’ড়াঝাটি হয়েছিল। পুরনো অধ্যায় তারা ভুলে গেছে, এখন শুধু নতুন অধ্যায় গড়ে তোলার স্বপ্ন দু’জনের মনে। চিরকাল এই বন্ধন যেন এমনই থাকে, ঠিক এই প্রার্থনাই এখন সকলের অন্তরে।
*****
দিনের আলো যেমন ঝকঝকে আয়নার মতো স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন, রাতের অন্ধকারটাও তেমন ঝাপসা! তবুও দিনের সৌন্দর্য আর রাতের সৌন্দর্য বরাবরই আলাদা। একফালি চাঁদের আলো আর ঝিকিমিকি হাজারও তারকারাজি যেভাবে দূর আকাশের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলে, সেভাবে দিনও সূর্যের আলোতে নিজেকে উজ্জ্বল সাজে সাজায়। দুটো সময়ই দুইভাবে আকৃষ্ট করে মানুষকে। বুঝিয়ে দেয়, কতই না নিপুণ হাতে তৈরী স্রষ্টার এই দারুণ সৃষ্টি। এমন সৌন্দর্য, এমন চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো রূপ কি কোনো মানুষের দ্বারা তৈরী করা সম্ভব? মহান রবের এই অসাধারণ ক্ষমতাকে উপলব্ধি করার মাঝেও মানব হৃদয়ে তৃপ্তির বাতাস বইয়ে দিতে বাধ্য। কী হতো, যদি তিনি ভূ-খণ্ড সৃষ্টি না করতেন? কী হতো যদি তিনি মানুষ জাতিকে সৃষ্টি না করতেন? কী হতো যদি তিনি মানব হৃদয়ে ভালোবাসা নামক ছোট্ট অনুভূতি না জাগাতেন? মানুষ কি আদৌ তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সবকিছু করতে পারতো? এত এত প্রশ্ন, এত এত কৌতূহল, মানুষের মনে জাগে দেখেই সৃষ্টির এই মর্ম মানুষ উপলব্ধি করতে পারে।
অনেকক্ষণ ধরে অন্ধকার রাতের নীরবতাকে একা একাই উপভোগ করছে অনিক। ভাবছে জীবনের খণ্ডাংশ। উপলদ্ধি করছে, স্রষ্টার সৃষ্টিকে। অন্তরের অন্তস্তল থেকে শুকরিয়া জানাচ্ছে প্রভুর দরবারে। তিনি চেয়েছেন বলেই, এই ধরনী দেখার সুযোগ হয়েছে মানুষের। তিনি চেয়েছেন বলেই, ভালোবাসা এসে ধরা দিয়েছে জীবনে। পরিপূর্ণ হয়েছে জীবন। বেঁচে থাকার জন্য এইটুকুই কি যথেষ্ট নয়? একটা সুন্দর জীবন তো এভাবেই হেসেখেলে কাটিয়ে দেয়া যায়, যদি ওপাশের মানুষটা সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে পাশাপাশি থাকে, হাতে হাত রাখে।
বেশ কিছুক্ষণ পর মাইসারার আগমন ঘটলো ছাদে। দূর থেকেই ভাবুকে চেহারায় নিজের অর্ধাঙ্গকে আবিষ্কার করে সামনে এগিয়ে গেল। সামনে যেতেই অভিমানে চোখ সরিয়ে নিল অনিক। পকেট থেকে ফোন বের করে ত্বোয়ার নাম্বারে ডায়াল করলো। মাইসারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কাণ্ডকারখানা দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো।
-“ছাদের সবক’টা বাতি নিভিয়ে দে।”
অনিকের এমন কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মাইসারা। ভ্রু নাচালো। জবাব না দিয়ে ফোন পকেটে রেখে রেলিঙের উপর হাত রেখে দূরে দৃষ্টি দিল। ঠিক তার পাঁচ মিনিটের মাথায় ছাদের সবগুলো বাতি নিভে গেল। এমনকি বাড়ির সামনের, পিছনের বাতিও নিভলো। মুহূর্তেই চারপাশটা কেমন গা ছমছমে রহস্যময় এক দৃশ্যে রূপান্তরিত হলো। ভয়ে খানিকটা কেঁপে উঠলো মাইসারা। দু’পা এগিয়ে ফটাফট পিছন থেকে অনিককে জড়িয়ে ধরলো। পিঠে মাথা রেখে বলল,
-“মাঝেমধ্যে কী ইচ্ছে হয় জানো, এভাবে মিশে থাকি তোমার সাথে। উপলব্ধি করি, তোমার রাগ, অভিমান আর ভালোবাসাকে। এইযে, রাগ দেখিয়ে চেহারা দেখবে না বলে বাতি নিভিয়ে দিতে বললে, এতেও কিন্তু তোমার রাগের বদলে ভালোবাসাটাই বেশি প্রকাশ পাচ্ছে!”
গম্ভীর চেহারা নিয়ে নীবরতা দিয়ে পুরোটাই নিজেকে আগলে নিল অনিক। আসলেই সে রেগে গেছে। মাইসারার তখনকার কাণ্ড যে ইচ্ছাকৃত সেটা বুঝেই রাগ এসে ভর করেছে চেহারায়। কিন্তু এখানেও মেয়েটা ভালোবাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে। অনিকের নীরবতা দেখে মাইসারা আবারও বলল,
-“তুমি চাও না, তোমার আর আমার এই রাত্রিযাপন কারও চোখে পড়ুক। আশেপাশে অনেক বাড়ি আছে, হুটহাট কারও নজর পড়বে আমাদের এই ছাদে। তখন সবাই হয়তো খারাপ কিছু ভাববে।”
মৃদু এক হাসির রেখে খেলে গেল অনিকের পুরো চেহারা জুড়ে। এমনটা ভেবেই বাতি নেভাতে বলেছিল সে। ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
-“তুই অনেক বেয়াদব সারা!”
-“আদব-কায়দা শিখিয়ে নাও। মানুষটা তো তোমারই। নিজের মতো করে গড়ে নিচ্ছো না কেন?”
-“দাও। তোমার আদুরে শা’স্তি গ্রহণ করতে আমি সবসময়ই প্রস্তুত।”
সম্পর্কে শত অভিমান আসুক, এমন টুকরো টুকরো সুখকর কথাতেই অভিমান গায়েব হয়ে যায়। তখন মনে হয়, শা’স্তিটা কেবল ভালোবেসেই হোক। পিছু ঘুরে মুখোমুখি হলো অনিক। মাইসারার মাথা ঠেকলো তার বুকের ঠিক বা’পাশে। ডানহাতের আলতো স্পর্শে খানিকটা উঁচু করে মায়াবী মুখের চাহনি দেখলো সে। জ্যোৎস্নার ঝলমলে আলো না থাকলেও রাত্রি তখনো গাঢ় অন্ধকার নয়। চোখাচোখিটা নিঃশব্দেই হলো। ওভাবে তাকিয়ে থেকেই কপালে অধর ছুঁইয়ে দিল সে। বলল,
-“সব ভুলের শা’স্তি এমনই হবে। সারাজীবন কাছে থাকবি, ভালোবাসবি। সম্পর্কে যতই রাগ আসুক, ঝগড়া আসুক, মান-অভিমান আর দূরত্ব আসুক, সবকিছুকে দূরে ঠে’লে ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়ে দিবি, এই সম্পর্ক টুকরো অভিমানকে সঙ্গী করে ভা’ঙ’নকে কখনোই ছুঁয়ে দেখতে চায় না। যা-ই হয়ে যাক, দিনশেষে আমরা আমাদের মাঝেই সুখকে খুঁজে নিব। ভালোবাসবো। রাজি…?”
-“যখন থেকে জেনেছি, অপ্রকাশ্য এক সুপ্ত অনুভূতিকে সঙ্গী করে দিন অতিবাহিত করছো, তখন থেকেই মনে-প্রাণে চেয়েছি, এই সম্পর্ক জোড়া লাগুক। বুঝিনি, তাইতো অসময়ে অবুঝের মতো কাজ করেছি, ভুলকে সঙ্গী করে দিন কাটিয়েছি, সবকিছু ভুলে নতুন জীবনকে আঁকড়ে ধরেছি, শুধু তোমায় ভরসা করে! আমি কখনোই চাইবো না, অভিমানের কাছে আমাদের স্বচ্ছ অনুভূতিটুকু হার মেনে যাক। আমি বিশ্বাস করি তোমায়, ভরসা করি, ভালোবাসি! সারাজীবন তোমায় ভালোবেসেই বাঁচতে চাই।”
জীবনে মানুষ একটু সুখকেই তো ছুঁয়ে দেখতে চায়। সেই সুখ দু’হাতের মুঠোয় ধরা দিতে কখনো কখনো অনেক সময় নেয়, আবার কখনো কখনো না চাইতেও আপনা হতেই চলে আসে জীবনে। মাইসারার মনে হলো, তার জীবনের খাঁচায়ও সুখপাখি ধরা দিয়েছে। সেই সুখকে আঁকড়েই বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে।
অর্ধাঙ্গিনীর এমন আবেগপ্রবণ জবাব শুনে নিরুত্তর অনিক কোনো কথা খুঁজে পেল না। সুখের অদ্ভুত মা’দ’ক’তা ছুঁয়ে দিল তার মন-প্রাণকে। শীতল স্পর্শে হৃদয়টা ভরিয়ে দিল। প্রশান্তি অনুভব করলো। সময় কে’টে গেল। মিনিট পেরুলো, রাত্রি ক্রমশ আঁধারে তলিয়ে যেতে শুরু করলো, তবু দু’জনার অনুভূতির লেনদেন থামলো না। ভালোবাসার এই সময়টা আরও ভালোবাসাময় হয়ে উঠলো! চোখে চোখে মনের অব্যক্ত কতশত কথা ডালপালা মেললো। তবু কেউ দূরত্বকে, কিংবা কথাদেরকে কাছে ঘেঁষতে দিল না। নিঃশব্দের এই সময়টা আরও নিস্তব্ধতা দিয়ে সীমাহীন অনুভূতি নিয়ে মুড়িয়ে নিল একে-অন্যেকে। আদুরে স্পর্শের কাছে রাত্রির গভীরতাও জানলো, ভালোবাসা আছে, থাকবে, অনন্তকাল। অনুভূতির লেনাদেনা এভাবেই চলছে, চলবে। তারা ভালোবেসেছে, ভালোবাসবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। তবু কমতি আসতে দিবে না ভালোবাসা প্রকাশে! এক জীবন তারা শুধু ভালোবেসেই বাঁচবে।
একটা ভে’ঙে যাওয়া পরিবার বাঁচাতে কত রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত তা সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নেই অনিকের। বয়সে ছোটো হলেও, ঘর, সংসার, পরিবারের মূল্য সে বুঝে। আর বুঝে বলেই ভা’ঙ’ন ঠেকাতে বড়ো ভাইকে নানাভাবে বুঝিয়ে চলেছে। কিছু হোক বা না হোক, প্রয়োজনে সে গা’লি শুনুক, ব’কা শুনুক তা-ও পরিবারটা আবারও আগের মতো হোক। হাসি, আনন্দে ভরে উঠুক চারপাশ। নাহিয়ানের দৌড়ঝাঁপ চলুক ঘরের এক কোণা থেকে অন্য কোণা। তবুও অবুঝ বাচ্চাটা জীবনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি না দাঁড়াক। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে ফাঁক পেলেই অনিক তার ভাইকে যথাসাধ্য বুঝানোর চেষ্টা করে। জবাবে আলিফ কতশত অজুহাত, লজিক দাঁড় করায়, তবুও মুখ ফুটে বলে না, ফারজানাকে বাড়ি নিয়ে আসবে। এ কারণে দিনের পর দিন দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে অনিক। কে চাইবে, সুখের সংসার ভা’ঙতে? কে চাইবে অবুঝ বাচ্চার জীবনে দোটানা আনতে? কেউ চাইবে না। একটা সুন্দর হাসি, তার সুন্দর স্মৃতি অকালেই সুদূরে মিলাক, সেসব কারও কাম্য নয়। তাই প্রত্যেকের আপ্রাণ চেষ্টা সংসারটা আবারও প্রাণ ফিরে পাক।
এই মুহূর্তে আরমান সাহেবও ছেলেকে বুঝাতে কোনোপ্রকার কমতি রাখছেন না। সকলের চেষ্টা এখানেই, সংসারটা আগের মতো করা। আলিফ শুধু বাবার কথা শুনছে, কোনো জবাব দিচ্ছে না। তার মাথাটা যথেষ্ট নিচু, নিজে নিজেই হয়তো কোনোকিছুর হিসাব কষছে নয়তো প্রিয়জনের পালটে যাওয়ার হিসাবটা বুঝতে চাইছে। ছেলের এমন নীরবতা দেখে ভদ্রলোক বললেন,
-“মেয়েটা ভুল করে ফেলেছে, তাকে ক্ষমা করে দেয়া উচিত বাবা। আরেকটা সুযোগ দিয়ে দেখি, হয়তো সে তার ভুল বুঝতে পারবে। বাচ্চাটার কথাও ভাবতে হবে তোকে। তুই কি চাস, সারার মতো ঠিকানাবিহীন জীবনযাপন তোর ছেলে করুক?”
প্রশ্ন তুলে চুপ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। আলিফ মাথা তুলে তাকালো। মাইসারার জীবনের প্রতিটা দিন সে দেখেছে। বাবা-মায়ের জন্য কতই না ছটফট করেছে অবুঝ বয়সে। বুঝ হওয়ার পর মানিয়ে নিয়েছে ঠিকই, তবুও বাবা-মায়ের প্রতি তার রাগ, অভিমান, অভিযোগ একটুও কমেনি। আলিফ চায় না, ভবিষ্যতে তার সন্তান তার উপর কোনো অভিযোগ রাখুক। এজন্য সে অনেক ভেবেছে। ভাবনা অনুযায়ী সিদ্ধান্তও নিয়েছে শুধু সবার মতামতের জন্যই নিজের কথাগুলো সে বলতে পারছে না। অনেকক্ষণ পর মুখ খুললো সে। বলল,
-“সন্তান দূরে থাকুক, এটা কোনো বাবা-মা চাইবে না বাবা। আমিও চাই না। তবে আমার একটা কথা, তোমার বউমা যদি আসতে চায় তাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসবো। কিন্তু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত না করা পর্যন্ত আমি তাকে ক্ষমা করবো না। এতে যদি তোমাদের আপত্তি তাকে বলো, আমি এগোবো না।”
-“তুই কি তাকে আরও শা’স্তি দেয়ার কথা ভাবছিস?”
আরমান সাহেব যে ছেলের ভেতরের ভাবনা ধরে ফেলবেন সেটা বুঝলাম পারেনি আলিফ। আবারও নীরব হয়ে গেল সে। শুধু মাথা নেড়ে নিজের সিদ্ধান্ত জানালো। আরমান সাহেব আবারও বললেন,
-“কী শা’স্তি?”
-“সেটা আমাদের দু’জনার ব্যাপার বাবা!”
ভদ্রলোক কথা বাড়ালেন না আর। মান-অভিমান তাদের দু’জনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেখানে তিনি বাবা হয়ে নাক গলাতে পারেন না। তবে শা’স্তিটা কতটা কঠিন আর হজম যোগ্য সেটাই ভাবাচ্ছে তাঁকে। তবুও ছেলের সিদ্ধান্তকে সহমত পোষণ করে বললেন,
-“যা শা’স্তি দিবে দিও, কিন্তু মনে রেখো, সেই শা’স্তিটা যেন নাহিয়ানের চোখের আড়ালে হয়! আমি চাই না, তোমাদের মধ্যে মনমালিন্য আমার নাতির উপর কোনো প্রভাব ফেলুক। তার মনে ভয় সঞ্চার হোক, এমন কোনো কাজ তুমি করবে না।”
আলিফ জবাবে মাথা নাড়লো। শা’স্তিটা কীভাবে দিবে সেটা শুধু সেই জানবে। বাকিরা কেউ টেরও পাবে না। আপাতত মুরব্বি মানুষের কথা শুনে, অবুঝ বাচ্চাটার কথা ভেবে ঘরের বউকে ঘরে ফিরিয়ে আনা যাক। বাকি কাজ তার একার। সেটা সে একাই করবে। ঘরের কোনো মানুষ জানা তো দূর, কাকপক্ষীও টের পাবে না তাদের নীরব রে’ষারে’ষি!
*****
ঘটা করে এক বিকেলে ত্বোয়াকে বাড়িতে রেখে সব পুরুষরাই ফারজানাদের বাড়িতে উপস্থিত হোন। তাদের হঠাৎ আগমনে ফারজানার মা বিচলিত হলেও খুশি ছিল ফারহান। সে বুঝতে পারছিল, সমস্যাটা এবার সমাধানের দিকে এগোবে। তাই সাদরে তাদেরকে গ্রহণ করেছে ঘরে। আপ্যায়নের ত্রুটি রাখছে না। একসঙ্গে বাড়ির এতজনকে দেখে নাহিয়ানের খুশিটা আর দেখে কে! সে এক দৌড়ে আলিফের দু’পায়ের ফাঁকে ঢুকে কোলে বসে পড়েছে। লতানো হাত দু’খানা দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। আহ্লাদী কণ্ঠে, অভিমানী চেহারা বানিয়ে আলিফকে শা’সিয়ে বলল,
-“তুমি খুব পঁচা! এতদিন আসোনি কেন? জানো, এখানে নানু মা’কে কত বকে! দিনরাত বকে! মা’রেও। নিয়ে যাও তোমার কাছে। তাহলে আর বকবে না।”
বাচ্চাদের সামনে বড়োরা যাই করবে, সেটাই তারা মুখস্থ করে বসে থাকবে। ভালো হোক মন্দ এর তফাৎ তারা বুঝতে পারে না দেখেই সবকথা সবাইকে বলে বেড়ায়। অনেক সময় তাদের এই কথাবার্তা সংসারে ঝামেলা টেনে আনে আবার অনেক সময় কঠিন সমস্যার সমাধানে পৌঁছায়। নাহিয়ানের এখনকার কথাও ঠিক সেরকমই প্রভাব ফেললো। আলিফ আড়চোখে ফারহানের দিকে দৃষ্টি দিল। জবাবে সে শুধু মাথা নাড়লো। বুঝালো, নাহিয়ানের কথাই সত্যি!
তখনও ফারজানা সেখানে এসে উপস্থিত হয়নি। তাই তাদের কথাবার্তা সে কিছুই শুনছে না। আরমান সাহেব হাত বাড়িয়ে নাতিকে নিজের কোলে নিয়ে আসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে গালে চুমু খেয়ে বললেন,
-“সব কথা সবাইকে শোনাতে হয় না দাদাভাই। এখন তো তুমি অবুঝ তাই হয়তো বুঝতে পারছো না। যখন বুঝবে, উপলব্ধি করবে, তখন এটাও মাথায় আসবে কখন কোন কথাটা কোথায় বলতে হয়! যাও, মায়ের কাছে যাও। গিয়ে বলো, আমরা এসেছি তোমাদের নিয়ে যেতে। বাড়ি যাবে না?”
-“যাব তো। মা’কে রোজ বলি, তা-ও নিয়ে যায় না। সারাদিন শুধু চুপচাপ বসে থাকে। আমি এক্ষুণি মা’কে বলছি, আজকেই আমরা বাড়ি যাব।”
খুশির খবর মা’কে দেয়ার লো’ভে দৌড়ে পালালো নাহিয়ান। ভদ্রলোক এবার নিজের বিয়াইনের সাথে আলোচনায় নামলেন। বললেন,
-“আমার ঘরের বউ আমি ঘরে ফিরিয়ে নিতে চাই। আপনার কোনো আপত্তি আছে বেয়াইন?”
সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব দিলেন না তিনি। কিছু একটা ভাবনায় ব্যস্ত! মেয়েকে এখানে রেখে অযথা বোঝা তৈরী করার ইচ্ছে তার নেই। এমনিতে এই কয়েক মাসে বেশ খরচ হয়েছে। যদিও সবটা ফারহানই সামলে নিয়েছে। কখনো টাকা-পয়সার কমতি আসলেও মুখ ফুটে বলার ছেলে সে নয়। নিজের বুদ্ধি দিয়েই ঘরের যাবতীয় দিক সে সামলাচ্ছে অতি যত্নে। তবুও প্রতি মাসে বাড়তি কিছু খরচ হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা। বিয়ে দিয়ে বিদায় করার পরেও যখন মেয়ের দায়িত্ব বাবা-মায়ের উপর এসে পড়ে তখন এটা তাদের কাছে বাড়তি খরচ হিসেবেই বিচার হয়। যদিও সব বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো এক নয়। অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে বললেন,
-“মেয়ে যেতে চাইলে আমার কোনো আপত্তি নেই বেয়াই! আপনারা বরং মেয়ের সাথে কথা বলুন!”
এ পর্যায়ে ফারহান নিজেই বোনকে ডেকে আনতে গেল। ফারজানাও ঘাড়ত্যাড়ামি করে বসলো তখন। কারও সামনে যাবে না, কোনো কথা বলবে না, এমনকি সে শ্বশুরবাড়িতে ফেরত যাবে না, একইভাবে এইসব কথা বলে ফারহানকে বিদায় করে দিল! কিছুক্ষণ পর নাহিয়ানকে পুরোটা তৈরী করে তার কাপড়চোপড় গুছিয়ে অনিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথা নিচু রেখেই বলল,
-“তোমাদের আমানত নিয়ে যাও।”
-“সেকী ভাবী! তুমি যাবে না? ঝটপট তৈরী হও প্লিজ। বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। তোমার হাতে খিচুড়ি খুব মিস করছি। আর অপেক্ষা করিও না। অনেকদিন তো হলো, এবার নিজের ঘরে চলো।”
-“না ভাই! ওই জায়গাটা আমার জন্য নয়। আমি এটাই ডিজার্ভ করি! এখানেই ভালো আছি। এভাবেই থাকবো।”
*****
অভিমান হোক কিংবা কষ্ট, ফারজানার এরূপ কথা শুনে ভীষণ চমকালেন সকলে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন শুধু। গুটি গুটি পা ফেলে চলে আসতে চাইলো। পিছন থেকে আরমান সাহেব বললেন,
-“ওটাই তোমার বাড়ি বউমা। বিয়ের পর বাপের বাড়ির চেয়ে শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের সবচেয়ে আপন ঘর হয়! নিজের ঘর ছেড়ে কেউ পরের ঘরে বসে থাকে না। তুমি কি তোমার শাশুড়ি মা’কে দেয়া কথাও রাখবে না?”
ফারজানার পা মাঝপথে থেমে গেল। দু’চোখ বন্ধ করে মনে করলো, শাশুড়ি মায়ের বলে যাওয়া কথাগুলো। অসুস্থ শরীর নিয়ে কত কাকুতিমিনতি করেছিলেন তিনি! বলেছিলেন, নিজের সবটা দিয়ে হলেও যেন ওই সংসার সে আগলে রাখেও। কথা দিয়েছিল ফারজানা। চেষ্টাও করেছিল। আগলে নিয়েছিল সবাইকে। কিন্তু হুট করে মায়ের কু’বুদ্ধি তার সোনার সংসারে আগু’ন জ্বালিয়ে দিল। সবকিছু হারিয়ে আজ সে নিঃস্ব! চোখ ফে’টে কান্না আসছে তার। এই পরিবারের লোকজন এতটাই ভালো যে, তার এত বড়ো অপরাধ জানা সত্ত্বেও খুব কম শা’স্তি দিয়েছে। অথচ সে এরচেয়েও কঠিন শা’স্তি ডিজার্ভ করে। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই জবাব দিল,
-“বাবা আমি আমার দায়িত্ব, কর্তব্য পালনে ব্যর্থ! আমাকে মাফ করে দিবেন। আমি আর ফিরে যেতে চাইছি না।”
আর কোনো কথা না শুনেই ঝটপট নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল ফারজানা। সবার বিস্মিত চেহারাকে অপেক্ষায় ফেলে সেই যে ভেতরে ঢুকলো আর বাইরে এলো না। অনেকক্ষণ পর ধড়াম করে একটা শব্দ হলো। সেই শব্দ শুনে দৌড়ের উপর বোনের রুমের কাছাকাছি আসলো ফারহান। দরজায় ধা’ক্কাতে ধা’ক্কাতে বলল,
-“আপু দরজা খোল! উল্টাপাল্টা কিছু করিস না। আমার কথা শোন। তোকে কোথাও যেতে হবে না। তুই আমার কাছে থাকবি। তা-ও নিজের ক্ষতি করিস না প্লিজ!”
ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না। শুধু গো’ঙা’নির আওয়াজ বেরিয়ে আসলো। ফারহানের গলার পানি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। চিৎকার করে ডাকলো আলিফকে। দু’জনে মিলে প্রায় অবিরত ধা’ক্কা দিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে ফেলতে পারলো। ভেতরে ঢুকে যা দেখলো, তা দেখবার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না কেউ! তখনও ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে ফারজানা। বাঁচার কোনো ইচ্ছাই নেই তার মধ্যে, সেটা তার নীরব বিস’র্জন দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ফ্লোরে পড়ে রয়েছে ছোট্ট টোল। যার সাহায্যে লম্বা কাপড় সে ফ্যানের সাথে পেঁ’চিয়ে মাথাটা তার মধ্যে ঢু’কিয়ে নিয়েছে। তড়িঘড়ি করে বিছানায় উঠলো আলিফ। দ্রুত গলা থেকে লম্বা কাপড়টা খুলে ফেললো! তখনো তার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়নি। গ্লাস থেকে পানি বাড়িয়ে দিল ফারহান। প্রথমে অর্ধাঙ্গিনীর চোখে-মুখে পানি ঝাপটা দিল সে। এরপর অল্প পানি খাইয়ে দু’হাতের মাঝখানে আগলে নিল। অনিক এমন দৃশ্য দেখে ঝটপট নাহিয়ানকে নিয়ে সরে পড়লো। ফারজানার মা দ্রুত ভেতরে ঢুকলেন। মেয়ের চুলের মুঠি টেনে ধরে আলিফের সামনেই দু’গালে পর পর দুটো চ’ড় মে’রে বললেন,
-“আমাকে ফাঁ’সা’তে চাস তুই? ম’র’বি তো ওই বাড়ি গিয়ে ম’র! আমার বাড়িতে তোর কোনো জায়গা নেই।”
আবারও আঘা’ত দেয়ার চেষ্টা করলে আলিফ আগলে নিল তাকে। রাগী চোখে শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল,
-“ও আমার স্ত্রী! যতক্ষণ আপনার মেয়ে আমার দায়িত্বে আছে ততক্ষণ তার উপর হাত তোলার অধিকার আপনার নেই! ফারহান, তোমার মা’কে এখান থেকে নিয়ে যাও। এই মহিলার মাথায় সমস্যা আছে। তাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে বলো, নয়তো আমি বাধ্য হবো পুলিশ আনতে।”
ততক্ষণে ফারহানও যথেষ্ট রেগে গেছে মায়ের এমন আচরণে। দু’হাতে টেনে ভদ্রমহিলাকে কোনোরকমে ঘরের বাইরে বের করে দরজা আটকে দিল।
*****
দু’পায়ের মাঝখানে মাথা রেখে অবিরাম চোখের পানি ফেলছে ফারজানা। চোখ তুলে সামনে তাকাচ্ছেও না। আলিফ নিজেই তাকে হাতের ভরে সোজা করলো। নরম কণ্ঠে বলল,
-“বাড়ি চলো!”
-“আমি কোথাও যাব না।”
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিল ফারজানা। খানিকক্ষণ চোখের পানি মুছে, আবারও ফুঁপিয়ে কাঁদে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও ফারজানার কোনো নড়চড় পেল না। সে ওভাবে কাঁদছেই। দেরী না করে দু’হাতের শূন্যে তুলে নিল তাকে। বলল,
-“তুমি নিজেই নিজেকে কোনো শা’স্তি দিবে না। অন্যায় তুমি আমাদের সাথে করেছো, শা’স্তিটা আমরাই দিব। সবসময় শুধু নিজের জন্যই ভেবেছো। এবার অন্তত বাচ্চাটার কথা ভাবো!”
-“আমায় ম’র’তে দাও প্লিজ। বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”
-“এভাবে আত্মহ’ত্যা করে কেউ অপরাধ কমিয়ে নিতে পারে না। এটা জঘ’ন্য অপরাধ! উভয় জাহানকে বরবাদ করে দিচ্ছিলে তুমি! অন্যায় করলে তা ক্ষমার মাধ্যমে মুক্তিও জড়িয়ে আছে, কিন্তু আত্মহ’ত্যা করলে মুক্তি নেই পাগ’ল!”
ফারজানা আর কথা খুঁজে পেল না। ওভাবেই মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। আলিফ সোজা তাকে গাড়িতে তুললো! অনিকের কোল থেকে নাহিয়ানকে এনে মায়ের পাশে বসালো। ফারহানের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলেন সকলে।
ফারজানা এমন একটা কাণ্ড করে বসবে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কেউ। ভাবেওনি, অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে, লজ্জাকে সঙ্গী করে শ্বশুরবাড়ি সে আর ফিরতে চায়নি। তাই নিজের শা’স্তির জন্য নিজেই এই পথ বেছে নিয়েছিল। এতসব কথা যখন মাইসারা শুনলো তখন সে রীতিমতো আঁতকে উঠলো। নিজে থেকেই কথা বলতে চাইলো ফারজানার সাথে। আজ আর কোনো অভিমান, অভিযোগ কিংবা রাগ, ঘৃ’ণাকে প্রশ্রয় দিল না ফারজানা। মোবাইল হাতে নিয়ে কানে রেখে চুপ করে রইলো। ওপাশ থেকে মাইসারা বলল,
-“মানুষ এত বোকা হয়, তোমাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। তোমার ঘর, তোমার সংসার, অথচ তুমি তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো। মানছি, অন্যায় হয়ে গেছে! তাই বলে কেউ এত অভিমান পুষে রাখে? আর এমনটা করো না কখনো। তোমার আমার উপর রাগ তাই তো? আমি বাড়ি না গেলেই তো হলো। তোমার সংসারে আমি কখনো বাড়তি ঝামেলা হবো না ভাবী। তা-ও প্লিজ, নিজের কোনো ক্ষ’তি করে নাহিয়ানের জীবনটাকে অ’ভিশ’প্ত করো না। বাচ্চাটা নিতে পারবে না এত চা’প! শুনছো তো আমার কথা?”
-“তোর উপর আমার কোনো রাগ নেই সারা!”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে জবাব দিল ফারজানা। মাইসারা কেবল হাসলো। সে জানে, ফারজানার রাগটা কোথায়! একদিকে হোস্টেল ছেড়ে দেয়ার সময় হয়ে এসেছে, অন্যদিকে বাড়িতে আসা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা! পরবর্তীতে এমন হবে না তার কি গ্যারান্টি? দু’দুবার তাকে মা’র’তে চেয়েছে, এই কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়, তবুও মানতে হচ্ছে তাকে। সত্যিই কি ফারজানা অনুতপ্ত নাকি এটা তার দ্বিতীয় কোনো নাটক! ভেতরে অকারণ এক বাড়তি চিন্তার উদয় হলো তার। যদিও সে এটা ভাবতে চায় না। বরাবরই ব্রেইন তাকে পজেটিভ সিগনাল দিচ্ছে তবুও পুরনো কথা ভেবে ভয় পাচ্ছে সে। অনেকক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিল মাইসারা। বলল,
-“রাগ পুষে রেখো না ভাবী! আমি কখনও তোমার কষ্টের কারণ হবো না।”
মাইসারার এমন কথায় খানিকটা চমকালো ফারজানা! মেয়েটা এমনভাবে বললো কেন সেটাই বোধগম্য হলো না। ঝটপট প্রশ্ন করলো,
-“আমি কি বলেছি তুই আমার কষ্টের কারণ?”
-“না, না! তা হবে কেন।”
-“তবে এভাবে বললি কেন?”
-“এসবের মূলে তো আমিই তাই না? বাড়তি ঝামেলা ছিলাম এতদিন, এখন হয়তো তোমার মনে হবে, আমি তোমার ঘর-সংসার কে’ড়ে নিচ্ছি। বিশ্বাস করো ভাবী, আমি কখনো এমনটা ভাবি না। আমার জন্য বাড়তি ঝামেলা যেন তৈরী না হয়, সেই ব্যবস্থাই করবো!”
-“কী বলছিস তুই এসব?”
ফারজানা বুঝেও বাড়তি প্রশ্ন করলো। মাইসারা জবাব দিল না। কথা ঘুরিয়ে বলল,
-“সাবধানে থেকো। আর নিজের যত্ন করো। কখনো এমন ভুল আর করো না। রাখছি!”
হতভম্ব হয়ে গেল ফারজানা। মাইসারা যা বলেছে তা পুরোটা বুঝতেও বেগ পেতে হচ্ছে। হ্যাঁ, একটা সময় সে তো তার ক্ষ’তি চেয়েছিল। কিন্তু এখন তো অনুতপ্ত! নিজের ভুলে নিজেকেই শা’স্তি দিতে প্রস্তুত ছিল সে। তবুও কি পা’পের বোঝা হালকা হয়নি তার? এখনো বাকি আছে আরও! কী চাইছে মাইসারা? কী করতে পারে সে? কেনই-বা এমন রহস্যময় কথা বলে দুঃশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দিল? আদতে এর কোনো উত্তর জানা নেই ফারজানার। ফোন রেখে নীরবে মাথা ঠেকালো বালিশে। গাল বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অশ্রুটুকু মুছলো না সে, শুকনো খটখটে বালিশের তুলোতে শুকিয়ে গেল চোখের পানি। কেউ বুঝলো না, দেখলো না, আড়ালের এই অশ্রু বিসর্জ’নের দৃশ্য!
দিন পেরিয়ে রাত নামে, আবার রাত শেষে ভোর! সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দিন অতিবাহিত হয়, তবুও মাইসারার দুঃশ্চিন্তা কমে না। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর ইন্টার্নিশিপের সমাপ্তি। পরবর্তী অধ্যায়টা কীভাবে করবে সেটা নিয়েও যথেষ্ট চিন্তিত সে। বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়েও এখন অবধি সুষ্ঠুভাবে সঠিক সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাতে পারেনি। এদিকে সময় এত দ্রুত যাচ্ছে যে, ডিউটি শেষে বাড়তি চিন্তাভাবনা করার সময় সে পাচ্ছে না। দিনের দুটো ভাগে খুব অল্প সময়ের জন্য অনিকের সাথে কথা হয়! কখনো কখনো রাত জেগে কথা বলে, নিজেদের মধ্যে থাকা টুকরো টুকরো ইচ্ছের প্রকাশ ঘটে, হাসি-আনন্দে সময়টা যে কীভাবে হাওয়ার বেগে উড়ে যায় টের পায় না মাইসারা!
একটানা ডিউটি করে প্রায় হাঁপিয়ে ওঠার অবস্থা হলো তার। ঘামে চটচটে শরীর নিয়ে দ্রুত রুমে ঢুকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসার পরই টের পেল বেয়া’দব ফোনটা অবিরত কাঁপছে। ডাটা অন থাকাতেই ইমোতে ভিডিও কল দেখতে পেল সে। রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে অনিক বলল,
-“কোথায় ছিলি তুই? এতক্ষণ লাগে ফোন রিসিভ করতে?”
-“শাওয়ার নিচ্ছিলাম তো, তাই খেয়াল করিনি। সবার কী খবর বলো?”
-“সবার খবর জানতে হলে সবাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর। আমি ফোন করেছি এখন আমার সঙ্গে কথা বলবি। শুধু আমাদের দু’জনার কথা হবে! বাড়তি কাউকে এলাও করবো না সারা।”
অনিকের এই পাগ’লাটে স্বভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে মাইসারা। দিনকেদিন অনুভূতি যতখানি প্রখর হচ্ছে, দায়িত্ব, কর্তব্য ততই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। হেলায়, ফেলায় অনেক তো দিন অতিবাহিত হলো, এবার কিছু স্বচ্ছ অনুভূতিকে ধরে রাখার চেষ্টা হোক! টাওয়াল দিয়ে মুখের পানি শুকিয়ে মোবাইলটা কাৎ করে ড্রেসিংটেবিলে রাখলো। ভেজা চুল মুছতে মুছতে বলল,
-“একটা জরুরী কথা বলার ছিল!”
-“বল! শুনছি। আরে চুলটা শুকিয়ে নে ভালো মতো। নয়তো ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আচ্ছা বলতো, তোর কী কী লাগবে? একটা লিস্ট তৈরী করে দিস। ওসব মেয়েলী ব্যাপার স্যাপারে খুব একটা আইডিয়া নেই। হেয়ার ড্রায়ার, স্টেইট মেশিন, আর কী কী লাগবে, সব লিখে দিস। কিনে রাখবো।”
-“তুমি তো দেখি তোমার গান গাইছো, আমার কথা শুনছো কই! রেখে দিব ফোন?”
বিরক্তি নিয়ে বললো মাইসারা। সেই কবে থেকে কথাটা বলবে বলে অপেক্ষার প্রহর গুনছে, ভয়ে তাসবীহ্ জপছে অথচ অনিক তাকে পাত্তাই দিতে চাইছে না। সে পুরোদমে প্রস্তুত নতুন সংসার সাজানোর জন্য। বউ বাড়ি যাওয়ার পর কী কী লাগবে সেটা পরেও তো আলোচনা করা যায়! এখনই কেন এতসব কথা বলতে হবে? সময় আসুক, তখন দেখা যাবে। মাইসারার গাল ফুলানোর ধরন দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো অনিক। বলল,
-“তুই তো বলছিস না। না বললে শুনবো কী করে! আমি তো আর তোর মনের ভেতর ঢুকে যাইনি যে, মনের কথা বলার আগেই বুঝে নিব!”
-“এত বুঝতে হবে না। যা বলছি শুনো। আমি চাইছি এখানকার ঝামেলা মিটে গেলে আমাদের সদরের কোনো একটা ক্লিনিকে প্রেকটিস শুরু করবো! সেজন্য কাছাকাছি একটা বাসা দেখা দরকার। অল্প খরচের মধ্যে হলে হবে। যেন যাতায়াতে সুবিধা হয়! চাইলে তুমিও তোমার সুবিধা অনুযায়ী দেখতে পারো, দু’জনে একসাথে বেরোলাম। দেখবে…!”
মাইসারার শান্তশিষ্ট মনের এমন কথায় প্রচণ্ড চমকালো অনিক। বুঝতে দেরী হলো না যে, মেয়েটা বাড়ি ফিরতে চাইছে না। কিন্তু কেন? এখন তো ফারজানা নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত! আর কীসের দুঃশ্চিন্তা। থম মে’রে কিছুক্ষণ বসে রইলো সে। ভ্রু কুঁচকে তখনো অর্ধাঙ্গিনীর বলা কথাকে একমনে ভেবে চলেছে। কোনো সঠিক ক্লু না পেয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো,
-“তুই বাড়ি আসতে চাইছিস না?”
সোজা ক্যামেরার দিকে দৃষ্টি ফেরালো মাইসারা। অনিকের গম্ভীর, রাগী চোখ দেখে ঘাবড়ে গেল। তাৎক্ষণিক কোনো জবাব মুখে আসলো না। শুধু ভীরু চোখে তাকিয়েই রইলো। রাগ নিয়ন্ত্রণ করা প্রচণ্ড কষ্টের মনে হলো তার। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-“ঠিক আছে। বাড়ির কাউকে তো তোর বিশ্বাস নেই, থাক তুই। একা একাই থাক। কেউ তোর আশেপাশে যাবে না। আমি আর কী করবো। বাসা একটা দেখে দেব। তুই যাওয়ার পর হাত-পা ছড়িয়ে আরাম-আয়েশে দিন কাটাবো। নিজের সেবাযত্ন আর বাদবাকি চা’হিদা মেটানোর জন্য আরও তিনটে বিয়ে করবো। প্রথম বউ আমাকে রোজগার করে টাকা-পয়সা এনে দিবে। দ্বিতীয় বউ দিনরাত সেবা করবে, তৃতীয় বউ ক্ষিধে পাওয়ার আগেই মুখের সামনে খাবার ধরে থাকবে, আর চতুর্থ বউ ভালোবাসার গল্প করবে। কী শান্তির জীবন কাটাবো আমি, ভাবতে পারছিস সারা? মন্দ হবে না একদমই। তুই থাক! আসার প্রয়োজন নেই।”
প্রথমে রাগ থাকলেও পরবর্তীতে অনিকের চেহারা বেশ সিরিয়াস দেখালো। চোখ গোল গোল করে অনিকের হাসিমাখা ফেসটা দেখলো মাইসারা। মনে হলো, এই ছেলে এরকমটাই করবে ভবিষ্যতে! দ্বিতীয়, তৃতীয় বউয়ের দৌড় ঠিক আছে। কিন্তু চতুর্থ জনের ভবিষ্যৎ দৃশ্য কল্পনা করে প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে তার। রোজ ভিউ রেস্টুরেন্টের দু’রাতের চমৎকার দৃশ্য চোখে ভাসছে। কতখানি আদরে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নিয়েছিল তাকে। এখন সে জায়গায় অন্য কেউ আসবে! চোখমুখ ফুলিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে, এমন অবস্থা হলো মাইসারার। অনিক ক্যামেরা অফ করে বিছানা কাঁপিয়ে হাসছে। তার সেই হাসি মাইসারার চোখে পড়ছে না, ততক্ষণে লাইন বিচ্ছিন্ন করে গাল গড়িয়ে অভিমানের অশ্রু ঝরিয়ে দিয়েছে মেয়েটা!
*****
অনেকক্ষণ, খুবক্ষণ, বহুক্ষণ পর আবারও মোবাইলের আওয়াজ কানে আসলো তার। ওভাবে বসেই কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে সে। অতিরিক্ত কান্নার কারণে নাকের ডগাও যথেষ্ট লাল হয়ে গেছে। খুব স্বাভাবিক হয়ে ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে রাখলো। অনিক প্রথমে কথা বলল না, চুপচাপ কিছু শোনার অপেক্ষায় রইলো। মাইসারাও রেসপন্স করলো না। ওভাবে কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর অনিক নিজেই বলল,
-“ফোন কে’টে দিলি কেন?”
গাল ফুলিয়ে বসে রইলো মাইসারা। জবাব দিল না। অভিমানীর এমন অভিমানের রূপ আগে কখনো দেখেনি অনিক। দূরত্বের এই সময়টা কষ্টের হলেও অনুভূতির প্রখরতা অনেকটা বেশিই ছিল, এটা সে দিব্যি বুঝতে পারছে। জবাব না পেয়ে আবারও বলল,
-“থাকতে পারবি আমায় ছাড়া?”
কোনো জবাব খুঁজে পেল না মাইসারা। সে এতটাই আবেগপ্রবণ যে, এই সম্পর্কে দূরত্ব রেখেই বুঝতে পেরেছে, নীরবে, গোপনে, মনের মনিকোঠায় খুব যতনে অনিক নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছে। দিন একবার তার কণ্ঠস্বর না শুনলে ভয়ে বুকে কাঁপন শুরু হয় তার। আবারও যদি নিজের ভুলে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়, তবে কি অভিমানের পাহাড় ডিঙিয়ে ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিতে অনিক ফের ছুটে আসবে কাছে? আসবে না হয়তো! ভুলকে ফুল ভেবে গ্রহণ করবে না। বরং অভিমানকে বাঁচিয়ে রাখতে অনুভূতিকে দূরে ঠে’লে দিবে। একটা মানুষ আর কত ধৈর্যের পরীক্ষা দিবে? অনেকক্ষণ পর গভীর করে শ্বাস টানলো মাইসারা। কেঁপে কেঁপে উচ্চারণ করলো,
-“তুমি আরও তিনটে বিয়ে করবে?”
মাইসারার বলার ধরন শুনে আবারও হাসি আসলো অনিকের। কোনোমতে তা দমিয়ে রেখে বলল,
-“করতে তো হবেই। আমার সব প্রয়োজন মেটাতে তুই তো আর কাছে আসবি না। তাই যারা কাছে থাকবে তাদেরকে দিয়ে চালিয়ে নিবো। দিন দিনের পথে গেল, রাত রাতের পথে। মাস ছ’য়েক পর কিংবা বছরে একবার দেখা করবো তোর সাথে! হবে না? দারুণ হবে। কম কম দেখা সাক্ষাৎ হলে অনুভূতিও প্রখর থাকবে।”
-“তুমি খুব খারাপ!”
-“আমি ভালো, সেই সার্টিফিকেট দেখিয়েছি কখনো?”
মাইসারা ফের নীরব হয়ে গেল। রাগে, দুঃখে প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে দু’চারটে কি’ল, ঘু’ষি মে’রে আসুক অনিককে। কিন্তু দূরত্বের এই পথ শুধু দূরেই নয়, নাগালেরও অনেক বাইরে। চাইলেও সে ছুটে যেতে পারবে না, রাগ অভিমান মিটিয়ে বৈধ পুরুষের প্রশস্ত বক্ষে মিশে যেতে পারবে না। অপেক্ষা করতে হবে কাঙ্ক্ষিত সময়ের জন্য। মনে মনে নিজেকে হাজারও স্বান্তনার বাণী শুনালো। শান্তস্বরে বলল,
-“তিনটে কেন দ্বিতীয় বিয়েরও নাম নিবে না তুমি!”
-“নিলে কী হবে?”
রসিকতা করে বলল অনিক। মাইসারাও অভিমানে জবাব দিল,
-“আমার ম’রা মুখ দেখবে!”
-“ছিঃ সারা! বা’জে কথা মুখে আনতে নেই।”
-“তুমি আরও তিনটে বিয়ে করবে এটা দোষের না! আমি ম’রার কথা বললেই দোষ?”
-“আচ্ছা আমি বিয়ে করলে তোর সমস্যা কী? তোকে তো ডি’ভোর্স দিচ্ছি না। তুই আমার প্রথম বউ আছিস, তাই-ই থাকবি। বাকিরা কেউ-ই তোর জায়গা নিতে পারবে না।”
-“মে’রে হাড়গোড় ভে’ঙে দেব তোমার!”
-“তুই ডাক্তার হওয়ার বদলে লেডি কি’লার হলি কবে?”
-“ফের শুধু বিয়ের নাম মুখে নিয়ে দেখো, তোমার মুখে আমি তালা ঝুলিয়ে দিব বা’জে ছেলে।”
-“তুই বাড়ি না আসলে চারটে বিয়ে কনফার্ম! ভেবে সিদ্ধান্ত জানা, ঠিক আছে? এখন রাখি। রাত অনেক হয়েছে সোনা বউ, ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখ, বাকি তিনটে বউ কীভাবে তাড়াবি!”
বেশ মজার ছলে মাইসারাকে রাগিয়ে দিচ্ছে অনিক। সামনে না থাকলেও বুঝতে দেরী হচ্ছে না যে, পাহাড়সম অভিযোগ দাঁড় করিয়ে ফেলেছে এই মেয়ে। কাছে আসলে নির্ঘাত শো’ধ তুলে ছাড়বে। বিদায় নিয়ে ভালোমতো ফোন কে’টে দিতে চাইলো অনিক। ওপাশ থেকে মাইসারা ঝটপট বলল,
-“একটা কথা শুনো!”
-“বল!”
-“প্রমিস করো, তুমি আর কারও দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।”
মাইসারার এই বোকা বোকা কথায় প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে অনিকের। এমনিতেও যথেষ্ট রেগে আছে মেয়েটা। আর রাগানো উচিত হবে না। তাই বেশ শান্ত গলায় বলল,
-“আমার জন্য শুধু একজন নারীই বৈধ। আর সেটা কেবল তুই!”
-“মিথ্যে কথা। যদি আমিই হতাম, তবে তুমি আরও তিনটে বিয়ে করতে চাইতে না। নিশ্চয়ই আরও তিনজনকে অপেক্ষায় ফেলে রেখেছো!”
নিশ্চুপে ফোনটা কানে লাগিয়ে বসে রইলো মাইসারা। এই প্রশ্নের কোনো জবাব তার জানা নেই! কতখানি ভালোবাসলে প্রিয়জনকে প্রাণ বলে সম্বোধন করা সম্ভব, আসলেই তা জানা নেই তার। শুধু জানে ওই অনুভূতিটুকু সব সময়ের জন্য সত্য। তবুও মজা করে বলল,
-“আমি আসার আগেই ওই তিনটে বউকে বিদায় করো, নয়তো ভালো হবে না বলছি।”
-“আসবি তো? আর অপেক্ষায় ফেলবি না তো আমাকে?”
উত্তরে শুধু ছোটো করে ‘ফিরবো’ উচ্চারণ করলো মাইসারা। তবে মনে মনে বিড়বিড় করলো তাকে খুব শীঘ্রই ফিরতে হবে। অপেক্ষার এই লম্বা সময় যেন খুব দ্রুত ফুরোয়, নীরবে সেই প্রার্থনাই রোজ করে সে। শুধু মুখ ফুটে বলতে পারে না, ‘আমার তোমাকে প্রয়োজন!’ প্রয়োজন হয় বলেই তো কাছের মানুষ প্রিয়জন হয়ে উঠে! তার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হলো না। মনে প্রাণে সে এইটুকুই মানে, বৈবাহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর স্বামীই একটা মেয়ের সবচেয়ে কাছের এবং আপন হয়ে উঠে। সেই হিসেবে অনিকের তো তুলনা হয় না। মানুষ হিসেবে হোক কিংবা জীবনসঙ্গী হিসেবে, নিঃসন্দেহে সে একজন উত্তম পুরুষ!
*****
দূরে থেকেও দু’জনার অনুভূতি এতটাই প্রখর যে, মন থেকে তারা কাছে অথচ আলিফ আর ফারজানার ব্যাপারটা এখন ভিন্ন। দু’জনে এতটাই কাছে থাকা সত্ত্বেও দূরত্ব আজ দু’জনার সব সময়ের সঙ্গী। আলিফ বলেছিল, নীরবে শা’স্তি দিবে প্রিয়জনকে। দিচ্ছেও। ঘরের ভেতরে থাকা মানুষগুলো টেরই পাচ্ছে না, দু’জনার মাঝখানে এখন অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরী হয়েছে। যে দুর্ভেদ্য দেয়াল ভে’ঙে ফেলার সাহস কিংবা শক্তি কোনোটাই ফারজানার নেই। সেই যে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছিল এরপর আলিফ তার সাথে মেপে মেপে কথা বলছে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ডাকে না, সবার সামনে যা হোক একটু কথা বলে কিন্তু চার দেয়ালের ভেতরে অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত হয় সে। কথা বলা তো দূর, তখন ফিরেও তাকায় না অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। আলিফের এই পরিবর্তন মানতে পারছে না ফারজানা। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। আশায় আছে হয়তো আবারও একদিন সব ঠিক হবে। সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। আগের মতো ভালোবাসা হবে, গল্প হবে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন। সময় ফুরাবে তবুও কথারা ফুরাবে না। বকবক চলতেই থাকবে।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে ফ্লোরের দিকে। একটা পাটি বিছিয়ে বালিশে মাথা, কপালে কনুই রেখে শুয়ে আছে আলিফ। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি জেগে আছে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। কোনো নড়চড় নেই ঠিকই তবুও ফারজানার কেন যেন মনে হলো, সে ঘুমায়নি। হয়তো জেগেই আছে। কথা বলে দেখবে কি? উত্তর দিবে? কিন্তু কী কথা বলবে? আগে তো দিনরাত নিজেদের মধ্যে কত কথা হতো, কারণে অকারণে কথা হতো। অথচ এখন কথারাও হুট করে ফুরিয়ে গেছে। মান-অভিমানের সাথে তারাও দূরত্বকে আপন করে নিয়েছে। অনেকক্ষণ চেয়েও কোনো কথা খুঁজে পেল না ফারজানা। নীরবে তাকিয়ে রইলো শুধু। কীভাবে শুরু করবে সেটা নিয়েই দোটানা তার মধ্যে। অপরাধটা যে তার অনেক বড়ো, ক্ষমা করলেও হয়তো আগের মতো বিশ্বাস করছে না। ঠিক কীভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত তার? নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছে এটাও কি কম ছিল? কমই তো। মৃ’ত্যুর চেয়েও কঠিন শা’স্তিই আলিফ তাকে দিচ্ছে। একেবারে নিঃসঙ্গ জীবন উপহার দিয়েছে। এরচেয়ে কঠিন শা’স্তি আর কী হতে পারে!
ভোররাতে অদ্ভুত এক ঘটনার সাক্ষী হলো আলিফ। বুকের কাছটায় ক্রমশ ভেজা ভেজা ঠেকলো। প্রথমে মনে হলো, গরমের ঘাম। অথচ উপরে সিলিংফ্যান চলছে। ঘাম আসার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু পরবর্তীতে নড়াচড়া করতে গিয়েই আবিষ্কার করলো অর্ধাঙ্গিনীর পুরো শরীর তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে। বহুদিন পর বিয়ের প্রথম রাতগুলোর কথা মনে পড়লো তার। আপনজন ছেড়ে এসে ঠিক এভাবেই কাঁদতো রোজ। সুখের আতিশয্যে একটা সময় সেই কান্নাও মুছে গেছে মেয়েটার। নিজের শরীর থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলো আলিফ। ফারজানা বাঁধ সাধলো। ওভাবেই জড়িয়ে রইলো, তবে হাতের বাঁধনটা আগের চেয়ে শক্ত করে দিল। এমন একটা সিচুয়েশনে পড়বে ভাবেইনি সে। এরকমটা হবে জানলে রুম আলাদা করতো, শা’স্তির জন্য শুধু শয্যা আলাদা করতো না। খানিকটা বিরক্তির সুরে বলল,
-“হাতটা সরাও। আযানের সময় হয়েছে। আমাকে উঠতে হবে তো। নাহিয়ান জেগে গেলে সমস্যা হবে। সরো!”
-“তুমি আমাকে মা’রো, বকো, যা খুশি বলো তা-ও কথা বলা বন্ধ করে দিও না। আমি আর নিতে পারছি না এসব।”
-“মা’রতে চাইলে সেদিনই মা’র’তে পারতাম।”
-“তবে ক্ষমা করে দাও। ভুল তো মানুষেরই হয়। নিজের ভুলে সব এলোমেলো করে ফেলেছি আমি। তুমি যদি ক্ষমা না করো, তবে তো আমার একটাই পথ খোলা থাকে!”
-“ক্ষমা করলেও ফের তুমি এমনটা করবে না তার কী গ্যারান্টি? বিশ্বাস করেছিলাম তোমাকে। সাজানো, গোছানো একটা সুন্দর সংসার চেয়েছিলাম। তুমি কী করলে? আমার এতদিনের সব ভালোবাসা আর বিশ্বাসকে মিথ্যে করে দিলে! এমনটা তো আমি কখনোই চাইনি। কেন করলে?”
-“মে’রে ফেলো আমাকে। যা অন্যা’য় করেছি তার প্রতিশো’ধ নাও। মুক্তি দাও এতসব যন্ত্রণা থেকে। এভাবে চলতে থাকলে, দম আট’কে মা’রা যাব আমি। তারচেয়ে ভালো, তুমি নিজেই মা’রো।”
-“একবার বিশ্বাস ভে’ঙে গেলে দ্বিতীয় বার তা আর জোড়া লাগে না! আমি কী করে আবারও তোমাকে বিশ্বাস করি?”
-“এজন্যই তো বলছি, নিজেই মে’রে ফেলো। বিশ্বাসও করতে হবে না আর।”
পরক্ষণেই কোনো নির্দিষ্ট জবাব খুঁজে পেল না আলিফ। হাত সরিয়ে জোরপূর্বক উঠার চেষ্টা করলো। ফারজানাও নাছোড়বান্দা। ওভাবেই চেপে ধরে শুয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল সে। বলল,
-“ভেবে দেখবো, ক্ষমা করা যায় কি-না! এখন উঠতে দাও।”
-“উঁহু, এভাবে থাকো। বেশি নড়াচড়া করলে উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবো!”
-“কী আর করবে! লম্বা একটা কাপড়ই শুধু গ’লায় ঝু’লা’তে পারবে। ভয়ে কলিজা কেঁপে উঠেছিল আমার।”
-“স্বীকার করছো তবে, এখনো আমাকে ভালোবাসো।”
কোন কুক্ষণে যে এমন একটা মুখে আনলো আলিফ, নিজেও বুঝলো না। ধাক্কাধা’ক্কি করেও ছুটতে পারছে না। মেয়েটা একেবারে সা’পের মতোই পেঁ’চিয়ে ধরেছে তাকে। দূরের মসজিদ থেকে তখন মুয়াজ্জিনের মধুর কণ্ঠের আজান ভেসে এলো। আলিফ একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে বলল,
-“এখন তো ছাড়ো। নামাজ পড়বো।”
-“ছাড়বো। আগে বলো ক্ষমা করেছো।”
-“একটা শর্তে ক্ষমা করবো। আজ তুমি আবারও ওয়াদা করবে, কোনোদিনও সংসারে ভা’ঙ’ন ডেকে আনবে না। কারও কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। ওয়াদাটা আমার সাথে নয়, আল্লাহর সাথে করবে। যেন পরবর্তীতে তোমার অন্যা’য়ের শা’স্তি তিনি নিজেই দিতে পারেন।”
আলিফের এই কথাটা যথেষ্ট কাজে দিল। ঝটপট সোজা হয়ে বসলো ফারজানা। চোখমুখ মুছে, এলোমেলো চুল খোঁপা করে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকলো। ওযু করে আলিফের আগেই জায়নামাজে দাঁড়ালো সে। সিজদাহ্’তে অনেকক্ষণ কাঁদলো! তার দীর্ঘ সিজদাহ্ দেখেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আলিফ। বুঝতে পারলো, এইবার ওয়াদার খেলাফ করতেও জাহান্না’মের আগু’নের ভয় তাকে কাঁপাবে। দেরী না করে সে নিজেও নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে অর্ধাঙ্গিনীর হাতটা শক্ত করে ধরলো সে৷ দৃঢ় বিশ্বাস আর ভরসাকে সঙ্গী করে বহুদিন পর স্ত্রীর কপালে অধর ছুঁলো। বলল,
-“শেষবারের মতো ক্ষমা করলাম। আর কখনো এমন ভুল করো না। প্রিয়জনের বদলে যাওয়া মারাত্ম’ক ব্যথার সৃষ্টি করে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, নিজের দেখা মানুষটা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে।”
মুখে আর কোনো জবাব আসলো না তার। গুটিসুটি মে’রে জড়িয়ে গেল আলিফের সাথে। বুকে মাথা রেখে আগের মতো লতানো হাতে পেঁ’চিয়ে ধরলো পুরোটা। অনেকক্ষণ পর টের পেল, আলিফ নিজেও দু’হাতে আগলে নিয়েছে তাকে। মন থেকে খোদার দরবারে শুকরিয়া জানালো ফারজানা। অনেক ভুল হয়েছে, অনেক মান-অভিমান হয়েছে, আর কোনো ভুল সে ভুলবশতও করবে না। ভা’ঙ’ন সে তো অনেক দূরের চিন্তাভাবনা।
উঁচু ভবনের একদম নিচে দাঁড়িয়ে ডান থেকে বায়ে, আবার বাম থেকে ডানে এভাবে পালাক্রমে হাঁটছে অনিক। কখনো ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে ফেইসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করছে আবার কখনো চোখ ঘুরিয়ে রাস্তা দেখছে। ফাঁকে ফাঁকে ঘড়িতেও চোখ বুলাচ্ছে। এখান থেকে মাইসারার হোস্টেল খুব বেশি দূরে নয়, এতক্ষণে চলে আসার কথা। অবশ্য অপেক্ষা করতে মন্দ লাগছে না তার। এভাবে প্রিয়জনদের জন্য অপেক্ষা করাটাও সুখের, আনন্দের। এজন্যই ইচ্ছে করেই আনতে যায়নি। তাছাড়া ওই মুহূর্তে হোস্টেলে বাড়তি কাউকে এলাও করতো কিনা ঠিক নেই। হয়তো চো’র-ডাকাত ভেবে পাগ’লা কু’কু’রের মতো তাড়া করতো। অযথা সন্দেহের পাত্র হওয়ার চেয়ে অপেক্ষা করাই শ্রেয়!
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে আসলো মাইসারা! অনিকের কাছাকাছি দাঁড়াতেই সবক’টা দাঁত বের করে প্রাপ্তির হাসি ফুটালো সে। মনে হলো বিশ্ব জয় করে ফেলেছে আজ। মাইসারা ভ্রু নাচালো। বলল,
-“তুমি এমন কেন? পাগ’লাটে স্বভাবের। আগে তো এমন ছিলে না। মাথায় কী ঢুকেছে! আর এখানে কেন রুম বুকিং করেছো? জানো, চব্বিশ ঘণ্টার ভাড়া কত আসবে? সিলেটে আর রেস্টুরেন্ট নেই?”
একসাথে এতগুলো কথা শুনে কোনোটারই জবাব দিল না অনিক। মাইসারার হাত ধরে চুপচাপ লিফটের কাছে চলে গেল। লিফটে উঠেও কোনো কথা বললো না। একদম রিসেপশনের কাছে এসে ম্যানেজারকে কিছু বললো। ভদ্রলোক মুচকি হেসে ক্যামেরা বের করে ঝটপট একটা কাপল ছবি তুললেন। মাইসারার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মে য়্যুওর ম্যারেড লাইফ বি হ্যাপি ম্যাম!”
মাইসারা উত্তরে লাজুক হাসলো। অনিক আবারও ম্যানেজারকে প্রয়োজনীয় কথা বলে লিফটের কাছে আসলো। মাইসারা তখন বলল,
-“ছবি তুললো কেন?”
-“এদের কাজই এমন। নিউ কাপলদের ছবি তুলে রাখা।”
প্রতুত্তরে আর কোনো জবাব খুঁজে পেল না মাইসারা। মুখ নিচু রেখেই অনিকের হাত ধরে রুমের ভেতর আসলো। রুমে প্রবেশ করেই দ্বিতীয় চমকটা খেল। ভেতরটা এত সুন্দর করে সাজানো যে, হুট করে যে কারও মনে হবে এটা স্বপ্নপুরীর চেয়েও কম যায় না। পুরো রুমে চোখ ঘুরিয়ে মারাত্মক শক খেল সে। প্রতিটা কোণায় রঙবেরঙের মোমবাতি জ্বালানো। শুধু মোমবাতির আলোতেই ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে। বাড়তি কোনো বিদ্যুতের প্রয়োজন হচ্ছে না। এসি’র হিমশীতল স্পর্শ অনুভব হচ্ছে শরীরে। ক্ষণে ক্ষণে চোখ ঘুরছে ধবধবে সাদা বিছানার উপর। মাঝখানে লাভ শেপের গোলাপ ফুল। তার সামনের দিকে দুটো হাঁস! মনে হচ্ছে একটা আরেকটার দিকে দৃষ্টি দিয়েই একে-অন্যের অনুভূতিকে উপলব্ধি করছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ বেশ যত্ন নিয়েই এটা সাজিয়েছে। মাইসারার মনে হলো, এইটুকুতেই অনিকের পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি টাকা খরচ হবে আজ! আলমারি থেকে কিছু বের করলো অনিক। ঝটপট সেটা মাইসারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-“এটা পরে আয়!”
-“কী?”
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সন্দিহান চোখে প্রশ্ন করলো মাইসারা। অনিক তাকে সোজা ওয়াশরুমে ঠেলে হাতে একগাদা সেফটিপিন দিয়ে বলল,
-“শাড়ি!”
-“এখন এটা পরবো?”
খানিকটা বিরক্তি আর লজ্জায় রাঙা হয়ে সংকোচ নিয়ে প্রশ্ন করলো মাইসারা। অনিক তা দেখে মুচকি হাসলো। দুষ্টামি করে বলল,
-“শাড়ি পরতে লজ্জা পাচ্ছিস? তোকে কষ্ট করতে হবে না। চোখ বন্ধ করে দাঁড়া, আমিই পরিয়ে দিই। শখ করে বউয়ের জন্য প্রথম কোনো উপহার নিয়ে আসলাম। তাতে তাকে কেমন লাগে দেখবো না? দু’চোখে প্রচুর তৃষ্ণা নিয়ে এসেছি সারা! প্লিজ…!
আর কথা বাড়ালে নির্ঘাত এই ছেলে তাকে আরও লজ্জায় ফেলবে। কোনোমতে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো সে। ততক্ষণে ওয়েটার খাবারটা রুমেই নিয়ে এসেছে। অনিক ছোট্ট টেবিলটায় খাবারগুলো সাজিয়ে নিল ঝটপট। সে জানে মেয়েদের শাড়ি পরা কতটা ঝা’মে’লার কাজ। আর একা পরা তো ভীষণ কষ্টের। তবুও এই কষ্টের মাঝেই ফেললো মাইসারাকে। ভেতরটা যেমন অস্থির হয়ে আছে, সেই অস্থিরতা থামানোর ঔষধ তো তার অর্ধাঙ্গিনীই। তাই তাকে মনমতো সাজিয়েই দু’চোখের তৃষ্ণা আর মনের অস্থিরতা দূর করার কৌশল বেছে নিতে হয়েছে তাকে।
*****
মেয়েদের কাছে সাজগোছ খুব একটা বিরক্তির নয়। বরং সাজতেই তারা পছন্দ করে বেশি। হুটহাট নানান সাজে সেজে প্রিয়জনকে চমকে দেয়াই তাদের কাজ। ওভাবে নিয়ম করে কারও জন্য সাজতে পারেনি মাইসারা। পড়াশোনার চাপ থাকায় প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ককে খুব একটা পাত্তা দিতে পারেনি। নিয়ম করে ডেটে যাওয়া হয়নি, পাশাপাশি হাঁটা হয়নি, ভালোবেসে চোখ চোখ রাখাও হয়নি। সানভির সাথে তার সম্পর্ক যান্ত্রিকই ছিল বটে। পড়াশোনার ফাঁকে দু’চার মিনিট ফোনে কথা বলা, সময় সুযোগ পেলে ক্যানটিনে দেখা করা, ব্যস। এইটুকুই। অথচ আজকের সময়টা পুরোপুরি ভিন্ন তার কাছে। একদম আলাদা। ভালো লাগার, ভালোবাসারও।
একা-একাই শাড়িটা সামলে নিল মাইসারা। হাতের কূর্তি, উড়না রেখে দিল হ্যাঙ্গারে! রুমে এসে প্রথমে বাতি জ্বাললো। কেমন অগোছালো, এলোমেলো লাগছে নিজেকে। সবদিক পারফেক্ট হলো কিনা সেটা দেখতেই আয়নার সামনে দাঁড়ালো। ট্রায়াল দেয়ার মতো এদিক-সেদিক দেখছিল সে। কোথাও ত্রুটি দেখলেই সামলে নিচ্ছিলো তা। দূর থেকে অনিক এই মুহূর্তটা দু’চোখে তৃপ্তি নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলো। ধীরপায়েই এগিয়ে আসলো সামনে। মাইসারার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। বলল,
-“হয়েছে, আর ঠিক করতে হবে না। একটা শাড়ি পরতে যে মেয়েদের এতক্ষণ লাগে তা জানা ছিল না আমার।”
লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো মাইসারা। চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। আজ এত লাজলজ্জা ভর করলো কেন, কে জানে! তবুও লজ্জা সরিয়ে বলল,
-“এতকিছুর প্রয়োজন ছিল না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট। এই টাকাগুলো থাকলে তো অন্য যেকোনো কাজে আসতো।”
-“আমার টাকা আমি যেদিকে খুশি খরচ করবো তাতে তোর সমস্যা কী!”
-“এটা বাড়তি খরচ হয়ে গেল না?”
-“চুপ থাক। পাকা গিন্নীর মতো কথা বলিস না। আমাকে এই মুহূর্তটা উপলব্ধি করতে দে।”
কথার তাল হারিয়ে ফেললো মাইসারা। অনিক শুধু কাছেই আসেনি, দু’হাতের আঁজলায় অর্ধাঙ্গিনীর নিষ্পলক চাহনিতে মুগ্ধতা খুঁজে নিচ্ছে সে। মনে হচ্ছে, দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে কাঙ্ক্ষিত মানুষের সম্মুখীন হয়েছে। এই মুহূর্তটা এতটাই দামী যে, অন্য কোনোকিছু মাথাতেই আসছে না তার। নিশ্চুপে চোখের মায়ায় হারিয়ে যেতে চাইলো সে। শুধু কোনো বাধা-বিপত্তিকে আলিঙ্গন করতে চাইলো না। মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো,
-“আজ যদি কোনো ভুল করে ফেলি, দূরে ঠেলে দিবি?”
পুরো চোখমুখে আবারও লজ্জার আভা ফুটে উঠলো তার। চোখ নামিয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি দিল মাইসারা। তা দেখে অনিক বলল,
-“আমায় বিশ্বাস করিস না?”
-“করি!”
-“তবে? ভয় কীসের?”
-“হারানোর। যখন মা’কে কাছে পেয়েছি তখনই মা হারিয়ে গেল। যদি তুমিও…!”
চোখ তুলে চমকে গেল মাইসারা। অনিক ততক্ষণে দূরে সরে গেছে। চুপচাপ প্লেটে খাবার সাজাচ্ছে সে। কোথাও তার এই কথায় মনে আঘাত পেল না তো? সে তো কষ্ট দিতে বলেনি। ভয়ে আপনা হতেই বেরিয়ে এসেছে। তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। এই ছেলেটার এমন এমন অদ্ভুত কাণ্ড কখন যে তাকে প্রাণে মে’রে ফেলে কে জানে! কখনো হাসে, আবার কখনো চুপচাপ থাকে। যেন হঠাৎ করেই রোদের ভেতর মেঘের লুকোচুরি চলে। খাবার প্লেটে তুলে পানিও গ্লাসে ঢাললো অনিক। বলল,
-“পেটে নিশ্চয়ই ক্ষিধে আছে! রাত হচ্ছে খেয়ে নিই আগে। এখন আর নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
বুঝতে দেরী হলো না যে, এই সামান্য কথাও তী’রের ধারা’লো ফ’লার মতো সুক্ষ্ণ আঘাত গেঁথে দিয়েছে বুকে। রক্তক্ষরণ ঠেকাতেই কথার ভাবভঙ্গিতে ভেতর ঢাকছে সে। পাশাপাশি না বসে চুপচাপ অনিকের উরুর উপর বসে পড়লো মাইসারা। দু’হাতে মুখটা তুলে সরাসরি দৃষ্টি ফেলার চেষ্টা করলো। অনিক সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিল। রাগ ভা’ঙা’তে মাইসারা কথার যুক্তি সাজিয়ে বলল,
-“এই সম্পর্কটা বিশ্বাসের! আমি বিশ্বাস ভা’ঙার কথা বলিনি। বলেছি হারানোর ভয়। মৃ’ত্যুর কাছে সব প্রাণীই অসহায়। তুমি, আমি, আমরা সবাই।”
অনিক জবাব দিল না। মাইসারা আবারও বলল,
-“বিশ্বাস কখনো প্রিয়জনকে দূরে ঠে’লে দিতে জানে না। কাছে টেনে নেয়। আমিও এই সম্পর্কের প্রিয় মুহূর্তটাকে সাদরে গ্রহণ করতে চাই। বাঁচতে চাই তোমার সাথে। একই ছাদের নিচে গোটা জীবন পার করে দিতে চাই। আমাদের গল্পটা হাসির হোক কিংবা দুঃখের। কান্নাহাসির প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্তে আমি তোমাকে কাছে চাই৷ পাশে চাই। মৃ’ত্যুর দ্বারে পৌঁছে গিয়েও দু’চোখে তৃপ্তি নিয়ে দেখতে চাই, তুমি কাছে আছো, পাশে আছো, আমার আছো, সবসময়।”
বহুদিন পর, ঠিক কতদিন পর হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলো সে, সেই হিসাবটা করার সময়, সুযোগ কিছুই হলো না অনিকের। দৃষ্টি ফিরিয়ে চোখে চোখ রাখতে গিয়েই থমকে গেল সে। অর্ধাঙ্গিনী সুপ্ত অনুভূতির জবাবে এতটাই প্রখরতা ছিল যে, অস্থির, অশান্ত, শূন্য মনের ঘর পরিপূর্ণ হয়ে গেল মুহূর্তে। মনের আকাশে এক টুকরো সুখের প্রজাপতি উড়ে বেড়ালো নিঃসন্দেহে। জবাবটা আর দিতে পারলো না অনিক, ততক্ষণে তার অধরোষ্ঠ সাক্ষী হলো অর্ধাঙ্গিনীর কঠিন ভালোবাসার আলিঙ্গনকে গ্রহণ করে।
*****
খোলা আকাশের নিচে এসে যে কেউ চঞ্চলতাকে খুঁজে নেয় মুহূর্তেই। হোক তা বৃষ্টি বাদলের ক্ষণ কিংবা রৌদ্রজ্বল বিকেল। অথবা কোনো বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা নয়তো কোনো ঝলমলে, নির্মল, সতেজ সকাল। আকাশের বুকে মিশে গিয়ে নিজেকে খুঁজে নেওয়ার সুখটাই অন্যরকম। আজকের এই বিকেলটাও তেমনি সুখকে ছুঁয়ে দিতে এসেছে। সকাল থেকে বিকেল পুরোদিন হসপিটালের দৈনন্দিন কাজ সামলে বিকেলেই দু’জনে ঘুরতে বেরিয়েছে। মাঝেমধ্যে যান্ত্রিক শহরের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারলে মন্দ হয় না। জীবনের কিছু সুখকে উপলব্ধি করতে এভাবে শত ব্যস্ততায়ও প্রিয়জনের জন্য একটুখানি সময় তো বের করে নিতেই হয়। এতে সম্পর্কে আস্থা আসবে, মনমালিন্য দূর হবে, ভালোবাসা আর বিশ্বাস গাঢ় হবে!
তখন সুরমা নদীর বুকে অসংখ্য ছোটো বড়ো নৌকার ছোটাছুটি চলছে। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে সেই নদীর কিনার ঘেঁষে ছুটে চলা কিছু সাধারণ মানুষের জীবনের খণ্ডচিত্র উপভোগ করছে মাইসারা। সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন কিছু নজরে পড়লেই ঝটপট মোবাইলে ক্লিক করে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। অনিকের মনে হলো, এবার অন্তত বাড়ির ঝামেলার কথা মাইসারাকে জানানো উচিত। মেয়েটা এখনো জানে না, একটা সাজানো গোছানো সংসার ভে’ঙে যেতে যাচ্ছে। কীভাবে তা জোড়া লাগাবে তা নিয়েই ভীষণ দুঃশ্চিন্তা আর দোটানায় ভুগছে অনিক। মাঝেমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত, পরামর্শের ভার অপরপক্ষের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। এতে করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায় এবং উপযুক্ত পরামর্শও খুঁজে পাওয়া যায়।
এমন সময় নদীর বুকে একঝাঁক বাচ্চাদের সাঁতার প্রতিযোগিতা চলছে। মূলত এটা তাদের নিত্যদিনের দৃশ্য। গোসলের সময় একছুট দৌড় তারা দিবেই। বাচ্চাদের এই দুষ্টুমিষ্টি মুহূর্তটা ফ্রেমে আটকে নিল মাইসারা। অনিকের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ওরা ভয় পাচ্ছে না? এত বড়ো নদী! যদি ডুবে যায়?”
-“সাঁতার না জানলে আসতো না নিশ্চয়ই! এদের দৌড় দেখেই বুঝা যাচ্ছে পাকা সাঁতারুর দলে নাম লেখাবে।”
ততক্ষণে ব্রিজের ওপর কনুই ঠেকিয়ে মাইসারার এই পাগ’লামি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অনিক। ছবি তোলা শেষে মোবাইলটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল সে। অনিকের দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। তার নীরব চাহনি দেখে মনে হলো, ভেতরে ভেতরে কথা গোছাচ্ছে সে। জরুরী কিছু বলবে নিশ্চয়ই। প্রিপারেশন নিয়েই পাশাপাশি দাঁড়ালো মাইসারা। হাতের বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
-“ঝটপট বলে পেল, কী সমস্যা!”
ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো অনিক। মেয়েটা তাকে বুঝতে পারে, এইটুকুই যেন এই মুহূর্তে অনেক দামী কিছু। জীবনে মানুষ এসবই চায়। প্রকৃত একটা মানুষ, যে মানুষ তাকে বুঝে, আগলে রাখে। প্রিয় মানুষটা মনের কথা মুখ ফুটে বলার আগে বুঝে নিতে জানে। ভাবনা থামিয়ে বলল,
-“বিশাল এক সমস্যা হয়েছে সারা, তার কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না।”
-“কী হয়েছে? বাড়িতে কোনো ঝামেলা?”
-“ভাইয়া ভাবীর মধ্যে ঝামেলা চলছে। সেপারেশনে যেতে চাইছে তারা। কিন্তু তাদের এই ভা’ঙ’ন নাহিয়ানের জীবনটাকে নষ্ট করে দিবে।”
অবিশ্বাস্য ঠেকলো সব কথা! মনে হলো এসব সে ভুল শুনছে। কত করে বুঝিয়ে এসেছিল আলিফকে, তবুও তার কোনো কথাকে কানে তুললো না সে। এমন সুন্দর সংসারে এখন ভা’ঙনকে জরুরী করে দিল। অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো মাইসারা। ঠিকঠাক কোনো জবাব খুঁজে পেল না। অনিকের কণ্ঠস্বর বলছে, চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি সে। অথচ আলিফ গুরুত্ব দেয়নি। সব শুনে, বুঝে নীরবে আবারও কিছুক্ষণ ভাবলো মাইসারা। ভরসা দিয়ে বলল,
-“তুমি চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“কীভাবে? ভাইয়া কারও কথা শুনতে চাইছে না। তার একটাই সিদ্ধান্ত, আলাদা হয়ে যাওয়া। হ্যাঁ প্রিয়জনের বদলে যাওয়া কষ্ট দেয়, তাই বলে তাকে কোনো সুযোগ দিবে না? এভাবে একতরফা বিচার হয় কী করে! ভুল তো মানুষই করে। ক্ষমাও মানুষ চায়। তাকে তো সুযোগ দিতে হবে। তা না করে উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নিলে তো হবে না।”
-“আমি ভাবীর সাথে কথা বলবো। তাকে বুঝাবো।”
-“পারবি?”
-“চেষ্টা করে দেখি। এভাবে তো ভে’ঙে যেতে দিতে পারি না। ঝামেলাটা যেহেতু আমাকে নিয়ে তৈরী, সমাধানও আমি দিব। অযথা দুঃশ্চিন্তা করো না। ভাইয়াকে বুঝাও। ভা’ঙ’নে কী ক্ষ’তি হয়, তা তো নিজেকে দিয়ে বুঝেছি! চোখের সামনে আরেকটা সন্তান বাবা-মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হবে, সেটা তো দেখতে পারবো না। কিছু একটা ভাবতে হবে। দ্রুত এর সমাধান খুঁজতে হবে। শুধু আমার উপর ভরসাটুকু রাখো।”
বহু সাধনার পর মানুষ মনের মতো যোগ্য সঙ্গী পায়। এই মুহূর্তে অনিকের ঠিক এই উপলব্ধিটাই হলো। এই মেয়ে প্রতি মুহূর্তে তাকে মায়ায় ফেলেছে, ভালোবাসতে বাধ্য করেছে, বাকি জীবন এই নারী ছাড়া সে রীতিমতো অসহায়, দিশেহারা পথিক হয়ে যাবে। চলার পথ শূণ্য হয়ে যাবে এই মনোহারিণী ছাড়া। যে তার মন বুঝে, তাকে বুঝে, সেই মানুষটাকে ভরসা না করে পারা যায় না। ঠোঁটে নির্ভরতার হাসি ফুটালো অনিক। মাথা নেড়ে অর্ধাঙ্গিনীর হাতটা শক্ত করে ধরলো। মৃদুস্বরে বলল,
-“আই অলওয়েজ ট্রাস্ট য়্যু, সারা। আই উইল ডু ইট ফোর দ্য রেস্ট অফ মাই লাইফ!”
হুট করে কোনোকিছু পাওয়া, আবার তা হুট করেই হারিয়ে ফেলার সময়টুকু যে কতখানি ব্যথার সৃষ্টি করে মনে, তা কেবল এই মুহূর্তে মাইসারাই উপলব্ধি করতে পারছে। সে তো বলেনি, অনিককে এখানে আসার জন্য! জো’রও করেনি। নিজের ইচ্ছায় এসেছিল, এখন কাজের তাড়া পড়েছে তাই চলে যেতে হচ্ছে। যেভাবে দু’হাত ভরতি ভালোবাসার রঙ নিয়ে মনের রুদ্ধদ্বারে কড়া নেড়ে এসেছিল আবারও সেই দ্বারকে অপেক্ষার প্রহরে ফেলে চলে যাচ্ছে। এই দুটোদিন যতখানি সুখের ছিল, এই মুহূর্তটা তারচেয়েও দ্বিগুণ দুঃখের। পোষমানা বিড়ালছানার মতো গুটিসুটি মে’রে প্রিয়জনের বক্ষস্থলে লুকিয়ে রইলো সে। চোখের জল বাঁধ মানছে না আর। ক্ষণে ক্ষণে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। খটখটে শুকনো বুকের মধ্যে হুটহাট বৃষ্টির আনাগোনা টের পাচ্ছে অনিক, তবুও কোনো কথা বলছে না। অর্ধাঙ্গিনীকে যত্ন করে আগলে রেখেছে! ঝরে পড়া অশ্রু মুছে দিতে খানিক পর পর অধর ছুঁইয়ে দিচ্ছে পুরো মুখমণ্ডলে। তবুও কান্নার রেশটা তার থামছে না।
-“কান্না থামা প্লিজ, ভালো লাগছে না। একটু ভালোমতো বিদায় দে৷ এভাবে একেবারে ইমোশনাল হয়ে যাবি জানলে আমি এখানে আসতাম না। এটাই শেষ, আর আসবো না দেখে নিস।”
মায়াবতীর নীরবতার চেয়ে বিরহের কান্নাটাই অন্তরে বিঁ’ধছে অনিকের। কেন যে সে এখানে আসতে গেল! মেয়েটা এমন আবেগী হয়ে যাবে জানলে পা রাখতো না নিশ্চয়ই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল অনিক, যতদিন না মাইসারার সার্টিফিকেট হাতে আসছে ততদিন আর সিলেট পা রাখবে না। বার বার এমন দৃশ্য দেখা সম্ভব না তার পক্ষে। মনকে কতই আর মানানো যায়, কতই স্বান্তনা দেয়া যায়! চুপচাপ বিছানা ছাড়লো অনিক। হাত বাড়িয়ে মাইসারাকে টেনে তুললো। হাতের স্পর্শে চোখের পানি মুছে চিবুক ধরে কপালে গভীর স্পর্শে অধর ছুঁলো! বুকের কাছটায় আগলে নিল দ্রুত। মাইসারার মাথার তালুতে তার থুতনি ঠেকলো। যদি সবসময়ের জন্য এখানেই পু’তে ফেলা যেত, তবে এত বিরহ আসতো না বোধহয়। ফিসফিস করে বলল,
-“কাঁদিস না সারা, আমরা চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল কখনোই হবো না। যোগাযোগ তো থাকবেই, তাই না! আমি তো আর প্রবাসী নই যে, সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি চিরদিনের জন্য। আমাদের দূরত্বটা কয়েকটা ঘণ্টার পথ মাত্র।”
আবেগী মেয়ে হুট করে যেভাবে বাচ্চা হয়ে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি হুট করে আবার ম্যাচিউরড হয়ে গেল। ঝটপট বিছানা ছাড়লো সে। ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ওড়নাটা ভালোমতো পেঁচিয়ে নিল। বলল,
-“ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে, এসো।”
অনিক অবাক চোখে একপলক তাকালো। দড়াম করে আকাশে বজ্রপাত যেমন হয়, বৃষ্টি হয়ে মাটির বুকে ঝরে পড়ে একটুকরো মেঘের ঘনঘটা, আবারও আকাশে মিশে গিয়ে রংধনুর সাতরঙে রাঙিয়ে দেয় আকাশ, তেমনি প্রিয়তমার মুখশ্রীও সেই রূপে ফিরে গেল তৎক্ষনাৎ। যেমনটা দু’চোখে বৃষ্টির জল নামিয়ে ছিল, তেমনটাই আবার তাকে রোদের আড়ালে লুকিয়ে নিয়েছে। নিজেকে মানিয়ে নেয়ার কত চেষ্টা যে প্রতিনিয়ত করে মানুষ, তা এই মুহূর্তে মাইসারাকে না দেখলে উপলব্ধি হতো না তার। কথার জবাবে শুধু চুপচাপ মাথা নাড়লো সে। তারপর ব্যাগ হাতে নিয়ে সোজা রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো দু’জনে। রিসেশনে এসে বিল মিটিয়ে রিকশা ডেকে নিল। মাইসারাকে হসপিটালের সামনে নামিয়ে স্টেশনের দিকে চলে গেল অনিক। দূরত্বের এই সীমানাটা দূর থেকেই দেখলো মাইসারা! ইচ্ছা থাকলেও উপায় জানা নেই তার। চাইলেও দায়িত্ব, কর্তব্যকে অবহেলা করা যায় না। এভাবেই কিছু চাওয়া-পাওয়াকে দূরে ঠে’লে দিতে হয়। ধৈর্য্য নিয়ে স্বপ্ন পূরণের শেষপ্রান্তে পৌঁছানোর পথ পেরোতে হয়। অপেক্ষা করতে হয়, আবারও দেখা হওয়ার জন্য, এক হওয়ার জন্য, একসাথে বাঁচার জন্য, ভালোবাসার জন্য।
*****
বেশ কিছুদিন ধরে কোনো কাজে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারছে না মাইসারা। বড্ড বেশি মুড সুইং হচ্ছে। কোথাও মন টিকছে না! কেমন অস্থির, এলোমেলো, অগোছালো লাগছে সবকিছু। অনিক যাওয়ার পর থেকেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। অকারণ মনের আকাশে মেঘ জমেছে। কখনো তা বৃষ্টির ফোঁটার মতো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মাইসারার এই পরিবর্তন খুব করে লক্ষ্য করছে রিপা। মেডিকেলে পড়াশোনার শুরু থেকেই রিপার সাথে সম্পর্ক তার খুব ভালো। সবকিছু শেয়ার করা ছাড়াও একে-অন্যের সুখ-দুঃখের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছে দু’জনে। মাঝেমধ্যে রিপাও বুঝতে পারে, প্রিয় বন্ধুর মন খারাপের আনাগোনাটা কেন হয়, কী কারণে হয়! সাধ্য অনুযায়ী মন ভালো করার চেষ্টা সে করেও। এই মুহূর্তেও ঠিক তাই করলো রিপা। একটা এলোমেলো রুবিকস কিউব এনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-“ঝটপট এটা মিলিয়ে নে। মন ভালো হয়ে যাবে!”
ঘাড় ফিরিয়ে গেইমের দিকে দৃষ্টি দিল মাইসারা। মুচকি হেসে বলল,
-“তোর কাজ তুই কর। সারাদিন এই-ই তো চলে।”
-“আরে ধর, ট্রাই কর! চাইলে ভাইয়ার সাথে কথা বলে মন হালকা করতে পারিস! তাছাড়া আধঘণ্টা পর ও.টি’তে ঢুকবি। এভাবে মাথার উপর বাড়তি চা’প নিয়ে ঢুকলে রোগীকে বাঁচানোর বদলে মে’রে ফেলবি!”
গেইমটা তৎক্ষনাৎ নিজের হাতে আনলো মাইসারা। রিপা এমনভাবে এলোমেলো করেছে প্রথমবার এটা যে মেলাতে যাবে তার মাথার ঘাম ঝরে যাবে। মাইসারার এই গেইমটা খেলার অভ্যাস আছে। ঝটপট কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সবক’টা কিউব মিলিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল আবার। বলল,
-“আরেকটু এলোমেলো করলে ভালো হতো। খানিকটা সময় ইনভেস্ট হতো!”
-“তোর হয়েছেটা কী বলতো? সারাক্ষণ এমন মনমরা হয়ে থাকলে চলবে? সময় কত দ্রুত যাচ্ছে খেয়াল আছে! হুট করেই একদিন এতসব ঝামেলার ছুটি হয়ে যাবে। নিজের একটা জায়গা তৈরী হবে। দৈনন্দিন কাজের চাপ বাড়বে। চারপাশে সারাদিন এত রোগী ছোটাছুটি করবে যে, মন খারাপ করার জন্যও বাড়তি সময় পাবি না। তাছাড়া তোকে এভাবে একদমই মানাচ্ছে না। একটু হাসতে তো পারিস।”
-“হাসি না আসলে জো’র করে কীভাবে হাসবো বল!”
-“ভাইয়া তোকে একটা দায়িত্ব দিয়ে গেছে, নিজেকে তৈরী করার। এইযে অযথা মন খারাপকে সঙ্গী করে দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছিস, এটা কি ঠিক হচ্ছে? এভাবে চলতে থাকলে শেষপ্রান্তের ঠিক কিনারায় পৌঁছার আগেই চলন্ত গাড়ির দৌড় থেমে যাবে। তখন তুই ওই একটা গানই গাইবি, ‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে, ও গাড়ি চলে না!’ শেষে এসে থেমে যাস না সারা, দৌড়া। জয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছেছি আমরা। এখানে থেমে যাস না দোস্ত!”
রিপার এই ঠে’লে ঠে’লে গাড়ি চলে না গান শুনে ফিক করে হেসে ফেললো মাইসারা। অনেকক্ষণ হাসলো। হাসি থামিয়ে বলল,
-“থ্যাংকস! এই হাসিটার প্রয়োজন ছিল!”
কিছুক্ষণ পর মাইসারা টের পেল সামান্য হালকা লাগছে। নিজেকে পুরোদমে স্বাভাবিক করে ঝটপট তৈরী হয়ে নিল। আর কিছুক্ষণ পরই একটা অপারেশন আছে। সকালেই একজন গর্ভবতী নারী এসে এডমিট হয়েছেন। তার কান্ডিশন ভালো থাকলেও তিনি লেবার পেইন সহ্য করতে পারবেন না বলেই অপারেশনে যেতে চাইছেন। অথচ প্রত্যেকেই চায়, সিজারিয়ান অপশন থেকে দূরে থাকতে। এই মহিলাটা পুরোটাই আলাদা! যখন তাকে চেকাপ করছিল, তখন তার ভীতিগ্রস্ত চোখমুখ দেখে প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিলো মাইসারার। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তার মনে হচ্ছিলো, মেয়েটা অভার অ্যাকটিং করছে। হাজবেন্ডের হাত ধরে সে কী কান্না! মুহূর্তেই সেই ঘটনা তাকে আরেকদফা হাসিয়ে দিল। হাসিটাকে শুধু ঠোঁটের কোণেই সীমাবদ্ধ রাখলো, বাড়তি আওয়াজ তৈরী হতে দিল না।
*****
অপা’রেশন থিয়েটারে যথেষ্ট সাহস আর যত্ন নিয়েই কাজ করে মাইসারা। আজকের কাজটায়ও বিন্দুমাত্র অবহেলা নেই। ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা একটা সুস্থ শিশুর জন্ম দেয়া, একজন মা’কে পরিপূর্ণ সুস্থ রাখা। সেই অনুযায়ী চেষ্টার কোনো কমতি রাখেন না তারা। ও.টি’র ঝামেলা শেষে যখন সুস্থ নবজাতককে তার মায়ের বুকে শুইয়ে দিল মাইসারা তখন সেই সদ্য মা হওয়া অনুভূতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরে আবেগে কেঁদে ফেললো মেয়েটি! তা দেখে মাইসারার চোখে জল এলো। একটা সন্তানকে মা ঠিক এইভাবেই বুকে আগলে রাখে, সারাজীবন। রোজ এই দৃশ্য যখন দেখে তখন নিজের ভাগ্যটা নিয়ে বড্ড আফসোস হয় তার, আবার পরক্ষণেই মন ভালো হয়ে যায়, যখন হাজারও না পাওয়ার ভিড়ে অনিকের হাসিটুকু চোখে ভাসে। এইটুকুতেই নিজেকে পরিপূর্ণ অনুভব করে সে।
অপা’রেশনের ঝামেলা শেষ করে মা এবং সন্তানকে আলাদা কেবিনে শিফট করা হলো। হাতের গ্লাভস খুলে হাত পরিষ্কার করলো দ্রুত। নিজের গায়ের সবুজ অ্যাপ্রোন খুলে ঝটপট রোগীর কাছে আসলো। আলাদা একটা বিছানায় তখন নবজাতককে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বাচ্চার বাবা এসে ততক্ষণে বাচ্চাকে একনজর দেখে গেছে। মাইসারা ভালোমতো চেক করলো বাচ্চাটাকে। কোনোপ্রকার অসুবিধা হচ্ছে কিনা তা দেখে নিল। তখন ভদ্রলোক বললেন,
-“ভবিষ্যতে বাচ্চার কোনো ক্ষ’তি হবে কী?”
-“মানে?”
আচমকা এমন প্রশ্নে ভরকে গেল মাইসারা। লোকটা তখন সামান্য হেসে বলল,
-“আসলে আমরা কাজিন। আমার মা একজন ডাক্তার। তবে তিনি এখানে নেই। আমাদের লাভ ম্যারেজ! কিন্তু মা বার বার বলতেন, কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হলে ফিউচারে বাচ্চাদের সমস্যা হতে পারে। তো সেটাই আরকি জানতে চাইছি।”
-“সমস্যা হলে সামলাবেন। ডাক্তার তো আছেই। রোগ আসলে রোগের মুক্তিও আছে। ভয় পাবেন না। আপনারা দু’জনে মিলে বাচ্চাকে আগলে রাখবেন। ইন-শা-আল্লাহ্ কঠিন কোনো রোগ হবে না! হলেও বাঁচানোর মালিক আল্লাহ! তবে মনে রাখবেন, যতই রোগবালাই আসুক, বাচ্চাকে কখনো বাবা-মায়ের আদর-স্নেহ থেকে বঞ্চিত করবেন না। অসুস্থ হোক বা সুস্থ, একটা বাচ্চা সবসময়ই ভালো থাকে যদি সে তার বাবা-মায়ের সংস্পর্শে থাকে। তাই তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আপনাদেরই।”
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন আবারও। মাইসারা কেবিন থেকে বেরিয়ে উপর থেকে নিচে আসছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখ গেল ওয়েটিং রুমে বসে থাকা নারীর দিকে। তার শারিরীক পরিবর্তন বলছে সে প্রেগন্যান্ট! সময়ের হিসাব করে চমকে গেল মাইসারা। দ্রুত এগিয়ে আসলো সামনে। অবাক হয়ে বলল,
মুচকি হেসে উত্তর দিল নামিরা। মাইসারা আঙুলের দাগে মাসের হিসাব করলো। সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল,
-“কীভাবে? বিয়ের তো মাত্র তিন মাস হলো! না না, আরও বেশি!”
-“বুদ্ধু! আমাদের বিয়ের এক বছর হয়ে গেছে! গত কয়েকদিন আগে বিবাহবার্ষিকী ছিল!”
-“কী?”
মাইসারার মনে হলো সে ধড়াম করে আকাশ থেকে মাটিতে পড়লো। কপালে হাত রেখে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো। নামিরা তার হাত ধরে বলল,
-“আসলে ভুলটা আমারই! জেনে-বুঝে তোমার মানুষটাকে কেড়ে নিতে চাইছিলাম আমি। সময়মতো সবাইকে সব সত্যি জানাইনি। তানভীর আর আমার ভালোবাসার সম্পর্ক। পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম আমরা। কিন্তু সে বিয়ে তার বাবা-মা মেনে নেননি। সবাই ডি’ভোর্সের জন্য চাপ দেয়৷ বাবা-মা এক প্রকার জো’র করে ডি’ভোর্স করিয়ে নিতে চান৷ কিন্তু পারেননি। জো’র করে অনিকের সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলেন। বিয়ের ব্যাপারটা অনিকও জানতো না। এত চাপ নিতে পারছিলাম না। এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়লাম। জানতে পারলাম, আমি প্রেগন্যান্ট। বাধ্য হয়ে মুখ খুললাম।”
-“মানে! তোমাদের বিয়ের ব্যাপারটা প্রথমে কেউ জানেনি?”
-“কাউকে জানাইনি! প্রেগন্যান্সির পরই আংকেলকে এসে সব বললাম। অনিককেও বুঝালাম। আমার বদলে তোমাকে বেছে নেওয়ার কথা বললাম। অনিক ভয় পাচ্ছিলো, যদি তুমি তাকে ফিরিয়ে দাও! যদি বলো, সানভিকেই চাও। তবে? এজন্যই!”
-“এতসব কথা তো আমাকে সরাসরি বললেই হতো। অনিক কেন চুপ ছিল?”
-“কারণ, তোমার ভেতরে সবসময় তুমি অন্য একজনকে বাঁচিয়ে রেখেছো! তোমাকে ভালোবাসি বলা, কিংবা সরাসরি বিয়ের কথা বলা এই নিয়ে প্রচুর দ্বিধার মাঝে ছিল অনিক। ও চায়নি এমন কিছুই। তখন আমার মনে হলো, যদি আমি সত্যিটা না বলি, তবে তুমি বিয়েতে রাজি হবে না। একদিকে তোমার জন্য শক্ত আশ্রয় তৈরী করা, অন্যদিকে তোমার মনে নিজের জন্য অনুভূতির সঞ্চার করা, দুটোই খুব কঠিন ছিল সারা। এই কঠিন কাজটা সহজে হতো না, যদি না আমি মাঝখানে আসতাম।”
-“সত্যি কথা বলতে এত ভয় কীসের আপু?”
-“সানভি দেশে আছে সারা। ওর সাথে অনিকের দেখাও হয়েছে। সব জানলে তুমি অনিককে ফিরিয়ে দিতে নিশ্চয়ই! আর তোমার প্রত্যাখ্যান ও মেনে নিতে পারতো না। তাই সরাসরি না এসে আমার মাধ্যমেই তোমার সামনে এসেছে!”
এতসব কথা শুনে মনে হলো, তার মাথার ভেতর হাজারও পোকামাকড়ের কিলবিল চলাচল করছে! দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো মাইসারা। তার ভেতরে তখন একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, সানভি দেশে ফিরেছে আর সেটা অনিক জেনেও লুকিয়ে গেছে। কেন? কী কথা হয়েছে দু’জনার মাঝে যা সে জানতেও পারেনি! কীসের এত লুকোচুরি চলছে? কেনই-বা এই লুকোচুরি?
*****
ফারজানাকে এই ক’দিনে অনেক বারই কল করেছে মাইসারা কিন্তু সে কল রিসিভ করেনি। প্রতিবার রিং বাজতে বাজতে একটা সময় বন্ধ হয়ে যেত, এপাশের মানুষটা ফোন রিসিভ করতো না। আজও হসপিটাল থেকে ফিরে বার কয়েক চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে বিছানায় বসে রইলো সে। মাথাটা যন্ত্রণায় ফে’টে যাচ্ছে তার। কোনোকিছুই ঠিকমতো ভাবতে পারছে না। অনিককে কথা দিয়েছিল, যেভাবে হোক ফারজানাকে বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠাবে কিন্তু তা আর রাখতে পারলো না। কোনোভাবেই ফোন রিসিভ করলো না সে। পরবর্তীতে কলও ব্যাক করলো না। দুঃশ্চিন্তায় বুকের ভেতর কাঁপন শুরু হয়েছে তার। একদিকে ফারজানা আর আলিফের সংসার, অন্যদিকে তার আর অনিকের সংসার, দুটো সংসার নিয়েই মাত্রাতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা ভর করছে মনে। সানভির সাথে অনিকের কী কথা হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো আইডিয়া আসছে না মাথায়! এর কারণেই কি তবে অনিক পাগ’লামি করছিল? হুটহাট না জানিয়ে চলে এসেছিল! কিছুই ভাবতে পারছে না সে। যতই ভাবছে সব ভাবনা একটা জায়গায় এসে থমকে যাচ্ছে, অনিকের সাথে তার সম্পর্কটা ঠিক কী? যান্ত্রিক নাকি হৃদয়ের সুপ্ত অনুভূতি! আদৌ এর কোনো সঠিক জবাব নেই তার কাছে।
যতসব জটিল ভাবনার কোনো সঠিক সমাধান খুঁজে পেল না সে। নীরবে মাথা ঠেকালো বালিশে। সারাদিনের দুঃশ্চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলো তবুও ব্যর্থতা উঁকি এসে বুঝিয়ে দিল, শত চেষ্টা করলেও দুঃশ্চিন্তা থেকে আজ আর মুক্তি নেই। দু’চোখে অশ্রু’রা ভিড় জমিয়েছে। তার মনে হচ্ছে, যে আশ্রয়েই সে পা রাখছে সেটাই হারিয়ে যাচ্ছে! একটা সময় হয়তো অনিকও হারিয়ে যাবে। টেনশনে পাগল পাগল অবস্থা হলো মাইসারার। ফোন হাতে নিয়ে আবারও ফারজানাকে ফোন করলো। অন্তত একটা কাজ সুষ্ঠুভাবে হোক। কিন্তু তা-ও হলো না। বাধ্য হয়ে শেষমেশ আলিফের নাম্বারে ফোন করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর রিসিভ হলো সেটা। চোখমুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করলো সে। সালাম দিয়ে জানতে চাইলো,
-“বাড়ির সবাই ভালো আছে তো ভাইয়া? ক’দিন ধরে নাহিয়ানের জন্য মনটা বড্ড ছটফট করছে। একটু ফোনটা দাও না, ওর সাথে কথা বলি।”
সরাসরি ভা’ঙনের প্রশ্নে গেল না মাইসারা। বুদ্ধি করে নাহিয়ানের কথা বলে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ পর আলিফ জবাব দিল,
-“ও তো ওর নানু বাড়ি আছে।”
-“কবে গেল?”
-“হয়ে গেছে অনেকদিন!”
-“কবে আসবে? ভাবীকে কতবার ফোন দিলাম, রিসিভ করলো না। কিছু কি হয়েছে ভাইয়া?”
-“কিছু হয়নি। তুই অযথা দুঃশ্চিন্তা করিস না।”
-“না না, আমি দুঃশ্চিন্তা করবো কেন। এমনিতেই মনে পড়লো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি এক কাজ করো, কাল গিয়ে বরং ওদেরকে বাড়ি নিয়ে এসো। ঘরের বউ ঘরে থাকবে এটাই তো সুন্দর, তাই না? কেন শুধু শুধু পরের বাড়িতে থাকবে!”
আলিফ তখন আর কোনো জবাব দিল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাবের অপেক্ষা করলো মাইসারা। কিন্তু ভাইয়ের নীরবতা দেখে বলল,
-“কবে নিয়ে আসবে বলো?”
-“আনবো সময় হলেই। আমার বাচ্চাকে তো আমি আনবোই। তবে তোর ভাবীকে আনবো না।”
ঠিক তারপরই লাইন কে’টে গেল। হতাশ হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো মাইসারা। কাকে, কীভাবে বুঝাবে কোনো আইডিয়া নেই তার। তবে যে করেই হোক, ভা’ঙ’ন আটকানোর চেষ্টা তাকে করতেই হবে। আলিফের জবাব পেলেও ফারজানার কোনো জবাব সে পায়নি। বুঝতেও পারলো না, কেন ফারজানা তার ফোন রিসিভ করছে না! সে তো কোনো দোষ করেনি! তবে? তার উপর কীসের এত রাগ তার? শুধু কি সম্পত্তির জন্যই? বেঁচে থাকার জন্য সম্পদটাই খুব প্রয়োজন কারো কারো কাছে? হবে হয়তো। নয়তো বিনা অপরাধে সে কেন কারও দুশ’মন হয়ে গেল?
কাঠফা’টা রোদে তৃষ্ণার্ত পথিক যেমন একটুখানি ছায়া আর বৃষ্টির জন্য পিপাসার্ত হয়ে দিকবিদিক ছোটাছুটি করে, দুঃসময়ে একফোঁটা পানি যার জন্য আত্মতৃপ্তি নিয়ে আসে; ঠিক তেমনি হাজারও উৎকণ্ঠা, ব্যথা-বেদনার সময়ে তৃষ্ণার্ত পথিকের মনে তৃপ্তির হাসি ফুটাতেই বোধহয় অসময়ে বাড়ির আঙিনায় পরিচিত মানুষের আগমন ঘটলো! বুকের ভেতর যতখানি যন্ত্রণার জন্ম নিয়েছিল, অনুশোচনা আর ন্যায়-অন্যায়ের অ’স্ত্র হিসেবে বিবেক যখন তাকে প্রতিনিয়ত নীরবে চাবু’কের আঘা’তে খণ্ডবিখণ্ড করে দিচ্ছিলো, তখনই চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া মনে প্রশান্তির একমুঠো সুখ নিয়ে হাজির হলো কেউ! আশ্চর্যের প্রতিটা রেখা ফুটে উঠলো তার চেহারার। বিশ্বাস, অবিশ্বাসের হিসাবে সে বরাবরই কাঁচা। তাই হুট করে এই আগমন অবিশ্বাস্যই ঠেকলো। যখন তার ইন্দ্রিয় জানান দিল, নাড়িছেঁড়া ধন তার কোলে ফিরে এসেছে তখনই নীরব আর্তনাদে বুক ভাসিয়ে দিল ফারজানা। অনেকক্ষণ ছেলেকে আঁকড়ে ধরে যন্ত্রণাটুকু উপশমের সামান্য চেষ্টা করতে লাগলো। অনিক উঠোন থেকে ভেতরে এসে সোজা তার মুখোমুখি দাঁড়ালো। ঔষধপত্র ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-“হুট করেই জ্বর চলে এসেছে! সাবধানে রেখো।”
ফারজানা মাথা নেড়ে ছেলেকে নিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল। বিছানায় শুইয়ে প্রথমে জ্বর চেক করলো। তখনো তার উত্তপ্ত শরীর বলছে, জ্বর খুব বেশিই। নিজের উপরই রাগ হলো তার। আজ তার সামান্য ভুলে ওইটুকু বাচ্চা কষ্ট পাচ্ছে। ভেতর নিংড়ে অনিকের জন্য প্রার্থনা বেরিয়ে এলো, তবে তা মুখে প্রকাশ করলো না। অনুতপ্ত মনের গোপন জায়গাতেই উপলব্ধিটাকে আটকে দিল সে। ফারহানের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলছিল অনিক! কী করবে, কীভাবে করবে, সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সমাধান নিয়ে আলোচনা করছিল। ঠিক তখনই ভদ্রমহিলা এসে অনিকের সামনে দাঁড়ান। তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অগোচরে নিজের রাগকে হাজারও চেষ্টায় দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না। চিৎকার করে বললেন,
-“খুব তো বাহাদুরি দেখিয়েছিল তোমার ভাই। রাখতে পারলো না কেন? সেই তো বাচ্চা নিয়ে ফিরে আসতে হলো! রাখতেই যদি পারবে না, তবে এত নাটক সাজিয়েছিল কেন? মা ছাড়া সন্তান লালন-পালন করা কি চাট্টিখানি কথা!”
অনিক তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিল না। মুরব্বি মানুষ, কথার সাথে কথা জড়িয়ে তর্কে যাওয়া উচিত হবে না। সমস্যা যাদের নিয়ে তৈরী হয়েছে, সমাধানে তাদেরই প্রয়োজন। কোনো তৃতীয় ব্যক্তির সাথে তর্কবিতর্ক করে সম্পর্ক নষ্ট করার প্রয়োজন দেখছে না সে। অনিকের নীরবতা দেখে তিনি আরও সাহস পেয়ে গেলেন। চেহারার কাঠিন্যতা বজায় রেখে বললেন,
-“তোমার ভাইকে বলো, বেশি বাড়াবাড়ি যেন সে না করে! ফের যদি বাচ্চা নিয়ে এসব ঝামেলা সে তৈরী করে তবে আমরা কোর্টে যেতে বাধ্য হবো।”
বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো অনিক। ত্বোয়াও চুপচাপ। তার আসলে কিছু বলার নেই। যেখানে অনিক দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে সে বাড়তি কথা বলে কেন অপরাধ নিজের মাথায় নিবে। তবুও চুপ থাকতে পারলো না সে। বলল,
-“ছোটো ভাইয়াকে ওসব বলে লাভ নেই আন্টি। ভাইয়া তখন বাড়িতে ছিল না। আপনার যদি কিছু বলার থাকে, বড়ো ভাইয়াকে বলবেন। চলো ভাইয়া উঠি, এখানে অযথা সময় নষ্ট করে লাভ নেই!”
এখানে বেশিক্ষণ থাকা মানে অযথা তর্কাতর্কি টে’নে আনা সেটা বেশ বুঝতে পারলো অনিক। তর্কে গিয়ে ফায়দা নেই, উলটে মুরব্বি মানুষটার উপর রাগ ঝাড়া। আপাতত এসবে দৃষ্টি নেই তার। নাহিয়ান সুস্থ হোক, এটাই চাওয়া। তাই সোজাসাপটা উঠে দাঁড়ালো। ফারহানকে বলল,
-“সুস্থ হওয়ার পর ফোন দিও। যাবতীয় আলাপ, আলোচনা নাহয় তখনই হবে।”
দু’জনে যখন উঠে দরজা পর্যন্ত চলে আসলো তখনই পিছন থেকে ফারজানা তাদের আটকে দিল। চা-নাশতা এনে টি-টেবিলে রেখে বলল,
-“কিছু তো মুখে দিয়ে যাও ভাই! এভাবে খালি মুখে…!”
হাসার চেষ্টা করলো অনিক, কিন্তু কোথাও মাতৃতুল্য ভাবীর উপর অভিমান এসে ভর করলো। বলল,
-“ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেছে ভাবী! যেদিন ফিরে যাবে সেদিন যদি কিছু খেতে বলো মানা করবো না। কিন্তু এই মুহূর্তে গলা দিয়ে কিছু নামবে না। জানি না কেন, কী কারণে বদলে গেলে তুমি? আমাদের পরিবারে কি সুখের অভাব ছিল? হাসি-আনন্দেই তো কাটছিল সময়, তবু কেন এই নীরব রে’ষারে’ষি? যদি এর পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা তুমি দিতে পারো, যদি আবারও নিজেকে আমাদের ঘরের একজন তৈরী করতে চাও তবে মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনো। আগে যেভাবে ঘর-সংসার আগলে রেখেছিলে, কোনো দ্ব’ন্দ্ব, হিং’সা-বিদ্বে’ষ ছাড়া, সেভাবেই আগলে নাও না প্লিজ!”
ফারজানা কোনো কথা খুঁজে পেল না। অনিক আবারও বলল,
-“সুখের সংসারে আগু’ন কখন লাগে জানো? দু’জন সুখী দম্পতির মাঝখানে যখন তৃতীয় ব্যক্তি চলে আসে! তোমাদের মাঝখানেও সেই তৃতীয় ব্যক্তিরই আগমন ঘটেছে! হয় জেনে-বুঝে ঘটিয়েছো, নয় না জেনে। কিন্তু যাই করো, ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। তোমার একটা ভুল নাহিয়ানের জীবনটা বি’ষিয়ে দিবে। যেমনটা সারার জীবন এলোমেলো হয়েছিল, তেমনটা এই বাচ্চার জীবনও এলোমেলো হবে। আর কিছু না হোক, অন্তত নিজের সন্তানের জন্য বুঝে কাজ করো। আমি বলবো না তুমি দো’ষী কিংবা তুমি নির্দোষ এ-ও প্রমাণ করতে চাইবো না। নিজেরটা তো পাগ’লেও বুঝে। আশাকরি তুমিও বুঝবে।”
এরকম কথার পরে আর কোনো উত্তর দেয়া যায় কিনা জানা নেই ফারজানার। আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেললো! সংসারটা স্বর্গই ছিল একদিন, নিজের ভুলে সেই স্বর্গ থেকে বিতাড়িত সে। যেখানে ননদ, দেবর কেউ-ই কোনোদিন কথা কাটাকা’টি করেনি, অপরাধী জেনেও কোনো প্রকার নালিশ দেয়নি, সেখানে তাদের উপর অহেতুক অবিচার করে কোনো জবাবের মাধ্যমে পা’প থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না! আজ তার মুক্তি নেই, সে দিব্যি বুঝতে পারছে। অপরাধবোধ আর লজ্জায় মাথা নুইয়ে আসছে তার। অনিক জবাবের অপেক্ষা করলো না অবশ্য, তার বিস্মিত চোখকে উপেক্ষা করে ত্বোয়াকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল!
*****
কুসুম গরম পানিতে ছোট্ট কাপড় ভিজিয়ে তা ছেলের মাথায় রেখে দিল ফারজানা। কিছুক্ষণ পর পর এভাবে জলপট্টি দিয়ে তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা করলো! হুট করেই মেয়ের ঘরে প্রবেশ করলেন ভদ্রমহিলা। মেয়ের এমন আহ্লাদ, আদর দেখে ঠোঁট বাঁ’কালেন। বললেন,
-“এত আদিখ্যেতা আমার এখানে করিস না! যেদিকে পারিস চলে যা। আমার ওতো টাকা-পয়সা নেই, ঘাড়ে দুটো বো’ঝা নিয়ে ঘুরবো।”
মায়ের হুটহাট এই পরিবর্তনে মনে ভীষণ আঘা’ত পেল ফারজানা। জবাব দেয়ার আগেই দু’গাল চেপে ধরলেন তিনি। বললেন,
-“মাথায় একটুও বুদ্ধি নেই। এখন যে বাচ্চা নিয়ে পথে নামলি, তার কী হবে! কে দেখবে এখন তোকে? জানিস না, এই ঘরে বাড়তি আয় হয় না। তোর ভরণপোষণের দায়িত্ব কে নিবে? ঘা’টের ম’রা, সব এখানেই এসে পড়লো।”
ব্যথায় আর্ত’নাদ করে উঠলো ফারজানা। এমনিতেও মনটা ভালো নেই। তার উপর মায়ের এই অনাকাঙ্ক্ষিত রূপ। মনের কোথাও বেজে উঠলো একই কথা। যা সে খুব নীরবে ঠাণ্ডা মাথায় মাইসারাকে শুনিয়েছিল। ভাইয়ের টাকায় খেতে হলে কি বোনকে কৈফিয়ত দিতে হয়? বোনেরা কি ভাইদের দায়িত্বে পড়ে না? কেন তারা বাড়তি বো’ঝা হয়? নিজের পা’পের শা’স্তি পাচ্ছে, এটা উপলব্ধি হতে বিন্দুমাত্র দেরী হলো না ফারজানার। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বলল,
-“আমার টাকাগুলো দাও! আমি তোমার বাড়িতে আর এক মুহূর্তও থাকবো না।”
ভদ্রমহিলা শুকনো ঢুক গিললেন। কীভাবে দিবেন এখন টাকা! ওসব টাকা তো তিনি সু’দের কাজে ব্যবহার করেছেন! কেউ পাঁচ’শো টাকা ধার চাইলে ফেরত নিতেন ছ’শো টাকা। এভাবে তো অনেকগুলো টাকাই তিনি খরচ করে ফেলেছেন। বাকি যা ব্যাংকে আছে তা তো নিজের নামে। কোথাও তো তিনি মেয়ে কিংবা নাতির নামে টাকা জমাননি! আমতা আমতা করে বললেন,
-“আমার কাছে কোনো টাকা নেই। সব টাকা খরচ হয়ে গেছে!”
মনে হলো হাজার টনের একগাদা বাঁশের বাড়ি এসে মাথার উপর পড়লো তার। বিস্মিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমার এতগুলো টাকা তুমি কীভাবে খরচ করতে পারো? দু’বছরে দু’লাখেরও বেশি টাকা দিয়েছি আমি তোমাকে। আমার টাকা আমায় ফেরত দাও, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে চলে যাব।”
-“যাওয়ার হয় যা, কোনো টাকা-পয়সা পাবি না। ওসব অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। পরের বোঝা হয়ে না চেপে নিজের রাস্তা মাপ!”
-“এই ছিল তোমার মনে? আসল রূপ দেখিয়ে দিলে তবে? যে মানুষগুলোকে তোমার জন্য, তোমার কথায়, খেতে পরতে কথা শুনিয়েছি সে মানুষগুলো এখনো চায়, আমি যেন ফিরে যাই। সেখানে তুমি তোমার মেয়েকে বো’ঝা ভাবছো! আমি তো জানতাম সারার মা খারাপ। এখন তো দেখছি আমার মা-ও ভালো নয়। পৃথিবীতে কেউ-ই ভালো হয় না। যারা ভালো হয়, তাদের সাথেই অন্যায় হয়! তোমার কথায় ওদেরকে ঘরছাড়া করতে চেয়েছি, বুঝিনি আমিই আজ আশ্রয়হীন হয়ে যাব।”
ফারজানা সবকিছু গুছিয়ে অসুস্থ নাহিয়ানকে কোলে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলো। তাদের দু’জনার এই তর্কাতর্কি এতক্ষণ ফারহান শুনলেও কোনো জবাব দেয়নি। এখন আর চুপ থাকতে পারলো না সে। ফের নাহিয়ানকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে বলল,
-“যতদিন না ঝামেলা মিটছে তুই এখানেই থাকবি! খাওয়াপরা নিয়ে আমি তোকে কখনো খোটা দেইনি, আর দিবও না। কে কী বললো, কী করলো তা নিয়ে মাথা ঘামাস না। এই সমাজে এখনো অনেক মা আছে, যারা নিজেরা কুমন্ত্রণার জা’লে ফেলে অন্যের সুন্দর সংসার নষ্ট করে দেয়। তোকে আগেই বুঝিয়েছি, তুই বুঝিসনি। এখন দেখলি তো, সব মায়েরা তোর শাশুড়ি মায়ের মতো নয়। কিছু মা ডা’ইনীর চেয়েও কম যায় না। এই মা’কে তো আমি চিনি, তাই চাইলেও শা’স্তি দিতে পারি না।”
-“আমার ভুল হয়ে গেছেরে ভাই! অনেক বড়ো ভুল হয়েছে। এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আমি কীভাবে করবো! ম’র’লেই বোধহয় সব পা’প মুছে যাবে।”
ফারহান বোনকে শান্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভদ্রমহিলা আর সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন না। কার্যসিদ্ধি তিনি আগেই করেছেন! মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনেকটা টাকা হাতে আনতে পেরেছেন। এখন যদি ছেলে তার দায়িত্ব না নেয়, তাতেও অসুবিধা নেই। তিনি ঠিকই খেয়েপড়ে বাঁচতে পারবেন। সুযোগ সন্ধানী মানুষ যেমন, অন্যের অনিষ্ট করে নিজের সুখ খুঁজে নেয়, তিনিও সেই দলেরই একজন। ফারহান সব বুঝেও জবাব দিতে পারে না। তার কাছে তো মোটা অংকের টাকা নেই, নেই অর্থবিত্ত আর প্রাচুর্যের অহংকার! যা আছে তা নিরেট সততা। প্রয়োজনে নিজে না খেয়ে বোনকে খাওয়াবে, তবুও কখনো বো’ঝা ভাববে না।
*****
পারিবারিক এই দ্ব’ন্দ্ব আর ঝামেলায় বড্ড অশান্তিতে পড়েছে অনিক। চুপ থাকা যাচ্ছে না, আবার ভাইয়ের বিরুদ্ধেও যাওয়া যাচ্ছে না। যুক্তির এটাই যে, ফারজানাকে অনুতপ্ত হতে দেয়া। যদি সে ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসে তবে আলিফ কোনোভাবেই তাকে ফিরিয়ে দিবে না। এদের দু’জনের ভালোবাসার গভীরতা তার দিব্যি জানা আছে। সহ্যের সীমা যখন ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তখনই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। একরকম বাধ্য হয়েই ভালোবাসার মানুষটিকে ঘরছাড়া করেছে তার ভাই।
রাত্রি তখন গভীর। এপাশ-ওপাশ করেও ঘুম আসছে না অনিকের। নানারকম দুঃশ্চিন্তা, ব্যথা-বেদনা ভর করছে মনে। এই সময়ে কাছের মানুষটাকে বড্ড প্রয়োজন হয়। অস্থির, অশান্ত মনকে সান্ত্বনা দিতে প্রিয়জনের সান্নিধ্য খুব বেশিই জরুরী। এই মুহূর্তে সে-ও প্রিয়জনের অভাব টের পেল। এত সমস্যা, এত দ্ব’ন্দ্বের ভার আর নেয়া যাচ্ছে না। শান্তির ঘুম দরকার, বিশ্রাম দরকার, অথচ তার সেটাও নেই আজকে। অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করেও ঘুমকে দু’চোখে টে’নে আনতে পারলো না। বুকের ভেতর ফাঁকা অনুভব করলো সে। মনে হলো, এই ফাঁকা জায়গাটায় যদি কেউ মাথা রাখতো তবে হয়তো শান্তিতে ঘুমোতে পারতো। অসময়ে মাইসারাকে বিরক্ত করতেও ইচ্ছে করছে না। সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করে মেয়েটা নিশ্চয়ই ক্লান্ত!
নানা ভাবনার জা’ল ছিঁড়’লো ফোনের হুটহাট রিংটোনে। হাত বাড়িয়ে ফোন কাছে এনেই থমকে গেল দৃষ্টি। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো রাত প্রায় দুটো। এতরাতে মাইসারার ফোন! কোথাও কোনো বিপদ হলো না তো! এমনিতেও যা পরিস্থিতি, তাতে মন ভালো কিছু ভাবতেই পারছে না। বুকের ভেতর কাঁপন শুরু হলো তার। ঝটপট তা রিসিভ করে বলল,
-“তুই ঠিক আছিস সারা? কোথাও কোনো অসুবিধা হয়নি তো! আমি কি আসবো?”
এমন আবেগঘন কথা আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে ওপাশে নীরব হয়ে গেল মাইসারা। মাত্রই ও.টি শেষ করে এসেছে। সারাদিনে অনিকের সাথে কথা হয়নি আর। হসপিটালে এতটাই ব্যস্ততা যে কাছের মানুষদের খোঁজ নেয়ারও সময় পাওয়া যায় না। নিজের জন্যই দু’দণ্ড সময় মিলে না, আবার অন্যের জন্য সময় বের করে তার খোঁজখবর নেয়া! দায়িত্ব, কর্তব্য হোক কি সম্পর্কের সম্মানেই হোক মাইসারার মনে হলো, কাজের ফাঁকে হলেও দু’মিনিটের জন্য এই মানুষটাকে কল করা উচিত ছিল তার। যদি সময়ে সময়ে খোঁজ-খবর নিত তবে অসময়ের এই ফোন তাকে ঘাবড়ে দিত না। অনিকের মনের অবস্থা যেন মুহূর্তের আয়ত্তে আনলো সে। ফোন কানে ঠেকিয়েই বলল,
-“আমি একদম ঠিক আছি। সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাই আর ফোন করতে পারিনি। এইমাত্র ফ্রি হলাম। তাই ভাবলাম, রাতে খেয়েছো কিনা খোঁজ নেই!”
যত দুঃশ্চিন্তা মনের ভেতরে এসে হুট করেই ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়েছিল, মাইসারার এই সামান্য কথাতে সব দুঃশ্চিন্তা ঝ’ড়ো হাওয়ার মতো সুদূরে পালিয়ে গেল। ফোন কানে রেখে পিঠে বালিশ ঠেকালো অনিক। বিড়বিড় করে বলল,
-“ঘুম আসছে না সারা! অনেকক্ষণ ধরে জেগে আছি। শূন্যতা এসে ভর করেছে বোধহয়। কেউ যদি মাথায় বুলিয়ে দিত, ঘুম পাড়িয়ে দিত, হয়তো একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারতাম। অথচ সেই কেউ’টাই অনেক দূরে! এতটাই দূরে যে, চাইলেও ছুটে যাওয়া যাবে না। কাছে টানা যাবে না, আগলে নেয়া যাবে না। দূরত্বের কাছে অনুভূতিগুলো হেরে গেল তাই না!”
-“তুমিই তো বলেছিলে, এই দূরত্বটা ক্ষণিকের! একদিনেই যদি এই অবস্থা হয়, তবে এতগুলো মাস আমি এখানে থাকবো কী করে?”
অনিক জবাব দিল না। তখন বুঝেনি, এই মেয়েটা আর অস্তিত্বে কতখানি মিশে আছে। তার নীরবতা দেখে ওপাশে আলগোছে চোখের পানি মুছলো মাইসারা। এই মানুষটা তাকে এতটাই ভালোবাসে যে, তার কোনো সীমা পরিসীমা সে খুঁজে না পেলেও অনুভূতির গভীরতা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছে। কণ্ঠ নামিয়ে শান্তস্বরে বলল,
-“রাত জেগো না, অসুস্থ হয়ে পড়বে!”
-“তোকে খুব মিস করছি সারা।”
-“যে মনের গভীরে থাকে, তাকে তো মানুষ সবসময়ই মিস করে! আমি খুব ভাগ্যবতী যে তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। যখন তুমি আমার ভরসা হয়েছো, আমাকে এতটা দূরে সরিয়ে গন্তব্য স্থির করে দিয়েছো, তখন আমাকে দুর্বল করে মাঝপথে সব থামিয়ে দিবে? এভাবে চলতে থাকলে এখানে থাকা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে।”
-“আচ্ছা, রাখছি। ঘুম প্রয়োজন।”
-“রাগ করলে?”
অভিমানে যে কথাখানি বলে ফোন রাখতে চেয়েছিল অনিক, মাইসারার কথা শুনে তা আরও দ্বিগুণ হয়ে চাপলো বুকে। কথার কোনো জবাব না দিয়ে ফোন কে’টে দিল সে! ওপাশে মাইসারা থমকে গেল অনিকের এমন আচরণে! যে মানুষটা সামনে থাকা সত্ত্বেও আবেগকে প্রশ্রয় দেয়নি, অনুভূতি প্রকাশ করেনি, দূরে আসাতে সেই মানুষটাই এখন ছেলেমানুষী করছে। মানুষের মন বড্ড অদ্ভুত, ক্ষণে ক্ষণে অস্থির হয় আবার শান্তও হয়। মাইসারার মনে হলো, অনিককে শান্ত করার জন্য ছোট্ট একটা কথা বলা জরুরী। এইভেবে পুণরায় ফোন করলো সে। অভিমানে প্রেমিক তার মনকে শক্ত করে নিয়েছে, তাই ফোন করে নিজেকে আর দুর্বল প্রমাণ করবে না সে। যথাসম্ভব ইগনোর করে ফোন সাইলেন্ট করে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। খেয়াল করলো না, অর্ধাঙ্গিনী তাকে স্বান্তনা দিতে কী চমৎকার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছে। অভিমান তার এতটাই গাঢ় হলো যে, ভুল করেও ফোনের দিকে হাত বাড়ালো না আর। নয়তো এই ম্যাসেজটা শত যন্ত্রণা আর অশান্তির একটুখানি প্রশান্তি হতে পারতো! বুঝতে পারতো, শুধু একাই সে বিরহকে সঙ্গী করে সময় অতিবাহিত করছে না, ওপাশের মানুষটাও নিঃসঙ্গ মুহূর্তটাকে উপেক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে!
আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস–
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস ।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো অনিকের। মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখতে গিয়েই চোখদুটো কুঠরে ঢুকে গেল তার। বেশ কয়েকবার ম্যাসেজের উল্লিখিত লাইনগুলো আওড়ে গেল। বাংলায় বিরহের কোনো ঋতু আছে কি? নির্দিষ্ট কোনো ঋতু? যা শুধু দুঃখজনক অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। ক্যালেন্ডারের পাতা অনুযায়ী তো এখন বর্ষার সিজন। বৃষ্টিবাদলের দিনে কোথায়, বাদলা দিনের একগুচ্ছ কদমফুল কিংবা কৃষ্ণচূড়ার রাঙা লাল টুকটুকে রঙ মেখে এক লাইন, দুই লাইন রোমান্টিক ছন্দ সাজাবে; তা না করে একরাশ বিরহ প্রকাশ করে দুটো লাইন লিখেই বুঝিয়ে দিল, সদ্য প্রেমে পড়া তরুণী প্রেমে পড়ার পরপরই বিরহে নিপতিত হয়েছে। তার বিরহের ঔষধ যে, তাকেই ছন্দ পাঠিয়েছে। যেন সে বুঝতে পারে, সময়টা নিঃসঙ্গ কাটছে। মনের অজান্তেই বিড়বিড় করলো অনিক,
-“আমার বউটা পাগ’ল হলো কবে?”
হুট করেই দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো মাথায়। সকাল সকাল মাইসারাকে ক্ষ্যা’পিয়ে দিতে পারলে মন্দ হয় না। দেরী না করে দ্রুত ডায়াল করলো প্রিয়তমার নাম্বারে। খানিকক্ষণ বাজার পরই রিসিভ হলো তা। ঘুম ঘুম চোখেই সালাম দিয়েই আটকে গেল মাইসারা। মুখের উপর জবাব দিয়ে ঝটপট বলল,
-“এখানে সারা নামে কেউ থাকে? নিশ্চিত মেয়েটার মাথার স্ক্রু সব ঢিলা হয়ে গেছে। নয়তো প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি জন্মানোর আগেই বিরহ এসে মনে ভর করলো কেন?”
রীতিমতো শকড হলো মাইসারা! সকাল সকাল এই ছেলেটা তাকে পাগ’ল সাজিয়ে দিল। চোখ টেনে টেনে ঘুম ঘুম ভাবটাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলো সে। অনিক আবারও বলল,
-“এইযে হ্যালো, যিনি ফোন রিসিভ করেছেন তাকে বলছি, আমার বউয়ের যদি ঘুম ভা’ঙে তাকে বলে দিবেন, ভুল করেও এমন বিরহমার্কা ম্যাসেজ যেন সে আর না পাঠায়। নইলে সোজা তুলে নিয়ে আসবো। আর দূরে পাঠাবো না।”
মাইসারা টের পেল তার কানে ভোতা ভোতা শব্দ হচ্ছে। একেই তো রাতে ভালো ঘুম হয়নি, তার মধ্যে সকালবেলাই এমন রম্যরচনার সূচনায় কথার খেই হারিয়ে ফেললো সে। চুপচাপ বসা ছাড়া কোনো জবাবও খুঁজে পেল না। অনিক ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বলল,
-“কী হলো, কথা আটকে গেল কেন?”
-“তোমার বউয়ের ঘুম পাচ্ছে। আপাতত সে আধোঘুমে কথা শুনছে। উল্টোপাল্টা কথার ধরন দেখে সে বুঝে গেছে, বিরহের চাপে পড়ে তোমার বউ না তোমারই মাথার স্ক্রু সব খুলে গেছে। আমারটা তা-ও ঢিলা হলেও খসে পড়েনি। ঠিক জায়গায়ই আছে!”
-“বাপরে! রাগ তো দেখি নাকের ডগায় নিয়ে ঘুরছিস! এমনভাবে রাগ ঝাড়ছিস যেন কোনো পরপুরুষকে ইচ্ছামতো ধুয়ে দিচ্ছিস!”
-“উল্টোপাল্টা কথা বলে রাগটা তুমিই বাড়িয়ে দিয়েছো। সকাল সকাল মাথা ন’ষ্ট!”
-“আচ্ছা, তাহলে রাগ ভা’ঙাবো কীভাবে? কোনো ওয়ে আছে? থাকলে বল, দেখি চেষ্টা করে!”
-“রাতে মুখের উপর ফোন কে’টে দিয়েছো, সেজন্য খুব রেগে আছি৷ এখন একদফা বকাঝকা করে মেজাজ ঠাণ্ডা করবো। আপাতত কানে তুলো দিয়ে বকা শুনো। মেজাজ ভালো হলে পরে বাকি কথা হবে!”
-“শা’লা’র এমন একটা বউ জুটলো কপালে, দুই লাইন রোমান্টিক কথা বলে মুহূর্তটা সুখে ভরিয়ে দিবে, তা নয় সে এখন বকা দেয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছে। তুই থাক তোর বকাঝকা নিয়ে, আমি অফিস গেলাম। সারাদিনে আর একবারও বিরক্ত করবি না।”
শুরু হলো ননস্টপ ঝগড়া। অফিস যাবে বলে ফোন রাখতে চেয়েও কানে চেপে কথার ফুলঝুরি খুলে বসলো অনিক। একজন আরেকজনকে ইচ্ছামতোই কথা শুনাচ্ছে। কেউ হার স্বীকার করতে রাজি নয়। দু’জনের মতে, দু’জনার দোষ। একা একজন কেন দোষের ভাগিদার হয়ে ভুক্তভোগী হবে। তার চেয়ে হা’ড্ডাহা’ড্ডি লড়াই চলুক, যথা সময়ে দেখা যাবে বিজয়ীর খাতায় কার নাম যোগ হলো!
*****
নাহিয়ান মোটামুটি সুস্থই বলা চলে। জ্বর নেমেছে পুরোপুরি তবে শরীরের দুর্বলতা কমেনি। অল্পকিছু খাবারও ঠিকঠাক খেতে পারছে না। যা খাচ্ছে, বমির সাথে সবকিছুই উগড়ে দিচ্ছে। আগের তুলনায় নিশ্চুপ হয়ে গেছে সে। বাবা-মায়ের ঝগ’ড়াঝাটি আর মান-অভিমানের সন্ধিক্ষণ কিঞ্চিৎ হলেও তার ছোট্ট মনকে প্রভাবিত করেছে। গুটিসুটি মে’রে বিছানার মাঝখানে শুয়ে রয়েছে। ফারজানা পাশে বসেই ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। একটা সময় মায়ের দিকে তাকালো নাহিয়ান। অভিযোগের সুরে বলল,
-“বাড়ি চলো আম্মু। এখানে ভালো লাগছে না।”
বুকফাটা আর্ত’নাদ ঝেঁকে বসলো তার অন্তর জুড়ে। তবু কাঁদতে পারলো না, কিছু বলতেও পারলো না। আলতো করে ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-“যাব! তুমি সুস্থ হও, তারপর।”
-“এখানে তো আমার ভালো লাগছে না। নানু সারাক্ষণ তোমাকে ব’কে। বাবার কাছে থাকলে কেউ তোমাকে বকবে না আর। চলো না আম্মু, যাই।”
-“তুমি তো এখন অসুস্থ সোনা, আগে সুস্থ হও। বাবা এসে নিয়ে যাবে তোমাকে।”
ফারজানার মনে হলো, এই মুহূর্তে মিথ্যে স্বান্তনাটাই ছেলেকে চুপ করানোর একমাত্র মাধ্যম। সে যেতে চাইলেও আলিফ যে পুনরায় তাকে গ্রহণ করবে তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। যতখানি অন্যায় সে করেছে সবার সাথে তার শোধ না তুলে, পর্যাপ্ত শা’স্তি না দিয়ে মুখও দেখতে চাইবে না। কী সুন্দর জীবন ছিল তার! হাসিখুশি সংসার ছিল! ছিল সে জীবনে চাওয়ার চেয়েও অতিরিক্ত পাওয়া। তবুও সে তার মূল্য দিতে পারলো না। গোটা জীবন সবার অভিশা’প, লাঞ্চনা আর অপ’মান নিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে তাকে। এখন তো পাড়াপ্রতিবেশি কেউ কিছু জানে না, যখন জানবে ধীরে ধীরে তার প্রত্যেকটা তীক্ষ্ণ কথার আঘা’ত এসে নাহিয়ানের ছোট্ট মনকে বি’ষিয়ে দিবে। তাছাড়া সুস্থ হওয়ার পরই যদি আলিফ তার বাচ্চাকে জো’র করে নিয়ে যেতে চায়, তখন সে কী করবে? সবকিছু ছেড়ে দেয়া যায় কিন্তু মা হয়ে নাড়িছেঁড়া ধনকে কীভাবে ছাড়বে সে? পারবে না তো এই কঠিন সত্যির মুখোমুখি হতে। এসব ভুলভাল ভাবতে ভাবতেই অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত নিল ফারজানা। নিজের সুক্ষ্ম চিন্তাভাবনা নিজের কাছেই গচ্ছিত রাখলো সে। আপাতত নাহিয়ান সুস্থ হোক, পরবর্তী পদক্ষেপ সে পরেই নিবে। এখন কোনো তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই। আগে দেখবে নাহিয়ান সুস্থ হওয়ার পর আলিফ ঠিক কতটা ছটফট করে তার বাচ্চার জন্য।
স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করছে আলিফ। ত্বোয়া সেই তখন থেকে ভাইকে লক্ষ্য করছে। কারও সাথে কথা বলছে না, কাউকে নাহিয়ান কিংবা ফারজানার কথাও জিজ্ঞেস করছে না। হাঁটতে হাঁটতেই একটা সময় পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলো সে। ফোনের গ্যালারি ওপেন করে নাহিয়ানের দুষ্টু মিষ্টি সবক’টা ছবিতে চোখ বুলালো। এমন হাসি হাসি মুখ দেখলে যে কারও অন্তরে প্রশান্তির বাতাস বয়ে যাবে। আর সে যদি হয় রক্তের টান, তবে তো কথাই নেই। দূর থেকে ত্বোয়া আবিষ্কার করলো, ক্ষণে ক্ষণে চোখের জল মুছছে আলিফ। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে তার, হাসিখুশি থাকা মানুষটাও আজ প্রিয়জনদের শূন্যতাতে কাঁদতে বাধ্য হচ্ছে। সাহস নিয়ে দু’পা এগিয়ে গেল সে। পুকুরপাড় চারপাশটাই পাকা, বসবার সিঁড়ি আর ব্রেঞ্চও আলাদা ইট-সিমেন্টের তৈরী৷ এখানে বসে প্রকৃতির এক সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। দু’চোখে মুগ্ধতা খুঁজে নেয়া যায়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাইয়ের পাশে বসে রইলো সে। আলিফ টের পেল না প্রথমে, পরক্ষণেই চোখ পড়তেই ঝটপট নিজেকে সামলে নিল। মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে রেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
-“কিছু বলবি?”
-“নাহিয়ানের সাথে কথা বলছো না কেন! ওর তো কোনো দোষ নেই। বিনা দোষে বাচ্চাটা শা’স্তি পাচ্ছে ভাইয়া। নিয়ে এসো দু’জনকে। এভাবে ঘরের বউ পরের বাড়িতে কয়দিন থাকবে? যতই বলো, এই বাড়িটাই ভাবীর সবকিছু। একটা সময় তো ভাবী সব দায়িত্বই ঠিকঠাক পালন করেছে। মানুষ তো ভুল করে, হয়তো সে-ও না বুঝে ভুল করেছে। সবকিছু ভুলে আবারও ঘরটাকে আগের মতো করে নাও-না। ঘরটা কেমন প্রাণহীন ধুধু মরুভূমির মতো হয়ে গেছে। এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে, প্রাণ থাকা সত্ত্বেও প্রাণী মৃ’ত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। আগের কথা ভেবে তার ভুলটা ক্ষমা করে দাও ভাইয়া। নিয়ে এসো ভাবীকে। ঘরের কর্ত্রী না থাকলে ঘর নিঃস্ব হয়ে যায়! প্লিজ…!”
নির্লিপ্ত চাহনি আলিফের। ভাবলেশহীন। নীরব, নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
-“ভাইয়ের থেকে ভাবীর প্রতি ভালোবাসাটা বেশিই প্রকাশ পাচ্ছে! অথচ তোর ভাবী তোদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতো।”
-“আমাদের তো তা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। কখনো নালিশও করিনি তোমার কাছে। তাকে সম্মান করি, ভালোবাসি দেখেই তার একটু একটু রাগ হজম করি। একটা সংসার সামলে রাখা অনেক কঠিন। হয়তো এই কঠিন চাপটা তার ভাবনাচিন্তার মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরী করেছে। যার কারণে ঠিক-ভুলের হিসাব না কষে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে। মাঝেমধ্যে আমিও তো ঝগ’ড়া বাঁধিয়ে ফেলতাম। সংসারে এমন টুকরো টুকরো ঝা’মে’লা হয়েই থাকে। তাই বলে সংসার ভে’ঙে দেয়া যুক্তিযুক্ত নয় ভাইয়া। তাকে বুঝাতে হবে, ক্ষমা চাওয়া কিংবা উপলব্ধি হওয়ার সময়টা তাকে দিতে হবে, কোনো সুযোগ না দিয়ে একতরফা অবিচার করো না তার উপর!”
আলিফ এবারও নিশ্চুপ। সবার চিন্তাভাবনা আর মতামতের যুক্তি সে দেখছে অথচ তার ভেতরটা কেউ দেখছে না। বিশ্বাস ভা’ঙার যন্ত্রণা সে কাকে বুঝাবে! কে বুঝবে সে ঠিক কতটা ভে’ঙে গুড়িয়ে গেছে প্রিয়জনের এই হুটহাট পরিবর্তনে। ফারজানার এই রূপ, এই আচরণ তার ভেতরে যতখানি ঝ’ড় তুলেছে, তার ক্ষ’তির পরিমাণটা কেবল সে-ই উপলব্ধি করছে; আর কেউ না।
*****
ব্যস্ততা পুরোপুরি ঝেঁকে ধরলো মাইসারাকে। সারাদিন ডিউটি করা, রোগীদের পিছনে সময় দেয়া, স্যারদের সাথে ফাঁকে ফাঁকে ও.টিতে যোগ দেয়া, নানারকম পেরেশানিতে সময় অতিবাহিত করছে সে। সময় যাচ্ছে তার হিসাবের দিন শেষ হচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু পারছে অনিকের খোঁজ নিচ্ছে। একদিন ফোন কিংবা ম্যাসেজ না করলেও দেখা যাচ্ছে রেগে বম হয়ে যাচ্ছে অনিক। মাঝেমধ্যে তার এই আচরণে ভীষণ হাসি পায় মাইসারার। সাহস করে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সময়ের যাতাকলে পি’ষ্ট হয়ে সে বুঝতে পারছে দূরত্ব কতখানি ব্যকুল করে মনকে।
ডিউটি শেষে রুমে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো মাইসারা! তখন কেবল সন্ধ্যা হয়েছে মাত্র। ব্যস্ত শহরের ছুটে চলা উপভোগ করছে সে। যান্ত্রিক এই শহরে রোজ রোজ কত মানুষের যাতায়াত চলে। কত মানুষ হাসে, কত মানুষ কাঁদে, কেউ ফিরে পায়, কেউবা হারায়, আবার কেউ একাকীত্বকেই আপন করে দিন অতিবাহিত করে। মানুষের চলাফেরার এই নিত্যনতুন দৃশ্য তাকে ভীষণ ভাবায়। বুঝতে শেখায়, কতকিছু উপলব্ধি করায়। একাকী ভাবনায় বিভোর ছিল সে। ফোনের অবিরত রিংটোন তাকে বুঝিয়ে দিল ওপাশের মানুষটার ধৈর্যের বাঁ’ধ ভে’ঙে যাচ্ছে। রিসিভ না করলে নির্ঘাত রাগ করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে। অনিকের এই বাচ্চাবাচ্চা কাণ্ডকারখানা ভীষণ আনন্দ দেয় তাকে। বুঝিয়ে দেয়, এক জীবন মানুষ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে গেলেও এই মানুষটা ভালোবেসে কখনও ক্লান্ত হবে না। রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে রীতিমতো আদেশ করলো অনিক। চড়াগলায় বলল,
-“আমি রোজ ভিউ’তে আছি। আধঘণ্টা সময় দিলাম। দ্রুত তৈরী হয়ে চলে আয়!”
-“মানে!”
বিস্মিত চোখে প্রশ্ন করলো মাইসারা। সে এখনো অনিকের কথা বুঝতে পারছে না। এই ভর সন্ধ্যে বেলায় পাগ’ল প্রেমিক সিলেট চলে এসেছে! এই ব্যাপারটা মাথায় পুরোপুরি ঢুকছে না তার। হজম করতেও বেশ খানিকটা বেগ পেতে হলো তাকে। অনিক আবারও বলল,
-“আসবি কি না? না আসলে বল তুলে নিয়ে আসি! পরে যদি লোকজন কিডন্যা’পার ভাবে বাঁচানোর দায়িত্ব কিন্তু তোর। অসময়ে নিজের মানুষকে চুরিডা’কাতি করতে চাইছি না।”
মাইসারার মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। মাত্র কয়েকটা দিনে এরকম পাগ’লামি করতে পারে অনিক, সেটা ভাবেওনি আগে। এই মুহূর্তে হোস্টেল থেকে বের হওয়াটাও তো মুশকিল। তার নীরবতা দেখে রেগে গেল অনিক। বলল,
-“আসবি না তো? ঠিক আছে। আসতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি। ভাবলাম দুটো দিন ছুটি পেলাম যখন, তখন এই সময়টা একসাথে উপভোগ করি। কিন্তু তুই তো বিরাট ব্যস্ত! ব্যস্ত ডাক্তারদের কারও জন্য দু’মিনিট সময় আছে নাকি। তুই এখনো অতীত থেকে বেরোতে পারিসনি তাই না? আমি এত চেষ্টা করছি সবকিছু স্বাভাবিক করার তা-ও পারছিস না! তোকে আর পারতে হবে না সারা।”
এ পর্যায়ে চুপ করে গেল অনিক। তার মনে হলো অযথাই বকবক করছে সে। এসেছিল হুট করে মাইসারাকে চমকে দিতে। অথচ তার নীরবতাই তাকে দ্বিগুণ চমকে দিয়েছে। কোথাও সে ভুল পথে অনুভূতির বিসর্জন দিল না তো? নয়তো এত চেষ্টার পরেও কেউ কীভাবে নিশ্চুপ থাকতে পারে। যা বুঝার তা বুঝা হয়ে গেছে তার। রাখছি বলে ফোন কা’টতে চাইলো সে। ওপাশ থেকে মাইসারা দ্রুত জবাব দিল,
-“আমি আসছি। একটু অপেক্ষা করো!”
এমন ভয়া’নক কণ্ঠস্বর শুনে অজান্তেই কেঁপে উঠলো মাইসারা! এই মানুষটাকে ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য তো তার নেই। তড়িঘড়ি করে তৈরী হলো আগে। হাতের সামনে কূর্তি পেয়ে সেটাই পরে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। বের হওয়ার পথেই রিপার সাথে দেখা হলো তার। এভাবে তাকে তাড়াহুড়ো করে ছুটতে দেখে বলল,
-“ফিরবি না মানে! যাচ্ছিস কোথায় সেটা অন্তত বলে যা।”
-“অনিক এসেছে!”
দৌড়ের উপর জবাব দিল মাইসারা। পিছনে ফিরে তাকালো না আর। তার এই দৌড়ঝাঁপ দেখে মুচকি হাসলো রিপা। বুঝতে পারলো, দাম্পত্য সম্পর্কের দায়িত্ব, কর্তব্য আর অনুভূতি কতখানি প্রখর! মাইসারার এই ছুটে যাওয়াই বুঝিয়ে দিচ্ছে, অগোচরে সে-ও সুপ্ত অনুভূতিকে ঠাঁই দিয়ে ফেলেছে মনে। যা অতি পবিত্র, সুন্দর, স্বচ্ছ। নির্ভেজাল এক অনুভূতি, যা কেবল একজনের জন্যই লুকায়িত থাকে অন্তরে! মাইসারা হয়তো নিজেও টের পায়নি, গোপনে সে কতখানি জড়িয়ে গেছে অনিকের সাথে। তাইতো সবকিছুকে উপেক্ষা করে প্রিয়জনের ডাকে সাড়া দিতে ছুটে যাচ্ছে সে। অভিমানের কাছে কখনো অনুভূতিকে হারতে দিতে চায় না কেউ, সে-ও দিবে না। অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলতেই হুটহাট ডাকে ছুটে যাওয়া। বুঝিয়ে দেয়া, তারা একে-অন্যকে কতখানি মূল্যায়ন করে।
একটা সংসার গড়তে যেমন অনেক কষ্ট, তার ভা’ঙ’ন আট’কানোটাও অনেকটা কঠিন। পরিপূর্ণ এক সংসারের যাবতীয় তত্ত্বাবধানে যখন পরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরের লোকজনের কথা, কাজ এবং ইশারাকে প্রাধান্য দেয়া হয়, তখন সেই সংসারে ভা’ঙ’নের চিত্র ফুটে ওঠে অতি সহজেই। কেউ মুখ ফুটে না বললেও তার কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে বুঝে নেয়া যায়, সে ভা’ঙ’ন চাইছে। বিশেষ করে এই সমাজের যৌথ পরিবারগুলোতে এই চিত্রটা বেশিই লক্ষ্মণীয়। একজন সংসার গড়তে চাইলে অন্যজন তা ভে’ঙে গুড়িয়ে দিতে চায়। একটা সংসার ভা’ঙ’তে একজন দু’মুখো নারী কতখানি প্রভাব ফেলে তা সেই নারীকে কাছ থেকে উপলব্ধি না করলেও বুঝা হবে না কখনো। তাই ব্যক্তিকে চিনতে, এমন মুখোশধা’রী দু’মুখো চরিত্রের নারীদের চিনতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি কাটাতে হবে অতি সুক্ষ্মভাবে। তবেই কিছুটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।
আরমান সাহেবের পরিবারটাও এমন। যতদিন এই ঘরের আসল কর্ত্রী, অর্থাৎ অনিক, আলিফের মা বেঁচে ছিলেন ততদিন সংসার সুখের স্বর্গ বৈ কম ছিল না। সংসার কীভাবে আগলে রাখতে হয় তা তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। যদিও ঝা’মে’লা খুব একটা ছিল না, তবুও একটা সংসারের গোটা দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। সন্তানদের লালন-পালন করা, স্বামীসেবা করা, ঘর আগলে রাখা ছাড়াও একজন নারী যেভাবে সংসার বাঁচাতে যত সেক্রিফাইস করে তার সবটাই করেছিলেন তিনি। দু’হাতে অতি যত্নে আগলে নিয়েছেন পুরো সংসারকে। কখনো অযত্ন, অবহেলা কিংবা কোনো ত্রুটিবিচ্যুতিকে ঘেঁষতে দেননি সংসারে। অথচ তাঁরই ছেলের বউ মারাত্ম’কভাবে বাইরের লোকের কথাকে প্রশ্রয় দিয়ে সংসারে ভা’ঙ’ন টে’নে আনছে। যা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কখনও!
মাইসারাকে বিদায় দেয়ার পর থেকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে ফারজানা। কার্যসিদ্ধি না হলেও, পথের কাঁ’টা আপাতত সামনে নেই; এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে স্বস্তির এবং শান্তির তার কাছে! হাসিমুখেই মায়ের সাথে বসে গল্প করছিল। হুট করেই আলিফ আজকে ভদ্রমহিলাকে এই বাড়িতে ডেকেছে৷ কেন ডেকেছে সেটা অবশ্য পরিষ্কার হয়নি, তবে তাদের আমোদফুর্তি দেখে বোঝা যাচ্ছে, বেশ সুখী তারা। ত্বোয়া চায়ের ট্রে’টা রেখে আলগোছে সরে গেল সেখান থেকে। এরপর আলিফ এসে সামনে দাঁড়ালো। ফারজানার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মায়ের সাথে দরকারি কিছু কথা আছে। তোমার ব্যাগপত্র গোছাও! আজ তো তোমারও এখান থেকে যাওয়া উচিত।”
-“মানে!”
বিস্ময় নিয়ে স্বামীর চেহারার ভাবভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করলো ফারজানা। কিছু বুঝতে পারলো না। আলিফ আবারও বলল,
-“যা বলছি তা করো। দ্রুত ব্যাগ গোছাও। আর আজকেই এই ঘর ছেড়ে বের হও।”
-“কী বলছো তুমি এটা! বের হবো মানে? এটা আমার ঘর, আমার সংসার। আমি কেন বের হবো? হ্যাঁ দু’চার দিন বেড়াতে যাওয়া যায়, তাই বলে ঘর ছেড়ে বের হবো৷ তোমার কথায় তো মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে ঘাড় ধা’ক্কা দিয়ে বের করে দিতে চাইছো।”
-“বেশি কথা বলো না, যা বলছি সেটা করো। অযথা বকবক করার সময় আমার নেই।”
ফারজানা নড়লোও না। আঁটসাঁট বেঁধে ওখানেই বসে রইলো! আলিফ সেটা দেখে আবারও বিরক্তি নিয়ে তাকালো। বলল,
-“কথা কানে যায়নি তোমার? মায়ের সাথে যেতে চাও তো, দ্রুত তৈরী হও। নইলে একাই এতটা রাস্তা যেতে হবে। রাত হলে একা যাওয়া রিস্ক! আমি এতটাই দায়িত্বহীন নই যে, নিজের স্ত্রীকে একা ছেড়ে দিব।”
ভদ্রমহিলাও আলিফের এহেন আচরণে ভীষণ চমকালেন। কিন্তু চেহারায় হাসি বজায় রাখতে বাধ্য হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
এ পর্যায়ে ফারজানা উঠে দাঁড়ালো। কিছু একটা ভাবতে ভাবতেই রুমের ভেতরে চলে গেল। এবার ঝেড়ে কাশলো আলিফ! নিজের ভেতরে রাখা লুকায়িত কথার ঢালি তুলে ধরলো শাশুড়ির সামনে! তিনি শুধু সব হজম করলেন। কোনো কথা বললেন না। বলার মুখ তার নেই, তবুও চুপ থাকাই যেন সম্মতিকে প্রশ্রয় দেয়। তিনি টের পেলেন, মেয়েকে কুযু’ক্তি দিয়ে ঘর আলাদা করতে আসেননি বরং ছলেব’লে কৌশলে নিজের অজান্তেই মেয়ের সংসার ভে’ঙে দিয়েছেন! তবে তিনি বেশি অবাক হলেন আলিফের কর্মকাণ্ডে। এমন শান্তশিষ্ট ছেলেটা হঠাৎ করে বউয়ের বিরু’দ্ধে চলে গেল কী করে!
*****
বিদায়ের সময় এক অভাবনীয় কাণ্ড করে বসলো আলিফ! যখনই মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, অমনি হাতের টানে নাহিয়ানকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। তার এমন আচরণে স্তব্ধ হয়ে গেলেন সকলে। আরমান সাহেবও স্থির চোখে চেয়ে রইলেন ছেলের মুখপানে। ছেলেকে সোজা কোলে তুলে ত্বোয়ার কাছে দিল। ফারজানার সামনে এসে বলল,
-“এবার যাও।”
-“মানে!”
একেই তো আলিফের আচরণ, ভাবভঙ্গি তার ঠিক লাগছে না, তারউপর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কার্যকলাপে রীতিমতো আগুন ঝড়ে পড়তে লাগলো তার চেহারা দিয়ে। দু’ঠোঁট একত্রে চেপে খানিকটা রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আলিফ মুচকি হাসলো। বলল,
-“কথা দিয়েছিলে, সংসারকে আগলে রাখবে। কিন্তু তা না করে, ভাঙ’ন ডেকে আনলে। ওইটুকু বাচ্চা, কী বুঝে এত ঝগ’ড়াঝাটি। তবুও ওর সামনেই তুমি সারাকে উল্টাপাল্টা কথা বলেছো। ভুলে গেছো, বাবা-মায়ের আচরণ সন্তানদের ভবিষ্যতের রূপকে চিহ্নিত করে। আজ তুমি যা করছো, তা ও শিখছে, নালিশ দিচ্ছে! তোমার কাছে থাকলে ও মানুষ হবে না। ঠিক তোমার মতোই, স্বার্থপ’র, সুবিধাবাদী আর লো’ভী তৈরী হবে!”
-“মুখ সামলে কথা বলো বাবা! কী বলছো বুঝে বলছো তো?”
ভদ্রমহিলার তর্জ’ন-গর্জ’নের রূপ দেখে অট্টহাসিতে ফে’টে পড়লো আলিফ। ত্বোয়াকে বলল,
-“যা ওকে ঘুম পাড়া!”
কোনো প্রকার দ্বিরুক্তি ছাড়াই মাথা নেড়ে নাহিয়ানকে নিয়ে চলে গেল ত্বোয়া। ফারজানা স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু। তার এখনো কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। আলিফ কী করছে, বা কী করতে পারে এমন কোনো ধারণাই এখনো উঁকি মারছে না মনে। তবে সে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। দু’হাতে খাম’ছে ধরেছে মায়ের হাত। ভয় ভয় চোখে তাকাচ্ছে স্বামীর দিকে। ছোট্ট একটা বোতল টি-টেবিলের উপর রাখলো আলিফ। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমি দুঃখিত বাবা, তুমি থাকা সত্ত্বেও আজ একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে আমাকে! যাকে আমার পছন্দে ঘরে এনে তুলেছিলাম, তাকে আমার ইচ্ছেতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বললাম। তুমি আমার উপর রাগ করো আর যাই করো, তোমার বউমা যদি এক্ষুণি এই ঘর ছেড়ে বের না হয়, তবে আমিই বেরিয়ে যাব।”
আরমান সাহেবকে খানিকটা বিচলিত দেখালো। তিনি তার সন্তানদের সঠিক শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ করেছেন। বুঝিয়েছেন, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য। কোথাও কি তিনি ভুল করেছেন, যার কারণে তার সন্তান আজ এরকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে? তিনি কঠোর গলায় বললেন,
-“কীসের ভিত্তিতে তুই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”
আলিফ বোতলটা হাতে নিল। তার উপরের লেখাটা বাবাকে পড়ে শুনালো। বলল,
-“যাকে বিশ্বাস করে তুমি-আমি, আমরা ঘর-সংসারের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলাম সেই মেয়েটাই তোমার ঘরটাকে ভে’ঙে দিচ্ছিলো বাবা! এই এসি’ডটা রান্নাঘরে রেখেছিল, যেন এটা সারার শরীরে লাগে।”
মাইসারা বাড়িতে আসার পর থেকে ফারজানার সাথে তার টুকটাক ঝগড়ার কথা নাহিয়ানের মুখ থেকেই শুনেছে আলিফ। ওইটুকু বাচ্চা ঝগড়ার দৃশ্য দেখে মুখস্থ করে বাবার কাছে বর্ণনা করেছে। যার ফলে, এত বছরের গড়ে তোলা সম্পর্কে টুকরো টুকরো সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে তার। যদিও আলিফ চাইতো না তার সন্দেহ আসুক, স্ত্রীকে দো’ষী সাব্যস্ত করুক, তবুও ফারজানার কিছু কিছু অহেতুক কাজ বার বার মনকে আঘাত করেছে। সন্দেহ সেদিনই গভীর হয়, যেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে স্ত্রী আর শাশুড়ির গোপনে দেখা-সাক্ষাতের দৃশ্য তার চোখে পড়েছিল। আড়ালে তাদের এসি’ডের বোতল দেয়া-নেয়ার দৃশ্যটাও চোখ এড়িয়ে যায়নি তার। বাড়ি ফিরে গভীরভাবে ভেবেছিল সে। অপেক্ষা করছিল স্ত্রীর পরবর্তী পদক্ষেপের। যখন দেখলো, ফারজানা এসি’ডের বোতলটা রান্নাঘরের শেলফে রেখে মা’কে ফোন করে বলেছিল,
-“জায়গামতো রেখে দিয়েছি মা। এবার শুধু সারার উপরে পড়লেই হবে। এই মেয়েটা যেকোনো দিন আমার সবকিছু কে’ড়ে নিবে। সাজানো-গোছানো সংসারকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হবে। যতই বলো, সারা তাদের আপন। আর আমি তো পরের ঝি! এত সহজে তাকে গোটা সংসারের দায়িত্ব কীভাবে দিয়ে দিই বলো! আমিও দেখে ছাড়বো, আমার ঘর, আমার সংসার কী করে সে আমার থেকে কে’ড়ে নেয়!”
এরপরই সে সুযোগ বুঝে বোতলটা সরিয়ে তেলের টিনটা সেখানে রেখে দিয়েছিল। ভাবেনি, ওতো বড়ো জিনিসটা গড়িয়ে পড়তে পারে। যার কারণে মাইসারাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যথা দিয়েছে সে। এরজন্য গোপনে মাইসারার কাছে ক্ষমাও চেয়েছে আলিফ। শুধু বলেছে চুপ থাকতে। মাইসারাও ভাইকে বুঝিয়েছে, যেন এসব ভুলে যায়। এ নিয়ে কোনো ঝা’মে’লা সে চায় না। অথচ আলিফ চুপ থাকতে পারছে না। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না, যাকে ভালোবেসে সবকিছুর ভার ছেড়ে দিয়েছিল, সেই পিছন থেকে ছু’রিকাঘা’তে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে মন! সব শুনে আরমান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলেন না তিনি। শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলে-বউমার দিকে।
*****
-“শুধু তাই নয় বাবা, সেদিন গ্যাসের চুলাতেও আগু’ন লাগা ওর ইচ্ছাকৃত কাজ! ও মনে-প্রাণে চায়, সারাকে মে’রে ফেলতে। যেন গোটা সংসারের ভোগবিলাসিতা সে একাই পেতে পারে!”
ফারজানা এবারও কোনো কথা বললো না। চুপচাপ শুনে গেল। আলিফ আবারও বলল,
-“প্রতি মাসে আমি সংসারে টাকা দেয়ার পরেও তোমার বউমা টান পড়েছে বলে তোমার কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেয়। সেই টাকা, ব্যাংকে জমা রাখে। এটা অবশ্য ফারহান বলেছে! একই মায়ের পেটে জন্ম হলেও, একটা মানুষ হয়েছে অন্যটা অ’মানুষ! ভাবতেও খারাপ লাগছে, এই অমানুষটাকে নিয়ে এতদিন সংসার করেছি, বিশ্বাস করেছি, ভালোবেসেছি! নিজেরই ঘৃ’ণা হচ্ছে এখন!”
আরমান সাহেবও কথা বাড়ালেন না। বুঝতে পারলেন, ছেলে আজ সব জেনেই মাঠে নেমেছে। কিছু না বললেও খারাপ দেখায়। তাই ঠাণ্ডা মাথায় বললেন,
-“তুমি যবে থেকে এখানে এসেছো, কখনো তোমাকে কোনোকিছু নিয়ে অভাব করতে হয়েছে? আমি জানি, মাস শেষে আলিফ সংসারের পিছনে টাকা দেয়, তবুও তুমি প্রতি মাসে বাড়তি পনেরো হাজার আমার কাছ থেকে নিয়েছো! বুঝিয়েছো, সংসারে টানাটানি হচ্ছে। আমি সেটাই বিশ্বাস করতাম। অথচ আমাদের ক্ষেত ভরা ধান, বারোমাসি সবজি, এমনকি মাছেরও অভাব নেই। তবুও তোমার চোখে সব জায়গায় অভাব ছিল। তোমাকে নিজের মেয়ে ভেবে, এতগুলো দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলাম, এটাই কি আমার ভুল ছিল মা? সংসার আগলে রাখতে পারবে না, এই ঘরে তুমি তোমার মনমতো কিছু পাচ্ছো না, সেটা আমাকে মুখ ফুটে বলতে! তোমাদের এই নীরব দ্ব’ন্দ্বের টানাপোড়নে আমি বয়স্ক মানুষটাকে কেন ফেললে, বলবে? দুনিয়াটা কি শুধুই ভোগ্যব’স্তু তোমাদের চোখে? শুধু পেলাম, খেলাম, জমালাম, এসব? ত্যাগ বলতে কিচ্ছু নেই? আমরা তবে সবাই ভুল ছিলাম। আমার আর কিছু বলার নেই বউমা! তোমাকে ধন্যবাদ, আমার, আমাদের সবার বিশ্বাসটাকে এভাবে ভে’ঙে দেয়ার জন্য!”
ফারজানা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চেয়েছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে আলিফ নিজেই বলল,
-“চলে যাও! সময়মতো ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে। তোমার মোহরানা তো আগেই দিয়েছি! রাখার মধ্যে আমি শুধু আমার সন্তানকে রেখে দিলাম। ব্যাংক, ব্যালেন্স যাবতীয় তোমারই রইলো! তুমি স্বাধীন। চারদেয়ালের এই গৃহস্থালি জীবন তোমার জন্য নয়!”
আহত চোখে তাকিয়ে রইলো সে। বলার মতো কোনো কথাই আজ তার কাছে অবশিষ্ট নেই। যা দিয়ে সে তার সংসার বাঁচাতে পারবে! কঠিন মনটা যেন এ পর্যায়ে আরও কঠিন হয়ে গেল! তবুও কোনো জবাব মুখ দিয়ে এলো না। ভদ্রমহিলা এবার মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরলেন। আলিফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“আমিও কোর্টে যাব! দেখে নিব, বাচ্চা তুমি কীভাবে আট’কে রাখো।”
আলিফ পালটা জবাবে হাসলো। ঘাড় নেড়ে বলল,
-“অসুবিধা নেই! আমিও এই এসি’ডের বোতলটা সোজা থানায় নিয়ে যাব। কোর্টে মা’ম’লা ঠুকে দিয়ে মা-মেয়েকে সারাজীবনের জন্য চারদেয়ালের ব’ন্দী জীবন উপহার দিব। আপনাদের এই সকল কাজের সাক্ষী, ফারহান। আমার বোনের দিকে আঙুল তুলেছে আপনার মেয়ে! ভাগ্য ভালো যে, তার হাত এখনো আমি ভে’ঙে ফেলিনি। বের হয়ে যান এখান থেকে!আপনাদের সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলছি, যদি বাড়াবা’ড়ি দেখি, ঘা’ড় ধ’রে বের করে দিব।”
আলিফের এমনতর কঠিন চেহারা আগে দেখেনি ফারজানা! আজ যেন নতুনভাবে, নতুনরূপে নিজের স্বামীকে আবিষ্কার করলো সে। হাত-পা ধরে ক্ষ’মা চাইলে অপরা’ধের শা’স্তি কম হবে কী? ভেবে পেল না ফারজানা। কিছু বলার আগেই হাতে টান অনুভব করলো সে। ভদ্রমহিলা একরকম টা’নতে টা’নতেই ঘর থেকে বাইরে বের করলেন তাকে। কিছুদূর যাওয়ার পর দরজা আ’টকানোর শব্দ শুনে পিছনে তাকালো সে। গ্রিলের ফাঁকে একজোড়া অভিমানী চোখ যেন তাকে তখনই কিছু বললো। বুঝিয়ে দিল, মানুষটা পুরোপুরি ভে’ঙে যাওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই দৃষ্টির ভাষা পড়তে খুব একটা বেগ পেতে হলো না তাকে। অথচ তা আরও আগে বুঝা উচিত ছিল তার।
*****
এতটা রাস্তার টানা ড্রাইভ করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরলো অনিক। যখন বাড়ি পৌঁছালো, তখন রাত প্রায় দশটা। মাইসারাকে পৌঁছে দিয়ে, তার সাথে কিছুটা সময় প্রয়োজনীয় কথা বলে সময় অতিবাহিত করার পিছনেই দেরী হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে শুধু জানালো, সে পৌঁছেছে। ফ্রেশ হয়ে যখন খাবার টেবিলে আসলো তখন সবকিছু নীরব। প্রতিদিন টেবিলে খাবার দিয়ে ফারজানা পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে! কী কী লাগবে, না লাগবে তা এগিয়ে দেয়ার জন্য। অথচ আজ সে সামনে নেই। গলার আওয়াজও শোনা গেল না। কিছুক্ষণ পর, লবণ আর লেবু নিয়ে খাবার টেবিলে আসলো ত্বোয়া। হাত ধুয়ে সে-ও খেতে বসলো। ঘরের এমন নীরব, থমথমে পরিবেশ দেখে অবাক হয়ে গেল অনিক। বলল,
ত্বোয়ার মূল কথা এটা ছিল না। মূলত সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেই এই কথা তুলেছিল। অনিক যেভাবে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে, যেকোনো সময় জানতে চাইবে ফারজানা কোথায়! তখন কীভাবে বলবে, সন্ধ্যের ঘটনা। বাড়তি কোনো কথা ছাড়াই খাওয়ায় মনোযোগ দিল ত্বোয়া। অনিকও খাবার মুখে তুলে বলল,
হাতটা থেমে গেল ত্বোয়ার। মুখের ভাত গিলে পানির গ্লাসটা হাতে তুললো। কয়েক ঢুক পানি পান করে নিজেকে ধাতস্থ করলো। এত চেষ্টা করেও এড়িয়ে যাওয়া আর হলো না। আলিফ কড়া করে বলেছে, অনিকের কানে যেন সন্ধ্যার ঘটনাটা না যায়! এবার কীভাবে পালাবে সে। কী জবাব দিবে? মিথ্যে বলবে! চেপে রাখবেই না কতক্ষণ? এখন না হোক, সকালে তো সে জানবেই। যখন নাহিয়ান মা’কে খুঁজবে তখন তো জবাব দিতেই হবে! মুখ নিচু রেখেই এতসব কথা ভেবে যাচ্ছিলো ত্বোয়া। বোনের এমন লুকোচুরি ভাবটা চট করে নজরে পড়লো তার। চোখ নাড়িয়ে বলল,
-“কী ভাবছিস এত? একটা সাধারণ প্রশ্ন! এত গভীরভাবে ভেবে জবাব দিতে হবে? কী হয়েছে বল তো!”
-“বড়ো ভাইয়া, আন্টিকে ডেকে এনে ভাবীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে!”
খাবার মুখে মারাত্ম’ক বিষম খেল অনিক। ঝটপট পানি পান করে গলা পরিষ্কার করে বলল,
-“কী? কেন? কী দোষ তার?”
আর চুপ থাকতে পারলো না ত্বোয়া! সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই অনিকের সামনে তুলে ধরলো সে। যদিও সে তখন সামনে ছিল না। নাহিয়ানকে ঘুম পাড়িয়ে আড়ালে থেকেই সব কথা শুনেছে। এরপর আলিফ যখন তাকে চুপ থেকে রান্নার কাজ সামলাতে বললো, তখনই পুরো ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলো সে। এমন না যে, মাইসারা কিংবা ত্বোয়া দু’জনে আলিফের কানে এসব ঝগ’ড়ার খণ্ডচিত্র তুলে ধরতো। কয়েকদিন ধরে নিজেই গোপনে পর্যবেক্ষণ করছিল সে। এমনকি আজকের সিদ্ধান্ত, তার ভেবেচিন্তে নেয়া। সব শুনে অনিক খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো! বেসিনে হাত ধুয়ে মূল দরজা খুলে আবারও বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইলো। পিছন থেকে আলিফ বাজখাঁ’ই কণ্ঠে বলল,
-“এত রাতে বাইরে যাস না, ঘরে আয়। যে যাওয়ার সে গেছে, তাকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন নেই।”
পা থামিয়ে দিল অনিক। কীভাবে বুঝলো, সে ফারজানাকেই ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছিলো। যেভাবেই বুঝুক, এভাবে তো সংসার ভা’ঙা যায় না। ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়! হয়তো জেনে-বুঝে মেয়েটা এসব করেনি। কারণ, ফারজানা কখনোই এমন ছিল না। সে বদলেছে, কেউ তাকে বদলে যেতে বাধ্য করেছে! এখানে তৃতীয় পক্ষের কানাঘুঁ’ষা নিশ্চয়ই আছে। ভা’ঙ’ন’টা আট’কাতেই হবে তাকে, নয়তো নাহিয়ানের জীবনটাও মাইসারার মতোই হয়ে যাবে। আরেকটা সুন্দর জীবন, আরেকটা সুন্দর স্বপ্ন ভে’ঙে যেতে বসেছে, যেভাবে হোক ভা’ঙ’নের আগেই জোড়া লাগাতে হবে।
অতীত এবং বর্তমানের সবচেয়ে বড়ো পার্থক্য হচ্ছে সময়ের সাথে সবকিছুর পরিবর্তন, আধুনিকতার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় যেকোনো কিছুর সহজলভ্যতা। এই আধুনিক যুগে দেশ যেমন উন্নত হচ্ছে, উন্নত হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। আগেরকার দিনে যেসব রোগবালাইয়ের সাথে হরদম যু’দ্ধ করে প্রাণের মায়া নিমিষেই মানুষ ত্যা’গ করে মৃ’ত্যুর কোলে ঢলে পড়তো, এখনকার সময়ে সেইসব রোগকে দূরে ঠেলে দেয়া যাচ্ছে যথাযোগ্য ঔষধপত্র সেবন করে। কঠিন কঠিন রোগও বিলীন হয়ে যাচ্ছে, দামী ঔষধ এবং সচেতনতার ফলে। যুগের এই পরিবর্তনের অন্যরকম চিত্রটা হসপিটালে প্রবেশের পরই আয়ত্তে আনা যায় সহজে। এখানে যত আধুনিক টেকনলোজি ব্যবহার হয়, যত যন্ত্রপাতি ব্যবহার সবকিছুই কোনো না কোনো রোগের সাথে সংপৃক্ত। যে রোগই মানবদেহে বাসস্থান গড়ে নেয় তারই নিরামক হিসেবে কাজ করে নিত্যনতুন ঔষধ।
শিশু-ওয়ার্ডে ডিউটি থাকায় ঝটপট তৈরী হচ্ছে মাইসারা। পাশেই একটা বই নিয়ে তাতে চোখ বুলাচ্ছে রিপা। আপাতত তার ডিউটি নেই, তাই ফাঁকেই প্রয়োজনীয় চ্যাপ্টারটা পুনরায় অধ্যয়ন করছে। আচমকাই ফোনটায় ভাইব্রেশন হলো। পুরো টেবিলসহ রিপা নিজেও কেঁপে উঠলো সেই আওয়াজে। চোখের সামনে স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটা নাম। সেটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে রিপা। বিড়বিড় করে ঠোঁট নেড়ে উচ্চারণ করলো,
-“মাই হ্যাপিনেস!”
মাইসারার তখনো সেদিকে দৃষ্টি নেই। সে গায়ে অ্যাপ্রোন জড়িয়ে হাতের ঘড়িটা ঠিক করছে। তখনি তার হাতের দিকে নজর যায় রিপার। গতকাল থেকেই খেয়াল করছে, বাড়ি থেকে ফেরার পর মাইসারার মধ্যে কিছুটা পালটানোর আভাস টের পাচ্ছে সে। যদিও সেটা কিঞ্চিৎ সন্দেহ! কিন্তু ফোনের স্ক্রিনের নামটা তার সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দিল। মাইসারা আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তুই? আমায় আগে কখনো দেখিসনি?”
-“আগে তো চুড়ি পরতি না! এটা খুলতে ইচ্ছে করছে না এখন? খুলে ফেল। কেমন যেন বিবাহিত, বিবাহিত, নববধূর মতো লাগছে!”
হাতের ঘড়িটা ঠিক মতো আট’কে দিল মাইসারা। অ্যাপ্রোনের উপরেই উড়না একপাশে রেখে দিল। রিপার কথার জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলো। এই হাসির অর্থ রিপা ধরতে পারলো না। কথা এড়িয়ে সরে যেতে চাইলে পথ আগলে দাঁড়ালো রিপা। চোখের সামনে ফোনটা ধরে স্ক্রিনের নাম্বার দেখিয়ে বলল,
-“তোর হ্যাপিনেসটা আবার কে বলতো! এত সকাল সকাল কী খুশির সংবাদ দিতে ফোন করছে সে!”
মাইসারার মুখটা হা হয়ে গেল। এইজন্যই মেয়েটা তার পিছনে এমন খবরদারি করছে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা আনতে গিয়েই পড়লো বিপদে। রিপা সারা রুম ছুটে বেড়াচ্ছে ফোন নিয়ে। কাছে ভিড়ছে না, আবার দৌড়ও থামাচ্ছে না। একটা সময় হাল ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। অনুরোধের সুরে বলল,
-“দে না প্লিজ। অফিস যাওয়ার সময় হয়ে গেছে তার। রিসিভ না করলে খুব কষ্ট পাবে! এমন করিস না, দোস্ত!”
মাইসারার এমন করুণ সুরেও তার চেহারায় কিঞ্চিৎ পরিমাণ দুঃখবোধের জন্ম হলো না। সে ঠিক একইভাবে জবাব দিল,
-“আহারে! কী প্রেম! একবার কথা না হলে, খুব কষ্ট পাবে! এই ক’দিনে সে এতটাই দামী হয়ে গেল তোর কাছে। বাহ্, ক্যায়া বাত। দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। কে সেই ভাগ্যবান পুরুষ, দেখেই ছাড়বো আজ। মাত্র এক সপ্তাহে সে আমার বান্ধবীকে আমার থেকে কে’ড়ে নিয়েছে।”
রিপা দেরী না করে ঝটপট ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিল। ওপাশে অনিক প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। পরক্ষণেই কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে সালামের জবাব দিয়ে বলল,
-“সারা কোথায়? অনেকক্ষণ ধরে কল করছি অথচ রিসিভ করছে না।”
এপাশে রিপাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তার মুখে কোনো কথা নেই। যেমন হা হয়ে ছিল, সেই হা হওয়া মুখে মাইসারার দিকে তাকালো সে। মাইসারা পারলে অট্টহাসি দেয়। কিন্তু রিপার এমন ফেস দেখে চুপ থেকে তাদের কথোপকথন হজম করার জন্যই দাঁড়িয়ে রইলো। রিপা পানসে মুখে জবাব দিল,
-“ভাইয়া আপনি! আমি তো ভাবলাম কে না কে, হুট করে সারার হ্যাপিনেসের কারণ হয়ে গেল। ও তো রুমে নেই, আপনি বরং এক ঘণ্টা পর ফোন করুন! আসলে বলবো, আপনি কল করে তার খোঁজ করেছেন। রাখি…?”
ওপাশ থেকে আর কোনো আওয়াজ আসলো না। রিপা এবার মোবাইল নিয়ে মাইসারার সামনে গেল। হাত টে’নে এনে মোবাইলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-“বুঝলাম না কিছুই! ভাইয়ার না বিয়ে ঠিক হয়েছিল? তাছাড়া অনিক ভাইয়ার নাম্বার তোর ফোনে ছোটো ভাইয়া দিয়ে সেইভ করা ছিল। হুট করে সেটা ‘মাই হ্যাপিনেস’ হয়ে গেল কী করে?”
মাইসারা ফের হাসলো। ফোনের গ্যালারি ওপেন করে তাদের বিয়ের ছবিটা বের করে রিপার মুখের সামনে ধরে বলল,
-“দেখ! কার সাথে হয়েছে।”
বর-কনের একত্রিত কয়েকটা কাপল ছবি দেখলো রিপা! কনের জায়গায় বরাবরই মাইসারাকে দেখা গেল। চোখ গোল গোল করে বলল,
-“ওরে শাঁ’কচু’ন্নি বিয়ে করে ফেললি! তা-ও নিজের কাজিনকেই। আর পাত্র ছিল না? তাছাড়া তোর সাথেই কেন?”
-“পরে বিস্তারিত বলি, এখন ডিউটি আছে।”
রিপা ঘাড় নাড়লো। রুম ছেড়ে বের হওয়ার পথে কন্টাক্ট লিস্টের প্রথম নাম্বারে ডায়াল করলো মাইসারা। ফোন কানে ঠেকিয়ে দ্রুত এগোতে লাগলো নির্ধারিত কাজের জায়গায়।
*****
নাশতার টেবিলে ভীষণ অন্যমনষ্ক দেখাচ্ছে ফারজানাকে। ভদ্রমহিলা মেয়ের এমন অহেতুক মন খারাপের কারণে খানিকটা রেগেই গেলেন। নাশতা সামনে অথচ সে খাচ্ছে না, কারও সাথে কথাও বলছে না। কেমন নীরবতার ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছে একদম। তিনি মেয়েকে সবসময় হাসিখুশি দেখতে পছন্দ করেন, এমন বিষণ্ণতায় ভরা চেহারা কিংবা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ মলিন চাহনি বড্ড বিরক্তিকর ঠেকলো তাঁর কাছে। খানিকটা ধম’কের সুরে বললেন,
-“খালি পেটে এমন ঢং করিস না তো। কিছু খেয়ে সারাদিন কাঁদলেও কেউ তোকে কিচ্ছু বলবে না। এই মুহূর্তে এসব ন্যাকামি বন্ধ কর। সেই আসছে পর থেকে কানের কাছে একই ঘ্যা’নঘ্যা’ন!”
মায়ের এমন কথায় ভীষণ চমকালো ফারজানা। এতদিন এই মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বেরিয়েছে। এখন তিক্ত কথা বের হচ্ছে। কষ্ট পেলেও নিজেকে মানিয়ে নিল সে। এই মায়ের কথাতেই নিজের সুখের সংসারে অশান্তির আগু’ন জ্বালিয়েছে এসেছে। যখন বুঝা উচিত ছিল, তখন এই বোধশক্তি ছিল না। মায়ের কথাই মূখ্য ছিল তার কাছে। মায়ের চিন্তাভাবনা আর যুক্তিই সঠিক ভেবেছিল সে। ভাবেনি, মায়ের এতসব যুক্তির প্যাঁ’চে পড়ে সব খো’য়াবে! আজ যখন নিঃস্ব হয়েছে তখন ঠিকই উপলব্ধি হচ্ছে। মন খারাপের রেশটা অল্প সরানোর চেষ্টা করলো সে। ম্লান হাসি ফুটিয়ে বলল,
-“যত পারো বকো, আমি কিছু বলবো না। পারলে আমার ছেলেটাকে এনে দাও।”
ভদ্রমহিলা ঠোঁট বাঁ’কিয়ে চলে গেলেন। ফারহান যতটা ধৈর্য্য নিয়ে নাশতা করতে বসেছিল, বোনের এই কথা শুনে তার ধৈর্যের বাঁ’ধটাও ভে’ঙে গেল। চোখেমুখে রাগের রেখা টে’নে বলল,
-“বার বার যখন বুঝাতাম তখন তো কথা কানে তুলিসনি! এখন বুঝ, মা আর সন্তানের টানটা কেমন! তেমনি রক্তের টানও এমন। তুই তার বোনের ক্ষ’তি করতে চেয়েছিলি, সে তোর ক্ষ’তি করে বুঝিয়ে দিল, পরের অনি’ষ্ট করতে গেলে নিজেরই অনি’ষ্ট হয়! মায়ের কথায় আরও লাফদে, যখন কোনো কূল-কিনারা পাবি না তখন টের পাবি। পস্তানো ছাড়া আর কোনোকিছুই করার থাকবে না।”
হাত ধুয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ফারহান। ঝটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল ভার্সিটিতে। এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি তার। মাস্টার্সের শেষ পর্যায়ে আছে। পাশাপাশি পার্ট-টাইম জবও করে সে। যা দিয়ে সংসার খরচ দিব্যি পুষিয়ে নেয়। ফারহান যাওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ ভাইয়ের কথাগুলো ভাবলো ফারজানা। হাতের মোবাইল নিয়ে ত্বোয়াকে ফোন করলো। এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই তারাও নাশতা করছে। যদি রিসিভ করে তবে নাহিয়ানের সাথে অল্পক্ষণ হলেও কথা বলে নিবে। এতে যদি মনটা একটু শান্ত হয়।
বার বার ঘড়ি দেখছে ত্বোয়া। ফাঁকে ফাঁকে নাহিয়ানকে নাশতা খাওয়াচ্ছে। একেবারেই তৈরী হয়ে গেছে দু’জনে। ভাইপোকে স্কুলে পাঠিয়ে সে-ও ভার্সিটি চলে যাবে। হুট করেই ফোন আসাতে তাতে দৃষ্টি দিল সে। ফারজানার নাম্বার দেখে দুই ভাইয়ের দিকে তাকালো। আলিফ সেটা খেয়াল না করলেও অনিক ইশারায় বলল রিসিভ করতে। ত্বোয়া চুপিসারে সেটা রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে রান্নাঘরে চলে এলো। ফারজানা ওপাশে ততক্ষণে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। শুধু একবার নাহিয়ানের জন্য কথা বলতে চায়, এমন সব আহাজারিতে অস্থির করে তুলেছে তাকে। ত্বোয়া কিছু বলার আগেই হাত থেকে ফোন কে’ড়ে নিল আলিফ। টানটান গলায় বলল,
-“এ বাড়িতে আপনার কেউ থাকে না, তাই অনুরোধ আগামীতে এখানকার কাউকে আর ফোন করবেন না। সব সম্পর্ক আপনি নিজে ভে’ঙে যেতে দিয়েছেন। দয়া করে আর কারও মাথা খাবেন না।”
মুখের উপর এতসব কথা বলে ফোন কে’টে দিল আলিফ। ঝটপট ফারজানার নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেলে ফোনটা ত্বোয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“ফের যেন এই লুকোচুরি না দেখি! সামলে রাখতে না পারলে বল; রাখবি না। আমার ছেলেকে আমিই সামলে নিতে পারবো। এরজন্য কারও সাহায্যের প্রয়োজন হবে না আমার।”
সকাল থেকে বেশ কয়েকবারই নাহিয়ান তার মা’কে খুঁজেছে। ত্বোয়া প্রতিবার এড়িয়ে গেছে, নয়তো কথার ছলে ভুলিয়ে দিয়েছে। তার জানা নেই, এভাবে একটা বাচ্চাকে মা ছাড়া কীভাবে আগলে রাখবে! খাওয়ানো, পড়ানো নিয়ে তো অসুবিধা নেই, অসুবিধা তো তখনই হয়, যখন অবুঝ মন মায়ের সঙ্গ পেতে ছটফ’ট করে। ত্বোয়া বুঝে উঠতে পারে না, তার কী করা উচিত। এই মুহূর্তে এসব ঘটনা মাইসারাকে জানানোও উচিত না। শুনলেই সবকিছু ছেড়ে ছুটে আসবে মেয়েটা। অথচ এই অসহায় মুহূর্তে ওর সহযোগিতার বড্ড প্রয়োজন অনুভব করলো ত্বোয়া।
*****
অনিকের মনে হলো এই মুহূর্তে তার ভাই একটু বাড়াবাড়ি করছে। হ্যাঁ অন্যায় করলে শা’স্তি অবশ্যই দেয়া উচিত। যে অন্যায় করেছে শা’স্তি কেবল তার জন্যই বরাদ্দ করা উচিত। শুধু শুধু মাছুম বাচ্চাটা কেন তার ফল ভোগ করবে। সকালে তাড়াহুড়ো ছিল দেখে কিছু বলার সুযোগ পায়নি। কিন্তু অফিস থেকে ফিরে যে দৃশ্য দেখলো তাতে সে বিচলিত হয়ে গেল। একরত্তি বাচ্চাটা মায়ের অভাবে কেমন নেতিয়ে গেছে। কয়েকটা ঘণ্টার ব্যবধানে গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে তার। গায়ের চাদর জড়িয়ে রাখার পরও তার কাঁপুনি থামছে না। ত্বোয়া একা একা কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। চিন্তায় আরমান সাহেবও দু’টানার মধ্যে পড়ে গেলেন। ছেলেকে বকতেও পারছেন না, বুঝাতেও পারছেন না। সব ঠিক হলেও এই একটা জায়গায় সবাই ভুল করছে। একজনকে শা’স্তি দিতে গিয়ে দু’জনকেই শা’স্তি দিচ্ছে। অনিক টের পেল, আর যদি সে চুপ করে তাকে এই বাচ্চাটা অকা’লেই ঝরে যাবে। ভাইয়ের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
-“সামলেছো? মাত্র কয়েক ঘণ্টায় দেখেছো কী অবস্থা? এভাবে যদি দু’দিন রাখো, বাঁচাতে পারবে? ভাইয়া, একটা সন্তানকে তার মা যতটুকু সুরক্ষা দেয়, ততটুকু সুরক্ষা তাকে আর কেউ দিতে পারে না। সে যেই হোক। বাবা, চাচা, খালা, এদের কারও সংস্পর্শই তাকে মায়ের অভাব ভুলিয়ে দিবে না। এই শক’টা ও সামলাতে পারছে না। এটা ওর ব্রেইনে কতখানি প্রভাব ফেলবে বুঝতে পারছো না তুমি?”
-“কেন? যে সন্তানের মা, সন্তান জন্ম দিয়েই মা’রা যায়; তার বাচ্চা বাঁচে না? সে যদি বাঁচতে পারে, তবে আমার বাচ্চাও বাঁচতে পারবে।”
-“ভাইয়া দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। তোমাদের এই মান-অভিমান, ন্যায়-অন্যায়ের প্রভাব পড়ছে ওর উপর! যা ধীরে ধীরে ওকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলবে। প্লিজ, এমনটা করো না৷ হয় ভাবীকে বাড়িতে আনো, নয় কয়েকটা দিনের জন্য বাচ্চাটাকে তার মায়ের কাছে রেখে এসো!”
-“অসম্ভব! আমার বাচ্চা আমি কারও কাছে রাখবো না। বাঁচুক, কী ম’রুক! ও এখানেই থাকবে।”
অনিক দু’হাতে চোখমুখ মুছলো। ভাইয়ের অনুমতিরও প্রয়োজন মনে করলো না আর। ওয়ারড্রব থেকে নাহিয়ানের প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় একটা ব্যাগে ভরে তাকে ত্বোয়ার কোলে দিল। ব্যাগটা দ্রুত হাতে বাইকের পিছনে আট’কে দিল। আলিফ আটকাতে চেয়েও পারেনি। ভাইকে জোরপূর্বক সরিয়ে নাহিয়ান আর ত্বোয়াকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। যাওয়ার বেলা শুধু বলে গেল,
-“আলাদা থাকবে কি একসাথে থাকবে এটা তোমাদের দু’জনের ব্যাপার! ভুল করেও যেন তার প্রভাব এসে এই বাচ্চাটার উপর না পড়ে! আমাকে বিগ’ড়ে যেতে বাধ্য করো না, ফল কিন্তু মোটেও ভালো হবে না।”
রাগে নিজের চুল খাম’চে ধরলো আলিফ। অনিক আর দেরী করলো না। প্রথমে সেই ডাক্তারের চেম্বারে আসলো, যেখানে ছোটোবেলা থেকেই নাহিয়ানের চিকিৎসা হয়! এরপর প্রয়োজনীয় ঔষধ আর পরামর্শ নিয়ে রওনা দিল ফারজানার বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ফোনের মাধ্যমে সেটা শুধু ফারহানকেই জানালো। অন্তত নাহিয়ানের সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনো প্রকার ঝা’মে’লা টে’নে আনবে না সে। যত সমস্যা আছে, সবকিছুর সমাধান হবে, আগে বাচ্চাটা সুস্থ হোক। আগের মতো হাসুক, দৌড়াক, নিশ্চিন্তমনে ঘুরে বেড়াক বাড়ির আনাচে-কানাচে। এইটুকু বয়সে যেন গুটিয়ে যাওয়া স্বভাব না আসে তার মধ্যে, সেদিকেই তীক্ষ্ণ নজর অনিকের। শৈশবের এতসব জটিল, কঠিন প্রভাবই বাচ্চার মস্তিষ্কে মারাত্ম’ক প্রভাব ফেলবে। এতে বাচ্চার ভবিষ্যৎটাও নষ্ট হয়ে যাবে! যার যার সমস্যা, তার তার নিজস্ব। তার জন্য কেন ওইটুকু বাচ্চার সুন্দর জীবন গঠনের পথ এখনই থেমে যাবে! কোনোভাবেই তা হতে দেয়া যাবে না। এমনসব চিন্তাভাবনা থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনিক।