সে আমারই পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
304

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩২

আমিনুল ইততেয়াজ বাড়ি ফিরে বিস্তারিত সব শুনে হম্বিতম্বি করলেন খুব। তার ছেলে হয়ে আফরান কীভাবে এই কাজ করতে পারল তা ভেবে ভেবে মাথার তার গুলো ছিঁড়ে যেতে শুরু করেছে। তার ছেলে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিল! তাও আবার মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েকে! ভেবে ভেবে তার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। তিনি তো মনে মনে কোটি পতি বিজনেস পার্টনারের মেয়েকে ছেলের জন্য ঠিক করেছিলেন। মেয়েটিও আফরানের প্রতি আগ্রহী, তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই মেয়েটির সাথে ছেলেকে বিয়ে দিতে পারলে ভালো তো হতোই তার উপর বিজনেসেও তিনি সমর্থন পেতেন। কিন্তু তার ভাবনায় জল ঢেলে ছেলে বিয়ে করে ফেলল! কি দেখেছে এই মেয়ের মধ্যে কে জানে? এই মেয়ের তো কোনো রূপও নেই, কালো মেয়ে! তার হীরার টুকরো ছেলে এই কাজ কীভাবে করতে পারল?
থম মেরে সোফায় বসে তিনি আকাশ পাতাল কত কিছু ভেবে আবার চেঁচিয়ে উঠলেন,

“এই বিয়ে আমি মানি না। এই মেয়ের কি যোগ্যতা আছে ইততেয়াজ পরিবারের বউ হবার? আমি মানি না।”

মিসেস সাইমা ঘাবড়ে আছেন ভীষণ। আমিনুল ইততেয়াজ যেসব শুরু করেছেন! এই কথা গুলো দৃষ্টির কানে গেলে মেয়েটা কষ্ট পাবে খুব। ও তো যেচে পড়ে আসেনি। আসতে বাধ্য হয়েছে শুধু আফরানের জন্য। তিনি অনুরোধের সুরে বললেন,

“আপনি দয়া করে শান্ত হোন। মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আপনার এসব কথা শুনতে পেলে ও কষ্ট পাবে খুব। তাছাড়া আপনি শুধু শুধু মেয়েটাকে তখন থেকে কেন যা তা বলে যাচ্ছেন? ও কি আপনার ছেলেকে জোর করে বিয়ে করেছে? বরং আপনার ছেলে ও’কে জোর করেছে।”

আমিনুল ইততেয়াজ ফুঁসে উঠলেন,

“একটা কালো মেয়েকে আমার ছেলে কীভাবে পছন্দ করল? ওই মেয়ে নিশ্চয় তাবিজ করেছে আমার ছেলেকে। নাহলে আমার ছেলে এমন কাজ কখনোই করতে পারে না।”

দৃষ্টি কথাটুকু শুনে সাবধানে সরে রুমে চলে গেল। আর নিতে পারছে না সে, মাথাটা ভার হয়ে আছে। কোনো কিছু না করেও তাকে এতো কথা কেন শুনতে হচ্ছে? সে তো আফরান কে বলেনি যে, ‘আমাকে বিয়ে করুন। আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচব না।’ উল্টো আফরান তাকে মে’রে ধরে বাধ্য করেছে। এখন কি করবে সে? চলে যাবে? কোন মুখে সে বাড়ি ফিরবে? এতোক্ষণে নিশ্চয়ই আশে পাশে সবাই জেনে ফেলেছে। সে শশুর বাড়ি আসার পর দিনই ফিরে গেলে তারা কি বলবে? তার বাবার সম্মান থাকবে? দৃষ্টি আর কিছু ভাবতে পারল না। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। মাথাটা যেন ব্যথায় ফেটে যাচ্ছে।

মিসেস সাইমা সূক্ষ্ম শ্বাস ফেললেন। এই লোককে বোঝাতে ব্যর্থ তিনি। শান্ত কন্ঠে বললেন,

“ছেলেকে ফোন দিন। তার কাছ থেকে কৈফিয়ত নিন। মেয়েটাকে আর কোনো বাজে কথা বলবেন না।”

আমিনুল ইততেয়াজ স্ত্রীর দিকে অসন্তুষ্টির দৃষ্টিতে তাকালেন। ওই মেয়েটা বোনের মেয়ে বলে তার এতো দরদ! তিনি ফোন বের করে আফরানের ফোনে কল করলেন। কিছুক্ষণ পরই তা রিসিভ হলো,

“আসসালামু আলাইকুম, বাবা। কেমন আছ? তুমি হঠাৎ ফোন করলে যে!”

তিনি সচরাচর ছেলেকে ফোন করেন না। আফরান একটু অবাক হলেও মনে মনে অসময়ে ফোন করার কারণ অনুমান করে ফেলল। আমিনুল ইততেয়াজ সালামের জবাব দিমে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

“একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য ফোন করতে হলো।”

“কি বিষয়, বাবা?”

“তুমি নাকি তোমার খালামনির ছোট মেয়েটাকে বিয়ে করেছ! এটা কি সত্যি?”

আফরানের অনুমান সঠিক হলো। সে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

“হ্যাঁ। মা তো বোধহয় সব বলেছে তোমাকে। তারপরও এই প্রশ্ন কেন?”

তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“দ্যাখো আফরান, মেয়েটা মিডলক্লাস ফ্যামেলির। তার উপর কালো। তোমার সাথে কোনো দিক থেকে তাকে মানায় না। ওর কোনো যোগ্যতা নেই তোমার পাশে দাঁড়ানোর। তুমি..”

কথার মাঝপথে আফরান তাকে থামাল। শান্ত অথচ তেজি কন্ঠে বলল,

“বাবা, তুমি কি ভুলে যাচ্ছ যে, যাকে তুমি মিডলক্লাস কালো মেয়ে বলে অপমান করছ সে আমার বউ? ধর্মীয় এবং আইন অনুযায়ী আমার স্ত্রী সে? তোমার ছেলের বউ? ইততেয়াজ বাড়ির বড় ছেলের বউ?”

আমিনুল ইততেয়াজ ভড়কালেন। তার ছেলে ওই মেয়ের প্রতি ভীষণ পজেসিভ তিনি টের পেলেন। কিছু বলতে নিলেই আফরান আবার বলে,

“আজ আমি শান্ত থাকলাম, বাবা। ওই বাড়িতে আমার স্ত্রীর যেন কোনো প্রকার অসম্মান, অমর্যাদা না হয়। যদি হয় তবে ভুলে যাবে তোমার একটা ছেলেও আছে।”

শীতল কন্ঠে কথাগুলোর ইতি টেনে সে ফোন কেটে দিল। আমিনুল ইততেয়াজ হতভম্ব হলেন। তার ছেলে মেয়েটার ব্যাপারের এতো সিরিয়াস! মিসেস সাইমা তাকে বিস্মিত হতে দেখে মৃদু হাসেন। বললেন,

“ছেলে দেশে ফিরলে সামনাসামনি বোঝা পড়া করবেন নাহয়। এখন কি আপনার খাবার বাড়ব?”

আমিনুল ইততেয়াজ চোরা চোখে তাকালেন। কড়া কন্ঠে বললেন,

“তোমার খাবার তুমি আর তোমার ওই বোনঝি মিলে খাও।”

গটগটিয়ে হেঁটে রুমের দিকে অগ্রসর হলেন। বাইরে থেকে খেয়ে এলেও প্রকাশ করলেন না। নাহলে রাগটা ঠিক দ্যাখানো যাবে না। তার যাবার পর মিসেস সাইমা আবার হেসে ফেললেন। আমিনুল ইততেয়াজ যে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছেন এই খবর তিনি আগেই পেয়েছেন। তিনি কাজের মেয়েটাকে সব গুছিয়ে রাখতে বলে রুমে গেলেন। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে আজ একটু দ্রুতই, শুধু তারা দুজন বাকি আছেন।

ফারদিন বাড়ি ফিরল বেশ রাত করে। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পার করেছে ইতোমধ্যে। কলিং বেল বাজালে পায়েল দরজা খুলে দিল। আগে ফারদিন ডুবলিকেট চাবি দিয়ে ভেতরে ঢুকত। কিন্তু পর পর কিছু দিন পায়েল কে জেগে বসে থাকতে দেখে সে আর ডুবলিকেট চাবি ব্যবহার করে না। সে ড্রয়িং রুমের কমন ওয়াশ রুম থেকে হাত, পা, মুখ ধুয়ে এলো। পায়েল খাবার বেড়ে সাজিয়ে রেখেছে। সে এগিয়ে এসে পায়েলের ওড়নায় মুখ মোছে। চেয়ারে বসে বলে,

“খেয়েছ?”

“হু।”

ফারদিন খাওয়া শুরু করে বলে,

“পড়ালেখা নেই? আমার জন্য এখানে বসে থাকতে বলেছি আমি?”

“এতোক্ষণ তো পড়ছিলাম। আপনি এসেছেন বলেই নিচে এসেছি।”

ফারদিন হাত চালিয়ে মিনিটে খাওয়া শেষ করল। প্লেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে পায়েল তাকে থামিয়ে বলল,

“আমি নিয়ে যাচ্ছি। আপনি রুমে যান।”

ফারদিন তার হাতে প্লেট দিয়ে চলে গেল। পায়েল সব গুছিয়ে ড্রয়িং রুমের লাইট নিভিয়ে রুমে গেল। ফারদিন চেঞ্জ করে ফেলেছে। পায়েলের জন্য সে রোজকার অভ্যাস বাদ দিয়েছে। সে চায় না পায়েল তার সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ুক। সে চায় পায়েল নিজের ইচ্ছে মতো চলাফেরা করুক। পায়েল রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে ফারদিনের দিকে চেয়ে রইল অপলক। এই মানুষটাকে নিয়ে তার মনে অল্পবিস্তর অনুভূতি ছিল, যা কদিনে প্রচণ্ড ভালোবাসার রূপ নিয়েছে। লোকটাকে কীভাবে ও এতোটা ভালোবেসে ফেলল তা নিজেও জানে না। আচ্ছা? ফারদিন যদি তাকে ছেড়ে দেয়? কোনো দিন যদি বলে, ‘তোমার প্রতি সকল দায় বদ্ধতা আমার শেষ। এবার তুমি যেতে পার।’ তখন পায়েল কি করবে? কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? বাঁচবেই বা কীভাবে? পায়েলের বুকের মাঝে কামড়ে ওঠে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সে পারবে না।
তাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারদিন জিজ্ঞেস করে,

“এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কি হয়েছে?”

বলতে বলতে সে রুমের দরজা লক করে। মেজাজটা আজ ভালো নেই। বাবার এই ব্যবসায় এতো ঝামেলা জানলে সে না পরীক্ষা দিত আর না ব্যবসার কাজ শিখতে চায়ত। থাকত মাস্টার্সে ঝুঁলে। সে চেয়ে দেখল পায়েল বিছানা ঠিক করেনি। সে কিছু বলল না, নিজেই ঠিক করতে উদ্যত হলো। এর মধ্যে পায়েল বলল,

“আপনি আমাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছেন, তাই না?”

তার হাত থেমে গেল। শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

“কি বললে?”

পায়েল এই লোকটাকে ভয় পায়। কিন্তু আজ সে বলবে। আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। নাহলে হুট করে কোনোদিন ফারদিন তাকে ছেড়ে দিলে সে ধাক্কা পাবে, পাগল হয়ে যাবে। তার থেকে ভালো ফারদিনের থেকে সব প্রশ্নের জবাব নেবে। সে শক্ত কন্ঠে বলল,

“আপনি আমাকে দয়া করেছেন? আর এই দয়া,। এই দায়বদ্ধতা শেষ হয়ে গেলে আমাকে ছেড়ে দেবেন, না?”

ফারদিন শান্ত রইল। তার মধ্যে জ্বলতে থাকা ভয়’ঙ্কর রাগের আগুন পায়েল দেখল না। দেখলে কি আর এসব বলে যেতে পারত? সে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলে,

“কি হয়েছে? এসব কথা কেন উঠছে হঠাৎ?”

পায়েল তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। আজ দমে গেলে চলবে না। হয় ছেড়ে দেবে নয়তো সারাজীবনের জন্য আঁকড়ে ধরবে। বলল,

“আমি আপনার উপর বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। অনেক তো বোঝা হলাম, আর কতো? আপনি বরং আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন। আমি চলে যাব, হোস্টেলে থাকব। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাব।”

বলতে বলতে সে চোখে চোখ রাখল। তৎক্ষণাৎ ভয়ে আঁতকে উঠল। তার র’ক্তিম চোখজোড়া দেখে র’ক্ত হীম হয়ে এলো। ফারদিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

“কি বললি তুই! আবার বল? ওই ওয়ার্ডটা আবার উচ্চারণ কর।”

পায়েল কাঁপতে থাকল থরথরিয়ে। এই লোকের ভয়াবহ রাগ সম্পর্কে সে অবগত। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হয়নি সেভাবে। ফাঁকা ঢোক গিলে বলার চেষ্টা করল,

“আ আপনি আম আমাকে ডি ডি..”

বাকিটা বলার আর রাস্তা রইল না। ফারদিনের রুক্ষ শুষ্ক অধরের মাঝে আটকা পড়ে গেল তার অধর। লতানো দেহ সে শক্ত হাতে পেঁচিয়ে ধরল। চক্ষুদ্বয় মুদে এলো তার। কিছু মুহূর্ত বাদে ফারদিন তাকে ছেড়ে দিল। ধাক্কা মে’রে বিছানায় ফেলে চোয়াল শক্ত করে বলল,

“ডিভোর্স! ডিভোর্স চায় তোর, তাই না? খুব শখ ডিভোর্স নিয়ে অন্য কারোর সাথে ঘর করার? আজকের পর থেকে এই শব্দটা সারাজীবনের জন্য ভুলে যাবি।”

সে আলো নিভিয়ে এগোলো। এগোতে এগোতে তার সদ্য পরিধান কৃত টিশার্ট স্থান পেল রুমের এক কোণে। পায়েলের মুখোমুখি হতেই সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে চায়ল কিছু। তবে ফারদিন সে সুযোগ দিল না। তার কঠোর ছোঁয়ায় পায়েলের চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াল। তবে ধীরে ধীরে সে ছোঁয়া শান্ত হলো, আদুরে হলো। ভালোবাসার স্রোতে ভেসে সে অন্য জগতে যেতে বাধ্য হলো।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৩

অশান্ত রাতের পর শান্ত এক সকাল। পাখিদের কিচিরমিচির কলরব জানান দিল যে তারাও জেগেছে। তো তারা কেন ঘুমিয়ে আছে এখনও? এতে তাদের তীব্র আপত্তি। ফারদিন মুখ কুঁচকে নিল চোখে আলোর ছটা পড়ায়। নড়তে গিয়ে বক্ষ মাঝে কারো অস্তিত্ব টের পেল। সতর্ক হলো সে। রাতের রাগের বশে করা কর্মকাণ্ড একে একে ভেসে উঠল চোখের সম্মুখে। ভীষণ অপরাধ বোধ হলো তার। রাগের মাথায় এমনটা করা একদমই উচিত হয়নি। তার ঠান্ডা মাথায় সবটা শোনা উচিত ছিল, সমাধান করা উচিত ছিল। তা না করে উল্টো! সে পায়েল কে টেনে বালিশে শুইয়ে দেয়। পায়েল নড়ে চড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে যায়। দৃশ্যমান হয় গ্রীবা দেশে জ্বল জ্বল করতে থাকা প্রণয়ের চিহ্ন। গলা থেকে ঘাড় এবং বুকের কাছের ক্ষত দেখে ফারদিন পুনরায় অনুতপ্ত হলো। হাত বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিল। মৃদু কন্ঠে ডাকল,

“পায়েল?”

পায়েল নড়ে ওঠে, তবে জাগে না। সে আবার ডাকে,

“পায়েল ওঠো।”

সে পিটপিট করে চোখ খোলে। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে ফারদিন কে চেয়ে থাকতে দেখে ভড়কে ওঠে হঠাৎই। রাতের মুহূর্ত মনে পড়তেই ভয়ে, লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসতেই মুচড়ে ওঠে ব্যথায়। মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। কাঁপতে থাকে থরথর। ফারদিন তাকে আগলে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“রিল্যাক্স, শান্ত হও।”

পায়েল এই ছোঁয়ায় যেন আহ্লাদ পেল। ডুকরে কেঁদে উঠল। ফারদিন শান্ত থাকে। অনবরত হাত চলে তার চুলে। ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় চুলের ভাজে। কিছু মুহূর্ত পর বলে,

“স্যরি! রাতে আমার কি হয়েছিল জানি না। আমার মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিল। তার উপর তুমি ওসব কথা বলেছিলে। আমি রেগে গিয়েছিলাম, কোনো জ্ঞান ছিল না আমার। ভীষণ বাজে ব্যবহার করলাম। আবারও স্যরি বলছি।”

পায়েল নাক টেনে শান্ত হয়ে যায়। লেপ্টে থাকে তার বুকে। এই লোকটার রাতের ব্যবহারে সে কঠোরতাও পেয়েছে আবার কোমলতাও। সে কঠোর ব্যবহারের জন্য কষ্ট পাবে নাকি কোমল ব্যবহারের জন্য খুশি হবে বুঝতে পারছে না। ফারদিন কোমল স্বরে বলে,

“ফ্রেশ হতে হবে। পারবে?”

পায়েল চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল। কি লজ্জা! সে হেঁটে ওয়াশ রুম পর্যন্ত যেতে পারবে না, সেটা কি বলা যায়? সে মিনমিন করে বলে,

“প পারব।”

ফারদিন তাকে ছেড়ে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“ঠিক আছে, তুমি আগে ফ্রেশ হও তারপর আমি যাচ্ছি।”

সে গায়ের চাদর শক্ত করে চেপে ধরে এক পা মেঝেতে ফেলল। পরক্ষণেই ব্যথায় কুঁকড়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। অসম্ভব যন্ত্রণা পুরো শরীর জুড়ে। ফারদিন সবটা বুঝল, ঝট করে কোলে তুলে ওয়াশ রুমে নামিয়ে দিল। চোখের পলকে কি হয়ে গেল, পায়েল চেঁচাতেও‌ পারল না। ফারদিন তার জামাকাপড় বের করে তার হাতে দিল। সে দরজা আটকে লম্বা শ্বাস নিল। শাওয়ারের নিচে দাঁড়াতেই ক্ষতগুলো ছ্যাৎ করে উঠল। পায়েল চোখ বন্ধ হাসে। রেগে থাকার কথা থাকলেও সে বিন্দু মাত্র রেগে নেই। কষ্টও হচ্ছে না। একটু ভয় ছিল, কিন্তু ফারদিন স্যরি বলার পর তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তার ছোঁয়ায় যে ভালোবাসা পেয়েছে সে। ভালোবাসাই তো চেয়েছিল সে, হোক না একটু যন্ত্রণাময়?

শাওয়ার শেষে দরজা খুলতেই ফারদিন কোথা থেকে হাওয়ার বেগে ছুটে এসে পায়েলকে তুলে বিছানায় নামিয়ে দিল। সে এবারও কিছু বলতে পারল না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফারদিন ফ্রেশ হয়ে আসে। গায়ে শার্ট জড়াতে দেখে পায়েল জিজ্ঞেস করে,

“কোথাও যাচ্ছেন? এতো সকালে!”

সে ব্যস্ত হাতে শার্টের বোতাম লাগিয়ে জবাব দেয়,

“হু, একটু কাজ আছে। যাব আর আসব। তুমি রুম থেকে বের হবে না।”

হুকুম জারি করে সে প্রস্থান করল। পায়েল বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। লম্বা করে শ্বাস টেনে নিল। এখন একটু ভালো লাগছে। তবে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে ঘুমাবে না ঘুমাবে না ভেবেও ঘুমিয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর ঘুমের মধ্যে মনে হলো কেউ তাকে দূর থেকে ডাকছে। সে আড়ামোড়া ভেঙে তাকাল। ফারদিন তাকে ধরে উঠিয়ে বসায়। একটা প্লেট এবং বাটি সামনে রাখে। পায়েল ঘুম ঘুম চোখে তাকায়। চেয়ে বলে,

“বাইরে থেকে নাস্তা এনেছেন!”

