সে আমারই পর্ব-০১

0
449

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#সূচনা_পর্ব

“ট্রাস্ট মি, ফিরোজ! আই লাভ ইউ। ট্রু টু সে আই লাভ ইউ সো মাচ! প্লিজ ডোন্ট লিভ মি। আই বেগ টু ইউ!”

ফোনের ওপাশে নিরবতা। ব্যক্তিটি যেন টু শব্দটি পর্যন্ত করতে জানে না। জন্ম বোবা যেন! কোনো শব্দ না পেয়ে মেয়েটি পুনরায় বলল,

“ওয়াট হ্যাপেন্ড ফিরোজ? সে সামথিং? কিছু তো বলো?”

ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ আসে। লম্বা শ্বাস টেনে সে বলে,

“আমি ফিরোজ নই, ফারনাজ!”

ফারনাজ বিভ্রান্তিতে পড়ে। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে বলে,

“আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি, জাহিদ। আসলে জিহ্বা পিছলে বেরিয়ে গিয়েছে। প্লিজ ডোন্ট গো।”

“আমি জাহিদও নই।”

“ওহ! তাহলে নিশ্চয়ই মুরাদ? আমি স্যরি বলছি, মুরাদ।”

ফোনের ওপাশ থেকে কর্কশ কন্ঠ ভেসে আসে,

“আমি মুরাদও নই!”

ফারনাজ এবার বিরক্ত হয়। চেঁচিয়ে বলে,

“আশ্চর্য! এতো গুলো নাম বললাম একটাও তুই না? তাহলে কে তুই?”

“আমি সাকিব।”

ফারনাজ নাক সিঁটকায়,

“ছিঃ! এতো ভালো ভালো নাম বললাম তা তোর পছন্দ হলো না। শেষ মেষ সাকিব! তুইও নিশ্চয়ই সাকিব খানের মতো লুই’চ্চা হবি! তুই কি ব্রেক আপ করবি? আমিই করলাম! যা।”

ফারনাজ খট করে ফোন কেটে দিল। সাকিব কিছুক্ষণ হা করে ফোনের দিকে চেয়ে রইল। সে তো নিজে এই মেয়েকে ছেড়ে দিচ্ছিল, ভেবেছিল হাতে পায়ে পড়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলে আবার প্যাচ আপ করে নেবে। কিন্তু এই মেয়ে তো নিজের বয়ফ্রেন্ডের নামটা প্রর্যন্ত মনে রাখতে পারে না! আর সাকিব নাম সে তো ইচ্ছে করে রাখেনি।‌ বাবা মা রাখলে তার কি দোষ? তখন কি তারা জানত সাকিব নামের নায়ক বের হবে আর একের পর এক খেল দ্যাখাবে?

ফোন বিছানায় এক প্রকার ছুড়ে ফেলে মুখ কুঁচকে নিল ফারনাজ। একটা জাতের বয়ফ্রেন্ড পাওয়া যাচ্ছে না। এসব সাকিব টাকিব কোথা থেকে আসে কে জানে? বিছানায় আরও এক রমনীর বিস্তার রয়েছে। তবে সে নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন। ডুবে রয়েছে উপন্যাসের বইয়ে। হুমায়ূন আহমেদের ‘অপেক্ষা’- এটি তার একটু বেশিই প্রিয় কিনা? তাই বারবার পড়া হয়। অথচ তার কাছে উপন্যাসের ভান্ডার পড়ে রয়েছে। ফারনাজ ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বইটি ছিনিয়ে নিল। সেটাও ফোনের ন্যায় ছুড়ে ফেলল। রমনী অতিব বিরক্ত হয়ে বলল,

“কি হয়েছে? বইটা এভাবে ফেললি কেন?”

ফারনাজ হা হুতাশ করে বলল,

“আমার ব্রেক আপ হয়ে গিয়েছে, দৃষ! প্লিজ গিভ মি সান্ত্বনা।”

দৃষ্টির মাঝে কোনো হেলদোল দ্যাখা গেল না। এটা তার কাছে খুবই সাধারণ ঘটনার মধ্য একটি। সে সরু চোখে চেয়ে বলল,

“তো কত নম্বর ব্রেক আপ হলো আপনার?”

ফারনাজ মুখে একটা কাঁদো কাঁদো ভাব আনে। চোখ থেকে গোল গোল ফ্রেমের চশমা টি খুলে একটু চোখের জল মোছার ভানও করে। অতঃপর বলে,

“ছয় নম্বর! তুই ভাবতে পারছিস আমার কি পরিমান কষ্ট হচ্ছে? যা শিগগিরই ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম নিয়ে আয়।”

দৃষ্টি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। বইটি যত্ন সহকারে শেলফে রেখে বলে,

“কষ্ট পেলে কেউ আইসক্রিম খায়?”

“অবশ্যই খায়। আলবাত খায়। যা তো নিয়ে আয় আমার মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। হাতে মুঠোয় পেলে ওই সাকিব না টাকিব ও’কে যে আমি কি করতাম!”

দৃষ্টি তাকে আর পাত্তা দেয় না। আলগোছে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। সে জানে তার বোন এখনও চার পাঁচ মিনিট ধরে আহাজারি করবে। তারপর আইসক্রিম পেলে ভুলেও যাবে তার ছয় নম্বর বয়ফ্রেন্ডের কথা।

ফাহাদ আবরারের বাড়িটি দুই তলা বিশিষ্ট। অনেক বড় না হলেও আবার অনেক ছোটও নয়। এই বাড়িটির কানায় কানায় পূর্ণ। এখানে তারা দুই ভাই স্ত্রীসহ তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে থাকেন। ফাহাদ আবরারের তিন ছেলে মেয়ে এবং ছোট জন অর্থাৎ রামিজ আবরারের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। তারা দুই ভাই ছোট খাটো একটা ব্যবসা করে খুব সাচ্ছন্দে সংসার চালিয়ে যেতে পারছেন। তাদের নেই কোনো অভাব।

এই বাড়িটির সকলে যতটা সম্ভব একসাথে খেতে বসার চেষ্টা করে। এই যেমন সকালে, দুই ভাই নাস্তা করে বের হবেন। তাদের সাথেই তাদের ছেলেমেয়েদেরও খাবার টেবিলে উপস্থিত থাকতে হবে। ফাহাদ আবরার ও রামিজ আবরার ইতোমধ্যে টেবিলে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের হাতে রয়েছে খবরের কাগজ। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে এক পর্যায়ে রামিজ আবরার বলেন,

“ভাই! আমাকে খেলার অংশটুকু দেবে? আমার এইটুকু পড়া হয়ে গিয়েছে।”

ফাহাদ আবরার বিনা বাক্যে তাকে তা এগিয়ে দিলেন। রামিজ আবরার তা হাতে নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলেন। তাদের স্ত্রীরা একে একে টেবিল খাবারে পূর্ণ করে ফেলেছেন। অথচ বাচ্চাদের আসন এখনও শূন্য। ফাহাদ আবরার খবরের কাগজ রেখে হাক ছাড়লেন,

“সীমা! বাচ্চারা এখনও ওঠেনি? এলো না যে!”

মিসেস সীমা এক পলক স্বামীর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফেরালেন। হাতের কাজ করতে করতে বললেন,

“তাদের সময় হলে ঠিক এসে পড়বে। রোজ রোজ বসে থাকার দরকার কি বুঝি না আমি।”

“জানোই তো একসাথে খেলে মহব্বত বাড়ে।”

মিসেস সীমা হাত ধুয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছলেন। যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে বললেন,

“তুই এদিকটা একটু দ্যাখ ছোট। আমি নবাবের কন্যা পুত্র গুলোকে একটু দেখে আসি।”

মিসেস বিউটি মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন। মিসেস সীমা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিলেই দেখলেন তার ছোট কন্যাটি পরিপাটি হয়ে নেমে আসছে। পাঁচ পাঁচটি ছেলে মেয়েদের মধ্যে তার এই কন্যাটি সব থেকে পরিপাটি ও শান্ত। দৃষ্টি মাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

“গুড মর্নিং আম্মু!”

মিসেস সীমা পাল্টা হেসে বললেন,

“গুড মর্নিং। আজ এত দেরি হলো কেন দৃষ? তোর বাবা, ছোট বাবা অপেক্ষা করছে তো।”

“স্যরি আম্মু। গতকাল একটু রাত জাগা পড়েছিল। তাই একটু দেরি হয়ে গেল।”

“ঠিক আছে। বোস, আমি রাজকন্যা রাজপুত্তুর দের তুলে নিয়ে আসি।”

তিনি সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলেন। দৃষ্টি নেমে এসে সর্বপ্রথম বাবা এবং ছোট বাবার সাথে কুশল বিনিময় করল, যা সে রোজই করে থাকে। ফাহাদ আবরার হাত বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“পড়ালেখা কেমন চলছে আম্মা?”

“ভালো আব্বু।”

“বেশি চাপ নেওয়ার দরকার নেই। ধীরে সুস্থে পড়বে। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে কেমন?”

“জি আব্বু।”

ফাহাদ আবরার মৃদু হাসেন। এমন বাধ্য এবং শান্ত মেয়ে দুনিয়ায় কটা আছে?

ছেলে মেয়েদের কানের মাথা খেয়ে তাদের ঘুম থেকে টেনে হিচড়ে তুমি এনেছেন মিসেস সীমা। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে! আর কখন উঠবে এরা? সিঁড়ি বেয়ে ধপাধপ পা ফেলে নেমে এলো ফারনাজ। বাবার পাশে বসে ঘুম ঘুম কন্ঠে অভিযোগ জানাল,

“আমার কাঁচা ঘুমটা কেন ভাঙা হলো আব্বু? কি সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলাম জানো? আম্মু সবটা ভেস্তে দিল। এর বিচার চাই আমি।”

“সকাল হয়ে গিয়েছে তো আম্মা। আজ রাতে আবার দেখে নিও।”

ফারনাজ মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। মিসেস সীমা বাপ বেটির আহ্লাদ দেখে মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলেন,

“এই আদরের জন্যই বাঁদর তৈরি হচ্ছে।”

পর পর আসন দখল করে ফারদিন, বন্যা ও বর্ষণ। ফারনাজের মেইল ভার্সন ফারদিন অর্থাৎ তারা জমজ। দুই মিনিটের বড় হওয়ায় তার ভাবের শেষ নেই। সেই এই বংশের বড় ছেলে! এটাই বড় কথা। আর বন্যা ও বর্ষণ রামিজ আবরারের কন্যা ও পুত্র। মিসেস বিউটি সকলকে খাবার পরিবেশন করে দিলেন। কেউ খাবারে হাত দিল না। ফাহাদ আবরার নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে একে একে সবার মুখে দিলেন। বাদ পড়লেন না রামিজ আবরারও। অতঃপর সকলের খাওয়া শুরু হলো। প্রচন্ড ঘুমের ঠ্যালায় বন্যা মুখে খাবার নিয়েই ঝিমোচ্ছে। মিসেস বিউটি দিলেন এক ধমক,

“কি হচ্ছে বন্যা? খাও ঠিক করে।”

ছোট্ট বন্যা ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসে। মায়ের চোখ রাঙানিতে ভয় পেয়ে গিলতে থাকে দ্রুত। গলায় আটকে গেলেও পানি দিয়ে গেলে। তবুও খাওয়া থামে না। মাকে সে একটু বেশিই ভয় পায়।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে