Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 399



সে আমারই পর্ব-১২+১৩

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১২

ক্লান্তিতে দু চোখে যখন ঘুম নেমে এসেছে, তখনই তীব্র ঝাঁকুনিতে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল তার। কপাল কুঁচকে বলল,

“খেতে তো দিবি না, অন্তত ঘুমাতে দে। খুব ক্লান্ত আমি।”

দৃষ্টি চাপা কন্ঠে বলে,

“আফরান ভাই! উঠুন, খাবার এনেছি আমি। খেয়ে নিন।”

আফরান চোখ মেলে উঠে বসল। পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,

“সত্যি খাবার এনেছিস! আমি তো ভেবেছিলাম তোর বাপ সব সাবাড় করে ফেলেছে।”

“আফরান ভাই! আপনি সব সময় বাবাকে নিয়ে এমন করেন কেন?”

“তো করব না? সেদিন ভাইকে নিয়ে তোদের বাড়িতে এলাম কতদিন পর বেড়াতে। আর তোর বাপ করলটা কি? হ্যাঁ? করলটা কি? শুধু চমচম দিয়ে কাজ সেরে নিল? একটু রসমালাই আনলে কি হতো? জামাই মানুষ একটু ভালো করে আপ্যায়ন করবে না?”

অতঃপর আফসোসের কন্ঠে বলল,

“বুঝলি দৃষ? তোর কপাল খুব খারাপ। তোর জামাই তো তোকে উঠতে বসতে পে’টাবে। বিয়েতে তোর বাপ দেবে ভাঙা খাট, ভাঙা আলমারি, সস্তা জিনিসপত্র। এর জন্য তোকে শশুর বাড়িতে উঠতে বসতে কথা শোনাবে।”

দৃষ্টি চোখ গরম করে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“ওসব নিয়ে আপনাকে এতো চিন্তা করতে হবে না। আপনার শশুর বাড়িতে তো আপনাকে দরজা থেকেই তাড়িয়ে দেবে। আর আপনি যে রসমালাই খাবেন, সেটা কি বাবা জানত? আপনি কীভাবে ডাক্তার হলেন আমি বুঝি না, একটুও তো স্বাস্থ্য সচেতন নন। আপনার থেকে তূরাগ ভাইয়া বেশ স্বাস্থ্য সচেতন।”

“হ্যাঁ! উচিত কথা বললে তো এখন খাবার খোঁটা দিবি। তোর বাপের..”

“চুপ! একদম চুপ। এক্ষুনি বিছানা থেকে নামবেন। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হবেন। তারপর খেয়ে নেবেন এবং আমাকে উদ্ধার করবেন। যান।”

দৃষ্টির ধমকে আফরান আর কিছু বলল না। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ল। এইটুকু মেয়ে তাকে ধমক দেয়! ভাবা যায়? ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আফরান পুনরায় বিছানায় আসন দখল করে। দৃষ্টি তাকে ইশারায় খেতে বলে। সে নিসংকোচ আবদার করে,

“খাইয়ে দিবি? হাতে খুব ব্যথা করছে।”

দৃষ্টি চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। আফরান মুখ গোমড়া করে বলে,

“সত্যি বলছি, হাতে খুব ব্যথা। থাক, আমি নাহয় খাব না।”

দৃষ্টি হাত ধুয়ে এসে প্লেট হাতে তুলে নেয়। ভাত মাখতে মাখতে বলে,

“আপনার ডাক্তার হওয়া উচিত হয়নি। আপনার চিত্রজগতে যাওয়া উচিত ছিল। খুব সহজে চান্স পেয়ে যেতেন। ভালো অভিনয় করতে পারেন।”

আফরান তার কথা গায়ে মাখল না। হা করে পড়ে রইল। বলতে চায়ল,

“তোকে একদম বউয়ের মতো লাগছে রে। ঠিক আমার বউয়ের মতো।”

তবে কথাটা মনের মধ্যেই চেপে রাখল। যদি দৃষ্টি রাগ করে? দৃষ্টির ছোট ছোট হাত থেকে একটু একটু করে খুব তৃপ্তির সাথে খাওয়া শেষ করল। তার মুখ মুছিয়ে দিয়ে দৃষ্টি নিজে হাত ধুয়ে নিল। আফরান হামি তুলে শুয়ে পড়ল। দৃষ্টি চোখ কপালে তুলে বলল,

“একি! শুয়ে পড়ছেন কেন? বাড়িতে যান।”

“তুই তোর বাপের মতোন রুড হয়ে যাচ্ছিস রে দৃষ। এই রাত বিরেতে তো একটা গরু ছাগল কেও বাড়ি থেকে কেউ বের করে দেয় না। আর সেখানে তো আমি জলজ্যান্ত একটা মানুষ। একটু তো দয়া কর।”

“আপনি!”

“প্লিজ দৃষ! মাথাটা প্রচন্ড ধরে আছে। একটু টিপে দে তো।”

মাথা ব্যথার কথা শুনে দৃষ্টি আর কিছু বলল না। নীরবে তার মাথার কাছে বসে আলতো হাতে চুলে আঙুল চালালো। আফরান আরাম পেল খুব। দ্রুত তার চোখে ঘুম নেমে এলো। ঘুমের ঘোরে অস্পষ্ট স্বরে বলল,

“ওই মৃন্ময়ের বাচ্চার থেকে দূরে থাকবি, দৃষ। ও’র নজর ভালো লাগে না আমার। কবে যে আমি ও’র ওপেন হার্ট সার্জারি করে দেব জানি না।”

বাক্যগুলো তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই সে ঠোঁট প্রসারিত করে। চোখ থেকে চশমা খুলে পাশে রাখে। ঘুমন্ত মুখের দিকে নিষ্পলক চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“এতো পা’গল কেন আপনি?”

আজ সকালে আর খাওয়ার সময় পেল না দৃষ্টি। বাবাদের সাথে থাকতেও পারেনি। রাতে দীর্ঘক্ষণ আফরান কে পর্যবেক্ষণ করার ফল এটা। ঘুমিয়ে পড়েছিল কখন সে জানে না। আবার ঘুম ভেঙেছেও দেরিতে। উঠে আফরানকে আশে পাশে দেখতে পায়নি। তারমানে লোকটা সকাল সকাল চলে গিয়েছে। আবার পাইপ বেয়ে নেমে গিয়েছে ভাবতেই সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে সে।

কলেজে দৌড়ে প্রবেশ করল দৃষ্টি। ক্লাস ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্লাসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল। অতঃপর ঢোক গিলে বলল,

“মে আই কাম ইন, স্যার?”

“ইউ আর ফাইভ মিনিটস্ লেইট, মিস দৃষ্টি।”

দৃষ্টি চোখ তুলে তাকায়। আজ যে প্রথম ক্লাসটা আফরানের সেটা তার খেয়ালে নেই। দৃষ্টি বিড়বিড় করে বলে,

“আপনার জন্যই তো আমার দেরি হলো।”

“মিস দৃষ্টি! কাম ইন।”

দৃষ্টি ভেতরে প্রবেশ করে। তবে আসন গ্রহণ করতে পারে না। আফরান জিজ্ঞেস করে,

“হোয়াই আর ইউ লেইট?”

দৃষ্টি আমতা আমতা করে বলে,

“না মানে স্যার, আজ ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছে। তাই..”

আফরান অবাক হওয়ার ভান করে বলে,

“সেকি! আপনার কি রাতে ঘুম হয়নি? এমনটা তো নয়? যে রাতে কেউ আপনার রুমে ঢুকেছিল এবং ঘুমিয়েও পড়েছিল। আর আপনি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে যেয়ে ঘুমানোর কথা ভুলে গিয়েছিলেন?”

ক্লাসের সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি দাঁতে দাঁত চাপে। ইচ্ছে করছে এই লোকের লম্বা নাকে দুটো ঘা দিতে। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“না, স্যার। এমনিই আজ দেরি হয়েছে।”

আফরান কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকায়। বলে,

“ডোন্ট মাইন্ড মিস দৃষ্টি। আ’ম জাস্ট জোকিং। সিট ডাউন প্লিজ। অ্যান্ড এটেনশান এভরিওয়ান।”

দৃষ্টি ধপ করে বসে পড়ে। আফরান ক্লাসে মনোযোগ দেয়। প্রভাষক হিসেবে খুব ভালো পড়ায় আফরান, সকলে তার ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পছন্দ করে।
ক্লাসের টাইম শেষে আফরান কোনো দিকে না তাকিয়েই বই নিয়ে বেরিয়ে গেল। পায়েল এসে বসল দৃষ্টির পাশে। তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

“আজ দেরি হলো কেন রে?”

দৃষ্টি রেগে গেল। চেঁচিয়ে বলল,

“বললাম তো ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে। যখন বলছিলাম তখন তুই কোথায় ছিলি? ঘুমোচ্ছিলি?”

পায়েল মুখ কালো করে বলে,

“রাগ করছিস কেন ইয়ার? খেয়ে আসিস নি মনে হয় সকালে। আমিও খাইনি, চল ক্যানটিনে যাই।”

দৃষ্টি নিজেকে শান্ত করে। ঠান্ডা কন্ঠে বলে,

“ক্লাস শেষে যাব।”

আজ মৃন্ময় আবার দৃষ্টিকে আটকাল। তবে পার্থক্য হলো আজ সাথে পায়েল আছে, গতকাল ছিল না। তারা তাকে সালাম দিল। মৃন্ময় বলল,

“দৃষ্টি চলো লাইব্রেরীতে যাই, কিছু বাকি ছিল তো গতকালের।”

দৃষ্টির সামনে আফরানের গতকাল রাতের কর্মকাণ্ড ভাসল। আজ মৃন্ময়ের সাথে গেলে আফরান আবার আসবে একদম শিওর। সে ধীর কন্ঠে বলল,

“আসলে স্যার আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে হবে।”

মৃন্ময় উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“কেন? কোনো সমস্যা? শরীর ঠিক আছে?”

দৃষ্টি দাঁত চেপে মনে মনে বলে, “ভালো নেই আমার কিচ্ছু ভালো নেই। ওই লু’চু ডাক্তার আমাকে পাগল করে দেবে।” মুখে বলে,

“কোনো সমস্যা নেই, স্যার। আর আমার শরীরও ঠিক আছে। পায়েলকে মা আজ নিয়ে যেতে বলেছে, তাই।”

ডাহা মিথ্যা কথা শুনে পায়েলের চোখ কপালে উঠল।

“স্যরি স্যার। আমি নাহয় অন্য কোনো দিন ওগুলো নোট করে নেব। আপনাকে এতো কাজ ফেলে অযথা সময় নষ্ট করতে হবে না।”

“আরে না না। সময় নষ্ট কেন? স্টুডেন্ট দের সাহায্য করা তো আমার কর্তব্য। বিশেষ করে তোমার।”

শেষের কথা সে মুখে ফোটাল না। দৃষ্টি কৃতজ্ঞতার সুরে বলে,

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। আমার অনেক উপকার হলো। আসি।”

পায়েল কে টেনে হিচড়ে বেরিয়ে গেল সে। বাইরে আসতেই পায়েল এতোক্ষণ চেপে রাখা কথা বের করল,

“আন্টি যে আমাকে যেতে বলেছেন আগে বলিসনি তো? তাছাড়া সেদিনই তো ঘুরে এলাম, আজ আবার বলবে কেন?”

আফরানের অত্যাচারের ভয়ে সে যে এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে তা সে বলতে পারবে না। কল্পনায় সে আফরানের গলা চেপে ধরল। এই লু’চু ডাক্তারের জন্য তাকে পদে পদে মিথ্যে বলতে হয়। সে হাঁটা ধরে বলল,

“ভুল করে বলে ফেলেছি স্যারের সামনে। রাতে ঘুম হয়নি মাথা ঠিক নেই। যা, বাড়িতে যা। আগামীকাল কথা হবে।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৩

পায়েলের চাচাতো ভাইয়ের কু’নজর যে বহুত আগে থেকেই তার উপর পড়েছে সেটা পায়েল জানে। এজন্য খুব সাবধানে চলাচল করে সবসময়। একটু সুযোগ পেলেই হাত ছাড়া করবে না নরপি’শাচ টা। তার গায়ে কল’ঙ্ক লেপ্টে তবেই থামবে। পায়েল সব সময় গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে চলাফেরা করে, মাথা থেকেও নামায় না বাড়ির মধ্যে হোক বা বাইরে। বাড়ি ভর্তি লোক জনের মধ্যে হয়তো কিছু করার সুযোগ পায় না নরপি’শাচ টা। তবে আজ?
আজ পায়েলের দুই চাচা, দুই চাচি এবং তাদের ছেলে মেয়েরা মিলে বাইরে গিয়েছে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে। তারা পায়েল কে নিজেদের পরিবারের মধ্যে গন্য করে না, তাই তাকে নিয়ে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পায়েল কে একা ফেলে তারা চলে গেল। তবে এই সুযোগ কীভাবে হাত ছাড়া করত চাচাতো ভাই সোহেল? সে বাহানা দিয়ে মাঝ পথ থেকেই বাড়িতে ফিরেছে। তখন থেকেই পায়েল দরজা বন্ধ করে বসে আছে। যতই ঝড় উঠুক তুফান আসুক সে দরজা খুলবে না। দরকার পড়লে না খেয়ে এর মধ্যেই ম’রবে। সে বই খুলে একটু পড়ার চেষ্টা করল। তার মধ্যেই দরজায় আঘাত হলো,

“পায়েল! কি করছিস দরজা বন্ধ করে? বাইরে আয় একটু গল্প গুজব করি। মা বাড়িতে থাকলে তো তোর সাথে একটু ভালো করে কথাও বলতে পারি না। আয়, বাইরে আয়।”

পায়েল শক্ত হয়ে বসে রইল। এমন মিষ্টি আচরণের পেছনে আছে ভয়’ঙ্কর নোংরা রূপ। সে জবাব দিল না। সোহেল আবার বলল,

“ঠিক আছে। তোকে বাইরে আসতে হবে না। আমি বরং বাইরে থেকে চা টা খেয়ে আসি।”

তার আওয়াজ আর পাওয়া গেল না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পাওয়া গেল না। পায়েল ভাবল সত্যিই চলে গিয়েছে কি? নাহ! তাও সে বের হবে না, এবাড়ির কাউকে সে বিশ্বাস করে না। ছোট বেলা থেকে সে চেনে এদের।
ঘড়ির কাঁটা দুপুর দুইটা ছুঁয়েছে। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করল সে। কোনো দিন সকালেই খাওয়া হয় না তার। আজ সকালেও হয়নি, তার উপর কাল রাতে এক কথায় দু কথায় তার গায়ে হাত তুলেছিল বড় চাচী। রাতেও খেতে দেয়নি। কলেজ গেলে ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেওয়া যেত, কিন্তু আজ এদের বেড়াতে যাবার জন্য যেতে পারল না।

সে-ই জানে কি কষ্ট করে এই প্রর্যন্ত এসেছে। ছোট চাচা দু এক সময় আড়ালে আবডালে তার হাতে টাকা দেয়। আবার তাকে সাহায্যও করে। তবে সম্মুখে কিছু করার সাহস তার নেই। মেডিকেলে চান্স না পেলে হয়তো তাকে কবেই কোনো বয়স্ক বড়লোক দেখে বিয়ে দিয়ে দিত। কপালের জোরে সে রক্ষা পেয়েছে এবং বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার একটা সুযোগ পেয়েছে। সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলল সে। এখন কিছু না খেলেই নয়, পড়াতেও মন বসবে না। ওড়নাটা ভালো করে গায়ে মাথায় পেঁচিয়ে সে রুম থেকে বের হলো। সকালের কিছু খাবার হয়তো থাকলেও থাকতে পারে। রান্না ঘরে প্রবেশ করল সেই আশায়। হঠাৎ পেছন থেকে কন্ঠস্বর এলো,

“অবশেষে বের হলি তাহলে? চল আজ আমরা খুব আড্ডা দেব।”

ভয়ে জমে গেল পায়েল। দুরু দুরু কেঁপে উঠল বুক। দৃষ্টি নিচে রেখে বলল,

“আজ অনেক পড়া আছে ভাইয়া। আমি রুমে যাই।”

সোহেল তার পথ রোধ করে। খপ করে চেপে ধরে হাত। বলে,

“চল আমার সাথে। একা একা ঘরে থাকতে কি ভালো লাগে? আমার সাথে থাকবি চল।”

পায়েল হাত মোচড়ায় অনুরোধের কন্ঠে বলে,

“আমাকে ছেড়ে দিন ভাইয়া। আমি আপনার বোন হই। আমি অন্য মেয়েদের মতো না।”

সোহেল আসল রূপে ফিরে এলো। কুটিল হেসে বলল,

“আজ সুযোগ পেয়েছি কীভাবে হাত ছাড়া করি বল? তাছাড়া সব মেয়েই আমার কাছে এক রকম। আর তুই খুব এনজয় করবি, সত্যি বলছি।”

পায়েলের গা গুলিয়ে উঠল। ঘৃণ্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“ছিঃ! যে নিজের বোনকে ওই নোং’রা চোখে দ্যাখে সে কোনো পুরুষের জাতের মধ্যে পড়ে না। থু!”

পায়েল থু থু ছেটায় তার মুখে। প্রচন্ড রেগে যায় সোহেল। এক হাতে মুখ মুছে দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করে বলে,

“আমি পুরুষ জাতের মধ্যে পড়ি কি পড়ি না আজ দ্যাখাব তোকে। তোর সব তেজ যদি ভেঙে গুঁড়িয়ে না দিয়েছি তো আমার নামও সোহেল না। এতো দিন পিছু পিছু ঘুরতাম বলে খুব দেমাগ বেড়েছে না তোর? আজ সব শেষ করব।”

তার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে। পায়েল চেঁচায়। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে। বারংবার কাতর স্বরে বলে,

“ছেড়ে দিন আমাকে। ছেড়ে দিন।”

সোহেল যেন ভয়’ঙ্কর জ’ন্তু তার কানে কিছুই যায় না। বিরক্ত করার ফলে পরপর দু ঘা বসিয়ে দেয় তার গালে। পায়েলের মাথা ঝিমঝিম করে। সে উপায়ান্তর না পেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে কামড় বসায় তার হাতে। আর্তনাদ করে পায়েল কে ছেড়ে দেয় সোহেল। ছাড়া পেয়ে পায়েল সদর দরজার দিকে ছোটে। বাড়ির মধ্যে তাকে বাঁচানোর কেউ নেই। সোহেল ছোটে তার পেছনে। শেষ মুহূর্তে পায়েলের কাঁধের ওড়না চেপে ধরে। টান দিতেই তা হাতে চলে আসে। বাধ্য হয়ে পায়েল ওড়না ছাড়াই বের হয় পথে।

ভর দুপুরে রাস্তা ফাঁকা। দুই একটা গাড়ি চলছে মাঝে মাঝে। উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ায় পায়েল। একটাই উদ্দেশ্য ইজ্জত বাঁচানো, সম্মান বাঁচানো। সে তো চায়লে ম’রতে পারত, তবে সে ম’রলে বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে কে? বুকটা হু হু করে ওঠে তার। বাবা মা কেন তাকে স্বার্থপরের মতো ফেলে গেল তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য? কেন তাদের সাথে নিয়ে গেল না? সে যে মাঝ রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে এটা খেয়াল নেই তার। হঠাৎ হাতে টান অনুভব করে কারো বুকে আছড়ে পড়ল। মুহূর্তেই পাশ থেকে শা করে চলে গেল একটি বাস।

পায়েল শ্বাস নেয় বড় বড়। চেনে না জানে না লোকটির গায়ের সাথে মিশে দাঁড়ায়। তবে তার গায়ের গন্ধটা পরিচিত ঠেকল। চোখ বন্ধ অবস্থায় লম্বা শ্বাস নিয়ে চিনে ফেলল তাকে। দুহাত বাড়িয়ে কোমরের কাছের টিশার্ট শক্ত করে খামচে ধরল। নিজেকে যেন খুব নিরাপদ মনে হলো। তাকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হলেই সে দুর্বল কন্ঠে বলল,

“আ আমার গায়ে ও ওড়না নেই।”

পরক্ষণেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সে কান্নার কোনো শব্দ নেই। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে দেহ। ভিজে যাচ্ছে লোকটির টি শার্টের বুকের অংশ। লোকটি তাকে আর সরানোর চেষ্টা করল না। না করল কোনো প্রকার শব্দ। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। পায়েল কে সময় দিল শান্ত হবার। পায়েল শান্ত হলো। ফারদিন তাকে একটু সরিয়ে টিশার্টের উপরে থাকা শার্ট খুলে তার গায়ে মেলে দিল। কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করেই বলল,

“চলো তোমাকে বাড়িতে এগিয়ে দিয়ে আসি।”

পায়েল চুপসে গেল। ভেজা কন্ঠে মিনমিন করে বলল,

“আমি, আমি যাব না।”

ফারদিন নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় পুরে নেয় তার কোমল হাত। সব থেকে ভরসা যোগ্য বাণী ছোড়ে,

“আমি আছি তো। কিচ্ছু হবে না।”

তারা এগোয়। ফারদিন জানে না পায়েলের সাথে ঠিক কি হয়েছে? তবে এটা বুঝেছে কোনো কিছু নিয়ে ভয়ে আছে খুব। আর এলোমেলো অবস্থা দেখেই ঠাওর করতে পারছে কিছু। সে তো এদিকে এসেছিল এক বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে টং এর দোকানে সিগারেটের সুখ টান দিচ্ছিল। তখনই দৃষ্টিতে আটকাল পায়েলের উন্মাদের ন্যায় মাঝ রাস্তা দিয়ে ছোটা। সঠিক সময়ে সে হাজির না হলে নির্ঘাত মেয়েটিকে আজ পি’ষে দিয়ে যেত।

পায়েল দের বাড়ির সামনে এসে থামল তারা। দরজাটা হাট করে খোলা যেমনটা সে রেখে গিয়েছিল। তবে কি সোহেল নেই? রাস্তার লোক জনের ভয়ে পালিয়েছে? ফারদিন তার হাত মুক্ত করে দিল। পায়েল মুখ উঁচু করে তাকাতেই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“আমি তোমার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করব না। যদি কখনও নিজ থেকে বলতে চাও তবেই শুনব। যাও, সাবধানে থেকো। গালে, ঠোঁটে মলম লাগিয়ে নিও।”

“আপনি..”

ফারদিন বুঝে ফেলল। বলল,

“না, আজ তোমাদের বাড়িতে আর যাব না। অন্য কোনো দিন আসব। হয়তো তুমি ডাকলেও আসব আর না ডাকলেও।”

সে চলে গেল। পায়েল তাকে যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে রইল। অতঃপর ধীর পা ফেলে রুমে গেল। দরজা বন্ধ করে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। গায়ে জড়ানো শার্টটার দিকে চেয়ে রইল নিষ্পলক। আজ ফারদিন না থাকলে কি হতো তার?

চলবে,

সে আমারই পর্ব-১০+১১

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১০

দৃষ্টিকে মেডিকেলে ড্রপ করতে এসেছে ফারদিন। বাইরেই পায়েল দাঁড়িয়ে ছিল। দৃষ্টিকে বাইক থেকে নামতে দেখে এগিয়ে গেল। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”

ফারদিন বরাবরের মতো গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল। অতঃপর কিছু দৃষ্টিগোচর হতেই বলল,

“দৃষ, তুই এগো। পায়েলের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

ভাইয়ের কথা অনুযায়ী দৃষ্টি অগ্রসর হলো। সে চলে যেতেই ফারদিন জিজ্ঞেস করে,

“বাড়ির সবাই ভালো আছে?”

“হ্যাঁ ভাইয়া।”

“পড়ালেখা করছ তো ভালো মতো?”

‘এইটুকু কলেজ আসতে পারছি তাই আমার কপাল ভালো। আর পড়ালেখা!’ মুখে বলে,

“জি।”

অতঃপর সে পায়েল কে আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলল,

“তুমি ঠিক আছ?”

হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারণ খুঁজে পেল না পায়েল। জোর পূর্বক হেসে বলল,

“হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”

“না, এমনিই জিজ্ঞেস করলাম।”

“হ্যাঁ ভাইয়া, আমি ঠিক আছি। ভালো আছি।”

“তাহলে গালে এই দাগ কীসের?”

সে আলতো আঙুল ছুঁয়ে দেয়। পায়েল চোখ বন্ধ করে নিল। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হলো না? হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল যেন। সে একটু পিছিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

“হবে কিছু একটার। খেয়াল নেই। ভাইয়া, আমি আসি তাহলে? ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”

বলে সে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। পায়েল কিছু লুকিয়ে গেল এটা স্পষ্ট। ফারদিনের কপালে ভাঁজ পড়ে। কি লুকাচ্ছে পায়েল?

ক্লাসে দৃষ্টির পাশে বসে লম্বা শ্বাস নিল পায়েল। দৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কি হয়েছে? কি বলল ভাইয়া?”

“আরে তেমন কিছু না। জিজ্ঞেস করছিল মুখের এই দাগ কীসের?”

দৃষ্টি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে পায়েলের বা গালে চার আঙুলের দাগ দেখতে পেল। আঁতকে উঠল সে। তার গালে হাত বুলিয়ে করুণ কন্ঠে বলল,

“কে মে’রেছে পায়েল?”

পায়েল তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

“কে আবার? বড় চাচি। কেন মে’রেছে জানিস? আজ কলেজ আসার জন্য তাড়াহুড়োয় একটা রুটি পুড়িয়ে ফেলেছিলাম তাই।”

দৃষ্টির ভীষণ কষ্ট হয়। ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে,

“তুই আমাদের বাড়িতে কেন চলে আসছিস না পায়েল? প্লিজ তুই ও বাড়ি ছেড়ে চলে আয়।”

পায়েল তার হাতে হাত রেখে বলে,

“এটা কখনও সম্ভব নয় রে। ওই বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় আমার বাবা মায়ের স্মৃতি আছে। আমি তা ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না। ওই স্মৃতি টুকু আঁকড়েই তো বেঁচে আছি। নাহলে ওই নরকের মধ্যে কে থাকতে চায়?”

দৃষ্টি তাকে আশ্বাস দেয়,

“দেখিস এমন কেউ তোর জীবনে আসবে যে তোর নরককে স্বর্গে পরিণত করবে। তোর সকল দুঃখকে সুখে রুপান্তরিত করবে। তোর সকল দোষীদের শাস্তি দেবে। আসবে, তাকে আসতেই হবে।”

পায়েল মৃদু হাসে। মনে মনে বলে,

“আমার ধৈর্য্যের সীমা পার হবার আগে কি সে আসবে, দৃষ?”

“রকস্টার তূরাগ ইততেয়াজ! উফ্, আমার ক্রাশ সে। যদি কোনো দিন সামনাসামনি দ্যাখা করতে পারতাম!”

ফারনাজের মেজাজ তুঙ্গে। একে তো ওই রকস্টারের জন্য নিজের ফোন নিজেই ভেঙেছে, তার উপর তার নামের গুনগান সহ্য হচ্ছে না। রুক্ষ কন্ঠে বলল,

“দ্যাখ পাপিয়া! এসব আলতু ফালতু বকা বন্ধ কর। মেজাজ ভালো নেই আমার।”

আফিয়া মুখ কুঁচকে তাকায়। কিছু বলতে নিলেই সুমি জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে নাজ? তুই তো এমন মুডে কখনও থাকিস না।”

“প্রচন্ড রাগ লাগছে আমার। একে তো আগের ফোনটা এক পাথর মানবের জন্য ভাঙলাম। তার পরের ফোনটা কিনতে যেয়ে মায়ের কাছ থেকে অনেক বকা শুনতে হয়েছে। আমার মেজাজ একদম ঠিক নেই।”

তারা বুঝল। আফিয়া বলল,

“কুল ডাউন, নাজ। আচ্ছা? তুই কি নতুন কোনো বয়ফ্রেন্ড পাসনি?”

“আর বয়ফ্রেন্ড! একটাও কি জাতের ছেলে নেই? নাকি আমার সামনে পড়ছে না?”

“চিন্তা করিস না। ঠিকই একজন পেয়ে যাবি। চল আজ তোর মুড ফ্রেশ করার জন্য ঘুরে আসি। তোর মন ভালো হয়ে যাবে।”

ফারনাজের মনে হলো ঘুরতে গেলে মন্দ হয় না। তাই সে রাজি হয়ে গেল। তিনজন মিলে ঘোরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
একটু ঘুরে ফিরে তারা গেল ফুচকা খেতে। আফিয়া ও সুমি এক প্লেট করে ফুচকা নিল। ফারনাজ বলল,

“আমার একজনের উপর ভীষণ রাগ বুঝলি তো? তাই আমি আজ বেশি ঝাল দিয়ে তিন প্লেট ফুচকা খাব। একটা একটা ফুচকার জায়গায় তার মাথা কল্পনা করে নেব। এবার তার মাথা চিবাবো আমি।”

তারা হতাশ শ্বাস ফেলে। কারো উপর রেগে গেলে ফারনাজ এমন কান্ড প্রায়ই ঘটিয়ে থাকে। আফিয়ারা নিজেদের ফুচকা শেষ করে বলল,

“নাজ, তুই খেতে থাক। আমরা ওইদিক থেকে আইসক্রিম নিয়ে আসি। একটু পর তোরই দরকার পড়বে।”

ফারনাজ খেতে খেতে মাথা নেড়ে সাঁই দিল। তারা চলে গেল। ফারনাজ একটা একটা ফুচকা মুখে দিচ্ছে আর তূরাগের চেহারা কল্পনা করছে। তার যে এতো শান্তি লাগছে! মনে হচ্ছে স্বয়ং তূরাগের মাথা খাচ্ছে সে। আহা! শান্তি শান্তি। তার রাগটাও কমে এসেছে। এদিকে ঝালের ঠ্যালায় তার চোখে জল এসে গিয়েছে। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মনটা চেঁচিয়ে উঠতে চাচ্ছে। চেঁচানোর আগেই হাতে টান অনুভব করল। একটা শক্ত পোক্ত হাত তাকে টেনে নিয়ে পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। পানির বোতল সামনে ধরে ধমকে বলল,

“পানি খাও ইডিয়েট।”

ফারনাজ হম্বিতম্বি করে পানি গিলল। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। লোকটা তার চশমা খুলে হাতে রুমাল দিয়ে বলল,

“মুখ মুছে নাও। ঝাল খেতে পারো না তো খেতে যাও কেন?”

ফারনাজ মুখ মুছে ফেলার পরপরই চশমা ফেরত পেল। মাথা উঁচু করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠাম দেহের অধিকারী লোকটাকে দেখতে চায়ল। মুখে মাস্ক আর চোখে সানগ্লাস পরিহিত একটা লোক। ফারনাজ লম্বা শ্বাস টেনে বলল,

“আপনি কে? আপনার কন্ঠস্বর কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।”

ভ্রু কুঁচকায় লোকটা। সানগ্লাস ভেদ করে দৃষ্টি বোঝা যায় না। আলতো হাতে তার মাথায় চাপড় মেরে বলে,

“মাথা মোটা কোথাকার!”

বলেই গটগটিয়ে হেঁটে ভীড়ে মিশে যায়। ফারনাজ তাকে আর খুঁজে পায় না। একটু পর আফিয়া ও সুমি ফিরে আসে। তাকে আশে পাশে তাকাতে দেখে জিজ্ঞেস করে,

“কি রে? কাকে খুঁজছিস?”

“আরে ওই লোকটাকে। ওই লোকটা না থাকলে আজ আমি ঝালের ঠ্যালায় চেঁচিয়ে পটল তুলতাম নিশ্চিত।”

সুমি তার দিকে আইসক্রিম এগিয়ে দেয়। বলে,

“এতো ঝাল খাবার দরকার কি ছিল?”

ফারনাজ আইসক্রিমে কামড় বসিয়ে বলে,

“কারণ ছিল। আমার মেজাজ এখন ভালো হয়ে গিয়েছে। আর রাগ লাগছে না।”

মৃদু হাসে তারা। ফারনাজের সকল কার্যক্রম উদ্ভট ধরনের।

“মিস দৃষ্টি!”

দৃষ্টি পিছু ফিরে তাকায়। মৃন্ময় কে দেখে মৃদু হেসে বলে,

“আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”

সে জবাব দেয়। বলে,

“বাড়ি ফিরছ?”

“জি।”

“একটু পর যেও। লাইব্রেরী থেকে কিছু নোটস করে দেব, নিয়ে যাও।”

দৃষ্টি একটু ভাবে। পড়ালেখার বিষয় বলে আর মানা করে না। সম্মতি দেয়,

“ওকে স্যার।”

তারা লাইব্রেরী তে গিয়ে বসে। মৃন্ময় বিভিন্ন বই ঘেঁটে তাকে নোট করে দেয়। দৃষ্টি মনোযোগ দিয়ে দ্যাখে। মৃন্ময় মাঝে মাঝে আড় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। এই মেয়েটার প্রতি ভালোলাগা কাজ করে তার। তাই তো সামনে বসিয়ে রাখার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। হঠাৎ মৃন্ময় বলে,

“ইউ আর লুকিং বিউটিফুল টুডে।”

দৃষ্টি বিব্রত বোধ করে। স্যারের থেকে এমন প্রশংসা সে আশা করেনি। জোর পূর্বক হেসে বলে,

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”

ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। দৃষ্টি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“আজ আমি আসি, স্যার। দেরি হয়ে গিয়েছে অনেক। বাড়িতে চিন্তা করবে।”

মৃন্ময়ও উঠে দাঁড়ায়। ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,

“ঠিক আছে, যাও। বাকিটা নাহয় আগামীকাল শেষ করব?”

“ওকে স্যার।”

দৃষ্টি বেরিয়ে গেল। স্যারের দৃষ্টি অন্য রকম লাগে তার। এই মেডিকেলে দুইজনই ইয়ং স্যার আছে। একজন মৃন্ময় আহমেদ ও অপরজন আফরান ইততেয়াজ। দৃষ্টি বের হওয়ার পথে সতর্ক দৃষ্টি বুলায়। তবে আশেপাশে আফরানকে দেখতে পায় না। সে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। ভাগ্যিস আশে পাশে নেই, নাহলে মৃন্ময় স্যারের সাথে তাকে দেখে না জানি কি কান্ড করত!

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১১

পড়ালেখার মধ্যে ব্যাঘাত একদম পছন্দ নয় দৃষ্টির। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পার করেছে। এই অসময়ে কে তাকে স্মরণ করল? সে বিরক্ত চোখে ফোনের দিকে তাকাল। সেখানে জ্বল জ্বল করছে “লু’চু ডাক্তার” নামটি। দৃষ্টি অবাক হয় না। আফরান মাঝে মধ্যেই এমন সময়ে কল দিয়ে থাকে এবং হাজার রকম কথা বলে তার মাথা খায়। সে রিসিভ করে কানে ধরে। মৃদু স্বরে বলে,

“বলুন।”

ওপাশ থেকে একটু থেমে আফরান জিজ্ঞেস করে,

“কি করছিস?”

“পড়ছি তো, আফরান ভাই। আপনি কি এটা শুনতে কল দিয়েছেন?”

“না। আচ্ছা শোন?”

“হু শুনছি।”

“বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে?”

“হ্যাঁ সবাই ঘুম। আমি বাদে।”

“আর, আর তোর ওই জল্লা’দ বাপ? ঘুমিয়েছে?”

বাবার এমন সম্বোধন শুনে দৃষ্টি রেগে গেল। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,

“দেখুন! বাবাকে উল্টা পাল্টা কিছু বলবেন না।”

“আচ্ছা বলব না। ঘুমিয়েছে কিনা বল।”

“হ্যাঁ ঘুমিয়েছে। আপনি এসব জেনে কি করবেন? আপনি কি হাসপাতালে নাকি বাড়িতে? বাড়িতে থাকলে ঘুমিয়ে পড়ুন।”

আফরান গম্ভীর কণ্ঠে ডাকে,

“দৃষ!”

দৃষ্টি একটু নড়েচড়ে বসে। আফরানের এমন গম্ভীর রূপ ও কন্ঠ সহজে দ্যাখা যায় না, শোনা যায় না।

“জি?”

“ব্যালকনির দরজা খোল।”

দৃষ্টি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“এই রাতে ব্যালকনির দরজা খুলতে যাব কেন? চোর ঢুকলে?”

আফরানের ভাবলেশহীন কন্ঠস্বর,

“আমি বলছি তাই। এক থেকে পাঁচ গুনব এর মধ্যে দরজা খুলবি।”

হতভম্ব দৃষ্টি ঠাঁই বসে রয়। হঠাৎ কেন দরজা খুলতে বলছে আফরান? সে বাধ্য হয়ে পড়ার টেবিল থেকে উঠে দরজা খোলে। নাহলে আফরান থামবে না। কানে ফোন ঠেকিয়ে বলে,

“খুলেছি। আর কিছু?”

“নাহ, আর কিছু করার দরকার নেই।”

আফরান দরজা দিল। বিস্ময়ে হতবাক দৃষ্টি হা করে চেয়ে রইল। তার সামনে স্বয়ং আফরান দাঁড়িয়ে আছে! বিশ্বাস হচ্ছে না তার। কম্পিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,

“আ আপনি! মানে, আপনি এখানে কীভাবে এলেন?”

আফরান আরাম করে বিছানায় বসল। কপাল কুঁচকে বলল,

“তোর বাপটা ভীষণ কিপ্টে রে, দৃষ। বাড়ির ওপাশটা প্লাস্টার না করে রেখে দিয়েছে কেন? এটুকু করতে গেলে কি তোর বাপকে পথে বসতে হতো? আমার হাতের চামড়া চুমড়ি গেল সব। উফ্!”

দৃষ্টি এগিয়ে আসে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,

“কই দেখি? আপনি কি পাইপ বেয়ে উঠেছেন? ও আল্লাহ্! যদি পড়ে যেতেন তাহলে কি হতো?”

আফরানের উভয় হাত থেকে চামড়া উঠে র’ক্ত বের হচ্ছে। দৃষ্টি দ্রুত ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। বিছানায় বসে তার হাত খুব যত্ন সহকারে ড্রেসিং করতে লাগল। আফরান তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“পড়ে গেলে হাত পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতাম। লোকে বলত পেশেন্টের জায়গায় ডাক্তার নিজেই ভর্তি। আর তুই আমার বহুত সেবা যত্ন করতিস। খুব ভালো হতো।”

মলম লাগানো শেষে দৃষ্টি বক্স জায়গায় রাখে। মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,

“সত্যি খুব ভালো হতো। কিন্তু আমি মোটেও আপনার সেবা করতে যেতাম না। ঠেকা পড়েনি আমার।”

“তাহলে এভাবে চিন্তিত হয়ে মলম লাগালি কেন? আমি কি বলেছিলাম যে, আমার খুব জ্বলছে মলম লাগিয়ে দে? যেখানে মলম লাগানোর কথা সেখানে তো লাগাবি না?”

দৃষ্টি তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলে,

“আর কোথায় ব্যথা পেয়েছেন?”

আফরান বুকের বা পাশে হাত রেখে বলে,

“এখানে খুব জ্ব’লে রে। দিবি? মলম লাগিয়ে?”

দৃষ্টি ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। তেজী কন্ঠে বলে,

“রাত বিরেতে আপনার মশকরা দ্যাখার ইচ্ছে নেই। চলে যান।”

“যাব না। যাব বলে কি পাইপ বেয়ে এতো দূর এসেছি? পাগলে কামড়েছে আমাকে?”

দৃষ্টি উত্তেজিত না হয়ে নিজেকে শান্ত করে। কোমল কন্ঠে বলে,

“আপনার আজ ডিউটি ছিল না?”

“ছিল তো। ওই ব্যাটার ঘাড়ে চাপিয়ে চলে এসেছি। আমার জিনিসে নজর দেওয়া মোটেও ভালো হবে না, তা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছাড়ব।”

অতঃপর দৃষ্টির হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসায়। বিছানায় পা তুলে তার মুখোমুখি বসে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে,

“ওই শা’লা মৃন্ময় তোর দিকে কেমন করে তাকায় কেন, দৃষ? আমার একদম সহ্য হয় না।”

দৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে বলে,

“ডাক্তারের মুখের কি ভাষা! তাছাড়া আপনিও তো তাকিয়ে থাকেন।”

নিজের কথাতে নিজেই বোকা বনে গেল সে। লজ্জা পেল মনে মনে, প্রকাশ করল না। আফরান শক্ত কন্ঠে বলে,

“আমার ভাষার কথা এখন বাদ। আমি আর ওই মৃন্ময় কি এক হলাম? আমি তো তোর দিকে একবার কেন হাজার বার.. এক মিনিট এক মিনিট! তুই দেখেছিস যে আমি তোর দিকে তাকিয়ে থাকি? তার মানে..”

দৃষ্টি চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। ধরে ফেলেছে। আফরান দুষ্টু হেসে বলে,

“তার মানে তুইও আমার দিকে তাকাস, দৃষ! ইশ্! তুই এমনটা করতে পারিস? তাই তো বলি ইদানিং আমার শরীর খারাপ লাগে কেন? তোর নজর লেগেছে আমার, দৃষ। আমার মতো সহজ সরল একটা ছেলের উপর তুই নজর দিতে পারলি?”

দৃষ্টি মুখ কুঁচকে বলে,

“আমি কোনো জ্বিন পরী না যে আমার নজর লাগবে। আর আপনিও কোনো সহজ সরল মানুষ নন।”

আফরান হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। থমথমে কন্ঠে বলল,

“আজ তুই লাইব্রেরীতে মৃন্ময়ের সাথে কি করছিলি?”

দৃষ্টি হকচকায়। আফরান তাহলে দেখে ফেলেছে? বলে,

“স্যার আমাকে কিছু নোটস করে দিচ্ছিলেন।”

সে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“কলেজের এতো স্টুডেন্ট থাকতে তুই কেন? বোঝা আমাকে। তুই’ই কেন?”

“আমি জানি না।”

“বেশ। তোর জানাও লাগবে না। লাইব্রেরীতে দু ঘন্টা ছিলি। এখন আমার সামনে সারা রাত বসে থাকবি। এটা তোর শাস্তি।”

দৃষ্টি হতবাক। বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে,

“আমার কি দোষ এখানে? আমি শাস্তি পেতে যাব কেন? আশ্চর্য!”

সে উঠে যেতে নিলেই আফরান হাত চেপে ধরে। শক্ত করে আকড়ে ধরে বলে,

“তোর শাস্তির প্রয়োজন আছে। সেটা এখন নয় পরে বুঝবি। এখন নড়াচড়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাক।”

দৃষ্টি আর পথ না পেয়ে মুখ কালো করে বসে থাকে। সে জানে এই লোক তার উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার আগে এখান থেকে যাবে না।
আফরান অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে। যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে দৃষ্টির মুখশ্রীর প্রতিটি অংশ, প্রতিটি কোণা। দৃষ্টি অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে কি শান্ত হয়ে বসা সম্ভব? চোখ নিচে থাকলেও আফরানের প্রখর দৃষ্টির তোপে তার দেহ কেঁপে কেঁপে ওঠে। এভাবেই ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরোলো। এবার আফরান একটু নড়ে উঠল। পলক ফেলল চোখের। নিচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“তুই ভীষণ নিষ্ঠুর রে দৃষ! একটা নিরীহ মানুষ দেওয়াল টপকে, পাইপ বেয়ে তোকে দেখতে এলো! আর তুই একটু নাস্তা পানির জন্যও বললি না? বুঝেছি, সব তোর ওই কিপ্টে বাপের থেকে শিখছিস।”

দৃষ্টি বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলে,

“বাবাকে নিয়ে এসব বলবেন না। আর এভাবে চোরের মতো বাড়িতে আসা কাউকে আমরা জামাই আদর করতে যাই না। হুহ!”

“ঠিক আছে। আমি সারা রাত না খেয়ে থাকি, আর সকালে অজ্ঞান হয়ে যাই। তারপর এখান থেকে আমাকে হাসপাতালে শিফট করিস। আর বাড়িতে খবর দিয়ে দিস, তোর বাপের একটুও খরচ হবে না।”

দৃষ্টি হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়। উঠে দাঁড়ালে সে বলে,

“কোথায় যাস? শাস্তি বাকি এখনও।”

“উফ্! আপনি একটু আস্তে কথা বলুন। কেউ দেখে ফেললে বাড়ি মাথায় তুলবে। চুপ করে বসে থাকুন, আমি আসছি।”

সে ধীর গতিতে দরজা খুলে উঁকি দেয়। আশে পাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে দরজা চাপিয়ে দিয়ে যায়। আফরান ধপ করে শুয়ে পড়ল। সারাদিনে অনেক ধকল গেল। ক্লাস নিয়ে, রোগী দেখে, ওয়ার্ড ঘুরে সে শ্বাস নেওয়ার সময় প্রর্যন্ত পায়নি। তার উপর এতো কাজের মধ্যে মৃন্ময়ের নজর দৃষ্টির উপর দেখে র’ক্ত ছলকে উঠেছিল তার। সে অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করেছে, আজ তার হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েও গেল। আফরানের জিনিসের উপর নজর দেওয়া! এর মাশুল মৃন্ময় কে গুনিয়েই ছাড়বে সে। তাই তো আজ শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে মৃন্ময়ের ঘাড়ে নাইট ডিউটি চাপিয়ে দিয়ে এলো।

চলবে,

সে আমারই পর্ব-৮+৯

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৮

আফরান তো এসেছেই সাথে তূরাগ কেও টেনে নিয়ে এসেছে। আফরান কে দ্যাখা মাত্রই ছোট্ট বন্যা তার গলা ধরে ঝুলে পড়ল। আফরান তাকে বগলদাবা করে একে একে সবার সাথে কুশল বিনিময় করে নিল। মিসেস সীমা তাকে দেখে গদগদ হয়ে বললেন,

“তুই এসেছিস! ডাক্তার হয়ে যাবার পর তো তোর আর দ্যাখাই পাওয়া যায় না। ভুলেই গিয়েছিস খালামনি কে।”

আফরান তাকে আলতো আলিঙ্গন করে বলল,

“খালামনিকে কীভাবে ভুলে যাই? তাই তো ছুটি নিয়ে চলে এলাম। আগে থেকেই বলে দিচ্ছি দুপুরে এবং রাতে খেয়ে তবেই ফিরব। রান্না বসাও।”

মিসেস সীমা খুব খুশি হলেন। দুই জা মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রান্নার আয়োজনে।
আজ শুক্রবার হওয়ায় ফাহাদ আবরার এবং রামিজ আবরার বাড়িতেই আছেন। আফরান আড়ালে তূরাগকে চোখ টিপে ফাহাদ আবরারের পাশে বসে পড়ল। জিজ্ঞেস করল,

“শ.. আই মিন আঙ্কেল কেমন আছেন?”

ফাহাদ আবরারের মুখ থমথমে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আফরানের আগমনে তিনি খুশি হননি। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“ভালো।”

আফরান হাসল। রামিজ আবরার হাসি মুখে তার সাথে টুকটাক কথা বললেন। তূরাগের সাথেও আলাপ করিয়ে দিল আফরান। অতঃপর বলল,

“খালামনির কাছে শুনলাম আপনার প্রেশার হাই থাকে সব সময়। একবার হাসপাতালে গেলেও তো পারেন।”

ফাহাদ আবরার তাকে পাত্তা না দিয়ে বললেন,

“তার কোনো দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।”

“তা কি করে হয়? আপনার খুব কাছের একজন আত্মীয় হওয়ার সুবাদে এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি যাওয়ার সময় আপনার চেক আপ করে যাব।”

ফাহাদ আবরার গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। তার এসবে কোনো আগ্রহ নেই।
বর্ষণ ঘর থেকে বেরিয়ে তূরাগ কে দেখে হা করে চেয়ে রইল। তূরাগের সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখতে লাগল। তূরাগের অস্বস্তি হলো খুব। তাও জোর পূর্বক বসে রইল। পর মুহূর্তে বর্ষণ চেঁচিয়ে উঠল,

“উরিম্মা! এতো বড় রকস্টার আমাদের বাড়িতে! আমি স্বপ্ন দেখছি। হায় আল্লাহ্!”

তূরাগ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মৃদু হাসল। এভাবে রিয়্যাক্ট করার কি আছে? আফরান তার মাথায় চাটি মেরে বলল,

“ঠিকই দেখছিস। রকস্টার তূরাগ ইততেয়াজ সশরীরে তোদের বাড়িতে উপস্থিত আছে।”

বর্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। ফিরে এলো হাতে কাগজ কলম নিয়ে। চকচকে চোখে তাকিয়ে বলল,

“আপনার আমি অনেক বড় ফ্যান। টিভিতে কত দেখেছি। ভাবতেও পারিনি আপনাকে সামনাসামনি কখনও দেখতে পাব। অটোগ্রাফ প্লিজ।”

তূরাগ হাত বাড়িয়ে কাগজ কলম নিয়ে অটোগ্রাফ দিল। এতে বর্ষণের পোষাল না। অনুরোধের কন্ঠে বলল,

“আপনার সাথে একটা সেলফি নিতে পারি? স্কুলের বন্ধুদের দ্যাখাব।”

আফরান তাকে গুঁতো দিয়ে বলল,

“বাচ্চা ছেলে একটা সেলফি চায়ছে। দিয়ে দে।”

তূরাগ রাজি হলো। বর্ষণ বলল,

“এখানে ছবি ভালো হবে না। চলুন ছাদে যাই।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও তূরাগ তার সাথে গেল। বাচ্চা ছেলে, তার মন খারাপ করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। ছাদে গিয়ে সেলফি তুলল কয়েকটা কিন্তু বর্ষণের মন মতো হলো না। তার থেকে তূরাগ অনেকটা লম্বা হওয়ায় ঠিক জমছে না। মুখ কালো করে ফেলল সে। হঠাৎ গুনগুন করে গানের শব্দে ছাদের অপর পাশে গেল তারা। দেখল ফারনাজ গুনগুন করছে আর ফুল গাছে পানি দিচ্ছে। তূরাগ ফারনাজ কে দেখেই বিরক্ত হলো। মুখে ফুটে উঠল তা। বর্ষণ ডাকল,

“নাজ আপু! দ্যাখো আমাদের বাড়িতে কে এসেছে!”

ফারনাজ মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। তূরাগকে দেখে মুখ ভঙ্গি অতি স্বাভাবিক রেখে বলল,

“কে এসেছে?”

তূরাগ ভ্রু কুঁচকাল। ফারনাজ কি তাকে দেখল না? সে কি অদৃশ্য? বর্ষণ অবাক কন্ঠে বলল,

“এই যে রকস্টারকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না?”

ফারনাজ আবার নিজের কাজে মন দিয়ে বলল,

“এতে আমি নাচানাচি করার মতো কিছু দেখছি না। তোর রকস্টার তুই পানি দিয়ে গিলে খা।”

তূরাগের চোয়াল কিঞ্চিত শক্ত হলো। ইচ্ছে করল এই মেয়ের চশমা খুলে কানের নিচে চটাস চটাস কয়েকটা দিতে। বর্ষণ বলল,

“ধুর! তুমি সব সময় মজা করো! শোনো না নাজ আপু? আমার রকস্টারের সাথে কয়েকটা ছবি তুলে দেবে?”

“না, পারব না।”

“দাও না প্লিজ? আমি আমার বন্ধুদের দ্যাখাব। প্লিজ প্লিজ প্লিজ?”

ফারনাজ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। নিজের ফোন তাক করে বলল,

“ঠিক হয়ে দাঁড়া।”

বর্ষণ ঠিকঠাক হয়ে তূরাগের পাশে দাঁড়াল। তূরাগ মুখ গম্ভীর করে রাখল। ফারনাজ মনে মনে ভেংচি কাটল,

“পাথর মানব কোথাকার!”

হঠাৎ মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলতেই কৌশলে ফোনের স্ন্যাপচ্যাট অ্যাপে ক্লিক করল। বিভিন্ন স্টিকার দিয়ে জুম করে কেবল তূরাগের ছবি তুলল। মনে মনে সে হেসে কুটিকুটি হলো। তবে বাইরে থেকে একদম স্বাভাবিক থাকল। একটু পর বলল,

“তোর ওই ফোনটা দে। আমার ফোনে ছবি ভালো আসছে না।”

তূরাগ মহা বিরক্ত হলো। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে এভাবে? বর্ষণ ফোন এগিয়ে দিলে সে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে দিয়ে দিল। তূরাগ ছাদ থেকে নেমে গেল তৎক্ষণাৎ। ফারনাজ কুটিল হেসে বলল,

“আমার ফোন ভেঙেছিলেন না? এবার আপনার এই ছবি দিয়ে মজা দ্যাখাব আপনাকে। নাকানিচুবানি না খাওয়ালে আমার নাম ফারনাজ আবরার নয়, হুহ।”

আফরান এসেছে শুনে দৃষ্টি দোর দিয়ে রুমে বসে আছে। ওই লু’চু ডাক্তারের মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছে’ই তার নেই। সে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে। বই পড়ার জন্য হলেও তাকে কেউ বিরক্ত করবে না।
দরজায় নক পড়ার শব্দে সে বই থেকে মুখ তুলল। এখন আবার কে এলো? কন্ঠস্বর উঁচিয়ে বলল,

“কে? পড়ছি আমি।”

“দৃষ আপু, আমি।”

বন্যার কন্ঠ শুনে সে নিশ্চিন্ত হলো। বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দিল। মাথা নিচু করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“কিছু বলবি? ভেতরে আয়।”

“অবশ্যই। কেন নয়? বন্যা তুমি যাও, তোমার জন্য যে চকলেট গুলো এনেছি ওগুলো খাও। আর ভাইয়ার সাথে শেয়ার করবে। ঠিক আছে?”

আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো আফরান। দৃষ্টি চমকাল। বন্যা ঘাড় কাত করে হেলতে দুলতে চলে গেল। সামনে স্বয়ং আফরান দাঁড়িয়ে আছে ভেবেই দৃষ্টি দ্রুত দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হলেই আফরান শক্ত পোক্ত হাতে দরজা আটকে ফেলল। অতঃপর দরজা ঠেলে প্রবেশ করে নিজেই দরজা লক করে দিল। দৃষ্টি ঢোক গিলে নিজেকে সামলে শক্ত কন্ঠে বলল,

“আপনি এখানে কেন? এক্ষুনি বেরিয়ে যান রুম থেকে।”

আফরান এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। চশমা দ্বারা আবৃত ওই তীক্ষ্ম চোখ জোড়ায় দৃষ্টি কখনও তাকাতে পারে না। আফরান মৃদু কন্ঠে বলল,

“কখন থেকে বসে আছি। তোর দ্যাখা নেই। রুমের মধ্যে ঘাপটি মে’রে বসে আছিস কেন?”

দৃষ্টি মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার ইচ্ছে, আমি রুম থেকে বের হবো কি হবো না।”

আফরান খুব আয়েশ করে দৃষ্টির বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। দৃষ্টি হতভম্ব। সে এগিয়ে গিয়ে চাপা কন্ঠে বলল,

“আশ্চর্য! আপনি এখানে শুয়ে পড়লেন কেন? উঠুন, আর বাইরে যান।”

“তোর ইচ্ছে তুই বাইরে যাসনি, আমারও ইচ্ছে আমি এখানে শুয়ে পড়েছি।”

“দেখুন আফরান ভাই! বাবা..”

আফরান দৃষ্টি কে হাতের কাছে পেয়ে সুযোগ ছাড়ল না। হেঁচকা টানে তাকে নিজের উপর ফেলল। দৃষ্টি শ্বাস রোধ হয়ে আসতে চায়ল। উঠে যেতে নিলেই আফরান শক্ত করে হাত চেপে ধরল। এক হাতে তার সামনের চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

“তোর বাপ বাড়িতে নেই। জামাইয়ের জন্য বাজার করতে গিয়েছে। তাই সে আসবে না তার জামাইয়ের কাজে ব্যাগড়া দিতে।”

দৃষ্টি ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। জামাই বলতে আফরান কাকে বুঝিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি নেই। সে মোচড়া মুচড়ি করে বল,

“ছাড়ুন আমাকে।”

“আরে এখন তো ছেড়েই দেব। কিন্তু যখন ধরার মোক্ষম সময় হবে তখন তুই ছাড় পাবি না রে দৃষ। তুই তখন ফি’নিস একদম!”

আফরান আরও কিছু বলতে চায়ল কিন্তু মিসেস বিউটির কন্ঠস্বরে বাঁধা পড়ল।

“দৃষ! কি করছিস তুই রুমে বসে? বাইরে দ্যাখ আফরান এসেছে আর তার ভাই এসেছে। সে আবার রকস্টার। আয় তাদের সাথে কথা টথা বল।”

দৃষ্টি কীভাবে বলবে? যে তাদের পেয়ারের আফরান তার রুমেই চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে? তাকে শ্বাসও নিতে দিচ্ছে না। সে জোর পূর্বক আফরানকে ছাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,

“আমি পড়ছি, ছোট মা। একটু পরেই বের হচ্ছি। তুমি যাও।”

চলবে..
#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৯

আফরান কে বাঁচাতে মিথ্যে বলে দৃষ্টি ফেঁসে গেল। আফরান তাকে ক্ষণে ক্ষণে খোঁচাচ্ছে।

“কি রে! তুই তো সত্যিটা বলতেই পারতিস। যে আমি তোর রুমে ঢুকে তোকে..”

“চুপ করুন আপনি। আপনার কথা বলে দিলে কি ভাবত সবাই? আপনি আর আমি দরজা বন্ধ করে কি করছিলাম?”

আফরান দুষ্টু হেসে দৃষ্টির গা ঘেঁষে বসে। কন্ঠস্বর নামিয়ে বলে,

“সবাই দেখে নিলে খুব ভালো হতো রে। তোকে ধরে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিত। আর সত্যি বলছি আমি একটুও রাগ করতাম না।”

দৃষ্টি বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

“আপনার এসব ফালতু কথা বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই না? চুপচাপ বসবেন নাহয় এক্ষুনি বেরিয়ে যাবেন।”

“আহা! রাগ করিস কেন? রাগ করলে তোর নাক লাল হয় জানিস? আর ইচ্ছে করে..”

দৃষ্টি তার মুখ চেপে ধরল। ধৈর্য্যহীন হয়ে বলে,

“আপনি দয়া করে আপনার মুখের লাগাম টানুন। মানুষ এতোটা ঠোঁট কা’টা হয় কীভাবে?”

আফরান সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দৃষ্টির হাতের পাতায় ঠোঁট ঠেসে ধরল। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বলল,

“আমি তো লাগামেই আছি রে দৃষ। এতেই তোর সহ্য হচ্ছে না? আর যখন লাগাম ছাড়া হবো তখন সহ্য করবি কীভাবে?”

দৃষ্টির কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। ভেতরে ভেতরে লজ্জায় নুইয়ে পড়লেও বাইরে প্রকাশ করে না। হাত টেনে সরিয়ে নেয়। বলে,

“ডাক্তার আর লেকচারার হয়েছেন কি করতে? এই চ্যাপ্টার বুঝিয়ে দিন।”

আফরান হতাশ শ্বাস ফেলে। হা হুতাশ করে বলে,

“তোকে যা বোঝাতে চাই তা তো বুঝবি না। শুধু পারবি নাকে দড়ি দিয়ে আমাকে ঘোরাতে।”

দৃষ্টি ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইল। তার যে পেট ফেটে হাসি আসছে, তা বোঝার বিন্দু মাত্র উপায় নেই। আফরান আর উপায় না পেয়ে বই মেলল। তার এখন মনে হচ্ছে এই মেয়ে বাসর ঘরেও বলবে ‘এই চ্যাপ্টার বুঝিয়ে দিন।’ আর তার বাসর মাঠে মা’রা যাবে।

দুপুরে খাবার পর ফারনাজ নিজের রুমে বসে তূরাগের ছবি গুলো দেখছে আর হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। বন্যা তার রুমে এসে বলল,

“নাজ আপু! তোমাকে নিচে ডাকছে।”

ফারনাজ হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

“পরে যাব। আগে এদিকে আয় তোকে মজার কিছু দ্যাখাই।”

বন্যা দুই লাফে ফারনাজের কাছে গেল। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“কই দেখি?”

ফারনাজ তাকে তূরাগের কিছু ছবি দ্যাখাল। বন্যা হি হি করে হেসে উঠল। হাসল ফারনাজও। সেই মুহূর্তে এক কন্ঠস্বর পাওয়া গেলে,

“কি করছ তোমরা, নাজ আপু?”

ফারনাজ না তাকিয়েই বলল,

“বর্ষণ এদিকে আয় তোকে একটা জিনিস দ্যাখাই।”

বর্ষণ রুমে প্রবেশ করে বলল,

“পরে দেখব। আমি এখন রকস্টার কে বাড়িটা ঘুরিয়ে দ্যাখাচ্ছি। এই দেখুন, এটা হলো নাজ আপুর রুম।”

তূরাগের কথা কানে আসতেই ফারনাজ এক ঝটকায় ফোন পেছনে লুকিয়ে ফেলল। মুখ তুলে তূরাগের থমথমে মুখশ্রী দৃষ্টিগোচর হলো। বর্ষণ বলল,

“চলুন এবার দৃষ আপুর রুমে যাই।”

তারা প্রস্থান করতে নিলেই বন্যা বলল,

“এই ভাইয়া! দ্যাখো নাজ আপুর ফোনে এই ভাইয়াটার ফানি ফানি ফটো আছে। এসো দ্যাখো।”

ফারনাজ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। এই মেয়ে যে এভাবে হাটে হাড়ি ভেঙে দেবে, তা কে জানত? তূরাগের চলমান পা থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে ফারনাজের চুপসানো মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত করে। সে এগিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কার ফটো? আমার?”

“হ্যাঁ তোমার। খুব ভালো লাগছে দেখতে।”

ফারনাজ ঢোক গেলে বারংবার। ফোনটা সে কিছুতেই ওই লোকের হাতে পড়তে দেবে না। আগেরবার আছড়ে ভাঙার ফলে তার হাজার টাকা খসে গেল ফোনের পেছনে। না, এবার কিছুতেই না। সে ধমকে উঠে বলল,

“কি বলছিস! কোনো ফানি ফটো টটো নেই। যা আমার রুম থেকে বের হ। ঘুমাব এখন। যা, যা।”

তূরাগ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বেরিয়ে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ফারনাজ। যাক, তার ফোনটা বোধহয় এবারের মতো বেঁচে গেল।

সুযোগ বুঝে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে ফারনাজের রুমে ঢুকে পড়ল সে। দরজাটা চাপিয়ে দিল সাবধানে। দৃষ্টি নিক্ষেপ করল বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। এই ভোলাভালা মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে কেউ বলবে যে এর পেটে পেটে এত শয়’তানী বুদ্ধি? ফোঁস করে শ্বাস ফেলে তূরাগ এগোয়। না চায়তেও তার ওড়না টেনে ঠিক করে। অতঃপর আশে পাশে কাঙ্ক্ষিত জিনিস খোঁজে, কিন্তু পায় না। না পেরে ফারনাজকে ডাকে সে,

“এই মেয়ে! এই!”

ফারনাজ ঘুমে কাত। তূরাগ বিরক্ত হয়। মানুষ এমন ম”রার মতো ঘুমায় কীভাবে? এখন তো একে তুলে ছুড়ে ফেললেও টের পাবে না। সে তার গালে একটা শক্ত চাপড় দিল,

“এই মেয়ে!”

ফারনাজ লাফিয়ে উঠল। ‘কে’ ‘কে’ করতে করতে পাশে হাতড়িয়ে চশমা নিয়ে চোখে দিল। কাছাকাছি তূরাগকে দেখে চিৎকার করতে নিলেই সে মুখে হাত ঠেসে আটকে দিল।

“চুপ! চেঁচাবে না একদম। লোকে খারাপ ভাববে। আমার কোনো খারাপ ইন্টেনশন নেই।”

ফারনাজ মুখে হাত চাপা অবস্থাতেই কথা বলে। তবে সেগুলো বোঝা যায় না। তূরাগ হাত সরায়।

“আপনি আমার ঘরে এসেছেন কেন? কি উদ্দেশ্য আপনার? হায় আল্লাহ্! আমি তাহলে ঠিকই শুনেছি রকস্টার দের ক্যারেক্টর ঢিলা হয়।”

তূরাগ দাঁতে দাঁত পিষে চাপা কন্ঠে ধমক দেয়,

“আমি তোমার এসব ফালতু বকবক শুনতে আসিনি। ফোন কোথায় তোমার?”

ফারনাজ সতর্ক হয়। তূরাগের অকস্মাৎ তার রুমে হাম’লা করার কারণ মস্তিষ্ক ধরে ফেলে। হড়বড়িয়ে বলে,

“নেই! আমার ফোন নেই।”

তূরাগ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জলদগম্ভীর কন্ঠে বলে,

“সরো।”

ফারনাজ তার কথা অনুযায়ী বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। তূরাগ বিছানা উল্টে পাল্টে দ্যাখে, কিন্তু পায় না। অতিষ্ট হয়ে বলে,

“কোথায় ফোন?”

“নেই তো।”

তূরাগ তেড়ে আসে। ফারনাজ ভয়ে দেওয়ালে লেগে দাঁড়ায়। তূরাগ তার অতি নিকটে এসে হিসহিসিয়ে বলে,

“বলো ফোন কোথায়?”

সে কাঁপা কন্ঠে বলে,

“ব বলব না।”

তূরাগ তিন আঙুলে তার গাল চেপে ধরে শক্ত করে,

“দ্যাখো ফারনাজ! আমি মোটেও মজা করার মুডে নেই, আর না কখনো থাকি। ভালোই ভালোই বলে দাও ফোন কোথায়, নাহলে চড়িয়ে তোমার গাল লাল করব। বলো!”

ফারনাজের দৃষ্টি ঝাপসা হয়। এভাবে কেউ কখনও তাকে মা’রার হুমকি দেয়নি। গালে ব্যথাও লাগছে। সে ফুঁপিয়ে উঠে বলে,

“আপনি খারাপ। আমার রুম থেকে বেরিয়ে যান।”

তূরাগ হতভম্ব। হাত সরিয়ে নিল। এইটুকুতে এই মেয়ে কাঁদতে বসল! আশ্চর্য তো! সে বলল,

“যাব। তোমার রুমে থাকতে আসিনি আমি। ফোন থেকে আমার ছবি ডিলিট করো। আমি চলে যাচ্ছি।”

তূরাগের উপর ফারনাজের রাগ হলো খুব। চশমার নিচ দিয়ে চোখ মুছে ওয়ারড্রব থেকে ফোন বের করল। তূরাগকে অবাক করে দিয়ে নিজের ফোন নিজেই সজোরে আছাড় মা’রল সে। তিন টুকরোতে ভাগ হয়ে গেল তা। সে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“এবার শান্তি? ফোনটাই আর রাখলাম না। এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যান। আপনার মতো খারাপ ব্যবহার কেউ কখনও করেনি আমার সাথে। আপনার মুখ কখনও দেখতে চাই না। দরকার পড়লে এই ভাঙা ফোন নিয়ে যান। আপনার কোনো ছবি দরকার নেই আমার।”

তূরাগ থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। সে তো শুধু ছবিগুলো ডিলিটই করতে বলেছিল, তাতে এতো রাগ! নিজের ফোন নিজেই ভেঙে ফেলল! সে বলতে চায়ল,

“শোনো মেয়ে..”

“কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি। আপনি বেরিয়ে যান।”

তূরাগ আর দাঁড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করল না। গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেল। ফারনাজ নিজের ভাঙা ফোনের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা চোখের জল ফেলল। তূরাগ কি বুঝতে পারল ফারনাজ তার ফোন ভাঙার থেকে তার কঠোর ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে? তার কোমল হৃদয়ে আঘাত লেগেছে?
কোনো কিছুর শব্দ পেয়ে আফরান এসে দাঁড়িয়েছিল ফারনাজের ঘরের সামনে। শক্ত মুখের তূরাগকে বের হতে দেখে বলল,

“কি হয়েছে রে? শব্দ হলো কীসের?”

তূরাগের মাথায় আগুন। সে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে,

“সেটা ওই বেয়াক্কেল, অভ’দ্র মেয়েকে জিজ্ঞেস কর।”

তূরাগ সোজা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আফরান হা করে দেখে গেল তার প্রস্থান। কি হলো ব্যাপারটা?

চলবে,

সে আমারই পর্ব-৬+৭

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৬

মেডিকেল কলেজের সবথেকে হ্যান্ডসাম এবং ড্যাসিং বয় আফরান ইততেয়াজ। একদম চকলেট বয়। তার আবার গার্লফ্রেন্ড এর অভাব নেই। আজ একজনের সঙ্গে দ্যাখা যায়, তো কাল আর একজনের সঙ্গে। শেষ বর্ষ ছিল তার। বেশ জমিয়ে মেয়ে নিয়ে ঘুরেছে। তবে ডেটিং প্রর্যন্তই সীমাবদ্ধ। একটু হাত ধরাধরি আর গালে একটা চুমু, ব্যস। অতি ঘনিষ্ঠ হওয়া তার ধাঁচে নেই। তারপর ভালো লাগল না, ছেড়ে দিল। এভাবেই চলে আসছে তার জীবন। আজ সে এসেছে খালামনির বাড়ি। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই। আসবে আর খালামনির হাতের সুস্বাদু খাবার গপগপিয়ে গিলবে। খালামনিকে দ্যাখা মাত্রই তাকে ঝাপটে ধরে বলল,

“ওহহো খালামনি! কেমন আছ তুমি?”

মিসেস সীমা মুচকি হেসে বললেন,

“ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? তোর তো খোঁজই পাওয়া যায় না।”

আফরান ধপ করে সোফায় বসে বলল,

“আর বলো না, খালামনি। পড়ালেখার এতো চাপ! কি খেয়ে ডাক্তারি পড়তে গেলাম কে জানে?”

“এভাবে বলছিস কেন? এই বছরটা গেলেই তো তোর নামের আগে ডাক্তার বসবে। কি ভালোটাই না লাগবে শুনতে বল তো? ডক্টর আফরান ইততেয়াজ!”

আফরান মৃদু হাসে। জিজ্ঞেস করে,

“তোমার ব’দমাশ গুলো কই সব? দেখতে পাচ্ছি না তো।”

“নাজ আর ফারদিন গিয়েছে ভার্সিটিতে। আর দৃষ, কলেজের নবীন বরণে যাবে বলে রেডি হচ্ছে হয়তো।”

আফরান এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“আচ্ছা? আমি দৃষের সঙ্গে দ্যাখা করে আসি। আমিই নাহয় কলেজে নামিয়ে দেব।”

সে সিড়ি বেয়ে চলে গেল। মিসেস সীমা বোনপোর জন্য নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কতদিন পর এলো ছেলেটা! পড়ালেখার চাপে তো আসতেই পারে না।

আফরান দৃষ্টির রুমে নক করে প্রবেশ করার প্রয়োজন অনুভব করল না। সে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল। কোনোদিকে না তাকিয়েই বলল,

“কিরে পিচ্চি! শুনলাম আজ নাকি তোদের কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান! সুন্দরী কোনো মেয়ে পাওয়া যাবে তোদের কলেজে? তবে তোর মতো কচি না, আরও বড় লাগবে।”

“আপনি না সেদিন একটা মেয়ে নিয়ে রেস্টুরেন্টে টাকা উড়িয়ে এলেন? আবার কি?”

আফরান চোখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি কে ড্রেসিং টেবিলের সামনে আবিষ্কার করল। পেছন থেকে তার মুখ দ্যাখা গেল না। সে বিছানায় ধপ করে বসে বলল,

“ছোট মানুষ ছোট মানুষের মতোই থাক। আর ঢং করে আবার শাড়ি পরছিস কেন? সেই তো লাগবে শ্যাওড়া গাছের পে’ত্নির মতো।”

আফরানের কথায় দৃষ্টি রেগে গেল খুব। হাতে থাকা বক্সটি শব্দ করে রেখে এক প্রকার তেড়ে গেল তার দিকে। এক হাত কোমরে গুঁজে, অন্য হাত নাড়িয়ে বলল,

“দেখুন আফরান ভাই! আমাকে একদম রাগাবেন না। আজ একটা ভালো দিন। আমার কলেজের প্রথম দিন। তাই আমি মোটেও মেজাজ খারাপ করতে চাইছি না।”

আফরান ভড়কে পেছন দিকে একটু ঝুঁকে গেল। দৃষ্টির দিকে চোখ পড়তেই কলিজা ছ্যা’ত করে উঠল। ওষ্ঠদ্বয় একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। লাল নাকে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা রমনীকে দেখে মুহূর্তেই মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে গেল। ফোলানো গালে তাকে আরও আকর্ষণীয় দেখাল। কপাল বেয়ে নামল সরু ঘামের রেখা তার। ঝাঁপসা হয়ে এলো চশমা। অকস্মাৎ নজর আটকাল তার গলদেশের মাঝ বরাবর ধূসর রঙা তিলটির দিকে। আফরান গলায় পানি শূন্যতা অনুভব করল। মনে হলো ওই তিলটি ছুঁতে না পারলে সে এই মুহূর্তে ম’রে যাবে। সে দৃষ্টির হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের উরুর উপর বসাল। শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরল কোমর। হকচকিয়ে গেল সে। আফরানের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,

“কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে।”

আফরানের কান পর্যন্ত তা পৌঁছাল না। এমন তো আগে কোনো মেয়েকে দেখে হয়নি। আফরান ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অধর ঠেকাল ঠিক তিলটির উপর। দৃষ্টির দেহ ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠল। খামচে ধরল তার চুল। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় তার দেহ নেতিয়ে পড়ছে। তবে আফরান থেমে নেই। তার গলায় শক্ত একটা কামড় বসিয়ে তবেই থামল সে। মুখ উঁচিয়ে দৃষ্টির মুখের দিকে তাকাতেই দেখল সে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। ঘোর থেকে বের হলো আফরান। থমকাল সে। কি করে ফেলেছে ভাবতেই হতভম্ব হয়ে পড়ল। ঢোক গিলে বলল,

“দৃষ, আমার কথাটা..”

“আপনি খুব খারাপ, আফরান ভাই।”

ডুকরে উঠল সে। আফরানের বড্ড অনুশোচনা হচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটার সাথে এমনটা করা মোটেও ঠিক হয়নি। সে কখনও কোনো মেয়েকে এভাবে ছুঁয়ে দেয়নি। তাহলে দৃষ্টিকে কেন? তার কি হয়েছিল সে নিজেও জানে না। এক হাতে দৃষ্টির চোখ মুছিয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,

“দৃষ পাখি! আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। কাঁদিস না প্লিজ।”

দৃষ্টি তাকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। জড়ানো গলায় তেজ ঢেলে বলল,

“আমি ভেবেছিলাম আপনি কেবল বাইরের মেয়েদের সাথেই! কিন্তু আপনি বোনের সাথেও..। আপনার চরিত্র এতো খারাপ! ছিঃ!”

আফরান রেগে গেল। কপালের রগ ফুলে উঠল। তার দিকে তেড়ে গিয়ে শক্ত করে বাহু আঁকড়ে বলল,

“কি করি আমি বাইরের মেয়েদের সাথে? বল! কি করি? শুধু তাদের নিয়ে একটু ঘোরাফেরা করি, ব্যস। তাদের কাউকে আমি ভালোবাসি না, দৃষ।”

অতঃপর এক হাতে তার গাল চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“আর কি বললি? বোন! তুই আমার বোন নস, দৃষ। আজ থেকে তোকে আমি বোন বলেই মানি না। বুঝেছিস তুই?”

একটু থেমে তাকে আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলে,

“এভাবে সেজেছিস কেন? হু? ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল। এক্ষুনি সব মুছবি।”

বলেই সে নিজেই পকেটে থেকে রুমাল বের করে দৃষ্টির মুখ ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে। এতে লাল বর্ণ ধারণ করে মেয়েটার মুখ। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বুঝতে পারে না আফরান আজ হঠাৎ এমন করছে কেন? ছোট্ট মন কিছুই বুঝছে না। আফরান সব মুছে ফেলে তবেই ক্ষান্ত হয়। অতঃপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চাপা কন্ঠে বলে,

“আজ তুই কোথাও যাবি না। এভাবে এই শাড়ি পরে তো একদমই না। নো ওয়ে। আমি খালামনিকে বলে দেব যে তোর শরীর খারাপ।”

সে হনহনিয়ে প্রস্থান করে। রাগে সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। দৃষ্টি মুখে হাত চেপে কাঁদে। তার ভালো মানুষ আফরান ভাই এই প্রথম এমন ব্যবহার করেছে। আগে কখনও কারো সাথে সে এমন ব্যবহার করতে দ্যাখেনি। আজ নিজে দোষ করে, দৃষ্টির উপর রাগ দেখিয়ে চলে গেল। দৃষ্টি শাড়ি সহ শাওয়ারের নিচে বসে। আফরানের ঠোঁট ছোঁয়ানো জায়গা অনবরত ঘষতে ঘষতে বিড়বিড় করে,

“আপনি খারাপ, আফরান ভাই। আপনি খুব খারাপ।”

অতিরিক্ত ভেজার ফলে দৃষ্টি ধুম জ্বরে পড়ল। ছোট মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে! মিসেস সীমার মাথায় প্রথমেই আফরানের নাম এলো। সে তো ভবিষ্যত ডাক্তার, এখন নিশ্চয় দৃষ্টির অবস্থা বুঝবে। তিনি তাকে সংবাদ দিলেন। খবর পেয়ে এক প্রকার উড়ে চলে এলো আফরান। এসে দেখল, দৃষ্টি বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। সে নিজেই তার মাথায় জল পট্টি দেওয়া শুরু করল। খেয়াল করল দৃষ্টি ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে। কান এগিয়ে শুনতে পেল,

“আপনি খুব খারাপ, আফরান ভাই। আমি আপনার সাথে আর কথা বলব না।”

আফরান মৃদু হাসে। মিসেস সীমা কে পাঠিয়ে দেয় সুপ আনার জন্য। তিনি চলে গেলে সে ঝুঁকে দৃষ্টির উত্তপ্ত কপালে অধর ছুঁইয়ে বলল,

“আ’ম স্যরি, দৃষ। আমি কখনও কারো সাথে এমন করিনি। আমার কি হয়েছিল আমি জানি না। তুই ছোট এবং খালামনির মেয়ে বলে তোকে কখনও আমি ভালো করে দেখিইনি। কিন্তু কাল শাড়িতে তোকে খুব বড় বড় লাগছিল। আমার বুকে তুই নতুন ব্যথার সৃষ্টি করেছিস, দৃষ।”

অতঃপর সে তার গলদেশে দাগের উপর আলতো বুড়ো আঙুল বুলিয়ে দিল।

তারপর থেকে আফরানের আর কোনো মেয়ে ভালো লাগে না। কারো সাথে ফ্লার্ট করতেও মন চায় না। চারপাশের সব যেন বিরক্তিকর। কোনো মেয়ে তার পেছনে ঘুরলেই সে দূর দূর করে তাড়িয়েছে। ভালো লাগে না তার, ভালো লাগে না। সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ওই পিচ্চি মেয়েটাই ঘুরঘুর করতে থাকে। আফরান চোখ বন্ধ করে দৃষ্টির নিষ্পাপ মুখ স্মরণ করে আওড়ায়,

“সব দোষ তোর, দৃষ। সব। তোর জন্যই আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। এ আমার কি সর্বনা’শ করে দিলি তুই? তোকে ছাড়া কোনো মেয়ের কথা ভাবতেই পারছি না। এখন যে এই খারাপ আমি থেকে তোর মুক্তি নেই। আমি তোকে মুক্তি দেব না।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৭

আজ পায়েল এসেছে দৃষ্টির বাড়িতে। মিসেস সীমা অনেক বার করে তাকে আসতে বলেছেন, কিন্তু সে সময়ই পায়নি। আজ সুযোগ বুঝে দৃষ্টির সঙ্গে চলেই এলো।‌ দৃষ্টির রুম থেকে দু’জনে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামল। এখন লাঞ্চের সময়। ডাইনিং টেবিলে বসে তারা টুকিটাকি কথা বলতে লাগল। মিসেস সীমা এবং মিসেস বিউটি রান্না ঘর থেকে খাবার এনে রাখছেন টেবিলে। কথা বলার মাঝেই কেউ এসে পায়েলের পাশে চেয়ার টেনে বসল। পায়েল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ফারদিন কে দেখে চুপসে গেল। এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া! ভালো আছেন?”

দৃষ্টি ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসল। ফারদিন ফোন থেকে মুখ তুলে তাকাল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছি। বসো।”

পায়েল আবার ধপ করে বসে পড়ল। এই ফারদিন কে য’মের মতো ভয় পায় সে। ফারদিন আবার বলে,

“পড়ালেখা চলছে তো ভালো মতো?”

“হ্যাঁ ভাইয়া।”

“গুড। ভালো করে পড়বে। ফাঁকি দেবে না।”

পায়েল ঘাড় বাঁকায়। দৃষ্টিকে হাসতে দেখে চোখ পাকিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“হাসছিস কেন?”

“তো কি করব? এমন একটা ভাব করলি যেন ভাইয়া স্যার আর তুই স্টুডেন্ট।”

“না না, তোর ভাই য’ম আর আমি সাধারণ পা’পী মানুষ।”

দৃষ্টি খিলখিলিয়ে হাসে। বলে,

“এতো ভয় পাস ভাইয়া কে?”

পায়েল দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বলে,

“ভয় পাব না? সে কোন একবার ভাইয়াকে ভুল করে নাজ আপু ভেবে বসেছিলাম। আর বলেছিলাম ‘আপু! আপনি কি যেমন খুশি তেমন সাজো তে নাম দিয়েছেন? একদম ছেলেদের মতো লাগছে।’ সেই যে ধমকটা দিয়েছিল আমাকে ইয়ার! আমি ইহকালে তা ভুলব না। একটু নাহয় গালটা টেনে দিয়েছিলাম, এতে কেউ এমন ধমক দেয়?”

“এতো কীসের কথা হচ্ছে, দৃষ? চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে যা।”

ভাইয়ের কথায় দু’জনে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। পায়েল পাশের য’মদূতের ভয়ে নাকে মুখে গিলে সবার আগেই উঠে গেল।

দৃষ্টি রুমে এসে দেখল পায়েল চার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টিকে দেখেই সে আহাজারি শুরু করল,

“তোর ওই গু’ন্ডা ভাইয়ের ঠ্যালায় আমি একটুও খেতে পারলাম না রে, দৃষ। ইশ! কত মজা হয়েছিল খাবার গুলো। পাশে য’ম বসে থাকলে কি আর ভালো করে খাওয়া যায়?”

“তুই ভাইয়াকে একটু বেশিই ভয় পাস। এটা তোর দোষ, ভাইয়ার না। আর খেতে পারিস নি এটাও তোর দোষ।”

“তুই নিজের ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বললি! এই তুই আমার বন্ধু! আজ থেকে তোর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি চললাম।”

চললাম বলেও পায়েল শুয়েই থাকল। দৃষ্টি ভ্রু নাচিয়ে বলল,

“কি হলো? যা!”

“দ্যাখ! আমার এখন প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠেই চলে যাব। একদম পাক্কা।”

দৃষ্টি হাসল। জীবনে এতো ব্যথা নিয়েও মেয়েটা কীভাবে এতো হাসি খুশি প্রাণখোলা থাকে সেটাই সে ভাবে।

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত যতটা ভালো কেটেছে, তার থেকে খারাপ কাটছে এখন। বাড়ি ফিরতেই বড় চাচির প্রশ্নের মুখোমুখি হলো পায়েল,

“কোথায় গিয়েছিলি? এতো দেরি হলো কেন আসতে?”

পায়েল স্পষ্ট কন্ঠে বলল,

“সেটা তুমি জেনে কি করবে? আমার ইচ্ছে।”

খেপে গেলেন মহিলা। তেড়ে এসে চুলের মুঠি ধরলেন। কুঁকড়ে উঠে আর্তনাদ করল পায়েল। তিনি বিশ্রী ভাষা দিয়ে বললেন,

“শা’লী! বাপ নাই মা নাই তার আবার তেজ! কারে দ্যাখাস তেজ? বসে বসে অন্ন ধ্বংস করে তেজ দ্যাখাতে আসিস! বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াই পড়াই কি তোর তেজ দ্যাখার জন্য? আজ তোর খাওয়া বন্ধ।‌ কাপড় ভিজিয়ে রেখেছি, সব এক্ষুনি ধুয়ে দিবি। যা, দূর হ।”

ধাক্কা দিলেন। পায়েলের এখন এসব সয়ে গিয়েছে। গায়ে লাগে না। তবে বাবা মা তুলে কথা বললে খারাপ লাগে খুব। সে নিজের ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্য হাসে। ঘরে ব্যাগ রেখে এসে কল পাড়ে কাপড় কাচতে বসে। সে জানে চাচি এখন তাকে মে’রে ফেললেও কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। তারা সকলে নিরব দর্শক। মজা লুটতে পিছ পা হয় না তারা।
পায়েল কাপড় কাচে আর মৃদু হেসে আওড়ায়,

“আমি শক্ত হলেও এরা শোধরাবে না, দৃষ। যার নিজের মাথার উপরই কেউ নেই তাকে কি কেউ গণ্য করে?”

তূরাগ নিজের ঘরের ব্যালকনিতে বসে গিটারের টুংটাং সুর তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু বারংবার তার সুর এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বার বার চোখে ভাসছে গোল চশমায় আবদ্ধ চোখ জোড়া। কানে বাজছে কাঁচের চুড়ির টুংটাং শব্দ। তূরাগ অতিষ্ট হয়ে গিটার রেখে দিল। সে সব সময় মেয়েদের থেকে দূরে থাকে। এই প্রর্যন্ত মা,বোন ব্যতীত কোনো মেয়ে তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আর কোথাকার কোন মেয়ে সরাসরি তার বুকে হামলা চালালো! এ এক প্রকার দণ্ডনীয় অপরাধ!
আফরান দুহাতে দুই কাপ কফি নিয়ে ভাইয়ের রুমে প্রবেশ করল। আনমনা ভাইকে দেখে ডাকল,

“তূরাগ!”

তার ভাবনা ভঙ্গ হলো। নড়েচড়ে উঠে বলল,

“হু?”

“এই নে কফি।”

তূরাগ হাত বাড়িয়ে নেয়। আফরান জায়গা দখল করে নেয় তার পাশে। কফিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,

“কি ভাবছিস এতো?”

“আচ্ছা ভাই? আমি কি খুব খারাপ গাই? আর আমাকে দেখতেও খারাপ?”

আফরানের ঠোঁট পুড়’তে যেয়েও পুড়’ল না। হা করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”

“বল না?”

আফরান সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,

“তুই কেমন দেখতে এবং কেমন গাস সেটা তোর ফ্যান ফলোয়ারই বলে দিচ্ছে। তোর বা আমার কথাই তা পরিবর্তন হবে না।”

তূরাগ মিনমিন করে বলল,

“তবে ওই মেয়েটা এমন বলল কেন?”

আফরান অবাক হয়ে বলে,

“কোন মেয়ে?”

তূরাগ মুখ কুঁচকে বলে,

“আরে তোর ওই বোন। কত কি না বলল আমাকে! আমি খারাপ গাই, আমাকে দেখতে খারাপ। আমাকে সে শিম্পা’ঞ্জি বলেছে। আমি নাকি গিটার নিয়ে স্টেজে লাফালাফি করি।”

আফরান হো হো করে হেসে ফেলল। হেসে তার গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। সে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

“তুই নাজের কথা বলছিস! সিরিয়াসলি! শোন ভাই, নাজ একটু অন্য রকম। যে যাকে পছন্দ করে তাকে মন প্রাণ দিয়ে পছন্দ করে। আর যাকে পছন্দ করে না, তাকে দু চোখে সহ্য করতে পারে না। মেয়ে টার মন খুব কোমল বুঝলি তো? দৃষ্টির মতো কঠিন নয়। কেউ রুড বিহ্যাব করলে সে রেগে যায় ভীষণ। আর যত রকমের আজে বাজে কথা সব তার নামে বলে। শুধুই তার সামনে, অন্য কারো না।”

একটু থেমে আবার বলে,

“তুই হয়তো একটু রুড হয়েছিস। তাই এমন বলেছে। সিরিয়াসলি নিস না।”

তূরাগ কিছু বলল না। তবে মেয়েটাকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করল। সে জিজ্ঞেস করল,

“কাল লিভ নিয়েছিস কেন?”

আফরান কফিতে চুমুক দিয়ে একটু থেমে বলে,

“অনেক দিন হলো খালামনির সাথে দ্যাখা করি না। রেগে আছে খুব আমার উপর। তাই তার রাগ ভাঙাতে যেতে হবে। এমনিতেই শশুর আমাকে দু চোক্ষে সহ্য করতে পারে না। তার সামনে দিয়ে একটু ঘুর ঘুর করে আসব।”

তূরাগ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

“সহ্য করতে পারে না কেন?”

“আর বলিস না! ছাত্র জীবনে এতো মেয়ে নিয়ে ঘুরলাম, কেউ না কেউ ঠিকই ধরে ফেলেছে। একদিন শশুরের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন থেকেই আমার নামটাও তার কানে বি’ষ। যদি জানতাম ওই লোক আমার ভবিষ্যত শশুর হবে তাহলে একটু সাবধানে থাকতাম।”

“শশুর হবে বলে তো মনে হয় না। দেখলাম তো দৃষ্টি তোকে দেখতেই পারে না। কেমন ফোঁস ফোঁস করছিল।”

মুচকি হাসে আফরান। আকাশের জ্বল জ্বল করা নক্ষত্র রাশির দিকে দৃষ্টি তাক করে বলে,

“কোনো উপায় নেই। সে নিজেই নিজের সর্বনা’শ ডেকেছিল। আমি যেচে পড়ে কিছু করিনি। যদি না সে শাড়ি পরত আর না আমি তাকে দেখে হুঁশ জ্ঞান হারাতাম। সে নিজেই আমার মন মস্তিষ্কে জায়গা করে নিয়েছে। এখন যখন ডক্টর আফরান ইততেয়াজের মাথা খারাপ করেই দিয়েছে, তখন চায়লেও সে আমার, না চায়লেও সে আমারই।”

চলবে,

সে আমারই পর্ব-৪+৫

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৪

ফারনাজ আগে অনেক গান শুনেছে। তবে সামনাসামনি এভাবে শোনা হয়নি। এমন মুগ্ধ সে আগে কখনও হয়নি। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, স্টেজে অবস্থান রত রকস্টারের দিকে। এদিকে চেঁচামেচি বেড়েই চলেছে, সিটি বাজছে আশে পাশে। আবার অতিরিক্ত গরমে এবং এতো ভীড়ের চাপে দম বন্ধ হয়ে আসছে দৃষ্টির। সে ঢোক গিলে দুর্বল কন্ঠে বলল,

“আমার খারাপ লাগছে আপু।”

ফারনাজ ঘোর থেকে বের হলো। বোনের বেহাল অবস্থা দেখে ভড়কে গেল। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

“চল, ওদিকটায় যাই।”

তাকে টেনে নিয়ে ভীড় ঠেলে বের হয়ে এক গাছের নিচে দাঁড়াল। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে বলল,

“তুই এখানে একটু কষ্ট করে দাঁড়া, দৃষ। আমি তোর জন্য পানি নিয়ে আসছি।”

সে দ্রুত পায়ে চলে গেল। দৃষ্টি বারণ করতে যেয়েও পারল না। তার শরীর সাঁই দিচ্ছে না। মাথা ভনভন করছে। মনে হচ্ছে এখনই শরীর ছেড়ে দেবে। হলোও তাই, মাথা ঘুরে উঠল তার। শরীর ছেড়ে পড়ল কারো বাহুডোরে। তবে ব্যক্তিটিকে দেখার পূর্ব মুহূর্তে চোখে আঁধার নেমে এলো।

হতভম্ব আফরান বার কয়েক পলক ফেলল। আদৌ তার ভ্রম কিনা! কিন্তু না এটা দৃষ্টিই। সে তার গালে মৃদু চাপড়ে ডাকে,

“দৃষ! এই মেয়ে!”

তার সাড়া নেই। আফরান চিন্তিত হয়। প্রেশার ফল করেছে নিশ্চয়। সে আজ না এলে কি হতো? নিশ্চয় এখানে পড়ে থাকত। মাথা ফাটাত। সে দৃষ্টিকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর হম্বিতম্বি করে ফারনাজ পানির বোতল নিয়ে এলো। দৃষ্টি কে জ্ঞানহীন অবস্থায় দেখে তার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। চিল্লিয়ে বলল,

“দৃষ! হায় আল্লাহ্! কি হলো তোর?”

আফরান বিরক্ত চোখে তাকায়। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,

“অসুস্থ অবস্থায় ও’কে রেখে কোথায় গিয়েছিলি তুই? আমি এসে না ধরলে কি হতো?”

ফারনাজ মুখ কালো করে বলল,

“আমি তো ওর জন্য পানি আনতে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে!”

আফরান দৃষ্টি কে কোলে তুলে নিল। এগোতে এগোতে বলল,

“এত ভীড়ের মধ্যে কেন এসেছিস? জানিস না দৃষ এতো ভীড় আর গরম সহ্য করতে পারে না? আর এসেছিস ভালো কথা ফারদিন কে নিয়ে আসিস নি কেন? গ’র্দ’ভ কোথাকার! আমার পিছু পিছু আয়।”

ফারনাজ মুখ বাঁকিয়ে তার পেছনে গেল। আফরান যে কোথায় যাচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে না। আশ্চর্য জনক ব্যাপার কেউ তাকে বাঁধা দিচ্ছে না। এতো এতো গার্ড চারপাশে, তার দিকে তাকাচ্ছে প্রর্যন্ত না।
আফরান একটা রুমের মধ্যে এনে দৃষ্টিকে বিছানায় আলতো হাতে শুইয়ে দিল। ফুল স্পীডে ফ্যান চালু করে দিল। ফারনাজ চারপাশে তাকাল। এটা সম্ভবত কোনো রেস্ট রুম। ফারনাজ জিজ্ঞেস করল,

“এটা কার রুম?”

“তোর শশুরের।”

“ভাই!”

আফরান চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে,

“আলতু ফালতু কথা না বলে পানির বোতল দে।”

ফারনাজ এগিয়ে দিল। আফরান হাত পানি নিয়ে দৃষ্টির মুখে আলতো ছিটিয়ে দিল। মাথায়ও অল্প পানি দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ফারনাজের এদিকে নজর নেই সে ঘুর ঘুর করতে ব্যস্ত। সে রুম ছেড়ে বেরিয়েই গেল। আশে পাশে উঁকি ঝুঁকি মে’রে দেখতে লাগল সে। পাশে তাকিয়ে সামনে এগোতেই কোনো পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার চোখ থেকে চশমা ছিটকে পড়ে গেল। ফারনাজের সামনে অধিকাংশ সব ঝাপসা হয়ে এলো। সে বেশি কিছু চশমা ছাড়া দেখতে পায় না। একেবারেই অচল বলা চলে। সে মুখ বিকৃত করে বলল,

“ধুর! এই পিলার টাও সামনে আসার সময় পেল না। এখন চশমা খুঁজব কীভাবে?”

কোনো উপায় নেই। হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে ফিরে যেতে পারবে কি? ফারনাজের পিলার উপাধি দেওয়া মানুষটি আশে পাশে তাকিয়ে চশমাটি তুলে নিল। ফারনাজ তখন ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মানুষটি শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে নিজের দিকে ফেরাল। ফারনাজ হকচকাল। পরপরই চোখে চশমার উপস্থিতি টের পেয়ে সামনে তাকাল। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। হা করে চেয়ে রইল সে। মানুষটি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“চোখে চশমা থাকা সত্ত্বেও জল জ্যান্ত মানুষকে পিলারের উপাধি দেওয়ার চেয়ে চশমা না থাকাই ভালো।”

ফারনাজ স্বাভাবিক হলো। কোণা চোখে রকস্টারের আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করল। হঠাৎ একটা বোকা কাজ করে বসল, রকস্টারের শক্ত পোক্ত বুকে এক হাত ঠেকিয়ে বলল,

“এই যে দেখুন! এমন শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেলে পিলার বলব না তো আর কি? পাথরও বলা যায়।”

তূরাগ থতমত খেয়ে দু পা পিছিয়ে যায়। এমন ঘটনা তার সাথে প্রথম। বলা নেই কওয়া নেই তার বুকে হাত ঠেকাল এই মেয়ে! আশ্চর্য! চোয়াল শক্ত করে ধমকে ওঠে,

“এই ফা’জিল মেয়ে! ম্যানারস্ জানা নেই কোনো? এভাবে এই অজ্ঞাত পুরুষের গায়ে হাত দেওয়া কোন ধরনের ভদ্রতা?”

ফারনাজ চুপসে গেল। সত্যিই তার কাজটা করা ঠিক হয়নি। কি মনে করে সে কাজ টা করল কে জানে? তাছাড়া এই লোকের কন্ঠে সে যতটা মুগ্ধ হয়েছিল, এই লোকের ব্যবহার ঠিক ততটা খারাপ। মিনমিন করে বলল,

“আপনিও তো আমার হাত ধরেছিলেন।”

তূরাগ বিস্মিত! সামান্য হাত ধরা আর এই কাজ কি এক হলো? সে থমথমে কন্ঠে বলল,

“কে তুমি? এখানে প্রবেশ করলে কীভাবে?”

ফারনাজের আর এই লোকের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এতো সুন্দর লোকের কথা এমন তেতো! তবুও সে বলে,

“ওই রুমে আমার বোন আছে।”

তূরাগ রুমের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা বিস্মিত হয়। খড়খড়ে কন্ঠে বলে,

“আমার রুমের মধ্যে তোমার বোন কীভাবে ঢুকল!”

সে লম্বা পা ফেলে এগোয়। ফারনাজ মুখ ভেংচি কেটে তার পিছু যায়। রুমে প্রবেশ করে ভাইকে অজ্ঞাত রমনীর পাশে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। ডাকে,

“ভাই!”

ফারনাজ চোখ পিটপিট করে। এই লোক আফরান ভাইকে ভাই ডাকছে কেন? দৃষ্টি আর আফরানও তাকায়। দৃষ্টির জ্ঞান ফিরেছে কিছু মুহূর্ত পূর্বে। ফারনাজ কোনো দিকে পাত্তা না দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলে,

“তোর জ্ঞান ফিরেছে, দৃষ! ঠিক আছিস তুই? চল বাড়ি যাই।”

দৃষ্টির কোনো নড়চড় না দেখে সে পুনরায় বলে,

“কি হলো? চল!”

আফরান গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

“দৃষ, আমার সাথে যেতে চায়ছে। আমি পৌঁছে দেব তোদের।”

আফরানের অকপট মিথ্যে কথায় দৃষ্টি কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল। যেন পারলে এখনই ভ’ষ্ম করে দেবে। হাত মোচড়ালো, তবে আফরানের শক্ত বাঁধন থেকে ছাড়াতে পারল না। তার ওড়নার নিচেই খুব কৌশলে তার হাত চেপে ধরে বসে আছে এই লোক। কারো চোখেই পড়ছে না তা। তূরাগ জিজ্ঞেস করল,

“এরা কারা ভাই? তুই চিনিস এদের?”

“হ্যাঁ, যে তোর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সে আমার খালামনির বড় মেয়ে, ফারনাজ। আর এই যে মহিলা আমার পাশে বসে আছে সে হলো খালামনির ছোট মেয়ে, দৃষ্টি। আর নাজ! এই রকস্টার হলো আমার ভাই তূরাগ ইততেয়াজ। তোদের সাথে হয়তো ছোট বেলায় দ্যাখা হয়েছিল। তাই তোরা চিনিস না। আমি তো জানতামই না তোরা তূরাগের এতো বড় ফ্যান। নাহলে আমিই নিয়ে আসতাম। টিকিটও কাটা লাগত না। আমি একদম ফ্রিতে এসেছি। কি সুবিধা দেখেছিস? রকস্টারের ভাই হওয়ার?”

ফারনাজ চোখ উল্টায়। ফ্যান না ছাই! এই পাথর মানবের ফ্যান কে হবে? এই পাথর মানবের গানটা যে এতো ভালো লেগেছিল! ভাবতেই ফারনাজ মনে মনে কয়েকবার তওবা করে। দৃষ্টিকে মহিলা বলায় সে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। ইচ্ছে তো করে এই লু’চু ডাক্তারের ভবলীলা সাঙ্গ করতে! আফরান আবার বলে,

“ভাই! তোর কি কাজ শেষ সব? বাড়ি ফিরবি?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে। চল তাহলে। এদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আমরা যাব।”

আফরান আলগোছে দৃষ্টির হাত মুক্ত করে দিতেই সে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। বোনের কাছে গিয়ে বলল,

“চল আপু। আমরা একাই চলে যাব। ওনাদের এত কষ্ট করতে হবে না।”

ফারনাজ তাকে বুঝিয়ে বলল,

“দৃষ! একে তো তোর শরীর ভালো নেই। তার উপর এখন রাত হয়ে গিয়েছে। আমরা কি একা যেতে পারব, বল? তার থেকে ভালো আফরান ভাই দিয়ে আসবে।”

ফারনাজের যুক্তির সামনে দৃষ্টি আর কিছু বলতে পারল না। তবে এটা বুঝল আফরান আবারও কিছু না কিছু করবে, লু’চু ডাক্তারের কোনো বিশ্বাস নেই।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৫

“শোন নাজ! তুই তূরাগের সাথে সামনে বোস, আমি পেছনে বসছি। বলা তো যায় না, দৃষ আবার কখন অসুস্থ হয়ে পড়ে।”

এই পাথর মানবের সাথে বসার একদমই ইচ্ছে নেই ফারনাজের। তবুও বোনের কথা ভেবে এক প্রকার বসতে বাধ্য হলো সে। তারা দু’জনে উঠে বসতেই তূরাগ শা করে গাড়ি টান দেয়। দৃষ্টি কটমটিয়ে আফরানের দিকে তাকাতেই সে দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দেয়। মুখ কুঁচকে ঘুরিয়ে নেয় দৃষ্টি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। আফরান সুযোগ বুঝে একটু চেপে বসে তার দিকে। তার হেলদোল না দেখে, সে আরও চেপে বসে। আলগোছে পিঠের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কোমর চেপে ধরে। শিউরে উঠে, অ’গ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। তবে আফরান এমন একটা ভাব করল যেন সে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। দৃষ্টি সা’পের ন্যায় মুচড়ে উঠে তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। হিতে বিপরীত হলো, আফরান হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করল। দৃষ্টি হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রইল। আফরান একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

“কি রে মহিলা! মুখটা এমন পেঁচার মতো করে রেখেছিস কেন? কেউ নিম পাতা খাইয়ে দিয়েছে?”

দৃষ্টি তেজী কিন্তু চাপা কন্ঠে বলল,

“আমাকে কোন দিক দিয়ে মহিলা মনে হয়? আর ছাড়ুন আমাকে।”

আফরান গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,

“উহু! তুই মহিলা নস। তুই হলি কচি নাদুসনুদুস একটা বাচ্চা। দেখলেই শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে। ওলে লে লে।”

বলেই তার গাল টেনে দেয়। তার গাল দুটো একটু ফোলা বলে আফরান তাকে নাদুসনুদুস বাচ্চা উপাধি দিল। দৃষ্টি ভয়’ঙ্কর রেগে যাচ্ছে দেখে আফরান একটু নড়েচড়ে বসল। বলল,

“এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? খেয়ে ফেলবি নাকি? দ্যাখ আমি কিন্তু খুবই ভদ্র একটা ছেলে। তোর এই নজর দিয়ে আমাকে কাবু করতে পারবি না।”

দৃষ্টি দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“দেখুন!”

“দ্যাখা।”

আফরান চোখ বড় বড় তাকাল। যেন সে কিছু দ্যাখারই অপেক্ষা করছে। দৃষ্টি হতাশ শ্বাস ফেলে পুনরায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল,

“লু’চু ডাক্তার কোথাকার!”

আফরান ঠোঁট কামড়ে হাসে। ছোট্ট এই মেয়েটার নাকের ডগায় রাগ দেখতে তার বেশ লাগে।

ফারনাজ একটানা চুপ করে বসে থাকতে পারে না। সে এখন কথা বলার জন্য উসখুস করছে। পেটে কথা চেপে না রাখতে পেরে বলেই ফেলল,

“আচ্ছা রকস্টার মশাই? আপনি কি দেশের বাইরে হাডুডু খেলতে গিয়েছিলেন? নাকি কাবাডি? নাকি কুস্তি?”

ফারনাজের এমন অকেজো কথা শুনে তূরাগ বিরক্ত হলো। সে একজন রকস্টার। একজন রকস্টার দেশের বাইরে কি করতে যায়? এই মেয়ে কি তা জানে না? সে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আর একটা ইউজলেস কথা বলেছ তো ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে আউট করে দেব। স্টু’পিড মেয়ে!”

ফারনাজ আড়ালে ভেংচি কেটে চশমা ঠিক করে ফোন বের করল। ‘অ্যাহ! ওনার সাথে কথা বলতে বয়েই গেছে আমার। রকস্টার হয়ে যেন মাথা কিনে নিয়েছে।’ সে ফোন লাগাল সুমির ফোনে। রিসিভ করতেই বলল,

“এই জুসি! তোরা গিয়েছিলি কনসার্টে?”

“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। আমিও গিয়েছিলাম। কি আর বলব! এমন বাজে কনসার্ট আমি আমার জীবনে দেখিনি।”

“কি বললি? ডুবে ডুবে ভালোবাসি গান? আরে ওইটা সব থেকে বি’শ্রী লেগেছে আমার কাছে। এমন বাজে কেউ কীভাবে গায়তে পারে? আমিও এর থেকে ভালো গাই।”

“কি! চেহারা সুন্দর ছিল! ছিঃ ছিঃ! তুই ওটাকে চেহারা বলিস! আমার তো মনে হলো কোনো শি’ম্পাঞ্জি গিটার নিয়ে নাচানাচি করছে।”

এক পর্যায়ে গাড়ির ব্রেক কষলো তূরাগ। মেজাজ তার আগে থেকেই বিগড়ে ছিল। তা বিগড়েছে স্বয়ং ফারনাজ। হঠাৎ ব্রেক কষায় হকচকাল সবাই। ফারনাজের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারে সে। ফারনাজ চেঁচায়,

“আরে! আমার ফোন!”

“চুপ! একদম চুপ! তোমাকে আমি চুপ থাকতে বলেছি না? অভ’দ্র মেয়ে!”

তূরাগের ধমকে কেঁপে উঠল ফারনাজ। আফরান উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“কি হয়েছে?”

আফরানের কন্ঠস্বর পেয়ে ফারনাজ ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠল। নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলল। তূরাগ অতিষ্ট ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। “আমার ফোন, আমার ফোন” করে কিছুক্ষণ আহাজারি করল সে। অতঃপর নাক টেনে বলল,

“দৃষ! আমাকে নিয়ে যা। এই লোক আমাকে বকেছে। এমন পাষা’ণ মানুষ আমি কোনো দিন দেখিনি। এই দৃষ! আমি তোর কাছে যাব।”

আফরান মুখ কুঁচকাল। কি সুন্দর দৃষ্টির পাশে বসে তাকে বিরক্ত করতে পারছিল। দৃষ্টির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও খুব ভালো লাগছিল। তার ভাইটাও না! ধৈর্য্য নেই একদম। এখন এখান থেকে না উঠলে ফারনাজ কেঁদে কুটে সমুদ্র বানিয়ে ফেলবে। আর ভালো লাগে না! সে দৃষ্টিকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নামল। বলল,

“নাম। যা পেছনে গিয়ে বোস।”

ফারনাজ দ্রুত ভঙ্গিতে নেমে গেল। চশমা উঁচু করে চোখ মুছে দৃষ্টির পাশে গিয়ে বসল। ফোনটা তুলে নিয়ে যেতে ভুলেনি। দৃষ্টি বোনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কি করেছিস তুই, আপু? তূরাগ ভাই চেঁচালেন কেন?”

ছলছল চোখে তাকিয়ে ফারনাজ বলে,

“আমি কিছু করিনি। ওই লোক এমনি এমনিই বকেছে।”

“আমার বিশ্বাস হয় না।”

“বিশ্বাস করতে হবে না। তোরা সবাই আমার ঘাড়েই দোষ দিবি। দ্যাখ আমার ফোনটার কি অবস্থা করেছে! কতদিনই বা বয়স হয়েছে এর?”

সে আবারও নাকে কাঁদল। তূরাগ ভ্রু কুঁচকে ফ্রন্ট মিররে তা দেখল। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল।
বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই ফারনাজ হম্বিতম্বি করে নেমে পড়ল। দৃষ্টি নেমে শান্ত কন্ঠে বলল,

“তূরাগ ভাইয়া! আসুন আমাদের বাড়ি। এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।”

তূরাগ মৃদু হেসে বলল,

“আজ নয়। অন্য কোনো দিন।”

আফরান সবে হা করেছে কিছু বলার জন্য। তাকে সে সুযোগ না দিয়েই তূরাগ গাড়ি স্টার্ট করল। তারা চলে যেতেই ফারনাজ মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“ওই পাথর মানবকে আবার ডাকতে গেলি কেন? আমি জানতাম যে আসবে না। পাথর মানবরা এমনই হয়। দেখলি না? আমার ফোনটা ভেঙে কি করেছে? সময় আমারও আসবে।”

“হ্যাঁ আসবে। চল।”

দৃষ্টি বাড়ির দিকে এগোলো। শিহরণে শরীর কাঁপছে এখনও তার। আফরান কাছে এলে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। বুকের ধুকপুক হাজার গুণ বেড়ে যায়। চারপাশে শতশত প্রজাতি উড়ে যায়। তবে সে আফরানকে পূর্ব থেকেই চেনে। আফরান কলেজে থাকাকালীন অনেক মেয়ের সাথে ঘুরতেও দেখেছে সে। তবে চার বছর ধরে সে মেয়ে নামক প্রাণী থেকে দূরে আছে, শুধু সে ছাড়া। তবে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে নার্সদের সাথে কথা বলে। আর ভাবে সে কিছুই বোঝে না।

“আচ্ছা ভাই? দৃষ্টিই কি তোর সেই পিচ্চি?”

আফরান সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বলে,

“হু আমার পিচ্চি। শুধু আমার।”

মুচকি হাসে তূরাগ। পরক্ষণে আফরান লাফিয়ে উঠে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

“দেখলি! তুই দেখলি! তোকে ভেতরে যেতে বলল, চা ও খেতে বলল। কিন্তু আমাকে যেতে বলল না। কি অপমানটাই না করল আমাকে। এই বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আমি আর পারি না।”

“তুইও কম যাস না, ভাই। আমি কিন্তু দেখেছি সব, পেছনে মেয়েটাকে কেমন বিরক্ত করছিলি।”

আফরান মুখ কালো করে। হতাশ শ্বাস ফেলে বলে,

“বিরক্ত না করে আর উপায় কি? মহারানী তো আমাকে পাত্তাই দেয় না। তাকায়ও না। একই মেডিকেলে সব সময় চোখের সামনে ঘুরঘুর করি। তাও!”

“কিন্তু কেন? আমার এমন হ্যান্ডসাম, ডক্টর ভাইকে পাত্তা দেয় না এমন কোনো মেয়ে পৃথিবীতে আছে নাকি!”

“দুঃখের কথা আর বলিস না ভাই। সেই চার বছর ধরে আমি ঝুঁলে আছি। খুব বাজে ভাবে ফাঁসিয়েছে এই মেয়ে আমাকে। সর্বনা’শ টা আমার চার বছর আগেই হয়েছে। যখন এই মেয়ে ভালোবাসার ‘ভ’ ও বুঝত না। আর আমি দিব্যি মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম! চার বছর আগেই আমি মেয়ে সঙ্গ ত্যাগ করেছি। কাউকেই আর ভালো লাগে না। এই মেয়ে নিজেও জানে না, নিজের অজান্তেই তীর ছুড়েছে এবং তা ঠিক আমার বুকে এসে লেগেছে।”

চলবে,

সে আমারই পর্ব-২+৩

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০২

ভার্সিটির ক্যাম্পাসে গালে হাত দিয়ে থমথমে মুখে বসে আছে ফারনাজ। তার মাথার ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলোর মতো মেঘগুলো। নীল আকাশে সাদা মেঘ বড়ই দৃষ্টিনন্দন। তার পাশে বসে রয়েছে তার সব থেকে প্রিয় বন্ধু গুলো। সুমি ও আফিয়া। এই তিন জন স্কুল জীবন থেকেই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। গলায় গলায় ভাব। তবে এর মধ্যে সুমি বিবাহিত। ফারনাজ ও আফিয়া এখনও কুমারী। হয়তো পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে তাদের বিয়ের ফুল ফুটলেও ফুটতে পারে। এর মধ্যে একটি বিষয় হলো ফারনাজ কোনো ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে না। সে সবাইকে বয়ফ্রেন্ডের দৃষ্টিতে দ্যাখে। ভাই এর চোখে দ্যাখার প্রশ্নই আসে না। ভাই তো জুনিয়র গুলো।
ফারনাজ কে মনম’রা হয়ে বসে থাকতে দেখে সুমি জিজ্ঞেস করে,

“কি ব্যাপার নাজ? সামান্য একটা ব্রেক আপ নিয়ে এতো চিন্তিত কেন তুই?”

ফারনাজ আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হতাশ শ্বাস ফেলে বলে,

“ব্রেক আপ এর জন্য না রে ফুলি।”

সুমি বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়। তার বাহুতে জোরে সোরে আঘা’ত করে বলে,

“আমি সুমি, নাজ!”

ফারনাজ মুখ কুঁচকে আঘা’তকৃত স্থানে হাত ঘষে বলে,

“ওই একই হলো।”

“এবার বল কাহিনী কি?”

“আই ব্যাডলি নিড অ্যা বয়ফ্রেন্ড, টুসি।”

সুমি দাঁতে দাঁত চাপে। শুধরে দিয়ে বলে,

“সুমি!”

“আরে রাখ তোর নাম। আমি আছি আমার জ্বালা’য়। ওই ডালিয়া তুই তো কিছু বল? এখন বয়ফ্রেন্ড কই পাব?”

এবার আফিয়া মুখ কুঁচকে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“বয়ফ্রেন্ড তো আর বাচ্চার হাতের মোয়া নয় নাজ। যে তুই চায়বি আর আমরা কেড়ে এনে দেব।”

ফারনাজ ঠোঁট উল্টে মুখ কাঁদো কাঁদো করে। যেন সে কোনো খেলনা চায়ছে এবং সেটা তার এই মুহূর্তে চায়। প্রসঙ্গ পাল্টে সুমি বলল,

“কাল আমার ফেভরেট রকস্টারের কনসার্ট আছে। কে কে যাবি বল?”

আফিয়া গদগদ হয়ে তৎক্ষণাৎ সায় দেয়। কারণ সে তারও পছন্দের। বলে,

“ওহ মাই গড! সত্যি বলছিস? সে দেশে ফিরেছে!”

“হ্যাঁ এবং সে এবার থেকে দেশেই গান গায়বে। বিদেশে আর যাবে না।”

উল্লাসে ফেটে পড়ে আফিয়া মৃদু চিৎকার করে। তবে ফারনাজ ভাবলেশহীন। সে এসব কনসার্ট ফনসার্ট খুব কমই দ্যাখে। টিভিতে মাঝে মধ্যে চোখে পড়লেও সামনাসামনি দ্যাখা হয়নি কখনও। আফিয়া তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,

“কি রে! তুই যাবি না? ভেবে দ্যাখ নাজ, ওখানে অনেক ছেলে থাকবে। তুই নিজের মতো একটা বেছে নিতে পারবি।”

ফারনাজের চোখ চকচকে হয়। সে অনবরত মাথা দুলিয়ে বলে,

“অবশ্যই যাব। আর তোরা দেখে নিস আমার সাত নম্বর বয়ফ্রেন্ড আমি ওখান থেকেই ঠিক করব।”

দুই বান্ধবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ক্ষণে ক্ষণে বয়ফ্রেন্ড পাল্টানো ফারনাজের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গোল চশমা চোখে ফারনাজকে খুব সুন্দর লাগে। সেই সাথে হলুদ ফর্সা গায়ের রং। কোমর ছুঁই ছুঁই চুল গুলো দেখলে কোনো ছেলে এক কথায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তারা মনে মনে প্রার্থনা করে খুব শীঘ্রই এমন কেউ আসুক যেন ফারনাজের সাতেই সমাপ্ত হয়।

“আই ওয়ার্ন ইউ, দৃষ! আমার কাছে আসবি না। আজ আমি সুইসাইড করেই ছাড়ব। নো ওয়ান ক্যান স্টপ মি।”

দৃষ্টি ক্যাটিনের টেবিলে বসে চোখের সামনে বই ধরে রেখেছে। পায়েল দৃষ্টির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে পুনরায় বলল,

“আ’ম সিরিয়াস দৃষ। এক্ষুনি আমি হাত কে’টে ফেলব।”

দৃষ্টি বই রেখে তার দিকে তাকাল। পায়েল সত্যি সত্যিই হাতে ছুরি চালাতে নিলে ছুরির আগা ধরে টান দিল সে। ফলে হাতের তালু কে’টে গেল। ঝরঝরিয়ে র’ক্ত পড়তে লাগল। আঁতকে উঠল পায়েল। তার হাত ধরতে নিলে সরিয়ে নিল সে। শান্ত কন্ঠে বলল,

“আ’ম ফাইন।”

পায়েল মানল না। চোখ ছলছল করে উঠল। ভো দৌড় দিয়ে ক্যানটিন থেকে বের হয়ে গেল। দৃষ্টি সেদিকে তাকিয়ে টিস্যু দিয়ে ক্ষ’ত স্থান চেপে ধরল। কিছুক্ষণ পরেই পায়েল এলো, তার সাথে এসেছে ডাক্তার এবং নার্স। বিরক্ত হলো দৃষ্টি। এই মেয়ে নিশ্চয় হাসপাতাল মাথায় তুলে এদের এনেছে। নার্স এগিয়ে এসে ফার্স্ট এইড বক্স দৃষ্টির সামনে রাখল। দৃষ্টি জানে এখানে উপস্থিত কেউই তার হাত স্পর্শ প্রর্যন্ত করবে না, ড্রেসিং করা তো দূরে থাক। দৃষ্টিকে বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হলো না। হম্বিতম্বি করে প্রবেশ করল এক পুরুষ। দৃষ্টির সামনে ধপ করে বসে শীতল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিল তাকে। পায়েল ভেজা কন্ঠে বলল,

“ড. আফরান ও’র খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি প্লিজ দ্রুত ড্রেসিং করে দিন।”

আফরান চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসল। ইশারায় ভীড় কমাতে বলল। শুধু থেকে গেল পায়েল এবং এক জন নার্স। আফরান নার্সটির দিকে তাকিয়ে বলল,

“মিস শীলা! ইউ আর লুকিং সো বিউটিফুল টুডে।”

শীলা লাজুক হেসে বলে,

“থ্যাঙ্ক ইউ, ডক্টর।”

দৃষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে উঠে যেতে নিলেই আফরান তার ক্ষ’ত হাত চেপে ধরে। শীলার দিকে তাকিয়েই বলে,

“বিউটিফুল লেডি! তুমি কি আমাকে তুলোতে করে একটু ডেটল দিতে পারো?”

“অফ কোর্স, ডক্টর।”

সে তুলো এগিয়ে দিল। আফরান সেটা দিয়ে দৃষ্টির ক্ষ’ত ধীরে ধীরে পরিষ্কার করতে লাগল। দৃষ্টি জ্বা’লায় চোখ খিচে নিলে সে ধীরে ধীরে ফুও দিল। অবশেষে গজ পেঁচিয়ে দিতে দিতে বলল,

“আপনার সতর্ক থাকা উচিত, মিস দৃষ্টি।”

দৃষ্টি কিছু বলে না। মুখ ঘুরিয়ে রাখল। আফরান দৃষ্টির শ্যামলা ফর্সা মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে নিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,

“আমাকে আর কত দৌড় করাবে মেয়ে? আমার হাড় মাংস আলাদা করে তবেই কি দম নেবে?”

দৃষ্টির কানে পৌঁছালেও সে নীরব থাকে। আফরান পুনরায় এক পলক দেখে চলে গেল। তার প্রস্থানের পর পায়েল আলতো করে দৃষ্টির হাত ধরে বলল,

“আমাকে মাফ করে দে জান। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি তুই এভাবে..”

দৃষ্টি হাত উঁচিয়ে তাকে থামায়। মৃদু স্বরে বলে,

“নিজেকে দোষারোপ করিস না। চল ক্লাসে যাই।”

সে উঠে দাঁড়ায়। পায়েল তার পিছু পিছু যেতে যেতে বলে,

“ড. আফরান খুব দয়ালু মানুষ তাই না? আমি একবার বলাতেই সকল ব্যস্ততা ফেলে ছুটে এলো। এমন মানুষ আর দুটো হয়?”

দৃষ্টি জবাব দেয় না। তাকে নির্বাক দেখে পায়েল আর কিছু বলে না। তবে ক্লাসে প্রবেশ করার আগে দৃষ্টি বলে,

“রোজ রোজ এমন পাগলামী করবি না পায়েল। প্রতিবাদ করতে শেখ। তুই একবার রুখে দাঁড়ালে নিশ্চয়ই তোর সাথে কেউ আর অন্যায় করার সুযোগ পাবে না। আমি জানি তুই আমার সাথে মজা করে হাতে ছু’রি ধরেছিলি। কিন্তু বাড়িতে থাকলে তুই এই কাজ করতে দুবার ভাববি না। তাই তোকে আরও শক্ত হতে হবে। আমি কি বোঝাতে পেরেছি?”

পায়েল মুখ গোমড়া করে ফেলল। পর পর ফেলল দীর্ঘশ্বাস। সে বুঝেছে এবং বোঝে। তবে সাহসে কুলোয় না। লড়তে লড়তেই তো এতদূর এসেছে। আর কত?

সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ভবনটি। বাইরে থেকে দেখলে নজর থমকাতে বাধ্য, না জানি ভেতরে কত সুন্দর হবে! এই ভবনটি আজ যেন নতুন বধুর ন্যায় সেজেছে। সাজবে না’ই বা কেন? সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে তাদের ছোট পুত্রটি দেশে ফিরছে যে! দেশ বিদেশে নাম কামিয়ে সে অবশেষে নিজ দেশে ফিরছে। এই তো ভবনে পা রাখল বলে। বাড়ির মধ্যে হইচই লেগে আছে, কোনো কিছু ভুল হলো না তো? মিসেস অনা ব্যস্ত হাতে ছেলের পছন্দের সব খাবার টেবিলে গুছিয়ে রাখছেন। তিনি ফের একবার দেখে নিলেন কোনো কিছু বাদ পড়ল কিনা। সকল খাবারের মধ্যে একটা খাবার অনুপস্থিত। তিনি গলা উঁচিয়ে হাক ছাড়লেন,

“আপা! চিনি ছাড়া পায়েসটা কই গো? শিগগিরই নিয়ে এসো। ছেলেটা আমার এলো বলে!”

রান্নাঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন মিসেস সাইমা। পায়েসের পাত্রটি টেবিলে রেখে বললেন,

“আর কিছু বাদ নেই তো, অনা?”

“না আপা। সব ঠিক আছে।”

স্বস্তির শ্বাস ফেললেন তিনি। ছোট ছেলের আগমনে তারা আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখতে চাননা। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন একবার। রাত আটটা বাজে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো আগমন ঘটবে তাদের কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে এলো। চকচক করে উঠল উভয়ের চোখ।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ০৩

“তুই কেমন আছিস বাবা? আমাদেরকে ভুলে গিয়েছিস? একবারও কি মনে পড়ত না আমাদের কথা? এতো পাষা’ণ তুই!”

ছেলের বুকে পড়ে নাক টেনে আহাজারি করে চলেছেন মিসেস অনা। মিসেস সাইমা পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষণে ক্ষণে আঁচলে চোখ মুছে নিচ্ছেন। তবে মানুষটি হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকেও। তিনি হাসি মুখে তাকে আলিঙ্গন করলেন। নিজেদের স্ত্রীদের এহেন কারবার দেখে বিরক্ত হচ্ছেন তিয়াস ইততেয়াজ ও আমিনুল ইততেয়াজ। তিয়াস ইততেয়াজ ধমকে উঠে বললেন,

“কি হচ্ছে কি অনা? ছেলেটা কতদূর থেকে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে এলো। আর তোমরা দরজায় দাঁড়িয়েই শুরু হয়ে গেলে? ছেলেকে একটু বিশ্রাম নিতে দেবে তো নাকি?”

মিসেস অনা নাক টেনে ছেলে থেকে সরে আসেন। অভিযোগের সুরে বলেন,

“দেখলি? তোর বাবা আমাকে শান্তিতে দুটো কথা বলতেও দেয় না। সব সময় ব্যাগড়া দিতেই হবে তাকে।”

ছেলে হাসে। মৃদু হাসি। যেন সে সব কিছু মেপে মেপে চলে। মিসেস সাইমা বললেন,

“হ্যাঁ রে অনা! ও’কে আগে একটু বিশ্রাম নিতে দে। তারপর যত কথা আছে সব বলিস। কেউ তখন আর বাধা দেবে না।”

মিসেস অনা মেনে নিলেন। ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,

“যা বাবা ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম করে নে। তারপর তোকে খেতে ডাকব। তোর পছন্দের সব কিছু রান্না করেছি আমরা।”

ছেলে তার মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে এগোয়। তবে আবার থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“ভাই কোথায়? আমাকে নিতে গেল না কেন এয়ারপোর্টে?”

শুকনো মুখে আমিনুল ইততেয়াজ জবাব দেন,

“তার ইমার্জেন্সি পড়ে গিয়েছিল। তাই যেতে পারেনি। এখনও বাড়িতেও ফেরেনি।”

ছেলে তাদের আর কিছু বলল না। জুতোর খট খট আওয়াজ তুলে প্রস্থান করল। পেছন থেকে সকলে একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলেন। আজ হয়তো বড়ো ছেলের কপালে স্বল্প বিস্তর দুঃখ রয়েছে।

বাড়ি পৌঁছে হাত ঘড়িতে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল আফরান। ঘড়ির কাঁটা বারোটায় ঠেকেছে। শান্তি নেই একদমই শান্তি নেই। একে তো দৃষ্টি নামক পাজি মেয়েটা মুখ কালো করে রেখে তার মাথা খারাপ করে, তার ওপর হাসপাতালের যত ঝামেলা। মনে হয় সে ছাড়া আর কোনো ডাক্তারই নেই যেন। ডুবলিকেট চাবি দিয়ে সে লক খুলে বাড়িতে প্রবেশ করে। সবাই নিশ্চয় ঘুমিয়ে? রাতও তো কম হয়নি। সে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। শরীরটাও যেন আর চলতে চায়ছে না। রুমে প্রবেশ করে লাইট অন না করেই জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করল। শাওয়ার না নিলেই নয়। দীর্ঘক্ষণ গা ভিজিয়ে সে বের হলো। ভাবল লাইট জ্বালিয়ে আর কি কাজ? এখন তার একটা দীর্ঘ ঘুম প্রয়োজন। সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। হাত পা ছড়িয়ে দিতেই কারো গায়ে লাগল। তার রুমে এই সময়ে কে থাকতে পারে? ভেবেই “ওমা গো” বলে লাফিয়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিল। পাশ ফিরে তাকিয়ে হাত পা ছড়ানো অবস্থায় অতি আপনজন কে আবিষ্কার করল। চাপা চিৎকার দিয়ে বলল,

“তূরাগ!”

হা করে চেয়ে রইল। এতো কাজের মধ্যে তার মনেই ছিল না যে আজ তার ভাইটির দেশে পা রাখার কথা। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভাইয়ের উপর। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলল,

“তূরাগ কেমন আছিস তুই? ওহ মাই গড! আমি ভাবতেও পারিনি বাড়ি এসে তোকে দেখতে পাব।”

তূরাগ মুখ কুঁচকে তাকে ছাড়াল। থমথমে কন্ঠে বলল,

“থাক! আর ন্যাকামো করতে হবে না।”

“কেন রে জানটুস? রাগ করেছিস আমার উপর?”

“না, আমি কারোর উপর রাগ করিনি। সর তুই।”

আফরান ফটাফট তার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,

“রাগ করে থাকিস না ভাই। বিশ্বাস কর! হাসপাতালে এত চাপ ছিল যে আমি তোর আসার কথাই ভুলে গিয়েছি।”

নাক সিঁটকায় তূরাগ। দ্রুত হাতে গাল ঘষে বলে,

“ছিঃ! নিজের বউকে গিয়ে চুমু দে। আমার কাছ থেকে সর। বাসায় কেন এসেছিস? হাসপাতালে রোগীদের সাথেই থাকতি। সাথে সুন্দর সুন্দর নার্স।”

“এমন বলিস না ভাই। তুই খুব ভালো করেই জানিস, তোর ভাই সেই কবেই এক বাচ্চাকে মন, প্রাণ, কলিজা, ফুসফুস, কিডনি, চক্ষু, নাসিকা সব দিয়ে বসে আছে। আমি এতটাও ফোর টুয়েন্টি নই যে সারা মেয়ের সাথে লাইন মে’রে বেড়াব।”

তূরাগ সশব্দে হাসে। ভাইয়ের পেটে গুঁতো দিয়ে বলে,

“নাইস জোক। তুই ফোর টুয়েন্টি নস এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে! তাহলে কলেজের কোনো মেয়ে যে তোর ফ্লার্টের হাত থেকে রক্ষা পায়নি, সে কথা কে বলবে?”

“ভাই বিশ্বাস কর! যেদিন থেকে ওই পিচ্চির মায়ায় আমি পিছলে গেছি, সেদিন থেকে সব বাদ। আমি কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না। তুই ভাবতে পারছিস? আমার এই ত্রিশ বছর বয়সে কি ঝড় টাই না তুলেছে ওই মেয়ে! যে আমি অন্য মেয়েদের দিকে তাকানোর সময় পাই না, আমার ইচ্ছেও করে না। জানিস কত সুন্দর সুন্দর নার্স চারপাশে ঘোরে? তোকে একটা সুন্দর নার্স এনে দেব। তোর ভালো সেবা যত্ন করতে পারবে।”

তূরাগ তাকে দুহাতে ঠেলে সরাল। নাকোচ করে বলল,

“দরকার নেই। আমি এমনই ঠিক আছি। সুন্দর নার্স লাগবে না। দ্যাখ ভাই, অনেক টায়ার্ড আমি, তুইও নিশ্চয়? ঘুমা আর আমাকেও ঘুমাতে দে। বাকি কথা সকালে হবে। কাল আবার আমার শো আছে। আই নিড স্লিপ।”

আফরান তাকে আর বিরক্ত করল না। নিজেও ক্লান্ত প্রচুর। তবে ভাইকে ছাড়ল না। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমে তলিয়ে গেল।

আজ ফারনাজ সুন্দর করে সেজেছে। চোখে কাজল দিয়েছে আর ঠোঁটে দিয়েছে লিপস্টিক। হাতে আবার কাঁচের চুড়িও পরেছে। চুলটা ছেড়ে রেখেছে। এতেই তাকে নজর কাড়া সুন্দর লাগছে। সে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে চোখে চশমা এনে ঘর ছেড়ে বের হলো। নিচে দৃষ্টি তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বোনকে দেখে সে বিরক্ত মাখা কন্ঠে বলে,

“এতো দেরি হয় কেন তোর আপু?”

“আরে দেরি করলাম কোথায়? তোরই তাড়াতাড়ি হয়ে গিয়েছে।”

ফারনাজ কনসার্টে যাচ্ছে। সাথে দৃষ্টিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তবে ফারনাজও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। ফারনাজ চেঁচিয়ে বলল,

“মা! আমরা গেলাম।”

পাল্টা কন্ঠস্বর এলো,

“ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।”

তারা রওনা দিল। সিএনজি তে চেপে কনসার্টের জন্য নির্ধারিত জায়গার দিকে অগ্রসর হলো।

প্রচুর ভীড়! দেখেই বোঝা যাচ্ছে রকস্টার কত বড় মাপের রকস্টার! ফারনাজ এই ভীড়ে বন্ধুদের খোঁজার মত বোকামি করতে গেল না। টিকিট কেটে বহু কষ্টে বোনকে নিয়ে প্রবেশ করল।
চারদিকে হাজার মানুষ হইহই করছে। অপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। এত ভীড়ে দৃষ্টি বোনের সঙ্গে লেগে গেল। ঠেলাঠেলি হচ্ছে ভীষণ। ফারনাজ করুণ কন্ঠে বলল,

“একটু সহ্য কর, দৃষ। কোনো ফাঁকা জায়গা পেলেই আমরা চলে যাব।”

দৃষ্টি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফারনাজ আশে পাশে দৃষ্টি ঘোরায়। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছিল, এত ভীড় দেখে তা মাঠে মা’রা গেল। তার এখন বিরক্ত লাগছে। এর মধ্যে থেকে এখন বের হবারও উপায় নেই। আবার গরমও লাগছে প্রচুর। এখন সন্ধ্যা হলেও গরম কম নয়। চুল ছেড়ে আসাটা যে মূর্খতামো হয়েছে, তা এখন টের পাচ্ছে সে।
হঠাৎ হই হুল্লোড় দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছে। অশান্ত পরিবেশ আবার শান্ত হয়েও গেল। ফারনাজের শ্রবণেন্দ্রিয়ে ভেসে এলো গিটারের শব্দের সাথে অদ্ভুত সুন্দর কন্ঠস্বর,

“তুমি না ডাকলে আসব না
কাছে না এসে ভালোবাসব না
দূরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
নাকি চলে যাবার বাহানা বানায়?

দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরোনো,

ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।

এটা কি ছেলে খেলা আমার এই স্বপ্ন নিয়ে?
চায়লে ভেঙে দেবে গড়ে দেবে ইচ্ছে হলে?

আমি গোপনে ভালোবেসেছি
বাড়ি ফেরা পিছিয়েছি,
তোমায় নিয়ে যাব বলে

এই বার এসে দেখো
হেসে বুকে মাথা রেখো,
বলে দেব চুলে রেখে হাত

দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরোনো,

ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।”

চলবে,

সে আমারই পর্ব-০১

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#সূচনা_পর্ব

“ট্রাস্ট মি, ফিরোজ! আই লাভ ইউ। ট্রু টু সে আই লাভ ইউ সো মাচ! প্লিজ ডোন্ট লিভ মি। আই বেগ টু ইউ!”

ফোনের ওপাশে নিরবতা। ব্যক্তিটি যেন টু শব্দটি পর্যন্ত করতে জানে না। জন্ম বোবা যেন! কোনো শব্দ না পেয়ে মেয়েটি পুনরায় বলল,

“ওয়াট হ্যাপেন্ড ফিরোজ? সে সামথিং? কিছু তো বলো?”

ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ আসে। লম্বা শ্বাস টেনে সে বলে,

“আমি ফিরোজ নই, ফারনাজ!”

ফারনাজ বিভ্রান্তিতে পড়ে। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে বলে,

“আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি, জাহিদ। আসলে জিহ্বা পিছলে বেরিয়ে গিয়েছে। প্লিজ ডোন্ট গো।”

“আমি জাহিদও নই।”

“ওহ! তাহলে নিশ্চয়ই মুরাদ? আমি স্যরি বলছি, মুরাদ।”

ফোনের ওপাশ থেকে কর্কশ কন্ঠ ভেসে আসে,

“আমি মুরাদও নই!”

ফারনাজ এবার বিরক্ত হয়। চেঁচিয়ে বলে,

“আশ্চর্য! এতো গুলো নাম বললাম একটাও তুই না? তাহলে কে তুই?”

“আমি সাকিব।”

ফারনাজ নাক সিঁটকায়,

“ছিঃ! এতো ভালো ভালো নাম বললাম তা তোর পছন্দ হলো না। শেষ মেষ সাকিব! তুইও নিশ্চয়ই সাকিব খানের মতো লুই’চ্চা হবি! তুই কি ব্রেক আপ করবি? আমিই করলাম! যা।”

ফারনাজ খট করে ফোন কেটে দিল। সাকিব কিছুক্ষণ হা করে ফোনের দিকে চেয়ে রইল। সে তো নিজে এই মেয়েকে ছেড়ে দিচ্ছিল, ভেবেছিল হাতে পায়ে পড়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলে আবার প্যাচ আপ করে নেবে। কিন্তু এই মেয়ে তো নিজের বয়ফ্রেন্ডের নামটা প্রর্যন্ত মনে রাখতে পারে না! আর সাকিব নাম সে তো ইচ্ছে করে রাখেনি।‌ বাবা মা রাখলে তার কি দোষ? তখন কি তারা জানত সাকিব নামের নায়ক বের হবে আর একের পর এক খেল দ্যাখাবে?

ফোন বিছানায় এক প্রকার ছুড়ে ফেলে মুখ কুঁচকে নিল ফারনাজ। একটা জাতের বয়ফ্রেন্ড পাওয়া যাচ্ছে না। এসব সাকিব টাকিব কোথা থেকে আসে কে জানে? বিছানায় আরও এক রমনীর বিস্তার রয়েছে। তবে সে নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন। ডুবে রয়েছে উপন্যাসের বইয়ে। হুমায়ূন আহমেদের ‘অপেক্ষা’- এটি তার একটু বেশিই প্রিয় কিনা? তাই বারবার পড়া হয়। অথচ তার কাছে উপন্যাসের ভান্ডার পড়ে রয়েছে। ফারনাজ ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বইটি ছিনিয়ে নিল। সেটাও ফোনের ন্যায় ছুড়ে ফেলল। রমনী অতিব বিরক্ত হয়ে বলল,

“কি হয়েছে? বইটা এভাবে ফেললি কেন?”

ফারনাজ হা হুতাশ করে বলল,

“আমার ব্রেক আপ হয়ে গিয়েছে, দৃষ! প্লিজ গিভ মি সান্ত্বনা।”

দৃষ্টির মাঝে কোনো হেলদোল দ্যাখা গেল না। এটা তার কাছে খুবই সাধারণ ঘটনার মধ্য একটি। সে সরু চোখে চেয়ে বলল,

“তো কত নম্বর ব্রেক আপ হলো আপনার?”

ফারনাজ মুখে একটা কাঁদো কাঁদো ভাব আনে। চোখ থেকে গোল গোল ফ্রেমের চশমা টি খুলে একটু চোখের জল মোছার ভানও করে। অতঃপর বলে,

“ছয় নম্বর! তুই ভাবতে পারছিস আমার কি পরিমান কষ্ট হচ্ছে? যা শিগগিরই ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম নিয়ে আয়।”

দৃষ্টি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। বইটি যত্ন সহকারে শেলফে রেখে বলে,

“কষ্ট পেলে কেউ আইসক্রিম খায়?”

“অবশ্যই খায়। আলবাত খায়। যা তো নিয়ে আয় আমার মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। হাতে মুঠোয় পেলে ওই সাকিব না টাকিব ও’কে যে আমি কি করতাম!”

দৃষ্টি তাকে আর পাত্তা দেয় না। আলগোছে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। সে জানে তার বোন এখনও চার পাঁচ মিনিট ধরে আহাজারি করবে। তারপর আইসক্রিম পেলে ভুলেও যাবে তার ছয় নম্বর বয়ফ্রেন্ডের কথা।

ফাহাদ আবরারের বাড়িটি দুই তলা বিশিষ্ট। অনেক বড় না হলেও আবার অনেক ছোটও নয়। এই বাড়িটির কানায় কানায় পূর্ণ। এখানে তারা দুই ভাই স্ত্রীসহ তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে থাকেন। ফাহাদ আবরারের তিন ছেলে মেয়ে এবং ছোট জন অর্থাৎ রামিজ আবরারের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। তারা দুই ভাই ছোট খাটো একটা ব্যবসা করে খুব সাচ্ছন্দে সংসার চালিয়ে যেতে পারছেন। তাদের নেই কোনো অভাব।

এই বাড়িটির সকলে যতটা সম্ভব একসাথে খেতে বসার চেষ্টা করে। এই যেমন সকালে, দুই ভাই নাস্তা করে বের হবেন। তাদের সাথেই তাদের ছেলেমেয়েদেরও খাবার টেবিলে উপস্থিত থাকতে হবে। ফাহাদ আবরার ও রামিজ আবরার ইতোমধ্যে টেবিলে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের হাতে রয়েছে খবরের কাগজ। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে এক পর্যায়ে রামিজ আবরার বলেন,

“ভাই! আমাকে খেলার অংশটুকু দেবে? আমার এইটুকু পড়া হয়ে গিয়েছে।”

ফাহাদ আবরার বিনা বাক্যে তাকে তা এগিয়ে দিলেন। রামিজ আবরার তা হাতে নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলেন। তাদের স্ত্রীরা একে একে টেবিল খাবারে পূর্ণ করে ফেলেছেন। অথচ বাচ্চাদের আসন এখনও শূন্য। ফাহাদ আবরার খবরের কাগজ রেখে হাক ছাড়লেন,

“সীমা! বাচ্চারা এখনও ওঠেনি? এলো না যে!”

মিসেস সীমা এক পলক স্বামীর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফেরালেন। হাতের কাজ করতে করতে বললেন,

“তাদের সময় হলে ঠিক এসে পড়বে। রোজ রোজ বসে থাকার দরকার কি বুঝি না আমি।”

“জানোই তো একসাথে খেলে মহব্বত বাড়ে।”

মিসেস সীমা হাত ধুয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছলেন। যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে বললেন,

“তুই এদিকটা একটু দ্যাখ ছোট। আমি নবাবের কন্যা পুত্র গুলোকে একটু দেখে আসি।”

মিসেস বিউটি মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন। মিসেস সীমা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিলেই দেখলেন তার ছোট কন্যাটি পরিপাটি হয়ে নেমে আসছে। পাঁচ পাঁচটি ছেলে মেয়েদের মধ্যে তার এই কন্যাটি সব থেকে পরিপাটি ও শান্ত। দৃষ্টি মাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

“গুড মর্নিং আম্মু!”

মিসেস সীমা পাল্টা হেসে বললেন,

“গুড মর্নিং। আজ এত দেরি হলো কেন দৃষ? তোর বাবা, ছোট বাবা অপেক্ষা করছে তো।”

“স্যরি আম্মু। গতকাল একটু রাত জাগা পড়েছিল। তাই একটু দেরি হয়ে গেল।”

“ঠিক আছে। বোস, আমি রাজকন্যা রাজপুত্তুর দের তুলে নিয়ে আসি।”

তিনি সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলেন। দৃষ্টি নেমে এসে সর্বপ্রথম বাবা এবং ছোট বাবার সাথে কুশল বিনিময় করল, যা সে রোজই করে থাকে। ফাহাদ আবরার হাত বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“পড়ালেখা কেমন চলছে আম্মা?”

“ভালো আব্বু।”

“বেশি চাপ নেওয়ার দরকার নেই। ধীরে সুস্থে পড়বে। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে কেমন?”

“জি আব্বু।”

ফাহাদ আবরার মৃদু হাসেন। এমন বাধ্য এবং শান্ত মেয়ে দুনিয়ায় কটা আছে?

ছেলে মেয়েদের কানের মাথা খেয়ে তাদের ঘুম থেকে টেনে হিচড়ে তুমি এনেছেন মিসেস সীমা। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে! আর কখন উঠবে এরা? সিঁড়ি বেয়ে ধপাধপ পা ফেলে নেমে এলো ফারনাজ। বাবার পাশে বসে ঘুম ঘুম কন্ঠে অভিযোগ জানাল,

“আমার কাঁচা ঘুমটা কেন ভাঙা হলো আব্বু? কি সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলাম জানো? আম্মু সবটা ভেস্তে দিল। এর বিচার চাই আমি।”

“সকাল হয়ে গিয়েছে তো আম্মা। আজ রাতে আবার দেখে নিও।”

ফারনাজ মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। মিসেস সীমা বাপ বেটির আহ্লাদ দেখে মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলেন,

“এই আদরের জন্যই বাঁদর তৈরি হচ্ছে।”

পর পর আসন দখল করে ফারদিন, বন্যা ও বর্ষণ। ফারনাজের মেইল ভার্সন ফারদিন অর্থাৎ তারা জমজ। দুই মিনিটের বড় হওয়ায় তার ভাবের শেষ নেই। সেই এই বংশের বড় ছেলে! এটাই বড় কথা। আর বন্যা ও বর্ষণ রামিজ আবরারের কন্যা ও পুত্র। মিসেস বিউটি সকলকে খাবার পরিবেশন করে দিলেন। কেউ খাবারে হাত দিল না। ফাহাদ আবরার নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে একে একে সবার মুখে দিলেন। বাদ পড়লেন না রামিজ আবরারও। অতঃপর সকলের খাওয়া শুরু হলো। প্রচন্ড ঘুমের ঠ্যালায় বন্যা মুখে খাবার নিয়েই ঝিমোচ্ছে। মিসেস বিউটি দিলেন এক ধমক,

“কি হচ্ছে বন্যা? খাও ঠিক করে।”

ছোট্ট বন্যা ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসে। মায়ের চোখ রাঙানিতে ভয় পেয়ে গিলতে থাকে দ্রুত। গলায় আটকে গেলেও পানি দিয়ে গেলে। তবুও খাওয়া থামে না। মাকে সে একটু বেশিই ভয় পায়।

চলবে?

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৮৫

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮৫|
মানুষের চারপাশ ঘিরে একটি বৃত্ত থাকে। যা কখনো জটিল। কখনো আবার খুব সহজ আর সুন্দর। ছোট্ট একটি জীবন। যার উত্থানপতন ঘটে বিস্তর। এসব মেনে নিয়েই জীবনের পথে অগ্রসর হতে হয়৷ জীবনের নিয়ম এটাই৷

দুপুরের আগমুহূর্তে আইয়াজ, ফারাহ এসে পৌঁছাল। ছ’মাসের উঁচু পেট নিয়ে ফারাহকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে প্রায় ছুটে এলো নামী৷ সাবধানে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল৷ ওর চোখে জল চিকচিক করছে। ফারাহ আবেগটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ কেঁদে ফেলল আচমকা। অভিমানী মনটা অভিযোগ তুলল শতশত। আইয়াজ সৌধ, সুহাসের সঙ্গে কুশলাদি সম্পন্ন করে ব্যাগপত্র নিয়ে ভেতরে এলো৷ নামী সাবধানে ফারাহকে ধরে এনে লিভিং রুমে বসল৷ ফারাহর মাথায়, শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

‘ স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে গেছে তোর! আমার গুলুমুলু বান্ধবীটার এত্ত পরিবর্তন। ঠিকঠাক খেতে পারিস না? বমি হয়? খাবারে অরুচি খুব? শোন আমি তোর পছন্দের সব রেঁধে খাওয়াব। অনেকদিন থাকতে হবে কিন্তু।’

‘ হয়েছে হয়েছে। নির্লজ্জের মতো কাছে এসেছি বলে দরদ দেখাচ্ছিস। তুই কত নিষ্ঠুররে নামী! এতগুলো দিন কীভাবে পারলি। ‘

ওরা একে-অপরের সঙ্গে কথায় মশগুল। ফারাহ অভিমান করে করে অনেক কথা বলল। নামী মৃদু হেসে ওকে বুঝিয়ে অভিমান ভাঙাল। একে অপরকে আরো একবার জড়িয়ে ধরে পিঠ বুলিয়ে দিল। এরপর ফারাহ উতলা হয়ে বলল,

‘ বাবু কোথায় রে? ওকে প্লিজ নিয়ে আয়। সামনাসামনি দেখে চোখটা জুড়াই। ‘

আর দেরি করল না নামী। উপরে গিয়ে সিমরানের থেকে সুহৃদকে নিয়ে এলো। ননদকে বলেও এলো, নিচে আসতে। ফারাহর কাছে নিয়ে আসার আগেই সুহৃদকে কোলে তুলে নিল আইয়াজ। দু-হাতে উঁচিয়ে ধরে বলল,

‘ আমাদের সুহাসের ব্যাটা নাকি? মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ। ‘

চশমাওয়ালা অপরিচিত মুখ দেখে হাসল সুহৃদ। হাত বাড়িয়ে চশমা ধরে খেলতে লাগল৷ আইয়াজের দুপাশে সৌধ, সুহাস৷ তিন বন্ধু মিলে অনেকক্ষণ মজা করল সুহৃদকে নিয়ে। সুহাসকে ক্ষ্যাপালো একটু। নামী, ফারাহ দূর থেকে ওদের কাণ্ড দেখে হাসল ভীষণ। সিমরান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। শুনতে পেল আইয়াজ ভাইয়া বলছে,

‘ এই সৌধ তুই তো পিছনে পড়ে গেলি ভাইই। প্রাচী নেক্সট ইয়ার একদম বেবি সহ বাংলাদেশে আসবে। তুই কি বসে বসে মুড়ি খাবি? আমাদের এতগুলো আব্বাজানের জন্য একটা আম্মাজান আনার ব্যবস্থা করবি না? ‘

আইয়াজের কথায় ফারাহ ফোঁড়ন দিয়ে বলল,

‘ এতগুলার জন্য একটা আম্মা মানে কি আয়াজ!
এক আম্মায় কী হবে? বাবা কয়টা হিসেব আছে? নিধি আপুর অনি, আমাদের একজোড়া, সুহৃদ বাবা৷’

মিটিমিটি হাসল নামী, সুহাস৷ এরপর হাসির ছলে নামী বলল,

‘ এক আম্মা আনলে কিন্তু ভেজাল হয়ে যাবে আয়াজ ভাই। ‘

দেহ শিরশির করে উঠল সৌধর৷ খেয়াল করল সিমরান আসছে৷ ত্বরিত আইয়াজের দিকে বড়ো বড়ো করে তাকাল৷ ইশারা করল চুপ করতে৷ সুহাসের মুখে হাসি হাসি ভাব দেখে ফিসফিস করে বলল,

‘ তুই কি ভুলে গেলি আমার বউ তোর বোন। ‘

ব্যস! বিমর্ষ মুখাবয়বে যাও একটু হাসির ঝাপটা লেগেছিল৷ সৌধর খোঁচা পেয়ে তা মুছে গেল। ওদের বন্ধুদের এসব কাণ্ড দেখে, শুনে তীব্র লজ্জায় লাল হয়ে গেল সিমরান। প্রচণ্ড ইতস্ততভাবে নিচে এসে আইয়াজ, ফারাহকে জিজ্ঞেস করল,

‘ কেমন আছো তোমরা? ‘

নিমেষে ফারাহ উঠে দাঁড়াল। কান্না পেয়ে গেল ভীষণ। কাছে টেনে জড়িয়ে ধরল সিমরানকে। একটা নারী বুক আর আদর পেয়ে সিমরানও কেঁদে ফেলল। নামী টের পেল, মেয়েটা অভিমান করে তার কাছে আসছে না৷ অথচ তাকে ভীষণ প্রয়োজন ওর ভীষণ। সিমরানের কান্না দেখে কিছুক্ষণ পূর্বের উৎফুল্লতা মিলিয়ে গেল৷ মুখভার হয়ে গেল সুহাস, সৌধর৷ আইয়াজ ওদের কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘ ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময় লাগবে৷ তোরা শক্ত থাক। ‘

সুহাসকে স্পেশালি বলল,

‘ পুরুষ মানুষ আমরা৷ আমাদের শক্ত থাকতেই হবে। তবেই না আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নরম মনের নারীদের ভরসার জায়গা হতে পারব। ‘

কথাটা বলেই ফারাহর কাছে গেল আইয়াজ৷ সিমরান চোখ মুছে বসল। ফারাহ ওকে সান্ত্বনা দিয়ে সুহৃদকে কোলে তুলে নিল৷ আদর করল বান্ধবীর ছেলেকে। মন ভরে চুমু খেল কপালে, গালে। এরপর সিমরানের কোলে দিয়ে বলল,

‘ এমন মিষ্টি একটা আব্বু থাকতে কেউ এভাবে কাঁদে সিনু?’

ম্লান হাসল সিমরান। আলতো করে সুহৃদকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফারাহ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ফের বলল,

‘ শক্ত হও বনু। তুমি কত ভাগ্যবতী জানো? আমাকে দেখো, বাবা নেই, মা নেই৷ একটা বোন আছে৷ ভাগ্যের নির্মমতায় তাকেও পাশে পাই না। তোমার সুহাস ভাইয়ের মতো একটা ভাই আছে। নামীর মতো ভাবি আছে, সুহৃদ আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সৌধ ভাইয়ের মতো হাজব্যান্ড আছে। এদের জন্য শুকরিয়া করো। আল্লাহ তায়ালা একেবারে কাউকে নিঃশ্ব করে না। ‘

ফারাহ কথা শেষ করতেই নামী সিমরানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ পৃথিবীতে কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়৷ আমি জানি সুহাস আর আমার সম্পর্কের জটিলতার কারণে শেষবেলায় বাবা আমাদের আর সুহৃদকে দেখতে পারেনি। এরজন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট আমি পাচ্ছি। কারণ আফসোসটা সবার চেয়ে অনেক বেশি আমার। কিন্তু মৃত্যুর ওপর আমার হাত নেই। জন্ম, মৃত্যুতে আমাদের কারো হাত থাকে না। ‘

চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল নামীরও৷ সিমরান চুপচাপ শুনল ওর কথা। বলল না কিছুই। ফারাহ বলল,

‘ হ্যাঁ রে আমরা সবাই সেটা জানি, বুঝি৷ সিনুও বুঝে সেটা। তাই না? ‘

মৃদু চমকাল সিমরান৷ এক পলক নামীর পানে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। কী যে অদ্ভুত এক অভিমান চেপে ধরেছে তাকে। ইচ্ছে হলেও কথা বলতে পারছে না৷ সৌধ এসে ওর কোল থেকে সুহৃদকে নিয়ে নামীকে কী যেন ইশারা করল। নিমেষে সিমরানের মুখোমুখি হলো নামী। কাছে এসে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে বলল,

‘ বড়ো ভাই, ভাবি বাবা, মায়ের মতো সিনু৷ আমি, সুহাস সবসময় তোমার পাশে আছি। ঠিক বাবা, মা যেভাবে থাকত সেভাবেই চেষ্টা করব আমরা। তাদের অভাব পুরোটা পূরণ করতে পারব না হয়তো৷ যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করব৷ তুমি প্লিজ আর অভিমান করে থেকো না৷ এই ভাঙা পরিবারটা আমি শক্ত হাতে গড়ে তুলতে চাই। রাই বাঘিনী ননদিনী হয়েই না হয় পাশে থাকো। তবু নিজেকে আমার থেকে নির্লিপ্ত করে রেখো না৷ ‘

ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল সিমরান৷ ভেতর থেকে সমস্ত অভিমান উপচে এলো। সহসা দু’হাতে জড়িয়ে ধরল নামীকে। বুকে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো ফুঁপাতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে সুহাস সরে গেল ওখান থেকে। সে ভাঙবে না, কিছুতেই না৷
আইয়াজ, সৌধও সুহৃদকে নিয়ে ওর পিছু পিছু উপরে উঠে গেল৷
.
.
বাড়ির সবাই রান্নাবান্নায় ব্যস্ত৷ আজ সুহাসের বন্ধু, বান্ধবে ভরপুর বাড়ি৷ আগামীকাল অনাথ শিশু, আর গরিবদের একবেলা খাওয়ানো হবে৷ দোয়া করা হবে বাবা, মায়ের নামে। এরপর সুহাসের মামা, মামি আর কাজিনরা চলে যাবে। থেকে যাবে শুধু নানু মনি। সুহাসের ভরা সংসার না দেখে এক পাও নড়বেন না বৃদ্ধা।

প্রাচী বলেছিল সবাই আণ্ডাবাচ্চা সহ এক হয়ে ভিডিও কল দিতে৷ দুপুর হয়ে এলো। অথচ আজিজ আর নিধির খবর নেই। বাধ্য হয়ে ওরা লাঞ্চের জন্য ডাইনিংরুমে এলো। সৌধ, সিমরান, আইয়াজ, ফারাহ পাশাপাশি বসেছে৷ সুহাস বসলে নামীকে ওর পাশে বসতে বলল আইয়াজ৷ নামী বসল না৷ সেলিনা আপার সঙ্গে মিলে সবার পাতে খাবার তুলে দিল। সুহাস ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে অত্যন্ত গম্ভীর মুখে তাকাল নামীর পানে। ঠান্ডা গলায় বলল,

‘ সেলিনা আপা তো আছে। বসলে সমস্যা কোথায়। এখানে সবাই আমরা আমরাই। নিজেরটা নিজে নিয়েই খেতে পারব। ‘

সুহাসের পেটে গুঁতো দিল সৌধ। কণ্ঠ নিচু করে বলল,

‘ এত সিরিয়াস হয়ে থাকিস না তো। নিজের ফর্মে ফিরে আয় দোস্ত৷ ‘

সুহাসকে কথাটা বলে মুখে হাসি টেনে গলা চওড়া করে নামীকে বলল,

‘ নামী বসো, বসো। তিন বন্ধু খেতে বসেছি৷ তিনজনের পাশে বউ থাকলে ব্যাপারটা সুন্দর হবে৷ ‘

সৌধর কথা শুনে লজ্জা পেল সিমরান৷ আড়চোখে তাকিয়ে পানি খেলো৷ আইয়াজ বউয়ের পাতে খাবার তুলে দিতে দিতে ওর কথায় সহমত পোষণ করল। সবার তোষামোদে বসল নামী। নিমেষে চোখ জুড়ানো দৃশ্য তৈরি হলো৷ ওরা তিনজন টুকিটাকি গল্প করতে করতে খাচ্ছিল। আইয়াজ ভীষণ যত্ন নিয়ে ওটা, সেটা তুলে দিচ্ছিল ফারাহর পাতে৷ ফারাহ নাক কুঁচকালেও স্বামীর মিষ্টি শাসনে খেতে বাধ্য হলো। সবার মাঝে সবচেয়ে কম খেলো সিমরান। সে অল্প একটু খেয়ে আচমকা উঠে দাঁড়ায়। মুহুর্তেই সৌধ বাম হাত বাড়িয়ে ওর বাহু টেনে ধরে। সুগভীর দৃষ্টিজোড়া মেলে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে,

‘ পেট ভরে গেছে? আমার তো ভরেনি। মাছ খেতে ইচ্ছে করছে। নাও বসো কাঁটা বেছে দাও৷ ইউ নো হোয়াট তোমার বর মাছের কাঁটা বাছতে জানে না। ‘

এ কথা শুনে আইয়াজ মুচকি হেসে বলল,

‘ হ্যাঁ সিনু, তোমার বর দুনিয়া উদ্ধার করতে পারলেও কাঁটা বেছে মাছ খেতে পারে না৷ আর কাঁটা সহ খেলে নিজেকে উদ্ধার করতে হিমশিম খায়। ‘

সুহাস চুপচাপ থাকলেও আইয়াজের কথা শুনে সৌধকে টিপ্পনী দিল,

‘ ঢঙ সব। ‘

সৌধ পাত্তা দিল না ওদের কথায়৷ সিমরান গায়ে জড়ানো চাদরটা আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে বসে কাঁটা বাছতে শুরু করল। সে কাঁটা বেছে সৌধর প্লেটে দেয় আর সৌধ নিজে খাওয়ার পাশাপাশি তার মুখেও তুলে দেয়৷ সিমরান নিতে চায় না অবশ্য৷ সৌধ আলতো হেসে বলে,

‘ ত্যাড়ামি নারীদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকে। অন্তত উপস্থিত তিনজন নারীর অবস্থা সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে। নাও হা করো৷ কী খেয়েছ পেটই উঁচু হয়নি। নো ঘাউড়ামি, কথা শোনো। ‘

সিমরান হা করল না। আইয়াজ সৌধর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘ পেট উঁচুর ব্যবস্থা করলেই পারিস। দেরি করিস না৷ তোদের বেবি নেওয়া উচিত। অন্তত সিনুর মাইন্ড অন্যদিকে ফোকাস করার জন্য এক্ষুনি নেওয়া উচিত। ‘

সৌধ চুপ করে রয়৷ কিছু বলে না। আইয়াজ মিটিমিটি হাসতে হাসতে সরে যায়৷ কেউ শুনতেই পায়নি ওর বলা কথাটি৷ আর না ধারণা করেছে সে এমন কথা বলেছে। বন্ধুমহল ব্যতীত সর্বমহলে বরাবর ইনোসেন্ট তকমা পাওয়া ছেলে কিনা…। সিমরান অবশ্য চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল৷ কিন্তু বুঝতে পারল না৷ সৌধ ভাজা মাছ দিয়ে ওর মুখে ভাত তুলেছে। তৃতীয়বারের মতো সে খাবার নাকোচ করলে চোখ গরম করল সৌধ। ঢোক গিলল সিমরান। সবার পানে একবার করে তাকিয়ে দেখল কেউ তাদের দেখছে কিনা৷ সৌধর থেকে শব্দহীন ধমক খেয়েছে সে৷ বিষয়টি অন্য কেউ টের পেলে ভীষণ লজ্জা পাবে৷ সম্মানে লাগবে৷ তাই ইচ্ছে না করলেও মুখে তুলল খাবার৷ নামী ফারাহর সঙ্গে টুকটাক কথায় ব্যস্ত ছিল। অকস্মাৎ গলায় খাবার আঁটকে কেশে উঠল। পাশে সুহাস। চকিতে তাকিয়ে ত্বরিত পানির গ্লাস সামনে ধরে। একনিশ্বাসে সে পানি খেয়ে নেয় নামী৷ সুহাস ওর মাথায় পিঠে মৃদু মৃদু থাপ্পড় দেয় তিনবার৷
.
আজিজ এলো ওরা খেয়ে উঠার পরপরই। এসে বন্ধু আর তাদের বউদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে সুহৃদকে সোজা কাঁধে তুলে নিল। দুষ্টু সুহৃদ ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওর মাথার চুল গুলো কাকের বাসা বানাতে। নামী গেল আজিজের জন্য খাবার গরম করতে। ওকে সাহায্য করতে গেল সিমরান৷ তিন বন্ধু মিলে আজিজকে বেশ ভালোই ক্ষ্যাপালো। আইয়াজ বলল,

‘ কী বন্ধু বয়স তো বসে নেই৷ বিয়েশাদি করবি না? ‘

উত্তরটা বেশ সরল মুখে দিল আজিজ,

‘ আম্মা মেয়ে দেখতেছে। ‘

সৌধ খোঁচা মেরে বলল,

‘ আম্মাই তো দেখবে ভোলাভালা, অবলা পুরুষ তুই। মেয়ে মানুষ থেকে দশহাত দূরে থাকতিস কিশোরকাল থেকে। ‘

আজিজ কাঁধ থেকে কোলে বসাল সুহৃদকে। এরপর ওর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ আমার মতো ভদ্রপোলা বাংলাদেশে বিরল তাই না?’

আজিজের কথা বলার ঢং দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল সুহৃদ। সে হাসি দেখে আনন্দে বিগলিত হয়ে মার্বেলের মতো চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে এমন
এক চিক্কুর দিল আজিজ,

‘ আরে সুহাইস্যার ব্যাটা কী হাসি দিছেরে। ‘

যে তাকানো, আনন্দ প্রকাশ আর চিৎকারে ভয় পেয়ে চোখমুখ খিঁচে কান্না শুরু করল সুহৃদ। সুহাস টের পেল তার ছেলে ভয় পেয়েছে। তাই গা লি দিল আজিজকে। ছোঁ মেরে সুহৃদকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখল। ছেলের কান্না শুনে ছুটে এলো নামী। পরিবেশ বদলে গেল আচমকা। সুহৃদের কান্না কিছুতেই থামছে না৷ আজিজ বেআক্কলের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সুহৃদের সামনে এসে কানে ধরল। কান্না বেড়ে গেল আরো। সকলে হতভম্ব। আজিজ পায়ে ধরল সুহৃদের। অধৈর্য্য হয়ে বলল,

‘ আরে বাপ থাম না৷ ‘

হতভম্ব আইয়াজ, সৌধ আজিজের কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল। ওর হাসি দেখে মুখে ওড়না চেপে আড়ালে হাসল সিমরানও৷ নামী এই হট্টগোলে ছেলেকে আর রাখলই না। সেলিনা আপাকে কাজ দিয়ে সে উপরে চলে গেল৷ ওদেরকে বলে গেল,

‘ চিন্তা করো না তোমরা৷ ঘুমের সময় হয়েছে ওর। একটু ভয়ও পেয়েছে তাই এমন করছে। আমি সামলে নিচ্ছি৷ ‘

নামীর পিছু পিছু সুহাসও গেল। আজিজ যখন খেতে বসবে তখন আগমন ঘটল নিধির৷ একটা ঝড় বয়ে প্রকৃতি শুনশান নীরবতায় ছেয়ে যাওয়ার পর এক টুকরো রোদ উঠার আনন্দ যেমন হয়৷ নিধির আগমনে অমন একটি আনন্দ হলো সবার৷ সৌধরা জেনেভা থেকে ফেরার পর নিধি এ বাড়িতে আসেনি আর৷ কারণ সিনুকে সামলাতে তখন সৌধ এসে গেছে৷ তাই আজ আসাতে সিমরান অনেক বেশি খুশি হলো। অনিরূপকে আদর করল কোলে নিয়ে। বলল,

‘ হাই বাবা, কেমন আছো তুমি? ‘

সিমরানের সঙ্গে কথা বলে আইয়াজ, সৌধ, ফারাহর সঙ্গে কথা বলল নিধি। ওরা খুব খুশি মনেই স্বাগত জানালো ওকে। ফারাহর চোখ, হাত পা সুক্ষ্ম নজরে দেখল নিধি। আইয়াজকে জিজ্ঞেস করল ওর হালচাল। সৌধ আলগোছে ওদের থেকে সরে গেল। সিমরানের কাছে গিয়ে অনিরূপের দিকে কয়েক পল তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ। এরপর শুধাল,

‘ হেই লিটল স্টার, হাউ আর ইউ? ‘

সৌধকে অবাক করে দিয়ে অনিরূপ আধো স্বরে বলল,

‘ ফান, ইউওও।’

‘ফাইন ইউ’ শব্দটি স্পষ্ট বলতে না পারলেও বুঝল ওরা। সিমরান আশ্চর্য হয়ে তাকাল সৌধর পানে। এরপর হেসে ফেলল দু’জনকে। সৌধ কোলে নিল অনিরূপকে। আজিজ খেয়েদেয়ে পেট ফুলিয়ে এসে অনিরূপের দিকে হাত বাড়াল,

‘ আরে মাম্মা আসো কোলে আসো। ‘

আকস্মিক ওর উচ্চ গলায় ভয় পেয়ে গেল অনিরূপ৷ সৌধর গলা জড়িয়ে ভীত হয়ে তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব৷ সৌধ চোখ কটমট করে তাকাল আজিজের পানে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘ ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলবি না৷ সরে যা ভয় পাচ্ছে ও। ‘

‘ উফ বুঝলাম না দুনিয়ার সব বাচ্চা আমি বলতে অজ্ঞান। আর এই সুহাইস্যা, আর নিধিপিদির বাচ্চা এমন করে ক্যান! ‘

সিমরান হেসে ফেলল শব্দ করে। হাসির শব্দ শুনে আজিজ তাকাল ওর পানে। অবাক হয়ে বলল,

‘ আরে সুহাসের বোন না? ওহ সরি সৌধর বউ আমার ভাবি না? এ তো পুরাই বলিউডের অনন্যা পান্ডের মতো হাসিরে! ‘

উত্তরে সৌধ কিছু বলতে উদ্যত হবে তক্ষুনি আইয়াজ ডাকল ওদের৷ আজিজ সৌধর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুরু করল,

‘ দোস্ত সত্যি বলছি ভাবিকে দেখতে অনন্যা পান্ডের মতো। হাসি আর চোখ দু’টো বস খাপে খাপ কিউট।’

সৌধ বিরক্ত হলো, মেজাজ খারাপ করে বলল,

‘ মুখটা বন্ধ কর। অন্যের বউয়ের সৌন্দর্যের প্রশংসা করে মুখে ফেনা না তুলে নিজের বউ কবে ঘরে তুলবি সে চিন্তা কর। ‘

‘এ ভাইই তুই কি আমাকে ঠান্ডা মস্তিষ্কে অপমান করলিইইই!’
.
.
বন্ধুরা মিলে প্রাচীকে ভিডিও কল দিল। ওকে ভিডিও কলে রেখে ওরা সবাই মিলে আড্ডা দিল খুব। কত গল্প, কত স্মৃতিচারণ! ওদের গল্প, আড্ডা এ বাড়ির শোকাবস্থা মলিন করে ফেলল একদম। এত অল্প সময়ে এই আমেজ অন্যান্য পরিবারে দৃষ্টিকটু লাগলেও সুহাসের পরিবারে লাগল না৷ কারণ নিকটাত্মীয় বলতে ওর মামা বাড়ির লোকেরাই। বাবার ভাই, বোন না থাকায় দাদা, দাদির মৃত্যুর পর সে পক্ষের আপন কেউ নেই৷ তাই সুহাসকে খুব তাড়াতাড়িই উঠে দাঁড়াতে হবে। সামলাতে হবে গোটা পরিবার আর বিজনেস। এর জন্য বন্ধুদের এই সঙ্গকে সবাই সাদরে গ্রহণ করল। প্রাচীর সঙ্গে কথা শেষে ওরা নিজেরা মিলেও অনেকক্ষণ আড্ডা দিল। কে কেমন আছে। কার ফ্যামিলিতে কী অবস্থা। আজিজের বিয়ে নিয়ে কত কাহিনি হচ্ছে। সব শুনল আর হাসির রোল পড়ল। ঊনত্রিশ বছর বয়সী আজিজের পছন্দ সতেরো, আঠারো বছর বয়সী যুবতী। কিন্তু সতরো, আঠারো বছর বয়সী যুবতীরা তাকে বুড়ো বলে রিজেক্ট করছে! এই নিয়ে তার মায়ের হতাশার শেষ নেই৷ আজিজ বলল,

‘ আমাকে মনে হয় আমার এক্সরা অভিশাপ দিছে। ‘

হাসির রোল পড়ল নিমেষে। সে হাসি থামল আইয়াজের কথায়। সে হঠাৎ অর্পণ স্যারের কথা তুলে সৌধকে বলল,

‘ আমি আর সুহাস স্যারকে সরি বলেছি। তোরও সরি বলা উচিত সৌধ। হাজার হোক আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ডের বর সে। ‘

প্রশ্ন শুনে নিধি আড়চোখে তাকাল সৌধর পানে। সে নিজেও মনে মনে চায় সেই ঘটনার জন্য সৌধ সরি হোক তার স্বামীর কাছে। মানুষটার তো সত্যি কোনো দোষ নেই৷ সময়ের স্রোতে তার প্রতি সৌধর অনুভূতিও ফিঁকে হয়ে গেছে৷ নিধির তাকানো খেয়াল করে তীক্ষ্ণ হলো সৌধর দৃষ্টি৷ লম্বা এক নিঃশ্বাস ফেলে দৃঢ় গলায় বলল,

‘ একদমই উচিত না৷ ‘

সৌধর এহেন কথায় পরিস্থিতি গুমোট বেঁধে গেল৷ থমকানো দৃষ্টিতে তাকাল নিধি৷ সিমরান নিশ্চুপ। ওর নীরব দৃষ্টি সৌধতে স্থির৷ বোনের নীরবতা দেখে সুহাস প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,

‘ এই আলোচনা এখানেই বন্ধ হোক। ‘

সত্যি সত্যি আলোচনা বন্ধ হলো। কিন্তু গুমোট একটা অনুভূতি দৃঢ় হয়ে রইল সৌধ, নিধি আর সিমরানের মনে।

সন্ধ্যার পর,

ছাদে কাঠ জড়ো করে আগুন ধরানো হয়েছে। একটু পর সবাই মিলে সেখানে আড্ডা দেবে। শীত মৌসুমে শহুরে ছেলেমেয়েদের এই আড্ডাটা দারুণ হয়৷ যাতে অভ্যস্ত সুহাসদের সার্কেলটা। সৌধ অনেকক্ষণ ধরেই নিধিকে একাকী খুঁজছিল। অনিরূপ ঘুমিয়েছে। তাই নামীর ঘরে ওকে শুইয়ে দিয়ে বেরোলো নিধি৷ সৌধ ওকে দেখতে পেয়েই ডাকল,

‘ নিধি, ছাদে চল। ‘

চমকে তাকাল নিধি৷ ইতস্ততভাবে বলল,

‘ নামী ওরা কোথায় আমি একা যাব?’

কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর স্বরে সৌধ উত্তর দিল,

‘ হু, একা যাবি। ‘

|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_১৩
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
______________________________
সংসার, পড়ালেখা, টিউশনি নিয়ে সূচনার সময় বেশ ভালোই কা ট ছে। প্রণয়ের সাথে নিজের সম্পর্ক টাও আগের চেয়ে আরো ভালোমতো গুছিয়ে নিয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে ঝগড়া ঝাটি হয়। তাও ছোটখাটো বিষয়ে, দুজনেই রা গী কি-না! অল্পতেই রে গে যাওয়া যেন প্রণয়ের স্বভাব। নুরাইয়া তা দেখে প্রায়ই বলেন,

” ছেলেটার মেজাজ যে এমন তা জানতাম কিন্তু ইদানীং যেন একটু বেশি ই। ”

সূচনা কিছু বলেনা, বলার কিছু নেই ও। যখন ঠান্ডা থাকে তখন সব ঠিক, দুনিয়া শান্তি। অথচ ছোট একটা বিষয় নিয়ে ই মাঝেমধ্যে এমন রে গে যায় যে তাকে অবাক হতে বাধ্য করে। মেজাজ ঠান্ডা হলে তখন আবার আফসোসের শেষ নেই। সূচনা আড়ালে আধ-পাগল উপাধি দিয়ে দিয়েছে আগেই। বা জে ছেলে যেমন প্রণয়ের জন্য তেমন প্রযোজ্য না এই আধ-পাগল উপাধি টা একদম খাপে খাপ।

সূচনা আজকে ভার্সিটি থেকে একা একা ই বাসায় ফিরেছে। ইরার কিছু বই কিনতে হবে, বাসায় এসে আবার যাওয়া ঝামেলা হয়ে যায় বলে ভার্সিটি থেকে বাসায় আসেনি। সূচনার বিকেলে পড়াতে যেতে হবে। সপ্তাহ খানেক পর বাচ্চা দুটোর পরীক্ষা। এর মধ্যে বন্ধ দেয়াটা ঠিক হবে না বলে সূচনা ইরার সাথে যায়নি। বাসায় ফিরে গোসল সেরে সূচনা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। প্রণয়কে দিয়ে কিছু গাছ আনিয়েছে সে। তার অতি শখের কাঠগোলাপ গাছটা বেড়ে উঠছে আস্তে আস্তে। সূচনা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসলো। দুইদিন ধরে তার দিশা বেগমের সাথে কথা হয়না। গতকালকে প্রণয়ের সাথে ও ছোটখাটো একটা ঝগড়া হ’য়েছে। এরপর থেকে আবার সেই মান অভিমান, কথা বন্ধ। সূচনা কয়েক মুহূর্ত দ্বিধায় থেকে মায়ের নাম্বারেই ডায়াল করলো। কিছুক্ষণ কথা বলে ফের কল করলো প্রণয়ের নাম্বারে। কিন্তু সবসময়ের মতোই ফোন রিসিভ করলো না প্রণয়। সূচনা গতকালকের কথা গুলো আবার মনে করলো। বুঝতে চেষ্টা করলো তার দোষটা কোথায় ছিল! গতকাল কে প্রণয় অফিস থেকে ফেরার পর গোসল করতে গেলে তার ফোনে কল আসে। সূচনা রুমেই ছিল, অনবরত কল আসছিল বিধায় না পারতেই সূচনা ফোন রিসিভ করে। রিসিভ করার পর ওপাশ হতে মেয়েলি কণ্ঠ শোনা যায়, সূচনাকে প্রণয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে সূচনা জানায়, প্রণয় ওয়াশরুমে আসলে কল ব্যাক করবে। মেয়েটা ফের প্রশ্ন করে সূচনার পরিচয় জানতে চাইলে সূচনা নির্দ্বিধায় ই বলে,

” আমি প্রণয়ের ওয়াইফ। ”

মেয়েটা বোধহয় একটু না বেশ অনেকটাই অবাক হয়। আশ্চর্য নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

” প্রণয় বিয়ে করলো কবে! কাউকে বললো না! আমাকে ও তো বলেনি৷ সত্যি বিয়ে করেছে! তুমি সত্যি ই ওর বউ! ”

সূচনার খানিক রা গ হয়, কে এই মেয়ে যাকে প্রণয় বিয়ের কথা না বলায় এত প্রশ্ন করছে! আবার জিজ্ঞেস করছে সত্যি ই তার বউ কি-না! সে বেশ রা গি কণ্ঠে ই বলে,

” কেন! প্রণয় বিয়ে করতে পারে না? সারা জীবন কী ব্যাচেলর ই থাকবে! আর আপনি কে যাকে জানিয়েই প্রণয়ের বিয়ে করা উচিত ছিল। ”

মেয়েটা সম্ভবত জবাব দিতে নিয়েছিল সেই সময়ই কেউ সূচনার কান থেকে ফোন ছিনিয়ে নেয়। সূচনা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে এই কেউ টা আসলে প্রণয়। ফোন নিয়েই সে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। সূচনা পূর্বের ন্যায় ই রা গি কণ্ঠে বলে,

” কা ট লে ন কেন আমি কয়েকটা কড়া কথা বলতাম। ”

” তুমি ফোন রিসিভ করেছো কেন! ”

সূচনার ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়, বলে

” বারবার কল করছিল তাই রিসিভ করেছি। কেন! ”

” কল করছিল করতো৷ রিসিভ করার প্রয়োজন ছিল না। ”

” রিসিভ করায় কী হয়েছে? এত রিয়েক্ট কেন করছেন আর এই মেয়ে কে? ”

সূচনার এহেন প্রশ্নে প্রণয় আরও রে গে যায়, পাল্টা প্রশ্ন করে,

” সন্দেহ করছো আমাকে? ”

” সন্দেহ তো এতক্ষণ আমি করিনি, এখনো করতে চাচ্ছিনা। কিন্তু আপনার ব্যবহার ভাবতে বাধ্য করছে আমায়। ”

সূচনা আর এক সেকেন্ড ও দেরি করেনি, রুম ত্যাগ করেছে। আর কিছু তো বলেনি, তার দোষটা আসলে কোথায় সেটা আজকে ও খুঁজে পেলনা। আর খুঁজতে চেষ্টা ও করলো না৷ আসুক বাসায় তার থেকেই জানবে।


” ইরাবতী! ”

বইয়ের দোকান থেকে বের হয়ে ইরা রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। তন্মধ্যেই চেনা স্বরে, সম্বোধনে তার নাম ধরে ডেকে উঠলো কেউ। ইরা পাশ ফিরে তাকাতেই দেখা গেল চেনা মানুষটা কে। বরাবরের মতোই পরিপাটি রূপে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ। ইরা এই সময়ে এখানে তার দেখা পেয়ে অবাক তার চেয়ে বেশি ভীত। সেদিন সূচনার কথা মতো মুগ্ধ কে বলেছিল সব। এরপর থেকে দুজনের যোগাযোগ একদম ই বন্ধ। ভার্সিটি তে দেখা হলেও দুজন দুজন কে না দেখার ভান করে। কারো কাছে কারো ফোন নাম্বার পর্যন্ত নেই। এমতাবস্থায় মুগ্ধ রাস্তার মধ্যে দেখে তাকে ডাক দেয়া তে ইরা খানিক বিব্রত বোধ করছে। মুগ্ধ একটু এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,

” এখানে একা একা কেন? তোমার ভাবি কোথায়? ”

ইরা মৃদুস্বরে প্রতুত্তর করলো,

” কিছু বই কেনার ছিল সেগুলো কিনতে এসেছিলাম। ভাবির কাজ ছিল তাই বাসায় চলে গেছে। আপনি এখানে? ”

” আমার ও কাজ ছিল একটু। ”

” মাঝ রাস্তায় ডেকে দাঁড় করালেন কেন! ”

” পরিচিত মানুষকে হুট করে দেখলে মানুষ ডাক দিয়ে কথা বলে না! আমি ও সেজন্য ডাক দিলাম। ”

” আমরা যোগাযোগ রাখবো না কথা ছিল। ”

” তো যোগাযোগ কে রাখছে! ”

” এই যে ডেকে দাঁড় করালেন, এখন কথা হবে, দেখা গেছে নাম্বার ও আদান-প্রদান হবে। তারপর রোজ রোজ কথা হবে, কথা হতে হতপ তারপর… ”

ইরা হড়বড়িয়ে কথাগুলো বলতে বলতে থেমে যায়। মুগ্ধ এক ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করে,

” তারপর? ”

মেয়েটা থতমত খেয়ে যায়, কী বলতে যেয়ে কী বলে ফেলছিল ভেবে ঈষৎ লজ্জা ও পায়। মুগ্ধ আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ায়। কিয়ৎক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে মায়া স্বরে বলে,

” তুমি ভীষণ বোকা ইরাবতী। ঐসব করার হলে আমি প্রথম থেকেই জোর দিতাম। আর না হয় তোমার সামনেই আর আসতাম না। আমার জন্য মেয়ের অভাব হবে না এটা মানো নিশ্চয়ই! ”

ইরা মৃদু স্বরে ‘ হু ‘ বলে শুধু। মুগ্ধ ফের বলে,

” আজকেও সামনে আসতাম না, কিন্তু পরে মনে হলো যে একটু মনে করিয়ে দিই। ”

” কী? ”

” এটাই যে এই বোকাসোকা মেয়েটা শুধু আমার। আমি যেমন তার জন্য অপেক্ষা করতে পারব তেমন তার ও অপেক্ষা করতে হবে৷ ”

ইরা ভীষণ লজ্জা পেল মুগ্ধর কথায়, লাজুক দৃষ্টি মুগ্ধর থেকে লুকাতে মাথা নিচু করে নিল। মুগ্ধ মৃদু হেসে বললো,

” এমন মাঝেমধ্যে মনে করিয়ে দিতে সামনে আসব আমি৷ বুঝেছো! ”

ইরা নত দৃষ্টি ওপরে তোলে, লাজুক ভাব কা টি য়ে সহজ গলায় বলে,

” রবী ঠাকুরের একটা কথা আছে, কী বলুন তো! ”

” কী? ”

” এটাই যে,

❝ যদি তুমি কাউকে ভালোবাসো তবে তাকে মুক্তি দাও, যদি সে ফিরে আসে তবে সে তোমার আর যদি ফিরে না আসে তবে সে কোনোদিন তোমার ছিল না হবেও না। ❞

” যথার্থ বলেছেন কিন্তু এটার সাথে আমাদের সম্পর্ক কী? ”

ইরা মুখ বাকাঁয়,

” একটু আগে তো বলছিলেন আমি বোকা। শুনুন আমি আপনাকে মুক্তি দিয়েছি, আজ হোক, কাল হোক কিংবা বছর পর ই হোক আপনি যদি আমার নিকট ই ফিরে আসেন তবে আপনি আমার। আপনার ক্ষেত্রে ও তাই। আর এমন টা না হলে বুঝতে হবে আমাদের জন্য সেটাই ভালো। ভাগ্যে যেটা আছে সেটা হবেই। ”

” লাইক যদি থাকে নসিবে আপনা আপনি আসিবে এই কথায় বিশ্বাস করা! ”

” ইঞ্জেক্টলি। আমি এখন আসি! ”

কথার মাঝে ই ইরা যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়। মুগ্ধ পেছন থেকে তার হিজাবের একাংশ টে নে ধরে। ইরা সাথে সাথে ই পেছনে ঘুরে তাকায়। ভীত চোখে তাকিয়ে বলে,

” কী করছেন? ছাড়ুন। ”

মুগ্ধ ছেড়ে দেয়, ভ্রূদ্বয়ের মাঝে ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,

” রবী ঠাকুর কাউকে ভালোবাসলে তাকে মুক্তি দিতে বলেছেন। তুমি আমাকে মুক্তি দিয়েছো তার মানে…

ইরার বোধগম্য হয় মুগ্ধর কথা, মুহূর্তেই গাল জোড়া তার লালাভ বর্ণ ধারণ করে৷ তার অভিব্যক্তি তে মুগ্ধ হেসে ফেলে। নরম স্বরে বলে,

” যাও, সাবধানে যেও। ”



আসরের নামাজ পড়ে ইরার সাথে কথা বলছিল সূচনা। পড়াতে যাওয়া হয়নি তার, অন্তিম নাকি অসুস্থ সেজন্য যেতে নিষেধ করেছে তার মা৷ ইরা বাসায় ফিরেছে আধ ঘন্টা মতো। সূচনার একা একা ভালো লাগছিল না বিধায় সাত পাচঁ না ভেবে ইরার কাছে চলে এসেছে। ইরা নতুন বইগুলো নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে তার সাথে কথা বলছিল। এর মধ্যে প্রণয় ঝড়ের বেগে ই তার রুমে প্রবেশ করে। তাকে দেখতে মোটেও স্বাভাবিক লাগে না দুজনের কারোর ই। প্রণয় সোজা যেয়ে ইরা কে প্রশ্ন করে,

” ছেলে টা কে ছিল ইরা? ”

কণ্ঠে কাঠিন্যতা, ইরা ভয় পেয়ে যায়। তার ভাই তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, কিন্তু তার রা গ যেন আকাশ ছোঁয়া। হুটহাট রে গে যায় কিছু বোঝার আগে ই। ইরা বেশ ভালোমতোই তা জানে। ইরা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে,

” কোন ছেলে ভাইয়া? ”

” ভান করিস না ইরা, বই কিনতে গিয়েছিলি না-কি ঐ ছেলের সাথে দেখা করতে! ”

প্রণয় তাকে মুগ্ধর সাথে দেখে ফেলেছে ভাবতেই চাপা ভয় খামচে ধরলো হৃদপিণ্ডটা। কিছু বলতে আর পারলো না স্বাভাবিক ভাবে। মিনমিনে কণ্ঠে শুধু বললো,

” দেখা করতে যাইনি, দেখা হয়ে গিয়েছিল। ”

সূচনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব ই দেখছিল। এতক্ষণ বোধগম্য না হলেও এখন বুঝতে পারছে প্রণয় হয়তো মুগ্ধর কথা বলছে। এদিকে ভাইয়ের ভয়ে ইরা মেয়েটা একদম সিঁটিয়ে গেছে। সূচনার রা গ বেড়ে গেল আরও। মানুষ এত বদ মেজাজি কীভাবে হয়! মেয়েটাকে ভালো করে ও তো বলা যেত। বসে সুন্দর করে জিজ্ঞেস করা যেত। কিন্তু তা না, সবকিছু তেই রা গ! সূচনা ইরার কাছে যেয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,

” তোমার ভাইয়া কী বলছে? কোনো ছেলের কথা বলছে? ”

ইরা প্রায় কেঁদে ই ফেলে,

” মুগ্ধর কথা বলছে ভাবি। ”

” তুমি মুগ্ধর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে! যাওনি তাই না। ”

” আমি দেখা করতে যাইনি ভাবি, বই কেনা শেষে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন ই দেখা। ”

সূচনা হাফ ছাড়ে, সে জানতো ইরা তার কথার অমান্য করবেনা। এতটুকু বিশ্বাস তার ছিল। সে প্রণয়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিবে তার আগেই প্রণয় তাকে জিজ্ঞেস করলো,

” তুমি মুগ্ধ নামের ঐ ছেলে কে চেনো কীভাবে? ”

সূচনা জবাব দিতে নিয়ে ও থেমে যায়, প্রণয়ের কণ্ঠে আগের থেকে ও বেশি রা গ। ঠিক কীভাবে বললে বুঝবে সূচনার জানা নেই। সে নিচু স্বরে বলে,

” দেখুন প্রণয়, আপনি রুমে আসুন আমি বুঝিয়ে বলছি। ”

প্রণয় এক পলক ইরার দিকে তাকায়, সূচনাকে কিছু বুঝে ওঠার আগে ই তার হাত চে পে ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে নিজেদের রুমে। স্ব শব্দে দরজা বন্ধ করে। রুমের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে সূচনা, প্রণয় দুই হাত বুকে ভাজ করে দাঁড়িয়ে বলে,

” বলো কী বলবে বুঝিয়ে৷ ”

সূচনা ভয় পায়, কণ্ঠ খসে শব্দ বের হতে চায় না। তার চুপি দেখে প্রণয়ের মেজাজ যেন আরও খারাপ হয়। এক ঝটকায় সূচনার হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে।আসে। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে বলে,

” আমার বোন কোনো ছেলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সেটা জেনে তুমি তাকে সাপোর্ট করেছো। ভালো করোনি। ”

সূচনার চোখজোড়ায় অশ্রুদের আনাগোনা বাড়ে। অশ্রুসিক্ত চোখে, ঠোঁটে মলিন হাসি টেনে বলে,

” সম্পর্ক টেকাতে বিশ্বাস থাকতে হয় প্রণয় অথচ আমাদের মধ্যে সব থাকতেও এটার বড় অভাব। আমি ভাবতাম সম্পর্কে টেকাতে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা টাই যথেষ্ট। কিন্তু আমার ভালোবাসা আপনার রা গ, জেদের কাছে দুর্বল। আপনার জন্য বা এই সম্পর্কের জন্য তা যথেষ্ট না। ”

প্রণয়ের হাত ঢিলে হয়, তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় সূচনা। তৎক্ষনাৎ রুম হতে প্রস্থান করে।


সেদিন সূচনা আর রুমে যায় না। রাতে ও ইরার সাথে ই ঘুমায়। সে রাতে ফের হঠাৎ ই সূচনার জ্বর ওঠে। দিক দিশা ভুলে যাওয়ার মতো জ্বর। তবে প্রণয়কে নয়। তীব্র জ্বরেও প্রণয়কে মনে পড়ে তার। বিকেলের ঘটনা গুলো পুরোপুরি মনে পড়ে। জ্বরের কষ্ট থেকে বেশি প্রণয়ের আচরণ গুলো মনে করলেই ভীষণ কান্না পায় তার। ইরা কী করবে বুঝতে না পেরে নুরাইয়া কে ডাকলো। নুরাইয়া এসে মাথায় পানি ঢাললেন, জল পট্টি দিলেন কিন্তু লাভ তেমন হলো না। পর দিন ইরাকে সাথে নিয়ে সূচনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল প্রণয়। একগাদা ওষুধ সমেত নেতিয়ে পড়া সূচনাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে। সূচনার এহেন অবস্থা আর নিজের অনুশোচনা দুইয়ে মিলে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে প্রণয়।
নয়দিনের জ্বরের পরে সূচনার ছোট হৃদয়ের যন্ত্রণাগুলো আরো ভয়াবহ হয়। নয়দিনে ছেলেটা একটা বার পারলো না একটু কথা বলে সব ঠিক করে নিতে! পড়ন্ত বিকেলে হুহু করা হৃদয় নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় একটা।


অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই খুলছিল প্রণয় সেসময় ই তার চোখ যায় আয়নার একপাশে হলুদ রঙের ছোট্ট একটা কাগজ লাগানো। চিরকুট মতো তা। প্রণয় কাগজ টা হাতে নেয়। ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,

” আপনার অতি ঠান্ডা মেজাজের কাছে, হুটহাট রে গে যাওয়ার কাছে, রে গে যেয়ে সন্দেহ করার কাছে এই ক্ষুদ্র মেয়ের ঠুনকো ভালোবাসা হেরে গেল প্রণয়। ”

প্রণয় একবার দুইবার অতঃপর কয়েকবার পড়ে লেখাটা। বুকে মোচর দিয়ে উঠে প্রণয়ের। কাগজটার দিক ফ্যালফ্যালে চোখে চেয়ে থেকে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে তার। বারকয়েক চুলে হাত বুলিয়ে শান্ত করে নিজেকে। গলা উঁচিয়ে ইরাকে ডাকে। প্রথম ডাকেই ইরা ছুটে আসে। প্রণয় সূচনার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলে,

” ভাবি দুপুরের খানিক পরে ই বেরিয়েছি। চট্টগ্রাম যাবে বিকেলের ট্রেনে। ”

প্রণয় ভাঙা কণ্ঠে বলে,

” যাবে বললো আর তোরা যেতে দিলি! ”

” তো কী করতাম ভাইয়া? এভাবে কষ্ট পাওয়ার মানে আছে! তোমার সমস্যা তুমি না বললে কেউ বুঝবেনা। ভাবির সাথে শেয়ার করবে মিলে সমাধান বের করবে তা না করে সারাক্ষণ মেজাজ দেখাও। এসব কী! এত রা গ থাকলে কোনো সম্পর্ক ই ভালো যায় না ভাইয়া। ”

ইরা প্রথমবারের মতো আজকে তার ভাইয়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বললো। অনেকদিন ধরে এই কথাগুলো বলতে চাইলেও বলতে পারেনি। আজকে বলতে পেরে যেন শান্তি লাগছে তার। প্রণয়কে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে তাড়া দিল সে,

“এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”

প্রণয় সম্ভিৎ ফিরে পেয়ে ব্যস্ত হয়ে ছুটঁ লাগায়।


রেল স্টেশনের এক পাশে যাত্রীদের জন্য রাখা বেঞ্চে মাথা নিচু করে বসে আছে সূচনা। সে কান্না করছে না, হাত ঘড়িতে সময় পরখ করছে বারবার। আশেপাশের মানুষের ব্যস্ততা ছিল এতক্ষণ, শব্দ ছিল। কিন্তু এখন তপমন মানুষ দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টির শব্দ ছাড়া তেমন কোনো শব্দ সূচনার কানে আসছেনা। ধুপ করে কেউ পাশে এসে বসলে তার মনোযোগ ক্ষুণ্ণ হয়, সে তাকায়। প্রণয়কে পাশে দেখেও দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। বৃষ্টিতে ভিজেঁ একাকার প্রণয় তার উপেক্ষা পেয়ে অবাক হয়। মুখ বাঁকিয়ে বলে,

” এই ছিল ভালোবাসা! বিশুদ্ধ প্রেম কিনা এত দ্রুত ই ছেড়ে চলে যায়! ”

” আমার ভালোবাসা নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই কারো। ”

” আমি বলবো কারণ তোমার ভালোবাসার হকদার আমি। ”

উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে প্রণয়, সূচনা নিশ্চুপ থাকে। প্রণয় ফের বলে,

” কে যেন বলেছিল সে আমাকে ভালোবাসে! ”

সূচনা প্রণয়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলে,

” আমিই বলেছিলাম। কিন্তু আমার ভালোবাসা অত তীব্র না। ”

প্রণয় তাকিয়ে থাকে, সোজা হয়প বসে বেঞ্চিতে। নিচু দৃষ্টিতে অপরাধী কণ্ঠে বলে,

” তুমি ঐদিন যার কল রিসিভ করেছিলে সেই মেয়েটা আমার কলিগ। অফিস জয়েন করার পর থেকেই আমার পেছনে পড়েছিল। কার থেকে যেন শুনেছিল আমি বিয়ে করেছি তারপর থেকে জা লি য়ে মা র ছিল। আমি চাচ্ছিলাম ওর একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করতে। ও চাচ্ছিল কোনো একটা ঝামেলা করতে। এসব নিয়ে এমনিতেই চিন্তিত ছিলাম তার মধ্যে ই তুমি সেদিন ওর ফোন রিসিভ করেছো, এরপর দিন ইরাকে ঐ ছেলেটার সাথে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল আরও। তুমি নাকি আবার আগে থেকে ই চেনো। সেটা শুনে আমি আরও..আগে থেকেই ডিস্টার্বড ছিলাম। ”

” এর মধ্যে একদিন ও পারলেন না কথা বলে সব পরিষ্কার করে নিতে! ”

সূচনার চাপা অভিমান, প্রণয় আগের ন্যায় ই বললো,

” আমি ভাবছিলাম কথা বলতে গিয়ে আমি আবার রে গে গিয়ে সব ওলটপালট করে ফেলব। সাহস হয়নি। ”

পরপরই বলে,

” এজন্য এত বড় কদম ওঠাবে! ছেড়ে যেতে হবে একটু ঝগড়া হলেই! ”

কথার পৃষ্ঠে সূচনা স্মিত হাসে, ক্ষীণ স্বরে বলে,

” ছেড়ে কে যাচ্ছে! ”

” মানে! এসব কী আর কেন? ”

” আমার সাথে ব্যাগ বা লাগেজ দেখতে পাচ্ছেন? ”

এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে প্রণয় অবাক স্বরে বলে,

” না মানে..”

সূচনা আয়েশি ভঙ্গিতে পায়ে পা তুলে বসে বলে,

” মানে আমি যাচ্ছি না। আপনাকে শিক্ষা দেয়ার একটু প্রচেষ্টা। ”

এগিয়ে এসে প্রণয়ের ওপর ঝুঁকে সুর দিয়ে গায়,,

” লোকে পাগল বলুক, মাতাল বলুক আমিই তোমার পিছু ছাড়ছি না। ”

প্রণয় তখন তাজ্জব বনে গেলেও এবার হেসে ফেলে। তার ধারণার বাইরে ছিল এসব। সব দ্বিধাদ্বন্ধ, ভাবনা ভুলে সে আলগোছে দুই হাত রাখে সূচনার গালে। সন্তপর্ণে ঠোঁট ছোঁয়ায় সূচনার কপালে। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। সূচনা কিছু টা লজ্জা পেয়ে বলে,

” তাকিয়ে আছেন কেন? ”

” তোমাকে দেখি। ”

” দেখার কী আছে! ”

” চোখের শান্তি। ”

” ওমা, দিন দুয়েক আগে ও তো আপনার চোখের বি ষ ছিলাম। অমনিই শান্তি হয়ে গেলাম! ”

” হ্যাঁ হয়ে গেলে তো! ”

” চা পে পড়ে বিয়ে করেছেন প্রেমে নিশ্চয়ই পড়েননি! পড়ার কথা ও না, ঐসব প্রেম আপনার জন্য না। ”

” তুমি পড়োনি! তুমি তো ভালোবাসো৷ বিয়ের আগের প্রেম আমার জন্য না, বিয়ের পরের প্রেম আমার জন্য। আমার সবটুকু প্রেম আমার স্ত্রীর প্রতি, প্রণয়ীর প্রতি, তোমার প্রতি। ”

” এখন ভালোবাসা আসছে অনেক। ”

” আসছে তো। মানুষ ভালোবেসে বিয়ে করে আমি বিয়ে করে ভালোবাসছি৷ ”

সূচনা বেশ কৌতুহলি কণ্ঠে বলে,

” প্রথম দেখা ট্রেনে ই হয়েছিল না! ”

প্রণয় মাথা নাড়িয়ে বলে,

” তারপর দ্বিতীয়বারের সাক্ষাৎ এ ঝুম বৃষ্টি, তৃতীয়বার পদ্ম বিলে পদ্মফুল হাতে জীবন্ত পদ্মফুল কে দেখে চতুর্থ বারের সাক্ষাৎ এ একেবারে নিজের করার জন্য #প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি তাকে। সে পদ্মফুল এখন আমার বুকের মধ্যিখানে থাকে। ”

কথার পৃষ্ঠে সূচনা নিজেকে আবদ্ধ করে প্রণয়ের বাহুডোরে, প্রণয়ও আবেশে জড়িয়ে নেয় তাকে। শীতল বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছাটঁ ছুয়ে দেয় তাদের।

#সমাপ্ত

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-১২

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_১২
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
___________________________________
পরের দিন সূচনার ঘুম ভাঙে বেশ বেলা করে ই৷ চোখ খুলে তাকালে চোখে আলো লাগতেই মাথা ঝিম ধরে গেল। দুই হাত দিয়ে চুল খামচে ধরতেই কপালে থাকা আধ ভেজাঁ রুমালটা হাতে লাগে। ভ্রু দ্বয়ের মাঝে তার ভাজঁ পরে। শরীর দুর্বল লাগছে ভীষণ, কোনোরকমে উঠে বসে কপাল থেকে রুমাল টা সরায়। বেডের পাশের ছোট টেবিলের ওপর মাঝারি সাইজের বাটিতে পানি দেখে সূচনা বোঝার চেষ্টা করে। মাথা খাটিয়ে এতটুকু ধারণা করে, রাতে হয়তো তার জ্বর বেড়েছিল তারপর ই জলপট্টি দিয়ে দিয়েছে কেউ। এর মধ্যেই নুরাইয়া রুমে আসলেন। সূচনার কাছে আসতে আসতে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

” শরীর কেমন এখন? জ্বর কমেছে একটু? ”

সূচনা মাথা ওপর নিচ করে জানান দিল, কমেছে একটু। নুরাইয়া হা হুতাশ করতে লাগলেন, বললেন,

” দুপুরে কত বার করে বললাম ঔষধটা খেয়ে নিও। খাওনি। এদিকে রাতে ও এত জ্বর বাড়লো, ছেলেটা ও কাউকে ডাকেনি। একা একাই মাতব্বরি করেছে। আমায় ডেকে দিলে কী হত! ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে এমন ভাব করে যেন সব তারাই বুঝে৷ ”

সূচনার বুঝতে বাকি রইলো না সেই কেউ টা যে প্রণয়। এদিকে নুরাইয়া কে হা হুতাশ করতে দেখে সূচনা কিঞ্চিৎ হাসলো। তার জ্বর হলে তার মা ও এমন ই করতো। মায়ের কথা মনে পরায় সূচনার চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো মুহূর্তেই। নুরাইয়ার চোখ এড়ালো না তা, বেশ নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

” কী হয়েছে? খারাপ লাগছে? ”

সূচনা দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,

” না খারাপ লাগছেনা, আসলে আম্মুর কথা মনে পরছিল। ”

নুরাইয়া এহেন জবাবে খানিক হাসলেন, হাসি বজায় রেখে ই বললেন,

” বোকা মেয়ে, তাই বলে কাঁদতে হবে! আপাকে কল করো, কথা বলো মন হালকা হবে। আর আমি তো আছিই। তুমি আমার ছেলের বউ তো কী হয়েছে! আমি তো তোমার মায়ের মতোই। ”

সূচনার চোখ আবারও ছলছল করে উঠলো৷ কী ছোট্ট একটা বাক্য, আমি তো আছিই। অথচ এর ভাবার্থ গভীর যদি সত্যি সত্যি থাকে। এমনভাবে বলে ভরসা দেয়ার মতো মানুষ সূচনা তার জীবনে বলতে গেলে পায় ই নি। এক মা ছাড়া তার পুরো দুনিয়ায় কেউ ছিল না, কেউ ভরসা দেয়নি, মাথায় হাত রাখেনি। সূচনা মৃদুস্বরে বলে,

” শাশুড়ী তো মা হয় না আম্মা। মানুষের মুখে এই কথা শুনে শুনে আমি অনেক ভয় পেতাম। যদি সত্যি ই অন্যদের মতো শাশুড়ী হয় আমার! কিন্তু আপনার মতো শাশুড়ী যে হয় সেই কথা তেমন কেউ বলেনি কখনো।”

নুরাইয়া আবারও হাসলেন, সূচনার কাছে বসে তার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,

” মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ কিন্তু এক হয়না, এক পিঠে যদি অমন দজ্জাল শাশুড়ী থাকে অন্য পিঠে আমার মতো শাশুড়ী ও থাকে। অবশ্য আমি অত ও ভালো না, এত প্রশংসা করতে হবেনা। আর শাশুড়ীর মা হবার দরকার কী! মা তো মা ই, আর শাশুড়ী তো শাশুড়ী। যে যার জায়গায় থাকবে। বুঝেছো! এবার ওঠো, বেলা হয়েছে অনেক। উঠে হাত মুখ ধুয়ে, খেয়ে ঔষধ খাও। এমনিতেই ছেলে আমার রে গে আছে দেখলাম। ”

প্রণয়ের রে গে থাকার কথা শুনে সূচনার গত কালকের কথা মনে পরে। নিজের ওপর ফের রা গ চেপে বসে। গত কাল বেশ চিন্তা ভাবনার পর বুঝতে পারে দোষটা আসলে তার ই। তার উচিত হয়নি ঐসময়ে অমন কথা বলা। বোঝার পর থেকে সে চেষ্টা করছে প্রণয়ের সাথে কথা বলার। কিন্তু নাছোরবান্দা প্রণয়, মুখ দিয়ে টু শব্দ ও করছে না যেন মৌনব্রত পালন করছে। দেখেও না দেখার ভান করে কী সুন্দর এড়িয়ে যাচ্ছে! সূচনা মূলত প্রণয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই ঔষধ না খেয়ে শুয়েছিল। ভেবেছিল হয়তো জোর করে খাওয়াবে৷ কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। টেবিলে ঔষধ আর পানির গ্লাস রেখে কানে ফোন ধরে গম্ভীর গলায় বলেছে,

” ঔষধ না খেয়ে অসুখ বাধানোর পরিকল্পনা যদি থাকে তাহলে যেন বাপের বাড়ি যায়। যেচে অসুখ বাধালে তার জন্য আমি অযথা টাকা নষ্ট করবো না। ”

ব্যস এতটুকু ই, সূচনার মনঃক্ষুণ্ন হয়, আ ঘা ত পায় ভীষণ। ঔষধ আর নেয় না, প্রণয় ও কোনো প্রকার জোর করেনা। সেসব ভেবে সূচনা মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

” লাভ টা কী হলো! আপনার ই তো রাত জেগে সেবা করতো হলো। ”


সূচনার বাকি দিন কা টে শুয়ে বসে ই। ইরা কিছু সময় তার সাথে কাটিয়ে নিজের রুমে চলে গেছে। মুগ্ধর কথা আর আজকে তোলেনি সূচনা তবে ইরাকে দেখে মনে হয়েছে কোনো বিষয়ে চিন্তিত সে। মুগ্ধর সাথে কিছু চলছে কি? সূচনা ভেবেছিল জিজ্ঞেস করবে কিন্তু করেনি আর। সন্দেহের ভিত্তিতে এসব বিষয় নিয়ে এগোনে যায় না৷ কিন্তু তাকে এতকিছু ভাবতে হয়না আর। ইরা সূচনার রুম থেকে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ই আবার ফিরে আসে। নত মস্তকে নিচু কণ্ঠে বলে,

” আমার একটু কথা ছিল ভাবি। ”

সূচনা সহজ ভাবেই বলে,

” বসো, কী কথা বলো। ”

ইরা শুরুতে আমতা আমতা করে, কীভাবে বলবে, কীভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারেনা। তার এহেন অবস্থা দেখে সূচনা তাকে সহজ হতে বললো,

” ঠান্ডা হও, এত ইতস্তত করতে হবে না৷ সহজ ভাবে বলো কী হয়েছে! ”

ইরা নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালায়, মৃদু স্বরে বলে,

” তোমার তো মুগ্ধর সাথে কথা হয়েছে তাই না! ও ছেলে হিসেবে কেমন? ”

সূচনার কপালে ভাজ পরে, এটা কেমন প্রশ্ন! সে কীভাবে জানবে মুগ্ধ কেমন ছেলে। সে ভ্রু কুটি করে বললো,

” আমি কীভাবে জানবো ইরা! মুগ্ধর সাথে আমার কথা হয়েছে একদিন। নিজ থেকে কথা বলেছিল, তোমায় পছন্দ করে সেটা বলতে৷ হ্যাঁ ভদ্রভাবেই কথা বলেছে কিন্তু এর দ্বারা তো বোঝা যায় না ছেলে হিসেবে কেমন। ”

” আচ্ছা। ”

” কেন জিজ্ঞেস করছো! ”

” ভাবি..আমি..

ইরা বলতে পারেনা, উসখুস করে। এবার সূচনা নিজ থেকে ই বললো,

” দেখো ইরা, এই সময়টাতে মুগ্ধর মতো হয়তো কয়েকজন ই আসবে। কেউ থাকতে আসবে কেউ বা এমনিই এমনিই। সময় নষ্ট করতে। জরুরি না যে তোমার সবার কথা চিন্তা করতে হবে, ভাবতে হবে। জরুরি এটা যে কে শেষ পর্যন্ত থাকবে। যে থাকবে তুমিও তার হয়ে ই থাকবে। মুগ্ধ অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে, কয়দিন পর চাকরি বাকরি পাবে, প্রতিষ্ঠিত হবে। সময়ের ব্যাপার, তোমার হাতে ও এখনো মোটামুটি ভালো সময় আছে। অন্তত অনার্স শেষ হওয়া অব্দি। সুতরাং এখন এসব চিন্তা ভাবনা বাদ দাও, তাকে ও বলবে এসব চিন্তা ভাবনা তোমার মাথায় দিয়ে মাথাটা যেন নষ্ট না করে। নিজের পড়ালেখায়, ক্যারিয়ারে মন দিতে বলো আর তোমাকেও তোমার মতো ছেড়ে দিতে। ”

ইরা প্রসন্ন হয়, তার প্রশ্নের জবাব সে পেয়ে গেছে। সূচনাকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে।



বিকেলের শেষ প্রহর, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছে সূচনা। আজকে অন্যদিনের তুলনায় বাতাস বেশি। জ্বর খানিক কমেছে তার। প্রণয়ের অফিস থেকে ফেরার সময় সাড়ে পাঁচটায়। এখন সময় প্রায় ছয়টা অথচ তার ফেরার খবর নেই। সূচনা কল করেছিল বার দুয়েক, কিন্তু রিসিভ করেনি কেউ। করবে কেন! কল রিসিভ করলে তো কথা বলতে হবে আর কথা তো সে বলছেনা। সেজন্য ইচ্ছে করেই রিসিভ করছেনা। সূচনার এমনই মনে হলো, কল করলো না আর।

প্রণয় সেদিন অফিস থেকে ফিরলো সাতটার সময়। এসেই ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে একেবারে রুমে আসলো নয়টার দিকে। সূচনা আগে ভাগে কাজ সব সেরে রুমে আসে। প্রণয় আসার পর থেকে সে বার কয়েক চেষ্টা চালিয়েছে কথা বলার। কিন্তু প্রণয় তাকে পাত্তা ই দেয়নি। যেন দেখে ও দেখেনি। সে যে সাহস করে নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করেছে। যেই সাজগোছ তার অপছন্দ অথচ এই ছেলের জন্য সেজেগুজে বসে আছে। ছেলেটা একবার ও খেয়াল করলো না, ভালো করে তাকালো না পর্যন্ত। এজন্য ই বলে হারিয়ে আফসোস করতে নেই। গতকাল ব্যাঘাত ঘটিয়ে আজকে নিজ থেকে যাচ্ছে! গত কালকে তার বলা ঐ কথার পর এই ছেলে যে নিজ থেকে তার ধারে কাছে ও ঘেঁষবে না সে সম্পর্কে সূচনা নিশ্চিত। কিন্তু কোনো ভাবে রা গ তো ভাঙাতে হবে! বোকামি যেহেতু করেছে এখন তো একটু বে হা য়া হতেই হবে। অবশ্য হওয়াই যায়, তার নিজের বর ই তো।
চিন্তা করতে করতে সূচনা হেসে ফেলে শব্দ করে। ব্যালকনিতে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে ছিল প্রণয়। হাসির শব্দে সে পেছনে তাকায়। সূচনাকে দেখা মাত্রই মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ বের করে ফের সামনে ঘুরে তাকায়। সূচনা পেছনে ভেংচি কে টে বিড়বিড় করতে করতে তার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। প্রণয় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সূচনা মিনমিনে গলায় বলে,

” কী সমস্যা আপনার! চোখে পট্টি বেঁধেছেন! দেখেও না দেখার ভান করছেন কেন! ”

প্রণয় ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকিয়ে বলে,

” দুঃখীত আমি কাউকে দেখছি না৷ ”

” চোখের সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছি আর বলছেন দেখছিনা। ”

” চোখে সমস্যা হয়েছে, গুরুতর সমস্যা। চোখ তোমাকে ছাড়া বাকি সবাইকে দেখতে পাচ্ছে। শুধু তোমাকে ই দেখতে পাচ্ছে না। এমন হচ্ছে কেন বলো তো! অবশ্য ভালো হয়েছে, অন্তত কোনোভাবে তোমার সুযোগ নিতে পারবনা। ”

ঠেস দিয়ে বলা কথা সূচনার বেশ হজম হয়। বুঝতে পারে ঐ কথার জন্য ই সাহেবের এত রা গ। সূচনা অনুতপ্তের সুরে বলে,

” কালকের কথার জন্য এত রাগ। আমি বুঝতে পারিনি, মুখ ফসকে বের হয়ে গিয়েছিল। মিন করে বলিনি। ”

” মনে যে কথা থাকে মুখ ফসকে তাই বের হয়৷ কে যেন বলেছিল! ”

কথাটা সূচনা ই বলেছিল তাদের দ্বিতীয় বারের দেখায়। সূচনা সেই কথা স্মরণে রেখে বললো,

” আমিই বলেছিলাম কিন্তু আপনি যে সেদিন বলেছিলেন মেয়ে মানুষ মানে ঝামেলা৷ আমাকে সাহায্য করতে যেয়ে উল্টো বিপদে পরেছেন। আবার আমাকে বিয়ে করবেন! এসব ই তো মুখ ফসকে বেরিয়েছিল। আমার খারাপ লেগেছিল কিন্তু মিন করে বলেননি, মাফ করে দিয়েছিলাম। তাহলে আপনি করতে পারবেন না কেন! ”

প্রণয় স্মৃতিচারণ করে, মনে পরে সব ই। হ্যাঁ ঐ কথা গুলো সে মন থেকে বলেনি। সূচনা ও মাফ করে দিয়েছিল। সূচনা ও তো কালকে মন থেকে ঐসব বলেনি, তার ও তো উচিত বোঝার। প্রণয়ের রা গ ঈষৎ কমে। গলার স্বর নরম হয়, সূচনার দিকে ঘুরে বলে,

” আচ্ছা রা গ পরে গেছে। ”

” কীভাবে পরলো! ”

” এমনিই। ”

” এমনি ই কীভাবে পরে! ”

সূচনা পরপর বলে,

” মানুষের এত রা গ থাকে! যা ই বলেছি ভুল করে বলেছি তার জন্য এত রা গ দেখাতে হবে! ”

সূচনা চোখ মুখ কুঁচকে কথাগুলো বলে। প্রণয় অদৃশ্য হাতে কপাল চাপড়ায়। মানে আ গু নে ঘি ঢেলে আ গু ন না বাড়তে বলা। তবে গত কালের ন্যায় প্রণয় রে গে যায় না। সূচনার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কোমল স্বরে বলে,

” দেখো, সুযোগ নেয়ার হলে আমি আর ও আগেই নিতাম। তোমার অসুস্থতা, সুস্থতা দেখতাম না। কালকে আমি কোনো সুযোগ নিচ্ছিলাম না। তুমি আমার স্ত্রী, তোমার ওপর আমার পুরো অধিকার আছে। আমি চাইলে অধিকার ফলাতে পারতাম আগেই। কিন্তু আমি চাইছিলাম আস্তে ধীরে সব হোক। আমি ধাপ এগোলে তুমি আরেক ধাপ এগোবে। কালকে এক ধাপ এগোতে চেয়েছিলাম আমি আর তুমি..

” সব নষ্ট করে দিয়েছি। ”

” হ্যাঁ। আর দোষ যে সব আমার দিচ্ছো, গত কালকে মেসেজ দিয়েছিল কে? মেসেজে কে বলেছিল ভদ্র থেকে বা জে হতে! ”

সূচনা কয়েক সেকেন্ড বোকার মতো চেয়ে থাকলো অতঃপর মনে হতেই মিনমিনে গলায় বললো,

” আমি ই বলেছিলাম৷ আবেগে বলে ফেলেছি, আসলে জ্বরের ঘোরে করেছি যা করার। ”

” এখন সব জ্বরের দোষ। ”

” সামান্য এক মেসেজে আপনি ফুসলে যাবেন! ”

” একমাত্র বউয়ের আবদার, ভদ্র থেকে বা জে হতে বলেছে না হয়ে কই যাই বলো! ”

প্রণয়ের ঠোঁটে দুষ্ট হাসি, সূচনা লজ্জা পায়। প্রণয় আসছি বলে সূচনার পাশ থেকে সরে যায়। সূচনা ডান দিকে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। প্রণয় যায় না, নিঃশব্দে সূচনার পাশে দাঁড়ায়। ঘাড়ে স্পর্শ পেতেই মেয়েটা ঘাড় ঘুরায়। প্রণয়কে পেছনে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার ন্যায় চমকে ওঠে। সে ভেবেছিল প্রণয় সত্যি চলে গেছে। কিন্তু যায়নি। দুজনের মাঝে দূরত্ব একেবারেই কম খেয়াল হতেই মেয়েটা তড়িৎ গতিতে পেছনে যেতে নিলে মাথা যেয়ে বারি খায় দেয়ালের সাথে। ঈষৎ ব্যথা ও পায়, হৃদ স্পন্দন তার অস্বাভাবিক। ঘনঘন শ্বাস টানছে। চোখ জোড়া একটু ভালো করে মেলে প্রণয়কে দেখে। তার দৃষ্টি জোড়ায় কেমন মাদকতা! মেয়েটা ভয় পায়। কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে যায় যেন। এত ভয়, এত কাঁপুনি কিসের! প্রণয় তন্মধ্যে ঝুঁকে পড়ে তার ওপর। কম্পনরত অধর জোড়ায় ডান হাতের বুড়ো আঙুল ছোঁয়ায়। চোখ জোড়া আপনাআপনি বুঁজে আসে নাজুক মেয়েটার। কাঁপুনি বাড়ে আরও। তার অধরে থাকা পুরুষালি আঙুল এপাশ হতে ওপাশ যায় অধরে থাকা কৃত্রিম রঙ মুছে দেয়। কর্ণকুহর হয় নেশাতুর কণ্ঠ,

” তোমার ঠোঁট জোড়া ঈষৎ গোলাপি না! সেখানে এই কৃত্রিম রঙ দিতে বলেছে কে! আমার আর যেন না দেখি। ”

সূচনা মুখ খুলে কিছু বলতে পারে না। যেন ভাষা হারিয়ে মেয়েটা নিঃস্ব। প্রণয় দুই বাহুতে হাত রেখে ললাটে ঠোঁট ছোঁয়াতে ই তার শরীর স্থির হয়। সূচনা ফট করে সামনে ঘুরে যায়। প্রণয়ের দিকে পিঠ করে দাঁড়ায়। তার বুক ধুকপুক করছে এখনো। প্রণয় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

” একটা গানের কথা মনে পরছে, গাইব! ”

সূচনা আখিঁ জোড়া বন্ধ অবস্থাতেই মাথা ওপর নিচ দুলিয়ে সম্মতি দেয়৷ সম্মতি পেতেই প্রণয় গান শুরু করে,

❝ হাওয়ায় হাওয়ায় দোলনা দোলে
সুরের ডানা মেলে…
তোমার মনের উঠান, লেপে দেবো
সাজিয়ে দেবো ফুলে…
তুমি এসো… তবু এসো, ভালোবেসে।

খেয়ালির শিশির, লুটাবে তাই
আঁচল টেনেছে মেঘে…
তোমারী জন্যে, শুধু তোমার জন্যে।

গোধূলি আকাশ লাজুক লাজুক,
সন্ধ্যা এখনও জেগে…
তোমারী জন্যে, শুধু তোমার জন্যে।

আমি সেই সুখে আজ
ফেলেছি মন আবেগ জড়ানো কূলে…
তুমি এসো… তবু এসো, ভালবেসে। ❞

গান শেষ হলেও সূচনার ঘোর কা টে না। চোখ বন্ধ করে প্রতিটা লাইন অনুভব করে। প্রণয় তার কাঁধে নিজের থুঁতনি রেখে বলে,

” লজ্জা লাগছে! ”

সূচনা মাথা দুই দিকে নাড়িয়ে বলে,

” উহুঁ। ”

” এদিকে ঘুরো দেখি। ”

সূচনার দুই বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরায় প্রণয়। সূচনা নত দৃষ্টি ওপরে তুলে তাকালে প্রণয় নেশাতুর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

” কালকের অর্ধেক কাজটা কী আজকে সাড়া যাবে? ”

সূচনা জবাব দেয় না, আলতোভাবে প্রণয়ের বুকে মাথা রাখে। প্রণয় বোধহয় তার জবাব পেয়ে যায়। সূচনার মাথায় চুমু খায়। ব্যালকনি হতে প্রস্থান করে, বদ্ধ ঘরে, অন্ধকারে ভারী শ্বাসে কক্ষের পাল্লা ভারি হয়। সম্পূর্ণ অচেনা হতে মন ও শরীর দুইয়েই দু’জনের কাছে দুজন চেনা রূপে ধরা দেয়।

#চলবে