“হ্যাঁ, খেয়ে নাও।”

পায়েলের ভীষণ অলসতা লাগছে। সে বলে,

“আমি খাব না এখন। পরে।”

ফারদিন শান্ত চোখে চেয়ে তার পাশে বসে। হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে মুখ খাবার তুলে ধরে। পায়েল খেয়াল করে না কোনো কিছু। ঘুমে দুলতে দুলতে সে খাওয়া শেষ করে। খাওয়া শেষে ফারদিন মুখের মধ্যে দুটো ওষুধ চালান করে দিল। পায়েল দেখলও না, শুনলও না। ওষুধ গিলে সে আবার শুয়ে পড়ল। খুব ঘুমে ধরেছে তাকে। ফারদিন মৃদু হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“ঘুমাও।”

ডাইনিং টেবিলে সকলে বসেছে সকালের নাস্তা সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে। দৃষ্টি মাথা নিচু করে বসে আছে। খাবার ঠিক গলা দিয়ে নামছে না। খাওয়ার মাঝে সে বলল,

“খালামনি, আমি বাড়িতে চলে যাই?”

মিসেস সাইমা বিস্মিত হলেন। তিনি মুখ খোলার আগে মিসেস অনা বললেন,

“সে কি? মাত্র কদিনই তো হলো শশুর বাড়িতে এলে। আর আজই আবার যাবে? না না, তা কি করে হয়?”

দৃষ্টি জবাব দিল না। মিসেস সাইমা শান্ত কন্ঠে বললেন,

“বাড়িতে যেতে চায়ছিস কেন? কিছু হয়েছে? বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে?”

সে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি দেয়। তার মন খারাপ করছে না। মিসেস সাইমা বুঝে নিলেন কিছু। দৃষ্টির কানে নিশ্চয় আমিনুল ইততেয়াজের কটু কথা গিয়েছে, তাই সে এমন করছে। তিনি বললেন,

“ঠিক আছে। আপাতত বাড়ি যাবার কথা বাদ। আর কদিন পর যাস।”

দৃষ্টি আর কিছু বলল না। আমিনুল ইততেয়াজ এবং তিয়াস ইততেয়াজ নাস্তা করে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলেন। দৃষ্টি অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে চলে যাবে। কিন্তু মিসেস সাইমা তা হতে দিলেন কই? খাওয়া শেষে মিসেস সাইমা বললেন,

“কলেজ যাবি আজ?”

দৃষ্টি জবাব দেওয়ার আগে তিনি আবার বললেন,

“থাক, আজ আর যেতে হবে না। কাল যাস।”

দৃষ্টি তার কথার বিরোধিতা করল না। রুমে গেল না আর। বসে রইল ড্রয়িং রুমে। ওই রুমে ওর ভীষণ অস্থির লাগে। মনে হয় আফরান চারপাশে ঘুর ঘুর করে। ঘুম আসে না। পুরো রুম জুড়ে যেন আফরানের গায়ের সুবাস ভেসে বেড়ায়। দম বন্ধ লাগে তার।
দৃষ্টি শান্ত হয়ে বসে থাকলেও ফারনাজ শান্ত হয়ে নেই। সে পুরো বাড়ি টো টো করে ঘুরে ছাদে থামল। বিশাল বড় ছাদ। ফারনাজ অনেক আগে এখানে এসেছে বলতে গেলে বছর চার আগে। আমিনুল ইততেয়াজ যে তাদের বিশেষ পছন্দ করেন না সেটা তারা জানে। তারপর থেকেই যাওয়া আসা কমিয়ে দিয়েছে তারা। ফারনাজ মুখ বাঁকায়। আঙ্কেল পছন্দ করে না, তাই কি? খালামনি তো আছে। সে ছাদের এক পাশ থেকে ঘুরে অন্য পাশে গেল। সেখানে ব্যায়ামরত পুরুষকে দৃষ্টিগোচর হতেই থেমে গেল সে। তার কাছে দৃশ্যটা এতো ভালো লাগল! যে সে স্থান, কাল, পাত্র ভুলে সে নির্লজ্জের মতো চেয়ে রইল। হৃদস্পন্দনের গতি যে কখন অস্বাভাবিক হয়ে গেল তাও টের পেল না।

ব্যায়ামরত পুরুষটি থামে। ফারনাজের দিকে এক পলক তাকিয়ে বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি শেষ করে। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,

“ওভাবে হা করে তাকিয়ে আছ কেন? খেয়ে ফেলবে নাকি?”

ফারনাজ হকচকায়। নজর সরিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। ঢোক গিলে ওড়নায় কপালের ঘাম মোছে। তার কি হয়েছিল হঠাৎ? এভাবে কখনো তো কোনো ছেলের দিকে তাকায়নি সে। যাদের সাথে এতো দিন রিলেশনে ছিল তাদের সাথেও না। বক্ষমাঝে এমন কম্পন আগে কখনো অনুভব করেনি। সে আমতা আমতা করে বলে,

“ও ওই গাছে একটা পাখি বসে আছে সেটা দেখছিলাম।”

তূরাগ ভ্রু কুঁচকে তাকায়,

“হ্যাঁ বিশ্বাস করে নিলাম। কচি খোকা তো আমি?”

নিজের সাফাই গেয়ে সে বলে,

“আসলে আপনি যে এখানে ছিলেন তা আমি জানতাম না। ভুল করে চলে এসেছি।”

তূরাগকে ডাইনিং টেবিলে না দেখে সে মাথা ঘামায়নি। তার ভেবে কি কাজ? কিন্তু সে যে এখানে লাফালাফি করছে তা কি সে জানত? তূরাগ তোয়ালেতে ঘাম মুছতে মুছতে বলে,

“এবার বেরোল তো সত্য কথা?”

ফারনাজ ধরা পড়ে যাবায় কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সে উল্টো ঘুরে পা বাড়াতে নিলে তূরাগ আবার বলে,

“বেশি ঘুর ঘুর করবে না। গোলক ধাঁধায় আটকে গেলে কিন্তু আর বের হতে পারবে না। সাবধান করে দিলাম।”

ফারনাজ কথাটা ঠিক বুঝল না। জিজ্ঞাসু সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“কেন ঘুরব না? আর কোন গোলক ধাঁধা? আমি তো কিছুই বুঝলাম না।”

তূরাগ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। যেন তাচ্ছিল্য করা হলো তাকে। বলল,

“তোমার মোটা মাথায় ঢুকবে না।”

বলেই সে হনহনিয়ে প্রস্থান করে। ফারনাজ বোকার মতো চেয়ে থাকে। হুট করেই মনে হয় এই কথাটা সে আগেও শুনেছে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে মনে করতে পারে না। নিজের উপর রেগে সে নিজেকে বকতে বকতে ছাদ থেকে নেমে গেল।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৩৪

“আমার চলে আসার কথা শুনে ভাইয়া কোনো রিয়্যাক্ট করেনি?”

“কি বলিস! তোর ভাই করবে রিয়্যাক্ট! তার মধ্যে কোনো অনুভূতি আছে আদৌ?”

দৃষ্টি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,

“অনুভূতি যে নেই তা তো দেখতেই পাচ্ছি।”

পায়েল হকচকিয়ে গলার ওড়না ঠিক করে বসে। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠ বলে,

“আমাদের মতো কি সে ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? আমি বলার আগে থেকেই সে জানে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কীভাবে জানেন? তখন বলল, ‘আমি বাড়ির সবার মতো ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না। যে বাড়ির মেয়ের হুট করে বিয়ে হয়ে গিয়েছে আর কেউ কিছু জানে না। আমার বোনের বিয়ে হয়ে যাবে আর আমি জানব না? আমি সব জানি। আফরান ভাই ভালো মানুষ বলে চুপ করে ছিলাম।’ তাহলে ভাব তোর ভাই কেমন?”

দৃষ্টি চুপ থাকে। আসলে তাই ভাই অদ্ভুত, একটু না অনেকটা। তবে তাদের সবাইকে খুব ভালোবাসে সে, প্রকাশ করে না।

“তুই ও বাড়িতে ভালো আছিস তো, দৃষ?”

দৃষ্টি বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,

“এই কথা তুই ক’বার জিজ্ঞেস করলি? কতবার বলতে হবে তোকে? আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি।”

পায়েল ছোট্ট শ্বাস ফ্যালে। সকলে তো তার ভালো থাকাটাই চায়। ভালো থাকলেই সব ভালো।

খালামনির বাড়ি থেকে শশুর বাড়ি হয়ে যাওয়া বাড়িতে এসে দৃষ্টিকে সারাদিন বসে থাকতে হয়। খালামনি তাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। সে কিছু করতে চায়লে বলেন,

“তোর কোনো কাজ করার দরকার নেই। আমি আছি, অনা আছে। তাছাড়া বাড়িতে কাজের লোকও তো আছে। তোকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না। তুই পড়ালেখা কর শুধু। আমার আফরানের মতো ডাক্তার হতে হবে তো, নাকি?”

দৃষ্টি মুখে কুলুপ এঁটে সরে আসে। তার ওই লুচু ডাক্তারের মতো ডাক্তার হতে বয়েই গেছে। সে হবে গাইনোকলজিস্ট, হার্ট সার্জন হওয়া তার দ্বারা হবে না। রুমে সে চুপচাপ বসে থাকে। আফরানের বারান্দাটা বেশ বড়ো। সেখানে বলতে গেলে কিছুই ছিল না, শুধু কয়েকটা এক্সসারসাইজ করার সরঞ্জাম ব্যতীত। দৃষ্টি সেখানে বেশ কিছু ফুল গাছ রেখেছে, টবে করে। এতে বারান্দার সৌন্দর্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে ভেবেছে একটা দোলনা কিনে এনে রাখবে। এখানে বসে থেকে পূর্ণিমার রাত উপভোগ করতে বেশ লাগবে। দৃষ্টি ভাবল খালামনিকে নাহয় তূরাগ ভাইয়াকে বলবে সে দোলনার কথা।
এসব কিছু ভাবতে ভাবতে তার চোখ গেল বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলে। সেখানে আফরানের একটা ছবির ফ্রেম রাখা আছে। প্রায়ই ঘুমাতে গেলে দৃষ্টির চোখ ওখানে যায়। তারপর ঘুমের মধ্যে যে এতো দুঃস্বপ্ন দ্যাখে, তা বলার মত নয়। সে খপ করে ছবিটা হাতে নিল। ছবিতে হাস্যরত আফরান। সে চোখ পাকিয়ে চেয়ে বলল,

“আমাকে জ্বালিয়ে আপনার খুব মজা লাগছে না? একবার দেশে আসুন না? আপনার সব মজা আমি ভাতে দিয়ে খাব। তারপর আমি শান্তিতে থাকব। দেশ ছেড়ে বিদেয় হয়েও আমাকে একটু শান্তি দিল না, লোকটা!”

দৃষ্টির খুব রাগ তার উপর। সে ব্যাগ হাতড়ে মার্কার বের করে। ইচ্ছে মতো আফরানের ছবির বারোটা বাজিয়ে সে শান্তির শ্বাস নেয়। এখন ভালো লাগছে। ছবির বদলে যদি ওই লোকটাকে পেত তাহলে আরও ভালো লাগত। তার চুল ছিঁড়ে ন্যাড়া বানিয়ে দিত। তারপর সবাই বলত ন্যাড়া ডাক্তার। দৃষ্টি আনমনে হেসে ফ্যালে। এই রুমে থাকতে থাকতে তার মনে হয় আফরান তার খুব কাছে। প্রথম প্রথম অস্বস্তি হলেও এখন ভালো লাগে। সে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে আফরানের একটা সাদা শার্ট বের করল। আফরান কিছু জামাকাপড় নিয়ে গিয়েছে আর বাকি সবটাই আছে। দৃষ্টি সেটা বিছানার উপর মেলে রাখে। তারপর অনবরত মার্কার চালায়।
লুচু ডাক্তার, অ’স’ভ্য ডাক্তার, বদমাশ ডাক্তার, আরও কিছু লিখে সাদা শার্ট ভরিয়ে ফেলল। তারপর ফুরফুরে মেজাজে শার্ট জায়গায় রেখে রুম থেকে বের হলো।
তূরাগ বাড়িতে নেই। আজ তার একটা কনসার্ট আছে। আর আমিনুল ইততেয়াজ ও তিয়াস ইততেয়াজের তো অফিস আছেই। বাড়িতে বাদ বাকি তারা। দুপুরের রান্না এখনো বসানো হয়নি। তারা সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে। আর মাঝে মধ্যে ফারনাজ ও মিসেস অনার কথা ভেসে আসছে। দুজনের মধ্যে যে এতো ভাব হয়েছে! দৃষ্টি এগিয়ে যায়, আজ সে কলেজ যাবে না। তো কিছু করা যাক। বলে,

“খালামনি, আজ আমি রান্না করি? প্লিজ?”

মিসেস সাইমা ভাবলেন নাকোচ করে দেবেন। কিন্তু মেয়েটার এতো আগ্রহ দেখে তিনি বারণ করতে পারলেন না। বললেন,

“আচ্ছা বেশ। কি রান্না করবি?”

দৃষ্টি একটু ভেবে বলে,

“চিংড়ির মালাইকারি আর সর্ষে ইলিশ। আর যা করা লাগে তুমি কোরো।”

তিনি হেসে বললেন,

“ঠিক আছে।”

কাজের মেয়েটাকে বলে দিলেন দৃষ্টিকে সাহায্য করার জন্য। দৃষ্টি রান্নাঘরে গেল। সে প্রায়ই রান্না করত, শখের বশে। সে থেকেই মোটামুটি রান্নাটা আয়ত্তে এসেছে। খুব যত্ন করে সে রান্না করে। চারদিকে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়লে কাজের মেয়েটা বলে,

“খুব সোন্দর ঘ্রাণ বাইর হয়তেছে, ভাবী। না জানি খাইতে কত্তো স্বাদ হবে।”

দৃষ্টি হাসে। বাকি সব খালামনিকে করতে বললেও সে নিজেই সম্পূর্ণ রান্না শেষ করে বের হয়। চিংড়ি আর ইলিশের সাথে সে বেগুন ভাজা করল। একটা টিভিন বক্সে ভরে রাখল। মিসেস সাইমা এসে দেখে বললেন,

“টিফিন বক্স কার জন্য?”

“আঙ্কেল দের জন্য।”

“কিন্তু ওরা তো অফিসে খায়।”

“আজ নাহয় বাড়ি থেকে খাবার যাবে। তুমি কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও।”

মিসেস সাইমা দ্বিরুক্তি না করে মৃদু হেসে টিফিন বক্স নিয়ে চলে গেলেন। ফারনাজ এসে আদুরে হাতে ওড়না দিয়ে তার ঘাম মুছে দেয়। অতঃপর তাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,

“কি রে! শশুর কে তেল লাগাচ্ছিস?”

“না, পে’ট্রোল।”

দুপুরে সবাই মিলে খাওয়া শেষ করে। দৃষ্টি কাজের মেয়েটাকেও তাদের সাথে জোর করে বসিয়ে খাওয়ায়।

রাতে ফিরে খেতে বসে মিসেস সাইমা চমকে গেলেন আমিনুল ইততেয়াজের কথায়,

“দুপুরে যে চিংড়ি আর ইলিশ পাঠিয়েছিলে, ওগুলো কি আর আছে?”

তিয়াস ইততেয়াজও বলেন,

“হ্যাঁ ভাবী, ওগুলো আর নেই?”

“কেন বলুন তো? আপনারা তো রাতে ভারী কিছু খান না।”

আমিনুল ইততেয়াজ বলেন,

“কতদিন পর যে এতো ভালো খাবার খেলাম! এখনো জিভে লেগে আছে। আমি আর তিয়াস তো কাড়াকাড়ি করে খেলাম। ভাগ্যিস কেউ দ্যাখেনি, নাহলে কি যে ভাবত। এতো সুন্দর রান্নার জন্য তুমি আমার কাছে কিছু চায়তে পারো, যা ইচ্ছে। আমি দিতে চাই।”

মিসেস সাইমা হেসে ফেললেন। মিসেস অনা রান্নাঘরে গিয়ে খাবারগুলো গরম করে নিয়ে এলেন। খাবার খেতে গিয়ে দু ভাই আবার কেড়ে কেড়ে খেল। মিসেস সাইমা গালে হাত দিয়ে বললেন,

“এতো ভালো হয়েছে খেতে!”

“হ্যাঁ, তোমার হাতের খাবার তো রোজ খাই। কিন্তু এমন স্বাদ তো আগে পাইনি। নাকি তুমি আগে ভালো করে রাঁধোনি?”

“এগুলো আমি রান্না করিনি। আপনার ছেলের বউ রান্না করেছে।”

আমিনুল ইততেয়াজের হাত থেমে গেল। কিন্তু এমন খাবার অগ্রাহ্য করা যায় না‌। তিনি আবারও খেতে শুরু করলেন। মিসেস সাইমা আবার বললেন,

“কিছু দিতে চায়লে তাকে দিন। মেয়েটা আজ একটা দোলনার কথা বলছিল। বারান্দায় রাখার খুব শখ ওর।”

আমিনুল ইততেয়াজ তাচ্ছিল্য করে বললেন,

“যে মেয়েকে আমি তাড়াতে চাই, তার জন্য দোলনা এনে দেব! পাগল পেয়েছ আমাকে?”

“আমি কিছু দিতে চেয়েছিলেন, তাই বললাম। দেবেন কি দেবেন না সেটা আপনার ব্যাপার। আবার এটা ভাববেন না ও আপনাকে খাইয়ে সব কিছু আদায় করতে চায়ছে। ওর কোনো চাহিদা নেই। আর ওর দোলনা কিনে দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই। তূরাগ নিয়ে আসবে ওর বোনের জন্য।”

আমিনুল ইততেয়াজ খেয়ে উঠে গেলেন। তূরাগ আবার মেয়েটাকে বোন বানিয়েছে, ভাবী তো ডাকে না কখনো। বোনের মতো আহ্লাদ করে। এতো আদিখ্যেতা তিনি পছন্দ করেন না মোটেও। তিনি তো তক্কে তক্কে আছে যে আফরান দেশে ফিরলেই কোনো ভাবে মেয়েটাকে বিদেয় করবেন। আর বিজনেস পার্টনারের মেয়ের সাথে আফরানের বিয়ে দেবেন। কিন্তু আফরান আসার আগ পর্যন্ত যেহেতু মেয়েটা এখানে থাকছে, তার একটা ইচ্ছে পূরণ করায় যায়। মেয়েটার রান্নার হাত ভালো, ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছেন তিনি। তার বদলে একটা দোলনা কিছুই না।

পরদিন দৃষ্টি কলেজ থেকে ফিরে চমকে গেল। সুন্দর একটা দোলনা তার বারান্দায় মৃদু বাতাসে দুলছে। দু’জন বসা যাবে এমন বড়ো একটা দোলনা। দৃষ্টি যে কতো খুশি হলো! সে ফ্রেশ না হয়েই দৌড়ে খালামনির কাছে গেল। তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, খালামনি। আই লাভ ইউ।”

মিসেস সাইমা তার মাথায় হাত রেখে মৃদু হেসে বলেন,

“দোলনার জন্য থ্যাঙ্কস্ দিচ্ছিস? কিন্তু সেটা তো আমি আনিনি।”

“তবে কে এনেছে? তূরাগ ভাইয়া?”

“উহু, তোর শশুর বাবা। তাকেই থ্যাঙ্ক ইউ দে।”

দৃষ্টির হাসি থেমে গেল। বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল। আমতা আমতা করে বলল,

“মানে উনি! কিন্তু কেন?”

“এনেছেন, ওনার ইচ্ছে হয়েছে ছেলের বউকে কিছু দেওয়ার।”

“খালামনি!”

“আচ্ছা, খালামনি আর কতদিন শুনতে হবে? মা ডাক শুনব কবে?”

দৃষ্টি মাথা নিচু করে বলল,

“সবটা স্বাভাবিক হলে তারপর। তুমি বলো না, উনি কেন আমার জন্য দোলনা এনেছেন?”

মিসেস সাইমা সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বললেন,

“তোর রান্না খেয়ে খুশি হয়েছেন, তাই।”

দৃষ্টি কিছু না বলে রুমে চলে গেল। চায়লেও আমিনুল ইততেয়াজের সামনে গিয়ে তাকে ধন্যবাদ দিতে পারবে না সে। অন্য কোনো দিন নাহয় সে ভিন্ন উপায়ে থ্যাঙ্কস্ বলে দেবে। এখন থেকে সে দোলনায় দুলে চন্দ্র বিলাস করবে! তার ভাবতেও ভীষণ ভালো লাগছে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে