Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 398



সে আমারই পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৮

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে আবরার পরিবার ইততেয়াজ ম্যানসন থেকে বিদায় নিল। তার চেয়েছিল দুই মেয়েকে সাথে নিতে কিন্তু তারা কেউই দেয়নি। অন্য কোনো দিন যাবে বলে তাদের বিদায় দিয়েছে। তূরাগ এতক্ষণের আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ল। ফারনাজকে তারা সাথে নিয়ে গেলে তার সমস্যা হতো খুব। বোকা বউয়ের রাগ ভাঙানো যে এখনো বাকি। সকলে একে একে ঘুমাতে চলে গেল। কেবল বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। ফারনাজ এখনো গেস্ট রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। এক ফাঁকে দৃষ্টি তাকে খায়িয়ে এসেছিল কিন্তু পরেই আবার দরজা এঁটেছে সে। তূরাগ কি একবার ডাকবে? যদি না খোলে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দেখল দৃষ্টি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। তূরাগ একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

“ঘুমাওনি?”

“হ্যাঁ ঘুমাব। আপনাকে এটা দিতে এলাম।”

বলেই তার দিকে একটা চাবি এগিয়ে দিল। তূরাগ হাত বাড়িয়ে তা নিয়ে বলল,

“এটা কীসের চাবি?”

“আপনার গন্তব্যের।”

সে মুচকি হেসে পুনরায় সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল। তূরাগ একটু লজ্জা পেল। কিন্তু মনে মনে দৃষ্টির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে গেস্ট রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চাবি ঘুরিয়ে খট শব্দে দরজা খুলে ফেলল। ভেতরে প্রবেশ করে আবার দরজা বন্ধ করে দিল। আজ দৃষ্টি না থাকলে যে কি হতো? এই ডুপলিকেট চাবিরই তো দরকার ছিল। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই দেখল তার কাঙ্ক্ষিত রমনী ঘুমিয়ে আছে। যে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। সে মৃদু হেসে এগিয়ে যায়। আলতো আলোয় তার মুখশ্রী ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে। তূরাগ সংকোচ বিহীন তার পাশে গিয়ে আধশোয়া হয়। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয় নরম গাল। ফারনাজ নড়ে ওঠে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,

“কে?”

তূরাগ ফিসফিসিয়ে বলে,

“তোমার স্বামী।”

সে আশা করেছিল ফারনাজ রিয়্যাক্ট করবে। হয় চিৎকার করবে নয়তো হতভম্ব হয়ে উঠে বসবে। কিন্তু এসবের কিছুই হলো না। ফারনাজ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,

“ওহ! আপনি? ঘুমিয়ে পড়ুন।”

তূরাগ নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল। টেনে তাকে তুলে বলল,

“ঘুমিয়ে পড়ুন মানে কি? তুমি অবাক হওনি? আমার উপর রাগ নেই? মনে কোনো প্রশ্ন নেই?”

“উফ্! দিলেন তো আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে?”

“আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও, ফারনাজ।”

ফারনাজ চোখ মেলে তার চোখে চোখ রাখে। বলে,

“আমার চশমা কই?”

তূরাগ হতাশ হয়। পাশের ছোট টেবিল থেকে তার চশমা হাতে নিয়ে চোখে ঠেলে দেয়। ফারনাজ ভালো করে তাকে দেখে নিয়ে বলে,

“কোনো কিডন্যাপারের সাথে আমি কথা বলতে ইচ্ছুক নই।”

তূরাগ বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে,

“কি বললে!”

“হ্যাঁ ঠিকই তো বললাম। আপনি একটা কিডন্যাপার আর আমাকে দশ দশবার কিডন্যাপ করেছেন। আবার ছেড়েও দিয়েছেন।”

তূরাগ দিশেহারা হয়ে বলে,

“তুমি! মানে তুমি কীভাবে জানলে?”

“মাথা মোটা মেয়ে একমাত্র কিডন্যাপারই আমাকে বার বার বলত। আর আপনার পারফিউমও একদম তার মতো। তারপর আজই প্রমাণ হয়ে গেল আপনি আমাকে ভালোবাসেন। অতএব আপনি সেই কিডন্যাপার।”

তূরাগ বোকা বনে গেল। বলল,

“প্রমাণ হলো মানে কি! তুমি আগে থেকেই টের পেয়েছিলে!”

“হ্যাঁ। কিডন্যাপারের কথায় কাজে আমি একটা অপ্রকাশিত ভালোবাসা খুঁজে পেতাম। আর আপনিই যেহেতু কিডন্যাপার সেহেতু..”

“ওয়েট, আজ বিকেলে রেস্টুরেন্টের ওসব কি ছিল?”

ফারনাজ দাঁত কেলিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“নাটক।”

“কিহ! আমাকে বোকা বানালে!”

সে হাই তুলে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল আবার। বলল,

“বোকা না বানালে আপনার পেটের কথা মুখে আসত না। কিন্তু এটা ভাবিনি পাগল হয়ে আমাকে বিয়ে করে নেবেন। পাগল একটা!”

সব বুঝতে পেরে তূরাগ হাসে। সে নিজেই বোকা মেয়েটার কাছে বোকা হয়ে গেল। পেছন থেকে জাপ্টে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজল। মৃদু কণ্ঠে বলল,

“আগেও তো তোমার রুমে যেতাম। সেটা ধরতে পারলে না কেন?”

“কিহ! আপনি আমার রুমে যেতেন! কেন?”

“তোমার ঘুমন্ত মুখ দ্যাখার লোভ সামলাতে পারতাম না, তাই।”

বলতে বলতে তার শুষ্ক অধর তার কাঁধ ছুঁয়ে যায়। সে পুনরায় বলে,

“বিয়েতে রাজি হয়েছ কেন? মানা করে দিলে তো কেউ জোর করত না।”

ফারনাজের শরীর শিরশির করে ওঠে। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

“আপনার মতো বোকা বুঝবে না।”

তূরাগ ফের হাসে। বোকা মেয়ে তাকেই বোকা বলছে! থেমে থেমে বলে,

“ভালোবাসো?”

ফারনাজ লাজুক হাসে। তা তূরাগের দৃষ্টিগোচর হয় না। সে বলে,

“না তো, ভালোবাসি না।”

তূরাগ আরও শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আমি তো বাসি। তাতেই হবে।”

সে ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে লম্বা শ্বাস নেয়। ফিসফিসিয়ে ডাকে,

“ফারনাজ?”

চোখ বন্ধ করে জবাব দেয় সে,

“হু?”

“তুমি জানতে চায়তে না, যে আমি না দেখেও কীভাবে তোমার উপস্থিতি টের পাই? তার উত্তর হলো, তোমার গায়ের এই মেয়েলী সুবাস আমার বড্ড চেনা, বড্ড প্রিয়। তাই তো আমি সহজেই ধরে ফেলি।”

ফারনাজ হাসে। তবে মুখ ফুটে বলে না যে তার শরীরের ঘ্রাণ তারও প্রিয়। তূরাগ তাকে পেঁচিয়ে ধরে চোখ বোজে। এখন থেকে সে আরাম করে ঘুমাবে। রাত জেগে ফারনাজের কথা ভাবা লাগবে না। কারণ পুরো ফারনাজটাই এখন তার, একান্ত তার। তার তো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, “সে আমার হয়েছে। আজ থেকে সে পুরোপুরি আমারই। শুধু আমার।”

অন্য রকম একটা সকাল। সব কিছু নতুন অনুভূত হয়। পাশে থাকা মানুষটা পুরোনো ঠিকই তবে সম্পর্ক টা নতুন। এই অনুভূতি নতুন, এই সকাল নতুন। তার বাহুডোরে নিজেকে আবিষ্কার করা নতুন। তার ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে চেয়ে মুগ্ধ হওয়া নতুন। হৃদয়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি লাভ করা নতুন। এই লাজুক হাসিটাও নতুন। ভাবতে ভাবতে ফারনাজ হেসে ফ্যালে। হাত বাড়িয়ে সংকোচ বিহীন ছুঁয়ে দেয় তার চোখের পাতা, নাকের ডগা। এলোমেলো করে দেয় চুল। সে নড়ে ওঠে। ফারনাজ আলগোছে উঠে পড়ে। লোকটা যে এতো জোরে চেপে ধরে ঘুমিয়ে ছিল! তার শরীরের হাড্ডি বোধহয় নড়ে গিয়েছে।

ফ্রেশ হয়ে রুম ছেড়ে বের হলো। তূরাগকে ডাকল না। রান্না ঘরে দুই জা মিলে নাস্তা তৈরি করছেন। তাদের সাথে হাত লাগাচ্ছে দৃষ্টি। সে কাজের ফাঁকে ফারনাজকে দেখে নিল। মুখটা গম্ভীর করে বলল,

“শশুর বাড়িতে এতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না, ছোট বউ। কাজে হাত লাগাও। এখন থেকে আমি যা বলব তাই করতে হবে। মনে রেখো আমি কিন্তু আমি এ বাড়ির বড় বউ এবং তোমার বড় জা।”

মিসেস সাইমা এবং মিসেস অনা হেসে ফেললেন। ফারনাজ হা করে তাকায়। মিসেস সাইমা দৃষ্টির কান টেনে দিয়ে বললেন,

“দুষ্টুমি করিস বড় বোনের সাথে? এসব কেমন কথা?”

দৃষ্টি মুখ কুঁচকে বলে,

“আমি তো আপুর বড় তাই না? বয়সে না হলেও সম্পর্কে বড়। তাই ওর উচিত আমাকে সম্মান করে চলা।”

ফারনাজ তার বাহুতে মৃদু চাপড় মে’রে বলে,

“সম্মান নেন বড় জা।”

হাসাহাসির মধ্যে নাস্তা তৈরি হয়ে গেল। হঠাৎ তূরাগের কণ্ঠে ফারনাজ চমকে উঠল। সে নির্লজ্জের মতো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তাকে ডাকছে। দৃষ্টি মিটিমিটি হাসে। ধাক্কা দিয়ে বলে,

“যাও ছোট জা, দ্যাখো আমার দেবরের কি লাগে?”

ফারনাজ তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে চলে গেল। খালামনি দের সামনে লজ্জায় পড়ে গেল এক প্রকার। সোজা তূরাগের রুমে গেল। সে এখান থেকেই ডাকছে। ফারনাজ রুমে প্রবেশ করে ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কি হয়েছে? এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন? কি ভাবল সবাই?”

“আশ্চর্য! সবাই কি ভাবল কি ভাবল না তোমার সে খেয়াল আছে। অথচ আমি বেচারার কথা মনে নেই? ঘুমের মধ্যে ফেলে রেখে চলে গেলে! জানো এর জন্য আমি কি শাস্তি দিতে পারি?”

বলতে বলতে সে দরজা আঁটে। ফারনাজ ভড়কায়। তূরাগ এগোয়। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর পানে চেয়ে রয় এক দৃষ্টিতে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয় সে। এ কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি! তূরাগ ঘনিষ্ঠ হয়। কোমল কোমর পেঁচিয়ে কাছে টানে। কানের কাছে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আজ একটা কনসার্ট আছে আমার। সেখান থেকে ফিরে আমার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ ভাবে আমার রুমে দেখতে চাই। রুমে প্রবেশ করতেই যেন আমার প্রিয় মেয়েলী ঘ্রাণটা আমি পাই। সে যেন গেস্ট রুম ছেড়ে স্বামীর রুমে চলে আসে। মনে থাকবে?”

সে ভারী শ্বাস ফেলে মাথা দোলায়, খুব মনে থাকবে। তূরাগ ফের বলে,

“তাকাও আমার দিকে?”

ফারনাজ দৃষ্টি ওঠায় না। তূরাগ তার চিবুক স্পর্শ করে মুখ উঁচু করে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই অকস্মাৎ অধরে অধর মিলে যায়। ফারনাজ কেঁপে ওঠে। আঁকড়ে ধরে তার কাঁধের অংশ। মুদে আসে তার চক্ষুদ্বয়। নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে তূরাগ ছাড়ে। ঘন শ্বাস ফ্যালে ফারনাজ। লজ্জায় মিইয়ে যায়। তূরাগ কপালে কপাল ঠেকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে,

“আমার বউ আমার সব। আমি যখন তখন যেখানে খুশি যেভাবে খুশি তাকে ছোঁবো, চুমু খাব। সে যেন মানা না করে।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৯

বেশ ক’দিন যাবত ফারদিনের সঙ্গে কোনো বাক্য বিনিময় করে না পায়েল। অতি সূক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে চলে তাকে। এর একটা কারণ অবশ্য আছে। সে চায়, ফারদিন নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখা অনুভূতি প্রকাশ করুক। তাকে জানিয়ে দিক নিজের মনের কথা। পায়েল যদিও বোঝে, কিন্তু সে শুনতে চায়।

ফারদিন আজ দ্রুত ফিরেছে। সবার সাথে বসে রাতের আহার সমাপ্ত করেছে। অতঃপর রুমে দাঁড়িয়ে বসে থেকেও যখন পায়েলের দ্যাখা পেল না, তখন সে বাইরে এসে নিচে তাকায়। দ্যাখে, টিভির সামনে বসে আছে তারা। বর্ষণ আর বন্যা টিভি দেখছে তাদের সঙ্গ দিচ্ছে সে। ফারদিন ছোট্ট শ্বাস ফ্যালে। রুমে না এসে বাচ্চাদের সাথে কার্টুন দ্যাখার কোনো মানে হয়? সে ডাকে,

“পায়েল! রুমে এসো।”

অন্য সময় হলে পায়েল লজ্জায় মিইয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটে যেত। কিন্তু এখন সে যাবে না।‌ সে না শোনার ভান ধরে পড়ে রইল। ফারদিন এবার গটগটিয়ে নেমে আসে। ছোট ভাইকে দেয় এক ধমক,

“এখনো বসে টিভি দেখছিস! কাল স্কুলে যেতে হবে না? যা, এখনই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

ভাইয়ের বকা খেয়ে বর্ষণ সুড়সুড় করে চলে গেল। কথার অমান্য করলে হয়তো কয়েক ঘা খেতে হতো। ফারদিন এবার বন্যার দিকে তাকায়। সে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে। ছোট্ট করে বলে,

“ভাইয়া, আমি আরেকটু মোটু পাতলু দেখি?”

ফারদিন আদুরে কণ্ঠে বলল,

“রুমে যাও, বোনু। অনেক রাত হয়েছে না? এখন ঘুমানোর সময়। যদি তুমি ঠিক সময়ে না ঘুমাও তাহলে তুমি ঠিক সময়ে উঠতে পারবে না। আর সবাই তোমাকে পঁচা মেয়ে বলবে। যাও ঘুমাও।”

বন্যা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। সত্যিই তো সকাল সকাল ঘুম থেকে না উঠলে তো সবাই পঁচা বলবে। সে তো বইয়ে পড়েছে “আরলি টু স্লিপ অ্যান্ড আরলি টু রাইজ।” সে ভদ্র মেয়ের মতো উঠে চলে গেল। এবার বাকি রইল পায়েল। ফারদিন শীতল কণ্ঠে বলল,

“তোমাকে কি আলাদা ভাবে বলতে হবে রুমে যাবার জন্য? চলো, রুমে চলো।”

পায়েল ধপ করে উঠল ধপ ধপ পা ফেলে চলে গেল। ফারদিন টিভি অফ করে রুমের দিকে পা বাড়ায়। যেতে যেতে ভাবে, পায়েলের সাহসটা বেড়েছে অনেক। এভাবে দিনের দিন তাকে ইগনোর করার কৈফিয়ত আজ নেবে সে। রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা আটল। রুম শূন্য। সে এগিয়ে ব্যালকনিতে যায়। পায়েল দাঁড়িয়ে সেখানে। দৃষ্টি কৃষ্ণ বর্ণ গগনে নিবদ্ধ। ফারদিন আলগোছে তার পেছনে দাঁড়ায়। বলিষ্ঠ হাত দুটো দ্বারা পেঁচিয়ে ধরে কোমর ভেদ করে উদর। অনুভব করে তার কাঁপুনি। মৃদু হাসে সে। নাক ডুবিয়ে দেয় চুলের ভাঁজে। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে,

“সমস্যা কি তোমার? কি চাও?”

পায়েল ফাঁকা ঢোক গেলে। ফারদিন এমন কাছে থাকাকালীন তার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে। তবুও সে গলায় আওয়াজ এনে বলে,

“আপনার মনের কথা জানতে চাই।”

ফারদিন আবার হাসে। রহস্য করে বলে,

“আমার মনের কথা শুনলে কিন্তু শাস্তি পেতে হবে। আমার মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা কথা শোনার অপরাধে শাস্তি।”

পায়েল দমে না, বলে,

“মেনে নেব সকল শাস্তি। তবুও আমি জানতে চাই।”

সে হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে। ফিসফিসিয়ে বলে,

“শুনতে চাও? তবে শোনো, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

পায়েলের শীর দাড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। প্রশান্তিতে চোখ বুজে এলো। সে মৃদু কণ্ঠে বলল,

“কবে থেকে?”

“যখন থেকে তুমি ভালোবাসো।”

“আমি তো বলিনি।”

“তবে আজ বলো।”

পায়েল তার বুকে শরীর এলিয়ে দেয়। বলে,

“বলার প্রয়োজন কি? বুঝে নিলেই তো হয়।”

“আমাকে কেন বলতে হলো তাহলে? তুমি কি বোঝো না?”

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বুকে মুখ গোঁজে। জড়ানো কণ্ঠে বলে,

“ভালোবাসি তো।”

ফারদিন চওড়া হাসে। কপালে দীর্ঘ চুমু এঁকে বলে,

“এবার তাহলে শাস্তি গ্রহণ করো, প্রস্তুত?”

“প্রস্তুত।”

ফারদিন তাকে শূন্যে উঠিয়ে রুমে পা বাড়ায়। তাদের রাতের শুরু হলো মধুর আলিঙ্গনে। পায়েল শিহরণে বারংবার আঁকড়ে ধরে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে। তাদের ভালোবাসা দেখে কি চাঁদ মুখ ঢাকবে? কিন্তু চাঁদই তো নেই, আজ তো অমাবস্যা। তাদের ভালোবাসায় নজর দেওয়ার মতো কেউ নেই। আঁধারে পায়েলের লজ্জা মাখা মুখ ঢাকতে কষ্ট হয় না।

পরবর্তী দিন গুলো বেশ দ্রুত যায়। দৃষ্টি এবং পায়েলের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে ইতোমধ্যেই। তারা আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিত্য দিনের ক্লাসে। ফারদিন পুরোপুরি বাবার ব্যবসায় যোগ দিয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে সে শশুর বাড়ির জামাই আদর খেয়ে আসতে ভোলে না। শশুর বাড়িতে যাবার জন্য তার বউয়েরও দরকার পড়ে না। ইচ্ছে হলেই চলে যায়। কয়েক বেলা ভালো মন্দ খেয়ে তাদের ইচ্ছে মতো জ্বালিয়ে আসে। হাসি ঠাট্টার ছলে সোহেলকে কয়েকটা চ’ড় ঘু’ষি দিয়েও আসে। সোহেল যখন ভ্যাবাচ্যকা খেয়ে রেগে তাকায়। তখন সে হাসতে হাসতে বলে,

“আরে শালা বাবু, মনে নিও না। হাসি মজার মাঝে কত হাত চলে!”

তূরাগ ব্যস্ত তার কনসার্ট নিয়ে। মাঝে মধ্যে বাবার সাথে অফিস থেকে ঘুরে আসে। দুটো কাজই তাকে সামলাতে হবে। কেননা আফরান বাবার ব্যবসার দিকে ফিরেও তাকাবে না। বিজনেস করার ইচ্ছে থাকলে সে কষ্ট করে ডাক্তারি পড়ত না।
বাকি রইল ফারনাজ, পাক্কা গিন্নির মতো সংসার করার চেষ্টা করছে সে। তূরাগ তাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে সে কিছু করতে চায় কিনা? কিন্তু সে মানা করে দিয়েছে। আপাতত সংসার করাই তার মূল উদ্দেশ্য। তূরাগ আপত্তি করে না। বাড়ি ফিরে যখন স্ত্রীকে ছুটে এসে ঠাণ্ডা পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দ্যাখে! যখন সে তার আঁচল টেনে তার কপালের ঘাম মুছে দেয়! তখন তার হৃদয়ে সুখেরা হানা দেয়। আদর মিশিয়ে কপালে অধর ছুঁইয়ে দেয় তার।

দৃষ্টির দিন কাটে কলেজ যাওয়া আসা আর খালামনির হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে দিয়ে। মাঝে মধ্যে তাকে রান্না করতেও হয় কারণ আমিনুল ইততেয়াজ পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেন তিনি বউমার রান্না খেতে চান। কিন্তু সরাসরি কখনো বলেন না। এতে তার ইগোতে লাগে। দৃষ্টি অগোচরে হাসে। তার শশুর মশাই যেন গলেও গলে না। শুধু এই মানুষটা ছাড়া আর সবার চোখের মণি হয়েছে সে।

আজ রাতে কোনো রকম খেয়ে সে রুমে গেল। আফরানের এই রুমটাকে এখন পর মনে হয় না। কখনো মনেই হয় না যে এটা তার রুম নয়। মনে হবেই বা কীভাবে? ওয়ারড্রবে তার জামাকাপড়, ড্রেসিং টেবিলে তার জিনিস পত্র, ওয়াশ রুমে তার শ্যাম্পু, তার ফেইস ওয়াশ, তারই বডি ওয়াশ। ব্যালকনিতে তার ফুলের গাছ, তার দোলনা। আফরানের টুকটাক জিনিস পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক ওদিক। দৃষ্টি মাঝে মধ্যে তা নাড়াচাড়া করে। সে ব্যালকনিতে তার সব চেয়ে পছন্দের দোলনায় গিয়ে বসে, যেটা তার শশুর মশাই তাকে দিয়েছেন। এখানে বসে থাকা তার পছন্দের কাজের মধ্যে একটা। শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দেয় তাকে। মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মন মস্তিষ্কে আফরানের চলাফেরাও হয়তো বন্ধ হয় কিছু মুহূর্তের জন্য। সে নিজেই নিজেকে অনুভব করে। দুলতে দুলতে এক সময় সে দোলনায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রুমে গিয়ে ঘুমানোর কথা দিব্যি ভুলে যায়।

ঘুমের মধ্যে ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে সে। এসির পাওয়ার টা এতো কমে গেল কীভাবে? গায়ে কমফর্টার থাকা সত্ত্বেও শীত লাগছে! দৃষ্টি নড়ে চড়ে উঠে গুটিয়ে যায়। কাছে উষ্ণতা অনুভব হওয়ায় আরেকটু এগিয়ে যায় উষ্ণতার উৎসের নিকট। হঠাৎই টনক নড়ে তার। চমকে ওঠে। সে দোলনায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, স্পষ্ট মনে আছে তার। তাহলে বিছানায় কি করে এলো? আর তাকে কীসে পেঁচিয়ে রেখেছে? আতঙ্কে জমে গেল সে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল মুহুর্তেই। সে ভুতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এখন তার সাথে যে ঘটনা ঘটছে তা কি অপ্রাকৃতিক? নাকি প্রাকৃতিক? ভারী ঘন শ্বাস গলায় আছড়ে পড়ে তার। দম বন্ধ করে সে কাঁপা কণ্ঠে আওড়ায়,

“ককে!”

জবাব আসে না। সে এবার চিৎকার দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেওয়ার পূর্বেই তার কোমল ঠোঁট বলিষ্ঠ হাতের নিচে চাপা পড়ে। কানে আসে ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর,

“চেঁচাবি না খবরদার। আমি কি চেঁচানোর মতো কিছু করেছি? কিছুই তো করতে পারলাম না। ভীষণ ক্লান্ত আমি। চেঁচালে সবাই ভাববে অন্য কিছু। বুঝেছিস কি ভাববে? আমি ভালো, ভোলাভালা ছেলে লজ্জায় পড়ে যাব। চুপ!”

দৃষ্টির শরীর হিম হয়ে আসে। কার কণ্ঠস্বর শুনল সে? এটা কি আদৌ সত্যি নাকি স্বপ্ন। সে হাতের নিচে চাপা থাকা ঠোঁট নাড়িয়ে বলার চেষ্টা করে,

“কে!”

হাতটা সরে যায়। তা গিয়ে পেঁচিয়ে যায় তার উদরের উপর দিয়ে। কানে উষ্ণ নিঃশ্বাসের সাথে আসে শীতল ফিসফিসানো আওয়াজ,

“তোর বাচ্চার বাপ।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪০

“দৃষ! তুই এতো সকালে রান্না ঘরে কেন? নাস্তা বানানোর এখনো তো অনেক সময় আছে।”

এখন দৃষ্টি কীভাবে বলবে যে তার ছেলেকে দেখতে দেখতেই রাত পার হয়েছে তার। চোখের পাতা এক করতে পারেনি সারা রাত। লোকটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। হয়তো তার চাপ দাঁড়ির প্রতিটা চুলও গুনে ফেলেছে। সে হাতের কাজ করতে করতে মৃদু হেসে বলে,

“ঘুম তাড়াতাড়ি ভেঙে গিয়েছে, খালামনি। তাই ভাবলাম শুধু বসে না থেকে নাস্তা বানাই। এই তো হয়ে এসেছে প্রায়।”

মিসেস সাইমা তার হাত থেকে চামচ কেড়ে নিলেন। বললেন,

“বাকিটা আমি করে নেব। তুই আফরানের জন্য কফি করে নিয়ে যা। সকালে উঠেই ওর আগে কফি চায়।”

দৃষ্টির ইচ্ছে হয় না ওই রুমে যেতে। কাল রাতে সে এতো ভয় পেয়েছিল! মেজাজ গরম হয়ে আছে ওই লোকটার উপর। এভাবে কেউ ভয় দ্যাখায়? সে নির্ঘাত মূর্ছা যেত। এখন আবার ওই লোকটার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে যেতে হবে! সে মুখ ফুটে বলতে পারে না যে, সে যেতে চায় না। খালামনির নির্দেশ অনুযায়ী কফি তৈরি করতে উদ্যত হয়। মিহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“উনি কখন এসেছেন, খালামনি?”

“কে? আফরান? ও তো কাল রাতেই ফিরল। তুই জলদি ঘুমাতে গিয়েছিলি বলে তোকে ডাকেনি কেউ।”

দৃষ্টি ভাবে ডাকলেই ভালো হতো। অনন্ত তাকে এমন চমকে যেতে হতো না। আর না তার সাথে এক ঘরে বাহুবন্দী হয়ে দম বন্ধ করে পড়ে থাকতে হতো। দৃষ্টি কফি তৈরি করে রুমের দিকে অগ্রসর হয়। দরজা ঠেলে প্রবেশ করে ঘুমন্ত আফরানকে আবিষ্কার করে। কেমন শান্তির ঘুম দিচ্ছে দ্যাখো! ইচ্ছে তো করেই এই কফি ওনার মাথায় ঢেলে দেই। সে লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজের রাগকে সংবরণ করে। এগিয়ে বিছানার পাশের টেবিলে ঠাস করে কাপ রাখে। আফরানের শান্তির ঘুম তার পছন্দ হয় না একটুও। জগ থেকে পানি ঢেলে দেয় তার মুখে। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। দৃষ্টির সরু চোখের দিকে চেয়ে থম মে’রে বসে থাকে কিছুক্ষণ। চুল ঝেড়ে বলে,

“এভাবে আমাকে ওয়ালকাম করলি! আরো অনেক পদ্ধতি ছিল তো। একটু জড়িয়ে ধরতে পারতি, একটা চু..”

“থামুন।”

সে চোখ রাঙিয়ে হাতে কফি ধরিয়ে দেয়। ফের বলে,

“বেশি কথা বন্ধ করে কফি গিলুন। আজ বানিয়েছি আর পারব না। নিজে বানিয়ে খেতে পারলে খাবেন, নয়তো কি করবেন জানি না।”

আফরান হা করে তাকায়। দুঃখি দুঃখি ভাব করে বলে,

“এতো দিন পর দেশে ফিরে এই ছিল আমার কপালে? তার চেয়ে বরং থেকে যেতাম ওখানে। কত সুন্দরী নার্স রেখে এলাম। আসার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল, কিছুতেই আসতে দেবে না। সে কি আদর যত্ন! আমি তো ওসব ফেলে জোর করে এলাম। তার উপর তুই একটু জড়িয়ে ধরা না, একটু ভালো করে কথা না, আর না একটা চুমু।”

দৃষ্টি তার কথাকে পাত্তা দেয় না। সকাল সকাল শুরু হয়ে গেছে লোকটা অসভ্য কথা বার্তা। মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। যেতে যেতে বলে গেল,

“আমি বলেছিলাম আসতে? যান না, আপনার সেই সুন্দরীদের কাছেই যান। তাদের কোলে উঠে বসে থাকুন। আমি বলার কেউ নই।”

আফরান হতাশ শ্বাস ফ্যালে। এই দিন দ্যাখার জন্য সে ফিরল? বউয়ের ঝাড়ি খাওয়ার জন্য? কোথায় স্বামী কতদিন পর ফিরেছে সেবা টেবা করবে, তা না; ঘুমের মধ্যে পানি ঢেলে দিয়ে চলে গেল। সে কফি শেষ করে ওয়াশ রুমে গেল। আজ আবার হাসপাতালে যেতে হবে।

নাস্তা টেবিলে সাজানো শেষ। এক একজন করে এসে নিজের আসন গ্রহণ করে। আমিনুল ইততেয়াজ, তিয়াস ইততেয়াজ সর্বশেষ তুরাগ ইততেয়াজ। মিসেস সাইমা নাস্তা পরিবেশন শুরু করতে নিলে আমিনুল ইততেয়াজ বাঁধা দেন। বলেন,

“আফরান আসুক, তারপর একসাথে খাওয়া যাবে।”

মিসেস সাইমা দ্বিরুক্তি করেন না। সকলে অপেক্ষা করে। তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আফরান নেমে আসে কিছুক্ষণ পরই। মিসেস সাইমা বললেন,

“আফরান বোস। নাস্তা করে নে। আজ হাসপা..”

ছেলের দিকে চেয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেল তার। তাকে বিস্ময়ে চেয়ে থাকতে দেখে সকলে আফরানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। দৃষ্টি মুখে হাত চেপে দৌড়ে রান্না ঘরে চলে গেল। লুচু ডাক্তার এবার বুঝুক মজা। সকলে হা করে চেয়ে রইল। আফরান হকচকায়। জিজ্ঞেস করে,

“এভাবে তাকিয়ে আছ কেন সবাই? আমার মাথায় কি শিং গজিয়েছে?”

পরক্ষণেই হাসিতে ফেটে পড়ে ফারনাজ। হাসতে হাসতে তুরাগের গায়ে হেলে পড়ে। তূরাগ ঠোঁট চেপে মৃদু হাসে। সকলে মুখ চেপে হাসে। হতভম্ব আফরান বলে,

“কি হয়েছে? এভাবে হাসছিস কেন?”

মিসেস অনা নিজেকে সামলে বললেন,

“পেছনে ঘোর তো, আফরান। দেখি একটু।”

আফরান বোকার মতো পেছনে ফেরে। ফারনাজের এবার হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার জোগাড়। মিসেস সাইমা এবং মিসেস অনাও হেসে ফেললেন। আমিনুল ইততেয়াজ ভ্রু কুঁচকে রেখেছেন। হাসি যে তার আসছে না এমন নয়। কিন্তু এখন হাসা ঠিক হবে না। আফরান অতিষ্ট হয়ে বলে,

“কি হয়েছে আমাকে বলবে? এভাবে হেসে যাচ্ছ তো হেসেই যাচ্ছ! আশ্চর্য, হাসপাতালে যেতে হবে আমাকে।”

“এভাবেই হাসপাতালে যাবি?”

মায়ের কথায় আফরান পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

“কেন কি হয়েছে?”

ফারনাজ হাসি থামিয়ে বলে,

“ভাই, শার্টটা দেখে পরোনি বোধহয়।”

“কেন? শার্টে কি সমস্যা? শার্ট তো শার্টই। সাদা শার্ট।”

মিসেস সাইমা মুখ লুকিয়ে হেসে বললেন,

“যা, বাবা চেঞ্জ করে আয়। যা।”

আফরান মাথা মুন্ডু কিছুই না বুঝে বিরক্ত হয়ে রুমে চলে এলো। গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। তৎক্ষণাৎ তার চোখ কপালে উঠল। ঘুরে ফিরে দেখে কথা হারিয়ে ফেলল। তার সাদা শার্টের সামনে লেখা লুচু ডাক্তার, অ’স’ভ্য ডাক্তার, বদমাশ ডাক্তার। আর পেছনে বড় বড় করে লেখা ‘আমি একজন গরুর ডাক্তার।’ বিস্ময়ে সে হতবাক হয়। বাড়ির সবার সামনে তার মান সম্মান ধুয়ে গেল। ভাগ্য ভালো এই শার্ট পরে সে হাসপাতালে যায়নি। শাওয়ার নিয়ে তাড়াহুড়ো করে কি গায়ে দিয়েছে খেয়লই করেনি। সে বিরস বদনে শার্ট পাল্টে বের হলো। ষড়’যন্ত্র! ঘোর ষড়’যন্ত্র! নিশ্চয়ই তার পাজি বউয়ের কারসাজি এসব। হাতের কাছেই পাচ্ছে না তাকে। একবার শুধু হাতে পাক। তারপর বোঝাপড়া হবে।

আফরান নিচে এসে বসতে না বসতেই হাওয়ার গতিতে কেউ এসে তার পাশে বসে পড়ল। প্রায় আফরানের গায়ে পড়ে বলল,

“গুড মর্নিং আফরান, গুড মর্নিং অল।”

আফরান কোনো প্রতিক্রিয়া দ্যাখায় না। মৃদু কণ্ঠে বলে,

“গুড মর্নিং, রূপসী। মা নাস্তা দাও এবার, দেরি হচ্ছে।”

মিসেস সাইমা এবং অনা সবাইকে নাস্তা দেন। দৃষ্টি এখনো রান্না ঘরে ঘাপটি মে’রে আছে। আফরান খাওয়ার মাঝে বেশ কয়েক বার রান্না ঘর থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। রূপসী খাওয়ার মধ্যে কত বকবক করে তা শোনে না। দৃষ্টি এক সময় রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। স্বামীর পাশে অপরিচিত মেয়ে দেখে তার ভ্রু খানিকটা কুঁচকে গেল। তবে বলল না কিছু। স্বামীর গায়ে পড়ে ভাব জমাতে চাওয়া মেয়েটাকে দেখে গা জ্বলে গেলেও প্রকাশ করে না। মিসেস সাইমা তাকে দেখে বললেন,

“নাস্তা করে নে। কলেজ যাবি না?”

দৃষ্টি আফরানের দিকে চায়। লোকটা কি সুন্দর হি হি করে মেয়েটার সাথে কথা বলছে! কে এই মেয়ে? সে জবাব দেয়,

“এখন আর খাব না। কলেজ গিয়ে খেয়ে নেব কিছু।”

সে গটগটিয়ে হেঁটে রুমে চলে গেল। পিছু ডাকা হলেও শুনল না। ওয়াশ রুম থেকে চেঞ্জ করে বের হলো। রাগে দুঃখে ছোড়াছুড়ি শুরু করল। এক দিকে তোয়ালে ছুঁড়ল, এক দিকে ছুঁড়ল ওড়না। চুলে চিরুনি চালিয়ে বেঁধে নিল। বই খাতা এভাবে ব্যাগের মধ্যে ভরল যেন সে বই খাতা নয় ওই মেয়েটাকে আছাড় দিচ্ছে। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে দেখল আফরান ঢুকেছে। সে শান্ত হয়ে গেল। তাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না কিছু। সে বলতে নিল,

“আপনি নক না করে..”

পরক্ষণেই মনে হলো এটা তো তারই রুম সে ইচ্ছে মতো আসা যাওয়া করতে পারে। পুনরায় বলল,

“আমি কলেজ থেকে ফিরে আপনার রুম খালি করে দেব। আপনার আর সমস্যা হবে না।”

আফরান শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে এগিয়ে আসে। দৃষ্টি ভড়কে এক পা পেছায়। আর পেছাতে পারে না, সে তাকে ধরে ফ্যালে। কাছে টেনে কানের কাছে মুখ রাখে। ফিসফিসিয়ে বল,

“আমি কি হই তোর?”

দৃষ্টি থেমে থেমে শ্বাস ফ্যালে। দম বন্ধ করে বলে,

“জজানি না।”

“জানিস না? বুঝে যাবি খুব শীঘ্রই।”

কানে আলতো অধর ছুঁইয়ে সে সরে আসে। চিরপরিচিত চঞ্চল রূপ ধারণ করে বলে,

“আমি ভালো ছেলেটা তোর জন্য খারাপ হয়ে যাব মনে হচ্ছে। এভাবে আমার সামনে থাকলে আমি উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলব। তখন বলিস নির্লজ্জ। কিন্তু আমার কোনো দোষই নেই। আমি শুধু ওয়ালেট নিতে এসেছিলাম।”

দৃষ্টি তার কথা বোঝার চেষ্টা করে। পরপরই ওড়না নেই খেয়াল করে ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায়। রাগের বশে ওড়না ছুঁড়ে ফেলেছিল। সে দ্রুত তা উঠিয়ে গায়ে জড়ায়। আফরান বখাটের মতো একটু হেসে বের হয়ে গেল। দৃষ্টি সেদিকে চেয়ে কটমটিয়ে বলল,

“অসভ্য, লুচু ডাক্তার!”

চলবে,

সে আমারই পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৫

“তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার

তাকে ছোঁবো ছোঁবো ভাবছি
আর ছুঁয়েই পালাচ্ছি
ফের তাকে ছুঁতে যাচ্ছি আবার..

অভিমান পিছু নাম
তাকে পিছু ফেরাও
তার কানে না যায় পিছু ডাক আমার
মুখ বুজেই তাকে ডাকছি আবার

তাকে অল্প কাছে ডাকছি
আর আগলে আগলে রাখছি
তবু অল্পেই হারাচ্ছি আবার”

রাতে এমন মধুর কন্ঠের গান কানে আসায় ফারনাজ নিজেকে ঘরে রাখতে পারল না। দরজা খুলে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল গানের উৎসের নিকট। গানের সুর ধরে সে বাগানে এসে থামে। এতো রাতে কে গান গায়ছে? তূরাগ নিশ্চয়? সে তার কন্ঠ খুব ভালো ভাবে চেনে। জেনে শুনেও ফারনাজ এগোয়। এতো রাতে বাগানে বসে চর্চা করছে কেন লোকটা? এটা কি কোনো গান গাওয়ার সময় হলো? সে খুব সতর্ক হয়ে পা ফ্যালে। মৃদু আলো আছে এদিকে। সে তাকে দেখতে পেল। ওই তো তার দিকে পিঠ রেখে একটা টুলে বসে গায়ছে। ফারনাজ শব্দ বিহীন দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। মনোযোগ দিয়ে গানের শেষের অংশ শোনে।

“ফাঁকা বুক, চেনা সুখ
জানি ঘুম সে ভাঙাবেই (২)

ভেজা মন, বলি শোন
রাতভোর জাগতে নেই

মুখচোরা ডাক তাকে
ঘুম পাড়াক এবার..
তাকে ছুঁয়ে স্বপ্ন বুনছি আবার”

হঠাৎই গান থেমে যায়। কানে কোনো আওয়াজ না আসায় ফারনাজ ফট করে চোখ মেলে তাকায়। মুখোমুখি তূরাগকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। তূরাগ রাশভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“এতো রাতে এখানে কি?”

সে মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে। কি জবাব দেবে ভেবে পায় না। গান শুনতে এসেছে জানলে তূরাগের ভাব নিশ্চয় অনেক বেড়ে যাবে? সে একথা একদমই স্বীকার করবে না। সে আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বলে,

“আপনি এখানে! কখন এলেন?”

সে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মুখশ্রীতে বিরক্ত ভাব উপচে পড়ে। বলে,

“আমার বাড়ি আমি যেখানে খুশি যখন খুশি থাকতে পারি। তুমি এখানে কেন তাই জিজ্ঞেস করছি আমি।”

“কেন আমি থাকতে পারি না?”

“না, পারো না। এটা তোমার বাড়ি নয়।”

মুখের উপর এভাবে বলে দেওয়ায় কোমল হৃদয়ের ফারনাজ কষ্ট পেল। তবুও দমে না গিয়ে বলল,

“আমার ঘুম আসছিল না, তাই দেখতে চলে এলাম রাত বিরেতে এভাবে চেঁচায় কে?”

তূরাগ কটমটিয়ে চেয়ে বলল,

“কি বললে তুমি! আমি চেঁচায়? গান বলে এটাকে মাথা মোটা।”

সে অবাক হবার ভান করে বলে,

“আপনি না বললে তো জানতামই না যে এটাকে গান বলে!”

তূরাগ পূর্বের জায়গায় গিয়ে বসে। গিটার হাতে নিয়ে বলে,

“তোমার সাথে ঝগড়া করার মুড নেই আমার। বিদেয় হও।”

ফারনাজ মুখ বাঁকিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দু হাত বুকে গুজে বলে,

“আমি তো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কোনো শব্দ করিনি। আপনি বুঝলেন কি করে যে আমি এসেছি? ঐ দিনও আপনি জবাব দেননি। আজ আমি জবাব না নিয়ে কোথাও যাব না। হুহ!”

সে শান্ত দৃষ্টি তাকায়। টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এক পা এক পা করে এগোতে এগোতে বলে,

“তোমার ভয় করে না?”

ফারনাজ চোখ বড় বড় করে তাকায়। দু পা পিছিয়ে বলে,

“কেন ভয় করবে কেন?আআর আপনি এএভাবে এগোচ্ছেন কেন?”

তূরাগ এগোতে থাকে। অতিরিক্ত শীতল কণ্ঠে বলতে থাকে,

“এখন গভীর রাত। আশে পাশে কেউ নেই। একদম শূন্য। বাগানে ঝোপঝাড়ের মধ্যে একজন ছেলে একজন মেয়ে। তুমি আর আমি। আমি ছেলে তুমি মেয়ে। এখন যদি..”

ফারনাজ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

“এএএখন যযদি?”

“এখন যদি আমি তোমাকে কিছু করি? ভয় করছে না?”

ফারনাজ পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যেতে নিলেই হোঁচট খায়। উপুড় হয়ে যাচ্ছিল পড়েই। তৎক্ষণাৎ তূরাগের শক্ত পোক্ত বলিষ্ঠ হাত এসে পেট জড়িয়ে আটকে দিল। ফারনাজের শ্বাস যেন থেমে গেল। প্রথম পুরুষালী গভীর স্পর্শে যেন দম বন্ধ হয়ে এলো। সে তাকে হেঁচকা টানে সোজা করে দাঁড়িয়ে দিতে চায়। ফারনাজ টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার বুকে। এবার হৃদস্পন্দন থেমে গেল তার। চোখের চশমা তো আগেই পড়ে গিয়েছে। চোখেও অন্ধকার দেখছে সে। কিন্তু মাথা রাখা শক্ত জায়গায় হৃদস্পন্দনের তীব্র গতি শুনতে পাচ্ছে সে। অস্বাভাবিক হারে চলছে তা। থমকানো মুহূর্ত পার হয়। তূরাগ দুরত্ব বাড়িয়ে দাঁড়ায়। ঝুঁকে তার চশমা তুলে হাতে দিয়ে বলে,

“যাও, রুমে যাও।”

ফারনাজ অপেক্ষা করে না এক মুহূর্তও। চশমা চোখে দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। রুমে এসে দরজা আটকে লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়। হৃদস্পন্দন এখন অস্বাভাবিক। হুট করেই হেসে ফেলল। আজ এক রহস্য সমাধানের সূত্র পেয়েছে সে। নব্বই শতাংশ সমাধান করা শেষ, শুধু দশ শতাংশ সমাধান হবার অপেক্ষা।

কলেজে আজ প্রায় অনেক দিন পর দৃষ্টি মৃন্ময়ের সাক্ষাৎ পেল। ভীষণ এলোমেলো লাগছে তাকে, উসকোখুসকো চুল। দৃষ্টি তাকে দেখে অপরাধবোধে মাথা নামিয়ে নিল। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে মৃন্ময় তাকে ডাকে,

“দৃষ্টি, কেমন আছ?”

দৃষ্টি থামে। মাথা নিচু রেখেই বলে,

“ভালো আছি, স্যার। আপনি কেমন আছেন? এতো দিন কোথায় ছিলেন আপনি?”

মৃন্ময় মৃদু হেসে বলে,

“আমি যে ছিলাম না সেটা খেয়াল করেছ তুমি! আমি ধন্য হলাম। আজ কি আমার সাথে একটু বসা যায়? এক কাপ কফি? চিন্তা নেই, প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব দেব না। ডক্টর ইততেয়াজকে ভয় পাবার দরকার নেই।”

সে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মৃন্ময়ের সাথে যায়। ক্যান্টিনে মৃন্ময় দু কাপ কফি অর্ডার করে বসে। বলে,

“সেদিন মা অনেক আবোল তাবোল কথা বলেছিল। আমি তার হয়ে স্যরি বলছি।”

দৃষ্টি চমকে উঠে বলে,

“না স্যার, তার কোনো দরকার নেই। ওনারা যে অপমানিত হয়েছেন, ওইটুকু কথা কিছুই না।”

মৃন্ময় একটু নীরব থেকে হুট করে জিজ্ঞেস করে,

“তুমি কি সত্যিই ভালো আছ, দৃষ্টি?”

দৃষ্টি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়। বলে,

“হ্যাঁ স্যার, আমি ভালো থাকব না কেন?”

সে শান্ত চোখে চেয়ে বলে,

“আমি শুনেছি, ডক্টর ইততেয়াজ তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছে। তুমি রাজি ছিলে না। তাহলে মতের বিরুদ্ধে করা বিয়েতে কি তুমি ভালো আছ?”

দৃষ্টি হঠাৎ হেসে ফ্যালে। মুচকি হেসে বলে,

“আমি আমার বাবার জন্য বিয়েতে রাজি হচ্ছিলাম না, স্যার। আমি চাইছিলাম বাবার অনুমতি নিয়েই বিয়েটা হোক। কিন্তু উনি শুনলেন না।”

“তার মানে তুমি!”

“জি, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। শুধু বাবার বিষয়টা ছাড়া।”

বলতে বলতে সে সদ্য রেখে যাওয়া কফিতে চুমুক দেয়। মৃন্ময় চেয়ে রয়। দৃষ্টি ফিসফিসিয়ে বলে,

“আমি যে তাকে ভালোবাসি, স্যার। কিন্তু তার সামনে আমি কখনো সেটা প্রকাশ করব না।”

মৃন্ময়ের কান পর্যন্ত তা যায় না। দৃষ্টি কফি শেষ করে বলে,

“আজ তাহলে উঠি, স্যার? আর হ্যাঁ! খুব শীঘ্রই আপনার বিয়ের দাওয়াত চাই কিন্তু।”

সে হাসে। বলে,

“অবশ্যই। সবার আগে তোমার কাছে দাওয়াত পৌঁছে যাবে।”

আজ বাড়ি ফিরতেই ছেলের বউয়ের সামনে পড়লেন আমিনুল ইততেয়াজ। ইতস্তত করে তাকে এড়িয়ে চলে যেতে চায়লে সে বলল,

“ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন।”

তিনি থেমে গিয়ে বললেন,

“তুমি কেন? সাইমা কোথায়?”

“খালামনি একটু অসুস্থ। ঘুমিয়ে পড়েছেন। ডাকবেন না যেন।”

আমিনুল ইততেয়াজ, তিয়াস ইততেয়াজ চলে গেলেন রুমে। ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলেন। দৃষ্টি তাদের সামনে দু গ্লাস লেবুর শরবত এগিয়ে দিল। ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বলল,

“খেয়ে নিন। ক্লান্তি গায়েব হয়ে যাবে।”

তারা তা নিয়ে ঢকঢক করে শেষ করে গ্লাস ফেরত দিল। সত্যিই এখন ভালো অনুভব হচ্ছে। দৃষ্টি গ্লাস নিয়ে যেতে যেতে বলল,

“একটু অপেক্ষা করুন, আমি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছি।”

সে অভিজ্ঞ হাতে টেবিল সাজায়। নিজের হাতে পরিবেশন করে তাদের। তিয়াস ইততেয়াজ রুটি মাংসের ঝোলে চুবিয়ে খেয়ে বললেন,

“আহা! সেই একই স্বাদ। তুমি রান্না করেছ নিশ্চয়?”

দৃষ্টি মৃদু হেসে সম্মতি দেয়। আমিনুল ইততেয়াজ গম্ভীর মুখে খেতে থাকেন। তারও যে ভালো লেগেছে তা প্রকাশ করলেন না। তিনি চান না এই মেয়ে হাওয়ায় উড়ুক। খাওয়া শেষে দুজনকে পায়েস দিল। আমিনুল ইততেয়াজকে বললেন,

“এটা থ্যাঙ্ক ইউ ট্রিট।”

তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“কীসের জন্য?”

“ওই যে আমার জন্য দোলনা এনে দিয়েছেন, সেজন্য। থ্যাঙ্ক ইউ।”

আমিনুল ইততেয়াজের পায়েসটাও দারুণ লাগল। কিন্তু তিনি স্বীকার করতে নারাজ। মনে মনে বললেন, ‘ঢং!’

তিয়াস ইততেয়াজ তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। এমন মজাদার খাবার তিনি জীবনেও খাননি। আমিনুল ইততেয়াজ চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে গেলেন। যাবার সময় তিয়াস ইততেয়াজ বললেন,

“ভাই, এতো ভালো খাবার আর তুমি কিছু বললে না কেন?”

তিনি ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন,

“অতো বলার দরকার নেই। শেষে দ্যাখা যাবে আমার মাথায় উঠে নাচবে।”

কথাটা তিয়াস ইততেয়াজের খারাপ লাগল। মেয়েটা তো খারাপ নয়। দেখতে কালোও নয়, উজ্জ্বল শ্যামলা। ভীষণ মিষ্টি মেয়ে। আর সর্ব গুণে পূর্ণ। এতো সুন্দর ব্যবহার, শান্ত শিষ্ট! তার ভাই মেয়েটার সাথে এমন করে শুধু বিজনেস পার্টনারের মেয়েটার জন্য। তবে মানতেই হবে আফরান খাঁটি রত্ন চিনেছে।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৬

নিশুতি রাত। ঘোর নীরবতা চারিদিকে। গভীর ঘুমে মগ্ন ফারনাজ। ক্ষণে ক্ষণে ফেলছে ভারী শ্বাস। ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে প্রবেশ করল একটি পুরুষালি অবয়ব। বিছানায় ঘুমন্ত রমনীর দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে বিড়বিড় করে,

“দরজাটা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, বোকা মেয়ে!”

মৃদু হেসে সে দরজা চাপিয়ে এগোয়। আলতো করে পা ফেলে এগিয়ে সে তার শিয়রের নিকট বসে। মুগ্ধ চোখে চেয়েই রয়। সে দৃষ্টির কোনো পরিবর্তন হয় না। আনমনে বলে,

“এতো পাগল আমাকে কীভাবে বানিয়ে দিলে, মেয়ে? এর শাস্তি খুব শীঘ্রই পাবে তুমি। কঠিন শাস্তি পাবে।”

হাত বাড়িয়ে তার নাক ছুঁয়ে দেয়। নড়েচড়ে ওঠে সে। নাক কুঁচকে পাশে থাকা তুলতুলে বালিশ জড়িয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে যায়। প্রশস্ত হাসে অবয়বটি। এলোমেলো চুলে আঙুল চালিয়ে আওড়ায়,

“খুব শীঘ্রই আমার খাঁচায় বন্দী হবে তুমি।”

পরপরই দ্রুত পা ফেলে প্রস্থান করে। বেশিক্ষণ থাকলে হয়তো উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলতে পারে।

কোলাহল পূর্ণ শহর। ফারনাজ আজ বেরিয়েছে। প্রায় একটা মাস হতে চলল সে খালামনির বাড়িতে আছে। বোর হয়ে গিয়েছে সে বাড়ির মধ্যে বসে থাকতে থাকতে। তাছাড়া তার বের হবার আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। সেটা খুবই গোপন। এই কারণটা সে খালামনিকে বলেনি, শুধু বাইরে ঘুরতে আসার নাম করে বেরিয়েছে। যদিও তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। সে বহু কষ্টে তাকে রাজি করিয়ে এসেছে। রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রবেশ করে সে শ্বাস ছাড়ে। এক কোণে সামান্য পরিচিত ব্যক্তি কে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে যায়। মৃদু হেসে বলে,

“হ্যালো রিমান? আমি ফারনাজ।”

রিমান ফারনাজের দিকে চেয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। ফোনের ছবির থেকেও দেখতে অত্যাধিক সুন্দর লাগছে তাকে। যেন জলজ্যান্ত পুতুল! ফারনাজ তাকে চেয়ে থাকতে দেখে আবার বলে,

“আমি কি বসতে পারি?”

রিমান ভাবনাচ্যুত হয়। চওড়া হেসে বলে,

“ইয়াহ, শিয়র। প্লিজ সিট।”

ফারনাজ চেয়ার টেনে বসে। এই ছেলেটার সাথে তার ফেসবুকে পরিচয় হয়েছে। ছেলেটার আগ্রহ দেখে ফারনাজ এগিয়েছে। তাই আজ দ্যাখা করতে এসেছে। যদিও ফারনাজ একদমই সিরিয়াস নয়। এখন দ্যাখা যাক বিষয়টা কতদূর এগোয়। দু কাপ কফি অর্ডার করে তারা টুক টাক কথা বার্তা শুরু করে। কথা বলতে বলতে এক সময় রিমান বলে,

“উইল ইউ ম্যারি মি, ফারনাজ?”

ফারনাজ হা করে তাকায়। আজই প্রথম দ্যাখা আর আজই সরাসরি বিয়ের প্রপোজ! বিস্ময় গিলে জিজ্ঞেস করে,

“কি!”

“তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? আমার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। তোমার কথা বার্তা চাল চলন সব কিছু।”

নিজের স্থানে দৃঢ় রিমান। ফারনাজ বিপদে পড়ল। সে তো শুধু টাইম পাসের জন্য এসেছিল। এরই মধ্যে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে যাবে কে জানত? সে জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,

“না মানে হঠাৎ..”

তার কথা তার মুখেই থেকে গেল বের হলো না আর। তৎক্ষণাৎ একটা শক্ত বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে তুলে সজোরে থা’প্পড় দিল। থা’প্পড়ের ভারে সে কিঞ্চিত হেলে পড়ল। গালে হাত ঠেকিয়ে সামনে তাকাতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তার সামনে দাঁড়িয়ে তূরাগ ফোঁস ফোঁস করছে। তার রাগান্বিত র’ক্তিম মুখশ্রী দেখে ফারনাজ গুটিয়ে গেল। এই লোক এখানে কেন? তাকে মারলই বা কেন? আর এতো রেগে আছে কেন? মাথা ভনভন করে ঘুরছে তার। গালটা প্রচুর জ্বলছে। মনে হচ্ছে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে ওখানে। রিমান চমকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“কে আপনি? ও’কে মা’রলেন কেন?”

তূরাগ চোয়াল শক্ত করে তাকায়। রাগে তার মাথা দপদপ করছে। আশে পাশের মানুষ তাকে দেখে এগোতে যেয়েও পারে না। রেগে থাকতে দেখে আর সাহস হয় না। সে তাকে কোনো জবাব না দিয়ে পুনরায় গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছলছল চোখের মেয়েটার দিকে তাকায়। রিমান আবার জিজ্ঞেস করে,

“ফারনাজ, কে উনি? তোমার ভাই?”

ফারনাজ মাথা উপর নিচ দোলায়। হ্যাঁ, তার ভাই। আফরান ভাইয়ের ভাই মানে তারও ভাই। তাই না? যদিও এখনো কোনোদিন ভাই ডাকার সুযোগ পায়নি তেমন, একবার ছাড়া। এই মাথা দোলানো যে তার কাল হয়ে দাঁড়াবে এটা সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। তূরাগ আরও ভয়ঙ্কর ভাবে তাকায়। বলে,

“আমি তোর ভাই? আমি তোর ভাই হই?”

ফারনাজের চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার উপক্রম। তার এবার কলিজার পানি শুকিয়ে গেল। সে কি ভুল বলে ফেলেছে? তূরাগ ভাই নয়তো কি? সে কাঁপতে কাঁপতে বলে,

“আআপনি ভাই না? ততাহলে কি?”

তূরাগ ক্ষিপ্র গতিতে তার হাত চেপে ধরে বলে,

“চল বোঝাই আমি তোর কি হই, কে হই? চল।”

সে তাকে টেনে হিচড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়। পেছনে রিমান চেঁচামেচি করেও বিশেষ কিছু করতে পারে না, দেখে যাওয়া ছাড়া। তূরাগ তাকে গাড়ির মধ্যে ছুঁড়ে ফ্যালে। ড্রাইভিং সিটে বসে শা করে গাড়ি টানে। ফারনাজ গুটিসুটি মে’রে বসে গুনগুন করে কাঁদছে। এতো জোরে চ’ড় সে কোনোদিন খায়নি। তূরাগ ফোন লাগায় কোথাও। তাকে গুনগুনিয়ে কাঁদতে দেখে দেয় এক ধমক,

“চুপ, একদম চুপপ।”

ফারনাজ ভয়ে গুটিয়ে মুখে হাত চেপে ফোঁপায়। তূরাগ ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কথা সেরে নিল। গাড়ি বাড়ির সামনে থামিয়ে তাকে পুনরায় টানতে টানতে নিয়ে গেল। কলিং বেল বাজাতেই কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। সে তাকে টেনে ড্রয়িং রুমের সোফায় ছুড়ে মা’রে। কাজের মেয়েটা ভড়কে গিয়ে সবাইকে ডেকে জড়ো করে। সবাই বলতে মিসেস সাইমা, মিসেস অনা এবং দৃষ্টি। দৃষ্টি বোনকে এভাবে মুখ চেপে কাঁদতে দেখে ছুটে যায়। জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে, আপু? কাঁদছিস কেন?”

সে কান্নার তোপে কথা বলতে পারে না। দৃষ্টি বোনের ফর্সা গালে চার আঙুলের ছাপ দেখে থমকায়। তার বোনের গায়ে কে হাত তুলল? তূরাগ এক কোণে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়। মা’কে বলে,

“এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও, মা।”

মিসেস অনা দ্রুত গিয়ে নিয়ে আসেন। ছেলের লাল হওয়া মুখ দেখে বুঝে নিলেন ছেলে কোনো কারণে রেগেছে। তূরাগ এক নিঃশ্বাসে পানি শেষ করে মায়ের হাতে গ্লাস দেয়। পুনরায় শ্বাস টেনে নিয়ে বলে,

“মা, আমি ফারনাজ কে বিয়ে করতে চাই। এক্ষুনি এবং এই মুহূর্তে।”

প্রচণ্ড ধাক্কা খেল সকলে। ফারনাজের কান্না থেমে গেল। সে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মিসেস অনা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,

“কি বললি?”

“হ্যাঁ, আমি ও’কে বিয়ে করব আজই। আর কিছুই জানি না আমি। কাজী আসছে। ওর পরিবার কে জানালে জানাও। প্রস্তাব দাও, রাজি না হলেও আমার কিছু করার নেই।”

মিসেস অনা শান্ত কন্ঠে বললেন,

“তুই কি নাজ কে পছন্দ করিস? আমরা নাহয় আস্তে ধীরে এগোয়। এতো তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।”

“আমি ও’কে পছন্দ নয় ভালোবাসি, মা। আমার ও’কে চাই, সারাজীবনের জন্য। আজই আমি ও’কে সম্পূর্ণ হালাল রূপে চাই।”

আর নির্লিপ্ত গম্ভীর কন্ঠস্বরে সকলে চিন্তায় পড়লেন। ফারনাজ জমে গেল। যে লোকটা তাকে একটু আগেও মা’রল সেই লোক তাকে ভালোবাসে? এটা কি বিশ্বাস করা সম্ভব? ফারনাজ হু হু করে কাঁদে,

“আমি বিয়ে করব না। এই লোক আমাকে বকে, আমাকে দেখতে পারে না। খারাপ ব্যবহার করে। আজ তো মে’রেওছে। বিয়ে করে নিলে তো রোজ রোজ মা’রবে।”

তূরাগ কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। চাপা ধমক দিয়ে বলে,

“তোমার কাছে শুনতে চায়নি কেউ। চুপচাপ বসে থাকো।”

মিসেস অনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,

“তুই মেয়েটাকে মে’রেছিস কেন, বাবা?”

তূরাগ এক পলক ফারনাজের মুখ দেখে নিয়ে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

“অন্য ছেলের সাথে রেস্টুরেন্টে বসে কফি খাবে, হাসবে, গল্প করবে। আবার সেই ছেলে ও’কে বিয়ের প্রস্তাব দেবে! আমার ভীষণ রাগ উঠে গিয়েছিল, মা এবং আমি এখনো রেগে আছি। তোমরা যদি আমার কথা না শোনো তাহলে আমি কি করে ফেলব জানি না।”

মিসেস অনা ভীষণ চিন্তায় পড়লেন। ছেলের যা চায় তা না দিলে ছেলে ভীষণ ক্ষেপে যাবে। হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধাবে। তিনি ইশারায় মিসেস সাইমা কে ডেকে একটু দূরে নিয়ে গেলেন,

“আপা, এখন কি করব তুমি বলো? তুমি তো ও’কে চেনো খুব ভালো করে।”

“তুই চিন্তা করিস না। আমি সীমাকে সব জানাই আগে। তারপর দেখি কি হয়।”

তিনি ফারনাজের দিকে তাকালেন। সে দৃষ্টির বুকে মুখ গুজে এক নাগাড়ে বলেই যাচ্ছে,

“আমার থেকে পাঁচ বছরের বড় একটা লোককে আমি বিয়ে করতে পারব না। এতো অনেক ডিফরেন্স। না না কিছুতেই না। আমার বর হবে আমার থেকে এক বছরের বড়ো।”

দৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তার মুখ খোলার আগে মিসেস সাইমা এগিয়ে এসে বলেন,

“তূরাগ তোর থেকে পাঁচ বছরের বড়ো বলে তোর এতো আপত্তি! আর আফরান যে দৃষের থেকে নয় বছরের বড়ো তার বেলা?”

বলতে বলতে তিনি ঠোঁট চেপে হেসে ফেললেন। ফারনাজ চোখ তুলে দৃষ্টিকে দ্যাখে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“তোর যখন এতো ডিফরেন্সে আপত্তি তাহলে আমাকে আটকালি না কেন? একটা বারও আমার বিয়ে নিয়ে আপত্তি করলি না! আমার সাথে তো নাচতে নাচতে চলে এলি।”

ফারনাজ ঠোঁট উল্টে বলে,

“আফরান ভাই তো পরিচিত, তোকে খুব ভালো রাখবে। তাছাড়া বিয়েটা তো হয়েই গিয়েছিল, আমি আটকে কি করতাম? আর তুই এই লোককে চিনিস না! রা’ক্ষস একটা।”

তূরাগ চোখ পাকিয়ে তাকাতেই সে দৃষ্টিকে জাপ্টে ধরে বলে,

“দ্যাখ দ্যাখ! কীভাবে তাকিয়ে আছে দ্যাখ? যেন এক্ষুনি আমাকে না চিবিয়ে আস্ত গিলে খাবে! আর ঢেকুরও তুলবে না।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৭

ফাহাদ আবরার থমথমে মুখে বসে আছেন। ক’দিনের মধ্যেই তার জীবনে কত কিছু ঘটে গেল! তার ছেলে বউ নিয়ে এলো, তার ছোট মেয়ে শশুর বাড়িতে চলে গেল। আবার বড়টাও নাকি যাবে! তাও আবার দুইবোন একই বাড়িতে! তিনি মাথা দুলিয়ে নাকোচ করে বললেন,

“নাহ, এ হয় না।”

মিসেস সাইমা শান্ত কন্ঠে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন,

“শুনুন ভাই, তূরাগ সত্যিই নাজকে পছন্দ করে। নাজ আমাদের কাছে ভালো তো থাকবেই তাছাড়া দুই বোন একসাথে থাকবে। আপনারা যখন খুশি তখন আসতে পারবেন মেয়েদের দেখতে। দুজনের শশুর বাড়ি একই হবে, তাই আলাদা জায়গায় বার বার যাওয়ার দরকার নেই। আর আমরা একটুও যৌতুক নেব না।”

এমন গুরুত্বর পরিবেশের মধ্যেও মিসেস সীমা হেসে ফেললেন। আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে। বাড়ির বড় ছেলে তার ছোট মেয়েকে হুট করে বিয়ে করে ফেলল, এখন নাকি ছোট ছেলেটা তার বড় মেয়েকে পছন্দ করে! তিনি তো হাতে একের পর এক চাঁদ পাচ্ছেন। দুটো মেয়েই তার বোনের কাছে থাকলে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারবেন। রাতে শান্তির ঘুম হবে। সকল দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হবেন। প্রথম প্রথম খবর পাওয়ায় একটু চমকে ছিলেন ঠিকই তবে এখন তিনি খুশি। তূরাগ ছেলেটাও তো আফরানের মতোই এক্কেবারে খাঁটি সোনা।
মিসেস সাইমা একটু থেমে আবার বললেন,

“তূরাগ কিন্তু আফরানের মতো একদমই নয়। ও ভীষণ দায়িত্ববান। আফরানের মতো চঞ্চল নয়। ও চায়লে আফরানের মতোই হুট করে নাজকে বিয়ে করে ফেলতে পারত। কিন্তু আপনাদের সবার মতামতের জন্য অপেক্ষা করছে সে। আপনাদের দোয়া নিয়েই বিয়ে সারবে। তাছাড়া ও তো গান বাজনা করছেই, তার উপর অফিসেও বসবে কদিন বাদেই। এখন আপনি ভেবে দেখুন মেয়ের জন্য এমন ছেলে আর পাবেন কিনা?”

ফাহাদ আবরার যেন অথৈ জলে পড়লেন। তাদের বাড়ির কাউকেই তো আমিনুল ইততেয়াজ পছন্দ করেন না। এই বাড়িতে মেয়েকে দেবেন? একটা নাহয় ভুল করেই এসে পড়েছে। এবার তিয়াস ইততেয়াজ মুখ খুললেন,

“ভাই, আপনার দুটো মেয়েকেই আমার খুবই ভালো লাগে। লক্ষ্মী মেয়ে দুটো! কি শান্ত! যদিও ফারনাজ একটু চঞ্চল। কি সুন্দর ব্যবহার! মানতেই হবে আপনাদের শিক্ষাকে। ফিরিয়ে দেবেন না আমাদের। অনেক আশা নিয়ে আপনাদের সবাইকে ডেকেছি। ফারনাজ আমার ছেলের বউ হলে আমরা সবাই খুশি হব। কি বলো ভাই?”

আমিনুল ইততেয়াজ নড়ে চড়ে বসলেন। তিনি সব শুনছেন মুখ বুজে। তিনি পছন্দ না করলেও ভাইয়ের যখন অমত নেই, তখন তার মানা করা সাজে না। তিনি বললেন,

“হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো হবে।”

ফাহাদ আবরার সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে ভাবলেন মেয়ের থেকে একটু শুনে নেওয়া উচিত। তিনি বললেন,

“নাজের কি মত আছে? ও কি রাজি?”

মিসেস সীমা বললেন,

“নাজের আবার কি মতামত? এতো ভালো ছেলে, ও রাজি হবে না কেন?”

“তবুও একবার শোনা দরকার। আমি জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত তাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাই না।”

মিসেস সীমা রুমে গিয়ে ফারনাজের মতামত জানতে চায়লে সে লাজুক মুখে বলে,

“তোমরা যা বলবে তাই। যা ভালো বুঝবে করো।”

“ভেবে বলছিস তো? তোর বাবা তোর মতামত ছাড়া এগোবেন না।”

ফারনাজ মাথা দুলিয়ে সম্মতি দেয়। দৃষ্টি বোনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,

“তুই না একটু আগেই বিয়ে করব না করব না বলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিলি? এখন হাওয়া বদলে গেল!”

ফারনাজ মৃদু হেসে বলে,

“তুই বুঝবি না। সে অনেক কাহিনী।”

সে মুখ ভেংচি কাটে,

“হুহ, আমি বুঝব না।”

ঘরোয়া ভাবে তৎক্ষণাৎ বিয়ের আয়োজন হলো। তূরাগ বলেছে বিয়ে করবে আজই তো বিয়ে আজই হতে হবে। ফাহাদ আবরার মৃদু আপত্তি নিয়ে বললেন,

“একটু তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে না? আর কদিন পর নাহয়..”

মিসেস অনা খুশির ঠ্যালায় এতক্ষণ কথা বলতে পারেননি। ফারনাজকে তার আগে থেকেই খুব পছন্দ ছিল। সে ছেলের বউ হলে তো কথাই নেই। তার পারমানেন্ট একটা গল্প করার সঙ্গী হবে। একজন সঙ্গী হিসেবে ফারনাজের তুলনা হয় না। তিনি গদগদ হয়ে বললেন,

“সমস্যা নেই, ভাই। আজ বিয়েটা হয়ে যাক। পরে আফরান ফিরলে দুই ভাইয়ের অনুষ্ঠান একসাথে করা যাবে। অনেক বড় করে অনুষ্ঠান করব। এখন আপাতত হয়ে যাক।”

ফাহাদ আবরার আবার মুখে কুলুপ আঁটলেন। তার আর কিছু বলার রইল না। এবার তার চোখের সামনে তার বড় মেয়ে অন্যের ঘরের বউ হয়ে গেল। আগে ছিল তার মেয়ে আর এখন হলো অন্যের বউ। বুক ভার হলো তার। তার ঘরের আলো যে দুইটা মেয়ে। দুজনই এতো দ্রুত পর হয়ে যাবে, তা ভাবেননি কখনো।
তিনি মুখ গম্ভীর করে বসে আছেন। তাকে সবাই উনিশ বিশ বুঝিয়ে বড়ো মেয়েটাকেও হাতিয়ে নিল!

আফরানকে ছাড়া বিয়ে করতে চায়নি তূরাগ। কিন্তু করতে হলো। এই বোকা মেয়েকে একদমই বিশ্বাস নেই। কখন কি করে বসে! তবে আফরান সশরীরে উপস্থিত হতে না পারলেও ভিডিও কলে উপস্থিত ছিল। তা দৃষ্টির ছিল অজানা। সে নিজের অজান্তেই হাসি হাসি মুখে ফোনের সামনে দিয়ে এসেছে এবং গিয়েছে। অজান্তেই আফরানের বুকে শান্তি ভরেছে। তার ছটফটানি বাড়িয়েছে। তার ধৈর্যশক্তি কমিয়ে দিয়েছে। বিয়ে সমাপ্ত হতেই তূরাগ লোকজনের মাঝ থেকে একটু সরে দাঁড়িয়ে ফোন কানে ধরে। পরপরই শুনতে পায়,

“বিয়েটা তাহলে করেই ফেললি! আমার জন্য একটু অপেক্ষা করা যেত না? আমি তো তোর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম আর তোকে সাক্ষীও বানিয়েছি।”

“তোর মতো অতো ধৈর্য আমার নেই। আমি অপেক্ষা করতে পারলাম না।”

“তা হবে কেন? আমার সুন্দরী শ্যালিকাকে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখে তো তোর মাথা আউট হয়ে গিয়েছিল, তাই বল।”

“হ্যাঁ তাই। তোর সুন্দরী মাথা মোটা শ্যালিকা আমার মাথা সত্যিই খারাপ করে ছেড়েছে। কত্তবড় সাহস ওর ভাব? ও রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল এক ছেলের সাথে দ্যাখা করতে আর সেই ছেলে তাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। মাথাটা যে এতো গরম হয়েছিল আমার! দিয়েছি ঠাস করে একটা।”

“কাকে? ওই ছেলেকে?”

“না, তোর মাথা মোটা শ্যালিকাকে।”

“কাজটা ঠিক করলি না। নাজ নরম মনের মানুষ। তোর ব্যবহারে নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছে। এমনিতেই তোর ব্যবহার খারাপ। ও’কে স্যরি বলে দিস, নাহলে বাসরের কথা ভুলে যা।”

“পারব না স্যরি বলতে। বাসর করার জন্য আমি ম’রে যাচ্ছি না।”

“আচ্ছা? ঠিক আছে। তবুও একটা পরামর্শ দিচ্ছি। আমি তোর বড় ভাই সেই হিসেবে তুই চাচ্চু হবি আগে। আমি দেশে না থাকার সুযোগে আমাকেই আগে চাচ্চু বানিয়ে দিস না। বুঝলি?”

আফরান আরো কিছু বলল। তূরাগের কান জ্ব’লে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল,

“ভাই! আমি তোর ভাই লাগি। একটু তো লজ্জা শরম রাখ। সব কি বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিস?”

“আরে! ডাক্তার হিসেবে আমার দায়িত্ব এসব পরামর্শ দেওয়া।”

“তোর দায়িত্ব তোর কাছেই রাখ। আর ফোন রাখ!”

ঝাড়ি দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল সে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে এগিয়ে আসা দৃষ্টির দিকে তাকাল। দৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে ভাইয়া?”

“তোমার জন্য আমার ভীষণ খারাপ লাগে, দৃষ্টি। তুমি এমন একটা ভালো মেয়ে, আমার ভাইয়ের হাতেই পড়লে! আমার ভাইটার কথা আর কি বলব? না জানি তুমি কীভাবে তাকে সামলাবে। তোমাদের বিয়েতে আমি সাক্ষী ছিলাম ভাবতেই আমার খারাপ লাগে।”

দৃষ্টি মৃদু হেসে বলল,

“বাদ দিন ওসব কথা। খেয়ে নেবেন চলুন।”

তূরাগ আমতা আমতা করে বলল,

“ইয়ে মানে, ফারনাজ কোথায়?”

“আপু গেস্ট রুমে দরজা আটকে বসে আছে। এখন সে কারো সাথে কথা বলবে না বলেছে। আপনি চিন্তা করবেন না। আপুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। সে এখানেই থাকবে।”

তূরাগ ছোট্ট শ্বাস ফ্যালে। তার ভয় ছিল বিয়ের পর যদি তারা ফারনাজকে নিয়ে যায়? বা ফারনাজ যদি যেতে চায়? তাহলে তো তূরাগ চেয়েও নির্লজ্জের মতো বউয়ের পিছু পিছু শশুর বাড়িতে উঠতে পারবে না। সে আফরানের মতো এতোটাও নির্লজ্জ নয়। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না দেখে ভালো লাগল তার। যতই রাগ করুক আর অভিমান করুক সে তাকে কোথাও যেতে দেবে না। বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে দেবে একদম।

চলবে,

সে আমারই পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩২

আমিনুল ইততেয়াজ বাড়ি ফিরে বিস্তারিত সব শুনে হম্বিতম্বি করলেন খুব। তার ছেলে হয়ে আফরান কীভাবে এই কাজ করতে পারল তা ভেবে ভেবে মাথার তার গুলো ছিঁড়ে যেতে শুরু করেছে। তার ছেলে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিল! তাও আবার মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েকে! ভেবে ভেবে তার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। তিনি তো মনে মনে কোটি পতি বিজনেস পার্টনারের মেয়েকে ছেলের জন্য ঠিক করেছিলেন। মেয়েটিও আফরানের প্রতি আগ্রহী, তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই মেয়েটির সাথে ছেলেকে বিয়ে দিতে পারলে ভালো তো হতোই তার উপর বিজনেসেও তিনি সমর্থন পেতেন। কিন্তু তার ভাবনায় জল ঢেলে ছেলে বিয়ে করে ফেলল! কি দেখেছে এই মেয়ের মধ্যে কে জানে? এই মেয়ের তো কোনো রূপও নেই, কালো মেয়ে! তার হীরার টুকরো ছেলে এই কাজ কীভাবে করতে পারল?
থম মেরে সোফায় বসে তিনি আকাশ পাতাল কত কিছু ভেবে আবার চেঁচিয়ে উঠলেন,

“এই বিয়ে আমি মানি না। এই মেয়ের কি যোগ্যতা আছে ইততেয়াজ পরিবারের বউ হবার? আমি মানি না।”

মিসেস সাইমা ঘাবড়ে আছেন ভীষণ। আমিনুল ইততেয়াজ যেসব শুরু করেছেন! এই কথা গুলো দৃষ্টির কানে গেলে মেয়েটা কষ্ট পাবে খুব। ও তো যেচে পড়ে আসেনি। আসতে বাধ্য হয়েছে শুধু আফরানের জন্য। তিনি অনুরোধের সুরে বললেন,

“আপনি দয়া করে শান্ত হোন। মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আপনার এসব কথা শুনতে পেলে ও কষ্ট পাবে খুব। তাছাড়া আপনি শুধু শুধু মেয়েটাকে তখন থেকে কেন যা তা বলে যাচ্ছেন? ও কি আপনার ছেলেকে জোর করে বিয়ে করেছে? বরং আপনার ছেলে ও’কে জোর করেছে।”

আমিনুল ইততেয়াজ ফুঁসে উঠলেন,

“একটা কালো মেয়েকে আমার ছেলে কীভাবে পছন্দ করল? ওই মেয়ে নিশ্চয় তাবিজ করেছে আমার ছেলেকে। নাহলে আমার ছেলে এমন কাজ কখনোই করতে পারে না।”

দৃষ্টি কথাটুকু শুনে সাবধানে সরে রুমে চলে গেল। আর নিতে পারছে না সে, মাথাটা ভার হয়ে আছে। কোনো কিছু না করেও তাকে এতো কথা কেন শুনতে হচ্ছে? সে তো আফরান কে বলেনি যে, ‘আমাকে বিয়ে করুন। আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচব না।’ উল্টো আফরান তাকে মে’রে ধরে বাধ্য করেছে। এখন কি করবে সে? চলে যাবে? কোন মুখে সে বাড়ি ফিরবে? এতোক্ষণে নিশ্চয়ই আশে পাশে সবাই জেনে ফেলেছে। সে শশুর বাড়ি আসার পর দিনই ফিরে গেলে তারা কি বলবে? তার বাবার সম্মান থাকবে? দৃষ্টি আর কিছু ভাবতে পারল না। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। মাথাটা যেন ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে।

মিসেস সাইমা সূক্ষ্ম শ্বাস ফেললেন। এই লোককে বোঝাতে ব্যর্থ তিনি। শান্ত কন্ঠে বললেন,

“ছেলেকে ফোন দিন। তার কাছ থেকে কৈফিয়ত নিন। মেয়েটাকে আর কোনো বাজে কথা বলবেন না।”

আমিনুল ইততেয়াজ স্ত্রীর দিকে অসন্তুষ্টির দৃষ্টিতে তাকালেন। ওই মেয়েটা বোনের মেয়ে বলে তার এতো দরদ! তিনি ফোন বের করে আফরানের ফোনে কল করলেন। কিছুক্ষণ পরই তা রিসিভ হলো,

“আসসালামু আলাইকুম, বাবা। কেমন আছ? তুমি হঠাৎ ফোন করলে যে!”

তিনি সচরাচর ছেলেকে ফোন করেন না। আফরান একটু অবাক হলেও মনে মনে অসময়ে ফোন করার কারণ অনুমান করে ফেলল। আমিনুল ইততেয়াজ সালামের জবাব দিমে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

“একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য ফোন করতে হলো।”

“কি বিষয়, বাবা?”

“তুমি নাকি তোমার খালামনির ছোট মেয়েটাকে বিয়ে করেছ! এটা কি সত্যি?”

আফরানের অনুমান সঠিক হলো। সে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

“হ্যাঁ। মা তো বোধহয় সব বলেছে তোমাকে। তারপরও এই প্রশ্ন কেন?”

তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“দ্যাখো আফরান, মেয়েটা মিডলক্লাস ফ্যামেলির। তার উপর কালো। তোমার সাথে কোনো দিক থেকে তাকে মানায় না। ওর কোনো যোগ্যতা নেই তোমার পাশে দাঁড়ানোর। তুমি..”

কথার মাঝপথে আফরান তাকে থামাল। শান্ত অথচ তেজি কন্ঠে বলল,

“বাবা, তুমি কি ভুলে যাচ্ছ যে, যাকে তুমি মিডলক্লাস কালো মেয়ে বলে অপমান করছ সে আমার বউ? ধর্মীয় এবং আইন অনুযায়ী আমার স্ত্রী সে? তোমার ছেলের বউ? ইততেয়াজ বাড়ির বড় ছেলের বউ?”

আমিনুল ইততেয়াজ ভড়কালেন। তার ছেলে ওই মেয়ের প্রতি ভীষণ পজেসিভ তিনি টের পেলেন। কিছু বলতে নিলেই আফরান আবার বলে,

“আজ আমি শান্ত থাকলাম, বাবা। ওই বাড়িতে আমার স্ত্রীর যেন কোনো প্রকার অসম্মান, অমর্যাদা না হয়। যদি হয় তবে ভুলে যাবে তোমার একটা ছেলেও আছে।”

শীতল কন্ঠে কথাগুলোর ইতি টেনে সে ফোন কেটে দিল। আমিনুল ইততেয়াজ হতভম্ব হলেন। তার ছেলে মেয়েটার ব্যাপারের এতো সিরিয়াস! মিসেস সাইমা তাকে বিস্মিত হতে দেখে মৃদু হাসেন। বললেন,

“ছেলে দেশে ফিরলে সামনাসামনি বোঝা পড়া করবেন নাহয়। এখন কি আপনার খাবার বাড়ব?”

আমিনুল ইততেয়াজ চোরা চোখে তাকালেন। কড়া কন্ঠে বললেন,

“তোমার খাবার তুমি আর তোমার ওই বোনঝি মিলে খাও।”

গটগটিয়ে হেঁটে রুমের দিকে অগ্রসর হলেন। বাইরে থেকে খেয়ে এলেও প্রকাশ করলেন না। নাহলে রাগটা ঠিক দ্যাখানো যাবে না। তার যাবার পর মিসেস সাইমা আবার হেসে ফেললেন। আমিনুল ইততেয়াজ যে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন এই খবর তিনি আগেই পেয়েছেন। তিনি কাজের মেয়েটাকে সব গুছিয়ে রাখতে বলে রুমে গেলেন। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে আজ একটু দ্রুতই, শুধু তারা দুজন বাকি আছেন।

ফারদিন বাড়ি ফিরল বেশ রাত করে। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পার করেছে ইতোমধ্যে। কলিং বেল বাজালে পায়েল দরজা খুলে দিল। আগে ফারদিন ডুবলিকেট চাবি দিয়ে ভেতরে ঢুকত। কিন্তু পর পর কিছু দিন পায়েল কে জেগে বসে থাকতে দেখে সে আর ডুবলিকেট চাবি ব্যবহার করে না। সে ড্রয়িং রুমের কমন ওয়াশ রুম থেকে হাত, পা, মুখ ধুয়ে এলো। পায়েল খাবার বেড়ে সাজিয়ে রেখেছে। সে এগিয়ে এসে পায়েলের ওড়নায় মুখ মোছে। চেয়ারে বসে বলে,

“খেয়েছ?”

“হু।”

ফারদিন খাওয়া শুরু করে বলে,

“পড়ালেখা নেই? আমার জন্য এখানে বসে থাকতে বলেছি আমি?”

“এতোক্ষণ তো পড়ছিলাম। আপনি এসেছেন বলেই নিচে এসেছি।”

ফারদিন হাত চালিয়ে মিনিটে খাওয়া শেষ করল। প্লেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে পায়েল তাকে থামিয়ে বলল,

“আমি নিয়ে যাচ্ছি। আপনি রুমে যান।”

ফারদিন তার হাতে প্লেট দিয়ে চলে গেল। পায়েল সব গুছিয়ে ড্রয়িং রুমের লাইট নিভিয়ে রুমে গেল। ফারদিন চেঞ্জ করে ফেলেছে। পায়েলের জন্য সে রোজকার অভ্যাস বাদ দিয়েছে। সে চায় না পায়েল তার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ুক। সে চায় পায়েল নিজের ইচ্ছে মতো চলাফেরা করুক। পায়েল রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে ফারদিনের দিকে চেয়ে রইল অপলক। এই মানুষটাকে নিয়ে তার মনে অল্পবিস্তর অনুভূতি ছিল, যা কদিনে প্রচণ্ড ভালোবাসার রূপ নিয়েছে। লোকটাকে কীভাবে ও এতোটা ভালোবেসে ফেলল তা নিজেও জানে না। আচ্ছা? ফারদিন যদি তাকে ছেড়ে দেয়? কোনো দিন যদি বলে, ‘তোমার প্রতি সকল দায় বদ্ধতা আমার শেষ। এবার তুমি যেতে পার।’ তখন পায়েল কি করবে? কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? বাঁচবেই বা কীভাবে? পায়েলের বুকের মাঝে কামড়ে ওঠে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সে পারবে না।
তাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারদিন জিজ্ঞেস করে,

“এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কি হয়েছে?”

বলতে বলতে সে রুমের দরজা লক করে। মেজাজটা আজ ভালো নেই। বাবার এই ব্যবসায় এতো ঝামেলা জানলে সে না পরীক্ষা দিত আর না ব্যবসার কাজ শিখতে চায়ত। থাকত মাস্টার্সে ঝুঁলে। সে চেয়ে দেখল পায়েল বিছানা ঠিক করেনি। সে কিছু বলল না, নিজেই ঠিক করতে উদ্যত হলো। এর মধ্যে পায়েল বলল,

“আপনি আমাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছেন, তাই না?”

তার হাত থেমে গেল। শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“কি বললে?”

পায়েল এই লোকটাকে ভয় পায়। কিন্তু আজ সে বলবে। আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। নাহলে হুট করে কোনোদিন ফারদিন তাকে ছেড়ে দিলে সে ধাক্কা পাবে, পাগল হয়ে যাবে। তার থেকে ভালো ফারদিনের থেকে সব প্রশ্নের জবাব নেবে। সে শক্ত কন্ঠে বলল,

“আপনি আমাকে দয়া করেছেন? আর এই দয়া,। এই দায়বদ্ধতা শেষ হয়ে গেলে আমাকে ছেড়ে দেবেন, না?”

ফারদিন শান্ত রইল। তার মধ্যে জ্বলতে থাকা ভয়’ঙ্কর রাগের আগুন পায়েল দেখল না। দেখলে কি আর এসব বলে যেতে পারত? সে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলে,

“কি হয়েছে? এসব কথা কেন উঠছে হঠাৎ?”

পায়েল তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। আজ দমে গেলে চলবে না। হয় ছেড়ে দেবে নয়তো সারাজীবনের জন্য আঁকড়ে ধরবে। বলল,

“আমি আপনার উপর বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। অনেক তো বোঝা হলাম, আর কতো? আপনি বরং আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। আমি চলে যাব, হোস্টেলে থাকব। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাব।”

বলতে বলতে সে চোখে চোখ রাখল। তৎক্ষণাৎ ভয়ে আঁতকে উঠল। তার র’ক্তিম চোখজোড়া দেখে র’ক্ত হীম হয়ে এলো। ফারদিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“কি বললি তুই! আবার বল? ওই ওয়ার্ডটা আবার উচ্চারণ কর।”

পায়েল কাঁপতে থাকল থরথরিয়ে। এই লোকের ভয়াবহ রাগ সম্পর্কে সে অবগত। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হয়নি সেভাবে। ফাঁকা ঢোক গিলে বলার চেষ্টা করল,

“আ আপনি আম আমাকে ডি ডি..”

বাকিটা বলার আর রাস্তা রইল না। ফারদিনের রুক্ষ শুষ্ক অধরের মাঝে আটকা পড়ে গেল তার অধর। লতানো দেহ সে শক্ত হাতে পেঁচিয়ে ধরল। চক্ষুদ্বয় মুদে এলো তার। কিছু মুহূর্ত বাদে ফারদিন তাকে ছেড়ে দিল। ধাক্কা মে’রে বিছানায় ফেলে চোয়াল শক্ত করে বলল,

“ডিভোর্স! ডিভোর্স চায় তোর, তাই না? খুব শখ ডিভোর্স নিয়ে অন্য কারোর সাথে ঘর করার? আজকের পর থেকে এই শব্দটা সারাজীবনের জন্য ভুলে যাবি।”

সে আলো নিভিয়ে এগোলো। এগোতে এগোতে তার সদ্য পরিধান কৃত টিশার্ট স্থান পেল রুমের এক কোণে। পায়েলের মুখোমুখি হতেই সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে চায়ল কিছু। তবে ফারদিন সে সুযোগ দিল না। তার কঠোর ছোঁয়ায় পায়েলের চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াল। তবে ধীরে ধীরে সে ছোঁয়া শান্ত হলো, আদুরে হলো। ভালোবাসার স্রোতে ভেসে সে অন্য জগতে যেতে বাধ্য হলো।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৩

অশান্ত রাতের পর শান্ত এক সকাল। পাখিদের কিচিরমিচির কলরব জানান দিল যে তারাও জেগেছে। তো তারা কেন ঘুমিয়ে আছে এখনও? এতে তাদের তীব্র আপত্তি। ফারদিন মুখ কুঁচকে নিল চোখে আলোর ছটা পড়ায়। নড়তে গিয়ে বক্ষ মাঝে কারো অস্তিত্ব টের পেল। সতর্ক হলো সে। রাতের রাগের বশে করা কর্মকাণ্ড একে একে ভেসে উঠল চোখের সম্মুখে। ভীষণ অপরাধ বোধ হলো তার। রাগের মাথায় এমনটা করা একদমই উচিত হয়নি। তার ঠান্ডা মাথায় সবটা শোনা উচিত ছিল, সমাধান করা উচিত ছিল। তা না করে উল্টো! সে পায়েল কে টেনে বালিশে শুইয়ে দেয়। পায়েল নড়ে চড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে যায়। দৃশ্যমান হয় গ্রীবা দেশে জ্বল জ্বল করতে থাকা প্রণয়ের চিহ্ন। গলা থেকে ঘাড় এবং বুকের কাছের ক্ষত দেখে ফারদিন পুনরায় অনুতপ্ত হলো। হাত বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিল। মৃদু কন্ঠে ডাকল,

“পায়েল?”

পায়েল নড়ে ওঠে, তবে জাগে না। সে আবার ডাকে,

“পায়েল ওঠো।”

সে পিটপিট করে চোখ খোলে। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে ফারদিন কে চেয়ে থাকতে দেখে ভড়কে ওঠে হঠাৎই। রাতের মুহূর্ত মনে পড়তেই ভয়ে, লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসতেই মুচড়ে ওঠে ব্যথায়। মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। কাঁপতে থাকে থরথর। ফারদিন তাকে আগলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“রিল্যাক্স, শান্ত হও।”

পায়েল এই ছোঁয়ায় যেন আহ্লাদ পেল। ডুকরে কেঁদে উঠল। ফারদিন শান্ত থাকে। অনবরত হাত চলে তার চুলে। ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় চুলের ভাজে। কিছু মুহূর্ত পর বলে,

“স্যরি! রাতে আমার কি হয়েছিল জানি না। আমার মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিল। তার উপর তুমি ওসব কথা বলেছিলে। আমি রেগে গিয়েছিলাম, কোনো জ্ঞান ছিল না আমার। ভীষণ বাজে ব্যবহার করলাম। আবারও স্যরি বলছি।”

পায়েল নাক টেনে শান্ত হয়ে যায়। লেপ্টে থাকে তার বুকে। এই লোকটার রাতের ব্যবহারে সে কঠোরতাও পেয়েছে আবার কোমলতাও। সে কঠোর ব্যবহারের জন্য কষ্ট পাবে নাকি কোমল ব্যবহারের জন্য খুশি হবে বুঝতে পারছে না। ফারদিন কোমল স্বরে বলে,

“ফ্রেশ হতে হবে। পারবে?”

পায়েল চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল। কি লজ্জা! সে হেঁটে ওয়াশ রুম পর্যন্ত যেতে পারবে না, সেটা কি বলা যায়? সে মিনমিন করে বলে,

“প পারব।”

ফারদিন তাকে ছেড়ে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“ঠিক আছে, তুমি আগে ফ্রেশ হও তারপর আমি যাচ্ছি।”

সে গায়ের চাদর শক্ত করে চেপে ধরে এক পা মেঝেতে ফেলল। পরক্ষণেই ব্যথায় কুঁকড়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। অসম্ভব যন্ত্রণা পুরো শরীর জুড়ে। ফারদিন সবটা বুঝল, ঝট করে কোলে তুলে ওয়াশ রুমে নামিয়ে দিল। চোখের পলকে কি হয়ে গেল, পায়েল চেঁচাতেও‌ পারল না। ফারদিন তার জামাকাপড় বের করে তার হাতে দিল। সে দরজা আটকে লম্বা শ্বাস নিল। শাওয়ারের নিচে দাঁড়াতেই ক্ষতগুলো ছ্যাৎ করে উঠল। পায়েল চোখ বন্ধ হাসে। রেগে থাকার কথা থাকলেও সে বিন্দু মাত্র রেগে নেই। কষ্টও হচ্ছে না। একটু ভয় ছিল, কিন্তু ফারদিন স্যরি বলার পর তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তার ছোঁয়ায় যে ভালোবাসা পেয়েছে সে। ভালোবাসাই তো চেয়েছিল সে, হোক না একটু যন্ত্রণাময়?

শাওয়ার শেষে দরজা খুলতেই ফারদিন কোথা থেকে হাওয়ার বেগে ছুটে এসে পায়েলকে তুলে বিছানায় নামিয়ে দিল। সে এবারও কিছু বলতে পারল না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফারদিন ফ্রেশ হয়ে আসে। গায়ে শার্ট জড়াতে দেখে পায়েল জিজ্ঞেস করে,

“কোথাও যাচ্ছেন? এতো সকালে!”

সে ব্যস্ত হাতে শার্টের বোতাম লাগিয়ে জবাব দেয়,

“হু, একটু কাজ আছে। যাব আর আসব। তুমি রুম থেকে বের হবে না।”

হুকুম জারি করে সে প্রস্থান করল। পায়েল বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। লম্বা করে শ্বাস টেনে নিল। এখন একটু ভালো লাগছে। তবে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে ঘুমাবে না ঘুমাবে না ভেবেও ঘুমিয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর ঘুমের মধ্যে মনে হলো কেউ তাকে দূর থেকে ডাকছে। সে আড়ামোড়া ভেঙে তাকাল। ফারদিন তাকে ধরে উঠিয়ে বসায়। একটা প্লেট এবং বাটি সামনে রাখে। পায়েল ঘুম ঘুম চোখে তাকায়। চেয়ে বলে,

“বাইরে থেকে নাস্তা এনেছেন!”

“হ্যাঁ, খেয়ে নাও।”

পায়েলের ভীষণ অলসতা লাগছে। সে বলে,

“আমি খাব না এখন। পরে।”

ফারদিন শান্ত চোখে চেয়ে তার পাশে বসে। হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে মুখ খাবার তুলে ধরে। পায়েল খেয়াল করে না কোনো কিছু। ঘুমে দুলতে দুলতে সে খাওয়া শেষ করে। খাওয়া শেষে ফারদিন মুখের মধ্যে দুটো ওষুধ চালান করে দিল। পায়েল দেখলও না, শুনলও না। ওষুধ গিলে সে আবার শুয়ে পড়ল। খুব ঘুমে ধরেছে তাকে। ফারদিন মৃদু হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“ঘুমাও।”

ডাইনিং টেবিলে সকলে বসেছে সকালের নাস্তা সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে। দৃষ্টি মাথা নিচু করে বসে আছে। খাবার ঠিক গলা দিয়ে নামছে না। খাওয়ার মাঝে সে বলল,

“খালামনি, আমি বাড়িতে চলে যাই?”

মিসেস সাইমা বিস্মিত হলেন। তিনি মুখ খোলার আগে মিসেস অনা বললেন,

“সে কি? মাত্র কদিনই তো হলো শশুর বাড়িতে এলে। আর আজই আবার যাবে? না না, তা কি করে হয়?”

দৃষ্টি জবাব দিল না। মিসেস সাইমা শান্ত কন্ঠে বললেন,

“বাড়িতে যেতে চায়ছিস কেন? কিছু হয়েছে? বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে?”

সে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি দেয়। তার মন খারাপ করছে না। মিসেস সাইমা বুঝে নিলেন কিছু। দৃষ্টির কানে নিশ্চয় আমিনুল ইততেয়াজের কটু কথা গিয়েছে, তাই সে এমন করছে। তিনি বললেন,

“ঠিক আছে। আপাতত বাড়ি যাবার কথা বাদ। আর কদিন পর যাস।”

দৃষ্টি আর কিছু বলল না। আমিনুল ইততেয়াজ এবং তিয়াস ইততেয়াজ নাস্তা করে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলেন। দৃষ্টি অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে চলে যাবে। কিন্তু মিসেস সাইমা তা হতে দিলেন কই? খাওয়া শেষে মিসেস সাইমা বললেন,

“কলেজ যাবি আজ?”

দৃষ্টি জবাব দেওয়ার আগে তিনি আবার বললেন,

“থাক, আজ আর যেতে হবে না। কাল যাস।”

দৃষ্টি তার কথার বিরোধিতা করল না। রুমে গেল না আর। বসে রইল ড্রয়িং রুমে। ওই রুমে ওর ভীষণ অস্থির লাগে। মনে হয় আফরান চারপাশে ঘুর ঘুর করে। ঘুম আসে না। পুরো রুম জুড়ে যেন আফরানের গায়ের সুবাস ভেসে বেড়ায়। দম বন্ধ লাগে তার।
দৃষ্টি শান্ত হয়ে বসে থাকলেও ফারনাজ শান্ত হয়ে নেই। সে পুরো বাড়ি টো টো করে ঘুরে ছাদে থামল। বিশাল বড় ছাদ। ফারনাজ অনেক আগে এখানে এসেছে বলতে গেলে বছর চার আগে। আমিনুল ইততেয়াজ যে তাদের বিশেষ পছন্দ করেন না সেটা তারা জানে। তারপর থেকেই যাওয়া আসা কমিয়ে দিয়েছে তারা। ফারনাজ মুখ বাঁকায়। আঙ্কেল পছন্দ করে না, তাই কি? খালামনি তো আছে। সে ছাদের এক পাশ থেকে ঘুরে অন্য পাশে গেল। সেখানে ব্যায়ামরত পুরুষকে দৃষ্টিগোচর হতেই থেমে গেল সে। তার কাছে দৃশ্যটা এতো ভালো লাগল! যে সে স্থান, কাল, পাত্র ভুলে সে নির্লজ্জের মতো চেয়ে রইল। হৃদস্পন্দনের গতি যে কখন অস্বাভাবিক হয়ে গেল তাও টের পেল না।

ব্যায়ামরত পুরুষটি থামে। ফারনাজের দিকে এক পলক তাকিয়ে বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি শেষ করে। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,

“ওভাবে হা করে তাকিয়ে আছ কেন? খেয়ে ফেলবে নাকি?”

ফারনাজ হকচকায়। নজর সরিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। ঢোক গিলে ওড়নায় কপালের ঘাম মোছে। তার কি হয়েছিল হঠাৎ? এভাবে কখনো তো কোনো ছেলের দিকে তাকায়নি সে। যাদের সাথে এতো দিন রিলেশনে ছিল তাদের সাথেও না। বক্ষমাঝে এমন কম্পন আগে কখনো অনুভব করেনি। সে আমতা আমতা করে বলে,

“ও ওই গাছে একটা পাখি বসে আছে সেটা দেখছিলাম।”

তূরাগ ভ্রু কুঁচকে তাকায়,

“হ্যাঁ বিশ্বাস করে নিলাম। কচি খোকা তো আমি?”

নিজের সাফাই গেয়ে সে বলে,

“আসলে আপনি যে এখানে ছিলেন তা আমি জানতাম না। ভুল করে চলে এসেছি।”

তূরাগকে ডাইনিং টেবিলে না দেখে সে মাথা ঘামায়নি। তার ভেবে কি কাজ? কিন্তু সে যে এখানে লাফালাফি করছে তা কি সে জানত? তূরাগ তোয়ালেতে ঘাম মুছতে মুছতে বলে,

“এবার বেরোল তো সত্য কথা?”

ফারনাজ ধরা পড়ে যাবায় কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সে উল্টো ঘুরে পা বাড়াতে নিলে তূরাগ আবার বলে,

“বেশি ঘুর ঘুর করবে না। গোলক ধাঁধায় আটকে গেলে কিন্তু আর বের হতে পারবে না। সাবধান করে দিলাম।”

ফারনাজ কথাটা ঠিক বুঝল না। জিজ্ঞাসু সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“কেন ঘুরব না? আর কোন গোলক ধাঁধা? আমি তো কিছুই বুঝলাম না।”

তূরাগ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। যেন তাচ্ছিল্য করা হলো তাকে। বলল,

“তোমার মোটা মাথায় ঢুকবে না।”

বলেই সে হনহনিয়ে প্রস্থান করে। ফারনাজ বোকার মতো চেয়ে থাকে। হুট করেই মনে হয় এই কথাটা সে আগেও শুনেছে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে মনে করতে পারে না। নিজের উপর রেগে সে নিজেকে বকতে বকতে ছাদ থেকে নেমে গেল।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৪

“আমার চলে আসার কথা শুনে ভাইয়া কোনো রিয়্যাক্ট করেনি?”

“কি বলিস! তোর ভাই করবে রিয়্যাক্ট! তার মধ্যে কোনো অনুভূতি আছে আদৌ?”

দৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,

“অনুভূতি যে নেই তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”

পায়েল হকচকিয়ে গলার ওড়না ঠিক করে বসে। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠ বলে,

“আমাদের মতো কি সে ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? আমি বলার আগে থেকেই সে জানে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কীভাবে জানেন? তখন বলল, ‘আমি বাড়ির সবার মতো ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না। যে বাড়ির মেয়ের হুট করে বিয়ে হয়ে গিয়েছে আর কেউ কিছু জানে না। আমার বোনের বিয়ে হয়ে যাবে আর আমি জানব না? আমি সব জানি। আফরান ভাই ভালো মানুষ বলে চুপ করে ছিলাম।’ তাহলে ভাব তোর ভাই কেমন?”

দৃষ্টি চুপ থাকে। আসলে তাই ভাই অদ্ভুত, একটু না অনেকটা। তবে তাদের সবাইকে খুব ভালোবাসে সে, প্রকাশ করে না।

“তুই ও বাড়িতে ভালো আছিস তো, দৃষ?”

দৃষ্টি বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,

“এই কথা তুই ক’বার জিজ্ঞেস করলি? কতবার বলতে হবে তোকে? আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি।”

পায়েল ছোট্ট শ্বাস ফ্যালে। সকলে তো তার ভালো থাকাটাই চায়। ভালো থাকলেই সব ভালো।

খালামনির বাড়ি থেকে শশুর বাড়ি হয়ে যাওয়া বাড়িতে এসে দৃষ্টিকে সারাদিন বসে থাকতে হয়। খালামনি তাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। সে কিছু করতে চায়লে বলেন,

“তোর কোনো কাজ করার দরকার নেই। আমি আছি, অনা আছে। তাছাড়া বাড়িতে কাজের লোকও তো আছে। তোকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না। তুই পড়ালেখা কর শুধু। আমার আফরানের মতো ডাক্তার হতে হবে তো, নাকি?”

দৃষ্টি মুখে কুলুপ এঁটে সরে আসে। তার ওই লুচু ডাক্তারের মতো ডাক্তার হতে বয়েই গেছে। সে হবে গাইনোকলজিস্ট, হার্ট সার্জন হওয়া তার দ্বারা হবে না। রুমে সে চুপচাপ বসে থাকে। আফরানের বারান্দাটা বেশ বড়ো। সেখানে বলতে গেলে কিছুই ছিল না, শুধু কয়েকটা এক্সসারসাইজ করার সরঞ্জাম ব্যতীত। দৃষ্টি সেখানে বেশ কিছু ফুল গাছ রেখেছে, টবে করে। এতে বারান্দার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে ভেবেছে একটা দোলনা কিনে এনে রাখবে। এখানে বসে থেকে পূর্ণিমার রাত উপভোগ করতে বেশ লাগবে। দৃষ্টি ভাবল খালামনিকে নাহয় তূরাগ ভাইয়াকে বলবে সে দোলনার কথা।
এসব কিছু ভাবতে ভাবতে তার চোখ গেল বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলে। সেখানে আফরানের একটা ছবির ফ্রেম রাখা আছে। প্রায়ই ঘুমাতে গেলে দৃষ্টির চোখ ওখানে যায়। তারপর ঘুমের মধ্যে যে এতো দুঃস্বপ্ন দ্যাখে, তা বলার মত নয়। সে খপ করে ছবিটা হাতে নিল। ছবিতে হাস্যরত আফরান। সে চোখ পাকিয়ে চেয়ে বলল,

“আমাকে জ্বালিয়ে আপনার খুব মজা লাগছে না? একবার দেশে আসুন না? আপনার সব মজা আমি ভাতে দিয়ে খাব। তারপর আমি শান্তিতে থাকব। দেশ ছেড়ে বিদেয় হয়েও আমাকে একটু শান্তি দিল না, লোকটা!”

দৃষ্টির খুব রাগ তার উপর। সে ব্যাগ হাতড়ে মার্কার বের করে। ইচ্ছে মতো আফরানের ছবির বারোটা বাজিয়ে সে শান্তির শ্বাস নেয়। এখন ভালো লাগছে। ছবির বদলে যদি ওই লোকটাকে পেত তাহলে আরও ভালো লাগত। তার চুল ছিঁড়ে ন্যাড়া বানিয়ে দিত। তারপর সবাই বলত ন্যাড়া ডাক্তার। দৃষ্টি আনমনে হেসে ফ্যালে। এই রুমে থাকতে থাকতে তার মনে হয় আফরান তার খুব কাছে। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হলেও এখন ভালো লাগে। সে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে আফরানের একটা সাদা শার্ট বের করল। আফরান কিছু জামাকাপড় নিয়ে গিয়েছে আর বাকি সবটাই আছে। দৃষ্টি সেটা বিছানার উপর মেলে রাখে। তারপর অনবরত মার্কার চালায়।
লুচু ডাক্তার, অ’স’ভ্য ডাক্তার, বদমাশ ডাক্তার, আরও কিছু লিখে সাদা শার্ট ভরিয়ে ফেলল। তারপর ফুরফুরে মেজাজে শার্ট জায়গায় রেখে রুম থেকে বের হলো।
তূরাগ বাড়িতে নেই। আজ তার একটা কনসার্ট আছে। আর আমিনুল ইততেয়াজ ও তিয়াস ইততেয়াজের তো অফিস আছেই। বাড়িতে বাদ বাকি তারা। দুপুরের রান্না এখনো বসানো হয়নি। তারা সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে। আর মাঝে মধ্যে ফারনাজ ও মিসেস অনার কথা ভেসে আসছে। দুজনের মধ্যে যে এতো ভাব হয়েছে! দৃষ্টি এগিয়ে যায়, আজ সে কলেজ যাবে না। তো কিছু করা যাক। বলে,

“খালামনি, আজ আমি রান্না করি? প্লিজ?”

মিসেস সাইমা ভাবলেন নাকোচ করে দেবেন। কিন্তু মেয়েটার এতো আগ্রহ দেখে তিনি বারণ করতে পারলেন না। বললেন,

“আচ্ছা বেশ। কি রান্না করবি?”

দৃষ্টি একটু ভেবে বলে,

“চিংড়ির মালাইকারি আর সর্ষে ইলিশ। আর যা করা লাগে তুমি কোরো।”

তিনি হেসে বললেন,

“ঠিক আছে।”

কাজের মেয়েটাকে বলে দিলেন দৃষ্টিকে সাহায্য করার জন্য। দৃষ্টি রান্নাঘরে গেল। সে প্রায়ই রান্না করত, শখের বশে। সে থেকেই মোটামুটি রান্নাটা আয়ত্তে এসেছে। খুব যত্ন করে সে রান্না করে। চারদিকে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়লে কাজের মেয়েটা বলে,

“খুব সোন্দর ঘ্রাণ বাইর হয়তেছে, ভাবী। না জানি খাইতে কত্তো স্বাদ হবে।”

দৃষ্টি হাসে। বাকি সব খালামনিকে করতে বললেও সে নিজেই সম্পূর্ণ রান্না শেষ করে বের হয়। চিংড়ি আর ইলিশের সাথে সে বেগুন ভাজা করল। একটা টিভিন বক্সে ভরে রাখল। মিসেস সাইমা এসে দেখে বললেন,

“টিফিন বক্স কার জন্য?”

“আঙ্কেল দের জন্য।”

“কিন্তু ওরা তো অফিসে খায়।”

“আজ নাহয় বাড়ি থেকে খাবার যাবে। তুমি কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও।”

মিসেস সাইমা দ্বিরুক্তি না করে মৃদু হেসে টিফিন বক্স নিয়ে চলে গেলেন। ফারনাজ এসে আদুরে হাতে ওড়না দিয়ে তার ঘাম মুছে দেয়। অতঃপর তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,

“কি রে! শশুর কে তেল লাগাচ্ছিস?”

“না, পে’ট্রোল।”

দুপুরে সবাই মিলে খাওয়া শেষ করে। দৃষ্টি কাজের মেয়েটাকেও তাদের সাথে জোর করে বসিয়ে খাওয়ায়।

রাতে ফিরে খেতে বসে মিসেস সাইমা চমকে গেলেন আমিনুল ইততেয়াজের কথায়,

“দুপুরে যে চিংড়ি আর ইলিশ পাঠিয়েছিলে, ওগুলো কি আর আছে?”

তিয়াস ইততেয়াজও বলেন,

“হ্যাঁ ভাবী, ওগুলো আর নেই?”

“কেন বলুন তো? আপনারা তো রাতে ভারী কিছু খান না।”

আমিনুল ইততেয়াজ বলেন,

“কতদিন পর যে এতো ভালো খাবার খেলাম! এখনো জিভে লেগে আছে। আমি আর তিয়াস তো কাড়াকাড়ি করে খেলাম। ভাগ্যিস কেউ দ্যাখেনি, নাহলে কি যে ভাবত। এতো সুন্দর রান্নার জন্য তুমি আমার কাছে কিছু চায়তে পারো, যা ইচ্ছে। আমি দিতে চাই।”

মিসেস সাইমা হেসে ফেললেন। মিসেস অনা রান্নাঘরে গিয়ে খাবারগুলো গরম করে নিয়ে এলেন। খাবার খেতে গিয়ে দু ভাই আবার কেড়ে কেড়ে খেল। মিসেস সাইমা গালে হাত দিয়ে বললেন,

“এতো ভালো হয়েছে খেতে!”

“হ্যাঁ, তোমার হাতের খাবার তো রোজ খাই। কিন্তু এমন স্বাদ তো আগে পাইনি। নাকি তুমি আগে ভালো করে রাঁধোনি?”

“এগুলো আমি রান্না করিনি। আপনার ছেলের বউ রান্না করেছে।”

আমিনুল ইততেয়াজের হাত থেমে গেল। কিন্তু এমন খাবার অগ্রাহ্য করা যায় না‌। তিনি আবারও খেতে শুরু করলেন। মিসেস সাইমা আবার বললেন,

“কিছু দিতে চায়লে তাকে দিন। মেয়েটা আজ একটা দোলনার কথা বলছিল। বারান্দায় রাখার খুব শখ ওর।”

আমিনুল ইততেয়াজ তাচ্ছিল্য করে বললেন,

“যে মেয়েকে আমি তাড়াতে চাই, তার জন্য দোলনা এনে দেব! পাগল পেয়েছ আমাকে?”

“আমি কিছু দিতে চেয়েছিলেন, তাই বললাম। দেবেন কি দেবেন না সেটা আপনার ব্যাপার। আবার এটা ভাববেন না ও আপনাকে খাইয়ে সব কিছু আদায় করতে চায়ছে। ওর কোনো চাহিদা নেই। আর ওর দোলনা কিনে দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই। তূরাগ নিয়ে আসবে ওর বোনের জন্য।”

আমিনুল ইততেয়াজ খেয়ে উঠে গেলেন। তূরাগ আবার মেয়েটাকে বোন বানিয়েছে, ভাবী তো ডাকে না কখনো। বোনের মতো আহ্লাদ করে। এতো আদিখ্যেতা তিনি পছন্দ করেন না মোটেও। তিনি তো তক্কে তক্কে আছে যে আফরান দেশে ফিরলেই কোনো ভাবে মেয়েটাকে বিদেয় করবেন। আর বিজনেস পার্টনারের মেয়ের সাথে আফরানের বিয়ে দেবেন। কিন্তু আফরান আসার আগ পর্যন্ত যেহেতু মেয়েটা এখানে থাকছে, তার একটা ইচ্ছে পূরণ করায় যায়। মেয়েটার রান্নার হাত ভালো, ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছেন তিনি। তার বদলে একটা দোলনা কিছুই না।

পরদিন দৃষ্টি কলেজ থেকে ফিরে চমকে গেল। সুন্দর একটা দোলনা তার বারান্দায় মৃদু বাতাসে দুলছে। দু’জন বসা যাবে এমন বড়ো একটা দোলনা। দৃষ্টি যে কতো খুশি হলো! সে ফ্রেশ না হয়েই দৌড়ে খালামনির কাছে গেল। তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, খালামনি। আই লাভ ইউ।”

মিসেস সাইমা তার মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে বলেন,

“দোলনার জন্য থ্যাঙ্কস্ দিচ্ছিস? কিন্তু সেটা তো আমি আনিনি।”

“তবে কে এনেছে? তূরাগ ভাইয়া?”

“উহু, তোর শশুর বাবা। তাকেই থ্যাঙ্ক ইউ দে।”

দৃষ্টির হাসি থেমে গেল। বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল। আমতা আমতা করে বলল,

“মানে উনি! কিন্তু কেন?”

“এনেছেন, ওনার ইচ্ছে হয়েছে ছেলের বউকে কিছু দেওয়ার।”

“খালামনি!”

“আচ্ছা, খালামনি আর কতদিন শুনতে হবে? মা ডাক শুনব কবে?”

দৃষ্টি মাথা নিচু করে বলল,

“সবটা স্বাভাবিক হলে তারপর। তুমি বলো না, উনি কেন আমার জন্য দোলনা এনেছেন?”

মিসেস সাইমা সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বললেন,

“তোর রান্না খেয়ে খুশি হয়েছেন, তাই।”

দৃষ্টি কিছু না বলে রুমে চলে গেল। চায়লেও আমিনুল ইততেয়াজের সামনে গিয়ে তাকে ধন্যবাদ দিতে পারবে না সে। অন্য কোনো দিন নাহয় সে ভিন্ন উপায়ে থ্যাঙ্কস্ বলে দেবে। এখন থেকে সে দোলনায় দুলে চন্দ্র বিলাস করবে! তার ভাবতেও ভীষণ ভালো লাগছে।

চলবে,

সে আমারই পর্ব-২৯+৩০+৩১

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৯

“আজ কলেজ যাবার দরকার নেই, দৃষ।”

মায়ের কথায় দৃষ্টির ভ্রু খানিকটা কুঁচকে গেল। হঠাৎ আজ কলেজ যেতে বারণ করার কারণ কি? কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,

“কেন, মা?”

মিসেস সীমা বসার ঘর গোছাচ্ছেন। জিনিসপত্র মুছে ঠিক করে সাজিয়ে রাখছেন। অতি সূক্ষ্ম নজর প্রদান করছেন যাতে একটাও জিনিস এক ইঞ্চিও বাঁকা না থাকে, না কিঞ্চিৎ পরিমাণ ধুলো। তিনি হাতের কাজ বজায় রেখেই বললেন,

“আজ কিছু মেহমান আসবে। পায়েলও যাবে না। অনেক কাজ আছে বুঝলি তো?”

দৃষ্টি আর কথা বাড়াল না। কারা আসবে তা শোনার প্রয়োজনও অনুভব করল না। এমনিতেই আজকাল তার মন প্রচন্ড ভাবে বিক্ষিপ্ত থাকে। ভালো লাগে না কিছুই। সে চুপচাপ উপরে চলে গেল। পায়েল মিসেস বিউটির সাথে রান্নাঘরে কাজে হাত লাগাচ্ছে। বাড়ির বউ যখন হয়েই গিয়েছে তখন তো আর পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা চলে না।
দৃষ্টি রুমে গিয়ে ভাবল একটু বই নিয়ে বসা যাক। পড়াতে তো মনই বসতে চায় না। মনে হয় সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি বই হাতে বিছানায় বসে। বই মেলতে না মেলতেই ফোন টুং করে ওঠে। ফোনটা পাশেই অবহেলায় পড়ে ছিল। সে হাত বাড়িয়ে টেনে নিল। একটা ভয়েস মেসেজ এসেছে। খানিকটা আনমনে সে তা চালু করে ফেলল। পরক্ষনেই চিরপরিচিত চঞ্চল কন্ঠে তার পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল।

“কেমন আছিস, দৃষ? নিশ্চয়ই খুব ভালো আছিস? ভালোই তো থাকার কথা, আমি তোর আশে পাশে না থাকলে তো তুই খুব ভালো থাকিস। আমি চলে আসার পর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছিস নিশ্চয়? আমিও খুব ভালো আছি জানিস তো? এখানকার হাসপাতাল আমাদের বাংলাদেশের হাসপাতালের মতো নয়। চারিদিকে এতো সুন্দর সুন্দর নার্স ঘোরে! উফ্! তোকে যে কি করে বোঝাই যে তারা ঠিক কতটা সুন্দরী! দুধের মতো ফকফকা সাদা গায়ের রঙ। আর এতো সুন্দর করে সেজে আসে! সব তো আমার পাশেই ঘুরঘুর করে। তিন চারটা তো আমাকে লাইন মা’রারও চেষ্টা করে। এতো মিষ্টি করে যে কথা বলে! আমার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। ভাবছি এখানেই থেকে যাব। এদের ছেড়ে তো আমি থাকতেই পারব না। তাছাড়া কার জন্যই বা দেশে ফিরব বল? আমার জন্য তো কেউ অপেক্ষা করছেই না। আচ্ছা এসব কথা এখন থাক। ওখানে এখন সকাল নিশ্চয়? আমার এখানে রাত বুঝলি? কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। ঘুমটা যেন দেশেই রেখে এসেছি। কিছুতেই চোখে ধরা দিতে চায় না। আর এতো সুন্দর সুন্দর নার্স দেখে তো আমার ঘুমই উড়ে গিয়েছে। অনেক কথা বলে ফেললাম, বিরক্ত হচ্ছিস? ঠিক আছে আর বললাম না। লাস্ট একটা কথা বলি? তোকে কতদিন দেখি না রে, দৃষ! কতদিন তোর আওয়াজ আমার কানে আসে না! ছয়টা মাস পেরিয়ে গেল!”

দৃষ্টি মুখে হাত চেপে নীরবে কেঁদে উঠল। কান্নার শব্দ চেপে রাখার দরুন মৃদু গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। দৃষ্টি তার পুরো কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেনি। সে তো লোকটার এতো দিন পর পাওয়া কন্ঠে শ্রবণেন্দ্রিয়ের তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল। তবে শেষের কথা সে বুঝেছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে কাঁদতে কাঁদতে আফসোস করল, কেন সে না দেখে মেসেজ অন করতে গেল? জোরে জোরে শ্বাস নিল। কান্না থামছে না। সে ছুটে ওয়াশ রুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। বইটা ফেলে রেখে শুয়ে চোখ বন্ধ করল। এখন আর পড়া হবে না। একটু কেঁদেই মাথা ধরে গিয়েছে।

“পায়েল!”

গুরুগম্ভীর কন্ঠের ডাকে পায়েলের হাত থেমে গেল। সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে আবারও কাজ করতে উদ্যত হলেই কন্ঠটা আবার এলো,

“পায়েল, রুমে এসো।”

পায়েল লজ্জা পেল খানিক। এভাবে ডাকার কোনো মানে আছে? মা, ছোট মা কি মনে করবে? মিসেস বিউটি মৃদু হেসে বললেন,

“যাও, কি জন্য ডাকছে শুনে এসো। নাহলে চেঁচাতেই থাকবে।”

পায়েল মাথা নিচু করে হাত ধুয়ে চলে গেল। ফারদিন রেডি হচ্ছে। কোথাও যাবে বোধহয়। সবে মাত্র ট্রাউজার ছেড়ে জিন্স পরেছে। পায়েল কে আসতে দেখে বলল,

“আমার শার্ট গুলো আয়রন করে কোথায় রেখেছ? বের করে দাও।”

পায়েল চুপচাপ ওয়ারড্রবের দিকে এগোলো। ফারদিন শার্ট খুঁজে পেল না কীভাবে? সে তো একদম চোখের সামনেই রেখেছে। সে একটা হালকা নীল রঙা শার্ট বের করে এগিয়ে দিল। ফারদিন তা হাতে নিয়েই ঝটপট গায়ে জড়িয়ে নিল। আপত্তি করল না একদমই। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,

“নিচে কি করছিলে? পড়ালেখা কিছু হচ্ছে নাকি সংসার সামলানো হচ্ছে শুধু?”

“পড়ি তো। আজ বাসায় মেহমান আসবে তাই একটু কাজে হাত লাগাচ্ছিলাম। আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?”

বোতাম লাগানো শেষে সে হাতে ঘড়ি লাগিয়ে নিল। আয়নার মধ্য দিয়ে পায়েলের মুখ দর্শন করে বলল,

“কাজ আছে একটু। তাই যেতে হচ্ছে।”

“ফিরবেন কখন? মেহমান আসবে আর আপনি বাসায় থাকবেন না!”

“মেহমান আসলো কি আসলো না তা দ্যাখার প্রয়োজন আমার নেই। যাদের মেহমান আসবে তারা বুঝে নেবে।”

পায়েল মুখটা ছোট করে ফেলল। ফারদিন তাকাল এক পলক। তার এসব মেহমানদের মাঝে থাকতে একদমই ভালো লাগে না। কোথাকার কারা আসবে তার ঠিক নেই। সে চুলে আঙুল চালিয়ে পায়েলের মুখোমুখি দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে তার মুখ উঁচু করে ধরে বলে,

“আজ কাজে হাত লাগাচ্ছ ঠিক আছে। কিন্তু পরবর্তীতে পড়ালেখা বাদ দিয়ে এসব করতে যেন আমি না দেখি। মনে থাকবে?”

পায়েল ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয়। ফারদিনের সান্নিধ্যে এখন আর তেমন লজ্জায় কুঁকড়ে ওঠে না। তবে লজ্জা নিঃশেষ হয়নি। তা কখনো হবার নয়। ফারদিন বেরিয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ফারদিন আর তার মাঝে ঠিক কেমন সম্পর্ক তা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। তার মনে হয় ফারদিন তাকে শুধুমাত্র প’শু গুলোর হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই বিয়ে করেছে।

দৃষ্টি যখন সবে চোখ মেলে উঠে বসেছে তখন মিসেস সীমা হুড়মুড় করে রুমে প্রবেশ করলেন। পেছনে পায়েল এলো। মুখটা কেমন যেন গোমড়া তার। মিসেস সীমা এগিয়ে এসে বললেন,

“দ্রুত রেডি হয়ে নে।”

তিনি হাত থেকে শাড়ি এবং প্রয়োজনীয় জিনিস বিছানায় রাখলেন। দৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

“এসব কীসের জন্য? আর রেডি হবই বা কেন?”

মিসেস সীমা তড়িঘড়ি করে বললেন,

“সেসব কথা পরে হবে। আগে তুই চোখ মুখ ধুয়ে এসে রেডি হ। পায়েল তোকে সাহায্য করবে। আমি যাই, অনেক কাজ আছে।”

তিনি হাওয়ার বেগে চলে গেলেন। দৃষ্টি পায়েলের দিকে তাকাল। বলল,

“কি ব্যাপার বল তো?”

পায়েল মুখ গোমড়া রেখেই বলল,

“তোকে দেখতে আসছে।”

দৃষ্টি যেন আকাশ থেকে পড়ল। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কানকেও বিশ্বাস হলো না। মৃদু চেঁচিয়ে বলল,

“কিহ!”

“হ্যাঁ রে। সে জন্যই তো সকাল থেকে এতো আয়োজন।”

“কিন্তু আপুকে রেখে আমাকে কেন? আর তুই আমাকে আগে জানাসনি কেন?”

“আমি কি করে বলতাম? একটু আগেই জানলাম।”

দৃষ্টি পাথর হয়ে বসে রইল। বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠল তার। এ অসম্ভব! অসম্ভব! পায়েল ভোঁতা মুখে বলল,

“রেডি হয়েই নে, দৃষ। দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। কোনো না কোনো সমাধান ঠিক হয়ে যাবে।”

দৃষ্টি ছলছল চোখে তাকাল। জড়ানো গলায় বলল,

“তুই তো সব জানিস, পায়েল। আমি কীভাবে আটকাব এসব?”

পায়েল তাকে আশ্বাস দেয়,

“চিন্তা করিস না। যা হবে ভালোই হবে দেখিস।”

পায়েল তাকে জোর করে রেডি করায়। নাহলে ফাহাদ আবরার তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাবেন। দৃষ্টি বড্ড অসহায় হয়ে পড়ে। সে তো আগে থেকেই একজনের কাছে সারাজীবনের জন্য আটকে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও অন্যের সামনে যেতে তার মন সাঁই দিচ্ছে না একটুও। দুরুদুরু বুক কাঁপছে। আজ নিশ্চয়ই কোনো অনর্থ হবে।
মিসেস সীমা কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এলেন। মেয়েকে এক পলক দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন,

“বাহ্! কি সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে!”

দৃষ্টি চোখে টলমলে অশ্রু নিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,

“আপু তো আমার বড়, মা। তাহলে আমাকে আগে এসবে জড়ানোর মানে কি?”

মিসেস সীমা হেসে বললেন,

“আরে ধুর পাগলি! দেখতে এলেই কি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নাকি? তাছাড়া তোকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবই না। শুধু শুধু কেঁদে কেটে সাজ নষ্ট করিস না। এখন চল দেখি।”

তিনি পায়েল কে তাগাদা দিয়ে দৃষ্টি কে নিয়ে নিচে নামলেন। মেহমানরা সবে নাস্তা পানিতে হাত দিয়েছে। দৃষ্টিকে দেখে তারা কিছু মুহূর্তের জন্য থেমে গেলেন। দৃষ্টি মাথা নিচু করেই রেখেছে। মিসেস সীমা তাকে একটা জায়গায় বসিয়ে দিলেন। কথা বার্তা চলল টুকটাক। সে জোরপূর্বক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এক পর্যায়ে পাত্রের মা বললেন,

“আমার মৃন্ময়ের পছন্দ আছে বলতে হবে। ভারি মিষ্টি আপনাদের মেয়ে।”

দৃষ্টি হোঁচট খেল। থতমত খেয়ে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সামনে তাকাল। মৃন্ময় স্মিত হেসে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিকে তাকাতে দেখে তার হাসি আরও চওড়া হলো। সে এই বিষয়টা নিয়েই তার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু দৃষ্টি সে সুযোগ দেয়নি। এখন নিশ্চয়ই সারপ্রাইজড্ হয়েছে? দৃষ্টির মনে হলো তার পুরো দুনিয়া টলছে। মৃন্ময় স্যার এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে! এবার কি হবে? স্যার তো তাকে আগে থেকেই পছন্দ করে। বাবা মা সহ সকলের হাসি মুখ দেখে তার প্রচন্ড কান্না পেল। তারা কি মৃন্ময় স্যারকে পছন্দ করে ফেলেছে? এতো গুলো মুখের হাসি সে কেড়ে নেবে কীভাবে? কি করবে সে? মনে মনে প্রার্থনা করল এসব বন্ধ হোক। যে করেই হোক বন্ধ হোক। মৃন্ময়ের মা জিজ্ঞেস করলেন,

“দৃষ্টি! আমার ছেলেকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো? আমাদের কিন্তু তোমাকে বেশ লেগেছে।”

দৃষ্টি কান্না আটকাতে মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে ধরল। সকলে ধরেই নিল যে সে লজ্জা পেয়েছে। মহিলা আবার বললেন,

“দুজনকে আলাদা একটু কথা বলতে দিলে ভালো হতো না?”

ফাহাদ আবরার কিছু বলার জন্য হা করতে নিলেই কলিং বেল বেজে উঠল। এমন অসময়ে কে আসতে পারে ভেবে সকলে ভ্রু কুঁচকে নিলেন। মিসেস সীমা এগিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখে বিস্মিত হবার পাশাপাশি আনন্দে আপ্লুত হয়ে বললেন,

“আপা! তুমি!”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩০

মিসেস সাইমা কে এই অসময়ে দেখে অবাক হয়েছেন সকলেই। মিসেস সাইমা একা আসেননি, সাথে এসেছেন মিসেস অনা এবং তূরাগ। মিসেস সীমা তড়িঘড়ি করে বোনকে ভেতরে প্রবেশ করালেন। বসতে অনুরোধ করলেন সবাইকে। ফাহাদ আবরার অবাক হলেও তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। মিসেস সাইমা চারপাশে চেয়ে বললেন,

“ভুল সময়ে এসে পড়লাম মনে হয়।”

মিসেস সীমা বললেন,

“আরে না না, আপা। কতদিন পর তুমি এলে! আর সবাই তো নিজেদেরই লোক। এই যে ওনারা দৃষ কে দেখতে এসেছেন। মৃন্ময় তো আফরানের সাথেই এক হাসপাতালে চাকরী করে।”

মিসেস সাইমা দৃষ্টির দিকে এক পলক তাকালেন। শাড়ি পরিয়ে তাকে পুতুলের মতো বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছলেন। তিনি তো জেনে বুঝেই এই অসময়ে এসেছেন। তিনি মৃদু হেসে বললেন,

“দরকারে আসতে হলো।”

“সব দরকার পরে হবে। আগে একটু নাস্তা করে নাও।”

“নাস্তা পানি সব পরে হবে। আমি এখানে খুব দরকারি একটা কাজে এসেছি। আশা করছি আমাকে তোরা ফিরিয়ে দিবি না।”

ফাহাদ আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। কি এমন দরকার পড়ল যে এই ভর দুপুরে ছুটে চলে এলেন? মিসেস সাইমা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল লাগালেন কোথাও। কল রিসিভ হাওয়ার পরপরই বললেন,

“হ্যালো আফরান?”

এই একটা নাম শুনেই দৃষ্টি জমে গেল। দুরুদুরু কেঁপে উঠল বুক। পরবর্তীতে ঘটা বিস্ফোরণের কথা কল্পনা করেই কপাল বেয়ে ঘামের রেখা নেমে গেল।
ফোনের ওপারের আফরান সকলকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিল। বলল,

“মা, পাশে খালামনি আছে?”

“হ্যাঁ আছে।”

“তাকে বলো আঙ্কেলের প্রেশারের ওষুধ টা হাতে রাখতে। কারণ এখন উনি যা যা শুনবেন এবং যা যা ঘটনা ঘটবে তাতে ওনার প্রেশার হাই হয়ে যাবে। আর একজন ডাক্তার হয়ে আমি আমার কর্তব্যে কখনো অবহেলা করি না। কি ডক্টর আহমেদ? আমি ঠিক বলছি তো?”

মৃন্ময় চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ কি থেকে কি হচ্ছে তার বোধগম্য হচ্ছে না। বিয়ের পাকা কথার মাঝে আফরান কোত্থেকে উদয় হলো? মিসেস সীমা আফরানের কথা মতো ছুটে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এলেন। তার বোন পো কখনো ভুল কথা বলে না। ফাহাদ আবরার বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নিলেন। আফরান এবার দৃষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, দৃষ! তোর এতো সাহস বেড়েছে যে আমার অনুপস্থিতিতে তুই সং সেজে অন্যের সামনে যাস! তোর দ্বারা তো ভুল নয়, পাপ হয়ে গেল।”

দৃষ্টি মাথা নিচু করে চোখের জল আটকাবার তীব্র প্রচেষ্টা করতে লাগল। ফাহাদ আবরার কিঞ্চিৎ রেগে বললেন,

“কি হচ্ছে এসব? তুমি আমার মেয়েকে এসব বলছ কেন?”

আফরান শব্দ করে হেসে বলল,

“বলছি কারণ এখানে আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। ও আমি ব্যতীত অন্য কারো সামনে সেজে বসতে পারল কি করে? অনেক সাহস বেড়েছে আপনার মেয়ের।”

“কীসের অধিকার তোমার আমার মেয়ের উপর? সামান্য কাজিন হয়ে এমন অধিকার বোধ দ্যাখাতে আসবে না।”

আফরান হাসল আবারও,

“সামান্য কাজিন! দৃষ? আমি তোর সামান্য কাজিন! এতো মজার মজার কথা শুনে তো আমার গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে মন চাচ্ছে।”

আফরান থামল একটু। পরপরই গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“অনেক হয়েছে মজা। আর না। আঙ্কেল, আমি আমার মাকে আপনাদের বাড়িতে পাঠিয়েছি আমার বউকে নিয়ে আসার জন্য। আজকের এমন হীন ঘটনার পর এক মুহূর্তও আমার বউ ওখানে থাকবে না। বলা তো যায় না আপনি মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ে করিয়ে দিলেন!”

ফাহাদ আবরার হতভম্ব হলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

“কি সব পাগলের প্রলাপ বকছ? কে তোমার বউ?”

ভরা সভার মাঝে আফরান বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উচ্চারণ করল,

“ফাহাদ আবরার এবং মিসেস সীমার তিন সন্তানের মধ্যে ছোট কন্যাটি যার নাম দৃষ্টি আবরার সে’ই আমার বউ। আমার স্ত্রী।”

মৃন্ময়ের পরিবার সহ ফাহাদ আবরার দাঁড়িয়ে পড়লেন। চোখে মুখে বিস্ময় খেলছে তাদের। মিসেস সীমা ফাহাদ আবরারের হাতে ওষুধ ধরিয়ে দিলেন। তিনি জানেন এখন কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। ফাহাদ আবরার যেন চোখে আঁধার দেখছেন। তিনি কোথাকার কোন ওষুধ ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বললেন,

“মশকরা করো আমার সাথে? আমার মেয়ে তোমার স্ত্রী হয়ে গেল আর আমিই জানি না? আমি মৃন্ময়ের সাথে দৃষ্টির বিয়ে দেব।”

“এ কাজ ভুলেও করতে যাবেন না। আমি এতো কাঁচা খেলোয়াড় নই। মাকে আমি সকল প্রমাণ সহ পাঠিয়েছি আর সাথে সাক্ষী হিসেবে আমার ভাই তূরাগও আছে। আপনার কিচ্ছু করার নেই এখানে। যদি বাঁধা দেন তবে আমি আইনের সাহায্য নিতে বাধ্য হব। আজই নিজের মেয়েকে বিদায় দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠান। আমি ফিরব খুব শীঘ্রই। তার পর যার যার সাথে যা হিসাব তা বুঝে নেব।”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইলেন ফাহাদ আবরার। তিনি বিশ্বাস করেন না এসব। তিনি গলায় জোর বাড়িয়ে বললেন,

“আমি এসব কিছুই বিশ্বাস করি না। আপা, চলে যান আপনারা।”

মিসেস সাইমা সূক্ষ্ম শ্বাস ফেললেন। এসেছেন যখন ছেলের বউকে নিয়েই ফিরবেন। খালি হাতে ফেরার উপায় নেই। আফরান ল’ঙ্কা কাণ্ড বাঁধবে! এতো বছরের সাধনার প্রশিক্ষণ ফেলে চলেও আসতে পারে। তিনি ব্যাগ থেকে তাদের কাবিননামার কাগজটা বের করে টেবিলে রাখলেন। এর থেকে বড় প্রমাণ আর হতে পারে না। আফরান সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে গিয়েছিল। সে হয়তো এমন কিছু ঘটার আভাস পেয়েছিল। ফাহাদ আবরার ধাক্কা খেলেন। হাত বাড়িয়ে কাগজ তুলে ধরে বড় বড় চোখে চেয়ে রইলেন। কনের সই এর জায়গায় জ্বল জ্বল করা মেয়ের স্বাক্ষর চিনতে তার অসুবিধা হলো না বিন্দু মাত্র। নিষ্পলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মেয়ের মুখশ্রীতে।
দৃষ্টি এখনো মাথা নিচু করেই আছে। ইতোমধ্যে গাল ভর্তি করে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ফেলেছে। বারংবার মনে হচ্ছে সে তার বাবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ফাহাদ আবরার মেয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। নির্লিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

“এগুলো কি সত্যি?”

দৃষ্টি জবাব দিল না। চিবুক ঠেকে গেল বুকে। ফাহাদ আবরার ধৈর্যহীন হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,

“আমি জিজ্ঞেস করছি তোমাকে, এসব কি সত্যি?”

দৃষ্টি ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠল। মাথা উপর নিচ দোলায়। এতে সকলে যা বোঝার বুঝে গেলেন। মৃন্ময়ের মা বললেন,

“এখানে দাঁড়িয়ে তামাশা দ্যাখার আর কোনো মানে নেই। একটা বিবাহিতা মেয়েকে আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আপনারা? ভাগ্যিস ওনারা ঠিক সময়ে চলে এসেছিলেন। নয়তো আমার ছেলের খুব বড় ক্ষতি হয়ে যেত।”

ফাহাদ আবরার চুপচাপ শুনে গেলেন। বড্ড একা অনুভব করছেন তিনি। তার অনুপস্থিতিতে রামিজ আবরার অফিস ছেড়ে আসতে পারেননি। তাই আজ তার পাশটা শূন্য। তারা আরও দু কথা শুনিয়ে প্রস্থান করলেন। যাবার আগে মৃন্ময় দৃষ্টির দিকে কাতর চোখে চেয়ে গেল। সে এসব কিছু দৃষ্টির থেকে আশা করেনি।
মিসেস সাইমা বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“দৃষ্টির ব্যাগ গুছিয়ে দে। আর বেশিক্ষণ বসব না আমরা।”

ফাহাদ আবরার মেয়ের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের কক্ষে চলে গেলেন। দৃষ্টি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল। বাবার এমন দৃষ্টি তার বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু করেছে। পায়েল এগিয়ে তাকে আগলে নিল। ফারনাজ এতোক্ষণ এখানে উপস্থিত ছিল না। সেও কোথা থেকে দৌড়ে এসে বোনকে সান্ত্বনা দিতে লাগল,

“কাঁদিস না, দৃষ। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

দৃষ্টি থামে না। সর্বদা সে ছিল বাবা মায়ের অনুগত বাধ্য মেয়ে। আজ সে বাবার বিরুদ্ধে যেয়ে তার চরম অপছন্দের পাত্রের সাথে জীবন জুড়েছে। তার বাবা কষ্ট পেয়েছেন। তিনি কখনো দৃষ্টির উপর রাগ দ্যাখাননি। সে কখনো ভুল করলে তিনি নীরব থাকতেন। কথা বলা বন্ধ করে দিতেন। এতেই দৃষ্টির শিক্ষা হতো। আজও তিনি এমনই করছেন। তবে দৃষ্টির কিচ্ছু করার নেই। সে কীভাবে আফরান কে ছেড়ে দেবে? সে ছাড়লেও আফরান তাকে কখনো ছাড়বে না। সকল কথা চিন্তা করে দৃষ্টি হাউমাউ করে কাঁদতেই থাকল।

মিসেস সীমা মনে মনে বেশ খুশি হয়েছেন। তবে বাইরে থেকে বুঝতে দিচ্ছেন না। আফরান তার চিরকাল পছন্দের পাত্র ছিল। তবে অকস্মাৎ এই রত্নকে তিনি ছোট জামাই হিসেবে পেয়ে যাবেন, তা কি কল্পনা করেছিলেন কোনোদিন? তিনি খুশি মনে মেয়ের ব্যাগ গোছাতে গেলেন।
মিসেস সাইমা এগিয়ে এসে দৃষ্টির মাথায় হাত রাখলেন। কোমল স্বরে বললেন,

“কাঁদিস না, মা। আজ আমার ছেলের একটা ছেলেমানুষীর জন্যই তোকে এসব কিছুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু কি বল তো? আমার ছেলেটা তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। এসব কিছু আন্দাজ করে সে তোকে বিয়ে করেই রেখে গিয়েছে। যাতে তোর উপর সম্পূর্ণ অধিকার ওর থাকে। নয়তো ও পারতো না এসব আটকাতে, ওর তো কোনো অধিকারই থাকত না। আর তুই অন্যকারো হয়ে যেতিস।”

দু হাতে তার মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,

“থাক! আর না। রেডি তো হয়েই আছিস, আর রেডি হতে হবে না। আর শোন! আজ যে আমার ছেলে তোকে এতো কাঁদাল, দেশে ফিরলে আচ্ছা মতো আমি তার কান মলে দেব দেখিস। এখন শান্ত হ?”

দৃষ্টি লম্বা শ্বাস নিয়ে শান্ত হলো। উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে বাবার রুমের দিকে অগ্রসর হলো।
ফাহাদ আবরার জানালার পাশে বিছানার কোণে বসে আছেন। দৃষ্টি তার জানালা ভেদ করে বাইরে। দৃষ্টি নিঃশব্দে বাবার পায়ের নিকটে বসে। কোলে রাখে মাথা। দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে বলে,

“আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি, বাবা।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩১

“আমাকে ক্ষমা করে দাও। বিশ্বাস করো আমার হাতে কিছুই ছিল না। আমি বাধ্য ছিলাম, বাবা। তোমার অমতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”

বলতে বলতে সে নীরবে চোখের জল ফেলে। ফাহাদ আবরার অনুভব করলেন উষ্ণ জলের স্পর্শ। তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। কোনোদিনই তিনি সন্তানের চোখের জল সহ্য করতে পারেন না। তবে মেয়ের এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাকে ভাবাচ্ছে। আফরান কে তিনি সর্বদায় খারাপ ছেলে ভেবে এসেছেন। তিনি জানেন না সে আদৌ শুধরেছে কিনা? আদৌ তার কলিজার টুকরা তার কাছে ভালো থাকবে কিনা? মেয়ের চোখের জলে তার বুকে চিনচিনে ব্যথা সৃষ্টি করল। তিনি আলতো করে হাত রাখলেন তার মাথায়। দৃষ্টি যেন ভরসা পেল। ফাহাদ আবরার মৃদু কন্ঠে বললেন,

“আমি জানি এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। সবটা ওই স্টুপিড ছেলের কাজ। কেন? আমার সামনে দাঁড়ানোর সৎ সাহস তার নেই? এভাবে হুট করে আমার মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল! তবে সে যদি ভেবে থাকে আমি তাকে ছেড়ে দেব, চরম ভুল। আমি তাকে উচিত শিক্ষা দেব। আগে তাকে দেশে ফিরতে দাও। তোমাকে আজ আটকে রাখলে স্টুপিডটা যদি ওদেশের সব ফেলে চলে আসে? তখন তো আমাকেই দোষ দেবে। আমার জন্য ওর ট্রেইনিং শেষ হয়নি বলে বলে আমার মাথা খাবে। ফাহাদ আবরার হাঁটুর বয়সী এক ছেলের কাছে হেরে যেতে পারে না।”

একটু থামলেন তিনি। শ্বাস টেনে নিয়ে বললেন,

“তুমি আপাতত যাও। স্টুপিডটা দেশে ফিরলে আমি তোমাকে নিয়ে আসব। ওর অনুপস্থিতিতে যুদ্ধটা ঠিক জমবে না।”

দৃষ্টির কান্না থেমে গিয়েছে আগেই। বাবার কথায় সে হেসে ফেলল। তিনি যে মেনে নিতে চেষ্টা করছেন সেটা তার কথাতেই দৃষ্টি বুঝেছে। সে চোখ মুছে বাবার দিকে চেয়ে বলল,

“তুমি আমাকে মাফ করেছ তো, বাবা?”

“তোমার কোনো ভুল নেই। তোমার মাফ চাওয়ারও দরকার নেই। যার দরকার তার সাথে আমি বুঝে নেব, যাও।”

দৃষ্টি প্রশান্তির হাসি হেসে বাবা আলতো আলিঙ্গন করে বলল,

“আমি তোমাকে ভালবাসি, বাবা।”

ফাহাদ আবরার মলিন হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি নিজে গেলেন মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিতে। সাথে ফারনাজ কে রেডি হয়ে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। মিসেস সীমা বললেন,

“আপা বলছিল, নাজের তো পরীক্ষা শেষ। শুধু শুধু বসে আছে ঘরে। তাই একটু ঘুরে আসুক।”

ফাহাদ আবরার কিছু বললেন না। তার নীরব সম্মতি পেয়ে ফারনাজ খুশি হলো। বেশ অনেক দিন পরই সে যাবে খালামনির বাড়ি। ‌
সকলকে বিদায় দিতে যেয়ে দৃষ্টির চোখ ভরে এলো, তবে অতিকষ্টে সে তা দমিয়ে রাখল। মিসেস সীমা মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

“কি থেকে কি হয়ে গেল! আমার ছোট্ট মেয়েটার কবে বিয়ে হয়ে গেল টেরই পেলাম না। তবে কি জানিস তো? বিয়েটাতে আমি খুব খুশি। আমি তোকে আফরানের কাছে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকব, কারণ আমি জানি সে তোকে খুব ভালো রাখবে। তুই খুব ভালো থাকবি দেখিস। আমাদের কথা ভেবে মন খারাপ করবি না একদম। যখনই আমাদের কথা মনে পড়বে তখনই চলে আসবি, নাহয় ফোন করবি তোর ভাই গিয়ে নিয়ে আসবে। ভালো থাকিস।”

দৃষ্টি মাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সব শেষে পায়েল কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ধরা গলায় বলল,

“তুই আমাকে তাড়াতে চেয়েছিলি না? দ্যাখ চলে যাচ্ছি।”

“হু চেয়েছিলাম তো। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি আমাকে শান্তি দিয়ে চলে যাবি, ভাবিনি।”

তার কন্ঠও জড়িয়ে আসছে। দৃষ্টি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বলল,

“ভাইয়ার সাথে দ্যাখা হলো না। বলে দিস আমি ও’কে খুব মিস করব। সবাইকে খুব মনে পড়বে আমার।”

পায়েল তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“আমাকে মনে করতে হবে না। মেডিকেলে দ্যাখা তো হবেই।”

দৃষ্টি মৃদু হাসে। বাবার কাছে গেলে তিনি বললেন,

“চিন্তা করবে না একদমই। কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে আমাকে ফোন করবে, আমি গিয়ে নিয়ে আসব। নয়তো কাউকে পাঠিয়ে দেব।”

বন্যা আর বর্ষণ তো কেঁদে ফেলল প্রায়। তারা দৃষ্টিকে যেতে দিতে নারাজ। দৃষ্টি কোনো মতে তাদের আদর করে, তাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসে। তূরাগ ড্রাইভ করে এসেছিল। সে ড্রাইভিং সিটে বসে। পেছনে মিসেস সাইমা, মিসেস অনা এবং দৃষ্টি। বাকি ফারনাজ, সে মাঝে বসার জায়গা পেল না। বাধ্য হয়ে তাকে তূরাগের পাশে উঠে বসতে হলো। গাড়ি চলতে শুরু করল। দৃষ্টি চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে দিল। এইটুকু তেই যেন ক্লান্তির শেষ নেই। মিসেস সাইমা সযত্নে তার মাথা নিজের কাঁধে রাখলেন। মিসেস অনা এতোক্ষণ ধরে ফারনাজের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। তিনি এবার মুখ খুললেন,

“তোমার নাম বুঝি নাজ?”

তাকে বলা হলো বুঝে ফারনাজ ঠোঁট টেনে হেসে বলল,

“না, আন্টি। আমার নাম ফারনাজ, সকলে ছোট করে নাজ বলে ডাকে।”

“তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?”

ফারনাজ ঘাড় পেছনে ঘুরিয়ে কপট হেসে বলে,

“আপনাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু চিনতে পারছি না ঠিক। কোথায় দেখেছি বলুন তো?”

মিসেস অনা উৎসাহ পেলেন। তিনি গদগদ কন্ঠে বললেন,

“মনে নেই? ওই যে শপিং মলে ভিড়ের মাঝে আমি আটকে পড়েছিলাম? আর তুমিই তো আমাকে বের করেছিলে।”

ফারনাজের মনে পড়ল। সে ভীষণ প্রফুল্ল হয়ে সিট বেল্ট খুলে মিসেস অনার দিকে ঘুরে বসল। বলল,

“আপনি সেই আন্টিটা! ইশ্ আমি একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। কেমন আছেন আপনি?”

গল্প জুড়ে দিল দু’জনে। সেদিন শপিং মলের কথা সহ আরও কত কথা! তূরাগ বিরক্ত হলো ভীষণ। এভাবে কেউ গল্প করে? গল্প করার সময় কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? সে দাঁত কিড়মিড় করে ধমকের সুরে বলল,

“এই মেয়ে! সোজা হয়ে বসো। এক্ষুনি সোজা হয়ে বসো।”

ফারনাজ ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। গাড়ির উপরিভাগে মাথায় আঘাত পেল। মৃদু আর্তনাদ করে সোজা হয়ে বসল। মাথায় হাত ঘষে মুখ কুঁচকে তূরাগের দিকে তাকাল। সে নির্লিপ্ত। মিসেস অনা বললেন,

“মেয়েটাকে ওভাবে বললি কেন, বাবা?”

তূরাগ বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,

“গাড়ির ভেতরে এভাবে গল্প করে কেউ? আমার সমস্যা হচ্ছে। বাড়িতে গিয়ে শান্ত হয়ে বসে, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প কোরো।”

মিসেস অনা আর কিছু বললেন না। তবে ফারনাজ মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

“আমরা গল্প করছি তাতে ওনার কি? হুহ! এই মেয়ে সোজা হয়ে বসো!”

মুখ ভেংচাল সে। তূরাগ গমগমে কন্ঠে আবার বলে,

“সিট বেল্ট কে লাগাবে? ভুতে?”

সে মুখ ছোট করে সিট বেল্ট লাগায়। এই লোকের সমস্যা কি সে বোঝে না। দ্যাখা হওয়া থেকে এই পর্যন্ত কোনো দিন তার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি এই পাথর মানব!
আরও আধঘন্টা পর তারা বাড়ি পৌঁছায়। মিসেস সাইমা এবং মিসেস অনা দৃষ্টিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। ফারনাজ পড়ল বিপাকে। সে ব্যাগ টেনে নিয়ে যেতে পারছে না। একটু বেশিই ভারী হয়ে গিয়েছে। হাল ছেড়ে দিয়ে সে কোমরে হাত ঠেকিয়ে লম্বা শ্বাস নিলো। তাকে তো একা ফেলে সবাই চলে গেল। তূরাগ গাড়ি পার্ক করে এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

“দাঁড়িয়ে আছ কেন? ফিরে যাবে নাকি?”

ফারনাজ কড়া জবাব দিতে গিয়েও দিল না। কারণ এই লোকের সাহায্য তার প্রয়োজন। সে বিনীত কন্ঠে বলল,

“আমাকে একটু সাহায্য করুন, প্লিজ? ব্যাগটা অনেক ভারী। আমি নিয়ে যেতে পারছি না।”

তূরাগ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়। এক হাতে ব্যাগ উঁচু করে বলে,

“কি এর মধ্যে? এতো ভারী কেন? সারাজীবনের জন্য থাকতে এসেছ নাকি?”

ফারনাজ অপমানিত হলো। সে মুখ কুঁচকে থমথমে কন্ঠে বলে,

“আমার তো খেয়ে কাজ নেই যে খালামনির বাড়িতে সারাজীবন থাকব! এতে দৃষের কিছু বই আছে। সব ওর ব্যাগে ধরেনি তাই।”

একটু থেমে বলল,

“আমি আপনাকে এসব বলতে যাচ্ছি কেন? আপনাকে সাহায্য করতে হবে না। আমিই পারব।”

ফারনাজ হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলে তূরাগ ব্যাগ উঠিয়ে হাঁটা ধরল। ফারনাজ চোখ ছোট ছোট করে বলে,

“সাহায্যও করবে আবার অপমানও।”

সে তূরাগের পেছনে পেছনে যায়। মনে মনে কতবার যে তাকে ধুয়ে দিল তার ইয়াত্তা নেই।

“খালামনি! এই রুমে থাকতে হবে? আমি নাহয় আপুর সাথে থাকি?”

মৃদু কন্ঠে বলল সে। তাকে শুধু শুধু এই রুমে থাকতে দেওয়ার কি দরকার। ফারনাজের সাথে গেস্ট রুমে দিব্বি থাকতে পারত সে। মিসেস সাইমা তার হাত টেনে বিছানায় বসালেন। বললেন,

“খালামনির বাড়িতে আসিসনি। শশুর বাড়িতে এসেছিস। তো এখন তো আর গেস্ট রুমে থাকলে চলবে না, স্বামীর রুমে থাকতে হবে। যদিও আফরান এখন নেই, কিন্তু তার সব কিছুতে তোর অর্ধেক অধিকার।”

দৃষ্টি চুপ রয়। বুকের মধ্যে কাঁপছে তার। আফরানের রুমে শেষবার কবে এসেছিল তার খেয়াল নেই। এখন থেকেই তাকে এই রুমে থাকতে হবে ভেবেই, তার বুক ভার হচ্ছে। কোনো ভাবে নাহয় থাকবে, কিন্তু আফরান আসার পর কি করবে?

“ফ্রেশ হয়ে নে। দুপুরে তো কারোরই কিছু খাওয়া হয়নি। ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে আসিস।‌ কেমন?”

দৃষ্টি ভাবনা থেকে বেরিয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয়। মিসেস সাইমা হেসে চলে গেলেন। ছেলের বউ হিসেবে দৃষ্টিকে তার মোটেও অপছন্দ নয়। ছোট থেকে দেখে এসেছেন, তুলনামূলক শান্ত এবং বাধ্য মেয়ে সে। যেখানে তার ছেলে চঞ্চল, অবাধ্য। তিনি ভেবেছিলেন ফাহাদ আবরারের কাছে দৃষ্টিকে চায়বেন, কিন্তু আফরানের বাবা আমিনুল ইততেয়াজের জন্য পারেননি। তিনি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষদের পছন্দ করেননা। তেমনই তার বোনের পরিবার অপছন্দের তালিকায় ছিল তার। ছেলের জন্য হয়তো কোনো কোটিপতির মেয়েকে চেয়েছেন। এখন ফিরে যখন সব জানতে পারবেন, তখন কি করবেন তিনি জানেন না। কীভাবে সবটা সামলাবেন কে জানে? এবার হয়তো বাপ ছেলের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধবে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে আওড়ালেন,

“সাহায্য করুন, আল্লাহ্! এসবের মধ্যে মেয়েটার কোনো দোষ নেই। সে যেন কষ্ট না পায়।”

চলবে,
বানান ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন।🙂

সে আমারই পর্ব-২৬+২৭+২৮

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৬

দৃষ্টি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। কানে বোধ হয় ভুল শুনল। ঘুম থেকে মাত্রই উঠে মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছে মনে হলো। নাহলে তার প্রশ্নের জবাবে ফারদিনের এহেন উদ্ভট কথা! কখনোই সম্ভব নয়। সে মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কি? কি বললে, ভাইয়া?”

ফারদিন বিরক্ত হয়। তা সম্পূর্ণ মুখশ্রীতে ফুটিয়ে তুলে বলে,

“দৃষ, দ্রুত তোর একটা জামা আর তার সাথে যা লাগবে সব কিছু দে। তাড়াতাড়ি কর। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব? ফ্রেশ হইনি এখনও।”

দৃষ্টি হকচকায়। তবে সে ঠিকই শুনেছিল। কিন্তু তার জামা দিয়ে ফারদিনের কি কাজ? জীবনেও কখনও সে ভাইকে মেয়েদের জামা পরতে দ্যাখেনি। দৃষ্টির মাথাটা ঠিক কাজ করছে না। সে কল্পনা করতে করতে এগিয়ে ওয়ারড্রব থেকে একটা জামা, পাজামা ও একটা ওড়না বের করে দিল। ফারদিন জামা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করল না। তৎক্ষণাৎ লম্বা লম্বা পা ফেলে রুমে প্রবেশ করে দরজা আটল। দৃষ্টি সেদিকে চেয়ে সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলল।

ফারদিন রুমে এসে পায়েল কে পেল না। অর্থাৎ সে এখনও ওয়াশ রুমে আছে। সে এগিয়ে নক করল। গমগমে কন্ঠে বলল,

“পায়েল! তুমি কি ভেতরে আছ?”

ফারদিনের কন্ঠে পায়েল চমকায়। লজ্জায় গুটিয়ে যায়। নিজেকে স্বাভাবিক করে মিনমিনিয়ে বলে,

“ইয়ে মানে, আমি ভুল করে শাওয়ার ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভিজে গিয়েছি। কিন্তু এখন কি করব?”

ফারদিন ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

“ফুল কোথাকার!”

কন্ঠনালিতে আওয়াজ এনে বলে,

“দরজা খোলো। আমি ড্রেস এনেছি।”

পায়েল ভাবুক হলো। এতো সকালে ফারদিন জামা জোগাড় করল কোথা থেকে? জিজ্ঞেস করল,

“আপনি জামা পেলেন কোথায়? আবার আপনার জামা দিচ্ছেন না তো? আমি কিন্তু ওসব পরতে পারব না।”

ফারদিনের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে দরজায় একটা থাবা বসিয়ে বলে,

“আমি এখানে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। আর আমাকেও ফ্রেশ হতে হবে। এক্ষুনি দরজা খোলো আর এগুলো নাও। আর একটা কথা বলেছ তো, দরজা ভেঙে ঢুকব।”

পায়েল ঢোক গিলল। ধীরে ধীরে দরজা একটু খুলে হাত বের করে দিল। ফারদিন কে বিশ্বাস নেই। সে পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু শুধু সে কখনোই হুমকি দেয় না। হাতের নাগালে কাপড় পেতেই তৎক্ষণাৎ হাত ভেরতে এনে দরজা দিল। দেখল একটা থ্রি পিস। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। পরপরই শাওয়ার শেষ করে কাপড় পাল্টে, ফারদিনের কাপড় ধুয়ে বের হলো। ফারদিন সোফায় বসে ছিল। পায়েল বের হতেই তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি স্থির করে উঠে দাঁড়াল। পায়েল বিব্রত হলো। আবারও সে উদাম গায়ে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি সরিয়ে নিল সে। ফারদিন ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটিয়ে আরও একটু এগিয়ে গেল। পায়েল যেন নড়তে ভুলে গেল। হাত বাড়াল সে, এক টানে পায়েলের চুল থেকে তোয়ালে ছাড়িয়ে নিল। পরপরই নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়াল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“আমি আসার আগে রুম থেকে বের হবে না। কেউ ডাকলেও না। মনে থাকবে?”

পায়েল বহু কষ্টে মাথা দোলায়। দৌড়ে ব্যালকনিতে চলে যায়। ফারদিন কে ওভাবে কাছে আসতে দেখে দম বন্ধ হয়েই যাচ্ছিল তার। উল্টো পাল্টা চিন্তা আসছিল মনে! সে লম্বা একটা শ্বাস নিল। টিশার্ট, ট্রাউজার মেলে দিয়ে রুমে এসে চুপ করে বসে রইল।

ফ্রেশ হয়ে বের হলো দৃষ্টি। টেবিলের উপরে রাখা ফোনটার দিকে নজর যেতেই সে এগোলো। হাতে নিয়ে দেখল রোজকার মতন রেজিস্টার্ড নম্বর থেকে অসংখ্য কল। যেন ব্যক্তিটি বিরক্ত হয় না একটুও। একটি মেসেজও এসেছে। মেসেজটি পড়েই সে থম মে’রে রইল।

“ফোন না ধরে তুই কি বোঝাতে চায়ছিস? তুই আমাকে তোর জীবন থেকে এক্কেবারে আউট করে দিয়েছিস? তবে চোখ খুলে দেখে রাখ, এই আফরান থেকে তোর মুক্তি নেই। আমার সাথে কথা বন্ধ করে কি ভুলটাই না করলি তুই, দৃষ! এর হিসেব আমি দেশে ফিরে গুনে গুনে নেব। এখন ভালো মতন শান্তিতে ঘুমিয়ে নে। তোর ঘুম হারাম করার জন্য খুব শীঘ্রই ফিরব আমি। তারপর? তারপর যে আমি কি করব দৃষ! সেটা আমি এলেই দেখতে পাবি। এখন বলব না কারণ তুই ভীষণ লজ্জা পাবি, আর তোর ওই লজ্জামাখা মুখ দ্যাখার জন্য আমি ওখানে নেই। আর হ্যাঁ! আমি মোটেও ভালো মানুষ নই।”

এতো হুমকি ধামকি পাবার পরও দৃষ্টি তার সাথে কথা বলবে না। যা খুশি করুক। খেয়ে তো আর ফেলবে না? সে ফোন জায়গায় রেখে নিচে নেমে এলো। আজ অফ ডে, সবাই একটু দেরিতেই উঠেছে। ডাইনিং টেবিলে বাবা ও ছোট বাবা বসে রয়েছেন। আর মা ও ছোট মা টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রাখছেন। ছোট রা কেউই এখনও আসেনি, শুধু সে ছাড়া। সে চেয়ার টেনে বসে বাবা ও ছোট বাবার সাথে কুশল বিনিময় করল। ফাহাদ আবরার ছোট মেয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“তুমি কি অসুস্থ, মা? শুকিয়ে যাচ্ছ যেন।”

দৃষ্টি একটু হেসে বলল,

“কই বাবা? তেমন কিছু নয়।”

মিসেস সীমা ভাজির বাটি শব্দ করে টেবিলে রেখে ফোড়ন কেটে বললেন,

“তেমন কিছু না? আপনি ঠিকই বলেছেন। দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে দেখেছেন? খাওয়া দাওয়া করে কিছু ঠিক মতো? অর্ধেক খেয়ে সব সময় উঠে যায়। পুরো খাবার খায় কখনও? তো ও অসুস্থ হবে না তো আমি হবো?”

ফাহাদ আবরার আদুরে কন্ঠে বললেন,

“আমাকে বলো, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? আমি নাহয় ডাক্তার দেখিয়ে আনব। পড়ালেখার চাপ একদম নেওয়ার দরকার নেই। ধীরে সুস্থে পড়লেই হবে। ঠিক আছে?”

দৃষ্টি মাথা দুলিয়ে বলে,

“জি, বাবা। আমার খারাপ লাগলে আমি বলব।”

একটু পরই ফারনাজ নেমে এলো। সে দৃষ্টির পাশে চেয়ার টেনে বসল। মিসেস সীমা পরিবেশন শুরু করলেন। আজ বন্যা এবং বর্ষণ একটু দেরিতে উঠবে। তারা পরে খেয়ে নেবে। ফারনাজ রুটি ছিড়ে মুখে দিল। দৃষ্টি সিঁড়ি দিকে পড়তেই কন্ঠস্বর উঁচিয়ে বলল,

“আরে পায়েল! তুমি কবে এলে? অনেক দিন পর এলে যে! কেমন আছ?”

দৃষ্টির হাত থেমে গেল। মিসেস সীমা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাজের মাঝে তিনি ভুলেই বসেছিলেন ছেলের কীর্তি। দৃষ্টি চোখ তুলে তাকায়। পায়েল ফারদিনের পেছনে কাচুমাচু হয়ে নামছে। পরনে দৃষ্টির সেই জামাটা যেটা আজ সে ফারদিন কে দিয়েছিল। তারা নেমে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। দৃষ্টি জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে পায়েলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় ঢুকছে না কিছু। ফাহাদ আবরার বললেন,

“পায়েল মামনি বসো। তুমি কখন এসেছ? রাতে তো তোমাকে ডিনারের সময় দেখলাম না।”

পায়েলের বুক দুরুদুরু কাঁপছে। কেউই হয়তো খেয়াল করেনি যে সে ফারদিনের ঘর থেকে বেরিয়েছে। ফারদিন গলা খাঁকারি দিল। মিসেস সীমা বো”মা বিস্ফোরণের জন্য মনে মনে তৈরি হলেন। ফারদিন স্পষ্ট কন্ঠে বলল,

“আমি বিয়ে করেছি, বাবা।”

ফাহাদ আবরারের হাত থেমে গেল। তিনি বোধহয় ভুল শুনলেন। বয়সও তো হয়েছে। চোখের পাওয়ার যখন কমেছে, কানেরটা কমতে কতক্ষণ? তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“কি বললে?”

ফারদিন পুনরায় নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

“আমি বিয়ে করেছি।”

মনে হলো ছোট খাটো একটা বাজ পড়ল তার মাথায়। তিনি ধপ করে দাঁড়িয়ে বললেন,

“এসব কি বলছ তুমি? সকাল সকাল এটা কেমন ধরনের মশকরা?”

মিসেস সীমার গলা শুকিয়ে গেল। তিনি পাশে থাকা মিসেস বিউটির হাত খপ করে ধরে ফেললেন। মিসেস বিউটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি মাথা নাড়লেন। তিনি যা বোঝার বুঝে গেলেন। ফারদিন টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বিয়ের কথা বলতে সে একটুও সংকোচ বোধ করছে না। সে সামনে তাকিয়েই বলল,

“মশকরা নয়, বাবা। তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি মশকরা করি না।”

ফাহাদ আবরার বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে ছেলেকে দেখছেন। তিনি কখনও ভাবতেই পারেননি যে ছেলে নিজে বিয়ে করে এসে, সে কথা তার সামনে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে বলবে। তিনি তার মধ্যে একটুও অপরাধবোধ দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি দাঁতে দাঁত পিষে বললেন,

“যা করার তা তো করেই ফেলেছ। এখন বলছ কেন? তুমি বিয়ে করেছ, বেশ। বউ আমি ঘরে তুলব না। তুমি বেরিয়ে যাও। যাকে তাকে আমি বাড়িতে জায়গা দেব না।”

পায়েলের চোখের কোণে জল জমে। কি হবে এখন? মিসেস সীমা স্বামীকে বোঝাতে চায়লেন,

“ওর কথাটা একটু শুনে দেখুন। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছিল। নয়তো ও এভাবে বিয়ে করর ছেলে নয়। আমার ছেলেকে আমি চিনি।”

ফাহাদ আবরার ধমকালেন,

“তুমি চুপ করো। ছেলেকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুমিই তুলেছ। এখন ছেলের হয়ে সাফাই গায়তে হবে না।”

অতঃপর ফারদিনের দিকে চেয়ে বললেন,

“তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বেরিয়ে যাও এক্ষুনি। পায়েল মামনি বসো। নাস্তা করে নাও।”

দৃষ্টি শীতল দৃষ্টিতে পায়েলের দিকে তাকিয়ে। পায়েল তার নজরে নজর মেলাতে পারছে না। সে মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। ফারদিন বলে,

“বউকে বাড়িতে তোলা হয়ে গিয়েছে, বাবা।”

ফাহাদ আবরার প্রচুর রেগে যাচ্ছেন। তার প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। রাগের চোটে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ছেন তিনি। চিৎকার করে বললেন,

“ডাকো তাকে। আর বের হও আমার বাড়ি থেকে। লজ্জা করে না? বাবার অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করে বউ ঘরে তুলতে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এই দিনও আমাকে দেখতে হলো।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৭

গমগমে বাড়ির পরিবেশ। সকলে থমকিত, চমকিত। বাড়ির ছেলের হঠাৎ এমন কাজ তাদের হজম করতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। তার উপর ফাহাদ আবরারের টগবগিয়ে ওঠা রাগ! সবটা মিলিয়ে মিসেস সীমার মাথা ভনভন করে ঘুরছে। মনে হচ্ছে এখনই ঠাস করে পড়ে যাবেন তিনি। একদিকে স্বামী অন্যদিকে ছেলে! কার পক্ষ নেবেন তিনি?
সকলের নাস্তা করা লাটে উঠেছে। আজ বোধহয় আর খাওয়া হবে না। ফাহাদ আবরার আবার চিৎকার করে উঠলেন,

“আমার প্রেশারের ওষুধ টা এনে দাও। প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে আমার, তোমার গুণধর ছেলের জন্য।”

মিসেস সীমা হম্বিতম্বি করে ছুটে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এলেন। ফাহাদ আবরার পানি দিয়ে তা টুপ করে গিলে নিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিলেন। ছেলের দিকে চেয়ে বললেন,

“তুমি এখনও আমার বাড়ি থেকে বের হওনি?”

ফারদিন কপাল চুলকে বলল,

“আগে আমার বউকে দোয়া দাও। তারপর যাচ্ছি। পায়েল, যাও সবাইকে একে একে সালাম করো।”

আরও একটা বাজ পড়ল যেন। পায়েল ইতোমধ্যে কেঁদে কেটে গাল ভিজিয়ে ফেলেছে। আকাশ পাতাল বিভিন্ন কথা ভেবে, মনে মনেই হাউমাউ করে কেঁদেছে। ফারদিনের কথায় সে কেঁপে ওঠে। শুকনো ঢোক গিলে এগিয়ে যায়। কাঁপা কন্ঠে বলে,

“আ আসসালামু আলাইকুম, আঙ্কেল।”

ফারদিন ধমক দেয়,

“আঙ্কেল কি? বাবা বলো।”

পায়েল কেঁদেই ফেলল। নাক টেনে বলল,

“আসসালামু আলাইকুম, বাবা।”

ফাহাদ আবরার হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন। তিনি কি বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। পায়েল মাথা নিচু করে কান পেতে রইল জবাব পাবার আশায়। সম্বিত ফিরে পেয়ে ফাহাদ আবরার হকচকিয়ে বললেন,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি! মানে, তুমি পায়েল কে বিয়ে করেছ?”

ফারদিন সাঁই দেয়। পরপরই বলে,

“পায়েল চলো। গুছিয়ে নাও।”

মিসেস সীমা ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাত উঁচিয়ে মাথায় বুলিয়ে বললেন,

“গুছিয়ে নেবে কেন, বাবা?”

“বাবা’ই তো বলল চলে যেতে।”

পায়েল এখনও কেঁদে যাচ্ছে চুপচাপ। ফাহাদ আবরার নরম হলেন। আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় রাগ তার নিমিষেই ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি বললেন,

“কাঁদছ কেন, মামনি? কোথাও যাচ্ছ না তোমরা।”

সকলে অবাক হয়ে তাকায়। পায়েল অবাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ফাহাদ আবরার আলতো হেসে বলেন,

“আমি তো ভেবেছিলাম এই বখাটে না জানি কোন মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। কেমন মেয়ে, ওর মতোই ছন্নছাড়া কিনা? কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে ও জীবনে একটা ভালো কাজ করেছে। তোমাকে বিয়ে করেছে। তোমার মতো লক্ষ্মী একটা মেয়ে ছেলের বউ হলে, না মেনে থাকা যায়? তুমি তো আমার আরেকটা মেয়ে।”

খুশি হলো সকলে। খুশিতে পায়েল আবারও কেঁদে ফেলল। ফাহাদ আবরার তার মাথায় হাত রেখে বললেন,

“কেঁদো না। আর কখনও কাঁদবে না তুমি। এখন বসো তো আমার পাশে, নাস্তা করে নাও।”

মিসেস সীমা এবং মিসেস বিউটি আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পরিবেশনে। ফারদিন স্মিত হেসে বসে পড়ে। সে জানে তার বাবা পায়েল কে কখনো ফেরাবে না। খাওয়ার মাঝে সকলে জেনে নেয় হঠাৎ বিয়ে হবার ঘটনা। ফারদিন বলে,

“আমি ট্যুরে গিয়েছিলাম, সেই সুযোগে ওর মামা মামীরা জোর করে ওর বিয়ে ঠিক করেছিল এক বুড়োর সাথে। কিন্তু আমি জেনে যায়। সব সময় ওর বাড়ির আশে পাশে আমার পাহারা থাকত। কারণ আমি ওর মামা মামী দের একদম বিশ্বাস করি না। কাজের লোককে টাকা খাইয়ে বিয়ের খবর জেনে যায় পাহারা দেওয়া ছেলেটা। তারপর আমাকে জানায়। আমি তখনই চলে আসি। পরিকল্পনা করে বুড়ো কে কিডন্যাপ করে তার জায়গায় আমি যায়। এখানে আমাকে আমার সিনিয়র ভাইয়েরাও অনেক সাহায্য করেছে।”

সকলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ফাহাদ আবরার বললেন,

“যা হবার হয়ে গিয়েছে। পায়েলের এখন একটাই পরিচয় সেটা হচ্ছে ও আবরার বাড়ির ছেলের বউ। ওর কোনো অযত্ন এখানে হবে না। তোমার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলেই বড় করে রিসিভশান হবে।”

পায়েলের চোখের কোণে জল জমে। এতো সুখ সে পাবে, কখনও কল্পনাও করেনি। ভেবেছিল অত্যাচার সহ্য করতে করতে এক সময় হয়তো শেষ হয়ে যাবে। নিজের একটা পরিবার পাবে সে ভাবেইনি কোনোদিন।

ফারদিনের বন্ধুরা আগেই প্রস্থান করেছে। ফাহাদ আবরারের রোষের মুখে তারা পড়তে চায়নি। মিসেস সীমা রান্নাঘরে যেতেই ফ্রিজ ঘেঁটে যা পেয়েছে তাই মুখে দিয়ে ভেগেছে। কারণ তিনি খালি মুখে যেতে দিচ্ছিলেন না এবং এটাও কথা নিয়েছেন যে তারা খুব শীঘ্রই দাওয়াতে আসবে।

খাওয়া শেষ হতেই দৃষ্টি দাঁড়াল না এক মুহূর্তও। গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেল। পায়েল করুণ দৃষ্টিতে সেদিকে দেখল। ফারনাজ যাবার আগে তাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানিয়ে গিয়েছে। পায়েল তার ভাইয়ের বউ হয়েছে এতে তার আনন্দের শেষ নেই। খাওয়া শেষে মিসেস সীমা ও মিসেস বিউটির সাথে কাজে হাত লাগাল। যদিও তারা মানা করেছিলেন। গুছিয়েই সে দৃষ্টির রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। ইতস্তত করে ভেতরে প্রবেশ করবে কি করবে না ভেবে।

“একদিনের মধ্যেই আমি তোর এতো পর হয়ে গেলাম যে আমার রুমে আসবি কিনা সেটা তোকে দাঁড়িয়ে ভাবতে হচ্ছে! ভাবীর কাছে কি ননদ একদিনের মধ্যেই বিরক্তির মানুষ হয়ে গেল?”

দৃষ্টির কন্ঠে চমকে ওঠে সে। নিজেকে সামলে দরজা ঠেলে প্রবেশ করে। দৃষ্টি ভাবলেশহীন ভাবে মুখের সামনে বই মেলে ধরে বসে আছে বিছানায়। পায়েল তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মৃদু কন্ঠে ডাকে,

“দৃষ।”

দৃষ্টি মুখের সামনে থেকে বই সরায়। অতঃপর অবাক হবার ভান করে বলে,

“আরে ভাবী! দাঁড়িয়ে আছেন কেন? প্লিজ বসুন। নাকি ননদের ঘরে আপনার বসতে অসুবিধা আছে?”

পায়েল ধপ করে তার সামনে বসে তার হাত চেপে ধরে। ছলছল চোখে চেয়ে বলে,

“এভাবে কথা বলছিস কেন, দৃষ? আমি কি কিছু করেছি?”

“তোর বাড়িতে এতো সমস্যা হচ্ছিল তা আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করিস নি? ভাইয়া যদি ঠিক সময়ে যেয়ে না পৌঁছাত তবে কি হতো? বুড়োকে বিয়ে করতিস?”

“আমি কিছুই বুঝিনি। ওরা আমার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছিল। আমি ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে ওরা এমন নিচ পরিকল্পনা করে রেখেছে। তারপর যখন জানলাম তখন আমার ফোনটা কেড়ে নিল। বিশ্বাস কর আমার কোনো উপায় ছিল না। আমি যে কতটা অসহায় ছিলাম তা তোকে বলে বোঝাতে পারব না। প্লিজ আমার উপর রাগ করে থাকিস না। তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে বল?”

বলতে বলতে সে দু ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিল। দৃষ্টি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে তাকে আগলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“তোর কান্নার দিন শেষ। আমি বলেছিলাম না যে তোর জীবনে কেউ আসবে? তবে সে কেউটা যে আমারই ভাই হবে সেটা ভাবিনি।”

একটু থেমে সে পায়েলের চোখের কোণ মুছে দিয়ে বলে,

“তবে ভালোই হলো, আজ থেকে তুই আমি একসাথে থাকব। একসাথে কলেজ যাব, একসাথে আসব।”

পায়েল হেসে ফেলল। নাক টেনে রসিকতা করে বলল,

“তা তো হবে না ননদিনী। খুব তাড়াতাড়ি তোমার বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দেব। এসব ননদের জ্বালা সহ্য করতে পারব না বাপু।”

একটু থেমে ফিসফিসিয়ে বলে,

“বিয়ে তো হয়ে আছেই। সে এলেই তুই টাটা বাই বাই।”

দৃষ্টি মুখ গম্ভীর করে বলল,

“সহ্য করতে হবে। কোথাও যাচ্ছি না আমি। সে এলেও না। যাও ভাবী, আমার জন্য ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত নিয়ে এসো। নাহলে কিন্তু ভাইয়ের কাছে তোমার নামে নালিশ করে মা’র খাওয়াব।”

পায়েল একটু ভয় পাবার ভান করল। পরপরই দুজন শব্দ করে হেসে ফেলল। ফারদিন পায়েল কে ডাকতে এসে রুমের বাইরে থেকে এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখে নীরবে সরে গেল। যা গেল মেয়েটার উপর দিয়ে, একটু রিল্যাক্স হোক।

গাড়িটি সামনে থামতেই ফারনাজ দাঁড়িয়ে গেল। এতো দিনে তার চেনা হয়ে গিয়েছে। গাড়ি থেকে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি নেমে দাঁড়াতেই সে দু হাত বাড়িয়ে দিল। ব্যক্তিটি বোধহয় একটু হাসল। কিন্তু তার সানগ্লাস এবং মাস্ক ভেদ করে তা বেরিয়ে আসতে পারল না। লোকটি আরও একটু এগিয়ে তার চশমা খুলে নিয়ে চোখ বাঁধল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আর হাত বাঁধার প্রয়োজন নেই।”

চোখ বেঁধে দিয়েই তাকে গাড়িতে বসাল। গাড়ি চলতে শুরু করলে ফারনাজ জিজ্ঞেস করল,

“আপনি আজ হাত বাঁধলেন না কেন?”

“কারণ আমি জানি তুমি শান্ত মেয়ে হয়ে বসে থাকবে।”

“তবে চোখটা কেন বাঁধলেন? এমনিতেও তো আপনার চেহারা বোঝার কোনো উপায় থাকে না।”

“গাড়িতে ওঠার পর আমি সানগ্লাস মাস্ক খুলে রাখি।”

বোকা ফারনাজের মাথায় একটা বিষয় আসতেই সে হাত বাড়িয়ে চোখের বাঁধন খোলার চেষ্টা করল। তবে পারল না। লোকটার হাসির শব্দ পেল। যেন সে ভীষণ মজা পেয়েছে।

“বোকা মেয়ে! আমাকে কি তোমার বোকা মনে হয়? এই বাঁধন এমন ভাবে দেওয়া যেটা আমি ছাড়া আর কেউ খুলতে পারবে না।”

ফারনাজ মুখ কালো করে ফেলল। বলল,

“আমাকে এভাবে বসিয়ে রেখে আপনার কি লাভ?”

লোকটা কেমন অদ্ভুত ভাবে বলল,

“শান্তি পাই। আমার সকল ক্লান্তি দূর হয়।”

ফারনাজ মুখ হা হয়ে গেল। তাকে এভাবে কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে কীসের শান্তি তার? কেমন ক্লান্তি দূর?

“এতো ভেবো না। তোমার মোটা মাথায় ঢুকবে না।”

অপমানে মুখ থমথমে করে ফারনাজ তার ভাবনা বাদ দিল। এই লোকটা শুধু তাকে কথায় কথায় অপমান করে। ফারনাজের তো ইচ্ছে হয় লোকটাকে তুলে একটা আছাড় মা’রতে। পরপরই নিজের সাইজ আর লোকটার সাইজ তুলনা করে সে তার ইচ্ছে থেকে পিছিয়ে আসে। তার মতো শরীর নিয়ে অত বড় দানবীয় শরীর তুলে আছাড় দেওয়া ইহকালে সম্ভব নয়। ছোট্ট শ্বাস ফেলে সে বসে থাকে। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে এই লোকের সঙ্গ তার ভালো না লাগলেও খারাপ লাগে না।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৮

চকচকে এমন সুন্দর একটা দিনে ফারদিন পায়েল কে নিয়ে বেরিয়েছে। পায়েল এখনও জানে না যে তারা যাচ্ছে কোথায়। সকালে নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়েছে তারা। সাথে একটা কাপড়ের ব্যাগও আছে। পায়েল তাকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখাতে পারল না। শুধু চলল সাথে সাথে।
নিজের বাড়ির সামনে রিক্সা থামতেই পায়েল হকচকিয়ে গেল। ফারদিন হঠাৎ এখানে কেন এলো? তাও আবার ব্যাগ গুছিয়ে। ফারদিন রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। ব্যাগ হাতে নিয়ে দেখল পায়েল এখনও চুপ করে বসে আছে। সে একটু জোরে বলল,

“নামছ না কেন?”

পায়েল ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে নেমে পড়ল। ফারদিন ব্যাগ হাতে এগোলো। পায়েল তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে মিনমিন করে বলল,

“আপনি হঠাৎ এখানে নিয়ে এলেন কেন?”

ফারদিন দাঁড়িয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলল,

“শশুর বাড়ি বেড়াতে এসেছি। বউকে ফেলে রেখে আসতাম কীভাবে?”

পায়েল ড্যাব ড্যাব করে তাকায়। ফারদিন এক আনাও পাত্তা না দিয়ে গটগটিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। হাক ছাড়ে,

“বড় চাচী শাশুড়ি! ছোট চাচী শাশুড়ি! আরে কই গেলেন সব? বাড়ির জামাই এসেছে, সে দিকে কারোর খেয়াল আছে?”

পায়েল এতক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। ফারদিনের হাক ডাক শুনে অবাক হলো সে। এমন আচরণ তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একদমই যায় না। ফারদিনের চিৎকার শুনে বড় চাচী, ছোট চাচী বেরিয়ে এলেন। বিরাট ধাক্কা খেয়েছেন তারা। কস্মিনকালেও হয়তো ভাবেননি যে আপদ আবার ঘাড়ে চেপে বসবে। বড় চাচী মেকি হেসে বললেন,

“আরে জামাই বাবা যে! হঠাৎ কি মনে করে?”

ফারদিন হাতের ব্যাগটা ফেলে সোফায় ধপ করে বসল। ক্লান্তির শ্বাস ফেলে বলল,

“এটা কেমন প্রশ্ন বড় শাশুড়ি? বিয়ের পর যে মেয়ে জামাই বেড়াতে আসে সেটা আপনারা জানেন না? আমরা এসেছি আপনাদের তো খুশি হওয়া উচিত। এতো কষ্ট করে এসেছি কোথায় শরবত টরবত দেবেন তা না করে দাঁড়িয়ে আছেন! বাই দ্য ওয়ে! আপনারা আমাদের দেখে খুশি হয়েছেন তো?”

দু’জনে জোর পূর্বক হেসে ঘাড় নেড়ে বোঝাল যে তারা খুশিতে ম’রে যাচ্ছে। ফারদিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“ঠিক আছে। আমি রুমে যাচ্ছি বিশ্রামের জন্য। ছোট শাশুড়ি ব্যাগটা উপরে দিয়ে আসবেন। আর বড় শাশুড়ি দ্রুত রান্নার আয়োজন করুন।”

বলে সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। পায়েলের রুমের দরজা খুলে সে এক পলক দেখে আবার নেমে এলো। আবারও সোফায় বসে বলল,

“নাহ! সব পরে হবে। আগে রুমটা ভালো করে ঘসে মেজে পরিষ্কার করে চকচকে করে দিন। যান।”

তাদের মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। পায়েল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল দেখছে। বড় চাচী হেসে বললেন,

“ওইটুকু তো পায়েলই করে দিতে পারবে। পায়েল, তুই যা পরিষ্কার করে দে।”

ফারদিন কড়া কন্ঠে বলল,

“না। আপনারা যাবেন। আর পায়েল এখানে বসে আমার সেবা করবে। আপনারা যাবেন নাকি আমি!”

ছোট চাচী তাড়াতাড়ি বললেন,

“তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না, বাবা। আমরা এক্ষুনি সব করে দিচ্ছি। তুমি বসো, হ্যাঁ? আর পায়েল, জামাই বাবাকে ঠান্ডা পানি দে। মাথা ঠান্ডা হবে। এতো মাথা গরম করে চলে নাকি? চলো, আপা চলো।”

দু’জনে উপরে চলে গেল। পায়েল ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলে ফারদিন বলে,

“হা করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? স্বামী যে কষ্ট করে এলো তার খেয়াল আছে? যাও ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো। পারলে আমার মাথায় ঢালো।”

পায়েল মাথা নিচু করে রান্না ঘর থেকে পানি এনে দিল। ফারদিন তা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে টি টেবিলে রেখে দিল। পায়েল বলল,

“আপনি বসুন, আমি একটু ওনাদের সাহায্য করি।”

“তার কোনো দরকার নেই। আমার পাশে চুপ করে বসে থাকবে। তারপর আমি গেলে আমার সাথেই রুমে যাবে এবং আমার সাথেই রুম থেকে বের হবে। আমি ছাড়া একটা মুহূর্তও না। তাদের তো জামাইয়ের ভীষণ শখ ছিল। তাই তোমাকে ধরে বিয়ে দিচ্ছিল। এবার একটু জামাইকে আপ্যায়ন করুক। বুঝেছ?”

পায়েল মাথা কাত হয়ে সাঁই জানিয়ে তার পাশে বসে। যে কাজ বড় চাচী ছোট চাচী জীবনেও করেননি আজ তাদের তাই করতে হচ্ছে। পায়েলের এতে একটুও খারাপ লাগছে না। হয়তো এটা হবারই ছিল। ধর্মের কল তো বাতাসে নড়ে, তাই না?

বাড়িতে তেমন কিছু না থাকায় মাছ ডিম দিয়ে আয়োজন করেছেন তারা। এতে ফারদিন একটু রাগারাগী করল। এটা কেমন জামাই আদর বলে? না গরু না খাসি না মুরগি। তার রাগের তোপে ভেজা বেড়াল হয়ে গেল সব। বড় চাচী বললেন,

“এখন এই খাও বাবা। তারপর বিকেলে তোমার বড় শশুর কে পাঠাব বাজারে।”

ফারদিন খাওয়া শুরু করল। পাশে জোর করে পায়েল কে বসিয়ে রেখেছে। না চাওয়া সত্ত্বেও তাকে খেতে হচ্ছে। যে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছেন তার দুই চাচী। ফারদিন মাছটা একটু মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিল। নাক কুঁচকে বলল,

“ওয়াক থু! এ কোনো রান্নার জাত হলো? এতো লবন! মাছটাও কাঁচা মনে হচ্ছে। আমি এখন খাব টা কি?”

বড় চাচী কাঁচুমাচু হয়ে বললেন,

“ডিম দিয়ে খাও, বাবা।”

ফারদিন সেটাও মুখে নিয়ে ফেলে দিল। টেবিলের উপর এক থাবা বসিয়ে বলল,

“কি রেঁধেছেন এগুলো? এসব মানুষে খায়? আপনারা এসব খান! এক্ষুনি নতুন কিছু বানিয়ে নিয়ে আসুন। নয়তো পেট খালি থাকলে আমার মাথা ভীষণ গরম হয়ে যায়। কি থেকে কি করে বসব জানি না।”

ভয় পেলেন তারা। ছুটে চলে গেলেন রান্নাঘরে ভালো করে কিছু বানানোর প্রচেষ্টায়। পায়েল খাবার খেয়েছে এবং তার কাছে মোটামুটি ঠিক লেগেছে। এমন অখাদ্য নয় যে মুখে তোলা যাবে না। সে বলল,

“খাবার তো ভালোই আছে। আপনি খেতে পারছেন না কেন?”

“তোমাকে এতো ভাবা লাগবে না। খাওয়া হয়ে গিয়েছে?”

সে মাথা নাড়ল। তার খাওয়া শেষ। ফারদিন আবার বলে,

“রুমে যাও তাহলে। শুয়ে একটা ঘুম দেবে। আমি খাওয়া শেষ করেই আসছি। যাও।”

তার আদেশে সে চুপচাপ উঠে রুমে চলে গেল। হঠাৎই তার মনে পড়ল আগেরকার দিনের কথা। খাবারে সামান্য একটু লবণের পরিমাণ কমবেশি হলে তাকে তা আবার রান্না করতে হতো। যতক্ষণ না তাদের মনে শান্তি হতো ততক্ষণ তাকে একই খাবার বার বার বানাতে হতো। এর সাথে তো কটু কথা এবং গায়ে হাত তোলাও ছিল। এসব কথা মনে পড়তেই পায়েল শান্ত হয়ে গেল। সকল চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে সে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। এবার থেকে ফারদিন যা ইচ্ছে করুক, সে কিছু বলবে না আর ভাববেও না।

আজ দৃষ্টি এবং পায়েল একসাথে কলেজে এসেছে। খুব ভালো ভাবেই তারা ক্লাসগুলো সম্পন্ন করল। তবে বের হবার সময় বাঁধ সাধল মৃন্ময়। সে চওড়া হেসে বলল,

“কেমন আছ, দৃষ্টি?”

দৃষ্টি সৌজন্য হেসে বলল,

“ভালো আছি, স্যার। আপনি কেমন আছেন?”

“আমিও ভালো আছি। কদিন বেশ ব্যস্ত ছিলাম বুঝলে? তাই তোমার সাথে দ্যাখা করা হয়ে ওঠেনি।”

দৃষ্টির মনে হলো মৃন্ময় তাকে কৈফিয়ত দিচ্ছে। যেখানে সে কিছুই জানতে চায়নি এবং মৃন্ময় কলেজে আছে কি নেই এটাও তার নজরে আসেনি। সে জোরপূর্বক হাসল একটু। পরপরই আফরানের কথা মনে পড়তেই গা হিম হয়ে গেল। সে আফরানের স্ত্রী, তার সাথে মৃন্ময়ের এমন আচরণ কখনোই সাঝে না। মৃন্ময় আবার বলল,

“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। তোমার কি সময় হবে?”

দৃষ্টি ঢোক গিলল। সে ভেবে দেখত যদি সে আফরানের স্ত্রী না হতো। কিন্তু আফরান তাকে বেঁধে রেখে গিয়েছে, এখন কোনো কিছুই সম্ভব নয়। অসম্ভব! পায়েল কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের শ্রোতার ভূমিকা পালন করছে। এই স্যারের হাব ভাব দেখেই তার মনে হয় যে দৃষ্টিকে সে খুব পছন্দ করে। আর সে একশো শতাংশ নিশ্চিত। তবে দৃষ্টি আফরান স্যারের বউ। এটা জানতে পারলে যে তিনি কি ঝটকাটাই না খাবেন! পায়েলের ভীষণ মায়া হলো। আহারে! তাদের বেচারা মৃন্ময় স্যারটা।
দৃষ্টি আমতা আমতা করে বলল,

“না মানে স্যার। আমাকে তো বাড়িতে যেতে হবে। একটু দেরি করলেই বাড়িতে খুব রাগারাগী করে। কলেজের সময়টুকু ছাড়া আমার বাইরে থাকা একদম অনুমতি নেই।”

মৃন্ময় একটু আহত হলো। সে অনেক আগে থেকেই দৃষ্টির সাথে আলাদা কথা বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ তার এখনও আসেনি। নানা বাহানা দিয়ে দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে এবং দৃষ্টির সাথে সেটা আলোচনা করতে চায়ছিল। তবে তা হলো না। এখন তাকে আলোচনা ছাড়াই সরাসরি পদক্ষেপ নিতে হবে। দৃষ্টি মাথা নিচু করে বলল,

“স্যরি স্যার।”

মৃন্ময় মৃদু হেসে বলল,

“কোনো সমস্যা নেই। বাড়িতে যাও, সাবধানে যেও।”

বলেই মৃন্ময় প্রস্থান করল। পায়েল হতাশ শ্বাস ফেলে বলল,

“ওনাকে এভাবে ফিরিয়ে দিলি কেন? আমি শিয়র আজ তোকে প্রপোজ করত।”

দৃষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“হ্যাঁ আর একজন এসে আমার ঘাড় মটকে দিক। যত্তসব অসহ্য! ওই একটা লোকের জন্য আমার জীবন ঝালাপালা হয়ে গেল।”

“ঝালাপালা হয়ে গেল? তাকে এত্তো ভালোবাসিস, আড়ালে কাঁদিস। চলে গিয়েছে বলে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেও কবে ফিরবে তার জন্য দিন গুনিস। আর আমাকে এসব বিশ্বাস করতে বলিস?”

দৃষ্টি রেগে কটমটিয়ে চেয়ে বলে,

“কচু ভালোবাসি। আমি কাউকে ভালোবাসি না। আমার এতো ঠ্যাকা পড়েনি যে তাকে ভালোবাসতে যাব।”

সে হনহনিয়ে এগোলো। পায়েল ঠোঁট চেপে হেসে তার পিছু গেল। সে তো সব দ্যাখে, দৃষ্টির চাল চলন। মাঝে মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। লুকিয়ে তাকে কাঁদতেও দেখেছে। অভিমান অভিযোগ পুষে রাখতে গিয়ে দৃষ্টি মাঝে মধ্যে নীরবে কাঁদে। আফরানের অনুপস্থিতি যে তাকে পোড়ায় তা পায়েল খুব ভালো ভাবেই বোঝে।

চলবে,

সে আমারই পর্ব-২৩+২৪+২৫

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৩

পূর্ণিমার রাত। আকাশে জ্বল জ্বল করছে থালার মত চাঁদ আর অসংখ্য নক্ষত্ররাশি। এই রাতেই তো কপোত কপোতীরা চন্দ্র বিলাস করে থাকে। একে অপরের বাহুতে আবদ্ধ হয়ে চাঁদ দ্যাখে। এক সময়ে হয়তো সময়েরও খেয়াল থাকে না। কেটে যায় মুহূর্তর পর মুহূর্ত। এই রোমাঞ্চকর মুহূর্তে তূরাগ একা। ব্যালকনিতে নিজের গিটার কোলে নিয়ে বসে আছে সে। এটাই তার নিঃসঙ্গতার একমাত্র সঙ্গী। তার যখন চন্দ্র বিলাস করার মানুষটি এসে যাবে তখনও এই গিটার তার সাথে থাকবে। বড্ড আপন যে! সে টুং শব্দে আওয়াজ তোলে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে ওঠে বোকা বোকা সুশ্রী চেহারা। প্রসস্ত হাসে সে। হঠাৎ করেই সুর তোলে।

“লিখে যাই, গল্প না থাকুক
ভুলে যাই যন্ত্রণাটুকু,
মন আমার তোর ইশারায়
খুঁজে বেড়ায় স্বপ্ন স্বপ্ন দেশ।

দূরে যায়, অল্প অল্প সে
সত্যি না, গল্প গল্প সে,
মন আমার সবই হারায়
খুঁজে বেড়ায় তোরই যে আবেশ।

দিন শুরু তোর কথায়
তুই ছাড়া নামে না রাত চাঁদ থেকে।

উড়েছে মন, পুড়েছে মন
যা ছিল আমার সবই তোর হাতে।

আকাশে দৃষ্টি তোর, বৃষ্টি তোর
মনে মেঘ জমে,
জানালার হাওয়াতে, ছাওয়াতে
মনের রোদ কমে।

চলে যাই দু’চোখের পথে
বলে যাই কথা তোরই যে,
মন আমার ভবঘুরে যাবে দূরে
তোকে না পেলে।

কেন তুই দূরে দূরে বল
আকাশে উড়ে উড়ে চল,
মিশে যাই এই আকাশে তোর বাতাসে
পাখনা মেলে।

দিন শুরু তোর কথায়
তুই ছাড়া নামে না রাত চাঁদ থেকে।

উড়েছে মন, পুড়েছে মন
যা ছিল আমার সবই তোর হাতে।

আকাশে দৃষ্টি তোর, বৃষ্টি তোর
মনে মেঘ জমে,
জানালার হাওয়াতে, ছাওয়াতে
মনের রোদ কমে।”

পুরো গানটা শেষ করে সে থামে। চোখ বন্ধ করে ভাবে এখনও। তার নিঃসঙ্গ জীবনে ভালোবাসার রং লাগতে পারে সে ভাবেইনি কখনও। তাও কে? একটা বোকা, চঞ্চল মেয়ে। যা সম্পূর্ণ তার স্বভাবের বিপরীত!

বেশ কদিন ধরে বাড়ির লোকের হাবভাব ভালো লাগছে না পায়েলের। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে এবং আড়ালে ফুসুর ফুসুর করে। নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে কোনো ষড়’যন্ত্র করা হচ্ছে? কিন্তু কি করবে তারা? এবার কি একেবারেই মে’রে ফেলবে? তাচ্ছিল্য হাসে পায়েল। যে ভেতর থেকে অনেক আগেই ম’রে গিয়েছে তাকে আর কি মা’রবে? তবে তার মনের মধ্যে কেমন একটা হচ্ছে। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে।

ফারদিন এলাকায় নেই। এটা কোনো ভাবে জানতে পেরেছিল সোহেল। সেই থেকেই তারা পাকাপাকি ভাবে পায়েল কে বিদায় করার জন্য পরিকল্পনায় মেতেছে। ফারদিন নেই মানে পায়েল কে বাঁচানোর কেউ নেই। এই মোক্ষম সুযোগ কে হাতছাড়া করবে? তবে তাদের এই পরিকল্পনা আড়াল থেকে শুনে ফেলল ছোট চাচার ছেলে মাহিন। সে পায়েল বলতে পাগল। পায়েল আপুই একমাত্র ব্যক্তি যে তার সাথে সময় কাটায়। খুব আদর করে। পায়েল কে নিয়ে এমন কথা শুনে আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে গেল তার। দৌড়ে গেল পায়েলের রুমে।
পায়েল কেবল বই নিয়ে বসেছিল। এমন সময় দৌড়ে প্রবেশ করে হাঁপাতে লাগল সে। পায়েল তার মাথায় হাত রেখে বলল,

“কি হয়েছে ভাই? ওভাবে দৌড়ে এলি কেন?”

“আপু! আপু!”

“কি হয়েছে, বল?”

“আ আপু, ওরা তোমার..”

সে আর বলতে পারল না। হাজির হলো বড় চাচী এবং ছোট চাচী। বড় চাচী দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,

“দেখেছিস ছোট? কি বলেছিলাম আমি? বলেছিলাম না যে ও’কে চোখে চোখে রাখ, নাহলে আমাদের সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দেবে!”

ছোট চাচী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে। তার হাত খপ করে চেপে ধরে বললেন,

“অ’মানুষ পেটে ধরেছি আমি। চল তোকে আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে দিচ্ছি। আর কোনো দিনও সাধের পায়েল আপুর কথা মুখে আনবি না।”

তিনি মাহিনকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। তার চুপসানো ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখেও পায়েল কিছু করতে পারল না। নিশ্চয়ই এখন তাকে খুব মা’রবে ছোট চাচী? বড় চাচী বললেন,

“তোর ফোনটা কোথায়?”

পায়েল ভ্রু কুঁচকে বলল,

“কেন? আমার ফোন দিয়ে তোমার কি কাজ?”

বড় চাচী রেগে গেলেন তবে সেটা প্রকাশ না করেই টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতিয়ে নিলেন। শয়তানি হেসে বললেন,

“খুব তেজ না? তোর বিষ দাঁত ভাঙার ব্যবস্থা করেছি। আর মাত্র কিছুক্ষণ। তারপর?”

কন্ঠ নিচু করে বললেন,

“তোকে বেচে দেব।”

বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন। যাবার আগে বাইরে থেকে দরজা আটকাতে ভুললেন না। পায়েল বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। বড় চাচীর কথা গুলো পুরোপুরি ভাবে মস্তিষ্কে আঘাত হানতেই সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। পায়েল ভাবতেও পারেনি তারা এত নিচে নামতে পারে! এখন কি করবে সে? ফোনটাও নিয়ে গেল, এখন কি হবে? পায়েল কে তাড়ানোর জন্য তারা এমন একটা জঘন্য খেলা খেলতেও পিছ পা হলো না! ছোট চাচা বাড়িতে নেই, অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছেন কিছু দিনের জন্য। তাকে এখন কে বাঁচাবে? দরজা ধাক্কাধাক্কি করল কিছুক্ষণ, চেঁচাল। কিন্তু কেউ শুনল না। চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই ফারদিনের চেহারা স্বচ্ছ জলের ন্যায় ভেসে উঠল। ফারদিন! একমাত্র ফারদিনই পারে তাকে বাঁচাতে। কিন্তু তার সাথে তো সেদিনের পর থেকে আর কথাই হয়নি, আর না যোগাযোগ। পায়েল নিজের মাথার চুল খামচে ধরল। সব শেষ হয়ে যাবে, সব।

রাতে বড় চাচী আবার রুমে এলেন। হাতে তার শাড়িসহ আরও কিছু জিনিসপত্র। পায়েল নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। বড় চাচী তাড়া দিয়ে বলেন,

“এগুলো পরে তৈরি হয়ে নে। তাড়াতাড়ি।”

পায়েল তাকিয়ে দেখল বিয়ের শাড়ি! হতভম্ব হয়ে গেল সে। সেগুলো সব ছুড়ে ফেলে চেঁচিয়ে বলল,

“কি করতে চায়ছ তোমরা? আমি কিছুতেই এসব পরব না।”

ক্ষেপে গেলেন মহিলা। কষিয়ে কয়েকটা চ’ড় বসালেন তার গালে। চুলের মুঠি চেপে ধরে বললেন,

“পরবি না মানে! এক্ষুনি এসব পরবি। নাহলে কি হবে জানিস তো? মাহিনকে মা’রতে মা’রতে বোধহয় মে’রেই ফেলবে ছোট। এমনিতেও আধম’রা হয়ে আছে।”

পায়েল বুক কেঁপে উঠল। ছোট্ট চেহারা কল্পনা করতেই চোখের বাধ ভাঙল। গাল বেয়ে অশ্রু নামতে লাগল। ছোট্ট ছেলেটাকেও এরা ছাড় দিচ্ছে না? কেমন পাষাণ এরা? পায়েল এদের কিছু না হলেও মাহিন তো এদের ছেলে! ঘৃণায় বিষিয়ে ওঠে তার মন, মস্তিষ্ক।

আজ পায়েলের বিয়ে। সকলে মিলে এক পঞ্চাশোর্ধ বুড়োর সাথে পায়েলের বিয়ে ঠিক করেছে। এতে অবশ্য তারা মোটা অংকের টাকা পেয়েছে। সহজ কথায় পায়েল কে তারা বিক্রি করে দিচ্ছে। সকলের চক্ষু অগোচরে এই রাতে তাদের আয়োজন। একটু হলেও তাদের আয়োজন করতে হচ্ছে। তাই কি? আপদ বিদেয় হলেই শান্তি। একটু পরেই বরপক্ষ চলে আসবে। হঠাৎ করেই বাইরে থেকে ঢাক ঢোল পেটানোর আওয়াজ এলো। প্রচন্ড জোরে বাজনা বাজছে বাইরে। তারা একে অপরের মুখে চাওয়া চাওয়ি করে। ভ্রু কুঁচকে ভাবে, এই বয়সে বুড়োর আমোদ ফুর্তির কমতি নেই। ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে বিয়ে করতে এসেছে। পর মুহূর্তে ক্ষিণ আতঙ্কিত হলো। লোকজন জানা জানি হয়ে গেলে আবার কিছু হবে না তো?
বাইরে বেরিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হলো তাদের। বড় চাচী, ছোট চাচী, বড় চাচা এবং সোহেল হা করে তাকিয়ে রইল। ব্যান্ড দলের সাথে নাচানাচি করছে এক দল ছেলেপেলে। আশ্চর্য জনক ব্যাপার হলো, বরবেশে থাকা বুড়ো লোকটাও নাচছে। তবে তার মুখটা পাগড়ির সামনে ঝুলন্ত ঝালরের নিচে ঢেকে গিয়েছে। বড় চাচী মাথায় চাপ প্রয়োগ করে মনে করলেন হিন্দি সিরিয়ালে তিনি এমন পাগড়ি দেখেছেন। তবে সামনাসামনি দেখে চমকে গিয়েছেন। বুড়ো কি হিন্দি সিরিয়াল দ্যাখে নাকি!

পায়েল পুতুলের ন্যায় ঘরে বসে আছে। তাকে বন্দি করে রেখে গিয়েছে বড় চাচী। ছোট্ট মাহিনের কথা ভেবে সে নিজেকে বধু রূপে সাজিয়েছে। কার জন্য সেজেছে সে জানে না। বাইরে থেকে আওয়াজ এসে তার কানে ধাক্কা খাচ্ছে। অবাক হলো সেও। আজকালকার যুগে এমন গান বাজিয়ে কে বিয়ে করতে আসে? সে একটু খেয়াল করে শুনতে পেল,

“চোখ তুলে দ্যাখো না কে এসেছে!”

প্রশেনজিৎ এর এই গানটা বাজছে। সে শুনতেই থাকল। কে এসেছে?

সোহেল হা করে তাকিয়ে বলল,

“এই বুড়ো এভাবে নাচছে কীভাবে, মা? গায়ে শক্তি আছে দেখছি!”

বড় চাচী বললেন,

“কচি মেয়ে বিয়ে করবে ভেবে বুড়োর আনন্দ আর ধরছে না।”

একটা ছেলে নাচতে নাচতে এগিয়ে এলো। দাঁত বের করে হেসে বলল,

“কিছু মনে করবেন না, আন্টি। আসলে বয়স হলেও দাদু মনের দিক থেকে এখনও ইয়ং। আপনারা বরনের ব্যবস্থা করুন।”

কেউ আর মাথা ঘামালো না। যত দ্রুত বিয়েটা হয়ে যাবে, তত দ্রুতই তাদের শান্তি।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৪

রাত্রের নিস্তব্ধ পরিবেশ মুহূর্তেই কোলাহল পূর্ণ হয়ে উঠেছে। গান বাজছে উচ্চ শব্দে। এতক্ষণ কেউ বুঝতে না পারলেও এখন পারছে যে বিয়ে লেগেছে! বড় চাচী মনে মনে একটু অবাক হচ্ছেন। যদিও বরপক্ষ থেকে কোনো মহিলা আসার কথা ছিল না। কিন্তু এত ইয়ং ছেলেপেলে এলো কোথা থেকে? বুড়োর সাথে তো বুড়োই মানায়। তাই না? এসব ছোট ছোট ছেলেদের নাচ গান চলে নাকি! তিনি মিষ্টির বাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে বরের কোনো হেলদোল নেই। সে আড়াল থেকে মুখ বের করছে না। পাশ থেকে একটা ছেলে বলল,

“কিছু মনে করবেন না, আন্টি। দাদু ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে তাই মুখ দ্যাখাতে চায়ছে না। একেবারে বিয়ের পরই মুখ দ্যাখাবে। আপনি বরং তখনই মিষ্টি খাওয়াবেন।”

বড় চাচী বুড়োর ঢং দেখে আড়ালে মুখ বাঁকালেন। বুড়োকে ভেতরে নিয়ে বসালেন। বাইরের গান বাজনা কিছু মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। বুড়ো সেই ছেলেটাকে ডেকে কানে কানে কিছু বলল। ছেলেটা হেসে বলল,

“আন্টি, এখন কনে কে নিয়ে আসুন। আমাদের দাদুর আর তর সইছে না।”

সকলে হেসে উঠল। বড় চাচী আর ছোট চাচী চলে গেলেন পায়েল কে নিয়ে আসতে। কাজী লেখালেখি করছে। ছেলেটা কাজীর কানের কাছে ঝুঁকে কিছু বলল। কাজী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আবার লিখতে শুরু করে। বড় চাচা ভ্রু কুঁচকে বললেন,

“তুমি কি বললে ওনার কানে?”

“আরে আপনারা হাইপার হবেন না। দাদুর নামের বানান ভুল ছিল সেটাই ঠিক করে দিলাম। পরে যদি সমস্যা হতো?”

বড় চাচা আর কিছু বললেন না। চারিদিকে অদ্ভুত কান্ড ঘটছে। তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে গেলেই তিনি বাঁচেন।

বড় চাচী এবং ছোট চাচী পায়েল কে নিয়ে আসলেন। যান্ত্রিক মানবীর ন্যায় হেঁটে আসছে সে। তারা তাকে বরের পাশে বসিয়ে দিলেন। পায়েল শুকনো মুখ তুলে আশে পাশে মাহিনকে খোঁজার চেষ্টা করল।‌ পেল না। মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল,

“মাহিন কোথায় ছোট চাচী?”

“আছে রুমে।”

“একটু নিয়ে আসবে ও’কে।”

তিনি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,

“আগে বিয়ের ঝামেলা শেষ কর। তারপর দেখছি।”

পায়েল আর কিছু বলল না। বুক ফেটে কান্না আসতে চায়লেও সে চেপে রাখে। আজ বাবা মা থাকলে তাকে এমন দিন দেখতে হতো না। দৃষ্টি! তার সাথে কি আর দ্যাখা হবে? এরা বিয়ের পর কোথায় নিয়ে যাবে, কে জানে? হয়তো কোনোদিন আর কারো সাথে দ্যাখা হবে না। আর ফারদিন! ফারদিন কে নিয়ে তার মনে উদয় হওয়া অনুভূতি এখানেই শেষ হবে। এখানেই, আজই ম’রণ হবে তার সকল সুপ্ত অনুভূতির। কেউ কখনও জানবে না। যাকে ঘিরে এই অনুভূতি, সেও না।
কাজীর কথায় হুঁশ ফেরে তার। কাজী তার কানে কিছু বলল। কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারল না ঠিক।

“একি কাজী সাহেব! আপনি কানে কানে বলছেন কেন?”

বড় চাচীর কথায় সেই ছেলেটি বলল,

“আন্টি, দাদুই অনুরোধ করেছেন। তিনি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছেন। আসলে তিনি ভীষণ লাজুক। প্রথম বিয়ের সময়ও তিনি এমন করেছিলেন।”

এমন কথা বাপের জন্মে কেউ শোনেনি। লজ্জার কারণে কানে কানে বলে বিয়ে পড়ানো! অতঃপর কাজী পায়েল কে কবুল বলতে বলল। শ্বাস রোধ হয়ে এলো। গলা আটকে এলো। ছোট চাচী একটু ঝুঁকে কানের কাছে বললেন,

“কবুল বলে দে চুপচাপ। নাহলে মাহিন আবারও মা’র খাবে। সকাল থেকেই ও’কে না খাইয়ে রেখেছি। তুই ভালো মেয়ের মতো বিয়ে না করলে রাতেও খাবার পাবে না।”

পায়েল ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সারাজীবন ঘৃণা করে গেলেও তাদের প্রতি এই ঘৃণা শেষ হবে না। বাধ্য হয়ে কবুল বলল সে। এবার বরের পালা। তাকে কবুল বলতে বললে সে একটু থেমে থেমে তিন বার কবুল বলে দিল। মুহূর্তে শরীর কেঁপে উঠল পায়েলের। এ কীভাবে সম্ভব! এ কার কন্ঠ শুনলো ও? বুড়ো বরের শক্ত গম্ভীর কণ্ঠের কবুল শুনে হতভম্ব হলো সকলেই। পায়েল ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাল। কাঁপা হাত বাড়িয়ে পাগড়ি এক টানে খুলে ফেলল। আঁকতে উঠে তারা পিছিয়ে গেল এক পা। পায়েলের মাথা ভনভন করে উঠল। বিশ্বাস করতে পারছে না সে। এ কাকে দেখছে! কীভাবে সম্ভব! বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইল শক্ত, গম্ভীর, নির্লিপ্ত মুখের দিকে। ফারদিনের তাদের বিস্ময়ে কোনো যায়‌ আসল না। হাত বাড়িয়ে কলম নিয়ে সই করল। এগিয়ে দিল পায়েলের দিকে। সে এখনও তাকিয়ে। স্বপ্ন না বাস্তব তা বোঝার চেষ্টা করছে। ফারদিন থমথমে কন্ঠে বলল,

“সাইন করো, ফাস্ট!”

পায়েল ঘোরের মধ্যে থেকেই সই করে দিল। কীভাবে কি হয়ে গেল! সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের অভিনন্দন জানাতে লাগল। পায়েল হা করে চেয়ে রইল। ফারদিন উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল কয়েক পা। বড় চাচা ঢোক গিলে বললেন,

“ত তুমি! তুমি এখানে? আসল বর কোথায়?”

ফারদিন বাঁকা হাসল। কন্ঠ উঁচিয়ে বলল,

“বরকে! ওপস্ প্রাক্তন বরকে নিয়ে আয়। বর তো এখন আমি, তাই না? চাচা শশুর মশাই?”

বাইরে কোথা থেকে যেন বুড়োকে নিয়ে আসে। বুড়োর হাত মুখ বাধা। ফারদিন এগিয়ে তার মুখের বাধন খুলে দেয়। তাচ্ছিল্য করে বলে,

“কচি মেয়েকে বিয়ে করার দেখি খুব শখ বুড়োর। শখ মিটিয়ে দিয়েছি একদম।”

বুড়ো ভয়ার্ত মুখে তাকিয়ে বলে,

“ছেড়ে দাও আমাকে। আমি এদের টাকা দিয়েছিলাম। এই মেয়েকে আমার কাছে বিক্রি করেছে তারা।”

ফারদিন চোয়াল শক্ত করে তাকায়। হুংকার ছেড়ে বলে,

“আপনাদের এতোই অভাব পড়েছে যে নিজের বাড়ির মেয়েকে বেচে দিতে দু বার ভাবলেন না? ছিঃ! টাকাগুলো এনে দেবেন নাকি আমি!”

বড় চাচী শক্ত হবার চেষ্টা করে বলেন,

“তুমি আমাদের ভয় দ্যাখাচ্ছ! আমরা এক্ষুনি পুলিশ ডাকব। এই সোহেল পুলিশকে ফোন কর।”

ফারদিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে তার সাথে থাকা ছেলেদের দিকে তাকায়। তারা হো হো করে হেসে ওঠে। ফারদিন ভয় পাবার ভান করে বলে,

“ওরে বাবা! আমি তো ভয় পেয়েছি চাচী শাশুড়ি মা। দয়া করে আমাকে পুলিশে দেবেন না। পুলিশ কে আমি খুব ভয় পাই। প্লিজ?”

বলেই আবার হেসে ওঠে। যেন এমন মজার ব্যাপার আর দুটি নেই। একটা লোক এগিয়ে আসে। ফারদিনের পাশে দাঁড়ায়। ফারদিন আলাপ করিয়ে দেয়,

“এই যে আমার সিনিয়র বড় ভাই, এই এলাকারই থানার এসআই। কষ্ট করে আর ফোন করার দরকার নেই শাশুড়ি মা। আপনি বরং ভাইকে সব খুলে বলুন।”

থরথর করে কাঁপতে থাকেন মহিলা। সিনিয়র ভাই বন্দু’ক বের করে সোহেলের কপালে ঠেকায়। বড় চাচী আঁতকে উঠলেন। সোহেল শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। সিনিয়র ভাই বললেন,

“কি হচ্ছিল এখানে? জোর করে একটা যুবতী মেয়েকে একটা বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে দিচ্ছিলেন আপনারা? আর এই মেয়েটার উপর দিনের পর দিন অত্যাচার করে এসেছেন! জানেন এর জন্য আপনাদের ঠিক কি শাস্তি হতে পারে?”

বড় চাচী কেঁদে উঠলেন। সিনিয়র ভাইয়ের হাতে পায়ে ধরে বললেন,

“আমার ছেলেকে ছেড়ে দিন, স্যার। আমরা সব টাকা দিয়ে দিচ্ছি।”

বড় চাচা দৌড়ে গিয়ে রুম থেকে টাকা বের করে দিলেন। দুই লাখ টাকা নিয়েছিলেন তারা। আবারও আকুতি করে বলল,

“ছেড়ে দিন, স্যার।”

“আমার হাতে কিছুই নেই। যদি ফারদিন বলে তো ছেড়ে দেব।”

এবার তারা ফারদিনের কাছে হাত জোড় করে। ফারদিন ভাবলেশহীন ভাবে বলে,

“আপনারা আমার দোষী না। আপনারা যার কাছে দোষী তার কাছে ক্ষমা চান। সে যদি মাফ করে দেয়, তাহলে এবারের মতো বেঁচে যাবেন।”

তারা ইতস্তত করে। পায়েলের কাছে ক্ষমা চায়তে হতে পারে এটা তারা ভাবেনি কোনোদিন। তারা পায়েলের সামনে গেল। পায়েল তখনও বসে বসে ফারদিন কে দেখছিল। দৃষ্টি সরায়নি এক মুহূর্তের জন্যও। বড় চাচার কথায় সে তাদের দিকে তাকায়,

“আমাদের ক্ষমা করে দে, মা। তোর উপর অনেক অন্যায় করেছি। আমাদের বাঁচা তুই।”

পায়েল উঠে দাঁড়াল। একে একে বড় চাচী, ছোট চাচী, সোহেল তার কাছে ক্ষমা চায়। পায়েলের তাদের ক্ষমা করতে মন চায় না। তাদের বছরের পর বছর করা অন্যায় গুলো হিসেব করলে তার ক্ষমা কক্ষনো হবে না। তবে ক্ষমা করা মহৎ গুণ। সে বলল,

“ক্ষমা করে দিয়েছি।”

তারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ফারদিন বলল,

“তাহলে শশুর শাশুড়ি এবং শালা বাবু! বেঁচে গেলেন! এখন সবাইকে মিষ্টি মুখ করান মেয়ের বিয়ে দিলেন, নাচানাচি করে এদের কষ্ট হয়ে গিয়েছে ঠান্ডা শরবতেরও ব্যবস্থা করুন।”

বড় চাচী, ছোট চাচী চলে যেতে নিলেই পায়েল বলল,

“মাহিন কে দিয়ে যাও ছোট চাচী।”

ছোট চাচী আড়চোখে ফারদিন কে একবার দেখে নিয়ে মাহিন কে নিয়ে এলেন। অতঃপর রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। পায়েল মাহিন কে দেখে কেঁদে ফেলল। জড়িয়ে ধরল তাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল গাল দুটো লাল হয়ে আছে। নিশ্চয়ই খুব মে’রেছে! আদুরে কন্ঠে বলল,

“মা খুব মে’রেছে ভাই?”

মাহিন মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। ফারদিন হুট করে এসে তাকে কোলে উঠিয়ে বলল,

“আর কেউ মা’রবে না শালাবাবু। আমি আছি না? গায়ে হাত দিলে একদম দেখে নেব। ঠিক আছে?”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২৫

ফারদিনের সাথে কমপক্ষে বিশ জন ছেলেপেলে এসেছে। কিছু তার বন্ধু, কিছু জুনিয়র আবার কয়েকজন সিনিয়র ভাই। সকলে তার শুভাকাঙ্ক্ষী। তারা নিজেদের সুবিধে মতো জায়গা দেখে বসে পড়েছে। নাচ গান করতে করতে সত্যিই ক্লান্ত তারা। বড় চাচী এবং ছোট চাচী তাদের জন্য শরবত এবং মিষ্টির ব্যবস্থা করছেন। সোহেল রান্না ঘর থেকে সেগুলো এনে সবাইকে দিচ্ছে। মুখ কালো হয়ে আছে তাদের। তবুও না করে উপায় নেই।
মাহিন ফারদিনের কোলে থেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকে দেখল। জিজ্ঞেস করল,

“তুমি কে? বরের মতো সেজেছ কেন? তুমি কি তাহলে পায়েল আপুর বর?”

কথাটা শুনে পায়েলের বুকের ধুকপুক বেড়ে গেল। ভাবতেই অবাক লাগছে ফারদিন তার স্বামী! এটা কি কখনও ভেবেছিল ও? ফারদিন হেসে বলে,

“হ্যাঁ, আমি তোমার দুলাভাই।”

“কিন্তু আমি শুনেছিলাম ওরা আপুকে একটা বুড়োর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে। তাহলে তোমার সাথে কেন দিল?”

ফারদিন তার গাল টেনে দিয়ে বলল,

“ম্যাজিক!”

মাহিন গোল গোল চোখে তাকায়। ফারদিন তাকে নামিয়ে দেয়। সে আবার গিয়ে পায়েলের পাশে বসে। গদগদ হয়ে বলে,

“দুলাভাই কত্ত হ্যান্ডসাম আপু! আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”

পায়েল ফারদিন কে এক পলক দেখে নিল। সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সিনিয়র ভাইদের সাথে কথা বলতে। ফারদিনের আজ এই পদক্ষেপ তার বাড়িতে মেনে নেবে তো? দ্বিধায় পড়ে সে।

খাওয়া দাওয়া শেষে পায়েল কে নিয়ে বেরিয়ে এলো ফারদিন। কাউকে বিদায় দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করল না। কেউ তার আপন নয়। গাড়ি যতই বাড়ির দিকে এগোচ্ছে ততোই পায়েলের হৃদযন্ত্রের লাফালাফি বেড়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড ভয় লাগছে তার। মনে হচ্ছে আজকের পর থেকে আঙ্কেল আন্টি কেউ তাকে আর ভালোবাসবে না, আদর করবে না। সে ফারদিনের দিকে তাকাল। সে নির্বিকার ভাবে ফোন চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও একটাও বাক্য বিনিময় করেনি তার সাথে। হঠাৎ পায়েলের মনে প্রশ্ন এলো, ফারদিন বিয়েটা কেন করল? তাকে বুড়োর হাত থেকে বাঁচাতে! নিজেকে বড্ড অসহায় অনুভব হলো। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে বাইরে চেয়ে রইল।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। বন্ধুরা আগে ভাগে নেমে গিয়ে কলিং বেল বাজাল। এখন রাত এগারোটা। এই রাতে কে এলো ভাবতে ভাবতে মিসেস সীমা দরজা খুলে দিলেন। দরজা খুলতেই তার বন্ধুরা বলল,

“কেমন আছেন আন্টি? আমরা ভালো আছি। আন্টি একটু কাজ আছে। আমরা গেলাম।”

তারা তড়িঘড়ি করে ফারদিনের রুমে চলে গেল। মিসেস সীমা বিস্ময় কাটিয়ে সামনে তাকাতেই হোঁচট খেলেন। চোখের ভুল ভেবে চোখ ঝাপটে আবার তাকালেন। কিন্তু না, তিনি ঠিকই দেখছেন। বিস্ফোরিত কন্ঠে বললেন,

“ফারদিন! পায়েল! তোরা এভাবে!”

ফারদিন ক্লান্ত অনুভব করছে। ধকল কম যায়নি। সে ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

“বিয়ে করে এসেছি, মা। বউকে বরণ করে নাও।”

পায়েল কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস সীমা তার দিকে তাকালেন। তাকেও বেশ ক্লান্ত দ্যাখাচ্ছে। তিনি কি করবেন খুঁজে পেলেন না। সকলে এখন গভীর ঘুমে মগ্ন। ডাকা কি ঠিক হবে? তাছাড়া ছেলে যখন বিয়ে করেই এসেছে ডাকলেও তাদের আর কিছু করার নেই। বরং ফাহাদ আবরার রেগে টেগে গেলে যদি তাদের ঢুকতে না দেন? বুদ্ধিমতী তিনি খুব কম আওয়াজ করে তাদের বরণ শেষে ভেতরে প্রবেশ করালেন। জিজ্ঞেস করলেন না কিছু। সকালে নাহয় সবাই একসাথে শুনবেন। রুমে যেতে ইশারা করে নিজের রুমে চলে গেলেন।‌ ফাহাদ আবরার ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে সূক্ষ্ম শ্বাস ফেললেন।

ফারদিন নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। পায়েল বুঝল না যে, সে এখন যাবে কোথায়? এ বাড়িতে এসে সব সময় দৃষ্টির রুমে থাকা হয়েছে। আজও যাবে কি? দৃষ্টির রুম রেখে ফারনাজের রুম তারপর একদম কোণে ফারদিনের। পায়েল হুট করে দৃষ্টির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে নক করতে নিলেই বাঁধা পেল। ফারদিন হাত টেনে সরিয়ে আনল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“দৃষের রুমে ধাক্কাতে যাচ্ছিলে কেন?”

ফারদিন এই প্রথম তার সাথে কথা বলল। তাও আবার কঠোর স্বরে। কষ্ট পেল সে। তবুও সেটা প্রকাশ না করে বলল,

“না মানে আমি তো দৃষের রুমে থাকতাম। তাই..”

ফারদিন শীতল কন্ঠে বলল,

“তুমি দৃষের ফ্রেন্ড হয়ে এ বাড়িতে আসো নি। যার পরিচয়ে এসেছ তার সাথেই থাকছ তুমি।”

পায়েলের সারা শরীরে কম্পন উঠে গেল। ফারদিন তা অনুভব করল। তার হাত ধরে টেনে নিয়ে নিজের রুমের সামনে দাঁড় করাল। তখনই রুম থেকে বেরিয়ে এলো তার দুই বন্ধু। ফারদিনের ঘাড়ে হাত রেখে বলল,

“কিছু মনে করিস না বন্ধু। তাড়াহুড়োয় ভালো মতো কিছুই করতে পারলাম না। যেটুকু করতে পেরেছি আপাতত সেটুকুতেই খুশি থাক।”

অতঃপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

“হ্যাপি বাসর।”

তাদের পাকনামোতে ফারদিন শক্ত হাতে মাথায় গাট্টা মা’রল। মুখ কুঁচকে নিল সে। ফারদিন গমগমে কন্ঠে বলল,

“যা, গেস্ট রুমে আজ রাত থেকে যা।”

তারা সম্মতি দিয়ে চলে গেল। ফারদিন রুমে প্রবেশ করল। স্বল্প পরিমিতিতে সাজানো দেখে তার কোনো হেলদোল হলো না। পায়েল কে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো।”

যেন আদেশ দিল তাকে। পায়েল গুটি গুটি পায়ে প্রবেশ করল। বাসর ঘরের ন্যায় রুম সাজানো দেখে ঢোক গিলল। এসবের মানে কি! তার আকাশ পাতাল ভাবার মাঝে ফারদিন দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। গা থেকে পাঞ্জাবি আলাদাও করে ফেলেছে। ওয়ারড্রব খুলে জিজ্ঞেস করল,

“ফ্রেশ হবে?”

পায়েল তার দিকে তাকাল। উদাম দেহের পিঠ নজরে আসতেই শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। লজ্জায় তৎক্ষণাৎ পেছনে ঘুরে গেল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,

“নির্লজ্জ! নির্লজ্জ!”

ফারদিন আবার বলে,

“কি হলো? কিছু জিজ্ঞেস করলাম আমি।”

সে আমতা আমতা করে বলে,

“না মানে হ্যাঁ।”

ফারদিন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকে পরখ করে বলল,

“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তারপর তুমি যাবে।”

সে জামাকাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। পায়েল থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল। আজ থেকে এই রুমেই থাকতে হবে! সে আগে কখনও এই রুমে আসেনি। সে আশে পাশে তাকিয়ে দেখল। খুবই পরিপাটি করে গোছানো রুম। ভালো লাগল তার। বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। সাজানো বলতে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছে বিছানায় আর কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতেই সুন্দর লাগছে তার কাছে।
দশ মিনিটে ফারদিন শাওয়ার নিয়ে বের হলো। খালি গায়েই ট্রাউজার পরে বের হলো। পায়েলের দৃষ্টি তার দিকে যেতেই আবার সে লজ্জা পেল। ফারদিন সামনে এসে তার হাতে তোয়ালে দিয়ে বলল,

“আমি রুমের মধ্যে প্রায় এভাবেই থাকি। তোমাকে মানিয়ে নিতে হবে। লজ্জায় নুইয়ে পড়লে চলবে না। যত দ্রুত পারো অভ্যস্থ হও। কি বলেছি বুঝেছ?”

পায়েল ঘাড় কাত করে আবার বিড়বিড় করে,

“নির্লজ্জ!”

ফারদিন ওয়ারড্রব থেকে একটা টি শার্ট এবং একটা ট্রাউজার তার হাতে দিল। পায়েল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল,

“ফ্রেশ হয়ে এগুলোই আপাতত পরতে হবে। আমার রুমে মেয়েদের কোনো জিনিস নেই।”

পায়েল উপায় না পেয়ে সেগুলো হাতে নিয়েই ফ্রেশ হতে চলে গেল। শাওয়ার নিতেই অর্ধেক ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ইতস্তত করে ফারদিনের টিশার্ট ট্রাউজার পরে নিল। ভীষণ লজ্জা লাগছে। আগে কখনও ছেলেদের পোশাক পরেনি সে। অদ্ভুত তো লাগবেই। সে মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। শাড়িটা কি করবে ভেবে পেল না।

“ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে এসো।”

সে চুপচাপ চলে গেল। শাড়ি সহ অন্যগুলো মেলে দিয়ে আবার ফিরে এলো। ট্রাউজার পায়ের নিয়ে পড়ছে। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে খুব। কয়েকবার তো হোঁচটও খেল। আর টিশার্ট তো কাঁধ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। হাঁটুর উপরে পড়েছে সেটা। সে টেনে টুনে ঠিক করছে বারবার। ফারদিন তার দিকেই শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পায়েল আড়চোখে তাকিয়ে দেখল গায়ে টিশার্ট জড়িয়েছে সে। স্বস্তির শ্বাস ফেলল। উদাম গায়ে কোনো পুরুষকে সব সময় সামনে দ্যাখা, যদিও সে তার স্বামী! তবুও অসম্ভব।
ফারদিন শুয়ে পড়েছে। শান্ত কন্ঠে বলল,

“শুয়ে পড়ো। অনেক ক্লান্ত নিশ্চয়?”

পায়েল কি করবে? কোথায় শোবে? দাঁড়িয়ে ভাবতেই থাকল। ফারদিন আবারও বলল,

“কি ভাবছ? বিছানায় সমস্যা কোনো? আমি ফুল গুলো ফেলে দিয়েছি। নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়তে পার। আমার শোয়া খারাপ নয়।”

শেষের কথাটা দ্বারা কি বোঝাতে চায়ল তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। পায়েল কি একবারও বলেছে গায়ে হাত পা তুলে দেওয়ার কথা? ঘুমের মধ্যে তো একটু এদিক ওদিক হতেই পারে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এক পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। একটু তাকাল তার দিকে। চোখে উপর এক হাত আড়াআড়ি ভাজ করে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে সে। পায়েল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজ রাতটা কীভাবে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল! ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সকালে ঘুম প্রতিদিনের থেকে একটু দেরিতেই ভাঙল পায়েলের। চোখ পিটপিট করে মেলল। পাশে তাকাতেই থমকে গেল। ফারদিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হকচকিয়ে গেল সে। কিছু মুহূর্তের জন্য হয়তো ভুলেই বসেছিল, সে এখন ফারদিনের স্ত্রী! নিজের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। কাঁধ বেয়ে টিশার্ট অনেকটা নিচে নেমে আছে। লজ্জায় কান গরম হয়ে গেল। এক লাফ দিয়ে উঠে এক প্রকার দৌড়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করল। ফারদিন সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট মেলে হাসল। তার হাসি দেখলে পায়েল নিশ্চয় আরেক দফা লজ্জা পেত। সে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দৃষ্টির রুমে নক করতেই সে খুলে দিল। সেও সবে ঘুম থেকে উঠেছে। রাতে ঘুম না হবার ফলে উঠতে একটু দেরি হয়। সে এখনও ফ্রেশ হয়নি। ফ্রেশ হতেই যাচ্ছিল, তখন ফারদিন নক করল। সে জিজ্ঞেস করল,

“ভাইয়া তুমি! কখন এলে?”

সে ভাইকে এ সময়ে আশা করেনি। বাড়িতে ছিল না সে। আর না থাকলেও সকাল সকাল বোনের রুমে নক করার কোনো রেকর্ড তার নেই। ফারদিন সে কথার জবাব দিল না। প্রসঙ্গের ধারে কাছেও না যেয়ে বলল,

“তোর একটা ড্রেস দে তো, দৃষ।”

চলবে,

সে আমারই পর্ব-২০+২১+২২

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২০

বিধ্ব’স্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিল দৃষ্টি।‌ সেই থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। দুপুরে খায়নি আর রাতেও না। মিসেস সীমা, মিসেস বিউটি, ফাহাদ আবরার, রামিজ আবরার সকলে এসে দু তিন বার করে ডেকে গেলেন। কিন্তু সে দরজা খুলল না। শরীর খারাপ লাগছে, ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে বলে কাটিয়ে উঠল। ফারদিন ও ফারনাজও এসে ডেকেছে। তবুও তার একই কথা। তারা অবশেষে হাল ছেড়ে দিল।

এদিকে দৃষ্টি ফিরে থেকেই কেঁদে চলেছে। কলেজের জামাকাপড় পরনে এখনও। ফ্রেশ হয়নি। বিছানায় পড়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে উঠলেও কাঁদছে। বারংবার চোখে ভাসছে আফরানের জোর করা, তার গায়ে হাত তোলা। বুকটা ঝাঁ’জরা হয়ে যাচ্ছে তার। আফরান কেন করল এমন? সে জানে, বোঝে যে আফরান তাকে ভালোবাসে। যদিও আফরান কখনও মুখে বলেনি। যদি ভালোবেসেই থাকে তাহলে এমন জোরাজুরি কেন? লুকোচুরি কেন? তার গায়ে হাতই বা তোলা হলো কেন? কেন? কেন?

কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে জানে না। ঘুমের মধ্যে মনে হলো কেউ তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। পুরো মুখ জুড়ে উষ্ণ স্পর্শ পাচ্ছে সে। সেই স্পর্শে কেঁপেও উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। সে চোখ টেনে মেলার চেষ্টা করে। ঘুমে তা বুজে আসে। গালে ঠান্ডা কিছুর আভাস পেতেই ঘুম হালকা হয়ে আসে। চোখ মেললেই পুরুষালী অবয়ব চোখে পড়ে। ধীরে ধীরে তা পরিষ্কার হয়। টনক নড়ে তার। আফরান! মুহূর্তেই মুচড়ে ওঠে,

“আপনি! কোন সাহসে আপনি আমার রুমে এসেছেন?”

আফরান তার কথাকে পাত্তা না দিয়ে গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। এখানেই তো মে’রেছিল। ইশ্ কেমন লাল হয়েছিল! বরফ দেওয়ার পর কমেছে। দৃষ্টি কেঁপে ওঠে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। আফরান ফিসফিসিয়ে বলে,

“ব্যালকনির দরজা এভাবে হাট করে খোলা রাখলে যে কেউ সহজেই আসতে পারবে। কোনো সাহসের দরকার পড়বে না।”

দৃষ্টির দম বন্ধ হয়ে আসে। এতো দিন তো আফরান একটু হলেও দূরে থাকত। কেননা তাদের মধ্যে হালাল কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এখন আছে। তার প্রয়োগ আফরান ভালো ভাবে করা শুরু করেছে। দৃষ্টি তাকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করে,

“মে’রে এখন আর দরদ দ্যাখাতে আসতে হবে না। সরুন।”

“তুই কি কেঁদেছিস নাকি রে, দৃষ? গলা ভেঙে গিয়েছে, চোখ লাল! কি সর্বনা’শ! দুপুরে রাতে খাসনি নিশ্চয়ই? তখন তো গটগট করে চলে এলি। সবাইকে ট্রিট দিয়েছি। তুই থাকলে কি হতো? ওঠ খেয়ে নিবি।”

“দৃষ! দৃষ বলছেন কেন? আমি কারো দৃষ নই। আমি দৃষ্টি।”

দৃষ্টি মুখ বাঁকায়। সে উঠবে না, খাবেও না, এভাবেই পড়ে থাকবে। তবে আফরান তার সে পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল। এক টানে তাকে উঠিয়ে বসাল। ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু হেসে বলল,

“রাগের মাথায় মানুষ কত কিছুই না করে! যা দৃষ একটু ফ্রেশ হয়ে আয়। পরনে দেখছি সেই কলেজের কাপড়! আশ্চর্য! তুই এমন করছিস যেন খুব বড় ছ্যাকা খেয়েছিস। যা, দ্রুত ওঠ।”

দৃষ্টি ওঠে না। ঠাঁই বসে রয়। আফরান সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে,

“তুই যদি দুই মিনিটে ফ্রেশ হয়ে না আসিস তাহলে আমিই তোকে ফ্রেশ করাতে নিয়ে যাব। নাউ ডিসিশন ইজ ইয়রস্।”

এ কথা শোনামাত্র দৃষ্টি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আফরানের দিকে কাঠ কাঠ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে। পনেরো মিনিটে শাওয়ার নিয়ে বের হয়। আফরান তাকে টেনে বিছানায় বসায়। হাত থেকে তোয়ালে কেড়ে নিয়ে আলতো হাতে চুল মোছে। দৃষ্টি মুখ গোমড়া করে ভাবে, আজ সারাদিন টা তার টানাটানির উপর দিয়েই গেল! চুল মোছা শেষে আফরান তোয়ালে ছুড়ে ফেলে, ওটা গিয়ে পড়ে রুমের এক কোণে। দৃষ্টি বিরক্ত মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“ওটা এভাবে ছুঁড়লেন কেন?”

“আমার হাতে এতো টাইম নেই। খেয়ে নে।”

সে এক প্যাকেট বিরিয়ানী তার সামনে ধরে। দৃষ্টি চোখ কপালে তুলে বলে,

“আপনি এসব কীভাবে এনেছেন? এগুলো হাতে নিয়ে পাইপ বেয়ে উঠলেন কীভাবে?”

আফরান সাবধানে প্যাকেট খোলে। চামচে করে বিরিয়ানী তার মুখের সামনে ধরে বলে,

“তূরাগ হেল্প করেছে।”

দৃষ্টি বাড়িয়ে দেওয়া খাবার মুখে নেয়। চিবিয়ে গিলে বলে,

“সবাইকে জ্বালাচ্ছেন এভাবে! শুধু শুধু আপনার জন্য তূরাগ ভাইকেও দেওয়াল টপকাতে হলো।”

“শুধু শুধু না, ও এসেছিল নিজের কাজে। আর আমি আমার কাজে।”

দৃষ্টি বোঝে না। তূরাগের কি কাজ থাকতে পারে এখানে? আফরান একটু একটু করে তাকে খাওয়ায়। অর্ধেক খাওয়া শেষে সে আর খাবে না বলে জানায়। আফরানও আর জোর করে না। বাকি টুকু সে নিজেই খেয়ে নেয়।
ইতোমধ্যে দৃষ্টি পুনরায় শুয়ে পড়েছে। আফরান তার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,

“আইসক্রিম খাবি না? যদিও গলে গিয়েছে। তোর গালে দিতে যেয়েই গলে গেল। এতো গরম গাল রে বাবা!”

সে সব গুছিয়ে রেখে এক লাফে দৃষ্টির পাশে শুয়ে পড়ে। দৃষ্টি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেই বলে,

“চলে যান এখন। মে’রে টেরে বহুত দরদ দ্যাখানো হয়েছে। এবার যেতে পারেন।”

কন্ঠে কি তীব্র অভিমান! আফরান হাসে। দৃষ্টি দ্যাখে না। এই হাসি যে ওর খুব প্রিয়। আফরান তাকে টেনে কাছে আনে,

“বিয়ে করেছি কি সরার জন্য? এভাবে জাপ্টে ধরে রাখার জন্য।”

দৃষ্টি কিছু বলে না। তবে মোচড়ানো শুরু করে। দৃষ্টিকে এতো কাছে পেয়ে আফরানের কেমন যেন হয়। গা শিরশির করে। গলা শুকিয়ে আসে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

“তোকে একটা চুমু খাই, দৃষ?”

দৃষ্টি চোখ বড় বড় করে তাকায়। এতক্ষণ এগুলো কি ছিল? এখন চুমু খেতে চায়ছে! কেমন চুমু? কিছু বলতে নিলেই আফরান আবারও বলে,

“স্যরি দৃষ। তোর অনুমতি পাবার অপেক্ষা করতে পারছি না।”

পরক্ষনেই ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়। হতভম্ব দৃষ্টি আফরানের শার্ট আঁকড়ে ধরে। থরথরিয়ে কাঁপে। চোখ বুজে আসে আপনাআপনি। অনুভব করে প্রথম ঠোঁটে ঠোঁটের ছোঁয়া, আফরানের গভীর ছোঁয়া। কিছুক্ষণ পর আফরান সরে আসে। কপালে কপাল ঠেকায়। লম্বা শ্বাস নেয়। দৃষ্টি গাল ভারি হয়েছে, অভিমান গলতে শুরু করেছে। তার মধ্যেই আফরান বলে,

“একটা কথা বলি, দৃষ?”

দৃষ্টি সম্মতিও দেয় না আবার মানাও করে না। ঘন ঘন শ্বাস নেয়। আফরান বলে,

“আমাকে ইউএসএ যেতে হবে। এক বছরের জন্য। ট্রেইনিং এর জন্য। ”

দৃষ্টি চোখ মেলে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়। আফরান মৃদু হেসে নাকে নাক ঘষে বলে,

“তাই তো এমন তাড়াহুড়ো করে বিয়ের কাজটা সেরে ফেললাম। তোকে মৃন্ময়ের সামনে এভাবে রেখে যেতে মন চায়ছিল না একদম। এবার আমি না থাকলেও তুই মৃন্ময়ের থেকে দূরে থাকার রাস্তা পেয়ে যাবি নিজেই। স্যরি।”

দৃষ্টির কন্ঠনালি জড়িয়ে আসে। শব্দগুলো কেমন পাকিয়ে যায়। চোখে আবারও অশ্রু জমা শুরু হয়।

“কাল সকালে আমার ফ্লাইট।”

এবার অশ্রুর বাঁধ ভাঙল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। আফরানের বুকে মাথা ঠেকাল। অদ্ভুত শান্তি অনুভব করল যেন। আফরান হকচকায়,

“আরে কাঁদছিস কেন? এক বছরই তো, তারপর চলে আসব।”

অতঃপর দুষ্টু হেসে বলে,

“আমার জন্য তোর কষ্ট হবে, দৃষ? সত্যি? সামথিং সামথিং?”

দৃষ্টি তবুও কাঁদে। ভিজে যায় তার বুকের অংশের শার্ট। জড়ানো গলায় বলে শুধু,

“আপনি খুব খারাপ। খুব খারাপ।”

কিছু মুহূর্ত পর সে শান্ত হয়। তবে আফরানের বুকে লেপ্টে থাকে। আফরান একটু পর পর তার চুলের ভাজে অধর ছোঁয়।

“আমি এভাবে তোকে বিয়ে করতে চাইনি। চেয়েছিলাম তোর বাপের কাছে তোকে চাইব। যদি দেয় তাহলে ধুমধাম করে তোকে উঠিয়ে নিয়ে যাব। আর যদি না দেয় তো! তোকে তুলে নিয়ে ধুমধাম করে বিয়ে করব। কিন্তু শা’লারা আমাকে ঠেলে ইউএসএ পাঠাচ্ছে। আর না গেলেও উপায় নেই। তোকে আমি কুমারী রূপে রেখে যাবার সাহসটা পেলাম না রে, দৃষ। তাই জোর করে বিয়ে করে নিলাম। পাকা পোক্ত সার্জারিয়ান হয়ে দেশে ফিরে সবার আগে ওই মৃন্ময়ের বাচ্চার বারোটা বাজাব! তারপর আর যত কাজ।”

একটু থেমে আবার বলে,

“আচ্ছা? জোর করে বিয়ে করায় তুই কি রাগ করেছিস? তবে আমি প্রমিস করছি ফিরে তোকে বউ সাজিয়ে আমার ঘরে তুলব।”

দৃষ্টির চোখ বেয়ে আবারও অশ্রু গড়ায়। সে কীভাবে থাকবে এই পাগল লোকটাকে ছেড়ে? সে আবার বলে,

“আপনি খুব খারাপ, আফরান ভাই।”

“একটা বছর শান্তিতে কাটিয়ে নিস। আমি ফেরার পর তোর সব শান্তি আমার হাতের মুঠোয়।”

দৃষ্টি বিড়বিড় করে বলে,

“আপনি কেন এলেন? কেন এমন করলেন? কেন আমাকে দুর্বল করে দিয়ে চলে যাবেন? আমি থাকব কি করে?”

আফরানের কান পর্যন্ত তা পৌঁছাল না। সে তার কপালে অধর ছুঁইয়ে বলে,

“তোকে বুকের মধ্যে নিয়ে আমার ভীষণ শান্তি লাগছে রে। আমি একটু ঘুমাতে চাই। একটা শান্তির ঘুম চাই। দিবি?”

দৃষ্টি জবাব দেয় না। তবে আফরান তার জবাবের তোয়াক্কা না করেই চোখ বোজে। মুহূর্তে ঘুমে তলিয়ে যায়। দৃষ্টি হাত বাড়িয়ে তার মুখের প্রতিটি অংশ একটু একটু ছুঁয়ে দেয়। বুক ভারি হয়, কান্না গলায় দলা পাকিয়ে যায়।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২১

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল দৃষ্টির জানা নেই। তীব্র দরজা ধাক্কানো তে ঘুম পাতলা হয়ে এলো। পিটপিট করে চোখ মেলে পাশে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে পেল না। বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। আফরান কি চলে গিয়েছে? দেশ ছেড়ে? তাকে ছেড়ে? আবারও কান্নায় চোখ ভিজে আসতে চায়ল, তবে দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ধৈর্যহীন ব্যক্তির জন্য তা আর হলো না। ঢোক গিলে উঠে দরজা খুলল। ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিসেস সীমা। মেয়েকে দরজা খুলতে দেখে তড়িঘড়ি করে বললেন,

“কটা বাজে দৃষ? কখন থেকে ডাকছি। তোর ঘুম এতো পুরু হলো কবে?”

দৃষ্টি নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মিসেস সীমা আবারও বললেন,

“তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

দৃষ্টি বিরস কন্ঠে বলে,

“কোথায় যাব? ভালো লাগছে না।”

মিসেস সীমা বেজায় বিরক্ত হলেন। মেয়েকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে ব্যস্ত হাতে বিছানা গোছাতে গোছাতে বললেন,

“দিন দিন বাপের মতো হয়ে যাচ্ছিস। আজ যে আমার আফরানটা অন্য দেশে চলে যাচ্ছে, তোর বাপকে বললাম, ‘চলুন যাই ও’র সাথে একটু দ্যাখা করে আসি। আর না জানি কবে দ্যাখা হবে?’ কিন্তু! তোর বাপ করল টা কি? ‘আমার কাজ আছে’ বলে চলে গেল! আর এখন তুই বলছিস ভালো লাগছে না?”

কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও দৃষ্টির চোখ চকচক করে ওঠে। আফরান তবে এখনও যায়নি? তাকে দ্যাখার এখনও সুযোগ আছে! সে দ্রুত জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে,

“থামো এবার। আমি যাব, মা।”

মিসেস সীমা অবাক হলেও পরপর খুশি হলেন। যাক! মেয়েটা তাহলে বাপের মতোন হচ্ছে না।

সকলে রেডি হয়ে গাড়ি চেপে বের হলেন। শুধু গেলেন না দুই ভাই। এতে মিসেস সীমা কম কথা শোনাচ্ছেন না। একটু গেলে কিই বা হতো? টাকা পয়সা কমে যেত? নাকি তার বোনের ছেলে তাদের টাকা পয়সা নিয়ে ফুড়ুৎ হয়ে যাচ্ছে?

এয়ারপোর্টে এসেই সবাইকে পেয়ে গেলেন তারা। মিসেস সীমা প্রথমেই বোনের সাথে ভাব বিনিময় করে নিলেন। কত দিন দ্যাখা হয় না! তিনি বোনকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কেমন আছ, আপা?”

প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়ে মিসেস সাইমা নাকে কাঁদা শুরু করলেন। পাশেই আফরান বসে ছিল। মা তাকে এসে থেকেই বগল দাবা করে রেখেছে। যেন যেতেই দেবে না। তার অক্ষি গোলক ছিল দৃষ্টির দিকেই স্থির। ইশ্! বিয়ের পর মেয়েটার রূপ বেড়েছে। আগের থেকেও এখন মা’রাত্মক সুন্দর লাগছে। এমন বউ ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে? তবুও বিধিধাম তাকে যেতে হচ্ছে। মায়ের নাকে কান্নায় সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে মুখ কুঁচকাল,

“খালামনি! প্লিজ তুমি মাকে একটু থামতে বলো। আমি কেবল এক বছরের জন্য যাচ্ছি। সারাজীবনের জন্য নয়। এভাবে কাঁদার কি আছে? যখন থেকে জেনেছে তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে!”

মিসেস সাইমা নাক টানলেন,

“দ্যাখ সীমা, মেয়েটাও সেই দূরে থাকে। হাতে গোনা বছরে হয়তো একবার আসে। আর ছেলেটাও এখন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কাঁদব না বল?”

মিসেস সীমা বোনের সাথে তাল মেলালেন। দুই বোন মিলে জুড়ে দিলেন যত আহাজারি। আফরান বিরক্ত মুখে একবার তাকিয়ে আবার দৃষ্টির দিকে মন স্থির করল। আর এক ঘন্টা পরই তো ফ্লাইট ততক্ষণে একটু মন ভরে দেখে নেওয়া যাক।

সকলে যখন আফরান কে নিয়ে ব্যস্ত তখন ফারনাজ তখন গুটি গুটি পায়ে তূরাগের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তূরাগ বাইরের দিকে চেয়ে ফোনে কথা বলছিল। মুখে মাস্ক। ফারনাজ অপেক্ষা করল তার কথা শেষ হবার। অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান ঘটল। তূরাগ ফোন পকেটে পুরে পেছনে ঘুরে তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। তাকে চমকাতে দ্যাখা গেল না একটুও। সে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কি? আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কি করছিলে?”

ফারনাজ অবাক হয়। চশমা ভেদ করে ডাগর আঁখি মেলে জিজ্ঞেস করে,

“আপনি কীভাবে বুঝলেন যে আমি অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি? আমি তো কোনো শব্দ করিনি।”

“আমি কাউকে এতো এক্সপ্লেইন করতে পারব না। কিছু বলার থাকলে বলো, নাহলে..”

ফারনাজ কথার মাঝপথে তাকে থামায়। তড়িঘড়ি করে বলে,

“ভালো আছেন, ভাইয়া?”

তূরাগের কপালে কটা ভাঁজ পড়ল। মতলব কি তার?

“এই কথা জিজ্ঞেস করার জন্য এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলে?”

ফারনাজ ইতস্তত বোধ করে। সেই ঘটনা এখনও ভোলেনি সে। সেই হুমকি! আবার যদি ধরে? তূরাগের সাথে সখ্যতা করতে পারলে হয়তো তার থেকে কিছু সাহায্য পাওয়া যাবে। তাই সে আগ বাড়িয়ে এসেছে কথা বলতে। নাহলে তার বয়েই গেছে এই পাথর মানবের সাথে কথা বলতে!

“না মানে ভাইয়া! আপনার সাথে তো সেই দ্যাখা হওয়া থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত ঝামেলা হয়ে এসেছে। ভালো মতো আলাপও হয়নি কখনও। তাই ভাবলাম একটু আলাপ করি।”

তূরাগ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বুক টান টান করে দাঁড়ায়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“তোমার কি মতলব বলো তো? এক মিনিট! তুমিও বাকি মেয়েদের মত নিশ্চয়ই আমার প্রেমে পা পিছলে পড়েছ? তাই এসেছে ভাব জমাতে। তাই না?”

ফারনাজ কিঞ্চিৎ হা করে তাকায়। তূরাগ কোথা থেকে কোথায় চলে গেল! তার বোকা বোকা মুখ দেখে তূরাগ আড়ালে ঠোঁট চেপে একটু হেসে নেয়। তবে ফারনাজের তা দৃষ্টি গোচর হয় না।

“এসব কি বলছেন? আমি তো সরল মনে এসেছিলাম আপনার সাথে একটু আলাপ করতে। আর আপনি কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেলেন!”

ফারনাজের কন্ঠে বিস্ময়। তূরাগ মুখটা ঘুরিয়ে নেয়,

“কিন্তু আমি ইচ্ছুক নই। তুমি যেতে পার।”

অপমানে থমথমে হয়ে গেল তার মুখ। তার ঘাট হয়েছে এই পাথর মানবের সাথে আলাপ করতে আসা। এই মানুষটার মধ্যে পাথর ছাড়া কিচ্ছু নেই। সে মুখ বিকৃত করে ভেংচি কেটে চলে গেল।

দৃষ্টি মায়ের পাশে বসে আছে চুপচাপ। মা আর খালামনির যেন গল্প শেষ হবার নাম নেই। আফরান চলে যাচ্ছে তাই নিয়ে কতই না দুঃখ তাদের! এদিকে সে না তাকিয়েও ঠিকই বুঝতে পারছে যে আফরান তাকে দেখছে। সেই দৃষ্টির কোনো নড়চড় নেই, কেবল আছে মুগ্ধতা। দৃষ্টির প্রচুর কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই লু’চু ডাক্তারের জন্য কেঁদে কেটে অজ্ঞান হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই অস’ভ্য লোকের জন্য সে কেন কাঁদবে? চোখটা জ্বলছে প্রচুর। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“মা, আমি একটু ওয়াশ রুম থেকে আসছি।”

মিসেস সীমা মাথা নাড়িয়ে নীরবে সম্মতি দিলেন। দৃষ্টি চলে গেল। ওয়াশ রুমে গিয়ে চোখে মুখে বেশি করে পানি ছিটিয়ে দিল। একে তো ঘুম হয়নি, তার উপর কান্না কাটি, চোখটা লাল আছে এখনও। লম্বা শ্বাস নিল সে। আর বেশিক্ষণ নেই, একটু পরই আফরান চলে যাবে। আর সেও বেঁচে যাবে খুব করে। মুখ মুছে পেছনে ফিরতেই থমকে গেল। আফরান টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে। চোখের দৃষ্টি খুব শান্ত। সে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই সে বাঁধা দেয়।

“মায়ের হাত থেকে কত কষ্ট করে বেরিয়ে এখানে এলাম। আর তুই চলে যাচ্ছিস!”

দৃষ্টি মুখ অন্যদিকে রেখেই বলে,

“আমি বলেছিলাম কাউকে এখানে আসতে? ছাড়ুন।”

আফরান তার কোমরে হাত গলিয়ে তাকে কাছে টানে। ছড়িয়ে থাকা চুল গুলো আলতো হাতে কানের পিঠে গুজে নরম কন্ঠে বলে,

“চলেই যাচ্ছি। শেষ বারের মতো তোকে একটু চোখ ভরে দেখতে এলাম। তাতেও তোর আপত্তি? আজ থেকে তো তোর শান্তির দিন শুরু তাই না?”

দৃষ্টি মুখ তুলে তাকায়। আফরানের ছোট ছোট চোখ জোড়া তাকে টানে ভীষণ। সেদিকে চেয়ে মনে মনে আওড়ায়,

“সত্যিই তো! আপনি চলে গেলেই তো আমার শান্তি। আমাকে আর কেউ বিরক্ত করবে না, হুট হাট জড়িয়ে ধরবে না। দৃষ দৃষ বলে মাথা খারাপ করবে না। তাহলে আমার এমন অদ্ভুত কষ্ট কেন হচ্ছে? মনে হচ্ছে যেন আমার আত্মাটাই আমার থেকে চলে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে এমন?”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ২২

ফারনাজের কপালটা এমন খারাপ কেন? ফারনাজ জানে না। না একটা বয়ফ্রেন্ড জুটছে আর না এই কিডন্যাপার পিছু ছাড়ছে! তার ইচ্ছে হয় গড়াগড়ি দিয়ে নাকের জল চোখের জল এক করে কাঁদতে। একটা বয়ফ্রেন্ড জুটলে অন্তত এই কিডন্যাপার থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। না পারে সইতে আর না পারে কাউকে বলতে। এই যেমন তাকে আজও কিডন্যাপ করা হয়েছে। রাস্তা দিয়ে একা চলার সুযোগে তাকে ওঠানো হয়েছে। এই নিয়ে তিন বার হলো। সে বোঝে না, কিডন্যাপার ব্যাটা বার বার এমন করে কি মজা পায়? তার ভাবনার মাঝেই গাড়িতে ঝাকুনি দিয়ে উঠল। সে হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিলেই বলিষ্ঠ শক্ত হাত তাকে আঁকড়ে ধরল। সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলল সে। দ্যাখার উপায় নেই, চোখ বাধা। হাত ছোড়াছুড়ি করার উপায় নেই, হাত বাধা। কেবল সে একটু কথা বলতে পারবে, কারণ মুখ বাধা নেই। সে অসহায় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“এমন করেন কেন আপনি? আজও কি বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসবেন? তাহলে কিডন্যাপ করে কি লাভ আপনার? না আটকে রাখেন, আর না কোনো টাকার দাবি করেন! এমন কিডন্যাপার আমি আমার বাপের জন্মে দেখিনি।”

লোকটি শ্বাস ফেলে, তা ফারনাজের মুখে আছড়ে পড়ে। মৃদু আন্দোলিত হয় তার হৃদয়। লোকটি ভারী কন্ঠে বলে,

“তবে তুমি চাও যে আমি তোমায় আটকে রাখি?”

ফারনাজ হকচকিয়ে বলে,

“না না একদম না।”

লোকটি মৃদু শব্দে হেসে বলে,

“মনে রেখো, আমি যদি আটকে রাখি তাহলে সারাজীবনের জন্য আটকে রাখব। আর কোনোদিন মুক্তি পাবে না তুমি।”

ফারনাজ ভীত হয়। তার ভীত মুখ দেখে লোকটি ভীষণ মজা পায়। ফারনাজের মাঝে মধ্যে মনে হয় এই লোক তার পরিচিত। কোথাও না কোথাও এই কন্ঠ ও শুনেছে। তবে ধরতে যেয়েও যেন ধরতে পারে না। হতাশ হয় সে। যদিন এই লোককে চিনতে পারবে সেদিন সে মজা দেখিয়ে ছাড়বে।

প্রায় দু ঘন্টা তাকে গাড়িতে করে এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে নামিয়ে দেওয়া হলো বাড়ির সামনে। হাতের বাঁধন হালকা করে চশমা গুঁজে দিয়েই হাওয়ার বেগে গাড়ি চলে গেল। ফারনাজ দ্রুত চোখ খুলেও গাড়ির টিকিটিও দেখতে পেল না। পুনরায় মুখ কালো করে সে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল। আচ্ছা এই ঘটনা কি বাড়ির লোকদের সাথে আলোচনা করবে? পরক্ষনেই লোকটির কথা মনে পড়ে,

“যদি বাড়ির কাউকে এই কথা বলেছ, তাহলে ধরব ঠিকই কিন্তু ছাড়ব না।”

সে শুকনো ঢোক গেলে। না থাক, বলার দরকার নেই। তার তো আর কোনো ক্ষতি করে না। শুধু চোখ আর হাত বেধে গাড়িতে করে চক্কর কা’টে। যেচে পড়ে কেন বিপদ ডাকবে সে?

খাবার টেবিলে সকলে জড় হয়েছে রাতের খাওয়া সারার জন্য। মিসেস সীমা পরিবেশন করছেন এবং আফরান কে নিয়ে গুনগান করে যাচ্ছেন। তার বোনপো বিদেশ গিয়েছে! আরও বড় ডাক্তার হয়ে দেশে ফিরবে! আরও কত কি! ফাহাদ আবরার স্ত্রীর উপর বিরক্ত হলেন। বড় ডাক্তার না ছাই! মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে দ্যাখো গিয়ে অ’স’ভ্য টা! তিনি কড়া কন্ঠে বললেন,

“তুমি থামবে? বোনের ছেলে নিয়ে আর এত নাচানাচি করতে হবে না। মাথা খেয়ে ফেলল আমার!”

মিসেস সীমা মুখ বাঁকান। তরকারির পাত্র শব্দ করে টেবিলে রেখে বলেন,

“আমার আফরান টাকে নিয়ে এত কীসের সমস্যা আপনার? আপনি ও’কে দু চোক্ষে সহ্য করতে পারেন না। কেন বলুন তো? এমন সোনার টুকরো ছেলে আজকাল দুটো দেখেছেন? আপনার ছেলেটা কেমন? রাজনীতি গু’ন্ডাগিরি করে বেড়ায়। আর আমি আমার বোনের ছেলের গুনগান গাইলে দোষ?”

ফারদিন উপস্থিত ছিল না। থাকলেও সে মায়ের কথার বিপরীতে কোনো জবাব দিত না। তার স্বভাবই এমন, শান্ত গম্ভীর। নিজের প্রশংসা শুনেও তার কোনো হেলদোল হয় না, আর না নিজের দুর্নাম শুনে। ফাহাদ আবরার চুপ করে গেলেন। ছেলেকে তিনি ব্যবসায় বসাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছেলের হাব ভাব দেখে বলতে পারছেন না কিছু। এখন কেবলই সময়ের অপেক্ষা।

দৃষ্টি চুপচাপ খেয়ে চলেছিল। তবে আফরানের প্রসঙ্গ উঠতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। বাবা আফরানের প্রতি এত অসন্তুষ্ট! আর যখন জানতে পারবে তার নিজের মেয়েই তার অপছন্দের পাত্রটিকে বিয়ে করে বসে আছে, তখন কি হবে? দৃষ্টি ভয়ে জমে যায়। তুলকালাম কাণ্ড বাঁধবে নিশ্চিত।
আজ একটা মাস আফরান নেই। তবে সে রোজ নিয়ম করে তাকে ফোন দেয়। কিন্তু দৃষ্টি ওঠায় না। আফরানের কন্ঠ শুনলেই তার শক্ত খোলস ভেঙে যাবে। তার কাছে ছুটে যেতে মন চায়বে। হতেও পারে আফরানের সামনেই কেঁদে ফেলবে! কি একটা লজ্জার ব্যাপার হবে! আর আফরান তো তাকে লজ্জা দিয়েই মে’রে ফেলবে। এই ভয়ে দৃষ্টি নিজেকে সামলে রেখেছে। সে ঢোক গিলে হাত ধুয়ে উঠে পড়ল। মিসেস সীমা জিজ্ঞেস করলেন,

“খাবার শেষ না করেই উঠলি কেন, দৃষ?”

“পেট ভরে গিয়েছে মা।”

সে চলে গেল। মিসেস সীমা ইদানীং লক্ষ্য করেন, দৃষ্টি খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করে না। চোখের নিচটায়ও কেমন কালি পড়ে আছে! ঘুমের কথা জিজ্ঞেস করলেই বলে, পড়ার ভীষণ চাপ। তিনি আর কিছু বলতে পারেন না।

দৃষ্টি রুমে এসে শুয়ে পড়ে। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। আফরান থাকতে যেমন তাকে উঠতে বসতে জ্বা’লাত, এখন কেউ তা করে না। তার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আফরান কে মিস করে ভীষণ। তবুও সে আফরানের সাথে কথা বলবে না। তাকে বউ বানিয়ে রেখে যাবার ফল স্বরূপ আফরান দেশে আসার পূর্ব পর্যন্ত না দৃষ্টির কন্ঠ শুনতে পাবে আর না তাকে দেখতে। তার ভাবনার মাঝেই ফোন রিং হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল। দৃষ্টি সেদিকে ফিরেও তাকাল না। সে জানে কে ফোন দিয়েছিল।

আফরান চলে যাবার পর থেকেই একা একা দিন কাটছে তুরাগের। দু একটা কনসার্ট আর তার টুকটাক কাজ, এই নিয়েই দিন কাটে। রাতে খেতে বসেছে সে। মিসেস অনা পাশে দাঁড়িয়ে যত্ন করে তাকে পরিবেশন করছেন। যদিও ছেলে ডায়েট চার্ট অনুযায়ী তেমন কিছুই খায় না। কিন্তু তাতে কি? তিনি সব সময় নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেকে খাওয়াতে চান। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই তিনি গদগদ কন্ঠে বললেন,

“তূরাগ, আজ শপিং করতে গিয়েছিলাম না?”

সে খেতে খেতে জবাব দেয়,

“হ্যাঁ, তো?”

“হ্যাঁ শোন হলো কি! একটা জায়গায় ভীষণ ভীড় ছিল। আমি তো জানিসই কেমন বোকা! আপার থেকে কখন যে আলাদা হয়ে গিয়েছি টেরই পাইনি। ওই ভীড়ের মধ্যে আমি আটকে পড়েছিলাম। মানুষ সব যেন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন একটা সুন্দর দেখতে মেয়ে এসে আমাকে টেনে ভীড় থেকে বের করল। কি সুন্দর মেয়েটা!”

তূরাগ ভ্রু কুঁচকাল। মনে মনে বুঝে গেল মা এর পর কি বলতে পারে। তার ভাবনা সত্যি করে মিসেস অনা বললেন,

“ইশ্! এমন একটা মেয়ে যদি আমার ছেলের বউ হতো! কিন্তু আমি মেয়েটাকে কিছু বলার সুযোগই পেলাম না। আমাকে ফাঁকা জায়গায় রেখে আবার সে চলে গেল। মনে হয় বড্ড চঞ্চল। নামটাও শুনতে পারলাম না, আর ফোন নম্বরটাও নিতে পারলাম না।”

মন খারাপ করে ফেললেন তিনি। তূরাগের খাওয়া শেষ। সে মায়ের শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে বলে,

“ভাই আমার বড়। আগে তার বিয়ে দিয়ে বউ আনো। তারপর আমার কথা ভেবো।”

ছোট থেকেই তূরাগের অভ্যাস মায়ের বা বড় মায়ের আঁচলে মুখ মোছা। হাতের কাছে কোনো আঁচল পেলেই যেন হাত নিশপিশ করে। সময় সাপেক্ষে হয়তো এই আঁচল বদলাতে পারে। মিসেস অনা মুখ গোমড়া করে বললেন,

“সেটা তো এক বছরের জন্য চলে গেল। কবে ফিরবে, তারপর মেয়ে দেখবে তারপর বিয়ে করবে! এতদিন তুই বুড়ো হয়ে যাবি।”

তূরাগ মায়ের বাচ্চামোতে হাসে। রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলে,

“বাবা মায়েদের কাছে সন্তানরা কখনও বড় হয় না। আর তুমি বিয়ে দেওয়ার জন্য ঊনত্রিশ বছরের ছেলেকে যে পরের বছর ত্রিশে পা রাখবে তাকে বুড়ো বানিয়ে দিচ্ছ!”

চলবে,

সে আমারই পর্ব-১৮+১৯

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৮

সকলের মিষ্টি রোদ। মিষ্টি পাখির কিচিরমিচির শব্দ। মিষ্টি হাওয়া। সব কিছুই মিষ্টি। তবে এই মিষ্টির মধ্যেও ভয়ে জমে আছে পায়েল। ফারদিন কাল তাদের বাড়িতে যেয়ে যে অনর্থ ঘটিয়ে এসেছে এতেই আরও একবার প্রমাণিত হয় যে সে গু’ন্ডা। গু’ন্ডার উপরের গু’ন্ডা। এখন তার বাড়িতে কি আর জায়গা হবে? বড় চাচী তো মে’রেই ফেলবেন। কি দরকার ছিল সবাইকে এমন হুমকি ধামকি দিয়ে তাকে নিয়ে আসা? শুধু শুধু ঝামেলা হলো না?
দৃষ্টি পাশে বসেই তার ওষুধ গুলো দেখে নিচ্ছে। আজ তাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এবং ফারদিন ঘোষণা দিয়েছে তাকে তাদের বাড়িতেই যেতে হবে। যতদিন না সে পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছে। এতে দুনিয়া উল্টে গেলে যাক। সব চুলোয় যাক। তবুও তাকে যেতেই হবে। সে অসহায় চোখে দৃষ্টির দিকে তাকাল। মিনমিন করে বলল,

“না গেলে হয় না? আমি নাহয় বাড়িতে চলে যাই? আমি তো এখন সুস্থ।”

দৃষ্টির ভাবলেশহীন কন্ঠস্বর,

“ঠিক আছে। ভাইয়াকে বলে যাস।”

পায়েল চুপসে গেল। এই ভাইয়াটার জন্যই তো যত সমস্যা। কিছু বলতে পারছে না সে চোখ রাঙানি আর গম্ভীরতার ঠ্যালায়। একটু পর ফারদিন কেবিনে প্রবেশ করল,

“বের হতে হবে, দৃষ। সব কাজ শেষ। চল। আর তোর বান্ধবী কি হেঁটে যেতে পারবে? জিজ্ঞেস কর তো।”

ফারদিন তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই পারত। এভাবে বলার কি আছে? সে মুখ গোমড়া করে জবাব দিল,

“আমি হেঁটে কেন দৌড়ে যেতে পারব, দৃষ। তোর ভাইকে বলে দে।”

“শুনে নিয়েছে।”

পায়েল মুখে বললেও ফারদিন জানে যে সে এখনও যথেষ্ট দুর্বল। হেঁটে যেতে পারবে না। সুতরাং যে দুই মিনিটের মধ্যে হুইলচেয়ার জোগাড় করে নিয়ে ফিরে এলো। পায়েল কিছুতেই বসতে চায়ল না,

“আমার পা খোঁড়া হয়ে যায় নি, দৃষ। হুইলচেয়ারের দরকার নেই।”

কেউ তার কথায় কান দিল না। ফারদিন তার দুই বাহু চেপে ধরে খপ করে উঠিয়ে খপ করে চোখের পলকে বসিয়ে দিল। পায়েলের গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। এভাবে কেউ ধরে? হাত কি দিয়ে তৈরি? লোহা? ব্যথা লেগেছে তো তার। ছলছল চোখে সে দৃষ্টির দিকে তাকাল। দৃষ্টি তার দিকে না তাকিয়েই হুইলচেয়ার ঠেলে চলল। ফারদিন তাদের পিছে। পায়েল ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,

“তোর ভাইয়ের হাত না অন্যকিছু? এভাবে কেউ ধরে? মনে হচ্ছে আমার হাত দুটোই খুলে চলে আসবে।”

দৃষ্টি ব্যতীত ফারদিন তা শুনতে পেল না। হাঁটতে হাঁটতে দৃষ্টি আস্তে করে বলে,

“তুই’ই বলিস আমার ভাই গু’ন্ডা। এখন দ্যাখ গু’ন্ডাদের হাতের শক্তি কেমন? কথা না শুনলে দেবে এক ঘা। তারপর?”

পায়েল শুকনো ঢোক গিলে বলে,

“তারপর?”

“তারপর তুই আবার হাসপাতালের বেডে।”

পায়েল মাথা ঘুরিয়ে পেছন ফারদিন কে একবার দেখে নেয়। যে এক হাতে তার ওষুধপত্র ধরে এক হাত পকেটে পুরে হাঁটছে। মুখে কি দারুণ গম্ভীর্যতা! ফারনাজ কেমন হাসি খুশি সহজ সরল আর তার সম্পূর্ণ বিপরীত ফারদিন। পায়েল কখনও তাকে হাসতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। পায়েল ভেবে পায় না, এই দুটি জমজ কীভাবে হলো? লোকে বিশ্বাস করবে? সে আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ হুইলচেয়ারে বসে রইল।

বাড়ি পৌঁছাতেই মিসেস সীমা এবং মিসেস বিউটি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাকে নিয়ে। ‘এখন কেমন আছ?’ ‘এসব কীভাবে হলো?’ ‘এখন ভালো লাগছে?’ ‘রেস্ট নেবে একটু?’ ‘কিছু খাও?’ ‘একটু স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসি?’ ইত্যাদি প্রশ্ন করতেই থাকলেন। পায়েল অভিভূত হয়ে দ্যাখে। তার এতো আপনজন থাকতেও কেউ তার খোঁজ খবর কখনও নেয়নি। আর দৃষ্টির পরিবার! এ যেন তারই পরিবার। চোখের কোণে অশ্রু জমে তার, তবে সকলের অলক্ষ্যে না মুছেও নেয়।
রাতে বাড়িতে ফিরে ফাহাদ আবরার এবং রামিজ আবরার ও তার খোঁজ নিলেন। পায়েল বুঝতেই পারল না যে এটা তার পরিবার নয়। সবাই এমন কেন? কই তার বাড়িতে তো এমন ভালো মানুষ নেই। একমাত্র ছোট চাচা ছাড়া। কিন্তু তিনিও তো ছোট চাচীর দাস!

পায়েল চুপচাপ বসে ভাবে। তখনই বিভিন্ন ফলমূল সহ ফলের রস নিয়ে প্রবেশ করেন দুই জা। সেগুলো সব নিয়ে তার সামনে রাখেন। পায়েল চমকে উঠে বলে,

“এসবের কি দরকার ছিল আন্টি? শুধু শুধু আপনারা কষ্ট করে এসব..”

মিসেস সীমা তার পাশে বসেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

“আমার কোনো এক সন্তান অসুস্থ হলে আমি এমনই করতাম। তুমিও তো আমার আরেকটা সন্তান তাই না? নাজ, দৃষ্টি, বন্যা এরা আমার কাছে যেমন, তুমিও তেমন। এখন খেয়ে নাও তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো।”

কথা গুলো পায়েলের হৃদয়ে গভীর ভাবে দাগ কাটে। বাবা মা নেই আজ দশটা বছর। কেউ তাকে এভাবে আদর করে বলে নি ‘খেয়ে নে’। কেউ তাকে বলেনি ‘তুই তো আমার মেয়ের মতোই’। হুট করেই সে তাকে জড়িয়ে ধরে। বুকে মাথা ঠেকিয়ে শব্দ করে কাঁদে। মিসেস সীমা চমকে উঠে পরপরই তাকে আগলে নেন। মিসেস বিউটি দ্রুত এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত রাখেন। মিসেস সীমা চিন্তিত কন্ঠে বলেন,

“কি হলো? কষ্ট হচ্ছে কোথাও? বলো? ছোট যা তো ফারদিন কে ডেকে নিয়ে আয়।”

মিসেস বিউটি লম্বা পা ফেলে চলে গেলেন। পায়েল এখনও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। মিসেস সীমা কি করবেন খুঁজে পান না। মেয়েটা কাঁদছে কেন হঠাৎ?
ফারদিন এসে বাইরে দাঁড়িয়ে দ্যাখে। শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। মস্তিষ্ক বুঝে নেয় সব। সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বলে,

“কিচ্ছু হয়নি, ছোট মা। থেমে যাবে নিজেই একটু পর। আর তোমরা দু’জন আজ ও’র সাথে থেকো বরং।”

সে প্রস্থান করে। তার কথা অনুযায়ী পায়েল একটু পরই শান্ত হয়ে এলো। শুকিয়ে এলো চোখের জল। তবে এখনও মিসেস সীমার বক্ষে লেপ্টে রইল। কেমন মা মা গন্ধ আসছে তার শরীর থেকে।
সেদিন ফারদিনের কথানুযায়ী তারা পায়েলের কাছে থেকে গেল। পায়েল কে মাঝে দিয়ে দুজন দুপাশে শুয়ে পড়ল। দৃষ্টি চলে গেল ফারনাজের ঘরে। পায়েলের ঘুমটা খুব ভালো হলো। শরীর মন উভয়ই চাঙ্গা হয়ে উঠল এক রাতেই।

সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন সকলে। বড় চাচী আর ছোট চাচী মুখ গোমড়া করে সব কাজ করছে। পায়েল থাকলে তাকে দিয়েই সব করাত তারা। কিন্তু এখন তাদেরই সব কাজ করতে হচ্ছে। পায়েল কে না দেখেও বড় চাচা কোনো প্রশ্ন করলেন না। তবে ছোট চাচা চুপ থাকতে পারলেন না,

“পায়েল কোথায়? কাল থেকে দেখছি না।”

বড় চাচী মুখ ঝামটা মে’রে বললেন,

“চুপ করো তো ছোট ভাই। নবাবের বেটি, জমিদারের বাচ্চার কোনো খবর আমরা জানি না। আছে কোথাও রঙঢঙ করে বেড়াচ্ছে।”

ছোট চাচা মুখ কালো করলেন। পায়েল খুব প্রিয় ভাতিজি তার। বাপ মা ম’রা অসহায় একটা মেয়ে। তারা ছাড়া তার আর কে আছে? মামা বাড়ির লোকজনও খোঁজ নিল না কোনো দিন। বোন নেই মানে তাদের সব সম্পর্ক শেষ। বড় চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন,

“খাবার সময় এসব কথা বাদ দাও তোমরা। ভালো লাগে না।”

দুই ভাই খেয়ে উঠে চলে গেল। ছোট চাচী মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

“দরদ দেখলে আর বাঁচি না! এতো দরদ কীসের ওই মেয়ের উপর? দেখলে গা জ্বলে যায়।”

বড় চাচীও তেজ ঝাড়লেন,

“না’গর জুটিয়ে আমাদের সবাইকে হুমকি দ্যাখায়! সাহস কত! ও’কে একবার হাতের মুঠোয় পেয়ে নিই! না’গর জোটানোর সাধ মেটাব।”

সোহেল চুপচাপ বসে গলাধঃকরণ করে যাচ্ছিল। কিছু মনে পড়তেই বড় চাচী জিজ্ঞেস করলেন,

“ওই ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিস, বাবা? কে ওই ছেলে?”

সোহেল পানি গিলল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“***ভার্সিটির ছাত্র লীগের নেতা ফারদিন আবরার। মা’র পিটের জন্য জনপ্রিয় বেশ। ভার্সিটির আশে পাশে শুনলাম ফারদিনের নাম শুনলেই ঠক ঠক করে কাঁপে সব। যাদের সে একবার ধরে, আধম’রা না করে ছাড়ে না। ভীষণ নামকরা গু’ন্ডা, সবাই বলে। ‌”

বলতে বলতে সোহেলের কপাল বেয়ে ঘামের রেখা নামে। বড় চাচী এবং ছোট চাচী ঢোক গিললেন। যা দ্যাখার তো দেখেই নিয়েছেন। ফারদিনের হাতে থাকা ভাঙা কাঁচের বোতলের কথা ভাবলেই এখনও তাদের বুক কাঁপে। ওটা যদি পেটে ঢুকিয়ে দিত? গু’ন্ডাদের একদমই বিশ্বাস নেই।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৯

টিফিন ব্রেকে ক্যান্টিনে বসে ছিল দৃষ্টি ও পায়েল। এখানে অনেকেই আছে। আছে কিছু ডাক্তারও। ফ্রি টাইমে এসে বসেছে একটু রেস্ট নেওয়ার এবং চা কফি খাওয়ার উদ্দেশ্যে। দৃষ্টি কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,

“তোর বাড়ির কি অবস্থা এখন?”

সেদিনের পর একমাস কে’টে গিয়েছে। পায়েল দৃষ্টির থেকে কিছুই লুকায় না এখন আর। সে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে,

“এখন আমি তাদের কাছে অদৃশ্য। আমাকে কোনো কাজেও ডাকে না। গায়ে হাত তোলা তো একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। সোহেল ভাইও এড়িয়ে চলেন। সামনে পড়লে কোণা চোখে একটু তাকিয়ে চলে যান। আমি আছি নিজের মতো। কথা বলার মানুষ বলতে এক ছোট চাচা আর ছোট চাচার ছোট ছেলেটা।”

দৃষ্টি মৃদু হাসে। পরক্ষণেই পায়েল চোখ কপালে তুলে বলে,

“তোর ভাই এ কি জাদু করল বলতো? আমাকে বাড়িতে রেখে আসার পর থেকেই তারা চুপচাপ আছে। আমি তো ভেবেছিলাম হাতের কাছে পেলে আমাকে মে’রেই ফেলবে।”

দৃষ্টি ভ্রু নাচিয়ে বলে,

“দেখতে হবে না কার ভাই? দৃষ্টির গু’ন্ডা ভাই ফারদিন।”

“সত্যি বলছিস দৃষ? ওরা ভাইয়াকে ভয় পেয়েছে?”

“সত্যি বলছি পায়েল। ভাইয়া যেভাবে তোর ভাইয়ের নাকে ঘু’ষি মে’রেছিল! আর কাঁচের ভাঙা বোতল তোর বড় চাচীর মুখের সামনে ধরেছিল! আমি তো ভেবেছিলাম রেগে সত্যি সত্যিই না পেটে ঢুকিয়ে দেয়! তবে বড় চাচী তোর খোঁজ না দিলে নিশ্চয় ভাইয়া হাত সাফ করে নিত।”

পায়েল ঢোক গেলে এবং ভেবে নেয় তাকে বাড়িতে দিয়ে আসার কথা,

দৃষ্টি দের বাড়িতে গুনে গুনে তিন দিন থাকার পর ফারদিন তাকে বাড়িতে দিয়ে এসেছিল। তাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দ্যাখায়নি তার চাচীরা। উল্টে ফারদিনের থেকে ভালো মন্দ শুনে , চা পানির কথা জিজ্ঞেস করেছিল। পায়েল কেবল হা করে চেয়ে ছিল। ফারদিন সব কিছু মানা করে তাকে গম্ভীর স্বরে “ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো” বলেই চলে গিয়েছিল।

“কি রে! ওমন হা করে কি ভাবছিস?”

পায়েল ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়। মাথা নাড়িয়ে বলে,

“না, কিছু না।”

হঠাৎ আফরান কে হম্বিতম্বি করে আসতে দ্যাখা যায়। সে তাদের টেবিলের সামনে এসে জোরে শ্বাস নেয়। পায়েল উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“আরে স্যার! বসুন না? আপনাকে চিন্তিত দ্যাখাচ্ছে। কিছু কি হয়েছে?”

“বসা টসা ওসব পরে হবে। দৃষ, চল আমার সাথে। আপনিও চলুন, মিস পায়েল।”

সে দৃষ্টির হাত চেপে ধরে। আফরানের কন্ঠের জোর এতোটাই ছিল যে আশে পাশে সকলের দৃষ্টি তাদের উপর পড়েছে। দৃষ্টি উঠে দাঁড়ায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,

“কি হয়েছে আপনার? কোথায় যাব আমরা?”

আফরান ভীষণ উত্তেজিত। ধৈর্যহীন কন্ঠে বলে,

“গেলেই দেখতে পাবি। তাড়াতাড়ি চল।”

সে দৃষ্টির হাত টেনেই এগোলো। পায়েল ছুটল পিছু। দৃষ্টি হতবাক, কলেজের মধ্যে আফরান কখনও তাকে তুই বা দৃষ বলে কথা বলে না। তাহলে কি হয়েছে? গুরুতর কিছু? পথিমধ্যে দ্যাখা হয় মৃন্ময়ের সাথে। সে হা করে কিছু বলতে পারে না। তার আগেই আফরান হাওয়া। মৃন্ময় অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিকে টানতে টানতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আফরান?
আফরান আজ বাড়ির গাড়ি এনেছে। দৃষ্টিকে ঠেলে ঢুকিয়ে সে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল। পায়েল পেছনে বসল। গাড়ি স্টার্ট হতেই সে জিজ্ঞেস করল,

“আমরা কোথায় যাচ্ছি, স্যার? কারো কি কিছু হয়েছে? কোনো রোগীর বাড়িতে যাচ্ছি?”

আফরান জবাব দেয় না। কেবল শ্বাস নেয় ঘন ঘন। দৃষ্টি পাশে বসেই দ্যাখে তার অস্থিরতা। শান্ত মানুষ এমন অশান্ত হয়ে উঠল কেন হঠাৎ?

বেশ কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামল। পায়েল মুখ বাড়িয়ে বাইরে তাকাল। কাজী অফিস দেখেই তার চক্ষু চড়কগাছ! আফরান নিজে নেমে টেনে দৃষ্টিকে নামাল। পায়েলও নামল। দৃষ্টি কাজী অফিস দেখে জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“আমরা এখানে কেন এলাম, আফরান ভাই?”

“ভেতরে গেলেই বুঝবি।”

শক্ত করে হাত চেপে ধরে সে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। ভেতরে অনেক অপরিচিত মুখ। তার মধ্যে একটাই পরিচিত মুখ দেখতে পেল, সে হলো তূরাগ। তাছাড়া দুজন মেয়ে ও দুজন ছেলে। আফরান একটা টেবিলের সামনে পাশাপাশি দুটো চেয়ারের একটাতে দৃষ্টিকে বসিয়ে অপরটাতে নিজে বসল। বলল,

“দ্রুত কাজ শুরু কর। সময় নেই একদমই।”

বোরখা পরিহিত মেয়েটি এগিয়ে এসে বলে,

“তাড়াতাড়ি বললে কীভাবে হবে আফরান? শাড়িটা পরবে না?”

আফরান বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বলে,

“রাখ তোর শাড়ি। লাল ওড়নাটা মাথায় দিয়ে দে। তাতেই হবে।”

মেয়েটি সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে আফরানের কথা মতো টুকটুকে লাল রঙা ওড়নাটি দৃষ্টির মাথায় সুন্দর করে মেলে দিল। হতভম্ব দৃষ্টি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। কি হচ্ছে এখানে? আফরান ক্ষণে ক্ষণে চেঁচিয়ে ওঠে,

“এই শা’লা কাজী কোথায়? ম’রছে নাকি?”

“আফরান তুই একটু শান্ত হ ভাই। কাজী এক নম্বর সারতে গিয়েছে। চলে আসবে এক্ষুনি।”

দুজন ছেলের মধ্যে একজন বলে। আফরান তেতে ওঠে,

“শা’লার এখনই এক নম্বর পেতে হলো? কিছুক্ষণ পর বলবে আমার দু নম্বর পেয়েছে।”

এসব কথা বার্তায় দৃষ্টির কান গরম হয়ে আসে। এ কাদের পাল্লায় পড়ল সে। ধপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“কি হচ্ছে এখানে? আফরান ভাই? এখানে কি হচ্ছে? এসব কাজী, লাল ওড়না! কি এগুলো?”

আফরান তার হাত টেনে পুনরায় বসায়। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,

“মেজাজ আমার ভীষণ চটে আছে, দৃষ। চুপচাপ বসে থাক। আমি যা বলব তাই করবি। বাড়তি একটা কথাও শুনতে চাই না আমি।”

আফরান এক হাতে চুল খামচে ধরে। ইতোমধ্যে ঘেমে খুব বাজে অবস্থা। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী হাজির হয়। পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসে একটু। আফরান দাঁত কিড়মিড় করে বন্ধুদের দিকে তাকায়। তা দেখে তার একজন বন্ধু এগিয়ে বলে,

“কাজী সাহেব! আমাদের আরও কাজ আছে তো নাকি? দয়া করে আপনি শুরু করুন।”

আফরানের শক্ত মুখ দেখে কাজী দ্রুত কাজ শুরু করে।

“কন্যার নাম?”

“দৃষ্টি আবরার।”

“কনের পিতা এবং মাতার নাম?”

“ফাহাদ আবরার, মিসেস সীমা আবরার।”

“বরের নাম?”

“আফরান ইততেয়াজ।”

দৃষ্টি থমকায়। এতক্ষণ সব বুঝতে পারলেও বিশ্বাস হচ্ছিল না তার। আবারও উঠে দাঁড়ানো চেষ্টা করে সে । তবে পারে না, আফরান শক্ত করে হাত চেপে ধরে আছে। তার কোমল হাত যেন ভেঙে যাবে! সে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

“এই বিয়ে আমি করব না। আফরান ভাই বন্ধ করুন এসব। মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে আপনার?”

“আমার মাথা আর গরম করিস না দৃষ। চুপচাপ বোস।”

“বললাম তো না। এসব হবে না।”

“দৃষ!”

“এ অন্যায়। ছাড়ুন আমাকে।”

হঠাৎ শব্দে পরিবেশ থমথমে হয়। পায়েল মুখে হাত চেপে ধরে। দৃষ্টি গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে আফরানের দিকে তাকায়। আফরান ভাই! তার আফরান ভাই প্রথমবারের মতো তার গায়ে হাত তুলল। আফরানের চোয়াল শক্ত। তার দুই জন বান্ধবী এসে দৃষ্টিকে আগলে নেয়। আর্তনাদ করে বলে,

“আফরান! পাগল হয়ে গেলি নাকি? মা’রলি কেন মেয়েটাকে? একটু বুঝিয়ে বললেই তো হতো।”

আফরান চেঁচায়,

“বুঝবে না ও। কোনো কিছুই বুঝবে না। আমি যে ম’রে যাচ্ছি তাও বুঝবে না। ছেড়ে দে ও’কে।”

তারা তাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। আফরান গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“কাজী সাহেব আপনি শুরু করুন।”

এসব দেখে ভীতু কাজী ভয় পেল। হড়বড়িয়ে সব বলা শেষে বলল,

“রাজি থাকলে বলুন মা কবুল?”

দৃষ্টি শক্ত হয়ে বসে থাকে। কাজী আবারও বলে, তাও দৃষ্টির মুখ ফোটে না। আফরান ধমক দেয়,

“বোবা হয়ে গিয়েছিস? বল কবুল। কবুল বল দৃষ্টি।”

শেষের দিকে কন্ঠ ঠান্ডা হয়ে আসে। দৃষ্টি তার দিকে তাকায়। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে এতক্ষণের জমা অশ্রু। আফরানের প্রতি ভীষণ রাগ, ক্ষোভ, অভিমান নিয়ে তিন বার কবুল বলে। আফরানও দ্রুত শেষ করে। শেষে রেজিস্ট্রি পেপারে সই করে। সাক্ষীর জায়গায় সই করে সকলে। বাদ যায় না পায়েলও। সে কাঁপা হাতে সই করে দেয়। এভাবেই দু’জনে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল ধর্মীয় এবং আইনগত ভাবে একে অপরের সাথে, সারা জীবনের জন্য।

চলবে,

সে আমারই পর্ব-১৬+১৭

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৬

বেশ কদিন যাবত কলেজে আসে না পায়েল। ফোনও রিসিভ হয় না। দৃষ্টি চিন্তায় পড়ে আছে। কিছু হলো না তো? সে-ই একমাত্র জানে পায়েলের বাড়ির অবস্থা। উঠতে বসতে তার উপর অত্যা’চার করা হয়। খেতেও দেওয়া হয় না ঠিক মতো। পায়েল বলেই টিকে আছে, সে হলে এতো দিন হয়তো সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ছাড়ত।
দৃষ্টি ঠিক করল পায়েলের বাড়ি গিয়ে তার খোঁজ নেবে আর দ্যাখা করে আসবে। ভাবনা অনুযায়ী রেডি হয়ে নিচে নামল। অসময়ে মেয়েকে তৈরি হয়ে বের হতে দেখে মিসেস সীমা জিজ্ঞেস করলেন,

“এই সময়ে কোথায় যাচ্ছিস, দৃষ?”

“মা, আমি একটু পায়েলের বাড়িতে যাব। অনেক দিন হলো কলেজে আসে না। আর ফোনেও পাচ্ছি না।”

“সে কি! মেয়েটা সুস্থ আছে তো? ঠিক আছে যা। তোর ভাইকে সাথে নিয়ে যা। এখন একা যাস না।”

দৃষ্টি ঘাড় কাত করে সম্মতি দেয়। ভাইয়ের রুমে গিয়ে বলে,

“ভাইয়া আমার সাথে চলো তো একটু।”

ফারদিন ল্যাপটপে কিছু করছিল। সে মুখ তুলে বলল,

“কোথায় যাবি?”

“পায়েলের বাড়ি।”

ফারদিন আর কোনো প্রশ্ন না করে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের উপর থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বলে,

“চল।”

দৃষ্টি অবাক হলো। কোনো জায়গায় যাবার কথা বললে কোথায় যাবি, কেন যাবি, কতক্ষণ লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন করে দৃষ্টির মাথা ঘুরিয়ে দেয়। আর আজ! কোনো প্রশ্ন ছাড়াই চল?

পায়েল দের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় কড়া নাড়ে দৃষ্টি। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দেয় এক মধ্য বয়স্ক মহিলা। ইনি পায়েলের বড় চাচী, দৃষ্টি চেনে। মহিলা ভ্রু কুঁচকে বললেন,

“কাকে চায়?”

দৃষ্টি ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিল। মহিলা তোয়াক্কা করলেন না। সে নম্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“পায়েল আছে আন্টি? আসলে ও অনেক দিন ধরে কলেজ যাচ্ছে না। আর ফোনও বন্ধ।”

মহিলা তাকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করলেন। খড়খড়ে কন্ঠে বললেন,

“কদিন যাচ্ছে না বলে হ্যাং’লার মতো চলে এলে!”

দৃষ্টি ধাক্কা খেল। তবে নিজেকে সামলে নিল দ্রুত। পাশে চোখ রক্তিম হতে থাকা ভাইয়ের হাত চেপে ধরল। নাহলে কি ঘটিয়ে বসবে কে জানে? মহিলা আবারও বললেন,

“পায়েল আর কলেজ যাবে না। তোমরা এবার যেতে পার। নির্লজ্জ কোথাকার!”

মহিলার সরাসরি অপমানে ধপ করে জ্ব’লে উঠল ফারদিন। কপালের রগ দপ দপ করছে তার। হাত মুঠো হয়ে এসেছে নিজের অজান্তেই। দৃষ্টি ভয়ার্ত মুখে ভাইয়ের দিকে তাকাল। ভাইকে না নিয়ে এলেই ভালো হতো। ফারদিন ঠান্ডা অথচ তেজী কন্ঠে বলে,

“পায়েল কোথায়?”

মহিলা ক্ষেপে গেলেন। ওই বাইরের মেয়ের জন্য এতো ঝামেলা তিনি পছন্দ করছেন না। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,

“বললাম তো পায়েল আর কলেজ যাবে না। তো আবার কি? চলে যাও। দাঁড়াও দাঁড়াও! তুমি আবার ও’র কোনো না’গর নও তো? বাহ্! কদিন কলেজ গেল কি গেল ন না’গর জুটিয়ে ফেলল। এজন্যই আমি ও’র পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছিলাম।”

ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল দৃষ্টির। তবে ফারদিন ভয়’ঙ্কর রেগে গেল। মহিলাকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। দৃষ্টি চেঁচায়,

“ভাইয়া!”

ফারদিন হাত উঁচিয়ে তাকে থামায়। হুংকার দিয়ে ওঠে,

“আপনি গুরুজন বলে এতোক্ষণ সহ্য করেছি। আমার ধৈর্য শক্তি খুব কম। ভালোই ভালোই বলে দিন পায়েল কোথায়?”

মহিলা চেঁচিয়ে বাড়ির লোক এক জায়গায় করলেন। ছোট চাচী বললেন,

“কি হয়েছে?”

“আরে দ্যাখ! এই বেয়াদব ছেলে আমাকে ধাক্কা মে’রে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।”

ফারদিন চোখ লাল করে প্রত্যেক কে দ্যাখে। একে তো বোনকে আজে বাজে কথা বলেছে, তার উপর পায়েল কে নিয়ে তার সাথে! সোহেল বাড়িতেই ছিল। ফারদিন কে দেখে এগিয়ে বলে,

“এই কে তুই? আমার মায়ের গায়ে হাত দিয়েছিস! এতো বড় সাহস তোর!”

সে এগিয়ে মা’রতে যায়। ফারদিন উল্টো তাকে ধরে নাকে এক ঘু’ষি দেয়। পিছিয়ে যায় সে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে নাক চেপে ধরে। বড় চাচী আর্তনাদ করেন,

“মেরে ফেলল গো! আমার কলিজার টুকরা কে মেরে ফেলল।”

অবস্থা বেগতিক। ফারদিন ডাইনিং টেবিলের উপর পানি ভর্তি কাঁচের বোতল দেখতে পায়। তা হাতে নিয়ে টেবিলে এক ঘায়ে ভাঙে। ভাঙা বোতল উঠিয়ে একবার তাক করে বড় চাচীর দিকে, তো একবার সোহেলের দিকে। শান্ত কন্ঠে বলে,

“পায়েল কোথায়? আমি আবারও জিজ্ঞেস করছি পায়েল কোথায়?”

ভয় থরথর করে কাঁপে মহিলা। এ ছেলে সুবিধের নয়, তা তিনি বুঝেছেন। ছোট চাচীও এক কোণে চলে গেলেন। বাড়িতে সোহেল ছাড়া আর কোনো পুরুষ মানুষ নেই। কিন্তু এই ছেলে তো সোহেলকেই কাত করে দিল। বড় চাচী কাঁপতে কাঁপতে বললেন,

“উ উপরে। উপরের ঘরে আছে।”

ফারদিন হুকুম দেয়,

“দৃষ! উপরে যা।”

দৃষ্টি দেরি করে না। ছুটে যায়। পায়েলের রুম বাইরে থেকে লক করা। সে দ্রুত দরজা খুলে প্রবেশ করে। বিছানায় অচেতন অবস্থায় প্রিয় বান্ধবী কে পড়ে থাকতে দেখে তার বুক কেঁপে ওঠে। ছুটে গিয়ে মাথার কাছে বসে। গালে হাত দিয়ে ডাকে,

“পায়েল! এই পায়েল!”

পায়েল চোখ মেলে না। দৃষ্টি খেয়াল করে হাতে পায়ে অসংখ্য দাগ। মুখে দাগ, ঠোঁটের কোণে কাঁ’টা। মুখটা বর্ণহীন, র’ক্তহীন। সে বাইরে যায়।

“ভাইয়া! পায়েল! তুমি তাড়াতাড়ি উপরে এসো।”

ফারদিন চোখ রাঙিয়ে সকলকে শাসায়। বলে,

“কেউ এক পাও নড়বে না এখান থেকে।”

ভয় গাট হয়ে সকলে দাঁড়িয়ে থাকে। এ কোন গু’ন্ডার কবলে পড়ল তারা?

ফারদিন রুমে এসে পায়েলের বিধ্বস্ত অবস্থা দ্যাখে। পালস রেট মেপে দ্যাখে খুবই ধীরে চলছে তা। সে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়,

“ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে নিতে হবে। চল।”

দৃষ্টি ভাইয়ের পেছনে পেছনে ছোটে। ফারদিন বাড়ি থেকে বের হবার আগে সকলের চেহারা থেকে দৃষ্টি আরও একবার ঘুরিয়ে নেয়,

“পায়েলের কিছু হয়ে গেলে আমি কাউকে ছাড়ব না। চৌদ্দ শিকের পেছনে পাঠিয়ে তবেই ছাড়ব। মাইন্ড ইট।”

তারা চলে গেল। বড় চাচী আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লেন। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

“কে এই ছেলে? পায়েলের কি হয়? এতো দরদ কীসের?”

সোহেল নাক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। মায়ের কথায় দাঁত চেপে বলে,

“খোঁজ নিতে হবে।”

পরক্ষণেই বড় চাচী গদগদ কন্ঠে বললেন,

“আমার ছেলেটার কি অবস্থা করে দিয়ে গেল! ভালো হবে না ওই মেয়ের, দেখে নিস। চল বাবা তোর নাকে ওষুধ লাগিয়ে দেই।”

হাসপাতালের শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে পায়েল। সেলাইন দেওয়া হয়েছে তাকে। কলেজের হাসপাতালেই আছে সে। তীব্র ফিনাইলের গন্ধে অসহ্য লাগছে। শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না। অথচ তাকে একটু নড়তেও দেওয়া হচ্ছে না। দৃষ্টি তার পাশেই বসে আছে। ফারদিন বাইরে গিয়েছে। পায়েল তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

“আমার আর শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না, দৃষ। উঠি একটু? ট্রাস্ট মি তোর গু’ন্ডা ভাই আসার আগেই আবার শুয়ে পড়ব।”

দৃষ্টি চোখ পাকিয়ে তাকায়। হাজার টা প্রশ্ন করেও উত্তর পায় নি যে পায়েলের এই অবস্থা কি করে হলো? মেজাজ চটে আছে তার। দৃষ্টি কিছু বলার আগেই গম্ভীর কন্ঠস্বর শোনা গেল,

“একটু নড়লেই তোমার হাড্ডি ভেঙে আবার ভর্তি করব। ইউ নো না? আমি একজন গু’ন্ডা।”

পায়েল থতমত খায়। ফারদিন কে চেনা থেকেই তাকে গু’ন্ডা বলে সম্বোধন করে আসছে সে। যে তেজ, যে রাগ! আর যে মা’রপিট করতে দেখেছে, তাতে এই নামটাই তার মানানসই লেগেছে। সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি। ফারদিন আফরান কে সাথে করে নিয়ে এসেছে। আফরানই পায়েলের চিকিৎসা করছে। আফরান তার প্রেশার মেপে, পালস রেট চেক করল। বলল,

“প্রেশার অনেকটা লো। তবে এখন ঠিক আছে। আপনি কদিন ধরে খান না, মিস পায়েল? আপনার মতো দুর্দান্ত স্টুডেন্ট এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া মানায় না। আর হাতে পায়ের দাগ গুলো কীসের? শুনলাম পিঠেও দাগ আছে। আপনি কি জানেন? ঠিক সময়ে আপনাকে হাসপাতালে না নিয়ে এলে কিছু হয়ে যেতে পারত? ইজ এনিথিং রং?”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৭

পায়েল মুখে কুলুপ এঁটে শুয়ে আছে। পারিবারিক বিষয় নিয়ে কি বলবে সে? খামোখা কেন সে এতো লোকের চিন্তার কারণ হবে? অতএব সে চুপ করেই রইল। আফরান সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বলল,

“ওকে ফাইন। আপনাকে কিচ্ছু বলতে হবে না। আজ রাতটা এখানেই থাকতে হবে। আগামীকাল রিলিজ পাবেন।”

পায়েল বলতে চায়ল,

“কিন্তু স্যার..”

“থাকবে ভাই। শুধু আজ রাত কেন দরকার পড়লে হাসপাতালেই পুরোপুরি শিফট করে দেব। থাকবে সারাজীবন।”

কথার মধ্যে ফারদিনের কড়া কন্ঠে চুপসে গেল সে। আর কিছু বলার সাহস পেল না। সে এখনও জানে না বাড়িতে কি হয়েছে? সে কীভাবে এখানে পৌঁছাল? আফরান বেরিয়ে গেল। সাথে ফারদিন প্রেসক্রিপশন নিয়ে বের হলো। ওষুধ কিনতে হবে। সাথে রাতের খাবারটা ও। আবার বাড়িতেও জানিয়ে দিতে হবে দৃষ্টির হাসপাতালে থাকার বিষয়টা।

তারা চলে গেলে পায়েল দৃষ্টির দিকে তাকায়। দুর্বল কন্ঠে বলে,

“বল না? আমাকে কীভাবে নিয়ে এলি?”

দৃষ্টি মুখ কুঁচকে বলল,

“তুই কি বলেছিস যে তোর এই অবস্থা কীভাবে হলো? তাহলে আমি বলব কেন? আমি তো তোর কেউ না। আমাকে বলতে যাবি কেন?”

শেষে তার কন্ঠ হতে অভিমান ঝরে পড়ে। পায়েল কাতর কন্ঠে বলে,

“তুই ছাড়া আমার আর আপন কেউ নেই রে, দৃষ। আমার আপন মানুষও আমার আপন নয়।”

চোখে অশ্রু জমে তার। ঢোক গিলে বলা শুরু করে,

“ভাইয়া যেদিন আমাকে বাঁচিয়ে ছিল সেদিন ভাইয়ার একটা শার্ট আমার কাছে থেকে গিয়েছিল। আমি সেটা যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম পরে সুযোগ বুঝে ফিরিয়ে দেব। জানতাম যে এই শার্ট কারো চোখে পড়লে কেলে’ঙ্কারি হবে। যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। সোহেল ভাই নানা রকম কথা বলে বড় চাচীর কান ভাঙালেন। আমার বাইরে কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে, আমি তাদের না থাকার সুযোগ নিয়ে বাড়িতে ছেলে নিয়ে আসি ইত্যাদি। বড় চাচী রেগে গেলেন খুব। আমার ঘরে এসে ঘর ওলোটপালোট করে হন্যে হয়ে প্রমাণ খুঁজলেন। পেয়েও গেলেন ভাইয়ার শার্ট। বরাবরের মতোই গায়ে হাত তুললেন। মুখের তিক্ত কথা দিয়ে অন্তর জ্বালিয়ে দিলেন, বাবা মা তুলে কথা বললেন। আমি সহ্য করতে পারলাম না। মুখের উপর বলে দিলাম কয়েকটা কথা। এতে আরও রেগে গেলেন। উনুন থেকে জলন্ত কাঠ নিয়ে এসে মা’রলেন। জানিস দৃষ? কেউ এগিয়ে আসেনি আমাকে বাঁচাতে। সকলে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল এবং আরও উস্কে দিচ্ছিল। ছোট চাচা বাড়িতে ছিলেন না। মা’রতে মা’রতে হাঁপিয়ে গিয়ে মা’রা থামিয়ে ছিলেন। তারপর ঘর বন্ধ করে রাখলেন। ম’রার মতো পড়ে থাকলাম। নড়ার শক্তি প্রর্যন্ত ছিল না। ম’রে আছি কি বেঁচে আছি কেউ আসেনি খোঁজ নিতে। কখন যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম জানি না। ছোট চাচা কেও চাচী আসতে দেননি। খুব করে চাইছিলাম আমি ম’রে যাই। বাবা মায়ের কাছে চলে যাই। আর পারছি না আমি।”

দৃষ্টি ফুঁপিয়ে উঠল। জাপ্টে ধরল তাকে। তবে পায়েলের চোখের কোণে জল মুখে হাসি। দৃষ্টি ভেজা কন্ঠে বলে,

“তুই এতো কিছু সহ্য করেছিস! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।”

পায়েল হাসে। এই মেয়েটি তার কষ্টে কষ্ট পায়। তাই তো পায়েলের একমাত্র আপন জন এই মেয়েটি। দৃষ্টির মাথায় হাত রেখে বলে,

“কাঁদিস না, দৃষ। এসব আমার সহ্য হয়ে গিয়েছে। যত দিন বাঁচব তত দিন তো সহ্য করতেই হবে। ম’রে গেলে তো সব শেষ।”

দৃষ্টি চুপ করে তাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। কেন এতো কষ্ট পায়েলের? কেউ কি আসবে না ও’কে এই নরক থেকে বের করতে?
ফারদিন নীরবে দরজা থেকে সরে গেল। সে এসেছিল তারা কি খাবে সেটা শুনতে। তবে পথিমধ্যে পায়েলের কন্ঠ শুনে তার পা জোড়া থেমে গিয়েছিল। পায়েলের প্রতিটা কথা শুনে ক্ষণে ক্ষণে র’ক্ত ছলকে উঠছিল তার। দ্রুত পায়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল। এখন একটা সিগারেট দরকার।

আজ দৃষ্টি হাসপাতালে আছে। আর রাতটাও এখানে থাকবে। দৃষ্টির সাথে টাইম পাসের ভালো একটা সুযোগ পাওয়া যাবে, ভাবটাও জমানো যাবে। তা ভেবে মৃন্ময় আজ নাইট ডিউটি তে থাকতে চায়ল। আফরানের কাছে গিয়ে বলল,

“ডক্টর ইততেয়াজ, আজ আমি ডিউটিতে থাকি। আপনি বাড়িতে যান।”

“সেটা কি করে হয়, ডক্টর আহমেদ? আপনি এক টানা এতো দিন নাইট ডিউটি করলেন। আমিই রেস্ট নিলাম। তারপর আবারও যদি আপনি আজ নাইট ডিউটি নেন তাহলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে। ভীষণ গিল্টি ফিল করব আমি।”

কন্ঠ হতে তার ঝর ঝর করে মধু ঝরে পড়ল। মৃন্ময় মৃদু হেসে বলে,

“ইটস্ ওকে, ডক্টর ইততেয়াজ। আপনি নাহয় আগামীকাল থেকে ডিউটি করবেন। আজ দিনটা আমি থেকে যাই।”

আফরান তীব্র বিরোধিতা করে বলল,

“এটা হয় না। আজ আমিই ডিউটি করব আর আপনি রেস্ট নেবেন। বিবেক বলে তো আমার কিছু আছে, নাকি? প্লিজ ডক্টর আহমেদ আপনি আজ বাড়িতে যান।”

আফরানের সাথে পেরে উঠল না মৃন্ময়। সে বাধ্য হয়ে বাড়িতে চলে গেল। তার প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল আফরান। মৃন্ময় কি মনে করেছে? সে কিছু জানে না? দৃষ্টির সাথে ভাব জমানোর জন্য আজ হাসপাতালে থাকতে চায়ছে তা আফরান খুব ভালো করেই বুঝেছে। আফরানের ব্যক্তিগত সম্পদের দিকে তাকাবে আর সে মেনে নেবে? কক্ষনো না।

“হ্যাঁ, হ্যালো দৃষ? পায়েলের কি অবস্থা এখন?”

“ভালো, মা।”

“যাক আলহামদুলিল্লাহ। যখন থেকে ফারদিনের কাছে শুনলাম তখন থেকেই মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। কি করছে এখন?”

দৃষ্টি এক পলক পায়েলের দিকে তাকাল। ক্লান্ত দ্যাখাচ্ছে তাকে।

“ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“আচ্ছা বেশ। থাকতে পারবি? নাকি আমি বা নাজ আসব?”

“পারব মা। তাছাড়া ভাইয়া তো আছেই। তোমরা আর চিন্তা করো না।”

আরও কিছু কথা বার্তা বলে ফোন রাখল সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল কি ফেলল না বলিষ্ঠ দু হাত তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। হকচকিয়ে গেল সে। হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই পরিচিত সুগন্ধি টের পেতেই শান্ত হলো। শক্ত কন্ঠে বলল,

“আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড কিংবা বউ নই যে এভাবে হুটহাট জড়িয়ে ধরবেন!”

আফরান দৃষ্টির কাঁধে থুতনি ঠেকায়। ফিসফিসিয়ে বলে,

“হতে কতক্ষণ?”

দৃষ্টি কেঁপে ওঠে। কি ছিল কন্ঠটায়? যা তাকে কাঁপিয়ে দিল? সে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,

“এখানে পায়েল আছে। আর যেকোনো সময় ভাইয়া চলে আসতে পারে।”

“তবে কি তুই চাচ্ছিস যে আমি কোনো নিরিবিলি জায়গায় তোকে জড়িয়ে ধরি?”

কন্ঠে তার দুষ্টুমি। দৃষ্টি মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,

“দেখুন, একদম মশকরা করবেন না।”

“ঠিক আছে। পায়েল ঘুমের মেডিসিনে ঘুমোচ্ছে আর ফারদিন কে আমি আমার কেবিনে একটু রেস্ট নিতে রেখে এসেছি। কোনো চাপ নেই। এবার একটু আমাকে শান্তি দে।”

দৃষ্টি চুপচাপ পড়ে রইল তার বন্ধনে। আফরান একই ভাবে তাকে জড়িয়ে রাখে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত শান্তি অনুভব হয়। কিছুক্ষণ পর দৃষ্টি জিজ্ঞেস করে,

“আপনার আর কোনো কাজ নেই? এখানে এভাবেই থাকতে হবে?”

“রাখ তোর কাজ। তোর থেকে কাজ বড় হলো নাকি?”

পরক্ষনেই আঙুল আকাশের দিকে তাক করে বলে,

“দ্যাখ দৃষ! এক ফালি চাঁদ কি সুন্দর দ্যাখাচ্ছে তাই না? আর ওই যে দেখছিস একদম পাশাপাশি, কাছাকাছি যে তারা দুটো আছে একটা ছোট একটা বড়! ওগুলো কারা জানিস?”

দৃষ্টি দ্যাখে। সত্যিই খুব সুন্দর দ্যাখাচ্ছে নক্ষত্র সজ্জিত কৃষ্ণবর্ণের গগণ। আফরান তার কানের নিকট মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“ওটা তুই আর ওটা আমি।”

আফরান পুনরায় আঙুল তাক করে দ্যাখায়। দৃষ্টির দেহ শিরশির করে। তবে সে নড়ে না একটুও। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। নক্ষত্র তো সব সময় এক জায়গায় থাকে না। আজ কাছাকাছি আছে তো কাল দূরে। ওই দুটো যদি সে এবং আফরান হয় তবে তো বিচ্ছেদ নিশ্চিত। আফরান কি তার থেকে দূরে চলে যাবে? নাকি সে আফরানের থেকে?

চলবে,

সে আমারই পর্ব-১৪+১৫

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৪

ফারনাজের বিরক্তির যেন শেষ নেই। তাদের ভার্সিটিতে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে নবীন বরণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে। আর ডাকা হয়েছে ওই পাথর মানব সহ তার দলবল কে। তখন থেকেই ফারনাজের মেজাজ চটে আছে। কেন ভাই? আর কোনো রকস্টার কি এরা পায়নি? ওই পাথর মানব কে কেন ডাকতে হবে? আবার ফারনাজ রা যেহেতু সিনিয়র তাই তাদের ঘাড়ের উপর সব দায়িত্ব পড়েছে। তার কেটে পড়ারও কোনো পথ নেই।
সে বিরস মুখে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিস গুলোর দিকে তাকাল। এখানে একটা কালো শাড়ি এবং প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র আছে। ড্রেস কোড শাড়ি এবং তারা সকল বান্ধবী মিলে কালো শাড়ি পরবে বলে ঠিক করেছে। ফারনাজ উৎসাহিত ছিল যতক্ষণ না রকস্টারের নাম শুনল। এখন তার বাড়ি থেকে বের হতেই ইচ্ছে করছে না।
মিসেস সীমা মেয়ের রুমে এসে এমন অবস্থা দেখে মাথায় হাত দিলেন। বললেন,

“তুই এখনও রেডি হোস নি, নাজ? অনুষ্ঠানে যাবি না, নাকি? আয় তোকে তাড়াতাড়ি করে শাড়িটা পরিয়ে দেই।”

ফারনাজ “যাব না” বলতে নিলেই ফোন বেজে উঠল। সে রিসিভ করে কানে ধরতেই আফিয়া গড়গড় করে বলে,

“তুই কই রে নাজ? আমরা সেই কখন চলে এসেছি, আর তোরই কোনো খোঁজ নেই। জলদি চলে আয়। এটা তো আমাদের শেষ নবীন বরণ তাই না? এরপর তো আমাদের বিদায় হয়ে যাবে, আর ভার্সিটির কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারব না। তাড়াতাড়ি চলে আয়। এবার খুব মজা করতে হবে।”

ফারনাজ ফোন কে’টে দিল। ইমোশনাল হয়ে পড়েছে সে। সত্যিই তো আর একটা বছর পরই তাদের ভার্সিটি ছাড়তে হবে। অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“শাড়ি পরিয়ে দাও মা।”

মিসেস সীমা খুব সুন্দর করে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। হালকার মধ্যে সাজিয়েও দিলেন। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক আর একটু মেকআপ। এক হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি এবং অন্য হাতে ঘড়ি। খোঁপা করে গুঁজে দিলেন আর্টিফিশিয়াল গাজরা। ব্যস, এতেই যেন চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছে তাকে। মানতেই হবে গুণের দিক দিয়ে ছোট জন এগিয়ে থাকলেও রূপের দিক দিয়ে বড় জন এগিয়ে। তবে ছোট জনেরও রূপ কম নয়। তবুও দুটো মেয়েই তার সোনার টুকরো। তিনি তার থুতনি ছুঁয়ে আঙুলে চুমু খেলেন,

“মাশাআল্লাহ! আমার মেয়েটার দিকে যেন কারো নজর না লাগে।”

সে মুখ গোমড়া করে বলে,

“দৃষ কেন কলেজ গেল মা? ও তো আমার সাথে যেতে পারত। দু বোন একসাথে যেতাম, ভালো হতো না?”

“ভালো তো হতো। কিন্তু দৃষের নাকি ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। তাই তো চলে গেল।”

ফারনাজ তড়িঘড়ি করে পার্স হাতে ছোটে। বলে,

“তোমার ছোট মেয়ের রোজ রোজ ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস থাকে। আমার কথার কোনো মূল্যই নেই কারো কাছে। আমি আসি আম্মু। সন্ধ্যার আগে চলে আসব।”

চলে গেল সে। মিসেস সীমা হাসলেন, মেয়েটা বড্ড সহজ সরল।

রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে শাড়ির কুচি চেপে ধরে দৌড় দিল ফারনাজ। ওই রকস্টার কে নিয়ে এতো না ভাবলে এমন দেরি হতো না। সে আফিয়া ও সুমির মাঝে গিয়ে দাঁড়াল। শ্বাস নিল ঘন ঘন। সুমি খোঁচা দিয়ে বলল,

“এতো দেরি করলি কেন? আর একটু দেরি করলেই ফুল টুল দেওয়া হয়ে যেত।”

ফারনাজ কিছু বলে না। শ্বাস নেয় কেবল। কিছুক্ষণ পর তাদের হাতে গোলাপ ফুল দেওয়া হলো নবীনদের দেওয়ার জন্য। তারা এগিয়ে সবাইকে ফুল দিল। ফুল দেওয়া শেষে স্যাররা নিজের মূল্যবান বক্তব্য রাখলেন। যা তারা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিল।
তারা তিনজন জায়গা বের করে বসে পড়ল। গরমে ফারনাজ লালবতী হয়ে আছে। হাঁসফাঁস করছে শুধু। ওই রকস্টার আসবে শুনে ক্যামপাস গম গম করছে মানুষের ভিড়ে।

“তোরা শাড়ি পরিস কীভাবে? আমার গরমে জানই চলে যাচ্ছে। বাবারে বাবা!”

“গরম লাগলেও শাড়িতে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। শাড়িতেই তো নারী সুন্দর, তাই না?”

আফিয়ার কথা শুনে সে মুখ কুঁচকে তাকায়। অসহ্য লাগছে।
স্যারদের বক্তব্য শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেল। এমনিতেই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল দেরিতে। এবার সবাইকে কিছু নাস্তা দেওয়া হলো। জানানো হলো যে খুব শীঘ্রই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে।

ফারনাজ আর থাকতে চায়ল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“আজ আমি যাই রে। এসব অনুষ্ঠান আর ভালো লাগছে না। গরমও লাগছে খুব।”

আফিয়ার শুরু হয়ে গেল ইমোশনাল ভাষণ। ফারনাজ আবার ধপ করে বসে পড়ল। বলল,

“তুই দয়া করে থাম। এই অনুষ্ঠানের শেষ না দেখে আমি এক পাও নড়ব না। কিন্তু তুই থাম।”

আফিয়া দাঁত কেলিয়ে হাসে। তার ভাষণ কাজে দিয়েছে ভেবেই ভীষণ গর্ববোধ করে।
অনুষ্ঠানের শুরু গান দিয়েই হবে। সুতরাং রকস্টার তূরাগ ইততেয়াজ এখন স্টেজে উঠবে। সকলে হই হই শুরু করে দিয়েছে। ফারনাজ আশেপাশে দ্যাখে। বাব্বাহ! এই পাথর মানবের এতো ফ্যান ফলোয়ার!
তূরাগকে স্টেজে উঠতে দ্যাখা যায়। হাতে গিটার সামনে মাইক। একটা ড্যাসিং রকস্টার লুকে প্রত্যেকটা মেয়ে বোধহয় হার্টবিট মিস করেছে। বাদ যায়নি ফারনাজও। তবে সে দ্রুত নিজেকে গা’লাগা’ল করে ফোন বের করে হাতে নিল। আর একটা বারও সে তাকাবে না স্টেজের দিকে। আর কানও দেবে না।

তূরাগ গান শুরু করার পূর্বে সামনে তাকাল এক পলক। এই এক পলক তাকানোতেই যে তার সর্ব’না’শ নিশ্চিত ছিল, তা জানলে সে কি তাকাত? না, তাকাত না। হৃদপিণ্ড অত্যাধিক হারে লাফাচ্ছে। চোখ দুটো যেন ঝলসে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে অনুভব হচ্ছে নতুন চিনচিনে ব্যথা। তূরাগ ভাবল আজ আর গান গাওয়া হবে না। তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হবে না। কিন্তু এখন নেমে গেলে ভীষণ বদনাম হবে। সে আশেপাশে তাকিয়ে ইশারা করে মিউজিশিয়ান দের বুঝিয়ে দিল কিছু। তারা ইশারা বুঝে সাঁই জানাল। তূরাগ আবারও চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের দিকে তাকাল। গিটারে টুং টাং আওয়াজ তুলল। মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল পরিবেশ।

“ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা

এই জীবন ছিল নদীর মতো গতি হারা
এই জীবন ছিল নদীর মতো গতি হারা, দিশা হারা।

ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা।”

ফারনাজ যতোই ফোনে চোখ রেখে বসে থাকুক, কানে তার গান পৌঁছাচ্ছে এবং সে মুগ্ধ হতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু তাকাচ্ছেও না আর মুগ্ধতা প্রকাশ করছেও না।
গান শেষ হবার সাথে সাথে তূরাগ নেমে গেল। তালির বর্ষণে মঞ্চ কেঁপে উঠল যেন। পুরোটা গান সে একাই গেয়েছে, গিটার বাজিয়ে। তূরাগ নেমে যাবার পরই ফারনাজ মুখ তুলল। এবার সে শান্তিতে বাকি অনুষ্ঠান দেখবে। হঠাৎ সুমি বলে,

“নাজ, তুই কি কিছু দেখেছিস?”

“কি দেখব?”

“আমার মনে হলো গান গাওয়ার সময় রকস্টার তোর দিকে তাকিয়ে ছিল‌।”

ফারনাজ হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে,

“তোর রকস্টার আমার দিকে কেন তাকাতে যাবে? হয় তার চোখ ট্যারা নাহয় তোর মনের ভুল।”

সুমি ভাবে। অতঃপর বলে,

“রকস্টারের চোখ ট্যারা হতেই পারে না। নিশ্চয় আমার মনের ভুল ছিল।

“হ্যাঁ, তাই। এখন চুপ করে বোস, আমাকে অনুষ্ঠান দেখতে দে।”

তারা হা করে তাকায়। এতো ভালো একটা গান হয়ে গেল ফারনাজ মুখ তুলেই তাকায়নি। আর এখন বলে অনুষ্ঠান দেখবে! আসল জিনিস শেষ হয়ে গেল এখন কি ঘোড়ার ডিম দেখবে?
অনুষ্ঠান চলাকালীন ফারনাজের অস্বস্তি হয়। কেন যেন মনে হয় কেউ ও’কে দেখছে। ভীষণ সূক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সে আশেপাশে চশমা ভেদ করে সতর্ক দৃষ্টি বুলায়। কিন্তু তেমন কাউকেই চোখে পড়ে না। হতাশ হয়ে আবার অনুষ্ঠানে মন দেওয়ার চেষ্টা করে।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ১৫

উচ্চ শব্দে মিউজিক এবং গায়ক গায়িকা দের বিরক্তিকর আওয়াজে ফারনাজের অসহ্য লাগছে সব কিছু। তূরাগের সফট গানের পর এসব তার ভালো লাগছে না। কানের মধ্যে দুমদাম বাজছে শুধু। কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম। এসব কোনো গানের পর্যায়ে পড়ে? ছ্যাহ্!
সে উঠে দাঁড়াল। অনেক হয়েছে, এখানে আর কিছুক্ষণ বসে থাকলে সে বয়রা হয়ে যাবে। সুমি তাকে দাঁড়াতে দেখে জিজ্ঞেস করে,

“উঠে দাঁড়ালি কেন? ওয়াশ রুমে যাবি?”

ফারনাজের মাথা যেন ভনভন করে ঘুরছে। সে দ্রুত ভঙ্গিতে বলে,

“হ্যাঁ ওয়াশ রুমে যাব।”

এখন এখান থেকে না গেলেই নয়। ওয়াশ রুমে যেয়ে চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে আসবে নাহয়। তারপর তাদের বলে বিদায় নেবে। এই অসহ্য পরিবেশে আর থাকা সম্ভব নয়। আফিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

“চল আমিও তোর সাথে যাই।”

“আরে না। তোকে যেতে হবে না। শেষ নবীন বরণ এনজয় কর। আমি যাব আর আসব। বেশি সময় লাগবে না।”

সে লম্বা পা ফেলে প্রস্থান করল। ভবনের শেষ প্রান্তে ওয়াশ রুম। এদিকটা ফাঁকা। সবাই ওই বিরক্তিকর কনসার্ট নিয়ে ব্যস্ত। ফারনাজ শাড়ির কুচি সামলে হেঁটে চলে। ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে চশমা খুলে রাখে। ট্যাব ছেড়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়। টিস্যু নিয়ে মুখ মোছে। হাতড়িয়ে চশমা নেওয়ার আগের অকস্মাৎ হাত চেপে ধরে কেউ। চোখের পলকে দুহাত সামনে নিয়ে বেঁধে ফেলে। ফারনাজ হকচকাল, ভয় পেল। চিৎকার করতে নিলেই তার মুখটাও বাঁধা পড়ল। ফারনাজ প্রতিবিম্বে দ্যাখার চেষ্টা করল অপহরণকারীর মুখ, তবে মাস্ক ও সানগ্লাসে আবৃত মুখমণ্ডল দেখা হলো না। চোখটাও বাঁধা পড়ল। পরপরই অনুভব করল হাওয়াতে ভাসছে সে। ছোটাছুটি করল ছাড়া পাবার জন্য, ব্যর্থ হলো। মুখ থেকে শব্দ বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু ‘উম উম’ ছাড়া আর কোনো শব্দ বের হলো না। কাঁদতেও পারছে না চোখ বাঁধা। তাকে কি ধরে নিয়ে বাবার কাছে টাকা দাবি করবে? টাকা দেওয়ার পরও যদি তাকে না ছাড়ে, তাহলে?
ফারনাজের হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই কিডন্যাপার কোনো পথ খোলা রাখেনি।

কোনো এক গাড়ির মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হলো তাকে। অনুভব করল পাশে উঠে বসেছে কেউ। তারপরই গাড়ি চলতে শুরু করল। পাশে অবস্থান করা লোকটি তার মুখের বাঁধন খুলে দিল। তবে চোখ এবং হাত খুলল না। ফারনাজ এবার চেঁচিয়ে উঠল,

“কে কে? কে আপনি? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ছেড়ে দিন আমাকে। আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি?”

ফারনাজের গলায় উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ল। শিউরে উঠল সে, বুঝল লোকটি তার অতি নিকটে অবস্থান করছে। কানে বাজল ভারি গম্ভীর কন্ঠস্বর,

“সর্বনা’শ করেছ তুমি আমার। আর জিজ্ঞেস করছ কি ক্ষতি করেছি?”

ফারনাজ থরথরিয়ে কাঁপে। সে আবার কার কি করল? কাঁপা কন্ঠে বলে,

“দ দেখুন, আ আমি কারো কিছু করিনি। আমি একটা ভালো মেয়ে।”

“জেনে বুঝে করোনি। তবে মনের অজান্তেই করেছ।”

তার ভীষণ কান্না আসে। মনের অজান্তেই কিছু হয়ে গেলে তার কি দোষ? ফারনাজ ভেজা কন্ঠে বলে,

“আপনার কন্ঠ চেনা চেনা লাগছে। কে আপনি?”

মৃদু হাসির শব্দ আসে। দুটো আঙুল ফারনাজের নাক টেনে দেয়। আবার কন্ঠস্বর আসে,

“মাথামোটা।”

সে ঢোক গেলে। বলে,

“আপনি কিন্তু মোটেও ঠিক করছেন না ‌ জানেন আমি কে?”

“কে তুমি? কোন দেশের রানী?”

কন্ঠে তার দুষ্টুমি, রসিকতা ঝরে পড়ে।

“ডক্টর আফরান ইততেয়াজের বোন হই আমি।”

“ওহ আচ্ছা।”

কিডন্যাপারের ভাবলেশহীন কন্ঠস্বর। ফারনাজ ঢোক গিলে আবার বলে,

“তাছাড়া রকস্টার তূরাগ ইততেয়াজও আমার ভাই হন। তাকে নিশ্চয় চেনেন।”

লোকটি উচ্চ শব্দে হাসে। খুব মজা পেয়েছে যেন। বলে,

“তাই নাকি! তাকে তো তুমি পছন্দই করো না। গানও না। তাকাও ও না। আর বিপদে পড়ে তাকে ভাই বানিয়ে দিলে! ভারি ধড়িবাজ মেয়ে তো তুমি।”

ফারনাজ ঘোর বিরোধিতা করে বলে,

“কে বলেছে তাকে আমার পছন্দ নয়? জানেন? প্রথম দ্যাখাতেই ক্রাশ খেয়েছিলাম। তার গান যে আমার এতো ভালো লাগে, তা বলে বোঝানো যাবে না। আজ এতো সুন্দর একটা গান গাইলেন! আমি তো রেকর্ডও করে নিয়েছি।”

তার সহজ সরল স্বীকারোক্তি। লোকটি তার চঞ্চল ঠোঁট বুড়ো আঙুলে ছুঁয়ে দেয়। কেঁপে ওঠে সে। এমন বিপদে সে জীবনে পড়েনি। লোকটি বলে,

“তবে সে তোমার ভাই নয় আর না তুমি তার বোন।”

“আশ্চর্য! আমার খালাতো ভাইয়ের ভাই তো আমারও ভাই হবে তাই না? যদিও তিনি আমাকে একদমই সহ্য করতে পারেন না। তবুও আমি অস্বীকার করতে পারি না।”

“উফ্! শুধু তোতা পাখির মতো বকবকানি! চুপ থাকো।”

“আমাকে ছেড়ে দিন। তাহলে চুপ থাকব।”

“তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি! তোমাকে কিডন্যাপ করেছি, এখন যদি মে’রে গুম করে দেই? ভয় লাগে না?”

ফারনাজ চুপ হয়ে গেল। টু শব্দটি করল না আর। জানের ভয় আছে তার। লোকটিও আর কোনো কথা বলে না। চোখ বাঁধা থাকলেও ফারনাজ অনুভব করে খুব কাছ থেকে তাকে দেখা হচ্ছে। বারংবার তপ্ত শ্বাস আছড়ে পড়ছে তার মুখশ্রীতে। যা তার আত্মা সহ কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর, তবে কতক্ষণ সে জানে না, গাড়ি থামানো হলো। লোকটি চেপে বসল তার গা ঘেঁষে। ফারনাজ অদ্ভুত সুন্দর একটা পুরুষালী পারফিউমের সুবাস পেল। কিডন্যাপার কি কোনো বিদেশী ব্রান্ডের পারফিউম ইউস করে? শুনতে পেল লোকটির কন্ঠস্বর,

“আজ এই পর্যন্তই। তবে ভেবো না যে শেষ। আবারও দ্যাখা হবে।”

পরপরই তাকে টেনে গাড়ি থেকে নামানো হলো। অনুভব করল হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে এসেছে। সে থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত চোখের বাঁধন খুলল। তবে তার আগেই গাড়িটি ধুলো উড়িয়ে চলে গিয়েছে। ফারনাজ হাতে থাকা চশমা চোখে দিল। লোকটি যাবার আগে তার হাতে চশমা গুঁজে দিয়েছিল। মনে হলো বহু জনম পর সে ধরিত্রী দেখছে। আশে পাশে তাকিয়ে আকাশ থেকে টুপ করে পড়ল যেন। সে তার বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সে বিড়বিড় করে,

“আশ্চর্য তো! লোকটা কিডন্যাপ করে আবার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিল কেন? আর আমার বাড়িই বা চিনল কীভাবে? আবার দ্যাখা হবে মানে!”

সে আকাশ পাতাল ভাবছে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে। ফারদিন বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। তাকে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,

“চলে এসেছিস! বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা, ভেতরে যা।”

বলা বাহুল্য তারা এক ক্লাসে হলেও এক ভার্সিটিতে পড়ে না। তাদের ভার্সিটি আলাদা। ফারনাজ ঘোর থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
অনেকক্ষণ ধরে সে ভাবল, এ কেমন অদ্ভুত কিডন্যাপার? ধরল আবার ছেড়ে দিল! আবার দ্যাখা হবে মানে কি আবার ধরবে নাকি! সে শুকনো ঢোক গিলল। খুব সাবধানে থাকতে হবে।

দৃষ্টির বাহু পেঁচিয়ে বসে আছে সে। দৃষ্টি বিরক্ত মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে। অতিষ্ট কন্ঠে বলে,

“সে এসে থেকে আমার হাত জড়িয়ে বসে আছিস! কি সমস্যা তোর আপু? আমি তো পড়তেও পারছি না ভালো করে।”

ফারনাজ কোণা চোখে তাকায়। কন্ঠে অভিমান ঢেলে বলে,

“আমার থেকে তোর কাছে এই পড়াশোনা বড় হয়ে গেল, দৃষ? আমি তোর কেউ না? এই পড়াশোনায় সব?”

“দ্যাখ আপু! আজে বাজে কথা বাদ দিয়ে মূল টপিকে আয়। কি হয়েছে তোর? রুমে যাচ্ছিস না কেন?”

ফারনাজ চুপসে যায়। বিকেলের ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে বলবে কিনা ভাবে। অবশেষে সে আর না ভেবে বলেই দেয় তার সাথে ঘটে যাওয়া করুণ কাহিনী। দৃষ্টি বিচলিত হলো না মোটেও। নির্লিপ্ত কন্ঠে বইয়ের দিকে চোখ রেখে বলল,

“নিশ্চয় তোর কোনো এক্স হবে। তোকে ভয় দ্যাখাতে চেয়েছে।”

“তা কি করে হয়? আমার এক্স গুলোর একটাও বিদেশ চোখে দ্যাখেনি। বিদেশী ব্রান্ডের নামই বা জানবে কি করে আর কিনবেই বা কি করে? এতো কিপ্টার কিপ্টা সব গুলো!”

“তাহলে দ্যাখ বিদেশী কেউ। তোকে দেখে আ’ছাড় খেয়েছে। এবার পিছু ছাড়াতে পারিস কিনা দ্যাখ।”

ফারনাজ চিন্তিত হয়। বিদেশী কেউ! তার মতো মেয়ের পেছনে শুধু শুধু কেন লাগতে যাবে? আচ্ছা? বিদেশী হলে ফড়ফড় করে বাংলা কীভাবে বলল? তার মাথা কাজ করে না। ধপ করে শুয়ে পড়ে বোনের পাশে। হাত পা ছড়িয়ে বলে,

“আমি আর ভাবতে পারছি না। অনেক ভেবেছি, যা হয় হোক। ব্রেইনের রেস্ট দরকার এখন। ঘুমাচ্ছি, আজ তোর রুমেই থাকব। ঘুমের মধ্যে নিশ্চিত জ্বর আসবে আমার। মা’কে বলে দিস রাতে খাব না।”

চলবে,