ভাইয়া আব্বু ডাকছে। আমার সাথে এসো। – পিছনে কারো কন্ঠ শুনে দ্রুত চোখ মুছে নিলাম।
– কিছু বললে তুমি!
– তুমি কান্না করছো?
– আমি কেন কান্না করবো বলো! কি বলছিলে তুমি?
– আব্বু ডাকছে তোমায়।
– আচ্ছা চলো।
রুমের মাঝে একজন বয়স্ক পুরুষ খাটের উপর বসে আছে আমি ঠিক তার কিছু দূর দাঁড়িয়ে আছি। খুব সম্ভবত উনিই আমার জন্মদাতা।
– অবন্তী তুমি বাইরে যাও।
– আচ্ছা আব্বু।
অবন্তী চলে গেলো যাওয়ার সময় শুধু একটুকু বললো- খাওয়ার সময় ভাইয়াকে সাথে নিয়ে আসবে।
– দাঁড়িয়ে আছো কেন! বসো।
– আমি এভাবেই ঠিক আছি।
– তোমার আম্মু কেমন আছে!
– প্রায় ছয় মাস হলো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।
কথাগুলো বলার সময় খুব কষ্টে নিজের চোখে বাঁধ বাঁধিয়ে রাখলাম। কিন্তু আমার সামনে বসা ভদ্রলোক চোখ থেকে চশমা খুলে চোখ জোড়া মুছে নিলো।
– এতো বছরে যে মানুষটার একটা বার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি তার মৃত্যুতে আপনার চোখে পানি আদৌও কি শোভা পায়!
– কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা অসহায় হয়ে পড়ি বাবা, যেটা না আমরা কাউকে বলতে পারি আর না নিজে সহ্য করতে পারি।
সামনের ভদ্রলোককে কেমন যেন অসহ্য লাগছে। এই লোকটা আমার ফুলের মতো মা’কে বেঁচে থাকতেই মৃত্যু যন্ত্রণায় প্রতিটি মুহুর্ত পুড়িয়েছে। তবে এখানে আসার আগেই শুধু তাকে এক নজর দেখার প্রবল ইচ্ছে মনের মাঝে প্রতিনিয়ত জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করেছিলো।
– আমায় এখানে ডাকার কারণ কি ছিলো?
– অবন্তী যখন থেকে জেনেছে তার একজন ভাই আছে তখন থেকে প্রায় বাহানা করতো ভাইয়ার কাছে যাবে বড় মা এর কাছে যাবে। কিন্তু ওর মা’য়ের জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। বাসায় প্রথম কারো বিয়ে হচ্ছে তাই ভাবলাম এটাই সুযোগ অবন্তীকে ওর ইচ্ছে পূর্ণ করানোর। তোমাকে চিঠিটা ঐ লিখেছে আমি তো শুধু ঠিকানা বলেছিলাম।
– আমি তাহলে এখানে অবন্তীর ইচ্ছায় এসেছি! ঠিক আছে, ওর সাথে আমার দেখা হয়ে গেছে আমি আগামী কাল চলে যাবো।
লোকটার প্রতি অসহ্য অনুভূতি ক্রমশ বাড়ছে।
– বিয়েতে থেকো।
– বিয়ে তো হচ্ছে না।
– বিয়ে হবে। সবাইকে ইনভাইটেশন দেওয়া শেষ হয়ে গেছে। এখন পরিবারের সম্মানের কথা, বিয়ে হতেই হবে। এই কয়দিন বোনটাকে একটু সময় দাও। তবে ওর মা যদি তোমায় কিছু বলে তবে কিছু মনে করবে না। ও তোমাদের কথা সহ্য করতে পারে না।
খাবার টেবিলে সবাই বসে আছে। একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো, দাদু, মেজো চাচ্চু, ছোট চাচ্চু, বড় ফুপি, ছোট ফুপি, চাচীরা, বড় ফুপির মেয়ে অধরা, মেজো চাচ্চুর মেয়ে রাদিয়া এবং রাফছি, ছোট চাচ্চুর একটা পিচ্চি আছে সেটা কেবল হাঁটতে শিখছে।
সবাই খাবার শুরু করলো। এর কিছু সময় পরই একজন মহিলা আসলো। উনাকে দেখিয়ে বড় ফুপি বললো- সুমন উনি তোমার ছোট মা।
কথাটা শেষ হতে না হতেই কর্কশ শব্দে উনি বললো- আমি কারো ছোট মা নই। আমার একটাই মেয়ে। বাসায় যে কোনো অতিথি আসলেই কি আমি সবার মা হয়ে যাবো নাকি!
আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলো যাতে উনার কথায় আমি কিছু মনে না করি। উনার মাথায় সমস্যা আছে।
আব্বুর ইশারা দেখে আমি আর অবন্তী ফিক করে হেঁসে দিলাম।
আমাদের হাসিটা ছোট মা’র দৃষ্টির আড়াল হয়নি- খেতে বসে এভাবে হাসছো কেন অবন্তী! এসব কি এই কয়েক ঘন্টায় শিখে ফেললে নাকি?
কথাটা যে আমায় কটাক্ষ করে বললো সেটুকু তো বুঝতে পারলাম। কিন্তু তবুও চুপচাপ খেতে লাগলাম।
– বিয়ে তো হচ্ছে না। বাইরে থেকে যে গেষ্ট আসছে তারা যেন কালকেই চলে যায়। নাকি পারমানেন্ট থাকার ইচ্ছে আছে!
এটা কথাও উনি আমাকেই বললো তাই এবার আর চুপ থাকলাম না – দেখুন আমাকে আপনার অসহ্য লাগতেই পারে, কিন্তু আমি তো এর আগে কখনো এখানে আসিনি বা আপনার কোনো ক্ষতি ও করিনি। একটু সুন্দর করে কথা তো বলতে পারেন! মেনে নিলাম আপনার গর্ভে আমার জন্ম হয়নি কিন্তু সম্পর্কে তো আপনি আমার মা’ই।লাগেন। সেদিক থেকে একটু সুন্দর করে কথা বললে খুব বেশি অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আমি এখানে থাকতে আসিনি এটা নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। আমি শুধু এতটুকু দেখতে আসছি আমার পরিবারটা কেমন। যেখানে থাকাটা হয়তো আমার অধিকারে থাকলেও ভাগ্য সঙ্গ দেয়নি।
আমার চোখে পনি টলমল করছে। এখানে আর কিছু সময় থাকলে সবার সামনেই হয়তো দুই এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়বে। সেখানে থেকে দ্রুত প্রস্থান করলাম।
যখন আমাদের আকাশ সমান এক্সপেক্টেশন একবারে মাটির সাথে গুড়িয়ে যায় তখন চোখের বাঁধ যতোই মজবুত হোক না কেন ভেঙে যায়। এতোদিন পরিবার ছিলো না তাই নিজেকে পাষাণ হৃদয়ের মানুষ বলেই জানতাম কিন্তু আজ পরিবারকে এতো কাছে পেয়ে তাদের বলা প্রতিটি কঠিন শব্দ আমার চোখে টলমল সৃষ্টির কারণ হয়ে যাচ্ছে ।
গেষ্ট রুমে নিজের মাথার চুল ধরে টানছি। তখন দরজায় নক পড়লো। অবন্তী হাতে একটা প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
– কিছু বলবা!
– তুমি তো কিছুই খেলে না তাই বড় ফুপি খাবার পাঠিয়ে দিলো।
– আমি খাবো না। তুমি নিয়ে যাও।
অবন্তী আমার পাশে এসে বসে বললো- ভাইয়া আমি তোমায় খাইয়ে দেই! আমার অনেক দিনের শক আমি তোমায় খাইয়ে দিবো।
অবন্তীর এমন করুন আর্জি না করতে পারলাম না।
– তুমি আম্মুর কথায় কিছু মনে করবে না ভাইয়া। এখানে কেউ তোমায় ভালো না বাসলেও আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তুমি শুধু আমার জন্য হলেও কিছু দিন থেকে যেও!
– আচ্ছা আপু।
– ভাই বোনের ইমোশনাল সিন শেষ হলে আমাকে একটু সুযোগ দিলে ভালো হয়।
দুজনেই দরজার দিকে তাকালাম। বড় ফুপির মেয়ে অধরা দাঁড়িয়ে আছে।
অবন্তী জিজ্ঞেস করলো- তুমি এখানে কি করছো?
– তোমার ভাইয়া কিছু খায়নি তখন তাই খাবার নিয়ে আসলাম।
– আমি আমার ভাইয়ার যত্ন নিতে পারি তোমায় লাগবে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
অবন্তীর কথা চেষ হওয়ার আগেই মেয়েটা ভয়ে চলে গেলো। কিন্তু তখন বুঝতে পারি নি দরজার পিছনে ছোট মা দাঁড়িয়ে ছিলো।
#প্রিয়া_চন্দ্রিমা
Sumon Al-Farabi
#২য়_পর্ব
অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কাঁথার ভিতরে থেকে মুখ বের করে দেখলাম একটা মেয়ে এতক্ষণ আমায় জাপ্টে ধরে ছিলো। আমায় দেখেই ভুত দেখার মতো চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
– আপনি! আপনি কে? এখানে কি করছেন?
– আমি এই বাসার গেষ্ট। আমাকে এই রুমে থাকার জন্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আপনি কে! এভাবে আমায় জাপ্টে ছিলেন কেন!
– আমি ভেবেছিলাম এটা বুঝি অবন্তী। মাঝে মাঝে ওকে এই রুমে পাওয়া যায় তো তাই এসেছিলাম।
– আপনার একবার সিউর হওয়া উচিৎ ছিলো। বাসায় একটা অনুষ্ঠান আছে চারদিন পরে এখন তো বাসাতে গেষ্ট আসবেই। তাই জন্য কারো মতো কাউকে মনে হলে আপনি তাকে জাপ্টে নিবেন এটা তো ঠিক না।
– হুম। আমি বুঝতে পারি নি।
– পরের বার থেকে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন।
– হয়েছে! হয়েছে! এতো জ্ঞান দিতে হবে না। কি একটু শান্ত গলায় কথা বলেছি জ্ঞান দেওয়া শুরু করছে। এই যে শুনুন আপনার ভাগ্য বুঝলেন যে চন্দ্রিমা আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলো নয়তো কতো ছেলে পিছনে পরে আছে আপনার মতো ছেলেদের দিকে ফিরেও তাকাই না। আসছে জ্ঞান দিতে।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠে মেয়েটির কাছে গিয়ে বললাম – আপনার পিছনে যারা ঘোরে তাদের পছন্দ খারাপ এতটুকু বুঝে গেছি তাছাড়া তাদের ব্যাক্তিত্বেরও কোনো সন্ধান হয়তো পাওয়া যাবে না। আমি তাদের মতো না। ওহ হ্যাঁ! নিজেকে অভার সুন্দরী ভেবে আকাশ পাতাল কল্পনা করা বাদ দিন কেমন। আপনি অতোটা সুন্দরী না তবে চলে মোটামুটি।
কথাগুলো বলে আমি ওয়াশরুমে গেলাম। ছোট বেলা থেকেই যে মানুষটি যেমন ব্যাবহার ডিজার্ভ করে তাকে ঠিক তার যোগ্য ব্যাবহার দেওয়ার এক অভাবনীয় প্রতিভা আছে আমার মাঝে। এখানেও তার ব্যাতিক্রম কিছুই হলো না।
এখন সন্ধ্যা।
ঘুম থেকে জেগে যাওয়ার পর পেটের মাঝে ইদুর লাফালাফি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এখানে তেমন কাউকে চিনি না। কাকে গিয়ে কি বলবো এটা ভেবেই রুম থেকে বের হওয়া হচ্ছে না।
যতোসব আকাশ পাতাল ভাবনা বাদ দিয়ে বের হয়ে রাফছিকে খুঁজতে শুরু করলাম। হঠাৎই চোখ পড়লো তখন যে মহিলা পানি দিয়েছিল তার দিকে। কিছুটা এগিয়ে গেলাম – এই যে শুনছেন!
উনি কিছু হাতের কাজ করছে। কাজ রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো- কিছু বলবা!
– আপনার সাথে আমার সম্পর্কের নামটা ঠিক আমার জানা নেই। যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি!
– আমি তোমার বড় ফুপু। বলো কি বলবে।
– আমার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে যদি খাবার মতো কিছু পাওয়া যেতো তবে ভালো হতো। না পাওয়া গেলেও সমস্যা নেই আপনি শুধু বলে দিন বাইরে কোথায় খাবারের দোকান পাওয়া যাবে আমি গিয়ে খেয়ে নিবো।
উনি আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রইলো- তুমি এই বাড়ির ছেলে শুধু বাড়ির ছেলে না বাড়ির সব থেকে বড় ছেলে তুমি বাইরে খাবে এটা কি খুব ভালো দেখায়! তুমি টেবিলে বসো আমি খাবার দিচ্ছি।
আমি খাচ্ছি উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
– আর কিছু লাগবে তোমার!
– না ফুপু এতটাই আমার জন্য অনেক।
– তোমার বাসায় আর কোনো ভাই বোন নেই!
– না। আমি একাই। তবে আম্মু একটা মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলো দু মাস আগে বিয়ে দিয়েছি।
– তুমি কিন্তু দেখতে একদম তোমার বাবার মতোই।
– হবে হয়তো। আম্মুও মাঝে মাঝে এমনটাই বলতো। কিন্তু আমার তো আর বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
– এসেছ যখন তখন অবশ্যই দেখা হবে। ভাইজান শপিং শেষ করে আসছে। হয়তো রুমে শুয়ে রেষ্ট করছে। তোমার কিছু দরকার হলে তুমি আমায় বলবে কেমন! একদম লজ্জা করবে না।
– আচ্ছা ।
খাওয়া শেষ করে আমি রুমে এসে শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করছি। দরজায় ঠকঠক শব্দে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালাম। রাফছি দাঁড়িয়ে আছে।
– কিছু বলবা!
– তোমায় ডাকে তাড়াতাড়ি ছাঁদে আসো। ভুলেও দেরি করবা না।
রাফছি দৌড়ে দিলো।
ছাঁদে আবার কি এমন জরুরি কাজ পড়ে গেলো যে এতো আর্জেন্ট যেতে হবে!
ছাঁদের রেলিঙের উপর বসে আছি। আমার সামনে রাফছিসহ পাঁচটা বাঘিনী দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে সুন্দর বনের আইনশৃঙ্খলা মেনে না চলায় সিংহ মামা তাদের সাজা হিসাবে সমাজবাস দিয়েছে।
– রাফছি আমায় ডেকে আনলে কেন!
– রাফছিকে ডেকে আনতে বলা হয়েছে জন্য ডেকে এনেছে। রাফছি তোর কাজ শেষ তুই এখন যা।
– আমিও থাকি আপু।
মেয়েটি এমন দৃষ্টিতে রাফছির দিকে তাকালো মনে হচ্ছে এখনই মনে হয় চোখ থেকে অগ্নি শিখা বের হয়ে রাফছিকে ঝলসে দিবে।
– রাফছি তো চলে এখন বলুন কি বলতে ডেকেছেন।
– আপনার সাহস হয় কি করে আমার বোনের মতো বান্ধবীকে অসুন্দরী বলার!
মেয়েটি অবন্তীর কাছে এসেছে তাহলে হয়তো এটাই অবন্তী। আমি কিছু না বলেই চুপচাপ অবন্তীর কথা শুনছি।
পাশে থেকে চন্দ্রিমা বললো- কি হলো এখন মুখে কোনো কথা আসছে না বুঝি। তখন আমায় একা পেয়ে যা নয় তাই শুনিয়ে দিয়েছে।
– তাছাড়া আপনাকে তো আগে কখনো আমাদের বাড়িতে দেখিনি। আপনি কে! কার কাছে এসেছেন! একজন গেষ্ট হয়ে বাড়ির মেয়েকে উল্টো পাল্টে কথা শোনানোর সাহস আসে কই থেকে!
অবন্তীর এই প্রশ্নটার উত্তর দিলাম – আমিও এই বাড়ির ছেলে হয়তো সাহস টা সেখানে থেকেই আসে।
অবন্তীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি এবার কথা বললো- আমি এ বাড়ির সব থেকে বড় মেয়ে আমি তো কোনো দিন আপনাকে দেখিনি। আপনি এই বাড়ির ছেলে হলেন কিভাবে!
– তুমি তাহলে রাদিয়া।
অবন্তীর রাগ মনে হচ্ছে আরও বেড়ে গেলো- আপনি আপুকে নাম ধরে তুমি করে বলছেন কেন! আপনি কি আপুর বড় নাকি! নাম কি আপনার বলুন ছোট চাচ্চুকে বলে তারপর আপনাকে মজা দেখাচ্ছি।
– আমি সুমন। আজ দুপুরেই ঢাকা থেকে এসেছি।
– তো কি হয়েছে! বিয়ে খেতে এসেছেন! বিয়ে হচ্ছে না। রাতের গাড়িতে আবার ফিরে যান।
অবন্তী রাদিয়ার হাত টেনে বললো- আপু চলো নিচে যাবো। এই চন্দ্রিমা চল। অধরা তুই ও চল।
অবন্তী হাত ধরে টেনে সবাইকে নিচে নিয়ে গেলো।
প্রায় ত্রিশ মিনিট হয়ে গেলো। আমি তখনও ছাঁদে সন্ধার ঝাপসা আলোয় চারদিকে কোথায় কি আছে সেটা দেখার চেষ্টা করছি।
কেমন আছো ভাইয়া! – কথাটা শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে পিছনে তাকালাম।
– ওহ অবন্তী তুমি।
– কি করে বুঝলে আমি অবন্তী!
– তোমার নিরবতা।
– বড় মা কেমন আছে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম – হয়তো ভালোই।
– ভাইয়া আমি যে তোমায় চিঠি দিয়েছিলাম সেটা তুমি প্লিজ আম্মুকে বলবা না। আম্মু জানতে পারলে আমাকে মেরেই ফেলবে।
– আচ্ছা ঠিক আছে বলবো না।
– একটা কথা বলি!
– হ্যাঁ বলো।
– আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবে ভাইয়া!
পাগলী মেয়েটা কথাটা শেষ করেই আমায় জড়িয়ে ধরলো। এই মুহুর্তের অনুভবি না ভাষায় প্রকাশ করা যায় আর না লিখে তুলে ধরা যায়। মনের ভিতরে প্রশান্তির বাতাস বইছে।
– আজ থেকে আমি সবাইকে বলবো আমারও ভাইয়া আছে। আর হ্যাঁ আসার জন্য ধন্যবাদ। একটু পর খেতে এসো রাতে সবাই একসাথে খাই।
অবন্তী যাওয়ার আগে আবার মনে করিয়ে দিলো যাতে করে আমি কোনো ভাবেই না বলি চিঠির কথা। ছোট মা কি এতটাই বদমেজাজী! হয়তো এই জন্য বাবা কখনো আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে চেষ্টা করলে হয়তো পেতো একটু খোঁজ নিতে মা কেমন আছে! সুমন কেমন আছে। কাছে থেকে আদর না পেলেও শব্দে আদরটা অনুভব করে নিতাম।
দুচোখের পাতা ঝাপসা হয়ে আসলো।
– মেয়ের ব্রেইন টিউমার আছে এতো বড় একটা সত্যি লুকিয়ে আপনার বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন! এটা কি আপনারা ঠিক করছিলেন?
পাত্র পক্ষের এমন কথায় থ’ হয়ে ছেলের বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো রাদিয়ার বাবা।
– আপনি এসব কি বলছেন! তাছাড়া আপনাকে এসব বললো কে?
– যেই বলুক না কেন আমি আমার ছেলের জীবন নষ্ট করতে পারবো না। তাছাড়া আপনার থেকে এমন কিছু আমি আশা করিনি।
বিষয়টা পুরোটা খোলাসা করে না বলেই ছেলের বাবা প্রস্তান করলেন।
চোখেমুখে রাজ্যের চিন্তা নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে রাদিয়ার বাবা। তার পাশে পরিবারের সবাই নিজেদের মতো আলোচনা করে যাচ্ছে। সকলের একটাই প্রশ্ন কে সেই ব্যাক্তি যে এমন মিথ্যা রটনা রটালো! তাদের ফুলের মতো মেয়েটার জীবন এভাবে নষ্ট করে দিলো।
বাসার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সকলের এমন সব কথোপকথন অবাক হয়ে শুনছি আমি। তারা আলোচনায় এতটাই নিমজ্জিত যে, কেউ খেয়াল করে নি অপরিচিত একটা ছেলে তাদের বাসায় এসে তাদের সব কথোপকথন শুনছে।
ঠিক অপরিচিত বললে ভুল হবে। তাদের সাথে আমার সম্পর্ক আছে, রক্তের সম্পর্ক। শুধু যোগাযোগ নেই। এখানে যারা আলোচনা করছে কেউ আমার চাচ্চু, কেউ ফুফু, কেউ চাচী। কিন্তু আমি তাদের কাউকেই চিনি না। জন্মের পর এই প্রথম তাদের সাথে আমার দেখা হচ্ছে।
এতক্ষণে কেউ একজন আমায় খেয়াল করলো। আমার কাছে এসে বললো- কে তুমি! এখানে দাঁড়িয়ে কি শুনছো?
আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কলার ধরে টেনে সকলের সামনে নিয়ে গেলো- ভাই এটাই মনে হয় সে মানুষ যে আমাদের মেয়ের ব্যাপারে গুজব রটিয়ে এখন মজা নিতে আসছে।
আমি অবাক হয়ে লোকটার চোখের দিকে তাকালাম। রাগের কারণে মানুষ যে তার সাধারণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তার বাস্তব উদাহরণ দেখছি।
লোকটার কথায় সবার আলোচনা বন্ধ হয়ে গেলো এখন সবার প্রধান আকর্ষন আমি। সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজেকে জেল পলাতক খুনীর মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত আসামি মনে হচ্ছে।
লোকটা তখনও আমার কলার ধরেই আছে যাতে করে আমি পালিয়ে যেতে না পারি। একজন বৃদ্ধমতো লোক এসে আমার কলার থেকে উনার হাত সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো- কে তুমি!
এতক্ষণে তাদের আচরণ দেখে রিতীমত আমার গলা শুকিয়ে কাঠ খড়ি হয়ে গেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু এতটুকু বললাম – আমি সুমন। আমায় এক গ্লাস পানি দিবেন! গলা শুকিয়ে গেছে।
একজন অল্প বয়স্ক মহিলা পানি ভর্তি একটা গ্লাস আমার দিকে এগিয়ে দিলো।
কলার ধরে নিয়ে আসা লোকটার চোখে এখনো আগুন ঝরছে। কর্কশ শব্দে জিজ্ঞেস করলো- গলা ভিজেছে! এখন বল কে তুই!আমাদের বাসায় কেন!
– আমি সুমন, আমার আম্মু সুলতানা।
– সেটা তো জানলাম কিন্তু আমাদের বাসায় আসার কারণ কি!
পাশে থেকে একটা মেয়ে বললো- তুমি কি আপুর বন্ধু! বিয়ের দাওয়াতে আসছো?
মেয়েটার দিকে তাকালাম মেয়েটার বয়স খুব বেশি হলে পনেরো হবে। মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলা ধমক দিয়ে মেয়েটিকে চুপ করিয়ে দিলো – সব সময় বড়দের কথার মাঝে কথা বলা।
বৃদ্ধ লোকটা আবার আমায় জিজ্ঞেস করলো- এখন তুমি বলো আমাদের বাসায় কেন এসেছো!
– জনাব কাশেম সাহেব আছেন?
– উনি বাইরে গেছেন। কিছু বলার হলে আমাদের বলো আমরা উনাকে বলে দিবো।
– আমি উনার ছেলে। ঢাকা থেকে এসেছি।
আমার এই একটা লাইন পুরো মহলকে পরিবর্তন করে দিলো। সবাই নিরব হয়ে আমার দেখছে। কারো মুখে কিচ্ছুটি বলছে না।
– গত সপ্তাহে আমার কাছে একটা ডাক আসে সেখানে ঠিকানা দেওয়া ছিলো আর ২০ তারিখের আগেই আসতে বলা হয়েছিলো। আমি কখনো ওনাকে দেখিনি তাই একনজর দেখার জন্য আসলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল দিন চলে আসছি।
– তেমন কিছু না।
চোখ রাঙিয়ে কথা বলা লোকটা এবার শান্ত গলায় বললো- তুমি অনেকটা জার্নি করছো ফ্রেশ হয়ে রেষ্ট নাও।
ছোট মেয়েটাকে বললো আমায় গেস্ট রুমে নিয়ে যেতে।
– ভাইয়া এইটা তোমার রুম। তুমি এখানেই আরাম করো।
– এই শোনো।
– কিছু বলবা!
– তোমার নাম কি?
– রাফছি।
– নিচে কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে!
– তেমন কিছু না। ২০ তারিখে আপুর বিয়ে ছিলো। কিন্তু কেউ একজন পাত্র পক্ষকে বলেছে আপুর নাকি ব্রেইন টিউমার আছে। তাই তারা আর বিয়ে দিবে না। এটা নিয়েই কথা বলছে সবাই।
এতটুকু বলে মেয়েটি আমার কানের কাছে এসে বললো- আমি কিন্তু জানি কে বলেছে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – তুমি কিভাবে জানো! জানোই যখন তাহলে সবাইকে বলে দিচ্ছো না কেন!
– বাইরের কেউ যদি বলতো তবে তো সেই কবেই বলে দিতাম কিন্তু আপু নিজেই পাত্র পক্ষের কাছে এগুলো বলিয়েছে তার বন্ধুদের দিয়ে।
-মারাত্মক ভয়ংকর মেয়ে তো, নিজের বিয়ে নিজেই ভেঙে দিচ্ছে।
– ছেলেটাকে আপুর একদম পছন্দ হয়নি। সত্যি বলতে আমার ও ভালো লাগেনি। তাই বাসায় কাউকে কিছু বলিনি নয়তো আপুর প্রতি আমার অনেক প্রতিশোধ নেওয়া বাকী আছে। আমি তো শুধু সুযোগের অপেক্ষা করছি।
– বনে বনেই শত্রুতা। আচ্ছা কাশেম সাহেব তোমার কে হন?
– বড় আব্বু।
– উনার ছেলে মেয়ে নেই!
– আছে তো অবন্তী আপু। ওনারা সবাই শপিংয়ে গেছে আসলে সবার সাথে পরিচিত হতে পারবে। আমি তাহলে এখন আসি ভাইয়া তুমি রেষ্ট করো।
রাফছি চলে গেলো। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিজেকে বিছানায় বিলিয়ে দিলাম। দীর্ঘ জার্নির পর দুচোখের পাতায় রাজ্যের যত ঘুম এসে জমাট বেঁধেছে। একটা কাঁথা পুড়ো শরীরে মুড়িয়ে শুয়ে পড়লাম।
নিশ্বাস ক্রমশ কম হয়ে আসছে নিজেকে মেলে ধরতে পারছি না, খুব অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে আমায় শক্ত কোনো রশি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। চোখ খুললাম কিন্তু আমি তখনও সম্পূর্ণ কাঁথার নিয়ে। নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই পারছি না। এমন সময় একটা কন্ঠ ভেসে আসলো- যতোই চেষ্টা করো ছাড়াতে পারবে না আজ তোমার নিস্তার নেই।
কথাটা ঠিক আন্দাজ করতে না পারলেও আমার পুরো শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। গলাতেও বিন্দু মাত্র লালার অবশিষ্ট নেই।
‘আব্বা, আমার কাছে আসবেন না। আমার কাছে আসলে আমি নিজেকে এক্ষুনি শেষ করে দিবো! ভাবেন একবার, আপনি কি চান আমার জীবন না আপনার জেদকে বহাল তবিয়তে রাখতে চান? আমি তাজফি ভাইকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না, শুনে রাখেন কান খুলে। আমার রাগ আর জেদ সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনি অবগত আব্বা? আমি যা বলি তা করেই ছাড়ি। এখনো বলছি সময় আছে।’
মতিউর রহমানের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। একমাত্র কন্যা তার। এভাবে তো তার জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন না তিনি। তার সোনার কন্যার জন্য তিনি জীবনের সবটুকু জেদ জলাঞ্জলি দিয়ে দিতে পারেন। নুরিশা হাতের ছু’রিটা তখনও গলায় ধরে রেখেছে। মেয়ের এমন রাগ আর জেদ সম্পর্কে সবাই অবগত। তথাপি বেশি উচ্চবাচ্চ করতে পারলেন না কেউ-ই। রিক্তা এক পাশে মুখে আঁচল চেপে ডুকরে উঠে কাঁদছেন। বিভা নানা রকম ভাবে তাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন। ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে সকলে। নীতি আর নুহাশ ওদের আপার এমন কান্ডে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। বাবা আর বড় চাচার এমন ভয়াবহ রূপ তারা আগে কখনোই দেখেনি।
‘ভাইজান, নুরিশা আপনারে ভয় দেখাইতাছে। আপনি ভয় পাবেন না। নিজের জীবন নেওয়া এতো ইজি না।’
চাচার কথা শেষ হতে না হতেই নুরিশা হাতে চাকু বসিয়ে টেনে দিয়েছে৷ হাতের ফিংকি দিয়ে শিরশির করে রক্ত ফ্লোরে গড়িয়ে পড়লো৷ হাহুতাশ করে উঠলো উপস্থিত সকলে। বিশেষ করে মতিউর রহমান। তাজফিকে মেয়েটা এতোটা ভালোবাসে? মতিউর রহমান এর চোখে পানি। তবে কি তিনি অনেক বড় ভুল করে ফেললেন? মতিউর রহমান এগিয়ে আসতে নিলে হাতের উলটো পাশে আবার ছুড়ি বসালো নুরিশা। অনেক কষ্টে বললো,
‘আব্বা, আপনি আমাকে তাজফি ভাইয়ের সঙ্গে বিয়া দিবেন কি না বলুন? যদি রাজি না হোন, তাহলে আমি নিজেকে আরও আঘাত করবো। আপনি আমাকে হারাবেন। আর আমার কাছে আসবেন না। আমি তাহলে আরও হাত কা’ট’বো, না নাহ, এবারে আমি সোজা গলায় কা’ট’বো।’
এরকম একটা ঘটনায় হতভম্ব রিক্তা আর বিভা ছুটে আসতে চাইলেন, কিন্তু নুরিশা কম্পনরত গলায় আবারও বললো,’খবরদার আম্মা, তুমি যদি আমার কাছে আসো তবে আমি আরও আঘাত করবো নিজেকে।’
‘ছু’ড়ি ফেলে দাও। আমি রাজি তোমার কথায়!’
‘নাহ এভাবে হবে না। আপনি কথার খেলাফ করতে পারেন আব্বা। আপনি আমার মৃত দাদির নামে শ্বপথ করে বলুন আপনি আমার আর তাজফি ভাইয়ের বিয়ে দিবেন!’
মহা বিপাকে পড়ে গেলেন মতিউর রহমান। শফিউল্লাহ ভাইকে দেখে বুঝে গেছেন তার ভাই মেয়ের খারাপ অবস্থা সহ্য করতে না পেরে রাজি হয়ে যাবেন। তিনিও নুরিশাকে ভালোবাসেন নিজের সন্তানদের মতো। তাই তিনিও নুরিশার ক্ষতি চান না। মতিউর রহমান গম্ভীর মুখে বললেন,
‘ঠিক আছে, আমি আমার মৃত মায়ের নামে শ্বপথ করছি ঐ বেকার, মেরুদণ্ডহীন ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো। এবারে ছু’রি রাখো।’
নুরিশা কথাটা শোনার পর শুষ্ক ঠোঁট জোড়া বাকা করে হাসলো। মনে মনে বললো, ‘আপনি তো এই কসম দেওয়ার খেলাটা শুরু করেছেন আব্বা, আর আজ আমি সেটা শেষ করলাম আপনাকে মাত দিয়ে৷’
কিয়ৎক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে সেখানেই লুটিয়ে পড়লো নুরিশা। তার হাতের অবস্থা ভয়াবহ। র’ক্তে রঞ্জিত হলো ফ্লোর। তার বন্ধ হওয়া চোখের পাতা গড়িয়ে অশ্রু কনারা ঝড়ে পরলো। বিভা আর রিক্তা দৌঁড়ে এলেন।
‘আমার মেয়েকে বাঁচাও তোমরা।’
রিক্তা বেগম চেঁচিয়ে উঠে জ্ঞান হারালেন। বিভা ব্যস্ত হতে পড়লেন তাকে নিয়ে। মতিউর আর শফিউল্লাহ্ কাছের হসপিটালে নিয়ে গেলেন নুরিশাকে। তার ভালো ভাবে চিকিৎসা করানো হলো। বেশি ক্ষতি হয়নি। তবে অনেক বড় কিছু হতে পারতো যদি ক্ষ’তটা গভীর হতো।
•
সপ্তাহ খানেক পরের কথা। তাজফি তখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে নুরিশার বাড়ি আসছে। রাত সারে নয়টা বাজে। এতো দিনে নুরিশা জানতে পেরেছে তাজফির বয়স্ক দাদু আছেন, যিনি গ্রামে থাকেন। উনি কাল গ্রাম থেকে নাতীর বিয়েতে এটেন্ড করবেন। গ্রামে তাজফির দাদুর অনেক সায়-সম্পত্তি! তাছাড়া স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা থেকে তার কবর রেখে কোথাও যান না। সেখানেই তিনি সুখ খুঁজে পান। নুরিশা তাজফির ঠিকানা জোগাড় করে তার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলো। সেদিন তার মুখে দাদুর কথা শুনে গোল গোল চোখে তাকিয়ে ছিলো।
‘আপনার দাদু আছে, আর সেটা আজ জানতে পারছি? আপনি তো আগে সব সময় বলতেন আপনার তিন কুলে কেউ নাই!’
‘আমিও জানতাম না। আমার আব্বা, আম্মা বিয়ে করেছিলেন আমার দাদার অমতে। আমার দাদি মেনে নিতে পারেন নি তাদের। ছেলের এমন একটা কাজের জন্য তিনি সেসময় রেগে বলেছিলেন, “আমি ম’ই’রা যাওনের পর তুই তোর বউরে এই বাড়ির চৌকাঠে আইনা দাঁড় করাস। আমার নিঃশ্বাস থাইকতে তোর বউরে আমি মাইনা নিমু না। আর যদি এই বাড়িত আসোস তাইলে আমার ম’র’ন দেখবি!’’ আমার দাদা ছিলেন বউ ভক্ত। আমার আব্বার জন্য মন পুড়লেও তিনি তার বউর মুখের উপর কথা বলেন নাই। আব্বা আম্মাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। অনেক কষ্টে শহরের এসে নিজেদের সংসার গড়ে তুলেন। আব্বা যখন যে কাজ পেতেন সেটাই করতেন। আমি যখন আমার আম্মার গর্ভে তখন আব্বা ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষিত হয়ে মা’রা যান। দাদি নাকি নীরবে কাঁদতেন আব্বার জন্য। একটাই ছেলের সঙ্গে, তিনি এতোটা কঠোর না হলেও পারতেন। আফসোসে পুড়তেন সব সময়। আমি তখন অনেক ছোট, আমাকে নিয়ে আম্মা হলেন দিশেহারা। নানা নানির বাড়ি হলো আমাদের থাকার জায়গা। আম্মা ওখানে কাজের বুয়ার মতো খাটতেন৷ কারণ নানা নানিরাও মেনে নেন নি তাদের অমতে বিয়ে করায়। আমি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম সবটা, আম্মার কষ্ট আমার চোখে সহ্য হতো না। ঐ বাড়ির সবাই আম্মার সঙ্গে যে ব্যবহার টা করতো, বোধহয় একটা নে’ড়ে কুকুরের সঙ্গেও ওতো জঘন্য ব্যবহার করা হতো না।
আম্মা আমাকে সব সময় তাদের সব গল্প বলতেন। বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করে তিনি সব হারিয়েছেন। আমি যেনো এমন কিছু না করি। কিন্তু কখনোই তিনি দাদা দাদির গ্রামের বাড়ির কথা বলেন নি। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আম্মা নড়ে না। সুস্থ সবল মানুষ, সকালে উঠে নেই। বুঝলাম আম্মাও আমার একা করে চলে গেলেন। আম্মা তো সম্পুর্ন সুস্থ ছিলো জানো বালিকা? হঠাৎই আম্মার মৃ’ত্যুটা মানতে পারি নি। আমি দশ বছর বয়সের ছোট্ট ছোকরা। মামা, নানা, নানির অত্যাচার সইতে না পেরে আমি ঐ বাড়ি ছাড়ি। তাদের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মে গেছিলো। আস্তে আস্তে নিজেই কাজ করতে থাকি, চায়ের দোকান, খবরের কাগজ বিক্রি করা, ফুটপাতে বসে ফুল বিক্রি করা, রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে কুলি গিড়ি করতাম। আর আমার স্কুলে ভর্তি হওয়া টা ছিলো অকল্পনীয়। আমাকে একজন হি’জ’ড়া স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। আমি তার কাছেও যাই। আমি এখন উনার কাছেই আছি। উনাকে আমি মিশু খালাম্মা বলে ডাকি ছোট থেকেই। কত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি আমি জানি। আমার অনার্সে ভর্তির পর দাদা আমার খোঁজ পান৷ আমার খোঁজ কিভাবে পেয়েছেন, কি করে পেয়েছেন আমি জানি না। দাদা কখনো বলেননি আমাকে। আমিও জিজ্ঞেস করিনি। মাঝে মধ্যে দাদা আমাকে কল দিতেন। সেদিন যখন হুরমুড়িয়ে তোমাদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম,তখন আসলে আমার কাছে আমার দাদির মৃ’ত্যু’র খবর আসে। তাই ছুটে গেছিলাম। যতোই হোক র’ক্তের টান তো আছে। এরপর প্রায় ই আমি দাদার কাছে যেতাম। তবে দাদার থেকে আর্থিক সাহায্য নিতে আমার বাঁধতো। আমি মনে করি আমি বরাবরই একা, নিঃস্ব মানুষ।’
‘আমাকে জানালে কি হতো?’
‘এসব জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি, বুঝলে বালিকা? তা বলো, কেন ডেকেছো? আশেপাশে তোমার বজ্জাত, বাপ চাচা নাই তো?’
নুরিশার চোখে তখন পানি চিকচিক করছে। নুরিশা নিজেকে দমিয়ে সহাস্যে বললো,
‘আরে আপনার সাহস তো কম না। আপনি আমার সামনে বসে থেকে আমার আব্বা আর চাচাকে বজ্জাত বলছেন?’
‘তো বজ্জাত, নির্দয় না হলে কি তারা আমাকে ওভাবে মা’র খাওয়াতে পারতো? আমার পায়ের কি হাল হয়েছে দেখেছো?’
‘আব্বা বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছেন। আপনি এখন আব্বার কাছে যেতে পারেন।’
‘আরেব্বাস, এই অসম্ভব কে সম্ভব করলে কি করে?’
নুরিশা তাজফির কাছে সবটা বলতে বলতে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিলো। তাজফি আচানক সেদিন তাকে দুই হাতে জাপটে ধরেছিলো। নুরিশা লজ্জা পাচ্ছিলো সেদিনের কথা ভেবে।
তাজফির নুরিশার বাড়িতে পৌঁছাতে দশটা বেজে গেলো। কলিং বেল টিপে দাঁড়িয়ে রইলো সে। এখন আর তাজফি ভয় পাচ্ছে না। সে এর আগেও দুদিন এসেছে। এসে মতিউর রহমানের মুখ ঝামটা সহ্য করেছে। তাকে দেখে তাজফি গা জ্বালানো হাসি দিয়েছে। নুরিশা দরজা খুললো, কপট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘আসতে এতো দেরি হলো?’
‘হাঁটতে ব্যাথা পাচ্ছিলাম তো।’
‘একটা রিকশা নিতে পারতেন!’
‘আমার কাছে একটা টাকাও নেই।’
নুরিশার চোখ আবারও ভিজে উঠলো। এই মানুষ টার সাথে সে কিভাবে সংসার করবে? এতো বেখায়ালি আর বেপরোয়া হলে চলে?
রোজকার মতোই মতিউর রহমান গম্ভীর মুখে এদিকে সেদিক তাকিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে রিক্তাকে বলে গেলেন চা দিতে। তাজফি আর নুরিশা পাশাপাশি বসলো।
‘এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আনো তো বালিকা।’
নুরিশা চলে গেলো পানি আনতে। রিক্তা বেগম এলেন তাজফির সঙ্গে কথা বলতে।
‘বাবা ভালো আছো?’
‘ভালো আছি আন্টি। আপনারা সবাই ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ, ভালো আছি। তোমার পায়ে এখনো ব্যাথা পাও?’
‘হ্যাঁ ব্যাথা লাগে!’
তাজফি মুখ গোমড়া করে বললো। রিক্তা বেগম মলিন মুখে চা নিয়ে চলে গেলেন স্বামীর রুমে।
চা দিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,’আজকে এখানে খেয়ে যেও৷ যেহেতু কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে না তাই কাউকেই দাওয়াত দেওয়া হয়নি। তোমার দাদুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমরা সবাই। তুমি তো বললে উনি কাল আসবেন! তাই কালই বিয়ে হচ্ছে!’
তাজফি লজ্জা পেলো। রিক্তা বেগম বললেন,’তোমাকে কি চা দিবো বাবা?’
‘দিন!’
নুরিশা পানি নিয়ে এলো তখন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রিক্তা বেগম চলে গেলেন চা আনতে। মেয়েটার মধ্যে এখনো বাচ্চা সুলভ আচরন আছে অনেকটা। তা না হলে সপ্তাহ খানেক আগে কেউ ওমন ভয়াবহ কাজ করে? এতো ভালো মেয়েটার এমন মতিভ্রম কবে হলো?
‘আম্মা আপনাকে খেয়ে যেতে বলছেন?’
‘হ্যাঁ বলেছেন।’
‘আজও খাবেন না তাই না?’
‘খাবো!’
‘যাক খুশি হলাম শুনে। তা আজ খেতে রাজি হলেন যে?’
‘আজ আন্টির চোখ মুখে আমার জন্য গভীর মাতৃত্ব দেখেছি। আর তার কথা অগ্রাহ্য করার অধিকার আমার নেই। আচ্ছা, তোমার কি রঙের শাড়ী পছন্দ? আগেই বলে দিচ্ছি একটা সস্তার শাড়ী তোমার বিয়েতে দেবো। আমার যা সামর্থ্য আছে তাতেই একটা শাড়ী কিনেছি। বেনারসি শাড়ি, লাল রঙের মধ্যে সবুজ রঙের কারুকাজ। অনেক সুন্দর দেখতে।’
নুরিশার আবার চোখ ভিজে উঠছে। এতো খুশি কেন লাগছে? কাল থেকে এই মানুষ টা তার হবে, একান্তই তার। আর কোনো বাঁধা বিপত্তি নেই। দুনিয়ার কেউ তাদের দিকে আর বাকা চোখে তাকাতে পারবে না।
‘নুরিশা চা নিয়ে যাও!’
‘আমি চা আনছি বসুন!’
নুরিশা উঠে গেলো। তাজফি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো৷ বাড়িটা অসম্ভব সুন্দর। এতো সুন্দর বাড়ি এই তল্লাটে নেই। রেহান আর আনিকা কোথা থেকে যেনো এলো। আনিকা তাকে দেখে হেসে বললো,’আরে তাজফি ভাই, কি অবস্থা? আপনাকে তো দেখা যায় না।’
‘আমার অবস্থা দেখতেই পারছেন ভাবি। আপনারা কোথা থেকে এলেন?’
‘আমরা তো আমাদের বাড়ি গেছিলাম। আমার আম্মার জ্বর করেছে খুব তাই তাকে দেখতে গেছিলাম। আর কাল আমার এক মাত্র ননদিনীর বিয়ে তাই রাতেই চলে এলাম। আম্মা এখন কিছু টা সুস্থ আছেন।’
আনিকা আরও কিছুক্ষন গল্প করে চলে গেলো। রেহান আর তাজফি আড্ডা দিতে লাগলো। তাদের মাঝের বন্ধুত্ব ঠিক সেই আগের মতো। সেই প্রথম দিনের মতোই সে মনে করে নুরিশা তাজফির কাছে সবচেয়ে নিরাপদে থাকবে। তার বোন তাজফির কাছে যতটা ভালো থাকবে এমন কোথাও আর সে ভালো থাকবে না। তাই তো সে নিজে সুবাশ নামক ছেলেটাকে বারণ করে দিয়েছে নুরিশাকে বিয়ে দেবে না সেখানে। সুবাশ শুধু অসহায় চোখে তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলেছিলো। রেহান স্পষ্ট দেখেছিলো সুবাশের চোখে তার বোনের জন্য দূর্বলতা রয়েছে। তবুও তার এখানে কিছু করার ছিলো না। কারণ তার বোন যে তাজফিকে মন থেকে ভালোবাসে। তাকে ছাড়া সে বাঁচতে পারতো না।
রাতের খাবার সবাই এক সঙ্গে খেলো। তাজফি প্রথমবার এতো তৃপ্তি করে খেয়েছে। রিক্তা বেগমকে একটু পর পর চোখ মুছতে দেখেছে তাজফি। মায়েরা বোধহয় এমনই হয়।
‘এখনি যাবেন তাজফি ভাই?’
‘হ্যাঁ, সারে এগারোটা বাজে। অনেক রাত হলো।’
‘বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে।’
‘হোক, আমি একটা রিকশা নিয়ে চলে যাবো!’
‘আপনার কাছে তো টাকা নেই বললেন!’
‘বাসায় টাকা আছে, আমার সঙ্গে নেই শুধু। ওখানে গিয়ে টাকা দিবো! কিছু বলবে?’
নুরিশা মাথা নত করলো। মাথা নত করে বললো, ‘আজকে আমি সাজুগুজু করেছিলাম। আপনি কি তা লক্ষ্য করেন নি?’
‘করেছি!’
‘তাহলে প্রশংসা করতে এমন কার্পণ্য বোধ করার মানে কি?’
‘আমি যে প্রশংসা করতে পারি না বালিকা।’
মন খারাপ করে বললো, ‘আচ্ছা, আপনি যান!’
‘সত্যি কথা বলবো?’
‘বলুন!’
‘আজকে তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘এয়্যাহ?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমার হি’টলার বাপের জন্য এখানে থাকাটা রিস্ক। দেখা গেলো আগামীকাল এখান থেকে আমার লাশ বের হচ্ছে। বউ নিয়ে আর যা-ওয়া হচ্ছে না।’
‘তাজফি ভাই, সব সময় বাজে কথা।’ রেগে গেলো নুরিশা।
‘আজ থেকে যান না তাজফি ভাই! বৃষ্টিতে ভিজবেন না।’
তাজফি আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই৷ সে নুরিশা কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘আজ এখানে থাকলে দ্বিতীয় বার তোমার সর্বনাশ হবে বালিকা।’
‘কি হবে?’
‘তোমায় ছুঁতে ইচ্ছে হবে। আমার হৃদয়ে প্রস্ফুটিত হওয়া প্রেমের বিষে তুমি দগ্ধ হবে। এই বৃষ্টি ভেজা রাতকে মনে হবে আলোকজ্জ্বল, চাঁদনী রাত। আমার বুকের খাঁচায় লুকিয়ে রেখে তোমার হৃদস্পন্দনের শব্দ গুনতে ইচ্ছে হবে। তখন অত্যন্ত অধৈর্য হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে দেবো। কথা বলার জন্য ঘরের এই কোণ থেকে ঐ কোণ ছুটাছুটি করবো। তুমি তখন বারণ করতে পারবে না। তোমার দু-চোখ আমাকে আগ্রাসী করে তুলবে। তোমার এই নিরবতার মধ্যে লুকিয়ে থাকবে হাজারো গীতিকথা! আমাকে বেপরোয়া করে দেবে, আর তুমি দগ্ধ হবে প্রেম অনলে, সোনার কন্যা!’
‘আমি আপনার প্রেমে দগ্ধ হতে চাই তাজফি ভাই! আজ থেকে যান!’
তাজফি মুচকি হেসে গান ধরলো। গান গাইতে গাইতে সে হাঁটা ধরলো।
“একটা ছিল সোনার কন্যা
মেঘ বরণ কেশ,
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ
দুই চোখে তার আহারে কি মায়া
নদীর জলে পড়ল কন্যার ছাঁয়া
তাহার কথা বলি
তাহার কথা বলতে বলতে নাও দৌঁড়াইয়া চলি!
কন্যার ছিল দীঘল চুল
তাহার কেশে জবা ফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা
কন্যা করল ভুল
কন্যা ভুল করিস না
ও কন্যা ভুল করিস না
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না
হাত খালি গলা খালি
কন্যার নাকে নাকফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা
কন্যা করল ভুল
এখন নিজের কথা বলি
নিজের কথা বলতে বলতে
নাও দৌঁড়াইয়া চলি
সবুজ বরণ লাও ডগায়
দুধসাদা ফুল ধরে
ভুল করা কন্যার লাগি
মন আনচান করে
আমার মন আনচান করে।”
নুরিশা দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রুমে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিলো তার প্রিয়তমকে।
ভালোবাসলে টান টা দুজনের দিক থেকেই থাকতে হয়। আর যে সম্পর্কগুলোতে পরস্পরের ওপর একে ওপরের বিশ্বাস আর ভালোবাসা থাকে সেই সম্পর্কগুলোই পূর্ণতা পায়। নুরিশা মনে করে তাদের দুজনের প্রতি এই টান আজীবন, শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থেকে যাবে।
রাত বাজে তিনটার কাছাকাছি। তাজফি আর নুরিশা পাশাপাশি বসে আছে। ব্রেঞ্চের এক প্রান্তে তাজফি আর আরেক প্রান্তে নুরিশা। অন্ধকারেও গভীর দৃষ্টিতে নুরিশা তাজফির দিকে তাকিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাজফি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে আকাশপানে তাকিয়ে আছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে নুরিশা প্রশ্ন করলো,
‘আপনার আর আমার দূরত্ব কত খানি তাজফি ভাই?’
‘ঐ যে আকাশ দেখছো, ঐ আকাশসম দূরত্ব!’
‘দূরত্বে আপনি সুখী হবেন?’
তাজফির ভেতরটা কেঁপে উঠলো। বললো,’হ্যাঁ!’
‘তবে তাই হবে, আমার কিছু প্রশ্ন আছে সেগুলোর উত্তর দিন!’
‘কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। আমার সঙ্গে থাকলে তুমি জীবনেও সুখী হবে না এটা মানো? তোমার দাদি আমায় তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন, আমি তোমাকে আমার নিজের কাছে রেখে অসুখী কি করে করি?’
‘সুখটা আসে ভেতর থেকে। আপনি যদি মনে করেন, টাকা আছে মানেই আমি সুখী হবো তবে আপনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। টাকা দিয়ে আর যাই হোক সুখ কেনা যায় না। যেখানে ভালোবাসা বিদ্যমান সেখানে সুখ আপনা ধরা দেই। টাকা দিয়ে ভালোবাসা বিচার করা যায় না!’
‘আমার কাছে তোমার জন্য এক বুক ভালোবাসা আছে, কিন্তু রাজরানীকে এক নিমিষেই পথের ভিখারি বানানোর সাহস নেই৷’
‘আপনি একটা কাপুরষ! কাপুরষরা দূর্বল হয়। আপনি কোনো দিন আমার ভালোবাসার যোগ্য ছিলেন না আর না ভবিষ্যতে হবেন!’
‘অযোগ্য মানুষকে ভালোবাসলে মৃ’ত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়৷ আর তুমি সেই যন্ত্রণা ভোগ করছো সেচ্ছাই। কিন্তু এই যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে যেতে পারো , নতুনে মজো। আর সেটা এক মাত্র আমার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ালেই তা সম্ভব হবে! তোমার বাবা মা যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছেন তাকেই বিয়ে করো!’
নুরিশা তাজফির দিকে এগিয়ে এলো। রাগে দুঃখে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাজফিকে থাপ্পড় দিলো। তাজফি নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলো। যেনো কিছুই হয়নি। তাজফি নড়লোও না। নুরিশা দু চোখের পানি ছেড়ে দিলো। কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে তার। চাপা ক্ষোভের সহিত বললো,
‘লজ্জা করে না আপনার? নিজের ভালোবাসার মানুষকে বলছেন অন্য কাউকে বিয়ে করতে! বলছেন নতুনে মজতে? ছিঃ মানছি সেদিন একটা দূর্ঘটনা ঘটেছিলো। কিন্তু যা হয়েছিলো তা কি বদলাতে পারবেন? পারবেন না। আমাকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিলে আমি সুখী হবো? সেই মানুষ টাকে ঠকানো হবে না? বলুন?
তাজফি নিশ্চুপ, একটি বাক্যও সে উচ্চারণ করলো না। নুরিশার দিকে তাকালো না একটিবার ও। নুরিশা আরও কিছুটা দূরত্ব কমালো। তাজফির দুই চিবুকে হাত রেখে তার দিকে ফেরালো। বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে গালে হাত বোলাতে বোলাতে ধরা গলায় বললো, ‘সেদিন আপনার আর আমার মাঝে যা কিছু হয়েছে সেটার কি কোনো মূল্য নেই? আমি জানি, সেদিন আপনার কোনো দোষ ছিলো না, আমিই জোর করে…! বাদ দিন সেসব কথা। আমি আপনাকে পাওয়ার জন্য মৃ’ত্যুর চাইতেও অধিক যন্ত্রণাকে বরণ করে নিতে রাজি। কিন্তু আমাকে নতুনে মজতে বলবেন না। সেটা আরও ভয়ংকর হবে। আমাকে আপনার থেকে আলাদা করবেন না তাজফি ভাই! আপনার পায়ে পড়ি আমি! আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে গ্রহণ করার আগে ম’রে যাবো। বুঝেছেন আপনি?’
‘তুমি এই মুহুর্তে আমার হাত ধরে চলে যেতে পারবে? আমি জানি পারবে না। আমি নিজেও চাই না এরকম কিছু। আমি যে বড্ড নিরুপায় বালিকা!’
‘আমি আমার বাড়ির মান সম্মান এভাবে ধুলোই মিশিয়ে দিতে পারবো না। আমি যেমন আপনাকে ভালোবাসি, তেমনই আমার পরিবারের সবাইকেও ভালোবাসি। তাই এমন কাজ করতে পারবো না। আপনি আমার আব্বার কাছে প্রস্তাব রাখুন।’
‘আপনি খুব ইনসেনসেটিভ, দয়া মায়া নেই। আপনি একটা দয়া মায়া হীন পুরুষ!’
‘পুরুষ মানুষের দয়া মায়া কম থাকে! জানো না?’
‘নাহ, পুরুষ মানুষের দয়া মায়া থাকে না কথাটা শুধুই আপনার জন্য প্রযোজ্য! আমার বাবা, ভাই তারা তো আপনার মতো না।’
‘বালিকা, শান্ত হোও। ঘরে যাও। আর থেকো না। চারিদিকে আলো ছডাচ্ছে। প্রায় চারটে বাজে, লোকে দেখলে তোমায় বদনাম দেবে!’
‘আমি আমার উত্তর চাই!’
‘কি জানতে চাও?’
নুরিশা তাজফির হাত ধরলো মুঠো করে। নিজের মাথায় হাত রেখে বললো,’আমার কসম তাজফি ভাই। আপনি কেন আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন? কেন এই দুরত্ব? কোন নিষেধাজ্ঞার জের ধরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন?’
‘তোমরা বাপ- মেয়েতে আমাকে কি পেয়েছো? আমাকে কি খেলার পুতুল পাইছো? তোমার বাপ দাদির কবর ছু্ইয়ে প্রতিজ্ঞা করাবে, বলবে তোমার থেকে দূরত্ব বাড়াতে। আর তুমি আমার কাছে আসার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছো? আমাকে কি শান্তি দেবে তোমরা? তুমি কি জানো, দাদির মৃত্যুর দিন আমি এসেছিলাম? রেহান আর আমি দাদির খাটিয়ার পেছনের অংশ ধরেছিলাম? দাদির কবর দেওয়ার পর যখন ফিরে যাচ্ছিলাম তখন তোমার বাবা আমাকে কাছে ডাকেন। অত্যন্ত সন্তর্পণে, ঠান্ডা মেজাজে আমাকে কলিজা ছিদ্র করা অপমান করেছেন? জানো কি বলেছেন তিনি? বলেছেন, “তাজফি বাবা, তুমি নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ। কিন্তু তোমার মতো বেজম্মার ঘরে আমি আমার মেয়েকে দিবো কিভাবে? হ্যাঁ আমি জানি তুমি আমার মেয়েকে পছন্দ করো, আমাদের নুরিও হইতো তোমাকে পছন্দ করে। সেদিন আম্মা আর তোমার কথা আমি শুনে নিয়েছিলাম। আম্মার ইচ্ছে ছিলো তোমাকে আমার মেয়েকে দেবেন। কিন্তু আম্মার ইচ্ছে হলেও এখন আম্মা নাই। তাই আম্মার ইচ্ছেরও কোনো মূল্য আমার কাছে নাই। আমি আমার মেয়ের বিয়ে একটা ভালো ছেলের সাথে ঠিক করেছি। তুমি যদি আমার মেয়ের ভালো চাও তাহলে ওর সামনে আর আসবে না। আমার মৃত মায়ের কিড়া দিলাম তোমাকে। আর আমার মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবা না। মনে রেখো আমি আমার মেয়েকে কোনো বেজম্মার ঘরে দিবো না।’
“অনেক বলেছেন আংকেল, আপনার ভাগ্য ভালো আপনি নুরিশার বাপ। সেজন্যই আপনি এখনো আস্তো আছে। গায়ে হাত উঠে যেতো আজ আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আজ যদি এটা শোকের বাড়ি না হতো তবে আমাকে বেজম্মা বলার সাধ ঘুঁচিয়ে দিতাম এখানেই। আমার আব্বা, আম্মা তুলে কথা বললে আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাই। আমি ছোট বড় কাউকে ছাড়ি না। আমি সম্পর্কে ভুলে যাই। জায়গা ভুলে যাই। কিন্তু আজকে আমি যে মানুষটাকে অধিক পরিমাণে সম্মান করি, ভালোবাসি, সেই মানুষটার ছেলে বলে গায়ে হাত তুলতে পারলাম না। আমি যাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি, যাকে ছাড়া প্রতিটি মুহুর্ত উপলব্ধি করি আমি নিঃস্ব, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যাকে ছাড়া, তাকে ছেড়ে দিলাম। আমি কথা দিচ্ছি আপনার মেয়ের ত্রিসীমানায় আসবো না। আসি।” সেদিন প্রথমবারের মতো তোমার বাবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছি। আর তোমাদের এই কিড়া, কসমের মধ্যে পড়ে আমি আমার জীবন শেষ করতে বসেছি।’
নুরিশার দু চোখের পানি যেনো বাঁধ মানছে না। তার বাবা এমন মানুষ? তার বাবা, বাবা হিসেবে ভালো হলেও একজন মানুষ হিসেবে জঘন্য! সে অত্যন্ত আবেগী হয়ে দুই হাতে তাজফির গলা জাপ্টে ধরলো। সে হুহু করে কেঁদে উঠলো। ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে দিয়ে নাক ঘষতে ঘষতে কান্নারত কন্ঠে বললো,
‘আপনি আমায় নিয়ে পালাবেন এক্ষুনি? এখন আমি বলছি, আমি আপনার হাত ধরে এক কাপড়ে এই ঘর ছাড়বো। আর কিচ্ছু চাই না। আমি শুধুই আপনাকে চাই। আপনি হলে আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না।’
তাজফি নুরিশাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। নিজেকে কঠোর করে বললো,’নুরিশা ঘরে যাও! এক্ষুনি!’
‘আমি কিন্তু মরে যাবো। নিজের জান শেষ করে দিবো এই মুহুর্তে! আমাকে আপনার সঙ্গে না নিয়ে গেলে!’
‘এসব পাগলামি করো না। শান্ত হও!’
‘আমি আর সতী নেই। আপনার দ্বারা আমার সতীত্ব
ভেঙেছে তাই আপনার আমাকে বিয়ে করতেই হবে। আপনি বাধ্য! আমাকে এভাবে এড়িয়ে যেতে পারবেন না কিছুতেই।’
তাজফি আর নুরিশার মাঝে যখন এসব কথা হচ্ছিলো সেসময় মতিউর রহমান আর শফিউল্লাহ নামাজের জন্য বের হচ্ছিলো। বাগানের দিকটাই দুটি ছাঁয়া মূর্তি দেখে এগিয়ে আসে তারা আর নুরিশার শেষ কথা শুনে ফেলে। মতিউর রহমান মেয়ের সতীত্ব সম্বন্ধে সব কথাটুকু শুনে ফেলার পর দিশাহারা হয়ে পড়লেন। তিনি ধারণা করে নিলেন, এই রাতের বেলাতেই এই অঘটন ঘটেছে। নিজের সোনার কন্যার এই হাল শুনে মেজাজ এমন ভাবে চটে গেলো তার যে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেন। মুহুর্তের মধ্যে চাপা গুঞ্জন শুরু হলো, শফিউল্লাহও মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। রাতের নিম্ন স্বরের কথাও অনেক ভারী শোনাচ্ছিলো সে সময়। এলাকার কিছু লোকজন জড়ো হলো। নুরিশা ভয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো তাজফির আড়ালে। এটা দেখে মতিউর রহমান এর মাথায় যেনো বাজ পড়লো।
শফিউল্লাহ এক ফাঁকে গিয়ে একটা লাঠি নিয়ে এলো। কোনো রকম কথা না বলেই তাজফির পায়ে আঘাত করলো। তাজফি কুঁকিয়ে উঠলো। পরবর্তী আঘাত করতে গেলে নুরিশা রুখে দাঁড়ালো। কন্ঠে কোপ নিয়ে বললো, ‘খবরদার চাচা, উনার গায়ে আর একটাও আঘাত যেনো না পড়ে। তাহলে খুব খারাপ হবে!’
এই গুঞ্জনে আশেপাশের বাড়ি ঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে এলো। মানুষ জনকে দেখে পরিস্থিতি সামলাতে তাজফির উপর অনেক রকম অপবাদ দিলো শফিউল্লাহ। সবাইকে ক্ষেপিয়ে তুললো মুহুর্তের মধ্যে।
তাজফি মাটিতে বসে পড়েছে। নুরিশা তাকে আগলাচ্ছে। তাজফি এবারে সরাসরি বললো, ‘আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই আংকেল। আপনি রাজি থাকলে সেটা এক্ষুনি করতে চাই! আপনাকে দেওয়া কথা রাখবো না আমি। আমি আমার ভালোবাসার জন্য এমন হাজারটা কথার খেলাফ করতে পারি। আমি আপনাকে দেওয়া কথা ফিরিয়ে নিলাম!’
‘তোর মতো একটা জাড়জের সঙ্গে আমাদের বাড়ির মেয়েকে বিয়ে দেবো ভাবলি কিভাবে? বাপ মায়ের ঠিক নেই, জন্মের ঠিক নেই তুই আমার ভাতিজিকে বিয়ে করবি? সাহস তো কম না। এই তোমরা কু****বা** কে শায়েস্তা করো আমাদের বাড়ির মেয়েকে বদনাম করার চেষ্টা করছে।’
কথাটা বলতে দেরি কিন্তু এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি করে আঘাত করতে দেরি হয়নি। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে নুরিশা পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইলো। সে আটকানোর চেষ্টা করলে তার বাবা তাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলো। নুরিশা বাবার পায়ের নিচে বসে পরলো।
‘আব্বা আমাকে যেতে দিন। ওরা বিনা দোষে তাজফি ভাইকে মা’র’তেছে। তাজফি ভাই কিছু করে নাই। আমাকে যেতে দাও!’
মেয়ের আহাজারি শুনে ততক্ষণে রিক্তা বেগম নিচে নেমে এসেছেন। মেয়েকে এভাবে বাবার পায়ে পড়ে কাঁদতে দেখে হতবাক হয়ে শুধালেন, ‘কি হইছে আপনি এমন করেন কেন?’
রিক্তা বেগম পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কথা বলার সাহস করলেন না। যা বুঝার তিনি বুঝে গেছেন। তার ঘুম এতো ভারী হলো কখন? রেহান আর আনিকা সন্ধ্যা বেলায় শ্বশুর বাড়িতে গেছে। হুট করেই যাওয়া হয়েছে রেহানের আনিকাদের বাড়িতে। সে থাকলে তাজফির গায়ে হইতো ফুলের টোকাও পড়তে দিতো না।
এদিকে তাজফিকে আঘাতে আঘাতে দগ্ধ করা হচ্ছে। তার নাকে মুখে র’ক্ত বমি চলে আসে। চোখ উলটে শেষ বার দেখার চেষ্টা করলো নুরিশার সুন্দর মুখ খানি। নুরিশা কি বলছে তার কোন কথায় তার কানে আসছে না। এক পর্যায়ে যখন তাজফির জ্ঞান হারালো তখন তাকে ধরাধরি করে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হলো। তাজফির শরীর পড়লো রকির সামনে। রকি হতবাক হয়ে অন্ধকারে তাজফিকে চেনার চেষ্টা করলো। লাইটের আলোই সে তাজফির ভয়াবহ অবস্থায় চিৎকার করে উঠলো। চিনতে পেরে দ্রুত তাজফিকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌঁড়ানোর চেষ্টা করলো।
‘আমার দম থাকতে আপনার কিছু হতে দেবো না ভাই। আমি সেদিনের মতোই আজও আপনাকে বাঁচাবো।’
কবুল বলার ঠিক কিছু মুহুর্ত আগে আছিয়া খাতুনের ঘর থেকে গোঙানির শব্দ এলো। সেই গোঙানির শব্দ প্রথমে কানে এলো সুবাশের। সুবাশ কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো, ‘আপনাদের ঐ রুম থেকে গোঙানির শব্দ আসছে। শুনেছি আপনার দাদি অসুস্থ, উনার কি কিছু হলো? চলুন আগে গিয়ে দেখা করে আসি। আজকের এই শুভ দিনে আপনার দাদীর দোয়া নেবো না?’
অশ্রুসিক্ত লোচনে কটমট করে তাকালো নুরিশা। তার চোখের পানি দরদরিয়ে পড়ছে। কেন এরকম একটা সময় তার জীবনে এলো? নুরিশার হৃদপিন্ড ছলাৎ ছলাৎ করে উঠছে। মনে হচ্ছে হৃদপিন্ড লাফিয়ে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে। আর তক্ষুনি র’ক্ত বমি হয়ে সে জ্ঞান হারাবে। এতোটা কষ্ট হচ্ছে কেন তার? একদিকে এতো অল্প সময়ে এই বা’জে, ধূর্ত লোকটা সবাইকে কনভিন্স করে ফেলেছে তাকে বিয়ে করার জন্য! একটা লোকের মধ্যে মানুষকে অতি দ্রুত আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা বিদ্যমান থাকতে পারে কিভাবে?
সবাই সুবাশের কথা শুনে আছিয়া খাতুনের রুমে চলে গেলো। আছিয়া খাতুন খাটে চোখ উলটে তাকিয়ে রইলেন নুরিশা আর সুবাশের দিকে। তার দু চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তিনি এখন আর কথাও বলতে পারেন না। শুধু ইশারা বাম হাতের একটা আঙুল তুলে নুরিশাকে কাছে ডাকলেন। ইশারায় কি যেনো বোঝাতে চাইলেন। রিক্তা আর বিভা আহাজারি শুরু করে দিয়েছেন আছিয়া খাতুনের অবস্থা এতো শোচনীয় দেখে। মতিউর আর শফিউল্লাহ নিজেদের মায়ের এই অবস্থা সহ্য করতে পারলেন না। নুরিশা কি বুঝলো কে জানে, সে দাদিকে বুকে জাপ্টে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। শেষবার তওবা পড়ে নিয়ে আছিয়া খাতুন এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চির বিদায় জানালেন। নুরিশা পাথরের মতো দাদির বুকের উপর মাথা রেখে কাঠ কাঠ হয়ে পরে রইলো। একটি আনন্দঘন বাড়ি মুহুর্তের মধ্যে হয়ে উঠলো বিষাদের ন্যায়। শয্যাশায়ী বৃদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে নানান মানুষ এলো। সুবাশের পরিবার সহ সবাই রয়ে গেলো। এভাবে তো আর যাওয়া যায় না। যতই হোক এই বাড়িতে তারা সম্বন্ধ করতে চাইছিলেন আজকে।
মতিউর রহমান, শফিউল্লাহ আর রেহান আছিয়া খাতুনের খাটিয়ে কাঁধে তুলে নিলেন। তাকে নিয়ে যাওয়ার আগে নুরিশা ছুটে এলো উদ্ভ্রান্তের মতো। শেষ বার দাদির মুখটা দেখে নুরিশা একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালো। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই দাফন কার্য সম্পন্ন করার পর সুবাশের পরিবার সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেলো। তাজফি জানতেও পারলো না তার অগোচরে কত কিছু হয়ে গেলো। তার প্রিয় একজন মানুষ তার নাম জপ করছিলো শেষ নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগ অব্দি!
সপ্তাহ গড়ালো৷ মাস গড়ালো তাজফির দেখা নেই৷ তাজফি কোথায় গেছে তারও হদিস পাওয়া গেলো না। নুরিশার বিয়ে ঠিক করা হলো আরও দুমাস পর। এবারে বিয়েটা ধুমধামে হবে। বাড়ির সবাই ধরেই নিয়েছিলো আছিয়া খাতুন এই বিয়েতে খুশি ছিলেন। কারণ মৃত্যুর পরও তার মুখে হাসি ছিলো। সব কিছু মিলিয়ে নুরিশা এখন সম্পুর্ন একা নিঃসঙ্গতায় দিন কাটাচ্ছে। পরীক্ষার পর এডমিশন কোচিং এ ভর্তি হয়েছে। কোচিং এ যায় আসে এছাড়া বইটি ছুঁয়েও দেখে না। ভালো ভার্সিটিতে চান্স না হলে সুবাশ নাকি অনেক রাগ করবে। সুবাশ চায় তার বউ কোনো ভালো ভার্সিটিতে টপ করুক। সুবাশ রাগ করুক আর না করুক তাতে নুরিশার কিছু যায় আসে না৷
এই এক মাসে রোজ একবার করে নুরিশা তাজফির ছোট্ট মেসে গিয়ে খোঁজ নিয়েছে। তাজফি নাকি এই মেস ছেড়ে দিয়েছে। আর আসবে না। কি কারণে তার এমন পালিয়ে বেড়ানো নুরিশা জানে না। আচ্ছা মানুষটা কি তার প্রিয় দাদির মৃ’ত্যু’র খবর পায়নি?
আনিকা নুরিশার কাছে এলো। নুরিশার জেদে আছিয়া খাতুনকে বাগানের একটা স্থানে কবর দেওয়া হয়েছে। ওখানে একটা ব্রেঞ্চ বসে নুরিশা বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেই। আনিকা নুরিশার পাশে বসে সস্নেহে জিজ্ঞেস করলো,’খাবে না? এখন বেলা গড়িয়ে চারটে বেজে গেছে! গত এক মাসে তোমার কি হাল হয়েছে দেখেছো?’
‘আমি ঠিক আছি ভাবিজান। ভাইয়া কোথায়? ভাইয়া কি তাজফি ভাইয়ার খবর পেয়েছে?’
‘আচ্ছা, আমি তোমার ভাইয়াকে আবার তাগদা দিবো! যেনো দ্রুত খুঁজে আনে তাজফি ভাইয়াকে।’
‘ভাবিজান!’
‘হু বলো?’
‘আমি এই বিয়েটা করতে চাই না।’
‘আমি জানি!’
‘তুমি জানো?’
‘হুম। তবে তোমার জন্য এই সম্পর্ক টা ঠিক লাগে আমার কাছে!’
‘আমার কাছে লাগে না যে!’
‘পরিবার যা চাই তার বিরুদ্ধে যেও না।’
‘তুমি যাওনি?’
‘কি বোঝাতে চাইছো?’
‘তুমি পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে দাদু ভাইকে বিয়ে করোনি?’
‘নাহ, যদি আমার আব্বা না চাইতেন তবে বিয়েটা সেদিন হতো না। আমি কিন্তু একটিও শব্দ উচ্চারণ করিনি সেদিন। তুমি তো যাওনি তাই জানো না নুরি!’
নুরিশা নিরস গলায় বললো, ‘আমি আমার দাদির কথা রাখতে সব করতে পারি ভাবিজান। সব মানে সব!’
‘নুরি!’
‘হু!’
‘তুমি তাজফি ভাইকে ভালোবাসো?’
‘হ্যাঁ!’ নুরির এমন অকপটে স্বীকারোক্তিতে যারপরনাই অবাক হয়ে চকিতে তাকালো আনিকা।সে আন্দাজে ঢিল ছুড়েছিলো, ঢিলটা যে ঠিক ঠাক নিশানায় লাগবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি। আনিকা নুরিশার মুখোমুখি হয়ে দুই কাঁধে হাত রেখে চোখে চোখ রাখলো। ম্লান কন্ঠে বললো, ‘তাজফি ভাই থার্টি টু, আর তুমি অনলি এইটিন, বয়সের তারতম্য দেখেছো? পরিবারের নিশ্চয়ই কেউ চাইবে না তোমার বিয়ে এতো বয়সের একজনের সঙ্গে হোক।’
নুরিশা উঠে দাদির কবের কাছে গেলো। কবরের পাশে সদ্য জন্মানো ঘাসের উপর হাত বুলিয়ে দিলো। অল্প আওয়াজে বললো, ‘ভাবিজান, এখন তুমি যাও। আমি দাদির সঙ্গে কথা বলবো!’
‘রোজ তুমি এই কাজ করো নুরি! নিজেকে সামলাও!’
‘সামলেছি বলেই জীবিত আছি ভাবিজান!’
আনিকা ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। নুরিশা যখন আপন মনে ফিসফিস বাক্যে কথা বলায় ব্যস্ত হলো তার কিয়ৎক্ষন পর প্রস্থান ঘটালো আনিকা। এভাবেই নুরিশা সন্ধ্যা অব্দি এখানে কাটাবে। এরপর রুমে ঢুকে দরজা আটকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। নানান আহাজারি, বিলাপের সঙ্গে তার সময় কাটে। রাতের খাবার তাকে ঘরে দেওয়া হয়। প্রথম প্রথম রিক্তা বেগম মেয়েকে নিজে হাহুতাশ করলেও এখন সবটা ছেড়ে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তার উপরে।
রাত নটার দিকে নুরিশার ফোনে কল এলো। সে জানে এটা কার ফোন। রিং হতে হতে ফোনের রিংটোন থেমে গেলো। সে নিজের মর্জি মতো ফোনটা রিসিভ করবে। বাজতে থাকুক। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যাক্তি বিরক্ত হোক। কিছু কিছু মানুষকে এভাবে বিরক্ত করতেও মজা পাওয়া যাই।
এটা রোজ ই হয়। নুরিশা ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় বসলো। বারান্দা থেকে স্পষ্ট দাদির কবর দেখা যায়। ফুলের টব থেকে সদ্য ফোটা ফুলের গন্ধ বাতাসের তোড়ে ভেসে এসে তার নাকে তাল খাচ্ছে।
নুরিশা ফোন হাতে নিয়ে বসেছে পাঁচ সেকেন্ড ও অতিক্রম হয়নি এর মধ্যেই কল এসেছে আবারও।
‘কি আপনি? একটা মানুষ এতো বার কল দিচ্ছে, রিসিভ না করে ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকার মানে কি?’
‘কিছু বলবেন?’
‘আপনি আমার হবু বউ, আমি আপনার হবু স্বামী হয়ে আপনাকে ফোন দিতে পারি না?’
‘নাহ পারেন না।’
‘কেন?’
‘আমাদের বিয়ে তো এখনো হয়নি। বিয়ে হলে কল করার অধিকার পাবেন, নতুবা না!’
‘আপনি আমাকে এতো অপছন্দ কেন করেন?’ সুবাশের কম্পিত স্বর শুনে চাপা হাসলো নুরিশা। তাচ্ছিল্য করে বললো, ‘আপনি অতিরিক্ত ভালো মানুষ। আর অতিরিক্ত ভালো মানুষ আমার সবচেয়ে অপছন্দের তালিকায় থাকে। কি দরকার বলুন?’
‘কোনো দরকার নেই।’
‘তাহলে রেখে দিন!’
‘দরকার ছাড়া কথা বলা যাবে না?’
‘নাহ!’
সুবাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিভে যাওয়া গলায় বললো, ‘এই মুহুর্তে আপনার সঙ্গে কথা বলতে না পারলে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমার খুব খুব ইচ্ছে হচ্ছে আপনার সঙ্গে রাত্রী জেগে কথা বলতে। আজকে একটু সময় দেবেন নুরিশা?’
‘আমি তো বলবো না নুরিশা, আমার তো আর আপনাকে অপছন্দ নয়। যতো কিছু হোক আমি আপনাকে ছাড়ছি না!’
‘এই জেদ আপনার জন্য ভয়ংকর হবে!’
‘হোক, আমি তবুও আ…..!’
সুবাশের পরবর্তী বাক্য শোনার অপেক্ষা করলো না নুরিশা। কল কে’টে দিয়ে বেড সাইটে রেখে অত্যন্ত গরমেও কাথা মুড়িয়ে শুয়ে পরলো৷
গভীর রাত, রাতের অন্ধকারে তাজফি নুরিশার বাড়ির ওয়াল টপকালো। রোজকার মতো দাদির কবরের কাছে বসে পরলো। দু চোখ ভিজে যাচ্ছে বার বার। সে তীব্র আর্তনাদ করে নিচুস্বরে বললো, ‘প্রেমিকা, আমাকে ক্ষমা করেছো তো? যে ভুলটা আমি করেছি, সেজন্য প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছি। আমি তোমার নুরির জন্য পার্ফেক্ট না কোনো দিক থেকেই। আমার মতো একটা জানুয়ার, বর্বর তোমার নুরির মতো নিষ্পাপ মেয়ের মানাই না। সুবাশ ছেলেটা সত্যিই ভালো, ওর কাছে তোমার নুরি ভালো থাকবে প্রেমিকা। তাছাড়া আমার যে হাত পা বাঁধা! আমি যে উনাকে কথা দিয়েছি নুরিশার সামনে যাবো না। আমার হাতে কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু না। আমি সবটা সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। যা কিছু হবে, যা কিছু সৃষ্টিকর্তা চান সেটাই হবে। কেউ জানবে না, আমি মধ্যরাতে তোমার কাছে আসি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও প্রেমিকা। ‘
‘কিন্তু আমি যে জেনে গেলাম, এবারে কোথায় পালাবেন আপনি? আপনি কার কথায় নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন তাজফি ভাই?’
শনিবার সন্ধ্যার কথা। নুরিশা সন্ধ্যার পর সবে বই সামনে নিয়ে বসেছে। তম্বন্ধে তার চাচাতো ভাই আর বোন এসে হাজির হলো। একজনের নাম নীতি আর একজনের নাম নুহাশ! নীতি ক্লাস নাইনে পড়ে, আর নুহাশ ক্লাস সেভেনে। ওরা দুজনেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে উত্তেজিত হয়ে জড়িয়ে ধরলো।
‘ইয়েএএ আমি আগে ধরেছি, আমি আগে ধরেছি আমার ডার্লিংকে!’
‘নুহাইশ্যা তুই না আমি আগে ধরেছি!’
‘ডার্লিং বলো তো, তোমায় কে আগে জড়িয়ে ধরেছে?’
‘তোরা কেউই না।’ নুরিশা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো! নুরিশা জানে এরা কতটা বিচ্ছু। দেখা গেলো এটাকে কেন্দ্র করেই ঝগড়া বাঁধিয়ে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। নীতি নুরিশাকে আবার জাপটে ধরলো। আদুরে ভঙ্গিতে বললো,
‘আস্তেই ধরলাম তো। তোমার গলায় কি হয়েছে দেখি?’গলা থেকে হাত সরাতে সরাতে বললো নীতি।
‘কিছু না, তার আগে বল তোরা কখন এলি?’
‘সেকি! ডার্লিং তুমি জানো না কিছু?’ বললো নুহাশ।
‘না ভাই, বল না কি হয়েছে?’
‘আজ তোমাকে দেখতে এসেছে ডার্লিং।’ নুহাশ মুখ গোমড়া করে বললো।
‘কিহ? দেখতে এসেছে মানে?’
‘উম্ ওমনি না? তুমি বুঝতে পারছো না?’
‘না নীতি, তোরা এতো রহস্য না করে বল না কি হয়েছে?’
‘আজকে তোমাকে পাত্র পক্ষরা দেখতে এসেছে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে।’
‘দেখতে এলেই কি বিয়ে হয় নাকি? বাড়িতে এতো কিছু হয়ে গেছে আর আমাকে কেউ কিছুই বলেনি? এসবের মানে কি?’
‘শুধু তাই না আপা, যদি তোমায় পাত্রপক্ষের পছন্দ হয়ে যায় আজ ই আকদ পড়িয়ে রাখবে। জেঠা খোঁজ নিয়েছে, ছেলে ভালো। আমি ছবি দেখেই আমি ক্রাশ খেয়ে ফেলছিলাম। বাস্তবে আরও কি যে সুন্দর বাপরে!’
‘তুই নাইনের পুচকি মেয়ে, ক্রাশের কি বুঝিস রে?’
‘আমাকে এতোটাও বাচ্চা ভেবো না নুরি আপা। আমাদের ক্লাসের মীরা কত গুলো প্রেম করে, তোমার কোনো আইডিয়া আছে?’
‘না নাই বোন। এখন যাহ তো আমার অনেক পড়া বাকি!’
‘পড়বে কি, এখন তো তোমাকে সাজাতে হবে। জেঠি আমাকে তোমায় রেডি করিয়ে দিতে বললো!’
‘সত্যিই পাত্রপক্ষ এসেছে আমাকে দেখতে?’
‘হ্যাঁ গো। এই নুহাশ যা তো আপার হবু বরের ছবি তুলে আন গিয়ে!’
‘আমার তো ঠেকা। তুই যা। আমাকে আমার ডার্লিং কে দেখতে দে। কতদিন পর দেখলাম। ডার্লিং তুমি যে কি সুন্দর হইছো! পাত্রপক্ষ তোমায় দেখলে ছেড়ে তো যাবেই না, খুটি গেড়ে বসবে। আমার কলিজায় আঘাত করবে আজকে এরা!’
‘তুই সব সময় আমার পেছনে কেন লাগিস? শয়তান একটা! জঘন্য! তুই ভাই হওয়ার যোগ্যতায় রাখিস না। বদমাশ!’
‘আর তুই, তুই তো খয়রাতি। তুই আমার আপা হলি কি করে? একটা হিংস্র সিংহী তুই!’
মুহুর্তের মধ্যেই নীতি আর নুহাশের মধ্যে চুল টানাটানি যুদ্ধ লেগে গেলো। কেউ কাউকে ছাড়ছে না। এদের ঝগড়া দেখে নুরিশা বিরক্ত হয়ে দুইজনকেই রাম ধমক দিলো, ‘এই তোরা থামবি….? মাথা খারাপ করে দিচ্ছিস আমার! এমনি আমার মাথা কাজ করছে না। বেরো আমার ঘর থেকে! দুইটার একটাও যদি ঘরে থাকিস, পি’টি’য়ে বের করবো! এমনি আমার মাথা কাজ করছে না কি করবো না করবো ভেবে পাচ্ছি। পাগল হয়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে তোদের ঝগড়া!’
নীতি আর নুহাশ নুরিশাকে হাউমাউ করে কাঁন্না করতে দেখে দুইজনই মা’রামারি থামিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
‘কি হয়েছে আপা, এই দেখো আমরা আর মারামারি করবো না৷ তুমি কেঁদো না প্লিজ!’
নুরিশা তাজফির কথা মাথায় আসতেই কাঁন্না করে দিয়েছে৷ এমন বিপর্যয় সে কিভাবে সামলে উঠবে? এদিকে তাজফির খোঁজ নেই গত দুই দিন থেকে।কোথায় গেছে লোকটা কে জানে? নুরিশা জানে ক’দিন পর পর লোকটার উঁধাও হওয়ার রোগ আছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার ঘটনার পর তো একবার খোঁজ নিতে পারতো তার? লোকটা এমন বেপরোয়া কেন? আর আজকের এই ঘটনা তো লোকটা জানতেও পারবে না। কিভাবে সামলাবে সে সবটা? সবটা ভেবেই সে ভেঙে পড়ছে।
‘আপা বলো না প্লিজ! কি হয়েছে? কাঁদো কেন? আমরা আর দুষ্টুমি করবো না তোমার সাথে! কেঁদো না প্লিজ!’
‘আমি এই জন্য কাঁদছি না। আমার ফাইনাল এক্সাম ও শেষ হতে দিচ্ছে না, এখনি আমার উপর চাপ প্রয়োগ করছে। বিয়ের জন্য পাত্র দেখছে! আমাকে মানসিক ভাবে ভেঙে, গুড়িয়ে দিচ্ছে! এসবের আগে একবারও আমার থেকে শুনলো না? না শুনেই নিজেরা নিজেরাই সবটা ডিসাইড করে ফেললো!’
‘তুমি কি কাউকে পছন্দ করো আপা?’
‘ডার্লিং আমায় বলো, আমি তোমার জন্য সব করবো!’
‘তোরা একটু আমাকে একা থাকতে দিবি?’
‘কেন তোমাকে একা কেন থাকতে দেওয়া হবে? এখনো রেডি হওনি তুমি?’ কথা বলতে বলতে রিক্তা ভেতরে প্রবেশ করলেন।
‘আম্মা এসব কি হচ্ছে? কাল আমার পরীক্ষা আছে ভুলে গেলে? আমার পরীক্ষার মধ্যে এসব শুরু করেছো তোমরা? এক ফোঁটাও কান্ডজ্ঞান নেই তোমাদের? এতে যে আমার উপর মানসিক ভাবে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে তা কি জানো?’
‘কিচ্ছু করার নেই। তোমার দাদীর শেষ ইচ্ছে, তোমার বিয়ে দেখতে চান তিনি!’
‘দাদির ইচ্ছের জন্য তো আমি আমার জীবন বিসর্জন দিতে পারবো না। আমি পাত্র পক্ষের সামনে যাবো না। ওদের বিদেয় করো এক্ষুনি যাও!’
রিক্তা মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন! মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে নীতি আর নুহাশকে ইশারায় চলে যেতে বললেন৷ নুরিশা আহ্লাদ পেয়ে শব্দ করে কাঁন্না করতে লাগলো।
‘কি হয়েছে মা? আমরা তো তোমার উপর চাপ প্রয়োগ করছি না। তোমার দাদী বৃদ্ধ মানুষ, তার কথা রাখতেই আমাদের এরকম পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। তাছাড়া তোমার বাবা, তোমার চাচা খোঁজ নিয়ে দেখেছে। ছেলেটা খুব ভালো। কোনো ব্যাড রেকর্ড নেই তার। যদি তাদের পছন্দ হয় তবে তোমাদের আজ রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করিয়ে রাখা হবে। তোমাকে তো আর আমরা আজ ই উঠিয়ে দিচ্ছি না। এক দুই বছর পর তোমাকে তুলে দেবো তাদের হাতে। এতে সবাই রাজি আছে!’
‘আম্মা, আমি এখনি বিয়ে করতে চাই না। আমার এই বিয়েতে মত নেই। আমাকে এখনি অন্যের উপর চাপিয়ে দিও না আম্মা। তোমাদের কাছে আমি বোঝা হয়ে গেছি এখনি? কেন করছো এসব আম্মা?’
‘তোমাকে এমন বিপর্যস্ত কেন লাগছে? তুমি কি কাউকে পছন্দ করো? নির্ভয়ে বলো! মা সবটা সামলে নিবো!’
নুরিশা কি যেনো ভাবলো। তার ছোট্ট মাথায় সেদিন সন্ধ্যার কথা মাথায় আসছে। সেদিনের কথা জানালে যদি বিয়েটা ভেঙে যায় তবে সে এই কথায় জানাবে তার মাকে। কিন্তু কিভাবে? সে তো একটা ভুল করেছে। এটা ভুল না শুধু, সে তার পরিবারের প্রতিটি মানুষের বিশ্বাস ভেঙে খাঁন খাঁন করে দিয়েছে। এরপর সে কোন মুখে মাকে বলবে এসব?
‘আম্মা, আ-আ-আমি আসলে!’
‘ভাবি, তাঁরা তো বসে আছে। আমাদের নুরিকে আনুন!’
‘বিভা তুমি যাও আমি ওকে তৈরি করে নিয়ে আসছি!’
‘আচ্ছা, ভাবি আসুন।’
বিভা চলে যাওয়ার আগে একবার নুরিশার দিকে তাকালেন। উনার কেমন অস্বাভাবিক লাগলো নুরিশাকে। তবুও বাইরে মেহমান বসিয়ে রেখে তিনি থাকতে পারলেন না। তারাহুরো করে চলে গেলেন।
‘আম্মা আমার ভয় করছে! আমি যাবো না।’
‘পাগলি মেয়ের কথা শোনো। সামনে তো যেতেই হবে। না হলে ওদের সামনে আমাদের নাক কা’টা যাবে। তুমি কি সেটাই চাও?’
‘আমার কথা ছিলো তোমার সঙ্গে!’
‘সব শুনবো। এখন এই নাও শাড়ীটা পড়ে নাও।’
নুরিশা বিষন্ন মনে শাড়ী হাতে নিয়ে অসহায় মুখে তাকালো মায়ের দিকে।
‘জলদি করো!’
রিক্তা নুরিশার কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
নুরিশা ধপ করে বিছানায় বসে অশ্রু ছেড়ে দিলো। কি করবে এখন সে? কিভাবে খবর পাঠাবে তাজফির কাছে। আজ যদি সত্যিই আকদ হয়ে যায়?
নুরিশা মায়ের তাড়া পেয়ে শাড়ী পড়ে নিলো। শাড়ী পড়া শেষে নুরিশা সামান্য চুল আঁচড়ে সামনে দিয়ে দিলো। ঘাড়ের দাগ টা দেখা যাচ্ছে। এটা তাজফি ভাইয়ের দেওয়া লাভ বাইটের চিহ্ন। এটা যদি কোনো ভাবে কারোর নজরে পড়ে যায়?
নুরিশাকে দেখে সবাই পছন্দ করে ফেললো। এমন সুন্দরী মেয়েকে দেখে কার সাধ্য আছে অপছন্দ করবে? ছেলেটার নাম সুবাশ। সুবাশের চোখ যেনো সরছে না নুরিশার দিক থেকে। এক ধ্যাঁনে তাকিয়ে রইলো সে।
‘তাহলে ভাই সাহেব, ছেলে আর মেয়ে একটু আলাদা কথা বলুক। ওদের ও তো কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন!’
‘হ্যাঁ তা তো প্রয়োজন আছে। যাও নুরিশা সুবাস বাবাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও! কথা বলে আসো দুইজনে।’
চাচা শফিউল্লাহর কথায় উঠে দাঁড়ালো নুরিশা। রাগে ক্ষোভে বিষিয়ে যাচ্ছে তার মন। এই লোকটার সঙ্গে এখন তাকে আলাদা কথা বলতে হবে? নুরিশা আগে আগে চলে গেলো। পেছন পেছন সুবাশও গেলো। রুমে ঢুকে নুরিশা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
সুবাশ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো, ‘আপনার এই ক্ষোভের কারণ কি মিস? বলা যাবে?’
নুরিশা অবাক হলো। প্রথম কথায় এভাবে শুরু করলো? তাছাড়া সে রেগে আছে এই লোকটা বুঝলো কি করে?
‘আপনাকে কে বললো আমি রেগে আছি?’
‘আমি মানুষের মুখ দেখেই তার মনের কথা বুঝতে পারি! বলুন এই ক্ষোভ কেন?’
‘আপনাদের কি আক্কেল জ্ঞান নেই? আমার যে পরীক্ষা চলছে এইচএসসি তা সম্পর্কে কি আপনারা অবগত নন?’
নুরিশার জন্য সম্বন্ধ এসেছে। নুরিশার ছোট চাচা অনেক দিন পর তাদের বাড়িতে এসেছে। তিনিই এই সম্বন্ধের ঘটকালি করছেন। ড্রয়িংরুমে তখন ছোট খাটো চাপা কথোপকথনের গুঞ্জন। মতিউর রহমান ছোট ভাই শফিউল্লাহর দিকে ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে আছেন। শফিউল্লাহ গলা ঝেড়ে বললেন,
‘ছেলেটা খুব ভালো ভাইজান। আর আম্মাও তো আমাদের নুরিশার বিয়ে দেখে যেতে চান। আম্মার তো শরীর টাও ভালো না। বুড়ো মানুষ, তার কথা কি ফেলে দেবেন? তার শেষ ইচ্ছে তো আমাদের পূরণ করা উচিত তাই না?’
‘সবই ঠিক আছে, কিন্তু ছেলেরা অনেক বড়লোক। বড়লোকদের আমার পছন্দ না। ভয় হয়! আমার ধারণা, এরা মানুষ খুব একটা সুবিধার না!’
‘ভয় কিসের ভাইজান? আমাদের নুরিশার কপাল অনেক ভালো যে এমন একটা সম্বন্ধ এসেছে। ওর কোনো কিছুর অভাব থাকবো না। আমি সব ভাবে খোঁজ নিয়ে দেখেছি ছেলের পরিবার বা ছেলের কোনো খারাপ রেকর্ড নেই। আমার যদি মেয়ে থাকতো তবে আমিই আমার মেয়েরে দিয়ে বিয়ে দিতাম।’
‘তবুও আমার মন সাই দিচ্ছে না। বড়লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে আমার হৃদয়ে শঙ্কায় কেমন যেনো আঁতকে উঠছে।’
‘বড়লোকরা কি মানুষ না? সবাই তো খারাপ হয় না। ওদের সম্পর্কে এলাকায় শুনেছি, ছেলে একদম হীরের টুকরো ছেলে! মাসে দুই লাখ টাকা সেলারি পায়। বড় ইঞ্জিনিয়ার। দেশের বাইরে থাকে, আমাদের নুরিশাকেও নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবে। ওর কোনো কষ্টই হবে না। ওর তো আর শ্বশুর শাশুড়ীর সঙ্গে থাকতে হচ্ছে না যে, শ্বশুর বাড়ির মানুষ জ্বালাবে। জামাই যেখানে যেখানে থাকবে আমাদের নুরিশাও তার সঙ্গে থাকবে।’
‘আচ্ছা ভাইজান। আমি কাল আবার আসবো। ওদের সবাইকে সঙ্গে করেই আনবো।’
‘আচ্ছা! চা খাবি?’
‘এই সবেই এক কাপ শেষ করেছি আর খাবো না ভাইজান। এখন আসি আমার তাড়া আছে। আম্মার সঙ্গে তো দেখা করেইছি।’
‘এই দাঁড়াও শফি, আম্মার সঙ্গে দেখা যাবে না যাওয়ার আগে?’
‘হ্যাঁ ভাবি দেখা তো করতে ইচ্ছে হয়। সত্যি কথা বলতে আম্মার এই অবস্থা দেখতে আমার ভালো লাগছে না। আমি সহ্য করতে পারছি না তাই আর যাবো না। আম্মাকে বলে দিয়েন, আমি চলে গেছি!’
‘তোমার বউ, বিভাকে নিয়ে এসো। তোমার ছেলে মেয়েদের তো মাঝে মধ্যে পাঠাতে পারো।’
‘ভাবি আমার ছেলে মেয়েদের কোথায় নিয়ে যাই না। ওদের নিয়ে আমাকে কম ঝামেলা পোহাতে হয় না। এতো দুষ্টু হয়েছে। ওদের দুষ্টুমির জন্য বিভা কোথাও গিয়ে শান্তিতে দুদন্ড বসতে পারে না। একেবারে বিচ্ছু বুঝলেন? ওদের সামলানোই মুশকিল।’
‘আহা, বাচ্চা পোলাপান একটু তো জ্বালাবেই। ওদেরকে আম্মা দেখতে চান। কাল একবার বিভা সহ ছেলে মেয়েকে এনো সাথে করে।’
‘ঠিক আছে আনবো ভাবি!’
রিক্তা বিদায় দিলো শফিউল্লাহকে। শফিউল্লাহ্ যেতেই, মতিউর রহমান সবটা শেয়ার করলেন ভাইয়ের বলা সব কথা। রিক্তা কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। স্ত্রীর অভিব্যাক্তি বুঝতে পারলো না মতিউর রহমান। তবে তিনি কিছুতেই মেয়েকে এখন বিয়ে দিতে চান না। কিন্তু তার বৃদ্ধ মায়ের ইচ্ছে টাও তিনি অগ্রাহ্য করতে পারবেন না।
•
নুরিশা পরীক্ষা শেষে মার্কেট গিয়ে একটা মাস্টার কালার শার্ট কিনে নিলো। সকালে তার ভুলের জন্য মানুষটার শার্ট ছিড়ে গেছে। এখন চারটে বাজে। এইচএসসির ফাইনাল পরীক্ষায় সে গোল্ডেন এ প্লাস পাবেই এভাবে বাকি পরীক্ষা ভালো হলে। ফিজিক্স নিয়ে টেনশান ছিলো তা এখন আর নেই। নুরিশা তাজফির বাড়ির সামনে রিকশা থামালো। চড়া রোদে মাথা ফেঁটে যাওয়ার জোগার। গরমে মনে হচ্ছে মাথার মগজ গলে যাবে।
বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেখলো বাড়ি থেকে ডক্টর বেরিয়ে যাচ্ছে। ডক্টর কেন তাজফি ভাইয়ের বাড়িতে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই সে আঁতকে উঠলো। সকালেই তো সে দেখলো তাজফি সুস্থ। তাজফি ছাড়া তো আর কেউ নেই এই বাড়িতে! তার মানে তাজফির ই কিছু হয়েছে।
রকি ডক্টরকে এগিয়ে দিয়ে আসার সময় দেখলো নুরিশা দাঁড়িয়ে আছে।
নুরিশা অপেক্ষা করেনি। কথাটা কর্ণপাত হতেই সে দৌঁড়ে তাজফির রুমে ঢুকলো। রকি নুরিশার উৎকন্ঠা দেখেই বুঝে নিলো সবটা। তার আর এখন এখানে কাজ নেই। খানিক পর আসা যাবে না হয়। আপাতত ডক্টর এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ আনতে যাওয়া যায়। সে চলে গেলো।
নুরিশার পদধ্বনিতে তাজফি চোখ পিটপিটিয়ে চাইলো। তাজফি ঝাঁপসা চোখে দেখলো নুরিশা দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। সে কাঁদছে। তার ফর্সা টসটসে গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রুকনারা ঝড়ে পড়ছে। নুরিশা তার জন্য কাঁদছে? এটাও হয় নাকি? সে ধরেই নিলো প্রথমবারের মতো এবারেও সে স্বপ্ন দেখছে। সে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো,
‘আমি আর নিজেকে ধোঁকা দেবো না। তুমি চলে যাও বালিকা। কেন বার বার আমার কল্পনায় এসে আমাকে পোঁড়াচ্ছো? ধরা দিয়েও ধরা দাও না। এই যাতনা যে সহে না। ছুঁতে চাইছি, পারছি না। তুমি তো বাস্তবে কখনোই আমার কাছে ধরা দেবে না! তবে কল্পনায় কেন জ্বালাচ্ছো?’
‘কি বলছেন তাজফি ভাই? বুঝতে পারছি না। এতো কথা বলবেন না। চুপ করে শুয়ে থাকুন। আপনি অসুস্থ!’
তাজফি চোখ বন্ধ করলো। নুরিশার চোখে পানি। সে ঘোলাটে চোখে অস্পষ্ট দেখছে। ব্যাগ রেখে তাজফির ঘর থেকে একটা স্টিলের বাটি পেলো। ঘরে তেমন আসবাবপত্র নেই৷ একটা কড়াই আর একটা হাড়ি। পাশেই গ্যাসের সিলিন্ডার। একটা জগ আর একটা গ্লাস। দুটো প্লেট আর একটা স্টিলের বাটি। সে বাটি ভর্তি করে পানি নিয়ে এলো বাইরের কল থেকে। ততক্ষণে আকাশ মেঘলা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও কাঠফাটা রোদের দরুণ বাইরে বেরোনো দায় হয়ে যাচ্ছিলো। তাজফিকে এই অবস্থায় রেখে যেতেও মন সাই দিচ্ছে না। মানুষটার জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এমন জ্বরাক্রান্ত মানুষকে রেখে সে কিভাবে যাবে? যা হবার হবে। এখনো তো বৃষ্টি আসেনি। আগে বৃষ্টি আসুক। পরের টা পরে দেখা যাবে।
নুরিশা পানি রেখে তার ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে ভিজিয়ে জল পট্টি দিতে লাগলো। ঘন্টা খানেক জলপট্টি দেওয়ার পর তাজফির জ্বর কমছে না। সে বার বার চেক করছিলো। তখনও তাজফি গোঙাচ্ছে। এই গরমেও থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। এতো সহজে জ্বর নামবে বলে মনে হচ্ছে না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাথা খুঁজলো নুরিশা। রুমে একটা আলনা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না।
‘এই যে শুনছেন? আপনার ঘরে কি কোনো কাথা নেই?’
‘কে?’ তাজফির কাতর কন্ঠঃস্বর।
‘আমি নুরিশা! বলুন কাথা কোথায় রেখেছেন!’
‘তুমি কল্পনায় কাথা চাইছো? আজব তো!’
‘কল্পনা মানে? আপনি কল্পনায় আমাকে দেখেন?’
‘ও কি কথা, কল্পনায় দেখি কল্পনার কথা বলছো তুমি!’
‘এটা কল্পনা না তাজফি ভাই। আমি সত্যিই এসেছি। সকালে আমার জন্য আপনার শার্টটা ছিড়ে গেছিলো। তাই একটা শার্ট কিনে এনেছি আপনাকে দেবো বলে!’
‘তুমি সত্যিই এসেছো?’ জ্বরের শরীরেও খানিকটা ঝাঁপিয়ে উঠলো তাজফি। তার চোখ বন্ধ ছিলো। আলতো করে খুলে দেখলো নুরিশা বসে আছে তার সামনে। তাজফি স্বপ্ন না বাস্তব পরখ করতে বললো,
‘তোমায় একটু ছোঁবো বালিকা?’
নুরিশা তাকালো তাজফির দিকে। মানুষটার এলোমেলো, উস্কোখুশকো চুল। শুষ্ক লাল খয়েরি ঠোঁট, অসুস্থতায় পুরো মুখ জুড়ে মলিনতা ছেঁয়ে আছে।
বিশ্বাস করাতে নুরিশা নিজেই তাজফির হাত নিয়ে নিজের গাল ছোঁয়ালো। তাজফি চমকে উঠলো আবারও। সে এবারে বিশ্বাস করলো সত্যিই নুরিশা এসেছে। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আর তাজফির নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে যাচ্ছে। সে উঠে দাঁড়ালো। জ্বর থাকলেও এখন তার শরীর টা একটু হলেও ভালো। সে অন্য দিকে ফিরে বললো,
‘বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। এখন কইটা বাজে? তুমি বাসায় যাও বালিকা। এখন মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ির সবাই চিন্তা করবে। কাল তোমার পরীক্ষা!’
‘কাল আমার পরীক্ষা নেই, কাল শুক্রবার। ‘
‘ওও মনে ছিলো না। তুমি এখন আর থেকো না চলে যাও। আমি ঠিক আছি।’
তাজফি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তুমি আসো, আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। এখানে তোমাকে কেউ দেখলে লোকে খারাপ বলবে। এটা তুমি কি করেছো হ্যাঁ? সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে বাড়ি যাওনি। তোমার আর একটা সেকেন্ডও থাকা ঠিক হবে না!’
‘আপনার জ্বর তাজফি ভাই, কি বলছেন এসব? এই অবস্থায় আমি আপনাকে ফেলে চলে যাবো?’
‘যাবে না কেন? এর আগেও আমার এমন অনেকবার জ্বর হয়েছে। বাবা মা নেই, একা মানুষ। নিজের অসুস্থতা নিজেকেই ছাড়াতে হয়। এসব কিছু হয় না আমাদের। তোমার মতো ননীর পুতুল না আমি বালিকা!’
নুরিশার কাঁন্না পেলো। এইভাবে কথা কেন বলছে লোকটা? কোথায় তার সেবা করার জন্য ধন্যবাদ দেবে তা না উল্টো চড়া গলায় কথা বলছে?
‘এই মেয়ে এই, কি করছো তুমি? দরজা আগলে দাঁড়ালে কেন?’
নুরিশা মুচকি হেসে গেয়ে উঠলো,
”টিপ বোঝে না কেমন পাগল লোক,
তাকে রাত পাহারা দেই যে
আমার চৌকিদারের চোখ
ওহোহো টিপ বোঝে না কেমন বাপু লোক,
হায় সয়না সয়না সয়না ওগো
সয়না এতো জ্বালা
ঘরেতে রয়না আমার এ মন
রয়না কেন রয়না রয়না
ময়না বলো তুমি কৃষ্ণ রাধে
তাকে মন দিতে যে চায়
কেমন বাঁধে….”
নুরিশার গান থামতেই ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো তাজফি। নুরিশা গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
‘আমি যাবো না এখন। আপনি অসুস্থ যান শুয়ে পড়ুন! আমি আপনার মাথায় পানি ঢালবো।’
‘আরেকটা থাপ্পড় খাবে তুমি? ভালো ভাবে বলছি জেদ করো না। তুমি না গেলে অনেক বড় অঘটন ঘটবে। আমি নিজের যত্ন নিজেই করতে পারবো। যাও এক্ষুনি!’
নুরিশাকে অনড় দেখে তাজফি গায়ের শক্তি দিয়ে নুরিশাকে বাইরে বের করে দিলো। দরজা আটকে দিতেই নুরিশা দরজায় ঠকঠক করলো। বৃষ্টির পানিতে নুরিশা ভিজে যাচ্ছে।
‘তাজফি ভাই, আমার ব্যাগ আপনার রুমে। ব্যাগটা দিন!’
নুরিশার কথা শুনে তাজফি ব্যাগ হাতে দরজা খুললো। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা আটকে দিলো নুরিশা। তাজফি কিছু বুঝে উঠার আগেই নুরিশা ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে৷ এরপর যা ঘটলো তা ছিলো কল্পনাতীত,অভাবনীয়।
তখনো বৃষ্টি হচ্ছে, মাঝে মধ্যে মেঘ গর্জে উঠছে আকাশ চিড়ে। নুরিশার হাসি, হাসি, লজ্জারাঙা মুখ। সাতটার দিকে নুরিশাকে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই চলে গেলো তাজফি। তখনো ধুম বৃষ্টি। বৃষ্টি থামার নাম নেই। আজ সে বিশাল একটা ভুল করে বসেছে। সে কি করে করলো এই নোংরা কাজ? নুরিশা তো বাচ্চা একটা মেয়ে। বোঝে না। সবে কিশোরীতে পরিণত হয়েছে সে। আর সে সবটা বুঝেও এমন ভুল কিভাবে করতে পারলো? বাসায় পৌঁছে দেখলো কারেন্ট নেই। সে মোমবাতি জ্বালালো। মোমবাতির আলোয় স্পষ্ট দেখলো বিছানায় র’ক্তে’র দাগ! ধপ করে বসে পড়লো তাজফি। রাগের বশবর্তী হয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হারিয়ে সে ব্লেড দিয়ে, হাতে জোরে জোরে ফেসাতে লাগলো। এই ভুলের ক্ষমা হয় না। কোনো ভাবেই এই ভুলের ক্ষমা হয় না৷ কি করে করলো সে এইরকমটা? কি করে সাই দিলো এই বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে? সে কেন বাঁধা দিলো না! এসব ভাবতে ভাবতে হাতের অতিরক্তি রক্তক্ষরণে সে জ্ঞান হারালো। হাত চুইয়ে চুইয়ে র’ক্তে’র ফোঁটা পরতে লাগলো মাটিতে।
তাজফির দেখা মিললো নুরিশার চতুর্থ পরীক্ষার দিন। নুরিশা আজ কেন যেনো টঙের দোকানের দিকে না তাকিয়েও বুঝলো, ওখানে তাজফি আছে। তার মনে হচ্ছে তাজফি তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই একটা হরলিকস্ কিনে হাতে নিয়ে দৌড়ে আসবে। এসে বলবে, ‘অনেক দিন হলো তোমাকে হরলিকস্ কিনে দি না, তুমি কি রাগ করেছো? রাগ করো না বালিকা। এখন থেকে রোজ কিনে দেবো!’
এই কথার উত্তরে সে কপট রাগ দেখিয়ে বলবে, ‘নাহ রাগ করবো কেন? আমি কি এখনো সেই চোদ্দ বছরের বাচ্চা মেয়ে নাকি? আপনি কি চোখে দেখতে পান না? আমি এখন কত লম্বা হয়েছি দেখেছেন? আপনার কাঁধ ছুঁই ছুঁই মাথা আমার।’
কিন্তু না, তাজফি আসেনি। নুরিশা চোখ তুলে দেখলো লোকটা দোকানদারের সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলছে। খেয়াল করলো তার মুখ ভর্তি দাঁড়ি আর বড় বড় চুল। চুল গুলো কাঁধ অব্দি নেমেছে। এতো বড় বড় চুল আর দাঁড়ি কবে থেকে রাখলো তাজফি ভাই? এক মাসের মধ্যে এতো বড় বড় চুল, গোফ হয়ে গেলো? নুরিশা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ব্রেঞ্চের উপর হাত দিয়ে ঠকঠক শব্দ করে তাজফির নজর তার দিকে ফেরালো। তাজফি মাথা ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে। একটা সুন্দর হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘আরে বালিকা যে, কিছু বলবে?’
‘নাহ, তাজফি ভাই, তেমন কোনো ব্যাপার নেই। দাদির শরীর টা খুব খারাপ, তিন চারদিন থেকে আপনাকে দেখতে চাইছেন। আপনি কি একবার আমাদের বাড়িতে যেতে পারবেন দেখা করতে?’
‘অবশ্যই যাবো।
‘আচ্ছা! আসছি!’ আসছি বলেও নুরিশা দাঁড়িয়ে রইলো। তার মনে হচ্ছে তাজফি ভাই আরও কিছু কথা বলবে। সত্যিই বললো। নুরিশা মনে মনে খুশি হলো কেন যেনো। কিন্তু মুখ টা গম্ভীর করেই রইলো উপরে উপরে। তাজফি লাইটার বের করে সিগারেট ধরালো। একটা টান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে বললো,
‘এক্সাম কেমন হচ্ছে তোমার? প্রশ্ন কমন আসছে?’
‘আসছে।’
‘ফুল মার্ক তুলতে পারছো?’
‘পারছি!’
‘ভেরি গুড! শুনলাম ফার্স্ট প্লেস কেউ পাচ্ছে না তুমি ছাড়া। সত্যি নাকি? আগে জানতাম তুমি খুবই দূর্বল স্টুডিওতে এখন শুনি খুবই ব্রিলিয়ান্ট হয়েছো৷ সবাই পরিবর্তন হয়, বিশেষ করে মানুষ জাতী খুবই দ্রুত পরিবর্তন হয়। মানুষ পরিবর্তনশীল বুঝলে? সময় আর পরিস্থিতি তো আর আমাদের কারো হাতে থাকে না। পড়াশোনা চালিয়ে যাও এভাবেই।’
নুরিশা মনে মনে বললো, ‘ঠিকই বলেছেন তাজফি ভাই, আপনিও সময়, পরিস্থিতির গ্যারাকলে পড়ে বিরাট বদলে গেছেন। এই যে এখন আগের মতো আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না পর্যন্ত! বিরাট এই পরিবর্তন কেন? সত্যিই মানুষ পরিবর্তনশীল!’
নুরিশা তাজফির দিকে কপাল ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
‘থ্যাংক ইউ তাজফি ভাই। আমি আসছি আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
নুরিশা কথা শেষ করে দাঁড়ালো। তাজফি আবারও দোকানদারের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প করতে লাগলো। এদিকে যে নুরিশা দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ই নেই? লোকটা কি আগের মতো তাকে পছন্দ করে না? নাকি কোনোদিন তাকে পছন্দই করেনি? তবে কি সে ভুল ভাবতো? তার মনে হওয়া টা ভুল? তাজফি ভাইয়ের চোখে যে তার জন্য অনুভূতি দেখতে পেতো, এখনো পাই, সেটা কি ভুল? নাকি সে মুগ্ধতা নিয়ে লোকটাকে দেখে বলেই তার এরকম মনে হয়? চট করে নুরিশার মাথা গরম হয়ে গেলো। তাজফির নিকটে গিয়ে হাত ধরে টেনে দোকান থেকে বের করে আনলো। হাত টা হ্যাচকা টানে একটু ছিটকে দূরে সরিয়ে দিলো। শার্ট খানা চেপে ধরার দরুণ ফ্যাস করে তাজফির শার্টের হাতা খানা ছিড়ে গেলো। নুরিশা হতভম্ব হয়ে গেলেও গায়ে মাখলো না। তাজফি অবাক হয়ে নুরিশার দিকে তাকিয়ে আছে৷ হঠাৎই কি হলো শান্তশিষ্ট মেয়েটার?
‘দেখতে পাচ্ছেন না? চোখে কি আজকাল কম দেখেন? কখন থেকে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি খেয়াল করেন নি? আগে তো যেচে রিক্সা ঠিক করে দিতেন প্রয়োজন না পরলেও৷ আর এখন যখন প্রয়োজন, রিকশা বা অটো কিছুই পাচ্ছি না তখন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? খোশগল্প শুরু করেছেন?’
হতবিহ্বল তাজফি তখনো নুরিশার রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে মত্ত্ব! নুরিশার রাগকে আজ ভয় লাগছে তার। ওর অগ্নিশর্মা হয়ে যাওয়া রূপের দিকে তাকিয়ে টু শব্দটি করলো না তাজফি। কোথাও একটা ফোন করে রিকশা ঠিক দিলো সে।
রিকশা আসতেই নুরিশা চুপচাপ রিকশায় বসে চলে গেলো। যতক্ষণ রিকশা দেখা গেলো তাজফি এক ভাবে তাকিয়ে রইলো! মেয়েটার মধ্যে কি তবে বালিকা থেকে কিশোরী রূপটা সত্যিই ফুটে উঠেছে? এ কেমন বোকা বোকা কথা! চার বছর কেটে গেলো চোখের সামনে দিয়ে সে টের পেলো না? অথচ এখনো তার মনে হয় মেয়েটা এখনো সেই বালিকা মেয়েটিই রয়ে গেছে। যে তাকে দেখলেই নাকের ডগা ফুলিয়ে বলতো, ‘আপনি আর আমাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে হরলিক্স কিনে দেবেন না। একদম না। আমি রোজ একটা করে হরলিকস্ খাই না। আর আমাকে রোজ রিকশা ঠিক করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই, আমি একাই রিকশা ঠিক নিতে পারি!’
আজ সেই বালিকার চোখ অন্য কিছু বলছিল, তাকে টানছিলো। তার দিকে ধাঁবিত করছিলো বালিকার সম্মোহনী দু-চোখ! সে এতোদিন কেন খেয়াল করেনি? নাকি এই পরিবর্তনে তার চোখে আজই ধরা দিলো মেয়েটা?
•
বারোটার পর তাজফি দেখা করতে গেলো আছিয়া খাতুনের সঙ্গে। যাওয়ার পথে দেখা হলো মতিউর রহমানের সঙ্গে। তাজফি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ভালো আছেন চাচা?’
‘ভালো আছি। তোমার কি খবর? দেখা যায় না যে!’
‘এই তো আল্লাহ্ রেখেছেন ভালোই!’
‘আজ বাড়িতে খতম পড়ানো হবে।’
‘ওহ আচ্ছা!’
‘এই খতম কেন পড়াচ্ছি জানো?’
‘জ্বী না, কেন?’
‘এই খতম আম্মার জন্য পড়াচ্ছি। এই খতম পড়ালে এক হয় অসুস্থ ব্যাক্তি একদম সুস্থ হবে আর না হলে মা’রা যাবে। আগেকার মানুষ বলতো।’
‘এসব এমনি, এগুলো বিশ্বাস করবেন না৷ শিরক করা হবে তবে! শিরক কারী ব্যাক্তিরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না! আল্লাহ্ তাদের ক্ষমা করেন না।’
‘আমি বিশ্বাস করি না। আম্মার হুকুমেই হচ্ছে সবটা। এলাকার সবাইকে দাওয়াত দিয়েছি! তুমিও খেয়ো!’
‘আচ্ছা।’
তাজফি আছিয়া খাতুনের ঘরে গেলো। আজ তাজফি ঘরে যাওয়ার পর আছিয়া খাতুন শরীরের গন্ধ ভালো ভাবে টেনে নিয়ে বলতে পারলেন তাজফি এসেছে।
‘কিগো প্রেমিকা, কেমন আছো?’
‘এইডা তোমার আওনের সময় হইলো? খবর কহন পাডাইছিলাম?’
‘সকালে নুরিশা বলেছে!’
‘আমি হেরও চারদিন আগে থেইকা খবর দেওনের চেষ্টা করছি। তোমারে পাওন যায় না। কই থাহো আইজকাল?’
‘এইতো থাকি, এদিক সেদিক!’
‘এহন কি করস? চাকরি পাইছস?’
‘নাহ!’
‘চার বছরে তোমার সাথের সব বন্ধুদের চাকরি বাকরি হইয়া গেলো, শুধু তোমার ই হইলো না?’
‘চাকরি ভালো লাগে না। যে টিউশনি গুলো করাচ্ছি ভাবছি সেগুলোও ছেড়ে দিবো। ব্যস্ততা ভালো লাগে না!’
‘আগামীকাল, শুক্কুরবার আমার জন্য খুতবায়ে খতম পড়ানো হইবো এলাকার লোকজনও খাওয়াইবো তুমি ও খাইয়ো! তুমিও তো ফকির মিসকিন দের মতোই!’
‘আচ্ছা!’
‘গোসা করলা কালাচাঁদ?’
‘নাহ, বেকার মানুষের মান-অপমান, রাগ থাকে না। ওদের গা সওয়া হয়ে যায় এসব। আর তুমি কি আমাকে ঐভাবে বলেছো যে রাগ করবো?’
‘বুড়ি মানুষের কথা ধরতে নাই। ওরা হয় একদম ছয় বছরের বাচ্চাদের মতোন। শোনো, আমি জানি আমি বাঁঁছুম না। আমি আজরাইল দেখবার পারি!’
‘আজরাইল কেমন দেখতে?’
‘কালা কালা দেহা যা। মনে হয় এই তো এইহানে কেউ দাঁড়াইয়ে আছে। কিন্তু খুঁজবার গেলেই হারাই যায়। আমি যদি ম’ই’রা যাই তুমি খাটিয়ার এক পাশ ধরবা। যা কিছু হোক না কেন। আর আমার নুরিরে দেহনের দায়িত্ব তোমার। ওর যেনো কোনো কষ্ট না হয়৷ ওরে দেইখা রাহনের দায়িত্ব আমি তোমারে দিলাম। কারণ আমি জানি তুমি ছাড়া আর কেউ-ই ওরে সুখী করবার পারবো না!’
‘আচ্ছা আমি আসছি!’
‘যাইবা? যাও। অসুস্থ মানুষের ঘরে কেউ বেশিক্ষণ থাকবার চাই না বুঝছো। আমি যতদিন থেইকা ব্যারামে পইরা রইছি ততদিন থেইকা আমার ঘরে কেউ বেশিক্ষণ থাহে নাই, গপ্পো করে নাই। শুধু তুমি আইলে বেশিক্ষণ থাইকা আমার লগে গপ্পো করো। তোমার জন্য আমি খাস দিলে দোয়া কইরা দিলাম। তোমার ম্যালা ভালো হইবো কালাচাঁদ!’
তাজফি আছিয়া খাতুনের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তার শরীর বড্ড খারাপ করছে। সে নুরিশা দের বাড়ির গেট পেরোতেই গলগলিয়ে বমি করে দিলো। কোনো রকমে হেঁটে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো। একটা টাকাও নেই যে রিকশা করে যাবে। বমি করতে করতে নাকে মুখে উঠে গেলো। তার পা দুলছিলো।
‘কই যাইতাছেন তাজফি ভাই?’
‘কে?’
‘আমারে চিনবার পারছুন তাজফি ভাই?’
‘কে তুমি?’
‘আমি রকি! আপনে আমারে সাহায্য করছিলেন মনে নাই? ভাই আপনের কি শরীলডা খারাপ?’
‘হ্যাঁ শরীর টা খুব খারাপ লাগছে। তুমি কি আমাকে একটু আমার বাসায় পৌঁছে দিতে পারবে?’
‘পারুম মানে, আমি আপনের লাইগা জান কুরবান কইরা দিতে পারি। আহেন আমার কান্ধে ভর দিয়া লন।’
তাজফিকে পৌঁছে দিলো রকি।
‘ভাই, আপনের বাড়িতে কি কেউই নাই?’
‘নাহ, এখন তুমি যাও। আমি শুয়ে পরবো। ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবো আমি!’
রকিকে চলে যেতে বললেও রকি গেলো না। তাজফির দরজার কাছে বসে রইলো। তাজফির যদি আবার কোনো কিছু প্রয়োজন হয়। তাজফির মাত্রাতিরিক্ত শরীর খারাপে কোনো কিছু বলতে পারলো না। গা কাঁপিয়ে ডুকরে উঠলো সে। কাথা মুড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো। রকি চিন্তিত হয়ে তাজফির রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে গেলো। তাজফির হুশ নেই। রকি তাজফির গা ছুয়ে দেখতেই ছিটকে গেলো। প্রচন্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তাজফির শরীর! রনি দৌঁড়ে চলে গেলো ডক্টর ডাকতে। সে থাকতে এই মানুষটার কোনো ক্ষতি সে হতে দেবে না।
•
তুমি জানো বালিকা? আমার ঘরে একটা ফ্যান ও নেই? খুব গরম পড়েছে। একটা হাত পাখা আছে, সেটাও ভেঙে যাওয়ার জোগার। বাতাস লাগে না!’
‘আপনি না স্টুডেন্ট পড়ান, একটা ফ্যান তো কিনতে পারেন! কিংবা একটা হাত পাখা!’
‘হাত পাখায় বাতাস করতে ভালো লাগে না। কারণ হাত নাড়ানোর পাঁচ মিনিটের মাথায় হাত লেগে যায়। বিরক্ত লাগে৷ তুমি কি আমাকে হাওয়া করবে?’
‘করবো। কিন্তু বিয়ের পর!’
‘তোমার আমার সঙ্গে বিয়ে হবে?’
‘ওমা হবে না কেন? হবে।’
‘তোমার আব্বা, মানবে না।’
‘কেন?’
‘তোমার আব্বা আমাকে অত্যন্ত অপছন্দ করেন।’
‘আপনি বুঝলেন কি করে? আপনাকে কখনোই বলেছে?’
‘নাহ!’
‘তাহলে?’
‘কারণ উনি জানেন আমি তোমাকে পছন্দ করি। আর কোনো বাবাই তার মেয়েকে একজন ভবঘুরে বেকার লোকের হাতে তুলে দিবে না। তার কলিজার টুকরা মেয়েকে কষ্টের মধ্যে ঠেলে দেবে নাকি? কোন বাবা চাইবেন তার রাজকন্যা কোনো ফকিরকে বিয়ে করুক?’
‘উফফ বেশি কথা বলছেন। এই কথা বলতে ভালো লাগছে না৷ অন্য কথা বলেন!’
‘অন্য কি কথা বলবো? তুমি জানো, আমি ইদানীং স্বপ্নে দেখি, তোমায় বিয়ে করছি!’
‘সত্যিই?’ চমকপ্রদ ভাবে হাসলো নুরিশা।
‘তুমি খুশি হলে?’
‘হুম খুব। আপনি খুশি না?’
‘নাহ। স্বপ্নে আমি তোমার বর, সেটা স্পষ্ট না। কারণ আমার মুখ দেখা যায় না। বরের জায়গায় একবার আমাকে তো একবার অন্য কাউকে দেখি, বিয়ে আমার তোমার সঙ্গে হচ্ছে অথচ আমার জায়গায় অন্য কেউ! এটা একটু অন্য রকম না?’
‘এসব উল্টোপালটা স্বপ্নের মানেই হয় না।’
নুরিশা তাজফির জ্বরের ঘোরে কল্পনায় রেগে চলে গেলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো তাজফি স্পষ্ট দেখেছে নুরিশার নাকের ডগা লাল, রাগে তার কপলের মাংসপেশি ফুলে উঠেছে। কিন্তু এটা তো তার কল্পনা, অথচ এই কল্পনা টা কতটা জীবন্ত লাগছে, এমন কেন হচ্ছে? তার প্রচন্ড জ্বর এসেছে সেজন্য?
নুরিশা ঘুম থেকে উঠলো বিষন্ন মন নিয়ে। আজ থেকে কলেজে পরীক্ষা শুরু। তার পড়া কমপ্লিট হয়নি। ফিজিক্সে সে দূর্বল। তারপর দেরি করে ঘুমানোর জন্য উঠতেও দেরি হলো। সে আগের তুলনায় আরও বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে। সে সঠিক সময় কলেজের জন্য তৈরি হয়ে বের হলো। মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে। কেনো যেনো এক্সামের আগে তাজফিকে দেখতে চাইছে। মাঝে মধ্যেই লোকটাকে দেখার তৃষ্ণায় ধুঁকে ভেতরে ভেতরে। কেন এই রকম মনোবাঞ্ছা হয় তার উত্তর নুরিশার কাছে থাকলেও নিজেই সেই উত্তরকে উপেক্ষা করে চলে সে। নিজের অনুভুতির কাছ থেকে নিজেই পালিয়ে বেড়াই সে। নুরিশা ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসলে আনিকা খাবার দিলো সামনে। নুরি একটু খেয়ে উঠতে নিলে আনিকা আবার বসিয়ে দিলো। কড়া গলায় বললো,
‘নুরি, এইটুকু খাবার কেন খাচ্ছিস? ঠিক করে না খেয়ে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি পরীক্ষার হোলে!’
‘আমার বমি আসে ভাবি। কি করবো? যেটুকু পারছি খেয়ে নিচ্ছি।’
‘একটুও খাবার রাখলে আছাড় দিবো। তোর ভাইকে আমি বলে দিবো তুই খাচ্ছিস না।’
‘উফফ ভাবি, আগে আম্মা জ্বালাতন করতো এখন তুমি! আম্মা উঠেছেন?’
‘নাহ! মায়ের শরীর ভালো না আজকে।’
‘সেকি! আম্মার শরীর খারাপ, আর আমাকে কেউ বলো নি একবারও?’
‘আহা তোর পরীক্ষা, তুই পড়ছিলি। তাই মা বারণ করেছিলো যেনো তোকে না জানাই!’
‘একদম ঠিক করোনি এটা।’
‘আনিকা, খাবার হয়েছে? মায়ের শরীর কেমন এখন?’
‘এই তো হয়েছে, আপনি বসুন খেতে বসুন!’
‘খাওয়াও তোমার বরকে আমি যায়। আমি হাড্ডি হতে চাই না। যাই।’
‘কোনো সমস্যা হলে তাজফি ভাইয়ের কাছে যেতে পারিস! তাজফি ভাই দারুণ পড়াই!’
নুরিশা কিছু বললো না। নামটা শুনলেই তার গলায় কাটার মতো খাবার আটকে যায়। ঠিক সেদিনের মতো অনুভুতি হয়। একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা দায়ক মিষ্টি অনুভূতি। আঠারো বছরের কিশোরীকে এখনো যখন লোকটা বালিকা সম্বোধন করে, তখন নুরিশা রাগ করতে পারে না আগের মতো। সেবার প্রথম যখন সাত দিন তাজফিকে দেখেনি, নুরিশা বুঝেছিলো, লোকটার শূন্যতা তাকে ভাবাচ্ছে, অন্তর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে। কিন্তু হায়, লোকটা এতো তাকিয়ে থাকে কিন্তু মনের কথা ব্যাক্ত করতে পারে না। ভেতর থেকে একটা চাপা শ্বাস ছেড়ে নুরিশা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলো।
রেহান আর আনিকার বিয়ের এক বছর হলো। হঠাৎই আনিকার বিয়ে ঠিক করে বাসা থেকে। রেহানকে জানানোর পর জেদ ধরে পরিবার নিয়ে হাজির হয়েছিলো আনিকার বাড়িতে। মতিউর রহমান অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে প্রস্তাব দিলেও আনিকার বাবা রাজি হোন না৷ রেহানের মতো এমন বেকার ছেলের কাছে মেয়ে দিতে রাজি না তিনি। সবশেষে রেহান সরাসরি বলেছিলো,’আংকেল আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি, তাকে বিয়ে করতে চাই। আজই বিয়ের ব্যবস্থা করুন৷ না হলে ঘটনা কিন্তু ঘটে যাবে। আর যদি আপনি চান যে মেয়েকে বড়, অনুষ্ঠান করে বিদায় দিবেন, তবে অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু আজ না। আজ, এই মুহুর্তে আপনার মেয়েকে, আমি আমার সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়ি যাবো। বৈধ ভাবে, সম্পুর্ন সম্মানের সঙ্গে! আমার বাড়িতে আমার মায়ের আরেকটা মেয়ে হয়ে সে আমার বাড়িতে থাকবে।’
আনিকার বাবা ফরিদ চৌধুরী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন,’তোমার মতো ম্যানার্সলেস, বেয়াদব ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো ভাবলে কিভাবে?’
‘আপনি মেয়ে দিতে বাধ্য। না হলে বাড়িতে হরতাল চলবে। পুরো এলাকায় রটিয়ে দেবো আপনার মেয়ে আমার বউ। এখন আমার বউ হওয়ার পরেও আমাকে পছন্দ না বলে অন্যত্র মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছেন আবার। ঘটনা কতদূর যাবে ভাবতেও পারবেন না। তখন কিন্তু আপনার মেয়ের এমনিতেও বিয়ে হবে না। আমার কাছেই মেয়ে দিতে হবে। নিজের কথা ফিরিয়ে নিতে হবে কিন্তু!’
আনিকা শুধু জ্বলজ্বল করে দেখছিলো রেহানের কর্মকান্ড! ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় তার। এভাবেও কেউ বলতে পারে? এতো দুঃসাহস কেন এই লোকটার? তার এমন ব্যবহারে যে তার বাবা আরও রেগে,অসন্তুষ্ট হচ্ছে লোকটা কি বুঝতে পারছে না?
‘তুমি যে অত্যন্ত অভদ্র, অসামাজিক, গাধা ছেলে তা কি জানো?’
‘হ্যাঁ জানি, আপনার মেয়েও জানে সেটা! কি জানেন না আনিকা?’ রেহানের তেছড়া উত্তরে ফরিদ চৌধুরী আরও রেগে যান।
আনিকার মাথা কা’টা যাচ্ছিলো রেহানের এরকম অসন্তোষ জনক ব্যবহারে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে সে দ্রুত সবার সামনে থেকে উঠে চলে যায়। সে চাইলেও বাবার মুখের উপর কথা বলতে পারবে না। কারণ সে তার বাবাকে অত্যন্ত সমীহ করে, সম্মান করে। সেই সম্মানিত মানুষটার মুখে মুখে কথা বলার মতো দুঃসাহসিক কাজ করছে রেহান। রেহানকে পাওয়ার ইচ্ছেটা বোধহয় এখানেই ছেড়ে দিতে হবে।
ছেলের এমন অভদ্র আচরণে মতিউর রহমাজ হতাশ হোন। লজ্জায়, অপমানে তার মুখ থমথমে হয়ে গেছে৷ রাম ধমক দিলেও সে থামেনি। শেষমেষ মতিউর রহমান ছেলেকে সবার সামনে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছেন। থাপ্পড় খেয়েও রেহান নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে ছিলো। মতিউর রহমান চেয়েও ছেলেকে এক চুল নড়াতে সক্ষম হয়নি। অধৈর্য হয়ে মতিউর রহমান সহ সবাই চলে আসেন। যাওয়ার আগে আনিকার বাবা ফরিদ চৌধুরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে যান। কিন্তু রেহানও আনিকাকে বিয়ে না করে নড়বে না। পুরো বারো ঘন্টা একভাবে বসে থেকে আনিকাকে বিয়ে করে, তার সঙ্গে নিয়ে তবেই ফিরেছে৷ তার এমন একরোখা কান্ডে মতিউর রহমানকে কম ভুগতে হয়নি। ওঁদের বিয়ের ঘটনা মনে হলে এখনো সবাই হাসে।
সব শেষে নুরিশা দাদির কাছে গেলো। তার দাদী এখন প্যারালাইজড একদম। শুধু ডান হাত নাড়াতে পারে আর কথা বলতে পারে। চোখেও কম দেখছেন তিনি আজকাল। বয়সের ভাড়ে চামড়া ঝুলে গেছে উনার। শরীরের হাড় ছাড়া কিছু দেখা যায় না। দাদির থেকে দোয়া নিতে নুরিশা ভেতরে প্রবেশ করলো। আছিয়া খাতুন এখন চোখে দেখেন না ঠিকই কিন্তু শরীরের গন্ধ আর পায়ের আওয়াজেই চিনতে পারেন সবাইকে।
‘কে নুরি নাকি?’
‘হ্যাঁ দাদি আজ আমার কলেজের পরীক্ষা! দোয়া করিও।’
‘আহা কবে কলেজে ভর্তি হইলা গো, এতো তারাতাড়ি কি পরীক্ষা দিতাছো? আচ্ছা, তোমার কি ট্যাকা লাগবো? তুমি তো হেইদিনও স্কুলে গেলা! আজই কলেজে পরীক্ষা?’
‘দাদি আমি আরও আগে স্কুল পাশ করেছি। এখন কলেজ পড়ি৷ রোজ ভুলে যাও, আমি রোজ মনে করিয়ে দেওয়ার পরেও।’
‘ওও হ্যাঁ তাই তো ভুইলা গেছিলাম। আমার কালাচাঁদ এর লগে দেহা হয় তোমার?’
‘নাহ, আমার কারোর সঙ্গে দেখা হয় না। তাকে দিয়ে তোমার কি কাজ?’
‘তার দেখা পেলে একবার আসতে বলিস,অনেক দিন দেখা হয় না!’
‘বলবো!’
নুরিশা দাদির সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নিচে নামলো।
যেতে যেতে নুরিশা বিরিয়ানির দোকানে তার বাবাকে খেয়াল করলো। হঠাৎই তার মাথা গরম হয়ে গেলো। পরীক্ষা শুরুর আরও এক ঘন্টা বাকি আছে। নুরিশা বিরিয়ানি হাউজে ঢুকলো। মেয়েকে দেখে মতিউর রহমান হকচকিয়ে গেলো। তিনি চুবচবে তেলে ভাজা পরোটা খাচ্ছেন আর পাশেই রসগোল্লার বাটি। মেয়ের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চোখ নামিয়েও নিলেন। পরোটাই এতোই তেল বেশি যে তার হাত চকচক করছে তেলে! মেয়ের তীর্য্বক চাহনীতে মনে হলো পরোটা উনার গলায় আটকে গেলো। খুকখুক করে কেশে উঠলেন তিনি। নুরিশা দ্রুততার সহিত সামনের জগ থেকে পানি ঢেলে দিলো।
বয়সের সঙ্গে মানুষ কতটা বদলায় তা নুরিশা বাবার দিকে তাকিয়ে বুঝলো। রাত জেগে তার পড়ার টেবিলের কাছে বসে থাকে তার বাবা। যেনো সে ভালো ভাবে পরীক্ষা দিতে পারে সেজন্য নফল নামাজ পড়ে দোয়া করেন। ভাইয়ার সময়ও নাকি তার বাবা দিনের পর দিন জেগে নামাজ পড়তেন, নফল রোজা রাখতেন৷ নুরিশা তার বাবার বাচ্চাদের মতো অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক হলো৷ রাগ দমন করে চেয়ার টেনে বসলো।
‘খাওয়া শেষ করুন!’
‘কি রে মা টাকা লাগবো?’
‘নাহ, আপনি যে অসুস্থ এটা ভুলে যান কেন? ডায়াবেটিস আছে আপনার, রসগোল্লা খাচ্ছেন, অতিরিক্ত তেল দেওয়া খাবার খাচ্ছেন। এগুলো যে আপনার খাওয়া বারণ জানেন না? তবুও কেন রোজ রোজ এরকম করছেন?’
‘তোর মা তেল ছাড়া খাইয়ে খাইয়ে আমাকে মে’রে ফেলতে চাই! তুই তো জানিস কতটা কষ্ট হয় আমার। তুই কি তোর আব্বার কষ্ট বুঝবি না মেয়ে হয়ে?’
‘ঐ কষ্ট কোনো কিছু না আব্বা, আপনার সুস্থতা সবচেয়ে বেশি জরুরি! আজকেই এখানে লাষ্ট খাওয়া আপনার। আমি লেবু ভাইকে বারণ করে দেবো যেনো, আপনি আসলে আপনাকে চিনি ছাড়া চা বাদে আর কোনো কিছু যেনো না দেওয়া হয়।’
মতিউর রহমান আরও অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। এই তো সেদিন এই টুকুন বাচ্চা মেয়ে ছিলো। কলেজে ভর্তি হতেই কি মেয়ের আরও জ্ঞান বুদ্ধি বেশি হলো? আরও বেশি কড়া শাসন করতে চাইছে? আগের চাইতেও এখন তিনি বেশি ভয় পান মেয়েকে।
‘তুমি কি একটা পরোটা খাবে নুরি?’
‘আমার সময় নেই আব্বা, আমার পরীক্ষা আছে জানেন তো। আপনি বাসায় যান এক্ষুনি।’
‘মর্নিং ওয়াক শেষ করে এমন ক্ষিধে পেয়েছিলো যে….!’
‘বাড়িতে রান্না শেষ সকাল আটটাই। আপনি যদি নিজের অসুস্থতার কথা চিন্তা না করেন তবে তো আমাদের ই করতে হবে। বাসায় যান, আমার জন্য দোয়া করবেন!’
নুরিশা তাকাতেই মতিউর রহমান সুরসুর করে বেরিয়ে এলেন। মেয়ে আবার কখন যে রেগে যান সেই ভয়। এখন তবুও মাথা ঠান্ডা হয়েছে!
নুরিশা টঙের দোকানের কাছে গিয়ে থামলো। তার দু-চোখ খুঁজলো তাজফি নামক পুরুষটিকে। কেন খুঁজলো তা জানা নেই। তবে অবচেতন মন একটা নজর দেখতে চাইছিলো মানুষটাকে। মনের এই উঁচাটন তাকে অস্থির করে তুললো। হাঁসফাঁস করতে করতে সে পরীক্ষা দিতে গেলো। মানুষটাকে দেখতে চাওয়া যেনো একটা বড়সড় অসুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।