Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 400



প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-১১

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_১১
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
_______________________________
” ইরাবতী দাঁড়ান তো। ”

ইরা ক্যাম্পাসে পা রাখা মাত্র ই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো তাকে। এই সম্বোধন যে করেছে ইরা একটু আধটু চেনে তাকে। ডাক শুনে ইরা পেছনে ঘুরে তাকায়, সূচনা আজকে ভার্সিটি তে আসেনি, গত রাত হতে তার জ্বর। গত সপ্তাহেই তারা তাদের নতুন বাসায় উঠেছে। টানা কাজ করায় ধকলে হয়তো জ্বর উঠেছে সূচনার। এদিকে সামনের সপ্তাহে ই ইনকোর্স পরীক্ষা। এই সময়ে দুজনই যদি ভার্সিটি না আসে তাহলে তো হয় না।

ইরা লক্ষ্য করেছে এই লম্বাটে, সুদর্শন মুগ্ধ নামের ছেলেটা কিছুদিন যাবৎ তার পিছু নিয়েছে। ছেলেটা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে, এই ভার্সিটিতেই। ইরার আশেপাশে যখন সূচনা না থাকে ছেলেটা ও তখনই ইরার সামনে আসে। যেমন এখন। ইরাকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুগ্ধ এগিয়ে আসে তার দিকে। চুলে হাত বুলিয়ে সামনের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে পকেটে হাত পুরে সটান হয়ে দাঁড়ায়। ইরা মনোযোগের সহিত সব খেয়াল করে৷

” হা করে তাকিয়ে থাকবেন না, আশেপাশের মানুষ মনে করবে মেয়েটা নির্ঘাত নির্লজ্জ যে চোখ দিয়েই ছেলেটা কে গিলে খাবে। ”

এহেন বাক্যে ইরার টনক নড়ে ওঠে, মুগ্ধর মুখের দিকে তাকায়। মুগ্ধর ঠোঁট জুড়ে বিস্তৃত হাসি, ইরা লক্ষ্য করেছে ছেলেটা যখন ই তার সামনে এসেছে হাসিমুখে এসেছে। হাসলে তাকে দারুন লাগে।

” এখনো তাকিয়ে আছেন! ”

ইরা দ্রুত গতিতে চোখ জোড়া সরিয়ে নেয়, ভারি লজ্জা লাগছে তার। সে এমন হা করে তাকিয়ে ছিল কেন! আশ্চর্য! ইরা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,

” আপনি এভাবে ডাকা ডাকি কেন করেন! মানুষ কী মনে করবে! ”

” আমি আমার মুখ দিয়ে, কণ্ঠ দিয়ে আপনাকে ডাকি, মানুষের কী তাতে! ”

গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো ছেলেটা, ইরা ইতস্তত করে বললো,

” আমার থেকে কী চাই আপনার? রোজ রোজ না ডেকে একদিন বলে দিলেই হয়। ”

মুগ্ধ ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বললো,

” বলে দিব! ”

” বলে দিন, এভাবে আর ডাকাডাকি করবেন না। ”

” ওকেহ। শুনুন তাহলে..

ইরা চোখ জোড়া এবার ভালো করে মুগ্ধ তে নিবদ্ধ করে, মুগ্ধ মুখ গম্ভীর করে বলে,

” শুনুন, ভালো করে, কান খাড়া করে..

ইরা মনোযোগ দিল ভালো করে, মুগ্ধ মুখটা গম্ভীর করে কিছু বলতে নিয়েও সেই কথা আর বললো না। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হেয়ো স্বরে বললো,

” নাহ বলব না আপনি নিতে পারবেন না ছোট মানুষ। ”

কথাটা ইরার গায়ে লাগলো, মুগ্ধ কে এক প্রকার জোর করলো,

” আমি ছোট মানুষ না, যা বলার স্পষ্ট ভাবে বলুন। কী চাই আমার থেকে! ”

” আপনাকে ই চাই। ”

মুগ্ধ সাবলীলভাবে বলে দেয়, ইরা সত্যি সত্যি তব্দ খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। টু শব্দ ও করতে পারে না কোনো। মুগ্ধ ইরার ওপর খানিক ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলে,

” আগেই বলেছিলাম নিতে পারবেন না, বাচ্চা মেয়ে। ”

ইরা এবার ও কোনো কিছু বলার মতো খুঁজে পায়না। মুগ্ধ তাকে পাশ কা টি য়ে চলে যায়। সেদিন আর সব গুলো ক্লাস করা হয়না ইরার। দুইটা ক্লাস করেই তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরে। তার অস্বস্তি হচ্ছে, অস্থির অস্থির লাগছে। মুগ্ধর ঐ কথার পৃষ্ঠে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না কেন তা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছে। গ্রামে তো কেউ চোখ তুলে তাকালেও কত কথা শুনিয়ে আসতো তাহলে আজকে পারলে না কেন!
ইরা বাসায় ফিরে দেখলো সূচনা রান্নাঘরে নুরাইয়ার সাথে দুপুরের রান্নায় সাহায্য করছে। নুরাইয়া বারবার নিষেধ করেছেন জ্বরের শরীরে কাজ করতে হবেনা, শুয়ে থাকো। সূচনা যায়নি, তার নাকি একা একা রুমে পরে থাকতে ভালো লাগেনা। নুরাইয়া বাধ্যঁ হয়ে বলেছেন, তাহলে এখানে ই বসো পিড়ি পেতে। বসে থাকতে বললে ও মেয়েটা খালি বসে থাকেনা। ধ ম ক খেয়েও টুকটাক কাজ করছে। শাশুড়ী কাজ করছে আর ছেলের বউ হাতে হাত তুলে বসে আছে ব্যাপারটা সূচনার কাছে মোটেও ভালো লাগছিল না।

ইরা বাসায় ফিরে সোজা নিজের রুমেই চলে যায়। তার মুখ দেখে সূচনার কিছুটা সন্দেহ হয়, এমনিতেও গত কয়েকদিন ধরে সে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। ইরাকে জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করা হয়নি। হোস্টেলে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়না, তন্মধ্যে হোস্টেল থেকে আবার এই বাসায় এসেছে। সব ঝামেলায় আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। এক সপ্তাহ ধরে সূচনা পড়াতেও যাচ্ছে না অন্তিমদের বাসায়।
রান্নাঘরের কাজ টাজ সব সেড়ে সূচনা নিজের রুমে আসে৷ প্রণয় অফিসে, এহতেশাম সাহেব গিয়েছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে যে ছোট ব্যবসা টা আছে সেটা সামলানোর দায়িত্ব ওনার ভাগ্নে কে দিয়েছেন। তাকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ই গিয়েছেন। প্রণয়কে বলেছিলেন কিন্তু প্রণয় সাফ জানিয়েছে, নিজে পড়াশোনা করেছি কষ্ট করে, নিজেই কিছু করব।

রুমে এসে সূচনার মনে পরে, তার ইরার সাথে কথা বলা দরকার। সেই উদ্দেশ্যেই ইরার রুমে যায়। ইরা গোসল সেরে বেরিয়েছে সবে। সূচনাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলো,

” ভাবি তুমি এখানে যে! ”

” কথা ছিল একটু। ”

” জরুরি কিছু? তোমার না শরীর খারাপ! ”

” হ্যাঁ জরুরি। বসো। ”

ইরা বিছানায় সূচনার কাছে যেয়ে বসে, সূচনা ঠান্ডা মাথায় সুন্দর করে ই জিজ্ঞেস করে ,

” মুগ্ধ নামের ছেলেটা কে তুমি চেনো ইরা? ”

ইরা আঁতকে ওঠে, এমনিতেই মুগ্ধর বলা কথা নিয়ে সে ভীত ছিল। ভীত হলেও সে মিথ্যা বলে না, সত্যি কথাই বলে,

” আমি তেমনভাবে চিনিনা ভাবি, এতটুকু জানি যে উনি আমাদের ভার্সিটিতে পড়েন, অনার্স ফাইনাল ইয়ারে, অরিন আপুদের সাথে। তুমি যখন আমার সাথে না থাকো উনি তখনই আমার সামনে আসেন। আজকে ও এসেছিলেন। আমি বলেছি যে রোজ রোজ এভাবে বিরক্ত না করে যা বলার একদিন বলে দিলেই হয়। তারপর.. তারপর উনি বললেন যে…

” তোমাকে পছন্দ করে! ”

ইরা বিস্ময় নিয়ে তাকায়, থেমে থেমে বলে,

” তু..তুমি জানো! ”

” আমার সাথে কথা হয়েছে । ”

” কবে? ”

” সপ্তাহ দুয়েক হবে, আমার সাথে কথা বলেছিল ভার্সিটি তে। ”

” ওহ। ”

” তুমি তাকে পছন্দ করো? ”

ইরা চকিত নয়নে তাকালো, এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। উত্তর দিতে ও পারেনা। সূচনা উত্তরের অপেক্ষা করেনা, হয়তো বুঝতে পারে ইরার অবস্থা।


সময় খুব দ্রুত ই কে টে যায় এটা জানা থাকলেও সূচনার কাছে মন হয় বিয়ের পর দেড় মাস খুব দ্রুত কে টে গেছে। তার এখনো মনে হয় সেদিন ও সে ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল। যারা দুনিয়া ছিল তার মা, সব দায়িত্ব, ভালোবাসা সব তার জন্য ই ছিল। অথচ এখন তার আরও একটা পরিবার আছে, শশুড়-শাশুড়ি, ননদ। আর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব, স্ত্রী হওয়ার দায়িত্ব। সে এখন কারো স্ত্রী, জীবন সঙ্গী। হুট করে বিয়ে হলেও এই দেড় মাসে মনের দূরত্ব ঘুচেছে বেশ। শুধু শরীরেরই দূরত্ব। সূচনা যতবার ই ভেবেছে সেই দূরত্ব কমানোর কথা ততবারই ঘাবড়ে গিয়েছে। অস্থিরতা, অস্বস্তিতে মন মস্তিষ্ক বি ষি য়ে উঠেছে। অতঃপর সেই ভাবনা বাদ দিয়েছে। সে বাদ দিলেও প্রণয় কেন বাদ দিয়ে রেখেছে! প্রণয় নিজ থেকে ও এগিয়ে আসেনি। এক বিছানায় থাকা স্বত্তেও তেমনভাবে কখনো স্পর্শ করেনি। এই দেড় মাসে হাত ধরা আর জড়িয়ে ধরা ছাড়া কিছু ই হয়নি৷ কী আজব! সূচনার ভীষণ বিরক্ত লাগলো নিজের ওপর৷
গোসল সেরে এসে ব্যালকনিতে এসে বসেছিল সে। দুইতলা বিশিষ্ট বাড়ি, সূচনারা দোতলাতে থাকছে। একতলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া হয়েছে, আরেকটা এখনো খালি। সূচনার নিজের রুমের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা এই ব্যালকনি টাই। তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সূচনা ঠিক করেছে ব্যালকনিতে কিছু গাছ রাখবে। কয়েকটা ফুল গাছ, মানি প্ল্যান্ট। প্রণয়কে বলেছে এনে দিতে। প্রণয়ের কথা মনে হতেই সূচনার মনে আবারও সেই চিন্তারা এসে হানা দিল।
বসা থেকে উঠে সূচনা রুম হতে নিজের ফোন টা নিয়ে আসলো। ভাবলো প্রণয়কে কল করবে কিন্তু করলো না। তার এই মুহূর্তে মনে হতে লাগলো, দোষ তো প্রণয়ের ই। এত ভদ্র হতে কে বলেছে! সূচনা কল লিস্টে যেয়ে প্রণয়ের নাম্বার টা খুঁজে বের করলো। প্রণয়ের নাম্বার সে সেভ করেছে বাজে ছেলে নাম দিয়ে। নামটা দেখে মৃদু হাসে। মেসেজ অপশনে যেয়ে ছোট একটা বার্তা পাঠালো,

” এত ভদ্র হতে কে বলেছিল বাজে ছেলে! বাজে ছেলে তো বাজে কাজ করবে আর আপনি বউ রেখে ভদ্র হ’য়ে ঘুরছেন! ”

মেসেজ পাঠিয়ে সূচনা খানিক ভীত হলো, বিব্রত হলো। এমন মেসেজ পাঠানো টা কী তার ঠিক হয়েছে?

” ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন! ”

ভাবনার মধ্যে ই নুরাইয়ার কণ্ঠ কানে আসে সূচনার। নুরাইয়া ব্যালকনির দরজায় দাঁড়িয়ে শাসনের স্বরে বলেন,

” এমনিতেই জ্বর উঠেছে তার মধ্যে ভেজাঁ চুল নিয়ে ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন! ঘরে আসো। ”

নুরাইয়ার কথা শুনে সূচনার হাত আপনা আপনি তার চুল স্পর্শ করলো৷ হ্যাঁ চুল ভেজাঁ, ভালো করে মোছা হয়নি। জ্বর বাড়ছে বোধহয়, মাথাটা ও কেমন ঝিমঝিম করছে। সূচনা ব্যালকনি থেকে তখনই রুমে আসলো। নুরাইয়া সাথে করে নিয়ে গেলেন খাওয়ার জন্য। দুপুরে অল্প একটু ই খেল সে, ঔষধ খাওয়ার কথা বললেও মেয়েটা ভুলে গেল। বিছানায় পিঠ লাগাতেই চোখ জোড়া ঘুমে বন্ধ হয়ে আসলো।

সন্ধ্যার খানিক আগে রুমে কারো উপস্থিতি টের পেলে তার ঘুম ভাঙলো। চোখ পিটপিট করে মেললে দেখা গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে টাই খুলতে ব্যস্ত প্রণয়। সূচনা উঠে বসলো কষ্ট করে, মাথা ভার হয়ে আছে তার। জ্বর কমেনি উল্টো বেড়েছে। তাকে উঠতে দেখে নিজের কাজ করতে করতে ই প্রণয় বললো,

” মা বললো তোমার জ্বর উঠেছে! ”

সূচনা নিরুত্তর রইলো, প্রণয় জিজ্ঞেস করলো,

” ঘুমিয়েছো কখন? ”

” দুপুরে। ”

মৃদুস্বরে জবাব দিল সূচনা, প্রণয়ের কাছে মনে হলো মেয়েটা ফিসফিসিয়ে জবাব দিয়েছে। প্রণয় খানিক রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করে,

” ঔষধ খেয়েছো? ”

” উহু। ”

ব্যস এতটুকু যথেষ্ট ছিল রা গে র মাত্রা বাড়ানোর জন্য। প্রণয় ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে চোখের পলকেই যেন সূচনার সামনে এসে দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে বললো,

” তা খাবে কেন! আস্তে কথা বলো কেন আজকে! গলায় জোর নেই! থাকবে কীভাবে অসুখ হয়েছে। অসুখ হলে ঔষধ যে খেতে হবে তা জানোনা! ”

সূচনা ভারি বিস্ময় নিয়ে তাকায় তার দিকে, কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে করুন চাহনি নিক্ষেপ করে। তাতে কাজ ও হয়, প্রণয় খানিক নরম হয়। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,

” ওঠো, হাত মুখ ধুয়ে ভারি কিছু খাবার খেয়ে তারপর ঔষধ খাও। ”

সূচনা হাফ ছাড়ে, মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে, গা থেকে কাথাঁ সরিয়ে উঠতে নিলে বিপত্তি বাঁধে। ঘুমালে শাড়ির অবস্থা নিশ্চয়ই খুব ভালো থাকেনা। তার বিব্রতবোধ দূর হয় প্রণয়ের বাক্যেই,

” লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই আমি ই, পাশের বাড়ির আন্টির ছেলে না। ওঠো তাড়াতাড়ি। ”

প্রণয় সোজাসাপটা কথা বলে ইদানীং যে কথাগুলো সূচনাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দেয়৷ সূচনা অবশ্য অভ্যাস করছে প্রণয়ের সোজাসাপটা কথা গুলো সহজ ভাবে হজম করে নিতে।
সূচনা হাত-মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হ’য়ে এসে দেখলো প্রণয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। সূচনা হাতের তোয়ালে টা নিয়ে ব্যালকনিতে যায়। প্রণয়ের পাশে যেয়ে দাঁড়ায়, সেখানে দাঁড়ালে সাথে সাথে ই দমকা হাওয়া সমস্ত শরীর ঠান্ডা করে দিয়ে যায় যেন। সূচনার শরীরে কাঁপন ধরে, নাহ ঔষধ বোধহয় খেতে ই হবে। জ্বর ভালোই আছে। প্রণয় কথা শেষে ফোন কান থেকে নামিয়ে সূচনার দিকে তাকালো। সূচনার মুখ শুকনো দেখাচ্ছে, প্রণয় জিজ্ঞেস করে,

” এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন আবার! কিছু খেয়ে আসো। ”

সূচনা কথা শুনে প্রণয়ের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়৷ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই প্রণয়ের চোখ জোড়া সূচনার মুখ হতে নেমে আসে সূচনার উদরে। শাড়ি সরে গিয়ে সেখানটা খানিক উন্মুক্ত। প্রণয় সাথে সাথে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চাইলেও পারেনা। দৃষ্টি অন্য রকম হয় তার, কেমন ঘোর লেগে যায়। সূচনা খেয়াল করতেই সাথে সাথে শাড়ি ঠিক করে নেয়। প্রণয়ের ঘোর কা টে, চোখ সরিয়ে নেয়। সূচনা মুখ বাঁকিয়ে মৃদু স্বরে আওড়ায়,

” বা জে ছেলে আমি শুধু শুধু বলেছি! ”

নিচু স্বরে বললেও প্রণয়ের কানে পোঁছায়, সে সূচনার আরেকটু গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,

” তুমি দেখালে দোষ না আমি দেখলেই দোষ! ”

” আমি কী ইচ্ছে করে দেখিয়েছি! ”

” আমি কী ইচ্ছে করে দেখেছি! ”

” কে জানে, পুরুষ মানুষের কী বিশ্বাস আছে! তার ওপর আপনি হচ্ছেন বাজে ছেলে। ”

সূচনার এই কথার পৃষ্ঠে প্রণয়ের গলার স্বরে পরিবর্তন এলো। সূচনার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

” বলছো! তাহলে বা জে ছেলের তো বা জে কাজ করতেই হয়। ”

সূচনা খানিক ঘাবড়ে যায়, প্রণয়ের দৃষ্টি একটু আগের ন্যায় ই ঘোর লাগানো। প্রণয়ের দুই হাত সূচনার কোমর স্পর্শ করতেই সূচনার সমস্ত শরীর যেন জমে যায়। হৃদ স্পন্দন বেড়ে দ্বিগুণ হয়। সূচনা আঁখি জোড়া বন্ধ করার আগে দেখে প্রণয় তার মুখটা এগিয়ে আনছে তার দিকে। সূচনা সেই মুহূর্তে ই আঁখি জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নেয়। অতঃপর ঠোঁট জোড়ায় উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে শরীরে ঝংকার ওঠে। সম্বিত ফিরে যখন তখন দুই হাতে ঠেলে সরিয়ে দেয় প্রণয়কে। খানিক উত্তেজিত হয়ে বলে,

” আপনি আমার অসুস্থতার সুযোগ নিচ্ছেন! অনুমতি নিলে কী আমি সম্মতি দিতাম না! ”

প্রণয়ের যখন খেয়াল হয় তখন নিজের ওপর ঈষৎ রা গ হলেও সূচনার কথাটা যেন আ গু নে ঘি ঢালার ন্যায় কাজ করে। তার প্রচন্ড রা গ হয়, চোখ জোড়া মুহূর্তে ই আরক্তিম হয়। সূচনাকে ছেড়ে দিয়ে বড় বড় কদমে সেই স্থান হতে প্রস্থান করে। পেছনে সূচনা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে না, একটু আগে যা হয়েছিল তা ভুল ছিল নাকি সে যা বলেছে তা ভুল ছিল!

#চলবে।

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-১০

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_১০
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
______________________________
শুক্রবারের বিকেলের সময়টা সূচনার ভালো কাটলেও শেষে ঐ একটা কথাতেই সব মন খারাপেরা মনে হা না দিয়েছিল। প্রণয় প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে ফেলে রাখলো মেয়েটাকে। ইরার সাথে কথা বলে দেখবে কি-না ভাবতে ভাবতে ও একদিন কেটে গেল। আজ রবিবার, ভার্সিটি তে নবীন বরণ। সকালেে তাড়াতাড়ি করে উঠে সব কাজ টাজ শেষে তৈরি হয়ে দুজন বেরিয়ে পরেছে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। ইরাকে বাসা থেকে ভার্সিটি আসা অব্দি অনেকগুলো ছবি তুলে দিয়েছে সূচনা। অথচ ইরা এত বার বলেও সূচনাকে রাজি করাতে পারেনি তার নিজের ছবি তোলার জন্য। ইরার মনে একবারের জন্য এই খেয়াল এসেই পরে,

” মেয়েটা কী নিরামিষ! আজকালের মেয়েরা এমন নিরামিষ হয়! হয় বোধহয় নাহলে এই মেয়ের কীভাবে আছে! ”

ভার্সিটি তে এক সপ্তাহে তেমন ভালো কোনো বন্ধু না হলেও মোটামুটি কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয়েছে। তাদের মধ্যেই একজন অরিন, মেয়েটা দুজনকে দেখেই এগিয়ে আসলো। কুশলাদি করে হাসিমুখে ই বললো,

” তোমাদের দুজনকে সুন্দর লাগছে। তোমার শাড়ির সাথে সাজের কালার কম্বিনেশনটা সুন্দর হয়েছে। ”

শেষ বাক্যটি সূচনার উদ্দেশ্যে করে মেয়েটা, তার কথা শুনে সূচনার নিজেকে ভালো করে একটু দেখে।

” তোমরা এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? ”

সূচনা মেয়েটার এহেন প্রশ্নে নিজের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে তাকায়। মৃদু স্বরে বলে,

” না আপু আসলে..

” আমার সাথে চলো, ভার্সিটি তে নতুন তো তোমরা। আসো কয়েকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ”

অরিন মেয়েটা এবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। তার সাথে পরিচয় হয়েছিল প্রথম দিনেই। ইরার কোনো একটা কাগজ নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। সেই বিষয়ে অরিন সাহায্য করেছিল। সেই থেকে ই পরিচয়। অরিন সূচনা ও ইরাকে নিয়ে যেয়ে তার বাকি বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পুরো ক্যাম্পাস ই আজকে নানান রঙে সজ্জিত। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত, এতক্ষণ এদের মধ্যে নিজেদের ভিনগ্রহের প্রাণী মনে হলেও এখন এমন মনে হচ্ছে না। ওরা আটজন, একসাথে বসে আছে ক্যাম্পাসে। সবাই মিশুক, মন খুলে কথা বলছে, হাসছে। ঐদিকে স্টেজে একজনের পর একজন বক্তব্য রাখছেন। সূচনা প্রথম কয়েক মিনিট চুপচাপ থাকলেও আস্তে আস্তে সহজ হলো, কথা বলা শুরু করলো। এদিকে ইরা লুকিয়ে সূচনার ছবি তুলে প্রণয়কে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালো। বয়সে ভাই বড় হলেও সম্পর্ক টা তাদের বিড়াল ইঁদুরের। যে যখন পারবে একজন আরেকজনকে জ্বা লা বে।


ভার্সিটি তে সময় টা ভালো কাটলেও বিপত্তি বাঁধে দুপুরের পর যখন আকস্মিক বৃষ্টি শুরু হয়। কোনোরূপ খবর না দিয়ে ই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই থেকে ঝুম বৃষ্টি, থামার নাম নেই৷ ভার্সিটির প্রোগ্রাম ও এই বৃষ্টির কারণে ঠিকঠাক ভাবে হলোনা। এদিকে বাসায় যাওয়ার সুযোগ টা ও যেন হচ্ছে না। এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে কীভাবে যাবে! রিকশা বা অন্য কোনো যান পাওয়া ও মুশকিল। অরিনরা ও বসে আছে, তাদের মধ্যে অবশ্য বাড়ি ফেরা নিয়ে চিন্তা দেখা যাচ্ছে না। ইরা টুকটাক কথা বলছে, সূচনার কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। মেজাজ খারাপ লাগছে, বৃষ্টির ছাঁট শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে বারংবার। বাতাসে তেমন বেগ না হলে ও নীলাম্বর ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন। যার দরুন সন্ধ্যা না নামতে ই সন্ধ্যা সন্ধ্যা মনে হচ্ছে। কংক্রিটের পিলারে ঠেস দিয়ে বসে চিন্তিত মেয়েটা। তপ্ত শ্বাস ফেলে সে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে। ভাবতে বসলো, আজকে এই অব্দি প্রণয়ের সাথে কথা হয়নি তার। প্রণয় জানে তারা ভার্সিটি তে এসেছে। কিন্তু এভাবে আঁটকে গেছে তা কী ধারণা করতে পারবে? নিতে আসবে তাদের? এমন অদ্ভুত ভাবনারা এসে মস্তিষ্কে হানা দিতেই সূচনা নিজেকে খানিক বকলো ও। উদ্ভট ভাবনা ইদানীং বেশি আসছে মনে৷

বৃষ্টি কমবে সে অপেক্ষা করতে করতে আরও দুই ঘন্টা পার হলো৷ অধৈর্য হয়ে ইরাকে বলেই ফেললো সূচনা,

” চলো বাইরে যেয়ে দেখি রিকশা বা অন্য কিছু পাই কি-না। ”

ইরার ঘোর আপত্তি, বিস্ময় নিয়ে বলে,

” কী বলছো ভাবি! এই বৃষ্টির মধ্যে তোমার মনে হয় কিছু পাওয়া যাবে? তার ওপর আমরা দুজনই মেয়ে, এত বৃষ্টির মধ্যে মানুষজন ও নেই রাস্তায়। ভাইয়া রা গা রা গি করবে। ”

ইরার বলার পর সূচনারও যেন হুঁশ হলো। নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মা র লো৷ কী বোকার মতো কথা বলছে!


অফিস টাইম শেষ, বৃষ্টির জন্য অফিস থেকে বের হতে পারছিল না বিধায় অফিসেই বসেছিল প্রণয়। এর মধ্যে ইরার ফোন পেয়ে বৃষ্টির মধ্যে ই সে বাইক নিয়ে ছুটে। সূচনার উদ্ভট ভাবনা কে সত্যি করে দিয়ে কাক ভেজাঁ হয়ে ভার্সিটি তে প্রবেশ করে প্রণয়। এসেই সূচনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে,

” তোমার কাছে ফোন নেই? ”

সূচনা থতমত খেয়ে উত্তর দেয়,

” আ..আছে তো। ”

” এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা না করে ফোন দাও নি কেন? ”

সূচনা জবাব দেয় না, প্রণয় ফের প্রশ্ন করেনা আর। হুট করে একটা ছেলে এসে এভাবে সূচনাকে প্রশ্ন করছে দেখে অরিন সহ বাকিরাও প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি তে তাদের দিক তাকিয়ে আছে। প্রণয় লক্ষ্য করলেও কিছু বলেনা। অরিন সূচনার কানের কাছে ঝুকে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে,

” ছেলেটা কে? তোমাকে এভাবে প্রশ্ন করছে কেন? ”

অপরিচিত মেয়েটা কে সূচনার কানে এমন ফিসফিস করতে দেখে প্রণয় কান খাড়া করে শোনে অতঃপর নিজেই কণ্ঠ খানিক উচুঁ করে জবাব দেয়,

” প্রশ্ন করছি কারণ আমি তার বর, আমার বউ হয়। ”

উত্তর দিয়ে ই প্রণয় ভার্সিটি থেকে বের হয়, একটা ব্যবস্থা যদি হয়! কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কোনো যান ই পাওয়া গেল না। পুনরায় ভার্সিটি তে ফিরে যায়, একসাথে দুজনকে নিয়ে বাইকে যাওয়া সম্ভব না। এমনিতেই বৃষ্টি তন্মধ্যে ঢাকা শহরের রাস্তা! একটু বেশি বৃষ্টি হলেই রাস্তায় হাঁটু সমান পানি হয়ে যায়। সূচনা ইতস্তত করতে করতে ই বলে,

” হোস্টেল এখান থেকে বিশ মিনিটের মতো দূরত্বে। এক কাজ করুন ইরাকে দিয়ে আসুন আগে, তারপর আমাকে নিয়ে যেয়েন। ”

প্রণয় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ইরা কে আদেশ করে,

” আয় তাড়াতাড়ি। ”

ইরাকে হোস্টেলে রেখে এসে প্রণয় ফের যায় ভার্সিটি তে। সূচনা আগের জায়গাতে ই বসেছিল। প্রণয়কে দেখামাত্র ই উঠে দাঁড়ায়। সামনে এগোতে নিলে প্রণয় হাত দিয়ে ইশারা করে আসতে নিষেধ করে। নিজেই এগিয়ে যায়, হোস্টেল থেকে ইরা ছাতা দিয়ে দিয়েছিল। প্রণয় ছাতা টা সূচনার হাতে দেয়। সূচনার আধ ভেজাঁ নীল রঙা শাড়ির আঁচল টা দিয়ে নিজের মাথা মুছতে নিলে সূচনা আড়চোখে তাকায় একবার কিন্তু কিছু বলার সাহস পায়না। সূচনা মাথায় ছাতা মেলে দিয়ে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায় বাইকের দিকে।

বৃষ্টির বেগ আগের তুলনায় কমলেও এখনও কম না। ভিজেঁ যাচ্ছে যে মেয়েটার কোনো হেলদোল নেই। প্রণয় লুকিং গ্লাসে এক পলক দেখে গম্ভীর স্বরে শোধালো,

” ভিজেঁ যাচ্ছো ছাতাঁ টা নিতে বললাম নিলেনা কেন! ”

” বাইকের ওপর বসে ছাতা কে নেয়? ”

” নিজেকে রক্ষা করতে অনেক কিছু ই নতুন করতে হয়। ”

” এটা বৃষ্টি কোনো যম না যে বেচেঁ ফিরব হ্যাঁ ব জ্র পা ত হলে আলাদা কথা, ওটাতে আমার ভীষণ ভয়। কিন্তু এমনিতে বৃষ্টি তো একটা অন্যরকম অনুভূতি, বৃষ্টি তে ভেজারঁ মধ্যে যে প্রশান্তি! উফফ! ”

” অসুস্থ হলে টের পাবে। ”

” হলে হবে। ”

সূচনা হেঁয়ালি করে ই বললো, প্রণয় আর কথা বাড়ালো না।

হোস্টেলে পোছাঁলে সূচনা বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো। প্রণয় লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে চুল ঝাড়ছিল নিজের। সূচনা মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে,

” এখন চলে যাবেন? ”

” না আজকে তোমার সাথে হোস্টেলেই থাকব ভাবছি। ”

সূচনা চোখমুখ শক্ত করে বললো,

” হোস্টেলে থাকবেন মানে! ”

প্রণয় লুকিং গ্লাস থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সূচনার দিকে তাকালো৷ হেয়ো স্বরে বললো,

” হ্যাঁ, থাকব। তো!

” আপনি হোস্টেলে কেন থাকতে যাবেন! বাসায় যাবেন আপনার৷ ”

” জানোই যেহেতু তাহলে জিজ্ঞেস করছো কেন! ”

প্রণয় বিরক্তি নিয়ে বললো, সূচনা মৃদু স্বরে বলে,

” আমি জিজ্ঞেস করেছি এখনই যাবেন কিনা সেটা। ”

” তো কী করব এখানে থেকে? ”

” ঘাস কা ট বে ন ঘাস। ”

মিনমিনিয়ে বলে সূচনা, প্রণয় এক ভ্রু উঁচু করে তার দিকে তাকালে সূচনা মেকি হেসে বলে,

” যান যান, বৃষ্টি বেড়ে যাবে আবার। ”

” হ্যাঁ যাবো ই তো। যেয়ে আবার এই শার্ট নিয়ে ধস্তাধস্তি করতে হবে। ”

সূচনা কথার মানে বুঝতে না পেরে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে প্রণয় হাত দিয়ে নিজের কাঁধের দিকে সফেদ রঙা শার্টের অংশে লাল হওয়া জায়গাটুকু দেখিয়ে দেয়। মুখ বাঁকিয়ে বলে,

” শার্টের মধ্যে আলপনা করেছো না! ”

সূচনা কথার পৃষ্ঠে নাক মুখ কুঁচকে বলে,

” ওটা আলতা। ”

” যাই হোক, ভেতরে যাও। ”

প্রণয় বলা মাত্র ই সূচনা যাচ্ছি বলে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। পেছনে থাকা প্রণয় তাকিয়ে থাকে তার দিকে। পেছন থেকেই তার মনে হয়, সূচনার পড়নের নীল শাড়ি টা যেনো তাকে প্রস্ফুটিত অপরাজিতা ফুলে প্রত্যাবর্তন করতে আড়ম্বর। মসৃণ দুহাতে সমানতালে দুলে যাচ্ছে নীল চুড়ি। হাতে লেপ্টে আছে আলতার লালিমা। অবশ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়েঁ হালকা হয়ে গেছে খানিক। প্রণয় হেলমেট পরতে পরতে বিড়বিড় করে বলে,

” বেশিদিন দূরে রাখা যাবে না দেখছি। ”

হোস্টেলে ফিরে ফ্রেশ হয়েই দুইজন ঘুম দিল। জ্বর ট্বর হলো না কারোরই।


তিনদিন দ্বিধায় ফেলে রেখে প্রণয় পরের দিন বিকেলে সূচনাকে কল করে টিউশনি করার ব্যাপারে কথা বলতে। ভার্সিটি থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আরাম করে গড়াগড়ি খাচ্ছিল সূচনা। এর মধ্যে ফোনের চিৎকার চে চা মে চি তে মেজাজ খারাপ হলো তার। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে না দেখেই রিসিভ করলো। কানে লাগিয়ে কর্কশ গলায় বললো,

” অসময়ে ফোন দিয়ে বিরক্ত করে কে হ্যাঁ! ”

” আমি বিরক্ত করছি তোমায়? ”

প্রশ্ন আর প্রশ্ন যে করেছে সে কণ্ঠের মালিককে ধরতে সূচনার বেগ পেতে হলো না। ইতিউতি করে বললো,

” না না। ”

” বললে যে! ”

” অন্য কাউকে ভেবেছিলাম। ”

মিনমিনে গলায় বলে মেয়েটা, প্রণয় একপ্রকার তেতেঁ উঠে বলে,

” অন্য কেউ মানে! অন্য কেউ তোমার ফোনে কল দিবে কেন! ”

সূচনা এহেন কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। থেমে থেমে বলে,

” আরে আমি আমি তো..

প্রণয় কথা শেষ করতে দেয়না। মেয়েটাকে কিছু বলতে না দিয়ে ই নিজের মতো করে বলে যায়। সূচনা শেষে চুপ করানোর জন্য জোরেসোরে ধ ম ক দিয়ে বসে যে প্রণয় তব্দ খেয়ে যায়। সেকেন্ড কয়েক চুপ করে থাকে, তারপর বিস্ময় নিয়ে বলে,

” তুমি আমাকে ধমক দিলে! ”

সূচনা ইতিউতি করতে থাকে, প্রণয় ফের বলে,

” স্বামীর সম্মান করতে হয় আর তুমি হু ম কি ধা ম কি দাও! ”

সূচনা দুঃখী দুঃখী গলায় বলে,

” দুঃখীত স্বামী, আমার ভুল হয়ে গেছে বিশ্বাস করুন এই ভুল আর জীবনে ও করবনা যদি আপনি নিজে নিজে ই সব ভেবে না নিয়ে আপনার স্ত্রী কে কথা বলতে দেন। ”

সূচনার ঠেস দিয়ে বলা কথা প্রণয়ের বেশ হজম হলো। সেই প্রসঙ্গ আর ঘাটলো না। গম্ভীর স্বরে বললো,

” বা জে কথা বন্ধ করো এবার, কাজের কথা শোনো। দুটো টিউশনি ঠিক করেছি কালকে ভার্সিটি শেষ করে তৈরি হয়ে থেকে আমি নিতে আসব। রাখি। ”

প্রণয়ের কথা শুনে সূচনা ফট করে শোয়া থেকে উঠে বসে। বিস্মায়াবিষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করে,

” সত্যি বলছেন আপনি? ”

কোনো জবাব আসলো না, সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে প্রণয় সাথে সাথে ই। সূচনা তবুও ফোন টা কানে লাগিয়ে রেখে থম মে রে বসে থাকে কিছু সময়। ভাবতে থাকে, এই ছেলে চমক দিতে এত পারদর্শী কেন! পিএইচডি করেছে এর ওপর!

অবাক ভাব কা টি য়ে সূচনা পাশে শুয়ে থাকা ইরাকে ডেকে ওঠায়। ইরাকে খবর টা দিলে ইরা ও খুশি ই হয়। সে কখনো নিজের হাত খরচ নিজে চালানোর জন্য কাজ টাজ করেনি। বাবা ই দেয় যা দরকার হয়, আর এখন প্রণয় ও যখন যা দরকার হয় দেয়। সূচনার এই সিদ্ধান্ত তার পছন্দ হয়েছে। সূচনা গ্রামপ ও টিউশনি করতো, সেখানে আর ও বেশি করতো। তা দিয়েই নিজের হাত খরচের পাশাপাশি নিজের মা-কে ও কিছু টাকা দিতো। ইরার অবাক লাগে, তারই বয়সের মেয়ে সূচনা অথচ মেয়েটা সাবলম্বী!


পরের দিন ভার্সিটি থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি করে তৈরি হয়ে সূচনা প্রণয়কে কল করলো। প্রণয় জানালো আধ ঘন্টার মধ্যে ই চলে আসবে। অপেক্ষা করতে করতে প্রায় আধ ঘন্টা পর ই প্রণয় আসে। কল পেয়ে সূচনা দ্রুত বের হয় ইরাকে বলে। হোস্টেলের বাইরে ই দাঁড়িয়ে ছিল প্রণয়। উল্টো ঘুরে ফোনে কথা বলছিল। তার সাথে বাইক নেই আজকে। সূচনা পেছন থেকে প্রণয়ের পিঠে আঙুল দিয়ে খোঁচা দেয়। প্রথমবারে প্রণয় সাড়া দেয়না। সূচনা আবারও একই কাজ করে। কাঁধের ঐখানটায় খোঁচা খোচিঁ করে। প্রণয় ফোন কানে নিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে এমন টা না করতে। সূচনা শোনেনা ফের একই কাজ করতে গেলে প্রণয় তার আঙুল ধরে ফেলে। অতঃপর হাত ধরে ঘুরিয়ে তাকে নিজের সামনে দাঁড় করায়। ফোনে কথা শেষ না হওয়া অব্দি হাত ধরে ই রাখে। ফোন রেখে প্রণয় বিরক্তি তে অসহ্য রকমের শব্দ করে। শক্ত কণ্ঠে বলে,

” কী সমস্যা! বাচ্চামো করছো কেন! ”

সূচনার ও মনঃক্ষুণ্ন হয় প্রণয়ের অভিব্যক্তিতে। সে মন খারাপ টুকু গিলে বললো,

” শার্টে ময়লা ছিল, প্রথমে হাত দিয়ে ঝাড়লে ও যায়নি সেজন্য খুঁটে দেখছিলাম। ”

প্রণয় দমে যায়, অযথা রা গ দেখিয়েছে ভেবে অনুশোচনা হয়। ক্ষীণ স্বরে শোধায়,

” সরি। ”

সূচনা মাথা নাড়ায়, প্রণয় ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,

” ময়লা গেল? শার্টের আর কি । ”

সূচনা মাথা উঁচিয়ে প্রণয়ের কাঁধের দিকে তাকায়। এখনো একটুখানি ময়লা রয়ে গেছে দেখে ফের হাত দিয়ে ঝেড়ে দেয়। প্রণয় অধর বাঁকিয়ে হাসে, মুখে কথা বলবে না আবার কথা শোনা হচ্ছে!

সূচনার জন্য দুইটা স্টুডেন্ট পেয়েছে প্রণয়। একটা ছেলে একটা মেয়ে, একই বাসায়, দুজন একই বিল্ডিং এ থাকে। সূচনা পড়াতে গেলে দুজন একই সময়ে একসাথে পড়িয়ে আসবে যেহেতু দুজনই একই ক্লাসের। অন্তিম আর তিথি, দুজনই ক্লাস সেভেনে পড়ছে। সূচনা দু-জনের সাথে পরিচিত হয়েছে, তাদের মায়েদের সাথে ও পরিচিত হয়েছে। আগামী কাল থেকে পড়াতে আসবে। তাদের সাথে পরিচিত হয়ে কথাবার্তা শেষ করে সেখান থেকে বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা নামেবে নামবে সময়। বিকেলের শেষ ভাগে টঙের দোকান হতে দুই কাপ চা পান করে সূচনাকে নিয়ে রিকশায় চেপে ফের রওনা হয় হোস্টেলের উদ্দেশ্যে। ঢাকা শহরের ব্যস্ততম রাস্তা এই সময়টায় একটু খানি নিশ্চুপ, নীরব থাকে, কোলাহল আছে তবে পরিমাণে একটু কম। যার যার মতো করে নিজ গন্তব্য রওনা হয়েছে মানুষ। এখানে কারো কারোর দিকে তাকানোর সময় ই নেই যেন। সূচনা উৎসুক দৃষ্টি তে সবকিছু তাকিয়ে দেখছিল। প্রণয় তখন আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিল তাকে। বিয়ের একদিন আগে ও তার এই মেয়ের ওপর রা গ উঠছিল এই ভেবে যে, মেয়ে টা বিয়েতে রাজি হলো কেন! অথচ আজকে মনে হচ্ছে রাজি না হলে এই মেয়ে হাতছাড়া হয়ে যেত। কিন্তু এই মেয়ে তো হাত ছাড়া হওয়ার মতো না, তুলে নিয়ে এসে বিয়ে করার মতন। সূচনা প্রণয়ের দিকে দৃষ্টি রাখলে দেখলো প্রণয়ের দৃষ্টি আগে থেকে তার ওপরই নিবদ্ধ। কিন্তু অন্য সময়ের থেকে কিছু টা অন্য রকম সেই চাহনি। তার অস্বস্তি হলো। ইতিউতি করে জিজ্ঞেস করলো,

” তাকিয়ে আছেন কেন? ”

প্রণয়ের টনক নড়ে ওঠে, ঘোর ভেঙে যায়, তৎক্ষনাৎ ই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলে,

” তাকিয়ে ছিলাম না। ”

সূচনা আপত্তি করলো, বললো,

” মিথ্যা কথা, আমি দেখলাম তো। এত অবুঝ ও না। ”

” তাহলে তো তাকিয়ে আছি কেন তা বুঝে যাওয়ার কথা। ”

সূচনার কথার পৃষ্ঠে বিড়বিড় করলো প্রণয়। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সূচনা প্রণয়ের কানের কাছে এসে মৃদু স্বরে বললো,

” বুঝি বুঝি, এত সুন্দর মেয়ে পাশে বসা থাকলে অমন প্রেমময়ী দৃষ্টি তে তো তাকাবেই। ”

প্রণয় ফট করে ই তাকালো সূচনার দিকে, সূচনা এক ভ্রু উঁচু করে ফের জিজ্ঞেস করলো,

” কী ঘটনা সত্যি না? ”

প্রণয় জবাব না দিয়ে সূচনার বলার ভঙ্গিমায় স্ব শব্দে হেসে দিল। তার পাশাপাশি সূচনা ও হাসছে। অপরাহ্নের শেষ প্রহরে রিকশায় চড়ে এক জোড়া কপোত-কপোতী যেন উল্লাসে মেতেছে। লোকে দেখে ভাববে তারা প্রেমিক প্রেমিকা। অথচ তারা একে অপরের প্রণয়ের ডোরে বাঁধা পরেছে।

#চলবে

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৯

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৯
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
_________________________________
সূচনাদের সাথে আরেকটা মেয়ে থাকে, মেয়েটার নাম সিন্থিয়া। সিন্থিয়ার বাবা মা ঢাকাতেই থাকেন কিন্তু কিছু সংগত কারণে সে নিজের বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে উঠেছে। প্রথম কথোপকথনের পর সূচনার কাছে মেয়েটাকে তেমন ভালো লাগলো না। আড়ালে ইরাকে ও বললো মনের কথা, অতঃপর বুঝতে পারলো দুইজনের মত আসলে একই। পরের দিন সকাল থেকে দুইজন মিলে নিজেদের জিনিসপত্র আস্তে আস্তে বের করে যেখানে যা রাখার গুছিয়ে রাখে। তাদের ক্লাস শুরু হতে এখনো দুই দিন বাকি। হোস্টেলের পরিবেশ, খাবার, মানুষ জন সবকিছু ই অন্য রকম। মানিয়ে নিতে যে একটু কষ্ট হবে বুঝতে বাকি রইলো না কারোরই। দুজনেই একটু পরপর একে অপরের দিকে করুন দৃষ্টি তে তাকাচ্ছে। কোথায় আসলো!

সেদিন বিকেলে বাসায় যাওয়ার পূর্বে প্রণয় আসলো তাদের সাথে দেখা করতে। দুজনকে নিয়ে মার্কেটের উদ্দেশ্য বের হলো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে কি-না! সন্ধ্যার দিকে আবার আগের দিনের মতোই দুজনকে নামিয়ে দিয়ে গেল। গতদিনের মতো আজকে ও ইরা আগে আগে ভেতরে চলে গেল। বাকি রইলো সূচনা, প্রণয় রিকশা ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে সূচনার উদ্দেশ্যে বললো,

” ক্লাস শুরু হতে আরও একদিন বাকি, এখনই এত চাপ নেয়ার প্রয়োজন নেই। এখন ঠিকঠাক মতো খাও, ঘুমাও, বিশ্রাম নাও। ইরা কে ও তাই করতে বলো। আর কিছু প্রয়োজন হলে তো আমি আছিই। ”

ধরনীতে তখন সন্ধ্যা নেমেছে, হোস্টেলের মেইন গেটের বাতিটা আজ জ্বালানো হয়নি বিধায় কেমন অন্ধকারে ঢেকে আছে। অন্ধকারের গাম্ভীর্যের ভাব হাতড়ে সূচনা চেষ্টা করলো প্রণয়কে স্পষ্ট ভাবে দেখতে। লাভ তেমন হলো না, তন্মধ্যে ছেলেটা হেলমেট পরিহিত। সূচনা মুখ ভার করে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ায় আর ছোট্ট করে বলে,

” আপনি ও নিজের খেয়াল রাখবেন। ”

প্রণয় স্মিত হাসে, সে হাসি অবশ্য সূচনা দেখতে পায় না। সূচনার থেকে বিদায় নিয়ে প্রণয় বাইকে উঠে বসে। হাত নাড়িয়ে বলে,

” যাও। ”

বলার সাথে সাথে ই সূচনা ঘুরে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়৷


এরপর দেখতে দেখতেই সপ্তাহ খানেক কে টে যায়। সূচনাদের ক্লাস শুরু হয়েছে ছয়দিন ধরে। আজ শুক্রবার আগামী দিন শনিবার বন্ধ দিয়ে রবিবার ভার্সিটির নবীন বরণ। প্রথমে সূচনা যেতে চাচ্ছিল না। না যাওয়ার বাহানা খুঁজছিল। কিন্তু ইরা মেয়েটা এক প্রকার জেদ ধরেছে, একা একা কেন যাবে! এমনিতে ই তো ভার্সিটির কাউকে তেমনভাবে এখনো চেনেনা
তন্মধ্যে সূচনা ও যদি না যায়! বাধ্য হয়ে সূচনা রাজি হয়েছে। শুক্রবার হওয়ায় ঘুম থেকে একটু দেরিতেই উঠেছে দুইজন। হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে সূচনা কিছুক্ষণ বই নিয়ে অযথাই নাড়াচাড়া করে। পাশের বেডে বসে নবীন বরণে কী পরবে, কখন যাবে নিয়ে বকবক করছে ইরা। সূচনার সেদিকে খেয়াল নেই তেমন। ইরা যখন অন্যমনস্ক সূচনাকে লক্ষ্য করে তখন নিজের কথা বন্ধ করে দেয়। ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,

” ভাবী তোমার কী মন খারাপ? ”

প্রথম বারে সূচনা শোনেনা, ইরা ফের জিজ্ঞেস করে, প্রথম বারের তুলনায় এবার একটু উচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করতেই সূচনা হকচকিয়ে তার দিকে তাকায়। প্রশ্নের পরিবর্তে পাল্টা প্রশ্ন করে,

” নবীন বরণে কী পরে যাবে ঠিক করেছো? ”

ইরা আর সেই প্রসঙ্গ উঠায় না। কয়েক মুহূর্ত সূচনার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বলে,

” শাড়ী পরব বলে ঠিক করেছি। ”

সূচনা ও প্রত্যুত্তরে স্মিত হাসে, সম্মতি দিয়ে বলে,

” ঠিক আছে তাহলে। ”


দুপুরে খাওয়ার পর সূচনা ভাত ঘুম দেয়ার উদ্দেশ্যে বিছানায় পিঠ ঠেকাতে নিলেই পাশের বিছানা হতে ইরা এক লাফে তার কাছে আসে। হড়বড়িয়ে বলে,

” তুমি এখন ঘুমাচ্ছো কেন! বিকেলে বের হতে হবে। ”

সূচনা ইরার এমন লাফিয়ে তার কাছে আসার দরুন তাজ্জব বনে তাকিয়েছিল। বিকেলে বের হওয়ার কথা শুনে বিস্ময় ভাব কা টি য়ে জিজ্ঞেস করে,

” কোথায় যাবে? ”

” যখন যাবে তখন দেখো, এখন যাও তৈরি হও। শাড়ী পরবে। ”

সূচনা কয়েক মুহূর্ত বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা পাগল হলো!


বিকেলে তৈরি হয়ে ইরা হোস্টেল থেকে বের হয়। নিচে নামতেই দেখা যায় বাইক নিয়ে প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে। ইরা সূচনাকে নিয়ে এগিয়ে যায় প্রণয়ের দিকে। সূচনাকে প্রণয়ের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,

” আমি যাই তাহলে, সময়মতো পোঁছে দিয়ে যেও। ”

প্রণয় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাতেই ইরা সেই স্থান ত্যাগ করে। সূচনা এই অব্দি কিছু না বুঝলেও এখন সব ই বুঝতে পারে। দুই ভাই বোনের তাহলে এই পরিকল্পনা ছিল! এজন্য ই ইরাকে বারবার জিজ্ঞেস করার পরে ও মেয়েটা মুখ খোলেনি। পাঁ জি মেয়ে।

” সারা বিকেল এখানেই কা টা নো র ইচ্ছে আছে! ”

প্রণয়ের গম্ভীর কণ্ঠে করা উক্তি তে সূচনার ভাবনার সুতোয় টা ন পড়ে। প্রণয় বাইকে উঠে পড়েছে আগেই, সূচনা ইতস্তত করতে করতে এক হাত প্রণয়ের কাঁধে রেখে বাইকে উঠে বসে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। প্রণয় বাইক চালু দিতে দিতে বলে,

” এখানকার রাস্তা কিন্তু বেশ একটা ভালো না। কখন, কোথায় ভাঙা রাস্তা পড়ে, ব্রেক করলাম আর পেছনে তাকিয়ে দেখলাম তুমি নেই। এর দায়ভার কিন্তু আমার না। ”

সূচনা বেশ বুঝতে পারে কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে ফেলেছে দেখেই যে প্রণয় তাকে এই কথা গুলো বলছে। সে পুনরায় নিজের ডান হাতটা প্রণয়ের কাঁধে রাখে। তারপর যেয়ে দুজন রওনা হয় গন্তব্যে।

প্রায় বিশ মিনিটের পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছল। কোলাহল পূর্ণ শহর অথচ এখানটায় তেমন কোলাহল নেই। খোলা আকাশ, এক পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদী, দুই পাশে ভর্তি বড় বড় গাছ। বসার জন্য দু চারটা কাঠের বেঞ্চ ও আছে। আশেপাশে আরও মানুষ দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগ ই জুটি অর্থাৎ স্বামী স্ত্রী হবে এমন। সূচনার জায়গাটা ভীষণ পছন্দ হলো। নিজের গ্রাম থেকে আসার পর এমন কোলাহল মুক্ত পরিবেশে মুক্ত ভাবে শ্বাস নেয়া হয়নি, খোলা আকাশ দেখা হয়নি। তার ভীষণ ভালো লাগলো, মন খারাপ, মনের অশান্তি, দুশ্চিন্তা নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে যেন। সূচনা উচ্ছ্বসিত নয়নে তাকিয়ে চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। হুট করে তার চোখ গেল একটা গাছের মধ্যে। এটা কাঠগোলাপ গাছ না! তাদের বাড়ির ওখানে ও তো আছে! কত ফুল কুড়িয়ে আনত! তার পছন্দের ফুলের মধ্যে একটা এটা। গাছের নিচে ফুল পড়ে থাকতে দেখে তার এখনো ও ইচ্ছে করলো একটা দৌড় দিয়ে যেয়ে সব ফুল কুড়িয়ে নিয়ে আসতে৷ কিন্তু ইচ্ছে টাকে ইচ্ছে পর্যন্ত ই সীমাবদ্ধ রাখলো।
সেখানে প্রায় ঘন্টা খানেকের মতো থেকে প্রণয় তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায়। খাওয়া দাওয়া শেষে ইরার জন্য ও কিছু খাবার নিয়ে আসে। প্রণয় সময় মতোই সূচনাকে হোস্টেলে পোঁছে দেয়। বাইক থেকে নামিয়ে দিয়ে প্রনয় তাকে যেতে বললে ও সূচনা যায় না। তার হাবভাব দেখেই প্রণয় বুঝতে পারে মেয়েটা হয়তো কিছু বলতে চায়। প্রণয় তাই সহজ গলায় বলে,

” কী বলবে নির্দ্বিধায় বলে ফেল। ”

সূচনা একটু অবাক হয়, নির্দ্বিধায় বলতে বললেও দ্বিধা কা টি য়ে উঠতে পারে না। ইতস্তত করে বলে,

” আমাকে দুইটা টিউশনি জোগাড় করে দিতে পারবেন? গ্রামে তো অনেক ছিল, আমি টিউশনির টাকা দিয়েই নিজের অর্ধেক খরচ চালাতাম। এখন ভার্সিটি শেষে ও আমার হাতে সময় থাকে। খালি বসে না থেকে যদি টিউশনি করি তো….

” ভেতরে যাও। ”

সূচনা নিজের কথা পুরো শেষ করার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রণয় এই কথা বলে। সূচনা ফের কিছু বলতে নিলে প্রণয় আবারও একই কথা বলে,

” ভেতরে যাও, পরে কথা হবে। ”

এবার খানিক জোরেই বলে প্রণয়, সূচনা আর কিছু বলতে না পেরে চলে আসে সেখান থেকে। প্রণয় আর দেরি না করে সেখান থেকে চলে যায়। সূচনার মনঃক্ষুণ্ন হয়, পুরো কথা শুনলো না, কিছু বললো ও না! বিকেলের ভালো মন টা নিমিষেই খারাপ হয়ে যায়। রুমে ফিরে এসে খাবারের ব্যাগটা ইরার হাতে ধরিয়ে দেয়। রেগে মেগে হাত থেকে একের পর এক চুড়ি গুলো খুলতে থাকে। তার খোঁপা করা চুলগুলো তন্মধ্যে খুলে পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। তখনই খেয়াল করে মেঝেতে একটা শুভ্র রঙা ফুল। সূচনা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে মেঝে থেকে ফুলটা হাতে নেয়। চিনতে তেমন অসুবিধা হয় না যে এটা কাঠগোলাপ। তার ভ্রু দ্বয়ের মাঝে ভাঁজ পড়ে। এই ফুল কোথা থেকে আসলো? তার খোঁপায় কী করে? উত্তর খুঁজতে গেলে মনে হয় প্রণয় ই দিয়েছে তাহলে? কীভাবে বুঝতে পারলো তার মনের কথা? ছেলেটা কী মানুষের মন পড়তে জানে? আশ্চর্য!

# চলবে

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৮

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৮
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
_______________________________
হাত-মুখ ধুয়ে এসে সূচনাকে রুমে পায়না প্রণয়। মুখ মুছতে মুছতে সে ঘর থেকে বের হয়। পানি পান করার উদ্দেশ্যে খাবার ঘরে যায় সে৷ সেখানে গেলেই দেখা মেলে সূচনার। সূচনা মেঝেতে মাদুর পেতে খাবার নিয়ে বসে আছে। প্রণয় ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে,

” এত আয়োজন কার জন্য? ”

সূচনা সহজ গলায় জবাব দিল,

” আপনার জন্য ই হবে, আর কার জন্য হবে! ”

প্রণয় ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করলো, জিজ্ঞেস করলো,

” আমার প্রতি এত যত্নশীল কবে হলে? ”

সূচনা এবারও স্বাভাবিক স্বরে ই জবাব দিল,

” যেই মুহূর্ত থেকে আপনি আমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। ”

” আমি কবে থেকে ভাবতে শুরু করলাম তোমাকে নিয়ে! ”

সূচনা জবাব দেয়ার জন্য মুখ খুলতে নিলেও চুপ হয়ে গেল। প্রণয়ের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। প্লেটে ভাত বাড়তে থাকে, তাড়া দিয়ে বলে,

” তাড়াতাড়ি আসুন নাহয় ঠান্ডা হয়ে যাবে। ”

প্রণয় এগিয়ে যায়, আসন পেতে বসে মাদুরে তারপর জিজ্ঞেস করে,

” ইরা শুয়ে পড়েছে? ”

সূচনা ভাত সমেত প্লেট এগিয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো,

” হ্যাঁ শুয়ে পড়েছে। ডাল আর তরকারি গরম করে দিয়েছি, তরকারি কম আছে তাই ডিম ভাজি করে দিয়েছি। চলবে? ”

” দৌড়াবে, এমনিতেই ক্ষুধা পেয়েছে এখন যতটুকু পাব ততটুকুই চলবে। ”

” আপনি যে আসবেন ইরা জানতো? ”

” না ও জানতো না, আমি পোঁছে ওকে ফোন করেছিলাম সদর দরজা খুলে দেয়ার জন্য। ”

” জানিয়ে আসলে কী হত? ”

” যে চ ম ক টা পেয়েছো তা পেতে না। ”

সূচনার দিকে তাকিয়ে বলে প্রণয়, সূচনা মুখ ভেংচি কেটে অন্য দিকে তাকায়, আর কিছু বলে না। মনে মনে অবশ্য এটাই ভাবে, যদি তাকে জানিয়ে আসতো তাহলে মধ্যরাতে এভাবে চমক টা সে পেত না। অভাবনীয় ব্যাপার হুটহাট ঘটে গেলেই মজা পাওয়া যায়। স্বাভাবিক নিয়মে ঘটলে সেই মজা পাওয়া যায় না।
খাওয়ার সময় আর দুজনের মধ্যে তেমন কথা হলো না। প্রণয়ের খাওয়া শেষ হলে সবকিছু গুছিয়ে রেখে দুজন একসাথে ই ঘরে আসতে নিয়েছিল৷ এর মধ্যে ই হুট করে সূচনার কিছু মনে হলো। পিছনে ফিরে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো,

” চা খাবেন? ”

প্রণয় ফোনে কিছু একটাা করতে করতে আসছিল সূচনার পেছন পেছন ই৷ তার প্রশ্ন শুনে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়িয়ে বলে,

” হ্যাঁ খাওয়া যায়। ”

” আপনি যান আমি নিয়ে আসি৷ ”


প্রণয় ঘরে যায়নি, পুরো সময় রান্না ঘরেই বসে থাকে। অবশ্য রান্নাঘরে বসে থাকলেও তার সম্পূর্ণ মনোযোগ ফোনের মধ্যে ই থাকে৷ সূচনা চা বানিয়ে দুই টা কাপের মধ্যে নেয়। একটা নিজের জন্য নিয়ে প্রণয়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় আরেকটা। প্রণয় হাতে নিয়ে ই চায়ে চুমুক বসায়, কিছু বলে না। সূচনা কোনো মন্তব্যের আশা করছিল কিন্তু ছেলেটা চা নিয়ে কোনো মন্তব্য করে না। সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করে,

” দস্যি রাণীর রা গ কী কমেছে? ”

সূচনা প্রথমে একটু অবাক হয় সম্বোধনে, অন্যরকম লাগে তার কাছে। ইতস্তত করে বলে,

” হ্য.. হ্যাঁ হয়তো। ”

” মানে কমেনি! ”

সূচনা কিছু বলে না, প্রণয় মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বলে,

” চলো। ”

সূচনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

” কোথায় যাব? ”

” তোমাকে বেচেঁ দিব। ”

প্রণয় মুখ বাঁকিয়ে এই কথা বলতেই সূচনা ও হেয়ো স্বরে বলে,

” দিন, সমস্যা নেই কিন্তু আমায় বেঁচতে গেলে আপনার বিশেষ কোনো লাভ হবেনা। ”

” হবেনা কেন! ”

” মানুষ কী টাকা দিয়ে আরেকজনের ব্যবহৃত জিনিস কিনবে? অবশ্যই কিনতে চাইবেনা। ”

” তুমি ব্যবহৃত? “কবে কীভাবে ব্যবহার করলাম? ”

সূচনার সাদা মনে বলা কথার পৃষ্ঠে ডান ভ্রু উঁচু করে প্রশ্ন দুইটা করে প্রণয়। সূচনা প্রথমে বুঝতে পারেনা তাই প্রণয়কে বোঝানোর জন্য বলে,

” আরে আমি বিবাহিতা এখন তো..

” তো! ছুঁয়ে তো দেখিনি এখনো সুতরাং ভালো লাভ হবে আমার। চলো। ”

সূচনা চুপসে যায়, তার ভারি লজ্জা লাগে। মনে মনে খানিক ব ক তে ইচ্ছে করে, ছেলেটা এমন করলো কেন!

প্রণয়ের কথা মত তার সাথে আসে সূচনা, প্রণয় বাড়ির সদর দরজা খুলে সিড়ির মধ্যে এসে বসে। সূচনা বসে না প্রথমে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রণয় ফের ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

” তাকিয়ে আছো কেন? বসো! ”

সূচনা প্রণয়ের পাশেই বসে, জিজ্ঞেস করে,

” তোমার পছন্দের রঙ কী? ”

” সবুজ। ”

” পছন্দের ফুল কী? ”

” কাঠগোলাপ। ”

” পছন্দের খাবার? ”

” তেমন করে পছন্দ নেই কোনো। ”

” আচ্ছা। ”

প্রণয় আরও কিছু প্রশ্ন করতো, কিন্তু করলো না। একদিনে সব জানার কী দরকার! হারিয়ে তো যাচ্ছে না। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ করে সেখানেই, ঝগড়া ছাড়াও তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কিছু কথোপকথন হয়। সবশেষে দুজনেই অনুধাবন করে তাদের দুজনের ই আসলে সময় দরকার, নিজেদের জানতে, বুঝতে।
রাতে ঘুমানোর সময়ও প্রথম দিনের মতো ঝগড়া হয় না৷ খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রণয় মাঝে একটা কোল বালিশ রেখে শুয়ে পড়ে। সূচনা প্রথম উসখুস করছিল তা দেখে প্রণয় মৃদুস্বরে বলে,

” দস্যি রানী এখন আবার উসখুস করছে, ঘুমাও। খেয়ে ফেলবনা তোমাকে। ”

সূচনা চোখ মুখ কুঁচকে প্রণয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে একপাশে যেয়ে শুয়ে পড়ে। মাঝে কোলবালিশ থাকা স্বত্তেও সে একেবারে খাটের শেষ প্রান্তে যেয়ে শুয়ে আছে। প্রণয় সাবধানী কণ্ঠে বলে,

” আরেকটু এদিকে এসো নাহয় পড়ে যাবে। ”

সূচনা শোনে না, কাছে আসার পরিবর্তে আরও দূরে সরতে গেলে খাট থেকে পড়ে যেতে নেয়। প্রণয় তড়িঘড়ি করে তার বাম বাহু চেপে ধরে নিজের দিকে টে নে নিয়ে আসে। সূচনার চোখ জোড়া স্থির হয় প্রণয়ের চোখ জোড়ায়। আকস্মিক ঘটনায় সূচনা হতভম্ব হয়, পড়ে গেলে মাথা ফা ট তো নিশ্চিত! প্রণয় ধ ম কের স্বরে বলে,

” মেয়ে মানুষ বোঝে বেশি। ”

সূচনা চোখ জোড়া নামিয়ে নেয়, মুখ চুপসে যায়। প্রণয় তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের অবস্থানে ফিরে।


তার পর আরও দুইদিন কে টে যায়। সূচনা ও ইরা আগামীকাল ঢাকা চলে যাবে। প্রণয়ই নিয়ে যাবে দুজনকে। সূচনার মন খারাপ ভীষণ, এর আগে মা কে ছেড়ে কোনোদিন ও এত দূরে যাওয়া হয়নি। গত কালকে দিশা বেগমের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সে। মেয়ে মন খারাপ করে থাকলেও দিশা বেগম যথেষ্ট শক্ত ছিলেন। হাসিমুখে কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় দিয়েছেন। সূচনা ও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। সূচনা যে হোস্টেলে থাকবে তাতে প্রণয়ের আপত্তি না থাকলেও সূচনার চিন্তা অন্য জায়গায়। অবশ্য এই চিন্তা সূচনার মাথায় নিজ থেকে ই আসেনি। দিশা বেগম ই বলেছেন, গত কাল সূচনা বাসায় যাওয়ার পর দিশা বেগম উৎকণ্ঠা নিয়ে বলছিলেন,

” শোন মা, বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়টা দিন। এর মধ্যে তুই থাকবি হোস্টেলে, জামাই থাকবে তার বাড়িতে। মানে তোদের বিয়েটা হলো যেই পরিস্থিতি তে! তার মধ্যে বিয়ের পরপরই দুজন আলাদা থাকবি! ”

সূচনা তখন পাত্তা না দিলেও পরবর্তী তে সে ও বিষয়টা নিয়ে ভাবে। ভাবতে না চাইলেও বারবার মাথায় এসেই পড়ে। প্রথমত তাদের দুজনের ই আগে নিজেদের জানতে হবে, বুঝতে হবে। আর তার জন্য একসাথে থাকাটা জরুরি না!


পরের সকালে সবার থেকে বিদায় নিয়ে সূচনা আর ইরাকে নিয়ে প্রণয় রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় পোঁছাতে পোঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়। দুইজনকে হোস্টেলে রেখে প্রণয় নিজের বাসায় যায়। একটা ফ্লাটের মধ্যে চারজন মিলে থাকে তারা। সূচনা ও ইরা হোস্টেলে ফিরেই একে একে গোসল করে নেয়। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে প্রণয় আবার যায় হোস্টেলে। দুপুরে খাওয়া হয়নি কারোর ই, দুজনকে নিয়ে আবার বাইরে বের হয় সে। ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল হয়, ইরা রিকশা থেকে নেমে আগেই ভেতরে ঢুকে পড়ে। সূচনা রিকশা থেকে নামতে নামতে প্রণয় বাইক থেকে নেমে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিকশা ভাড়া চুকিয়ে দেয়, সূচনা ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে প্রণয়ের সামনে দাঁড়িয়েছে। প্রণয় ফোন সমেত হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। সূচনা প্রথমে খেয়াল করে না দেখে প্রণয় ই বলে,

” তোমার ফোন। নিয়ে যাব সাথে? ”

সূচনার খেয়াল হয়, মনে পড়ে খাওয়ার সময় তার ফোনটা প্রণয়কে দিয়েছিল রাখতে। সূচনা হাত বাড়িয়ে ফোন নিতে গেলে প্রণয় হাত ধরে ফেলে। মিষ্টি, কোমল সুর বলে,

” নিজের খেয়াল রেখো, কিছু লাগলে আমাকে জানাবে আগে। ইরাকে ও দেখে রেখো, সম বয়সী পরে তার আগে তুমি তার ভাবী। সেদিকে লক্ষ্য রেখো। আম্মাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না আমি আছি। ”

সূচনা এক ধ্যানে শুনে যায়, ঘোর গ্রস্তের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে ‘ হু ‘ বলে। প্রণয় হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

” আসি তাহলে! ”

সূচনা আগের ন্যায়ই ঘাড় নাড়ায়, প্রণয় বাইকে উঠে বাইল স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। সূচনা তাকিয়ে থাকে যতক্ষন অব্দি দেখা যায়। তার হুট করে কেমন যেন নিজেকে ফাঁকা ফাঁকা লাগে, বুক ভার হয়ে আসে। কিন্তু কেন!

#চলবে

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৭

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৭
#নাজিয়া_শিফা ( লেখনীতে )
______________________________
রাতে খাবার টেবিলে ইরা ভার্সিটির প্রসঙ্গে কথা বললো। সাথে নিজের পরিকল্পনার কথা ও এহতেশাম সাহেবকে জানালো। এহতেশাম সাহেব খুশিই হলেন, মেয়ের পরিকল্পনা তার পছন্দ হয়েছে। এই সুবাদে ওনার দুই মেয়েই একসাথে থাকবে আর বেশি দিনের কথা ও না৷ উনি বললেন আগামীকাল ঢাকা যেয়ে হোস্টেল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আসবেন। সূচনার চিন্তা কিছু সময়ের জন্য পিছু ছাড়লো৷ রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ফ্রেশ হয়ে ইরার রুমে গেলে ইরা হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো,

” ভাবি, ভাইয়া কথা বলবে ধরো। ”

ফোন হাতে ধরিয়ে দিয়ে আর রুমে দাঁড়ালো না, বাইরে বেরিয়ে গেল। ভাই ভাবি কথা বলবে এর মধ্যে থাকাটা শোভা পায় না৷ এই জ্ঞান মেয়েটার আছে অবশ্যই। সূচনা ফোন হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড থম মে রে রইলো। ওপাশ থেকে প্রণয়ের আওয়াজ শুনলে তার ঘোর কা ট লো। যত রা গ ই থাকুক প্রথমে প্রকাশ না করেই সে বিনয়ী ভঙ্গিতে সালাম দিলে প্রণয় সালামের জবাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” কেমন আছো? ”

সূচনা পূর্বের ন্যায় জবাব দিল,

” এই তো আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো আছি। ”

পাল্টা প্রশ্ন করলো না প্রণয় কে। প্রণয় সেদিকে পাত্তা না দিয়ে টুকটাক কথা বলে গেল। মেয়েটা হু হা শব্দ করে গেল শুধু। প্রণয় না পেরে সেদিনের প্রসঙ্গ তুললো। জিজ্ঞেস করলো,

” আমি ঢাকা এসেছি দুইদিন হয়ে গেল অথচ তুমি একদিন খোঁজ ও নিলে না! ”

” খোঁজ নেয়ার রাস্তাটা ছেড়ে যাননি। ”

” ইরার ফোন দিয়ে করতে! ”

” ইরা যখন জিজ্ঞেস করতো আমার ফোনের কথা তখন কী বলতাম! তোমার ভাই ভেঙে ফেলেছে! ”

প্রণয় থতমত খায়, সে এমনিতেই অনুতপ্ত হচ্ছিল ফোনটা ভেঙে ফেলায়। সেদিন কেন যে তার মাথা এত গরম হয়ে গিয়েছিল! ভাবলে ই রা গ লাগছে এখন। প্রসঙ্গ দ্রুত পরিবর্তন করে সে। ঠাট্টার ছলে বলে,

” এভাবে ঢাকায় যদি পড়ে থাকি তাহলে দেখা যাবে তোমার বরকে নিয়ে অন্য মহিলা পালিয়ে গেছে। তখন কী করবে! ”

” ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখলে সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটে না। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা নেই, বিয়েটা স্বাভাবিক না তাই তৃতীয় ব্যক্তির কথা আসছে। ”

সূচনা সহজ গলায় কথা বললেও প্রণয়ের কাছে ভালো লাগলো না। সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,

” এখনো রা গ করে আছো! সেদিন মাথা গরম ছিল কী থেকে কী বলে ফেলেছি বুঝিনি তখন। পরে বোঝার পর মনে হলো এখন তোমার সাথে থাকলে এর চেয়ে খারাপ আচরণ করে ফেলতে পারি। সেজন্য পরের দিন ই কাজের বাহানা দিয়ে ঢাকা চলে এসেছি। ”

সূচনা চুপচাপ শুনলো কিছু বললো না, তার নীরবতা দেখে প্রণয় ফের বললো,

” রা গ করে না বউ। ”

এহেন বাক্যে, প্রণয়ের গলার স্বরে মেয়েটার কী যেন হয়ে গেল। কেমন অন্য রকম কিছু অনুভূত হলো। দুইদিন আগে তো সহ্য করতে পারতনা আর দুইদিনে পরিবর্তন! মেয়েটা ভাষা হারিয়ে ফেলে যেন। কিছু বলতে গেলেও শব্দেরা কণ্ঠনালি হতে নিঃসৃত হতে চায়না। প্রণয় উত্তরের আশা করে না আর, পরে ফোন দিবে বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে৷ সূচনা তবুও কয়েক সেকেন্ড কানে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।


পরের সকালে এহতেশাম সাহেব যান ঢাকায়, হোস্টেলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আসেন। ওনারা বলেন পরে জানাবেন। এহতেশাম সাহেব ঢাকা থেকে বাড়িতে ফেরেন সন্ধ্যার পরে। ফিরে এসে সূচনার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দেন। বলেন যে প্রণয় দিয়েছে। সূচনার ভারি লজ্জা লাগে, ছেলের কান্ড জ্ঞান নেই নাকি! বাবার কাছে কীসের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েছে! সূচনা নত দৃষ্টিতে মাথা এলিয়ে এহতেশাম সাহেবের কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঘরে যায়। খুলে দেখে না, টেবিলের ওপর রেখে দেয়। রাতে খাবার শেষ করে সব কাজ সেরে সূচনা ঘরে আসে। হাত মুখ ধুয়ে মুছে সে ব্যাগটা নিয়ে বসে। ব্যাগ খুলে দেখে একটা নতুন ফোন৷ নিজে ফোন ভেঙে নিজেই কিনে দিচ্ছে! শুধু ফোন না ফোনের বক্সের মধ্যে একটা ছোট চিরকুট ও পাওয়া যায়৷ সূচনা চিরকুট টা খুলে ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে শব্দ করে চিরকুটের লেখাটা পড়ে,

” রা গ করে না বউ, রা গ টা কমাও। এই ছেলেটার ধৈর্য কম, মাথা সবসময় গরম থাকে। মাথা গরম থাকলে কী থেকে কী বলে নিজেও বোঝেনা৷ সেজন্য বাবা বাউণ্ডুলে নাম দিয়েছে বহু আগে। তুমি বেয়াদব ছেলে বানিয়েছো। তন্মধ্যে তোমার ও যদি এত রা গ থাকে সংসার কে সামলাবে? সময় দাও আমায় একটু ঠিক করে নিই নিজেকে! ”

সূচনা কয়েকবার চিরকুটের লেখাগুলো পড়ে আর প্রতিবার ই বউ শব্দ টায় এসে আঁটকে যায়। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দ তে মনোযোগ ক্ষুণ্ন হয়। তার ফোনটাই বাজছে। দুইবার তিনবার রিং হওয়ার পর সূচনা ফোন রিসিভ করলো। রিসিভ করে কানে তুললো, প্রণয় ঈষৎ ধমকের স্বরে বললো,

” ফোন হাতে পেয়ে সাথে সাথে ফোন দিলে না কেন! ”

সূচনা ধমকে খানিক চমকে ওঠে, পরমুহূর্তে গলা উঁচিয়ে বলে,

” আবার ধমকাচ্ছেন! ”

প্রণয় দমে যায়, ইতিউতি করে বলে,

” ঐ আর কি, কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম তুমি ফোন দিবে৷ দাও নি সেজন্য। ”

” আমি ফোন দিব তা ভাবলেন কেন! ”

” কেন দিতে না? ”

” অবশ্যই না। ”

মুখের ওপর না করে দেয়ায় প্রণয় খানিক অপমানিত বোধ করে। মেয়ের সাহস কত! মুখের ওপর না করে!
মেকি হেসে বলে,

” তুমি না দিলেও আমি অবশ্যই দিতাম। ”

” যদি রিসিভ না করতাম? ”

” সারারাত দিতাম! না উঠিয়ে যাবে কোথায়! ”

” ফোন বন্ধ করে রাখলে! ”

” ইরাকে দিতাম। ওকে বিরক্ত করতাম৷ তুমি নিশ্চয়ই তোমার জন্য ইরাকে বিরক্ত হতে দিতে না। ফোন রিসিভ করতেই। ”

প্রণয়ের ফটাফট জবাব, সূচনা খানিক অবাক হলো৷ প্রথম দিনের প্রণয়ের সাথে এই প্রণয়ের মিল পেল সে। অথচ সেদিন রাতের প্রণয় যেন অন্য কেউ ছিল। সূচনার ভালো লাগে, যাক সোজা মুখে কথা তো বলছে৷ সেরাতে তাদের মধ্যে প্রায় আধ ঘন্টার মতো সময় কথা হয়। স্বাভাবিক কিছু কথা ই হয়। প্রণয় বিয়ের প্রসঙ্গ তোলে না তাই সূচনাও কিছু বলে না। দিন দুই পরে হোস্টেল কর্তৃপক্ষের থেকে কল আসে। ওনারা জানান একটা সিট খালি করে দেয়া হয়েছে। ঐ রুমে যে ছিল তাকে অন্য রুমে দিয়ে দেয়া হয়েছে। সূচনার চিন্তা যেন আরেকটু কমে। অবশ্য তার একটু খারাপ ও লাগে তার জন্য অন্য একজনের জায়গা বদল করতে হয়েছে ভেবে৷ ক্লাস যেহেতু সপ্তাহ খানেকের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে তাই এহতেশাম সাহেব বললেন,

” যা যা লাগবে গোছাতে থাকো, দুইদিন আগেই চলে যাবে৷ ওখানে যেয়ে আগে ভাগেই সব গুছিয়ে নিবে। ”

সূচনা আর ইরা তাই করলো পরের দিন থেকেই টুকটাক করে সবকিছু গোছাতে লাগলো। সেদিন আর প্রণয়ের সাথে যোগাযোগ হয়নি মেয়েটার৷ ফোন করে হোস্টেলে সিট পাওয়ার কথা বলবে বলবে করে ও সময় করে উঠতে পারেনি কাজের ব্যস্ততায়। অতঃপর ক্লান্ত শরীরটা রাতে ঘরে যেয়ে বিছানায় এলিয়ে দিতে ই রাজ্যের ঘুম চোখে ধরা দিল। ফোন আর করা হলো না, মাঝরাতে রুমের মধ্যে কারো উপস্থিতি টের পেল, জিনিস পত্র নাড়াচাড়া করার শব্দ ও কানে আসলো৷ মেয়েটা ভয় পেয়ে যায়। ভীত, শঙ্কিত মনে লাফ দিয়ে ওঠে৷ চোখের সামনে প্রণয়কে দেখতে পেয়ে যেন আরও চমকায়। জেগে জেগে স্বপ্ন কেন দেখছে সে! প্রণয় ঢাকাতে তাহলে এখানে কীভাবে আসবে! সূচনাকে এমন করে উঠতে দেখে প্রণয় পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ, হা করে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। প্রণয় যেয়ে বিছানার এক পাশে বসে। সূচনা নিজের চোখকে তখনো অবিশ্বাস করে, অবাক হয়ে বলে,

” আমি সত্যি দেখছি! ‘

প্রণয় ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে,

” সন্দেহ আছে? ”

” কথা ও বলছেন! ”

আরও বিস্ময় নিয়ে বলে সূচনা, প্রণয় বিরক্তি নিয়ে বলে,

” কথা বলবনা কেন! আমি কী বোবা! ”

সূচনা তবুও হা করে তাকিয়ে রইলো, প্রণয় নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

” নাও ছুঁয়ে দেখো বিশ্বাস না হলে। ”

সূচনা সত্যি সত্যি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখলো, শুধু ছুঁয়ে ই দেখলো না রীতিমতো চিমটি কে টে বসলো। প্রণয় চোখ মুখ কুঁচকে বললো,

” ছুঁয়ে দেখতে বলেছিলাম, মাং স তুলে আনতে বলিনি। ”

সূচনার এবার বিশ্বাস হয়, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় নিজের কাজে। মেকি হেসে বলে,

” আমি তো পরীক্ষা করছিলাম সত্যি আপনি নাকি কোনো জ্বীন টিন। ”

সূচনার কথার পৃষ্ঠে প্রণয় গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

” আমাকে জ্বীনের মতো দেখা যায়! ”

” আশ্চর্য জ্বীন কী তার আসল রূপে আসবে! আসবে তো কারো না কারো রূপে। ”

” শিক্ষিত মেয়ে অথচ কীসব বলছো! ”

” তো কী হয়েছে! শিক্ষিত দেখে কী জ্বীন নেই আমার জন্য! ”

” স্ব চক্ষে কখনো দেখেছো? ”

” না। ”

প্রণয় বিছানা থেকে উঠে আলমারির কাছে যেতে যেতে বলে,

” কী বলো! আমি কত দেখেছি! কাল চলো পদ্মবিলে ঐখানেই তো জ্বীনের অভাব নেই। তোমায় নিয়ে দেখে আসব। ”

” খেয়ে কাজ নেই আমার! ”

” ঠিক আছে এবার বলো জ্বীন গবেষণা শেষ হয়েছে? ”

” হয়েছে৷ ”

” যাক। ”

” এত রাতে আপনি কোথা থেকে আসলেন ? ”

নিজের ভয় ভীতি সব কমিয়ে সূচনা প্রশ্ন করলো। প্রণয় টি-শার্ট ট্রাউজার ঠিক করতে করতে জবাব দিল,

” ঢাকা থেকে আসছি। ”

” কিন্তু এত রাতে কেন! ”

” একটা মাত্র বউকে চমকে দিতে। ”

কথাটুকু বলেই প্রণয় বাথরুমে ঢুকে পড়ে। পেছনে সূচনা বিস্ময় নিয়ে বসে থাকে এই ভেবে যে তাকে চমকে দিতে এত রাতে এখানে এসেছে!

#চলবে

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৬

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৬
#নাজিয়া_শিফা( লেখণীতে)
_______________________________
নুরাইয়া সব নিয়ম কানুন মেনেই ছেলে ও ছেলে বউকে ঘরে তুললেন৷ ইরা সূচনাকে নিয়ে গেলো প্রণয়ের ঘরে, কোথায় কী আছে দেখিয়ে দিল। সূচনা নিজের ব্যাগ থেকে খুব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই শুধু বের করে প্রণয়ের আলমারি তে রাখলো। ব্যাগ একপাশে সরিয়ে রেখে সে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলো প্রণয় ঘরে এসেছে। বিছানায় আরাম করে হেলান দিয়ে বসে ফোন টিপছে। তাকে এক পলক দেখে সূচনা হাত মুখ মুছে ঘর হতে বের হতে নিলেই প্রণয় কঠিন স্বরে ডেকে ওঠে,

” এই মেয়ে! ”

সূচনা থমকায়, তৎক্ষনাৎ ই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। চোখের ইশারায় জানতে চায়, ” কী হয়েছে? ”
প্রণয় বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফের কঠিন স্বরে বলে,

” তোমার জবান নেই! মুখে জিজ্ঞেস করতে পারো না কী হয়েছে! ”

সূচনা ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে মনে মনে ভাবে,

” একে তো আপনি থেকে তুমি তে নেমেছে তারওপর ধমকা ধমকি করছে! ”

” চুপ করে আছো কেন! বোবা তুমি? ”

সূচনা এবার রে গে যায়, কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলে,

” বোবা কেন হতে যাব হ্যাঁ! আর ধমকা ধমকি করছেন কেন! ”

” তো কী করব! বাচ্চা মেয়েকে আপনি আপনি বলেছি, বেশি সম্মান করে ফেলেছিলাম তাই তো মাথায় চড়েছো৷ ”

” বেশি বলছেন আপনি। ”

” এখনো কিছু বলিনি, শোনো এই রুমে…

” কী এই রুমে আমি থাকতে পারবনা! ”

প্রণয়ের কথা শেষ করতে দেয়না সূচনা, কথার মাঝখানে ই উক্ত কথা বলে। প্রণয়ের মেজাজ বি গ ড়ে যায়, আরও কঠিন স্বরেই বলে,

” না পারবেনা। এই ঘরে কেন আমার জীবনেও থাকতে পারবেনা। বুঝেছো! ”

সূচনা চুপ হয়ে যায়, কথার পৃষ্ঠে আর কোনো কথা বলতে পারে না। ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তখনই। প্রণয় রা গে নিজের মাথা চেপে ধরে। তার হুট করেই সব কিছু তে রা গ লাগছে। সবকিছু বিরক্তি লাগছে। বিয়েতে অমত করেনি, বাবার জন্য রাজি হয়েছে, মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে, বিয়েটা এভাবে হয়ে যাবে সে অবশ্য ভাবেনি। সবকিছু গোলমেলে লাগছে ভীষণ। ছেলেটা এতটুকু বুঝতে পারে তার ধৈর্য ধরতে হবে অনেক। সময় দিতে হবে, নিজেকে আর মেয়েটাকেও। নাহয় এই সম্পর্ক টেকানো সম্ভবত কঠিন। উপরন্তু দুইজন দুই মেরুর, স্বভাবে, আচরণে কোনো মিল নেই। পছন্দ, অপছন্দ মানসিকতা এসব সম্পর্কে তো কোনো ধারণা ই নেই। কীভাবে টিকবে এই সম্পর্ক!


শশুর বাড়ি তে সূচনার প্রথম দিন বেশ ভালো কা টে। নুরাইয়ার সাথে টুকটাক কাজ ও করে দিয়েছে সে। অবশ্য নুরাইয়া করতে দিতে চাননি, সূচনা জোর করেই করেছে। ইরার সাথে ও মোটামুটি কথা হয়েছে, মেয়েটা তার বয়সেরই, তার ওপর একই ভার্সিটি তে সুযোগ হয়েছে দুজনের। এহতেশাম সাহেব সকালে বেরিয়ে গিয়েছেন, রাতে আসার পর দেখা হয়েছে এবং সূচনার সাথে। কথা তেমন হয়নি, খাবার টেবিলে টুকটাক ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সূচনাকে। তার জবাব দিয়েছে শুধু। মায়ের সাথে বিকেলে কথা হয়েছিল সূচনার৷ প্রণয়ের সঙ্গে পুরো দিনে তেমন কথা ই হয়নি। প্রণয় ও কথা বলতে আসেনি৷ সূচনা ঘরে ও যায়নি। কিন্তু রাতে ঘুমাতে যেয়ে বিপত্তি বাঁধে। দুজনের কেউ ই কথা বলছেনা, প্রণয় সোজাসাপটা বলে দিয়েছে তার ঘরে বা জীবনে কোথাও জায়গা হবেনা। দুপুরের সেই কথা মনে পড়তেই সূচনার মনঃক্ষুণ্ন হয় ফের। কী করবে বুঝতে পারে না, বাইরে যেয়ে শোয়া সম্ভব না। কিন্তু এখানে ঘুমাবে? অসম্ভব। সে রা গে, ক্ষো ভে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে প্রণয় আঁটকায়। এতক্ষণ বিছানায় বসে আড়চোখে তাকিয়ে সূচনার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছিল। তাকে ঘর হতে বের হয়ে যেতে দেখলেই তার নাম ধরে ডেকে ওঠে। সূচনার পা জোড়া থেমে যায় ঠিক কিন্তু পিছু ফিরে প্রণয় কে দেখে না৷ প্রণয় নিজেই এগিয়ে যায় তার দিকে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে,

” রাত করে বাইরে যাচ্ছো কেন? ”

” কারো ঘরে যেহেতু জায়গা হবে না আমার তো বাইরেই যেতে হবে। আর কোথায় যাব! ”

সূচনার কণ্ঠে রা গ নাকি অভিমান প্রকাশ পেল প্রণয় তা ধরতে পারলো না। সে নরম স্বরে শোধালো,

” দেখো, এখন বাইরে গেলে বাবা-মা ভালো চোখে নিশ্চয়ই দেখবেন না। ”

” তাহলে কোথায় যাব! ”

” এই ঘরেই থাকবে। ”

” কেন! জীবনে ই যেহেতু রাখবেন না ঘরে কেন থাকতে যাব! ”

গলার স্বর এবার খানিক উঁচু হয় সূচনার। প্রণয়ের মেজাজ ফের বি গ ড়ে যায়৷ সে সূচনার ডান বাহুতে জোর দিয়ে তাকে দরজার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। দুই হাতে চে পে ধরে তার বাহু জোড়া। রা গে, দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে হিসহিসিয়ে বলে,

” কী সমস্যা তোমার হ্যাঁ! সোজা কথা কানে যায় না! চেচাঁচ্ছো কেন! সবাইকে জানাতে! ”

সূচনা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে চোখ জোড়া নামিয়ে রেখেছে, দৃষ্টি তার বাহুতে থাকা প্রণয়ের হাতের দিকে৷ প্রণয় জবাব না পেয়ে আরও বল প্রয়োগ করতেই সূচনা ব্যথায় মৃদু স্বরে চিৎকার করে ওঠে। সে শব্দ কানে পোঁছাতেই প্রণয় নরম হয়। তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দেয় বাহু জোড়া। কিছু বলতে নিলেও বলে না, সরে যায় সামনে থেকে। ধুপধাপ পায়ে দরজা খুলে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। সূচনার চোখ জোড়া তখন ঝাপসা হয়ে আসে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয় সেখানেই। কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হলে নিজের জায়গা থেকে সরে সে দরজার বাইরে উঁকি দেয়। অন্ধকার ছাড়া কিছু ই নজরে আসেনা। টেবিল থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ঘর থেকে বের হয় সে। ড্রয়িংরুমে কাউকে দেখতে পায়না। সদর দরজা ঈষৎ খোলা দেখে সেদিকেই পা বাড়ায়। দরজা একটু খুলে বাইরে উঁকি দিতে ই দেখা উঠোনে পুরুষালী অবয়ব লক্ষ্য করে। যাক বাইরে কোথাও যায়নি ভেবে চিন্তা মুক্ত হয় খানিক। তার কী যেয়ে কথা বলা উচিত? নাকি এভাবেই থাকবে? সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা মেয়েটা। কিছু সময় ঐভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর সাহস করে এগিয়ে যায়। প্রণয়ের পেছনে যেয়ে দাঁড়ায়, পায়ের শব্দ পেয়ে প্রণয় ও পেছনে তাকায়। সূচনাকে দেখতে পেয়ে মেজাজ বি গ ড়ে গেল আরও! সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। তার অভিব্যক্তি বুঝতে সূচনা ফোনের আলো তার দিকে ধরে এতেই যেন বিরক্ত হয় প্রণয়। ছো মে রে তার হাত থেকে ফোন নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। রুঢ় কণ্ঠে বলে,

” কী সমস্যা? ঘর ছেড়ে দিয়েছি না! আবার আসছো কেন! ”

মেয়েটা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এত রুঢ় ব্যবহার যেন নিতে পারে না। সে তো অনুতপ্ত ছিল, সেজন্য বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে এসেছিল। অথচ এই ছেলের ব্যবহার এমন! সূচনা বিস্ময়, রা গ, ক্ষো ভ সবকিছু এক বাক্যে প্রকাশ করে,

” আপনি এত বদমেজাজি প্রথম দেখায় তো বুঝিনি। ”

উক্ত কথা বলে মেয়েটা আর দাঁড়ায় না, এক প্রকার ছুটে ঘরে চলে যায়। পেছনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রণয়। সে আসলেই এত বদমেজাজী! না তো!


পরের দিন দুপুরে কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে প্রণয় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নুরাইয়া বা এহতেশাম সাহেব কেউই যেতে দিতে চাননি কিন্তু প্রণয় এত ব্যস্ততা দেখাচ্ছিল যে শেষে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। যাওয়ার সময়ও সূচনাকে কিছু বলে যায়নি। একবার অবশ্য বলতে গিয়েছিল কিন্তু সূচনা সুযোগটা দেয়নি। প্রণয় ঢাকায় চলে গেলে, সূচনা ইরার সাথে থাকে, প্রণয়ের ঘরে আর ঘুমায়নি। প্রণয় ঢাকা গিয়েছে আজ দুইদিন। দুইদিনে সে যোগাযোগ করেনি আর সূচনার সাথে। সূচনা ও করেনি, করবে কীভাবে! যোগাযোগ করার রাস্তা তো প্রণয় বন্ধ করে দিয়ে গেছে। রাস্তা যেহেতু সে বন্ধ করে দিয়ে গেছে খুলবে ও সেই। প্রণয়ের সাথে ঝামেলা বাদে বাকিসব কিছু ভালো ই চলছে তার। যার পরিচয়ে আসা শুধু মাত্র সেখানেই সমস্যা। সূচনার হাসি পায়, বেশ কিছুক্ষণ হাসি জারি রেখে মৃদু স্বরে আওড়ায়,

” এই সম্পর্কের শেষ কোথায় হবে যদি শুরু ই না হয়! ”

” ভাবি..! ”

সূচনা চমকায়, ইরাকে দেখে নিজেকে সহজ করে জবাব দেয়,

” হ্য..হ্যাঁ। ”

” কী বলছিলে একা একা? ”

” ক..কই কী বলছিলাম! কিছু ই না। ”

” আমি শুনলাম তো আচ্ছা শোনো সামনের সপ্তাহে তো আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। তা কিছু ভেবেছো? ”

সূচনার মস্তিষ্ক সজাগ হয়, মনে পড়ে বিয়ের পর শশুর বাড়ি থেকে পড়ার কথা ছিল তার। কিন্তু এখন! এখন কী করবে?

” ভাবি! ”

” হ্যাঁ বলো। ”

” বললাম তো। আচ্ছা শোনো, আমাদের তো ঢাকাতে বাড়ির কাজ চলছে। কাজ মোটামুটি শেষ প্রায় আর কাজ শেষ হলে বাবা-মা ও ঢাকা চলে যাবে। তখন সবাই সেখানেই থাকতে পারব। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত আমাকে হোস্টেলে থাকতে হবে। আর ভাইয়াকে তার ব্যাচেলর বাসায়। আর তুমি! আমি ভাবছি বাবার সাথে কথা বলব, যদি কোনোভাবে আমি যে রুমে আছি সেই রুমের একটা সিট খালি করানো যায় তো ভালো হবে। দুজন একসাথেই থাকতে পারব। কী বলো! ”

সূচনা অবাক হয়, এতকিছু সে ভাবেনি, মেয়েটা যে তাকে নিয়ে এতকিছু ভাববে সেটা ভেবেও তার বিস্ময় কাজ করছে। কিন্তু সত্যি ই তার শশুর শাশুড়ী মেনে নিবে? মনের প্রশ্ন টা সে ইরাকে সত্যি সত্যি কর ফেলে,

” আঙ্কেল আন্টি মেনে নিবেন? ”

তার এহেন প্রশ্ন টাকে যেন ইরা হেসে উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললো,

” কী যে বলো! এত ভালো রেজাল্ট তোমার, নিজের যোগ্যতায় সুযোগ পেয়েছো আর বাবা আঁটকাবে! আমার রেজাল্ট ভালো আর সুযোগ হয়েছে দেখেই বাবা নিষেধ করেননি। উল্টো ভর্তি থেকে হোস্টেলে সিট নেয়ার পর্যন্ত সব বাবা করেছেন। আমি ওনার মেয়ে তোমাকেও মেয়ে হিসেবে এনেছেন৷ বুঝেছো! ”

বিনিময়ে সূচনা শুধু মাথা এলিয়ে সম্মতি দেয়। মেয়েটা সত্যি অবাক হয়েছে, তার ভাগ্য এত ভালো কীভাবে হলো যে এমন শশুর শাশুরী পেল!

#চলবে

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৫

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৫
#নাজিয়া_শিফা( লেখনীতে )
_______________________________
দিন দুই পার হয়ে যায় দেখতে দেখতে ই। ছেলে মেয়ে উভয়ের বিয়েতে সম্মতি থাকায় বিয়েতে বিলম্ব করলেন না। একেবারে ছোট্ট পরিসরে ই আজকে সন্ধ্যায় সূচনাদের বাসায় বিয়ে টা পড়ানো হয়। সূচনাদের তরফ থেকে আত্মীয় স্বজন কেউ ই ছিলেন না। প্রণয়ের বাবা-মা, বোন, বড় মামা ও চাচা উপস্থিত ছিলেন শুধু। সূচনার বিয়ে ভেঙে গিয়েছে সেটা সবাই জানলেও কিন্তু ফের যে বিয়ে হচ্ছে সে সম্বন্ধে লোকে জানেনা। সেজন্য গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবকে ও আনা হয়েছিল। যেন মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছে এই নিয়ে কোনো ক টু কথা দিশা বেগমকে না শুনতে হয়। বিয়ে পড়ানো শেষ হলে ওনারা চলে যান। বাকিরা বসার রুমে কথা বলছেন। সূচনাকে নিজের পাশে বসিয়েছেন নুরাইয়া৷ মেয়েটা নত মস্তকে বসে আছে, পড়নে তার সাদামাটা একটা শাড়ি, মুখেও কোনো সাজ নেই। বিয়ের কোনো আমেজ ই লক্ষ্য করা যায় না। প্রণয়ের ক্ষেত্রে ও তাই, বাবা এহতেশাম আহমদের পাশে বসে সে। মুখটা গম্ভীর, সম্ভবত বিরক্ত ও সে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেনা। দুজনকে নীরব দেখে নুরাইয়া সূচনাকে বললেন,

” এক কাজ করো তো মা, রুমে যাও৷ একটু বিশ্রাম নাও, ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে নাও। আর প্রণয়কে ও সাথে নিয়ে যাও। ”

সূচনা অবাক বা বিস্ময় তেমন প্রকাশ করলো না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উঠে অগ্রসর হলো নিজের রুমের দিকে। প্রণয়কে ও আসতে বললো।

রুমে এসে সূচনা কী করবে বুঝতে পারলো না। শেষে সিদ্ধান্ত নিলো ব্যাগটা ই গোছানো যাক! সে আলমারি থেকে একটা ব্যাগ বের করে। একে একে কাপড় ভাজঁ করে ব্যাগে ভরতে থাকে। প্রণয় খানিক বিরক্ত হয়, একজন মানুষকে বসিয়ে রেখে নিজের মতোই কাজ করে যাচ্ছে। পাত্তাই দিচ্ছে না! আশ্চর্য মেয়ে! সূচনা নিজেও উসখুস করছিল কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে ও পাচ্ছে না। তার ওপর প্রণয়ের মতিগতি ও সূচনা বুঝতে পারছেনা। তার দ্বন্দ দূর করলে প্রণয়ই, বিরক্তির সুরেই বললো,

” আপনি মহা ব্যস্ত মনে হচ্ছে! রুমে আরও একজন ও উপস্থিত আছে। ”

সূচনার হাত থেমে যায় কয়েক সেকেন্ডর জন্য, একবার প্রণয়ের দিকে তাকিয়েও চোখ সরিয়ে নেয়। নিজের কাজ করতে করতে বলে,

” আমার চোখ আছে, আমি দেখতে পারছি তাকে। ”

সূচনার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে মেজাজ খানিক চ টে গেল ছেলেটার। সে বসা থেকে উঠে যেয়ে সূচনার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। তার ডান হাত চে পে ধরে দাঁতে দাঁত চে পে বলে,

” আপনি তো ভারি বে য়া দ ব মেয়ে! এমনিতে তো প্রশংসা শুনলাম সবার থেকে। আসলে এমন! ”

প্রণয়ের এহেন আচরণে মেয়েটা রে গে যায় না বরং সহজ গলায় বলে,

” শুনুন প্র.. সরি বা জে ছেলে, শুনুন, আমি মোটেও ভদ্র নই। আমি ভেতরে ভেতরে আসলে প্রচন্ড বে য়া দ ব। ”

” তা তো দেখতেই পারছি। ”

” আপনার চোখের জ্যোতি স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অনেক বেশি সেজন্য দেখতে পারছেন। ”

” খোঁ চা? ”

” হ্যাঁ অবশ্যই। ”

” বেয়াদব মেয়ে। ”

প্রণয় রা গে ফুঁসতে ফুঁসতে বলার মতো কিছু না পেয়ে শেষে এটাই বলে৷ সূচনার হাত ছেড়ে দিয়ে ফের নিজের জায়গায় যেয়ে বসে পড়ে। প্রণয় নিজের জায়গায় বসেই আড় চোখে সূচনাকে পরখ করে। লক্ষ্য করে সে ব্যাগের মধ্যে বেশিরভাগ ই শাড়ি নিচ্ছে। মেয়েটা কী শাড়ি ই পরে বেশিরভাগ? অবশ্য পরলে খারাপ লাগে না, সুন্দর লাগে। এহেন ভাবনা মনে আসতেই অদৃশ্য হাতে নিজের গাল জোড়া চাপড়ায় প্রণয়। বিড়বিড়িয়ে বলে,

” দেখতে যতই সুন্দর হোক, স্বভাবে তো আসলে দস্যিরাণী। ”

কিন্তু তার জানার আগ্রহ টা সে দমিয়ে রাখতে পারেনা। জিজ্ঞেস করেই ফেলে,

” আপনি কী বেশিরভাগ সময় শাড়ি ই পরেন? ”

সূচনা একটু অবাক হয়, পরক্ষণেই সহজ হয়ে উত্তর দেয়,

” হ্যাঁ, শাড়ি পরতে বেশি পছন্দ করি। ”

প্রণয় মনে মনে খুশিই হয়, অনেক মেয়েরাই শাড়ি পরতে অপছন্দ করে, ঝামেলা মনে করে। অথচ এই মেয়ে নাকি শাড়ি পরতে বেশি পছন্দ করে!



সেদিন রাতে আর সূচনাকে প্রণয়দের বাসায় নেয়া হয় না। নুরাইয়া নিতে দেন না, যতই হোক উনি গ্রামের মানুষ। ওনার মতে নতুন বউ, সবে বিয়ে হয়েছে ঘন্টা কয়েক। এর মধ্যে রাত করে এত পথ যাওয়া ঠিক হবে না। তাই সূচনাকে এই বাড়িতেই রেখে যান। তবে প্রণয়কে নিয়ে যান সাথে। ছেলে এসে নিয়ে যাবে তার বউকে। তাই পরের সকালে প্রণয়কে পাঠানো হয় সূচনাকে নিয়ে যেতে। সূচনা আগে থেকে ই তৈরি হয়ে বসে ছিল। প্রণয় কে দেখে দিশা বেগম ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আগে পেছনে যাই হয়ে থাকুক, প্রণয় এখন একমাত্র মেয়ে জামাই ওনার৷ যত্ন-আত্তি তে কোনো কমতি রাখা যায় না। তার ওপর ওনার ছেলে ও নেই। এই সুবাদে যদি ছেলের অভাব খানিক পূরণ হয়! প্রণয় ও বেশ সাদরে ই সব গ্রহণ করে। মেয়ে যেমন ই হোক শাশুড়ী তার যথেষ্ট ভালো বোঝা যায়।

বিদায় নেয়ার সময় ফরিদা ভীষণ কান্নাকাটি করলো৷ মেয়েটা ছাড়বেই না তার আপাকে। দিশা বেগম কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলেন। বিদায় দিলেন দুজনকে৷ প্রাণভরে দোয়া ও করলেন। তার মেয়েটা যেন একটু সুখী হয়। তার মেয়ে যেন এই ছেলে আর তার পরিবারকে নিজের ভেবে আগলে রাখতে পারে।


সূচনাকে নিয়ে বের হতে হতে দেরি হয়ে যায়। বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় এসে রিকশা নেয় প্রণয়। পাশাপাশি বসতে যেয়ে প্রথমে একটু অস্বস্তি কাজ করে দু’জনেরই। কিন্তু দুজনেই অস্বস্তি একপাশে রেখে উঠে বসে। রিকশা চলতে শুরু করলে প্রণয় সতর্ক করে বলে,

” শাড়ি সামলে বসুন। ”

আগে থেকে ঠিকঠাক করে রাখলেও সূচনা আরেকবার ভালো করে পরখ করে। না সব ঠিক আছে। তার পড়নের শাড়িটা নুরাইয়াা অর্থায়নে তার শাশুড়ী দিয়েছে। লাল আর সাদার সংমিশ্রণের শাড়িটা তার পছন্দ হয়েছে। অন্য দিনের থেকে আজকে একটু গাঢ় করে কাজল দিয়েছে। চুলগুলো বেণী করে রেখো দিয়েছে এক পাশে। কাল ইরা যাওয়ার সময় বলে গেছে,

” ভাবি কাল যখন ভাইয়া নিতে আসবে তখন একটু সেজেগুজেঁ এসো। সাজলে হয়তো আরও সুন্দর লাগবে। ”

ইরার কথা প্রথমে অবশ্য ভালো লাগেনি সূচনার। তার প্রথমে মনে হয়েছিল,

” বিয়ে হতে না হতেই পরিবর্তন হতে বলছে ! ”

পরমুহূর্তে নিজেকে ই বিরক্ত লাগলো। মেয়েটা এমন কী আর বলেছে! তার একমাত্র ভাইয়ের বউ, বিয়েটা যেভাবে হলো তাতে তার কোনো শখ বা আবদার ই তো পূরণ করতে পারেনি। একটু সাজতে বলেছে, এতে আর তেমন কী!
মাথায় ঈষৎ ব্যথা অনুভব হওয়ায় সূচনার ভাবনার সুতোয় টা ন পড়ে। ঝাঁকুনি খেয়ে রিকশার ওপরের অংশের সাথে মাথায় আ ঘা ত লেগেছে। ব্যথায় আর বিরক্তি তে মুখ দিয়ে ‘ চ ‘ সূচক শব্দ বেরিয়ে আসে। তার এহেন অভিব্যক্তিতে প্রণয় আরও বিরক্তি নিয়ে বলে,

” কী! রিকশায় ও বসতে পারেন না! ভাঙা রাস্তায় ভালো করে ধরে বসতে হয়, এমন ফ্রী হয়ে বসলে তো এমন হবেই। দেখি! ”

সূচনার মেজাজ এবার তুঙ্গে, মাথা ডলতে ডলতে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,

” দেখা লাগবেনা, আমি তে কিছু ই পারিনা। সব পারুয়া সব জান্তা তো আপনিই। ”

প্রণয় অবাক ভঙ্গি তে মুখে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,

” সব পারুয়া আবার কী? ”

” যে সব জানে সে সবজান্তা, সে হিসেবে যে সব পারে সে সব পারুয়া ই তো! ”

প্রণয় কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে থাকে, অতঃপর শব্দ করে হাসতে থাকে। তার হাসি তে যেন মেয়েটা চরম পর্যায়ে বিরক্ত হয়। মুখ ঘুরিয়ে অন্য পাশে তাকিয়ে থাকে। ঐদিকে প্রণয় হাসতে হাসতে অপলক তাকিয়ে থাকে সূচনার দিকে। হুট করে একটা কথা তার কানে বাজতে থাকে,

” এই মেয়েটা আস্ত বে য়া দ ব, দস্যি রাণী আর এই মেয়েটাই তার অর্ধাঙ্গিনী! ”

#চলবে

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৪

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৪
#নাজিয়া_শিফা( লেখনীতে )
________________________________
সূচনা বাসায় ফেরে যখন তখন প্রায় সন্ধ্যা। সূচনা কে দেখতেই ইরা ও বিদায় নিয়ে চলে যায়। দিশা বেগম সূচনাকে কিছু বলেন না। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না ওনার। আসলে খুঁজে ও পাচ্ছেন না কি বলবেন। এর মধ্যে সূচনাই নিজ থেকে বললো,

” মা একটু চা দিবে! মাথা ধরেছে। ”

দিশা বেগম অবাক হন, সাথে খুশি ও হন। মেয়ে যে রাগ না করে নিজে থেকে কথা বলেছে! দিশা বেগম চট জলদি রান্নাঘরে চলে গেলেন। ফরিদা চা বানিয়ে দিবে বললেও দিলেন না। মেয়ের জন্য নিজেই চা বানাবেন। সূচনা নিজের রুমে চলে আসে। বিছানায় বসে ফোন হাতে নিয়ে সময় পরখ করলো। আযান দিয়ে দিবে একটু পরই। সূচনা রুমে থেকেই গলা উঁচিয়ে বললো,

” মা চা দিও না এখন৷ নামাজ পড়ে দিও। ”

দিশা বেগম তাড়াহুড়ো করছিলেন, মেয়ের কথা শুনে তাড়াহুড়ো করলেন না আর৷ সূচনা ওযু করার জন্য বাথরুমে যেতে নিলে ফরিদা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

” আপা মণি কী কী কথা হইলো? ”

সূচনা ভ্রু কুটি করে, প্রশ্নের মানে বুঝলেও সে জিজ্ঞেস করে,

” কীসের কথা বলছিস? ”

” আরে ভাই জানের লগে কথা কইবার গেলেন যে! ”

সূচনা এবার খানিকটা শক্ত হলো, বললো,

” ফরিদা তুই বয়সে ছোট, আমাকে এসব বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবিনা। এইসব প্রসঙ্গ নিয়ে কথা ও বলবিনা। ”

সূচনা আর দেরি করেনা, বাথরুমে ঢুকে পড়ে। ফরিদা মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার আপা ও দিশা আম্মা যখন তাকে ব কা দেয় তার একটুও ভালো লাগেনা।


” আমি কী কারণে তোমার কাছে এসেছি সেটা নিশ্চয়ই জানো! ”

” জ্বি জানি। ”

” তোমার বাবা আমার বন্ধু ছিল৷ আমার ওপর ওর অনেক ঋণ। সেগুলো শোধ করতে না পারি অন্তত বিপদে পাশে দাঁড়ানোর সূযোগ টা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। তুমি যদি রাজি হতে..! ”

” বাবা আপনার বন্ধু ছিলেন, ওনার তখন সামর্থ্য ছিল সেজন্য আপনার বিপদে দাড়াঁতে পেরেছেন। আপনিও তো আমাদের জন্য অনেক কিছু করেন। এখানে ঋণের কিছু নেই। ”

” তোমার কাছে না থাকতে পারে আমার কাছে অনেক কিছু। আমি পারলে তোমাকে বুঝাতাম, কিন্তু তা সম্ভব না। আর আমার ছেলে যদি খারাপ হতো তাহলে এই প্রস্তাব আমি কখনো রাখতাম না। আমার ছেলে তোমার জন্য পা গ ল থাকলেও কখনো রাজি হতাম না আমি। কিন্তু আমার ছেলে খারাপ না, আমি ওর বাবা, আমার থেকে ভালো তো জানবে না কেউ। আর মেয়ে হিসেবে তোমাকেও আমার জানা৷ সব বিবেচনা করে এই প্রস্তাব দেয়া। তুমি একটাবার ভেবে দেখতে পারো। তুমি আমার মেয়ের মতোই, এখন শুধু মেয়ে বানাতে চাইছি। ”

এহতেশাম সাহেব নিজের কথা শেষ করে সূচনার দিকে তাকালেন। সূচনা নীরব ই রইলো৷ এহতেশাম সাহেব ব্যথিত হন, মেয়েটা একবার ভেবে দেখতে পারে না! উনি সূচনার মাথায় হাত রেখে শেষবারের মতো বলেন,

” একবার ভেবে দেখিও মা, আমি অপেক্ষায় থাকব। ”

সূচনার চোখ জোড়া টলমল করতে থাকে এহতেশাম সাহেবের মুখে মা ডাক শুনে। কী আদুরে লাগলো তার কাছে শুনতে! ওনার হাত মাথায় রাখার পর সূচনার কেবলই মনে হলো ওনার মাথায় হাত রাখার মধ্যে সে ভরসা পাচ্ছে। কিন্তু কেন! এহতেশাম সাহেব চলে যান তার রুম হতে। উনি চলে যেতেই টলমল করা চোখ জোড়া হতে পানি গড়িয়ে পড়ে সূচনার৷ মেয়েটা ভারি বিপাকে পড়ে যায়। কী করবে, কী না করবে নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে।


এহতেশাম সাহেব বাড়ি ফেরার পরই নুরাইয়া ছুটে আসেন ওনার দিকে। হাতে পানির গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,

” কী বললো? কী কথা হলো? ”

এহতেশাম সাহেব পানি পান করে গ্লাসটা পুনরায় স্ত্রীর কাছে ফিরিয়ে দিলেন। কিছুটা হতাশ হয়ে বললেন,

” কিছু বলেনি, আমার যা কথা ছিল বললাম কিন্তু মেয়ে কিছু বললো না। ”

” কথাবার্তায় কী মনে হলো? ”

” নুরাইয়া মাত্র ই তো বললাম মেয়ে কিছু বলেনি। ”

” ও…ওহ। আচ্ছা আচরণে, মুখের ভাবে কী মনে হলো? ”

” জানিনা আমি। কিছু বলেনি, তবে যেটাই বলুক তা ই হবে। ”

” তা তো হবে। আচ্ছা আমরা কী ঠিক করছি? মানে প্রণয়ের পছন্দ টা.. ”

” বেঠিক করছি! তোমার ছেলে ভালো মেয়ে খুঁজে পাবে? ”

নুরাইয়া এই প্রশ্নে কিছুটা দমে যান। আসলে তো প্রণয় পাবেনা, তার পছন্দ তো আর পাঁচটা ছেলের মতো না। এই খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছেলের সর্বগুণ সম্পন্ন মেয়ে লাগবে। এক মেয়ের মধ্যে সব গুণ কীভাবে থাকবে! আদোও থাকে! থাকেনা তো৷ মানুষ কী সব দিক হতে সম্পন্ন হয়! খুতঁ তো একটা না একটা থাকেই, সেটা নিয়েই তো মেনে নিতে হয়। অথচ ছেলেটা কেন যে বোঝেনা! এদিকে স্বামীর কাছে ছেলের বিয়ের প্রসঙ্গ উঠালেই ওনাকে এই খোঁচা শুনতে হয়৷ ব দ ছেলে।


বিকেলে বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকেছিল প্রণয়। এরপর আর বের হয়নি। নুরাইয়া এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন, প্রণয় না আসায় উনি নিজেই তার রুমে গেলেন। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল প্রণয়। নুরাইয়া পিঠে চাপড় মে রে তাকে উঠালেন৷ প্রণয় হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে বিরক্তি নিয়ে বলে,

” আমি বড় হয়ে গেছি মা আর কত মা র বে! ”

” সময়ে অসময়ে ঘুমিয়ে থাকলে মা র ব না তো কী করব! ”

নুরাইয়ার বিরক্তি মাখা কণ্ঠ। প্রণয় তার দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বললো,

” এই বাড়িতে আমার কোনো ইজ্জত ই নেই। এতদিন পর এসেছি শান্তি তে ঘুমানো ও যায় না। ”

” তাড়াতাড়ি ওঠ। তোকে ঘুমানোর জন্য এখানে আনা হয়নাই। ”

” কীসের জন্য আনা হয়েছে শুনি! ”

” বিয়ে করার জন্য। ভুলে গেছিস! ”

প্রণয়ের মস্তিষ্ক সজাগ হয় এবার, এতক্ষণ ঘুমের ঘোরে কীসব বলছিল! সে আমতা আমতা করে বলে,

” ও..ওহ হ্যাঁ। ”

নুরাইয়া চোখ বাঁকিয়ে তাকান, প্রণয় ও অধর বাঁকিয়ে বলে,

” যার বিয়ের জন্য পা গ ল হয়েছো তার কী বিয়ের চিন্তা আছে! ”

নুরাইয়া ফের বিরক্ত হলেন, এই ছেলের ধৈর্য এত কম কেন! উনি ধ ম কে র স্বরে বলেন,

” তোর ধৈর্য এত কম কেন হ্যাঁ! মেয়েটাকে একটু সময় তো দিবি! ”

প্রণয় চুপসে যায়, কিছু বলতে নিলেও বলে না। তার মতে পরিস্থিতি এখন তার অনুকূলে। সে যা বলবে, তার দাম দেয়া হবেনা। উল্টো অপমানিত হবে৷ তাই চুপ ই রইলো।


এশার নামাজ পড়ে সূচনা জানালার ধারে এসে বসে। দুপুরের বৃষ্টির পর থেকে আবহাওয়া গুমোট। কেমন থম মে রে আছে যেন। সূচনার মন কেমন কেমন করে, সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছিল সে। তার মন বলে যে হাত মাথায় রাখতে সে ভরসা পেল সে মানুষটাকে বিশ্বাস করতে। মস্তিষ্ক বলে অন্য কিছু। বিশ্বাস নাহয় সে মানুষটাকে করলো কিন্তু তার ছেলে! ছেলে কেমন হবে? উনি যে বললেন, ওনার ছেলে, আর নিজের ছেলের ওপর ওনার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে, ভালোভাবে চেনেন। এখনকার যুগে নিজের সন্তান কে নিয়ে কয়জন বাবা মা এত বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে পারে? বিয়ে করবে কী করবে না সেটা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করছেনা। বিয়ে করবে সে সিদ্ধান্ত তো আগেই নিয়েছিল। কিন্তু এখন! এখন কাকে বিয়ে করবে? প্রণয় কী সঠিক সিদ্ধান্ত হবে? সূচনা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। দিশা বেগম তার রুমে এসে দেখেন সূচনা জানালার ধারে বসে আছে। উনি কাছে যেয়ে তার মাথায় হাত রাখতেই সূচনা ওনার দিকে তাকায়। উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে,

” মা আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা কেন! ”

মেয়ের উদ্বেগের কারণ উনি নিজেকেই মনে করলেন। অপরাধী কণ্ঠে বললেন,

” তোর এমন পরিস্থিতির কারণ আমিই। আমার জন্য ই এস…

” মা যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন কী করব! কী সিদ্ধান্ত নিব! ”

দিশা বেগম নিজের আবেগ সামলে নেন, নিজেকে স্বাভাবিক করে বলেন,

” দেখ এবার আমি আমার কোনো সিদ্ধান্ত দিবনা। তোর মন যা বলে তুই তাই কর। আমি তোর সাথে আছি। ”

সূচনা মায়ের কথা শোনে, বেখেয়ালি হয়ে যায়, আনমনে বলেও ফেলে,

” মন তো বলে ওনার কথা বিশ্বাস করতে..”

নিজের কথায় থতমত খায় মেয়েটা, প্রসঙ্গ পাল্টানোর সময় পায়না। তার আগেই দিশা বেগম বলেন,

” মন যেহেতু বলছে তাহলে তাই কর। ”

সূচনা অবাক চোখে তাকায়, দিশা বেগম মৃদু হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

” ভাত বাড়ছি আয় খেতে আয়। ”

দিশা বেগম চলে যান, পেছনে সূচনা মৃদুস্বরে কয়েকবার আওড়ায়,

” মন যা বলে তা করো। ”


রাতে খাওয়ার সময় এহতেশাম সাহেব প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলেন,

” আমি যে সূচনার সাথে বিয়ের কথা বলেছি তোমার তাতে সমস্যা আছে? ”

বাবার সামনে সে এমনিতেও কথা বলবেনা, বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার প্রশ্ন তো আসেনা। সুতরাং প্রণয় সহজ গলায় ই বললো,

” না বাবা, সমস্যা নেই। ”

প্রণয়ের উত্তর পাওয়ার পরপর ই এহতেশাম সাহেব গলা উঁচিয়ে নিজের স্ত্রীর নাম ধরে ডাকলেন। নুরাইয়া একপ্রকার ছুটেঁ আসলেন। জানতে চাইলেন কী হয়েছে! এহতেশাম সাহেব বরাবরের ন্যায়ই গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

” তোমার ছেলেকে বোলো এত অধৈর্য না-হতে। এবার একটু ধৈর্য শীল হতে বলো। দায়িত্ব নিতে হবে আমার মেয়ের। ”

প্রণয় সবে ভাতের লোকমা টা মুখে দিয়েছিল, এহতেশাম সাহেবের কথা শুনে গলায় আ টঁ কে কাশি উঠে গেল তার। পাশ থেকে ইরা পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। প্রণয় পানি পান করতে করতে ইরার উৎসুক কণ্ঠে করা উক্তিটুকু শুনলো,

” তার মানে আপু বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে! ”

প্রণয়ের কাছে মনে হলো তার কানে আর কোনো কথা আসছে না। শুধু ঐ একটা কথাই কানে বাজছে। মেয়েটা তাহলে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল!

#চলবে

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০৩

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০৩
#নাজিয়া_শিফা( লেখনীতে)
_______________________________
ভেজাঁ জামা কাপড় নিয়ে ই সূচনার রুমের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়। তার হাতে একটা গামছা, সূচনা দিয়েছে। তাকে বসতে বলা হলেও সে বসেনি। গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ইতিমধ্যে বসার রুমে হওয়া সব কথা ই প্রণয় বলে ফেলেছে। তা শুনে আরেক দফা অবাক, হতভম্ব হয়ে গেছে সূচনা। মেয়েটা মুখ ফুটে এবার বলেই ফেলে,

” একদিনে আর কত চমক পাবো! পরের দিনের জন্য ও কিছু বাকি থাকুক। ”

কথাটুকু বলেই সূচনা নিজেই থতমত খায়, প্রণয়ের সময় লাগেনা বুঝতে কথার মানে। তার নিজের ও কিছু টা খারাপ লাগে। সত্যি ই তো, কিছু সময়ের ব্যবধানে মেয়েটার সাথে কতকিছু হয়ে গেল! অস্বস্তিতে পড়ে যাওয়ায় সূচনা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,

” আপনি বাইরে যাবেন কীভাবে! ”

” কেন পা দিয়ে যাব৷ ”

অসময়ের মজা সূচনার পছন্দ হয়না, চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

” বা জে ছেলে, একে তো কিছু বোঝেননা, তার ওপর হাত ধরে টে নে নিয়ে এনে ঠাট্টা করছেন! ”

” বা জে ছেলে কে? ”

” আপনি। ভালো ছেলেরা নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের হাত ধরে টা না টা নি করেনা। ”

” গেলাম বাঁচাতে আর এখন নাকি বা জে ছেলে! দুনিয়ায় ভালো মানুষের ভাত নেই। ”

চোখ ছোট ছোট করে উক্ত বাক্যখানি করতেই সূচনা ফুঁসে ওঠে বলে,

” বাঁচানোর জন্য হাত ই কেন টা ন তে হবে! ”

” ভদ্র ভাবে বলেছিলাম, সোজা কথা তো কারো মাথায় ঢুকে না। ”

সূচনা এবার একটু চুপসে যায় তবে চুপ থাকে না কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিবে তার আগেই ফরিদা এসে জানায়, তাদের বাইরে যেতে বলছে। এবার দুজনের মাথায়ই যেন বা জ পড়ে। সূচনা তো ঠিক আছে কিন্তু প্রণয় বাইরে যাবে কীভাবে এই ভেজাঁ কাপড় নিয়ে!
সূচনা ফরিদা কে বাইরে যেতে বলে প্রণয়ের দিকে তাকায়। প্রণয় আগে থেকে ই তাকিয়ে ছিল তার দিকে, সূচনা তাকাতেই যেন ছেলেটা তেতিয়ে উঠে,

” মেয়ে মানুষ মানেই ঝামেলা, আশেপাশে থাকলেও ঝামেলায় ফেলে দেয়। সাহায্য করতে যেয়ে নিজেই বিপদে পড়লাম আবার তাকে বিয়ে করব! ”

শেষোক্তি তে সূচনা ভ্রু কুটি করে, বিরক্তিতে ছেয়ে যায় অবয়ব। ততক্ষণে প্রণয় ও বুঝতে পারে মুখ ফসকে ভুল কথা বেরিয়ে গিয়েছে। এভাবে বলাটা মোটেও উচিত হয়নি। কিন্তু সূচনার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আর বিরক্তি তে ছেয়ে যাওয়া মুখ দেখে আর কিছু বলতে পারে না। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে সেই অবস্থাতেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় প্রণয়। সূচনার নিজের ও আর কিছু বলার ইচ্ছে হয় না। মস্তিষ্ক বি ষি য়ে ওঠে তার। রা গে দপদপ করে, হাতের সামনে টেবিলের ওপর থাকা ফুলদানি টা স্ব শব্দে ভেঙ্গে ফেলে। পরমুহূর্তেই খেয়াল হয় বাইরে শব্দ পোঁছায় নি তো আবার! সে এক প্রকার দৌড়েঁ যেয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে কেউ আসছে কিনা! কোনো শব্দ না পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে যেন। ভেঙ্গে যাওয়া ফুলদানির টুকরো গুলো এক এক করে উঠায়। একটা কাগজের মধ্যে জমা করে টেবিলের ওপর রাখে। তার এখন আফসোস হয়, শুধু শুধু ই ভেঙ্গে ফেললো না! এখন তো চাইলেই জুড়ে দেয়া যাবেনা। ভাঙা জিনিস সহজে জোরা লাগে? লাগে না তো। লাগলেও আগের মতো কী আর হয়!



” ভাইয়া তুমি ভিজঁলে কীভাবে? ”

বাসায় এসে গোসল সেরে বসেছিল প্রণয়, ইরা চা দিতে এসে উক্ত প্রশ্নটা করে। এমনিতে মেজাজ চ টে আছে তার ওপর ইরার প্রশ্ন যেন আ গু নে ঘি ঢালার ন্যায় ছিল। উত্তর দেয়ার বদলে ইরাকে কড়া কথা বলতে নিলেও মাথা ঠান্ডা রাখলো। ইরার কী দোষ, সে তো আর জানেনা কোন দস্যি রাণীর সাথে তার ভাইয়ের পাল্লা পড়েছে। প্রণয় আ গু ন হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কে ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,

” তেমন কিছু ই না, ঐ মেয়ের রুমের সাথে দরজা ছিল। সেখান দিয়ে উঠোনে যাওয়া যায়। আমি ও একটু গেলাম এর মধ্যে বৃষ্টি বেড়ে গেল। তাই ভিজেঁ গেছিলাম। ”

ইরা চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করে,

” এত বা জে মিথ্যা কীভাবে বলো ভাইয়া! মিথ্যা বলবে যখন লজিক্যালি বলো। ”

” যা তো এখান থেকে। ”

ইরা কথা বাড়ায় না আর। সে জানে তার ভাই মিথ্যা বলছে, সত্যি টা বলতে চাইছে না। তাই আর না ঘাটিয়ে রুম হতে প্রস্থান করে। ইরার মুখে বা জে শব্দটা শুনে প্রণয়ের ফের মনে পড়ে সূচনার কথা। তার মোটেও উচিত হয়নি মেয়েটাকে এমন কথা বলা। বলে আবার চলে ও এলো, সরি ও বললো না! এমনিতেই বা জে ছেলে বলে দিয়েছে, এখন অসভ্য, অভদ্র সবই বলবে। এক মেয়ে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার সব উলোটপালোট করে দিচ্ছে। কী আশ্চর্য কথাবার্তা!


বিকেলে নুরাইয়া এসে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করেন, সূচনার সাথে তার কী আলাপ হলো! কিন্তু যুতসই কোনো জবাব তিনি প্রণয় থেকে পেলেন না। কীভাবে পাবেন, আলাপ তো তেমন হয় ই নি। উল্টো ঝ গ ড়া আর মনোমালিন্য হলো শেষে। নুরাইয়া হয়তো কিছু আচ করতে পারলেন। প্রণয়কে ফের বললেন সূচনার সাথে দেখা করতে। বললেন,

” তুই একা যেয়ে এবার দেখা করে ঠান্ডা মাথায় কথা বল। দেখ কী হয়! ”

প্রণয় রা গ দেখালো, বিরক্তি নিয়ে বললো,

” মা তখন আমার নিজেকে ছ্যা চ রা মনে হবে। মনে হবে যে ঐ মেয়ের জন্য আমি দেওয়ানা হয়ে গেছি। তার পেছনে লাট্টু হয়ে ঘুরছি। ”

নুরাইয়া দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বললেন,

” গা ধা তোকে পেছনে ঘুরতে বলছে কে! বলছি যেয়ে দেখা করে সামনাসামনি কথা বলে আয়। ”

” তুমি আমাকে অপমান করছো মা! এই ছাব্বিশ বছরে এই প্রথম বার এমন অপমান! ”

” ইদানীং ছবি টবি বেশি দেখিস মনে হচ্ছে! যা এখনই যা। ”

নুরাইয়া ভীষণ স্বাভাবিক, ওনার কথাগুলো স্বাভাবিক। কিন্তু প্রণয়ের কাছে আপাতত ওনার বলা কথা পালন করা সম্ভব মনে হচ্ছে না। দুপুরে যা হলো তারপর আবার হুট করে তার সাথে দেখা করতে যাওয়াটা মোটেও শোভা পায়না। কিন্তু নুরাইয়া একবারেই স্বাভাবিক গলায় প্রণয়কে বলে গেলেন। আদেশ করে গেলেন, যেতে বলেছি মানে যেতে হবে। প্রণয় ফের বিপদে পড়ে, নিজের মাথার চুল নিজেই খামচে ধরে। বিরক্তির সুরে আওড়ায়,

” কি মেয়ের সাথে দেখা হলো, বিয়ে না হতে ই ঝামেলার পর ঝামেলায় ফেলছে। ”


ইরাকে সাথে নিয়ে প্রণয় সূচনার সাথে দেখা করতে এসেছে। সূচনাদের বাড়ির পাশের পদ্ম বিলে এসেছে তারা। ইরা সূচনাদের বাড়িতে, প্রণয় অপেক্ষা করছে সূচনার জন্য। বিলের টলমলে সবুজ পানিতে ফুটেঁ আছে পদ্ম ফুল। বিলের একপাশের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য, মুক্ত বাতাস, অরণ্য এসব মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে যেকোনো মানুষের মন ই জুড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার মধ্যে এখন তেমন কিছু ই কাজ করছেনা। তার সঙ্কোচ হচ্ছে, অস্বস্তি তে মাথা নুইয়ে পড়ছে যেন। এর মধ্যে ই কারো পায়ের শব্দে প্রণয়ের মস্তিষ্ক সচকিত হয়। সে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে সূচনা দাঁড়িয়ে আছে। প্রণয় উহুম শব্দে গলা পরিষ্কার করে, সূচনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সূচনা সালাম দেয়, কণ্ঠ তার স্বাভাবিক হলেও কেমন ভারিক্ষি স্বর। প্রণয় সালামের জবাব দেয়। জিজ্ঞেস করে,

” কেমন আছেন? ”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি? ”

” এই তো আলহামদুলিল্লাহ। ”

সূচনা নীরব থাকে, তার দৃষ্টি প্রণয়ের দিকে না, অন্য দিকে। প্রণয় ফের তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে, গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলে,

” দুপুরের কথার জন্য দুঃখীত, আমি সেভাবে বলতে চাইনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছিল। ”

” মনে যা থাকে মুখ ফসকে তো তাই বের হয়, সমস্যা নেই। ”

” আমার মনে এমন কিছু নেই। হ্যাঁ এই পরিস্থিতি ভিন্ন, এভাবে হুট করে বিয়ের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলাটা ও অন্য রকম। আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু তাই বলে কোনো মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে আর সেটা নিয়ে মজা করার মানুষ আমি নই। ”

” আজকে বিলে অনেকগুলো পদ্ম ফুল ফুটেছে। অনেকদিন পর এত গুলো দেখলাম। ”

” কথা ঘোরাচ্ছেন! ”

” খারাপ কথা আর স্মৃতি মনে রাখতে নেই। দুঃখ ছাড়া কিছু ই দেয় না। ”

” আপনি সরি কবুল না করলে আমি বারংবার মনে করাব। দুঃখ পেলে দোষ দিতে পারবেন না। ”

” হু ম কি দিচ্ছেন! ”

” ঐসব বা জে ছেলেরা দেয়, আমি আবার ভালো ছেলে। ”

প্রণয়ের কথা শুনে এবার তার দিকে তাকায় সূচনা। প্রণয় খেয়াল করে না, অধরে তার দুষ্ট হাসি। সূচনা ও হেসে ফেলে, তবে হাসি চেপে টিপ্পনী কে টে বলে,

” বেশি ভালো ভালো না। খারাপ হওয়া ভালো আর আপনি ভালো ছেলে ও না। বা জে ছেলে যে সামনের মেয়েদের হাত ধরে টা না টা নি করে। ”

সূচনার মজা বুঝতে পারলেও, প্রণয় ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলে,

” ফর আ কারেকশন মেয়েদের না মেয়ে, শুধু এক মেয়ের হাত ই ধরেছি, হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছি। ”

” ঐ একই, বা জে ছেলে। ”

” কথায় কথায় বা জে ছেলে বলছেন, কেউ শুনলে ভাববে না জানি কী করেছি আপনার সাথে। ”

” মানুষ তো কত কিছু ই বলে, তাদের মুখ্য কাজই বোধহয় এটা। ”

সূচনার গলার স্বরে পরিবর্তন আসে, কেমন গম্ভীর শোনায় কথাটুকু। প্রণয় তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,

” পদ্ম ফুল লাগবে? ”

” আপনি এনে দিবেন? ”

” হ্যাঁ লাগলে এনে দিব। ”

” সত্যি আনতে পারবেন? ”

সূচনার বিস্ময় দেখে প্রণয় খানিক অপমানিত বোধ করে। কথা না বাড়িয়ে সে বিলের একেবারে সামনে ফুটে থাকা একটা পদ্ম ফুল তুলে সূচনার সামনে দাঁড়ায়। সূচনা তখনো অবাক, প্রণয় হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলে,

” এত অবাক হওয়ার কিছু নেই, আমি গ্রামেই বড় হয়েছি। ”

সূচনা অবাক ভাব কাটায়, ফুলটা হাতে নেয়। তারপর ভেংচি কে টে বলে,

” এনেছেন তো একেবারে সামনের ফুলটাই। ”

” দূরের গুলো আনতে গেলে অর্ধেক ভিজেঁ যেতাম। একদিনে আর কয়বার ভিজঁব! ”

সূচনা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারে না, হেসে ফেলে৷ তার হাসি দেখে প্রণয় ও হেসে ফেলে। প্রণয় পূর্ণ দৃষ্টি তে মেয়েটার দিকে তাকায়। তার কেবলই মনে হয় পদ্ম ফুল হাতে আরেকটা ফুল দাঁড়িয়ে হাসছে। প্রণয় তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয়। সূচনা খেয়াল করে অবশ্য, সে কিছু টা গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

” যে কারণে পাঠানো হয়েছে আপনি সে কথা এখনো বলেননি। ”

” অস্বস্তি হচ্ছে। ”

প্রণয় চট করেই সূচনার কথা বুঝে যেয়ে উত্তর দেয়। সূচনা ও ফটাফট জবাব দেয় যেন উত্তর আগে থেকে ই ঠিক করা ছিল। সে সহজ গলায় ই বলে,

” আপনাকে নিয়ে ট্রেনে ও কোনো খারাপ ধারণা আসেনি৷ এখনো আসছেনা শুধু দুপুরের কথায় একটু… তবে আপনি অতটাা ও খারাপ না। ”

” মানে আপনার পছন্দ হয়েছে না মনে মনে! ”

প্রণয়ের দাঁত কেলানো দেখে সূচনা চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

” আপনি সত্যি ই বা জে ছেলে। মনে মনে পছন্দ হতে যাবে কেন! একটু প্রশংসা করলেই হয়েছে.. ”

সূচনার এহেন কথায় মুখ চুপসে যায় প্রণয়ের। কিছুটা মুখ ভার করে ই সূচনাকে বলে,

“আচ্ছা এবার বাসায় যান, সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ”

সূচনা মাথা নাড়ায়, যাওয়ার জন্য অগ্রসর হয়। প্রণয় পেছনে ঘুরে একবার তাকে দেখে ফের বিলের পানিতে চোখ স্থির করে। পানিগুলো টলমলে, ওপরের পানিগুলো কেমন স্বচ্ছ মনে হচ্ছে। ফুলগুলো কী অদ্ভুত সুন্দর!

” আপনাকে এখন অপছন্দ হচ্ছে না বা জে ছেলে। ”

প্রণয় চমকায়, চকিত ঘাড় ঘুরায়, সূচনা বাড়ির রাস্তায় পা বাড়িয়েছে। যেতে যেতে বলে গেছে কথাটা। সত্যি ই সে বলেছে নাকি কান বাজছে তার! বললে তো আগেই বলতে পারত। কীভাবে দ্বিধায় ফেলে গেল। কী আশ্চর্য মেয়ে!

#চলবে

প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০২

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#পর্ব_০২
#নাজিয়া_শিফা( লেখনীতে)
_______________________________
বিষন্ন মনে, আনমনা হয়ে জানালার ধারে বসে ছিল মেয়েটা। এর মধ্যেই কেউ এসে খবর দিল, ঢাকা থেকে লোক এসেছে৷ বিয়ে ভেঙে দেয়া সেই পরিবার হতেই তিনজন লোক এসেছে। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তারই ফুপাতো ভাইয়ের জন্য ফের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। আঁখি জোড়া শুঁকিয়ে যাওয়ার আগেই ফের সিক্ত হয় সূচনার। রা গে, ক্ষোভে ফে টে পড়ে মেয়েটা। নিজেকে ঠিকঠাক করে সে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হয় বসার রুমে। দুজন মহিলা আর একজন মধ্যবয়সী পুরুষ। একজনকে সূচনা চেনে, ছেলের মা সে। সূচনা সালাম দেয়, সরাসরি জিজ্ঞেস করে,

” আপনারা এখানে কেন এসেছেন? ”

সোজাসাপটা প্রশ্নে অপমানিত হওয়ার কথা থাকলেও একজন মহিলা খুবই নম্র গলায় বললেন,

” দেখো মা, আমাদের পুরো পরিবারের ই তোমাকে পছন্দ হয়েছিল। সেজন্য ই তোমাকে নিজের একমাত্র ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু ছেলেটা শেষ মুহূর্তে যেয়ে বললো, তার নাকি কার সাথে প্রেমের সম্পর্ক। তাই..সে যাই হোক, আমার ননদের ও তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে৷ সেজন্য চাইছিল যে তার ছেলের জন্য তোমাকে নেয়া গেলে…”

” আপনাদের মনে হয়েছে আর মুখ উঠিয়ে চলে এসেছেন! তাই না! একবার ও মাথায় কাজ করলো না যে, আপনাদের জন্য একটা মেয়ের মান সম্মানের কী হলো! ”

” আমাদের ভুল হয়েছে, ভুল শোধরানোর জন্য ই এই কথা বলছি। ”

” আপনাদের সমাধান চাইনি আন্টি, যা করেছেন তাই অনেক। এখন আপনারা আসুন। ”

মহিলা দুজন আরও কিছু কথা বললো, দিশা বেগম কোনোভাবে ই পারলেন না তাদের কড়া কথা শোনাতে। মিনমিনে গলায় কয়েকটা কথা বলছেন কিন্তু তার থেকে তাদের গলার স্বর স্পষ্ট। সূচনা যে গতিতে এসেছিল সে গতিতেই পুনরায় নিজের কক্ষে গেল। বিছানার ওপর পড়ে থাকা শপিং ব্যাগগুলো হাতে নিল, আলমারি তে থাকা পার্স হতে টাকা ও নিল। ফের বসার রুমে গেল, শপিং ব্যাগ আর টাকা গুলো টেবিলের ওপর রেখে বললো,

” এই ব্যাগগুলো তে কিছু জিনিস আছে, আপনাদের দেয়া টাকা দিয়ে কেনা। আর এই টাকা গুলো ও আপনাদের। নিয়ে যান এগুলো, আর দ্বিতীয় বার এই বাড়ি মুখো হবেন না। আপনারা বয়সে আমার অনেক বড়। আমি চাই না আপনাদের সাথে আর খারাপ আচরণ করি। ”

আর কোনো বাক্য বিনিময় হলো না, নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ওনারা প্রস্থান করলেন। সূচনা ও আর দাঁড়ালো না, মায়ের সঙ্গে ও কথা বললো না। মেয়ের এহেন আচরণে দিশা বেগম ও টু শব্দ টি করলেন না।


দুপুরের প্রহর, আকাশে কালো মেঘেদের ঘনঘটা, দুপুর বেলাকে ও সন্ধ্যে মনে হচ্ছে যেন। কর্দমাক্ত উঠান, গত রাতে বৃষ্টি হয়েছিল যে! টিনের চালে বৃষ্টির টুংটাং শব্দ হচ্ছে এখন। সম্ভবত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। বিষন্ন মনে জানালার ধারে বসে থাকা সূচনার বিষন্নতার পরিমাণ দ্বিগুণ হলো এমন পরিবেশে। এতক্ষণ কান্না করলেও এখন আর কাঁদছে না। চোখের দৃষ্টি ও স্বাভাবিক, সে তাকিয়ে আছে গেটের দিকে। তার রুমের জানালা হতে গেটটা বরাবর ই স্পষ্ট দেখা যায়। হঠাৎ ই গেটের বাইরে একটা অটোরিকশা এসে থামলো। সূচনা আগেই দূর থেকে সেটা লক্ষ্য করলেও ভেবেছিল অন্য কোথাও চলে যাবে। কিন্তু তাদের বাড়ির সামনেই এসে থেমেছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে, জানালা বন্ধ করে দিল স্ব শব্দে। নিজের কাজে নিজেই অবাক হয় সে। কে এসেছে তার তো জানা নেই, এভাবে লুকালো কেন!


দিশা বেগম সবে বাইরে থেকে শুকনো কাপড় চোপড় ঘরে এনে রাখছিলেন। বৃষ্টি তে খানিক ভিজেঁ ও গেছে। তন্মধ্যে দরজায় চোখ যেতেই বিস্মিত হন তিনি। এহতেশাম আহমেদ সালাম দিলেন ওনার নজরে পড়তেই। দিশা বেগম অবাক ভাব নিয়েই সালামের জবাব দিলেন। নুরাইয়া কাছে এসে কুশলাদি করলেন। ওনাদের বসতে দেয়া হলো সোফায়। দিশা বেগম এখনো অবাক হয়ে আছেন। এহতেশাম সাহেব ওনার পুরো পরিবার সমেত তাদের বাসায় উপস্থিত হয়েছেন, ওনার ছেলে সমেত। তাতে অবাক হওয়ার ই কথা। এহতেশাম সাহেব সূচনার বিয়ে ঠিক করা হতে, ভেঙে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছু নিয়েই কথা বললেন। বিয়ে ঠিক করার আগে এহতেশাম সাহেব ও খোঁজ খবর নিয়েছিলেন। ছেলের ব্যাপারে খারাপ কিছু পাননি, বলেছিলেন মেয়ের মত থাকলে দিতে পারেন ভাবি।

সূচনার বাবা আরহাম সাহেবের ভালো বন্ধু এহতেশাম সাহেব। বন্ধুর মৃত্যুর পর আড়ালে থেকে হলে ও বন্ধুর পরিবারকে সাহায্য করেছেন টুকটাক। নুরাইয়া ও যোগাযোগ রেখেছেন। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে ছেলেমেয়ে গুলোর মধ্যে যোগাযোগ ছিল না। সেই প্রসঙ্গ বাদ যাক, এহতেশাম সাহেব সব কথার শেষে অনুতপ্ত হয়ে বললেন,

” ভাবি, আমি আর আরহাম তো বন্ধু ছিলাম। আমাদের আলাদা আলাদা করে দুজনেরই ছোট ব্যবসা ছিল। প্রণয় যখন হবে তখন অর্থনৈতিক দিক থেকে আমার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এমনকি চিকিৎসা, নুরাইয়ার ডেলিভারি, ঔষধ এসবের জন্য যেই পরিমাণ টাকার দরকার ছিল আমার কাছে তাও ছিল না। তখন আরহাম ই সাহায্য করেছিল আমায়, শুধু তখনই না, এসবের পরেও নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে ও টাকা দিয়েছিল আমায়। এখন যা আছে সবই ওর জন্য। আমার ওপর ওর অনেক ঋণ, যা শোধ করার মতো না। শোধ করার সুযোগ ও তেমন পাইনি। কিন্তু আমার মনে হয় একটা সুযোগ আমি এবার পেয়েছি। আপনার মেয়েকে আমি নিজের ছেলের বউ আর আমার মেয়ে হিসেবে নিতে চাই। ”

শেষোক্তি তে দিশা বেগম বজ্রাহত হলেন। অন্য দিকে বাবা আর তার বন্ধুর মধ্যে হওয়া ঘটনা গুলো শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেছে ইরা ও প্রণয়। দুই ভাই বোন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে শুধু। তারা তো এসব কিছু সম্পর্কে কোনো কালেই অবগত ছিল না। শুধু আরহাম নামটা শুনেছে, বাবার বন্ধুর নাম। কিন্তু এতকিছু তো জানা ছিল না!

” ভাইজান, সূচনা এমনিতেই ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যে..

দিশা বেগমের কথায় ঘোর কাটলো তাদের, এদিকে সূচনা নামটা শুনেই প্রণয় খানিক ভড়কালো। নামটা চেনা চেনা ঠেকঁছে তার কাছে। কোথায় শুনেছে ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে, সেই হলদেটে ফর্সা বর্ণের, হিজাব পড়া, নাকে নোজ পিন ওয়ালা মেয়েটা! যাকে দেখতে প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর মনে হয়েছিল! যার সাথে ট্রেনে পরিচয়, আবার ট্রেন থেকে নেমেই লাপাত্তা হয়ে গেল! আচ্ছা এই মেয়ে কী সেই মেয়ে! অজান্তেই মনে উক্ত খেয়াল এলো। প্রণয় জানেনা তার এমন ভাবার কারণ। কিন্তু তবুও তার মনে হলো।তন্মধ্যেই দিশা বেগম আবার বললেন,

” ভাইজান, ঐ ছেলের সাথে বিয়ে ভাঙার পর, তার ফুপাতো ভাইয়ের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল তারা। এটাতে মেয়েটা আরও রে গে গিয়েছে। আমার সাথে ও কথা বলছেনা। এর মধ্যে আমি বিয়ের কথা আর তুলতে পারিনা। ”

এহতেশাম সাহেব হাল ছাড়লেন না, বললেন,

” আরেকবার বলে দেখুন ভাবি, নুরাইয়া ও বলবে, দুজন মিলে বলুন। আর বিয়ে তো প্রণয় করবে, দরকার হলে প্রণয় কথা বলুক। যদি খারাপ না লাগে তাহলে তো সমস্যা নেই। আমার ছেলে তো আমার ওর ওপর বিশ্বাস আছে। আপনার তো আমার আর নুরাইয়ার ওপর বিশ্বাস আছে না! ”

” বিশ্বাস আপনাদের ওপর আছে ভাইজান। ওর বাবা মা রা গেল প্রায় আট বছর। এই আট বছরে পরিবারের মানুষ ও তো তেমন খোঁজ নেয়নি যতটা আপনারা দুইজন নিয়েছেন। আপনারা এক গ্রামে থাকেন, আমরা এক গ্রামে থাকি। কত লোকে জানতো না, কিন্তু খবর ও নেয়না। আপনারা ও চাইলে ভুলে যেতে পারতেন। ভুলেননি। কিন্তু আমার আর জোর করার বা কিছু বলার মুখ নেই ভাইজান। চাইলে ভাবি কথা বলতে পারেন, প্রণয় কথা বলে দেখতে পারে। হ্যাঁ না যেটাই হোক তার সিদ্ধান্ত তেই সব হবে। ”

একটু যেন ভরসা পেলেন এহতেশাম সাহেব ও নুরাইয়া বেগম। নুরাইয়া নিজে গেলেন না, পাশে মুখ ভার করে বসে থাকা ছেলের কানে ফিসফিস করে বললেন,

” হা দা র মতো এখনো বসে আছিস কেন! যা। ”

প্রণয় খানিক অপমানিত বোধ করলো, তার ভাষ্যমতে বিয়ের আগেই এই মেয়ের জন্য মায়ের থেকে ইজ্জতের রফাদফা হয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত বিয়ে হয়ে গেলে তার পর কী হবে? ভাবতে ভাবতে প্রণয় উঠে দাঁড়ায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ইতিমধ্যে তীব্র বর্ষণে রূপ নিয়েছে। ব জ্র পা ত ও হচ্ছে, দিশা বেগম বাড়ির ছোট মেয়েটিকে ডাকলেন, তার নাম ফরিদা। বয়স সতেরো, চাপা গায়ের রঙ, রোগা-সোগা মেয়ে। এই বাড়িতেই থাকে, বর্তমানে পুরো দুনিয়ায় তার আপন বলতে তার সূচনা আপা আর দিশা আম্মা ই আছে। ফরিদা আসলো, তাকে সূচনার কথা জিজ্ঞেস করা হলে বললো,

” আপা তো রুমে আছে। ”

রুমে আছে শুনে দিশা বেগম প্রণয়কে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিলেন। ফরিদা তাকে নিয়ে যাবে, ফরিদার পেছন পেছন য়ায় প্রণয়। ভেতরের দিকে রুমের সামনে দিয়ে ফরিদা চলে যায়। দরজা খোলা, প্রণয় লম্বা শ্বাস টা নে। সব চিন্তা, উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা এক পাশে রেখে সে রুমের ভেতরে পা বাড়ায়। কিন্তু পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে কাউকে নজরে আসেনা। চলে আসবে কি না ভাবে তখনই তার চোখ যায় জানালা ভেদ করে বাইরের উঠানের দিকে। ভারি, বর্ষণে, কর্দমাক্ত উঠানে ছাই রঙা শাড়ি পড়নে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। পড়নের শাড়িটা তো ভিজেঁ একাকার। মেয়েটা স্থির এক জায়গা তেই, কোনো নড়চড় নেই। হঠাৎ ব জ্র পা তের শব্দে মনোযোগ নষ্ট হয় প্রণয়ের। সচকিত হয়, ব জ্র পা ত হচ্ছে, এত বৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে এই মেয়ে এমন স্বাভাবিক ভাবে কোনো নড়চড় না করে দাড়িঁয়ে আছে কীভাবে! প্রণয় গলা উঁচিয়ে একবার ডাকতে নিয়েও থেমে যায়। সে এখান থেকে ডাক দিলে ঘরে উপস্থিত মানুষগুলো ও তো শুনবে। সে ডাকে না, রুম থেকে বের হয়ে আসে, ফরিদার খোজেঁ। সৌভাগ্য বশত সে ফরিদা কে পায় পাশের ছোট রুমটাতেই। দেখে মনে হলো এই ছোট্ট রুমটাতেই ফরিদা থাকে। প্রণয় রুমে প্রবেশ করে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে,

” শোনো মেয়ে, তোমার আপা, সে তো রুমে নেই। বাইরে উঠানে বৃষ্টি তে ভিজঁছে। তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো যেয়ে। ”

ফরিদা মেয়েটা উক্ত বাক্য শুনতেই হাতের কাজ ফেলে এক প্রকার দৌড়ে তার রুম হতে বেরিয়ে যায়। সূচনার রুমে যেয়ে জানালা দিয়ে সূচনাকে দেখে। অতঃপর ঘর থেকে বের হতে নেয় কিন্তু থেমে যায়। তার থেমে যাওয়াতে প্রণয় অধৈর্য হয়ে বলে,

” থেমে গেলে কেন! যাও! ”

মেয়েটা ইতস্তত, ভীত স্বরে বলে,

” আ..আসলে ভাইজান বাইরে তো ঠা ডা পড়তাছে, আমার ম্যালা ভ য় লাগে। আমি যামুনা। ”

প্রথমত মেয়েটার এলোমেলো কথা, আর দ্বিতীয়ত এই সময়ে তার ভ য় কে প্রাধান্য দেয়ায় প্রণয় আরও বিরক্ত হয়। রা গা ন্বি ত কণ্ঠে বলে,

” তোমার আপার এই অবস্থা আর তুমি ভ য় নিয়ে পড়ে আছো? ”

” আপারে আমি ম্যালা ভালা পাই ভাইজান কিন্তু আমার ভ য় লাগে ভাইজান। ”

মেয়েটা আগের ন্যায়ই ভীত কণ্ঠে বলে। তার কণ্ঠে প্রণয় খানিক নরম হয়। সে কিছু বলার পূর্বেই মেয়েটা আবার বলে,

” ভাইজান আপনে যান, আপারে নিয়াহেন। এই যে এইহান দিয়া একটা বারান্দার লাহান আছে, দরজা খুইল্যা দেই, আপনে যান। ”

প্রণয় চকিতে তাকায় ফরিদার দিকে, ফের তাকায় জানালার দিকে। সে যাবে! তন্মধ্যে ই ফরিদা মেয়েটা হাতের বাম পাশে টিনের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা কাঠের টেবিলটা সরিয়ে, সেখান দিয়ে ছোট দরজার মতো খুলে দিয়েছে। প্রণয় দোটানায় পড়ে একবার দরজার দিকে তাকায় আরেকবার জানালা দিয়ে মেয়েটাকে দেখে। ফরিদা হাতে একটা ছাতা ধরিয়ে দেয় তাকে, অতঃপর আর কিছু না ভেবে প্রণয় উঠানে কদম রাখে। এগিয়ে যায় মেয়েটার দিকে, এতক্ষণে মেয়েটার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে একটু পরিবর্তন লক্ষ্য করে সে। প্রণয় পেছনে যেয়ে দাড়িঁয়ে মেয়েটার নাম ধরে ডাকতে নেয়। প্রথমবারে হয় না, কেমন আ ট কে যায়। ফের চেষ্টা করে, অর্ধেক এসে বাকিটুকু আ ট কে যায়। নিজের ওপর বেশ বিরক্ত হয় প্রণয়, এক মেয়ের নাম ধরে ডাকতে এত ভ য় – ভীতি কিসের! তৃতীয় বারের ন্যায় চেষ্টা করে, এবার সফল হয়, পুরো নামটা ই নেয় কিন্তু বৃষ্টির ঝুম শব্দে সম্ভবত মেয়েটা শুনতে পায় না। প্রণয় এবার গলার স্বর আরও উঁচু করে ডাকে। এবার মেয়েটা শুনতে পায়, চকিতে পেছনে তাকায়। অতঃপর দুজনের দৃষ্টির মিলন হলে দুজনই হতবিহ্বলের ন্যায় তাকিয়ে থাকে কয়েক পল। ট্রেনে পরিচয় হয়ে ট্রেন থেকে নেমেই লাপাত্তা হয়ে যাওয়া মেয়েটা তার সামনে। যাকে দেখে প্রেমে পড়া নিয়ে প্রশ্ন জাগা সেই মেয়েটা ই তো সামনে! প্রণয়ের তো এমনি এমনি খেয়ালে এসেছিল। অথচ সত্যি সত্যি ই এমন কিছু হবে সে ভাবেনি।

” আপনি এখানে? ”

অভাবনীয় ঘটনা ঘটায় ছেলেটা ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন। কিছু বলতে পারছেনা, সূচনা তার নীরবতা দেখে ফের প্রশ্ন করে,

” আপনি এখানে কী করছেন? ”

এবার মুখ খোলে প্রণয়, থেমে থেমে বলে,

” আমি..আসলে..ভেতরে চলুন। ভেতরে যেয়ে বুঝিয়ে বলি! ”

” বৃষ্টিতে ভেজাঁর শখ তাহলে ছাতা এনেছিলেন কেন! ”

প্রণয় বোঝেনা, কেমন ঘোরগ্রস্তের ন্যায় বলে,

” হু..? ”

” ছাতা নিচে পড়ে গেছে, আপনি ভিজেঁ গিয়েছেন। ”

এবার যেন হুঁশ ফেরে ছেলেটার, খেয়াল করে ছাতা তার হাতে নেই। নিচে তাকিয়ে দেখে ছাতা নিচে পড়ে আছে। তার পড়নের শুভ্র পাঞ্জাবি, পায়জামা ভিজেঁ একাকার। সে এসেছিল সূচনাকে নিতে এখন নিজেই কাক ভেজাঁ। নিজের এহেন কান্ডে সে অবাক, বিরক্ত দুটোই হলো। বুঝে উঠতে পারলো না, ছাতা হাত থেকে কখন পড়লো আবার!

” ভেতরে যান। ”

” আমি আপনাকে নিতে এসেছিলাম। ”

” আপনি যান, আমি আসছি। ”

প্রণয় শুকনো ঢোক গিললো, তর্ক সে এখন করবেনা, করার ইচ্ছে নেই। সে চট করে সূচনার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। কোনো বাক্য বিনিময় না করেই সে হাটাঁ দিল ঘরের উদ্দেশ্যে।
পাশাপাশি, হাত ধরে হাটাঁ দিয়ে তবে কী নতুন পথচলার শুরু নাকি এখানেই শেষ!

#চলবে