Saturday, July 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 396



আরেকটি বার পর্ব-২০+২১

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২০
#Esrat_Ety

একটা পরিচিত অনুভূতি ঘিরে ধরে রেখেছে উর্বীকে আপাদমস্তক।সে তাকিয়ে আছে, তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। যে এসেছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। আর আজকের এই আসাটা? এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কি?

রাওনাফ ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে । উর্বী মোমবাতি হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ কাঁপছে, ফরসা রঙের পরিনত মুখটা ঠান্ডায় জমে নীলাভ হয়ে গিয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে উর্বীর চোখে চোখ রেখে বলে,”কি?”

উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”কি?”

_আমি তো সেটাই বলছি, কি? আরে ভেতরে আসতে দেবে না আমাকে? দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছো তুমি!

উর্বী লজ্জা পেয়ে সরে দাঁড়ায়। বাইরে যে মানুষটা ভিজছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেইনি এতক্ষন। দরজার পাশে সরে দাঁড়িয়ে মোমবাতিটা কিছুটা নিচু করে হাতে ধরে রাখে। রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। সে অনবরত কাঁ’প’ছে।

উর্বী দরজা লাগিয়ে দেয়। রাওনাফ উর্বীকে একপলক দেখে, সে ঠকঠক করে কাঁপলেও কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”এখন আমার ইচ্ছা করছে একটা সিগারেট খেতে।”

উর্বী দরজা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় রাওনাফকে বলে,”আমার ভাইয়া সিগারেট খায়। তার প্যাকেট থেকে একটা এনে দেবো?”
রাওনাফ কাঁপতে কাঁপতেই হেসে ফেলে,
_না থাক। তুমি আমাকে এক কাপ চা দাও। ইটস এ্যান ইমার্জেন্সি।

কথাটি বলেই রাওনাফ উর্বীর ঘরের দিকে যাওয়া শুরু করে।
উর্বী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে রাওনাফকে। রাওনাফকে দেখে তার মনে হচ্ছে সে বহুবার এবাড়িতে এসেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে সে সোজা উর্বীর শোবার ঘরে ঢোকে।
উর্বী কয়েক মুহূর্ত দাড়িয়ে থেকে তার পিছু পিছু যায়।

রাওনাফ রীতিমতো হাঁচি দিতে শুরু করেছে। উর্বী আলমারি থেকে একটা পরিষ্কার তোয়ালে বের করে রাওনাফের দিকে এগিয়ে দেয়।

“নিন,মাথাটা মুছে ফেলুন। সর্দি লেগে যাবে।”

রাওনাফ নিশ্চুপ হাসি দিয়ে তোয়ালে টা নিয়ে মাথা মুছতে থাকে।

উর্বী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। তার হাতে কিছু কাপড়।

রাওনাফ তোয়ালে রেখে তাকায়, বলে,”কি ওগুলো?”

_ভাইয়ার ধোয়া পাজামা আর পাঞ্জাবী। সব তো ভিজিয়ে ফেলেছেন। এখন এভাবে থাকবেন? নিন,এটা পরে নিন। আপনার ফিট হয়ে যাবে। আমি চা নিয়ে আসছি।

রাওনাফ হাত বাড়িয়ে কাপড় গুলো নিয়ে নেয়।

উর্বী চা বানিয়ে নিয়ে এসে দরজায় টোকা দেয়,”আসবো?”

_হ্যা এসো।
উর্বী ভেতরে ঢোকে। চায়ের কাপটা রাওনাফের দিকে এগিয়ে দেয়। রাওনাফ চায়ের কাপটা নিতে নিতে বলে,”একটু লেবু হলে ভালো হতো।”

উর্বী অবাক হয়। এ আজ এতো স্বামীদের মতো আবদার করছে কেনো !
কয়েক মুহূর্ত রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে উর্বী লেবু আনতে রান্নাঘরে যায়।
রাওনাফ হাতে চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসে থাকে।

লেবু চিপে রাওনাফের কাপে দিতে দিতে উর্বী বলে,”আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আমি তো আপনাকে মেসেজ দিয়েছি। পড়েননি ঠিকভাবে?”
রাওনাফ কাপে চুমুক দিয়ে গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,”হ্যা পড়েছি। আমি এখানে,এই কাছেই এসেছিলাম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে, ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। অন্যায় করে ফেললাম?
উর্বী মাথা নিচু করে মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,
_না।
তারপর আবারও থেমে থেমে জিজ্ঞেস করে,”কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনার এখানে?”

রাওনাফ চা শেষ করে, তারপর নিচুগলায় বলে,
_বলবো, তার আগে আমাকে কিছু খেতে দাও। খিদেয় আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে।

উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। মানুষ টা এতদূর থেকে এলো,তার উপরে এই অবস্থা। উর্বীর শুরুতেই মাথায় রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু এই রাতে রাওনাফকে কি খেতে দেবে সে। অলসতার জন্য উর্বী নিজের জন্য কিছুই রান্না করেনি রাতে।
সে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমাকে বিশ মিনিট সময় দিন,আমি আসছি।”
রাওনাফ মাথা ঝাঁকায় , উর্বী দৌড়ে রান্না ঘরে যায়। তাকে ঝটপট কিছু বানাতে হবে। কিন্তু কি করবে সে ! টেবিলে দুপুরের কিছু শুকনো ভাত ছাড়া তো আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তখনি তার মাথায় একটা উপায় আসে। সে পেঁয়াজ,ক্যাপসিকাম কুচি করে কাটতে থাকে। তার হাতের গতি তীব্র।

হঠাৎ রাওনাফ রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়, উর্বীর পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি শর্মীর ফোন ধরছিলে না কেনো?”

“মাগো!”
উর্বী আচমকা ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। সে বুঝতেই পারেনি রাওনাফ এখানে এসেছে। বুকে থুথুরি দিয়ে সে রাওনাফকে বলে,”আপনি এখানে এসেছেন কেনো?”

রাওনাফ হতভম্ব হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে উর্বী ভয় পেয়ে যাবে সে বোঝেনি। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,”এখানে কোথাও তো লেখা নেই আমি আসতে পারবো না ! তাই চলে এসেছি!”

_পুরুষ মানুষের রান্নাঘরে ঢোকা আমার একেবারে পছন্দ না। আপনি রুমে গিয়ে বসে থাকুন। আমি আসছি।

রাওনাফ উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা কি করছো?”

_ভাত ভাজি করছি।

_সেটা আবার কি?

_ফ্রাইড রাইসের বাংলা ভার্সন ! ছোটবেলায় মা ঝটপট করে বানিয়ে দিতো স্কুলে যাওয়ার আগে।

_ওও আচ্ছা। ইন্টারেস্টিং। খেয়ে দেখতে হয় তবে। আচ্ছা তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না, শর্মীর ফোন ধোরছো না কেনো?

উর্বী হাতের কাজ থামিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
_আপনাকে তো মেসেজে বললাম। আমি একটু স্পেস চাই। সবাই যেনো আমাকে ফোন না দেয়। তাহলে আমি কারো ফোন কেনো ধরবো?

রাওনাফের দৃষ্টি উর্বীর নিচু করে রাখা মাথার চুলের সিঁথিতে নিবদ্ধ। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,

_তাহলে আমীরুনকে বারেবারে ফোন দিয়ে শর্মী কি করছে, স্কুলে টিফিন ঠিকঠাক মতো নেয় কিনা, মা ওষুধ খায় কিনা, আমি হসপিটাল থেকে ফিরেছি কিনা, অন্তরার শরীর খারাপ করে কিনা, নাবিল-শায়মীর রেজাল্ট কবে দেবে এসব কেনো জানতে চাও? তখন স্পেস নিতে অসুবিধা হয়না তোমার মৃদুলা উর্বী?

উর্বী ধাক্কার মতো খায়। চ’ম’কে উঠে মাথা তুলে তাকিয়ে হাত থেকে ছু’ড়ি ফেলে দেয়। আমীরুন সব বলে দিয়েছে ! কি অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার। উর্বীর চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুহুর্তেই। এমনটা উর্বীর অপ্রত্যাশিত ছিলো! আমীরুনের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে উর্বীর।

উর্বী ঘামতে থাকে। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে,তার মুখ ভাবলেশহীন! উর্বী তোতলাতে তোতলাতে বলে,”এমনিই। আমার আর পাঁচ মিনিট লাগবে। আপনি কি এই রান্নাঘরে বসে খাবেন? নাকি রুমে যাবেন?”

_যাচ্ছি।
অস্ফুট স্বরে বলে রাওনাফ চলে যায়। উর্বী ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

***
রাওনাফ খাচ্ছে। উর্বী রাওনাফের সামনে বসে ছিলো। মোমবাতির টিমটিমে আলোয় তাকে কিছুক্ষণ দেখে উর্বী উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফের ভেজা কাপড় গুলো মেলে দিতে হবে । তাই সে বেলকোনিতে চলে যায়। কাপড় গুলো মেলে দিয়ে নিজের এহেন কান্ডে সে যারপরনাই অবাক হয়! এমন কাজ সে কখনোই করেনি। আজ করলো কেন! কেন একজন স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার মতো এই সহজাত আচরণ টা করে ফেললো অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে! কোনো সংকোচ ছাড়াই!
কাপড় মেলে দিয়ে উর্বী ধীরপায়ে রাওনাফের দিকে এগিয়ে আসে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চম’কাচ্ছে।

রাওনাফ চামচ দিয়ে খাচ্ছে। খেতে খেতে বলে,”আসলেই বেশ ভালো খেতে এটা।”

_তেমন ভালো নয় তবে আপনার পেটে খিদে ছিলো তাই বেশি ভালো লাগছে।
উর্বী নিচুস্বরে বলে। মানুষটাকে খেতে দেখতে তার ভালো লাগছে খুব। আরো ভালো কিছু খাওয়াতে না পেরে একটা সূক্ষ্ম অ’প’রা’ধবোধ হচ্ছে মনে, কিন্তু সময় যে খুবই অল্প। তাই ঝটপট করে যা পেরেছে করেছে।

খাওয়া শেষ করে রাওনাফ তার হাত থেকে ঘড়িটা খুলে রেখে দেয়।
উর্বী বলে,”এবার বলুন, এখানে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে এসেছিলেন আপনি হাসপাতাল,ডাক্তারি রেখে?”

হঠাৎ ধপপ করে আওয়াজ হয়। শব্দটা বাইরের আঙিনা থেকে এসেছে। রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। উর্বী বলে,”বাড়ির কয়েকটা ঘরের রেনোভেশনের কাজ চলছে। বাইরের স্টোর ঘরে ভাইয়া কিছু সিমেন্টের বস্তা রাখিয়েছিলেন,সেখানের টিনের আলগা ছাউনি সম্ভবত খুলে পরে গিয়েছে ঝড়ো বাতাসে। আমি যাই, ঠিক করে দিয়ে আসি নয়তো বস্তাগুলো সব ভিজে যাবে।”

“কিন্তু তুমি ভিজে যাবে যে….”
রাওনাফের কথা শেষ হবার আগেই উর্বী হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। রাওনাফ উর্বীর যাওয়া দেখে বিছানার একপাশে চুপচাপ বসে থাকে।

টিনের ছাউনি তুলে ধরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে উর্বী। ঠিক যায়গা মতো সেট করতে পারছে না। কিন্তু বৃষ্টি তাকে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিয়েছে। পায়ের কাছে স্তুপ করে রাখা বালি ভিজে যা তা অবস্থা। সবকিছুই রেনোভেশনের জন্য কিনে রেখেছিলো রেজাউল কবির। ঘন ঘন বিদ্যুত চম’কাচ্ছে।‌ উর্বীর এবার বেশ ভয় ভয় করছে!
বৃষ্টির পানি অসম্ভব ঠান্ডা, এখন বোঝা যাচ্ছে কেন রাওনাফ ওভাবে ঠকঠক করে কাঁপছিল।

ছাউনি ঠিক করে দেওয়ার আগেই খুব নিকটে বিকট আওয়াজে পরপর দু’টো বাজ পরে।

রাওনাফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। দ্রুতপায়ে হেঁটে সদর দরজা পেরিয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করে আঙিনায় চলে যায় স্টোর ঘরের কাছে। উর্বী আ’ত’ঙ্কি’ত মুখে কান চে’পে ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছিলো। কয়েক মুহূর্ত আগে তার শরীর থেকে প্রানটা বেরিয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। রাওনাফ বৃষ্টি গায়ে মাখিয়ে এগিয়ে যায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”আর ইউ ওকে!”

উর্বী নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,”ঠিক আছি।‌ আপনি এলেন কেনো। ভিজে গেলেন যে!”

কথাটা বলে উর্বী পুনরায় টিনের ছাউনি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে, রাওনাফ পেছন থেকে বলে,”মে আই হেল্প ইউ!”

_না,তার দরকার……

বাকিটা বলার আগেই ধপ করে উর্বী ছাউনিটা হাত থেকে ফেলে দেয়। ঝড়ো হাওয়া ছাউনিটাকে খানিকটা সামনে উড়িয়ে নিতেই উর্বী ধরতে গেলে পা পিছলে পরে যায়।
রাওনাফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উর্বীর চঞ্চলতা অবলোকন করছিলো। কাজটা যতটা সহজ ভাবে করা যেতো এই মেয়ে জটিল করছে!

উর্বীকে বালির স্তুপে মুখ থুবড়ে পরতে দেখে সেও ছুট লাগায় উর্বীকে টেনে তোলার জন্য। হাত বাড়িয়ে দিতেই উর্বী নির্দ্বিধায় রাওনাফের হাতে হাত রাখে। রাওনাফ টেনে তোলে। বালি-পানিতে পুরো মাখামাখি অবস্থা। উর্বীর গা গুলিয়ে উঠছে।
রাওনাফ উর্বীর দিকে এক পলক তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। ছাউনিটা তুলে এনে যায়গা মতো রেখে কয়েকটা ইট দিয়ে প্রাথমিক ভাবে চাপা দিয়ে দেয়। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি, সিমেন্ট ভর্তি বস্তাগুলো ভিজে গিয়েছে ইতিমধ্যে। তবে বাকিটা রাত আর ভিজবে না। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। অবশ্য বিদ্যুৎ চমকানো কমেছে। রাওনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এই হালকা ছাউনি টা ঠিক করে দিতে পারছিলে না এতক্ষণ ধরে?”

_আমি আপনার মতো লম্বা নই! তাই বেগ পেতে হচ্ছিল।

নিচুস্বরে জবাব দেয় উর্বী।

রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে। চলো ভেতরে। তোমাকে একটা হাসের ছানার মতো লাগছে। মনে হচ্ছে এই মাত্র কাদাপানিতে সাঁতার কেটে ডাঙায় এসেছো।”

কথাটা বলে রাওনাফ ঘুরে হাঁটতে থাকে। উর্বী লাজুক হাসি হাসে,কয়েক মুহূর্ত লজ্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে রাওনাফের পিছু পিছু যায়।

ঘরে ঢুকে উর্বী রেজাউল কবিরের আরেক সেট পাজামা পাঞ্জাবী রাওনাফকে বের করে দিয়ে নিজে ফ্রেশ হতে চলে যায়। দীর্ঘসময় নিয়ে সে গোসল করে বেরিয়ে আসে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে। কিন্তু তার মন এখনও খুঁতখুঁত করছে। মনে হচ্ছে শরীরের কোথাও না কোথাও বালিকণা থেকেই গিয়েছে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে উর্বী রাওনাফকে জায়নামাজে আবিষ্কার করে। এশার সালাত আদায় করে মোনাজাত ধরেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। তারপর চোখ সরিয়ে নেয়।

সালাত আদায় করে রাওনাফ জায়নামাজ যথাস্থানে রেখে, হাতে ফোনটা নিয়ে নেয়। ফোনটা পুরো সুইচ অফ হয়ে আছে। শর্মীকে জানানো হয়নি। এখানে এমন লোড শেডিং থাকবে কে জানতো!

উর্বী তোয়ালেটা হাত থেকে যায়গা মতো রেখে রাওনাফের দিকে ঘুরে তাকায়। গায়ে তার বেগুনী রঙের একটা সুতি শাড়ি। ভেজা চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে তার। ফরসা গাল দুটো ঠান্ডায় গোলাপী আভা ধারণ করেছে। গভীর এবং সরল ঐ বাদামী চোখের চাহনি।
রাওনাফ চোখ সরিয়ে নিয়ে চোখ নামিয়ে রাখে। উর্বী অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলে,”বলুন! কি কাজ ছিলো এই মফস্বলে? কোনো সেমিনার?”

রাওনাফ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিভু নিভু জ্বলতে থাকা মোমবাতির দিকে তাকায়, সেও অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলে,

_মা বলেছে এখান থেকে তার পুত্রবধূ কে নিয়ে কাল সকালেই ঢাকায় ফিরে যেতে। তাই এলাম।

উর্বী তাকিয়ে আছে। রাওনাফের দৃষ্টি মোমবাতির দিকে। উর্বী একদৃষ্টে তাকিয়েই থাকে রাওনাফের দিকে। সামান্য একটা বাক্য শুনে তার এমন দুর্বল লাগছে কেনো, হাত পা কাঁপছে কেনো!

নিজের অনূভুতিকে পাত্তা না দিয়ে সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,”আপনাকে তো বলেই এসেছি, কিছুদিন স্পেস চাই। তা জানা স্বত্তেও এলেন কেনো?”

রাওনাফ এবার উর্বীর দিকে তাকায়। স্বাভাবিক এবং স্পষ্টভাবে বলে,
_বলেছো স্পেস চাও, দেবো। ডি’ভোর্স চাইলেও পাবে। তবে তার জন্য ঢাকা তোমাকে ফিরতেই হবে। এভাবে হুট করে তো কিছু হয়না মৃদুলা উর্বী তাইনা? আর তাছাড়া তোমাকে না নিয়ে গেলে আমাকে মেলা ঝামেলা পোহাতে হবে,তা তো নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো এতদিনে তাই না?

উর্বী ম্লান হাসে, একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
_ওওও তার মানে, যাতে আপনাকে কোনো ঝামেলা পোহাতে না হয় সেজন্য আপনি এসেছেন নিতে আমায়?

রাওনাফ এবার সরাসরি উর্বীর চোখের দিকে তাকায়, গলার স্বর যথেষ্ট নমনীয় রেখে প্রশ্ন করে,”কেনো তুমি কি আশা করো আমার আসার পেছনে অন্য কোনো কারন থাকুক? বিশেষ কোনো,ব্যক্তিগত কোনো কারন থাকুক?

উর্বী চোখ সরিয়ে নেয়। নামিয়ে নেয় চোখ। হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে শক্ত করে।
রাওনাফ ডাকে,”মৃদুলা উর্বী!”

_বলুন।
অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে বলে উর্বী।

_এদিকে তাকাও।

উর্বী তাকায় না। রাওনাফ বলে,”এতো দোটানায় কেনো ভুগছো উর্বী? তুমি কি বুঝতে পারছো না তুমি কি চাও?”

উর্বী চুপ করেই থাকে, হঠাৎ তার চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো দুফোটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে।
রাওনাফ সেদিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে হাত বাড়িয়ে সেই পানির ফোটা সে ছোঁয়। উর্বী নড়েচড়ে ওঠে।

রাওনাফ বলে,”চোখের পানি যদি কোনো কাজে লাগতো,যেমন ধরো কোনো ওষুধ বানাতে কাজে লাগতো তাহলে তুমি এতদিনে কোটিপতি হয়ে যেতে মৃদুলা উর্বী।”

উর্বী কিছু বলে না।
রাওনাফ বলতে থাকে,”ডি’ভো’র্স চাও? দিয়ে দেবো। তাতে কাঁ’দতে হয় এভাবে প্রতিদিন? দু’জনে বসে আলোচনা করার বিষয় এটা। একা একা রাতে ফুঁপিয়ে কাঁদার বিষয় না।”

উর্বী চেঁচিয়ে ওঠে,”আপনাকে আমি বলেছি আমি ডি’ভো’র্স চাই? আমি ডিভোর্সের জন্য কাঁদি? কেনো একই কথা বারবার বলছেন।!”

_আচ্ছা আচ্ছা। রিল্যাক্স! শান্ত হও। ডি’ভোর্স চাওনা। তার মানে সংসার করতে চাও তাইতো?

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,
_কি জ্বালা। বলবে তো! হয় ডিভোর্স,নয় সংসার। যেকোনো একটা তো চাইতে হবে উর্বী!

উর্বী নিরবতা ভেঙে ফুঁপিয়ে ওঠে।

রাওনাফ মৃদু স্বরে বলে,”উর্বী। আমি বুঝতে পারছি তুমি কোথাও আটকে গিয়েছো। কোনো সমস্যা হচ্ছে তোমার। কোনো ভয়াবহ সমস্যা। যা থেকে তুমি ছাড়া পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছো। যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে হলে অবশ্যই কারো সাহায্য দরকার হয়। আমি কি তোমার সেই উপকারী বন্ধুটি হতে পারি? যার সাথে যেকোনো সমস্যা মন খুলে বলা যায়? সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে আমি নিয়মিত কথা বলি উর্বী। তুমি নিজে না চাইলে এই সমস্যা থেকে বের হতেই পারবে না।”

রাওনাফ ক্রন্দনরত উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে কথা গুলো বলে।

উর্বী কান্না থামিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। তারপর ধরা গলায় বলে,”আমি যদি বলি আমি আপনার সাথে সংসার করতে চাই। ওই বাড়িতে ফিরতে চাই তাহলে আপনি কি করবেন?”

_আমি তোমায় কাল সকালেই নিয়ে যাবো।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় রাওনাফ।

_আর যদি আপনি জানতে পারেন আপনি যাকে নিজে হাতে ধরে আপনার সংসারের ঘরনী করে নিয়ে গেছেন সে একটা অতি ফালতু,দুশ্চরিত্রা, ন’ষ্টা মেয়ে মানুষ তাহলে আপনি সেদিন কি করবেন?

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে কথাটি শুনে। উর্বী বলে ওঠে,

“কি হলো! চুপ হয়ে গেলেন কেনো! বলুন কি করবেন? তখনো কি নিজের জীবনের সাথে আপনি আমাকে জড়াতে চাইবেন? বলুন?”

রাওনাফ ম্লান হাসে, ঠান্ডা গলায় বলে,”আমার মনে হয় আজ থেকে পাঁচ মাস ১৩ দিন আগেই আমি একজন অতি ফালতু,ন’ষ্টা,দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে নিজের জীবন অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে জরিয়ে ফেলেছি, দ্বিতীয়বার আবার কিভাবে জড়াবো?”

উর্বী তাচ্ছিল্যর হাসি হাসে,”মজা ভাবছেন আপনি তাই না? আপনি যদি আমার অতীত জানতে পারেন তাহলে ভুলেও চাইবেন না আমায়। শুধুই ঘৃনা করবেন আমায়। থুতু ফেলবেন আমার নামে।”

রাওনাফ দীর্ঘসময় উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে ওঠে,
_আচ্ছা বলো তো তোমার অতীত। কখনো কাউকে ঘৃণা করিনি। এই ঘৃণার টেস্ট কি রকমের? স্বাদ নিতে চাচ্ছি আমি!

বলতে বলতে রাওনাফ বিছানায় দুহাত মাথার পেছনে দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে পরে। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
_ওও আরেকটা কথা। আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দাও প্লিজ। এটা তো ফুরিয়ে গেলো। অন্ধকারে তোমার অতীত শুনতে ভালো লাগবে না।

উর্বী কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখছে সে তার সামনে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে থাকা পুরুষটিকে।

চলমান……

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২১
#Esrat_Ety

হু হু করে বাতাস বইছে বাইরে। অসময়ের বৃষ্টি বেশ গুছিয়েই তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিতে।
উর্বী একটা মোমবাতি জালিয়ে রাওনাফের কাছে, বিছানার পাশের টেবিলে রেখে দেয়। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে।
মোমবাতির আলোয় কাছে থেকে উর্বীর ফরসা গোল মুখটা সোনালী বর্ণের দেখাচ্ছে।

রাওনাফ একটা বালিশ টেনে নেয় নিজের হাতের নিচে, বেশ গুছিয়ে বসে আছে সে, তাকিয়ে আছে উর্বীর চোখের দিকে।

উর্বী রাওনাফের থেকে একটু দূরেই, মুখোমুখি হয়ে বসে।
তাকে অনেকটা শান্ত লাগছে। চোখ মুখ স্বাভাবিক। বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে।
উর্বী নীরাবতা ভেঙে বলা শুরু করে, “বিয়ের আগে আমার একজনের সাথে সম্পর্ক ছিলো। বহু বছরের সম্পর্ক। আমার কলেজ জীবনের শুরু থেকে। সিনিয়র ছিলো সে আমার। অপজিশন পার্টির একজন ফরমার মিনিস্টারের ছেলে। এজন্য তার অনেক ঠাট বাট ছিলো শহরে।
প্রনয় অত্যন্ত গভীর ছিলো। সময় যতো যেতে থাকলো, সম্পর্ক যতো পুরনো হতে থাকলো আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম সে একটু অস্বাভাবিক। আমাকে নিয়ে অতিরিক্ত ছিলো সবকিছু তার। প্রথম প্রথম বিষয়টা প্রেমিকের পাগলামি ভেবে মানিয়ে নিতাম, কিন্তু ধীরে ধীরে সবকিছু অতিরিক্ত হয়ে উঠলো। সে স্বভাবে ছিলো বদরাগী,জেদী। এতটুকুই দোষ চোখে পরেছিলো শুরুতে। মানিয়ে নিয়েই অনুভূতি দেওয়া নেওয়া করেছি। কিন্তু একটা সময় আবিষ্কার করলাম মানুষটা খুবই ত্রুটিপূর্ণ। বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলের যত বদ গুণ থাকতে পারে প্রায় সবগুলো গুণই তার মধ্যে ছিলো। গুন্ডামি, নেশা করা, মারামারি। সবকিছুই করতো সে।

আমি সব মেনে নিয়েছিলাম। ভাবতাম সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, দিন দিন সে আরো উচ্ছন্নে যেতে থাকে। তার সাথে বাড়তে থাকে আমার প্রতি তার মানসিক অত্যাচার। প্রচুর পাগলামি করতো আমায় নিয়ে, ভালোবাসার নামে গলার কাটা হয়ে বিঁধে যাচ্ছিলো সে। যাকে উপড়ানোর ক্ষমতা আমার ছিলো না। না ছিলো মানিয়ে নেওয়ার।

ভাইয়া সব জানতে পেরে আমার ওপর ভীষণ ক্ষে’পে গেলেন। ভাইয়া ওকে শুরু থেকেই জানতো, ওর স্বভাব সম্পর্কে সবাই জানতো শুধু আমি অন্ধ ছিলাম। নিজের জীবনে অমানিশা নামিয়ে আনবার জন্যই আমি অন্ধ ছিলাম। একদিকে ওকে শোধরাতে পারিনি,অন্যদিকে ভাইয়া আমার জন্য ছেলে দেখতে লাগলেন।

একটা সময় আমি পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়লাম ওর মানসিক টর্চার নিতে না পেরে। আমার স্বাধীনতা একেবারে কব্জা করে নিয়ে বসেছিলো।

তারপর অনেক ভেবে ওর সাথে বিচ্ছেদ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। স্নিগ্ধ একটা শুরু থেকে তিক্ত একটা বিচ্ছেদ। অনেকটা মানসিক শক্তি যোগার করে সিদ্ধান্তটা নিলাম। ওকে বললাম , ভালো করে বুঝিয়ে বললাম আমি এই সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছি না। ও খুবই ঠাণ্ডা মাথায় শুনলো। আমাকে বললো আমার সাথে দেখা করতে চায়। একটা সুযোগ চায় আলোচনা করার।

এবং…..”

এই পর্যন্ত এসে উর্বীর গলা কাঁপতে শুরু করে।

রাওনাফ উর্বীর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। সে দেখছে উর্বী কান্না আটকে রাখার কঠিন প্রচেষ্টা করছে।

উর্বী একটা নিঃশ্বাস নিয়ে কান্নাটা দমিয়ে ফেলে,তারপর বলতে শুরু করে,”সে তো আমাকে ছাড়বে না। ভালোবাসা নামে জেদ ছিলাম তো আমি তার। যখন দেখলো কিছুতেই কিছু হবে না, আমি বিচ্ছেদ ঘটাবোই,তারপর সে আমাকে আঁটকে রাখার একটা অভিনব উপায় বের করলো। হি টাচড্ মি উইদাউট মাই কনসেন্ট!”

উর্বী তুমুল প্রচেষ্টা করছে না কাঁদার। থেমে থেমে বলতে থাকে,”শত পাগলামি করলেও কখনো আমার গাঁয়ে হাত না দেওয়া ছেলেটা আমাকে আটকে রাখতে তার নিকৃষ্ট রুপটা দেখালো। তার মনে হয়েছিল,মন না আটকাতে পারলে কি হবে! শরীর আটকে দেবো!
এ্যান্ড হি রেইপড মি!”

উর্বী ফুঁপিয়ে ওঠে। রাওনাফ একই ভাবে দেখছে উর্বীকে। উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়। চোখের পানি গড়িয়ে পরতেই বলতে থাকে,”এবং সে আমাকে বললো,”এখন কিভাবে আমাকে ছাড়িস আমি দেখবো!”
চার বছরের ভালোবাসা হিংস্রতা হয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে বলেছিলো এই কথাটা জানেন।”

বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেও যখন পারলো না তখন হাল ছেড়ে দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ করতে থাকে কিছুক্ষণ। অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে বলতে থাকে,”তারপর আমাকে বললো, তৈরি থাকতে। বিয়ে করবে আমাকে। কিন্তু আমি তো একজন রে’পিস্টকে বিয়ে করবো না। সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম।

মানসিক ভাবে ভেঙে পরলেও কাউকে কিছু বুঝতে দিইনি বাড়ির। ভাইয়া আমার জন্য ছেলে দেখতে লাগলেন। দিন যায়, ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম আমি সন্তানসম্ভবা।”

উর্বী থামে। হাপাচ্ছে সে। মাথা নিচু করে রেখেছে সে এখন। কাঁদছে না, কিন্তু কথাগুলো বলছে খুবই কষ্টে। কন্ঠনালী থেকে যেনো বেরোতে চাইছে না।
রাওনাফ ঐ মুখটার দিকে কোনো এক অজানা কারনে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ সরিয়ে উর্বীর হাতের দিকে তাকায়, হাত দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে রেখেছে উর্বী।

“পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিলো যেন। কি করবো! কি হবে! কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তারপর নিজের মনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাধ্য হয়ে, নিরুপায় হয়ে ঐ হীন মানুষটার কাছে বলতে গিয়েছিলাম “আমাকে বিয়ে করো।”

কিন্তু নিয়তি আমার সাথে এখানেও তামাশা করলো। খবর পেলাম তাকে পুলিশ এ্যারেস্ট করেছে। তার নামে জোরা খুন মামলা সহ মোট তিনটা চার্জ লাগানো হয়েছে।

আমি অসহায়ের মতো তরপাতে থাকি।
হাজতে গিয়েছিলাম তার সাথে দেখা করতে। দেখা করতে পারি নি।

বাড়িতে যখন জানালাম আমার কথা। মা ঘে’ন্নায় সু’ই’সাইড করতে গেলো। ভাইয়া নিশ্চুপ হয়ে রইলো। গোটা পৃথিবী আমার কাছে মিথ্যে মনে হতে লাগলো। জানেন সবসময়ই আমার ইচ্ছে করতো আমি ম’রে যাই, কিন্তু আমার অত সাহস নেই। আমি ভীতু। আমি ম’রতে ভীষণ ভ’য় পাই।

খবর পেলাম তাকে কেরানীগঞ্জ শিফট করেছে। সাথে দশ বছরের জেল। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হলো আমার কিছু আত্মীয় স্বজন, জীবনটা আমার ন’রক করে ফেলেছিলো। কোনোভাবে আমার প্রেগ’ন্যা’ন্সির খবরটা ছড়িয়ে গেলো। বাড়ির কেউ কোথাও বেরোতে পারতো না।
তখন আমি ঠান্ডা মাথায় পৃথিবীর সবথেকে নি’কৃষ্ট কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এ্যা’বর্শন করে ফেললাম। মে’রে দিলাম আমি।”

শেষের বাক্যটা বলে উর্বী কান্নায় ভেঙে পড়ে। শরীর কাঁপিয়ে কাঁদছে সে। বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে অদ্ভুত শোনাচ্ছে সে কান্না।

রাওনাফ ফ্যালফ্যাল করে দেখছে উর্বীকে। একবার ভাবলো সে বলবে,”বুঝেছি পুরোটা। আর বলতে হবে না!”
কিন্তু সে বললো না।
উর্বী হু হু করে কাঁদছে। মোমবাতির আলোয় তার সে চোখের পানি চিকচিক করছে।

কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”জানেন। আমি না চাইনি আমার এই নষ্ট জীবনটা কোনো ভালো, নিষ্পাপ জীবনের সাথে জ’ড়াতে। একেবারেই চাইনি। একা একা বেশ চলে যেতো জীবনটা। আমি শুরু থেকেই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু বাড়ির মানুষগুলো ! তারা আর মানলো কই। তার ওপর উপমার বয়স বেড়ে যাচ্ছিলো! পাত্রপক্ষের কাছে উপমার চরিত্রের চাইতে আমার বিয়ে নিয়ে বেশি মাথাব্যথা ছিলো। উপমার সব গুণ ছাপিয়ে যেতে থাকলো আমার কলঙ্কের দোষে। জেদ করে ঠেলতে ঠেলতে ত্রিশের কোঠায় এনেছিলাম ধূসর রঙের এই জীবনটাকে। আর পারিনি। ভাবলাম আবার একটু নিজের জীবনটাকে নিয়ে খেলে দেখি।

যখন সামিউলের সাথে বিয়ের দিন বিয়েটা ভেঙ্গে যায়। আমি তখন খুব হেসেছি। এটা ভেবে যে,কারো জীবন নষ্ট হবে না। কিন্তু দেখুন, শেষমেষ আপনি জরিয়ে গেলেন।”

উর্বী থেমে যায়, তার গাল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পরছে,ধীর গতিতে, ‌যেনো তার কান্নাগুলোও এখন ক্লান্ত। সে একহাত দিয়ে বিছানার চাদর খামছে ধরে বসে আছে।

খানিক বাদে আবারও বলতে শুরু করে,” এই পাঁচ মাসে বিয়েটা আপনার কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত, চাপিয়ে দেওয়াই রয়ে গিয়েছে কি না জানি না। তবে আমার কাছে না থাকেনি জানেন? জানিনা কি অদৃশ্য শক্তি রয়েছে ঐ একটা কাগজের। যে কিনা মানুষের অনূভুতি প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। রোজ আপনি এলে আপনাকে এক কাপ কফি এগিয়ে দেওয়া, আমি ঘুমিয়ে থাকলে আমার গায়ে আপনার চাদর টেনে দেওয়া,প্রতিদিন সময় করে আমীরুনকে দিয়ে আমার জন্য একগ্লাস দুধ পাঠানোর নিয়ম, কিংবা আপনার বাচ্চাদের জন্য আগ বাড়িয়ে আমার কনসার্ন দেখানো। এগুলো আমার কাছে,আমার চোখে শুধুমাত্র দায়বদ্ধতা হয়েই থাকেনি। অন্যকিছু হয়ে গিয়েছে।

বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আপনার সাথে কাটানো আমার সব মুহুর্ত আমার কাছে বিশুদ্ধ স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমি খুব শান্তি পেয়েছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। স্বামী স্ত্রী না হতে পারলেও আমি এটা ভেবে শান্তি পাবো যে আমি একজন অতি ভালো লোকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। যার যোগ্য আমি না।

ওই বাড়িটা আমায় খুব শান্তি দিয়েছে,ওবাড়ির প্রতিটা ইট আমায় খুব শান্তি দিয়েছে। আমি চির কৃতজ্ঞ।

উর্বী মুখে আঁচল গুজে কাঁদছে। রাওনাফ এক মনে উর্বীকে কাঁদতে দেখছে। তার কোনো ভাবান্তর নেই।

পুনরায় দম নিয়ে উর্বী বলে, “আপনি কাল চলে যান,দয়া করে চলে যান। মায়ের সাথে ফোনে আমি কথা বলে নেবো। করবে না বকাবকি আপনাকে। আপনি ভাবতেও পারবেন না আমার কতটা শান্তি লাগছে এখন আপনাকে সবটা বলে। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ এখানে আসার জন্য।”

এবার হাঁটুতে মাথা রেখে উর্বী কাঁদতে থাকে। কেঁদে কেঁদেই বলে,”আমি ওবাড়ির প্রত্যেকটা লোককে মিস করবো।‌ আপনাকে সবথেকে বেশি মিস করবো ডক্টর খান।”

উর্বীর খুবই দুর্বল লাগছে এখন, শরীর ভেঙে আসছে, সে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার এতো খারাপ লাগছে কেনো। সে কি মরে যাচ্ছে!

রাওনাফ উর্বীর অদ্ভুত সেসব আচরন দেখতে থাকে। গলাকাটা মুরগির মতো তড়পাচ্ছে।

“ধীরে ধীরে কিভাবে কিভাবে যেনো আমি আপনার মায়ায় পরে যাচ্ছিলাম। মনের ভীতর একটা সুপ্ত বাসনা জেগে উঠলো আপনার সাথে সংসার করার। কিন্তু তা আর হলো না, আমি এসব থেকে কখনোই বের হতেই পারবো না,বরং আপনার জীবনটা ও নোংরা করে দেবো।”

একটু থেমে উর্বী আবারও বলে ওঠে,”সবার মতো আপনিও প্লিজ এখন আমাকে এই প্রশ্ন করবেন না যে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ছিলো,আমি কোন সাহসে,কোন ভরসাতে একটা পুরুষের কাছে গিয়েছিলাম বোকার মতো। না গেলে তো এত বড় সর্বনাশ হতোই না আমার। করবেন না এমন প্রশ্ন। এর ব্যখ্যা তেইশের উর্বী দিতে পারেনি,ত্রিশের উর্বীও দিতে পারবে না। আমি শুধু জানি আমার সর্বনাশ হয়েছে। এটুকুই জানি।”

উর্বী থেমে যায়, তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রাওনাফ এবার উঠে আসে।

“উর্বী কি হয়েছে? তোমার কি হয়েছে?”

উর্বী তার জবাব দেয়না, বিড়বিড় করে বলতে থাকে,”আপনি চলে যান, এখান থেকে প্লিজ চলে যান। আমি আর দুর্বল হতে চাই না।”

“আচ্ছা সেটা দেখা যাবে। তুমি ওঠো। ঠিক হয়ে শুয়ে পরো। এখন ঘুমাও।”

উর্বী ওঠে না। কাঁদছে।
রাওনাফ উর্বীর হাত ধরে তাকে উঠানোর জন্য। উর্বী রাওনাফের হাত সরিয়ে দেয়,”আমাকে ধরবেন না দয়া করে। আপনার হাত নোংরা হবে।”
রাওনাফ উর্বীকে বলে,”আচ্ছা ধরবো না। শান্ত হও।”

উর্বী শান্ত হয়না। কাঁদতে থাকে। উন্মাদের মতো কাঁদতে থাকে বিছানার চাদর খামচে ধরে। রাওনাফ তাকে দেখতে থাকে অপলক।

দীর্ঘসময় পরে চুপচাপ হয়ে যায় উর্বী। সে না চাইতেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই হিং’স্রতার দৃশ্যটি। উর্বী ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। সে মনে করতে চায়না। দেখতেই চায়না সেই দৃশ্যটা আবারও। কিন্তু সে দেখে ফেলে।

“উচ্ছাস চুপচাপ পায়ের ওপর পা তুলে ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি উর্বীর মুখের দিকে। উচ্ছাসের চোখ দেখে উর্বী আজ কিছুই পড়তে পারছে না। শীতল দৃষ্টি। ঐ দু’চোখে না আছে রাগ,না আছে অন্যকোনো অনুভূতি। কেমন শান্ত হয়ে বসে আছে। অথচ যে উচ্ছাসকে উর্বী চেনে,এতক্ষণে সবকিছু ভাঙচুর করে ফেলার কথা।

উর্বী মাথা নিচু করে বলে,”সম্ভব না আর সম্পর্ক কনটিনিউ করা। তুমি তো কখনও শোধরাবে না। তারচেয়ে তুমি তোমার মতো থাকো। আমি মুক্তি চাই।”

উচ্ছাস ম্লান হাসে উর্বীর কথা শুনে, নীরবতা ভেঙে বলে,”মুক্তি চাও?”

_হ্যা। ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করো।

_কিন্তু উচ্ছাস তো ভুলের শা’স্তি দেয়! ক্ষমা নয়।

উর্বী মাথা তুলে তাকায়। উচ্ছাস বলতে থাকে,”আমাকে ভালোবেসেই ভুল করেছো। মাফ করেছি । আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েও ভুল করেছো। মাফ করেছি। তবে এখন যেটা করতে চাইছো,মানে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বললে। এজন্য তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে! কোনো মাফ হবে না।”

উর্বী অবাক চোখে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। উচ্ছাস উঠে দাঁড়ায়। দরজা বন্ধ করে উর্বীর দিকে তাকায়, তার চোখ মুখ ভাবলেশহীন। উর্বী তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে,কাঁপা গলায় বলে,”দরজা আটকালে কেনো!”

উচ্ছাস কোনো কথার জবাব না দিয়ে উর্বীর সামনে এসে দাঁড়ায়। এক টানে উর্বীর ওড়না ফেলে দিয়ে উর্বীকে ধাক্কা দিয়ে ডিভানে ফেলে দেয়। হতভম্ব,আহত, শংকিত উর্বী নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই উচ্ছাস এসে উর্বীকে চেপে ধরে ডিভানের সাথে। উর্বীর গলা থেকে আর্তনাদের মতো আওয়াজ বের হওয়ার আগেই উচ্ছাস তার মুখ চেপে ধরে। উর্বী কাঁদছে। উচ্ছাস দীর্ঘসময় উর্বীর সে কান্না দেখতে থাকে, তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে না পাখি, আমার সহ্য হয়না।”

উর্বী তড়পাতে থাকে। শরীরটা ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে যেতে শুরু করে। উর্বীর মনে হচ্ছিলো উর্বী মরে যাচ্ছে,তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।”

আর কিছু কল্পনা করতে পারে না উর্বী। শুধু নিশ্চুপ কেঁদে যায়। রাওনাফকেও সে কিছু বলে না আর ।

কাঁদতে কাঁদতে একসময় উর্বী ঘুমিয়ে পরে। চোখের পানি গালে শুকিয়ে লেপ্টে আছে। মোমবাতি ফুরিয়ে যাচ্ছে। মোমবাতির সে ক্ষীণ আলোয় উর্বীর মুখটা চিনামাটির একটি বিবর্ণ পুতুলের মতো লাগছে।

রাওনাফ উঠে উর্বীর গায়ে চাদর টেনে দিয়ে আরেকটা মোমবাতি জ্বেলে নেয়। তারপর চুপচাপ জেগে বসে থাকে যতক্ষন ঐ মোমবাতিটা আলো দিচ্ছিলো ততক্ষন। কাছের মসজিদে ফজরের আযান দিয়ে দেয়।
উঠে ওযু করে সালাত আদায় করে সেও বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেয়, পরপর রাওনাফের চোখ দুটোও লেগে যায়।

সদর দরজার বাইরে থেকে রেজাউল কবির আর তহুরা দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। নুরুন্নাহারের বাড়ি থেকে শুধুমাত্র সে, তহুরা আর লুৎফুন্নাহার ফিরে এসেছে সকাল সকাল। বাকিরা বিকেলে আসবে। কিন্তু উর্বী দরজা খুলছে না দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পরে রেজাউল। তহুরার দিকে তাকিয়ে বলে,”জ্ঞান হারিয়ে ফেললো নাকি আবার! পেছনের দরজা বাইরে থেকে লক করা ছিলো না? যাও গিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে দাও।”

তহুরা মাথা নাড়িয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বাড়ির পেছনের দরজার কাছে চলে যায়।

রাওনাফের ঘুম ভাঙ্গে রেজাউলের গলা পেয়ে। তহুরা অনবরত উর্বীর রুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে।

“এই উর্বী। দরজা খোল। বেলা এগারোটা বেজে গেছে। এতবেলা অবধি ঘুমাচ্ছিস কেনো! এই উর্বী।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। নিজে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।

লুৎফুন্নাহার চমকে ওঠেন তাঁর মেয়ে জামাইকে দেখে।

তহুরা আর রেজাউল একে অপরের দিকে তাকায়।

রাওনাফ তাদের তাকিয়ে থাকার ধরন দেখে বিব্রত বোধ করতে থাকে,কয়েকমুহুর্ত পরে হাসি দিয়ে তাদের সালাম দেয়,”আসসালামুয়ালাইকুম। আপনারা ভালো আছেন?”

লুৎফুন্নাহার প্রচন্ড খুশি হয়ে যান। তার মেয়ে জামাই মেয়ের কাছে এসেছে,এটা তার কাছে অনেক আনন্দের একটি ব্যাপার।

উর্বী তখনো ঘুমাচ্ছে।

***
হাসাহাসির শব্দে উর্বীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। বসার ঘর থেকে আসছে। রেজাউল কবিরের গলা। ভাইয়া কার সাথে হাসছে?

উর্বী উঠে বসতে যেয়ে টের পায় তার মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। কাদলেই তার এমন হয়। অসহ্য যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম,তবু সে মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়ায়। রাওনাফকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। টেবিলের ওপর তার ফোন,ওয়ালেট আর ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মানে সে চলে যায়নি।

উর্বী ধীরপায়ে হেটে বসার ঘরে যায়। রাওনাফ তার ভাইয়ার সাথে হেসে হেসে গল্প করছে। উর্বী অবাক হয়ে যায়। রাওনাফকে সে এভাবে কথা বলতে কখনোই দেখেনি। আড্ডা বেশ জমে গেছে মনে হচ্ছে।
উর্বীকে দেখে তার ভাইয়া বলে,”তুই উঠেছিস। যা হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে যা। দেখ তোর ভাবীর নাস্তা বানানো হয়েছে কি না।”

উর্বী রাওনাফের দিকে চায়। রাওনাফ তার দিকে তাকায় না,সে মাথা নিচু করে চায়ের কাপে চুমুক দেয়।

রান্নাঘরে তহুরা পরোটা বেলছে , চুলোয় বসিয়েছে মুরগী ভুনা। লুৎফুন্নাহার পিঠা বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ তাকে খুবই আনন্দিত দেখাচ্ছে। তার মেয়ে জামাই এসেছে। এর থেকে আনন্দের বিষয় তার কাছে আর কি হতে পারে !

উর্বী গিয়ে তহুরার পাশে দাঁড়ায় ‌। তহুরা মাথা ঘুরিয়ে উর্বীকে দেখে বলে,”মাংসটা একটু নেড়ে দে তো,তলায় লেগে যাবে।”

উর্বী মাংস নেড়ে তার দিকে তাকায়। বলে,
“কি ব্যাপার! খুশি চোখ মুখ থেকে ফেটে পরছে যে!”

_পরবে না? তুই কি বুঝবি!

উর্বী শুকনো হাসি হাসে।
লুৎফুন্নাহার বলে,”আমি তো ভেবেছিলাম জামাইটা গোমরা মুখো পেয়েছি। কথাই বলতে জানে না। কিন্তু আমার ধারনা ভুল। কি সুন্দর গল্প করছে রেজাউলের সাথে! মন ভরে যায় দেখে। ”

উর্বী তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে,তার মা খুশিতে বাচ্চা বাচ্চা গলায় কথা বলছে।
লুৎফুন্নাহার বলতে থাকে,”কতটা বিনয়ী, সভ্য শান্ত। এতো সম্মান করে আমাদের,ভাবা যায় ! তোর উচ্ছাসের মতো বেয়াদব আর উশৃঙ্খল নয়,এর পায়ের নখের যোগ্যও নয় ওই কু’লাঙ্গার।”

উর্বী তার মায়ের দিকে তাকায়। লুৎফুন্নাহার নিজের জিভ কাটে। মুখ ফসকে এসব কেনো বলতে গেলো মেয়েকে!

সে দ্রুত প্রসঙ্গ পালটে বলে,”জামাই রাতে কটায় এসেছে রে?”
_সারে দশটা নাগাদ ‌।

_কি দিয়েছিলি খেতে?

_ডিম দিয়ে ভাত ভেজে।

লুৎফুন্নাহার মুখ দিয়ে “ওহহহ” বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এতো বড় একজন ডাক্তার,এতো টাকা যার। সে নতুন শশুরবাড়িতে এসে বাসি ভাত ভাজা খেয়েছে! এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে।
লুৎফুন্নাহারের লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।

উর্বী মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,” বড়লোক জামাইকে ভাত ভাজি খাইয়েছি দেখে লজ্জা পাচ্ছো? উনি তেমন মানুষ নয়। বাদ দাও।”

_জানি তো, জামাইটা পেয়েছি সেরা! ওবাড়ির সবাই সেরা। কপাল তোর বুঝলি। হ্যা রে! ছেলেমেয়ে তিনটা তোকে পছন্দ করে? জালায় না তো তোকে?

_নাহ,ওরাও ওদের বাবার মতো।

লুৎফুন্নাহার খুব খুশি হয়। বলে,”হ্যা। দেখেছি তো। ছোটো টা খুব মিষ্টি। ওকে আমার ভালোবাসা দিস গিয়ে। আচ্ছা ভালো কথা, আমি কি পিঠা বানিয়ে দেবো কিছু? ঝাল পিঠা? যাওয়ার সময় নিয়ে যাবি ওবাড়ির জন্য?

_কোথায় যাবো আমি?
উর্বী মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

তহুরা অবাক হয়ে তার ননদের দিকে তাকায়, বলে,”তোর বাড়িতে, আবার কোথায়?”

_আমি কোথাও যাচ্ছি না ভাবী। আর তোমার রাওনাফ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখো সে পিঠা নিয়ে যাবে কি না।

কথাটি বলে উর্বী রান্নাঘর থেকে বের হয়। তহুরা আর লুৎফুন্নাহার একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ।

***
নাস্তা সেরে রাওনাফ রুমে ঢোকে। উর্বী তার দিকে একবার তাকিয়ে বলে,”আপনার জামা কাপড় শুকিয়ে ইস্ত্রি করে দিয়েছি।”

রাওনাফ কিছু না বলে ফোনটা উর্বীর দিকে দিয়ে বলে,”মা ! কথা বলো।”

উর্বী কি করবে বুঝতে পারে না ‌। সে ফোনটা নেয়। ভিডিও কলে রওশান আরা। রওশান আরা কটমট দৃষ্টি দিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী সালাম দেয়। রওশান আরা সালামের জবাব দিয়ে বলে,
” আগের বার যে তেঁতুল নিয়ে এসেছিলে ও বাড়ি থেকে সেটা ফুরিয়ে গেছে। তোমার ছোটো জা,পোয়াতি মানুষ খেতে চাইছে খুব। নিয়ে এসো ‌। আর হ্যা শোনো, বেয়ানকে বলো শুটকি দিয়ে দিতে আমার জন্য। আর পিঠাও নিয়ে এসো। আর হ্যা, রাওনাফের আবার রাজশাহী যেতে হবে,ওর সাথে পারলে আজই ফিরে আসো। তোমার ননদেরাও এসেছে। বাপের বাড়ি বেরাতে এসে এখন কি তারা রান্না করে খাবে?”

উর্বী চুপ করে তাকিয়ে থাকে।
রওশান আরা বলে,”তোমার শর্মী খুব ক্ষেপে আছে তোমার উপরে। কিভাবে তার রাগ ভাঙাবে জানি না। এখন রাখো,আমার ছেলের যেনো কোনো অযত্ন না হয়।”

রওশান আরা ফোন কেটে দেয়। উর্বীর খুব হাসি পায় তার শাশুড়ির রাগী রাগী হওয়ার ভান দেখলে।

রাওনাফ উর্বীর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলে, ” আমরা তাহলে দুপুরে খেয়েই রওনা দেই! কি বলো!”

উর্বী অবাক হয়ে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে নিশ্চুপ।

রাওনাফ উর্বীর দিকে একটু এগিয়ে আসে।
“কিছু বোলছো না যে!

উর্বী বলে,”আপনি কিন্তু জেনে শুনে ভুল করছেন,আমি বারবার বলছি আপনাকে!”

রাওনাফ ঘুরে উর্বীর বিছানায় বসে পরে।

উর্বী বলে,”ভুল করছেন আপনি”

রাওনাফ বলতে থাকে,”সমস্যা কোথায়? কেনো নিজেকে নিচু করে দেখছো? দ্যা প্রবলেম ইজ,ইউ আর নট ভার্জিন, রাইট? সো হোয়্যাট! আমিও তো ভার্জিন নই। তিনটা বাচ্চার বাবা আমি!”

উর্বী ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে,”মজা করছেন আপনি?”

_না।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় রাওনাফ। তারপর বলে ওঠে,”শরীর কখনো নোংরা হয়না মৃদুলা উর্বী। যেটা হয় সেটা আমাদের মন আর মস্তিষ্ক। তোমার কি মনে হয়? আমি গতকাল রাতে তোমার অতীত জানবার জন্য তোমার অতীত জানতে চেয়েছি? না, আমি তোমার অতীত জানতে চেয়েছি যাতে তুমি বলতে পারো। আমার যা জানার, বোঝার, আমি আমীরুনের থেকে জেনে নিয়েছি।

উর্বী চুপ। রাওনাফ আবার বলে ওঠে,”গুছিয়ে নাও। ঐ বাড়ির কিছু মানুষ তোমাকে মিস করছে। ঐ বাড়ির ইট গুলো, যারা তোমাকে স্বস্তি দিয়েছে তারা তোমাকে মিস করছে, হয়তোবা তোমাকে ওদের প্রয়োজন।”

_আর আপনার?

উর্বী তাকিয়ে আছে রাওনাফের দিকে উত্তরের অপেক্ষায়।

রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ধীরে তবে স্পষ্ট করে বলে,”হয়তোবা আমারো তোমাকে প্রয়োজন মৃদুলা উর্বী। হয়তোবা সম্পর্ক টা কেবল কফির কাপ এগিয়ে দেওয়া,গায়ে চাদর টেনে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।”

উর্বী কিছুক্ষণ রাওনাফের মুখপানে চেয়ে থেকে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাওনাফ শুয়ে পরে। তার দু’চোখ ঘুমে জরিয়ে যাচ্ছে। কাল রাত ঘুম হয়নি তাই।

উর্বী দৌড়ে সোজা কলঘরে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে সে কাঁদতে থাকে।
পেছন থেকে তহুরা উর্বীর কাঁধে হাত রাখে।
উর্বী তাকায়।
তহুরা চিন্তিত হয়ে বলে,”কাঁদছিস কেনো?”

উর্বী নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”শুটকি বানিয়েছিলে না? দিয়ে দিও। আমার শাশুড়ি খেতে চেয়েছেন। আর ভাইয়াকে বলো গাছ থেকে লোক খাটিয়ে পাকা তেঁতুল তুলে আনতে। ছোটো জা’য়ের জন্য নেবো। আমাদের বড় মোরগটা জবাই করে রান্না করে দিও ভাবী। আমার ননদদের বাচ্চাদের জন্য নিয়ে যাবো। আর হ্যা, ভাইয়াকে বলো লোকজন দিয়ে পুকুর থেকে গলদা চিংড়ি ধরতে, তোমার রাওনাফ ভাইয়ের খুব পছন্দ শুনেছি। দুপুরে খেয়ে যাবো আমরা।”

তহুরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তহুরাকে জরিয়ে ধরে,”আমি, আমি ওনার সাথে যেতে চাই ভাবী। ভাবী আমি ওনার সাথে থাকতে চাই, সংসার করতে চাই ওনার সাথে।”
তহুরা উর্বীর মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সে মনে মনে আল্লাহকে বলে,”আল্লাহ! তুমি এই মেয়েটাকে খুব সুখী রাখো,খুব সুখী!”

চলমান….

আরেকটি বার পর্ব-১৮+১৯

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৮
#Esrat_Ety

সাব ইন্সপেক্টর রাওনাফকে বলছে, “আপনার স্ত্রীকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। একটা খু’ন হয়ে গিয়েছে। আমাদের সাথে কোঅপারেট করুন।”

রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে উর্বীকে দেখে। একটা বেঞ্চিতে তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সে পরে আছে নিস্তেজ হয়ে। লামিয়া তাকে ধরে রেখেছে। সাব ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে রাওনাফ বলে,”আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমরা অন্য রিসোর্টে শিফট হচ্ছি। আমার স্ত্রীর মানসিক অবস্থা আপনাদের বুঝতে হবে।”

_তা বুঝতে পেরেছি কিন্তু আপনার স্ত্রীর স্টেটমেন্ট না নিয়ে এই কেসে আগানো সম্ভব না। আমরা পুরো হোটেল তন্যতন্য করে খুঁজেছি কোথাও কোনো প্রাথমিক এভিডেন্স নেই। লা’শেরও কোনো প্রাথমিক পরিচয় পাওয়া যায়নি।

_আমার স্ত্রীকে আগে কিছু সময় দিন। আমার নাম্বার রাখুন, আমি নিজে আপনাদের কাছে আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাবো।

অফিসার রাওনাফের থেকে তার নাম্বার নিয়ে নেয়।

লামিয়া উর্বীকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। সবাই উর্বীর দিকে দরদ মাখা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। উর্বী গাড়িতে উঠেই চোখ বন্ধ করে থাকে। তার চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে। রাওনাফ বারবার উর্বীর দিকে তাকায়।

সবার উর্বীর জন্য খারাপ লাগছে। জাহাঙ্গীর নিচু স্বরে বলে ওঠে,”ধূরর! এই সেন্টমার্টিনে আসাটা একেবারেই উচিৎ হয়নি!”

মিতা উর্বীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”একটু পানি খাবে উর্বী?”
উর্বী কোনো কথা বলে না। আশিক বলে ওঠে,”আহা ভাবি। থাক।বেচারী আগে একটু ঠিক হয়ে নিক।”

রাত তিনটায় তারা কাছেই অন্য হোটেলে শিফট করে। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে উর্বী দেখলো উর্বীর শরীরে কোনো জোর নেই। সে দাঁড়াতে পারছে না। এক পা মাটিতে দিতেই সে মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়। সবার আগে রাওনাফ গিয়ে উর্বীকে ধরে। তারপর ধরে ধরে উর্বীকে নিয়ে হোটেলে ঢোকে।
রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে সবাই যে যার ঘরে চলে যায়।

রুমে ঢুকে রাওনাফ উর্বীকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। রুমবয় তাদের লাগেজ রুমে দিয়ে চলে যায়।
রাওনাফ দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর উর্বীর সামনে এসে বসে বলে,”খিদে পেয়েছে উর্বী? খাবার আনিয়ে দেবো?”

উর্বী কোনো কথা বলে না।
রাওনাফ বলে,”কোনো ভয় নেই। আমরা খুব শিগগিরই বাড়ি যাবো।”

উর্বী বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত। রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
_ঠিকাছে। খেতে হবে না। তুমি ঘুমোও।

রাওনাফ উর্বীর বালিশ ঠিক করে দিয়ে উর্বীকে ঘুমাতে বলে। উর্বী একইভাবে চুপচাপ বসে আছে।
এবার রাওনাফ উর্বীর মুখের দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে জড়তা কাটিয়ে উর্বীকে ধরে শুইয়ে দেয়।

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ উর্বীর গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বলে,”ভয়ের কিছুই নেই। এটা অন্য হোটেল। আমি আছি। আমি জেগেই আছি। তুমি ঘুমাও।”

কথাটি বলে রাওনাফ চলে যেতে নিলে উর্বী রাওনাফের একটা হাত ধরে ফেলে।
রাওনাফ অবাক হয়ে ঘুরে তাকায়, উর্বীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”কিছু বলবে?”

উর্বী অস্পষ্ট স্বরে বলে,”আপনি দূরে যাবেন না প্লিজ। এখানেই বসে থাকুন।”

রাওনাফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বসে পরে।
***
উর্বী চোখ মেলে দেখে রাওনাফ তার পাশেই বিছানায় বসে আছে। বসে বসে খাটে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
উর্বী নড়েচড়ে উঠতে চায়। মাথাটা অসহ্য যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।

রাওনাফ উর্বীর অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ মেলে তাকায়। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“উঠে গিয়েছো তুমি !”

উর্বী মাথায় হাত চেপে বসে থাকে।

“কি হয়েছে,মাথা ব্যাথা করছে?”
রাওনাফ উর্বীকে তাকিয়ে দেখছে।

উর্বী উত্তর না দিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। তার মুখে কথা নেই।
রাওনাফ উর্বীর হাত ছুঁয়ে ডাকে,”মৃদুলা উর্বী!”

উর্বী তাকায়।

রাওনাফ বলে,”মুখ হাত ধুয়ে নাও। আমি খাবার অর্ডার দিচ্ছি। খেয়ে মাথা ব্যাথার ঔষধ খেয়ে নেবে।”

উর্বী গাঁয়ের চাদর সরিয়ে ধীরে ধীরে খাট থেকে নামতে যায়। তার শরীরে একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই। কাল দুপুরের পর থেকে তো কিছুই মুখে দেয়নি।
রাওনাফও উঠে দাঁড়ায়। উর্বী বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পরে যায়। রাওনাফ এসে ধরে।

উর্বীর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে রাওনাফ বলে,”তোমাকে তো একেবারেই দুর্বল লাগছে! ”

_আমি ঠিক আছি ! শুধু মাথাটা চ’ক্কর দিয়েছে।
অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে উর্বী।

_এসো তোমাকে ওয়াশ রুম পর্যন্ত এগিয়ে দেই।

_লাগবে না।আমি পারবো।

_পারবে না। এসো।

রাওনাফ উর্বীকে জোর করে ওয়াশ রুম পর্যন্ত দিয়ে আসে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে সে আর রাওনাফ যেনো সাধারণ কোনো দম্পতি যাদের মধ্যে ভালোবাসার কোনো ঘাটতি নেই।

নাস্তা করে উর্বী একটু শক্তি ফিরে পায়। রাওনাফ একটা ওষুধ উর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা খাও,মাথা ব্যাথা থাকবে না !”
উর্বী ওষুধটা নিয়ে খায়।
রাওনাফ তাকিয়ে আছে। উর্বী ওষুধ খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।
রাওনাফ খাবারের প্লেট সরিয়ে উর্বীর গায়ে একটা চাদর টেনে দেয়। তারপর জানালার পর্দা টেনে দিয়ে সে রুমের বাইরে চলে যায়। উর্বী অপলক দৃষ্টিতে রাওনাফের যাওয়া দেখে ।

কিছুক্ষণ পরে রাওনাফ ফিরে আসে। তার হাতে একটা রাবিং বামের কৌটো। রুমে ঢুকে সে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয় আবার। উর্বী চোখ বন্ধ করে ছিলো,সে উর্বীর দিকে তাকিয়ে ডাকে,
“উর্বী!”

উর্বী “হু” বলে মৃদু আওয়াজ করে।

_ঘুমাচ্ছো?

_না, কিছু বলবেন?

_এটা কপালে লাগিয়ে নিলে খুব ভালো হতো। একটু উঠে লাগিয়ে নেবে কষ্ট করে?

_কি?

_রাবিং বাম।

উর্বী উঠে বসে।

রাওনাফ বলে,”উর্বী!”

_বলুন।

_আজ বিকেলে পুলিশ আসবে তোমায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। তারা বলেছে তুমি ঠিক হলে ফোন দিতে ‌তাদের।

উর্বী চুপ করে থেকে বলে, “কি বলবো?”

_যা হয়েছে,তুমি যা যা দেখেছো তাই বলবে। কোনো প্যানিক হবার কিছু নেই। তুমি একজন ভিকটিম,পুলিশের সাসপেক্ট নও।

উর্বী কপালে রাবিং বাম লাগিয়ে আবারও ওদিকে ফিরে শুয়ে পরে। দু’চোখ বন্ধ বলে,” আপনি এখুনি তাদের আসতে বলুন। আমরা বিকেলেই চলে যাবো। আমি এখানে আর থাকতে চাই না।

***
“তো এখন বলুন। গতকাল রাতে ঠিক কি হয়েছিলো।”
সাব-ইন্সপেক্টর লোকটি প্রশ্নটি করে উর্বীকে।
উর্বীর চোখ মুখ স্বাভাবিক। যেনো কিছুই হয়নি। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে।

সাব ইন্সপেক্টর আবারো জিগ্যেস করে,”কাল রাতে যে খু’ন হয়েছিলো,২০৪ নাম্বার রুমে। যেটা কিনা আপনাদের ছিলো। সেই খু’ন হওয়া ব্যক্তিকে আপনি চেনেন?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। সে চেনে না।

_কি বলছেন,আপনি চেনেননা জানেন না কিন্তু একটা লোক আপনার রুমে ঢুকে খু’ন হয়ে গেলো? এরকম কথা শুনেছেন আপনি কখনো?

রাওনাফ সাব ইন্সপেক্টরকে কে বলে,”দেখুন আপনি আমার স্ত্রীকে এভাবে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন না। আমার স্ত্রী অসুস্থ।”

উর্বী রাওনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”আমি বলছি। আমাকে বলতে দিন।”
কথাটা বলে উর্বী একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়, তারপর বলতে শুরু করে,
_কাল সন্ধ্যায় আমি পার্টি থেকে রুমে চলে যাই আমার ভীষণ মাথা ব্যথা হচ্ছিলো তাই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভাবলাম পার্টিতে ফিরবো তাই দরজা খুলতে যাই। তখন দেখি এই লোককে কোনো সন্ত্রাসী তাঁরা করছে। সে দৌড়ে আমার রুমে ঢোকে প্রান বাঁচাতে, আমার রুমের দরজা খোলা পেয়ে। তার পিছনে সেই সন্ত্রাসীও ঢুকে পরে। দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। আর দুর্ঘটনা বসত গু’লি বের হয়ে যায় পিস্তল থেকে। তারপর হত্যাকারী পালিয়ে যায়।”

উর্বী থেমে যায়। সে একনাগাড়ে কথাগুলো বললো। যেনো আগে থেকে মু’খস্থ করে রেখেছিলো।
পুলিশের লোক দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সাব ইন্সপেক্টর উর্বীকে বলে,”ব্যাস এটুকুই?”

তার মানে হত্যাকারী বা ভিক্টিম, কারো সাথেই আপনার কোনো পুর্ব সম্পর্ক নেই?
রাওনাফ রে’গে যায়।
“কিসব বলছেন আপনি। আপনি কিন্তু আমার স্ত্রীকে অ’পমান করছেন।”
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যর হাসি হাসে। তার মতো একটা তুচ্ছ মেয়ের হয়ে বারবার এই লোক ডিফেন্ড করছে। কেন !সে যদি সত্যিটা জানে তাহলে সে কি করবে?

পুলিশের লোকটা বলে,”আপনি এভাবে বারবার জিজ্ঞাসাবাদের মাঝে ঢুকে পরতে পারেন না। দেখুন এটা আমাদের কাজ,আমাদের উদ্দেশ্য আপনার স্ত্রীকে অপমান করা নয়।”
তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”আচ্ছা কাল দেখলাম আপনি খুবই বিদ্ধস্ত অবস্থায় ছিলেন। সন্ত্রাসী কি আপনার উপর এটাক করেছিলো?”
_না,ওদের ধস্তাধস্তিতে ভয় পেয়ে আমি নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে হোঁ’চট খেয়ে পরে যাই।
_আচ্ছা বুঝলাম।
সাব ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়ায়। সে কিছু বুঝতে পারছে না। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলেছে সে। এই সিজনটা বেশ আরামে কাটছিলো। কি এক উটকো ঝামেলা হাতে এলো! ম’রতে এরা এই দ্বীপে কেন আসে কে জানে!

রাওনাফের দিকে তাকিয়ে পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর বলে,”শুনুন আমরা যাচ্ছি। তবে যদি কখনও দরকার পরে তাহলে কোঅপারেট করবেন!”
রাওনাফ মাথা নেড়ে সাব ইন্সপেক্টরের দিকে তার একটা কার্ড এগিয়ে দেয়।

পুলিশের লোক গুলো চলে যেতেই সবাই নড়েচড়ে বসে। মিতা বলে ওঠে,”কেনো যে এলাম এখানে! রক্ষা করো আল্লাহ!”

উর্বী মিতার দিকে তাকায়। লামিয়া এসে উর্বীকে ধরে বসে থাকে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“সবাইকে বলুন। আমরা রওনা দেবো ঢাকায়।”

***
নাবিল ছাদে এসে দেখে উর্বী ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল ছাদে এসেছিলো একটু হাওয়া খেতে।
উর্বীকে দেখে সে দ্বিধায় পরে যায়। সে কি চলে যাবে ?

উর্বী নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিল অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। কিন্তু সে এগিয়ে আসে।

“কিছু বলবে?” উর্বী নিস্তেজ কন্ঠে বলে।

“আপনার কি শরীর খারাপ?”

_কেনো বলো তো!

_না মানে সেন্টমার্টিন থেকে আসার পর থেকে দেখছি চুপচাপ। কারো ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে মাতব্বরি করতে যাচ্ছেন না।

উর্বী মৃদু হেসে বলে,”আমি মাতব্বরি না করলেই খুশি থাকো?”

নাবিল কি বলবে ভেবে পায়না। সে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে কোনো উল্টোপাল্টা কথা না বলার। সে বেয়াদব ছেলে না।

উর্বী উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে।
নাবিল বলে,”কেউ না চাইলে তার ব্যাপারে মাতব্বরি না করাটাই তো ভালো তাইনা?”

_আচ্ছা,আর কখনো করবো না। নিশ্চিন্তে থাকো‌।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় উর্বী।

নাবিল অবাক হচ্ছে। এর আবার কি হলো !

সে বললো,
“নিচে দেখলাম পাপা আপনাকে খুঁজছে।”

উর্বী কিছু না বলেই সাথে সাথে রোবটের মতো হেটে চলে যায়।

নাবিল আরো অবাক হয়ে যায়।

****
“ছাদে গিয়েছিলে?”

“হু”
রাওনাফের প্রশ্নে জবাব দেয় উর্বী।

“মা ফোন দিয়েছে। তোমাকে ফোনে পাচ্ছে না। কথা বলে নিও। আজকাল তো মা আমার থেকে তোমার নামই বেশি জপ করে। জাদু করেছো নাকি মাকে!”
কথাটি বলে রাওনাফ নিজেই লজ্জা পায়। সে এতো হালকা মজা করছে কেনো উর্বীর সাথে!

উর্বী কোনো উত্তর না দিয়ে তার শাশুড়িকে ফোন দেয়। রওশান আরা তার ছোটো মেয়ে রুমার বাড়িতে গিয়েছে। ছোটোজামাই এসে নিয়ে গিয়েছে দুদিন হলো।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী তার শাশুড়ির সাথে কথা বলছে। তার চোখ মুখ শুকনো।

উর্বী কথা শেষ করে বলে,”আপনি ডিউটিতে যাবেন? কফি দেবো?”

_না,লাগবে না। তুমি কি অসুস্থ?

_না

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে কিছু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,”এরকম বহু দুর্ঘটনা মানুষের সাথে ঘটছে। প্রতিদিন যে ঘটতে থাকবে এমন তো কোনো কথা নেই।”

উর্বী নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাওনাফ বলে,”অফিস যাওনি কেন?”

_রেজিগনেশন লেটার দিয়ে দিয়েছি। চাকরিটা করছি না আমি।

রাওনাফ অবাক হয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,
_এনি প্রবলেম?
_না
কথাটি বলেই রাওনাফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উর্বী ঘর থেকে বেরিয়ে যায় । রাওনাফ তাকিয়ে থাকে।
উর্বী তাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে কেনো !

***
অন্তরা লিভিং রুমে হাঁটছে। সামিউল বসে তার ল্যাপটপে কাজ করছে।
উর্বীকে নিচে নামতে দেখে অন্তরা দাঁড়িয়ে পরে।
উর্বী অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলে,”সাবধানে হাটো। চারপাশ টা দেখে।”
অন্তরা হাসে। সামিউল ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে উর্বীকে দেখে।

উর্বী বলে,”কিছু খাবে? বানিয়ে দেই?”

অন্তরা মাথা নাড়ায়,”খুব হাসফাস লাগছে ভাবি ! মনে হচ্ছে দমটা বেরিয়ে যাবে।”
উর্বী অন্তরাকে দেখে। কি সুন্দর মুখশ্রীর কি হাল হয়েছে। একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে আছে।

উর্বী নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”কয় মাস হয়েছে?”
_এইতোহ চারমাস হলো।
উর্বী বলে,”তুমি ঘরে যাও। আমি ফল কেটে পাঠাচ্ছি।”

সামিউল উঠে অন্তরাকে ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠাতে থাকে।
উর্বী সে দৃশ্য দেখতে থাকে। তার মুখ ভাবলেশহীন।

শর্মী পেছন থেকে উর্বীর চোখ চেপে ধরে।

উর্বী বলে,”শর্মী !”

শর্মী হাত সরিয়ে বলে,”আন্টি তুমি বোঝো কিভাবে বলোতো!”

উর্বী নিচুস্বরে বলে,”বোকার মতো কথা বলে এই মেয়ে। এ বাড়িতে তুমি ছাড়া আমার সাথে এমন টা কে করবে? নাবিল শায়মী? নাকি আমার শাশুড়ি?”
শর্মী হাসতে হাসতে বলে,”তাই তোহ‌।”

উর্বী শর্মীকে দেখতে থাকে। এই মেয়েটার প্রতি এতো মায়া জমেছে তার। কেনো জমেছে !

***
রাওনাফ ঘরে ঢুকে দেখে ঘর অন্ধকার। উর্বী ঘুমিয়ে পরেছে। ফ্রেশ হয়ে সেও গিয়ে শুয়ে পরে। তার ঘুম আসছে না। কিছুসময় এপাশ ওপাশ করতে থাকে। একসময় সেও প্রায় ঘুমিয়ে পরে।

উর্বী ঘুমোয়নি। সে জেগে আছে। রাওনাফের জন্য চিন্তা তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। উচ্ছাস যখন বলেছে তখন সেই কাজ, কিংবা কোনো চেষ্টা সে করবেই। উর্বী জেনেশুনে রাওনাফকে বিপদে ফেলে দেবে? এই মানুষটির জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের জীবন। রাওনাফের কি দোষ? কোনো দোষ নেই। দোষ নেই এবাড়ির কারো। দোষ কি উর্বীর তবে? উর্বী তো ধারনাই করতে পারেনি উচ্ছাস এভাবে ফিরে আসতে পারে!
এখন উর্বীর কি করা উচিত! উর্বীর জন্য উপমার বিয়েটা আটকে ছিলো। এখন উপমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তার কি রাওনাফের সাথে ছাড়াছাড়ি করা উচিত রাওনাফের ভালোর জন্য! কিন্তু তার এতো খারাপ লাগছে কেনো? রাওনাফের সাথে ছাড়াছাড়ি করলে তার তো এতো কষ্ট হবার কথা না। এটা তো অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ে ছিলো!

উর্বীর দুচোখ বেয়ে পানি পরে। একসময় একটা চাপা কষ্ট তার গলা টি’পে ধরে। সে ফুঁপিয়ে ওঠে। সে কি করবে এখন? এমন একটা জালে সে জরিয়ে গিয়েছে, কার ধৈর্য্য হবে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার!

রাওনাফ চোখ খোলে। দু’জনে দুদিকে ফিরে শুয়ে আছে। উর্বী কি কাঁদছে? সে এভাবে কাঁদছে কেনো? তার কি হয়েছে !

***
“স্যার আপনার রাউন্ডের সময় এখন।”

_তুমি যাও,আমি আসছি।

নার্সের কথায় জবাব দেয় রাওনাফ। টুং টুং আওয়াজ করে হঠাৎ তার ফোনে একটি নোটিফিকেশন আসে। মেসেজটা উর্বীর থেকে এসেছে। রাওনাফ খুবই আগ্রহী হয়ে ওঠে মেসেজটি পড়ার জন্য।

এই সময়ে হঠাৎ উর্বী মেসেজ দিয়েছে কেনো। সে মেসেজটি ওপেন করে।

“আমি ও বাড়ি চলে যাচ্ছি। আই নিড সাম স্পেস। মাকে এবং শর্মীকে বোঝাবেন। ভালো থাকবেন।”

রাওনাফ একদৃষ্টে মেসেজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এসব কি! উর্বী কি মজা করছে!

রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উর্বীর নাম্বারে ফোন দিতে থাকে । উর্বী ফোন ধরে না। রাওনাফের মেজাজ বিগড়ে যায়।

স্পেস চাই মানে ! নিক স্পেস। সেটা এভাবে বলতে হবে?,মেসেজ দিয়ে? সামনাসামনি বলা যেতো না? সে কি উর্বীকে বেঁধে রাখতো? আটকে রাখতো বাড়িতে?

রাওনাফ অবাক হচ্ছে,তার এতো রা’গ হচ্ছে কেনো! উর্বী যাচ্ছে যাক,ওর জীবন। স্পেস চাইলে নেবে। তাকে বলার কি আছে! কিন্তু তাতে তার এতো রা’গ হচ্ছে কেনো !

ফোনটা রেখে রাওনাফ বসে থাকে। তার রাউন্ডে যাওয়ার কথা মনে নেই। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে।
একবার সামনাসামনি কথা বললে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো! কিভাবে এমন করে গেলো উর্বী। সে কি কিছুই না? যত যাই হোক, কাগজে কলমে স্বা’মী তো!

শর্মী লিভিং রুমে বসে ছিলো। রাওনাফকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে সে তার কাছে আসে। তার চোখ মুখ বিষন্ন।

“পাপা আন্টির সাথে তোমার কথা হয়েছে?”
_না।
রাওনাফ বলে।
_আন্টি তার বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছে। কবে ফিরবে?
রাওনাফ শান্ত ভাবে বলে,”আমি জানিনা শর্মী।”

শর্মী চুপ হয়ে যায়,রাওনাফ সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠে। এখন তার নিজের উপর নিজেরই রা’গ হচ্ছে। বারবার উর্বীর কথা মনে পরছে কেনো তার। অদ্ভুত!
সে রাওনাফের সাথে সামনাসামনি বলার প্রয়োজন মনে করেনি, বলেনি। ব্যস!

স্পেস চাইছে,স্পেস নিক। মন ভরে নিক। রাওনাফের বয়েই গিয়েছে তাকে বিরক্ত করতে। আর কখনোই কল বা মেসেজ দিবে না রাওনাফ উর্বীকে,যদি না সে দেয়।

চলমান….

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৯
#Esrat_Ety

উচ্ছাস খবর পেয়েছে উর্বী ও বাড়ি চলে গিয়েছে। এতো বড়ো একটা সুযোগ। অথচ শহরে ঢোকাই যাবে না। রাগে উচ্ছাসের মাথার দুই পাশের রগ দপদপ করছে।

সজীব আড়চোখে উচ্ছাসকে দেখছে। একটা খু’ন করে পালিয়েছে তাঁতে কোনো হেলদোল নেই! এখনও এই লোকের মাথায় ঐ মেয়েটার চিন্তা। এই অর্ধ উন্মাদের সাথে থাকতে থাকতে একদিন সজীব মারা পরবে নির্ঘাত!

সজীব ভাইব্রেশনের শব্দে হাতের ফোনটার দিকে তাকায় তারপর ফোনটা উচ্ছাসের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”ভাই কাকা ফোন দিচ্ছে!”

উচ্ছাস বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোনটা হাতে নিয়ে কানে চেপে ধরে, ওপাশ থেকে শাখাওয়াত চৌধুরীর কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে,”সেন্টমার্টিন গিয়েছিলে কেন?”

উচ্ছাস নিশ্চুপ। শাখাওয়াত চৌধুরী চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”জবাব দাও সেন্টমার্টিন গিয়েছিলে কেনো?”

_ঘুরতে।
এক শব্দে জবাব দেয় উচ্ছাস।

_ঘোরাঘুরি করার ছেলে তো তুমি নও! কি অঘটন ঘটিয়ে এসেছো? আবার কি খেসারত দিতে হবে আমার? বলো!

উচ্ছাস জবাব দেয় না। সজীব উচ্ছাসকে দেখছে। বড়লোকের শিক্ষিত ছেলে, সুদর্শন। ক্ষমতাবান মানুষের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করে,কত লাক্সারিয়াস লাইফ কাটায়। আর এই ছেলে সেকেন্ড চান্স পেয়েও হত্যে দিয়ে শুধু ঐ মেয়েটার পেছনেই পরে আছে, যে কি না এখন প্রায় ত্রিশের বুড়ি। কি হাস্যকর একটা ব্যাপার। ঐ মেয়ের চাইতে হাজার গুণ সুন্দরী মেয়ে বাগিয়ে নিতে পারে এখনও। আজব!

উচ্ছাস নিশ্চুপ দেখে শাখাওয়াত চৌধুরী বলতে থাকে,”নির্বাচন টা গেলে ফ্রান্স পাঠাবো তোমায়। ততদিন দয়া করে একটু সমঝে চলো। আর হ্যা, ঐ মেয়েটার পেছনে লেগো না। ওর বিয়ে হয়েছে, আমি আমার ছেলে খুনি মানতে পারবো, আমার ছেলে পরস্ত্রীর দিকে নজর দিচ্ছে এটা মানতে আমার রুচিতে বাঁধবে। সব ঠিকঠাক হলে ওর থেকেও সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে দেবো তোমার। এর মাঝে আর কোনো ঝামেলা বাধিও না যাতে করে আবার তোমায় জেলে যেতে হয়।

শেফালী স্বামীর হাত থেকে ফোন নিয়ে কানে চেপে ধরে উচ্ছাসকে বলে,”বাবা।”

উচ্ছাস জবাব না দিয়ে ফোন কে’টে দেয়। শেফালী অশ্রুসিক্ত চোখে হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

উচ্ছাস স্বাভাবিক গলায় সজীবকে বলে,”ঝামেলা হয়েছিলো কোনো। চেক আউট তো আগেই করে নিয়েছিলি তাই না?”

_হ।
সজীব উত্তর দেয়। উচ্ছাস বলতে থাকে,”আচ্ছা যা। আমি কিছুক্ষণ একা থাকবো!”

উর্বী চুপচাপ বসে আছে।

লুৎফুন্নাহার চিন্তিত হয়ে মেয়েকে দেখছেন। এভাবে হঠাৎ করে চলে এলো কেনো উর্বী! জামাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে! কিছু বলছেও না।

সে উর্বীর কাঁধে হাত দেয়,” হ্যা রে।ওদিকে সব ভালো? ”

_হু,সব ভালো।

_তাহলে হঠাৎ এলি যে !

উর্বী রে’গে যায়,”কি এসেছি পর থেকে একই কথা বলে যাচ্ছো। এসেছি খুশি হওনি নাকি! ঠিকাছে চলে যাবো।”

উর্বী উঠে গিয়ে রুমে ঢুকে ধপাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়।

লুৎফুন্নাহার চুপ করে বসে আছে। তহুরা আর তার স্বামী রেজাউল কবির একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

***
রওশান আরা নিজ বাড়িতে ফিরেছেন। বাড়ি ফিরেই তিনি লিভিং রুমের সোফাতে আ’রাম করে বসে প্রথম যে কথাটি বললেন তা হলো,”বড় বৌমা ! আমাকে একটু পানি খাওয়াও তো !”

উর্বী পানি নিয়ে আসে না। পানি আনে আমীরুন।

“তুই এনেছিস কেনো? তোর কাছে চেয়েছি আমি?”

আমিরুন থতমত খেয়ে বলে,”ভাবি তো বাড়িতে নাই আম্মা।”

_কোথাও বেরিয়েছে? রাওনাফ কোথায়? হসপিটালে?

_ভাবী হের বাপের বাড়ি চইলা গেছে আম্মা।

রওশান আরা আমীরুনের দিকে তাকায়, রাগী কন্ঠে বলে, “বাপের বাড়ি গিয়েছে মা’নে? কখন? ফিরবে কখন? আশ্চর্য আমাকে ফোন দিয়ে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না একবারো? ”

আমীরুন ভয় পেয়ে যায়। রওশান আরা খে’পে গিয়েছেন। এখন একে কিভাবে থামাবে সে?
_রাওনাফ কই। ও তো আমায় কিছু বললো না।

_ভাইজান হাসপাতাল আম্মা। ভাবি ভাইজানরেও কিছু বলে নাই। একা একা চইলা গেছে।

রওশান আরা অবাক হয়, উর্বী একা একা চলে গিয়েছে! কেনো!

_ফিরবে কবে জানিস কিছু? জানিয়েছে?

_না আম্মা। কি হইতেছে তাই বুঝতে পারতেছি না।

_রাওনাফের সাথে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়েছিলো?

_তা আমি কেমনে কমু আম্মা।

রওশান আরা রাগে দাঁত কিরমির করতে থাকে। সামিউল সিড়ি দিয়ে নিচে নামছে।
রওশান আরা সামিউলকে দেখে বলে,”তোর বৌ কোথায়?”

_ছাদে মা,কেনো?

_বাহ। একটা পোয়াতি মেয়ে মাগরিবের ওয়াক্তে ছাদে গিয়ে ঢ্যাংঢ্যাং করছে আর বাড়ির বড় বৌ কাউকে কিছু না বলে চলে গিয়েছে। চমৎকার। তোর মনে হচ্ছে না এ বাড়ির বৌদের শাসনে না রাখার ফল এটা?

সামিউল বলে,”মা অন্তরা একটু হাওয়া খাচ্ছে। আর ভাবি বাপের বাড়িতেই তো গিয়েছে। চলে আসবে। এতো হাইপার হচ্ছো কেনো?

_রাগ উঠবে না আমার ? দুটোতে মিলমিশ করাতে আমার জান বেড়িয়ে যাচ্ছে। উর্বী তো এভাবে চলে যাওয়ার মেয়ে নয়। নিশ্চয়ই আমার বড়ছেলের অবদান আছে এতে।

“তা থাকতে পারে। ভাইজান তো ভাবীরে পাত্তাই দেয়না,খালি হাসপাতাল হাসপাতাল কইরা শেষ হইয়া যায়।”
আমিরুন রওশান আরাকে সম্মতি জানিয়ে বলে।

সামিউল আমীরুনকে চোখ রাঙানি দেয়। আমীরুন চুপ হয়ে যায়।

রওশান আরা সামিউলকে বলে,”তুই ওকে চোখ রাঙাচ্ছিস কেনো? ও কি ভুল বলেছে? আমি দেখি না? আমার চোখ নেই? সাতদিনের জন্য পাঠিয়েছিলাম ঘুরতে। তারা তিনদিনেই ফিরে এসেছে। নিশ্চয়ই হাসপাতালের দোহাই দিয়ে এসেছে তোর বড় ভাই। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। রাওনাফের সাথে রাগারাগি করেই উর্বী চলে গিয়েছে। কত সংসারী একটা মেয়ে,তোর বড় ভাই একটু বুঝবে না?

_মা সেটা ভাইয়ার সাথে উর্বীর বিয়েটা দেওয়ার আগে তোমার মাথায় আনা উচিত ছিলো। তুমি আর নুরুন্নাহার খালা। তোমরা দু’জনে দায়ী।

রওশান আরা রে’গে সামিউলের দিকে চায়,”পুরনো কথা টেনে আনছিস তুই?”

সামিউল ভয় পেয়ে যায়,মনে মনে বলে,”এইরে। মাকে খেপিয়ে দিলাম!”
রওশান আরা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
_যা গিয়ে তোর বৌয়ের ঘা’ড় ধরে ছাদ থেকে নিয়ে আয়। মাগরীবের আজান দিয়ে দেবে। হাওয়া খেতে গিয়েছে ! এহহহ,আমরা যেনো বাচ্চা হওয়াইনি।”

সামিউল বুঝতে পারে,তার মা ভীষণ খেপেছে। তার এখান থেকে কে’টে পরাই ভালো। সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে আ’ছাড় খায়। তারপর আবার উঠে দৌড়াতে থাকে।

রওশান আরা বিরবির করে বলে,”ছাগল একটা!”

আমীরুন ফিক করে হেসে দেয়।

রওশান আরা রাগী দৃষ্টিতে সেদিকে তাকায়,বলে,”তুই হাসছিস কেনো? যা আমার চোখের সামনে থেকে। তো শ্রদ্ধেও বড় ভাইজান এলে বলবি আমার সাথে যেনো দেখা করে। আমি আমার ঘরে গেলাম। কেউ বিরক্ত করবি না।”

***
শর্মী উর্বীকে ফোন দিচ্ছে।

নাবিল পেছন থেকে বলে,”কাকে ফোন দিচ্ছিস?”

শর্মী হঠাৎ করে ভয় পেয়ে হাত থেকে ফোন ফেলে দেয়,
তারপর বুকে থুথুরি দিয়ে বলে,”তুমি আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছো ভাইয়া‌!’

_আচ্ছা সরি। কাকে ফোন দিচ্ছিলি?

কথাটি বলে নাবিল মেঝে থেকে শর্মীর ফোন উঠিয়ে দিতে গিয়ে দেখে উর্বীর নাম্বার।
নাবিল হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,”ও তোর মাকে। তা আন্টি লিখে রেখেছিস কেনো? বোকা মেয়ে। মা কে কি কেউ আন্টি বলে?”

শায়মী এসে নাবিলের পেছনে দাঁড়ায়,বলে,”নাবিল তোর কোনো কাজ নেই? যা এখান থেকে। ওকে খেপাচ্ছিস কেনো?”

নাবিল মুখ ভেঙচিয়ে বলে,”ওওওও আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।তোরও তো মা।”

শায়মী রেগে নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাবিল হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হয়। যাওয়ার সময় দরজার বাইরে থেকে বলে,”তোদের মা তো গেলো। এখন কার কোলে শুয়ে ফিটু খাবি শর্মী?”

শর্মী রেগে গিয়ে কিছু বলতে এগিয়ে যায়। শায়মী শর্মীর হাত ধরে আটকায়,”ছাড় তো ওর কথা। তোকে খেপাচ্ছে। আন্টিকে ফোনে পেলি?”

_ ধরছে না আপু।

_কি হলো বলতো?

শর্মী তাকিয়ে আছে। আন্টি এরকম কেনো করছে? আন্টি তার সাথে কথা বলতে চায় না?

***
আমিরুন সদর দরজা খুলে দেয়, রাওনাফ ঘরের ভেতরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা রাখতেই আমীরুন বলে ওঠে,”আপনেরে আম্মা হের কথা শুনতে বলছে ভাইজান।”

“মা আসবো!”
রওশান আরা একটা ইসলামিক বই পড়ছিলো। রাওনাফের কথায় তার দিকে না তাকিয়েই বলে,”আয়।”

রাওনাফ সরাসরি রওশান আরার ঘরে এসেছে। তার হাতে এপ্রোন, স্টেথোস্কোপ।

রওশান আরা বলে,”বোস।”

_তুমি বলো কি জন্য ডেকেছিলে।

_বৌমা কেন গিয়েছে?

রাওনাফ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। রওশান আরা বলতে থাকে,”কি করেছিস তুই?”

_আমি কি করেছি মানে? মা তোমার কি মনে হয়না তুমি….

_মেয়েটাকে তো দেখেছি আমি। কতটা সংসারী হয়ে উঠেছিলো। তোর অবদান ছাড়া এভাবে হুট করে চলে যেতে পারে না।
রাওনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলে রওশান আরা।

_স্টপ মা! নাউ প্লিজ স্টপ! বরাবর নিজের মতামত, নিজের ধারণা দিয়ে তুমি সব বলো। মা তুমি জানো তুমি কতটা ভুল?

রওশান আরা ছেলের ধ’ম’ক শুনে অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকায়।

রাওনাফ বলতে থাকে,”কি বলেছিলে, পাত্রী রাজি। কারন তার বড়ভাই,খালা বলেছে পাত্রী রাজি। আমাকে একটু সময় অব্দি দিলে না। পুরো দুনিয়ার কাছে একটা উপহাসের পাত্র বানিয়ে ছেড়ে দিলে। সবাই আঙুল তুলছে আমার দিকে। আমার ব্যক্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এই একটা যায়গায় এসে। তুমি আর তোমার এই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং। এগুলো বন্ধ করো এখন। প্লিজ! আমি পাজেলড হয়ে আছি মা।”

রওশান আরা অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে,”তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস? তুই? বেশ করেছি! যা করেছি বেশ করেছি। দে আমাকে ফাঁসি দে সবাই। দে।”

রাওনাফ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি শোধরাবে না তাই না?”

কথাটি বলে রাওনাফ হন্তদন্ত হয়ে ঘরের দিকে যায়। রওশান আরা দরজার দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে।

***
ঘরে ঢুকে রাওনাফ এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে ধপ করে বিছানার একপাশে বসে পরে। টাইয়ের নট আলগা করে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে থাকে চুপচাপ। দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়। মাথা তুলে রাওনাফ ধীরে ধীরে বেড সাইডের টেবিলের ওপর রাখা শিমালার ফটোফ্রেমটির দিকে তাকায়। অস্বাভাবিক দুর্বল লাগছে হঠাৎ নিজেকে। কাঁপা কাঁপা হাতে শিমালার ফটোফ্রেমটি তুলে নিয়ে দেখতে থাকে ছবিটা। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”প্লিজ কনসোল মি শিমালা!”

দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায় আমীরুন। নিচু গলায় ডাকে,”ভাইজান আসবো?”

রাওনাফ ফটোফ্রেমটা যায়গামতো রেখে বলে ওঠ,” আয়! ”

আমীরুন ঘরে ঢোকে। রাওনাফ বলে,”কিছু বলবি?”

_আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো ভাইজান।

রাওনাফ অবাক হয়ে আমীরুনের দিকে তাকিয়ে থাকে,”কথা? কি,বল!”

***
“এসেছিস কেন?”

প্রশ্নটি করে উর্বীর খালা নুরুন্নাহার উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি তার মেয়ের ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উর্বীদের বাড়ির সবাইকে নিয়ে যেতে এসেছে। উর্বী নির্বিকার চিত্তে তার শাড়ি গুলো ভাজ করে আলমারিতে তুলে রাখতে থাকে।

তারপর বলে,”আমার বাপের বাড়ি আসবো না?”

_জামাই ছাড়া আসবি না। জামাই নিয়ে বছরে দুই ঈদে বেড়াতে আসবি তাও দুদিনের জন্য।

_এটা বাংলাদেশের কোন সংবিধানে লেখা?

_নেই এমন কোনো নিয়ম,এই নিয়ম শুধুমাত্র তোর জন্য।

উর্বী চুপ করে থাকে। নুরুন্নাহার বলতে থাকে,”কি? কথা বলছিস না কেনো?”

উর্বী চুপ করেই থাকে। নুরুন্নাহার বলতে থাকে,”যাই হোক! গুছিয়ে নে সবকিছু। এখানেই আছিস যখন,তুইও চল আমাদের বাড়িতে!”

****
গাড়ী এখানেই থামাতে হচ্ছে। এই গাড়ী নিয়ে উর্বীদের পাড়ার সরু রাস্তায় ঢোকা মুশকিল। রাওনাফ চিন্তিত হয়ে বসে আছে। গাড়ি না হয় এখানে থাকবে কিন্তু সে কি করবে? এই ঝুম বৃষ্টিতে বাইরে পা দেবে কিভাবে? আধাঘণ্টা ধরে সে একই ভাবে বসে আছে। রাতও অনেক হয়েছে। রাত দশটা যদিও তেমন বেশি রাত না তবে উর্বীদের এলাকা শুনশান হয়ে আছে। বৃষ্টির জন্যও হতে পারে।

রাওনাফ রওনা দিয়েছে সন্ধ্যা নাগাদ। হসপিটাল থেকেই রওনা দিয়েছে। এখানে পৌছেই বৃষ্টি তাকে পেয়ে বসলো। এখন রাওনাফ কি করবে! এভাবে তো বসে থাকা যায়না। মেইন রোড থেকে সাত আট মিনিটের রাস্তা। রাওনাফ হেটে যাবে? এই বৃষ্টিতে?

উর্বীর মন মেজাজ বি’গড়ে আছে। সন্ধ্যে থেকে লোডশেডিং , মোমবাতির টিমটিমে আলো আর তার উপরে মশার উপদ্রব।
মোবাইল টা অফ হয়ে আছে। শর্মীর কথা মনে পরছে খুব উর্বীর। উর্বী শর্মীর ফোন ধরেনি তার জন্য খুব অনুশোচনা হচ্ছে। মেয়েটার সাথে একটু কথা বলে নিলে খুব তো ক্ষতি হয়ে যেতো না তার!

সে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলো,মাথা তুলে তহুরাকে ডাকে,” ভাবী । আরেকটা কয়েল জালিয়ে দাও না। আগেরটা শেষ হয়ে গেলো যে।”

তারপর তার মনে পরে সে বাড়িতে একা। জেদ করে যায়নি সবার সাথে।

বাইরে ঝমঝম শব্দ করে বৃষ্টি পরছে। উর্বীর বেশ শীত লাগছে। সে একটা কয়েল জালিয়ে নিজের ঘরে যেতে নেয় তখনি দরজায় কেউ ধাক্কা দেয়। উর্বী দাঁড়িয়ে পরে। এতো রাতে কে এলো! বাড়ির সবাই নয়তো? কিন্তু তাদের তো আজ আসার কথা না! উর্বীর হঠাৎ খুব ভয় হতে শুরু করে। প্রতিবেশীর বাড়িও তাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। খুব ভয় করছে তার।

উর্বী কয়েল রেখে মোমবাতি নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজার এপাশ থেকে বলে,”কে?”
রাওনাফ শীতে কাপছে। সে কাঁপতে কাঁপতেই জবাব দেয়,”উর্বী আমি রাওনাফ! দরজা খোলো।”

উর্বী চ’ম’কে ওঠে। কার গলা শুনছে সে! কে এসেছে! এই ভারি পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে তার বুক চিনচিনিয়ে উঠলো কেনো। এমন অনুভূতি তখন হয় যখন কেউ কারো অপেক্ষা করতে করতে একসময় তার সান্নিধ্য পায়। তবে কি সে রাওনাফের জন্য অপেক্ষা করছিলো? সে জানতো না, নিজেও মানতো না,ভাবে নি রাওনাফ আসবে। রাওনাফের আসার তো কথা না। তবে তার অবচেতন মন চাইতো রাওনাফ আসুক? এমনটা নাকি? এমনটাই কি?

উর্বী কিছুই বুঝতে পারছে না। সত্যিই কি রাওনাফ? নাকি তার ভ্রম। নিশ্চিত হবার জন্য সে কাঁপা গলায় আবারও বলে,”কে?”

ওপাশ থেকে রাওনাফ বলে,”আরে আমি রাওনাফ উর্বী। দরজাটা খুলে দাও তাড়াতাড়ি।”

উর্বী একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে হাতটা বাড়িয়ে দেয়। সিটকিনি তুলে দরজা খুলে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। ক্লান্ত কিন্তু অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখতে থাকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বাটে, ছিমছাম গড়নের, গভীর চাহনির, শান্ত , গোছালো, মধ্যবয়সী পুরুষটিকে।

চলমান……

আরেকটি বার পর্ব-১৬+১৭

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৬
#Esrat_Ety

উর্বী বুঝতে পারছে না সে কোথায়।‌ হাত দিয়ে চোখ ডলছে সে। পরক্ষনেই মনে পরলো সে তো সেন্টমার্টিনের একটা রিসোর্টের রুমে আছে। বাইরে থেকে মিষ্টি রোদ জানালার সাদা রঙের পাতলা পর্দা ভেদ করে রুমের ভিতর উঁকি দিচ্ছে। তাদের ঘরটা বেশ বড়ো। গোটা রিসোর্টটাই অনেক বড়। উর্বী গা থেকে চাদর সরিয়ে মেঝেতে পা রাখে। রাওনাফকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। কোথাও বেরিয়েছে নাকি!
সে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। এতো বেলা অব্দি সে ঘুমোয় না। কিন্তু গতকাল রাতে জার্নি করে সে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো। উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার দিকে তাকায়। রাওনাফের ব্যবহৃত চাদরটা একেবারে গুছিয়ে ভাজ করে রাখা। এই মানুষটি খুবই গোছালো, এতো গোছালো পুরুষ উর্বী দেখেনি।

বিছানার সাথে লাগোয়া টেবিলটায় একটা কফি মেকার আর কিছু ইন্সট্যান্ট কফির পাতা দেখতে পায় সে। দেখেই উর্বীর কফি খেতে ইচ্ছে করছে। সে নিজের জন্য এক মগ কফি বানিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বারান্দায় গিয়ে সে চ’ম’কে যায়। এখান থেকে সমুদ্র সৈকতের চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করা যাচ্ছে। উর্বীদের ঘরটি চারতলায়। রিসোর্টের বাগানে প্রচুর লোকজন, সবাই যে যার মতো আনন্দ করছে। হঠাৎ রাওনাফের দিকে তার চোখ যায়। পুল সাইডের পাশে একটা টেবিলে তারা বন্ধুরা মিলে হৈ হৈ করে গল্প করছে।
রাওনাফকেও বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে। রাওনাফের বন্ধুদের বৌয়েরা ব্যস্ত সেলফি নিতে। উর্বী কফিটা শেষ করে। সে এখন কি করবে ! রাওনাফকে ফোন দেবে?
রাওনাফকে ফোন দিতে হয় না, রাওনাফই তাকে ফোন দেয়। উর্বী কানে ফোন চেপে ধরে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে।

_হ্যা তুমি উঠেছো?

_হ্যা এইতো কিছুক্ষণ হলো।

_আমরা সবাই এখন ব্রেকফাস্ট করবো,তুমি ফ্রেশ হয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসতে পারবে? নাকি আমি আসবো?

_না,আমি পারবো আপনার আসতে হবে না।

রাওনাফ ঠিক আছে বলে ফোন রেখে দেয়। সে হাত নেড়ে নেড়ে পুনরায় বন্ধুদের সাথে গল্প করতে শুরু করে। উর্বী দুমিনিট তার দিকে তাকিয়ে থেকে রেডি হতে যায়।

***
উর্বীকে আজ উর্বীর চোখেই ভীষণ সুন্দর লাগছে। সে আকাশী রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি পরেছে। মুখে একটু পাউডার লাগিয়েছে। একটু লিপস্টিকও কি দেবে? কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে থেকে লিপস্টিক না লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে। যা সেজেছে সেটাই ঢের। সাজবেই বা কেন উর্বী! নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে পার্স টা হাতে তুলে নেয়। তারপর পা বাড়ায় রুমের বাইরে।

উর্বী রুম লক করে ঘুরে দাঁড়াতেই চ’ম’কে ওঠে। তাদের রুমের বিপরীতে রুম নাম্বার টু ওয়ান টুতে একজন লোক ঢুকলো। পেছন থেকে এক ঝলক দেখলো উর্বী। লোকটির অবয়ব এমন চেনা চেনা মনে হলো কেনো?

“দাঁড়িয়ে আছো কেনো? যাবে না?”
উর্বী ঘুরে তাকায়। রাওনাফ দাঁড়িয়ে আছে।

“আপনি এলেন কেনো? আমিই যেতাম।”

_তোমার দেড়ি হচ্ছিলো দেখে ভাবলাম কোনো অসুবিধে হয়েছে। মানে ওরা পাঠিয়েছে।

উর্বী মনে মনে হাসে। রাওনাফ করিম খানকে সবসময় সবাই জোর করে।

মুখে বলে,”আমি কি ছোটো বাচ্চা?”

_তা ঠিক না, চলো সবাই অপেক্ষা করছে।

উর্বী রাওনাফের পিছু পিছু যেতে থাকে। কিছুক্ষণ বাদেই টু ওয়ান টু থেকে বেরিয়ে আসে উচ্ছাস। বেরিয়ে সে মুখে মাস্ক লাগিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে থাকে।

খাওয়ার সময়ও সেলফি! এবার উর্বীর খুবই বিরক্ত লাগছে।

জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মিতা বলে,”আরে সবাই মিলে একটা সেলফি তুলি চলো! সবাই তাকাও।”

সবাই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। যে যার বৌয়ের কাঁধে হাত রেখেছে। হঠাৎ উর্বীর কাছে দৃশটা খুবই ভালো লাগে।

জুনায়েদের স্ত্রী রাবেয়া বলে ওঠে,”আরে রাওনাফ ভাই! আপনিও ভাবীকে ধরে রাখুন না।”
উর্বী হকচকিয়ে ওঠে। রাওনাফও ভীষণ বিব্রত হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। মৌমিতা বলে ওঠে,”আরে বাদ দাও না। লজ্জা পাচ্ছে এরা। তোমরাও না!”

লামিয়া পাশ থেকে মৃদু হেসে বলে ওঠে,”চলো এবার সবাই তাকাও। তখন থেকে সেল্ফি স্টিক তুলে বসে আছি। তাকাও!”

তারা ছবি তুলছে। লামিয়া মাথা ঘুরিয়ে উর্বীকে নিচু স্বরে বলে,”হাসো!”

উর্বী হাসার চেষ্টা করে।

দূরের টেবিলে বসে আছে উচ্ছাস। সে অপলক দৃষ্টিতে উর্বীকে দেখছে।

***
নাবিল স্যান্ডউইচ নিয়ে খুটছে শুধু, খাচ্ছে না। শায়মী আর শর্মী দুজন মিলে অতি উৎসাহের সাথে পরিকল্পনা করছে খালামনিদের বাড়িতে গিয়ে কি কি করবে। খাবার টেবিলে তারা পাঁচজন। শর্মী,শায়মী,নাবিল আর সামিউল-অন্তরা।

কিছুক্ষণ পরে নাবিল শর্মীদের ধমক দিয়ে বলে,”চুপ করবি তোরা! আমার বিরক্ত লাগছে এসব শুনতে!”

সবাই মাথা তুলে নাবিলের দিকে তাকায়। শায়মী কড়া গলায় বলে,”গতকাল থেকে খিটখিটে করেই যাচ্ছিস! দিস ইজ ঠু মাচ নাবিল!”

নাবিল চুপ করে থাকে। শায়মী ক্ষনবাদে বলে ওঠে,”পাপা তার ওয়াইফকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছে।”

সামিউল শায়মীর কথা শুনে নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিলের মেজাজ এজন্য চটে আছে!

নাবিল চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”কাল বুঝেছি, পাপা ওয়ার্ল্ডস বেস্ট পাপা হলেও কখনো বেস্ট হাজবেন্ড ছিলোই না। মাম্মাকে কখনও পাপা ভালোবাসেনি।”

সামিউল পাশ থেকে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”ভালো না বাসলে তোরা পৃথিবীতে টপকালি কিভাবে!”
অন্তরা সামিউলকে খোঁচা মেরে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”থামবে তুমি! ওরা বাচ্চা!”

শায়মী নাবিলের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”নাবিল! প্লিজ পাপাকে এভাবে জাজ করিস না!”

_চাই না তো! হয়ে যায়!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে নাবিল।

***
দুপুরে সবাই মিলে সমুদ্র স্নানে বের হয়েছে। উর্বীর একদমই যেতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু সবাই মিলে তাকে টেনে নিয়ে যায় । সে শাড়ি পরে আছে। মেরুন রঙের সাধারণ সুতি শাড়ি।

রাওনাফ চুপচাপ হাঁটছে।‌

উর্বীর কাছে এসে মিতা বলে,”কি ব্যাপার উর্বী! তুমি এভাবে রাওনাফ ভাইয়ের থেকে আলাদা হয়ে থাকো কেনো? আরে লজ্জা কিসের? আমরা আমরাই তো।”

উর্বী কি বলবে বুঝতে পারছে না। জবাবে সে শুধু মুচকি হাসে।

“রাওনাফ ভাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি রাতে?”
পেছন থেকে আশিকের স্ত্রী জান্নাত বলে ওঠে।

_না তো, ঝগড়া কেনো হবে?

_তাহলে তার কাছে যাও।
কথাটি বলেই জান্নাত উর্বীকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে রাওনাফের দিকে পাঠিয়ে দেয়। রাওনাফের চোখে উর্বীর চোখ পরে। সে চোখ নামিয়ে হাটতে থাকে।

উর্বীর এখন একটু শান্তি লাগছে। বীচে এসে এখন কেউ আর তাদের নিয়ে পরে নেই। যে যার স্বামীর সাথে সমুদ্রস্নান করছে। এদের দেখে উর্বীর সত্যি সত্যি অবাক লাগে। এদের ছেলেমেয়েরা নাকি আবার স্কুলে পরে। তবে উর্বীর খুব ভালো লাগে এদের স্বামী-স্ত্রীতে খুনসুটি গুলো।

সৈকতে একা একা হাঁটতে থাকে সে। মৃদুমন্দ বাতাসে তার খোলা চুলগুলো উড়ছে। উর্বী চুলে কোনোমতে একটা খোঁপা বেঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। কিছু ঝিনুক তার পায়ে লাগে। সে ঝিনুকটা উঠিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে। বাহ বেশ সুন্দর তো!

উর্বী দুমিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ঝিনুক কুঁড়াতে শুরু করে।

“কি করছো?”
পেছন থেকে বলে রাওনাফ।

উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”ঝিনুক কুড়োচ্ছি।”

_এগুলো দিয়ে কি হবে?
অবাক হয়ে উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

_এগুলো খুবই সুন্দর। শর্মী নিতে বলেছিলো। ও কি একটা ক্রাফ্ট বানিয়ে নেবে বলছিলো ওর চারুকলা ক্লাসে।

রাওনাফ হাসে। উর্বীকে তার এখন শর্মীর মতোই একটা বাচ্চা মনে হচ্ছে।

উর্বী কথা না বাড়িয়ে ঝিনুক কুঁড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরে। রাওনাফ কিছুক্ষণ তাকে দেখে। খানিক বাদে সেও তার পায়ের কাছ থেকে একটা ঝিনুক উঠিয়ে উর্বীকে এগিয়ে দেয়। উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তার হাতের দিকে তাকায়, তারপর মুচকি হাসি দিয়ে সেটি নেয়।

“এই দেখো দেখো ওদিকে দেখো।”
মিতার কথায় সবাই দূরে রাওনাফ আর উর্বীর দিকে তাকায়। দুজনে পাল্লা দিয়ে ঝিনুক কুড়িয়ে জড়ো করছে।

জুনায়েদ বলে,”আমাদের সামনে এমন ভাব করে যেনো ভাজা মাছ টা উলটে খেতে পারে না এরা দুজন। গলায় গলায় কত ভাব দেখেছো?”

” দাঁড়াও এখনই ধরছি দুটোকে।”
মৌমিতা এগিয়ে যেতে নেয়।
সবাই হো হো করে হাসতে থাকে। লামিয়া তাকে বাধা দিয়ে বলে,”মৌমিতা প্লিজ যাসনা। ওরা ওদের মতো থাকুক। আমাদের ওদেরকে নিজেদের মতো করে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ।”

“ঠিক বলেছো।”
জাহাঙ্গীর লামিয়ার কথার পিঠে বলে।

দূর থেকে উচ্ছাস উর্বী আর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। সে দীর্ঘসময় আগে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলো,কিন্তু সেটি তার হাতেই পুড়ছে। ওড়াচ্ছে না সে ধোয়া।

***
“পুরুষ দের আর পছন্দ কি। শেষ মেষ তো তোমরা তোমাদের পছন্দ অনুযায়ীই সব কিনবে। আমরা কয় বন্ধু এখানে বসে কফি খেতে খেতে আড্ডা দেই। তোমরা ঘুরেফিরে কেনাকাটা করো।”

আশিক বলে কথাটি। তারা সবাই সন্ধ্যায় শপিং করতে বেরিয়েছে। উর্বী চুপচাপ বসে আছে। তাকে অন্যরা টানাটানি করছে। শেষমেষ বাধ্য হয়ে সে উঠলো।

মহিলারা সবাই বিভিন্ন জিনিস দেখছে। দরদাম করছে। উর্বী সব ঘুরেফিরে দেখছে। সেন্টমার্টিনের সবথেকে বড় লোকাল মার্কেট এটি।
উর্বী ঘুরেফিরে একটা চাদরে হাত দেয়। এগুলো পার্বত্য এলাকার মানুষের বুননকৃত শাল। তার মা আর শাশুড়ি রওশান আরার জন্য পছন্দ হয়েছে চাদরটি। সে বেছে বেছে দু’টো নিয়ে নেয় দু’জনের জন্য।
অন্য ভাবিরাও ঘুরতে ঘুরতে তার কাছে চলে আসে।

লামিয়া উৎসাহী হয়ে উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”বেশ সুন্দর তো! কার জন্য নিলে?”

_মা আর শাশুড়ি।

লামিয়া মৃদু হাসে। উর্বীর মাথাটা হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠতেই লামিয়া এসে ধরে ফেলে। মিতা চেঁ’চি’য়ে ওঠে,”আরে ওকে কেউ বসিয়ে দাও।”

লামিয়া উর্বীকে বসিয়ে দেয়। মিতা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,”নাও এটা খাও।”

উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”ঠিক আছি আমি।”

মিতা বলে,”কি হয়েছে? মাথা ঘুরছে?”

_আসলে আজ অনেক বেশি ঘোরাঘুরি হয়ে গিয়েছে। একদিনে এত বেশি স্ট্রেস নিতে পারি না আমি।

রাবেয়া সাথে সাথে বলে ওঠে,”আমি ভেবেছি সুখবর আছে বোধহয় কোনো।”

সবাই উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। উর্বী বসে বসে নিজেকে ধাতস্থ করে। বাকিদের মশকরায় তার কোনো হেলদোল নেই। মৌমিতা বলে ওঠে,”তা উর্বী! প্লানিং করেছো কোনো?”

_কিসের প্ল্যানিং?

_ফ্যামিলি প্ল্যানিং!
সবাই দ্বিতীয় দফায় হাসতে থাকে।

উর্বী নিশ্চুপ। লামিয়া হাসতে হাসতে বলে ওঠে,” রাওনাফ কখনো করতে পেরেছে ফ্যামিলি প্ল্যানিং? ও কখনো প্ল্যান করে বাচ্চা নিতে পারেনি, শিমালাই পিল খেতে ভুলে যেতো। সবসময় হেসেছি আমরা বন্ধুরা এটা নিয়ে। কিন্তু রাওনাফ বরাবর সবকিছু খুবই দায়িত্বের সাথে সামলেছে। শিমালা প্রথম যখন কনসিভ করেছে তখন রাওনাফ স্টুডেন্ট ছিলো, শিমালা একবার চেয়েছিলো এ’ব’র’শ’ন করাতে। তখন রাওনাফ কি রাগটাই না করেছিলো শিমালার উপরে! সপ্তাহখানেক তো শিমালার সাথে রেগে কথাই বলেনি। রাওনাফ প্লান না করলেও তার পিতৃত্ব নিয়ে বরাবর এক্সাইটেড ছিলো। নাবিল শায়মীর পরে শিমালা একটা লম্বা গ্যাপ দিতে চেয়েছিলো। কারন নাবিল শায়মী জমজ ছিলো। কিন্তু বেশি গ্যাপ দিতে পারেনি, শর্মীর বেলায়ও শিমালা পিল খেতে ভুলে গিয়েছিলো। রাওনাফ সেবারও খুবই খুবই এক্সাইটেড ছিলো। রাওনাফ বরাবর বেস্ট ফাদার নামে স্বীকৃত আমাদের কাছে।”

উর্বী লামিয়ার কথা শুনে নিচু স্বরে বলে,”এসব কথা আমাকে বলছেন কেন?”

লামিয়া হেসে ফেলে। রাবেয়া বলে,”লামিয়া এটা বলেছে তোমাকে বোঝাতে, প্ল্যান করার দরকার নেই অতশত। ইচ্ছে হলে বাচ্চা নিয়ে নাও। রাওনাফ ভাই খুবই চমৎকার একজন বাবা হবে! তোমার চিন্তা নেই!”
মিতা হাসছে। লামিয়া রাবেয়াকে থামিয়ে উর্বীর চোখে চোখ রেখে বলে,”অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বাচ্চা কিংবা বিয়ে। রাওনাফ খুবই দায়িত্বের সাথে সামলাতে জানে মৃদুলা উর্বী। এটাই বোঝাতে চেয়েছি।”

উর্বী লামিয়ার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,”আমি উঠছি! রিসোর্টে ফিরবো।”

***
রাতের ডিনার শেষে যে যার রুমে ঢুকবে। উর্বী লবিতে একা দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফ সবার সাথে আগামী কালকের স্কেজিওল নিয়ে কথা বলছে। কাল তারা একটা পিকনিকের আয়োজন করেছে রিসোর্টে।

উর্বী একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেয়ালে পেইন্টিং দেখছে। তার শপিং ব্যাগ গুলো রাওনাফের হাতে। বাড়ির সবার জন্যই টুকটাক কিনেছে অনেক কিছু।

উর্বীকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উচ্ছাস। সে এই সুযোগটাই খুঁজছিলো। আশেপাশে কেউ নেই। বেয়াদপটাকে ঘা’ড় ধরে রুমে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে উচ্ছাসের। সে হাত মুঠো করে তার রা’গ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। উর্বী উচ্ছাসের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল।উচ্ছাস উর্বীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ রাওনাফ উর্বীর কাছে চলে আসে।

উচ্ছাস দাঁড়িয়ে পরে।

উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে রাওনাফকে বলে,”কথা শেষ হয়েছে আপনাদের?”

“হ্যা।”
রাওনাফ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে।

***
রাওনাফ দেখছে তার দিকে একজন ২৯-৩০ বছরের রুপবতী নারী এগিয়ে আসছে। পরনে তার বাসন্তী-লাল রঙের জামদানি শাড়ি। উর্বীর উচ্চতা কম। ছোটোখাটো আনন। আজ খানিকটা বেশি লম্বা দেখাচ্ছে। হাই হিল পরেছে হয়তো।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকাতেই সে বিব্রত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। খোপায় আবার গাজরা লাগিয়েছে। অতি সাধারণ বাঙালি মেয়েদের সাজ। অথচ উর্বীকে দেখে এতটা স্নিগ্ধ লাগছে! উর্বী খুব কাছে চলে আসে। রাওনাফ বন্ধুদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

উর্বীকে আসতে দেখে রাবেয়া বলে ওঠে,”এইযে এসে গিয়েছে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি। যার জন্য এতো আয়োজন! ”

সবাই উর্বীর দিকে তাকায়।
উর্বীর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। সে যে বাড়তি সাজ হিসেবে চুলে এই গাজরা টা লাগিয়েছে এটা কি বেশি হয়ে গিয়েছে!

পার্টিতে অনেক অপরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছে। উর্বী এদের চেনে না। এখানে,এই অচেনা যায়গায় এতো অতিথি এরা পেলো কোথায়‌ !

মিতা এসে উর্বীর হাত ধরে টেনে রাওনাফের কাছে নিয়ে যায়।

“সাজতে সাজতে এতো সময় লাগিয়ে দিলে এখন স্বামীর সাথে কেক কাটবে এসো।”

_কেক কেনো কাটবো?
অবাক হয়ে জানতে চায় উর্বী।

_আরে এই পিকনিক থুড়ি পার্টিটা তোমাদের অনারে রেখেছি আমরা। তোমাদের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা। এখন কেক কেটে একটু আমাদের উদ্ধার করুন আপনারা দুজন।

_এতো অতিথি! এরা কারা?

_এরা এই রিসোর্টের গেইস্ট। সবাই ইনভাইটেড আজ।
উর্বী অবাক হয়ে যায়। তাদের জন্য এতো আয়োজনের কি আছে! এখানে কি রাওনাফ আর উর্বীর বিয়ে হচ্ছে নাকি!

উচ্ছাস অনেকটা দূরে একটি চেয়ার পেতে বসে ড্রিংকস খাচ্ছে। তার শীতল দৃষ্টি উর্বীর দিকে। এতো সাজ,এতো জেল্লা মুখে ! সব স্বামীর জন্য। একটা নীরব পৈশাচিক হাসিতে উচ্ছাসের ঠোট প্রশস্ত হয়ে যায়।

রাওনাফের বন্ধুরা পার্টিতে আসা প্রত্যেক গেইস্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পার্টির আরম্ভ ঘোষণা করে দিয়েছে।

“কি হলো! কেইক কাটো।!”
মিতা ধমকের সুরে বলে ওদের। উর্বী ছুড়িটা কেকের উপর বসায় তখনই মৌমিতা রাওনাফকে বলে,”তুই এভাবে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? বৌয়ের সাথে কেক কাট!”
রাওনাফ ছুড়িটা ধরতে গিয়ে উর্বীর হাতের উপর হাত রেখে ফেলে। রাওনাফ খানিকটা বিব্রত বোধ করছে। উর্বীর কোনো ভাবান্তর নেই। সে নির্লিপ্ত হয়েই কেক কাটতে থাকে।

উচ্ছাস তাদের দেখছে। সে উর্বী আর রাওনাফের মুখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাদের হাতের দিকে তাকায়। একটা কাজ করলে কেমন হয়! ওই ছুড়িটা দিয়ে উর্বীর স্বামীর গ’লাটা কেটে দেবে সে?

***
মামুন বসে আছে। তার সাগরেদ রানা এসে তার সামনে দাঁড়ায়, “ভাই হারামজাদা নিচে পা’র্টি করছে।”
_কিসের পা’র্টি?
_জানি না,হোটেলের কোন মালদার গেস্ট আয়োজন করেছে। বিবাহোত্তর সংবর্ধনা। আমাদেরও দাওয়াত ছিলো।

_ওহহ। ওর সাথে ওই নেংটি ইঁদুর টা, সজীব না যেনো কি নাম। সে কোথায়?

_ওই কু’ত্তাকে আজ দেখছি না, হয়তো কোথাও ঘাপটি মেরে আছে।

_ আচ্ছা ওটাকে পরে দেখে নেবো,শোন,সময় সুযোগ বুঝে ওকে শেষ করবি। কাজ শেষে আনোয়ার আর রউফকে ঝাউবনের ওদিকটায় থাকতে বলবি। লা’শ’টাকে ওখান থেকে ভাসিয়ে দিবি।
রানা মাথা নাড়ায়। সে তার বসের কথামতোই সব কাজ করবে।

***
পার্টিতে সবাই মুগ্ধ হয়ে জাহাঙ্গীরের গান শুনছে। উর্বী অবাক হচ্ছে। এই লোক এতো সুন্দর গান জানেন! আচ্ছা রাওনাফের বন্ধুদের এক একজন এক এক গুনের অধিকারী। রাওনাফের ডাক্তারি করা ছাড়া আর কোন গুন আছে? মায়ের আদেশ পালন আর কিউট কিউট বাচ্চা তিনটাকে পড়াশোনার জন্য সবসময় বকাঝকা করা ?

কথাটা ভেবেই উর্বী নিজেই নিজেকে ধমকায়,”ছিঃ মৃদুলা উর্বী। একজন ভদ্রলোককে সবসময় এভাবে খোঁচা মারতে পারো না তুমি!”

গান শেষে সবাই কড়জোরে হাততালি দিচ্ছে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফও হাততালি দিতে দিতে উর্বীর দিকে তাকাতেই উর্বী অন্যদিকে চোখ ফেরায়।

সবাই এবার যে যার পার্টনারের সাথে হালকা মিউজিকের তালে তালে নাচছে ‌। উর্বী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না,তার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।

উচ্ছাস আর অপেক্ষা করে না। একটা বাকা হাসি হেসে সে উঠে দাঁড়ায়। একটা গ্লাস হাতে উর্বীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরপায়ে। তার চোখে চশমা এবং মুখে মাস্ক।

উর্বী মিতা ভাবির সাথে কথা বলছে,”ভাবি আমি কিছু সময় নিড়িবিলি থাকতে পারি? আমার ভীষণ মাথাব্যথা করছে!”

_সেকি ! মাত্র তো পার্টি শুরু হলো।

_ভাবি শুধু ত্রিশ মিনিট!

উচ্ছাস ভিড়ের মধ্যে উর্বীর গা ঘেঁষে হেটে যাওয়ার সময় উর্বীকে ধাক্কা দিয়ে তার হাতের গ্লাসের শরবত টুকু উর্বীর গায়ে ফেলে দেয়।

_সরি ম্যাম সরি। আমি দেখতে পাইনি।

কন্ঠ যথাসাধ্য চাপিয়ে কথাটি বলে উচ্ছাস। রাওনাফ সেদিকে তাকায়।
উর্বী শাড়ি সামলাতে সামলাতে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে চোখের আড়াল হয়ে যায়। পার্টির ঘোলাটে লাইটিং-এর জন্য আশেপাশে তাকিয়ে কিছু ঠাহর করতে পারছে না সে।
রাওনাফ এসে বলে,”কি হয়েছে উর্বী? তোমার শাড়ীটা তো নষ্ট হয়ে গেলো!”
_একজনের সাথে ধাক্কা লেগেছিলো। তার গ্লাস থেকে পরেছে।

কথাটি বলে উর্বী এদিক ওদিক তাকাতে থাকে‌।

_কি দেখছো?

_ জানেন লোকটাকে কেমন অদ্ভুত লাগলো, মুখে মাস্ক পরা।

_মুখে মাস্ক পরলেই অদ্ভুত! তার তো সর্দি কাশি থাকতে পারে। সেজন্য পরেছে।

_চশমা ছিলো! রাতেও সানগ্লাস!

_আই ইনফেকশন থাকতে পারে!

রাওনাফের কথায় উর্বী স্বস্তি পায়না। উর্বীর মন খুতখুত করছে।

লামিয়া বলে,”যাহ! হয়ে গেলো। আচ্ছা উর্বী যাও,তুমি শাড়ীটাও চেইঞ্জ করে এসো আর কিছুক্ষণ রেস্টও নিয়ে এসো। আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আজ অনেক রাত অবধি জাগবো।”

উর্বী মাথা নাড়ায়।
পাশ থেকে মৌমিতা বলে ওঠে,
_ডাক্তারকে পাঠাবো সাথে? না মানে ওষুধ দিতে আরকি! তোমার না মাথা ব্যাথা করছে?
হাসতে হাসতে কথাটি বলে সে।
উর্বী আস্তে করে বলে,”তার দরকার নেই।”

***
উর্বীর মনে হচ্ছে কে যেনো তার পিছু নিয়েছে। রিসোর্টের সবাই পার্টিতে। পুরো দালান নিশ্চুপ হয়ে আছে। পার্টি হচ্ছে রিসোর্টের বাগানে। এখান থেকে খানিকটা দূরেই বলা যায়। উর্বীর বেশ ভয় ভয় করছে। তবু সে তার রুমের দিকে এগোয়। রুমে ঢুকেই দরজা লক করে দেয় উর্বী।

শাড়িটা পাল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। একটু আরাম লাগছে এখন। দু’চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে।

দুমিনিট পরে তার রুমের দরজায় কেউ ধাক্কা দিতে থাকে।
কে আসতে পারে! নিশ্চয়ই ভাবীরা রাওনাফকে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়েছে। তাদেরও কাজ নেই কোনো।

উর্বী উঠে গিয়ে দরজা খোলে। দরজা খুলে সামনে তাকাতেই তার পুরো পৃথিবী ওলটপালট হতে শুরু করে, বুকের পাঁজর টনটন করে ওঠে। তার শরীর টা এতো কাপছে কেনো!

উচ্ছাস শীতল চোখে উর্বীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে রুমে প্রবেশ করেই উর্বীকে আগলে ধরেই দরজা লাগিয়ে দেয়। উর্বী কিছু বলতে পারছে না। সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে শুধু। সে তার অনূভুতি বুঝতে পারছে না। তার শরীরে কি প্রান নেই!

উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী একটা কাঁপুনি দিয়ে ওঠে,ভেতর থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসতেই দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে,”মার্ডারার! রেপিস্ট!”

চলমান…..

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৭
#Esrat_Ety

“মার্ডারার, রেপিস্ট।”

শব্দ দুটি উচ্চারণ করে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে উর্বী।

উচ্ছাস উর্বীর গালদুটো হাত দিয়ে আগলে ধরে নরম গলায় বলে,”পালাতে চাও আমার থেকে?”

উর্বী নিজের হুশ ফিরে পায়।
সে দুহাত দিয়ে উচ্ছাসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু উচ্ছাসের শক্তির কাছে সে অপারগ।

সে কাঁদছে, বাঁধভাঙা কান্না। উচ্ছাস উর্বীর কান্না উপেক্ষা করে বলতে থাকে,”ত্রিশের উর্বীকে ঠিক তেইশের উর্বীই লাগছে। একটুও বদলায়নি তোমার সৌন্দর্য।”

উর্বী কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে ওঠে,উচ্ছাসকে কাঁপা গলায় বলে,”আমাকে ছেড়ে দাও তুমি দয়া করে। চলে যাও তুমি এখান থেকে। আমার জীবন থেকে।”

উচ্ছাস উর্বীর কথা শুনতেই সজোরে একটা থাপ্পড় মারে উর্বীর গালে, উর্বী চ’ড়ের ধাক্কা সইতে না পেরে মেঝেতে পরে যায়। সে সেখানেই চুপ করে পরে থাকে। তার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে।

উচ্ছাস গিয়ে উর্বীর চুল মুঠি করে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”টাকা চিনেছিস তুই! ফালতু মেয়ে, গোল্ড ডিগার। ছলনাময়ী।”

উর্বী কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,”হ্যা আমি তাই। তুমি চলে যাও এখান থেকে। আমাকে আমার মতো বাঁচতে দাও।”

উচ্ছাস এবার উর্বীর চুল ধরে টেনে তোলে। তারপর আরেকটা চ’ড় মে’রে দেয় উর্বীকে। উর্বী টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় পরে।

উচ্ছাস এসে উর্বীকে বিছানার সাথে চে’পে ধরে।

“নিজের মতো বাচবি? তোর স্বামীকে নিয়ে? সে আর এজন্মে হচ্ছে না। তোর স্বামী ভেবে তোর দেবরকে ছু’ড়ি মেরেছিলাম জানিস? এবার তোর স্বামীকেই মা’রবো।”

উর্বী অবাক হয়ে দেখছে উচ্ছাসকে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, এটাই কি সেই উচ্ছাস! এসব কি শুনছে সে!

নিজেকে উচ্ছাসের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলতে থাকে,”ছিহঃ তুমি এত্তো নিচ! ছাড়ো আমাকে,ছেরে দাও তুমি। আমার ঘেন্না লাগছে তোমাকে। ঘেন্না করি তোমাকে আমি।”

উচ্ছাস হাসতে হাসতে বলে,
“ছেরে দেবো?

উর্বী দম নিতে পারছে না। গাল বেয়ে তার অঝোরে পানি ঝরছে।

উচ্ছাস নিশ্চুপ উর্বীকে কাঁদতে দেখে। এই মেয়েটার ওপর সে এতটা ক’ঠিন কি করে হচ্ছে! সে দুর্বল হয়ে পরতে চায়, কিন্তু না,তাকে দুর্বল হলে চলবে না।

উর্বী বলতে থাকে,”ঘৃণা করি তোমাকে শুধু। এটুকু কেন মেনে নিতে পারছো না।”
উচ্ছাস উর্বীর সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে তার কপালে চুমু দিতে উদ্যত হয়। উর্বী তাকে বাধা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে,কেঁদে বলে ওঠে,”উচ্ছাস দোহাই লাগে তোমার,আমি এখন অন্য কারো স্ত্রী। এতটুকু বোঝার চেষ্টা করো।”

উচ্ছাস থেমে যায়, কিছুসময় উর্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে বসে। উর্বী একই ভাবে পরে থাকে নিস্তেজ হয়ে। উচ্ছাস নরম গলায় বলতে থাকে,”ওটা কোনো বিয়ে না। ভুল করেছো। মাফ করেছি। এবার সব চুকিয়ে ফেলবে।”

“কি চুকিয়ে ফেলবো আমি?”
উর্বী চেঁ’চি’য়ে ওঠে।

_তালাক দেবে স্বামীকে।

_তোমার কথায়?

_হ্যা।

উর্বী উঠে বসে। চোখের পানি মুছে উচ্ছাসের দিকে তাকায়। মুহুর্তেই তার চোখে মুখে কাঠিন্যতা ছেয়ে যায়। কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,”দেবো না। কি করবে তুমি?”

উচ্ছাস হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে চুপ হয়ে যায়। কোনো উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করে না সে।

_আমার স্বামীর কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা তুমি করবে না উচ্ছাস।
তেজী কন্ঠে বলে উর্বী।

উচ্ছাস আবারও হাসে, হাসি থামিয়ে বলে, “খুউব প্রেম না? খুউউউব প্রেম? বুড়ো স্বামী একেবারে মন ভরিয়ে দিয়েছে দেখছি!!”

উর্বী দুচোখ বন্ধ করে বলে,”ছিহ! কি চাও তুমি?”

_তোমার স্বামীকে তালাক দিয়ে আমার কাছে চলে আসবে। ব্যস এটুকুই।

_অসম্ভব!
উর্বী চেঁচিয়ে ওঠে।
_আমি কোনো রে’পি’স্ট,খুনীর কাছে ফিরবো না। ম’রে গেলেও না।

উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উর্বীর সামনে হাটু গেড়ে বসে উর্বীর চোখে চোখ রাখে। নরম কন্ঠে বলে,”রে’পিস্ট? উর্বী একটা ইন্সিডেন্ট দিয়ে তুমি আমার গোটা অনূভুতিকে জাজ করে ফেললে।”

উর্বী চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”উচ্ছাস আটটা বছর ন’র’কযন্ত্রণা ভোগ করেছি। ম’রতে চেয়েও পারিনি ভীতু বলে। কিন্তু জানো,বর্তমানে কেন জানি খুব জীবনের প্রতি টান অনুভব করতে শুরু করেছি। এখন আমি একটু বাঁচতে চাই, তোমার থেকে বাঁচতে চাই। আমাকে একটু বাঁচতে দাও।”

উচ্ছাস উর্বীর পা ধরে,”এই উর্বী তুমি আমায় একটু দয়া করো উর্বী। মাফ করো আমায়। জানো আমার না কেউ নেই। জানো তো?”

উর্বী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে।

উচ্ছাস উর্বীর কোলে মাথা রাখে। বাচ্চাদের মতো নরম গলায় বলে,”আমি আর তোমাকে জালাতন করবো না উর্বী। তুমি যেভাবে চলতে বলবে আমি সেভাবে চলবো। একটা চাকরি নেবো। দুজনে সুন্দর একটা সংসার সাজাবো উর্বী। যা হয়েছে ভুলে যাও একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে। তুমি ছাড়া আমাকে কেউ বোঝে না উর্বী। তুমিও যদি আমায় না বোঝো। আমি বড্ড অসহায়। আমাকে একটু শান্তি দাও না উর্বী। তোমার কাছে আমি ভিক্ষা চাইছি।”

উর্বী উচ্ছাসের মাথার দিকে তাকায়। তারপর বিছানার চাদর খামছে ধরে বসে থাকে।

***
মামুন বুঝতে পারছে না এতক্ষন ধরে উচ্ছাস ২০৪ নাম্বার রুমে কি করছে ! যাই হোক। গোটা রিসোর্ট ফাঁকা। টপকালে এখনই টপকাতে হবে।

রাওনাফ চুপচাপ বসে আছে। জাহাঙ্গীর এসে পাশে বসে। রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কিরে। ভাবির খোজ নিয়েছিস ? মাথা ব্যাথা কমেছে?

_না,ফোন দিইনি। ঘুমাচ্ছে বোধ হয়,ঘুমাক।

জাহাঙ্গীর খুকখুক করে কাশে। রাওনাফ সেদিকে তাকায়, বলে,
“কি কিছু বলবি?”

_না মানে, সত্যি করে বলতো আমায়, ভাবীর সাথে তোর তেমন কোনো ইন্টিমেসি গড়ে ওঠেনি তাইনা?
রাওনাফ রেগে যায়,”আচ্ছা তোরা কি আমাদের দুজনকে নিয়ে গবেষণা করতেই এখানে এসেছিস? নিজেদের নিয়ে থাক না! যা গিয়ে ভাবীকে সময় দে।”

জাহাঙ্গীর ভয় পাওয়া গলায় বলে,”আচ্ছা এই বাদ দিলাম। প্লিজ রেগে যাস না। আমাদের চিন্তা হয় তো।”

রাওনাফ কিছু বলে না,ফোনের দিকে তাকায়। আধা ঘন্টার বেশি হয়ে গিয়েছে। উর্বী কি ঘুমাচ্ছে! ঘুমাচ্ছেই বোধ হয়। থাক ফোন দিয়ে কাজ নেই। রুমে আছে রুমে থাকুক। এখানে এলেই তো সবাই মিলে আবার বিরক্ত করা শুরু করবে।
***
উর্বী নীরব। উচ্ছাস তার কোল থেকে মাথা উঠিয়ে তার পাশে বসে, হাত দিয়ে উর্বীর দুই গাল ধরে বলে,”তুমি বলো,আমার কথা শুনবে না?।”
এক ঝটকায় উচ্ছাসের হাত সরিয়ে দেয়,”তুমি এই মুহুর্তে এখান থেকে চলে যাও। এক্ষুনি।”

উর্বীর ফোন বেজে উঠছে। রাওনাফ ফোন দিয়েছে। উর্বী ফোনটা রিসিভ করতে যায় কিন্তু উচ্ছাস ছিনিয়ে নেয় ফোন। চেঁচিয়ে উঠে উর্বীকে বলে, “তুমি আমাকে কঠিন হতে বাধ্য কোরো না উর্বী। বলো তুমি তোমার স্বামীকে তালাক দিয়ে আমার কাছে ফিরবে। তাহলে কিন্তু তোমার স্বামীরও কোনো ক্ষতি আমি করবো না।”

উর্বী চেঁচিয়ে ওঠে,”শর্ত দিচ্ছো তুমি আমায় ! শর্ত ! তারপর কি হবে? শর্ত অনুযায়ী তোমার সাথে শু’তে হবে? সারাজীবন তোমার রক্ষিতা হয়ে থাকতে হবে? যেমন টা তুমি চেয়েছিলে। কারন তোমার তো বিয়ে করে কাউকে স্বীকৃতি দেওয়ার মুরোদ নেই। আছে শুধু রে’ইপ করার।”

রাওনাফ ফোন দিয়েই যাচ্ছে। উচ্ছাস উর্বীকে ফোন ধরতে দিচ্ছে না। উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“করবো বিয়ে তোমায়। সত্যিই বিয়ে হবে আমাদের। তুমি শুধু একবার রাজি হও।”

_মরে গেলেও না। কারন আমি বিবাহিতা, বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার এবং বিয়ে যদি নাও হতো তবুও একটা রে’পিস্টকে কখনোই বিয়ে করতাম না আমি।
চেঁচিয়ে বলে উর্বী। উচ্ছাস বলে,”রেপিস্ট কে বিয়ে করবে না? বুঝলাম। তবে এটা কোন বিয়েতে আটকে আছো তুমি? চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্ক।

উর্বী হাসে,হাসতে হাসতেই বলে,”কোনটা চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্ক? সজ্ঞানেই কবুল বলেছি আমি। আমি কবুল না বলতে চাইলে আমার ভাইয়ার সাধ্যি ছিলো না আমাকে দিয়ে কবুল বলানোর।
তুমি আমার সাথে বরাবর যা করেছো সেটা চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্ক। আর তুমি ঠিক বলেছো, এই বিয়েটা করা একদিক থেকে ভুলই ছিলো আমার। সত্যিকার অর্থে ভুলটা হলো ঐ ভালো মানুষটাকে আমার এই জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলা। ওটাই একমাত্র ভুল। উচিৎ হয়নি আমার।

উচ্ছাস তাকিয়ে আছে। উর্বী বলতে থাকে,”আমার স্বামী ভুল না। যদিও আমি তাকে চাইনি। হয়তো আল্লাহ চেয়েছেন।”

_স্বামী?

_হ্যা। উনি আমার স্বামী। শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে হয়েছে আমাদের। ঐ অতটুকুই পবিত্রতা,সান্ত্বনা,স্বচ্ছতা আছে আমার জীবনে এখন পর্যন্ত, যে আমি কারো সাথে বৈধ সম্পর্কে আছি। আর কোথাও কোনো পবিত্রতা নেই আমার। তুমি থাকতে দাওনি। এবার অন্তত আমাকে মুক্তি দাও। সব শেষ। তুমি শেষ করেছো, আমি শেষ করেছি। জেল খেটেছো,জামিন পেয়েছো এখন একটা সুন্দর জীবনে ফিরে এসো। আমাকেও এই জীবনে থাকতে দাও যে জীবনে আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। দোহাই তোমার।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে উর্বী থামে, তারপর আবার কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করে,”আর তুমি! তুমি অভিশাপ হয়েই থাকবে আমার জীবনে! যার আমার জীবনে আসার প্রয়োজন ছিলো কেবল আমার শরীর, জীবন নোংরা করতে। অন্য কোনো গুরুত্ব তুমি বহন করো না আমার জীবনে। জেনে নাও তুমি। আর ঐ বাচ্চাটা……”

থেমে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে উর্বী। অঝোর ধারায় কাঁদছে সে। শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। একটা গোঙানির মতো শব্দ বের হচ্ছে।

উচ্ছাস নরম গলায় বলে,”উর্বী। লাইফ সবাইকে সেকেন্ড চান্স দেয় না। আমাকে দিয়েছে। খুব একটা দেরি হয়নি। চলো এবার সংসার করি। আমি যা করেছি তার জন্য সত্যিই আমি অনুতপ্ত।”

_কিসের অনুতপ্ত? সেই এক প্রতিহিংসা, সেই আগের মতো আমার চুলের মুঠি ধরা, পাগলা কুত্তার মতো আচরণ করা। এসব তোমার অনুতাপ? একজনকে ছু’ড়ি মে’রে মারতে চেয়েছিলে ওটা অনুতাপ?

_এসব তোমার জন্য উর্বী। তুমি কেন কখনো বুঝতে পারো না।

_না আমি বুঝতে চাই না। কখনোই কিছু বুঝতে পারিনি, বুঝতে পারলে এসব কিছুই হতো না আমার সাথে। নিজের সাথে যা হয়েছে সবকিছু মেনে নিয়েছি। ওসব হবারই ছিলো। অদৃষ্টকে কেউ বদলাতে পারে না,আর সেটা নিজের দোষে হলে তো কথাই নেই। তবে ঐ উপরে যিনি আছেন তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, উর্বী তুমি যাকে নিজের জন্য পছন্দ করেছো আমি না চাইলে সেটা তোমার জীবন ধ্বংসের কারণই হবে। আমি যে তোমার জন্য অন্য কাউকে বেছে রেখেছি।

উচ্ছাস শীতল চোখে তাকিয়ে ছিলো ,রাগে ক্ষোভে আবারও উর্বীর চুলের মুঠি ধরে,উর্বী নিজেকে ছাড়াতে চায়। পারে না।

“খবরদার আমাকে রাগাস না। খবরদার ! নয়তো এখানে স্বামী স্ত্রী দুটোকে পু’তে রেখে দেবো।”

উর্বী অসহায়ের মতো উচ্ছাসের দিকে চায়।
“বাহহ! এইতো এলে আসল রুপে। এতক্ষন নরম গলায় নাটক করছিলে!”
উচ্ছাস দাঁত কিরমির করে বলে,”বল তালাক দিবি কি না স্বামীকে।”

_না। দেবো না।
তেজী কন্ঠে বলে ওঠে উর্বী।

তক্ষুনি কেউ দরজা ধাক্কাতে থাকে।
উচ্ছাস হেসে বলে,”ওই যে তোমার স্বামী এসেছে। এবার তোমার চোখের সামনেই ওটাকে শেষ করবো। তারপর জেলে যাবো।”

কথাটি বলেই উচ্ছাস প্যান্টের পকেট থেকে এক টান দিয়ে একটা রিভলবার বের করে। উর্বী শিউরে ওঠে। লাফ দিয়ে উচ্ছাসের সামনে দাঁড়ায়। তারপর উচ্ছাসের পা ধরে,”তোমার দোহাই লাগে ওনাকে কিছু করবে না। উচ্ছাস আমি দয়া চাইছি।”

উচ্ছাস নির্বিকার চিত্তে ধাক্কা দিয়ে উর্বীকে সরিয়ে দেয়। উর্বী মেঝেতে পরে গেলেও উঠে দাঁড়ায়। তার বুক থেকে শাড়ীর আঁচল পরে যায়। সে গিয়ে দরজা আটকে দাঁড়ায়,”না! তুমি এটা করতে পারো না উচ্ছাস।”
উচ্ছাস হাসে,”পারি।”
শব্দটা উচ্চারণ করে উচ্ছাস উর্বীর ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তারপর দরজা খুলে দেয়।

***
রাওনাফ হাতের ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এতবার কল করে নিজের কাছেই কেমন যেন লাগছে তার। কিন্তু উর্বী ফোন ধরেনি কেন! হয়তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। ঘুমাক।

দরজা খুলেই উচ্ছাস দেখতে পায় মামুন দাঁড়িয়ে আছে তাদের দিকেই একটা রিভলবার তাক করা ‌।
মামুন একবার উচ্ছাসকে দেখে, একবার উর্বীকে দেখে ‌। উর্বী দ্রুত শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে নেয়।

মামুন বাকা হাসি দিয়ে বলে,”ও এই ব্যাপার! তুই এখানে নটি নিয়ে ফুর্তি করছিস। আমি ভেবেছি কি না কি!”

উচ্ছাস চেঁচিয়ে বলে,”মুখ সামলে কথা বল শু’য়ো’রের বাচ্চা নয়তো এখানেই পু’তে দেবো তোকে।”
_পুতবো তো তোকে আমি আজ। তোর এই নটিকে বল ম’রতে না চাইলে এখান থেকে দশ সেকেন্ডে কেটে পরতে।

উর্বী ভয়ে গুটিয়ে আছে। মামুন উর্বীর দিকে হায়েনার মতো তাকায়, যেনো চোখ দিয়ে গিলে খেতে চাচ্ছে।

উচ্ছাস চেঁচিয়ে ওঠে,”ওর থেকে চোখ নামা। চোখ গেলে দেবো তোর।”

মামুন এবার লাফ দিয়ে উর্বীকে ধরে, তারপর রিভলবার উর্বীর মাথায় ঠেকায়।
উচ্ছাস চেঁচিয়ে ওঠে,”ওর কিছু হলে আমি তোর বাপ মা সহ কবর দিয়ে দেবো তোকে কসম।”

মামুন হাসে,”বাহ! এতো প্রেম। তবে তো এটাকেই আগে মারবো।”
কথাটি মামুন শেষ করতে পারেনা, তার আগেই উচ্ছাসের রিভলবারের গুলি এসে তার গলা ভেদ করে চলে যায়।

মামুন মুখ থুবড়ে মাটি তে পরে যায়।
উর্বী মুখ ঢেকে বিকট চিতকার দিয়ে ওঠে।

পার্টিতে উচ্চ ভলিউমে মিউজিক বাজছে। কেউই শুনতে পায়না গুলির শব্দ, রাওনাফ শুনতে পায়না উর্বীর সে চিতকার।

রিসিপশনিস্ট মেয়েটি ঘাবড়ে যায়, গুলির শব্দ মনে হচ্ছে! সে ভয় পেয়ে রিসিপশনের এলার্ট বেল টিপতে থাকে।
রিসোর্টের কিছু কর্মী বাইরে থেকে ছুটে আসে। এরা সবাই ভয় পেয়েছে। এখন কি করবে ! আওয়াজটা চারতলা থেকে এসেছে। গিয়ে দেখবে? কিন্তু অযথা জীবনের ঝুকি নিয়ে লাভ কি,তারচে বরং পুলিশ কে ফোন দেওয়া যাক। একজন স্টাফ টেলিফোন লাইনের কাছে গিয়ে পুলিশ স্টেশনে ফোন লাগায়।

উর্বী কাঁপছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বিরবির করছে,”মেরে দিলে।”
তার শরীর ভেঙে নিচে পরে যেতে চাইছে।

_আমি না মে’রে দিলে ও তোমাকে মেরে দিতো।

_তাই বলে তুমি!
উর্বী আর কিছু বলতে পারছে না। সে মাটিতে লুটিয়ে পরে।

উচ্ছাস গিয়ে উর্বীর হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে আর বলে,”চলো। সময় নেই। এখানে এখন বিরাট ঝামেলা লেগে যাবে। তার আগে যেতে হবে।”
উর্বীর মাথা বনবন করছে। সে অসহায়ের মতো চারদিকে তাকাতে থাকে।

_কি হলো চলো।
ধ’ম’কে ওঠে উচ্ছাস।

_কোথায় যাবো আমি! একটা খুনীর সাথে কোথায় যাবো? তুমি একটা সাক্ষাৎ পি’শাচ।

_হ্যা আমি তাই‌।
কথাটি বলে উচ্ছাস উর্বীকে জোর করে তোলার চেষ্টা করছে। উর্বী নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে উচ্ছাসকে আটকাতে চায়।

উচ্ছাস উর্বীর চুলের মুঠি ধরে টেনে হিচরে রুম থেকে বের করার চেষ্টা করছে। উর্বী অনবরত উচ্ছাসের বুকে কিল চড় মারতে থাকে। তাতে উচ্ছাসের কোনো ভাবান্তর হয়না,তার বলিষ্ঠ শরীরে কোনো প্রভাব পরে না। সে উর্বীকে টানছে তো টানছেই।

সজীব দৌড়ে এসে বলে,”ভাই! কি করছেন আপনি!”

তারপর মামুনের লা’শ দেখেই মুখ চেপে ধরে। সে এই ভয়টাই পেয়েছিলো।

সজীব তোতলাতে তোতলাতে বলে,”ভাই, কি করছেন ভাই। ওকে ছাড়েন ভাই। নিচে পুলিশ আসছে হয়তো। আর দুই মিনিট দেরি করলে আপনি আমি দুজনেই শেষ। ওকে ছাড়েন ভাই,ওকে পরে দেখার মেলা সময় পাবেন।”

উচ্ছাস উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কাজ টা ঠিক করলে না তুমি, একেবারেই ঠিক করলে না। এই জন্মে উচ্ছাসের ছায়া সরাতে পারবে না নিজের শরীর থেকে। আমি মরলে ভিন্ন কথা ‌”
উর্বী ঘোলাটে চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে।

সজীব বলে,”ভাই এদিকে ইমার্জেন্সি এক্সিট আছে একটা। এদিকে আসেন।”
কথাটি বলে সজীব মামুনের লা’শের পকেট থেকে ফোন,মানিব্যাগ এবং আ’ই’ডিকার্ড নিয়ে নেয়।

উচ্ছাস উর্বীর দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকায়,তারপর সজীবের পিছু নেয়।

***
পার্টির মিউজিক অফ হয়ে যায়। এটা কিসের চেঁচামেচি হচ্ছে। সব গেস্টরা কৌতূহলী হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে।
রিসোর্টের একজন স্টাফ দৌড়ে আসছে এদিকেই, সে চেঁচিয়ে বলছে,”চারতলায় গুলির আওয়াজ হয়েছে‌ । পুলিশ এসেছে পুলিশ। আপনারা সাবধানে থাকুন সবাই।”

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলছে এ!!

রাওনাফের বন্ধুরা হতবাক হয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, তারপর প্রায় দৌড়ে রিসোর্টের দিকে যেতে থাকে। তার এতো ভয়
হচ্ছে কেনো! উর্বীর কথা ভেবে তার বুকে এতো ব্যাথা হচ্ছে কেনো !

বাকিরা সবাই তার পিছু নেয়।

রিসোর্টের লবিতে পুলিশ রাওনাফকে আটকায়।

_আপনি কোথায় যাচ্ছেন। আগে আমাদের দেখতে দিন বিষয়টা।

_উপরে আমার স্ত্রী একা রয়েছে। আমাকে যেতে দিন।
উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে ওঠে রাওনাফ।

_আপনি অপেক্ষা করুন। আমরা দেখছি তো!

রাওনাফের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়,সে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,
“বললাম না! আমার স্ত্রী আছে,আমাকে যেতে হবে!”

কনস্টেবল আর কিছু বলে না। রাওনাফ উপরে উঠতে থাকে। তিনজন কনস্টেবল তার পিছু নেয়।

উর্বী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে আছে। চুল এলোমেলো। শরীরে আঘাতের চিহ্ন।
তার পায়ের কাছে পরে আছে মামুনের লা’শ।

রাওনাফ রুমে ঢুকেই সে দৃশ্য দেখে “উর্বী” বলে চেচিয়ে ওঠে।

কনস্টেবল তিনজনও রুমে ঢোকে।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায় না। সে যেনো কারো কথা শুনতে পাচ্ছে না।

কনস্টেবলের মধ্যে একজন বলে ওঠে,”ও মাই গড! লাশ!”

রাওনাফ ছুটে গিয়ে উর্বীর শাড়ির আঁচল উঠিয়ে তার গায়ে জরিয়ে দেয়। উর্বী চুপ হয়ে আছে।

রাওনাফ উর্বীর কাঁধ ধরে ধাক্কা দেয়,”উর্বী! ‌উর্বী!”

উর্বী যেনো আঁতকে উঠে রাওনাফের দিকে তাকায়।
রাওনাফ কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। কিভাবে উর্বীকে স্বাভাবিক করবে সে!

রাওনাফ কিছু বলে ওঠার আগেই উর্বী একটা বিকট চিৎকার দিয়ে রাওনাফকে জরিয়ে ধরে। সে কাঁদছে। ঠিকভাবে নিশ্বাস নিতে পারছে না। রাওনাফ বোকার মতো আশেপাশে তাকাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পরে জড়তা কাটিয়ে উর্বীকে দুহাত দিয়ে আগলে ধরে। ধীরে ধীরে ডান হাত উর্বীর মাথায় রেখে অস্ফুট স্বরে বলে,”কাম ডাউন। সব ঠিক আছে! কিচ্ছু হয়নি।”

উর্বী শান্ত হয়না। সে রাওনাফের শার্ট খামচে ধরে কাঁদতে থাকে।

কনস্টেবল তিনজন কিসব বলাবলি করছে। রাওনাফ তা শোনে না। তার এই মেয়েটির জন্য উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে।

চলমান…..

আরেকটি বার পর্ব-১৪+১৫

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৪
#Esrat_Ety

রওশান আরা একপ্রকার জোর করেই উর্বীকে নিয়ে বিকেলে রওনা দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।
লুৎফুন্নাহার কাঁদছেন।
উর্বী তার কাছে গিয়ে বলে,”বিয়ে দেওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করতে,এখন মেয়ে শশুরবাড়িতে যাচ্ছে বলে কাঁদছো! এক কাজ করো তারচেয়ে আমাকে ডাক্তারের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসলেই পারো। আজীবন আর কাঁদতে হবেনা।”

তহুরা চ’ম’কে উঠে উর্বীর দিকে তাকায়। কি সর্বনেশে কথা ! লুৎফুন্নাহার চোখ মুছে ফেলেন। বলেন,”অনেক কপাল করে এমন শাশুড়ি পেয়েছিস। আর এমন ফালতু মজা করবি না কখনো।”

উর্বী বিড়বিড় করে বলে,
_হ্যা তা ঠিক। কপাল করে শাশুড়িটাই পেয়েছি।
তহুরা ব্যস্ত হয়ে পরে। সে উর্বীর শশুর বাড়ির জন্য নানা রকমের পিঠা প্যাক করে দিতে থাকে। লুৎফুন্নাহারের আদেশে রাওনাফের জন্য আলাদা করে সব দেয়।

উর্বী বলে,”এসব করতে হবে না ভাবী, সে এসব খায় না। শুধু শুধু কষ্ট করবে না।”
_খাবে,তুই শুধু সামনে রাখিস।

উর্বী ভাবীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরের দিকে যায়।

রেডি হয়ে উর্বী দাঁড়িয়ে পরে। উপমা হাতের ফোনের স্ক্রিনের থেকে চোখ সরিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”অনেক্ষণ ধরে দেখলাম আপু। আমার স্বামীর থেকে তোর স্বামী বেশিই সুন্দর।”

উর্বী হাসতে হাসতে বিছানার একপাশে বসে মজার ছলে বলে,”সান্ত্বনা দিচ্ছিস?”

_মোটেও না। আসিফ মটুর থেকে রাওনাফ ভাইয়া সুন্দর!

উর্বী উপমার বাচ্চাসুলভ কথা শুনে হাসতে থাকে। উপমা বলে ওঠে,”ঐ উচ্ছাসের থেকেও সুন্দর।”
বাক্যটা উচ্চারণ করেই উপমা জিভ কাটে। মুখ ফসকে এটা কি বলে ফেলেছে সে!
উর্বীর চোখে মুখে কাঠিন্যতা ছেয়ে যায়। উপমা বোনের দিকে তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,”সরি আপু!”

উর্বী উঠে দ্রুত চলে যায় সেখান থেকে।

***
নাবিলের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে উর্বী বারবার উঁকি দিচ্ছে। বিষয়টি নাবিল খেয়াল করেছে। সে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। যদি এই মহিলা এখান থেকে না সরে তাহলে সে আজ অনেক কঠিন কথা শোনাবে।
উর্বী বাইরে থেকে বলে,”নাবিল,আমি একটু আসবো?”
_না।
ঠান্ডা ভাবে বলে নাবিল। উর্বীর নিজেকে জোকার মনে হচ্ছে। এভাবে মুখের উপর না করে দিলো? এই ছেলেটি আসলেই ত্যাদোর। এর মা কি এমন ছিলো? রাওনাফকে দেখে তো এমন মনে হয় না। বোধ হয় এই ছেলেটি তার দাদীর মতো হয়েছে।
তার জেদ চেপে গিয়েছে। আজতো এই ছেলেকে পিঠা খাইয়েই যাবে।

সে বলে,” নাবিল মালপোয়া খাবে ?”
_না। আপনি প্লিজ যান এখান থেকে।
উর্বী ভেতরে ঢোকে। তার হাতে এক ট্রে ভর্তি পিঠা।
নাবিল উঠে দাঁড়ায়।

উর্বী বলতে থাকে,
_এই নাও। পিঠা খাও। আমার মা তোমার নানু হয় তাই না? তোমার নানু বানিয়েছে। শুনলাম তোমার পিঠা খুব পছন্দ।
_ আচ্ছা আপনি কি কানে শুনতে পাচ্ছেন না? আমি যেতে বলছি আপনাকে। নিজেকে কি আমার মা ভাবতে শুরু করেছেন নাকি।

_মা না হই,সৎ মা তো। মা-ই তো হলাম একদিক থেকে।
উর্বীও দাঁতে দাঁত চেপে বলে। আজ এই জেদী ছেলেটার সাথে সমানে সমান হিসেব হবে।

নাবিল কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী বলতে থাকে,

_শোনো আমাদের বাড়িতে কিন্তু পিঠা বানানোর লোক নেই। তুমি প্রায়ই দেখি পিঠার জন্য হা হুতাশ করো তোমার দাদুর কাছে। এই সুযোগ টা মিস করবে না।
নাবিল পিঠার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি আগের নাবিল হলে এই পিঠে ভর্তি ট্রে এতক্ষনে ডাস্টবিনে থাকতো। আপনি যান বলছি। প্লিজ‌।”

উর্বীর ধৈর্য্যর বাধ ভেঙ্গে যায়। সে হাত থেকে পিঠার থালা টেবিলে ধপ করে রেখে চেঁচিয়ে ওঠে,”এই ছেলে! তুমি কি ভাবো কি নিজেকে হ্যা? কিচ্ছু বলিনা বলে যা ইচ্ছে তাই করবে? যা ইচ্ছে তাই বলবে? একটা ঠাটিয়ে চ’ড় মারবো তোমাকে আমি! বড়দের সাথে কথা বলতে জানে না। খালি বইয়ের পড়া মুখস্থ করেই মেধাবী। তোমার চেয়ে শর্মী ঢের বুঝদার। তোমার মাথাভর্তি গোবর। কাচা গোবর। ”

নাবিল হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
নাবিলের রুমের বাইরে সবাই ভীড় জমায়।

উর্বী নাবিলের হাত ধরে টানতে টানতে বিছানায় নিয়ে বসায়। নাবিল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। উর্বীর এই রুপের সাথে নাবিল পরিচিত নয়। উর্বী পিঠার থালা এনে নাবিলের হাতে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে তার সামনে বসে। দাত কিড়মিড় করে বলে,

“কসম! সবকটা পিঠা শেষ না করলে আমি এই ঘর থেকে যাবো না।কসম।”
রাগে উর্বীর গলা কাপছে। নাবিল একবার পিঠার দিকে তাকায় একবার উর্বীর দিকে।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভয় পেয়েছে খুব।

***
গটগট করতে করতে সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে উর্বী নাবিলের ঘর থেকে বের হয়। নাবিল বিছানায় চুপচাপ বসে আছে। তার পাশে রাখা পিঠার ট্রে টা পুরো খালি। উর্বী সবগুলো পিঠা খাইয়ে তবেই দম নিয়েছে।

“কি ভেবেছে সবাই! উর্বী‌ বাজারের সস্তা দরের আলু পটল! সবাই সারাজীবন উর্বীকে কথা শুনিয়েছে, শুনিয়ে যাবে ! ঐ পিচ্চি ছেলেটা পর্যন্ত ধ’ম’ক দিয়ে কথা বলে! এখন থেকে আর চলবে না! এটা তোমার পাপার বাড়ি হলে, এটা আমারও স্বামীর বাড়ি নাবিল, এখন থেকে একেবারে হাংকি পাংকি করলে এভাবেই শাস্তি দেবো আমি…..”

বিড়বিড় করতে করতে উর্বী সিড়ি ভাঙতে থাকে! তার মে’জাজ ভীষণ চটে আছে! কি বলছে সে নিজেও জানে না!

হন্তদন্ত হয় নিজের ঘরের সামনে এসেই সে দাঁড়িয়ে পরে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ঘরের ভেতর দৃষ্টি দিয়ে।

রাওনাফ উর্বীকে দেখতেই খাওয়া থামিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”আমি ভেবেছি আমার জন্য রেখেছো এগুলো,এগুলো আমার জন্য ছিলো না?”

উর্বী কিছুক্ষণ অনর্থক তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলে। সে এতক্ষন রাওনাফকে পিঠে খেতে দেখছিলো। হাসি থামিয়ে বলে ওঠে,

_এগুলো আপনার জন্যই ছিলো। আপনি খান‌। আমিতো শুধু দেখছিলাম একজন অতি স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ কিভাবে আরাম করে এই তেল মিষ্টি পিঠা খাচ্ছে। ভালোই লাগছিলো দেখতে। ভাবিনি খাবেন। আমি তো আনতেই চাইনি,ভাবী জোর করে দিয়েছে।

রাওনাফ মুচকি হেসে বলে,”তোমার মা দারুন পিঠা বানায়। এরকম পিঠা অনেক বছর হয় খাইনি। নাবিলের মাম্মাও ঠিক এরকম মজাদার পিঠা বানাতো। তার মতো পিঠা কেউ বানাতে পারতো না। শুধু পিঠা না,যেকোনো রান্না।”

উর্বী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এমন সময় আমীরুন এসে ঘরের দরজায় দাঁড়ায়। রাওনাফকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,”সুমনা আর ঝুমুর আপায় আসছে বড় ভাইজান।”

***
“দুলাভাইকে যতটা ভদ্রলোক মনে হয় দুলাভাই কিন্তু ততটা ভদ্রলোক নয় উর্বী।”

সুমনার কথায় উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। রাওনাফ স্তব্ধ হয়ে সুমনার দিকে তাকিয়ে আছে। সুমনা রাওনাফকে বলতে থাকে,”কি? এভাবে কি দেখছেন!”

রাওনাফ কিছু না বলে কফির মগে চুমুক বসায়। সুমনা আর ঝুমুরকে সে খুব ভালো করে চেনে। এরা একবার যখন রাওনাফকে নিয়ে পরেছে,সহজে ছাড়বে না। তার চেয়ে এখান থেকে উঠে পরা যাক!

রাওনাফ হাতঘড়ির দিকে তাকায়। সুমনা আর ঝুমুর হঠাৎ করে এসেছে রাওনাফের সাথে দেখা করতে, রাওনাফের স্ত্রীকে দেখতে। উর্বী বিনয়ের সাথে হেসে সুমনাকে বলে,”আপনারা বসুন! আমি, চা নিয়ে আসছি!”

ঝুমুর উর্বীর হাত টেনে ধরে। হেসে বলে,”আরে বসুন। চা পরে হবে!”

উর্বী বসে পরে। সুমনা বলতে থাকে,”সত্যি কথাই বললাম। ওনাকে দেখতে শান্তশিষ্ট দেখাতে পারে কিন্তু মোটেও তেমনটি নয়। আপাকে সবসময় ডমিনেট করে রাখতো।‌ খুব পজেসিভ,বলতে গেলে মাত্রাতিরিক্ত পজেসিভ ছিলো। ইনফ্যাক্ট আপাকে দুলাভাই দুলাভাইয়ের কোনো ছেলে বন্ধুদের সাথেও কথা বলতে দিতো না।”

রাওনাফ অবাক হয়ে সুমনার ফাজলামি টাইপের কথাগুলো শুনছে! সে আদৌ এমন ছিলো না!

উর্বী হাসি চেপে রেখে সুমনাকে বলে,”ঠিকাছে। পরে শুনবো। বসুন আপনারা। আমি চা নিয়ে আসছি।”

উর্বী চলে যেতেই রাওনাফ সুমনাকে কিছু বলতে যাবে, সুমনা বলে ওঠে,”একটু ভাঙচি দিচ্ছিলাম আপনার নামে দুলাভাই আপনার বৌয়ের কাছে!”

ঝুমুর বলতে থাকে,”আপনার স্ত্রী খুবই খুবই খুবই চাঁপা স্বভাবের মনে হচ্ছে দুলাভাই। বড় আপা ছিলো চঞ্চল। দু’জন সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী চরিত্রের মানুষের সাথে সংসার করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে যদি একটু বলতেন!”

রাওনাফ মুখ চ কারন্ত শব্দ করে বলে,”থামবে তুমি! হাউ চাইল্ডিশ!”

সুমনা আর ঝুমুর উচ্চশব্দে হাসতে থাকে।

রাওনাফ শুকনো হাসি হেসে বলে,”হঠাৎ করে এলে যে! এতো করে বলি তখন সারা দাও না!”

ঝুমুর বলে ওঠে,”আপনার বৌকে দেখতে এলাম। তাছাড়া আপনার সাথে কথা ছিলো!”

রাওনাফের ভ্রু কুঞ্চিত হয়, ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে বলে,” কি কথা?”

_বাবার প্রোপার্টি ভাগ হয়েছে। আপার অংশ খুব শিগগিরই তার ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে দিতে একটা পারিবারিক বৈঠক বসাতে চাইছি। আপনি যদি একটু সময় দিতেন!”

চায়ের ট্রে নিয়ে উর্বী ভেতরে ঢোকে। সবাই চুপ হয়ে যায়। উর্বী সবার মুখের দিকে তাকায়। তার একটুও এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। সুমনা আর ঝুমুরের কত ব্যক্তিগত কথা থাকতে পারে তাদের আপার স্বামীর সাথে! উর্বীর তৃতীয় পক্ষ হয়ে থাকার ইচ্ছে নেই।
ঝুমুর উঠে দাঁড়িয়ে উর্বীর হাত থেকে ট্রে নামিয়ে বলে,”বসুন আপনি। আজ আপনার সাথে অনেক আড্ডা দেবো!”

বিনয়ী হাসি হেসে ঝুমুর আর সুমনার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে উর্বী বলে,”আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি!”

ঘর থেকে বেরিয়ে উর্বী সরাসরি নিচে চলে যায়। আজ যেহেতু একটু সময় পেয়েছে রান্নাটা বরং সে নিজের হাতে করবে।

***
অন্তরা বসে বসে টিভি দেখছিলো। উর্বী দরজার বাইরে এসে বলে,”আসবো।”

_আসুন ভাবি।
অন্তরা উঠে বসে।

উর্বীর হাতে এক বাটি কদবেল ভর্তা।

বিছানার এক পাশে বসতে বসতে সে বলে,
_নাও এটা খাও।

অন্তরা কদবেল মাখা দেখে খুশি হয়। তার আসলেই টক কিছু খেতে ইচ্ছে করছিলো।
সে বাটি থেকে ভর্তা তুলে মুখে দিতে দিতে বলে,”আপনিও খান না ভাবি।”

-না,এটা তোমার জন্য তোমার শাশুড়ি বানিয়েছে। এটা শুধু তুমিই খাবে।

অন্তরা উর্বীর দিকে অবাক হয়ে তাকায়। উর্বীর মুখ হাসি হাসি। বলে ওঠে,”কি একটা ম্যাজিক দেখো অন্তরা! নাতি নাতনি আসার খবর শুনলেই বাঙালি জাঁদরেল শাশুড়ি গুলো গলে যায় পুরো।”

অন্তরা লাজুক হাসি হাসে।

_আজ থেকে রান্না বান্নার ঝামেলা করবে না। মা আমাদের সাথে খেতে বলেছেন।

অন্তরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মানে কি তার শাশুড়ি তাকে মেনে নিয়েছেন!

উর্বী বলে,”যদিও মা বলেছেন বাবু হবার পরে তোমাদের আবার আলাদা থাকতে হবে তবে আমি জানি মা নাতী নাতনির মুখ দেখলে আর তোমাদের দূরে সরিয়ে রাখবে না।”

উর্বী অন্তরার পাশ থেকে একটা নকশি কাথা উঠিয়ে বলে,”এটা কি! বাবুর জন্য করছিলে? তোমার ফোড় টা তো হয়নি। দাড়াও দেখিয়ে দিচ্ছি।”
অন্তরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের জন্য যে মেয়েটার এতবড় ক্ষতি হলো সেই মেয়েটা তাদের প্রতি কতটা আন্তরিক !

অন্তরা উর্বীকে বলে,”একটা কথা বলবো ভাবি যদি কিছু মনে না করেন।”
-হ্যা। বলো।
-ভাইয়াকে আপনি মেনে নিয়েছেন নিজের স্বামী হিসেবে?

উর্বী হাসে। কিছুক্ষণ হেসে অন্তরার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে আমাকে একটা কাথা দাও। আমিও বাবুর জন্য নকশি কাথা বানাবো।

***
ঘুম ভাঙতেই গাঁয়ের ওপর ভারি কিছুর অস্তিত্ব টের পায় উর্বী। তার গাঁয়ের ওপর দু’টো কম্ফোর্টার চাপানো। কাল রাতে হারকাপানো শীতে উর্বী বড্ড ভুগেছিলো, একটা কম্ফোর্টারে মানছিলোই না যেন। কিন্তু অলসতার কারণে গুটিসুটি মেরেই ঘুমিয়েছিলো।
এটা রাওনাফ করিম খানের কাজ। উর্বী জানে। কম্ফোর্টার দু’টো সরিয়ে উর্বী আনমনে হাসে। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে সেদিকে চোখ যায়। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতেই স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে উর্বী চমকায়। বুকের মধ্যে সেই চিরচেনা আতঙ্ক এসে ভর করে। একবার রিং হয়ে কে’টে যায়। উর্বী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। দ্বিতীয় বার আবারও ফোন বেজে উঠতেই কাঁপা কাঁপা হাতে উর্বী ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ বলে ওঠে,”আসসালামুয়ালাইকুম মৃদুলা আপা। আমি লিটন বলছিলাম।”

উর্বী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অস্ফুট স্বরে বলে,”ওয়ালাইকুমুস সালাম, বলুন।”

_আপা, মনির ভাই মিটিং ফিক্সড করেছে আপনি জানেন?

_জি, জানি। আমি ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছে যাবো।

_ঠিকাছে আপা,রাখছি।

ফোনটা হুট করে সুইচ অফ করে হাত থেকে ফেলে চুপচাপ বসে থাকে উর্বী। বুকটা ক্রমশ ভার হয়ে উঠছে হঠাৎ। যেভাবে বসা ছিলো সেভাবেই হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকে। হঠাৎ মাথায় কারো হাতের অস্তিত্ব টের পেতেই উর্বী মাথা তুলে তাকায়। রওশান আরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”মাথা ঘুরাচ্ছে নাকি বৌমা? আজ তবে অফিস যেও না!”

উর্বী ম্লান হেসে বলে,”মা, ওটা আমার অফিস। এভাবে হুটহাট ছুটি নেওয়া যায় না। আমি ঠিক আছি।”

রওশান আরা হাতের ফোনটা উর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”রাওনাফ ফোন করেছে। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে নাকি। নাও ধরো।”

উর্বী খানিকটা অবাক হয়। ফোনটা হাতে নিতেই রওশান আরা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

উর্বী একপলক ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ফোনটা কানে ধরে।

ওপাশ থেকে রাওনাফের গলার আওয়াজ শোনা যায়, সে নিচুস্বরে উর্বীকে বলে,”তুমি কি অসুস্থ নাকি?”

_না তো।

রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”উর্বী তুমি কি বিকেলে ফ্রি আছো, অফিস টাইমের পরে?”

_আমার আবার কি কাজ? আমি তো বাড়িতেই থাকি। কেনো বলুনতো?

_না মানে,আমার কলিগরা অনেকদিন থেকেই বলছে গেট টুগেদারের কথা ‌। আজ হুট করে আমায় না জানিয়েই একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করেছে “রিভানায়”। খুব জোরাজুরি করছে। কি করবো বুঝতে পারছি না।

_আমাকে আসতে হবে?
নিচু স্বরে বলে ওঠে উর্বী।

_হ্যা,তবে তুমি না চাইলে দরকার নেই। পুরোটাই তোমার ইচ্ছে।

_আচ্ছা আমি আসবো।

_উর্বী।

_হ্যা বলুন। ব্যাপারটা কি জটিল হয়ে যাচ্ছে তোমার মনে হয়?

_না। আর কেউ যাবে না এ বাড়ি থেকে?

_না, শুধু শর্মী আসবে। ওকে নিয়ে এসো। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।

***
শর্মী দূরে দাঁড়িয়ে তার পরিচিত বন্ধুদের সাথে গল্প করছে।

উর্বীর মনে হচ্ছে উর্বী একটা ল্যাম্পোস্ট। সে ঠিক ল্যাম্পোস্টের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।
রাওনাফ তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।
পার্টিতে যে মহিলারা এসেছে তাদের একটিকেও উর্বীর পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে রাওনাফের বন্ধুদের স্ত্রীদের। যারা কোনো স্বাভাবিক মজাই করতে পারে না।
মধ্যবয়সী মহিলা হিসেবে তাদের আচরণ বেমানান।

এতক্ষণ সবাই উর্বীকে ঘিরে ধরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। পাঁচ মিনিট হলো উর্বীকে ছাড় দিয়েছে।

লামিয়া উর্বীর দিকে এগিয়ে আসে। উর্বীর কাছে এই মহিলাকে ভালো লেগেছে।

“কি ব্যাপার উর্বী? এখানে দাড়িয়ে কেনো?
_না এমনিই।

_তোমার বুঝি বিরক্তি লাগছে এই পরিবেশে? রাওনাফকে পাঠিয়ে দেবো?
_না না। তার দরকার নেই।

রাওনাফ উর্বীদের দিকেই আসছে। লামিয়া বলে,”আচ্ছা তোমার বর এদিকেই আসছে। আমি যাই হ্যা?”

উর্বী লামিয়াকে যেতে দেয় না। লামিয়া দাঁড়িয়ে থাকে। রাওনাফ এসে উর্বীকে বলে,”শরীর ঠিক আছে তোমার?”

_হ্যা,কেনো বলুন তো?

_না, চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছো।

_এতো আলো সব চোখে লাগছে আমার। আর কিছু না।

_কিছু খেয়েছো?

_না,এখানের কিছুই আমার পছন্দ হচ্ছে না।

_কোনো পানীয় খেলে খেতে পারো। ভালো লাগবে।

উর্বী চুপচাপ একটা গ্লাস উঠিয়ে নিতেই রাওনাফ বলে ওঠে,”ওটা যেখানে ছিলো সেখানেই রাখো। ওটা খেও না।”

উর্বী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। রাওনাফ সংকোচ নিয়ে নিচু স্বরে বলে,”ব্লাডি মেরি!”

উর্বী হতভম্ব হয়ে তার হাতের গ্লাসের দিকে তাকায়। তারপর চুপচাপ গ্লাসটা রেখে দিয়ে ঘুরে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনারা খান?”

রাওনাফ থতমত খেয়ে যায়। পরমুহূর্তেই বলে ওঠে,
_আরে না না। এগুলো তো আমার কয়েকজন কলিগরা এনেছে । ওরা খ্রীষ্টান।

উর্বী সরু চোখে রাওনাফকে দেখছে।
রাওনাফ মিনমিন করে বলে,” ডোন্ট জাজ মি! আমি জীবনে একটা সিগারেট খেয়ে দেখিনি।”

পাশ থেকে লামিয়া উচ্চশব্দে হেসে ওঠে। রাওনাফ আর উর্বী তার দিকে তাকায়। লামিয়া বলতে থাকে,”সিরিয়াসলি রাওনাফ তোমাদের দুজনের এই সিনটা কতটা কিউট বলে বোঝাতে পারবো না! মনে হচ্ছে কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকার কাছে সিগারেট খাওয়া নিয়ে কৈফিয়ত দিচ্ছে!”

রাওনাফ আর উর্বী চ’মকে ওঠে তারপর বিব্রত ভঙ্গিতে একে অপরের দিকে তাকায়। উর্বী মাথা নিচু করে অন্যদিকে চলে যায়। লামিয়া উচ্চশব্দে হাসতেই থাকে। রাওনাফ দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মতো, সে কি আসলেই কৈফিয়ত দিচ্ছিলো উর্বীর কাছে! কিন্তু কেন!”

অনুষ্ঠান শেষে উর্বীরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাওনাফ গাড়ি চালাচ্ছে। উর্বী আর শর্মী পেছনে বসে গল্প করছে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে। শর্মী বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়,সে উর্বীকেও বলে ছুঁতে। উর্বী ধমক দিয়ে শর্মীর হাত ভেতরে টেনে আনে এবং গাড়ির জানালার কাচ উঠিয়ে দেয়।
রাওনাফ মিররে তাদের দেখে। শর্মী হাতের পানি উর্বীর মুখে ছিটিয়ে দিয়ে খিকখিক করে হাসে। উর্বী টিস্যু দিয়ে শর্মীর হাত মুছিয়ে দেয়।

রাওনাফের কাছে শর্মীর সে হাঁসি শুনতে বড্ড ভালো লাগে। তার চোখে হঠাৎ শর্মীর প্রতি উর্বীর অদৃশ্য একটা অধিকাবোধ ধরা পরে।

***
রাওনাফ তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দিয়েছে। দশটায় পরিক্ষা শুরু হবে। এখন আটটা বেজে গিয়েছে, হাতে মাত্র দুঘন্টা বাকি। সে তার ছেলেমেয়েকে তাড়া দিচ্ছে,”কি তোমাদের হয়নি এখনো? আরে তাড়াতাড়ি করো,রাস্তায় জ্যাম থাকতে পারে। কুইক।”

আজ নাবিল আর শায়মীর মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে। নাবিল শায়মী তাদের দাদুর ঘরে, দাদুর থেকে দোয়া চাইতে এসেছে।
রওশান আরা তার নাতী নাতনির কপালে চুমু একে দেন।

রাওনাফ নিচতলায় দাঁড়িয়ে চেঁচায়,”কি তোমাদের হলো? আরে জ্যামে পরে গেলে কিন্তু বিপদে পরবে, তাড়াতাড়ি।”

নাবিল শায়মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”চল,এই লোক মনে হচ্ছে এখন থামবে না। ”
দু’জনে নিচে নেমে আসে, নাবিল বলে,”সব নিয়েছিস তো গুছিয়ে? হু নিয়েছি। এই নে তোর ফাইল। চেক করে নে। নিজের টা তো নিজে গুছিয়ে নিতে পারিস না !

নাবিল আর শায়মী নিচে নেমে সবার থেকে দোয়া নেয়। উর্বী দূরে দাঁড়িয়ে আছে। শায়মী এসে উর্বীর কাছে দোয়া চাইলেও নাবিল মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকে এককোণে।

ওরা গাড়িতে উঠলে উর্বী ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে। পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে আছে। সব আমীরুনকে নিয়ে গোছাতে হবে আজ।

কেন্দ্রে যাওয়ার পথে রাস্তায় মোটামুটি জ্যাম ছিলো। নাবিল শায়মীকে কেন্দ্রের গেইটে ছেড়ে দিয়ে রাওনাফ বাড়ির পথে রওনা দেয়। হাতে এখনো পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি আছে। সে আগেই চলে এসেছে। তাকে চেম্বারে বসতে হবে। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম লেগে যায়। রাওনাফ মেজাজ খারাপ করে গাড়িতে বসে আছে।

হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। উর্বী এখন তাকে ফোন দিচ্ছে কেনো!
সে ফোনটা রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই উর্বীর গলা শোনা যায়,”আপনি কোথায়? আপনি শিগগির বাসায় আসুন নয়তো অঘটন ঘটে যাবে।”

_কি হয়েছে,ধীরে সুস্থে বলো।

_নাবিলের রেজিস্ট্রেশন কার্ড আর এডমিট কার্ড বাড়িতেই রেখে গিয়েছে।

_হোয়্যাট!!!!
রাওনাফের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। এখন কি করবে সে? কি হবে তার ছেলের!

রাওনাফ নিজেকে যথাসাধ্য ঠান্ডা রেখে বলে,”বাড়িতে সামিউল আছে? ”
_না তো। উনি সেই কখন বেড়িয়েছে। এখন কি করবো?

_আমি বুঝতে পারছি না,আমি মাঝ রাস্তায় জ্যামে আটকে আছি। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

উর্বী একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলে,”শুনুন। আপনি শান্ত থাকুন। আমি বাড়ি থেকে এখনই বের হচ্ছি। আমি আপনাকে জানাবো।”

রাওনাফ কিছু বলার আগেই উর্বী ফোন কেটে দেয়। তার হাতে সময় নেই। সে দৌড়াতে দৌড়াতে সিড়ি ভেঙে নিচে নামছে। আজ সময়ের সাথে তাকে পাল্লা দিতে হবে।

চলমান…..

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৫
#Esrat_Ety

শায়মী কাঁদছে। বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। নাবিল বুঝতে পারছে না সে শায়মীর উপর রাগ দেখাবে নাকি ওকে একটা ঠাঁটিয়ে চ’ড় মারবে নাকি ওর কান্না থামাবে।
কেন্দ্রের ভেতরে তাদের দুজনকে ঘিরে ছোটোখাটো জটলা। দুজন পরীক্ষার্থী তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রই নিয়ে আসেনি সাথে করে। দুজন পুলিশ এসে তাদের সাথে কথা বলেছে। এই মুহূর্তে নাবিল একটা কাজই করতে পারে। তার পাপাকে ফোন দেওয়া। সে পুলিশের সাহায্য নিয়ে রাওনাফকে ফোন দেয়।

রাওনাফ ফোন রিসিভ করে।
গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে নাবিল বলে,”পাপা আমি নাবিল বলছি….”

রাওনাফ তাকে কিছু বলতে না দিয়েই বলে ওঠে,”বাবা শোনো। দু ভাইবোন মাথা ঠান্ডা করে বসে থাকো, একেবারে মাথা ঠান্ডা রাখো। পড়া গুলো মনে করার চেষ্টা করো। সামারি গুলো দুজন মিলে আলোচনা করে নাও আবার। হাতে এখনো চল্লিশ মিনিট আছে। কিচ্ছু হবে না বাবা। আমি আসছি! শায়মী কি করছে?”

_কাদছে।
ওকে শান্ত করো। তোমার পাপার উপর বিশ্বাস রাখো। একটা ব্যবস্থা আমি করবোই ‌।
রাওনাফ ফোন রেখে দেয়। নাবিল শায়মীর দিকে তাকায়।
শায়মী বলে,”বিশ্বাস কর নাবিল আমি সত্যিই সব গুছিয়ে নিয়েছিলাম। আমি কি করে বুঝবো ফাইল দুটো এভাবে অদলবদল হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই এটা আমীরুন খালামনির কাজ। সে আমাদের টেবিল গুছিয়েছে সকালে!”

নাবিলের এবার বোনের উপর খুব মায়া হয়, সে শায়মীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তুই থাম। আজ আমি পরিক্ষা দেবোই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তুই যা তোর হলে। যা।”

পাঁচ মিনিট ধরে উর্বী জ্যামে আটকে পরেছে। সে সিএনজি নিয়ে শর্টকাট রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো। এখানেও জ্যাম। দশটা বাজতে আর মাত্র ত্রিশ মিনিট বাকি। ছেলে মেয়ে দুটো এখন কেমন করছে কে জানে। রাওনাফ বারবার ফোন দিচ্ছে। উর্বী তার লোকেশন জানিয়েছে। রাওনাফ এদিকেই আসছে।

দুমিনিট অপেক্ষা করে কোনো গতি না পেয়ে উর্বী সিএনজি ড্রাইভারকে বলে,”ভাই আর কতক্ষন লাগবে, তাড়াতাড়ি। একটা ছেলের গোটা একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে।”

_আপা ,আমি তো কিছুই করতে পারবো না। সামনে তাকিয়ে দেখেন কত জ্যাম। অন্তত চল্লিশ-পয়তাল্লিশ মিনিট তো লাগবেই।

_এতক্ষন! অসম্ভব! আচ্ছা হেটে গেলে উত্তরা হাইস্কুল এখান থেকে কতদূর,মানে কতক্ষণ লাগতে পারে বলুন তো!

_বেশি না আপা,আধাঘন্টা,তারও কম।

উর্বী মনে মনে হিসেব করে, আধাঘণ্টা। মানে দ্রুত হেঁটে গেলে পঁচিশ মিনিটের মতো লাগবে। তার ওপর একটা বাইক রাইডার পেয়ে গেলে তো কথাই নেই। সে ড্রাইভারকে বলে,”ভাইয়া আমি নামবো, আপনার কত হয়েছে?”
ড্রাইভার অবাক হয়ে বলে,”একশো বিশ টাকা আপা। হেটে যাবেন?”

_না দৌড়ে।

উর্বী টাকাটা দিয়ে নেমে প্রায় ছুটতে থাকে। সে ঘামছে। তৃষ্ণায় তার গলা ফেটে যাচ্ছে।

***
যুবকটি দেখছে একজন মেয়ে শাড়ি পরে আলুথালু হয়ে দৌড়াচ্ছে, মেয়েটির খোপা আলগা হয়ে এখনই খুলে যাবে। সে অবাক চোখে মেয়েটির মুখমন্ডল অবলোকন করে। গোলগাল মায়াবী মুখশ্রী, রক্তিম হয়ে আছে সৌন্দর্য। ওপাশ থেকে মোটামুটি স্পীড নিয়ে বাইক চালিয়ে আসছিলো যুবকটি। বাম দিক থেকে মেয়েটি হঠাৎ করে তার বাইকের সামনে চলে আসে। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজেকে রাস্তার মাঝখানে আবিষ্কার করে।
মুহূর্ত কেটে যায়। একটু দূরেই রাস্তার ঠিক মাঝামাঝি পয়েন্টে বসে মেয়েটি তার শাড়ি ঠিক করছে আর আশেপাশে তাকাচ্ছে। লোকজন জড়ো হয়ে আছে। যুবকটির পরনে সেনাবাহিনী কর্মকর্তার পোশাক দেখে কেউই কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।

যুবকটি উঠে দাঁড়ায়,তার হাটু ছিলে গিয়েছে। পায়ে ভিষন যন্ত্রনা করছে। সে ধীরপায়ে উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত উর্বীকে দেখে। উর্বী নিজের শাড়ি ঠিক করছে। যুবক তার দিকে তাকিয়েই থাকে বোকার মতো। ভদ্রমহিলার বয়স আন্দাজ করতে পারছে না। হাত ছিলে গিয়েছে,ঠোট কেটে রক্ত পরছে। কপালেও আঘাতের চিহ্ন। যুবক বলে,”আপনি ঠিক আছেন? দৌড়াচ্ছিলেন কেনো? সু’ই’সা’ই’ড কেস?”

উর্বী ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে তাকায়। যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী একবার তাকে দেখে, একবার তার বাইক।
হঠাৎ বলে,”আপনি তো ভালো স্পীড নিয়েই বাইক চালান, আমাকে দশ মিনিটের মধ্যে উত্তরা হাইস্কুল পৌছে দেবেন প্লিজ?”
যুবকটি হা হয়ে উর্বীকে দেখে। তার মনে হচ্ছে মেয়েটি এখনই কেঁদে ফেলবে।

***
কেন্দ্রের সামনে ভিড় জমে গিয়েছে। একজন আহত মহিলা সিকিউরিটি গার্ডের সাথে সমানে তর্ক করছে। সে ভিতরে ঢুকবেই। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ড পারমিশন ছাড়া এভাবে কাউকে কেন্দ্রে এলাউ করতে পারে না। আর্মী যুবকটি মহিলার কর্মকাণ্ড কয়েক মূহুর্ত দেখে। কার জন্য এতো মরিয়া হয়ে ছুটে এসেছেন উনি? ভাই-বোন? সে এগিয়ে গিয়ে সি’কিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলে। সিকিউরিটি গার্ড তার এককথায় রাজি হয়ে যায়। উর্বী যুবকটির দিকে একবার তাকিয়ে ভিতরে চলে যায় তাকে ধন্যবাদ না জানিয়েই।

আর মাত্র সাত মিনিট বাকি। যারা ভিড় করে নাবিলদের দেখছিলো তারাও যে যার হলে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মাঠে দাঁড়িয়ে আছে নাবিল,শায়মী আর পুলিশ দুজন। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েকজন বলে ওঠে,”আরে আরে এ কে?”

নাবিল শায়মী গেইটের দিকে তাকায়। সব পরিক্ষার্থী তাকিয়ে দেখে। একটা মেয়ে শাড়ি পরে হাতে একটা ফাইল নিয়ে ছুটে আসছে। মেয়েটা আহত। ঠোঁট,কপাল বেয়ে রক্ত পরছে। মেয়েটি এদিকেই আসছে।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মেয়েটি হাসছে।
দর্শকরা সবাই অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখে, আশ্চর্য মেয়েটি হাসছে কেনো!

নাবিল তাকিয়ে আছে।
কিছু শিক্ষকও কৌতূহলী হয়ে উকি দিচ্ছে।

নাবিলের হঠাৎ করে একটা দৃশ্য মনে পরে যায়। ছোটো বেলায় তার মা তাদের স্কুলের গেইট ঢুকিয়ে দিয়ে যায়, পরে তার মনে পরেছিল সে টিফিন বক্স দেয়নি। সে ঠিক একই ভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে আসে,তার মুখে ছিলো প্রশস্ত হাসি। দু’টো দৃশ্যই প্রায় একইরকম।

***
রাওনাফ গেইটের কাছে গাড়ি থামিয়ে বাইরে নামে। লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে দেখে উর্বী একটা টুলের উপর ভাবলেশহীন হয়ে বসে আছে।
খোলা চুল, শাড়ি আলুথালু হয়ে আছে, আহত উর্বীকে দেখে চ’ম’কে যায় রাওনাফ।
দ্রুত গিয়ে উর্বীর সামনে দাঁড়ায়,কন্ঠে উ’ৎ’ক’ণ্ঠা নিয়ে বলে,”একি হাল তোমার? কি হয়েছে? ওরা কোথায়? তুমি এ’ক্সি’ডেন্ট করেছো?”

_আমি ঠিক আছি, একেবারেই ঠিক আছি। নাবিল শায়মী যে যার হলে ঢুকেছে। আর চিন্তা নেই।
হাঁপাতে হাঁপাতে একনাগাড়ে বলে উর্বী!

রাওনাফ দেখছে উর্বীর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।

_তুমি চলো, তুমি ঠিক নেই। তোমার ফার্স্ট এইড দরকার। চলো।

উর্বী বলে,”যাবো। আগে কিছুক্ষণ বসি এখানে। খুব ক্লান্ত আমি।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উর্বীর পাশে বসে পরে।
মুহূর্ত কেটে যায়। উর্বী আশেপাশে তাকায়।

“কাউকে খুজছো?”
রাওনাফ বলে।

_হু, জানেন। আজ এক লোক আমায় সাহায্য করেছিলো এখানে আসতে। আমি তাড়াহুড়োয় তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে গিয়েছি।

_ওহহ এই ব্যাপার। তা পরে যদি দেখা হয় দিয়ে দেবে না হয়।

_আবার কিভাবে দেখা হবে?

_পৃথিবীটা গোল। দেখা হতেই পারে।

উর্বী একটু পরপর চিৎকার দিয়ে উঠছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষ’ত। ওষুধ লাগাতেই পুড়ে যেতে চাইছে। রাওনাফ নার্সের থেকে ওষুধ কে’ড়ে নিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”দেখি আমাকে দাও। সামান্য ওষুধ লাগাতেও এতো হিমসিম খাচ্ছো।”

_স্যার,ম্যাম বারবার নড়ছে।

_আচ্ছা আমি দেখছি।

রাওনাফ এসে উর্বীর সামনে বসে। উর্বী আর্তনাদ করে বলে,”হয়েছে অনেক হয়েছে,আর ওষুধ লাগাতে হবে না। এমনিই সেরে যাবে।”

_চুপ করে বসো, নড়লে আরো বেশি ব্যাথা পাবে।

_আরে আমি বলছি আপনাকে, আমার ক্ষ’ত এমনিতেই সেরে যায়। আগে ব্যাথা পেলে কিংবা ছিলে গেলে আমি একটু বন পাতার রস লাগিয়ে নিতাম। ব্যাস চলে যেতো।

_এটা বন পাতার রস লাগানোর মতো ক্ষত নয়। আর বন পাতা কি?
রাওনাফ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে।

_আছে একটা জংলি পাতা। দেখাবো আপনাকে।

রাওনাফ উর্বীর ব্যান্ডেজ করে দেয়।

_আজ তোমার স্টামিনা দেখে আমি অবাক হয়েছি! না মানে হুট হাট জ্ঞান হারিয়ে ফেলো কি না!
নিচু স্বরে রাওনাফ বলে।

উর্বী জবাব দেয় না। রাওনাফ বলে,”তোমার এবারের চাকরি টা বোধহয় আমার জন্য চলে যাবে মৃদুলা উর্বী, আমার বাচ্চাদের জন্য!”

উর্বী মাথা নিচু করে ছিলো, সেকথার উত্তর না দিয়ে বলে ওঠে,”আচ্ছা ওদের তো তিনঘন্টা পরিক্ষা। সময় তো হয়ে গিয়েছে। আনতে যাবেন না?”

_হু যাবো, তুমি এখানে শুয়ে রেস্ট নাও। এখন তো হাটতেও পারবে না। কিছুক্ষণ থাকো। আমি ওদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে তোমায় নিয়ে যাবো।

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করতে থাকে। উর্বী তার দিকে তাকায়, বলে ওঠে,”কিছু বলবেন?”

_থ্যাংকস মৃদুলা উর্বী।

বাক্যটা উচ্চারিত হতে যতক্ষন সময় লেগেছে রাওনাফের কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে তত সময় লাগেনি।

উর্বী বসে থাকে চুপচাপ, মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে।

***
রওশান আরার টেনশন হচ্ছে খুব। সেই যে উর্বী বের হলো এখনো আসছে না। ফোন দিলেই বলছে এসে জানাচ্ছি। ফোনে বললে কি অসুবিধে? এদিকে সামিউল বাড়িতে নেই,অন্তরাও কেমন হাসফাস করছে,মেজো বৌও তো চট্টগ্রাম। রওশান আরা খুব একটা বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারেন না। তবে আমীরুনকে দিয়ে বারবার খোজ নিচ্ছে। নাবিল শায়মীর পরীক্ষা কেমন হয়েছে কে জানে। টেনশনে সব ভুলে যায়নি তো!

রাওনাফ গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। একে একে সবাই এক্সাম দিয়ে বের হচ্ছে। তার ছেলেমেয়ে দুটোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সে বারবার ঘড়ি দেখতে থাকে। হঠাৎ দূরে দেখতে পায় নাবিল শায়মীকে। ওরা এদিক ওদিক দেখছে। তাদের পাপাকেই খুঁজছে সম্ভবত।
রাওনাফ গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকতে থাকে তাদের।
নাবিল শায়মী তাদের পাপাকে দেখতে পায়। দুজনেই প্রায় দৌড়ে আসে।

_কি হয়েছে? কেমন হয়েছে? সবকিছুর আন্সার করেছো তো? ঘাবড়ে যাওনি তো?

_আরে পাপা,একটা একটা করে জিজ্ঞেস করো। আমার এক্সাম খুবই ভালো হয়েছে পাপা। নাবিল তোর কেমন হয়েছে?
শায়মী জিজ্ঞেস করে নাবিলকে।

_এক্সাম কেমন হয়েছে সেটা রেজাল্টেই বুঝবি। ঘ্যান ঘ্যান করিস না।আজ তোকে বাড়ি গিয়ে বুঝাচ্ছি। বেকুব মেয়ে একটা।
দাঁত খিচিয়ে বলে নাবিল।

শায়মী মুখ কালো করে বলে,”একে তো নিজের জিনিস নিজে ক্যারি করতে পারিস না তার উপর আমাকে বকছিস ভুলের জন্য,আমি কি করে বুঝবো ফাইল দুটো অদলবদল হয়ে যাবে?”

রাওনাফ তার ছেলেমেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”ব্যস ব্যস ব্যস।এনাফ! এখন বাড়ি চলো। নিজেদের আরো স্মার্ট এবং স্মার্ট বানাতে হবে বুঝলে। ওঠো গাড়িতে। আব্দুল তোমাদের নিয়ে যাবে।

_কেনো পাপা,তুমি যাচ্ছো না?
জিজ্ঞেস করে নাবিল।

_না তোমার আন্টিকে হসপিটাল থেকে পিক করতে হবে। ওখানে তার ড্রেসিং হয়েছে।

_বেশ তো আমরাও যাই চলো।
শায়মী বলে ওঠে।

রাওনাফ শায়মীর দিকে অবাক চোখে তাকায়।
শায়মী বলে,”চলো পাপা। আন্টি দেখলাম খুব আ’ঘাত পেয়েছে। তাড়াহুড়োতে কিছু জানতেই পারলাম না। কি হয়েছিলো পাপা?’
_বাইকের সাথে এ’ক্সি’ডেন্ট করেছে দৌড়াতে গিয়ে।

নাবিল তার পাপার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যস্ত রাস্তায় কেউ শাড়ি পরে দৌড়ায় ! এই মহিলাকে নাবিলের কখনোই স্বাভাবিক মনে হয়নি। এই মহিলা সত্যিই অস্বাভাবিক।

***
সবাই উর্বীর দিকেই তাকিয়ে আছে। এদিকে যে দুজন পরিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কারো হুশ নেই।

রওশান আরা চেঁ’চি’য়ে বলে,”একি! একি হাল! কি হয়েছে বৌমার?”

_মা কিছু হয়নি,ছোট্টো একটা এক্সিডেন্ট,আমি ঠিক আছি।
উত্তর দেয় উর্বী।

_ এটা ছোটো এক্সিডেন্ট? কখন হলো? কিভাবে হলো?

_মা এটা কিন্তু ঠিক না। দেখছেন দুজন পরিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে আর আপনি আমায় নিয়ে পরে আছেন!

রওশান আরা লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে,বলে,” ওদের পরিক্ষা কেমন হয়েছে তা আমি জানি। ওরা রাওনাফ করিমের ছেলে মেয়ে।”

উর্বীকে রাওনাফ বলে,”এখন তুমি রেস্ট নাও”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ তার ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে,

_শায়মী, নাবিল তোমরাও ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো। আমি টেবিলে অপেক্ষা করছি। তারপর কোয়েশ্চন পেপার দেখবো তোমাদের!

নাবিল ওর নিজের রুমে চলে যায়। উর্বী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চায় কিন্তু পায়ে খুব ব্যাথা। শায়মী এসে তাকে ধরে,”দেখি আন্টি।আপনি আমার সাথে আসুন।”

উর্বী শায়মীর মুখের দিকে তাকায়। এই মেয়েটা তাকে ধরেছে।

রওশান আরা তাকিয়ে আছে সেদিকে তার কাছে সে দৃশ্য ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে।

শর্মী উর্বীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

_এই মেয়ে তুমি হাসছো কেনো?
উর্বী শর্মীর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলে।

_কিছু না,এমনিই।

_বলতে বলেছি আমি!
ধমকের সুরে বলে উর্বী।

_জানো আন্টি। তোমাকে একেবারে মিশরের মমিদের মতো লাগছে। পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ করা। দ্যা মাম্মি রিটার্নস!

খিকখিক করে হাসতে থাকে শর্মী।

উর্বী হেসে ফেলে। এই বাচ্চা মেয়েটা এত্তো কথা জানে। অথচ প্রথম প্রথম কেমন গম্ভীর সাজার ভান ধরে থাকতো‌।

অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উর্বী হাত বাড়িয়ে শর্মীকে কাছে টেনে নেয়। নিজের কোলের উপর মাথা টা রেখে চুলে হাত বোলাতে থাকে।
শর্মীর সে আদরে কেমন শান্তি শান্তি লাগে। সে চোখ বন্ধ করে নেয়। কিশোরী অবুঝ মন কল্পনায় দেখে সে তার মায়ের কোলে শুয়ে আছে। কি নরম হাত! কি সুন্দর গন্ধ। যে হাতটা তার মাথায় বিলি কাটছে সেটা কি চমৎকার আরাম দিচ্ছে।

বিছানার উপরে সেই দৃশ্যটা দেখে রাওনাফ দাঁড়িয়ে পরে। তারপর নিশ্চুপ হয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বিরক্ত করে না উর্বী আর শর্মীকে।

***
আক্তারুজ্জামান উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”গত রবিবার আসার কথা ছিলো আপনার!”

_আসলে এতো ব্যস্ত!
উর্বী নিচুস্বরে জবাব দেয়।

_গুড! ব্যস্ত থাকা ভালো, নিজেকে ব্যস্ত রাখা ভালো। এমন ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন যাতে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে আসার প্রয়োজনই না পরে। অবশ্য তাতে আমার ইনকাম কমে যাবে।

আক্তারুজ্জামান হো হো করে হাসতে থাকে কথাটি বলে। উর্বী চুপ করে বসে থাকে। আক্তারুজ্জামান নড়েচড়ে বসে। তারপর বলে,”চলুন তবে শুরু করি। আজ আপনাকে কিছু টাস্ক দেবো।”

***
উর্বীর কাছে মনে হচ্ছে এই ব্যস্ত নগরীর সবথেকে সুন্দর স্থান হচ্ছে নীলক্ষেত। চারিদিকে শুধু বই আর বই। তার ইচ্ছে করছে বইয়ের রাজ্যে হারিয়ে যেতে।

শর্মীর জন্য সে জাফর ইকবালের দুটো সাইন্স ফিকশন নিয়েছে। শায়মীর জন্য কি কিছু নিয়ে যাবে? পরীক্ষা শেষ দুজনের। ওদের পরীক্ষার সময় সবাই ওদের কিছু না কিছু দিয়েছে,শুধু উর্বীই দেয়নি।

আচ্ছা হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটা বই নেওয়া যায়। উর্বী কিছুক্ষণ ভেবে মনে মনে বলে, না বাবা থাক, ওই লোকের বই দিয়ে কাজ নেই। কিশোরী বয়সে ওই লোকের বই পড়লে মেয়েদের মাথা খারাপ হয়ে যায়।
উর্বী ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে কিছু না পেয়ে সে বই বাদ দিয়ে অন্য কিছু দেবে বলে ভাবে। কিন্তু কি দেবে?

উর্বী আড়ং-এ যাবে বলে ঠিক করে। সব বড়লোকের ছেলেমেয়ে,আড়ং থেকে কিনলে নিশ্চই পছন্দ হবে।

উর্বী ঘুরেঘুরে সব দেখতে থাকে। প্রত্যেকটা জিনিসের প্রাইজ ট্যাগে চোখ বুলিয়েই সে সেটা যথাস্থানে রেখে দেয়।
ঘুরতে ঘুরতে উর্বীর চোখ আটকে যায় একটা ড্রেসে। অসম্ভব সুন্দর একটা ড্রেস। একেবারেই শায়মীকে মানিয়ে যাবে।

শায়মীর জন্য ড্রেসটা কিনে উর্বী জেন্টস পয়েন্টের পাশ দিয়ে হাটতে থাকে। তার চোখ খোঁজাখুঁজি করছে। নাবিলের জন্য কি নেওয়া যায় ! হঠাৎ-ই একটা পাঞ্জাবি দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে হাত বুলিয়ে দেখে পাঞ্জাবিটা, একেবারে মসৃণ আর আরামদায়ক। উর্বীর ইচ্ছা করছে এটাই নিয়ে নিতে। দেখে তো মনে হচ্ছে সাইজ ঠিকই হবে। কিন্তু প্রাইজ টা আগে দেখে নিতে হবে। উর্বী উল্টে পাল্টে প্রাইজ ট্যাগ খুঁজতে থাকে।
একজন স্টাফ এসে বলে,”এনি প্রবলেম ম্যাম?”

_আসলে এটার দাম টা জানতে চাই। কোনো প্রাইজ ট্যাগ খুজে পাচ্ছি না।

_ম্যাম,এটার প্রাইজ জেনেও কোনো লাভ নেই,এটা অলরেডি সোল্ড আউট। সরি।

উর্বী বিষন্ন ভঙ্গিতে পাঞ্জাবীটার দিকে তাকায়।

“আপনি চাইলে নিতে পারেন। এটা আমি নিচ্ছি না।”

ভারি এবং হাস্কি পুরুষালি কন্ঠস্বর। উর্বী ঘার ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। কন্ঠটা কেমন চেনা চেনা লাগলো। ভদ্রলোক মুখে মাস্ক পরে আছেন।

উর্বী বলে,”সরি আমি বুঝতে পারছি না। আপনি আমায় বললেন?”

_জ্বি আপনাকে, এটা আপনি নিতে পারেন। আমি অর্ডার ক্যান্সেল করে ফেলেছি।

লোকটা উর্বীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। উর্বীর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। পাশ থেকে স্টাফ লোকটি বলে,”তাহলে তো ভালোই হলো ম্যাম। এটার দাম মাত্র ২৯০০ টাকা।”
উর্বী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ২৯০০ টাকা মাত্র !

লোকটা এখনো দাঁড়িয়ে। উর্বী মিনমিন করে স্টাফকে বলে,”ঠিকাছে আপনি এটা প্যাক করে দিন।”

স্টাফ লোকটি চলে যায়। উর্বী তার সামনে মাস্ক পরে থাকা লোকটিকে বলে,”আমি কি আপনাকে চিনি?”
লোকটি হেসে ফেলে। বলে,
“চিনলেও চিনতে পারেন,যদি আপনার মেমোরি ভালো হয়।”

এরপর সে মাস্ক টি খুলে ফেলে। উর্বী তাকিয়ে আছে। এ তো সে,যার বাইকে তার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।

উর্বী বলে,”আপনিই সেই লোক না?”
ছেলেটি বলে,”এইতোহ। আপনার মেমোরি তো দেখছি খুব ভালো। এভাবে একজন পথচারীর কথা মনে আছে।”
উর্বী হেসে বলে,”আপনাকে সেদিন তাড়াহুড়োয় ধন্যবাদ দিতে পারিনি। আমার ছেলেমেয়ের পরিক্ষা শুরু হয়ে যাচ্ছিলো আসলে।”

ছেলেটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”আপনার ছেলে মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে? ”
উর্বী হেসে মাথা নাড়ায়। যুবকটি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়েই থাকে।

***
উচ্ছাস রাগে ফুঁসছে। উর্বীর আগের নাম্বার টা বন্ধ। বেয়াদব টা নাম্বার বন্ধ করে রেখেছে ! নাম্বার বন্ধ করেই ভেবেছে তার থেকে পালাবে। এত্তো সোজা? বোকা মেয়ে! আজীবন বোকাই থেকে যাবে।

***
সামনে জাহাঙ্গীর। উর্বীর ইচ্ছা করছে কোথাও পালিয়ে থাকতে। এই লোকটা তাকে পেলেই রাজ্যের মশকরা শুরু করে দেয়। উর্বীর অসহ্য লাগে সেসব। সেদিন বাড়িতে গিয়ে সবার সামনে দাঁত বের করে বলে,”ভাবি নকশী কাঁথা কার জন্য বানাচ্ছেন? নতুন অতিথি আসছে নাকি!”
তারপর রাওনাফের কানে ফিসফিস করে কি যেনো বললো।

অসহ্য! সে কি জানে না এ বাড়িতে অন্তরার বাচ্চা হবে !

উর্বী পালাতে পারে না। জাহাঙ্গীর তাকে দেখেই চিতকার দিয়ে ওঠে।
“ভাবি! এদিকে আসুন। এদিকে।”
উর্বী আশ্চর্য হয়ে যায়, এটা তো হসপিটাল। এভাবে কেউ চেঁচায়?

সে দাঁড়িয়ে পরে, জাহাঙ্গীরের পেছন থেকে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মিতা উঁকি দেয়, বলে,”আরেহ ভাবি যে। রাওনাফ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছেন বুঝি”
উর্বী মনে মনে বলে,”ব্যাস হয়ে গেলো। এক রামে রক্ষে নেই,লক্ষন তার দোসর।”
উর্বীর কাছে জাহাঙ্গীরের থেকে তার বৌকে বেশি ভয় হচ্ছে। এই মহিলা চোখ টিপি দিয়ে এমন এমন সব মজা করে উর্বীর হাড় ঠান্ডা হয়ে যায় পুরো।

সে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলে,”কেমন আছেন আপনারা? সব ভালো?”
_আমরা তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনার খবর কি? রাওনাফের কাছে এসেছেন কেনো? দুজনে ঘুরতে টুরতে যাবেন না কি?
উর্বী বিব্রত হয়ে বলে,”না মানে কিছু কেনাকাটা করতে এসেছিলাম। হসপিটাল কাছেই ছিলো তাই ভাবলাম আসি। উনিই বলেছিলো,আমার কিছু টেস্ট করাতে হবে।”

_কেনো কেনো? কি টেস্ট ভাবি? কি ব্যাপার?
দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী।

উর্বী মিতার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যায়, সামান্য এই ব্যাপারটাকে নিয়েও এদের ডাবল মিনিং বের করতে হবে!

সে বলে,”কিছু না,কদিন থেকে জ্বর আসছে আর চলে যাচ্ছে। তাই আর কি।”

মিতা কনুই দিয়ে জাহাঙ্গীর কে খোঁচা দিয়ে বলে,”কি হলো। আসল কথা বলো।”

জাহাঙ্গীর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,
_ওহহ হ্যা। ভাবি আমরা এসেছিলাম একটা কাজে। রাওনাফকে তো বলেছিলাম,ও হয়তো আপনাকে এখনো বলেনি। আমরা সবাই মিলে ট্যুরে যাচ্ছি। সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। মোট ছয় ফ্যামিলি যাচ্ছি। উইদাউট বাচ্চা কাচ্চা। রাওনাফকে অনেক জোর করেও রাজি করাতে পারিনি। এখন যাচ্ছি চাচী আম্মার কাছে। সেই পারবে।

***
নিজের ঘরে এসেই নাবিলের চোখে পরে তার বিছানার উপর একটি সুন্দর পাঞ্জাবী। সে হাত বুলিয়ে দেখে। ভীষণ সুন্দর একটা পাঞ্জাবি।কে কিনেছে? তার পাপা? পাপাই হয়তো। পাপা তো প্রায়ই কিছু না কিছু কিনে এভাবে রেখে যায়। নাবিলের বেশ পছন্দ হয়। সে পাঞ্জাবী টা সাথে সাথে পরে নেয়। একেবারেই মসৃন। সত্যিই পাপার পছন্দ আছে!

রাওনাফ নাবিলকে দেখে বলে,”লুকিং গ্রেট বেটা।”

_থ্যাংকস পাপা।

_কখন নিলে? আড়ং এর মনে হচ্ছে।

নাবিল অবাক হয়। খাবার টেবিলে সবাই চুপচাপ। নাবিল বলতে থাকে, “কখন নিলে মানে? এটা তুমি আমায় দাওনি?”

_না তো,আমি দিইনি।

_তবে!

শর্মী পাশ থেকে বলে,”এটা আন্টি কিনেছে তোমার জন্য ভাইয়া। আপুকেও একটা ড্রেস দিয়েছে। ভীষণ সুন্দর! আমাকে দিয়েছে অনেকগুলো বই।”
নাবিল উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী চুপচাপ খাচ্ছে। নাবিল কিছু বলে না। সেদিনের ঘটনার পর থেকেই উর্বীকে ভিষন সমঝে চলে সে। তবুও উর্বীর দেয়া পাঞ্জাবিটা পরে থাকতে তার ইচ্ছে করছে না। তার ধারণা উর্বীর দেওয়া পাঞ্জাবি পরে থাকা মানে উর্বীকে মাম্মার যায়গা দিয়ে দেওয়া। নাবিল তা করবে না।

কিছু না বলে নাবিল উঠে নিজের ঘরে চলে যায়।

উর্বী চুপচাপ খেতে থাকে। তার চোখ মুখ স্বাভাবিক। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী স্বাভাবিক ভাবে খাচ্ছে। খেতে খেতে সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“একি আপনারা বসে আছেন কেনো? খাচ্ছেন না কেনো সবাই? শর্মী খাও!”

***
উর্বীকে রুমে কোথাও না পেয়ে রাওনাফ বারান্দায় চলে আসে। উর্বী অন্ধকারে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

“উর্বী”
রাওনাফের ডাক শুনেই উর্বী চমকে ওঠে।

“ভয় পেয়েছো? আ’ম সরি। তুমি এভাবে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”

_এমনিই।

রাওনাফ কিছু বলার আগেই উর্বী বলে ওঠে,” মিতা ভাবি ফোন দিয়েছে অনেকবার। ”

_আর বোলো না,আমাকে পাগল করে ছাড়বে। এখন আবার মাকে ধরেছে। মা ওদের কেনো লাই দিচ্ছে বুঝি না। পাঁচ মিনিট আগে ফোন দিয়ে সব কনফার্ম করে ফেলেছে।

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”সে হয়তো চাচ্ছে তার ছেলে আর ছেলের বৌ একে অপরের প্রেমে পড়ুক। তাই একটু নিড়িবিলিতে পাঠাতে চাচ্ছে।”

উর্বীর মুখে এমন কথা শুনে রাওনাফ বিব্রত হয়। কেশে বলে,
“আচ্ছা আমি যাই হ্যা।”

রাওনাফ রুমের ভেতর চলে যায়।
উর্বী মুখে আঁচল দিয়ে হাসতে থাকে। এতো সামান্য কথায় এতো লজ্জা কিভাবে পায় একজন পুরুষ? সে কি রাওনাফকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে নাকি! আজব লোক!

হাসতে থাকে উর্বী। হাসতে হাসতেই তার মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে একদৃষ্টে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে।

নাবিল চোখ বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘর অন্ধকার। রওশান আরা এসে বাতি জ্বালিয়ে দেয়। নাবিল উঠে বসে, রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে,”ওও দাদু তুমি ! এসো। কিছু বলবে?”

_না তোকে দেখতে এলাম। তোর সাথে একটু গল্প করতে এলাম।

রওশান আরা বসে পরে। নাবিল চুপ করে আছে।

_তোর কি রাগ পরেছে?

_রাগ? আমি কেনো রাগ করবো? দাদু প্লিজ। ওনার গল্প করতে আসলে তুমি যেতে পারো।

রওশান আরা বলে,”দাদুভাই একটা কথা বলতো!”

_কি!

_উর্বীকে এতদিন ধরে দেখছিস। তোর কেনো ওর উপরে এতো রাগ?

নাবিল কোনো উত্তর দেয়না।
রওশান আরা বলতে থাকে,
_তুই ভয় পাচ্ছিস যে ও রাওনাফকে তোদের থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। তোদের মায়ের জায়গা নিয়ে নেবে। কেউ কি কারো যায়গা কখনো নিতে পারে দাদু?

নাবিল ধীরে ধীরে বলে,”তুমি কেনো এমন টা করলে দাদু। পাপার সাথে ওনার বিয়ে দেওয়াটা কি খুব দরকার ছিলো?”

_না দরকার ছিলো না। পুরোটাই হয়েছে আমার খেয়াল খুশির জন্য। আমি মানি। কিন্তু আমি পরে অনেক ভেবেছি, উর্বীর সাথে তোমার পাপার বিয়ে দেওয়াটা ছিলো আমার সঠিক সিদ্ধান্তের মধ্যে একটি।
তোমার পাপা খুবই ভালো মানুষ। আর উর্বীও একটি চমৎকার মেয়ে। ভালোয় ভালোয় মিলেমিশে গেলে কি হয় জানো তো দাদু? সবকিছু ভালো হয়ে যায়। এই সংসারটা কখনোই আর ছন্নছাড়া হবে না। আমি নিশ্চিত। উর্বী হতে দেবে না।

_তুমি ওই মেয়েটির নামে অন্ধ হয়ে গিয়েছো দাদু।

রওশান আরা হাসে,”অন্ধ ঠিক না দাদু। উর্বীর মধ্যে আমি আরেকটা রওশান আরা দেখি।”

_রওশান আরা খুব ভালো কোনো মহিলাও নন। সবাইকে সবসময় জোরজবরদস্তি করে রওশান আরা।

রওশান আরা নাতীর কথায় হাসে, বলে,”তোমরা একদিন যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরবে,এ বাড়ি খালি হবে। আমি মরে যাবো। তখন তোমার পাপার অবস্থা কি হবে তুমি ভেবেছো কখনো? জীবন এভাবে কাটতে পারে না দাদু। একজন কাছের মানুষ খুবই দরকার,নিজের মানুষ। একদিন তুমি বুঝবে দাদু। এখন তুমি সেটা বোঝার পরিস্থিতি তে নেই।

_হ্যা সেজন্য বুড়ো বয়সে এসে বিয়ে করতে হবে। তা তুমি বসে আছো কেনো? তুমিও একটা বিয়ে করে নাও। নিজের লোক বানাও‌ একটা।
রওশান আরা হেসে বলে,
_আমার জন্য তো তুমি আছোই দাদু। নিজের লোক।
নাবিল হেসে ফেলে।
_ভাত খাবে না দাদু? তোমার নতুন মা তোমার জন্য টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছে।
নাবিল আড়চোখে তাকায়। রওশান আরা হাঁসি চাপিয়ে আছে।
নাবিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”আমি কি আজ ওনার সাথে বেশি বাজে ব্যাবহার করেছি দাদু? ওনাকে কি ভালো করে থ্যাংকস বলা উচিত ছিলো?”
_মিথ্যে কথা বলবো না দাদু। তবে তুমি এমনটা না করলেও পারতে।
হুট করে তোমার ওভাবে চলে আসি উচিত হয়নি।

_আমার কি তাকে সরি বলা উচিৎ দাদু?

রওশান আরা তাকিয়ে আছে নাবিলের দিকে। নাবিল নরম হয়ে জানতে চাইছে।

রওশান আরা নাতীর দিকে চুপ করে তাকিয়েই থাকে। নাবিল বলতে থাকে,”কিন্তু আমি কখনোই আমার মাম্মার জায়গা অন্য কাউকে দেবো না দাদু। আমি শর্মী আর শায়মী নই।”

***
“ভাবি এদিকে আসেন এদিকে! আপনি ভাইয়ের পাশে বসেন। পেছনে বসছেন কেনো?”

উর্বী মিতার দিকে তাকায়, তারপর রোবটের মতো এসে রাওনাফের পাশে বসে। তারা সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।

গাড়িতে মিউজিক চলছে। সবাই হৈ হৈ করছে। চুপ করে আছে শুধু রাওনাফ এবং উর্বী।
উর্বী মনে মনে ভাবে,”কে বলবে এদের বয়স হয়েছে। এখনই এত ফুর্তিবাজ। না জানি কলেজ জীবনে কি করেছে।”
আড়চোখে একপলক রাওনাফের দিকে তাকায় সে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা পড়ছে সে। উর্বী মনে মনে হাসে। এই ডাক্তারদের পড়াশোনা কখনোই শেষ হয় না!

উচ্ছাস হাসছে।
“ভাই হাসছেন কেনো?”
সজীব অবাক হয়ে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে আছে।

_ব্যাপারটা কেমন সিনেমেটিক হয়ে গেলো। আমার প্রেমিকা সামনের গাড়িতে তার স্বামীর পাশে বসে আছে। আর আমি হন্য হয়ে তাদের ফলো করছি। আমায় আবার ফলো করছে আমার শত্রু। এরকম একটা সিনেমা মনে হচ্ছে যেন দেখেছি।

সজীব চুপ করে আছে। তার ভীষণ ভয় লাগছে। এতবার করে বলেছে এতো রি’স্ক নিয়ে লাভ নেই। কে শোনে কার কথা! এই শু’য়ো’রের বাচ্চা মামুন আবার তাদের ফলো করছে কেনো! ভাই নিজের জন্য কোন বিপদ ডাকতে চলেছে কে জানে!

রাত ন’টা নাগাদ তারা সেন্টমার্টিন পৌঁছে যায়। তারা সবাই উঠেছে সেন্টমার্টিনের সুপরিচিত ব্লু-প্যারাডাইজ রিসোর্টে।
সবাই খুব ক্লান্ত। সবাই মিলে ঠিক করেছিলো রিসোর্টে পৌছেই আগে রেস্ট নেবে,তারপর খাওয়া-দাওয়া।
উর্বীদের জন্য ঠিক হয়েছে ৪০৪ নাম্বার রুম। সবাই সবার লাগেজ নিয়ে সবার রুমে যাচ্ছে। রাওনাফ রিসিপশন থেকে চাবি নিয়ে এসেছে। তারা রুম বয়কে অনুসরণ করে নিজেদের রুমের দিকে এগোচ্ছে। উর্বী তার স্বামীর পিছু পিছু হাটছে। সে ধারনাও করতে পারছে না এই রিসোর্টেই রুম নাম্বার ৪১২-তে তার জন্য অপেক্ষা করছে কেউ।

চলমান…..

আরেকটি বার পর্ব-১২+১৩

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১২
#Esrat_Ety

রাওনাফ একদৃষ্টে উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। লামিয়া হালকা কেশে রাওনাফের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করে,রাওনাফ বিব্রত ভঙ্গিতে চোখ সরিয়ে লামিয়ার দিকে তাকায়। লামিয়া নিচু স্বরে বলে ওঠে,”পুরুষ বিয়ে করে বৌ আনে,তুমি পেশেন্ট এনেছো। তোমার পার্মানেন্ট পেশেন্ট।”

রাওনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও উর্বীকে দেখে। লামিয়ার কথার জবাব না দিয়ে বলে,”টেস্ট গুলো করাতে হবে।”

_হুম।
মৃদু আওয়াজ করে লামিয়া উর্বীকে মিনিট দুয়েক পর্যবেক্ষণ করে রাওনাফকে বলে ওঠে,”তবে একটা কথা বলতেই হয় রাওনাফ। তোমার বৌ ভাগ্য কিন্তু চমৎকার! শিমালাও সুন্দরী ছিলো,আর উর্বীও।”

রাওনাফ কপাল কুঁ’চ’কে লামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা মজা করার সময়?”

লামিয়া হেসে ফেলে,মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,”অবশ্যই না। তবে এভাবে তোমার বৌয়ের মুখ দেখবো ভাবিনি। কলিগের বৌয়ের মুখ অচেতন অবস্থায় দেখে কি উপহার দেবো সেটাই বুঝতে পারছি না! আচ্ছা এর এক্সাক্ট বয়স কত? বললে ত্রিশ! আমার আরো কম মনে হচ্ছে! হয়তো রোগা বলে! নয়তো মেইনটেইন করে নিজেকে!”

রাওনাফ হাতের ফাইল গুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। একটু পরে তার ও.টি. , পেশেন্টের রিপোর্ট গুলোতে চোখ বোলাতে বোলাতে আবারও উর্বীর দিকে তাকায়। কেনো তাকালো তা রাওনাফ জানে না। লামিয়া বলতে থাকে,”এত এত পাত্রী দেখলাম আমরা ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই তোমার জন্য। রাজি হলে না। শেষ মেষ ছোটো ভাইয়ের জন্য পছন্দ করা পাত্রীকে মায়ের কথায় বিয়ে করে নিলে। এর পেছনে সলিড একটা যুক্তি দেখাতে পারছো না!”

রাওনাফ লামিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে হাতের ফাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে খুবই শান্ত ভাবে বলে,”যুক্তি নেই। মায়ের খামখেয়ালিপনা ছিলো। আর ক্লিন ইমেজের রাওনাফ করিম খানকে আজীবন সবাই পচাবে তার জন্য একটা সলিড রিজনের প্রয়োজন ছিলো।”

লামিয়া হেসে ফেলে, বলে,”মোটেও পচাইনি তোমাকে। আমি খুশি। ইনফ্যাক্ট আমরা বন্ধুমহলের সবাই খুশি হবো। তুমি শুধু শুধু জাহাঙ্গীরদের জানাতে দিচ্ছো না।”

_দেশে ফিরুক! এলেই দেখতে পারবে।

লামিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে থেকে বলে ওঠে,”যে ফিলোসফি টা আমি সবসময় আওরাই সেটা আমি এখনও আওরাবো,”Everything that happens in this world has a strong reason.”

হাতের রিপোর্ট টা হেড নার্সের হাতে ধরিয়ে দিয়ে রাওনাফ পেশেন্টকে ও.টি. তে ঢোকানোর নির্দেশ দেয়।
তারপর রাওনাফ লামিয়াকে বলে,”হু। ঐ যে বললাম আমাকে সবাই পচাবে। তার একটা রাস্তা তৈরি করে দিলাম! এজন্যই সবকিছু ঘটেছে!”

নার্স চলে গেলে রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। জ্ঞান ফেরেনি এখনও। স্যালাইন চলছে। লামিয়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে আড়চোখে রাওনাফকে দেখে বলে,”আমি আছি এখানে। কিছু হবে না তোমার বৌয়ের। তুমি যাও, ও.টি. শেষ করে এসো! বরাবর বৌ পাগলা রয়ে গেলে!”

রাওনাফ লামিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,”তোমার কি মনে হয় না বয়স বাড়ার সাথে সাথে তুমি একটু বেশিই ফাজিল হচ্ছো?”

লামিয়া মাথা নেড়ে কাট কাট বলে ওঠে,”না।”

রাওনাফ কিছু না বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। লামিয়া মাথা ঘুরিয়ে উর্বীকে দেখে। তার পাশে দুজন এ্যাসিস্ট্যান্ট নার্স দাঁড়িয়ে। নিচু স্বরে লামিয়া তাদের বলে,”তোমাদের স্যারের ওয়াইফকে কেমন লাগছে? মানিয়েছে না স্যারের পাশে?”

_জি ম্যাম। খুব মানিয়েছে।
প্রফুল্ল চিত্তে নার্স দুজন জবাব দেয় লামিয়ার প্রশ্নের।

****
চেতনা ফিরে পেতেই নাকে কড়া মেডিসিনের গন্ধ এসে লাগে। চোখ খুলে তাকানোর আগেই সে বুঝে যায় তার অবস্থান। অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা চারদিকে। অলসতার কারনে চোখ মেলে তাকায়না। কিংবা তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনা।

“মনে হচ্ছে তোমার এই চাকরি টাও বেশিদিন টিকবে না মৃদুলা উর্বী!”

রাওনাফের গম্ভীর কন্ঠস্বর কানে যেতেই উর্বী চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে। প্রথম বার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় বার সফল হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায় রাওনাফ কেবিনের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। দৃষ্টি জানালার বাইরে নিবদ্ধ। উর্বী নড়েচড়ে উঠে বসতে গিয়ে ডান হাতের পিঠে সুক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। তার হাতে ক্যানুলা লাগানো ছিলো। মুখে “আহ” উচ্চারিত হতেই রাওনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় উর্বীর দিকে। কফির মগ রেখে ধীরপায়ে এগিয়ে এসে উর্বীর হাত থেকে ক্যানুলা সরিয়ে দেয়।
একপলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”আমরা খুব ভালো হাসবেন্ড ওয়াইফ হতে পারবো কিনা তা তো জানি না মৃদুলা উর্বী, তবে আমরা কখনওই খুব ভালো ডক্টর এ্যান্ড পেশেন্ট হতে পারবো না যদি না তুমি কো-অপারেট করো। চলো ওঠো, কিছু টেস্ট করাতে হবে তোমার।”

উর্বী তার সামনে বসে থাকা শান্ত স্বভাবের মানুষটাকে কিছু সময় দেখে। তারপর ধীরে ধীরে বেড থেকে নেমে পরে বাধ্য মেয়ের মতো। সে টের পেলো তার শরীরে আর কোনো দুর্বলতা অনুভব করছে না সে। রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”নার্স ডাকবো? আমার তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে একাই যেতে পারবে তুমি।”

_জি পারবো। আ’ম ফাইন!

_বেশ, চলো।

ইমেজিং রুমে পুরোটা সময় রাওনাফ উর্বীর পাশেই ছিলো। উর্বী মাঝে মাঝে আড়চোখে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ রেডিওলজি বিভাগের প্রধানের সাথে কথা বলছে। কি বলছে উর্বী তা শুনতে পাচ্ছে না। ভেতর থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস বেরিয়ে যায় উর্বীর। তার ম্যারমেরে জীবনে রাওনাফ নামের লোকটির ভূমিকা কি হতে চলেছে? বুঝতে পারছে না সে।

***
“সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা
রঙ ছিল ফাল্গুনি হাওয়াতে
সব ভালো লাগছিল চন্দ্রিমায়
খুব কাছে তোমাকে পাওয়াতে”

উর্বী মাথা তুলে তাকায়। তার ঘরের সোজাসুজি কোনো ঘর থেকে গানটির আওয়াজ ভেসে আসছে। সম্ভবত সামিউল আর অন্তরা গান শুনছে। এ বাড়িতে তারা ব্যতীত এসব গান শোনার মতো কেউ নেই। উর্বী ম্লান হেসে হাতের বই রেখে উঠে দাঁড়ায়। তার ভালোই লাগে অন্তরা-সামিউল জুটিটাকে। টোনাটুনি জুটি। উর্বী সিদ্ধান্ত নিয়েছে রওশান আরাকে আবারও সে অনুরোধ করবে যাতে সে অন্তরাকে মেনে নেয়। এভাবে একই বাড়িতে আলাদা সংসার পেতে খাচ্ছে,এটা মোটেও ভালো লাগছে না উর্বীর। কোনো অপরাধ তো তাদের নেই। দোষ যা ছিলো সব রওশান আরার। তিনি ছেলের মতিগতি না জেনেই বিয়ে ঠিক করেছিলেন অজ্ঞ মানুষের মতো, জোর জবরদস্তি করেছেন, যেটা সম্পূর্ণ অনুচিত। এটা ঐ বৃদ্ধা মহিলাকে কে বোঝাবে!

উর্বী উঠে দাঁড়ায়। শরীর যতটা খারাপ থাকার কথা ততটা খারাপ নেই। বরং বেশ ভালো ঠেকছে তার। আলগা হয়ে যাওয়া খোঁপা খুলে নতুন করে খোপা বেঁধে নিয়ে নিচতলায় যায়।
খাবার টেবিলে রাওনাফ করিম খানের মাতা এবং তিন ছানা বসে রাতের খাবার খাচ্ছে। উর্বীকে দেখে রওশান আরা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে ওঠে,”একি! তুমি নেমে এলে কেনো? খাবার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম মা।”

উর্বী ম্লান হেসে বলে ওঠে,”আমি পুরোপুরি সুস্থ মা। চিন্তা করবেন না।”

কথাটি বলে উর্বী শায়মী আর নাবিলের দিকে তাকায়। দু’জনে কপাল কুঁ’চ’কে খাচ্ছে। শুধু শর্মীই উর্বীকে দেখে মুখ হাসি হাসি করে রেখেছে। রওশান আরার খাওয়া প্রায় শেষ। উর্বী তার পাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমীরুন আপা,তুমি মাকে ধরে ধরে উপরে দিয়ে এসো। আমি মায়ের গরম পানি করছি।”

আমীরুন মাথা নেড়ে রওশান আরাকে ধরে। শর্মীও খাওয়া হয়ে গেলে চলে যায়। উর্বী রান্নাঘরে চলে যায়, শাশুড়ির জন্য গরম পানি করে আনতে।
নাবিল খুব দ্রুত খাবার টা খাওয়ার চেষ্টা করছে। এখান থেকে সে দ্রুত চলে যেতে চায়। হঠাৎ চাঁপা আর্তনাদের আওয়াজে শায়মী আর নাবিল মাথা তুলে তাকায়।
রান্নাঘরে উর্বী বাম হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে রেখে চোখ বন্ধ করে আর্তনাদ করে যাচ্ছে। হাতে টগবগে ফুটন্ত গরম পানি পরেছে তার।
শায়মী আর নাবিল উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ছুটে যায় উর্বীর কাছে। একটা বাটিতে আইসকিউব নিয়ে এসে উর্বীর হাত ডুবিয়ে দেয় তাতে শায়মী। নাবিল গিয়ে একটা মলম নিয়ে এসে শায়মীর হাতে দেয়।

ঘটনা গুলো এতো দ্রুত ঘটছে যে ঘটনার আকস্মিকতায় উর্বী আর্তনাদ থামিয়ে শায়মী আর নাবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বী টের পেলো সে এইমাত্র রাওনাফ করিম খানের গোমরামুখো বড় ছানা দুটোকে পছন্দ করে ফেলেছে।
নিজের হাতের যন্ত্রনা ভুলে সে মুচকি মুচকি হাসছে। ভালো মানুষ রাওনাফ করিম খানের গোমরামুখো বড় ছানা দু’টো নিজেদের ভালোমানুষী লুকিয়ে রাখতে পারলো না শেষমেশ।

উর্বীর হাতে মলম লাগিয়ে দিয়ে নাবিল ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। শায়মী তাকে হেল্প করছে। হঠাৎ উর্বীর চোখে চোখ পরতেই দু’জনেই আবার কপাল কুঁ’চ’কে ফেলে। উর্বী চোখ সরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,”থ্যাংকস!”

নাবিল আর শায়মী কিছু না বলে মুখ গোমড়া করে সেখান থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে চলে যায়। উর্বী দাঁড়িয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে!

রাওনাফ ঘরে ঢুকেই থ’ম’কে দাঁড়িয়ে যায়। একবার উর্বীর দিকে, একবার তার হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”না মানে তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছো সবসময় পেশেন্ট হয়েই ঘুরবে?”

উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে বলে,”গরম পানি পরেছে! চামড়া উঠেছে কিছুটা!”

রাওনাফ উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”প্রপার ড্রেসিং হয়েছে?”

উর্বী সেই কথার জবাব না দিয়ে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বলে,”আপনার তিনটা ছানাই চমৎকার!”

রাওনাফ উর্বীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলে,”ছানা?”

উর্বী থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে ওঠে,”না মানে! আম…মানে আপনার বাচ্চা গুলো চমৎকার। ওরাই ড্রেসিং করে দিয়েছে।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হাতের ফাইলটা বিছানায় রেখে বলে,”তোমার রিপোর্ট গুলো দেখলাম। কোনো কম্প্লিকেসি নেই।”

উর্বী নিশ্চুপ। রাওনাফ কিছুটা জড়তা নিয়ে বলে,”ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড একটা কথা বলতে চাই।”

_বলুন।
অস্ফুট স্বরে জবাব দেয় উর্বী।

_ওয়ান অফ মাই কলিগস রেকমেন্ডেড মি আ সাইক্রিয়াটিস্ট ফর ইউ। আই থিংক ইউ শ্যুড গো ফর…

উর্বী রাওনাফের চোখের দিকে তাকায়। রাওনাফ আমতা আমতা করে বলে,”ডিড ইউ মাইন্ড?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। খুবই নিচু স্বরে বলে,”আমাকে কার্ড দিয়েন। আমি যেতে চাচ্ছি।”

রাওনাফ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তোমাদের বাড়ি থেকে আসার পরে যেও। ও বাড়ি থেকে ফোন দিচ্ছে বারবার। উপমার শশুর বাড়ি থেকে লোক আসবে বিয়ের কথা পাকা করে যেতে!”

***
সকালবেলা বাজার থেকে বেছে বেছে টাটকা দুটো বড় ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছেন রেজাউল কবির। তহুরা পিঠা বানাচ্ছে। পাচ রকমের পিঠা। এই প্রথম উর্বী-রাওনাফ বাড়িতে আসবে, এটুকু আয়োজন তো করতেই হবে।
রেজাউল কবির রান্না ঘরে একটা মোড়া পেতে বসে বলে,”মাংসটা সিদ্ধ হতে কতক্ষন লাগবে? ওরা তো এসে পরবে”
-এইতো হয়ে গিয়েছে। তুমি এখানে বসে আছো কেনো। বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। একটু এগিয়ে নিয়ে আসবে না?

-এই তো যাচ্ছি,তাছাড়া ওরা তো গাড়ি নিয়েই আসবে।

-তবুও রাস্তার মাথায় গিয়ে দাড়াও। যা বলছি তা করো।

রেজাউল কবির মিনমিন করে বলে,” আচ্ছা আত্মীয় স্বজনদের একটু জানালে ভালো হতো না? জামাইকে দেখবে না তারা? উর্বীর স্বামীকে?”

তহুরা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে,”বোনকে ভালো থাকতে দিতে চাচ্ছো না তাই না? এমনিতেও উপমার শশুর বাড়ী থেকে ঐ অশিক্ষিত লোক গুলো এসে রাওনাফ ভাইয়ের সামনে উল্টো পাল্টা বেফাঁস কথা বলে ফেললে কিভাবে সামাল দেবো সেটাই বুঝতে পারছি না।”

-ঠিকাছে। বলবো না।

_যাও গিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকো।

অত্যন্ত কঠিন স্বরে বলে তহুরা। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার সবটা সামাল দিতে গিয়ে।

রেজাউল আর কোনো কথা বলে না। সে চলে যায় উর্বীদের এগিয়ে নিয়ে আসতে।

****
“কোথায় তুমি? ফিরবে কবে?”

লামিয়ার কন্ঠস্বর। রাওনাফ নিচুস্বরে বলে,”শশুরবাড়ি।”

_পুরনো নাকি নতুন?

_নতুন।

লামিয়া হাসতে থাকে। রাওনাফ ধমকের মতো করে বলে,”শাট আপ লামিয়া! আহসান কে বলবো তোমাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে।”

লামিয়া হাসি থামিয়ে বলে,”না শোনো রাওনাফ। তৌফিকের সাথে কিছুক্ষণ আগে কথা হলো। ও বলছিলো যে ও এখনও একটা শশুরবাড়ির মুখ দেখতে পারলো না আর তুমি দুইটা শশুরবাড়ি গেলে।”

রাওনাফ বলে ওঠে,”ওর কি অবস্থা?”

_ডেট করছে একটা তেইশ বছরের ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েকে! হাউ ডিস্টার্বিং!

রাওনাফ হেসে বলে,”শা’লার চরিত্র বরাবর একই রকম রয়ে গেল!”

উর্বী ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়ে পরে রাওনাফের মুখে “শালা” শব্দটা শুনে। রাওনাফ থতমত খেয়ে ফোন রেখে উর্বীকে বলে,”স্যরি! বন্ধু বান্ধবের সাথে কথা বার্তা একটু ইনফরমাল ওয়েতে বলা হয়!”

উর্বীর বেশ হাসি পাচ্ছে। সে স্বাভাবিক গলায় বলে,”সমস্যা নেই! আমি এর থেকেও ভয়ানক গালি দেই!”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”রিয়েলি!”

_হুম! মনে মনে!

রাওনাফ হেসে ফেলে! উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে তার হাসি দেখে। তারপর বলে,”আপনাকে ভাইয়া ডেকেছে। উপমার শশুর বাড়ী থেকে লোক এসেছে। কথাবার্তা বলবে!”

****
সজীব এসে উচ্ছাসের পেছনে দাঁড়ায়। উচ্ছাস চুপ করে বসে থাকে। সজীব আমতা আমতা করে বলে ওঠে,”কাকা পয়ত্রিশ হাজারের বেশী একটাকাও দিতে পারবে না বলে দিয়েছে!”

_প্রয়োজন নেই! খরচ হচ্ছে কোথায়!

সজীব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”কাকা দশ বারো দিন আপনাকে এখান থেকে বের হতে নিষেধ করেছে। মামুনের সাথে থানার নতুন ওসির খুব ভাব। ও আবার আপনাকে কেস খাওয়াবে।”

উচ্ছাস নিশ্চুপ। সজীব জানে, এসব কথায় উচ্ছাসের কোনো আগ্রহ নেই। সে জানতে চায় শুধু উর্বীর কথা। সজীব বলতে থাকে,”উর্বী স্বামীকে নিয়ে ও বাড়িতে গিয়েছে!”

উচ্ছাস নীরবতা ভাঙে, ঠান্ডা গলায় বলে,”বেয়াদব টাকে সামনে পেলে আমি কি করবো আমি নিজেও জানি না!”

সজীব চুপ করে থাকে। উচ্ছাস বলে,”যা এখান থেকে। মাকে বলবি ভালো আছি।”

সজীব তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চলে যায়। উচ্ছাস ফোনটা হাতে নিয়ে উর্বীর নাম্বারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নাম্বার টা ডায়াল করে।

উর্বী ঘুমিয়েছিলো। হঠাত তার ফোন বেজে ওঠে। আওয়াজে উর্বী ধরফরিয়ে উঠে বসে। ঘুমঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে কেউ কোনো আওয়াজ দিচ্ছে না। উর্বী ঘুম ঘুম গলায় বলে,”হ্যালো। কে বলছেন?”

বিপরীত পাশের মানুষটা চুপ করে থাকে। উর্বী “অদ্ভুত” বলে ফোনটা কেটে দিতে যাবে অমনি একটা নিচু গলায় উচ্ছাস বলে ওঠে,”উর্বী”

উর্বীর দুনিয়া থেমে যায়। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নিঃশ্বাস টা হঠাৎ করে আটকে গিয়েছে যেন। তার হাত থেকে ফোনটা পরে যায়।
দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে সে। সমস্ত শরীর কাপছে তার।

মাঝ রাতে রাওনাফের ঘুম ভেঙে যায়। উঠে ওয়াশরুমে যাবে তখন সে দেখতে পায় উর্বী তার যায়গায় নেই। ওয়াশরুমেও কেউ নেই।ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। রাওনাফ কি মনে করে বারান্দার দিকে যায়। সে খুব সন্তর্পণে দরজা ঠেলে দেখে উর্বী বারান্দার মেঝেতে হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। তার শরীর একটু পরপর কেপে কেপে উঠছে।
রাওনাফ দরজা টেনে ভেতরে আসে। সে বুঝতে পারছে না এই মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেনো।

***
উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে তহুরা ধাক্কার মতো খায়। চোখ ফুলে গিয়েছে। স্পষ্ট মনে হচ্ছে কেঁদেছে খুব। উর্বী দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার দৃষ্টি তহুরার হাতের দিকে নিবদ্ধ। তহুরা হাতের কাপটা উর্বীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”রাওনাফ ভাই মসজিদ থেকে ফিরেছেন। এক্ষুনি রুমে ঢুকবেন হয়তো। ভাবলাম শহুরে মানুষ,ঘুম থেকে উঠেই চা কফি খাওয়ার অভ্যাস। নে ধর।”

উর্বী কফির কাপটা নেয়না। ধীরে ধীরে তহুরার দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”ও জামিন পেয়েছে!”

কথাটা শুনেই তহুরার হাত থেকে কাপটা পরে যায়। উর্বী তহুরার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ওয়াশ রুমে ঢোকে। তহুরা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে শক্ত হয়ে।

***
দেয়ালে জয়নুল আবেদীনের একটা পেইন্টিং। এছাড়া পুরো কামড়ায় তেমন কোনো সাজসজ্জা নেই চোখে পড়ার মতো। উর্বী হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। অফিসের সময় পেরিয়ে গিয়েছে আধাঘণ্টা আগেই। আজ আধাবেলা লিভ নিয়েছে উর্বী। ম্যানেজারকে অনেক কষ্টে মানিয়েছে সে। রাওনাফ সেদিন ঠিকই বলেছিলো,উর্বীর এই চাকরীটাও বেশিদিন টিকবে না।

উর্বী-রাওনাফ ওবাড়ি থেকে ফিরেছে দু’দিন আগে। উপমার রেজিস্ট্রি হয়েছে শুধু। ছেলের বাবা হজ্ব করে ফিরলেই তাকে শশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে।

“মৃদুলা উর্বী?”
রিসিপশনিস্টের ডাকে উর্বী মাথা তুলে তাকিয়ে বলে,”জি!”

_আপনাকে স্যার ভেতরে ডেকেছেন।

উর্বী ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কেবিনের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একজন চল্লিশোর্ধ ভদ্রলোক বলে ওঠে,”বসুন।”

উর্বী চেয়ারে বসতে বসতে লোকটিকে দেখে। বয়স খুব একটা বেশি না হলেও মাথা পুরো ফাঁকা। লোকটাকে সাইক্রিয়াটিস্ট কম মিষ্টির দোকানের ময়রা বেশি লাগছে।

কথাটা ভাবতেই উর্বী নিজেই নিজেকে শাসায় মনে মনে,”ছিহ উর্বী! অভদ্রমহিলা!”

পুরো নাম আক্তারুজ্জামান বাবুল। নেইম প্লেটে লেখা, A.J.B.!
আক্তারুজ্জামান উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”মৃদুলা উর্বী নামের অর্থ কি?”

***
জাহাঙ্গীর রাওনাফের সামনে বসে আছে। রাওনাফ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,”চোখ নামা! এবার ভয় লাগছে আমার!”

জাহাঙ্গীর নিশ্চুপ।

রাওনাফ নরম সুরে বলে,দোস্ত প্লিজ রাগ করিস না। আসলে সবকিছু একটা এক্সিডেন্টের মতো হয়ে গেলো যে কাউকে জানাতে পারি নি।আর পরে ভাবলাম দেশে ফিরে জানবি না হয়! প্লিজ রাগ করিস না।

-এক্সিডেন্ট? বিয়েটা না হয় হুট করে করেছিস,বিয়ের পরে দু মাস চলে গেলো এখনো তো সময় হয়নি জানানোর। লামিয়ার থেকে জানতে হয় আমাদের!

রাওনাফ খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে বসে থাকে।
জাহাঙ্গীর বলে,”যা করেছিস সেটা ক্ষমার যোগ্য না। তোর শাস্তি হওয়া দরকার। সবাই খেপে আছে তোর উপরে। জুনায়েদ, আশিক, মৌমিতা। সবাই।”

রাওনাফ হেসে বলে,”কি শাস্তি!”

ভাবীর হাতের রান্না খাওয়াতে হবে। আমি মেন্যু বলে দেবো,আমাদের সব বন্ধুকে দাওয়াত করে খাওয়াবি।

রাওনাফ হাসতে হাসতে বলে,”জো হুকুম মেরে আকাহ!”

হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে রাওনাফের। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন নারীকন্ঠ বলে ওঠে,”স্যার আমি দিগন্তের রিসিপশনিস্ট!”

রাওনাফ সাথে সাথে বলে ওঠে,”আবার কি হয়েছে! অসুস্থ হয়ে পরেছে মৃদুলা উর্বী?”

_আরেহ,না না স্যার। তেমন কিছু না! ম্যাম আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।

উর্বী রিসিপশনিস্টের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিচু স্বরে বলে,”আসলে আমার ফোনটা ডেড হয়ে পরে আছে। আপনি একটু মাকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন আজ আমার ফিরতে দেরী হবে? উনি দুশ্চিন্তা করবেন। সেজন্যই ফোন দেওয়া আপনাকে!”

রাওনাফ নিচু স্বরে বলে ওঠে,”ঠিকাছে। বলে দিচ্ছি।”

উর্বী ফোন কেটে দেয়।

জাহাঙ্গীর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আচ্ছা! তোদের মধ্যে Understanding হয়েছে?”

রাওনাফ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে! অস্ফুট স্বরে বলে,”এইতোহ!”

***

“স্যার ডক্টর রাওনাফ এসেছে!”

আক্তারুজ্জামান মাথা তুলে তাকায়। এ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”বসিয়ে রেখেছো ? স্টুপিড। নিয়ে এসো!”

রাওনাফ নিজেই কেবিনে ঢোকে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,”খুব অল্প সময় নিয়ে এসেছি হাতে! ঘন্টাখানেক বাদেই ও.টি. । বলুন। কি কথা!”

আক্তারুজ্জামান হাতের ফাইল উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলে,” আপনার ওয়াইফ এসেছিলেন আজ। দেখলাম তাকে।”

রাওনাফ তাকিয়ে আছে। আক্তারুজ্জামান বলতে থাকে,”কথা হলো দীর্ঘসময়। পেশেন্টের সাথে কনভারসেশন রিভিল করা নীতি বিরুদ্ধ কাজ। শুধু বলতে চাই, আপনার স্ত্রী কনভার্সন ডিজঅর্ডারে ভুগছেন ডক্টর খান।”

রাওনাফ একদৃষ্টে আক্তারুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে থাকে । তারপর বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”As I guessed!”

চলমান……

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১৩
#Esrat_Ety

অন্তরা শুয়ে ছিলো। ইদানীং তার শরীর টা ভালো নেই। অনেক দুর্বল লাগে এবং মাথা ঘুরতে থাকে।
রওশান আরা তার ঘরে ঢুকে সামিউলকে ডাকতে থাকে।
অন্তরা উঠে বসে। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
_সামিউল তো নেই মা। অফিসে গিয়েছে।

_ওও।
রওশান আরা অন্তরার ঘর দেখতে থাকে। ঘরটা অন্তরা বেশ চমৎকার করেই সাজিয়েছে।
অন্তরা তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।

রওশান আরা অন্তরার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”শুনলাম শরীর নাকি ভালো নেই তোমার। আমীরুন আছে,কোনো দরকার লাগলে ওকে ডেকে নিও। কিছু হলে তো আবার আমার দুর্নাম হবে।”

রওশান আরা চলে যায়। অন্তরা সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

সামিউল বিকেলে বাড়ি এসে দেখে অন্তরা কাঁদছে। সামিউল অন্তরাকে ধরে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে? মা কিছু বলেছে?”
অন্তরা বলে,”মা এসে আমার খোজ নিয়েছে। দেখতে এসেছিলো আমি কেমন আছি।”

সামিউল হাসে। এতে কান্না করার কি হলো সে বুঝতে পারে না।মেয়েদের এই একটা ব্যাপার তার মাথায় ঢোকে না। যেখানে খুশি হওয়ার কথা সেখানে কাদে।

***
“ভাবি, রাওনাফের একটা কাহিনী বলি আপনাকে, রাওনাফ বোধ হয় আপনাকে বলে নি। আমরা বন্ধুরা সবাই নেপাল গিয়েছিলাম। কারো ফ্যামিলি সাথে নেইনি, প্লেনে…..”

-আহ,কি হচ্ছে জাহাঙ্গীর। খেতে বসে এতো কথা বলছিস কেনো।

জাহাঙ্গীর কে থামিয়ে দেয় রাওনাফ। পাশ থেকেই আশিক বলে,”এই তোর ডাক্তার না হয়ে প্রফেসর হওয়া উচিৎ ছিলো। সব ব্যাপারে সবাইকে কথা শুনাতে থাকিস। ভাবি পুরো গল্প আমি বলছি। প্লেনে সবাই এক মন্ত্রীর আশেপাশেই বসেছিলাম,মন্ত্রীর নাম বলবো না। সে রাওনাফকে দেখে,ওর সাথে কথা বলে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে যায় যে সে সরাসরি প্লেনেই রাওনাফকে তার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেয়। রাওনাফ তখন তাকে বললো সে বিবাহিত। সে মানলোই না। দেশে ফিরেই সে রাওনাফের বাড়িতে আসে দেখার জন্য রাওনাফ সত্যিই বিবাহিত কি না। এসে দেখে রাওনাফ শুধু বিবাহিতই না,তার দুই জমজ ছেলে মেয়েও আছে। শায়মী নাবিলের তখন তিন বছর বয়স।”

খাবার টেবিলে বসা অন্যরা হো হো করে হাসতে থাকে।

রাওনাফ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। উর্বী রাওনাফের আরেক বন্ধু জুনায়েদের পাতে মাংস তুলে দিতে যাবে তখন জুনায়েদ উর্বীকে বলে,”আপনারা কোথাও ঘুরতে যাননি ভাবি? এই শীতে তো সবাই ইচ্ছে মতো ট্যুর দিচ্ছে।”
জুনায়েদের স্ত্রী রাবেয়া বলে,”তোমার মনে হয় তোমার বন্ধু কোথাও নিয়ে যাবে ঘুরতে? সে তো তোমাদেরই বন্ধু।”

-কেনো ভাবি? এরকম বলছেন কেনো? আমরা কি করলাম। আমরা আমাদের স্ত্রীদের নিয়ে ঘুরি না?
জাহাঙ্গীর উত্তর দেয়।

জাহাঙ্গীরের স্ত্রী মিতা ব্যঙ্গ করে বলে,”তুমি শেষ কবে আমাদের নিয়ে ঘুরেছো সে তো আমার মনেই নেই। কখনো নিয়ে গিয়েছিলে কোথাও?

-আচ্ছা তাহলে এই কথা। বেশ এবার তাহলে আমরা সবাই মিলে একটা ট্যুর দেই চলো। শুধু স্বামী স্ত্রী যাবো। কোনো বাচ্চা কাচ্চা নেবো না।
আশিক সম্মতি দিয়ে বলে,”হ্যা হ্যা। তুনার মাও কয়েকদিন ধরে খুব বলছিলো। চল তাহলে এবার একটা ট্যুর দেওয়া যাক।”
সবাই তার কথায় সম্মতি জানায়।
রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি ব্যস্ত। এমনিতেই বেশ কয়েকবার ছুটি নিয়েছি। একজন ডাক্তার হয়ে এরকম আমি করতে পারি না।”

“একজন ডাক্তার হয়ে আমি এমন করতে পারি না! কোথাকার কোন মহাপুরুষ এসেছেন।”
ব্যঙ্গ কেটে জবাব দেয় জাহাঙ্গীর। রাওনাফ রেগে বলে,”তোদের দেখে মনে হয় না তোদের বয়স হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা সব স্কুলে পড়ছে। খুবই হাস্যকর।”

-এই বয়সে তুই বিয়ে করতে পারলে আমরা একটু ঘুরতে পারবো না?

মৌমিতা রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কথাটি বলে। রাওনাফ চুপ হয়ে যায়।

সবাই উচ্চশব্দে হাসতে থাকে।
উর্বীর ইচ্ছে করছে সেখান থেকে চলে যেতে।

-আমরা অত কথা শুনতে চাই না রাওনাফ ভাই। আমরা যাচ্ছিই।আর আপনিও যাচ্ছেন নতুন ভাবীকে নিয়ে আমাদের সাথে। সেটা যদি না হয় এটাই আমাদের শেষ আসা আপনাদের বাড়িতে।
বলে রাবেয়া।
-হ্যা হ্যা ঠিক তাই।

লামিয়া বলে ওঠে। জাহাঙ্গীর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”শোন রাওনাফ। এখন নয়। শায়মী নাবিলের এক্সামের শেষে। তখন তোর কোনো কথা আমরা শুনছি না!”

তার সাথে তাল মিলিয়ে বলে অন্যরাও।

***
বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কেউ বারবার ফোন দিচ্ছে। উর্বী নিচে যায়। গিয়ে কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে একজন ভদ্রমহিলা সালাম দেয়। উর্বী সালামের উত্তর দেয়।

ভদ্রমহিলা বলে,”আমি শায়মীর স্কুল থেকে বাংলা শিক্ষিকা বলছি আমি কি শায়মীর বাড়ির কারো সাথে কথা বলছি?”
-জ্বী বলছেন। বলুন কি দরকার!
-আপনি শায়মীর কি হন?

উর্বী ইতস্তত করে বলে,”আপনি বলুন না কি দরকার!”

-আপনাদের বাড়ি থেকে এখনি কাউকে স্কুলে এসে আমার সাথে দেখা করতে হবে।

-কেনো কি হয়েছে জানতে পারি?

-সেটা আসলেই বুঝতে পারবেন।
ভদ্রমহিলা ফোন রেখে দেয়। উর্বী তার ফোন দিয়ে রাওনাফের নাম্বারে বারবার ফোন দিচ্ছে। ফোনটা বন্ধ। উর্বী চিন্তায় পরে যায়। এখন কি করবে সে!

উর্বীর আজ অফ ডে ছিলো। উর্বীকে তৈরি হতে দেখে রওশান আরা জিজ্ঞেস করে,”কোথাও যাচ্ছো মা?”
-হ্যা মা একটু বের হচ্ছি। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। আপনি মনে করে দুপুরের ওষুধ টা খেয়ে নিবেন।

শায়মীদের স্কুলের বাংলা শিক্ষিকা আদুরী ইয়াসমিনকে টিচার্স রুমে পাওয়া গেলো। শায়মী একটা চেয়ারে বসে আছে, সে কাঁদছে।
উর্বী কক্ষে ঢুকে দেখে শায়মী কাঁদছে। আদুরী ইয়াসমিন উর্বীকে জিজ্ঞেস করে,”আপনি কে?”

-আমি শায়মীর বাড়ি থেকে এসেছি।

-ওহ,আপনার সাথেই কথা হয়েছিলো আমার? আপনি শায়মীর কি হন?
উর্বী বলে,”এটা জানা টা কি খুবই জরুরি?

-অবশ্যই।

-আমি সম্পর্কে ওর মা হই।
শব্দগুলো খুবই স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করে উর্বী।

আদুরী ইয়াসমিন অবাক হয়ে তাকায়।
-আপনি শায়মীর মা?
-জি।
-বয়স কতো আপনার?
-ত্রিশ বছর।
-একজন ত্রিশ বছরের মায়ের ষোলো বছরের মেয়ে? এর ব্যাখ্যা কি? ওয়েট! রাওনাফ করিম খানের ব্যাপারে যা শুনেছি তা সত্যি তাহলে!

-আপনি দয়া করে বলবেন কি হয়েছে? আমার মেয়ে কাঁদছে কেনো?
উর্বী কাট কাট বলে ওঠে।

-শায়মী ক্লাসের টাইমে তার ছেলেবন্ধুর সাথে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। আপনারা জানেন সেটা?

উর্বী হতবাক হয়ে যায়। সে শায়মীর মুখের দিকে তাকায়। শায়মী কাঁদছে, সে উর্বীকে বলে,”আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করুন।”

উর্বী শায়মীকে বলে,”তুমি শান্ত হও। আমি দেখছি।”

আদুরী ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে উর্বী বলে,”আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। শায়মী এমনটা করবে না।”

-দেখুন। আমাদের কোথাও ভুল হয়নি। আমাদের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হাসান সাহেব নিজে তাদের একটি রেস্তোরায় হাতে নাতে ধরেছে। ছেলেটি ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র। সামনে ওর এক্সাম! কত ব্রাইট স্টুডেন্ট ও। ডক্টর রাওনাফের মেয়ে ও।
ব্যাপারটা আমি এবং হাসান সাহেবের মধ্যেই আছে। শায়মী খুবই ভালো ছাত্রী। আমরা ওর ভালো চাই। তাই বিষয়টা আপনাদের জানানো হয়েছে। ওকে নিয়ে বাড়ি যান,ওকে বোঝাবেন।

উর্বী শায়মীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শায়মী কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আপনি প্লিজ পাপাকে কিছু বলবেন না,আমি আর এরকম কিছু করবো না কখনো। আপনি প্লিজ পাপাকে বলবেন না। পাপা আমাকে মেরেই ফেলবে!”
উর্বী শায়মীর গালে হাত রেখে বলে,”আমি কাউকেই কিছু বলছি না।তুমি চোখ মোছো। বাড়ি যেতে হবে আমাদের।”

***
রাওনাফ শুকনো মুখ নিয়ে ঘরে ঢোকে। উর্বী বইয়ে মুখ গুজেছিলো রাওনাফের আওয়াজ পেয়ে সে সেদিকে তাকায়, তাকিয়ে বলে,”আপনি অসুস্থ?”
-কই। নাতো।
-সেরকমই দেখাচ্ছে।
-ওহ তেমন কিছু না। আই এ্যাম অলরাইট।

তারপর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।
উর্বী বই রেখে উঠে পরে। রাওনাফ ওয়াশরুম থেকে বের হলে তাকে বলে,”আপনার খাবার টেবিলে দিয়ে দেবো?”
– নাহ। পরে খাবো। আজ শায়মীর স্কুলে গিয়েছিলে? মা বললো।

উর্বী থতমত খেয়ে বলে,”হ্যা। ওর বাংলা টিচার ফোন করে বললো ওর শরীরটা নাকি ভালো লাগছে না। তাই গিয়ে নিয়ে এসেছি। আপনি অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন তখন, আপনার নাম্বার বন্ধ ছিলো। জানাতে পারিনি।”

-সে কি! তারপরে তো কেউ জানাতে পারতে। আশ্চর্য!

-শায়মী এখন ঠিক আছে। মনে হচ্ছে লো ব্লাড প্রেশার ওর।

-তা তো হবেই। কিচ্ছু মুখে দেয় সারাদিন!

রাওনাফ একটু থেমে বলে,”তুমি না চাইতেও আমার পরিবারের সমস্যাগুলি সামলাতে হচ্ছে তোমাকে!”
উর্বী কিছু একটা বলতে যাবে তখনই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আমিরুন ডাকে,”ভাবি খাইতে আসেন। খাবার দিয়া দিছি।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়।
-তুমি এখনো খাওনি?

-মা বললেন আপনি একা একা খান,তাই আমি যেনো আপনার সাথে খাই।

-মা বললেই সেটা করতে হবে? আশ্চর্য!
কন্ঠে বিরক্তিভাব রাওনাফের।

উর্বী অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে তাকে। এতো রেগে যাওয়ার কি হলো! তার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না। বিয়েটা মায়ের কথায় করতে পেরেছে! এখন নাটক করছে! ভারি অদ্ভুত লোক!

শায়মী ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। রাওনাফ বাইরে থেকে ডাক দেয়,”মামনী! ”
শায়মী উঠে বসে। তার ভিষন ভয় করছে। ওই মেয়েটা পাপাকে সব বলে দিয়েছে কি?
রাওনাফ ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বলে,”এই সময়ে ঘর অন্ধকার করে বসে আছো কেনো?”
-না মানে এমনিই পাপা।

-শর্মী কোথায়?

-দাদীর ঘরে গিয়েছে।
– তোমার কি অবস্থা। এরকম হলে চলবে কি করে? সামনে পরীক্ষা!

শায়মী কিছুই বুঝতে পারছে না। তার বুক ধুকপুক করছে।‌ তার পাপা যদি সব জেনে যায় তাহলে কি পাপা তাকে চ’ড় মারবে যেমন মাহজাবীনের পাপা মাহজাবীনকে মেরেছিল!

রাওনাফ বলে,”আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ডাক্তারি ছেড়ে তোমাদের তিন ভাই বোনকে সময় দেই। তোমরা যে যার মতো করে থাকো। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছো।”

শায়মী শীতেও ঘামতে থাকে। রাওনাফ বলতে,”আজ শরীর বেশি খারাপ করেছিলো মামনী?”

শায়মী এবার বুঝতে পারে,তার পাপার কাছে ওই মেয়েটা তার অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়েছে। সে কিছুটা স্বস্তি পায়।

মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে জবাব দেয়,”একটু খারাপ করেছিলো পাপা!”

***
দরজার ওপাশ থেকে উর্বী উঁকি দিয়ে বলে ওঠে,”ইন্সট্যান্ট স্ন্যাকস বানিয়েছি শর্মী। খাবে তুমি?”

শর্মীর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়না। সে বিছানায় উপুড় হয়ে পেটে হাত দিয়ে কাতরাচ্ছে। শায়মী বই থেকে মাথা তুলে তাকায়। উর্বী ঘরের ভেতরে ঢুকে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”কি হয়েছে শর্মী?”

_পেটে ব্যাথা আন্টি!

উর্বী বলে,”পিরিয়ড হয়েছে? গরম পানি এনে দেবো?”

শর্মী মাথা নাড়ায়।

উর্বী বিছানার একপাশে বসে বলে,”কি হয়েছে! খুলে বলো।”

কাঁতরাতে কাঁতরাতে বলে,”চটপটি খেয়ে এসেছি স্কুল থেকে। আপনি প্লিজ পাপাকে বলবেন না।”

উর্বী হেসে ফেলে। তারপর বলে,”সিক্রেট রাখবো?”

শায়মী উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী শায়মীর চোখে চোখ রেখে শর্মীকে বলতে থাকে,” তোমাদের এতো এতো সিক্রেট পেটে রাখতে রাখতে আমার পেট তো রীতিমত ফুলে যাচ্ছে! এর বিনিময়ে আমি কি পাবো!”

শায়মী মাথা নিচু করে হাসে। তারপর নিচু স্বরে বলে ওঠে,”থ্যাংকস আন্টি! পাপাকে কিছু না বলার জন্য।”

***
উর্বী ব্যাগ গোছাচ্ছিলো। রাওনাফ এসে মাথা থেকে টুপি খুলে আলমারিতে তুলে রেখে ঘুরে উর্বীর দিকে তাকায়। সে এই মাত্র জুম্মার নামাজ আদায় করে ফিরেছে। পরনে তার ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবি। উর্বী একপলক রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ নিচু স্বরে বলে,”আমি দুঃখিত, তোমার মা অসুস্থ। আমি যেতে পারছি না। ওনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী!”

উর্বী ম্লান হেসে বলে,”এভাবে বলার কিছু নেই। আর তাছাড়া মা অসুস্থ নয়। আমাকে দেখতে চাইছেন বলে মিথ্যা বলেছে। এমনিতে তো আমি যেতাম না।”

রাওনাফ দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
রওশান আরা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে তার বড়ছেলের উপর।
উর্বীকে এভাবে একা কেনো ছাড়া হচ্ছে তাই।

রাওনাফ বারবার তার মাকে বুঝিয়েছে তার অনেক কাজ আছে। তবুও চেঁচামেচি কমছেই না।

কিছু সময় বাদে রওশান আরা মুখ ভার করে পায়চারি করছে।
উর্বী তার ব্যাগ রেখে রওশান আরার ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়।
“মা।”
রওশান আরা তাকায়।
_মা আমি তবে এবার রওনা দিলাম। আপনি ভালো থাকবেন, ওষুধ ঠিকঠাক মতো খাবেন।
রওশান আরা বলে,”দু’দিন কিন্তু। দেরী করবে না। মনে থাকে যেন।”

উর্বী হেসে মাথা নাড়ায়।
রওশান আরার কাছে সে হাসি বড্ড মধুর লাগে।

উর্বী বলে,”দুদিনের বেশি থাকতেও পারবো না মা। আমার অফিস আছে।”

_তবুও। বাপের বাড়ি গেলে মেয়েদের পা আটকে যায় কি না।
মজার ছলে বলে ওঠে রওশান আরা।

_ঠিকাছে। আপনি আমাকে একটা কথা দিন এবার।

_কি কথা?
কৌতুহলী হয়ে রওশান আরা জানতে চায়। উর্বী বলে,”অন্তরার উপর চেঁচামেচি করবেন না। সেদিন যেমন আদর করেছিলেন,তেমন করেই আদর করবেন!”

অন্তরার ঘরের দরজা খোলাই ছিলো। সে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তার শরীরটা বেজায় খারাপ।
উর্বী ঢুকে বিছানায় বসে। অন্তরা উঠে বসতে চায়। উর্বী বাঁধা দেয়।

“আপনি রওনা দিচ্ছেন ভাবি?”
_হু,এইতো এখন দেবো।

_একটু যে নিচে নামবো তাও পারছি না। মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছি না।
_তোমার নামতে হবে না। তুমি বিশ্রাম করো। যেকোনো সমস্যার কথা আমীরুনকে জানিও। ও সব করে দেবে। তাছাড়া তোমার মেজো ভাবিও দু একদিনের মধ্যে এসে পরবে।

অন্তরা মাথা নাড়ায়।
_আপনি না থাকলে বাড়িটা অন্যরকম হয়ে যাবে ভাবি। ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যাবে।

উর্বী হাসে। অন্তরা বলতে থাকে,”হাসবেন না ভাবী। আপনাকে যে কতটা পছন্দ করে ফেলেছি আপনি জানেন না।”

শর্মীকে বলে উর্বী গাড়িতে ওঠে। শর্মীর বলতে ইচ্ছা করছে সে আন্টিকে মিস করবে কিন্তু পাশেই নাবিল দাঁড়িয়ে। তাই সে চুপ করে থাকে।
উর্বী গাড়িতে উঠে বসে জানালা দিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায় ‌। রাওনাফ ফোনে কথা বলছে। উর্বী কেন এমনটা করলো উর্বী জানে না। সে কেনো তাকালো রাওনাফের দিকে!

ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়। নাবিল বিড়বিড় করে বলে,”থাক দুটো দিন শান্তিতে থাকতে পারবো।”
শায়মী আর শর্মী কপাল কুঁ’চ’কে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

***
তহুরা একটা পেয়ালায় কিছু কাঠবাদাম নিয়ে এসে উর্বীর সামনে রাখে। তারপর উর্বীর পাশে বসে।
উর্বী মাথা তুলে ভাবীর দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বলে,”মায়ের মিছিমিছি অসুস্থতার কথা বলা উচিৎ হয়নি। এমনি বললেই চলে আসতাম।”

তহুরা তার জবাব না দিয়ে বলে,
“নে বাদাম খা। ভাত খাবি এখন? ভাত বেড়ে দেই?”
_না। পরে।

_হ্যারে, জামাইয়ের সাথে কথা হয়?
পাশ থেকে লুৎফুন্নাহার বলে ওঠে।

_কেনো মা?

_না,সারাদিনে একবার ও দেখলাম না ফোন দিতে।

_মা সে একজন ডাক্তার, তার কত কাজ জানো?

_তা বুঝলাম,রাতে তো দিতে পারে। তুইও তো দিতে পারিস।

উর্বী হাসে,বলে,” আমার দরকার হলে আমি দেবো। তুমি এত চিন্তা করছো কেনো?”
_ চিন্তা করবো না? ওবাড়ির সবার সাথে কথা বলিস অথচ যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার সাথেই কথা বলিস না। চিন্তা করবো না আমি?

_না করবে না।

লুৎফুন্নাহার চুপ হয়ে যায়, কিছু সময় পরে বলতে থাকে,”এতো শিক্ষিত না হয়ে ভালোই করেছি। বাবা মা যার সাথে বিয়ে দিয়েছে। চুপচাপ মেনে নিয়েছি। সুখে থেকেছি।”

“আর কিছু বলবে?”
জিজ্ঞেস করে উর্বী।

_নাহ।
লুৎফুন্নাহার চলে যায়। তহুরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বলে,”তুই কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো উর্বী?”

_হ্যা। করো।

_রাওনাফ ভাই আর তুই, তোরা এক বিছানায় ঘুমাস তো?

উর্বী হাসে, পাগলের মতো গা দুলিয়ে হাসে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলে,”হ্যা, একেবারে একবিছানায়, পাশাপাশি, কাছাকাছি ঘুমাই। যাও তুমি। ভাত খাবো ভাবী।”

তহুরা বসে থাকে‌ উর্বীর দিকে তাকিয়ে। আল্লাহ যেনো তার ননদ ননদাইকে ভালো রাখে, সে সেই দোয়া করতে থাকে মনে মনে। সে উর্বীর জীবনে আর কোনো ঝামেলা চায়না।

উর্বী ফোনের দিকে তাকায়। সত্যিই তো‌। এতগুলো ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে, তার শাশুড়ি ফোন দিয়েছে,তার জা দুজন ফোন দিয়েছে,শর্মীও ফোন দিয়েছে। শুধু রাওনাফ দেয়নি। রাওনাফের কি ফোন দেওয়া উচিত ছিলো? স্ত্রী হিসেবে সামনা সামনি এতোটা কনসার্ন দেখায় উর্বীর প্রতি। এই সম্পর্কের সমীকরণ উর্বী বুঝতে পারছে না। পাজেলড হয়ে আছে সে। অবশ্য এটা ঐ জীবনের থেকে বেটার। যেটা উর্বীর অতীত ছিলো। যেটুকু সম্মান পাচ্ছে তাই সই! একজীবনে সব পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই!

হুট করে হাতে ফোনটা তুলে নেয় সে। সামনের সপ্তাহে আক্তারুজ্জামানের কাছে কাউন্সিলিং-এর জন্য যেতে হবে। উর্বী একমনে হাসতে থাকে। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”পাগলের ডাক্তার তোমাকে সারাতে পারবে উর্বী?”

***
অন্তরা ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে আছে ‌। তার সামনে সামিউল দাঁড়িয়ে। স্ত্রীর জন্য তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখা যাচ্ছে।

লামিয়া বলে ওঠে,
“হুম বাচ্চার অবস্থা স্বাভাবিক একেবারে। ভয়ের কিছুই নেই। এই সময়ে একটু শরীর খারাপ লাগবেই। ভয়ের কিছুই নেই। আমি কিছু মেডিসিন প্রেস্ক্রাইব করে দিচ্ছি। বেশি অসুবিধা মনে হলে আমাকে জানাবে।”

অন্তরা উঠে বসে। দুজন নার্স তাকে সাহায্য করে। তার সমস্ত শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা।
রাওনাফ ডক্টর লামিয়ার কেবিনের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। লামিয়া বলে,”রাওনাফ শোনো, তোমার ভাইয়ের বৌয়ের পাশাপাশি তোমার ভাইয়ের খেয়াল রেখো। বৌয়ের চিন্তায় চিন্তায় আবার কি না কি হয়।”
সামিউল লজ্জা পায়। রাওনাফ মৃদু হাসে। বলে,”অন্তরাকে নিয়ে আমার কেবিনে যা। আমি লামিয়ার সাথে কথা বলে আসছি।”

ওরা চলে যায়। রাওনাফ বলে,”কোনো অসুবিধা নেই তো? ”
‌_নো ম্যান,অল ইজ ওয়েল।
_যেভাবে দূর্বল হয়ে পরছে। সামিউল খুব চিন্তা করছিলো। আচ্ছা আমি যাই। আমার একটা ও.টি. আছে আধ ঘন্টা পর।
_রাওনাফ শোনো।

রাওনাফ লামিয়ার দিকে তাকায়।

_তোমার বৌ আসবে কবে?

_আগামীকাল হয়তোবা। কেনো!
_জাহাঙ্গীর একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করছে রিভানায়।

রাওনাফ কিছু বলে না,মুচকি হেসে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়।

নিজের কেবিনের দিকে যেতে যেতে সে হাতের ফোনটার দিকে একপলক তাকায়। তার কি একবার উর্বীকে ফোন করা উচিত? উর্বী কি কিছু মনে করবে? সবসময় আগ বাড়িয়ে সবকিছু তো রাওনাফই করে। না, ফোন দিয়ে কাজ নেই। যদি বাড়াবাড়ি ভাবে!

***
নাবিল তার গিটারে সুর তুলছিল। শায়মী এসে পাশে বসে। নাবিল বলে,”নতুন গানটা শোন আমার। শর্মী কোথায়? ওকে ডাক।”

_শর্মী বিজি।
_কি করছে পড়ছে?
_না আন্টির সাথে কথা বলছে। ফোনে।

_বাহঃ চমৎকার! তা তুই আন্টি আন্টি করছিস কেনো? ছোটো মা বল!

তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে নাবিল।
শায়মী নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাবিল বলে ওঠে,
_শুনলাম রাফিকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ধরা খেয়েছিস হাসান স্যারের কাছে।
শায়মী ভয় পেয়ে বলে,”তুই জানলি কিভাবে?”
_আকিব বলেছে। আর এগোস না, বেয়াদব একটা। তোর নামে আজেবাজে কথা বলে বন্ধুমহলে। ওকে ব্লক করে দে।

শায়মী মুখ কালো করে বসে থাকে। নাবিলের মুখে সে এই বিষয়ে কোনো কথা শুনতে প্রস্তুত ছিলো না।

কিছু সময় পরে বলে,
_জানিস পাপার কাছে আন্টি কিছুই বলেনি এ ব্যাপারে। আমি তো অবাক হচ্ছি।
_আমি মোটেও হচ্ছি না।
_কেনো বলতো?
_খুব সিম্পল। এটা হচ্ছে ওনার চাল। শর্মীকে হাত করেছে। এখন তোকেও হাত করতে চাচ্ছে। তারপর আমাকে করবে।

শায়মী চুপ করে নাবিলের কথা শোনে। বিড়বিড় করে বলে,”উনি অমন মহিলা নন নাবিল, আমার মনে হয়।”

_যেমন হোক। আমি আমার মাম্মার যায়গা কাউকে দেবো না।
কঠিন গলায় বলে নাবিল ।

দোতলা থেকে শর্মীর খিক খিক হাসির শব্দ আসছে। সে উর্বীর সাথে কথা বলছে।
নাবিল মুখে চ কারন্ত শব্দ করে উঠে দাঁড়ায়। শায়মী বলে,”কোথায় যাচ্ছিস?”
_যাই গিয়ে ওকে কানের গোড়ায় একটা চ’ড় মেরে আসি।

শায়মী অবাক হয়ে তার ভাইয়ের কর্মকাণ্ড দেখে।

***

উর্বী হাটছে। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। সে দু হাত দিয়ে হাতরে পথ খুঁজতে থাকে। তার ভয় ভয় করছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পায়ের কাছ দিয়ে একটা সাপ চলে যায়। উর্বী জোরে চিৎকার দেয়। রাওনাফ এসে উর্বীকে ধরে। উর্বী ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে।
রাওনাফ বলে,”কিছু হবে না। ভয় পেয়ো না। আমি আছি।”
উর্বী শান্ত হতে চেষ্টা করে। হঠাৎ পায়ে ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব করতে থাকে। নিচে তাকিয়ে দেখে আরেকটা সাপ।

উর্বী জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে। সে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো তবে।
শর্মী খিকখিক করে হাসছে।
“কি আন্টি? পায়ে কেমন ঠান্ডা দিলাম বলো?”

উর্বী জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। সে বিষয়টা বুঝতে দুমিনিট সময় নেয়।
শর্মী বলে,”আন্টি তোমাকে সালোয়ার কামিজে একেবারে বাজে লাগছে। যাও গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে শাড়ি পরো।”
উর্বী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই শর্মী তো এটা?

_আরে আন্টি এভাবে ভয় পাচ্ছো কেনো। সত্যিই এটা আমি শর্মী। তোমায় নিতে এসেছি দাদুর সাথে।
উর্বী এবার বুঝতে পারে।

“আচ্ছা আন্টি! তোমার রুমটা এতো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখো কিভাবে?”
শর্মী ঘরের আশেপাশে দেখতে দেখতে বলে।

_তোমরা কখন এলে? মা কোথায়?
_দাদু তোমার আম্মু আর ভাবীর সাথে তোমাদের রান্নাঘরে। আমরা এসেছি ফজরের পরে। রাত তিনটায় রওনা দিয়েছি আমরা।
_রাত তিনটায়?
_হ্যা। দাদু বললো,ভোরে এসেই খেজুরের রস খাবে। তাই এতো তাড়াতাড়ি এলাম।
_আর কে কে এসেছে?
_আর কেউ না।

উর্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”তোমার পাপা আসেনি?”
_ওমা‌। পাপা কিভাবে আসবে? পাপা তো রাজশাহী গিয়েছে। তুমি জানো না আন্টি?
উর্বী অবাক হয়ে বলে,”না। রাজশাহী কি?”
_সেখানে আমাদের হসপিটালের একটা শাখা খোলা হয়েছে। সেটা দেখতেই গিয়েছে। আজ বিকেলে ফিরতে পারে।

উর্বী কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢোকে। তার হঠাৎ করে এমন অদ্ভুত লাগছে কেনো। তার অবচেতন মন কি চাইতো রাওনাফ আসুক?

চলমান………

আরেকটি বার পর্ব-১০+১১

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১০
#Esrat_Ety

উর্বী বসে আছে। বাইরে সবাই খুব হৈ হুল্লোড় করছে। বহুদিন পরে সবাই সবাইকে পেয়েছে। তাছাড়া এ বাড়িতে আজমেরীর ছোটো ননদের বিয়ে। রুমা আর তার পরিবারও এসেছে। আত্মীয় স্বজনে গমগম করছে পুরো বাড়ি।

উর্বী আর রাওনাফের জন্য দেওয়া হয়েছে দোতলার সবথেকে কোনার দিকের একটি ঘর। বাড়িটা কিছুটা পুরনো দিনের জমিদার বাড়ির মতো,অনেক বড়। আজমেরীর স্বামী হাফিজুরেরা একান্নবর্তী পরিবার। উর্বীর এই ঘরটি অনেক পছন্দ হয়েছে। বিশাল বড় জানালা আর বড় একটা টানা বারান্দা তাও আবার দক্ষিনমূখী। উর্বী খাটের উপর চুপ বসে আছে। আঙিনায় সবাই হেসে হেসে উচ্চস্বরে কথা বলছে। সে ভেবে পাচ্ছে না তার সেখানে যাওয়া উচিৎ হবে কিনা।

উর্বীর ঘরের দরজার বাইরে থেকে গ্রামের কিছু মহিলা আর বাচ্চারা উকি দিচ্ছে বারবার। তারা উর্বীকে দেখছে, ডাক্তার সা’বের নতুন বৌকে দেখছে।
উর্বীর ভিষন অস্বস্তি হচ্ছে। আজমেরী এসে মহিলাদের সরিয়ে দেয়,”আরে আপনারা এখানে! যান গিয়ে আগে পান-মিষ্টি খান! যান,যান!”
সবাই তাদের কৌতুহল সাময়িক ভাবে দমিয়ে নিয়ে চলে যায়। আজমেরী ভেতরে ঢুকে উর্বীকে বলে,”এখানে বসে আছো কেনো। চলো সবাই কত মজা করছে। চলো চলো!”

-না আপা আমি এখানেই ঠিক আছি।
নিচু স্বরে বলে ওঠে উর্বী।

-নাবিলের জন্য যাচ্ছো না? ও নেই, আমার কিছু চাচাতো দেবর আছে ওর সমবয়সী তাদের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে। তুমি চলো।আমার আত্মীয়রা এসেছে তোমাকে দেখবে বলে, তাদের আর কতক্ষন অপেক্ষা করাবো !

উর্বী আঁচল টেনে উঠে দাঁড়ায়। তার যেতে এতটুকুও ইচ্ছ করছে না।

***
এ বাড়িতে আজ হাফিজুরের ছোটো বোন চিত্রার গাঁয়ে হলুদ। ছেলের বাড়ি তাদের ঠিক পাশের বাড়িই। প্রেমের বিয়ে।
দুবাড়ির লোক মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে একই প্যান্ডেলের নিচে দু বাড়ির অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। গাঁয়ে হলুদও হবে একই সাথে।‌ সবাই যখন বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততায় নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। উর্বী তখন জমিদার বাড়ির মতো বিশাল এই বাড়ির দোতলার সবগুলো ঘর পরিদর্শন করতে ব্যস্ত। দু বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই বিয়ে বাড়ীর প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। সাউন্ড বক্সে নব্বই দশকের হিন্দি গান বাজছে। হাফিজুরদের বাড়ি পুরো ফাঁকা। সবাই গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গিয়েছে। বাড়িতে শুধু রয়ে গিয়েছে রাওনাফ আর উর্বী। উর্বী নিজের মনে ফাঁকা বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রাওনাফকে দেখে এসেছে একটার পর একটা ফোনকল রিসিভ করে কথা বলতে। হসপিটালের ফোন।

হঠাৎ দোতলার সিঁড়ি ভে’ঙে উপরে উঠতে থাকে হাফিজুরের আরেক বোন লতা। বয়স আজমেরীর কাছাকাছি। তার পেছনে রয়েছে এই বাড়ির কিছু বৌ, যারা সবসময় ঘোমটার আড়ালে থাকে। কিন্তু এরা একে অন্যের সাথে সবসময় অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে মজা করে। উর্বী বিকেলে গোসল করেছিলো, উর্বীর চুল ভেজা দেখে ঘোমটার নিচ থেকে লাজুক একটা মুখ বলে ওঠে,”ডাক্তার দেখছি তোমাকে তিন বেলা গোসল করাচ্ছে নতুন ভাবী।”

উর্বী হা হয়ে মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মহিলা কথাটি বলেই তার এক জা’য়ের গাঁয়ে হাসতে হাসতে হু’মরি খেয়ে পরেছে। উর্বী এখানে আসার পর থেকেই একটু এড়িয়ে চলে আজমেরীর জা’গুলোকে,সাথে আজমেরীর ননদ লতাকেও।

উর্বীকে অবাক করে দিয়ে লতা মহিলা গুলোকে নিয়ে হুরমুর করে পশ্চিমের ঘরটাতে প্রবেশ করে। উর্বী বুঝতে পারছে না তারা কিভাবে জানলো উর্বী ঠিক এই ঘরেই আছে, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই লতা এসে উর্বীর হাত ধরে টানতে টানতে ঘর থেকে বেড় করে। উর্বী অবাক হয়ে বলে,”কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে আপনারা?”

_ডাক্তারের কাছে।
হাসতে হাসতে জবাব দেয় লতা।

_কেন?

_ওষুধ দেবে ডাক্তার।

উর্বীকে কিছু বলতে না দিয়ে সবাই উর্বীকে টেনে রাওনাফের ঘরে ঢোকায়। রাওনাফ এই মাত্র ডক্টর কিশোরের সাথে কনফারেন্স কল শেষ করে ল্যাপটপ চার্জে বসিয়েছে। উর্বী আর লতাদের দেখে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। লতা বলে,”প্যান্ডেলে যেতে হবে।”

_মানে!
রাওনাফ হতভম্ব হয়ে বলে। পর পর বলে,
_দেখো,আমি হাফিজুরকে বলেছি লতা তোমরা আনন্দ করো,আমার কল আসছে একটার পর একটা হসপিটাল থেকে!

লতা এগিয়ে গিয়ে বলে,”ওসব কিছু শুনতে চাই না। চিত্রা আর সাকিবের গাঁয়ে হলুদের সাথে সাথে আরো অনেকের গায়ে হলুদ হচ্ছে সেখানে, সামিউল আর অন্তরারও হচ্ছে। আপনার আর নতুন ভাবীর টা বাদ থাকবে কেন? চলেন। এক্ষুনি চলেন।”

রাওনাফ অস্বস্তি নিয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। লতা বলে ওঠে,”নতুন ভাবীকে কোলে তুলুন।”

উর্বী হতভম্ব হয়ে লতার দিকে তাকায়। রাওনাফ বলে ওঠে,”হোয়াট!”

_হোয়াট ফোয়াট আবার কি? এ বাড়ির বিয়ে কি প্রথম দেখছেন? বর বৌকে কোলে করে নিয়ে যাবে। নিন, তাড়াতাড়ি ভাবীকে কোলে তুলুন।

রাওনাফ ধমক দিয়ে কথা বলতে জানেনা, নয়তো অনেক বড় সর একটা ধ’ম’ক দিতো লতাকে আজ। সে শুধু ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে,”তোমরা গিয়ে আনন্দ করো লতা। আমার ফোন এসেছে হসপিটাল থেকে।”

উর্বী ঘর থেকে প্রায় ছুটে বের হতে চাইলে অন্যান্য মহিলারা উর্বীর হাত ধরে ফেলে। লতা রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,”আমরা আমরাই তো বেয়াই! অসুবিধা কি? বিয়ে করতে পেরেছেন এখন ল’জ্জা পাচ্ছেন কেন!”

রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে,”আমার বাচ্চারা রয়েছে লতা। এসব বন্ধ করো!”

_তাই নাকি! তাহলে বাচ্চাদের সামনে ভাবীকে নিয়ে ঘরের দরজার সিটকিনি কিভাবে লাগান!

উর্বীর কান গ’রম হয়ে গিয়েছে। রাওনাফ থতমত খেয়ে লতার দিকে তাকিয়ে আছে। লতার পেছন আজমেরী লতাকে ধ’ম’কে ওঠে,”লতা! কি হচ্ছে এসব!”

লতা মাথা ঘুরিয়ে তার ভাবীর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের বলে,”বেয়াই সা’বের সাথে মস্করা করছি! তুমি নাক গলাতে এসো না!”

আজমেরী ঘরে ঢুকে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইজান মোল্লা বাড়ি থেকে মোর্শেদ চাচা আর ওনার ওয়াইফ এসেছে,তুমি চেনো। তোমাকে পাঁচ বছর আগে দেখেছে। চলো ওনাদের সাথে কথা বলবে।”

রাওনাফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এই লতার খপ্পরে পরলে আজ মান সম্মানের বারোটা বেজেই যেতো। মনে মনে সে আজমেরীকে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয়।

আজমেরী আর রাওনাফ চলে যায়। উর্বী চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে, লতা বলে,”পারলাম নাহ!”
তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এমনিতে কোলে তোলে তো অসুখ সারানোর বাহানায়?”

লতার পাশে দাঁড়ানো ভাবী দুজন উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। উর্বী নিচু স্বরে বলে ওঠে,”আমি নিচে যাচ্ছি।”

_হ্যা যাও। তোমার স্বামী ওদিকেই গিয়েছে!

হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে লতা এবং বাকি মহিলারা। উর্বী দ্রুত পা ফেলতে থাকে।
দূরের প্যান্ডেল থেকে গান ভেসে আসছে,”আজ ব্লু হ্যা পানি পানি!” এটা নিশ্চয়ই শর্মী আর তার দলবলের কাজ!

***
আজ সকাল টা বেশ চমৎকার! কোনো গাড়ির হর্নের শব্দ নেই বরং চারিদিকে শুধু পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ।
উর্বী ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নেয়। রাওনাফ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কাল রাওনাফ, হাফিজুর, শাফিউল, রুমার স্বামী সোহেল আর হাফিজুরের ভাইয়েরা মিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছে। রাওনাফ রাতে কখন ঘরে এসেছে তা উর্বী জানে না তবে সম্ভবত ফজরের আজান যখন দিয়েছে তখন রাওনাফ মসজিদে গিয়েছিলো টুপি হাতে,ঘুম ঘুম চোখে দেছিলো উর্বী,একটু একটু মনে আসছে!

শরীরটা খুব কাহিল লাগছে ইদানিং,বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছে করে না। একজন গাইনোকলজিস্টের সাথে কি কথা বলে নেবে উর্বী !

দরজায় টোকা পরে হঠাৎ। উর্বী দরজা খুলে দেখে অন্তরা দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী বলে,”কিছু বলবে?”
-বড় আপা দেখতে বলেছে আপনারা উঠেছেন কি না। তাহলে যেনো খাবার ঘরে যেতে বলে দেই।

-তোমরা কখন উঠেছো?

-আমরা খুব ভোরেই উঠেছি।

এই বলে অন্তরা চলে যায়। উর্বী খাবার ঘরের দিকে না গিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। সেখান থেকে আজমেরীর গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে,মোহনা এবং বাকি মহিলারাও রয়েছে এ বাড়ির। উর্বী রান্না ঘরে ঢুকতেই আজমেরীর বড় জা রুকাইয়া বলে,”আরে এই যে আসল লোক এসে গিয়েছে। কিগো নতুন বউ ঘুম ভালো হয়েছে?”

উর্বী হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়। আজমেরী একথালা পিঠা ভেজে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে খাবার ঘরের দিকে যায়। রুকাইয়া উর্বীর কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,”চোখের নিচে কালি কেন? রাওনাফ ভাইয়া ঘুমাতে দেয়না ঠিকঠাক মতো?”
উর্বী হতবাক হয়ে তাকায়। সে বুঝতে পারে না এ ধরনের মশকরায় কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ। এ বাড়িতে মেয়েলী আলাপ যেদিক থেকেই শুরু হোক না কেনো তা শেষ হয় উর্বী রাওনাফের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে। যেনো আর কোনো প্রসঙ্গ নেই কথা বলার। অথচ অন্যান্যদের নিয়ে এতটা রসালো মশকরা কেউ করে না।

উর্বী চোখে মুখে এক রাশ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মোহনা বুঝতে পেরে বলে,”উর্বী মানে ভাবী দেখো তো রুমার মেয়ে মিশফা কোথায়। ও সকাল থেকে বড়মামী বড়মামী বলে তোমায় খুজেছে ।”

উর্বী যেনো হাফ ছেড়ে বাচে। সে এক প্রকার পালিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে।

***
বিয়ে বাড়ির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। এ বাড়ির মেয়েকে পাশের বাড়িতে অর্থাৎ তার শশুর বাড়ীতে তুলে নেওয়া হয়েছে। বাড়িতে এখনও রাজ্যের মেহমান। সারাক্ষণ হৈ হুল্লোড় লেগেই থাকে। উর্বীর এতো হৈ হুল্লোড় ভালো লাগে না তবে রাওনাফ করিম খানের তিনটা গোমরামুখো ছানা এখানে এসে আনন্দে মেতে আছে। উর্বীর এই ব্যাপারটা দেখতে ভালোই লাগছে।

দোতলার বারান্দায় বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে উর্বী দাঁড়িয়ে পরে। মাথাটা ভীষণ ভার হয়ে আছে। জ্বর আসার আগে যেরকম অনুভূতি হয় ঠিক সেরকম। আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি। শীতকালের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর সর্দি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উর্বী বৃষ্টিতেও ভেজেনি। এমনিতেও উর্বীকে অসুখ বিসুখ চট জলদি কাবু করে ফেলে ইদানীং। বাইরে বৃষ্টি এখনও থামেনি। রাওনাফের আজ ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো। সে কোনো কারণে যেতে পারেনি। উর্বীর সাথে সকাল থেকেই তার কথা হয়নি। দোতলার রেলিং ধরে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পায় ডক্টর রাওনাফ করিম খান তার তিন ছানাকে ধমকে শীতের পোশাক পরাচ্ছেন। উর্বী সেদিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। শর্মী তার পাপাকে জরিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আহ্লাদী কন্ঠে বলছে,”সোয়েটার পরে নিতে পারি যদি তুমি আমাদের রেখে ঢাকা না চলে যাও তো।”

বায়না করছে পাপার কাছে। রাওনাফের মুখ হাসি হাসি। সে খুবই নিচু স্বরে তার ছেলে মেয়েদের কিছু একটা বলছে। দোতলা থেকে উর্বী শুনতে পাচ্ছে না সেসব কথা। সে শুধু রাওনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কতটা সুখী একজন মানুষ। যার খুবই সরল একটা জীবন,যার জীবনটা সরল রেখায় চলে। ফজরের আজান হলেই উঠে মসজিদে যায়। মসজিদ থেকে ফিরে নিয়ম করে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে হালকা কিছু খেয়ে ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পরে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের খাইয়ে হসপিটালে চলে যায়,সেখান থেকে চেম্বার, বাড়িতে ফিরে পরিবারকে সময় দেয়। ইনি হচ্ছেন পৃথিবীর সবথেকে ব্যস্ততম সুখী মানুষ। কত সরল জীবন তার, উর্বী নামের জটিলতার সাথে শুধু শুধু জরিয়ে ফেলেছে নিজেকে।
রাওনাফ একজন সুখী মানুষ, উর্বী একজন দুঃখী মানুষ। রাওনাফ একজন সরল মানুষ, উর্বী একজন জটিল মানুষ। রাওনাফ একজন আশীর্বাদ প্রাপ্ত মানুষ,উর্বী একজন অভিশপ্ত মানুষ। কিছুর মিল নেই, কিচ্ছুটির নেই।
না বয়স, না চিন্তা ভাবনার, না অবস্থানের, সবকিছুর অমিল। পরিস্থিতি এসে বলেছে,”তুমি তোমার জীবনের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত বৈশিষ্ট্যের একটা জীবন জরিয়ে ফেলতে চলেছো, বলো,কবুল, কবুল, কবুল।”

আর দুজন বোকা মেরুদণ্ডহীন প্রানী, রাওনাফ করিম খান এবং মৃদুলা উর্বী বলে ফেলেছে, কবুল।

এতো অমিল অথচ একটা রে’জি’স্ট্রেশন পেপারে দুজনের স্বাক্ষর খুব যত্নে আলমারিতে পরে আছে।

উর্বী বাবা ছেলে মেয়েদের খুনসুটি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরে। বাচ্চাগুলো একেবারেই রাওনাফের মতো হয়েছে। চেহারার গঠন তাই বলে। তিনটা বাচ্চাই চমৎকার দেখতে। উর্বীর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে বাচ্চাগুলোর নাক টিপে দিতে।
দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উর্বী রাওনাফের হাতের দিকে তাকায়। ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা লোকটার। আজ দুপুরে এ বাড়ির পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে গিয়েছিলো এ বাড়ির বড় পুকুরে। ছিপে একটা মাছ না গাথলেও রাওনাফের হাতে ঠিকই গেঁথেছে হুকটা। কেমন অদ্ভুত লোক! বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ক্ষ’ত হয়েছে।

উর্বী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ইচ্ছে করছে বিছানার সাথে মিশে যেতে। তবে সে নিশ্চিত, এখন বিছানা নিলেই তিনদিনের জন্য পরে থাকবে সে। শরীর তাই বলছে। ধীরপায়ে হেঁটে সে ঘরে ঢোকে। তাদের যে ঘরটিতে থাকতে দেওয়া হয়েছে সে ঘরটিতে একটা বিশাল বড় বইয়ের আলমারি আছে। বই দেখে প্রথমে উর্বী অনেক খুশি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আলমারি খুলে দেখে সব কিশোর সংকলন।
উর্বী ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফোনটাতে চার্জ নেই। ভুল করে সে চার্জার টা ফেলে রেখে এসেছে। কারো কাছ থেকে চেয়ে আনারও প্রয়োজন বোধ করেনি সে,তার ফোনে বিশেষ কোনো কাজ নেই।

দরজা ঠেলে রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। উর্বী ঘা’ড় ঘুরিয়ে তাকায়। রাওনাফের হাতের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফ নিজের ব্যাগ গোছাতে তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দেয়। উর্বী বলে ওঠে,”আপনি চলে যাচ্ছেন?”

রাওনাফ তার ব্যাগ এনে বিছানার উপরে রেখে বলে,”হু।”

এক হাত দিয়ে ব্যাগের চেইন খুলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। উর্বী বলে,”হেল্প করবো?”

রাওনাফ ম্লান হেসে বলে,”পারবো।”

কথাটি বলতে না বলতে ব্যান্ডেজ করা হাতের সার্জিক্যাল গজ কাপড়ের সাথে চেইনের হুক আটকে যায়,রাওনাফ খেয়াল না করেই বাম হাত দিয়ে চেইন ধরে টান দিতেই ডান হাতে ব্যাথা পায়। টান লেগে যাওয়ায় হাত দিয়ে গলগল করে র’ক্ত ঝ’রতে থাকে। রাওনাফ দাঁতে দাঁত চেপে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
কয়েক মুহূর্তের ঘটনায় উর্বী হতভম্ব। সে বেড সাইডের টেবিল থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে রাওনাফের মুখোমুখি বসে। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”আমাকে বললেই হতো।”

রাওনাফ কিছু না বলে র’ক্তা’ক্ত ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলে। উর্বী রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বলে,”জ’খম টা মারাত্মক। কাউকে ব্যাগ গুছিয়ে দিতে বললেই তাকে জোর করা হয়না,তাকে অ’ত্যা’চার করা হয় না। বলতে পারতেন আমাকে।”

রাওনাফ চুপ করে থেকে উর্বীর দিকে একপলক তাকায়। উর্বী নতুন করে তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলে,”আপনি বসুন। আমি রুমা আপাকে ডেকে আনছি ‌। আপনার ব্যাগ গুছিয়ে দেবে।”

***
রাওনাফের ঢাকা যাওয়া হয়নি। শর্মী পাপাকে যেতে দেবে না তাই গাড়ির চাবি লুকিয়ে রেখেছে।

সন্ধ্যার পর থেকে উর্বীর শরীর টা খারাপ হতে শুরু করে। রাওনাফ নিচ তলায় গিয়েছে। উর্বী ঘরে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।

বাইরে থেকে রুমা উকি দিয়ে ডাকে,”ভাবী বের হও না। সন্ধ্যা বেলায় কি শুয়ে আছো! নিচে সবাই গানের কলি খেলছে। মালাই চা আর আলুর চপ আছে সাথে।”

-আমার শরীর টা ঠিক লাগছে না আপা। তোমরা আনন্দ করো।

-সে কি! কি হয়েছে!
রুমা উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে।

-মনে হচ্ছে গায়ে জ্বর আসতে চলেছে। মাথা টা ভারি হয়ে আসছে।

রুমা এসে উর্বীর কপালে হাত দেয়।
-তাইতো! তোমার গা তো বেশ গরম হয়ে আছে। হঠাত এমন হলো কেনো!

-মাঝেমাঝে আমার সাথে এমন হয়। আমি অভ্যস্ত এতে।

-দাড়াও ভাইয়াকে ডাকি।

রুমা উঠে যেতে চাইলে উর্বী তার হাত টেনে ধরে। আস্তে করে বলে,”তোমার ভাইয়াকে ডাকতে হবে না আপা,কিছু হলে আমি ওষুধ খেয়ে নেবো।”
রুমা উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে,”আমি ভাইয়াকে ডাকতে যাচ্ছিলাম কারন সে একজন ডাক্তার। এই সময় যদি তোমাকে জ্বর পেয়ে বসে তাহলে সবার আনন্দ মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি চাও না ভাইয়া আসুক,এসে তোমাকে দেখুক।”

-না আসলে এই সামান্য ব্যাপারে তাকে ডাকার, তাছাড়া তার হাতে ব্যা’থা।

রুমা উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”বুঝেছি। ডাকবো না আমি। কোনো অসুবিধে হলে আমায় ডেকে নিও।”

রুমা চলে যায়। উর্বী এক দৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।

***
রাওনাফ রুমে ঢুকে দেখে উর্বী ঘুমিয়ে আছে। রাতে সে খেতেও যায়নি। রুমা ঘরে খাবার দিয়ে গিয়েছিলো। খাবারটা ঠিক সেভাবেই পরে আছে।
রাওনাফ গিয়ে বিছানার অন্যপাশে শুয়ে পরে। হাতের ব্যাথাটা কিছুটা কমেছে।

কিছুক্ষন পরে রাওনাফ খেয়াল করে উর্বী কি যেনো বিড়বিড় করছে।

রাওনাফ বুঝতে পারে না কিছু। সে উঠে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে উর্বী কাঁপছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে রাওনাফ ডাকে,”উর্বী!কোনো সমস্যা!”

উর্বী উত্তর দেয় না। সে জ্বরে প্র’লাপ বকছে। রাওনাফ শুনতে পায় উর্বী “মা মা” বলে কিসব বলছে। যেটুকু বলছে খুবই অস্পষ্ট!

রাওনাফ বুঝতে পারছে না সে কি করবে, কাউকে কি ডাকবে! সে অনেকটা সংকোচ নিয়ে উর্বীর কপালে হাত রাখে। কপালে হাত রাখতেই সে চ’মকে ওঠে। উর্বীর শরীর জ্বরে পু’ড়ে যাচ্ছে। রাওনাফ উঠে দ্রুত তার ব্যাগ থেকে থার্মোমিটার বের করে নিয়ে আসে। উর্বীর কপালে ধরতেই সে দেখতে পায় তাপমাত্রা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অথচ সন্ধ্যায় যখন দেখা হয়েছিলো তখন দেখে মনে হয়নি মেয়েটা অসুস্থ!
রাওনাফ চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হয়ে রুমাদের ঘরের কাছে যায়। রুমার দরজায় ধাক্কা দেওয়ার পরে রুমা ঘুম চোখে বের হয়ে আসে,”কি হয়েছে ভাইয়া?”

-তুই একটু আমার রুমে আয় তো।
রুমা অবাক হয়ে রাওনাফের পিছু পিছু যায়।

ঘরে ঢুকেই রাওনাফ বলে,”বুঝতে পারছি না কি করা যায় বলতো।এতো জ্বর উঠেছে। ডাকলে সারাও দিচ্ছে না।”

রুমা দ্রুত উর্বীকে গিয়ে ধরে,”ও ভাবী। শুনতে পাচ্ছো কথা আমার!”
উর্বী কোনো কথা বলতে পারে না। কাঁ’পতে থাকে।

রাওনাফ বলে,”ইমেডিয়েটলি আমাদের জ্বর নামাতে হবে। তুই একটা বালতিতে পানি আর একটা মগ নিয়ে আয়।”
রুমা দৌরে আজমেরীকে ডেকে তোলে। তারপর একটা মগ আর পানি ভর্তি বালতি নিয়ে আসে।
উর্বীর কাঁপুনি থামছেই না।

আজমেরী উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘরে ঢুকে বলা শুরু করে,”রাতে বললো ওষুধ খেয়েছে। বললাম ভাইজানকে বলি, বললো জ্বর হলে কি ওষুধ খেতে হয় তা আমি জানি। তোমার ভাইয়াকে বলতে হবে না। আজ তো আমরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজেছি। ভাবী তো ভেজেনি! হঠাৎ এমন জ্বর উঠবে কেন!”

রাওনাফ বলে,”ঠান্ডা থেকে এই জ্বর হয়নি। দেখেই তো মনে হচ্ছে ইমিউনিটি কম। মাথায় পানি ঢালতে থাক।”
রুমা উর্বীর মাথায় পানি ঢালতে থাকে। রাওনাফ আজমেরী কে বলে,”তুই যা, গিয়ে ঘুমা। বিয়ে বাড়ির ধকল গিয়েছে তোর উপর দিয়ে। রুমা আছে,ও দেখবে।”

আজমেরী আরো কিছু সময় থেকে রাওনাফের জোরাজুরিতে চলে যায়।
দীর্ঘ সময় ধরে রুমা উর্বীর মাথায় পানি ঢালে, তাপমাত্রা একটু কমে আসতে শুরু করেছে।
হঠাত রুমার মেয়ে মিশফা কেঁদে ওঠে। রাওনাফ বলে,”তুইও যা।আর পানি ঢালার প্রয়োজন নেই। আমি দেখছি।”

-তুমি পারবে?
রুমা অবাক হয়ে জিগ্যেস করে।

-হ্যা। তুই যা।
রুমা চলে যায়। রাওনাফ বিছানার একপাশে চুপচাপ বসে পরে।

উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”উর্বী।”
উর্বী কোনো সা’ড়া দেয়না। রাওনাফের চোখ চলে যায় উর্বীর হাতের দিকে। ডান হাতের কব্জির কাছটাতে বিরাট ক্ষ’ত। এটা সে সেদিন খেয়াল করেছে পালস রেট চেক করতে গিয়ে। রাওনাফ ম্লান হাসে। সে একটা জিনিস খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছে তার ডাক্তারি জীবনে,তার কাছে এ পর্যন্ত সতেরো-ত্রিশ বছর বয়সী যতগুলো মেয়ে পেশেন্ট এসেছে,তাদের মধ্যে ৭০% মেয়েদের হাতে, কব্জিতে কাটার চিহ্ন। বাংলাদেশের এই স্টেজের মেয়েরা চারিত্রিক ভাবে খুব আবেগী থাকে। শিমালার কথা মনে পরে যায় রাওনাফের। শিমালার বাবা মা যখন জেনে গিয়েছিল রাওনাফের সাথে শিমালার সম্পর্ক রয়েছে তখন মেয়েটাকে প্রচুর মা’রধর করেছিলো। রাগে, দুঃখে, রাওনাফকে না পাওয়ার যন্ত্র’না’য় হাতের শিরা কাঁটার চেষ্টা করেছিলো শিমালা।
উর্বীও কি ঐ আবেগী কাতারের মেয়ে? দেখে তো মনে হয় না! এই মেয়েটিও কারো জন্য হাত কেটেছিল তরুণী বয়সে! ক্ষ’তটা দেখে মনে হচ্ছে কয়েক বছরের পুরনো।
হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উর্বীর মুখের দিকে তাকায় রাওনাফ। শিমালার সাথে এই মেয়েটির চেহারার কোনো মিল নেই কিন্তু এই মেয়েটির থুতনিতে টোল আছে, যেটা শিমালারও ছিলো।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাওনাফ আবার ডাকে,”উর্বী!”

উর্বী কিছুটা সময় নিয়ে “হু” বলে সারা দেয়। রাওনাফ বলে বলে, “কি কি ওষুধ খেয়েছিলে রাতে? নাম বলো।”

উর্বী আবারো “হু” বলে। রাওনাফ বুঝতে পারে উর্বী ঠিক নেই। সে উঠে দরজার সিটকিনি তুলে দেয়। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”মৃদুলা উর্বী। তুমি দেখছি দিনকে দিন আমাকে তোমার পার্সোনাল ডক্টর বানিয়ে ফেলছো। কি অদ্ভুত!”

চলমান…..

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_১১
#Esrat_Ety

উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে বসে আছে। সে তার গায়ে একটা কালো রঙের শাল জরিয়ে রেখেছে। কাল রাতে তার জন্য কতগুলো মানুষের ঘুম ন’ষ্ট হয়েছে। এটা ভেবেই তার সুপ্ত অপরাধবোধ হচ্ছে। মোহনার কাছ থেকে সে জানতে পেরেছে সব। কাল রাতের পর আর জ্বর আসেনি। তবে শরীরটা অস্বাভাবিক ক্লান্ত। বিছানা থেকে উঠে সে বারান্দায় হাটতে থাকে। সামিউল এদিকেই আসছিলো। উর্বীকে বারান্দায় দেখে দাঁড়িয়ে পরে। উর্বীর সামনে পরলেই তার ভিষন লজ্জা লাগে। সহজে সে উর্বীর সামনে পরে না। জড়তা কাটিয়ে সে উর্বীকে বলে,”আপনার জ্বর সেরেছে…….ভাবী?”

উর্বী হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায়। এই লোকটাকে কোনো এক কারণে উর্বী বেশ পছন্দ করে। স্বভাবে ভীতু শ্রেনীর পুরুষ হলেও অন্তরার প্রতি সামিউলের ভালোবাসা দেখেই সামিউলকে ভালো লাগে উর্বীর।

সামিউল চলে যায়। যে পথ দিয়ে সামিউল গিয়েছে সে পথ দিয়ে রাওনাফকে আসতে দেখা যায়। উর্বী মানুষটার দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়, বিয়ের পর থেকে সমঝোতা হচ্ছে নাকি হচ্ছে না উর্বী বুঝতে পারছে না,তবে উর্বীর জন্য রাওনাফ নামের এই লোকটার ভোগান্তি বেড়েই চলছে। অবশ্য এসব তো উর্বী জানতোই। রাওনাফ উর্বীকে দেখে বলে,”এখন কি অবস্থা! হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিয়েছো দেখছি!”

-আমি ঠিক আছি। জ্বর আর ওঠেনি।
নিচু স্বরে বলে ওঠে উর্বী।

-বেশ ভালো। তাহলে জ্বরের ওষুধ টা স্কিপ করে যেও। ওটা জ্বর থাকলেই খেয়ো। আর এভাবে জ্বর উঠলে আন্দাজে কোনো ওষুধ খাওয়া উচিৎ না।

উর্বী মুচকি হাসে। বাইরে থেকে সকালের মিষ্টি রোদ উর্বীর মুখের উপরে পরায় উর্বীকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। তার চুলগুলী এলোমেলো হয়ে আছে, চুলে বিনুনি করা ছিলো।
উর্বী বলে ওঠে,”কাল রাতে আপনাদের অনেক বিরক্ত করেছি!আসলে আমার এরকম হয় মাঝে মাঝে।”

-হুম বুঝতে পেরেছি। এভাবে হঠাত করে জ্বর আসা আবার হঠাত করে চলে যাওয়া স্বাভাবিক কোনো বিষয় না।

-এরকম আমার ছোটোবেলা থেকেই হয়।

-তোমার জ্বরের মুড সুইং হয় সম্ভবত।

উর্বী হাসে। রাওনাফের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আপনার হাতের ব্যাথা সেরেছে?”

রাওনাফ নিজের হাত উল্টে পাল্টে বলে,”হাতে ব্যাথা পেয়েছি কিনা সেটাই মনে পরছে না। যাও গিয়ে রেস্ট নাও। আমরা বিকেলে চলে যাবো।”

***
শর্মী উর্বীর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। উর্বী বলে, “এসো এদিকে এসো। কিছু লাগবে?”

-আমীরুন খালামনিকে দেখেছেন?
-আমীরুন আপা তো বাইরে গিয়েছেন। কি দরকার আমায় বলো।আমি ফ্রি আছি।

-আসলে আমার চুল বেধে দেয় আমীরুন খালামনি। আমি ভাইয়া আপির সাথে বের হবো।

-এজন্য আমীরুন আপাকে ডাকতে হবে? এসো আমি বেধে দিচ্ছি।

শর্মী এদিক ওদিক তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ঘরে ঢোকে। আপি ভাইয়া যদি দেখতে পায় এই মেয়েটা তার চুল বাধছে তাহলে নির্ঘাত ব’ক’বে।

তবুও শর্মী ঘরে ঢোকে, শর্মী বড়দের ফিরিয়ে দিতে পারে না কখনোই। ঘরে ঢুকে উর্বীর কাছে এসে বসে সে।
নিচু স্বরে বলে,
-আপনার জ্বর সেরেছে?

-হ্যা। দেখি মাথা টা সোজা করো। দুটো বেনী করবো না একটা?

-দুটো। আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

-হ্যা অবশ্যই বলো।

-না থাক। কি দেখে হাসছিলেন ফোনে?

-একটা খুবই মজার কমেডী শো। তুমি দেখবে?

শর্মী কিছু বলার আগেই উর্বী তার ফোন টা শর্মীর হাতে দেয়।
শর্মী একটু পরপর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। উর্বী শর্মীর ছেলেমানুষি দেখে খুবই মজা পাচ্ছে। এমন সময় শায়মী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শর্মী কে ডাকে।

উর্বী বলে,”এসো ভেতরে এসো। ”

-এটা আমার পাপার ঘর।‌ আপনার আমাকে আসতে বলার প্রয়োজন নেই।
এতো বড় কড়া কথাটি শায়মী খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলে।

উর্বী চুপ করে থাকে। শর্মী মোবাইল টা রেখে উঠে দাঁড়ায়।

নাবিল শর্মীর দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। শর্মী বুঝতে পারছে না ভাইয়া এমন করছে কেনো!

-আজকাল নতুন মায়ের সাথে বেশ ভাব জমিয়েছিস তাইনা শর্মী!
দাঁত খিচিয়ে বলে ওঠে নাবিল।

-আমিতো শুধু চুল বাধতে গিয়েছিলাম ভাইয়া।

-ওহহ। আপনি চুল বাধতে গিয়ে নতুন মায়ের কোলে উঠে হাসাহাসি করছিলেন?

শর্মীর মন খারাপ হয়ে যায়। ভাইয়া তাকে খুবই কড়া করে কথাগুলি বলছে।

“উনি কিন্তু অতটাও খারাপ না ভাইয়া।” শর্মি খুব ভয়ে ভয়ে বলে ওঠে কথাটি।

নাবিল কয়েক মূহুর্ত শর্মীর দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থেকে বলে ওঠে,
-শায়মী ওকে চুপ থাকতে বল নয়তো গাড়ি থেকে ওকে ছু’ড়ে বাইরে ফেলে দেবো।

শর্মী নাবিলের কথা শুনে চুপ করে বসে থাকে।

***
শাফিউলের কলেজ থেকে ট্রান্সফার লেটার এসেছে। তাকে চট্টগ্রামের একটি স্বনামধন্য কলেজে ট্রান্সফার করা হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে যেতে হবে সেখানে। রওশান আরা মোহনাকেও সাথে যাওয়ার আদেশ দিয়েছেন। মোহনা বুঝতে পারছে না এতো বড় সংসার ছেড়ে কিভাবে সে অন্যখানে গিয়ে থাকবে।
রওশান আরা তার শাশুড়িকে বলে,”মা,আমি গেলে এদিকটা কে সামলাবে?”
-কেনো! আমার বড় ছেলের বৌ। এখন থেকে সে সব সামলাবে।

মোহনা উর্বীর দিকে তাকায়। রওশান আরা মোহনাকে বলে,”এটা তোমার সংসার না, স্বামীর সাথে যেখানে থাকবে সেটাই তোমার সংসার। একটা মেয়ের কাছে তার স্বামীই সবকিছু।”

রওশান আরা উর্বীর দিকে তাকিয়ে মোহনাকে বলে,”আমার বড় বৌমার উপরে আমার আস্থা রয়েছে। তুমি নিশ্চিন্তে শাফিউলের সাথে যাও মেজো বৌমা।”

দু একদিনের মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে মোহনা আর শাফিউল চলে যায়। বাড়িতে দু দুজন মানুষের অনুপস্থিতি বেশ উপলব্ধি করা যাচ্ছে।

মোহনা প্রতিদিন ফোন করে বাড়ির সবার সাথে কথা বলে। তারা দুজন সেখানে বেশ ভালোই আছে নিজেদের ছোট্ট সংসার নিয়ে।

শর্মীর ফাইনাল পরিক্ষা শুরু হতে চলেছে। তাকে সবসময় তার পড়ার টেবিলেই পাওয়া যায়।
শায়মী আর শান্তর মাধ্যমিকের নির্বাচনী পরিক্ষার রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে। তারা দুজনেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। এখন দুজনেই মন লাগিয়ে মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

অন্তরা খুবই যত্নের সাথে তার দুই রুমের সংসার টাকে সাজাচ্ছে। সামিউলের একটা বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে। খুবই ভালো বেতন। তারাও বেশ সুখে আছে। তবে রওশান আরা এখনও তাদের মেনে নেন নি।

***
আগামী কাল থেকে উর্বীর অফিস শুরু। কিছু জরুরী কাগজপত্র দেখে উর্বী ফাইলে ঢুকিয়ে রাখে।

শর্মী এসে বারবার বাইরে থেকে উকি দিচ্ছে। উর্বী অনেক আগেই তা খেয়াল করেছে। সে ঠান্ডা গলায় ডাকে, “শর্মী! এদিকে এসো।”

শর্মী ঘরে ঢোকে। তার হাতে অংক বই। উর্বী তাকে বলে,”কিছু বলবে?”
-পাপার কাছে এসেছিলাম।
ঝটপট উত্তর দেয় শর্মী।

-কিন্তু তোমার পাপা তো তোমার দাদুর ঘরে। তোমার দাদুর প্রেশার চেক করতে গিয়েছেন। মা অসুস্থ বোধ করছেন হঠাৎ।

-ও আচ্ছা।
শুকনো গলায় বলে শর্মী চলে যেতে গেলে উর্বী বলে ওঠে,

-অংক নিয়ে কোনো প্রবলেম হলে আমায় বলতে পারো। আমি অংক ভালোই বুঝি।

শর্মী উর্বীর দিকে ফিরে তাকায়। তার জ্যামিতি চ্যাপ্টারে একটু সমস্যা হয়েছে। এটা কাল সন্ধ্যায় তার টিচার আর রাতে তার পাপাও বুঝিয়ে দিয়েছিলো। এখন আবার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। নাবিল আর শায়মী কেউ বাসায় নেই নয়তো সে তাদের কাছেই যেতো। শর্মী ভাবে, তার পাপাকে জিজ্ঞেস করলে যদি পাপা বিরক্ত হয়। তার চেয়ে উর্বীর থেকে বুঝে নেওয়া যাক।
শর্মী বিছানার একপাশে বসে তার অংকের বইটা উর্বীর দিকে এগিয়ে দেয়।
উর্বী বইটা হাতে নিয়ে বলে,”ওহ এইটা। এইটা তো পানির মতো সহজ। এদিকে এগিয়ে বসো। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
শর্মী এগিয়ে বসে।

রাওনাফ এসে দরজার বাইরে থেকে দেখে অবাক হয়ে যায়। শর্মী চোখ বড় বড় করে উর্বীরর দিকে তাকিয়ে উর্বীর কথা শুনছে।

রাওনাফ ঘরে ঢোকে না, সেখান থেকে সরে যায়।

***
রওশান আরা চোখ বন্ধ করে তার আরাম কেদারায় শুয়ে আছেন। উর্বী এসে তাকে ডাকে,”মা আমায় ডেকেছিলেন?”

-হু। এদিকে এসো। বসো।

উর্বী রওশান আরার কাছে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে। রওশান আরা উর্বীকে দেখে,কি সুন্দর মুখশ্রী! দেখলেই রওশান আরা এক অদ্ভুত টান অনুভব করে। প্রথম দিন থেকেই।

রওশান আরা বলেন,”রাওনাফ এসেছে?”

-না,এখনো ফেরেননি।

-আচ্ছা। আজ তোমার ভাইয়া ফোন দিয়েছিলো। তুমি নাকি ওবাড়িতে যেতে চাচ্ছো না। কোনো সমস্যা?

-না মা আসলে নতুন চাকরি,এখনি ছুটিছাটা নিতে চাচ্ছি না।

-বুঝলাম। কিন্তু তাই বলে নতুন বিয়ে হয়েছে সেই মেয়ে আর মেয়ে জামাই তাদের বাড়িতে যায়নি,বিয়ের দেড় মাস হয়ে গিয়েছে। এটা তো ভালো দেখায় না মা। সবচেয়ে বড় কথা তোমার ছোটো বোনের বিয়ে।

উর্বী চুপ করে থাকে। রওশান আরা বলে,”রাওনাফ কি যেতে চাচ্ছে না? এরকম কিছু?”
-না মা,সেরকম টা না।
-তাহলে আমি রেজাউল কে ফোন করে বলছি তোমরা সামনের সপ্তাহে যাবে। রাওনাফ আসলে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিও। এখন তুমি যাও।

উর্বী উঠতে যাবে অমনি রাওনাফ এসে রুমে ঢোকে। রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে,”মা আমিরুনকে কোথাও দেখছি না!”

-আমিরুন একটু দেশের বাড়ি গিয়েছে। তার বাবা অসুস্থ।
-ও আচ্ছা।
-তুই কখন এলি। আর আমিরুনকে ডাকছিলি কেনো।

-এই তো এইমাত্র এসেছি,আমিরুনকে ডাকছিলাম একটু কফির জন্য।

-সব সময় আমিরুন আমিরুন করিস কেনো। কিছু লাগলে বৌমাকে তো বলতে পারিস।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়।
রওশান আরা বলেন,”বৌমা তুমি রাওনাফ আর আমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এসো। আর রাওনাফ তুই বোস, তোর সাথে আমার কথা আছে।”

***
অফিস থেকে বেরিয়ে গেইটের কাছে এসে উর্বী দাঁড়িয়ে পরে। রাওনাফের গাড়ি ঠিক অফিস ছুটির টাইমেই এসে গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রাওনাফের নির্দেশে আব্দুল ভাই প্রতিদিন উর্বীকে অফিসে দিয়ে আসে,নিয়ে যায়।
গাড়ির দরজা খুলে উর্বী দেখে ভেতরে শর্মী বসে আছে। উর্বী কিছুটা অবাক হয়ে বলে,”তুমি!”

শর্মী তার হাতের ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”বেস্ট ফ্রেন্ডের বাড়িতে গিয়েছিলাম।”

উর্বী উঠে বসে। আব্দুল ভাই গাড়ি স্টার্ট করে। শর্মী আবারও ফোনে মনোযোগ দেয়। উর্বী শর্মীর হাতের ফোনটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আবার দেখছো এটা! কতবার দেখবে এটা?”

শর্মী লাজুক হেসে বলে,”আমার খুব পছন্দের মুভি।”

উর্বী শর্মীর দিকে তাকায়। দিনকে দিন মেয়েটা তার সাথে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করছে। সে ঠান্ডা গলায় বলে,”এই মুভিটার নাম কি?”

শর্মী উৎফুল্ল হয়ে বলে,”বিউটি এ্যান্ড দ্যা বিস্ট।”

_এটা ফেইরি টেইল? আমি আসলে দেখিনি। আমরা ছোটো থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সিসিমপুর,মিনা রাজু,মনের কথা,এসব দেখে বড় হয়েছি। এগুলো সম্পর্কে ধারণা নেই। আচ্ছা এই লোকটা এমন দেখতে কেনো? পশুর মতো দেখতে, রাজকুমারীর সাথে এমন ব্যবহার করছে কেনো? এর রাজকুমার কোথায়?

_এটাই রাজকুমার। ও শুরুতে অভিশপ্ত থাকে। কিন্তু খুব ভালো। নায়িকাকে পরে ভালোবাসে।
শর্মী খুব আন্তরিকতার সাথে বলতে থাকে উর্বীকে।

উর্বী হেসে বলে,”তুমি ভালোবাসা বোঝো?”

শর্মীর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে তো কিছু কিছু বোঝে। উর্বী বলে,”এই হিরো কি এভাবেই থাকবে? এমন পশুর মতো দেখতে থাকবে?”

_না না,ও তো মানুষই। রাজকুমার ও। পশুর রূপ নিয়ে আছে এখন।

উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ম্লান হেসে বলে,”এসব ফেইরি টেলেই সম্ভব। রাজকুমার বিস্টের বেশে থাকে। বাস্তবে কি হয় জানো? উল্টো হয়। বাস্তবে রাজকুমারের বেশে একটা বিস্ট আসে, একটা পশু থাকে রাজকুমার সেজে। তারা রাজকুমারীদের কষ্ট দেয় শুধু।”

শর্মী অবাক হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বী কথাটা বলে নিজেই চ’ম’কে ওঠে! এতটুকু বাচ্চা মেয়ের সাথে কিসব কথা বলছে সে!
প্রসঙ্গ পালটে বলে,”ফুচকা খাবে?”

ফুচকার কথা শুনেই শর্মীর জিভে পানি চলে আসে। কিন্তু সে আমতা আমতা করে বলে,”পাপা!”

_তোমার পাপা জানবে না। আমি বলবো না, আব্দুল ভাই আপনি বলবেন?”

আব্দুল হেসে মাথা নাড়ায়। সেও বলবে না।

উর্বী বলে,”ঠিকাছে তবে গাড়ি থামান।”

সেদিন বিকেলটা উর্বী শর্মী নামের সরল কিশোরীর সাথে দারুন উপভোগ করেছে। দুজন একসাথে ফুচকা খেয়েছে, কিছু কেনাকাটা করেছে।
রওশান মঞ্জিলে ফিরে হাসিহাসি মুখ করে শর্মী উর্বীর দিকে তাকায়। কোনো এক অজানা কারনে শর্মীর এই মহিলাকে ভয় লাগছে না,খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে কিছুটা। কিছুটা নয়। বেশ ভালো লাগছে।

সদর দরজা খুলে দেয় আমীরুন। হাতের শপিং ব্যাগপত্র নিয়ে উর্বী আর শর্মী ভেতরে ঢোকে। নিচতলার লিভিং রুমে শায়মী আর নাবিল চুপচাপ বসেছিলো। শর্মীকে উর্বীর সাথে দেখে নাবিল ক’ট’ম’ট দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। শর্মী ভাইয়ার দৃষ্টি দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে উর্বীর থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে দোতলায় চলে যায়।

***
রাওনাফকে ঘরে ঢুকতে দেখে উর্বী উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফ নিচুগলায় বলে ওঠে,”কফি খেয়ে এসেছি। আনতে হবে না।”

উর্বী ম্লান হেসে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তারা হচ্ছে কফি কাপল। সম্পর্কটা কফি দেওয়া নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। রোজ চব্বিশ ঘন্টায় স্বামীর প্রতি কেবল মাত্র এই একটা দায়িত্ব এসে বর্তায় উর্বীর ঘাড়ে। আজ তাতেও ছুটি!

হাতের ব্যাগটা আলমারিতে তুলে রেখে রাওনাফ হাত ঘড়ি খুলে রাখে। আড়চোখে উর্বীকে একপলক দেখে স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”অফিসে কেমন কাটছে তোমার!”

_ভালো।
উর্বী একশব্দে জবাব দেয়। রাওনাফ আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। আলমারি খুলে সে দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো আলমারি ভর্তি উর্বীর শাড়ি! তার জামাকাপড় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। না চাইতেও উর্বীর শাড়ি গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে সে নিজের পোশাক খুঁজতে থাকে। উর্বী বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে বলে,”আপনার জামাকাপড় নিচের সাড়িতে। আমীরুন এসে গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছে। দাঁড়ান আমি বের করে দিচ্ছি।”

কথাটি বলে উর্বী সামনে এগোয়,রাওনাফ পেছনে এগোতেই উর্বীর সাথে ধাক্কা লেগে উর্বী পরে যেতে নেয় ঠিক তখনই রাওনাফ শক্ত করে উর্বীকে ধরে ফেলে। দু’জনে বিব্রত হয়ে কয়েক মূহুর্ত একে অপরকে দেখে। উর্বীর লতানো কোমর থেকে রাওনাফের হাতের বাঁধন আলগা হতেই উর্বী লাফিয়ে দুকদম ডানে সরে দাঁড়ায়। রাওনাফের চোখে মুখে অস্বস্তি। উর্বী ঝটপট করে রাওনাফের ঘরে পরার পোশাক বের করে তার হাতে দিয়ে বারান্দায় চলে যায়।
রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে চলে যায় ছেলেমেয়েদের খোঁজ নিতে।

রাওনাফ করিম খানের তিন ছানা নিচতলার লিভিং রুমে বিড়াল ছানার মতো গুটিসুটি মেরে বসে আছে। আমীরুন দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। রাওনাফ গম্ভীর কন্ঠে তার ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,”আজ আমি একটু আগে ভাগে চলে আসায় খুব অসুবিধা হয়ে গেলো তোমাদের তাই না? ভেবেছিলে দুধ না খেয়েই চুপচাপ কেটে পরবে।”

তিন ছানার কেউ কোনো কথা বলে না। রাওনাফ আমীরুনকে বলে,”শাস্তিস্বরূপ ওদের দু গ্লাস দুধ খাইয়ে ছাড়বি আজ।”

_জে,আইচ্ছা ভাইজান!
হাসতে হাসতে জবাব দেয় আমীরুন। রাওনাফ গম্ভীর কন্ঠে বলতে থাকে,”একটু নাইট ওয়াকে বেড়োবো। আমার ঘরেও এক গ্লাস দুধ দিয়ে আয়। বলবি খেয়ে নিতে।”

আমীরুন মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়। রাওনাফ গ্রে কালারের জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

বারান্দায় কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে উর্বী রুমে ঢোকে। বিছানা ঠিক করে আয়নার সামনে গিয়ে চুল আঁচড়ে নেয়। তখনই দরজায় টোকা পরে,বাইরে থেকে আমীরুন নিচু গলায় বলে ওঠে,”আসবো ভাবী?”

_এসো।

আমীরুন ঘরে ঢোকে। তার হাতে একটা দুধের গ্লাস। উর্বী গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। সে জানে এটা কে পাঠিয়েছে। তবুও আমীরুন গলার স্বর উঁচু করে আহ্লাদী গলায় বলে ওঠে,”ভাইজান পাঠাইলো ভাবী।”

উর্বী জানে এখন শুরু হবে আমীরুনের কন্ঠে তার বড় ভাইজানকে নিয়ে রাঙিয়ে চাঙিয়ে কথা। সে স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”ঠিকাছে! ওটা ওখানে রেখে দাও।”

আমীরুন তার ঠোঁট নাড়াতে শুরু করে,”না না। এইটা আপনি এখন আমার সামনে দাড়ায়া থাইকা খাইবেন। বড় ভাইজান তো বারবার করে বলে দিছে, “আমীরুন,তোর বড় ভাবীকে না খাইয়ে আসবি না খবরদার।”

উর্বীর বেশ হাসি পাচ্ছে আমীরুনের মিথ্যা কথা গুলো শুনে। রাওনাফ কখনোই এভাবে বলেই নি। কিন্তু আমীরুন তার বড় ভাইজানকে উর্বীর সামনে অত্যন্ত ভালো ডেডিকেটেড স্বামী প্রমাণ করেই ছাড়বে।

***
পরপর দু’টো অপারেশন শেষ করে আধাঘণ্টার জন্য নিজের কেবিনে ঢুকে সার্জিক্যাল এপ্রোন টা খুলে ফেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয় রাওনাফ। কপালে ডানহাত টা রেখে চোখ বন্ধ করে থাকে দীর্ঘসময়। বাইরে থেকে ডক্টর কিশোর উঁকি দিয়ে বলে,”মে আই কাম ইন?”

_হ্যা।
রাওনাফ চোখ মেলে তাকায় । কিশোর ভেতরে ঢুকে বলে,”ওপেন হার্ট সার্জারির পেশেন্টের কাছ থেকে দশহাজার টাকা বিল কম রাখার নির্দেশ তুমি দিয়েছো?”

_হ্যা। সো হোয়াট?
রাওনাফ বলে ওঠে।

_না, কিছুই হয়নি। তবে আমরা কেউ জানি না তো!

_প্রয়োজন মনে করিনি। অসুবিধা হলে আমার প্রফিট থেকে দশ হাজার কেটে রেখো।

_ভুল ভাবছো রাওনাফ। এমন কিছু মিন করিনি। বাই দ্যা ওয়ে, নেক্সট ওটি কটায় তোমার?

_দু ঘন্টা পরে।

কিশোর তথ্যটা জেনে চলে যায়।

ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে রাওনাফ সেদিকে তাকায়। হাত বাড়িয়ে যন্ত্রটাকে তুলে নিয়ে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে শর্মীর ইংলিশ ম্যাম রাবিয়া রহমান বলে ওঠে,”আমি কি ডক্টর রাওনাফ করিমের সাথে কথা বলছি?”

_ইয়েস!

_আমি শর্মীর ইংলিশ টিচার রাবিয়া রহমান বলছি।

রাওনাফের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। জিজ্ঞেস করে,”ম্যাম আপনি হঠাৎ! ইজ এভরিথিং ফাইন?”

_নট এ্যাট অল । শর্মী হঠাৎ খুবই অসুস্থ হয়ে পরেছে।

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। উদ্বিগ্নতার সাথে চেঁচিয়ে ওঠে,”মানে! কি হয়েছে!”

_পেটে ব্যাথা।

_ঠিক আছে! আমি আসছি। ওকে বিশ মিনিট দেখে রাখুন। আমি এক্ষুনি আসছি।

ফোন কেটে রাওনাফ তাড়াহুড়ো করে পোশাক পাল্টে নিতে থাকে। দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় ডক্টর লামিয়া, স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ,সিটি মেডিকেয়ার হসপিটালের। রাওনাফকে দেখে বলে,”কোথাও যাচ্ছো তুমি? তোমার তো ও.টি. আছে দুই ঘণ্টা পরে।”

_শর্মী সামহোয়াট সিক! স্কুল থেকে ফোন দিয়েছে।

_ও গড! আচ্ছা যাও যাও!
লামিয়া দরজা থেকে সরে কেবিনে ঢোকে। রাওনাফ বলে,”কিছু বলবে?”

_হ্যা,ওই আমার একটু পরে ও.টি. আছে। আমি এ্যানেস্থেসিয়া স্পেশালিস্ট খাইরুল ইসলামকে কল করতে চাচ্ছি। মাহবুব আউট অব দ্যা সিটি যেহেতু। তুমি যদি পারমিশন দাও।

রাওনাফ অবাক হয়ে বলে,”ডেকে নাও। খাইরুলের সাথে তো আমার শত্রুতা নেই যে আপত্তি করবো!”

_না,তবুও। তুমিও তো একজন মালিক এই হসপিটালের।

রাওনাফ বলে,”ডেকে নাও।”
তারপর তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।

***
উর্বীর হাতে আজ তেমন কোনো কাজ নেই। অবশ্য অফিস জয়েনিং-এর পর থেকে কখনই কাজের ব্যাস্ততা ছিলো না তার। টুকটাক প্রজেক্ট নিয়ে ফিল্ড ম্যানেজারদের সাথে মিটিং আর কিছু ফাইলে সাইন। কাজ বলতে এতটুকুই। উর্বীদের এনজিওটা বহুমুখী কাজ করে থাকে।
হাত ঘড়িতে বারবার সময় দেখছে সে। চেহারায়ও নেমে এসেছে বিরক্তির ছাপ। তার কারণ আজ উর্বী একটু অসুস্থ। সকাল থেকেই ব্লাড প্রেশার অস্বাভাবিক লো মনে হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে রওশান আরা ফোন দিয়েছিলেন প্রায় ঘন্টাখানেক আগে। উর্বী খেয়ালই করলো না! উর্বী কল ব্যাক করে কথা বলে নেয়। কোনো এক অদ্ভুত কারনে রওশান আরা নামের বৃদ্ধা মহিলাটির উর্বীর প্রতি ঢেলে দেওয়া অস্বাভাবিক মমতা উর্বী উপেক্ষা করতে পারে না। অবশ্য ভালোবাসা,মায়া জিনিসটা উর্বী কখনোই উপেক্ষা করতে পারেনি। যারা উপেক্ষা করতে পারে তারা বেঁচে যায়,যারা পারে না তারা জরিয়ে যায়, নিজেদের তুলে দেয় সর্বনাশের মুঠোয়।

দরজায় এসে দাঁড়ায় উর্বীর কলিগ মনিরুল ইসলাম। উর্বী বলে ওঠে,”আরে মনির ভাই! ভেতরে আসুন। ওখানে দাঁড়িয়ে কেন?”

মনিরুল হেসে বলে,”আপা আমাদের নতুন অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট জয়েন করেছে। তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো আপনাকে। তাকে নিয়ে এসেছি।”

উর্বী উঠে দাঁড়ায়,”হ্যা নিশ্চয়ই! ওনাকে নিয়ে আসুন।”

মনিরের পিছু পিছু একজন সাতাশ-আঠাশ বছরের ছেলে উর্বীর কেবিনে ঢোকে। ছেলেটি উর্বীকে বিনয়ের সাথে সালাম দেয়। উর্বী ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি দিয়ে সালামের উত্তর দেয়। মনিরুল ইসলাম উর্বীর সাথে ছেলেটির পরিচয় করিয়ে দিতে বলে ওঠে,”আপা ওর নাম হচ্ছে উচ্ছাস! ও এখন থেকে আমাদের অফিস এ্যাসিস্ট্যান্ট!”

উর্বী যেনো কেঁ’পে ওঠে উচ্ছাস নামটি কানে যেতেই। মুখভঙ্গি মুহুর্তেই বদলে যায় পুরোপুরি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ঠোঁট কাঁপছে তার।
উচ্ছাস নামের ছেলেটি উর্বীর দিকে বিনয়ী হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। উর্বী তার দিকে তাকায়। সেই পরিচিত ব্যাথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে মস্তিষ্কে।
মনিরুল ইসলাম বলতে থাকে,”উচ্ছাস! ইনি হচ্ছেন তোমার সিনিয়র। মৃদুলা উর্বী।”

***
শর্মীর দিকে তাকিয়ে থেকে রাওনাফ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। শর্মী পেটে হাত চেপে কাতরাচ্ছিলো, নরম গলায় বলে ওঠে,”ভীষণ পেটে ব্যাথা করছে আমার পাপা।”

_চলো, বাড়িতে চলো। মেডিসিন দিয়ে দেবো। সেরে যাবে।

মেয়েকে পাঁজাকোলা করে স্কুলের কমনরুম থেকে বের হয়ে গেইটের কাছে যায়। গেইটের বাইরে রাওনাফের গাড়িটা রাখা। আব্দুল দরজা খুলে দিতেই শর্মীকে বসিয়ে নিজেও বসে। আব্দুলকে বলে,”বাড়িতে চলো। ওকে বাড়িতে রেখে আমি হসপিটাল যাবো।

শর্মীকে বাড়িতে রেখে মেডিসিন খাইয়ে দিয়ে আমীরুনকে সব বুঝিয়ে দিয়ে রাওনাফ গাড়িতে এসে বসে। আব্দুল গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগেই রাওনাফের ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসে। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটা নারী কন্ঠ বলে ওঠে,”আমি কি ডক্টর রাওনাফ করিম খানের সঙ্গে কথা বলছি?”

_ইয়েস,হু’স দিজ?

_স্যার,আমি দিগন্তের রিসিপশনিস্ট আঁখি বলছি।

রাওনাফ বলে ওঠে,”হ্যা বলুন!”

_স্যার,মৃদুলা ম্যাম হঠাৎ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। আপনাকে আসতে হবে!

চলমান………

আরেকটি বার পর্ব-০৯

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৯
#Esrat_Ety

“সকাল সকাল চলে এলে যে!”

তহুরার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে উর্বী। তার কন্ঠস্বর শুনে আন্দাজ করা যাচ্ছে তার অসুস্থতার পরিমাণ। তহুরা ননদের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,”ননদের শশুর বাড়িতে সকাল সকাল আসতে নেই বুঝি?”

_হুট করে কুটুম বাড়িতে আসতে নেই‌।
নিচু স্বরে বলে দেয় উর্বী।

_তুই অ’সু’স্থ তাই এলাম। রাওনাফ ভাই ফোন দিয়েছিলেন রাতে। উনিই আসতে বলেছেন। আমরা আসলে নাকি তোর ভালো লাগবে।

_কিন্তু আমার তো ভালো লাগছে না।
স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে উর্বী।
তহুরা কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে প্রসঙ্গ পালটে বলে ওঠে,”এখন কেমন আছিস? কোনো অসুবিধে?”

_নাহ, একেবারে ঠিকঠাক।

তহুরা আর কথা না বাড়িয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বিয়ের পরে বয়স আরো কম কম মনে হচ্ছে মেয়েটার। মনে হচ্ছে বয়স বাইশ -তেইশের সেই উর্বী। যে লাফাতো, খিলখিল করে হাসতো, কতটা চঞ্চল ছিলো মেয়েটা !

উর্বী বলে ওঠে,”শুধু ভাইয়া আর তুমিই এসেছো?”

_হু।

_উপমার বিয়ে কবে?

_কথাবার্তা চলছে। তোর শশুরবাড়ি এসে দাওয়াত দিয়ে যাবো।

_আমি গেলে উপমার বিয়ে হবে?
কাটকাট বলে ওঠে উর্বী।

তহুরা উদাসী দুটি চোখে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি তোকে আর আমার নিজের বোনকে কখনো আলাদা চোখে দেখিনি এটা জানিস তো? তাই তোর প্রতি ভাবী হিসেবে নয় বড় বোন হিসেবে অনুরোধ থাকবে যেটুকু ভালো সৃষ্টিকর্তা রাখতে চাইবেন, ততটুকু সুযোগ নিজেকে দিবি।”

উর্বী তহুরার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তো তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ভালো থাকতে চাচ্ছি না? আমি তো ভালোই আছি। না না,আমি আনন্দিত আসলে। হিন্দিতে একটা কথা আছে না,”উপর ওয়ালা যব ভি দেতা,দেতা ছাপ্পড় ফাড়কে।” আমার জীবনের সাথে এমনটাই হয়েছে। দেখো একসময় এমন পরিস্থিতি ছিলো আমার বিয়ে দিতে পারবে না কোথাও,আর এখন দেখো স্বামী, বাচ্চা কাচ্চা,ভরা সংসার সব একসাথে পেয়ে গিয়েছি। তোমার কি মনে হচ্ছে আমি উদাসীন আমার সংসারের প্রতি? মোটেও না। রোজ স্বামী বাড়িতে ফিরলে তার কাছে কফি নিয়ে ছুটে যাই, শাশুড়ি ওষুধ খেলো কিনা খোজ নিই। আমার চাবির গোছা দেখবে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”

কন্ঠে কিছুটা বিদ্রুপ উর্বীর, সে অসুস্থ শরীর নিয়ে খাট থেকে নামতে যায় তখনই রাওনাফ ঘরে ঢুকে স্বাভাবিক গলায় বলে,”নামছো কেনো!”

উর্বী বসে পরে। রাওনাফের পিছন পিছন ঘরে ঢোকে রেজাউল কবির। সে বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে তহুরাকে বলে,”চলো,আমাদের বেড়োতে হবে। গিয়ে অফিসে যাবো। হাফ বেলার লিভ নিয়েছিলাম।”

রাওনাফ রেজাউল কবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,”যদি কিছু মনে না করতেন তাহলে আমার গাড়ি আপনাদের পৌঁছে দিতো।”

রেজাউল কবির আপত্তি না জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়। যাওয়ার আগে সে আরো একবার উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী অন্যদিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।

রেজাউল কবির আর তহুরাকে বিদায় দিয়ে রাওনাফ ঘরে ঢুকে উর্বীর দিকে একপলক তাকিয়ে জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দেয়। সকালের কড়া মিষ্টি রোদ এসে ঘরটাতে ছড়িয়ে যায়। উর্বী মাথা ঘুরিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ বলতে থাকে,”এই রকমের না’জুক অবস্থা শরীরের, চাকুরী কিভাবে করতে? অদ্ভুত!”

_মাসের মধ্যে দশদিন অ’সুস্থ থাকতাম। এজন্য দু’টো চাকুরী খুইয়েছি।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় উর্বী। রাওনাফ বলতে থাকে,”তোমার এ্যাপ’য়েন’মেন্ট লেটার এসেছে। ঘুমে ছিলে তাই আমি সাইন করে রেখে দিয়েছি। এক তারিখে জয়েনিং। পারবে?”

_পারবো না কেনো?
রাওনাফের দিকে তাকায় উর্বী।

রাওনাফ সেকথার জবাব না দিয়ে বলে,
_আমার সাথে আজ হসপিটালে যেতে হবে তোমার। কিছু টেস্ট করাবো।

_প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি। কোনো প্রয়োজন নেই।
নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে উর্বী।

_আমি কেউ না, আমি একজন ডক্টর। অসুবিধার কথা খুলে বললে আমার বুঝতে সুবিধা হতো। আর মহিলা গাইনোকলজিস্ট দেখাতে চাইলে লামিয়া আছে,আমার ফ্রেন্ড। ও খুব ভালো। ওর কাছে নিয়ে যেতে পারি!

_ধন্যবাদ। তেমন কোনো অসুবিধা নেই। হলে আপনাকে জানাবো।

একঢালা উত্তর শুনে রাওনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে উর্বীর একপলক তাকায়, তারপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিচে চলে যায়।

***
নাবিল মুখ ভার করে ব্রেডে মাখন লাগিয়ে যাচ্ছে। রাওনাফ নাবিলের হাত থেকে ব্রেড আর ছু’ড়ি টা নিয়ে নেয়, তারপর নিজে মাখন লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,”এতো বড় হয়েছো। এখনো পারফেক্ট ভাবে পারছো না!”

নাবিল চুপচাপ পাপার হাত থেকে ব্রেড টা নিয়ে খাচ্ছে। শর্মী চুপচাপ উঠে পরতে গেলে রাওনাফ ডেকে ওঠে,”শর্মী!”

শর্মী এই ভয়টাই পেয়েছিলো। সে আসলে পালাতে চাইছিলো। আ’ত’ঙ্কিত মুখ নিয়ে পাপার দিকে তাকায়। রাওনাফ কফির কাপে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে,”জুস টা খাও।”

_পাপা প্লিজ!
আপত্তি জানায় শর্মী!

রাওনাফ বলতে থাকে,”গাছের কমলা। গাছগুলো তোমাদের জন্য লাগিয়েছি। আমি নিশ্চয়ই বাজারে বিক্রি করার জন্য ফলের গাছ লাগাইনা।”

শর্মী নাক চোখ কুঁচকে জুসের গ্লাসটা হাতে তুলে নেয়। রাওনাফ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”বন্ধুদের সাথে কোল্ডড্রিংকস কিনে খাওয়ার সময় কোনো অলসতা দেখি না। পকেটমানি কমিয়ে দেবো একেবারে!”

_খাচ্ছি তো!
অভিমানী গলায় বলে ওঠে শর্মী। রাওনাফ রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”রাতের ওষুধ নিয়েছিলে?”

রওশান আরা অপরাধী গলায় বলে,”মনে ছিলো না।”

_কেনো?

_তুই মনে করিয়ে দিসনি।

রাওনাফ মায়ের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ওঠে,”তোমরা সবাই আমার উপরে নির্ভরশীল কেনো থাকো সবসময়।”

রওশান আরা মুচকি হাসে। আমীরুন একটা ট্রেতে কিছু খাবার নিয়ে নেয় উর্বীকে দিয়ে আসবে বলে। রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”দাড়া।”

আমীরুন দাঁড়িয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ ঠান্ডা গলায়
বলে ওঠে,”জুস টা নিয়ে যা। বাড়ির সবার জন্য বানিয়েছি।”

আমীরুন একটা গ্লাস হাতে তুলে নেয়। নাবিল তার বাবার দিকে একপলক তাকায়। রাওনাফ হাতে এপ্রোন,স্টেথোস্কোপ আর ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর তার তিন ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই যে তোমরা তিনজন! আজ সারাদিন খুব ব্যস্ত থাকবো। ফোন দিতে পারবো না। প্রত্যেকে আজ কোথায় কোথায় যাবে তার আপডেট আমাকে মেসেজে জানাবে। আমার অবগতির বাইরে কিছু করেছো সেটা পরে টের পেলে প্রত্যেকের ল্যাপটপ আর সেলফোন বাজেয়াপ্ত করা হবে।”

আমীরুন খাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢোকে। উর্বী চুলে খোঁপা বেঁধে নিতে নিতে বলে,”আনলে কেনো? আমি তো ঠিক আছি এখন! নিচে গিয়ে খেয়ে নিতাম।”

আমীরুন দাঁত বের করে বলে,”ভাইজান পাঠাইলো।”

উর্বী চুপ করে থাকে।
আমীরুন বলতে থাকে,”ভাইজান তো বারবার বলে দিয়েছে আমারে,আমীরুন, তোর ভাবীর দিকে খেয়াল রাখবি! সে যেনো আজ সারাদিনে নিচে না নামে। তার যা যা লাগবে সব দিয়ে আসবি ঘরে।”

উর্বী বিব্রত হয় খুব। রাওনাফ কি সত্যিই এমন ভাবে বলেছে নাকি আমীরুন একটু রাঙিয়ে বলছে! আমীরুনকে সে যতটা চিনেছে মেয়েটা প্রচুর বানিয়ে কথা বলে,বাড়িয়ে কথা বলে। রাওনাফের প্রসঙ্গ উঠলে তো আরো বেশি বেশি করে বলে।

উর্বীর নীরবতা দেখে আমীরুন নিজে নিজে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,”মানুষ একটা আমার বড় ভাইজান। সবদিকে খেয়াল। পোলা,মাইয়া,মা,বৌ,রোগী সবার জন্য হের যত্নের কমতি নাই।”

***
“আরে কি করছো ঝুমুর! তুমি তো সেই বাচ্চাই রয়ে গেলে দেখছি!”

ঝুমুর রাওনাফের চুল টেনে দিয়ে বলে,”দেখছিলাম এগুলো নকল কি না দুলাভাই। এতো বছরেও এতো ঘন চুল।”

রাওনাফ হাসে শিমালার ছোটো বোন ঝুমুরের কথায়। সুমনা পাশ থেকে বলে ওঠে,”তা আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসলেন না কেনো? ভালো লাগতো আমাদের!”

_সত্যিই কি ভালো লাগতো?
রাওনাফ সুমনাকে কথাগুলো বলে হেসে ফেলে। সুমনা বলে,”কাম অন দুলাভাই! আমরা নাবিল নই। যাই হোক, কেমন আছে আপনার ওয়াইফ?”

_ভালো। তোমাদের খবর বলো। তোমার হাজব্যান্ড দেশে কবে ফিরবে?

_সামনের মাসে হয়তোবা।

_আমাদের বাড়িতে যাওয়া ভুলেই গিয়েছো দেখছি!

সুমনা হেসে ফেলে, বলে,”তেমন কিছু না দুলাভাই। সবাই সংসার নিয়ে এতোটা ব্যস্ত হয়ে পরেছি!”

_তাই বোনের স্বামী,ছেলে,মেয়েদের ভুলে গিয়েছি তাইতো? কিন্তু আমি তোমাদের ভুলিনি। তোমরা আমার কাছে সেই সুমনা, ঝুমুর। শিমালার আদরের ছোটো দুই বোন। সময় পেলে যাবে আমার বাড়িতে, তোমার বোনের বাড়িতে। মা সবসময় তোমাদের কথা বলে!

রাওনাফ কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। ঝুমুর বলে ওঠে,”আমরা আসলে আগে থেকেই চাইতাম আপনি একটা বিয়ে করেন। সাহস করে বলে উঠতে পারিনি কখনো।”

রাওনাফ ঝুমুরের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে।

***
ঘরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে রাওনাফ। উর্বী বিছানায় চুপচাপ একটা বই নিয়ে বসে আছে। রোজকার খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য। রাওনাফ জানে এরপর কি কি হবে, রাওনাফ ওয়াশ রুমে ঢুকবে,বের হয়ে দেখবে উর্বী ঘরে নেই। একটু পর হাতে এক মগ কফি এনে রোবটের মতো বলবে,”আপনার কফি!”

রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়ে দেখে উর্বী ঘরে নেই। বিছানার ওপর একটা বই রাখা। রাওনাফ ম্লান হেসে নিজের ওয়ালেট থেকে কিছু ক্যাশ টাকা বের করে বইটার নিচে রাখে।

খানিক বাদে উর্বী কফি হাতে ঘরে ঢুকে কফিটা রাওনাফকে দেয়। রাওনাফ হাত বাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,”থ্যাংক ইউ।”

উর্বী ম্লান হাসে। তারপর বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে বইটা তুলে হাতে নিতেই বইয়ের নিচে ক্যাশ টাকা গুলো দেখে অবাক হয় যায়। তারপর রাওনাফের দিকে তাকায়।

রাওনাফের দৃষ্টি মোবাইলে নিবদ্ধ। কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে ওঠে,”কাল মোহনা শপিং-এ যাবে। শীতের পোশাক কিনবে, মা আর বাচ্চাদের শপিং ও করে এবাড়ির। তোমাকে নিয়ে যাবে। তোমার জন্য কিছু শীতবস্ত্র কিনে নিও। শীত পরছে বেশ।”

উর্বী কিছু বলে না ‌। চুপচাপ হাতের টাকা গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

আশপাশটা কেমন ধোঁয়াশা হয়ে আছে। রাওনাফ হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। নাবিল ভাবলো তার পাপা তাকেই ডাকছে। সে এগিয়ে যায়। কিন্তু না। রাওনাফ তাকে ডাকছে না। রাওনাফ ছোটো একটা বাচ্চা ছেলেকে ডাকছে। ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে “পাপা” বলে চিৎকার দিয়ে রাওনাফের কোলে ওঠে। রাওনাফ তার কপালে চুমু খায়। নাবিল চেঁচিয়ে ওঠে,”পাপা! ও কে! ও কেনো তোমাকে পাপা ডাকছে!”
রাওনাফ কপাল কুঁ’চ’কে নাবিলের দিকে তাকায়। রাওনাফের কোলের ছেলেটি বলে ওঠে,”এটা আমার পাপা! তোমার পাপা না!”

নাবিল চ’ম’কে ওঠে। উর্বী নামের ভদ্রমহিলা এসে রাওনাফের হাত ধরে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে উর্বী নাবিলের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কঠিন করে ফেলে বলে,”এটা আমার ছেলের পাপা। তুমি কেউ না! তুমি যাও।”

নাবিল অসহায়ের মতো তার পাপার দিকে তাকায়। রাওনাফ নাবিলের দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উর্বীর হাত ধরে,বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে চলে যায়। নাবিল পেছন থেকে গলা ফাটিয়ে ডাকতে থাকে রাওনাফকে। রাওনাফ শোনেনা তার ডাক।

লাফিয়ে উঠে হাঁফাতে থাকে নাবিল। স্বপ্ন আর বাস্তবতার পার্থক্য বুঝতে সে দুই মিনিট খানেক সময় নেয় সে।

রাওনাফ জানালা বন্ধ করে দিতে দিতে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে ওঠে,”কি হয়েছে বাবা! দুঃস্বপ্ন দেখেছো!”
নাবিল কিছু না বলে তাকিয়ে থাকে তার বাবার দিকে। রাওনাফ মশা মারার মেশিন অন করে দিতে দিতে বলে,”এভাবে অগোছালো হয়ে ঘুমাচ্ছো কেনো! জানালা খোলা রেখে। গায়ে কম্ফোর্টার ছিলোনা। ঠান্ডা বাঁধিয়ে ফেলবে দেখছি!”

নাবিল তখনও চুপ। রাওনাফ নাবিলকে এক গ্লাস পানি খাইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দরজা চাপিয়ে দিয়ে চলে যায়। দোতলায় উঠে সে শায়মী আর শর্মীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে এখানেও সেই একই অবস্থা। কারো গায়ে কম্ফোর্টার নেই। অথচ গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে শীতে। রাওনাফ দু’জনের গায়ে কম্ফোর্টার চাপিয়ে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যায়। ঘরে ঢুকে সে রীতিমতো তাজ্জব বনে যায়। এখানের দৃশ্যটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। উর্বী শুধুমাত্র গা থেকে কম্ফোর্টার সরিয়েই ফেলেনি, বরং লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। অথচ শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে শীতে কাঁপছে মেয়েটা। রাওনাফ মনে মনে ভাবে, এই মেয়েকে কাল বলবে ঘুমানোর আগে কম্ফোর্টার গায়ে চাপিয়ে কম্ফোর্টারের চারকোনায় চারটা পেরেক মেরে নিতে বিছানার সাথে, যাতে গা থেকে সরে না যায়!

রাওনাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উর্বীর গাঁয়ে কম্ফোর্টার টেনে দিয়ে নিজেও শুয়ে পরে। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত, আর চলছে না! বাবা মা’রা যাওয়ার পরে আঠেরো বছর বয়স থেকে শুধু দায়িত্ব আর দায়িত্ব। একটার পর একটা দায়িত্ব এসে বর্তাচ্ছে রাওনাফের ওপর। নতুন দায়িত্বের নাম মৃদুলা উর্বী। ওয়াইফ অব রাওনাফ করিম খান। বয়স ত্রিশ উচ্চতা পাঁচ ফুট দেড় কি দুই ইঞ্চি, যে ভদ্রমহিলা ঠিকঠাক ভাবে ঘুমাতে অবধি শেখেনি এতো বছর বয়সেও!
এক পলক উর্বীর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে শিমালার ফটোফ্রেম টা হাতে নিয়ে ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে ওঠে,”হাসছো নাকি রা’গ করছো!”

***
হাফিজুর রহমান ড্রয়িং রুমে বসে আছে। তার হাতে চায়ের কাপ। সে খুবই উৎফুল্লের সাথে তার শাশুড়ি রওশান আরার সাথে গল্প করছে।সে এসেছে এবাড়ির সবাইকে নিতে।

বাড়ির সবাই নিজেদের জামাকাপড় গোছাতে ব্যস্ত। সবার মুখ হাসি হাসি। বিশেষ করে শর্মীর। কদিন তার পড়তে বসতে হবে না এটা ভেবেই তার খুব আনন্দ হচ্ছে।

রাওনাফ এসে সামিউলের রুমের সামনে দাঁড়ায়। বাইরে থেকে ডাকে,”সামিউল তোদের সব কিছু গোছানো হয়েছে?”

সামিউল বাইরে আসে। রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,
-ভাইয়া আমাদের যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

-কেনো ঠিক হবে না? তুই তোর বোনের শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস! তোরা তো এবাড়ির ই লোক। আর তাছাড়া হাফিজ বারবার তোদের কথা উল্লেখ করেছেন।

-মা যদি কিছু বলে?
-মা কিছুই বলবে না। আজমেরী তোর বোন। আর মা আমাদের সাথে যাচ্ছেন না।

-মা বাড়িতে একা থাকবে?

-আমিরুন থাকবে। তিনটা দিনেরই তো ব্যাপার। আমি আগেই চলে আসতে পারি। তোরা রেডি হ। আমি আর ডাকতে আসবো না।

রাওনাফ চলে যায়। সামিউল অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে কি কি নিবে প্যাক করো।

উর্বী তার ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হয়ে বসে আছে। রাওনাফের ব্যাগ গোছানো হয়নি। তাকে কোথাও দেখাও যাচ্ছে না।

রাওনাফ গিয়েছিলো শর্মীদের ঘরে। শর্মী আর শায়মীর ব্যাগ গোছানো হয়েছে কিনা দেখতে।
কিছুক্ষণ সেখানে থেকে সে রুমে ঢুকেই নিজের ব্যাগ গোছাতে তাড়াহুড়া লাগিয়ে দেয়। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি হেল্প করবো?”

-লাগবে না। থ্যাংক ইউ।
রাওনাফ বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে। উর্বী চুপ করে বসে থাকে। লোকটা তার প্রতি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে চেষ্টা করে। উর্বীও চেষ্টা করলো কিছুটা শোধ করে দেওয়ার। তাদের এই নামমাত্র সম্পর্কটা একপ্রকার শোধ শোধ খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা দুজন প্লেয়ার।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উর্বী সংকোচের সাথে জিজ্ঞেস করে,”নাবিল যেতে রাজি হয়েছে?”

-হু,রাজি হবে না কেনো।

-আমি ভেবেছি আমি যাচ্ছি বলে রাজি হবে না।

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়, কিছু বলে না। নিজের ব্যাগ গোছাতে ব্যাস্ত হয়ে পরে।

আমিরুনকে সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সবাই বাড়ি থেকে বের হয়। খান পরিবারের সবাইকেই খুবই খুশিখুশি দেখা যাচ্ছে। দু’টো গাড়ির একটাতে বসেছে সামিউল, শাফিউল, হাফিজুর,শর্মী,শায়মী। এই গাড়িটা ড্রাইভ করবে শাফিউল। অন্য গাড়িতে বসেছে মোহনা,অন্তরা,রাওনাফ। রাওনাফ গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে। উর্বী পেছনের একটা সিটে বসতে গেলে মোহনা বলে ওঠে,”ভাবী সামনের সিটে বসুন।”

উর্বী রোবটের মতো সামনের সিটের দরজা খুলতেই পেছন থেকে নাবিল বলে ওঠে,”আমি পাপার পাশে বসবো।”

উর্বী ঘুরে নাবিলের দিকে তাকায়। তারপর একটা ম্লান হাসি দিয়ে বলে,”শিওর।”

রাওনাফ চুপচাপ বসে থাকে। উর্বী গিয়ে পেছনের সিটে বসে।

***
হাত থেকে “কনফেশন অফ আ মা’র্ডা’রার” বইটা নামিয়ে রেখে উচ্ছাস বাইকের চাবি হাতে নেয়। সজীব আর মাহমুদ উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে আছে। সজীব অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে বলে ওঠে,”কোথাও যাবেন ভাই?”

_হু। অসীমের সাথে জরুরি বৈঠক আছে।

_ভাই মামুনের বাচ্চা বেশি ফাল পারতেছে।

_ওকে পরে দেখবো। উর্বী ছাড়া অন্যকিছু মাথায় আনতে চাচ্ছি না আপাতত।

সজীব বিরস মুখে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে দিনকে দিন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। সারাটা দিন শুধু উর্বী উর্বী উর্বী! যদি কোনো অপ্সরা হতো তাহলে না হয় মানা যেতো। মোটামুটি ধরনের চেহারা। উচ্ছাস ভাই চাইলে হাত বাড়ালেই দশ গুণ সুন্দরী মেয়ে পেতে পারে এখনও। তা না করে ঐ মেয়েটার জন্য ম’র’ন খেলায় মেতেছে।

উচ্ছাস বইটা সেলফে তুলে রেখে বলে,”উর্বীকে মনে মনে গালাগাল দিচ্ছিস? খবরদার না। ওকে ভালোবাসা, গালাগাল দেওয়া, সবকিছুর অধিকার শুধু আমার।”

সজীব সাহস যোগার করে বলে,”যার জন্য এখনও এতো পাগলামি করছেন সে কি করেছে? সারাদিন আপনাকে বিয়ে করো বিয়ে করো বলে প্যারা দিতো সে এখন তো দিব্যি অন্যের ঘর করছে।”

উচ্ছাস তার কথার জবাব না দিয়ে বলে,”হানিমুনে গিয়েছে নাকি আত্মীয়ের বাড়িতে!”

_ওর শশুরবাড়ির দিকে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি।

উচ্ছাস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”একটার পর একটা ভুল করেই যাচ্ছে মেয়েটা। প্রথম ভুল আমাকে ভালোবাসা, দ্বিতীয় ভুল আমার মতো পশুকে ভালোবাসতে শেখানো, তৃতীয় ভুল আমার থেকে দূরে যাওয়ার কথা বলা, প্রথম তিনটা ভুলের শা’স্তি দিয়েছি আমি।
চতুর্থ ভুল আমাকে ভুলে অন্যকাউকে গ্রহণ করা। এটার শাস্তিও খুব শিগগিরই পাবে। শাস্তি দিয়ে তারপর ওকে বিয়ে করবো। কিছু ক্যাশ নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। ছোটো সংসার পাতবো ওকে নিয়ে।”

_ভাই! ও তো আর আপনাকে চায় না। এখনো এসব করার মানে আছে কোনো!

উচ্ছাস সজীবের দিকে তাকায়।
_চায় না মানে! চাইতে হবে! চাইতে হবেই! এখনো এসব করার মানে আছে মানে? যেদিন ম’র’বো সেদিন ঐ উর্বী ওর থেকে পিছু ছাড়াতে পারবে আমার। তার আগে না। কখনোই না।

চলমান……

আরেকটি বার পর্ব-০৮

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৮
#Esrat_Ety

নভেম্বর মাসের শুরু। এখনই বেশ শীত পরতে শুরু করেছে। উর্বীর সন্ধ্যে থেকে গা শিরশির করছে শীতে। গাঁয়ে একটা পাতলা চাদর জরিয়ে রেখেছে। হাতে তার একটা বই।
এই বইটা হাতে নিয়ে উর্বী দুদিন ধরে বসে থাকে,অথচ একটা পাতাও পড়া হয়ে ওঠে না।
কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থেকে উর্বী উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দেয়।

আমিরুন ঘরে এসে উর্বীকে ডাকে,”ভাবি আপনেরে আম্মায় ডাকতাছে। বড় আপায় ভিডিও কল দিছে আপনের লগে কথা কইবো”
উর্বী বিছানা থেকে বইটা নিয়ে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখে আমিরুনের সাথে সেদিকে চলে যায়।

রওশান আরার মুখ হাসিহাসি। সে উর্বীর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়েই বলে,”তোমার বড় ননদ,আর ননদাইও আছে কিন্তু। সালাম দিও।”

উর্বী সালাম দেয়। ওপাশ থেকে আজমেরীর স্বামী হাফিজুর রহমান সালামের উত্তর দেয়।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাবী ভালো আছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন?
উর্বী বিব্রত হয় এতো বড় একজন লোকের মুখে ভাবি ডাক শুনে, সে বলে,”জী ভাইয়া।”

হাফিজুর রহমানের মুখ হাসি হাসি। সে বলে,”কি যে বলি ভাবি সরকারের চাকর আমি। করি সরকারি চাকুরী। ছুটিছাটা তো আর মন মর্জি মতো পাই না। বিয়েতে যেতে পারিনি। কদিন আগে সামিউলের এতো বড় একটা এ’ক্সি’ডেন্ট হলো তাতেও যেতে পারিনি। আপনার ননদ তো রে’গে আমার সাথে কথাই বলেনি তিন দিন।”

উর্বী তাকিয়ে আছে তার ননদের স্বামীর দিকে। সে কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। ওপাশ থেকে হাফিজুর রহমান বলে,”ভাবী কাজের কথায় আসি। সামনে একটা ছুটি পেতে যাচ্ছি। আমি ঠিক করেছি এবারের ছুটি আমি আমার গ্রামের বাড়িতে কাটাবো। রাওনাফ ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। আপনাদের সবাইকে এসে আমি নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে। সবাই মিলে আমরা আনন্দ করে ছুটি টা কাটাবো। আপনাকে বলে রাখলাম ভাবি।”

উর্বী জবাব না দিয়ে ম্লান হাসে। ওপাশে আজমেরী হাফিজুরের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলে, “আমাকেও একটু কথা বলতে দাও তো।”
তারপর উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”উর্বী শোনো, ভাইয়াকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। জানোই তো তার কাছে তার হসপিটাল,ডাক্তারিই সব। আমি রুমাদেরও আসতে বলেছি। খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হতে যাচ্ছে।”

উর্বী মাথা নাড়ায়। আজমেরী আরো কথা বলতে থাকে।
বাইরে রাওনাফের গাড়ির হর্ন বাজে। রাওনাফ এসেছে।

আজমেরী ফোন রেখে দেয়। উর্বী রওশান আরার কাছে বসে থাকে।মোহনাও সেখানে আছে। আমিরুনও রয়েছে। রাওনাফ দোতলায় উঠে রুমে না গিয়ে উঁচু গলায় আমিরুনকে ডাকে,”আমিরুন একটু কফি দিয়ে যা তো আমায়।”

রওশান আরা উর্বীকে বলে,”বৌমা যাও। এভাবে বসে আছো কেনো। স্বামী বাইরে থেকে ফিরলে তাকে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়াটা স্ত্রীর কর্তব্য। আশা করি আমার বারবার তোমাকে বলে দিতে হবে না।”

উর্বী চলে যায়। মোহনা তার শাশুড়িকে বলে,”মা এভাবে কাজ হবে?”
রওশান আরা হাসে,বলে,”আমার শাশুড়ির কাছে একটা কথা শুনেছিলাম মেজো বৌমা,”দেখলে মায়া,না দেখলে ছায়া।”

মোহনা তার শাশুড়ির কথা বুঝতে পারছে না। তার শাশুড়ি কি করতে চাইছেন?

***
রাওনাফ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় আরাম করে হেলান দিয়ে বসে পরে।

উর্বী কফি নিয়ে রুমে ঢোকে। রাওনাফের দিকে কফি এগিয়ে দিতে দিতে বলে,”আপনার কফি।”
রাওনাফ তার দিকে তাকায়। কফিটা নিতে নিতে বলে,”তুমি!!আমিরুন কোথায়।”

-মা তাকে একটু কাজে ডেকেছে।

এই বলে উর্বী ঘর থেকে বের হতে চায়। রাওনাফ ডাকে,”উর্বী।”

উর্বী ফিরে তাকায়। রাওনাফ বলে,”যেটা তোমার মন চাইবে না সেটা অন্য কেউ বললেও করার দরকার নেই, অন্তত এখানে, আমার বাড়িতে।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”আপনার এটা কেন মনে হয় সবাই শুধু আমাকে সবসময় জোর করে সবকিছু চাপিয়ে দেয়।”

রাওনাফ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে,”এমনটা মিন করিনি।”

রাওনাফ তার ফোনের দিকে মনোযোগ দেয়। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এইযে এই আ’ই’ডি টা তোমার? মৃদুলা উর্বী?”

উর্বী বলে,”হ্যা।”

-তোমার ভালো নাম মৃদুলা?

-হ্যা। কেন কবুল বলার সময় খেয়াল করেননি? কাজী বলেনি?
ঠান্ডা গলায় বলে উর্বী।

রাওনাফ থতমত খেয়ে যায়। তার ফোনটা পাশে রেখে বলে,”আজমেরীর স্বামী ফোন করেছিলো। তোমাকেও বোধ হয় বলেছে। নেক্সট উইক আমাদের সবাইকে নিতে আসবে। তোমার যদি ইচ্ছে না থাকে যাওয়ার আমায় খোলাখুলি বলতে পারো।”

-আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই আপনাকে কে বললো?

-না,হতে পারে না? ইচ্ছে নাই থাকতে পারে।

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি যেতে চাই। আমার কোনো অসুবিধা নেই।”

***
শর্মী মনে মনে ভাবছে তার যদি বড় কোনো অসুখ হতো, তাহলে তো আর স্কুলে যাওয়া লাগবে না। আমিরুন এসে শর্মীর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
“আম্মু কিচ্চু খাইবা না? স্কুলের সময় হইয়া গেছে তো।”

-না খালামনি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।

আমিরুন দাঁড়িয়ে থাকে। বলে,”টিফিন বক্সে ভইরা দিয়া দিমু?”

-হু দিতে পারো।

শর্মী তার ব্যাগ গোছাতে থাকে। শায়মী নাবিল স্কুলে গেছে। বাড়িতে আছে শুধু তার দাদু,উর্বী আর আমিরুন। অন্যরা সবাই বেরিয়েছে।

স্কুল ড্রেস গায়ে চাপিয়ে শর্মী তার পাপাকে ফোন করে।

-হ্যালো পাপা তুমি কখন আসবে?

-আমার তো আসতে বারোটা বেজে যাবে মামুনি। কেনো?

-কেনো মানে,তুমি ভুলে গিয়েছো আজ আমাদের স্কুলে প্যারেন্টস টিচার মিটিং।

-ওহহ হো মামুনি। আমি একেবারে ভুলে বসে আছি। সরি মামুনি।আচ্ছা মোহনা বাড়িতে নেই? ওকে নিয়ে যাও।

-বাড়িতে কেউ নেই পাপা সবাই বেরিয়েছে। সবার কাজ আছে।

-ঠিক আছে আমি তোমার ক্লাস টিচারের সাথে কথা বলছি। তুমি স্কুলে যাও মামুনি।

-লাগবে না, তুমি থাকো তোমার কাজ নিয়ে।

শর্মী রে’গে ফোনটা রেখে দেয়। আজ তাকে তার ক্লাস টিচার অনেক কথা শোনাবে। শর্মীর খুব কান্না পাচ্ছে। সে স্কুল ব্যাগ নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায়। আমিরুন পেছন থেকে ডাকতে থাকে,”আম্মু টিফিন নিলা না যে। ও আম্মু দাড়াও।”

শর্মী দাঁড়ায় না। উর্বী আমিরুনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে আমিরুন আপা।”

-জানি না ভাবি। টিফিন না নিয়াই চইলা গেলো গটগট কইরা। রাইগা গেলো কেনো বুঝবার পারতাছি না। সব কয়টা পোলাপাইন ভাইজানের রা’গ পাইছে।

-তোমার ভাইজানের অনেক রা’গ? কই দেখে মনে হয় না তো।

-ভাইজান সব সময় রা’গ দেখায় না। যখন দেখায় তখন বুঝা যায়। তয় আমার ভাইজান সেরা ভাবি।

-হয়েছে আর ভাইজানের গুন গাইতে হবে না। টিফিন বক্স টা আমার হাতে দাও। আমি দিয়ে আসছি।

আমিরুন অবাক হয়ে বলে,”আপনি যাইবেন ভাবি?”

-হ্যা,আমার একটু কাজ আছে বাইরে। একটা চাকুরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছে।

আমিরুন উর্বীর হাতে টিফিন বক্সটা দেয়। উর্বী বলে,”সিনথিয়া শর্মী তো ওর নাম? ক্লাস সেভেন, রোল ৩৭ তাই না?

-হ ভাবি।

উর্বী বেরিয়ে পরে। বাড়ির ড্রাইভার আব্দুল বলে,”কই যান ভাবি।ওঠেন গাড়িতে ওঠেন।”

উর্বী গাড়িতে উঠতে উঠতে বলে শর্মীদের স্কুলে চলুন।

***
ক্লাস টিচার ওয়াহিদুজ্জামান উর্বীকে বসতে বলে নিজেও একটা চেয়ারে বসলেন। শর্মী দাঁড়িয়ে আছে। তার ভিষন রা’গ হচ্ছে। এই মহিলা এখানে কি করছে। কত্তো বড় সাহস!

ওয়াহিদুজ্জামান বলে,”আপনি শর্মীর কি হন?”

উর্বী খুব বিব্রত বোধ করতে থাকে। সে শুধু চেয়েছিলো শর্মীর হাতে টিফিন বক্স টা দিয়েই বেরিয়ে যাবে কিন্তু ওয়াহিদুজ্জামান তাকে দেখেই এগিয়ে আসে।
উর্বী আমতা আমতা করে বলে,”আমি শর্মীর বাড়ির লোক।”

-বাড়ির লোক বুঝলাম। কিন্তু আপনাকে কখনও দেখিনি। সম্পর্কে কি হন? কাজিন?

শর্মীর কান গরম হয়ে যায় লজ্জায়। তার পেছনে দাঁড়ানো তার বন্ধুরা উচ্চস্বরে হেসে ফেলে। ওয়াহিদুজ্জামান তাদের দিকে রা’গী চোখে তাকায়। তারা দমে যায়। শর্মীর ইচ্ছে করছে এখান থেকে পালিয়ে যেতে।

উর্বী ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি ডক্টর রাওনাফ করিম খানের ওয়াইফ।”

ওয়াহিদুজ্জামান অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,”ও আই সি। আমি এরকমটা শুনেছি। আপনি ডক্টর খানের ওয়াইফ! যাই হোক,বাড়ির লোকই তো। আপনাকেই বলি। শর্মীর প্রতি আপনাদের বাড়ি থেকে আরেকটু খেয়াল দিতে হবে। আমি মানছি ডক্টর খান বিজি মানুষ বাট…. শায়মী আর নাবিলকে নিয়ে আমার কখনো অভিযোগ করতে হয়নি কোনো ব্যাপারে। আপনি প্লিজ দেখবেন।”

-আচ্ছা।
উত্তর দেয় উর্বী।

-ডক্টর খানকে আমার সালাম দেবেন। সময় পেলে যাবো আপনাদের বাড়ি। চা খেতে।
হাসতে হাসতে বলে ওয়াহিদুজ্জামান।
উর্বী মুচকি হেসে বেরিয়ে যায়। দরজার কাছে শর্মী দাঁড়িয়ে। কটমট চোখে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে।

***
খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে।

শায়মী,শর্মী চুপচাপ খাচ্ছে। রাওনাফ শুধু সালাদ খাচ্ছে। রওশান আরা উর্বীকে খেতে বসার জন্য জোরাজুরি করছেন।

উর্বী খাবার পরিবেশন করছিলো, নাবিলের প্লেটে মাংস তুলে দিতে যাবে অমনি নাবিল বলে,”আমি নিয়ে নিতে পারবো।”

উর্বী থেমে যায়।

-আপনাকে যেনো আমাদের তিন ভাইবোনের কোনো ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে ঢুকে পরতে না দেখি। শর্মীর স্কুলে যাওয়ার সাহস কিভাবে হয় আপনার। আপনি কি আমাদের মা হওয়ার ভান করছেন নাকি।দূরে থাকবেন আমাদের থেকে!

রাওনাফ মাথা তুলে নাবিলের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকায়। তারপর উর্বীর দিকে তাকায়।

উর্বী খুবই শান্ত ভাবে বলে,”আচ্ছা।”

রাওনাফ ছেলেকে কিছুই বলে না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। তারপর মাথা ঘুরিয়ে রওশান আরার দিকে তাকায়। রওশান আরা খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে।

নাবিল কিচ্ছু বলে না আর। এমন ভাবে খেতে থাকে যেনো কিচ্ছু হয়নি। সে কিচ্ছু করেইনি।
উর্বী খাবার টেবিল ছেড়ে রুমে চলে যায়। রওশান আরা ডাকে, “ও বৌমা। না খেয়ে কোথায় যাচ্ছো।”

উর্বী দাঁড়ায় না।

শর্মী আর শায়মী দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ চুপচাপ উঠে পরে।

শর্মী তার দাদুকে বলে,”দাদু উনি কি খাবেন না?

-না বোধ হয়,তোমার ভাইয়া যা করেছে!
রওশান আরা আড়চোখে নাবিলের দিকে তাকায়। নাবিল খেতে থাকে।
শর্মীর ভিষন খারাপ লাগছে। কেনো যে সে ভাইয়াকে বলতে গেলো স্কুলের কথা। তার জন্য একজন মানুষ না খেয়ে থাকবে !

ক্লান্ত ভঙ্গিতে রাওনাফ হেঁটে ঘরের দিকে যায়। এই সবকিছু তারজন্য হচ্ছে। ঘরের দরজা চাপিয়ে রাখা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই সে চ’ম’কে ওঠে।

উর্বী মেঝেতে পরে আছে। রাওনাফ কয়েক মূহুর্ত থম মে’রে দাঁড়িয়ে থেকে ছুটে যায় সেদিকে। হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে ডাকতে থাকে,”উর্বী! উর্বী!”

উর্বী কোনো সাড়া দেয়না। রাওনাফ জড়তা নিয়ে উর্বীর মুখটা ঘুরিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো চ’ম’কে ওঠে, মুখ থেকে ফ্যা’না বের হয়েছে।

“ইয়া আল্লাহ! এসব কি! উর্বী! তুমি শুনতে পাচ্ছো! উর্বী!”

রাওনাফ উঁচু গলায় ডাকতে থাকে। উর্বী একই অবস্থায় পরে থাকে। রাওনাফ কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে উর্বীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়।
বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথার কাছে বসে উর্বীর পালস চেক করে। চোখ দেখে। এবং ডাকতে থাকে,”উর্বী! উর্বী।”

উর্বীর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। রাওনাফ উঠে মোহনা আর আমিরুনকে ডাকতে থাকে।
মোহনা ছুটে আসে। উর্বীর এমন অবস্থা দেখে মোহনাও হতভম্ব হয়ে যায়।

মাথার কাছে বসে ডাকতে থাকে,”এই উর্বী!”

রাওনাফ উর্বীর লক্ষণ দেখে একবার চিন্তা করলো হস’পিটালাইজড করার। পরক্ষনেই উর্বীর ভাই রেজাউলকে ফোন দেয় সে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করে রেজাউল সালামের উত্তর দেয়। রাওনাফ একটু তাড়াহুড়া করে বলে ওঠে,”প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। একটা কথা জানার ছিলো। উর্বী কি হি’স্টিরিয়ার রোগী? মানে আগে কখনও লক্ষন দেখেছেন কোনো?”

রেজাউল কবির উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”না! এমন কিছু নেই। কেনো? কি হয়েছে!”
চেঁচিয়ে ওঠে রেজাউল।

রাওনাফ বলে,”উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছি। একটু সেন্স’লেস হয়ে গিয়েছে। নাথিং সিরিয়াস। আপনাকে ফোন দিয়েছি কথাটা জানতে। আমার ধরন বোঝা দরকার। চিকিৎসা দিতে হবে। টেনশনের কিছু নেই। ভালোমন্দ জানাবো আপনাদের।”

রাওনাফ ফোন কেটে উর্বীর দিকে এগিয়ে যায়। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে উর্বীর চোখে মুখে পানি ছেটাতে থাকে। মোহনা বলে ওঠে,”ভাইয়া হাতের তালু ঘামছে খুব!”

রাওনাফ কিছু একটা চিন্তা করে বলে,”তুমি ওর শরীর থেকে কাপড় কিছুটা আলগা করে দাও। তারপর ম্যাসাজ দাও। জানো তো কিভাবে দেয়?”

মোহনা মাথা নাড়ায়। রাওনাফ এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”দিতে থাকো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”

ফোন হাতে নিয়ে রেজাউল তহুরার দিকে তাকায়। তহুরা এগিয়ে এসে বলে,”কি হয়েছে! কি হয়েছে ওর!”

_সেন্স’লেস হয়ে গিয়েছে হঠাৎ!

_আবার! আবার শুরু হয়েছে সেসব!
তহুরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে।

রেজাউল কবির স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে উদাসী গলায় বলে,”শান্তি পাবে না কখনো!”

***
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রাওনাফ। কিছুক্ষণ পরে বাইরে থেকে মোহনাকে বলে ওঠে,”ইজ এভরিথিং ওকে মোহনা!”

_ভাইয়া,জ্ঞান ফিরছে।

_ঠিকাছে। তোমাকে যা বলেছি তাই করো। ওর পোশাক পালটে দিও পারলে।

_দিয়েছি ভাইয়া।

রাওনাফ মাথা নিচু করে তার টি-শার্টের দিকে তাকায়। উর্বীর মুখ থেকে নিঃসৃত ফ্যা’না কিছুটা তার গায়ে লেগে গিয়েছিল যখন উর্বীকে কোলে তুলেছিল। নিজেকে দেখে রাওনাফ ম্লান হাসে।

শর্মী এসে তার পাপার সামনে দাঁড়ায়। রাওনাফের ঘরের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলে ওঠে,”ওনার জ্ঞান ফেরেনি পাপা?”

_ফিরছে মামুনি।

শর্মী চুপ হয়ে যায়, তারপর আবার বলে ওঠে,”তখন ভাইয়া ওনার সাথে বাজে ব্যাবহার করেছে সেজন্য এমন হয়েছে পাপা?”

রাওনাফ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”না। এটা এক ধরনের অ’সুস্থতা মামুনি।”

শর্মী তবুও চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। রাওনাফ নিজের সরল মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ্য করে। তারপর বলে,”তোমার কি ওনার জন্য খারাপ লাগছে?”

শর্মী পাপার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। তার খারাপ লাগছে।

***
উচ্ছাস বসে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে সি’গারেট। বুঝতে পারছে না কলটা রিসিভ করবে কি না। তার মা ফোন করছে। গত দুইদিনে বেশ কয়েকবার তার মা ফোন দিয়েছিলো। সে রিসিভ করেনি। সে জানে তার সাথে কথা বলার জন্য তার মাকে অনেক কথা শুনতে হবে।
উচ্ছাস অ্যাশট্রে তে অর্ধেক খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে তার মা শেফালির কন্ঠ ভেসে আসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ,”বাবা। বাবারে! তুই আমার ফোন ধরিস না কেনো বাবা। তোর মাকে এইভাবে কষ্ট দিবি বাবা।?”

-ফোন দিচ্ছো কেনো। সজীব বলে নি আমি ভালো আছি। এই বয়সে তা’লাক খাওয়ার শখ হয়েছে?
ক’ড়া কন্ঠে বলে উচ্ছাস। শেফালি জবাব দেয়,”দিক তালাক,এই লোকের সাথে আমি থাকতে চাই না। আমার কলিজার টুকরাকে আমি দেখতে পারি না এই লোকের জন্য। ও বাবা! আমি তোকে একটু দেখতে চাই। তুই একটু………”

শেফালি কথা শেষ করতে পারে না। তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয় শাখাওয়াত চৌধুরি।
সে উচ্ছাসকে বলে,”আমার জীবনে প্রথম ভুল হচ্ছে তোমার মতো একটা কু’লা’ঙ্গার কে জন্ম দেওয়া আর দ্বিতীয় ভুল হচ্ছে সেদিন তোমায় গু’লি না করা।”
উচ্ছাস কোনো কথা বলে না। শাখাওয়াত বলে,”তোমার মায়ের জন্য চিন্তা করতে হবে না। তাকে আমি তা’লাক দেবো না। আমি এতো বোকা না যে ইলে’কশ’নের আগে এইরকম বোকামি করবো।”

উচ্ছাস চুপ করেই থাকে। শাখাওয়াত বলতে থাকে,”আর একটা কথা মাথায় রাখবে। উর্বী মেয়েটার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, সেটা নিশ্চই জেনে গিয়েছো। আমি যদি শুনি তুমি ওর ব্যাপারে আর নাক গলিয়েছো তাহলে ভালো হবে না। তোমার জন্য যদি আমার পলি’টিক্যা’ল লাইফে আর কোনো প্রভাব পরে তবে আমি তোমায় ছা’ড়বো না।”
শাখাওয়াত ফোনটা নিজের স্ত্রীর হাতে দিয়ে চলে যায়। শেফালী ফোন কানে ধরে ফোপাতে থাকে, উচ্ছাস বলে ওঠে,”তোমার স্বামীর কথামতো চলো মা। হুটহাট ফোন দিও না।”
কথাটা বলে উচ্ছাস ফোনটা রেখে দেয়। তারপর ঠোট বাকা করে হাসে। তার দৃষ্টি ফোনের স্ক্রি’নে উর্বীর ছবিতে নিবদ্ধ। উর্বী বই হাতে নিয়ে দাড়িয়ে হাসছে। আকাশী রঙের সালোয়ার কামিজ পরনে তার।এই ছবিটা উচ্ছাস তুলে দিয়েছিলো।

***
ঘরের দরজা বন্ধ করে রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে বিছানায় উর্বীকে একপলক দেখে। জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু খুবই অসুস্থ শরীরটা।

আলমারি থেকে একটা টিশার্ট বের করে রাওনাফ ওয়াশ রুমে ঢুকে টি-শার্ট টা পালটে নেয়। তারপর এসে বিছানার কাছে দাড়ায়।

ঘড়িতে সময় রাত দেড়টা। উর্বী দু’চোখ বন্ধ করে রেখেছে। রাওনাফ উর্বীকে ভালো করে লক্ষ্য করে। একে শুধু শুধু রো’গা মনে হয় না, এই মেয়েটা নিশ্চিত কোনো ভয়াবহ শারীরিক জটিলতায় ভু’গছে। কিছু টে’স্ট করাতে হবে।

উর্বীর মুখের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে রাওনাফ তাকিয়ে আছে। খুবই চমৎকার একটি মুখশ্রী। শিক্ষিতা একজন মহিলা। কিন্তু কেনো যেনো রাওনাফের কাছে স্বাভাবিক মনে হয় না! এই স্তরের আর পাঁচজন মেয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মেয়েটি। কখনো যথেষ্ট ম্যাচিওর লাগে তো কখনও একেবারে বাচ্চা। আচরণ কিছুটা এলোমেলো।

সম্ভবত শীত লাগছে উর্বীর। পায়ের কাছ থেকে কমফোর্টার গায়ে টেনে দিয়ে আবারও উর্বীর দিকে তাকায়।
বিড়বিড় করে নিজের মনে রাওনাফ বলে ওঠে,”সম্পর্কে বোঝাপড়ার কথা তো জানি না মৃদুলা উর্বী! তবে আমার মনে হচ্ছে এখন থেকে আমাকে তিন টা নয়, চার টা বাচ্চার দেখভাল করতে হবে!”

মশা মারার মেশিন অন করে দিয়ে বিছানায় এসে বসে। উর্বীকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।

বিছানায় উঠে বেড সাইডের টেবিল থেকে শিমালার ছবিটা হাতে তুলে নেয় রাওনাফ। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে ওঠে,”তোমার আমার এই অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে! রাগ হচ্ছে! দুঃখ হচ্ছে! হিংসা হচ্ছে! কোনটা হচ্ছে জানি না!
তবে আমার কিন্তু নিজের ওপর অনেক মায়া হচ্ছে শিমালা। সাথে এই মেয়েটির ওপরেও!”

চলমান…..

আরেকটি বার পর্ব-০৭

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৭
#Esrat_Ety

রাওনাফ উর্বীর প্রেশার চেক করে উর্বীর দিকে তাকায়। বয়সের তুলনায় ছোটো দেখতে লাগার পাশাপাশি মেয়েটাকে দেখলে খুবই নাজুক প্রকৃতির মনে হয়। যেন অসুস্থতা রয়েছে।

উর্বী নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। রাওনাফ উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে উর্বীকে দেয়। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে পানি খায়। রাওনাফ খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে,”প্যানিক অ্যাটাক। এরকম সবসময় হয়? ধরো মাসে দু তিনবার।”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে ঘুমিয়ে পরো। মানে চেষ্টা করো।”

কথাটি বলে রাওনাফ পর্দা টেনে দিতে যাবে তখনই উর্বী বলে ওঠে,”ওটার প্রয়োজন নেই।”

রাওনাফ মাথা ঘুরিয়ে তাকায় উর্বীর দিকে। উর্বী বলতে থাকে,”এখন হঠাৎ কেনো যেনো হাস্যকর লাগে।‌ এমনিতেই অদৃশ্যমান পর্দা রয়েছে। ওটাতে তেমন কোন পার্থক্য হয়না।”

রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পর্দা সরিয়ে আলমারিতে তুলে রাখে। উর্বী চুপচাপ বসে থাকে । রাওনাফ এসে নিজের পাশটায় শুয়ে পরে।
অনেকটা সময় নিয়ে উর্বী ধাতস্থ হয়। রাওনাফ চুপচাপ শুয়ে আছে।

উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে রাওনাফকে দেখে বলে ওঠে,”আপনি মায়ের অনেক বাধ্য ছেলে!”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে,”হ্যা। সেই তকমা দিতে পারো।”

উর্বী কিছু বলে না। রাওনাফ হুট করে বলে ওঠে,”তুমিও ভাইয়ের অনেক বাধ্য বোন।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে প্রসঙ্গ পালটে বলে ওঠে,”আপনার সাবেক স্ত্রীর সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি যদি কিছু মনে না করেন তো। মানে ওনার সাথে আপনার বিয়েটাও কি পারিবারিক ভাবে হয়েছে? হুট করে!”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী প্রশ্নটি করে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছিলো। রাওনাফ স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”লাভ ম্যারেজ ছিলো। হুট করে কিছুই ছিলো না। ওর বাবা আমার মায়ের দূরসম্পর্কের ভাই ছিলো, ওরা বড়লোক ছিলো। শহরে থাকতো, পড়াশোনার জন্য আমি ওদের বাড়িতে থাকতাম,ওর ছোটো ভাই-বোনদের পড়া দেখিয়ে দিতাম। সেখান থেকে মন দেওয়া নেওয়া হয়। পরে ওর পরিবার সবটা জেনে গেলে আমাকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলে। আমি মেস ভারা করে থাকতে শুরু করি। হঠাৎ বাড়ি ছেড়ে একদিন আমার মেসে চলে এসে বলে,”আমাকে বিয়ে করো।”
তখন আমি মেডিকেল স্টুডেন্ট। তৃতীয় বর্ষ।”

উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। এই লোকের জীবনেও প্রেম ছিলো!

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”আরো কিছু জানতে চাও?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ বলে,”জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করো। তোমার তো অধিকার আছে!”

উর্বী রাওনাফের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে ওঠে,”আপনারও তো অধিকার আছে। আপনি জানতে চাইবেন না?”

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,”তোমার তো প্রাক্তন হাজবেন্ড নেই। থাকলে ভদ্রলোকের সম্পর্কে টুকটাক জানতে চাইতাম। বাকি রইলো তোমার পাস্ট লাইফ। সেটা আদৌও আমাদের বোঝাপড়ায় দরকার হবে কিনা আমি জানি না। বোঝাপড়া বর্তমান নিয়ে হয়। অতীত নিয়ে নয়। আর যদি বলো ওসব জানাটা আমার অধিকারের মধ্যে পরে তাহলে বলবো কাউকে অস্বস্তি দিয়ে আমি অধিকার খাটানো অপছন্দ করি। এমন অধিকার না খাটালেই আমার স্বস্তি।”

কাছের মসজিদে ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। রাওনাফ উঠে ফ্রেশ হয়ে টুপি হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়। উর্বী ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিছু সময় পরেই সে ঘুমিয়ে পরে।

রাওনাফ মসজিদ থেকে ফিরে এসে দেখে উর্বী গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে । বাইরে আলো ফুটে গিয়েছে। অক্টোবর শেষ হতে না হতেই একটা হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে ভোরের দিকে, কেমন শীত শীত ভাব।
রাওনাফ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এসি অফ করে উর্বীর পায়ের কাছে রাখা চাদরটা তার গায়ে টেনে দিয়ে চলে যায়।

***
ঘুম ভাঙার পর উর্বী ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তখন ক’টা বাজে। দেখে মনে হচ্ছে বেলা গড়িয়ে গিয়েছে বেশ। কেউ তাকে ডাকতে আসেনি। রাওনাফ নেই। দরজা চাপিয়ে রাখা।

উর্বী ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার ওপর একটা ওষুধের পাতা দেখতে পায়। সাথে একটা টুকরো কাগজ। হাত বাড়িয়ে কাগজটা তুলে নিয়ে দেখে তাতে লেখা,”খাওয়ার পরে একটা খেয়ে নিও।”

ডাক্তার তার ডাক্তারি করে গিয়েছে। উর্বী ওষুধের পাতার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে। দুঃখের কোনো ওষুধ আছে? আছে কোনো ডাক্তার? যারা রোগীর দুঃখ শুনে বলবে,”এই নাও! এই ট্যাবলেট টা দিনে তিনবার খাওয়ার পরে খাবে। তাহলে তোমার দুঃখ তুমি ভুলে যাবে। কখনও মনেই পরবে না,পরবেই না!”

***
শর্মীকে আজ খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। স্কুল থেকে ফিরে সে সেই যে ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি। তার গায়ে জ্ব’র এসেছে। সে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
শায়মী আর নাবিল বাড়িতে নেই, কোচিং এ গিয়েছে। শর্মী তার ফোন থেকে তার পাপাকে কল করে,ওপাশ থেকে রাওনাফ ফোন রিসিভ করে বলে,”হ্যা মামনি। কিছু বলবে?”
-পাপা আমার মনে হচ্ছে আমার গায়ে জ্ব’র এসেছে।
-সে কি! আচ্ছা আমি মোহনাকে বলছি তোমাকে মেডিসিন দিয়ে দিতে।
-চাচী আমাকে মেডিসিন দিয়ে দিয়েছে পাপা।

-গুড। তুমি রেস্ট নাও। আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো।

-পাপা!

-হ্যা মামনী বলো।

-এবারও যদি আমি অংকে ফেইল করি তুমি কি আমার উপরে রাগ করবে।

রাওনাফ বুঝে যায়, শর্মীর রেজাল্ট ভালো হয়নি আর সেটার স্ট্রে’স থেকেই জ্ব’র বাধিয়েছে।
সে বলে,”এইসব রেজাল্ট আমার কাছে একদমই মূল্যহীন মামনি, তুমি সুস্থ থাকো আমি এটাই চাই।”
শর্মী চুপ করে থাকে। তার ভিষন কান্না পাচ্ছে। সে তার পাপাকে বারবার হতাশ করে।
রাওনাফ বলে,”আচ্ছা মামনী তুমি রাখো,আমি একটু তোমার চাচ্চুকে দেখতে যাবো, আমি শিঘ্রই ফিরবো। আজ তোমার চাচ্চুকে নিয়ে ফিরবো, তুমি রেস্ট নাও।”
রাওনাফ ফোন কেটে দেয়। শর্মী দেয়ালের দিকে তাকায়। দেয়ালে তার মায়ের একটা ছবি টাঙানো। তার মায়ের কথা তার অল্প অল্প মনে আছে। তার যখন পাঁচ বছর তখন তার মা একটা এ’ক্সি’ডেন্টে মা’রা যায়।

শর্মীর জ্বর বাড়তে থাকে। সে দেয়ালের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে,”মাম্মা।”
তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়।

****
“এবার আস্তে আস্তে বলুন তো সেদিন আপনার সাথে কি হয়েছিলো।”
পুলিশ অফিসার সামিউলের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সামিউল রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ চোখ দিয়ে ইশারা করে সব বলতে।
অন্তরা পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
সামিউল ধীরেধীরে মুখ খোলে,”সেদিন আমি ওই বস্তিতে আমার একটা প্র’জে’ক্টের কাজে গিয়েছিলাম। আমার সাথে আমার কিছু টিম মেম্বার ছিলো। তারা একটু ওয়াশরুমে যাবে বলে বস্তির ভিতরে ঢুকেছিলো। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নির্জন ছিলো জায়গাটা।হঠাত একটা লোক আসে আমার কাছে। মুখে মা’স্ক পরা। আমাকে এসে বলে আমি অনেক বড় ভুল করেছি,আমার সেটা করা উচিৎ হয়নি। তার নাকি আমাকে মে’রে অনেক খারাপ লাগবে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাত কোত্থেকে সেখানে আরো দুজন লোক আসলো,তারাও মুখে মা’স্ক পরে ছিলো। তারা এসেই আমাকে ধরে ফেলে। আর আগের লোকটি পকেট থেকে একটা ছু’ড়ি বের করে প্রথমে আমার পেটের ডাক দিকে একটা……
অন্তরা সামিউলকে থামিয়ে দেয়,বলে,”প্লিজ আর বলতে হবে না।”
সামিউল বলে,”তারপর আমার কিছু মনে নেই অফিসার।”

-তারমানে লোকগুলোর চেহারা আপনি দেখেননি?

-না অফিসার।

-আপনার কাউকে সন্দেহ হচ্ছে? আপনার কোনো শ’ত্রু?

-না অফিসার। এমন কোনো শত্রু আমার নেই।

পুলিশের অফিসারের কপাল কুঁচকে যায়। কোনো তথ্য পাওয়া গেলো না যেটা তাকে আসামী ধরতে সাহায্য করবে।

সে বলে,”যাই হোক,কি আর করা। বস্তির কয়েকজনের থেকে জানতে পারি আ’সা’মীরা তিনজন তাদের দেখে একটা মোটরসাইকেলে উঠে পালিয়ে যায়। তারা মোটরসাইকেলের নাম্বার প্লেট থেকে নাম্বারটা লিখে রেখেছিলো। খোজ নিয়ে জানা গেলো সেটা ভু’য়া নাম্বার প্লেট ছিলো। আজকাল যা শুরু হয়েছে দেশে।

যাইহোক,সাবধানে থাকবেন। কাউকে সন্দেহ হলে জানাবেন। আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।”

পু’লি’শ অফিসার চলে যায়। রাওনাফ অন্তরাকে বলে,”সবকিছু গুছিয়ে নাও। এখন বাড়ি যাবো।”

***
সামিউলকে দেখেই রওশান আরা ডুকরে কেঁদে ওঠে। সে পরম মমতায় তার ছেলেকে বু’কে টেনে নিতে চায়। রাওনাফ বাধা দেয়,”মা শান্ত হও। ওর ক্ষত পুরোপুরিভাবে সারে নি। ইন*ফেকশন হয়ে যেতে পারে।”
রওশান আরা দাঁড়িয়ে যায়। সামিউল বলে,”আমি ঠিক আছি মা,তুমি চিন্তা কোরো না। সেরে উঠবো আমি।”
রওশান আরা অন্তরার দিকে শীতল চোখে তাকায়। তারপর সামিউলকে বলে,”না তুই ঠিক থাকতে পারবি না। এই মেয়েটা যতদিন তোর জীবনে আছে তুই ঠিক থাকতে পারবি না। আমি নিশ্চিত ওর জন্যই আজকে তোর এই অবস্থা হয়েছে!”

রাওনাফ বলে,”মা কি বলছো তুমি। এতে অন্তরার দোষ কোথায়?”

-কে বলতে পারে ওর কোনো পুরনো প্রেমিক কিংবা স্বামী সামিউলকে মা’রতে চেয়েছে কি না। নয়তো আমার সাদাসিধে ছেলেটার তো কখনো শ’ত্রু ছিলো না।

অন্তরা রওশান আরার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ বেয়ে পানি পরছে। উর্বী দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে। তার এই মেয়েটার জন্য ভিষন খারাপ লাগছে।

রাওনাফ মাকে জোর করে রুম থেকে বের করে নিয়ে যায়। রওশান আরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পরেছে। উর্বী তাদের পিছু পিছু বেরিয়ে যায়।

***
মোহনার কোলে মাথা দিয়ে শর্মী শুয়ে আছে। তার জ্ব’র কিছুটা কমেছে। রাওনাফ রুমে ঢোকে। মোহনা বলে,”আপনার কথা মতো মাথায় পানি ঢেলেছি ভাইয়া,তাই একটু কমেছে জ্বর।”
রাওনাফ বিছানায় বসে। তার মেয়ের মাথায় হাত রাখে। শায়মী স্টাডি টেবিলে বসে পড়ছিলো।
রাওনাফ মোহনার দিকে তাকিয়ে বলে,”দোষ আমার মোহনা, বাচ্চা গুলোকে আমি একদম সময় দিতে পারি না। আমি ভুলেই যাই ওদের মা নেই।”
শায়মী পড়া রেখে তার পাপার দিকে তাকায়। মোহনা বলে,”এমন কথা বলছেন কেনো ভাইয়া, ওরা আমার ছেলেমেয়ের থেকে কি কম! সবসময় চেষ্টা করি ওদের মায়ের অভাবটা বুঝতে না দিতে।আমি ভাবি ওরা তিনজন আমারই ছেলেমেয়ে।”

-আমি জানি মোহনা। তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

শর্মী তার পাপাকে ডাকে,”পাপা!”
-হ্যা মামনি বলো!
-নেক্সট টাইম আমি অনেক ভালো করবো প্রমিজ। অনেক বেশি মার্কস এনে দেবো।
রাওনাফ তার ছোট্ট মেয়েটাকে নিজের কোলের কাছে টেনে নেয়।তার মায়াভরা মুখটার দিকে তাকালে রাওনাফের বুকটা হুহু করে ওঠে।

উর্বী পর্দার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে থাকে তাদের। জীবনের মানে গিয়ে তার কাছে দাড়িয়েছে শুধুই অনুশোচনা। সময়,পরিস্থিতির চাপে একটা কাজ করে ফেলে অনুশোচনা করার নামই জীবন। এই অনুশোচনা অনুশোচনা খেলা সেদিন ফুরায় যেদিন জীবন ফুরিয়ে যায়।

***
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দীর্ঘ আটবছর পরে আবারও কিছু মেয়েলী প্রসাধনী এসে স্থান নিয়েছে। রাওনাফ গায়ে ব্লেজার চাপিয়ে নিতে নিতে সেদিকে একপলক তাকিয়ে আয়নায় উর্বীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। উর্বী একটা বই হাতে চুপচাপ বসে আছে। কয়েকপলক উর্বীকে দেখে রাওনাফ বলে ওঠে,”তুমি কি আগামীকাল যেতে পারবে? না মানে, চোখে এ’লা’র্জি আছে বললে। আমাদের হসপিটালে ডক্টর ফিলিপ হফম্যান বলে একজন আই স্পেশালিস্ট আসেন সিঙ্গাপুর থেকে দুমাস পর পর। তুমি চাইলে তাকে দেখাতে পারতে।”

উর্বী কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। এলার্জি যে তার গোটা জীবনে, চোখে নয়। সে কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,”বেশি অসুবিধা হলে আপনাকে জানাবো। আপাতত থাক।”

তারপর রাওনাফের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,”একটু ব্যাংকে যেতে চাচ্ছিলাম আমি।”

রাওনাফ ঘুরে তাকায়। তারপর বলে,”একা যেতে পারবে? আমি যাবো?”

উর্বী মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বলে ওঠে,”ভালো হতো।”

_ঠিকাছে তুমি রেডি হও। আমি অপেক্ষা করছি।

উর্বী আলমারি থেকে শাড়ি বের করে ওয়াশ রুমে ঢোকে। রাওনাফ টেবিলের ওপর থেকে গাড়ির চাবিটা তুলে নিতে গিয়ে ছোটো ফটোফ্রেমটাতে চোখ যায় তার। হাত বাড়িয়ে ফ্রেমটা তুলে নিয়ে শিমালার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে।

উর্বী ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। একবার রাওনাফের দিকে, একবার তার হাতের দিকে তাকায়। কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,”চাইলে এরিয়ে যেতেই পারতেন। মায়ের এতোটাও বাধ্য ছেলে হবার প্রয়োজন ছিলো না। নিজের বাধ্যতা দেখাতে গিয়ে এখন রিগ্রেট ফিল করছেন।”

রাওনাফ ছবিটা রেখে উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর বলে ওঠে,”রিগ্রেট কেনো?”

_এই যে, ভালোবাসার মানুষটি যে ছবিতে বন্দী হয়ে আছে। তার দিকে অপরাধীর মতো তাকিয়ে আছেন। আট বছর নিজের বিশ্বস্ততা দেখিয়ে শেষরক্ষা আর করতে পারলেন না।

রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”তা ঠিক বলেছো। শেষ রক্ষা হলো না। তবে বাকি কথা গুলো ভুল, অনুশোচনা হতো যদি কোনো অন্যায় করতাম। আমি কোনো অন্যায় করিনি। না শিমালাকে ঠকিয়েছি,না ওর যায়গা কাউকে দিয়েছি। পৃথিবীতে কারো স্থান কেউ নিতে পারেনা উর্বী। একটা মনে একাধিক মানুষ যার যার নির্দিষ্ট স্থান নিয়ে থাকে,একে অন্যের স্থান নিয়ে নয়। না দেওয়া যায়। তাই অনুশোচনা হচ্ছে না।”

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলে,”তবে হ্যা। একটা বিষয়ে খুব রিগ্রেট হয়। তুমি কখনোই তিনটা বাচ্চা ওয়ালা সঙ্গি ডিজার্ভ করোনা। মা অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছিলো মেয়ের পূর্ণ সম্মতি রয়েছে। বয়স ত্রিশ শুনে ভাবলাম আর যাই হোক, সে নিজের ভালোমন্দ বুঝেই হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মনে হয় তুমি এসব কিছু ডিজার্ভ করো না। আরো ভালো কিছু ডিজার্ভ করো। আ বেটার লাইফ!”

উর্বী ম্লান হাসে। রাওনাফ বলতে থাকে,” আর কি যেনো বললে? এরিয়ে যেতে পারতাম। বাধ্য ছেলে হবার প্রয়োজন ছিলো না। অবশ্যই , আমারও এটা এখন মনে হচ্ছে, কিন্তু তখন পরিস্থিতির উল্টো চলার মতো মনের জোর পাইনি। একটা মানুষ সবসময় একই রকমের মানসিক ক্ষমতা নিয়ে বসে থাকে না, কখনো কখনো এলোমেলো হয়ে যায় তার ছকে বাঁধা আচরণ। মানব চরিত্রের খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। জীবনের সব পরিস্থিতিতে ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত শুধু মাত্র তারাই নিতে পারে যারা আশীর্বাদ প্রাপ্ত। দূর্ভাগ্যবশত রাওনাফ করিম খান আশীর্বাদ প্রাপ্ত নয়। ভুল ভাল কাজ সেও করে বসে।”

উর্বী রাওনাফের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ গাড়ির চাবি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।

***
গাড়ি গুলো সব বাম দিকে টার্ন নিচ্ছে! রাওনাফ এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে ওঠে,”ভুল করে ফেললাম। সিটি ব্যাংকের পেছনের রাস্তা দিয়ে আসা উচিত ছিলো। সামনে সম্ভবত রাস্তা ব্লক এখন ইউটার্ন নেওয়া সম্ভব না। গাড়িটাকে বামে কোথাও পার্ক করে রাখি। তুমি নামো। অপজিটে গিয়ে দাঁড়াও।

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ গাড়িটা বাম পাশের রাস্তা সংলগ্ন একটি পার্কের পার্কিং লটে রাখে।
উর্বী না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই রাওনাফ এসে উর্বীর হাত টেনে নেয়। হুশ করে একটা একটা বাইক চলে যায়।

মূহুর্ত কেটে যায়। উর্বী পুরো ব্যাপারটা যতক্ষনে বুঝতে পারে দেখতে পায় ততক্ষণে রাওনাফকে শক্ত করে ধরে রেখেছে নিজের হাত দিয়ে। আঁকড়ে ধরা যাকে বলে। রাওনাফ বিব্রত ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে। উর্বী বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। বাইকের চালক বাইক থামিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,”কানা নাকি!!”

রাওনাফ হাত উঠিয়ে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে,”সরি!”

উর্বী তখনও হাপাচ্ছে। রাওনাফকে ছেড়ে একপাশে দাঁড়িয়ে। রাওনাফ ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”আমি বুঝতেই পারিনি একজন ত্রিশ বছরের ভদ্রমহিলা ফাঁকা রাস্তা পার হতে জানে না।”

উর্বী কিছু বলেনা। হাঁপাতে থাকে। রাওনাফ বলে,”কাম ডাউন। কিছুই হয়নি।”

_আমি ভয় পাই। আমি ম’রতে ভিষন ভয় পাই।
হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উর্বী।

_সবাই পায়। আমিও পাই।

উর্বী চোখ তুলে রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ বলে,”চলো। তোমাকে রাস্তা পার হওয়া শিখিয়ে দিচ্ছি। এটা তোমাদের মফস্বল নয়। এখানের লাইফস্টাইল অন্যরকম। মেয়েরা শাড়ি বোরখা পরে কিভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাসে ওঠে, জার্নি করে, রাস্তা পার হয় দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। রাস্তা পার হওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং একটা ব্যাপার। রাজধানীর রাস্তা আর মফস্বলের রাস্তা এক নয়। এসো শিখিয়ে দিচ্ছি। ”

কথাগুলো উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলতে বলতে রাওনাফ সামনে পা বাড়াতেই উর্বী রাওনাফের হাত টেনে ধরে। হুশ করে একটা লেগুনা গাড়ি চলে যায়। রাওনাফ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।

উর্বী ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে,”আগে নিজে রাস্তা পার হতে শিখেন।”

রাওনাফ লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। উর্বী মাথা নিচু করে ডানদিক,বামদিকে দেখে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। রাওনাফ তাকে অনুসরণ করে।
এভাবে নিজেকে পণ্ডিত জাহির করতে গিয়ে লজ্জা পাবে সে বুঝে উঠতে পারেনি।

***
বেলকোনিতে চেয়ার পেতে চুপচাপ বসে আছে উচ্ছাস। তার হাতে তার গিটার। ধূসর রঙের টি শার্টের উপরে একটা ব্ল্যাক শার্ট পরে আছে,হাতা ফোল্ড করে রাখা।
সজীব এসে দরজার কাছাকাছি দাঁড়ায়। উচ্ছাস তার দিকে না তাকিয়ে বলে ওঠে,”উর্বীর কোনো খবর থাকলে বলবি।”

_স্বামীর সাথে বেরিয়েছে।

_কি করছিলো? হাসছিলো? খুব আহ্লাদ করছিলো বেয়াদব টা?

_অতটা দেখিনি। এ ঝলক দেখতে পেয়েছি। গাড়িতে শুধু ও আর ওর স্বামীই ছিলো।

উচ্ছাস চুপ হয়ে যায়। সজীবকে ঠান্ডা গলায় বলে,”যা।”

সজীব চলে যায়। উচ্ছাস বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”লোভী মেয়ে মানুষ যত্তসব!”

চলমান…..

আরেকটি বার পর্ব-০৬

0

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৬
#Esrat_Ety

সামিউলের কদিন থেকে মনে হচ্ছে কেউ একজন তাকে ফলো করছে। প্রথম প্রথম সে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এখন সে বেশ বুঝতে পারে কেউ একজন তার পিছু নেয়।
সামিউল একটা প্র’জে’ক্ট হাতে নিয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ। আজ দুদিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন বস্তির আশেপাশে তার যাওয়া আসা। অন্তরাকে দিনে খুব একটা সময় দিতে পারে না।
সামিউল তার বাইকের সাথে ঝুলিয়ে রাখা টিফিন ব’ক্স’টার দিকে তাকায়। অন্তরা খুব ভোরে উঠে তার জন্য রান্না করে দেয়। সামিউল হাত দিয়ে টিফিন ব’ক্স’টা আলতো করে ছোঁ’য়। তার মুখে হাঁসি।

অন্তরার ফোন আসে। সামিউল ফোন রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে অন্তরা বলে,”আজ কোথায়?”

-এই আছি বাড্ডার কাছে একটা বস্তিতে।

-ওমা,এতদূর চলে গেলে!! খেয়েছো?

-এইতো এখনই খাবো। তুমি খেয়েছো?

-না,আমিও খাবো। আচ্ছা আমি আমার স্টোরিতে একটা ফটো দিয়েছি তুমি কোনো কমেন্ট করলে না যে!

-ভুল হয়ে গেছে আমার, মাফ করে দেন।

সামিউল অত্যন্ত নাটকীয় ভাবে বলে কথাটা।

অন্তরা খিলখিল করে হাসে। সামিউলের কাছে সে হাসি বড় মধুর লাগে শুনতে।
সামিউল বলে,”আজ হাতে কিছু টাকা পেয়েছি, শিহাব ভাই এ’ড’ভা’ন্স দিয়ে দিয়েছে। তোমার কি লাগবে অন্তরা?”

-আমি চাই আমার স্বামী যেনো সন্ধ্যে সন্ধ্যে বাড়ি ফিরে আসে। আমার একা একা মশার কা’ম’ড় খেতে ভালো লাগে না।

সামিউল হাসে। বলে,”যথা আজ্ঞা মহারাণী। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি।”

***
শর্মীর মন আজ খুব খারাপ। সে একা একা বেলকোনিতে বসে আছে। তার হাতে একটা বই। একটু আগে তার পাপা তাকে রুমে ডেকেছিলো। তখন ওই মহিলাও পাপার রুমে ছিলো। পাপার বুকশেলফ থেকে বই নামিয়ে পড়ছিলো। কত বড় সাহস। পাপা তাকে রুমে ডেকেছিলো তার পরিক্ষার কথা জানতে। তার মি’ড টা’র্ম এ’ক্সাম চলছে। আজ ছিলো ম্যা’থ। শর্মি পাপাকে খুব ভ’য় পায়।তার পাপা লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই স্ট্রি’ক্ট। শর্মি ম্যা’থে বরাবরই কাঁচা। রাওনাফ শর্মির কো’য়েশ্চন পেপার থেকে শর্মিকে কিছু দুই মার্কের প্রশ্ন সলভ করতে বলে। শর্মী বলতে পারে না। রাওনাফ বুঝে যায় শর্মী কেমন পরিক্ষা দিয়েছে।

রাওনাফ বলে ওঠে,”এগুলো তো অত্যন্ত সহজ ছিলো। আমি গত পরশু রাতেও তোমাকে সলভ করা শিখিয়েছি! শেখাইনি?”

শর্মি মাথা না’ড়ে।

-তাহলে পারলে না কেনো?

-পাপা আমি সব গুলিয়ে…….

-আর কোনো এক্সকিউজ না।

রাওনাফ ধ’মকে ওঠে। উর্বী বই বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে।

রাওনাফ বলে,”লেখাপড়ায় বড্ড ফাঁকিবাজ হয়েছো। তখন মাথা নেড়ে কেনো বলেছিলে তুমি সব বুঝেছো? আমি যাতে তাড়াতাড়ি তোমাকে ছেড়ে দিই এজন্য? I didn’t expect this from you. আমি ম্যা’থের টিচারকে ফোন করে দিচ্ছি আজ থেকে সে তোমাকে একবেলা নয়,দু বেলা পড়িয়ে যাবে। আশা করি ফাইনালে তুমি আমায় হতাশ করবে না। আর শোনো, কখনও ফাঁকি দেবে না, না বুঝলে বলবে, একশো বার বুঝিয়ে দেবো।”

শর্মী চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এই অংক সাবজেক্ট টা থেকে সে পালিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু সেটা সম্ভব না।
শর্মীর তার বাবার ধ’ম’কে একটুও খারাপ লাগছে না কিন্তু ওই মহিলা তাকে ধ’ম’ক খেতে দেখেছে বলে তার খুব রা’গ হচ্ছে। তার রাগে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে।

***
রওশান আরা চেয়ারে বসে ঝি’মুচ্ছে। আজকাল তার শরীর খুব একটা ঠিক যাচ্ছে না। আমিরুন তার পায়ের ন’খ কে’টে দিচ্ছে। উর্বী এসে তার পাশে বসে।
রওশান আরা উর্বীর দিকে তাকায়। কি সুন্দর একটা মুখশ্রী! রওশান আরার মন ভরে যায় দেখলেই। সে উর্বীকে বলে,”রাওনাফ একটু ফ্রি হলে তোমাকে আর রাওনাফকে ও বাড়িতে পাঠাবো।”

উর্বী মাথা নাড়ায়।
রওশান আরা তার দিকে তাকিয়ে বলে,
-রাওনাফ ফিরেছে?

-জি।

রাওনাফ ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। তাকে একটা রোগীর রি’পো’র্ট লন্ডনে তার বন্ধুর কাছে পাঠাতে হবে। তার অনেক কাজ। শর্মীর টিচার আসলে তার সাথে কথা বলতে হবে। সন্ধ্যায় হসপিটালে যেতে হবে। আজ তার নাইট ডিউটি।

রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। আগে একটু কফি খেয়ে নিতে হবে। সে আমিরুনকে ডাকতে ডাকতে তাদের কাছে চলে আসে। তারপর আমিরুনের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওহ তুই ব্যস্ত। আচ্ছা ঠিকাছে।তারপর আমায় একটু কফি খাওয়াতে পারবি? আমিই বানাতাম কিন্তু আমার একটু কাজ আছে।”
আমিরুন বলে,”জে আইচ্ছা ভাইজান। আমি আনতাছি।”

রাওনাফ চলে যায়। আমিরুন নখ কা’টা শেষ করে উঠতে যাবে তখন রওশান আরা বলেন,”আমিরুন! তুই গিয়ে ছাদ থেকে কাপড়গুলো আন। বৌমা রাওনাফের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে যাবে।”

উর্বী তার শাশুড়ির দিকে তাকায়। রওশান আরা চোখ বন্ধ করে গুনগুন করে গজল গাইতে শুরু করে।
আমিরুন উর্বীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে ছাদে চলে যায়।

***
রওশান মঞ্জিলে একটা দূ’র্ঘটনা ঘটে গেছে। কেউ বা কারা সামিউলকে ছু’ড়ি দিয়ে জ’খ’ম করেছে।

ফোনটা প্রথমে রাওনাফের কাছে আসে। সামিউলের একজন টিম মেম্বার ফোন দিয়ে রাওনাফকে জানায়। সামিউলকে রাওনাফের হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। অবস্থা গু’রু’ত’র। রাওনাফ বুঝতে পারছে না বাড়ির লোকদের কিভাবে খবর টা দেবে। অন্তরাকে জানানো দরকার। শাফিউল আর মোহনা এখনো বাড়িতে ফেরে নি। রাওনাফ বুঝতে পারছে না কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবে। সে আমিরুন কে ডাকে। আমিরুন দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়,”ভাইজান কিছু কইবেন।”

-আমিরুন আমি যা বলবো মন দিয়ে শুনবি। সামিউলের একটা এ’ক্সি’ডেন্ট হয়েছে। অবস্থা গু’রু’তর। ওকে আমাদের হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। মাকে কিছু বলবি না। অন্তরাকে জানা। ওকে শান্ত রাখার চেষ্টা করবি। মনে থাকবে?

আমিরুন হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে রাওনাফের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। রাওনাফ বলে,”যা বললাম তা যেনো মাথায় থাকে। মা যদি জেনেও যায় তাকে সামলানোর দায়িত্ব তোর।”
রাওনাফ বেরিয়ে যায়। আমিরুনের হাত পা কাপছে। সে দৌড়ে অন্তরার রুমের দিকে যায়। উর্বী তাকে দেখে তার পিছু নেয়। আমিরুন উর্বীকে সবটা খুলে বলে।

অন্তরা অতি উৎসাহের সাথে সামিউলের জন্য ফুলকপির ব’ড়া বানাচ্ছিলো। দরজায় টোকার আওয়াজ পেয়ে অন্তরা গিয়ে দরজা খোলে। দরজার বাইরে আমিরুন আর উর্বী দাঁড়িয়ে। অন্তরা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিরুন কাঁ’দছে। অন্তরা কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাত আমিরুন বলে,”ছুডো ভাইজানরে কারা যেনো ছু’ড়ি মা’রছে গো গানের আপা”।

অন্তরা তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলছে এরা!কিছুক্ষন আগেই তো কথা হলো। অন্তরার মনে হচ্ছে সে এখনি নিচে পরে যাবে। উর্বী এসে অন্তরার হাত ধরে। অন্তরা শুধু বলতে পারে,”আমাকে ওর কাছে নিয়ে যান।”
তারপরই অন্তরা অজ্ঞান হয়ে যায়।

সামিউল আইসিইউ তে। আশরাফ পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার সাথে আরো দুজন ডাক্তার।
অন্তরা আইসিইউ রুমের দরজার কাচ দিয়ে সামিউলকে দেখছে।জ্ঞান ফেরার পরে সে পাগলের মতো করছিলো। শাফিউল তাই তাকে নিয়ে আসে হসপিটাল। হসপিটালে বাড়ির প্রায় সবাই এসেছে, শাফিউল, মোহনা, শায়মী, নাবিল, আমিরুন। বাড়িতে আছে শুধু উর্বী, রওশান আরা আর শর্মী।

রওশান আরা অ’স্থি’র হয়ে আছেন। সে সন্ধ্যা থেকে ছটফট করছেন। সবাই বলছে ছোটো খাটো একটা এ’ক্সি’ডেন্ট, হাত পায়ের ছা’ল উঠে গিয়েছে শুধু। কিন্তু তিনি বেশ বুঝতে পারছেন সবাই তার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে।
সে উর্বীকে বারবার জিজ্ঞেস করছে,”সত্যি করে বলো আমার ছেলেটার কি হয়েছে। একদম মিথ্যে বলবে না।”
উর্বী বারবার একই উত্তর দেয়,”আপনি উত্তেজিত হবেন না মা। তার সামান্য চো’ট লেগেছে।”

রওশান আরা শান্ত হতে পারে না। নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ আদায় করে রওশান আরা হসপিটালে যাবে বলে তৈরি হয়। সে নিজের চোখে তার ছেলেকে দেখবে। উর্বী তাকে বারবার আটকানোর চেষ্টা করে। সে কোনো কথা শোনে না। শর্মী এসে রওশান আরাকে বলে,”আমিও যাবো দাদু। আমিও চাচ্চুকে দেখবো।”
তার চোখে পানি।

রওশান আরা বলে,”আয় তাহলে।”
বাধ্য হয়ে উর্বী তাদেরকে নিয়ে হসপিটাল যাবে বলে ঠিক করে।

উর্বী শর্মীকে বললো,”আমি তো তোমাদের হসপিটাল চিনি না। আব্দুল ভাইও তো নেই।”

শর্মী কপাল কুঁচকে রিমিকে বলে,”আমাদের হসপিটালের নাম বললে যে কোনো ড্রা’ইভার চিনবে। আপনি শুধু দাদুর হাত ধরে রাখুন।”

বাড়িতে কোনো গাড়ি নেই। বাড়ি থেকে বের হয়ে তারা তিনজন মেইন’রোডে এসে নামে।
সেখানে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে।

***
রাওনাফ আইসিইউ রুম থেকে বের হয়। সবাইকে বলে,”চব্বিশ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। তোমরা সবাই শান্ত থাকো। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আমার ভাইকে বাঁচাবো।”
তারপর অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলে,”এই মূহুর্তে সবথেকে বেশি তোমাকে শ’ক্ত থাকতে হবে, আশা করি তুমি বুঝতে পারছো।”

অন্তরা বলে,”আমি কি এক মিনিটের জন্য ওর কাছে যেতে পারি।
শুধু এক মিনিট। ”
আকুল অনুরোধ অন্তরার।
রাওনাফ কি যেনো ভাবে, তারপর বলে,”যাও তবে কান্নাকাটি করো না,প্লিজ।”

রওশান আরা অস্থির হয়ে আছেন। শর্মীকে বারবার বলছেন,”আর কতদূর? আর কতসময় লাগবে? ”
_এই তো দাদু,আর একটু খানি।

রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। উর্বী রওশান আরার হাত ধরে আছে।
আশেপাশে শুধু গাড়ির হর্ন বাজানোর শব্দ ভাসছে। সবাই বিরক্ত হয়ে হর্ন বাজাচ্ছে। উর্বী সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের সিএনজির পেছনে ডানপাশে একটা লাল রঙের গাড়ি এসে থামে। রোড লাইটের আলোতে সে গাড়ির চালকের মুখ উর্বী তাদের সিএনজির আয়নায় দেখতে পায়। মুখে মাস্ক পরা। চোখ দেখা যায় শুধু। উর্বীর মনে হলো তাদের গাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে। উর্বী চ’ম’কে ওঠে।এই চোখ দুটো যে তার বড্ড চেনা। উর্বী চোখ সরিয়ে নেয়। তার হাত পা কাঁ’প’ছে।
রওশান আরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। উর্বী তাকে শক্ত করে ধরে রাখে। সে ভ’য়ে ভ’য়ে আবার মিররে তাকায়। এবার আর কাউকে সে দেখতে পায় না।

অন্তরা সামিউলের হাত ধরে আছে। সামিউলের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। অন্তরা সামিউলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,”আমার সাথে এভাবে বেঈমানি করলে তোমাকে আমি কখনোও ক্ষমা করবো না। কথা ছিলো না কিন্তু এমন কিছুর!”

***
রাওনাফ এসে শাফিউলকে বললো,”ওদের সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেই। মা বাড়িতে নিশ্চই টেনশন করছে। তুই থাক শুধু। পুলিশ ত’দন্ত করছে। আমি এদিকটা দেখছি,তুই সেদিক টা দেখ।”

-পুলিশ তদন্ত করে কি জানতে পেরেছে?

-পুলিশ ধারনা করছে ছি’ন’তাইয়ের কে’ইস।
-শুধু ছি’ন’তা’ইয়ের কেইস হলে এতোটা জ’ঘন্য ভাবে কেউ কাউকে মা’রবে?
-বুঝতে পারছি না। আগে আমার ভাইটা সুস্থ হোক। আল্লাহ্‌ কে ডাক।

রওশান আরাকে আসতে দেখে রাওনাফ আর শাফিউল হতবাক হয়ে যায়। মা হসপিটালে কি করছে!
রওশান আরা পাগলের মতো ছুটে আসছে,তার পেছনে আসছে উর্বী আর শর্মী।
রাওনাফ রওশান আরাকে ধরে ফেলে। শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”মাকে এখানে এনেছো কেনো।?”
তারপর উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী চুপ করে থাকে।

রওশান আরা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে,”ওরে রাওনাফ, আমার ছেলেটা কই। আমাকে আমার ছেলের কাছে নিয়ে যা বাপ,আমার দমটা যে বেরিয়ে গেলো।”
শাফিউল এসে মাকে ধরে। রওশান আরাকে নিয়ে রাওনাফের কেবিনে যাবে। এই মূহুর্তে মাকে কিছুতেই সামিউলের সামনে নেওয়া যাবে না।

উর্বী অন্তরার কাছে এসে দাঁড়ায়। তারা সবাই ওয়েটিংরুমে বসে আছে। অন্তরার চোখের পানি শুকিয়ে গালের সাথে লেপ্টে আছে।তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

উর্বীকে দেখেই নাবিল বলে,”এখানেও আপনি চলে এসেছেন।”

উর্বী নাবিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। মোহনা নাবিলকে ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”নাবিল, স্টপ!”

রওশান আরা রাওনাফকে বলে,”আমি শুধু একটা বার আমার ছেলেটার মুখ টা দেখবো। আমায় একটু নিয়ে যা বাবা।”

রাওনাফ বলে,”মা ভাই আগে সুস্থ হোক। তারপর তুমি দেখো। তুমি এরকম করলে অসুস্থ হয়ে পরবে। এখন আমি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি ওদের সাথে যাবে।
রওশান আরা কাঁদতে থাকে। তার মন মানছে না। শাফিউল তাকে ধরে রেখেছে।

ওয়েটিং রুমের এক পাশে বসে মাস্ক পরা একজন মুখের সামনে খবরের কাগজ ধরে পড়ছিলো। তার দৃষ্টি ছিলো খবরের কাগজে, কিন্তু সে এসেছিলো অন্য কিছু দেখতে।

***
অন্তরা হাসপাতালে থেকে গেছে। অন্যরা সবাই বাড়ি ফিরে এসেছে।কেউ রাতে কিছু খায়নি। যে যার ঘরে শুয়ে আছে।
উর্বীও বাতি জালিয়ে রেখেই শুয়ে আছে। রাত বারোটার বেশি বেজে গিয়েছে। রাওনাফ আজ রাতে ফিরবে না। তার অনেক ভ’য় ভ’য় করছে, কোনো এক অজানা কারনে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।রওশান আরার ঘরে আমিরুনকে থাকতে বলেছে রাওনাফ নয়তো সে আমিরুনের সাথে থাকতো। উর্বী উঠে বসে।

দরজার বাইরে একটা আওয়াজ হয়। উর্বী চ’মকে ওঠে। তারপর মিউমিউ শব্দ আসে। এটা শর্মীর বেড়াল। উর্বী বুঝতে পারে তার ঘুম আসবে না। সে ধীরপায়ে হেটে রওশান আরার রুমের দিকে যায়, দরজা খোলাই ছিলো। সে ভিতরে ঢোকে। রওশান আরা ঘুমাচ্ছে,আমিরুন মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমিয়ে পরেছে।
সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে লিভিং রুমের দিকে চলে যায়। টিভি অন করে সোফাতে বসে পরে। কিছুক্ষন খবরের চ্যানেল ঘাটাঘাটি করে। পরে হাতে একটা ম্যাগাজিন তুলে নেয়। উর্বী বুঝতেই পারেনি সে এভাবেই সোফাতে ঘুমিয়ে যাবে। রাত তখন ৩টা তেইশ মিনিট।

***
সজীব রুমে ঢুকতেই সজীবের গালে সশব্দে উচ্ছাস একটা চ’ড় বসিয়ে দেয়। সজীব এই চ’ড়ের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে মাটিতে পরে যায়।
উচ্ছাস ওর শার্টের কলার ধরে ওপরে ওঠায়। চেঁচিয়ে বলে,”কি বললি,এখনো বেচে আছে? তোদের না বলেছিলাম পুরোপুরি খ’তম না করে যায়গা থেকে নড়বি না!”
_ভাই,বস্তির লোকজন চলে আসছিলো তাই আমরা….

উচ্ছাস হাত দিয়ে থামিয়ে দেয়। গলার স্বর হঠাৎ করে স্বাভাবিক হয়ে যায়। ঠান্ডা গলায় বলে,”কপাল ভালো।”

সজীবের কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। সে নিশ্চিত উচ্ছাসকে সে এখন যে কথাটি বলতে যাবে তা শুনলে উচ্ছাস তাকে মেরেই ফেলবে।তবু সজীব বুকে সাহস জমা করে। অন্যদের কাছ থেকে জানার থেকে সজীব নিজেই বলবে। সে উচ্ছাসকে কে ডাকে,”ভাই।”
উচ্ছাস অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়,”এখনো তুই দাঁড়িয়ে আছিস, যা আমার চোখের সামনে থেকে।”
-ভাই একটা বিরাট গণ্ডগোল হয়ে গেছে।
-আবার কি গণ্ডগোল হয়েছে।
উচ্ছাস ধমকে ওঠে।
-ভাই আজ যাকে আমরা মারলাম তার সাথে উর্বীর বিয়ে হয়নি। উর্বীর বিয়ে হয়েছে তার বড় ভাইয়ের সাথে। ডাক্তার রাওনাফ করিম খান, সিটি মেডিকেয়ার হসপিটালের একজন চেয়ারম্যান।

কথাগুলো একনাগারে বলে সজীব।
উচ্ছাস সজীবের দিকে তাকিয়ে থাকে। সজীব উচ্ছাসের চোখ দেখে মনের কথা পরতে পারছেনা। এতো বড় ভুলের জন্য উচ্ছাস তাকে কি করবে?

***
রাওনাফ ঘুমন্ত উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না উর্বী এভাবে সোফাতে কেনো ঘুমাচ্ছে। টিভি অন করাই আছে। রাওনাফ টিভি অফ করে দেয়। উর্বীকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাওনাফ খানিকটা ইতস্তত ভঙ্গিতে উর্বীকে ডাকে। উর্বী ঘুমিয়েই আছে।
রাওনাফ আরেকটু জোরে ডাক দেয়,”উর্বী।”
উর্বী লাফিয়ে ওঠে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে কিচ্ছু বুঝতে পারে না। রাওনাফের দিকে তাকায়।
রাওনাফ বলে,”দুঃখিত। তবে এভাবে সোফায় ঘুমাচ্ছিলে কেনো?”

_ টিভি দেখছিলাম ঘুমিয়ে যাবো বুঝতে পারিনি।
রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে এখন রুমে যাও। ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে।”
_কিন্তু আপনি ভিতরে আসলেন কিভাবে, দরজা খুলেছে কে?
_আমার কাছে চাবি ছিলো।
_আপনার ছোটোভাইয়ের এখন কি অবস্থা?
অনেক টা জড়তা নিয়ে প্রশ্ন করে উর্বী।
_আগে চব্বিশ ঘন্টা যাক।
রাওনাফ ক্লান্ত ভঙ্গিতে ওপরে ওঠে। তার ঘুমানোর প্রয়োজন। উর্বী তার পিছু পিছু ওপরে ওঠে।

***
সামিউলের অবস্থা এখন কিছুটা আশংকামুক্ত। তার জ্ঞান ফিরেছে তবে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
অন্তরা সামিউলের মাথার কাছে বসে আছে। সামিউলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সামিউল চোখ মেলে তার দিকে তাকায়।

তার শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা। অন্তরা বলে,”তুমি ঘুমোও।”
সামিউল চোখ বন্ধ করে।

রাওনাফ পু’লিশের সাথে হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। পুলিশ ইন্স’পে’ক্টর বলছে,”আপনার ভাইয়ের যদি জ্ঞান ফিরে থাকে তবে আমরা তাকে কিছু সামান্য জিগ্যাসাবাদ করতে চাই আমাদের তদন্তের জন্য।”

_আমার ভাই এখনো কথা বলার মতো অবস্থায় নেই অফিসার।

_ঠিকাছে আমরা তবে আরো একদিন অপেক্ষা করি।

পুলিশ অফিসার চলে যাবার পরে রাওনাফ সামিউলের কেবিনের কাছে এসে দাঁড়ায়। সে একটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখতে পায়। অন্তরা সামিউলের কপালে চু’মু দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রাওনাফ কেবিনে ঢোকে না। তার কাজ শেষ,এখন সব দায়িত্ব অন্তরার। রাওনাফ নিশ্চিত অন্তরা তার দায়িত্ব খুব ভালো ভাবে পালন করবে।

***
সম্ভবত শেষ রাতের পাখিটাও ঘুমিয়ে গিয়েছে। রাত এতোটাই গভীর। ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই উর্বীর ঘুম ভেঙে যায়। তার বুকটা কেমন ধরফরিয়ে ওঠে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে দেখতে পায় একটা অচেনা নাম্বার। নতুন সিমকার্ডে অচেনা নাম্বার টা দেখে তার খানিকটা খটকা লাগে। না চাইতেও ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশের ব্যক্তি নীরব। দীর্ঘক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। উর্বী কয়েক মূহুর্ত পরে বলে ওঠে,”কে বলছেন!”

ওপাশের ব্যক্তি কোনো কথা বলে না। মাঝেমাঝে নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে শুধু। কান খাড়া করে উর্বী শুনতে থাকে। ওপাশের ব্যক্তিটি একটা গান শুনছে, পরিচিত একটা গান। গানের একটা লাইন শুনতে পেয়েই উর্বীর চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা কেটে দিয়ে পাথরের ন্যায় বসে থাকে।

রাওনাফের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো উর্বীর ফোনের রিংটোন শুনেই। নীরবতা ভেঙে উর্বীর পাশ থেকে অদ্ভুত শব্দ তার কানে আসছে। দীর্ঘসময় পরে চাপা গোঙানির আওয়াজ রাওনাফের কানে পৌঁছায়। রাওনাফ উঠে বসে বেড সাইডের বাতি জ্বেলে দেয়। অনেকটা সংকোচ নিয়ে পর্দা সরিয়ে সে দেখে উর্বী হাপাচ্ছে। তার চোখে পানি। শাড়ির আঁচল দলা পাকিয়ে মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে কাঁদছে যাতে আওয়াজ না বের হয়। রাওনাফ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”আর ইউ ওকে! অসুস্থ বোধ করছো! ”

উর্বী স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেও পারেনা। বিষাদের স্মৃতিগুলো তার গলা চে’পে ধরছে।

রাওনাফ এগিয়ে যায়,বলে,”Asthma আছে নাকি তোমার?”

উর্বী মাথা নাড়ায়। রাওনাফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,”ওকে,যা বলছি সেটা করো। যাস্ট ব্রিদ ইন। ব্রিদ আউট।”

উর্বী করার চেষ্টা করে। রাওনাফ বলতে থাকে,”হ্যা এভাবেই, ব্রিদ ইন! ব্রিদ আউট!”

চলমান……