Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 401



প্রণয় ডোরে বেঁধেছি পর্ব-০১

0

#প্রণয়_ডোরে_বেঁধেছি
#সূচনা_পর্ব
#নাজিয়া_শিফা(লেখনীতে)

” আপনি একটু আমার সিটটায় বসবেন? ”

উক্ত বাক্য শুনে ফোনের দিকে আবদ্ধ দৃষ্টিজোড়া স্থির হলো সামনে বসে থাকা মেয়েটার পানে। প্রণয়ের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে। মেয়েটাকে ভালো করে পরখ করে বলল,

” কেন? কোনো সমস্যা? ”

” হ্যাঁ আসলে..”

মেয়েটা পুরো কথা শেষ করল না, ইতস্তত বোধ করল বোধহয়। প্রণয়ের ভ্রু জোড়া তখনো কুঞ্চিত। খানিক বিরক্তির সুরে বলল,

” জানালার পাশেই তো সিট, একই তো। বদলানোর কী আছে? বুঝলামনা। ”

মেয়েটা সম্ভবত একটু অপমানিত বোধ করল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল, কিছু বলল না আর। মিনিট দুয়েক বাদেই প্রণয় নিজের ফোন আর পানির বোতল টা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাকে দাঁড়াতে দেখেও মেয়েটার ভ্রুক্ষেপহীন ঠায় বসে রইল। নড়ল না পর্যন্ত। প্রণয় ফের বিরক্তি নিয়ে বলল,

” না উঠলে কী আপনার কোলে বসব? ”

প্রণয়ের এহেন বিরক্তি মাখা উক্তিতে হকচকায় মেয়েটি। চকিত নেত্রে প্রণয়ের দিকে তাকাল, সাথে সাথে ই উঠে দাঁড়াল। দুজনে নিজেদের জায়গায় বদল করল। প্রণয় ফের ব্যস্ত হলো ফোনে। প্রচন্ড মাথা ব্যথা, সাথে মাইগ্রেনের সমস্যা। তার ওপর ট্রেনের দুলুনি আর শব্দ যেন মাথা ব্যথা তীব্র করছে মেয়েটার। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ঔষধ বের করল সে। ঔষধ খেয়ে নিয়ে মাথাটা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখল। এর পরপরই মেয়েটার দিকে তাকাল প্রণয়। হালকা গোলাপি রঙের গাউন তার সাথে নীল রঙা হিজাব পড়া মেয়েটা। সাদামাটা, হলদেটে ফর্সা বর্ণের গোলগাল মুখ, ঈষৎ বোঁচা নাক, তাতে সোনালী রঙের নথ পর্যন্ত সব কিছু ই খেয়াল করল প্রণয়। মেয়েটা সুন্দর, প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর। তার কী প্রেমে পড়া উচিত? প্রশ্নটি মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই নড়েচড়ে বসল প্রণয়। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই লক্ষ্য করল হাতের ডান পাশে তার সিট থেকে দুই সিট সামনে একটা মোটামুটি বয়স্ক লোক তাকিয়ে আছে। প্রণয়ের মনে সন্দেহ জাগে, মেয়েটা কী এজন্য ই সিট পরিবর্তন করল? এমন হলে তো সে খারাপ ব্যবহার করেছে মেয়েটার সঙ্গে। তার কী ক্ষমা চাওয়া উচিত? সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে। বেশ কিছু সময় নীরবতা বিরাজমান। ট্রেন চলতে থাকে নিজ গতিতে।


প্রকৃতির চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখতে মাথা ব্যথা নিয়ে ও মেয়েটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রণয় কিছুক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করছে কথা বলার কিন্তু পারছে না। পাছে মেয়েটা যদি মনে করে‚ মেয়ে দেখেই ভাব জমাতে এসেছে!

” আপনি কিছু বলবেন? ”

সহজ গলায় করা প্রশ্ন। প্রণয় উহুম শব্দে গলা ঠিক করে, তারপর বলে,

” হ্যাঁ আসলে আপনি সিট পরিবর্তন করেছেন কী এর জন্য? ”

সামনের দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে প্রণয়। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বোঝে মেয়েটা। ইতস্তত ভাব রেখেই বলে,

” হ্যাঁ আসলে সামনের ঐ লোকটা বসার পর থেকে ই কেমন দৃষ্টি তে যেন তাকিয়ে ছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল তাই..”

” বুঝতে পেরেছি। সরি আমি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। ”

” সমস্যা নেই। ”

মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে মেয়েটা। প্রণয় ঈষৎ হেসে জিজ্ঞেস করে,

” আপনার নাম? ”

” সূচনা কবির তানজুম। আপনার? ”

” প্রণয় আহমেদ। ”

” গন্তব্য? ”

” চট্টগ্রাম। আপনার? ”

” চট্টগ্রাম ই। ”

ছোট্ট জবাবের পর প্রণয় আর কিছু বলল না। পিন পতন নীরবতায় কা টে কিছুক্ষণ। মাথা ব্যথা খানিক কমে যাওয়ায় এখন অনেকটাই শান্তি লাগছে। প্রণয় চোরাচোখে এক পলক তাকায় তার দিক। ফের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। জরুরি তলবে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে তার। জরুরি কারণ টা ঠিক কী সেটা জানে না ও। শুধু এতটুকুই জানে, বাবা যেতে বলেছেন সুতরাং যেতে হবে। বাবার আদেশ পেয়ে তৎক্ষনাৎ ছুট লাগিয়েছে। তৈরি হয়ে রওনা হয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। এত তাড়া দিয়ে গ্রামে নেয়ার কারণ টা সে জানে আর তেমন পাত্তা ও দেয় না। অথচ ছেলেটা জানেই না তার জীবন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে চলছে।


টানা চার ঘন্টার জার্নি শেষে নিজের বাসায় এসে পৌঁছায় প্রণয়। সূচনা নামের মেয়েটাকে সে হারিয়ে ফেলেছে স্টেশনেই। আর দেখলোই না ট্রেন থেকে নামার পর। প্রণয়ের ভারি অবাক লাগে, মেয়েটা গেল কই! পরমুহূর্তেই ভাবে স্টেশনে এত ভীড়ের মধ্যে একটা মেয়েকে এভাবে খুজেঁ পাওয়া তো সহজ নয়। সে ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়েঁ ফেলার চেষ্টা করে। বাড়িতে পোঁছেই মাকে ডাকতে শুরু করে। নুরাইয়া ছেলের গলার আওয়াজ পেয়ে এক প্রকার দৌড়ে আসেন রান্নাঘর হতে। এতদিন পর ছেলেকে দেখে মুখে হাসির সাথে সাথে আঁখি জোড়া সিক্তও হয়। ছেলের বাহুতে হাত রেখে কপালে আদুরে চুমু খান। আহ্লাদী স্বরে কত কথা বলেন। প্রণয় নিজেও মায়ের খোঁজ নেয়। ততক্ষণে ছোট বোন ইরা ও ভেতরের কক্ষ হতে বেরিয়ে আসে। ভাইকে দেখেই সালাম দিয়ে হালচাল জেনে নেয়। প্রণয় তন্মধ্যে ই জিজ্ঞেস করে,

” বাবা কোথায়? ”

নুরাইয়া বলেন,

” আগে হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নেয় তারপর দেখা করিস। ওনার জরুরি কথা শুরু হলে খাওয়ার দেরি হয়ে যাবে। কত পথ জার্নি করে আসছিস! ”


পুরো বাড়ি সাজানো, অথচ বাড়িটাতে বিয়ে বাড়ির ন্যায় কোনো আমেজই নেই। সব কেমন নিস্তব্ধতায় মোড়ানো। বাড়ির উঠোনে পা দিতেই সূচনার বুক কেমন করে ওঠে। এত নীরবতা কেন! সে টিপটিপ পায়ে সদর দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়ির ভেতরের মানুষ দের নজরে পড়তেই কেউ একজন বলে ওঠে,

” আহারে, সূচনা। কত আশা নিয়ে বিয়ে করতে রাজি হইছিলি আর কী হয়ে গেল! ”

সূচনার কানে আসে কথা কিন্তু মস্তিষ্ক কাজ করে না, কথার মানে বুঝতে পারে না। খেয়াল করে কথাখানা তার বড় খালা বলেছে। মুখে আঁচল চেপে উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিক। এর মধ্যেই সূচনার মা দিশা ছুটে এলেন। সূচনা কে টেনে নিয়ে গেলেন কোথাও। কোনো কক্ষে! কক্ষের দরজা ও বন্ধ করে দিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় তেমন কিছু ই বোধগম্য হলো না মেয়েটার। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু।

বাবা ম রা মেয়ে, তার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে খবরটা ইতিমধ্যে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। সূচনাও একটু আগে অবগত হয়েছে সে সম্পর্কে। তার মা দিশাই জানিয়েছে তাকে। এমন খবরে সূচনা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। সে বুঝতে পারছে না তার এই মুহূর্তে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। তার থমথমে মুখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে, বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার শোকে মেয়ে টা পাথর হয়ে গেছে।তার মায়েরও এমন মনে হচ্ছে। উনি বিচলিত হয়ে উঠলেন, কান্নারত কণ্ঠে বললেন,

” কিরে কিছু বল! চুপ করে আছিস কেন! ”

” একটু একা থাকতে দিবে? ”

আর কিছু বলতে পারলেন না দিশা। বিনা বাক্য ব্যয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন। থমথমে মুখ এতক্ষণে কোমল হলো। পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। কেমন শ্রান্ত‚ বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। কিয়ৎক্ষণের মাঝেই নেত্রযুগল সিক্ত হলো। জীবনে উত্থান পতন কী তাদের কম হলো! অভাব, অপমান, নিন্দা তাও তো কম ছিল না। এখন নতুন করে আরেকটা!


স্বাভাবিক, স্থির দৃষ্টিতে বাবার দিকে নেত্রযুগল আবদ্ধ প্রণয়ের। কিঞ্চিৎ পরিমাণ বিষ্ময়ও বটে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ বললে ভুল হবে। পরিমাণটা এরও অধিক হতে পারে। মায়ের মুখে সেই একই কথা শুনে মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছে তার। নিস্তব্ধ, নির্বাক প্রণয় চুপটি করে বিছানার উপর ঠায় বসে রইল। কী বলছে তারা! বিয়ে করে নেয়! বললো আর বিয়ে করে নিল! তাও এমন একজনকে যাকে এই অবধি দেখেনি। এহতেশাম আহমেদ ততক্ষণে কক্ষ ত্যাগ করেছেন। প্রণয় এবার সাহস করে মুখ খুললো। মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

” মা তোমরা কী শুরু করেছো এসব? ”

নুরাইয়া থমথমে গলায় বললেন,

” দেখ প্রণয়, এবার আর তোর মর্জি চলবেনা। যা যা করতে চেয়েছিস সব করতে দিয়েছি। শহরে যেয়ে পড়তে চেয়েছিস দিয়েছি। তোর বাবার বিরুদ্ধে যেয়েও, কথাও শুনেছি। কিন্তু এবার না। এবার উনি যা বলছেন তাই কর। বাপ ম রা মেয়ে, মা কষ্ট করে বড় করেছে। যথেষ্ট ভালো, দেখতে সুন্দর, পড়াশোনায় ও ভালো। আমাদের ইরা শহরে যে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ও সেখানেই ভর্তি হয়েছে। বিয়ে ও ঠিক হয়েছিল সেই শহরে ই। কিন্তু বিয়ে তো ভেঙ্গে গেল। গ্রামের অবস্থা তো বুঝিস ই৷ একটা কিছু হলে কেউ সাহায্য করতে না পারলেও ব দ না ম ঠিকই রটাতে পারে। আর এটাতো বিয়ের মতো ব্যাপার। ”

” সেই মেয়েকে বাঁচাতে বাবা তার ছেলেকেই কু র বা নি দিয়ে এলো! ”

” এভাবে বলিস না। মেয়েটা তোর অযোগ্য না কোনো অংশে। হয়তো পরিবার, টাকা-পয়সার দিক দিয়ে কম আছে। ”

” সবে তিনমাস হয়েছে চাকরি পেয়েছি এর মধ্যে ই এত বড় দায়িত্ব দিতে চাচ্ছো! আর বাবা যে শহরে বাড়ির কাজ করছে! এর মধ্যে এসব! ”

” বাড়ির কাজ প্রায় শেষ, আর তোর বাবা যা বলছে তা নিশ্চয়ই ভেবে চিন্তে বলছে। বাবার ওপর বিশ্বাস নেই? ”

নুরাইয়ার কথায় টনক নড়ে ওঠে তার। বাবার ওপর তো তার বিশ্বাস আছে। থাকবে না কেন! কিন্তু!

চলবে।

মনেরও গোপনে পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#শেষ_পর্ব
(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিলো সুমির। পাঁচ দিন পর সুমিকে আজ বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। এই পাঁচ দিন হসপিটালের বেডের পাশে ছায়ার মতো বসে ছিলো শরীফ। মিতুকেও মাঝে মধ্যে সুমির কাছে নিয়ে এসেছিলো। আনন্দে কেঁদে ছিলো সুমি। একটা মানুষ তাকে এতটা ভালোবাসে ভাবতেই শরীর শিউরে উঠে তার। রুদ্র এদিকে তালাকনামা তৈরি করে ফেলেছে। সুমির সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো এতদিন। সুমিকে দেখাশোনা করতে ফুলবানু আসেন প্রায়ই। আর রহমান তো থাকেনই। এক জীবনে এতটা ভালোবাসে পাবে ভাবতেও পারেনি হতভাগী সুমি।
” তোমার শরীর এখন কেমন আছে সুমি?”
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে রুদ্র মিহিকে নিয়ে সুমির ঘরে এসেছে। সুমি বিছানায় শোয়া ছিলো রুদ্রকে দেখে উঠতে চাইলে মিহি পাশে বসে সুমিকে আবারও শুইয়ে দেয়। ঘরের টিভিটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে মিতু বসার ঘরে টিভি দেখছে।
” ভালা আছি ভাইজান। আফনেগো যে ক্যামনে ধন্যবাদ দিমু হেই ভাষা আমার জানা নাই। ”
” ধুরর পাগলি,ধন্যবাদ দেবে কেনো? এটা আমাদের কর্তব্য। আচ্ছা শোনো,তোমার অনুমতি নিয়েই তো শরীফ আমাকে তোমার স্বামীর সাথে ডিভোর্সের কথাটা বলেছিলো। আমার সমস্ত কাজ শেষ। তুমি অনুমতি দিলে কালই তোমাদের গ্রামে যাবো সবুজের সাইন নিয়ে আসতে। ”
” আমার কোনো আপত্তি নাই ভাই। ওই জানোয়ারের জইন্য আমার বাচ্চা মইরা গেছে। ”
মুহুর্তেই ঝাপসা হয়ে গেছে সুমির চক্ষুদ্বয়। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কোনো মা ভুলতে পারে না কখনো। স্বামী শত অত্যাচার করলেও তাকে হয়তো ক্ষমা করা যায় কিন্তু সন্তান হত্যাকারী স্বামীকে কোনো মা মন থেকে কখনো ক্ষমা করতে পারে না।
” ঠিক আছে। ”
” তয় ও কি সই করবো? মনে হয় না। ও নিশ্চয়ই আমারে এত সহজে মুক্তি দিবো না। ”
” এজন্যই তো সরাসরি আমি যাবো। যাতে টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে কাজটা হাসিল করতে পারি। আমি ভাবছি অন্য কথা। ”
” কী ভাবছেন আপনি আবার? ”
মিহি রুদ্রর চিন্তাযুক্ত মুখাবয়ব দেখে শুধালো। রুদ্র ম্লান স্বরে বললো,
” সুমির বাবা-মা কেমন বলো তো? এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিলো!”
” আসলে ভাইজান তহন আমার বাপের মাথায় খালি একটাই চিন্তা ছিলো। শরীফের লগে বিয়া না হওয়ার চিন্তা। তাই ঠিকমতো খোঁজ না নিয়াই তার লগে বিয়া দিয়া দিলো।”
” সবকিছুর উর্ধ্বে তকদীর বলতে একটা বিষয় আছে সুমি। আমাদের প্রত্যেকের নিয়তি উপরওয়ালা যেমন লিখেছেন তেমনই হবে। এটা ভেবে নিজের মনকে শান্ত করো। ”
” হ আপা।”

” কী করছো?”
খিলখিল করে হাসতে হাসতে আদ্রিয়ানকে প্রশ্ন করলো রাহি। ছেলেটা তখন থেকে রাহির পেটে কান লাগিয়ে বসে আছে। রাহি বিছানায় শুয়ে আছে আর আদ্রিয়ান বসে মাথা ঝুঁকিয়ে আছে।
” বুঝতে পারছো না? আমাদের বেবি কী বলছে সেটা শুনতে চেষ্টা করছি। ”
” তাই বুঝি? তা কী বলছে শুনি!”
” বলছে, আমার বাবার মতো হবো আমি। মায়ের মতো মোটেও দুষ্ট হবো না। ”
” আমি দুষ্ট! ”
রাহি আদ্রিয়ানের পিঠে আলতো ঘুষি মারলো কয়েকটা। আদ্রিয়ান বসা থেকে শুয়ে পড়লো রাহির পাশে।
” তা নয়তো কী? মনে নেই বিয়ের আগে কতো দুষ্টমি করতে? কতোবার আমাকে ভয় দেখাতে মনে আছে? আমি প্রচুর জেলাস ছিলাম বলে প্রায় ছেলে বন্ধুদের নাম নিয়ে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করতে। ”
” সেটা তো মজা করতাম। ”
” হ্যাঁ আমি জ্বলে যেতাম। ”
” আগের মতো তো এখন ভালোবাসো না!”
রাহির দৃষ্টি উপরের দিকে। হঠাৎ মাঝখানের অসময়ের স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। না চাইতেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো রাহির বুক চিড়ে। আদ্রিয়ানের কেমন অপরাধী লাগছে নিজেকে। আলতো করে রাহিকে জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে হাতে হাত রেখে আদ্রিয়ান বললো,
” যা হয়ে গেছে তা কখনো বদলাতে পারবোনা আমি। কিন্তু কথা দিচ্ছি আমৃত্যু আমি তোমার থাকবো এবং ভালোবাসবো। প্লিজ কষ্ট পেও না লক্ষ্মীটি। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি… ”
” ঠিক আছে হয়েছে। আর বলতে হবে না, এখন ঘুমাও।”
” আচ্ছা। শুভ রাত্রি। ”

সকাল হতেই কুলসুমের বাড়িতে এসেছে সবুজ। বিয়ের জন্য যেনো তর সইছে না। কিন্তু কুলসুমের এক কথা! সুমিকে তালাক না দেওয়া পর্যন্ত সে সবুজকে বিয়ে করবে না।
” সুমিরে আমি কই পামু বল তো কুলসুম? ”
” হেইডা আমি ক্যামনে কমু? আপনার মাথা আপনার ব্যাথা। ”
সবুজ আর কোনো কথা বাড়ালো না। হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো কুলসুমের বাড়ি থেকে। দু-এক দিনের মধ্যে শহরে যাবে সুমিকে খুঁজতে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করে। বাড়ি ফিরতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়। কিন্তু বাড়ির সামনে যেতেই দেখে বড়সড় একটা চার চাকার গাড়ি। চমকায় সবুজ। এতো বড়ো গাড়ি তা-ও তার নিজের বাড়ির সামনে? গাড়ির সামনে যেতেই ভেতরে একজন লোককে কোট,সুট – বুট পরে বসে থাকতে দেখলো। এক নজর তাকিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে যাবে এমন সময় তার নাম ধরে ডাকলো রুদ্র।
” এই যে সবুজ মিয়া!”
লোকটার মুখে নিজের নাম শুনে তো সবুজের বিস্ময় কাটে না। রুদ্র এতক্ষণ নিশ্চিত ছিলো না এই লোকটাই সবুজ। কিন্তু যখন বাড়ির মধ্যে ঢুকতে গেলো তখন বুঝলো। সবুজ আবারও গাড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো।
” হ আমি সবুজ,তয় আফনে কেডা?”
রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে সবুজের সামনে দাঁড়ায়।
” আমাকে আপনি চিনবেন না তবুও ভদ্রতার খাতিরে পরিচয় দিতে হয়। আমি রুদ্র চৌধুরী, শহরের ডাক্তার। আপনার সাথে জরুরি কথা ছিলো।”
” আমার লগে আফনার জরুরি কথা! আসেন ঘরে আসেন বইয়া কথা কইবেন।”
সবুজের চোখদুটো লোভে চকচক করে উঠলো। শহর থেকে এসেছে তা-ও তার কাছে না-কি জরুরি কাজ! মনে মনে ভাবলো নিশ্চয়ই কয়েকটা টিকটক ভিডিও করে সে ভাইরাল হয়ে গেছে। তাই কোনো বড়ো মানুষ এসেছে কথা বলতে। এসব ভেবে রুদ্রকে নিয়ে নিজের ঘরে বসালো। টিনের ঘরে প্রচন্ড রোদের তাপ দুপরবেলা। রুদ্র গলার টা-ই আলগা করে গরমে হাসফাস করছে।
” তো সবুজ মিয়া যে কারণে এসেছিলাম, আপনার স্ত্রী সুমি ও মেয়ে মিতু এখন আমার বাসায় আছে।”
রুদ্রর কাছ থেকে এ ধরনের কথা আশাতীত ছিলো সবুজের। তাই স্বাভাবিকভাবেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। তবুও কুলসুমের কথা ভাবতেই মন ভালো হয়ে গেলো। এবার তাহলে সুমিকে তালাক দেওয়া যাবে।
” ও ভালা তো। আফনে তারা গিয়া বইলেন আমি তারে মুখে তালাক দিলাম। এক তালাক,দুই তালাক,তিন তালাক।”
সবুজের আচার-আচরণে রুদ্রর রাগ উঠে গেছে। একটা মানুষ এতটা জানোয়ার হয় কীভাবে? এতদিন পরে স্ত্রী, সন্তানের কথা শুনেও একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করালো না কেমন আছে? অবশ্য ভালোই হয়েছে। কোনো ঝামেলা ছাড়া তালাক দিয়ে দিবে।
” এভাবে মুখে বললে তো তালাক হয় না। আপনি বরং এই কাগজে সাইন করে দিন।”
রুদ্র নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বললো। কিন্তু সবুজ লেখাপড়া জানে না একবারেই। বিষয়টা রুদ্র আগেই আন্দাজ করেছিলো বলে টিপসই এর ব্যবস্থা রেখেছিল সাথে। সবুজ কোনো প্রথম প্রশ্ন না করেই ডিভোর্স পেপারে টিপসই দিয়ে দিলো। রুদ্র আর এক মুহুর্তও দেরি না করে বেরিয়ে আসে সবুজের বাড়ি থেকে। ইচ্ছে করছিলো কয়েক ঘা দিতে। কোথায় শরীফ আর কোথায় এই অসভ্য সবুজ! এসব ভাবতে ভাবতে গাড়িতে বসে ড্রাইভ করতে শুরু করলো রুদ্র।

ডিসেম্বরের রাত! ঢাকা শহরে মোটামুটি শীতের প্রকোপ বেড়েছে। শহরের অলিতে-গলিতে সোডিয়াম আলোর ছড়াছড়ি। জানালা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শরীর এলিয়ে দিলো রুদ্র।
” লোকটা কতবড় অসভ্য! ”
মিহি বিস্ময় নিয়ে বললো কথাটা। রুদ্র ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে আছে মিহির দিকে। সবুজের কর্মকাণ্ডের কথা শুনে মেয়েটা অবাক হয়েছে।
” হুম। মনে হয় সুমিকে ডিভোর্স দিয়ে বেঁচে গেলো।”
” বেঁচে গেছে সুমি,ওর মতো অসভ্য লোকের থেকে। আমি ভাবতেই পারছিনা! ”
” থাক এসব তোমার ভাবতেও হবে না মিহির দানা। তুমি বরং দেখো তো আমার ঠোঁট কেমন ফেটে গেছে। ”
রুদ্র কনুইতে ভড় দিয়ে শুয়ে আছে। মিহি বালিশ থেকে উঠে রুদ্রকে ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে নিজে তার বুকে শোয়। রুদ্র হাসছে। মিহি জানে এই হাসির মানে কী!
” বয়স তো কম হলো না। তা এতো ঢং কীভাবে করেন?”
” বউয়ের সাথে ঢং করা দোষের কিছু না। ”
” দাঁড়ান আসছি।”
” এই শীতে বুক ছেড়ে কই যাও?”
” আসছি বললাম না।”
মিহি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে পাশের ড্রয়ার থেকে ভ্যাসলিনের কৌটা নিয়ে ফের রুদ্রর পাশে বসলো। রুদ্র আগের মতো শুয়ে আছে। মিহি কৌটা থেকে আঙুলে ভ্যাসলিন নিয়ে রুদ্রর ঠোঁটে ভালো করে লাগিয়ে দিলো। রুদ্র বোকার মতো তাকিয়ে রইলো শুধু।
” এই নিন ডাক্তার সাহেব, আপনার ঠোঁটের চিকিৎসা। ফাটাফাটি বন্ধ হবে এবার।”
” মিহির দানা! ”
” জি বলুন। ”
” তুমি এত দুষ্ট হলে কবে?”
” যেদিন থেকে আপনি ন্যাকামি শুরু করেছেন সেদিন থেকেই। ”
রুদ্র মিহিকে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। গভীর আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো মিহি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেও যখন কাঙ্খিত জিনিস পেলো না তখন তাকিয়ে দেখলো রুদ্র মিটমিটিয়ে হাসছে।
” পাজি লোক একটা। যান আর কখনো আদর করতেই দিবো না। ”
” তুমি পারবে কাছে না এসে থাকতে?”
” বেশ পারবো।”
” কিন্তু আমি তো পারবোনা। আমার একমাত্র বউকে আদর না করে, ভালো না বেসে আমি থাকতেই পারবোনা। ”
” হয়েছে। আপনাকে না বললাম একটা ছাতা কিনে নিতে?”
” কালকে ভিজেছি বলে বলছো?”
” হ্যাঁ। অসময়েও তো বৃষ্টি আসে।”
” তা আসে। আমার ছাতাটা কয়েক বছর আগে খোয়া গেছে। ”
” হারিয়ে গেছে না-কি? ”
ছাতার কথা ভাবতেই মিহির পুরনো স্মৃতি মনে পড়লো। সেই ছাতাটা আজও রাখা আছে ও বাড়িতে।
” আরে না। একজনকে দিয়েছিলো আমার বন্ধু। গাড়িতে ছিলাম। বাইরে বৃষ্টি! এরমধ্যে দেখলাম একজন যুবতী ভিজতে ভিজতে কোথাও যাচ্ছে। হাতেই ছিলো ছাতাটা,শালা আমার হাত থেকে নিয়ে জানালা দিয়ে মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলো।”
মিহির বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো। কী শুনলো এটা? সেই মেয়েটা কী মিহি ছিলো? বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য মিহি শুধালো,
” তারপর মেয়েটা ফিরিয়ে দেয়নি? ”
” ফেরাবে কী করে বলো! গাড়ি তো থামাইনি। ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেছিলো যে মেয়েটা সম্ভবত দেখতে পর্যন্ত পায়নি কে দিয়েছে ছাতা।”
” আপনার বন্ধুর পরনে কী রঙের শার্ট ছিলো?”
” কেনো বলো তো মিহির দানা? ”
” আরে বলুন আগে তারপর বলছি।”
মিহির চোখমুখ কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। বিষয়টা বুঝতে পেরে রুদ্র আর কালক্ষেপণ না করে বলতে শুরু করে।
” নীল রঙের শার্ট পরে ছিলো আর আমি মেরুন রঙের। ”
মিহির সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। মানুষটা তাহলে রুদ্রর পরিচিত কেউ! মিহির চোখমুখ দেখে রুদ্র প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” তোমার কী হলো তাতে?”
” ওইদিন ওই মেয়েটা আমি ছিলাম। আপনার ছাতা এখনো যত্নে রাখা আছে। ”
” কী! দারুণ তো। তাহলে ওই বাড়িতে গিয়ে ছাতাটা নিয়ে এসো পরে। ”
” হ্যাঁ যাবো। এখন ঘুমান,রাত হয়েছে অনেক।”
” ঘুমাবো মানে? আজকে একুশে ডিসেম্বর, বছরের সবচেয়ে বড়ো রাত। সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে না?”
রুদ্র হেসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মিহিকে। কিন্তু মিহির মনে অন্য কিছু চলছে। মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে লড়াই চলছে তার। রুদ্র তার বর্তমান আর লোকটা কেবল দূরের মানুষ। এসব ভাবনা না ভেবে এই মানুষটাকে নিয়ে ভালো থাকাটাই এখন উচিত।
” কী হলো চুপ করে রইলে কেনো?”
” আপনি আমাকে ভালোবাসেন ডাক্তার সাহেব? ”
” অবশ্যই! বউকে তো ভালোবাসবোই। ”
” আজীবন এভাবেই ভালোবাসবেন তো?”
” নিসন্দেহে। কেবল ভালোবেসে বসে থাকবো না একটা ক্রিকেট টিমও গড়বো।”
মিহি হাসলো মুচকি। আলতো করে রুদ্রর ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো। ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক নয়। এই মানুষটাকে ভালোবাসে মিহি আর অদেখা মানুষটাকে ভালোলাগে। কিছু ভালো লাগা সারাজীবন মনের গোপনে রেখে দিতে হয়। এক জীবনে সবকিছু পাওয়া সম্ভব হয় না যে!
কয়েকদিনের মধ্যেই সুমি আর সবুজের তালাক সম্পন্ন হয়। সুমির শরীরও আগের চেয়ে মোটামুটি ভালো। মিতুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে রুদ্র। মিহিও মন দিয়ে সংসার করছে রুদ্রর সাথে। সময় চলছে তার আপন গতিতে। সামনের বৈশাখে সুমি ও শরীফের বিয়ে হবে বলে ঠিক করেছে সবাই। এরমধ্যে মিতু আরেকটু বড়ো হোক,আর সুমিও সুস্থ হোক একেবারে।
কয়েক মাস পর….
রাহির প্রসব বেদনা উঠেছে। প্রথমে নরমাল ডেলিভারিতে হওয়ার জন্য বেশ কিছুক্ষণ বাড়িতে নার্স আনিয়ে অপেক্ষা করেন রিনা বেগম। কিন্তু যখন নার্স বললেন বেবির পজিশন ঠিক নেই তখনই হসপিটালে নিয়ে ছুটলো সবাই। যদিও মিহি শুরু থেকেই হসপিটালে নিতে বলেছিলো। কিন্তু রিনা বেগমের কথামতো বাড়িতে নার্স এসেছিলো। আদ্রিয়ান অপারেশন রুমের বাইরে পায়চারি করছে। বাইরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মাগরিবের আজান দিয়েছে। সালমান খুরশিদ বসে আছেন করিডোরের চেয়ারে। মিহি এক পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি করছে। কারণ আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে আগেই জানা গেছিলো বেবির পজিশন ঠিক নেই। কিন্তু মিহির মায়ের খামখেয়ালি কথা, ডাক্তাররা না-কি ওরকম বলে যাতে সিজার করায় পেসেন্ট। আর সিজার করলেই তারা টাকা পায়!
” শোনো মা তোমার এসব আজগুবি কাজকর্মের জন্য যদি ভাবির কিছু হয় তাহলে কিন্তু তোমাকে কখনো ক্ষমা করবে না কেউ। ”
” চুপ কর তুই। কিছু হবে না আমার নাতিনাতনির। রাহিও সুস্থ থাকবে। এখানে ওর বাবার বাড়ির লোকজন আছে এসব আলোচনা বন্ধ কর।”
আসলেই রাহির বোন,দুলাভাই আছে এখানেই। তাই মিহি চুপ করে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আদ্রিয়ান ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো তার সামনে।
” ডক্টর আমার স্ত্রী কেমন আছে? আর বেবি?”
” বেবি মোটামুটি সুস্থ আছে কিন্তু অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। সরি টু সে মি.আপনার স্ত্রী’কে বাঁচাতে পারিনি আমরা।”
আদ্রিয়ানের কানের মধ্যে কেমন একটা ঝিমঝিম শব্দ হচ্ছে। কথাগুলো মনে হচ্ছে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মাথার মধ্যে। কোনো কিছু বলতে পারলোনা সে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো ফ্লোরে। মিহি দৌড়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। রিনা বেগম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। সালমান খুরশিদ দাঁড়িয়ে রইলেন শুধু। সবাই যেনো একটা ঘোরে আঁটকে গেছে।
” কী বলছেন ডক্টর? আমার বোন আর নেই! ”

রাহির বোন মিথিলা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। মিথিলার স্বামী পারভেজ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। একটা নতুন প্রাণ পৃথিবীতে আনতে গিয়ে হারিয়ে গেলো আরেকটা প্রান!

কুলসুম সবুজকে বিয়ে করেনি শেষ পর্যন্ত। শুধু পিছনে ঘুরিয়েছে এতদিন। এজন্য আজ সবুজ রেগেমেগে কুলসুমের কাছে এসেছে।
” তুই আমারে বিয়া করার কতা কইয়া করবি না ক্যান?”
” তোর মতো মাতালরে কেডায় বিয়া করবো? আমি কী সুমির মতো বলদি?”
সবুজ চমকায়! এত বড়ো অপমান?
” কুলসুম তুই নিজে কী? বারোবাতাড়ি মাইয়া একটা তুই। পুরুষ মাইনষেরে ভাইঙ্গা খাস তুই। ”
কুলসুম এগিয়ে এসে সপাটে চড় মারে সবুজের গালে। সবুজ রাগে কটমট করতে করতে কুলসুমকে মারতে যাবে এমন সময় দু’জন পুরুষ এসে মারতে শুরু করে সবুজকে। যখন সবুজের অবস্থা খারাপ হয়ে যায় তখন তারা কুলসুমের কথা মারা বন্ধ করে।
” বলছি না আমি সুমি না। মাইয়াডা ভালো ছিলো বইলা তর মতো বেডার লগে এতো বছর আছিলো। এরপর যদি তরে এই গ্যারামের আশেপাশে দেহি তাইলে পরাণ নিয়া ফিরতে পারবি না।”
সবুজের কিছু বলার মতো সাহস কিংবা অবস্থা কোনোটাই নেই। অনেক সময় নিয়ে কুলসুমের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সে। পকেটে ভাগ্য করে কিছু টাকা ছিলো বলে গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরতে সক্ষম হয়। আজ এত বছর পর সুমির গুরুত্ব বুঝতে পারছে সবুজ। কিন্তু কথায় আছে না দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য বোঝে না। তেমনই সময় গেলে আর সাধন হয় না।
সময় গড়ায় তার আপন খেয়ালে। সময়ের সাথে সবকিছুই বদলে যায়। এই গল্পের চরিত্রগুলোর জীবনও সময়ের সাথে সাথে আবর্তিত হবে। কিন্তু গল্পের সমাপ্তি এখানেই টানলাম। পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম সুমি আর শরীফের পরিণতি। তারা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিক এদের পরিণয়। আর সদ্য জন্মানো শিশু অর্পার ভবিষ্যতও!

সমাপ্ত

মনেরও গোপনে পর্ব-২৮+২৯

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৮
(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

সবুজ সিগারেটের বাকি অংশ না শেষ করেই মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো সেটা। রুহুল কবিরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঠিক কিন্তু কিছু না বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো সে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তার বিপক্ষে। বিকেলের দিকেই পাশের গ্রামে কুলসুমের সাথে দেখা করতে যায় সবুজ। কুলসুম দেখতে সুন্দরী, যথেষ্ট আকর্ষণীয়। আর সেই মোহে মজেছে সবুজ। কুলসুমের বিষয় এই গ্রামে মোটামুটি সবাই জানে। অনেকেই বলে অনেকগুলো বিয়ে করেছিলো সে। আবার অনেক পুরুষের সাথে বিনা বিয়েতেও শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। এতকিছু সবুজ জেনেও এই মেয়ের জন্যই উতলা হয়ে আছে। অবশ্য কুলসুম কীসের জন্য সবুজকে পাত্তা দিচ্ছে সেটা কারো বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ সবুজ তো আর্থিকভাবে সচ্ছল না।
বিকেলের ম্লান রোদ্দুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কুলসুম। বাড়িতে সদস্য বলতে কেউ নেই। একা একটা টিনের বাড়িতে থাকে সে। মাঝে মধ্যে লোকের বাড়িতে গিয়ে কাজকর্ম করে কুলসুম। কিন্তু সবাই কুলসুমের সাথে মেশে না।
সবুজ বারান্দায় চেয়ারে বসে একদৃষ্টি তাকিয়ে আছে কুলসুমের পাতলা শাড়ির দিকে। শাড়ি ভেদ করে তার দৃষ্টি এখন কুলসুমের শরীরের ভাঁজে। কুলসুম সবুজের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।
” কী দ্যাখতাছেন?”
সবুজ হাসলো। হাসির বদলে কুলসুম ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে সবুজের পাশে এসে বসলো। কুলসুমের কাছে ইশারা পেয়ে সহসাই সবুজ কুলসুমের হাত চেপে ধরে। কুলসুম আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিলো।
” বোঝোস না তুই? আর কতো দূরে দূরে থাকবি! এবার তো কাছে আয়।”
” আমারে পাওন এত্তো সোজা না সবুজ মিয়া। তা আফনের বউয়ের কোনো খবর পাইছেন? ”
সুমির কথা তুলতেই চকিতে মুখ গম্ভীর করে ফেলে সবুজ। মনে হচ্ছে সুমি নামটা এই মুহুর্তে অসহ্য লাগছে।
” জানি না। তয় ও ফিরলেও আমি তালাক দিমু।”
” দেহেন কী করবেন। তয় আমি আবার ভাগাভাগি করতে পারুম না। আমার সব লাগবো। ”
” তয় একখানা সমস্যা আচে।”
” কী সমস্যা? আফনের বউয়ের কাবিনের টেহা বেশি? ”
” আরে না কুলসুম। ওর পেটে তো বাচ্চা এহন। আর হুজুর কইলো এই অবস্থায় তালাক হইবো না।”
” ওওও। ”
কুলসুম বারান্দা পেরিয়ে বাইরে নামে। পিছনে পিছনে সবুজও হাঁটে। দুই গ্রামের লোকজন আড়ালে কানাকানি করে। সুমির মতো ভালো মেয়েটাকে কীভাবে সবুজের সাথে বিয়ে হয়েছিল সেসব নিয়ে কতো কথা।
দিন দিন শরীর খারাপ হচ্ছে সুমির। কিন্তু সেসব সুমি মিহিকে বলে না। কারণ সুমি জানে সবুজের অমানবিক মারধরের জন্য হয়তো শরীরে এত কষ্ট। এমনও হয়েছে রাতে ঠিকমতো তৃপ্তি মেটাতে না পারায় এই অবস্থায় পেটে,পিঠে লাথি মেরে*ছে সবুজ। রাত গভীর কিন্তু চোখে ঘুম নেই। মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সুমি। দৃষ্টি জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে খোলা আকাশের দিকে। শরীরের এই অবস্থা রুদ্র কিংবা মিহিকে জানানো উচিত। নিজের জন্য না হলেও অনাগত সন্তানের জন্য তো বটেই। সারারাত বালিশে মাথা রেখে এই সিন্ধান্ত নিয়েছে সুমি। তাই সকাল হতেই মিহিকে বলার জন্য ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছে সুমি। রহমান চাচা প্রতিদিনের মতো খাবার তৈরি করে টেবিলে রেখে দিয়েছে। মিতু আগেই খেয়ে নিজের ঘরে বসে টিভি দেখছে। টিভি যন্ত্রটা একেবারে নতুন মিতুর কাছে। তাই এ বাড়িতে আসার পর থেকেই টিভিতে বিভিন্ন কার্টুন দেখছে সে।
” সুমি মা তোমাকে এত অস্থির লাগছে কেনো? শরীর ঠিক আছে তো?”
রহমান চাচা সুমির পাশের চেয়ারে বসলেন। সুমিকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে উনার। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
” আসলে শরীলডা কেমন লাগে ইদানীং। হেই লাইগা আপারে কমু।”
” ওই তো মিহি আসছে। ”
সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় সুমির কথাগুলো শুনেছে মিহি।
” তোমার শরীর খারাপ আগে বলোনি কেনো?”
” আগে তো বেশি ছিলো না এইজন্য কমু কমু কইরা কওয়া হয়নাই। ”
” ঠিক আছে। তুমি নাস্তা করে রেডি হয়ে নাও, আমার আজ ক্লাস নেই। তোমাকে নিয়ে হসপিটালে যাবো।”
মিহি নাস্তা খেতে খেতে বললো। রুদ্র কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। যেদিন মিহির ক্লাস থাকে না সেদিন একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সে। সুমি তেমন কিছু খেলো না কেবল এক টুকরো পাউরুটি খেয়ে পানি পান করলো।
” আমারে মাফ কইরা দিয়েন আপা। আফনেরে এতো জ্বালা দিতাছি।”
” আরে পাগলি কীসের কষ্ট? যাও মিতুকেও রেডি করো। কিছু জামাকাপড় কিনে দিবো ওকে।”
সুমি কিছু বললো না শুধু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ঘরে গিয়ে মিতুকে রেডি করে নিজেও বোরকা পরে নিলো। হসপিটালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা বারোটা বেজে গেছে প্রায়। এখানে সব ডাক্তারের রোগীদের সিরিয়াল অনুযায়ী দেখা হয়। কিন্তু মিহি বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই রুদ্রকে সিরিয়ালের ব্যবস্থা করতে বলায় অসুবিধা হয়নি। ডাক্তার তামান্না ইসলামের চেম্বারে বসে আছে মিহি ও সুমি। মিতু শরীফের সাথে বাইরে আছে। তামান্না ইসলাম গাইনী বিশেষজ্ঞ।
” আপনি ডক্টর রুদ্র চৌধুরীর স্ত্রী? ”
তামান্না ইসলাম মিহিকে ভালো করে দেখে নিলেন একবার। সুমির পোশাক-আশাক আর মিহির পোশাক-আশাকের আকাশ পাতাল পার্থক্য। মিহির পরনে মেরুন রঙের দামী থ্রি-পিস আর সুমির আপাদমস্তক কালো রঙের বোরখা দিয়ে আবৃত।
” জি। ”
” রোগী আপনার কী হয়?”
” আমাদের অতিথি। আপনি কাইন্ডলি ভালো করে দেখুন ম্যাম ওর কী সমস্যা। ”
” আপনি গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি আসছি।”
মিহি সুমিকে ইশারায় রোগীর সিটে গিয়ে শুতে বলে। সুমি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো। ডাক্তার তামান্না সুমির কাছে গিয়ে প্রেশার মাপলেন। চোখ,জিহ্বা দেখলেন। তারপর ফের মিহির পাশে এসে বসলো সুমি।
” মিসেস রুদ্র আমি কিছু টেস্ট লিখে দিচ্ছি এগুলো আজকের মধ্যেই করানোর চেষ্টা করুন।”
” অ্যানিথিং সিরিয়াস ডক্টর? ”
” যেটা আন্দাজ করছি সেটা হলে অবশ্যই সিরিয়াস ইস্যু। যাইহোক নেগেটিভ ভেবে মন খারাপ করবেন না। টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসুন।”
এমনিতেই সুমি ভীতু তার উপর ডাক্তারের ভারিক্কি কথোপকথনে আরো ঘাবড়ে গেছে। মিহি সুমিকে নিয়ে চেম্বারের বাইরে বেরোতেই রুদ্রকে দেখলো। রুদ্র দাঁড়িয়েছিলো এতক্ষণ।
” ভাইয়া আমার মাইয়া কই?”
” মিতু শরীফের সাথে আছে। বাইরে গেলো একটু আগেই। কী বললেন ডাক্তার? কোনো টেস্ট দিয়েছেন? ”
” আপাতত এই টেস্টগুলো করাতে হবে। আপনিও আমাদের সাথে চলুন।”
” ঠিক আছে চলো। দোতলায় ডায়াগনস্টিক ল্যাব। ”
” ওকে।”
সুমিকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করানোর উদ্দেশ্যে দোতলায় গেলো রুদ্র ও মিহি।

বাসার সামনেই একটা ছোটো পার্ক আছে আদ্রিয়ানদের। সেখানেই স্বামীকে নিয়ে এসেছেন রিনা বেগম। সকালে হুট করেই সালমান খুরশিদ বললেন কতদিন একসাথে হাঁটা হয়নি দুজনের। কথাটা তলিয়ে ভাবতে রিনা নিজেও তার সত্যতা উপলব্ধি করে। তাই রাহিকে বাসায় রেখে দু’জন হাঁটতে বের হয়েছে। অবশ্য বাসায় মর্জিনাও আছে। আদ্রিয়ান অফিসের কাজে কক্সবাজার গিয়েছে গতকাল। রাহিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু মায়ের বারণে আর জোর করেনি আদ্রিয়ান। রাহির অবশ্য তাতে একটু মন খারাপ হয়েছে। কারণ আদ্রিয়ানের সাথে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেছে এবারের মতো। পার্কের এক পাশে বেঞ্চে বসেছেন সালমান খুরশিদ ও রিনা বেগম।
” কী হলো শরীর ক্লান্ত লাগছে? ”
” নাহ মিহির মা। এমনি বসলাম। কেনো জানি আজকে খুব পুরনো দিনগুলো মনে পড়ছে। তোমার মনে পড়ে আমাদের বিয়ের পরে কত ঝগড়া হতো?”

রিনা বেগম হাসলেন। পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতেই হাসির মাত্রা দ্বিগুণ হলো।
” হ্যাঁ সেসব কি ভোলার মতো? আমিই তো ছিলাম সব ঝগড়ার হোতা। তুমি তো কখনো নিজে থেকে সেধে ঝামেলা করতে না।”
” সেইজন্যই তো সবার আড়ালে ঝগরুটে রিনা বলে ডাকতাম। ”
” আচ্ছা আমি কি এখনও আগের মতো ঝগরুটে আছি?”
” ঝগরুটে না থাকলেও কূট বুদ্ধি মাথা ভর্তি।”
রিনা বেগম চোখ বড়সড় করে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে স্বামীর দিকে। সালমান খুরশিদ স্ত্রী’র অঙ্গভঙ্গিতে হাসলেন আবারও।
” এখনো এরকম চোখ বড়সড় করে তাকানোর দরকার কী? আমি তো এখন তোমার অনুচর হয়ে আছি। স্বাধীনতা কাকে বলে বিয়ের পরে আর মনে নেই। মনে হচ্ছে পাকিস্তানিরা তাদের বংশধর রেখে গেছে। ”
আজকে বড়োই ফুরফুরে মেজাজে আছেন সালমান খুরশিদ। রিনা বেগম স্বামীর পাগলামিতে ক্ষেপলেন না। আজ অনেক বছর পর উনি এরকম মজা করছেন।
” হ্যাঁ ভালো হয়েছে। তুমি তো মুক্তিবাহিনীর বংশধর। ”
” থাক থাক মুখ গোমড়া করে রেখো না। চলো বাসার দিকে এগোই। ”
” হুমম রাহি একা আছে, চলো।”

চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৯
(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

” হ্যাঁ ভালো হয়েছে। তুমি তো মুক্তিবাহিনীর বংশধর। ”
” থাক থাক মুখ গোমড়া করে রেখো না। চলো বাসার দিকে এগোই। ”
” হুমম রাহি একা আছে, চলো।”
” হ্যাঁ চলো। ”
যৌবনের শুরু থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত একে অপরের হাত ধরে এভাবেই পথ চলে এসেছে এই দম্পতি। ভালোবাসা সুন্দর যদি মানুষটা সঠিক হয়। হাতের পাঁচ আঙুল যেমন সমান নয় তেমনই পৃথিবীর সকল নারী-পুরুষও এক রকম না। কেউ কেউ আজীবন থেকে যায়, আগলে রাখে।

তামান্না ইসলামের চেম্বারে বসে আছে মিহি ও সুমি। শরীফ মিতুকে বাইরে থেকে বিভিন্ন খাবার খাইয়ে নিয়ে এসে এখন কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করছে। রুদ্র যদিও নিজের চেম্বারে রোগী দেখতে গেছে কিন্তু কোনো প্রয়োজন হলে মিহিকে কল দিয়ে জানাতে বলেছে। ডাক্তার তামান্না বেশ মনোযোগ দিয়ে সুমির রিপোর্টগুলো দেখছেন। সুমির চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এতো যন্ত্র তার অচেনা। টেস্ট করার পুরোটা সময় মিহি সাথে ছিলো তার।
” মিসেস রুদ্র, উনার উপর সৃষ্টিকর্তা খুব প্রসন্ন। এজন্য এ যাত্রায় উনার কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু.. ”
” কিন্তু কী ডক্টর? ”
” কী হইছে ডাক্তার আপা? আমার বাচ্চা ভালা আচে তো!”
সুমির আঁখি যুগল ছলছল করছে। মনের ভেতর কেমন অস্থির লাগছে। মিহি সুমির হাত ধরে শান্ত হতে বলে ইশারায়।
” সরি টু সে,উনার বেবিটা বেঁচে নেই। অনেক আগেই মারা গেছে। কোনো আঘাতের ফলেই এরকম হয়েছে মনে হচ্ছে। এতদিন গর্ভে থেকেও মায়ের কোনো প্রকার ইনফেকশন হয়নি। কিন্তু অনেক বড়ো ক্ষতি হতো পারতো..”
ডাক্তার তামান্না ইসলামের কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো।
” আর কী ক্ষতি হইতো আমার! আমার বাচ্চা যহন বাঁইচা নাই তহন আর আমার বাঁইচা কী হইবো আপা? আমি বাঁচতে চাই না মিহি আপা। মিতুর বাপ আমার বাচ্চা মাইরা ফালাইলো।”
” সুমি শান্ত হও। মিতুর জন্য তোমাকে বাঁচতে হবে। মিতু তোমার মেয়ে। আমি হয়তো মায়ের কষ্ট বুঝতে পারছি না কিন্তু যে আছে তার জন্য না বেঁচে যে নেই তার জন্য কেনো নিজেকে শেষ করবে বোন? মিতুর কি অধিকার নেই ওর মায়ের সাথে বাঁচার? আর সবুজ ঠিক ওর কর্মের ফল ভোগ করবে। আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্য করেন।”
” আপনি উনাকে একটু শান্ত করুন। বুঝতেই পারছেন এটা হসপিটাল। আপনারা যতো দ্রুত সম্ভব অপারেশন করে বাচ্চাটা বের করান। ”
মিহি সুমির মাথায়, গালে হাত বুলিয়ে শান্ত করলো কিছুটা। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে রুদ্রকে কল দিয়ে সবকিছু বলে। তারপর শরীফ মিহি, সুমি ও মিতুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। শরীফের মনটাও ভীষণ খারাপ লাগছে। সুমিকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না। কিন্তু তার হাতে তো কিছু নেই। বাড়ি ফিরে মিহি সুমির সাথে সাথে থাকে সারাদিন। মেয়েটার মনটা একেবারে ভেঙে গেছে। দুপুরে খাবার খাওয়ার পরে মিহি নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। সুমিকে এক প্রকার জোরাজোরি করে খাইয়ে দিয়েছে মিহি। মিতুও মায়ের মন ভালো করতে চেষ্টা করছে। বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিলো মিহি রাহির কাছে কল দিবে ভেবে । সুমির খবরটা জেনে মিহির মনটা কেমন ভয় ভয় লাগছে। যদিও সুমির বিষয় আলাদা। সবুজের অত্যাচারের ফলেই সুমির বাচ্চা গর্ভে থাকতেই শেষ হয়ে গেছে।
” আসসালামু আলাইকুম ভাবি,কেমন আছো তুমি? ”
” আলহামদুলিল্লাহ মিহি। তোমরা কেমন আছো বলো।”
” এমনিতে ভালোই। তুমি সাবধানে চলাফেরা করবে বুঝলে? আর ভারী কাজকর্ম করবে না। ভাইয়াকে বলে ডাক্তারের কাছে যেও একবার। ”
” আরে পাগলি এইতো কয়েকদিন আগেই ডাক্তারের কাছে গেলাম। কী হয়েছে বলো তো? এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছো!”
” সুমির বেবিটা বেঁচে নেই ভাবি। ডাক্তার দ্রুত অপারেশন করে বাচ্চাটা বের করতে বললো আজ।”
” ইশশ! সুমির কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
” না,আল্লাহ সব দিক থেকে কাউকে শেষ করে দেন না। বাড়ি ফিরুক ডাক্তার সাহেব, তারপর আলোচনা করে দেখি কবে অপারেশন করাবেন। ”
” সুমিকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিও তুমি। আর শরীফকেও বলবে সুমিকে সময় দিতে। ”
” ঠিক আছে। রাখছি এখন টেইক কেয়ার। ”
” সেইম টু ইউ। ”
রাতে রুদ্র বাসায় ফেরার পরে সব শুনে ঠিক করে আগামীকাল বিকেলেই অপারেশন করা হবে সুমির। যতো দ্রুত সম্ভব অপারেশন করতে হবে বলেই এত তাড়াতাড়ি অপারেশন করানোর কথা বললো রুদ্র। প্রথমে সুমির মানসিক অবস্থা ভীষণ খারাপ থাকার জন্য অপারেশনের বিষয় খেয়াল ছিলো না। কিন্তু রাত পেরুতেই সুমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে। অপারেশন শব্দটা গ্রামে থাকতে শুনলেও এরকম ছুরি দিয়ে পেট কাটবে শুনতে*ই কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু এছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

” বিশ্বাস করো সুমি তুমি কোনো ব্যাথা টের পাবেনা। এমন মেডিসিন দিবে তখন শরীর অসার হয়ে যাবে। যদিও সেটা কেবল কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত। ”

গাড়িতে বসে আছে মিহি ও সুমি। মিতুকে সাথে আনেনি, রহমান চাচার সাথে তাদের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
” আপা আমার খুব ভয় লাগে, আগে তো কহনো এসব কাটাকাটি হয়নাই। ”
” কিছু হবে না সুমি। আমরা তোমার সাথে আছি।”
সামনে থেকে শরীফ বললো। মিহি সুমির হাত ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে পৌঁছালো ওঁরা। সুমি হঠাৎ হঠাৎ কাঁদছে, অনাগত সন্তানকে নিয়ে কতশত স্বপ্ন বুনেছিল সে। আজ তাকেই এভাবে বের করতে হবে তা-ও মৃত! এসব ভাবতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মিহির। মাতৃত্বের চেয়ে বড়ো কোনো সুখ মেয়েদের জন্য হয় না। আর যখন সেই সন্তান নিজের শরীরে থাকা অবস্থায় প্রাণ হারায় তখন একটা মেয়ের মন কতটা উতলা হতে পারে তারই প্রমাণ সুমি।
” আর কয়েকটা বিস্কিট দিবো নাতি?”
মিতুকে উদ্দেশ্য করে বললেন ফুলবানু। রহমানের স্ত্রী তিনি। মিতুকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছেন ভদ্রমহিলা। স্বামীর কাছ থেকে সুমির বিষয় সবকিছুই শুনেছেন তিনি। মেয়েটার জন্য খুব আফসোস করেছেন ফুলবানু। রহমান মিতুর জন্য বাইরে থেকে ঝালমুড়ি আর চকলেট কিনে নিয়ে এসেছেন। সেগুলো দেখে মিতু অকপটে বললো,
” আমি ওইগুলান খামু এহন,মুড়ি মাহানো ওইডা আগে দাও। ”
ফুলবানু ও রহমান হাসলেন। শিশুর মন কতটা অবুঝ! মায়ের অপারেশনের কথা জেনেও খেয়াল নেই।
” ঠিক আছে। ফুলবানু তুমি ওগুলো ওকে খেতে দ্যান।”
” হ্যাঁ দিচ্ছি। ”
ফুলবানু কাগজের ঠোঙা থেকে ঝালমুড়ি বের করে একটা বাটিতে করে সেগুলো মিতুকে খেতে দিলো। মিতু হাসি হাসি মুখ করে সেগুলো নিয়ে খেতে শুরু করলো। ফুলবানু মিতুর কাছ থেকে সরে রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বললেন,
” মিহি মা’কে একবার কল দিয়ে দেখতেন, অপারেশন কতদূর হলো।”
রহমানের নিজেরও বেশ চিন্তা হচ্ছে।
” হ্যাঁ দিবো একটু পর। অপারেশন শুরু হলো আধঘন্টা হবে। ”
” ঠিক আছে। ”
ফুলবানু আবারও মিতুর পাশে গিয়ে বসলেন। হঠাৎ মিতুর মায়ের কথা মনে পড়তেই চোখমুখ মলিন হয়ে গেছে। খাবার পাশে রেখে অস্থিরতা মিশ্রিত নয়নে রহমানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” নানা আমারে মায়ের কাছে নিয়া চলেন তো। মায়ের অপারেশন হয়নাই এহনো? নানা অপারেশনে কী হয়!”
রহমান নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে মিতুর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
” অপারেশন করলে মা সুস্থ হয়ে যাবে। একটু পরেই মায়ের কাছে নিয়ে যাবো তোমাকে। তুমি চিন্তা না করে খাওয়া শেষ করো।”
” জানেন নানা, গ্যারামে থাকতে মায়েরে আব্বা কত মারতো। আমার খুব কষ্ট হইতো তয় কিচ্ছু করবার পারতাম না। এইহানের সবাই কত্ত ভালা! আফনেরা,ওই বাড়ির সক্কলে তারপর শরীফ চাচায়।”
ছোটো মেয়েটির কথা বলতে বলতে চোখমুখ হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ফুলবানুও মিতুর পাশে বসে। শ্যামবতী বললে কোনো ভুল হবে না মিতুকে। ডাগর ডাগর আঁখি যুগল তার। মায়ের মতো হাসলে গালে টোল পড়ে।
” ওসব ভেবে কষ্ট পেও না। এখন তো আমরা সবাই আছি।”
” হ নানী। আপনি ওই বাড়ি যাইয়েন,আমরা একলগে ঘুরতে যামু।”
” ঠিক আছে। তোমার মা সুস্থ হোক তারপর সবাই একসাথে ঘুরবো পাঁকা মেয়ে। ”
মিতু শেষ মুঠো ঝালমুড়ি মুখে পুরে হ্যাঁ বোধক ইশারা করে মাথা নাড়িয়ে।
চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-২৬+২৭

0

##মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৬
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

রাহি হাসিমুখে গাড়িতে উঠে আদ্রিয়ানের পাশে বসলো আর বেলুনগুলো পিছনের সিটে রাখলো। ভালোবাসা আসলেই সুন্দর। ভালোবাসার মানুষের কাছে কোনো রাখঢাক রেখে কিছু চাওয়া লাগে না। গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। আদ্রিয়ান এক হাতে গাড়ি চালাচ্ছে অন্য হাতে রাহির হাত ধরে আছে।

সালমান খুরশিদের বাসায় আজ আনন্দের ঢল নেমেছে। সবাই খুব খুশি। বাড়িতে নতুন সদস্য আসছে বহু বছর পর। রিনা বেগমও নাতিনাতনি আসার সুসংবাদে পুত্রবধূকে আরো বেশি আদর যত্ন করতে শুরু করেছেন।
” রাহি তুমি আজ থেকে আর কোনো কাজকর্ম করবে না। যা দরকার আমি নিজে করবো।”
বসার ঘরে সোফায় বসে কথাগুলো বললেন রিনা বেগম। সালমান খুরশিদ, আদ্রিয়ান, রাহি সবাই এখানে উপস্থিত। মায়ের কথার প্রতুত্তরে আদ্রিয়ান বললো,
” আমি কাজকর্ম করার জন্য একজন লোক রেখে দিবো মা। এই বয়সে তোমাকে সব কাজ করতে হবে না। ”
” হ্যাঁ মা আপনার ছেলে ঠিক বলেছে। আপনি আমার সাথে গল্প করবেন,আপনার যা ভালো লাগে তাই করবেন।”
” লোক রাখলেও আমি রান্নাবান্না দেখে নিবো সব। নিজের সংসারের কাজকর্ম বাইরের লোক দিয়ে করালে ঠিক শান্তি আসে না রাহি।”
” আচ্ছা মা আপনার যেমন ইচ্ছে। ”
” তোমার সাথে এমনিতেই গল্প করবো। ”
রিনা বেগমের কথায় রাহি মুচকি হাসলো। সালমান খুরশিদ আদ্রিয়ানের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত। দুই দিন পর মিহিদের পরিবারের সবাইকে ডেকে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করবে। পরিবারের সবাই একসাথে নতুন অতিথি আসার সংবাদ পাওয়ার আনন্দে একত্রিত হবে। রাহি আনমনে একবার শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। সময় সবকিছু কেমন করে বদলে দেয় তাই না? একটা সময় রিনা বেগম রাহিকে চোখে দেখতে পারতো না আর আজ!
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে গিয়ে মিহিকে কল করে রাহি। রাহি বিছানায় বসে আছে আর আদ্রিয়ান রাহির কোলে শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে।
“হ্যালো মিহি,কেমন আছো তোমরা?”
” এইতো ভালো ভাবি, তোমরা কেমন আছো? ”
” আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো আছি। তোমাকে একটা খবর দেওয়ার জন্য কল দিলাম। ”
” হ্যাঁ বলো,সবকিছু ঠিক আছে তো ভাবি?”
মিহির কন্ঠে ব্যতিব্যস্ততা অনুভব করে রাহি আর হেয়ালি না করে সরাসরি বললো,
” তুমি ফুপি হতে যাচ্ছো।”
” কী বললে? সত্যি ভাবি? দিনে বললে না কেনো? আমি আসতাম তখনই। ”
” আরে পাগলি শান্ত হও। বাবা রুদ্রকে কল দিয়ে দাওয়াত করবেন, পরশু এসো সবাইকে নিয়ে। ”
” ঠিক আছে ভাবিইইই। আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো লাগছে। ”
” এখন রাখছি পরে কথা হবে। ”
মিহি উত্তেজনায় বিছানায় বসা থেকে উঠে দৌড়ে রুদ্রকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো। রুদ্র ল্যাপটপে একটা জটিল রোগ সম্পর্কে কিছু আর্টিকেল পড়ছিল। মিহির হঠাৎ এরকম কান্ডে বেশ অবাক হলো। সেদিনের পর থেকে মিহি বেশ দূরে দূরে থেকেছে। কিছুতেই ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি। রুদ্রকে বলেছে কয়েকদিন সময় লাগবে তার। তাই রুদ্র নিজে থেকেও কোনো প্রকার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেনি।
” কী হয়েছে মিহির দানা? এত এক্সাইটেড কেনো? ”
মিহি রুদ্রকে ছেড়ে সামনের একটা চেয়ারে হাসি হাসি মুখ করে বসলো।
” আমি ফুপি হতে যাচ্ছি ডাক্তার সাহেব! ”
” ওহ খুব ভালো নিউজ তো। ”
” ইয়েস। অলরেডি রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে, নইলে এখুনি যেতাম ভাবির কাছে। ”
” নিজের তো মুরোদ নেই তাই ভাবির বেবির খবর শুনেই আনন্দ করো আরকি। সুমিরও বেবি হবে জানো তো?”
মিহি ঠোঁট উল্টে বললো,
” হুম জানি কিন্তু আমার মুরোদ নেই কে বললো আপনাকে? ”
” আছে বলছো?”
” আলবাত আছে। সেদিন না বললেন আমি এখনো ছোটো, ওইসব করার বয়স হয়নি। ”
রুদ্র ল্যাপটপ বন্ধ করে রেখে মিহির হাত ধরে চোখে চোখ রেখে বললো,
” আমার বউ যথেষ্ট বড়ো হয়েছে। এখন থেকেই বাচ্চাকাচ্চা নেওয়া শুরু না করলে ভবিষ্যতে ক্রিকেট টিম কীভাবে গঠন করবো বলো তো?”
” এই শুরু হয়েছে আপনার বদমাইশি। ”
রুদ্র মিহির হাতদুটো টান দিয়ে মিহিকে নিজের দিকে টানলো আরেকটু। কিন্তু মিহি ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছিলো প্রায়। কিন্তু রুদ্র ধরে নিজের কোলে বসালো। মিহি বেশ অপ্রস্তুত হলো তাতে।
” ডু ইউ লাভ মি মিহির দানা? ”
” উমম…ভেবে বলবো। ”
” অপেক্ষায় রইলাম তাহলে। তবে ভালো না বাসলেও চলবে। শুধু আমার সন্তানের মা হবে তাতেই চলবে। ”
” কী বাজে লোক! ”
রুদ্র মিহিকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। রুদ্রর প্রতিটি হৃৎস্পন্দনের আওয়াজে মিহির মনের মধ্যে কেমন যেনো অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। ইচ্ছে করছে লোকটাকে আপন করে নিতে। আসলে মিহি যতোই রুদ্রকে নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা করে, দিনশেষে সেই অচেনা লোকটার স্পর্শ তাকে রুদ্রর স্পর্শ পেতে কোথাও যেনো আঁটকে ফেলে। কিন্তু আজ মিহি মনস্থির করেছে রুদ্রকে তার অধিকার দিবে। সেই স্পর্শ যতই ভাবাক তাকে সেটা পরপুরুষের, কিন্তু রুদ্র তার স্বামী। মিহির নিরবতা রুদ্রকে ভাবাচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেখা চিন্তিত স্বরে শুধালো,
” তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে মিহির দানা? হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে! ”
” ঠিক আছি আমি। আপনার বুকের ধুকপুকানি শুনছিলাম। ”
” তা কী শুনলে? কী বলে হৃদয়? ”
” বলছে, আজ মিহির দানাকে খুব করে কাছাকাছি চাচ্ছে সে।”
” বাব্বাহ! সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছিলো? ”
মিহি রুদ্রর বুকে আলতো করে আদুরে ঘুষি মারলো কয়েকটা। রুদ্র মিহির ঘাড়ে মুখ গুঁজে চুলগুলো এক পাশে সরালো। নিমিষেই মিহির শরীর জুড়ে কেমন একটা অজানা অনুভূতি বয়ে গেলো। কন্ঠে ব্যাকুলতা নিয়ে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে রুদ্রর দিকে চেয়ে মিহি। রুদ্র ততক্ষণে ঘাড় থেকে মুখ সরিয়ে মিহির আঁখি যুগলের পানে দৃষ্টিপাত করেছে।
” এভাবে লাজলজ্জা সবকিছু কেড়ে নিলে আপনার সামনে আসতে পারবোনা আর আমি। ”
” আমি তোমার স্বামী। সারাজীবন আমার সামনেই আসতে হবে বুঝলে?”
” ইশশ! ”
” বিছানায় কী হেঁটে যাবে না-কি কোলে তুলে নিবো?”
” আরামে যেতে পারলে কে কষ্ট করে বলুন।”
রুদ্র মুচকি হেসে মিহিকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রুমের বাতি নিভিয়ে মিহির পাশে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” জানো আমার মায়ের চেহারার সাথে তোমার চেহারার একটু একটু সাদৃশ্য খুঁজে পাই আমি। ”
মানুষটার মায়ের কথা মনে পড়েছে। মিহি বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজে থেকেই রুদ্রকে জড়িয়ে ধরলো।
” পৃথিবীতে অনেকের সাথে অনেকের চেহারার মিল থাকে। মায়ের কথা যখন খুব মনে পড়বে দু’রাকাআত নফল নামাজ পড়ে মায়ের জন্য দোয়া করবেন। মন শান্ত হবে।”
” আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তোমার মতো একজন জীবন সঙ্গী দিয়েছেন। ”
” আমিও শুকরিয়া আদায় করি। ”
স্ত্রী’র ললাটে চুম্বন এঁকে গভীর আলিঙ্গনে চোখ বন্ধ করলো রুদ্র। ভালোবাসার মানুষদেরকে বক্ষে জড়ানোতে যে তৃপ্তি কিংবা শান্তি তা আরকিছুতে নেই। সেটা হতে পারে মা,বাবা কিংবা স্বামী – স্ত্রী।

সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছে সুমি ও শরীফ। বাড়ির বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিলো শরীফ। রাত বাড়তেই সুমির আসার কথা ছিলো। দিনে এক ফাঁকে দেখা করার কথা বলেছিলো শরীফ। যতই পরস্ত্রী হোকনা কেনো সুমি শরীফের ডাক অগ্রাহ্য করতে পারেনি। তাই মিতু ঘুমানো মাত্রই গুটিগুটি পায়ে দরজা খুলে বাইরে চলে এসেছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ধরে দু’জন দাঁড়িয়ে অথচ কারো মুখে কোনো কথা নেই। এতদিন অনেক দ্বিধায় ছিলো শরীফ। যতবার ভেবেছে সুমিকে আপন করে নিবে ততবারই সমাজের কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো তার। এই সমাজ কখনোই একজন অবিবাহিত পুরুষের জীবনে, একজন ডিভোর্সি সন্তানসহ নারীকে গ্রহণ করাকে ভালো চোখে দেখবে না। তার উপর মিতুও যথেষ্ট বোঝে এখন। সাথে সুমির অনাগত সন্তানের কথাও ভাবতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সুমির ডিভোর্স হয়নি এখনও। আদৌও সুমি তার সাথে থাকতে চায় কি-না তা-ও জানে না শরীফ। এতো এতো সমস্যা নিয়ে কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলো না শরীফ। কিন্তু আজ সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ধুয়েমুছে সুমির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে শরীফ।
” কেমন আচেন? ”
নীরবতা ভেঙে সুমি নিজেই প্রশ্ন করলো। শরীফ নড়েচড়ে উঠলো। আকাশে অগুনিত তারা,চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। ডিসেম্বরের ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে দু’জনের সর্বাঙ্গে।
” তুমি ভালো নেই সুমি এটা জানার পর একটা মুহুর্ত আমি ভালো নেই। ”
” কিচু করার নাই। তকদিরে যা ছিলো তাই হইছে। আফনে বিয়াশাদী করলেন না ক্যান?”
” তাহলে তোমার কী হতো সুমি?”
শরীফের কথায় সুমি চমকালো। কী বলতে চাচ্ছে লোকটা? করুণা করছে না-কি ভালোবাসা!
” আমার যা হওয়ার তাই হইবো। ”
” সুমি,ভালোবাসো এখনও? ”
” সময়ের যাঁতাকলে ভালোবাসা ভুইলা দায়িত্ব আর কর্তব্য পালন করছি ঠিক। তয় মনের মইধ্যে ঠিক সুপ্ত ভালোবাসা রইয়া গেছে। ”
” একবার তোমার হাত ধরবো?”
” না, আমি এহনো পরস্ত্রী। ”
সুমির এই কথাটা বুকের ভেতর কেমন তীরের মতো বিঁধলো শরীফের। এত বছর পরেও উপেক্ষা? শুধু একটু হাত ছুঁয়ে দেখতেই তো চেয়েছিল। শরীফ কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকে নিজেকে সামলে নিতে।
” ঠিক আছে। তুমি কি তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চাও?”
সুমি নিজের পেটের উপর হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” না চাইলেও যাইতে হইবো। তয় জানি না হেয় আমারে ঘরে তুলবো কি-না। ”
” তাহলে কেনো যাবে তুমি? ”
” এইখানে থাইকা কী হইবো? মিতু একলা থাকলেও একটা কথা হইতো। আরেকজন যে আইতাছে সে?”
” আমি যদি তাকে নিজের সন্তানের পরিচয় দেই সুমি? মিতুকে তুমি বোঝাতে পারবেনা? ”
সুমির বিস্ময় কাটে না শরীফের কথা শুনে। আসলেই সত্যি না-কি সবকিছুই কল্পনা কিংবা স্বপ্ন? সুমির চক্ষুদ্বয় ছলছল করছে। এরকম তো না হলেও হতো। শরীফের সাথে থাকলে কী বিধাতার খুব ক্ষতি হতো? মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তীব্র অভিমান করে সুমি। সুমির নীরবতা দেখে শরীফ আবারও বলে,
” সুমি? আমি তোমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে চাই। তবু কি ফিরিয়ে দিবে আমাকে? ”
শরীফের কন্ঠে এতটা আকুলতা সুমির আর দ্বিধা রইলো না সিন্ধান্ত নিতে।
” আফনে মিতুর বাপের সাথে তালাকের ব্যবস্থা করেন, আমি মিতুরে বুঝামু।”
” আমি কালকেই এ বিষয় রুদ্র ভাইয়াকে বলবো। উনার সাথে আমি সব কথা শেয়ার করি,তোমার বিষয়ও জানে।”
” আইচ্ছা। এহন যাই, ম্যালা রাইত হইছে। আফনেও যান ঠান্ডা লাগবো।”
” আচ্ছা সাবধানে যেও, আসছি।”
শরীফ যতক্ষণ দৃষ্টি সীমানার মধ্যে ছিলো সুমি দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর দৃষ্টির আড়াল হতেই দ্রুত পায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দরজা আঁটকে নিজের রুমে চলে গিয়েছে।
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৭
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

শরীফ যতক্ষণ দৃষ্টি সীমানার মধ্যে ছিলো সুমি দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর দৃষ্টির আড়াল হতেই দ্রুত পায়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে দরজা আঁটকে নিজের রুমে চলে গিয়েছে। মিতু পাশ ফিরে কম্বল মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। সুমি আস্তে করে মেয়ের পাশে শুয়ে ললাটে চুম্বন এঁকে দিলো। মিতু ছোটো থেকে মায়ের কষ্ট বোঝে। বাবার অত্যাচার দিন দিন দেখতে দেখতে বাবা নামক মানুষটাকে ঘৃণা করে এখন। কিন্তু সেই বাবার জায়গায় অন্য কোনো মানুষকে কি মেনে নিবে সে? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে বারবার ঘুরছে সুমির। মিতুর অমতে কিছুতেই শরীফকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে পারবেনা।

সকালের মিঠে রোদ্দুর জানালা ভেদ করে চেম্বারে প্রবেশ করছে। শহুরে মানুষের কোলাহলে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারদিক। সকাল সকাল তেমন রোগীর ভীড় না থাকলেও জনাকয়েক রোগী আছে বটে। রুদ্র এক এক করে সবাইকে দেখে বিদায় দিতেই শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। আসলে সকাল থেকেই রুদ্র শরীফের অস্থিরতা খেয়াল করেছে। তাই সুযোগ হতেই কথা বলবে বলে ভেবে রেখেছিলো রুদ্র।
” শরীফ,সামনের চেয়ারে এসে বসো তো।”
শরীফ রুদ্রর কথা দ্বিমত পোষণ না করে চেয়ারে এসে বসলো। দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো শরীফ। গতরাতে যেভাবে বিষয়টা বলবে ভেবেছিলো এখন মনে হচ্ছে বিষয়টা ততো সহজ না। পরস্ত্রী’কে বিয়ে করার ইচ্ছে বড়ো ভাই সমতুল্য লোকটাকে অকপটে বলার সাহস হচ্ছে না তার।
” এখন বলো এক্সাক্টলি কী হয়েছে? ”
শরীফকে চুপ থাকতে দেখে ফের রুদ্র প্রশ্ন করলো। শরীফ দোনোমোনো করতে করতে বললো,
” ভাই কাল সুমির সাথে কথা হয়েছিলো।”
” তারপর? কী বললো?”
রুদ্র বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শরীফের চেহারার দিকে। শরীফ লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
” ওর স্বামীর থেকে ডিভোর্স আনতে হবে ভাই। কীভাবে কী করবেন আপনি জানেন। আপনি ছাড়া এসব দেখা কিংবা বোঝার মতো আর কোনো মানুষ নেই আমার। ”
” আমার যতদূর মনে হয় ওর হাসবেন্ড এমনি ডিভোর্স পেপারে সাইন করবে। কারণ এতদিন গেলো অথচ স্ত্রী’র কোনো খোঁজ নিতে আসেনি। অবশ্য কোথায় এসেছে সেসব তো জানেও না সে।”
” সুমির কাছে যতটা শুনেছি খুব অত্যাচার করতো লোকটা। ”
” আমি উকিল আঙ্কেলের সাথে কথা বলে আজই ডিভোর্স পেপার তৈরি করার কার্যক্রম শুরু করতে বলছি। তারপর যদি সাইন না করে দেখা যাবে। তবে সুমি এক তরফাও ডিভোর্স দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে সবুজের কিছু করার নেই। দেশে নারীদের পক্ষে আইনের সুবিধা একটু বেশিই। ”
” ঠিক আছে ভাইয়া। কিন্তু কতদিন লাগবে কাগজ আসতে? ”
” আমার ভাইয়ের কী বিয়ের জন্য আর তর সইছে না?”
রুদ্র মজা করেছে বুঝতে পেরে শরীফ বেশ লজ্জা পেলো।
” ভাইয়া!”
” হয়ে যাবে। অপেক্ষা করো কিছুদিন। আমি নিজে যাবো সবুজের সাইন নিয়ে আসতে। ”
” আচ্ছা ভাইয়া।”
পরিবারে নতুন সদস্য আসার জন্য আজ সালমান খুরশিদের বাড়ি ভোজ উৎসব। মিহি,রুদ্র, রহমান, সুমি,মিতু ও শরীফ সবাই এসেছে। তোশাদের পরিবারের সবাইকে বলেছিলো যদিও কিন্তু তোশা নতুন সংসার ফেলে আসতে পারেনি। আর ওর বাবা-মাও তাদের নিজস্ব কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে বলে জানিয়েছে। রান্নার জন্য আলাদা লোক রাখা হয়েছে। মর্জিনা নামে মাঝ বয়সী একজন মহিলা এখন বাসার সব কাজ করে। রিনা বেগম অবশ্য রান্নার সময় উপস্থিত থাকেন। যোহরের আজান দিয়েছে। রান্নাবান্নাও শেষের পথে। সবাই নিজেদের মধ্যে যার যার পছন্দ সহিত বিষয় নিয়ে কথা বলছে। মিহি রাহির সাথে বেডরুমে এসেছে অনেকক্ষণ।
” তারপর? ভালোবাসা হলো তো দুজনের মধ্যে? ”
রাহি মিহিকে জিজ্ঞেস করলো। মিহি হেসে বললো,
” তা হয়েছে। পাগল লোক একটা! ”
” তাই বুঝি? ননদী আমার ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে যে! এতো লজ্জাবতী হলে কবে থেকে? ”
” ভাবি! ভালো হবে না বলছি। আমি বুঝি বেশরম? ”
” তা হবে কেনো? আমি বললাম বিয়ের পরে লজ্জা আরো বেড়ে গেছে। লোকে অবশ্য বলে,বিয়ের পরে না-কি লজ্জাশরম কমে যায়। ”
” লোকের সব কথা যে সঠিক হয় না তা তো প্রমাণ পেলেই! তোমার শরীর কেমন আছে এখন?”
” আলহামদুলিল্লাহ। বাড়ির সবাই এত খেয়াল রাখছে ভালো না থেকে উপায় আছে বলো?”
” যাক মা যে তোমাকে মন থেকে ভালোবাসতে পেরেছে এটাই শুকরিয়া। ”
” হ্যাঁ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসা দিলে ঠিক ভালোবাসা মিলে। তবে সময় লাগে, কষ্ট সহ্য করতে হয়। আর এরপরেও যদি কেউ ভালো না বাসে তার ভালোবাসার দরকার নেই। কারণ সব সময় সবাইকে ভালোবাসলেও ভালোবাসা মিলে না।”
” তা ঠিক বলেছো। নিচে চলো,দেখি রান্না কতদূর হলো। আজকে মা চিংড়ী মাছের মালাইকারি রান্না হচ্ছে শুনে ক্ষিদে পেয়ে গেছে। ”
” হাহাহা! চলো তাহলে। ”
মিতুকে বাগানে খেলতে পাঠিয়ে দিয়ে রুদ্র, শরীফ ও সুমির বিষয় সবকিছু খুলে বলেছে। যেহেতু সুমি প্রথমে এই বাড়িতেই এসেছিলো তাই তাদের সবার জানার অধিকার আছে এ বিষয়। রিনা বেগম স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টা মন থেকে মানতে পারছেন না। তাই বসার ঘর থেকে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। একটা মেয়ে আছে আবার আরেকটা পেটে! এই অবস্থায় অন্য একটা পুরুষের সাথে কীভাবে বিয়ের কথা ভাবতে পারে মেয়েটা? নাহ মিহির বরের কোনো বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। মনে মনে এরকম অনেক কথাই ভাবতে লাগলেন রিনা বেগম। সালমান খুরশিদ সবকিছু শুনে চুপ করে আছেন। সুমি আর শরীফ ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র সোফায় বসা।
” দেখো সুমি তোমার স্বামী তোমার উপর যেসব অত্যাচার করেছে সেসব আমি সমর্থন করি না। সবচেয়ে বড়ো কথা, তোমার জীবন তোমার সিন্ধান্ত। বাবা-মা সব সময় সন্তানের মঙ্গল চাইলেও আদতে সর্বদা মঙ্গল হয় না। যেমনটা তোমার সাথে হয়েছিল। তাই এবার নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী বিয়ে করে দেখো তকদীরে কী আছে। আর শরীফকে আমি যতটুকু দেখেছি, ছেলেটা তোমাকে অযত্নে রাখবে না। তোমার সন্তানরা-ও ভালো থাকবে। ”
বেশ লম্বা কথা বললেন সালমান খুরশিদ। সবাই সেগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। সুমি সালমান খুরশিদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। যদিও তিনি এরকম সালাম করা পছন্দ করেননা তবুও সুমিকে কিছু বললেন না। বরং মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিঞ্চিৎ।
” দোয়া করবেন চাচা।”
” আমার দোয়া সব সময় তোমাদের সাথে আছে। ”

” কী ব্যাপার সবার মুখ এত সিরিয়াস মনে হচ্ছে কেনো? ডাক্তার সাহেব! কিছু হয়েছে? ”
সুমি ও সালমান খুরশিদের কথোপকথনের মধ্যে রাহি ও মিহি এসে উপস্থিত হয়েছে বসার ঘরে। রুদ্র মুচকি হেসে বললো,
” তেমন কিছু হয়নি। বাড়ি গিয়ে সবকিছু বলবো তোমাকে। ”
” আচ্ছা তোমরা বসো সবাই আমি গিয়ে দেখে আসি রান্না কতদূর। ”
রাহি রান্নাঘরের দিকে গেলো। মিহি বাবার পাশের সোফায় বসলো। এদিকে রান্না শেষে মর্জিনা আর রিনা বেগম খাবার ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাহিকে দেখেই রিনা বেগম বললেন,
” শুনেছো কিছু? ”
” কী শুনবো মা?”
” ওই ড্রাইভার শরীফের সাথে না-কি সুমির বিয়ে হবে। কী অনাচার! ”
বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগলো রাহির। তাহলে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তখন। কিন্তু মিহি মনে হয় কিছু জানে না এইসব বিষয়।
” মা যার জীবন সে যেভাবে ইচ্ছে চালনা করুক। তাতে আমাদের কী? আমরা বরং আমাদের নিজেদের কথা ভাবি?”
পুত্রবধূর কথা বিশেষ ভালো লাগেনি রিনা বেগমের। তবুও ম্লান হাসলেন তিনি।
” তুমি গিয়ে সবাইকে খাওয়ার টেবিলে আসতে বলো। আমরা খাবার নিয়ে আসছি। ”
” হ্যাঁ আসুন। মিহিকে আজকে বেশি চিংড়ীর মালাইকারি দিবেন মা। আপনার হাতের রান্না খায়নি অনেক দিন। ”
মেয়ের কথা শুনে প্রানখুলে হাসলেন রিনা। আহ্লাদী কন্ঠে বললেন,
” পাগল মেয়ে আমার। ”

দুপুরে সবাই গল্প করতে করতে খাওয়াদাওয়া শেষ করলো। রুদ্র হসপিটাল থেকে একদিনের ছুটি নিয়েছে। আজকে এই বাড়িতে থাকবে। কাল সকালে শরীফ রুদ্রকে পৌঁছে দিয়ে পরে মিহি আর সুমিদের বাসায় নিয়ে যাবে।
দুপুরের রোদের তেজ কমে এসেছে। ডিসেম্বরের হালকা হিমেল বাতাসে গ্রামের শীত ভালোই পড়েছে। মাটির রাস্তার একেবারে শেষ মাথায় একটা ছোটো দোকান। সেখানেই বসে সিগারেট ফুঁকছে সবুজ। পাশে আরো লোকজন বসে চা-সিগারেট খাচ্ছে।
” কী রে সবুজ তোর বউ তো আর ফিইরা আইলো না! কার লগে পলাইয়া গেলো রে?”
দোকানী রুহুল কবিরের কাছ থেকে সুমির বিষয় এসব কথা শুনে কোনো প্রকার হেলদোল নেই সবুজের। সিগারেটের ছাই পাশে ফেলে আরেকটা সুখটান দিয়ে ভাবলেশহীনভাবে বলে,
” গেছে ভালা হইছে। ওই গ্যারামের কুলসুম আছে না? হেয় আমারে খুব পছন্দ করে। ওরে বিয়া করমু ভাবতেছি।”
দোকানী রুহুল কবির সবুজের কথায় হাসে। সবুজ বোঝে এরা বিদ্রুপের হাসি। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে সবুজের। কিছুটা রাগ সংবরণ করে ফের বলে সবুজ,
” দাঁত বাইর কইরা হাসেন ক্যান মিয়া?”
” বিয়া যে করবি তা খাওয়াবি কী হুনি? থাহোস তো অর্ধেক দিন বাংলা মদ খাইয়া।”
সবুজ সিগারেটের বাকি অংশ না শেষ করেই মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো সেটা। রুহুল কবিরের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ঠিক কিন্তু কিছু না বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-২৪+২৫

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৪
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

” আপনি থাকতে আমারে ডাকলেন ক্যান ভাই? ”
” কথা পরে বলো আগে পাল্টে দাও প্লিজ,ঠান্ডা লেগেছে খুব ওর। আমারই ভুল ড্যাম ইট!”
রুদ্র নিজের উপর রেগে গেছে খুব। কেনো যে তখন বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়ার কথা বললো! মিহির জন্য আলমারি থেকে থ্রিপিস বের করে দিয়ে রুদ্র ওয়াশরুমে গিয়ে ভেজা জামাকাপড় পাল্টাতে গেলো। সুমি মিহির জামাকাপড় পাল্টে পাশে বসে হাত ও পায়ের তালুতে ঘষা দিচ্ছে। একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে মিহির শরীর। সুমি বেশ ভরকে গেছে বটে। রুদ্র ওয়াশরুম থেকে বের হতেই সুমি ভয় জড়সড়ভাব করে বললো,
” ভাই আপার কী হইছে! এক্কেরে সারা শরীল ঠান্ডা হইয়া গেছে। ”
” বৃষ্টিতে ভিজেছে এজন্য। তুমি এখন যাও আমি সামলে নিবো। চিন্তা করতে হবে না। ”
” আইচ্ছা ভাই লাগলে ডাক দিয়েন আবার। ”
সুমি নিঃশব্দে ঘর ত্যাগ করলো। রুদ্র মিহির পাশে বসলো। মিহির চোখ বন্ধ কিন্তু ঠোঁটগুলি কাঁপছে। রুদ্র মিহির গায়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা বোঝার চেষ্টা করছে। শরীরে তেমন তাপ বৃদ্ধি পায়নি উল্টো ঠান্ডা হয়ে আছে। রুদ্র ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত একটা বেজেছে। মিহিকে আরো ভালো করে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়ে ঘরে পায়চারি করতে শুরু করলো। দেখে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না শুধু শরীরের তাপমাত্রা কমে গেছে ঠাণ্ডায়।
” মা….”
মিহি অস্ফুটে কিছু বলতেই রুদ্র তড়িৎ গতিতে মিহির পাশে বসে।
” মিহির দানা? এই মিহির দানা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার? ”
” ডাক্তার সাহেব… ”
মিহির মুখে “ডাক্তার সাহেব ” ডাকটা শুনে কেমন ভালো লাগলো রুদ্রর। কপালে হাত রেখে রুদ্র হেসে বললো,
” হ্যাঁ বলো।”
” আমার… ”
” হ্যাঁ তোমার কী?”
” খু…”
মিহি কথা বলতে পারছেনা ঠিকমতো। শরীর কাঁপছে রীতিমতো ঠান্ডায়। অবস্থা বেগতিক দেখে রুদ্র মিহির কম্বলের মধ্যে ঢুকে জড়িয়ে ধরলো। মিহি রুদ্রর শরীরের উষ্ণতায় একটু নড়েচড়ে উঠলো। হিমশীতল শরীরের পাশে হঠাৎ রুদ্রর উপস্থিতি তাপের সঞ্চার মনে হলো মিহির অবচেতন মনের। রুদ্র মিহির হাতের তালুতে ঘষা দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটু গরম হয় মিহির হাত। শীতের মধ্যে কেনো যে বৃষ্টিতে ভিজতে গেলো এই কারণে বারবার নিজের উপর ক্ষেপে যাচ্ছে রুদ্র।
” ডাক্তার সাহেব! ”
আনমনে তাকিয়ে ছিলো রুদ্র। মিহির ডাকে তার দিকে তাকালো সে। অল্প অল্প চোখ মেলে তাকিয়েছে মিহি।
” কেমন লাগছে এখন?”
রুদ্র আস্তে করে সরে যেতে চাইলো মিহির কাছে থেকে। কিন্তু মিহু দূর্বল শরীরে জড়িয়ে রাখতে চাইলো রুদ্রকে।
” ছেড়েই যখন যাবেন তাহলে কাছাকাছি এসেছিলেন কেনো?”
” তোমার শরীর, মাথা কোনোটাই ঠিক নেই এখন।”

মিহি রুদ্রর পিঠে এত জোরে আঙুল দিয়ে ধরেছে যে রীতিমতো নখের কারণে ব্যথা পাচ্ছে সে। কিন্তু রুদ্র কিচ্ছু বললো না। মিহি আধো আধো চোখে রুদ্রর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলো। রুদ্র চমকালো,মেয়েটার কী হয়েছে! কিন্তু রুদ্র কিছু বলার আগেই মিহি রুদ্রর ওষ্ঠ নিজের দখলে করে নিলো। মুহুর্তেই কেঁপে উঠলো রুদ্র। মিহি এখন হুঁশে নেই বলে ছাড়াতে চাইলো সে। কিন্তু মিহির আবেদন অগ্রাহ্য করার সাধ্য হলোনা তার। মিহিকে জড়িয়ে ধরে নিজেও গভীর চুম্বনে লিপ্ত হলো প্রিয়তমার সাথে।

সকাল হতেই সুমি কয়েকবার রুদ্র ও মিহির ঘরের বাইরে এসেছিলো। কিন্তু এখনো ভেতর থেকে দরজা আঁটকা ছিলো বলে আর ডাকতে পারেনি সে। অগত্যা রহমান চাচার সাথে হাতে হাতে নাস্তা তৈরি করতে শুরু করে সুমি। মিতুও ঘুমোচ্ছে এখনো। রহমান চাচা ফজরের নামাজ শেষে আর ঘুমান না। সোজা এই বাড়িতে এসে নাস্তা তৈরি করার কাজে লেগে যায়। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে তার স্ত্রী তহমিনা অভিমান করেন অবশ্য। তবে রুদ্রর প্রতি রহমানের ভালোবাসা তারও কিছু কম নয়। চুলোয় চায়ের জন্য পানি বসিয়ে টোস্ট তৈরি করছেন রহমান চাচা। সুমি পাশে দাঁড়িয়ে সেদ্ধ ডিমগুলোর খোসা ছাড়িয়ে অন্য পাত্রে রাখছে।
” তুমি আবার বাসনকোসন পরিষ্কার করতে গেলে কেনো মা?”
রহমান চাচা পরম মমতার সাথে সুমির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। সুমি হাসলো, রহমান চাচার ঠোঁটের কোণেও হাসি।
” আফনে আমার বাবার বয়সী, সব কাম আফনেরে ক্যামনে করতে দেই?”
সুমির কথায় রহমানের বুকের ভেতর কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো। বাবা! দু-চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে রহমান চাচার। সুমি বিষয়টা বুঝতে পেরে ফের বলে উঠলো,
” আমার তো বাপ থাইকাও নাই, আপনার বুঝি মাইয়া নাই? ”
” নাহ মা, আমার কোনো সন্তান নেই। ”
” তাতে কী হইছে! রুদ্র ভাই তো আফনের পোলার মতোই আর এহন তো আমিও আছি। আফনের মাইয়া!”
রহমান চাচা হুট করেই সুমির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে কেঁদে উঠলেন। সুমি উনার চোখের অশ্রু মুছে দিলো।
” সত্যি তুমি আজ থেকে আমার মেয়ে। ”
নতুন মেয়েকে নিয়ে রহমান চাচা খুব খুশি আর সুমিও। দু’জনে মিলে হাতে হাতে খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন করে। তারপর চেয়ারে বসে আরো কিছুক্ষণ কথোপকথন চলে তাদের। এরমধ্যেই শরীফ এসে উপস্থিত হয়। দরজা ভেজানো ছিলো বলে বিনা কলিংবেলের আওয়াজে বাসায় প্রবেশ করেছে সে। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা শরীফকে দেখা মাত্রই ফের দগদগে হয়ে উঠলো সুমির।
” শরীফ তুমি! তা-ও এই সকালবেলা? ”
এমনিতে সকালে রুদ্র নিজেই ড্রাইভ করে হসপিটালে যায়। তাই রহমান চাচা শরীফের আগমনে কিছুটা অবাক হয়েছেন।
” আসলে আজকে যদিও হসপিটাল ছুটি কিন্তু ডাক্তারদের তো ছুটির সুযোগ কম। আজকে একটা সিরিয়াস পেসেন্ট আসবে, হঠাৎ করে কল দিলেন তারা। আর যেহেতু আগেও এসেছিলেন তাই না করা যায়নি। এদিকে রাত থেকে রুদ্র ভাইয়াকে কতবার কল দিলাম ধরছে না। ভাবলাম কোনো বিপদআপদ হয়নি তো?”
বিপদের কথা শুনে সুমি ভাবলো মিহি আপার শরীর খারাপের কথা বলা দরকার সবাইকে।
” চাচা মিহি আফার শরীর খারাপ ছিলো গত রাইতে। মনে হয় ঘুমাইতেও পারেনাই ভাই ঠিকমতো। ”
শরীফ সুমির কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো। দীর্ঘ দিন পর কথা বলতে দেখলো প্রেয়সীকে। রহমান চাচা কিছুটা উদগ্রীব হয়ে শরীফকে বললেন,
” তাহলে এখন ডাকতে হবে না ওদেরকে। সাড়ে আটটা বাজে তো কেবল,তা রোগী মনে হয় আরো দেরিতে আসবে তাই না? ”
” হ্যাঁ উনারা সাড়ে দশটার দিকে আসবেন বলেছেন। ”
” তুমি তাহলে নাস্তা করতে শুরু করো। রুদ্র বাবা আর মিহি মা একসাথে খেয়ে নিবে।”
রহমান চাচা, শরীফ ও সুমিকে সকালের নাস্তা খেতে দিলেন। এ বাড়িতে কাউকে হেয় চোখে দেখে না রুদ্র। এখানে সবার পরিচয় শুধু মানুষ হিসেবে ধনী-গরিব হিসেবে নয়।
সকালের মিঠে রোদ জানালা দিয়ে প্রবেশ করে মিহির মুখখানায় পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো তার। ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকালো মিহি। বিবস্ত্র শরীরে মিহিকে জড়িয়ে আছে রুদ্র। যদিও শুধু টিশার্ট নেই। মিহি দ্রুত রুদ্রর বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো ।
” উফ! মিহির দানা একটু ঘুমোতে দাও প্লিজ।”
” ইশশ! কী আদুরে আবদার। ছাড়ুন বলছি।”
রুদ্র ছাড়লো না মিহিকে। ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছে আবারও সে। মিহি আস্তে করে রুদ্রর হাত নিজের গায়ের উপর থেকে সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। কিন্তু ওড়না খুঁজতে গিয়ে দেখলো সেটা ফ্লোরে পড়ে আছে। মিহির বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। কী হয়েছিলো গতরাতে? মিহি দ্রুত আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো চুলগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেছে। ঠোঁটের কোণে কেমন লাল দাগ হয়ে গেছে। সবকিছু বুঝে উঠতেই ভীষণ লজ্জা পেলো মিহির। সবকিছু এভাবে না হয়ে অন্যভাবে হলেও তো হতো? কিছু মনে নেই মিহির এটা ভাবতেই খারাপ লাগছে। লোকটা কেনো তার অবচেতন অবস্থায় এসব করতে গেলো! ন’টা বেজেছে, এলার্ম-ঘড়ি তার সময়মতো বাজতে শুরু করেছে তাই। মিহি জানে রুদ্রর ঘুম এখুনি ভেঙে যাবে। তাই আর দেরি না করে দ্রুত বাথরুমে চলে গেলো গোসল করতে। এরকম এলোমেলো অবস্থায় সামনে পড়তে চায় না সে মোটেও।
এলার্ম-ঘড়ির অত্যাচারে বেশিক্ষণ ঘুমানো সম্ভব হলো না রুদ্রর পক্ষে। মিহিকে পাশে দেখতে না পেয়ে বাথরুমের দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করলো সে। বাইরে থেকে লক করা না মানে ভেতরে মিহি আছে। গতরাতের সুখকর স্মৃতি রোমন্থন করতেই আনমনে হেসে উঠলো রুদ্র। নিশ্চয়ই মেয়েটার কিছু মনে নেই ভেবে ঠোঁটের কোণের হাসি আরও প্রসস্থ হলো।
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৫
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

বাইরে থেকে লক করা না, মানে ভেতরে মিহি আছে। গতরাতের সুখকর স্মৃতি রোমন্থন করতেই আনমনে হেসে উঠলো রুদ্র। নিশ্চয়ই মেয়েটার কিছু মনে নেই ভেবে ঠোঁটের কোণের হাসি আরও প্রসস্থ হলো। এরমধ্যেই মিহি বাথরুম থেকে বেরোলো। কিন্তু বিছানার দিকে না তাকিয়ে সোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসে ভেজা চুলগুলো মুছতে লাগলো। রুদ্র বিষয়টা খেয়াল করে মিহির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মিহি অবশ্য আনমনে তাকিয়ে ছিলো আয়নার দিকে।
” কী হয়েছে? এরকম দৃষ্টি নিচে রেখে চলছো কেনো?”
রুদ্রর উপস্থিতিতে মিহি খুব বিব্রতবোধ করছে। কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে। কেনো যে রাতে ঠান্ডা লাগাতে গেলো!
” না মানে আসলে..”
” ব্যথাও দিলে তুমি আর এড়িয়েও যাচ্ছো তুমি!”
” আপনার কোনো লাজলজ্জা নেই? ”
মিহি আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। রুদ্র সেদিকে তাকিয়ে হাসলো।
” আছে বলেই তো যখন তুমি ঠোঁটে আমার স্পর্শ চাচ্ছিলে তখন আমি সরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো ছাড়লে না। উপরন্তু আমার পিঠের কী অবস্থা করেছো দেখো।”
রুদ্র পিছনে ফিরে দাঁড়ালে মিহি আয়নায় দেখলো নখ বসে গেছে সমস্ত পিঠে। কী লজ্জার কান্ড! অবচেতন অবস্থায় এসব কীভাবে করলো ভেবেই মরমে মরে যাচ্ছে মেয়েটা। লোকটা নিশ্চয়ই খুব ব্যথা পেয়েছিলো তখন? পেলে পেয়েছে তাতে কী হুহ্?
” চাইবোই তো,আপনি আমার একমাত্র স্বামী। বেশ করেছি নখ বসিয়ে দিয়েছি। আপনি কী করেছেন? ঠোঁট ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে আমার। ”
রুদ্র আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলো মিহিকে। আসলেই তো!
“এতকিছু কী খেয়াল থাকে না-কি তখন? ভালোবাসার সময় এরকম একটু-আধটু হয়। ”
” আপনি একটা যাচ্ছে তাই। ঘরের বাইরে গেলে সবাই কী ভাববে? ইশশ! লজ্জায় মরেই যাবো আমি। ”
” হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। একটু কিস করেছি আরকিছুই না। তাছাড়া এসব সবাই করে, নতুন কিছু না। ”
মিহি চিরুনি রেখে রুদ্রর দিকে দৃষ্টিপাত করলো। লোকটা কি সত্যি বলছে? আসলেই কিছু হয়নি গতরাতে! অবশ্য মিথ্যা কেনো বলবে।
“নির্লজ্জ লোক একটা, তারমানে আমাদের ফুলসজ্জা হয়নি?”
” না মিহির দানা। তুমি এখনও ছোটো বুঝলে,আগে বড়ো হও তারপর এসব করবো।”
” আমি ছোটো? মাস্টার্সে পড়া মেয়েকে পৃথিবীর আর কে ছোটো বলেছে আমার জানা নেই।”
” তারমানে তুমি চাচ্ছিলে সবকিছু হোক? সমস্যা নেই তাহলে আজকে রাতে কন্টিনিউ করবো।”
” ধ্যাৎ! অসভ্য লোক।”
মিহি ভেংচি কেটে দরজার দিকে দৌড়ে চলে গেলো। রুদ্র একটু গলা উঁচিয়ে বলেলো,
” এখন থেকে মনে মনে না ডেকে এমনিতেই ডাক্তার সাহেব বলে ডেকো,ভালোই লাগে শুনতে।”
” ঠিক আছে ডাক্তার সাহেব, তাড়াতাড়ি নিচে আসুন।”
রুদ্র গোসল করার জন্য বাথরুমে গেলো। গত রাতের পাগলামির কথা ভাবতেই বারবার হাসি পাচ্ছে মিহির। এরমধ্যে বসার ঘরে উপস্থিত হলো মিহি। শরীফ, আর রহমান চাচা বসে গল্পগুজব করছেন। সুমি আর মিতুর কথার আওয়াজ আসছে ডাইনিং টেবিলের দিক থেকে। যদিও সুমি আগেভাগে খেতে চায়নি কিন্তু রহমান চাচার বলায় আর না করেনি। এখন মিতুকে খাইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা এসব খাবারে শান্তি পায় না।
” শরীফ ভাই কী খবর?”
” এইতো ভাবি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন? ”
” হ্যাঁ ভালোই। চাচা আপনারা খেয়েছেন তো?”
শরীফ এক নজর মিহির দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে কথা বললো। মিহি বিষয়টা বুঝতে পেরে বেশ অস্তিত্বতে পড়েছে। মনে মনে রুদ্রর উপর খুব রাগ হলো তার। একটুও বুদ্ধি নেই না-কি লোকটার? রহমান চাচাও অন্য দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো,
” আমি খাইনি,ওদেরকে খাইয়েছি। মিতুকে খাওয়াতে গেলো সুমি।”
” আচ্ছা চাচা।”
মিহি বসার ঘর পেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে গেলো। এখানে বেশিক্ষণ আর থাকা সম্ভব হচ্ছিলো না। মিতুকে খাওয়ানোর জন্য বেশ বকাবকি করছে সুমি।
” আমি এগুলান খামু না মা। আমারে পান্তা ভাত আর কাঁচা মরিচ দাও। এইসব রুডি, ফলমূলে পরানে শান্তি পাই না। ”
” ওগুলান কই পামু! এগুলাই খাইতে হইবো। ”
মিহিকে দেখে চুপ করলো সুমি। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে শুধালো,
” এহন কেমন আছেন আপা?”
” কেনো কী হয়েছিলো আমার! ”
মিহি কিছুটা চমকালো। অসুস্থ হয়েছিল বলে তো কিছু মনে পড়ছে না। তাহলে কী গতরাতে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার বিষয়টা সুমিও জানে?
” আরে কাইলকা রাইতে ভাই হঠাৎ আইসা কইলো আপনের শরীল খারাপ খুব। গিয়া দেখলাম জামাকাপড় ভেজা,উনি কইলেন সেগুলো পাল্টাইয়া দিতে। তারপর পাল্টাইয়া দিয়া আমি আমার ঘরে আসছিলাম। ”
রুদ্র এতটা ভালো! ভাবতেই মিহির মনে রুদ্রর প্রতি খুব শ্রদ্ধা জাগলো মনে। অনুমতি না নিয়ে তাকে বাজেভাবে দেখার কথাও ভাবেনি মানুষটা।
” আসলে আমার সেসব মনে ছিলো না। এখন ঠিক আছি। মিতু কী বলছিলো? পান্তা ভাতের কথা কী জানি বললো।”
” আর বইলেন না আপা,মাইয়া আমার শহরের খাওনদাওন পছন্দ করে না। ”
” আমি চাচাকে বলে দিবো ভাত বেশি রান্না করতে। রাতে পানি দিয়ে রাখবে, সকালে সেগুলো খাইয়ে দিও ওকে।”
” আপা আফনে এত্তো ভালো! আল্লাহ আফনের ভালো করুক।”
মিহি হেসে মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সত্যি আজ নিজেকে খুব সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। রুদ্রকে পেয়ে জীবনটা ভালোবাসাময় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
কথামতো বিয়ের আগেই তোশাদের বাড়ি গিয়েছিলো রাহি ও আদ্রিয়ান। দেখতে দেখতে তোশার বিয়ে হয়ে যায়। তোশা বেশ স্বাভাবিকভাবেই ওদের সাথে কথাবার্তা বলছে সেই ক’দিন। তবে আদ্রিয়ানও খুব সতর্ক ছিলো রাহির ব্যাপারে। কিন্তু তোশা আসলেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলো। তাই হাসিমুখে বিয়ে করে নিজের সংসারে পাড়ি জমিয়েছে সে।

পড়ন্ত বিকেলে চন্দ্রিমা উদ্যানের একপাশে হাতে হাত রেখে বসে আছে আদ্রিয়ান ও রাহি। দুজনের মুখেই হাসির রেখা ফুটে আছে। আশেপাশে ওদের মতো আরো অনেক কাপল আছে। তবে ওদের আনন্দ আলাদা। একটু আগেই প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট হাতে পেয়েছে রাহি। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে এখানে এসে বসেছে দু’জন। এত বছর পর মা হওয়ার স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে ভাবতেই রাহির মনে আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।
” রাহি!”
” হ্যাঁ বলো।”
” কী চাও বলো।”
” হঠাৎ করে কী চাইবো? ”
” তুমি আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো খবরটা দিলে,আমি বাবা হচ্ছি রাহি! তাই আমার সন্তানকে ধারণ করার জন্য উপহার দিতে চাই তোমাকে। ”
” আমার শুধু তোমাকে চাই। ”
” আমি তো আছি তোমারই, ইনশাআল্লাহ আজীবন থাকবো। ”
” তাহলেই হবে। তুমি থাকলে শাড়ি,গয়না,বই সব অটোমেটিক পেয়ে যাবো।”
রাহি দুষ্টমি করে হেসে বললো কথাটা। আদ্রিয়ানও রাহির দুষ্ট কথায় হাসলো। রাহির কপালে উড়ে আসা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিলো আদ্রিয়ান।
” বুদ্ধিমতী বউ আমার। চলো এবার বাসায় ফিরতে হবে। বাবা-মা কতটা খুশি হবেন ভাবতেই খুব এক্সাইটেড লাগছে। ”
” হ্যাঁ, মিহিও খুব খুশি হবে।”
” তা তো বটেই। বাসায় গিয়ে কল দিয়ে জানিও বরং।”
” আচ্ছা। ”
রাহির হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় উঠলো আদ্রিয়ান। গাড়িতে উঠতেই যাবে এমন সময় হঠাৎ রাহি বললো,
” শোনো না। ”
” কী হলো? ”
” আমি বেলুন কিনবো।”
রাহি একটু ভয়ে ভয়ে বললো কথাটা। না জানি বাচ্চাদের মতো বেলুন কিনতে চাওয়াকে কেমন ভাববে আদ্রিয়ান। কিন্তু আদ্রিয়ান মুখে কিছু না বলপ সোজা বেলুন বিক্রেতার কাছে গিয়ে দশটা বেলুন কিনে নিয়ে এসে রাহির হাতে দিলো।
” এই নাও। আরকিছু লাগবে? ”
” আপাতত লাগবে না, চলো।”
রাহি হাসিমুখে গাড়িতে উঠে আদ্রিয়ানের পাশে বসলো আর বেলুনগুলো পিছনের সিটে রাখলো। ভালোবাসা আসলেই সুন্দর। ভালোবাসার মানুষের কাছে কোনো রাখঢাক রেখে কিছু চাওয়া লাগে না।
চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-২২+২৩

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২২
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
মিহি কথা শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভালোই হবে বাসায় ছোটো একটা মেয়েও আসবে। ভাবতেই মিহির খুব ভালো লাগছে। ফুরফুরে মেজাজে মিহি রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। অহনার সাথে দেখা হবে ভেবে আরো ভালোলাগার রেশ বয়ে যাচ্ছে হৃদয়ে। সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাওয়া দরকার বলে মনে হয়েছিল মিহির।

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে ঘরে এসে মিতুকে সুমি বললো,
” এদিকে আয় তোকে রেডি কইরা দেই।”
ছোট্ট মিতু কৌতুহল নিয়ে মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে শুধালো,
” ক্যান মা? আমরা কই যামু?”
সুমি সব জামাকাপড় আলনা থেকে সরিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। মিতুকে কাছে টেনে চুলগুলো পরিপাটি করে বেনী করে দিচ্ছে।
” এই বাড়ির মাইয়ার শ্বশুর বাড়ি যামু। শুনছি হেয় একলা থাকে।”
” তুমি লগে থাকলে আমার সব জায়গা সমান আম্মা।”
মেয়ের কথায় সুমি হেসে জড়িয়ে ধরে তাকে।

চেম্বারের এক কোণে চেয়ারে বসে আছে মিহি। শরীফ দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রর পাশে,রুদ্র রোগী দেখছে। আজকের রোগীর চাপ বেশি থাকায় দেরি হচ্ছে খাওয়াদাওয়ায়। রুদ্র একটু সময় পর পর মিহির দিকে তাকিয়ে দেখছে। মিহি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে।
” শরীফ আর কেউ আছে? ”
” নাহ ভাইয়া আপাতত কেউ নেই, বিকেলে আসবে হয়তো। ”
” মিহি চলো আজ হসপিটালের ক্যান্টিনে গিয়ে খাবো। ”
” কেনো? বাসায় গেলে হয় না? ”
মিহি ফোনের উপর থেকে নজর সরিয়ে বললো। রুদ্র ততক্ষণে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
” এত সময় হবে না। চলো তারচে তিনজন একসাথে এখানেই লাঞ্চ করি। ক্যান্টিনে কিন্তু ভালো ভালো খাবার পাওয়া যায়। ”
” আচ্ছা চলুন তাহলে। ”
ক্যান্টিনে বসে তিনজনে একসাথে খাবার খাচ্ছে। মিহি রুদ্রকে বলে ওর বাবার বাড়ি অলরেডি একজন আছেন, যার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। শরীফকে পাঠিয়ে দিলেই সে চলে আসবে।
” তাহলে খাওয়া শেষ হলে তুমি চলে যাও শরীফ। ”
” ঠিক আছে ভাইয়া।”
খাওয়াদাওয়া শেষে শরীফ মিহির বাবার বাড়ি চলে যায়। আসরের আজান দিয়েছে। রাহি নামাজ শেষে রান্নাঘরে সবার জন্য চা তৈরি করতে ঢুকেছে। শরীফ বসার ঘরে সোফায় বসে আছে একাই। সালমান খুরশিদও এরমধ্যে নিচে চলে এলেন। শরীফের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। রাহি চা তৈরি করার পরে সুমিকে গিয়ে রেডি হতে বলে। কিন্তু সুমি আর মিতু আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকায় রাহির সাথেই বসার ঘরে এলো। শরীফ তখন চা খাচ্ছিলো।
” শরীফ ভাই এই হলো সুমি আর এই মিতু ওর মেয়ে। আর সুমি তোমরা উনার সাথে নিশ্চিন্তে যেতে পারো।”
শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই সুমির হৃদকম্পন যেনো কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুমি। শরীফ নিজেও বরফের মতো জমে গেছে। এটা স্বপ্ন না-কি সত্যি বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে এই মুহুর্তটা আর এগোবে না,সবকিছু কেমন ঘোরলাগা হয়ে গেছে। রাহি সুমির নিস্তব্ধতা দেখে ফের বলে উঠলো,
” সুমি? ”
রাহির ডাকে হুঁশ ফিরলো সুমির। চক্ষুদ্বয় ছলছল করছে। আশেপাশে লোকজন আছে বলেই হয়তো চোখের জল সংবরণ করলো সে।
” ঠিক আছে ভাবি। চাচা আমরা গেলাম, কোনো ভুল করলে মাফ কইরা দিয়েন আর চাচিরেও কইয়েন। ”
” আরে কীসের ভুল পাগলি? তাছাড়া যাচ্ছো তো আমার মেয়ের বাসায়, দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। ”
“আচ্চা।”
সুমি স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতেও কেমন যেনো আঁটকে যাচ্ছে বারবার। মনের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এই অনুভূতি বলে বোঝনো সম্ভব নয়। শরীফ এখনও স্থির নেত্রে তাকিয়ে আছে সুমির দিকে। হাতে থাকা চায়ের কাপের চা ঠান্ডা হয়ে গেছে কখন সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। সালমান খুরশিদের কথায় টনক নড়ে উঠলো শরীফের। কোনো প্রকার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে পৌঁছুলো শরীফ। সুমি পিছনে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। মিতু গাড়ির দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। শরীফ এক নজর তাকালো সুমির দিকে তারপর গাড়ির দরজা খুলে ইশারায় ভেতরে বসতে বললো। সুমি বিনবাক্যে মিতুকে নিয়ে
গাড়ির ভেতর বসলো। শরীফ ড্রাইভিং সিটে বসেছে কিন্তু গাড়ি স্টার্ট না করে গাড়ি থেকে নেমে সুমির ও মিতুর সিট বেল্ট বেঁধে দিলো। সুমি আর চোখের জল সংবরণ করতে পারলোনা। নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়ালো। তবে মিতু কিংবা শরীফ কেউ সেটা খেয়াল করেনি। শরীফকে দেখে মিতুর মনে হচ্ছে তাকে দেখে কোনো হেলদোল নেই শরীফের। এসব ভেবেই কেনো যেনো সুমির কষ্টের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়ছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। এত বছর পর দেখা তবুও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। মানুষ দূরে থেকেও মনের দিক থেকে কাছাকাছি থাকতে পারে যেমন তেমনই পাশাপাশি থেকেও মন থেকে অনেক দূরে থাকতে পারে। লোকটা নিশ্চয়ই এতদিনে বিয়ে-শাদি করে সুন্দরভাবে সংসার করছে! এসব ভেবে বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছে সুমি।
” মা আর কতক্ষণ লাগবো?”
” রাস্তায় জ্যাম আছে, ঘন্টাখানেক তো লাগবেই। তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে? ”
মিতুর প্রশ্নের উত্তর শরীফ দিলো। সুমি কিছু বললো না। মিতু শরীফের সাথে আরো টুকটাক কথা বলতে লাগলো। সুমি বাইরের তাকিয়ে রইলো বাকি সময়।

সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় পৌঁছালো সুমি,শরীফ ও মিতু। মিহি ওদের জন্য অপেক্ষা করেই বসে ছিলো। তাই কলিংবেলের আওয়াজ শুনতেই দরজা খুলে দেয় মিহি। সুমি আর মিতুকে পৌঁছে দিয়ে শরীফ গাড়ি নিয়ে রুদ্রর হসপিটালের দিকে রওনা দিলো।
” আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো তোমাদের? ”
সুমি ও মিতুকে দোতলায় ঘর দেখিয়ে দিয়েছে মিহি। বিছানায় বসে আছে মিতু,সুমি দাঁড়িয়ে।
” না আপা।”
” আচ্ছা শোনো আমি তোমাদের তুমি করে ডাকবো,তোমরাও তাই ডেকো।”
” আচ্চা আপা।”
” তোমার কি শরীর ঠিক আছে সুমি? না-কি এভাবেই কম কথা বলো তুমি? ”
সুমির কথাবার্তা কেমন অদ্ভুত ঠেকলো মিহির কাছে এজন্যই জিজ্ঞেস করলো। আসলে শরীফের আচরণে খুব খারাপ লেগেছে সুমির। বেশি কিছু তো আশা করেনি সে,অন্তত “কেমন আছো ” জিজ্ঞেস করতে পারতো!
” আসলে আপা মাতা ব্যাথা করতাছে একটু এইজন্য আরকি।”
” ওহ আচ্ছা। তুমি বরং রেস্ট করো,আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি। সেগুলো খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবে। আর তোমার মেয়েকেও কিছু খাইয়ে দিও। ”
মিহির আন্তরিকতায় সুমি অবাক হলো। এতটা ভালো কীভাবে কেউ হয়!
” না আপা কিচ্ছু লাগবো না এহন। রাইতে খাইয়া ঔষধ খামু লাগলে।”
” ঔষধ না খেলেও কিছু খেতে পারো। ডাইনিং টেবিলের উপর ফলের ঝুড়ি রাখা আছে, সেখান থেকে না হয় কিছু ফল দিও ওকে।”
মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো মিহি। সুমি উত্তর করলোনা। মিহি নিজের ঘরে পড়তে চলে গেলো।
চেম্বার থেকে বের হয়েছে রুদ্র ও শরীফ। শরীফের চোখমুখ কেমন শুকনো লাগছে রুদ্রর। এতক্ষণ চেম্বারে অনেক রোগীর ভীড় থাকায় কথা বলার সুযোগ পায়নি সে। কিন্তু হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসা মাত্রই শরীফকে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে?
” কিছু হয়নি ভাইয়া।”
শরীফ গাড়ি চালাচ্ছে, রুদ্র পাশের সিটে বসেছে আজ। শরীফ এমনিতে রুদ্রর থেকে কখনো কিছু লুকায় না।
” শরীফ আমি তোমার চোখ পড়তে পারি,কী হয়েছে বলো।”
” ভাইয়া সুমিকে দেখলাম আজ কতগুলো বছর পর। ”
” কোথায়!”
” তোমাদের বাসায় দিয়ে এলাম,ওই বাড়ি থেকে যাকে আনতে গিয়েছিলাম সেই সুমি।”
” ও মাই গড! তারপর কী হলো? কথা বললে?”
” নাহ। ওর একটা মেয়ে আছে পাঁচ / ছয় বছর হবে। ”
” তারজন্য কথা বলোনি?”
রুদ্রর এই প্রশ্নে শরীফ উত্তর দিলো না। নিজেকে নিজেই বুঝতে পারছেনা রুদ্রকে কী বলবে? রুদ্র ফের শুধালো,
” কী হলো বলো? এত বছর পর দেখা হলো অথচ সে কেমন আছে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না?”
” জিজ্ঞেস করার দরকার ছিল না ভাইয়া,ওর চোখমুখ বলে দিচ্ছিলো ও ভালো নেই। চোখের নিচের কালো দাগ বলে দিচ্ছিলো এক আকাশ চিন্তা নিয়ে কতো রাত নির্ঘুম কেটেছে তার।”
” এখনও এতো ভালোবাসো?”
” আপনি কী ভুলতে পেরেছেন ভাইয়া? তাছাড়া সুমি আমাকে ঠকায়নি। ও এখনো আমাকে ভালোবাসে, চোখ কখনো মিথ্যা বলে না।”
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শরীফের কাঁধে হাত রাখলো।
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২৩
(কঠোরভাবে মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

আপনি কী ভুলতে পেরেছেন ভাইয়া? তাছাড়া সুমি আমাকে ঠকায়নি। ও এখনো আমাকে ভালোবাসে, চোখ কখনো মিথ্যা বলে না।”
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শরীফের কাঁধে হাত রাখলো।
” তোমার কথা ঠিক আছে কিন্তু অতীতকে আঁকড়ে আমি আর বর্তমানকে নষ্ট করবোনা। মিহি যথেষ্ট এগোচ্ছে সম্পর্কে আমি অহেতুক নবনীর স্মৃতি নিয়ে বসে থাকবো কেনো? তা-ও যদি সে আমাকে ভালোবাসতো! ”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া। আমিও এটাই বলেছিলাম, ভাবি যথেষ্ট ভালো মনের মানুষ। আপনারা সুখে হলে আমার দেখেও শান্তি লাগবে। ”
” তাহলে সুমির সাথে কথা বলবে কখন? এখনই চলো আমার সাথে। ”
শরীফ গাড়ি থামিয়েছে। বাসার সামনে চলে এসেছে রুদ্র।
” না একটু সময় লাগবে আমার। ”
” ভালোবাসা কী মনস্তাত্ত্বিক না-কি শরীরবৃত্তীয়? ”
রুদ্রর এরকম প্রশ্নের হেতু বুঝতে সময় লাগে না শরীফের। তবুও দোনোমোনো করে বললো,
” দুটোই দরকার ভাইয়া।”
” হ্যাঁ সেটা ঠিক আছে। মন ও শরীর দুই প্রয়োজন কিন্তু মন যদি না থাকে সেখানে কী ভালোবাসা হয়?”
” না।”
” অথচ শরীর না ছুঁয়ে কিন্তু আমরা ভালোবাসি। দেহ হলো নদীর পানির মতো। কতকিছুই তো সেই পানিতে মিশে সাগরে যায় তাতে কী পানি নষ্ট হয়ে যায় শরীফ? তুমি যদি সত্যি মন থেকে সুমিকে ভালোবাসো তাহলে ওর ছেলেমেয়ে থাকাটা কোনো বিষয় হওয়ার কথা নয়।”
” কিন্তু এই সমাজ! ”
” এসব নিয়ে কাল কথা বলবো। তুমি নিজেকে আগে জিজ্ঞেস করো কী চাও! পরে সমাজের কথা ভেবো,আসছি।”
শরীফ কোনো কথা বললো না আর। রুদ্র বাসায় ঢুকলো। গ্যারেজে গাড়ি রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো শরীফ। রুদ্রর বাসা থেকে পনেরো মিনিট হাঁটলেই তার বাড়ি। তবে নিজের নয়,ভাড়া।
ডাইনিং টেবিলে বসে আড্ডায় মেতে উঠেছিল মিহি,সুমি ও রহমান চাচা। এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দিয়েছেন রহিম চাচা। মিতু সোফায় বসে টিভিতে কার্টুন দেখছে। রুদ্র মিহির দিকে এক নজর তাকিয়ে নিজের রুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য গেলো।
” আপা ভাই আসছে আপনি গেলেন না?”
” উনি এসেছে, ফ্রেশ হয়ে খেতে আসবেন। আমি গিয়ে কী করবো সুমি?”
” সোয়ামি কামকাজ থেইকা ফিরলে বউয়ের যাওয়া দরকার। ”
সুমির কথাটা একটু মনে ধরলো মিহির। সেদিন রাতের পর থেকে রুদ্রর জন্য খুব মায়া হয় মিহির। পৃথিবীতে আপম বলতে কেউ নেই লোকটার অথচ কত সুন্দর করে সবাইকে খুশি রাখতে চায়! সুমিকে বসিয়ে রেখে মিহি রুমে চলে যায়। এদিকে রহমান চাচা রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করছেন। আজকে কারো খাওয়া হয়নি, সবাই একসাথেই খেতে পারবে। এমনিতে মিহি একা খেয়ে নেয় তারপর রহমান চাচা বাসায় চলে যান । রুদ্র এসে রাতে একা একা খাবার খায়।
” কী ব্যাপার কিছু লাগবে? ”
মিহিকে রুমে ঢুকতে দেখে রুদ্র বললো। রুদ্র বাইরের পোশাক নিয়েই ওয়াশরুমের দিকে এগোলো,হাতে টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট।
” না,আপনার কিছু লাগলে বলবেন। আমি রুমে আছি।”
” পারলে আমার সাথে ভেতরে চলো।”
“কী! অসভ্য লোক একটা। ”
মিহি ঠোঁট উল্টে বললো। রুদ্র হাসছে। ওয়াশরুমের দরজার বাইরে মাথা বের করে রেখেছে সে। মিহি তা দেখে রাগে কটমট করতে করতে আবারও বলে,
” সব সময় শুধু শয়তানি বুদ্ধি। ”
” আরে বাবা আমার পিঠে একটু সাবান দিয়ে দেওয়ার জন্য ডেকেছিলাম, নিজে নিজে কী ভালো করে দেওয়া যায় বলো?”
” দিতে হবে না সাবান। তাড়াতাড়ি গোসল করে নিচে খেতে আসুন আমি যাচ্ছি। ”
মিহি হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রুদ্র ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে দরজা আঁটকে দিলো। মিতুকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে সুমি। সব সময় একা খেতে পারে না মেয়েটা। কিন্তু সুমির শরীরও বিশেষ ভালো নেই। পেটে কেমন যেনো ব্যথা করে ইদানীং। বাচ্চাটা ঠিকঠাক আছে কি-না এই নিয়েও চিন্তায় থাকে সুমি।
সোফায় বসে ল্যাপটপে মাথা গুঁজে কাজ করছে আদ্রিয়ান। রাহি মশারী টাঙিয়ে বিছানায় শুয়েছে । আদ্রিয়ানের সেলফোন রাহির হাতে, রাহির ফোনের ব্যাটারিতে সমস্যা হওয়াতে বারবার ফোন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই আদ্রিয়ানের ফোন দিয়ে বাবার বাড়ি কল দিয়ে কথা বললো রাহি।
” আর কতক্ষণ লাগবে তোমার? ”
” কেনো খুব মিস করছো না-কি? ”
” সামনেই তো বসে আছো মিস করার কী আছে মিস্টার? ”
” আদর মিস করছো মনে হয়, আজকে হবে? ”
আদ্রিয়ানের লাগামহীন কথায় রাহি লজ্জা পেলো। ঠোঁট টিপে মুচকি হেসে মেকি রাগ দেখালো।
” ধ্যাৎ! এসব কথা বলবা না…”
রাহির কথা শেষ হওয়ার আগেই আদ্রিয়ানের ফোনের আওয়াজ ভেসে এলো কর্ণকুহরে। রাহি ফোন হাতে নিতেই দেখলো স্ক্রিনে তোশার নাম ভেসে উঠেছে। রাত এগারোটার সময় তোশার কল দেওয়ার কারণ বুঝতে পারছে না রাহি। স্ত্রী’র হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া খেয়াল করে আদ্রিয়ান প্রশ্নতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” কে কল দিলো?”
” তোশা।”
তোশা! কিন্তু কীসের জন্য কল দিয়েছে সে? ল্যাপটপ বন্ধ করে বিছানায় রাহির পাশে বসলো আদ্রিয়ান।
” কল ধরে দেখো কী বলে।”
” তোমার ফোন আমি কেনো রিসিভ করবো।”
” আমি আর তুমি আলাদা নই।”
রাহি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরলো।
” হ্যালো ভাইয়া, কেমন আছো তোমরা?”
তোশার মুখে ভাইয়া সম্মোধন শুনে চারশো বিশ ভোল্টের শক খেলো রাহি। এ যে ভুতের মুখে রামনাম!
” আমি ভাবি বলছি।”
” বাহ ভালো হয়েছে তুমি রিসিভ করছো। আচ্ছা শোনো, সামনের সপ্তাহে আমার বিয়ে। বাবা কালকে বাসার সবাইকে দাওয়াত করে আসবে। তোমরা কিন্তু কাল-পরশুর মধ্যে চলে আসবা। ”
আদ্রিয়ান দুজনের কথোপকথন বুঝতে পারছিলো না বলে স্পীকার অন করতে বললো। রাহি তোশার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না।
” অভিনন্দন তোশা। আমারা অবশ্যই যাবো।”
” ধন্যবাদ ভাবি,শুভ রাত্রি। শীঘ্রই দেখা হচ্ছে। ”
” ইনশাআল্লাহ। ”
তোশা অপরপ্রান্ত থেকে কল কাটা মাত্রই আদ্রিয়ান রাহির চোখাচোখি হলো।
“কী ব্যাপার বলো তো! এতো পরিবর্তন? ”
আদ্রিয়ানের চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। সত্যি বলতে রাহি নিজেও বেশ অবাক হয়েছে। তবুও সবকিছুর জন্য শুকরিয়া আদায় করে সে।
” সে যাইহোক অবশেষে তোশা বিয়ে করে নিবে।”
” হ্যাঁ সেটাই। ”
আদ্রিয়ান আর কাজকর্মে মন দিতে পারলোনা। তোশাকে ছোটো থেকে চেনে আদ্রিয়ান, এই মেয়ে এতো সহজে দমে যেতে পারে না। মনটা কেমন অস্থির লাগছে। কী জানি বিয়েতে কী হয়!

অসময়ে বৃষ্টি একদম ভালো লাগে না মিহির। এই ডিসেম্বর মাসেও বৃষ্টি হতে হবে? শীতের মধ্যে বৃষ্টি হলে শীত বেড়ে তিনগুণ হয়। তবুও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে সে। ঠান্ডা বাতাসে মাঝে মধ্যে কেঁপে উঠছে তার শরীর। রুদ্র এখনো রুমে আসেনি। কে জানে সুমির সাথে তার কীসের এত কথা! দরজা ভেজানো ছিল, রুদ্র প্রবেশ করাতে টের পেলো মিহি। কিন্তু আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো সে। রুদ্র আস্তে পা টিপে টিপে মিহির একদম পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
” কিছু বলবেন? ”
” তুমি বুঝলে কীভাবে আমি তোমার পিছনে? ”
মিহি রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো।
” দরজা খোলার আওয়াজে বুঝতে পেরেছি আপনি এসেছেন। তারপর আপনার পায়ের আওয়াজেও বুঝতে পেরেছি। ”
” বাব্বাহ! তোমার কানের শ্রবনশক্তি খুব প্রখর তো।”
” আমার সব ইন্দ্রিয়ই প্রখর। তা এতক্ষণ কী কথা হচ্ছিলো? ”
” তেমন কিছু না। সুমির বাড়ি কোথায়, কেনো শহরে এসেছে এইসব। ”
” উমম.…চলুন। ”
” কোথায়? ”
” কোথায় আবার? ঘুমুতে। ”
রুদ্র হাসলো,মিহির হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে সে-ও পাশে বসলো।
” এমনভাবে বললে মনে হচ্ছিলো অন্য কিছু। ”
মিহি বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো,
” কী মনে হচ্ছিলো?”
” ভেবেছিলাম ছাঁদে যাবে বৃষ্টিতে ভিজতে। ”
” মাথা খারাপ না-কি! এই ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত জ্বর আসবে।”
” কিচ্ছু হবে না আমার। তবে তোমার হলে আলাদা বিষয়। ”
মিহি কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলো। একবার ইচ্ছে করছে রুদ্রর সাথে ছাঁদে গিয়ে ভিজে একাকার হতে আবার পরক্ষণেই নবনীর কথা মনে পড়তেই আর ইচ্ছে করছে না। মিহি বেশ বুঝতে পারে রুদ্র সব সময় কেমন একটা দূরত্ব বজায় রাখে। যদিও বন্ধুর মতো সারাক্ষণ পাশে থাকে কিন্তু সেটা কেবলই দায়িত্ব, ভালোবাসে নয়। মিহিকে চুপ করে থাকতে দেখে রুদ্র আবারও কথার খেই ধরলো।
” বুঝতে পেরেছি, ভাবছো বৃষ্টিতে ভিজতে গেলে যদি অঘটন ঘটে যায়। ”
” এ্যা! কীসের অঘটন? ”
” যদি কোলে তুলে ছাঁদে হাঁটি কিংবা রোমান্টিক হয়ে যাই তখন?”
” সেসব আপনি করবেন না আমি জানি। নবনী ম্যাডামের সাথে তাহলে অবিচার হয়ে যাবে না!”
রুদ্র মিহির চোখের দিকে তাকালো। হালকা অভিমান ফুটে উঠেছে সেই চোখের মাঝে। রুদ্র মিহির হাত ধরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
” তাহলে চাইছো আমি ওসব করি?”
রুদ্রর এমন প্রশ্নে মিহি থতমত খেয়ে গেছে। প্রশ্নটা করার সময় রুদ্রর চোখেমুখে কেমন একটা দুষ্টমি খেলা করছিলো। তারজন্যই মিহি আর রুদ্রর দিকে তাকাতে পারছেনা। রুদ্রও আর কিছু বললো না। মিহির হাত ধরে সোজা সিড়ি বেয়ে ছাঁদে পৌঁছুলো। বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে লাগতেই ঠান্ডায় কেঁপে উঠলো মিহি। ছাঁদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে মিহির হাত ছেড়ে দিয়ে, দু-হাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো রুদ্র। মিহির শরীর কাঁপছে কিন্তু রুদ্রকে দেখে বেশ ভালো লাগছে। মিনিট পাঁচেক পরে রুদ্র মিহির দিকে তাকালো। মিহির তখন রীতিমতো শীতে জুবুথুবু অবস্থা। রুদ্র বুঝতে পেরে বুকে জায়গা দিলো তাকে। শীতের মধ্যেও অন্য কোনো অনুভূতিতে সাড়া শরীর শিহরিত হলো। মিহি কোনো বাক্যব্যয় না করে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুদ্রকে। মিহির শরীরের অবস্থা বুঝে রুদ্র তাকে কোলে তুলে নিয়ে ছাঁদ থেকে রুমে নিয়ে এলো। মিহির ভেজা ঠোঁটের দিকে তাকাতেই রুদ্র নিজেকে সামলাতে পারলোনা। কিছু সময়ের ব্যবধানে দুজনের ওষ্ঠাধর মিলিত হলো। মিহির চোখ তখন বন্ধ করা ছিলো। মিহির তেমন রেসপন্স না পেয়ে রুদ্র মিহিকে বিছানায় শোয়ালো। মিহির জ্ঞান নেই! রুদ্র ভড়কে গেলো খুব। কী হলো মেয়েটার? রুদ্র দ্রুত সুমির ঘরে গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে এলো। সুমি গভীর ঘুমে তলিয়ে ছিলো। হঠাৎ দরজায় করাঘাত পড়তেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার।
” সুমি তুমি একটু মিহির জামাকাপড় পালটে দাও,আমিও চেইঞ্জ করে আসছি।”
” আপনি থাকতে আমারে ডাকলেন ক্যান ভাই? ”
” কথা পরে বলো আগে পাল্টে দাও প্লিজ,ঠান্ডা লেগেছে খুব ওর। আমারই ভুল ড্যাম ইট!”
রুদ্র নিজের উপর রেগে গেছে খুব। কেনো যে তখন বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়ার কথা বললো!
চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-২০+২১

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২০
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)

” হুম কচুর মজা।”
” ছি অশ্লীল কথা। ”
রুদ্রর এমন কথায় মিহি চোখ বড়সড় করে তার দিকে তাকালো। রুদ্র ঠোঁট টিপে হাসছে। মিহি বুঝতে পেরেছে লোকটা তাকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছে নির্ঘাত।
” কোনটা অশ্লীল কথা? ”
” এই যে কচু বললে সেটাই। ”
” কেনো কচু খাননা? না-কি অ্যালার্জি! ”
রুদ্র এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলোনা। জোরে হাসতে হাসতে ছাদের এক পাশ থেকে অন্য পাশে গেলো। মিহি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রুদ্রর কান্ডকারখানা দেখছে। লোকটা যে এরকম আধপাগল হবে বুঝলে বাবার কথামতো বিয়ে করতোনা মিহি।
” হাসাহাসি বন্ধ করুন তো,গা জ্বলে যাচ্ছে। ”
” ফায়ারসার্ভিসে কল দিবো না-কি? ”
” আমি পাবনা সিট বুকিং করে দিচ্ছি। আপনি কাইন্ডলি সেখানে চলে যান।”
” কিন্তু কেনো বলো তো?”
“কারণ আপনি ওখানকার বাসিন্দা।
” পাগল তো সেই কবেই হয়েছি মিহি,মানুষটা যখন ঠকালো! ছোটো থেকে একা একা বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যখন বড়ো হলাম, তখন নবনীকে পেয়ে জীবনে নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে জেগেছিল। ”
হঠাৎ রুদ্রর চোখমুখ কেমন শক্ত হয়ে গেছে। মিহি খেয়াল করলো এই প্রথম রুদ্র মিহিকে মিহিরদানা না ডেকে শুধু মিহি বলে ডাকলো। রুদ্র নিজের জীবনের কথা মিহির সাথে বলতে চাইছে ভেবে মিহি সাহস সঞ্চার করে বললো,
” আজকের রাতটা চলুন গল্প করে কাটাই তবে হ্যাঁ এই খোলা ছাদের নিচে না।”
” ঠিক আছে রুমে চলো।”
রুদ্র ও মিহি ছাদ ত্যাগ করে তাদের রুমে ঢুকে মুখোমুখি বসলো। রুদ্রর চেহারা স্বাভাবিক না,দেখে মনে হচ্ছে নীলচে ব্যথারা বুকের মধ্যে তীব্র গতিতে ছোটাছুটি করছে।
” কী হয়েছিল আন্টি-আঙ্কেলের?
” বলছি..”
রুদ্রর বয়স তখন সবে ছয় বছর, ডাক্তার হঠাৎ করে একদিন বললেন রুদ্রর মা ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। বড়োজোর কয়েকদিন বাঁচতে পারে। রুদ্র তখন অতকিছু না বুঝলেও নানার মুখ দেখে ঠিক বুঝেছিলো বাবার মতো মা’কেও আর দেখতে পারবে না হয়তো। জন্মের পরে বাবাকে দেখেনি ছেলেটা। মায়ের মুখে শুনেছিল রুদ্র গর্ভে থাকতেই একটা গাড়ি দূর্ঘটনায় নিহত হন তিনি। এমনিতেই প্রেমের বিয়ে ছিল পারিবারিক অশান্তি ছিল রুদ্রর দাদার বাড়ি থেকে। তাই রুদ্রর বাবা মারা যাওয়ার পরে ওর মাকে সবাই তাড়িয়ে দেয় শ্বশুরবাড়ি থেকে। তারপর থেকে নানাবাড়ি বড়ো হয়েছে রুদ্র। রুদ্রর মা ছিলো পরিবারের একমাত্র সন্তান। মা মারা যাওয়ার পরে একেবারে এতিম হয়ে গেলো রুদ্র। নানা বড়ো করে তুলেছিলো ছেলেটাকে। নানী পরপারে গেছিলো অনেক আগে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ যখন তখনই আলাপ হয় নবনীর সাথে। নবনী তখন কলেজে ভর্তি হয়েছিল মাত্র। দেখতে দেখতে সময় গড়ায়,দুজনের সম্পর্ক গভীর হয়। রুদ্রর ইন্টারমিডিয়েট শেষ হওয়ার পরে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও নবনীর জন্য রাজি হয় না। নানা অনেক বোঝায় কিন্তু রুদ্র কিছুতেই নবনীর মায়া কাটিয়ে দূরে যেতে পারছিলো না। নানার সাথে এ নিয়ে একটু মনোমালিন্য হয় বটে। তবুও জেদ করে স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতেই মেডিকেল শেষ করে। তবে রুদ্র দেখিয়ে দিয়েছিলো লেখাপড়ার ইচ্ছে থাকলে সব জায়গায় বসেই ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। কিন্তু আরো ভালো করার জন্য পিএইচডি করতে ঢাকা যেতেই হতো। তাই একদিন দুপুরে নবনীর সাথে দেখা করতে গিয়ে নিজেরই এক বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পায় নবনীকে। ব্যস!সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। নবনী নিজেই রুদ্রকে স্পষ্ট জানায় সে তার বন্ধুকে চায় তাকে না। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকায়নি রুদ্র। সেদিনই ঢাকা চলে আসে।
ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা ছেয়ে গেছে। মিহি ঠিক কী বলবে বুঝতে পারছেনা। তার জীবনে এরকম কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই। অথচ রুদ্র ছোটো থেকেই সব হারিয়ে বেঁচে আছে। রুদ্রর চোখ কেমন লাল হয়ে গেছে। কেবল মাত্র পুরুষ মানুষ বলেই হয়তো হাউমাউ করে কাঁদতে পারছেনা। মিহি হুট করে রুদ্রর হাত ধরে। রুদ্র কিঞ্চিৎ চমকায়।
” কী হয়েছে? ”
” এই হাত দিয়ে নবনীকে ছুঁয়েছেন? ”
মিহির এরকম প্রশ্নের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা রুদ্র। কিছুটা থতমত খেয়ে বললো,
” তুমি কী কখনো প্রেম করোনি?”
” নাহ,আমি এসবে জড়াইনি। ”
” খারাপভাবে কখনো স্পর্শ করিনি তবে.. ”
” তবে? ”
” সে আমার জীবনে প্রথম নারী, একসাথে হাত ধরে অনেকটা পথ চলেছি। সেই চলার পথে মাঝে মধ্যে আঁকড়ে ধরেছিলাম হারিয়ে ফেলার ভয়।”
” হয়েছে হয়েছে। নিজের বউয়ের জন্য অপেক্ষা না করে পরনারীর সাথে লটরপটর করেছেন বলেই হারিয়েছেন। ”
মিহির কথায় রুদ্রর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। এ যে ভুতের মুখে রামনাম!
” কীসব বলছো? তোমার শরীর ঠিক আছে মিহির দানা? আর লটরপটর কেমন শব্দ? ”
মিহি রুদ্রর হাত ছেড়ে দিয়ে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো। রাত প্রায় শেষের দিকে। ঘরের বাতি বন্ধ করে রুদ্রকে পাশ কাটিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। রুদ্র আগের মতোই ঠাঁয় বসে রইলো। মেয়েটা কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করলো আজ। তবে কী সম্পর্কে এগোতে চাইছে সে? কিন্তু রুদ্র যে কেবল তাকে বন্ধুর মতো আগলে রেখেছে। মিহির বাবাকে দেওয়া কথার কারণে সব সময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করেছে,তার বেশি কিছু হওয়ার নয়। নবনী ঠকালেও রুদ্র আজও মনে মনে স্রেফ নবনীর।
ভোরের আলো ফুটতেই রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে সুমি। মিতু অবশ্য এখনো ঘুমোচ্ছে। এঁটো থালাগুলো জড়ো করে সেগুলো ধুয়ে নাস্তা তৈরি করার জন্য ভাবছে। কালকে রাতে রাহির থেকে মোটামুটি রান্নাঘরের কোথায় কী আছে দেখে নিয়েছিল। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এত তাড়াতাড়ি শেখা সম্ভব হবে না সুমির। তাছাড়া শহুরে খাবারদাবারও তৈরি করতে জানে না সে। গ্রামে থাকতে তো সকালে পান্তাভাত খেতো। অন্য খাবার বলতে মাঝে মধ্যে পিঠে তৈরি করতো আর নুডলস। এসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা সময় গড়িয়ে গেলো। আচ্ছা সবুজ কী তাকে খুঁজেছে একবারও? নাহ ওই মানুষটার কথা মোটেও ভাবতে চায় না সুমি। কিন্তু যাইহোক ওই লোকটাই সুমির সন্তানদের বাবা।
” এত সকালে তুমি রান্নাঘরে কী করছো?”
হঠাৎ রাহির প্রশ্নে ভাবনার সুতো ছিড়ে গেলো। স্নিগ্ধ মুখখানায় হাসি ফুটিয়ে সুমি বললো,
” আসলে ভাবি নাস্তা বানাইতে আইছিলাম কিন্তু এই মেশিনগুলা দিয়ে কেমনে কী করে তা তো জানি না।”
সুমির কথায় হাসলো রাহি। পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে। টোস্টার মেশিনের ওপর হাত রেখে বললো,
” এটা দিয়ে টোস্ট তৈরি করে, আর এটা দিয়ে মশলা গুড়ো করা হয়। তবে চাইলে অনেককিছুই ভাঙা যায়। আর এটা হচ্ছে জুস তৈরি করার মেশিন।”
রাহি একটা একটা করে রান্নাঘরের সব যন্ত্রপাতি সুমিকে দেখালো এবং কার্যকারিতা বললো। কিন্তু সব কথা সুমি বুঝলো কিনা সেটা বোঝা গেলোনা।
” আচ্ছা ভাবি এহন কী তৈরি করবেন খাওয়ার জন্য? ”
” উমম…সেদ্ধ ডিম, জুস, কিছু ফল সাথে সান্ডউইচ। ”
” আচ্ছা আমি তাইলে ডিম সেদ্ধ করতাছি আপনি উইস বানান।”
” ওটা সান্ডউইচ হবে সুমি।”
সুমি গ্যাস অন করে একটা পাতিলে পানি দিয়ে চুলোয় বসিয়ে ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে সেদ্ধ দিলো। এগুলো শিখে নিয়েছে আগেই।
” ওই হইলো ভাবি। তা ভাবি একখানা কথা কমু?”
রাহি ফ্রিজ থেকে কিছু আপেল আর কমলা বের করে সেগুলো খোসা ছাড়িয়ে রাখতে রাখতে বললো,
” হ্যাঁ বলো।”
” আপনার বাচ্চাকাচ্চা নাই? ”
” থাকলে তো দেখতে তাই না? তবে হয়ে যাবে ব্যাপার না। ”
রাহি একটু লজ্জাই পেলো মনে হয়। মনে মনে ভাবলো এবার হয়তো সত্যি একটা বাচ্চা দরকার সংসারে। আদ্রিয়ানের সাথে কথা বলতে হবে রাতে।

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। আজকে বিকেলেই বাসায় ফিরে এসেছে সে। মিহি ঘুমোচ্ছে রুমে। গতকাল রাতের পর থেকে মিহির আচরণে কেমন বদল এসেছে। রুদ্র বিষয়টা খেয়াল করলেও মিহিকে কিছু বললো না। সকালে রুদ্রর আগে উঠেই নাস্তা করার জন্য ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষা করছিলো মিহি। দুপুরে কলেজ থেকে সরাসরি চেম্বারে চলে গিয়েছিল। সবকিছুই কি দয়া করছে মিহি? কেউ নেই বলে এই করুণা? রুদ্রর ভাবনার অতলে ডুবে যাচ্ছে বারবার। ভালোই তো দুষ্টমিষ্টি সম্পর্ক ছিলো দুজনার। অতীতের কথা না বললে হয়তো মিহি এরকম করুণা করতো না তাকে। রুদ্র আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নানার কথা ভাবে।
” কেনো আমাকে রেখে চলে গেলে নানা? সবাই কি পণ করেছিলে আমাকে একা রেখে চলে যাওয়ার? ”
আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে রুদ্র। সে জানে কোনো উত্তর আসবে না এই প্রশ্নের তবুও মনকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা। আজ পর্যন্ত কেউ থাকেনি রুদ্রর জীবনে, তাই নতুন করে মিহিকে নিজের সাথে জড়াতে চায় না। হুট করে কাছে এসে ভালোবেসে আবার বদলে গেলে খুব কষ্ট হয়। তারচে মানুষের থেকে দূরে থাকাই ভালো।
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_২১
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত)
আজ পর্যন্ত কেউ থাকেনি রুদ্রর জীবনে, তাই নতুন করে মিহিকে নিজের সাথে জড়াতে চায় না। হুট করে কাছে এসে ভালোবেসে আবার বদলে গেলে খুব কষ্ট হয়। তারচে মানুষের থেকে দূরে থাকাই ভালো।
” আজকে তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে?”
হঠাৎ মিহির কথায় নড়েচড়ে উঠলো রুদ্র। এরমধ্যেই ঘুম ভেঙে গেলো মেয়েটার? রুদ্র চোখমুখ স্বাভাবিক করে মিহির দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললো,
” কেনো আগেভাগে আসলো সমস্যা? ”
” আমার আবার কীসের সমস্যা? আরো ভালো হয়েছে, সারাদিন একা একা বাড়িতে থাকা লাগে। ”
” রহমান চাচা তো মাঝে মধ্যে থাকেন।”
” মাঝে মধ্যে সব সময় তো থাকেন না।”
” তা সব সময় থাকার জন্য কাউকে লাগবে? ”
রুদ্র ঠিক কী বললো বুঝতে পারলোনা মিহি। কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলো। তারপর কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
” খবরদার যদি আমার আশেপাশে আসেন। এহহ শখ কতো!”
” কী আশ্চর্য কথাবার্তা বলতেছো! তোমার কাছাকাছি কেনো যাবো আমি? দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে? ”
” মানে? আপনি কি বাইরে মেয়েদের সাথে ইটিসপিটিস করেন?”
” কি পিটিস করি? এসব কোথা থেকে শিখছো তুমি মিহির দানা? ”
” বন্ধুরা বলে।”
” তাই তো বলি! যাইহোক তুমি বরং রাহি ভাবি কিংবা আম্মাকে কল দিয়ে বলো একজন মহিলাকে ঠিক করে দিতে। কোনো কাজকর্ম করতে হবে না শুধু তোমার সাথে থাকবে। ”
” ঠিক আছে বলবো। আপনি দাঁড়ান আমি কফি নিয়ে আসছি।”
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। একাকীত্ব অভিশাপ না-কি আর্শীবাদ? মানুষ যখন বাজেভাবে ঠকে যায় তখন মনে করে একাকীত্ব সুন্দর। কারো সাথে থেকে কষ্ট পাওয়ার থেকে একা থেকে নিজের মতো বাঁচা ঢের ভালো। আবার যখন প্রিয় মানুষটা দূরে থাকে অথচ ব্যস্ততার জন্য কথা বলতেও তেমন সময় হয় না তখন একাকীত্ব অভিশাপ।
সারাদিন শেষে রাতে মা-মেয়ে বসেছে নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য। এ বাড়ির লোকজন খুব ভালো বলেই অতিথিদের জন্য যে রুম বরাদ্দ সেখানেই থাকে মিতু ও সুমি। বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে দু’জন। সবুজের কথা ভেবে সুমির একটুআধটু খারাপ লাগছে। কিন্তু মিতুও মোটেও বাবাকে মিস করছে না। ছোট্ট মিতুর মনে বাবার প্রতিদিনের অন্যায় কর্মকাণ্ড তার প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্ম দিয়েছে।
” মিতু তুই কী আমার লগে রাগ করছিস?”
” না তো মা। তোমার লগে রাগ করমু কেন?”
” তোর বাপের থেইকা দূরে নিয়া আইলাম তোরে এইজন্যে।”
মিতু আরেকটু গভীরভাবে মা’কে জড়িয়ে ধরে। সুমি মিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
” তুমি যা করবা তাতেই আমার স্বায় থাকবো মা।”
” আমার সোনাচান।”
সুমি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করে। মিতুও মায়ের আলিঙ্গনে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
ঘরের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান। শোয়ারঘর ভেতর থেকে বন্ধ করে রেখেছে রাহি। কিন্তু কীসের জন্য সেটা বুঝতে পারছেনা আদ্রিয়ান। কয়েকবার ডাকাডাকি করলে রাহি বলেছে কিছুক্ষণ অপেক্ষার করতে। সেই জন্য ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা! হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে ঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করলো আদ্রিয়ান। দরজা খুলে দিয়েছে রাহি। আদ্রিয়ান কৌতুহল নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দেখলো সারা ঘরে বৈদ্যুতিক বাতির বদলে মোমবাতি জ্বলছে। আদ্রিয়ানের মনে পড়ে গেলো প্রথম বিবাহবার্ষিকীর কথা। সেদিন রাতে ঠিক এরকমভাবে ঘর সাজিয়ে সারপ্রাইজ দিয়েছিল রাহিকে। আজ বুঝি তার উল্টো হলো। আদ্রিয়ান এবার বিছানার দিকে তাকাতে দেখলো রাহি সেজেগুজে বসে আছে। চোখেমুখে তার লাজুক হাসি লেপ্টে আছে। আদ্রিয়ানের প্রিয় কালো রঙের শাড়ি পরেছে সে। সাথে হাতে কালো চুড়ি, কপালে ছোট্ট কালো টিপ,ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল। আদ্রিয়ান ঘরের দরজা আঁটকে ধীরে ধীরে গিয়ে রাহির পাশে বসলো।
” কী ব্যাপার বলো তো এতো সাজগোছ! আজ তো আমাদের বিবাহবার্ষিকীও নয়।”
” তাতে কী হয়েছে? এমনি একটু সারপ্রাইজ দিলাম।”
” তা ঠিক আছে,নতুন করে আরেকবার ফুলসজ্জা করে নিবো। কী বলো?”
আদ্রিয়ান রাহির হাতে হাত রেখে হেসে বললো। রাহি মাথা নিচু করে ফেললো কিছুটা।
” শোনো না একটা কথা বলবো?”
” হ্যাঁ বলো। বিয়ে হলো কত বছর এখনো এত লজ্জা কীভাবে পাও তুমি? ”
” ধ্যাৎ! সুমি বলছিলো আমাদের কোনো বাচ্চা নেই কেনো।”
আদ্রিয়ান হেসে রাহিকে বুকে জড়িয়ে নিলো। রাহি কোনো কথা না বলে চুপচাপ প্রিয়তমের বুকের হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ শুনছে।
” তাহলে এই কথা? তাহলে নতুন অতিথি আসুক?”
রাহি মুখে কোনো উত্তর দিলো না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো কেবল। আদ্রিয়ান বিছানা থেকে উঠে ঘরের সমস্ত মোমবাতি নিভিয়ে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে ফের রাহির পাশে এসে বসলো।
” ওগুলো নিভালে কেনো?”
” ম্যাডাম আমরা তো এখন আর আমাদের মধ্যে থাকবো না,মহাকাশ ভ্রমণে যাবো। তাই তখন তো এই পৃথিবীর কোনো খেয়াল থাকবে না। কোনো দূর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য বুঝলেন? ”
” ভাবছি তুমি বিজ্ঞানী হলে না কেনো?”
” আমি না হলেও আমার ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য চেষ্টা করবো ঠিক আছে। ”
রাহি আদ্রিয়ানের কথায় হাসলো কেবল। আদ্রিয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। কী সুন্দর স্নিগ্ধ মুখখানা তার! হাসিতে যেনো প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে তার। আদ্রিয়ান রাহিকে জড়িয়ে কপালে ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিলো। রাহিও আদ্রিয়ানের গালে,নাকের ডগায় ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো।
” রাহি।”
” হ্যাঁ বলো।”
” একটা গান শোনাবে?”
” এখন?”
” হুম। ”
ভালোবাসি ভালোবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়
বাজায় বাঁশি
ভালোবাসি ভালোবাসি

আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে
দিগন্তে কার কালো আঁখি
আঁখির জলে যায় ভাসি
ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি

সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে
সেই সূরে সাগর কূলে বাঁধন খুলে
অতল রোদন উঠে দুলে

সেই সুরে বাজে মনে অকারনে
ভুলে যাওয়া গানের বাণী
ভোলা দিনের কাঁদন
কাঁদন হাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি!!

সকাল সকাল মেয়ের নম্বর থেকে কল আসায় কিছুটা চিন্তায় নিমজ্জিত হলেন রিনা বেগম। ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন তিনি। রাহি আর সুমি সকালের নাস্তা পরিবেশন করছে। রিনা বেগম কল রিসিভ করলেন।
” সবকিছু ঠিক আছে মিহি? সকাল সকাল কল দিলি!”
” ঠিক না থাকার কী আছে বলো তো? বাসায় আমি আর সে,ঝামেলা হবে কার সাথে? ”
” তাহলে ঠিক আছে। কেমন আছিস তোরা?”
” আলহামদুলিল্লাহ, তোমরা কেমন আছো? ”
” হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ। নাস্তা খেয়েছিস?”
” হ্যাঁ। আচ্ছা মা একজন মহিলাকে ঠিক করো তো,আমার সাথে থাকবে সারাদিন। সকালে আসবে সন্ধ্যায় যাবে বাসায় এরকম। কোনো কাজকর্ম করা লাগবে না, সেসব রহমান চাচা করেন।”
” তাই? ভালোই হবে তাহলে আমাদের বাসায় তোর বাবার পূর্ব পরিচিত গ্রাম থেকে একটি মেয়ে এসেছে। ওর একটা ছয় বছরের মেয়েও আছে সাথে, আমাদের এখানেই থাকবে। আমি বরং ওকে তোর ওখানে পাঠিয়ে দিবো,দিন-রাত সব সময় থাকবে।”
” আরে বাহ! তাহলে আজকেই পাঠিয়ে দিও। ভাইয়ার সমস্যা থাকলে শরীফ ভাই গিয়ে নিয়ে আসবে।”
” আদ্রিয়ান তো সকাল সকাল না খেয়ে বেরিয়ে গেলো। অফিসে না-কি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। ”
” ওকে তাহলে আমি উনাকে বলে শরীফ ভাইকে পাঠিয়ে দিবো বিকেলে, এখন তো কলেজে যাবো। ”
” ঠিক আছে। ”
” আচ্ছা ভালো থেকো।”
” তুইও নিজের খেয়াল রাখিস সাথে সংসারেরও।”
ফোন কেটে নাস্তার দিকে মনোযোগ দিলো রিনা বেগম। রাহি অবশ্য বুঝতে পেরেছে সুমিকে নিয়ে কিছু বলেছে।
” সুমি!”
সুমি রান্নাঘরে ছিলো,রিনা বেগমের ডাকে দ্রুত পা চালিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো।
” হ্যাঁ ম্যাডাম।”
” বিকেলে তোমাকে নেওয়ার জন্য লোক পাঠাবে আমার মেয়ে। খুব ভালো মানুষ আমার মেয়ে, ওর শ্বশুর বাড়িতে কেউ নেই। সারাদিন একা থাকে বলে একজন লোক খুঁজতে বলছিলো। তুমি আর মিতু যখন আছো বাইরে লোক কেনো খুঁজবো বলো?”

সুমি রাহির দিকে একপলক তাকালো। রাহি মুচকি হাসলো সুমির দিকে তাকিয়ে। সময় কম হলেও এরমধ্যেই রাহিকে ভরসা করতে শুরু করেছে সুমি।
” ঠিক আছে। আমরা যাবো।”
রিনা বেগম খুশি মনে খাবার খেতে শুরু করলেন।

মিহি কথা শেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ভালোই হবে বাসায় ছোটো একটা মেয়েও আসবে। ভাবতেই মিহির খুব ভালো লাগছে। ফুরফুরে মেজাজে মিহি রেডি হয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-১৮+১৯

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৮
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

এরকম করে কাউকে ভালোবাসার কথা শুনলেও হয়তো রুদ্র হাসতো! কিছু কথা অজানা থাকাই ভালো, নিজের সব কথা বলতে নেই। এমনকি খুব ভালো বন্ধু কিংবা ভালোবাসার মানুষকেও না। কারণ মানুষ বদলায়, বদলায় সম্পর্ক।

ছবির মতো সুন্দর গ্রামের ছোটো একটা টিনের দোতলা ঘরের জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে সকালের মৃদু রোদ এসে গায়ে লেগেছে মিতুর।
রোদের আলো মুখময় খেলা করার কারণে ঘুমটা কেমন আলগা হয়ে গেলো তার। কিন্তু হঠাৎ করে
মায়ের কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো মিতুর। বিছানা থেকে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। ছয় বছর বয়সী মেয়েটা বয়সের তুলনায় অনেক কিছু ভালো বুঝতে পারে। তাই এক মুহুর্ত দেরি না করে মায়ের ঘরে দৌড়ে চলে গেলো মিতু। যা ভেবেছিলো তাই! মিতুর বাবা তার মা’কে মেরেছে। সুমি মাটিতে পড়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে আর সবুজ এখনো গালমন্দ করে চলেছে। মিতু ভয়ে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো। যতক্ষণ সবুজ ঘর থেকে বেরিয়ে না যাবে ততক্ষণ এরকমই দাঁড়িয়ে থাকবে মিতু।
” কতবার বলছি তোরে বাপের বাড়ি গিয়া কিছু টাহাপয়সা নিয়া আয়,তা তো যাবিনা। তাইলে পইড়া মাইর খা আরকি।”
সবুজ আরেকবার লাথি দিলো সুমিকে। সুমি ব্যথায় ককিয়ে উঠলো।
” পিঠে আর লাথি দিও না,আমার আর সহ্য হইতেছে না। ”
মায়ের কান্নাজড়িত কথাগুলো মিতুর কলিজায় বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধছে। ইচ্ছে করছে বাবা নামক মানুষটাকে বটি দিয়ে এক কোপে ঘাড় নামিয়ে দিতে। কিন্তু ছোটো বলে মারা তো দূর কোনো কথা অবধি বলতে পারে না সে। একদিন অবশ্য মায়ের হয়ে কথা বলেছিল মিতু। কিন্তু সেদিন ছোটো মিতুকেও বাবার থাপ্পড় খেতে হয়েছিল।
” সহ্য না হইলে বাপের বাড়ি যা, নইলে শহরে গিয়া বড়ো গাড়ির নিচে পইড়া মর।”
সবুজ আর কোনো কথা না বলে ঘর থেকে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো। বাবা প্রস্থান করা মাত্রই মিতু মায়ের পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। সুমি মৃদু হাসার চেষ্টা করে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে,
” কাঁদিস না মা, আমরা অনেক দূরে চইলা যামু। ”
” কই যামু মা? বাবা কী আমাদের যাইতে দিবে?”
মেয়ের হাত ধরে আস্তে করে উঠে বসে সুমি। দু-চোখ মুছে সবকিছু বিবেচনা করে চোখেমুখ শক্ত করে বলে,
” কাইলকা যামু আমরা, দরকার হইলে মা-মেয়ে গাড়ির নিচে পইড়া সত্যি মরমু তা-ও এই জালিমের হাতে মাইর খামু না। ”
মিতু মা’কে জড়িয়ে ধরে। মায়ের কষ্ট সহ্য হয় না তার। সুমি মেয়ের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই বয়সে কোথায় স্কুলে যাবে,খেলাধুলা করবে কিন্তু সেসবের কিছু মিতুর কপালে নেই।

এলার্ম ঘড়ির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো মিহির। চোখ খুলে সবার আগে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। আজ ক্লাস আছে ভার্সিটিতে। বিছানা ছেড়ে উঠে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। রুদ্র আগেই হসপিটালে চলে গেছে। মিহি নয়টার আগে ঘুম থেকে উঠে না কিন্তু রুদ্রর নয়টার মধ্যে হসপিটালে যেতে হয় বলে আগেভাগে চলে যায় সে। রহমান চাচা সকালে এসেই নাস্তা তৈরি করে দিয়ে চলে যান। তবে মাঝে মধ্যে মিহির সাথে গল্প করার জন্য থেকে যান। দুপুরের দিকে আবার বাসায় যান। ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি একটা বাসন্তী রঙের থ্রিপিস পরে মিহি,হাতে ব্রেসলেট, কানে ছোটো দুল। চুলগুলো বরাবরই খোলা রাখে মিহি আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেলো মিহি। আজকাল ঘুমটা একটু বেশি হচ্ছে মিহির সেই নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তার। রুদ্রর বাসা থেকে মিহির ভার্সিটি কাছে হওয়াতে বেশি সময় লাগলো না পৌঁছুতে। ক্যাম্পাসে গিয়ে দাঁড়িয়ে অহনাকে ডাক দিলো।
” অহনা! ”
অহনা মিহিকে দেখে মুচকি হেসে এগিয়ে এসেছে।
” কেমন আছিস?”
” ভালোই, ক্লাস করবি না?”
” আজ স্যার নেই, অবশ্য অন্য কোনো স্যারকে বললে নিশ্চিত ক্লাস নিবেন। কিন্তু ইচ্ছে করছে না রে।”
” এটা কোনো কথা! আমি আরো কত তাড়াহুড়ো করে এলাম।”
” খেয়ে এসেছিস তো?”
” উঁহু খাইনি। ”
” চল ক্যান্টিনে গিয়ে খাবি।”
” আরে এখন আর খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
অহনা ও মিহিকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে রউফ এগিয়ে এলো। রউফ ওদের ক্লাসমেট তবে ডিপার্টমেন্ট আলাদা।
” কী খবর তোদের? মিহির তো বিয়ের পর দেখা মেলা দুষ্কর হয়ে গেছে। ”
” ধ্যাৎ কী যে বলিস! আমি তো ভালো আছি,অহনা কেমন আছে তা জানি না। ”
” হ্যাঁ আমিও ভালো। রউফ চল ক্যান্টিনে যাই মিহি না খেয়ে এসেছে। ”
মিহি অহনার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো। একদিন সকালে নাস্তা করেনি সেটা কি জনে জনে বলতে হবে! কিন্তু কিছু বললো না মিহি। তিনজনে একসাথে ক্যান্টিনে গিয়ে বসলো। মিহি একটা স্যান্ডউইচ খেলো কেবল। রউফ যদিও খেয়ে এসেছিলো তবুও আবারও একবার নাস্তা সেড়ে নিলো। অহনা চুপচাপ ওদের খাওয়া দেখছিলো।
” যখন ক্লাস হবে না তখন আর বসে কী করবি? তারচেয়ে বাসায় চলে যা বরং।”
রউফ মিহিকে বললো কিন্তু মিহি বাসায় যাবে না বললো। অহনার মাথায় তখন দুষ্ট বুদ্ধি ঘুরছিলো। হুট করেই বলে উঠলো,
” আচ্ছা শোন না আমার সাথে একটু হসপিটালে যাবি?”
” সেকি হসপিটালে কেনো?”
রউফ আবারও দুজনের কথার মধ্যে নাক গলানোতে অহনা বিরক্তি নিয়ে বললো,
” তোর বউয়ের বাচ্চা হয়েছে সেটা দেখতে। ”
” হুঁশ বিয়ে করলাম না আবার বউ,বাচ্চা। বুঝতে পেরেছি অহনা আপার মেজাজ চটে যাচ্ছে। মিহি আমি গেলাম। ”
” ঠিক আছে যা।”
রউফ চলে যেতে মিহি আর অহনা ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সোজা রিকশায় চড়ে বসলো।
” কোন হসপিটালে যাবি? ”
” সামনেই।”
” কেনো যাবি তা তো বললি না তখন।”
” তোর স্বামীকে দেখতে যাবো।”
” স্বামী! ”
” তাহলে কী ভাসুর? ”
” অসভ্য মেয়ে কোথাকার। ”
বিয়ে হয়েছে দু’মাস হয়ে গেছে মিহি ও রুদ্রর। তবুও এতদিনেও স্বামী কথাটা কেমন অচেনা ঠেকলো মিহির। তবে রুদ্র স্বামী হিসেবে খারাপ না। মানুষটার অতীত থাকলেও মিহির প্রতি সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছে। সব সময় মিহির সাথে খুনসুটি করে লোকটা। এতে অবশ্য মাঝে মধ্যে মিহির বিরক্ত লাগে কিন্তু তবুও রুদ্র চুপ থাকে না। এইতো গতকালই মিহি সন্ধ্যায় বিরিয়ানি রান্না করেছিল। কিন্তু লবনে একটু বেশি হওয়ায় রুদ্র যতক্ষণ জেগে ছিলো ততক্ষণই ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করে গেছিলো।
রিকশা থামলো সানরাইজ হসপিটালের সামনে। মজার কথা এতদিনেও মিহি জানে না তার স্বামী কোন হসপিটালে চাকরি করে। অহনা রিকশাওয়ালা মামাকে ভাড়া মিটিয়ে অহনা ও মিহি হসপিটালের ভেতরে প্রবেশ করলো। অহনা রিসিপশনের সামনে গিয়ে মিহিকে বললো,
” তুই একটু ওইদিকে গিয়ে দাঁড়া আমি আসছি।”
” ঠিক আছে। ”
মিহি রিসিপশনের বিপরীত দিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়েছে। অহনা রিসিপশনের মেয়েটিকে রুদ্রর চেম্বারের কথা জিজ্ঞেস করলে সেই মেয়েটি বলে আগে থেকে সিরিয়াল না রাখলে হুট করে এসে রুদ্র চৌধুরীর চেম্বারে যাওয়া যায় না। সব রোগী দেখা শেষ হলপ তবেই যাওয়া যাবে।
” সবই বুঝলাম কিন্তু আপনি ডাক্তার সাহেবকে কল দিয়ে বলুন উনার স্ত্রী মিহি এসেছে তাহলেই হবে। ”
অহনার মুখে স্ত্রী কথাটা শুনে মেয়েটি হেসে বললো,
” ম্যাডাম আপনি এসেছেন আগে বললেই হতো। সোজা গিয়ে ডান দিকে স্যারের রুম।”
” ঠিক আছে ধন্যবাদ। ”
রিসিপশন থেকে মিহির কাছে গিয়ে মিহিকে নিয়ে রুদ্রর রুমের দিকে এগোতে লাগলো অহনা। কপাল ভালো আজকে তেমন রোগী নেই চেম্বারের সামনে। মিহি তখনও ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে ছিলো। রাহি কিছু ছবি পাঠিয়েছে সেগুলো দেখছিলো।
” মিহি ভেতরে আয়।”
মিহি আশেপাশে না তাকিয়ে চেম্বারের ভেতরে ঢুকলো। রুদ্র মিহিকে দেখেই হকচকিয়ে গেলো। শরীফ হেসে সালাম দিতেই মিহি চমকালো।
” আসসালামু আলাইকুম ভাবী।”
” তুমি! ”
” তুমি চেম্বারে এসেছো কেনো? শরীর ঠিক আছে তো!”
রুদ্র চেয়ার থেকে উঠে এসে মিহির সামনে এসে বললো। মিহি ঘটনার আকস্মিকতায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একবার অহনার দিকে তাকিয়ে ফের রুদ্রর দিকে দৃষ্টিপাত করলো মিহি।
” আমার কিছু হয়নি আমার বান্ধবীর মনে হয় বুকে ব্যাথা।”
” আরে না আমি ঠিক আছি। আসলে দুলাভাইয়ের থেকে ট্রিট নিতে এসেছি। ”
” ওহ আচ্ছা তা কী ট্রিট লাগবে শালিকা?”
মিহি মনে মনে খুব রেগে গেছে অহনার উপর। কিন্তু এখানে বসে কিছু বললো না। রুদ্র নিজের চেয়ারে বসে অহনাকেও বসতে বললো। মিহি বসলো না, শরীফ আর মিহি দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৯
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
মিহি মনে মনে খুব রেগে গেছে অহনার উপর। কিন্তু এখানে বসে কিছু বললো না। রুদ্র নিজের চেয়ারে বসে অহনাকেও বসতে বললো। মিহি বসলো না, শরীফ আর মিহি দাঁড়িয়ে আছে।
” আপাতত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়ালেই হবে। ”
” ব্যস এতটুকুই! বেশ চলো দুই বান্ধবীকে ফুচকা খাওয়াবো।”
অহনা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠে দাঁড়াতেই মিহি গম্ভীর স্বরে বললো,
” ওকে নিয়ে খাইয়ে আসুন আমি শরীফ ভাইয়ের সাথে এখানেই বসছি।”
মিহির গম্ভীরতা দেখে অহনা আর কিছু বলার সাহস পেলো না। কিন্তু রুদ্র হেসে বললো,
” এত রাগ করার কি হয়েছে মিহির দানা? অহনা তোমার স্বামীর চেম্বারেই নিয়ে এসেছে,পরপুরুষের কাছে তো না।”
” আপনি চুপ করুন! আবারও মিহির দানা, অসহ্য। ”
মিহির রাগ দেখে শরীফ মুখ টিপে টিপে মিটিমিটি হাসছে। অহনা তো ভয়ে জড়সড়ভাব করে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। রুদ্র কিছু বললো না, উঠে মিহির হাত ধরে অহনাকে ও শরীফকেও পিছু পিছু আসতে বললো। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে একটু সামনে হেঁটে যেতেই রাস্তার পাশে ফুচকাওয়ালার দেখা মিললো। মিহি বারবার রুদ্রর থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চাইলেও শক্তিতে পেরে উঠেনি বলে চুপ করে গেছে।
” মামা চার প্লেট ফুচকা দিন তো।”
” ঝাল বেশি না-কি নরমাল? ”
রুদ্র অহনা ও মিহির দিকে তাকালো একবার। মিহি কিছু বললো না কিন্তু অহনা বলে মিহি ঝাল বেশি খায় আর সে কম খায়। খাওয়া শেষে শরীফকে মিহিকে বাসায় দিয়ে আসতে বললো রুদ্র। অহনাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে রুদ্র হসপিটালে চলে যায়।

দুপুরের তপ্ত রোদে হাঁটতে ক্লান্ত লাগছে ছোটো মেয়েটির। মিতুকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে দুইটা ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছে সুমি। সুমির শরীরও বিশেষ ভালো না। এই অবস্থায় প্রতিদিন মারধর এবং পৈশাচিক অত্যাচার সহ্য করতে পারে না শরীর। শহরের রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ অচেনা সুমির কাছে তবুও লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে কাঙ্খিত ঠিকানায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে সে। আশেপাশের বড়ো বড়ো দালানকোঠা দেখে মিতুর ছোট্ট মন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
” কী রে দাঁড়ালি কেন?”
” মা দেহো কত্ত বড়ো বড়ো দালান!”
” এগুলান দেইখা দাঁড়াইয়া থাকলে কী কাম হইবো? তাড়াতাড়ি পা চালা,লোকটা তো কইলো সামনেই এই ঠিকানা। ”
” আইচ্ছা মা আমরা কই যাইতাছি?।”
মেয়ের প্রশ্নে সুমির চোখমুখ মলিন হয়ে গেলো। সত্যি বলতে যেখানে যাচ্ছে সেখানে আদৌও তাদের জায়গা হবে কি-না জানে না সে।
” যামু একজন ভালো মানুষের বাড়ি। কথা বলিস না চল। ”
সুমির কথামতো মিতু আর কোনো প্রশ্ন করলো না মা’কে। মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বড়ো একটা দালানের সামনে এসে দাঁড়ালো। সুমি আঁচলের ডগার পুটলি খুলে গেট দারোয়ানকে একটা কার্ড দেখাতে দারোয়ান গেট খুলে দিলো। মনে মনে যদিও ভয়ে ছিলো কার্ড দেখালেও ভেতরে প্রবেশ করতে দিবে কি-না ভেবে। লোহার গেইট পেরিয়ে বাড়ির দরজার সামনে এসে দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ করলো সুমি। কিন্তু অনেকক্ষণ টোকা দেওয়ার পরেও যখন কেউ দরজা খুললো না তখন করুন স্বরে মিতুকে বললো,
” মা রে আমাগো কপাল মনে হয় একেবারেই পোড়া। কত্তবার ধাক্কা দিলাম কেউ তো খুললো না দরজা। ”
” মা দরজার পাশে ওইডা কী?”
কলিংবেলের সুইচবোর্ডের দিকে তাকিয়ে বললো মিতু। মেয়ের কথায় সুমিও সেদিকে দৃষ্টিপাত করলো। ভালো করে তাকিয়ে জিনিসটা কী বোঝার চেষ্টা করছে সুমি। হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতেই সুইচটা উঁচু নিচু হতেই শব্দ হওয়াতে চমকালো দু’জন। কিয়ৎক্ষণ বাদেই সুমি বুঝতে পারলো এটা দিয়ে বাড়ির লোকজনকে সংকেত পাঠানো হয়। তাই আরো একবার সুইচ টিপে মিতুর দিকে তাকালো সে। এরমধ্যেই একজন সুন্দরী নারী দরজা খুলে দিলো। সুমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী সুন্দর ফর্সা তার চেহারা, ঠোঁটে লিপস্টিক,চুলগুলো খোলা! গ্রামে কেউ এমন করে সাজেনি কখনো। সুমির ভাবনায় ছেদ ঘটলো সুন্দরী নারীর মিষ্টি কন্ঠে।
” কাকে চাই? ”
” সালমান চাচায় আছেন? আমি পুবালিপুর গেরাম থেইকা আইছি,উনার সাথে আগে কথা হইছিল আমার। ”
” বাবার পরিচিত, আচ্ছা ভেতরে আসুন।”
সুমি রাহির কথামতো বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো মিতুকে নিয়ে।
” আপনি এখানে বসুন আমি বাবাকে ডেকে নিয়ে আসছি।
সোফার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো সুমি। এত সুন্দর জায়গায় সে বসবে! কিন্তু মিতু বলা মাত্রই দৌড়ে গিয়ে সোফায় বসে পড়েছে। ততক্ষণে রাহি দোতলায় চলে গেছে সালমান খুরশিদকে ডাকতে। রান্নাঘর থেকে রিনা বেগম রাহিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো কে এসেছে? কিন্তু কোনো উত্তর না পেয়ে রিনা বেগম নিজেই বসার ঘরে এলেন। সুমি আর মিতুকে ভালো করে দেখলেন তিনি। দেখে চিনতে পারলেন না,মনে হয় না কখনো দেখেছেন বলে।
” তোমরা কারা! কী করতে এসেছো?”
রিনা বেগমের কথায় ভরকে গেল সুমি। মিতু আপনমনে সোফায় বসে পুরো ঘর দেখছে।
” আ..আ.আমি সুমি।”
” সেটা তো বুঝলাম কিন্তু কোথা থেকে এসেছো আর কেনো?”
রিনার প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্যে সালমান খুরশিদ সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসেছেন। পিছন পিছন রাহিও এসেছে। সুমিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। সুমি এখনও রিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে।
” কে তুমি? আমার সাথে দেখা করতে এসেছো?”
সালমান খুরশিদের প্রশ্নে ঘুরে তাকালো সুমি। ভদ্রলোককে দেখে ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠেছে তার।
” চাচা আমি সুমি,ওই পুবালিপুর গেছিলেন আট বছর আগে? ”
এতক্ষণে খেয়াল করলো সালমান খুরশিদ। সেই চঞ্চল কিশোরী মেয়েটির চেহারার আজ কী দশা হয়েছে! চোখমুখ কেমন মলিন,চোখের নিচে কালো দাগগুলো চিন্তিত আর নির্ঘুম রাতের সাক্ষী।
” হ্যাঁ মনে পড়েছে। বসো,রাহি ওঁকে কিছু নাস্তা দাও।”
রাহি শ্বশুরের কথামতো রান্নাঘরের দিকে গেলো। সুমি সোফায় না বসে ফ্লোরে বসলো। কিন্তু রিনা বেগমও যখন সোফায় বসতে বললো তখন মিতুর পাশেই বসলো। সালমান খুরশিদও বসলেন বিপরীত পাশের সোফায়। রাহি এরমধ্যে কিছু ফল আর শরবত নিয়ে এসেছে। সুমি কিছু খেলো না, মিতুকে খেতে বললো রাহি। রিনা বেগমও কিছু জানেন না বলে বসে রইলেন ঘটনা কী সেটা জানার জন্য। কিন্তু চুলোয় রান্না চাপানো থাকার জন্য রাহিকে রান্নাঘরে যেতে হলো।
” এখন বলো তো এত বছর পর হঠাৎ আমার কাছে এলে! তা-ও এই জীর্ণশীর্ণ অবস্থায়। ”
সুমি বিয়ের পর থেকে সবুজের করা সব অত্যাচারের কথাই বললো সংক্ষিপ্ত আকারে। শুধুমাত্র স্বামী স্ত্রীর একান্ত সময়ের অত্যাচারের কথা বলতে পারেনি। সবকিছু শুনে রিনা বেগম ও সালমান খুরশিদ দুজনেই করুন দৃষ্টিতে তাকালো সুমির দিকে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা। ফুলের মতো একটা মেয়ের জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই সালমান খুরশিদের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো।
” ওর কথা তো সবই শুনলাম মিহির বাবা,এক কাজ করো ওঁরা এখানেই থাকুক। আমাদের কাজে সাহায্য করবে।”
” হ্যাঁ সেটাই বলতাম আমিও। তবে ওর শরীর ভালো না তাই সব কাজ ওকে করতে দিও না। আর মিতুকে আমি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবো।”
বাড়িতে জায়গা দিলেও পরের মেয়েকে স্কুলে দেওয়ার কথা শুনে রিনার চোখমুখ কুঁচকে গেলো। সুমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। সত্যি সত্যি এত সুখ ছিল তার কপালে?
” না না চাচা ওরে ভর্তি করা লাগবো না, আমগো শুধু একটু মাথা গুঁজবার জন্য জায়গা দিলেই হয়।”
” সুমি যখন চাচ্ছে না তাহলে ওর মেয়েকে ভর্তি করার দরকার নেই। ”
” সেটা আমি বুঝে নিবো রিনা। বাঁচবো কয়দিন আর বলো? পরপারে যাওয়ার আগে তো ভালো কাজকর্ম করে যেতে হবে তাই না?”
রিনা বেগম আরকিছু বললেন না। সুমি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো।
রাতের আকাশে কালো মেঘেরা ছোটাছুটি করছে। মাঝে মধ্যে চাঁদ ঢাকা পড়ছে মেঘের আড়ালে। মিহি ছাঁদে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছে। এ বাড়িতে আসার পর থেকে রাতে চাঁদ দেখা হয়নি আর,আজকেই প্রথম। আজকে যখন রুদ্র মিহির হাত ধরেছিলো কেনো জানি মিহির বারবার মনে হচ্ছিল এই স্পর্শ মিহির পরিচিত। কিন্তু রুদ্র এ-র আগে কখনো ছোঁয়নি তাকে। ডিসেম্বরের রাতে ঠান্ডা বাতাসে শরীর কেঁপে উঠলো মিহির। পাতলা চাদরের মধ্যে থেকেও কাজ হচ্ছে না। সন্ধ্যায় আবার বৃষ্টি হয়েছিল তাই ঠান্ডা বেড়ে গেছে একটু।
” আজকে কী এখানেই ঘুমানোর প্ল্যান করলে না-কি মিহির দানা? ”
মিহি পিছনে ঘুরলো না। কারণ এ বাড়িতে রুদ্র ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ নেই। আকাশের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো সে।
” ঠান্ডায় জমে মরার শখ নেই আমার। ”
” উমম বুঝলাম। আজকে ওমন রাগ দেখালে কেনো? বেচারি তোমার বান্ধবী কী ভয়টা না পেয়েছিলো।”
” ও ঢং করে বলেছিলো ডাক্তার দেখাতে যাবে। সরাসরি বললেই তো হতো ওর ট্রিট চাই আপনার থেকে। ”
” আহা তেমন কিছু তো ডিমান্ড করেনি জাস্ট মজা করার জন্য করেছে মেয়েটা।”
” হুম কচুর মজা।”
” ছি অশ্লীল কথা। ”
রুদ্রর এমন কথায় মিহি চোখ বড়সড় করে তার দিকে তাকালো। রুদ্র ঠোঁট টিপে হাসছে। মিহি বুঝতে পেরেছে লোকটা তাকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছে নির্ঘাত।
চলবে,

মনেরও গোপনে পর্ব-১৬+১৭

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৬
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” হ্যাঁ এজন্যই তো সকাল সকাল আপনার ছেলেকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছি। রাহি বাড়িঘর সুন্দর করে পরিপাটি করে রেখেছে কালকেই। ”
” বুঝলে রিনা আমাদের সৌভাগ্য এই যুগে রাহির মতো একটা ছেলের বউ পেয়েছি। ”
” হ্যাঁ নিসন্দেহে ঠিক বলেছেন। আপনি চা শেষ করে ঘরে রেখে দিন, আমি রাহির সাথে কিছু আলোচনা করবো।”
” ঠিক আছে। ”
সালমান খুরশিদ আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গাছগুলোর সাথে সময় কাটাচ্ছেন। রিনা বেগম সরাসরি রান্নাঘরে রাহির কাছে এসেছে। আদ্রিয়ান সবে বাজার থেকে ফিরলো। রাহি বাজারের ব্যাগ থেকে সবকিছু বের করতে ব্যস্ত। আদ্রিয়ান নিজের ঘরে চলে গেছে।
” মা দেখুন তো সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি-না? ”
” তুমি বরং বাজারের লিস্টের সাথে মিলিয়ে নাও সবকিছু, কোনো কিছু বাদ গেলে বলবে। ”
” আচ্ছা মা।”
রিনা বেগমের কথামতো রাহি সমস্ত বাজার লিস্ট অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ করে নিলো। মুরগির মাংস, গরুর মাংস, পোলাও এর চাল,ডিম, মাছ, শাকসবজি সবকিছুই আছে।
” কিছু লাগবে আর? মশলা আছে সব?”
” হ্যাঁ মা সবকিছু ঠিক আছে। আমি বরং এখুনি রান্না শুরু করে দিচ্ছি। বেলা তো কম হলোনা ন’টা বেজেছে। ”
” হ্যাঁ আমিও হাতে হাতে সাহায্য করছি। ওরা এসে যাবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে। ”

কথামতো শ্বাশুড়ি বউমা একসাথে রান্নাবান্না শুরু করেছে। আদ্রিয়ান আজকে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে,বোন আর বোনের বরের সাথে সময় কাটানোর জন্য। সালমান খুরশিদ বসার ঘরে এসে টিভি অন করে খবর দেখতে বসলেন। কিন্তু ন’টার খবর একটু আগেই শুরু হয়ে গেছে। অগত্যা খবরের মাঝখান থেকে দেখতে শুরু করলেন তিনি। সামনে নির্বাচন সেই নিয়ে নানাজন নানারকম মতবাদ জানাচ্ছে আজকাল। সেই রকম একটা রাজনৈতিক টকশো দেখায় মনোনিবেশ করলেন তিনি।

” কী হলো রেডি হবে কখন? ”
মিহি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। রুদ্র রেডি হয়ে এসে দাঁড়িয়ে শুধালো রাহিকে।
” চোখ কি গেছে? ”
মিহির কথায় রুদ্র একবার তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো মিহিকে। পিওর কটনের কালো রঙের একটা শাড়ি সাথে একইরকম রঙের ব্লাউজ। এমনিতেই সুন্দরী তার উপর কালো শাড়ীতে অসাধারণ লাগছিল তাকে। চুলগুলো পাশ থেকে সিধি করে কানে ছোটো একজোড়া কালো পাথরের দুল পড়েছে।
” সব ঠিক আছে কিন্তু মুখে কোনো মেকআপ ব্যবহার করবে না? ”
” না আমি ওসব পছন্দ করি না। আপনার হলে চলুন বের হই।”
” ন্যাচারাল মিহির দানা! ঠিক আছে চলো।”
” আবারও! ”
রুদ্র ও মিহি এভাবেই খুনসুটি করলো সারা রাস্তা। কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে বসলেন আদ্রিয়ানের বাবা। রিনা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দিলেন। মেয়েকে দেখে আনন্দে দু-চোখ টলমল করছে উনার।
” আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন? ”
” আলহামদুলিল্লাহ তোমরা ভেতরে এসো।”
রুদ্র ও মিহি বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো। বাবা কেমন আছেন কুশলাদি বিনিময়ের পরে মায়ের সাথে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালো মিহি। এদিকে রুদ্র শ্বশুরের সাথে বসে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে বসেছে।
” তোমার কী মনে হয় রুদ্র সুষ্ঠু নির্বাচন হবে? কোনো ঝামেলা হবে না? ”
” সেটা বলা মুশকিল। আচ্ছা আপনার শরীরের অবস্থা কেমন এখন?”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তোমার দেওয়া ঔষধ ভালোই কাজ করেছে। ”
” আমার জন্য না সবকিছু উপরওয়ালার ইচ্ছে হয়েছে। ভাইয়াকে দেখছি না! উনি কি অফিসে? ”
” না না তোমরা আসবে বলে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে আজকে। মনে হয় ঘরে ঘুমিয়ে আছে! ”
” আচ্ছা আঙ্কেল। ”
মিহিকে দেখে রাহি বেশ খুশি হয়েছে। রাহি মাংস কষিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে মিহির সাথে কথা বলতে শুরু করলো।
” সবকিছু কেমন চলছে? সংসার, কলেজ? ”
” ভালোই চলছে। কিন্তু বাসায় তো আমাকে কোনো রান্নাবান্না করতে দেননা উনি। রহমান চাচা আছেন তিনি সবকিছু করেন।”
” তা থাক তবুও নিজের সংসারের রান্না নিজে করবি বুঝলি?”
” ঠিক আছে মা। ”
” মা ঠিক বলেছেন মিহি।”
মিহি ইশারায় রাহির কথায় সম্মতি জানায়। রিনা বেগম পোলাও রান্না করছেন। রাহি মুরগির মাংস চুলোয় রেখে গরুর মাংসের জন্য মশলা বাটছে শিলনোড়ায়। রেডিমেড মশলা দিয়ে রান্না করলে সেই স্বাদ আসে না যেটা বাটা মশলার তরকারির মাঝে থাকে।
” অনেকক্ষণ তো হলো ছেলেটা ড্রইং রুমে বসে আছে, তুই এবার ওকে তোর রুমে নিয়ে যা।”
” থাকুক বসে বদের হাড্ডি একটা! ”
” কী বললি মিহি?”
” কিছু না মা আমি যাচ্ছি। ”
মিহি আস্তে করে বললেও কিছু একটা শুনেছেন বলেই রিনা বেগম শুধিয়েছিলেন। মিহি বসার ঘরে গিয়ে ইশারায় রুদ্রকে তার পিছুপিছু আসতে বললো্ রুদ্রও মিহির সাথে দোতলায় চলে গেলো। সিড়ি দিয়ে উঠে কয়েক কদম এগিয়ে মিহির রুম। কয়েকদিন পরে নিজের রুমের মধ্যে ঢুকেছে বলে অন্য রকম একটা অনুভূতি অনুভব হচ্ছে। একদম গোছানো আছে সবকিছুই। এসব নিশ্চয়ই ভাবি করেছে ভেবে মুচকি হাসলো মিহি।
” কী হলো অহেতুক হাসছো কেনো?”
” আমি যে অকারণে হাসলাম সে কথা আপনাকে কে বললো শুনি?”
” সব সময় ত্যাড়া কথা! ”
” আপনি যে ভুলভাল বলেন তার বেলায় কিচ্ছু না?”
” মিহির দানা এক গ্লাস জল পাওয়া যাবে? ”
” হ্যাঁ জল,পানি,ওয়াটার সবকিছুই আছে। অপেক্ষা করুন আসছি।”
মিহি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই রুদ্র ঘরটা ভালো করে দেখছে। খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো সবকিছু। দেয়ালের পেইন্টিংগুলো বেশি সুন্দর।
” এই নিন আপনার পানি।”
” হ্যাঁ দাও।”
” কী দেখছিলেন এত মনোযোগ সহকারে? ”
রুদ্র এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করে মিহির হাতে গ্লাস দিয়েছে।
” তোমার ঘরের দেয়াল দেখছিলাম। ”
” ওগুলো ভাবি পেইন্ট করেছে, খুব ভালো পেইন্ট করে। ”
” হ্যাঁ আসলেই খুব সুন্দর হয়েছে। ”
” আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। ”
” আমিও নিচে আঙ্কেলের কাছে যাবো।”
” ওকে।”
রুদ্র ব্যাগ থেকে নিজের পোশাক বের করে ওয়াশরুমে ঢুকেছে।

” ওঁরা কী এখনো আসেনি বাবা?”
আদ্রিয়ান বাবার পাশে বসে বললো। এরমধ্যেই মিহি দোতলা থেকে বসার ঘরে চলে এসেছে।
” না আসবো কীভাবে বলো? তুমি রুমে ঘুমিয়ে ছিলে বলেই তো মাত্র উপর থেকে ল্যান্ড করলাম আমরা।”
আদ্রিয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ঠাট্টা করে বললো। আদ্রিয়ান মিহির মাথায় আস্তে করে একটা গাট্টা মেরে দিলো।
” কেমন আছিস বোন? রুদ্র কি রুমে?”
” ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? উনি চেঞ্জ করে আসছেন। ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আমাকে ডাক দিলি না কেনো?”
” ভাবলাম আমরা তো আছিই তুমি না হয় ঘুমিয়ে নাও।”

দুই ভাইবোনের কথোপকথনের মধ্যে রুদ্র এসে হাজির হলো সেখানে। মিহি রান্নাঘরে গেলো আর রুদ্র আর আদ্রিয়ান গল্প জুড়ে বসেছে। সালমান খুরশিদ নিজের মতো করে এখনও টিভি দেখে চলছেন।
দুপুরের কড়া রোদের মধ্যে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শরীফ। নীল আকাশে সাদা মেঘগুলো কেমন ছোপ ছোপ দাগের মতো লাগছে। রুদ্র ভাই বিয়ে করে নিয়েছে অথচ শরীফ বিয়ের কথা ভাবতে পারবেনা কখনো। রুদ্রর ভালোবাসার মানুষটা তে ঠকিয়েছিল তাকে, তাই হয়তো সবটা রেখে এগিয়ে যেত পেরেছে। কিন্তু শরীফের বেলায় প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিলো। সুমিও খুব ভালোবাসতো শরীফকে। কিন্তু বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারেনি। আপাতদৃষ্টিতে সুমিকে দোষী ভাবলেও আসলে কি সুমি দোষী? যে বাবা-মা ছোটো থেকে লালনপালন করে বড়ে করে তুলেছেন তাদের মনে কষ্ট দিয়ে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরতে পারেনি সে। শরীফের কথা পরিবারকে জানিয়েছিল সুমি,কিন্তু তাতে আরো অত্যাচারীত হয়েছিল মেয়েটা। শেষমেশ বাধ্য হয়ে বিয়ে করলো অন্য একটা লোককে। সবকিছু শেষ!
আকাশের দিকে তাকিয়ে শরীফের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সুমি থাকলে আজ জীবনটা অন্য রকম হতো।
চলবে

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৭
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

শেষমেশ বাধ্য হয়ে বিয়ে করলো অন্য একটা লোককে। সবকিছু শেষ! আকাশের দিকে তাকিয়ে শরীফের বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সুমি থাকলে আজ জীবনটা অন্য রকম হতো। “কেমন আছে মেয়েটা! শেষ বার শুনেছিলাম মেয়ের মা হয়েছে সে। মনে হয় ভালোই আছে। ” আকাশ পানে তাকিয়ে নিজ মনে কথাগুলো বললো শরীফ।

রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে মিহি রাহিকে নিজের রুমে নিয়ে এসেছে। রুদ্র আগে থেকেই খেয়েদেয়ে রুমে এসে শুয়ে আছে। রাহিকে দেখে সোজা হয়ে উঠে বসলো রুদ্র।
” ভাবি বসুন।”
” আরে দেখো না মিহি নিয়ে এলো এখন,তুমি না-কি আমার পেইন্টিং এর খুব প্রশংসা করছিলে?”
” ভালো করেছে নিয়ে এসেছে, হ্যাঁ প্রশংসা তো করবোই। সত্যি খুব সুন্দর আঁকতে পারেন আপনি। ”
” হয়েছে হয়েছে স্বামী স্ত্রী প্রশংসা করে আমাকে মাথায় উঠাতে হবে না আর। তা কেমন চলছে দু’জনার সংসার? ”
রাহি একটা চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসেছে আর মিহি বিছানার এক পাশে। রুদ্র খাটের মাঝ বরাবর বসেছে।
” আর সংসার! ”
মিহি মুখ ভেংচি কেটে বললো। রুদ্র অবশ্য তাতে মুচকি হেসে বললো,
” ভাবি আপনার ননদ আমাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না। ”
” দেখবে কী করে বলো? সব সময় আমার সুন্দর নামটাকে কীরকম করে ডাকবে।”
” কীরকম করে ডাকে আবার তোমাকে? ”
রাহি কৌতুহল প্রকাশ করে শুধালো মিহিকে। মিহি কিছু বলার আগেই রুদ্র বলে উঠে,
” মিহির দানা, দানাপানি। ”
মিহি এবার কপট রাগ করে চোখ পাকিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। রাহি দুজনের অবস্থা দেখে তো হেসে কুটিকুটি অবস্থা। এরমধ্যে রুমে আদ্রিয়ান এসে উপস্থিত হয়েছে। ভাইকে দেখে মিহি রাহির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
” দেখো ভাই আমার চোখে হারাচ্ছে তোমাকে। ”
” ধ্যাৎ! ”
আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বললো,
” রাহি আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইল খুঁজে পাচ্ছি না, তুমি একটু আসবে? ”
মিহি রাহিকে ইশারা দিয়ে মুখ টিপে মিটিমিটি হাসছে। রুদ্রর বুঝতে কিছুটা সময় লাগলেও পরে বুঝে মুচকি হেসে রাহিকে বললো,
” ভাবি কালকে কথা হবে শুভ রাত্রি। ”
” ঠিক আছে শুভ রাত্রি। ”
রাহি আদ্রিয়ানের পিছুপিছু মিহিদের রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাহি চুপচাপ রুমে ঢুকে ফাইল খুঁজতে শুরু করলো। আদ্রিয়ান আস্তে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে পা টিপে টিপে পেছন দিক থেকে রাহিকে জড়িয়ে ধরলো।
” কী করছো! কোন ফাইলটা সেটা তো বললে না? আর আমিও বোকার মতো নাম না জেনেই খোঁজাখুঁজি শুরু করেছি।”
” সরি ম্যাম। আসলে তোমাকে মিহিদের রুম থেকে বের করে আনার জন্য মিথ্যে বলেছিলাম।”
” কী! ”
আদ্রিয়ান রাহির খোঁপা করা চুলগুলো হেঁচকা টানে খুলে দিলো। চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বললো,
” বাইরে দেখেছো কী সুন্দর রোমান্টিক ওয়েদার? এখন কি মিহিদের রুমে বসে থাকা উচিত ছিল তোমার? আফটার অল ওঁরা নতুন দম্পতি। ”
” হয়েছে হয়েছে ওদের কথা না বলে নিজের কথা বলো। ইচ্ছে করছে নিজের ঢং করতে বাহানা দিচ্ছে অন্য কারো।”
রাহি আদ্রিয়ানকে ছাড়িয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকালো বৃষ্টির তোপখানা কতটুকু বুঝতে। সকাল থেকে অল্প অল্প বৃষ্টি থাকলেও এখন বেড়েছে আরো। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করে রইলো রাহি। অসময়ে কিংবা সময়ে সব সময় বৃষ্টি খুব প্রিয় রাহির। আদ্রিয়ান রুমের বাতি বন্ধ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে।
” কী হলো ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিলে?”
রাহি বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখেই শুধালো। আদ্রিয়ান কিছু বললো না। হুট করেই রাহিকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে শোয়ালো। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় দু’জন দু’জনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ানের দৃষ্টি আলাদা এখন। রাহি জানে এই চাহনির অর্থ নেশা। তাই কোনো প্রকার বাঁধা না দিয়ে সেই নেশাতে বুদ হলো দু’জন।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটায় আলাদা কোনো অনুভূতি টের পায়না সুমি। বিছানা থেকে নেমে আস্তে আস্তে নিজের ঘর পেরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলো সে। মিতু অঘোরে ঘুমাচ্ছে কিন্তু ঠাণ্ডায় কেমন গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। কম্বল-খানা পায়ের কাছে ঠেকেছে গিয়ে। সুমি পরম মমতা সহকারে কম্বলটা আস্তে করে মেয়ের গায়ে দিয়ে দিলো। তারপর আবারও নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ওই ঘরে নেশাগ্রস্ত সবুজ ঘুমাচ্ছে। আজ কোনো হুঁশ ছিলোনা বলেই সুমি মারধর আর মানসিক অত্যাচার থেকে বেঁচেছে। সুমির বিয়ের পরেই তার বাবা মারা গিয়েছিলেন,রইলো এক ভাই আর মা। কিন্তু তারা কখনো যোগাযোগ করেনি সুমির সাথে। যেখানে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়াতে সুমির রাগ করা উচিত ছিল সেখানে উনারা কেনো রেগে যোগাযোগ আছে করে আছেন বুঝতে পারেনা সুমি। বিয়ে হলো কত বছর! শরীরে অন্য কারো স্পর্শ পেলো,সন্তানের মা হলো কই সুমি তো শরীফকে ভুলতে পারলোনা। সব পুরুষ যেমন এক নয় তেমনই সব নারীও এক না। ভালো-মন্দ মিলিয়ে জগৎসংসার। হয়তো প্রাক্তনকে মনে রাখা অন্যায় কিছু স্মৃতি কি ভোলা সম্ভব কখনো? নিজের পেটে হাত রেখে বাইরে দৃষ্টিপাত করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সুমি। সংসার নামক গাছটা অনেকটা ডালপালা মেলে ফেলেছে, সেই সাথে তার শিকড়ও পৌঁছে গেছে অনেকটা গভীরে। তাই কোনোভাবেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয় বলেই মেনে নিয়েছে সুমি।

” তুমি তখন মিটমাট করে হাসছিলে কেনো?”
রুদ্রর প্রশ্ন শুনে মিহি ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
” আপনি যে কারণে হাসছিলেন আমিও সেই কারণে হেসেছিলাম। ”
রুদ্র ফোনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মিহির দিকে তাকালো। মিহি ফ্লোরে বিছানা করে শুয়েছে আর রুদ্র বিছানায়।
” মানে! তুমি দেখলে কখন আমি হেসেছি?”
” চোখ থাকলে সব দেখা যায়। তা আপনার না-কি প্রাক্তন ছিল! আচার-আচরণে তো মনে হয় আমিই আপনার জীবনের একমাত্র মহীয়সী নারী। ”
মিহি ইচ্ছে করে রুদ্রকে কথাগুলো বললো যাতে রেগে গিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু রুদ্র মোটেই রাগ করলো না। উল্টো বিছানার পাশে এসে মিহির মাথার উপর উঁকি দিয়ে বললো,
” ছিল মানে অতীত কিন্তু তুমি আছো মানে বর্তমান। অতীতকে আঁকড়ে ধরে বর্তমান নষ্ট করা বোকামি মিহির দানা। তাছাড়া সেই মানুষটা আমাকে ঠকিয়ে চলে গেছিলো। সে যখন আমি থাকতে অন্য কারো হাত ধরে চলে গিয়ে সুখী হতে পেরেছে আমি কেনো সে না থাকতেও সুখী হওয়ার চেষ্টা করবো না? ”
রুদ্রর কথাগুলো বুকের ভেতর পর্যন্ত গিয়ে লাগলো মিহির। লোকটাকে এভাবে আঘাত করতে চায়নি সে। একটা মানুষকে না দেখে না জেনেই এতটা ভাবে মিহি তাহলে রুদ্র তো একটা মানুষের উপস্থিতিতে ভালোবেসেছিল!
” সরি আমি আপনাকে আঘাত করতে চাইনি।”
” আঘাতের কী আছে বোকা মেয়ে? বহু বছরের পুরনো ক্ষত এটা নতুন করে সেই রকম ব্যথা হয় না। তবে মাঝে মধ্যে চিনচিনে ব্যথা একটু হয় বটে। কিন্তু ব্যাপার না মানুষের মনতো যেকোনো সময় বদলে যায়। ”
” শোনাবেন আপনার সেই মানুষটার কথা? ”
” কী হবে ওইসব শুনে? শুধু এতটুকু শোনো,আমাকে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে আমার বন্ধুর সাথে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল সে। ”
” তারা আমাদের ভালোবাসে না কেনো?”
” কারণ আমরা তাদের যোগ্য নই কিংবা তারা আমাদের যোগ্য না। অথবা আমরা একে অপরের জন্য তৈরি হইনি এজন্য তাদের সাথে আমাদের মিল হয় না।”
” একজীবনে সবকিছু পেয়ে গেলে জীবনকে কী আর দোষারোপ করতে পারতাম? এজন্যই হয়তো এমনটা হয়।”
” তা ঠিক। অনেক রাত হয়েছে মিহির দানা, ঘুমিয়ে পড়ো।”
” সেইম টু ইউ, গুড নাইট। ”
” গুড নাইট। ”
রুদ্র নিজের বালিশে গিয়ে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। মিহি না চাইতেও আজ রুদ্রকে নবনীর কথা মনে করিয়ে বেশ আঘাত দিয়ে ফেলেছে। মিহিরও ইচ্ছে হচ্ছিল রুদ্রর কাছে তার কথা জানাতে কিন্তু এটা তো কোনো প্রেমের কাহিনি নয়, নয় কোনো যুক্তিসঙ্গত কথা। এরকম করে কাউকে ভালোবাসার কথা শুনলেও হয়তো রুদ্র হাসতো! কিছু কথা অজানা থাকাই ভালো, নিজের সব কথা বলতে নেই।
চলবে।

মনেরও গোপনে পর্ব-১৪+১৫

0

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৪
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)

“আরে না, তুই চিন্তা করিস না। একটু প্রেশার বেড়ে গেছিলো। নিজের খেয়াল রাখিস রাখছি।”
” বাবার খেয়াল রেখো আর নিজেরও টাটা।”

” শুনতে খারাপ লাগলেও মেয়েটা মরলেই ভালো হতো।”
মায়ের সাথে কথা বলা শেষে কিছুটা ক্ষোভের উদ্রেকই কথাটা বললো মিহি। তোশা সম্পর্কে বোন হলেও তার প্রতি চরম বিতৃষ্ণা তার। যে মেয়ে জেনেশুনে অন্য মেয়ের স্বামীর দিকে নজর দেয় সেরকম মেয়ের বেঁচে থাকার দরকার নেই।
” কে মরলে ভালো হতো তোমার? ”
” আপনার দরকার নেই তাতে, শুনুন সারাদিন আমার সাথে এরকম করবেন না। ”
রুদ্র আলমারি থেকে ফর্মাল পোশাক বের করে রেডি হচ্ছে।
” কী করলাম আমি! আমি তো খুব ভালো আচরণ করছি। ”
” ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করুন আগে, লাজ লজ্জা কিচ্ছু নেই। ”
” আমি তো সবকিছু খুলে চেঞ্জ করছি না। ”
“যান বলছিইই।”
“ঠিক আছে যাচ্ছি যাচ্ছি মিহির দানা। ”
মিহির চোখ পাকানোর জন্য রুদ্র আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে রেডি হয়ে বের হলো।
” বিকেলে ভাবি আসবে বাসায়। ”
” সমস্যা নেই বাজার করা আছে শুধু রহমান চাচাকে বললেই সবকিছু তৈরি করে দিবেন। ”
” ওকে।”

রুদ্র কখনোই দুপুরে বাসায় খেতো না তাই বিয়ের পরেও আজকেও আসেনি। কিন্তু রহমান চাচা মিহির জন্য সবকিছু রান্নাবান্না করেছেন। যেহেতু রহমান চাচা উনার স্ত্রী’কে রেখে খাবার খাননা তাই দুপুরে একাই খাবার খেতে হলো মিহিকে। কোমরের ব্যথায় হাঁটতে অবশ্য একটু কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার। কিন্তু চলাফেরা তো করতেই হবে। খাওয়া শেষে নিজের রুমে গিয়ে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে মিহি। রুমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে বুকশেলফ। অনেকগুলো বই রাখা আছে সেখানে। মিহি আস্তে আস্তে বইগুলো দেখতে শুরু করলো। বেশির ভাগ বই হুমায়ূন আহমেদ স্যারের তারপর কিছু সমসাময়িক লেখকের বই। তারমধ্যে হুমায়ূন আহমেদের “অপেক্ষা” নামক বইটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসলো। বিকেলে ভাবি আসবে তাই তার আগ পর্যন্ত বই পড়ে সময় কাটাবে বলে সিন্ধান্ত নিলো মিহি।

” কী হলো হুট করে এই ভরদুপুরে ঘরের দোর দিলে কেনো?”
রাহি ঘরের দেয়ালে আঁকি ঝুকি করছিলো। রাহি ভালো আঁকতে পারে তাই দেয়ালে কিছু পেইন্ট করবে বলে ভাবছিল সকাল থেকে। আদ্রিয়ান খাওয়া শেষে ঘরে এসে দরজা আঁটকে রাহির পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
” তুমি কী ঠিক করেছো আমাকে এভাবে পোড়াবে?”
” মাথা ঠিক আছে তো! এসব কী বলতেছো?”
আদ্রিয়ানের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে রাহি। আদ্রিয়ানের চোখমুখ লাল হয়ে আছে। কোনো প্রকার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রাহির হাত ধরে টেনে বিছানায় বসালো।
” এতটা কষ্ট দিও না। ”
” আদ্রিয়ান! ”
” কী? আমি পুরুষ মানুষ তোমার মতো সহ্য শক্তি আমার নেই। এরকম তিলে তিলে কষ্ট না দিয়ে একেবারে মেরে ফেলো। একই বিছানায় আমার ভালোবাসার মানুষটা থাকে অথচ আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে পর্যন্ত পারিনা। তুমি দূরে ছিলে এতটা উতলা ছিলাম না তখন কিন্তু পাশে শুয়ে এতটা দূরত্ব সত্যি আমার সহ্য হয় না। ”
সত্যি বলতে রাহিরও কষ্ট হয় ভীষণ। কতদিন প্রিয়তম স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমানো হয়নি তার! তোশার কথাগুলো কিছুতেই কেনো জানি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। কিন্তু মানুষ মাত্রই তো ভুল করে। আদ্রিয়ান তার ব্যতিক্রম নয়।
” তাহলে কি আলাদা ঘরে থাকবো আজ থেকে?
” সেই সুযোগ পাবে না।”
রাহি কিছু বুঝে উঠার আগেই আদ্রিয়ান দু’হাতে আলতো ধাক্কা দিয়ে বিছানায় শুয়ে দিলো তাকে। রাহি অবাক হয়েছে আদ্রিয়ানের আচরণে। কতটা অধৈর্য হয়ে গেছে লোকটা?
” আদ্রিয়ান তুমি আমাকে এভাবে জোর করতে পারো না।”
আদ্রিয়ান কোনো উত্তর দিলো না। কোনো বাক্যব্যয় না করে রাহির ওষ্ঠ নিজের ওষ্ট যুগলে বন্দী করে নিলো। কেমন একটু কেঁপে উঠলো রাহি। কিন্তু ছাড়াতে চাইলো না আদ্রিয়ানকে। গভীর আলিঙ্গনে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নিজেও সাড়া দিলো। রাহির সাড়া পেয়ে আদ্রিয়ান আলতো করে গালে, কপালে চুম্বন এঁকে দিলো। রাহি দু-চোখ বন্ধ করে আছে।
” উঠে রেডি হয়ে নাও মিহিদের বাসায় যেতে হবে না?”
” একটু দেরি হলে কিচ্ছু হবে না। কন্টিনিউ করো।”
রাহির আশকারায় আদ্রিয়ান ভালোবাসার পরশে সিক্ত হলো।

সময় যেনো কিছুতেই কাটছে না আজ। বই পড়ায়ও মন দিতে পারেনি মিহি। রহমান চাচা ছিলেন কতক্ষণ কিন্তু মিহি নিজেই তাকে বাসায় ফিরে যেতে বলেছে। তবে যাওয়ার আগে অতিথিদের জন্য কিছু খাবার-দাবার প্রস্তুত করে ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন করে রেখে গিয়েছেন। যেহেতু একা ভালো লাগছিল না তাই এরমধ্যে একবার কল করে অহনার সাথে কথা বলবে বলে ভাবলো মিহি। তাই দেরি না করে অহনার নম্বরে ডায়াল করলো।
” কী খবর নতুন বউয়ের?”
” আর বলিস না রে কোমরে লেগেছে খুব, ব্যথা হচ্ছে ভালোই। ”
” হায় হায় দুলাভাই দেখি পুরাই আগুন। ”
” নাউজুবিল্লাহ, অসভ্য মেয়ে। মুখ সামলে কথা বল, ফ্লোরে পড়ে গেছিলাম সকালে এজন্য লেগেছে। ”
” ওহ এই কথা আমি ভাবলাম রাতের ঘটনার জন্য হয়েছে। ”
” শোন বিয়ে হলেই কেউ বরের সাথে ওসব করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে না। আমি ভাবতেই পারছিনা এসব অশালীন কথাবার্তা কীভাবে তুই বললি!”
” হয়েছে হয়েছে শালীনতার প্রতীক এসেছেন। দুপুরে খেয়েছিস?”
” হ্যাঁ, তুই? ”
” হ্যাঁ খেয়ে বের হলাম একটু। রাতে কথা হবে টেইক কেয়ার মিহি।”
” সেইম টু ইউ চুন্নি। ”
কথা শেষ হতেই কলিংবেলের শব্দ ভেসে এলো মিহির কর্ণকুহরে। ভাই-ভাবী এসেছে ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেছে মেয়েটার। কিন্তু যতটা দ্রুত দরজা খোলার জন্য যেতে চাচ্ছিলো ততটা দ্রুত যেতে পারছিলো না। অগত্যা আস্তে আস্তে গিয়ে দরজা খুলে দিলো মিহি।
” কেমন আছিস মিহি?”
” ভালো আছি ভাইয়া,তোমরা আগে ভেতরে এসো।”
আদ্রিয়ান ও রাহি মিহির পিছুপিছু বাসায় প্রবেশ করে বসার ঘরে সোফায় বসলো।
” মিহি তোর কী হয়েছে! এরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিস কেনো?”
বোনের শরীর খারাপ ভেবে প্রশ্ন করলো আদ্রিয়ান। কিন্তু রাহি পাশে থেকে চিমটি কেটে বললো,
” তুমি চুপ করো,মিহি রুদ্র ভাই হসপিটালে?”
” হ্যাঁ উনি একেবারে রাতে ফিরবেন। ভাইয়া সকালে ফ্লোরে পড়ে গেছিলাম এজন্য কোমরে লেগেছে একটু।”
” সেকি পড়লে কীভাবে? ঔষধ খেয়েছো? ”
” হ্যাঁ ভাবি। বাবা এখন কেমন আছেন? ”
” চিন্তার কিছু নেই প্রেশার বেড়ে গেছিলো একটু।”
” আচ্ছা ডাইনিং টেবিলে বসবে চলো,নাস্তা খেতে খেতে আলাপ করবো।”
” আরে এখানেই বসো মিহি। মাত্র খেয়ে এলাম তো।”
” আচ্ছা তাহলে ঘরে চলো।”
সারা বিকেল ভাই ভাবীর সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে খুব সুন্দরভাবেই কাটলো মিহির। কিন্তু সন্ধ্যার আগে আদ্রিয়ান ও রাহি চলে যাওয়াতে আবারও একাকীত্ব গ্রাস করলো মিহিকে। হুট করে এরকম একা থাকাতে খারাপ লাগছিল। বারবার চোখের সামনে মা-বাবা, ভাই-ভাবীর সাথে কাটানো সময়গুলো মিস করছে।
” এই যে মিহির দানা, ব্যথা কমেছে? ”
হঠাৎ ফোনের স্ক্রিনে অচেনা একটা নম্বর থেকে টেক্সট দেখলো মিহি। এটা যে ডক্টর রুদ্র চৌধুরী সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই মিহির। মেসেজের কোনো রিপ্লাই দিতে ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। মাগরিবের নামাজ পড়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আশেপাশের বিল্ডিং দেখছে মিহি। জায়গায়টা একেবারে নতুন মিহির জন্য। ডিসেম্বর মাসেও আকাশে কালো মেঘেরা আনাগোনা করছিলো বিকেলো। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশের বাড়ির ছাঁদে নজর দিলো মিহি। সেখানে কিছু ছেলেরা ব্যাডমিন্টন খেলতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখলো মেয়েটা। কাল থেকে ক্লাসে যাওয়ার কথা ছিল মিহির কিন্তু কোমরে চোট পেয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে এখন। কেনো যে সকালবেলা ওরকম লাফিয়ে ফ্লোরে পড়তে গেলো ভেবে নিজেকে নিজেই গালি দিলো মিহি। যাতে ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতিতে আর পড়তে না হয় এজন্য মিহি ভাবছে আজ থেকে আর এক বিছানায় শোবে না।
চলবে,

#মনেরও_গোপনে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৫
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
কেনো যে সকালবেলা ওরকম লাফিয়ে ফ্লোরে পড়তে গেলো ভেবে নিজেকে নিজেই গালি দিলো মিহি। যাতে ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতিতে আর পড়তে না হয় এজন্য মিহি ভাবছে আজ থেকে আর এক বিছানায় শোবে না। এশার আজানের ধ্বনিতে মিহির ভাবনার ছেদ ঘটলো। ছেলেগুলো সেই কখন ছাদ থেকে চলে গেছে অথচ অন্যমনস্ক থাকায় সেসব খেয়াল করেনি মিহি। ওজু করে এশার নামাজ আদায় করে নিলো সে। জায়নামাজে বসে আছে এখনও। মনটা খুব অস্থির লাগছে মিহির। মানুষটা কখনো না থেকেও মিহির মনের গোপনে বাসা বেঁধে বসে আছে। যদিও রুদ্র এখন তার স্বামী কিন্তু সেই মানুষটার কথা কখনো ভুলতে পারবে না মিহি। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে নিজের মনকে শান্ত করার জন্য প্রার্থনা করেছে মেয়েটা। ফোনের রিংটোনের শব্দে জায়নামাজ থেকে উঠে বিছানায় গিয়ে বসলো মিহি। অচেনা নম্বর যদিও কিন্তু এই নম্বর থেকেই একটু আগে টেক্সট এসেছিল। তারমানে রুদ্র কল করেছে নিশ্চিত।
” এই মিহির দানা দরজা খুলো,আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ”
” কলিংবেল বাজালেও তো হতো কলের কী দরকার ছিলো!”
” একা বাড়িতে দরজা কেউ নক করলেই খুলতে নেই। ”
” আচ্ছা আসছি।”
মিহি কল কেটে দিয়ে ধীরে ধীরে দোতলা থেকে নিচে বসার ঘরে গেলো। তারপর দরজা খুললো।
” আপনি এলেন কিন্তু চাচা তো আসলেন না?”
রুদ্র বাসায় ভেতরে প্রবেশ করলো, মিহি দরজা আঁটকে রুদ্রর পিছনে পিছনে আবারও রুমে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো ।
” আজ চাচা আসবেন না,চাচীর শরীর হুট করে খারাপ হয়ে গেছে। ”
” ও আচ্ছা। রান্না তো করাই আছে, কিছু নাস্তাও আছে। ভাইয়া আর ভাবী একেবারেই খেতে চাচ্ছিলো না জোরাজোরি করে অল্প দিয়েছিলাম। ”
” ভালো করেছো। তোমার কোমরের ব্যথার কী খবর? ”
” কমেছে। ”
বসার ঘর পেরিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। রুদ্র একবার মিহির দিকে তাকিয়ে দেখলো। পরমুহূর্তে মিহিকে পাঁজা কোলা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।
” এই কী করছেন! ছাড়ুন আমাকে, আমি একাই চলে যাচ্ছি। ”
” হ্যাঁ বললে তো কমেছে ব্যথা, আমি তো দেখলাম দরজা আঁটকে আগের মতোই খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছিলে।”
” আপনি আসলে যাচ্ছেতাই, এবার নামান ঘরের সামনে তো এসে গেছি। ”
রুদ্র সাবধানে মিহিকে কোল থেকে নামালো। মিহি রুমে ঢুকে জানালার পাশে একটা চেয়ারে বসেছে। রুদ্র তোয়ালে আর টি-শার্ট, লুঙ্গি নিয়ে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকেছে। কেনো জানি কিচ্ছু ভালো লাগছে না মিহির। কেমন সবকিছু একঘেয়ে লাগছে একদিনেই।
” আনমনে কী ভাবছো এত?”
রুদ্র মাথার চুল মুছতে মুছতে মিহিকে শুধালো। মিহি ভাবলেশহীনভাবে বসেই আছে। কেনো জানি কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। মিহির নিস্তব্ধতা দেখে রুদ্র পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” একা একা বোর হয়েছো সারাদিন? ”
” হ্যাঁ, আমি এখনো এরকম একা থাকিনি। ”
” সেটা বুঝতে পেরেছি। কাল থেকে কলেজে যাবে।”
” কিন্তু ব্যথা!”
” আমি হাই ডোজের ঔষধ নিয়ে এসেছি আর ব্যথা কমানোর জন্য স্প্রে আছে। ”
” ঠিক আছে। শুনুন! ”
” হ্যাঁ বলো।”
” আজ থেকে আমরা আলাদা ঘুমাবো।”
” আমি সোফায় শুতে পারবোনা এই শীতে, তোমার ইচ্ছে হলে শোবে।”
” আমি ফ্লোরে শোবো, আপনি বিছানায়। ”
” ভুলভাল বুঝে লাফিয়ে পড়ে ব্যথা পেলে নিজে আর আমার দোষ! ”
” হয়েছে হয়েছে কথা এটাই ফাইনাল। এখন চলুন ডিনার করে নিবো।”
” আসো। ”
” আরে আরে কোলে তুলতে হবে না আর।”
কিন্তু মিহির কথায় কর্ণপাত করেনি রুদ্র। কোলে তুলে নিয়ে সোজা ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসালো মিহিকে। এমনিতে মিহি শুকনো, ওজনের বালাই নেই। তার উপর রুদ্র সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ায় মিহিকে কোলে করে হাঁটা কোনো ব্যাপারই না তার জন্য। রাতের খাবারের তালিকায় আজকে আছে পাবদা মাছ ভাজা, মুসুরি ডাল, বাঁধাকপি ভাজা। মিহি খুব খাবারের বিষয় খুঁতখুঁতে স্বভাবের খুব। তাই শুধু মাছ দিয়ে খাওয়া শেষ করলো। রুদ্র অবশ্য ভোজনরসিক মানুষ। সব ধরনের খাবারই তার রোচে।

ঘড়ির কাঁটায় রাত এগোরাটা বেজেছে। কিন্তু এরমধ্যেই গ্রামের সব বাড়ির মানুষ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। চারদিকে শুনশান নীরবতা ছেয়ে আছে। শহুরে জীবনে রাত এগোরাটা সবে সন্ধ্যার মতো মনে হলেও গ্রামে সেটা মধ্যরাতের সমান। ছয় বছর বয়সী মিতু পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে। উত্তর দিকের ঘরে তার বাব-মা শোয়। টিনের দোতলা বাড়ি তাদের, গ্রামে এটাকে মাঁচা বলে। সুমি বিছানায় শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সবুজ অন্য কাজে ব্যস্ত। সহবাস করার সময় স্ত্রীর কোনো ইচ্ছে আছে কিনা সেটা কখনো ভাবেনি এই লোকটা। কিছুক্ষণ পরে ক্লান্ত শরীরে সুমির শরীরের উপর থেকে নেমে পাশের বালিশে শুয়ে পড়লো সবুজ। সুমি জামাকাপড় ঠিক করে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে। একটা মানুষকে ভালোবেসে অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার করার মতো কঠিন কাজটা করতে হয়েছে সুমিকে। কিন্তু যে মানুষকে বিয়ে করেছে সে যে এরকম পশুর মতো হবে ভাবতেও পারেনি সে। প্রায় দিন গায়ে হাত তোলে সবুজ। কখনো কখনো প্রতিবাদ করে সুমি কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়। বাবা-মা তো সন্তানের অমঙ্গল চাননা কখনো কিন্তু মাঝে মধ্যে না চাইতেও সেটা হয়ে যায়। সুমির ভালোবাসার মানুষটাকে তখন তারা মানতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে সবুজের মতো একটা নেশাখোর পশুর সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য সবুজের এই খারাপ রূপ তো তারা জানতেন না তখন। এখন আর কিছু করার নেই! একটা মেয়ে আছে তার উপর আবারও গর্ভবতী হয়েছে সুমি। দীর্ঘশ্বাসে জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু দুঃখ ফুরায় না।

” এই সুমি!”
সবুজের ডাকে সাড়া দিলো না সুমি। মানুষটা এত খারাপ যে দ্বিতীয় বার কাছাকাছি আসতেও পারে। সেই ভয়ে সুমি ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে।
” সুমি? আমার তৃষ্ণা পেয়েছে আবারও। ”
সুমির কান্না পাচ্ছে খুব। এই শরীরে এসব সহ্য করতে খুব কষ্ট হয় মেয়েটার। কিন্তু সুমি জানে সবুজ আরেকবার মিলিত না হয়ে চুপ হবে না এখন। সবুজ হেঁচকা টানে সুমির শরীরের পোশাক খুলে আবারও পশুর মতো ঝাপিয়ে পড়লো। সুমি শুধু চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছে। অবিবাহিত মেয়ের কেউ ধর্ষণ করলে সমাজে বিচারব্যবস্থা আছে কিন্তু বিয়ের পরেও যে একটা মেয়ে ধর্ষণ হতে পারে কথাটা শুনলেও অধিকাংশ মানুষ হেসে উড়িয়ে দেয়। ইচ্ছের বিরুদ্ধে সহবাস করলে সেটাই যদি ধর্ষণ হয় তবে স্বামীর ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত। সুমির এসব ভাবনা কতটা যুক্তিসঙ্গত জানে না সে।
সকালের ম্লান রোদ্দুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিক্ত হচ্ছেন সালমান খুরশিদ। আজকে শরীরটা বেশ ভালো লাগছে। বারান্দার এক পাশে কিছু পাতাবাহারের গাছ আছে। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করলেন মিহির বাবা। এরমধ্যেই রিনা বেগম হাতে চা নিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করলেন।
” কী ব্যাপার সকাল সকাল এত ফুরফুরে মেজাজে আছেন?”
” শরীরটা ভালো লাগছে আগের চেয়ে। আর গতকাল রাতে শাহআলম কল দিয়েছিলো।”
রিনা বেগমের হাত থেকে চায়ের কাপ নিজের হাতে নিলেন সালমান খুরশিদ। বারান্দার গ্রিল ধরে অন্য হাতে চায়ে চুমুক দিলেন।
” তা কী বললো তোশার বাবা? তোশার শরীর কেমন? ”
” তোশা ঠিক আছে। ওর বিয়ে নিয়ে আলোচনা করলো কিছুক্ষণ। বয়স তো কম হলোনা, পাগলামিও করলো অনেক। এবার সত্যি বিয়ে দিতে চাচ্ছে ওর বাবা-মা। এরমধ্যেই ছেলে ঠিক করে ফেলেছে তবুও ছেলের বিষয় আরকটু খোঁজ খবর নিতে বললো আমাকে। ”
” বাহ ভালোই হবে তাহলে। আপনি বরং আদ্রিয়ানকে ছেলের বয়ো ডাটা বলে দিন ও গিয়ে সব জেনেশুনে আসবে। ”
” হ্যাঁ তাই করবো। বুঝলে রিনা,এবার আমি মোটামুটি নিশ্চিন্ত। তোশার থেকে মুক্তি পাবে আদ্রিয়ান আর মিহিরও ভালো ঘর মিলেছে। ”
” ঠিক বলেছেন। সন্তানের জীবনে আনন্দ দেখে গেলে বাবামায়ের মরেও শান্তি। ”
” আজকে মিহি আর রুদ্রর আসার কথা না? যদিও রুদ্র একা এসে দেখা দিয়ে যাওয়ার নিয়ম কিন্তু রুদ্র বললো মিহিকেও নিয়ে আসবে।”
” হ্যাঁ এজন্যই তো সকাল সকাল আপনার ছেলেকে বাজারে পাঠিয়ে দিয়েছি। রাহি বাড়িঘর সুন্দর করে পরিপাটি করে রেখেছে কালকেই। ”
চলবে,