Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 397



আরেকটি বার পর্ব-০৫

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৫
#Esrat_Ety

দরজার বাইরে থেকে দরজায় টো/কা দিচ্ছে আজমেরী, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুমা।
রাওনাফ গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে রুমা বলে,”ভাবি উঠেছে ভাইয়া?”

রাওনাফ কিছু বলে না। দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। ওয়াশরুমে ঢোকে। আজমেরী আর রুমা ভিতরে ঢোকে।
উর্বী দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে মুখে সং/কোচ।
আজমেরী বলে,”বেলা ৯টা বেজে গিয়েছে। খিদে পায়নি?”

উর্বী হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। তার খিদে পেয়েছে।

_মনে হচ্ছে এখনো ফ্রে/শ হওনি। যাও গিয়ে চোখে মুখে পানি দাও।আজ কিন্তু অনুষ্ঠান। বাড়িতে রাজ্যের মানুষ আসবে। গয়নাগুলো পরে থেকো আজ, খালি গলায় থেকো না।

উর্বী মাথা না’ড়ায়। সে পরবে।

রুমা বলে,”তোমাকে বিয়েতে যে গোলাপি জামদানি টা দিয়েছিলাম,ওটা পরবে। ওটায় তোমাকে ভালো মানাবে। দাড়াও আমি বের করছি আলমারি থেকে। ”

উর্বী বলে,”আপা লাগবে না। আমি যখন শাড়ি পাল্টাবো তখন বের করবো।”

_আচ্ছা তাহলে রে/ডি হয়ে ভাইয়াকে নিয়ে নিচে এসো। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে।
আজমেরী আর রুমা চলে যায়। উর্বী গিয়ে আলমারি থেকে শাড়ি বের করে ।

রাওনাফ টেবিলে খেতে বসেছে। তার সামনা সামনি চেয়ারে বসে আছে নাবিল। সে একমনে খাচ্ছে। রাওনাফ আ’ড় চোখে তাকে দেখছে। আজমেরী রাওনাফের প্লে’টে খাবার তুলে দিতে দিতে বলে,”ভাইয়া তুমি রেডি হয়ে আছো কেনো, কোথাও যাচ্ছো।?”

_হ্যা,একটু চে*ম্বা*রে বসবো। কাল বসিনি। আজ যেতেই হবে।

_তোমাকে মা যেতে নি’ষেধ করেছে,আজ বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান।

_মা কে বলে দিস আমি একজন ডাক্তার, সেটা যেনো সে ভুলে না যায়। তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো।

আজমেরী চুপ করে থাকে। নাবিলের খাওয়া শেষ হয়। সে প্লেট সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে এখন তার পাপার রুমে যাবে। গিয়ে তার একটা দায়িত্ব পালন করবে।

নাবিলকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে দেখে মোহনা ফিসফিস করে বলে,”ও আপা। নাবিল ভাইয়ার রুমে যাচ্ছে না তো?”

আজমেরী বলে,”হয়তো ছাদে যাচ্ছে।”

আরে দেখো ডান পাশে মো’ড় নিলো। ছাদের সিঁড়ি তো বাম পাশে।আজমেরী তাকায়। তাইতো! আবার কি করবে এই ছেলে! সেদিন রাতে মায়ের উপর রা’গ করে এই ছেলে বাড়িতে ভা*ঙ*চু*র করেছে। আজ যদি উর্বীকে কিছু বলে!
আজমেরী ছুটে যায়। মোহনাও পিছু পিছু যায়।

রাওনাফ খাওয়া রেখে তাকিয়ে থাকে। এদের আবার কি হলো।

***
শর্মী ছাদে দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কে*টা*রিং-এর লোকজন অনুষ্ঠানের রান্নাবান্নার আয়োজন করছে।
হঠাত পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকে,”শর্মী।”

শর্মী পেছনে ফিরে তাকায়। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অন্তরা। তার মুখ হাসি হাসি।

শর্মীর রা*গ লাগে। সে এই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারছে না। এই মেয়েটার জন্যও আজ বাড়িতে এতো অশান্তি। এতটুকু শর্মী বুঝতে পেরেছে।

“তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে শর্মী? মি*ড টা*র্ম এ’ক্সাম কবে?গানের রেওয়াজ করছো ঠিকভাবে?”
জিজ্ঞেস করে অন্তরা।

শর্মী নিচু স্বরে বলে,”জি করছি।”
তারপর নাক মুখ কু’চকে চলে যায়।

অন্তরা দাঁড়িয়ে থাকে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে বা’বুর্চি দের রান্না বান্না দেখছে। আজ তো তারও রিসিপশনের দিন।

***
উর্বী নিজেকে আয়নায় দেখছে। গোলাপি শাড়িতে তাকে বেশ মানিয়েছে। তার সামনে গয়নার বাক্স। সে বেছে বেছে তার পছন্দমত হালকা গয়না পরছে।
হঠাৎ বাইরে থেকে কেউ দরজায় কড়া না’ড়ে। উর্বী মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।

নাবিল ভেতরে ঢোকে। উর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নাবিল তাকে আরো অবাক করে দিয়ে বলে,”পাপার আলমারির চাবি কোথায়? চাবি দিন।”
উর্বী তর্জনী আ’ঙুল তুলে চাবি দেখায়। টেবিলের ওপর থেকে চাবি নিয়ে নাবিল আলমারি খোলে।

আজমেরী আর মোহনা ঘরে ঢোকে। আজমেরী নাবিলকে জিজ্ঞেস করে,”কি করছো নাবিল! আলমারিতে কি?”

নাবিল কোনো উত্তর দেয় না।
আলমারি থেকে তার মায়ের শাড়ি আর আনু’ষ’ঙ্গিক সবকিছু বের করে আনে। তার মায়ের জিনিসপত্র বের করে আনতে গিয়ে সে উর্বীর সবকিছু ফেলে দেয়। বোঝাই যাচ্ছে এটা ইচ্ছাকৃত।
রাওনাফ ঘরে ঢোকে, হ*ত*ভম্ব হয়ে নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাবিল তার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে, “আমার মাম্মার সব কিছু আমি আমার কাছে রাখবো, এগুলো আর তোমার কাছে সুর*ক্ষিত না পাপা। আমি এগুলো নিয়ে যাচ্ছি।”

নাবিল উর্বীর হাতের দিকে তাকায়। তারপর নিচু স্বরে বলে,”হাত থেকে চু’ড়ি খুলে দিন, ওগুলো আমার মাম্মার।”

উর্বী কিছুটা হতবাক হলেও মুচকি হেসে হাত থেকে চুড়ি খুলতে থাকে। সে জানতো না এটা রাওনাফের প্রথম স্ত্রীর। তাকে বলা হয়নি।

আজমেরী নাবিলকে ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”এসব কি হচ্ছে নাবিল! এত বেয়া*দব হয়েছো তুমি!।”

নাবিল হাসে। উর্বীর হাত থেকে চুড়ি নিতে নিতে বলে,
“আপনি আমাদের কেউ না!”

নাবিল খুবই শান্ত ভাবে শব্দ গুলো উচ্চারণ করে।
রুমে থাকা সবাই হতবাক হয়ে যায়। আজমেরী নাবিলকে কিছু একটা বলতে এগিয়ে আসে। নাবিল সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তার মায়ের জিনিসপত্র নিয়ে বেড়িয়ে যায়। দরজার কাছে রওশান আরা দাঁড়িয়ে আছে। নাবিল সেদিকে তাকায় না।

মোহনা আর আজমেরী নাবিলের পিছু পিছু যায়।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। এগিয়ে এসে নরম গলায় বলে,”আই ক্যা’ন এ’ক্স’প্লে’ইন! ও এমন ছেলেই নয়। আ’ম স্যরি। স্যরি ফর এভ’রিথিং!

উর্বী ম্লান হেসে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”অতটুকু বাচ্চা ছেলের এমন আচরণের কারণ আপনাকে ব্যখ্যা দিতে হবে? আমি ছোট নই! ওর মন’স্তা’ত্ত্বিক দিকটা আমি বুঝতে পেরেছি! ”

“নাবিল দাঁড়াও। নাবিল ডু হো’য়াট আই সে’ইড!”

নাবিল দাঁড়িয়ে তার পাপার দিকে তাকায়। রাওনাফ তার কাছে এগিয়ে যায়, খুবই নরম গলায় বলে,”অনুচিত কাজ কখনোই করোনি তুমি নাবিল। চলো ওনার কাছে স্যরি বলবে। আমি চাইনা নতুন কোনো ব্যক্তি আমার জান বাচ্চা গুলোর প্রতি নে’গে’টিভ ধারণা পো’ষণ করে থাকুক।”

নাবিল মৃদু হে’সে বলে,”পাপা ডো’ন্ট এ’ক্স’পে’ক্ট দিজ ফ্রম মি!”

_আই উইল! কারন তুমি এমন ছেলেই নও। তুমি আমার নাবিল! যে কাউকে কখনো অ’স’ম্মান করে কথা বলে না।

নাবিল কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
রাওনাফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একহাতে এ’প্রো’ন,আরেক হাতে স্টে’থো’স্কোপ নিয়ে।

দোতলা থেকে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে উর্বী।

***
অন্তরা চুলায় চা বসিয়েছে। ছাদ থেকে আসার পর তার ভিষন মাথা ব্যা*থা করছে। ফু’ট’ন্ত গরম পানিতে সে চায়ের পাতা ঢেলে দেয়।পেছন থেকে সামিউল জরিয়ে ধরে। অন্তরা চ’ম’কে যায়। ঘা’ড় ঘুরিয়ে সামিউলকে দেখতে পেয়ে বলে,”ওহহ তুমি! আমি তো ভ’য় পেয়ে গিয়েছি।”
-ভ’য় পাওয়ার কি হলো। তুমি কি ভেবেছিলে ভু’ত?

-না,সেটা ভাবি নি।

অন্তরা পাতিল থেকে কাপে চা ঢেলে নিতে নিতে বলে,”চা খাবে?”

-হুম। খেতে পারি!

অন্তরা তার কাপের চা অন্য একটি কাপে ভাগ করে নেয়। সামিউল বলে,”তোমার কম পরে যাবে নাতো?”
অন্তরা চায়ের কাপে চু’মুক দিতে দিতে বলে,”না,বাজার এনেছো?”

-হ্যা। দেখো লি’স্ট অনুযায়ী সব ঠিক আছে কিনা। সর’ষের তেল টা আনতে ভুলে গিয়েছি। বিকালে এনে দেবো।

অন্তরা চা শেষ করে বাজারের ব্যাগে হাত দেয়। বেগুন,কাঁচামরিচ, ২ হালি ডিম, মশলা পাতি, তিন কেজি চাল, তেল, চিনি, নুন আর একটা ইলিশ মাছ।
সামিউল বলে “আপাতত দুদিন এই দিয়ে খাই। পরে আবার বাজার এনে দেবো। রান্নার পাতিল-হা’ড়ি, থালা বাসন সব আছে না? ”

-হ্যা। রুমা আপা সব দিয়ে গিয়েছে।

-কিছু বলেছে?
জিজ্ঞেস করে সামিউল।

-হ্যা, দুপুরে তোমার বড়ভাই আমাদের ওদের ওখানে খেতে বলেছে। আর রাতেও।

সামিউল কিছু বলে না, চায়ের কাপে শেষ চু’মু’ক দেয়। অন্তরা ইলিশ মাছ কু’ট’তে বসে পরে, সামিউল পাশে বসে অন্তরাকে দেখতে থাকে।

***
রওশান আরা মেজাজ খারাপ করে বসেছিলো। তার কাছে রাওনাফের ফোন এসেছিলো। সে এই বেলা আসতে পারবে না।তাকে হসপিটালে ই মা র্জে ন্সি ডেকেছে। রওশান আরা ভেবে পাচ্ছেন না এখন তিনি উর্বীর পরিবারকে কি জবাব দেবেন। বোনের শ্বশুরবাড়ি এসে যদি নিজের বোন জামাইকে না দেখতে পায়। রা*গে তার মাথা ধরে গিয়েছে।
হঠাৎ সে দেখে অন্তরা তার ঘরের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছে। রওশান আরা রা’গে চেচিয়ে ওঠে।
“মেজো বউ! এই নি’র্ল’জ্জ মেয়েটা ঘুরঘুর করছে কেনো।?”

মোহনা ছুটে আসে। অন্তরাকে বলে,”তুমি মায়ের ঘরের সামনে কেনো এসেছো?”
অন্তরা রওশান আরাকে বলে,”মা আমি ঘুর ঘুর করছি না। ছাদে কাপড় মেলে দিয়ে এসেছি।”
রওশান আরা চেঁ’চিয়ে ওঠে,”এই মেয়ে! খবরদার যদি তুমি আমাকে মা ডেকেছো। মুখ ভে*ঙে দেবো। মেজো বৌ, এই অ*স*ভ্য মেয়েটাকে বলে দাও যেনো সং সেজে বাড়িতে আজ ঘুর ঘুর না করে। রাজ্যের মানুষ আজ বাড়িতে। সবাই নানান প্রশ্ন করছে।”

মোহনা চুপ করে থাকে। অন্তরার চোখ ভিজে ওঠে।

দূরে দাড়িয়ে সামিউল দেখে সে দৃ*শ্য। সে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে অন্তরার দিকে।

***
উর্বীদের বাড়ি থেকে উর্বীর মা বাদে সবাই এসেছে। সবাইকে আজমেরী খুবই আদরের সহিত আ*প্যা*য়*ন করছে।
তহুরা আর রেজাউল এসে উর্বীর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।উর্বী দরজার দিকে তাকায়। কেউ ভিতরে আসছে। দরজা ঠেলে তার ভাই ভাবী ভিতরে ঢোকে। উর্বী শান্ত ভঙ্গিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

বোনকে দেখে রেজাউল কবিরের চোখ ভিজে ওঠে। সে কোমল কন্ঠে বোনকে জিজ্ঞেস করে,”ভালো আছিস বোন?”

-হ্যা,তোমরা ভালো আছো?

-ভালো নেই, তোকে শশুর বাড়িতে পাঠিয়ে আমরা কেউ ভালো নেই।

-কেনো ভালো নেই! উর্বী নামের তোমাদের একটা দু’র্নাম বিদায় হয়েছে। তোমাদের তো ভালো থাকতেই হবে ভাইয়া। জোর করে হলেও ভালো থাকতে হবে।

অ’ত্য’ন্ত ঠান্ডাভাবে জবাব দেয় উর্বী। তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক।

রেজাউল কবির হা’হা’কার করে বলে,”আমি তোর গায়ে হা*ত তুলেছি। তুই আমায় ক্ষমা কর বোন।”

উর্বী বলে,”আমি তোমাদের উপর রা*গ করে নেই ভাইয়া। তোমরা ভুল ভাবছো। আমি আসলে কারো উপরই রা’গ করে নেই।”

তহুরা উর্বীর হাত দুটো মুঠো করে ধরে বলে,”তুই কি জানিস তুই চলে আসার পর থেকে তোর ভাইয়া এক রাতও ঘুমায় নি। সারারাত ছ’ট’ফ’ট করতে থাকে। এই মানুষটার উপর অভিমান করে থাকবি?”
উর্বী তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। রেজাউল কবির রুমাল দিয়ে নিজের চোখ মোছে।
উর্বীর বুক ভে*ঙে কা*ন্না আসে। সে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”আমি ম*রে গেলেও তোমার উপর রা*গ করে থাকতে পারবো না ভাইয়া,আমার অ*ভি*শ*প্ত দিনগুলোতে তুমি সবার মতো আমাকে ঘৃ*না করে দূরে সরিয়ে না দিয়ে আমার পাশে থেকেছো। আজ দুটো থা*প্প*ড় দিয়েছো বলে তোমার বোন তোমার উপর রা*গ করে থাকবে? এটা তুমি ভাবলে কি করে ভাইয়া?”

রাওনাফ দুপুর নাগাদ চলে এসেছিলো। অতিথিদের অসম্মান করার লোক সে নয়। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে উর্বীর বাড়ির সবাইকে খাইয়েছে। যাওয়ার আগে বেশ খানিকক্ষণ তাদের সাথে আলাপ করেছে। নিজের গাড়িতে তাদের পৌঁছে দিয়েছে।

***
শাখওয়াত চৌধুরীর ব্লা*ড প্রে*শার টা আজকাল খুব বেরেছে। সামনে ইলে*ক*শন। গো*দের উপর বি’ষ’ফোঁ’ড়া।
তিনি একা এই চাপ নিতে পারছেন না। কারো উপর যে দায়িত্ব দেবে তেমন কেউ নেই। রা*জ*নীতির লাইনে সবাই মুখে মুখে ভাই ভাই করলেও সুযোগ পেলে পেছনে ছু*ড়ি ঢোকাবেই। সে সবসময় সুস্থ থাকার চেষ্টা করছে। এতো বছরের চেয়ার সে কিছুতেই ছা*ড়বে না। আর ম*ন্ত্রীর পদটাও তারই চাই এবার। সে নিয়মিত প্রে*শার চে’ক করিয়ে ওষুধ নিচ্ছে। তবু ক*ন্ট্রো*লে থাকছে না। তার জন্য তিনি তার স্ত্রী শেফালিকে দায়ী মনে করেন। এই মহিলা রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যে ভা*ঙা রে’কর্ড বাজাতে থাকেন তার কানের কাছে।

তিনি কতবার বলেছেন,ওই কু*লা*ঙ্গা*রের নাম যেনো এই বাড়িতে কেউ মুখে না নেয়। তবু শেফালি প্রতিদিন তার কাছে আকুতি মিনুতি করে তার ছেলেকে যেনো শাখওয়াত এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন।যেটা শাখওয়াতের পক্ষে সম্ভব না। সামনে ই*লে*ক*শন। ওই কু*লা*ঙ্গার কে বাড়িতে এনে তিনি নিজের পায়ে নিজে কু’ড়া’ল মা*র*তে চায় না।

সজীব এসে শাখওয়াতের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। শাখওয়াত বলে,”কি। আবার কি অঘটন ঘটিয়েছে তোর গুরু?”

_কাকা,ভাই কিছু টাকা চেয়েছে।
মিন মিন করে জবাব দেয় সজীব।

শাখওয়াত এটাই আন্দাজ করেছিলো। বলে,”পঁচিশ হাজার টাকা দু’দিনে শেষ? ওকে বলে দিবি এভাবে চলতে থাকলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। এমনিতেও ওর পিছনে উকিল ঠিক করতে আমার লা’খ লা’খ টাকা গিয়েছে। এখানে ওখানে টাকা ছ’ড়াতে হয়েছে।”
সজীব মাথা নেড়ে বলে,”আচ্ছা কাকা।”
শাখওয়াত ড্র*য়ার থেকে একটা বা*ন্ডি*ল বের করে সজীবের হাতে দেয়।
শেফালি ঘরে ঢুকে সজীবকে বলে,”আমার বাবু কেমন আছে? খায় দায় ঠিকমতো।?”
_জি কাকি। আপনি চিন্তা করবেন না।

_আর চিন্তা। রাতে ঘুমাতে পারি না বাবা ছেলেটার চিন্তায়। যদি একটু দেখতে পারতাম, যদি একটু ছুঁ*তে পারতাম।”

সজীব বলে,”আপনি ভিডিও কলে কথা বলবেন কাকি? আমি ফোন দেবো ভাইকে?”
শেফালির চোখ মুখ খুশিতে ঝলমল করে ওঠে,”দাও বাবা,এক্ষুনি দাও।”
শাখাওয়াত হুং*কা*র দিয়ে ওঠে।
_এই খবরদার। ওই ব*দ*মাই*শের সাথে কথা বলতে হলে অন্যখানে যাও। আমি তোমাদের এইসব ন্যা’কা’মি দেখতে চাই না।

সজীব ভ’য় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শেফালি তার স্বামীর দিকে আ’হ’ত চোখে তাকিয়ে থাকে।

***
উর্বী বইয়ের তাক থেকে স’ম’রেশ মজুমদারের “সাতকাহন ” বইটা বের করে পড়ছে। বাড়ির সবাই চলে যাওয়ার পর তার মন ভার হয়ে ছিলো। এই জিনিসটা তার মন ভালো করে দিয়েছে। রাওনাফের বইয়ের তাকে রাজ্যের বই। সবই মে’ডি’কেলের বই। তার মাঝখান থেকে সে এটা খুজে পেয়েছে। আরো তিনটা উপন্যাস আছে। হুমায়ুন আহমেদের। এসব কে পড়তো উর্বী বুঝতে পারছে না। রাওনাফের মতো লোক উপন্যাস পড়বে এটা হতেই পারেনা! এই জিনিসটা তার ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না একেবারেই।

উর্বী উপুর হয়ে বু’কের নিচে বালিশ দিয়ে বইটা পড়ছে। রাওনাফ ঘরে ঢুকতেই সে তড়িঘড়ি উঠে বসে। তার চোখে মুখে সং’কো’চ।

রাওনাফ উর্বীর পাশে একটা ব’ক্স রেখে দিয়ে বলে, “নতুন ফোন। এটা এখন থেকে ব্যাবহার করতে পারো।”

উর্বী অবাক হয়ে ব’ক্সটা হাতে নেয়।

রাওনাফ ব্লে’জা’র খুলে আলমারিতে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে
“কোথায় চাকুরী করতে?”

_দুটো এন’জিওতে করেছি। এক বছর করে।

_কোন সা’ব’জেক্ট নিয়ে পড়াশোনা?

_পলি’টি*ক্যাল সা’ই’ন্স।

_চাকুরী কি করতে চাও?

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলে, “যদি চাও তাহলে সাহায্য করতে পারি। আমার চেনাজানা কিছু এ’ন’জিও রয়েছে। পরিচালনা মহিলারা করেন।”

উর্বী তখনও চুপ,রাওনাফ বলতে থাকে,”যেহেতু এ’ক্স’পে’রি’য়েন্স আছে তাই বললাম এন’জিওর কথা। এছাড়াও কিছু কি’ন্ডা’র’গার্টেন স্কুলের বি’জ্ঞা’পন নজরে পরলো আজ। করতে চাইলে বলো। কথা বলবো।”

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”আমি আপনাকে জানাবো।”

***
নোটি*ফিকে*শনের টুংটাং আওয়াজে উর্বীর মাথা ব্যা*থা করছে।অনেকদিন পর তার ফেইসবুকের আ’ই’ডি’টা’তে সে ল*গ ইন করেছে। অনেকগুলো নো*টি*ফি*কে*শন এসে জমা হয়েছে। পরিচিতরা অনেক মেসেজ দিয়ে রেখেছে।
উর্বীর ইচ্ছে করে না সেসব দেখতে। সে খানিকক্ষণ নিউজ*ফিড দেখে থেমে যায়। হুট করে রাওনাফের আ’ই’ডি’টা দেখতে পায়।

আ’ই’ডি’র নাম ডক্টর রাও! প্রো*ফাইলে রাওনাফ গলায় একটা স্টে*থো*স্কোপ নিয়ে হাসিখুশি দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে কয়েকজন ফ’রেইনার।
উর্বী আগ্রহী ভাব নিয়ে রাওনাফের আ’ই’ডি’টাতে ঢোকে। আ’ই’ডি’র কভারে রাওনাফ তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে একটা হ্র’দের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী রাওনাফের টা’ই’ম’লা’ইন ঘুরে অবাক হয়ে যায়। পুরো আ*ই*ডি জুরে শুধু অ্যা*ওয়ার্ড আর অ্যা*ওয়ার্ডের ছবি। হয় রাওনাফ কারো কাছ থেকে অ্যা*ওয়ার্ড নিচ্ছে, নয় সে কাউকে দিচ্ছে। উর্বীর ভিষন হাসি পায়।

হঠাৎ একটা আওয়াজ ভেসে আসে। বাড়িতে কেউ মিউজিক শুনছে।

“এরপর বি’ষ’ণ্ন দিন, বাজে না ম’ন’বীণ
অবসাদে ঘিরে থাকা সে দীর্ঘ দিন,
হাজার কবিতা, বেকার সবই তা
তার কথা কেউ বলে না
সে প্রথম প্রেম আমার নী’লা’ঞ্জনা!”

উর্বী ফোন হাত থেকে ফেলে কান চে’পে ধরে বসে থাকে। মিউজিকের আওয়াজ তী’ব্র থেকে তী’ব্র’তর হচ্ছে। এই গানটা উর্বীর মস্তি’ষ্কে আ’লো’ড়’ন সৃষ্টি করছে। তার কুঁ’চকে যাওয়া অনূভুতিকে আরো একটু পি’ষে দিতে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”বন্ধ করো! এই গান শুনতে ভালো লাগেনা।”

চোখ বেয়ে পানি পরতে শুরু করে তার। মন ম’স্তি’ষ্কে যু’দ্ধ চলছে, র’ক্তপা’ত হচ্ছে চোখে। পাথরের ন্যায় চুপচাপ বসে থাকে সে।

রাওনাফ হসপিটালে যাবে বলে তৈরি হতে ঘরে ঢুকেছিল। উর্বীর দিকে চোখ পরতেই সে দাঁড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জ’ড়তা কাটিয়ে প্রশ্ন করে,”আর ইউ ওকে!”

উর্বী তার দিকে তাকায়। না সে চোখের পানি মোছার চেষ্টা করেছে। না তা আ’ড়াল করার চেষ্টা করছে। রাওনাফ এগিয়ে গিয়ে বলে,”কোনো অসুবিধে?”

উর্বী কিছুক্ষণ সময় নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলে,”না।”

_কাঁ’দছো যে!

_আজ কি বার?

রাওনাফ অবাক হয়ে বলে,”আজ বুধবার। কেনো?”

_আমি প্রত্যেক বুধবার এভাবে কাঁ’দি। আপনি প্লিজ পাত্তা দেবেন না!

রাওনাফ হতভম্ব হয়ে বলে,”কা’ন্নার সাথে বুধবারের কি সম্পর্ক!”

_আছে। প্রত্যেক বুধবার, আমার ওপর জ্বি’নে’র আ’ছড় হয়। মা বলেছে।

রাওনাফ চ’রম হতভম্ব হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী হেসে ফেলে, তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে,”মজা করছিলাম। চোখ জ্বা’লা করছিলো আমার। চোখে এ’লা’র্জি আছে। তাই পানি পরছিলো।

রাওনাফ ঘুরে হাতে এ’প্রো’ন উঠিয়ে নেয়। তারপর বলে,”ডক্টরের কাছে এ্যাপ’য়েন’মেন্ট দিয়ে রাখবো। চোখ খুবই সেন’সে’টিভ জায়গা! চিকিৎসা নেওয়া দরকার!”

***
রওশান মঞ্জিলে আজকে কোনো হৈ চৈ এর আওয়াজ হচ্ছে না।কোথাও কোনো শো’র’গোল নেই। আজমেরী আর রুমা সকালে বাচ্চাদের নিয়ে যে যার শশুরবাড়িতে চলে গিয়েছে। এই সময়ে বাড়িতে মাত্র চারজন মানুষ। রওশান আরা, উর্বী, অন্তরা আর আমিরুন। বাকি সবাই যে যার কাজে গিয়েছে।
রাওনাফ হসপিটালে, রাওনাফের তিন ছেলেমেয়ে স্কুলে আছে।

মোহনাকে নিয়ে শাফিউল একটু বেরিয়েছে আর সামিউল তার ফটোগ্রাফির কাজে।
আমিরুন উর্বীকে রান্নার কাজে সাহায্য করছে। আসলে সে কিছুই করছে না। উর্বী তাকে চুপচাপ দাড় করিয়ে রেখেছে। উর্বী নাকি আজ একটা বিশেষ পদ রাঁ’ধ’তে চায় সবার জন্য।
আমিরুন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার নতুনভাবিকে দেখছে। তার খুব ভালো লাগে এই মেয়েটাকে। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ খুব গরম তাই না আমিরুন আপা”
-জে নুতনভাবি। আপনার কষ্ট হইলে আমারে দেন। আমি ইলিশ পোলাও রাধতে জানি।

-না আমার কষ্ট হচ্ছে না। তুমি এক কাজ করো,আমাদের চারজনের জন্য লেবুর শরবত বানাও। ঠান্ডা ঠান্ডা।

-আমরা চারজন কই ভাবি? আমরা তো তিনজন বাড়িতে।আপনে,আম্মায় আর আমি।

উর্বী হাসে। বলে,”তোমাদের ছোট ভাইজানের বউও তো আছে বাড়িতে। তার কথা ভুলে যাও কেন?”
আমিরুন জিভ কা’মড়ে দিয়ে বলে,”ইশশশ। এক্কেরে ভুইলা বইসা আছি। আমি অক্ষন বানাইতেছি।”
আমিরুন কাজ করতে করতে বলে,”আইচ্ছা ভাবি আপনার রা’গ লাগে না হের উপর?”

-না।
উত্তর দেয় উর্বী।
আমিরুন বলতে থাকে,”তবে ওই মা’ষ্টার আপা কিন্তু ভালা মানুষ।এক্কেবারে আপনের মতো।”

-আমি ভালো?
উর্বী হাসতে হাসতে জিগ্যেস করে।
-হ ভালা। এইজন্য আপনেরে আল্লাহ ভাইজানের লগে মিলাইয়া দিছে। আমার বড় ভাইজান এই দুনিয়ার সবচেয়ে ভালা মানুষ।

উর্বী আমিরুনের দিকে তাকায়। আমিরুন বলে,”আমি জানি ভাবি,আপনে ভাইজানরে মানতে পারতেছেন না। এই যুগের মাইয়া।তবে দেইখেন আপনে একদিন দ্যাখবেন কেমনে কেমনে জানি এই মানুষটার মা’য়ায় পইরা গেছেন।”
আমিরুন উর্বীর দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে এই কথা টা বলে।

উর্বী প্র’সঙ্গ পালটে বলে,”আমার শাশুড়ি কেনো অন্তরাকে অপছন্দ করেন? এর পেছনে কারণ কি?”

আমিরুন এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,”অন্তরা আপার আগে বিয়ে হইছিলো ভাবী। অনেক কাহিনী!’

***
নিজের পুরনো গি’টারটায় হাত বুলিয়ে উচ্ছাস ম্লান হাসে। এই বস্তুটা সে ছোয়নি প্রায় ছয় বছর।
গিটারের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিজের হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর নিচু স্বরে বলে,”এই হাত দিয়ে সব হয়।”

সজীব দূরে দাঁড়িয়ে উচ্ছাসের কর্ম’কাণ্ড দেখছে । হিং’স্র মানুষটা কেমন শান্ত হয়ে গিয়েছে। উর্বীকে নিয়ে ঝামেলা করছে না এটাও স্বস্তির। বারবার রা’গের মাথায় অঘটন ঘটায় এই লোকটা।

উচ্ছাস ফোন ঘেঁ’টে উর্বীর একটা ছবি বের করে দেখে। ছবিটা সম্ভবত কিছুদিন আগের। মুখ হাঁসি হাঁসি উর্বীর।
একটু কি মোটা হয়েছে মেয়েটা! চোখ সরু করে ছবিটা জুম করে দেখে সে। না, আগের মতো রো’গা পট’কাই আছে! তবে চেহারায় মহিলা মহিলা একটা ভাব এসেছে। ছয় বছর তো কম সময় না!

সজীব রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই উচ্ছাস ফোনের স্ক্রিনে উর্বীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে,”গান শুনবে?”

হাতে গিটারটা তুলে নিয়ে উচ্ছাস মাথা নিচু করে গাইতে শুরু করে,

“বলবো তোমায়! আজকে আমি,
একটি ছেলের গল্প প্রেমের,
চুপি চুপি, কার ছবি!
একেছিলো ছিলো যে সে অন্তরে!”

নোট: [আমার গল্পগুলো সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনী থেকে নির্মিত। বাস্তবতার সাথে এর মিল খুঁজে মন ম’স্তি’ষ্কে সং’ঘাত সৃষ্টি না করার অনুরোধ]

[ গান দুটো আমার ভিষন পছন্দের!]

চলবে।

আরেকটি বার পর্ব-০৪

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৪
#Esrat_Ety
[বড় পর্ব! সবাই মেইন ফেসবুক দিয়ে পড়বেন]

তহুরা ভিজিয়ে রাখা ডাল শিল নোড়ায় বাটছে। আজ তার মে’জাজ ঠিক নেই। সারাদিনে বিদ্যুৎ নেই,পানি শেষ। বালতিতে করে যেটুকু পানি তুলে রেখেছিলো তাও শেষের পথে। এই এলাকায় আজকাল ঘন ঘন লোডশেডিং এর সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বরিশাল এদিক দিয়ে ভালো আছে। লোডশেডিং খুব কম হয় বরিশালে।
রেজাউল কবির এসে রান্না ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়ায়। তহুরা তার উপস্থিতি টের পেয়েই বলে,”কে ফোন করেছিলো? উর্বীর শশুর বাড়ি থেকে?”
_হু।
উত্তর দেয় রেজাউল কবির।

_কি বললো? উর্বীর সাথে কথা হয়েছে?
_আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছেন, কাল বৌভাত। ওবাড়ির মেজো ছেলে বারবার করে বলে দিয়েছে যাতে আমরা সকলেই যাই।
ডাল বাটা থামিয়ে দেয় তহুরা।
বলে,
-তুমি গেলে যেয়ো। আমি পারবো না যেতে,আমি উর্বীর সামনে গিয়ে দাড়াতে পারবো না।

রেজাউল কবির দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। তার আদরের বোন, যাকে তিনি ছোট থেকে কখনো রাতে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতেও রাখেনি। সেই মেয়ে আজ দুদিন হবে বাড়িতে নেই। বাড়িটা মাতিয়ে রাখা মেয়েটা চলে যাবার পর বাড়িটা খালি খালি লাগছে। রেজাউল কবির তার হাতের দিকে তাকায়, তার ইচ্ছে করছে চুলায় ঢুকিয়ে তার হাত পু’ড়িয়ে ফেলতে। এই হাত দিয়ে সে তার আদরের বোনকে মে’রেছে।

তহুরা আবার জিগ্যেস করে,”উর্বীর সাথে কথা হয়েছে?”

-না।

-জানতাম,ওই মেয়ে আমাদের সাথে আর কথা বলবে না। আমরা ঠিক করিনি, ঠিক করিনি মেয়েটার সাথে।

আমি তোমাকে বারবার বলেছি,আরেকবার ভেবে দেখো। তুমি শোনোনি। তোমার কাছে তোমার মান সম্মান বড় হয়ে গিয়েছিলো।এখন বোঝো কেমন লাগে।

রেজাউল কবির অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। তার কাছে মনে হচ্ছে তিনি পৃথিবীর সবথেকে নি’কৃষ্ট বড় ভাই।

***
উর্বী দূরে দারিয়ে সামিউল আর অন্তরাকে দেখছে। মোহনা দুজনকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। তারা আজ সারাদিন না খেয়ে ছিলো। উর্বী অবাক হচ্ছে,এতকিছুর পরেও তার সামিউলের ওপর রা’গ হচ্ছে না। বরং সামিউল আর অন্তরাকে দেখতে তার বেশ ভালো লাগছে। দুজনকে ভালোই মানিয়েছে। সামিউল লম্বা, এবাড়ির সব ছেলেরাই লম্বা, তাদের পাশে লম্বা বৌকেই মানায়। মোহনা লম্বা,অন্তরাও লম্বা। উর্বী খাটো।

পেছন থেকে আজমেরী ডাক দেয়,”উর্বী।”
উর্বী ঘুরে তাকায়।
_তোমাকে মা ড্রয়িং রুমে ডাকছেন। কয়েকজন মহিলা এসেছেন তোমায় দেখতে। সম্পর্কে তারা তোমার ফুপু শাশুড়ি হয়। গিয়ে তাদের সালাম দেবে, পা ছুয়ে না। মুখে বলে সালাম দেবে।

“জি আপা।”
উর্বী বলে।

-মাথার ঘোমটা টা টেনে যাও, তারা পুরনো দিনের মানুষ তো।
উর্বী মাথায় ঘোমটা টানে। তার ব্যাপার গুলো কেন জানি বেশ ভালো লাগছে, জীবনটা কাছের মানুষের “ছিঃছিৎকারে” একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিলো। একটু নতুনত্বের গন্ধ পাচ্ছে!
আজমেরী উর্বীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কোথাও যেন বড় ভাবীর সাথে এই মেয়েটার মিল সে খুঁজে পায়।

আজমেরী বলে,
_তুমি যাও,আমি আমিরুন কে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। নিজের হাতে পরিবেশন করবে তাদের মাঝে।

উর্বী মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে।
আজমেরী বলে,”এখন যাও।”

উর্বী চলে যায়। আজমেরী ডাইনিং রুমে ঢোকে। রুমা তাকে দেখতে পেয়ে বলে বলে,”উর্বী মেয়েটা কি জা’দু জানে নাকি রে আপা! তার এক কথাতেই মা সামিউলদের এবাড়িতে থাকতে দিয়েছে!”

_থাকতে দিয়েছে শুধু। ওরা কাল থেকে আলাদা খাবে। উত্তরের দুটো কামরা ওদের জন্য খুলে পরিষ্কার করে দিতে বলিস। ওরা যেন ওদের জিনিসপত্র নিয়ে সেখানে ওঠে।
উত্তর দেয় আজমেরী।
মোহনা বলে,”উর্বী দরজা বন্ধ করে মাকে কি বললো ভাবছি! মা এই মেয়েকে অনেক পছন্দ করেছে। দেখলে না একদিনের আলাপেই এই মেয়েকে সামিউলের জন্য পছন্দ করে ফেলেছিলো।”
সামিউলের গলায় খাবার আটকে যায়। সে অনবরত কাশতে থাকে।
অন্তরা তার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।

***
নাবিল এই মুহুর্তে একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে। তার কিছুটা সামনে বাচ্চারা খেলছে। নাবিলের থেকে কয়েক গজ দূরে একটা বেঞ্চে একজন মা তার ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে বসে আছে। নাবিল সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তার ছোটবেলার কথা মনে পরে যায়। তার মা রোজ বিকেলে তাকে আর শায়মীকে নিয়ে পার্কে আসতো।
হঠাৎ নাবিলের ফোন বেজে ওঠে। শায়মীর ফোন। নাবিল ফোন কে’টে দিতে গিয়েও দেয় না। ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরে। শায়মী বলে ওঠে,”হ্যালো! নাবিল তুই কোথায়?”

নাবিল কথা বলে না। শায়মী আবার বলে,”নাবিল চুপ করে আছিস কেনো। বল তুই কোথায়!”

নাবিল বলে,”আছি এক যায়গায়। ভালো আছি।”
_বাসায় ফিরবি না?
কোমল সুরে জানতে চায় শায়মী।

_ফিরবো না কেনো। আমার বাড়িতে আমি অবশ্যই ফিরবো।

-কখন ফিরবি?

-যখন মনে চাইবে তখন।

শায়মী চুপ করে শোনে। নাবিল বলে,”টেনশন করিস না। কোনো অঘটন ঘটাইনি এবার। আর মনে হয়না ঘটাবো। আমার মনটা খুব ভালো আজ।”
শায়মী বুঝতে পারে না কিছু। নাবিলের এতো স্বাভাবিক ব্যাবহার তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে।
নাবিল বলে,”কিরে কথা বলছিস না যে।”

শায়মী বলে,”ছোটো চাচ্চু ফিরেছে বাড়িতে।”

_ভালো কথা। সেটা আমাকে বলছিস কেনো।

_সাথে অন্তরা ম্যাম। তারা বিয়ে করে নিয়েছে।

নাবিল বলে,”ও আচ্ছা। ভালোই তো, বাড়িতে শুধু বিয়ে আর বিয়ে।আমি ভাবছি আমিও একটা বিয়ে করবো। বিয়ে করে ডক্টর রাওনাফ করিম খান আর তার মা দ্যা গ্রেট রওশান আরাকে চমকে দেবো। কি বলিস! হাহাহাহাহা, ভালো হবে না বল?”

শায়মী কিছু বলে না। নাবিল বলে,”আজ আমার মনটা এতো ভালো কেনো জানতে চাইবি না?
শায়মী বলে,”বল,কেনো!”
_আজ দাদাবাড়ি গিয়েছিলাম,মাম্মার কবরের কাছে।

শায়মী চুপ করে থাকে।

নাবিল বলে,”আর কিছু বলবি?”

_তুই ফিরে আয় নাবিল। শর্মী কাঁদছে।

_দেখি।

নাবিল ফোন কেটে দেয়। মাগরিবের আজানের সময় হয়ে গেছে।পার্ক থেকে লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। নাবিলও উঠে দাঁড়ায়।

***
উর্বী মাগরিবের নামাজ আদায় করে ঘরে বসে আছে। বাচ্চা গুলি দরজার বাইরে থেকে উকি দিচ্ছে। কেউ ভেতরে আসছে না। উর্বী হাত দিয়ে তাদের ডাকে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে যে বড় সে ভেতরে ঢুকতেই অন্যরাও তার দেখাদেখি ভেতরে ঢোকে। উর্বী তাদের নিজের পাশে বসায়।
তারপর নাম জিগ্যেস করে। তাদের মধ্যে একজন দায়িত্ব নিয়ে একে একে নিজেদের নাম বলতে থাকে,”আমার নাম রনি,ওর নাম মিশফা,ওর নাম ইফতি, ওর নাম জারা আর ওর নাম রাকিন।”

ওদের মধ্যে সবচে যে ছোট,সে উর্বীকে বলে,”আর তোমার নাম “বড় মামী”?”
উর্বী হেসে ফেলে, সেই বাচ্চাটাকে নিজের কোলের কাছে টেনে বলে,” না বাবু,আমার নাম বড় মামী না,আমার নাম হচ্ছে উর্বী।”

দরজা ঠেলে রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। উর্বী খেয়াল করে যে কয়বার রাওনাফ উর্বী থাকা অবস্থায় এই রুমে ঢুকেছে, তার মুখ দেখে মনে হয় সে কোনো অন্যায় করে ফেলেছে এবং সে লজ্জিত। উর্বী ভেবে পায়না নিজের বাড়ি নিজের রুম তবু এতে এতো দ্বিধার কি আছে। এতো দ্বিধা থাকলে বিয়ে করার দরকার কি ছিলো!

ছোট বাচ্চাটা, যার নাম মিশফা। সে আবার বলে,”মা বলেছে,তোমাকে যেন আমরা বড়মামী ডাকি। তুমি আমাদের বড় মামার বউ।”
উর্বী আর রাওনাফ দুজনেই বিব্রত বোধ করে।

বাচ্চাগুলো রাওনাফকে ঘিরে ধরে। রনি বলে,”বড় মামা,তুমি আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছিলে,আমরা ঘুরতে যাবো না?”
_হ্যা যাবো তো মামা,আজ আমাকে হসপিটাল যেতে হবে,কাল সব্বাইকে নিয়ে যাবো ঘুরতে।
_আর বড়মামীও যাবে আমাদের সাথে?

রাওনাফ কিছু বলে না। তড়িঘড়ি করে তার পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। তাকে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে হসপিটাল যেতে হবে।

উর্বীকে মোহনা ডাকতে আসে। প্রতিবেশীরা নতুন বউ দেখতে এসেছে। উর্বী উঠে নিচে চলে যায়। বাচ্চাগুলোও তাকে অনুসরণ করে।

***
আমীরুন বাইরে থেকে দরজায় টোকা দেয়। ওপাশ থেকে সামিউল বলে,”কে?!!”
_আমি আমিরুন ছুডো ভাইজান। দরজা খুলেন।

দরজা খোলে অন্তরা। আমিরুনের হাতে একটা মশারি। সে মশারি টা বিছানায় রাখতে রাখতে বলে,”বড় আপায় পাঠাইছে। অনেক মশা।”

সামিউল বলে,”ঠিকাছে,তোমাকে ধন্যবাদ।”

আমিরুন খুশি হয়,সে অন্তরাকে দেখে বলে,”তুমারে সত্যই নতুন বৌদের মতো লাগতাচে গানের আপা।”
অন্তরা মুচকি হাসে।

আমীরুন বলে,”বড় আপায় জিগাইতে কইছে,আপনেগো আর কিছু লাগবে কি না।”
-না,আপাতত আর কিছু লাগবে না।
সামিউল বলে।

আমিরুন মশারি টাঙিয়ে দিয়ে বলে,”নেন,আপনেরা বিশ্রাম করেন।কাইল বাড়িতে বৌভাত,মেলা কাম আছে,আমি যাই গা। গিয়া ঘুমাই।”

_আচ্ছা, উর্বীর সাথে বড় ভাইয়ার বিয়েটা কিভাবে হলো আমীরুন?
সামিউলের এমন প্রশ্নে অন্তরা তার দিকে তাকায়।

আমিরুন বলে,”এইসব অহন হুইনা কি আর করবেন ভাইজান।এইসব অহন হুনোনের কোনো দরকার আছে? তয় ছুডো মুখে একখান কতা কই ভাইজান। আপনি কাজটা ভালা করেন নাই। বিয়া যখন না করনেরই আছিলো তয় বিয়ায় রাজি হইয়া আম্মারে আশা দিছিলেন ক্যান। আপনার অন্যায় হইছে ভাইজান।”

আমীরুন চলে যায়। সামিউল সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
অন্তরা দরজা বন্ধ করতে করতে বলে,”অনু’শোচনা হচ্ছে?”
_কিসের অনুশোচনা?
_এইযে বিয়ের আংটি পরিয়ে একটা মেয়েকে বিয়ে না করার।

সামিউল খাটে শুতে শুতে বলে,”হ্যা,সেরকম অপরাধবোধ তো একটু হচ্ছেই। মাকে ঠান্ডা রাখতে আংটি পরিয়ে রাখার সম্মতি দিয়েছিলাম। আমার উর্বীর সামনে পরলেই ভিষন লজ্জিত লাগছে।”

অন্তরা এসে সামিউলের পাশে শোয়। তার এখন শান্তি শান্তি লাগছে।সে বিশ্বাস ই করতে পারছে না সামিউল তার স্বামী।
কত ঝড় ঝাপটা পেড়িয়ে তারা দুজন এক হতে পেরেছে।
সামিউল অন্তরার হাতের ওপর একটা হাত রাখে। অন্তরা সেদিকে তাকায়। সামিউল বলে,”তোমার বাড়ির কথা মনে পরছে?”
_না।
অন্তরা বলে,”বাড়ির কথা মনে পরলেও এখন আর কিচ্ছু হবার নেই।সবাইকে ত্যাগ করে এসেছি। ”

অন্তরা দুদিন আগেও ভাবতে পারেনি তার কপালে এই সুখ লেখা আছে। অন্তরা ভাবে, সময় মানুষের জীবনে কত কি বদলে দেয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে তার জীবনের অনেকটা বদলে গেছে। এই তো কদিন আগে, অন্তরা যখন এ বাড়িতে পা রাখে তখনকার কথা।কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিয়েছিলো উষ্কখুষ্ক চুলের এক সুদর্শন পুরুষ। অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,”কাকে চাই?”

_আমি অন্তরা। আপনাদের বাড়ি থেকে আমায় ফোন করা হয়েছিলো। শর্মিকে গান শেখানো আর ইংলিশ পড়ানোর জন্য।

_ও আচ্ছা আচ্ছা,তাই বুঝি। আমি আসলে জানিনা। ভেতরে আসুন।

অন্তরা ভেতরে ঢোকে। সামিউল তাকে সোফায় বসতে বলে।

অন্তরা সোফায় বসতে বসতে বলে,”শর্মী কোথায়?”
_শর্মী তো বাড়িতে নেই,আসলে আজ কেউ বাসায় নেই। আজ শর্মীর বড়বোন আর বড়ভাই দুজনের জন্মদিন। সবাই রেস্তোরায় খেতে গিয়েছে।
অন্তরা অবাক হয়। এই কথাটা আগে বলে দিলেই তো পারতো উনি। নিশ্চই বাড়িতে একা। এই মুহুর্তে একটা অচেনা মেয়েকে বাড়িতে ঢুকিয়ে সোফায় বসতে দেওয়াটা যতোটা না ভদ্রতা তার চেয়েও কেমন একটা জানি। অন্তরা সরু চোখে তাকায়।
সামিউল অন্তরার সেই চাহনী বুঝতে পেরে যায়। সে ভাবতে পারেনি এই সামান্য ব্যাপারে এই মেয়েটা মাইন্ড করবে। তখন দরজা খুলে মেয়েটাকে দেখে মনে হয়েছিলো মেয়েটা অনেকটা পথ হেটে এসেছে,একটু বসতে চায়। সে বিব্রত হয়ে বলে ,”আপনি কাল বরং আসুন এই সময়ে।”
অন্তরা উঠে পালিয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বেরিয়ে যায়।

পরেরদিন অন্তরা আবার এসে কলিং বেল বাজায়, সামিউল দরজা খোলে। অন্তরাকে বলে,”আপনাকে ফোনে জানানো হয়নি তাই দুঃখিত আজকেও শর্মী বাড়িতে নেই। সে বাড়ির সবার সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছে।”
অন্তরার মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টি পরছে। সে ভাবতেই পারেনি এই অসময়ে বৃষ্টি হতে পারে। ছাতা নেই সাথে। এখন এখান থেকে বের হলে নির্ঘাত বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে যাবে।ইতিমধ্যে বৃষ্টি তাকে পেয়ে বসেছিল তখন সে দৌড়ে রওশান মঞ্জিলে ঢোকে।
অন্তরা চিন্তায় পরে যায়। সে কখনোই এই বাড়িতে বসে অপেক্ষা করবে না বৃষ্টি থামার। আবার বৃষ্টিতে ভিজলেও তার খুব করুনদশা হয়। তার ঠান্ডা লাগার অভ্যেস। আগেরবার শখ করে বৃষ্টিতে ভিজে সে একমাস নিউমোনিয়া বাধিয়ে বিছানা নিয়েছিলো। অন্তরা অসহায়ের মতো চারদিকে তাকায়।
সামিউল বলে,”আপনি চাইলে এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে পারেন,ভেতরে ঢুকতে হবে না। বৃষ্টি থামলে চলে যাবেন।”

অন্তরা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিউল দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে যায়। কিছুক্ষন পর আবার দরজা খোলার শব্দ পেয়ে অন্তরা সেদিক তাকায়। সামিউলেরর হাতে একটা মগ। সে বলে,”বাড়িতে কোনো ছাতা খুজে পাচ্ছি না। নয়তো আপনাকে দিতাম। তবে আপনি চাইলে এই কফিটা খেতে পারেন।”
অন্তরা কফিটা না নিয়েই বলে,”ধন্যবাদ। আমি কফি খাই না।”
সামিউল ভেতরে যায়। কিছুক্ষন পরে সে আবার আসে। হাতে একটা ছাতা। সে বলে,”নিন এটা,অনেক খুজে পেলাম। এটা নিয়ে বাড়ি যান। কাল নিয়ে আসবেন।”
অন্তরা হাত বাড়িয়ে ছাতাটা নেয়।

এইতো কদিন আগের কাহিনী এটা। তারপর গোটা ন’মাস কেটে গেলো। কতকিছু যে হয়ে গেলো। রওশান আরা সব জানতে পেরে তাকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এইতো কদিন আগেরই কাহিনী যেনো সব।
সামিউল অন্তরার মুখের উপরে থাকা এক গোছা চুল আঙুল দিয়ে কানে গুজে দিতে দিতে বলে,”এই অন্তু। কি ভাবছো?”
_কিছু না।

অস্ফুট স্বরে বলে চুপ হয়ে যায় তারপর আবার বলে,”জানো তোমাদের বাড়িতে অনেকটা শান্তি শান্তি লাগছে। কাল শিউলিদের বাড়িতে আমি সারারাত ছটফট করেছি। তুমি তো নাক ডেকে ঘুমিয়েছিলে। আমি একটুকুও ঘুমাতে পারি নি।”

_আজ রাতেও পারবে না।
সামিউল খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে।

অন্তরার গাল দুটো লজ্জায় লাল হতে চায়। সে কিছু একটা বলতে যাবে, সামিউল সে সুযোগ দেয় না। সে তার বৌকে পরম আদরে কাছে টেনে নেয়।

***
ড্রয়িং রুমের বাতি এখনো জ্বলছে। কেউ জেগে আছে। আজমেরী সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। রওশান আরা সোফাতে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। তার চোখ বোজা অবস্থায়। আজমেরী তার মায়ের কাধে হাত রাখে। রওশান আরা তার দিকে তাকায়।

_কিরে তুই এখনো জেগে আছিস যে?
_পানি খেতে উঠেছিলাম আম্মা। দেখলাম বসার ঘরের বাতি জ্বলছে।তুমি এখনো ঘুমাচ্ছো না কেনো?
_রাওনাফের জন্য বসে আছি। ওর হসপিটাল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। তাছাড়া ঘুম আসছিলো না। আজকাল রাতে খুব একটা ঘুম আসে না।
আজমেরী মায়ের পাশে বসে। রওশান আরা বলে,”কিছু বলবি?”
_মা উর্বী আর বড়ভাইজানের বিয়েটা দিয়ে তোমার কোনো অনুশোচনা হচ্ছে নাতো?

_না তো! কিসের অনুশোচনা? ওদের একটু সময়ের দরকার শুধু।বয়স কোনো ব্যাপার না,আমার রাওনাফ কি হেলা ফেলা নাকি।এখনো আমার ছেলেকে রাজপুত্রের মতো দেখতে লাগে।

আজমেরী হাসে। বলে,”একটু আগে আমি বড় ভাইয়ার রুমে গিয়েছিলাম মা। যদিও আমার অন্যায় হয়েছে। তুমি রাগ কোরো না দয়া করে। দরজা খোলা ছিলো দেখে ঢুকলাম। দেখি উর্বী সোফাতে ঘুমিয়ে আছে।”
রওশান আরা আজমেরীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কলিং বেল বাজছে।আজমেরী উঠে গিয়ে দরজা খোলে।

রাওনাফ বাড়িতে ঢোকে। বসার ঘরে মাকে দেখতে পেয়ে সে বলে,”এখনো জেগে আছো কেনো মা,তোমায় না বলেছি টাইমলি শুয়ে পরবে। ওষুধ খেয়েছো?”
_খেয়েছি। তুই একটু আমার কাছে বোস বাবা তোর সাথে কথা আছে।
রাওনাফ তার মায়ের কাছে গিয়ে বসে। বলে,”তোমায় এরকম চিন্তিত দেখাচ্ছে কেনো মা? সামিউলের ব্যাপারে চিন্তা করছো?”

রওশান আরা দৃঢ় ভাবে উত্তর দেয়,”না। ওর কথা আমি ভাবছি না।আর ভাবতেও চাই না। আমি তোর কথা ভাবছি। আচ্ছা বাবা তুই আমাকে একটা কথা বল,আমি কি তোর উপর অন্যায় করেছি বিয়ে করতে জোর করে?”
_এরকম কথা বোলছো কেনো মা,এইসব কথা থাক।
উত্তর দেয় রাওনাফ।

রওশান আরা উত্তেজিত হয়ে পরে। বলে,”না,আগে বল। এ বাড়ির সবার চোখে আমি অপরাধী হয়ে গেছি। তোর ছেলেমেয়েরা আমার সাথে কথা বলে না। তুই বল,আমি খুব বড় একটা অন্যায় করেছি?আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিৎ?”

রাওনাফ তার মায়ের হাত মুঠো করে ধরে রাখে। বলে,”তুমি কোনো অন্যায় করোনি মা, তুমি তো আমাদের ভালোই চাও। ”

আজমেরী বলে,”মা,এইসব কথা থাক। ভাইয়া অনেক পরিশ্রম করে এসেছে,তাকে ঘুমাতে যেতে দাও। তুমি এসো আমার সাথে,ঘুমাবে।”

রওশন আরা উঠে দাঁড়ায়,রাওনাফকে বলে,”তোর সেদিনের পিচ্চি জেদী ছেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে, নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে। আসার পর থেকে কারো সাথে কথা বলে নি।”
আজমেরী মাকে নিয়ে রুমে চলে যায়, রাওনাফ নিচতলায় নাবিলের রুমের দিকে তাকায়।

***
ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। দরজার বাইরে থেকে আসা আলোতে সে দেখতে পায় উর্বী সোফায় ঘুমাচ্ছে। রাওনাফ চুপচাপ হাতের ঘড়িটা খুলে রেখে ওয়াশরুমে ঢোকে। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। এতো সামান্য আলোতে সে টাওয়াল খুজে পাচ্ছে না। এখন লাইট অন করলে যদি উর্বীর ঘুম ভেঙে যায় তাই সে ফোনের ফ্লাশ লাইট অন করে টাওয়াল খুঁজতে থাকে। হঠাত তার ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে।
উর্বী ধড়িফড়িয়ে উঠে বসে। সে ভিষন ভয় পেয়ে গিয়েছে।
রাওনাফ বিব্রতভাব নিয়ে ফোন রিসিভ করে, হসপিটাল থেকে কল এসেছে। সে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে কেউ কিছু একটা বলে। রাওনাফ উত্তর দেয়,”ঠিকাছে তুমি পেশেন্টের প্রেশার চেক করে আমায় মেসেজ করবে।”
উর্বী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। তার বুক ধুকপুক করছে।এমনিতেও সে অচেনা যায়গায় একা ঘুমাতে পারে না। এতো বড় রুমে তার ভিষন ভয় করে। সে ভয় নিয়েই ঘুমিয়ে গেছিলো সোফায়।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়, বলে,”দুঃখিত। আমি ফোন সাইলেন্ট করতে ভুলে গেছিলাম।”

এই প্রথম রাওনাফ উর্বীকে কিছু বলেছে। উর্বী কিছু বলে না। তার পানির পিপাসা পেয়েছে। আধো অন্ধকারে সে পানির জগ খুজতে থাকে।
রাওনাফ অনুমান করতে পেরে, তার হাতের কাছে থাকা পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে উর্বীর দিকে এগিয়ে দেয়। উর্বী হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নেয়। এরপর পুরো গ্লাসের পানি ঢকঢক করে পান করে।
রাওনাফ বিছানা থেকে একটা চাদর নিতে নিতে বলে,”তোমার সোফায় ঘুমানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি বিছানায় ঘুমাতে পারো। সোফায় আমি ঘুমাচ্ছি।”

_না না,তা কেনো। আপনি কাল সোফায় রাতে ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেন নি। জরোসড়ো হয়ে ছিলেন। আপনি আপনার বিছানায় ঘুমান। আমি খাটো মানুষ, আমার সোফায় ঘুমাতে অসুবিধা হবে না।

উত্তর দেয় উর্বী। রাওনাফ একপলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে,”প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড বাট তোমার আসল বয়স ত্রিশ?”

উর্বী নিচুস্বরে বলে,”হ্যা।”

রাওনাফ বেশ অবাক হয়। এই মেয়েটার বয়স কখনো ত্রিশ হতেই পারেনা। আরো কম মনে হয়। হয়তোবা মেয়েটির উচ্চতা এবং স্বাস্থ্যের জন্য এমন লাগছে। অনেক রোগা মেয়েটি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাওনাফ বলে,”তুমি জীবনের পরিস্থিতি বিশ্বাস করো উর্বী?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। পরিস্থিতির একটার পর একটা উদাহরণ তার জীবনের মতো কারো জীবনে নেই।

রাওনাফ বলতে থাকে,”আমিও করি। আর আজ আমরা দুজন, সম্পূর্ণ আলাদা দুজন মানুষ ঐ জিনিসটার স্বীকার। তোমার কাছে হাস্যকর লাগতে পারে, কিংবা এই একটা সিদ্ধান্তের জন্য আমাকে বোকা মনে হতে পারে। কিন্তু এমনটা নয়,আমি ভেবে চিন্তে ডিসিশন নিই বরাবর। আমি খুবই ঠাণ্ডা মাথার লোক।”

উর্বী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না লোকটা ঠিক কি বলতে চাইছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”প্রতিটা সম্পর্ককে আমি খুবই রেসপেক্টের সাথে দেখি। সেটা রক্তের হোক কিংবা আইনের। বিয়ে জিনিসটা আমার কাছে হেলা ফেলা কিছুনা। আমার আচরণ দেখে সেটা ভেবো না। তবে আমি এটাও মনে করি সম্পর্ক মানে নিজের চাওয়া পাওয়া সরিয়ে রেখে কম্প্রোমাইজ করা না। ওটা জু’লুম।”

এটুকু বলে রাওনাফ থামে তারপর বলতে থাকে,”যদি ভেবে থাকো কবুল বলেছো বলে আমাকে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও মানতেই হবে সেটা ভাববার প্রয়োজন নেই,
যদি মনে হয় আমার তিনটা বাচ্চা, যাদের সাথে তোমার কোনো ধরণের সম্পর্ক নেই, তবুও মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ফরমালিটি দেখাতে হবে তাহলে আমি বলে দিচ্ছি তোমার এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে নিজের ভালোলাগা,মন্দলাগা অনুযায়ী চলার। বিয়েটা পরিস্থিতির জন্য বলে সবকিছুকে পরিস্থিতি ভেবে নিতে হবে এমন নয়। তোমাকে দেখে যথেষ্ট আত্মনির্ভরশীল মনে হয়। এটা তোমাদের মফস্বল নয় যে মানুষ কি বলবে। এখানে মানুষ কিছুই বলবে না। তাই অসহায় অসহায় বাধ্য বাধ্য ভাব করার প্রয়োজন নেই।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”আই রিপিট। সম্পর্কে কম্প্রোমাইজ, অসহায়ত্ব,বাধ্যতা বলে কিছু থাকে না। যেটা একটা সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যায় সেটি হলো বোঝাপড়া। যেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তোমার সময় তুমি নাও। এবং যদি মনে হয় না তুমি পারবে না তাহলে দ্যাটস টোটালি ফাইন। আই উইল হেল্প ইউ দেন!”

উর্বী তখনও চুপচাপ। রাওনাফ আর কিছু বলে না, সে চাদর হাতে সোফার দিকে এগিয়ে যায়। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়না সে উর্বীর কথা শুনবে, সে-ই সোফাতে ঘুমাবে।
উর্বী বিরক্ত হয়। রাওনাফ সোফায় শুয়ে পরে। কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করে। কাল রাতে আসলেই তার ঘুমাতে খুব কষ্ট হয়েছে।কিন্তু সে কখনোই নিজে বিছানায় আরামে ঘুমিয়ে একজন মেয়ে মানুষকে সোফায় ঘুমাতে দিতে পারে না। সে একজন ভদ্রলোক।

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়,এভাবে চলতে পারে না। তাকে একটা উপায় বের করতে হবে। অন্য রুমে গিয়ে যে ঘুমাবে সেটা অসম্ভব। রাওনাফ গিয়ে আলমারি খোলে,আলমারির ভেতর থেকে আরো একটা চাদর বের করে আনে।
উর্বী রাওনাফের কর্মকান্ড দেখতে থাকে। রাওনাফ চাদরটা মেঝেতে বিছিয়ে দেয়। উর্বী অবাক হয়ে বলে,”এটা কি করছেন? আপনি মেঝেতে শোবেন?”
_হ্যা। সমস্যা নেই। আমার মেঝেতে শোবার অভ্যেস আছে। ব্যাচেলর লাইফে একবছর এভাবেই শুয়েছি। এটা সোফার থেকে বেটার। যাই হোক,হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানো যাবে।

_সেরকম হলে আমি মেঝেতে ঘুমাবো। আপনি আপনার বিছানায় থাকুন।
উর্বী অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলে।
রাওনাফ কোনো উত্তর দেয়না। উর্বী বুঝতে পারে এই লোক তার কথা মানবে না। সে হতাশ হয়ে চারদিকে তাকায়।
হঠাত রাওনাফকে বলে,”আমার কাছে অন্য একটা অপশন আছে।”
রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকায়।”

***
রাত তিনটা ২৬ মিনিট। যখন রওশান মঞ্জিলের সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাওনাফের ঘরে তখনও বাতি জ্বলছে। রাওনাফ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি উর্বীর দিকে। উর্বী কিছু একটা বানানোর চেষ্টায় আছে। সে আলমারি থেকে একটা চাদর বের করে এনেছিলো। সেই চাদরটা দিয়েই কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করছে উর্বী।
রাওনাফ ভেবে পায়না উর্বী কি করছে। উর্বী চাদরটাকে খাটের লম্বালম্বি মাঝ বরাবর টাঙিয়ে দেয়।
রাওনাফ অবাক হয়ে জিগ্যেস করে,”এটা দিয়ে কি হবে?”

উর্বী বলে,”আপনার খাট টা অনেক বড়। খাট টাকে ভাগ করে নিলাম। আপনি ওই পাশটাতে থাকতে পারেন। আমার কোনো অসুবিধা হবে না।”
রাওনাফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। হতভম্ব ভাব নিয়ে বলে,”আর ইউ শিওর?”

উর্বী মনে মনে হাসে। তারপর মাথা নাড়ায়,তার কোনো অসুবিধা নেই।

রাওনাফ মেঝে থেকে চাদর আর বালিশ তুলে নিয়ে তার পাশটাতে রাখে। তার চোখে মুখে সংকোচ।
উর্বীও তার পাশ টাতে শুয়ে পরে। তার খুব ঘুম পাচ্ছে।

জানালার ফাঁক দিয়ে কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে হলো পুর্নিমার চাঁদ। সে রাতের পাখিদের কাছে প্রশ্ন করছে,এই পর্দাটুকু কতখানি মজবুত? অনেক বেশি মজবুত? দুজন ভিন্ন সময়ের মানুষ, সম্পূর্ন ভিন্ন মতের, ভিন্ন চিন্তাধারার, ভিন্ন তাদের চাওয়া পাওয়া।দুটো আলাদা সময়ের মানুষকে নিয়তি একটা সময়ে এসে বেধে ফেলেছে। এদের সময় এখন থেকে একসাথে চলবে। আচ্ছা এরা কখনো এই পর্দা সরিয়ে ফেলতে পারবে? রাতের পাখিরা উত্তর দিতে পারে না।

***

পায়ের উপর পা তুলে মেয়েটা খুবই কুৎসিত ভঙ্গিতে বসে আছে।

উচ্ছাস কিছুটা টলছে। মিলি উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি কপাল তোমার। জামিন হবার কোনো চান্সই ছিলো না,হুট করে হয়ে গেলো, তবে জামিন আর দু’রাত আগে হলে কি হতো! আমার ভীষণ আফসোস হচ্ছে। জামিন দুদিন আগে হলে উর্বী এতক্ষণে তোমার বুকে থাকতো!”
উচ্ছাস দুলছে। সামনের সবকিছু তার কাছে ঘোলাটে লাগছে।

মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে। অতিরঞ্জিত হাসি। উচ্ছাস সে দিকে তাকায়। তার কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটা উর্বী। উর্বী তাকে ডাকছে।এইতো উর্বী হাসছে।
উচ্ছাস এগিয়ে যায়। তার চোখ দেখছে উর্বী হেসেই যাচ্ছে। উচ্ছাস তার কাল্পনিক উর্বীর কাছে যায়। উর্বীর গাল দুটো হাত দিয়ে ধরে।বিড়বিড় করে বলে,”উর্বী। আমি তোমাকে বিয়ে করব। আমি সত্যিই তোমাকে বিয়ে করবো।”
মেয়েটা উচ্ছাসকে ধাক্কা দেয়।
-এইই! কে উর্বী? আরে আমি মিলি। ভুলে গেলে? তোমাদের বন্ধু! উর্বীকে মাথা থেকে বের করতে পারছো না।?

উচ্ছাস মেয়েটার দিকে তাকায়। এই মেয়ে তো উর্বী না। উচ্ছাস হাসে। বলে,”হ্যা। তুই তো উর্বী না। তুই তো একটা বাজে মেয়ে।আমার উর্বী কখনো তোর মতো লোকের সাথে শু*য়ে বেড়ায় না।

মিলির রাগ হয়। তাচ্ছিল্যর হাসি হেসে বলে,”তোমার সতী উর্বী এখন রোজ তার বরের বুকে শুয়ে আদর খাবে।”
মিলি উচ্চসরে হাসতে থাকে।
সেই হাসি উচ্ছাস সহ্য করতে পারে না। মিলির চুলের মুঠি ধরে বলে,”চুপপ!!একদম চুপ। একদম হাসবি না।”
মিলি হাসি থামায় না। উচ্ছাসের র’ক্ত গ’রম হয়ে যায়। তার ইচ্ছে করে মিলির গলায় ছু’ড়ি চালিয়ে দিতে। সে হাত দিয়ে ছু’ড়ি খুজে পায়না। মিলির গলা চে’পে ধরে।
মিলি অনেক কষ্টে উচ্ছাসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তার কাশি উঠে গিয়েছে। সে চিৎকার দিয়ে বলে,”রাত দুপুরে ডেকে এনে ফাজলামি হচ্ছে!”
তোর দেবদাস গিরি আমি ঘুচিয়ে দেবো জানোয়ার।

মিলি হোটেলের রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।
উচ্ছাস উবু হয়ে পরে থাকে। তার নেশা কাটছে না। সে কল্পনা করে উর্বীকে একটা লোক ছু’তে এগিয়ে যাচ্ছে, উর্বী তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তাকে বাধা দিচ্ছে না। লোকটা উর্বীর কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। উর্বীর বুক থেকে শাড়ীর আচল সরিয়ে ফেলছে।

উচ্ছাস “না” বলে চিৎকার দেয়। সে আর কিচ্ছু কল্পনা করতে চায় না। সে বিছানার চাদর খামছে ধরে। তার চোখ বেয়ে পানি পরে অঝোর ধারায়।

***
শায়মী নাবিলের মাথার কাছে বসে আছে। নাবিল ঘুমাচ্ছে।
শায়মীর ইচ্ছে করছে না নাবিলকে ডাকতে। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।
বাড়িতে হৈহৈ পরে গিয়েছে। আজ বাড়িতে বৌভাত। কত আদিখ্যেতা!
শায়মী আজ সারাদিন বাইরে বন্ধুদের সাথে কাটাবে কিংবা খালামনির বাড়িতে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। সে নাবিলকে সেটাই বলতে এসেছে।
নাবিলের ঘুম ভাঙছে না। হয়তো এতো তাড়াতাড়ি ভাঙবেও না।বাড়িতে বেশি লোকজন আসার আগে শায়মীকে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। শায়মী উঠে দাঁড়ায়। নাবিল তখন উঠে পরে।শায়মীকে বলে,”কিছু বলতে এসেছিলি?”

_হ্যা আমি একটু বেরোচ্ছি। সন্ধ্যে নাগাদ ফিরবো। ওরা সবাই ঘুরতে যাবে ওদের সাথে যাবো। তুই যাবি?
শায়মী আবার বিছানায় বসতে বসতে বলে।

_না। আজ বাড়িতে অনুষ্ঠান দেখছিস না। কতো কাজ,আমি গিয়ে মেজো চাচ্চুর হাতে হাতে এগিয়ে দেই, যাই।

শায়মী অবাক হয়ে নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিল বলে,”এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো,আরে আমাদের বাড়িতে আমাদের ছোটমা এসেছে। আমরা এরকম করলে চলবে?”
নাবিলের মুখ হাসিহাসি।

শায়মী বুঝতে পারে নাবিল স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। শায়মী বলে,”নাবিল পাপার উপর রাগ করে থাকিস না।”

_আমি পাপার উপর রাগ করে নেই শায়মী। এই একটা লোকের উপর আমি কিছুতেই রাগ করে থাকতে পারি না। জানিস কাল রাতে পাপা আমার রুমে এসেছিলো।

_তোর সাথে পাপার কথা হয়েছিলো?

_না, পাপা ভেবেছিলো আমি ঘুমিয়ে আছি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে। পাপার উপর আমার কোনো রাগ নেই।

_তুই কি আমার সাথে সত্যিই যাবি না। সত্যিই এই অনুষ্ঠানে থাকবি?

_হ্যা,আমার একটা বিশেষ কাজ আছে।
শায়মী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
নাবিল বলে,”অতো জেনে কাজ নেই তোর। তুই যা তোর কাজে যা,Have fun!

চলমান…….

আরেকটি বার পর্ব-০৩

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩
#Esrat_Ety

সুমনা হাতে একটা বাটিতে খানিকটা পায়েশ নিয়ে ঘরে ঢোকে। নাবিল বিছানায় চুপচাপ বসে আছে। সুমনা এসে তার পাশে বসে, হাতের পায়েশের বাটি টা একবার দেখে নিজের বোনের ছেলের মুখের দিকে তাকায়। বয়স ষোলো। এখনই লম্বা হয়েছে বেশ। মনে হচ্ছে তার পাপাকেও ছাড়িয়ে যাবে। অত্যন্ত সুদর্শন দেখতে হয়েছে ছেলেটা। দেখলে মনে হয় সে যেনো পচিশ ছাব্বিশ বছরের দুলাভাইকেই দেখছে এই ছেলেটার মধ্যে। শিমালা আর রাওনাফের দু’জনের সৌন্দর্য এক সাথে পেয়েছে ছেলেটা।

নাবিল সুমনার হাতের দিকে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”খাবো না খালামনি।”

_দুলাভাই আমাকে বারবার ফোন দিচ্ছে। চলো তোমাকে ও বাড়িতে দিয়ে আসি।

_যাবো না।

সুমনা মৃদু হেসে বলে,”একেবারেই যে তুমি নাবালক একটি ছেলে তা কিন্তু নয়। তোমার এই বয়সে তোমার বাবাকে দেখেছিলাম,কতটা বুঝদার ছিলেন। তাই পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করো।”

_ত্রিশ বছর বয়স ঐ ভদ্রমহিলার। আমার বন্ধুরা হাসবে খালামনি।
উদাসী গলায় নাবিল বলে।

সুমনা হাসে,নাবিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”এটা তোমার সমস্যা না বাবা। তোমার সমস্যা কোথায় সেটা আমি ধরতে পেরেছি। তোমার মতো একটি পুঁচকে ছেলের সাথে আমি এখন আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না। চলো তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিই।”

_লাগবে না, আমি যেতে পারবো।

_কখন যাবে?

_যখন ইচ্ছে তখন। তোমার কাছে দুই হাজার টাকা হবে খালামনি? আমাকে দাও।

সুমনা মাথা নেড়ে নাবিলকে টাকাটা দিয়ে দেয়। তারপর নাবিলের ফোনটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,”পাপা ফোন করলে কথা বলবে। এটা আমার আদেশ।”

সুমনার বাড়ি থেকে বের হয়ে নাবিল রাস্তায় রাস্তায় উদ্দেশহীন ভাবে হাটছে,এই শহরে তাদের আত্মীয়ের অভাব নেই। খালামনির বাড়ি ছাড়া নাবিলের কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না কখনো। তার সবসময়ই একা থাকতে ইচ্ছে করে। হঠাৎ নাবিলের পাশ দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স চলে গেলো সাইরেন বাজাতে বাজাতে। নাবিল দাঁড়িয়ে পরে, গাড়িটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। তারপর একটা রিকশা নিয়ে তার দাদাবাড়ির দিকে রওনা হয়। সে তার মায়ের ক’বর জিয়ারত করবে।

***
রওশান মঞ্জিলের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর একটুখানি আলোকপাত করা যাক।
রওশান আরা তার মৃত স্বামীর আরাম কেদারায় শুয়ে আছে। তার মাথা ধরেছে,আমিরুন তার মাথা টিপে দিচ্ছে। সকালে সে শায়মীর কথা বার্তা সবই শুনেছে। সে ইচ্ছে করেই বাইরে আসে নি।ছেলেমেয়েগুলো খুবই কষ্ট পেয়েছে,ওদের সামনে সে যেতে চাচ্ছে না।
বাচ্চারা হৈ হৈ করে ক্যারাম খেলছে,আজমেরী দুইবার এসে তাদের বলেছে আস্তে শব্দ করে খেলতে, চিৎকার চেঁচামেচি কারোরই সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি,বরং চিৎকার চেঁচামিচি আগের থেকে বেরেছে।
মোহনা,রুমা, শাফিউল মিলে লিস্ট করছে অতিথীদের। কাল বাড়িতে বৌভাত। ছোট করে হলেও করতে হবে রওশান আরার আদেশ।
শায়মী নিজের বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে,শর্মী পাশে বসে আছে। দুপুরে কেউ খেতে যায়নি।

রাওনাফ একটা প্লেটে খাবার নিয়ে রুমে ঢুকলো। পাপাকে দেখে শর্মী নড়েচড়ে বসলো। শর্মী বরাবর তার পাপাকে ভ’য় পায়। অথচ রাওনাফ কখনই তার মা মরা মেয়েদের বকাবকি করে না।
রাওনাফ বিছানায় বসে শায়মীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শর্মী বললো,আজ তোমার ডিউটি নেই পাপা?
_আছে তো,রাত আট টা থেকে ।
উত্তর দিয়েই থালায় ভাত মাখাতে শুরু করে।

শায়মী উঠে বসে। সে বলে সে খাবে না। রাওনাফ তবু তার মুখের কাছে ভাতের লোকমা তুলে ধরে। শায়মী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। রাওনাফ ভাতের লোকমা সরিয়ে নেয় না। কোমল কন্ঠে ডাকে,”মামনী”
শায়মীর চোখ ভিজে ওঠে। রাওনাফ বলে, “তোমরা না খাওয়া অব্দি আমিও খাবো না আমার মামনীরা। খেয়ে দেয়ে আমি তোমাদের সব শাস্তি মাথা পেতে নেবো। তার আগে তোমাদের পাপাকে এতো কষ্ট দিও না মামনী রা।”
শায়মী আর বসে থাকতে পারে না। পাপাকে জড়িয়ে ধরে। শর্মীও ছুটে আসে। সে তার পাপাকে জরিয়ে ধরার কোনো সুযোগ মিস করবে না।

দরজার এপাশে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবা মেয়েদের এই মধুর মুহুর্ত উপভোগ করছিলো উর্বী।
মেয়েদের খাইয়ে রাওনাফ উঠে পরতেই উর্বী পর্দার ওপাশ থেকে সরে রুমে চলে যায়।

***
জেলখানার মেইন গেইট দিয়ে জেলার হারুন ও দুইজন কন’স্টেবল ভেতরে ঢোকে। তাদের পিছু পিছু ঢোকে শহরের ক্ষমতাবান ক্রি’মি’নাল লইয়ার বিধান চন্দ্র রায়। তার হাতে জামিনের পেপার।
আঠেরো নাম্বার সেলের সামনে এসে জেলার দাঁড়ায়। হাতের লাঠি দিয়ে মেঝেতে দুইবার আওয়াজ করে কয়েদী নাম্বার আঠেরো কে ডাকে। কয়েদী নাম্বার আঠেরো মাথা তুলে তাকায়। তার হাত বেধে রাখা হয়েছে,চোখে মুখে তার হিংস্র’তা। কিছুক্ষন আগে কয়েদী নাম্বার বিয়াল্লিশের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে এসেছে। একটা সামান্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে এই গণ্ডগোলের সৃষ্টি। শা’স্তি হিসেবে তার হাত দুটো বেধে রাখা হয়েছে। সাবেক ম’ন্ত্রীর ছেলে বিধায় তাকে অতি নগন্য শা’স্তি দেওয়া হয়েছে। নয়তো জেলার হারুন হেন অপ’রাধে অনেক কয়েদীর হাত ভেঙে দিয়েছিলো।
জেলার হারুন ডেকে বলে,”এই যে তুমি,তোমার বাবা তোমার জামিন করিয়ে নিয়েছে, হাত খুলে দিচ্ছি। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও।”

দুজন হাবিলদার গিয়ে ভয়ে ভয়ে তার হাতের বাধন খুলতে থাকে, মারপিটের সময় তারা কয়েদিকে পেছন থেকে লা’থি দিয়েছিলো।তাদের ভয় হাত খুললেই কি না তাদের মা’রধোর করা শুরু করে দেয়।
কিন্তু কয়েদি কিছু বলে না। উঠে দাঁড়ায়, হাত দিয়ে চুল ঠিক করে নেয়। তার কোনো জিনিসপত্র গোছানোর প্রয়োজন সে মনে করে না।লাত্থি দিয়ে কাপড়ের ব্যাগ টাকে দূরে সরিয়ে দেয়। হাবিলদার দুজন পিছনে সরে দাঁড়ায়। তাচ্ছিল্য মাখা হাসি দিয়ে সেল নাম্বার আঠেরো থেকে বেড়িয়ে আসে সে। উকিল বিধান চন্দ্র রায় পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,”সবই তোমার কপাল বুঝেছো বাবা। ভগবান চাইলে কি না পারে,আর পাচ মিনিট দেড়ি হলে তোমার জামিন আজ করাতে পারতাম না,আরো দশ বারোদিন লেগে যেতো। সবই গোপালের কৃপা,ভালোয় ভালোয়…..”

এইইইইইইই”
কর্কশ কন্ঠে চেচিয়ে ওঠে কয়েদী।
-এতো কিছু শুনতে চাইছি আমি? একদম কথা কম।

বিধান চন্দ্র হকচকিয়ে যায়, সে ভিষন অপমানিত বোধ করে।
তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে হেলে দুলে জেলারের পিছু পিছু মেইন গেটের দিকে চলে যায় কয়েদী নাম্বার আঠেরো।

বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বিশ পঁচিশজনের একটা দল। ছয় বছর পরে তাদের গুরু ছাড়া পাচ্ছে। তারা আবার তাদের কলিজার জোর ফিরে পাচ্ছে। সজীবের হাতে ফুলের মালা। গুরুর ডান হাত হিসেবে মালা পড়ানোর দায়িত্ব তার। সে এতে খুবই অহংকার বোধ করছে।

গেইটের বাইরে পা রাখতেই দুপুরের করা রোদ সরাসরি উচ্ছাসের মুখে গিয়ে পরে, সে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে, এতদিন জে’লের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থেকে সে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। আস্তে আস্তে সে মুখ থেকে হাত টা সরায়।
দাত বের করে ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে আসছে সজীব।

সে “ভাইইইই” বলে গগন কাপানো চিৎকার দেয়, তার সাথে তার দলের অন্যরাও মিছিল দিতে শুরু করে।
সজীব ফুলের মালা পরাতেই যাবে অমনি উচ্ছাস হাত দিয়ে সজীবকে থামিয়ে দেয়। সজীব কিছু বুঝতে পারে না।
উচ্ছাস জিগ্যেস করে, “বাবা আসবে না?”
সজীব ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়,”না মানে ভাই,কাকা তো খুব ব্যস্ত তাই আমাদের পাঠিয়ে তোমাকে একটা নিরাপদ যায়গায় রাখতে বলেছে কদিনের জন্য….”
উচ্ছাস বুঝতে পারে তার বাবা তাকে দেখতে চায় না।
সে সজীবকে থামিয়ে বলে, “আসল কথা বল।”
সজীব পকেট থেকে একটা টাকার বান্ডিল, একটা মোবাইল আর খাম বের করে উচ্ছাসের হাতে দেয়। উচ্ছাস মোবাইল আর টাকার বান্ডিল দুই পকেটে ঢুকিয়ে রাখে। খামটা খুলতে খুলতে বলে,”এটা আবার কি?”

সজীব মাথা নুইয়ে বলে,”উর্বীর স্বামীর ছবি আর বায়োডাটা।”

উচ্ছাসের হাত থেমে যায় উর্বী নামটা শুনে। সে সজীবের দিকে তাকায়। সজীব মিনমিন করে বলে,”ওরা বরিশাল থেকে চলে গিয়েছে। পরশু রাতে বিয়ে হইছে ভাই!”

উচ্ছাস খাম খুলে একটা ছবি আর বায়োডাটা বের করে। শ্যামলা উজ্জ্বল বর্ণের একজন পুরুষের ছবি। বায়ো ডাটায় লেখা,
নাম: সামিউল করিম খান।
বয়স: বত্রিশ।
পেশা: ফটোগ্রাফার।

ঠিকানা:……………..।
উচ্ছাস ছবি আর বায়োডাটায় চোখ বুলিয়ে দুটোই ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়। তার শিষ্যরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
উচ্ছাস ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাটা শুরু করে, এই ছবি আর বায়োডাটা তার মাথায় ঢুকে গেছে। মুখস্থ হয়ে গেছে। সে কখনো ভুলবে না।

***
রওশান আরা চোখ বুজে চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছে। এই মূহুর্তে তার ভ’য়ংকর একটা কাজ করতে ইচ্ছে করছে, যা সে কখনো করে নি। তার ইচ্ছে করছে পায়ের কাছে বসে থাকা তার ছেলেকে মারতে মারতে মেরে ফেলতে।
তার পায়ের কাছে বসে আছে সামিউল। সে হাত দিয়ে তার মায়ের পা ধরে রেখেছে,যতক্ষন না তার মা তাকে মাফ করে দেয় সে পা ছাড়বে না। সামিউলের পিছনে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে অন্তরা। তার বুক ধুকপুক করছে। সে সামিউলের মাকে আগা গোরা দেখতে থাকে। ভদ্রমহিলার ভাব দেখে মনে হচ্ছে না সে তাদের মেনে নেবে। অন্তরা চিন্তায় পরে যায়।
রওশান আরা শাফিউলকে ডাকে,”শাফিউল,এই শাফিউল।”

শাফিউল,মোহনা,আজমেরী, রুমা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে ছিলো। মায়ের ডাক পেয়েই শাফিউল দৌড়ে আসে।
-মা,কি হয়েছে?
-এই কু’লা’ঙ্গার টা এখানে কি করে এলো,বাড়িতে কিভাবে ঢুকলো? রাওনাফ জানে? যা রাওনাফকে ডেকে নিয়ে আয়।
শাফিউল মিন মিন করে বলে,”মা ভাইয়াই সৈকতকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।”
রওশান আরা অবাক হয়,
-কি বললি! রাওনাফ নিয়ে এসেছে? আজকাল দেখছি আমার উপরে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে। রাওনাফ কোথায়,ওকে ডাক।

রাওনাফকে ডাকতে হয় না। সে রুমে ঢুকে বলে,”মা,ও তো ক্ষমা চাইছে,ওকে মেনে নাও,তোমার সব কথা আমি শুনি,তুমি আমার এই একটা কথা মানতে পারবে না?”

রওশান গর্জে ওঠে, বলে,
“কোনোদিনো না,আমি বেঁচে থাকতে না,আমি ম’রে গেলে যেনো ও ওর এই দুশ্চ’রিত্রা বৌকে নিয়ে আমার লা’শের ওপর দিয়ে এ বাড়িতে ঢোকে,ওকে এখনই বেরিয়ে যেতে বল, এখনই।”
রাওনাফ মায়ের হাত ধরে,”মা অন্তরাকে নিয়ে এভাবে বাজে কথা বলবে না। ও তোমার ছেলের বৌ এখন। তোমার কাছ থেকে এমন কিছু আশা করিনা।”
রওশান আরা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,”এই মেয়েকে এক্ষুনি ঘা’র ধরে বের করে দে তোরা, সাথে এই কু’লা’ঙ্গার টাকেও। এই মেজো বৌ,কথা কানে যায় না,এই দুটোকে বের করে দাও। এক্ষুনি।

মোহনা ঘামতে থাকে,”শাশুড়ি তাকে এ কি আদেশ দিচ্ছে।”

সামিউল মায়ের পা ধরে আবারও,”মা,তুমি চাইলে আমরা এই বাড়িতে আর আসবো না। তবু একটিবার বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো। মা একটিবার বলো।”

রওশান আরা চেচিয়ে ওঠে,”ক্ষমা! তোর মতো কু’লাঙ্গার কে করবো আমি ক্ষমা। তোর জন্য একটা আমার মান সম্মান সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো, আর তুই! একবার আমার মানসম্মানের কথা ভাবলি না।দূর হ তুই,দূর হ।

উর্বী রুমে চুপচাপ বসেছিলো।‌ রওশান আরার হাক-ডাক শুনে সে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। রওশান আরার ঘরের বাইরে দেখতে পায়, বাচ্চারা উকি দিয়ে দেখছে ভেতরে কিছু হচ্ছে। শায়মী শর্মীও দাঁড়িয়ে আছে। উর্বীকে দেখতে পেয়ে দুজনেই কপাল কুচকে নিজেদের রুমের দিকে চলে যায়।
উর্বী পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকে। রওশান আরা তার বড় ছেলে রাওনাফের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ফোপাচ্ছে। তার পায়ের কাছে বসে আছে সামিউল করিম খান। এ বাড়ির ছোট ছেলে। যার সাথে উর্বীর বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। সামিউলের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে, উর্বী মেয়েটির দিক থেকে চোখ সরাতে পারে না। অসম্ভব সুন্দরী এই শ্যামবর্ণের মেয়েটি।
হঠাত মোহনা উর্বীকে দেখতে পেয়ে বলে,”একি তুমি! তুমি এখানে কেনো আসলে?”
সবাই উর্বীর দিকে তাকায়, সামিউল মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকাতেই একটা ধাক্কার মতো খায়। এই মেয়েটা তাদের বাড়িতে কি করছে!
সে অবাক হয়ে জিগ্যেস করে,”উর্বী, আপনি এখানে!”

রওশান আরা ক্ষে’পে যায়, সামিউলকে বলে,”এই খবরদার! উর্বী বলে ডাকবি না,একদম নাম ধরে ডাকবি না। বড় ভাবি বলবি,সম্মানের সাথে ডাকবি।”

সামিউল অবাক হয়ে যায়। সবার মুখের দিকে তাকায়। রাওনাফ মাথা নিচু করে রাখে। অন্তরা অবাক হয়ে উর্বীকে দেখছে। এই সেই ভদ্রমহিলা, যার সাথে সামিউলের বিয়ে ঠিক করেছিলো সামিউলের মা। মহিলা ছবির চেয়ে সুন্দর। সারা মুখে স্নিগ্ধ একটা ভাব লেগে আছে।

সামিউলের ঘোর কাটে না, মোহনাকে জিগ্যেস করে,”এই মেজো ভাবী, কি বলছে মা। বড় ভাবি মানে? কার সাথে বিয়ে হয়েছে ওনার?

-সেদিন রাতে,মা বড় ভাইয়ার সাথে উর্বীর বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।

ঠান্ডা গলায় উত্তর দেয় মোহনা।

সামিউল মাথা নিচু করে রাখে। সে এই পুরো ব্যাপার টা জানতো না।শাফিউল বা রাওনাফ বলে নি ফোনে। জানলে সে এই বাড়িতেই আসতো না। সে কখনোই উর্বীর সামনে পরতে চায়নি।

রওশান আরা বলে,”কি! এখনো বসে আছিস যে। চলে যা”! তোর এই মুখ আমাকে দেখাবি না। হয়েছে শান্তি এখানে এসে? তুই তোর বৌ নিয়ে সুখে থাক বাপ,যা এ বাড়ি থেকে। যা।”

রওশান আরা হাপাতে থাকে। রাওনাফ বলে, “একটু শান্ত হও মা।তুমি অসুস্থ হয়ে পরবে।”
রওশান আরা শান্ত হতে পারে না। অন্তরা নামের একটি ঝ’ড় তার সুখের নীড় টাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। সে কাঁদতে থাকে।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে উর্বী এসে রওশান আরার একটা হাত ধরে। রওশান আরা মাথা তুলে তাকায়।
উর্বী নরম সুরে বলে,”আপনারা সবাই একটু বাইরে যাবেন? আমি মায়ের সাথে একটু কথা বলবো।”

রাওনাফ কিছুটা অবাক হলেও চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

মোহনা এসে সামিউলকে টেনে উঠায়। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যায়,অন্তরা রুম থেকে বের হতে হতে পেছনে ফিরে তাকায় উর্বীর দিকে। কি চাচ্ছে এই মহিলা!?

চলমান….

আরেকটি বার পর্ব-০২

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২
#Esrat_Ety

ঘড়ির কাটা টিক টিক শব্দ করে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। রাত বারোটা সাঁইত্রিশ। মাথার ওপরে একটা ফ্যান চলছে। এই দুরকমের আওয়াজ ব্যাতীত অন্য কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ খানিকক্ষণ আগেও বাড়িটা মানুষের পদচারণায় গমগম করছিলো।বাচ্চাদের হাসি, চিৎকারে মুখরিত ছিলো। এখন পরিবেশটা নিশ্চুপ হয়ে আছে। বাইরে দূরে কোথাও থেকে মৃদু একটা গানের সুর ভেসে আসছে। উর্বী কান খা’ড়া করে শুনতে চেষ্টা করলো,রবীন্দ্র সংগীত কি না। জানালা টা খুলে দিলে আওয়াজ টা ভালো করে শুনতে পেতো। জানালা খুলতে ইচ্ছে করছে না। তার লাগেজ টা রুমের ভেতরেই দেওয়া হয়েছে,তাকে আলমারির নির্দিষ্ট কিছু যায়গা দেখিয়ে বলা হয়েছে তার কাপড়-চোপড় যেনো সে সেখানে গুছিয়ে রাখে। উর্বী ধীরেধীরে খাট থেকে নামতে গিয়ে আবার বসে পরলো।ডান পা টা ঝিম ঝিম করছে। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে সে একই ভাবে বসে ছিলো। পা ঝিমঝিম করাটা স্বাভাবিক। উর্বী মুখে “চ” কারন্ত শব্দ করলো। এতো ভারি শাড়ি গায়ে পরে থাকতে তার খুবই অসহ্য লাগছে, সাথে এতো গয়না। উর্বীর রীতিমত গা চুলকাচ্ছে। ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে নিলে ভালো লাগবে। সে মাথা ঘুরিয়ে ওয়াশরুম খুজতে লাগলো,এমন সময় দরজায় টোকা পরলো। পুরুষালি গলায় দুবার গলা খাঁকারি দিয়ে দরজা ঠেলে রাওনাফ রুমে ঢুকলো। তার চেহারার কানায় কানায় অস্বস্তি ছেয়ে আছে। দরজার বাইরে সে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলো। তার ইচ্ছে করছিলো অন্য কোনো রুমে গিয়ে ঘুমোতে। কিন্তু এটা করা যাবে না। তার মা রওশান আরা তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দেবে। এমনিতেই কিছুক্ষন আগে বড় সর একটা সিনক্রিয়েট হয়ে গেছে বাড়িতে। সে আর ঝামেলা বাড়াতে চায় না। ভোর পাচটায় একটা অপা*রেশন আছে,তার ঘুমানো দরকার। দরজা লক করার শব্দ হলো। উর্বী ব্যাগ থেকে একটা খয়েরী রঙের শাড়ী বের করে বিব্রত ভঙ্গিতে বসে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। রাওনাফ ঘামছে, তার ইচ্ছে করছে দরজা খুলে ছুটে পালিয়ে যেতে। এই বয়সে এসে এরকম শিশুসুলভ আচরণ করা যায়না,তাকে মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। উর্বী উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। রাওনাফ হাত থেকে ঘড়ি খুলে টেবিলের ওপর রাখলো। তাকে জোর করে হলেও ঘুমাতে হবে,কাল সকালে হয়তো বাড়িতে আরেকটা নাটক হবে,তাকে তার আগে হসপিটালে যেতে হবে। সে খাট থেকে একটা চাদর আর বালিশ নিয়ে সোফায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে,আজ রাতটা সোফাতেই কাটিয়ে দিবে।

***
শাফিউল একমনে ফেইসবুক ব্যবহার করছে,তার সম্পূর্ণ মনোযোগ মোবাইলে। এই এলোমেলো পরিস্থিতিতে মোহনার অপ্রয়োজনীয় কথাগুলি সে এড়িয়ে যেতে চায়।
মোহনা শফিউলকেকে ধা’ক্কা দিয়ে বললো,”এই উত্তর দিচ্ছো না কেনো,এসব কি শুরু করেছেন আমার শাশুড়ি! আমরা লোকজনকে মুখ দেখাতে পারবো কাল থেকে?”

-মুখ দেখাতে না পারলে কাল থেকে বোরখা পরে বাইরে যেও। উত্তর দেয় শাফিউল।

মোহনা ভ্র কুচকে তাকিয়ে থাকে। সিরিয়াস মুহুর্তে শাফিউলের এই ধরনের রসিকতা মোহনার পছন্দ না। সে আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
-না মানে,মা না হয় একটু সেকেলে চিন্তাভাবনার মানুষ,রাগের মাথায় নিজেদের বাড়ির মানসম্মানের কথা ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাই বলে ভাইয়ার সেটা মেনে নিতে হবে? উর্বী মেয়েটা তার থেকে কত ছোটো,একবারো চিন্তা করলো না এই সম্পর্কের ভবিষৎ….

শাফিউল বলে,”শোনো মোহনা,ভাইয়া বা মা কেউই উর্বী বা তার পরিবারকে জোর করেনি,সবাই সুস্থ মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত টা নিয়েছে।তোমার তাদের সম্পর্ক বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার দরকার নেই,তুমি তোমার কাজ করো।”
মোহনা মিন মিন করে বলে,”সেটাই তো,দেখেছো কি লোভী পরিবার, এতো ভালো ফ্যামিলি যাতে হাত ফসকে না যায় সেজন্য হাটুর বয়সী মেয়েকে একটা….”

-তুমি থামবে।
মোহনাকে ধমকে থামিয়ে দেয় শাফিউল।

মোহনা কিছুক্ষন চুপ থাকে,তারপর আবার বলে,”সামিউলকে ফোনে পাওয়া গেল?”
শাফিউল বলে,”হু। কাল আসছে বাড়িতে। আল্লাহ জানেন কাল কি হবে।”

-কি আর হবে। এই ক’দিন তো কম ঝ’ড় হয়নি বাড়িতে,কাল টর্নেডো হবে।

***
উর্বীর নিজেকে এখন অনেকটা ফ্রেস লাগছে, সেই সাথে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার ফলে হাচিও দিচ্ছে। বাইরে বের হয়ে সে কিছুটা অবাক হয়ে যায়। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একবার বিছানার দিকে তাকায়,একবার সোফার দিকে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে সে খাটের ওপর বসে পরে। তার হাতে বিয়ের গয়না। সোনার গয়নাগুলি নিয়ে সে বিপদে পরেছে,এতগুলো গয়না তার আর পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। কোথায় রাখবে সেটাও বুঝতে পারছে না। কাল সকালে সে এ বাড়ির কারো কাছে দিয়ে দেবে ঠিক করলো,আপাতত বিছানার উপরে থাক। রাওনাফ বলে লোকটা সম্ভবত ঘুমিয়ে গেছে। উর্বী তাকিয়ে আছে, ছ ফুটের মতো লম্বা একটা লোক,সোফায় ঘুমাতে ভিষন কষ্ট হচ্ছে বোধ হয়। লোকটা সোফায় কেনো ঘুমাচ্ছে উর্বী সেটাই বুঝতে পারছে না! বিয়েতে যে খুব একটা মত এই লোকের ছিলোনা তা তার আচরণেই টের পেয়েছে উর্বী। তবে রাজি কেনো হয়েছে বিয়েতে? মায়ের কথায়? এতো মা ভক্তি!
অবশ্য এরকম কাহিনী সে সিনেমা নাটকে দেখেছে, লাফিয়ে লাফিয়ে মায়ের কথায় বিয়েটা ঠিক করে নেয় কিন্তু বাসর ঘরে বলে,”এই বিয়ে আমি মানি না!”
নিশ্চয়ই ঐ লোকটা ঐসব দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছে!

উর্বী ঠোঁট টিপে কিছুক্ষণ হেসে নেয়, পৃথিবীতে সেই সম্ভবত একমাত্র মহিলা যে সিরিয়াস মুহুর্তে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস চিন্তা করে! লোকটাকে সাত-আটবার দেখেছে উর্বী। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের পুরুষ, বিয়াল্লিশ বছরে ত্বক যেরকম থাকার কথা সেরকম, নামাজ পড়তে পড়তে সম্ভবত কপালের মাঝখানে একটা দাগ বসিয়েছে। বাড়তি কিছুই নেই, হ্যা শুধু একটু লম্বা। তবে লোকটা খারাপ না দেখতে, বত্রিশ তেত্রিশ বছর সময়টাতে বেশ সুদর্শন ছিলেন, যার প্রমাণ তার চেহারায় আংশিক এখনও আছে।
তবে একটু বোকা বোকা লাগলো উর্বীর কাছে, নয়তো মায়ের কথায় নিজের বাচ্চাদের অনুমতি না নিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়! এতো একেবারে দুদুভাতু ছেলে মায়ের! আর লোকটার চুলগুলো অস্বাভাবিক কালো,এটা ঠিক প্রাকৃতিক লাগলো না উর্বীর কাছে, সম্ভবত চুলে কালার করেছে, বয়স ঢাকার জন্য !

উর্বী রাওনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠিক করলো এখন থেকে সে সোফায় ঘুমাবে। এমনিতেও সে অযাচিত ভাবে রাওনাফের জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে,তার জন্য কাউকে ভোগান্তি পোহাতে হবে না। উর্বী ঠিক করেছে জীবন তাকে যেদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়,সে সেদিকে ভেসে যাবে। জীবনের থেকে আর কোনো প্রত্যাশা নেই তার। যদি ওই সোফায় শুয়ে থাকা লোকটা এসে বলে উর্বীকে তার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে হবে,সে তাতেও রাজি হবে। উর্বী শুয়ে পরে,সে এখন বুঝতে পারছে সে কতটা ক্লান্ত।তার দু চোখ ঘুমে জরিয়ে যাচ্ছে।

***
ফোনের রিং একবার বাজতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে,”নাম্বারটি এই মূহুর্তে ব্যস্ত আছে।”
শায়মী ফোন রেখে দেয়,সে জানে নাবিল এখন আর ফোন ধরবে না।কোনোভাবেই না। তার চিন্তা হচ্ছে। রাগের মাথায় নাবিল অনেক উলটো পালটা কাজ করে। আজ কি ঘটাবে কে জানে।
শর্মী জেগে ছিলো,শায়মীর দিকে ফিরে শুয়ে জিগ্যেস করলো,”ভাইয়া ফোন ধরছে না আপু?”
-না,কেটে দিচ্ছে,মনে হয় আজ ধরবে না।
-তুমি কোথাও যাবে?
শায়মী তার জামাকাপড় একটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকাচ্ছিলো।বললো,”হু,কাল সকালে খালামনির বাসায় যাবো।”

শর্মীর মন খারাপ হয়ে যায়,সে এ বাড়িতে একা হয়ে যাবে। তার কান্না পাচ্ছে,তার ইচ্ছে করছে উর্বী নামের মহিলাটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে, কিন্তু শর্মীর অতো সাহস নেই তার ভাইয়ার মতো। সে খুব ভীতু।
শায়মী ডাক দেয়,”এই শর্মী, তুই ঘুমাবি না?”
শর্মী কথা বলে না,সে মনে মনে ভাবতে থাকে,বড়রা যা চায় তাই করতে পারে। তাদের কেউ কিছু বলে না। এইযে ভাইয়া আজ রাগ করে টিভি,জিনিষ পত্র ভাঙচুর করলো। পাপা তাকে কিচ্ছু বলো না,চুপচাপ দেখলো। অথচ রাগ করে সে একদিন প্লেট ভে’ঙেছিল, পাপা না বকলেও সে পাপার চাহনী দেখে খুব ভ’য় পেয়েছিলো। কাল সকালে আপু বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে,পাপার ধমকেও কাজ হবে না। আপু যাবেই। শুধু সে কখনো জেদ করতে পারবে না।কারন সে ছোট। তারপর,সে আপু ভাইয়ার মতো মেধাবী না। অংকে কখনোই চল্লিশের উপরে পায় না। তাই হয়তো কেউ তার কথা শোনে না। শর্মীর ইচ্ছা করে তার আপুর সাথে খালামনির বাসায় থাকতে, কিন্তু সেটা সম্ভব না।

***
বাড়ির নাম,”রওশান মঞ্জিল”। রাওনাফ অনেক শখ করে তার মায়ের জন্য এই বাড়িটি বানিয়েছে। বাড়িটা দেখলে সবার চোখ আটকে যায়,ধবধবে সাদা রঙের এই বাড়িটায় মোট বারোটা টা শোবার ঘর। রাজ প্রাসাদের মতো না হলেও,এতো বড় ডু’প্লেক্স বাড়ি আজকাল কেউ বানানোর সাহস করে না তাদের শ্রেনীর ভদ্রলোকেরা যারা রয়েছেন, রাওনাফ সেই সাহস করেছে। তার মা আজীবন তাদের পাচ ভাইবোন কে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। তার মায়ের আজীবনের কষ্টের কাছে এই বাড়ি খুব সামান্য উপহার।

উর্বী চোখ বড় বড় করে রুমের চারপাশ টা দেখতে থাকে, টাকা পয়সা থাকলেও অনেকের রুচি থাকে না, কিন্তু এ বাড়ির মানুষের আছে। রাতে এতো টা খেয়াল করেনি সে। তার মনে হচ্ছে কোনো পাঁচতারা হোটেলের কামরায় বসে আছে। উর্বীর চোখে পরে বিছানার পাশের টেবিলে একটা ফটো ফ্রেম উপুড় করে রাখা, সে ফ্রেমটা তুলে হাতে নেয়, রাওনাফ আর তার আগের স্ত্রীর ছবি সম্ভবত। ভদ্রমহিলা অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। উর্বী একমনে তাকিয়ে থাকে, রাওনাফের মুখ হাসি হাসি, বৌ সুন্দরী ছিলো তাই মনে হয় খুশি একটু বেশিই চোখে মুখে। এক হাত দিয়ে সে তার স্ত্রীকে ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে একটু বেশিই শক্ত করে ধরে রেখেছে,যেনো তার সুন্দরী বৌকে কেউ ছো মেরে নিয়ে যাবে। দুজনকে বেশ মানিয়েছিলো। দুজনেই সুন্দর। উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে ডানপাশে একটা দরজা দেখতে পায়। সে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে যায়। বিশাল বড় একটা বারান্দা। কিছু সাদা রঙের কবুতর বসে ছিলো,উর্বীর দরজা খোলার শব্দে সব উড়ে গেলো। উর্বী দেখতে থাকে,হরেক রকমের ফুল গাছ আর ক্যাকটাস প্লান্টস দিয়ে বারান্দাটি সাজানো হয়েছে। সে হঠাৎ টের পায় তার ভিষন খিদে পেয়েছে। কাকে গিয়ে বলবে এটা ভেবেই সে অস্বস্তিতে পরে যায়। রুমের ভেতরে চলে যায় সে।
রাওনাফ নামের লোকটা নেই, ঘুম থেকে ওঠার পরে উর্বী তাকে দেখেনি , বালিশ আর চাদর ভাজ করে বিছানার একপাশে রেখে গিয়েছে। দরজা চাপানো, হয়তো বাইরে গেছে।
উর্বী খাটে বসতে যাবে অমনি দরজায় আওয়াজ হয়,কেউ ভেতরে আসছে। দরজা ঠেলে আমিরুন ভেতরে ঢোকে। তার হাতে একটা খাবারের থালা। ঠোট প্রশস্ত হয়ে আছে হাসিতে। সে খাবারের থালাটা বিছানায় রাখতে রাখতে বলে, “ঘুম ভালা হইছে ভাবি?”
উর্বী মাথা হ্যা সূচক নাড়ায়। সে বলে,”আপনি কে?”
আমীরুন উত্তর দেয়,”আমি আমীরুন,আমীরুন্নেছা। এই বাড়িতে কাম করি ভাবি,হেই ছুডো থেকে,এই হানেই থাকি। আপনার যখন যা দরকার আমারে বলবেন।”
উর্বী দরজার বাইরে তাকায়। আমিরুন দেখে আর বলে,”বড় ভাইজান রে খুজতাছেন? হে তো বাড়িত নাই,হাসপাতাল গেছে সকালে,অহন মনে হয় চেম্বারে। বারোটার আগে আইতো না।”

উর্বী অস্বস্তিতে পরে যায়। বলে,”আমি কাউকে খুজছি না। আচ্ছা এ বাড়ির সব মেহমান চলে গেছে?”
বাইরে থেকে আওয়াজ আসে,”না, আমরা আছি, সবাই আছে,কেউ যায়নি”
কথাটি বলে আজমেরী। এ বাড়ির বড় মেয়ে,রাওনাফের ছোট বোন,তার থেকে চার বছরের ছোট । রুমে ঢুকেই বিছানায় বসে পরে উর্বীর পাশে। উর্বী তাকে চিনতে পারে না। আমিরুনের দিকে তাকায়।
আমীরুন বলে,”আপনের বড় ননদ গো ভাবি,এই বাড়ির বড় আপা।”

উর্বী সালাম দেয়।
আজমেরী সালামের উত্তর দিয়ে বলে,”তোমাকে নাম ধরে ডাকবো নাকি ভাবি ডাকবো বুঝতে পারছি না।”
উর্বী আস্তে করে বলে,”আপনি আমায় উর্বী বলে ডাকতে পারেন আপা।”
আজমেরী হাসে,উর্বীকে দেখতে থাকে। উর্বীকে দেখতে যাওয়ার সময় সে ছিলো না, ছবি দেখেছিলো। উর্বী ছবির থেকে সুন্দর।
আজমেরী নরম গলায় উর্বীকে বলে,”খাচ্ছো না কেনো,খাও। খিদে পেয়েছে নিশ্চই অনেক,আসলে দেরী হয়ে গেলো নাস্তা দিতে,বাড়ির পরিস্থিতি তো বুঝতেই পারছো। কারো মন ভালো নেই। সবাই দেরী করে ঘুম থেকে উঠেছে।”

উর্বী বলে,”কোনো ব্যাপার না আপা আমার অতোটাও খিদে পায়নি।”

আজমেরী হেসে বলে,”আচ্ছা এখন খাও। এত বেলা অব্দি না খেয়ে আছো।”
উর্বী খাবারের থালায় হাত দেয়। পরোটা আর মাংসকষা দেওয়া হয়েছে। খিদের পেটে উর্বীর ভালোই লাগছে খাবার টা। আজমেরী আমিরুন কে বলে,”যা গিয়ে দেখ বাচ্চাদের খাওয়া হলো কি না”

আমিরুন চলে যায়। উর্বী খেতে থাকে। আজমেরী উর্বীর দিকে একটা চাবি এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা নাও।”
উর্বী মাথা তুলে তাকায়,”এটা কিসের চাবি?”
_ভাইজানের আলমারির চাবি,আম্মা দিয়েছে, তোমাকে দিতে বলেছে,গয়না গুলো এভাবে ছড়িয়ে রেখো না। পরতে ইচ্ছে না হলে তুলে রাখো,গা একেবারে খালিও রেখো না,ওই নেকলেস টা পরো।ওটা একেবারে সিম্পল।
উর্বী অবাক হয়ে বলে,”এতো গয়না সব আমার কাছে রাখবো?”
_হ্যা,তোমার গয়না তোমার কাছে রাখবে এতে অবাক হচ্ছো কেনো।আর চাবিটা সাবধানে রেখো।

উর্বী খাওয়া শেষ করে,হাত ধুতে ওয়াশরুমে চলে যায়।
আজমেরী গয়না গুলো তুলে রাখে আলমারিতে।
হঠাত বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা যায়,চেঁচামেচি করছে রাওনাফের সবথেকে ছোট বোন রুমা। চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে সে কাউকে আটকাতে চাচ্ছে।
উর্বী ওয়াশরুম থেকে বাইরে আসে। আজমেরী ছুটে যায় নিচ তলায়। উর্বীও সেদিকে যায়,বাড়িতে আবার ঝামেলা হচ্ছে,ঝামেলার কেন্দ্রবিন্দু যে উর্বী তা সে আন্দাজ করতে পারছে।

***
রুমা শায়মীর বাম হাত ধরে আছে,শায়মী হাত ছাড়ানোর প্রানপন চেষ্টা করছে,তার ডান হাতে একটা ব্যাগ।
শায়মী দৃঢ় ভাবে বলছে,”আমার হাত ছেড়ে দাও ছোট ফুপি। আমাকে তোমরা আটকাতে পারবে না। আমি যাবোই। নাবিলকেও আটকাতে পারো নি,আমাকেও পারবে না। আমি এই বাড়িতে থাকবো না। ছাড়ো আমার হাত।
রুমা হাত ছাড়ে না,সে সবাইকে ডাকতে থাকে,”আম্মা,বড় আপা,মেজো ভাবি,কই তোমরা! দেখো শায়মী কি করছে। তাড়াতাড়ি এসো,শাফিউল ভাইয়া কোথায়,ভাইয়া এদিকে এসো তাড়াতাড়ি। ”

মোহনা,আজমেরী ছুটে আসে। শাফিউল বাজারে গিয়েছিলো,সবে মাত্র ফিরলো। সেও এসে শায়মীকে আটকাতে চায়।
উর্বী দূরে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছে দৃশ্য টা।
শায়মী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে,বলে,”তোমরা বৃথা চেষ্টা করছো। আমায় তোমরা আটকাতে পারবে না। তোমরা ভুলে যেওনা,আমি হচ্ছি ডক্টর রাওনাফ করিম খানের মেয়ে। বাবার জেদ কিছুটা আমিও পেয়েছি। আমাকে ছাড়ো তোমরা।”
শাফিউল শায়মীর হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নেয়। ব্যাগটাকে দূরে ছুড়ে মারে। ব্যাগ টা গিয়ে উর্বীর পায়ের কাছে পরে। উর্বী হকচকিয়ে যায়।সবাই উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী সেখান থেকে রুমের দিকে যায়।
বাড়ির বাচ্চারা সব পর্দার আড়াল থেকে দেখছে। কাল রাত থেকে বাড়িতে কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। ছোট মামার বিয়েতে সবাই কত মজা করবে বলে প্লান করে রেখেছিলো। অথচ এখানে কোনো মজাই হচ্ছে না। সবাই শুধু রাগ করে ভাঙচুর করছে,বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বাইরে গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। রাওনাফের গাড়ি। এই সময়ে রাওনাফের ফেরার কথা না। সে আজ চেম্বারে যায়নি। অপা*রেশন থিয়েটার থেকে বের হতেই তার ফোনে আজমেরীর ফোন আসে,আজমেরী সকালে শায়মীর ঘরে গিয়ে তার ব্যাগ গুছানো দেখতে পায়। সে দেরী না করে রাওনাফকে ফোন করেছিলো।
শায়মী রুমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,”বেশ ব্যাগ লাগবে না,আমি এক কাপড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছি। ঐ বুড়িকে জিগ্যেস করবে,এবার তার শান্তি হয়েছে কিনা।”
শায়মী যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়াতেই রাওনাফ এসে শায়মীকে ধরে ফেলে। শায়মী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।
_ছাড়ো পাপা, তোমার সাথে আমি একটা কথাও বলতে চাই না, একটাও না। আমায় ভালোয় ভালোয় যেতে দাও নয়তো বাড়িতে আগুন জ্বা’লিয়ে দেবো।
রাওনাফ ছাড়ে না,সে তার মেয়েকে পরম মমতায় জরিয়ে ধরে রেখেছে। শায়মী কাঁদছে, একটু পরপর কেপে কেপে উঠছে। দুরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে শর্মী। এসব কি হচ্ছে তাদের বাড়িতে?

***
জেল*খানার ভেতরের এরিয়ায় দক্ষিণ পাশের বড় বটগাছটার নিচে বসে আছে কয়েদি নাম্বার আঠেরো। বটগাছের আসপাশটা শান বাঁধানো। হাঁটু গেড়ে বসে সে ইটের টুকরো দিয়ে মেঝেতে কিছু একটা লিখে যাচ্ছে।
তার থেকে কয়েকশ’গজ দূরে কিছু সংখ্যক কয়েদি শরীর চর্চা করতে ব্যস্ত। ওদের মধ্যে সবথেকে বদ হিসেবে পরিচিত মনজুরুল শরীর চর্চা থামিয়ে দিয়ে কয়েদি নাম্বার আঠেরোর দিকে তাকায়। তারপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলে,”শা’লায় এই সব কি করে?”

শাওন নামের একজন জবাব দেয়,”শিক্ষিত বড় ঘরের পোলা না? তাই দেখাইতে চায় সবাইরে,আমগো ধারে কাছে ঘেঁ’ষে না,মাটিতে সারাদিন কি সব লেইখা বেড়ায়।”

মনজুরুল খানিকটা কৌতুহলী হয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। খুব কাছে গিয়ে বলে ওঠে,”এই শোন।”

কয়েদি নাম্বার আঠেরো চুপচাপ। মনজুরুল বলে ওঠে,”তোর কাছে সিগারেট আছে? থাকলে একটা দে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভারি এবং হাস্কি গলায় কয়েদি নাম্বার আঠেরো বলে ওঠে,”এখান থেকে যা । ভালোয় ভালোয় কে’টে পর।”

মনজুরুল খানিকটা অপমানিত আর ক্রো’ধিত হয়ে সেখান থেকে চলে যায়। এই মালটাকে সে পরে দেখে নেবে। কত্তবড় বেয়া*দব।

কয়েদি নাম্বার আঠেরো তার হাত থামিয়ে একদৃষ্টে মেঝেতে “Urbi” লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

চলমান….

আরেকটি বার পর্ব-০১

0

#গল্প_আরেকটি_বার
#সূচনা_পর্ব
#Esrat_Ety

শাড়ির কুঁচি ধরে খানিকটা উঁচু করে সন্তর্পনে ইট দিয়ে বাঁধানো সরু রাস্তায় পা ফেলে সে। কর্দমাক্ত নরম মাটিতে স্থানে স্থানে ইট দেবে গিয়েছে, হাঁটতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে। শাড়ির নিচের দিকের পাড় কাঁদা পানিতে নোংরা হয়ে যাচ্ছে। যতখানি সম্ভব ততখানি উপরে তুলেছে শাড়ি।
এই শাড়িটা উর্বি তার এক বান্ধবীর কাছ থেকে চেয়ে এনেছে ইন্টারভিউয়ের জন্য,তার এমন শাড়ি নেই। একটা মহিলা সংস্থায় ইন্টারভিউ ছিলো আজ তার। শাড়ির জমিন সাদা,নেভি ব্লু রঙের পাড়। যেকোনো ধরণের এনজিওর চাকুরীর ভাইভার জন্য মানানসই পুরোপুরি। শাড়িটাতে উর্বিকে কেমন লাগছে উর্বি ঠিক জানে না । যে কয়বার আয়নায় নিজেকে দেখেছে ,তার ধারণা হয়েছে তাকে কিছুটা মাদার তেরেসার মতো লাগছে, ত্রিশ বছরের ইয়াং মাদার তেরেসা,যার গাল এখনও কুঁচকে যেতে শুরু করেনি,তবে যাবো যাবো করছে।

উর্বী এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আসন্ন ভূমিকম্পের কথা চিন্তা করে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুমিনিট দাঁড়িয়ে থেকে দরজার কড়া নাড়ে। সে মনে প্রাণে চাইছে দরজাটা যাতে মা অথবা রুহি-রাইসা খোলে,অন্যকেউ নয়।
খট করে ভেতর থেকে দরজার সিটকিনি খোলার শব্দ হয়। উর্বি নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই দরজা খুলে তার দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে তার বড় ভাবী তহুরা।

তহুরার দিকে তাকিয়ে উর্বী একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। ভেতর থেকে উর্বীর দুই ভাইজি রুহি-রাইসার পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

তহুরা উর্বীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে কোনো কথা না বলে ভেতরে চলে যায়। ভাবীর এমন শীতল রূপ উর্বী আশা করেনি। সামান্য খটকা তার লেগেছে। ঘরে ঢুকে দরজার সিটকিনি তুলে ঘুরে দাঁড়াতেই সে থ’ম’কে যায়। মুহুর্তেই ফরসা মুখটা আ’ত’ঙ্কে জমে যায় এক প্রকার।

উর্বীর ভাই রেজাউল কবির বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বি ঝটপট কিছু কথা সাজিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু সে জানে,সে সাজানো কথার একটি বাক্যও বলতে পারবে না। এমন কিছু বলে ফেলবে যার দরুন আজ উর্বীর রাতের খাবার খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

“কোথায় গিয়েছিলি?”
গমগম করে ওঠে চল্লিশ বছর বয়সী রেজাউল কবির।

প্রথম প্রশ্নের উত্তর উর্বির সাজানো। নিচু স্বরে কিন্তু দৃঢ় ভাবে বলে ওঠে,”ইন্টারভিউ ছিলো “জেগে ওঠো নারী” সংস্থায়।”

_কিসের ইন্টারভিউ?

_চাকরির। ফিল্ড ম্যানেজার।

রেজাউল কবির বোনের দিকে তাকিয়ে আছে।‌ কয়েক মূহুর্ত পরে বলে ওঠে,”আগামীকাল যার বিয়ে তার চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এখানে ওখানে অযথা ঘুরে বেড়ালে তোর হবু শশুর বাড়ীর মানুষের কানে উঠবে কথাগুলো।”

উর্বী চুপ করে থাকে। তার মা লুৎফুন্নাহার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

রেজাউল কবির বলে ওঠে,”যা ঘরে যা। কাল ছেলের বাড়ি থেকে কিছু মানুষ এসে বিয়ে পরিয়ে তোকে নিয়ে যাবে চুপচাপ। তাঁরা এখন অনুষ্ঠান করতে চাইছে না, আমারো সামর্থ্য বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। এটাই ভালো হয়েছে।”

উর্বী অনেকটা সাহস যোগার করে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। তারপর বলে ওঠে,”বিয়েটা আমি করবো না ভাইয়া।”

সাথে সাথে রেজাউল কবির উর্বীর গালে এক চ’ড় বসিয়ে দেয়। তহুরা ছুটে এসে স্বামীর হাত ধরে বলে ওঠে,”করছো কি! ত্রিশ বছর বয়সী একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর গায়ে হাত তুলছো! মাথা কি খারাপ হয়ে গিয়েছে?”

উর্বী গালে হাত চেপে ভাইয়ের দিকে অনূভুতি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”এভাবে কাউকে ঠকানো ঠিক না ভাইয়া। এটা তুমিও জানো।”

বৃদ্ধা লুৎফুন্নাহার চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভেতরের ঘর থেকে রুহি- রাইসা গলা ফাটিয়ে বইয়ের পড়া মুখস্থ করে যাচ্ছে।
রেজাউল কবির দ্রুত নিজের ঘরে চলে যায়, দুমিনিট পরে হাতে ছোটো একটা কাগজের টুকরো নিয়ে ফিরে এসে উর্বীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,”নে। এই নে ছেলের নাম্বার। ফোন করে তোর কেচ্ছা- কাহিনী নিজে জানিয়ে দে। যা।”

উর্বী হাতের কাগজটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে যায়। তহুরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”শান্ত হও তুমি। শান্ত হও। প্রেশার বেরে যাবে।”

_কি শান্ত হবো? কি শান্ত হবো আমি? ছোটো বোনটার বিয়ের বয়স হয়ে এলো,তাকে বিয়ে দিতে হবে না? ওর ভাইজি দু’টো বড় হচ্ছে তাদের বিয়ে দিতে হবে না? আর কত? আর কত জ্বালাবে ও আমাদের?

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া লুৎফুন্নাহার ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উর্বীর ঘরের দিকে যায়।

রুহি-রাইসা তাদের বাবার চিৎকার চেঁচামেচিতে পড়া থামিয়ে দিয়েছিলো। রেজাউল কবির থেমে যাওয়াতে তারা আবার পড়তে শুরু করে।

উর্বী ঘরে ঢুকে শাড়ি পাল্টে কাগজের টুকরো টা হাতে তুলে নেয়। নাম্বারটা নিজের ফোনে তুলে কাগজটাকে দূরে ছু’ড়ে মা’রে। এমন সময় লুৎফুন্নাহার দরজায় এসে দাঁড়ায়। উর্বী বৃদ্ধা মায়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,”তোমার ছেলে ডান গালে চ’ড় মে’রেছে, গালটা এখনও গ’রম হয়ে আছে। তুমিও আরেকটা চ’ড় মেরে বাম গালটা গ’রম করে দিয়ে যাও।”

লুৎফুন্নাহার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”কাল চুপচাপ কবুল বলে আমাদের উদ্ধার করিস।”

দু’জনের কেউই আর কোনো কথা বারায় না। লুৎফুন্নাহার চলে যায় চুপচাপ।

ঘড়ির কাঁ’টা তার গতিতে ছুটতে থাকে। পুরো ঘর অন্ধকার,কাঠের জানালার কপাট দু’টো খোলা,বাইরে থেকে জোৎস্নার আলো এসে ঘরটাকে একটু আলোকিত করার চেষ্টা করলো। উর্বী পাশ ফিরে শোয়। তার পাশেই শুয়ে আছে তার থেকে চার বছরের ছোট বোন উপমা। ফোন কানে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে তার প্রেমিকের সাথে। উপমা ছোটো বেলা থেকেই একটু সু-স্বাস্থের অধিকারিণী। যার সাথে তার প্রণয় সেই প্রেমিকটিও তার থেকে দ্বিগুণ সু-স্বাস্থের অধিকারী।

উপমা ফোনে ফিসফিসিয়ে এমন ভাবে কথা বলছে শুনে মনে হচ্ছে চিনা হাঁস হিসহিস করে পায়চারি করছে উঠানে। শব্দটা উর্বীর কানে ঠিক সেরকমই লাগছে। এই ধরণের শব্দের জন্য এর থেকে ভালো আর উপযুক্ত বর্ণনা উর্বীর জানা নেই। আচ্ছা উপমাকে বলবে একটু জোরে কথা বলতে? এভাবে হাসের মতো হিসহিস না করতে?

উর্বী আধো অন্ধকারে বোনের কার্যকলাপ কিছুক্ষণ দেখে বিছানা থেকে নামে। বলুক যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে কথা। কত রঙিন দিন দুজনের, দু’চোখ ভর্তি কত স্বপ্ন ঐ সু-স্বাস্থবান প্রেমীযুগলের। স্বপ্নটা সত্যি হতে দেরী নেই, কাল যদি উর্বীর বিয়ে হয়ে যায় তাহলে সব ঝামেলা শেষ।

টেবিলের ওপরে চার্জে লাগানো ফোনটা হাতে নিয়ে “বিয়ের পাত্র” নামে সেইভ করে রাখা নাম্বারটায় ফোন দেয় উর্বী। ফোনটা কানে ধরতেই উপমার হাসির শব্দ শোনা যায়। প্রেমিকের সাথে খিলখিলিয়ে হাসছে।
উর্বীর বড্ড মায়া হয়,সে যদি এখন ফোন করে বিয়েটা ভেস্তে দেয় তবে ঐ হাসি আর শুনতে পাবে সে?

“দ্যা নাম্বার ইউ আর ট্রাইং টু কল ইজ কারেন্টলি সুইচস্টপড।”

রোবটিক নারী কন্ঠটি জানিয়ে দিলো,উর্বী চাইলেও সত্যিটা জানতে চায়না পাত্র। না জেনে শুনে পঁ’চা শামুকে পা কাটবে পাত্র। পাত্রের জন্য উর্বীর বেশ দুঃখ হচ্ছে। বেচারা!

সাত-আটবার চেষ্টা করলো ১০ মিনিটের ব্যাবধান নিয়ে। নাম্বারটা বন্ধ। উর্বী হাল ছেড়ে দিয়ে ফোনটাকে চার্জে বসায় আবারও। ঘাড় ঘুরিয়ে আধো অন্ধকারে উপমার দিকে তাকায়। উপমা সম্ভবত ঘুমিয়ে পরেছে। এখন নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে তার বিয়ে হচ্ছে ঐ আসিফ নামের সু-স্বাস্থবান প্রোমোটারের সাথে।

বিছানায় এসে পুনরায় শুয়ে পরে সে। তাকে এখন ঘুমোতে হবে, কাল তার বিয়ে। কাল সেই দিন। তার জীবনের সাথে জরিয়ে থাকা মানুষগুলোর মহা আনন্দের দিন, স্বস্তির দিন।

***
এটাকে ঠিক বিয়ে বাড়ি বলে কেউ মানতে চাইবে না। বাড়িটাকে উর্বীর কাছে কোনো মৃ’ত ব্যক্তির শোক-বাড়ির মতো মনে হচ্ছে। যার চারদিন আগে মৃ’ত্যু হয়েছে এবং পরিবারের লোকজন শো’কপালন করছে।

উর্বী বিছানায় চুপচাপ বসে ছিলো। তার বিছানার উপরে একটা বড় লাগেজ। এটা পাত্রপক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে। পাত্রপক্ষ বর্তমানে জেলা শহরে উর্বীর খালার বাড়িতে আছে। বিকেলে এসে বিয়ে পরিয়ে নিয়ে যাবে উর্বীকে। সম্বন্ধটা মূলত উর্বীর ছোটো খালা নুরুন্নাহার ঠিক করেছে। তার শশুর বাড়ীর দিকের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয় ছেলের পরিবার।

তহুরা এসে উর্বীকে লাগেজ থেকে একটা শাড়ি বের করে পরে নিতে তা’ড়া দেয়।
উর্বী মাথা ঘুরিয়ে তহুরাকে একপলক দেখে। তারপর লাগেজের দিকে তাকায়।

তহুরা বসার ঘরে তার স্বামী রেজাউল কবিরের কাছে যায়। রেজাউল কবির ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলেন, সম্ভবত কাউকে নিমন্ত্রণ করছিলেন। ফোন কেটে তহুরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে?”

_কাকে দাওয়াত করছো?

_আমার এক কলিগ কে। বিয়েতে মেয়ের বাড়ির কোনো রিলেটিভ না দেখলে পাত্রপক্ষ কিছু মনে করে বসতে পারে।

_তাহলে রিলেটিভকে দাওয়াত করো। জানিয়ে দাও উর্বীর বিয়ে হচ্ছে।

রেজাউল কবির চোখ মুখ শক্ত করে তহুরার দিকে তাকিয়ে বলে,”উর্বির জীবনে তাদের অবদান এমনিতেই অপরিসীম। বিয়েতে থাকার কোনো দরকার নেই আর। আমি চাইনা আমার বোনটা বিয়ের দিনেও দম আটকে কা’দুক।”

তহুরা প্রসঙ্গ পালটে বলে,”পাত্রপক্ষের জন্য কোনো আয়োজন করা হচ্ছে না, এটা কেমন দৃষ্টিকটু না?”

_ছোটোখালা কিছু করতে নিষেধ করেছেন। পাত্রপক্ষ আসবে,বিয়েটা পরাবে তারপর উর্বীকে নিয়ে চলে যাবে।

তহুরা বসার ঘরের জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলে,”পাত্রপক্ষের এতো তাড়াহুড়ো ব্যাপারটা আমার কাছে খ’টকা লাগছে। না মানে তুমি ভাবো,অত বড় বাড়ির ছেলে,তারা এমন মফস্বলের একটি মেয়েকে পছন্দ করলো,তার ওপর উর্বীর বয়স নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। বিষয়টি খ’টকা লাগার মতো নয়কি? আচ্ছা পাত্র ল্যাংড়া-খোড়া নয়তো?”

রেজাউল কবির চুপ করে থেকে বলে,”গিয়ে উর্বীকে সাজাও। পাত্রের খুঁত থাকলেও বিয়েটা এইখানেই হবে। সাজাও ওকে।”

কুঁচি গুলো গুঁজে নিয়ে আঁচল বুকে তুলে আয়নায় নিজেকে একপলক দেখে নেয় উর্বী। মেরুন রঙের বেনারসী,গলায় একটা স্বর্ণের সরু চেইন। সাজসজ্জা এতটুকুই। উর্বী আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তোকে সুন্দর লাগছে বুড়ো পঁচা শামুক।”

উপমা ঘরে ঢুকে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তুমি সারাদিন কত কিছু খাও তবুও তুমি স্লিম। আর আমি একটু পানি খেলেও ফুলে ফেঁপে উঠি।”

উর্বী চুলে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে বলে ওঠে,”তুই কি সুখী মানুষ?”

_মনে তো হচ্ছে। আপাতত কোনো কষ্ট নেই আমার।

_তাহলে তো ফুলতেই থাকবি। তোর চর্বি খাওয়ার কেউ নেই।

_চর্বি খাওয়ার কেউ নেই মানে?

_মানে দুঃখ মানুষের চর্বি খেয়ে ফেলে। যে যত দুঃখী সে ততো স্লিম।

উপমা বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ওঠে,”পাত্রের মা তোমার সাথে দরজা বন্ধ করে কি বলেছিল সেদিন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।”

_তোর জানার দরকার নেই। তুই যা,তোর গোলোমোলু প্রেমিককে বল তার বাড়ির লোককে জানাতে তোদের ব্যাপারে। আমি বিয়েটা করে নিচ্ছি। ঝামেলা বিদায় হচ্ছে।

***
বাড়ির পরিবেশ কোনো কারনে থমথমে হয়ে আছে। উর্বী কারন টা বুঝতে পারছে না। সে নিজের ঘরের বিছানায় চুপচাপ বসে ছিলো। আসরের নামাজ বাদ ছেলেপক্ষ চলে আসার কথা। তারা এখনও আসেনি। আসলে উর্বীকে জানানো হতো। উর্বীর ঘরের দরজা চাপানো,বাইরে কি হচ্ছে তা স্পষ্ট সে শুনতে পারছে না। তবে এটুকু বুঝতে পারছে রেজাউল কবির কারো সাথে তর্ক করছে ফোনে।

উর্বী যেভাবে বসেছিলো ঠিক সেভাবেই বসে থাকে, চুপচাপ। হঠাৎ করে রুহি হুরমুর করে ঘরে ঢুকে উর্বীর দিকে তাকায়।

উর্বী কিছু জানতে চাওয়ার আগেই রুহি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে,”তোমার যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা। সে পালিয়েছে ফুঁপি।”

উর্বী রুহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তহুরা এসে ঘরে ঢুকে বলতে থাকে,”পাত্র পালিয়েছে।”

উর্বী স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”আচ্ছা।”

তহুরা উর্বীর কথা শুনে অবাক হয় না। সে জানে উর্বী এই প্রকৃতির মহিলা। আগে অবশ্য ছিলোনা,তবে হয়ে গিয়েছে।

উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে তহুরার দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমরা ঘর থেকে বেরিয়ে যাও ভাবী। আমি শাড়িটা চেঞ্জ করবো। গা চুলকাচ্ছে আমার।”

তহুরা রুহিকে নিয়ে চলে গেলে উর্বী গাঁয়ের শাড়িটা পালটে নেয়। শাড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছিলো উর্বীর।
হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে শাড়িটা বিছানার উপর রেখে দেয়।
আচ্ছা এটা কেমন হলো? পাত্র জানিয়ে দিলেই পারতো সে বিয়ে করতে চায়না। পালালো কেনো? তাকে কি জোর করে বেঁধে উর্বির সাথে বিয়ে দিতো? কলিজা পঁ’চা লোক সম্ভবত।

তবে বেশ হয়েছে। উর্বীর হঠাৎ কেন জানি খুব হাসি পাচ্ছে।

রেজাউল কবির যদি এখন এসে বলে দেয়,”অনেক হয়েছে! এবার তুই বাড়ি থেকে বের হ। তোর নিজের জীবন তুই বোঝ, তাহলে উর্বীর জীবনের ষোলকলা পূর্ণ হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দু দুটো চাকরি খুইয়ে উর্বীর এবার চাকরি পেতে খুব বেগ পেতে হচ্ছে। এই মূহুর্তে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না। ঘুরে ঘুরে টিউশনি করানোর মতো অ’দম্য মানসিক শক্তি তার নেই। চাকরি একটা পেয়ে গেলেই কিছু একটা ভাবনা চিন্তা করা যাবে।”

বাড়ির পরিস্থিতি এখন খুবই ঠাণ্ডা। অবশ্য কিছুক্ষণ আগে রেজাউল কবির ছোটোখালার ফোন পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। কেনো গিয়েছে তা উর্বী জানে না। সে ঘর থেকেই বের হয়নি।

এশার নামাজের সময় হয়ে গিয়েছে। জানালা থেকে তাকিয়ে ল্যাম্পোস্টের আলোতে দেখা যাচ্ছে মুসল্লিরা সবাই টুপি মাথায় দিয়ে পাড়ার মসজিদে যাচ্ছে।
জানালার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উর্বী জানালা বন্ধ করে দেয়। বাড়িতে, বসার ঘর থেকে আবারও রেজাউল কবিরের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তার সাথে তহুরার তর্কা/তর্কি হচ্ছে। চারঘন্টা বাইরে কাটিয়ে কি করে এসেছে রেজাউল কবির?

উর্বী নিজের বিছানায় চুপ করে বসে থাকে। কি হচ্ছে না হচ্ছে তা দিয়ে তার কি! ফোনটা হাতে নিয়ে আরেকটা এনজিওতে নিজের সিভি পাঠিয়ে দেয়।
ঠিক তখনই রুহি এসে আবারও হুরমুর করে ঘরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”ফুপি ফুপি! তোমার বিয়ে হবে।”

***
উর্বী ভাইয়ের দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। রেজাউল কবির তহুরার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”ওকে শাড়ি পরতে বলো তহুরা। খালাম্মা আর ত্রিশ মিনিটের মধ্যে পাত্রপক্ষ নিয়ে আসবে। পাত্র,পাত্রের মা,পাত্রের মেজো ভাই আর তার বৌ।”

উর্বী হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,”পাত্র পালিয়েছে বলে তার বিপত্নীক বড়ভাইকে বিয়ে করতে হবে? এতোটাও অসহায় ভাবি না আমি নিজেকে। হাস্যকর।”

রেজাউল কবির বোনের দিকে তে’ড়ে যায়,”কি ভাবিস তুই তাহলে?”

_আমার রুচিতে বাঁধছে ভাইয়া।

_তাই নাকি? আর তোর সত্যিটা জানলে কোনো ছেলের রুচিতে কুলোবেনা তোকে তাও নিশ্চই জানিস।

রেজাউল কবিরের এই একটা কথায় উর্বী চুপ হয়ে যায়। রেজাউল কবির বোনকে অতি জঘন্য কথাটা বলে নিজে নিজেকে মনে মনে ধি’ক্কার দিতে থাকে,কিন্তু সে কঠিন গলায় তহুরাকে বলে,”ওকে তৈরি হতে বলো। পাত্রের বয়স বিয়াল্লিশ বছর। আমাদের মা যদি সতের বছরের ছোটো হয়ে বাবার সাথে সংসার করতে পারে তাহলে ও বারো বছরের পার্থক্য নিয়ে দিব্যি পারবে। ছেলের তিনটা বাচ্চা আছে। এটাও কোনো বিষয় না, খুঁতে খুঁতে কাটা’কাটি হয়ে যাবে। ও নিজে দুধে ধোওয়া তুলসী পাতা হলে চিন্তা করতাম।”

কথাগুলো শেষ করে রেজাউল কবির হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির আঙিনায় চলে যায়। উর্বী মাথা ঘুরিয়ে তার ভাবীর দিকে তাকায়। তহুরা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

***
লম্বা একটা ঘোমটা টেনে উর্বী চুপচাপ বসে আছে। বাড়িতে কিছুক্ষণ আগে পাত্রপক্ষ চলে এসেছে। সবাই সম্ভবত বসার ঘরে বসে আছে।

উর্বী একদৃষ্টে বিছানার চাদরের নকশার দিকে তাকিয়ে আছে। এই চাদরটাকে আগে কখনও দেখেনি। নতুন নিয়েছে নাকি ভাবী! রুহি-রাইসা,উপমা কেউই নেই আশেপাশে।

হুট করে দরজা ঠেলে রেজাউল কবির ঘরে ঢোকে,তার পিছু পিছু কাজী সাহেব।
তহুরা এসে উর্বীর বিছানার সামনে একটা চেয়ার টেনে দেয়। কাজী সাহেব বসে উর্বীর দিকে একপলক তাকিয়ে বলতে থাকে,”পাত্র ঢাকার উত্তরা নিবাসী মোহাম্মদ রাওনাফ করিম খান। পিতা মরহুম তোফায়েল করিম খান। পাত্র তোমাকে নগদ তিন লক্ষ এক টাকা মোহরানা প্রদান করে বিবাহ করতে চায়,তুমি যদি এই বিয়েতে রাজি থাকো তাহলে কবুল বলো মা।”

উর্বীর হঠাৎ করে খুব হাসি পাচ্ছে। সে বহু কষ্টেও হাসি চেপে না রাখতে পেরে হেসে ফেলে।

কাজী খানিকটা ভড়কে যায় উর্বীর এমন অদ্ভুত আচরণে। তহুরা আর রেজাউল কবির একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

দীর্ঘক্ষণ হেসে উর্বী চুপ হয়ে যায়, চোখের কোণে দুফোঁটা অশ্রু জড়ো হয়েছে যা মেরুন রঙের বেনারসীর ঘোমটার আড়ালে সবার অগোচরেই থেকে যায়। সে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”কবুল।”

চলমান……..

সে আমারই পর্ব-৫১ এবং শেষ পর্ব

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৫১
#অন্তিম_পর্ব

এবারের পালা ফারদিনের। সে চুপচাপ চেয়ে আছে বাকি পাঁচটা হাতের দিকে। সিনথিয়া তাড়া দিচ্ছে তাকে। ফারদিন বিরক্ত চরম। এসেছে বিয়ে করে চলে যাবে। তা না! এসব মশকরা! সিনথিয়া ফের তাড়া দিল,

“কি রে! হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি বউ নিয়ে বিদেয় হ।”

ফারদিন কিছু ভাবে। হঠাৎই কিছু ভেবে বাঁকা হাসে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“আপু এখানে দৃষ আর পায়েল ছাড়াও তিনটা মেয়ের হাত আছে, না?”

“হ্যাঁ, তো?”

“পায়েল কে খুঁজতে হলে আমায় সব কটা মেয়েকে ছুঁতে হবে। তাদের হাত ধরে ধরে দেখতে হবে। তাতেও যদি না বুঝি তাহলে জোরে চেপে ধরে বুঝতে হবে। সব রকম পদ্ধতি ব্যবহার না করলে তো আমি খুঁজে পাব না, তাই না!”

সিনথিয়া ভেবে বলে,

“ঠিকই বলেছিস। তুরাগও তো ওভাবে খুঁজে নিয়ে গেল। যদিও ওর অতটা ধরাধরি করা লাগেনি। তোর যদি দরকার হয় তাহলে ধরবি।”

পাঁচ নম্বর হাতটা ফট করে বেরিয়ে এলো। অগ্নি দৃষ্টিতে ফারদিনের দিকে চেয়ে বলল,

“কি বললেন আপনি! মেয়েদের হাত ধরাধরি করবেন! তাও আবার জোরে চেপে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ এই দিনটাও আমাকে দেখতে হলো। অন্য মেয়ের হাত ধরলে আপনার হাত আমি ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেব।”

সিনথিয়া হা করে তাকিয়ে রইল। ফারদিন ঠোঁট কামড়ে হাসে। তীর ঠিক জায়গায় গিয়েই লেগেছে। সিনথিয়া চেঁচিয়ে উঠল,

“একি! তুমি বেরিয়ে এলে কেন? ও তো না খুঁজেই তোমাকে পেয়ে গেল। ধুর!”

পায়েল হতভম্ব হয়ে গেল। সত্যি তো! লোকটার কথায় গা জ্বলে যাচ্ছিল তার, থাকতে পারেনি। বেরিয়ে এসেছে। ফারদিন তার হাত ধরে বলল,

“বউ পেয়ে গিয়েছি, এবার চললাম। ভাই, এবার তুমি খোঁজো।”

যেতে যেতে ফিসফিসিয়ে বলে,

“বোকা বউ।”

পায়েল মুখ গোমড়া করে ফেলল। কথার জালে ফেলে তাকে বের হতে বাধ্য করেছে বদমাশ টা! অতঃপর কাজীর কাছে যেতেই তাদের বিয়েটাও সম্পন্ন হয়ে গেল।

বাকি রইল আফরান। সে কুল কুল করে ঘামতে ব্যস্ত। ওদের তো হয়ে গেল! এখন সে যদি বউ খুঁজে না পায় তাহলে তো ঝামেলা হয়ে যাবে। সিনথিয়া চোখ পাকিয়ে বলে,

“তোকে কি এখন ইনভাইট করতে হবে বউ খোঁজার জন্য?”

সে মিনমিন করে বলল,

“আপু একটু হেল্প করে দে প্লিজ। তোকে দশ হাজার দিলাম ভুলে গেলি?”

সরাসরি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

“না না আমি মীর জাফর গিরি করতে পারব না। তুই কোনো হেল্প পাবি না। নিজেকেই করতে হবে।”

“তুই অলরেডি মীর জাফর গিরি করছিস আমার সাথে। না, মীর জাফর না। তুই হলি ঘসেটি বেগম।”

“বকে বকে মাথা খারাপ করিস না তো। কাজী চলে যাবে একটু পর। তখন মজা বুঝবি।”

অসহায় আফরান। ঘুরে ফিরে হাত গুলো দ্যাখে। ছুঁতে মন চায় না। বউ বাদে অন্য কারো হাত ধরতে রাজি নয় সে। হঠাৎ একটা জিনিস খেয়াল হতেই হাহাকার করে উঠল,

“নেই! আমার বউ এখানে নেই। এই আপু! আমার বউ কই?”

“নেই মানে! তুই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেই বুঝে গেলি? এর মধ্যেই আছে।”

“না নেই। আমি বলছি তো নেই। কোথায় রেখেছিস ওকে? বের করে দে।”

“দ্যাখ ভাই, আগে ব্যাখ্যা কর। তুই কি শিয়র যে তোর বউ এখানে নেই? ভালো করে ভেবে বলবি কিন্তু।”

“আমি একদম শিয়র। ও নেই এর মধ্যে।”

সিনথিয়া হেসে ফেলল। পা উঁচু করে তার চুল নেড়ে চেড়ে খুলে রাখা পাগড়ি পরিয়ে দিল। যেটা টেনশনে আফরান খুলে রেখেছিল। বলল,

“যা, স্টেজে যা।”

আফরানের অস্থির কণ্ঠস্বর,

“ওখানে আছে?”

“যেয়ে দ্যাখ।”

আফরান প্রায় ছুটতে ছুটতে গেল। দেখল স্টেজে লাল টুকটুকে বউ। জানে পানি এলো তার। এক লাফে তার পাশে গিয়ে বসল। ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইল। দৃষ্টি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,

“এমন হ্যাংলার মতো তাকিয়ে আছেন কেন?”

“দৃষ! তুই সত্যিই আছিস?”

“না, মিথ্যে আছি।”

“তাহলে তুই সত্যি সত্যি আছিস। আমি কত ভয় পেয়েছিলাম জানিস? ভেবেছিলাম আমাকে ফাঁদে ফেলে তোকে দেবে না।”

“এতো চেঁচামেচি করছিলেন যে এখানে বসে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। সবাই কি ভাবল?”

“টেনশনে আমি কোমায় যাচ্ছিলাম আর তুই আছিস সবাই নিয়ে!”

“আপনি কীভাবে বুঝলেন যে আমি ওখানে নেই?”

আফরান খুব যত্নের সাথে দৃষ্টির হাত উঠিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। বলে,

“এই যে হাত। আমি জানি তুই কখনো নখ বড় রাখিস না আর নেইলপলিশও পরিস না। ওখানে সব গুলো হাতে হয় নখ বড় ছিল নয় নেইলপলিশ লাগানো ছিল।”

দৃষ্টি আড়ালে একটু হেসে হাত সরিয়ে নেয়। মেকি বিরক্ত হবার ভান করে বলে,

“এমন চালাকি না করলে আমাকে খুঁজেই পেতেন না।”

আফরান কিছু বলতে চেয়েও পারে না। মৃন্ময় কোথা থেকে এসে তাদের অভিনন্দন জানায়। আফরান হাত মিলিয়ে বলে,

“আপনাকেই এতক্ষণ ধরে খুঁজছিলাম, ডক্টর আহমেদ।”

“আমার সৌভাগ্য।’

“সে যাইহোক। আমার ছেলে মেয়ে কিন্তু আপনাকে বড় মামা বলে ডাকবে আমি আগে থেকেই বলে দিলাম। আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?”

মেকি হেসে সে বলে,

“একদমই না। আমি তাকে মাথায় করে রাখব। আপনাদের ভবিষ্যত জীবনের জন্য অনেক শুভকামনা রইল।”

দৃষ্টি মৃদু হেসে বলল,

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।”

মৃন্ময় যেতেই আফরান চেঁচিয়ে উঠল,

“কাজী কই? চলে গেল নাকি শা’লা!”

কাজীকে হম্বিতম্বি করে এগিয়ে আসতে দ্যাখা গেল। আফরান তাকে দেখে চমকে গেল।

“আরে এটা তো!”

“হ্যাঁ, আমাদের প্রথম বিয়ে ইনি পড়িয়েছিলেন আর দ্বিতীয় বিয়েও পড়াবেন।”

আফরানের এই মিষ্টি মুখ খানা দেখে পাগল হবার দশা। বউয়ের সাজে এতো আদুরে লাগছে! কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করল। পরিবারের সবাই তাদের ঘিরে ধরল। সবার সামনে দৃষ্টি স্ব ইচ্ছাই কবুল বলল। সেদিনের মতো অনিচ্ছায় নয়।

বিয়ে শেষে আমিনুল ইততেয়াজ হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন,

“মেয়ে কি এই বাবাকে মাফ করতে পেরেছে?”

সেদিন তাদের বাড়িতে যাবার পর সব মিটমাট হয়ে গেলেও সবার সামনে এমন করে বলায় দৃষ্টি লজ্জা পেল। নিচু কণ্ঠে বলল,

“এভাবে বলবেন না, বাবা। আপনি মাফ চাওয়ার মতো কিছু করেননি। সব করেছে আপনার ছেলে।”

আফরান দোষটা মোটেও ঘাড়ে নিতে চায়ল না,

“আমি কি করলাম? আমি একটা ভালো ছেলে। এখনো শিশুর মতোই পবিত্র।”

সবাই তার কথায় হাসে। দৃষ্টি দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিসিয়ে বলে,

“শিশুর মতো পবিত্র বলেই তো বউ বউ করে চেঁচাচ্ছিলেন। কচুর পবিত্র।”

সে থতমত খেল। সিনথিয়াকে ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাল সে রুমে যেতে চায়। এখানেই তিনটা রুম বুকিং দেওয়া আছে তাদের জন্য। সেখানেই আজকের রাতটা তারা থাকবে। তুরাগ আর ফারদিন তো আগে আগেই চলে গেল। সব নিয়ম কেবল তার জন্য। এর দোয়া, ওর দোয়া। এই মিষ্টি এই শরবত।
সিনথিয়া দৃষ্টিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

“আমি ও’কে নিয়ে যাচ্ছি। তুই বসে থাক। আমি না ডাকা পর্যন্ত নড়বি না।”

সে চলে গেল। ফেলে গেল দুঃখী আফরানকে। সে দুনিয়ার সব থেকে দুঃখী মানুষ। বউয়ের কাছে যেতে গেলেও তার এখন আপুর ডাকের অপেক্ষা করতে হবে। এই দিনটা দ্যাখার জন্যই তো বয়স একত্রিশ করে ফেলেছে!
ফাহাদ আবরার হাতে মেশিন ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

“নাও, আমার প্রেশার মাপো।”

“এখন আপনার প্রেশার মাপতে হবে?”

“অবশ্যই। গ্রাম থেকে সকল আত্মীয় এসেছে। সবার প্রেশার মাপতে হবে। আমার জামাই ডাক্তার বলে কথা! ফ্রিতে প্রেশার মাপতে পারবে না?”

এ কি জ্বালায় পড়ল সে! চৌদ্দ গোষ্ঠীর প্রেশার মাপতে হবে নাকি সারারাত ধরে? ছলছল চোখ করে সে প্রেশার মাপতে শুরু করে। লাইন দিয়ে সব দাঁড়িয়ে আছে। সে মাপতেই থাকে। আশপাশ থেকে শুনতে পায় নিজের প্রশংসা,

“কত ভালো ডাক্তার দেখেছ? বিয়ের দিনও ডাক্তারি করে, তাও ফ্রিতে।”

“আজ কোথায় যাবে? আমাকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে ছিলে, মনে আছে তো?”

পায়েল জোর পূর্বক হেসে বলে,

“আপনিও তো আজ আমায় বোকা বানালেন। তো শোধ হয়ে গিয়েছে। আপনারও দোষ নেই আমারও নেই। হি হি।”

মুখটা বেজায় গম্ভীর করে ফারদিন বলে,

“কোনো শোধ হয়নি। আমি এখন প্রতিশোধ নেব।”

আতংকে পায়েল পুরো ঘর জুড়ে ছোটে। বার বার বলে,

“আমাকে মারবেন না, প্লিজ। ছেড়ে দিন আমাকে। আমি আর এমন করব না, প্রমিজ।”

ফারদিন তাকে খপ করে ধরে তুলতুলে বিছানায় ছুড়ে ফ্যালে। এগিয়ে তার উপর ঝুঁকে নাকে নাক ঘষে বলে,

“কোনো ছাড়াছাড়ি চলবে না। শাস্তি তো পেতেই হবে। তিন রাত আমাকে একা রাখার শাস্তি।”

চোখ খিঁচে বন্ধ করে রাখা নিষ্ক্রিয় পায়েলের হাত জোড়া কখন যে তার হাতের মুঠোয় চলে গেল, তা পায়েল নিজেও জানে না। পরপর অধরের আক্রমণে সে শ্বাস নেওয়ারও সুযোগ পেল না।

দু দুবার বমি করে ক্লান্ত ফারনাজের দেহে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। তুরাগ তাকে বিছানায় বসিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“কষ্ট হচ্ছে খুব?”

সে মাথা নাড়ায়। তবুও তুরাগ বোঝে। পানি পান করিয়ে শুয়ে পড়ে। হাত ধরে টেনে বুকে নিয়ে বলে,

“বাসর রাতে সবাই কি করে! আর আমার বউ তো শক্তি খুইয়ে বসে আছে।”

ফারনাজ রেগে বুকে কিল ঘুষি মারে। বলে,

“আমার এই অবস্থা কার জন্য হয়েছে? ভাবটা এমন করছ যেন তোমার কপালে বাসর জোটেনি। এভাবে আমাকে খোঁচা মা’রলে খবর আছে তোমার।”

হেসে ফেলল সে। চেপে জড়িয়ে ধরে বলল,

“তোমাকে না পেলে যে আমি কি করতাম! একটা মুহূর্তও ভাবতে পারি না তোমাকে ছাড়া।”

বলতে বলতে মাথার তালুতে ঠোঁট ছোঁয়। ফারনাজ লাজুক হেসে তার বুকে মুখ গোঁজে। চাপা স্বরে বলে,

“আমিও কি ভাবতে পারি তোমায় ছাড়া? আমার নিঃশ্বাসেও মিশে গিয়েছ তুমি।”

আফরানের ইচ্ছে করছে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে। হাত ব্যথা হবার জোগাড়। এই আপুটা এখনো ডাকছে না কেন? এক টানা পনেরো জনের প্রেশার মাপার পর যখন তার হাত কাঁপতে শুরু করেছে তখন দেবদূতের মতো সিনথিয়া এসে তাকে রক্ষা করল। ভাইকে নিয়ে সে চলল রুমের দিকে। আফরান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,

“তুই এতো দেরি করলি কেন রে, আপু? আমার হাত ব্যথায় টনটন করছে। মনে হচ্ছে এখনই খুলে পড়ে যাবে। এই দ্যাখ আঙুল গুলোও নাড়াতে পারছি না।”

সিনথিয়া তাকে রুমের ভেতরে ধাক্কা দিয়ে বলল,

“ভেতরে গিয়েই দ্যাখ দেরি হলো কেন।”

বাইরে থেকে দরজা আটকে সে চলে গেল। আফরান নিজেও ভেতর থেকে সিটকিনি তুলে দেয়, কোনো রিস্ক নেওয়ার মানেই হয় না। যদি হুট করে দরজা খুলে কেউ ঢুকে পড়ে? মাথা থেকে পাগড়ি খুলে রাখে। শেরোয়ানির দুটো বোতাম ছাড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে,

“কি গরম রে বাবা!”

চোখ এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বিছানায় গিয়ে আটকায়। হোঁচট খায় সে। গায়ের রক্ত ছলাৎ করে ওঠে, টগবগিয়ে ওঠে। এবার গরম লাগা দ্বিগুণ হয়। গায়ে আগুন লেগে যাবার মতো অনুভূতি হয়। বিছানায় বসে যে তার প্রাণের প্রেয়সী। যার জন্য গুনে গুনে পাঁচটা বছর ধৈর্য ধরতে হয়েছে তাকে। যাকে এক দন্ড কাছে পাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত ছটফট করতে হয়েছে তাকে। সে চঞ্চল পা এগিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে। আগা গোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলে,

“তুই কি আমাকে মা’রার পরিকল্পনা করেছিস? ফুল কুমারী সাজতে হলো কেন তোকে?”

দৃষ্টির পা থেকে মাথা অবদি ফুলে মোড়ানো সাথে সিনথিয়ার দেওয়া সেই শাড়িটা। ফুলের গহনা পরিহিত বউয়ের এই রূপ দেখে আফরান বোধহয় হার্ট অ্যাটাক করবে। দৃষ্টি পিটপিট করে চেয়ে বলে,

“আমি পরতে চাইনি তো। সিনথিয়া আপু পরিয়ে দিয়ে গেল। বলল চুপ করে বসে থাকতে।”

আফরানের যে এতো গরম লাগছে! সে এক টানে শেরোয়ানি খুলে ফেলল। দৃষ্টির সামনে উঠে বসে বলল,

“চুপ করে বসে থাক। আমি একটু দেখি তোকে।”

দৃষ্টি লজ্জায় কেমন গুটিয়ে গেল। এই লোকটা এমন লজ্জা দেওয়া কথা বার্তা বলে কেন শুধু? লজ্জা দিয়েই তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে ওস্তাদ তিনি। আফরান এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, এই দৃষ্টির কোনো নড়চড় নেই। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কখন যে নেশা ভর করল কে জানে? হুট করে দু হাতে তার কোমর জড়িয়ে খুব কাছে নিয়ে এলো। এক ইঞ্চি দূরত্বও রইল না। তার মুখশ্রীতে উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,

“বাসর রাতে নাকি বউকে গিফট দিতে হয়। কি চায় তোর?”

সে আঁখি জোড়া মুদে কাঁপতে কাঁপতে বলে,

“ককিচ্ছু চচাই না আম আমার।”

অকস্মাৎ আফরান কপালে কপাল ঠেকায়। ফিসফিসিয়ে বলে,

“কিন্তু আমার তো চাই। একটা রাজকন্যা চাই আমার। বয়স তো বসে নেই। আমার বয়সে তোর বাপ দুই বাচ্চার বাপ ছিল।”

ঘন ঘন শ্বাস ফ্যালে সে। থেমে থেমে বলে,

“আমার এখনো ফাইনাল এক্সাম বাকি। এন্টার্নি বাকি।”

সে সন্তর্পনে তার গ্রীবাদেশে অধর ছোঁয়ায়। উত্তপ্ত স্পর্শে কাঁপিয়ে দিয়ে বলে,

“তো কি হয়েছে? আমার রাজকন্যাকে সামলানোর জন্য মানুষের অভাব নেই। ও তো সব সময় আমার সাথেই থাকবে। হাসপাতালে গেলে আমার সাথে করে নিয়ে যাব। তাছাড়া তোর বাড়ির লোক আর আমার বাড়ির লোক। দুই বাড়ির মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে বড় হয়ে যাবে সে। আমার তো চাই ই চাই।”

দৃষ্টি আর কি বলবে? এমন পাগলামীর সামনে সে কি টিকতে পারবে? যেখানে সে নিজেই হেরে যেতে প্রস্তুত। ভাবনার মাঝেই বিছানায় পিঠ ঠেকল। শাড়ির আঁচলটাও কখন যেন খসে পড়ল। আফরানের অবাধ্য, নির্লজ্জ ওষ্ঠজোড়া ছোটাছুটি শুরু করেছে তার দেহের আনাচে কানাচে। তার কপালে অধর ছুঁইয়ে বলল,

“যেদিন তাকে মন দিয়ে বসেছিলাম, সেদিন থেকেই আমার মন বারংবার বলত সে আমার হবে। তাকে আমার হতেই হবে। আমি তাকে ছাড়া অপূর্ণ। আর এখন? এখন বলে সে শুধু আমার, শুধু আমারই। আমি পেরেছি তাকে নিজের করতে। হৃদয়ের পিঞ্জিরায় তাকে বন্দি করতে পেরছি আমি।”

মুখে আর কথা হলো না তাদের। কথা হলো ঠোঁটে ঠোঁটে। কথা হলো প্রতিটি স্পর্শে। সৌন্দর্যে পূর্ণ ফুলের রানী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল এদিক ওদিক। তার যে সময় শেষ। আফরানের রানীর অলংকার হওয়ার সময় শেষ। এখন সে নিজেই নিজের রানীর অলংকার, তার লজ্জা নিবারণের চাদর।

দুই জোড়া কপোত কপোতী যখন পুরোনো ভালোবাসার সৌন্দর্য নতুন রূপে উন্মোচন করতে ব্যস্ত, তখন তুরাগ প্রিয়তমার আবদারে ব্যালকনীতে গিটার হাতে বসে। তার যে একটা গান শোনার বড্ড ইচ্ছে হয়েছে। পাশেই ঘনিষ্ঠ ভাবে কাঁধে মাথা রেখে বসে সে। তুরাগ হাত বাড়িয়ে এলোমেলো কেশ গুচ্ছ গুছিয়ে দেয়। গভীর ভালোবাসায় কপালে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে গিটারে সুর তোলে। আর ফারনাজ? সে চোখ বন্ধ করে সেই সুরে হৃদয় বিলিয়ে দিতে ব্যস্ত।

“ভালো আছি ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।

ভালো আছি ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।

দিও তোমার মালা খানি,
বাউলের এই মনটারে।

আমার ভিতর বাহিরে অনন্তে অন্তরে,
আছ তুমি হৃদয় জুড়ে।

ঢেকে রাখে যেমন কুসুম,
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম।

তেমনি তোমার নিবিড় চলা,
মরমের মূল পথ ধরে।

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে,
আছ তুমি হৃদয় জুড়ে।”

সমাপ্ত!

সে আমারই পর্ব-৪৯+৫০

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৯

বেশ অনেক দিন পর ফারনাজ বাপের বাড়িতে এসে খুব খুশি। অবশেষে তুরাগ তাকে আসতে দিল। না আসতে দিয়েও উপায় ছিল না যদিও। তবে কড়াকড়ি ভাবে সাবধানে থাকতে বলেছে। ছোটাছুটিও করতে একদম বারণ করেছে। কারণ একবার পড়ে টড়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ফারনাজ বোঝে না, নাকি? সে কেন যেচে পড়ে নিজেদের অংশের ক্ষতি করতে যাবে? সে অবশ্যই সাবধানে থাকবে। তাছাড়া সবাই তো আছেই তাকে দেখে রাখার জন্য। সব থেকে বড় কথা, একটা ভবিষ্যৎ ডাক্তার আছে না? সে তো তাকে বড়দের মতো বকাঝকাও করে। শরীরের কোনো অবহেলা করার উপায় নেই।

রাত নটার দিকে তুরাগের কল এলো। ফারনাজ তখন দৃষ্টির পাশে শুয়ে হাজারটা গল্পে ব্যস্ত। রিসিভ করে কানে ধরতেই তুরাগ বলে,

“কি করছ?”

“শুয়ে আছি, দৃষ্টির পাশে। তুমি?”

বহু কষ্টে ফারনাজ কে আপনি থেকে তুমিতে এনেছে। এই ‘তুমি’ তার মুখে শুনলে তার হৃদয় জুড়িয়ে যায়।

“আমি অফিস থেকে মাত্র ফিরলাম। খেয়েছ? আর মেডিসিন নিয়েছ?”

“হ্যাঁ সব হয়েছে। তুমি একটু চিন্তা করা বন্ধ করো তো। সবাই তো আছে, নাকি? আমার খেয়াল রাখার মানুষের অভাব নেই।”

“তবুও আমার চিন্তা হয়। তুমি তো খুব শান্ত মানুষ! আমি চিন্তা না করে পারি না। বাড়িতে যাওয়ার কি দরকার ছিল? জেদ করে চলে গেলে আমাকেও বাধ্য করলে তোমাকে যেতে দিতে।”

“দুটো দিন কি তুমি থাকতে পারবে না? নিতে তো আসবেই দুদিন পর।”

“আমার জায়গায় তুমি থাকলে বুঝতে।”

“অতো বুঝতে চাইছি না। অফিস থেকে এসেছ খাও তারপর ঘুমাও। রাতে আর ফোন দিয়ে আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। হুহ!”

খট করে কেটে দিল। তুরাগ হতাশ শ্বাস ফ্যালে। দুদিন পরই তাদের রিসিভশনের তারিখ ধার্য করা হয়েছে। আফরানের কারসাজি, দেরি তার সহ্য হবে না বলেই দুদিন পর ঠিক করা হয়েছে। ফাহাদ আবরার যদিও একটু অমত পোষণ করেছিলেন, তবে আফরানের অস্থিরতার সামনে হার মানলেন। তাদের তিন ভাইয়েরই একই দিনে ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হবে। আফরান, তুরাগ আর ফারদিন। ফাঁকে আরো একবার কবুলও বলে নেবে।
হঠাৎ করে তুরাগকে চেপে ধরে আফরান ন্যাকা সুরে কাঁদার ভান করে। সে বিরক্ত হয়। বলে,

“এভাবে চেপে ধরেছিস কেন? আমি তোর বউ নই।”

“আমি বউকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। আর তুই আমার বউ হতে যাবি কেন? আমার বউ একমন শক্ত নয় ও তুলোর মতো তুলতুলে।”

তুরাগ নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়,

“ঢং করিস না তো। একটা বছর ছেড়ে থাকতে পারলি আর এখন দুটো দিন পারছিস না।”

আফরান তার বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল,

“তখন পেরেছিলাম, কিন্তু এখন পারছি না। আমরাও চল যাই। কি হবে গেলে?”

“গেলে তুই যা। আমি তোর মতো নির্লজ্জ হতে পারছি না।”

কিছুক্ষণ চুপ থাকে আফরান। অতঃপর বলে,

“ঠিক আছে, যাব না। তবে আজ আমি তোর সাথে থাকব। একা থাকতে আমার ভয় করবে।”

তুরাগ বালিশ ছুড়ে মারল তার মুখে। বলল,

“আমার রুমে থাকা যাবে না। এক্ষুনি বের হ।”

“নিজের বড় ভাইকে বের করে দিবি! এটা কেমন বেয়াদবি!”

তুরাগ হাল ছেড়ে দিল। মুখ কুঁচকে যেতে যেতে বলল,

“থাক তবে। আমি খেয়ে আসি।”

আফরান বালিশ জড়িয়ে ধরে রাখে। আহারে! বউটা যদি কাছে থাকত, কি ভালো টাই না হতো। আগের রাতের মতো খুব আদর করত। যদিও বউ একটু ঘাড়ত্যাড়া। কিন্তু সে ঠিকই সামলে নিত। তুলতুলে শরীরটা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রাখত। যতোই ছাড়তে বলুক না কেন, সে ছাড়ত না। দুটো দিন কীভাবে পার করবে? আজ আবার চুরি করে গেলে হয় না? পর মুহূর্তে মনে পড়ল দৃষ্টি তাকে কড়া ভাবে মানা করেছে। দুদিন যেন তাকে ও বাড়ির আশে পাশেও দ্যাখা না যায়। যদি দ্যাখা যায়, তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। সে কবুল বলবে না, আর শশুর বাড়িতেও যাবে না। এবং আফরানকে বিবাহিত ব্যাচেলর হয়ে থাকতে হবে। আফরান মনে মনে হাহাকার করে, সে কিছুতেই বিবাহিত ব্যাচেলর হয়ে থাকতে চায় না। সে বউয়ের সাথে থাকতে চায়।

পায়েলের মনটা একটু খারাপ। বেশি নয় একটুখানি খারাপ। তার কারণটা অবশ্য গুরুত্বর। সে ভেবেছিল বান্ধবীর বিয়েতে নাচবে। কিন্তু এখন তো তারও বিয়ে। নিজের বিয়েতে কি কেউ নাচে? মন খারাপ করে সে বলল,

“আমি না আর বিয়ে করব না। বিয়ে তো একবার হয়েছেই।”

ফারদিন ভ্রু কুঁচকে নেয়। বলে,

“কেন? কি সমস্যা তোমার?”

“তেমন কিছু না। আমি দৃষের বিয়েতে একটু মজা করতে চাইছিলাম। কিন্তু এখন তো আমারও বিয়ে! নিজের বিয়েতে মজা করা যায় না।”

“অতো মজা করে কাজ নেই। যা হচ্ছে হবে। নাচতে ইচ্ছে হলে নাচবে। মোচড়া মুচড়ি করা বন্ধ করো।”

পায়েল কিঞ্চিত রেগে গেল। এই লোক কখনো শান্ত সুরে কথা বলতে পারে না। সব সময় গম্ভীর! বিয়ে বিয়ে করে লাফাচ্ছে কেন সে কি জানে না? খুব জানে। বদ লোকটাকে চেনা হয়ে গেছে তার। সেও মুখ গম্ভীর করে বলল,

“ঠিক আছে। আমি দু’দিন আপু আর দৃষের সঙ্গে থাকব। চলি।”

ফারদিন তৎক্ষণাৎ তাকে চেপে ধরে। বলে,

“আপুদের সাথে থাকব! এর মানে কি?”

“আপনি দেখলেন না? বিয়ে বলে নাজ আপু চলে এসেছে আর আফরান স্যারও চলে গিয়েছে। তাহলে আমি আপনার সাথে কেন থাকব? ছাড়ুন আমাকে, আমি যাব।”

“না, তুমি যেতে পারবে না।”

“আমি যাবই যাব। ছাড়ুন নাহলে কিন্তু চেঁচাব।”

“আমাকে রাগিয়ে দিও না, পায়েল। খুব খারাপ হবে কিন্তু।”

হঠাৎ পায়েল দরজার দিকে চেয়ে বলল,

“আরে নাজ আপু আপনি! কিছু বলবেন নাকি?”

ফারদিন তাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল। সুযোগ বুঝে পায়েল দৌড়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল,

“বোকা বর।”

সে ভ্যাবাচ্যাকা খেল। দরজার কাছে কেউ নেই। দাঁত কিড়মিড় করে ভাবল এর শোধ সে খুব ভালো ভাবেই তুলবে।

দৃষ্টির ঘরে দৌড়ে ঢুকে দরজা মে’রে সে শ্বাস নিল ঘন ঘন। দৃষ্টি কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে? কীসে তাড়া করল তোকে?”

সে মুখ কালো করে বিছানার এক কোণে বসে পড়ল। বলল,

“তোর ভাই একটা গু’ন্ডা।”

“আমি জানি। আর তুই গু’ন্ডার বউ।”

পায়েল বিছানার উপর পা উঠিয়ে বাবু হয়ে বসে। বলে,

“বুঝলে, নাজ আপু? এই দুই ভাই বোন একই রকম ঘাড়ত্যাড়া, একজন নিজের বউকে আর অন্যজন নিজের বরকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে খুব ভালোবাসে। দ্যাখো না কীভাবে আমার উপর অত্যাচার করে? উঠতে বসতে ধমক দেয়। কড়া চোখে তাকায়। একটু এদিক ওদিক হলে আর রক্ষে নেই। গুন্ডাটাই তো আমাকে জোর করে বিয়ে করল। আমি কি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম? এমন গুন্ডাকে আমি কখনোই বিয়ে করতাম না। সব তো আমার কপালে ছিল বলে হলো।”

ফারনাজ ভীষণ মনোযোগের সহিত শুনছে। সে ফের বলে,

“তোমরা দুজন তো জমজ, কিন্তু লোকটা তোমার মতো এমন মিষ্টি হলো না কেন বলো তো? আস্ত একটা তিতা করোলা।”

ফারনাজ ফিক করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এলো। দৃষ্টি বলল,

“এতো হাসিস না, শ্বাস নিতে কষ্ট হবে।”

সে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল। পায়েলের দিকে চোখ পাকিয়ে চেয়ে দৃষ্টি বলে,

“এতো সব কথা যে বললি, তা যদি ভাইয়ার কানে যায়। তাহলে তোর কি হবে?”

পায়েল মোটেও ভয় পায়নি এমন ভাবে বলল,

“আমি তোর ভাইকে ভয় পাই নাকি? সে বাঘ না ভাল্লুক?”

“বাঘ ভাল্লুক তো নয় কিন্তু আস্ত একটা তিতা করোলা গু’ন্ডা।”

পায়েল একটু মিইয়ে গেল বোধহয়। ঝপাৎ করে দৃষ্টির গায়ের উপর পড়ে বলল,

“তোর মনে এখন কি চলছে আমি জানি। তুই তোর ভাইয়ের কাছে আমার নামে নালিশ করতে চায়ছিস। তাই না?”

“একদম ঠিক ধরেছিস।”

সে এবার রূপ বদলে ফেলল,

“এই না না, বলিস না প্লিজ। এসব জানতে পারলে আমাকে বস্তায় ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। আজ এমনিতেই বোকা বানিয়ে আমি তোদের রুমে চলে এসেছি। হাতের কাছে পেলে নিশ্চয়ই ছাড়বে না। আর এ কথা জানলে আমার শাস্তি ডাবল হবে। প্লিজ বলিস না।”

দৃষ্টি তাকে ঠেলে উঠিয়ে বলল,

“মুখ বন্ধ রাখ। লাইট অফ করে দিয়ে এক পাশে শুয়ে পড়। আর না থাকতে চায়লে বের হ।”

পায়েল দ্রুত আলো নিভিয়ে এক পাশে শুয়ে পড়ল। সে কিছুতেই যেতে চায় না। এক হাতে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে শুরু করল তার সকল পরিকল্পনা। তাদের তিন জনের তিন বরকে ঘোর ফাঁদে ফ্যালার পরিকল্পনা।
চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৫০

জীবনের একটা মুহূর্ত থাকে। যেই মুহূর্তটা আসার জন্য সকলে ছটফট করে। মনে হয় কখন আসবে সেই সুবর্ণ সময়? এমনই একটা মুহূর্ত আফরানের জন্য, যেদিন সে সবার সম্মুখে কবুল বলে পুনরায় দৃষ্টিকে নিজের জীবনের সাথে জুড়বে। আর এতে কোনো বাঁধা থাকবে না। কোনো চিন্তা থাকবে না। সারাজীবন সে তাকে মনের কুঠুরিতে আটকে রাখবে। সামান্য ফাঁকও রাখবে না।
কাঙ্ক্ষিত দিনটি এসেই গেল। আজ তাদের বিয়ের দিন এবং রিসিভশনও বটে। শেরোয়ানির দিকে তাকিয়ে তার ভীষণ আনন্দ লাগছে। আগের বিয়েতে তো কিছুই হয়নি। নিজে ফর্মাল গেটআপে ছিল আর দৃষ্টির জন্য একটা লাল ওড়না কিনেছিল। যা তার মাথায় দিয়ে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। আফরানের এও মনে আছে যে, জীবনে প্রথমবারের মতো সে তার গায়ে হাত তুলেছিল। এবং সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিল, এই প্রথম এই শেষ। আর কখনো তার গায়ে ফুলের টোকাও দেবে না।
সে শেরোয়ানি গায়ে এঁটে আয়নার সামনে দাঁড়াল। বাহ্! ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। এবার বউয়ের নজরে পড়লেই হয়। বউটা তো তাকে দেখেও দ্যাখে না। মাথায় পাগড়ি দিয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো। তার যে আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। বউয়ের সাজে দৃষ্টিকে দ্যাখার জন্য কলিজাটা দপ দপ করছে। তুরাগের রুমের মধ্যে প্রবেশ করে বলল,

“রেডি হয়েছিস? চল যাই।”

তুরাগ তখন বিছানায় শুয়ে ফোনে কিছু করছিল। ভাইকে দেখে উঠে বসে হা করে তাকাল। আফরান একটু লজ্জা পাবার ভান করে বলল,

“এভাবে তাকাস কেন? ক্রাশ খেলি নাকি? আমাকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছে, বল?”

তুরাগ বিরক্ত হয়ে বলে,

“তুই এখন সেজে গুজে বসে আছিস কেন! যাবার এখনো চার ঘণ্টা দেরি আছে।”

আফরান যেন আকাশ থেকে পড়ল,

“কি বলিস! এখনো চার ঘণ্টা?”

“হ্যাঁ।”

“না না আমি বিশ্বাস করি না। এখনই চল। একটু আগে গেলে কি হবে?”

তুরাগ ফের শুয়ে পড়ে বলল,

“এটাকে একটু আগে বলে না। নাটক না করে ঘরে গিয়ে ঘুম দে।”

একটু থেমে চোখ চিপে বলল,

“নাহলে কিন্তু রাত জাগতে পারবি না। যা, ঘরে যা।”

আফরান ভেবে দেখল তুরাগের কথাই ঠিক। উত্তেজনায় ঘুম হয়নি ঠিক মতো। একটা ঘুম না দিলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সে কিছুতেই আজকের রাত ঘুমিয়ে কাটাতে চায় না। পুরো রাত জাগবে এবং সাথে বউকেও জাগিয়ে রাখবে। ভাবতে কি যে ভালো লাগল! সে সুরসুর করে রুমে গিয়ে শেরোয়ানি খুলে শুয়ে পড়ল। ভাবল কখন যে চারটা ঘন্টা পার হবে?

খুব শীঘ্রই যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। নিজে দায়িত্ব নিয়ে সিনথিয়া দুই ভাইকে সাজিয়ে দিল। অতঃপর বলল,

“বাহ্! খুব সুন্দর লাগছে আমার ভাইদের। নজর না লাগে।”

আফরান মুচড়িয়ে উঠে বলল,

“কখন যাব, আপু? চল না যাই।”

“শুরু হয়ে গেল! আপু তুই জানিস? চার ঘন্টা আগে থেকেই ও লাফাচ্ছে। বলে ‘চল এখন যাই, একটু আগে গেলে কিছু হবে না’। আমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে রুমে পাঠালাম।”

সিনথিয়া হেসে ফেলল। ভাইয়ের মাথার পাগড়ি ঠিক করে দিয়ে বলল,

“আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে, ভাই। জানিস তো? সবুরে মেওয়া ফলে।”

আফরান ভালো ছেলের মতো মেনে নিল। আর একটু অপেক্ষা তারপর! তারপর দৃষ্টি তার সামনে। আজ বউ সাজে তাকে খুব ভালো করে দেখবে। চোখ একটুও সরাবে না। ধৈর্যের ফল সে খুব ভালো ভাবেই বুঝে নেবে।

তাদের রিসিভসনের জন্য বিরাট একটা কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করা হয়েছে। তাদের সবার পরিবারের ও নিজেদের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাইকে জানানো হয়েছে। আর এতো লোকের জন্য একটা বড় জায়গা তো লাগবেই। দুই পরিবারের তিন ছেলের রিসিভসনের আয়োজন বড় ধুমধামের সাথে করা হচ্ছে। চোখে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো আয়োজন।
তিন ভাই একসাথে গেটের সামনে দাঁড়াল। গেট আগলে দাঁড়িয়ে আছে ফারনাজ, দৃষ্টি ও পায়েলের কিছু বন্ধু বান্ধবী। মিষ্টি মুখ করিয়ে তারা বড় আকারের অ্যামাউন্ট দাবি করেছে। সব থেকে বড় কথা সিনথিয়া এসেই রূপ বদলে ফেলেছে। সে বর পক্ষ থেকে ইউ টার্ন নিয়ে কনে পক্ষ হয়ে গেছে। আফরান আহত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

“তুই এভাবে পল্টি খেলি, আপু? তুই তো বরপক্ষ।”

সিনথিয়া তার কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল,

“আমি তোদের চিনিই না। আমি জন্ম থেকে কনে পক্ষ। তাড়াতাড়ি টাকা বের কর আর ভেতরে আয়। নাহলে সারা রাত ধরে দাঁড়িয়ে থাক। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”

তিন ভাইয়ের কাছে দশ হাজার করে দাবি করা হয়েছে। মোট ত্রিশ হাজার। পাশ থেকে তাদের বন্ধুরা টাকা দিয়ে দিল। আফরান ফের বলল,

“তুই এমন চিটারি করবি আমি ভাবতেও পারিনি।”

সিনথিয়া তার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

“যা ভাগ।”

মাথায় হাত বুলিয়ে মুখ ছোট করে সে প্রবেশ করল। তিনজনকে পাশাপাশি বসানো হলো। বেশ খাতির করা হলো। মিষ্টি, শরবত এই ওই খাওয়ানো হলো। আফরানের মনের মধ্যে কু গায়ছে। শ্যালিকাদের মুখ দেখে সুবিধার মনে হচ্ছে না। নিশ্চয়ই কোনো গভীর ষড়যন্ত্র করছে। তুরাগের হাত চেপে ধরে বলল,

“আমার এসব ভালো লাগছে না। বউদের নিয়ে এলেই তো হয়। এদের মতলব ভালো লাগছে না।”

সেও তাল মিলিয়ে বলল,

“আমারও কেমন লাগছে। সবাই মিটিমিটি হাসছে। কারণ কি হতে পারে?”

কেউই বিশেষ কিছু বুঝতে পারল না। তবে জানা গেল একটু পরই যখন তাদের বউদের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো। মাঝে বিরাট পর্দা। ওপাশে তাদের বউ। ছটা ডান হাত পর্দা এপাশে বের করা। সব গুলো হাতেই একই মেহেদীর ডিজাইন। তুরাগ বিরক্ত হয়ে বলল,

“এসব কি আপু? কষ্ট করে এলাম বিয়ে করে চলে যাব। এগুলো কেমন মজা?”

সিনথিয়া তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল,

“তুই চুপ কর। বউ পেতে গেলে এই ধাপ পার করতেই হবে। নিজেরা নিজেদের বউ চিনে নিতে পারলে নিবি। আর যদি চিনতে না পারিস তাহলে বউ তোদের ভাগ্যে নেই ধরে নে।”

সিনথিয়া তাদের বুঝিয়ে দিল। ছটা ডান হাতের মধ্যে তাদের তিনজনের বউয়ের হাত আছে। তাদের তিনজন কে তিনটা হাত বেছে নিতে হবে। যদি বউ চিনে নিতে পারে তো ভালো, নাহলে বাইরে যাবার রাস্তাটাও দেখিয়ে দিল খুব ভালো করে।
আফরান চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে বলল,

“এসব ভালো হচ্ছে না কিন্তু, আপু। এর শোধ কিন্তু আমি তুলব।”

সিনথিয়া তার কথাকে পাত্তা দিল না। বরং বলল,

“তাড়াতাড়ি বউ চিনে নিয়ে চল। কাজি বসে আছে।”

তুরাগ শ্বাস ফেলে এগোলো। ফারনাজ কে চিনতে পারবে না সে? তা কীভাবে সম্ভব? ছোঁয়া ছুঁয়ি তো কম হয়নি। তার চুলের গোড়া থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবটা চেনা আছে। পর পর দুটো হাত পরখ করে তৃতীয় হাত সে ধরে ফেলল। এটাই তার সম্পদ। প্রেগন্যান্সির জন্য ফারনাজের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে, তাছাড়া সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। বলল,

“এটাই আমার বউ। দ্রুত আমার হাতে দিয়ে দে।”

সিনথিয়া চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল,

“তুই শিয়র?”

“একশো ভাগ।”

হাত ধরে টানতেই সত্যি সত্যি ফারনাজ বেরিয়ে এলো। সকলে বাহবা দিল তাকে। তুরাগ কাউকে পরোয়া না করে টেনে তাকে নিয়ে গেল। ফারনাজ চোখ পাকিয়ে চেয়ে বলল,

“তুমি আমাকে চিনলে কীভাবে?”

সে তার হাতের উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

“কারণ আমি চিনি।”

ফারনাজ লজ্জা পেল। তুরাগ তাকে নিয়ে কাজীর কাছে গেল। বাবাকে বলল,

“বাবা তাড়াতাড়ি শেষ করো এটা। ওর শরীরের উপর অনেক ধকল গিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়বে শেষে।”

তার কথা শতভাগ ঠিক। তাই সবাই তাদের বিয়েটা পড়িয়ে দিলেন। সবার সম্মুখে তুরাগ পুনরায় কবুল বলে ফারনাজকে নিজের জীবনের সাথে জুড়ে নিল।

চলবে,

সে আমারই পর্ব-৪৭+৪৮

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৭

আজ সকালটা রোজকার সকালের মতন নয়। একটু নয়, পুরোটাই অন্যরকম। দৃষ্টি বিছানার সঙ্গে লেপ্টে আছে। পাশেই তাকে আগলে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে আফরান। সে হাত বাড়িয়ে তার চুলে আঙুল চালায়। অনুভব করে নড়ার শক্তি খুব কমই আছে। সর্বাঙ্গে চিনচিনে অসহ্য ব্যথা। সকাল তো বেশ হয়েছে। এখনো তাকে কেউ ডাকতে আসেনি। হয়তো ঘুমানোর সুযোগ দিয়েছে। তারা তো আর জানে না রাতভর চোখের পাতা এক করতে দেওয়া হয়নি তাকে। রাত্রির শেষ প্রহর এতো দিনের জমিয়ে রাখা কথা বলতে বলতেই কেটে গেল। তারপর ঘুমিয়েছে লোকটা, কিন্তু সে আর ঘুমাতে পারেনি।
দৃষ্টির মনে হলো তার কাছে কোনো রকম পেইন কিলার নেই। ওটার এই মুহূর্তে বড্ড প্রয়োজন। নাহলে আজ সারাদিন এই বিছানাতেই পড়ে থাকতে হবে। কিছু একটা ভেবে সে পায়েলের নম্বরে ফোন দিল। রিসিভ হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল।

“কি রে! তুই ওই রুম থেকে আমাকে ফোন করছিস কেন? ডাকলেই তো হতো।”

“নিজের কথা বন্ধ করে আমার কথাটা আগে শোন।”

দুর্বলতা তার কণ্ঠে। সে বলল,

“আচ্ছা বল।”

ভীষণ ইতস্তত করে দৃষ্টি বলল,

“তোর কাছে ব্যথার ওষুধ আছে?”

“হ্যাঁ, আছে তো। কেন?”

“সব কথায় তোর পাল্টা প্রশ্ন না করলে হয় না, না? রাতে কীভাবে শুয়ে ছিলাম জানিনা। এখন আমার ঘাড় ব্যথা করছে। তাই দরকার। এবার খুশি? দিয়ে যা আমার রুমে।”

পায়েল মিনমিন করে বলল,

“আচ্ছা বাবা, আসছি। এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?”

সে ফোন রাখার পূর্ব মুহূর্তে মনে পড়ল। লোকটার কোনো জামা কাপড় এখানে নেই। শার্টটা রাতেই ছিঁড়ে এসেছে আর প্যান্ট ভেজা। সে শাওয়ার নিয়ে তোয়ালে জড়িয়েই ঘুমাচ্ছে। কি একটা সমস্যা! তড়িঘড়ি করে বলল,

“ফোন রাখবি না। শোন আমার কথা।”

“বল।”

“ভাইয়ার একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার দিয়ে যাস।”

পায়েল ভ্রু কুঁচকে বলল,

“তোর ভাইয়ের জামা কাপড় দিয়ে তুই আবার কি করবি?”

দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে,

“আবার প্রশ্ন! তুই কি স্কুলের ম্যাডাম সেজেছিস? শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন! এতো না বলে নিয়ে আয়। আমি পরব, হয়েছে শান্তি?”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। একে তো শরীর খারাপ লাগছে তার উপর পায়েলে এ কেন? তা কেন? হাজারটা প্রশ্ন!

কিছুক্ষণ পর পায়েল দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল। দৃষ্টি গায়ে ওড়না জড়িয়ে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেল। দরজা অল্প খুলে হাত বাড়িয়ে দিল। পায়েল তার হাতে জিনিস গুলো দিয়ে বলল,

“ঘাড় খুব ব্যথা করছে? আমি তাহলে তেল মালিশ করে দেই?”

“না, লাগবে না। ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“খালি পেটে খাবি? ব্রেকফাস্ট করে খাস বরং।”

“রুমে বিস্কিট আছে। তাতেই হয়ে যাবে।”

একটু থেমে তাকে দেখে নিয়ে পায়েল আবার বলে,

“এমন দ্যাখাচ্ছে কেন? ঘুম হয়নি নাকি? কিন্তু তুই তো কাল তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লি। অন্যরকম লাগছে। আর এতো সকালে শাওয়ারও নিয়ে ফেলেছিস!”

দৃষ্টি অতিষ্ট হয়ে গেল তার জেরায়। রেগে গিয়ে বলল,

“ঘাড় ব্যথা করছে বলে দ্রুত শাওয়ার নিয়েছি। আর এমন দ্যাখাচ্ছে কেন তা তুই বুঝিস না! বিয়ে হয়েছে না তোর? আর ভাইয়ার জামাও তো আমি পরে নাচার জন্য নিয়েছি! গ”র্দভ! পুলিশের মতো জেরা শুধু।”

দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিল। পায়েল কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টির কথাগুলো ব্যাখ্যা করতেই সবটা বুঝে ফেলল। নিজেই লজ্জায় পড়ে গেল। আফরান স্যার নিশ্চয়ই আছেন। ফারদিন তো তাকে ঠিকই বলে, সে একটা গ’র্দভ।
রুমে যেতেই ফারদিন তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল,

“এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন? দিনের বেলা তো আমি ভদ্র হয়ে থাকি।”

এই আরেক নির্লজ্জ লোক! কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

“আপনি একটা যা তা।”

একটু এগিয়ে গিয়ে বলল,

“দৃষ্টি আমার কাছে আপনার জামা কাপড় চেয়েছিল। স্যার আছেন মনে হয়।”

“হ্যাঁ আছে। তো?”

তার নির্লিপ্ততা দেখে সে হা করে চেয়ে বলল,

“আপনি জানেন!”

উদাম গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বলল,

“আমার বোনের সব খবর আমি রাখি।”

সে নিজেই বোনের বরকে ঘরে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছে। আর সে জানবে না?

বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কা ধাক্কি করে আফরান কে তোলা গেল। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়েছে সে। বিরক্ত হয়ে বলল,

“এতো সকালে ডাকছিস কেন? এখনো সূর্যও ওঠেনি। ঘুমাতে দে।”

“হ্যাঁ, সূর্য তো আপনার জন্য বসে আছে। সকাল আটটা বাজে।”

“এ্যা!”

তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে উঠে বসল সে। মাথায় হাত দিয়ে বলল,

“সর্বনাশ! আমার ডিউটির কি হবে? এখন তো রুম ছেড়েও বের হতো পারব না। তোর দ’জ্জাল বাপ দেখলে নিশ্চয়ই গু’লি করে আমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেবে। এই দৃষ! তোদের বাড়িতে ব’ন্দুক নেই তো আবার?”

দৃষ্টি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল,

“ফাজলামো সাইডে রেখে চেঞ্জ করে নিন। ভাইয়ার জামা কাপড় আছে দেখুন। তোয়ালে পরে আর কতক্ষন থাকবেন? নাকি এটা পরেই বাইরে বের হবেন?”

আফরানের টনক নড়ল। তবে টি শার্ট গায়ে দেওয়ার আগে দৃষ্টির হাত টেনে ধরল। নিজের দিকে তাকে ফিরিয়ে বলল,

“টিশার্ট পরার আগে দেখে নে আমার কোথায় কি কি করেছিস।”

সে মুখ কুঁচকে ফেলল। শুরু হয়ে গেছে লজ্জাহীন কথা বার্তা। আফরান তাকে বুকের কাছে দাঁতের ছাপ, পিঠে নখের আঁচড় সহ কিছু দাগ দ্যাখাল। ব্যথাতুর মুখ বানিয়ে বলল,

“কত ব্যথা পেয়েছি জানিস? এখনো ব্যথা করছে, জ্বলছে। একটু আদর করে দে তো।”

আসল ব্যাপারটা মুহূর্তেই দৃষ্টি ধরে ফেলল। চোখ রাঙিয়ে বলল,

“আমাকে রাগালে কিন্তু মোটেও ভালো হবে না। ইচ্ছে করেই আমাকে লজ্জায় ফ্যালার ধান্দা, না? বেশি কথা বললে আপনি একদম রুমের বাইরে। বুঝেছেন?”

মুখ ছোট করে সে বলে,

“এমন করিস কেন? আচ্ছা ঠিক আছে। লাগবে না আদর। তুই কিপ্টে হতে পারিস কিন্তু আমি না।”

চোখের পলকে ঝুঁকে দৃষ্টির গলা সহ কাঁধের আশে পাশের মৃদু দাগে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফেলল। দৃষ্টি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল,

“ধুর! সরুন তো।”

আফরান মৃদু হেসে গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে নিল। ফারদিনের টিশার্ট একটু ছোটই হলো। শরীরে লেপ্টে গেল একেবারে। ট্রাউজার একটু খাটো হয়ে গেল। কি আর করার? ফোন বের করে কল লাগাল কোথাও। রিসিভ হতেই বলল,

“হ্যালো ডক্টর আহমেদ?”

“হ্যাঁ, বলুন।”

“আমি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে আটকে পড়েছি। আপনি কি আমার ডিউটির দিকটা হ্যান্ডেল করতে পারবেন? আমার দুটো ক্লাসও ছিল আজ।”

“নো প্রবলেম, ডক্টর ইততেয়াজ। আমি সামলে নেব।”

“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ। বড় থ্যাঙ্ক ইউ হিসেবে আপনাকে গুড নিউজ খুব শিঘ্রই দেব। রাখছি।”

তার শেষের কথায় মৃন্ময় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ডক্টর ইততেয়াজও না! মাঝে মধ্যে অদ্ভুত ব্যবহার করেন।

কথা শেষে আফরান আবারও শুয়ে পড়ল। দৃষ্টির গায়ে হাত রাখতেই ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল সে। কড়া কণ্ঠে বলল,

“আমার গায়ে হাত দিলে খবর আছে বলে দিলাম।”

কি ব্যাপার বউয়ের গায়ে এমন বিদ্যুৎ কেন? হাত দিতে না দিতেই ঝটকা খেতে হলো। শান্ত সুরে বলল,

“পেইন কিলার নিয়েছিস? নাকি আমি গিয়ে নিয়ে আসব?”

“নিয়েছি। আপনাকে অত ভাবতে হবে না। মুখটা বন্ধ রাখলে খুশি হব।”

“তোর কি ভীষণ ঘুম পাচ্ছে? ঘুমের জন্য মনে হয় তোর মেজাজ ভালো নেই। তার চেয়ে বরং তুই ঘুমিয়ে নে। আমি আর বিরক্ত করব না।”

আফরান বুঝে ফ্যালায় তার ভালো লাগল। তবে অর্ধেক বুঝেছে, পুরোটা নয়। ঘুমের পাশাপাশি শরীর খারাপ তার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছে। পাশ ফিরে তার বুকের মধ্যে ঢুকে গিয়ে বলল,

“সত্যি ঘুমের জন্য আমার মাথা ব্যথা করছে। আমাকে ঘুমাতে না দিলে আমি আপনার নাক ফাটিয়ে ফেলব।”

সে হেসে তার মাথায় অধর ছুঁইয়ে বলল,

“ঘুমিয়ে পড়। একদমই বিরক্ত করব না। নাক ফাটানোর ইচ্ছে নেই। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৮

সকাল সকাল ছেলের শশুর বাড়িতে হানা দিলেন আমিনুল ইততেয়াজ। তিনি সকালের নাস্তা করে এসেছেন কিনা সেটা এখনো রহস্য। বাড়ির প্রত্যেকে হতভম্ব, বিস্মিত। বহু বছর পর আজ হঠাৎ আগমনের কারণ কি? মিসেস সীমা তড়িঘড়ি করে চা পরিবেশন করলেন। আমিনুল ইততেয়াজ চুমুক দিয়ে তৃপ্তির হাসি সহিত বললেন,

“চা টা দারুন হয়েছে, সীমা। কত দিন পর তোমার হাতের চা খাচ্ছি, বলো তো!”

মিসেস সীমা একটু হাসেন। ফাহাদ আবরার মুখ গম্ভীর করে বসে আসেন। আমিনুল ইততেয়াজের এমন ব্যবহার তিনি মানতে পারছেন না। বেয়াই মশাই ফের বললেন,

“কিছু মনে কোরো না, সীমা। ফাহাদ কখন বাড়িতে থাকে কি না থাকে, তাই ভেবে আমি সকাল সকাল চলে এলাম।”

“আপনি নাস্তা করে আসেননি, দুলাভাই?”

“না, তা আর সময় পেলাম কই। তুমি বরং নাস্তার ব্যবস্থা করো। আমি ফাহাদের সাথে কথা শেষ করি। তারপর নাস্তা করেই বের হব।”

মিসেস সীমা স্বামীর মুখের দিকে এক পলক চেয়ে চলে গেলেন। ফাহাদ আবরার একটু নড়েচড়ে বসে গলা খাঁকারি দিলেন। বললেন,

“কি এমন জরুরী কথা, যেটা বলতে সকালের নাস্তা না করেই চলে এলেন!”

তিনি হাসেন। রহস্য করে বললেন,

“আমি কেমন শুকিয়ে গিয়েছি, দেখেছ? দশ দিন আগে কেমন দেখেছিলে আর আজ কেমন দেখছ?”

ফাহাদ আবরার পরখ করে দেখলেন, সত্যিই তাকে একটু শুকনো লাগছে। মুখ আগের থেকে শুকিয়ে গেছে।

“খাওয়া দাওয়া করতে পারি না, বুঝলে? মনে হয় যে খাবারে কি যেন নেই। গলা দিয়ে নামেই না। আমি আমার মুখের রুচি তোমার থেকে ফেরত চাইছি।”

তারা বুঝলেন না কিছুই। রামিজ আবরার বললেন,

“সকাল সকাল মশকরা করতে এসেছেন? আপনার মুখের রুচি আমরা ফিরিয়ে দেব মানে কি? মুখের রুচি কি ছিনিয়ে নেওয়ার মতো জিনিস?”

আমিনুল ইততেয়াজ চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে কাপ রেখে দিলেন। বিষণ্ণ মাখা সুরে বললেন,

“তোমার মেয়ে যখন প্রথম আমাদের বাড়িতে গেল, আমার তখন খুব রাগ হলো। আমি চেয়েছিলাম বিজনেস পার্টনারের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে। ভীষণ রেগে ছিলাম মেয়েটার উপর। তবে একদিন কি হলো জানো? অফিসে সেদিন প্রচুর কাজ ছিল। আমরা দুই ভাই সমান ব্যস্ত। দুপুরে খাওয়া হয় কি না হয় ঠিক নেই। এদিকে ক্ষুধার জ্বালায় পেট ডাকে। তিয়াস বলল লোক পাঠিয়ে বাইরে থেকে খাবার কিনে নিয়ে আসতে। আমিও ভাবলাম তাই হোক, এভাবে থাকা সম্ভব না। আর বাইরে গিয়ে খাওয়ার সময়ও নেই। লোক ডাকার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বাড়ি থেকে একজন গার্ড এলো। সাথে নিয়ে এলো দু দুটো টিফিন বক্স। আমরা তো চমকে গেলাম। বাড়ি থেকে খাবার আসার তো কথা ছিল না। সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। খেতে গিয়ে আরো চমকে উঠলাম। অপূর্ব স্বাদ! এমন খাবার শেষ খেয়েছিলাম আমার মায়ের হাতে। এতো ভালো লাগল আমার! আমি তিয়াসের থেকেও একটু নিলাম। তিয়াস তো দিতেই চায়ছিল না। বাড়ি এসে রাতেও সেই ভারী খাবার খেলাম। শেষে কি জানতে পারলাম জানো? তোমার মেয়ে রেঁধেছিল সেগুলো। আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। মনে মনে খুশি হলেও বাইরে তা প্রকাশ করলাম না। খুশি হয়ে আমি নিজেই ওকে দোলনা কিনে দিলাম। মেয়েটা এতো খুশি হলো! ছোট ছোট জিনিসে কেউ এতো খুশি হতে পারে তা আমি দেখলাম। প্রায়ই পরোক্ষভাবে ওর হাতের রান্না খেতে চাইতাম। ও বুঝত কিনা জানিনা, তবে যত্ন করে আমার জন্য রান্না করত।”

ফোঁস করে শ্বাস ফ্যালেন তিনি। হাঁপিয়ে উঠেছেন এক নাগাড়ে বলতে গিয়ে। শ্বাস নিয়ে পুনরায় বললেন,

“তোমার মেয়েই আমার রুচির পরিবর্তন করেছে। তাতে আমার কোনো হাত নেই। রূপসী আমার বিজনেস পার্টনারের মেয়ে। তাকে আমি বহু আগে বলেছিলাম আফরানের কথা। হঠাৎ যখন দুজনের দ্যাখা হয়ে গেল রূপসী আফরানের সাথে চলে এলো। আমি ও’কে আসতে বলিনি। এসেই শুরু করে দিল আফরানকে পাবার কীর্তন। আমি কিছু বলতে পারিনি, শুধু তার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়েছি। এতেও আমার ভুল ছিল। দৃষ্টি সেটা জানতে পেরেই তোমার সাথে চলে এলো। সেদিন যখন আমার সামনেই কাঁদল? বিশ্বাস করো আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। বাবা বলে যখন ডাকল তখন মনে হলো খুব আপন কেউ আমাকে ডাকছে। তাও আমি পারিনি ও’কে বাঁধা দিতে। মুখ লুকিয়ে বসে ছিলাম। মানতে পারছিলাম না, অল্প দিনেই একটা মেয়ে আমার অনেক আপন হয়ে গিয়েছে। আমি তাকে মেয়ের চোখেই দেখতে শুরু করেছি। আমার মনে আমার মেয়ের মতোই স্থান তৈরি করেছে ও।”

ফাহাদ আবরার, রামিজ আবরার চুপ করে বসে রইলেন। এখন তারা সবটা বুঝতে পারছেন। সবটাই এখন স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার। আমিনুল ইততেয়াজ হঠাৎ ফাহাদ আবরারের দুহাত মুঠোয় ধরে বসলেন। বললেন,

“তোমার মেয়েকে আমি ফেরত চাইছি। আমার ঘরের বউ নয়, মেয়ে করে রাখতে চাই তাকে। আমার পূর্বের সকল ভুল ও অন্যায়ের জন্য আমি লজ্জিত এবং তোমাদের কাছে মাফ চাইছি।”

ফাহাদ আবরার নিজেই লজ্জা পেলেন। বয়সে বড় একটা মানুষ! তার এভাবে মাফ চাওয়া শোভা পায় না। তিনি হাতের উপর হাত রেখে বললেন,

“এভাবে বলবেন না। আপনি আমার বড়।”

“সেসব পরে হবে। তার আগে বলো মেয়েকে ফিরিয়ে দেবে কিনা? আমি কিন্তু আমার মেয়েকে ধুমধাম করে উঠিয়ে নিয়ে যাব।”

ফাহাদ আবরার একটু মোচড়া মুচড়ি করলেন। বুঝতে পেরে আমিনুল ইততেয়াজ বললেন,

“তোমার আফরানের উপর রাগ তো? ঠিক আছে আফরানও মাফ চায়বে। আমি এক্ষুনি ওকে আসতে বলছি।”

তিনি সাথে সাথে ফোন করলেন ছেলেকে। বললেন যেখানেই থাকুক যেন এখনই চলে আসে। আফরান পড়লো বিপাকে, এখন তো রুম থেকেই বের হতে হবে। যাগগে, যা হবার হবে। এখন শশুর কে মানাতে হবে। সে হাত দিয়ে চুলটা একটু ঠিক করে। চশমাটা চোখে দিল। দৃষ্টির গায়ের চাদরটা একটু টেনে দিয়ে বের হলো। সকলের যখন দরজার দিকে নজর তখন আফরান নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। আমিনুল ইততেয়াজ অবাক না হলেও দুই ভাই চমকালেন। ফাহাদ আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন,

“তুমি আমার বাড়িতে! কখন এলে?”

আফরান মাথা চুলকে বলল,

“ইয়ে মানে, সেটা বলা কি খুব দরকার? না বললে হয় না শশুর বাবা?”

তিনি দাঁত কটমট করে বললেন,

“দেখেছেন আপনার ছেলের কাণ্ড? চুরি করে আমার বাড়িতে এসে আমারই মেয়ের ঘরে ঘাপটি মে’রে বসে ছিল। আমার কি উচিত আপনার ছেলের কাছে মেয়েকে দেওয়া?”

সে হঠাৎ শশুর কে জাপটে ধরে। হাহাকার করে বলে,

“এমন কথা বলবেন না, শশুর বাবা। আপনার মেয়েকে এভাবে আটকে রাখবেন না। দিয়ে দিন আমাকে। আমি তাকে রানী করে রাখব। কোনো কষ্ট তার পর্যন্ত যেতে দেব না। আমি ও’কে ছাড়া থাকতে পারব না, বিশ্বাস করুন। আর আজ পর্যন্ত সকল বিষয় যেগুলো আপনার খারাপ লেগেছে, সব কিছু জন্য আমি স্যরি। একদম মন থেকে স্যরি।”

ফাহাদ আবরার একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন। পিঠ চাপড়ে বললেন,

“ছাড়ো আমাকে। শশুর কে মে’রে ফেলে তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চায়ছ নাকি!”

সে দ্রুত তাকে ছেড়ে দেয়। মুখ গোমড়া করে বলে,

“না, আমি চাই শশুর আমার বিয়েতে নাচবে।”

তিনি ধাক্কা খেলেন। চোখ পাকিয়ে বললেন,

“মশকরা করো আমার সাথে?”

তিনি গলা উঁচিয়ে মিসেস সীমাকে ডাকেন। রান্না ঘর থেকে ছুটে আসেন তিনি। বলেন,

“কি হলো?”

আফরানকে দেখে চমকে উঠে বললেন,

“তুই কখন এলি! আর এগুলো তো ফারদিনের জামা কাপড় মনে হচ্ছে। এগুলোই বা কখন পরলি?”

“আহা সীমা! বাদ দাও এসব। তার আগে বেয়াই আর জামাইকে খেতে দাও। সকাল কটা বাজে খেয়াল আছে?”

তিনি ফের রান্না ঘরের দিকে ছুটতে ছুটতে বললেন,

“সব শেষ। এখনই টেবিলে দিয়ে দিচ্ছি। আপনারা আসুন। পায়েল যাও তো ফারদিন আর দৃষ্টিকে ডেকে দাও। বর্ষন আর বন্যাকে এখন ডাকার দরকার নেই। ইচ্ছে মতো আজ ঘুমাক।”

পায়েল তো খুশিতে আটখানা। ছুটে গেল তাদের ডাকতে। শশুরের শান্ত কণ্ঠ শুনে মনে হলো তিনি গলে গিয়েছেন। এবার সে বান্ধবীর দ্বিতীয়বার বিয়েতে খুব নাচবে। আগেরবার তো ভয়ের জন্য হলোই না কিছু। সাজবেও অনেক। হলুদে এক রকম, মেহেদীতে এক রকম আবার বিয়েতে এক রকম। তিন রকম সাজবে। বিশেষ করে তার বরটাকে তাক লাগিয়ে দেবে একদম। সেজেগুজে বশ করে ফেলবে যাতে বকাঝকা একটু কম করে।

চলবে,

সে আমারই পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৪

বাবাকে অপেক্ষা করতে বলে দৃষ্টি রুমে চলে গেল। দুই জা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বেয়াইকে আপ্যায়ন করার জন্য। তিনি সোফায় বসেন। ফারনাজ বাবার সাথে কথা বলতে আরম্ভ করে। কত কথা তার! তিন চার মাসের জমিয়ে রাখা কথাগুলো যেন আজই শেষ করবে। ফাহাদ আবরার মনোযোগ দিয়ে মেয়ের কথা শোনেন। বড় মেয়ের চঞ্চলতা মিস করেন খুব। আফরান বোকার মতো দাঁড়িয়ে একপাশে। শশুর তো তাকে দেখেও দেখল না। সে নিজে এগিয়ে গিয়ে লম্বা একটা সালাম দেয়,

“আসসালামু আলাইকুম, শশুর বাবা।”

ফাহাদ আবরার গম্ভীর মুখে জবাব দেন। আফরান পাশে বসে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি এতো সহজে গলে যাবার মানুষ নন। হঠাৎ ফারনাজ জিজ্ঞেস করে,

“তুমি না জানিয়ে হঠাৎ চলে এলে যে বাবা! কিছু কি হয়েছে?”

“দৃষ্টি আমাকে আসতে বলল। বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে নাকি, তাই নিতে এসেছি।”

আফরান আকাশ থেকে পড়ে। বউ চলে যাবে! সে কেমন কথা! এখনো তো কিছুই হলো না, আর তাকে বউ হীন করে চলে যাবে। সে ব্যাকুল হয়ে বলে,

“না না, দৃষ যাবে না। এখনো তো বা.. আই মিন কিছু না। কিন্তু, না যেতে পারবে না।”

ফাহাদ আবরার বিরক্ত হলেন, বললেন,

“আমার মেয়ে আমার সাথে যাবে। এতে তোমার এতো সমস্যা কীসের?”

অসহায় আফরান কিছুই বলতে পারল না। শশুরের সাথে কি বলা যায়? একটু হলেও তো লজ্জা অবশিষ্ট আছে।
গাইগুই করেও আফরান বিশেষ কিছু করতে পারল না। সিনথিয়া গেছে কিছুদিনের জন্য টুরে, মেয়েকে সাথে নিয়ে। সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে। যাবার সময় বলে গেছে, “ভাইদের রিসিভশনের আগেই আমি এসে পড়ব। তার আগে মেয়েকে একটু বাংলাদেশ ঘুরিয়ে আনি।” তার সাথে গিয়েছে দুজন সব থেকে বিশ্বস্ত এবং পুরোনো গার্ড। সে থাকলে নিশ্চয় কিছু না কিছু করে দৃষ্টিকে আটকাতে পারত। দৃষ্টি তৈরি হয়ে লাগেজ হাতে নেমে এলো। তাকে দেখে মিসেস সাইমা বললেন,

“বেড়াতে যাচ্ছিস? তাড়াতাড়ি চলে আসিস, কেমন? তোকে ছাড়া বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে রে।”

দৃষ্টি মৃদু তাচ্ছিল্য হাসে। আর আসা, কারো মাথা ব্যথা হয়ে সে থাকতে চায় না। আর না কারো পথের কাঁ’টা হয়ে। ফাহাদ আবরার উঠে দাঁড়ালেন। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে ছোট মেয়ের লাগেজ হাতে নিলেন। ফারনাজ মোচড়া মুচড়ি করছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। সেও যেতে চায় বাবার সাথে। বলল,

“আমিও যাব, বাবা।”

তিনি মুখ খোলার আগেই মিসেস অনা বললেন,

“এখন একদমই জার্নি করা যাবে না, নাজ। তুমি বরং কিছুদিন পর যেও। তুরাগ দিয়ে আসবে।”

তাহলে আর কি? ফারনাজ চুপ হয়ে গেল। ফাহাদ আবরার বড় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন,

“সাবধানে থাকবে। আর তুরাগকে আমি বলব ও বাড়িতে যাবার কথা।”

সে ভীষণ খুশি হলো। বাবার বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর তিনি বাড়ি থেকে বের হলেন। পিছু পিছু আফরান চলে এলো গাড়ি পর্যন্ত। সেও তো জামাই কিন্তু তাকে দাওয়াত করা তো দূরে থাক, ভালো করে কথাই বলল না শশুর। ফাহাদ আবরার গাড়িতে লাগেজ উঠিয়ে দিলেন। দৃষ্টি কোনোদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ উঠে বসে। তিনি আফরানের দিকে চেয়ে বলেন,

“বিদায় দিতে কি আমার বাড়ি পর্যন্ত যাবে?”

আফরানের মুখটা চোরের মতো হয়ে গেল।‌ সে সত্যিই চায়ছিল এক ফাঁকে গাড়িতে উঠে বসতে। জোর পূর্বক হেসে বলল,

“না না, আমার তো ডিউটি আছে। আপনারা সাবধানে যাবেন। আর নিজের মেয়েকে একটু দেখে রাখবেন।”

তিনি কঠোর কণ্ঠে জবাব দিলেন,

“সে কথা তোমাকে বলে দিতে হবে না।”

চোখের পলকে গাড়ি ইততেয়াজ ম্যানশন থেকে বেরিয়ে গেল। আফরান কেবল দাঁড়িয়ে রইল শূন্য বুকে। কেমন খালি খালি লাগছে না?
বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতেই রূপসী এসে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করল,

“আফরান চলো না আজ কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”

“আমার ডিউটি আছে, রূপসী।”

তবুও সে বলে,

“ছুটি নিয়ে নাও। চলো আজ যাবই যাব। তাছাড়া তুমি কাল রাতে আমাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছিলে বলে আমি রাগ করে আছি। কি হতো একটু গল্প করলে?”

বেশ পীড়াপীড়ি শুরু করল সে। আফরানের মেজাজ গতকাল থেকেই চটে আছে। দৃষ্টির সাথে তার সম্পর্ক টা একটু হলেও অস্বাভাবিক যেটা সে কালই ঠিক করে নিত। যেভাবেই হোক ঠিক করত। তার সব অভিমান, অভিযোগ সামনে বসিয়ে রেখে শুনত। কিন্তু রূপসী সেটা হতে দেয়নি। তার জন্য আফরানের সেই সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। আর আজ? আজ পুরো বউই হাতছাড়া। এতোটা মেজাজ খারাপ হয়ে গেল যে, সে কড়া কণ্ঠে ধমক দিল। ধমকের তোপে রূপসীর আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। সে শান্ত চঞ্চল আফরানকে চেনে, কিন্তু সে রেগে গেলে কেমন হয়ে যায় তা জানে না। আফরান দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

“কি বলেছি কানে যায়নি? বলছি না আমার ডিউটি আছে? হাসপাতালের অসুস্থ রোগী রেখে আমি তোমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াব? কে তুমি, হ্যাঁ? কে? যে তোমাকে আসতে বলেছে তার সাথেই ঘোরো। আমি কি বলেছিলাম নাচতে নাচতে আমার পিছু পিছু চলে আসতে? বিদায় হও চোখের সামনে থেকে। যাও!”

রূপসী কাঁপতে কাঁপতে চলে গেল। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। শান্ত মানুষ রেগে গেলে এমন ভ’য়ঙ্কর হয় তা সে জানত না। এখন সে আমিনুল ইততেয়াজের কাছে গিয়ে তার নামে নালিশ করবে।
মিসেস সাইমা ছেলের চেঁচামেচি শুনে ছুটে এলেন। আফরান সোফায় বসে কপালে আঙুল ঘষে চলেছে সমান তালে। তিনি বললেন,

“কি হয়েছে? হঠাৎ এমন অস্থির হয়ে উঠলি কেন?”

“ভালো লাগছে না, মা। এসব আমি আর নিতে পারছি না। হাসপাতালে যাব।”

“নাস্তা করবি না?”

“না।”

বলেই সে উঠে দাঁড়ায়। রুমে যাবার আগে রুক্ষ সুরে বলে,

“বাড়ি এসে যেন আমি রূপসীকে না দেখি। আমার সামনে আবার যদি আসে তাহলে আমি কি করব, আমি জানি না।”

মিসেস সাইমা ভীষণ বিস্মিত হলেন। ছেলেকে এভাবে রেগে যেতে তিনি খুব কমই দ্যাখেন। তার ছেলে মাথায় হাজার টেনশন নিয়েও মাথা ঠান্ডা রেখে সব সামলাতে পারে। তবে কি হলো আজ?

দৃষ্টি বাড়িতে পা রাখার পর পরই সেখানে যেন উৎসব শুরু হলো। মেয়েটা আজ কতদিন পর এলো! পায়েল বান্ধবীর গলা জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কাটাল। যদিও কলেজে দ্যাখা হয়। তাই কি? এভাবে তো কতদিন থাকা হয়নি। দৃষ্টি মুখের উপর নকল একটা পর্দা টেনে রেখেছে। যে পর্দা ভেদ করে তার মনের খবর কারো কাছে পৌঁছাবে না। বন্যা আর বর্ষণ বাড়িতে নেই। তারা এলেও নিশ্চয় হইহই শুরু করবে। মা আর ছোট মা’কে একসাথে বসিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখল। মৃদু স্বরে বলল,

“তোমাদের মিস করেছি খুব।”

তারাও মেয়েকে পেয়ে খুশি। পরপরই তাকে বিশ্রামের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। নিজেরা ব্যস্ত হলেন মেয়ের পছন্দের হরেক রকম খাবারের আয়োজনে।
দৃষ্টি রুমে গিয়ে শ্বাস নিল। নিজের রুম তার ভালো লাগছে না। কয়েক মাসেই যেন এই রুম পর হয়ে গেছে আর অন্যের রুম আপন। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। বৈবাহিক জীবনের চিন্তা কি মস্তিষ্কে আসে? অবশ্যই আসে। তার এই অনিশ্চিত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি? তার ভাবনার মাঝেই পায়েল হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে প্রবেশ করে। বিছানায় তার পাশে বসে গদগদ কণ্ঠে বলে,

“কি গো ননদিনী! জামাইকে নিয়ে এলে না কেন সাথে?”

দৃষ্টির মজা করার মতো মেজাজ নেই। তবুও সে শান্ত সুরে বলল,

“তার হাসপাতালে হাজার কাজ আছে। সময় পেলে আসবে না পেলে আসবে না।”

“এটা কেমন কথা, দৃষ? ও বাড়িতে যাবার পর এই প্রথম আসলি, তাও একা! স্যারকে নিয়ে এলেই পারতি। স্যার তো এখান থেকেই হাসপাতালে যেতে পারতেন। মা আর ছোট মা কতো মন খারাপ করছেন, স্যার আসেননি তাই।”

দৃষ্টির এত কথা ভালো লাগছে না। মুখ কুঁচকে বলল,

“না এলে আমি কি করব?”

“একবারও বলেছিলি আসার কথা? বাবা বলেছিলেন?”

একটু চুপ থেকে সে বলল,

“না। আমিও বলিনি আর বাবাও বলেনি। তুই এখন যা তো পায়েল। আমি ঘুমাব একটু। ডাকবি না একদম।”

মুখ ঘুরিয়ে নিল সে। পায়েল কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তার মন বলছে কিছু হয়েছে। কোনো ঝামেলা হয়েছে কি? ভাবল পরে দৃষ্টির সাথে আবার কথা বলে নেবে। এখন ক্লান্ত যখন, তখন ঘুমাক। ধীরে বিছানা থেকে নেমে দরজা চাপিয়ে চলে গেল।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৫

ছুটির দিনে দুপুরে খেতে বসতে না বসতেই আমিনুল ইততেয়াজ মুখ কুঁচকে ফেললেন। যেন তিনি ভীষণ রকমের অখাদ্য গিলে ফেলেছেন। এমন স্বাদহীন খাদ্য গলাধঃকরণ করেননি আগে কখনো। বললেন,

“তরকারিতে কিছু একটা যেন নেই। কেমন যেন লাগছে। গিলতেই পারছি না এমন। কি নেই বলো তো, সাইমা?”

মিসেস সাইমা মুখ গম্ভীর করে ফেললেন। বলেন,

“আজ রান্নায় আপনার ছেলের বউয়ের ছোঁয়া নেই। সপ্তাহে চারদিনই তো সে রান্না করত, শুক্রবারে করত স্পেশাল রান্না। তাও কেবল আপনার জন্য। আপনার আবদার, এই খাব সেই খাব। সব মেনে নিয়ে কেবল ও আপনার জন্য রাঁধত।”

আমিনুল ইততেয়াজ থমকে গেলেন। হঠাৎই তার মনে পড়ে গেল একদিন শুক্রবার সকালের কথা।
সেদিন সবে সকলে বসে চা পান করছেন। দৃষ্টি নিজেই সবাইকে পরিবেশন করে দিচ্ছিল। তার মনটা চায়ছিল মেয়েটা কিছু রেঁধে খাওয়াক। তিনি আড়চোখে তার দিকে চেয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন,

“রোজকার খাবার আজ খেতে ইচ্ছে করছে না, তিয়াস। তাই না?”

“হ্যাঁ, ভাই। আজ শুক্রবারে অন্যরকম কিছু হলে বেশ হতো।”

“ঠিকই বলেছিস। তবে তোর ভাবীর হাতের রান্না খেতে খেতে বোর হয়ে গিয়েছি।”

“তাহলে অনা রাঁধুক?”

“অনার রান্নাও তো প্রায়ই খাই। তার থেকে বরং আজ রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনে খাই।”

সব শুনে দৃষ্টি মৃদু স্বরে বলল,

“বাইরের খাবার খাওয়া তো ভালো না, আঙ্কেল। শরীর খারাপ করতে পারে। তার চেয়ে আপনি কি খাবেন বলুন? আমি তৈরি করে দেব।”

আমিনুল ইততেয়াজ এটাই চেয়েছিলেন। যেন দৃষ্টি নিজেই তাকে জিজ্ঞেস করে। কারণ তিনি কখনো তাকে বলবেন না। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বললেন,

“তুমি রাঁধবে?”

“আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে।”

“বেশ, তুমি বরং গরুর মাংস দিয়ে বিরিয়ানী করো। আর তোমার যা ইচ্ছে।”

অগত্যা দৃষ্টি তা মেনে নিল। সেদিন দুপুরে প্রতিবারের মতোই তিনি চেটেপুটে খেয়েছেন। মেয়েটার রান্নার হাত যে এতো ভালো! কিন্তু তিনি মুখ ফুটে কিছু বলেন না। দৃষ্টি কিছু চায়ওনি শুধু তার আবদার পূরণ করে গেছে।

আবারও মিসেস সাইমার কণ্ঠ শোনা গেল,

“সেদিন যখন ও ওর বাবার সাথে চলে গেল, একটু বিদায় দিতেও তো এলেন না। বাড়িতে ছিলেন অথচ ঘরের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। কি হতো মেয়েটার মাথায় একটু হাত রাখতে? কি করেনি ও আপনার জন্য? আপনার কত কটু কথা মুখ বুজে সহ্য করেছে জানেন? মুখ ফুটে কিছু বলে না বলে কি আমি বুঝি না? নিজের পরিবার ছেড়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আমাদেরও উচিত ছিল তাকে তার পরিবারের মতই আগলে রাখা। কিন্তু আমরা ব্যর্থ, এখন ওই রত্ন আমাদের বাড়িতে ফিরে এলেই হলো। এতো অবহেলার পর ও ফিরবে বলে তো মনে হয় না।”

আমিনুল ইততেয়াজ কোনো জবাব দিতে পারলেন না। দৃষ্টি চলে যাবার দিনই রূপসী ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বাড়ি ছেড়েছে। আফরানের রাগকে এতোই ভয় পেয়েছে যে তাকে বাড়ি ছাড়ার কথা বলা লাগেনি। আঙ্কেলকে বলে যখন তার কোনো হেলদোল দেখল না, তখন সে নিজের ইচ্ছাতেই বের হয়ে গেছে। আমিনুল ইততেয়াজও নিজের ভুলটা হয়তো বুঝেছেন। অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে ধরেছে তাকে। বাড়িতে এলেই যে পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরত সে নেই। তার চাওয়ার আগেই যে চা এনে হাজির হতো সে নেই। তার নিত্য নতুন আবদারে যে ঘাম ঝরিয়ে রান্না করত সে নেই। সামান্য একটা দোলনা কিনে দেওয়ায় পৃথিবী জয় করার মতো যে খুশি হয়েছিল সে নেই।
তিনি হাত ধুয়ে উঠে গেলেন। এখন আর গলা দিয়ে তার কিচ্ছু নামবে না। টের পেলেন মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে গেছেন তিনি।

“কান খুলে শুনে রাখো, আমার মেয়ে তোমাদের বাড়িতে ফিরবে না। ওর সাথে ঠিক কেমন ব্যবহার হতো প্রথম দিন থেকেই তা আমি জানি না ভেবেছ? সব জানি আমি। তাই ফোন করা বন্ধ করো।”

আফরানকে দ্বিতীয়বার কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। হতাশ শ্বাস ফ্যালে সে। এ জ্বালা আর ভালো লাগে না। দৃষ্টিকেও বলিহারি! ফোনটা কেন বাপের কাছে জমা দিতে হলো? তারা তো স্বামী স্ত্রী নাকি? প্রেমিক প্রেমিকা তো নয়, যে ফোন দেওয়া বারণ। ফোন দিলেই শশুর ধরে আর তাকে ঝাড়ি মা’রে। কোনো জায়গায় শান্তি নেই। দশ দিন হয়ে গেল অথচ বউয়ের সাথে একটু কথাও বলতে পারল না শশুরের জ্বালায়। আজ আর থাকা যাচ্ছে না। অনেক হয়েছে। সে ওরারড্রব থেকে শার্ট বের করে গায়ে জড়ায়। জিন্স বের করতেই দরজার নক হয়। গিয়ে দরজা খুলে বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দ্যাখে। চমকাল বটে। আমিনুল ইততেয়াজ ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। তাকে তৈরি হতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

“যাচ্ছ কোথাও?”

“হু।”

“এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ?”

আফরান জবাব দিল না। বাবাকে বলবে যে, বউয়ের কাছে যাচ্ছি? তাও শশুর মানা করার পরও হ্যাংলার মতো! আমিনুল ইততেয়াজ বুঝে নিলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

“আমি একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”

“বলো।”

“ভাবছি যে তোমাদের রিসিভশনটা সেরে ফেললে কেমন হয়? ফারনাজ আর কদিন পর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার আগেই এসব সেরে নিলাম।”

আফরান যে কতটা চমকেছে তা তার চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি একটু ইতস্তত করেন। বলেন,

“তোমার কি মতামত? হাতে সময় আছে? হাসপাতাল থেকে ছুটি নেওয়া যাবে দুটো দিন?”

সে সূক্ষ্ম শ্বাস ফেলে বলে,

“সেটা তো পারের কথা, বাবা। তার আগে শশুর মশাই তার মেয়েকে এ বাড়িতে আবার পাঠাবে কিনা জানা দরকার।”

তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন,

“সে কি কথা? পাঠাবে না কেন?”

“সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো।”

তিনি শান্ত হয়ে গেলেন। তার জন্যই! চিরাচরিত অহংকারের পর্দা সরিয়ে তিনি বললেন,

“আমি যাব কাল কথা বলতে। দরকার হলে হাত জোড় করে অনুরোধ করব।”

“বাবা তুমি!”

“হ্যাঁ আমি। আমিই তো সেই শুরু থেকে মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। তাই আমারই উচিত দায়িত্ব নিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনা। দরকার পড়লে ফাহাদের কাছে মাফ চেয়ে নেব।”

আফরান যেন অন্য এক বাবাকে আবিষ্কার করল। যে বাবার অহংকার নেই। বিজনেস পার্টনারের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। সব ভুলে সে মাথা ঝুঁকতে প্রস্তুত। সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আবেগে আপ্লুত কন্ঠে বলে,

“থ্যাঙ্ক ইউ, বাবা। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ!”

তিনি হাসেন। শেষ কবে ছেলে এভাবে জড়িয়ে ধরেছিল? তার এতো ভালো লাগল। ছেলের পিঠ চাপড়ে দিলেন। বললেন,

“যাও, বৌমার রাগ ভাঙাও গিয়ে। আর আমি সকাল সকাল চলে যাব তোমার শশুর বাড়িতে। তাদের রাজি না করিয়ে ফিরব না।”

আফরান একটু লজ্জা পেল। বাবা বুঝে ফেলেছেন! সে ফিটফাট হয়ে তৈরি হয়ে বউয়ের অভিমান ভাঙানোর মিশনে নেমে পড়ল।

দৃষ্টির রুমের নিচে দাঁড়িয়ে আফরান বেশ বিপাকে পড়ল। দেওয়াল টপকে তো চলে এলো, কিন্তু ব্যালকনির দরজা তো বন্ধ। এখন কি হবে? কিছুক্ষণ ভেবে সে ফারদিনের নম্বরে ফোন করে। ফারদিন তখন পড়ালেখায় অবহেলার জন্য পায়েলের বিশেষ ক্লাস নিচ্ছে। দু আঙুলে তার ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে বলল,

“আজকাল খুব চলে এই দুটো। কথার ফোয়ারা বয়। অথচ পড়ালেখার নাম নেই। পড়ালেখায় বেলায় এটা কাজ করে না। তাই না? তাহলে সেলাই করে দেই?”

পায়েল ব্যথা পাচ্ছে। র’ক্ত জমে গেছে ইতিমধ্যেই। তার হাত ছুটিয়ে বলল,

“ব্যথা পাচ্ছি তো। পড়ালেখা করি না আপনাকে কে বলল? সারাদিন কি বাড়িতে থেকে দ্যাখেন যে পড়ি কি পড়ি না? আর নিজে ব্যথা দিচ্ছেন আবার নিজের কাজে এই দুটো ব্যবহার করলে খবর আছে।”

হেঁচকা টেনে সে বলে,

“কি করবে ব্যবহার করলে? একশো বার কাজে লাগাব। ব্যথা দেবও আমি আর সারাবও আমি। এই সব তো আমারই।”

বলেই পরপর দু’বার অধরে অধর ছোঁয়ায়। সে লজ্জা পেয়ে বলে,

“ধুর! ছাড়ুন তো।”

ফারদিনের ইচ্ছে, আরো একটু শায়েস্তা করা। তবে ফোনের শব্দে আপাতত ক্লাসে বিরতি দিতে হলো। সুযোগ পেয়ে পায়েলও ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। ছোট্ট শ্বাস ফেলে সে ফোন উঠিয়ে কানে ধরে। বলে,

“কি হয়েছে? এতো রাতে আমাকে মনে পড়ল কেন?”

“শেষ বারের মতো আমাকে একটা উপকার করে দে। শেষ বার কেন? এই প্রথম এই শেষ।”

“এতো ভূমিকা ফেলে পয়েন্টে এসো।”

“তোর বোনের ব্যালকনির দরজাটা খুলে দে।”

“মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোমার? ও ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন আমি যাব ওর ব্যালকনির দরজা খুলতে!”

“প্লিজ যা। আমার জীবন ম’রনের প্রশ্ন।”

“আমি পারব না।”

“পারবি না? তুই পারবি না? আমি এক্ষুনি পায়েল কে ফোন করে তোর বারোটা বাজাব।”

“ও কি করবে আমাকে? সাহস আছে?”

“ও অনেক কিছুই করতে পারে। ওকে বলব আজ দৃষ্টির সঙ্গে গিয়ে থাকতে। ও কিন্তু আমার কথা ফেলবে না। তারপর তোর রাত কীভাবে কাটবে ভেবে নে।”

ফারদিন ভীষণ বিরক্ত হলো। এসবের মানে কি? তবে বোনের সংসারের ঝামেলা মিটিয়ে দেওয়া তারও একটু কর্তব্য আছে। বলল,

“যদি আজই ওকে মানাতে পারো তবেই আমি এই কাজ করব।”

আফরান দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলল,

“পারব।”

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৬
[বাচ্চারা দূরে থাকো।🥱]

“ভাইয়া! কিছু লাগবে তোমার?”

বোনের ঘুম ঘুম কণ্ঠে ফারদিনের বড্ড মায়া হয়। নিশ্চয়ই গভীর ঘুম থেকে উঠে এসেছে! সেও বা কি করতে পারে? বিরক্ত না করে উপায় নেই। আফরানের উপর রাগ হয় ভীষণ। সে মৃদু কণ্ঠে বলল,

“ঘুমিয়ে পড়েছিলি?”

বলতে বলতে সে রুমে প্রবেশ করে। দৃষ্টি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কদিন ধরে ঘুম হয় না ঠিক ঠাক। আজ কি মনে করে ঘুম এলো কে জানে? আর ভাইয়াই বা কি মনে করে এলো? বলল,

“হু, তোমার দরকার কিছু?”

ফারদিন একটু এদিক ওদিক ঘুরল। সরাসরি তো আর ব্যালকনির দরজা হাট করে খোলা যায় না। তার জন্য উপযুক্ত কারণ দরকার। সে বলল,

“জানলা দরজা সব বন্ধ করে রেখেছিস কেন? হুট হাট বিদ্যুৎ কখন চলে যায় ঠিক আছে? তার চেয়ে বরং এই জানালাটা আর ব্যালকনির দরজাটা খুলে রাখ।”

সে নিজেই দরজা আর জানালা খুলে দিল। বলল,

“বাইরের হওয়া এলে আর দম বন্ধ লাগবে না। ভালো ঘুমাতে পারবি।”

দৃষ্টি তার কথা মেনে নেয়। ফারদিন তার মাথায় হাত রেখে বলল,

“এতো চিন্তা কীসের তোর? চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। খাসও না ঠিক মতো। এমন করে চললে বাঁচবি? আর আমরা আছি কি করতে? তোর সব চিন্তা আমাদের, আমার। যা হবে সব ভালো হবে। ভালো মানুষদের সাথে কখনো খারাপ হতে পারে না। খুব ভালো থাকবি তুই, নাজের মতোই বা তার থেকেও ভালো। ঘুমিয়ে পড়।”

কথা শেষ করে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল। দৃষ্টির চোখ ভিজে এলো। সে সত্যিই ভালো থাকবে, নাকি ভাইয়া তাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেল? দরজা আটকে, আলো নিভিয়ে সে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। ঘুম ভেঙে গেছে। এখন কি আর ঘুম আসবে?
হঠাৎ মস্তিষ্কে প্রবেশ করল বজ্জাত লোকটা। সে মনে প্রাণে তাকে বিশ্বাস করে, ভরসা করে। রূপসী অস’ভ্যতামির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও তার স্বামী ফিরেও তাকাবে না। সে জানে। আফরান যে তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে তাও সে জানে। কিন্তু আমিনুল ইততেয়াজ তো তাকে পছন্দ করে না। কেন অন্যের অপছন্দের মানুষ হয়ে তার সামনে ঘুর ঘুর করবে? চলে এসেই ঠিক হয়েছে, এখন নিশ্চয়ই তিনি শান্তিতে আছেন।
আচমকা শব্দে সে চমকে ওঠে। জানালা দিয়ে আগত মৃদু আলোয় আবিষ্কার করে এক কৃষ্ণ অবয়ব। শব্দটা ব্যালকনির দরজা বন্ধের ছিল। দৃষ্টি ভয় পেল না। চুপচাপ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল।

আফরান ঘন ঘন শ্বাস ফ্যালে। অনেক দিন পর আজ আবার এভাবে উঠতে গিয়ে ভীষণ ধকল গেছে। সে বিছানার অপর প্রান্তে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে। পাশের টেবিল ল্যাম্প টা জ্বালিয়ে গজ গজ করে বলে,

“বয়স হচ্ছে তো আমার নাকি? আর কতদিন এভাবে কচি প্রেমিকদের মতো এভাবে লাফালাফি করতে হবে, বল তো?”

দৃষ্টি তাকে একদমই পাত্তা দেয় না। সে যেন অদৃশ্য! আফরান খেয়াল করল তার শার্টের হাতা এবং বুকের বা পাশের কিছু অংশ ছিঁড়ে গেছে। পাইপ বেয়ে উঠতে গিয়েই এমন হলো। বুকের কাছটা তো জ্বলছেও, কে’টে গেল নাকি! গা থেকে শার্ট ছাড়িয়ে সে বুকে হাত রাখে, একটু চামড়া উঠেছে। আর কিছু না। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,

“দ্যাখ তোর কাছে আসতে গিয়ে কত কষ্ট করতে হচ্ছে আমাকে। আর ওই এক শশুর যে আমাকে সহ্যও করতে পারে না আর বউয়ের কাছে আসতেও দেয় না। আমি যে কি জ্বালায় আছি।”

সে কোনো প্রকার জবাব দেয় না। আফরান আবার বলে,

“ঘুমিয়ে পড়লি নাকি! আমি এতো কষ্ট করে এলাম আর তুই ঘুমাবি!”

শার্ট এক কোণে ছুড়ে ফেলে বিছানায় পা উঠিয়ে বসে। হাত বাড়িয়ে তার বাহু চেপে হেঁচকা টানে উঠিয়ে বসায়। কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

“ঘুমিয়ে পড়লে মোটেও ভালো হবে না বলে দিলাম। আমার কষ্ট তোর চোখে পড়ে না?”

সে বিরক্ত হয়। বলে,

“এভাবে রাত বিরাতে এসে এসব বিরক্ত করছেন কেন? কোনো কাজে আসলে তা শেষ করে চলে যান।”

আফরান ফিসফিসিয়ে বলে,

“সত্যি? যে কাজে এসেছি তা করব?”

দৃষ্টি এবার চুপ হয়ে গেল কোনো কথা বলল না। আফরান তার মুখোমুখি বসল। কোথা থেকে যেন কয়েকটা বক্স বের করল। একটা মাঝারি আর একটা একটু ছোট এবং অন্যটা একেবারেই ছোট। তিনটা বক্স তার সামনে রেখে একটা হাতে নিল। সেটা খুলতেই বেরিয়ে এলো দুটো চিকন চকচকে চুড়ি। খেয়াল করতেই বোঝা যাবে তাতে হীরা বসানো। দৃষ্টি ছটফটিয়ে উঠতেই সে দিল এক ধমক। অতঃপর বউয়ের হাতে সে খুব যত্ন করে চুড়ি পরিয়ে দিল। পরবর্তী বক্স খুলতেই দ্যাখা গেল একটা লকেট ওয়ালা চেইন এবং ছোট ছোট কানের দুল। তাও হীরা দিয়ে তৈরি। আফরান এবার একটু কাছাকাছি গেল। চুল সরিয়ে চেইন পরিয়ে দিল। এগুলো পরাতে তার ভীষণ ভালো লাগল, কারণ চেইন পরানোর অযুহাতে তাকে ছুঁয়ে দিতে পারছে। কানের দুল পরানো শেষে অবশিষ্ট বক্সে পাওয়া গেল একটা ছোট্ট নাকফুল। তাও হীরার! আফরান যেন গোঁ ধরে বসেছে তার স্ত্রীকে হীরায় মুড়িয়ে দেবে। সব শেষে আফরান অবাক হয়ে চেয়ে রইল। দৃষ্টিকে তার কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে। চোখ ধাঁধিয়ে যাবার মতো সুন্দর। তার উপর পরে রয়েছে শাড়ি। বলল,

“আজ আমি আমার সত্যিকারের বউকে দেখছি। আমার সামনে তো কখনো শাড়িই পরিস না। অথচ এখানে এসে শাড়ি পরে ঘুর ঘুর করছিস! কি লাভ শাড়ি পরে যদি আমিই খু.. আই মিন দেখতে না পারি?”

আচমকা জড়িয়ে ধরে। কণ্ঠে দরদ মিশিয়ে বলে,

“বউ, বউ, ও বউ! শোন না? এতো রাগ কেন আমার উপর? ভালোবাসি তো।”

এতো বছর পর কাঙ্ক্ষিত শব্দ কর্ণগোচর হতেই দৃষ্টি শরীর ছেড়ে দিল। পুরোপুরি আফরানের বুকে মিশে গেল। সে তাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরল। শ্বাস রুদ্ধ করে দৃষ্টি বলল,

“কি বললেন?”

“শুনিস নি?”

“আবার বলুন।”

“ভালোবাসি।”

“আবার।”

“ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।”

হু হু করে কেঁদে উঠল সে। সকল অভিমান, অভিযোগের দেওয়াল যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। জড়ানো কণ্ঠে বলল,

“আমি ভালোবাসি না, ভালোবাসি না। একদম ভালোবাসি না। শুনেছেন আপনি?”

আফরান মৃদু শব্দে হেসে ওঠে। বলে,

“হু, শুনেছি। তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস।”

“না।”

দৃষ্টির খেয়াল হলো আফরান শরীরে শার্ট নেই। আগে খেয়ালে আসেনি। লজ্জায় মিইয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে সরে এলো। নজর সরিয়ে বলল,

“চলে যান।”

সে কেমন বাচ্চাদের মতো করে বলল,

“যাব না। চলে যাবার জন্য এসেছি নাকি?”

দৃষ্টি কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। বলল না কিছু। আফরান এগিয়ে তার কানের কাছে মুখ রেখে বলল,

“এই দৃষ? একটু আদর দিবি?”

হৃদয় কেমন কেঁপে উঠল না? কুঁকড়ে গিয়ে বলল,

“আমি কেন? রূপসী আছে না?”

“ও তো বউ নয়। আমার তো বউয়ের আদর চাই।”

তার এমন লাগামহীন কথায় দৃষ্টির কি হচ্ছে তা যদি সে বুঝত! আফরান ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল তার কাঁধে। বিড়বিড় করে বলল,

“একটু দয়া কর আমার উপর। তোর একটু ছোঁয়ার জন্য আমি মুখিয়ে আছি।”

পাশ ফিরতেই দৃষ্টি তার বুকের নিচে চলে গেল। চোখ অন্যদিকে রেখে বলল,

“আপনি কখনো কোনো কিছু করার আগে অনুমতি নিয়েছেন আমার? বিয়েটাও তো আমার অনুমতি নিয়ে করেননি। আজ এমন করছেন কেন?”

আফরান বিস্ময়ে চেয়ে বলে,

“অনুমতি নেওয়া লাগবে না?”

সে তার বুকের দিকে চেয়ে বলল,

“এখানে লাগল কীভাবে?”

“এই তো উঠতে গিয়ে লাগল।”

দৃষ্টি তৎক্ষণাৎ এক অভাবনীয় কাজ করে ফেলল। কোমল ঠোঁট জোড়া দিয়ে সে মৃদু ক্ষত স্থানে চুমু খেল। আফরানের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। অবাক হয়ে বলল,

“তুই আমাকে নিজ থেকে ছুঁয়ে দিলি!”

সে আর কিছু বলে না। এই লোককে কি সব ব্যাখ্যা করতে হবে? আফরান মৃদু হাসে। উত্তর যা পাবার তা আগেই পেয়েছে। তার হাত ধরে বলল,

“এতো চাপা স্বভাবের কেন তুই? সরাসরি কিছু বলতে পারিস না। বললেই হয় আমাকে আদর করুন। তা না! অতো সব কি আমি বুঝি?”

তার চুড়ি দুটো খুলে পাশে রেখে দিল। দৃষ্টি তার চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে ছোট ছোট চোখ জোড়ায় চেয়ে বলল,

“বুঝলে বুঝুন না বুঝলে নেই। বর হয়েছেন কেন? বউয়ের মনে খবর বুঝতে পারেন না।”

ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখেই সে কানের দুল খুলে নিল। বলল,

“মাঝে মধ্যে না বললে তো বুঝব না। সব সময় কি বোঝা যায়? তবে আকার ইঙ্গিত করলেও আমি বুঝব। অতোটাও মূর্খ নই।”

“আপনি তো কপিবাজ। কপি করে ডাক্তারি পাস করেছেন। এমন অ’সভ্য ডাক্তার আমি জীবনেও দেখিনি।”

আফরান তার গলার নিচে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল,

“শুধু আমি না, অনেক ডাক্তারই অসভ্য হয়। সবাই হয়। তারা তো তোকে দ্যাখাতে আসবে না যে, দ্যাখো আমি অসভ্য। সে শুধু তার বউকে দ্যাখাবে। যেমন আমি দ্যাখাই।”

চেইন টাও খুলে রেখে দিল। যেভাবে নিজে অলংকারে আবৃত করেছিল ঠিক সেভাবেই অলংকার হীন করে ফেলল। কেবল রইল নোজপিন। আফরান ঝুঁকে তার কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল,

“কত অপেক্ষা করেছি এই মুহূর্তের জন্য জানিস? যেমন অভিমান করবি তেমনই অভিমান ভাঙানোর পথও দেখিয়ে দিবি। নাহলে আমি পথই খুঁজে পাব না।”

দৃষ্টি আর কথা বলে না। আফরান আলো নিভিয়ে দিল। সে চায় না দৃষ্টির কোনো প্রকার অস্বস্তি হোক। অতঃপর তার অধরে অধর ছুঁইয়ে দিল। এতটুকুতে সে কি ক্ষান্ত হবে? ধীরে ধীরে দৃষ্টির শরীরের কোনো অংশ ছুঁতে বাদ রাখল না। ক্ষণে ক্ষণে লজ্জায় কঁকিয়ে উঠল সে। দন্তের দংশ’নে পীড়ায় জর্জরিত হয়ে দৃষ্টি ফিসফিসিয়ে শুধায়,

“কোন জন্মের রাগ মেটাচ্ছেন আমার উপর?”

আফরান উন্মাদ। নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে আগেই। বুকে মুখ গুঁজে অধর ছুঁইয়ে বলে,

“রাগ নয়, পাঁচ বছরের ধরে রাখা ধৈর্য নিঃশেষ করছি। লাগাম বদ্ধ আমিকে লাগাম ছাড়া করে দিচ্ছি।”

উন্মাদ আফরান সামলাতে বেশ বেগ পোহাতে হলো তাকে। দু হাতে আগলে নিল স্বামীকে। এতো আদরে সোহাগে তার মনে হলো, সে ম’রে যাবে। এমন সুখের য’ন্ত্রণায় সে ম’রে যাবে।

চলবে,

সে আমারই পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪১

“ওয়েলকাম ব্যাক ডক্টর ইততেয়াজ।”

“থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, ডক্টর আহমেদ। হা হা।”

“তো কেমন আছেন বলুন? হে হে।”

“আমি তো খুব ভালো আছি। তবে বউ রেখে গিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম। হে হে।”

“আরে কীসের চিন্তা? আমরা সবাই ছিলাম। আপনার বউ একদম সুরক্ষিত ছিল। হা হা।”

“হ্যাঁ যেমনটা ছাগলের সামনে ঘাস। হা হা।”

“আপনি কি আমাকে ছাগল বললেন! হে হে।”

“আই ওয়াজ জোকিং। তারপর বলুন বিয়ে করবেন না? হে হে।”

“হ্যাঁ, বিয়ে তো করতেই হবে। হা হা।”

“দৃষ আমাকে বলল ও নাকি ফুপি হতে চায়। আপনি তো ওর আপন ভাই এর মতো। দায়িত্বটা আপনি নিয়ে নিন। হা হা।”

“আমি দৃষ্টির ভাই! হ্যাঁ ভাই’ই তো। হে হে।”

“আপনিও খুব শীঘ্রই মামা হবেন। হে হে।”

দৃষ্টি এসব আর নিতে পারল না। কানে হাত চেপে মৃদু চিৎকার করে বেরিয়ে গেল। সে একটা ফাইলে মৃন্ময়ের সাইন নিতে এসেছিল। মৃন্ময় তাকে সাথে নিয়েই আফরানকে স্বাগত জানাতে এলো। আর তাকেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা গিলতে হলো। হাসতে হাসতে কেমন অদ্ভুত ভাবে কথা বলছিল দুজন। দৃষ্টির দরকার নেই কোনো সাইন। লাগাম ছাড়া কথা বার্তার মধ্যে সে থাকতে চায় না।

দৃষ্টির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আফরান একটু হেসে বলল,

“কি হলো বলুন তো? এভাবে দৌড়ে চলে গেল কেন?”

মৃন্ময় ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,

“আপনার কথা ওর কান আর সহ্য করতে পারেনি। তাই কান বাঁচাতে চলে গেল।”

আফরান আবার হেসে ফেলল। বলল,

“একটু বেশি বলে ফেললাম বোধহয়।”

বাড়ি ফিরে বিশাল আয়োজন দেখে দৃষ্টি খালামনির নিকট ছুটে গেল। জিজ্ঞেস করল,

“এতো আয়োজন কেন খালামনি? কেউ আসবে নাকি?”

মিসেস সাইমা ভীষণ ব্যস্ত। তিনি ছোটাছুটি করতে করতে জবাব দিলেন,

“আরে দৃষ! অনেক কাজ বুঝলি? ফ্রেশ হয়ে এসে তুইও হাত লাগা।”

“কে আসবে? সেটা তো বলো?”

“তোর আপু আসছে আজ। কতদিন পর আমার মেয়েটা আসবে! আর সাথে আমার নাতনিটাও আসছে।”

দৃষ্টির ভ্রু শিথিল হয়। মিসেস সাইমা কাজে মনোযোগ দিয়ে আবার বললেন,

“আফরান ফিরেছে যেহেতু, সেহেতু তোদের রিসিভশন করা হবে শীঘ্রই। সেই বাহানা দিয়েই আসছে ও।”

দৃষ্টি রুমে চলে গেল। সিনথিয়া আপু আসছে, সাথে তার মেয়ে রিয়া। অনেক দিন আপু আসে না। দেশের বাইরে স্যাটেল হওয়ায় তারা বার বার আসতে পারে না। বছরে একবার নাহয় কয়েক বছর পর একবার আসে। রুমে গিয়ে সে ভাবল বাড়িতে মেহমান আসছে, এখন কি রুম ছেড়ে অন্য রুমে যাওয়া ঠিক হবে? কি মনে করবে সবাই? ওহ! খালামনিকে তো জিজ্ঞেস করাই হলো না যে ওই গায়ে পড়া মেয়েটা কে? আর কি কাজ তার এই বাড়িতে? আফরানের আশে পাশেই বা কি কাজ? সে ফ্রেশ হয়ে নিচে গেল।
ফারনাজকে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে দ্যাখা যাচ্ছে। সে তাকে থামায়। টেনে সোফায় বসিয়ে বলে,

“এভাবে ছোটাছুটি করছিস কেন? তুরাগ ভাইয়া দেখলে রাগ করবে। বকলে তখন ভ্যা ভ্যা করতে করতে আমার কাছে নালিশ করতে এলে খবর আছে তোর।”

সে মুখ কালো করে ফ্যালে। ডাগর ডাগর আঁখি জোড়া কুঁচকে বলে,

“এমন ভাব করিস তোরা যেন আমি ন মাসে পড়েছি। আমি বাচ্চা নাকি?”

“তুই বাচ্চার চেয়ে কম নোস, আপু। শুধু দেখতে আর বয়সটাই বেড়েছে তোর। আর এই সময়টা খুব সাবধানে থাকতে হবে। আমি পড়ছি তো, আমি জানি। প্রথম তিন মাস খুব সাবধানে চলতে হবে।”

“বুঝেছি। কিন্তু এতো কাজ পড়ে আছে তার কি হবে?”

সে আশ্বস্ত করে,

“আমি আছি তো। সব সামলে নেব।”

সে চলে যেতে নিয়ে আবার থেমে গেল। ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল,

“ওই মেয়েটা কে রে, আপু?”

ফারনাজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

“কোন মেয়েটা?”

দৃষ্টি বিরক্ত হয়। মেয়েটার নাম মুখে নিতে কেমন রাগ হচ্ছে তার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“রূপসী না কুপসী, ওই মেয়েটা।”

“ওহ! রূপসী! ও তো আঙ্কেলের বিজনেস পার্টনারের মেয়ে। ভাইয়ের সাথে নাকি বন্ধুত্বও আছে রূপসীর। বেড়াতে এসেছে। কিছু দিন থাকবে নাকি। জানিস? ভাইয়া যে দেশে গিয়েছিল সেও ওই দেশে গিয়েছিল টুর দিতে। তাই ভাইয়ার সাথেই চলে এসেছে। অতো রাতে কারো বাড়িতে আসা কেমন একটা না, বল?”

দৃষ্টি উঠে দাঁড়ায়। রান্না ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে ভাবে, এ কেমন বন্ধু? শুধু বন্ধু নাকি আরও গভীর কিছু? আফরান দেশে আসার সাথে সাথেই চলে এলো? তাও তার সাথে রাতে! দৃষ্টির ভালো লাগছে না কিছুই। সে খালামনি দের হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিয়ে রুমে চলে গেল। আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার দরুন তার খোঁজ আর কেউ নিল না।

বাইরে থেকে শব্দ ভেসে আসছে। ক্ষণে ক্ষণে উচ্চ স্বরে হাসি এবং কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যায়। দৃষ্টি উঠে বসে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হবে হবে ভাব। বেশ অনেকক্ষণ ঘুমানো হলো। রাতে ঘুম না হওয়ার ফল। সে এতোক্ষণ রুমে অথচ কেউ তার খোঁজ করল না? সে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। নিচে চেয়ে দ্যাখে সবাই জড় হয়ে গল্প করছে, হাসি মজা করছে। তার সব থেকে দৃষ্টি কটু বিষয় রূপসী আফরানের গা ঘেঁষে বসে গল্পে মেতে আছে। দৃষ্টির এই মুহূর্তে মনে হলো সে এই বাড়ির কেউ নয়, নিতান্তই বাইরের লোক। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সে পুনরায় রুমে ফিরতে চায়ল, কিন্তু পারল না।

“আরে দৃষ্টি! আয়, নিচে আয়। আমি কখন থেকে তোকে খুঁজে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি চলে আয়।”

সিনথিয়া আপুর ডাক সে উপেক্ষা করতে পারল না। ঠোঁটের কোণে নকল হাসি ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলো। সিনথিয়া আপুর পাশে তুরাগ বসে ছিল। সে তাকে ঠেলে উঠিয়ে বলল,

“এই তুই ওঠ, দৃষ্টিকে বসতে দে।”

তুরাগ উঠে গিয়ে পেছনে দাঁড়াল। সিনথিয়া টেনে দৃষ্টিকে বসিয়ে বলে,

“কখন এসেছি জানিস? খুঁজে যাচ্ছি তোকে, আফরান বলল তুই নাকি ঘুমিয়ে আছিস। তাই তোকে ডাকেনি। ঘুম থেকে ডেকে তুললে যদি মাথা ব্যথা করে? আমার তো মাথা ব্যথা করে আমি বুঝি। তারপর বল কেমন আছিস?”

দৃষ্টির মনে পড়ল সিনথিয়া আপু খুবই চঞ্চল। ঠিক অ’স’ভ্য ডাক্তার টার মতো। কিন্তু খুব ভালো মানুষ। সে মৃদু হেসে বলে,

“ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“আর ভালো থাকি কি করে বল? বিয়ে দিয়ে আমাকে কত্ত দূরে পাঠিয়ে দিল! বাপের বাড়ি বেড়াতেও আসতে পারি না। কয়েক বছর পর পর আসতে হয়। রিয়া তো সেই ছোট্ট বেলায় এসেছিল আর এই এলো। ঠিক ঠাক চিনতেও পারছে না সবাইকে। ভিডিও কলে কথা না হলে ভুলেই যেত। তোর দুলাভাই কিছুতেই এলো না। না আসে না আসুক, আমার কি? আমি তো বলে দিয়েছিলাম তুমি না গেলেও এবার আমি যাবই যাব। আমার ভাইয়ের রিসিভশন কিছুতেই মিস করব না।”

দম নিল সে। দৃষ্টি হেসে রিয়াকে আদর করল। রিয়ার বয়স সাত। আগের বার যখন এসেছিল তখন হয়তো চার বা পাঁচ ছিল। মেয়েটা ভীষণ কিউট, একদম ফকফকা সাদা। এরই মধ্যে রূপসী বলল,

“তুমি কি এভাবেই থাকো, দৃষ্টি? ভুতের মতো লাগছে দেখতে। এমনিতেই কালো ঘুম থেকে উঠে এসে আরও কালো লাগছে। তুমি কি মুখে কোনো ক্রিম বা ফেইস ওয়াশ ইউজ করো না? বা কোনো মেকআপ করো না? আমাকে বলতে পারো আমি শিখিয়ে দেব।”

পরিবেশ থমথমে হয়ে গেল। ইতস্তত বোধ করল সকলে। মেহমান হওয়ার খাতিরে রূপসীকে কড়া কথা বলতে পারল না কেউ। এতো লোক জনের মধ্যে যদিও সবাই বাড়ির লোক, তবুও দৃষ্টি অপমান বোধ করল। মৃদু হেসে বলল,

“ধন্যবাদ, আপু। মেকআপ করে সাদা ভুত হয়ে থাকার ইচ্ছে আমার নেই। আমি কালো ভুতই ভালো আছি।”

সে এক পলক আফরানের দিকে চেয়ে দৃষ্টি আবার ফিরিয়ে নিল। বলল,

“আপনার নাম রূপসী এবং আপনি ঠিক তেমনই সুন্দর। কিন্তু মনটা এমন কুপসীর মতো কেন?”

রূপসী রেগে গেল, যা বোঝা গেল তার ক্রুদ্ধ চাহনি দেখে। দৃষ্টি উঠে দাঁড়ালে সিনথিয়াও তার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। বলল,

“সবার গিফট দেওয়া শেষ। তোরটা আর ফারনাজের টা বাকি। চল আমার সাথে। ফারনাজ তুইও চল।”

ফারনাজ লাফিয়ে উঠে তার পিছু নিল। তুরাগ আঁতকে উঠে বলল,

“সাবধানে!”

সে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে ভেংচি কেটে চলে গেল। তূরাগ হতাশ শ্বাস ফেলল। এই বাচ্চা মেয়ে বাচ্চা কীভাবে সামলাবে? ভেবে পায় না সে। তাকেই তার বাচ্চা সামলাতে হবে।

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪২
(৫০+ এলার্ট 🥱)
সিনথিয়া দু দুটো শাড়ি তাদের হাতে ধরিয়ে দিল। ভীষণ সুন্দর শাড়ি দুটো। তুলতুলে কোমল কাপড়। ফারনাজেরটা কালো আর দৃষ্টিরটা গোলাপী। সিনথিয়া বলল,

“আজ দুজনে এই শাড়ি পরবি, আমি দেখব। আমার পছন্দ করে আনা জিনিসে তোদেরকে কেমন লাগে?”

দৃষ্টি একটু আমতা আমতা করল। বলল,

“আপু, না মমানে এমন শাড়ি!”

“হ্যাঁ কি হয়েছে শাড়িতে? পছন্দ হয়নি? সব থেকে ভালো ব্রান্ডের শাড়ি, ওদেশে ভীষণ ফেমাস। অন্য কিছু আনতে পারতাম কিন্তু তাতে তোরা কমফর্টেবল ফিল করবি না, তাই আনিনি।”

দৃষ্টি আর কিছু বলল না। আপু ভালোবেসে যখন দিয়েছে তখন তার আপত্তি করা বাজে দ্যাখায়। সিনথিয়া জিজ্ঞেস করে,

“আফরান কিছু আনেনি তোদের জন্য?”

দৃষ্টি এই বিষয়ে কিছুই জানে না। তাই সে জবাব দিতে পারল না। জবাব দিল ফারনাজ,

“দুই মায়ের জন্য দুটো শীতের শাল এনেছে। আর বাবাদের জন্য কোট আর ওর জন্য জুতো এনেছে। আমার জন্য কি এনেছে জানো? চার চারটা চশমা।”

বলে সে মুখ গোমড়া করে ফেলল। আফরান তাকে পরোক্ষভাবে কানা বলতে চেয়েছে। সিনথিয়া হেসে ফেলল। বিদেশ থেকে কেউ এসব আনে? বয়স বেড়েছে কিন্তু তার ভাইয়ের দুষ্টুমি যায়নি। হেসে বলল,

“অদ্ভুত একটা।”

ছাদে দাঁড়িয়ে দুই ভাই। দু জনের হাতে দুটো কফির কাপ। তুরাগ এক চুমুক দিয়ে বলল,

“আহা! তোর এই কফিটা ভীষণ মিস করছিলাম। তবে তোকে না।”

আফরান সামনে চেয়ে বলে,

“তোর মিস করা না করা দিয়ে আমার কোনো যায়ই আসল না। সব থেকে বড় একটা অপরাধ করেছিস তুই।”

তুরাগ আফরানের কথায় বিশেষ পাত্তা দেয় না। নিজের মতোই চুমুক দেয় কাপে। হঠাৎ আফরান দানবীয় হাতের থাবা বসায় তার পিঠে। নাকে মুখে কফি উঠে যায় তার। কাশতে কাশতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ধাতস্থ হলো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল,

“কি হলো! এমন করলি কেন?”

সে মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,

“তো কেমন করব! তুই শুনেছিস আমার কথা?”

“তোর কোন কথা শুনিনি? তাছাড়া তোর কোন কথাটাই বা আমি শুনি?”

“আসলেই তুই আমার কোনো কথা শুনিস না। তোকে বললাম আগে চাচ্চু হবার অধিকার তোর। কিন্তু তুই শুনলি? উল্টে আমাকে চাচ্চু বানাতে চলেছিস।”

ব্যাপার বুঝে তুরাগ স্বাভাবিক ভাবে আবার কাপে চুমুক দিল। বলল,

“তুই পারিস নি এটা তোর ব্যর্থতা। আমি কি করব? তোর জন্য কি বাবা হবো না, নাকি?”

আফরান বিরক্ত হয়। বউকে এখনো হাতে পায়নি। কপালে আদৌ বাবা হওয়া আছে কিনা কে জানে?

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সিনথিয়া দৃষ্টিকে টেনে রুমে নিয়ে গেল। বলল,

“ফারনাজ শাড়িটা যখন ইচ্ছে পরুক, ওর শরীর এমনিতেই ভালো নেই। কিন্তু তুই এখন পর। আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।”

দৃষ্টির না বলতে বাঁধল। আপু এতো উৎসাহের সাথে তাকে বলছে! তার মুখের এই মিষ্টি হাসিটা তার কেড়ে নিতে ইচ্ছে করল না। সিনথিয়া নিজের হাতে তাকে শাড়ি পরাল। টুকটাক সাজিয়ে দিল। কানে ছোট ছোট দুল পরিয়ে সাজ শেষ করল। অতঃপর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকে বলল,

“বাহ্! খুব সুন্দর লাগছে তোকে। তোকে কালো বলেছিল না ওই রূপসী? ইচ্ছে তো করছে ওর মুখে কালি ঘষে দিতে। কি সুন্দর লাগছে তোকে! কারো নজর যেন না লাগে।”

দৃষ্টি হাসে। আপু যা বলছে তা কি সত্যি? নাকি সে এমনি এমনিই বলছে? সে বলল,

“আমি এখন রুমে যাই?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ যা। চল আমি তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”

সিনথিয়া তাকে রুম পর্যন্ত দিয়ে আবার ফিরে এলো। দৃষ্টি রুমের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে আবেদনময়ী রূপে আবিষ্কার করে। এই শাড়ির সমস্যা এটাই। ফিনফিনে পাতলা একটা শাড়ি। যা পরা আর না পরা সমান কথা তার কাছে। ভাগ্যিস রুমে আসার সময় কেউ দেখে ফ্যালেনি। রূপ যেমনই হোক সে তো কালো। হ্যাঁ কালোই, আজ সবার নীরবতায় তা প্রমাণ হয়ে গেল। আর কেউ কিছু বললেই বা কি? সে কালো এটা তো আর পাল্টে যাবে না। দৃষ্টি ভাবল শাড়িটা কি পাল্টাবে? নাকি আরেকটু পরে থাকবে? ভীষণ হালকা শাড়ি পরেও আরাম আছে। কিন্তু বাইরে বের হওয়া যাবে না।

“হ্যাঁ? পেশেন্ট সিগারেট খেতে চায়ছে? গোপাল বিড়ি? হাদা রামকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিন। ম’রবে নাকি শা’লা?”

আফরান ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করে। মাঝে মধ্যে রাগের বশে মুখ ফসকে দু একটা কথা বেরিয়ে যায়। সে বাইরে থেকে নয়, ব্যালকনি থেকে রুমে এলো। তারমানে আফরান এতক্ষণ রুমে ছিল? দৃষ্টি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে তাকে এভাবে দেখলে কি হবে? আফরান ফোন রেখে বলল,

“ব’লদ জুটেছে সব আমার কপালে। সব বলে দেওয়া লাগে।”

দৃষ্টির দিকে চেয়ে বলতে নেয়,

“আরে দৃষ, তুই কখন..”

থেমে যায় সে। আপাদমস্তক দেখে নেয় এই আবেদনময়ী নারীর। র’ক্ত ছলকে ওঠে তার। চশমার কাঁচ ঝাঁপসা হয়ে আসে। চোখ থেকে খুলে তা হাতে নেয়। দৃষ্টি তাকে থমকে যেতে দেখে ঢোক গিলে বলে,

“আআমি গেস্ট ররুমে যাচ্ছি, ননাহলে আপনার ঘঘুমাতে অসুবিধা হবে।”

তার কথা শেষ হতেই আফরানকে লম্বা পা ফেলে দরজার দিকে এগোতে দ্যাখা যায়। দৃষ্টি ভাবে সে হয়তো বাইরে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে সে দরজা লক করে ফিরে এলো। দৃষ্টির এবার দম বন্ধ হবার জোগাড়। আফরান তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। দৃষ্টির কাঁধে উষ্ণ শ্বাস অনুভব করে শিউরে ওঠে। অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে ওঠে। দুহাতে শাড়ি খামচে ধরে সরে যেতে নিলেই বাধা পড়ে। আফরান বলিষ্ঠ হাতে পেঁচিয়ে ধরে পেছন থেকে উদর। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আর কত অভিমান করে থাকবি? এবার তো গলে যা। একটা বছর আমার সাথে কথা বলিসনি। চেহারাও দ্যাখাসনি নিজের। আমার কষ্ট হয় না? আমি ছটফট করি নি? মা’র কা’ট যা খুশি কর কিন্তু অভিমান করে আর থাকিস না।”

সে কিছু বলতে পারে না। আপ্রাণ চেষ্টা চালায় কাঁপুনি থামানোর। আফরান মৃদু হাসে। দুষ্টু হেসে বলে,

“শাড়ি পরে নিশ্চয় আমাকে পটাতে এসেছিস? তুই ভেবেছিস এভাবে শাড়ি পরে সামনে আসবি আর আমি পটে যাব?”

অতঃপর কাঁধে মুখ ঘষে বলে,

“পটে তো পাঁচ বছর আগেই গিয়েছি। ওই ছোট্ট দৃষকে দেখেই।”

দৃষ্টির বুকের মাঝে তুফান হয়। কোনো মতে কণ্ঠে আওয়াজ এনে বলে,

“ছছাড়ুন।”

পরপরই জবাব আসে,

“উঁহু।”

পরপর তার শুষ্ক অধরদ্বয় ছুঁয়ে যায় দৃষ্টির কাঁধ। ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে ওঠে সে। তার মনে হলো আজ তার সকল শক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। নড়তেও পারছে না যেন। আর আফরানের হাতের বাঁধন? তা নরম হবার নামই নেই। আফরান আরও গভীরে যাবার আগেই হুট করে দরজা নক হয়। চমকে ওঠে তারা। দৃষ্টি ছিটকে সরে যায়। লম্বা শ্বাস নেয়। দরজার ওপাশের ব্যক্তি থেমে নেই, দুরুম দুরুম করে দরজা ধাক্কাতেই আছে। ভেঙে ফেলবে যেন এক্ষুনি দরজা না খুললে। দৃষ্টি এগিয়ে দরজা খুলে দেয়। রূপসীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কি প্রতিক্রিয়া করবে তা ভুলে যায়। রূপসী তার আপাদমস্তক দেখে বলে,

“ভালো লাগছে তোমাকে। আফরান কোথায়?”

আফরান পেছন থেকে বলে,

“এখানে আমি। তুমি কি কোনো দরকারে এসেছ?”

“না মানে, আমার ঘুম আসছিল না। তাই ভাবছিলাম তোমাদের সাথে গল্প করি।”

দৃষ্টির চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সে ঠিক কি পরিমান রাগে ফুঁসছে ভেতরে ভেতরে। সে হেসে বলল,

“অবশ্যই, আসুন ভেতরে।”

রূপসী প্রবেশ করে। দৃষ্টি আড় চোখে একবার স্বামী নামক ভাইকে দেখে নেয়। তার এখন কেঁদে দেওয়ার মতো অবস্থা। সে সম্পূর্ণ তাকে অবজ্ঞা করে ওয়ারড্রব থেকে কাপড় হাতে নেয়। রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিয়েই রূপসী জিজ্ঞেস করে,

“কোথায় যাচ্ছ তুমি? গল্প করবে না?”

সে মুচকি হেসে বলে,

“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, আপু। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। আপনারা গল্প করুন। দরকার পড়লে সারারাত ধরে গল্প করুন, কেউ বিরক্ত করবে না।”

সে গটগটিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। আফরান কেবল অসহায় চোখে চেয়ে রইল।

বাড়িতে কয়েকটা গেস্ট রুম রয়েছে। একটাতে রূপসীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দৃষ্টি অন্য একটাতে এসে চেঞ্জ করে নিল। আলো নিভিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল। পরক্ষনেই বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। রূপসীকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ছিল। আজ সে না এলে বোধহয় আফরানকে বাঁধা দিতে পারত না। আফরান ঠিকই বুঝে নিত নিজের অধিকার। সত্যিই তো সে কষ্ট কম পায়নি। দৃষ্টি নিজে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে তাকে কষ্ট দিয়েছে। নিজেও তো রাতের পর রাত কেঁদে ভাসিয়েছে। সে ভীষণ দ্বিধায় পড়ে, কি করা উচিত তার?

চলবে,

#সে_আমারই
#মোহনা_মিম
#পর্বঃ৪৩

আমিনুল ইততেয়াজ আজ বসার ঘরে আসননি। দৃষ্টি তার জন্য চা নিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। দরজার কাছাকাছি আসতেই তার পা জোড়া থেমে গেল।

“আফরানকে আমি সত্যিই কি পাব, আঙ্কেল?”

“কেন পাবে না? দেখছ না, আফরান তোমার কত খেয়াল রাখছে? তোমরা কোনো অবহেলা করছে কি?”

“কিন্তু সে তো দৃষ্টিকে ভালোবাসে। তাকে কি ডিভোর্স দিতে রাজি হবে?”

“হবে হবে, সব হবে। তুমি একটু ধৈর্য করে থাকো মামনি। আমি আছি তো।”

দৃষ্টির পায়ের নীচের জমিন কেঁপে ওঠে। শূন্য দৃষ্টিতে সে কেবল চেয়ে রয়। আঙ্কেল তাকে এতোটাই অপছন্দ করেন যে, তাকে তাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন! এতো দিনে কি সে তার মনে একটুও জায়গা বানাতে পারেনি? এতোটাই ব্যর্থ সে!
রূপসী বেরিয়ে যাবার পর দৃষ্টি আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। পা দুটো টেনে প্রবেশ করে। আমিনুল ইততেয়াজ হাতে ফাইল নিয়ে কোনো প্রজেক্ট এর ডিটেইলস্ দেখছিলেন। দৃষ্টি মিহি স্বরে বলে,

“আঙ্কেল, আপনার চা।”

আমিনুল ইততেয়াজ চোখ উঠিয়ে তাকান। পুনরায় কাজে মনোনিবেশ করে বলেন,

“রেখে যাও।”

দৃষ্টি তার সামনের ছোট্ট টেবিলে কাপ রাখে। দাঁড়িয়ে থাকে ঠাঁয়। তিনি তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

“কিছু বলবে?”

সে সূক্ষ্ম শ্বাস ফ্যালে। ঢোক গিলে বলে,

“আপনি আমাকে এতোটা অপছন্দ করেন কেন, বাবা?”

দৃষ্টি আজ এই প্রথম তাঁকে বাবা বলল। আমিনুল ইততেয়াজ থমকালেন, পুরোনো মুখে নতুন সম্বোধন শুনে তার ভেতরটা কেমন করে উঠল যেন। সে আবার বলে,

“আমি কি এতোটাই নি’কৃষ্ট মানুষ যে আপনি আমাকে একটুও পছন্দ করেন না, বাবা! এতো দিন আপনার চোখের সামনে থাকলাম, নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম আপনাদের সবার মনের মতো হবার। তবুও, আমি ব্যর্থ। আমার উপর কি একটুও দয়া হয় না আপনার?”

বলতে বলতে তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে তার। আমিনুল ইততেয়াজ নিশ্চুপ। দৃষ্টি ঢোক গিলে বলে,

“অপছন্দ করার মাত্রা এতোটা ছাড়িয়েছে যে আপনি আমার সংসার ভাঙার জন্য একটা মেয়েকে নিয়ে এলেন! কেন বাবা? আমি কালো বলে? আমার বাবা কোটিপতি নয় বলে?”

এবার সে চোখে হাত চেপে কেঁদেই ফেলল। এমনটা কেন হয় শুধু তার সাথে? জড়ানো কণ্ঠেই বলল,

“তবে আপনার ছেলে কেন ভালোবাসলো আমাকে? কেন আমাকে সে ভালোবাসতে বাধ্য করল?”

আমিনুল ইততেয়াজ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছেন। সত্যি কথাগুলো মেয়েটার মুখ থেকে শুনতে ভীষণ খারাপ লাগছে।

“এতো চেষ্টা করেও যখন আমি ব্যর্থ, তখন আমি চলে যাব। আর আমার মুখ দ্যাখাব না আপনাদের। আপনি নিজের পছন্দ মতো মেয়ের সাথে আপনার ছেলের বিয়ে দেবেন। আর ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবেন, আমি সই করে দেব। আমার কোনো দাবি নেই আপনাদের কাছে।”

সে ওড়নার আঁচল টেনে চোখ, মুখ মুছে চায়ের কাপ উঠিয়ে নেয়। বলে,

“চা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। আমি আবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

নিস্তেজ হয়ে সে বেরিয়ে গেল। আমিনুল ইততেয়াজ থম মে’রে বসে রইলেন। পথের কাঁটা নিজে নিজেই সরে যাচ্ছে! তার তো আনন্দ করা উচিত, তবে এমন খারাপ লাগছে কেন?

দৃষ্টি কাজের মেয়েটাকে দিয়ে আমিনুল ইততেয়াজের চা পাঠিয়ে দিল। রুমে গিয়ে দেখল আফরান ঘুমিয়ে আছে। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে। এখনও ওঠেনি কেন? সত্যিই সারারাত জেগে গল্প করেছে দু’জনে? সে তাচ্ছিল্য হাসে। সে তো চলেই যাচ্ছে, এখন আর তাদের পথে কোনো বাঁধা থাকবে না। নিজেদের ইচ্ছেমতো চলতে পারবে। সে ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে যায়। বাবার নম্বর বের করে ফোন দেয়। কিছুক্ষণ বাদেই কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,

“কেমন আছ, মা?”

দৃষ্টি ঠোঁট চেপে কেঁদে ফ্যালে, নিঃশব্দে। বলে,

“ভালো আছি, বাবা। তোমাদের সবার কথা খুব মনে পড়ছে। তোমরা কেমন আছ?”

“ভালো আছি তো। তোমার মা একটু আগেই তোমার কথা বলে গেল। আমি কল দিতেই যাচ্ছিলাম, তার আগেই তুমি কল দিলে।”

দৃষ্টি হু হু করে কেঁদে ওঠে। ফাহাদ আবরার চমকে উঠলেন। যেদিন এই বাড়ি ছেড়েছিল সেদিন ছাড়া মেয়েকে তিনি আর কাঁদতে দ্যাখেননি। তবে আজ কেন কাঁদছে? তিনি ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,

“কাঁদছ কেন? কি হয়েছে? বলো আমাকে।”

সে কাঁদতে কাঁদতেই বলে,

“আমি তোমার কাছে যাব, বাবা। আমি মায়ের কাছে যাব। আমাকে নিয়ে যাও। এক্ষুনি এসে আমাকে নিয়ে যাও। আর এক মুহূর্তও আমি এখানে থাকতে পারব না। আমার.. আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ তুমি আমাকে নিয়ে যাও।”

ফাহাদ আবরার শান্ত কণ্ঠে বললেন,

“আমি আসছি।”

কল বিচ্ছিন্ন করলেন তিনি। দৃষ্টি দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদে বেশ কিছুক্ষণ। আফরানের ঘুম এতোই গাঢ় যে, সে টের পায় না কিছুই। দৃষ্টি চোখ মুখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। রুমে এসে লাগেজ বের করে। যা সাথে করে এনেছিল সেগুলোই ভরতে শুরু করে। এখান থেকে যা পেয়েছে তার কিছুই নেবে না। এ বাড়ির লোকের দেওয়া জিনিস এ বাড়িতেই থাক। আফরানের দিকে তাকায় ফের। চুপচাপ বিছানার এক কোণে বসে পড়ে। নিষ্পলক চেয়ে থাকে স্বামীর মুখশ্রীতে। সে নড়েচড়ে উঠতেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
আফরান পিটপিট করে চোখ মেলে সময় দ্যাখে। তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে ওঠে। দৃষ্টির পানে চেয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,

“ডাকিসনি কেন আমাকে? কত দেরি হয়ে গেল।”

সে জবাব দেয় না। আফরান দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসে। ওয়ারড্রবের দিকে এগোতে গিয়ে বেখেয়ালে দৃষ্টির লাগেজের সাথে পা আটকে পড়তে নেয়। কোনো মতে নিজেকে সামলে সে নিচে তাকায়। কৌতূহল মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,

“লাগেজ এখানে ফেলে রেখেছিস কেন? আরেকটু হলে তো পড়েই যেতাম। লটকে পড়ে থাকলে তখন আসতিস সেবা করতে?”

টেনে সরাতে গিয়ে অনুভব করে অতিরিক্ত ওজন। সে ভ্রু কুঁচকে ফ্যালে,

“কি ব্যাপার, দৃষ? লাগেজে কি আছে?”

“যা থাকার কথা তাই।”

তার নির্লিপ্ত জবাব। আফরান লাগেজ খুলে চমকে ওঠে। সে চোখে পলকে দৃষ্টির সামনে গিয়ে দুহাতে তার বাহু চেপে ধরে। ব্যাকুল হয়ে বলে,

“লাগেজে তোর জামা কাপড় কেন? কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

“যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে।”

“কি হয়েছে তোর? এভাবে কথা বলছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে তোকে? বাবা কিছু বলেছে? রূপসী?”

সে জোর পূর্বক হাত ছাড়িয়ে নেয়। রুষ্ট কণ্ঠে বলে,

“এভাবে যখন তখন ছোঁবেন না আমাকে।”

গটগটিয়ে সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আফরান বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ কি হলো ওর?

ডাইনিং টেবিলে সবাই একে একে বসে পড়ছে। নাস্তা করে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়বে। দৃষ্টি চুপচাপ সোফায় বসে। অন্য দিনের মতো হাত লাগায় না নাস্তা পরিবেশনের কাজে। মিসেস সাইমা এবং মিসেস অনা কিঞ্চিত অবাক হলেন। তাদের ওঠার আগেই যে মেয়ের অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়, সে মেয়ে আজ শান্ত।
আমিনুল ইততেয়াজের গলা দিয়ে যেন খাবার নামতে চায়ছে না। কেমন যেন অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কখনো মেয়েটাকে ওভাবে কাঁদতে দ্যাখেননি। তিনি মাঝে মাঝে শক্ত দু এক কথা বললেও শান্ত থাকত। যেন তার উপর কোনো প্রভাবই পড়ত না। তবে আজ! মেয়েটা বোধহয় বড্ড কষ্ট পেয়েছে। তাছাড়া সংসার ভাঙার আভাস পেয়ে যেকোনো মেয়েই এমন আচরণ করবে।

ফারনাজকে নিজের পাশে বসিয়ে নিজ দায়িত্বে গেলাচ্ছে তুরাগ। মেয়েটা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে এক প্রকার। জোর না করলে তার গলা দিয়ে কিছুই নামে না। ফারনাজ মুখ কুঁচকে ধীরে ধীরে গিলছে। প্রচন্ড ক্ষুধা লাগলেও খেতে পারে না। সে পানি খেয়ে ডাকে,

“দৃষ, আজ কলেজ যাবি না? সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। খেয়ে নে।”

দৃষ্টি নড়ে না। দৃষ্টি নত করে বসে রয়। আফরান হতদন্ত হয়ে নিচে নেমে আসে। গায়ে তার বাড়ির পোশাক। হাসপাতালে যাওয়ার কোনো তাড়াহুড়ো নেই তার মধ্যে। মিসেস সাইমা বলেন,

“নাস্তা করে নে। হাসপাতালে যাবি না? ন’টা বাজতে চলল।”

আফরানের সেদিকে খেয়াল নেই। উতলা হয়ে আছে সে। লম্বা পা ফেলে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

“দৃষের কি কিছু হয়েছে, মা?”

তার কপালে ভাঁজ পড়ে। সত্যিই তো! মেয়েটার কি কিছু হয়েছে? নাহলে এমন শান্ত হয়ে তো কোনো দিন থাকে না। তিনি মাথা নেড়ে বোঝালেন যে, তিনি কিছু্ই জানেন না। আমিনুল ইততেয়াজের হাত থেমে যায়। মেয়েটা কি বলে দিয়েছে তার পরিকল্পনার ব্যাপারে?

রূপসী ঘুম থেকে উঠেই ডাইনিং টেবিলে বসেছে। গদগদ কণ্ঠে আফরানকে ডাকে,

“আফরান, এসো একসাথে ব্রেকফাস্ট করি।”

আফরানের এখন আদিখ্যেতা করার মুড নেই। চিন্তায় মাথা খারাপ হবার অবস্থা। কোনো জবাব দিল না সে। চুপচাপ অপেক্ষা করল, দৃষ্টির এমন আচরণের কারণ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে। এভাবে অতিক্রম হলো প্রায় এক ঘন্টা। তিয়াস ইততেয়াজ এবং তুরাগ অফিসে চলে গেলেও কোনো এক কারণে থেকে গেলেন আমিনুল ইততেয়াজ। আফরানও গেল না হাসপাতালে। রূপসী সাধাসাধি করেও তাকে খাওয়াতে পারল না। আর মিসেস সাইমা এবং মিসেস অনা খাওয়াতে পারলেন না দৃষ্টিকে।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠায় দৃষ্টি দাঁড়িয়ে পড়ে। এগিয়ে গিয়ে খুলে দেয় দরজা। সকলে দরজার দিকে চেয়ে। কৌতূহল, এখন কে এলো? ফাহাদ আবরার কে চমকালেন সবাই। তিনি ফারনাজের বিয়ের পর আবার আজ এ বাড়িতে পা রাখলেন।

চলবে,