পড়ন্ত বিকেল, পার্কের বেঞ্চে বসে প্রহর গুণছে সাফাইত। এরমাঝে তার নজরে এলো হন্তদন্ত হয়ে ইশরা তার দিকেই আসছে। দ্রুত পায়ে এসে মেয়েটা ধপ কর তার পাশে বসে পড়ল।
” এতো তাড়াহুড়ো করে আসছ কেন? আর সাথে এতো ব্যাগপত্র কেন? কি আছে এতে?”
” খাবার আছে এতে। কতদিন তোমাকে কিছু রান্না করে খাওয়ানো হয়নি। নাও নাও দ্রুত খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে? ঠান্ডা হয়ে যাবে বলে একপ্রকার দৌড়ে এসেছি।” কথার মাঝে ছোট বেঞ্চে বেশ কয়েকটা বাটি সাজিয়ে ফেলেছে ইশরা। একটা বাটি থেকে একটুখানি খাবার খেলো সে। ইশরা উৎসুক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুসময় পর সাফাইত চোখ-মুখ বিকৃত করে বলল,
চমকে উঠল ইশরা। আতংক ছেয়ে গেল তার মুখশ্রীতে। দ্রুত নিজেকেও একটু খেয়ে দেখল। কিন্তু না লবণ তো একদম পরিমাণ মতোই আছে। তাহলে? কিছুসময় সে সাফাইতের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক সেকেন্ড পর অনুধাবন করতে পারল মূল বিষয়টা। সাফাইত মজা করছে বুঝতে পেরে তার হাতে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল।
” বাঁদর একটা। আমি কি ভয়ই না পেয়েছিলাম। আমি মশলার পরিমাণ ঠিকঠাক দিয়েছিলাম তাও লবণ কম হয়েছে শুনে তো আমার ঘাম ছুটে গিয়েছিল।”
আরেকটু বাটি তুলে খেতে খেতে সাফাইত বলল,
” তোমার রিয়েকশন দেখতে চেয়েছিলাম।”
” চুপ। এই তুমি না বলেছ লবণ কম হয়েছে তাহলে আবার খাচ্ছো কেন? দাও এদিকে দাও।”
সাফাইত অন্যদিকে ঘুরে বলল, ” আমি তো ওই বাটির কথা বলেছি, এই বাটিতে কোন সমস্যা নেই।”
ইশরা নিজের কপাল চাপড়ে বলল,
” এই বাঁদর ছেলের সাথে কোনদিনও কথায় পেরে উঠা যায় না। সবসময় এটা ওটা বলে নিজের কথা প্রমাণ করে দেয়।”
” ইয়েস, কখনোই এই সাফাইতকে তোমরা যুক্তিতে হারাতে পারবে না।” গর্ব করে বলল সে।
হাসি ঠাট্টা করে বেশ কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটল তারা। এবার যাওয়ার পালা৷ ফিরে আসার আগে ইশরা আরেকটা ব্যাগ সাফাইতের হাতে ধরিয়ে দিল।
সাফাইত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
” এটা তুমি খুলবে না, তোমার জন্য না এটা।”
” তো কার জন্য? এতে কি আছে?” বলে সে খুলতে নিলেও ইশরা আটকে দিল। ধমকে বলল,
” বলেছি না খুলবে না। এতে খাবার আছে কিছু, এটা তুমি এখন তোহা আপুকে দিয়ে আসবে। যদিও বা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে তবে গরম করে খেলে সাধ ঠিক থাকবে।”
সাফাইত অবাক কন্ঠে বলল, ” এটা তুমি তোহার জন্য এনেছ!”
” এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আনতে পারিনা আমি?”
” না তা নয়, তবে হঠাৎ এতো কিছু করলে তাই আরকি।”
” সেদিন আপু তোমাকে নিজের রক্ত দিল, তোমার কাছে শুনলাম ওনি সে সময় অসুস্থ ছিল। দেখাও করে যায়নি একবার। তাই ইচ্ছে হলো নিজ হাতে কিছু রান্না করে খাওয়াব। এখন যাও, আপুর হাতে দেবে। তুমি নিজে আবার যেতে যেতে শেষ করে ফেলো না। আমি কিন্তু পরে হিসাব নেব।”
সাফাইত যেতে যেতে বলল,
” না যেতে যেতে খাবো না কারণ এগুলো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে৷ তবে ওর বাসায় গিয়ে ওকে গরম করে দিতে বলব। তারপর আরাম করে খাবো।”
” পাজি ছেলে। নিজেদেরটা খেয়ে এখন অন্যেরটাতেও ভাগ বসানোর চিন্তা করছে।”
” কি করব বলো? তোমার রান্না কি আর প্রতিদিন খাওয়ার সৌভাগ্য হয়৷ তার উপর বেস্টফ্রেন্ড হচ্ছে নিজের মানুষ, তাদের সাথে সম্পর্ক হয় ইঁদুর বিড়ালের মতো। তেমনি তোহার জিনিসে ভাগ না বসালে শান্তি লাগেনা।”
ইশরা মজা করে চোখ মুখ বিকৃত করে বলল,
” ইশ… কি লোভী মানুষ। দূরে থাকো আমার থেকে। এমন লোভী মানুষ আমার পছন্দ না।”
তার কথা শুনে সাফাইত খপ করে তার হাত ধরে বলল, ” এই নাও দূরে গিয়েছি। আরো যাবো?”
ইশরা হাসিমুখে সাফাইতের হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে বলল, ” আরো দূরে যাও, এতো দূরে যেন তুমি দৃষ্টির বাইরে চলে যাও।”
.
.
সাফাইতের সাথে নিজের স্কুলে পড়াকালীন ছবি দেখছিল তোহা৷ ফোনের শব্দ তা থেকে নজর সরিয়ে নিল৷ আননোন নম্বর দেখে দ্বিধায় পড়ে গেল রিসিভ করবে না। পরে জরুরি কোন ফোন হতে পারে ভেবে রিসিভ করল। সালাম দিয়ে জানতে চাইল কে।
অপর পাশ থেকে বলল, ” কেমন আছো আপু?”
” জ্বি আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনি কে বলছেন? আমি ঠিক চিনতে পারছিনা।”
” আমি ইশরা বলছি।”
” ও ইশরা। দুঃখিত নম্বর সেভ না থাকার কারণে চিনতে পারিনি৷ কেমন আছেন তুমি? এই সময়ে ফোন করেছ যে?”
” ভালো আছি আপু৷ ফোন করে বিরক্ত করেছি কি?”
” আরে না, কি যে বলো। তুমি আমি দূরের মানুষ নাকি? তবে আগে কখনো ফোন করোনি তাই আগ্রহ হলো জানার।”
” বুঝেছি, স্বাভাবিক ব্যপার এটা। সে যাইহোক সাফাইত তোমাকে ব্যাগটা দিয়েছিল?”
” ও হ্যাঁ, ও বিকেলের দিকে এসেছিল। তুমি কেন শুধু শুধু এতো ঝামেলা করতে গেলে বলো তো? তুমি ছোট মানুষ, এতো কেন করলে?”
” আমি তো ঝামেলা মনে করিনি। আমার মন তোমাকে নিজের হাতে তৈরি কি খাওয়ার জন্য কেন জানি অস্থির হয়েছিল। তাই নিজের মনের অস্থিরতা কমাতেই এই সামান্য আয়োজন। কেমন লেগেছে তোমার?”
” বেশ ভালো হয়েছে প্রতিটা পদ। মা’ও বেশ প্রশংসা করেছে। সাফাইত তো আজ মায়ের কাছে তোমার প্রশংসার ফুলঝুরি খুলে বসেছিল।”
” তাই নাকি!”
” তা নয়তো কি? সে যে কারো ব্যপারে এতো প্রশংসা করতে পারে আজকে নিজের চোখে না দেখলে জানতাম না। মায়ের কাছে ছোট থেকে আমার ব্যপারে নালিশই দিয়ে এসেছে শুধু আর সেই সাফাইত তোমার ব্যপারে অনেক প্রশংসা করেছে।”
ইশরা মনে মনে খুশি হলো৷
” সাফাইত তোমার সব খাবার খেয়ে ফেলেছে নাকি?”
” তা আর বলতে। অর্ধেকেরও বেশি তো সেই খেয়েছি আর তোতাপাখির মতো তোমার গুণগান গেয়েছে।”
” ইশরে… এই ছেলেটাকে বলেছিলাম ভাগ না বসাতে কিন্তু সে ঠিকই তাই করল৷ সমস্যা নেই আমি আবারো তোমার আর আন্টির জন্য রান্না করব। তখন আমি নিজে গিয়ে তোমার হাতে দিয়ে আসব।”
” আচ্ছা। এসো একবার বাড়িতে, মায়ের ইচ্ছে হয়েছে তোমার সাথে দেখা করবে।”
.
.
মাঠের এককোণে ঘাসের উপর বসে বই পড়ছিল তোহা। সেসময় কেউ তার সামনে একটা ফুল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” ওগো প্রিয়তমা, তোমার ওই গভীর চোখে ডুবে গিয়েছি আমি। তোমার ওই ঘন কালো কেশের সুগন্ধে বিমোহিত হয়ে পড়েছি আমি। আমি আমার ভালোবাসায় তোমাকে রাঙাতে চাই। দেবে কি আমাকে সেই সুযোগ প্রিয়তমা।”
কন্ঠে শুনে পিলে চমকে উঠল তোহা। বই থেকে চোখ সরিয়ে দেখলে সাফাইত তার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। সে পলকহীনভাবে তাকে পরখ করতে লাগল৷ কিছুসময় চুপ করে বলল,
” আপনার ড্রামা শেষ হয়েছে সাফাইত সাহেব? দয়া করে এবার ফুলটা সরান। না হলে আপনার আসল প্রিয়তমা দেখলে আপনার আর তাকে প্রেমের রঙে রাঙাতে হবে না। সে আপনাকে মারের রঙে রাঙাবে।”
সাফাইত হতাশ হয়ে তোহার পাশে বসে পড়ল।
” আরে ধুর, কই ভেবেছিলাম তুই চমকে যাবি। অবাক হয়ে বলবি ‘এসব কি সাফু! তোর না প্রেমিকা আছে? তুই ইশরাকে ছেড়ে আমাকে প্রপোজ করছিস!’ কিন্তু তুই কি করলি। একটু অভিনয় তো করতে পারতি।”
” হ্যাঁ তারপর তোমার প্রিয়তমা এসে আমাকে পিটুনি দেবে।”
” তাও ঠিক। অবশ্য তোমাকে সত্যিকারের প্রপোজ করলেও কোন লাভ হতোনা। তুমি যে রিজেক্ট করতে তা আমি জানি।” অন্যদিকে তাকিয়ে বলল সাফাইত। চমকে উঠল তোহা, ঠান্ডা একটা শ্রোত বয়ে গেল পিঠ দিয়ে৷
” মানে!”
সাফাইত গালে হাত দিয়ে তোহার দিকে পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে ফট করে বলে বসল,
সাফাইতের এক্সিডেন্টের খবর শুনে ধরফর করে শোয়া থেকে উঠে বসল তোহা। কোনভাবে পোশাকটা পাল্টে হসপিটালে ছুটে এসেছে সে। সাফাইতের বাবা-মা থেকে জানতে পারল তার জন্য এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। যেহেতু আগেও সে সাফাইতকে রক্ত দিয়েছিল তাই এবারো সে দেবে বলে ঠিক করল।
রক্ত দিয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিল তোহা। সাফাইতের সাথে দেখা করবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলো সে। বেশকিছু সময় চিন্তা করার পর সিদ্ধান্ত নিলো সে যাবে। সাফাইতের জন্য বরাদ্দ কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল তোহা। দরজার অপর পারের দৃশ্য দেখে হৃদয় থমকে গেল তার। সাফাইতের বুকে মাথা দিয়ে আছে ইশরা। তোহা আবারো দ্বিধায় পড়ে গেল। ভাবতে লাগল তার যাওয়া উচিত হবে না। সাফাইতকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে নিঃশব্দে ভিতরে প্রবেশ করল। ইশরার সামনে এসে বুঝতে পারলো সেও ঘুমে তলিয়ে গিয়েছে। চোখের কোণে জল শুকিয়ে তার ছাপ সৃষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এই দৃশ্য দেখে তোহার একদিকে কষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে সাফাইত ভালো আছে ভেবে খুশিও হচ্ছে। হালকা হাতে সাফাইতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। বেরিয়ে আসার পর তার নজর পড়ল ইশরার গলায় থাকা লকেটটার দিকে। সূক্ষ্ম চোখে তা পরখ দেখে দেখে বুঝতে পারল এটা তাকে সাফাইত দিয়েছে। কারণ বেশ কিছু মাস আগে সে এটার ছবি সাফাইতের ফোনে দেখেছিল তবে সাফাইত তাকে এই বিষয়ে কোন কথা বলেনি। ঠোঁটে কষ্টমাখা রেখে তোহা বিরবির করে বলল,
” তোদের মাঝে আমার উপস্থিতি না চাইলে আমি আসবো নারে। এতে বরং আমারই ভালো, এই বিরহের দহনে কম পুড়তে হবে। মিথ্যা বলব না, তোদের একসাথে দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে ইশরাকে হিংসেও হয় বটে। তবে যাইহোক না কেন, আমি যতই না পাওয়ার বেদনায় তলিয়ে যাই তাতে কোন সমস্যা নেই৷ আমার একটাই চাওয়া তুই যেন ভালো থাকিস। সেটা যার সাথেই হোক।”
পুনরায় আরেকবার সাফাইতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নীরবে স্থান ত্যাগ করল তোহা। হসপিটালে আর বেশিক্ষণ থাকলে সে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে।
.
.
ঘুম থেকে জেগে সাফাইতকে চোখের সামনে দেখে ভড়কে গেল তোহা৷ প্রথমে ভেবেছিল হয়তো অতিরিক্ত তার ব্যপারে ভাবার ফলে ভূল দেখছে কিন্তু যখন মাথায় ঠোকা পড়ল তখন নিশ্চিত হলো আসলেই সাফাইত তার সামনে উপস্থিত আছে। অবাক কন্ঠে বলল,
” কিরে তুই এখানে এই সময় কি করছিস?”
সাফাইত ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
” এক মহারাণীকে দেখতে এলাম। তার তো এখন আর পাত্তা নেই। আমি তো আবার একজনের বেলায় প্রচন্ড রকমের বেহায়া। তাই থাকতে না পেরে বেহায়ার মতো ছুটে এলাম তার খোঁজ নিতে।”
তোহা কাঁথা ভাজ করতে করতে শান্তভাবে ভাঙা কন্ঠে বলল,
” একটু অসুস্থ ছিলাম তাই যোগাযোগ করা হয়নি। বাইরে আয়, মাকে বলছি তোকে কিছু রান্না করে দিতে।”
তোহা বেরিয়ে যাবে সেসময় সাফাইত তার হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দিল। চোখের পলকে নিজেও উঠে বসল এবং তোহার কপালে, গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরখ করে দেখল।
” এখন তো মোটামুটি ঠিক আছে। জ্বর বাঁধালি কি করে? গলা তো ভেঙে একেবারে অবস্থা খাবার।”
” ও কিছুনা৷ সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার কারণে একটু ঠান্ডা লেগেছে৷ ঠিক হয়ে যাবে।”
” হুম জানি কতটা ঠিক হবে। একমাসের আগে যে তোমার কাশি যাবে না তা আমার জানা আছে। কে বলেছে ভিজতে? ছাতা আমাদের দিয়ে ওভাবে চলে এলি কেন? ফোন দিলাম, ধরলিও না।”
” আরে বুদ্ধু আমি তোমাদের একটু একান্ত সময় দিয়েছিলাম। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, ঠান্ডা বাতাস, এক ছাতার নিচে তোরা দু’জন। উফ… কি রোমান্টিক!”
” কচু রোমান্টিক। এসবের চক্করে যে তুই অসুস্থ হয়ে গেলি। না জানি এবার সারতে কতদিন লাগে।” চিন্তিত কন্ঠে বলল সে।
তোহা কথা ঘুরানোর জন্য বলল, ” আরে এসব বাদ দে। এটা বল তুই এখন কেমন আছিস? হসপিটাল থেকে কখন ছেড়েছে? আর এসব হলো কি করে?”
” আর বলিস না। ভোরের দিকে একটা কাজে বাইক নিয়ে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়াতে রাস্তা ঠিক মতো দেখতে পাইনি।”
” আচ্ছা তুই বস, আমি মুখ-হাত ধুয়ে আসছি।”
মুখ হাত ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম সামনে এগোতেই অসাবধানতাবশত স্লিপ খেয়ে পড়ে যেতে নিলে সাফাইত তার হাত টেনে ধরল। তাকে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
” তোর বোধবুদ্ধি কখন হবে বলতো? এরকম ভেজা পা নিয়ে যে টাইলস করা ফ্লোরে নায়িকাদের মতো হাঁটছিস তো তুই পড়বি না তো কি আমি পড়ব?”
” নিজে যেন কত সচেতনবান ব্যক্তি। আপনি যে হিরোদের মতো বৃষ্টির মধ্যে বাইক চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে পড়ে ছিলেন তার বেলায়?”
” তুই হসপিটালে এসেছিস, এমনকি রক্ত দিয়েছিস। আমার সাথে দেখা করে যাসনি কেন?”
অস্বস্তিতে পড়ে গেলে তোহা। চোখের সামনে ভেসে উঠল সাফাইতের বুকে ইশরার মাথা রাখার দৃশ্যটি।
” তোকে বলেছে? আমি যাইনি হসপিটাল।”
” মিথ্যা বলবি না তোহা, চুল টেনে ছিঁড়ে দেবো। ইশরা আমাকে বলেছে ও তোকে রক্ত দিতে দেখেছিল। জানিস মেয়েটা তোর জন্য কত সময় অপেক্ষা করেছিল। তোর জন্য খাবার এনে রেখেছিল, আমাকে দেখতে এলে যত্নসহকারে তোকে খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। কিন্তু তুই তো একেবারেই উধাও হয়ে গেলি। মেয়েটা মন খারাপ করেছিল সারাদিন।”
তোহা খানিকটা অবাক হলো৷ ইশরা যে তাকে দেখেছে এটা সে জানতো না।
” সত্যি বলছিস তুই?”
” আরে আমি মিথ্যা কথা কেন বলব? আমরা দু’জন কত সময় তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এসময় দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জেগে উঠে দেখি দুপুর হয়ে গিয়েছে। ইশরা তোকে বেশ কয়েকবার খুঁজেছিল, ফোনও তো তুই ধরিসনি।”
” ওই আসলে, আমার খারাপ লাগছিল তো। তাই দ্রুত চলে এসেছিলাম। এমনিতেও তোকে নিয়ে সবাই চিন্তিত ছিল আমার অসুখের কথা বলে আর ঝামেলায় ফেলতে চাইনি।”
” তুই এভাবে বলতে পারলি তোহারাণী। আমি না তোর বেস্টফ্রেন্ড, তোর সমস্যা আমাকে কেন ঝামেলায় ফেলবে? আমি আগে জানলে তোকেও আমার কেবিন ভর্তি করিয়ে দিতাম।”
তোহা পা উঁচু করে সাফাইতের কাঁধে কনুই ঠেকিয়ে বলল,
” তাহলে তুই আর ইশরা প্রেম করতি কি করে?”
সাফাইত গালে হাত দিয়ে বলল,
” তাও ঠিক।”
” ইশ… কি নির্লজ্জ।” সাফাইতের কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল সে।
” হাসিতামাশা পরে করা যাবে। এখন বাইরে আয়, কিছু খেয়ে নে। আমারো অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।”
” তুই যা আমি আসছি।”
” তুই আবার কোথায় যাবি?”
” আরে ওটা ছেলেদের ব্যক্তিগত সমস্যা তুই বুঝবিনা, যা যা।”
যেতে যেতে তোহা নিজেকে বলল,
” এতোদিন শুনেছি মেয়েদের ব্যক্তিগত সমস্যা থাকে, এই পাগল না জানি কোথা থেকে ছেলেদের ব্যক্তিগত সমস্যা তৈরি করেছে।”
বেশ কিছুসময় তোহার সাথে কাটানোর পর এবার সাফাইতের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তোহা তার সাথে গেট পর্যন্ত গেল। সাফাইত হাত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
” সাবধানে থাকিস আর এখন ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই৷ আরো কয়েকদিন রেস্ট নে। নোট নিয়ে চিন্তা করিস না, ওটা আমি দিয়ে দেব।”
তোহা মজা করে বলল,
” কি বলেছিস শুনে পাইনি। আবার বলতো।”
” বলেছি ক্লাস নিয়ে চিন্তা করিস না, নোট আমি দিয়ে দেব।”
তোহা জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগল। কোনমতে হাসি আটকে রেখে বলল,
” গিনিস ওয়ার্ল্ডের উচিত তোকে এওয়ার্ড দেওয়া, জোক’স অফ দ্যা ইয়ারের। তুই নিজেই ক্লাস ঠিক মতো করিস না আমাকে কি নোট’স দিবি?” বলে আবারো হাসতে লাগল সে। সাফাইত রেগে তোহার চুল ধরে টান ছিল।
” এই বাঁদর চুল ছাড়।”
” আমি ক্লাসও করব আর তোর থেকে ভালো নোট’সও করব।”
” আচ্ছা ঠিক আছে দেখা যাবে। সাথে আমাকে পড়াও বুঝিয়ে দিতে হবে।”
সাফাইত বাইকে বসে মুখ ভেঙিয়ে বলল,
” ঠিক আছে চ্যালেঞ্জ এক্সেপটেড। তোর থেকেও ভালো বোঝাবো আমি।”
বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে তোহা বলল, ” দেখা যাবে সাফাইত সাহেব।”
সাফাইত কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল তোহা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল,
সবকটা ফুল নাড়াচাড়া করে দেখছে তোহা। ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে বিষাদের হাসি। এই ফুল সে নিজের পছন্দের মানুষকে দেওয়ার জন্য কিনছে তবে এই ফুলের তোড়া তার পছন্দ পুরুষটা দেবে অন্য এক রমণীকে যার নাম ইশরা। বেশ কয়েকটা তোড়া দেখার পর একটা তোড়া পছন্দ করলো সে। সাফাইত বিনা বাক্যে সেটাই নিয়ে নিল।
পাশাপাশি নীরবে হাঁটছে তোহা এবং সাফাইত৷ নীরবতা ভেঙে সাফাইত অস্থির কন্ঠে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
” ইশরা মানবে তো?”
তোহা নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, ” চেষ্টা করে দেখ।”
” আমি সত্যি বলছি ওকে আমি খেয়াল করিনি। না-বুঝে ওভাবে সরিয়ে দিয়েছিলাম।” অনুশোচনা করে বলল সে।
” মেয়েরা স্বভাবগত একটু কোমল হয়। তোর হঠাৎ আচরণে তার মন খারাপ হয়েছে তবে তা ক্ষণস্থায়ী। দেখবি তুই ওর সাথে একটু ভালোবেসে ব্যবহার করলে ও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
কথা বলতে বলতে দু’জনে ক্যান্টিনে চলে এসেছে। কোণার একটা টেবিলে দেখল ইশরা একা বসে বই পড়ছে। ফুলের তোড়াটা তোহার কাছে রেখে সাফাইত ছুটে তার পেছনে এসে দাঁড়াল এবং হুট করে হাত দিয়ে চোখজোড়া চেপে ধরল। ঘাবড়ে গেল ইশরা। চোখ থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করতে লাগল।
” বাবু তুমি আমাকে চিন্তা পারছ না? আমি আকাশ, তোমার আকাশ।” বলে মুখ টিপে হাসল সে।
” কে আকাশ? কোন আকাশ? ছাড়ুন আমার চোখ তারপর যা বলার বলুন। কি হলো ছাড়ুন।”
সাফাইত ঘাড় গুঁড়িয়ে কিছু দূরে থাকা তোহার দিকে তাকাল। সে ইশরায় বলল ছেড়ে দিতে। এরই মাঝে ইশরা ঝাড়া দিয়ে হাতটা সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল, ” এই কে আপনি? হুট করে…..” সাফাইতকে দেখে কথা বন্ধ হয়ে গেল তার। রাগের পরবর্তীতে মুখশ্রীতে গম্ভীরতা ছেঁয়ে গেল। চুপচাপ চলে আসতে যাবে কিন্তু সাফাইত দিল না। জোর করে তাকে চেয়ারে বসিয়ে নিজেও পাশে বসল। যেন উঠতে না পারে তাই হাতজোড়া চেপে ধরল।
” ইশরা আমি সত্যিই দুঃখিত, অনুতপ্ত আমি। ছেলেটা তোহার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে জেনে আমার মেজাজ ঠিক ছিল না তখন। তাই না বুঝতে তোমাকে আঘাত করে বসেছি। প্লিজ ইশরা এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। তুমি এভাবে কথা না বলে থাকলে যে আমার ভালো লাগছেনা, দমবন্ধ লাগছে। প্লিজ ইশু এবারের মতো ভুলটা ক্ষমা করে দাও।”
কথার মাঝে তোহার কাছ থেকে ইশরার অগোচরে তোড়াটা নিয়ে নিলো সাফাইত। সেটা ইশরার দিকে বাড়িয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো বলল,
” যদি তুমি এটা নাও তাহলে বুঝব আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ।”
বেশ কিছুসময় পরেও যখন ইশরা তা নিল না তখন সাফাইতের মন ভেঙে গেল। মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, ” কি ব্যর্থ প্রেমিক আমি। প্রেমিকার রাগ ভাঙাতে পারছিনা। প্রেমিক নামে কঙ্কল আমি। প্রেমিক সমাজ থেকে না আমাকে বিতারিত করে দেয়।”
এই সিরিয়াস মোমেন্টে সাফাইতের এধরণের হেয়ালিপনা দেখে ইশরা ফিক করে হেসে ফেলল। যা দেখে সাফাইতের খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
” এই তুমি হেসেছ তাই না? তার মানে তুমি আর রেগে নেয়।”
” কই হেসেছি? আমি তো হাসিছি।” হাসি আটকে রেখে বলল সে। সাফাইত বুঝল ইশরা তার মজা নিচ্ছে। তাই সেও মজা নিতে বলল,
” ও… তাহলে হয়তো আমিই ভুল দেখেছি। থাক আর কি করার। এই ফুলের তোড়া দেখি কাকে দেওয়া যায়৷ সাথে প্রেমিক সমিতি থেকে নামটা কেটে দিতে হবে।”
ইশরা তোড়াটা কেড়ে নিয়ে বলল, ” কাকে দেবে শুনি? আমার জন্য আনা জিনিস অন্যকাউকে দিলে খবর আছে।”
সাফাইত চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালে ইশরা না হেসে পারলনা। তাদের এই মান অভিমানের পালা শেষ হয়েছে দেখে তোহা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। এতোসময় পর সাফাইতে প্রাণ খুলে হাসতে দেখে তারও মন ভালো হয়ে গেল। নীরবে সেখান থেকে সরে এলো সে।
.
.
ভাসির্টির সময় তখন প্রায় শেষ। সেসময় কোন পূর্বাভাস ছাড়াই ঝুম করে বৃষ্টি নামল। তোহার কাছে সবসময় ছাতা থাকে বিধায় তার কোনরূপ চিন্তা ছিল না। একহাতে ছাতা অপর হাতে পায়জামা খানিকটা উঁচু করে ধরে সাবধানে মাঠ পেরিয়ে গেটের কাছে যাচ্ছিল তোহা। সেরকম কোথা থেকে দু’জন ছুটে এসে তার ছাতায় ঢুকে তাকে দু’পাশ থেকে চেপে ধরল। আচমকা এধরণের ঘটনায় চমকে উঠল সে। তবে নিজের পাশে সাফাইত এবং ইশরা দেখে ভীতি দূর হলো তার।
” উফ… তোরা! আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কে না কে ধরেছে ভেবে।”
” তোকে আসলেই তুলে নিয়ে যাওয়া দরকার। তুই একা ছাতা নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছিস৷ এদিকে যে আমাদের কাছে ছাতা নেয়, তুই তো একবারো আমাদের খোঁজ নিলি না।”
তোহা খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বলল, ” তোমাদের কাছে যে ছাতা নেয় তা আমি কি করে জানব? আমি কি অন্তর্যামী? তুমি আমাকে না বলেই কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছ। নিজেও তো একবার ফোন করোনি।”
” আরে বাবা কুল কুল। এতো রেগে যাচ্ছিস কেন? এই বৃষ্টির দিনে ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় মাথা গরম করা ঠিক না। তোর বেশি মাথা গরম হলে যা কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে আয়।”
তোহা রাগী চোখে তার দিকে তাকাল। ইশরা পাশ থেকে বলল,
” উফ… তুমিও না। সারাদিন আপুর পেছনে লেগে থাকো। আর বিরক্ত করো নাতো। আপু রেগে গেলে ঠেলে তোমাকে ছাতা থেকে বের করে দেবে। তখন ভিজে ভিজে যেতে হবে।”
” আমি ওকে ভয় পাই নাকি? আমাকে ছাতা থেকে বের করে দিলে ওকে আমি ছেড়ে দেবো?”
তার কথার মাঝে তোহা ছাতাটা সাফাইতের হাত ধরিয়ে দিয়ে ছুটে একটা রিকশায় উঠে গেল। তার দিকে একবারো ফিরে তাকালো না সে, রিকশাচালকে দ্রুত রিকশা টানতে বলল। ঘটনা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গিয়েছে যে সাফাইত এবং ইশরার বিষয়টা বুঝতে কিছুটা সময় লাগল।
” এটা কি হলো?” অবাক কন্ঠে বলল সাফাইত।
” আমিও তাই ভাবছি। আপু কোন কথা না বলে এভাবে চলে গেল কেন?”
.
.
রিকশা থেকে নেমে একছুটে বাড়ির ছাদে চলে গেল তোহা। ছাদের দরজা বন্ধ করে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে চোখের জল বির্সজন দিতে লাগল সে। প্রথমে নীরবে কান্না করলেও একসময় নিজের অনুভূতিকে আর ধরে রাখতে পারল না। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল সে। চিৎকার করে কান্না করতে লাগল। বৃষ্টির শব্দে আশেপাশের কেউ শুনতে পাবেনা বলে সে প্রাণ খুলে কান্না করতে লাগাল।
” কেন, আমার সাথেই কেন এরকমটা হলো? কি ক্ষতি করেছি আমি? কেন আমি নিজের অনুভূতিকে আটকে রাখতে পারিনি? কেন আমি সাফাইতকে দেখলে দুর্বল হয়ে পড়ি? কেন তাদের দু’জনকে একসাথে দেখলে আমার কষ্ট হয়? সাফাইত ইশরার মাঝে কি এমন পেয়েছে যা আমার মধ্যে ছিল না? কোন গুণের কারণে সাফাইত ইশরাকে বেছে নিয়েছে? এতোবছর ধরে সে আমাকে দেখছে একটুও কি বুঝলো না আমার অনুভূতি?”
পরক্ষনেই সে চোখ মুছে ফেলল।
” না না এসব আমি কি বলছি। সাফাইত কিভাবে বুঝবে? সে যেন না বুঝতে পারে সেই চেষ্টাই তো আমি করছি। নিজের অনুভূতিকে নিজের মধ্যে দাফন করে রাখেছি। এতে সাফাইতের তো কোন দোষ নেই৷ ইশরা যথেষ্ট ভালো মেয়ে। সাফাইত এরও তো নিজস্ব অনুভূতি আছে। আমি তাকে জানাতে পারিনি এটা আমার ব্যর্থ।না না, এখন তাদের সুখের নজর দেওয়া উচিত হবেনা।”
এসব বলে নিজেকে বোঝাল তোহা। তবে তখনো তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সে এখন দোটানায় ভুগছে। প্রতিনিয়ত পছন্দের মানুষকে অন্যজনের পাশে দেখে একপাক্ষিক প্রণয়ের অনলে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে সে।
প্রিন্সিপালের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সাফাইত, সিয়াম এবং তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তোহা। উনি যে বেশ রেগে আছেন তা ওনার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
” এসব কি সাফাইত? সিনিয়র হয়ে যদি তোমরা এরকম আচরণ করো তাহলে নতুনরা কি শিখবে? তোদের কার্যক্রম ইতোমধ্যে ভার্সিটি পেরিয়ে বাইরের মানুষের কানে পৌঁছে গিয়েছে। শখানেক জায়গায় তোমাদের মারামারি ভিডিও শেয়ার হয়েছে। পরিচিতরা আমাকে তাতে মেনশন দিচ্ছে। ভার্সিটি নিয়ে নিন্দা করছে সবাই।”
” সরি স্যার। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে হয়ে গিয়েছে।” মাথা নিচু করে বলল সাফাইত।
রিফাত সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন, ” সরি বললেই কি সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে? এটা তোমার রাগ দেখানোর জায়গা নয়। রাগ দেখাতে হলে, গুন্ডামী করতে হলে ভার্সিটির বাইরে গিয়ে দেখাবে তখন কেউ কৈফিয়ৎ চাইবেনা।”
সাফাইত পরবর্তীতে কিছু বলার সাহস পেল না। তোহা এতো সময় চুপ করে থাকলেও এবার মুখ খুলল।
” স্যার আমার কিছু বলার আছে।”
সরু চোখে তাকালেন রিফাত সাহেব।
” তুমি সেই মেয়েটা না যে ওকে চড় মেরেছিলে?”
” জ্বি স্যার, আমার নাম তোহা।”
” তুমি কেন এর মাঝে এসেছ? কোন অধিকারে ওর গায়ে হাত তুলেছিলে তুমি?”
সাফাইত কিছু বলবে তার আগে তোহা তাকে ইশারায় থামিয়ে নিজে বলল, ” আমি সাফাইতের বেস্টফ্রেন্ড। তাদের মাঝে আসার কারণ ঘটনা মূলত আমাকেই ঘিরে। আজ সকালে করিডোর দিয়ে আসার সময় সিয়াম নামক ছেলেটি আমার সাথে অসভ্যতা করেছিল, সবার সামনে আমার হাত ধরে টানাহেঁচড়া করেছিল৷ সাফাইত এটা শুনে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। তাই রাগের বশে এসব করে ফেলেছে। ওর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি স্যার। কোন শাস্তি দিতে হলে আমাকে দিতে পারেন।”
সিয়াম ভেবেছিল সে ভিক্টিম কার্ড প্লে করে বেঁচে যাবে কিন্তু তোহার কথা শুনে প্রিন্সিপালের দিকে তাকিয়ে বুঝল আর তার রক্ষে নেয়।
” তুমি কি সিয়ামের কোন শাস্তি চাও?”
তোহা একদম সরাসরি বলে দিল, ” জ্বি স্যার। পড়াশোনার করার স্থানে এধরণের নিম্নমানের কাজ খুবই অসন্তোষজনক। আমি শাস্তির বিষয়টা আপনাদের উপর ছেড়ে দিসি। আশা করবো আপনারা এর যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।”
” ঠিক আছে। তোমরা দু’জন এখন আসতে পারো তবে দ্বিতীয়বার যেন এরকম কিছু না হয়। কোন সমস্যা হলে আমাদের জানাবে, নিজে থেকে কিছু করতে যাবে না।”
” ঠিক আছে স্যার, ধন্যবাদ।”
রুম থেকে বেরিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিল তোহা। সাফাইতকে টেনে মেডিসিন রুমে নিয়ে এলো সে। হাত এবং মুখে আঘাত পাওয়া জায়গাগুলোতে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। তার এই নীরবতা সাফাইতের ভালো লাগছেনা।
” কিরে তোহারাণী কথা বলছিস না কেন? আচ্ছা বাবা সরি আমি আর কখনো এরকম করবো না। এবার তো কথা বল।”
তোহা কোনরূপ উওর দিল না৷ ব্যান্ডেজ করে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো তবে বেশিদূর যেতে পারল না। কয়েককদম যেতে পেছন থেকে সাফাইত তার ব্যাগ টেনে নিজের সামনে নিয়ে এলো।
” এরকম করছিস কেন? আমি কি ভূল করেছি বল? ওকে শিক্ষা না দিলে হতো না।”
” সাফাইত ব্যাগ ছাড় আমার।” ব্যাগ ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলে এবার সাফাইত তার হাত টেনে ধরল। এবার খানিকটা রাগী স্বরে বলল, ” এবার কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তোহা। এরকম করছিস কেন তুই? আমি তো ভূল কিছু করিনি? প্রিন্সিপালের রুমে যেতে হয়েছে বলে তুই মন খারাপ করেছিস? আরে উনি তো আমাদের বকা দেননি তাহলে কি হয়েছে?”
তোহা কোনপ্রকার উওর না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
” এই তোহা তুই কি সিয়ামের ওইসব কথায় মন খারাপ করেছিস? আমার দিকে তাকা।” সাফাইত তার মুখ নিজের দিকে ফেরালো। তোহার চোখে জল দেখে সাফাইত অস্থির হয়ে উঠল। বুঝল সিয়ামের কথায় সে আঘাত পেয়েছে।
” আরে আরে তোহারাণী কান্না করছিস কেন? দেখ ও তো বাজে ছেলে, ওর চিন্তাভাবনাও বাজে। তুই কেন শুধু শুধু ওর কথা মাথায় নিয়ে বসে আছিস বলত? দেখ আমার দিকে, আমরা তো জানি আমরা স্বচ্ছ, আমাদের বন্ধুত্ব স্বচ্ছ। তাহলে বাইরের মানুষের কথা কেন গায়ে মাখব?”
তোহার কি হলো সে জানে না আচমকা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। সাফাইত যত্নসহকারে তার কপালটা নিজের বুকে ঠেকাল। বেশ কিছুসময় পর নিজেই তা সরিয়ে যত্ন সহকারে চোখের জল মুছে দিল।
” হয়েছে এবার বাচ্চাদের মতো কান্না বন্ধ কর। আমার শার্টটা ভিজিয়ে দিয়েছিস। দেখ তোর নাকটা পুরো লাল টমেটো হয়ে গিয়েছে। ইশ… তুই নাক মুছেছিস নাকি শার্টে? ইউ….” বমির নাটক করে বলল সাফাইত। তোহা তার হাতে একটা চাপড় দিল, পরমুহূর্তে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।
” শান্তিতে একটু কান্নাও করতে দিবি না।”
” না দেবো না। তোমাকে শান্তিতে দেখলে আমার জ্বলে।”
” যা শয়তান আমার সাথে কথা বলবিনা।”
সাফাইত তোহার ব্যাগ টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
” আমার অনেক ক্ষিধে পেয়েছে। মন ভালো করার মতো কিছু খেয়েনি, খাওয়া শেষে বিলটা দেওয়ার পর আর কথা বলিস না।”
” সাফাইতের বাচ্চা, ছাড় আমার ব্যাগ। আমি যাবোনা তোর সাথে।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। সাফাইত ভাবলেশহীনভাবে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
.
.
নিউজফিড স্ক্রল করছে ইশরা। তার পুরো নিউজফিড জুরে ক্যাম্পাসে হওয়া সকালের ঘটনার ভিডিও ছড়াছড়ি। কেউ রোমান্টিক ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে তা এডিট করেছে তো কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে পোস্ট করেছে। পরিচিতরা সকলে তাকে মেসেজ দিয়ে জানতে চাইছে সাফাইতে চড় মেরেছে মেয়েটা কে৷ ইশরা তা দেখেও কোনরূপ জবাব দিল না। এবার ইশরার তোহার উপর খানিকটা রাগ হচ্ছে।
” কেন চড় মারতে গেল? ও কি বুঝতে পারেনি এতে সাফাইতের কথাটা সম্মানহানী হবে? এতোটা নির্বোধ মানুষ কি করে হয়? কি এমন হয়েছে যে সাফাইত এতোটা রেগে কাউকে আঘাত করেছে? আমাকে পর্যন্ত খেয়াল করেনি। কিন্তু তোহা আসতেই সে শান্ত হয়েছে গেল!”
ভাবনায় ছেদ পড়ল ফোনের রিংটোনে। স্ক্রিনে সাফাইত নামটা জ্বলজ্বল করছে। ফোন দেখে ইশরার সকালে ধাক্কা দেওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। রাগ হলো তার, ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বালিশ দিয়ে কান চেপে শুয়ে রইল। অনবরত ফোনের রিংটোন সহ্য করতে না পেরে উঠে বসল সে। রিসিভ করে গমগম কন্ঠে বলল,
” কি সমস্যা তোমার? দেখছ ফোন রিসিভ করছিনা তাও বারবার কেন ফোন দিচ্ছো?”
” আরে আরে ইশু কুল কুল। এতো রাগে আছো কেন? কেউ কিছু বলেছে?”
” তা জেনে তুমি কি করবে? আমাকে আর কল দিবেনা। পুরো দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর উনি এসেছে ঢং দেখাতে৷ আরেকবার ফোন দিলে খবর আছে।”
” আরে ইশরা শোন তো। এতো রেগে আছো কেন? আচ্ছা বাবা সরি, তুমি তো দেখেছোই সকাল থেকে কি ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। তোহাটাও সারাদিন মন খারাপ করে ছিলো। এখন তুমিও যদি রাগ করে থাকো তাহলে আমি কোথায় যাবো?”
” আমার মাথার উপর যাও। থাকো তুমি তোমার তোহাকে নিয়ে। সেই তো সব, আমি কে? তাই তো সে আসতেই তুমি থেমে গেলে৷ আমি কতবার তোমাকে ডেকেছিলাম কিন্তু তুমি কি করলে? আর কখনোই আমার সাথে যোগাযোগ করবে না।” রাগে কষ্টে নিজের অজান্তে কথাগুলো বলে ফেলল ইশরা। সিয়ামের কথাগুলো সে শুনেছে, তখন থেকেই তার মাথায় হাজারখানেক বাজে চিন্তা এসে ভর করেছে। ফলে নিজের মেজাজ আর অনুভূতি ঠিক রাখতে পারছে না সে৷ বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল ইশরা। সাফাইতকে সে ভীষণ ভালোবাসে। সে হারিয়ে গেলে ইশরা একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।
ইশরার কথা শুনে সাফাইত সকালের ঘটনাটা আবারো মনে করতে লাগল। তখন সে বুঝতে পারলো ভুলবশত সে ইশরাকে ধাক্কা দিয়েছিল। সাফাইত নিজের কপাল চাপড়ালো।
” হায় হায়, এটা আমি কি করে বসলাম। এবার কি করে ইশরাকে মানাবো! আরে ইয়ার, ধুর।”
কড়া রোদে সবার জান যায় যায় অবস্থা। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে তোহা এবং সাফাইত। এদিক-সেদিক তাকাতে তোহার নজর পড়ল রাস্তায়৷ কিছু একটা দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। খানিকটা পিছিয়ে গেল সে। ঘাড়টা সামান্য বাঁকা করল যেন সাফাইতের ছায়ার কাঁধে কাছে তার মাথাটা যায়। আস্তে করে ফোনটা বের করল এবং এই মূহুর্তেটা ক্যামেরা বন্দি করে রাখল।
বিরবির করে বলল, ” এইভাবে যদি ভালোবাসা মানুষ হিসেবে তোর কাঁধে মাথা রাখতে পারতাম সাফু। কি হতো যদি ইশরা তোর জীবনে না আসত? কি হতো যদি আমি তোকে নিজের মনের কথা বলে দিতাম? তুই আমার না হয় সাফু কিন্তু এই ছোটছোট মূহুর্তগুলো আমি যত্ন করে স্মৃতিতে সাজিয়ে রাখব।”
” কিরে তোহা এই দামড়ি বয়সেও ছায়ার সাথে কথা বলছিস।”
নিজের অনুভূতি সূক্ষ্মভাবে গোপন করে সে মিথ্যা ভাব দেখিয়ে বলল, ” করছি তোর সমস্যা? আমার ছায়া, আমার যা ইচ্ছে করব।”
” তাহলে তুই এই রোদে দাঁড়িয়ে ছায়ার সাথে গল্প কর, আমি গেলাম।”
সাফাইত রিকশায় চড়ে বসেই তোহাও তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল।
” বেয়া’দব আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস কেন?”
” তোরই তো ছায়ার সাথে আড্ডা দেওয়ার শখ হয়েছে, তো তুই থাক না৷ চলে যাচ্ছিস কেন?”
” চুপ কর শয়’তান। আর বাজে কথা বললে রিকশা থেকে ফেলে দেব।”
রিকশা তার আপনগতিতে চললে, সাথে পুরো রাস্তাজুড়ে চললো দু’জনের দুষ্টমিষ্টি ঝগড়াও।
.
.
” তুমি যেভাবে বলেছ তাড়াতাড়ি নিচে নামতে চিন্তায় আমি আপনাআপনি ছুটে চলে এসেছি। এবার তাড়াতাড়ি বলো কেন ডেকেছ? পড়াপ্রতিবেশী কেউ দেখে ফেললে রক্ষে নেই।”
সাফাইতে একটা ব্যাগ ইশরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় তা নিতে বলল। ইশরা ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে দেখলে কয়েকটা খাবারের প্যাকেট, যা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ নাকে এসে পৌঁছাচ্ছে।
” এগুলো কি?”
” কাল না বলেছিলে তোমার কাচ্চি খেতে মন চাইছে। কাল তো পারিনি তাই আজ নিয়ে এলাম।”
ইশরা মনে মনে ভীষণ খুশি হলো৷ তবে তা প্রকাশ না করে বলল,
” কেন শুধু শুধু টাকা খরচ করতে গেলে? ওটা তো আমি এমনিতে বলেছিলাম। আমি টিউশনির টাকা পেলে ঘরেই বানিয়ে নিতাম।”
” তোমার ইচ্ছে হয়েছে তা কি আমি পূরণ না করে থাকতে পারি?” এগিয়ে এলো সাফাইত৷ ইশরার হাতজোড়া আঁকড়ে ধরে তার চোখে তাকিয়ে বলল, ” টাকা কোন ব্যপার না ইশরা। টাকা আসবে, যাবে কিন্তু এই সামান্যতে তোমার যে খুশি তার কাছে টাকা কিছুই না। তোমার খুশির জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি। ভালোবাসার কাছে এসব কিছুই না।”
” হয়েছে আমার প্রেমিক পুরুষ৷ এবার আমি যাই, মা খোঁজ করবে আমার।”
” সাবধানে যেও আর আন্টিকে বলো আমার তরফ থেকে এগুলো ট্রিট।”
ইশরা গেট পার হয়ে চলে গেল কিন্তু সাফাইত এখনই গেল না। কিছুসময় পর ইশরা বারান্দা এসে বিদায় জানালো৷ সাফাইত ইশরায় ভালোবাসি বলে বাইকে চড়ে নিজের গন্তব্যে পাড়ি দিল।
.
.
” কিরে তোহারাণী এভাবে মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস কেন?” ঘাসের উপর বসে বলল সাফাইত। কিন্তু তোহার কোন ভাবান্তর সে দেখল না। পুনরায় একই প্রশ্ন করেও যখন কোন উওর পেলো না তখন সাথে বসে থাকা ইলাকে প্রশ্ন করল,
” কি হয়েছে ইলা? তোহা এরকম মূর্তির মতো বোবা হয়ে বসে আছে কেন?”
ইলা তোহার দিকে তাকাল, সে ইশারায় না বলল যা সাফাইতের চোখ এড়িয়ে গেল না। সে অস্থির হয়ে গেল।
” ইলা কিছু লুকাবিনা, বল কি হয়েছে? কোন সমস্যা হয়েছে কি? বল ইলা।” শেষে ধমক দিয়ে জানতে চাইল সাফাইত। ধমক খেয়ে ইলা গড়গড়িয়ে বলতে লাগল,
” সিয়াম বেশ কয়েকদিন ধরে তোহাকে বিরক্ত করছিল। আজতো সীমা পার করে ফেলেছে।”
” কী করেছে?” গম্ভীর কন্ঠে বলল সে।
” আমরা দু’জন করিডোর দিয়ে আসছিলাম তখন সে কোথা থেকে এসে তোহার হাত ধরে বাজে বাজে কথা বলতে শুরু করেছে। অনেক টানাহেঁচড়া করে তোহা নিজের হাত ছাড়িয়েছে।”
সাফাইত তোহার দিকে তাকাল। সে মনমরা হয়ে ঘাস নাড়াচাড়া করছে৷ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সাফাইত উঠে দাঁড়াল৷ তাকে চলে যেতে দেখে তোহা ধীর কন্ঠে জানতে চাইল, ” কোথায় যাচ্ছিস? ইশরার কাছে?”
সাফাইত গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
” কাজ আছে৷ তুই ইশার সাথে ক্লাসে চলে যা।”
তোহা আর কিছু বলল না। আপাতত তার কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা। অপরিচিত একটা ছেলে এভাবে সবার সামনে হাত ধরে টানাহেঁচড়া করেছে, ধাক্কাটা সে এখনো সামলিয়ে উঠতে পারছেনা।
ইশরা ক্লাসে বসে গল্প করছিল। সেসময় একটা মেয়ে দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে তাকে জানাল,
” ইশরা তাড়াতাড়ি চল। সাফাইত ভাই অনেক বড় ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছে।”
” কি হয়েছে সাফাইতের?”
” কয়েকটা ছেলের সাথে গেটের কাছে মারামারি করছে সাফাইত ভাই। আমি ওদিক আসার সময় দেখলাম।”
মেয়েটার কথা শুনে ইশরা একমুহূর্তও দেরি করল না। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দৌড় লাগাল গেটের কাছে।
সিয়াম নামক ছেলেটির গালে পুনরায় সজোড়ে থা’প্পড় মারল সাফাইত। রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ” শা’লা তোর সাহস তো কম না তুই তোহার সাথে অসভ্যতামী করেছিস। আজ তো একেবারে সীমা পার করে ফেলেছিস। ইচ্ছে করছে তোকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁ’তে দি। কু** বা** শরীরে অনেক জ্বালা না তোর। তোর জ্বালা আমি আজকে যদি না মিটিয়েছি না।”
মার খেয়েও সিয়ামের মধ্যে কোনরূপ অনুশোচনা কিংবা ভয়ের রেশ দেখা গেল না। বরং সে কুৎসিতভাবে হেসে বলল, ” আমার শরীরে না হয় জ্বালা ধরেছে তাই ওই মেয়ের হাত ধরেছি ফিল নেওয়ার জন্য। কিন্তু তোর এতো জ্বলছে কেন? এতো রাগ করছিস কেন? শুনেছি ওই মেয়ে তোর বন্ধু, তা শুধুই কি বন্ধু নাকি ফ্রেন্ড’স উইথ বেনিফিট? আরে বলতে পারিস কোন সমস্যা নেই। ফাঁকা জায়গা লাগলে আমাকে বলতে পারিস।”
সিয়ামের কুৎসিত কথা শুনে সাফাইতের মাথায় আগুণ ধরে গেল। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে সিয়ামকে আঘাত করতে লাগল সে। সাফাইতের এধরণের ক্ষিপ্ত রুপ দেখে ঘাবড়ে গেল ইশরা। প্রথমে এগিয়ে আসার সাহস না পেলেও সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে এলো তাকে আটকানোর জন্য৷
” সাফাইত ছেড়ে দাও ওকে৷ ওর রক্তক্ষরণ হচ্ছে আরো মারলে বড় কিছু হয়ে যাবে। ছাড়ো সাফাইত।”
তাকে টানাটানি করতে লাগল ইশরা কিন্তু সাফাইতকে একচুলও সরাতে পারল না সে। একসময় সাফাইত খেয়াল না রেখে ইশরাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল। যার ফলে সে ছিটকে খানিকটা দূরে সরে গেল। ইশরা এগিয়ে এলোনা, অবাক নয়নে সাফাইতের দিকে তাকিয়ে রইল।
এরইমাঝে কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো তোহা। সে ভার্সিটি পেরিয়ে অর্ধেক রাস্তা চলে গিয়েছিল, ইলার ফোন পেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে পুনরায় ফিরে এসেছে।
” সাফু ছাড় ওকে, মরে যাবে ও। সাফু ছেড়ে দে।”
বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরেও যখন তোহা ব্যর্থ হলো তখন উপায় না পেয়ে চড় মেরে বসল সাফাইতের গালে। থমকে গেল সবাই। কিছু মূহুর্ত আগেও জায়গাটা কোলাহলপূর্ণ ছিল মূহুর্তেই তা নীরবতায় ছেঁয়ে গেল৷ তার আচমকিক কাজে সবার সাথে ইশরাও অবাক হলো, সঙ্গে তার খানিকটা রাগও হলো। তবে সাফাইতের মুখভাব পরিবর্তন হলোনা। সে এখনো হিংস্র বাঘের মতো সিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে। তোহা হুংকার দিয়ে বলল,
” এটা ভার্সিটি সাফাইত, তুই এখানের পড়াশোনা করতে এসেছিস গুন্ডামি করতে নয়৷ কে বলেছে তোকে এসব করতে? আমি বলেছিলাম আমার হয়ে লড়তে আয়? বলেছিলাম বল? ওর উল্টাপাল্টা কিছু হলে তোর ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে এটা বুঝতে পারছিস না?”
” এতোগুলা মানুষ আটকানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। যেই না তোহা এলো ওমনি সরে গেলি। কি ব্যপার গুরু? আমি যা বলেছি তাই না? কি তোহা বন্ধুত্বের নামে ভালোই চললে না? আমিও তো তোমার বন্ধুই হতে এসেছিলাম বিনিময়ে তুমি যদি….” সিয়ামের কুৎসিত চাহনি এবং কথাবার্তায় গা গুলিয়ে এলো তোহার। সে সহ্য করতে না পেরে সজোড়ে চড় মেরে বসল সিয়ামের গালে। মাটিতে একদলা থুতু ফেলে ঘৃণা ভারা কন্ঠে বলল,
” এই থুতু তোর মুখে মারতে পারলে শান্তি পেতাম। তুই নোংরা বলে অন্যজনও নোংরা হবে এই ভাবনা ছেড়ে দে। তোর চরিত্র খারাপ বলে অন্যরাও যে সে পথে হাঁটছে এই ভূল ধারণা থেকে বেরিয়ে আয়। তোদের মতো কুকুরদের সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে।”
সিয়াম থেকে চোখ সরিয়ে সাফাইতের দিকে তাকাল তোহা। দেখল সে হাত মুষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে।
” কুকুর যদি তোকে কামড় দেয় তুইও কি তাকে কামড় দিবি? কেন শুধু শুধু পচা নর্দমা হাত দিতে যাস বলতো? নর্দমা যতই পরিষ্কার করা হোক না কেনো তা থেকে পচা গন্ধ আসবেই। কেন নর্দমায় গিয়ে নিজেকে দূষিত করছিস? চল এখান থেকে।”
সাফাইতে টেনে নিয়ে গেল তোহা। সিয়ামকে কয়েকটা ছেলে মিলে ব্যান্ডেজ করাতে নিয়ে গেল। আস্তে আস্তে জায়গাটাও ফাঁকা হতে লাগল। তবে ইশরা এখনো সেই জায়গায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবতেও পারছেনা সাফাইত তাকে খেয়ালই করেনি৷ সাফাইতের এই হিংস্র রুপ, এধরণের ব্যবহার দেখে সে একপ্রকার ঘোরে চলে গিয়েছে।
” আপনাদের একসাথে বেশ লাগছে ভাইয়া। আপুটা কিন্তু বেশ সুন্দরী। এই নেন আপনার ফুল।”
সাফাইত প্রতিউওরে কিছু বললনা। হেঁসে ছেলেটা থেকে ফুল জোড়া নিয়ে টাকা পরিশোধ করে সামনে এগিয়ে গেল। একটা ফুল পকেটে রেখে অন্যটা তোহার চুলে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল। নীরবতা কাটিয়ে তোহা বলল,
” ছেলেটার ভূল ধারণা ভাঙালিনা কেন? ও তো অন্যকিছু মনে করছে।”
” কি মনে করছে? আমাদের একসাথে তো ভালোই লাগছে, ম্যাচিং ম্যাচিং কালার। বেস্টফ্রেন্ডরাতো ম্যাচিং ম্যাচিং পড়তেই পারে। কিন্তু ছেলেটা একটাই ভূল কথা বলেছে।”
” কী?”
” এই যে তুই সুন্দরী৷ নির্ঘাত ওর চোখে কেউ জাদু করেছিল তাই তোকে ওর সুন্দর লেগেছে। তোর দিকে তাকালে তো আমার শেওড়া গাছে পা ঝুলিয়ে থাকা পেত্নীর কথা মনে পড়ে।”
” শয়’তানরা কখনো ভালো জিনিসের মূল্য করতে জানেনা৷ তোর চোখ যে নষ্ট তা আমি জানি।”
সাফাইত চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকাল। তোহা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তাকে ছেড়েই হাঁটতে লাগল।
তোহা সাফাইতের দিকে তার আইসক্রিমটা বাড়িয়ে দিয়ে নিজেরটা খাবে তার আগেই সাফাইত বেশখানিকটা খেয়ে ফেলল।
” কি করলি তুই! কুত্তা তুই আমারটা কেন খেলি?”
সাফাইত নিজের আইসক্রিমে কামড় বসিয়ে ভাব দেখিয়ে বলল, ” আমি কোন বিনামূল্যে করিনা। তোর মুখে লেগে থাকা আইসক্রিম পরিষ্কার করে দিয়েছে তার তো কিছু মূল্য দিতে হবে। আমি তো জানি তোর থেকে চেয়ে লাভ নেই তাই নিজেরটা নিজেই বুঝে নিলাম।”
নিজের আইসক্রিমটাও সাফাইতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তোহা রেগে ধুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল তার পিঠে। যদিও সে খুব বেশি ব্যথা পায়নি তবুও নাটক করে বলল, ” ও আম্মা গো আমার পিঠের হাড় মনে হয় ভেঙে গিয়েছে। আন্টি আপনার মেয়ে আমাকে পঙ্গু করে দিয়েছে।”
তোহা তার মাথায় টোকা দিয়ে বলল, ” গাধা মানুষ পায়ে হাঁটতে না পারলে তাকে পঙ্গু বলে।
তাদের এই হাসিঠাট্টা কেউ দূর থেকে যে দেখছে এটা দু’জনের কেউ লক্ষ্য করেনি।
মাকে রান্নায় সাহায্য করছিল ইশরা, ফোনের শব্দে রুমে এসে দেখল আননোন নম্বর থেকে কল এসেছে।
” কে বলছেন?”
” ইশরা আমি সিনথিয়া। কেমন আছিস?”
” এইতো ভালো আছি। তোর কি খবর? নম্বর সেভ না থাকার কারণে বুঝতে পারিনি।”
” আমিও ভালো আছি। আচ্ছা তোর কি সাফাইত ভাইয়ের সাথে ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে নাকি?”
সিনথিয়ার কথা শুনে চমকে উঠল ইশরা। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ” না না সেরকম কিছু হয়নি। আমাদের মাঝে তো সবঠিকই আছে।”
” দেখ ইশরা আমি তোর ক্লোজ ফ্রেন্ড না হলেও আমরা ক্লাসমেট। তোর সাথে আমার কোন ঝামেলাও নেই যে আমি তোর ক্ষতি চাইব। তোর ভালো চাই বলেই জানানোর জন্য তোকে ফোন করলাম।”
মেয়েটার কথার ভঙ্গিমা দেখে ইশরা মন ঘাবড়াতে লাগল।
” সিনথিয়া হেঁয়ালি না করে একটু পরিষ্কার করে বল কি হয়েছে?”
” আসলে আমি একটা পার্কে এসেছিলাম ঘুরতে। এখানে সাফাইত ভাইকে একটা মেয়ের সাথে দেখলাম। বেশ হেসেখেলে সময় কাটাচ্ছে তারা। ম্যাচিং কালারের ড্রেসও গায়ে দেখছি। ভেবেছিলাম হয়তো তোদের ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছে এখন শুনি সেরকম কিছুই হয়নি৷ তার মানে কি সাফাইত ভাইয়া চিট করছে নাতো?”
সাফাইতকে অন্য মেয়ের সাথে হেসেখেলে সময় কাটাচ্ছে জেনে ইশরার বুক কেঁপে উঠল। সাফাইতকে সে প্রচুর বিশ্বাস করে, সে যদি বিশ্বাস ভেঙে দেয় তাহলে ইশরা পরবর্তীতে কাউকে ভরসার করার সাহস দেখাবেনা।
” কি হলো ইশরা? তুই ঠিক আছিস? আমি বুঝতে পারছি কথাটা শুনে…..”
” আচ্ছা মেয়েটা কেমন দেখতে বলতো।”
” আমি তোকে ছবি ওয়াটসএপ করেছি, নিজেই দেখে নে।”
ইশরা দ্রুত ছবিটা দেখল। ছবিতে তোহাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল সে।
” ধুর মেয়ে তুই তো আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলি। আরে এটা ওর বেস্টফ্রেন্ড, আমি চিনি আপুকে। তুই আর চিন্তা করিস না। সাফাইত আমাকে কখনো ধোঁকা দিবে না।”
” ও…আচ্ছা।” নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল মেয়েটি। পরবর্তী আবারো বলল, ” তাও এখন যা অবস্থা, কোন কিছুর বিশ্বাস নেয়। খেয়াল রাখিস ওদের দিকে। বন্ধুদের পেছনে তোর অগোচরে যদি কিছু করে বেড়ায়। বেশি বিশ্বাস করে ছেড়ে দিসনা, হারিয়ে গেলে তখন পস্তাবি। রাখছি আমি।”
সিনথিয়া ফোন তো রেখে দিল কিন্তু ইশরার মনে ভয় এবং সন্দেহের বীজ পুঁতে দিয়েছে।
.
.
ঘাসের উপর ধপ করে ইশরার পাশে বসে পড়ল সাফাইত। তাকে চুপচাপ দেখে জানতে চাইল,
” কি হয়েছে? এভাবে চুপচাপ বসে আছো কেন? সকালে কিছু খাওনি নাকি?”
” খেয়েছি।” র্নিলিপ্ত কন্ঠে বলল সে।
” তাহলে এভাবে বসে আছো কেন? কিছু বলো। এই ইশু তোমার কি মন খারাপ? আমার দিকে তাকাও তো।” গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে ফেরালো সাফাইত। ইশরা গাল থেকে হাত সরিয়ে তা আঁকড়ে ধরে বলল, ” কাল একবারো ফোন করোনি কেন? জানো কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম।”
” আচ্ছা এই কারণে মহারাণীর মন খারাপ। আসলে কাল ফোনটা পানি পড়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আসার পর ঠিক করাতে দিয়ে এসেছি। পরে তোমাকে অন্য ফোন থেকে ফোন দিতেও মনে ছিল না। দাঁড়াও তোমাকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল।”
ব্যাগ থেকে একটা শুকনো গোলাপ ফুল তার দিকে এগিয়ে দিল সে, যার কয়েকটা পাপড়ি ইতোমধ্যে ঝড়ে গিয়েছে।
” এটা তোমার জন্য কালকে নিয়েছিলাম। তখন অনেক তাজা ছিল, কি টকটকে লাল ছিল রঙ। কিন্তু এখন দেখো শুকিয়ে মরা হয়ে গিয়েছে। তোমার কথা ভেবে নিয়েছিলাম এখন না দিলেও শান্তি পাবো না। তাই শুকনো, মরমরেটাই দিলাম।”
ইশরা হেসে ফুলটা নিয়ে বলল, ” তুমি আমাকে ভালোবেসে যায় দাও না কেন আমি তাতেই খুশি।”
কথায় কথায় ইশরা অন্যদিকে চলে গেল। সে ভেবেছিল কড়া করে জিজ্ঞেস করবে সাফাইত কাল কোথায় ছিল যদিও বা সে জানে। কিন্তু কথার তালে তা সম্পূর্ণ ভূলে গিয়েছে।
তবে বেশ কিছু সময় কথার তালে সাফাইত নিজেকেই বলল, ” জানো কালকে তোহাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিলাম৷ সেসময় এই ফুলটা নিয়েছি। ওর আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছিলাম বলে সে কি রাগ।”
ইশরা কথা কাটানোর জন্য বলল,
” তা তো অবশ্যই করবে। আচ্ছা সেসব বাদ তাও, তুমি….. ” পুনরায় তারা অন্য কথায় চলে গেল। আপাতত ইশরা সেসব নিয়ে কোন ধরনের কথা বলে তাদের সুন্দর মূহুর্তটা নষ্ট করতে চাইনা।
.
.
সাফাইত বারবার ঘড়ি দেখছে দেখে তোহা বলল,
” কিরে এতোবার ঘড়ি দেখছিস কেন? কি হয়েছে?”
” সময় যাচ্ছেই না। কখন যে এই ক্লাসটা শেষ হবে।” বেঞ্জে কপাল ঠেকিয়ে বলল সে।
” বারবার ঘড়ি দেখলে কি সময় দ্রুত চলে যায়? কোন জরুরি কাজ আছে নাকি?”
” হুম ইশরার সাথে দেখা করতে যাবো। পরের ক্লাসে ওর অফ।”
সাফাইত নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দিল। তবে তোহা সেটা সরিয়ে বাম হাতটা সামনে আনলো এবং ঘড়িটা খুলে নিজের ব্যাগে রেখে দিল।
” ঘড়ি খুলেছিস কেন? পছন্দ হয়েছে তোর? নিয়ে যাবি?”
” তোর তুই পঁচা ঘড়ি আমার লাগবেনা। বারবার সময় দেখলে অস্থিরতা বাড়বে। তাই এটা এখন আমার কাছে থাক এখন তুই ক্লাসে মনোযোগ দে। পরে আমাকে যদি বলিস বুঝিয়ে দিতে তাহলে তোর খবর আছে।”
সাফাইত হতাশ হয়ে গালে হাত দিকে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইল শুধু, কোন পড়াই তার কানে যাচ্ছেনা। তার অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তোহা।
লিখতে লিখতে বলল,
” কবে যে এই ছেলে ঠিক হবে।”
ক্লাস থেকে স্যার বেরিয়ে যেতেই সাফাইতের মনে যেন প্রাণ এলো। তার সব অলসতা যেন মূর্হুতে উবে গেল। তা দেখে তোহা খোঁচা দিয়ে বলল,
” এতোক্ষণ তো ম’রা মুরগীর মতো ঝিমচ্ছিলি এখন বুলেট ট্রেনের মতো দৌড়াচ্ছিস।”
” ও তুই বুঝবিনা। প্রেম করতে হলে মরা মুরগী হলে চলেনা। বুলেট ট্রেন নাহলে প্রেম করে মজা আছে নাকি?”
সাফাইত ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। পেছন থেকে তোহা উচ্চস্বরে বলল, ” আরে সাফু তোর ঘড়ি তো নিয়ে যা।”
সাফাইত না থেমেই জবাবে বলল, ” তোর কাছে রেখে দে আমি কাল নেব। পরবর্তী ক্লাসগুলো মন দিয়ে করিস, আমাকে নোট’স পাঠিয়ে দিস।”
” আর ক্লাস করবি না আজ?”
” নারে তোহারাণী৷ আজ আমি গেলাম, সাবধানে বাড়ি যাস। তোর কিছু হলে আমি নোট’স পাবো না।” শেষ কথাটা শুনে তোহা কটমট করে তার দিকে তাকাল। যা দেখে সাফাইত ভীষণ মজা পেল। হাসতে হাসতে ক্লাস রুম ত্যাগ করলে সে।
ইশরা এবং সাফাইতকে একসাথে দেখে তোহা ভাবতে লাগল তার যাওয়া উচিত হবে কিনা। তারপর নিজেই নিজেকে ধমকে বলল,
” সাফাইতের সাথে যেই থাকুক এতো দ্বিধা করার কি আছে? সেকি আমার দূরের কেউ নাকি? তোহা তুই নিজেই নিজেকে অস্বস্তির মধ্যে ঠেলে দিছিস।”
সাফাইতের পাশে এসে দাঁড়াল সে। ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে টেবিল রাখল।
” এই নে তোর এসাইনমেন্ট। যত্ন করে রাখিস, হারিয়ে আবার কান্নাকাটি করিস না। আমি তখন আর করে দেব না।”
” আরে আমার তোহারাণী থ্যাংক ইউ। তুই বস, আমি তোর জন্য গরম গরম চা নিয়ে আসছি। কাল রাতে ঠিকমতো ঘুমাসনি আমি জানি।”
তোহা প্রথমে বারণ করতে চাইলেও পরবর্তীতে করল না। খালি চেয়ারটাতে বসে পড়ল। মুখে হাসি রেখে বলল,
” এই যে আমি তোমাদের মাঝে চলে আসি এতে তুমি বিরক্ত হও বুঝি?”
