Tuesday, August 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 438



সোনার কন্যা পর্ব-০৪

0

#সোনার_কন্যা
#পর্ব৪
#রাউফুন

রাতের খাবার টেবিলে সাজানো হচ্ছিলো। প্রথম বারের মতো তাজফি নুরিশাদের বাড়িতে খেতে বসবে। লজ্জা, অস্বস্তিতে বিমূঢ় হয়ে হয়ে গেছে সে। রেহান হাসি মুখে এটা সেটা গল্প করছে। নুরিশা নত মস্তকে টিভির রিমোট হাতে কার্টুন দেখছে। যদি তার টিভিতে মন বসছে না, তবুও সে টিভি দেখার বাহানায় নিচে এসেছে। নিজের অবাধ্য, চঞ্চল মনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি সে। বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই যখন সে তাজফিকে দেখলো, তার মনে হচ্ছিলো তার ভেতরের সবকিছু তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। সম্পুর্ন শরীর অচেনা অনুভূতিতে থরথর করে কাঁপছিলো। বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা হৃদযন্ত্র টাকে মনে হচ্ছিলো লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে। ঢিপঢিপ! ঢিপঢিপ! ঢিপঢিপ! পরপর, বার বার, একবার দু-বার, তিনবার বহুবার। সে আর দাঁড়াইনি। নিজের রুমে গিয়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়াতেও লজ্জা পাচ্ছিলো। আশ্চর্য তার লজ্জা কেন লাগছিলো? সে পালাতে চাইছিলো এই নতুন অনুভূতির থেকে কিন্তু নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে নিচে নেমে আসে। এসেই টিভি ছেড়ে এক ভাবে বসে আছে। নিজের বেহায়া চোখ গুলো চলে যাচ্ছিলো খয়েরি সোয়েটার পড়া ব্যাক্তির দিকে।

টেবিলে খাবার সাজানো শেষে সবাই টেবিলে বসলো রিক্তা বেগম, আছিয়া খাতুন আর নুরিশা এক পাশে বসেছে। অপর পাশে মতিউর রহমান, রেহান, আর তাজফি। নুরিশা তার ভাইয়ের মুখোমুখি বসেছে। তার বুকে এখনো কেমন যেনো হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি দিয়ে ক্রমশ আঘাত করছে। আবারও এরকম কেন হচ্ছে? গলা দিয়ে খাবার নামাতে পারছে না সে। মতিউর রহমান গলা ঝেড়ে বললেন, ‘বাবা তাজফি, এখন কি করছো?’

‘জ্বী, কিছু না আংকেল!’

‘তাহলে তোমার চলছে কিভাবে? কিছু করবে না? ফিউচারের জন্য কি ভাবছো? চলবে কিভাবে পরবর্তীতে?’

‘তিনটে টিউশনি করাচ্ছি। আমি একা মানুষ, মাস যেতে চার, সারে চার হাজার টাকা আসছে ওতেই চলছে।’

‘চাকরি বাকরির চেষ্টা করছো?’

‘জ্বী নাহ!’

‘আমার হাতে একটা চাকরি আছে, করবে? মাসে ছয় সাত হাজার সম্মানী পাবে। করবে?’

তাজফি এখনো পর্যন্ত খাবার মুখে তুলেনি, কারণ নুরিশাও মুখে খাবার তুলেনি। মেয়েটা কি তাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে?

‘আব্বা, খাওয়ার সময় আপনে এসব আলোচনা করবেন না তো। আমার ভালো লাগছে না!’

‘তুই চুপ কর রেহান৷ আজীবন তুই বেকার হয়ে ঘুরে বেড়ালেও চলবে, কিন্তু ছেলেটার চলবে কিভাবে? বেশি বুঝবি না।’

রিক্তা আর আছিয়া শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। নুরিশার দপ করে মাথা গরম হয়ে গেলো। কেন এই রাগের উপদ্রব হচ্ছে সে বুঝলো না। তবে রাগ হচ্ছে, কিন্তু রাগ টা কার উপর? নিজের বাবা নাকি মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা লোকটার উপর? চরম অসহ্য লোকতো? অন্য সময় এতো ফটরফটর করে কথা বলে, তবে এখন কি হয়েছে? উচিৎ কথায়, প্রকাট্য ভাবে জবাব দিতে কি কষ্ট হচ্ছে?

তাজফি অত্যন্ত অপ্রতিভ হয়ে গেছে। সে কোনো কথা বলতেই পারছে না। সে বলতে পারছে না মুখ ফুটে যে, ‘আমার কারোর দয়া চাই না।’ কিন্তু সে একটা বুলিও কা’ট’তে পারলো না। কারণ টা বোধহয় পরিষ্কার। কারণ লোকটা নুরিশার পিতা। সে কোনো ভাবেই মুখের উপর জবাব দিয়ে তাকে অসম্মান করতে চাইলো না।

তম্বন্ধে তাজফির ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো৷ নোকিয়া বাটন ফোন তার হাতে। সে ফোন ধরলো।
ফোনের অপর পাশে একজন কিছু একটা বললো। সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললো,

‘দুঃখিত আংকেল আন্টি, আমি আসছি। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে!’

‘সেকি বাবা! তুমি তো মুখে ভাত ই দাওনি।’

‘তুমি আমারে কথা দিসো কালাচাঁদ। তুমি খাইয়া যাবা!’

‘আমি তোমার কথা রাখবো দাদি। কিন্তু এখন আমাকে যেতেই হবে!’

‘আমিও যাচ্ছি তাজফি ভাই!’

‘নাহ, রেহান তুই থাক। খেয়ে নে সবার সঙ্গে। আমি একাই যাচ্ছি।’

তাজফি সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। নুরিশার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। যে বুকে একটু আগেও দ্রিমদ্রিম শব্দে দামামা বাজছিলো, রাগে, ক্ষোভে জর্জরিত হচ্ছিলো, সেই বুকে এখন চিনচিন ব্যাথা করছে। কাউকে কিছু না বলেই নুরিশা ছুটে চলে গেলো। ক্ষুধার্ত মানুষটা না খেয়ে আছে, আর সে কিভাবে খাবে? কখনোই কি এমন হয়েছে, যে তার সামনে কোনো ক্ষুধার্ত ব্যাক্তি না খেতে পেয়ে কষ্ট পেয়েছে? তাহলে আজ হবে কিভাবে? হতেই পারে না।

‘আরে নুরি যাও কই? খাইবা না?’

নুরিশা জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো। আছিয়া খাতুন হাতের ভাত ঝেড়ে চিন্তিত হয়ে বললেন,

‘কি গো বৌ যাও না, নুরি চইলা গেলো ক্যা শুনো। বাচ্চা মাইয়া, শীতের রাত। এতো বড় রাত হে না খাইয়া থাকবো?’

‘আম্মা, ঐ মেয়ের কখন কি হয় বুঝি না। এখন যাবো দেখা গেলো রাগে আমায় ভষ্ম করে দিচ্ছে পারলে। এখন, আজকে রাগ করার মতো তো কিছুই ঘটে নাই।’

মতিউর রহমান কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনিও টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন!

‘আরে কি হইলো মতি? তুমি আবার যাও কয়?’

‘আম্মা, আমার ছোট্ট মেয়েটা না খেলে আমি খাবো কিভাবে?’

‘আমিও খাবো না, আমার বোন না খেলে আমারও গলা দিয়ে খাবার নামবে না।’

‘আমি আর কমু? আমি বুড়ি মানুষ না খাইয়া তো থাকবার পারি না। কিন্তু আমার নুরি যে না খাইয়া রইলো গো! বৌ কিছু করো।’

‘আমি এক কাম করি আম্মা, খাবার গুলান গিয়া ফালাই দিয়া আসি। কারোরই খাওয়ার দরকার নাই।’

বাড়ির মেয়ে খেলো না বলে বাড়ির প্রতিটি মানুষের খাওয়া হলো না। টেবিল ভর্তি খাবার কিন্তু খাওয়ার কেউ-ই নাই। রাগে দুঃখে রিক্তা বেগম বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে থেকে বিড়বিড় করে খাবার গুছিয়ে রাখলেন। এক গ্লাস পানি খেয়ে চলে গেলেন ঘরে। মেয়েটা কি এখন দরজা খুলবে? তিনি কি নিজেই খাবার হাতে যাবেন ওর রুমে? নিজের হাতে ভাত মেখে খাওয়াবেন তিনি? কিন্তু মেয়েটার হলো কি হঠাৎ?

নুরিশা দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! এমন কেন হচ্ছে তার? এ কেমন নতুন ব্যাথার উপদ্রব হচ্ছে? কেন হচ্ছে? ঐ মানুষটা তো তার কেউ না। সে না খেলে তার কি? নুরিশা নাক টেনে আবার জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলো। সে ঘরে এসেই তাজফির প্রস্থান দেখেছে। মানুষটা আরও কতক্ষণ আগে চলে গেছে অথচ তার এখনো মনে হচ্ছে এইতো মানুষ টা যাচ্ছে। হাফ স্লিভস লাল সোয়েটার আর সাদা শার্ট পড়নে। তার অবচেতন মন চাইছিলো কিছু একটা৷ যা পেলে সে খুশি হবে, শান্তি পাবে। তাজফিকে যে সে আজই প্রথম বার দেখলো তা তো নয়? তবে আজ কেন তার এমন লাগছিলো? তবে কি আজ থেকেই তার সর্বনাশের দিন শুরু?

তাজফিকে কল করলো রেহান। তিনবারের সময় তাজফি কল ব্যাক করলো। তাজফির ভাঙা ফেঁসফেঁসে কন্ঠ,

‘হ্যাঁ রেহান বল, কি হয়েছে?’

‘আপনার কন্ঠ এমন কাঁপছে কেন ভাই? কি হয়েছে?’

‘কিছু না,বল কি বলবি?’

‘আপনি তো আমাদের আড্ডার জায়গায় নেই, তাজফি ভাই। আজ কারোর সঙ্গে ঝামেলাও হয়নি তবে আপনি কার ফোন পেয়ে ছুটলেন?’

‘আমাকে কিছু দিন পাবি না এলাকায়। আর এখন কোনো প্রশ্ন করিস না, আমি পরে কথা বলবো!’

কল কেটে গেলো। রেহান হতবিহ্বল হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনটা বড্ড খারাপ হয়েছে তাজফির ব্যবহারে। সে একজনকে কল দিলো। অত্যন্ত মন খারাপে সে এই একজনকেই মনে করে। কল রিসিভ হলো। দুজনের নিঃসৃত নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোনো কথা হলো না। কোমল গলায় সেই নারীটি প্রশ্ন করলো,

‘আজ মন খারাপ কেন?’

‘তেমন কিছু না। আমার মন খারাপ বুঝলেন কিভাবে আনিকা?’

‘আপনি মন খারাপ ছাড়া আমায় নিজে থেকে কল করেন না। বলুন কি হয়েছে?’

‘কিছু না, আমি তোমার বাড়ির সামনে এসেছি। বারান্দায় আসবে?’

‘কখন এলেন?’

‘এক্ষুনি এসে দাঁড়িয়েছি।’

‘এতো দ্রুত?’

‘আপনাকে ফোন করার আগে থেকেই হাঁটছিলাম।’

‘আচ্ছা আসছি!’

রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। রেহান দাঁড়িয়ে থেকে দূর হতে তাকে দেখলো। অন্ধকারের অবয়ব দেখেও তার মন শান্ত হলো। স্পষ্ট নয় মেয়েটির মুখ৷ আনিকার সঙ্গে রেহানের পরিচয় রং নাম্বারের মাধ্যমে। আস্তে আস্তে পরিচিতি বেড়েছে, জানাশোনা হয়েছে। সে জানতোও না আনিকা তার পাশের এলাকার মেয়ে। মেয়েটা তাকে নিয়ম করে মাসে দুবার কল করে। আনিকা শুরুর দিকে ঘনঘন ফোন দিতো। রেহান বিরক্ত হতো খুব। একদিন খুব রাগারাগির পর অনেক দিন রেহানকে কল করেনি আনিকা। পরবর্তীতে রেহান ই যোগাযোগ করেছিলো এবং বলেছিলো মাসে দুবার কল করা যাবে। আনিকা মেনে নিয়েছিলো। তবে রেহান মাঝে মধ্যেই সেই নিয়ম ব্রেক করে অত্যন্ত মন খারাপে আনিকাকে কল করে। এক বছরে তার বিষয়ে সবকিছুই মেয়েটা মুখস্থ করে ফেলেছে।

রেহানের ভাবনার মাঝে আবারো সুন্দর মিষ্টি কন্ঠঃস্বর কানে বাজলো। সম্বিৎ ফিরে পেলো রেহান।

‘বললেন না যে, কি কারণে মন খারাপ!’

‘ইচ্ছে করছে না। আপনি আরও কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকুন আমি চলে যাবো!’

‘আমি আছি। তবে আপনার বিষন্ন কন্ঠ আমায় বড্ড পীড়া দিচ্ছে! দম বন্ধ লাগছে!’

‘জানেন আনিকা, আজ প্রথম বার এমন হয়েছে যে তাজফি ভাই আমাকে কিছু বলেন নি। উনি কোথাও একটা যাচ্ছেন কিন্তু আমাকে জানালেন না।’

‘এই সামান্য কারণে আপনার এতো মন খারাপ?’

‘এটা সামান্য না। যার থেকে আপনি যতো প্রায়োরিটি পাবেন তার কাছে আপনার এক্সপেকটেশন ততোই বাড়বে। কিন্তু হুট করেই যদি আপনি প্রায়োরিটি না পান তখন আপনার বুকে ব্যাথা অনুভব হবে। আমারও বুকে ব্যাথা হচ্ছে। তাজফি ভাইয়ের এই ব্যবহারটা মানতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আমাকে বড় কিছু থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।’

#চলবে

সোনার কন্যা পর্ব-০৩

0

#সোনার_কন্যা
#পর্ব৩
#রাউফুন

নুরিশার হাতে তাজফির এতো দিন পর্যন্ত দেওয়া হরলিক্স এর বোতল। এগুলো আজকে মিশুকে দিয়ে দেবে সে। মিশুর দশ বছরের একটা বোন আর আট বছরের একটা ভাই আছে। ওরা খাবে এগুলো। ক্লাসের সবাই নুরিশার সঙ্গে মিশতে চাই শুধুই তার চাকচিক্য দেখে। তবে নুরিশার কাউকেই ভালো লাগেনি যতটা মিশুকে তার ভালো আর আপন লেগেছে। মেয়েটা এতো মায়াবী। চোখ গুলো দেখলেই মনে হয় যেনো স্বচ্ছ সরোবর। ওর ভাসা ভাসা চোখগুলো যেনো তারার মতো চিকচিক করে সব সময়। এতো মায়াবী মুখের দিকে তাকালে কি যে শান্তি লাগে তার। নুরিশা স্কুলে গিয়ে নুরিশার হাতে হরলিকস্ ভর্তি ব্যাগটা ধরিয়ে দিলো। মিশু হরলিক্স দেখে অবাক হয় না। কারণ নুরিশা প্রায়ই তার ভাই বোনদের জন্য এগুলো কিনে আনে। কিছু বললেই মিশুকে হুমকি সরুপ বলে, ‘এগুলো না নিলে তোর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ!’ কালকে তার ব্যাগে যে টাকা গুলো নুরিশা রেখেছে তা সে জানে।

‘আজকে আসতে এতো দেরি হলো যে?’

‘এমনিতেই, হেঁটে এসেছি তাই।’

‘তোর তো বেশি হাঁটা বারণ। কেন তুই জেদ করিস? পায়ের সমস্যাটা বাড়ুক, দেখবি কি ঝাড় খাস আমার থেকে।’

নুরিশা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে মুচকি হেসে মিশুর হাত চেপে ধরলো। বললো, ‘ছুটির পর আমরা মার্কেটে যাবো। যাবি সঙ্গে?’

‘মার্কেটে? কিন্তু কেন?’

‘সেসব জেনে তোর কাজ নেই। স্কুল শেষে মার্কেটে যাচ্ছি আমরা ব্যস্!’

‘আচ্ছা। তোর কালাচাঁদ এর কি খবর বল!’

‘আমার কি হুম? এই আমার কি করে কালাচাঁদ সে? তাকে আমার দাদি কালাচাঁদ বলে। আমাকে একদম ক্ষ্যাপাবি না।’

‘তো? ক্ষ্যাপানোর বিষয় হলে ক্ষ্যাপাবো না?’

‘নাহ! ঠিক কোন বিষয়ের জন্য তুই আমাকে ক্ষ্যাপাবি বল তো?’

‘কেন? এই যে তোর এতো খেয়াল রাখে, তোকে তো আবার আদর করে বালিকাও বলে। হরলিকস্, চকলেট, কোক এটা সেটা কিনে দেন। রিকশা ঠিক করে দেন। এসব কি একটা পুরুষ মানুষ এমনিতেই করে?’

‘হ্যাঁ এমনিতেই করে। একটা মাস্টার্স পাশ গাঁধা লোকটা। পড়াশোনা শেষে চাকরি বাকরি না করে টো-টো কোম্পানির মতো ঘুরে বেড়ায়। তাছাড়া ঐ লোকটার আর আমার বয়সের তারতম্য দেখেছিস? সে টোয়েন্টি এইট আর আমি অনলি ফোরটিন। বয়সের গ্যাপ গুণে গুণে চোদ্দ বছর বেশি। আমার মতো বাচ্চাকে সে পছন্দ করবে? মাথা তোর খারাপ না ঐ কালাচাঁদের? আর আমার কি ওসব প্রেম ভালোবাসার বয়স? লোকে শুনলে খারাপ বলবে না?’

‘বয়স কোনো ম্যাটার না বান্ধবী! আমি স্পষ্ট দেখতে পাই তোর জন্য তার মনের দূর্বলতা আছে।’

‘তুই থামবি? চুপ কর এখন। ক্লাস শুরু হবে!’

ক্লাস শেষে নুরিশা আর মিশু গেলো মার্কেটের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছু জিনিস কিনলো সে। মিশু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। গুনে গুনে কতকগুলো কোম্বল আর সোয়েটার কিনে একটা ভেন ঠিক করে তার উপর রাখলো। হাতে এখনো বেশ কিছু টাকা আছে। শেষ টাইমে তার চোখ পড়লো একটা সুন্দর সোয়েটারের দিকে। সে কি যেনো মনে করে দুটো শার্ট আর একটা সোয়েটার কিনলো। আলাদা করে সেগুলো ব্যাগে ভরে ভেনে চেপে বসলো। মিশু অবাকের পর অবাক হয়ে শুধু নুরিশাকে দেখছিলো।

‘তুই এসব কি করবি বল তো?’

‘দেখবিই তো। ভেনওয়ালা চাচা চলুন। আমরা শক্ত করে চেপে বসেছি।’

ভেন চলতে শুরু করলো। নুরিশা আগের দিন কোচিং থেকে বাসায় যাওয়ার সময় দেখেছিলো রাস্তার পাশে বসে থাকে কত গুলো গরীব মানুষ। তারা শীতে ভীষণ কষ্ট পায়। এই প্রচন্ডরকম শীতে তাদের হাত পা ফেঁটে গেছে বিশ্রিভাবে। তাদের জন্যই নুরিশা এতো গুলো টাকা নিলো বাবা মায়ের থেকে। নুরিশা উড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো এবং মিশুর মুখও ঢেকে দিলো। গরীব দূস্থ মানুষের হাতে একটা করে কোম্বল আর একটা করে সোয়েটার দিলো। সবার চোখে আনন্দের অশ্রু। সবাই নুরিশার হাত ধরে, কেঁদে কেঁদে দোয়া করলো একদম অন্তর থেকে।

কোম্বল বিতরণ শেষে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো মিশু আর নুরিশা। মিশু যারপরনাই অবাক হয়ে বললো,

‘তুই এই মানুষ গুলোর জন্য এতো ভাবিস?’

‘ভাবি না তো ভাবতে হয়। আমার মাথায়, আমার বুকে জ্বালাপোড়া হয়। আমার দম বন্ধ হওয়ার মতো কষ্ট হয়। আমার দু-চোখে সহ্য হয় না এই মানুষ গুলোর কষ্ট। মনে হয় আমি কেন বেঁচে আছি? আমি বেঁচে থাকতে কেন তাদের এতো কষ্ট পোহাতে হচ্ছে? দুই হাজার চোদ্দ সালে এসেও এই অবস্থা মানুষের, মানা যায়? আমি মানতে পারি না। আমার মানতে কষ্ট হয়। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তবে আমি এই রকম সব দুস্থ মানুষের জন্য কিছু না কিছু করতাম। তাদের এরকম খারাপ অবস্থা থেকে তাদের মুক্ত করতাম।’

‘তাই বলে তোর ভাবতে হবে? আমরা অনেক ছোট নুরি!’

‘তো কি? কাউকে মন থেকে কিছু দেওয়ার জন্য ছোট আর বড় হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। কাউকে কিছু দেওয়াটাই আসল ব্যাপার! আমি বড় হওয়ার অপেক্ষা করবো কেন? কাউকে সাহায্য করার জন্য অনেক বড়লোক হওয়ার প্রয়োজন নেই। যদি ইচ্ছে থাকে নিজের খারাপ অবস্থা থেকেও সাহায্য করা যায়। আর হ্যাঁ আমি যায় করি না কেন, যা কিছু করবো, তুই অবশ্যই আমার সঙ্গে থাকবি। কিন্তু ততদিন, যতদিন এই বিষয় গুলো লুকায়িত থাকবে সবার কাছে!’

‘কিন্তু লোক জনের জানা দরকার আছে। হতেই পারে এসব জেনে তারাও সাহায্য করবে তোর মতো। তাছাড়াও তোর কত নামডাক হবে বলতো? যখন তোর এতো সুন্দর ভাবনা গুলোকে সম্মান জানাবে সবাই তখন তোরও ভালো লাগবে।’

‘আমি কি এসব সম্মান, নাম-ডাক আর নিজেকে ভালো প্রুফ করার জন্য মানুষকে সাহায্য করি? আমার লোক দেখিয়ে সাহায্য করে নাম কেনার কোনো মনোবাসনা নেই৷ তুই আমার প্রিয় বান্ধবী তাই তোকে সঙ্গে রাখছি। তাছাড়া কিছুই না। লোককে সাহায্য করার মাঝে যে আনন্দ পাওয়া যায়, দুনিয়াতে এমন আনন্দ কোথাও পাওয়া যায় না।’

আরও বিভিন্ন কথা বলে নুরিশা আর মিশু কোচিং এ গেলো। কোচিং থেকে ফেরার সময় আজ নুরিশা নিজেই তাজফির নিকটে গেলো। তাজফি যাবে কি? সে তো নুরিশার আগমণে হতবাক। নুরিশা ব্যাগ থেকে সোয়েটার আর শার্ট বের করলো। কোনো রকম বাক্য বিনিময় না করে সেগুলো তাজফির হাতে ধরিয়ে দিলো। তাজফি নির্বাক ছিলো। সে যেনো স্বপ্ন দেখছিলো। তার যখন সম্বিত ফিরলো তখন সে ডাকলো নুরিশাকে!

‘এই যে বালিকা দাঁড়িয়ে যাও। এসব কি? আমাকে কেন দিচ্ছো?’

নুরিশা দাঁডাইনি। সে তাজফির ডাক উপেক্ষা করে চলে গেছে নিজের বাড়িতে।

তাজফি দেখলো, ভেতরে টকটকে লাল খয়েরি রঙের একটি সোয়েটার বেশ দামী। আর কালো আর সাদা শার্ট। শার্ট দুটোও বেশ দামী। সব কিছু এক হাজারের কমে তো হয়নি৷ সে উল্টেপাল্টে দেখার সময় খেয়াল করলো একটা ছোট্ট চিরকুট!
গোটাগোটা অক্ষরে লেখা,

‘আপনি গত বছরেও এই ছেড়া-ফাড়া সোয়েটার পড়ে কাটিয়েছেন। আপনি একটা পুরনো শার্টের নিচে সোয়াটারের সেই ছেড়া অংশ ঢাঁকার চেষ্টা করেন। এতো দিন এতো এতো হরলিকস্ কিনে দিয়েছেন তার বিনিময়ে আজকের এই শার্ট আর সোয়েটার দিলাম। আবার অন্য কিছু ভাবার দরকার নেই। আমি এখনো ছোট, নিজের মন আর মস্তিষ্ককে দমিয়ে রাখুন!’

চিরকুটটার আগে পিছে কিছু নেই৷ তাজফি নিজের দিকে তাকালো৷ কোথায়? ছেড়াটা তো কোনো ভাবেই দেখতে পাওয়ার কথা না তবে মেয়েটা দেখলো কিভাবে?

তাজফি হেলেদুলে বাসায় গেলো। মেয়েটা কি তাকে নিয়ে ভাবে? এই বাচ্চা মেয়ের প্রতি তার এই টান কেন তাজফি তা জানে না। দুই ধরনের মানুষ নিজের অনুভূতি ব্যাক্ত করতে পারে না, সবল মনের মানুষ আর দূর্বল মনের মানুষ! তাজফি মনে করে সে খুবই দূর্বল মনের মানুষ! সে জীবনেও নুরিশাকে তার পছন্দের কথা বলতে পারবে না।

সন্ধ্যায় তাজফি উপস্থিত হলো নুরিশার বাড়িতে। নুরিশা তখন সবে স্নান করে সোফায় বসে গিদগিদ করে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে সে হুংকার দিয়ে বললো,’আম্মা আমাকে এক কাপ গরম চা দাও। ভীষণ শীত করছে!’

‘করবেই তো, আমি কতবার বললাম এখন গোসল করিস না।’

‘গোসল না করলে তো নামাজ হতো না আম্মা। আসার সময় কু’ত্তার মলে পা পড়েছিলো।’

কথাটা বলতে বলতে হা হয়ে গেলো নুরিশা। কি যেনো ভেবে সে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলো। তাজফি তাজ্জব বনে নুরিশার প্রস্থান দেখলো। মেয়েটা এভাবে পালিয়ে গেলো কেন? তাকে কি সাদা শার্ট আর খয়েরী রঙের সোয়েটারে বিশ্রি লাগছে? নিজেই তো দিয়ে আসলো এখন নিজেই দেখে পালাচ্ছে? আজব তো!

‘আরে তাজফি বাবা, কখন এলে?’

‘এইতো আন্টি এখনি। ভালো আছেন?’

রিক্তা এগিয়ে এলেন। কন্ঠে স্নেহ ঢেলে বললেন,’ভালো আছি বাবা। তোমাকে তো দারুণ লাগছে। কিন্তু মুখ শুকনো কেন বাবা? কিছু খাওনি?’

তাজফি লজ্জায় মুখ কাচুমাচু করে বসে রইলো। রিক্তা বুঝলেন ছেলেটা খাইনি কিছুই। বাবা মা না থাকলে বোধহয় এমনি হয়? ছেলেটার কষ্ট তার একদম সহ্য হয় না। তিনি এতো করে বলেছেন যেনো রেহানের সঙ্গে এসে তাদের বাড়িতেই থাকে। কিন্তু ছেলেটার এতো আত্মসম্মানবোধ প্রবল যে এখানে এসে দু মুঠো খাবেও না।

‘আন্টি আমি দাদির সঙ্গে দেখা করে আসি।’

‘যাও বাবা, আজকে আন্টির হাতের রান্না খেয়ে যেও।’

‘আচ্ছা খাবো আন্টি!’

রিক্তা খুশি হলেও আবার মুখ ভার করলেন। এর আগে বহুবার তাজফি বলেছে সে খাবে কিন্তু সে কখনোই খায়নি। এটা, সেটা বাহানা করে চলে গেছে। আজ তিনি কিছুতেই যেতে দেবেন না ঠিক করলেন।

‘প্রেমিকা, তুমি কি রুমেই আছো? আসবো?’

‘আসো কালাচাঁদ। দরজা খোলো আছে।’

আছিয়া খাতুন পানের পিচকারি এস্ট্রেতে ফেলে বললেন,’তা কালাচাঁদের মুখ হুকনা ক্যা? কিছু খাও নাই?’

‘কি যে বলো প্রেমিকা, আমার মুখ তো এমনি। আমি তো চিক্কু মিয়া!’

কথা শেষ করে হো হো করে হাসার চেষ্টা করলো তাজফি।

‘তোমার কি মনে হয়, আমি বুজি না কিছু? আমার চুল গুলান কি এমনি এমনি পাঁকছে?’

‘আহা এতো বিচলিত হইয়ো না প্রেমিকা। আমি ঠিক আছি। টঙের দোকানে একটু আগে গরম চা খেয়ে এসেছি।’

‘আজকে এখানে খেয়ে যেও। এটা আমার আদেশ। ‘

‘আচ্ছা খাবো। তোমার আমাকে খাইয়ে দিতে হবে তবে। না হলে খাবো না প্রেমিকা।’

‘তোমারে যদি হাতে তুইলা খাওয়াই দেই, তয় যে আরেকজনের অন্তর পুঁড়বো গো। দেইখো, তুমি ভষ্ম না হও।’

আছিয়া খাতুন খিলখিল করে হাসলেন। তাজফিও হাসলো। রাতের রান্নার আয়োজন বেশ জমজমাট। মতিউর রহমান নিজের হাতে বড় বড় মাছ, মাংস, কাচা সবজি কিনে এনেছে। আর যায় হোক, এই বৃদ্ধার কথা ফেলার জো তাজফির নেই। এতো দিন সে আছিয়া খাতুনকে সমীহ করে অনেক কথায় শুনেছে। তবে এতোক্ষণ এই বাড়িতে থাকা হয়নি। আজই বোধহয় সবচেয়ে দীর্ঘ সময় কাটালো সে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা মিললো না। সে কি তাকে দেখা দেবে বলেই রুমে নিজেকে বন্দী করেছে? এ কেমন যাতনা? সে ইতিউতি করছে।

‘তুমি যারে খুঁজতাছো হেই মনে হয় আইবো না এহন। মন পুঁইড়া যাইতাছে দেহি আমার কালাচাঁদের!বলি, এহন কি আর এই বুড়ি প্রেমিকারে ভালা লাগে না? ‘

#চলবে

সোনার কন্যা পর্ব-০২

0

#সোনার_কন্যা
#পর্ব২
#রাউফুন

নুরিশা ভাই রেহানকে দেখতেই কাঁন্না জুড়ে দিলো৷ বাইরে থেকে এসেই রেহান নুরিশার চোখে পানি দেখে বিচলিত হলো। বোনের কাঁন্না তার সহ্য হয় না।
মনে হয় বক্ষ পিঞ্জিরায় কেউ ধারালো ছু’রি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভেতরটা যেনো তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। সে অস্থির হয়ে বললো,

‘আরে কি হয়েছে নুরি? কাঁদিস কেন? কেউ বকেছে? কার এতো সাহস এই বাড়িতে যে তোকে বকে? আম্মা, আম্মা, ও দাদি, আব্বা, কই আপনারা? আমার বইনেরে কি বলছেন আপনেরা? সে কাঁন্দে ক্যা?’

‘আহা, দাদু ভাই, বাড়ির কেউ বকেনি। থামো তুমি!’ নুরিশা মাথা নেড়ে বললো।

‘তাহলে কাঁদিস কেন? তুই জানিস না ভাইয়া তোর চোখের পানি সহ্য করতে পারি না!’

‘একটা ধেড়ে দামড়া, গন্ডার মার্কা লোক, আমাকে রোজ বিরক্ত করে। সেজন্য কাঁদছি! স্কুলে যাওয়ার সময়, আবার স্কুলে থেকে আসার সময়। কোচিং-এ যাওয়ার সময় আবার আসার সময়। রোজ এমন করে বদমাশ টা! কেউ যদি রোজ আমার সঙ্গে এমন করে তো কাঁদবো না কি করবো?’

রেহানের চোয়াল শক্ত হলো। সে রেগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,’আমাদের এলাকার কেউ?’

‘হ্যাঁ!’

রেহান নুরিশার কথায় আশ্চর্য হলো। যে এলাকায় তাজফি ভাইয়ের মতো মানুষ আছে সেখানে তার বোনকে কে ডিস্টার্ব করছে রোজ? এমন তো হওয়ার কথা নয়৷

‘তুই তাকে চিনিস? নাম কি ওর?’

‘তাজফি নাম। হ্যাঁ তাজফি নামের ঐ বদের হাড্ডিটা আমাকে রাস্তা ঘাটে বিরক্ত করে।’

কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে হো হো করে হেসে উঠলো রেহান। বোনের মাথায় গাট্টা মে’রে বললো, ‘ধুর বোকা মেয়ে, তাজফি ভাই তোকে বিরক্ত কেন করবে? সে কি ওমন মানুষ নাকি? ভুলভাল বকিস না!’

‘তাজফি ভাই আমাকে বিরক্ত করে, রোজ রাস্তা ঘাটে সবার সামনে হরলিকস্ কিনে দেই, আবার যেখানে দেখে সেখানেই বালিকা, বালিকা বলে ছুটে আসে। আমি বুঝি না, আমি যেখানেই যাই সেখানেই কেন সে উপস্থিত থাকে?’

‘আরে বোন, তাজফি ভাই তো ভালো মানুষ। ওরে এতো ভয় পাওনের কিছু নাই। সেই যদি আমার এই চাঁদের মতো বোনরে আমার কাছে চাই তাও আমি চোখ বন্ধ কইরা দিয়া দিমু।’

‘দাদু ভাই, তুমিও আমারে সঙ্গ দিলা না? তোমার ঐ রাজনীতির জন্য আমাকেও দিয়ে দিবে? কেমন ভাই তুমি? আমাকে সে রোজ ডিস্টার্ব করে।’

‘ডিস্টার্ব কোথায় করে? বরং তুই যে শান্তিতে চলাফেরা করতে পারিস এটা একমাত্র তাজফি ভাইয়ের জন্য। তাজফি ভাইয়ের জন্য তোর দিকে কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস করে না৷ সে তোকে প্রটেকশন দেই। যখন যেখানে তোর সমস্যা তাজফি ভাই হাজির হয়। নিশ্চিত কোনো না কোনো ভাবে তোকে সাহায্য করতেই তাজফি ভাই সেখানে উপস্থিত থাকে। আর তোকে রোজ একটা হরলিকস্ এর বোতল কিনে দেই বলেই সে তোকে ডিস্টার্ব করে? এর মধ্যে তো আমি ডিস্টার্বের কিছু দেখছি না। তার তোর জন্য করা সকল কিছুর জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত নুরি!’

‘এহন বোঝছস, সে কি জন্য কাঁনতেছে? ভাই বোনেতে মিলে আমাদের হাড় মাংস ভেজে খাস না আর। এবারে ক্ষ্যামা দে তোরা। বোনকে আরও মাথায় তুলে রাখ।’ রিক্তা বেগম রান্না ঘর থেকে বললেন।

‘আমার কি দশ বারোটা বোন? মাথায় তুলে রাখবো না তো মাটিতে ফেলে রাখবো? তোমরা আমি বাঁইচা থাকতে কেউ আমার বোনকে কিছু বলতে পারবা না। ও আম্মা, দেও আমারে চারটে ভাত দেও খাইয়া কামে যামু!’

‘হো বেকার মানষের ম্যালা কাম!’

‘আম্মা, আমারে সব সময় বেকার কইবেন না তো। শরম করে। আমি রাজনীতি করমু। রাজনীতি তো খারাপ না৷’

‘হো, রাজা মশাই আসেন, চারটে গিলে আমাকে উদ্ধার করেন।’

আছিয়া বেগম লাঠিতে ভর দিয়ে বাইরে এলেন। সাদা নীল পাড়ের শাড়ী পড়েছেন তিনি। শাড়ীর কয়েক জায়গায় পানের পিক পড়াই লাল, ফোঁটা ফোঁটা দাগ দেখা যাচ্ছে। পানের খিলি দিয়ে যে কটা দাঁত আছে সেই দাঁত গুলো খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন,

‘বউ, খাওন চাইলেই আমার নাতীরে ঐভাবে কইবা না৷ কামাই তুমি করো না, আমার পোলায় করে৷ হের বাপে করে৷ আমাগোর কম নাই যে তুমি তারে কামে পাডানির লাইগা কথা কইবা।’

‘আম্মা, সে বিগড়ে যাচ্ছে। আপনি আর লাই দিবেন না।’

নুরিশা খিলখিল করে হাসলো। রিক্তা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সে লাল টকটকে একটা ফ্রোক পড়েছে। হাটু অব্দি ঢাকা সেই ফ্রোকে তার ন’গ্ন পা। কি যে সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। এই মেয়েটাকে নিয়ে তাদের যত ভয়। মেয়েটা এতো সুন্দর না হলেও পারতো। সুন্দর হয়েছে বলেই বুঝি এতো ভয় তার? নিজের ই নজর লেগে যাচ্ছে। তিনি চোখ ফিরিয়ে নিলেন। এতক্ষণে বাড়ির মেয়ের হাসি দেখে স্বস্তি পেলো সবাই। উফফ, বাড়ি যেনো অন্ধকার লাগছিলো একবারে।

‘দাদু ভাই, আমার তোমার কথা দারুণ লাগে। কি সুন্দর করে কথা বলো মাঝে মধ্যে!’

‘তোর ভাল্লাগে? তাইলে আমি প্রতি দিনই কমু!’

‘আচ্ছা দাদু ভাই!’

সবার মাথা থেকে যেনো ভারী কিছু নেমে গেলো। বাচ্চা মেয়েটার যতোই রাগ হোক, ভেতরটা যে একদম কোমল তা সবাই জানে। এখনি মেয়েটা গরীব দুঃখীদের জন্য কতটা ভাবে। এইতো সেদিন, ভাত রান্না করা নেই অল্প কিছু টা খাবার আছে বাকি গুলো শেষ হয়ে গেছে। স্কুল থেকে এসেই খেতে বসেছে। সেদিন রিক্তার শরীর টা খারাপ ছিলো বিধায় উঠে কাজ করতে পারেন নি। কাজের মেয়েটাও আসেনি। ঘরে রান্না করা আছে অল্প কিছু খাবার। মেয়েটা সবে মুখে একটু ভাত দিবে তখনই এক ভিক্ষুকের আগমণ। একেবারে বাড়ির ভেতরে চলে এসেছে দরজা খোলা পেয়ে৷ আছিয়া খাতুন বকাবকি করতে যাবেন ভিক্ষুককে তখনই ভিক্ষুক মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন বাড়ির দরজায়। নুরিশা ছুটে গেলো। অস্থির হয়ে কাঁন্না জুড়ে দিলো তখনি। চেনে না, জানে না তার জন্য মেয়ে বুক কেঁদে ভাসাচ্ছে? ছুটে গিয়ে পানি নিয়ে এলো সে। তাড়াহুরো করে জ্ঞান ফেরালো বৃদ্ধর চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে। ভিক্ষুক চোখ খুললে নুরিশা বললো,

‘আপনার কি হয়েছে দাদু? আপনার কি বেশি শরীর খারাপ?’

ভিক্ষুক কোনো রকমে জবাব দিলেন,’ আমি অনাহারে রয়েছি দুই রাত্রী হতে চললো। তাই শরীর টা খারাপ করেছে। ঘরে খাবার কিছু ছিলো না, খালি ভাত খেতে পারি না৷ চাল আছে, চাল ফুটিয়ে যে কেউ রেঁধে দেবে তেমন কেউ-ই নেই। তাই শরীর টা দূর্বল হয়ে গেছে!’

বৃদ্ধর কথা শুনে মেয়ের ঝরঝর করে কাঁদছে। নুরিশার কাঁন্না দেখে হতবিহ্বল সবাই। সে দ্রুত নিজের বেড়ে রাখা খাবার এনে বৃদ্ধ ভিক্ষুককে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে লাগলো। খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,

‘শোনেন দাদু, আপনার যখনই খিদে পাবে আমাদের বাড়িতে চলে আসবেন। আমি নিজে যদি নাও থাকি আমার পরিবারের লোকজন থাকবে। তাদের বলবেন আপনাকে খাবার দেবে।’

ভিক্ষুক যেনো ভাবতেই পারেনি কেউ তার জন্য এভাবে কাঁদবে, তার যত্ন নিবে। তিনি অবাক হয়ে শুধু নুরিশাকে দেখছিলো। আজ তার নাত্নী থাকলে বোধহয় এমনই বয়সের হতো?

‘তুমি বড় ভালো মেয়ে, কতদিন আমাকে এতো আদর করে খাইয়ে দেইনি। আমার এতো নোংরা জামা কাপড় দেখে তো কেউ কাছেই আসতে চাইনি৷’

‘কি যে বলেন দাদু, নোংরা কাপড় কোথায় এটা তো পুরনো কাপড়৷ আমি আপনাকে নতুন কাপড় দিবো। আপনি বসুন।’

মেয়েটা ছুটে গিয়ে বাবার নতুন কয়েক সেট কাপড় এনে ভিক্ষুককে দিয়ে দিলো অনায়াসে। উঠোনে বসিয়ে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে এলো। বৃদ্ধ মানুষটি যেনো একের পর এক কান্ডে অবাক হয়ে যাচ্ছিলো। নুরিশা বৃদ্ধকে গোসল করিয়ে দিলো নিজে হাতে। বৃদ্ধ নিজেই গা মুছতে চাইলো কিন্তু নুরিশা আগ্রহ নিয়ে নিজেই করলো। ভেজা কাপড় চোপড় বৃদ্ধ নিজেই বদলালো।

‘দাদু, শরীর টা এখন ঝরঝরে লাগছে তো?’

বৃদ্ধ হাউমাউ করে কেঁদে নুরিশাকে বুকে আগলে নিলেন। স্নেহের হাত মাথায় বুলিয়ে দিলেন। আরও কতক্ষণ বিশ্রামের পর চলে গেলেন তিনি। যতক্ষণ ছিলেন নুরিশা গল্প করছিলো বৃদ্ধর সঙ্গে।

আছিয়া খাতুন এবং রিক্তা মেয়ের এমন কাজে খুশি হোন। মেয়েটার এতো দয়ার শরীর কবে থেকে হলো? বউ শাশুড়ী দুজনের চোখেই পানি চিকচিক করছে। উনারা শুধু দেখতে চাইছিলেন নুরিশা কি করে!

নুরিশা সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে বাবার কাছে গেলো। মতিউর রহমান চা খাচ্ছেন আর খবরের কাগজ উল্টাচ্ছেন। ভাব এমন যেনো তিনি কাগজের একটা অক্ষরও পড়া বাদ রাখছেন না৷ অথচ তিনি খবরের কাগজের কিছু ছবি ছাড়া আর কিছুই দেখছেন না৷

‘আব্বা, আমাকে টাকা দেন!’

‘কত টাকা? কাল-ই তো তোমাকে এক সপ্তাহের টাকা দিয়েছিলাম!’

‘ওগুলো শেষ, আজকে আবার লাগবে!’

‘কত লাগবে?’

‘দেন এক হাজার।’

‘তুমি বাচ্চা মেয়ে, এতো টাকা দিয়ে কি করবে?’

‘দরকার ছাড়া চাইছি না আব্বা। আপনি কি টাকা দেবেন? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!’

‘আহা দিচ্ছি। রাগ করো না।’

‘আব্বা, আপনার যে ওষুধ শেষ হয়ে গেছে সে খেয়াল আছে? তা থাকবে কেন! আপনি তো বেঁচে যান ওষুধ না খেতে পারলে। আর আপনি বিরিয়ানির দোকানে রোজ যান৷ ওখান থেকে মিষ্টি খান লুকিয়ে লুকিয়ে। আমি কি আম্মাকে বলবো? আজকের পর যদি আপনি আর কোনো মিষ্টি খান দেখবেন কি হয়!’

মতিউর রহমান মেয়ের জোরে আওয়াজে কথা বলতে দেখে অবাক হলেন। যেনো তিনি একটা ছয় বছরের বাচ্চা, আর ইনি তার মা। মা হয়ে ছেলেকে বকাবকি করছেন এভাবে। আর তিনি যে বিরিয়ানির দোকানে গিয়ে রোজ মিষ্টি খান এটাই বা কিভাবে জানলো? আশ্চর্য, এটুকু মেয়ের এতো সব দিকে কেনো খেয়াল থাকবে? সবে ক্লাস এইটের ছাত্রী। তিনি সুরসুর করে মানি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলেন। নুরিশা চুপচাপ বেরিয়ে দাদির কাছে গেলো।

‘দাদি, ও দাদি।’

‘কি হইলো নুরি? ভিতরে আসো।’

‘আমার টাকা লাগবো দাদি!’

‘কই ট্যাকা?’

‘পাঁচশো দাও!’

‘কাল-ই যে টাকা দিলাম, আজ আবার?’

‘তুমি কি টাকা দিবা? নাকি চলে যাবো?’

‘দিতাছি এতো রাগ করো ক্যান?’

আছিয়া খাতুন নিজের কোমড়ের কাছে ছোট্ট ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলেন।

‘শোনো নুরি, যাওয়ার সময় পথে যদি আমার কালাচাঁদকে দেখো তয় তারে কইয়ো আমার লগে যেনো দেখা করে আজই।’

‘পারবো না।’

‘মনে কইরা কইয়ো!’

নুরিশা চলে এলো। হিসেব করে দেখলো আরও এক হাজার, পাঁচশো টাকা বাকি। তিন হাজার লাগবে। মায়ের কাছ থেকে নিতে হবে। সে তার মায়ের কাছ থেকেও টাকা নিলো। বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে স্কুলের যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেলো।

যাওয়ার সময় রোজকার মতোই পথে দেখা হলো তাজফির সঙ্গে। নুরিশা মুখ ফুলিয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে এখনি লোকটা আসবে আর বলবে,’বালিকা, স্কুলে যাচ্ছো? আমি রিকশা ঠিক করে দিচ্ছি, রিকশা করে যাও! আর রাস্তা ঘাটে কেউ কিছু বললে আমাকে জানাবা!’

নুরিশা যা ভাবছিলো তাই হলো। তাজফি এরকম ধরনের কথায় বললো। নুরিশা ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,

‘আপনি রোজ এই একই কথা বলেন, জানেন তো আমি স্কুলে যায় এই সময়ে। রোজ একটা করে হরলিকস্ কিনে দেন, এটা কি কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ করতে পারে? আপনি টাকা কোথায় পান? আপনি তো মনে হয় না কোনো কাজ করেন। বেকার মানুষ। ভবঘুরের মতো ঘুরেন, ফিরেন, খান -দান, আড্ডা দেন। আজকে আমি জানতে চাই কেন এমন করেন আপনি!’

‘কিছু না, কোনো কারণ নেই। যাও স্কুলে যাও। আমি রিকশা ঠিক করে দিচ্ছি।’

‘আমি নিজেই পারবো।’

‘আচ্ছা! যদি কেউ কাচাল করে আমাকে জানাই দিবা কিন্তু। ওকে এঁফোড় ওঁফোড় করে দিবো। সাবধানে যাইয়ো বালিকা!’

‘এতো বলতে হবে না। ভাইকে বলবেন আব্বার ওষুধ শেষ,সে যেনো নিয়ে যায়। আর দাদি আপনাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন সন্ধ্যায়!’

নুরিশা ধুপধুপ আওয়াজ তুলে সামনে এগিয়ে গেলো। তাজফি হা করে তাকিয়ে রইলো নুরিশার যাওয়ার পানে। ব্যাগে কি? তাজফির আগ্রহ হলো। কিন্তু সে আর নুরিশার সামনে গেলো না।মেয়েটাকে আজ অনেক বড় বড় লাগছিলো।

#চলবে

সোনার কন্যা পর্ব-০১

0

#সোনার_কন্যা
#পর্ব১
#রাউফুন

‘এইযে বালিকা, এদিকে আসো। একটা হরলিকস্ কিনে দিই, নিয়ে বাসায় যাও।’

নুরিশা পিছু মুড়লো।অত্যন্ত অসন্তোষজনক মুখাবয়বের সহিত কচ্ছপের গতিতে এগিয়ে গেলো ব্যাক্তিটির নিকট।সুন্দর পুরুষটি মাথা চুলকে গা দুলিয়ে হাসলো।নুরিশা কাছে যেতেই বললো,

‘তুমি এমন মুখ বেজার করে আছো কেন? তুমি যে হরলিকস্ খাও এটা আমি জানি৷ তাই কিনে দিই। তাহলে খুশি হওয়ার বদলে মুখ ভার কেন?’

‘এমনি!’

‘আমায় ভয় পাও? পেলেও, কেন পাও? আমি কি খুব ভয়ংকর দেখতে? মানে ভুতের মতো দেখতে?’

নুরিশা চুপ করে রইলো। তাজফি আবারও হাসলো। মুখ গম্ভীর করে বললো,’কি হলো, বলো? আমাকে কি ভুতের মতো দেখতে?’

‘নাহ!’

‘তাহলে শুকনা মুখে আমার সামনে আসো কেন? দেখে মনে হয় অনেক ভয় পাও!’

নুরিশার গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো,’ভয় পাই না, নুরিশা ভয় পাওয়ার মেয়ে নয়। আপনাকে আমার অসহ্য লাগে। আপনার বিরক্তিকর হাসি দেখলে গা জ্বলে যায়! গায়ে পড়ে কথা বলাটা বিরক্ত লাগে। রোজ আমাকে কিছু না কিছু কিনে দেওয়াটা বিরক্ত লাগে। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয় তখন যখন আমাকে বালিকা সম্বোধন করেন আর সবার সামনে হরলিকস্ কিনে দেন!’

কিন্তু নুরিশা একটা রা ও কা’টতে পারলো না। নিশ্চুপ মুখোভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষটা হরলিকস্, তার প্রিয় চকলেট আর দুইটা কোক কিনে দিলো। যাওয়ার আগে আবারও বললো, ‘শোনো বালিকা, তোমার যখন বিয়ে হবে তখনো হরলিকস্ খাবা, বিয়ের পরেও খাবা, তারপর যখন তোমার বাচ্চা হবে তখনও বাচ্চার সঙ্গে খাবা। মেয়ে আর মা মিলে পিকপিক করে হরলিকস্ খাবা আর আমি দেখবো!’

‘আপনি দেখবেন কি করে? আপনি তো আর আমার শ্বশুর বাড়িতে থাকতে যাবেন না!’

‘আমিই থাকবো বুঝলা বালিকা? এই জন্যই এখনো হরলিকস্ খেতে হয়। বুদ্ধি তো হাঁটুতে। তোমার রোজ একটা করে হরলিকস্ এর বোতল খালি করা উচিত। দ্রুত বুদ্ধি হবে!’

লজ্জায় লাল হয়ে নুরিশা সেখান থেকে চলে এলো।
কিছুটা আসতেই আবারও লোকটার আগমন ঘটলো।

‘রিকশা ঠিক করে দিলাম, রিকশা করে যাও বালিকা।’

‘দুই মিনিট লাগবে যেতে, এটুকুর জন্য রিকশায় চাপবো?’

‘হ্যাঁ চাপবে। ননীর পুতুল কিনা হেঁটে, বাসায় যাচ্ছে। যাও রিকশাই চেপে বসো।’

নুরিশা জানে, এখন রিকশায় না বসলে এই লোকটা তাকে তো যেতেই দেবে না আর না নিজে এখান থেকে নড়বে। তাই না ঘাটানোই ভালো মনে হলো তার। তাছাড়া আজকে শরীরটা ভালো লাগছে না। তার শরীর দুলছে। তার কাছে টাকা নেই। টাকা ছিলো না এমন না। তার বান্ধবী মিশুর আজ পিরিয়ড হয়েছে। ফার্মেসী থেকে এক সঙ্গে অনেক গুলো প্যাড আর ব্যাথার ওষুধ কিনে দিয়েছে সে। আর তার কাছে যা টাকা ছিলো তাও মিশুর অজান্তে ওর ব্যাগে দিয়ে দিয়েছে। মিশুকে রিকশায় তুলে দিয়ে সে ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে। সে জানে মিশুর ভাই বোনের খাতা কলম কেনার টাকা নেই৷ সামনাসামনি দিলে মিশু টাকা নিতে লজ্জা পাবে বলে সে লুকিয়ে দিয়েছে। সে কখনো হাঁটাহাঁটি করে না। পায়ের সমস্যাটা বোধহয় বেড়েছে। রগটা এখনো চিনচিন করছে ব্যাথায়। লোকটা কি তার অসুস্থতা বুঝেই রিকশা ঠিক করে দিলো? সে কোচিং থেকে আসার পথে রোজ মানুষটা একটা করে হরলিকস্ এর বোতল ধরিয়ে দেবে। আর এটা সেটা বলে ব্যাঙ্গ করবে। নুরিশার খুব কাঁন্না পেলো। বাসাতেও লোকটার নামে নালিশ করে কিছু বলতে পারে না সে। সবাই লোকটার অন্ধ ভক্ত কি না। কিন্তু আজ সে একটা না একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। আর কত সহ্য করবে এই লোককে? সে হরলিকস্ খাই, তো খেলেই কি হয়েছে? তার বাবা কি তাকে হরলিকস্ কিনে দিতে অক্ষম নাকি যে ঐ লোক কিনে দিবে? যদিও সে লোকটার দেওয়া একটা হরলিকস্ ও খাই না। নুরিশা বাড়িতে ঢুকে ধুপধাপ শব্দ করে রুমে গিয়ে ব্যাগ ছুড়ে মা’র’লো। রাগে সর্বাঙ্গে শিরশিরানি অনুভব হচ্ছে। সে চুল খামচে ধরে নিজেকে শান্ত করতে চাইলো। রিক্তা বেগম মেয়ের মতিগতি ভালো না দেখে মতিউর রহমানকে জানালেন। শাসন করলেও মেয়ের রাগকে উনারা ভীষণ ভয় পান৷ মেয়ের রাগ সম্পর্কে তো তারা অবগত।

‘হে-গো শুনছেন? রেহানের বাবা, আপনার মেয়ের আজকে আবার কি হয়েছে? এতো রেগে আছে যে! আপনি একটু ওর কাছে গিয়ে দেখুন না!’

‘আমি কেন যাবো? তুমি যাও! তুমি তো মা! মেয়েরা মায়ের সঙ্গ বেশি পছন্দ করে।’

‘হুম আপনাকে বলেছে, মেয়েরা বাপ ভক্ত হয় বেশি। দেখেন না, মেয়ে আপনি ছাড়া কিছু বোঝে না।’

মতিউর রহমান খবরের কাগজ দিয়ে মুখ ঢেঁকে ফেললেন৷ বললেন,’আমার মেয়ের রাগ তার নানীর মতো হয়েছে। চেহেরাও তো তার মতোই। দেখো না? এই জন্যই আমার তোমার মেয়েকে ভয় লাগে। কখন কি ছুড়ে মা’রে মুখের উপর ঠিক নেই। তোমার মা বেঁচে থাকতেই আমি তাকে ভয় পেতাম। নিজে তো গেছেন কিন্তু আমার মেয়েকে নিজের সব গুণাবলী দিয়ে গেছেন!’

‘এই থামেন তো। আমার মাকে নিয়ে একটাও বাজে কথা না। হ্যাঁ আমার আম্মা একটু রাগী ছিলেন কিন্তু মানুষটা ছিলেন খাঁটি!’

‘এক কাপ চা কি পাবো?’

‘পাবেন, আগে মেয়ের কাছে যান!’

‘তুমি যাও!’

‘পারছি না!’

রিক্তা হাত কঁচলাতে লাগলেন৷ চোদ্দ বছরের মেয়ের এতো রাগ হলো কি করে? এতো রাগকে নিয়ন্ত্রণেই বা আনবেন কিভাবে? উনার মেয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ভয় লাগছে। নিজের মেয়ের মাঝে নিজের মাকে দেখে বলেই কি, কিছু বলার সাহস হয় না উনার? কি আশ্চর্য, এই টুকু মেয়ের রাগকে তিনি ভয় পাচ্ছেন? তারা উনারা কেউ-ই যেতে চাইছেন না জনক-জননী হয়েও?

নুরিশা চুপচাপ হাত মুখে পানি দিয়ে আবারও শব্দ করে হেঁটে দাদি আছিয়া খাতুনের কাছে গেলো। কোনো বাক্যলাপ না করেই দাদির কাছে, দাদির বিছানায় শুয়ে পড়লো। তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো। আছিয়া খাতুন মুচকি হেসে নুরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধালেন,’কি হইছে আমাগো নুরির? কেউ কিছু কইচছে কোচিং থেইক্কা আসার সুময়?’

‘দাদি, তুমি ঐ কালাচাঁদকে আমার হরলিকস্ খাওয়ার কথা জানিয়েছিলে প্রথমে?’

‘হো তাইলে কি হইছে বুবুজান? তোমারে কি কিছু কইছে আমার কালাচাঁদ?’

‘তোমার কালাচাঁদ মানে কি দাদি? আমার তারে সহ্য হয় না। ঐ কালাচাঁদকে আমি দেখতে পারি না জানো না? কালো রঙের মতো ঐ কালাচাঁদরেও ঘৃণা করি। আর তুমি ঐ কালাচাঁদরেই ভালোবাসো বেশি, আমারে না।’

‘আহা, এতো রাইগা আছো ক্যান? আমি কি কইছি তারে আমি তোমার থেইক্কা বেশি ভালোবাসি? কেউ কালা হইলে তারে কালা কইতে হয় না জানো না? সৃষ্টির সেরা জীব হইলো গিয়া মানুষজাতি৷ আল্লাহর সৃষ্টিকে অবহেলা করা মানে আল্লাহ্কে অবহেলা করা৷ কোনো মানুষরেই তাই ছোডো কইরা দেহন উচিত না। আর আমার কালাচাঁদ তো ম্যালা ভালা মানুষ।’

‘আমি তারে সহ্য করতে পারি না দাদি।’

‘শান্ত হও। এইটুকুন বয়সে এতো উত্তেজিত হওয়া ভালা লক্ষ্যন না। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করো!’

‘পারছি না দাদি।’

‘আইচ্ছা ধরো, সকালে উইঠা তুমি দেখলা, তোমার সব গুলা চুল পাইকা গেছে। তোমার কি ভালো লাগবো? সাদা চুলে? এই বয়সেই তোমারে হজ্ঞলে বু’ড়ি বইলা ক্ষ্যাপাবো।’

‘মোটেও না। ক্ষ্যাপাবে কেন? তাছাড়া আমি এখনো ছোট মানুষ, আমার চুল ক্যান সাদা হবে। তোমার মতো বয়স হলে না হবে চুল সাদা!’

‘কালা যদি মন্দ হয় তাইলে কেশ পাকিবার কথা শুনলে কাঁন্দে ক্যা মানুষ? তোমার দাদা আমার যখন প্রথম চুলে পাক ধরলো তখন কইছিলো, “ মা*** দেহি বুড়ি হইছস। তোর তো চুল পাঁইকা গেছে। তোরে দিয়া কি করমু রে। তোর কাম শেষ! ” বলেই পরদিন একটা কচি মাইয়ারে বিয়া কইরা আনলো। আমি সেদিন তার কথার উত্তর দিছিলাম, আমার কয়েকটা চুল সাদা হইছে বইলা একটা বিয়া কইরা আনলেন? এইডা কিন্তু মিথ্যা। আসলে আপনে আরো আগেই বিয়া করতে চাইছিলেন। আমার শ্বশুর বাঁইচা আছিলো জন্য পারেন নাই। কালা কেশের মর্ম বুঝলেন, আমার কালা চামড়ার মর্ম বুঝলেন না? একদিন কিন্তু আপনার এই কচি বউটারও চুলে পাক ধরবো।’

‘আচ্ছা, দাদা কি তোমারে অনেক কষ্ট দিসিলো?’

‘এই সব আর মনে আনবার চাই না। মানুষটা তো আর বাঁইচা না। তাই থাউক এই কথা গুলান!’

‘দাদা কিভাবে মা’রা গেছিলো?’

‘আমাগো মণে মণে ধান হইতো। একদিন ধান কাইটা আইসা কইলো, ক্ষেতের মধ্যে ইন্দুরের গর্ত আছিলো। উনি হেই গর্তের কাছে হাত নিয়া যাইতেই সাপে ছোবল দিসে। মানুষটা দৌঁড়াইয়া আইছে বাড়িতে। কিন্তু ততক্ষণে ম্যালা দেরি হয়ে গেছিলো। মানুষটারে বাঁচানো যায় নাই। তার লাল টুকটুকে ফর্সা শরীর খানা হইলো সাপের বিষে নীল। চোখ বন্ধ করনের আগে আমারে কাছে ডাইকা কইলো, ”আমি বাঁচুম না, কারণ আমি আজরাইল দেখবার পারতাছি। তোমার সঙ্গে আমি ম্যালা অন্যায় করছি, আমারে মাফ দিও। তুমি আমার পরথম বউ, তুমি মাফ না দিলে আল্লাহও আমারে মাফ করবো না।”
কথা শেষ কইরাই মানুষটা আমার হাতে নিঃশ্বাস ছাইড়া দিলেন।’

নুরিশার দুই চোখ বেয়ে পানি পরছে। কাঁদতে কাঁদতে নুরিশা জিজ্ঞেস করলো,’তাইলে দাদার ছোটো বউ কোথায়?’

‘ঐ মা’*** তো আরেক নাগরের লগে ভাগছে। আমার সোয়ামির কাছে বিয়া বইছিলো তো তার এত্তো এত্তো সম্পত্তি দেইখা। ভাড়ার ঘর থেইক্কা ধান, গম, আর ঘরত থেইকা মাল কড়ি নিয়া ভাগছে। যদিও আসল যে সম্পত্তি আছিলো তার কথা খালি আমিই জানতাম। ঐ সম্পদ গুলা যদি না পাইতাম না তাইলে তোমার আব্বা আর বড় চাচাগোর মানুষ করবার পারতাম না।’

‘দাদি আমি যায়, আমার পড়া আছে!’

নুরিশা উঠে চলে এলো। আছিয়া খাতুন হাসলেন। বড়োই আদরের নাত্নী তার। একদম সোনার কন্যা। খালি রাগটা একটু বেশি।

#চলবে

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

1

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_১৪
#অনন্যা_অসমি

সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে গিয়েছে। সময়ের সাথে তোহা এবং সাফাইতের বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ইতি ঘটেছে। আজ তাদের বিদায় অনুষ্ঠান। তারা দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে ভেবেছিল শেষ দিনটা তারা অনেক আনন্দে কাটাবে যেন তা সারাজীবন সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকে। কিন্তু সব চিন্তা ধারণাই যে বাস্তবে রুপ নেই না। তারা ভেবেছিল অনেক আনন্দ উল্লাস করে শেষ দিনটা উপভোগ করবে কিন্তু সেই আনন্দ তোহা কিংবা সাফাইত কারোরই ভেতর থেকে আসছেনা। সেইদিনের পর আগের সেই হাসিখুশি থাকা সাফাইত একদম নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। পূর্বে যাকে পরীক্ষার আগে ছাড়া ক্লাস কিংবা বইয়ের কাছে দেখা যেতো না সেইদিনের পর থেকে সে সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে। তার এই পরিবর্তনের কারণে তোহার মনেও তার প্রভাব পড়েছে। দু’জনের বন্ধুত্ব থাকলেও না চাইতেও কোথাও একটা অদৃশ্য ভাসা ভাসা দেয়াল তৈরি হয়েছে তাদের মাঝে। আগের তুলনায় অনেকাংশে কম কথাবার্তা হয়। সংক্ষেপে কথাবার্তা শেষ করলেই যেন তারা বাঁচে।

অনুষ্ঠানের মাঝে তোহা সাহস জুগিয়ে মিনমিন করে সাফাইতকে বলল,

” একবার ইশরাকে ফোন দিবি? হয়তো এতোদিনে সব ভুলে গিয়েছে। একটু কথা বলে দেখ, সে মেনে নেবে।”

কথার মাঝেই সাফাইত শান্তভাবে তার দিকে তাকালেও তার চোখে রাগের আভাস স্পষ্ট বুঝতে পারল তোহা। পরবর্তীতে কিছু বলার সাহস হলো না তার।
.
.

দেখতে দেখতে আরো একটি বছর পার হয়ে গেল।

দরজার সামনে অনেকগুলো জুতো দেখে কপাল কুচকে এলো ইশরার। নিজের জুতো জোড়া জায়গা মতো রেখে কৌতূহলী নয়নে ভেতরে প্রবেশ করল সে।

বসার ঘরে পরিচিত দু’জনের পাশে বর্তমানে বিতৃষ্ণার তালিকায় থাকা মানুষটিকে দেখে ইশরা কিছুটা অবাক এবং বিরক্ত হলো।

ইশরাকে দেখে তার দিকে হাসিমুখে তাকাল তোহা। তবে ইশরা কোনরূপ বিপরীত প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রান্নাঘরে নিজের মায়ের কাছে চলে গেল।

” মা ওনারা এখানে কেন এসেছেন?”

ইশরার মা সাফাইতের কথা জানলেও তাদের সম্পর্কের এই উত্থানপতন, বিচ্ছেদ এসবের কিছু সম্পর্কেই তিনি অবগত নন বলেই হাসিমুখে বললেন,

” আরে ওনারা তোর জন্য সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন। যা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। তুই আমাদের আগে বলবি না। তাহলে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম।”

অবাকের চেয়েও বেশি বিরক্ত এবং রাগ হলো ইশরার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” এসেছে ভালো মন্দ কিছু পরিবেশন করে ওনাদের প্রস্থান করতে বলো। ওনারা যেই আশায় এসেছেন সেটা হবে না।”

” কিসব বলছিস তুই?”

” আমি এই প্রস্তাবে রাজি নয়৷ সাফাইত নামে কোন পুরুষের স্থান এখন আমার জীবনে নেই। তুমিই ওনাদের বিদেয় করবে৷ আমাকে যদি কিছু বলতে হয় কাউকে কথা শোনাতে ছাড়ব না।”

পরবর্তীতে মায়ের কোনরূপ কথা না শুনে ইশরা নিজের ঘরে চলে এলো৷ তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে তোহার বুঝতে বাকি নেই ইশরা তাদের আগমনে মোটেও খুশি হয়নি। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোহা।

রাগে কষ্টে চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইশরা। এতোদিন পর পুনরায় এই মানুষগুলোর সম্মুখীন হয়ে তার ভেতরে অস্থিরতা বেড়ে গিয়েছে। মানসপটে পুরোনো স্মৃতি আবারো জীবিত হয়ে উঠছে।

ঠকঠক শব্দে ধ্যান ভাঙল ইশরার। ভাবল হয়তো তার মা এসেছে। দরজা খুলতে খুলতে রাগী কন্ঠে বলল,

” মা তোমাকে না বলেছি আমাকে ডাকবে না। আমি…..” মাঝেই চুপ হয়ে গেল সে। দরজার ওপারে তোহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমথমে ভাব ছেঁয়ে গেল তার মুখশ্রীতে।

” ভেতরে আসতে দেবে না?” হাসিমুখে বলল সে। ইশরারও ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য সরে ভেতরে আসার জায়গা করে দিল। তোহা ভিতরে ঢুকে পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিল৷

” বেশ গোছানো তোমার ঘরটা।”

ইশরা তার কথায় মনোযোগ না দিয়ে গমগম কন্ঠে প্রশ্ন করল, ” এখানে কেন এসেছ? কি চাই এতোদিন পর?”

” বসতে পারি?”

তার এধরণের ভাবলেশহীন কথা বিরক্ত হলো ইশরা। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। একটা চেয়ার টেনে বসে তোহা ধীরেসুস্থে বলল,

” আন্টি থেকে তো শুনেছ কেন আমরা এখানে এসেছি।”

” হুম শুনেছি আর নিজের উওরও বলে এসেছি। এখন তোমাকে আবারো বলছি দয়া করে এখান থেকে চলে যাও। সাফাইতের সাথে আমি কোনরূপ সম্পর্ক রাখতে চাইছিনা৷ দু’বছর পর আবারো অভিনয় করতে এসেছ কেন? ভালো ভালোই তো সরে গিয়েছিলাম তোমাদের দু’জনের মাঝখান থেকে। নিজেকে নিয়ে বেশ ভালোই ছিলাম, তাহলে কেন পুনরায় আবারো আমাকে পীড়া দিতে এলে? আঙ্কেল আন্টিকে আমি কোনরূপ অসম্মান করতে চাইছিনা। তাই তোমার কাছে অনুরোধ করছি ওনাদের নিয়ে চলে যাও।”

” কেন তুমি সাফাইতের থেকে দূরে সরে এলে? আমার কারণেই তো?”

চুপ হয়ে গেল ইশরা। তার এই বিষয়ে কথা বলতেও বিতৃষ্ণা লাগছে।

” কি হলো বলো?”

” হ্যাঁ। শুনতে খারাপ লাগলেও তোমার কারণেই আমাদের মাঝে এই অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব৷ এতোগুলা দিন, এতোগুলা মাস আমরা দূরে থেকেছি শুধুমাত্র তোমার কারণে।”

” কেন? আমাদের বন্ধুত্বটা কি তোমার পছন্দ নয়?”

” তোমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে আমার কোন সমস্যা কোনকালেই ছিল না৷ কিন্তু তোমাদের এই বাড়াবাড়ি আমি আর নিতে পারছিলাম না।”

” সাফাইত তো বলেছেই সে আমাকে বন্ধু ছাড়া অন্য কোন দৃষ্টিতে দেখে না৷ তাও কেন এই সম্পর্কের ইতি টানলে?”

” সত্যিই দেখে না? এই দু’বছরে কি তার মধ্যে এমন কোন কিছুর আভাসই তুমি পাওনি?”

” না।” সোজাসাপ্টা জবাব দিল তোহা৷ পরবর্তীতে আরো বলল, ” সাফাইত খুবই পবিত্র মনের একজন মানুষ। সে প্রত্যেকটা সম্পর্ককে সম্মান করে এবং তা নিয়ে খুবই সিরিয়াস৷ শুনতে ভালো না লাগলেও তোমার আগে তার জীবনে আমার আগমন হয়েছে। তাই সে আমাকে নিয়ে বেশি ভাবতো, এখনো ভাবে। তবে তা শুধু একজন ভালো বন্ধু হিসেবে। যা একজন প্রকৃত বন্ধুর বৈশিষ্ট্য। এইযে এতো উত্থানপতন, সম্পর্কের বিচ্ছেদ এতে সে আগের থেকে চুপচাপ হয়ে গিয়েছে, আগের সেই মুক্ত পাখির মতো উড়া স্বভাবটা সে খাঁচার মধ্যে বন্ধ করে রাখলেও আমাদের বন্ধুত্ব আজো অটুট। একজন বন্ধু হিসেবে সে আজো আমার পাশে আছে৷”

ইশরা কিছুসময় চুপ থেকে বলল,

” সাফাইত নাহয় তোমাকে বন্ধুর নজরে দেখে কিন্তু তুমি? তুমিও কি শুধু তাকে বন্ধুই ভাবো? নিজের বুকে হাত রেখে বলতে পারবে?”

থমকে গেল তোহা। মূহুর্তেই কোনরূপ উওর সে দিতে পারল না৷ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মুখে হাসি রেখে বলল, ” সে আমার ভালো বন্ধু, বিপদের সঙ্গী, হাসি-কান্নার ভাগীদার এবং আমার গোপন কথার ভান্ডার।”

তোহা খানিকটা এগিয়ে এসে ইশরার কাঁধে হাত রেখে বলল, ” সাফাইতকে কি তুমি সত্যিই আর ভালোবাসো না ইশরা। সে ফিরে আসতে চাইলেও কি তাকে ফিরিয়ে দেবে?”

ইশরা উওর দিতে না পেরে চোখ দিক ওদিক ঘুরাতে লাগল। তোহা তাকে ঘুরিয়ে আয়নার দিকে ফিরিয়ে বলল, ” তোমার চোখের ভাব’ই বলে দিচ্ছে তুমি আজো সাফাইতকে আগের মতো ভালোবাসো। ইশরা ভালোবাসায় ঝগড়া, মনোমালিন্য, খুনসুটি থাকে। এসব ছাড়া ভালোবাসা ফিকে। কিন্তু ভালোবাসায় ইগো থাকতে নেই। ইগো থাকলে সেই সম্পর্ক কখনোই সুখকর হয় না।”

বিছানায় রাখা ব্যাগটা ইশরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, ” সাফাইত তোমার ছিল, তোমারই থাকবে। আমি কখনোই তোমাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির ভূমিকা পালন করব না বরং একজন বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে তোমাদের পাশে থাকব।”

ইশরা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল তার এখন কি করা উচিত।

” আসতে পারি?”

এতোগুলা দিন পর আবারো সেই চিরচেনা কন্ঠ শুনে বুক হু হু করে উঠল ইশরার। কম্পনরত কন্ঠে ছোট করে বলল,

” আসুন।”

সম্মতি পেয়ে ভেতরে এলো সাফাইত। দরজাটা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দু’জনের মাঝে অস্বস্তি৷ ইশরা ভাবতে লাগল একসময় পাশের মানুষটা তার কতটা আপন ছিল, তার সাথে কথা বলার জন্য মন উতলা হয়ে থাকত। অথচ আজ সেই মানুষটার উপস্থিতই তাকে অস্বস্তিতে ফেলছে। নীরবতার অবসান ঘটিয়ে সাফাইত প্রথমে বলল,

” কেমন আছেন?”

” ভালো।”

” আপনাকে ভালো লাগছে দেখতে।”

” আপনার বন্ধু সাজিয়ে বলে?” কোথাও একটা সূক্ষ্ম আক্রোশ থেকে নিজের অজান্তে বলে বসল ইশরা। সাফাইত খানিকটা বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করল না। এবার ইশরা ভালো করে তার দিকে তাকাল৷ পরখ করে বুঝতে পারল আগের মানুষটার সাথে এই মানুষটার পোশাক, আচরণ কোনটাই মিল নেই৷ সেই সময় সাফাইত একদম ক্যাজুয়াল থাকতে পছন্দ করত। অথচ এখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাফাইত একদম ফর্মাল পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে।

” হঠাৎ এতো পরিবর্তন?”

সাফাইত তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

” সময়ের সাথে সবই পরিবর্তন হয়ে যায়, হতে বাধ্য হয়।”

” ঠিক বলেছেন। আমাদের সম্পর্ক থেকে ভালো উদাহারণ আর কি হতে পারে।” আকাশের পানে তাকিয়ে উদাস কন্ঠে বলল ইশরা৷ চোখ ঘুরিয়ে আবারো তার দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করল,

” এতোগুলা দিন কেন খোঁজ নিলেন না? ভালোবাসা কমে গিয়েছিল বুঝি? নাকি ইগো হার্ট হয়েছিল?”

” আপনার প্রতি আমার ভালো একবিন্দুও কমেনি বরং তা এক সমুদ্র পরিমাণ বেড়েছে৷ কিন্তু সেই ভালোবাসার স্রোতে ভাসিয়ে নেওয়ার মানুষটা হারিয়ে গিয়েছিল বলে স্রোতের তীব্রতা সম্পর্কে সে অবগত নয়। ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকতে হয়, না হলে সম্পর্কটা আজীবন নড়বড়ে থেকে যায়। কারো আমার প্রতি এতো নড়বড়ে বিশ্বাস দেখে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিল, ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। এখন যদি কেউ সেটাকে ইগো হিসেবে বিবেচনা করে তাহলে এটা তার ব্যর্থতা।”

” এতোগুলা দিন পর কি মনে করে আবারো ফিরে এলেন? তোহা বলেছে বলে?”

সাফাইত ঘুরে দাঁড়াল। ইশরার চোখে চোখ রেখে জানতে চাইল , “কোনটা শুনতে চান? সত্যিটা নাকি মিথ্যা, যা আপনার মনকে সন্তুষ্ট করবে?”

” সত্যিটা।”

” হ্যাঁ তোহার প্রচেষ্টার কারণেই আজ আমরা আবার মুখোমুখি হয়েছি। আপনি আমাকে কষ্টের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলেও সে ছেড়ে যায়নি। বরং মাঝির ভূমিকা পালন করে আমাকে সেই সমুদ্র থেকে তুলে এনেছে। মেয়েটা আজো প্রতিনিয়ত নিজেকে দোষী ভেবে গুমড়ে মরছে। এই সম্পর্কে টানাপোড়নের কারণ নিজেকে মনে করছে৷ সে আমাদের এক করার জন্য বদ্ধ পরিপক্ক ছিল, তাই তো আমাদের এক করার জন্য কোন পথই সে বাদ রাখেনি।”

” এখন যদি সে বলে আমাকে ছেড়ে দিতে তাহলে কি ছেড়ে দেবেন? কিংবা যদি বলে সে আপনাকে বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু মনে করে তখন?”

” তোহা কখনোই এরকম করবে না৷ এটা আমার বিশ্বাস৷ সে জানে আমি একজনকে কতটা ভালোবাসি৷ প্রয়োজনে নিজেকে কষ্ট দেবে তাও জেনে বুঝে কারো ক্ষতি সে কখনোই করবে না।”

” এখন যদি আমি বলি এরপরেও আমি আপনার সাথে সম্পর্ক গড়তে চাই না৷ তখন?”

সাফাইত হতাশা ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

” যদি এই সিদ্ধান্তই হয় তবে ভবিষ্যতে জীবনের জন্য শুভাকামনা। সবসময় ভালো থাকবেন।”

নিজের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে তোহার দিকে তাকাল ইশরা। তোহা কি বুঝল সে জানেনা তবে সে মুচকি হেসে তাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল। যা দেখে কোথাও যেন ইশরার একটা শান্তি অনুভব করল, মনে হলো কোন বোঝা কমে গিয়েছে।

” আমি রাজি এই বিয়েতে।” হাসিমুখে জানল সে৷ তার উওরে পুরো ঘরে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। সাফাইতের মা সাথে নিয়ে আসা আংটিটা ইশরার হাতে পড়িয়ে দিয়ে বিয়ের কথা পাকা করল।

সাফাইত এবং ইশরা তার দিকে তাকালে তোহা হেসে ইশরায় তাদের একসাথে ভালো লাগছে বোঝাল। সাফাইত তাকে বিনা শব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে ধন্যবাদ জানাল। হাসিমুখেই বাকি সময়টা কাটল তারা, তোহাও তাদের সাথে সম্পূর্ণ সময়টা হাসি মজাতে কাটল। তবে বাইরে হাসিখুশি থাকলেও অন্তরে তার কি চলছে তা শুধু একমাত্র সে এবং তার সৃষ্টিকর্তায় জানে।
.
.

চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে সাফাইত এবং ইশরার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। বর্তমানে দু’ই পরিবারই বিয়ের আয়োজন এবং কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত। আয়োজনে তোহা থেকেও যেন নেই। সাফাইত এবং তার মা তোহাকে একবার বলেছিল যেন কেনাকাটা করতে সেও তাদের সাথে যায় তবে তোহা গেল না, বাহানা দিয়ে সুকৌশলে কাটিয়ে গেল৷ কারণ সে জানে তার যাওয়াটা ইশরা খুব একটা পছন্দ করবে না। আর সে জেনে বুঝে কারো সুখীর দিনে তার মনে কষ্ট দিতে চাইনা। সাফাইত বুঝল তোহার এড়িয়ে যাওয়াটা তবে এবার সেও বেশি জোর করল না৷ কিন্তু তোহার জন্য পছন্দ করে পোশাক কিনতে ভুলল না এবং তার ইশরার পছন্দসই কিনেছে।

অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে, বহুপ্রতিক্ষার পর সেই দিনের আগমন অবশেষে ঘটল। বিয়ের পুরো সময়টা তোহা সেখানেই উপস্থিত ছিল। কারণ সে চাইনা শেষ সময়ে এসে অদ্ভুত ব্যবহার করতে যা সবার নজরে খুবই সহজে পড়ে যাবে এবং তাতে ঝামেলা বাড়বে বয় কমবে না।

বিয়ে শেষ হওয়ার কিছুসময় পর তোহা দু’জনের কাছে এলো।

” নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল। আমার এই বন্ধুটার খেয়াল রেখো ইশরা৷ সাহেব এখন গম্ভীর গম্ভীর ভাব দেখালেও ভেতরে কিন্তু সেই আগের মতোন’ই আছে৷”

একটা রেপিং পেপারে মোড়ানো বক্স এগিয়ে দিল ইশরার দিকে৷ ইশরা তা নিতেই সে দু’টো ব্যাসলেটের মতো জিনিস সামনে এগিয়ে বলল,

” ওকে এটা পড়িয়ে দিতে পারবো কি? নাকি তোমার বর হয়ে গিয়েছে বলে এখন তাকে আর ছোঁয়া যাবে না?” হেসে বলল সে। ইশরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উওর দিল। তোহা মুখে হাসি বজায় রেখে একটা সাফাইতকে এবং অপরটা ইশরাকে পড়িয়ে দিল এবং নিজের বামটা সামনে এগিয়ে আনল।

” এটি আমি নিজের হাতে ভালোবেসে বানিয়েছি, আমাদের বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে। যাতে আমি না থাকলেও আমাকে একজন বন্ধু হিসেবে সবসময় মনে রাখো।”

সাফাইত হেসে বলল, ” কেন? শশুড়বাড়ি যাওয়ার জন্য প্ল্যান করছিস নাকি?”

তোহা ঢোক গিলে বলল, ” হ্যাঁরে৷ তবে শশুড়বাড়ি নয় দূর সম্পর্কে শশুড়বাড়ি যাওয়ার। আমার ওপ্পারা যে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

এবার সাফাইত সিরিয়াস হলো৷ বুঝল তোহা মজা করছে দেখালেও সে মজা করার মুডে নেই।

” এই কি হয়েছে তোর? কিসব বলছিস এগুলো?”

” হ্যাঁ সাফু তুই যা বুঝেছিস তাই। কয়েকঘন্টা পরেই আমার ফ্লাইট৷ আমি আজকেই কোরিয়া চলে যাচ্ছি।”

” মানে! এই তুই এসব কি বলছিস? কখন করেছিস এগুলো? তোর আজ ফ্লাইট, তুই কি আমাকে এখন বলছিস! এটা তোর ধরণের মজা তোহা?” শেষে রাগী কন্ঠ বলল সে৷

” প্রস্তুতি তো অনেক আগে থেকেই নিচ্ছিলাম কিন্তু হুট করেই ভিসা হয়ে গেলো। মাঝে তুই এতো ব্যস্ত ছিলিস তোকে জানিয়ে বিরক্ত করতে চাইনি।”

” বিরক্ত! আমার তো এখন রাগ হচ্ছে। তুই এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলি আর আমাকে একটাবারো জানালি না। এই আমি তোর বেস্টফ্রেন্ড?”

” আরে বাবা সরি। বললাম তো হুট করেই ভিসা হয়ে গেল৷”

” ভিসা নাহয় হলো কিন্তু প্রসেসিং? প্রিপারেশন? তার বেলায়? তোর থেকে একটা আমি আশা করিনি। তুই আমার সাথে একদম কথা বলবি না।” সাফাইত রাগ করে চেয়ারে বসে পড়ল। তোহা জানত সাফাইত ভীষণ রাগ করবে, কষ্ট পাবে।

” কিছুসময় পর তো চলেই যাবো৷ শেষ সময়ে কি একটু কথা বলবি না?” বেশ ইমোশনাল হয়ে বলল তোহা। এবার নিজের কঠোরতা আর বজায় রাখতে পারল না সাফাইত। হাজার হোক এতোবছরের বন্ধুত্ব।

ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,

” তুই এটা ঠিক করছিসনি তোহারাণী। এভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারছিস তুই।”

” আরে বাবা আমি তো কয়েকবছর পর চলেই আসব। এরকম করলে কিন্তু আমার যেতে খারাপ লাগবে। তুই কি সেটাই চাইছিস?”

” না। চল তোকে আজ কবজি ডুবিয়ে খাওয়াবো৷ শেষ বারের মতো দেশের খাবার তৃপ্তি করে খেয়ে নে। ওখানে গিয়ে এসব সুস্বাদু খাবার জীবনেও পাবিনা৷ তখন আমি তোকে ফোন দিয়ে এসব খাবার দেখাবো। তুই শুধু দেখবি আর মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়বে।”

” ছিঃ, চুপ কর শয়তান। আমাকে খাবারের লোভ দেখাতে আসবিনা।”

তোহার বেশ যত্ন আঁত্তি করল সবাই, এমনকি ইশরাও। বিদায় বেলায় সবাই তোহার সাথে টুকটাক কথা বলল, কেউই প্রস্তুত ছিল না তোহার এই অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্তে। তোহা ইশরাকে জড়িয়ে ধরল।

” ভালো থেকো তোমরা।”

” তুমি আমার কথায় কষ্ট পেয়ে দেশ ছাড়ছ৷ তাই না আপু?”

কেঁপে উঠল তোহা। নড়বড়ে কন্ঠে বলল, ” না, একদমই না। তোমার কথায় আমি একটুও কষ্ট পাইনি। আমার আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল বাইরে যাওয়ার৷ তাই তো আগে থেকেই সবকিছুর প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলাম।” ইশরাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল তোহা৷ তার কাঁধে হাত রেখে আবারো বলল, ” এসব কথা এখন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। নতুন একটা জীবন শুরু করছ, এতে অতীতের স্মৃতি নিয়ে প্রবেশ করো না। নতুন করে সব সাজাও, নিজের মনের মতো করে। ভালো থেকো সবসময়।”

সাফাইতের বাহুতে হাত রেখে তোহা টলমলে চোখে বলল, ” ভালো থাকিস সাফু। তোকে অনেক মিস করব। আমার জায়গাটা কাউকে দিসনা।”

” তোর জায়গা সবসময় তোরই থাকবে। সেটা আর কেউই পূরণ করতে পারবে না। সাবধানে যাস, পৌঁছে জানাতে ভুলবিনা।” মাথায় হাত বুলিয়ে বলল সে।

বিদায় পর্ব শেষে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়াল তোহা। শেষ বারের মতোন পেছন ফিরে হাত নাড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানাল।

গাড়ি চলছে শুরু করেছে। সাইড মিররে নবদম্পতির হাসি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে তোহা নিজের মনে বলল,

” আমি চাইলেই পারতাম তোদের দূরত্বের সুযোগটা নিতে। চাইলেই পারতাম তোকে নিজের করে নিতে। কিন্তু আমি এতোটাও নিষ্ঠুর হতে পারিনি। পারিনি নিজের স্বার্থের জন্য দু’জন ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করতে। হয়তো দেখা যেতো মনের কথা জানালে হীতে বিপরীত হতো। আমাদের বন্ধুত্বই হয়তো ভেঙে যেতো। আমার প্রতি তোর বিশ্বাস ভেঙে যেতো, তোর নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হতো। আমার থেকে দূরে চলে যেতি তুই। কিন্তু আমি তো তা চাইনা সাফাইত। তুই আমার ভালোবাসার মানুষ হিসেবে, জীবনসঙ্গী হিসেবে আমার জীবনে না থাক। কিন্তু বন্ধু হিসেবে সারাজীবন আমার পাশে থাক এটাই আমার চাওয়া। তোকে একেবারে হারিয়ে ফেললে যে আমি ধুঁকে ধুঁকে মরবো। আমার একপাক্ষিক ভালোবাসা আমার হৃদয়েই থাক। আমার অনুভূতি একমাত্র আমার। কাছ থেকে তোকে না পাই দূর থেকে না হয় তোকে সারাজীবন ভালোবেসে যাবো। তাও তুই ভালো থাক।”

অশ্রভেজা নয়নে চাঁদবিহীন অন্ধকার আকাশের পানে চেয়ে রইল তোহা৷ গাড়িতে থাকা রেডিও থেকে ভেসে এলো,

” দূর হতে আমি তারে সাধিব
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব।”

_________________ সমাপ্ত ___________________

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব-১৩

0

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_১৩
#অনন্যা_অসমি

” কিরে সাফু এসব আমি কি দেখছি? তোর হঠাৎ এই অবস্থা কেন? কয়েকদিন ধরে ভার্সিটি আসছিস না, ফোনও করছিস না, মেসেজের কোন রেসপন্স নেই। আজ সকালে আন্টি আমাকে ফোন করে জানতে চাইল কি হয়েছে। তুই নাকি খাওয়া-দাওয়াও করছিস না ঠিকমতো, দরজা বন্ধ করে বসে থাকিস। কি হয়েছে তোর?” ব্যাগটা রেখে চেয়ার টেনে বসল তোহা৷ সাফাইত কোন উওর না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল৷ তোহা পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখল আগের থেকেও ঘরটা বেশি এলোমেলো৷ ভাবল গুছিয়ে রাখবে কিন্তু পরে আর তা করল না। সাফাইত বেরিয়ে এলে তার দিকে ভালো করে তাকাল, পর্যবেক্ষণ করল তাকে।

” চোখ মুখের এ কি অবস্থা করে রেখেছিস তুই? চুলগুলো একেবারে কাকের বাসা হয়ে গিয়েছে। সেইভ করিসনি কতদিন? পুরো একটা বনমানুষ লাগছে তোকে। তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে গিয়েছিস। একেবারে পুরো দেবদাস লাইট।” যদিও তোহা শেষের কথাগুলো না-জেনে মজা করে বলেছিল কিন্তু সে তো আর জানেনা তার মজাই বাস্তবে ঘটেছে।

সাফাইত বিছানার চাদর ভাঁজ করতে করতে বলল,

” ঠিকই বলেছিস। জীবনে একটাই প্রেম করেছিলাম আর তাতেই ব্যর্থ হলাম।”

তোহা তার কথার অর্থ বুঝতে পারল না।

” মানে? এই সাফাইত একদম মজা করবিনা, সত্যি করে বল কি হয়েছে?”

” বললাম তো তুই যা বলেছিস তাই। বিরহের কষ্টে দেবদাস হয়ে গিয়েছি।”

তোহা মূহুর্তেই উঠে দাঁড়াল। অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করল,

” কি! কিসব বলছিস তুই? এই সাফু কোথায় যাচ্ছিস? খোলসা করে আমাকে বল।”

সাফাইত বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ” বস, আমি চা নিয়ে আসছি। আমার খুব মাথা ধরেছে।”

তোহা বসল না, অস্থির হয়ে পুরো রুমে পায়চারি করতে লাগল।

সাফাইত একটা কাপ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আরেকটা নিয়ে আরাম করে বিছানায় বসল৷ তার এরকম নির্লিপ্ত ব্যবহার দেখে তোহা কিছুটা বিরক্ত হলো। চেয়ারটা টেনে তার মুখোমুখি বসে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,

” কিরে বল কি হয়েছে তোর? তখন ওসব কি বললি? ইশরার সাথে কি তোর সত্যিই কোন ঝামেলা হয়েছে? ঝগড়া হয়েছে?”

সাফাইত কাপে চুমুক দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, ” আমাদের সম্পর্কের সমাপ্তি হয়ে গিয়েছে তোহা।”

” মানে!” বুক কেঁপে উঠল তার।

” মানে ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে আমাদের। এখন আমাদের দু’জনের পথ সম্পূর্ণ আলাদা।”

” তুই কি সব আবোলতাবোল বলছিস? মাথা ঠিক আছে তোর? রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়েছে তোর? কি বলছিস তুই নিজে জানিস?”

” এটাই সত্যি তোহা। আমাদের মাঝে সব সম্পর্ক শেষ।”

” কিন্তু কেন? হঠাৎ তোদের মাঝে কী এমন হলো? আমাকে পরিষ্কার করে বলল।”

” ও একটা…..” বলতে গিয়েও থেমে গেলে সাফাইত। ভাবল, ” না ইশরার কথাগুলো তোহাকে বলা যাবে না। তাহলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। তার থেকেও বড় কথা ইশরার সম্পর্কে তার একটা খারাপ ধারণা তৈরি হবে৷ যত যাইহোক আমি ইশরাকে কারো সামনে ছোট করতে পারব না।”

” কিরে চুপ করে গেলি কেন?”

” আমাদের মনে হয়েছে আমাদের মাঝে আর কোন ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই, কোন ফিলিংস নেই তাই আমরা ব্রেকাপ করে নিয়েছি।”

” তুই মিথ্যা বলছিস সাফাইত। আমি জানি তুই ইশরাকে কতটা ভালোবাসিস আর সেই তুই কিনা বলছিস তোর মাঝে আর কোন ফিলিংস নেই! আমাকে বাচ্চা ভেবেছিস তুই।”

” এটাই সত্যি তোহা। ভালোবাসা একটা আপেক্ষিক জিনিস। যেকোন সময় পরিবর্তন হতে পারে। আমারো হয়েছে।”

” তাহলে তুই কেন মনমরা হয়েছে নিজেকে বন্দী করে রেখেছিস? যদি ভালোবাসা শেষই হয়ে থাকে তাহলে তোর এখন মজা করার কথা, ফুর্তি করার কথা কিন্তু তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে না তুই মজায় আছিস।”

এবার কিছু বলতে পারল না সাফাইত৷ চুপচাপ কাপটা নিয়ে আবারো বেরিয়ে গেল। তোহা বুঝতে পারল ইশরার সাথে সাফাইতের বড় কোন ঝামেলা হয়েছে। আর সেটার কারণ সাফাইত থাকে পরিষ্কার করে বলবে না এটাও সে বুঝতে পেরে গিয়েছে। সমস্যার কারণ এবার তাকে শুধু একজনই বলতে পারে।

” ইশরা।”
.
.

বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর আজ অবশেষে ইশরার দেখা পেলো তোহা। সে পেছন থেকে কয়েকবার ডাকলেও ইশরার কোনরূপ উওর না পেয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।

” তোমাকে কতবার ডেকেছি।”

ইশরা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে তোহা তার পথ আটকে দাঁড়াল।

” কি হয়েছে তোমাদের মাঝে? তোমারই বা কি হয়েছে? এমন ব্যবহার করছ কেন তুমি? আমাকে কেন এড়িয়ে যাচ্ছো? তোমাদের দু’জনের কি হয়েছে বলো তো? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা হঠাৎ তোমরা এতোবড় সিদ্ধান্ত কেন নিলে? সাফাইত তো আমাকে খুলে কিছু বলছেনা, অন্তত তুমি বলো।”

” ও…. এতোসব কিছু করে এখন বলছো কিছুই বুঝতে পারছো না। বাহ্ এতো ভালো অভিনয় করতে পারো তুমি। তোমার তো অভিনয়ে নাম দেওয়া দরকার।” বিদ্রুপ করে বলল সে।

” কিসব বলছ তুমি ইশরা! আমি অভিনয় করছি! দেখো এতো ঘুরিয়ে কথা বলে সরাসরি আমাকে বলো কি বোঝাতে চাইছ তুমি? কি হয়েছে তোমাদের মাঝে? কোনো হঠাৎ এতোটা দূরত্ব তৈরি হলো তোমাদের মাঝে?”

” ও প্লিজ আর অবুঝের অভিনয় করো না তোহা আপু, তোমার প্রতি নূন্যতম যে সম্মানটা আছে সেটাও না মুছে যায়। আমাদের মাঝে দূরত্বের একমাত্র কারণ শুধু এবং শুধু তুমি।”

তোহার মাথায় যেন বাজ পড়ল। অবাক কন্ঠে বলল,

” আমি! আমার কারণে তোমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে!”

” হ্যাঁ তুমি৷ তোমরা দু’জনেই বেইমান, স্বার্থপর। তোমরা দু’জন মিলে আমার অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছ। সবাই বলতো তোমাদের মাঝে কিছু আছে কিন্তু আমি বোকা বিশ্বাস করিনি। উল্টো বলেছি তোমরা অন্যদের মতোন না, তোমরা শুধুই বন্ধু। কিন্তু পরিশেষে কি হলো? সবার কথায় সত্যি হলো, তোমরা দু’জন মিলে আমার অনুভূতিকে গলা টিপে মেরে ফেলেছ।” বলতে বলতে ইশরার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

” ইশরা বিশ্বাস করো আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নেই।”

তোহার কথা শ্রবণ না করে ইশরা আবারো বলল,

” কেন করলে আমার সাথে এরকমটা বলো? কি ক্ষতি করেছি আমি তোমাদের? আমি তো নিজে তোমাদের মাঝে আসিনি। বেশ তো একা ছিলাম আমি। কেন সাফাইত আমার জীবনে এলো? সে যদি তোমাকেই পছন্দ করতো তাহলে কেন আমার জীবনে ক্ষাণিকের জন্য এসে আমার গোছানো জীবনটা এলোমেলো করে দিল? আমি তো ওর কাছে যাইনি। কেন তোমরা আমার সাথে এতোবড় জঘন্য খেলা খেললে? আচ্ছা তুমি তো একজন মেয়ে, তুমি কি করে এসব করলে? তোমরা যা ইচ্ছে করতে আমার কিছু যাই আসতো না। কেন তোমাদের মাঝে আমাকে নিয়ে এলে, বলো? উওর দাও।” অনবরত তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তার কান্না দেখে তোহার চোখেও জল জমে গিয়েছে৷ সে ইশরার কাঁধে হাত রেখে বলল,

” বোন বিশ্বাস করো সাফাইত শুধু তোমাকে ভালোবাসে। তার মনে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন ভালোবাসার নারী নেই। আমাকে সে সর্বদায় একজন ভালো বন্ধু হিসেবে দেখে এসেছে। প্লিজ তোমরা এভাবে ভুলবোঝাবুঝির জন্য দূরে সরে যেও না।”

ইশরা ঝটকা দিয়ে তার হাত সরিয়ে দিলো৷ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল, ” চুপ একদম চুপ। আমাকে আর বোঝাতে হবে না। তোমাদের মধ্যে কিছু না থাকলে সাফাইত এভাবে তোমার জন্য চিন্তিত থাকত না, ফোন করলেই ছুটে যেত না। কথায় কথায় তোমার গুণগান গাইত না। এতোদিন চোখে ভালোবাসার মিথ্যা কাপড় পড়েছিলাম এখন তা খুলে গিয়েছে৷ আমি আর কোন কিছুতে মানবো না। সম্পর্ক শেষ মানে শেষ। এবার তোমরা দু’জন ভালো থাকো, পারলে বিয়েও করে ফেলো৷ ইশরা নামক কোন মানবী আর তোমাদের জীবনে আসবে না।”

সে চলে যেতে নিয়েও থেমে গেল৷ চোখের জল মুছে শক্ত মুখ করে বলল, ” আর হ্যাঁ যদি নূন্যতম লজ্জাবোধ থাকে তবে কোনদিন নিজের এই মুখটা আমাকে দেখাবে না। মিথ্যা বলব না, তোমার এই চেহারা দেখলে এখন আমার ঘৃণা লাগে। নারী নামে কলঙ্ক তুমি।”

দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল ইশরা। তোহা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুসময় পর তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

” যে সম্পর্ক ভাঙনের ভয়ে এতোগুলা দিন নিজের অনুভূতিতে লুকিয়ে রেখেছি, গোপনে নিজের মনের কথা আড়াল করে রেখেছি আজ সেই কারণেই তাদের সম্পর্ক ভাঙন ধরল! তাহলে আমার এই অনুভূতি লুকিয়ে রাখার ফল কি পেলাম?”
.
.

” তুই কেন ওর কাছে গিয়ে ব্যাখা করতে গেলি বল? আমি বলেছিলাম তোকে? কেন শুধু শুধু ওর কাছে গিয়ে এতোগুলা কথা শুনলি?” চিৎকার করে বলল সাফাইত।

” আস্তে কথা বল সাফাইত, মা বাড়িতেই আছে। তোকে কে বলেছে আমি ইশরার কাছে গিয়েছিলাম?”

” সেই আমাকে ফোন করে বলছে। সাথে আমাদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলতেও ছাড়েনি৷ তুই কষ্ট পাবি তাই আমি তোকে কিছুই জানাইনি। কেন তুই গেলি বল?”

” দেখ সাফু, ইশরার বুঝতে ভূল হয়েছে। তোর উচিত ওর সাথে বসে কথা বলে সব ঠিক করে নেওয়া।”

” না যার মন এতোটা সন্দেহ আর অবিশ্বাসে ভরা তাকে এখন মানিয়ে নিলেও ভবিষ্যতে ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকবে। যে তার ভালোবাসার মানুষের উপর এতটুকু ভরসা করতে পারেনা তার সাথে আমি থাকতে পারব না৷ সে আমার চরিত্র নিয়ে কথা তুলতেও দ্বিধা করেনি৷ তুই আর চেষ্টা করছিস না তোহা, এই সম্পর্ক আর কখনোই ঠিক হওয়ার নয়৷”

এককদম এগিয়ে সে পেছনে না থাকিয়ে বলল,

” পুনরায় চেষ্টা করলে নিজে যেছে অপমানিত হবি, সাথে আমাদের বন্ধুত্বেও ফাটল ধরবে।”

সাফাইত চলে যেতেই তোহা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল৷ চুলগুলো মুঠো করে ধরে বিরবির করে বলল,

” আমার জন্যই এসব কিছু হচ্ছে৷ যে সম্পর্ক ঠিকিয়ে রাখার জন্য নিজের ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছিলাম এখন সেটা প্রকাশ না করেও সম্পর্ক ঠিকিয়ে রাখতো পারিনি। সব আমার জন্য হচ্ছে, সব দোষ আমার।”

এভাবেই নিজেকে দোষারোপ করতে লাগল তোহা। পরক্ষণে আবারো শুধাল,

” আমার কি উচিত এই সুযোগটা ব্যবহার করা?”

চলবে….

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব-১২

0

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_১২
#অনন্যা_অসমি

” আমি আর তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইনা সাফাইত। তোমার ভাষার ইট’স ওভার, ব্রেকাপ।”

বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো সাফাইত। নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছে না ইশরা কখনো এধরণের কথা বলবে। মনে হলো সে দিবাস্বপ্ন দেখছে।

কয়েক কদম এগিয়ে এলো সে। বিস্ময়মিশ্রিত কন্ঠে বলল, ” তুমি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য মজা করছো তাই না ইশরা? তুমি জানো আমি এই কথা শুনে অস্থির হয়ে যাবো। তাই না, বল?”

এবার ইশরা একটু উঁচু স্বরেই বলল,

” বাংলা কথা বোঝো না তুমি? বললাম না একবার আমি তোমার সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখতে চাইনা। এই সম্পর্ক আমার কাছে এখন বিষাক্ত মধুর মতো লাগছে। সেটা দেখতে তো মিষ্টি কিন্তু গলাধঃকরণ করলে নিশ্চিত মৃ’ত্যু৷ কিন্তু আমি বাঁচতে চাই সাফাইত।”

সাফাইতের মনে এবার ভয় গ্রাস করল। সে ইশরার হাত ধরে মিনতি করে বলল, ” এরকম কেন করছো ইশুপাখি? তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি সত্যিই একা হয়ে যাবো, পাগল হয়ে যাবো আমি। কেন তুমি এরকম কথা বলছ? আমি কি কোন ভূল করেছি, করলে বলো আমি তা ঠিক করে দেবো।”

” সত্যিই ঠিক করতে পারবে তো সাফাইত?” বিদ্রুপ করে বলল সে।

সাফাইত অস্থির কন্ঠে বলল, ” হ্যাঁ পারব পারব, তুমি শুধু বলো আমার ভূলটা কোথায়?”

” সত্যিই তুমি পারবে আমার মনের ক্ষতটা সারিয়ে তুলতে? পারবে আমার জন্মদিনের সময়টা ফিরিয়ে আনতে? পারবে কি যে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে আমি পড়েছিলাম সেই সময়টা পরিবর্তন করতে? বলো পারবে?”

সাফাইত এখনো পর্যন্ত তার কথার কোন অর্থ বুঝতে পারলো না৷

” ইশরা তুমি এসব কি বলছ? সেদিন কি হয়েছিল? আমি পরবর্তীতে আবারো রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম কিন্তু গিয়ে কাউকে পাইনি৷ তোমার সাথে যোগাযোগ করার কত চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি কোন উওর দাওনি।”

” কেন ফিরে গিয়েছিলে? আমাকে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে দেখে মজা নিতে?”

” এসব তুমি কি বলছ ইশরা! আমি কেন তোমাকে…. ”

” সেদিন তুমি আমাকে একবার বলে যেতে পারতে। আমাকে খুঁজে বলে যেতে পারতে তুমি কোথায় যাচ্ছো৷ কি হতো সর্বোচ্চ একটা মিনিট অতিবাহিত হতো। কিন্তু না তোমার কি আর সেই সময় আছে নাকি? আমি কে? তোমার জীবনে তো আমার কোন মূল্যই নেই এখন৷ সেদিন যখন সবাই তোমার খোঁজ করছিল, জানতে চাইছিল তোমার ব্যপারে আমি কিছু বলতে পারি। সবাই কানাঘুষা করছিল, বলছিল আমি কতটা উদাসিনী যে নিজের প্রেমিক কোথায় তা জানিনা। তখন একজন বলল তোমাকে নাকি তোহা ফোন করেছিল৷ তোমার জীবনে সে গুরুত্বপূর্ণ একজন তা আমি জানি, আমি আজ পর্যন্ত তোমাদের নিয়ে কোন চিন্তা মাথায় আনিনি৷ সবসময় ভালোদৃষ্টিতে তোমাদের দেখেছি। তার গুরুত্ব তোমার কাছে অনেক মানলাম কিন্তু আমি? আমি কি এতোটাই ফেলনা?”

” ইশরা আমার কথাটা তো শোন আগে। তারপর সিদ্ধান্ত নিও।”

” কি শুনব আমি? কি শোনার বাকি রেখেছ আর?”

ইশরা চলে যেতে চাইলে সাফাইত তাকে জোড় করে ধরে রাখল৷

” সেদিন আন্টি অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তোহা বাড়িতে একা ছিল, ছোট তমালকে নিয়ে সে কি করবে বুঝতে না পেরে আমাকে ফোন দিয়েছিল। আন্টি একদিন হসপিটালে ছিল। আমি ছাড়া তোহা কাউকে ভরসা করতে পারে না বলেই সে আমাকে ফোন করেছিল। আমিও টেনশনে তোমাকে জানিয়ে বের হওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। সরি বলছি তো আর কখনো হবে না।”

” সাফাইত আমিও একটা মানুষ, আমারো কিছু নিজস্ব ইচ্ছে, শখ আছে৷ আমারো ইচ্ছে হয় নিজের প্রেমিকপুরুষের সাথে একান্তে সময় কাটাতে, বসে দু’টো নিজের কথা বলতে। কিন্তু তুমি, তুমি প্রায় সময় তোহা আপু নিজে থেকে আমাদের মাঝে নিয়ে আসো৷ আমি কখনোই তা নিয়ে কিছু বলিনি, না ওভার রিয়েক্ট করেছি৷ আমরা একা থাকলেও তুমি আমাদের কথার মাঝেও তোহা আপুর কথায় নিয়ে আসতে। তখনও আমি কিছু বলতাম না, নীরবে তোমার কথা শুনে যেতাম। কিন্তু সেদিন আমার জন্মদিনের নাম করে আমাকে সবার সামনে যেরকম লজ্জায় ফেললে আমি সত্যিই কখনো এটা আশা করিনি।”

” ইশরা আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি তোহা আমাদের সাথে থাকলে তোমার সমস্যা হয়। আমরা সেই স্কুল লাইফ থেকে বন্ধু, সে আমি ছাড়া বাকিদের সাথে তেমন করে মিশে না। এখন সম্পর্কে জড়িয়ে যদি আমি তাকে একেবারেই ভুলে যায় তাহলে সে কষ্ট পাবে।”

ইশরা আহত কন্ঠে বলল, ” তুমি শুধু ওর কষ্টটাই বুঝলে আমারটা বুঝতে পারলে না তুমি।”

” সরি ইশরা৷ আচ্ছা এবার থেকে আমি আমাদের মাঝে তোহাকে আনব না। সত্যি বলছি, তাও তুমি যেও না।”

” সত্যি পারবে তো?”

” হ্যাঁ, আমি ওকে বলে দেবো ওইসময় যেন আমার সাথে যোগাযোগ না করে।”

” আর আমি যদি বলি শুধু কয়েকঘন্টা নয় একেবারে সারাজীবনের জন্য যোগাযোগ বন্ধ করে দাও, পারবে সাফাইত?”

” এসব তুমি কি বলছ ইশরা! এটা কখনোই সম্ভব নয়।”

” কেন সম্ভব নয় সাফাইত?”

” আমি আগেও বলেছি তোহা আমার বেস্টফ্রেন্ড। এভাবে কোন কারণ ছাড়া আমি ওর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারি না?”

” কেন পারো না সাফাইত? তোমরা কি আসলেই বন্ধু? নাকি আশেপাশের স্টুডেন্টরা যা বলে তাই সত্যি? তোমরা দু’জন বন্ধুর থেকেও বেশি কি?”

” ইশরা।” হুংকার দিয়ে উঠল সাফাইত৷ লোকসমাগম থেকে একটু দূরে থাকায় তেমন কেউ তাদের খেয়াল করল না৷ ইশরা মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেলো৷ চোখে জল জমতে চাইলেও সে আটকে রাখল। বিদ্রুপ করে হেসে বলল,

” গায়ে লেগেছে না খুব? খুব বড় সত্যি বলে ফেলেছি কি আমি? তারমানে লোকে যা বলতো তাই সত্যি৷ তোমরা আসলেই ফ্রেন্ড’স উইথ বেনিফিট। তাই জন্যই কি সে ফোন দিলেই তুমি সব কাজ ফেলে ছুটে যাও তার কাছে?”

” চুপ একদম চুপ৷ তোমাকে ভালোবাসি বলে এতোসময় সহ্য করেছি কিন্তু আর নয়। তোমার ওই নোংরা মুখ বন্ধ করো। ছিঃ এরকম একটা নিচু মনমানসিকতার মেয়েকে আমি সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছি ভাবতেই লজ্জা লাগছে।”

সাফাইতের কথায় বেশ আহত হলো ইশরা৷

” ও… এখন আমি নোংরা হয়ে গেলাম। কেন বলতো? সত্যিটা বলেছি তাই?”

” চুপ করো ইশরা। তুমি এতোটা নিচু মনের হবে আমি ভাবতেও পারিনি৷ ভেবেছিলাম বাকিরা যাই বলুক অন্তত তোমার চিন্তাধারা ভিন্ন হবে, পবিত্র হবে। কেন? দু’জন ছেলে কিংবা দু’জন মেয়ে যদি বন্ধু হতে পারে তবে একজন ছেলে এবং একজন মেয়েকে কেন হতে পারে না? বন্ধুত্ব কি লিঙ্গ দিয়ে হয়? বন্ধুত্ব একটা মধুর সম্পর্ক, যাদের রক্তের মিল না থাকলেও মনের মিল থাকে৷ তোহা আর আমার বন্ধুত্বটাও ঠিক সেইরকম। আমি কখনই তোহাকে সেই নজরে দেখিনি। ওকে সবসময় বন্ধুর নজরে দেখিছি, একজন বোনের নজরে দেখেছি। তাই তো সবসময় চেষ্টা করি ওকে ভালো রাখার, সুরক্ষিত রাখার। আর তুমি কিনা! ছিঃ। ইশরা আর যাইহোক তোমার মুখ থেকে এই কথা শোনার পর আমি তোমার সাথে আর থাকতে পারব না। তোমাকে দেখলেই আমার এখন গা ঘিন ঘিন করছে। আজকের পর থেকে তুমি কি আমিই তোমার সাথে আর সম্পর্ক রাখব না। যার এখনই মনমানসিকতা এরকম তাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনি হিসেবে আমি অন্তত মেনে নিতে পারব না৷ ভালো থেকো।”

সাফাইত দ্রুত স্থান ত্যাগ করল, একবারো পেছনে ফিরে তাকালো না। ইশরা সেখানে থাকা বেঞ্চে বসে নীরবে এতো সময় আটকে রাখা চোখের জল বির্সজন দিতে লাগল৷ তখন কষ্ট এবং রাগের মাথায় কথাগুলো বললেও এখন তার কষ্ট হচ্ছে, প্রিয় মানুষ হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট। আর যাইহোক তার ভালবাসা একদম পবিত্র ছিল, সে মন থেকেই সাফাইতকে ভালোবেসেছিল৷ ইশরা নিজেও কখনোই চিন্তা করেনি এরকম একটা পরিস্থিতি কখনো তৈরি হতে পারে।

চলবে….

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব-১১

0

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_১১
#অনন্যা_অসমি

অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলেও ক্যাম্পাস এখনো ছাত্রছাত্রীতে পরিপূর্ণ৷ বিদায়প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীরা শেষবারের মতো নিজেদের প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখছে, কেউ কেউ নিজের প্রিয় বন্ধুদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। এসব দৃশ্য দেখে সাফাইত ইশরারকে বলল,

” পরের বছর এভাবে আমাদেরও বিদায় অনুষ্ঠান হবে।”

” হুম। এখন তো প্রতিদিন তোমার সাথে ভার্সিটির বাহানায় হলেও দেখা হচ্ছে৷ কিন্তু তখন কিভাবে দেখা হবে? তখন তো এভাবে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমরা ঘুরতে পারব না।”

ইশরা মন খারাপ করেছে বুঝতে পেরে সাফাইত হালকা হেসে তার মাথায় হাত রেখে বলল,

” আরে ধুর এতে মন খারাপ করার কি আছে? আমাদের কম দেখা হবে এটা না ভেবে এটা ভাবো এরপর আমি জবের জন্য চেষ্টা করতে পারব। আর একটা ভালো চাকরি যদি আমি জোগাড় করতে পারি তবে তোমার ফাইনাল ইয়ার শেষ হওয়ার পরেই আমরা বিয়ে করে নিতে পারব। ততোদিনে হয়তো আমার পজিশনেও ভালো পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। তখন তোমার বাবা-মাও আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না।”

সাফাইতের কথায় ইশরার খারাপ লাগা ভাব মূহুর্তেই দূর হয়ে গেল৷ ভাবল,

” এক-দুবছর হয়তো একটু কম দেখা হবে কিন্তু যদি সাফাইত একটা ভালো জায়গায় পৌঁছাতে পারে তখন আমাদের সম্পর্ক পূর্ণতা পাবে। তখন তো সারাজীবন আমরা একসাথে থাকব।”
.
.

বয়ে চলা নদীর জলে দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তোহা। আশেপাশের কিছুতেই যে তার মনোযোগ নেই সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

” কি হয়েছে তোহারাণী? এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস যে?”

ঘাড় ঘুড়িয়ে সাফাইতের দিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। শান্ত কন্ঠে বলল,

” কিছু হয়নি সাফু। তুই যা।”

” আমি অন্ধ নয় তোহা৷ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার কিছু হয়েছে। সেদিন বলেছিলি প্র্যাকটিসের জন্য আমার সাথে কথা বলার সময় পাচ্ছিলি না। কিন্তু অনুষ্টান শেষ হলো আজ এক সপ্তাহ। কিন্তু এখন? এখন তো তোর কোন প্র্যাকটিস বা অন্য কোন কিছু নেই। আচমকা এধরণের অদ্ভুত ব্যবহার করছিস কেন তুই? ঠিকমতো কথা বলছিস না, চারটা কথার জবাবে একটা উওর দিচ্ছিস। ফোন দিলে ধরিস না। কি হয়েছে তোহারাণী আমাকে বল।”

এরপরেও তোহার হেলদোল না দেখে সাফাইত তাকে জোড় করে নিজের দিকে ঘোরালো। তার দিকে তাকাতেই সর্বপ্রথম তার নজরে এলো তোহার চোখে জল জমে আছে। বিচলিত কন্ঠে সাফাইত প্রশ্ন করল, “এই তোহা কি হয়েছে তোর? কান্না করছিস কেন?”

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তোহা এবার বলল,

” আমি যাকেই পছন্দ করি সেই কেন আমাকে পছন্দ করে না বলতে পারবি সাফু? কেন আমার পছন্দের জিনিস অন্যকারো পছন্দ হয়ে যায়? কেন অন্যরাই সেটা পাই? অন্যরা নিজের পছন্দ ছিনিয়ে নিতে পারলে আমি কেন পারিনা বলতে পারবি তুই? কেন ছিনিয়ে নেওয়ার মনোভাবটা আমার মধ্যে নেই সাফু? কেন আমি এতোটা ভালো? এই ভালোমানুষি দেখাতে গিয়ে যে আমার পছন্দের জিনিস আমার চোখের সামনে অন্যকারো হয়ে যাচ্ছে জেনেও হাত গুটিয়ে বসে থাকি?” কথার মাঝে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

সাফাইত বুঝল তোহার মন ভীষণভাবে খারাপ। এবার সে বিচলিত হলোনা। ধীরে সুস্থে বলল,

” কারণ আমার তোহারাণী স্বার্থপর নয়৷ সে অন্তর থেকে একজন ভালো মানুষ, একজন ভালো মনের অধিকারী। স্বার্থপর হওয়া ভালো নয় কিন্তু কিছুক্ষেত্রে স্বার্থপর না হয়েও উপায় নেই। ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ছে তাই না? তাই তুই সেদিন স্টেজে ওই গানটা গেয়েছিলি। কি আমি ঠিক বলছি তো?”

তোহা ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। সাফাইতের কথায় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো সে। নাক টেনে বলল,

” জানিস সেদিন ওকে অনেক সুর্দশন লাগছিল। সাথে ওর ভালোবাসার মানুষটাকেও৷ দু’জনকে অনেক মিষ্টি লাগছিল৷ আমি পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে চেষ্টা করেছি এড়িয়ে চলার কিন্তু পারিনিরে৷ তারা দু’জন আমার চোখের সামনেই হাতে-হাত ধরে ছিল, ভালোবাসাময় কথার আদানপ্রদান করছিলো। আমি শুধু নিষ্প্রাণ চোখে তাদের দেখছিলাম৷ আচ্ছা মেয়েটার জায়গায় আমি কেন হলাম না? কেন আমার ভাগ্যে সে নেই, বলতে পারিস?”

” তুই তো আমাকে ছেলেটার নাম, ঠিকানা কিছুই বলছিস না। এমনকি ছেলেটা দেখতে কেমন তাও বলছিস না। কেন শুধু শুধু নিজেকে এভাবে কষ্টের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছিস তোহা? তুই যদি সাহস করে বলতে না পারিস আমাকে শুধু একবার বল, আমি নিজেকে তোদের এক করার ব্যবস্থা করে দেবো।”

” না সাফাইত ভুলেও সেই ছেলের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করবি না৷ আমাকে ছুঁয়ে কথা দে তুই কখনো সেই ছেলে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবি না। বল তুই আমাকে ছুঁয়ে।”

এবার সাফাইত খানিকটা রেগে গেল। তেজী কন্ঠে বলল, ” তুই নিজেও বলবি না, আমাকেও কিছু করার বা বলার সুযোগ দিচ্ছিস না। তাহলে কি করবি তুই? এভাবেই কি সারাজীবন কষ্ট বয়ে বেড়াবি? শোন ছেলেটাকে নিজের মনের কথা বলে দে৷ তারপর যা হবে দেখা যাবে। কেন নিজেকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস তোহা?”

তোহা নীরবে বয়ে চলা নদীর দিকে তাকিয়ে বিষাদের হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে বলল,

” বুঝলি সাফু আমার গল্পে আমি নায়িকা। আমার গল্প শুনলে সবাই কষ্ট পাবে, সেই মেয়েকে দোষারোপ করবে। কিন্তু তাদের গল্পে আমি নিছক এক তুচ্ছ চরিত্র। তাদের ভালোবাসার গল্পে আমি কেবল মাত্র একজন তৃতীয় ব্যক্তি। তুই যতই মন উজার করে ভালোবাসিস একপক্ষিক ভালোবাসার পরিসমাপ্তিতে শুধু কষ্ট আর বিষাদের ছোঁয়াই থেকে যায়।”

সাফাইতের তোহার জন্য খারাপ লাগল। সে মন খারাপ করে বলল, ” আমি তোর জন্য কিছু করতে পারছিনা ভেবে আমার খারাপ লাগছে ভীষণ। তোকে কষ্ট পেতে দেখে আমার একটুও ভালো লাগেনা তোহারাণী।”

” কিছু করতে হবে না তোর। শুধু আমার পাশে থেকে আমাকে একটু শক্ত থাকার সাহস দে। তাতেই হবে।”

সাফাইত পরবর্তীতে কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পেলো না। তোহাও আর বেশি কিছু বললো না। দু’জনেই বয়ে চলা নদীর দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে রইল৷ একজনের মন খারাপ বন্ধুকে কষ্ট পেতে দেখে, অপরদিকে আরেকজন ভালোবাসার মানুষকে মনের কথা বলতে না পেরে গুমরে মরছে।
.
.

কাছের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ইশরার জন্মদিনের অনুষ্টানের আয়োজন করেছে সাফাইত। বন্ধুবান্ধবরা সবাই বেশ হাসিখুশি, তাদের সম্পর্কের কথা তারা সবাই জানে বিধায় তারাও প্রেমিকযুগলের এই ভালোবাসা দেখে বেশ খুশি। বন্ধুদের সাথে কথার মাঝে সাফাইতের ফোন বেজে উঠল। ফোন বের করে দেখল তোহা ফোন দিয়েছে। ঠোঁটের কোণে থাকা হাসি আরো চওড়া হলো। একটু দূরে এসে ফোন রিসিভ করে বলল,

” কি ব্যস্ত মানুষ ইদানীং তো আপনার খোঁজই পাওয়া দুষ্কর৷ তা হঠাৎ কি মনে করে ফোন দিলেন? এই এখন এটা বলবি না যে তুই আসছিস না। না এলে আমি তুলে নিয়ে আসব। সব ফ্রেন্ডসরা থাকবে আর আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে তুই থাকবি না, তা তো হতে পারে না।”

সাফাইতের কথায় গুরুত্ব দিল না তোহা। সে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বলল, ” সাফু তুই একটু আসতে পারবি দোস্ত।”

তোহার কন্ঠ শুনে সাফাইতের হাসি মিলিয়ে গেল। অস্বস্তির হয়ে উঠল সে।

” তোহা কি হয়েছে তোর? তোর কন্ঠ এরকম শোনাচ্ছে কেন? কান্না করছিস তুই? তোহা কি হলো উওর দে।”

” মা কথা বলছেনা সাফু। আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু জ্ঞান ফিরছেনা৷ এখন তো দাঁত খিঁচে ফেলেছে। বাবা এখন অনেকদূরে, ফিরতে রাত পেরিয়ে যাবে। আমি কি করব বুঝতে পারছিনা, তুই প্লিজ আয় সাফু। আমার অনেক ভয় করছে। মায়ের কিছু হয়ে গেলে আমরা বাঁচবো নারে।”

তোহার পাশে তার ছোট ভাই তমালও কান্না করছে। দুই ভাইবোনের কান্না শুনে সাফাইত ঘাবড়ে গেল তবে তা প্রকাশ করল না। নিজেকে শান্ত করে বলল,

” তোহা কান্না বন্ধ কর৷ শোন আমার কথা, তুই উপরে কিংবা চিনে কাউকে খুঁজে দেখ। আমি অ্যাম্বুলেন্স কল করছি৷ আমি আসার আগে যদি এম্বুলেন্স চলে আসে তুই তমালকে নিয়ে চলে যাস। একদম কান্নাকাটি করবি না আর। দেখ তোর কান্না দেখে তমালও ভয় পেয়ে গিয়েছে৷ তুই না সাহসী মেয়ে, ভেঙে পড়িস না। আমি আসছি।”

সাফাইত কাছে থাকা এক বন্ধুকে কাজ আছে বলে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। এদিকে তোহাও সাফাইতের কথা মতো পাড়াপ্রতিবেশী কারো খোঁজ করতে গেল৷ এম্বুলেন্স এলে তাদের সাহায্যে মাকে হসপিটালে নিয়ে গেল তোহা।

একটা খাবারের প্যাকেট তমালের হাতে দিয়ে পানির বোতলটা তোহার দিকে বাড়িয়ে দিল সাফাইত। তোহা তা নিয়ে কিছুটা খেয়ে চুপ করে বসে রইল। সাফাইত তার মাথা হাত রেখে বলল,

” চিন্তা করিস না, আন্টি ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার তো বলেছে সিনিয়াস কিছু না। প্রেশার বেশি লো হয়ে যাওয়াতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। একটু বিশ্রাম আর পুষ্টিকর খাবার খেলেই সুসাং হয়ে যাবেন।”

” ধন্যবাদ সাফাইত। সরি তোকে বিরক্ত করলাম, তোর এতো মূল্যবান সময়ে তোকে ফোন করে বিরক্ত করলাম। আসলে আমি চাইনি তোকে ফোন করতে কিন্তু কি করব বল। মায়ের এই অবস্থা দেখে আমার মাথা কাজ করছিল না। ভুলে গিয়েছিলাম তুই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ছিলি৷ সরিরে তোর বিশেষ মূহুর্তটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি।”

” এভাবে বলছিস কেন তোহা? আন্টি কি আমার পর নাকি? আন্টিকে কি আমি আজ দেখছে? আন্টি আমাকে কত স্নেহ করেন, নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসেন। আমার মা হলে কি আমি ওনার কাছে না এসে আনন্দ উল্লাস করতাম?”

” না তাও আমার উচিত হয়নি তোকে ফোন করার।”

” তুই কি আমাকে পর করে দিচ্ছিস তোহা?” আহত কন্ঠে বলল সে৷ তোহা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

” নারে তুই আমাদের আপন ছিলিস আর সারাজীবন থাকবি। সে যাইহোক তুই এখন যা, নাহয় ইশরা আজকের দিকেও মন খারাপ করবে। আর ওকে বলে দিস এই বিশেষ দিনেও তোকে দূরে নিয়ে আসার জন্য আমি দুঃখিত। যা আর দাঁড়িয়ে থাকিস না।”

সাফাইতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তোহা তমালকে নিয়ে কেবিনে ঢুকে দরজা লক করে দিল। ফলে সাফাইত চেয়েও তোহার সাথে কোন কথা বলতে পারেনি।
.
.

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ইশরা এবং সাফাইত। অনেকখানি সময় চুপ করে থাকার পর ইশরা গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” কিছু বলার থাকলে বলো৷ আমার টিউশনে যেতে হবে।”

সাফাইত খানিকটা রেগে বলল,

” তোমার কি হয়েছে বলো তো? গত দু’দিন ধরে তোমাকে ফোন করছি ধরছো না, ভার্সিটি আসছো না। বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোন রেসপন্স নেই, মেসেজের উওর দিচ্ছো না। আচমকা এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করছো কেন তুমি?”

ইশরা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে একদম শান্ত কন্ঠে বলল, ” আর কিছু বলার আছে? নাকি আমি এবার যেতে পারি?”

এবার সাফাইতের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বাজখাঁই কন্ঠে বলল, ” কিছু বলার আছে মানে? আমি তোমাকে কি জিজ্ঞেস করেছি আর তুমি কোনপ্রকার উওর না দিয়ে চলে যাচ্ছো। মনে হচ্ছে তুমি আমার কথা পাত্তাই দিচ্ছিনা, আমি মানুষটাকেই পাত্তা দিচ্ছো না। কেমন যেন গা ছাড়া ভাব নিয়ে আছো তুমি।”

” জানতে চাইছো তো কেন আমি কোনরূপ রেসপন্স করছি না?”

” হুম।”

ইশরা আবারো কিছুসময় চুপ করে নিজেকে শান্ত করে বলল, ” এই সম্পর্ক আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সাফাইত। আমাদের সম্পর্কের ইতি এখানে টানলেই ভালো হবে। আর বেশিদূর এগিয়ে গেলে এই সম্পর্কের প্রতি যা ভালোবাসা, সম্মান, মায়া ছিলো তা উবে গিয়ে বিষাক্ত অনুভূতির সৃষ্টি হবে। যা আমি কোন কালেই চাইনা।”

সাফাইত ভাবলো ইশরা হয়তো মজা করছে। আগেও কয়েকবার ঝগড়ার মাঝে সে এরকম কথা বলেছিলো।

” তুমি মজা করছো তাই না? বুঝতে পেরেছি কোনকিছু নিয়ে রেগে আছো। আচ্ছা চলো তোমার প্রিয় আইসক্রিম খেতে খেতে তোমার অভিযোগ শুনব।”

সাফাইত ইশরার হাত ধরতে গেলে সে সরিয়ে ফেলল।

” প্রিয় জিনিস প্রিয় মানুষের সাথেই উপভোগ করা যায়। যখন মানুষটাই প্রিয় এর তালিকা থেকে বিদায় নেওয়ার উপক্রম সেখানে তার সাথে প্রিয় খাবার খাওয়া বড্ড বেমানান।”

” ইশরা তোমার এই সাহ্যিতক কথাবার্তা আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। কি হয়েছে তোমার?”

” আমি আর তোমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইনা সাফাইত। তোমার ভাষার ইট’স ওভার, ব্রেকাপ।”

বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো সাফাইত। নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছে না ইশরা কখনো এধরণের কথা বলবে। মনে হলো সে দিবাস্বপ্ন দেখছে।

চলবে….

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব-১০

0

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_১০
#অনন্যা_অসমি

বেগুণী শাড়িতে এক রমনীকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে থমকে গেল সাফাইত। শুকনো ঢোক গিলে পরপর কয়েকবার পলক ফেলল। পাশ থেকে তার এক বন্ধু ফিসফিস করে বলল,

” এভাবে তাকিয়ে আছিস যে আজ প্রথম দেখছিস ওকে। এভাবে যে তাকিয়ে আছিস নজর লেগে যাবে তো।”

সেটা ফিসফিস করে বললেও আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ২/৩ জনের কানেও তা পৌঁছেছে। সবাই মিটিমিটি আসছে৷

ইশরা মিষ্টি হেসে সাফাইতের পাশে থাকা বাকিদের বলল, ” কেমন আছেন ভাইয়ারা?”

” আমরা বেশ ভালো আছি বোন। কিন্তু মনে হচ্ছে তোমাকে দেখে কারো বেহাল অবস্থা এখন।”

সাফাইতের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে লাজুকভাবে হাসল সে। কথা ঘোরানোর জন্য বলল,

” তোহা আপু কোথায়? ওনাকে দেখছি না যে? এখনো আসেনি?”

” এসেছে সে অনেক আগে। তার তো পারফরম্যান্স আছে, তাই সবার সাথে প্র্যাকটিস করছে। তোমরা থাকো, আমরা দেখি কারো কোন সাহায্য লাগবে কিনা।”

সবাই চলে গেল, সাফাইত এবং ইশরার মাঝে এখন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিছুসময় চুপ থেকে ইশরাই প্রথমে বলল,

” ওভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলে কেন? ভাইয়া গুলো কি ভেবেছিল।”

সাফাইত ইশরার হাত আঁকড়ে ধরে বলল,

” যা ইচ্ছে ভাবুক। আমি অন্য কারো জিনিসের উপর নজর দিচ্ছিলাম নাকি? তুমি আমার ব্যক্তিগত মানুষটা উপর নজর দিয়েছি।”

” ইদানীং একটু বেশিই প্রেমিক পুরুষের মতো কথা বলছ। তা কোন বই পড়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছো?”

” ইশরা নামক এক মানবীর হৃদয় পুস্তক পড়ে।”

তিন তলা থেকে দু’জনকে একদৃষ্টিতে দেখে চলেছে তোহা। আজ সেও কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। আজ তাদের ভার্সিটির শেষ বর্ষের বিদায় অনুষ্ঠান। তা নিয়েই সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিজের অনুভূতিকে পুনরায় যত্ন সহকারে লুকিয়ে রেখে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে স্টেজের পেছনে চলে গেল।

একে একে সবার পরিবেশনা শেষ হতে লাগল। এবার তোহার পালা। উপস্থাপিকা তোহার নাম ঘোষণা করতেই উত্তেজনায় তার হদস্পদন বেড়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে মঞ্চে উঠে এলো সে।

গান গাওয়ার পূর্বে একবার চোখ বুলিয়ে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে নিল তোহা। তার বন্ধুরা তাকে চেয়ার আপ করছে। সাফাইতের দিকে নজর পড়তে সে ইশরায় বেস্ট অফ লাক বলল। অবশেষে গলা ঠিক করে গানে মনোযোগ দিলো সে।

” কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া
কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া

চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে সখা, কত ভালোবাসি।”

খুব মনোযোগ দিয়ে গান গাইল তোহা। এই গানটা বর্তমানে তার ভীষণ প্রিয় একটা গান। মাঝেমাঝেই অজান্তেই গুণগণ করে গাইতে থাকে সে। তার মনে হয় তার মতো মানুষের এধরণের পরিস্থিতির জন্যই এই গান লিখা হয়েছে। গানের প্রতিটা লাইন যেন তার বর্তমান অবস্থার বহিঃপ্রকাশ৷

স্টেজ থেকে নামার পর ক্লাসমেট, ফ্রেন্ড, সিনিয়র, জুনিয়র সবাই তোহার কন্ঠের প্রশংসা করতে ভুলল না। সেও প্রতিবারের মতো হেসে সবাই ধন্যবাদ জানল৷ সাফাইতকে এড়িয়ে অন্যদিকে চলে যেতে চেয়েও পারল না তোহা। সাফাইত ঠিকই তার পথ আটকে দাঁড়াল।

” কিরে তোহারাণী আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিস কেন? এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিস নাকি? দেখ তোহা আমাকে এড়িয়ে চললে কিন্তু ভালো হবেনা৷ চুল একটাও মাথায় থাকবে না।”

মনে মনে একটু ঘাবড়ে গেলেও বহিঃপ্রকাশ করল না তোহা৷ খানিকটা বিরক্তিভাব মুখশ্রীতে ফুটিয়ে বলল, ” সবসময় চুল ছিঁড়ে ফেলার কথা বলিস কেন? আমার চুল কি তোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি? যে ইচ্ছে হলে আর ছিঁড়ে ফেলবি।”

” না হলেও ছিঁড়ে তোকে টাকলু মাথা করতে বেশি সময় লাগবে না৷ এবার কথা না ঘুরিয়ে বল আমার সাথে কথা না বলে চলে যাচ্ছিস কেন? ২/৩ দিন ধরে লক্ষ্য করছি আমার থেকে কেমন দূরে দূরে থাকছিস। ক্লাসেও চুপচাপ, ফোন দিলে গুণে গুণে কথা বলে তাড়াহুড়ো করে কেটে দিস। আজও এসেছিস কত সময় পেরিয়ে গিয়েছে আমার সাথে একবারো কথা বলতে এলিনা। একটা ফোন দিয়েও জানতে চাইছিলিনা আমি এসেছি কিনা। কি ব্যপার বলত?”

তোহা চুপ হয়ে গেল। সে যে আসলেই সাফাইতকে এড়িয়ে চলার বৃথা চেষ্টা করছে সেটা সে বুঝতে পেরে গিয়েছে জেনে থতমত খেয়ে গেল সে। অস্বস্তি ঘিরে ধরল তাকে। তাও নিজেকে স্বাভাবিক রাখল যেন সাফাইতের সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত না হয়।

” আরে সাফু তুই এসব কি বলছিস। আমি কি তোকে এড়িয়ে যেতে পারি? আমাদের বন্ধুত্ব কি আজকের নাকি? সেই হাইস্কুল থেকে আমরা একসাথে আছি, আমি কি করে তোকে এড়িয়ে যাবো? সে সাহস কি আমার আছে নাকি?”

সাফাইত সন্দেহদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” সত্যি তো? আমার কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছেনা।”

” আরে বাবা সত্যি সত্যি। তুই বল কেন আমি কোন কারণ ছাড়া তোকে এড়িয়ে চলব? আমাদের কি কোনপ্রকার ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্য হয়েছে? হয়নি তো, তাহলে? আসলে এ কয়েকদিন আমি গানের প্র্যাকটিস নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম, তাই তোর সাথে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারিনি৷ তাই তোর এরকম মনে হয়েছে।”

সাফাইত গম্ভীরমুখ করে বলল,

” তাই যেন হয়৷ আমার থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করলে কিন্তু খবর আছে তোর।”

” আরে বাবা এতোবছর যখন ছেড়ে যাইনি তখন ভবিষ্যতেও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। টেনশন নট।” আচমকা কিছু একটা খেয়াল হতে তোহা প্রশ্ন করল, ” কিরে সাফু ইশরা কোথায়? তোর সাথেই না ছিল। এতোসময় আমরা এখানে কথা বলছি ওর দেখা পাচ্ছিনা যে।”

” ও তো বলল ওয়াশরুমে যাবে। কিন্তু এতোটা সময় কেন লাগছে বুঝতে পারছিনা।”

” ফোন দিয়ে দেখ কোন সমস্যা হয়েছে কিনা।”

সাফাইত দ্রুত ইশরা ফোন দিল৷

” ইশু কোথায় তুমি? সেই যে কখন গেলে এতোটা সময় কি করছ?”

ইশরা কিছু সময় চুপ থেকে ধীর কন্ঠে বলল,

” তোহা আপু কি তোমার সাথে আছে?”

” হ্যাঁ আছে তো। দেবো ওকে?”

” হুম।”

সাফাইত ফোনটা তোহার দিকে এগিয়ে দিলে সে কিছুটা অবাক হলো। সাফাইত ইশরায় তাকে নিতে বলল।

” হ্যাঁ ইশরা বলো।”

” আপু তুমি প্লিজ একটু তিনতালার গার্লস ওয়াশরুমে আসবে? একটু তাড়াতাড়ি এসো।” অস্থির কন্ঠে বলল সে। তোহা বুঝতে পারল ইশরা কোন সমস্যা আছে৷ সে আসছি বলে ফোনটা সাফাইতকে ফেরত দিল।

” তুই কোথায় যাচ্ছিস?”

” তুই যেখানে যাচ্ছিস সেখানে।” বোকার মতে বলে বসল সাফাইত।

” গার্লস ওয়াশরুমে তুই গিয়ে কি করবি? তুই এখানে থেকে দেখে কারো কোন সাহায্য লাগবে কিনা। অনুষ্ঠানে কাজের অভাব নেই৷ আমি যাচ্ছি।”

” কিন্তু…. ”

তোহা আশ্বস্ত করে বলল, ” চিন্তা করার কিছু হয়নি। আমি আছি তো।”

তোহা আর কথা বাড়ালো না। দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে চলে এলো। প্রতিটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ধীর কন্ঠে ইশরার নাম ধরে ডাকতে লাগল। তার কন্ঠ শুনে ইশরার প্রাণে যেন পানি এলো। দ্রুত ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সে।

পেছন ফিরে তোহা দেখল ইশরার শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে৷ ছেড়ে দেওয়া আঁচলটা এখন কাঁধে তোলা, যেটা সে শক্ত করে ধরে আছে।

তোহা এগিয়ে এসে জানতে চাইল,

” কি হয়েছে ইশরা? তোমার এ অবস্থা কেন? মুখটাও কেমন শুকিয়ে গিয়েছে।”

ইশরা আশেপাশে তাকিয়ে নিচু কন্ঠে বলল,

” আমার পেছনে ব্লাউজের ফিতে খুলে গিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও বাঁধতে পারিনি৷ একটু বেঁধে দেবে?”

” আরে বোকা মেয়ে আগে বলবে না। এতোটা সময় শুধু শুধু যুদ্ধ করেছ। ওয়াশরুমে আসা কাউকে দিয়ে বেঁধে নিতে পারতে।”

” না আমি অপরিচিত কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা। আমি তো জানিনা মানুষটা কেমন। যদি বাইরে গিয়ে তিলকে তাল করে বলে তখন আমার সম্মানহানী হতে সময় লাগবেনা৷ কেউ কেউ তো তাল থেকে তাল গাছ করে ফেলবে। তখন চরিত্র নিয়ে কথা উঠতে সময় লাগবেনা।”

কথার মাঝে ইশরা তোহার ফিতে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে।

” নাও হয়ে গিয়েছে। এতটুকু মেয়ে তুমি আর চিন্তা এতোদূর। ভাবা যায়!”

ইশরা মুচকি হেসে বলল,

” না করে কি উপায় আছে? আমাদের আশেপাশের পরিস্থিতি বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে৷ তাই যাকে তাকে বিশ্বাস করতে মন টানে না।”

” বুঝেছি। এসো তোমার কুচিটা ঠিক করে দি, এলোমেলো হয়ে গিয়েছে অনেক। দেখতে ভালো লাগছেনা।”

শাড়ি ঠিক করে নীচে নেমে এলো দুজনে। তাদের দেখে সাফাইত দূরে এলো।

” কোথায় ছিলে তোমরা? ওয়াশরুমে কি মুভি চলছে নাকি? প্রথমে ইশরা গিয়ে আটকে ছিল এরপর তুই। কি করছিলি এতোটা সময়।”

দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে হেসে একসাথে বলল,

” এটা আমাদের পার্সোনাল ব্যপার। কোন ছেলেকে বলা যাবে না।”

এরপর তোহা বলল,

” তোর ভাষার গার্লস টক৷ তোকে বলা যাবে না। এবার যা আমাদের জন্য কিছু নিয়ে আয়। অনেক খিদে লেগেছে। ইশরা এসো আমরা অনুষ্ঠান দেখি।”

তোহা এবং ইশরা কথা বলতে বলতে স্টেজের দিকে চলে গেল৷ সাফাইত বোকা বোকা চাহনিতে তাদের যাওয়া দেখতে লাগল।

” কি হলো এটা?”

চলবে…..

দূর হতে আমি তারে সাধিব পর্ব-০৯

0

#দূর_হতে_আমি_তারে_সাধিব
#পর্ব_০৯
#অনন্যা_অসমি

” তুই কাউকে পছন্দ করিস তাই না তোহা?”

কয়েকটা হৃদস্পন্দন মিস হয়ে গেল তোহার। হার্টবিট বেড়ে গেল। ভীতদৃষ্টিতে সাফাইতের দিকে তাকাল সে। আমতাআমতা করে বলল,

” কিসব বলছিস তুই? এরকম কিছুই নেই। তুই ভূল বুঝছিস।”

” ও তাই বুঝি। তাহলে হয়তো কেউ ঘুমের ঘোরে নিজের খাতার পেছনে কবির মতো ভালোবাসার কবিতা লিখেছে।”

কথা বন্ধ হয়ে গেল তোহার। সাফাইত ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল, ” কি তোহারাণী ধরা পড়ে গেলে তো। তাই তো বলি ইদানীং তোমার মন কোথায় থাকে। আমার সাথে আগে যে পরিমাণ কথা বলতে এখন তো তার একাংশও বলো না। এবার চটপট বলে ফেলো তো কে সেই পুরুষ। যাকে আমার বেস্টু নিজের দিল দিয়ে বসে আছে।”

তোহা বুঝতে পারেনি সাফাইতের কাছে এভাবে ধরা পড়ে যাবে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তার, তা দেখে সাফাইত বলল, ” এতো আমতাআমতা করছিস কেন বলতো? কই স্কুল লাইফে কোন ছেলেই পছন্দ হলে ফট করে আমাকে বলে বসতি আর এখন লজ্জাবতীর মতো চুপসে আছিস কেন?”

” ওটা স্কুল লাইফ ছিল এখন আমরা আর স্কুলে নেয়। আর তোর এসব জানতে হবেনা, নিজের কাজে মনোযোগ দে।” কথা এড়ানোর জন্য মিথ্যা রাগ দেখিয়ে বলল সে। তবে সাফাইতও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়৷

” তোকে বলতেই হবে ছেলেটা কে। না বলা পর্যন্ত তোকে আমি ছাড়ছিনা। যদি না বলিস তাহলে আমি আন্টিকে গিয়ে বলে দেবে, ৪/৫ লাইন বাড়িয়ে বলব।”

তোহা বুঝল এখন তাকে কিছু বলে শান্ত না করলে ব্যপারটা আরো ঘোলা হয়ে যাবে। কিছুটা সময় নিয়ে মাথায় কথা সাজিয়ে নিল সে।

” ছেলেটা আমাদের সিনিয়র ছিল, আগের বছরই বেরিয়ে গিয়েছে। ভার্সিটির প্রথম থেকেই তাকে আমি পছন্দ করতাম। কিন্তু যখন সাহস করে মনের কথা বলতে যাবো তখন জানলাম তার প্রেমিকা আছে এবং তাদের পরিকল্পনা বিয়ে পর্যন্ত। আমার সাথেই কেন এরকম হয় সাফু? আমি যেটাই পছন্দ করি তাই কেন অন্যের ভাগ্যে থাকে? কাকে দোষ দেবো? নিজেকে নাকি ভাগ্য কে? তুই যেটা পড়েছিস ওটা অনেক পুরোনো লেখা।”

” নাম বল ছেলের। বাড়ি কোথায় জানিস? কোন ডিপার্টমেন্ট বা দেখতে কেমন বল। পুরো নাম বল ফেসবুক খুঁজে দেখি।”

” সাফু শান্ত হ। এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? এখন বলেও লাভ নেই। তার অলরেডি প্রেমিকা আছে। তারা দু’জন খুশি আছে, তাদের যদি নিজের সুখের কথা চিন্তা করে আলাদা করি তাহলে আমি কখনোই সুখী হতে পারব না।”

” আরে অন্তত ওনাকে বলে দেখতি। হয়তো উনি বিষয়টা ভেবেও দেখত।”

” না সাফাইত এটা ঠিক হবে না। ওনাকে এই মূহুর্তে নিজের অনুভূতির কথা বললে উনার মন, মস্তিষ্কে এই ব্যপারটা নিয়েই ঘুরপাক খাবে। তখন ওনাদের সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হবে। উনি আমার প্রস্তাব মেনে নিলেও অন্যকারো দীর্ঘশ্বাস পড়বে তাতে। তাই জেনে বুঝতে কোন সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হোক আমি চাইনা। আমার অনুভূতি একান্ত আমার, কেন তার জন্য দু’টো মানুষকে আলাদা করব? সবারই নিজের পছন্দ আছে। আমি যেমন উনাকে পছন্দ করি তেমনি উনারও অধিকার আছে কাউকে ভালোবাসার। বাদে দে এসব, এখন আর কিছু পরিবর্তন হওয়ার নয়।”

” কিন্তু তুই যে কষ্ট পাচ্ছিস। আমার ভালো লাগছেনা। আমি কি ইশরাকে বলব মেয়েটার সাথে একবার কথা বলার জন্য? কিংবা আমি সেই ছেলের সাথে কথা বলব।”

” ভূলেও এসব কিছু করবি না সাফু। এই জন্যই আমি এতোদিন তোকে কিছু বলিনি। বলেছি এসব নিয়ে আর জল ঘোলা করিস না। ক্রাশ কত আসবে যাবে, এতো নিয়ে চিন্তা করার সময় আছে নাকি?”

” তাও ঠিক। তোর তো আবার ক্রাশ লিস্ট অনেক লম্বা।”

তোহা আজ প্রতিউত্তরে তেমন কিছু বলল না। কারণ এই মূহুর্তে বেশি কথা বললে সমস্যা। সে মনে মনে বলল, ” আমাকে ক্ষমা করে দিস সাফু। তোকে মিথ্যা কথা না বললে যে তুই একসময় খুঁটিয়ে বের করে ফেলতি। তখন আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কেও ফাটল ধরে যেত। জীবনসঙ্গী হিসেবে তোকে না পাই কিন্তু প্রিয়বন্ধু হিসেবে তোকে আমি সারাজীবন চাই। তুই ইশরাকে যে কতটা ভালোবাসিস আমি জানি। ভালো থাক তোরা, আমার অনুভূতি একান্তই আমার কখনোই তোর সামনে প্রকাশ করবো না। নিজের অনুভূতি সারাজীবন নিজের মধ্যে গোপন করে রাখব।”

ইশরার কন্ঠে ভাবনার ইতি টানলো তোহা। সে তোহার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

” তোমাকে আমি সেই কখন থেকে খুঁজে চলেছি আর তুমি এখানে বসে আছো। আমার এই ক্লাসটা হবেনা, তুমি কি যাবে আমার সাথে? নাকি আমি বন্ধুদের সাথে যাবো?”

সাফাইত চটজলদি উঠে দাঁড়াল।

” আরে আগে বলবে না। চলো চলো, এই সুযোগ বারবার আসবে না।”

” তোমার ক্লাস নেই?”

” আরে এখন ক্লাসে গেলেও আমার মন বসবে না৷ ওই পরীক্ষার আগেই ম্যাডাম তোহারাণীর কাছে আমার যেতে হবে। তার থেকে বরং এখন একটু প্রেম করে আসি। তোহা ম্যাডাম একটু কষ্ট করে সব তুলে রাখবেন কারণ পরবর্তীতে আমাকে বোঝাতে হবে।”

তোহা মিথ্যা রাগ দেখিয়ে বলল,

” পারব না। নিজেরটা নিজে করে নাও। আমি কেন তোমার জন্য এতোসময় ধরে ক্লাস করব? বিনিময়ে আমাকে সেই একই বার্গার ছাড়া তো আর কিছু অফার করবে না।”

” তো এই কথা। বললেই তো হতো তুই আমার পকেট ফাঁকা করতে চাস। আচ্ছা ঠিক আছে তোকে আমি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবো, তুই নিজের পছন্দ মতো নিস। এবার আমি আসি, বাই বাই।”

সাফাইতকে টেনে নিয়ে গেল ইশরা। তবে কিছুদূর গিয়ে সাফাইত দৌড়ে ফিরে এলো। একটা খাতা তোহার ব্যাগের উপর রেখে ভাব দেখিয়ে বলল,

” এতোদিন আসেননি যে তার নোট’স। দেখুন সব ঠিকঠাক লিখেছি। আমি আপনাকে এই কয়েকদিনের নোট’স দিয়েছি তার বিনিময়ে আপনি আমাকে আজকের নোট’স দিবেন। নোট’স নোট’স কাটা কাটি। মানে নো ট্রিট, বাই বাই।”

তোহা চোখ মুখ বিকৃত করে বলল,

” আমি জানতাম তুই একটা কিপ্টা। ইশরা আমাকে তো এই কিপ্টে জিনিসে ভালো কিছু দেয়নি দেখো তুমি পারো কিনা এর পকেট খালি করতে। স্কুল লাইফ থেকেই ওর পকেট থেকে টাকা বের করতে আমার ঘাম ছুটে গিয়েছে প্রতিবার।”

ইশরা এগিয়ে এসে হালকা হেসে বলল,

” এটাতো ভালো স্বভাব। এমনিতেও অঝোতা টাকা খরচ করা মোটেও উচিত হয়। হিসাব না করে টাকা খরচ করলে দেখা যাবে একদিন আমাদের অর্থভান্ডার শূণ্য হয়ে গিয়েছে। তখন আফসোস করা ছাড়া কোন পথ থাকবেনা।”

হাসি মিলিয়ে গেল তোহার মুখশ্রী হতে। সে সম্পূর্ণ মজা করেই কথাটা বলেছি, বিপরীতে এই শান্ত উওর সে আশা করেনি। ইশরা হেসে পুনরায় বলল,

” তবে হ্যাঁ এতোটাও হিসাবি হওয়া ঠিক হয় যাতে আপন মানুষরা কষ্ট পাই। লাখ টাকা হতে শখানেক টাকা নিজের কাছের মানুষদের জন্য খরচ করাই যাই। তুমি চিন্তা করো না, এর কিপ্টামি স্বভাব আমি লাইনে নিয়ে আসব। এখন আসি আপু।”

সাফাইতকে টেনে নিয়ে গেল ইশরা। তোহা পুনরায় পড়ায় মনোযোগ দিল। সাফাইতের রেখে যাওয়া খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখল সে ভালোই নোট’স করেছে। যেটা অনেকাংশে তার নিজের থেকেও বেশি ভালো হয়েছে। তোহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

” না জানি এই ছেলে কবে সিরিয়াস হবে। পড়াশোনায় এতো ভালো তাও সারাবছর পড়বে না, চিল করবে। পরীক্ষার দু’দিন আগে একটানা পড়ে খুশি মনে পরীক্ষা দিতে যাবে। আর এদিকে আমি, সারাবছর গাধার মতো খাটুনি করেও পরীক্ষায় দ্বিধায় থাকি উওর কোনটা হবে। হায়রে আমার ভাগ্য!”

চলবে…..