” আরে না না কি বলছ এসব? তুমি সাফাইতের বেস্টফ্রেন্ড, সে হিসেবে তুমি আমারো বন্ধু। তার থেকেও বেশি আমি তোমাকে বড় বোনের নজরে দেখি। সাফাইত আমাকে সবসময় তোমার কথা বলে, তুমি নাকি ওর জীবন্ত ডায়রি।”
” সত্যি সে আমার কথা বলে?”
” তা নয়তো কি? মিথ্যা বলব না, প্রথমদিকে যখন সে তোমার কথা বলত তখন না আমার হিংসে হতো। সাথে তোমাকে দেখার সুপ্ত ইচ্ছে জেগেছিল। যখন তোমার সাথে দেখা হলো, তোমার সাথে কথা বলা শুরু হলো। বুঝতে পারলাম কেন সাফাইত তোমার এতো প্রশংসা করে।”
সাফাইত তার কথা ইশরাকে বলে জানতে পেরে তোহার অধরের কোণে তৃপ্তিমাখা হাসি ফুটে উঠল।
চা হাতে সাফাইত ফিরে এলো। তোহাকে দেওয়ার আগে কয়েকবার তাতে ফুঁ দিল।
” সাবধানে খাবি, গরম। আবার জিহ্বা পুড়িয়ে মুখের সাধ খারাপ করে রাখবি।”
” কথা বলবি না আমার সাথে আর বেয়া’দব। আমি গেলাম, তুই থাক একা।”
আধো গরম চা’টা এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিল সে। যদিওবা গলা খানিকটা জ্বলছে তবে তা প্রকাশ করল না। আরেকবার ভেংচি কেটে গটগট করে চলে গেল।
” বুঝলে ইশরা ছোট থেকেই সে এরকম। কথায় পেরে না উঠলে রাগ দেখিয়ে চলে যায়।”
“তা তো তোমাদের কান্ড দেখেই বুঝতে পেরেছি। তুমিও কম না, সবসময় ওর পেছনে পড়ে থাকো।”
” কি করব বলো? পেটের ভাত হজম করতে হবে তো।”
সাফাইতের কথা শুনে ইশরা না হেসে পারল না।
.
.
টিউশনি করিয়ে বাড়ির ফিরে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল তোহা। ঘুমের মাঝে কানের কাছে ঠান্ডা বাতাস অনুভব হতেই নড়ে চড়ে উঠল। কাঁথাটা আরো গায়ে জড়িয়ে নিল। পুনরায় আবারো একি ধরণের বাতাস অনুভব করলে সে অপর পাশে ফিরে গেল। তবে ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
” তোকে এখন আমি নিয়ে যাবো। আমাদের জ্বিন সর্দার তোকে খুব পছন্দ করেছে। হিহিহি….” কথা শেষে বিদঘুটে হাসি শুনে ধরফরিয়ে উঠে বসল তোহা। নিঃশ্বাস দ্রুত বেগে উঠানামা করছে৷ তার অবস্থা দেখে সাফাইত উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তার হাসি দেখে তোহার বড্ড রাগ হলো। বালিশ নিয়ে ছুঁড়ে মারল তার দিকে।
” আরে পেত্নী কি করছিস? লাগছে তো।”
” লাগুক, লাগার জন্যই তো মেরেছি। এটা কি ছিল? এভাবে কেউ রাক্ষসের মতো হাসে? আরেকটু হলে আমার প্রাণ বেরিয়ে যেত।” কথা শেষে বুকে হাত দিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস নিল সে।
তোহা বালিশটা উঁচিয়ে বলল, ” আবারো বাবু বলেছিস। তোকে তো আমি এবার শেষ করে ফেলব।”
” আচ্ছা তোহা, তোহা। এবার বালিশটা রেখে দে, এই নাদান বাচ্চাকে আর মারিস না।”
তোহা আড়চোখে তাকিয়ে বালিশটা জায়গায় রেখে দিল। চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল, ” এখানে কি এখন? আবারো কি কোন কাজ আছে নাকি? থাকলে তাড়াতাড়ি বলে ফেলল।”
” আমি তো সবসময় তোর কাছে কাজ করানোর জন্য আসি।” মুখ ভার করে বলল সে। তোহা ততক্ষণে বিছানা থেকে নেমে পড়েছে৷ সে এগিয়ে এসে সাফাইতের থুতনি ধরে ঢং করে বলল,
” না তুমি তো আমার কাজ করে দিতে আসো।”
” যা তাহলে আমি আর আসব না। কাট্টি তোর সাথে।”
” হয়েছে এবার নাটক বন্ধ কর আর আসল কথায় আয়। মা কোথায়? কিছু খেতে দেয়নি তোকে?”
” জিজ্ঞেস করেছিল কী খাবো তবে আমি বারণ করেছি। কারণ বাইরে গিয়ে খাবো। এখন তুই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।”
” কেন? কোথায় যাবো? আমি কিছুক্ষণ আগেই এলাম, এখন আর বাইরে যেতে ইচ্ছে করছেনা।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। আলমারি খুলে সব জামাকাপড় নাড়াচাড়া করে একটা জামা নিয়ে তোহার হাতে ধরিয়ে দিল সে। একপ্রকার ঠেলে তাকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিয়ে বলল,
” তাড়াতাড়ি বের হবি, না হলে এই অবস্থায় তুলে নিয়ে যাবো।”
আর কথা বাড়াল না তোহা। কারণ সে ভালোই জানে গলা ফাঁটিয়ে ফেললেও সাফাইত তার কথায় কোন কান দেবে না।
বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তোহা। সাফাইত একটা হেলমেট নিজে পড়ে নিল। অপরটা তোহার দিকে বাড়িয়ে দিতে গিয়েও দিল না। তোহার মন ক্ষুণ্ণ হল। সে ভাবল হয়তো এখন ইশরা এটা ব্যবহার করে বলে সাফাইতের দিতে দ্বিধা লাগছে।
” থাক কেন অন্যের জিনিসে ভাগ বসাব? এটা তো সামান্য হেলমেট, একদিন না পড়লে কিছু হবে না। যেখানে পুরো মানুষটাকেই দিয়ে দিয়েছি, সেখানে এটা তো সামান্য হেলমেট।”
সে যখন নিজ ভাবনায় মত্ত ছিল সেসময় সাফাইত তার চুলগুলো যত্ন সহকারে গুছিয়ে বাঁধলো। তোহা ভাবনায় ইতি টেনে অবাক নয়নে তার কাজকর্ম দেখে চলেছে। সাফাইত হেলমেটটা পড়িয়ে দিয়ে বেল্টখানা বাঁধতে বাঁধতে বলল,
” এভাবে চোখ গিয়ে গিলে খাচ্ছিস কেন? নতুন দেখছিস আমাকে?”
” তোকে বহু বছর ধরে দেখলেও যে আমার দেখার তৃষ্ণা মিটবে নারে৷” বিরবির করে বলল তোহা।
” কি বিরবির করছিস? বড় করে বল।” এতোক্ষণে সাফাইত দূরে সরে গিয়েছে। তোহা মাথা নাড়িয়ে জানাল কিছুনা।
” বুঝিনা বাপু তুই মাঝেমধ্যে কি এতো বিরবির করিস। নে এবার উঠে বস, আমাকে ভালো করে ধরবি। পড়ে গেলে এখানে-ওখানে যাওয়ার বদলে হসপিটালে ঘুরতে হবে।”
সাফাইতের পর তোহা উঠে বসল। দু’হাত রাখল সাফাইতের কাঁধে। বাইক সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। শোঁ শোঁ বাতাসে তার পেছনে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়তে লাগল। শখানেক মানুষ, গাড়ি পেরিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। তবে সেসবে এখন তোহার খেয়াল নেয়। সে সাইড মিররে সাফাইতের প্রতিচ্ছবি দেখতে ব্যস্থ। মানুষটাকে আজ যে প্রথম দেখছে না, তার সবকিছু তোহার জানা। তবুও সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখে চলেছে। তৃষ্ণার্ত পাখির মতো সাফাইতকে দেখে নিজের চোখের তৃষ্ণা নিবারণ করার চেষ্টা করছে সে।
” সাফাইত তুই কি আমার জীবনে এখন অতিথি পাখি হয়ে গেলি? সময় শেষ হতেই কি আমাকে একা করে চলে যাবি? তুইহীনা আমি পারব তো থাকতে?”
নিজের পছন্দের পুরুষকে অন্য রমণীর হাত ধরে হাঁটতে দেখে থমকে গেল তোহা। দাঁতে দাঁত চেপে চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করছে সে। নীরবে সরে আসার পূর্বেই মানুষটা তাকে দেখে ফেলল। ছুটে এসে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
” কিরে তোহারাণী, আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিস কেন?”
সাফাইতের প্রশ্নে তোহার বেহায়া চোখে পুনরায় জল জমতে শুরু করেছে। সে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল। সাফাইতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীকে আড়চোখে পরখ করে বলল,
” তোদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হতে চাইনি। তোরা কথা বল, আমি ক্লাসে যাচ্ছি।”
তোহা এড়িয়ে চলে আসতে চেয়েও ব্যর্থ হলো। সাফাইত তার হাত টেনে আটকে দিয়েছে।
” কোনো ক্লাসটাস করতে হবেনা। ইশরার ইচ্ছে হয়েছে আজ দুপুরে খাবার রেস্টুরেন্টে খাবে। তুইও যাবি আমাদের সাথে।”
তোহা নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
” নারে তোরা যা। তোদের মাঝে আমি গিয়ে কী করব? তোরা হলি লাভ বার্ড’স, সেখানে আমি কেবল মাত্র তৃতীয় ব্যক্তি। আমি গেলে তোরা নিজের সময় ঠিক মতো উপভোগ করতে পারবিনা। তার থেকে ভালো তোরা যা, আমি ক্লাস করে বাসায় চলে যাবো।”
তার কথায় কোনরূপ মনোযোগ দিলনা সাফাইত। পুনরায় হাত ধরল, অপরদিকে ধরল ইশরার হাত। টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ” আমি তোর থেকে উওর জানতে চাইনি, শুধু জানিয়েছি। ইদানীং বড্ড বেশি কথা বলছিস তুই।”
ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে তোহা মনে মনে বলল,
” বেশি কথা বলছি বলেই তো ভিতরে ভিতরে গুমড়ে মরছি৷”
ইশরা এবং সাফাইত পাশাপাশি বসল, তাদের মুখোমুখি বসল তোহা। খাওয়ার সময় তারা দু’জন কথা বললও তোহা নীরব শ্রোতার মতো মনযোগহীনভাবে তাদের শুনে গেল। আচমকাই পরিচিত মানুষটার সামনে বসতে তার অস্বস্তি হতে লাগল, ভেতরে ভেতরে নিঃশ্বাস আটকে আসছে বলে মনে হচ্ছে।
ডেজার্ট খাওয়ার সময় তোহা খেয়াল করল ইশরা কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিছুসময় ভেবে সে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ দাঁড়ানোর কারণে দু’জনের কথার মাঝে ব্যঘাত ঘটল। তারা কোন প্রশ্ন করবে তার পূর্বেই সে দ্রুততার সাথে বলল,
” তোমরা কথা বলো আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।” দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল সে।
ওয়াশরুমে এসে বেশ কয়েকবার মুখে পানি ঝাপটা দিল তোহা। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবিয়ে গেল সে।
তোহা চলে যাওয়ার পর সাফাইত চেয়ারটা টেনে ইশরার আরেকটু পাশে এসে বসল। টেবিলের নিচে হাতখানা আঁকড়ে ধরে বলল,
” তোহা আমাদের সাথে এসেছে বলে কি তুমি মন খারাপ করেছে ইশরা?”
” তা হবে কেন? তোহা আপু কি অপরিচিত কেউ নাকি?”
” দেখো ইশরা তোহা আমার অনেক পুরোনো বন্ধু। আমার সকল সুখ-দুঃখের ভাগীদার তোহা। বলতে গেলে সে আমার জীবন্ত ডায়রি৷ ওর সাথে আমি মেলামেশা করি বলে তুমি মন খারাপ করো না ইশরা। ওকে ছাড়া আমি একপ্রকার অচল। তোহাবিহীন আমার কেন যেন সবকিছু আনন্দহীন লাগে।”
ইশরা সাফাইতের বাহু আঁকড়ে ধরে বলল,
” আগে তো আমার জায়গাটা ফাঁকা ছিল, এখন তো আমি আছি। তাই তোহা না থাকলেও তোমাকে আমি হাসিখুশি রাখব। একটা সম্পর্কে বিশ্বাস অতীব প্রয়োজন। তোমার উপর আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে তুমি কখনোই এমন কিছু করবেনা যা দেখে আমি কষ্ট পাবো কিংবা আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরবে৷ তার থেকেও বড় কথা ভালো মূহুর্তগুলো কাছের মানুষের সাথে ভাগ করে নিলে তা আরো আনন্দঘন হয়।”
” এই না হলে আমার ইশরাপাখি। তুমি এতো বুঝদার বলেই তো আমার তোমাকে এতো ভালো লাগে। এই নাও এবার কেকটা খেয়ে একটু মিষ্টিমুখ করতো দেখি।”
চামচ দিয়ে একে-অপরকে কেক খাইয়ে দিল তারা। এর ফাঁকে সাফাইত দুষ্টমি করে একটু ক্রিম ইশরার নাকে লাগিয়ে দিল। ইশরাও মিথ্যা রেগে যাওয়ার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে নিল৷ সাফাইত রাগ ভাঙানোর চেষ্টায় যখন ব্যস্ত ছিলে ইশরাও সুযোগ বুঝে তার গালে ক্রিম লাগিয়ে দিল৷ তার মুখভাব দেখে হাসি আটকাতে পারল না ইশরা। হাসিতে মগ্ন থাকা প্রেয়শীকে মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগল সাফাইত।
খানিকটা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছে তোহা। দাঁতে দাঁত চেপে ওড়নার একপ্রান্ত খাঁমচে ধরে দু’জনকে দেখে চলেছে সে। তবে এখনোই ফিরে এলোনা। বেশকিছুসময় আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তাদের এই ভালোবাসার মূহুর্তটা সে নষ্ট করতে চাইনা।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো তিনজন। সাফাইত একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে তোহার দিকে ফিরে বলল,
” তোহা তুই বাড়ি চলে যা।”
” তুই যাবি না?”
” যাবো তবে আগে ইশরাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।” তারপর তার কানে ফিসফিস করে বলল, ” বুঝিস না ওকে ছাড়তে আমার দিলে লাগে। সারাদিন ওর সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে।”
সেও হেসে ফিসফিস করে বলল, “ওরে আমার প্রেমিক পুরুষরে। এখন তো তোরই সময়। যা যা একান্তে সময় কথাটা, আমি আর হাড্ডি হব না।”
রিকশা চড়ে বসল সে। ইশরার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল, ” আসি ইশরা। সাবধানে যেও আর এই পাগলটার খেয়াল রেখো৷ রাস্তায় চলাফেরার সময় তার মন আকাশে-বাতাসে থাকে।”
” ইশরে…দিলি তো আমার মানসম্মান ডুবিয়ে৷ মামা এই ফাজিলটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বিদেয় হন। না হলে আরো কী কী বলে আমার ইজ্জতের ফালুদা বানাবে তার ঠিক নেয়।”
হাত নাড়িয়ে দু’জনকে বিদায় জানল তোহা। রিকশা খানিকটা এগিয়ে যেতে সে পেছন ফিরে তাকাল। দূরে দেখা যাচ্ছে সাফাইত যত্ন সহকারে ইশরার হাত ধরে আছে, দু’জনে পা মিলিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। যতক্ষণ দেখা যায় সে তাকিয়ে ছিল, চলতে চলতে একসময় তারা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
.
.
পড়াশোনা করছিল তোহা, ফোনের শব্দে বিরতি নিল সে। স্ক্রিনে “সাফাইত” নামটা দেখে কিছুসময় সে তাকিয়ে রইল। বেশ কয়েকমাস আগেও এই মানুষটার ফোন পেলে সে সব কাজকর্ম ফেলে ছুটে আসত, এখন সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখন কেন যেন তার সাফাইত নামক মানুষটা আশেপাশে থাকলেও দ্বিধা লাগে কথা বলতে।
পুনরায় রিংটোনের শব্দে তোহা ভাবনায় ইতি টানল। গলা পরিষ্কার করে কন্ঠ স্বাভাবিক করল।
” হ্যাঁ সাফু বল।”
” কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? কতবার ফোন দিয়েছি।”
” মিথ্যা কথা বলবিনা, মাত্র একবারই দিয়েছিস।” মিথ্যা রাগ দেখিয়ে বলল সে। অপর প্রান্ত হতে সাফাইত হেসে বলল,
” আরে এসব তো কথার কথা। আচ্ছা ওসব রাখ, শোন না তোহারাণী।”
” জ্বি বলুন না সাফাইত সাহেব।” তাকে অনুকরণ করে বলল তোহা।
” সেটা দেখা যাবে তবে এই বাবু টাবু ডাকবিনা। আমি তোর বাচ্চা নাকি?”
” অবশ্য তুই আমার বড় বাচ্চা৷ আচ্ছা আমি এখন রাখছি, ইশরা ফোন দিচ্ছে। বাই বাই তোহারাণী।”
তোহা বাই বলবে তার আগেই ফোন কেটে গেল। হতাশ নয়নে সে ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবল,
“একসময় আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতাম আর এখন সেসব শুধু স্মৃতি। তুই কি আমার থেকে সত্যি সত্যি দূরে চলে যাচ্ছিস সাফাইত?”
#প্রেম_প্রেম_পায়রা
#পর্ব_১৫ এবং শেষ
#গোলাপী_আক্তার_সোনালী
“কিন্তু নুহাশ আমার মনে হয় সাব্বির ভাইয়া নিজে এটা দিলে বেশি ভালো হয়।আর আজ তো গায়ে হলুদ নুর যে শাড়ি এনেছে সবার জন্য ওটাই তো পরবে সবাই।
” তাহলে বলবে আগামী কাল পরতে সিম্পল। আর সাব্বির নিজে দিচ্ছে না কারন তোমার এসিস্ট্যান্টকে ও জমের মতো ভয় পায়।দেখা গেলো প্রপোজ করার অপরাধে চড় দিয়ে ওর গালের বারোটা বাজিয়ে দিলো।
“মিলি এতোটাও খারাপ নয়।একটু ছটফটে এই যা।ঠিক আছে আমি না হয় দিয়ে দিলাম তবে বিয়ের কথাটা আমি বলতে পারবো না বলে দিলাম।
” হ্যাঁ এতেই হবে বাকিটা ও বুঝে নিবে।
গায়ে হলুদের প্রোগ্রামের আয়োজন ছাদে করা হয়েছে।যেহেতু ছাদের রেলিং যথেষ্ট বড় তাই বাচ্চা কাচ্চাদের কোনো সমস্যা হবে না।তাছাড়া ছাদের যে বিশাল বাগান তা হলুদের প্রোগ্রামকে আরো সুন্দর করে তুলবে।হলুদের ফুল সব নুহাশের বাগান থেকেই নেয়া।যথেষ্ট পরিমাণে ফুল ও গাছ থাকায় আর বাইরে থেকে কিনতে হয়নি।ন্যাচারাল লুকেই নুর হলুদের সাজ সেজেছে। গয়না বলতে ফুলের গয়না।এতেই যেন অপরুপ লাগছে।ছোয়াকে কোনো কাজই করতে দেয়া হচ্ছে না।বেচারি একা একা বোরিং হচ্ছে বলে মিলিও পাশে বসে এটা ওটা বলছে।
নুরকে প্রথম হলুদ নুহাশই দিয়েছে।যতই বোনের সাথে ঝগড়া হোক, মান অভিমান হোক দিন শেষে ভাইয়ের চেয়ে আপন আর কে আছে।নুরকে হলুদ দেয়ার সময় নুহাশের চোখদুটো ছলছল করছিলো নুর সেটা লক্ষ্য করে ভাইকে জরিয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরে।
“এই পাগলি কান্না করছিস কেন।ইশ আমি কোথায় ভেবেছিলাম তোর জামাইকে ঘরজামাই করে রাখবো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা করবো না।তোকে বিদাই না করলে আমার কপালে ভাত জুটবে না।
” ভাইয়া ভালো হচ্ছে না কিন্তু। আজকেও তুমি এমন মজা করবে?
“মজা না সত্যি বলছি।ইশ বেচারা রোহিত কি ভেবে তোকে যে বিয়ে করছে কে জানে।তুই যে কি সেটা তো আমি জানি।হার মাংস জালিয়ে খাস।
” বেশ করি। আরো করবো।তোমাকে জালিয়ে পুরিয়ে ছাই বানাবো তবেই আমার নাম নুর হুহ।আই লাভ ইউ ভাইয়া।
“আমি প্রতিদিনই এসব দেখি ছোট ভাবি।এবার তোমরাও দেখো এই অসভ্য গুলোকে আমি কিভাবে সহ্য করি।
” আমি মোটেই অসভ্য নই মা তোমার ছেলে অসভ্য।
“আমি অসভ্য নাকি তুই অসভ্য?
” উফ আপনারা থামুন না।নুহাশ কিছুদিন বাদে আপনি বাবুর বাবা হবেন এখনো এমন করলে আমার বাচ্চা তো পাগল হয়ে যাবে।
“তাতে তোমার কি? আমার বাচ্চা পাগল হোক আর যাই হোক আমারই হবে বুঝলে।
” আম্মা!
“নুহাশ আব্বা যাও তো এখান থেকে কেন আমার মেয়ে দুটোকে জালাচ্ছো।সাব্বির একে এখান থেকে নিয়ে যাও তো বাবা।
” হ্যাঁ আন্টি।এই নুহাশ চল আমরা খাবারের দিকটা দেখে আসি সব ঠিকঠাক আছে কি না।
নুহাশ আর সাব্বির পাশাপাশি হাটছে আর খাবারের আয়োজন কতটা এগিয়েছে সেটাই পর্যবেক্ষণ করছে।
“তুই মাঝে মাঝে এমন বাচ্চামি করিস না নুহাশ আমি ভেবে পাই না রাজনীতি কিভাবে করিস তুই।আর তোর যে ভয়ংকর একটা দিক আছে সেটা তো এখনকার তোর সাথে আমি মিলাতেই পারি না।আচ্ছা তুই নুরের পিছনে এতো লাগিস কেন বলতো?
” আসলে নুরটাকে আমি এতো ভালোবাসি না যখন মনে হয় ও আমাকে আম্মাকে ছেড়ে অন্য বাড়িতে চলে যাবে আমার ভেতরটা কেমন যেন দুমড়ে মুচড়ে যায়।সম্পর্ক কেমন একটা টান তাই না।এই দেখনা ওদের সাথে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই অথচ ওরা আমাকে কখনোই সেটা বুঝতে দেয় নি।আর নুর ও যে আমার কাছে কি সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।আম্মার মুখে শুনেছি ছোট বেলায় আমি নাকি কোথাও গেলে নুরের হাত ধরে রাখতাম।বাড়িতে না আসা পর্যন্ত নাকি সেই হাত ছাড়তাম না।আমরা নাকি কখনো কেউ কারো সাথে মারামারি পর্যন্ত করতাম না।বাবা কিছু এনে দিলে দুজনের কেউই একা খেতাম না।নুরটা ছোট বেলা থেকেই নরম মনের মানুষ ।কোনো খেলনা এনে দিলে যদি সেটা একটা হতো সবার আগে নুর সেটা আমাকে দিতো।যদিও পরে নুরই তার ভাগিদার হতো।কিন্তু আমি কখনোই দেখিনি আমার আগে নুর কোনো জিনিস নিয়েছে বা নিতে চেয়েছে।আর আমার সেই ছোট্ট পরিটা কতো বড় হয়ে গেছে।আজ বাদে কাল অন্য কারো ঘরে যাবে তার ঘর আলো করতে।এই সময়টা একটা ভাইয়ের কাছে কতটা কষ্টের তোকে বলে বুঝাতে পারবো না রে।তখন ওকে হলুদ লাগানোর সময় ওর কান্নাভেজা চোখ দেখে আমি আর চুপ থাকতে পারিনি তাই তো এমনটা করলাম একটু হাসানোর জন্য।
“ইশ আমার যদি একটা বোন থাকতো। মা বেঁচে থাকলে হয়তো হতো।যাই হোক চল প্রোগ্রামের দিকটাও তো দেখতে হবে।
” একটা কথা বলি?
“অনুমতি কেন নিচ্ছিস বলে ফেল না ভাই।
” তুই মিলিকে বলে দে না। আমার মনে হয় ও রাজি হবে।
“আমি আসলে রিলেশন করতে চাইছি না নুহাশ।আমি চাই মিলিকে বিয়ে করতে।কিন্তু ও রাজি হবে না।তাছাড়া আমার এই জীবনে ওকে এনে বিষাদ দিতে চাই না।
” কেন তুই কি স্মাগলার নাকি কোনো জেল পলাতক আসামি?
“তা হয়তো না।কিন্তু আমার আছে কি বলতো।একটা বাড়ি তাও বাবার রেখে যাওয়া।আমি তো কোনো কোটিপতি নই আর না আমার তেমন কোনো সেভিংস আছে।যা আছে সবকিছুই বাবার আর তোর বাবার । এছাড়াও আমি একা মানুষ। কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। যে প্রফেশন এ আছি যখন তখন যা কিছু হয়ে যেতে পারে।হ্যাঁ এটা ঠিক আমি পুলিশের যব করছি দুই বছর কিন্তু এর আগে যেহেতু স্পেশাল ক্রাইম গ্রুপে কাজ করেছি সেখানে জানাশোনা শত্রুর অভাব নেই।আমার এই অনিশ্চিত জীবনে ওকে কি করে আগলে রাখবো?
” পুরো সিনেমার ডায়লগ। কেন আমরা কি তোর কেউ না।তাছাড়া সব মেয়েরা টাকা পয়সা, অর্থ সম্পদ চায় না।মিলিও তেমন মেয়ে না।আমি তো বলবো তোর জন্য মিলির মতো মেয়েই পারফেক্ট। তাই বলছি পাখি অন্য খাচায় বন্দী হওয়ার আগে নিজের খাচায় বন্দী কর।আমি বলছি তুই হারবি না।
“বলছিস?
” হ্যাঁ চেষ্টা করতে ক্ষতি কি।
হলুদে সবার অবস্থা যা তা।কেউ কেউ তো হলুদ দিয়ে ভুত সেজেছে এমন।নুহাশ তখন থেকে ছোয়াকে খুজে যাচ্ছে।ছোয়ার এই অবস্থায় নুহাশ বেশিক্ষণ ছাদে থাকতে দেয় নি।সবাই আনন্দ করেছে ছোয়া করতে পারেনি বলে নুহাশের ওপর অভিমান জমেছে তার মনে।তাই তো মায়ের ঘরে চুপটি করে বসে আচার খাচ্ছিলো।এদিকে নুহাশ সব যায়গা খুজেও যখন ছোয়াকে পেলো না তখন মায়ের ঘরের কথা মনে হলো।যা ভেবেছিলো তাই।এদিকে তাকে খুজে পাগলপ্রায় নুহাশ আর তিনি মনের সুখে আচার খাচ্ছে।
“কতবার বলেছি ছোয়া আচার খাও তবে লিমিটেড। এখন এটা রাখো।
” কি সমস্যা কথা কেন বলছো না?
“কেন বলবো সবাই কতো মজা আনন্দ করলো আর আমি কি করলাম ঘরে এসে সঙের মতো বসে আছি।আমাকে একা রেখে নিজেও চলে গেলেন।এখন কেন এসেছেন শুনি যান তো এখান থেকে।
” অযথা রাগ দেখাবে না তো।তুমি খুব ভালো করেই জানো সেখানে কেন থাকতে দেই নি।তুমি আসার পর বাকিরাও সব চলে এসেছে তুমি নেই বলে।
“সত্যি!
” হ্যাঁ এবার চলো।সবাই অপেক্ষা করছে তো।
★
হলুদের পরে সবাই নিচে নেমে গেছে অনেক আগেই।ছোয়া মিলিকে একটা শাড়ির প্যাকেট দিয়েছে এবং বলেছে এটা সাব্বির ওর জন্য কিনেছে।সাথে এও বলেছে যে সাব্বির ওকে ভালোবাসে বিয়ে করতে চায়।এটা নিয়েই ভাবছে মিলি।
মিলির মা নেই। ছোট বেলা থেকে বাবাই তার সবকিছু।মিলির এক্স বয়ফ্রেন্ড এর কথা তিনি সবই জানতেন।তার বিয়ে ঠিক হয়েছে এটাও তিনি জানেন।তিনি শুধু মিলিকে বলেছিলো তুই যেটাতে খুশি থাকিস তাই করিস মা।তুই যাকে ভালোবাসিস তাকেই বিয়ে করিস।মিলি শহরে একা থাকে তার পেছনেও যথেষ্ট কারণ আছে। মিলির মা মারা যাওয়ার পর চাচা ফুপুরা জোর করে অন্য যায়গায় বিয়ে দিতে চেয়েছিলো।মিলির বয়স তখন মাত্র পনেরো বছর ।মিলির বাবা মেয়েকে নিয়ে শহরে চলে আসেন যাতে মিলি নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই গড়ে নিতে পারে।মেয়ে যেন কোনো দিক থেকেই অবহেলিত না হয় তাই তিনি তার গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে এখানে একটা ফ্ল্যাট কিনেন।বিগত দুই বছর ধরে তিনি গ্রামে গেছেন।নিজের জমি চাষাবাদের জন্য।তাই মিলি এখানে একাই থাকেন।ছোয়ার সাথে মিলি শুরু থেকেই আছে।কিন্তু সাব্বির কি মিলিকে সত্যি ভালোবাসে? যদি ভালোই বাসে আগে কেন বলেনি?
ভাবনার সুতো কাটলো সাব্বিরের কাপা কাপা কন্ঠে বিয়ের কথা শুনে।
“আ…আমাকে বিয়ে করবে মিলি?
” আপনি জানেন না আমার বয়ফ্রেন্ড আছে?
“ছিলো কিন্তু এখন তো নেই তাই না।
” আপনি আমায় কবে থেকে পছন্দ করেন?
“গুনে দেখিনি তো।তবে অনেকদিন হলো।কেন বলো তো?
” এমনি।কিন্তু আমি তো আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।
” কেন!
” আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়।
“এটা কোনো কারন হতেই পারে না।তাছাড়া খুব বেশি বড় ও নই আমি।
” সে আপনি যাই বলুন আমি আপনাকে বিয়ে করবো না।
“দেখো আমি খুব ভালো করেই জানি তোমার আপাতত কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।আর আমি তো প্রেম করবো না বিয়ে করবো।আজ যদি তুমি বিয়ে করতে না চাও তাহলে কিন্তু।
” কি।
ভ্রু কুচকে জানতে চাইলো মিলি।
“তাহলে এই যে আমি মাটিতে বসে পরলাম যতক্ষন তুমি রাজি না হবে আমি এখানেই বসে থাকবো।
“কিন্তু এটা মাটি নয় ছাদ।
” একই তো।উফ এখানে উকিল গিরি দেখিও না তো।
সাব্বির বসে বসে মশা মারছে আর বির বির করছে।এদিকে সাব্বিরের অবস্থা দেখে মিলি পারছে না দমফাটা হাসি দিতে।কেউ বিয়ে করতে চাইলেও এভাবে বলে।বিয়ে বাড়ি আশেপাশে লোকজন এদিক সেদিক ছুটে বেরাচ্ছে।এবার মিলির খুব অস্বস্তি হতে লাগলো।
“আপনি এভাবে কেন নিচে বসে আছেন সাব্বির ভাই?উঠুন।
” না আগে বলো তুমি আমায় বিয়ে করবে কি না।
“আশ্চর্য আমি যদি রাজি না হই আপনি কি এভাবেই বসে থাকবেন।তাছাড়া কেউ দেখলে কি ভাববে?
” সেটা তো আমি ভাববো না তুমি ভাববে।তুমি হ্যাঁ না বললে আমি উঠছি না দ্যাটস ফাইনাল।
“ঠিক আছে তাহলে আপনি বসে বসে মশার কামড় খান। আমি গেলাম কেমন।
” যা সত্যি সত্যিই চলে গেলো? কি পাষাণীর প্রেমে পরলি রে সাব্বির ধুর।
রাত প্রায় ১২টা ছুই ছুই।নুহাশ সবে মাত্র ঘরে এলো।বাইরের সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা সব দেখে নিশ্চিত হয়ে তবেই ঘরে এসেছে।পরিবারের এক ছেলে হলে যা হয় তাও আবার বড়। ভাগ্যিস সাব্বিরের মতো কিছু বন্দু ছিলো নইলে নুহাশের একার অবস্থা হতো ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি।একটা বিয়েতে যে কতো ঝামেলা।হঠাৎ করেই বাবার কথা মনে পরে গেলো নুহাশের।বাবা বেঁচে থাকলে কি নুহাশের এতো কষ্ট করতে হতো?
ছোয়া ঘুমিয়ে আছে গুটিশুটি হয়ে।হালকা শীত শীত আমেজ।পাতলা কম্বল টা জরিয়ে দিলো প্রান প্রিয় স্ত্রীর গায়ে।কারো স্পর্শ পেয়ে ঘুম হালকা হয় ছোয়ার।নুহাশকে দেখে এক গাল হেসে ওঠে।
“কখন এলেন?
” মাত্রই। উঠছো কেন শুয়ে থাকো।
“আপনার খাবার দিতে হবে তো।
” খেয়েছি।তুমি খেয়েছিলে?
“হ্যাঁ স্যুপ খেয়েছিলাম।
” মানে কি ছোয়া স্যুপ এ কারো পেট ভরে?দাঁড়াও আমি ফল কেটে আনছি সবগুলো খেতে হবে।
“আরে আমি এখন কিছুই খাবো না।আপনি একটু আমার পাশে বসুন না প্লিজ।
” আচ্ছা শুয়ে পরো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
নুর এখনো ঘুমোয়নি।তার চোখে ঘুম নেই।কাল ভাই মাকে ছেড়ে চলে যাবে বলেই আজ তার মন খারাপ।যতই ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে যাক না কেন এই মানুষ টাকে পেতেও তো নুরের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।
নাহার বেগম আজ মেয়ের সাথেই ঘুমিয়েছেন।পানি তৃষ্ণা পাওয়ায় উঠে নুরকে না দেখে একটু ঘাবড়ে যান তিনি।পরে দেখলেন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে মেয়ে।
“কি রে না ঘুমিয়ে এখানে কি করছিস।ঠান্ডা পরেছে আয় ঘুমোবি।
” একটু থাকো না মা।আমার কেন যেন কিছুই ভালো লাগছে না।কেমন যেন একটা কষ্ট হচ্ছে।
“সেকি কি হয়েছে তোর।কষ্ট লাগছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো।দাঁড়া আমি নুহাশকে ডাকছি।
” মা আমার কিছু হয়নি এতো হাইপার কেন হচ্ছো।আর ভাইয়া সবে মাত্র ঘরে গেলো ডাকাডাকি করো না তো।
“তাহলে বললি কেন কষ্ট হচ্ছে?
” আসলে তোমাদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।তাই ভালো লাগছে না।কি অদ্ভুত তাই না মা।ছোট থেকে যেখানে থাকলাম,যাদের খেয়ে পরে বড় হলাম এখন নাকি সেটাই আমার আসল যায়গা নয়।আসল যায়গা কোথায় শশুর বাড়ি।আমি বিয়ে কিরবো না মা।
“পাগলি।সব মেয়েদেরই এই ত্যাগ টা করতে হয়।আর বিয়ে করবি না মানে কি? এভাবে কেউ বলে বিয়ে তো একদিন করতেই হবে এটাই তো নিয়ম রে।
ঘড়ির কাটায় রাত দুটো বেজে পনেরো মিনিট। নুহাশ খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে আর ছোয়া নুহাশের বুকে মাথা দিয়ে।মুলত ছোয়ার জন্যই এভাবে আধশোয়া হয়ে আছে নুহাশ নয়তো ছোয়ার অসুবিধা হবে।
” দুটো বাজে তুমি এখনো কেন জেগে আছো বলতো?
“ঘুম আসছে না তো আমি কি করবো!
” এভাবে থাকলে কি ঘুম হবে তার জন্য তো ভালো করে শুতে হবে নাকি।
“আপনার কি খারাপ লাগছে এভাবে আমাকে রেখে।ঠিক আছে উঠে যাচ্ছি আমি।
” আমি কি সেটা বলেছি? তুমি যত ইচ্ছে এভাবে থাকো আমার একটুও খারাপ লাগবে না।
“আচ্ছা আপনি ছেলে হলে খুশি হবেন নাকি মেয়ে?
” আল্লাহ যা দিবেন আমি তাতেই খুশি।
“বলুন না। অনেকেই তো আছে ছেলে চায় আপনার এমন কোনো ইচ্ছে নেই?
” না। আমার একটাই চাওয়া যেই আসুক সে এবং তুমি দুজনেই যেন সুস্থ থাকো।আর কিচ্ছু চাই না।
“আর যদি আমি মারা যাই।যদি ডক্টর বলে হয় বাচ্ছা না হয় মা আপনি কোনটা বেছে নিবেন?
” ছোয়া!
“আরে আমি তো মজা করছি এভাবে কেউ ধাক্কা দেয় যদি পরে যেতাম।ধুর মেজাজ টাই খারাপ করে দিলো।আমার ঘুম পেয়েছে গুড নাইট।
নুহাশ আর কিছুই বললো না।ছোয়া কথাটা মজা করে বললেও নুহাশই জানে তার বুকে কথাটা তীরের মতো বিধেছে।নুহাশ দেখলো ছোয়া ঘুমিয়ে গেছে।
” কেন এসব বলো ছোয়া।যদি এমন পরিস্থিতি আসে আমি সত্যিই জানি না তখন কি করবো।না আমি আমার সন্তানকে মারতে পারবো আর না তোমাকে। আমি দুজনকেই চাই।আমি ভালো বাবা হতে চাই।ভালো স্বামী হতে চাই।দ্বিতীয় কোনো নুহাশ হোক সেটা আমি চাই না। আল্লাহ যেন এমন সিচুয়েশন আমাকে না দেন।
★
সকাল থেকে নুহাশের ব্যাস্ততা বেড়ে গেলো।ছোয়ার কোনো কাজ নেই সে শুধু বসে বসে এদিক সেদিক লক্ষ্য করে যাচ্ছে।এদিকে নুরকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে মেয়েরা এসেছে।সাথে বাকি মেয়েদেরও সাজিয়ে দিবে।
মিলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কাল ছাদ থেকে আসার পর সে সাব্বিরকে আর দেখেনি।তাহলে লোকটা কষ্ট পেয়েছে? নাকি রাগ করে চলে গেছে। কাউকে তো বলতেও পারবে না এই কথা।
“কি ব্যাপার মিলি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো যে?
” কিছু না ম্যাম এমনিতেই।
কথা এড়াতেই সেখান থেকে চলে গেলো মিলি।ছোয়া সবটাই জানে।নুহাশ বলেছে সাব্বিরের থেকে শুনে।সে নিয়ে দুজনেই খুব হেসেছে।আপাতত সাব্বির গেছে মিলির বাবাকে আনতে।ছোয়া বিশেষ ভাবে ইনভাইট করেছে তাকে।সাব্বিরের ব্যাপারেও সব বলেছে।এতে তিনি অমত করেন নি।মেয়ে একা থাকে বিধায় তারও খুব চিন্তা হয়।বয়স হয়েছে মেয়ের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখার ইচ্ছা সব বাবা মায়েরই।তিনিও সেদিক থেকে ব্যাতিক্রম না।সবাই মিলে প্ল্যান করেছে নুরের সাথে মিলির বিয়েটাও দিয়ে দেবে।কিন্তু এ বিষয়ে মিলিকে কিছুই জানানো হয়নি।
বর যাত্রী এসে গেছে।অনেকদিন পর বাবাকে পেয়ে মিলি তার থেকে সরছেই না।বাবা মেয়ে মিলে অনেক গল্প করলো।
কাজি নুরের বিয়ে পরানোর আগে নুহাশ সাব্বির এবং মিলির বিয়ের কথাও ঘোষণা করে দিলো।এটা শুনে মিলির কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। শেষে যখন মিলির বাবা সবটা বুঝিয়ে বললো তারপর মিলিও রাজি হয়ে গেলো।বিদায়ের সময় আবারও কান্নার রোল পরে গেলো।নুরের পর মিলিরও বিদায়ের পালা এলো।মিলির কান্না যখন কিছুতেই থামছিলো না সাব্বির এক প্রকার বিরক্ত হয়ে গেলো।এতো কান্না করার কি আছে সেটাই বুঝতে পারছে না।
“এভাবে কাঁদছো কেন? আমি কি মারা গেছি?
কথাটা শুনে কটমট চোকে সাব্বিরের দিকে তাকালো মিলি।
” ম্যাম আমি এই ছেলের সংসার করবো না।বিয়ের দিনই আকে এভাবে বলছে না জানি এখান থেকে যাওয়ার পর কি ব্যাবহার টাই করবে।
“আমি আবার কি বললাম আজব তো!
” তোমার ম্যাম ও শুরুতে এটাই বলেছিলো বুঝলে মিলি।কিন্তু দেখো এখন সে আর বাচ্চার মা হতে যাচ্ছে।যাই হোক অনেক ঝগড়া করেছিস।পারলে মারামারি কর কিন্তু এখান থেকে বিদায় হ আগে।
নুহাশের কথায় বাকিরাও এবার শব্দ করে হেসে দিলো।অত:পর মিলিও চলে গেলো।মিলিরা চলে যাওয়ার পর কাছাকাছি যারা আত্নীয় ছিলেন এবার তারাও একে একে যার যার বাড়ি চলে গেলেন।রইলো মিলির বাবা,লুবনা বেগম আর নুহাশের চাচা চাচি এবং বাকি কাজিনরা।
ছোয়া ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে নুরের বিয়ের সব ছবি দেখছিলো।হঠাৎ করেই হাতের ফোনটা নিচে ফেলে দেয়।কিছু পরার শব্দে নুহাশ ফিরে তাকায়।ছোয়ার চোখমুখ দেখেই সে বুঝে গেলো প্রসবের সময় হয়েছে।বিপুলকে গাড়ি বের করতে বলে ছোয়াকে কোলে তুলে নেয়।বিপুল গাড়ি বের করে নাহার বেগম,লুবনা বেগমকে ডাকে।ততক্ষণে নুহাশ ছোয়াকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছে সাবধানে।বিপুলকে বলে বাকিরা যারা আসবে তাদের নিয়ে আসতে।
ছোয়াকে ওটিতে নেয়া হয়েছে।নুহাশ পায়চারি করেই যাচ্ছে তখন থেকে।সাব্বির বা রোহিত কাউকেই খবর দেয়া হয়নি।আজ ওদের বিশেষ রাত এখন বিরক্ত করাটা ঠিক মনে হয়নি নুহাশের।
নাহার বেগম ছেলেকে সান্তনা দিয়ে যাচ্ছে।
“চিন্তা করো না আব্বা সব ঠিক হবে।ছোয়া আর বাচ্চা সবাই ভালোই থাকবে দেখো।
” দোয়া করুন আম্মা তাই যেন হয়।
একটু পর কেবিন থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা গেলো।নার্স বাইরে এসে খবর দিলো তাদের একটি মেয়ে হয়েছে।মা এবং বাচ্চা দুজনেই ভালো আছে।একটু পর কেবিনে শিফট করা হবে তখন সবাই দেখা করতে পারবে।সবকিছু শুনে নুহাশ যেন স্বস্তি পেলো।
রাতে সেখানে শুধু লুবনা বেগম,নাহার বেগম এবং নুহাশ রইলো।বাইরে অবশ্য গার্ড আছে দুজন। বিপুলকে সবাইকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
নাহার বেগম আর লুবনা বেগম বাইরে বসে আছে।নুহাশ মেয়েকে কোলে নিয়ে বার বার চুমু খাচ্ছে।সাথে ছোয়াকেও বাদ রাখেনি।
“আপনি খুশি হয়েছেন নুহাশ?
” অনেক।ধন্যবাদ তোমাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার দেয়ার জন্য।
সকালে নুর এবং মিলি এলো।ফজরের নামাজ পরে ওদের খবর দিয়েছে নুহাশ।
“তুমি এমন কেন ভাইয়া আমাকে আগে কেন বলনি?
” বললেই কি তখন আসতে পারতি।তাছাড়া ওবাড়িতে এতো লোকজন ছিলো সবাইকে রেখে এখানে আসাটা ঠিক হতো না তাই বলিনি।
ছোয়ার শারীরিক ককন্ডিশন ভালো থাকায় পরদিনই ওকে বাড়িতে নিয়ে গেছে নুহাশ।বাড়িতে বেশ রমরমা পরিবেশে। সবকিছু দেখে নুহাশের এটাই মনে হলো এইতো আমার পরিবার। আমার পুর্নতা।এই জীবনে আর কিইবা চাওয়ার থাকতে পারে।
“আপিনি ভুল বলছেন নুহাশ আমার নয় আমাদের পুর্নতা।
” আচ্ছা ওর ডাক নাম পুর্নতা রাখলে কেমন হয় ম্যাম?
“বাহঃ ভালো কথা বলেছো তো।আমি এই নামেই ডাকবো।
” ঠিক আছে আমরা সবাই এই নামেই ডাকবো।” নুহাশ ছোয়ার পুর্নতা”।
সেদিনের পর কেটে গেছে দুদিন। নুহাশ এখন আগের থেকে স্বাভাবিক। নুহাশকে যখন বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয় নাহার বেগম প্রায় এক ঘন্টা ছেলেকে বুকে জরিয়ে ছিলেন।নুহাশ তার খুব যত্নের। নুহাশকে তিনি মনে প্রানে নিজের বড় সন্তান ভাবেন।তাই তো দিনের অর্ধেক সময় ছেলের অপেক্ষাতেই কাটে তার।
সেদিনই লুবনা বেগম ও ফিরে এসেছেন ছোয়াকে কিছু না জানিয়েই।তবে এতে ছোয়া কিছুই বলেনি।সেও মাকে খুব মিস করছিলো।
এরশাদ শিকদারের দুই বছর কারাদণ্ড এবং দুই বছর পর ফাঁসির রায় দিছে আদালত।এতে অনেকটাই ভেঙ্গে পরেছেন তিনি।শামসুল শিকদারের ১০ বছর জেল এবং তার পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এই সব অবৈধ কাজের সাথে জড়িত থাকার জন্য।যদিও ছোয়া এই রায়ে মনে মনে খুশি নয়।সে চেয়েছিল বাবার খুনিকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে।তবে নুহাশের জন্য সেটা আর করেনি।
অনেকদিন পর চৌধুরী বাড়িতে যেন প্রান ফিরে এলো।নুর আগের মতো চঞ্চল হয়ে গেছে।রোহিতের সঙ্গ পেলে মেয়েটা সব অতীত ভুলে যায় মুহুর্তেই।
“আচ্ছা আপনি তো বললেন না এরশাদ শিকদারের নারী পাচারের খবর আপনি কোথা থেকে পেলেন? আর এসব ওই মুহূর্তে কেই বা আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলো? আমি সেদিন শুধু ফোনটাই দেখেছিলাম সাথে যে আরো কিছু ছিলো খেয়ালই করিনি।ভাগ্যিস মিলি সেটা দেখেছিলো।
” ম্যাজিক মেডাম।তুমি এখনো অনেক কিছুই জানো না।
“আচ্ছা আরো কিছু জানার বাকি আছে বুঝি?
” হ্যাঁ। চলো আমরা বেরুবো।
“কিন্তু কোথায়?
” চলোই না দেখতেই পাবে।
বেশ কিছুক্ষণ পর ছোয়া দেখলো তাদের গাড়িটা কারাগারে সামনে এসে থামলো।ছোয়ার জানা মনে এটা সেই কারাগার যেখানে এরশাদ শিকদার এবং শামসুল আছে।
“আমরা এখানে কেন এলাম নুহাশ?
” বললাম না তোমাকে কিছু জানানোর আছে।এখন কথা কম শুধু আমাকে ফলো করো।
গাড়ি থেকে নেমেই ইন্সপেক্টর সাব্বির কে দেখা গেলো।তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে সাব্বির। নুহাশের সাথে হাত মেলালো।
“এসে গেছিস। তোদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
” হুম।সব ব্যবস্থা আছে তো।কোনো সমস্যা হবে না?
“একদম না।তার জন্য তো আমি আছি।তবে হ্যাঁ যত দ্রুত সম্ভব কথা শেষ করতে হবে।বুঝতেই পারছিস বিষয় টা।
“বেশি সময় লাগবে না।চিন্তা করিস না।চলো ছোয়া।
একটা রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে এরশাদ শিকদারকে।মাথার উপরে বড় একটা লাইট ঝুলে আছে।সামনে একটা কাঠের টেবিল আর দুটো চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই তেমন।দরজা ঠেকে ভেতরে প্রবেশ করে নুহাশ সাথে ছোয়া।শিকদার কে দেখে ছোয়া ভ্রু কুচকে তাকায় নুহাশের পানে।তার চোখমুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।আর তারা এখানেই বা কেন এলো।নুহাশ ছোয়ার অবস্থা বুঝে ফিসফিস করে বললো-
” এখনই সব বুঝতে পারবে।একটু অপেক্ষা করো।
“কেমন আছেন বাবা!
কারো বাবা ডাক শুনে পিছনে ফিরে তাকায় এরশাদ শিকদার। তার মানে নুহাশ সব জেনে গেছে?তাকে জানতে দিবে না বলেই তো আলহাজ্ব চৌধুরীকে খুন করেছিলো সে।যদিও সোলাইমানের বিষয় টাও সে জানতো তবে এই সত্যি টা নুহাশ জানতে পারুক সেটা তিনি চাননি। এরশাদ শিকদারের ভাবনার মধ্যেই নুহাশ ছোয়াকে নিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পরলো।
” কি ঝটকা লাগলো?
আমারও লেগেছিলো।যখন আমি জানতে পেরেছিলাম আপনার মতো নোংরা লোকটা আমার জন্মদাতা।
“তুমি!
” সব জানি।বিশ্বাস করুন আমার একটুও খারাপ লাগেনি আপনাকে এই অবস্থায় দেখে।আপনি আমার সব কিছু কেরে নিয়েছেন।আমার বাবাকে।আমার সুন্দর একটা জীবনকে।এমনকি আমার জন্মদাত্রী মাকেও।
“কিন্তু তোমার মাকে আমি মারিনি।সে নিজেই সু*ই*সা*ই*ড করেছে।
” হ্যাঁ। কিন্তু তার জন্য দায়ি ছিলেন আপনি।আপনি যদি আমার মাকে মেনে নিতেন আমাকে মেনে নিতেন তাহলে আমার মা এভাবে নিজেকে শেষ করতো না।কি ভাবছেন এতো কিছু জেনেও কেন আমি এতোদিন কিছু বলিনি আর সেদিন কোর্টেও কেন এই বিষয় টা সামনে আসেনি তাই তো?কারণ আমি চাইনি আমাকে আপনার ছেলে হিসেবে কেউ চিনুক এবং আমার মায়ের সম্মন্ধে কেউ খারাপ ধারণা করুক।এখন কি করবেন? যে সত্য প্রকাশ এর ভয়ে আপনি এতোগুলো খুন করলেন সেই সত্যি তো সবাই জেনে গেছে।
“কিন্তু আমার সহপাঠীদের আমি মারিনি। এর পিছনে তুমিই আছো তাই না?
” আমরা আছি।কিন্তু এতে তো কোনো লাভ নেই।কারন আপনার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
একবার ভেবেছিলেন সদ্য জন্ম নেয়া একটা শিশু ওই বৃষ্টির রাতে ওভাবে যদি মরে যেত,যদি কোনো কুকুর বেড়াল খেয়ে নিতো।কিভাবে পারলেন এমনটা করতে।আরে মেনে না নিয়েছেন একটা এতিম খানায় রেখে আসতেন।কিন্তু আপনি কি করলেন সোজা ডাস্টবিন!আমার মাকে তো ভালোবেসেই কাছে টেনেছিলেন তাহলে আমার বেলায় তিক্ততা কেন? এখন থেকে যতদিন এখানে থাকবেন মরার আগ পর্যন্ত এই সত্যি টা আপনাকে কুরে কুরে খাবে।
নুহাশ ছোয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।ছোয়া এখনো একটা ঘোরে আছে।তার মানে নুহাশের আসল বাবা এরশাদ শিকদার। নুহাশ এটা জানতো।সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু ইন্সপেক্টর সাব্বির! সে কি নুহাশের আপন কেউ?
“আচ্ছা নুহাশ-
” আমি জানি তুমি কি জানতে চাও।সাব্বিরের সাথে আমার কি সম্পর্ক তাই তো?
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেন?
” আমি তোমার সবকিছুই বুঝতে পারি।সাব্বির আমার ছোট বেলার বন্ধু।তাছাড়া সাব্বিরের বাবার সাথে আমার বাবার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো।সাব্বিরের মা ছিলো না।ও ওর বাবাকে নিয়ে দেশের বাইরে থাকতো।আংকেল একদিন স্ট্রোক করে আর তারপর থেকে বাবাই ওর সব দায়িত্ব নিয়ে ওর লেখাপড়ার খরচ চালায়।এতোদিন দেশের বাইরেই ছিলো।বছর খানেক হলো বাংলাদেশ এসে এখানে জয়েন করেছে সেটাও আমি চেয়েছিলাম বলে।এই যে তোমার এতো ইনফরমেশন, এসবকিছুই সাব্বির মেনেজ করতে হেল্প করেছে।তাছাড়া আমার সমস্ত গোপনীয় কাজ সাব্বিরই করে দেয়।বুঝলে?
“তার মানে সেদিন এরশাদ শিকদারের বাংলো থেকে আসার সময় আমার পিছু যে করছিলো সেটা উনিই ছিলো।
” হ্যাঁ ভাবি আমিই ছিলাম।
“আপনারা যে এতো দুরন্ত আগে বুঝতে পারিনি।
” আমরাও বুঝিনি আপনি এতোটা বুদ্ধিমতি।
★
সেদিন কারাগার থেকে ফেরার পর এরশাদ শিকদার অনেক সময় নিয়ে সেই রুমে বসে ছিলেন।অনেক সমীকরণ মিলিয়ে শেষে একটাই সমাধান তা হলো তার পাশে কেউ নেই।যেই সুখের জন্য যাদের জন্য তিনি এতো কিছু করেছেন তারা তার এই দুঃসময়ে তার পাশে নেই।পাশে থাকা তো দূর তার সাথে কেউ দেখাও করেনি এখনো। এতোদিন সত্যি না জানলেও এবার নুহাশের জন্য একটা কষ্ট অনুভব করলো শিকদার সাহেব।
নুহাশের মা রেবেকা সম্পর্কে এরশাদের ক্লাসমেট ছিল। এরশাদ শিকদারকে খুব ভালোবাসতেন তিনি।কিন্তু এরশাদ শিকদার তার স্ত্রী লুসিকে ভালোবাসত।
লুসি একজন খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে।বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে।অন্যদিকে রেবেকা খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে।টাকার লোভে রেবেকাকে প্রায় পায়ে ঠেলেছিলেন এরশাদ। লুসি এই বিষয় এখনো জানে না।কিন্তু রেবেকাকে ভোগ করার লোভ বরাবরই ছিলো এরশাদের।সেটা সে পেয়েও গেছে।লুসিকে বিয়ের এক সপ্তাহ পর জানতে পারে রেবেগা প্রেগন্যান্ট। তখন থেকেই রেবেকার সঙ্গে দুরত্ব বাড়ায়।রেবেকা স্ত্রীর অধিকার চায়নি।শুধু নুহাশের জন্য একটা আশ্রয় চেয়েছিলো সেটাও দেয়নি।যখন শুনলো তার তিনদিনের শিশুকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে রেবেকা সেটা মেনে নিতে পারেনি।সমাজের লোকজনের গালমন্দ তো ছিলোই সেই সাথে সন্তান হারানোর শোক মেনে নিতে না পেরেই আত্ন*হ*ত্যার পথ বেছে নেন।ঘটনার অনেক বছর কেটে গেছে কিন্তু রেবেকাকে এখনো ভুলতে পারেনি এরশাদ।আজ এতোগুলো বছর পর মনে হচ্ছে লুসি নয় রেবেকাই তাকে সত্যিকারের ভালোবাসত।কিন্তু এখন আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।নুহাশের চোখে তার জন্য সে ঘৃনা দেখেছে।তাই নুহাশরা চলে যাওয়ার পর তিনিও আত্নহত্যা করেন।
পরের দিন খবরের কাগজে এই খবর পড়ে নুহাশ।একটু তো খারাপ লাগেই কিন্তু সেটা ভেতরেই রয়ে যায়।ছোয়া বুঝতে পারে নুহাশের কষ্ট কিন্তু বাবা হারানোর শোক সেও ভোগ করেছে।আর যার জন্য সে বাবাকে হারিয়েছে তার মৃত্যুতে একটুও খারাপ লাগেনি ছোয়ার।
ছোয়ার প্রেগ্ন্যাসির ৯ মাস চলছে। নুরের পরিক্ষা শেষ। কথা অনুযায়ী নুর এবং রোহিতের বিয়ে হবার কথা নুরের পরিক্ষার পরে।তাই বিয়ের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।এই সপ্তাহেই নুরের বিয়ে। বাড়ির বড় বউ হিসেবে ছোয়ার অনেক কাজ সাথে যোগ দিয়েছে মিলিও। ইদানীং মিলি কেমন যেন মন মরা হয়ে থাকে।বিষয়টা ছোয়া খেয়াল করলেও কখনো জিগ্যেস করতে পারেনি। মিলি সবসয় এড়িয়ে গেছে বিষয় টা। আজ ছোয়া জিগ্যেস করেই ফেললো।
“কোনো সমস্যা মিলি তোমাকে বেশ কিছুদিন ধরেই কেমন যেন অন্যমনস্ক লাগছে।কি হয়েছে বলো আমায়।
” কি..কিছু না ম্যাম ওই একটু প্রেশার যাচ্ছে তো তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে।আসলে এসব তো আগে কখনো করিনি।
“মিথ্যে বলো না তো।তোমাকে আমি অনেকদিন ধরেই দেখছি কখনো কোনোকিছুতে তোমাকে টায়ার্ড হতে দেখিনি।সত্যি করে বলো মিলি কি হয়েছে।
” আসলে ম্যাম শিহাবের সাথে একটু সমস্যা হয়েছে তাই।
“শিহাব তোমার ওই বয়ফ্রেন্ড?
” হ্যাঁ।
“কি সমস্যা শুনি?
” ওর বিয়ে ঠিক করেছে পরিবার।মেয়ে অনেক ধনি পরিবারের। শুনেছি তারা মোটা অংকের যৌতুক দিবে সাথে বাইক।আমি যদি এই বিয়েটা আটকাতে চাই তাহলে যেন এক কোটি টাকা দেই।কিন্তু ম্যাম বিশ্বাস করুন আমার কাছে এতো টাকা নেই।থাকলে আমি একবারও ভাবতাম না।ও জানে যেই ফ্ল্যাটে আমি থাকি সেটা আমার নামে আর এটাই ও চাইছে ওর নামে করে নিতে।কিন্তু এই ফ্ল্যাট টা আমার বাবা অনেক কষ্টের টাকায় কেনা। আমার নামে ঠিকই কিন্তু আমি এটা কাউকে দিতে পারি না।
“হুম বুঝলাম।দেখো মিলি যেই ছেলে তোমার কাছে ভালোবাসা পেতে অপশন রাখে এবং কোনো ডিমান্ড করে সেই ছেলে আর যাই হোক কখনোই ভালোবাসেনি।তাই বলবো যা করবে ভেবে করবে।তুমি আমার ছোট বোনের মতো।মতো কেন বলছি আমার মা তোমাকে কতটা ভালোবাসে তা তো জানই তুমি আমার ছোট বোন।নুর আমার কাছে যেমন সত্যি বলতে তুমিও তেমনই।তাই আমি বলবো এমন ছেলে তুমি ডিসার্ভ করো না।তাই যে যেতে চায় তাকে যেতে দাও।দেখবে সঠিক সময়ে তোমার যোগ্য কেউ ঠিক তোমার কাছে চলে আসবে।
” বুঝতে পেরেছি ম্যাম।থ্যাঙ্কিউ। আসলেই আপনি আমার বড় বোন।আই লাভ ইউ ম্যাম।
“আরে আস্তে আমার বউ ব্যাথা পাবে তো এভাবে কেউ জরিয়ে ধরে।
নুহাশের কথায় দুজনেই তার দিকে ফিরে তাকালো।মিলি ভ্রু কুচকে বললো।
” বিয়ের আগে আপনার বউকে আমিই আগলে রেখেছি ভাইয়া।আমি সারাক্ষণ আপনার বউ এর আশেপাশে থেকেছি।এমনকি আপনার বউয়ের বেড রুমেও।
“হুম এবার দাঁড়াও তোমার বেড রুমে বিপরী কারোর থাকার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি।আর এই যে বউ তখন থেকে তো এদিক সেদিল খেয়াল রাখছো বিয়ের এখনো চার দিন বাকি।তাই এতো কিছু দেখতে হবে না।সবকিছু দেখতে গিয়ে যে নিজের খেয়াল রাখছো না। খেয়েছো সকালে?
” ভুলেই গেছিলাম।আপনিও তো খাননি চলুন আমি খাবার দিচ্ছি।
“আমাকে নিয়ে ভাবার সময় তোমার আছে?যাই হোক তোমাকে এখন কিছুই কিরতে হবে না।ঘরে চলো আমি খাবার রেখে এসেছি এখনই খেয়ে নিবে।
ছোয়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ঘরে নিয়ে গেলো।নিজের হাতেই খাইয়ে দিলো ছোয়াকে।বিকেলে সবাই গেলো শপিং করতে।নাহার বেগম আর নুহাশ থেকে গেলো।বিপুলকে পাঠানো হলো নুরের সাথে। সাথে অবশ্য নুরের কাজিনরা,মিলি,সাব্বিরও আছে।সাব্বির মুলত যাচ্ছে মিলির জন্যই।শুরু থেকেই মিলিকে সাব্বিরের পছন্দ। আগে কোর্টে, থানায় বিভিন্ন কাজের জন্য ছোয়ার সাথে দেখা যেত মিলিকে।মিলির রেগে রেগে চোখমুখ কুচকে কথা বলা সাব্বিরের খুব ভালো লাগে।কিন্তু মিলির বয়ফ্রেন্ড আছে যেনে সেদিকে আর পাত্তা দেয়নি সাব্বির। তবে আজ মিলির মন খারাপ দেখে ওর কেমন যেন লাগছে।তাই না চাইতেও মিলির দিকে বার বার দেখছে।একসময় মিলি খেয়াল করলো সাব্বির ওকে দেখছে।
” কিছু বলবেন সাব্বির ভাই?
“না তো।
” ঠিক আছে।
শপিং এ সবার জন্যই কেনাকাটা করা হলো।কিন্তু মিলি কিছুই নিলো না।সাব্বির সবার আড়ালে মিলির জন্য একটা শাড়ি নিলো।সাথে প্রয়োজনীয় সবকিছুই। এটা ছোয়াকে দিয়েই মিলিকে দিবে। সাব্বির খুব ভালো করেই জানে তার থেকে মিলি এটা নিবে না।
“সবার কেনাকাটাই তো হলো।গায়ে হলুদের শাড়ি কেনা বাকি।আচ্ছা মিলি আমার রিসিপশনের জন্য কি নিই বলতো শাড়ি নাকি লেহেঙ্গা?
” তুমি যেটাতে কম্ফোর্ট হও সেটাই নাও নুর আপু।
“তা বললে হবে।আচ্ছা তুমি কোনটাতে কম্ফোর্ট হও?
” আমার বরাবরই শাড়ি পছন্দ। তাহলে চলো শাড়িই নেবো।আর আমি তুমি একই রকমের শাড়ি নিবো বুঝলে।ভাবির জন্য ভাইয়া নিজেই ড্রেস নিবে তাই আমি আলাদা নিতে চাই না।
“আমি কেন।আমার কিছু লাগবে না নুর আপু।আমার অনেক ড্রেস আছে যেগুলো এখনো পড়া হয়নি।তুমি নিজের জন্যই নাও না।
” মামা এই মেরুন রঙের শাড়ি দুটো প্যাক করে দিন তো।আর ওই যে গোল্ডেন কাজ করা লেহেঙ্গা সেটাও দিবেন।শাড়িটা ভাইয়ার তরফ থেকে আর লেহেঙ্গা আমার তরফ থেকে।
“এসবের দরকার ছিলো না নুর আপু!
” খুব দরকার ছিলো। আচ্ছা তুমি ভাবলে কি করে তোমাকে ছাড়াই আমি আনন্দ করবো? তুমি তো আমার পরিবারের একজন তাই না।আর আমি না তোমার বড়। বড়দের কথা মানতে হয় বুঝলে।
খুশিতে মিলি নুরকে জরিয়ে ধরলো।আসলে এই পরিবার দুটোর মানুষগুলো তার আপনই মনে হয়।এদের মধ্যে থাকলে কখনো মনেই হয় না ও বাইরের কেউ।
বিয়ের তোরজোর চলছে পুরো দমে।সাব্বিরকে এতোদিন সবাই সেভাবে না চিনলেও ওর পুরো পরিচয় দেয়ার পর সবাই খুব সহজেই মেনে নিয়েছে।ছোট বেলায় সাব্বিরকে নাহার বেগন দেখলেও সেটা অনেক আগের কথা।তাই প্রথম দেখায় চিনতে পারেনি।
আজ বাদে কাল বিয়ে।আজ গায়ে হলুদ।এদিকে সাব্বির মিলির জন্য আনা শাড়িটা এখনো দিতে না পেরে কেমন অস্থির করছে।নুহাশ সাব্বিরকে জিগ্যেস করলো এমন কেন করছে।এতোদিন লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা সাব্বির আজ নুহাশের কাছে প্রকাশ করে দিলো।সব শুনে নুহাশ একটা হতাশার নিশ্বাস নিলো।
“ভাই তুই এমন একটা মেয়ের প্রেমে পরেছিস না যে সারাজীবন তোকে জালিয়ে মারবে।যাই হোক ছোয়ার থেকে শুনেছি মিলি যাকে ভালোবাসত তার বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক হয়েছে।মিলিও এখন তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে না।সবকিছু মিলিয়ে বেচারির মন খারাপ।তুই কেন তোর অনুভূতির কথা ওকে বলছিস না?
” পাগল যে মেয়ে দেখা গেলো এই অপরাধে আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিলো অথবা গুলি করে মারলো।
এখন এই শাড়িটা কিভাবে দেবো সেটাই বুঝতে পারছি না।তুই ভাবিকে দিয়ে দেয়া না প্লিজ।
“আমি কেন দিতে যাবো তুই দে না।ভালোবাসিস তুই আমি আমার বউ কোনো হেল্প করতে পারবো না।
” তুই না আমার বন্ধু প্লিজ এই উপকারটা কর আমার।আমি চাই আজ এটা মিলি পরুক প্লিজ।